মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
একথা কেবল মুসলমানেরই নয়, দুনিয়ায় কারো অজানা থাকার কথা নয় যে, ইসলামের বুনিয়াদী আকীদা হচ্ছে তওহীদ। ‘তওহীদ’ মানে আল্লাহ্র একত্ব। আল্লাহ্র এর একত্ব সার্বিক, পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাত্মক। এ দৃষ্টিতে আল্লাহ শুধু সৃষ্টিকর্তাই নন তিনি একমাত্র পালনকর্তা, মালিক, রিযিকদাতা, রক্ষাকর্তা ও আইন বিধানদাতাও। অতএব মানুষ ভয় করবে কেবল আল্লাহ কে, ইবাদত বন্দেগী ও দাসত্ব করবে একমাত্র আল্লাহ্র। সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও লালন পালনকারী হিসেবে মানবে একমাত্র আল্লাহকে। এসব দিক দিয়ে তিনিই একমাত্র ‘ইলাহ’। তিনি ছাড়া কেউ ইলাহ নেই, কেউ ইলাহ নয় এবং কেউ ইলাহ হতে পারেনা এবং তিনিই একমাত্র রব, তিনি ছাড়া লালনপালনকারী ও ক্রমবিকাশদাতা, রক্ষাকর্তা ও প্রয়োজন পূরণকারী আর কেউ নেই। মাবুদ ও একমাত্র তিনি-ই। তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদাত-বন্দেগী আনুগত্য পাবার অধিকারী নয়। অতএব মানুষের উপর আইন-বিধান কেবল আল্লাহরই চলবে। সংক্ষেপ কথায়ঃ রব্ব হওয়ার দিক দিয়েও তিনি এক, একক, অনন্য; আর ইলাহ হওয়ার দিক দিয়েও তিনি এক, লা-শরীক। রবুবিয়তের দিক দিয়েও আল্লাহ এক, উলুহিয়াতের দিক দিয়েও তিনি এক। এর কোনো একটি দিক দিয়েও তাঁর শরীক কেউ নেই, জুড়ি কেউ নেই, সমতুল্য কেউ নেই।
শুধু এখানেই শেষ নয়। তিনি তাঁর যাত- মূল সত্তায় এক, অনন্য। তাঁর গুণাবলীতেও তিনি একক-শরীকহীন। মাখলুকাতের ওপর-অতএব মানুষের ওপর-হক বা অধিকার তাঁরই অপ্রতিদ্বন্ধী। এ হক-হকুকের দিক দিয়েও তাঁর শরীক কেউ নেই। এবং ক্ষমতা ইখতিয়ারও একমাত্র তাঁরই রয়েছে, সৃষ্টির ওপর, এই মানুষের ওপর। আর এসব ক্ষেত্রেও তাঁর শরীক কেউ নেই, কিছু নেই। কাউকেই তাঁর শরীক হওয়ার মর্যাদা দেয়া যেতে পারেনা।
ইসলামের এই তওহীদী আকীদা কুরআন হতে প্রমাণিত; প্রমাণিত হাদীস থেকেও। রাসূলে করীম(স) সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে এই আকীদা-ই পেশ করেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। দাওয়াত দিয়েছেন মৌলিক আকীদা হিসেবে এ তওহীদকে গ্রহণ করার। যারাই সেদিন ইসলাম কবুল করেছিলেন, তাঁরা সকলে ইসলামের এ ধারণার প্রতি ঈমান এনেই হয়েছিলেন মুসলমান। অতএব রাসূলের সাহাবীরাও ছিলেন এই আকীদায় বিশ্বাসী। এই ব্যাপারে তাঁরা কখনো দূর্বলতা দেখাননি, এক্ষেত্রে কারো সাথে তাঁরা রাজি হননি কোনোরূপ আপোস বা সমঝোতা করতে। অতএব, এ-ই হচ্ছে সুন্নাতের তওহীদী আকীদা। আকীদার সুন্নাত এ-ই।
কিন্তু ইসলামের এই সুন্নাতী আকীদায় কিংবা বলা যায়-আকীদার এই সুন্নাতে বর্তমানে দেখা দিয়েছে নানা শির্ক এর বিদয়াত। মুসলিম সমাজে আল্লাহকে এক ও অনন্য বলে সাধারণভাবে স্বীকার করা হয় বটে। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, আল্লাহ্র উলুহিয়াতী তওহীদের প্রতি যদিও বিশ্বাস রয়েছে; কিন্তু তাঁর রবুবিয়াতের তওহীদ স্বীকার করা হচ্ছেনা। মুখে স্বীকার করা হলেও কার্য্ত অস্বীকারই করা হচ্ছে। রব্ব হিসেবে মেনে নেয়া হচ্ছে আরো অনেক শক্তিকে; মুখে নয়-বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে। আর এ-ই হচ্ছে শির্ক। শব্দগত আকীদা হিসেবে যদিও আল্লাহকে-ই রিযিকদাতা, জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভাবশালী, কর্তৃত্বসম্পন্ন, বিশ্ব ব্যবস্থাপক এবং রব্ব বলে স্বীকার করা হয়, কিন্তু এ শ্রেণীর লোকেরাই মৃত ‘বুযুর্গ’ লোকদের নিকট প্রার্থনা করে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদেরই ভয় করে চলে, তাদেরই নিকট হতে কোনো কিছু পেতে আশা পোষণ করে। বিপদে পড়লে তাদের নিকটই নিষ্কৃতি চায়, উন্নতি তাদের নিকট থেকেই চায় লাভ করতে। মনে করেঃ এর অলৌকিকভাবে মানুষের দোয়া শুনতে ও কবুল করতে পারে, সাহায্য করতে পারে, ফয়েজ করতে পারে। ভালো মন্দ করাতে ও ঘটাতে পারে। এই উদ্দেশ্যে তাদের সন্তোষ কামনা করে। আর তাদের সন্তোষ বিধানের জন্যেই তাদের উদ্দেশ্যে মানত করে, জন্তু জবাই করে, মরার পর তাঁদের কবরের উপর সিজদায় মাথা লুটিয়ে দেয়, নিজেদের ধন-সম্পদের একটা অংশ তাদের জন্য ব্যয় করা কর্তব্য মনে করে। আর এসব কারণেই দেখা যায়, এ শ্রেণীর লোকদের কবরকে নানাভাবে ইজ্জত ও তাজীম করা হচ্ছে, বহু অর্থ খরচ করে কবরের ওপর পাকা-পোখত কুব্বা নির্মাণ করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে দেশ-দেশান্তর সফর করা হয়। এক নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে চারিদিক হতে ভক্তরা এসে জমায়েত হয়। ঠিক যেমন মুশরিক জাতিগুলো গমন করে তাদের জাতীয় তীর্থভূমে।
ইসলামের তওহীদী আকীদার দৃষ্টিতে আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো নিকট-আর কাউকে সম্বোধন করে দো‘আ করা সুস্পষ্ট শিরক। ইসলামে তা স্পষ্ট ভাষায় নিষিদ্ধ। কুরআন মজীদে এ সংক্রান্ত অসংখ্য আয়াত তার অকাট্য প্রমাণ। কুরআনের কোনো কোনো আয়াতে মুশরিকদের লক্ষ্য করে, কোনো কোনো আয়াতে সাধারণভাবে এবং অনেক আয়াতে তওহীদবাদী মুসলিমদের লক্ষ্য করেই এই নিষেধ বাণী উচ্চারিত হয়েছে।
এ পর্যায়ে কুরআনের কয়েকটি আয়াত পেশ করা হচ্ছে। একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ
-আল্লাহকে বাদ দিয়ে(বা আল্লাহ ছাড়াও) যারা এমন সবকে ডাকে- দো‘আ করে, যারা তাদের জন্যে কিয়ামত পর্য্ন্তও জবাব দিতে পারবেনা আর তারা তাদের দো‘আ সম্পর্কে কিছুই জানেনা, এই শ্রেণীর লোকদের চেয়ে অধিক গোমরাহ আর কে হতে পারে। (আল আহক্বাফ)
-সব মসজিদ-ই আল্লাহর। অতএব, আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকেই ডাকবেনা। (জ্বীনঃ17)
এ আয়াতটিতে স্বয়ং রাসূলে করীম ও মুসলমানদের সম্বোধন করা হয়েছে। এ আয়াতের তফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তারা যেন তাঁর ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে একমাত্র তাঁকেই ডাকে, তাঁরই একত্বকে প্রতিষ্ঠিত রাখে এবং তাঁর সাথে অপর কাউকেই যেন ডাকা না হয়, তাঁর সাথে যেন কোনোরূপ শিরক করা না হয়।
একটি আয়াতে খোদ নবী করীম(স) কে লক্ষ্য করে বলা হয়েছেঃ
তুমি আল্লাহর সাথে অপর কোনো ইলাহ্ কে একত্র করে ডেকোনা- একত্রিত করোনা। যদি তা করে, তাহলে তুমি আযাবপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে গণ্য হবে।
আয়াতে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে স্বয়ং নবী করীম(স) কে। ‘তফসীরে ফতহুল বয়ান’ এ লেখা হয়েছেঃ আল্লাহতা‘আলা যখন কুরআনের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করলেন, প্রমাণ করে দিলেন যে, কুরআন তাঁর নিকট হতে অবতীর্ণ কিতাব, তখন তিনি তাঁর নবী মুহাম্মদ(স) কে নির্দেশ দিলেন এককভাবে কেবলমাত্র তাঁকেই ডাকবার, কেবল তাঁরই নিকট দো‘আ করার। আর আয়াতের শেষাংশের ব্যাখ্যা উক্ত তফসীরে লেখা হয়েছে এভাবেঃ
রাসূলে করীমকে বলা হয়েছে যে, যদি তুমি তাই করো, তাহলে তোমাকে আযাব দেয়া হবে। এখানে মুহাম্মদ(স) কে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছে। তিনি নিজে যদিও শিরকের গুনাহ হতে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ পবিত্র, তবুও তাঁকে লক্ষ্য করে একথা বলা হয়েছে তওহীদ সম্পর্কে মুমিন বান্দাগণকে উদ্বুদ্ধ করার ও সর্ব প্রকার শিরক-এর স্পর্শ হতে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে। তাহলে কথাটি এই দাঁড়াল যে, আল্লাহ বললেনঃ তুমি তো সৃষ্টিলোকের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত, আমার নিকট সবচাইতে মর্যাদাবান, সবচেয়ে বেশি প্রিয়; কিন্তু এতদসত্ত্বেও তুমি যদি আমি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ আছে বলে বিশ্বাস করো, তাহলে আমি তোমাকেও আযাব দেবো। অতএব ভেবে দেখো, অন্যান্য বান্দারা এরূপ করলে তাদের পরিণতি কি হবে?
আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকেই ডাকা শির্ক, অন্য কারো নিকট দো‘আ করা শির্ক-অতএব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত কয়টি থেকেও প্রমাণিত হয়।
-আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডাকবেনা, যা তোমাকে কোনো উপকার দিতে পারেনা, তোমার কোনো ক্ষতি সাধনও করতে পারেনা। তুমিও যদি তা-ই করো, তাহলে তুমিও জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।
সুরা মুমিন এর এ আয়াতটি এ পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দো‘আ সম্পর্কে ইতিবাচকভাবে পথনির্দেশ করেছে এ আয়াত।
-তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ছাড়া মাবুদ নেই। অতএব তোমরা ডাকো কেবল তাঁকেই একনিষ্ঠভাবে তাঁরই আনুগত্য সহকারে। আর সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, যিনি সারাজাহানের রব্ব।
আল্লাহকে জীবন্ত ও চিরঞ্জীব বলার মানে-ই হলো এই যে, তিনি ছাড়া আর যত মা‘বুদ-যাদের তোমরা মাবুদ বলে স্বীকার করো, বাস্তবভাবে যাদের তোমরা বন্দেগী ও দাসত্ব করো-তারা সবাই আসলে মৃত। জীবনের কোনো সন্ধানই সেখানে পাওয়া যাবেনা। আর যারা মৃত, জীবনহীন, তাদের ডাকার-তাদের নিকট কাতর স্বরে দো‘আর প্রার্থনা করার কি সার্থকতা থাকতে পারে। কেননা মৃতদের না দো‘আ শুনবার ক্ষমতা আছে, না শুনে তা কবুল করার ও দো‘আ অনুযায়ী কোনো কাজ করে দেবার আছে সামর্থ্য্। জীবন্ত ও চিরঞ্জীবতো একমাত্র আল্লাহ; তাঁর কোনো লয়, ক্ষয় বা কোনোরূপ অক্ষমতা নেই। অতএব কেবলমাত্র তাঁকেই ডাকা উচিত, তাঁরই নিকট দো‘আ ও প্রার্থনা করা বাঞ্চনীয়-সব সময়, সকল অবস্থায়। এর ব্যতিক্রম কিছু হতে পারেনা।
এ আয়াত থেকে আরো স্পষ্টভাবে জানা গেল যে, যিনি প্রকৃত ইলাহ, দো‘আ কেবল তাঁরই নিকট করা যেতে পারে এবং যাঁর নিকট দো‘আ করা হবে, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে বাস্তব আনুগত্য ও করতে হবে একমাত্র তাঁরই। আর দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর জন্য সব তায়ীফ ও প্রশংসা উৎসর্গ করা। আন্তরিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য বাস্তব জীবনে না করলে এবং মুখে অকৃত্রিমভাবে তাঁর প্রশংসা না করলে তাঁর নিকট দো‘আর করার কোনো অর্থ হয়না। তুমি যাঁর আনুগত্য করে চলতে রাজি নও, যার প্রশংসা ও শোকর তোমার মুখে ধ্বনিত হয়না, তাঁর নিকট তোমার দো‘আ করারও কোনো অধিকার থাকতে পারেনা। আর তিনিই বা সে দো‘আ কবুল করবেন কেন?
তাই সুরা আল আরাফে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহতা‘আলাঃ
-সাবধান, মনে রেখ, সৃষ্টি তাঁরই, বিধানও তাঁরই চলবে। মহান বরকতওয়ালা আল্লাহতা‘আলা যিনি সারা জাহানের রব্ব। তোমরা ডাকো তোমাদের এই রব্বকে কাঁদ কাঁদ স্বরে, চুপে চুপে। নিশ্চয়ই তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।(আরাফঃ55)
এ আয়াত স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে যে গভীর তত্ত্ব উদঘাটিত করে, তা হলো এই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, অতএব দুনিয়া জাহানে আইন ও বিধান চলবে একমাত্র তাঁরই। এই সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা আল্লাহ বড় মহান, অসীম বরকতের মালিক। তোমাদের এই রব্বকেই তোমরা ডাকবে। ডাকবে কাঁদ কাঁদ স্বরে-বিনীত অবনত মস্তকে কাতর কন্ঠে। এবং ডাকবে গোপনে, অনুচ্চ স্বরে। আর শেষ কথাটি বলা হচ্ছে যে, যে লোক আল্লাহকেই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা বিধানদাতা বলে মানেনা, মানেনা বরকতওয়ালা মহান আল্লাহরূপে এবং তাঁরই নিকট যে লোক দো‘আর করেনা, বিপদে আপদে একমাত্র তাঁকেই ডাকেনা, তারাই সীমালংঘনকারী। আর সীমালংঘনকারীরা আল্লাহর ভালোবাসা পায়না।
কোনো কোনো মহল মনে করে যে, কুরআনে এসব আয়াতে যে ‘দো‘আ’ শব্দ উল্লিখিত হয়েছে, তার মানে হচ্ছে ইবাদত আর এ আয়াত কয়টির মানে হলোঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করোনা, তা করা শিরক। অতএব আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট দো‘আ করা নিষিদ্ধ নয়, শিরক-ও নয়। কিন্তু এ কথা যে কতখানি ভুল ও প্রকৃত সত্যের বিপরীত, তা বলাই বাহুল্য। আসল কথা হলো, কুরআন মজীদের এসব আয়াতে যে দো‘আ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এর প্রকৃত অর্থঃ ধ্বনি দেয়া, আওয়াজ দেয়া এবং এমনভাবে কারো কাছে প্রার্থনা করা যার নিকট দো‘আ কবুল হতে বা প্রার্থিত জিনিস পাওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা সংশয় নেই। ইবাদত এ শব্দের প্রকৃত অর্থ নয়। তা হচ্ছে এর ‘মাজাজী’ বা পরোক্ষ অর্থ। (আরবি) অভিধানে বা শরীয়তে কোনো দিক দিয়েই এর অর্থ ‘ইবাদত’ নয়। (আরবি) ভাষার কোনো অভিধানেই এর অর্থ ইবাদত লেখা হয়নি। এমনকি জাহিলিয়াতের যুগের কোনো কবি-সাহিত্যিকের লেখায়ও এ শব্দের ব্যবহার এ অর্থে হতে দেখা যাবেনা। এখানে আমরা কয়েকটি (আরবি) প্রাচীণ ও প্রমাণিক অভিধান হতে কিছু উদ্বৃতি করছি।
আল জাওহীরি তাঁর অভিধানে লিখেছেনঃ
(আরবি)
আমি অমুক ব্যক্তিকে ডেকেছি, মানেঃ তার নাম করে আওয়াজ দিয়েছি, তাকে আহবান জানিয়েছি। তার জন্যে আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছি। আর তার উপর বদদো‘আ করেছি। দাওয়াত মানে একবার ডাকা। আর দো‘আ হলো এক বচন শব্দ। এর বহুবচন দাওয়াত বা দো‘আসমূহ।
এখানে ‘দো‘আ’ শব্দের ভিন্ন রূপ ও প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। সবক্ষেত্রেই অর্থ হলো প্রার্থনা, ডাকা, আহবান করা।
আর আলকেমিস এ বলা হয়েছে-
দো‘আ মানে আল্লাহর দিকে নিষ্ঠাপূর্ণ আহবান , ঝোঁক প্রবণতা। তাঁকে ডাকো যেমন ডাকা দরকার। অপরের ওপর তাদের জন্য দাওয়াত অর্থাৎ দো‘আ তাদের থেকেই শুরু করা হবে। তাদের ডাকো, মানেঃ তাদের একত্রিত করো। নবী করীম(স) আল্লাহর (দিকে)আহবানকারী। মুয়াযযিনকেও আহবানকারী বলা হয়।
মোটকথা (আরবি) অভিধানের কোনো কিতাবেই দো‘আ মানে ইবাদত লিখিত হয়নি।
অবশ্য আল্লামা ইবনুল হাজার বলেছেনঃ দো‘আ শব্দটি ইবাদত অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই এ শব্দের প্রত্যক্ষ ও প্রকৃত অর্থ নয়, পরোক্ষ অর্থ হবে।
শায়খ আবুল কাশেম আল কুশাইরী লিখেছেনঃ কুরআনে দো‘আ শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথাঃ ইবাদত, কাতর ফরিয়াদ, প্রার্থনা, কথা, আওয়াজ, ধ্বনি, প্রশংসা ইত্যাদি।
আল্লামা তাকীউদ্দীন আসসুবকী লিখেছেনঃ তা সত্ত্বেও এ আয়াতে ‘দো‘আ’ শব্দের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করাই উত্তম।
কেননা দো‘আ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যত আয়াতে তার কোথাও এমন কোনো কারণ দেখা যায়না, যার দরুণ শব্দটির আসল ও বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের পরিবর্তে পরোক্ষ অর্থ গ্রহণ করা দরকারী হতে পারে। কুরআনের সব তাফসীরকারকই এই মত পোষণ করেছেন। কাজেই কুরআনের ব্যবহৃত ‘দো‘আ’ শব্দের ইবাদত অর্থ করা এবং এই সুযোগে আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির নিকট দো‘আ করাকে জায়েয মনে করা চরম বাতুলতা এবং সুস্পষ্ট বিদয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়।
আয়াতের দো‘আ শব্দের অর্থ হলো উপকার পেতে চাওয়া, ক্ষতি থেকে বাঁচতে চাওয়া। আর আয়াতের অর্থ হলোঃ তুমি যদি আল্লাহ ছাড়া অপর কারো নিকট উপকার বা ক্ষতির জন্য প্রার্থনায় মনোনিবেশ করো, তাহলে তুমি জুলুমকারী হবে। কেননা জুলুম বলা হয় কোনো জিনিসকে তার আসল জায়গা ছাড়া অন্য জায়গায় স্থাপন করা। আর আল্লাহ ছাড়া যখন কারোই কোনো ক্ষমতা নেই, তখন কোনো প্রকার ক্ষমতা চালানাকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি অর্পণ করা অন্য কারো ক্ষমতা চালাবার শক্তি আছে বলে মনে করা নিঃসন্দেহে জুলুম।
আর এই ‘দো‘আ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘ইবাদত’ না হলেও দো‘আ ও এক প্রকারের ইবাদত। অতএব তা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নিকট করা যেতে পারেনা।
তাহলে আল্লাহ ছাড়া নানাভাবে নানা শক্তি ব্যক্তির নিকট যে দো‘আ করা হয়, বিপদ মুক্তি ও দুনিয়ার উন্নতির জন্য প্রার্থনা করা হয়, নিরাময়তা চাওয়া হয়, সেগুলো কি হবে? সেগুলো যে সুস্পষ্ট শিরক হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এ শিরক হচ্ছে ইসলামের তওহীদী সুন্নাতের এক মহা বিদয়াত। কেননা একজন যে অপরজনকে ডাকে, অপর একজনের নিকট দো‘আ করে এমন এক কাজের জন্যে, যা করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোই নেই-থাকতে পারেনা। এভাবে ডাকার মানেই এই যে, সে তাকে অলৌকিক ক্ষমতার মালিক মনে করে, বিশ্বাস করে তার কিছু একটা করার ক্ষমতা আছে। তা মনে না করলে সে কিছুতেই তাকে ডাকত না, তার নিকট দো‘আর করতো না। ফলে তার মনে তার নিকট কেবল দো‘আ করেই ক্ষান্ত হয়না; শান্ত হয়না, বরং তার ইবাদত করতেও আগ্রহাণ্বিত হয়ে পড়ে। আর এরূপ হচ্ছে সুস্পষ্ট শিরক।
-কোনো দুঃখ বা বিপদ যদি তোমাকে গ্রাস করে থাকে তা(আল্লাহর মর্জিতেই হয়েছে বলে মনে করতে হবে এবং তা)দূর করার কেউ নেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। এমনিভাবে তুমি যদি কল্যাণ লাভ করে থাকো তবে তিনিই তো সর্বশক্তিমান। (আল আনআমঃ ১৫)
অর্থাৎ এ কল্যাণ দান করার ক্ষমতাও তাঁরই রয়েছে এবং তাঁরই অনুগ্রহে তুমি এ কল্যাণ লাভ করেছো। তিনি ছাড়া এ কল্যাণ তোমাকে আর কেউই দিতে পারেনি। কেননা অন্য কারোই কিছু করার ক্ষমতা নেই, সামর্থ্য নেই।
-আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো ক্ষতি বা বিপদ দেন, তবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ-ই দূর করতে পারবেনা। আর তিনিই যদি তোমার প্রতি কোনো কল্যাণ দান করতে ইচ্ছে করেন, তাহলে তাঁর এই কল্যাণ দানকে প্রত্যাহার করতে পারে এমন কেউ নেই। তবে তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে চান কল্যাণ দেন, তিনিই ক্ষমা দানকারী, করুণাময়। (ইউনূসঃ107)
এ আয়াত দুটো-এমনিভাবে কুরআনের আরো ভুরি ভুরি আয়াত এবং রাসূলে করীম(স) এর হাদীস স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ বিপদ দিতে পারেনা, কেউ সে বিপদ দূরও করতে সক্ষম নয় আল্লাহ ছাড়া। অনুরূপভাবে আল্লাহ ছাড়া কেউ কল্যাণ করতে পারেনা কারো। তিনি কারো কল্যাণ করতে চাইলে তা ফেরাতেও এবং সেই কল্যাণ হতে তাকে বঞ্চিত রাখতেও পারেনা কেউই। সব শক্তির একচ্ছত্র মালিকতো তিনিই। অতএব দো‘আ একমাত্র আল্লাহর নিকটই করা কর্তব্য। কর্তব্য সব রকমের বিপদ হতে উদ্ধার পাওয়ার জন্য দো‘আ করা, কর্তব্য সব ধরণের কল্যাণ লাভের জন্য দো‘আ করা। এবং সেই দো‘আ হবে সরাসরি আল্লাহর নিকট, অন্য কারো অসীলা দিয়ে বা দোহাই দিয়ে নয়, অন্য কারো মাধ্যমেও নয়। তওহীদ বিশ্বাসের ঐকান্তিক দাবিও হলো এই। কেননা আল্লাহ ছাড়া অপর কারো নিকট দো‘আ করার কোনো ফল নেই, নেই কোনো সার্থকতা।
আল্লাহতা‘আলা এই পর্যায়ে আরো স্পষ্ট ও বলিষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেনঃ
-আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা আর যার নিকটই দো‘আ করো, তাদের কেউ একবিন্দু জিনিসের মালিক নয়। তা সত্ত্বেও যদি তোমরা তাদেরই ডাকো- তাদের নিকটই দো‘আ করো, তবে তারা তো তোমাদের ডাকও শুনতে পারেনা। (আল ফাতীরঃ13-14)
তোমাদের দো‘আ আর যদি শুনতে পায়ও, তবু এ কথা চূড়ান্ত যে, তারা না দিবে তোমাদের ডাকের জবাব, না পারবে কবুল করতে তোমাদের দো‘আ।
বস্তুত দো‘আ যে কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটই করতে হবে খালেসভাবে অপর কারো দোহাই দিয়ে নয়, কাউকে তাঁর নিকট অসীলা বানিয়ে নয়, একথা কুরআন মজীদে উদ্বৃত অসংখ্য দো‘আ থেকেও আমাদের শেখানো হয়েছে। কুরআনে উল্লেখীত যে কোনো দো‘আ-ই তার দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ কুরআনের বিশেষ কয়েকটি দো‘আ উদ্বৃত করা হচ্ছে।
কুরআনের প্রথম সূরা আল ফাতিহায় উদ্বৃত হয়েছে এই দো‘আঃ
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ [١:٦]
-হে আল্লাহ তুমিই আমাদের সরল সঠিক দৃঢ় পথ দেখাও-পরিচালিত করো সে পথে।
এরূপ দো‘আ করতে শেখানো হয়নিঃ হে আল্লাহ! অমুক পীরের অসীলায় আমাদের সরল সঠিক সুদৃঢ় পথ দেখাও।
সূরা আল বাকারা’র শেষ আয়াত কয়টিও আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া দো‘আ। তাতে কোনো একটি কথা সরাসরিভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট কিংবা কারো অসীলা ধরে আল্লাহর নিকট দো‘আ করার শিক্ষা দেয়া হয়নি। এই পর্যায়ে হযরত ইবরাহীম(আ) এর দো‘আ ও উল্লেখযোগ্য। কাবা ঘর নির্মাণের সময় তিনি এবং হযরত ঈসমাইল(আ) দো‘আ করেছিলেনঃ
-হে আল্লাহ! তুমি আমাদের দো‘আ কবুল করো। তুমি সব-ই শোনো, সব-ই জানো। হে আমাদের আল্লাহ তুমি আমাদের দুজনকে মুসলিম-তোমার অনুগত বানাও। আর আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন এক উম্মত জাগ্রত করো, যা হবে তোমার অনুগত। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের যাবতীয় ইবাদত বন্দেগীর-হজ্জ ও কুরবানীর নিয়ম-নীতি জানিয়ে দাও, আমাদের তওবা কবুল করো। কেননা তুমি তওবা কবুলকারী।
বস্তুত বান্দার মনে দুঃখ ও ব্যথা বেদনার কথা কেবল আল্লাহর নিকটই বলা যেতে পারে, বলতে হবে কেবলমাত্র তাঁরই সমীপে। কেননা সে দুঃখ বেদনার সৃষ্টিও যেমন হয়েছে আল্লাহর মঞ্জুরীতে, তা দূর করার ক্ষমতাও একমাত্র তাঁরই রয়েছে। হযরত ইয়াকুব(আ) পুত্রহারা হয়ে তাঁর মর্মবেদনা পেশ করেছিলেন দুনিয়ার অপর কারো নিকট নয়, নয় কোনো পীর বা গদ্দীনশীনের নিকট; বলেছিলেন কেবলমাত্র আল্লাহর নিকট।
তাঁর তখনকার কথা উদ্বৃত হয়েছে কুরআন মজীদে এ ভাষায়ঃ
(আরবি)
-আমি আমার দুঃখ-বেদনা এবং চিন্তা-ভাবনার কথা কেবল আল্লাহর নিকটই প্রকাশ করছি, পেশ করছি।
হযরত মূসা(আ) এর দো‘আ ছিল নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
-(আরবি)
-হে আল্লাহ! তোমার জন্যেই সব প্রশংসা, সব অভিযোগ তোমারই নিকট, কেবল তোমার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা, কেবল তোমার নিকটই ফরিয়াদ। কেবল তোমার উপরই ভরসা। কেননা কোনো কিছু করার সামর্থ্য্ এবং ক্ষমতা ও শক্তি তুমি ছাড়া আর কারো নিকটই নাই।
আল্লাহ নিজেই হযরত জাকারিয়া এবং তাঁর স্ত্রীর প্রশংসা করে ইরশাদ করেছেনঃ
-(আরবি)
-তারা ছিল সব কল্যাণময় কাজে উৎসাহী, প্রতিযোগী ও তৎপর। তারা কেবল আমাকে ডাকত-আমারই নিকট দো‘আ করতো আগ্রহ উৎসাহ এবং ভয় আতংক সহকারে। আসলে তারা সব সময় আমার জন্যেই ভীত হয়ে থাকত।
স্বয়ং আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ(স)-এর নীতিও ছিল তাই। কোনো ব্যতিক্রম ছিলনা এ থেকে। বদরের যুদ্ধে তাঁর সঙ্গী সাথীদের সংখ্যাল্পতা দেখে তিনি আল্লাহর দিকে মুখ করে দু’হাত তুলে দো‘আ করেছিলেনঃ
-(আরবি)
-হে আল্লাহ! তুমি আমার কাছে যে ওয়াদা করেছ তা আজ পূর্ণ করো। হে আল্লাহ! ইসলামের ধারক এ মুষ্টিমেয় বাহিনীকে যদি তুমি ধ্বংস করে দাও তাহলে যে দুনিয়ায় তোমার বন্দেগী করা হবেনা।
-তোমরা যখন তোমাদের আল্লাহর নিকট-ই ফরিয়াদ করলে, তখন তিনি তোমাদের জবাব দিলেন, তোমাদের দো‘আ ও ফরিয়াদ কবুল করে নিলেন। এবং বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমি তোমাদের পর পর এক হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করবো। (আনফালঃ 9)
এ আয়াত থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, ফরিয়াদ যদি একান্তভাবে আল্লাহর নিকট করা হয়, কোনো মাধ্যম, অসীলা আর ওয়াস্তা ছাড়াই, তাহলেই তিনি দো‘আ কবুল করেন, অন্যথায় তাঁর কোনো ঠেকা নেই কারো দো‘আ কবুল করার। কেউ তাঁকে সেজন্য বাধ্যও করতে পারেনা। দো‘আ কার কাছে করতে হবে সে কথা অধিক স্পষ্ট করে তোলবার জন্য নবী করীম(স) ঘোষণা করেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেই যেন নিজের যাবতীয় প্রয়োজন কেবল আল্লাহর নিকট চায়। এমনকি কারো জুতার ফিতাও যদি ছিঁড়ে যায়, তবুও তাঁর নিকটই চাইবে। তিনি যদি না-ই দেন, তবে তা কেউ-ই দিতে পারবেনা।
আল্লাহর শিক্ষা ও রাসূলের শিক্ষাও এই যে, ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত বিপদের কালে ফরিয়াদ করতে হবে একমাত্র আল্লাহর নিকট এবং তাতে অন্য কাউকে অসীলা ধরা কিংবা কারো দোহাই দেয়ার এই শিক্ষা-ইসলামের এই সুন্নাতের সম্পূর্ণ বিপরীত। নবী-রাসূলগণই যদি নিজেদের সব ব্যাপারে কেবলমাত্র আল্লাহরই নিকট ফরিয়াদ করে থাকেন এবং এ ব্যাপারে আর কারো নিকট কোনো ইন্তেমদাদ(সাহায্য প্রার্থনা)না করে থাকেন, তাহলে আমরা সাধারণ মুসলমানরাই বা কেনো অন্য কারো প্রতি মুখাপেক্ষী হবো, নির্ভরশীল হবো, কেন অন্য কাউকে অসীলা ধরবো? অথচ এই নবী-রাসূলগণই তো আমাদের চিরন্তন আদর্শ। তাঁদের কাজও যেমন আমাদের কাছে অনুসরণীয় তেমনি অনুসরণীয় তাঁদের কর্মনীতি ও কর্মপদ্ধতিও। বিশেষত আল্লাহ এসব দো‘আ শিক্ষা দিয়ে আমাদেরকেও অনুরূপ আল্লাহ মুখী হতে, কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটই দো‘আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
অবশ্য এ কথা অস্বীকার করা যাচ্ছেনা যে, নবী করীমের(স) জীবদ্দশায় তাঁকে অসীলা বানিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছেন তদানীন্তন মুসলমানেরা। হাদীসে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু তা হলো রাসূলের জীবদ্দশায়, রাসূল নিজে একজন প্রার্থনাকারী হিসেবে লোকদের মাঝে উপস্থিত থাকা অবস্থায়। আর তা থেকে অতটুকুই প্রমাণিত হয়, রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁকে অসীলা বানিয়ে দো‘আ করা জায়েয ছিল। কিন্তু রাসূলে করীমের ইন্তিকালের পর আর কোনো দিন সাহাবায়ে কিরাম তাঁকে দো‘আ প্রার্থনায় অসীলা বানাননি। ‘অসীলা’ বানানো হয়নি এমন কোনো ব্যক্তিকে যে মরে গেছে এবং যে নিজে দো‘আর অনুষ্ঠানে শরীক নেই। এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের আরো দু’টি আয়াত বিবেচ্য। সূরা সেজদায় আল্লাহ নেক বান্দাদের পরিচয় দান প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
-তাদের পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশ সুখশয্যা হতে বিচ্ছিন্ন হয়েই থাকে, তারা (তাদের আল্লাহর প্রতি) ভয় ও আশা পোষণ করেই ডাকতে থাকে তাদের আল্লাহকে। তদুপরি আমি তাদের যা দান করেছি তা থেকে (আমার পথে) ব্যয় করে।
এ আয়াতে ‘ইয়াদয়ুদা রাব্বাহুম খাওফান ওয়া তামআন’ বাক্যাংশ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আল্লাহর আয়াতের প্রতি প্রকৃত যারা ঈমানদার তারা ভয় পায় কেবলমাত্র আল্লাহকে, আশা পোষণ করে একমাত্র আল্লাহর প্রতিই, যিনি তাদের রব্ব। বিপরীত অর্থে তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয়ও করেনা, কারো প্রতি কিছু আশাও পোষণ করেনা। আর ভয়ের কারণ হলেও তাঁরা ডাকে কেবল আল্লাহকে, আল্লাহর-ই নিকট দো‘আ প্রার্থনা করে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকটই প্রার্থনা করেনা। অনুরূপভাবে কোনো কিছু পাওয়ার আশাও করে কেবলমাত্র আল্লাহর নিকট থেকে, সে জন্যেও দো‘আ করে তাঁরই নিকট। আল্লাহর নিকট ছাড়া আর কারো নিকট হতে কিছুই পাওয়ার আশা করেনা তারা এবং কোনো কিছু পাওয়ার প্রয়োজন হলে একমাত্র আল্লাহর নিকটই সেজন্য দো‘আ করে, প্রার্থনা করে।
তাছাড়া প্রথমাংশে বলা হয়েছে নামায পড়ার কথা, শেষাংশে বলা হয়েছে দো‘আ করার কথা। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী লিখেছেনঃ দো‘আ ও নামায প্রকৃত অর্থের দিক দিয়ে একই জিনিস।
অর্থাৎ নামায যেমন আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যে, কারো উদ্দেশ্যে পড়া হয়না, দো‘আ ও তেমনি আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট করা যায়না।
আর একটি আয়াত হলোঃ
(আরবি)
-যে লোক আল্লাহর অনুগত-আল্লাহর-ই হুকুম পালনকারী, রাতের বেলা আল্লাহকে সেজদা করে, পরকালকে ভয় করে এবং কেবলমাত্র আল্লাহর রহমতেরই আশা করে, তার পরিণতি কি মুশরিক ব্যক্তিদের মতো হতে পারে?
তার মানে এসব গুণ যার আছে সে মুশরিক নয়, সে তওহীদবাদী। আর যার এসব গুণ নেই, নেই এর কোনো একটি গুণও, সে-ই মুশরিক হয়ে যাবে প্রকৃত ব্যাপারের দিক দিয়ে। যেমন কেউ যদি আল্লাহর অনুগত না হয়ে অনুগত হয় আল্লাহর সৃষ্ট কোনো শক্তির- যে লোক পরকালকে ভয় করেনা কিংবা যে লোক তার আল্লাহর রহমতের আশা করেনা বা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কারো রহমত ও অনুগ্রহ দৃষ্টি লাভের আশা পোঁষণ করে-কুরআনের এ আয়াতের ঘোষণা অনুযায়ী সে-ই মুশরিক হবে। অতএব আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা কুরআনের দৃষ্টিতে কিছুতেই জায়েয হতে পারেনা।
এ আলোচনার শেষ পর্যায়ে শায়খ আবদুল কাদের জিলানী(রহ) এর দু-তিনটি কথা এখানে প্রমাণ হিসেবে উদ্বৃত করা জরুরী মনে করছি। তিনি তাঁর গ্রন্থ…..এর শুরুতেই লিখেছেনঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর-ই জন্য, যাঁর প্রশংসা সহকারে সব কিতাবই শুরু করা হয় এবং যাঁর জিকির করে সব কথা শুরু করতে হয়। তাঁরই প্রশংসার দৌলতে জান্নাতী লোকেরা জান্নাত পাবে, তিনিই এমন সত্তা যে তাঁর নাম উচ্চারণ করলে সব রোগ নিরাময় হয়, তাঁরই নামে সব চিন্তা দুঃখ ও বিপদ দূর হয়ে যায়। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দকালে তাঁরই দরবারে কাতর কন্ঠে কাঁদ কাঁদ স্বরে দো‘আ করা হয়। তাঁর জাত-ই এমন যে, নানা বুলি ও নানা ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সমস্ত দো‘আ প্রার্থনাকারীর ডাক তিনি শুনেন, বিপদগ্রস্ত কাতর মানুষের দো‘আ তিনিই কবুল করেন।
তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘ফাতাউল গায়েব’ এ লিখেছেনঃ আমাদের কান্না-কাটা, আমাদের দো‘আ এবং সব অবস্থায় আমাদের রুজু হতে হবে একমাত্র আল্লাহর-ই নিকট, যিনি আমাদের পরোয়ারদিগার, আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের রিযিকদাতা। তিনি খাওয়ান, তিনিই পান করান, তিনিই উপকার দেন, তিনিই মুহাফিজ, তিনিই নিগাহবান। আমাদের জীবন তাঁরই হাতে।
“অতএব তোমার প্রার্থনা হবে এবং নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য ডাকবে একমাত্র আল্লাহকেই, আল্লাহরই নিকটে, তিনি একাই তোমার দাতা, তিনি-ই তোমার লক্ষ্য হবেন।”
“যে লোক নিজেরই মতো কোনো মাখলুকের ওপর ভরসা করে, সে অভিশপ্ত।”
শায়খ জিলানী মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তাঁর পুত্র আবদুল ওহাব তাঁকে বললেনঃ “আমাকে এমন কিছু অসীয়ত করুন, আপনার পরে যা অনুসরণ করে আমি চলবো, আমল করবো”।
তখন তিনি বললেনঃ আল্লাহকে ভয় করে চলাই তোমাদের কর্তব্য; আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবেনা, আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট কিছু চাইবেনা-কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করবেনা। সব প্রয়োজনকেই এক আল্লাহর ওপরই সোপর্দ করে দেবে। সেই এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট কিছুমাত্র ভরসা করবেনা, নির্ভরতা গ্রহণ করবেনা। সব কিছু কেবল তাঁরই নিকট হতে পেতে চাইবে। আল্লাহ ছাড়া কারো প্রতি আস্থা স্থাপন করবেনা। তওহীদকেই ধারণ করবে, তওহীদকেই ধারণ করবে, তওহীদকেই ধারণ করবে। সকলেই এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত।
এ পর্যায়ে শেষ কথা এই যে, দো‘আ কবুলকারী যদি কেবলমাত্র আল্লাহতা‘আলা ই হয়ে থাকেন, আর তিনি-ই যদি সরাসরি তাঁরই নিকট দো‘আ করতে বলে থাকেন, তাহলে অন্য কারো নিকট দো‘আ করা, দো‘আয় অন্য কাউকে অসীলা বানানো আল্লাহর ওপর খোদকারী ছাড়া আর কিছু নয়। যারা তা করতে বলে তারা শুধু বিদয়াতী-ই নয়, তারা সুস্পষ্টরূপে শিরক- এ লিপ্ত-শিরক প্রচারকারী তারা। ইসলামের তওহীদি আকীদায় শিরক-এর আমদানি করে।
বস্তুত ইসলামের ঐকান্তিক দাবি হলো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মা‘বুদ ও (অলৌকিকভাবে) প্রয়োজন পূরণকারী বলে মেনে নিতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করবে এবং কোনোরূপ শরীকদারী ছাড়াই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই অনন্য মা‘বুদ হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করবে। এই হচ্ছে প্রকৃত তওহীদী আকীদা এবং কালেমায়ে তাইয়্যেবার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এর তাৎপর্য্। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ(স) কে আল্লাহতা‘আলার রাসূল মানবে। অর্থাৎ জীবন যাপনে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি, তা জানবার সর্বশেষ একমাত্র ব্যক্তি হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ(স)। তাই জীবন যাপনের অপরাপর নিয়ম ও পদ্ধতিকে-যা হযরত মুহাম্মদ(স) কর্তৃক প্রচারিত নয় তা-ও মেনে নিতে অস্বীকার করতে হবে। কলেমার দ্বিতীয় অংশের এই হচ্ছে তাৎপর্য্।
পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণও তাঁদের উম্মতদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহ যে উত্তরকালে তারা গোমরাহ হয়ে শিরকে নিমজ্জিত হয়েছে। এই পর্যায়ে হযরত মুহাম্মদ(স) কালেমার এই উভয় পর্যায়ে বৈপরীত্য শিরক ও বিদয়াতের গোমরাহীতে নিমজ্জিত হওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। কেননা তার কোনো একটি দিক দিয়েও শিরকে নিমজ্জিত হলে নিঃসন্দেহে জাহান্নামে যেতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/289/23
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।