HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আম্মা পারা

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
সূরাভিত্তিক তাফসীর (আম্মা পারা)

[আরবি আয়াত, শাব্দিক অনুবাদ, সরল অনুবাদ, আয়াত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা এবং গুরুত্বপূর্ণ টীকা সম্বলিত]

সংকলন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

সম্পাদনা

মোহাম্মাদ ইমাম হোসাইন কামরুল

প্রথম কথা
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِه مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ

৩০তম পারাটি প্রকাশ করতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর উপর।

কুরআন মাজীদ হেদায়াতের মূল উৎস। এটা আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজের মানুষ অনেকেই কুরআন থেকে হেদায়াত নিতে চায় না। আবার অনেকে কুরআন তিলাওয়াত করে শুধু নেকী অর্জনের কাজে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তারা এ কথা চিন্তা করেন না যে, আল্লাহ তা‘আলা শুধু শব্দ তিলাওয়াত করার জন্য কুরআন নাযিল করেননি। তিনি এটা নাযিল করেছেন, এটা পড়ে-বুঝে সে অনুযায়ী নিজেদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করার জন্য। মানুষ যাতে সহজে কুরআন বুঝতে পারে এবং সাধারণ মানুষের নিকট কুরআনের শিক্ষাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় সে লক্ষ্যেই এ প্রচেষ্টা।

কুরআন মাজীদের ৩০তম পারাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কুরআন মাজীদের ছোট ছোট সূরাগুলো এ পারাতেই রয়েছে এবং এ সূরাগুলো প্রায় সকল মুসল্লীই সালাতের মধ্যে পড়ে থাকেন। তাই সালাতে খুশু-খুজু ধরে রাখার জন্য এবং পঠিত সূরা থেকে শিক্ষা লাভের জন্য এ সূরাগুলার অর্থ ও ব্যাখ্যা জানা অতীব জরুরি। এ কিতাবটিতে ৩০তম পারার সূরাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি মুসলিম ভাই-বোনেরা এ থেকে যথেষ্ট উপকার লাভ করতে পারবেন ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন বুঝে কুরআন অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন

বইটি প্রকাশনার কাজে যাদের সহযোগিতা রয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন

দু‘আ প্রার্থী

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

০১৯১২-১৭৫৩৯৬

১৭/০৫/২০১৮ ইং

১ রমাদ্বান ১৪৩৯ হিঃ

৭৮- সূরা নাবা
সূরার নামকরণ :

সূরাটির দ্বিতীয় আয়াতে উল্লেখিত اَلنَّبَاُ (আন নাবা) শব্দটিকেই সূরার নাম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। নাবা শব্দের অর্থ হচ্ছে, সংবাদ বা খবর।

নাযিলের সময়কাল :

এই সূরাটি ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।

সূরার বিষয়বস্তু :

ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ ﷺ যেসব বিষয়ের উপর দাওয়াত প্রদান করেছিলেন তা হলো- (১) তাওহীদ, (২) নবীর রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, (৩) আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন।

প্রথম দুটি বিষয়ের তুলনায় তৃতীয় বিষয়টি মেনে নেয়া মক্কাবাসীদের জন্য অনেক বেশি কঠিন ছিল। এ কারণে মক্কার প্রাথমিক যুগের সূরাগুলোতে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসকে মনের মধ্যে মজবুতভাবে বদ্ধমূল করে দেয়ার উপরই বেশি জোর দেয়া হয়েছে।

এ সূরাটিতে মূলত চারটি বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। (এক) কিয়ামতের ভয়াবহতার বিবরণ। (দুই) মূর্খদের ধমক প্রদান। (তিন) কিয়ামতের প্রমাণ উপস্থাপন। (চার) কিয়ামতের পর চূড়ান্ত শাস্তি অথবা সুখের বর্ণনা।

কিয়ামতের খবর শুনে সর্বত্র যেসব আলোচনা, সমালোচনা শুরু হয়েছিল সবার আগে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারপর অস্বীকারকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তোমাদের জন্য যে জমিকে আমি বিছানা বানিয়ে দিয়েছি তা কি তোমাদের নজরে পড়ে না? জমির মধ্যে আমি এই যে উঁচু বিশাল বিস্তৃত পাহাড়সমূহ গেঁড়ে রেখেছি তা কি তোমাদের নজরে পড়ে না? এসব জিনিস কি তোমাদের এ কথা জানাচ্ছে না যে, আমি কিয়ামত কায়েম করতে সক্ষম।

এরপর নিশ্চিতভাবে বলা হয়েছে, বিচারের দিন নির্ধারিত সময়ে অবশ্যই আসবে। শিঙ্গায় ফুঁক দেবার সাথে সাথেই তোমাদের যেসব বিষয়ের খবর দেয়া হচ্ছে তা সবই সামনে এসে যাবে। তোমরা যে যেখানে মরে থাকবে সেখান থেকে নিজেদের হিসাব দেবার জন্য দলে দলে বের হয়ে আসবে।

এরপর বলা হয়েছে, যারা হিসাব-নিকাশের আশা করে না এবং যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে তাদের প্রত্যেকটি কথা ও কাজ লিখা হচ্ছে। তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য জাহান্নাম ওঁৎ পেতে বসে আছে।

এরপর এমনসব লোকের উত্তম প্রতিদানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যারা আল্লাহর কাছে নিজেদের সমস্ত কাজের জবাবদিহিতার ভয় করত। তারা দুনিয়ার জীবনে আখেরাতের কাজ করেছে। তাদের কার্যাবলীর শুধু প্রতিদানই দেয়া হবে না; বরং তার চাইতে বেশি পুরস্কারও দেয়া হবে।

সবশেষে আল্লাহর আদালতের চিত্র আঁকা হয়েছে। সেখানে কারো নিজের সাথে সম্পর্কিত লোকদের মাফ করিয়ে নেয়া তো দূরের কথা, অনুমতি ছাড়া কেউ কথাই বলতে পারবে না।

তারপর এক সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বক্তব্য শেষ করা হয়েছে। এ সাবধানবাণী সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বুঝবে না সে কেবল অনুতাপই করবে। সে আফসোস করে বলতে থাকবে, হায়! যদি দুনিয়ায় আমার জন্মই না হতো। আজ যে দুনিয়ার প্রেমে সে পাগল সেদিন সেই দুনিয়ার জন্যই তার মনে এ অনুভূতি জাগবে।

আয়াত : ১-১৬



عَمَّ يَتَسَآءَلُوْنَ (১) عَنِ النَّبَاِ الْعَظِيْمِ (২) اَلَّذِيْ هُمْ فِيْهِ مُخْتَلِفُوْنَ (৩) كَلَّا سَيَعْلَمُوْنَ (৪) ثُمَّ كَلَّا سَيَعْلَمُوْنَ (৫) اَلَمْ نَجْعَلِ الْاَرْضَ مِهَادًا (৬) وَالْجِبَالَ اَوْتَادًا (৭) وَخَلَقْنَاكُمْ اَزْوَاجًا (৮) وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا (৯) وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (১০) وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا (১১) وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا (১২) وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَّهَّاجًا (১৩) وَاَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَآءً ثَجَّاجًا (১৪) لِنُخْرِجَ بِه حَبًّا وَّنَبَاتًا (১৫) وَجَنَّاتٍ اَلْفَافًا (১৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) عَمَّ কোন বিষয়ে يَتَسَآءَلُوْنَ তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করছে? (২) عَنِ النَّبَاِ সে সংবাদের বিষয়ে اَلْعَظِيْمِ মহা। (৩) اَلَّذِيْ هُمْ فِيْهِ যে বিষয়ে তারা مُخْتَلِفُوْنَ মতভেদ করছে।

(৪) كَلَّا কখনই নয়, سَيَعْلَمُوْنَ শীঘ্রই তারা জানতে পারবে। (৫) ثُمَّ অতঃপর كَلَّا কখনই নয় سَيَعْلَمُوْنَ শীঘ্রই তারা জানতে পারবে। (৬) اَلَمْ نَجْعَلْ আমি কি করিনি اَلْاَرْضَ জমিনকে مِهَادًا বিছানাস্বরূপ? (৭) وَالْجِبَالَ এবং পাহাড়সমূহকে اَوْتَادًا পেরেকস্বরূপ? (৮) وَخَلَقْنَاكُمْ আর আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি اَزْوَاجًا জোড়ায় জোড়ায়। (৯) وَجَعَلْنَا আর আমি করেছি نَوْمَكُمْ তোমাদের নিদ্রাকে سُبَاتًا আরামদায়ক। (১০) وَجَعَلْنَا এবং করেছি اَللَّيْلَ রাত্রিকে لِبَاسًا আবরণস্বরূপ। (১১) وَجَعَلْنَا আর আমিই করেছি اَلنَّهَارَ দিনকে مَعَاشًا জীবিকা অর্জনের (সময়); (১২) وَبَنَيْنَا আর আমিই নির্মাণ করেছি فَوْقَكُمْ তোমাদের উপর سَبْعًا সাতটি (আকাশ) شِدَادًا মজবুত। (১৩) وَجَعَلْنَا এবং আমি সৃষ্টি করেছি سِرَاجًا একটি প্রদীপ وَهَّاجًا দীপ্তমান, (১৪) وَاَنْزَلْنَا আর আমিই বর্ষণ করি مِنَ الْمُعْصِرَاتِ মেঘমালা থেকে مَآءً পানি ثَجَّاجًا প্রচুর, (১৫) لِنُخْرِجَ যেন আমি উৎপন্ন করি بِه  তা দিয়ে حَبًّا শস্য وَنَبَاتًا ও উদ্ভিদ, (১৬) وَجَنَّاتٍ এবং বাগানসমূহ اَلْفَافًا ঘনপল্লবিত।

সরল অনুবাদ :

(১) তারা পরস্পর কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? (২) সেই মহা সংবাদের বিষয়ে।১ (৩) যে বিষয়ে তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে।২ (৪) কখনই নয়৩, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে; (৫) অতঃপর কখনই নয়, শীঘ্রই তারা জানতে পারবে। (৬) আমি কি জমিনকে বিছানাস্বরূপ করিনি? (৭) এবং পাহাড়সমূহকে পেরেকস্বরূপ। (৮) আর আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়। (৯) আমিই তোমাদের নিদ্রাকে করেছি আরামদায়ক।৪ (১০) এবং রাত্রিকে করেছি আবরণস্বরূপ। (১১) আর আমি দিবসকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়; (১২) আর আমিই নির্মাণ করেছি তোমাদের উপর সাতটি মজবুত আসমান।৫ (১৩) এবং আমি সৃষ্টি করেছি একটি দীপ্তিমান প্রদীপ।৬ (১৪) আমিই বর্ষণ করি মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টির পানি, (১৫) যেন আমি তা দিয়ে উৎপন্ন করি শস্য ও উদ্ভিদ, (১৬) এবং বৃক্ষাদিতে পরিপূর্ণ বাগানসমূহ ।

টীকা :

[১] তারা কী বিষয়ে পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? এ প্রশ্ন করার পর আল্লাহ নিজেই উত্তর দিয়েছেন যে, মহাখবর সম্পর্কে। এখানে মহাখবর বলে কিয়ামত দিবসকে বুঝানো হয়েছে।

[২] পরকাল সম্পর্কে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মত ছিল। কেউ কেউ একদম পরিষ্কার বলতো, ‘‘আমাদের এ দুনিয়ার জীবনটিই সবকিছু এবং মরার পর আমাদের আর কখনো দ্বিতীয়বার উঠানো হবে না’’- (সূরা আনআম- ২৯)। আবার কেউ কেউ আখেরাত পুরোপুরি অস্বীকার করতো না, তবে তা ঘটতে পারে কি না, এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ ছিল। কুরআন মাজীদে এ ধরনের লোকদের উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে এভাবে, ‘‘আমরা তো মাত্র একটি ধারণাই পোষণ করি, আমাদের কোন নিশ্চিত বিশ্বাস নেই’’- (সূরা জাসিয়াহ- ৩২)।

[৩] অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে যেসব কথা এরা বলে যাচ্ছে এগুলো সবই ভুল। এরা যা কিছু মনে করেছে ও বুঝেছে তা কোনক্রমেই সঠিক নয়।

[৪] মানুষকে দুনিয়ায় কাজ করার যোগ্য করার জন্য মহান আল্লাহ তার প্রকৃতিতে ঘুমের এক চাহিদা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কর্মের ক্লান্তির পর ঘুম তাকে আরাম ও শান্তি দান করে।

[৫] মজবুত বলা হয়েছে এ অর্থে যে, আকাশ তৈরি হয়েছে অত্যন্ত দৃঢ়-সংঘবদ্ধভাবে, তার মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও কখনো হয় না, ধ্বংস হয় না।

[৬] এখানে সূর্যকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রজ্বলিত প্রদীপ।

আয়াত : ১৭-৩০

اِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيْقَاتًا (১৭) يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّوْرِ فَتَأْتُوْنَ اَفْوَاجًا (১৮) وَفُتِحَتِ السَّمَآءُ فَكَانَتْ اَبْوَابًا (১৯) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (২০) اِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (২১) لِلطَّاغِيْنَ مَاٰبًا (২২) لَابِثِيْنَ فِيْهَاۤ اَحْقَابًا (২৩) لَا يَذُوْقُوْنَ فِيْهَا بَرْدًا وَّلَا شَرَابًا (২৪) اِلَّا حَمِيْمًا وَّغَسَّاقًا (২৫) جَزَآءً وِّفَاقًا (২৬) اِنَّهُمْ كَانُوْا لَا يَرْجُوْنَ حِسَابًا (২৭) وَكَذَّبُوْا بِاٰيَاتِنَا كِذَّابًا (২৮) وَكُلَّ شَيْءٍ اَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا (২৯) فَذُوْقُوْا فَلَنْ نَّزِيْدَكُمْ اِلَّا عَذَابًا (৩০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৭) اِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ নিশ্চয় বিচারের দিন كَانَ مِيْقَاتًا নির্ধারিত সময়; (১৮) يَوْمَ যেদিন يُنْفَخُ ফুঁ দেয়া হবে فِي الصُّوْرِ শিঙ্গায়, فَتَأْتُوْنَ তখন তোমরা আসবে اَفْوَاجًا দলে দলে, (১৯) وَفُتِحَتْ আর খুলে দেয়া হবে اَلسَّمَآءُ আসমানসমূহ, فَكَانَتْ ফলে তা হয়ে যাবে اَبْوَابًا বহু দরজা বিশিষ্ট, (২০) وَسُيِّرَتْ এবং চালিত করা হবে اَلْجِبَالُ পাহাড়সমূহকে, سَرَابًا মরীচিকার মতো। (২১) اِنَّ جَهَنَّمَ নিশ্চয় জাহান্নাম كَانَتْ مِرْصَادًا ওঁৎ পেতে রয়েছে; (২২) لِلطَّاغِيْنَ নাফরমানদের জন্য مَاٰبًا আশ্রয়স্থল হিসেবে; (২৩) لَابِثِيْنَ فِيْهَا সেখানে তারা অবস্থান করবে اَحْقَابًا শতাব্দীর পর শতাব্দী; (২৪) لَايَذُوْقُوْنَ তারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না فِيْهَا সেখানে بَرْدًا শীতলতার, وَلَا شَرَابًا আর না কোন পানীয় বস্তুর; (২৫) اِلَّا ব্যতীত حَمِيْمًا ফুটন্ত পানি وَغَسَّاقًا ও পুঁজ; (২৬) جَزَآءً প্রতিদানস্বরূপ وِفَاقًا পরিপূর্ণ। (২৭) اِنَّهُمْ নিশ্চয় তারা لَايَرْجُوْنَ كَانُوْا আকাঙ্ক্ষা করত না حِسَابًا হিসাব-নিকাশের। (২৮) وَكَذَّبُوْا এবং তারা অবিশ্বাস করেছিলো بِاٰيَاتِنَا আমার আয়াতসমূহকে كِذَّابًا অবিশ্বাস করার মতো। (২৯) وَكُلَّ شَيْءٍ আর সব কিছুই اَحْصَيْنَاهُ আমি তা সংরক্ষিত রেখেছি كِتَابًا লিখিতভাবে। (৩০) فَذُوْقُوْا অতএব এখন তোমরা স্বাদ গ্রহণ কর, فَلَنْ نَّزِيْدَكُمْ আর আমি কখনো বৃদ্ধি করব না اِلَّا عَذَابًا শাস্তি ছাড়া (অন্যকিছু)।

সরল অনুবাদ :

(১৭) নিশ্চয় বিচারের দিন একটি নির্ধারিত সময়;৭ (১৮) যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, তখন তোমরা দলে দলে আসবে,৮ (১৯) আসমান খুলে দেয়া হবে, ফলে তাতে বহু দরজা হবে,৯ (২০) এবং পাহাড়সমূহকে চালিত করা হবে, ফলে সেগুলো হবে মরীচিকার ন্যায়।১০ (২১) নিশ্চয় জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে; (২২) নাফরমানদের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে; (২৩) সেখানে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী অবস্থান করবে;১১ (২৪) সেখানে তারা কোন প্রকার শীতলতার স্বাদও গ্রহণ করতে পারবে না, আর না কোন পানীয় বস্তুর; (২৫) ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ব্যতীত;১২ (২৬) তা স্বীয় কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিফলস্বরূপ পাবে।২৩ (২৭) তারা তো হিসাব-নিকাশের আকাঙ্ক্ষা করত না। (২৮) এবং তারা আমার আয়াতসমূহকে পুরোপুরিভাবে অবিশ্বাস করেছিল।১৪ (২৯) আর আমি সব কিছুই লিখিতভাবে সংরক্ষিত রেখেছি। (৩০) অতএব এখন তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করো। আমি তোমাদের জন্য শাস্তি ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করব না।

টীকা :

[৭] যেদিন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির মাঝে বিচার-মীমাংসা করবেন সেদিন তথা কিয়ামত নির্দিষ্ট সময়ে আসবেই।

[৮] শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকারের সাথে সাথে সমগ্র বিশ্ব ধ্বংস প্রাপ্ত হবে এবং দ্বিতীয় ফুৎকারের সাথে সাথে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এ সময় বিশ্বের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষ দলে দলে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। এ স্থানে শিঙ্গার দ্বিতীয় ফুঁকের কথা বলা হয়েছে। এর আওয়াজ বুলন্দ হওয়ার সাথে সাথেই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত মৃত মানুষ জেগে উঠবে।

[৯] ‘‘আকাশ খুলে দেয়া হবে’’ এর মানে এটাও হতে পারে যে, ঊর্ধ্বজগতে কোন বাধা ও বন্ধন থাকবে না। আসমানে বিভিন্ন দরজা তৈরি হয়ে সেগুলো হতে সবদিক থেকে ফেরেশতারা নেমে আসতে থাকবে। (ইবনে কাসীর)

[১০] পাহাড়ের চলার ও মরীচিকায় পরিণত হওয়ার মানে হচ্ছে, দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যে পর্বতমালা ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এমনভাবে মরীচিকার মতো ছড়িয়ে পড়বে যে, মনে হবে সেখানে কিছু আছে, কিন্তু কিছুই নেই। যেখানে একটু আগে বিশাল পর্বত ছিল সেখানে কিছুই থাকবে না। এ অবস্থাকে অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘‘এরা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, সেদিন এ পাহাড় কোথায় চলে যাবে? এদের বলে দিন, আমার রব তাদেরকে ধূলায় পরিণত করে দেবেন যে, তাদের মধ্যে কোথাও একটুও অসমতল ও উঁচু-নীচু জায়গা এবং সামান্যতম ভাঁজও দেখতে পাবে না’’- (সূরা ত্বা-হা : ১০৫-১০৭)।

[১১] আয়াতে ব্যবহৃত أَحْقَابٌ (আহকাব) দ্বারা ‘সুদীর্ঘ সময়’ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা কোন সুনির্দিষ্ট সময় বুঝা উচিত হবে না। এর মানে হচ্ছে একের পর এক আগমনকারী দীর্ঘ সময় তারা সেখানে অবস্থান করবে। এমন একটি ধারাবাহিক যুগ যে, একটি যুগ শেষ হওয়ার পর আরেকটি যুগ শুরু হয়ে যায়।

[১২] غَسَّاقٌ শব্দের অর্থ হয়- পুঁজ, রক্ত, পুঁজ মেশানো রক্ত এবং চোখ ও গায়ের চামড়া থেকে যেসব রস বের হয়, যা প্রচন্ড দুর্গন্ধযুক্ত।

[১৩] জাহান্নামে তাদেরকে যে শাস্তি দেয়া হবে, তা ন্যায় ও ইনসাফের দৃষ্টিতে তাদের বাতিল বিশ্বাস ও কুকর্মের অনুরূপ হবে। এতে কোন বাড়াবাড়ি হবে না।

[১৪] এটা হচ্ছে তাদের জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব ভোগ করার কারণ। তারা আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজেদের হিসাব পেশ করার সময়ের কোন আশা করত না। আর আল্লাহ যেসব আয়াত পাঠিয়েছিলেন সেগুলো মেনে নিতে তারা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করত এবং সেগুলোকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করত।

আয়াত : ৩১-৪০

اِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ مَفَازًا (৩১) حَدَآئِقَ وَاَعْنَابًا (৩২) وَكَوَاعِبَ اَتْرَابًا (৩৩) وَكَأْسًا دِهَاقًا (৩৪) لَا يَسْمَعُوْنَ فِيْهَا لَغْوًا وَّلَا كِذَّابًا (৩৫) جَزَآءً مِّنْ رَّبِّكَ عَطَآءً حِسَابًا (৩৬) رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمٰنِ لَا يَمْلِكُوْنَ مِنْهُ خِطَابًا (৩৭) يَوْمَ يَقُوْمُ الرُّوْحُ وَالْمَلَآئِكَةُ صَفًّا لَّا يَتَكَلَّمُوْنَ اِلَّا مَنْ اَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ وَقَالَ صَوَابًا (৩৮) ذٰلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰى رَبِّه مَاٰبًا (৩৯) اِنَّاۤ اَنْذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيْبًا يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُوْلُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِيْ كُنْتُ تُرَابًا (৪০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(৩১) اِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ নিশ্চয় মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে مَفَازًا সাফল্য; (৩২) حَدَآئِقَ উদ্যানসমূহ وَاَعْنَابًا ও নানাবিধ আঙ্গুর, (৩৩) وَكَوَاعِبَ এবং সমবয়স্কা, اَتْرَابًا পূর্ণ যৌবনা তরুণী। (৩৪) وَكَأْسًا এবং পানপাত্র دِهَاقًا পরিপূর্ণ। (৩৫) لَا يَسْمَعُوْنَ فِيْهَا সেখানে তারা শুনবে না لَغْوًا নিরর্থক কথা, وَلَا كِذَّابًا আর না কোন মিথ্যা বাক্য; (৩৬) جَزَآءً এটা হল পুরস্কারস্বরূপ مِنْ رَّبِّكَ আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে عَطَآءً حِسَابًا যথোপযুক্ত দান। (৩৭) رَبِّ প্রতিপালক اَلسَّمَاوَاتِ আসমানসমূহের وَالْاَرْضِ এবং জমিনের وَمَا بَيْنَهُمَا এবং এ দুয়ের মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর, اَلرَّحْمٰنِ যিনি পরম দয়ালু; لَا يَمْلِكُوْنَ مِنْهُ এগুলো থেকে কেউ অধিকার লাভ করতে পারবে না خِطَابًا আবেদন-নিবেদন করার; (৩৮) يَوْمَ সেদিন يَقُوْمُ দাঁড়াবে اَلرُّوْحُ রূহ وَالْمَلَآئِكَةُ ও ফেরেশতাগণ صَفًّا সারিবদ্ধভাবে; لَا يَتَكَلَّمُوْنَ কেউ কথা বলতে পারবে না اِلَّا তবে مَنْ اَذِنَ لَهُ যাকে অনুমতি দেবেন اَلرَّحْمٰنُ দয়াময় (আল্লাহ), وَقَالَ এবং সে বলবে صَوَابًا সঠিক কথা। (৩৯) ذٰلِكَ এটা اَلْيَوْمُ الْحَقُّ সত্য দিন। فَمَنْ شَآءَ সুতরাং যার ইচ্ছা اِتَّخَذَ সে গ্রহণ করুক اِلٰى رَبِّه  তার প্রতিপালকের কাছে مَاٰبًا আশ্রয়। (৪০) اِنَّاۤ اَنْذَرْنَاكُمْ আমি তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করছি عَذَابًا قَرِيْبًا এক আসন্ন আযাবের; يَوْمَ সেদিন يَنْظُرُ الْمَرْءُ মানুষ দেখবে مَا قَدَّمَتْ যা সে আগে পাঠিয়েছে يَدَاهُ তার দু’হাত। وَيَقُوْلُ الْكَافِرُ তখন কাফির ব্যক্তি বলে উঠবে, يَا لَيْتَنِيْ হায়! كُنْتُ تُرَابًا আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম!

সরল অনুবাদ :

(৩১) নিশ্চয় মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে সাফল্য (৩২) উদ্যানসমূহ ও নানাবিধ আঙ্গুর, (৩৩) আরও আছে সমবয়স্কা, পূর্ণ যৌবনা তরুণী। (৩৪) এবং পরিপূর্ণ পানপাত্র। (৩৫) তারা সেথায় শুনবে না কোন প্রকার নিরর্থক কথা, আর না কোন মিথ্যা বাক্য;১৫ (৩৬) এটা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যথোচিত দান- যথোপযুক্ত পুরস্কারস্বরূপ।১৬ (৩৭) যিনি আসমান-জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর প্রতিপালক, যিনি পরম দয়ালু; (সেদিন) তাঁর কাছে আবেদন-নিবেদন করার ক্ষমতা কারো থাকবে না (৩৮) সেদিন রূহ ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে;১৭ কেউ কোন কথা বলতে পারবে না- তবে দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত; উপরন্তু সে সঠিক কথা বলবে।১৮ (৩৯) এ দিনটি সুনিশ্চিত সত্য; সুতরাং যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করুক। (৪০) আমি তো তোমাদেরকে এক আসন্ন আযাবের ভয় প্রদর্শন করলাম; সেদিন মানুষ দেখতে পাবে, যা সে নিজ হাতে আগে পাঠিয়েছিল। তখন কাফির ব্যক্তি বলবে, হায়! (এর আগেই) আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।১৯

টীকা :

[১৫] জান্নাতে কোন আজেবাজে গল্পগুজব হবে না। কেউ কারো সাথে মিথ্যা বলবে না। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টিকে জান্নাতের বিরাট নিয়ামত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

[১৬] এসব নিয়ামত বর্ণনা করে বলা হয়েছে, জান্নাতের এসব নিয়ামত মুমিনদের প্রতিদান এবং আপনার রবের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত দান। এখানে জান্নাতের নিয়ামতসমূহকে প্রথমে কর্মের প্রতিদান ও পরে আল্লাহর দান বলা হয়েছে। প্রতিদান শব্দের পরে আবার যথেষ্ট পুরস্কার দেবার কথা বলার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তারা নিজেদের সৎকাজের বিনিময়ে যে প্রতিদান লাভের অধিকারী হবে কেবলমাত্র ততটুকুই তাদেরকে দেয়া হবে না, বরং তার উপর অতিরিক্ত পুরস্কারও দেয়া হবে। বিপরীতপক্ষ জাহান্নামবাসীদের জন্য কেবলমাত্র এতটুকুই বলা হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের যে পরিমাণ অপরাধ তার চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া হবে না।

[১৭] অধিকাংশ তাফসীরকারগণের মতে এখানে ‘রূহ’ বলে জিবরাঈল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে।

[১৮] এখানে কথা বলা মানে শাফাআত করা বলা হয়েছে। শাফাআত করতে হলে যে ব্যক্তিকে যে গুনাহগারের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফাআত করার অনুমতি দেয়া হবে একমাত্র সে-ই ঐ ব্যক্তির জন্য শাফাআত করতে পারবে। আর শাফাআতকারীকে সঠিক ও যথার্থ সত্য কথা বলতে হবে। কোন অন্যায় সুপারিশ করতে পারবে না।

[১৯] আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। কিয়ামতের দিন সমগ্র ভূপৃষ্ঠ এক সমতল ভূমি হয়ে যাবে। এতে মানব, জিন, গৃহপালিত জন্তু এবং বন্য জন্তু সবাইকে একত্রিত করা হবে। জন্তুদের মধ্যে কেউ দুনিয়াতে অন্য জন্তুর উপর জুলুম করে থাকলে তার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়া হবে। এমনকি কোন শিংবিশিষ্ট ছাগল কোন শিংবিহীন ছাগলকে মেরে থাকলে সেদিন তার প্রতিশোধ নেয়া হবে। এ কর্ম সমাপ্ত হলে সব জন্তুকে আদেশ করা হবে, মাটি হয়ে যাও। তখন সব মাটি হয়ে যাবে। এই দৃশ্য দেখে কাফিররা আকাঙ্ক্ষা করবে- হায়! আমরাও যদি মাটি হয়ে যেতাম। (মুস্তাদরাকে হাকেম ২/৩৪৫, ৪/৫৭৫; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৯৬৬)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে- এতে কোন সন্দেহ নেই; এটি সংঘটিত হওয়ার সময় আল্লাহর কাছে নির্ধারিত রয়েছে।

কিয়ামত আসার সাথে সাথেই এতদ্বসংক্রান্ত যাবতীয় সন্দেহের অবসান ঘটবে।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অসংখ্য অমূল্য নিয়ামত দ্বারা বেষ্টিত করে রেখেছেন; আকাশ, জমিন, পাহাড়-পর্বত, দিন-রাত, চন্দ্র-সূর্য, মেঘমালা, শস্য, উদ্ভিদ ইত্যাদি তাঁরই নিয়ামতের কতিপয় নমুনা।

ঘুম আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ নিয়ামত।

শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর পরিস্থিতি অতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

জাহান্নামে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে; পিপাসার্ত হওয়া, ফুটন্ত পানি ও পুঁজ খেতে দেয়াটা এরই একটি নমুনা।

জাহান্নাম থেকে বাঁচতে হলে সর্বদা নিজেকে উত্তম কর্মে ব্যস্ত রাখতে হবে।

হিসাব-নিকাশের চিন্তা-ভাবনা না করা এবং আল্লাহর যে কোন নিদর্শনকে অবিশ্বাস করাটাও একটি বড় ধরনের নাফরমানী।

মানুষের যাবতীয় কর্ম প্রতিনিয়ত লিখিত আকারে রেকর্ড করা হচ্ছে; কিয়ামতের দিন এর আলোকেই প্রতিদান প্রদান করা হবে।

কিয়ামতের দিন মুত্তাকীরাই হবে সবচেয়ে বড় সাফল্যবান; সেদিন তারা নিজেদের কর্মফল হিসেবে জান্নাত লাভ করে আল্লাহ তা‘আলার অশেষ নিয়ামত ভোগ করতে পারবে।

শাফায়াতের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলা; তিনি যার জন্য এবং যার পক্ষে সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন, কেবল সেই সুপারিশ করতে পারবে।

কিয়ামতের দিন কাফিররা ভীষণভাবে আফসোস করবে; কিন্তু সেদিন আফসোস করে কোন লাভ হবে না।

৭৯- সূরা নাযিআত
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দ اَلنَّازِعَاتُ হতে এর নাম সূরা আন-নাযিআত রাখা হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে আস-সাহিরাহ ও আত-ত্বাম্মাহ নামে অভিহিত করেছেন। আন-নাযিআত শব্দের অর্থ হচ্ছে, উৎপাটনকারী।

নাযিলের সময়কাল :

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘‘আম্মা ইয়াতাসা-আলূন’’ এর পরে এ সূরাটি নাযিল হয়। এটি মাক্কী যুগের প্রথম দিকের সূরা।

সূরার বিষয়বস্তু :

এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে কিয়ামাত ও মৃত্যুর পরের জীবনের প্রমাণ এবং আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যা বলার পরিণাম সম্পর্কে সাবধানবাণী।

বক্তব্যের সূচনায় মৃত্যুকালে প্রাণ হরণকারী, আল্লাহর বিধানসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নকারী এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সারা বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থা পরিচালনাকারী ফেরেশতাদের কসম খেয়ে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে যে, কিয়ামত অবশ্যই হবে এবং মৃত্যুর পরে নিশ্চিতভাবে আরেকটি নতুন জীবনের সূচনা হবে।

এরপর লোকদের জানানো হয়েছে, এই যে কাজটিকে তোমরা একেবারেই অসম্ভব মনে করো, আল্লাহর জন্য এটি এমন কোন কঠিন কাজই নয়, যার জন্য বিরাট ধরনের কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হতে পারে। একবার ঝাঁকুনি দিলেই দুনিয়ার এ সমস্ত ব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যাবে। তখন যারা এ পরবর্তী জগতের কথা অস্বীকার করতো তারা ভয়ে কাঁপতে থাকবে।

তারপর সংক্ষেপে মূসা (আঃ) ও ফিরাউনের কথা বর্ণনা করে লোকদেরকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যা বলার এবং তাঁর হিদায়াত ও পথনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করার পরিণাম ফিরাউন দেখেছে। ফিরাউনের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তোমরা যদি নিজেদের কর্মনীতি পরিবর্তন না কর, তাহলে তোমাদের পরিণামও এ রকম হবে।

এরপর ২৭ থেকে ৩৩ আয়াত পর্যন্ত মৃত্যুর পরের জীবনের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে এ প্রসঙ্গে প্রথমেই অস্বীকারকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তোমাদেরকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা বেশি কঠিন কাজ নাকি এ বিশাল বিস্তীর্ণ বিশ্ব-জগত সৃষ্টি করা কঠিন কাজ।

দুনিয়ায় নির্ধারিত সীমানা লঙ্ঘন করে কে পার্থিব লাভ, স্বার্থ ও স্বাদ আস্বাদনকে উদ্দেশ্যে পরিণত করেছে এবং কে নিজের রবের সামনে হিসাব-নিকাশের জন্য দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীতি অনুভব করেছে ও নফসের অবৈধ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে অস্বীকার করেছে, এরই ভিত্তিতে সেদিন ফায়সালা হবে।

মক্কার কাফিরদের একটি প্রশ্ন ছিল কিয়ামত কবে আসবে, সবশেষে তার জবাব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কিয়ামত কবে হবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র কিয়ামত যে অবশ্যই হবে এ সম্পর্কে লোকদেরকে সতর্ক করে দেয়া। এ দুনিয়ার জীবনের জন্য যারা প্রাণ দিতো এবং একেই সবকিছু মনে করতো, তারা অনুভব করতে থাকবে যে, এ দুনিয়ার বুকে তারা মাত্র সামান্য সময় অবস্থান করেছিল। তখন তারা জানতে পারবে, এই মাত্র কয়েক দিনের জীবনের বিনিময়ে তারা চিরকালের জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎ কীভাবে বরবাদ করে দিয়েছে।

আয়াত : ১-১৪



وَالنَّازِعَاتِ غَرْقًا (১) وَالنَّاشِطَاتِ نَشْطًا (২) وَالسَّابِحَاتِ سَبْحًا (৩) فَالسَّابِقَاتِ سَبْقًا (৪) فَالْمُدَبِّرَاتِ اَمْرًا (৫) يَوْمَ تَرْجُفُ الرَّاجِفَةُ (৬) تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ (৭) قُلُوْبٌ يَّوْمَئِذٍ وَّاجِفَةٌ (৮) اَبْصَارُهَا خَاشِعَةٌ (৯) يَقُوْلُوْنَ اَاِنَّا لَمَرْدُوْدُوْنَ فِي الْحَافِرَةِ (১০) اَاِذَا كُنَّا عِظَامًا نَّخِرَةً (১১) قَالُوْا تِلْكَ اِذًا كَرَّةٌ خَاسِرَةٌ (১২) فَاِنَّمَا هِيَ زَجْرَةٌ وَّاحِدَةٌ (১৩) فَاِذَا هُمْ بِالسَّاهِرَةِ (১৪)

শাব্দিক অর্থ :

(১) وَالنَّازِعَاتِ শপথ কঠোরভাবে উৎপাটনকারীদের غَرْقًا যারা ডুব দিয়ে টেনে বের করে (২) وَالنَّاشِطَاتِ আর শপথ মৃদুভাবে বন্ধন মুক্তকারীদের نَشْطًا যারা মৃদুভাবে টেনে বের করে, (৩) وَالسَّابِحَاتِ শপথ দ্রুত সাঁতারকারীদের سَبْحًا যারা (শূন্য লোকে) সাঁতরে চলে, (৪) فَالسَّابِقَاتِ অতঃপর শপথ দ্রুত গতিশীলদের سَبْقًا যারা দ্রুত এগিয়ে যায়। (৫) فَالْمُدَبِّرَاتِ অতঃপর শপথ নির্বাহকারীদের اَمْرًا কর্ম। (৬) يَوْمَ সেদিন تَرْجُفُ প্রকম্পিত হবে اَلرَّاجِفَةُ প্রকম্পনকারী, (৭) تَتْبَعُهَا তাকে অনুসরণ করবে اَلرَّادِفَةُ পরবর্তী প্রকম্পন। (৮) قُلُوْبٌ হৃদয়সমূহ হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন وَاجِفَةٌ কম্পিত। (৯) اَبْصَارُهَا তাদের দৃষ্টিসমূহ হবে خَاشِعَةٌ ভীত-বিহবল। (১০) يَقُوْلُوْنَ তারা বলে, اَاِنَّا لَمَرْدُوْدُوْنَ আমরা কি প্রত্যাবর্তিত হব فِي الْحَافِرَةِ পূর্বাবস্থায়? (১১) اَاِذَا كُنَّا যখন আমরা হব عِظَامًا হাড্ডি نَخِرَةً গলিত। (১২) قَالُوْا তারা বলে, تِلْكَ اِذًا তখন তা হবে كَرَّةٌ প্রত্যাবর্তন خَاسِرَةٌ লোকসানের! (১৩) فَاِنَّمَا هِيَ এটা তো কেবল وَّاحِدَةٌ زَجْرَةٌ একটি ভয়ঙ্কর ধমক মাত্র। (১৪) فَاِذَا هُمْ ফলে তারা উপস্থিত হবে بِالسَّاهِرَةِ প্রশস্ত ময়দানে।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ সজোরে উৎপাটনকারী (ফেরেশতার), যারা কঠোরভাবে (রূহ্) টেনে বের করে১ (২) আর শপথ মৃদুভাবে (রূহের) বন্ধন মুক্তকারীদের,২ (৩) শপথ দ্রুত সাঁতারকারীদের, যারা তীব্র গতিতে (শূন্য লোকে) সাঁতরে চলে,৩ (৪) অতঃপর শপথ দ্রুত গতিশীলদের, যারা দ্রুত অগ্রসর হয়,৪ (৫) অতঃপর শপথ কর্ম নির্বাহকারীদের।৫ (৬) সেদিন প্রকম্পনকারী প্রবলভাবে কাঁপিয়ে তুলবে, (৭) তাকে অনুসরণ করবে পরবর্তী প্রকম্পন।৬ (৮) সেদিন হৃদয়সমূহ ভীত-সন্ত্রস্ত হবে।৭ (৯) তাদের দৃষ্টিসমূহ হবে ভয়ে অবনত। (১০) তারা বলে, আমরা কি পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তিত হব? (১১) যখন আমরা গলিত হাড্ডিতে পরিণত হয়ে যাব। (১২) তারা বলে, তাহলে সেই প্রত্যাবর্তনটি হবে খুবই ক্ষতিকর! (১৩) এটা তো একটি ভয়ঙ্কর ধমক মাত্র।৮ (১৪) ফলে হঠাৎ প্রশস্ত ময়দানে তাদের আবির্ভাব হবে।৯

টীকা :

[১] ডুব দিয়ে টানা এমন সব ফেরেশতার কাজ, যারা মৃত্যুকালে প্রাণ টেনে বের করে। এখানে আযাবের সেসব ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা কাফেরের আত্মা নির্মমভাবে বের করে।

[২] এটা ফেরেশতাগণের দ্বিতীয় বিশেষণ। তারা মুমিনের রূহ কবজ করার সময় অনায়াসে রূহ কবজ করে, কঠোরতা করে না। প্রকৃত কারণ এই যে, কাফেরের আত্মা বের করার সময় থেকেই বারযাখের আযাব সামনে এসে যায়। এতে তার আত্মা অস্থির হয়ে দেহে আত্মগোপন করতে চায়। ফেরেশতা জোরে-জোরে টানা-হেঁচড়া করে তাকে বের করে। পক্ষান্তরে মুমিনের রূহের সামনে বারযাখের নিয়ামত ও সুসংবাদ ভেসে উঠে। ফলে সে দ্রুতবেগে সেদিকে যেতে চায়।

[৩] سَابِحَاتُ (সাবিহাত) এর আভিধানিক অর্থ সাঁতার কাটা। ফেরেশতাগণ মানুষের রূহ কবজ করার পর তা দ্রুতগতিতে আকাশের দিকে নিয়ে যায়।

[৪] যে আত্মা ফেরেশতাগণের হস্তগত হয় তাকে ভাল অথবা মন্দ ঠিকানায় পৌঁছানোর কাজে তারা দ্রুত একে অপরকে ডিঙ্গিয়ে যায়। তারা মুমিনের আত্মাকে জান্নাতের আবহাওয়ায় ও কাফিরের আত্মাকে আযাবের জায়গায় পৌঁছিয়ে দেয়।

[৫] ফেরেশতাদের কাজ এটাও যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে দুনিয়ার বিভিন্ন কাজ নির্বাহের ব্যবস্থা করে।

[৬] প্রথম প্রকম্পনকারী বলতে এমন প্রকম্পন বুঝানো হয়েছে, যা পৃথিবী ও তার মধ্যকার সমস্ত জিনিস ধ্বংস করে দেবে। আর দ্বিতীয় প্রকম্পন বলতে যে কম্পনে সমস্ত মৃত জীবিত হয়ে বের হয়ে আসবে তাকে বুঝানো হয়েছে।

[৭] এখানে ‘‘কতক হৃদয়’’ বলতে কাফির ও নাফরমানদের বুঝানো হয়েছে। কিয়ামতের দিন তারা ভীত ও আতঙ্কিত হবে। তবে সৎ মুমিন বান্দাদের উপর এ ভীতি প্রভাব বিস্তার করবে না। (সূরা আন্বিয়া- ১০৩)

[৮] অর্থাৎ আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিন কাজ নয়। এ কাজটি করতে তাঁকে কোন বড় রকমের প্রস্তুতি নিতে হবে না। এর জন্য শুধুমাত্র একটি ধমক বা আওয়াজই যথেষ্ট। এরপরই তোমরা সমতল ময়দানে আবির্ভূত হবে।

[৯] আয়াতে বর্ণিত سَاهِرَةٌ শব্দের অর্থ সমতল ময়দান। কিয়ামতের দিন পুনরায় যে ভূ-পৃষ্ঠ সৃষ্টি করা হবে, তা সমতল হবে।

আয়াত : ১৫-২৬

هَلْ اَتَاكَ حَدِيْثُ مُوْسٰى (১৫) اِذْ نَادَاهُ رَبُّهٗ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى (১৬) اِذْهَبْ اِلٰى فِرْعَوْنَ اِنَّهٗ طَغٰى (১৭) فَقُلْ هَلْ لَّكَ اِلٰۤى اَنْ تَزَكّٰى (১৮) وَاَهْدِيَكَ اِلٰى رَبِّكَ فَتَخْشٰى (১৯) فَاَرَاهُ الْاٰيَةَ الْكُبْرٰى (২০) فَكَذَّبَ وَعَصٰى (২১) ثُمَّ اَدْبَرَ يَسْعٰى (২২) فَحَشَرَ فَنَادٰى (২৩) فَقَالَ اَنَا رَبُّكُمُ الْاَعْلٰى (২৪) فَاَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْاٰخِرَةِ وَالْاُوْلٰى (২৫) اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّمَنْ يَّخْشٰى (২৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৫) هَلْ اَتَاكَ তোমার নিকট পৌঁছেছে কি حَدِيْثُ مُوْسٰى মূসার কাহিনী? (১৬) اِذْ যখন نَادَاهُ তাকে ডেকেছিলেন رَبُّهٗ তাঁর প্রতিপালক بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ পবিত্র উপত্যকা طُوًى তোওয়ায়। (৭) اِذْهَبْ তুমি যাও اِلٰى فِرْعَوْنَ ফিরাউনের নিকট اِنَّهٗ নিশ্চয় সে طَغٰى সীমালঙ্ঘন করেছে। (১৮) فَقُلْ এবং বলো, هَلْ لَّكَ তুমি কি চাও اِلٰۤى اَنْ تَزَكّٰى পবিত্র হতে? (১৯) وَاَهْدِيَكَ আর আমি তোমাকে পথ দেখাবো اِلٰى رَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের দিকে فَتَخْشٰى অতঃপর তুমি তাকে ভয় করবে। (২০) فَاَرَاهُ অতঃপর তিনি তাকে দেখালেন اَلْاٰيَةَ الْكُبْرٰى বড় নিদর্শন। (২১) فَكَذَّبَ কিন্তু সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো وَعَصٰى এবং অবাধ্য হলো। (২২) ثُمَّ তারপর اَدْبَرَ সে পিছনে ফিরে গেলো يَسْعٰى দ্রুত পায়ে। (২৩) فَحَشَرَ এরপর সে সকলকে সমবেত করলো فَنَادٰى এবং ঘোষণা করলো, (২৪) فَقَالَ অতঃপর বললো, اَنَا আমিই رَبُّكُمُ الْاَعْلٰى তোমাদের সর্বোচ্চ প্রতিপালক। (২৫) فَاَخَذَهُ اللهُ ফলে আল্লাহ তাকে পাকড়াও করলেন نَكَالَ আযাবে اَلْاٰخِرَةِ وَالْاُوْلٰى পরকালের ও ইহকালের, (২৬) اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ নিশ্চয় এতে রয়েছে لَعِبْرَةً উপদেশ لِمَنْ তার জন্য যে يَخْشٰى ভয় করে।

সরল অনুবাদ :

(১৫) (হে মুহাম্মদ!) তোমার নিকট মূসা (আঃ)-এর কাহিনী পৌঁছেছে কি?১০ (১৬) যখন তাঁর প্রতিপালক পবিত্র তোওয়া উপত্যকায় তাকে ডেকে বলেছিলেন, (১৭) ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে, (১৮) এবং (তাকে) বল, তুমি কি পবিত্র হতে চাও? (১৯) আর আমি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের দিকে পথ দেখাব, যাতে তুমি তাঁকে ভয় কর। (২০) অতঃপর তিনি তাকে বড় নিদর্শন দেখালেন।১১ (২১) কিন্তু সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো এবং অবাধ্য হলো। (২২) আর সে পুনরায় পিছনে ফিরে গেলো দ্রুত পায়ে।১২ (২৩) সে সকলকে সমবেত করল এবং ঘোষণা করল, (২৪) অতঃপর বলল, আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ প্রতিপালক। (২৫) ফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের আযাবে পাকড়াও করলেন,১৩ (২৬) এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যে ভয় করে।

টীকা :

[১০] কাফিরদের অবিশবাস, হঠকারিতা ও শত্রুতার ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ যে মর্মপীড়া অনুভব করতেন, তা দূর করার উদ্দেশ্যে মূসা (আঃ) ও ফিরাউনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শত্রুরা কেবল আপনাকেই কষ্ট দেয়নি, পূর্ববর্তী সকল রাসূলকেও কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তাদের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। সুতরাং আপনিও সবর করুন।

[১১] বড় নিদর্শন বলতে সবগুলো মুজিযা উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার লাঠির অজগর হয়ে যাওয়া এবং হাত শুভ্র হওয়ার কথাও বুঝানো হতে পারে।

[১২] অর্থাৎ হককে বাতিল দ্বারা প্রতিহত করতে চেষ্টা করতে লাগল।

[১৩] نَكَالٌ (নাকাল) শব্দের অর্থ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যা দেখে অন্যরাও আতঙ্কিত হয়ে যায় এবং শিক্ষা পায়।

আয়াত : ২৭-৪৬

اَاَنْتُمْ اَشَدُّ خَلْقًا اَمِ السَّمَآءُ بَنَاهَا (২৭) رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا (২৮) وَاَغْطَشَ لَيْلَهَا وَاَخْرَجَ ضُحَاهَا (২৯) وَالْاَرْضَ بَعْدَ ذٰلِكَ دَحَاهَا (৩০) اَخْرَجَ مِنْهَا مَآءَهَا وَمَرْعَاهَا (৩১) وَالْجِبَالَ اَرْسَاهَا (৩২) مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِاَنْعَامِكُمْ (৩৩) فَاِذَا جَآءَتِ الطَّآمَّةُ الْكُبْرٰى (৩৪) يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْاِنْسَانُ مَا سَعٰى (৩৫) وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِمَنْ يَّرٰى (৩৬) فَاَمَّا مَنْ طَغٰى (৩৭) وَاٰثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (৩৮) فَاِنَّ الْجَحِيْمَ هِيَ الْمَأْوٰى (৩৯) وَاَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّه وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوٰى (৪০) فَاِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوٰى (৪১) يَسْاَلُوْنَكَ عَنِ السَّاعَةِ اَيَّانَ مُرْسَاهَا (৪২) فِيْمَ اَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا (৪৩) اِلٰى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا (৪৪) اِنَّمَاۤ اَنْتَ مُنْذِرُ مَنْ يَّخْشَاهَا (৪৫) كَاَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْاۤ اِلَّا عَشِيَّةً اَوْ ضُحَاهَا (৪৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(২৭) اَاَنْتُمْ اَشَدُّ خَلْقًا তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কি কঠিন কাজ, اَمْ নাকি اَلسَّمَآءُ আকাশ? بَنَاهَا তিনি তা সৃষ্টি করেছেন। (২৮) رَفَعَ سَمْكَهَا তিনি তার ছাদ সুউচ্চ করেছেন فَسَوَّاهَا অতঃপর তা সুবিন্যস্ত করেছেন। (২৯) وَاَغْطَشَ এবং তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন لَيْلَهَا এর রজনীকে وَاَخْرَجَ এবং বের করেছেন ضُحَاهَا তার দিবসকে। (৩০) وَالْاَرْضَ এবং পৃথিবীকে بَعْدَ ذٰلِكَ এরপর دَحَاهَا বিস্তৃত করেছেন। (৩১) اَخْرَجَ তিনি বের করেছেন مِنْهَا তা থেকে مَآءَهَا তার পানি وَمَرْعَاهَا ও তার উদ্ভিদ, (৩২) وَالْجِبَالَ আর পাহাড়সমূহ اَرْسَاهَا তিনি সেগুলোকে দৃঢ়ভাবে গেঁড়ে দিয়েছেন, (৩৩) مَتَاعًا এগুলো সামগ্রীস্বরূপ لَكُمْ তেমাদের জন্য وَلِاَنْعَامِكُمْ এবং তোমাদের গৃহপালিত জন্তুর জন্য। (৩৪) فَاِذَا جَآءَتْ অতঃপর যখন উপস্থিত হবে اَلطَّآمَّةُ اَلْكُبْرٰى মহা বিপর্যয় (৩৫) يَوْمَ সেদিন يَتَذَكَّرُ الْاِنْسَانُ মানুষ স্মরণ করবে مَا سَعٰى সে যা করেছে, (৩৬) وَبُرِّزَتْ এবং প্রকাশ করা হবে اَلْجَحِيْمُ জাহান্নামকে لِمَنْ يَّرٰى যে দেখবে তার জন্যে। (৩৭) فَاَمَّا مَنْ অনন্তর যে طَغٰى সীমালঙ্ঘন করেছে, (৩৮) وَاٰثَرَ এবং অগ্রাধিকার দিয়েছে اَلْحَيَاةَ الدُّنْيَا দুনিয়ার জীবনকে, (৩৯) فَاِنَّ الْجَحِيْمَ নিশ্চয় জাহান্নামই হবে هِيَ الْمَأْوٰى তার ঠিকানা। (৪০) وَاَمَّا مَنْ পক্ষান্তরে যে خَافَ ভয় করেছে مَقَامَ رَبِّه  নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর وَنَهَى এবং বিরত রেখেছে اَلنَّفْسَ নিজেকে عَنِ الْهَوٰى কুপ্রবৃত্তি হতে, (৪১) فَاِنَّ الْجَنَّةَ অবশ্যই জান্নাত হবে هِيَ الْمَأْوٰى তার ঠিকানা। (৪২) يَسْاَلُوْنَكَ তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে عَنِ السَّاعَةِ কিয়ামত সম্পর্কে اَيَّانَ কখন مُرْسَاهَا তা ঘটবে? (৪৩) فِيْمَ اَنْتَ তোমার কী সম্পর্ক مِنْ ذِكْرَاهَا এ আলোচনার সাথে। (৪৪) اِلٰى رَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে مُنْتَهَاهَا এ ব্যাপারে চূড়ান্ত জ্ঞান, (৪৫) اِنَّمَاۤ اَنْتَ নিশ্চয় তুমি কেবল مُنْذِرُ সতর্ককারী مَنْ يَّخْشَاهَا যে একে ভয় করে। (৪৬) كَاَنَّهُمْ যেন তারা يَوْمَ يَرَوْنَهَا যেদিন এটা দেখবে, لَمْ يَلْبَثُوْا তারা (পৃথিবীতে) অবস্থান করেনি اِلَّا عَشِيَّةً এক সন্ধ্যা ব্যতীত اَوْ ضُحَاهَا অথবা এক সকাল।

সরল অনুবাদ :

(২৭) তোমাদেরকে১৪ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ, না আকাশ সৃষ্টি করা? তিনিই এটা নির্মাণ করেছেন।১৫ (২৮) তিনি তার ছাদ সুউচ্চ ও সুবিন্যস্ত করেছেন। (২৯) আর তিনি এর রজনীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন এবং স্পষ্ট করেছেন তার দিবসকে। (৩০) এরপর তিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন। (৩১) তিনি তা থেকে বের করেছেন পানি ও উদ্ভিদ, (৩২) আর পাহাড়সমূহকে তিনি দৃঢ়ভাবে গেঁড়ে দিয়েছেন, (৩৩) এসব ও তোমাদের গৃহপালিত জন্তুর সামগ্রীরূপে। (৩৪) অতঃপর যখন মহা বিপর্যয় (কিয়ামত) উপস্থিত হবে,১৬ (৩৫) সেদিন মানুষ যা করেছে তা স্মরণ করবে, (৩৬) আর যে দেখবে তার জন্যে প্রকাশ করা হবে জাহান্নামকে। (৩৭) অনন্তর যে সীমালঙ্ঘন করেছে, (৩৮) এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, (৩৯) নিশ্চয় জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা।১৭ (৪০) পক্ষান্তরে যে নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় রেখেছে১৮ এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রেখেছে, (৪১) অবশ্যই তার ঠিকানা হবে জান্নাত। (৪২) তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত সম্পর্কে যে, ওটা কখন ঘটবে? (৪৩) এর আলোচনার সাথে তোমার কী সম্পর্ক? (৪৪) এ ব্যাপারে চূড়ান্ত জ্ঞান তো তোমার প্রতিপালকের নিকট,১৯ (৪৫) তুমি তো শুধু তার সতর্ককারী, যে ওটাকে ভয় করে। (৪৬) যেদিন তারা ওটা দেখবে, তখন (তাদের মনে হবে) যেন তারা (পৃথিবীতে) এক সন্ধ্যা অথবা এক সকালের বেশি অবস্থান করেনি।২০

টীকা :

[১৪] কিয়ামত ও মৃত্যুর পরের জীবন যে সম্ভব এ কথার যৌক্তিকতা এখানে পেশ করা হয়েছে।

[১৫] এখানে মরে মাটিতে পরিণত হওয়ার পর পুনরুজ্জীবিত কীরূপে হবে, কাফিরদের এ কথার জবাব দেয়া হয়েছে। এখানে সৃষ্টি করা মানে দ্বিতীয়বার মানুষ সৃষ্টি করা। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে এই যুক্তিটিই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে পেশ করা হয়েছে। (সূরা ইয়াসীন- ৮১) (সূরা গাফির- ৫৭)।

[১৬] এই মহাসংকট ও বিপর্যয় হচ্ছে কিয়ামত। এজন্য এখানে ‘‘আত-তাম্মাতুল কুবরা’’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘তাম্মাহ’ বলতে এমন ধরনের মহাবিপর্যয় বুঝায়, যা সবকিছুর উপর ছেয়ে যায়। এরপর আবার তার সাথে ‘কুবরা’ (মহা) শব্দ ব্যবহার করে এ কথা প্রকাশ করা হয়েছে যে, সেই বিপদ, সংকট ও বিপর্যয় হবে অতি ভয়াবহ ও ব্যাপক।

[১৭] এ আয়াতে জাহান্নামবাসীদের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, আর পার্থিব জীবনকে আখেরাতের উপর অগ্রাধিকার দেবে অর্থাৎ আখেরাতের কাজ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার সুখ ও আনন্দকেই অগ্রাধিকার দিবে; তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাহান্নামই তার ঠিকানা।

[১৮] রবের সামনে অবস্থানের দুটি অর্থ হতে পারে- (এক) রবের সামনে হাজির হয়ে হিসাব নিকাশের সম্মুখীন হতে হবে- এ বিশ্বাস করে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে যে নিজেকে হেফাযত করেছে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। (দুই) রবের যে সুমহান মর্যাদা ও তাঁর উচ্চ মর্তবার কথা স্মরণ করে অন্যায় কাজ ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিরত থেকেছে সে জান্নাতী হবে।

[১৯] এ সম্পর্কে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত কখন ঘটবে। বলুন, এ বিষয়ের জ্ঞান আমার প্রতিপালকেরই আছে। শুধু তিনিই যথাসময়ে এর প্রকাশ ঘটাবেন; এটা আকাশমন্ডলী ও জমিনের একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা হবে। হাদীসেও জিবরাঈলের প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ ﷺ একই উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, সে প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশি জানে না।’’-(বুখারী হা/৫০)

[২০] কিয়ামতের দিন দুনিয়ার জীবনের কথা মানুষের মনে পড়বে, কিন্তু দুনিয়াতে তারা কতদিন ছিল এ নিয়ে নানা রকম কথা বলবে। কেউ বলবে দশ দিন, (সূরা ত্বা-হা ১০৩)। কেউ বলবে একদিন (সূরা ত্বা-হা ১০৪), কেউ বলবে একদিন বা অর্ধদিন, (সূরা মু’মিনূন ১১৩)। কেউ বলবে দিবসের মাত্র এক মুহূর্তকাল- (সূরা ইউনুস ৪৫), (সূরা আহকাফ ৩৫), (সূরা রূম ৫৫)।

কিয়ামতের দিন লোকেরা নিজেদের দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে আন্দাজ করে নেবে যে, তা ছিল অতি সামান্য কয়েকটি দিন। মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে সময়কাল অতিবাহিত হবে সে সম্পর্কেও তাদের প্রায় একই ধরনের অনুমান হবে। নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় একটি চিরন্তন জীবন যখন তাদের সামনে উপস্থিত হবে এবং তারা দেখবে যে, এখানকার জন্য তারা কিছুই করেনি, তখন তারা চরম আক্ষেপ ও হতাশার সাথে নিজেদের দুনিয়ার জীবনের দিকে ফিরে দেখবে এবং দুঃখ করে বলতে থাকবে, হায়! মাত্র দু’দিনের আনন্দ ও ভোগবিলাসের লোভে আমরা চিরকালের জন্য নিজেদের জীবনকে ধ্বংস করলাম।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

যার পক্ষে আসমান সৃষ্টির মতো আশ্চর্য বস্তু সৃষ্টি করা সম্ভব, সে মহান আল্লাহর পক্ষে পুনরুত্থান ঘটানো মোটেও কঠিন নয়।

কিয়ামত আকস্মিকভাবে সংঘটিত হয়ে যাবে।

কিয়ামতের দিন কঠিন পরিস্থিতি দেখে মানুষ তার ইহকালীন জীবনের কথা স্মরণ করবে এবং আফসোস করবে।

ফিরাউন দুনিয়ার সাময়িক ক্ষমতা লাভ করেই নিজেকে রব হিসেবে দাবী করেছিল; সুতরাং বর্তমান যুগের শাসকদের জন্য ফিরাউনের কার্যকলাপ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

সীমালঙ্ঘন করা এবং দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়াটা জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

আল্লাহকে ভয় করা এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেদেরকে বিরত রাখাটা জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম।

রাসূলুল্লাহ ﷺ ইলমে গায়েব সম্পর্কে অবগত নন; তিনি কেবলমাত্র একজন সতর্ককারী।

আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার সময়কাল একটি সন্ধ্যা বা একটি সকালের সমতুল্য।

৮০- সূরা আবাসা
সূরার নামকরণ :

প্রথম শব্দ عَبَسَ (আবাসা)- কে এর নাম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে সাফারাহ ও সাখখাহ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। আবাসা শব্দের অর্থ বিরক্তি প্রকাশ করা।

নাযিলের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট :

একবার নবী ﷺ এর মজলিসে মক্কা মুয়াযযামার কয়েকজন বড় বড় সরদার বসেছিলেন। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগী করার জন্য তিনি তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করছিলেন। এমন সময় ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) নামক একজন অন্ধ সাহাবী তাঁর খেদমতে হাজির হলেন এবং তাঁর কাছে ইসলাম সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। তার এই প্রশ্নে সরদারদের সাথে আলাপে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় নবী ﷺ বিরক্ত হলেন। তিনি তার কথায় কান দিলেন না। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সূরাটি নাযিল হয়।

ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) ইসলাম প্রচারের একেবারে প্রথম দিকে মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন।

সূরার বিষয়বস্তু :

ভাষণের সূচনায় যে বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা দেখে মনে হয়, এ সূরায় নবী ﷺ এর প্রতি তিরস্কার ও ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পুরো সূরাটির সমস্ত বিষয়বস্তুকে নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে, আসলে এখানে ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে কুরাইশদের কাফির সরদারদের বিরুদ্ধে। কারণ এই সরদাররা তাদের অহঙ্কার ও বিমুখতার কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সত্যের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

কুরাইশ সরদারদের প্রতি মনোযোগী হওয়ার কারণ এ ছিল না যে, তিনি বড় লোকদের বেশি সম্মানিত মনে করতেন এবং একজন অন্ধকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। বরং আসল ব্যাপার ছিল, একজন সত্য দীনের দাওয়াত দানকারী চান, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করুক। এভাবে তাঁর কাজ সহজ হয়ে যাবে। প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ ﷺও একই ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে বুঝালেন, এটা ইসলামী দাওয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। এখানে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুরুত্বের অধিকারী, যে সত্যের সন্ধানে ফিরছে, সে যতই দুর্বল, প্রভাবহীন ও অক্ষম হোক না কেন। আবার ইলামের দৃষ্টিতে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই গুরুত্বহীন, যে নিজেই সত্যবিমুখ, সে সমাজে যত বড় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন। তাই ইসলামের দাওয়াত আপনি সবাইকে দিয়ে যান, কিন্তু যাদের মধ্যে সত্যের দাওয়াত গ্রহণ করার আগ্রহ পাওয়া যায় তারাই হবে আপনার আগ্রহের আসল কেন্দ্রবিন্দু।

তারপর ১৭ আয়াত থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী কাফিরদের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা নিজেদের স্রষ্টা ও রিযিকদাতা আল্লাহর মোকাবিলায় যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছিল, প্রথমে সেজন্য তাদের নিন্দা ও তিরস্কার করা হয়েছে। সবশেষে তাদেরকে এই মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের এই কর্মনীতির অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণাম দেখতে পাবে।

আয়াত : ১-১০



عَبَسَ وَتَوَلّٰى (১) اَنْ جَآءَهُ الْاَعْمٰى (২) وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّهٗ يَزَّكّٰى (৩) اَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرٰى (৪) اَمَّا مَنِ اسْتَغْنٰى (৫) فَاَنْتَ لَهٗ تَصَدّٰى (৬) وَمَا عَلَيْكَ اَلَّا يَزَّكّٰى (৭) وَاَمَّا مَنْ جَآءَكَ يَسْعٰى (৮) وَهُوَ يَخْشٰى (৯) فَاَنْتَ عَنْهُ تَلَهّٰى (১০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) عَبَسَ ভ্রু কুঞ্চিত করল وَتَوَلّٰى এবং মুখ ফিরিয়ে নিলো, (২) اَنْ جَآءَهُ কারণ তার নিকট এসেছিল اَلْاَعْمٰى অন্ধ লোকটি। (৩) وَمَا يُدْرِيْكَ তোমাকে কিসে জানাবে لَعَلَّهٗ হয়ত সে يَزَّكّٰى পরিশুদ্ধ হতো। (৪) اَوْ يَذَّكَّرُ অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো, فَتَنْفَعَهُ ফলে তার উপকারে আসতো اَلذِّكْرٰى উপদেশ (৫) اَمَّا পক্ষান্তরে مَنِ اسْتَغْنٰى যে পরওয়া করে না, (৬) فَاَنْتَ لَهٗ তুমি তার প্রতি تَصَدّٰى মনোযোগ দিচ্ছো। (৭) وَمَا عَلَيْكَ অথচ তোমার দায়িত্ব নেই اَلَّا يَزَّكّٰى সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে, (৮) وَاَمَّا পক্ষান্তরে مَنْ جَآءَكَ যে তোমার নিকট আসলো, يَسْعٰى দৌড়ে। (৯) وَهُوَ আর সে يَخْشٰى ভয় করে (১০) عَنْهُ فَاَنْتَ অতঃপর তুমি তার প্রতি تَلَهّٰى অবজ্ঞা প্রদর্শন করলে।

সরল অনুবাদ :

(১) সে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল,১ (২) কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি২ এসেছিল। (৩) তুমি কি জান সে হয় তো পরিশুদ্ধ হতো, (৪) অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসতো।৩ (৫) পক্ষান্তরে যে পরওয়া করে না, (৬) তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছো। (৭) অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নেই, (৮) পক্ষান্তরে যে তোমার নিকট ছুটে আসলো, (৯) আর সে (আল্লাহকে) ভয় করতো। (১০) তুমি তার প্রতি অবজ্ঞা করলে।

টীকা :

[১] عَبَسَ শব্দের অর্থ রুষ্টতা অবলম্বন করা এবং চোখে-মুখে বিরক্তি প্রকাশ করা। تَوَلّٰى শব্দের অর্থ মুখ ফিরিয়ে নেয়া।

[২] এখানে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) এর কথা বলা হয়েছে। তাঁর মা উম্মে মাকতুম ছিলেন খাদীজা (রাঃ) এর পিতা খুয়াইলিদের সহোদর বোন। তিনি ছিলেন নবী ﷺ এর শ্যালক। তিনি বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে সমাজের সাধারণ শ্রেণীভুক্ত নন; বরং অভিজাত বংশীয় ছিলেন।

[৩] অর্থাৎ আপনি কি জানেন এই সাহাবী যা জিজ্ঞেস করেছিল তা তাকে শিক্ষা দিলে সে তা দ্বারা পরিশুদ্ধ হতে পারত কিংবা কমপক্ষে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে উপকার লাভ করতে পারত।

আয়াত : ১১-২২

كَلَّاۤ اِنَّهَا تَذْكِرَةٌ (১১) فَمَنْ شَآءَ ذَكَرَهٗ (১২) فِيْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ (১৩) مَرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ (১৪) بِاَيْدِيْ سَفَرَةٍ (১৫) كِرَامٍ ۢبَرَرَةٍ (১৬) قُتِلَ الْاِنْسَانُ مَاۤ اَكْفَرَهٗ (১৭) مِنْ اَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهٗ (১৮) مِنْ نُّطْفَةٍ خَلَقَهٗ فَقَدَّرَهٗ (১৯) ثُمَّ السَّبِيْلَ يَسَّرَهٗ (২০) ثُمَّ اَمَاتَهٗ فَاَقْبَرَهٗ (২১) ثُمَّ اِذَا شَآءَ اَنْشَرَهٗ (২২)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১১) كَلَّا কখনো নয়, اِنَّهَا এটা তো تَذْكِرَةٌ উপদেশবাণী; (১২) فَمَنْ সুতরাং যে ব্যক্তি شَآءَ ইচ্ছা করবে ذَكَرَهٗ সে এটা স্মরণ রাখবে, (১৩) فِيْ صُحُفٍ লিপিবদ্ধ কিতাবে مُكَرَّمَةٍ সম্মানিত। (১৪) مَرْفُوْعَةٍ যেটা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন مُطَهَّرَةٍ পবিত্র। (৫) بِاَيْدِيْ سَفَرَةٍ লেখকদের হাতে থাকে। (৬) كِرَامٍ যারা সম্মানিত بَرَرَةٍ সৎ। (৭) قُتِلَ ধ্বংস হোক اَلْاِنْسَانُ মানুষ! مَاۤ اَكْفَرَهٗ সে কতই না অকৃতজ্ঞ! (১৮) مِنْ اَيِّ شَيْءٍ কোন বস্তু হতে خَلَقَهٗ তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন? (১৯) مِنْ نُّطْفَةٍ শুক্রবিন্দু হতে خَلَقَهٗ তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন فَقَدَّرَهٗ অতঃপর তার তাকদীর নির্ধারণ করেছেন (২০) ثُمَّ অতঃপর اَلسَّبِيْلَ চলার পথ يَسَّرَهٗ তার জন্য সহজ করেছেন; (২১) ثُمَّ اَمَاتَهٗ অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান فَاَقْبَرَهٗ পরে তাকে কবরস্থ করেন। (২২) ثُمَّ اِذَا অতঃপর যখন شَآءَ তিনি ইচ্ছা করবেন اَنْشَرَهٗ তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।

সরল অনুবাদ :

(১১) কখনও নয়, এটা তো উপদেশবাণী;৪ (১২) যে ইচ্ছা করবে সে এটা স্মরণ রাখবে, (১৩) ওটা সম্মানিত কিতাবে (লাওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ (১৪) যেটা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও পবিত্র।৫ (১৫) এমন লেখকদের হাতে থাকে।৬ (১৬) যারা সম্মানিত ও সৎ। (১৭) মানুষ ধ্বংস হোক! সে কত অকৃতজ্ঞ!৭ (১৮) তাকে তিনি কোন্ বস্তু হতে সৃষ্টি করেছেন? (১৯) তিনি তাকে সৃষ্টি করেন শুক্রবিন্দু হতে, তারপর তার তাকদীর নির্ধারণ করেন,৮ (২০) তারপর তার জন্যে পথ সহজ করে দেন;৯ (২১) অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান এবং তাকে কবরস্থ করেন। (২২) এরপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।১০

টীকা :

[৪] অর্থাৎ এমনটি কখনো করবেন না। যেসব লোক আল্লাহকে ভুলে আছে এবং যারা নিজেদের দুনিয়াবী সহায়-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অহঙ্কারে মত্ত হয়ে আছে, তাদেরকে অযথা গুরুত্ব দিবেন না। ইসলাম এমন কিছু নয় যে, যে ব্যক্তি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তার সামনে নতজানু হয়ে তা পেশ করতে হবে। যে সত্যের মুখাপেক্ষী নয় সত্যও তার মুখাপেক্ষী নয়।

[৫] مُكَرَّمَةٌ অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাসম্পন্ন। مَرْفُوْعَةٌ বলে বুঝানো হয়েছে এর মর্যাদা অনেক উচ্চ । আর مُطَهَّرَةٌ বলে হাসান বসরীর মতে বুঝানো হয়েছে যাবতীয় নাপাক থেকে পবিত্র। ইবনে কাসীর বলেন, এর অর্থ এটি বাড়তি-কমতি ও অপবিত্রতা থেকে পবিত্র ও মুক্ত।

[৬] سَفَرَةٌ শব্দটি سَافِرٌ এর বহুবচন হতে পারে। তখন অর্থ হবে লিপিকার বা লেখক। আর যদি سَفَرَةٌ শব্দটি سَفَارَةٌ থেকে আসে, তখন এর অর্থ দূতগণ। এখানে ফেরেশতা উদ্দেশ্য।

[৭] এর অর্থ, সে কত বড় সত্য-অস্বীকারকারী। তাছাড়া এ আয়াতের আরো একটি অর্থ হলো ‘‘কোন জিনিসটি তাকে সত্য অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে?’’

[৮] قَدَّرَهُ অর্থাৎ সুপরিমিত করেছেন, তার গঠন-প্রকৃতি, আকার-আকৃতি সুপরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছেন। قَدَّرَهُ শব্দের এরূপ অর্থও হতে পারে যে, মানুষ যখন মাতৃগর্ভে সৃষ্টি হতে থাকে তখন আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ, বয়স, রিযিক, ভাগ্য ইত্যাদি তাকদীর নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

[৯] আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ক্ষমতাবলে মাতৃগর্ভে মানুষকে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনিই তাকে মাতৃগর্ভ থেকে জীবিত ও পূর্ণাঙ্গরূপে বাইরে আসার পথ সহজ করে দেন। এছাড়া আয়াতের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, দুনিয়াতে যে ব্যক্তি নিজের জন্য ভালো বা মন্দ, কৃতজ্ঞতা বা অকৃতজ্ঞতা, আনুগত্য বা অবাধ্যতার মধ্যে সে কোন্ পথ চায় তিনি তা তার সামনে খুলে রেখে দিয়েছেন অথবা সহজ করে দিয়েছেন। ফলে সে শুকরিয়া আদায় করে সৎপথ গ্রহণ করতে পারে, আবার কুফরী করে বিপথেও যেতে পারে।

[১০] মৃত্যুর পর আল্লাহ তা‘আলাই মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। একমাত্র তিনিই এগুলো করার ক্ষমতা রাখেন। তারপরও মানুষ তাঁকে অস্বীকার করে, তাঁর হক আদায় করে না।

আয়াত : ২৩-৩২

كَلَّا لَمَّا يَقْضِ مَاۤ اَمَرَهٗ (২৩) فَلْيَنْظُرِ الْاِنْسَانُ اِلٰى طَعَامِه (২৪) اَنَّا صَبَبْنَا الْمَآءَ صَبًّا (২৫) ثُمَّ شَقَقْنَا الْاَرْضَ شَقًّا (২৬) فَاَنْۢبَتْنَا فِيْهَا حَبًّا (২৭) وَعِنَبًا وَّقَضْبًا (২৮) وَزَيْتُوْنًا وَّنَخْلًا (২৯) وَحَدَآئِقَ غُلْبًا (৩০) وَفَاكِهَةً وَّاَبًّا (৩১) مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِاَنْعَامِكُمْ (৩২)

শাব্দিক অনুবাদ :

(২৩) كَلَّا কখনো নয়, لَمَّا يَقْضِ সে বাস্তবায়িত করেনি مَاۤ اَمَرَهٗ তিনি তাকে যে আদেশ করেছেন। (২৪) فَلْيَنْظُرِ الْاِنْسَانُ মানুষ লক্ষ্য করুক اِلٰى طَعَامِه  তার খাদ্যের প্রতি। (২৫) اَنَّا صَبَبْنَا নিশ্চয় আমি বর্ষণ করি اَلْمَآءَ পানি صَبًّا প্রচুর পরিমাণে, (২৬) ثُمَّ شَقَقْنَا অতঃপর আমি বিদীর্ণ করি اَلْاَرْضَ ভূমিকে شَقًّا বিদীর্ণ করার মতো, (২৭) فَاَنْۢبَتْنَا এবং আমি উৎপন্ন করি فِيْهَا তাতে حَبًّا শস্য; (২৮) وَعِنَبًا আঙ্গুর, وَقَضْبًا শাক-সবজি, (২৯) وَزَيْتُوْنًا যায়তুন, وَنَخْلًا খেজুর, (৩০) وَحَدَآئِقَ বহু বাগান غُلْبًا নিবিড়-ঘন, (৩১) وَفَاكِهَةً ফল وَاَبًّا এবং ঘাস, (৩২) مَتَاعًا ভোগের সামগ্রী হিসেবে لَكُمْ তোমাদের জন্য وَلِاَنْعَامِكُمْ ও তোমাদের পশুগুলোর জন্য।

সরল অনুবাদ :

(২৩) কখনও নয়, তিনি তাকে যা আদেশ করেছেন, সে তা এখনো বাস্তবায়িত করেনি। (২৪) মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক।১১ (২৫) আমিই প্রচুর পানি বর্ষণ করি, (২৬) অতঃপর আমি ভূমিকে বিদীর্ণ করি বিদীর্ণ করার মতো, (২৭) এবং তাতে উৎপন্ন করি শস্য; (২৮) আঙ্গুর, শাক-সবজি, (২৯) যায়তুন, খেজুর, (৩০) বহু নিবিড়-ঘন বাগান, (৩১) আর ফল এবং (গবাদি পশুর খাদ্য) ঘাস (৩২) তোমাদের ও তোমাদের পশুগুলোর ভোগের সামগ্রী হিসেবে।১২

টীকা :

[১১] মানবসৃষ্টির সূচনা উল্লেখ করার পর মানুষ যে খাদ্যের নিয়ামত ভোগ করে, এখানে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এসব নিয়ামত তিনি মানুষকে দিয়েছেন, যাতে মানুষ কিয়ামতের প্রস্তুতির জন্য এর সাহায্যে আল্লাহর ইবাদাত করে।

[১২] কেবল তোমাদের জন্যই নয়, বরং তোমাদের যেসব পশু রয়েছে, তাদের জন্যও। এসব নিয়ামতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মহান আল্লাহর ইবাদাত, তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করা ও তার নির্দেশাবলি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা ফুটে ওঠে।

আয়াত : ৩৩-৪২

فَاِذَا جَآءَتِ الصَّآخَّةُ (৩৩) يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ اَخِيْهِ (৩৪) وَاُمِّه وَاَبِيْهِ (৩৫) وَصَاحِبَتِه وَبَنِيْهِ (৩৬) لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُّغْنِيْهِ (৩৭) وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ (৩৮) ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ (৩৯) وَوُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ (৪০) تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ (৪১) اُولٰٓئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ (৪২)

শাব্দিক অনুবাদ :

(৩৩) فَاِذَا অতঃপর যখন جَآءَتْ এসে পড়বে اَلصَّآخَّةُ বিকট ধ্বনি; (৩৪) يَوْمَ সেদিন يَفِرُّ পলায়ন করবে اَلْمَرْءُ মানুষ مِنْ اَخِيْهِ তার ভাই হতে, (৩৫) وَاُمِّه  তার মা হতে, وَاَبِيْهِ তার পিতা হতে, (৩৬) وَصَاحِبَتِه  তার স্ত্রী হতে وَبَنِيْهِ ও তার সন্তান হতে, (৭) لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ তাদের প্রত্যেকের হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন شَأْنٌ ব্যস্ততা يُغْنِيْهِ যা তাকে ব্যস্ত রাখবে। (৩৮) وُجُوْهٌ অনেক মুখমন্ডল يَوْمَئِذٍ সেদিন مُسْفِرَةٌ উজ্জ্বল হবে; (৩৯) ضَاحِكَةٌ হাসি মুখ مُسْتَبْشِرَةٌ প্রফুল্ল। (৪০) وَوُجُوْهٌ এবং অনেক মুখমন্ডল হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন عَلَيْهَا غَبَرَةٌ ধূলি মিশ্রিত। (৪১) تَرْهَقُهَا সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে قَتَرَةٌ কালো বর্ণ। (৪২) اُولٰٓئِكَ هُمْ তারাই اَلْكَفَرَةُ কাফির اَلْفَجَرَةُ পাপাচারী।

সরল অনুবাদ :

(৩৩) যখন ঐ বিকট ধ্বনি এসে পড়বে;১৩ (৩৪) সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার নিজের ভাই হতে, (৩৫) এবং তার মাতা, তার পিতা, (৩৬) তার স্ত্রী ও তার সন্তান হতে,১৪ (৩৭) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন গুরুতর অবস্থা হবে, যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে। (৩৮) সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে; (৩৯) হাসি মুখ ও প্রফুল্ল। (৪০) আর সেদিন অনেক মুখমন্ডল হবে ধূলি মিশ্রিত। (৪১) সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে কালো বর্ণ। (৪২) তারাই কাফির ও পাপাচারী।

টীকা :

[১৩] আয়াতে বর্ণিত اَلصَّاخَّةُ শব্দটির মূল অর্থ হলো, ‘এমন কঠোর ডাক, যার ফলে মানুষ শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলে। এখানে কিয়ামতের দ্বিতীয় শিঙ্গাধ্বনির কথা বলা হয়েছে। এই বিকট আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই মরা মানুষ জীবিত হয়ে উঠবে এবং কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে।

[১৪] এখানে হাশরের ময়দানে সকলের সমাবেশের দিন বুঝানো হয়েছে, সেদিন প্রত্যেক মানুষ আপন চিন্তায় বিভোর হবে। সেদিন মানুষ তার অতি-নিকটাত্মীয়কে দেখলেও মুখ লুকাবে এবং পালিয়ে বেড়াবে। এই একই ধরনের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে সূরা মা‘আরিজের ১০ থেকে ১৪ পর্যন্ত আয়াতেও।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

ইসলামের দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে ধনী-গরীব, উঁচু-নীচু ও সাদা-কালো ইত্যাদি কোন প্রকার পার্থক্য করা যাবে না।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে উপদেশ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা উচিত; তাহলে আল্লাহর কৃতজ্ঞ হওয়া যাবে।

কিয়ামতের দিন মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে এবং প্রত্যেকেই শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

জান্নাতবাসীদের চেহারা উজ্জ্বল হবে এবং তারা হাসিমুখি থাকবে। পক্ষান্তরে জাহান্নামী কাফির এবং গোনাহগার বান্দাদের চেহারা হবে মলিন এবং তাদের চেহারায় ধূলোবালির ছাপ হবে।

৮১- সূরা তাকভীর
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত كُوِّرَتْ (কুওভিরাত) শব্দটি থেকে এ সূরার নাম تَكْوِيْرٌ (তাকভীর) বলে নামকরণ করা হয়েছে। তাকভীর ( تَكْوِيْرٌ ) হচ্ছে মূল শব্দ। এর মানে হচ্ছে, গুটিয়ে ফেলা।

নাযিলের সময়কাল :

বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গী থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায়, এটি মক্কায় প্রথম যুগে নাযিল হওয়া সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে দুটি : আখেরাত ও রিসালাত। প্রথম ছয়টি আয়াতে কিয়ামতের প্রথম পর্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী সাতটি আয়াতে কিয়ামতের দ্বিতীয় পর্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর রিসালাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের সামনে যা কিছু পেশ করেছেন সেগুলো কোন পাগলের প্রলাপ নয়। কোন শয়তানের ওয়াসওয়াসা ও বিভ্রান্তিও নয়। বরং সেগুলো আল্লাহর প্রেরিত একজন উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন বিশ্বস্ত বাণীবাহকের বিবৃতি। এই শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তোমরা কোন দিকে চলে যাচ্ছো।

আয়াত : ১-১৪



اِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ (১) وَاِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَتْ (২) وَاِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ (৩) وَاِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ (৪) وَاِذَا الْوُحُوْشُ حُشِرَتْ (৫) وَاِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ (৬) وَاِذَا النُّفُوْسُ زُوِّجَتْ (৭) وَاِذَا الْمَوْءُوْدَةُ سُئِلَتْ (৮) بِاَيِّ ذَنْۢبٍ قُتِلَتْ (৯) وَاِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتْ (১০) وَاِذَا السَّمَآءُ كُشِطَتْ (১১) وَاِذَا الْجَحِيْمُ سُعِّرَتْ (১২) وَاِذَا الْجَنَّةُ اُزْلِفَتْ (১৩) عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّاۤ اَحْضَرَتْ (১৪)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِذَا যখন اَلشَّمْسُ সূর্য كُوِّرَتْ গুটিয়ে নেয়া হবে, (২) وَاِذَا আর যখন اَلنُّجُوْمُ নক্ষত্ররাজি اِنْكَدَرَتْ খসে পড়বে, (৩) وَاِذَا আর যখন اَلْجِبَالُ পর্বতসমূহকে سُيِّرَتْ চলমান করা হবে, (৪) وَاِذَا আর যখন اَلْعِشَارُ দশ মাসের গর্ভবতী উষ্ট্রী عُطِّلَتْ উপেক্ষিত হবে, (৫) وَاِذَا আর যখন اَلْوُحُوْشُ বন্য পশুগুলিকে حُشِرَتْ একত্রিত করা হবে, (৬) وَاِذَا আর যখন اَلْبِحَارُ সমুদ্রগুলিকে سُجِّرَتْ উদ্বেলিত করা হবে; (৭) وَاِذَا আর যখন اَلنُّفُوْسُ প্রাণগুলিকে زُوِّجَتْ মিলিত করা হবে; (৮) وَاِذَا আর যখন اَلْمَوْءُوْدَةُ জীবন্ত কবর দেয়া কন্যাকে سُئِلَتْ জিজ্ঞেস করা হবে; (৯) بِاَيِّ কোন ذَنْۢبٍ অপরাধে قُتِلَتْ তাকে হত্যা করা হয়েছিল? (১০) وَاِذَا আর যখন اَلصُّحُفُ আমলনামাসমূহ نُشِرَتْ প্রকাশ করা হবে, (১১) وَاِذَا আর যখন اَلسَّمَآءُ আকাশ كُشِطَتْ আবরণ অপসারিত করা হবে, (১২) وَاِذَا আর যখন اَلْجَحِيْمُ জাহান্নামকে سُعِّرَتْ প্রজ্বলিত করা হবে, (১৩) وَاِذَا আর যখন اَلْجَنَّةُ জান্নাতকে اُزْلِفَتْ নিকটবর্তী করা হবে, (১৪) عَلِمَتْ তখন জানবে نَفْسٌ প্রত্যেক ব্যক্তিই مَاۤ اَحْضَرَتْ সে কি নিয়ে এসেছে।

সরল অনুবাদ :

(১) যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে,১ (২) যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে,২ (৩) যখন পর্বতসমূহকে চলমান করা হবে,৩ (৪) যখন (দশ মাসের গর্ভবতী) উষ্ট্রী উপেক্ষিত হবে,৪ (৫) যখন বন্য পশুগুলিকে একত্রিত করা হবে, (৬) যখন সমুদ্রগুলিকে উদ্বেলিত করা হবে;৫ (৭) যখন প্রাণগুলিকে (দেহে) মিলিত করা হবে;৬ (৮) যখন জীবন্ত কবর দেয়া কন্যাকে৭ জিজ্ঞেস করা হবে, (৯) কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?৮ (১০) যখন আমলনামাসমূহ প্রকাশ করা হবে, (১১) যখন আকাশের আবরণ অপসারিত করা হবে,৯ (১২) যখন জাহান্নামের অগ্নি প্রজ্জলিত করা হবে, (১৩) এবং যখন জান্নাতকে নিকটবর্তী করা হবে, (১৪) তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে যে, সে কী নিয়ে এসেছে।১০

টীকা :

[১] আরবী ভাষায় تَكْوِيْرٌ (তাকভীর) মানে হচ্ছে গুটিয়ে দেয়া। অর্থাৎ তার আলোকবিচ্ছুরণ বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া كُوِّرَتْ এর অপর অর্থ নিক্ষেপ করাও হয়ে থাকে। হাদীসে এসেছে, ‘‘চাঁদ ও সূর্যকে কিয়ামতের দিন পেঁচিয়ে রাখা হবে।’’-

(সহীহ বুখারী, হা/৩২০০)

[২] যে বাঁধনের কারণে তারা নিজেদের কক্ষপথে ও নিজেদের জায়গায় বাঁধা আছে তা খুলে যাবে এবং সমস্ত গ্রহ-তারকা বিশ্ব-জাহানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়াও তারা শুধু ছড়িয়েই পড়বে না; বরং এই সঙ্গে আলোহীন হয়ে অন্ধকারও হয়ে যাবে।

[৩] পাহাড়সমূহকে কয়েকটি পর্যায়ে চলমান করা হবে। প্রথমে তা বিক্ষিপ্ত বালুরাশির মতো হবে, তারপর তা ধুনিত পশমের মতো হবে, সবশেষে তা উৎক্ষিপ্ত ধুলিকণা হয়ে যাবে এবং তার জায়গায় আর অবস্থিত থাকবে না।

[৪] আরবদের কাছে গর্ভবতী মাদী উট, যার প্রসবের সময় অতি নিকটে, তার চেয়ে বেশি মূল্যবান আর কোন সম্পদই ছিল না। এ সময় তার হেফাজত ও দেখাশুনার জন্য সবচেয়ে বেশি যত্ন নেয়া হতো। কিয়ামতের বিপদ যখন তাদের উপর এসে পড়বে, তখন এই সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ সংরক্ষণের কথা তাদের খেয়ালই থাকবে না। আরবদেরকে কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা বুঝাবার জন্য এটি ছিল একটি চমৎকার বর্ণনা পদ্ধতি।

[৫] এর কয়েকটি অর্থ রয়েছে। একটি অর্থ হল অগ্নিসংযোগ করা ও প্রজ্বলিত করা। কেউ কেউ বলেন, সমুদ্রগুলোকে স্ফীত করা হবে। কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন, পানি পূর্ণ করা হবে। অন্য কেউ অর্থ নিয়েছেন, মিশ্রিত করা অর্থাৎ সমুদ্র এক করে দেয়া হবে। সাধারণ চুল্লীতে আগুন জ্বালাবার জন্য তাসজীর শব্দ ব্যবহার করা হয়। কিয়ামতের দিন সমুদ্রে আগুন লেগে যাবে, এ কথাটা বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু পানির মূল তত্ত্ব ও উপাদান সম্পর্কে ধারণা থাকলে এর মধ্যে কোন কিছুই বিস্ময়কর মনে হবে না। আল্লাহ তাঁর ক্ষমতার সাহায্যে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের মতো এমন দুটি গ্যাসকে একসাথে মিশ্রত করে রেখেছেন, যাদের একটি আগুন জ্বালায় এবং অন্যটি নিজে জ্বলে। এই দুটি গ্যাসের সংমিশ্রণে পানির মতো এমন একটি বস্তু সৃষ্টি করেছেন, যা আগুন নিভিয়ে দেয়। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার একটি ইঙ্গিতই পানির এই মিশ্রণ পরিবর্তন করে দেবার জন্য যথেষ্ট। তখন তারা পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে তাদের মূল প্রকৃতি অনুযায়ী আগুন জ্বালাবার ও জ্বলার কাজ করবে।

[৬] এর অর্থ হচ্ছে, যখন আত্মাকে দেহের সাথে পুনঃমিলিত করা হবে। কিয়ামতের সময়ে সকলকে জীবিত করার জন্য প্রথমে দেহকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে। অতঃপর আত্মাকে দেহের সাথে সংযোজন করা হবে। এর আরেকটি অর্থ হল, যখন মানুষকে জোড়া জোড়া করা হবে। অর্থাৎ মানুষের আমল অনুসারে তাদের শ্রেণীবিভাগ করা হবে। যখন হাশরে সমবত লোকদেরকে বিভিন্ন দলে দলবদ্ধ করে দেয়া হবে। এই দলবদ্ধকরণ ঈমান ও কর্মের দিক দিয়ে করা হবে। ইহুদীরা ইহুদীদের সাথে, নাসারারা নাসারাদের সাথে, মুনাফিকরা মুনাফিকদের সাথে এক জায়গায় সমবেত হবে। মূলত হাশরে লোকদের তিনটি প্রধান দল হবে- (এক) পূর্ববর্তী সৎকর্মী লোকদের (দুই) আসহাবুল ইয়ামীনের এবং (তিন) আসহাবুশ শিমালের দল। প্রথমোক্ত দুই দল মুক্তি পাবে এবং তৃতীয় দলটি হবে কাফির পাপাচারীদের- তারা মুক্তি পাবে না।

[৭] اَلْمَوْءُوْدَةُ শব্দের অর্থ জীবন্ত প্রোথিত কন্যা। জাহেলিয়াত যুগের কোন কোন আরব গোত্র কন্যা সন্তান জন্ম হওয়াকে লজ্জাকর মনে করত। ফলে তারা তাকে জীবিত অবস্থাতেই মাটিতে প্রোথিত করে দিত। কোথাও সন্তান প্রসবকালেই মায়ের সামনে একটি গর্ত খনন করে রাখা হতো। মেয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তখনই তাকে গর্তে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হতো। আবার কোথাও যদি মা এতে রাজী না হতো বা তার পরিবারের কেউ এতে বাধা দিত তাহলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাপ কিছুদিন তাকে লালন পালন করতো। তারপর একদিন মরুভূমি, পাহাড় বা জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে কোথাও তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিতো। এই ধরনের রেওয়াজ আরবের বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে ইসলাম এই কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে।

[৮] অপরাধ করেছে পিতা বা মাতা, কিন্তু তাদেরকে কিছুই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে না। এ আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীতে মারাত্মক ধরনের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। আর তা হলো, যেসব পিতা বা মাতা তাদের মেয়েকে জীবিত পুঁতে ফেলেছে তারা আল্লাহর কাছে এত বেশি ঘৃণিত হবে যে, যখন আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের মাঠে সমস্ত মানুষের বিচার-ফায়সালা করবেন তখন তাদেরকে সম্বোধন করে এ কথা জিজ্ঞেস করা হবে না যে, তোমরা এই নিষ্পাপ শিশুটিকে কোন্ অপরাধে হত্যা করেছিলে? বরং সেদিন তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোট্ট নিরপরাধ মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন্ অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল?

[৯] كُشِطَتْ এর আভিধানিক অর্থ জন্তুর চামড়া খসানো। এর অপর অর্থ অপসারণ করা, সরিয়ে নেয়া। এ হিসেবে আয়াতের অর্থ এই যে, যখন মাথার উপর ছাদের ন্যায় বিস্তৃত এই আকাশকে অপসারিত করা হবে।

[১০] অর্থাৎ কিয়ামতের পরিস্থিতিতে প্রত্যেকেই জেনে নিবে যে, সে সৎকর্ম কিংবা অসৎকর্ম কী নিয়ে এসেছে।

আয়াত : ১৫-২৯

فَلَاۤ اُقْسِمُ بِالْخُنَّسِ (১৫) اَلْجَوَارِ الْكُنَّسِ (১৬) وَاللَّيْلِ اِذَا عَسْعَسَ (১৭) وَالصُّبْحِ اِذَا تَنَفَّسَ (১৮) اِنَّهٗ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِيْمٍ (১৯) ذِيْ قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِيْنٍ (২০) مُطَاعٍ ثَمَّ اَمِيْنٍ (২১) وَمَا صَاحِبُكُمْ بِمَجْنُوْنٍ (২২) وَلَقَدْ رَاٰهُ بِالْاُفُقِ الْمُبِيْنِ (২৩) وَمَا هُوَ عَلَى الْغَيْبِ بِضَنِيْنٍ (২৪) وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَيْطَانٍ رَّجِيْمٍ (২৫) فَاَيْنَ تَذْهَبُوْنَ (২৬) اِنْ هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِيْنَ (২৭) لِمَنْ شَآءَ مِنْكُمْ اَنْ يَّسْتَقِيْمَ (২৮) وَمَا تَشَآءُوْنَ اِلَّاۤ اَنْ يَّشَآءَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ (২৯)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৫) فَلَاۤ اُقْسِمُ কিন্তু না, আমি শপথ করছি بِالْخُنَّسِ প্রত্যাবর্তনকারী তারকারাজির; (১৬) اَلْجَوَارِ যা গতিশীল اَلْكُنَّسِ ও স্থিতিমান; (১৭) وَاللَّيْلِ শপথ রাতের اِذَا عَسْعَسَ যখন সে চলে যেতে থাকে। (১৮) وَالصُّبْحِ শপথ প্রভাতের اِذَا تَنَفَّسَ যখন এর আবির্ভাব হয়, (১৯) اِنَّهٗ নিশ্চয় এটা لَقَوْلُ বাণী رَسُوْلٍ كَرِيْمٍ সম্মানিত বার্তাবাহকের, (২০) ذِيْ قُوَّةٍ সে শক্তিশালী عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ আরশের মালিকের নিকট مَكِيْنٍ মর্যাদা সম্পন্ন, (২১) مُطَاعٍ ثَمَّ সেখানে সে আস্থাভাজন ও اَمِيْنٍ বিশ্বাস ভাজন। (২২) وَمَا صَاحِبُكُمْ আর তোমাদের সাথী (মুহাম্মাদ) নন بِمَجْنُوْنٍ পাগল (২৩) وَلَقَدْ رَاٰهُ তিনি তো তাঁকে দেখেছিলেন بِالْاُفُقِ الْمُبِيْنِ স্পষ্ট দিগন্তে। (২৪) وَمَا هُوَ আর তিনি নন عَلَى الْغَيْبِ অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা করতে بِضَنِيْنٍ কৃপণ। (২৫) وَمَا هُوَ আর এটা (কুরআন) নয় بِقَوْلِ شَيْطَانٍ কোন শয়তানের বাক্য رَجِيْمٍ যে অভিশপ্ত । (২৬) فَاَيْنَ সুতরাং তোমরা কোথায় تَذْهَبُوْنَ চলেছো? (২৭) اِنْ هُوَ নিশ্চয় এটা তো اِلَّا ذِكْرٌ কেবল উপদেশ لِلْعَالَمِيْنَ বিশ্ববাসীর জন্যে, (২৮) لِمَنْ যে شَآءَ চায় مِنْكُمْ তোমাদের মধ্য হতে اَنْ يَّسْتَقِيْمَ সরল পথে চলতে। (২৯) وَمَا تَشَآءُوْنَ আর তোমরা কিছুই চাইবে না, اِلَّاۤ اَنْ يَّشَآءَ اللهُ তবে যদি আল্লাহ চান, رَبُّ الْعَالَمِيْنَ যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

সরল অনুবাদ :

(১৫) কিন্তু না, আমি শপথ করছি প্রত্যাবর্তনকারী তারকারাজির; (১৬) যা গতিশীল ও স্থিতিমান; (১৭) শপথ রাতের, যখন সে চলে যেতে থাকে।১১ (১৮) আর (শপথ) প্রভাতের, যখন এর আবির্ভাব হয়, (১৯) নিশ্চয় এই কুরআন সম্মানিত বার্তাবাহকের আনীত বাণী,১২ (২০) সে শক্তিশালী আরশের মালিকের নিকট মর্যাদা সম্পন্ন, (২১) সেখানে তাকে মান্য করা হয় এবং সে বিশ্বাস ভাজন।১৩ (২২) এবং তোমাদের সাথী (মুহাম্মাদ) পাগল নন,১৪ (২৩) তিনি তো তাঁকে (জিবরাঈলকে) দিগন্তে দেখেছিলেন।১৫ (২৪) তিনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা করতে কৃপণ নন।১৬ (২৫) এবং এটা (কুরআন) কোন অভিশপ্ত শয়তানের বাক্য নয়। (২৬) সুতরাং তোমরা কোথায় চলেছো? (২৭) এটা তো কেবল বিশ্ববাসীর জন্যে উপদেশ, (২৮) তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্যে।১৭ (২৯) তোমরা কিছুই চাইবে না, যদি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তা না চান।১৮

টীকা :

[১১] عَسْعَسَ শব্দটির দুটি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে বিদায় নেয়া, শেষ হওয়া। অপর অর্থ হল আগমন করা, প্রবেশ করা। তখন আয়াতটির অর্থ হয়, শপথ রাতের, যখন তা আগমন করে।

[১২] এখানে সম্মানিত বাণীবাহক رَسُوْلٌ كَرِيْمٌ বলতে অহী আনার কাজে লিপ্ত ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) কে বুঝানো হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে একথাটি আরো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে। নবী-রাসূলগণের মতো ফেরেশতাগণের বেলায়ও রাসূল শব্দ ব্যবহৃত হয়। উল্লেখিত সবগুলো বিশ্লেষণ জিবরাঈল (আঃ) এর জন্য প্রযোজ্য। কুরআনকে ‘‘বাণীবাহকের বাণী’’ বলার অর্থ এই নয় যে, এটি ঐ সংশ্লিষ্ট ফেরেশতার নিজের কথা। বরং এটি সেই সত্তার বাণী যিনি তাকে বাণীবাহক করে পাঠিয়েছেন।

[১৩] অর্থাৎ এই কুরআন একজন সম্মানিত দূতের আনীত কালাম। তিনি শক্তিশালী, আরশের অধিপতির কাছে মর্যাদাশীল। তিনি ফেরেশতাদের নিকট মান্য। সমস্ত ফেরেশতা তাকে মান্য করে। তিনি আল্লাহর বিশ্বাসভাজন; পয়গাম আনা নেয়ার কাজে তার তরফ থেকে বিশ্বাসভঙ্গ ও কম বেশি করার সম্ভাবনা নেই। বরং তিনি এমন পর্যায়ের আমানতদার যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু বলা হয় সেগুলো তিনি হুবহু পৌঁছিয়ে দেন।

[১৪] এখানে সাথী বলতে মুহাম্মাদ ﷺ কে বুঝানো হয়েছে। যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে উম্মাদ বলত এতে তাদেরকে জবাব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের এ ধারণা ঠিক নয় যে, কুরআনে যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো কোন পাগলের প্রলাপ বা শয়তানের বক্তব্য।

[১৫] অর্থাৎ মুহাম্মাদ ﷺ কে প্রকাশ্য দিগন্তে, মূল আকৃতিতে দেখেছেন। এই দেখার কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, তিনি ওহী নিয়ে আগমনকারী জিবরাঈল (আঃ) এর সাথে পরিচিত ছিলেন। তাকে আসল আকার আকৃতিতেও দেখেছিলেন। তাই এই ওহীতে কোনরূপ সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই।

[১৬] রাসূলুল্লাহ ﷺ তোমাদের কাছ থেকে কোন কথা গোপন রাখেন না। গায়েব থেকে তার কাছে যেসব তথ্য বা অহী আসে তা সবই তিনি একটুও কমবেশি না করে তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন।

[১৭] অন্য কথায় বলা যায়, এ বাণীটি তো সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য উপদেশ এ কথা ঠিক, কিন্তু এর থেকে ফায়দা একমাত্র সেই ব্যক্তি হাসিল করতে পারে যে নিজে সত্য-সরল পথে চলতে চায়। এ উপদেশ থেকে উপকৃত হবার জন্য মানুষের সত্য-সন্ধানী ও সত্য প্রিয় হওয়া প্রথম শর্ত।

[১৮] অর্থাৎ তোমরা সরল পথে চলতে চাইলে এবং আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে চাইলেই থাকতে পারবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ইচ্ছা না করবেন। সুতরাং তাঁর কাছেই তাওফীক কামনা করো। তবে এটা সত্য যে, কেউ যদি আল্লাহর পথে চলতে ইচ্ছে করে তবে আল্লাহও তাকে সেদিকে চলতে সহযোগিতা করেন। মূলত আল্লাহর ইচ্ছা হওয়ার পরই বান্দার সে পথে চলার তাওফীক হয়। বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারেই হয়। তবে যদি ভাল কাজ হয়, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে, এটাকে বলা হয় আল্লাহর শরীয়তগত ইচ্ছা। পক্ষান্তরে খারাপ কাজ হলে আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হলেও তাতে তাঁর সন্তুষ্টি থাকে না। এটাকে বলা হয় আল্লাহর প্রাকৃতিক ইচ্ছা। এ দু‘ধরনের ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য না করার কারণে অতীতে ও বর্তমানে অনেক দল ও ফের্কার উদ্ভব ঘটেছে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে।

কন্যা সন্তানকে হত্যা করা মারাত্মক অপরাধ।

কিয়ামতের দিন ভালো-মন্দ সমস্ত আমলনামা প্রকাশ করা হবে।

কিয়ামতের দিন জান্নাত ও জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে।

কুরআন আল্লাহ তা‘আলার বাণী; কোন শয়তান, গণক বা জ্যোতিষীর কথা নয়।

মুহাম্মাদ ﷺ সরাসরি জিবরাঈল (আঃ)-কে দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সত্য পথে চলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য কুরআন হচ্ছে একটি আদর্শ গ্রন্থ।

৮২- সূরা ইনফিতার
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতের শব্দ اِنْفَطَرَتْ থেকেই এর নামকরণ করা হয়েছে। এর মূল শব্দ হলো اِنْفِطَارٌ (ইনফিতার), এর অর্থ ফেটে যাওয়া।

নাযিলের সময়কাল :

এই সূরার ও সূরা আত-তাকভীরের বিষয়বস্তুর মধ্যে গভীর মিল দেখা যায়। এ থেকে বুঝা যায়, এই সূরা দুটি প্রায় একই সময়ে নাযিল হয়েছে।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে আখেরাত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ سَرَّهٗ أَنْ يَنْظُرَ إِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهٗ رَأْيُ عَيْنٍ فَلْيَقْرَأْ إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ، وَإِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ ، وَإِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ

যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনটি নিজের চোখে দেখতে চায় সে যেন সূরা তাকভীর, সূরা ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পড়ে নেয়।

এখানে প্রথমে কিয়ামতের দিনের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। তারপর মানুষের মনে অনুভূতি জাগানো হয়েছে যে, যে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে অস্তিত্ব দান করলেন এবং যার অনুগ্রহে তুমি আজ সমস্ত সৃষ্ট জীবের মধ্যে সবচেয়ে ভালো শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহকারে বিচরণ করছো, তিনি ইনসাফকারী নন এটা মনে করো না। তারপর মানুষকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে, তোমার পুরো আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য লেখকরা সবসময় তোমার সমস্ত কথাবার্তা, উঠাবসা, চলাফেরা ও যাবতীয় কাজকর্ম লিখে চলছেন। সবশেষে পূর্ণ দৃঢ়তা সহকারে বলা হয়েছে, অবশ্যই একদিন কিয়ামত হবে। সেদিন নেককার লোকেরা জান্নাতে সুখের জীবন লাভ করবে এবং পাপীরা জাহান্নামের আযাব ভোগ করবে।

আয়াত : ১-১২



اِذَا السَّمَآءُ انْفَطَرَتْ (১) وَاِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ (২) وَاِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ (৩) وَاِذَا الْقُبُوْرُ بُعْثِرَتْ (৪) عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ وَاَخَّرَتْ (৫) يَاۤ اَيُّهَا الْاِنْسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيْمِ (৬) اَلَّذِيْ خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ (৭) فِيْۤ اَيِّ صُوْرَةٍ مَّا شَآءَ رَكَّبَكَ (৮) كَلَّا بَلْ تُكَذِّبُوْنَ بِالدِّيْنِ (৯) وَاِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِيْنَ (১০) كِرَامًا كَاتِبِيْنَ (১১) يَعْلَمُوْنَ مَا تَفْعَلُوْنَ (১২)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِذَا যখন اَلسَّمَآءُ আকাশ اِنْفَطَرَتْ ফেটে যাবে, (২) وَاِذَا الْكَوَاكِبُ যখন তারকারাজী اِنْتَثَرَتْ বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে, (৩) وَاِذَا الْبِحَارُ যখন সমুদ্রগুলি فُجِّرَتْ উত্তাল করা হবে, (৪) وَاِذَا الْقُبُوْرُ এবং যখন কবরসমূহ بُعْثِرَتْ উন্মোচিত হবে; (৫) عَلِمَتْ তখন জেনে নেবে نَفْسٌ প্রত্যেকে مَا قَدَّمَتْ যা সে পূর্বে প্রেরণ করেছে وَاَخَّرَتْ এবং পশ্চাতে ছেড়ে এসেছে। (৬) يَاۤ اَيُّهَا الْاِنْسَانُ হে মানুষ! مَا غَرَّكَ কিসে তোমাকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে بِرَبِّكَ الْكَرِيْمِ তোমার মহান প্রতিপালকের ব্যাপারে? (৭) اَلَّذِيْ যিনি خَلَقَكَ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, فَسَوَّاكَ অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন فَعَدَلَكَ তারপর সুবিন্যস্ত করেছেন, (৮) فِيْۤ اَيِّ صُوْرَةٍ যে আকৃতিতে مَا شَآءَ তিনি চেয়েছেন رَكَّبَكَ তোমাকে সংযোজিত করেছেন। (৯) كَلَّا কখনই না, بَلْ বরং تُكَذِّبُوْنَ তোমরা তো মিথ্যা প্রতিপন্ন করে থাকো بِالدِّيْنِ বিচার দিবসকে; (১০) وَاِنَّ عَلَيْكُمْ আর নিশ্চয় তোমাদের উপর নিযুক্ত রয়েছে لَحَافِظِيْنَ সংরক্ষকগণ। (১১) كِرَامًا সম্মানিত كَاتِبِيْنَ লেখকগণ; (১২) يَعْلَمُوْنَ তাঁরা অবগত থাকেন مَا تَفْعَلُوْنَ তোমরা যা কর।

সরল অনুবাদ :

(১) যখন আকাশ ফেটে যাবে, (২) যখন তারকারাজী বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে, (৩) যখন সমুদ্রগুলি উত্তাল করবে, (৪) এবং যখন কবরসমূহ উন্মোচিত হবে;১ (৫) তখন প্রত্যেকে জেনে নেবে যা সে পূর্বে প্রেরণ করেছে এবং পশ্চাতে ছেড়ে এসেছে।২ (৬) হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালকের ব্যাপারে ধোকায় ফেলেছে? (৭) যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন তারপর সুবিন্যস্ত করেছেন,৩ (৮) তিনি যে আকৃতিতে চেয়েছেন, তোমাকে সংযোজিত করেছেন।৪ (৯) না কখনই না, তোমরা তো বিচার দিবসকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করে থাকো;৫ (১০) আর নিশ্চয় তোমাদের উপর সংরক্ষকগণ নিযুক্ত রয়েছে। (১১) সম্মানিত লেখকগণ; (১২) তোমরা যা কর তা তাঁরা অবগত থাকেন।৬

টীকা :

[১] প্রথম তিনটি আয়াতে কিয়ামতের প্রথম পর্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই আয়াতে দ্বিতীয় পর্বের কথা বলা হয়েছে। কবর খুলে ফেলার মানে হচ্ছে, তা খুলে তা থেকে মানুষকে আবার নতুন করে জীবিত করে উঠানো।

[২] অর্থাৎ আকাশ বিদীর্ণ হওয়া, নক্ষত্রসমূহ ঝড়ে পড়া, সমুদ্র একাকার হয়ে যাওয়া, কবর থেকে মৃতদের বের হয়ে আসা কিয়ামতের এসব ঘটনা যখন ঘটে যাবে, তখন প্রত্যেকেই জেনে নিবে সে কী অগ্রে প্রেরণ করেছে এবং কী পশ্চাতে ছেড়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে مَا قَدَّمَتْ وَاَخَّرَتْ । এ শব্দগুলোর কয়েকটি অর্থ হতে পারে এবং সবগুলো অর্থই এখানে প্রযোজ্য। (এক) যে ভালো ও মন্দ কাজ করে মানুষ আগে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে مَا قَدَّمَتْ এবং যেগুলো করতে সে বিরত থেকেছে তাকে مَاا َخَّرَتْ বলা যায়। সুতরাং কিয়ামতের দিন প্রত্যেকেই জেনে নিবে সে সৎ-অসৎ কি কর্ম করেছে এবং কি করেনি। (দুই) যা কিছু প্রথমে করেছে তা مَا قَدَّمَتْ এবং যা কিছু পরে করেছে তা مَاا َخَّرَتْ এর অন্তর্ভুক্ত। (তিন) যেসব ভালো বা মন্দ কাজ মানুষ তার জীবনে করেছে সেগুলো مَا قَدَّمَتْ এর অন্তর্ভুক্ত। এ মানুষের সমাজে এসব কাজের যে প্রভাব ও ফলাফল সে নিজের পেছনে রেখে এসেছে সেগুলো مَاا َخَّرَتْ এর অন্তর্ভুক্ত। কাজটি সৎ হলে তার সওয়াব সে পেতে থাকবে এবং অসৎ হলে তার গোনাহ আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম সুন্নত ও নিয়ম চালু করে সে তার সওয়াব সবসময় পেতে থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোন কুপ্রথা অথবা পাপ কাজ চালু করে আর যতদিন মানুষ এই পাপ কাজ করবে ততদিন তার আমলনামায় এর গোনাহ লেখা হতে থাকবে।

[৩] মহান আল্লাহ তোমাকে এই পূর্ণাঙ্গ মানবিক আকৃতি দান করেছেন। তোমার সামনে সব রকমের প্রাণী রয়েছে, তাদের মোকাবিলায় তোমার সবচেয়ে সুন্দর শারীরিক কাঠামো এবং শ্রেষ্ঠ ও উন্নত শক্তি একেবারেই সুস্পষ্ট। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘‘অবশ্যই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।’’

[৪] এখানে মানুষ সৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তদুপরি তোমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুবিন্যস্ত করেছেন। এরপর বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সব মানুষকে, যাকে যেরূপে ইচ্ছা সে আকার-আকৃতিতে সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি কোটি কোটি মানুষের আকার-আকৃতি এমনভাবে গঠন করেছেন যে, পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। আর তা আল্লাহ তা‘আলার এক বড় নিদর্শন।

[৫] যে জিনিসটি তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে, তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে তা হল এই ধারণা যে, দুনিয়ায় এই কর্মজগতের পরে আর কোন কর্মফল, প্রতিদান ও বিচারের জগত নেই। এ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারণাই তোমাকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে।

[৬] ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেকটি কাজ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। সব জায়গায় সব অবস্থায় সকল ব্যক্তির সাথে তারা এমনভাবে লেগে আছেন যে, তারা জানতেই পারছে না যে, কেউ তাদের কাজ পরিদর্শন করছে। কোন ব্যক্তি কোন নিয়তে কি কাজ করেছে তাও তারা জানতে পারেন। সূরা কাহাফের ৪৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন অপরাধীরা অবাক হয়ে দেখবে তাদের সামনে যে আমলনামা পেশ করা হচ্ছে তার মধ্যে তাদের ছোট-বড় কোন একটি কাজও লিখা হতে বাদ যায়নি। যা কিছু তারা করেছিল সব হুবহু ঠিক তেমনিভাবেই তাদের সামনে আনা হয়েছে।

আয়াত : ১৩-১৯

اِنَّ الْاَبْرَارَ لَفِيْ نَعِيْمٍ (১৩) وَاِنَّ الْفُجَّارَ لَفِيْ جَحِيْمٍ (১৪) يَصْلَوْنَهَا يَوْمَ الدِّيْنِ (১৫) وَمَا هُمْ عَنْهَا بِغَآئِبِيْنَ (১৬) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّيْنِ (১৭) ثُمَّ مَاۤ اَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّيْنِ (১৮) يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَيْئًا وَّالْاَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِّلّٰهِ (১৯)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৩) اِنَّ الْاَبْرَارَ নিশ্চয় পুণ্যবানগণ لَفِيْ نَعِيْمٍ নিয়ামতসমূহে অবস্থান করবে; (১৪) وَاِنَّ الْفُجَّارَ এবং পাপীরা থাকবে لَفِيْ جَحِيْمٍ জাহান্নামে; (১৫) يَصْلَوْنَهَا তারা তাতে প্রবেশ করবে يَوْمَ الدِّيْنِ প্রতিদান দিবসে; (১৬) وَمَا هُمْ তারা থাকতে পারবে না عَنْهَا ওটা হতে بِغَآئِبِيْنَ দূরে। (১৭) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জানো مَا يَوْمُ الدِّيْنِ প্রতিদান দিবস কী? (১৮) ثُمَّ অতঃপর (আবার বলি) مَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জানো مَا يَوْمُ الدِّيْنِ প্রতিদান দিবস কী? (১৯) يَوْمَ সেদিন لَا تَمْلِكُ কোন অধিকার রাখবে না نَفْسٌ কোন ব্যক্তি لِنَفْسٍ অপর কোন ব্যক্তির জন্য شَيْئًا কোন কিছুর وَالْاَمْرُ আর সমস্ত কর্তৃত্ব হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন لِلّٰهِ একমাত্র আল্লাহর।

সরল অনুবাদ :

(১৩) নিশ্চয় পুণ্যবানগণ নিয়ামতসমূহে অবস্থান করবে;৭ (১৪) এবং পাপীরা থাকবে জাহান্নামে;৮ (১৫) প্রতিদান দিবসে তারা তাতে প্রবেশ করবে; (১৬) তারা ওটা হতে দূরে থাকতে পারবে না।৯ (১৭) প্রতিদান দিবস কি তা কি তুমি জানো? (১৮) অতঃপর আবারও বলি, প্রতিদান দিবস কী তা কি তুমি অবগত আছ? (১৯) সেদিন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির জন্য কোন কিছু করার অধিকার রাখবে না এবং সেদিন সমস্ত কর্তৃত্ব হবে একমাত্র আল্লাহর।১০

টীকা :

[৭] অন্যত্র এসেছে, পুণ্যবানগণ থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে, তারা সুসজ্জিত আসনে বসে অবলোকন করবে। আপনি তাদের মুখমন্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের দীপ্তি দেখতে পাবেন। তাদেরকে মোহর করা বিশুদ্ধ পানীয় পান করানো হবে; ওটার মোহর মিসকের, এ বিষয়ে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক। ওটার মিশ্রণ হবে তাসনীমের; তা একটা প্রস্রবণ, যা থেকে সান্নিধ্যপ্রাপ্তরা পান করে।

(সূরা মুতাফ্ফিফীন : ১৮-২৮)

[৮] পাপাচারীরা কী কঠিন শাস্তিতে থাকবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, অবশ্যই সেদিন তারা তাদের প্রতিপালক হতে আড়ালে থাকবে; তারপর তারা তো জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তারপর বলা হবে, এটাই তা যাকে তোমরা অস্বীকার করতে। (সূরা মুতাফ্ফিফীন : ৭-১৭)

[৯] জাহান্নামীরা কোন সময় জাহান্নাম থেকে পৃথক হবে না, অনুপস্থিত থাকতে পারবে না; মৃত্যুর মাধ্যমেও নয়, বের হওয়ার মাধ্যমেও নয়।

[১০] অর্থাৎ হাশরের ময়দানে কোন ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় অন্যের কোন উপকার করতে পারবে না এবং কারো কষ্টও দূর করতে পারবে না। অনুরূপভাবে সুপারিশও কারো নিজ ইচ্ছার উপর হবে না, যে পর্যন্ত আল্লাহ কাউকে কারো জন্য সুপারিশ করার অনুমতি না দেন।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

শয়তানের ধোঁকায় না পড়ে মহান আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করতে হবে।

প্রতিটি মানুষের জন্য দু’জন সম্মানিত লেখক ফেরেশতা আছেন, যারা তার প্রতিটি ভাল-মন্দ কাজ লিপিবদ্ধ করেন।

বিচার দিবসে কারো সুপারিশ ও বন্ধুত্ব কোন কাজে আসবে না। এমনকি সেদিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কোন কথা বলতে পারবে না।

৮৩- সূরা মুত্বাফফিফীন
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْمُطَفِّفِيْنُ শব্দের আলোকে এ সূরাটির নামকরণ হয় সূরা আল-মুত্বাফফিফীন। এর মূল শব্দ হলো تَطْفِيْفٌ যার অর্থ মাপ ও ওজনে কম দেয়া।

নাযিলের সময়কাল :

এই সূরার বিষয়বস্তু থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এটি মক্কায় প্রথম দিকে নাযিল হয়। সূরাটি ঠিক তখনই নাযিল হয় যখন মক্কার লোকেরা পথে-ঘাটে বাজারে-মজলিসে মুসলিমদেরকে টিটকারী দিচ্ছিল এবং তাদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করছিল। তবে জুলুম, নিপীড়ন ও মারপিট করার যুগ তখনো শুরু হয়নি।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু আখেরাত। ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সাধারণ বেঈমানী রয়েছে যে, তারা অন্যের থেকে নেয়ার সময় ওজন ও মাপ পুরো করে নেয়; কিন্তু অন্যদেরকে দেয়ার সময় কিছু না কিছু কম দেয়। সমাজের আরো অসংখ্য অসৎকাজের মধ্যে এটি এমন একটি অসৎকাজ, যার অসৎ হবার ব্যাপারটি কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এটি আখেরাত থেকে গাফেল হয়ে থাকার অপরিহার্য ফল।

দুষ্কৃতকারীদের কাজের বিবরণী লেখা হচ্ছে এবং আখেরাতে তাদেরকে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। সবশেষে বলা হয়েছে, যারা সর্বদা ঈমানদারদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করার কাজে লিপ্ত আছে, কিয়ামতের দিন তারা অপরাধীর পর্যায়ে থাকবে এবং নিজেদের এ কাজের জন্য অত্যন্ত খারাপ পরিণাম দেখবে। আর সেদিন এ ঈমানদাররা এ অপরাধীদের খারাপ ও ভয়াবহ পরিণাম দেখে নিজেদের চোখ শীতল করবে।

আয়াত : ১-৬



وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ (১) اَلَّذِيْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ (২) وَاِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ (৩) اَلَا يَظُنُّ اُولٰٓئِكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ (৪) لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ (৫) يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ (৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَيْلٌ মন্দ পরিণাম لِلْمُطَفِّفِيْنَ পরিমাপে কমকারীদের জন্য, (২) اَلَّذِيْنَ যারা اِذَا اكْتَالُوْا যখন মেপে নেয় عَلَى النَّاسِ লোকের নিকট হতে يَسْتَوْفُوْنَ পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, (৩) وَاِذَا كَالُوْهُمْ এবং যখন তাদের জন্যে মেপে দেয় اَوْ অথবা وَزَنُوْهُمْ ওজন করে দেয়, يُخْسِرُوْنَ তখন কম দেয়। (৪) اَلَا يَظُنُّ কি চিন্তা করে না اُولٰٓئِكَ ঐসব লোকেরা اَنَّهُمْ অবশ্যই তারা مَبْعُوْثُوْنَ পুনরুত্থিত হবে। (৫) لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ সে মহান দিবসে; (৬) يَوْمَ যেদিন يَقُوْمُ দাঁড়াবে اَلنَّاسُ সমস্ত মানুষ لِرَبِّ প্রতিপালকের সামনে اَلْعَالَمِيْنَ জগত সমূহের।

সরল অনুবাদ :

(১) মন্দ পরিণাম পরিমাপে কম দানকারীদের জন্য,২ (২) যারা লোকের নিকট হতে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, (৩) (পক্ষান্তরে) যখন তাদের জন্যে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। (৪) তারা কি চিন্তা করে না যে, তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে। (৫) সে মহান দিবসে (৬) যেদিন সমস্ত মানুষ জগতসমূহের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে।৩

টীকা :

[১] বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন মদীনাবাসীরা মাপে কম দেওয়াতে খুবই অভ্যস্ত ছিল। এর প্রেক্ষিতে সূরা মুত্বাফ্ফিফীন নাযিল হয়। এই সূরা নাযিল হওয়ার পর তারা এই বদভ্যাস থেকে বিরত হয়। (সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/১১৫৯০; ইবনে মাজাহ, হা/২২২৩)

[২] تَطْفِيْفٌ এর অর্থ মাপে কম দেয়া। যে এরূপ করে তাকে বলা হয় مُطَفِّفٌ । আরবী ভাষায় তাতফীফ ছোট্ট, তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসকে বলা হয়ে থাকে। পারিভাষিক অর্থে তাতফীফ মানে হচ্ছে মাপে ও ওজনে চুরি করা। কারণ এ কাজ করার সময় এক ব্যক্তি মাপ ও ওজনের মাধ্যমে কোন বড় পরিমাণ জিনিস চুরি করে না। বরং প্রত্যেক ক্রেতার অংশ থেকে সামান্য সামান্য করে বাচিয়ে নেয়। ফলে বিক্রেতা কতটুকু চুরি করেছে ক্রেতা তা টেরও পায় না।

কুরআনের এই আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসে মাপ ও ওজনে কম দেয়াকে হারাম করা হয়েছে এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করার জন্য কড়া তাগিদ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়ছে, ‘‘মাপার সময় পুরো মাপবে এবং সঠিক পাল্লা দিয়ে ওজন করবে।’’- (সূরা ইসরা- ৩৫)

তবে আয়াতে উল্লেখিত تَطْفِيْفٌ শুধু মাপ ও ওজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং মাপ ও ওজনের মাধ্যমে হোক, গণনার মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোন পন্থায় প্রাপককে তার প্রাপ্য কম দিলে তা تَطْفِيْفٌ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে। সুতরাং প্রত্যেক প্রাপকের প্রাপ্য পূর্ণমাত্রায় দেয়াই আয়াতের উদ্দেশ্যে।

[৩] ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যেদিন সমস্ত মানুষ জগতসমূহের রবের সামনে দাঁড়াবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের কানের মধ্যভাগ পর্যন্ত ঘামে ডুবে থাকবে। (সহীহ বুখারী, হা/৬৫৩১) অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কিয়ামতের দিন সূর্যকে সৃষ্টির এত নিকটে আনা হবে যে, তাদের মধ্যে দূরত্ব হবে এক মাইল। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জানি না- এখানে মাইল বলে পরিচিত এক মাইল না সুরমাদানি (যা আরবিতে মাইল বলা হয় তা) বুঝানো হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, মানুষ তাদের স্বীয় আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। কারো ঘাম হবে গোড়ালি পর্যন্ত, কারো হবে হাঁটু পর্যন্ত। আবার কারো ঘাম হবে কমর পর্যন্ত। কারো ঘাম মুখের লাগামের মতো হবে। (সহীহ মুসলিম, হা/২৮৬৪)

আয়াত : ৭-১৭

كَلَّاۤ اِنَّ كِتَابَ الْفُجَّارِ لَفِيْ سِجِّيْنٍ (৭) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا سِجِّيْنٌ (৮) كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ (৯) وَيْلٌ يَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِيْنَ (১০) اَلَّذِيْنَ يُكَذِّبُوْنَ بِيَوْمِ الدِّيْنِ (১১) وَمَا يُكَذِّبُ بِه ۤ اِلَّا كُلُّ مُعْتَدٍ اَثِيْمٍ (১২) اِذَا تُتْلٰى عَلَيْهِ اٰيَاتُنَا قَالَ اَسَاطِيْرُ الْاَوَّلِيْنَ (১৩) كَلَّا بَلْ ٚ رَانَ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ (১৪) كَلَّاۤ اِنَّهُمْ عَنْ رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوْبُوْنَ (১৫) ثُمَّ اِنَّهُمْ لَصَالُو الْجَحِيْمِ (১৬) ثُمَّ يُقَالُ هٰذَا الَّذِيْ كُنْتُمْ بِه تُكَذِّبُوْنَ (১৭)

শাব্দিক অনুবাদ :

(৭) كَلَّا কখনই না, اِنَّ كِتَابَ নিশ্চয় আমলনামা اَلْفُجَّارِ পাপাচারীদের لَفِيْ سِجِّيْنٍ সিজ্জীনে থাকে; (৮) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জান مَا سِجِّيْنٌ সিজ্জীন কী? (৯) كِتَابٌ ওটা হচ্ছে কিতাব مَرْقُوْمٌ লিখিত। (১০) وَيْلٌ মন্দ পরিণাম يَوْمَئِذٍ সেদিন لِلْمُكَذِّبِيْنَ মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের। (১১) اَلَّذِيْنَ যারা يُكَذِّبُوْنَ মিথ্যা প্রতিপন্ন করে بِيَوْمِ الدِّيْنِ কর্মফল দিবসকে, (১২) وَمَا يُكَذِّبُ بِه  আর কেউই ওকে মিথ্যা বলতে পারে না اِلَّا ব্যতীত كُلُّ প্রত্যেক مُعْتَدٍ সীমালঙ্ঘনকারী اَثِيْمٍ মহাপাপী। (১৩) اِذَا যখন تُتْلٰى তেলাওয়াত করা হয় عَلَيْهِ তার নিকট اٰيَاتُنَا আমার আয়াতসমূহ قَالَ তখন সে বলে اَسَاطِيْرُ এটা তো কাহিনী اَلْاَوَّلِيْنَ পূর্বযুগের! (১৪) كَلَّا কখনো নয়; بَلْ বরং رَانَ মরিচা জমে গেছে عَلٰى قُلُوْبِهِمْ তাদের মনের উপর مَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ যা তারা উপার্জন করেছেন। (১৫) كَلَّا কখনো নয়, اِنَّهُمْ অবশ্যই তারা عَنْ رَّبِّهِمْ তাদের প্রতিপালক থেকে يَوْمَئِذٍ সেদিন لَمَحْجُوْبُوْنَ বাধাগ্রস্ত হবে। (১৬) ثُمَّ অতঃপর اِنَّهُمْ নিশ্চয় তারা لَصَالُو প্রবেশ করবে اَلْجَحِيْمِ জাহান্নামে; (১৭) ثُمَّ অতঃপর يُقَالُ বলা হবে, هٰذَا এটাই সেটা اَلَّذِيْ كُنْتُمْ بِه  যাকে তোমরা تُكَذِّبُوْنَ মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে।

সরল অনুবাদ :

(৭) কখনই না, নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে থাকে;৪ (৮) তুমি কি জান- সিজ্জীন কী? (৯) ওটা হচ্ছে লিখিত কিতাব।৫ (১০) সেদিন মন্দ পরিণাম হবে মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের। (১১) যারা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল, (১২) আর সীমালঙ্ঘনকারী মহাপাপী ব্যতীত, কেউই ওটাকে মিথ্যা বলতে পারে না। (১৩) যখন তার নিকট আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে বলে, এটা তো পুরনো দিনের কাহিনী! (১৪) কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের উপর মরিচারূপে জমে গেছে।৬ (১৫) কখনও নয়, অবশ্যই সেদিন তারা তাদের প্রতিপালকের দর্শন লাভ হতে বাঁধাগ্রস্ত হবে।৭ (১৬) নিশ্চয় তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে; (১৭) অতঃপর বলা হবে, এটাই তা যাকে তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে।

টীকা :

[৪] سِجْنٌ এর অর্থ সংকীর্ণ জায়গায় বন্দী করা। আর سِجِّيْنٍ এর অর্থ চিরস্থায়ী কয়েদ। এটি একটি বিশেষ স্থানের নাম। যেখানে কাফিরদের রূহ অবস্থান করে। অথবা এখানেই তাদের আমলনামা থাকে।

[৫] مَرْقُوْمٌ শব্দের কয়েকটি অর্থ আছে, লিখিত, চিহ্নিত এবং মোহরাঙ্কিত। অর্থাৎ কিতাবটি লিখা শেষ হওয়ার পর তাতে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। ফলে তাতে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে না। আর কিতাব বলতে, আমলনামা বুঝানো হয়েছে। কাফির ও পাপাচারীদের আমলনামা মোহর লাগিয়ে সংরক্ষিত করা হবে। মহান আল্লাহ কাফিরদের রূহ হরণ হওয়ার পর বলবেন, اُكْتُبُوْا كِتَابَهٗ فِيْ سِجِّيْنَ فِيْ الْاَرْضِ السُّفْلٰى অর্থাৎ তাঁর কিতাবকে সর্বনিম্ন জমিনে সিজ্জীনে লিখে রাখ।

(মুসনাদে আহমাদ ৪/২৮৭)

[৬] رَانَ শব্দটি رَيْنٌ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ প্রাধান্য বিস্তার করা, ঢেকে রাখা। অর্থাৎ শাস্তি ও পুরস্কারকে গল্প বা উপকথা গণ্য করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু যে কারণে তারা একে গল্প বলছে তা হচ্ছে এই যে, এরা যেসব গোনাহে লিপ্ত রয়েছে তাদের অন্তরে মরিচা ধরেছে। মরিচা যেমন লোহাকে খেয়ে মাটিতে পরিণত করে দেয়, তেমনি তাদের পাপের মরিচা তাদের অন্তরের যোগ্যতা নিঃশেষ করে দিয়েছে। ফলে তারা ভাল ও মন্দের পার্থক্য বুঝে না। ফলে পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত কথাও এদের কাছে গল্প বলে মনে হচ্ছে। এই জং ও মরিচার ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, বান্দা যখন কোন গোনাহ করে, তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। সে তওবা করলে দাগটি উঠে যায়। কিন্তু যদি সে গোনাহ করে যেতেই থাকে তাহলে সমগ্র অন্তরের উপর তা ছেয়ে যায়।

(তিরমিযী, হা/৩৩৩৪; ইবনে মাজাহ, হা/৪২৪৪)

[৭] অর্থাৎ কিয়ামতের দিন এই কাফিররা তাদের রবের দীদার বা দর্শন ও যিয়ারত থেকে বঞ্চিত থাকবে এবং পর্দার আড়ালে অবস্থান করবে। এই আয়াত থেকে জানা যায় যে, সেদিন মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলার দীদার ও যিয়ারত লাভে ধন্য হবে।

আয়াত : ১৮-২৮

كَلَّاۤ اِنَّ كِتَابَ الْاَبْرَارِ لَفِيْ عِلِّيِّيْنَ (১৮) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا عِلِّيُّوْنَ (১৯) كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ (২০) يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُوْنَ (২১) اِنَّ الْاَبْرَارَ لَفِيْ نَعِيْمٍ (২২) عَلَى الْاَرَآئِكِ يَنْظُرُوْنَ (২৩) تَعْرِفُ فِيْ وُجُوْهِهِمْ نَضْرَةَ النَّعِيْمِ (২৪) يُسْقَوْنَ مِنْ رَّحِيْقٍ مَّخْتُوْمٍ (২৫) خِتَامُهٗ مِسْكٌ وَّفِيْ ذٰلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ (২৬) وَمِزَاجُهٗ مِنْ تَسْنِيْمٍ (২৭) عَيْنًا يَّشْرَبُ بِهَا الْمُقَرَّبُوْنَ (২৮)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৮) كَلَّا কখনো না اِنَّ অবশ্যই كِتَابَ الْاَبْرَارِ পুণ্যবানদের আমলনামা لَفِيْ عِلِّيِّيْنَ ইল্লিয়্যীনে থাকবে, (১৯) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জান مَا عِلِّيُّوْنَ ইল্লিয়্যীন কী? (২০) كِتَابٌ مَّرْقُوْمٌ লিখিত কিতাব। (২১) يَشْهَدُهٗ ওটা প্রত্যক্ষ করবে اَلْمُقَرَّبُوْنَ সান্নিধ্যপ্রাপ্তরা। (২২) اِنَّ নিশ্চয় اَلْاَبْرَارَ পুণ্যবানগণ لَفِيْ نَعِيْمٍ অতি স্বাচ্ছন্দ্যে (জান্নাতে) থাকবে (২৩) عَلَى الْاَرَآئِكِ সুসজ্জিত আসনে বসে يَنْظُرُوْنَ তারা দেখতে থাকবে। (২৪) تَعْرِفُ তুমি চিনতে পারবে فِيْ وُجُوْهِهِمْ তাদের মুখমন্ডলে نَضْرَةَ দীপ্তি اَلنَّعِيْمِ স্বাচ্ছন্দ্যের, (২৫) يُسْقَوْنَ তাদেরকে পান করানো হবে مِنْ رَّحِيْقٍ বিশুদ্ধতম শরাব হতে مَخْتُوْمٍ মোহর করা, (২৬) خِتَامُهٗ এর মোহর হচ্ছে مِسْكٌ কস্তুরীর। وَفِيْ ذٰلِكَ সুতরাং এ বিষয়ে فَلْيَتَنَافَسِ প্রতিযোগিতা করুক اَلْمُتَنَافِسُوْنَ প্রতিযোগীরা। (২৭) وَمِزَاجُهٗ এর মিশ্রণ হবে مِنْ تَسْنِيْمٍ তাসনীমের, (২৮) عَيْنًا এটা একটা ঝর্ণা, يَشْرَبُ بِهَا যা হতে পান করবে اَلْمُقَرَّبُوْنَ নৈকট্যপ্রাপ্তগণ।

সরল অনুবাদ :

(১৮) অবশ্যই পুণ্যবানদের আমলনামা ইল্লিয়্যীনে থাকবে,৮ (১৯) ইল্লিয়্যীন কী তা তুমি জান? (২০) (তা হচ্ছে) লিখিত কিতাব।৯ (২১) (আল্লাহর) সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ফেরেশ্তারা ওটা প্রত্যক্ষ করবে।১০ (২২) পুণ্যবানগণ তো থাকবে অতি স্বাচ্ছন্দ্যে (জান্নাতে) (২৩) তারা সুসজ্জিত আসনে বসে দেখতে থাকবে। (২৪) তুমি তাদের মুখমন্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের দীপ্তি অনুভব করবে, (২৫) তাদেরকে মোহর করা বিশুদ্ধতম শরাব হতে পান করানো হবে, (২৬) এর মোহর হচ্ছে কস্তুরীর।১১ সুতরাং প্রতিযোগীরা এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করুক।১২ (২৭) এর মিশ্রণ হবে তাসনীমের,১৩ (২৮) এটা একটি ঝর্ণা, যা হতে নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পান করবে।

টীকা :

[৮] عِلِّيِّيْنٌ একটি জায়গার নাম। বারা ইবনে আযিব (রাঃ) এর হাদীসে এসেছে, ফেরেশতাগণ রূহ নিয়ে উঠতেই থাকবেন। শেষ পর্যন্ত সপ্তম আসমানে উঠবেন, তখন মহান আল্লাহ বলবেন, আমার বান্দার কিতাব ইল্লিয়্যীনে লিখে নাও’’- (মুসনাদে আহমাদ ৪/২৮৭)। এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ইল্লিয়্যীন সপ্তম আকাশে আরশের কাছে একটি স্থানের নাম। এতে মুমিনদের রূহ ও আমলনামা রাখা হয়।

[৯] হাদীসে এসেছে, মহান আল্লাহ মুমিনদের রূহ কবজ করার পর বলবেন, اُكْتُبُوْا كِتَابَ عَبْدِيْ فِيْ عِلِّيِّيْنَ অর্থাৎ অতঃপর আমার বানদার আমলনামা ইল্লিয়্যীনে লিখে রাখ। (মুসনাদে আহমাদ ৪/২৮৭)

[১০] يَشْهَدُ শব্দটি شُهُوْدٌ থেকে উদ্ভূত। شُهُوْدٌ এর এক অর্থ প্রত্যক্ষ করা, তত্ত্বাবধান করা। তখন আয়াতের উদ্দেশ্য হবে এই যে, সৎকর্মশীলদের আমলনামা আসমানের নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ দেখবে অর্থাৎ তত্ত্বাবধান ও হেফাযত করবে। তাছাড়া شُهُوْدٌ এর আরেক অর্থ উপস্থিত হওয়া। তখন এর অর্থ হবে, প্রতি আসমানের নৈকট্যপ্রাপ্তগণ সেখানে হাযির হবেন এবং সেটাকে হেফাযত করবেন; কেননা এটা নেক আমলকারীর জন্য জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তা পত্র এবং জান্নাতে যাওয়ার সফলতার গ্যারান্টি।

[১১] যেসব পাত্রে এই শরাব রাখা হবে তার ওপর মাটি বা মোমের পরিবর্তে মিশকের মোহর লাগানো থাকবে। এ অর্থের দিক দিয়ে আয়াতের অর্থ হয়; এটি হবে উন্নত পর্যায়ের পরিচ্ছন্ন শরাব। এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে : এই শরাব যখন পানকারীদের গলা দিয়ে নামবে তখন শেষের দিকে তারা মিশকের খুশবু পাবে। এই অবস্থাটি দুনিয়ার শরাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে শরাবের বোতল খোলার সাথে সাথেই একটি দুর্গন্ধ নাকে লাগে। পান করার সময়ও এর দুর্গন্ধ অনুভব হতে থাকে এবং গলা দিয়ে নামবার সময় মস্তিষ্কের অভ্যন্তরেও পঁচা গন্ধ পৌঁছে যায়। এর ফলে শরাবীর চেহারায় বিস্বাদের একটা ভাব জেগে ওঠে।

[১২] কোন বিশেষ পছন্দনীয় জিনিস অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা করার নাম تَنَافُسٌ । এখানে জান্নাতের নিয়ামতরাজি উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা‘আলা গাফেল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, আজ তোমরা যেসব বস্তুকে প্রিয় ও কাম্য মনে করে সেগুলো অর্জন করার জন্য অগ্রে চলে যাওয়ার চেষ্টায় রত আছ, সেগুলো অসম্পূর্ণ ও ধ্বংসশীল নিয়ামত। এসব নিয়ামত প্রতিযোগিতার যোগ্য নয়। এসব ক্ষণস্থায়ী সুখের সামগ্রী হাতছাড়া হয়ে গেলেও তেমন দুঃখের কারণ নয়। হ্যাঁ- জান্নাতের নিয়ামতরাজির জন্যই প্রতিযোগিতা করা উচিত। এগুলো সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ চিরস্থায়ী।

[১৩] তাসনীম মানে উন্নত ও উঁচু। কোন কোন মুফাসসির বলেন, ঝরনাকে তাসনীম বলার মানে হচ্ছে এই যে, তা উঁচু থেকে প্রবাহিত হয়ে নীচের দিকে আসে।

আয়াত : ২৯-৩৬

اِنَّ الَّذِيْنَ اَجْرَمُوْا كَانُوْا مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا يَضْحَكُوْنَ (২৯) وَاِذَا مَرُّوْا بِهِمْ يَتَغَامَزُوْنَ (৩০) وَاِذَا انْقَلَبُوْاۤ اِلٰۤى اَهْلِهِمُ انْقَلَبُوْا فَكِهِيْنَ (৩১) وَاِذَا رَاَوْهُمْ قَالُوْاۤ اِنَّ هٰۤؤُلَآءِ لَضَآلُّوْنَ (৩২) وَمَاۤ اُرْسِلُوْا عَلَيْهِمْ حَافِظِيْنَ (৩৩) فَالْيَوْمَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنَ الْكُفَّارِ يَضْحَكُوْنَ (৩৪) عَلَى الْاَرَآئِكِ يَنْظُرُوْنَ (৩৫) هَلْ ثُوِّبَ الْكُفَّارُ مَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ (৩৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(২৯) اِنَّ নিশ্চয় اَلَّذِيْنَ যারা اَجْرَمُوْا অপরাধী كَانُوْا তারা এমন ছিল যে مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে يَضْحَكُوْنَ তারা উপহাস করতো। (৩০) وَاِذَا এবং যখন مَرُّوْا তারা অতিক্রম করতো بِهِمْ তাদের পাশ দিয়ে يَتَغَامَزُوْنَ তখন চোখ টিপে কটাক্ষ করতো। (৩১) وَاِذَا এবং যখন اِنْقَلَبُوْا তারা ফিরে আসতো اِلٰۤى اَهْلِهِمُ তাদের আপনজনের নিকট اِنْقَلَبُوْا তখন তারা ফিরতো فَكِهِيْنَ উৎফুল্ল হয়ে, (৩২) وَاِذَا এবং যখন رَاَوْهُمْ তাদেরকে দেখতো قَالُوْا তখন বলতো, اِنَّ নিশ্চয় هٰۤؤُلَآءِ এরা لَضَآلُّوْنَ পথভ্রষ্ট, (৩৩) وَمَاۤ اُرْسِلُوْا তাদেরকে তো পাঠানো হয়নি عَلَيْهِمْ এদের জন্য حَافِظِيْنَ সংরক্ষকরূপে (৩৪) فَالْيَوْمَ তাই আজ, اَلَّذِيْنَ যারা اٰمَنُوْا ঈমান এনেছে (তারা) مِنَ الْكُفَّارِ কাফিরদেরকে يَضْحَكُوْنَ উপহাস করছে, (৩৫) عَلَى الْاَرَآئِكِ সুসজ্জিত আসনে বসে يَنْظُرُوْنَ তারা (তাদেরকে) দেখছে। (৩৬) هَلْ ثُوِّبَ ফল পেলো তো اَلْكُفَّارُ কাফিররা مَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ যা তারা করত তার?

সরল অনুবাদ :

(২৯) নিশ্চয় যারা অপরাধে লিপ্ত তারা মু’মিনদেরকে উপহাস করতো।১৪ (৩০) তারা যখন তাদের নিকট দিয়ে যেতো তখন চোখ টিপে কটাক্ষ করতো। (৩১) (পক্ষান্তরে) যখন তারা আপনজনের নিকট ফিরে আসতো তখন তারা উৎফুল্ল হয়ে ফিরতো, (৩২) এবং যখন তাদেরকে দেখতো তখন বলতো, নিশ্চয় এরা পথভ্রষ্ট,১৫ (৩৩) তাদেরকে তো এদের সংরক্ষকরূপে পাঠানো হয়নি!১৬ (৩৪) তাই আজ, মুমিনগণ উপহাস করছে কাফিরদেরকে, (৩৫) সুসজ্জিত আসনে বসে তাদেরকে দেখছে। (৩৬) কাফিররা তাদের কৃতকর্মের ফল পেলো তো?

টীকা :

[১৪] অর্থাৎ এ কথা ভাবতে ভাবতে ঘরের দিকে ফিরতো; আজ তো বড়ই মজা। অমুক মুসলিমকে বিদ্রূপ করে বড়ই মজা পাওয়া গেছে এবং সাধারণ মানুষের সামনে তাকে চরমভাবে অপদস্থ করা গেছে। মোটকথা তারা মুমিনদের নিয়ে অপমানজনক কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, ইশারা-ইঙ্গিত করত।

[১৫] এরা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। মুহাম্মাদ ﷺ এদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের চক্করে ফেলে দিয়েছেন। ফলে এরা নিজেরা নিজেদেরকে দুনিয়ার লোভ, স্বার্থ ও ভোগ-বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে এবং সব রকমের আশঙ্কা ও বিপদ আপদের মুখোমুখি হয়েছে। এভাবে যুগে যুগে মুমিনদেরকে অপমানজনক কথা সহ্য করতে হয়েছে। বর্তমানেও কেউ দ্বীনদার হলে তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে শোনা যায়।

[১৬] এই ছোট বাক্যটিতে বিদ্রূপকারীদের জন্য বড়ই শিক্ষাপ্রদ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে অর্থাৎ ধরে নেয়া যাক মুসলিমরা যা কিছুর প্রতি ঈমান এনেছে সবকিছুই ভুল। কিন্তু তাতে তারা তোমাদের তো কোন ক্ষতি করছে না। যে জিনিসকে তারা সত্য মনে করেছে সেই অনুযায়ী তারা নিজেরাই আমল করছে। তোমরা তাদের সমালোচনা করেছ কেন? আল্লাহ কি তোমাদেরকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন? মুমিনদের কর্মকান্ড হেফাযত করার দায়িত্ব তো তোমাদেরকে দেয়া হয়নি। তাহলে সেটা করতে যাবে কেন? এটাকেই তোমাদের উদ্দেশ্য বানিয়েছ কেন?

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

মাল কেনা-বেচার সময় ওজন বা মাপে কম বেশি করা হারাম। যারা এমন গর্হিত অন্যায় করবে, তাদের পরিণাম অতি ভয়াবহ হবে।

কিয়ামতের বিচার অবশ্যই হবে এবং আল্লাহ প্রত্যেককে স্বীয় আমলের বদলা দেবেন। ভাল করলে ভাল ফলাফল পাবে। আর মন্দ করলে মন্দের প্রতিফল যথাযথভাবে পাবে।

মুমিনদের আত্মা সর্বোচ্চ মঞ্জিলে এবং কাফিরদের আত্মা সবচেয়ে নিম্ন মঞ্জিলে রাখা হবে।

কাফিররা আল্লাহর দীদার/দর্শন হতে বঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে মুমিনরা সেদিন মহান আল্লাহর দর্শন পেয়ে ধন্য হবে।

নেকীর কাজে প্রতিযোগিতা করা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ সে মর্মে তাঁর বান্দাদেরকে উৎসাহিত করেছেন।

শেষ পরিণতি শুভ হওয়া একান্তই কাম্য, যার শেষ ভাল হবে এবং ঈমানের উপর মৃত্যু হবে সে-ই হবে সফলকাম।

দুনিয়ায় কাফিররা ঈমানদারদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। কিন্তু মহান আল্লাহ এর বদলা নেয়ার সুযোগ করে দিবেন। মুমিনরা জান্নাতে এবং কাফিররা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তখন মুমিনরা কাফিরদের করুণ পরিণতি দেখে হাসবে এবং দুনিয়ার হাসি-ঠাট্টার জাবাব দেবে।

৮৪- সূরা ইনশিকাক
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اِنْشَقَّتْ (ইনশাক্কাত) শব্দটি থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এর মূলে রয়েছে اِنْشِقَاقٌ (ইনশিকাক) শব্দ। اِنْشِقَاقٌ অর্থ হচ্ছে, ফেটে যাওয়া।

নাযিলের সময়কাল :

এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

সূরার বিষয়বস্তু :

এ সূরাটির বিষয়বস্তু হচ্ছে কিয়ামত ও আখেরাত। এর প্রথম পাঁচটি আয়াতে কিয়ামতের অবস্থা ও কিয়ামত যে সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে তার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।

এরপর ৬ থেকে ১৯ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষ সচেতন বা অচেতন যে কোনভাবেই হোক না কেন সেই মনযিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নিজেকে তার রবের সামনে পেশ করতে হবে। তখন সমস্ত মানুষ দুভাগে ভাগ হয়ে যাবে। (এক) যাদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে। তাদেরকে কোন প্রকার কঠিন হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই সহজে মাফ করে দেয়া হবে। (দুই) যাদের আমলনামা পিঠের দিকে দেয়া হবে। তারা চাইবে কোনভাবে যদি তাদের মৃত্যু হতো। কিন্তু মৃত্যুর বদলে তাদেরকে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে।

সবশেষে কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির খবর শুনানো হয়েছে। এর সঙ্গে যারা ঈমান এনে নেক আমল করে তাদেরকে অগণিত পুরস্কার ও উত্তম প্রতিদানের সুখবর শুনানো হয়েছে।

আয়াত : ১-১৫



اِذَا السَّمَآءُ انْشَقَّتْ (১) وَاَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ (২) وَاِذَا الْاَرْضُ مُدَّتْ (৩) وَاَلْقَتْ مَا فِيْهَا وَتَخَلَّتْ (৪) وَاَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ (৫) يَاۤ اَيُّهَا الْاِنْسَانُ اِنَّكَ كَادِحٌ اِلٰى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيْهِ (৬) فَاَمَّا مَنْ اُوْتِيَ كِتَابَهٗ بِيَمِيْنِه (৭) فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَّسِيْرًا (৮) وَيَنْقَلِبُ اِلٰۤى اَهْلِه مَسْرُوْرًا (৯) وَاَمَّا مَنْ اُوْتِيَ كِتَابَهٗ وَرَآءَ ظَهْرِه (১০) فَسَوْفَ يَدْعُوْ ثُبُوْرًا (১১) وَيَصْلٰى سَعِيْرًا (১২) اِنَّهٗ كَانَ فِيْۤ اَهْلِه مَسْرُوْرًا (১৩) اِنَّهٗ ظَنَّ اَنْ لَّنْ يَّحُوْرَ (১৪) بَلٰۤى اِنَّ رَبَّهٗ كَانَ بِه بَصِيْرًا (১৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِذَا যখন اَلسَّمَآءُ আকাশ اِنْشَقَّتْ ফেটে যাবে, (২) وَاَذِنَتْ এবং আদেশ পালন করবে لِرَبِّهَا স্বীয় প্রতিপালকের وَحُقَّتْ আর সে এরই উপযুক্ত। (৩) وَاِذَا এবং যখন اَلْاَرْضُ জমিন مُدَّتْ সম্প্রসারিত করা হবে। (৪) وَاَلْقَتْ এবং সে নিক্ষেপ করবে مَا যা আছে فِيْهَا তার অভ্যন্তরে وَتَخَلَّتْ এবং খালি হয়ে যাবে। (৫) وَاَذِنَتْ এবং আদেশ পালন করবে لِرَبِّهَا তার প্রতিপালকের وَحُقَّتْ এবং এটাই তার করণীয়। (৬) يَاۤ اَيُّهَا الْاِنْسَانُ হে মানবজাতি! اِنَّكَ নিশ্চয় তুমি كَادِحٌ কঠোর সাধনাকারী اِلٰى رَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের নিকট পৌঁছার জন্য كَدْحًا কঠোর চেষ্টার মতো فَمُلَاقِيْهِ অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে। (৭) فَاَمَّا অতএব مَنْ যাকে اُوْتِيَ দেয়া হবে كِتَابَهٗ তার আমলনামা بِيَمِيْنِه  তার ডান হাতে, (৮) فَسَوْفَ অচিরেই يُحَاسَبُ হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে حِسَابًا يَّسِيْرًا অতি সহজ হিসাব। (৯) وَيَنْقَلِبُ এবং সে ফিরে যাবে اِلٰۤى اَهْلِه  তার স্বজনদের নিকট مَسْرُوْرًا আনন্দিত হয়ে; (১০) وَاَمَّا আর مَنْ যাকে اُوْتِيَ দেয়া হবে كِتَابَهٗ তার আমলনামা وَرَآءَ পিছন দিকে ظَهْرِه  তাদের পিঠের। (১১) فَسَوْفَ অতঃপর অচিরেই يَدْعُوْ সে ডাকবে ثُبُوْرًا ধ্বংসকে। (১২) وَيَصْلٰى এবং সে প্রবেশ করবে سَعِيْرًا জ্বলন্ত অগ্নিতে। (১৩) اِنَّهٗ অবশ্য সে كَانَ ছিল فِيْۤ اَهْلِه  তার স্বজনদের মধ্যে مَسْرُوْرًا সানন্দে, (১৪) اِنَّهٗ নিশ্চয় সে ظَنَّ ভাবতো اَنْ لَّنْ يَّحُوْرَ তাকে কখনই ফিরে যেতে হবে না। (১৫) بَلٰى হ্যাঁ, اِنَّ নিশ্চয় رَبَّهٗ তার প্রতিপালক كَانَ হলেন بِه  তার উপর بَصِيْرًا সর্বদ্রষ্টা।

সরল অনুবাদ :

(১) যখন আকাশ ফেটে যাবে,১ (২) এবং স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে; আর সে এরই উপযুক্ত।২ (৩) আর যখন জমিনকে সম্প্রসারিত করা হবে।৩ (৪) এবং জমিন তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে এবং খালি হয়ে যাবে।৪ (৫) আর সে তার প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে এবং সে এরই উপযুক্ত।৫ (৬) হে মানব! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট পৌঁছার জন্য কঠোর সাধনা করছ, অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবেই।৬ (৭) অতএব যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, (৮) তার হিসাব-নিকাশ অতি সহজভাবে নেয়া হবে।৭ (৯) এবং সে তার স্বজনদের নিকট৮ আনন্দিত হয়ে ফিরে যাবে; (১০) এবং যাকে তার আমলনামা পিঠের পিছন দিকে দেয়া হবে। (১১) অতঃপর অচিরেই সে মৃত্যুকে ডাকবে। (১২) এবং সে জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করবে। (১৩) অবশ্য সে তো স্বজনদের মধ্যে সানন্দে ছিল, (১৪) যেহেতু সে ভাবতো যে, তাকে কখনই (আল্লাহর নিকট) ফিরে যেতে হবে না।৯ (১৫) হ্যাঁ,১০ নিশ্চয় তার প্রতিপালক তার উপর দৃষ্টি রাখেন।

টীকা :

[১] সেটা হবে কিয়ামতের দিন।

[২] এখানে কিয়ামতের দিন আকাশ ও পৃথিবীর উপর আল্লাহ তা‘আলার কর্তৃত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, وَاَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ এর মধ্যে اَذِنَتْ অর্থ শুনেছে তথা আদেশ পালন করেছে। সে হিসেবে وَاَذِنَتْ لِرَبِّهَا এর শাব্দিক অর্থ হয়, সে নিজের রবের হুকুম শুনবে। এর মানে শুধুমাত্র হুকুম শুনা নয়; বরং এর মানে সে হুকুম শুনে একজন অনুগতের ন্যায় নির্দেশ পালন করেছে এবং একটুও অবাধ্যতা প্রকাশ করেনি। আর حُقَّتْ এর অর্থ আদেশ পালন করাই তার কর্তব্য ছিল। কারণ সে একজন মহান বাদশার কর্তৃত্বাধীন ও পরিচালনাধীন। যার নির্দেশ অমান্য করা যায় না, আর তার হুকুমের বিপরীত করা যায় না।

[৩] مُدَّتْ এর অর্থ টেনে লম্বা করা, ছড়িয়ে দেয়া। পৃথিবীকে ছড়িয়ে দেবার মানে হচ্ছে, সাগর নদী ও সমস্ত জলাশয় ভরে দেয়া হবে। পাহাড়গুলো চূর্ণবিচূর্ণ করে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হবে। পৃথিবীর সমস্ত উঁচু-নীচু জায়গা সমান করে সমগ্র পৃথিবীটাকে একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করা হবে। (সূরা ত্ব-হা : ১০৬- ১০৭)

[৪] অর্থাৎ পৃথিবী তার গর্ভস্থিত সবকিছু বের করে একেবারে শূণ্য হয়ে যাবে। পৃথিবীর গর্ভে গুপ্ত ধনভান্ডার, খনি এবং সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মৃত মানুষের দেহকণা ইত্যাদি রয়েছে। জমিন এসব বস্তু আপন গর্ভ থেকে বাইরে নিক্ষেপ করবে। অনুরূপভাবে যত মৃত মানুষ তার মধ্যে রয়েছে সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দেবে।

[৫] যখন এসব ঘটনাবলি ঘটবে তখন কী হবে, এ কথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। কারণ এর পরবর্তী বক্তব্যগুলো নিজে নিজেই তা প্রকাশ করে দিচ্ছে। এ বক্তব্যগুলোতে বলা হচ্ছে, হে মানুষ! তুমি তোমার রবের দিকে এগিয়ে চলছো। শীঘ্রই তাঁর সামনে হাযির হয়ে যাবে। তখন তোমার আমলনামা তোমার হাতে দেয়া হবে। আর তোমার আমলনামা অনুযায়ী তোমাকে পুরস্কার দেয়া হবে।

[৬] كَدْحٌ এর অর্থ কোন কাজে পূর্ণ চেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করা। মানুষের প্রত্যেক চেষ্টা ও অধ্যবসায় আল্লাহর দিকে চূড়ান্ত হবে। অর্থাৎ মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু কষ্ট-সাধনা প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে সে মনে করতে পারে যে তা কেবল দুনিয়ার জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এবং দুনিয়াবী স্বার্থ লাভ করাই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু আসলে সে সচেতন বা অচেতনভাবে নিজের রবের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং অবশেষে তাকে তাঁর কাছেই পৌঁছতে হবে। প্রত্যেক মানুষ আখেরাতে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং হিসাবের জন্য তাঁর সামনে উপস্থিত হবে।

[৭] এতে মুমিনদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাদের আমলনামা ডান হাতে আসবে এবং তাদের সহজ হিসাব নিয়ে জান্নাতের সুসংবাদ দান করা হবে। তারা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে। তার হিসেব নেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে, সে আযাব থেকে রক্ষা পাবে না। এ কথা শুনে আয়েশা (রাঃ) প্রশ্ন করলেন, কুরআনে কি فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَّسِيْرًا বলা হয়নি? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এই আয়াতে যাকে সহজ হিসাব বলা হয়েছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণ হিসাব নয়; বরং কেবল আল্লাহ রাববুল আলামীনের সামনে পেশ করা। যে ব্যক্তির কাছ থেকে তার কাজকর্মের পুরোপুরি হিসাব নেয়া হবে, সে আযাব থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৩৯; সহীহ মুসলিম, হা/২৮৭৬)

[৮] কোন কোন মুফাসসির বলেন, নিজের লোকজন বলতে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও সাথী-সহযোগীদের কথা বুঝানো হয়েছে। কাতাদাহ বলেন, এখানে পরিবার বলে জান্নাতে তার যে পরিবার থাকবে তাদের বুঝানো হয়েছে।

[৯] অর্থাৎ যার আমলনামা তার পিঠের দিক থেকে বাম হাতে আসবে, সে মরে মাটি হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে, যাতে আযাব থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু সেখানে তা সম্ভবপর হবে না। তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। এর এক কারণ এই বলা হয়েছে যে, সে দুনিয়াতে তার পরিবার-পরিজনের মধ্যে আখেরাতের প্রতি উদাসীন হয়ে আনন্দ-উল্লাসে জীবন যাপন করত। সে তার রবের কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিল না। আর যেহেতু পুনরুত্থান ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী ছিল না, সুতরাং হিসাব-নিকাশও গ্রহণ করা হবে না।

[১০] অর্থাৎ সে যা মনে করেছে তা ঠিক নয়। সে অবশ্যই তার রবের কাছে ফিরে যাবে। অবশ্যই সে পুনরুত্থিত হবে।

আয়াত : ১৬-২৫

فَلَاۤ اُقْسِمُ بِالشَّفَقِ (১৬) وَاللَّيْلِ وَمَا وَسَقَ (১৭) وَالْقَمَرِ اِذَا اتَّسَقَ (১৮) لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍ (১৯) فَمَا لَهُمْ لَا يُؤْمِنُوْنَ (২০) وَاِذَا قُرِئَ عَلَيْهِمُ الْقُرْاٰنُ لَا يَسْجُدُوْنَ (২১) بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُكَذِّبُوْنَ (২২) وَاللهُ اَعْلَمُ بِمَا يُوْعُوْنَ (২৩) فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ (২৪) اِلَّا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ اَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُوْنٍ (২৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৬) فَلَا অতএব না, اُقْسِمُ আমি শপথ করি بِالشَّفَقِ আকাশের লালিমার (১৭) وَاللَّيْلِ এবং শপথ রাত্রির وَمَا وَسَقَ আর তাতে যা কিছুর সমাবেশ ঘটে তার, (১৮) وَالْقَمَرِ এবং শপথ চন্দ্রের, اِذَا যখন اِتَّسَقَ তা পরিপূর্ণ হয়, (১৯) لَتَرْكَبُنَّ নিশ্চয় তোমরা আরোহণ করবে طَبَقًا অন্য স্তরে عَنْ طَبَقٍ এক স্তর হতে। (২০) فَمَا لَهُمْ সুতরাং তাদের কী হলো যে, لَا يُؤْمِنُوْنَ তারা ঈমান আনে না। (২১) وَاِذَا আর যখন قُرِئَ পাঠ করা হয় عَلَيْهِمْ তাদের নিকট اَلْقُرْاٰنُ কুর’আন لَا يَسْجُدُوْنَ তখন তারা সিজদাহ করে না? (২২) بَلْ বরং اَلَّذِيْنَ যারা كَفَرُوْا কুফরি করেছে يُكَذِّبُوْنَ তারাই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। (২৩) وَاللهُ (অথচ) আল্লাহ اَعْلَمُ ভালোভাবে জানেন بِمَا সে সম্পর্কে যা يُوْعُوْنَ তারা জমা করত। (২৪) فَبَشِّرْهُمْ সুতরাং তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির। (২৫) اِلَّا তবে اَلَّذِيْنَ যারা اٰمَنُوْا ঈমান আনে وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ ও সৎকর্ম করে لَهُمْ তাদের জন্য রয়েছে اَجْرٌ পুরস্কার غَيْرُ مَمْنُوْنٍ অফুরন্ত।

সরল অনুবাদ :

(১৬) আমি শপথ করি১১ আকাশের লালিমার (১৭) এবং রজনীর, আর তাতে যা কিছুর সমাবেশ ঘটে তার, (১৮) এবং শপথ চন্দ্রের, যখন তা পরিপূর্ণ হয়, (১৯) নিশ্চয় তোমরা এক স্তর হতে অন্য স্তরে আরোহণ করবে।১২ (২০) সুতরাং তাদের কী হলো যে, তারা ঈমান আনে না। (২১) এবং তাদের নিকট কুরআন পাঠ করা হলে তারা সিজদা করে না?১৩ (২২) বরং কাফিররাই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। (২৩) (অথচ) তারা (আমলনামায়) যা জমা করেছে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে বেশি পরিজ্ঞাত। (২৪) সুতরাং তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান কর। (২৫) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্যে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।

টীকা :

[১১] এখানে আল্লাহ তা‘আলা তিনটি বস্তুর শপথ করে মানুষকে আবার اِنَّكَ كَادِحٌ اِلٰى رَبِّكَ كَدْحًا আয়াতে বর্ণিত বিষয়ের প্রতি মনোযোগী করেছেন। শপথের জবাবে বলা হয়েছে যে, মানুষ এক অবস্থার উপর স্থিতিশীল থাকে না। বরং তার অবস্থা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হতে থাকে। যৌবন থেকে বার্ধক্য, বার্ধক্য থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে বরযখ (মৃত্যু ও কিয়ামতের মাঝখানের জীবন), বরযখ থেকে পুনরুজ্জীবন, পুনরুজ্জীবন থেকে হাশরের ময়দান, তারপর হিসেব-নিকেশ এবং শাস্তি ও পুরস্কারের অসংখ্য মনযিল মানুষকে অতিক্রম করতে হবে। এ বিভিন্ন পর্যায় প্রমাণ করছে যে, একমাত্র আল্লাহই তার মাবুদ, তিনি বান্দাদের কর্মকান্ড নিজস্ব প্রজ্ঞা ও রহমতে নিয়ন্ত্রণ করেন। আর বান্দা মুখাপেক্ষী, অপারগ, মহান প্রবল পরাক্রমশালী দয়ালু আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন।

[১২] اِتَّسَقَ শব্দটি وَسَقَ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ একত্রিত করা, পূর্ণ করা। চন্দ্রের একত্রিত করার অর্থ তার আলোকে একত্রিত করা। এটা চৌদ্দ তারিখের রাত্রিতে হয়, যখন চন্দ্র পূর্ণ হয়ে যায়। এখানে চন্দ্রের বিভিন্ন অবস্থার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। চন্দ্র প্রথমে খুবই সরু ধনুকের মতো দেখা যায়। এরপর প্রত্যহ এর আলো বৃদ্ধি পেতে পেতে পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে যায়। অবিরাম পরিবর্তনের সাক্ষ্যদাতা উপরোক্ত বস্তুগুলোর শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, অবশ্যই তোমরা ধাপে ধাপে আরোহণ করবে।

[১৩] অর্থাৎ যখন তাদের সামনে সুস্পষ্ট হেদায়াত পরিপূর্ণ কুরআন পাঠ করা হয়, তখনও তারা আল্লাহর দিকে নত হয় না। سُجُوْدٌ এর আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, আনুগত্য করা। বলাবাহুল্য, এখানে পারিভাষিক সাজদার পাশাপাশি আল্লাহর সামনে আনুগত্য সহকারে নত ও বিনীত হওয়াও উদ্দেশ্য। আবু হুরায়রা (রাঃ) এ সূরা পড়ে সাজদাহ করলেন, তারপর লোকদের দিকে ফিরে জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং এ সূরা পড়ার পরে সাজদাহ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হা/৫৭৮)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

মানুষ অবশ্যই তার রবের সাথে সাক্ষাত করবে।

ঈমানদারদের হিসাব সহজ হবে। আর তা হবে কেবল প্রদর্শনী মাত্র।

মহান আল্লাহ সকল প্রকার দলীল পেশ করে ঈমান আনতে আদেশ করেছেন। কাজেই মানুষের নাফরমানী করার কোন যুক্তি নেই।

সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা করতে হবে।

১০
৮৫- সূরা বুরূজ
সূরার নামকরণ:

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْبُرُوْجُ শব্দ থেকে এ সূরার নাম আল-বুরূজ রাখা হয়েছে। بُرُوْجٌ এর অর্থ বড় গ্রহ-নক্ষত্র।

নাযিলের সময়কাল :

এর বিষয়বস্তু থেকেই এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এ সূরাটি মক্কায় এমন এক সময় নাযিল হয়, যখন মুশরিকদের জুলুম নিপীড়ন তুঙ্গে উঠেছিল এবং তারা কঠিনতম শাস্তি দিয়ে মুসলমানদের ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছিল।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে, ঈমানদারদের উপর কাফিররা যে জুলুম করছিল সে সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করা এবং ঈমানদারদেরকে এই মর্মে সান্ত্বনা দেয়া যে, যদি তারা এসব জুলুম-নিপীড়নের মোকাবিলায় অবিচল থাকে তাহলে তারা এর জন্য সর্বোত্তম পুরস্কার পাবে এবং আল্লাহ নিজেই জালেমদের থেকে বদলা নিবেন।

এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম আসহাবুল উখদুদের (গর্ত ওয়ালাদের) কাহিনী শুনানো হয়েছে। তারা ঈমানদারদেরকে আগুনে ভরা গর্তে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল। এ কাহিনীর মাধ্যমে মুমিন ও কাফিরদেরকে কয়েকটি কথা বুঝানো হয়েছে। (এক) গর্তওয়ালারা যেমন আল্লাহর অভিশাপ ও তাঁর শাস্তির উপযুক্ত হয়েছে তেমনি মক্কার মুশরিক সরদাররাও তার অধিকারী হবে। (দুই) ঈমানদাররা যেমন তখন ঈমান ত্যাগ করার পরিবর্তে আগুনে ভরা গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে জীবন দেয়াকে বেছে নিয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে এখনও ঈমানদারদের ঈমানের পথ থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত না হওয়া উচিত।

তারপর কাফিরদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ অত্যন্ত শক্ত ও কঠোরভাবে পাকড়াও করে থাকেন। আল্লাহর অসীম শক্তি তোমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে। এই ঘেরাও কেটে বের হওয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আর যে কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তোমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো, তার প্রত্যেকটি শব্দ অপরিবর্তনীয়। এই কুরআনের প্রতিটি শব্দ লওহে মাহফুযের গায়ে এমনভাবে খোদিত আছে যে, হাজার চেষ্টা করেও কেউ তা বদলাতে পারবে না।

আয়াত : ১-১১



وَالسَّمَآءِ ذَاتِ الْبُرُوْجِ (১) وَالْيَوْمِ الْمَوْعُوْدِ (২) وَشَاهِدٍ وَّمَشْهُوْدٍ (৩) قُتِلَ اَصْحَابُ الْاُخْدُوْدِ (৪) اَلنَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ (৫) اِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ (৬) وَهُمْ عَلٰى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ (৭) وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ اِلَّاۤ اَنْ يُّؤْمِنُوْا بِاللهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ (৮) اَلَّذِيْ لَهٗ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِ وَاللهُ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ (৯) اِنَّ الَّذِيْنَ فَتَنُوا الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوْبُوْا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيْقِ (১০) اِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهَارُ ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيْرُ (১১)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالسَّمَآءِ শপথ আকাশের ذَاتِ الْبُرُوْجِ বুরূজ (তারকা-রাশিচক্র) বিশিষ্ট, (২) وَالْيَوْمِ শপথ দিবসের اَلْمَوْعُوْدِ প্রতিশ্রুত, (৩) وَشَاهِدٍ শপথ দর্শকের وَمَشْهُوْدٍ এবং দৃশ্যের, (৪) قُتِلَ ধ্বংস করা হয়েছে اَصْحَابُ الْاُخْدُوْدِ গর্ত ওয়ালারা, (৫) اَلنَّارِ অগ্নিওয়ালা ذَاتِ الْوَقُوْدِ ইন্ধনবিশিষ্ট, (৬) اِذْ যখন هُمْ তারা عَلَيْهَا তার উপর قُعُوْدٌ উপবিষ্ট ছিল; (৭) وَهُمْ এবং তারা ছিল عَلٰى তার উপর مَا يَفْعَلُوْنَ তারা যা করেছিল بِالْمُؤْمِنِيْنَ মুমিনদের সাথে شُهُوْدٌ (তার) প্রত্যক্ষ সাক্ষী। (৮) وَمَا نَقَمُوْا আর তারা প্রতিশোধ নেয়নি مِنْهُمْ তাদের থেকে اِلَّا তবে এ কারণে اَنْ যে, يُؤْمِنُوْا তারা ঈমান এনেছিল بِاللهِ আল্লাহর প্রতি اَلْعَزِيْزِ পরাক্রান্ত اَلْحَمِيْدِ প্রশংসাভাজন। (৯) اَلَّذِيْ لَهٗ যার হাতে مُلْكُ কর্তৃত্ব اَلسَّمَاوَاتِ আকাশমন্ডলীর وَالْاَرْضِ ও পৃথিবীর, وَاللهُ আর আল্লাহ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ সর্ব বিষয়ের উপর شَهِيْدٌ সর্বদ্রষ্টা। (১০) اِنَّ الَّذِيْنَ নিশ্চয় যারা فَتَنُوْا যুলুম-নির্যাতন করেছে اَلْمُؤْمِنِيْنَ ঈমানদারদের উপর وَالْمُؤْمِنَاتِ ঈমানদার নারীদের উপর ثُمَّ অতঃপর لَمْ يَتُوْبُوْا সে পরে তাওবাও করেনি, فَلَهُمْ তাদের জন্য রয়েছে عَذَابُ আযাব جَهَنَّمَ জাহান্নামের وَلَهُمْ আর তাদের রয়েছে عَذَابُ আযাব اَلْحَرِيْقِ দহন যন্ত্রণার। (১১) اِنَّ الَّذِيْنَ নিশ্চয় যারা اٰمَنُوْا ঈমান আনে وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ও সৎকর্ম করেছে لَهُمْ তাদের জন্যেই রয়েছে جَنَّاتٌ এমন জান্নাত تَجْرِيْ প্রবাহিত হচ্ছে مِنْ تَحْتِهَا যার তলদেশ দিয়ে اَلْاَنْهَارُ নদীসমূহ; ذٰلِكَ এটাই اَلْفَوْزُ সফলতা اَلْكَبِيْرُ মহা।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ বুরূজ (তারকা-রাশিচক্র) বিশিষ্ট১ আকাশের, (২) শপথ প্রতিশ্রুত দিবসের, (৩) শপথ দর্শক ও দৃশ্যের,২ (৪) ধ্বংস করা হয়েছে৩ গর্ত ওয়ালাদেরকে,৪ (৫) যারা ছিল ইন্ধনপূর্ণ অগ্নিওয়ালা, (৬) যখন তারা তার উপর উপবিষ্ট ছিল; (৭) এবং তারা মু’মিনদের সাথে যা করেছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। (৮) তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এই কারণে যে, তারা পরাক্রান্ত ও প্রশংসাভাজন আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। (৯) যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিক; আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে দেখেন। (১০) যারা ঈমানদার নর-নারীর উপর যুলুম-নির্যাতন করেছে৫ এবং পরে তাওবাও করেনি,৬ তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব ও দহন যন্ত্রণা।৭ (১১) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্যই রয়েছে এমন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত রয়েছে; এটাই বড় সফলতা।

টীকা :

[১] بُرُوْجٌ শব্দটি بَرْجٌ এর বহুবচন। অর্থ বড় প্রাসাদ ও দুর্গ। অন্য আয়াতে আছে وَلَوْ كُنْتُمْ فِىْ بُرُوْجٍ مُّشَيَّدَةٍ এখানে এই অর্থই বুঝানো হয়েছে। অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে আলোচ্য আয়াতে بُرُوْجٌ এর অর্থ বড় গ্রহ-নক্ষত্র। আয়াতের অর্থ হবে, সেই আসমানের শপথ! যাতে রয়েছে চাঁদ ও সূর্যের অবতরণস্থানসমূহ। অনুরূপভাবে তাতে রয়েছে সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রের অবতরণস্থল, যেগুলো নিয়ম মেনে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চলছে। এ সুন্দর চলন ও সুন্দর নিয়মই আল্লাহর অপার শক্তি, রহমত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রমাণ বহন করছে।

[২] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, وَالْيَوْمِ الْمَوْعُوْدِ বা প্রতিশ্রুত দিনের অর্থ কিয়ামতের দিন। আর مَشْهُوْدٌ এর অর্থ আরাফার দিন এবং شَاهِدٌ এর অর্থ শুক্রবার দিন। জুমুআর দিনের চেয়ে উত্তম কোন দিনে কোন সূর্য উদিত হয়নি এবং ডুবেওনি। সেদিন এমন একটি সময় আছে, কোন মুমিন বান্দা যখনই কোন কল্যাণের দু‘আ করে তখনই তার দু‘আ কবুল করা হয়। অথবা যদি কোন অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়, তখনই তাকে আল্লাহ তা থেকে আশ্রয় দেন। (তিরমিযী, হা/৩৩৩৯)

[৩] এখানে আল্লাহ তা‘আলা চারটি বস্তুর শপথ করার পর মূল কথা বর্ণনা করেছেন। (এক) বুরূজবিশিষ্ট আকাশের; (দুই) কিয়ামত দিবসের; (তিন) আরাফার দিনের এবং (চার) শুক্রবারের। এসব শপথের সম্পর্ক এই যে, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ শক্তি, কিয়ামতের হিসাব-নিকাশ এবং শাস্তি ও প্রতিদানের দলীল। শুক্রবার ও আরাফার দিন মুসলিমদের জন্য আখেরাতের পুঁজি সংগ্রহের পবিত্র দিন।

[৪] যারা পূর্ব যুগে বড় বড় গর্তের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং তাদের জ্বলে পুরে মরার বীভৎস দৃশ্য নিজেদের চোখে দেখেছিল তাদেরকে এখানে গর্তওয়ালা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাদের উপর আল্লাহর লানত পড়েছিল এবং তারা আল্লাহর আযাবের অধিকারী হয়েছিল।

[৬] কাফিরদের জাহান্নামের আযাব ও দহন যন্ত্রণার খবর দেয়ার সাথে সাথে কুরআন বলছে যে, এই আযাব তাদের উপর পতিত হবে, যারা এই দুষ্কর্মের কারণে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করেনি। এতে তাদেরকে তাওবার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। হাসান বসরী বলেন, বাস্তবিকই আল্লাহর অনুগ্রহের কোন তুলনা নেই। তারা তো আল্লাহর নেক বান্দাদেরকে জীবিত দগ্ধ করে তামাশা দেখছে, আর আল্লাহ তা‘আলা এরপর তাদেরকে তাওবা ও মাগফিরাতের দাওয়াত দিচ্ছেন।

[৭] এখানে অত্যাচারী কাফিরদের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে, যারা মুমিনদেরকে কেবল ঈমানের কারণে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল। শাস্তি প্রসঙ্গে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে- (এক) তাদের জন্য আখেরাতে জাহান্নামের আযাব রয়েছে, (দুই) তাদের জন্য দহনযন্ত্রণা রয়েছে। অর্থাৎ জাহান্নামে গিয়ে তারা চিরকাল দহনযন্ত্রণা ভোগ করবে।

আয়াত : ১২-২২

اِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيْدٌ (১২) اِنَّهٗ هُوَ يُبْدِئُ وَيُعِيْدُ (১৩) وَهُوَ الْغَفُوْرُ الْوَدُوْدُ (১৪) ذُو الْعَرْشِ الْمَجِيْدُ (১৫) فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيْدُ (১৬) هَلْ اَتَاكَ حَدِيْثُ الْجُنُوْدِ (১৭) فِرْعَوْنَ وَثَمُوْدَ (১৮) بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ تَكْذِيْبٍ (১৯) وَاللهُ مِنْ وَّرَآئِهِمْ مُّحِيْطٌ (২০) بَلْ هُوَ قُرْاٰنٌ مَّجِيْدٌ (২১) فِيْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ (২২)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১২) اِنَّ নিশ্চয় بَطْشَ পাকড়াও رَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের لَشَدِيْدٌ বড়ই কঠিন। (১৩) اِنَّهٗ هُوَ নিশ্চয় তিনিই يُبْدِئُ প্রথমবার সৃষ্টি করেন وَيُعِيْدُ এবং পুনরায় সৃষ্টি করবেন। (১৪) وَهُوَ আর তিনিই اَلْغَفُوْرُ ক্ষমাশীল, اَلْوَدُوْدُ প্রেমময়। (১৫) ذُو الْعَرْشِ আরশের অধিপতি, اَلْمَجِيْدُ মহিমাময়। (১৬) فَعَّالٌ তিনি তাই করেন لِمَا يُرِيْدُ যা তিনি চান। (১৭) هَلْ اَتَاكَ তোমার নিকট কি পৌঁছেছে حَدِيْثُ খবর اَلْجُنُوْدِ সৈন্যবাহিনীর? (১৮) فِرْعَوْنَ ফিরাউন وَثَمُوْدَ ও সামূদের? (১৯) بَلْ বরং اَلَّذِيْنَ যারা كَفَرُوْا কুফরী করে فِيْ تَكْذِيْبٍ তারা মিথ্যারোপ করে থাকে, (২০) وَاللهُ আর আল্লাহ مِنْ وَرَآئِهِمْ তাদেরকে সবদিক হতে مُحِيْطٌ পরিবেষ্টনকারী। (২১) بَلْ বরং هُوَ এটা قُرْاٰنٌ কুরআন مَجِيْدٌ অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। (২২) فِيْ لَوْحٍ ফলকে (লিপিবদ্ধ) مَحْفُوْظٍ সংরক্ষিত।

সরল অনুবাদ :

(১২) নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের পাকড়াও বড়ই কঠিন। (১৩) তিনিই প্রথমবার সৃষ্টি করেন এবং পুনরায় ফিরিয়ে আনবেন। (১৪) আর তিনি ক্ষমাশীল ও প্রেমময়।৮ (১৫) আরশের অধিপতি ও মহিমাময়। (১৬) তিনি যা চান তাই করেন।৯ (১৭) তোমার নিকট সৈন্যবাহিনীর খবর পৌঁছেছে কি? (১৮) ফিরাউন ও সামূদের? (১৯) তবুও কাফিররা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কাজে লিপ্ত, (২০) আর আল্লাহ তাদেরকে সর্বদিক হতে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। (২১) বরং এটা অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কুরআন। (২২) সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।

টীকা :

[৮] اَلْوَدُوْدُ শব্দটির অর্থ প্রিয় বা প্রিয়পাত্র। যার ভালোবাসায় কোন কমতি নেই। যারা তাঁকে ভালোবাসেন তিনিও তাদেরকে ভালোবাসেন। তিনি এমন সত্তা যাকে তার ভালোবাসার পাত্ররা এমন ভালোবাসে যে ভালোবাসার কোন উদাহরণ দেয়া সম্ভব হয় না।

[৯] ‘‘তিনি ক্ষমাশীল’’ বলে এই মর্মে আশান্বিত করা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি গোনাহ করা থেকে বিরত হয়ে যদি তাওবা করে তাহলে সে আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে। তিনি গোনাহগারদের প্রতি এতই ক্ষমাশীল যে, তাদেরকে লজ্জা দেন না। আর তিনি তার আনুগত্যকারী বন্ধুদেরকে অতিশয় ভালোবাসেন।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

মুমিনদের জন্য দুনিয়া আরামের নয়; বরং সেটি পরীক্ষার জায়গা। যারা সবরের সাথে যাবতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তারা জান্নাতের অশেষ পুরস্কার পেয়ে ধন্য হবে।

কিন্তু যারা অহঙ্কারী ও কাফির, ঈমান আনার দায়ে মুমিনদের নানাবিধ কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের প্রজ্বলিত আগুনের কঠিন শাস্তি।

ঈমানের উপর অটল থাকা মুমিনদের কর্তব্য।

মহাগ্রন্থ কুরআন আল্লাহ সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

১১
৮৬- সূরা ত্বারিক
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلطَّارِقُ (আত-ত্বারিক) শব্দের আলোকে এ সূরাটির নাম সূরা ত্বারিক রাখা হয়েছে। এর অর্থ উজ্জ্বল নক্ষত্র।

সূরার বিষয়বস্তু :

সর্বপ্রথম আকাশের তারকাগুলোকে এ মর্মে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়েছে যে, এ বিশ্বে কোন একটি জিনিসও নেই, যা কোন এক সত্তার রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। তারপর মানুষের নিজের সত্তার প্রতি আকৃষ্ট করে বলা হয়েছে, দেখো কীভাবে এক বিন্দু শুক্র থেকে অস্তিত্ব দান করে তাকে একটি জীবন্তত গতিশীল মানুষে পরিণত করা হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, যে আল্লাহ এভাবে তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন তিনি নিশ্চিতভাবেই তাকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন।

সবশেষে বলা হয়েছে, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ এবং মাটি থেকে গাছপালা ও ফসল উৎপাদন যেমন কোন খেল-তামাশার ব্যাপার নয়, বরং একটি দায়িত্বপূর্ণ কাজ, ঠিক তেমনি কুরআনে যেসব প্রকৃত সত্য ও নিগূঢ় তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোও কোন হাসি-তামাশার ব্যাপার নয়। বরং সেগুলো একেবারে পাকাপোক্ত ও অপরিবর্তনীয় কথা। কাফিররা এ ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে যে, তাদের চালবাজী ও কৌশল কুরআনের এই দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তারা জানে না যে, আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং তাঁর কৌশলের মোকাবিলায় কাফিরদের যাবতীয় চালবাজী ও কৌশল ব্যর্থ হয়ে যাবে। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সান্ত্বনা এবং কাফিরদেরকে ধমক দিয়ে কথা এভাবে শেষ করা হয়েছে যে, তুমি একটু সবর করো এবং কিছু দিন কাফিরদেরকে ইচ্ছেমতো চলার সুযোগ দাও। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা টের পেয়ে যাবে যে, তাদের চালবাজী ও প্রতারণা কুরআনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।

আয়াত : ১-১৭



وَالسَّمَآءِ وَالطَّارِقِ (১) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ (২) اَلنَّجْمُ الثَّاقِبُ (৩) اِنْ كُلُّ نَفْسٍ لَّمَّا عَلَيْهَا حَافِظٌ (৪) فَلْيَنْظُرِ الْاِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ (৫) خُلِقَ مِنْ مَّآءٍ دَافِقٍ (৬) يَخْرُجُ مِنْ ۢبَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَآئِبِ (৭) اِنَّهٗ عَلٰى رَجْعِه لَقَادِرٌ (৮) يَوْمَ تُبْلَى السَّرَآئِرُ (৯) فَمَا لَهٗ مِنْ قُوَّةٍ وَّلَا نَاصِرٍ (১০) وَالسَّمَآءِ ذَاتِ الرَّجْعِ (১১) وَالْاَرْضِ ذَاتِ الصَّدْعِ (১২) اِنَّهٗ لَقَوْلٌ فَصْلٌ (১৩) وَمَا هُوَ بِالْهَزْلِ (১৪) اِنَّهُمْ يَكِيْدُوْنَ كَيْدًا (১৫) وَاَكِيْدُ كَيْدًا (১৬) فَمَهِّلِ الْكَافِرِيْنَ اَمْهِلْهُمْ رُوَيْدًا (১৭)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالسَّمَآءِ শপথ আকাশের وَالطَّارِقِ এবং রাত্রিতে আগমনকারীর; (২) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জান مَا الطَّارِقُ রাত্রিতে আগমনকারী কী? (৩) اَلنَّجْمُ ওটা নক্ষত্র اَلثَّاقِبُ উজ্জ্বল! (৪) اِنْ নেই كُلُّ এমন কোন نَفْسٍ জীব لَمَّا নেই عَلَيْهَا যার উপর حَافِظٌ কোন সংরক্ষক। (৫) فَلْيَنْظُرْ সুতরাং লক্ষ্য করা উচিত اَلْاِنْسَانُ মানুষের مِمَّ خُلِقَ তাকে কিসের থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (৬) خُلِقَ তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে مِنْ مَّآءٍ পানি হতে دَافِقٍ প্রবল বেগে নির্গত, (৭) يَخْرُجُ যা বের হয় مِنْ ۢبَيْنِ মধ্য হতে اَلصُّلْبِ পিঠ وَالتَّرَآئِبِ ও বুকের হাড়ের। (৮) اِنَّهٗ নিশ্চয় তিনি عَلٰى رَجْعِه  তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে لَقَادِرٌ সক্ষম। (৯) يَوْمَ যেদিন تُبْلٰى যাচাই-বাছাই হবে اَلسَّرَآئِرُ গোপন বিষয় সমূহের, (১০) فَمَا সেদিন থাকবে না لَهٗ তার জন্য مِنْ قُوَّةٍ কোন শক্তি وَلَا نَاصِرٍ এবং সাহায্যকারীও না। (১১) وَالسَّمَآءِ শপথ আকাশের ذَاتِ الرَّجْعِ বৃষ্টিধারণকারী, (১২) وَالْاَرْضِ এবং শপথ জমিনের ذَاتِ الصَّدْعِ ফেটে যাওয়া, (১৩) اِنَّهٗ নিশ্চয় এটা لَقَوْلٌ কথা فَصْلٌ মীমাংসাকারী। (১৪) وَمَا এবং নয় هُوَ এটা بِالْهَزْلِ বেহুদা কথাবার্তা। (১৫) اِنَّهُمْ নিশ্চয় তারা يَكِيْدُوْنَ ষড়যন্ত্র করেছে كَيْدًا ভীষণ ষড়যন্ত্র (১৬) وَاَكِيْدُ আর আমিও একটি কৌশল অবলম্বন করি كَيْدًا ভীষণ কৌশল। (১৭) فَمَهِّلِ অতএব অবকাশ দাও اَلْكَافِرِيْنَ কাফিরদেরকে, اَمْهِلْهُمْ তাদেরকে অবকাশ দাও رُوَيْدًا কিছু কালের জন্যে।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ আকাশের এবং রাত্রিতে আগমনকারীর; (২) তুমি কি জান রাত্রিতে আগমনকারী কী? (৩) ওটা উজ্জ্বল নক্ষত্র!১ (৪) নিশ্চয় প্রত্যেক জীবের উপরই এক সংরক্ষক রয়েছে।২ (৫) সুতরাং মানুষের লক্ষ্য করা উচিত যে, তাকে কিসের দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।৩ (৬) তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রবল বেগে নির্গত পানি হতে,৪ (৭) যা বের হয় পিঠ ও বুকের হাড়ের মধ্য হতে।৫ (৮) নিশ্চয় তিনি তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম।৬ (৯) যেদিন গোপন বিষয়সমূহের যাচাই-বাছাই হবে,৭ (১০) সেদিন তার কোন শক্তি থাকবে না এবং সাহায্যকারীও থাকবে না। (১১) শপথ বেশি বেশি বৃষ্টি বর্ষণকারী আকাশের,৮ (১২) এবং শপথ জমিনের- যা ফেটে যায়,৯ (১৩) নিশ্চয় এটি (কুর’আন) মীমাংসাকারী কথা। (১৪) এবং এটা বেহুদা কথাবার্তা নয়।১০ (১৫) নিশ্চয় তারা (কাফিররা) ভীষণভাবে ষড়যন্ত্র করে।১১ (১৬) আর আমিও একটি কৌশল করি।১২ (১৭) অতএব কাফিরদেরকে অবকাশ দাও; আর তাদেরকে অবকাশ দাও কিছু কালের জন্যে।১৩

টীকা :

[১] প্রথম শপথে আকাশের সাথে وَالطَّارِقُ শব্দ যোগ করা হয়েছে। এর অর্থ রাত্রিতে আগমনকারী। নক্ষত্র দিনের বেলায় লুক্কায়িত থাকে এবং রাতে প্রকাশ পায়, এজন্য নক্ষত্রকে اَلطَّارِقُ বলা হয়েছে। আয়াতে কোন নক্ষত্রকে নির্দিষ্ট করা হয়নি। তাই যে কোন উজ্জল নক্ষত্রকে বুঝানো যায়।

[২] এটা শপথের জবাব। حَافِظٌ শব্দের অর্থ তত্ত্বাবধায়ক। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আকাশ ও নক্ষত্রের শপথ করে বলেছেন, প্রত্যেক মানুষের উপর তত্ত্বাবধায়ক বা আমলনামা লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। সে তার সমস্ত কাজকর্ম ও নড়াচড়া দেখে ও জানে। অন্য আয়াতে আছে, নিশ্চয় তোমাদের উপর নিয়োজিত রয়েছে তত্ত্বাবধায়করা, সম্মানিত লেখকরা। (সূরা ইনফিতার : ১০ -১১)

তাছাড়া حَافِظٌ এর অপর অর্থ বিপদাপদ থেকে হেফাযতকারীও হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মানুষের হেফাযতের জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। তারা দিন-রাত মানুষের হেফাযতে নিয়োজিত থাকে। এক আয়াতে এ কথা পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘মানুষের জন্য পালাক্রমে আগমনকারী পাহারাদার ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। তারা আল্লাহর আদেশে সামনে ও পেছনে থেকে তার হেফাযত করে।’’ (সূরা রাদ : ১১) তবে আল্লাহ তা‘আলা যার জন্য যে বিপদ অবধারিত করে দিয়েছেন, তারা সে বিপদ থেকে হেফাযত করে না।

[৩] এখানে আল্লাহ তা‘আলা যে মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম তার উপর মানুষেরই নিজের সত্তা থেকে প্রমাণাদি উপস্থাপন করছেন। মানুষ তার নিজের সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখুক। তাকে কীভাবে কোথা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে অত্যন্ত দুর্বল বস্তু হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। যিনি প্রথমবার তাকে সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি অবশ্যই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে সক্ষম।

[৪] অর্থাৎ বীর্য থেকে, যা পুরুষ ও নারী থেকে সবেগে বের হয়। এ থেকেই সন্তান জন্মলাভ করে।

[৫] এখানে মূল আয়াতে সুলব ( صُلْبٌ ) ও তারায়েব ( تَرَائِبٌ ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সুলব মেরুদন্ডকে ও তারায়েব বুকের পাঁজরকে বলা হয়। যেহেতু যে উপাদান থেকে পুরুষ ও নারীর জন্ম হয় তা মেরুদন্ড ও বুকের মধ্যস্থিত ধড় থেকে বের হয়, তাই বলা হয়েছে পিঠ ও বুকের মধ্যস্থল থেকে নির্গত পানি থেকে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের হাত-পা কর্তিত অবস্থায়ও এ উপাদান জন্ম নেয়। তাই এ কথা বলা ঠিক নয় যে, সারা শরীর থেকে এ উপাদান বের হয়। আসলে শরীরের প্রধান অঙ্গগুলোই হচ্ছে এর উৎস।

[৬] উদ্দেশ্য এই যে, যিনি প্রথমবার বীর্য থেকে একজন জীবিত শ্রোতা ও দ্রষ্টা মানব সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাকে পুনরায় ফিরিয়ে দিতে অর্থাৎ, মৃত্যুর পর জীবিত করতে আরো ভালরূপে সক্ষম। যদি তিনি প্রথমটির ক্ষমতা রেখে থাকেন এবং তারই বদৌলতে মানুষ দুনিয়ায় জীবন ধারণ করছে, তাহলে তিনি দ্বিতীয়টির ক্ষমতা রাখেন না, এ ধারণা পোষণ করার পেছনে এমন কী শক্তিশালী যুক্তি পেশ করা যেতে পারে?

[৭] গোপন রহস্য বলতে মানুষের যেসব বিশ্বাস ও সংকল্প অন্তরে লুকায়িত ছিল, দুনিয়াতে কেউ জানত না এবং যেসব কাজকর্ম সে গোপনে করেছিল, কিয়ামতের দিন সে সবগুলোও প্রকাশ করে দেয়া হবে। অর্থাৎ তাদের আমলনামা পেশ করা হবে, আর তখন ভাল-মন্দ, উত্তম-অনুত্তম সবই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

[৮] আকাশের জন্য (বৃষ্টি বর্ষণকারী) বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘রাজআ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ফিরে আসা। তবে পরোক্ষভাবে আরবী ভাষায় এ শব্দটি বৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয়। কারণ বৃষ্টি মাত্র একবার বর্ষিত হয়েই খতম হয়ে যায় না; বরং একই মওসূমে বারবার এবং কখনো মওসূম ছাড়াই একাধিকবার ফিরে আসে এবং যখন তখন বর্ষিত হয়।

[৯] জমিন বিদীর্ণ হওয়ার অর্থ উদ্ভিদ উৎপন্ন হওয়া।

[১০] আসমান ও জমিনের শপথ করে যে কথাটি বলা হয়েছে সেটা হচ্ছে, কুরআনের সত্যতা প্রমাণ করা। বলা হয়েছে, এ কুরআন হক ও সত্য বাণী।

[১১] অর্থাৎ কাফিররা কুরআনের দাওয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য নানা ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। কুরআনের পথ থেকে মানুষদেরকে দূরে রাখতে চাচ্ছে।

[১২] অর্থাৎ এদের কোন অপকৌশল কামিয়াব হবে না। অবশেষে এরা যেন ব্যর্থ হয়ে যায় সে জন্য আমি কৌশল করছি। আমি তাদেরকে এমনভাবে ছাড় দিচ্ছি যে তারা বুঝতেই পারছে না।

[১৩] অর্থাৎ এদেরকে ছেড়ে দিন, তাদের ধ্বংসের ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করবেন না। তাদেরকে অল্প কিছু দিন অবকাশ দিন। দেখুন, তাদের শাস্তি, আযাব ও ধ্বংস কিভাবে তাদের উপর আপতিত হয়।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

মানুষের যাবতীয় আমল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রত্যেককে তার আমল অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া হবে।

মানুষের অন্তর তার বিশুদ্ধ আক্বীদার মূল কেন্দ্রবিন্দু। কিয়ামত দিবসে তার হৃদয়ে লালিত সকল গোপন বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটবে এবং সে আলোকেই তার বিচার হবে।

কুরআন মানুষের জীবনবিধান- এর মধ্যেই রয়েছে মানব জাতির যাবতীয় বিষয়ের সমাধান।

দুনিয়ায় কাফির-মুশরিকদের জৌলুশ দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই; বরং আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্রের যথোচিত জবাব দেবেন।

১২
৮৭- সূরা আ‘লা
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْاَعْلٰى (আল আ‘লা) শব্দের আলোকে এ সূরাটির নাম রাখা হয়েছে। এর অর্থ সর্বোচ্চ ও মহান।

নাযিলের সময় :

এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এর আলোচ্য বিষয় থেকে জানা যায় যে, এটি একেবারে প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম।

সূরার বিষয়বস্তু :

এ ছোট্ট সূরাটিতে তিনটি বিষয়বস্তুর আলোচনা করা হয়েছে। (এক) তাওহীদ। (দুই) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উপদেশ দান। (তিন) আখেরাত।

তাওহীদের শিক্ষাকে প্রথম আয়াতের একটি বাক্যের মধ্যেই সীমিত করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহর নামে তাসবীহ পাঠ করো। অর্থাৎ তাঁকে এমন কোন নামে স্মরণ করা যাবে না, যার মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি, অভাব, দোষ, দুর্বলতা বা সৃষ্টির সাথে কোন দিক দিয়ে কোন প্রকার মিল রয়ে গেছে।

তারপর দুটি আয়াতে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উপদেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যে কুরআন তোমার প্রতি নাযিল হচ্ছে এর প্রতিটি শব্দ কীভাবে তোমার মুখস্থ থাকবে, এ ব্যাপারে তুমি কোন চিন্তা করো না। একে তোমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত করে দেয়া আমার কাজ।

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়নি। বরং তোমার কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র সত্যের প্রচার করা। আর এই প্রচারের সরল পদ্ধতি হচ্ছে, যে ব্যক্তি উপদেশ শুনতে ও তা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে তাকে উপদেশ দাও। আর যে ব্যক্তি তাতে প্রস্তুত নয় তার পেছনে লেগে থাকার প্রয়োজন নেই।

সবশেষে বলা হয়েছে, সাফল্য কেবল তাদের জন্য যারা আকীদা-বিশ্বাস, কর্ম ও চরিত্রে পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা অবলম্বন করবে এবং নিজেদের রবের নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করবে। কিন্তু লোকেরা শুধুমাত্র এ দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও আনন্দের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে। অথচ তাদের আখেরাতের চিন্তা করা উচিত। কারণ এ দুনিয়া তো ক্ষণস্থায়ী। অন্যদিকে আখেরাত চিরস্থায়ী। এ সত্যটি কেবল কুরআনেই বর্ণনা করা হয়নি, ইবরাহীম (আঃ) ও মূসা (আঃ) এর সহীফাসমূহেও মানুষকে এই একই সত্যের সন্ধান দেয়া হয়েছিল।

এ সূরার গুরুত্ব :

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ জুমু‘আ ও দুই ঈদের সালাতে সূরা আ‘লা, সূরা গাশিয়াহ পড়তেন। এমনকি কখনো যদি জুমু‘আ ও ঈদের সালাত একই দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে যেত তখন তিনি উভয় সালাতে এ দু’সূরাই পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, হা/৮৭৮; আবু দাউদ, হা/১১২২)

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখনই এর প্রথম আয়াত পড়তেন তখন বলতেন, ‘‘সুবহানা রাবিবয়াল আ‘লা’’। (আবু দাউদ, হা/৮৮৩)

আয়াত: ১-৯



سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلٰى (১) اَلَّذِيْ خَلَقَ فَسَوّٰى (২) وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدٰى (৩) وَالَّذِيْۤ اَخْرَجَ الْمَرْعٰى (৪) فَجَعَلَهٗ غُثَآءً اَحْوٰى (৫) سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسٰى (৬) اِلَّا مَا شَآءَ اللهُ اِنَّهٗ يَعْلَمُ الْجَهْرَ وَمَا يَخْفٰى (৭) وَنُيَسِّرُكَ لِلْيُسْرٰى (৮) فَذَكِّرْ اِنْ نَّفَعَتِ الذِّكْرٰى (৯)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) سَبِّحْ তুমি পবিত্রতা ঘোষণা করো اِسْمَ رَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের নামের اَلْاَعْلٰى সর্বোচ্চ, (২) اَلَّذِيْ যিনি خَلَقَ সৃষ্টি করেছেন فَسَوّٰى অতঃপর সুঠাম করেছেন, (৩) وَالَّذِيْ এবং যিনি قَدَّرَ নিরূপণ করেছেন, فَهَدٰى তারপর হেদায়েত দিয়েছেন, (৪) وَالَّذِيْ এবং যিনি اَخْرَجَ উৎপন্ন করেছেন اَلْمَرْعٰى উদ্ভিদ, (৫) فَجَعَلَهٗ অতঃপর ওটাকে পরিণত করেছেন غُثَآءً আবর্জনাময় اَحْوٰى ধূসর বর্ণের। (৬) سَنُقْرِئُكَ অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাবো, فَلَا تَنْسٰى ফলে তুমি আর ভুলবে না, (৭) اِلَّا তবে তা ব্যতীত مَا شَآءَ اللهُ আল্লাহ যা ইচ্ছা করবেন, اِنَّهٗ নিশ্চয় তিনি يَعْلَمُ জানেন اَلْجَهْرَ প্রকাশ্য বিষয় وَمَا يَخْفٰى এবং যা গোপন থাকে। (৮) وَنُيَسِّرُكَ আমি তোমার জন্যে সহজ করে দেব لِلْيُسْرٰى সরল পথে চলাকে। (৯) فَذَكِّرْ অতএব উপদেশ দাও اِنْ نَّفَعَتْ যদি উপকারী হয় اَلذِّكْرٰى উপদেশ।

সরল অনুবাদ :

(১) তুমি তোমার সর্বোচ্চ প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা করো,১ (২) যিনি২ সৃষ্টি করেছেন;৩ অতঃপর সুঠাম করেছেন,৪ (৩) এবং যিনি নিরূপণ করেছেন,৫ তারপর হেদায়েত দিয়েছেন,৬ (৪) এবং যিনি উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছেন,৭ (৫) অতঃপর ওটাকে পরিণত করেন আবর্জনায়- দূসর বর্ণের। (৬) অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাব, ফলে তুমি আর ভুলবে না,৮ (৭) তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন;৯ তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন সম্পর্কে। (৮) আমি তোমার জন্য সরল পথে চলাকে সহজ করে দেব।১০ (৯) অতএব উপদেশ দাও- যদি উপদেশ উপকারী হয়।১১

টীকা :

[১] আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে তাঁর তাসবীহ বা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। যে পবিত্রতা ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহর যিকর, ইবাদাত, তাঁর মাহাত্ম্যের জন্য বিনয় ও হীন অবস্থা প্রকাশ পায়। আর তাঁর তাসবীহ যেন তাঁর সত্তার মাহাত্ম্য উপযোগী হয়।

[২] এখানে মূলত আল্লাহ তা‘আলার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার কারণসমূহ বর্ণনা করা হচ্ছে। এ আয়াত এবং এর পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে জগৎ সৃষ্টিতে আল্লাহর অপার রহস্য ও শক্তি সম্পর্কিত কতিপয় কর্মগত গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে।

[৩] অর্থাৎ সৃষ্টি করেছেন। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর অসীম কুদরতে কোন পূর্ব-নমুনা ব্যতিরেকে যখন যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন।

[৪] অর্থ সামঞ্জস্যপূর্ণ, মজবুত ও সুন্দর করেছেন। যে জিনিসটিই সৃষ্টি করেছেন তাকে সঠিক ও সুঠাম দেহ দান করেছেন এবং তার মধ্যে ভারসাম্য ও শক্তির অনুপাত সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

[৫] অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর তাকদীর নির্ধারণ করেছেন। প্রতিটি জিনিস সে তাকদীরের অনুসরণ করছে।

[৬] অর্থাৎ স্রষ্টা যে কাজের জন্য যাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে সে কাজের পথনির্দেশও দিয়েছেন। সত্যিকারের এ পথনির্দেশে আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টিই অন্তর্ভুক্ত আছে। কেননা এক বিশেষ ধরনের বুদ্ধি ও চেতনা আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে দিয়েছেন, যদিও তা মানুষের বুদ্ধি ও চেতনা থেকে নিম্নস্তরের। অন্য আয়াতে আছে, ‘‘তিনি বললেন, আমাদের প্রতিপালক তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুর জন্য তাকদীর নির্ধারণ করেছেন, তারপর পথনির্দেশ করেছেন।’’- (সূরা ত্বাহা- ৫০)

[৭] তিনি চারণভূমির ব্যবস্থা করেছেন। ( غُثَاءٌ শব্দের অর্থ খড়-কুটো, আবর্জনা, যা বন্যার পানির উপর ভাসমান থাকে। اَحْوٰى শব্দের অর্থ গাঢ় সবুজ রং। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা উদ্ভিদ সম্পর্কিত স্বীয় কুদরত ও হেকমত বর্ণনা করেছেন। তিনি ভূমি থেকে সবুজ-শ্যামল ঘাস উৎপন্ন করেছেন। অতঃপর একে শুঁকিয়ে কালো রং-এ পরিণত করেছেন এবং সবুজতা বিলীন করে দিয়েছেন। এতে দুনিয়ার চাকচিক্য যে ক্ষণস্থায়ী সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন।

[৮] এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সুসংবাদ জানানো হচ্ছে যে, তিনি কুরআনের কোন আয়াত বিস্মৃত হবেন না। তার কাছে কিতাবের যে ওহী আল্লাহ পাঠিয়েছেন সেটার হেফাযত তিনি নিজেই করবেন। আল্লাহ তার অন্তরে সেটা গেঁথে দেবেন, ফলে নবী তা ভুলে যাবেন না।

[৯] এই বাক্যটির কয়েকটি অর্থ হতে পারে। (এক) কুরআনের কিছু আয়াত রহিত করার এক পদ্ধতি হচ্ছে প্রথম আদেশের বিপরীতে পরিষ্কার দ্বিতীয় আদেশ নাযিল করা। এর আরেকটি পদ্ধতি হলো সংশ্লিষ্ট আয়াতটিই রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সকল মুসলিমের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়া। এ সম্পর্কে এক আয়াতে আছে, ‘‘আমি কোন আয়াত রহিত করি অথবা আপনার স্মৃতি থেকে উধাও করে দেই’’- (সূরা বাকারা- ১০৬) (দুই) অথবা আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, কখনো সাময়িকভাবে আপনার ভুলে যাওয়া এবং কোন আয়াত বা শব্দ আপনার কোন সময় ভুলে যাওয়া এই ওয়াদার ব্যতিক্রম। যে ব্যাপারে ওয়াদা করা হচ্ছে যে, আপনি স্থায়ীভাবে কুরআনের কোন শব্দ ভুলে যাবেন না।

[১০] অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আপনার জন্য সহজ সরল শরীয়ত প্রদান করবেন। যাতে কোন বক্রতা থাকবে না।

[১১] অর্থাৎ যেখানে স্মরণ করিয়ে দিলে কাজে লাগে সেখানে স্মরণ করিয়ে দিবেন। এর দ্বারা জ্ঞান দেয়ার আদব ও নিয়ম নীতি বুঝা যায়। সুতরাং যারা জ্ঞান গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়; তাদের কাছে সেটা দিতে নেই। যেমন- আলী (রাঃ) বলেন, তুমি যদি এমন কওমের কাছে কোন কথা বল, যা তাদের বিবেকে ঢুকবে না, তাহলে সেটা তাদের কারো কারো জন্য বিপদের কারণ হবে। তারপর তিনি বললেন, মানুষ যা চিনে তা-ই শুধু তাদেরকে জানাও, তুমি কি চাও যে, লোকেরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর মিথ্যারোপ করুক?

আয়াত : ১০-১৯

سَيَذَّكَّرُ مَنْ يَّخْشٰى (১০) وَيَتَجَنَّبُهَا الْاَشْقٰى (১১) اَلَّذِيْ يَصْلَى النَّارَ الْكُبْرٰى (১২) ثُمَّ لَا يَمُوْتُ فِيْهَا وَلَا يَحْيٰى (১৩) قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰى (১৪) وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّه فَصَلّٰى (১৫) بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا (১৬) وَالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ وَّاَبْقٰى (১৭) اِنَّ هٰذَا لَفِي الصُّحُفِ الْاُوْلٰى (১৮) صُحُفِ اِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسٰى (১৯)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১০) سَيَذَّكَّرُ অচিরেই উপদেশ গ্রহণ করবে مَنْ يَّخْشٰى যারা ভয় করে। (১১) وَيَتَجَنَّبُهَا আর তাকে উপেক্ষা করবে اَلْاَشْقٰى নিতান্ত হতভাগ্যরা, (১২) اَلَّذِيْ যে يَصْلَى প্রবেশ করবে اَلنَّارَ الْكُبْرٰى বৃহত্তম অগ্নিতে, (১৩) ثُمَّ অতঃপর لَا يَمُوْتُ সে মরবে না فِيْهَا সেখানে এবং وَلَا يَحْيٰى বাঁচবেও না। (১৪) قَدْ اَفْلَحَ নিশ্চয় সে সাফল্য লাভ করে مَنْ تَزَكّٰى যে পবিত্রতা অবলম্বন করে। (১৫) وَذَكَرَ এবং স্মরণ করে اِسْمَ رَبِّه  তার প্রতিপালকের নাম فَصَلّٰى ও সালাত আদায় করে। (১৬) بَلْ কিন্তু تُؤْثِرُوْنَ তোমরা তো অগ্রাধিকার দিয়ে থাকো اَلْحَيَاةَ الدُّنْيَا পার্থিব জীবনকে। (১৭) وَالْاٰخِرَةُ অথচ আখেরাত خَيْرٌ উত্তম وَاَبْقٰى ও চিরস্থায়ী। (১৮) اِنَّ নিশ্চয় هٰذَا এটা আছে لَفِي الصُّحُفِ الْاُوْلٰى পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে, (১৯) صُحُفِ কিতাবে اِبْرَاهِيْمَ ইবরাহীম وَمُوْسٰى ও মূসার।

সরল অনুবাদ :

(১০) যারা ভয় করে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।১২ (১১) আর তা উপেক্ষা করবে নিতান্ত হতভাগ্যরাই, (১২) সে বৃহৎ অগ্নিতে প্রবেশ করবে, (১৩) অতঃপর সে সেখানে মরবেও না, বাঁচবেও না।১৩ (১৪) নিশ্চয় সে সাফল্য লাভ করে, যে পবিত্রতা অবলম্বন করে।১৪ (১৫) এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও সালাত কায়েম করে।১৫ (১৬) কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকো। (১৭) অথচ আখেরাত উত্তম১৬ ও চিরস্থায়ী১৭। (১৮) নিশ্চয় এটা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও রয়েছে, (১৯) (বিশেষত) ইবরাহীম (আঃ) ও মূসা (আঃ)- এর কিতাবসমূহে।১৮

টীকা :

[১২] অর্থাৎ যে ব্যক্তির মনে আল্লাহর ভয় এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে এমন ধারণা কাজ করে সে অবশ্যই আপনার উপদেশ মনোযোগ সহকারে শুনবে।

[১৩] অর্থাৎ তার মৃত্যু হবে না। যার ফলে আযাব থেকে রেহাই পাবে না। আবার বাঁচার মতো বাঁচবেও না। যার ফলে জীবনের কোন স্বাদও পাবে না।

[১৪] এখানে পরিশুদ্ধ বা পবিত্রতার অর্থ কুফর ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা, অসৎ আচার-আচরণ ত্যাগ করে সদাচার অবলম্বন করা এবং অসৎকাজ ত্যাগ করে সৎকাজ করা। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে যা নাযিল হয়েছে তার অনুসরণ করা। আয়াতের আরেক অর্থ, ধন-সম্পদের যাকাত প্রদান করা। এখানে تَزَكّٰى শব্দের অর্থ ব্যাপক হতে পারে। ফলে ঈমানগত ও চরিত্রগত পরিশুদ্ধি এবং আর্থিক যাকাত প্রদান সবই এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

[১৫] কেউ কেউ অর্থ করেছেন, তারা তাদের রবের নাম স্মরণ করে এবং সালাত আদায় করে। বাহ্যত এতে ফরয ও নফল সবরকম সালাত অন্তর্ভুক্ত। কোন কোন মুফাসসির বলেন, নাম স্মরণ করা বলতে আল্লাহকে মনে মনে স্মরণ করা এবং মুখে তা উচ্চারণ করাও উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহকে মনে মনে বা মুখে উচ্চারণ করে স্মরণ করেছে, তারপর সালাত আদায় করেছে। সে শুধু আল্লাহর স্মরণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি। বরং নিয়মিত সালাত আদায়ে ব্যাপৃত ছিল।

[১৬] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া তো শুধু এমন যেন তোমাদের কেউ সমূদ্রে তার আঙ্গুল ডুবিয়েছে। তারপর সে যেন দেখে নেয় সে আঙ্গুল কী নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে? (সহীহ মুসলিম, হা/২৮৫৮)

[১৭] অর্থাৎ আখেরাত দু’দিক দিয়ে দুনিয়ার মোকাবিলায় অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। প্রথমত তার সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামতের চাইতে অনেক বেশি ও অনেক উচ্চ পর্যায়ের। দ্বিতীয়ত দুনিয়া ধ্বংসশীল এবং আখেরাত চিরস্থায়ী।

[১৮] অর্থাৎ এই সূরার সব বিষয়বস্তু অথবা সর্বশেষ বিষয়বস্তু (আখেরাত উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী হওয়া) এ কথা পূর্ববর্তী ইবরাহীম ও মূসা (আঃ) এর সহীফাসমূহেও লিখিত আছে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

মহান আল্লাহর শান অনুযায়ী তাঁর প্রশংসা করা আবশ্যক।

সবুজ ঘাস যেমন এক সময়ে মরে আবর্জনায় পরিণত হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মানুষও এক সময় বার্ধক্য, অতঃপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে- এটিই চূড়ান্ত সত্য।

শরীয়ত সম্মত পন্থায় আত্মশুদ্ধি অর্জন করা জরুরি।

দুনিয়ার প্রতি লোভ কমিয়ে আখেরাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

নবী ও রাসূলদের দ্বীন এক। তাঁদের কাছে প্রেরিত সকল গ্রন্থই আসমানী।

১৩
৮৮- সূরা গাশিয়াহ
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْغَاشِيَةُ (আল-গাশিয়াহ) শব্দের আলোকে এ সূরাটির নাম আল-গাশিয়াহ রাখা হয়েছে। এর অর্থ আচ্ছন্নকারী।

নাযিলের সময়কাল :

এ সূরাটি সমগ্র বিষয়বস্তু এ কথা প্রমাণ করে যে, এটিও প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটি এমন সময় নাযিল হয়, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং মক্কার লোকেরা তাঁর দাওয়াত শুনে তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করতে থাকে।

সূরার বিষয়বস্তু :

ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রধানত দুটি কথা লোকদেরকে বুঝাবার মধ্যেই তার দাওয়াত সীমাবদ্ধ রাখেন। একটি তাওহীদ ও দ্বিতীয়টি আখেরাত। আর মক্কাবাসীরা এই দুটি কথা মেনে নিতে অস্বীকার করতে থাকে। এখানে সবার আগে গাফলতির জীবনে ডুবে থাকা লোকদেরকে চমকে দেবার জন্য হঠাৎ তাদের সামনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, তোমরা কি সে সময়ের কোন খবর রাখো, যখন সারা দুনিয়ার উপর ছেয়ে যাবার মতো একটি বিপদ অবতীর্ণ হবে? এরপর সাথে সাথেই এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, সে সময় সমস্ত মানুষ দুটি ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দুটি ভিন্ন পরিণামের সম্মুখীন হবে। একদল জাহান্নামে যাবে। দ্বিতীয় দলটি উন্নত ও উচ্চ মর্যাদার জান্নাতে যাবে।

এভাবে লোকদেরকে চমকে দেবার পর হঠাৎ প্রশ্ন করা হয়, যারা কুরআনের তাওহীদী শিক্ষা ও আখেরাতের খবর শুনে নাক সিটকায় তারা কি নিজেদের চোখের সামনে প্রতি মুহূর্তে যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেগুলো দেখে না? আরবের দিগন্ত বিস্তৃত সাহারায় যেসব উটের উপর তাদের সমগ্র জীবন যাপন প্রণালী নির্ভরশীল তারা কীভাবে ঠিক মরু জীবনের উপযোগী বৈশিষ্ট ও গুণাবলী সম্পন্ন পশু হিসেবে গড়ে উঠেছে, এ কথা কি তারা একটুও চিন্তা করে না? পথে সফর করার সময় তারা আকাশ, পাহাড় বা বিশাল পৃথিবী দেখে না। এই তিনটি জিনিস সম্পর্কেই তারা চিন্তা করে না কেন? যে আল্লাহর এসব কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা ছিল, সেই আল্লাহ কিয়ামত সংঘটিত করার ক্ষমতাও রাখেন, মানুষদের পুনর্বার সৃষ্টি করার ক্ষমতাও রাখেন।

এরপর কাফিরদের দিক থেকে ফিরে নবী ﷺ-কে সম্বোধন করা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, এরা না মানতে চাইলে না মানুক, তোমাকে তো এদের উপর বল প্রয়োগকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়নি। তুমি জোর করে এদের থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে পারো না। তোমার কাজ উপদেশ দেয়া। কাজেই তুমি উপদেশ দিয়ে যেতে থাকো। সবশেষে তাদের অবশ্যই আমার কাছেই আসতে হবে। সে সময় আমি তাদের কাছ থেকে পুরো হিসেব নিয়ে নেব।

আয়াত : ১-১৬



هَلْ اَتَاكَ حَدِيْثُ الْغَاشِيَةِ (১) وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ (২) عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ (৩) تَصْلٰى نَارًا حَامِيَةً (৪) تُسْقٰى مِنْ عَيْنٍ اٰنِيَةٍ (৫) لَيْسَ لَهُمْ طَعَامٌ اِلَّا مِنْ ضَرِيْعٍ (৬) لَا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِيْ مِنْ جُوْعٍ (৭) وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَّاعِمَةٌ (৮) لِسَعْيِهَا رَاضِيَةٌ (৯) فِيْ جَنَّةٍ عَالِيَةٍ (১০) لَا تَسْمَعُ فِيْهَا لَاغِيَةً (১১) فِيْهَا عَيْنٌ جَارِيَةٌ (১২) فِيْهَا سُرُرٌ مَّرْفُوْعَةٌ (১৩) وَاَكْوَابٌ مَّوْضُوْعَةٌ (১৪) وَنَمَارِقُ مَصْفُوْفَةٌ (১৫) وَزَرَابِيُّ مَبْثُوْثَةٌ (১৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) هَلْ اَتَاكَ তোমার কাছে কি এসেছে حَدِيْثُ সংবাদ اَلْغَاشِيَةِ আচ্ছন্নকারীর? (২) وُجُوْهٌ কতক মুখমন্ডল হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন خَاشِعَةٌ ভীত-সন্ত্রস্ত; (৩) عَامِلَةٌ কঠোর শ্রমরত نَاصِبَةٌ বিপর্যস্ত; (৪) تَصْلٰى তারা প্রবেশ করবে نَارًا আগুনে حَامِيَةً জ্বলন্ত; (৫) تُسْقٰى তাদেরকে পান করানো হবে مِنْ عَيْنٍ اٰنِيَةٍ উত্তপ্ত ঝর্ণা হতে; (৬) لَيْسَ নেই لَهُمْ তাদের জন্যে طَعَامٌ কোন খাদ্য اِلَّا ব্যতীত مِنْ ضَرِيْعٍ বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত শুকনো খড় (৭) لَا يُسْمِنُ তা তাদেরকে পুষ্ট করবে না وَلَا يُغْنِيْ এবং মেটাবে না مِنْ جُوْعٍ ক্ষুধা। (৮) وُجُوْهٌ কতক মুখমন্ডল হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন نَاعِمَةٌ আনন্দোজ্জ্বল, (৯) لِسَعْيِهَا নিজেদের প্রচেষ্টায় رَاضِيَةٌ সন্তুষ্ট হবে। (১০) فِيْ جَنَّةٍ জান্নাতে অবস্থান করবে عَالِيَةٍ সুউচ্চ। (১১) لَا تَسْمَعُ তারা শুনবে না فِيْهَا সেখানে لَاغِيَةً কোন অবান্তর বাক্য। (১২) فِيْهَا সেখানে আছে عَيْنٌ ঝরণা-সমূহ جَارِيَةٌ প্রবাহমান, (১৩) فِيْهَا তন্মধ্যে রয়েছে سُرُرٌ আসনসমূহ مَرْفُوْعَةٌ সমুচ্চ (১৪) وَاَكْوَابٌ এবং পান পাত্রসমূহ مَوْضُوْعَةٌ সুরক্ষিত (১৫) وَنَمَارِقُ এবং বালিশসমূহ مَصْفُوْفَةٌ সারি সারি; (১৬) وَزَرَابِيُّ এবং গালিচাসমূহ مَبْثُوْثَةٌ সম্প্রসারিত।

সরল অনুবাদ :

(১) তোমার কাছে কি আচ্ছন্নকারীর (কিয়ামতের) সংবাদ এসেছে? (২) সেদিন অনেক চেহারা ভীত-সন্ত্রস্ত হবে;১ (৩) কঠোর শ্রমরত ও বিপর্যস্ত;২ (৪) তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে;৩ (৫) তাদেরকে উত্তপ্ত ঝর্ণা হতে (পানি) পান করানো হবে; (৬) তাদের জন্য থাকবে না বিষাক্ত কাটাযুক্ত শুকনো খড় ব্যতীত কোন খাদ্য;৪ (৭) তা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধাও মেটাবে না। (৮) সেদিন অনেক মুখমন্ডল আনন্দোজ্জ্বল হবে, (৯) নিজেদের কর্মে সন্তুষ্ট হবে।৫ (১০) তারা উচ্চ মর্যাদার জান্নাতে অবস্থান করবে। (১১) সেখানে তারা অবান্তর বাক্য শুনবে না।৬ (১২) সেখানে আছে প্রবাহমান ঝরণাসমূহ, (১৩) তন্মধ্যে রয়েছে সমুচ্চ৭ আসনসমূহ (১৪) এবং সুরক্ষিত পান পাত্রসমূহ (১৫) ও সারি সারি বালিশসমূহ; (১৬) এবং সম্প্রসারিত গালিচাসমূহ।

টীকা :

[১] গাশিয়াহ বলে কিয়ামতকে বুঝানো হয়েছে। এটি কিয়ামতেরই একটি নাম। এর আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে আচ্ছন্নকারী। অর্থাৎ যে বিপদটা সারা সৃষ্টিকুলকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। কিয়ামতে মুমিন ও কাফির আলাদা আলাদা বিভক্ত দু’দল হবে এবং মুখমন্ডল দ্বারা পৃথকভাবে পরিচিত হবে। এই আয়াতে কাফিরদের মুখমন্ডলের এক অবস্থা এই বর্ণিত হয়েছে যে, তা خَاشِعَةٌ অর্থাৎ হেয় হবে।

[২] দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থা হবে عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ বাকপদ্ধতিতে অবিরাম কর্মের কারণে পরিশ্রান্ত ব্যক্তিকে عَامِلَةٌ এবং ক্লান্ত ও ক্লিষ্ট ব্যক্তিকে বলা হয় نَاصِبَةٌ । কোন কোন মুফাসসিরের মতে, কাফিরদের এ দুরাবস্থা দুনিয়াতেই হবে। কেননা অনেক কাফির দুনিয়াতে মুশরিকসুলভ ইবাদত এবং বাতিল পন্থায় অধ্যবসায় ও সাধনা করে থাকে। তারা আন্তরিকতা সহকারে আল্লাহ তা‘আলারই সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে ইবাদাত ও সাধনা করে থাকে এবং এতে অসাধারণ পরিশ্রম স্বীকার করে। কিন্তু এসব ইবাদাত মুশরিকসুলভ ও বাতিল পন্থায় হওয়ার কারণে আল্লাহর কাছে সওয়াব ও পুরস্কার লাভের যোগ্য হয় না। অতএব তাদের মুখমন্ডল দুনিয়াতেও ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত রইল এবং আখেরাতে তাদেরকে লাঞ্ছনা ও অপমান আচ্ছন্ন করে রাখবে। খলীফা ওমর ফারুক (রাঃ) যখন শাম সফর করেন, তখন জনৈক নাসারা বৃদ্ধ পাদ্রী তাঁর কাছ দিয়ে যেতে দেখলেন। সে তাঁর ধর্মীয় ইবাদাত সাধনা ও মোজাহাদায় এত বেশি আত্মনিয়োগ করেছিল যে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে চেহারা বিকৃত এবং দেহ শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। খলীফা তাকে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেসিত হলে তিনি বললেন, এই বৃদ্ধার করুণ অবস্থা দেখে আমি ক্রন্দন করতে বাধ্য হয়েছি। বেচারী স্বীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবনভর পরিশ্রম ও সাধনা করেছে; কিন্তু সে তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি। তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন।

হাসান বসরী ও সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.) বলেন, তারা যেহেতু দুনিয়াতে আল্লাহর জন্য কোন নেক আমল করেনি, সেহেতু সেখানে তারা জাহান্নামে কঠিন খাটুনি ও কষ্ট করবে। ফলে কষ্ট ও ক্লান্তি উভয়টিরই সম্মুখীন হবে।

[৩] حَامِيَةً শব্দের অর্থ গরম উত্তপ্ত। অগ্নি স্বভাবতই উত্তপ্ত। এর সাথে উত্তপ্ত বিশেষণ যুক্ত করা এ কথা বলার জন্য যে, এই অগ্নির উত্তাপ দুনিয়ার অগ্নির ন্যায় কোন সময় কম অথবা নিঃশেষ হয় না; বরং এটা চিরন্তন উত্তপ্ত। সে আগুন তাদেরকে সবদিক থেকে ঘিরে ধরবে।

[৪] ضَرِيْعٌ শব্দের অর্থ করা হয়েছে, কাটাযুক্ত গুল্ম। অর্থাৎ জাহান্নামীরা কোন খাদ্য পাবে না কেবল এক প্রকার কাটাবিশিষ্ট ঘাস ছাড়া। দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত কাটার কারণে জন্তু-জানোয়ারও এর ধারে কাছে যায় না। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ضَرِيْعٌ হচ্ছে জাহানণামের একটি গাছ- যা খেয়ে কেউ মোটা তাজা হবে না এবং এতে ক্ষুধা থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে না।

[৫] অর্থাৎ দুনিয়ায় তারা যেসব প্রচেষ্টা চালিয়ে ও কাজ করে এসেছে আখেরাতে তার চমৎকার ফল দেখে তারা আনন্দিত হবে।

৬] অর্থাৎ জান্নাতে জান্নাতীরা কোনো অসার কথাবার্তা শুনতে পাবে না। মিথ্যা, কুফরী কথাবার্তা, গালিগালাজ, অপবাদ ও পীড়াদায়ক কথাবার্তা সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

[৭] এ উন্নত অবস্থা সার্বিক দিকেই হবে। এ সমস্ত শয্যা অবস্থান, মর্যাদা ও স্থান সবদিক থেকেই উন্নত। সাধারণত মানুষ এ ধরনের শয্যা পছন্দ করে থাকে। আল্লাহর বন্ধুরা যখন এ সমস্ত শয্যায় বসতে চাইবে, তখনি সেগুলো তাদের জন্য নিচু হয়ে আসবে।

আয়াত : ১৭-২৬

اَفَلَا يَنْظُرُوْنَ اِلَى الْاِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ (১৭) وَاِلَى السَّمَآءِ كَيْفَ رُفِعَتْ (১৮) وَاِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ (১৯) وَاِلَى الْاَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ (২০) فَذَكِّرْ اِنَّمَاۤ اَنْتَ مُذَكِّرٌ (২১) لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ (২২) اِلَّا مَنْ تَوَلّٰى وَكَفَرَ (২৩) فَيُعَذِّبُهُ اللهُ الْعَذَابَ الْاَكْبَرَ (২৪) اِنَّ اِلَيْنَاۤ اِيَابَهُمْ (২৫) ثُمَّ اِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ (২৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৭) اَفَلَا يَنْظُرُوْنَ তবে কি তারা লক্ষ্য করে না اِلَى الْاِبِلِ উটের দিকে كَيْفَ কিভাবে خُلِقَتْ তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? (১৮) وَاِلَى السَّمَآءِ এবং আকাশের দিকে كَيْفَ কিভাবে رُفِعَتْ ওটাকে সমুচ্চ করা হয়েছে? (১৯) وَاِلَى الْجِبَالِ এবং পর্বতমালার দিকে كَيْفَ কিভাবে نُصِبَتْ ওটাকে বসানো হয়েছে? (২০) وَاِلَى الْاَرْضِ এবং জমিনের দিকে كَيْفَ কিভাবে سُطِحَتْ ওটাকে সমতল করা হয়েছে? (২১) فَذَكِّرْ অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো, اِنَّمَا اَنْتَ নিশ্চয় তুমি مُذَكِّرٌ একজন উপদেশ দাতা। (২২) لَسْتَ তুমি নও عَلَيْهِمْ তাদের উপর بِمُصَيْطِرٍ যিম্মাদার। (২৩) اِلَّا তবে مَنْ যে ব্যক্তি تَوَلّٰى মুখ ফিরিয়ে নেয় وَكَفَرَ ও কুফরী করে (২৪) فَيُعَذِّبُهُ اللهُ আল্লাহ তাকে আযাব দেবেন اَلْعَذَابَ الْاَكْبَرَ কঠোর আযাব। (২৫) اِنَّ নিশ্চয় اِلَيْنَا আমারই নিকট اِيَابَهُمْ তাদের প্রত্যাবর্তন। (২৬) ثُمَّ অতঃপর اِنَّ নিশ্চয় عَلَيْنَا আমার উপরই حِسَابَهُمْ তাদের হিসাব-নিকাশ।

সরল অনুবাদ :

(১৭) তবে কি তারা উষ্ট্রপালের দিকে লক্ষ্য করে না যে, কীভাবে এদের সৃষ্টি করা হয়েছে? (১৮) এবং আকাশের দিকে (লক্ষ্য করে না) যে, কীভাবে ওটাকে সমুচ্চ করা হয়েছে? (১৯) এবং পর্বতমালার দিকে (লক্ষ্য করে না) যে, কীভাবে ওটাকে বসানো হয়েছে? (২০) এবং ভূ-তলের দিকে (লক্ষ্য করে না) যে, কীভাবে ওটাকে সমতল করা হয়েছে?৮ (২১) অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো, তুমি তো একজন উপদেশদাতা মাত্র।৯ (২২) তুমি তাদের যিম্মাদার নও। (২৩) তবে যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং কুফরী করবে, (২৪) আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন। (২৫) নিশ্চয় আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। (২৬) অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ (নেয়ার দায়িত্ব) আমার উপরই।

টীকা :

[৮] কিয়ামতের অবস্থা এবং মুমিন ও কাফেরের প্রতিদান এবং শাস্তি বর্ণনা করার পর কিয়ামতে অবিশ্বাসী হঠকারীদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কুদরতের কয়েকটি নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার কথা বলেছেন। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীতে অসংখ্য। এখানে মরুচারী আরবদের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল চারটি নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আরবরা উটে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্তে সফর করে। তখন তাদের সর্বাধিক নিকটে থাকে উট, উপরে আকাশ, নিচে ভূপৃষ্ঠ এবং অগ্র-পশ্চাতে সারি সারি পর্বতমালা। এই চারটি বস্তু সম্পর্কেই তাদেরকে চিন্তা-ভাবনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে।

[৯] এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সান্ত্বনার জন্য বলা হয়েছে, আপনার বর্ণিত ন্যায়সঙ্গত যুক্তি মানতে যদি কোন ব্যক্তি প্রস্তুত না হয়, তাহলে মানা না মানা তার ইচ্ছা। আপনি তাদের শাসক নন যে, তাদেরকে মুমিন করতেই হবে। আপনার কাজ শুধু প্রচার করা ও উপদেশ দেয়া। লোকদেরকে ভুল ও সঠিক এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য জানিয়ে দেয়া। তাদেরকে ভুল পথে চলার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা। কাজেই এ দায়িত্ব আপনি পালন করে যেতে থাকুন। এতটুকু করেই আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তাদের হিসাব-নিকাশ, শাস্তি ও প্রতিদান আমার কাজ।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কিয়ামত নিশ্চয় সংঘটিত হবে এবং প্রতিফল দিবস কায়েম হবে।

কিয়ামতের অপর নাম আল-গাশিয়াহ বা আচ্ছাদনকারী।

আল্লাহর পথে আহবানকারীর দায়িত্ব পথ দেখিয়ে দেয়া।

মানুষের প্রত্যাবর্তন মহান আল্লাহর দিকে, তিনিই সকলের হিসাব নেবেন।

১৪
৮৯- সূরা ফাজর
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দ اَلْفَجْرُ (আল-ফাজর) এর আলোকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। ফাজর অর্থ হচ্ছে, প্রতিদিনের ফজরের সময়।

নাযিলের সময় :

সকলের মতে, এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এটি এমন এক যুগে নাযিল হয়, যখন মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন চলছিল।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের সত্যতা প্রমাণ করা। মানব জাতির ইতিহাস থেকে প্রমাণ পেশ করে উদাহরণস্বরূপ আদ ও সামূদ জাতি এবং ফিরাউনের পরিণাম পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যখন তারা সীমা পেরিয়ে গেছে এবং পৃথিবীতে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তখন আল্লাহর আযাব তাদেরকে গ্রাস করেছে।

তারপর মানব সমাজের সাধারণত নৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে তার দুটি দিকের সমালোচনা করা হয়েছে। (এক) সাধারণ মানুষের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। যার ফলে তারা নৈতিক ভালো-মন্দের দিকটাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র পার্থিব ধনসম্পদ, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অর্জন বা এর অভাবকে সম্মানহানির মানদন্ড গণ্য করেছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল, সম্পদশালীতা কোন পুরস্কার নয় এবং আর্থিক অভাব অনটন কোন শাস্তি নয়; বরং এ দুটি অবস্থাতেই মহান আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছেন। সম্পদ লাভ করে মানুষ কী দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি অবলম্বন করে এবং আর্থিক অনটন ক্লিষ্ট হয়ে সে কোন পথে চলে- এটা দেখাই তাঁর উদ্দেশ্য। (দুই) লোকদের সাধারণ কর্মনীতি। পিতার মৃত্যুর সাথে সাথেই তাদের সমাজে এতীম ছেলেমেয়েরা চরম দুরাবস্থার সম্মুখীন হয়। গরীবদের খবর নেয়ার এবং তাদের পক্ষে কথা বলার একটি লোকও পাওয়া যায় না। যার ক্ষমতা থাকে সে মৃতের সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করে বসে।

সবশেষে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, হিসেব-নিকেশ অবশ্যই হবে। সেদিন তাদের বোধগম্য হবে। কিন্তু তখন কোন লাভ হবে না। অস্বীকারকারী সেদিন আফসোস করে বলবে, হায়! আজকের দিনের জন্য। কিন্তু এই লজ্জা ও দুঃখ তাকে আল্লাহর আযাব হতে বাঁচাতে পারবে না।

তবে যেসব লোক আসমানী কিতাব ও আল্লাহর নবীগণের পেশকৃত সত্য মেনে নিয়েছিল আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং তারাও আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিদান পেয়ে সন্তুষ্ট হবে। তাদেরকে আহবান জানানো হবে, তোমরা নিজেদের রবের প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করো।

আয়াত : ১-১৪



وَالْفَجْرِ (১) وَلَيَالٍ عَشْرٍ (২) وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ (৩) وَاللَّيْلِ اِذَا يَسْرِ (৪) هَلْ فِيْ ذٰلِكَ قَسَمٌ لِّذِيْ حِجْرٍ (৫) اَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ (৬) اِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ (৭) اَلَّتِيْ لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ (৮) وَثَمُوْدَ الَّذِيْنَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ (৯) وَفِرْعَوْنَ ذِي الْاَوْتَادِ (১০) اَلَّذِيْنَ طَغَوْا فِي الْبِلَادِ (১১) فَاَكْثَرُوْا فِيْهَا الْفَسَادَ (১২) فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ (১৩) اِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ (১৪)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالْفَجْرِ শপথ ফজরের, (২) وَلَيَالٍ শপথ রাত্রির عَشْرٍ দশ, (৩) وَالشَّفْعِ এবং জোড় وَالْوَتْرِ ও বেজোড়ের, (৪) وَاللَّيْلِ এবং শপথ রাত্রির اِذَا যখন يَسْرِ তা গত হতে থাকে, (৫) هَلْ فِيْ ذٰلِكَ এর মধ্যে আছে কি قَسَمٌ কোন শপথ لِذِيْ حِجْرٍ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য। (৬) اَلَمْ تَرَ আপনি কি লক্ষ্য করেননি, كَيْفَ কিরূপ فَعَلَ আচরণ করেছিলেন رَبُّكَ আপনার পালনকর্তা بِعَادٍ আদ জাতির সাথে (৭) اِرَمَ ইরাম গোত্র ذَاتِ অধিকারী اَلْعِمَادِ সুউচ্চ স্তম্ভের (৮) اَلَّتِيْ যাদের لَمْ يُخْلَقْ সৃজিত হয়নি مِثْلُهَا তাদের মতো فِي الْبِلَادِ শহরসমূহে, (৯) وَثَمُوْدَ এবং সামূদ গোত্রের সাথে, اَلَّذِيْنَ যারা جَابُوْا কেটে (গৃহ) নির্মাণ করেছিল اَلصَّخْرَ পাথর بِالْوَادِ উপত্যকায়। (১০) وَفِرْعَوْنَ এবং ফিরাউনের সাথে ذِي الْاَوْتَادِ কীলকসমূহের অধিপতি, (১১) اَلَّذِيْنَ যারা طَغَوْا সীমালঙ্ঘন করেছিল فِي الْبِلَادِ সারাদেশে। (১২) فَاَكْثَرُوْا অতঃপর তারা বাড়িয়ে দিয়েছিল فِيْهَا সেখানে اَلْفَسَادَ অশান্তি। (১৩) فَصَبَّ অতঃপর মারলেন عَلَيْهِمْ তাদের উপর رَبُّكَ আপনার প্রতিপালক سَوْطَ কোড়া عَذَابٍ শাস্তির। (১৪) اِنَّ নিশ্চয় رَبَّكَ আপনার পালনকর্তা لَبِالْمِرْصَادِ ঘাঁটিতেই আছেন।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ ফজরের,১ (২) শপথ দশ রাত্রির,২ (৩) শপথ জোড় ও বেজোড়ের,৩ (৪) শপথ রাত্রির- যখন তা গত হতে থাকে,৪ (৫) এর মধ্যে আছে কি কোন শপথ- জ্ঞানী লোকদের জন্য।৫ (৬) আপনি কি লক্ষ্য করেননি, আপনার প্রতিপালক আদ জাতির সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন, (৭) ইরাম গোত্রের;৬ যাদের দৈহিক গঠন ছিল স্তম্ভ ও খুঁটির ন্যায় দীর্ঘ এবং (৮) যাদের মতো (শক্তিশালী) কাউকে কোন দেশে সৃষ্টি করা হয়নি।৭ (৯) আর (আপনি কি লক্ষ্য করেননি) সামূদ জাতির সাথে (কিরূপ আচরণ করা হয়েছিল), যারা উপত্যকায়৮ পাথর কেটে গৃহ নির্মাণ করেছিল। (১০) আর (আপনি কি লক্ষ্য করেননি) বহু কীলকের অধিপতি ফিরাউনের সাথে (কিরূপ আচরণ করা হয়েছিল),৯ (১১) যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছিল। (১২) অতঃপর সেখানে ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি করেছিল। (১৩) অতঃপর আপনার প্রতিপালক তাদেরকে শাস্তির কোড়া মারলেন। (১৪) নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।১০

টীকা :

[১] সূরার বর্ণনাভঙ্গি সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, প্রথম থেকে কোন আলোচনা চলছিল। সেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি কথা পেশ করেছিলেন এবং অস্বীকারকারীরা তা অস্বীকার করছিল। এ প্রসঙ্গে রাসূলের কথার সত্যতা প্রমাণ করে বলা হয়েছে, এই এই জিনিসের কসম! যা কিছু মুহাম্মাদ ﷺ বলছেন সব সত্য। তারপর এ প্রশ্নের ভিত্তিতে এ বক্তব্য পেশ করা হয়েছে যে, কোন বুদ্ধিমান লোকের জন্য কি এর মধ্যে কোন কসম আছে। মুহাম্মাদ ﷺ যে কথা বলছেন তা জেনে নেবার জন্য কি একজন বুদ্ধি-বিবেকমান ব্যক্তির জন্য এই কসমই যথেষ্ট নয়? সূরার শেষ পর্যন্ত সমগ্র আলোচ্য বিষয় থেকে জানা যায়, আলোচনা চলছিল শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে।

শপথের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম বিষয় হচ্ছে ফজর অর্থাৎ সুবহে-সাদিকের সময়, যা ঊষা নামে খ্যাত। অর্থাৎ যখন রাতের অন্ধকার ভেদ করে দিনের প্রথম আলো পূর্ব দিগন্তে একটি সাদা রেখার মতো আত্মপ্রকাশ করে।

[২] শপথের দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে দশ রাত্রি। ইবনে আববাস (রাঃ), কাতাদা ও মুজাহিদ প্রমুখ তাফসীরবিদের মতে এতে যিলহজ্জ মাসের দশ দিন বুঝানো হয়েছে। যা সর্বোত্তম দিন বলে বিভিন্ন হাদীসে স্বীকৃত।

[৩] এ দুটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যথাক্রমে- জোড় ও বিজোড়। এই জোড় ও বিজোড় বলে আসলে কী বুঝানো হয়েছে, এ ব্যাপারে জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, বেজোড় এর অর্থ আরাফা দিবস (যিলহজ্জের নবম তারিখ) এবং জোড় এর অর্থ ইয়াওমুন নাহার (যিলহজ্জের দশম তারিখ)’’। (মুসনাদে আহমাদ : ৩/৩২৭) কোন কোন তাফসীরবিদ বলেন, জোড় বলে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ বুঝানো হয়েছে। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর বিপরীতে বিজোড় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সত্তা।

[৪] يَسْرِي অর্থ রাত্রিতে চলা। অর্থাৎ রাত্রির শপথ, যখন সে চলতে থাকে তথা খতম হতে থাকে।

[৫] উপরোক্ত পাঁচটি শপথ উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা‘আলা গাফেল মানুষকে চিন্তাভাবনা করার জন্য বলেছেন, ‘‘এতে কি বিবেকবানরা শপথ নেয়ার মতো গুরুত্ব খুঁজে পায়? মূলতঃ حِجْرٌ এর শাব্দিক অর্থ বাধা দেয়া। মানুষের বিবেক মানুষকে মন্দ ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে বাধা দান করে। তাই حِجْرٌ এর অর্থ বিবেকও হয়ে থাকে। এখানে তাই বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ এই যে, বিবেকবানের জন্য এসব শপথও যথেষ্ট কিনা? এই প্রশ্ন প্রকৃতপক্ষে মানুষকে গাফলতি থেকে জাগ্রত করার একটি কৌশল।

[৬] আদ ও সামূদ জাতিদ্বয়ের বংশতালিকা উপরের দিকে ইরামে গিয়ে এক হয়ে যায়। তাই আয়াতে বর্ণিত ইরাম শব্দটি আদ ও সামূদ উভয়ের বেলায় প্রযোজ্য। এখানে ইরাম শব্দ ব্যবহার করে আদ গোত্রের পূর্ববর্তী বংশধর তথা প্রথম আদকে নির্দিষ্ট করা হয়ছে।

এখানে তাদের বিশেষণে বলা হয়েছে, ذَاتُ الْعِمَادِ । মূলত عِمَادٌ শব্দের অর্থ স্তম্ভ। দুনিয়ায় তারাই সর্বপ্রথম উঁচু উঁচু স্তম্ভের উপর ইমারাত নির্মাণ করার কাজ শুরু করে। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘‘আর তারা পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করত নিরাপদে বসবাসের জন্য।’’ (সূরা হিজর : ৮২)

[৭] অর্থাৎ আদ জাতি দৈহিক গঠন ও শক্তি-সাহসে অন্যসব জাতি থেকে স্বতন্ত্র ছিল। কুরআনের অন্য স্থানে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে তোমাদের অবয়বকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন। (সূরা আরাফ : ৬৯)

[৮] উপত্যকা বলতে ‘আল কুরা’ উপত্যকা বুঝানো হয়েছে। সামূদ জাতির লোকেরা সেখানে পাথর কেটে কেটে তার মধ্যে এভাবে ইমারত নির্মাণের রীতি প্রচলন করেছিল।

[৯] أَوْتَادٌ শব্দটি وَتَدٌ এর বহুচন। এর অর্থ কীলক। ফিরাউনকে কীলকওয়ালা বলার বিভিন্ন কারণ তাফসীরবিদগণ বর্ণনা করেছেন। কারো কারো মতে এর দ্বারা যুলুম নিপীড়ন বুঝানোই উদ্দেশ্য। কারণ ফিরাউন যার উপর ক্রোধান্বিত হত, তার হাত-পা চারটি পেরেকে বেঁধে অথবা চার হাত-পায়ে পেরেক মেরে রৌদ্রে শুইয়ে রাখত অথবা কোন গাছের সাথে পেরেক মেরে রাখত। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেন, এখানে তার সেনাবাহিনীকেই কীলকের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং সেই অর্থে কীলকধারী মানে সেনাবাহিনীর অধিকারী। কারো কারো মতে, এর দ্বারা ফিরাউনের প্রাসাদ-অট্টালিকা বুঝানো হয়েছে। এসবের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। ফিরাউন মূলত এসবেরই অধিকারী ছিল।

[১০] অর্থাৎ এ দুনিয়াতে তোমরা যা কিছু করছ, তার শাস্তি ও প্রতিদান অপরিহার্য ও নিশ্চিত। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম ও গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন এবং সবাইকে প্রতিদান ও শাস্তি দেবেন।

আয়াত : ১৫-২০

فَاَمَّا الْاِنْسَانُ اِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهٗ فَاَكْرَمَهٗ وَنَعَّمَهٗ فَيَقُوْلُ رَبِّيْۤ اَكْرَمَنِ (১৫) وَاَمَّاۤ اِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهٗ فَيَقُوْلُ رَبِّيْۤ اَهَانَنِ (১৬) كَلَّا بَلْ لَّا تُكْرِمُوْنَ الْيَتِيْمَ (১৭) وَلَا تَحَآضُّوْنَ عَلٰى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ (১৮) وَتَأْكُلُوْنَ التُّرَاثَ اَكْلًا لَّمًّا (১৯) وَتُحِبُّوْنَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّا (২০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১৫) فَاَمَّا الْاِنْسَانُ মানুষ এরূপ যে, اِذَا যখন مَا ابْتَلَاهُ তাকে পরীক্ষা করেন رَبُّهٗ তার পালনকর্তা, فَاَكْرَمَهٗ অতঃপর তাকে সম্মান দান করেন وَنَعَّمَهٗ এবং তাকে অনুগ্রহ দান করেন, فَيَقُوْلُ তখন সে বলে, رَبِّيْ আমার পালনকর্তা اَكْرَمَنِ আমাকে সম্মান দান করেছেন। (১৬) اِذَا وَاَمَّا আর যখন مَا ابْتَلَاهُ তাকে পরীক্ষা করেন فَقَدَرَ অতঃপর সংকুচিত করে দেন عَلَيْهِ তার উপর رِزْقَهٗ তার রিযিক, فَيَقُوْلُ তখন সে বলে, رَبِّيْ আমার পালনকর্তা اَهَانَنِ আমাকে হেয় করেছেন। (১৭) كَلَّا কখনো নয় بَلْ বরং لَا تُكْرِمُوْنَ তোমরা সম্মান কর না اَلْيَتِيْمَ এতীমকে। (১৮) وَلَا تَحَآضُّوْنَ এবং একে অপরকে উৎসাহিত কর না عَلٰى طَعَامِ খাদ্যদানে اَلْمِسْكِيْنِ মিসকীনকে। (১৯) وَتَأْكُلُوْنَ এবং তোমরা খেয়ে ফেল اَلتُّرَاثَ মীরাসী ধন-সম্পদ اَكْلًا لَّمًّا সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেল। (২০) وَتُحِبُّوْنَ এবং তোমরা ভালোবাস اَلْمَالَ ধন-সম্পদকে حُبًّا جَمًّا অধিক ভালোবাসা।

সরল অনুবাদ :

(১৫) মানুষ এরূপ যে, যখন তার প্রতিপালক তাকে পরীক্ষা করেন এবং সম্মান ও অনুগ্রহ দান করেন, তখন সে বলে- আমার প্রতিপালক আমাকে সম্মান দান করেছেন।১১ (১৬) আর যখন তাকে পরীক্ষা করেন এবং রিযিক সংকুচিত করে দেন, তখন বলে- আমার প্রতিপালক আমাকে হেয় করেছেন। (১৭) কখনো নয়;১২ বরং১৩ তোমরা এতীমকে সম্মান কর না। (১৮) এবং মিসকীনকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না।১৪ (১৯) উপরন্তু তোমরা মৃতের পরিত্যাজ্য সম্পত্তি সম্পূর্ণরূপে কুক্ষিগত করে ফেল।১৫ (২০) এবং তোমরা ধন-সম্পদকে অত্যাধিক ভালোবাস।১৬

টীকা :

[১১] আল্লাহ তা‘আলা যখন কাউকে জীবনোপকরণে সমৃদ্ধি দান করেন, তখন শয়তান তাকে বিভিন্নভাবে ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত করে। সে মনে করতে থাকে যে, এটা আমার ব্যক্তিগত প্রতিভা, গুণ-গরিমা ও কর্ম প্রচেষ্টারই অবশ্যাম্ভাবী ফলশ্রুতি, যা আমার লাভ করাই সঙ্গত। আমি এর যোগ্য পাত্র। সে আরো মনে করে যে, আমি আল্লাহর কাছেও প্রিয় পাত্র। যদি প্রত্যাখ্যাত হতাম, তবে তিনি আমাকে এসব নিয়ামত দান করতেন না। এমনিভাবে কেউ অভাব-অনটন ও দারিদ্রের সম্মুখীন হলে একে আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দলীল মনে করে।

[১২] পূর্ববর্তী ধারণা খন্ডানোর জন্যই মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলেছেন যে, তোমাদের ধারণাসমূহ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন। দুনিয়াতে জীবনোপকরণের স্বাচ্ছন্দ যেরকমভাবে সৎ ও আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার আলামত নয়, তেমনি অভাব-অনটন ও দারিদ্র প্রত্যাখ্যাত ও লাঞ্ছিত হওয়ার দলীল নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে থাকে। কারণ কোন কোন নবী-রাসূল কঠিন কষ্ট ভোগ করেছেন, আবার কোন কোন আল্লাহদ্রোহী আরাম-আয়েশে জীবন অতিবাহিত করে দিয়েছে।

[১৩] এখানে কাফির ও তাদের অনুসারী ফাসিকদের কয়েকটি মন্দ অভ্যাস সম্পর্কে সাবধান করা হচ্ছে। প্রথমেই বলা হয়েছে যে, তোমরা এতীমকে সম্মান করো না। এখানে আসলে বলার উদ্দেশ্য, তোমরা এতীমদের প্রাপ্য আদায় করো না এবং তাদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার গ্রহণ করো না।

[১৪] এখানে তাদের দ্বিতীয় মন্দ অভ্যাস বর্ণনা করা হয়েছে যে, তোমরা নিজেরা তো গরীব-মিসকীনকে খাবার দাও না, উপরন্তু অপরকেও এ কাজে উৎসাহিত কর না।

[১৫] এখানে তাদের তৃতীয় মন্দ অভ্যাস বর্ণনা করা হয়েছে যে, তোমরা হালাল ও হারাম সব রকম ওয়ারিশী সম্পদ একত্রিত করে খেয়ে ফেল।

[১৬] এখানে চতুর্থ মন্দ অভ্যাস বর্ণনা করা হয়েছে যে, তোমরা ধন-সম্পদকে অত্যাধিক ভালোবাস।

আয়াত : ২১-৩০

كَلَّاۤ اِذَا دُكَّتِ الْاَرْضُ دَكًّا دَكًّا (২১) وَجَآءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا (২২) وَجِيْۤٓءَ يَوْمَئِذٍ ۢبِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَّتَذَكَّرُ الْاِنْسَانُ وَاَنّٰى لَهُ الذِّكْرٰى (২৩) يَقُوْلُ يَا لَيْتَنِيْ قَدَّمْتُ لِحَيَاتِيْ (২৪) فَيَوْمَئِذٍ لَّا يُعَذِّبُ عَذَابَهٗۤ اَحَدٌ (২৫) وَلَا يُوْثِقُ وَثَاقَهٗۤ اَحَدٌ (২৬) يَاۤ اَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ (২৭) اِرْجِعِيْۤ اِلٰى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً (২৮) فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ (২৯) وَادْخُلِيْ جَنَّتِيْ (৩০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(২১) كَلَّا কখনো নয় اِذَا যখন دُكَّتْ চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে اَلْاَرْضُ পৃথিবী دَكًّا دَكًّا চূর্ণ-বিচূর্ণের মতো (২২) وَجَآءَ এবং উপস্থিত হবেন رَبُّكَ আপনার পালনকর্তা وَالْمَلَكُ ও ফেরেশতাগণ صَفًّا صَفًّا সারিবদ্ধভাবে, (২৩) وَجِيْٓءَ এবং আনা হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন بِجَهَنَّمَ জাহান্নামকে, يَوْمَئِذٍ আর সেদিন يَتَذَكَّرُ বুঝতে পারবে اَلْاِنْسَانُ মানুষ, وَاَنّٰى কিন্তু কী (লাভ) হবে لَهُ তার জন্য اَلذِّكْرٰى বুঝতে পারায়? (২৪) يَقُوْلُ সে বলবে يَا لَيْتَنِيْ হায়! قَدَّمْتُ আমি যদি কিছু অগ্রীম পাঠাতাম لِحَيَاتِيْ আমার এ জীবনের জন্যে! (২৫) فَيَوْمَئِذٍ অতঃপর সেদিন لَا يُعَذِّبُ আযাব দিতে পারবে না عَذَابَهٗ তাঁর (আল্লাহ্র) আযাবের মত اَحَدٌ কেউই, (২৬) وَلَا يُوْثِقُ এবং বাঁধতে পারবে না وَثَاقَهٗ তাঁর বন্ধনের মত اَحَدٌ কেউই। (২৭) يَاۤ اَيَّتُهَا হে اَلنَّفْسُ আত্মা اَلْمُطْمَئِنَّةُ প্রশান্ত! (২৮) اِرْجِعِيْ তুমি ফিরে এসো اِلٰى رَبِّكِ তোমার প্রতিপালকের নিকট رَاضِيَةً সন্তুষ্ট مَرْضِيَّةً ও প্রিয়পাত্র হয়ে। (২৯) فَادْخُلِيْ অতএব তুমি প্রবেশ করো فِيْ عِبَادِيْ আমার বান্দাদের মধ্যে, (৩০) وَادْخُلِيْ এবং তুমি প্রবেশ করো جَنَّتِيْ আমার জান্নাতে।

সরল অনুবাদ :

(২১) কখনো নয়;১৭ যখন পৃথিবী চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে,১৮ (২২) এবং আপনার প্রতিপালক ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবেন,১৯ (২৩) আর যেদিন জাহান্নামকে আনা হবে,২০ সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু এই স্মরণ তার কী কাজে আসবে?২১ (২৪) সে বলবে, হায়! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রীম পাঠাতাম! (২৫) সেদিন তাঁর (আল্লাহ্র) আযাবের মত আযাব কেউ দিতে পারবে না, (২৬) এবং তাঁর বন্ধনের মত বন্ধনও কেউ করতে পারবে না। (২৭) হে প্রশান্ত আত্মা! (২৮) তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও প্রিয়পাত্র হয়ে।২২ (২৯) আর তুমি আমার বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হও,২৩ (৩০) এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।

টীকা :

[১৭] অর্থাৎ তোমাদের কাজ এরকম হওয়া উচিত নয়।

[১৮] কাফিরদের মন্দ অভ্যাসসমূহ বর্ণনার পর আবার আখেরাতের আলোচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, যখন ভূ-কম্পন শুরু হয়ে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে; তখন কার কী অবস্থা হবে একটু চিন্তা করা দরকার।

[১৯] আয়াতে বলা হয়েছে وَجَاءَ رَبُّكَ এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে, ‘‘আপনার রব আসবেন’’। এখানে হাশরের মাঠে আল্লাহর আগমনকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। তিনি অবশ্যই হাশরের মাঠে বিচার ফায়সালা করার জন্য স্বয়ং আসবেন। যেভাবে আসা তাঁর জন্য উপযুক্ত তিনি সেভাবে আসবেন। এই আগমনের অর্থ আমরা বুঝি কিন্তু তিনি কিভাবে আগমন করবেন তা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না।

[২০] অর্থাৎ সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে বা সামনে উপস্থিত করা হবে। হাদীসে এসেছে, জাহান্নামকে ফেরেশতারা টেনে নিয়ে আসবে, সেদিন জাহান্নামের হাজার লাগাম হবে, প্রতি লাগামে সত্তর হাজার ফেরেশতা থাকবে।

(সহীহ মুসলিম, হা/২৮৪২; তিরমিযী, হা/২৫৭৩)

[২১] يَتَذَكَّرُ এর অর্থ এখানে বুঝে আসা। সুতরাং সেদিন মানুষ সচেতন হবে। সে উপদেশ গ্রহণ করবে। সে বুঝতে পারবে, নবীগণ তাকে যা কিছু বলেছিলেন তাই ছিল সঠিক এবং তাদের কথা না মেনে সে বোকামি করেছে। কিন্তু সে সময় সচেতন হওয়া, উপদেশ গ্রহণ করা এবং নিজের ভুল বুঝতে পারায় কী লাভ?।

অথবা يَتَذَكَّرُ অর্থ স্মরণ করা। অর্থাৎ সেদিন মানুষ দুনিয়ায় যা কিছু করে এসেছে তা স্মরণ করবে এবং সেজন্য লজ্জিত হবে। কিন্তু তখন স্মরণ করায় এবং লজ্জিত হওয়ায় কোন লাভ হবে না।

[২২] এখানে মুমিনদের রূহকে ‘আন-নাফসুল মুতমায়িন্নাহ’ বা প্রশান্ত আত্মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ এ আত্মা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রতি সন্তুষ্ট। কেননা বান্দার সন্তুষ্টির দ্বারাই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট। আল্লাহ বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট না হলে বান্দা আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট হওয়ার তাওফীকই পায় না।

এখন প্রশ্ন হলো, এ কথা তাকে কখন বলা হবে? বলা হয় মৃত্যুকালে বলা হবে; অথবা সে সময়ও বলা হবে এবং আল্লাহর আদালতে পেশ করার সময়ও তাকে এ কথা বলা হবে। প্রতিটি পর্যায়ে তাকে এই কর্মে নিশ্চয়তা দান করা হবে যে, সে আল্লাহর রহমতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

[২৩] প্রশান্ত আত্মাকে সম্বোধন করে বলা হবে, আমার বিশেষ বান্দাদের কাতারভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। এ আদেশ হতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, জান্নাতে প্রবেশ করা নেককার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপর নির্ভরশীল। তাদের সাথেই জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে। এ কারণেই সুলাইমান (আঃ) দু‘আ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘আপনার অনুগ্রহে আমাকে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শামিল করুন’’- (সূরা নামল : ১৯)।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।

যারা দুনিয়ায় ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের পরিণাম অতি মারাত্মক হবে।

প্রত্যেক ব্যক্তির যাবতীয় হিসাব মহান আল্লাহ সংরক্ষণ করছেন; সে আলোকে আখেরাতে তাকে প্রতিফল দেয়া হবে।

ধনসম্পদের মোহ মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

এতীমদের সম্মান করা ও ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দেয়া আবশ্যক।

অন্যের হক্ব আত্মসাৎ করা অতি ঘৃণিত অপরাধ।

যারা আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত আছে, তারা কিয়ামতের দিন কঠিন আফসোস করবে।

প্রশান্ত ও নেক আত্মার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সুখবর রয়েছে।

১৫
৯০- সূরা বালাদ
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতের أَلْبَلَدُ (আল-বালাদ) শব্দের আলোকে এর নাম রাখা হয়েছে সূরা বালাদ। এর অর্থ শহর, দেশ।

নাযিলের সময়কাল :

এ সূরাটি এমন এক সময় নাযিল হয়েছিল, যখন মক্কার কাফিররা নবী ﷺ এর বিরোধিতায় উঠেপড়ে লেগেছিল এবং তাঁর উপর সব রকমের জুলুম নিপীড়ন চালাচ্ছিল।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে, দুনিয়ায় মানুষের সঠিক অবস্থান, মর্যাদা ও ভূমিকা বুঝিয়ে দেয়া। মানুষকে এ কথা জানিয়ে দেয়া যে, আল্লাহ মানুষের জন্য সৌভাগ্যের ও দুর্ভাগ্যের উভয় পথই খুলে রেখেছেন, সেগুলো দেখার ও সেগুলোর উপর দিয়ে চলার যাবতীয় উপকরণও তাদেরকে সরবরাহ করেছেন। এখন মানুষ সৌভাগ্যের পথে চলে শুভ পরিণতি লাভ করবে নাকি দুর্ভাগ্যের পথে চলে অশুভ পরিণতির মুখোমুখি হবে, এটি তার নিজের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে।

এই দুনিয়াটা মানুষের জন্য কোন আরাম আয়েশের জায়গা নয়। এখানে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে আনন্দ উল্লাস করার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়নি। বরং এখানে কষ্টের মধ্যেই তার জন্ম হয়েছে।

এরপর যারা এ ভুল ধারণা করে যে, মানুষই এখানেই সবকিছু, তার উপর কোন উচ্চতর ক্ষমতা নেই যে, তার কাজের যথাযথ হিসেব নেবে, তাদের এই ভুল ধারণা দূর করে দেয়া হয়েছে।

তারপর মানুষের বহু জাহেলী নৈতিক চিন্তাধারার মধ্য থেকে এটিকে দৃষ্টান্তস্বরূপ গ্রহণ করে দুনিয়ায় সে অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্বের যেসব ভুল মানদন্ডের প্রচলন করে রেখেছে তা তুলে ধরা হয়েছে।

এরপর মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি মানুষকে জ্ঞানের বিভিন্ন উপকরণ এবং চিন্তা ও উপলব্ধির যোগ্যতা দিয়ে তার সামনে ভালো ও মন্দ দুটি পথই উন্মুক্ত করে দিয়েছি। একটি পথ মানুষকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে নিয়ে যায়। এ পথে চলার জন্য কোন কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। দ্বিতীয় পথটি মানুষকে নৈতিক উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। এটি একটি দুর্গম গিরিপথের মতো।

আয়াত : ১-১০



لَاۤ اُقْسِمُ بِهٰذَا الْبَلَدِ (১) وَاَنْتَ حِلٌّ ۢبِهٰذَا الْبَلَدِ (২) وَوَالِدٍ وَّمَا وَلَدَ (৩) لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِيْ كَبَدٍ (৪) اَيَحْسَبُ اَنْ لَّنْ يَّقْدِرَ عَلَيْهِ اَحَدٌ (৫) يَقُوْلُ اَهْلَكْتُ مَالًا لُّبَدًا (৬) اَيَحْسَبُ اَنْ لَّمْ يَرَهٗۤ اَحَدٌ (৭) اَلَمْ نَجْعَلْ لَّهٗ عَيْنَيْنِ (৮) وَلِسَانًا وَّشَفَتَيْنِ (৯) وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ (১০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) لَا না - اُقْسِمُ আমি শপথ করছি بِهٰذَا এই اَلْبَلَدِ নগরীর, (২) وَاَنْتَ আর তুমি حِلٌّ হালালকারী بِهٰذَا এই اَلْبَلَدِ নগরীর। (৩) وَوَالِدٍ শপথ পিতার وَمَا وَلَدَ আর যা সে জন্ম দিয়েছে তার। (৪) لَقَدْ خَلَقْنَا অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি اَلْاِنْسَانَ মানুষকে فِيْ كَبَدٍ কষ্টের মধ্যে। (৫) اَيَحْسَبُ সে কি মনে করে اَنْ যে, لَنْ يَّقْدِرَ কখনো ক্ষমতাবান হবে না عَلَيْهِ তার উপর اَحَدٌ কেউ? (৬) يَقُوْلُ সে বলে اَهْلَكْتُ আমি নষ্ট করেছি مَالًا সম্পদ لُبَدًا অনেক। (৭) اَيَحْسَبُ সে কি ধারণা করে اَنْ যে, لَمْ يَرَهٗ তাকে দেখছে না اَحَدٌ কেউই? (৮) اَلَمْ نَجْعَلْ আমি কি বানাইনি لَهٗ তার জন্যে عَيْنَيْنِ দু’টি চোখ? (৯) وَلِسَانًا আর একটি জি‎হবা وَشَفَتَيْنِ ও দু‘টি ঠোট? (১০) وَهَدَيْنَاهُ এবং আমি তাকে দেখিয়েছি اَلنَّجْدَيْنِ দু’টি পথ।

সরল অনুবাদ :

(১) না,১ আমি শপথ করছি এই (মক্কা) নগরীর,২ (২) আর তুমি এই নগরীর হালালকারী।৩ (৩) শপথ পিতার এবং যা সে জন্ম দিয়েছে তার।৪ (৪) অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্টের মধ্যে।৫ (৫) সে কি মনে করে যে, কখনো তার উপর কেউ ক্ষমতাবান হবে না? (৬) সে বলে, আমি অনেক ধন-সম্পদ নষ্ট করেছি।৬ (৭) সে কি ধারণা করে যে, তাকে কেউই দেখছে না? (৮) আমি কি তার জন্য দু’টি চোখ বানাইনি? (৯) আর একটি জিহবা ও দুটি ঠোঁট? (১০) আর আমি তাকে দেখিয়েছি৭ দু’টি পথ৮।

টীকা :

[১] এ সূরার প্রথমেই বলা হয়েছে لَا ; কিন্তু এখানে لَا শব্দটি কি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে। এখানে لَا শব্দটি অতিরিক্ত এবং আরবী বাকপদ্ধতিতে এর অতিরিক্ত ব্যবহার সুবিদিত। তবে বিশুদ্ধ উক্তি এই যে, প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত ধারণা খন্ডন করার জন্য এই لَا শব্দটি শপথ বাক্যের শুরুতে ব্যবহৃত হয়। উদ্দেশ্য এই যে, এটা কেবল আপনার ধারণা নয়; বরং আমি শপথ সহকারে যা বলছি, তাই বাস্তব সত্য।

[২] اَلْبَلَدُ বা নগরী বলে এখানে মক্কা নগরীকে বুঝানো হয়েছে। সূরা তীনে এমনিভাবে মক্কা নগরীর শপথ করা হয়েছে এবং সেই সাথে أَمِيْنٌ বিশেষণও উল্লেখ করা হয়েছে।

[৩] حِلٌّ শব্দের দুটি অর্থ হতে পারে। এটা حُلُوْلٌ থেকে উদ্ভূত। অর্থ কোন কিছুতে অবস্থান নেয়া, থাকা ও অবতরণ করা। সে হিসেবে আয়াতের মর্মার্থ এই যে, মক্কা নগরী নিজেও সম্মানিত ও পবিত্র, বিশেষত আপনিও এ নগরীতে বসবাস করেন। বসবাসকারীর শ্রেষ্ঠত্বের দরুন বাসস্থানের শ্রেষ্ঠত্ব বেড়ে যায়। কাজেই আপনার বসবাসের কারণে এ নগরীর মাহাত্ম ও সম্মান দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অপর অর্থ এই যে, আপনার জন্য হারামে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হালাল করে দেয়া হবে। বস্তুত মক্কা বিজয়ের সময় একদিনের জন্যই তাই করা হয়েছিল। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা বিজয়ের দিন মাথায় শিরস্ত্রাণ পরিধান করে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তারপর যখন তিনি তা খুললেন, এক লোক এসে তাকে বলল যে, ইবনে খাত্তাল কাবার পর্দা ধরে আছে। তিনি বললেন, তাকে হত্যা কর। কারণ, পূর্ব থেকেই রাসূল ﷺ তার মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

(সহীহ বুখারী, হা/১৮৪৬; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫০)

[৪] যেহেতু বাপ ও তার ঔরসে জন্ম গ্রহণকারী সন্তানদের ব্যাপারে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সামনের দিকে মানুষের কথা বলা হয়েছে, তাই বাপ মানে আদম (আঃ)-ই হতে পারেন। আর তাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণকারী সন্তান বলতে দুনিয়ার সব মানুষকে বুঝানো হয়েছে। এভাবে এতে আদম ও দুনিয়ার আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সব বনী আদমের শপথ করা হয়েছে।

[৫] كَبَدٌ এর শাব্দিক অর্থ শ্রম ও কষ্ট। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টিগতভাবে আজীবন শ্রম ও কষ্টের মধ্যে থাকে। (ইবনে কাসীর; ফাতহুল কাদীর)

[৬] সে বলে, আমি প্রচুর ধন-সম্পদ উড়িয়ে দিয়েছি। এই শব্দগুলোই প্রকাশ করে, বক্তা তার ধনসম্পদের প্রাচুর্যে কী পরিমাণ গর্বিত। যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ সে খরচ করেছে নিজের সামগ্রিক সম্পদের তুলনায় তার কাছে তার পরিমাণ এত সামান্য ছিল যে, তা উড়িয়ে বা ফুঁকিয়ে দেবার কোন পরোয়াই সে করেনি। আর এই সম্পদ সে কোন কাজে উড়িয়েছে? কোন প্রকৃত নেকীর কাজে নয়, যেমন সামনের আয়াতগুলো থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। বরং এই সম্পদ সে উড়িয়েছে নিজের ধনাঢ্যতার প্রদর্শনী এবং নিজের অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য।

[৭] অর্থাৎ ভাল ও মন্দ দুটি পথের দিশাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে দিয়েছেন। শুধুমাত্র বুদ্ধি ও চিন্তার শক্তি দান করে তাকে নিজের পথ নিজে খুঁজে নেবার জন্য ছেড়ে দেননি। বরং তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। তার সামনে ভালো ও মন্দ এবং নেকী ও গোনাহের দুটি পথ সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তার মধ্য হতে নিজ দায়িত্বে যে পথটি ইচ্ছা সে গ্রহণ করতে পারে। কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে। ‘‘আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, চাইলে সে শোকরকারী হতে পারে বা কুফরকারীও হতে পারে। (সূরা দাহর : ২-৩)

[৮] نَجْدَيْنِ শব্দটি نَجْدٌ এর দ্বিবচন। এর শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগামী পথ। এখানে প্রকাশ্য পথ বুঝানো হয়েছে। এ পথ দুটির একটি হচ্ছে সৌভাগ্য ও সাফল্যের পথ এবং অপরটি হচ্ছে অনিষ্ট ও ধ্বংসের পথ। এ পথ দুটির একটি গেছে উপরের দিকে। কিন্তু সেখানে যেতে হলে খুব কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়। সে পথটি বড়ই দুর্গম। সে পথে যেতে হলে মানুষকে নিজের প্রবৃত্তি ও তার আকাঙ্ক্ষা এবং শয়তানের প্ররোচনার সাথে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়। আর দ্বিতীয় পথটি বড়ই সহজ। এটি খাদের মধ্যে নেমে গেছে। এই পথ দিয়ে নীচের দিকে নেমে যাবার জন্য কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। মানুষ আপনা আপনি গড়িয়ে যেতে থাকে।

আয়াত : ১১-২০

فَلَا اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ (১১) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ (১২) فَكُّ رَقَبَةٍ (১৩) اَوْ اِطْعَامٌ فِيْ يَوْمٍ ذِيْ مَسْغَبَةٍ (১৪) يَتِيْمًا ذَا مَقْرَبَةٍ (১৫) اَوْ مِسْكِيْنًا ذَا مَتْرَبَةٍ (১৬) ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ (১৭) اُولٰٓئِكَ اَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ (১৮) وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِاٰيَاتِنَا هُمْ اَصْحَابُ الْمَشْاَمَةِ (১৯) عَلَيْهِمْ نَارٌ مُّؤْصَدَةٌ (২০)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১১) فَلَا اقْتَحَمَ কিন্তু সেতো অতিক্রম করেনি اَلْعَقَبَةَ বন্ধুর গিরিপথটি। (১২) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জান যে, مَا الْعَقَبَةُ বন্ধুর গিরিপথটি কী? (১৩) فَكُّ মুক্ত করা رَقَبَةٍ দাসকে; (১৪) اَوْ অথবা اِطْعَامٌ খাদ্যদান فِيْ يَوْمٍ ذِيْ مَسْغَبَةٍ দুর্ভিক্ষের দিনে; (১৫) يَتِيْمًا কোন এতীম, ذَا مَقْرَبَةٍ আত্মীয়কে, (১৬) اَوْ অথবা مِسْكِيْنًا দরিদ্রকে ذَا مَتْرَبَةٍ ধূলায় লুণ্ঠিত, (১৭) ثُمَّ তারপর كَانَ হওয়া مِنَ الَّذِيْنَ তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা اٰمَنُوْا ঈমান এনেছে وَتَوَاصَوْا এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় بِالصَّبْرِ ধৈর্যধারণের وَتَوَاصَوْا আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় بِالْمَرْحَمَةِ করুণার; (১৮) اُولٰٓئِكَ এরাই اَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ ডান হাতওয়ালা। (১৯) وَالَّذِيْنَ আর যারা كَفَرُوْا অস্বীকার করেছে بِاٰيَاتِنَا আমার নিদর্শনসমূহ, هُمْ তারাই اَصْحَابُ الْمَشْاَمَةِ বাম হাতওয়ালা। (২০) عَلَيْهِمْ তাদের উপরই (ছেয়ে) থাকবে نَارٌ অগ্নি مُؤْصَدَةٌ অবরুদ্ধ।

সরল অনুবাদ :

(১১) কিন্তু সে তো বন্ধুর গিরিপথে৯ প্রবেশ করলো না। (১২) তুমি কি জান যে, বন্ধুর গিরিপথটি কী? (১৩) এটা হচ্ছে, কোন দাসকে মুক্ত করা;১০ (১৪) অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য দান করা;১১ (১৫) কোন এতীম আত্মীয়-স্বজনকে,১২ (১৬) অথবা ধূলায় লুণ্ঠিত নিঃস্ব মিসকীনকে, (১৭) তারপর তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান এনেছে এবং যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য্যধারণের ও দয়া করুণার;১৩ (১৮) এরাই ডান হাতওয়ালা। (১৯) আর যারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করেছে, তারাই বাম হাতওয়ালা। (২০) তাদের উপরই ছেয়ে থাকবে অবরুদ্ধ অগ্নি।

টীকা :

[৯] عَقَبَةٌ বলা হয় পাহাড়ের বিরাট প্রস্তরখন্ডকে এবং দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী গিরিপথকে।

[১০] এসব সৎকর্মের মধ্যে প্রথমে দাসমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এটা খুবই বড় ইবাদাত। বিভিন্ন হাদীসে এর অনেক সওয়াবের কথা উল্লেখ আছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘‘যে কেউ কোন দাসকে মুক্ত করবে, সেটা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে।’’।

(মুসনাদে আহমাদ : ৪/১৪৭, ১৫০)

[১১] দ্বিতীয় সৎকর্ম হচ্ছে ক্ষুধার্তকে অন্নদান। যে কাউকে অন্নদান করলে তা সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। তাই বলা হয়েছে, বিশেষভাবে যদি আত্মীয় এতীমকে অন্ন দান করা হয়, তবে তাতে দ্বিগুণ সওয়াব হয়। (এক) ক্ষুধার্তের ক্ষুধা দূর করার সওয়াব এবং (দুই) আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ও তার হক আদায় করার সওয়াব।

[১২] এ ধরনের এতীমের হক সবচেয়ে বেশি। একদিকে সে এতীম, দ্বিতীয়ত সে তার নিকটাত্মীয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘‘মিসকীনকে দান করা নিঃসন্দেহে একটি দান। কিন্তু আত্মীয়দের দান করা দুটি সওয়াব। একটি দানের ও অপরটি আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার। (মুসনাদে আহমাদ : ৪/৪১৪; তিরমিযী, হা/৬৫৩)

[১৩] এ আয়াতে ঈমানের পর মুমিনের এই কর্তব্য ব্যক্ত করা হয়েছে যে, সে অন্যান্য মুসলিম ভাইকে সবর ও অনুকম্পার উপদেশ দেবে। সবরের অর্থ নিজেকে মন্দ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সৎকর্ম সম্পাদন করা। مَرْحَمَةٌ এর অর্থ অপরের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া। অপরের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করে তাকে কষ্টদান ও যুলুম করা থেকে বিরত হওয়া। নবী ﷺ নিজের উম্মতের মধ্যে এই রহম ও করুণাবৃত্তিটির মতো উন্নত নৈতিক বৃত্তিটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রসারিত করতে চেয়েছেন। হাদীসে এসেছে, ‘‘যে মানুষের প্রতি রহমত করে না আল্লাহ তার প্রতি রহমত করেন না।’’ (সহীহ বুখারী, হা/৭৩৭৬; সহীহ মুসলিম, হা/৩১৯)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

দুনিয়া পরিশ্রমের স্থান; এখানে নেক আমল করেই মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে অর্থ ব্যয় বড়ই ন্যাক্কারজনক কাজ।

এতীম ও অসহায়দের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানো সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

১৬
৯১- সূরা শামস
সূরার নামকরণ :

সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلشَّمْسُ এর আলোকে এর নামকরণ হয়েছে সূরা আশ-শামস। এর অর্থ সূর্য।

নাযিলের সময়কাল :

বিষয়বস্তু থেকে জানা যায় যে, এ সূরাটিও মক্কায় প্রথম যুগে নাযিল হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে, সৎ ও অসৎ, নেকী ও গোনাহের পার্থক্য বুঝানো এবং যারা এই পার্থক্য বুঝতে অস্বীকার করে আর গোনাহের পথে চলার উপরই জোর দেয় তাদেরকে খারাপ পরিণতির ভয় দেখানো।

প্রথম অংশে বুঝানো হয়েছে। সূর্য ও চন্দ্র, দিন ও রাত, পৃথিবী ও আকাশ যেমন পরস্পর থেকে ভিন্ন এবং প্রভাব ও ফলাফলের দিক দিয়ে পরস্পর বিরোধী, ঠিক তেমনি সৎ ও অসৎ এবং নেকী ও গোনাহও পরস্পর ভিন্ন এবং প্রভাব ও ফলাফলের দিক দিয়েও পরস্পর বিরোধী। মহান আল্লাহ মানবাত্মাকে দেহ, ইন্দ্রীয় ও বুদ্ধি-শক্তি দিয়ে দুনিয়ায় একেবারে চেতনাহীনভাবে ছেড়ে দেননি; বরং একটি প্রাকৃতিক চেতনার মাধ্যমে তার অচেতন মনে নেকী ও গোনাহের পার্থক্য, ভালো ও মন্দের প্রভেদ এবং ভালোর ভালো হওয়া ও মন্দের মন্দ হওয়ার বোধশক্তি সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

যদি সে সৎ প্রবণতায় উদ্দীপিত হয় এবং অসৎ প্রবণতাসমূহ থেকে নিজের নফসকে পবিত্র করে, তাহলে সে সাফল্য লাভ করবে। বিপরীতপক্ষে যদি সে নফসের সৎপ্রবণতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে থাকে এবং অসৎ প্রবণতাকে উদ্দীপিত করতে থাকে তাহলে সে ব্যর্থ হবে।

দ্বিতীয় অংশে সামূদ জাতির ঐতিহাসিক নজীর পেশ করে রিসালাতের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ দুনিয়ায় অনেক নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। একজন নবী ছিলেন সালেহ (আঃ)। তাঁকে সামূদ জাতির কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সামূদ জাতি তাকে অমান্য করেছিল। এর ফলে শেষ পর্যন্ত সমগ্র জাতি ধ্বংস হয়ে গেল।

আয়াত : ১-১৫



وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا (১) وَالْقَمَرِ اِذَا تَلَاهَا (২) وَالنَّهَارِ اِذَا جَلَّاهَا (৩) وَاللَّيْلِ اِذَا يَغْشَاهَا (৪) وَالسَّمَآءِ وَمَا بَنَاهَا (৫) وَالْاَرْضِ وَمَا طَحَاهَا (৬) وَنَفْسٍ وَّمَا سَوَّاهَا (৭) فَاَلْهَمَهَا فُجُوْرَهَا وَتَقْوَاهَا (৮) قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا (৯) وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا (১০) كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ بِطَغْوَاهَا (১১) اِذِ انْۢبَعَثَ اَشْقَاهَا (১২) فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ نَاقَةَ اللهِ وَسُقْيَاهَا (১৩) فَكَذَّبُوْهُ فَعَقَرُوْهَا فَدَمْدَمَ عَلَيْهِمْ رَبُّهُمْ بِذَنْۢبِهِمْ فَسَوَّاهَا (১৪) وَلَا يَخَافُ عُقْبَاهَا (১৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالشَّمْسِ শপথ সূর্যের وَضُحَاهَا ও তার কিরণের, (২) وَالْقَمَرِ শপথ চন্দ্রের اِذَا যখন تَلَاهَا তা তার পশ্চাতে আসে, (৩) وَالنَّهَارِ শপথ দিবসের اِذَا যখন جَلَّاهَا সে তাকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে, (৪) وَاللَّيْلِ শপথ রাত্রির اِذَا যখন يَغْشَاهَا সে তাকে আচ্ছাদিত করে, (৫) وَالسَّمَآءِ শপথ আকাশের وَمَا بَنَاهَا এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন তাঁর। (৬) وَالْاَرْضِ শপথ পৃথিবীর وَمَا طَحَاهَا এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন তাঁর (৭) وَنَفْسٍ শপথ প্রাণের وَمَا سَوَّاهَا এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর (৮) فَاَلْهَمَهَا অতঃপর তাকে জ্ঞান দান করেছেন فُجُوْرَهَا তার অসৎকর্ম وَتَقْوَاهَا ও সৎকর্মের, (৯) قَدْ اَفْلَحَ সেই সফলকাম হয় مَنْ যে ব্যক্তি زَكَّاهَا নিজেকে পরিশুদ্ধ করে। (১০) وَقَدْ خَابَ এবং সে ব্যর্থ হয় مَنْ যে ব্যক্তি دَسَّاهَا নিজেকে কলুষিত করে। (১১) كَذَّبَتْ মিথ্যারোপ করেছিল ثَمُوْدُ সামূদ সম্প্রদায় بِطَغْوَاهَا অবাধ্যতাবশত (১২) اِذْ যখন اِنْۢبَعَثَ তৎপর হয়ে উঠেছিল اَشْقَاهَا তাদের সর্বাধিক হতভাগ্য ব্যক্তি, (১৩) فَقَالَ অতঃপর বলেছিলেন لَهُمْ তাদেরকে رَسُوْلُ اللهِ আল্লাহর রাসূল نَاقَةَ اللهِ (এটা) আল্লাহর উষ্ট্রী وَسُقْيَاهَا তাকে পানি পান করানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকো। (১৪) فَكَذَّبُوْهُ অতঃপর ওরা তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল فَعَقَرُوْهَا এবং তারা তার পা কর্তন করেছিল। فَدَمْدَمَ অতঃপর সমূলে ধ্বংস করে দিলেন عَلَيْهِمْ তাদেরকে رَبُّهُمْ তাদের প্রতিপালক بِذَنْۢبِهِمْ তাদের পাপের কারণে فَسَوَّاهَا অতঃপর তাদেরকে একাকার করে দিলেন। (১৫) وَلَا يَخَافُ আর তিনি তো আশঙ্কা করেন না عُقْبَاهَا তার পরিণামকে।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ সূর্যের ও তার কিরণের,১ (২) শপথ চন্দ্রের- যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে,২ (৩) শপথ দিবসের- যখন সে সূর্যকে প্রখরভাবে প্রকাশ করে,৩ (৪) শপথ রাত্রির- যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে,৪ (৫) শপথ আকাশের এবং যিনি তা নির্মাণ করেছেন তাঁর।৫ (৬) শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন তাঁর,৬ (৭) শপথ প্রাণের৭ এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর৮ (৮) অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন,৯ (৯) যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। (১০) আর যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ হয়।১০ (১১) সামূদ সম্প্রদায় অবাধ্যতাবশত১১ মিথ্যারোপ করেছিল। (১২) যখন তাদের সর্বাধিক হতভাগ্য ব্যক্তি তৎপর হয়ে উঠেছিল, (১৩) অতঃপর আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বলেছিলেন, (এটা) আল্লাহর উষ্ট্রী! তোমরা তাকে পানি পান করানোর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো।১২ (১৪) অতঃপর ওরা তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল এবং উষ্ট্রীর পা কর্তন করেছিল।১৩ তাদের পাপের কারণে তাদের প্রতিপালক তাদের উপর ধ্বংস নাযিল করে একাকার করে দিলেন।১৪ (১৫) আর তিনি তো তার পরিণামকে ভয় করেন না।১৫

টীকা :

[১] এখানে ضُحٰى শব্দের অর্থ দিনের প্রথমভাগ। এর আরেকটি অর্থ হতে পারে, সূর্যের কিরণ বা আলো।

[২] এর অর্থ এও হতে পারে যে, যখন চন্দ্র সূর্যাস্তের পরপরই উদিত হয়। মাসের মধ্যভাগে এরূপ হয়। তখন চন্দ্র প্রায় পরিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।

[৩] অর্থাৎ শপথ দিবসের, যখন তা সূর্যকে প্রকাশ করে। অথবা যখন তা অন্ধকারকে আলোকিত করে দুনিয়াকে প্রকাশ করে। এর তৃতীয় অর্থ হতে পারে, শপথ সূর্যের, যখন তা পৃথিবীকে প্রকাশিত করে।

[৪] এর অর্থ সূর্যের কিরণকে ঢেকে দেয়। এর আরেকটি অর্থ হলো, শপথ রাত্রির, যখন পৃথিবীকে আচ্ছাদিত করে; শপথ সূর্যের, যখন তা পৃথিবীকে প্রকাশিত করে।

[৫] অর্থাৎ শপথ আকাশের ও যিনি তা নির্মাণ করেছেন তাঁর। এ-অর্থানুসারে مَا কে مَنْ এর অর্থে নিতে হবে। আয়াতের আরেক অর্থ হচ্ছে, শপথ আকাশের এবং তা নির্মাণের। এ অবস্থায় مَا কে مَصْدَرِيَّةٌ এর অর্থে নিতে হবে।

[৬] এর এক অর্থ, শপথ পৃথিবীর এবং যিনি তা বিস্তৃত করেছেন। এর অপর অর্থ হচ্ছে, শপথ পৃথিবীর এবং একে বিস্তৃত করার।

[৭] এখানে মূলে نَفْسٌ শব্দটি বলা হয়েছে। নফস শব্দটি দ্বারা যেকোন প্রাণীর নফস বা আত্মা উদ্দেশ্য হতে পারে, আবার জবাবদিহি করতে বাধ্য মানুষের নফসও উদ্দেশ্য হতে পারে।

[৮] এখানেও দু‘রকম অর্থ হতে পারে। একটি হলো, শপথ নফসের এবং তাঁর, যিনি সেটাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। আরেকটি হলো, শপথ মানুষের প্রাণের এবং তা সুবিন্যস্ত করার। এখানে سَوَّاهَا মানে হচ্ছে, নফসকে তিনি সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্তভাবে তৈরি করেছেন। এছাড়া সুবিন্যস্ত করার মধ্যে এ অর্থও রয়েছে যে, তাকে জন্মগতভাবে সহজ সরল প্রকৃতির উপর সৃষ্টি করেছেন। (ইবনে কাসীর)

[৯] এর অর্থ, আল্লাহ তার নফসের মধ্যে নেকি ও গুনাহ উভয়টি স্পষ্ট করেছেন এবং চিনিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রত্যেক নফসের মধ্যেই ভালো ও মন্দ কাজ করার ক্ষমতা রেখে দিয়েছেন এবং যা তাকদীরে লেখা রয়েছে তা সহজ করে দিয়েছেন। এ কথাটিই অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে, ‘‘আর আমি ভালো ও মন্দ উভয় পথ তার জন্য সুস্পষ্ট করে রেখে দিয়েছি।’’ (সরা বালাদ : ১০) আল্লাহ তা‘আলা মানুষের মধ্যে গোনাহ ও ইবাদাতের যোগ্যতা গচ্ছিত রেখেছেন। কিন্তু তাকে কোন একটি করতে বাধ্য করেননি; বরং তাকে উভয়ের মধ্য থেকে যে কোন একটি করার ক্ষমতা দান করেছেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ দু‘আ করতেন : اَللّٰهُمَّ اٰتِ نَفْسِىْ تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا اَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا اَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে তাক্বওয়ার তাওফীক দান করুন এবং নাফসকে পবিত্র করুন, আপনিই তো উত্তম পবিত্রকারী। আর আপনিই আমার নাফসের অভিভাবক ও মালিক।

(সহীহ মুসলিম, হা/২৭২২)

[১০] পূর্বোক্ত শপথগুলোর জবাবে এ আয়াতগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে زَكَّاهَا শব্দটি تَزْكِيَةٌ থেকে উদগত। এর অর্থ পরিশুদ্ধতা; বৃদ্ধি বা উন্নতি। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নিজের নফস ও প্রবৃত্তিকে দুষ্প্রকৃতি থেকে পাক-পবিত্র করে, তাকে সৎকাজ ও নেকীর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ ও উনণত করে পবিত্রতা অর্জন করে, সে সফলকাম হয়েছে। এর মোকাবেলায় বলা হয়েছে, دَسَّاهَا এর শব্দমূল হচ্ছে تَدْسِيْسٌ । যার মানে হচ্ছে দাবিয়ে দেয়া, লুকিয়ে ফেলা, পথভ্রষ্ট করা। পূর্বাপর সম্পর্কের ভিত্তিতে এর অর্থও এখানে সুস্পষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ সেই ব্যক্তিই ব্যর্থ, যে নিজের নফসকে নেকী ও সৎকর্মের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করার পরিবর্তে দাবিয়ে দেয়, তাকে বিভ্রান্ত করে অসৎপ্রবণতার দিকে নিয়ে যায়।

[১১] অর্থাৎ তারা সালেহ (আঃ) এর নবুওয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সালেহ (আঃ) যে তাকওয়ার দিকে তাদেরকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন তা গ্রহণ করতেও তারা চাইছিল না।

[১২] কুরআন মাজীদের অন্যান্য স্থানে এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সামূদ জাতির লোকেরা সালেহ (আঃ)-কে বলে দিয়েছিল যে, যদি তুমি সত্যবাদী হও তাহলে কোন মুজিযা পেশ করো। এ কথায় সালেহ (আঃ) মুজিযা হিসেবে একটি উটনী তাদের সামনে হাযির করেন।

[১৩] পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, উটনীকে হত্যা করার পর সামূদের লোকেরা সালেহ (আঃ) কে বলল, তুমি আমাদের যে আযাবের ভয় দেখাতে এখন সেই আযাব আনো। (সূরা আরাফ : ৭৭) তখন সালেহ (আঃ) তাদেরকে বললেন, তিনদিন পর্যন্ত নিজেদের গৃহে আরাম-আয়েশ করে নাও, তারপর আযাব এসে যাবে এবং এটি এমন একটি সতর্কবাণী, যা মিথ্যা প্রমাণিত হবে না। (সূরা হুদ : ৬৫)

[১৪] আয়াতে উল্লেখিত دَمْدَمَ শব্দটি এমন কঠোর শাস্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যা বার বার কোন ব্যক্তি অথবা জাতির উপর পতিত হয়ে তাকে সম্পূর্ণ নাস্তানাবুদ করে দেয়। এখানে سَوَّاهَا এর দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, এ আযাব জাতির সবাইকে বেষ্টন করে নিয়েছিল।

[১৫] অর্থাৎ তাদের প্রতি যে আযাব নাযিল করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা এর কোন পরিণামের ভয় করেন না। কেননা তিনি সবার উপর কর্তৃত্বশালী, সর্ব-নিয়ন্ত্রণকারী ও একচ্ছত্র অধিপতি। তাঁর আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার বাইরে কোন কিছুই হতে পারে না। তাঁর হুকুম ও নির্দেশ প্রজ্ঞারই নিদর্শন।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

সফলতা ও বিফলতা মানুষের কর্মের উপর নির্ভরশীল।

প্রত্যেক সন্তান ইসলামের উপর জন্ম নেয়। অতঃপর পিতা-মাতা যে ধর্ম বা প্রকৃতির হয় সন্তানকে সেভাবেই লালন-পালন করে গড়ে তুলে।

শিরক, বিদআত ও গোনাহ দ্বারা আত্মাকে কলুষিত করলে জাহান্নাম অনিবার্য হয়ে পড়বে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিরোধিতা করলে দুনিয়া ও আখেরাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।

১৭
৯২- সূরা আল-লাইল
সূরার নামকরণ :

সূরার প্রথমে উল্লেখিত اَللَّيْلُ (আল-লাইল) শব্দের আলোকে এ সূরার নাম রাখা হয় সূরা আল-লাইল। এর অর্থ রাত্রি।

নাযিলের সময়কাল :

পূর্ববর্তী সূরা আশ-শামসের সাথে এই সূরাটির বিষয়বস্তুর গভীর মিল দেখা যায়। এ থেকে বুঝা যায় যে, এ দুটি সূরা প্রায় একই সময়ে মক্কায় নাযিল হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

জীবনের দুটি ভিন্ন পথের পার্থক্য এবং তাদের পরিণাম ও ফলাফলের প্রভেদ বর্ণনা করাই হচ্ছে এর মূল বিষয়বস্তু। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, মানুষ ব্যক্তিগত, জাতিগত ও দলগতভাবে দুনিয়ায় যা কিছু প্রচেষ্টা ও কর্ম তৎপরতা চালায় তা অনিবার্যভাবে নৈতিক দিক দিয়ে ঠিক তেমনি ভিন্ন, যেমন দিন ও রাত এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে।

এই উভয় প্রকার নমুনা বর্ণনা করা হয়েছে ছোট ছোট সুগঠিত বাক্যের সাহায্যে। প্রথম ধরনের বৈশিষ্টগুলো হচ্ছে, অর্থ-সম্পদ দান করা, আল্লাহভীতি ও তাকওয়া অবলম্বন করা এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয়া। দ্বিতীয় ধরনের বৈশিষ্টগুলো হচ্ছে কৃপণতা করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির পরোয়া না করা এবং ভালো কথাকে মিথ্যা বলে গণ্য করা। তারপর বলা হয়েছে, এই উভয় ধরনের পরস্পর বিরোধী কর্ম নিজের পরিণাম ও ফলাফলের দিক থেকে মোটেই এক নয়।

দ্বিতীয় অংশেও এই একই রকম সংক্ষিপ্তভাবে তিনটি মৌলিক তত্ত পেশ করা হয়েছে। (এক) দুনিয়ার এই পরীক্ষাগারে আল্লাহ মানুষকে কিছু না জানিয়ে একেবারে অজ্ঞ করে পাঠিয়ে দেননি। বরং জীবনের বিভিন্ন পথের মধ্যে সোজা পথ কোনটি এটি তাকে জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তিনি নিজের জিম্মায় নিয়েছেন। এখন মানুষ এর মধ্যে থেকে কোনটি চাইবে- সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানুষের নিজের দায়িত্ব।

রাসূলুল্লাহ ﷺ ও কিতাবের মাধ্যমে যে হিদায়াত পেশ করা হচ্ছে, যে ব্যক্তি তাকে মিথ্যা গণ্য করবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে জ্বলন্ত আগুন। আর যে আল্লাহভীরু ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে নিছক নিজের রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের ধন-মাল সৎপথে ব্যয় করবে তার রব তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং তাকে এত বেশি দান করবেন, যার ফলে সে খুশী হয়ে যাবে।

আয়াত : ১-১১



وَاللَّيْلِ اِذَا يَغْشٰى (১) وَالنَّهَارِ اِذَا تَجَلّٰى (২) وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْاُنْثٰى (৩) اِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتّٰى (৪) فَاَمَّا مَنْ اَعْطٰى وَاتَّقٰى (৫) وَصَدَّقَ بِالْحُسْنٰى (৬) فَسَنُيَسِّرُهٗ لِلْيُسْرٰى (৭) وَاَمَّا مَنْ ۢبَخِلَ وَاسْتَغْنٰى (৮) وَكَذَّبَ بِالْحُسْنٰى (৯) فَسَنُيَسِّرُهٗ لِلْعُسْرٰى (১০) وَمَا يُغْنِيْ عَنْهُ مَالُهٗۤ اِذَا تَرَدّٰى (১১)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَاللَّيْلِ শপথ রাত্রির, اِذَا যখন يَغْشٰى সে আচ্ছন্ন করে, (২) وَالنَّهَارِ শপথ দিনের, اِذَا যখন تَجَلّٰى সে আলোকিত হয় (৩) وَمَا এবং যিনি, خَلَقَ সৃষ্টি করেছেন اَلذَّكَرَ নর وَالْاُنْثٰى ও নারী, (৪) اِنَّ নিশ্চয় سَعْيَكُمْ তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা لَشَتّٰى বিভিন্ন ধরনের। (৫) فَاَمَّا অতএব مَنْ যে ব্যক্তি اَعْطٰى দান করে وَاتَّقٰى এবং খোদাভীরু হয়, (৬) وَصَدَّقَ এবং সত্য মনে করে بِالْحُسْنٰى উত্তম বিষয়কে, (৭) فَسَنُيَسِّرُهٗ অতঃপর আমি তার জন্য সহজ করে দেব لِلْيُسْرٰى সহজ পথে চলাকে। (৮) مَنْ وَاَمَّا আর যে ব্যক্তি بَخِلَ কৃপণতা করে وَاسْتَغْنٰى ও বেপরোয়া হয় (৯) وَكَذَّبَ এবং মিথ্যা মনে করে بِالْحُسْنٰى উত্তম বিষয়কে, (১০) فَسَنُيَسِّرُهٗ আমি তার জন্য সহজ করে দেব لِلْعُسْرٰى কঠিন পরিণামের পথে চলাকে। (১১) وَمَا يُغْنِيْ আর কোনই কাজে আসবে না عَنْهُ তার জন্য مَالُهٗ তার ধন-সম্পদ اِذَا যখন تَرَدّٰى সে অধঃপতিত হবে।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ রাত্রির- যখন সে আচ্ছন্ন করে, (২) শপথ দিনের- যখন সে আলোকিত হয় (৩) এবং তাঁর, যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন, (৪) নিশ্চয় তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের।১ (৫) অতএব২ যে দান করে এবং খোদাভীরু হয়, (৬) এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, (৭) আমি তাকে সহজ পথে চলাকে সুগম করে দেব।৩ (৮) আর৪ যে কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয় (৯) এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, (১০) আমি তাকে কঠিন পরিণামের পথে চলাকে সুগম করে দেব।৫ (১১) যখন সে (জাহান্নামে) অধঃপতিত হবে, তখন তার ধন-সম্পদ তার কোনই কাজে আসবে না।৬

টীকা :

[১] এ কথার জন্যই রাত ও দিন এবং নারী ও পুরুষের জন্মের কসম খাওয়া হয়েছে। এর তাৎপর্য এই যে, যেভাবে রাত ও দিন এবং পুরুষ ও নারী পরস্পর থেকে ভিন্ন ও বিপরীত ঠিক তেমনই তোমরা যেসব কর্মপ্রচেষ্টা চালাচ্ছো সেগুলোও বিভিন্ন ধরনের এবং বিপরীত। কেউ ভালো কাজ করে, আবার কেউ খারাপ কাজ করে। হাদীসে আছে, প্রত্যেক মানুষ সকাল বেলায় উঠে নিজেকে ব্যবসায়ে নিয়োজিত করে। অতঃপর কেউ এই ব্যবসায়ে সফলতা অর্জন করে এবং নিজেকে আখেরাতের আযাব থেকে মুক্ত করে; আবার কেউ নিজেকে ধ্বংস করে।

(সহীহ মুসলিম, হা/২২৩)

[২] আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তিতে মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং প্রত্যেকের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।

[৩] এটি হচ্ছে উপরোক্ত প্রচেষ্টার ফল। যে ব্যক্তি উক্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য উত্তম কাজ করা আর খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা সহজ করে দেন।

[৪] এটি দ্বিতীয় ধরনের মানসিক প্রচেষ্টা। মহান আল্লাহ এখানে তাদের তিনটি কর্ম উল্লেখ করে বলেছেন। আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন তা তাঁর পথে ব্যয় করার ব্যাপারে কৃপণতা করে তথা ফরয-ওয়াজিব-মুস্তাহাব কোন প্রকার সাদাকা দেয় না, তাঁর ইবাদাত হতে বিমুখ হয়ে নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করে এবং উত্তম কালেমা তথা ঈমানের যাবতীয় বিষয়কে মিথ্যা মনে করে; তার জন্য কঠিন পথে চলা সহজ হয়। এখানে কঠিন পথ অর্থ খারাপ কাজকে সহজ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

[৫] এ আয়াতগুলোতে তাকদীরের সু্স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া আছে। হাদীসে এসেছে, আলী (রাঃ) বলেন, আমরা বাকী আল-গারকাদে এক জানাযায় এসেছিলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ-ও সেখানে আসলেন, তিনি বসলে আমরাও বসে গেলাম। তার হাতে ছিল একটি ছড়ি। তিনি সেটি দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিচ্ছিলেন। তারপর বললেন, তোমাদের প্রত্যেকের এমনকি প্রতিটি আত্মারই স্থান জান্নাত কিংবা জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গেছে। প্রত্যেকের জন্যই সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য লিখে দেয়া হয়েছে। তখন একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আমাদের লিখার উপর নির্ভর করে কাজ-কর্ম ছেড়ে দেব না? কারণ যারা সৌভাগ্যশালী তারা তো অচিরেই সৌভাগ্যের দিকে ধাবিত হবে। আর যারা দুর্ভাগা তারা দুর্ভাগ্যের দিকে ধাবিত হবে। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, যারা সৌভাগ্যশালী তাদের জন্য সৌভাগ্যপূর্ণ কাজ করা সহজ করে দেয়া হবে, পক্ষান্তরে যারা দুর্ভাগা তাদের জন্য দুর্ভাগাপূর্ণ কাজ করা সহজ করে দেয়া হবে। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৪৮; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৭)

[৬] تَرَدّٰى এর শাব্দিক অর্থ অধঃপতিত হওয়া ও ধ্বংস হওয়া। অর্থাৎ একদিন তাকে অবশ্যই মরতে হবে। তখন দুনিয়াতে যেসব ধন-সম্পদে কৃপণতা করেছিল তা তার কোন কাজে আসবে না। (মুয়াসসার)

আয়াত : ১২-২১

اِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدٰى (১২) وَاِنَّ لَنَا لَلْاٰخِرَةَ وَالْاُوْلٰى (১৩) فَاَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظّٰى (১৪) لَا يَصْلَاهَاۤ اِلَّا الْاَشْقٰى (১৫) اَلَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰى (১৬) وَسَيُجَنَّبُهَا الْاَتْقٰى (১৭) اَلَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَهٗ يَتَزَكّٰى (১৮) وَمَا لِاَحَدٍ عِنْدَهٗ مِنْ نِّعْمَةٍ تُجْزٰى (১৯) اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْاَعْلٰى (২০) وَلَسَوْفَ يَرْضٰى (২১)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১২) اِنَّ নিশ্চয় عَلَيْنَا আমার দায়িত্ব لَلْهُدٰى পথপ্রদর্শন করা। (১৩) وَاِنَّ আর অবশ্যই لَنَا আমাদের অধিকারে لَلْاٰخِرَةَ পরকাল وَالْاُوْلٰى ইহকাল। (১৪) فَاَنْذَرْتُكُمْ অতএব আমি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছি نَارًا অগ্নি সম্পর্কে تَلَظّٰى প্রজ্বলিত। (১৫) لَا يَصْلَاهَا এতে প্রবেশ করবে না اِلَّا ব্যতীত اَلْاَشْقٰى হতভাগা, (১৬) اَلَّذِيْ যে كَذَّبَ মিথ্যারোপ করে وَتَوَلّٰى ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। (১৭) وَسَيُجَنَّبُهَا অচিরেই তা থেকে দূরে রাখা হবে اَلْاَتْقٰى খোদাভীরু ব্যক্তিকে, (১৮) اَلَّذِيْ যে يُؤْتِيْ দান করে مَالَهٗ তার ধন-সম্পদ يَتَزَكّٰى আত্মশুদ্ধির জন্যে। (১৯) وَمَا এবং নেই لِاَحَدٍ কারো জন্য عِنْدَهٗ তার নিকট مِنْ نِّعْمَةٍ কোন অনুগ্রহ تُجْزٰى যার প্রতিদান তাকে দিতে হবে। (২০) اِلَّا তবে اِبْتِغَآءَ আশায় وَجْهِ সন্তুষ্টি رَبِّه  তার প্রতিপালকের اَلْاَعْلٰى মহান। (২১) وَلَسَوْفَ অচিরেই يَرْضٰى সে সন্তুষ্টি লাভ করবে।

সরল অনুবাদ :

(১২) নিশ্চয় আমার দায়িত্ব হলো পথপ্রদর্শন করা।৭ (১৩) আর আমি ইহকালের ও পরকালের মালিক।৮ (১৪) অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি৯ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। (১৫) এতে প্রবেশ করবে না সেই হতভাগা ছাড়া, (১৬) যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।১০ (১৭) আর এ থেকে দূরে রাখা হবে খোদাভীরু ব্যক্তিকে, (১৮) যে আত্মশুদ্ধির জন্যে তার ধন-সম্পদ দান করে।১১ (১৯) এবং তার উপর কারো কোন প্রতিদানযোগ্য অনুগ্রহ থাকে না।১২ (২০) তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত। (২১) সে সত্বরই সন্তুষ্টি লাভ করবে।১৩

টীকা :

[৭] অর্থাৎ হেদায়াত ও প্রদর্শিত সরল পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলার। এ আয়াতের আরেকটি অর্থ হতে পারে। আর তা হলো, হেদায়াতপূর্ণ সরল পথ আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়, যেমনিভাবে ভ্রষ্টপথ জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। নর

[৮] এ বক্তব্যটির অর্থ, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের মালিক আল্লাহ তা‘আলাই। উভয় জাহানেই আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ মালিকানা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত। তাই একমাত্র তাঁরই নিকটে চাওয়া উচিত, অন্য কোন সৃষ্টির নিকট নয়।

[৯] এ লেলিহান আগুনের ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কিয়ামতের দিন যে জাহান্নামীর সবচেয়ে হালকা আযাব হবে তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, তার পায়ের নীচে আগুনের কয়লা রাখা হবে। আর এতেই তার মগজ উৎলাতে থাকবে। (সহীহ বুখারী, হা/৬৫৬১; সহীহ মুসলিম, হা/২১৩)

[১০] অর্থাৎ এই জাহান্নামে নিতান্ত হতভাগা ব্যক্তিই দাখিল হবে, যে আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি মিথ্যারোপ করে এবং আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, প্রত্যেক উম্মতই জান্নাতে যাবে তবে যে অস্বীকার করবে (সে জান্নাতে যেতে পারবে না)। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কে অস্বীকার করবে? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে জান্নাতে যাবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই আমাকে অস্বীকার করবে।

(সহীহ বুখারী, হা/৭২৮০)

[১১] এতে সৌভাগ্যশালী মুত্তাকীদের প্রতিদান বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর তাক্বওয়া শক্তভাবে অবলম্বন করে এবং নিজের গোনাহ থেকে বিশুদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্যে একমাত্র আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখা হবে।

[১২] সে নিজের অর্থ যাদের জন্য ব্যয় করে, তাদের কোন অনুগ্রহ তার উপর ছিল না, যার প্রতিদান বা পুরস্কার দিচ্ছে অথবা ভবিষ্যতে তাদের থেকে কোন স্বার্থ উদ্ধারের অপেক্ষায় তাদেরকে উপহার-উপঢৌকন ইত্যাদি ব্যয় করছে; বরং সে নিজের মহান সর্বশক্তিমান রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্যই এসব লোককে সাহায্য করছে। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, এ আয়াতটি আবু বকর (রাঃ) এর শানে নাযিল হয়েছে। মক্কার যেসব অসহায় গোলাম ও বাঁদীরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং এই অপরাধে তাদের মালিকরা তাদের উপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছিল, সেসব দাসকে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) প্রচুর অর্থ দিয়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন। এ ধরনের মুসলিমরা সাধারণত দুর্বল ও শক্তিহীন হত। একদিন তার পিতা আবু কোহাফা বললেন, তুমি যখন গোলামদেরকে মুক্তই করে দাও, তখন শক্তিশালী ও সাহসী গোলাম দেখেই মুক্ত করো, যাতে ভবিষ্যতে সে শত্রুর হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারে। আবু বকর (রাঃ) বললেন, কোন মুক্ত করা মুসলিম থেকে উপকার লাভ করা আমার লক্ষ্য নয়। আমি তো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই তাদেরকে মুক্ত করি। (মুস্তাদরাকে হাকিম : ২/৫৭২, নং ৩৯৪২)

[১৩] বলা হয়েছে, শীঘ্রই আল্লাহ এ ব্যক্তিকে এত কিছু দেবেন, যার ফলে সে খুশী হয়ে যাবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই দুনিয়াতে তার ধনসম্পদ ব্যয় করেছে এবং কষ্ট করেছে, আল্লাহ তা‘আলাও আখেরাতে তাকে সন্তুষ্ট করবেন এবং জান্নাতের মহা নিয়ামত দান করবেন।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

মহান আল্লাহ অসীম ক্ষমতার মালিক।

বান্দার আগ্রহের উপর ভিত্তি করে মহান আল্লাহ তাকে ভালো কাজের তাওফীক্ব দিয়ে থাকেন।

মহান আল্লাহ বান্দাহকে নবী-রাসূল পাঠিয়ে এবং কিতাব নাযিল করে হেদায়াতের পথ বাতলে দিয়েছেন।

দুনিয়া ও আখেরাতের একচ্ছত্র মালিকানা মহান আল্লাহর। তাই কেবল তাঁর কাছেই চাইতে হবে।

আবু বকর (রাঃ) জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন।

১৮
৯৩- সূরা আদ-দ্বোহা
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلضُّحٰى (আদ-দ্বোহা) শব্দের আলোকে নামকরণ করা হয়েছে সূরা আদ-দ্বোহা। এর অর্থ পূর্বাহ্ন, ভোর বেলা।

অবতরণকাল :

এই সূরার বিষয় থেকে এ কথা পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এটি মক্কায় প্রথম যুগে নাযিল হয়। হাদীস থেকেও জানা যায়, কিছুদিন অহীর অবতরণ বন্ধ ছিল। এ জন্য নবী ﷺ অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। বারবার তাঁর মনে এই আশঙ্কার উদয় হচ্ছিল, হয়তো তাঁর এমন কোন ত্রুটি হয়ে গেছে, যার ফলে তাঁর রব তাঁর প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। এজন্য তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, কোন প্রকার অসন্তুষ্টির কারণে অহীর সিলসিলা বন্ধ করা হয়নি। সে সময় অহী নাযিলের কষ্ট বরদাশত করার অভ্যাস তাঁর গড়ে ওঠেনি। তাই মাঝে মাঝে ফাঁক দেবার প্রয়োজন ছিল। পরে তাঁর মধ্যে এই মহা ভার বরদাশত করার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়ে গেলে আর দীর্ঘ ফাঁক দেবার প্রয়োজন থাকেনি।

এই সূরা অবতরণের কারণ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার অসুস্থ হলেন। ফলে তিনি একরাত বা দু’রাত সালাত আদায়ের জন্য বের হলেন। তখন এক মহিলা এসে বলল, মুহাম্মাদ আমি তো দেখছি তোমার শয়তান তোমাকে ত্যাগ করছে, এক রাত বা দু’রাত তো তোমার কাছেও আসেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৫০) অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট ওহী আসতে বিলম্ব হয়, এতে করে মুশরিকরা বলতে শুরু করে যে, মুহাম্মাদকে তার আল্লাহ পরিত্যাগ করেছেন ও তার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে সূরা আদ-দ্বোহা অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম, হা/১৭৯৭)

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সান্ত্বনা দেয়া। আর এই সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্য ছিল অহী নাযিলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তাঁর মধ্যে যে পেরেশানী দেখা দিয়েছিল তা দূর করা। প্রথমে আলো ঝলমল দিনের এবং রাতের নীরবতা ও প্রশান্তির কসম খেয়ে তাঁকে এই কর্মে নিশ্চিন্ততা দান করা হয়েছে যে, তার রব তাঁকে মোটেই পরিত্যাগ করেননি এবং তিনি তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হননি। এরপর তাকে সুসংবাদ দান করা হয়েছে যে, ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে যেসব কঠিন সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এগুলো মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার। তাঁর জন্য পরবর্তী প্রত্যেকটি পর্যায় পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে উন্নত হতে থাকবে এবং কিছু দিনের মধ্যেই মহান আল্লাহ তাঁর উপর এমনভাবে তাঁর দান বর্ষণ করতে থাকবেন, যার ফলে তিনি খুশী হয়ে যাবেন।

তারপর মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু মুহাম্মাদ ﷺ কে বলেন, আমি তোমাকে পরিত্যাগ করেছি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছি- এ ধরনের পেরেশানীতে তুমি ভুগছো কেন? আমি তো তোমার জন্মের দিন থেকেই তোমার প্রতি অবিরাম মেহেরবানী করে আসছি। তুমি এতীম অবস্থায় জন্ম লাভ করেছিলে, আমি তোমার প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা করেছি। তুমি অনভিজ্ঞ ছিলে, আমি তোমাকে পথের সন্ধান দিয়েছি। তুমি অর্থ-সম্পদহীন ছিলে, আমি তোমাকে বিত্তশালী করেছি। এসব কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তুমি শুরু থেকেই আমার প্রিয়পাত্র আছো এবং আমার মেহেরবানী, অনুগ্রহ দান স্থায়ীভাবে তোমার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে।

সবশেষে মহান আল্লাহ নবী ﷺ এর প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন তার জবাবে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে তার কি ধরনের আচরণ করা উচিত এবং তার নিয়ামতের শুকরিয়া কিভাবে আদায় করতে হবে এ কথা তাঁকে জানিয়ে দেন।

আয়াত : ১-১১



وَالضُّحٰى (১) وَاللَّيْلِ اِذَا سَجٰى (২) مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلٰى (৩) وَلَلْاٰخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ الْاُوْلٰى (৪) وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰى (৫) اَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيْمًا فَاٰوٰى (৬) وَوَجَدَكَ ضَآلًّا فَهَدٰى (৭) وَوَجَدَكَ عَآئِلًا فَاَغْنٰى (৮) فَاَمَّا الْيَتِيْمَ فَلَا تَقْهَرْ (৯) وَاَمَّا السَّآئِلَ فَلَا تَنْهَرْ (১০) وَاَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ (১১)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالضُّحٰى শপথ পূর্বাহ্নের, (২) وَاللَّيْلِ শপথ রাত্রির اِذَا যখন سَجٰى তা গভীর হয়, (৩) مَا وَدَّعَكَ আপনাকে ত্যাগ করেননি رَبُّكَ আপনার পালনকর্তা وَمَا قَلٰى এবং আপনার প্রতি বিরূপ হননি। (৪) وَلَلْاٰخِرَةُ পরকালই خَيْرٌ উত্তম لَكَ আপনার জন্য مِنَ الْاُوْلٰى ইহকাল থেকে। (৫) وَلَسَوْفَ অচিরেই يُعْطِيْكَ আপনাকে দান করবেন رَبُّكَ আপনার পালনকর্তা, فَتَرْضٰى অতঃপর আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। (৬) اَلَمْ يَجِدْكَ তিনি কি আপনাকে পাননি يَتِيْمًا এতীমরূপে? فَاٰوٰى অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। (৭) وَوَجَدَكَ আর তিনি আপনাকে পেয়েছেন ضَآلًّا পথহারা অবস্থায় فَهَدٰى অতঃপর তিনি পথপ্রদর্শন করেছেন। (৮) وَوَجَدَكَ আর তিনি আপনাকে পেয়েছেন عَآئِلًا নিঃস্ব অবস্থায়, فَاَغْنٰى অতঃপর তিনি অভাবমুক্ত করেছেন। (৯) فَاَمَّا অতএব اَلْيَتِيْمَ এতীমের প্রতি فَلَا تَقْهَرْ কঠোর হবেন না; (১০) وَاَمَّا আর اَلسَّآئِلَ সওয়ালকারীদেরকে فَلَا تَنْهَرْ ধমক দিবেন না (১১) وَاَمَّا এবং بِنِعْمَةِ رَبِّكَ আপনার পালনকর্তার নিয়ামত সম্পর্কে فَحَدِّثْ জানিয়ে দিন।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ পূর্বা‎হ্নের, (২) শপথ রাত্রির- যখন তা গভীর হয়,১ (৩) আপনার প্রতিপালক আপনাকে ত্যাগ করেননি২ এবং আপনার প্রতি বিরূপ হননি। (৪) আপনার জন্য পরকাল ইহকাল অপেক্ষা শ্রেয়।৩ (৫) আপনার প্রতিপালক অচিরেই আপনাকে দান করবেন, তখন আপনি খুশি হয়ে যাবেন।৪ (৬) তিনি কি আপনাকে এতীমরূপে পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।৫ (৭) তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা অবস্থায়, অতঃপর তিনিই আপনাকে পথপ্রদর্শন করেছেন।৬ (৮) তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব অবস্থায়, অতঃপর তিনিই আপনাকে অভাবমুক্ত করেছেন।৭ (৯) সুতরাং আপনি এতীমের প্রতি কঠোর হবেন না;৮ (১০) ভিক্ষুকদেরকে ধমক দিবেন না।৯ (১১) আর আপনি আপনার প্রতিপালকের নিয়ামত সম্পর্কে জানিয়ে দিন।১০

টীকা :

[১] سَجٰى এর আরেকটি অর্থ হতে পারে। আর তা হলো, অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া। এখানে দিনের আলো ও রাতের নীরবতা বা অন্ধকারের কসম খেয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলা হয়েছে, আপনার রব আপনাকে বিদায় দেননি।

[২] এখানে وَدَّعَ এর আরেকটি অর্থ হতে পারে, আর তা হলো, বিদায় দেয়া।

[৩] এখানে اَلْاٰخِرَةُ এবং أَلْاُوْلٰى শব্দদ্বয়ের প্রসিদ্ধ অর্থ আখেরাত ও দুনিয়া নেয়া হলে এর ব্যাখ্যা হবে যে, সেখানে আপনাকে দুনিয়ার চেয়ে অনেক বেশি নিয়ামত দান করা হবে। তাছাড়া اَلْاٰخِرَةُ কে পরবর্তী অবস্থা ও أَلْاُوْلٰى কে প্রথম অবস্থার অর্থেও নেয়া যায়। তখন আয়াতের অর্থ হবে, আপনার প্রতি আল্লাহর নিয়ামত দিন দিন বেড়েই যাবে এবং প্রত্যেক প্রথম অবস্থা থেকে পরবর্তী অবস্থা উত্তম ও শ্রেয় হবে।

[৪] অর্থাৎ আপনার পালনকর্তা আপনাকে এত প্রাচুর্য দেবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। এতে কি দিবেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, প্রত্যেক কাম্যবস্তুই প্রচুর পরিমাণে দেবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাম্যবস্তুসমূহের মধ্যে ছিল ইসলামের ও কুরআনের উন্নতি, সারা বিশ্বে হিদায়াতের প্রসার, শত্রুর বিরুদ্ধে তার বিজয়লাভ, শত্রুদেশে ইসলামের কালেমা সমুন্নত করা ইত্যাদি। হাদীসে আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট পরবর্তীতে যে সমস্ত জনপদ বিজীত হবে তা একটি একটি করে পেশ করা হচ্ছিল। এতে তিনি খুশি হলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা ‘‘অচিরেই আপনার রব আপনাকে এমন দান করবেন, যে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন’’ এ আয়াত নাযিল করলেন। (মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৫২৬)

[৫] এখানে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি কিছু নিয়ামতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। প্রথম নিয়ামত হচ্ছে, আমি আপনাকে পিতৃহীন পেয়েছি। আপনার জন্মের পূর্বেই পিতা ইন্তেকাল করেছিল এবং ছোট থাকতেই মা মারা যায়। অতঃপর আমি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। অর্থাৎ প্রথমে পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব, পরবর্তীতে পিতৃব্য আবু তালেব যত্নসহকারে আপনাকে লালন-পালন করতেন। (সাদী)

[৬] দ্বিতীয় নিয়ামত হচ্ছে, আপনাকে ضَالٌّ পেয়েছি। এ শব্দটির অর্থ ভ্রষ্ট, অনভিজ্ঞ, অনবহিত বা গাফেল। নবুওয়াত লাভের পূর্বে তিনি আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে, ঈমান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। অতঃপর নবুওয়াতের পদ দান করে তাকে পথনির্দেশ দেয়া হয়, যা তিনি জানতেন না তা জানানো হয় এবং সর্বোত্তম আমলের তৌফিক দেয়া হয়।

[৭] তৃতীয় নিয়ামত হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে নিঃস্ব পেয়েছেন; অতঃপর আপনাকে অভাবমুক্ত করেছেন এবং ধৈর্যশীল ও সন্তুষ্ট করেছেন। এখানে اَغْنٰى বলতে দুটি অর্থ হতে পারে। এক অর্থ, তিনি আপনাকে ধনশালী করেছেন। অপর অর্থ, তিনি আপনাকে তাঁর নিয়ামতে সন্তুষ্ট করেছেন।

[৮] এ নিয়ামতগুলো উল্লেখ করার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কয়েকটি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম নির্দেশ হচ্ছে, এতীমের সাথে কঠোর ব্যবহার করবেন না। অর্থাৎ আপনি কোন পিতৃহীনকে অসহায় ও বেওয়ারিশ মনে করে তার ধন-সম্পদ জবরদস্তিমূলকভাবে নিজ অধিকারভুক্ত করে নেবেন না।

[৯] দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছে, অর্থগত ও জ্ঞানগত প্রার্থীকে ধমক বা ভৎর্সনা না করতে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে নির্দেশ করা হয়েছে। যদি প্রার্থনাকারী বলতে এখানে সাহায্য প্রার্থনাকারী অভাবী ধরা হয়, তাহলে এর অর্থ হয়, তাকে সাহায্য করতে পারলে করুন আর না করতে পারলে কোমল স্বরে তাকে নিজের অক্ষমতা বুঝিয়ে দিন। কিন্তু কোনক্রমে তার সাথে দুর্ব্যবহার করবেন না। আর যদি প্রার্থী দ্বীনের কোন বিষয় বা বিধান জিজ্ঞেসকারী হয়, তাহলে এই ধরনের লোক যতই মূর্খ ও অজ্ঞ হোক না কেন স্নেহশীলতা ও কোমলতা সহকারে তকে জবাব দিন এবং ধমক দিয়ে বা কড়া কথা বলে তাকে তাড়িয়ে দিবেন না।

[১০] তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে, মানুষের সামনে আল্লাহর নিয়ামতসমূহ বর্ণনা করুন, স্মরণ করুন। নিয়ামত শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর অর্থ দুনিয়ার নিয়ামতও হতে পারে; আবার এমন সব নিয়ামতও হতে পারে, যা আল্লাহ তা‘আলা আখেরাতে দান করবেন। এ নিয়ামত প্রকাশ করার পদ্ধতি বিভিন্ন হতে পারে। সামগ্রিকভাবে সমস্ত নিয়ামত প্রকাশের পদ্ধতি হলো আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং এ স্বীকৃতি দেয়া যে, আমি যেসব নিয়ামত লাভ করেছি সবই আল্লাহর মেহেরবাণী ও অনুগ্রহের ফল। নবুওয়াতের এবং অহীর নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার করার মাধ্যমে। এছাড়া একজন অন্যজনের প্রতি যে অনুগ্রহ করে তার শোকর আদায় করাও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি পন্থা। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি অপরের অনুগ্রহের শোকর আদায় করে না, সে আল্লাহ তা‘আলারও শোকর আদায় করে না। (আবু দাউদ, হা/৪৮১১; তিরমিযী, হা/১৯৫৫)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন।

নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা আবশ্যক।

নিয়ামত পেলে তা নিজেদের আচার-আচরণ ও পোষাক-পরিচ্ছদে প্রকাশ করা উত্তম।

এতীম ও সওয়ালকারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা মারাত্মক অপরাধ।

১৯
৯৪- সূরা ইনশিরাহ
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে اَلَمْ نَشْرَحْ শব্দটি এসেছে। এ শব্দের মূল اَلْاِنْشِرَاحُ (আল-ইনশিরাহ); তাই এ সূরাকে সূরা আল-ইনশিরাহ বলা হয়। এর অর্থ উন্মুক্ত করা।

নাযিলের সময় :

সূরা আদ-দ্বোহার সাথে এ সূরার বিষয়বস্তুর গভীর মিল দেখা যায়। এ থেকে বুঝা যায় এ সূরা দুটি প্রায় একই সময়ে একই অবস্থার প্রেক্ষিতে মক্কায় নাযিল হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

এ সূরাটির উদ্দেশ্যও রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সান্ত্বনা দান করা। নবুওয়াত লাভ করার পর ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করার সাথে সাথেই তাঁকে যেসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, নবুওয়াত লাভের আগে তাঁকে কখনো তেমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়নি। তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করার সাথে সাথেই দেখতে দেখতে সমগ্র সমাজ তাঁর দুশমন হয়ে যায়। যেসব আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গোত্রীয় লোকজন ও মহল্লাবাসী ইতিপূর্বে তাঁকে মাথায় তুলে রাখতো তারাই এখন তাঁকে গালিগালাজ করতে থাকে। মক্কায় এখন আর কেউ তাঁর কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই প্রথম দিকের দিনগুলো তাঁর জন্য ছিল বড়ই কঠিন এবং এগুলো তাঁর মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।

এজন্য তাঁকে সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যে প্রথমে সূরা আদ-দ্বোহা এবং পরে এই সূরাটি নাযিল হয়।

এই সূরায় আল্লাহ তা‘আলা প্রথমেই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন, আমি তোমাকে তিনটি বিরাট বিরাট নিয়ামত দান করেছি। এগুলোর উপস্থিতিতে তোমার মানসিক দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়ার কোন কারণ নেই। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেয়ার নিয়ামত। দ্বিতীয় নিয়ামতটি হচ্ছে, নবুওয়াত লাভের পূর্বে যে ভারী বোঝা তোমার কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল তা। তৃতীয়টি হচ্ছে, সুনাম ও সুখ্যাতিকে উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত করার নিয়ামত। এই নিয়ামতটি তাঁর চেয়ে বেশি আর কাউকে দেয়া তো দূরের কথা তাঁর সমানও কাউকে কখনো দেয়া হয়নি।

এরপর বিশ্ব-জাহানের প্রভু তাঁর বান্দা ও রাসূলকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দান করেছেন যে, সমস্যা ও সংকটের যে যুগের মধ্য দিয়ে তুমি এগিয়ে চলছো এটা কোন সুদীর্ঘ যুগ নয়। বরং এখানে সমস্যা, সংকট ও সংকীর্ণতার সাথে সাথে প্রশস্ততার যুগও চলে আসছে। এক কথায়, তোমার জন্য প্রত্যেকটি পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো হবে এবং শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এমন সবকিছু দেবেন, যাতে তোমার মন খুশিতে ভরে যাবে।

সবশেষে নবী ﷺ কে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, প্রাথমিক যুগের এসব কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করার শক্তি তোমার মধ্যে সৃষ্টি হবে একটি মাত্র জিনিসের সাহায্যে। সেটি হচ্ছে, নিজের কাজ-কর্ম থেকে অবসর পাওয়ার সাথে সাথেই তুমি পরিশ্রমপূর্ণ ইবাদাত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত হয়ে যাও। আর সমস্ত জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের রবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করো।

আয়াত : ১-৮



اَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ (১) وَوَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَ (২) اَلَّذِيْۤ اَنْقَضَ ظَهْرَكَ (৩) وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ (৪) فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا (৫) اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا (৬) فَاِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ (৭) وَاِلٰى رَبِّكَ فَارْغَبْ (৮)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اَلَمْ نَشْرَحْ আমি কি উন্মুক্ত করে দেইনি لَكَ আপনার জন্য صَدْرَكَ আপনার বক্ষকে? (২) وَوَضَعْنَا আমি লাঘব করেছি عَنْكَ আপনার থেকে وِزْرَكَ বোঝা, (৩) اَلَّذِيْ যা اَنْقَضَ ভেঙ্গে দিচ্ছিল ظَهْرَكَ আপনার পিঠকে। (৪) وَرَفَعْنَا আমি সমুচচ করেছি لَكَ আপনার জন্য ذِكْرَكَ আপনার আলোচনাকে। (৫) فَاِنَّ নিশ্চয় مَعَ الْعُسْرِ কষ্টের সাথে রয়েছে يُسْرًا স্বস্তি । (৬) اِنَّ নিশ্চয় مَعَ الْعُسْرِ কষ্টের সাথে রয়েছে يُسْرًا স্বস্তি। (৭) فَاِذَا অতএব যখন فَرَغْتَ আপনি অবসর পান فَانْصَبْ পরিশ্রম করুন। (৮) وَاِلٰى رَبِّكَ এবং আপনার পালনকর্তার প্রতি فَارْغَبْ মনোনিবেশ করুন।

সরল অনুবাদ :

(১) আমি কি আপনার বক্ষ উন্মুক্ত করে দেইনি?১ (২) আমি লাঘব করেছি আপনার উপর থেকে আপনার বোঝা, (৩) যা ভেঙে দিচ্ছিল আপনার পিঠকে।২ (৪) আর আমি আপনার জন্যই আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।৩ (৫) নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি । (৬) নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্থি।৪ (৭) অতএব যখন অবসর পান পরিশ্রম করুন। (৮) এবং আপনার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করুন।৫

টীকা :

[১] شَرْحٌ শব্দের অর্থ উন্মুক্ত করা। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেবার শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ হেদায়াত দান করার ইচ্ছা করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।’’- (সূরা আনআম : ১২৫) আবার বলা হয়েছে, ‘‘আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং সে তার রবের দেয়া আলোতে রয়েছে, সে কি তার সমান যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণ থেকে কঠোর! তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে। (সূরা যুমার : ২২) এই উভয় স্থানে বক্ষদেশ উন্মুক্ত করার অর্থই হচ্ছে, সব রকমের মানসিক অশান্তি ও সংশয়মুক্ত হওয়া, জ্ঞান ও সত্য উপলব্ধি করার উপযুক্ত করা এবং বক্ষকে প্রজ্ঞার আধার করার জন্য প্রস্তুত করা। জ্ঞান, তত্ত্বকথা ও উত্তম চরিত্রের জন্য তার বক্ষকে প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছে। কোন কোন তাফসীরবিদ এখানে বক্ষ উন্মুক্ত করার অর্থ সে বক্ষ বিদারণই নিয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর আদেশে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বক্ষ বিদারণ করে তাকে যাবতীয় পঙ্কিলতা থেকে পরিষ্কার করে তাতে জ্ঞান ও তত্ত্বকথা দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন।

(সহীহ মুসলিম, হা/১৬৪; তিরমিযী, হা/৩৩৪৬)

[২] وِزْرٌ এর শাব্দিক অর্থ বোঝা; আর نَقْضُ الظَّهْرِ এর শাব্দিক অর্থ কোমর বা পিঠ ভারী করে দেয়া। অর্থাৎ কোমরকে নুইয়ে দেয়া। কোন বড় বোঝা কারো মাথায় তুলে দিলে যেমন তার কোমর নুয়ে পড়ে, তেমনি আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে বোঝা আপনার কোমরকে নুইয়ে দিয়েছিল, আমি তাকে আপনার উপর থেকে অপসারিত করে দিয়েছি। সে বোঝা কী ছিল, তার ব্যাখ্যায় কোন কোন তাফসীরবিদ বলেছেন যে, নবুওয়াতের গুরুভার তার অন্তর থেকে সরিয়ে দেয়া ও তা সহজ করে দেয়ার সুসংবাদ এ আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে। وِزْرٌ এর মূর অর্থ হচ্ছে ভারি বোঝা। আর নবীর জন্য এখানে ভারি বোঝা বলতে এ জিনিসটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, মানুষের জাহিলী কর্মকান্ড এবং সমাজের চারদিকে প্রচলিত শিরক, কুসংস্কার, নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা, নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ও জুলুম-নিপীড়ন ইত্যাদি সমাজের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মেয়েদেরকে জীবন্ত কবর দেয়া হচ্ছিল, এক গোত্র আরেক গোত্রের উপর আক্রমন চালিয়ে লুটতরাজ করত। এ সকল অন্যায় অনাচার দেখে আল্লাহর নবী ﷺ সব সময় ভারাক্রান্ত থাকতেন এবং এর পরিবর্তন হবে কী করে এ নিয়ে চিন্তা করতেন। এটা ছিল তার উপর একটি বোঝা, যা তার কোমরকে নুয়ে দিচ্ছিল।

[৩] অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ﷺ কে অনেক সম্মানিত করা হয়েছে; কোন সৃষ্টিকে তার মতো প্রশংসনীয় করা হয়নি। এমনকি আযান, ইকামত, খুতবা, ইত্যাদির ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নামের সাথেও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নাম স্মরণ করা হয়। এভাবে তার মর্যাদা ও স্মরণ সমুন্নত করা হয়েছে। এছাড়াও তার উম্মত ও অনুসারীদের নিকট তার সম-মর্যাদার আর কেউ নেই। (সাদী)

[৪] আরবী ভাষায় একটি নীতি এই যে, আলিফ ও লামযুক্ত শব্দকে যদি পুনরায় আলিফ ও লাম সহকারে উল্লেখ করা হয়, তবে উভয় জায়গায় একই বস্তুসত্তা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং আলিফ ও লাম ব্যতিরেকে পুনরায় উল্লেখ করা হলে উভয় জায়গায় পৃথক পৃথক বস্তুসত্তা বুঝানো হয়ে থাকে। আলোচ্য আয়াতে أَلْعُسْرُ শব্দটি যখন পুনরায় أَلْعُسْرُ উল্লেখিত হয়েছে, তখন বুঝা গেল যে, উভয় জায়গায় একই কষ্ট বুঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে يُسْرٌ শব্দটি উভয় জায়গায় আলিফ ও লাম ব্যতিরেকে উল্লেখিত হয়েছে। এতে নিয়মানুযায়ী বুঝা যায় যে, দ্বিতীয় يُسْرٌ তথা স্বস্তি প্রথম يُسْرٌ তথা স্বস্তি থেকে ভিন্ন। অতএব আয়াতে اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا এর পুনরুল্লেখ থেকে জানা গেল যে, একই কষ্টের জন্য দুটি স্বস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। আর দুই এর উদ্দেশ্যও এখানে বিশেষ দুই সংখ্যা নয়; বরং উদ্দেশ্য অনেক। অতএব সারকথা এই যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি কষ্টের সাথে তাকে অনেক স্বস্তি দান করা হবে। হাদীসে এসেছে, নিশ্চয় বিপদের সাথে মুক্তি আছে। আর নিশ্চয় কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি। (মুসনাদে আহমাদ : ১/৩০৭)

[৫] اَلنَّصَبُ অর্থ কঠোর প্রচেষ্টার পর ক্লান্ত হওয়া। এ প্রচেষ্টাটি দুনিয়ার কাজেও হতে পারে, আবার আখেরাতের কাজেও হতে পারে। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ সালাতের পর দু‘আয় রত হওয়া। কেউ কেউ বলেন, ফরযের পর নফল ইবাদতে রত হওয়া। মূলত এখানে উদ্দেশ্য দুনিয়ার কাজ থেকে খালি হওয়ার পর আখেরাতের কাজে রত হওয়া। এ আয়াতে মুমিনদের জীবনে বেকারত্বের কোন স্থান দেয়া হয়নি। হয় সে দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকবে, নয় আখেরাতের কাজে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

নবী ﷺ এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন।

মানবজীবনে কষ্ট ও সুখ চক্রভাবে আগমন করে থাকে।

কঠিন অবস্থা সহ্য করে উঠতে পারলেই বিজয় নিশ্চিত হয়।

পরিশ্রম করলে তা কখনো বৃথা যায় না; দুনিয়াতে এর ফল পাওয়া না গেলে আখেরাতে পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে।

আল্লাহর ইবাদাতে কষ্ট স্বীকার করতে হয়।

২০
৯৫- সূরা তীন
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দ اَلتِّيْنُ (আত-তীন)-কে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এটি একটি ফলের নাম।

নাযিলের সময়কাল :

এটি মক্কায় অবতীর্ণ প্রথম দিকের সূরা।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে পুরস্কার ও শাস্তির স্বীকৃতি। এই উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম মহান মর্যাদাশীল নবীগণের আত্মপ্রকাশের স্থানসমূহের কসম খেয়ে বলা হয়েছে। মানুষকে এমন উত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে তার মধ্যে নবুওয়াতের মতো সর্বাধিক উন্নত পদমর্যাদা সম্পন্ন লোক জন্ম নিয়েছে। আর এই নবুওয়াতের চাইতে উঁচু পদমর্যাদা আল্লাহর অন্য কোন সৃষ্টি লাভ করেনি।

সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করার পরও যখন মানুষ নিজের দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলোকে দুষ্কৃতির পথে ব্যবহার করে তখন আল্লাহ তাকে উপযুক্ত প্রতিদান হিসেবে জাহান্নামকে তার আবাসস্থল বানিয়ে দেন।

দ্বিতীয় ধরনের মানুষ ঈমান ও সৎকাজের পথ অবলম্বন করে এই পতন থেকে রক্ষা পায়। তাদেরকে সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করার অপরিহার্য দাবী যে উন্নত স্থান সে স্থানেই তারা প্রতিষ্ঠিত থাকে। মানব জাতির মধ্যে এই দুই ধরনের লোকের অস্তিত্ব এমন একটি বাস্তব সত্য, যাকে কোনক্রমেই অস্বীকার করা যেতে পারে না। কারণ মানুষের সমাজে সব জায়গায় সবসময় এটি দেখা যাচ্ছে।

সবশেষে বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে যখন এই দুটি আলাদা আলাদা এবং পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানুষ পাওয়া যায়, তখন কাজের প্রতিদানের ব্যাপারটি কেমন করে একই হয়। তাহলে এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহর রাজত্বে কোন ইনসাফ নেই। অথচ শাসককে ইনসাফ অবশ্যই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ যিনি সকল শাসকের বড় শাসক তিনি ইনসাফ করবেন না, এ কথা কী করে কল্পনা করা যেতে পারে।

বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার সফরে দু’রাকাআতের যে কোন রাকাআতে সূরা তীন পাঠ করলেন। আমি তার মতো সুন্দর স্বর ও পড়া আর কোন দিন শুনিনি। (সহীহ বুখারী, হা/৭৬৭)

আয়াত : ১-৮



وَالتِّيْنِ وَالزَّيْتُوْنِ (১) وَطُوْرِ سِيْنِيْنَ (২) وَهٰذَا الْبَلَدِ الْاَمِيْنِ (৩) لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِيْۤ اَحْسَنِ تَقْوِيْمٍ (৪) ثُمَّ رَدَدْنَاهُ اَسْفَلَ سَافِلِيْنَ (৫) اِلَّا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ اَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُوْنٍ (৬) فَمَا يُكَذِّبُكَ بَعْدُ بِالدِّيْنِ (৭) اَلَيْسَ اللهُ بِاَحْكَمِ الْحَاكِمِيْنَ (৮)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالتِّيْنِ শপথ তীনের وَالزَّيْتُوْنِ ও যায়তুনের, (২) وَطُوْرِ এবং তূর পর্বতের سِيْنِيْنَ সিনাই প্রান্তরস্থ, (৩) وَهٰذَا এবং এই اَلْبَلَدِ الْاَمِيْنِ নিরাপদ নগরীর। (৪) لَقَدْ خَلَقْنَا আমি সৃষ্টি করেছি اَلْاِنْسَانَ মানুষকে فِيْۤ اَحْسَنِ تَقْوِيْمٍ সুন্দরতর অবয়বে (৫) ثُمَّ অতঃপর رَدَدْنَاهُ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি اَسْفَلَ হীনতমরূপে سَافِلِيْنَ হিনতাগ্রস্ত ব্যক্তিদের থেকেও (৬) اِلَّا তবে اَلَّذِيْنَ যারা اٰمَنُوْا বিশ্বাস স্থাপন করেছে وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ও সৎকর্ম করেছে, فَلَهُمْ তাদের জন্যে রয়েছে اَجْرٌ পুরস্কার غَيْرُ مَمْنُوْنٍ অশেষ। (৭) فَمَا يُكَذِّبُكَ অতঃপর কেন তুমি অবিশ্বাস করছ بَعْدُ এরপরও بِالدِّيْنِ কিয়ামতকে? (৮) اَلَيْسَ اللهُ আল্লাহ্ কি নন بِاَحْكَمِ শ্রেষ্ঠ বিচারক اَلْحَاكِمِيْنَ বিচারকদের মধ্যে?

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ তীন ও যায়তুনের,১ (২) শপথ সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বতের,২ (৩) শপথ এই নিরাপদ নগরীর।৩ (৪) নিশ্চয় আমি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে সৃষ্টি করেছি।৪ (৫) অতঃপর তাকে ফিরিয়ে নেই হীনতম রূপে- হীনতাগ্রস্ত লোকদের থেকে।৫ (৬) কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্যে রয়েছে অশেষ পুরস্কার।৬ (৭) সুতরাং এরপরও কিসে আপনাকে কর্মফল দিবস সম্পর্কে অবিশ্বাসী করে তুলে?৭ (৮) আল্লাহ্ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?৮

টীকা :

[১] তীন হচ্ছে গোল হালকা কালচে বর্ণের এক রকম মিষ্টি ফল- যা লোকেরা খায়। আর যায়তুন বলতেও ঐ যায়তুনই বুঝানো হয়েছে, যা থেকে তেল বের হয়। কোন কোন মুফাসসির বলেন, তীন ও যায়তুন শব্দের অর্থ এই ফল দুটি উৎপাদনের সমগ্র এলাকা হতে পারে। এটি হচ্ছে সিরিয়া ও ফিলিস্তীন এলাকা। কারণ সে যুগের আরবে তীন ও যায়তুন উৎপাদনের জন্য এ দুটি এলাকাই পরিচিত ছিল। ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) এই ব্যাখ্যা অবলম্বন করেছেন।

[২] তূরে সীনীন এর অর্থ, সীনীন অঞ্চলের তূর পর্বত। এ পাহাড়ে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) এর সাথে কথা বলেছিলেন। এ পাহাড় সীনীন উপত্যকায় অবস্থিত, যার অপর নাম সাইনা।

[৩] এ সূরায় কয়েকটি বস্তুর শপথ করা হয়েছে। (এক) তীন অর্থাৎ আঞ্জির বা ডুমুর এবং যায়তুন। (দুই) সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বত। (তিন) নিরাপদ শহর তথা মক্কা মোকাররামা। এই বিশেষ শপথের কারণ এই হতে পারে যে, তূর পর্বত ও মক্কা নগরীর ন্যায় ডুমুর ও যায়তুন বৃক্ষও বিপুল উপকারী বস্তু। অথবা এটাও সম্ভবপর যে, এখানে তীন ও যায়তুন উল্লেখ করে সে স্থানকে বুঝানো হয়েছে, যেখানে এ বৃক্ষ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। আর সে স্থান হচ্ছে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অঞ্চল, যা অগণিত রাসূলগণের আবাসভূমি। বিশেষ করে তা ঈসা (আঃ) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির স্থান। আর তূর পর্বত মূসা (আঃ) এর আল্লাহর সাথে বাক্যালাপের স্থান। সীনীন অথবা সাইনা- তূর পর্বতের অবস্থানস্থলের নাম। পরবর্তীতে উল্লেখ করা নিরাপদ শহর হল পবিত্র মক্কা; যা শেষ নবী ﷺ এর জন্মস্থান ও নবুওয়াতপ্রাপ্তির স্থান।

[৪] কসম এ কথাটির উপরই করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথার মানে হচ্ছে এই যে, তাকে এমন উন্নত পর্যায়ের দৈহিক সৌষ্ঠব দান করা হয়েছে, যা অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হয়নি। আয়াতে বর্ণিত تَقْوِيْمٌ এর অর্থ কোন কিছুর অবয়বকে যেরূপ করা উচিত, সে রকমভাবে পরিপূর্ণ আকারে গঠন করা। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দৈহিক অবয়ব এবং আকার-আকৃতি ও আচার-ব্যবহার অন্যান্য সব প্রাণী অপেক্ষা সুন্দরতম করেছেন। আকার আকৃতির বাইরেও আল্লাহ তা‘আলা তাকে জ্ঞানী, শক্তিবান, বক্তা, শ্রোতা, কুশলী এবং প্রজ্ঞাবান করেছেন।

[৫] মুফাসসিরগণ সাধারণত এর দুটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। (এক) আমি তাকে যৌবনের পর বার্ধক্যের এমন এক অবস্থার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি, যেখানে সে কিছু চিন্তা করার, বুঝার ও কাজ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে; ছোট শিশুর মতো হয়ে যায়। (দুই) আয়াতের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি তাকে জাহান্নামের সর্বনিম্ন পর্যায়ের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি। সর্বোত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করার পর যখন মানুষ নিজের দৈহিক ও মানসিক শক্তিগুলোকে দুষ্কৃতির পথে ব্যবহার করে তখন আল্লাহ তাকে উপযুক্ত প্রতিদান হিসেবে জাহান্নামকে তার আবাসস্থল বানিয়ে দেন।

[৬] এ আয়াতে মুমিন সৎকর্মশীলগণ এর ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বার্ধক্যজনিত বেকারত্ব ও কর্ম হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও তাদের আমলনামায় সেসব কর্ম লিখিত হয়, যা তারা শক্তিমান অবস্থায় করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কোন মুসলিম অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা মুসাফির হলে আল্লাহ তা‘আলা আমল লেখক ফেরেশতাগণকে আদেশ দেন, সুস্থ অবস্থায় সে যেসব সৎকর্ম করত সেগুলো তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করতে থাকো। (সহীহ বুখারী, হা/২৯৯৬) তাদেরকে জাহান্নামের হীনতম ও পর্যায়ে পৌঁছানো হবে না; বরং তারা জান্নাতে এমন পুরস্কার পাবে, যার ধারাবাহিকতা কোনদিন শেষ হবে না, যে পুরষ্কারের কোন কমতিও হবে না।

[৭] এতে কিয়ামতে অবিশ্বাসীদেরকে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, আল্লাহর কুদরতের দৃশ্য দেখার পরও তোমাদের জন্য আখেরাত ও কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করার কী অবকাশ থাকতে পারে? তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তারপরও কেন তোমরা তা অস্বীকার করবে? দুষ্কৃতিকারীরা কি এ কথা মনে করেছে, আমি তাদেরকে সেসব লোকের মতো করে দেব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের উভয়ের জীবন ও মৃত্যু এক রকম হবে? খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত, যা তারা করছে। (সূরা জাসিয়াহ : ২১)

[৮] আল্লাহ তা‘আলা কি সব বিচারকের মহাবিচারক নন? তিনি কি সকল শাসকবর্গের মধ্যে সর্বোত্তম শাসক নন? এই ন্যায় বিচারের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রত্যেক অপরাধীকে তার শাস্তি ও প্রত্যেক সৎকর্মীকে তার উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করা।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

তীন ও যায়তুন- এ দুটি অনেক উপকারি ফল।

পৃথিবীর অন্যান্য শহর থেকে মক্কার মর্যাদা অনেক বেশি।

মানুষকে উত্তম অবয়বে সৃষ্টি করাটাও আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ অনুগ্রহ।

আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক।

২১
৯৬- সূরা আলাক
সূরার নামকরণ :

সূরাটির দ্বিতীয় আয়াতে উল্লেখিত আলাক ( عَلَقٌ ) শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে। এর অর্থ ঝুলন্ত, জমাটবাধা রক্ত।

নাযিলের সময়কাল :

এই সূরাটির দুটি অংশ। প্রথম অংশটি اِقْرَأْ থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম আয়াতে مَا لَمْ يَعْلَمْ এ গিয়ে শেষ হয়েছে। আর দ্বিতীয় অংশটি كَلَّاۤ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَيَطْغٰى থেকে শুরু করে সূরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। প্রথম অংশটি যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর অবতীর্ণ সর্বপ্রথম অহী- এ ব্যাপারে আলেম সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একমত। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন হারামে সালাত আদায় শুরু করেন এবং আবু জাহেল তাঁকে হুমকি দিয়ে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে তখন দ্বিতীয় অংশটি নাযিল হয়।

নাযিলের প্রেক্ষাপট :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট ওহী আগমনের সূচনা হয় ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। স্বপ্নে তিনি যা দেখতেন তা-ই প্রভাতের আলোর ন্যায় তাঁর কাছে প্রকাশ হয়ে যেত। কিছুকাল এ অবস্থা চলার পর আপনা থেকেই তাঁর অন্তরে নির্জনে থাকার প্রেরণা জাগ্রত হয়। তিনি (মক্কা নগরী হতে তিন মাইল দূরে) হেরা গুহায় নির্জনে (ইবাদাতের উদ্দেশ্যে) অবস্থান করতে লাগলেন। তিনি তাঁর পরিবারের নিকট না গিয়ে সেথায় কয়েক রাত পর্যন্ত ইবাদাতে মগ্ন থাকতে লাগলেন। এজন্য তিনি সঙ্গে কিছু খাবার নিয়ে যেতেন। তারপর খাদীজা (রাঃ) এর নিকট ফিরে যেতেন। পুনরায় কিছু খাবার নিয়ে (একাধারে ইবাদাতে রত হওয়ার জন্য) হেরা গুহায় চলে যেতেন।

এমনিভাবে হেরা গুহায় থাকাকালীন হঠাৎ তাঁর নিকট হক্ব (ওহী) এল। অর্থাৎ ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) আসলেন। অতঃপর বললেন, اِقْرَأْ (ইক্রা) (হে নবী) ‘‘আপনি পড়ুন।’’ উত্তরে তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, এ কথা শুনে জিবরীল আমাকে ধরে এমন জোরে চাপ দিলেন যাতে আমার খুব কষ্ট অনুভূত হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি পড়ুন!’ জবাবে আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি না। এটা শুনে আবার (তিনি) আমাকে ধরে এমন জোরে চাপ দিলেন যাতে এবার আমার আরো বেশি কষ্ট অনুভূত হতে লাগল। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বললেন, ‘‘আপনি পড়ুন’’। জবাবে আমি আগের ন্যায় বললাম, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ এটা শুনে জিবরাঈল (আঃ) তৃতীয় বার আমাকে জোরে চাপ দিলেন, তারপর ছেড়ে দিয়ে নিচের আয়াতগুলো পাঠ করতে বললেন-

اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ - ‐ خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ - اِقْرَأْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ - اَلَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ঝুলন্ত রক্তপিন্ড হতে। পড়ুন, আপনার পালনকর্তা অতি সম্মানিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক- ১-৫)

তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ উক্ত আয়াতসমূহ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তখন ভয়ে তাঁর অন্তর কাঁপতেছিল। তিনি তাঁর স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ এর কাছে এসে বললেন, আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও! আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও। অতঃপর খাদীজা (রাঃ) তাঁকে চাদর জড়িয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর থেকে ভয় কেটে গেলে তিনি বিবি খাদীজাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। তিনি বললেন, আমি আমার জীবন নিয়ে ভয় করছি। তখন খাদীজা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! মহান আল্লাহ আপনাকে কখনো চিন্তায় ফেলবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করেন। এতিম, বিধবা, অন্ধ ও অক্ষমদের খাওয়া পরা ও থাকার ব্যবস্থা করেন। বেকারদের কর্মসংস্থান করেন। মেহমানের সমাদর করেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্দশাগ্রস্ত জনগণকে সাহায্য করেন। (অতএব এ অবস্থায় আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই)।

এরূপ সান্ত্বনা দেয়ার পর খাদীজা (রাঃ) রাসূল ﷺ কে সাথে নিয়ে স্বীয় চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল এর নিকট গেলেন। যিনি জাহেলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় কিতাব লিখতেন। সুতরাং আল্লাহ যতটুকু চাইতেন তিনি ইঞ্জিল হতে ততটুকু হিব্রু ভাষায় লিখতেন। তিনি সেসময় খুব বৃদ্ধ হওয়ায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে চাচাত ভাই! আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। তখন ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল রাসূলুল্লাহ ﷺ কে লক্ষ্য করে বললেন, হে ভাতিজা! তুমি কী দেখেছ? রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে সব কাহিনী খুলে বললেন। কাহিনী শুনার পর ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল রাসূল ﷺ কে বললেন, ইনি তো সেই জিবরাঈল, যাকে আল্লাহ মূসা (আঃ) এর নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! (তোমার নবুওয়াতের প্রচারকালে) যদি আমি ক্ষমতাশালী যুবক হতাম, যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার জাতি তোমাকে দেশান্তরিত করে ছাড়বে!

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, আমার দেশবাসী কি আমাকে বিতাড়িত করবে? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ! তুমি সত্য দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছ। তোমার ন্যায় যাঁরা পূর্বে এরূপ সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের সকলের সাথেই শত্রুতা করা হয়েছে। (আমি তোমাকে কথা দিলাম) যদি আমি সেদিন জীবিত থাকি, তাহলে অবশ্যই প্রবলভাবে তোমাকে সাহায্য করব। এ কাহিনীর অল্পদিন পরই ওয়ারাকা ইন্তেকাল করেন। এরপর (কিছু দিন) ওহী নাযিল হওয়া বন্ধ ছিল। (বুখারী হা/৩)

সূরার বিষয়বস্তু :

এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াতে জ্ঞান অর্জনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, জ্ঞানের মূল উৎস হলেন আল্লাহ তা‘আলা। সকল জ্ঞান তার কাছ থেকেই আসে। তিনি যাকে যতটুকু ইচ্ছা জ্ঞান দান করেন। সেই সাথে এখানে কলমের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে লেখালেখির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, তিনি কলম দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দান করেছেন।

সূরার দ্বিতীয় অংশে ঐসকল কাফির-মুশরিকদেরকে হুশিয়ারী শুনানো হয়েছে, যারা নবী ﷺ এর নবুওয়াতকে মানতে রাজি ছিল না- এমনকি তাকে আল্লাহর ঘরে ইবাদাত করতেও বাধা প্রদান করত। এর কারণ ছিল যে, তারা নিজেদেরকে অমুখাপেক্ষী মনে করত। কারো সামনে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে- এ বিশ্বাস তাদের ছিল না। এজন্য তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে কঠিনভাবে পাকড়াও করে শাস্তি দেবেন। সবশেষে নবী ﷺ কে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে তার ইবাদাত করা এবং তাকে সিজদা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।



আয়াত : ১-৫



-اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ (১) خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ (২) اِقْرَأْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ (৩) اَلَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ (৪) عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ (৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِقْرَأْ পাঠ করুন بِاسْمِ رَبِّكَ আপনার পালনকর্তার নামে اَلَّذِيْ যিনি خَلَقَ সৃষ্টি করেছেন (২) خَلَقَ তিনি সৃষ্টি করেছেন اَلْاِنْسَانَ মানুষকে مِنْ عَلَقٍ জমাটবাধা রক্ত থেকে। (৩) اِقْرَأْ পাঠ করুন, وَرَبُّكَ আপনার পালনকর্তা اَلْاَكْرَمُ মহান দয়ালু, (৪) اَلَّذِيْ যিনি عَلَّمَ শিক্ষা দিয়েছেন بِالْقَلَمِ কলমের দ্বারা, (৫) عَلَّمَ তিনি শিক্ষা দিয়েছেন اَلْاِنْسَانَ মানুষকে مَا যা لَمْ يَعْلَمْ সে জানত না।

সরল অনুবাদ :

(১) পাঠ করুন! আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।১ (২) তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবাধা রক্ত থেকে।২ (৩) পাঠ করুন! আপনার প্রতিপালক মহান দয়ালু।৩ (৪) যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।৪ (৫) তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।৫

টীকা :

[১] শুধু বলা হয়েছে, সৃষ্টি করেছেন। কাকে সৃষ্টি করেছেন তা বলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আপনা-আপনিই এ অর্থ বের হয়ে আসে যে, সেই রবের নাম নিয়ে পড়ো, যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা।

[২] পূর্বের আয়াতে সমগ্র সৃষ্টিজগত সৃষ্টির বর্ণনা ছিল। এ আয়াতে সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানব সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, মানুষকে আলাক থেকে সৃষ্টি করেছেন। আলাক হচ্ছে জমাটবাধা রক্ত। সাধারণভাবে বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টির কথা বলার পর বিশেষ করে মানুষের কথা বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ কেমন হীন অবস্থা থেকে তার সৃষ্টিপর্ব শুরু করে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন।

[৩] এখানে পড়ার আদেশের পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, প্রথম আদেশটি নিজে পাঠ করার আদেশ, আর দ্বিতীয়টি অন্যকে পাঠ করানো বা অন্যের নিকট প্রচারের নির্দেশ। অতঃপর মহান রব আল্লাহর সাথে أَلْاَكْرَمُ বিশেষণ যোগ্য করার মধ্যে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ সৃষ্টি করা এবং তাদের শিক্ষাদান করার নিয়ামতের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার নিজের কোন স্বার্থ ও লাভ নেই; বরং এগুলো তাঁরই অনুগ্রহ এবং তারই দান। তিনি সর্বমহান দানশীল ও মহিমান্বিত।

[৪] মানব সৃষ্টির কারণ বর্ণনার পর এখানে মানুষের শিক্ষার প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হয়েছে। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণী যে, তিনি মানুষকে কলমের মাধ্যমে লেখার শিক্ষা দান করেছেন। তা না হলে মানুষের মধ্যে উন্নতি, ক্রমবিকাশ সম্ভব হতো না। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সবকিছুই সংরক্ষিত হয়েছে লেখনির মাধ্যমে। কলম না থাকলে, দ্বীন এবং দুনিয়ার কোন কিছুই পূর্ণরূপে গড়ে উঠত না। হাদীসে আরো বলা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সে মতে কলম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। (মুসনাদে আহমাদ : ৫/৩১৭)

[৫] পূর্বের আয়াতে ছিল কলমের সাহায্যে শিক্ষা দানের বর্ণনা। এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রকৃত শিক্ষাদাতা আল্লাহ তা‘আলা। মানুষ আসলে ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞানহীন। আল্লাহর কাছ থেকেই সে যা কিছু জ্ঞান লাভ করেছে। কলমের সাহায্যে যে শিক্ষা দেয়া হয়ছে, তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তিনি এমন সব বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষ জানত না।

আয়াত : ৬-১৯

كَلَّاۤ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَيَطْغٰى (৬) اَنْ رَّاٰهُ اسْتَغْنٰى (৭) اِنَّ اِلٰى رَبِّكَ الرُّجْعٰى (৮) اَرَاَيْتَ الَّذِيْ يَنْهٰى (৯) عَبْدًا اِذَا صَلّٰى (১০) اَرَاَيْتَ اِنْ كَانَ عَلَى الْهُدٰى (১১) اَوْ اَمَرَ بِالتَّقْوٰى (১২) اَرَاَيْتَ اِنْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰى (১৩) اَلَمْ يَعْلَمْ بِاَنَّ اللهَ يَرٰى (১৪) كَلَّا لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ لَنَسْفَعًا ۢبِالنَّاصِيَةِ (১৫) نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ (১৬) فَلْيَدْعُ نَادِيَهٗ (১৭) سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ (১৮) كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ (১৯)

শাব্দিক অনুবাদ :

(৬) كَلَّا কখনো নয় اِنَّ অবশ্যই اَلْاِنْسَانَ মানুষ لَيَطْغٰى সীমালঙ্ঘন করে, (৭) اَنْ কেননা رَاٰهُ সে নিজেকে মনে করে اِسْتَغْنٰى অভাবমুক্ত। (৮) اِنَّ নিশ্চয় اِلٰى رَبِّكَ আপনার পালনকর্তার দিকেই اَلرُّجْعٰى সমস্ত প্রত্যাবর্তন। (৯) اَرَاَيْتَ আপনি কি দেখেছেন اَلَّذِيْ তাকে, যে يَنْهٰى নিষেধ করে। (১০) عَبْدًا এক বান্দাকে اِذَا যখন صَلّٰى সে সালাত আদায় করে? (১১) اَرَاَيْتَ আপনি কি দেখেছেন اِنْ যদি كَانَ সে থাকে عَلَى الْهُدٰى সৎপথে (১২) اَوْ অথবা اَمَرَ নির্দেশ দেয় بِالتَّقْوٰى খোদাভীতির। (১৩) اَرَاَيْتَ আপনি কি দেখেছেন, اِنْ যদি كَذَّبَ সে মিথ্যারোপ করে وَتَوَلّٰى ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। (১৪) اَلَمْ يَعْلَمْ সে কি জানে না بِاَنَّ اللهَ নিশ্চয় আল্লাহ يَرٰى দেখছেন? (১৫) كَلَّا কখনই নয়, لَئِنْ যদি لَمْ يَنْتَهِ সে বিরত না হয়, لَنَسْفَعًا তবে আমি হেঁচড়াবই بِالنَّاصِيَةِ মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে। (১৬) نَاصِيَةٍ সেই কেশগুচ্ছ كَاذِبَةٍ মিথ্যাচারী خَاطِئَةٍ ও পাপীর। (১৭) فَلْيَدْعُ অতএব সে আহবান করুক نَادِيَهٗ তার সভা সদস্যদেরকে। (১৮) سَنَدْعُ আমিও আহবান করব اَلزَّبَانِيَةَ জাহান্নামের প্রহরীকে (১৯) كَلَّا কখনই নয়, لَا تُطِعْهُ আপনি তার আনুগত্য করবেন না। وَاسْجُدْ (বরং) আপনি সিজদা করুন وَاقْتَرِبْ ও আমার নৈকট্য অর্জন করুন।

সরল অনুবাদ :

(৬) কখনো নয়, অবশ্যই৬ মানুষ সীমালঙ্ঘন করে, (৭) কেননা সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।৭ (৮) নিশ্চয় সমস্ত প্রত্যাবর্তন আপনার প্রতিপালকের দিকেই।৮ (৯) আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে নিষেধ করে। (১০) এক বান্দাকে-৯ যখন সে সালাত আদায় করে? (১১) আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, সে যদি সৎপথে থাকে, (১২) অথবা আল্লাহভীতির নির্দেশ দেয়। (১৩) আপনি কি মনে করেন, যদি সে (বাধাদানকারী) মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। (১৪) সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখেন?১০ (১৫) কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই-১১ (১৬) মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ। (১৭) অতএব সে তার সভা সদস্যদেরকে আহবান করুক। (১৮) আমিও আহবান করব জাহান্নামের প্রহরীদেরকে১২ (১৯) কখনই নয়, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। (বরং) আপনি সিজদা করুন এবং (আমার) নৈকট্য অর্জন করুন।১৩

টীকা :

[৬] كَلَّا বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, حَقًّا বা বাস্তবেই, অবশ্যই হয় এমন।

[৭] অর্থাৎ দুনিয়ায় ধন-দৌলত, সম্মান-প্রতিপত্তি যা কিছু সে চাইতো তার সবই সে লাভ করেছে এ দৃশ্য দেখে সে কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে, বরং বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেছে। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, একবার আবু জাহেল বলল, যদি মুহাম্মদকে কিবলার দিকে ফিরে সালাত আদায় করতে দেখি তবে আমি অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাত আদায় করতে আসলে আবু জাহেল তাকে বলল, তোমাকে কি আমি সালাত আদায় করতে নিষেধ করিনি? রাসূল তার কাছ থেকে ফিরে আসলেন। আবু জাহেলের সাথে তার বিতন্ডা হলো, তখন আবু জাহেল বলল, আমার চেয়ে বড় সভাসদের অধিকারী কি কেউ আছে? তখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করলেন যে, সে যেন তার সভাসদদের ডাকে, আমরাও সভাসদদের ডাকব। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৫৮; তিরমিযী, হা/৩৩৪৯)

আয়াতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী আবু জাহেলকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রাখা হলেও ব্যাপক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের একটি নৈতিক দুর্বলতা বিধৃত হয়েছে। মানুষ যতদিন নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অমুখাপেক্ষী মনে না করে, ততদিন সে সীমালঙ্ঘন করে না। কিন্তু যখন সে মনে করতে থাকে যে, সে কারো মুখাপেক্ষী নয়; তখন তার মধ্যে অবাধ্যতা এবং সীমালঙ্ঘনের প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমনকি তার রবের সাথেও সীমালঙ্ঘন করে।

[৮] অর্থাৎ দুনিয়ায় সে যা কিছুই অর্জন করে থাকুক না কেন এবং তার ভিত্তিতে অহঙ্কার ও বিদ্রোহ করতে থাকুক না কেন, অবশেষে তাকে আপনার রবের কাছেই ফিরে যেতে হবে। সেখানে সে অবাধ্যতার কুপরিণাম তখন স্বচক্ষে দেখে নেবে।

[৯] বান্দা বলতে এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বুঝানো হয়েছে। এ পদ্ধতিতে কুরআনের কয়েক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- [(সূরা ইসরা : ১) (সূরা কাহফ : ১) (সূরা জিন : ১৯)]

[১০] এখানে আশ্চর্যবোধক এবং তিরস্কারসূচক প্রশ্ন করা হয়েছে যে, সে কি জানে না, আল্লাহ তাকে দেখছেন এবং তার কাজ-কর্মের প্রতিদান দেবেন? তবুও সে অবাধ্যতা করছে ও সৎকাজে বাধা প্রদান করছে কেন? (কুরতুবী)

[১১] سَفْعٌ এর অর্থ কোন কিছু ধরে কঠোরভাবে হেঁচড়ানো। আর نَاصِيَةٌ শব্দের অর্থ কপালের উপরিভাগের কেশগুচ্ছ। আরবদের মধ্যে রীতি ছিল যে, কাউকে অতি অসম্মান করার জন্য এই কেশগুচ্ছ মুঠোর ভেতরে নেয়া হত।

[১২] এখানে যাবানিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, জাহান্নামের প্রহরী কঠোর ফেরেশতাগণ। কাতাদাহ বলেন, আরবী ভাষায় ‘যাবানিয়া’ শব্দের অর্থই হলো প্রহরী পুলিশ।

[১৩] এতে নবী করীম ﷺ কে আদেশ করা হয়েছে যে, আবু জাহেলের কথায় কর্ণপাত করবেন না এবং সিজদা ও সালাতে মশগুল থাকুন। সিজদা করা মানে সালাত আদায় করা। অর্থাৎ হে নবী! আপনি নির্ভয়ে আগের মতো সালাত আদায় করতে থাকুন। এর মাধ্যমে নিজের রবের নৈকট্য লাভ করুন। কারণ এটাই আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের উপায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, বান্দা যখন সিজদায় থাকে, তখন তার পালনকর্তার অধিক নিকটবর্তী হয়। তাই তোমরা সিজদায় বেশি পরিমাণে দু‘আ কর। (সহীহ মুসলিম, হা/৪৮২; আবু দাউদ, হা/৮৭৫)



এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

জ্ঞানের মূল উৎস হলেন আল্লাহ তা‘আলা।

জ্ঞানের জগতে কলমের অনেক গুরুত্ব রয়েছে।

নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করা বৈধ নয়; কেননা এরূপ করলে সীমালঙ্ঘন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

সৎকাজে বাধা প্রদান করা মারাত্মক অপরাধ; এজন্য দুনিয়া ও আখেরাতে ভয়াবহ আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।

শত বাধা সত্ত্বেও সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে এবং বেশি বেশি সিজদা করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

২২
৯৭- সূরা কদর
সূরার নামকরণ :

অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْقَدْرُ শব্দের আলোকেই এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। কদর শব্দের অর্থ হচ্ছে মর্যাদা, মহিমান্বিত ইত্যাদি। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার কাছে এ রাতের কদর বা মর্যাদা অনেক বেশি এবং এ রাতে মহান আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী আগামী বছরের জন্য জীবন-মৃত্যু ও রিযিক ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় নির্ধারিত করেন- এ কারণে এ রাতটিকে লাইলাতুল কদর বলা হয়।

নাযিলের সময়কাল :

এর সূরাটি মক্কী অথবা মাদানী হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। তবে বিষয়বস্তুর আলোকে এটি মক্কী হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত।

সূরার বিষয়বস্তু :

লোকদেরকে কুরআন মাজীদের মূল্য, মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করাই এই সূরাটির বিষয়বস্তু। কুরআন মাজীদের বিন্যাসের ক্ষেত্রে একে সূরা আলাকের পরে রাখাই এ কথা প্রকাশ করে যে, সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে যে পবিত্র কিতাবটির নাযিল শুরু হয়েছিল তা কেমন ভাগ্য নির্ণয়কারী রাতে নাযিল হয়, কেমন মহান মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব।

প্রথমেই আল্লাহ বলেছেন, আমি এটি নাযিল করেছি। অর্থাৎ এটি মুহাম্মাদ ﷺ এর নিজের রচনা নয়; বরং আমিই এটি নাযিল করেছি। এরপর বলেছেন, কদরের রাতে আমার পক্ষ থেকে এটি নাযিল হয়েছে। এটি হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। এর সাহায্যে মক্কায় কাফিরদেরকে পরোক্ষভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে মুহাম্মাদ ﷺ এর পেশকৃত এই কিতাবকে নিজেদের জন্য একটি বিপদ মনে করেছো। অথচ যে রাতে এর নাযিল হবার ফায়সালা জারী করা হয় সেটি ছিল পরম কল্যাণ ও বরকতের রাত। এই একটি রাতে মানুষের কল্যাণের জন্য এত বেশি কাজ করা হয়েছে, যা মানুষের ইতিহাসে হাজার মাসেও করা হয়নি।

সবশেষে বলা হয়েছে, এই রাতে ফেরেশতারা এবং জিব্রাঈল নিজেদের রবের অনুমতি নিয়ে সব রকমের আদেশ-নিষেশ সহকারে নাযিল হন। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত এটি হয় পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার রাত। অর্থাৎ কোন প্রকার অনিষ্ট এ রাতে প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ আল্লাহর সমস্ত ফায়সালার মূল লক্ষ্য হয় কল্যাণ। মানুষের জন্য তার মধ্যে কোন অকল্যাণ থাকে না। এমনকি তিনি কোন জাতিকে ধ্বংস করার ফায়সালা করলেও তা করেন মানুষের কল্যাণের জন্য।

আয়াত : ১-৫



اِنَّاۤ اَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ (১) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (২) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ (৩) تَنَزَّلُ الْمَلَآئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِاِذْنِ رَبِّهِمْ مِّنْ كُلِّ اَمْرٍ (৪) سَلَامٌ هِيَ حَتّٰى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِنَّا নিশ্চয় আমি اَنْزَلْنَاهُ একে নাযিল করেছি فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ কদরের রাত্রে। (২) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জানো مَا لَيْلَةُ اَلْقَدْرِ কদরের রাত কী? (৩) لَيْلَةُ الْقَدْرِ কদরের রাত হল خَيْرٌ উত্তম مِنْ اَلْفِ شَهْرٍ এক হাজার মাসের চেয়েও। (৪) تَنَزَّلُ অবতীর্ণ হয় اَلْمَلَآئِكَةُ ফেরেশতাগণ وَالرُّوْحُ এবং রূহসমূহ فِيْهَا এতে بِاِذْنِ নির্দেশক্রমে رَبِّهِمْ তাদের পালনকর্তার مِنْ كُلِّ اَمْرٍ প্রত্যেক কাজের জন্যে। (৫) سَلَامٌ শান্তিময় هِيَ সেটা (সেই রাত) حَتّٰى যতক্ষণ না مَطْلَعِ উদয় হয় اَلْفَجْرِ ফজর।

সরল অনুবাদ :

(১) আমি একে নাযিল করেছি১ কদরের রাতে২। (২) তুমি কি জানো কদরের রাত কী? (৩) কদরের রাত হল এক হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।৩ (৪) তাতে ফেরেশতা ও রূহ (জিবরাঈল) অবতীর্ণ হয়৪- তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি বিষয়ের নির্দেশ৫ নিয়ে। (৫) শান্তিময়৬ সেই রাত ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে৭।

টীকা :

[১] এখানে বলা হয়েছে, আমি কদরের রাতে কুরআন নাযিল করেছি। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে, রামাযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। (সূরা বাকারা- ১৮৫) এ থেকে জানা যায় যে, নবী ﷺ এর কছে হেরা গুহায় যে রাতে আল্লাহর ফেরেশতা অহী নিয়ে এসেছিলেন সেটি ছিল রামাযান মাসের একটি রাত। এই রাতকে এখানে কদরের রাত বলা হয়েছে। সূরা দুখানে এটাকে মুবারক রাত বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, অবশ্যই আমরা একে একটি বরকতপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি। (সূরা দুখান : ৩) এ আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, কুরআন লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ হয়েছে। এর এক অর্থ এই যে, সমস্ত কুরআন লওহে মাহফুয থেকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করা হয়েছে, অতঃপর জিবরাঈল একে ধীরে ধীরে তেইশ বছর ধরে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে পৌঁছাতে থাকেন। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, এ রাতে কয়েকটি আয়াত অবতরণের মাধ্যমে কুরআন অবতরণের ধারাবাহিকতা সূচনা হয়ে যায়। এরপর অবশিষ্ট কুরআন পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে পূর্ণ তেইশ বছরে নাযিল করা হয়।

[২] কদরের এক অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এর মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে একে লাইলাতুল কদর তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। কদরের আরেক অর্থ তাকদীর এবং আদেশও হয়ে থাকে। এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত ও বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, فِيْهَا يُفْرَقُ كَلُّ اَمْرٍ حَكِيْمٍ (সূরা দুখান : ৪) এ আয়াতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, পবিত্র রাত্রে তাকদীর সংক্রান্ত সব ফায়সালা লিপিবদ্ধ করা হয়। এই রাত্রিতে তাকদীর সংক্রান্ত বিষয়াদি নিষ্পন্ন হওয়ার অর্থ এ বছর যেসব বিষয় প্রয়োগ করা হবে, সেগুলো লওহে মাহফুয থেকে নকল করে ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করা। নতুবা আসল বিধি-লিপি আদিকালেই লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে।

[৩] মুফাসসিরগণ এর অর্থ করেছেন, এ রাতের সৎকাজ অন্য রাতের হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘‘যে কেউ ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদর রাত্রিতে সালাত আদায় করতে দাঁড়াবে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

(সহীহ বুখারী, হা/১০৯১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৬০)

[৪] اَلرُّوْحُ বলে কী বুঝানো হয়েছে- এ ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকলেও প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো, এর দ্বারা জিবরাঈল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। জিবরাঈল (আঃ) এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কারণে সমস্ত ফেরেশতা থেকে আলাদা করে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। জিবরাঈল (আঃ) এর সাথে ফেরেশতারাও সে রাত্রিতে অবতরণ করে। হাদীসে আছে, লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশি অবতরণ করেন যে, তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশি।

(মুসনাদে আহমাদ : ২/৫১৯, মুসনাদে তায়ালুসী : ২৫৪৫)

[৪] সকল সিদ্ধান্ত বা প্রত্যেক হুকুম বলতে অন্যত্র বর্ণিত ‘‘আমরে হাকীম’’ (বিজ্ঞতাপূর্ণ কাজ) [সূরা রুখান : ৪] অর্থাৎ ফেরেশতাগণ শবে কদরে সারা বছরের অবধারিত ঘটনাবলি নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন।

[৫] অর্থাৎ সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারাটা রাত শুধু শান্তিই শান্তি, মঙ্গলই মঙ্গল তথা কল্যাণে পরিপূর্ণ। সে রাত্র সর্বপ্রকার অনিষ্ট থেকে মুক্ত।

[৬] অর্থাৎ লাইলাতুল কদরের এই বরকতময় রাত্রির শুরু অর্থাৎ সূর্যাস্তের পর হতে ফজরের উদয় পর্যন্ত বিস্তৃত।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

কদরের রাতেই কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়েছিল।

কদরের রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক রহমত নাযিল হয়।

রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত বিদ্যমান রয়েছে।

কদরের রাতের সম্পূর্ণ অংশই প্রশান্তিময় থাকে।

২৩
৯৮- সূরা বাইয়্যিনাহ্
সূরার নামকরণ :

অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত أَلْبَيِّنَةُ শব্দের আলোকেই এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। أَلْبَيِّنَةُ অর্থ সুস্পষ্ট প্রমাণ, দলীল ইত্যাদি।

নাযিলের সময়কাল :

অনেক মুফাসসির বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতে এটি মক্কী সূরা। আবার অনেক মুফাসসির বলেন, এটি মাদানী সূরা। অন্যদিকে সূরাটির বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন কোন আলামত পাওয়া যায় না, যা থেকে এর মক্কী বা মাদানী হওয়ার ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত ফায়সালা করা যেতে পারে।

সূরার বিষয়বস্তু :

কুরআন মাজীদের বিন্যাসের ক্ষেত্রে একে সূরা আলাক ও সূরা কদরের পরে রাখাটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সূরা আলাকে সর্বপ্রথম নাযিলকৃত অহী লিপিবদ্ধ হয়েছে। সূরা কদরে বলা হয়েছে সেগুলো কবে নাযিল হয়। আর এই সূরায় এই পবিত্র কিতাবের সাথে একজন রাসূল পাঠানো জরুরি ছিল কেন তা বলা হয়েছে।

আহলে কিতাব ও মুশরিক নির্বিশেষে দুনিয়াবাসীরা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে। একজন রাসূল পাঠানো ছাড়া এই কুফরীর বেড়াজাল ভেদ করে তাদের বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। তিনি লোকদের সামনে আল্লাহর কিতাবকে তার আসল ও সঠিক আকৃতিতে পেশ করবেন। অতীতের আসমানী কিতাবসমূহে যেমন বাতিলের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছিল তেমন কোন মিশ্রণ তাতে থাকবে না এবং তা হবে পুরোপুরি সত্য ও সঠিক শিক্ষা সমন্নিত।

এরপর আহলে কিতাবদের গোমরাহী তুলে ধরা হয়েছে, বলা হয়েছে তাদের এই বিভিন্ন ভুল পথে ছুটে বেড়ানোর মানে এ নয় যে, আল্লাহ তাদেরকে পথ দেখাননি। বরং তাদের সামনে সঠিক পথের বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে এসে যাওয়ার পরপরই তারা ভুল পথে পাড়ি জমিয়েছে।

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব নবী এসেছিলেন তাঁরা সবাই একটি মাত্র হুকুম দিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে, সব পথ ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর তাওহীদের পথ অবলম্বন করো। তাঁর ইবাদাত ও আনুগত্যের সাথে আর কারো ইবাদাত ও আনুগত্য শামিল করো না। সালাত কায়েম করো এবং যাকাত দাও। চিরকাল এটিই সঠিক দ্বীন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে।

সবশেষে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, যেসব আহলে কিতাব ও মুশরিক এই রাসূলকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। তাদের শাস্তি চিরন্তন জাহান্নাম। আর যারা ঈমান এনে সৎকর্মের পথ অবলম্বন করবে এবং দুনিয়ায় আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করবে তারা সর্বোত্তম সৃষ্টি। তারা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। এই তাদের পুরস্কার। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ উবাই ইবনে কাব (রাঃ) কে বললেন, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমাকে ‘‘লাম ইয়াকুনিল্লাযিনা কাফারু’’ (সূরা) পড়ে শোনাই। উবাই ইবনে কাব বললেন, আমার নাম দিয়ে আপনাকে বলেছেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই ইবনে কাব (রাঃ) খুশিতে কেঁদে ফেললেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩৮০৮, ৪৯৫৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯৯)



আয়াত : ১-৫



لَمْ يَكُنِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ مُنْفَكِّيْنَ حَتّٰى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ (১) رَسُوْلٌ مِّنَ اللهِ يَتْلُوْ صُحُفًا مُّطَهَّرَةً (২) فِيْهَا كُتُبٌ قَيِّمَةٌ (৩) وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتَابَ اِلَّا مِنْ ۢبَعْدِ مَا جَآءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ (৪) وَمَاۤ اُمِرُوْاۤ اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَآءَ وَيُقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذٰلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ (৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) لَمْ يَكُنِ হবে না اَلَّذِيْنَ যারা كَفَرُوْا কুফরী করেছে مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ আহলে-কিতাবদের থেকে وَالْمُشْرِكِيْنَ এবং মুশরিকদের থেকে مُنْفَكِّيْنَ বিরত حَتّٰى যতক্ষণ না تَأْتِيَهُمْ তাদের কাছে আসত اَلْبَيِّنَةُ সুস্পষ্ট প্রমাণ। (২) رَسُوْلٌ একজন রাসূল مِنَ اللهِ আল্লাহর পক্ষ থেকে يَتْلُوْ যিনি আবৃত্তি করতেন صُحُفًا مُّطَهَّرَةً পবিত্র সহীফা। (৩) فِيْهَا যাতে আছে, كُتُبٌ লিখিত বিধি-বিধান قَيِّمَةٌ সত্য-সঠিক। (৪) وَمَا تَفَرَّقَ আর তারা তো বিভেদ সৃষ্টি করেনি اَلَّذِيْنَ যাদেরকে اُوْتُوْا দেয়া হয়েছিল اَلْكِتَابَ কিতাব اِلَّا তবে (তারা তো বিভেদ সৃষ্টি করেছিল) مِنْ ۢبَعْدِ مَا جَآءَتْهُمْ তাদের নিকট যা এসেছিল তার পরেই اَلْبَيِّنَةُ সুষ্পষ্ট প্রমাণ। (৫) وَمَاۤ اُمِرُوْا তাদেরকে কোন নির্দেশ করা হয়নি اِلَّا এছাড়া যে, لِيَعْبُدُوْا তারা যেন ইবাদাত করে اَللهَ আল্লাহর مُخْلِصِيْنَ খাটি মনে لَهُ তার জন্য اَلدِّيْنَ দ্বীনকে حُنَفَآءَ একনিষ্ঠ করে, وَيُقِيْمُوْا কায়েম করে اَلصَّلَاةَ নামায وَيُؤْتُوْا এবং দেয় اَلزَّكَاةَ যাকাত। وَذٰلِكَ আর এটাই دِيْنُ الْقَيِّمَةِ সঠিক ধর্ম।

সরল অনুবাদ :

(১) আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের১ মধ্যে যারা কুফরী করেছে, তারা (কুফরী থেকে) বিরত হবে না- যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আসে।২ (২) আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রাসূল, যিনি আবৃত্তি করবেন পবিত্র সহীফাসমূহ-৩ (৩) তাতে থাকবে লিখিত সত্য ও সঠিক বিধানসমূহ।৪ (৪) আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তা তো বিভেদ সৃষ্টি করেনি- তাদের প্রতি সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর ছাড়া।৫ (৫) তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে; এটাই সঠিক ধর্ম।৬

টীকা :

[১] আহলে কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকান্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দুটি পৃথক নাম দেয়া হয়েছে। যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলে কিতাব; আর তারা হল ইয়াহুদী ও নাসারাগণ। আর যারা মূর্তি-পূজারী বা অগ্নি-পূজারী বা অন্যান্য শিরকে লিপ্ত ছিল তারা ছিল মুশরিক।

[২] অর্থাৎ তারা তাদের কুফরী থেকে নিবৃত্ত হবে না- যতক্ষণ না একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে তাদেরকে কুফরীর প্রতিটি গলদ ও সত্য বিষয় বুঝাবে এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে সত্য সঠিক পথ তাদের সামনে পেশ করবে, এর মাধ্যমে তারা কুফরী থেকে বের হতে পারবে। এর মানে এ নয় যে, এই সু্স্পষ্ট প্রমাণটি এসে যাবার পর তারা সবাই কুফরী পরিত্যাগ করবে। তবে তা আসার পরও তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের কুফরীর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তাবে। এরপর তারা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আপনি আমাদের হেদায়াতের কোন ব্যবস্থা করেননি।

(সূরা নিসা : ১৬৪-১৬৫), (সূরা মায়েদা : ১৯)

[৩] صُحُفٌ শব্দটি صَحِيْفَةٌ এর বহুবচন। আভিধানিক অর্থে সহীফা বলা হয় লেখার জন্য প্রস্তুত, কিংবা লিখিত পাতাকে। এখানে পবিত্র সহীফা মানে হচ্ছে এমন সব সহীফা, যার মধ্যে কোন প্রকার বাতিল, কোন ধরনের গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা নেই এবং শয়তান যার নিকটে আসে না। এখানে পবিত্র সহীফা তিলাওয়াত করে শুনানো অর্থ তিনি সেসব বিধান শুনাতেন, যা পরে সহীফার মাধ্যমে সংরক্ষিত করা হয়। কেননা প্রথমে রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন সহীফা থেকে নয়, স্মৃতি থেকে পাঠ করে শুনাতেন।

[৪] যে সমস্ত লিখিত লিপিসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, তা সত্য, ইনসাফপূর্ণ ও সরল-সহজ। এর বিধি-বিধানই মানুষকে সরল পথের সন্ধান দেয়।

[৫] আহলে কিতাবদের নিকটেই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর গুণাবলি, পরিচিতি ইত্যাদি জ্ঞান ছিল; তাই আয়াতে তাদের কথাই বলা হয়েছে- মুশরিকদের উল্লেখ করা হয়নি। আহলে কিতাবরা সত্যকে জানার পরেও অনেকে তা অস্বীকার করেছিল। কিন্তু প্রথম ব্যাপারে উভয় দলই শরীক ছিল।

[৬] অর্থাৎ আহলে কিতাবদেরকে আদেশ করা হয়েছিল খাঁটি মনে ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করতে, সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে। এরপর বলা হয়েছে, এ নির্দেশটি শুধুমাত্র বর্তমান কিতাবধারীদের জন্য নয়; বরং সঠিক মিল্লাতের অথবা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সমস্ত কিতাবধারীদের তরীকাও তাই।

আয়াত : ৬-৮

اِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَاۤ اُولٰٓئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ (৬) اِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ اُولٰٓئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ (৭) جَزَآؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَاۤ اَبَدًا رَّضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ذٰلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهٗ (৮)

শাব্দিক অনুবাদ :

(৬) اِنَّ الَّذِيْنَ নিশ্চয় যারা كَفَرُوْا কুফরী করেছে مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ আহলে-কিতাবদের থেকে وَالْمُشْرِكِيْنَ এবং মুশরিকদের থেকে فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ তারা থাকবে জাহান্নামের আগুনে خَالِدِيْنَ স্থায়ীভাবে فِيْهَا সেখানে اُولٰٓئِكَ هُمْ তারাই হবে شَرُّ অধম اَلْبَرِيَّةِ সৃষ্টির মধ্যে। (৭) اِنَّ الَّذِيْنَ নিশ্চয় যারা اٰمَنُوْا ঈমান এনেছে وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ এবং সৎকর্ম করেছে, اُولٰٓئِكَ هُمْ তারাই হবে خَيْرُ উত্তম اَلْبَرِيَّةِ সৃষ্টির মধ্যে। (৮) جَزَآؤُهُمْ তাদের প্রতিদান রয়েছে عِنْدَ رَبِّهِمْ তাদের পালনকর্তার কাছে جَنَّاتُ জান্নাত عَدْنٍ চিরস্থায়ী تَجْرِيْ প্রবাহিত রয়েছে مِنْ تَحْتِهَا যার তলদেশ দিয়ে اَلْاَنْهَارُ ঝর্ণাধারা; خَالِدِيْنَ চিরস্থায়ীভাবে থাকবে فِيْهَا সেখানে اَبَدًا সর্বদা। رَضِيَ সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন اَللهُ আল্লাহ عَنْهُمْ তাদের প্রতি وَرَضُوْا এবং তারাও সন্তুষ্ট হয়ে গেছে عَنْهُ তাঁর (আল্লাহর) প্রতি। ذٰلِكَ এটা لِمَنْ তার জন্যে যে خَشِيَ ভয় করে رَبَّهٗ তার পালনকর্তাকে।

সরল অনুবাদ :

(৬) আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফির, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।৭ (৭) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা। (৮) তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান- চিরস্থায়ী জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট৮ এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার প্রতিপালককে ভয় করে।৯

টীকা :

[৭] অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি আর নেই। এমনকি তারা পশুর চেয়েও অধম। কারণ পশুর বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি নেই। কিন্তু এরা বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি সত্ত্বেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

[৮] এ আয়াতে জান্নাতীদের প্রতি সর্ববৃহৎ নিয়ামত আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, হে জান্নাতীগণ! তখন তারা জবাব দেবে, হে আমাদের রব! আমরা উপস্থিত এবং আপনার আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত, সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট? তারা জবাব দেবে, হে আমাদের রব! এখনও সন্তুষ্ট হব না কেন? আপনি তো আমাদেরকে এতসব দিয়েছেন, যা অন্য কোন সৃষ্টি পায়নি। আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদেরকে আরো উত্তম নিয়ামত দিচ্ছি। আমি তোমাদের প্রতি আমার সন্তুষ্টি নাযিল করেছি। অতঃপর কখনও তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হব না। (সহীহ বুখারী, হা/৬৫৪৯; ৭৫১৮; সহীহ মুসলিম, হা/২৮২৯)

[৯] অন্য কথায় যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক এবং তাঁর মোকাবিলায় দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে জীবন যাপন করে না। বরং দুনিয়ায় প্রতি পদে পদে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করে; তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে তাকওয়া অবলম্বন করে। তার জন্যই আল্লাহর কাছে রয়েছে এই প্রতিদান ও পুরস্কার।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যেও ইসলাম আগমন করেছিল; কিন্তু তারা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করার মাধ্যমে দ্বীন থেকে বিচ্যূত হয়ে গিয়েছিল।

স্পষ্ট প্রমাণ আসার সাথে সাথেই দ্বীন গ্রহণ করে নেয়া উচিত।

রাসূল আগমন করা এবং তাদের উপর কিতাব বা সহিফা নাযিল হওয়াটা আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম নিদর্শন।

ইয়াহুদীরা নবী ﷺ এর আগমন সম্পর্কে অপেক্ষমান ছিল। অতঃপর তার আগমনের পর তারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে যায়; কেউ ঈমান আনে এবং কেউ ইয়াহুদীই থেকে যায়।

কাফিররা সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে অধম। তাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।

ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকেরাই হচ্ছে সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। তারা পরকালে স্থায়ীভাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

জান্নাতীরা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহ তা‘আলাও জান্নাতীদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন।

আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাঁকে যথাযথভাবে ভয় করা।

২৪
৯৯- সূরা যিলযাল
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতে উল্লেখিত زِلْزَالَهَا শব্দ থেকে এ সূরার নাম সূরা যিলযাল রাখা হয়েছে। এর অর্থ প্রকম্পিত হওয়া।

নাযিলের সময়কাল :

এটি মক্কায় প্রাথমিক যুগে এমন সময় নাযিল হয়, যখন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে ইসলামের বুনিয়াদী আকিদা-বিশ্বাস মানুষের সামনে পেশ করা হচ্ছিল।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন এবং সেখানে দুনিয়ায় করা সমস্ত কাজের হিসেব মানুষের সামনে এসে যাওয়া। সর্বপ্রথম তিনটি ছোট ছোট বাক্যে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মানুষের দ্বিতীয় জীবনের সূত্রপাত কিভাবে হবে এবং মানুষের জন্য তা হবে কেমন বিস্ময়কর। তারপর দুটি বাক্যে বলা হয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীর বুকে অবস্থান করে নিশ্চিন্তে সব রকমের কাজ করে গেছে। সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই নিষ্প্রাণ জিনিস কোনদিন তার কাজকর্মের পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহর হুকুমে সেদিন সে কথা বলতে থাকবে। প্রত্যেকটি লোকের ব্যাপারে সে বলবে, কোন সময় কোথায় সে কী কাজ করেছিল। তারপর বলা হয়েছে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ নিজেদের কবর থেকে বের হয়ে দলে দলে আসতে থাকবে। তাদের কর্মকান্ড তাদেরকে দেখানো হবে। এমন পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিতভাবে এই কর্মকান্ড পেশ করা হবে যে, সামান্য বালুকণা পরিমাণ নেকী বা পাপও সামনে এসে যাবে।

আয়াত : ১-৮



اِذَا زُلْزِلَتِ الْاَرْضُ زِلْزَالَهَا (১) وَاَخْرَجَتِ الْاَرْضُ اَثْقَالَهَا (২) وَقَالَ الْاِنْسَانُ مَا لَهَا (৩) يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ اَخْبَارَهَا (৪) بِاَنَّ رَبَّكَ اَوْحٰى لَهَا (৫) يَوْمَئِذٍ يَّصْدُرُ النَّاسُ اَشْتَاتًا لِّيُرَوْا اَعْمَالَهُمْ (৬) فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَهٗ (৭) وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَهٗ (৮)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِذَا যখন زُلْزِلَتْ প্রকম্পিত হবে اَلْاَرْضُ পৃথিবী زِلْزَالَهَا তাঁর কম্পনে। (২) وَاَخْرَجَتْ এবং বের করে দেবে اَلْاَرْضُ পৃথিবী اَثْقَالَهَا তাঁর বোঝা। (৩) وَقَالَ এবং বলবে اَلْاِنْسَانُ মানুষ مَا لَهَا এর কী হল? (৪) يَوْمَئِذٍ সেদিন تُحَدِّثُ সে বর্ণনা করবে اَخْبَارَهَا তার বৃত্তান্ত। (৫) بِاَنَّ কারণ رَبَّكَ আপনার পালনকর্তা اَوْحٰى আদেশ করবেন لَهَا তাকে। (৬) يَوْمَئِذٍ সেদিন يَصْدُرُ প্রকাশ পাবে اَلنَّاسُ মানুষ اَشْتَاتًا বিভিন্ন দলে, لِيُرَوْا যাতে তাদেরকে দেখানো হয় اَعْمَالَهُمْ তাদের কৃতকর্ম। (৭) فَمَنْ অতঃপর যে ব্যক্তি يَعْمَلْ কাজ করবে مِثْقَالَ ذَرَّةٍ অণু পরিমাণ خَيْرًا সৎ (কাজ) يَرَهٗ সে তা দেখতে পাবে। (৮) وَمَنْ এবং যে ব্যক্তি يَعْمَلْ কাজ করবে مِثْقَالَ ذَرَّةٍ অণু পরিমাণ شَرًّا অসৎ (কাজ) يَرَهٗ সে তা দেখতে পাবে।

সরল অনুবাদ :

(১) যখন জমিন তাঁর কম্পনে ভীষণভাবে প্রকম্পিত হবে,১ (২) যখন সে তাঁর বোঝা বের করে দেবে২ (৩) এবং মানুষ বলবে, এর কী হল?৩ (৪) সেদিন সে তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে,৪ (৫) কারণ, আপনার প্রতিপালক তাকে আদেশ করবেন। (৬) সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বের হবে,৫ যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্মসমূহ দেখানো যায়।৬ (৭) অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে,৭ (৮) আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।৮

টীকা :

[১] ‘যিলযাল’ মানে হচ্ছে প্রচন্ডভাবে জোরে জোরে ঝাড়া দেয়া, ভূকম্পিত হওয়া।

[২] এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। (এক) মরা মানুষ মাটির বুকে যেখানে যে অবস্থায় যে আকৃতিতে আছে দ্বিতীয় ফুঁৎকারের পরে তাদের সবাইকে বের করে সে বাইরে ফেলে দেবে এবং যাবতীয় মৃতকে বের করে হাশরের মাঠের দিকে চালিত করবে। মানুষের শরীরের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অংশগুলো এক জায়গায় জমা হয়ে নতুন করে আবার সেই একই আকৃতি সহকারে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন সে তার প্রথম জীবনের অবস্থায় ছিল। (দুই) এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র মৃত মানুষদেরকে সে বাইরে নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হবে না; বরং তাদের প্রথম জীবনের সমস্ত কথা ও কাজ এবং যাবতীয় আচার-আচরণের রেকর্ড ও সাক্ষ্য-প্রমাণের যে স্তূপ তার গর্ভে চাপা পড়ে আছে সেগুলোকেও বের করে বাইরে ফেলে দেবে। পরবর্তী বাক্যটিতে এ কথারই প্রকাশ ঘটেছে। তাতে বলা হয়েছে, জমিন তার উপর যা কিছু ঘটেছে তা বর্ণনা করবে। (তিন) কোন কোন মুফাসসির এর তৃতীয় একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন। সেটি হচ্ছে সোনা, রূপা, হীরা, মনি-মুক্তা এবং অন্যান্য যেসব মূল্যবান সম্পদ ভূগর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সেগুলোর বিশাল বিশাল স্তূপও সেদিন জমিন উগলে দেবে। তখন যে ব্যক্তি ধন-সম্পদের জন্য কাউকে হত্যা করেছিল, সে তা দেখে বলবে, এর জন্যই কি আমি এত বড় অপরাধ করেছিলাম? অতঃপর কেউ এসব স্বর্ণখন্ডের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না।

(সহীহ মুসলিম, হা/১০১৩)

[৩] মানুষ অর্থ প্রত্যেকটি মানুষ হতে পারে। কারণ পুনরায় জীবন লাভ করে চেতনা ফিরে পাবার সাথে সাথেই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া এটিই হবে যে, এসব কী হচ্ছে? এটা যে হাশরের দিন এ কথা সে পরে বুঝতে পারবে। আবার মানুষ অর্থ আখেরাত অস্বীকারকারী মানুষও হতে পারে। কারণ যে বিষয়কে অসম্ভব মনে করতো তা তার সামনে ঘটে যেতে থাকবে এবং সে এসব দেখে অবাক ও পেরেশান হবে। তবে ঈমানদারদের মনে এ ধরনের বিস্ময় ও পেরেশানি থাকবে না।

[৪] এর এক অর্থ, জমিন তার থেকে যা যা বের করে দিল (সম্পদরাজি) তা জানিয়ে দিবে। এর আরেকটি অর্থ জমিন তার মধ্যে কৃত ভাল-মন্দ যাবতীয় কর্মকান্ডের হিসাব দাখিল করবে।

জমিনের উপর যা কিছু ঘটে গেছে তার সবকিছু সে কিয়ামতের দিন বলে দেবে, জমিন সম্পর্কে এ কথাটি প্রাচীন যুগে মানুষকে অবাক করে দিয়ে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ তারা মনে করে থাকবে, জমিন আবার কেমন করে কথা বলবে? কিন্তু আজ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন নতুন জ্ঞান-গবেষণা, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, লাউড স্পীকার, রেডিও, টেলিভিশন, টেপরেকর্ডার ও ইলেকট্রনিক ইত্যাদি যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের এ যুগে জমিন তার নিজের অবস্থা ও নিজের উপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী কিভাবে বর্ণনা করবে এ কথা অনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয়। মানুষ তার মুখ থেকে যা কিছু উচ্চারণ করে তার পূর্ণ অবয়ব বাতাসে, রেডিও তরঙ্গে, ঘরের দেয়ালে, মেঝে এবং কোন পথে, ময়দানে বা ক্ষেতে কোন কথা বলে থাকলে সেখানকার প্রতিটি অণু-কণিকায় তা গেঁথে আছে। আল্লাহ যখনি চাইবেন এ কথাগুলোকে এসব জিনিসের মাধ্যমে তখনই হুবহু ঠিক তেমিনভাবে শুনিয়ে দিতে পারবেন যেভাবে সেগুলো একদিন মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। সে সময় মানুষ নিজের কানেই নিজের এই আওয়াজ শুনে নেবে। তার পরিচিত জনেরাও তার এই আওয়াজ চিনে নেবে এবং তারা একে তারই কণ্ঠধ্বনি ও বাকভঙ্গীমা বলে শনাক্ত করবে। তারপর মানুষ জমিনের যেখানেই যে অবস্থায় যে কোন কাজ করেছে তার প্রতিটি নড়াচড়া ও অঙ্গভঙ্গির প্রতিচ্ছবি তার চারপাশের সমস্ত বস্তুতে পড়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে সেসব চিত্রায়িত হয়ে রয়েছে। একেবারে নিকষ কালো আধারের বুকে সে কোন কাজ করে থাকলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীন এমন সব রশ্মি রয়েছে যেগুলোর কাছে আলো-আধার সমান, তারা সকল অবস্থায় তার ছবি তুলতে পারে। এসব ছবি কিয়ামতের দিন একটি ফিল্মের মতো মানুষের সামনে এসে যাবে এবং সারা জীবন সে কোথায় কী করেছে তা তাকে দেখিয়ে দেবে।

[৫] এর অর্থ, সেদিন মানুষ হাশরের মাঠ থেকে তাদের আমল অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাবে; তাদের কেউ জান্নাতে যাবে, কেউ যাবে জাহান্নামে। এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, বিগত হাজার হাজার বছরে সমস্ত মানুষ যে যেখানে মরেছিল সেখান থেকে অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে আসতে থাকবে। (সূরা নাবা : ১৮)

[৬] অর্থাৎ তাদের আমল তাদেরকে দেখানো হবে। প্রত্যেকে দুনিয়ায় কী কাজ করে এসেছে তা তাকে বলা হবে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কাফির, মুমিন, সৎকর্মশীল ও ফাসেক, আল্লাহর হুকুমের অনুগত ও নাফরমান সবাইকে অবশ্যই তাদের আমলনামা দেয়া হবে। (সূরা হাক্কাহ : ১৯,২৫; সূরা ইনশিকাক : ৭-১০)

[৭] এ আয়াতে خَيْرٌ বলে শরীয়তসম্মত সৎকর্ম বুঝানো হয়েছে, যা ঈমানের সাথে সম্পাদিত হয়ে থাকে। কেননা ঈমান ব্যতীত কোন সৎকর্মই আল্লাহর কাছে সৎকর্ম নয়। কুফর অবস্থায় কৃত সৎকর্ম আখেরাতে ধর্তব্য হবে না- যদিও দুনিয়াতে তার প্রতিদান দেয়া হয়।

[৮] প্রত্যেকটি সামান্যতম ও নগণ্যতম সৎকাজেরও একটি ওজন ও মূল্য রয়েছে এবং অনুরূপ অবস্থা অসৎকাজেরও। অসৎকাজ যত ছোটই হোক না কেন অবশ্যই তার হিসাব হবে এবং তা কোনক্রমেই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই কোন ছোট সৎকাজকে ছোট মনে করে ত্যাগ করা উচিত নয়। অনুরূপভাবে কোন ছোট ও নগণ্য অসৎকাজও না করা উচিত; কারণ এই ধরনের অনেকগুলো ছোট গোনাহ একত্র হয়ে একটি বিরাট গোনাহের স্তূপ জমে উঠতে পারে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা করো, তা এক টুকরো খেজুর দান করা বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন (সহীহ বুখারী, হা/৬৫৪০) । রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো বলেন, সাবধান! ছোট গোনাহসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কারণ সেগুলো সব মানুষের উপর একত্র হয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে।

(মুসনাদে আহমাদ : ১/৪০২)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কিয়ামতের পূর্বে ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে, যার ফলে জমিন থেকে সকল মৃত মানুষ ও ধন সম্পদ বের হয়ে আসবে।

কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে।

কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে জমিন মানুষের কৃতকর্মের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করবে।

কিয়ামতের দিন মানুষের সমস্ত কৃতকর্ম প্রকাশ পেয়ে যাবে।

২৫
১০০- সূরা আদিয়াত
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম শব্দ اَلْعَادِيَاتُ (আল আদিয়াত)-কে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। عَدْوٌ অর্থ দৌড়ানো। এখানে ঘোড়াকে বুঝানো হয়েছে।

নাযিলের সময়কাল :

এটি মক্কী যুগের প্রথম দিকে নাযিল হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

মানুষ আখেরাতকে অস্বীকার করে অথবা তা থেকে গাফেল হয়ে কেমন নৈতিক অধঃপতনের দিকে চলে যায়- এ কথা লোকদের বুঝানোই এই সূরাটির উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে আরবে সাধারণভাবে যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে ছিল এবং যার ফলে সমগ্র দেশবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তাকে যুক্তি ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে।

এ পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন এবং সেখানে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করার ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে মানুষ তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়েছে। সে আল্লাহর দেয়া ক্ষমতাগুলোকে জুলুম-নিপীড়নের কাজে ব্যবহার করছে। সে ধন-সম্পদের প্রেমে অন্ধ হয়ে তা অর্জন করার জন্য যে কোন অন্যায়, অসৎ ও গর্হিত পন্থা অবলম্বন করতে কুণ্ঠিত হয় না। তার অবস্থা নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সে নিজের রবের দেয়া শক্তিগুলোর অপব্যবহার করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাহীনতার প্রকাশ করছে। যদি সে সেই সময়ের কথা জানতো যখন কবর থেকে জীবিত হয়ে আবার উঠতে হবে তাহলে সে এই দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি কখনই অবলম্বন করতে পারতো না। দুনিয়ায় কে কী করে এসেছে এবং কার সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করা উচিত মানুষের রব সে সময় সে কথা খুব ভালোভাবেই জানবেন।

আয়াত : ১-১১



وَالْعَادِيَاتِ ضَبْحًا (১) فَالْمُوْرِيَاتِ قَدْحًا (২) فَالْمُغِيْرَاتِ صُبْحًا (৩) فَاَثَرْنَ بِه نَقْعًا (৪) فَوَسَطْنَ بِه جَمْعًا (৫) اِنَّ الْاِنْسَانَ لِرَبِّه لَكَنُوْدٌ (৬) وَاِنَّهٗ عَلٰى ذٰلِكَ لَشَهِيْدٌ (৭) وَاِنَّهٗ لِحُبِّ الْخَيْرِ لَشَدِيْدٌ (৮) اَفَلَا يَعْلَمُ اِذَا بُعْثِرَ مَا فِي الْقُبُوْرِ (৯) وَحُصِّلَ مَا فِي الصُّدُوْرِ (১০) اِنَّ رَبَّهُمْ بِهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّخَبِيْرٌ (১১)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالْعَادِيَاتِ শপথ অশ্বসমূহের ضَبْحًا ঊর্ধ্বশ্বাসে চলমান, (২) فَالْمُوْرِيَاتِ অতঃপর ক্ষুরাঘাতে বিচ্ছুরণকারী قَدْحًا আগুনের ফুলকী। (৩) فَالْمُغِيْرَاتِ অতঃপর আগমনকারী অশ্বসমূহের صُبْحًا প্রভাতকালে (৪) فَاَثَرْنَ আর তারা উৎক্ষিপ্ত করে بِه  তা দ্বারা نَقْعًا ধূলিকণা। (৫) فَوَسَطْنَ অতঃপর যারা ঢুকে পড়ে بِه  যার দ্বারা جَمْعًا কোন জনপদে। (৬) اِنَّ নিশ্চয় اَلْاِنْسَانَ মানুষ لِرَبِّه  তার পালনকর্তার প্রতি لَكَنُوْدٌ অকৃতজ্ঞ। (৭) وَاِنَّهٗ এবং নিশ্চয় সে عَلٰى ذٰلِكَ এ বিষয়ে لَشَهِيْدٌ অকাট্য সাক্ষী। (৮) وَاِنَّهٗ এবং নিশ্চয় সে لِحُبِّ الْخَيْرِ ধন-সম্পদের ভালোবাসায় لَشَدِيْدٌ খুব বেশি মত্ত। (৯) اَفَلَا يَعْلَمُ সে কি জানে না, اِذَا যখন بُعْثِرَ উত্থিত হবে مَا فِي الْقُبُوْرِ কবরে যা আছে তা, (১০) وَحُصِّلَ এবং প্রকাশ করা হবে مَا فِي الصُّدُوْرِ অন্তরে যা আছে? (১১) اِنَّ নিশ্চয় رَبَّهُمْ তাদের প্রতিপালক بِهِمْ তাদের সম্পর্কে يَوْمَئِذٍ সেদিন لَخَبِيْرٌ সবিশেষ জ্ঞাত।

সরল অনুবাদ :

(১) শপথ ঊর্ধ্বশ্বাসে চলমান অশ্বসমূহের।১ (২) অতঃপর ক্ষুরাঘাতে অগ্নিবিচ্ছুরক অশ্বসমূহের।২ (৩) অতঃপর প্রভাতকালে অভিযানকারীর৩ (৪) যার দ্বারা তারা ধূলি উড়ায়।৪ (৫) অতঃপর তারা তার মাধ্যমে কোনো জনপদে ঢুকে পড়ে।৫ (৬) নিশ্চয় মানুষ তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।৬ (৭) আর অবশ্যই সে এ বিষয়ে নিজেই অকাট্য সাক্ষী।৭ (৮) এবং নিশ্চয় সে ধন-সম্পদের ভালোবাসায় মত্ত।৮ (৯) সে কি জানে না, যখন কবরে যা আছে তা উত্থিত হবে, (১০) এবং অন্তরে যা আছে, তা প্রকাশ করা হবে?৯ (১১) সেদিন তাদের কী হবে, সে সম্পর্কে তাদের প্রতিপালক সবিশেষ জ্ঞাত।১০

টীকা :

[১] اَلْعَادِيَاتُ অর্থ দৌড়ানো। ضَبْحٌ বলা হয় ঘোড়ার দৌড় দেয়ার সময় তার বক্ষ থেকে নির্গত আওয়াজকে। কোন কোন গবেষকের মতে এখানে দৌড়ানো শব্দের মাধ্যমে ঘোড়া বা উট অথবা উভয়টিও উদ্দেশ্য হতে পারে। তবে ইমাম কুরতুবী ঘোড়াকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

[২] مُوْرِيَاتٌ অর্থ অগ্নি নির্গত করা। قَدْحٌ এর অর্থ আঘাত করা, ঘর্ষণ করা, যার কারণে আগুন তৈরি হয়। লৌহনাল পরিহিত অবস্থায় ঘোড়া যখন প্রস্তরময় মাটিতে ক্ষুরাঘাত করে দৌড় দেয়, তখন অগ্নিস্ফূলিঙ্গ নির্গত হয়।

[৩] مُغِيْرَاتٌ শব্দটি إِغَارَةٌ থেকে উদ্ভূত। অর্থ হামলা করা, হানা দেয়া। صُبْحًا ভোর বেলায় বলে আরবদের অভ্যাস হিসেবে প্রভাতকালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, আরববাসীদের নিয়ম ছিল, কোন জনপদে অতর্কিত আক্রমণ করতে হলে তারা রাতের আঁধারে বের হয়ে পড়তো। এর ফলে শত্রুপক্ষ পূর্বে সতর্ক হতে পারতো না। এভাবে একেবারে খুব সকালে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো।

[৪] أَثَرْنَ শব্দটি إِثَارَةٌ থেকে উৎপন্ন। অর্থ ধূলি উড়ানো। نَقْعٌ বলা হয় ধূলিকে। আর بِه  শব্দের অর্থ, সে সময়ে বা শত্রুদের সে স্থানে। অর্থাৎ অশ্বসমূহ যুদ্ধক্ষেত্রে এত দ্রুত ধাবমান হয় যে, তাদের ক্ষুর থেকে ধূলি উড়ে চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে ফেলে।

[৫] وَسَطْنَ শব্দটির অর্থ কোন কিছুর মধ্যভাগে পৌঁছে দেওয়া। جَمْعًا অর্থ দল বা গোষ্ঠী। আর بِه  অর্থ, তা দ্বারা। এখানে তা বলতে আরোহীদের দ্বারা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ অশ্বসমূহ ধূলিকণা উড়িয়ে তাদের আরোহীদের নিয়ে শত্রুদের মধ্যভাগে পৌঁছে যায়।

[৬] এত বড় শপথ করার পরে এখানে যে উদ্দেশ্যে শপথ করা হয়েছে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। শপথের মূলকথা হচ্ছে এটা বর্ণনা করা যে, মানুষ তার প্রভুর অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে থাকে। كَنُوْدٌ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, মানুষ তার রবের নিয়ামতের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ। হাসান বসরী বলেন, كَنُوْدٌ এর অর্থ সে ব্যক্তি, যে বিপদ স্মরণ রাখে এবং নিয়ামত ভুলে যায়।

[৭] এখানে ‘সে’ বলে বুঝানো হচ্ছে, মানুষ নিজেই এ বিষয়ে সাক্ষী। এ সাক্ষ্য নিজ মুখেই প্রকাশ করতে পারে, আবার কাজ-কর্ম ও অবস্থার মাধ্যমেও প্রকাশিত হতে পারে। এর আরেকটি অর্থ হতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের এ অকৃতজ্ঞতার ব্যাপারে সাক্ষী।

[৮] خَيْرٌ এর শাব্দিক অর্থ মঙ্গল। এখানে ব্যাপক অর্থ ত্যাগ করে আরবের বাকপদ্ধতি অনুযায়ী এ আয়াতে ধন-সম্পদকে خَيْرٌ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এ আয়াতটির অর্থও দু’রকম হতে পারে। (এক) সে সম্পদের আসক্তির কারণে প্রচন্ড কৃপণ; (দুই) সম্পদের প্রতি তার আসক্তি অত্যন্ত প্রবল। দ্বিতীয় অর্থটির মধ্যেই মূলত প্রথমটি চলে আসে; কেননা সম্পদের প্রতি প্রচন্ড আসক্তিই কৃপণতার কারণ।

[৯] অর্থাৎ অন্তরের ভালো-মন্দ পৃথক করে প্রকাশ করে দেওয়া হবে। ফলে গোপনগুলো প্রকাশ হয়ে পড়বে; মানুষের কর্মফল তাদের চেহারায় ফুটে উঠবে।

[১০] অর্থাৎ তাদের রব তাদের ব্যাপারে অবশ্যই যথেষ্ট অবহিত, তাদের কোন কাজই তার নিকট গোপন নয়। তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বা গোপন সব কাজ-কর্মই তিনি জানেন। তিনি তাদেরকে এগুলোর উপযুক্ত প্রতিদানও দেবেন।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাটাই হচ্ছে মানুষের চিরন্তন স্বভাব।

প্রতিটি মানুষ নিজেই নিজের জন্য সাক্ষী।

অধিকাংশ মানুষ পার্থিব ধন-সম্পদের ভালোবাসায় মুহিত হয়ে থাকে।

কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে।

কিয়ামতের দিন মানুষের অন্তরে লুকায়িত সমস্ত বিষয় প্রকাশ পেয়ে যাবে।

২৬
১০১- সূরা কারি’আহ
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম শব্দ اَلْقَارِعَةُ (আল কারি‘আহ)-কে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর অর্থ করাঘাতকারী। এখানে মহাপ্রলয়ের ভয়ঙ্কর অবস্থা উদ্দেশ্য।

নাযিলের সময়কাল :

এ সূরা মক্কী হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। এটি মক্কায় প্রথম যুগে অবতীর্ণ হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে কিয়ামত ও আখেরাত। সর্বপ্রথম লোকদেরকে একটি মহাদুর্ঘটনা বলে আতংকিত করে দেয়া হয়েছে। কী সেই মহাদুর্ঘটনা? তুমি কী জানো সেই মহা দুর্ঘটনাটি কী? এভাবে শ্রোতাদেরকে একটি ভয়াবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর শোনার জন্য প্রস্তুত করার পর দুটি বাক্যে তাদের সামনে কিয়ামতের নকশা এঁকে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সেদিন লোকেরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এমনভাবে চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে যেমন প্রদীপের আলোর চারদিকে পতঙ্গরা নির্লিপ্তভাবে ছুটাছুটি করতে থাকে। পাহাড়গুলো সমূলে উৎপাটিত হয়ে স্থানচ্যূত হবে। তাদের বাঁধন থাকবে না। তারা তখন হয়ে যাবে ধূনা পশমের মতো। তারপর বলা হয়েছে, আখেরাতে লোকদের কাজের হিসেব নিকেশ করার জন্য যখন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে তখন কার সৎকাজ তার অসৎকাজের চাইতে ওজনে ভারী এবং কার সৎকাজ হালকা- এরই ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধরনের লোকেরা আরাম ও সুখের জীবন লাভ করে আনন্দিত হবে। আর দ্বিতীয় ধরনের লোকদেরকে এমন গভীর গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হবে, যেগুলো থাকবে শুধু আগুনে ভরা।

আয়াত : ১-১১



اَلْقَارِعَةُ (১) مَا الْقَارِعَةُ (২) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ (৩) يَوْمَ يَكُوْنُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوْثِ (৪) وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوْشِ (৫) فَاَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِيْنُهٗ (৬) فَهُوَ فِيْ عِيْشَةٍ رَّاضِيَةٍ (৭) وَاَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِيْنُهٗ (৮) فَاُمُّهٗ هَاوِيَةٌ (৯) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا هِيَهْ (১০) نَارٌ حَامِيَةٌ (১১)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اَلْقَارِعَةُ করাঘাতকারী, (২) مَا الْقَارِعَةُ করাঘাতকারী কী? (৩) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জান مَا الْقَارِعَةُ করাঘাতকারী কী? (৪) يَوْمَ যেদিন يَكُوْنُ হবে اَلنَّاسُ মানুষ كَالْفَرَاشِ পতঙ্গের মতো اَلْمَبْثُوْثِ বিক্ষিপ্ত (৫) وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ এবং পর্বতসমূহ হবে كَالْعِهْنِ রঙীন পশমের মতো اَلْمَنْفُوْشِ ধূনিত। (৬) فَاَمَّا তখন مَنْ যার ثَقُلَتْ ভারী হবে مَوَازِيْنُهٗ (নেকীর) পাল্লা, (৭) فَهُوَ সে তো থাকবে فِيْ عِيْشَةٍ رَّاضِيَةٍ সন্তোষজনক জীবনে (৮) وَاَمَّا আর مَنْ যার خَفَّتْ হালকা হবে مَوَازِيْنُهٗ পাল্লা, (৯) فَاُمُّهٗ তার ঠিকানা হবে هَاوِيَةٌ হাবিয়া। (১০) وَمَاۤ اَدْرَاكَ তুমি কি জান مَا هِيَهْ তা কী? (১১) نَارٌ حَامِيَةٌ প্রজ্বলিত অগ্নি।

সরল অনুবাদ :

(১) করাঘাতকারী,১ (২) করাঘাতকারী কী? (৩) আপনি কি জানেন, করাঘাতকারী কী? (৪) যেদিন মানুষ বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো হয়ে যাবে।২ (৫) এবং পর্বতগুলো হবে ধূনিত রঙীন পশমের মতো।৩ (৬) অতএব যার পাল্লা৪ ভারী হবে,৫ (৭) সে সুখী জীবন-যাপন করবে। (৮) আর যার পাল্লা হালকা হবে,৬ (৯) তার ঠিকানা হবে হাবিয়া।৭ (১০) আপনি জানেন, সেটা কী? (১১) (সেটা হলো) প্রজ্বলিত অগ্নি।৮

টীকা:

[১] এখানে মূল শব্দ হচ্ছে ‘কারিআহ’; এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, মহাবিপদ। ‘কারা‘আ’ মানে কোন জিনিসকে কোন জিনিসের উপর এমন জোরে মারা, যার ফলে তা থেকে প্রচন্ড আওয়াজ হয়। এই শাব্দিক অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বিপদের ক্ষেত্রে কারিআহ শব্দ বলা হয়ে থাকে। এখানে আল কারিআহ শব্দটি কিয়ামতের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

[২] সেদিনের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ তাদের বিক্ষিপ্ততা, আনা-গোনা ইত্যাদিতে উদ্ভ্রান্তের মতো থাকবে। মনে হবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল। আগুন জ্বালানোর পর পোকা-মাকড় যেমন সবদিক থেকে হন্য হয়ে আগুনের দিকে ছুটে আসে, সেদিন মানুষ তেমনিভাবে হাশরের মাঠের দিকে ছুটে আসবে।

[৩] অর্থাৎ তখন মহাদুর্ঘটনা ঘটে যাবে আর এর ফলে সারা দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, লোকেরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে। পাহাড়গুলো ধূনা পশমের মতো হবে- যা হালকা বাতাসে উড়ে যাবে।

[৪] এ সূরায় আমলের ওজন ও তার হালকা এবং ভারী হওয়ার প্রেক্ষিতে জাহান্নাম অথবা জান্নাত লাভের বিষয় আলোচিত হয়েছে। মূলে মাওয়াযীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দটি বহুবচন। এর কারণ হয় মীযানগুলো কয়েকটি হবে; অথবা যে আমলগুলো ওজন করা হবে, সেগুলো বিভিন্ন প্রকারের হবে। কিয়ামতের দিন মানুষের আমল ওজন করা হবে- গণনা হবে না। আমলের ওজন ইখলাস তথা আন্তরিকতা ও সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্যের কারণে বেড়ে যায়। যার আমল আন্তরিকতাপূর্ণ ও সুন্নতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সংখ্যায় কম হলেও তার আমলের ওজন বেশি হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সংখ্যায় সালাত, সাওম, দান-সাদাকা, হজ্জ-ওমরা অনেক করে, কিন্তু আন্তরিকতা ও সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্য কম, তাদের আমলের ওজন কম হবে।

[৫] বলা হয়েছে, যার পাল্লাসমূহ ভারী হবে সে থাকবে সন্তোষজনক জীবনে। পাল্লাভারী হওয়ার অর্থ সৎকর্মের পাল্লা অসৎকর্ম থেকে ভারী হওয়া।

[৬] অর্থাৎ যাদের অসৎকর্মের পাল্লা থেকে ভারী হবে।

[৭] اُمٌّ শব্দের অর্থ স্থান বা ঠিকানাও হয়। তাছাড়া আয়াতের আরেক অর্থ হলো, সে জাহান্নামের আগুনে অধোমুখে মাথার মগজসহ পতিত হবে। তাছাড়া যদি اُمٌّ শব্দটির মূল অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, মা। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তার মা হবে জাহান্নাম। মায়ের কোলে যেমন শিশুর অবস্থান হয়, তেমনি জাহান্নামবাসীদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া আর কোন অবস্থান হবে না। আয়াতে উল্লেখিত ‘হাভিয়াহ’ শব্দটি জাহান্নামের একটি নাম। এর অর্থ হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে নীচুতে পড়ে যাওয়া। আর যে গভীর গর্তে কোন জিনিস পড়ে যায় তাকে হাভিয়াহ বলে। জাহান্নামকে হাভিয়াহ বলার কারণ হচ্ছে, জাহান্নাম হবে অত্যন্ত গভীর এবং জাহান্নামবাসীদেরকে তার মধ্যে উপর থেকে নিক্ষেপ করা হবে।

[৮] এখানে حَامِيَةٌ বলে বুঝানো হয়েছে, আগুনটি হবে অত্যন্ত উত্তপ্ত ও লেলিহান। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আদম সন্তান যে আগুন ব্যবহার করে সেটি জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের একভাগ উত্তপ্ততা সম্পন্ন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটাই তো শাস্তির জন্য যথেষ্ট। তিনি বললেন, জাহান্নামের আগুন তার থেকে ঊনসত্তর গুণ বেশি উত্তপ্ত।

(সহীহ বুখারী, হা/৩২৬৫)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কিয়ামতের দিন মানুষকে পুনরুত্থান করা হবে এবং সেদিন তাদেরকে তাদের কর্মের যথাযথ প্রতিদান দেয়া হবে।

কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার প্রারম্ভে পৃথিবীতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

কিয়ামতের দিন আমল ওজন করার জন্য দাঁড়িপাল্লা প্রতিষ্ঠিত করা হবে। অতঃপর যার আমলের ওজন ভারি হবে সে জানণাতে যাবে এবং যার আমলের ওজন হালকা হবে সে জাহান্নামে যাবে।

২৭
১০২- সূরা তাকাসুর
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلتَّكَاثُرُ (আত-তাকাসুর) শব্দের আলোকে এর নাম রাখা হয় সূরা আত-তাকাসুর। এর অর্থ আধিক্য, প্রাচুর্য লাভের জন্য পরস্পরের অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা।

নাযিলের সময়কাল :

এটি মক্কী জীবনের প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম।

সূরার বিষয়বস্তু :

এই সূরায় মানুষকে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও বৈষয়িক স্বার্থ পূজার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এই ভালোবাসা ও স্বার্থ পূজার কারণে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেশি বেশি ধন-সম্পদ আহরণ, পার্থিব লাভ, স্বার্থ, উদ্ধার, ভোগ, প্রতিপত্তি ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ এবং তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে একজন আরেকজনকে টপকে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব অর্জন করার ব্যাপারে অহঙ্কারে মেতে থাকে। এই একটি মাত্র চিন্তা তাদেরকে এমনভাবে ব্যস্ত করে রেখেছে, যার ফলে এর চেয়ে উন্নততর কোন জিনিসের প্রতি নজর দেবার মানসিকতাই তাদের নেই। এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়ার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে, যেসব নিয়ামত তোমরা নিশ্চিন্তে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত, এগুলো শুধুমাত্র নিয়ামত নয়; বরং এগুলো তোমাদের জন্য পরীক্ষার বস্তুও। এগুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটি নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদেরকে আখেরাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

আয়াত : ১-৮



اَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ (১) حَتّٰى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (২) كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ (৩) ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ (৪) كَلَّا لَوْ تَعْلَمُوْنَ عِلْمَ الْيَقِيْنِ (৫) لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ (৬) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِيْنِ (৭) ثُمَّ لَتُسْاَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيْمِ (৮)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اَلْهَاكُمُ তোমাদেরকে গাফেল রাখে اَلتَّكَاثُرُ প্রাচুর্যের লালসা, (২) حَتّٰى যতক্ষণ না زُرْتُمْ তোমরা পৌঁছ اَلْمَقَابِرَ কবরস্থানে। (৩) كَلَّا কখনও (এটা সঙ্গত) নয়, سَوْفَ অচিরেই تَعْلَمُوْنَ তোমরা জানতে পারবে। (৪) ثُمَّ অতঃপর (আবার শুনে নাও) كَلَّا কখনও (এটা সঙ্গত) নয়, سَوْفَ অচিরেই تَعْلَمُوْنَ তোমরা জানতে পারবে। (৫) كَلَّا কখনই নয়; لَوْ যদি تَعْلَمُوْنَ তোমরা জানতে عِلْمَ الْيَقِيْنِ নিশ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে। (৬) لَتَرَوُنَّ তোমরা অবশ্যই দেখবে اَلْجَحِيْمَ জাহান্নাম। (৭) ثُمَّ অতঃপর (আবার শুনে নাও) لَتَرَوُنَّهَا তোমরা তা অবশ্যই দেখবে عَيْنَ الْيَقِيْنِ দিব্য-প্রত্যয়ে, (৮) ثُمَّ অতঃপর لَتُسْاَلُنَّ অবশ্যই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে يَوْمَئِذٍ সেদিন عَنِ النَّعِيْمِ নিয়ামত সম্পর্কে ।

সরল অনুবাদ :

(১) প্রাচুর্যের লালসা১ তোমাদেরকে গাফেল করে রেখেছে,১ (২) যতক্ষণ না তোমরা কবর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছ।৩ (৩) কখনো (সঙ্গত) নয়, অচিরেই তোমরা তা জানতে পারবে।৪ (৪) আবারও (শুনে নাও) কখনো (সঙ্গত) নয়, অচিরেই তোমরা তা জানতে পারবে। (৫) কখনো নয়, যদি তোমরা নিশ্চিত জানতে-৫ (তবে প্রাচুর্যের লালসা করতে না)। (৬) তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখতে পাবে। (৭) আবারও (শুনে নাও) তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখতে পাবে।৬ (৮) এরপর সেদিন তোমরা সেই নেয়ামত সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞেসিত হবে।৭

টীকা:

[১] বেশি বেশি বৈষয়িক স্বার্থ অর্জন করা, তার মধ্যে একে অন্যের অগ্রবর্তী হওয়া এবং অন্যের মোকাবেলায় তা নিয়ে গর্ব করার মোহ যেমন ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করে তেমনি আচ্ছন্ন করে গোত্র ও জাতিকেও। এখানে প্রাচুর্য বলতে যা কিছুর প্রাচুর্যের জন্য মানুষ সাধারণত চেষ্টা করে থাকে এবং অহঙ্কার করে থাকে সবই বুঝানো হয়েছে। হতে পারে সেটা ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, সাহায্য-সহযোগিতাকারী, সৈন্য-সামন্ত, দাস-দাসী, মান-মর্যাদা ইত্যাদি যাই মানুষ বেশি পেতে চায় এবং অপরের উপর প্রাধান্য নেয়ার চেষ্টা করে। আর যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকে না। এভাবে মানুষ আল্লাহ থেকে, তাঁর মাগফিরাত থেকে, তার দিকে প্রত্যাবর্তন থেকে, তাঁর ভালোবাসাকে সবকিছুর ভালোবাসার উপর স্থান দেয়া থেকে, যে ইবাদাতের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা থেকে গাফেল হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে তারা আখেরাত থেকেও গাফেল হয়ে গেছে।

[২] تَكَاثُرٌ শব্দটি كَثْرَةٌ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। এখানে উদ্দেশ্য, প্রাচুর্য লাভ করার জন্য মানুষের পরস্পরের অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা ও প্রতিযোগিতা করা; লোকদের অন্যের তুলনায় বেশি প্রাচুর্য লাভ করার কথা নিয়ে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করে বেড়ানো।

[৩] এখানে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থান যিয়ারত কর। এখানে যিয়ারত করার অর্থ মরে গিয়ে কবরে পৌঁছানো। কাতাদাহ বলেন, তারা বলত, আমরা অমুক বংশের লোক, আমরা অমুক গোত্রের চেয়ে বেশি, আমাদের সংখ্যা অনেক। এভাবে বলতেই থাকল অথচ তারা কমতে কমতে সবাই কবরবাসী হয়ে গেল। অতএব আয়াতের মর্মার্থ এই যে, বলা হয়েছে, যারা ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির ভালোবাসায় এমনভাবে মত্ত হয়ে পড়ে যে, নিজের পরিণাম চিন্তা করার ফুরসতই পায় না। আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখির (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট পৌঁছে দেখলাম তিনি اَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ তিলাওয়াত করে বলেছিলেন, ‘‘মানুষ বলে আমার ধন! আমার ধন! অথচ তোমার অংশ তো ততটুকুই যতটুকু তুমি খেয়ে শেষ করে ফেল, অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও, অথবা সাদাকা করে সম্মুখে পাঠিয়ে দাও। এছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে- তুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম, হা/২৯৫৮)

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, তবে সে (তাতে সন্তুষ্ট হবে না; বরং) দুটি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ তো (কবরের) মাটি ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়। যে আল্লাহর দিকে নিজেকে তৈরি করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। (সহীহ বুখারী, হা/৬৪৩৯; ৬৪৪০)

[৫] এখানে لَو বা ‘যদি’ শব্দের জবাব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ তোমরা যদি কিয়ামতের হিসাব-নিকাশে নিশ্চিত বিশ্বাসী হতে, তবে কখনও প্রাচুর্যের বড়াই করতে না এবং উদাসীন হতে না।

[৬] উপরে বলা হয়েছে, عَيْنَ الْيَقِيْنِ এর অর্থ সে প্রত্যয়, যা সরাসরি দেখা থেকে অর্জিত হয়।

[৭] অর্থাৎ তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে যে, সেগুলোর শোকর আদায় করছ কি না, সেগুলোতে আল্লাহর হক আদায় করেছ কি না; নাকি পাপকাজে ব্যয় করেছ? এতে সকল প্রকার নিয়ামত এসে যায়। অন্য আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে, ‘‘কান, চোখ, হৃদয়- এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা ইসরা : ৩৬) এতে মানুষের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয় সম্পর্কিত লাখো নিয়ামত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যেগুলো সে প্রতি মুহূর্তে ব্যবহার করে। বিভিন্ন হাদীসেও নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার কথা স্পষ্টভাবে এসেছে। যেমন- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, দুটি নিয়ামত আছে, যাতে অধিকাংশ মানুষই ঠক খায়। তার একটি হলো, স্বাস্থ্য অপরটি হচ্ছে অবসর সময়। (সহীহ বুখারী, হা/৬৪১২)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কবরের আযাব সত্য; অপরাধীদেরকে অবশ্যই এই আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।

কবরের জগতে অপরাধীরা তাদের পরবর্তী আবাসস্থল জাহান্নামকে সরাসরি দেখতে পাবে।

কবরে যাওয়ার পর এতদ্ববিষয়ে অস্বীকারকারীদের সমস্ত ভ্রান্ত মতবাদ সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

ধন-সম্পদের প্রাচুর্য লাভ করাটা আল্লাহ তা‘আলা একটি বড় ধরনের নিয়ামত এবং পরীক্ষাস্বরূপ; কিয়ামতের দিন এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

প্রাচুর্যের লালসায় বিভোর হয়ে থাকাটা মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য; তবে এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।

প্রাচুর্যের লালসা মানুষকে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক অনেক কর্মে লিপ্ত করে রাখে।

২৮
১০৩- সূরা আসর
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْعَصْرُ (আল-আসর) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় আল-আসর। এর অর্থ সময়।

নাযিলের সময়কাল :

এই সূরার বিষয়বস্তু সাক্ষ্য দেয় যে, এটি মক্কী যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে নাযিল হয়। সে সময় ইসলামের শিক্ষাকে সংক্ষিপ্ত ও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী বাক্যের সাহায্যে বর্ণনা করা হতো।

সূরার বিষয়বস্তু :

এ সূরাটি ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্য সমন্বিত বাণীর একটি অতুলনীয় নমুনা। কয়েকটা মাপজোকা শব্দের মধ্যে গভীর অর্থের এমন এক ভান্ডার রেখে দেয়া হয়েছে, যা বর্ণনা করার জন্য একটি বিরাট গ্রন্থও যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের এবং তার ধ্বংস ও সর্বনাশের পথ বর্ণনা করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূরা। তারা দুজন যখন পরস্পর মিলিত হতেন, তখন তারা একজন অপরজনকে সূরা আসর না শুনানো এবং সালাম বিনিময় না করা পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিদায় নিতেন না। (তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত : ৫১২০)

আয়াত : ১-৩



وَالْعَصْرِ (১) اِنَّ الْاِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ (২) اِلَّا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (৩)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَالْعَصْرِ কসম যুগের, (২) اِنَّ নিশ্চয় اَلْاِنْسَانَ মানুষ لَفِيْ خُسْرٍ ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে রয়েছে। (৩) اِلَّا তবে (তারা নয়) اَلَّذِيْنَ যারা اٰمَنُوْا বিশ্বাস স্থাপন করেছে وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ও সৎকাজ করেছে وَتَوَاصَوْا এবং পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে بِالْحَقِّ সত্যের وَتَوَاصَوْا এবং পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে بِالصَّبْرِ ধৈর্যধারণের।

সরল অনুবাদ :

(১) কসম যুগের,১ (২) নিশ্চয় মানুষ২ ক্ষতিগ্রস্ত;৩ (৩) কিন্তু তারা নয়,৪ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে৫ এবং সৎকাজ করে;৬ আর যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় সত্যের৭ এবং উপদেশ দেয় সবরের।৮

টীকা :

এ সূরায় এ কথার উপর সময়ের শপথ করা হয়েছে যে, মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে এবং এই ক্ষতি থেকে একমাত্র তারাই রক্ষা পেয়েছে, যারা চারটি গুণাবলির অধিকারী : (১) ঈমান (২) সৎকাজ (৩) পরস্পরকে হকের উপদেশ দেয়া এবং (৪) একে অন্যকে সবর করার উপেদেশ দেয়া।

[১] আয়াতের প্রথমেই সময় বা যুগের শপথ করা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, বিষয়বস্তুর সাথে সময় বা যুগের কী সম্পর্ক, যার কসম করা হয়েছে? কসম ও কসমের জবাবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। অধিকাংশ তাফসীরবিদ বলেন, মানুষের সব কর্ম, গতিবিধি, উঠাবসা ইত্যাদি সব যুগের মধ্যে সংঘটিত হয়। এ সূরায় যেসব কর্মের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেগুলোও এই যুগ-কালেরই দিবা-রাত্রিতে সংঘটিত হবে। এরই প্রেক্ষিতে যুগের শপথ করা হয়েছে।

[২] এখানে মানুষ বলে সমস্ত মানুষই উদ্দেশ্য। কারণ, পরের বাক্যে চারটি গুণ সম্পন্ন লোকদেরকে তার থেকে আলাদা করে নেয়া হয়েছে। তাই এটা অবশ্যই মানতে হবে যে, এখানে মানুষ শব্দটিতে দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সমানভাবে শামিল। কাজেই উপরোল্লেখিত চারটি গুণ কোন ব্যক্তি, জাতি বা সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যার মধ্যে থাকবে না সেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই বিধানটি সর্বাবস্থায় সত্য প্রমাণিত হবে।

[৩] আভিধানিক অর্থে ক্ষতি হচ্ছে লাভের বিপরীত শব্দ। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ শব্দটির ব্যবহার এমন সময় হয় যখন কোন ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে। আবার সমস্ত পুঁজি লোকসান দিয়ে যখন কোন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যায় তখনো এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

[৪] এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত মানবজাতি যে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে আছে তার থেকে উত্তরণের পথ বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ক্ষতির কবল থেকে কেবল তারাই মুক্ত, যারা চারটি বিষয় নিষ্ঠার সাথে লালন করে। এ ব্যবস্থাপত্রের প্রথম দুটি বিষয় আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় দুটি বিষয় অপর মুসলিমদের হেদায়াত ও সংশোধন সম্পর্কিত।

[৫] এই সূরার দৃষ্টিতে যে চারটি গুণের উপস্থিতিতে মানুষ ক্ষতিমুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে তন্মধ্যে প্রথম গুণটি হচ্ছে ঈমান। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে স্বীকৃতি দেয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কাজ-কর্মে ইসলামের বিধান বাস্তবায়ন।

[৬] ঈমানের পরে মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি অপরিহার্য সেটি হচ্ছে সৎকাজ। কুরআনের পরিভাষায় একে বলা হয় আমলে সালেহ। সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ধরনের সৎকাজ ও সৎবৃত্তি এর বাইরে থাকে না। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে যে কাজের মূলে ঈমান নেই এবং যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়নি তা কখনো সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।

[৭] এখানে হক শব্দের কয়েকটি অর্থ বর্ণিত হয়েছে। কেউ বলেন, ঈমান ও তাওহীদ। কেউ বলেন, কুরআন। কেউ বলেন, এখানে হক বলে আল্লাহকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। কেউ বলেন, এখানে হক বলে শরীয়তে নির্দেশিত কাজগুলো করা এবং শরীয়ত নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিত্যাগ করা বুঝানো হয়েছে। কারো কারো মতে, হক বলে বুঝানো হয়েছে যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজ। সেটা তাওহীদ, শরীয়তের আনুগত্য, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ, দুনিয়াবিমুখ ও আখেরাতমুখী হওয়া সবই বুঝায়।

[৮] সবর শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাধা দেয়া। এখানে কয়েকটি অর্থ হতে পারে। (এক) যাবতীয় গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা। (দুই) সৎকাজ করা এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। (তিন) বিপদাপদে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। সুতরাং সৎকর্ম সম্পাদন, গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা এবং এতদসংক্রান্ত বিপদাপদ মোকাবেলা করা সবই সবর এর মধ্যে শামিল। সুতরাং আয়াতের অর্থ হচ্ছে, হকের নসিহত করার সাথে সাথে দ্বিতীয় যে জিনিসটি ঈমানদারগণকে ও তাদের সমাজকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবে তা হচ্ছে এই যে, এই সমাজের ব্যক্তিবর্গ পরস্পরকে সবর করার উপদেশ দিতে থাকবে। হককে সমর্থন করতে ও তার অনুসারী হতে গিয়ে যেসব সমস্যা ও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এ পথে যেসব কষ্ট পরিশ্রম, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও বঞ্চনা মানুষকে পীড়িত করে তার মোকাবেলায়, তারা পরস্পর অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকার উপদেশ দিতে থাকবে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

সূরা আসরে বর্ণিত চারটি বৈশিষ্ট্যই মুমিনদের আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

সূরা আসরে বর্ণিত চারটি বৈশিষ্ট্যের বাহিরে অন্য বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সমস্ত মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত।

ঈমান ও সৎ আমল একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তথা একটি অপরটির সম্পূরক।

মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা ঈমানের অন্যতম দাবী।

মুসলিমদেরকে হকের ও সবরের দাওয়াত দেয়া জরুরি।

হকের পথে অটল থেকে সবর অবলম্বন করাটা হচ্ছে সফলতার চাবিকাঠি।

২৯
১০৪- সূরা হুমাযাহ্
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত هُمَزَةٌ (হুমাযাহ) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় আল-হুমাযাহ। এর অর্থ পশ্চাতে পরনিন্দাকারী।

নাযিলের সময়কাল :

এ সূরাটির মক্কী হওয়ার ব্যাপারে সকল মুফাসসির একমত পোষণ করেছেন। এর বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গী বিশ্লেষণ করলে এটি মক্কায় প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

এই সূরায় এমন কিছু অনৈতিক কাজের নিন্দা করা হয়েছে, যেগুলো জাহেলী সমাজে অর্থলোভী ধনীদের মধ্যে পাওয়া যেতো। প্রত্যেক আরববাসী জানতো, এই অসৎ-প্রবণতাগুলো যথার্থই তাদের সমাজে সক্রিয় রয়েছে। এই জঘন্য প্রবণতাগুলো পেশ করার পর আখেরাতে এই ধরনের চরিত্রের অধিকারী লোকদের পরিণাম কী হবে তা বলা হয়েছে। এই দুটি বিষয় এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার ফলে শ্রোতা নিজে নিজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে যে, এই ধরনের কাজের ও চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির পরিণাম এটিই হয়ে থাকে।

আয়াত : ১-৯



وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ (১) اَلَّذِيْ جَمَعَ مَالًا وَّعَدَّدَهٗ (২) يَحْسَبُ اَنَّ مَالَهٗۤ اَخْلَدَهٗ (৩) كَلَّا لَيُنْۢبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ (৪) وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ (৫) نَارُ اللهِ الْمُوْقَدَةُ (৬) اَلَّتِيْ تَطَّلِعُ عَلَى الْاَفْئِدَةِ (৭) اِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُّؤْصَدَةٌ (৮) فِيْ عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ (৯)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) وَيْلٌ দুর্ভোগ لِكُلِّ প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য هُمَزَةٍ যে লোকের পশ্চাতে অপবাদ রটায় لُمَزَةٍ সম্মুখে (মানুষকে) অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে, (২) اَلَّذِيْ যে جَمَعَ সঞ্চিত করে مَالًا অর্থ وَعَدَّدَهٗ এবং তা গণনা করে (৩) يَحْسَبُ সে মনে করে اَنَّ যে مَالَهٗ তার অর্থ اَخْلَدَهٗ তাকে চিরস্থায়ী করবে। (৪) كَلَّا কখনও না, لَيُنْۢبَذَنَّ অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে فِي الْحُطَمَةِ পিষ্টকারীর মধ্যে। (৫) وَمَاۤ اَدْرَاكَ আপনি কি জানেন, مَا الْحُطَمَةُ পিষ্টকারী কী? (৬) اللهِ نَارُ (এটা হল) আল্লাহর আগুন اَلْمُوْقَدَةُ প্রজ্বলিত, (৭) اَلَّتِيْ যা تَطَّلِعُ পৌঁছবে عَلَى الْاَفْئِدَةِ হৃদয় পর্যন্ত। (৮) اِنَّهَا নিশ্চয় তা عَلَيْهِمْ তাদের উপর مُؤْصَدَةٌ বেঁধে দেয়া হবে, (৯) فِيْ عَمَدٍ খুঁটির সাথে (তারা বাঁধা থাকবে) مُمَدَّدَةٍ লম্বা লম্বা।

সরল অনুবাদ :

(১) প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ,১ (২) যে ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে এবং তা গুনে গুনে রাখে।২ (৩) সে মনে করে যে, তার ধন-সম্পদ চিরকাল তার সাথে থাকবে।৩ (৪) কখনো না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে।৪ (৫) আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কী? (৬) এটা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি,৫ (৭) যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। (৮) এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে,৬ (৯) লম্বা লম্বা খুঁটিতে।৭

টীকা :

[১] আয়াতে ‘হুমাযাহ’ ও ‘লুমাযাহ’ দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে هُمَزَةٌ এর অর্থ গীবত অর্থাৎ পশ্চাতে পরনিন্দা করা এবং لُمَزَةٌ এর অর্থ সামনাসামনি দোষারোপ করা ও মন্দ বলা। এ দুটি কাজই জঘন্য গোনাহ। তাফসীরকারদের বর্ণিত তাফসীর অনুসারে উভয় শব্দ মিলে এখানে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হচ্ছে, সে কাউকে লাঞ্ছিত ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। কারোর প্রতি তাচ্ছিল্য ভরে আংগুলি নির্দেশ করে। চোখের ইশারায় কাউকে ব্যঙ্গ করে কারো বংশের নিন্দা করে। কারো ব্যক্তি সত্তার বিরূপ সমালোচনা করে। কারো মুখের উপর তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করে। কারো পেছনে তার দোষ বলে বেড়ায়। কোথাও এর কথা ওর কানে লাগিয়ে বন্ধুদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। কোথাও ভাইদের পারস্পরিক ঐক্যে ফাটল ধরায়। কোথাও লোকদের নাম বিকৃত করে খারাপ নামে অভিহিত করে। কোথাও কথার খোঁচায় কাউকে আহত করে এবং কাউকে দোষারোপ করে। এসব তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এসবই মারাত্মক গোনাহ। পশ্চাতে পরনিন্দার শাস্তির কথা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ এরূপ হতে পারে যে, এ গোনাহের মশগুল হওয়ার পথে সামনে কোন বাধা থাকে না। যে এতে মশগুল হয়, সে কেবল এগিয়েই চলে। ফলে গোনাহ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর ও অধিকতর হতে থাকে। সম্মুখের নিন্দা এরূপ নয়। এতে প্রতিপক্ষও বাধা দিতে প্রস্তুত থাকে। ফলে গোনাহ দীর্ঘ হয় না। এছাড়া কারো পশ্চাতে নিন্দা করা এ কারণেও বড় অন্যায় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানতেও পারে না যে, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে নিকৃষ্টতম তারা, যারা পরোক্ষ নিন্দা করে, বন্ধুদের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে এবং নিরপরাধ লোকদের দোষ খুঁজে ফিরে।

[২] অর্থাৎ নিজের অগাধ ধনদৌলতের অহঙ্কারে সে মানুষকে এভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে। যেসব বদভ্যাসের কারণে আয়াতে শাস্তির কথা উচ্চারণ করা হয়েছে তন্মধ্যে এটি হচ্ছে তৃতীয়। যার মূল কথা হচ্ছে, অর্থ লিপ্সা। আয়াতে একে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে- অর্থলিপ্সার কারণে সে তা বার বার গণনা করে। তবে অন্যান্য আয়াত ও হাদীস সাক্ষ্য দেয় যে, অর্থ সঞ্চয় করা সর্বাবস্থায় হারাম ও গোনাহ নয়। তাই এখানে উদ্দেশ্য সেই সঞ্চয় হবে, যাতে জরুরি হক আদায় করা হয় না, কিংবা গর্ব ও অহমিকা লক্ষ্য হয় কিংবা লালসার কারণে দ্বীনের জরুরি কাজ বিঘ্নিত হয়।

[৩] এর অর্থ হচ্ছে এই যে, সে মনে করে তার অর্থ-সম্পদ তাকে চিরন্তন জীবন দান করবে। তার মনে কখনো এ চিন্তার উদয় হয় না যে, এক সময় তাকে এসব কিছু ছেড়ে দিয়ে খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। তাছাড়া তাকে এ সম্পদের হিসাবও দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কিয়ামতের দিন কোন বান্দার দুপা সামনে অগ্রসর হতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তার জীবনকে কিসে নিঃশেষ করেছে; তার জ্ঞান দ্বারা সে কী করেছে; তার সম্পদ কোথা থেকে আহরণ করেছে ও কিসে ব্যয় করেছে এবং তার শরীর কিসে খাটিয়েছে। (তিরমিযী, হা/২৪১৭)

[৪] আরবী ভাষায় نَبْذٌ ‘নবয’ শব্দটি কোন জিনিসকে তুচ্ছ মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। নিজের ধনশালী হওয়ার কারণে সে দুনিয়ায় নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকে ঘৃণাভরে জাহান্নামে ছুঁড়ে দেয়া হবে।

[৫] হুতামা শব্দটির মূল হচ্ছে, হাত্ম। এর মানে ভেঙ্গে ফেলা, পিষে ফেলা ও টুকরা করে ফেলা। জাহান্নামকে হাত্ম নামে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে যা কিছু ফেলে দেয়া হবে তাকে সে নিজের গভীরতা ও আগুনের কারণে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে।

[৬] এখানে مُوْقَدَةٌ অর্থ অত্যন্ত লেলিহান শিখাযুক্ত প্রজ্বলিত আগুন। এই আগুনকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে এর প্রচন্ডতা ও ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে।

[৭] ‘তাত্তালিউ’ শব্দটির মূলে হচ্ছে ইত্তিলা। আর ‘ইত্তিলা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে চড়া, আরোহণ করা ও উপরে পৌঁছে যাওয়া। আফইদাহ শব্দটি হচ্ছে বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে ফুওয়াদ। এর মানে হৃদয়। অর্থাৎ জাহান্নামের এই আগুন হৃদয়কে পর্যন্ত গ্রাস করবে। হৃদয় পর্যন্ত এই আগুন পৌঁছবার একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, এই আগুন এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখানে মানুষের অসৎচিন্তা, ভুল আকীদা-বিশ্বাস, অপবিত্র ইচ্ছা, বাসনা, প্রবৃত্তি, আবেগ এবং দুষ্ট সংকল্প ও নিয়তের কেন্দ্র। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর এই আগুন দুনিয়ার আগুনের মতো অন্ধ হবে না। সে দোষী ও নির্দোষ সবাইকে জ্বালিয়ে দেবে না। বরং প্রত্যেক অপরাধীর হৃদয় অভ্যন্তরে পৌঁছে সে তার অপরাধের প্রকৃতি নির্ধারণ করবে এবং প্রত্যেককে তার দোষ ও অপরাধ অনুযায়ী আযাব দেবে। এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, দুনিয়ার আগুন মানুষের দেহে লাগলেই মানুষ মারা যায়; কিন্তু জাহান্নামের আগুন হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে এবং হৃদয়-দহনের তীব্র কষ্ট মানুষ অনুভব করবে।

[৮] অর্থাৎ অপরাধীদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নিক্ষেপ করে উপর থেকে তা বন্ধ করে দেয়া হবে। কোন দরজা তো দূরের কথা তার কোন একটি ছিদ্রও খোলা থাকবে না।

[৯] ‘ফি আমাদিম মুমাদ্দাদাহ’ এর একটি অর্থ হচ্ছে, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে তার উপর উঁচু উঁচু থাম গেঁড়ে দেয়া হবে। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, এই অপরাধীরা উঁচু উঁচু থামের গায়ে বাঁধা থাকবে। এর তৃতীয় অর্থ হল এরূপ স্তম্ভসমূহ বা থাম দিয়ে জাহান্নামীদের শাস্তি প্রদান করা হবে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

পরনিন্দা করা ও যাকাত আদায় না করে সম্পদ সঞ্চয় করা- এগুলো মারাত্মক অপরাধ।

ধন-সম্পদ মানুষের ক্ষণস্থায়ী সঙ্গী; সুতরাং ধন-সম্পদের পেছনে পড়ে থাকাটা খুবই নিন্দনীয় কাজ।

জাহান্নামের আগুন হৃদয় পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম।

জাহান্নামে লম্বা লম্বা খুঁটি রয়েছে; সেখানে জাহান্নামীদেরকে বেঁধে শাস্তি প্রদান করা হবে।

৩০
১০৫- সূরা ফীল
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْفِيْلُ (আল-ফীল) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় আল-ফীল। এর অর্থ হাতী।

নাযিলের সময়কাল :

এ সূরাটির মক্কী হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। এর ঐতিহাসিক পটভূমি সামনে রাখলে মক্কায় ইসলামের প্রথম যুগে এটি নাযিল হয় বলে মনে হবে।

ঐতিহাসিক পটভূমি:

ইয়ামানের বাদশা আবরাহার উদ্দেশ্য ছিল, একদিকে আরবে খৃস্ট ধর্ম প্রচার করা এবং অন্যদিকে আরবদের মাধ্যমে রোম সম্রাজ্য ও প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে যে ব্যবসা চলতো তাকে পুরোপুরি নিজেদের দখলে নিয়ে আসা। এ উদ্দেশ্যে আবরাহা ইয়ামানের রাজধানী সানআয় একটি বিশাল গীর্জা নির্মাণ করে। এ কাজটি সম্পন্ন করার পর সে আরবদের হজ্জকে মক্কায় কাবার পরিবর্তে সানআর এ গীর্জার দিকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছিল। এজন্য সে কাবাঘরকে ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করে।

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ৫৭০ বা ৫৭১ খৃস্টাব্দে সে ৬০ হাজার পদাতিক, ১৩টি হাতি (অন্য বর্ণনা মতে ৯টি হাতি) সহকারে মক্কার পথে রওয়ানা হয়। এ সেনাদল তায়েফের নিকটবর্তী হলে বনু সাকীফ অনুভব করে এত বড় শক্তি মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং এই সঙ্গে তারা এ আশঙ্কাও করতে থাকে যে, হয়তো তাদের লাত দেবতার মন্দিরও তারা ভেঙ্গে ফেলবে। ফলে তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে আবরাহার সাথে সাক্ষাৎ করে। তারা তাকে বলে, আপনি যে উপাসনালয়টি ভাংতে এসেছেন আমাদের এ মন্দিরটি সে উপাসনালয় নয়। সেটি মক্কায় অবস্থিত। কাজেই আপনি আমাদেরটায় হাত দেবেন না। আমরা মক্কার পথ দেখানোর জন্য আপনাকে পথপ্রদর্শক সংগ্রহ করে দিচ্ছি। আবরাহা তাদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে বনু সাকীফ আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তিকে তার সাথে দিয়ে দেয়। মক্কার কাছাকাছি আল মাগাম্মেস নামক স্থানে পৌঁছলে আবু রিগাল মারা যায়।

আল মাগাম্মেস থেকে আবরাহা তার অগ্রবাহিনীকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। তারা তিহামার অধিবাসীদের ও কুরাইশদের উট, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি বহু পালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দাদা আবদুল মুত্তালিবেরও ২০০টি উট ছিল। এরপর সে মক্কাবাসীদের কাছে নিজের একজন দূতকে পাঠায়। তার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের কাছে এই মর্মে বাণী পাঠায় যে, আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমি এসেছি শুধুমাত্র এই ঘরটি (কাবা) ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে।

আবদুল মুত্তালিব তখন ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বড় সরদার। দূত তাঁর সাথে সাক্ষাত করে আবরাহার সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আবরাহার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। এটা আল্লাহর ঘর, তিনি চাইলে তাঁর ঘর রক্ষা করবেন। দূত বলে, আপনি আমার সাথে আবরাহার কাছে চলুন। তিনি সম্মত হন এবং দূতের সাথে আবরাহার কাছে যান। সে তাঁকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কী চান? তিনি বলেন, আমার যে উটগুলো ধরে নেয়া হয়েছে সেগুলো আমাকে ফেরত দেয়া হোক। আবরাহা বলল, আপনাকে দেখে তো আমি বড়ই প্রভাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি নিজের উটের দাবী জানাচ্ছেন, অথচ এই যে ঘরটা আপনার ও আপনার পূর্বপুরুষদের ধর্মের কেন্দ্র সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। তিনি বলেন, আমি তো কেবল আমার উটের মালিক এবং সেগুলোর জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আর এই ঘর! এর একজন মালিক ও প্রভু আছেন। তিনি নিজেই এর হেফাযত করবেন। আজ পর্যন্ত তিনি কাউকে এর উপর চেপে বসতে দেননি। আবরাহা জবাব দেয়, আমি একে বিধ্বস্ত না করে এখান থেকে সরে যাব না। আবদুল মুত্তালিব বলেন, আপনি যা কিছু চান আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান। কিন্তু আবরাহা অস্বীকার করে। আবদুল মুত্তালিবকে পেছনে রেখে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

আবরাহার সেনাদলের কাছ থেকে ফিরে এসে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে বলেন, নিজেদের পরিবার পরিজনদের নিয়ে পাহাড়ের উপর চলে যাও। এভাবে ব্যাপক গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে। তারপর তিনি ও কুরাইশদের কয়েকজন সরদার হারাম শরীফে হাযির হয়ে যান। তারা কাবার দরজার কড়া ধরে আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে থাকেন যে, তিনি যেন তার ঘর ও তাঁর খাদেমদের হেফাজত করেন। সে সময় কাবা ঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। কিন্তু এই সংকটকালে তারা সবাই এই মূর্তিগুলোর কথা ভুলে যায়। তারা একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে।

এ দু‘আ করার পর আবদুল মুত্তালিব ও তার সাথিরাও পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরের দিন আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু তার বিশেষ হাতী মাহমুদ ছিল সবার আগে, সে হঠাৎ বসে পড়ে। কুড়ালের বাট দিয়ে তার গায়ে বারবার আঘাত করতে করতে তাকে আহত করে ফেলা হয়। কিন্তু এত বেশি মারপিট ও নির্যাতনের পরেও সে একটুও নড়ে না।

এ সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ঠোঁটে ও পাঞ্জায় পাথরকণা নিয়ে উড়ে আসে। তারা এ সেনাদলের উপর পাথর বর্ষণ করতে থাকে। যার উপর পাথরকণা পড়তো তার দেহ সঙ্গে সঙ্গে গলে যেতে থাকতো। ইবনে আববাসের বর্ণনা মতে, যার উপরই পাথরকণা পড়তো, তার সারা গায়ে ভীষণ চুলকানি শুরু হতো এবং চুলকাতে চুলকাতে চামড়া ছিলে গোশত ঝরে পড়তে থাকতো। আবরাহা নিজেও এই অবস্থার সম্মুখীন হয়। তার শরীর টুকরো হয়ে খসে পড়তো এবং যেখান থেকে এক টুকরো গোশত খসে পড়তো সেখান থেকে রক্ত ও পুঁজ ঝড়ে পড়তে থাকতো। বিশৃঙ্খলা ও ছুটাছুটির মধ্যে তারা ইয়ামানের দিকে পালাতে শুরু করে। ফলে কিছু লোক সেখানে মারা পড়ে আর দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু লোক পথের উপর পড়ে যেতে থাকে। এভাবে সারাটা পথে তাদের লাশ বিছিয়ে থাকে। আবরাহাও খাশআম এলাকায় পৌঁছে মারা যায়।

মুযদালিফা ও মিনার মধ্যে অবস্থিত মহাসাব উপত্যকার সন্নিকটে মুহাসসির নামক স্থানে এ ঘটনাটি ঘটে। হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে গেলেন তখন মুহাসসির উপত্যকায় তিনি চলার গতি দ্রুত করে দেন।

এটা একটা মস্তবড় ঘটনা ছিল। সমগ্র আরবে এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক কবি এ নিয়ে কবিতা লেখেন। এ সমস্ত কবিতার একক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, সবখানেই একে আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কোন একটি কবিতাতে ইশারা-ইঙ্গিতেও এ কথা বলা হয়নি যে, কাবার অভ্যন্তরে রক্ষিত যেসব মূর্তির পূজা করা হতো তাদের কারো এতে সামান্যতম হাত ছিল।

যে বছর এ ঘটনাটি ঘটে আরববাসীরা সে বছরটিকে আমুল ফীল (হাতির বছর) বলে আখ্যায়িত করে। সেই বছরই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্ম হয়। আসহাবে ফীলের ঘটনাটি ঘটে মহররম মাসে এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্ম হয় রবিউল আউয়াল মাসে। অধিকাংশের মতে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্ম হয় হাতির ঘটনার ৫০ দিন পরে।

মূল বক্তব্য :

এ সূরায় শুধুমাত্র আসহাবে ফীলের উপর মহান আল্লাহর আযাবের কথা বর্ণনা করেই শেষ করে দেয়া হয়েছে। ঘটনা খুব বেশি পুরানো ছিল না। মক্কার সবাই এ ঘটনা জানতো। আরবের লোকেরা সাধারণভাবে এ সম্পর্কে অবহিত ছিল। সমগ্র আরববাসী স্বীকার করতো আবরাহার এ আক্রমণ থেকে কাবাঘরকে কোন দেবতা বা দেবী নয়; বরং আল্লাহই এর হেফাজত করেছেন। কুরাইশ সরদাররা আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু‘আ করেছিল। আবার এ ঘটনা কুরাইশদেরকে কয়েক বছর পর্যন্ত এত বেশি প্রভাবিত করে রেখেছিল যে, তারা সে সময় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করেনি। তাই সূরা ফীলে এসব বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। বরং শুধুমাত্র এ ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। এভাবে স্মরণ করিয়ে দেবার ফলে বিশেষ করে কুরাইশরা এবং সাধারণভাবে সমগ্র আরববাসী মনে মনে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারে যে, মুহাম্মাদ যে বিষয়ের দিকে আহবান জানাচ্ছেন সেটি অন্যান্য মাবুদদেরকে ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া তারা এ কথাটিও ভেবে দেখার সুযোগ পাবে যে, এ হকের দাওয়াত যদি তারা বল প্রয়োগ করে দমন করতে চায়, তাহলে যে আল্লাহ আসহাবে ফীলকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন তারা তাঁরই ক্রোধের শিকার হবে।

আয়াত : ১-৫



اَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِاَصْحَابِ الْفِيْلِ (১) اَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِيْ تَضْلِيْلٍ (২) وَاَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا اَبَابِيْلَ (৩) تَرْمِيْهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ (৪) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُوْلٍ (৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اَلَمْ تَرَ তুমি কি দেখনি, كَيْفَ فَعَلَ কী ব্যবহার করেছেন رَبُّكَ তোমার প্রতিপালক بِاَصْحَابِ الْفِيْلِ হাতিওয়ালাদের সাথে? (২) اَلَمْ يَجْعَلْ তিনি কি করে দেননি كَيْدَهُمْ তাদের ষড়যন্ত্রসমূহ فِيْ تَضْلِيْلٍ নস্যাৎ? (৩) وَاَرْسَلَ এবং তিনি পাঠিয়েছেন عَلَيْهِمْ তাদের উপর طَيْرًا اَبَابِيْلَ আবাবীল পাখি। (৪) تَرْمِيْهِمْ তারা তাদের উপর নিক্ষেপ করছিল بِحِجَارَةٍ পাথরের টুকরো مِنْ سِجِّيْلٍ পোড়ামাটির । (৫) فَجَعَلَهُمْ অতঃপর তিনি তাদেরকে করে দিলেন كَعَصْفٍ ভূষির মতো مَأْكُوْلٍ ভক্ষিত।

সরল অনুবাদ :

(১) তুমি কি দেখনি,১ তোমার মালিক (কা’বা ধ্বংসের জন্য আগত) হাতিওয়ালাদের সাথে কী ব্যবহার করেছেন? (২) তিনি কি (সে সময়) তাদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেননি? (৩) আর২ তিনি তাদের উপর আবাবীল (ঝাঁকে-ঝাঁকে) পাখি পাঠালেন।৩ (৪) যারা তাদের উপর পোড়া মাটির পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করেছিল।৪ (৫) অতঃপর তিনি তাদেরকে জন্তু-জানোয়ারের চর্বিত ঘাস-পাতার মতো করে দিলেন।৫

টীকা :

[১] এখানে اَلَمْ تَرَ অর্থাৎ ‘আপনি কি দেখেননি’ বলা হয়েছে। বাহ্যত এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সম্বোধন করা হয়েছে, অথচ এটা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জন্মের কিছুদিন পূর্বেকার ঘটনা। কোন কোন মুফাসসির এর সমাধানে বলেন, এখানে শুধু কুরাইশদেরকেই নয়; বরং সমগ্র আরববাসীকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তারা এই সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিল। কুরআন মাজীদের বহু স্থানে ‘আলাম তারা’ বা আপনি কি দেখেননি? শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নয়; বরং সাধারণ লোকদেরকে সম্বোধন করাই উদ্দেশ্য। অপর কোন কোন তাফসিরবিদ বলেন, যে ঘটনা এরূপ নিশ্চিত যে, তা ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ করা হয়, সে ঘটনার জ্ঞানকেও দেখা বলে ব্যক্ত করা হয়; যেন এটা চাক্ষুষ ঘটনা।

[২] যদি আয়াতটিকে পূর্বের আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট ধরা হয়, তখন এ আয়াতটির অর্থ হয়, তিনি কি তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠাননি? পক্ষান্তরে যদি আয়াতটিকে প্রথম আয়াতটির সাথে সম্পৃক্ত করা হয়, তখন এর অর্থ হবে, আপনি কি দেখেননি, তিনি তাঁদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠিয়েছিলেন?

[৩] اَبَابِيْلٌ শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে, ঝাঁকে ঝাঁকে, যা একটার পর একটা আসে। কারো কারো মতে, শব্দটি বহুবচন। অর্থ পাখির ঝাঁক- কোন বিশেষ প্রাণীর নাম নয়। বলা হয়ে থাকে যে, এ জাতীয় পাখি পূর্বে কখনও দেখা যায়নি।

[৪] سِجِّيْلٌ এর অর্থ করা হয়েছে, পোঁড়া মাটির কঙ্কর। কারো কারো মতে, ভিজা মাটি আগুনে পুড়ে শক্ত হয়ে যে কঙ্কর তৈরি হয়, সে কঙ্করকে سِجِّيْلٌ বলা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ অতি শক্ত পাথরের কঙ্কর।

[৫] عَصْفٌ এর অর্থ শুষ্ক তৃণলতা, শুকনো খড়কুটো। শুষ্ক তৃণ ভক্ষিত হওয়ার পর যা হয় কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে আবরাহার সেনাবাহিনীর অবস্থা তদ্রূপই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে নিজেদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বিরোধীদেরকে দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে থাকেন।

ইসলাম বিরোধী শক্তিসমূহ যত ভয়ঙ্করই দেখা যাক না কেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর মোকাবেলায় একেবারেই তুচ্ছ।

আল্লাহ তা‘আলা সাধারণ কিছু দ্বারাও আযাব দিতে সক্ষম।

পূর্ববর্তী ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

৩১
১০৬- সূরা কুরাইশ
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত قُرَيْشٌ (কুরাইশ) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় আল-কুরাইশ। আবার প্রথম শব্দের প্রতি লক্ষ্য করে কেউ কেউ এটিকে সূরা ঈলাফ বলে অভিহিত করেছেন। কুরাইশ একটি গোত্রের নাম

নাযিলের সময়কাল :

সূরা আল ফীলের বিষয়বস্তুর সাথে এর এত গভীর সম্পর্ক রয়েছে যে, আল ফীল নাযিল হওয়ার পর পরই এ সূরাটি নাযিল হয়ে থাকবে বলে মনে হয়।

ঐতিহাসিক পটভূমি :

আবদুল মুত্তালিবের পিতা ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রপিতামহ হাশেমের মনে সর্বপ্রথম আরবের সাথে প্রাচ্য এলাকার দেশসমূহ এবং সিরিয়া ও মিসরের মধ্যে যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলতো তাতে অংশগ্রহণ করার এবং সেই সঙ্গে আরববাসীদের জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনার চিন্তা জাগে। সেসময় দক্ষিণ আরব থেকে লোহিত সাগরের উপকূল ঘেঁসে সিরিয়া ও মিসরের দিকে প্রসারিত বাণিজ্য পথে ব্যবসা বিপুলভাবে জমে উঠেছিল। আরবের অন্যান্য বাণিজ্য কাফেলার তুলনায় কুরাইশদের বাড়তি সুবিধা ছিল। কাবার খাদেম হওয়ার কারণে পথের সমস্ত গোত্র তাদেরকে মর্যাদার চোখে দেখতো। হজ্জের সময় কুরাইশ বংশীয় লোকেরা যে আন্তরিকতা, উদারতা ও বদান্যতা সহকারে হাজীদের খেদমত করতো সে জন্য সবাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। কাজেই কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার উপর ডাকাতদের আক্রমণ হত না। পথের বিভিন্ন গোত্র অন্যান্য বাণিজ্য কাফেলার কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ চাদা আদায় করতো তাও তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতো না। এভাবে তাদের ব্যবসা দ্রুত উন্নতি লাভ করতে থাকে। আর এই সঙ্গে তারা আশপাশের গোত্রদের ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সেজন্য তাদেরকে ‘আসহাবুল ঈলাফ’ তথা প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টিকারী বলা হতো।

এ ব্যবসার কারণে কুরাইশ বংশীয় লোকেরা সিরিয়া, মিসর, ইরান, ইয়ামান ও হাবশার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করে। সরাসরি বিভিন্ন দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতার সংস্পর্শে আসার কারণে তাদের দেখার, জানার ও উপলব্ধি করার মান অনেক উন্নত হতে থাকে। ফলে আরবের দ্বিতীয় কোন গোত্র তাদের সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। ধন-সম্পদের দিক দিয়েও তারা আরবের সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মক্কা পরিণত হয়েছিল সমগ্র আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্রে।

কুরাইশরা এভাবে একের পর এক উন্নতির মনযিল অতিক্রম করে চলছিল। এমন সময় আবরাহা কর্তৃক মক্কা আক্রমণের ঘটনা ঘটে। যদি সে সময় আবরাহা কাবা ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হতো তাহলে এ ঘরের খাদেম হিসেবে সারা দেশে কুরাইশদের যে মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তাও মুহূর্তের মধ্যে ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতো। কিন্তু মহান আল্লাহ তার অসীম কুদরতের খেলা দেখান। পক্ষীবাহিনী পাথর মেরে মেরে আবরাহার ৬০ হাজারের বিশাল হাবশী বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। এই সঙ্গে সারা দেশে কুরাইশদের প্রতিপত্তি আগের চাইতেও আরো অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এরা নির্বিঘ্নে আরবের যে কোন অংশে যেতো এবং নিজেদের বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যে কোন এলাকা অতিক্রম করতো।

মূল বক্তব্য :

নবী ﷺ এর আবির্ভাবকালে যেহেতু এ অবস্থা সবার জানা ছিল তাই এসব কথা আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল না। এ কারণে এ ছোট্ট সূরাটিতে চারটি বাক্যের মধ্য দিয়ে কুরাইশদেরকে কেবলমাত্র এতটুকু কথা বলাই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে যে, যখন তোমরা নিজেরাই এ ঘরটিকে (কাবা ঘর) দেবমূর্তির মন্দির নয় বরং আল্লাহর ঘর বলে মনে করো এবং যখন তোমরা ভালোভাবেই জান যে, আল্লাহই তোমাদেরকে এ ঘরের বদৌলতে এ পর্যায়ের শান্তি ও নিরাপত্তা দান করেছেন, তোমাদের ব্যবসায় উন্নতি দান করেছেন এবং অভাব-অনাহার থেকে রক্ষা করে তোমাদেরকে এ ধরনের সমৃদ্ধি দান করেছেন, তখন তোমাদের তো আসলে তাঁরই ইবাদাত করা উচিত।

আয়াত : ১-৪



لِاِيْلَافِ قُرَيْشٍ (১) اِيْلَافِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَآءِ وَالصَّيْفِ (২) فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هٰذَا الْبَيْتِ (৩) اَلَّذِيْۤ اَطْعَمَهُمْ مِّنْ جُوْعٍ وَّاٰمَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ (৪)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) لِاِيْلَافِ যেহেতু আসক্তি রয়েছে قُرَيْشٍ কুরাইশদের। (২) اِيْلَافِهِمْ তাদের আসক্তি রয়েছে رِحْلَةَ সফরের اَلشِّتَآءِ শীতকালীন وَالصَّيْفِ ও গ্রীষ্মকালীন। (৩) فَلْيَعْبُدُوْا অতএব তাদের ইবাদত করা উচিত رَبَّ প্রতিপালকের هٰذَا الْبَيْتِ এ ঘরের। (৪) اَلَّذِيْ যিনি اَطْعَمَهُمْ তাদের খাবার সরবরাহ করেছেন مِنْ جُوْعٍ ক্ষুধার সময় وَاٰمَنَهُمْ এবং তাদেরকে নিরাপদ রেখেছেন مِنْ خَوْفٍ ভয়-ভীতি থেকে।

সরল অনুবাদ :

(১) কুরাইশদের১ অনুকূল (ও নিরাপদ) হওয়ার কারণে২। (২) অনুকূলে হওয়ার কারণে তাদের শীত ও গ্রীষ্ম কালের (ব্যবসায়িক) সফর।৩ (৩) অতএব তাদের এ ঘরের মালিকেরই ইবাদত করা উচিত।৪ (৪) যিনি ক্ষুধায় তাদের খাবার সরবরাহ করেছেন৫ এবং তাদেরকে ভয়-ভীতি থেকে নিরাপদ রেখেছেন।৫

টীকা :

[১] কুরাইশ একটি গোত্রের নাম। নদর এর সন্তানদেরকে কুরাইশ বলা হয়। কারো কারো মতে, ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নাদর ইবনে কিনানাহ এর বংশধরদেরকে কুরাইশ বলা হয়। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ইসমাঈলের বংশধর থেকে কিনানাহকে, কিনানাহর বংশধর থেকে কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনী হাশেমকে, বনী হাশেম থেকে আমাকে পছন্দ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হা/২২৭৬)

[২] إِيْلَافٌ শব্দটি تَأْلِيْفٌ থেকে এসেছে। তখন অর্থ হবে, মিল-মহববত থাকা, একত্রিত থাকা। অর্থাৎ কুরাইশদেরকে একত্রিত রাখা, বিচ্ছেদের পর মিলিত হওয়া এবং তাদের সাথে মানুষের সম্পর্ক ঠিক রাখা। বলা হয়েছে, কুরাইশদের আসক্তির কারণে। কিন্তু আসক্তির কারণে কী হয়েছে? এ কথা উহ্য আছে। কেউ কেউ বলেন, এখানে উহ্য বাক্য হচ্ছে, আমি হস্তীবাহিনীকে এজন্য ধ্বংস করেছি কিংবা আমি তাদেরকে ভক্ষিত তৃণের সাদৃশ্য এজন্য করেছি, যাতে কুরাইশদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন দুই সফরের পথে কোন বাধাবিপত্তি না থাকে এবং সবার অন্তরে তাদের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে উহ্য বাক্য হচ্ছে أَعْجَبُوْا অর্থাৎ তোমরা কুরাইশদের ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ কর, তারা কীভাবে শীত ও গ্রীষ্মের সফর নিরাপদে নির্বিবাদে করে, তবুও তারা এ ঘরের রবের ইবাদাত করে না। এ মতটি ইমাম তাবারী গ্রহণ করেছেন।

কেউ কেউ বলেন, এর সম্পর্ক পরবর্তী বাক্য فَلْيَعْبُدُوْا এর সাথে। অর্থাৎ এই নিয়ামতের কারণে কুরাইশদের কৃতজ্ঞ হওয়া ও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা উচিত।

[৩] শীত ও গ্রীষ্মের সফরের অর্থ হচ্ছে গ্রীষ্মকালে কুরাইশরা সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের দিকে বাণিজ্য সফর করত। কারণ এ দুটি শীত প্রধান দেশ। আর শীতকালে সফর করতো দক্ষিণ আরব তথা ইয়েমেনের দিকে। কারণ সেটি গ্রীষ্ম প্রধান এলাকা।

[৪] ‘এ ঘর’ অর্থ কাবা ঘর। বলা হয়েছে, এ ঘরের রবের ইবাদাত করো। এখানে ঘরটিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করার মাধ্যমে ঘরকে সম্মানিত করাই উদ্দেশ্য। আর এই গৃহই যেহেতু তাদের সব শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণের উৎস ছিল, তাই বিশেষভাবে এই গৃহের মৌলিক গুণটির উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, এটি মহান রবের ঘর। অর্থাৎ এ ঘরের বদৌলতেই কুরাইশরা এই নিয়ামতের অধিকারী হয়েছে।

[৫] মক্কায় আসার পূর্বে কুরাইশরা যখন আরবের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তখন তারা অনাহারে মরতে বসেছিল। এখানে আসার পর তাদের জন্য রিযিকের দরজাগুলো খুলে যেতে থাকে। তাদের স্বপক্ষে ইবরাহীম (আঃ) দু‘আ করেছিলেন, হে আল্লাহ! তাদের খাবারের জন্য ফলমূল দান করুন। (সূরা ইবরাহীম : ৩৭)

[৬] অর্থাৎ যে ভীতি থেকে আরব দেশের কেউ নিরাপদ নয়, তা থেকে তারা নিরাপদ রয়েছে। সে যুগে আরবের অবস্থা এমন ছিল যে, সারা দেশে এমন কোন জনপদ ছিল না যেখানে লোকেরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো। কারণ সবসময় তারা আশঙ্কা করতো, এই বুঝি কোন লুটের দল রাতের অন্ধকারে হঠাৎ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাদের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেলো। কিন্তু কুরাইশরা মক্কায় সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। তাদের নিজেদের উপর কোন শত্রুর আক্রমণের ভয় ছিল না।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, সুখী জীবনের জন্য যা যা দরকার তা সমস্তই এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরাইশকে এগুলো দান করেছিলেন। اَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوْعٍ বলে পানাহারের যাবতীয় সরঞ্জাম বুঝানো হয়েছে এবং وَاٰمَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ বাক্যে দস্যু ও শত্রুদের থেকে এবং যাবতীয় ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা বুঝানো হয়েছে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

সত্যকে জানার পর সত্যের বিরোধিতা করা উচিত নয়।

সর্বদা নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার একমাত্র পদ্ধতি হলো একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদাত করা এবং এ ক্ষেত্রে কাউকে শরীক না করা।

ক্ষুধার সময় খাদ্য পাওয়া এবং ভয়ের সময় নিরাপত্তা লাভ করা অনেক বড় নিয়ামত।

৩২
১০৭- সূরা মাউন
সূরার নামকরণ :

সূরার শেষ আয়াতে উল্লেখিত اَلْمَاعُوْنُ (আল-মাউন) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় আল-মাউন। এর অর্থ ছোটখাটো জিনিস।

নাযিলের সময়কাল :

এই সূরার মধ্যে এমন একটি অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য রয়েছে, যা এর মাদানী হবার প্রমাণ পেশ করে। সেটি হচ্ছে, এ সূরায় এমন সব নামাযীদেরকে ধ্বংসের বার্তা শুনানো হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে গাফলতি করে এবং লোক দেখানো সালাত আদায় করে। এ ধরনের মুনাফিক মদীনায় পাওয়া যেতো।

সূরার বিষয়বস্তু :

আখেরাতের প্রতি ঈমান না আনলে মানুষের মধ্যে কোন ধরনের নৈতিকতা জন্ম নেয় তার বর্ণনা করাই এর মূল বিষয়বস্তু। ২ ও ৩ নং আয়াতে এমন সব কাফিরদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যারা প্রকাশ্যে আখেরাতকে মিথ্যা বলে। আর শেষ চার আয়াতে যেসব মুনাফিক আপাত দৃষ্টিতে মুসলমান মনে হয়, কিন্তু তাদের আখেরাত এবং এর শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, তাদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আখেরাতে বিশ্বাস ছাড়া মানুষের মধ্যে একটি মজবুত শক্তিশালী ও পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্র গড়ে তোলা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়, এ সত্যটি মানুষের হৃদয়ে অঙ্কিত করে দেয়াই এ সূরার মূল উদ্দেশ্য।

আয়াত : ১-৭



اَرَاَيْتَ الَّذِيْ يُكَذِّبُ بِالدِّيْنِ (১) فَذٰلِكَ الَّذِيْ يَدُعُّ الْيَتِيْمَ (২) وَلَا يَحُضُّ عَلٰى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ (৩) فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ (৪) اَلَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ (৫) اَلَّذِيْنَ هُمْ يُرَآءُوْنَ (৬) وَيَمْنَعُوْنَ الْمَاعُوْنَ (৭)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اَرَاَيْتَ তুমি কি ভেবে দেখেছো (সে ব্যক্তির কথা) اَلَّذِيْ যে يُكَذِّبُ অস্বীকার করে بِالدِّيْنِ কর্মফল দিবসকে। (২) فَذٰلِكَ এ তো হচ্ছে সেই ব্যক্তি اَلَّذِيْ যে يَدُعُّ ধাক্কা দেয় اَلْيَتِيْمَ এতীমকে, (৩) وَلَا يَحُضُّ সে কখনো উৎসাহ দেয় না عَلٰى طَعَامِ খাবার দিতে اَلْمِسْكِيْنِ মিস্কীনদের, (৪) فَوَيْلٌ (মর্মান্তিক) দুর্ভোগ রয়েছে لِلْمُصَلِّيْنَ সেসব (মুনাফিক) নামাযীদের জন্যে। (৫) اَلَّذِيْنَ هُمْ যারা عَنْ صَلَاتِهِمْ নিজেদের সালাত থেকে سَاهُوْنَ উদাসীন থাকে। (৬) اَلَّذِيْنَ هُمْ যারা যাবতীয় يُرَآءُوْنَ লোক দেখায়। (৭) وَيَمْنَعُوْنَ এবং তারা (সাহায্য দেয়া থেকে) বিরত থাকে اَلْمَاعُوْنَ ছোটখাটো জিনিস।

সরল অনুবাদ :

(১) তুমি কি সে ব্যক্তির কথা (কখনো) ভেবে দেখেছো,১ যে শেষ বিচারের দিনকে২ অস্বীকার করে। (২) সে তো এমন লোক, যে (নিরীহ) এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়।৩ (৩) আর সে কখনো উৎসাহিত করে না৪ (নিজেকে ও অন্যকে) মিসকীনকে খাবার দিতে। (৪) অতএব দুর্ভোগ সেসব (মুনাফিক) নামাযীদের জন্য। (৫) যারা নিজেদের সালাত থেকে উদাসীন থাকে। (৬) তারা যাবতীয় কাজ-কর্ম শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্যই করে থাকে।৫ (৭) এবং ছোটখাটো জিনিস৬ পর্যন্ত (অন্যদেরকে) দেয়া থেকে বিরত থাকে।

টীকা :

[১] এখানে বাহ্যত নবী ﷺ-কে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী অনুযায়ী দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত প্রত্যেক জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা সম্পন্ন লোকদেরকেই এভাবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। আর দেখা মানে চোখ দিয়ে দেখাও হয়; আবার এর মানে জানা, বুঝা ও চিন্তা-ভাবনা করাও হতে পারে।

[২] এ আয়াতে ‘আদ-দীন’ শব্দটির অর্থ আখেরাতে কর্মফল ও বিচার।

[৩] এখানে يَدُعُّ বলা হয়েছে। এর অর্থ, দৃঢ়ভাবে তাড়ানো, কঠোরভাবে দূর করে দেয়া। এতীমদের প্রতি অসদাচরণ করা, তাদের প্রতি দয়া না করে কঠোরভাবে ধিক্কার ও যুলুম করা, তাদেরকে খাদ্য দান না করা এবং তাদের হক আদায় না করাই এখানে উদ্দেশ্য।

[৪] لَا يَحُضُّ শব্দের মানে হচ্ছে সে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে না, নিজের পরিবারের লোকদেরকেও মিসকিনের খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ করে না এবং অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে না।

[৫] এটা মুনাফিকদের অবস্থা। তারা লোক দেখানোর জন্য এবং মুসলিম হওয়ার দাবী প্রমাণ করার জন্য সালাত পড়ে। কিন্তু সালাত যে ফরয, এ বিষয়ে তারা বিশ্বাসী নয়। ফলে সময়ের প্রতিও লক্ষ্য রাখে না এবং আসল সালাতেও খেয়াল রাখে না। লোক দেখানোর জায়গা হলে পড়ে, নতুবা ছেড়ে দেয়। আর সালাত আদায় করলেও এর ওয়াজিবসমূহ, শর্ত ইত্যাদি পূর্ণ করে না। আসল সালাতের প্রতিই ভ্রুক্ষেপ না করা মুনাফিকদের অভ্যাস এবং سَاهُوْنٌ শব্দের আসল অর্থও তাই।

[৬] مَاعُوْنٌ শব্দের অর্থ অধিকাংশ মুফাসসিরদের নিকট যৎকিঞ্চিৎ ও সামান্য উপকারী বস্তু। মূলত মাউন ছোট ও সামান্য পরিমাণ জিনিসকে বলা হয়- যা লোকদের কোন কাজে লাগে বা এর থেকে তারা ফায়দা অর্জন করতে পারে। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে, সাধারণত প্রতিবেশীরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে দৈনন্দিন যেসব জিনিস চেয়ে নিয়ে থাকে, যেগুলোর পারস্পরিক লেনদেন সাধারণ মানবতারূপে গণ্য হয়; যথা কুড়াল, কোদাল অথবা রান্না-বান্নার পাত্র এ সবই মাউনের অন্তর্ভুক্ত। আবার কারো কারো মতে আলোচ্য আয়াতে مَاعُوْنٌ বলে যাকাত বুঝানো হয়েছে। যাকাতকে مَاعُوْنٌ বলার কারণ সম্ভবত এই যে, যাকাত পরিমাণে আসল অর্থের তুলনায় খুবই কম।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

আখেরাতের উপর বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম মূলভিত্তি।

এতীম ও মিসকীনদের সাথে সর্বদা সদ্ব্যবহার করা উচিত।

সালাতের মধ্যে মনোযোগী হওয়া খুবই জরুরি।

সালাতের মধ্যে অমনোযোগী হওয়াটা মুনাফিকের আলামত।

আল্লাহর উদ্দেশ্য ব্যতীত কোন উদ্দেশ্যে ইবাদাত করা যাবে না।

লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদাত করা কবীরা গোনাহ।

প্রতিবেশী বা অপর কোন মুসলিম ভাইকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করা ঈমানের অন্যতম দাবী।

৩৩
১০৮- সূরা কাউসার
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْكَوْثَرُ (আল-কাউসার) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় সূরা আল-কাউসার। এর অর্থ বেশি, অজস্র কল্যাণ।

নাযিলের সময়কাল :

সূরা কাউসার মক্কায় এমন এক সময় নাযিল হয় যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ অত্যন্ত কঠিন হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক পটভূমি :

সূরা দ্বোহা ও সূরা আলাম নাশরাহ- এ দেখা গেছে, নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগে মুহাম্মাদ ﷺ যখন সবচেয়ে কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সমগ্র জাতি তাঁর সাথে শত্রুতা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, বাধার বিরাট পাহাড়গুলো তাঁর পথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, চতুর্দিকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার ও তাঁর মনে সাহস সঞ্চারের জন্য মহান আল্লাহ বহু আয়াত নাযিল করেন।

এমনি এক অবস্থা ও পরিস্থিতিতে সূরা কাউসার নাযিল করে আল্লাহ, নবী ﷺ কে সান্ত্বনা দান করেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে ধ্বংস করে দেবার ভবিষ্যদ্বাণীও শুনিয়ে দেন। কুরাইশ বংশীয় কাফিররা বলতো, মুহাম্মাদ ﷺ সমগ্র জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তার অবস্থা হয়ে গেছে একজন সহায় ও বান্ধবহীন ব্যক্তির মতো। ইকরামা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, মুহাম্মাদ ﷺ কে যখন নবীর পদে অধিষ্ঠিত করা হয় এবং তিনি কুরাইশদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন, তখন কুরাইশরা বলতে থাকে بَتِرَ مُحَمَّدٌ مِنَّا অর্থাৎ মুহাম্মাদ নিজের জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যেমন কোন গাছের শিকড় কেটে দেয়া হলে তার অবস্থা হয়। কিছুদিনের মধ্যে সেটি শুঁকিয়ে মাটির সাথে মিশে যায়।

ইবনে সাদ ও ইবনে আসাকিরের বর্ণনা অনুযায়ী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সবচেয়ে বড় ছেলের নাম ছিল কাসেম, তার ছোট ছিলেন যয়নাব, তার ছোট ছিলেন আবদুল্লাহ। তারপর জন্ম নেন যথাক্রমে তিন কন্যা; উম্মে কুলসুম, ফাতেমা ও রুকাইয়া। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম মারা যান কাসেম। তারপর মারা যান আবদুল্লাহ। এ অবস্থা দেখে আস ইবনে ওয়ায়েল বলে, তার বংশই খতম হয়ে গেছে। এখন সে আবতার অর্থাৎ তার শিকড় কেটে গেছে।

আতা বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দ্বিতীয় পুত্র ইন্তিকালের পর তাঁর চাচা আবু লাহাব (তার ঘর ছিল রাসূলের ঘরের সাথেই) দৌড়ে মুশরিকদের কাছে চলে যায় এবং তাদের এই সুখবর দেয় যে, রাতে মুহাম্মাদ সন্তান হারা হয়ে গেছে অথবা তার শিকড় কেটে গেছে।

এ ধরনের চরম হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে নবী ﷺ এর উপর সূরা কাউসার নাযিল করা হয়। তিনি কেবল আল্লাহর ইবাদাত করতেন এবং আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করাকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এ কারণে কুরাইশরা ছিল তার প্রতি বিরূপ। এ জন্যই নবুওয়াত লাভের আগে সমগ্র জাতির মধ্যে তার যে মর্যাদা ছিল নবুওয়াত লাভের পর তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। তাঁকে এক রকম গোত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। তাঁর সঙ্গী-সাথী ছিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক। তাঁরাও ছিলেন বন্ধু-বান্ধব ও সহায়-সম্বলহীন। তাঁরাও জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করে চলছিলেন। এই সাথে তাঁর একের পর এক সন্তানের মৃত্যুতে তার উপর যেন দুঃখ ও শোকের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছিল। এ সময় আত্মীয়-স্বজন জাতি-গোষ্ঠী ও প্রতিবেশীদের পক্ষ থেকে সহানুভূতি প্রকাশ ও সান্ত্বনাবাণী শুনাবার পরিবর্তে আনন্দ করা হচ্ছিল। এমন একজন লোক যিনি শুধু আপন লোকদের সাথেই নয়, অপরিচিত ও অনাত্মীয়দের সাথেও সবসময় পরম প্রীতিপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল ব্যবহার করছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের বিভিন্ন অপ্রীতিকর কথা ও আচরণ তাঁর মনভেঙ্গে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। এ অবস্থায় এ ছোট্ট সূরাটির একটি বাক্যে আল্লাহ তাঁকে এমন একটি সুখবর দিয়েছেন যার চাইতে বড় সুখবর দুনিয়ার কোন মানুষকে কোন দিন দেয়া হয়নি। এই সঙ্গে তাঁকে এ সিদ্ধান্তও শুনিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাঁর বিরোধিতাকারীদেরই শিকড় কেটে যাবে।

আয়াত : ১-৩



اِنَّاۤ اَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (১) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (২) اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ (৩)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِنَّاۤ اَعْطَيْنَاكَ আমি অবশ্যই তোমাকে দান করেছি اَلْكَوْثَرَ কাওসার। (২) فَصَلِّ অতএব তুমি সালাত কায়েম করো لِرَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে وَانْحَرْ এবং কুরবানী করো; (৩) اِنَّ নিশ্চয় شَانِئَكَ তোমার শত্রুই هُوَ সে اَلْاَبْتَرُ শিকড়-কাটা (অসহায়)।

সরল অনুবাদ :

(১) (হে নবী!) আমি অবশ্যই তোমাকে (নিয়ামতের ভান্ডার) কাওসার১ দান করেছি।

(২) অতএব, (আমার স্মরণের জন্য) তুমি সালাত কায়েম করো এবং (আমারই উদ্দেশ্যে) কুরবানী করো।২

(৩) নিশ্চয় (পরিশেষে) তোমার নিন্দুকরাই হবে শিকড়-কাটা (অসহায়)।৩

টীকা :

[১] ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, কাউসার সেই অজস্র কল্যাণ, যা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দান করেছেন। ইকরিমা বলেন, এটা নবুওয়াত, কুরআন ও আখেরাতের সওয়াব। অনুরূপভাবে কাউসার জান্নাতের একটি প্রস্রবণের নাম। এ তাফসীরসমূহে কোনবিরোধ নেই; কারণ কাউসার নামক প্রস্রবণটি অজস্র কল্যাণের একটি। আসলে কাউসার শব্দটি এখানে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাতে এক শব্দে এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ শব্দটি মূলত বিপুল ও অত্যধিক পরিমাণ বুঝাবার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সীমাহীন আধিক্য। কিন্তু যে অবস্থায় ও পরিবেশে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে শুধুমাত্র আধিক্য নয়; বরং কল্যাণ ও নিয়ামতের আধিক্য।

বিভিন্ন হাদীসে কাউসার ঝর্ণাধারার কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমরা কি জান ‘কাওসার’ কী? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশি ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটা একটা ঝর্ণা। আমার প্রতিপালক আমাকে তা দেয়ার জন্য ওয়াদা করেছেন। এর মধ্যে অশেষ কল্যাণ রয়েছে, আমার উম্মতের লোকেরা কিয়ামতের দিন এ হাউযের পানি পান করতে আসবে। এ হাউযে রয়েছে তারকার মতো অসংখ্য পানপাত্র (গ্লাস)। একটি দলকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, প্রভু! এরা আমার উম্মতেরই লোক। আমাকে তখন বলা হবে, তুমি জান না, তোমার মৃত্যুর পর এরা কী অভিনব কাজ (বিদআত) করেছে। (সহীহ মুসলিম, হা/৪০০; মুসনাদে আহমাদ : ৩/১০২)

[২] نَحْرٌ শব্দের অর্থ উট কুরবানী করা। এর প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে হাত-পা বেঁধে কণ্ঠনালীতে বর্শা অথবা ছুরি দিয়ে আঘাত করা এবং রক্ত বের করে দেয়া। গরু-ছাগল ইত্যাদির কুরবানীর পদ্ধতি যবাই করা। অর্থাৎ জন্তুকে শুইয়ে কণ্ঠনালিতে ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করা। আরবে সাধারণত উট কুরবানী করা হতো। তাই কুরবানী বুঝানোর জন্য এখানে نَحْرٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মাঝে মাঝে এ শব্দটি যে কোন কুরবানীর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ আয়াতে পূর্ববর্তী আয়াতে প্রদত্ত কাউসারের কারণে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দুটি কাজ করতে বলা হয়েছে। (এক) একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করা। (দুই) তাঁরই উদ্দেশ্যে কুরবানী করা ও যবাই করা। কেননা, সালাত শারিরীক ইবাদাতসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং কুরবানী আর্থিক ইবাদাতসমূহের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।

[৩] সাধারণত যে ব্যক্তির পুত্র সন্তান মারা যায়, আরবে তাকে أَبْتَرَ বা নির্বংশ বলা হত। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পুত্র কাসেম অথবা ইবরাহীম যখন শৈশবেই মারা গেলেন, তখন কাফিররা তাকে নির্বংশ বলে উপহাস করত। এ আয়াতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি নির্বংশ বলে যে দোষারোপ করা হতো তার জবাব দেয়া হয়েছে। শুধু পুত্র সন্তান না থাকার কারণে যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে নির্বংশ বলে টিটকারী করে, তারা তার প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বেখবর। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বংশগত সন্তান-সন্ততিও কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা কন্যা-সন্তানের তরফ থেকে হয়। তাছাড়া নবীর আধ্যাত্মিক সন্তান অর্থাৎ উম্মত তো এত অধিক সংখ্যক হবে যে, পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের সমষ্টি অপেক্ষাও বেশি হবে। এছাড়া এ সূরায় রাসূলুল্লাহ ﷺ যে আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রিয় ও সম্মানিত তাও বিবৃত হয়েছে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

হাউজে কাউসার আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মুহাম্মাদ ﷺ-কে প্রদত্ত একটি বিশেষ নিয়ামত।

কিয়ামতের দিন বিদআতীরা হাউজে কাউসারের পানি পান করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে না।

আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার জন্য সালাত ও কুরবানী হচ্ছে দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত।

মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর আরোপিত নির্বংশ অভিযোগটি যথার্থ নয়; কেননা তার বংশ এখনো পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে।

৩৪
১০৯- সূরা কাফিরূন
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত اَلْكَافِرُوْنَ (আল-কাফিরূন) শব্দের আলোকে এ সূরার নামকরণ করা হয় আল-কাফিরূন। এর অর্থ কাফির সম্প্রদায়।

নাযিলের সময়কাল :

অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে এটি মক্কী সূরা। তাছাড়া এর বিষয়বস্তুই এর মক্কী হওয়ার কথা প্রমাণ করে।

ঐতিহাসিক পটভূমি :

মক্কায় এমন এক যুগ ছিল যখন নবী ﷺ এর দাওয়াতের বিরুদ্ধে মুশরিক সমাজে প্রচন্ড বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কোন না কোন প্রকারে আপোষ করতে উদ্বুদ্ধ করা যাবে বলে কুরাইশ সরদাররা মনে করতো। এ ব্যাপারে তারা তখনো নিরাশ হয়নি। এজন্য তারা মাঝে মধ্যে তাঁর কাছে আপোষের ফরমূলা নিয়ে হাযির হতো। তিনি তার মধ্য থেকে কোন একটি প্রস্তাব মেনে নিলেই তাঁর ও তাদের মধ্যকার ঝগড়া মিটে যাবে বলে তারা মনে করতো। হাদীসে এ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বললো, আমরা আপনাকে এত বেশি পরিমাণ ধন-সম্পদ দেবো, যার ফলে আপনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। যে মেয়েটিকে আপনি পছন্দ করবেন তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবো। আমরা আপনার পিছনে চলতে প্রস্তুত। আপনি শুধু আমাদের একটি কথা মেনে নেবেন- আমাদের উপাস্যদের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবটি আপনার পছন্দ না হলে আমরা আরেকটি প্রস্তাব পেশ করছি। এ প্রস্তাবে আপনার লাভ এবং আমাদেরও লাভ। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, সেটি কী? তারা বলল, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যের ইবাদাত করবেন এবং আমরাও এক বছর আপনার উপাস্যদের ইবাদাত করবো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, থামো! আমি দেখি আমার রবের পক্ষ থেকে কী হুকুম আসে। তখনই সূরা কাফিরূন এবং এই আয়াত নাযিল হয় : قُلْ اَفَغَيْرَ اللهِ تَأْمُرُوْنِّىْ اَعْبُدُ اَيُّهَا الْجَاهِلُوْنَ অর্থাৎ ওদের বলে দাও, হে মূর্খের দল! তোমরা কি আমাকে বলছো, আল্লাহ ছাড়া আমি আর কারো ইবাদাত করবো? (সূরা যুমার- ৬৪)

সূরার বিষয়বস্তু :

উপরোক্ত প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে যে, আসলে ধর্মীয় উদারতার উপদেশ দেবার জন্য সূরাটি নাযিল হয়নি। বরং এ কথাগুলোকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে কিয়ামত পর্যন্ত এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, কুফরী ধর্ম দুনিয়ার যেখানেই যে আকৃতিতে আছে তার সাথে সম্পর্কহীনতা ও দায়িত্ব মুক্তির ঘোষণা তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত। কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই তাদের এ কথা জানিয়ে দেয়া উচিত যে, দ্বীনের ব্যাপারে তারা কাফিরদের সাথে কোন প্রকার আপোষ বা উদারনীতির আশ্রয় গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। কারণ কুফরী ও কাফেরের কার্যকলাপ থেকে সম্পর্কহীনতা ঈমানের চিরন্তন দাবী।

ফযীলত :

এটা কুরআনের এক চতুর্থাংশ : রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সূরা কাফিরূন কুরআনের এক চতুর্থাংশের মর্যাদা রাখে। (তিরমিযী, হা/২৮৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৫১০)

ঘুমানোর সময় এটা পড়লে শিরক থেকে মুক্ত থাকা যায় : ফরওয়া ইবনে নওফেল (রাঃ) বলেন, আমি নবী ﷺ এর কাছে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কিছু শিক্ষা দিন, যা আমি শোয়ার সময় পড়ব। তখন তিনি বললেন, সূরা কাফিরূন পাঠ করো; কেননা এটা শিরক থেকে মুক্তকারী।

(তিরমিযী, হা/৩৪০৩; আবু দাউদ, হা/৫০৫৭)

সালাতে এটা পড়ার গুরুত্ব :

১. রাসূলুল্লাহ ﷺ ফজরের দু’রাকআত সুন্নাতে এবং মাগরিবের দু’রাকআত সুন্নাতে সূরা কাফিরূন এবং সূরা ইখলাস পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, হা/১৭২৩)

২. জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাওয়াফের দু’রাকআত সালাতে সূরা কাফিরূন এবং সূরা ইখলাস পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, হা/১২১৮।)



আয়াত : ১-৬



قُلْ يَاۤ اَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ (১) لَاۤ اَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ (২) وَلَاۤ اَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَاۤ اَعْبُدُ (৩) وَلَاۤ اَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدْتُّمْ (৪) وَلَاۤ اَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَاۤ اَعْبُدُ (৫) لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ (৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) قُلْ তুমি বলে দাও, يَاۤ اَيُّهَا হে اَلْكَافِرُوْنَ কাফিররা! (২) لَاۤ اَعْبُدُ আমি (তাদের) ইবাদত করি না, مَا تَعْبُدُوْنَ যাদের ইবাদত তোমরা করো, (৩) وَلَاۤ اَنْتُمْ আর তোমরা নও عَابِدُوْنَ (তার) ইবাদতকারী مَاۤ اَعْبُدُ যার ইবাদত আমি করি। (৪) وَلَاۤ اَنَا এবং আমি নই عَابِدٌ (তাদের) ইবাদতকারী مَا عَبَدْتُّمْ যাদের ইবাদত তোমরা করো। (৫) وَلَاۤ اَنْتُمْ আর তোমরা নও عَابِدُوْنَ (তার) ইবাদতকারী مَاۤ اَعْبُدُ যার ইবাদত আমি করি। (৬) لَكُمْ তোমাদের জন্যে دِيْنُكُمْ তোমাদের দ্বীন وَلِيَ আর আমার জন্যে دِيْنِ আমার দ্বীন।

সরল অনুবাদ :

(১) (হে নবী!) তুমি বলে দাও, হে কাফিররা! (২) আমি (তাদের) ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা কর,১ (৩) আর তোমরা (তার) ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি।২ (৪) এবং আমি (কখনই তাদের) ইবাদতকারী নই, যাদের ইবাদত তোমরা করো। (৫) আর তোমরা (তার) ইবাদতকারী নও, যার ইবাদত আমি করি। (৬) (এ দীনের মধ্যে কোন মিশ্রণ সম্ভব নয়, অতএব) তোমাদের পথ তোমাদের জন্য; আর আমার পথ আমার জন্য।৩

টীকা :

[১] সারা দুনিয়ার কাফির মুশরিকরা যেসব বাতিল উপাস্যের উপাসনা, আরাধনা ও পূজা করত বা করে- সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

[২] এ সূরায় কয়েকটি বাক্য বার বার উল্লেখিত হয়েছে। অনেক তাফসীরবিদ বলেছেন যে, একই বাক্য একবার বর্তমানকালের জন্য এবং একবার ভবিষ্যৎকালের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমি এখন তোমাদের উপাস্যদের ইবাদাত করি না এবং তোমরাও আমার উপাস্যের ইবাদাত কর না এবং ভবিষ্যতেও এরূপ হতে পারে না। আয়াতের অর্থ এটাও হতে পারে যে, আমার ও তোমাদের ইবাদাতের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। আমি তোমাদের মতো ইবাদাত করতে পারি না। এভাবে প্রথম জায়গায় উপাস্যদের বিভিন্নতা এবং দ্বিতীয় জায়গায় ইবাদাত পদ্ধতির বিভিন্নতা বর্ণিত হয়েছে।

[৩] এ বাক্যটি তেমনি যেমন অন্য আয়াতে আছে,

وَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقُلْ لِّي عَمَلِيْ وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ أَنْتُمْ بَرِيْئُوْنَ مِمَّا أَعْمَلُ وَأَنَا بَرِيْءٌ مِمَّا تَعْمَلُوْنَ

অর্থাৎ আর তারা যদি আপনার প্রতি মিথ্যারোপ করে তবে আপনি বলবেন, আমার কাজের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের। (সূরা ইউনুস : ৪১) অন্য আয়াতে এসেছে, لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ অর্থাৎ আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য। (সূরা কাসাস : ৫৫; সূরা শুরা : ১৫)

এর সারমর্ম এই যে, প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমার দ্বীন আলাদা এবং তোমাদের দ্বীন আলাদা। আমি তোমাদের মাবুদদের পূজা-উপাসনা করি না এবং তোমরাও আমার মাবুদের ইবাদাত করো না। তাই আমার ও তোমাদের পথ কখনো এক হতে পারে না।

এ সূরায় কাফিরদের দ্বীনের কোন প্রকার স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি। মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা দ্বীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না- এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়া এবং তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার ঘোষণাই এ সূরার উদ্দেশ্য।

বর্তমান কালের কোন কোন জাহিল মনে করে থাকে যে, এখানে কাফিরদেরকে তাদের দ্বীনের উপর থাকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তারা এটা ইসলামের উদারনীতির প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকে। নিঃসন্দেহে ইসলাম উদার। ইসলাম কাউকে অযথা হত্যা বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে অনুমতি দেয় না। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে কুফরী থেকে মুক্তি দিতে তাদের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনের প্রচার-প্রসার ঘটানো থেকে বিরত থাকতে বলেনি। ইসলাম চায় প্রত্যেকটি কাফির ও মুশরিক ইসলামের ছায়াতলে এসে শান্তির বার্তা গ্রহণ করুক। আর এজন্য ইসলাম প্রজ্ঞা, উত্তম উপদেশবাণী, উত্তম পদ্ধতিতে তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর পথে আহবান করাকে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অবশ্য করণীয় বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ সমস্ত জাহিলরা বিষয়টিকে বুঝতে চায় না। তারা এ আয়াত দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামক কুফরী মতবাদকে জায়েয প্রমাণ করতে চায়। এটা নিঃসন্দেহে ঈমান আনার পরে কুফরী করার শামিল।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে একটি উত্তম আদর্শ। (সেটি হচ্ছে) তারা নিজেদের জাতিকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমরা তোমাদের থেকে ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদদের পূজা তোমরা কর তাদের থেকে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। আমরা তোমাদের কুফরী করি ও অস্বীকৃতি জানাই এবং যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে গেছে।

(সূরা মুমতাহিনাহ : ৪)

আয়াতের মূল ভাষ্য হচ্ছে, এখানে কাফিরদের সাথে সম্পর্কচ্যূতির ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এটাও লক্ষণীয় যে, পবিত্র কুরআনে এ কথাও আছে, কাফিররা সন্ধি করতে চাইলে তোমরাও সন্ধি কর। (সূরা আনফাল : ৬১) তাছাড়া মদীনায় হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর ও ইয়াহুদীদের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। মূলত সন্ধির বৈধতা ও অবৈধতার আসল কারণ হচ্ছে স্থান-কাল-পাত্র এবং সন্ধির শর্তাবলি। রাসূলুল্লাহ ﷺ এক ফায়সালা দিতে গিয়ে বলেছেন, সে সন্ধি অবৈধ, যা কোন হারামকে হালাল কিংবা হালালকে হারাম করে।

(আবু দাউদ, হা/৩৫৯৪; তিরমিযী, হা/১৩৫২; ইবনে মাজাহ, হা/২৫৫৩)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

ইসলাম ও কুফর এবং শির্ক ও তাওহীদ কখনো মিলিত হতে পারে না।

বাতিলের সাথে কখনো আপোষ করা যাবে না।

শিরকের নিন্দা করাই হচ্ছে তাওহীদের অন্যতম দাবী।

৩৫
১১০- সূরা নাসর
সূরার নামকরণ :

প্রথম আয়াতে উল্লেখিত نَصْرٌ (নাসর) শব্দকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর অর্থ সাহায্য, বিজয়।

নাযিলের সময়কাল :

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) একে কুরআন মাজীদের শেষ সূরা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরপর নবী ﷺ এর উপর আর কোন পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়নি। (সহীহ মুসলিম, হা/৩০২৪)

এ সূরায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গিত আছে। সূরা আন-নাসরের নাযিল হওয়া ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ইন্তিকালের মধ্যে ৩ মাস কয়েক দিনের ব্যবধান ছিল।

সূরার বিষয়বস্তু :

আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলে দিয়েছিলেন, যখন আরবে ইসলামের বিজয় পূর্ণ হয়ে যাবে এবং লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকবে তখন এর মানে হবে, আপনাকে যে কাজের জন্য দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল তা পূর্ণ হয়ে গেছে। তারপর তাঁকে হুকুম দেয়া হয়েছে, আপনি আল্লাহর হামদ ও প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতে থাকুন। কারণ তাঁরই অনুগ্রহে আপনি এতবড় কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর তাঁর কাছে এ মর্মে দু‘আ করুন যে, এই বিরাট কাজ করতে গিয়ে যে ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে তা যেন তিনি মাফ করে দেন।

এখানে একজন সাধারণ নেতা ও একজন নবীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। একজন সাধারণ নেতা যে বিপ্লব করার জন্য কাজ করে যায় নিজের জীবদ্দশাতেই যদি সেই বিপ্লব সফলকাম হয়ে যায় তাহলে এ জন্য সে বিজয় উৎসব পালন করে এবং নিজের নেতৃত্বের গর্ব করে বেড়ায়। কিন্তু একজন নবী এতবড় মহৎ কাজ সম্পন্ন করার পরও তাঁকে উৎসব পালন করার নয়; বরং আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনা করার এবং তাঁর কাছে মাগফিরাতের দু‘আ করার হুকুম দেয়া হয়েছে। আর তিনি পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে সেই হুকুম পালন করতে থাকেন।

আয়াত : ১-৩



اِذَا جَآءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ (১) وَرَاَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ اَفْوَاجًا (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا (৩)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) اِذَا যখন جَآءَ আসবে نَصْرُ সাহায্য اَللهِ আল্লাহর وَالْفَتْحُ ও বিজয়। (২) وَرَاَيْتَ তখন তুমি দেখবে اَلنَّاسَ মানুষদেরকে, يَدْخُلُوْنَ তারা দাখিল হচ্ছে فِيْ دِيْنِ اللهِ আল্লাহর দ্বীনে اَفْوَاجًا দলে দলে। (৩) فَسَبِّحْ অতঃপর তুমি তাসবীহ পাঠ করতে থাকো بِحَمْدِ প্রশংসার সাথে رَبِّكَ তোমার প্রতিপালকের وَاسْتَغْفِرْهُ এবং তার কাছেই ক্ষমাপ্রার্থনা কর; اِنَّهٗ অবশ্যই তিনি كَانَ تَوَّابًا তাওবা কবুলকারী।

সরল অনুবাদ :

(১) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে।১ (২) তখন মানুষদেরকে তুমি দেখবে, তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে দাখিল হচ্ছে।২ (৩) অতঃপর তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা করো এবং তার কাছেই ক্ষমাপ্রার্থনা কর; অবশ্যই তিনি তাওবা কবুলকারী।৩

টীকা :

[১] এখানে বিজয় বলে মক্কা বিজয় বুঝানো হয়েছে। আর বিজয় মানে কোন একটি সাধারণ যুদ্ধে বিজয় নয়। বরং এর মানে হচ্ছে এমন একটি চূড়ান্ত বিজয়, যার পরে ইসলামের সাথে সংঘর্ষ করার মতো আর কোন শক্তির অস্তিত্ব দেশের বুকে থাকবে না এবং এ কথাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমানে আরবে এ দ্বীনটিই প্রাধান্য বিস্তার করবে।

[২] অর্থাৎ লোকদের একজন দু’জন করে ইসলাম গ্রহণ করার যুগ শেষ হয়ে যাবে। তখন এমন যুগের সূচনা হবে যখন একটি গোত্রের সবাই এবং এক একটি বড় বড় এলাকার সমস্ত অধিবাসী কোন প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ ও চাপ প্রয়োগ ছাড়াই স্বতষ্ফূর্তভাবে মুসলিম হয়ে যেতে থাকবে। মক্কা বিজয়ের পূর্বে এমন লোকদের সংখ্যাও প্রচুর ছিল, যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর রিসালত ও ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাসের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু কুরাইশদের ভয়ে অথবা অন্য কোন কারণে তারা ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। মক্কা বিজয় তাদের সেই বাধা দূর করে দেয়। সে মতে তারা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করে। সাধারণ আরবরাও এমনিভাবে দলে দলে ইসলামে দাখিল হয়।

[৩] একাধিক হাদীসে সাহাবীদের উক্তি আছে যে, এ সূরায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত আছে। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদা উমর (রাঃ) আমাকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ সাহাবীদের সঙ্গে তাঁর দরবারে শামিল করলেন। এ কারণে সম্ভবত তাদের কারো কারো মনে প্রশ্ন জেগে থাকবে। তাই একজন বললেন, আপনি একে আমাদের সঙ্গে শামিল করলেন কেন? আমাদেরও তো তার মতো সন্তান আছে। উমর বললেন, তার বিষয়ে তো আপনারা ভাল করেই জানেন। অতঃপর তিনি একদিন তাকে (আবদুল্লাহ ইবনু আববাসকে) তাঁদের সাথে ডাকলেন। আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি বুঝতে পারলাম আজকে তিনি তাঁদেরকে কিছু দেখানোর জন্য আমাকে ডেকেছেন। তিনি (উমর) সবাইকে বললেন মহান আল্লাহর বাণীঃ ‘‘ইযা জা-আ নাসরুল্লা-হি ওয়াল ফাতহ্’’ অর্থাৎ ‘‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে’’ এ সম্পর্কে আপনারা কী বলেন? উত্তরে তাঁদের কেউ বললেন, আমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হলে ও বিজয় লাভ করলে এ আয়াতে আমাদেরকে আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ কিছু না বলে নীরব থাকলেন। তখন তিনি আমাকে বললেন, হে আবদুল্লাহ ইবনু আববাস! তুমিও কি তা-ই বল? তখন আমি বললাম, না- আমি এমনটি মনে করি না। উমর (রাঃ) বললেন, তাহলে তুমি কী বলতে চাও? আমি বললাম, এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসলে সেটিই হবে তোমার মৃত্যুর লক্ষণ। তখন তুমি তোমার রবের প্রশংসা বর্ণনার সাথে সাথে তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা কর। তিনিই তাওবা কবুলকারী। এ কথা শুনে উমর (রাঃ) বললেন, তুমি যা বলছো এ আয়াতের অর্থ আমিও তাই বুঝি। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৭০)

সুতরাং সূরার অর্থ হচ্ছে আপনার দুনিয়াতে অবস্থান করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে, তাবলীগ তথা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালিত হয়েছে। অতএব, আপনি তাসবীহ ও ইস্তেগফারে মনোবিবেশ করুন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, এই সূরা নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাতের রুকূ ও সিজদায় এ দু‘আ পাঠ করতেন,

سُبْحَانَكَ اَللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِيْ

সুব্হা-নাকা আল্লা-হুম্মা রববানা ওয়াবিহামদিকা আল্লা-হুম্মাগ্ফিরলী।

অর্থ : হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার প্রশংসার সাথে আমরা তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দাও। (সহীহ বুখারী, হা/৭৯৪)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

সফলতা ও বিজয় আল্লাহর সাহায্য দ্বারাই অর্জিত হয়।

আল্লাহ কোন বান্দাকে নিয়ামত দান করলে সেজন্য গর্বিত না হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করার জন্য বেশি বেশি এ দু‘আ পাঠ করা উচিত- ‘‘সুবহানাকা আল্লা-হুম্মা রাববানা ওয়াবিহাম্দিকা আল্লা-হুম্মাগ্ ফিরলী’’।

মৃত্যু নিকটবর্তী মনে হলে বেশি বেশি তাসবীহ ও ইসতেগফার করা উচিত।

৩৬
১১১- সূরা লাহাব
সূরার নামকরণ :

সূরাটির প্রথম আয়াতে উল্লেখিত لَهَبٌ (লাহাব) শব্দকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই সূরাটিকে সূরা তাববাত বলেও আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ লেলিহান আগুন।

নাযিলের সময়কাল :

এর মক্কী হওয়ার ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর ইসলাম দাওয়াতের বিরুদ্ধে আবু লাহাবের যে ভূমিকা এখানে দেখা গেছে তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, সূরাটি এমন সময় নাযিল হয়ে থাকবে যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে শত্রুতা চরম আকার ধারণ করেছিল।

পটভূমি :

কুরআনে মাত্র এ একটি জায়গাতেই ইসলামের শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা করা হয়েছে। প্রাচীন যুগে যেহেতু সারা আরব দেশের সব জায়গায় অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, লুটতরাজ ও রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল, এজন্য আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন আরবের এ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তার সরদাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেনি; বরং প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেনি।

জাহেলী যুগেও আরবের লোকেরা এ নৈতিক আদর্শকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতো। অথচ শুধুমাত্র একজন লোক ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এ আদর্শ ও মূলনীতি লংঘন করে। সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চাচা। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পিতা এবং এ আবু লাহাব ছিল একই পিতার সন্তান। আরবে চাচাকে বাপের মতই মনে করা হতো। বিশেষ করে যখন ভাতিজার বাপের ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল তখন আরবীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী চাচার কাছে আশা করা হয়েছিল, সে ভাতিজাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু এ ব্যক্তি কুফরী প্রেমে ডুবে গিয়ে এ সমস্ত আরবীয় ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছিল।

মক্কায় আবু লাহাব ছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিল। উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। এ ছাড়াও হাকাম ইবনে আস, উকবা ইবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরাও তাঁর প্রতিবেশি ছিল। এরা বাড়িতেও রাসূলুল্লাহ ﷺ কে নিশ্চিন্তে থাকতে দিত না। তিনি যখন সালাত আদায় করতেন, এরা তখন উপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্নার হাঁড়ির মধ্যে ময়লা ছুড়ে দিতো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন প্রতিবেশীসূলভ আচরণ?

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন) প্রতি রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ঘরের দরজার সামনে কাঁটা, গাছের ডাল-পালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ। যাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ বা তাঁর শিশু-সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিধে যায়।

সে যে কেমন জঘন্য মানসিকতার অধিকারী ছিল তার পরিচয় একটি ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। রাসূলুললাহ ﷺ এর ছেলে আবুল কাসেমের ইন্তিকালের পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে আবদুল্লাহরও ইন্তিকাল হয়। এ অবস্থায় আবু লাহাব তার ভাতিজার শোকে শরীক না হয়ে বরং আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌঁড়ে কুরাইশ সরদারদের কাছে যায়। সে তাদেরকে জানায়, শোনো! আজ মুহাম্মাদের নাম নিশানা মুছে গেছে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ যেখানে যেখানে ইসলামের দাওয়াত দিতে যেতেন আবু লাহাবও তাঁর পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে পৌঁছতো এবং লোকদেরকে তাঁর কথা শোনার কাজে বাধা দিতো। ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ অর্থাৎ তুমি তোমার একান্ত নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করে দাও- (সূরা শুয়ারা- ২১৪) এ আয়াতটি নাযিল হল, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বের হয়ে সাফা পর্বতে উঠলেন। অতঃপর يَا صَبَاحَاهْ (ভোর বেলার বিপদ সাবধান) বলে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিলেন। তখন তারা সকলেই তাঁর নিকট গিয়ে একত্রিত হল। তিনি বললেন, আমি যদি তোমাদেরকে সংবাদ দেই যে, এ পর্বতের পেছনে একটি অশ্বারোহী সৈন্যদল তোমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? জবাবে সবাই বলল, আপনার উপর মিথ্যারোপ করার ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। তখন তিনি বললেন, ‘‘আমি তোমাদেরকে আসন্ন কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি।’’ (সূরাহ সাবা- ৩৪/৪৬)

এ কথা শুনে আবু লাহাব বলল, তোমার ধ্বংস হোক। তুমি কি আমাদেরকে এজন্যই একত্রিত করেছ? অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ দাঁড়ালেন। তারপর নাযিল হল : تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ (ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও)। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৭১-৭২; সহীহ মুসলিম, হা/২০৮)

মক্কার বাইরের আরবের যেসব লোকেরা হজ্জের জন্য আসতো অথবা বিভিন্ন স্থনে যেসব বাজার বসতো সেখানে যারা জমায়েত হতো, তাদের সামনে যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিজের চাচা তাঁর পিছনে ঘুরে ঘুরে তাঁর বিরোধিতা করতো, তখন বাইরের লোকদের উপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়তো। কারণ আরবের প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে কোন চাচা বিনা কারণে অন্যদের সামনে তার নিজের ভাতিজাকে গালিগালাজ করবে, তার গায়ে পাথর মারবে এবং তার প্রতি দোষারোপ করবে এটা কল্পনাতীত ছিল। তাই তারা আবু লাহাবের কথায় প্রভাবিত হয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেতো। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হওয়ার পর যখন আবু লাহাব রাগে অন্ধ হয়ে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিরোধিতার ব্যাপারে তার কোন কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে নিজের ভাতিজার শত্রুতায় অন্ধ হয়ে গেছে।

আয়াত : ১-৫



تَبَّتْ يَدَاۤ اَبِيْ لَهَبٍ وَّتَبَّ (১) مَاۤ اَغْنٰى عَنْهُ مَالُهٗ وَمَا كَسَبَ (২) سَيَصْلٰى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ (৩) وَامْرَاَتُهٗ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (৪) فِيْ جِيْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ (৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) تَبَّتْ ধ্বংস হয়ে যাক يَدَا দু’হাতই اَبِيْ لَهَبٍ আবূ লাহাবের وَّتَبَّ ধ্বংস হয়ে যাক (সে নিজেও); (২) مَاۤ اَغْنٰى কোন কাজে আসেনি عَنْهُ তার জন্য مَالُهٗ তার ধন-সম্পদ وَمَا كَسَبَ এবং সে যা উপার্জন করেছে তা; (৩) سَيَصْلٰى অচিরেই সে নিক্ষিপ্ত হবে نَارًا আগুনে ذَاتَ لَهَبٍ লেলিহান শিখা বিশিষ্ট। (৪) وَامْرَاَتُهٗ এবং (ধ্বংস হোক) তার স্ত্রীও حَمَّالَةَ বহনকারিণী اَلْحَطَبِ জ্বালানি কাঠ। (৫) فِيْ جِيْدِهَا তার গলায় থাকবে حَبْلٌ রশি مِنْ مَّسَدٍ খেজুর পাতার পাকানো।

সরল অনুবাদ :

(১) আবূ লাহাবের১ দু’হাতই২ ধ্বংস হয়ে যাক; ধ্বংস হয়ে যাক সে নিজেও; (২) তার ধন-সম্পদ ও আয়-উপার্জন৩ তার কোন কাজে আসবে না; (৩) অচিরেই সে লেলিহান শিখা বিশিষ্ট আগুনে প্রবেশ করবে।৪ (৪) সাথে থাকবে জ্বালানি কাঠের বোঝা বহনকারিণী৫ তার স্ত্রীও।৬ (৫) (অবস্থা দেখে মনে হবে) তার গলায়৭ যেন খেজুর পাতার পাকানো শক্ত কোন রশি৮ জড়িয়ে আছে।

টীকা :

[১] আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা। সে ছিল আবদুল মুত্তালিবের অন্যতম সন্তান। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চাচা। গৌরবর্ণের কারণে তার ডাক নাম হয়ে যায় আবু লাহাব। কারণ লাহাব বলা হয় আগুনের লেলিহান শিখাকে। লেলিহান শিখার রং হচ্ছে গৌরবর্ণ। সে অনুসারে আবু লাহাব অর্থ গৌরবর্ণবিশিষ্ট। পবিত্র কুরআনে তার আসল নাম বর্জন করা হয়েছে; কেননা সেটা মুশরিকসূলভ নাম। এছাড়া আবু লাহাব ডাক নামের মধ্যে জাহান্নামের সাথে বেশ মিলও রয়েছে। কারণ জাহান্নামের অগ্নির লেলিহান শিখা তাকে পাকড়াও করবে। সে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কট্টর শত্রু ও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল।

[২] يَدٌ শব্দের অর্থ হাত। মানুষের সব কাজে হাতের প্রভাবই বেশি, তাই কোন ব্যক্তি সত্তাকে হাত বলেই ব্যক্ত করে দেয়া হয়; تَبَّتْ يَدَاۤ اَبِيْ لَهَبٍ وَّتَبَّ এর অর্থ কোন তাফসীরকার করেছেন, ভেঙ্গে যাক আবু লাহাবের হাত এবং সে ধ্বংস হয়ে যাক অথবা সে ধ্বংস হয়ে গেছে। কোন কোন তাফসীরকার বলেন, এটা আবু লাহাবের প্রতি একটি ভবিষ্যদ্বাণী। এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীত কালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মানে, তার হওয়াটা যেন এত বেশি নিশ্চিত যেমন তা হয়ে গেছে। আর এ সূরায় কয়েক বছর আগে যা বর্ণনা করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাই সত্য হলো। এখানে হাত ভেঙ্গে যাওয়ার মানে শুধু শরীরের একটি অঙ্গ ভেঙ্গে যাওয়াই নয়। বরং পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যাওয়াই এর উদ্দেশ্য। এ সূরাটি নাযিল হওয়ার মাত্র সাত আট বছর পরেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সরদার নিহত হয়। তারা সবাই ইসলামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের সহযোগী ছিল। এ পরাজয়ের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সে এত বেশি মর্মাহত হয় যে, এরপর সে সাত দিনের বেশি জীবিত থাকতে পারেনি। যে দ্বীনের অগ্রগতির পথ রোধ করার জন্য সে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, তার সন্তানদের সেই দ্বীন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার আরো বেশি ও পূর্ণ পরাজয় সম্পন্ন হয়। সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মু‘আত্তাব রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার হাতে বাইআত করেন। (রুহুল মাআনী)

[৩] كَسَبٌ এর অর্থ ধন-সম্পদ দ্বারা অর্জিত মুনাফা। এর অর্থ সন্তান-সন্ততিও হতে পারে। কেননা সন্তান-সন্ততিকেও মানুষের উপার্জন বলা হয়। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, মানুষ যা খায়, তন্মধ্যে তার উপার্জিত বস্তুই সর্বাধিক হালাল ও পবিত্র; আর তার সন্তান-সন্ততিও তার উপার্জিত বস্তুর মধ্যে দাখিল (নাসায়ী : ৪৪৪৯; আবু দাউদ, হা/৩৫২৮)। অর্থাৎ সন্তানের উপার্জন খাওয়াও নিজের উপার্জন খাওয়ারই নামান্তর। এ কারণে কয়েকজন তাফসীরবিদ এ স্থলে كَسَبٌ এর অর্থ করেছেন সন্তান-সন্ততি। আল্লাহ তা‘আলা আবু লাহাবকে যেমন দিয়েছিলেন অগাধ ধন-সম্পদ, যেমনি দিয়েছিলেন অনেক সন্তান-সন্ততি। অকৃজ্ঞতার কারণে এ দুটি বস্তুই তার গর্ব, অহমিকা ও শাস্তির কারণ হয়ে যায়।

[৪] অর্থাৎ কিয়ামতে অথবা মৃত্যুর পর কবরেই সে এক লেলিহান অগ্নিতে প্রবেশ করবে। তার নামের সাথে মিল রেখে অগ্নির বিশেষণ ذَاتَ لَهَبٍ বলার মধ্যে বিশেষ অলংকার রয়েছে।

[৫] আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল আরওয়া। সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন ও হরব ইবনে উমাইয়্যার কন্যা। তাকে উম্মে জামীল বলা হত। আবু লাহাবের ন্যায় তার স্ত্রীও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি বিদ্বেষী ছিল। সে এ ব্যাপারে তার স্বামীকে সাহায্য করত। আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এই হতভাগিনীও তার স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

[৬] حَمَّالَةَ الْحَطَبِ এর শাব্দিক অর্থ শুষ্ককাঠ বহনকারী। আরবের বাকপদ্ধতিতে পশ্চাতে নিন্দাকারীকে খড়ি-বাহক বলা হত। শুষ্ককাঠ একত্রিত করে যেমন কেউ অগ্নি সংযোগের ব্যবস্থা করে, পরোক্ষ নিন্দাকার্যটিও তেমনি। এর মাধ্যমে সে ব্যক্তিবর্গ ও পরিবারের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কিরামকে কষ্ট দেয়ার জন্য আবু লাহাব পত্নী পরোক্ষ নিন্দাকার্যের সাথেও জড়িত ছিল। অধিকাংশ তাফসীরবিদ এখানে এ তাফসীরই করেছেন। অপরপক্ষে কোন কোন তাফসীরবিদ একে আক্ষরিক অর্থেই রেখেছেন যে, এই নারী বন থেকে কণ্টকযুক্ত লাকড়ি চয়ন করে আনত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ কে কষ্ট দেয়ার জন্য তার পথে বিছিয়ে রাখত।

[৭] তার গলার জন্য ‘জীদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় গলাকে জীদ বলা হয়। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বলেন, সে একটি অতি মূল্যবান হার গলায় পরতো এবং বলতো, লাত ও উযযার কসম, এ হার বিক্রি করে আমি এর মূল্য বাবদ পাওয়া সমস্ত অর্থ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কাজ করার জন্য ব্যয় করব। এ কারণে জীদ শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাঙ্গার্থে। অর্থাৎ এ অলংকার পরিহিত সুসজ্জিত গলায়, যেখানে পরিহিত হার নিয়ে সে গর্ব করে বেড়ায়, কিয়ামতের দিন সেখানে রশি বাঁধা হবে।

[৮] বলা হয়েছে, তার গলায় বাঁধা রশিটি মাসাদ ধরনের। মাসাদ এর অর্থ নির্ণয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, খুব মজবুত করে পাকানো রশিকে মাসাদ বলা হয়। দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, খেজুর গাছের (ডালের) ছাল/আঁশ থেকে তৈরি শক্ত পাকানো খসখসে রশি মাসাদ নামে পরিচিত। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, এর অর্থ লোহার তারের পাকানো রশি বা লোহার বেড়ি। কোন কোন মুফাসসির বলেন, তার গলায় আগুনের রশি পরানো হবে। তা তাকে তুলে আগুনের প্রান্তে উঠাবে আবার তাকে এ গর্তদেশে নিক্ষেপ করবে। এভাবে তার শাস্তি চলতে থাকবে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে দুশমনি করার পরিণাম হলো উভয় জগতে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা।

মাল আর সন্তান কোন কাজে আসবে না- যদি এসব আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাজে ব্যবহার না করা হয়।

পাপ কাজে যারা একে অন্যের সহযোগী হয় কিয়ামতের দিন তাদের সকলকে একত্র করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

শিরক ও কুফরী থাকলে নিকটাত্মীয় কোন কাজে আসবে না।

যারাই এ পৃথিবীতে ইসলামের বিরোধিতা করেছে, তারা কেউই এ দুনিয়া থেকে সম্মানে বিদায় নিতে পারেনি। ভবিষ্যতেও কেউ পারবে না, আর পরকালের শাস্তি তো আছেই।

৩৭
১১২- সূরা ইখলাস
সূরার নামকরণ :

কুরআন মাজীদের অন্যান্য সূরার ক্ষেত্রে সাধারণত সেখানে ব্যবহৃত কোন শব্দের মাধ্যমে তার নামকরণ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এ সূরাটিতে ইখলাস শব্দ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কাজেই এর এ নামকরণ করা হয়েছে এর অর্থের ভিত্তিতে। কারণ এখানে খালেস তথা নির্ভেজাল তাওহীদের আলোচনা করা হয়েছে। ইখলাস অর্থ খাঁটি, নির্ভেজাল।

নাযিলের সময়কাল :

এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে একে মক্কায় একেবারে প্রথম যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনের কোন বিস্তারিত আয়াত তখনো পর্যন্ত নাযিল হয়নি।

শানে নুযূল :

মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে প্রশ্ন করেছিল- আল্লাহ তা‘আলা কিসের তৈরি? এর জবাবে সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।

(সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী : ৬/৩৭০; তাবারানী; মু‘জামুল আওসাত : ৩/৯৬)

রাসূলুল্লাহ ﷺ যে মাবুদের ইবাদাত ও বন্দেগী করার প্রতি লোকদের আহবান জানাচ্ছিলেন তার মৌলিক সত্তা ও অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক প্রশ্ন করেছিল। এ ধরনের প্রশ্ন যখনই এসেছে তখনই তিনি জবাবে আল্লাহর হুকুমে লোকদেরকে এ সূরাটিই পড়ে শুনিয়েছেন। সর্বপ্রথম মক্কায় কুরাইশ বংশীয় মুশরিকরা তাঁকে এ প্রশ্ন করে। তাদের এ প্রশ্নের জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়।

সূরার বিষয়বস্তু :

রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তখন মূর্তি পূজারী মুশরিকরা কাঠ, পাথর, সোনা, রূপা ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসের তৈরি মূর্তিসমূহের পূজা করতো। সেই মূর্তিগুলোর আকার, আকৃতি ও দেহাবয়ব ছিল। এ দেবদেবীদের রীতিমত বংশধারাও ছিল। কোন দেবী এমন ছিল না, যার স্বামী ছিল না; আবার কোন দেবতা এমন ছিল না, যার স্ত্রী ছিল না। তাদের খাবার দাবারেরও প্রয়োজন দেখা দিতো। তাদের পূজারীরা তাদের জন্য এসবের ব্যবস্থা করতো। এ অবস্থায় যখন লোকদেরকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর আনুগত্য করার দাওয়াত দেয়া হয় তখন তাদের মনে এ প্রশ্ন জাগা নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে, সেই রব কেমন। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে কুরআন মূলত আল্লাহর অস্তিত্বের এমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা পেশ করে দিয়েছে, যা সব ধরনের মুশরিকী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটন করে এবং আল্লাহর সত্তার সাথে সৃষ্টির গুণাবলির মধ্য থেকে কোন একটি গুণকেও সংযুক্ত করার কোন অবকাশই রাখেনি।

গুরুত্ব ও ফযীলত :

এ সূরার বহু ফযীলত রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :

১. এর ভালোবাসা জান্নাতে যাওয়ার কারণ; হাদীসে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে আরয করল; আমি এই সূরাকে খুব ভালোবাসি। তিনি বললেন, এর ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে দাখিল করবে। (মুসনাদে আহমাদ : ৩/১৪১, ১৫০)

২. এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ : হাদীসে এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমরা সবাই একত্রিত হয়ে যাও। আমি তোমাদেরকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ শোনাব। অতঃপর যাদের পক্ষে সম্ভব ছিল, তারা একত্রিত হলে তিনি আগমন করলেন এবং সূরা ইখলাস পাঠ করে শোনালেন। তিনি আরো বললেন, এই সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। (মুসলিম : ৮১২; তিরমিযী, হা/২৯০০)

৩. বিপদাপদে উপকারী : হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মুসীবত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট হবে। (আবু দাউদ, হা/৫০৮২; তিরমিযী, হা/৩৫৭৫)

৪. ঘুমানোর আগে পড়ার উপর গুরুত্ব : রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, হে উকবা ইবনে আমের! আমি কি তোমাকে এমন তিনটি উত্তম সূরা শিক্ষা দিব না, যার মতো কিছু তাওরাত, ইঞ্জীল, যাবূর এবং কুরআনেও নাযিল হয়নি। উকবা বললেন, আমি বললাম, অবশ্যই হ্যাঁ! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন। উকবা বলেন, তারপর রাসূল ﷺ আমাকে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস এ সূরাগুলো পড়ালেন। তারপর বললেন, হে উকবা! রাত্রিতে তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত নিদ্রা যেয়ো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ কর। উকবা (রাঃ) বলেন, সেদিন থেকে আমি কখনও এই আমল ছাড়িনি। (মুসনাদে আহমাদ : ৪/৪১৮, ১৫৮-৫৯)

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিয়মিত আমল : আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন বিছানায় ঘুমানোর জন্য যেতেন তখন তিনি তার দু’হাতের তালু একত্রিত করতেন। তারপর সেখানে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। তারপ এ দু’হাতের তালু দিয়ে তার শরীরের যতটুকু সম্ভব মাসেহ করতেন। তার মাথা ও মুখ থেকে শুরু করে শরীরের সামনের অংশে তা করতেন। এমনটি রাসূল ﷺ তিনবার করতেন।

(সহীহ বুখারী, হা/৫০১৭; আবু দাউদ, হা/৫০৫৬; তিরমিযী, হা/৩৪০২)

আয়াত : ১-৪



قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ (১) اَللهُ الصَّمَدُ (২) لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ (৩) وَلَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ (৪)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) قُلْ তুমি বলো, هُوَ তিনিই اَللهُ আল্লাহ اَحَدٌ একক-অদ্বিতীয়। (২) اَللهُ আল্লাহ اَلصَّمَدُ অমুখাপেক্ষী। (৩) لَمْ يَلِدْ তিনি কাউকে জন্ম দেননি, وَلَمْ يُوْلَدْ আর তিনিও কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। (৪) وَلَمْ يَكُنْ আর নেই لَهٗ তাঁর كُفُوًا সমতুল্য اَحَدٌ কেউই।

সরল অনুবাদ :

(১) (হে মুহাম্মদ) তুমি বলো,১ তিনিই আল্লাহ, তিনি এক ও একক।২ (২) তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।৩ (৩) তাঁর থেকে কেউ জন্ম নেয়নি আর তিনিও কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি।৪ (৪) আর তাঁর সমতুল্য কেউ-ই নেই।৫

টীকা :

[১] এখানে বলুন শব্দটির মাধ্যমে প্রথমত রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ তাকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনার রব কে? তিনি কেমন? আবার তাকেই হুকুম দেয়া হয়েছিল, প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর এ সম্বোধনটি প্রত্যেক মুমিনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ কে যে কথা বলার হুকুম দেয়া হয়েছিল, এখন সে কথা প্রত্যেক মুমিনকেই বলতে হবে।

[২] এ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে যাঁর সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছ তিনি আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন সমকক্ষ, সদৃশ, স্ত্রী, সন্তান, অংশীদার কিছুই নেই। তাই তিনি পূর্ণতার অধিকারী। সুন্দর নামসমূহ, পূর্ণ শ্রেষ্ঠ গুণাবলী এককভাবে শুধুমাত্র তাঁরই। أَحَدٌ শব্দটি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা তিনিই গুণাবলী ও কার্যাবলীতে একমাত্র পরিপূর্ণ সত্তা।

[৩] صَمَدٌ শব্দের অর্থ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের অনেক উক্তি আছে। আলী (রাঃ) ও ইকরামা বলেছেন, সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা- যাঁর কাছে সবাই তাদের প্রয়োজন পেশ করে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, তিনি এমন সরদার, নেতা, যার নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা তথা শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার সমস্ত গুণাবলিতে পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ।

আসল ও প্রকৃত সামাদ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সৃষ্টি যদি কোন দিক দিয়ে সামাদ হয়ে থাকে তাহলে অন্য দিক দিয়ে সামাদ নয়। কোন কোন সৃষ্টি তার মুখাপেক্ষী হলেও সে নিজে আবার কারো মুখাপেক্ষী। তার নেতৃত্ব আপেক্ষিক, নিরংকুশ নয়। কারো তুলনায় সে শ্রেষ্ঠতম হলেও তার তুলনায় আবার অন্য কেউ আছে শ্রেষ্ঠতম। কিছু সৃষ্টির কিছু প্রয়োজন সে পূর্ণ করতে পারে; কিন্তু সবার সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই। বিপরীত পক্ষে আল্লাহর সামাদ হবার গুণ অর্থাৎ তাঁর মুখাপেক্ষীহীনতার গুণ সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ। সারা দুনিয়া তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সামাদ হবার কারণে তাঁর একক মাবুদ হবার ব্যাপারটিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই।

[৪] যারা আল্লাহর বংশ পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিল, এটা তাদের জবাব। সন্তান প্রজনন সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য- স্রষ্টার নয়। অতএব, তিনি কারো সন্তান নন এবং তাঁর কোন সন্তান নেই। আবূ হুরায়রা (রাঃ) নাবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, কিছুসংখ্যক বানী আদম আমার প্রতি মিথ্যারোপ করছে। অথচ তাদের এমনটি করা উচিত নয়। আর কিছুসংখ্যক বানী আদম আমাকে গালি দিচ্ছে। অথচ তাদের এ রকম করা উচিত হয়নি। আমার প্রতি তাদের মিথ্যারোপ করার অর্থ, তারা বলে, আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু (মৃত্যুর পর) পুনরায় জীবিত করবেন না। অথচ তাকে পুনরায় জীবিত করার চেয়ে প্রথম বার সৃষ্টি করা সহজ নয়। আর আমাকে তাদের গালি দেয়ার অর্থ, তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। অথচ আমি একক, কারো মুখাপেক্ষী নই আমি কাউকে জন্ম দেইনি, কেউ আমাকে জন্ম দেয়নি এবং আমার কোন সমকক্ষও নেই। (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৭৪)

[৫] মূলে বলা হয়েছে কুফূ। এর মানে হচ্ছে, নজীর, সদৃশ, সমান, সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমতুল্য। আয়াতের মানে হচ্ছে, সারা বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সমকক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদাসম্পন্ন কিংবা নিজের গুণাবলী, কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোন দিন ছিল না এবং কোন দিন হতেও পারবে না এবং আকার-আকৃতিতেও কেউ তাঁর সাথে সামঞ্জস্য রাখে না।

মুশরিকরা প্রতি যুগে মাবুদদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করে এসেছে যে, মানুষের মতো তাদেরও একটি জাতি বা শ্রেণি আছে। তার সদস্য সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যে বিয়ে-শাদী এবং বংশ বিস্তারের কাজও চলে। তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনকেও এ জাহেলী ধারণা থেকে মুক্ত রাখেনি। তাঁর জন্য সন্তান সন্ততিও ঠিক করে নিয়েছে। তারা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহর কন্যা গণ্য করতো। যদিও তাদের কেউ কাউকে আল্লাহর পিতা গণ্য করার সাহস করেনি। এ সবের উত্তরেই এ সূরায় বলা হয়েছে, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। যদিও মহান আল্লাহকে আহাদ ও আস-সামাদ বললে এসব উদ্ভট ধারণা-কল্পনার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, তবুও এরপর না তার কোন সন্তান আছে, না তিনি কারো সন্তান- এ কথা বলায় এ ব্যাপারে আর কোন প্রকার সংশয় সন্দেহের অবকাশই থাকে না।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হলে তাঁর গুণাবলি দেখেই ঈমান আনতে হবে। তাঁর গুণাবলিই তাঁর পরিচয় বহন করে।

মানুষের স্রষ্টা ও পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ। তাই আন্তরিকতা ও ইখলাসের সাথে তাঁর ইবাদাত করাই মানুষের কর্তব্য।

আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনিই আইন রচনা করেন এবং হুকুম জারি করেন। এজন্য আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে মানুষের তৈরি করা আইনের অনুসরণ করা শির্ক।

শির্কের সকল ছিদ্রপথ বন্ধ করে, খাঁটিভাবে তাওহীদবাদী হতে হবে- এটাই ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর।

অত্র সূরায় উল্লেখিত চারটি বৈশিষ্ট্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে।

৩৮
১১৩-১১৪ সূরা ফালাক ও নাস
নামকরণ :

সূরা ফালাক ও সূরা নাস এ দুটি আলাদা আলাদা সূরা হলেও এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত গভীর যার ফলে এদের একটি যুক্ত নাম রাখা হয়েছে মু‘আওবিযাতাইন (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার দুটি সূরা)। ফালাক অর্থ প্রভাত, ভোর। আর নাস অর্থ হলো মানুষ।

নাযিলের সময়কাল :

এদের বিষয়বস্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে, মক্কায় এমন এক সময় সূরা দুটি নাযিল হয়েছিল, যখন সেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

সূরাদ্বয়ের উপকারিতা :

সূরা ফালাক ও নাস এর উপকারিতা ও কল্যাণ অপরিসীম এবং মানুষের জন্য এ দুটি সূরার প্রয়োজন অত্যধিক। বদনজর এবং সমস্ত দৈহিক ও আত্মিক অনিষ্টতা দূর করার জন্য এ সূরাদ্বয়ের কার্যকারিতা অনেক। নির্ভরযোগ্য হাদীসমূহে উভয় সূরার অনেক ফযীলত ও বরকত বর্ণিত আছে।

ঝাড়ফুঁক করা :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পরিবারবর্গের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ‘মু‘আব্বিযাত’ সূরাগুলো পড়ে তাকে ফুঁক দিতেন। পরবর্তীতে তিনি যখন মৃত্যুরোগে আক্রান্ত হলেন তখন আমি তাকে ফুঁক দিতে লাগলাম এবং তাঁর-ই হাত দিয়ে তাঁর দেহ মুছে দিতে লাগলাম।

(সহীহ বুখারী, হা/৫০১৬; সহীহ মুসলিম, হা/২১৯২)

শুয়ার সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিয়মিত আমল :

সূরা ইখলাসের ফযীলতে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রত্যেক সালাতের পর পড়ার জন্য নবী নির্দেশ দিয়েছেন :

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন প্রত্যেক সালাতের পর সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করি।

(সুনানে নাসাঈ, হা/১৩৩৬)

সারকথা এই যে, যাবতীয় বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম এই সূরাদ্বয়ের আমল করতেন।

পটভূমি :

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দাওয়াত যতই বিস্তার লাভ করেছে কুরাইশ বংশীয় কাফিরদের বিরোধিতাও ততোই বেড়েছে। যতদিন তাদের আশা ছিল, কোন রকম দেয়া-নেয়া করে অথবা ফুসলিয়ে তাঁকে ইসলামী দাওয়াতের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারা যাবে, ততদিন তো বিদ্বেষ ও শত্রুতার তীব্রতা কিছুটা কম ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন দীনের ব্যাপারে কোন প্রকার আপোষ করার প্রশ্নে তাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে দিলেন এবং সূরা আল-কাফিরুনের মাধ্যমে তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিলেন- যাদের ইবাদাত তোমরা করছো আমি তাদের ইবাদাত করবো না। তখন কাফিরদের শত্রুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ঘরে ঘরে তাঁকে অভিশাপ দেয়া হচ্ছিল। কোন দিন রাতের আঁধারে লুকিয়ে তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। যাতে বনী হাশেমদের কেউ হত্যাকারীর সন্ধান পেয়ে আবার প্রতিশোধ নিতে না পারে। তাঁকে যাদুটোনাও করা হয়েছিল।

নবী ﷺ এর উপর যাদুর ঘটনা :

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মহানবী ﷺ যখন মদিনায় আগমন করলেন, তখন ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খাইবার হতে একদল ইয়াহুদি মদিনায় আগমন করে বিখ্যাত যাদুকর লাবীদের সাথে সাক্ষাৎ করল। তারা বলল, আমরা মুহাম্মাদকে ধ্বংস করার জন্য বহুবার যাদু করার চেষ্টা করেছি; কিন্তু তাতে সফল হতে পারিনি। আমরা তোমাকে তিনটি আশরাফি (স্বর্ণমুদ্রা) দিচ্ছি, তুমি তার উপর খুব শক্ত আকারের যাদু করো। এ সময় এক ইয়াহুদি ছেলে মহানবী ﷺ এর খাদিম ছিল। তারা তার সাথে যোগাযোগ করে নবী ﷺ এর চিরুনির একটি অংশ সংগ্রহ করে নিল, যাতে নবী ﷺ এর চুল লাগানো ছিল। লাবীদ, অন্য বর্ণনায় তার যাদুকর বোন এ চিরুনি ও চুলের সঙ্গে এগার গিরা বিশিষ্ট এক গাছি সূতা ও সুঁচ বিশিষ্ট একটি মোমের পুতলিসহ খেজুর গাছের ছড়ার আবরণে রেখে যারওয়ান কূপের নিচে একটি পাথরের তলায় চাপা দিয়ে রেখেছিল।

নবী ﷺ এর উপর এ যাদুর প্রভাব পড়ল, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মুসনাদে আহমাদে আছে নবীর এ অসুস্থতা ছয় মাস পর্যন্ত চলছিল। অবশেষে নবী ﷺ আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে অবস্থান করে আল্লাহর দরবারে পর পর দু‘আ করলেন। এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। জেগে উঠে আয়েশা (রাঃ) কে বললেন, আমি আল্লাহর কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম তা তিনি আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, সেটা কী? নবী ﷺ বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, দু’জন ফেরেশতা মানুষের আকৃতি ধারণ করে একজন আমার মাথার দিকে ও অপরজন পায়ের দিকে বসলেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, এর কী হয়েছে? অপরজন উত্তর দিলেন, এর উপর যাদু করা হয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করলেন, কে যাদু করেছে? বলা হলো লাবীদ। জিজ্ঞেস করা হলো, কিসে? বলা হলো- চিরুনি ও চুলে একটি পুরুষ খেজুর গাছের আবরণের মধ্যে। বলা হলো কোথায়? উত্তর হলো, যারওয়ান কূপের তলায় পাথরের নিচে। বলা হলো, এখন কী করা যায়? উত্তর হলো, পানি শুঁকিয়ে তা বের করতে হবে।

নবী ﷺ কয়েকজন সাহাবীকে সাথে নিয়ে কূপে গেলেন। পানি শুঁকিয়ে জিনিসটা বের করলেন, জিবরাঈল এসে নবী ﷺ কে বললেন, আপনি ফালাক ও নাস সূরা দুটি পড়ুন। নবী ﷺ একটি করে আয়াত পড়তে লাগলেন- এতে একেকটি গিরা খুলতে লাগল, এভাবে এগারটি আয়াত পড়া শেষ করলেন।

এতে এগারটি গিরা খুলে গেল এবং সকল সুঁচ পুতলি হতে বের হয়ে গেল। এবার নবী ﷺ এর শরীরে শক্তি ফিরে আসলো এবং তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। মনে হলো যেন আট-সাট করে বেঁধে রাখা একজন মানুষকে এই মাত্র ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

অতঃপর নবী ﷺ লাবীদকে ডেকে এনে কৈফিয়ত চাইলে সে তার দোষ স্বীকার করে নিল। ফলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন। কারণ নবী ﷺ ব্যক্তিগত কারণে কখনো কারো কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতেন না। তখন কোন কোন সাহাবী বলেছিলেন, হে আল্লাহর নবী! আমরা এ খবীসকে হত্যা করব না কেন? তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করে দিয়েছেন- আমি কারো কষ্টের কারণ হতে চাই না।

(তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা নাস ও ফালাকের তাফসীর দ্রষ্টব্য।)

সূরার বিষয়বস্তু :

রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলা হয়েছে, এদেরকে বলে দাও আমি আশ্রয় চাচ্ছি আমার রবের নিকট সমুদয় সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে। এটা মূসা (আঃ) এর ঠিক সেই সময়ের কথার মতো, যখন ফিরাউন ভরা দরবারে তাঁকে হত্যা করার সংকল্প প্রকাশ করেছিল। মূসা (আঃ) তখন বলেছিলেন, ‘‘আর তোমরা আমার উপর আক্রমণ করবে এজন্য আমি নিজের ও তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি। (সূরা দুখান : ২০)

মূলত যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে, আল্লাহর শক্তি সব শক্তির সেরা, তাঁর মোকাবেলায় দুনিয়ার সব শক্তি তুচ্ছ এবং যে ব্যক্তি তাঁর আশ্রয় নিয়েছে তার সামান্যতম ক্ষতি করার ক্ষমতা কারো নেই।

সূরা ফালাক- এ দুনিয়াবী বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সূরা নাসে আখেরাতের আপদ ও মুসীবত থেকে আশ্রয় প্রার্থনার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে।

সূরা ফালাক



قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (১) مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ (২) وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ اِذَا وَقَبَ (৩) وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ (৪) وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ اِذَا حَسَدَ (৫)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) قُلْ তুমি বলো, اَعُوْذُ আমি আশ্রয় চাই بِرَبِّ প্রতিপালকের নিকট اَلْفَلَقِ প্রভাতের। (২) مِنْ شَرِّ অনিষ্ট থেকে مَا خَلَقَ যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। (৩) وَمِنْ شَرِّ এবং অনিষ্ট থেকে غَاسِقٍ রাতের অন্ধকারে اِذَا যখন وَقَبَ তা গভীর হয়। (৪) وَمِنْ شَرِّ এবং অনিষ্ট থেকে اَلنَّفَّاثَاتِ যাদুটোনাকারিণীদের فِي الْعُقَدِ গিরায়। (৫) وَمِنْ شَرِّ এবং অনিষ্ট থেকে حَاسِدٍ হিংসুকের اِذَا যখন حَسَدَ সে হিংসা করে।

সরল অনুবাদ :

(১) তুমি বলো, আমি উজ্জ্বল প্রভাতের১ মালিকের কাছে আশ্রয় চাই।২ (২) তাঁর সৃষ্টি করা প্রতিটি জিনিসের অনিষ্ট থেকে।৩ (৩) আমি আশ্রয় চাই রাতের অন্ধকারে সংঘটিত অনিষ্ট থেকে, (বিশেষ করে) যখন রাত তার অন্ধকার বিছিয়ে দেয়।৪ (৪) গিরায় ফুঁক দিয়ে যাদুটোনাকারিণীদের অনিষ্ট থেকে।৫ (৫) হিংসুক ব্যক্তির৬ (সব ধরনের হিংসার) অনিষ্ট থেকেও যখন সে হিংসা করে।৭

টীকা :

[১] ফালাক শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে ফাটানো, চিরে ফেলা বা ভেদ করা। অন্য এক আয়াতে আল্লাহর গুণ فَالِقُ الْاِصْبَاحِ (সূরা আনআম : ৯৬) বর্ণনা করা হয়েছে। এর একটি অর্থ হল- প্রভাত। রাতের অন্ধকার চিরে প্রভাতের শুভ্রতা বেরিয়ে আসার কারণে এরূপ বলা হয়েছে।

ফালাক শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে সৃষ্টি। এখানে ফালাক বলতে আল্লাহ যেসব বস্তু একটি অপরটি থেকে চিরে বা ভেদ করে বের করেছেন, তা সবই উদ্দেশ্য। যেমন- দিবস বের হয় রাতের আবরণ চিরে; বীজের বুক চিরে সব ধরনের গাছ ও উদ্ভিদের অংকুর বের হয়; জমিন থেকে তরু-লতা, ফসল ইত্যাদি বের করা হয়; সব ধরনের প্রাণী মায়ের গর্ভাশয় চিরে অথবা ডিম ফুটে কিংবা অন্য কোন আবরণ ভেদ করে বের হয়; বৃষ্টির ধারা মেঘের স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে নামে। এখানে ফালাক বলতে যা বুঝায় তার সবই উদ্দেশ্য হবে।

[২] রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর কাছে যেভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন তা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, প্রতিটি বিপদ-আপদ ও অনিষ্টতার মোকাবিলায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়াটাই মুমিনের কাজ, অন্য কারো কাছে নয়। তাছাড়া আল্লাহর প্রতি বিমুখ ও অনির্ভর হয়ে নিজের উপর ভরসা করাও তার কাজ নয়।

[৩] আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) বলেন, شَرٌّ শব্দটি দু‘প্রকার বিষয়বস্তুকে শামিল করে- (এক) প্রত্যক্ষ অনিষ্ট ও বিপদ, যা দ্বারা মানুষ সরাসরি কষ্ট পায়, (দুই) যা মুসীবত ও বিপদাপদের কারণ হয়ে থাকে, যেমন কুফর ও শিরক। কুরআন ও হাদীসে যেসব বস্তু থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা আছে, সেগুলো এই প্রকারদ্বয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেগুলো হয় নিজেই বিপদ, না হয় কোন বিপদের কারণ।

[৪] পূর্বোক্ত আয়াতের ভাষায় সমগ্র সৃষ্টির অনিষ্টই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই আশ্রয় গ্রহণের জন্য এ বাক্যটিই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এ স্থলে আরো তিনটি বিষয় আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রায়ই বিপদ ও মুসীবতের কারণ হয়ে থাকে। প্রথমে বলা হয়েছে, غَاسِقٍ اِذَا وَقَبَ এখানে غَسَقٌ শব্দের অর্থ অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া। কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেন রাত্রি। وَقَبَ এর অর্থ অন্ধকার পূর্ণরূপে বৃদ্ধি পাওয়া বা ছেয়ে যাওয়া। আয়াতের অর্থ এই যে, আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তার অন্ধকার গভীর হয়। রাতের অন্ধকারের অনিষ্টকারিতা থেকে বিশেষ করে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেবার কারণ হচ্ছে এই যে, রাত্রিবেলায় জিন, শয়তান, ইতর প্রাণী, কীট-পতঙ্গ ও চোর-ডাকাত বিচরণ করে এবং অপকার করতে পারে। তাই রাতের বেলা যেসব অনিষ্টকারিতা ও বিপদ-আপদ নাযিল হয় সেগুলো থেকে আশ্রয় চাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে।

[৫] দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, اَلنَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ এখানে نَفَثٌ এর অর্থ ফুঁ দেয়া। عُقَدٌ অর্থ গ্রন্থি। যারা যাদু করে, তারা ডোরা ইত্যাদিতে গিরা লাগিয়ে তাতে যাদুমন্ত্র পড়ে ফুঁ দেয়। এখানে نَفَّاثَاتُ স্ত্রী লিঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে। বাহ্যত এটি নারীর বিশেষণ। এটি খারাপ আত্মাকেও বুঝাতে পারে। তখন অর্থ হবে ফুঁকদানকারী খারাপ আত্মা থেকে আমি আশ্রয় চাচ্ছি। আবার এটা ফুঁ দানকারীদের সমষ্টিকেও নির্দেশ করতে পারে, যাতে পুরুষ ও নারী উভয়ই দাখিল আছে।

[৬] তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, حَسَدٌ যার শাব্দিক অর্থ হিংসা। হিংসার মানে হচ্ছে, কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ, শ্রেষ্ঠত্ব বা গুণাবলী দান করেছে তা দেখে কোন ব্যক্তি নিজের মধ্যে জবালা অনুভব করে এবং তার থেকে এগুলো ছিনিয়ে নিয়ে এ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেয়া হোক, অথবা কমপক্ষে তার থেকে সেগুলো ছিনিয়ে নেয়া হোক- এ আশা করা। তবে কোন ব্যক্তি যদি আশা করে অন্যের প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছে তার প্রতিও তাই করা হোক, তাহলে এটাকে হিংসার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। সুতরাং হিংসার মূল হলো, কারো নিয়ামত ও সুখ দেখে অসন্তুষ্ট হওয়া ও সে নিয়ামতের অবসান কামনা করা।

[৭] এখানে বলা হয়েছে, হিংসুক যখন হিংসা করে অর্থাৎ তার মনের আগুন নিবারণের জন্য নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কোন পদক্ষেপ নেয়, তার হিংসাকে প্রকাশ করে, সেই অবস্থায় তার অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় চাওয়া হয়েছে।

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

সকল অবস্থায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা জরুরি।

উজ্জ্বল প্রভাত আল্লাহ তা‘আলার একটি বড় ধরনের নিয়ামত।

শয়তানের দল রাতের মধ্যে অধিক কার্য সম্পাদন করে থাকে।

অনেক সময় হিংসুক ব্যক্তিরা কারো অনিষ্ট করার জন্য যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।

হিংসা মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়; সুতরাং হিংসা থেকে দূরে থাকা অতি জরুরি।

আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করলে যাদুকরদের যাদু এবং হিংসুকদের হিংসা থেকে আত্মরক্ষা লাভ করা যায়।

১১৪- সূরা নাস



قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ (১) مَلِكِ النَّاسِ (২) اِلٰهِ النَّاسِ (৩) مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ (৪) اَلَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِيْ صُدُوْرِ النَّاسِ (৫) مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ (৬)

শাব্দিক অনুবাদ :

(১) قُلْ তুমি বলো, اَعُوْذُ আমি আশ্রয় চাই بِرَبِّ প্রতিপালকের নিকট اَلنَّاسِ মানুষের। (২) مَلِكِ (যিনি) বাদশাহ اَلنَّاسِ মানুষের। (৩) اِلٰهِ ইলাহ اَلنَّاسِ মানুষের। (৪) مِنْ شَرِّ অনিষ্ট থেকে اَلْوَسْوَاسِ কুমন্ত্রণার اَلْخَنَّاسِ আত্মগোপনকারী শয়তানের। (৫) اَلَّذِيْ যে يُوَسْوِسُ কুমন্ত্রণা দেয় فِيْ صُدُوْرِ অন্তরে اَلنَّاسِ মানুষের। (৬) مِنَ الْجِنَّةِ জিনদের মধ্য থেকে হোক وَالنَّاسِ বা মানুষদের মধ্য থেকে হোক।

সরল অনুবাদ :

(১) তুমি বলো, আমি আশ্রয় চাই মানুষের প্রতিপালকের কাছে। (২) মানুষের (আসল) বাদশাহের কাছে। (৩) মানুষের (একমাত্র) মা‘বুদের কাছে।১ (৪) কুমন্ত্রণাকারীর২ অনিষ্ট থেকে, যে (প্ররোচনা দিয়েই) গা ঢাকা দেয়। (৫) যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। (৬) জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষদের মধ্য থেকে।৩

টীকা :

[১] এখানে রব, মালিক এবং ইলাহ এ তিনটি গুণের অধিকারীর নিকট আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। আল্লাহ রব, মালিক বা অধিপতি, মাবুদ সবই। সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি, তাঁর মালিকানাধীন এবং তাঁর বান্দা। তাই আশ্রয় প্রার্থনাকারীকে তিনটি গুণে গুণান্বিত মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

[২] এখানে কুমন্ত্রণাদাতা বলতে মানুষের সাথে নিয়োগকৃত শয়তানের কথা বলা হয়েছে, যে সঙ্গী তাকে খারাপ কাজ করাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের সাথেই একজন শয়তান সঙ্গী নিয়োগ করা হয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার সাথেও? তিনি বললেন, হ্যাঁ- তবে আল্লাহ আমাকে তার উপর নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছেন। ফলে তার থেকে আমি নিরাপদ হয়েছি এবং সে আমাকে শুধুমাত্র ভাল কাজের কথাই বলে। (সহীহ মুসলিম, হা/২৮১৪)

[৩] কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান জিনদের মধ্য থেকেও হয়, মানুষের মধ্য থেকেও হয়। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলকে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন জিন-শয়তানের অনিষ্ট থেকে এবং মানুষ-শয়তানের অনিষ্ট থেকে। জিন-শয়তানের কুমন্ত্রণা হল অলক্ষ্যে থেকে মানুষের অন্তরে কোন কথা রাখা। শয়তান যেমন মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়, তেমনিভাবে মানুষের নফসও মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ ﷺ আপন নফসের অনিষ্ট থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় চাই, আমার নফসের অনিষ্ট হতে, শয়তানের অনিষ্ট থেকেও এবং তার শিরক (বা জাল) থেকেও। (আবু দাউদ, হা/৫০৬৭; তিরমিযী, হা/৩৩৯২; মুসনাদে আহমাদ : ১/৯)

এ সূরার শিক্ষাসমূহ :

কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হলে তা বৈধ রয়েছে, অন্যথায় তা অবৈধ।

কারো উপর যাদুর প্রভাব পড়লে এ দুটি সূরা বেশি করে পড়া উচিত।

যেকোন ধরনের বিপদাপদের সম্মুখীন হলে আল্লাহর আশ্রয় নিতে হবে।

সত্যের পথে তথা ইসলামের পথে দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বদায় বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

শয়তানের কুমন্ত্রণা খুবই গোপনীয় ও সূক্ষ্ম।

কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তান শুধুমাত্র জিনদের মধ্যেই হয় না; বরং অনেক সময় মানুষের মধ্যেও হতে পারে।

সর্বদা শয়তানের চক্রান্ত থেকে সতর্ক থাকা উচিত।

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي بِنِعْمَتِه تَتِمُّ الصَّالِحَاتُ

وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন