hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ

লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী

২৭
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্যাতনকারী অমুসলিমদের সাথে তাঁর সদাচরণ
পিছনের ঘটনাবলীতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র বৈশিষ্ট্য দেখে মুগ্ধ ও অবাক হলেও তা ছিল আমাদের বোধগম্য এবং বিবেক মেনে নেওয়ার মতো বিষয়। কিন্তু যে বিষয়টি আকলেরও মেনে নিতে কষ্ট হয় তা হচ্ছে ঐসব লোকদের সাথেও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণ করা যারা তাঁকে নানাবিধ কষ্ট দিয়েছিলো এবং তাঁর ওপর যুলুম-অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে ছিল।

যে কোনো মহৎ চরিত্রের মানুষের নিকট নিজের ওপর যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতনকারীদের সাথেও ইনসাফ বজায় রেখে চলার আশা করা যায়। কিন্তু নিজের ওপর যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতনকারীদের সাথে ইনসাফ নয় শুধু; বরং অনুগ্রহ, সহানুভুতি ও সদাচরণ দেখানো তো অসাধারণ আশচর্যজনক ব্যাপারই বটে..!!

বহুবার আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী পড়েছি যে, “তার সাথেও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ যে তোমার সাথে তা বিচ্ছন্ন করে। তাকেও দান কর যে তোমাকে বঞ্চিত করে। ক্ষমা কর তাকেও যে তোমার প্রতি অত্যাচার করে।” [. আহমদ: হাদিস নং ১৭৪৮৮। শুয়াইব আল আরনাউত বলেন, তার সনদ হাসান।]

কিন্তু এর ওপর পরিপূর্ণ আমল করা আমরাদের মুসলিমদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয না। কেননা সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, বঞ্চিতকারীকে দান করা, অত্যাচারীকে ক্ষমা করা (তারা মুসলিম হলেও) অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। আর যদিও সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী, বঞ্চিতকারী ও অত্যাচারী ব্যক্তি অমুসলিম হয় তাহলে তো এমনটি চিন্তা করাও কঠিন..?!

এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এধরণের ঘটনা অনেক বেশি। যার প্রত্যেকটিই উন্নত চরিত্র ও উত্তম আখলাকের অনুপম নিদর্শন হয়ে আছে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন আচরণ একক ব্যক্তির সাথেও করেছেন এবং দলবদ্ধ লোকদের সাথেও করেছেন। করেছেন বিভিন্ন গোত্র ও শহরবাশীদের সাথেও...।

জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘নাখল’ নামক স্থানে খাসফার যুদ্ধে [. আদনান গোত্রের খাসফা ইবন কায়স ইবন গায়লা।] ছিলেন। এমন সময় মুসলিমদের অসতর্কতায় হঠাৎ গাওরাস ইবনুল হারিস নামক এক ব্যক্তি তরবারি হাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার নিকট এসে দাঁড়াল এবং বলল: কে এখন আপনাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ’। (এ উত্তর শোনার সাথে সাথে) তার হাত থেকে তরবারি পড়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরবারিটি উঠিয়ে বললেন, এখন কে তোমাকে আমার থেকে রক্ষা করবে? সে বলল: ‘আপনি আমার প্রতি দয়াবান হোন।’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই? সে বলল: না, কিন্তু আমি আপনার সাথে অঙ্গীকার করছি যে, আমি আপনার সাথে আর যুদ্ধে লিপ্ত হব না এবং যারা আপনার সাথে যুদ্ধ করে তাদের অন্তর্ভুক্তও হব না। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ছেড়ে দিলেন। বর্ণনাকারী জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, অতঃপর সে তার সাথীদের নিকট [. ইবন হাজার উল্লেখ করেন, তার গোত্রের লোকেরা ইসলাম করেছে। দেখুন- ইবন হাজার: ফাতহুল বারী (৭/৪২৮)] গিয়ে বলল, আমি এখন পৃথিবীর সর্বোত্তম ব্যক্তির নিকট থেকে এসেছি।” [. সহীহ বুখারী ( كتاب المغازي ، باب غزوة ذات الرقاع ) হাদীস নং ৩৯০৫; সহীহ মুসলিম, ( كتاب الفضائل ، باب توكله على الله تعالى و عصمة الله تعالى له من الناس ) হাদীস নং ৮৪৩।]

দেখুন, লোকটি তরবারি নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার নিকট এসে তাঁকে হত্যার হুমকি দিল; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুক্তি দিলেন। সাথে সাথে অবস্থাই পরিবর্তন হয়ে গেল। তরবারি চলে আসলো রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে প্রতিহিংসার কোনো চিন্তাই আসে নি; বরং তিনি তার নিকট ইসলামকে উপস্থাপন করলেন। লোকটি ইসলামকে গ্রহণ করে নি। শুধু তাঁর (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে যুদ্ধ না করার অঙ্গীকার করেছে মাত্র। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সরলতার সাথে তার কথাকে গ্রহণ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিয়ে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিলেন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একক ব্যক্তির সাথেই কেবল ক্ষমা, অনুগ্রহ ও সদাচরণ করেন নি; বরং অনেক গোত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর এ ধরণের ক্ষমা ছিল ব্যাপক। অনেক বড় বড় শহরবাসীদের ক্ষেত্রেও তিনি একই ধরণের আচরণ করেছেন বহুবার। যে শহরের শত শত ও হাজার হাজার লোক তাঁর সাথে শত্রুতা পোষণ করত এবং তাঁকে সর্বদা দুঃখ-কষ্ট দিয়েই যেত।

কুরাইশদের পক্ষ থেকে তিনি এমন দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্চনা পেয়েছেন যা বর্ণনাতীত। তারা তাঁকে ও তার সাহাবীদেরকে প্রকাশ্যে, গোপনে, শারীরিক, মানসিক সর্বদিক থেকেই কষ্ট দিয়েছে। মক্কায় তো কষ্ট দিয়েছে। মদীনাতে যাওয়ার পরও ছাড়ে নি। এমনকি সাহাবায়ে কেরাম যখন আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন সেখানেও তারা তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করল।

এভাবেই তাদের এ ইসলাম বিরোধী অভিযান দীর্ঘ কয়েক বছর চলতে থাকে। অবশেষে উহুদ যুদ্ধের দিন ঘটে গেল এক করুন ট্রাজেডি। সে দিন কুরাইশরা সত্তরজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবীকে শহীদ করে। তারা আরবের রীতি-নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে শহীদদের লাশের বিশেষ করে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্মমভাবে বিকৃতি সাধন করে। এতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত হলেন। তিনি দেখলেন সাহাবায়ে কেরামের শহীদী লাশগুলো উহুদের ময়দানে টুকরা টুকরা হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও শহীদ করার হীন চেষ্টা চালিয়েছে। তাই তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে। যার কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দিনের যোহরের সালাত দাঁড়িয়ে আদায় করতে পারেন নি; বরং বসে বসে আদায় করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মুবারক থেকে রক্ত ঝরে পড়েছে, আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্যেও রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। এরই মাঝে কিছু সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাহাড়ে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের কঠিন মূহুর্তগুলোর মধ্য হতে এটিই ছিল সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক মূহুর্ত।

এমন কষ্ট, ফেরেশানী ও বিপর্যস্থ অবস্থায়ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেহারা মুবারক থেকে রক্ত মুছতে মুছতে তাদের জন্য বদ-দো‘আ না করে বরং দো‘আ করে বললেন,

«رب اغفرلقومي فإنهم لا يعلمون»

“হে আল্লাহ! আপনি আমার জাতিকে ক্ষমা করুন, কারণ তারা আমাকে চিনতে পারে নি।” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب استتابة المرتدين المعاندين و قتالهم ، باب إذا عرض الذمي بسب النبي صلى الله عليه وسلم ولم يصرح نحو قوله : السام عليكم ) হাদীস নং ৬৫৩০; সহীহ মুসলিম:( كتاب الجهاد والسير : باب غزوة أحد ) হাদীস নং ১৭৯২।]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে ঠিক তেমন সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করেছেন যেমনটি দয়াদ্র পিতা তার সন্তানের পক্ষ থেকে দুঃখ-বেদনা ও কষ্ট-ক্লেশ পাওয়া সত্যেও করে থাকেন। তাইতো রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানের দিকে হাত তুলে তাদের জন্য দো‘আ করলেন; কিন্তু বদ-দো‘আ করলেন না।

ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুরাইশরা বার বার চ্যালেঞ্জ এবং মুসলিমদের সুবিন্যস্ত ঐক্যকে নির্মূল করার জন্য ধারাবাহিক যুদ্ধের পায়তারা করেই যাচ্ছিল। এ্ররই প্রেক্ষিতে আরবের দশ হাজার যোদ্ধা একত্রিত হয়ে ৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উমরা করতে বাধা দিয়ে বসল। অতঃপর হুদাইবিয়ার সন্ধি-চুক্তি সম্পাদিত হলো। কিছু দিন না যেতেই কুরাইশ কর্তৃকই পুনরায় চুক্তি ভঙ্গ হলো। পরিশেষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম দীর্ঘ বিশ বছরেরও অধিক সময় বিভিন্ন যুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ করার পর বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিজয় বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং মক্কার ঐ সকল লোকেরা একত্রিত হলো যারা এতোদিন তাদের মাঝে বসবাস করেছে ঠিকই কিন্তু তারা তাদের প্রাপ্য সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মানটুকুও পায় নি। তাই তারা সকলেই এমন একটি রক্তপাতের দিনের প্রত্যাশা করেছে, যে দিন বিগত বছরগুলোর কষ্টের প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

অহংকারী কুরাইশবাসী লজ্জিত ও অপমানিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে দণ্ডায়মান হলো। অপেক্ষা করতে লাগল যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তাদের ব্যাপারে হত্যার আদেশ করেন, নাকি দেশান্তর অথবা গোলামে পরিণত করার আদেশ করেন...। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ের সাথে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন,

» يا معشر قريش ما ترون أني فاعل منكم ؟

“হে কুরাইশবাসীরা, তোমরা কী মনে কর? আমি তোমাদের ব্যাপারে কী সিন্ধান্ত নেব?”

তারা সকলেই বলে উঠল: ‘কল্যাণের ফয়সালা করবেন। আপনি অত্যন্ত দয়ালু এবং দয়ালু পিতার সন্তান।’

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাও তোমরা সকলেই মুক্ত-স্বাধীন।” [. ইবন হিশাম: السيرة النبوية (২/৪১১), ইবনুল কাইয়ুম: زاد المعاد (৩/৩৫৬), আস সাহীলী: الروض الأنف (৪/১৭০), ইবন কাসীর: السيرة النبوي (৩/৫৭০) এবং দেখুন ইবন হাজার: ফাতহুল বারী (৮/১৮)।]

এমনই...!

এমনই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ..!!

না ছিল কোনো ধরণের নিন্দা ও তিরস্কার..!!

না ছিল কোনো ‘আযাব ও শাস্তি..!!

সত্যিই, ইতিহাসে এমন ঘটনা খুবই বিরল ও বিস্ময়কর..!!

ঘটনাটি শুধু আমাদের দৃষ্টিতেই বিস্ময়কর নয়; বরং সমকালীন সকল সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের দৃষ্টিতেও বিস্ময়কর ছিল..

সা‘দ ইবন উবাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মক্কার নেতা আবু সুফিয়ানকে সম্বোধন করে বললেন,

«يا أبا سفيان ، اليوم يوم الملحمة ، اليوم تستحل الكعبة»

“হে আবু সুফিয়ান, আজ তো রক্তপাতের দিন, আজ তো মক্কায় (রক্তপাত) হালালের দিন।” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب المغازي ، باب أين ركز النبي صلى الله عليه وسلم رأيته يوم الفتح ) হাদীস নং ৪০৩০।]

সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু শত্রুতাবশতঃ বা বিদ্বেষ করে এ কথা বলেন নি; বরং মক্কা থেকে বিতাড়নের পর দীর্ঘ সফরের প্রত্যাশাই ছিল এটা।

কিন্তু সা‘দ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ কথা যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছল, তখন তিনি বললেন,

«كذب سعد، ولكن هذا يوم يعظم الله فيه الكعبة، و يوم تكسى فيه الكعبة»

“সা‘দ ভুল বলেছে বরং আজ এমন দিন যে দিন আল্লাহ তা‘আলা কা‘বাকে সম্মানিত করবেন এবং আজকের দিনে কা‘বাকে গিলাফে আচ্ছাদিত করা হবে।” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب المغازي ، باب أين ركز النبي صلى الله عليه وسلم رأيته يوم الفتح ) হাদীস নং ৪০৩০; বায়হাকী, হাদীস নং ১৮০৫৮।]

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«اليوم يوم المرحمة، اليوم يعز الله فيه قريشا»

“আজ তো দয়া ও অনুগ্রহের দিন, আজকের দিনে আল্লাহ তা‘আলা কুরাইশদেরকে সম্মানিত করবেন।” [. দেখুন- ইবন হাজার: ফাতহুল বারী (৮/৯)।]

এ ধরণের অভূতপূর্ব সদাচারণ দেখে আনসারী সাহাবীগণ বিস্মিত হয়ে গেলেন। এমনকি তারা পরস্পরে বলতে লাগলেন: “ব্যক্তিটিকে স্বদেশ-প্রেম ও স্বজনপ্রীতি পেয়ে বসেছে”।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

«وَجَاءَ الْوَحْىُ وَكَانَ إِذَا جَاءَ الْوَحْىُ لاَ يَخْفَى عَلَيْنَا فَإِذَا جَاءَ فَلَيْسَ أَحَدٌ يَرْفَعُ طَرْفَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم- حَتَّى يَنْقَضِىَ الْوَحْىُ فَلَمَّا انْقَضَى الْوَحْىُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم «يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ» . قَالُوا لَبَّيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ «قُلْتُمْ أَمَّا الرَّجُلُ فَأَدْرَكَتْهُ رَغْبَةٌ فِى قَرْيَتِهِ» . قَالُوا قَدْ كَانَ ذَاكَ . قَالَ «كَلاَّ إِنِّى عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ هَاجَرْتُ إِلَى اللَّهِ وَإِلَيْكُمْ وَالْمَحْيَا مَحْيَاكُمْ وَالْمَمَاتُ مَمَاتُكُمْ» . فَأَقْبَلُوا إِلَيْهِ يَبْكُونَ وَيَقُولُونَ وَاللَّهِ مَا قُلْنَا الَّذِى قُلْنَا إِلاَّ الضِّنَّ بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- «إِنَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُصَدِّقَانِكُمْ وَيَعْذِرَانِكُمْ» .

“এমন সময় অহী নাযিল হলো। বস্তুত অহী যখন নাযিল হতে থাকে তখন আমদের থেকে গোপন থাকে না। (তার অবস্থা দেখেই আমরা বুঝতে পারি) ফলে অহী নাযিল হওয়ার প্রাক্কালে এবং তা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাদের কেউ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে চোখ তুলেও তাকাই না। অহী আসার সিলসিলা শেষ হতেই তিনি আনসারীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আনসার সম্প্রদায়! জবাবে তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ তো আমরা উপস্থিত আছি। তিনি বললেন, তোমরা মন্তব্য করেছিলে যে, “ব্যক্তিটিকে স্বদেশ-প্রেম ও স্বজনপ্রীতিই পেয়ে বসেছে”। তারা বলল, অবশ্যই এমন কথা কেউ বলেছে। তিনি বললেন, তা কখনো না, আমি আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল! আল্লাহ ও তোমাদের দিকেই হিজরত করেছি। আমার জীবন তোমাদের জীবনের সাথে ও আমার মৃত্যু তোমাদের মৃত্যুর সাথে জড়িত। (তাঁর কথা শুনে) তারা (আনসারীরা) ক্রন্দনরত অবস্থায় তার সামনে আসল এবং নিজেদের উদ্ভট উক্তি স্বীকার করে বলল, আল্লাহর কসম, আমরা যা উক্তি করেছি তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি কার্পণ্য ছাড়া কিছুই নয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তোমাদের এ স্বীকারোক্তিকে গ্রহণ করে তোমাদের দুর্বলতাটিকে মাফ করে দিয়েছেন”। [. সহীহ মুসলিম: ( كتاب الجهاد : باب فتح مكة ) হাদীস নং ১৭৮০; আবু দাউদ, হাদীস নং ৩০২৪; নাসায়ী, হাদীস নং ১৩৫৬১; ইবন আবী শাইবাহ, হাদীস নং ১৭৮৪৫।]

আনসারদের চারিত্রিক ও মানসিক মাহাত্ম্য থাকার পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এহেন অবস্থান তাদের অনুধাবনেরও উর্দ্ধে ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জানতেন যে, তাঁর অবস্থান সাধারণের পক্ষে অনুধাবন কঠিন। এ জন্যেই তিনি সহজভাবে বলে দিলেন:

« إِنَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُصَدِّقَانِكُمْ وَيَعْذِرَانِكُمْ »

“আল্লাহ তোমাদের এ স্বীকারোক্তিকে গ্রহণ করে তোমাদের দুর্বলতাটিকে মাফ করে দিয়েছেন”

এ ঐতিহাসিক দিনে তিনি শুধুমাত্র এ একটি পদক্ষেপই গ্রহণ করেন নি; বরং সেথায় তিনি এর থেকেও আরো অনেক চমকপ্রদ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আগামী অধ্যায়গুলোতে যার বিবরণ উপস্থাপন করার প্রয়াস চালাবো ইনশা-আল্লাহ।

আরব উপদ্বীপের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী তায়েফ। যেখানে আরবের কয়েকটি সুশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত গোত্র বসবাস করে। এ তায়েফবাসীর সাথেও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠিক সেরূপ আচরণ করলেন যেমনটি করলেন মক্কাবাসীর সাথে।

নবুওয়াত প্রাপ্তির দশম বছরে চাচা আবু তালিবের ইন্তেকালের পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ গেলেন। তায়েফবাসীকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। কিন্তু আরব্য অহংকার ও সম্ভ্রান্তির অহমিকা তাদেরকে প্রভাবান্বিত করে রেখেছিল। ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য তাদের কি করে হয়.?! তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঠাট্টা ও উপহাসের পাত্র বানিয়ে নিয়েছিল যা তিনি কল্পনাও করেন নি। তাদের কর্তা ব্যক্তিগণ তাঁর সাথে নির্লজ্বতা ও মূর্খতাসুলভ মন্তব্য করতে লাগল। দল নেতাদের এ আচরণে তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। কোনো গোত্রের প্রধান বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নিকট থেকে এ ধরণের আচরণ খুব কমই প্রকাশ পায়।

আবদ ইয়ালীল ইবন আমর বলল, “আল্লাহ যদি তাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়ে থাকেন তাহলে সে কা‘বার গিলাফের পশম উপড়ানোয় লেগে যাক।”

মাসঊদ বলল, “আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে খুজে পায় নি..?!”

হাবীব বলল, “আল্লাহর শপথ! আমি তোমার সাথে কোনো কথাই বলব না। যদি তুমি সত্য নবী হয়ে থাক তাহলে তোমার প্রতিউত্তর করলে তুমি আমার জন্য মহা ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াবে। আর যদি তুমি মিথ্যা বলে থাক তাহলে তো তোমার সাথে আমার কথা বলাই উচিত নয়..!!” [. সীরাতে ইবন হিশাম (২/২৬৭)।]

এতো কিছুর পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে দশ দিন [. ইবন সা‘আদ: আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা: (১/২১২)।] অবস্থান করে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং প্রতিটি ব্যক্তির দ্বারে দ্বারে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিলেন। কিন্তু তায়েফ নগরীর সকলেই একজোট হয়ে তাঁকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল এবং বলল, তুমি আমাদের শহর থেকে বের হয়ে যাও।

শুধু তাই নয় বরং তখন তারা তাদের নির্বোধ ও বখাটে বালকদেরকে শহরের বাহিরে প্রেরণ করে রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দিল এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গী যায়েদ ইবন হারিসাকে দুই সারির মাঝখান দিয়ে যেতে বাধ্য করল আর ওরা তাঁকে প্রস্তরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে চলল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে তা পা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। আর যায়েদ ইবন হারিছার [. যায়েদ ইবন হারিছা ইবন শারাহিল আল-কালবী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আযাদকৃত গোলাম। গোলামেদর মাঝে সর্ব প্রথম তিনিই ইসলাম গ্রহণ করেন। যয়নব বিনতে জাহাশকে বিবাহ করেন। অতঃপর তাকে তালাক দিয়ে উম্মে আইমানকে বিবাহ করেন। তার সন্তানদের মাঝে উসামাহ ইবন যায়েদ একজন। তিনি অষ্টম হিজরীতে শাম ভূ-খণ্ডের মুতা যুদ্ধে সেনাপতি হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন। দেখুন- ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতিয়াব (২/১১৪), ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (২/১৪০), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (জীবনী নং ২৮৮৫)।] মাথা ফেটে গেল। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যায়েদ ইবন হারিছা আত্মরক্ষার্থে দ্রুত শহর থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। তথাপি ঐ নির্বোধেরা গালি-গালাজ ও প্রস্তর নিক্ষেপ করতে করতে তাদের পিছু নিল। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তাঁরা রবী‘আহ-এর দুই পুত্র উ‌তবাহ ও শাইবাহ-এর বাগানে আশ্রয় নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যথাতুর হৃদয়ে অশ্রুপাত করতে করতে এ প্রসিদ্ধ দো‘আটি করলেন: তিনি বললেন,

» اللهم إنِّيْ أَشْكُو إلَيْكَ ضَعْفَ قُوَّتِيْ ، وَ قِلَّةَ حِيْلَتِيْ، وَ هَوَنِيْ عَلى النَّاسِ، أَنْتَ اَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ، إلى مَنْ تَكِلُنِي ؟ إلى عدو يتجهمني ؟ إِلَى قَرِيْبٍ مَلَّكْتَه أَمْرِي ؟ إِنْ لَمْ تَكُنْ غَضْبَانَ عَلَيَّ فَلا أُبَالِي، غَيْرَ أنَّ عَافِيَتَكَ أَوْسَعُ لِي، أَعُوذُ بِوَجْهِكَ الَّذي أشْرَقَتْ لَه الظُّلُمَاتُ، و صَلحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنْيَا وَالآخِرَةُ أنْ يَنْزِلَ بِي غَضَبُكَ، أَوْ يَحُلُّ بِي سَخَطُكَ، لَكَ العُتْبَى حَتَّى تَرْضَى، وَلاَ حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ »

“হে আল্লাহ! আপনার কাছেই আমার স্বামথ্যের দুর্বলতা, তদবীরের স্বল্পতা ও মানুষের মাঝে লাঞ্চনার অভিযোগ করছি। আপনিই সর্বোত্তম দয়ালু। আপনি আমাকে কার কাছে সোপর্দ করছেন? এমন শত্রুর কাছে যে আমার প্রতি বিষণ্ন? নাকি এমন নিকটবর্তী কারো কাছে যাকে আপনি আমার ওপর ক্ষমতাশীল বানিয়েছেন? যদি আপনি আমার ওপর রাগান্বিত না হন তাহলে আমার কোনো পরোয়া নেই। তবে আপনার ক্ষমা আমার জন্য অধিক প্রসস্ত। আপনার যে নিয়মের দ্বারা আধার চিরে আলো ওঠে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের নিয়ন্ত্রণ ঠিক রয়েছে তার অসীলায় আপনার গযব নাযিল হওয়া কিংবা শাস্তি অবতীর্ণ হওয়া থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। আপনার ওপরই সন্তুষ্ট যতক্ষণ আপনি রাজি থাকেন। আপনার সামর্থ দেওয়া ছাড়া কেউ গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে পারে না এবং আপনার তাওফীক ছাড়া কেউ নেক কাজও করতে পারে না।” [. মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ গ্রন্থে আল্লামা হাইসামী বলেন, এ হাদীসটি যদিও ত্বাবরানী বর্ণনা করেছেন; কিন্তু তাতে ইবন ইসহাক নামের একজন বর্ণনাকারী আছেন, যার গ্রহণযোগ্যতা মুদলিস পর্যায়ের। আর অন্য বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই।]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিমুখে চললেন আর ভাবছিলেন যে, কীভাবে মক্কা প্রবেশ করবেন? মক্কাবাসীরাও তো তাঁর সাথে একই আচরণ করে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সময়কার তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলছেন,

«فَانْطَلَقْتُ وَأَنَا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِي فَلَمْ أَسْتَفِقْ إِلَّا وَأَنَا بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ»

‍“তখন আমি অত্যন্ত বিষণ্ন অবস্থায় সম্মুখের দিকে চলতে লাগলাম এবং কারনূস ছা‘আলিব নামক স্থানে না পৌছা পর্যন্ত আমি সম্বিৎ ফিরে পাই নি” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب بدء الخلق : باب إذا قال أحدكم آمين والملائكة في السماء فوافقت احداهما الآخرى ) হাদীস নং ৩০৫৯; সহীহ মুসলিম: ( كتاب الجهادوالسير : باب ما لقى النبيّ صلى الله عليه وسلم من أذى المشركين والمنافقين ) হাদীস নং ১৭৯৫। আল-কারনূস ছা‘আলিব মক্কা থেকে দুই মারহালাহ দূরত্বের একটি স্থান। যা নাজদবাসীর জন্য হজের মীকাত।]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তামগ্ন হয়ে কষ্ট সহ্যকরে পথ চলতেছিলেন। যার বর্ণনায় তিনি বলেছেন,

«فَلَمْ أَسْتَفِقْ إِلَّا وَأَنَا بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ»

“কারনূস ছা‘আলিব নামক স্থানে না পৌছা পর্যন্ত আমি সম্বিৎ ফিরে পাইনি” কারনূস ছা‘আলিব তায়েফ থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরের একটি স্থান। নিশ্চই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য এটি একটি কঠিনতম মুহুর্ত। এমন কঠিনতম মুহুর্তেও তিনি বললেন,

«فَرَفَعْتُ رَأْسِي فَإِذَا أَنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أَظَلَّتْنِي فَنَظَرْتُ فَإِذَا فِيهَا جِبْرِيلُ فَنَادَانِي فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الْجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ فَنَادَانِي مَلَكُ الْجِبَالِ فَسَلَّمَ عَلَيَّ ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ فَقَالَ ذَلِكَ فِيمَا شِئْتَ إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمْ الْأَخْشَبَيْنِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللَّهُ مِنْ أَصْلَابِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ وَحْدَهُ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا»

“তারপর যখন আমি মাথা উঠালাম তখন দেখি, একখণ্ড মেঘ আমাকে ছায়াপাত করছে এবং এর মধ্যে জিবরীল আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, মহা মহিমান্বিত আল্লাহ আপনার প্রতি আপনার সম্প্রদায়ের উক্তি এবং আপনার বিরুদ্ধে তাদের উত্তরও শুনেছেন এখন তিনি আপনার নিকট পাহাড়ের ফিরিশতাকে পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আপনার সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপারে যেরূপ ইচ্ছা সেরূপ আদেশ তাঁকে করেন। তখন পাহাড়ের ফিরিশতাও আমাকে ডাক দিলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন। তারপর বললেন, ইয়া মুহাম্মাদ! আপনার রব আপনার কাছে আমাকে এজন্যে পাঠিয়েছেন যেন আপনি আপনার ইচ্ছামত আমাকে নির্দেশ দেন। (আপনি বললে) আমি এ পাহাড় দু’টিকে তাদের উপর চাপা দিয়ে দিব। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বললেন, আমি বরং আশা করছি যে, আল্লাহ তা‘আলা হয়তো এদের ঔরস থেকেই এমন বংশধরদের জন্ম দিবেন, যারা তাঁর সঙ্গে কিছু-কে শরীক না করে এক আল্লাহর ইবাদত করবে।” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب بدء الخلق : باب إذا قال أحدكم آمين والملائكة في السماء فوافقت احداهما الآخرى ) হাদীস নং ৩০৫৯।]

নিশ্চয় এটি ইতিহাসের এক বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত!!

আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাগণসহ জিবরীল আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করলেন যেন তায়েফবাসীকে ধ্বংস করে দেওয়ার ব্যাপারে একমত হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আহ্বান করেন এবং তাঁর আদেশ অনুযায়ী কাজ করেন।

সরাসরি পাহাড়ের ফিরিশতাকে পাঠানোর দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাদের ধ্বংস কামনা করতেন তাহলে এতে আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হতেন না। কিন্তু মুশরিক অবস্থায় কারো নিহত হওয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আনন্দ দেয় না। তাঁর তো মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অন্যটি। তিনি তো তায়েফবাসীকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য তায়েফে গমন করেন নি। তিনি তো তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে চাচ্ছেন, কিন্তু মানুষ তা বুঝে না। মানুষ জাহান্নামের দিকেই দৌড়াচ্ছে। চিরস্থায়ী ধ্বংস ঠেকানোর জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিজেদের চেয়েও তাদের জীবনের প্রতি অধিক উৎসুক। তাইতো তিনি ফিরিশতাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কোনো দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন “আল্লাহ তা‘আলা হয়তো এদের ঔরস থেকেই এমন বংশধরদের জন্ম দিবেন, যারা তাঁর সঙ্গে কিছু-কে শরীক না করে এক আল্লাহর ইবাদত করবে।”

কোনো জাতির কি এমন ইতিহাস আছে.?

মুসলিমরা কি তাদের অতীত ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠার পরতে পরতে এবং নবী জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে মহা ধন-ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে সেগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত?

দিন অতিবাহিত হচ্ছে। সময় ফেরিয়ে যাচ্ছে। তায়েফের সাক্বীফ গোত্র এখনো কুফুরীতেই অটল আছে। এর মধ্যে ইসলামের অনেক বিরোধিতা করেছে। আল্লাহর দীনের পথে বহু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এক পর্যায়ে মুসলিমদেরকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য হাওয়াযিন গোত্রের সাথে মিলিত হয়ে হুনাইনের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পরিশেষে পরাজিত হয়ে পালিয়ে তায়েফে গিয়ে উঠল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমাস পর্যন্ত তায়েফ অবরোধ করে রাখলেন। কিন্তু তায়েফের দূর্গগুলোর মজবুতি ও সৈন্যদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে তায়েফ বিজয় করতে পারলেন না এবং সেখান থেকেই অবরোধ উঠিয়ে ফিরে আসলেন। সাহাবীদের ব্যাপারটি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সাকীফের তিরন্দাজ বাহিনী আমাদেরকে অনেক জ্বালিয়েছে। আপনি তাদের জন্য বদ-দো‘আ করুন।

তিনি বললেন, হে আল্লাহ আপনি সাকীফ গোত্রকে হিদায়াত দান করুন..!! [. তিরমিযী হাদীস নং ৩৯৪২। তিনি বলেন, এটি হাসান, সহীহ, গারীব। আহমদ, হাদীস নং ১৪৭৪৩।]

এত সব দুঃখ-কষ্ট ও যাতনার পরেও তাঁর প্রতি উত্তর ছিল -হে আল্লাহ আপনি সাকীফ গোত্রকে হিদায়াত দান করুন..!!

হ্যাঁ, হে আল্লাহ আপনি সাকীফ গোত্রকে হিদায়াত দান করুন এবং গোটা মানবজাতিকে হিদায়াত দান করুন...!

যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে জানে। যে তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও টার্গেট সম্পর্কে অবহিত। যে তাঁর চারিত্রিক মাহাত্ম, গুণ-গরিমার শ্রেষ্ঠত্ব, আভ্যন্তরীন পরিচ্ছন্নতা ও ক্বলবের স্বচ্ছতাকে বুঝতে পেরেছে....।

এ সব কিছু যে ব্যক্তি জানে তার কাছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কাজই অবাক করার মতো মনে হবে না। তাঁর কোনো আচরণেই সে আশ্চর্যান্বিত হবে না।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সংক্ষিপ্ততা ও দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়াকে, জান্নাতের মূল্য ও তার মাহাত্মকে এবং জাহান্নামের শাস্তি ও তার কঠোরতাকে ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি পুরো জীবনটাকেই গোটা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন। নিজের কোনো অধিকারের চিন্তা তিনি করেন নি। নিজস্ব স্বার্থ-চিন্তা কিংবা নিজের প্রতি কারো অবিচারের প্রতিশোধ চিন্তা কিছুই করেন নি।

হে আল্লাহ! আপনি তাঁর দলে আমাদের হাশর করুন এবং তাঁর ঝাণ্ডার নিচেই আমাদের একত্রিত করুন।

আল্লাহ চাহে তো, আগামী অধ্যায়ে আশ্চর্যজনক ও অভূতপূর্ব সব দৃশ্য চিত্রিত হবে। কতই না পবিত্র সেই সত্ত্বা যিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কৃত অনুগ্রহকে বিশেষায়িত করেছেন এভাবে যে,

﴿وَكانَ فَضلُ اللهِ عليكَ عَظِيمًا﴾ [ النساء : ١١٣ ]

“আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৩]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন