hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ

লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী

৩৮
দুই. ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ‌’র সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণ।
মালেক ইবন ‘আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো একই ধরণের আচরণ করেছেন তিনি তাঈ গোত্রের অধিপতি ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ‌’র সাথেও। বনু তাঈ ছিল দীর্ঘদিন থেকে ইসলামের বিরোধিতায় অতি কট্টর একটি গোত্র। তাদের অতীত প্রেক্ষাপটে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা তাদের এ নতুন দীন ইসলামে প্রবেশকে আরো কঠিন করে দিয়েছে। এটি ছিল কাহতানী [. আরবের গোত্রগুলো প্রধানত দু’টি শাখায় বিভক্ত। আদনান ও কাহতান। আদনানের উপশাখা হচ্ছে- সাক্বীফ, বনু কিলাব ও বনু বকর ইবন ওয়ায়েল। কাহতানের উপশাখা হলো- বুজাইলাহ ও বনু তাঈ।] শাখাসমূহের একটি। যাদের অবস্থান ছিল আদনানী শাখা কুরাইশ থেকে অনেক দিক থেকেই দূরে। এজন্যই উভয়ের মাঝের গোত্রগত বিভেদ-বিভাজন ছিল সর্বোচ্ছ পর্যায়ের। বনু তাঈ গোত্রের নিজস্ব একটি দেবতা ছিল। যার নাম ছিল ‘ফিলস’। বিভিন্ন স্থান থেকে লোকেরা তা দেখার জন্য আসত। আবার তাদের মধ্যে কিছুলোক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে রোম সম্রাজ্যের সাথে মিত্রতা গড়ে তোলে এবং তাদের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চলতে শুরু করে। এজন্যই এ গোত্রের ইসলামি চিন্তা-চেতনাকে গ্রহণ করার পেছনে অনেকগুলো বিষয় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোত্রীয় বিভেদ, চিন্তাগত অনৈক্য ও তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র তথা রোম সম্রাজ্যের সাথে তাদের বন্ধুত্ব স্থাপন তার মধ্যে অন্যতম। উপরন্তু সে সময় তারা ছিল ঐ সমস্ত গোত্রসমূহের মধ্যে একটি, যারা আরব উপ-দ্বীপের অনেক দূর পর্যন্ত নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল। এমনকি বনু তাঈ গোত্রের লোকদের সন্তুষ্টি ও অনুমোদন ব্যতীত ইরাক কিংবা শাম অভিমুখে কেউ নিরাপদে সফর পর্যন্ত করতে পারতো না। এবার একটু ভেবে দেখুন যে, তাদের ইসলাম গ্রহণ করা কতটা দুরূহ ব্যাপার ছিল। ইসলাম বিরোধিতায় তাদের অবস্থান আরো ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবেন যখন আপনি শুনবেন যে, কুখ্যাত ইয়াহূদী নেতা কা‌‘ব ইবন আশরাফ এ গোত্রেরই লোক ছিল। যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলিমদের জন্য শত্রুতার জাল বিছিয়ে রাখতো। তার পিতা ছিল তাঈ গোত্রের। মাতা বনু নাদ্বীরের। যখন তার ষড়যন্ত্র মাত্রারিক্ত বেড়ে গিয়েছিল এবং গোটা আরব ভূ-খণ্ডকে সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তাকে হত্যা করে ফেলা হয়। তাঈ গোত্র আরবের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য যতগুলো পয়েন্ট ছিল কা‘ব ইবন আশরাফের হত্যার মধ্য দিয়ে তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট ঝরে গেল। এ প্রভাবশালী গোত্রের গোত্রপতি ছিল দানশীলতা ও মেহমানদারীর প্রবাদপুরুষ প্রখ্যাত আরবনেতা হাতেম তাঈ’র ছেলে ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ‌। ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ‌ দেখল যে, তার পায়ের নিচের জমিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আরব উপ-দ্বীপে তার অবস্থান অত্যন্ত নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। তাই সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রচণ্ডরকম হিংসা করতে শুরু করল। এমনকি সে বলে ফেলল যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রেরিত হয়েছেন তখন তার চেয়ে অধিক ঘৃণা আমি কখনো কোনো কিছুকেই করি নি। [. ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (৩/৫০৪), আয-যাহবী: তারীখুল ইসলাম (১/৩৫৪)।]

অনেক দিন পরের কথা। মক্কা বিজয় হয়ে গেল। মক্কাবাসীরা নিরাপত্তার সাথে বসবাস করছে। হাওয়াযিনও ইসলামের ছায়াতলে এসে গেল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন স্থানে মানুষের গড়া দেব-দেবিগুলোকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য অনেকগুলো সারিয়্যাহ (অভিযান) প্রেরণ করলেন। বনু তাঈ গোত্রের দেবতা ‘ফিলস’কে ধ্বংস করার জন্যও আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। প্রথমে তারা এ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিল। অনেকে বন্দি হয়। ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ পালিয়ে শামের মিত্রদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। তার বোনকেও বন্দি করা হয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মুক্তিপণ ছাড়াই তাকে ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পেয়ে সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে আসার জন্য শামের বিভিন্ন অঞ্চলে তার ভাইকে খুঁজতে লাগল। এক পর্যায়ে ভাইকে খুঁজে পেয়ে বলল, ‘তুমি এমন কাজ করেছ যা তোমার বাবা কখনো করে নি। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক চল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে যাই।’ [. মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৯৪০০; ইবন হিব্বান হাদীস নং ৭২০৬; তাবরানী, হাদীস নং ১৩৯২৫।]

সে সময় অন্য দেশে আশ্রিত হয়ে থাকার জন্য ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ নিজেই নিজ জীবনের ওপর ছিল অতীষ্ট। সে সময়কার তার অবস্থার চিত্রায়ন তার মুখ থেকেই শুনুন- ‘আদী ইবন হাতেম বলেন, “সে সময় আমার অবস্থানের ওপর আমি নিজেই সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমার মনে হলো যে, পালিয়ে না এসে যুদ্ধমাঠে নিহত হয়ে যাওয়াই আমার জন্য অনেক ভালো ছিল। তাই আমি আমার বোনকে বললাম যে, আমি তার (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) নিকট যাবো। যদি তিনি সত্যবাদী হন তাহলে আমি তার কথা মেনে নেব। আর যদি সে মিথ্যাবাদী হয় তাহলে সে আমার কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না।” [. মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৯৩৯৭; মুসতাদরাকে হাকিম হাদীস নং ৮৫৮২; ইবন হিব্বান হাদীস নং ৬৬৭৯; ইমাম বুখারীও নবুওয়াতের আলামত অধ্যায়ে এ হাদীসের কিছু অংশ উল্লেখ করেছেন: হাদীস নং ৩৪০০।]

ভগ্ন হৃদয়, দুর্বল চিত্ত ও বিপর্যস্ত মানসিকতা নিয়ে ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ মদীনায় ফিরে আসল। আর তার দুরাবস্থার কথা তো কারো কাছেই অজানা নয়। দেখা যাক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কেমন আচরণ করেন।

আদী’র নিজেরই বর্ণনা, “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আদী ইবন হাতেম! ইসলাম গ্রহণ কর, শান্তিতে থাকতে পারবে। একথা তিনি তিনবার বললেন।

আমি বললাম, আমি তো একটি দীনের ওপর রয়েছি।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার দীন সম্পর্কে তোমার চেয়ে আমি বেশি জানি।

আমি বললাম: আপনি আমার দীন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানেন?!

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি কি রকুসিয়্যাহ [. খ্রিস্টানদের একটি বিকৃত শাখা।] সম্প্রদায়ের লোক নও? তুমি কি তোমার সম্প্রদায়ের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক চতুর্থাংশ খেয়ে ফেলো না?

আমি বললাম: হ্যাঁ।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: তোমার দীন অনুযায়ী এটা তোমার জন্য বৈধ নয়।

(‘আদী ইবন হাতেম বলেন) এরপর তিনি যাই বললেন আমি অবনত মস্তকে শুধু শুনে গেলাম।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কেন এখনো ইসলাম গ্রহণ করতে পারছো না তাও আমি জানি। তুমি ভাবছো যে, আমার অনুসারীগণ সবাই দরিদ্র শ্রেণির লোক। আমাদের কোন শক্তি-সামর্থ্য নেই। আরবরা আমাদেরকে একবার তাড়িয়ে দিয়েছিল। আচ্ছা তুমি কি হেরাত [. ইরাকের কূফা নগরীর একটি স্থান।] চেনো?

আমি বলল: নাম শুনেছি। কখনো দেখি নি।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঐ সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! আল্লাহ অবশ্যই এ দীনের পরিপূর্ণতা দান করবেন। এমন এক সময় আসবে যখন হেরাত থেকে একজন উষ্ট্রারোহিনী নারী একাকি ভ্রমন করে কা‘বা ঘর তাওয়াফ করে নিরাপদে ফিরে যেতে পারবে। আল্লাহ অবশ্যই কিসরা ইবন হরমুজের ধন-ভাণ্ডারকেও আমাদের হস্তগত করে দেবেন।

আমি বললাম, কিসরা ইবন হরমুজের?

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হ্যাঁ, কিসরা ইবন হরমুজের এবং মুসলিমদেরকে এত বেশি সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়া হবে যে, দান করার জন্য লোক খুঁজা হবে; কিন্তু কেউ তা গ্রহণ করবে না।” [. মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৯৩৯৭।]

এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত সহজেই এক প্রসিদ্ধ কাফির নেতাকে মুসলিমদের সারিতে যুক্ত করে নিলেন। এটাও ভাবলেন না যে, হতে পারে সে ভেতরে ভেতরে বনু তাঈ গোত্রকে আবারও ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। তাকে অতীতের তার ইসলাম বিরোধী যুদ্ধগুলোর কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন না। তার সাথে কোনোরূপ অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশও করলেন না; বরং তিনি তার সাথে ধৈর্য ও নম্রতার সাথে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করলেন।

পরবর্তীতে ‘আদী ইবন হাতেম তাঈ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন: “এখন তো একজন উষ্ট্রারোহিনী নারী হেরাত থেকে একাকি ভ্রমন করে কা‘বা ঘর তাওয়াফ করে নিরাপদে ঘরে ফিরে যেতে পারে। কিসরা ইবন হরমুজের ধন-ভাণ্ডারের বিজয়াভিযানে আমি নিজেই উপস্থিত ছিলাম। আর তৃতীয় কথাটিও (দান গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া না যাওয়ার কথা) অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে, কারণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বলেছেন।”

তিন. আবদ ইয়ালীল ইবন আমর আস-সাক্বাফী-র সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণ।

উপসংহারে আমরা এমন এক আশ্চর্যজনক ব্যক্তির সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণের ঘটনার অবতারণা করছি কেউ ভাবতেও পারে নি যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরণের ব্যক্তির সাথেও ভালো আচরণ করবেন। এ ব্যক্তি দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে অনেকগুলো গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে রেখেছিল। আবার যখনও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসেছিল তখনও অন্যান্য শত্রুনেতাদের মতো ইসলাম গ্রহণের মানসিকতা নিয়ে নয়; বরং এসেছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঝগড়া ও বিতর্ক করার জন্য। গোটা আরব ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এ ছিল একজন। এ হচ্ছে প্রখ্যাত সাক্বীফ গোত্রের অধিপতি আবদ ইয়ালীল ইবন আমর আস-সাক্বাফী। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার অতীতের অধ্যায় অত্যন্ত কলংজনক।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার ঘটনার সূচনা হয় নবী-পিতৃব্য আবু তালিবের মৃত্যুর পর মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলামি দাওয়াতের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সাক্বীফ গোত্রকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য তায়েফ অভিমুখে রওয়ানা করলেন। তাদের নিকট থেকে তিনি সম্মানজনক আচরণের আশা করেছিলেন। সাক্বীফের নেতৃস্থানীয় তিন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করলেন। যাদের প্রধান ছিল এ আবদ ইয়ালীল ইবন আমর আস-সাক্বাফী। তাদের নিকট বিষয়টি পেশ করলেন। কিন্তু ধারণাতিতভাবে তাদের নিকট অসম্মতি, অস্বীকার ও বিরুদ্ধাচণ ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। শুধু কি তাই? বরং তারা তাকে ঠাট্টা, বিদ্রুপ, অপমান-অপদস্থ ও কটুক্তি করতেও কমতি করে নি। এমনকি তাদের প্রধান আবদ ইয়ালীল ইবন আমর মন্তব্য করেছিল যে,“আল্লাহ যদি তাকে নবী করে পাঠিয়ে থাকেন তাহলে সে কা‘বার গিলাফের পশম উপড়ানোয় লেগে যাক।” [. তাবারী: তারীখুল উমামি ওয়াল মুলুক (১/৫৫৪)।]

এরপর তারা বখাটে বালক ও নির্বোধ লোকদেরকে লেলিয়ে দিল। যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথী যায়েদ ইবন হারেছাকে গালাগালি ও পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে তায়েফের সীমানা থেকে বের করে দিয়েছিল। দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত বড় আঘাত আর কোথাও পান নি।

সাক্কীফের খুব কম লোকই ঈমান এনেছিল। সম্ভবত মক্কা বিজয়ের পূর্বে প্রসিদ্ধ সাহাবী মুগীরাহ ইবন শু‘বাহ [. মুগীরাহ ইবন শু’বাহ ইবন আবু আমের ইবন মাসঊদ সাক্বাফী। খনদকের দিন (কারো মতে, হুদায়বিয়ার দিন) ইসলাম গ্রহণ করেন। শা’বী হতে বর্ণিত: ‘আরবে চারজন বিচক্ষন ব্যক্তি ছিলেন। মু‘আবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান, আমর ইবনুল আস, মুগীরাহ ইবন শু‘বাহ ও যিয়াদ।’ তিনি ৫০ হিজরীতে কুফায় ইন্তিকাল করেন। অধিকতর জানতে- ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (৪/৪৫৪), ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতি‘আব (৪/৭), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (৮২৭৯)।] ব্যতীত সাক্বীফ গোত্রের আর কেউই ঈমান গ্রহণ করে নি।

এরপর তারা হাওয়াযিন গোত্রের সাথে মিত্রতা করে মুসলিমদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। অষ্টম হিজরীর হুনাইন যুদ্ধে [. মক্কা বিজয়ের পর।] যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পর তাদের সৈনিকরা তায়েফের দূর্গগুলোতে আশ্রয় নেয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণ একমাস [. তাবারী: তারীখুল উমামি ওয়াল মুলুক (২/১৭১)।] পর্যন্ত সে দূর্গগুলো অবরোধ করে রাখেন। কিন্তু তাদেরকে বের করে আনতে সক্ষম হলেন না। অতঃপর এ অবস্থাতে তায়েফ বিজয় ছাড়াই স্থান ত্যাগ করে ফিরে আসেন। এটি মেনে নিতে সাহাবীদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টিকে সহজ করে দিলেন এবং সাক্বীফ গোত্রের হিদায়াতের জন্য দো‘আ করলেন।

সাক্বীফের অপরাধ আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যখন তারা তাদের নেতা উরওয়া ইবন মাসউদ [. উরওয়া ইবন মাসঊদ ইবন সাক্বীফ। হুদায়বিয়ার দিন কুরাইশরা যাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পাঠিয়েছিল তিনি তাদের মধ্যে ছিলেন। নিজ সম্প্রদায়ের সামনে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন এবং তাদেরেক ইসলামের প্রতি আহ্বান জানান। কওমের লোকেরা চতুর্দিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলে একটি তীর বিদ্ধ হয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তে তাকে প্রশ্ন করা হলো যে, তোমার এ মৃত্যু সম্পর্কে তোমার মন্তব্য কী? তিনি বললেন, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান এবং শাহাদাতের অমীয় সুধা যা আল্লাহ আমাকে পান করিয়েছেন। আমি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আল্লাহর রাহে শাহাদাত বরণকারীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি। তোমরা আমাকে তাদের সাথে সমাহিত করিও। তাকে শহীদদের সাথেই সমাহিত করা হয়েছে। অধিকতর জানতে- ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতি‘আব (৩/১৭৬), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (৫৫২৭)।] রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইসলাম গ্রহণ ও ইসলামের প্রতি তাদেরকে আহ্বান করার অপরাধে হত্যা করে ফেলে। এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে খুব প্রভাব ফেলেছিল।

অনেক দিন পর নবম হিজরীর রমযান মাসে সাক্বীফ গোত্রের লোকেরা যখন দেখল যে, মুসলিমরাই এখন আরব উপ-দ্বীপের একমাত্র প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে তাবুকে রোমীয়দের পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর। তখন তারা মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণের চিন্তা মাথায় নিল। তাদের কথা ও কাজ-কর্ম দ্বারা স্পষ্ট বুঝা গিয়েছিল যে, তারা ইসলামকে ভালোবেসে বা ইসলামের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে নয়; বরং তারা এজন্যই ইসলামকে মেনে নিচ্ছে যে, এখন আর ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই তারা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মতবিনিময়, কথোপকথন ও সম্ভাব্য সর্বোচ্ছ পর্যায়ের সু-সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি প্রতিনিধি দলকে প্রেরণ করল। যাদের নেতৃত্বে ছিল সেই আবদ ইয়ালীল ইবন আমর যে কোনো একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অত্যন্ত লজ্জাজনক বিদ্রুপ করেছিল। কিন্তু সময় অনেক বদলেছে। এখন সে দুর্বল চিত্তে অবনত মস্তকে শক্তি ও ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মহান রাষ্ট্রনায়ক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছে।

আবদ ইয়ালীল ইবন আমরের নেতৃত্বে সাক্বীফের প্রতিনিধি দলকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের অতীতের কোনো কিছুই স্মরণ করিয়ে দেন নি। যেদিন সাহায্যের আবেদন নিয়ে তাদের নিকট গিয়েছিলেন সেদিনের অপমানকর ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাসের কথাও উল্লেখ করেন নি। এটাও বলেন নি যে, আজ প্রতিশোধের দিন। আজকের দিন সেদিনের বদলা নেওয়ার দিন, যেদিন তোমরা আমাকে উপহাস করেছিলে। বরং তিনি তাদেরকে অভিবাদন, হাসি-মুখ, সদাচরণ, ভোজ-সভা ও উপঢৌকন দ্বারা বরণ করে নিলেন। তদের নিকট বসলেন। তাদের মতামত ও চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতামূলক উপস্থাপনাগুলো শুনে গেলেন। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না এবং রাগান্বিতও হলেন না। বাদানুবাদ করলেন শান্ত স্বরে। কথা বললেন ধীরতার সাথে। তারা কয়েকটি শর্তে ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করল। তাদেরকে সুদ, যিনা-ব্যভিচার ও মদ্যপানের অনুমতি দিতে হবে। সালাত মওকূফ করে দিতে হবে। তাদের দেবতা ‘লাত’-কে [. ‘লাত’ হচ্ছে তায়েফের সাক্বীফ গোত্রের একটি দেবতার নাম। দেখুন- ইবনুল আসীর: আন-নিহায়াতু ফী গারীবিল আসার (৪/৪১৩)।] অক্ষত রাখতে হবে। [. দেখুন- ইবন কাসীর: আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ (৫/৩৩), ইবনু সাইয়িদিন নাস: উয়ূনুল আসার (২/৩০৬)।]

তাদের এসব নির্বুদ্ধিতামূলক দাবী প্রমাণ করে যে, তারা ইসলামের অর্থই বুঝে নি। তাদের এসব অমূলক দাবী-দাওয়ার কথা শুনেও তিনি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন না এবং তাদের থেকে বিচ্ছিন্নও হলেন না; বরং তাদেরকে বিস্তারিত বুঝাতে লাগলেন এবং অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে তাদের দাবীগুলো প্রত্যাখ্যান করে গেলেন। সকল কথার ক্ষেত্রেই তিনি নম্রতা ও কোমলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। ইশার পর থেকে সারারাত তিনি তাদের সাথে আলাপচারিতায় কাটিয়ে দিলেন। তাদের সম্মানার্থে মসজিদে নববীতে তিনি তাদের জন্য আলাদা তাঁবু স্থাপন করলেন। [. ইবন সা‘দ: আত-তাবাকাতুল কুবরা (১/৩১৩)।] অথচ তারা এখনো পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করে নি।

চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে সাক্বীফ গোত্রের প্রতিনিধি দল কোনো ছাড় ও অপূর্ণতা ছাড়াই ইসলামকে গ্রহণ করে নিল। পরে গোত্রের অন্য সকলেও ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হল। পরবর্তীতে তারাই ছিল দীনের ওপর অধিক অটল ও অবিচল। এমনকি ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফিতনা ছড়িয়ে পড়লেও।

এটা নিশ্চিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন। তাদেরকে দূরাবস্থায় পেয়ে যদি আনন্দ ও মনোতুষ্টি প্রকাশ করতেন। তাহলে বর্তমান অবস্থায় তাদেরকে নিয়ে আসা যেত না; বরং আরব ভূখণ্ডে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তারা পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে যা দেখতে পেলাম এতে তিনি আমাদেরকে নম্রতা ও সদাচরণেরই সবক শেখালেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إن الله رفيق يحب الرفق، ويعطي على الرفق مالايعطي على العنف ومالايعطي على ماسواه»

“আল্লাহ সহনশীল। তিনি সহনশীলতাকে পছন্দ করেন। তিনি সহনশীলতার অবস্থায় যা দান করেন কঠোরতার অবস্থায় তা দান করেন না এবং অন্য কোনো অবস্থায়ও তা দান করেন না।” [. সহীহ মুসলিম: ( كتاب البر والصلة والأدب، باب فضل الرفق ) হাদীস নং ২৫৯৩, ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৫৫২, বায়হাকী: আস-সুনানুল কুবরা, হাদীস নং ২০৫৮৬।]

আরব ভূ-খণ্ডেরই নয় শুধু; বরং গোটা পৃথিবীর শান্তি ও কল্যাণ বিরুদ্ধাচারীদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আচরণ-বিধিতেই আমরা দেখতে পেয়েছি। বিনয় ও নম্রতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে কতইনা চমৎকার কথা তিনি বলেছেন,

«من يحرم الرفق يحرم الخير»

“যে নম্রতা থেকে বঞ্চিত সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।” [. সহীহ মুসলিম: ( كتاب البر والصلة والأدب، باب فضل الرفق ) হাদীস নং ২৫৯২, সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৮০৯, ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৬৮৭, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৯২২৯, ইবন হিব্বান: জুবাইর হতে, তিনি আব্দুল্লাহ আল-বাজালী হতে- হাদীস নং ৫৪৮।]

وصل اللهم و سلم و بارك على من علم الناس الخير وهداهم إلى الرشد ... رسول الله و على آله وصحبه وسلم .

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন