মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
এ অনুচ্ছেদে আমরা শব্দ বা বাক্যের পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে বাইবেলে মধ্যে যে সকল বিকৃতি সাধন করা হয়েছে তার সামান্য কিছু নমুনা আলোচনা করতে চাই।
১- প্লাবন পূর্ব মহাপুরুষদের বয়স বর্ণনায় বিকৃতি:
আদিপুস্তকের ৫ম অধ্যায়ের ১-৩২ শ্লোকে আদমের আলাইহিস সালাম সৃষ্টি থেকে নূহ আলাইহিস সালাম-এর প্লাবন পর্যন্ত সময়কাল বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে আদম আলাইহিস সালাম থেকে নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত মহাপুরুষদের বয়সকালও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাইবেলের তিন সংস্করণে [ইহূদী-খৃস্টানগণের নিকট সংরক্ষিত পুরাতন নিয়মের পুস্তকাবলির তিনটি মূল সংস্করণ ও পাণ্ডুলিপি রয়েছে। (১) হিব্রু সংস্করণ বা হিব্রু পাণ্ডুলিপি (২) গ্রীক সংস্করণ বা গ্রীক পাণ্ডুলিপি ও (৩) শমরীয় (Samaritan) সংস্করণ বা শমরীয় পাণ্ডুলিপি। ইহূদীগণের ধর্মীয় ও ব্যবহারিক ভাষা হিব্রু ভাষা। এ ভাষাতেই তাদের সকল ধর্মগ্রন্থ লিখিত হয়। স্বভাবতই পুরাতন নিয়মের সকল গ্রন্থই হিব্রু ভাষায় লিখিত ছিল। খৃস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার প্যালেস্টাইন দখল করেন এবং তা গ্রীক সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ইহূদীগণ গ্রীক রাজ্যের নাগরিকে পরিণত হয় এবং তাদের মধ্যে গ্রীক ভাষার কিছু প্রচলন ক্রমান্বয়ে শুরু হয়। প্রায় এক শতাব্দী পরে, খৃস্টপূর্ব ২৮৫-২৪৫ সালের দিকে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নামে পরিচিত ইহূদী ধর্মগ্রন্থগুলি গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কথিত আছে যে, মিসরের শাসক ২য় টলেমি: টলেমি ফিলাডেলফাস (Ptolemy Philadelphus)- এর রাজত্বকালে (খৃ. পূ. ২৮৫-২৪৬) তাঁর নিদের্শে নির্দেশে ৭০/৭২ জন পন্ডিত তা ‘আলেকজেন্ড্রীয় গ্রীক ভাষায়’ অনুবাদ করেন। এই গ্রীক অনুবাদটিই the Septuagint (LXX) বা ‘সত্তরের’ অনুবাদ বলে প্রসিদ্ধ। যীশুখৃস্টের সময়ে এ অনুবাদটি প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। ১৫শ শতাব্দী পর্যন্ত খৃস্টানগণ গ্রীক অনুবাদকেই পুরাতন নিয়মের বিশুদ্ধ সংস্করণ বলে দাবি করতেন। গ্রীক অনুবাদ থেকে তারা ল্যাটিন অনুবাদ করেন। তারা দাবি করেন যে, গ্রীক অনুবাদের অশুদ্ধতা প্রমাণ করার জন্য ১৩০ খৃস্টাব্দের দিকে ইহূদীগণ হিব্রু বাইবেলের মধ্যে ইচ্ছাপূর্বক বিকৃতি সাধন করে। প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, মূল হিব্রু বাইবেলেই বিশুদ্ধ এবং গ্রীক অনুবাদ অসংখ্য ভুলে ভরা। সুলাইমান (আ)-এর পরেই ইহূদীগণ বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের এক সম্প্রদায়কে শমরীয় (Samaritans) বলা হয়, যারা প্রাচীন ফিলিস্তিনের শামেরা বা শামারিয়া (Samaria) রাজ্যে বসবাস করত। এদের নিকট সংরক্ষিত তাওরাতের প্রাচীন সংস্করণকে শমরীয় তাওরাত বলা হয়।] এ সময়কার তিন প্রকার লেখা হয়েছে।
শমরীয় সংস্করণ অনুসারে আদম থেকে প্লাবন পর্যন্ত সময়কাল এক হাজার তিনশত সাত (১৩০৭) বৎসর। হিব্রু সংস্করণে এ সময় এক হাজার ছয়শত ছাপ্পান্ন (১৬৫৬) বছর। গ্রীক সংস্করণ অনুসারে এ সময় দুই হাজার দুই শত বাষট্টি (২২৬২) বছর। এভাবে আমরা দেখছি যে, তিনটি সংস্করণের মধ্যে সময়ের বিবরণে বিরাট পার্থক্য ও বিশ্রী বৈপরীত্য রয়েছে। এ বৈপরীত্য ও পার্থক্য সমন্বয় করা সম্ভব নয়। (নিঃসন্দেহে দুটি বা সবগুলি সংস্করণে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকৃতি সাধন করা হয়েছে।)
তিনটি সংস্করণই একমত যে, আদম আলাইহিস সালামের মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৯৩০ বৎসর (আদিপুস্তক ৫/৫) এবং তিন সংস্করণই একমত যে, প্লাবনের সময় নূহ আলাইহিস সালাম-এর বয়স ছিল ৬০০ বৎসর (আদিপুস্তক ৭/৬)।
এতে শমরীয় সংস্করণের বর্ণনা অনুসারে প্লাবনের মাত্র ৩৭৭ বৎসর পূর্বে (১৩০৭-৯৩০) আদমের মৃত্যু হয়। আর যেহেতু প্লাবনের ৬০০ বৎসর পূর্বে নূহ আলাইহিস সালামের জন্ম, সেহেতু আদমের মৃত্যুর সময় নোহের বয়স ছিল ২২৩ বৎসর (৬০০-৩৭৭)। ঐতিহাসিকগণ একমত যে বিষয়টি বাতিল। হিব্রু ও গ্রীক বাইবেল তা মিথ্যা প্রমাণ করে। আদমের বয়স ও প্লাবনের সময় নূহের বয়সের সমষ্টি (৯৩০+৬০০=) ১৫৩০ বৎসর। হিব্রু বাইবেলের তথ্য অনুযায়ী (১৬৫৬-১৫৩০) আদমের মৃত্যুর ১২৬ বৎসর পরে নোহের জন্ম। আর গ্রীক বাইবেলের তথ্য অনুসারে (২২৬২-১৫৩০) আদমের মৃত্যুর ৭৩২ বৎসর পরে নোহের জন্ম।
প্রথম খৃস্টীয় শতাব্দীর প্রসিদ্ধতম ইয়াহূদী ঐতিহাসিক জোসেফাস (Flavius Josephus) খৃস্টানদের নিকটও নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য। এই বিশ্রী বৈপরীত্য ও পার্থক্যের কারণে তিনি ‘পুরাতন নিয়মের’ এই তিন সংস্করণের কোনোটির বিবরণই গ্রহণ করেন নি। তিনি লিখেছেন যে, আদমের সৃষ্টি থেকে নোহের প্লাবন পর্যন্ত সময়কাল ছিল দুই হাজার দুইশত ছাপ্পান্ন (২২৫৬) বৎসর।
২- প্লাবন পরবর্তী মহাপুরুষদের বয়স বর্ণনায় বিকৃতি:
আদিপুস্তকের ১১ অধ্যায়ের ১০-২৬ শ্লোকে নূহ আলাইহিস সালাম-এর প্লাবন থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সময়কাল বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে নূহ আলাইহিস সালাম থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত মহাপুরুষদের বয়সকালও উল্লেখ করা হয়েছে। বাইবেলের তিন সংস্করণে এ সময়কার তিন প্রকার লেখা হয়েছে।
নূহের প্লাবন থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর জন্ম পর্যন্ত সময়কাল হিব্রু সংস্করণ অনুসারে দুইশত বিরানববই (২৯২) বৎসর, শমরীয় সংস্করণ অনুসারে নয়শত বিয়াল্লিশ (৯৪২) বৎসর এবং গ্রীক সংস্করণ অনুসারে একহাজার বাহাত্তর (১০৭২) বৎসর। এখানেও তিন সংস্করণের মধ্যে বিশ্রী রকমের বৈপরীত্য রয়েছে, যার মধ্যে সমন্বয় সম্ভব নয়। যা সবগুলি বা দুটি সংস্করণে পরিবর্তন ও বিকৃতি প্রমাণ করে।
তিন সংস্করণই একমত যে, প্লাবনের পরে নূহ আলাইহিস সালাম ৩৫০ বৎসর জীবিত ছিলেন (আদিপুস্তক ৯/২৮)। ৩৫০ থেকে ২৯২ বৎসর বাদ দিলে ৫৮ বৎসর থাকে। এতে হিব্রু বাইবেল অনুসারে প্রমাণিত হয় যে, নোহের মৃত্যুর সময় অবরাহামের বয়স ছিল ৫৮ বৎসর। ঐতিহাসিকগণ একমত যে কথাটি বাতিল। গ্রীক ও শমরীয় সংস্করণও তা মিথ্যা প্রমাণ করে। শমরীয় সংস্করণের ভাষ্য অনুযায়ী ইবরাহীমের আলাইহিস সালাম জন্ম নূহের আলাইহিস সালাম মৃত্যুর পাঁচশত বিরানববই (৫৯২) বৎসর পরে (৯৪২-৩৫০=৫৯২)। আর গ্রীক সংস্করণের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর জন্ম নূহের আলাইহিস সালাম মৃত্যুর সাতশত বাইশ (৭২২) বৎসর পরে (১০৭২-৩৫০=৭২২)।
বাইবেলের তিন সংস্করণের মধ্যকার এই বিরাট ও বিশ্রী বৈপরীত্যের কারণে খৃস্টানগণ নিজেদের মধ্যে মতভেদ করেছেন। ঐতিহাসিকগণ এই তিন বিবরণই বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, নূহ আলাইহিস সালাম থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর জন্ম পর্যন্ত সময় হলো তিনশত বাহান্ন (৩৫২) বৎসর।
১ম খৃস্টীয় শতকের প্রসিদ্ধ ইয়াহূদী ঐতিহাসিক জোসেফাস (Flavius Josephus) এ সকল বিবরণের কোনোটিই গ্রহণ করেন নি; বরং তিনি বলেছেন: এই সময়কাল ছিল নয়শত তিরানববই (৯৯৩) বৎসর। হেনরী ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থে জোসেফাসের মতটি উদ্ধৃত করা হয়েছে।
হেনরী ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থে তারা চতুর্থ শতকের শ্রেষ্ঠ খৃস্টান পণ্ডিত ও ধর্মগুরু (যাজক) সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine, Bishop of Hippo: 354–430)-এর মতামত উল্লেখ করেছেন যে, প্লাবনের আগের ও পরের যুগের মানুষদের বর্ণনার ক্ষেত্রে ইয়াহূদীরা হিব্রু সংস্করণ বিকৃত করেছে। গ্রীক সংস্করণ যাতে অনির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয় সেজন্য এবং খৃস্টধর্মের বিরোধিতার জন্য তারা এই বিকৃতি করেছে। ১৩০ খৃস্টাব্দে ইয়াহূদীরা এই বিকৃতি সাধন করে। হর্ন তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেছেন, গবেষক হেলস শক্তিশালী প্রমাণাদির দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, ইয়াহূদীরা তাদের ধর্মগ্রন্থ বিকৃত করেছিল। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত কেনিকটও প্রমাণ করেছেন যে, ইয়াহূদীরা ইচ্ছাকৃতভাবে পুরাতন নিয়মের হিব্রু সংস্করণ বিকৃত করে।
বিবেকবান পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করছেন যে, এ সকল খৃস্টান গবেষক পণ্ডিত ও ব্যাখ্যাকারগণের শেষ গতি বিকৃতির কথা স্বীকার করা। তারা স্বীকার করছেন যে, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও শত্রুতার কারণে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কমবেশি করে তাদের ঐতিহাসিক বিবরণগুলি বিকৃত করেছেন।
৩-প্রস্তর স্থাপনের জন্য নির্ধারিত পর্বতের নামে বিকৃতি:
দ্বিতীয় বিবরণ পুস্তকের ২৭ অধ্যায়ের ৪র্থ শ্লোকটি নিম্নরূপ: ‘‘আর আমি অদ্য যে প্রস্তরগুলির বিষয়ে তোমাদিগকে আদেশ করিলাম, তোমরা যর্দন পার হইলে পর এবল পর্বতে সেই সকল প্রস্তর স্থাপন করিবে, ও তাহা চুন দিয়া লেপন করিবে।’’
এ শ্লোকটি শমরীয় সংস্করণে নিম্নরূপ: ‘‘আর আমি অদ্য যে প্রস্তরগুলির বিষয়ে তোমাদিগকে আদেশ করিলাম.... গরিষীম পর্বতে সেই সকল প্রস্তর স্থাপন করিবে, ও তাহা চুন দিয়া লেপন করিবে।’’
দ্বিতীয় বিবরণের ২৭/১২-১৩ এবং এ পুস্তকের ১১/২৯ শ্লোক থেকে জানা যায় যে, এবল ও গরিষীম(Mount Ebal & Mount Ger'izim) ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দুটি পাশাপাশি পাহাড়। দ্বিতীয় বিবরণ ১১/২৯ শ্লোকটি নিম্নরূপ: ‘‘আর তুমি যে দেশ অধিকার করিতে যাইতেছ, সেই দেশে তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু যখন তোমাকে প্রবেশ করাইবেন, তখন তুমি গরিষীম পর্বতে ঐ আশীর্বাদ, এবং এবল পর্বতে ঐ অভিশাপ স্থাপন করিবে।’’
হিব্রু সংস্করণ থেকে জানা যায় যে, মোশি এবল পাহাড়ে ধর্মধাম বা মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। আর শমরীয় সংস্করণ থেকে জানা যায় যে, মোশি গরিষীম পাহাড়ে ধর্মধাম নির্মাণের নির্দেশ দেন। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত ইয়াহূদী ও শমরীয়দের মধ্যে এ বিষয়ে বির্তক খুবই প্রসিদ্ধ। প্রত্যেক সম্প্রদায় দাবি করেন যে, অন্য সম্প্রদায় এস্থলে তোরাহের বক্তব্য বিকৃত করেছে। প্রটেস্টান্ট পণ্ডিতগণের মধ্যেও এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ হিব্রু সংস্করণের বিশুদ্ধতা দাবি করেছেন এবং কেউ শমরীয় সংস্করণের বিশুদ্ধতা দাবি করেছেন। প্রসিদ্ধ বাইবেল ব্যাখ্যাকার আদম ক্লার্ক, প্রসিদ্ধ গবেষক কেনিকট (Benjamin Kennicott) ও অন্যান্য পণ্ডিত শমরীয় সংস্করণের বিশুদ্ধতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তারা প্রমাণ করেন যে, শমরীয়দের সাথে শত্রুতার কারণে ইয়াহূদীরা এখানে তোরাহ-এর বক্তব্য বিকৃত করেছে। আর একথা তো সকলেই জানেন যে, গরিষীম পাহাড়টি অনেক ঝর্ণা, বাগিচা, বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ। পক্ষান্তরে এবল একটি শুষ্ক পাহাড়। তাতে এসব কিছুই নেই। এমতাবস্থায় স্বভাবতই প্রথম পাহাড়টি দোয়া ও বরকতের জন্য এবং দ্বিতীয় পাহাড়টি অভিশাপ প্রদানের জন্য শোভনীয়।
এভাবে আমরা দেখছি যে, খৃস্টান সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ এখানে হিব্রু বাইবেলের বিকৃতির কথা স্বীকার করছেন।
৪- রাজ্যের নামে বিকৃতি:
হিব্রু বাইবেলে ২ বংশাবলির ২৮ অধ্যায়ের ১৯ শ্লোকে বলা হয়েছে: ‘‘কেননা ইস্রায়েল রাজ আহসের জন্য সদাপ্রভু যিহূদাকে নত করিলেন...।’’
এখানে ‘ইস্রায়েল’ কথাটি নিশ্চিতরূপে বিকৃত ও ভুল; কারণ আহস কখনোই ‘ইস্রায়েল’ রাজ্যের রাজা ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘যিহূদা’ রাজ্যের রাজা। [সুলাইমান (আ)-এর মৃত্যুর পরে তার পুত্র রুহবিয়ামের রাজত্বকালে (খৃ. পূ ৯২২ অব্দে) ইহূদীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং তাদের রাজ্য দুটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তর প্যালেস্টাইনের রাজ্যকে ইস্রাইল রাজ্য (the Kingdom of Israel) বলা হতো। এর রাজধানী ছিল নাবলুস। আর দক্ষিণ প্যালেস্টাইনের রাজ্যকে ‘যিহূদা রাজ্য’ (the Kingdom of Judea, also Judaea or Judah) বলা হতো। এর রাজধানী ছিল যিরূশালেম। উত্তরের ইস্রায়েল রাজ্যকে অনেক সময় শামেরা (Samaria) বা ইফ্রমিয় (Ephraimites) বলা হতো। বাইবেলের একটি বড় অংশ এ দুই রাজ্যের মধ্যকার হানাহানি, গণহত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, মুর্তিপূজা, অনাচার ইত্যাদির বর্ণনা।] গ্রীক ও ল্যাটিন অনুবাদে ‘যিহূদা’ শব্দ রয়েছে। কাজেই বিকৃতিটি ঘটেছে হিব্রু সংস্করণের মধ্যে।
৫- না বনাম হ্যাঁ:
গীতসংহিতার ১০৫ নং গীতের ২৮ শ্লোকে হিব্রু সংস্করণে বলা হয়েছে: ‘‘তাঁহারা তাঁহার বাক্যের বিরুদ্ধাচরণ করিলেন না।’’ এখানে গ্রীক সংস্করণে বলা হয়েছে: ‘‘তাঁহারা তাঁহার বাক্যের বিরুদ্ধাচরণ করিলেন।’’
হিব্রু বাইবেলে বাক্যটি না-বাচক কিন্তু গ্রীক বাইবেলে বাক্যটি হাঁ-বাচক। দুটি বাক্যের একটি নিঃসন্দেহে বিকৃত ও ভুল।
এখানেও খৃস্টান পণ্ডিতগণ দ্বিধাগ্রস্থ হয়েছেন। হেনরী ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলা হয়েছে, এ দুই সংস্করণের মধ্যে বিরাজমান এ পার্থক্যের কারণে অনেক দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। বাহ্যত কোনো একটি সংস্করণে ‘না’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে, অথবা বাড়ানো হয়েছে। এভাবে তারা এখানে বিকৃতির কথা স্বীকার করলেন, কিন্তু তারা কোন সংস্করণে বিকৃতিটি ঘটেছে তা নির্ধারণ করতে পারলেন না।
৬. প্রচলিত তাওরাত মূসা আলাইহিস সালাম-এর পরে লেখা হয়েছে:
আদিপুস্তক ৩৬/৩১ শ্লোকটি নিম্নরূপ: ‘‘ইস্রায়েল-সন্তানদের উপরে কোন রাজা রাজত্ব করিবার পূর্বে ইঁহারা ইদোম দেশের রাজা ছিলেন।’’ এরপর পরবর্তী শ্লোকগুলিতে ইস্রায়েল-সন্তানদের প্রথম রাজা তালূত (শৌল)-এর রাজত্ব লাভের পূর্ব পর্যন্ত ইদোমের রাজাদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। [মোশির মৃত্যুর পরে দীর্ঘ প্রায় তিন শতাব্দী যাবৎ ইস্রায়েল সন্তানগণের মধ্যে কোনো রাজা বা রাজত্ব ছিল না। নবী (ভাববাদী) বা বিচারকর্তৃগণ তাদেরকে পরিচালনা করতেন। সর্বশেষ বিচারকর্তা শমূয়েল ভাববাদীর সময়ে ইস্রায়েলীয়গণ তাঁর নিকট একজন রাজা নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। তখন কীশের পুত্র শৌল (তালুত) নামক এক ব্যক্তি রাজা মনোনিত হন। আনুমানিক খৃ. পূ. ১০১৫/১০০০ অব্দে অমালিকা সম্প্রদায়ের রাজা জালূত (Golieth)-কে পরাজিত করে তালুত প্রথম ইস্রায়েলীয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রথম ইস্রায়েলীয় রাজা বলে গণ্য হন। তাহলে মূসার (আ) লিখিত বলে কথিত ‘‘তাওরাতের’’ পাঁচ পুস্তকের প্রথম পুস্তকে মূসার (আ) মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিন শত বৎসর পরের ঘটনাবলি লেখা হচ্ছে।] তালূতের পরে ইস্রায়েলীয়দের রাজা হন দায়ূদ আলাইহিস সালাম। তাঁদের পূর্বে ইস্রায়েলীয়গণ বিচারকগণ কর্তৃক শাসিত ও পরিচালিত হতেন।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, আদিপুস্তকের ৩৬ অধ্যায়ের ৩১-৩৯ শ্লোকগুলি অবিকল ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায়ের ৪৩-৫০ শ্লোক। রাজাবলির মধ্যে এ বিষয়গুলি আলোচিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক; এ শ্লোকগুলি নিশ্চিত প্রমাণ করে যে, এগুলির লেখক মূসা আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর ৩৫৬ বৎসর পরে তালূত (শৌল)-এর রাজ্যভার গ্রহণের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে বণী ইস্রায়েল বা ইস্রায়েল-সন্তানদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরের যুগের মানুষ। আর বংশাবলি তালূদের যুগের অনেক পরে লেখা সে বিষয়ে মতভেদ নেই।
তবে ‘আদিপুস্তক’-এ কথাগুলির থাকার কোনোরূপ কোনো ব্যাখ্যা নেই। যে পুস্তক তালুতের যুগের সাড়ে তিন শত বৎসর পূর্বে মূসা আলাইহিস সালাম-এর লেখা তাওরাতের প্রথম পুস্তক তার মধ্যে এ কথা কিভাবে লেখা হলো?
আদম ক্লার্ক তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন, আমার দৃঢ় ধারণা হলো এ শ্লোকগুলি কখনোই মোশি লিখেন নি। বরং এগুলি সম্ভবত আদিপুস্তকের কোনো পাণ্ডুলিপির টীকায় লেখা ছিল। অনুলিপিকার একে মূল পাঠের অংশ মনে করে মূল পাঠের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন।
এভাবে এ ব্যাখ্যাকার বাইবেলের মধ্যে বিকৃতি ও সংযোজনের কথা স্বীকার করলেন। তাঁর স্বীকারোক্তি থেকে বুঝা যায় যে, তাঁদের ধর্মগ্রন্থগুলি বিকৃতি যোগ্য ও বিকৃতির উর্ধ্বে নয়। কারণ এ নয়টি শ্লোক তোরাহ-এর অংশ না হওয়া সত্ত্বেও তা তোরাহের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং এরপর সকল পাণ্ডুলিপিতে তা প্রচারিত হয়েছে।
৭- ‘‘অদ্য পর্যন্ত’’ সংযোজনের বিকৃতি:
দ্বিতীয় বিবরণের তৃতীয় অধ্যায়ের ১৪ শ্লোকটি নিম্নরূপ: ‘‘মনঃশির সন্তান যায়ীর গশূরীয়দের ও মাখাথীয়দের সীমা পর্যন্ত অর্গোবের সমস্ত অঞ্চল লইয়া আপন নামানুসারে বাশন দেশের সেই সকল স্থানের নাম হবেবাৎ-যায়ীর রাখিল; অদ্য পর্যন্ত (সেই নাম চলিত আছে)।’’
মূসা আলাইহিস সালাম-এর লিখিত বলে প্রচারিত তাওরাতের ৫ম পুস্তক ‘দ্বিতীয় বিবরণের’-এর এ কথাটি কখনোই মোশির কথা হতে পারে না (যদিও তা মোশির বক্তব্যের মধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে)। উপরের শ্লোকটিতে ‘অদ্য পর্যন্ত’ কথাটি থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এ কথাটি যিনি বলেছেন বা লিখেছেন তিনি অবশ্যই মনঃশির সন্তান যায়ীরের যুগের অনেক পরের মানুষ। ইয়াহূদী-খৃস্টান পণ্ডিতগণ বিস্তারিত গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, অনেক পরের মানুষেরা ছাড়া কেউ এই প্রকারের শব্দাবলি ব্যবহার করে না।
৬ নং বিকৃতি ও ৭ নং বিকৃতির বিষয়ে প্রসিদ্ধ গবেষক পণ্ডিত হর্ন তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন: এ দুইটি বক্তব্য বা অনুচ্ছেদ কোনো প্রকারেই মোশির কথা হতে পারে না। কারণ প্রথম বক্তব্য প্রমাণ করে যে, এ পুস্তকের লেখক ইস্রায়েল-সন্তানগণের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরের যুগের মানুষ ছিলেন। আর দ্বিতীয় বক্তব্য প্রমাণ করে যে, এ পুস্তকের লেখক ইয়াহূদীদের প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপনের পরের যুগের মানুষ ছিলেন। এ দুটি অনুচ্ছেদ শুধু অর্থহীনই নয়; বরং মুল পাঠের মধ্যে বিরক্তিকর সংযোজন বলে গণ্য। বিশেষত দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটি। কারণ এটি মোশিই লিখুন আর অন্য যেই লিখুন তিনি ‘অদ্য পর্যন্ত’ কথাটি বলবেন না। এজন্য যতদূর মনে হয়, এ কথাটি ছিল নিম্নরূপ: ‘‘মনঃশির সন্তান যায়ীর গশূরীয়দের ও মাখাথীয়দের সীমা পর্যন্ত অর্গোবের সমস্ত অঞ্চল লইয়া আপন নামানুসারে বাশন দেশের সেই সকল স্থানের নাম হবেবাৎ-যায়ীর রাখিল।’’ এরপর অনেক শতাব্দী পরে ‘অদ্য পর্যন্ত’ কথাটি পাদটীকায় লেখা হয়, যেন জানা যায় যে যায়ীর যে নাম রেখেছিলেন তা অদ্যাবধি চালু রয়েছে। এরপর এই কথাটি পরবর্তী কপিগুলিতে পাদটীকা থেকে মূল বক্তব্যের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। যদি কারো এ বিষয়ে সন্দেহ হয় তবে গ্রীক কপিগুলি দেখতে পারেন। তিনি দেখবেন যে, কোনো কোনো পাণ্ডুলিপিতে কিছু কথা মূল পাঠের মধ্যে সংযোজিত রয়েছে; আর কোনো কোনো পাণ্ডুলিপিতে তা পাদটীকায় রয়েছে।
তাঁর এ কথা প্রমাণ করে যে, এ পবিত্র ও ঐশ্বরিক পুস্তকগুলি লিখিত হওয়ার শত শত বৎসর পরেও এগুলিতে সংযোজন, বিয়োজন বা বিকৃতির সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল। কারণ তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, পুস্তকটি লিখিত হওয়ার অনেক শতাব্দী পরে এ কথাটিকে সংযোজন করা হয়েছে। এত পরে সংযোজিত কথাটিও পবিত্র পুস্তকের অংশে পরিণত হয়েছে এবং পরবর্তী সকল কপি ও সংস্করণে প্রচারিত হয়েছে!
উপরের শ্লোকটির মতই আরেকটি শ্লোক গণনাপুস্তকের ৩২ অধ্যায়ের ৪১ শ্লোক (কোনো কোনো মুদ্রণে ৪০ শ্লোক) নিম্নরূপ: ‘‘আর মনঃশির সন্তান যায়ীর গিয়া তথাকার গ্রাম সকল হস্তগত করিল, এবং তাহাদের নাম হবেবাৎ-যায়ীর (যায়ীরের গ্রামসমূহ) রাখিল।’’
এখানে আরো একটি ভুল রয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, ‘মনঃশির সন্তান যায়ীর’। কথাটি ভুল। যায়ীরের পিতার নাম ‘সগূব’। ১ বংশাবলির ২য় অধ্যায়ের ২২ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘সগুবের পুত্র যায়ীর, গিলিয়দ দেশে তাঁহার তেইশটি নগর ছিল।’’ [১ বংশাবলির ২য় ও ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে প্রদত্ত তথ্য থেকে স্পষ্টত জানা যায় যে, যায়ীর নামক এ ব্যক্তি মোশির পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক মানুষ ছিলেন না বরং তিনি মোশির পরের প্রজন্মের মানুষ ছিলেন। যাকোবের পুত্র লেবি, তার পুত্র কহাৎ, তাঁর পুত্র অম্রান, তাঁর পুত্র মোশি। আর যাকোবের অন্য পুত্র যিহূদা, তাঁর পুত্র পেরস, তাঁর পুত্র হিষ্রোণ, তাঁর পুত্র সগূব, তাঁর পুত্র যায়ীর। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, সগূব ছিলেন মোশির সমসাময়িক এবং তাঁর পুত্র যায়ীর মোশির পরের প্রজন্মের মানুষ। কাজেই একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, এই বক্তব্যটির পুরোটিই অনেক পরের সংযোজন। সংযোজনকারী যায়ীরের নাম ও তাঁর মালিকানাধীন গ্রামগুলির নামের বিষয়ে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে কথাটি লিখেছেন। এজন্য তিনি যায়ীরের পিতার নামও ঠিকমত লিখতে পারেন নি। দেখুন ১ বংশাবলি ২/১-২৩ ও ৬/১-৩।]
এভাবে আমরা দেখছি যে, দ্বিতীয় বিবরণ ও গণনা পুস্তকের মধ্যে পরবর্তী যুগের সংযোজন প্রমাণিত হয়েছে এবং ভুল তথ্য সংযোজনও প্রমাণিত হয়েছে। আর বংশাবলির মধ্যেও পিতার নাম ভুল লেখা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
‘বাইবেল ডিক্সনারী’ গ্রন্থটি আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড ও ভারতে মুদ্রিত হয়েছে। এ গ্রন্থের লেখকগণ বলেন: মোশির পুস্তকে এমন কিছু কথা পাওয়া যায় যা স্পষ্টত প্রমাণ করে যে, তা মোশির কথা নয়। অনুরূপভাবে কিছু কিছু বক্তব্য থেকে দেখা যায় যে, সেগুলি মোশির বাচনভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোন্ ব্যক্তি এই সকল বাক্য ও অনুচ্ছেদ সংযোজন করেছেন তা আমরা নিশ্চিতরূপে বলতে পারি না।
হেনরি ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংকলকগণ বলেন: ‘অদ্যাপি’, ‘অদ্য পর্যন্ত’ (unto this day) জাতীয় বাক্যাংশ পুরাতন নিয়মের অধিকাংশ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। যতদূর বুঝা যায়, এগুলি পরবর্তীকালে সংযোজিত। তাঁদের স্বীকৃতি অনুসারে শুধু ‘যিহোশূয়ের পুস্তকের’ মধ্যেই আরো ৮টি স্থানে পরবর্তী যুগে এইরূপ বাক্যাদি সংযোজনের মাধ্যমে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। যদি পুরাতন নিয়মের অন্যান্য স্থানে এইরূপ সংযোজন ও বিকৃতির কথা উল্লেখ করি তাহলে তালিকা অত্যন্ত লম্বা হয়ে যাবে।
৮- বিভিন্ন পুস্তকে ভূমিকা ও অধ্যায় সংযোজন:
দ্বিতীয় বিবরণের প্রথম অধ্যায়ের ১-৫ শ্লোক পাঠ করলে পাঠক নিশ্চিত হবেন যে, এগুলি কখনোই মূসা আলাইহিস সালাম-এর কথা নয়। এখানে লেখক মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে নাম পুরুষ (3rd person) ব্যবহার করে বলেছেন: ‘‘(১) যর্দনের পুর্বপারস্থিত প্রান্তরে .... মোশি সমস্ত ইস্রায়েলকে এই সকল কথা কহিলেন। ... (৩) সদাপ্রভু যে যে কথা ইস্রায়েল-সন্তানগণকে বলিতে মোশিকে আজ্ঞা দিয়াছিলেন, তদনুসারে মোশি চল্লিশ বৎসরের একাদশ মাসে, মাসের প্রথম দিনে তাহাদিগকে কহিতে লাগিলেন। .... (৫) যর্দনের পূর্বপারে মোয়াব দেশে মোশি এই ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন...।’’
বাইবেল ভাষ্যকার আদম ক্লার্ক তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থে দ্বিতীয় বিবরণের প্রথম অধ্যায়ের ব্যাখ্যার শুরুতে বলেন: এ অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম ৫টি শ্লোক এ পুস্তকের ভূমিকাস্বরূপ। এই শ্লোকগুলি মোশির কথা নয়। তিনি আরো বলেন যে, এ পুস্তকের (দ্বিতীয় বিবরণের) ৩৪ অধ্যায়টিও মোশির কথা নয়। মোশির বক্তব্য পূর্ববর্তী (৩৩) অধ্যায়ের সমাপ্তির সাথে সাথে শেষ হয়েছে। এ কথা বলা সম্ভব নয় যে, মোশি ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা লাভ করে এই অধ্যায়টিও লিখেছেন। কারণ এ সম্ভাবনা সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা থেকে অনেক দূরে। [এই অধ্যায়ে মোশির মৃত্যু, মৃত্যুর পরে ত্রিশ দিন যাবৎ ইহূদীদের শোকপালন, যুগের আবর্তনের মোশির কবর হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।] আদম ক্লার্ক দাবি করেছেন যে, এ অধ্যায়টি যিহোশূয়ের পুস্তকের প্রথম অধ্যায় ছিল। পক্ষান্তরে অনেক ব্যাখ্যাকার দাবি করেছেন যে, মোশির মৃত্যুর অনেক পরে ‘৭০ গোত্রপতি’ [মোশি ৭০ গোত্রপতির একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করেন বিচারকর্তৃগণকে সাহায্য করার জন্য। পরবর্তী কালে সকল যুগে ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে এইরূপ ‘কাউন্সিল’ ছিল।] এই ৩৪ অধ্যায়টি রচনা করেন। তখন এ অধ্যায়টি যিহোশূয়ের পুস্তকের প্রথম অধ্যায় ছিল। [আদম ক্লার্ক, জনৈক ইহূদী পন্ডিত ও অন্যান্যদের এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় বিবরণের ৩৪ অধ্যায়ের ৫-৬ শ্লোক প্রমাণ করে যে, এই অধ্যায়টি যিহোশূয়ের অনেক শতাব্দী পরে লেখা হয়েছে। এই শ্লোকদ্বয়ে বলা হয়েছে: ‘‘তখন সদাপ্রভুর দাস মোশি সদাপ্রভুর বাক্যানুসারে সেই স্থানে মোয়াব দেশে মরিলেন। আর তিনি মোয়াব দেশে বৈৎপিয়োরের সম্মুখস্থ উপত্যকাতে তাঁহাকে কবর দিলেন। কিন্তু তাঁহার কবরস্থান অদ্যাপি কেহ জানে না। (but no man knoweth of his sepulchre unto this day.)’’ মোশির মৃত্যুর মাত্র ১৫/১৬ বৎসর পরে যিহোশূয় মৃত্যুবরণ করেন। গণনা পুস্তকের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৭ লক্ষাধিক ইস্রায়েল সন্তান মোশির সাথে মিশর থেকে আগমন করেন। একথা কি কল্পনা করা সম্ভব যে, ১৫/১৬ বৎসরের মধ্যে এই ৭ লক্ষ ইস্রায়েল সন্তান তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা, ভাববাদী ও মুক্তিদাতার কবরের স্থানটি ভুলে গেলেন? এমনকি মোশির নিকটতম পরিচারক যিহোশূয়ও কবরটির স্থান পর্যন্ত ভুলে গেলেন?! শুধু তাই নয়, উপরন্তু তিনি তাঁর পুস্তকে নির্বিকার চিত্তে কথাটি লিপিবদ্ধ করলেন!!!] কিন্তু তা স্থানান্তরিত হয়ে এ স্থানে চলে এসেছে। [কত সহজ বিষয়! একটি ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায় ইচ্ছামত এক পুস্তক থেকে অন্য পুস্তকে ঢুকে পড়ে!!]
এভাবে তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, মূসার তাওরাতের এ সকল কথা মূসার কথা নয়। এরপর দাবি করলেন যে, ৭০ গোত্রপতি তা রচনা করেছেন। তাদের এ দাবি একেবারেই প্রমাণবিহীন আন্দায দাবি। এর বড় প্রমাণ হলো, এ বিষয়ে তাদের নানামুনির নানা মত। হেনরী ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংকলকগণ বলেন, মোশির কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়েই শেষ হয়েছে। এ অধ্যায়টি পরবর্তীকালে সংযোজিত। সংযোজনকারী সম্ভবত যিহোশূয় অথবা শমূয়েল অথবা ইয্রা অথবা তাঁদের পরের যুগের অন্য কোনো ভাববাদী (নবী)। [... অথবা কোনো লিপিকার, অথবা কোনো ধর্মত্যাগী মুর্তিপূজক রাজা, অথবা কোনো শয়তান ....। এ কথাগুলি থেকে মনে পড়ে মোল্লা দোপেয়াজীর ও বাদশাহ আকবরের মধ্যকার সংলাপ। বাদশাহ বললেন, এদেশে মোট কাকের সংখ্যা কত? মোল্লা দোপেয়াজী একটি কাল্পনিক সংখ্যা বললেন: এত লক্ষ... এত হাজার এত... । আপনার সন্দেহ হলে গুণে দেখুন। যদি বেশি হয় তাহলে বুঝতে হবে বাইরের কোনো কাক এদেশে বেড়াতে এসেছে। আর যদি কম হয় তাহলে বুঝতে হবে এদেশের কোনো কাক বাইরে বেড়াতে গিয়েছে। এ সকল পন্ডিতদের ভিত্তিহীন কাল্পনিক সম্ভাবনাগুলির সাথে মোল্লা দোপেয়াজীর কথার কি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়?] এ বিষয়ে নিশ্চিতরূপে কিছুই জানা যায় না। শেষ শ্লোকগুলি সম্ভবত ইস্রায়েল-সন্তানদের ব্যাবিলনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে সংযোজন করা হয়েছে।’’
পাঠক এখানে এ সকল পণ্ডিতের কথাগুলি একটু চিন্তা করুন! তাঁরা বললেন: ‘‘সংযোজনকারী সম্ভবত যিহোশূয়, অথবা ... অথবা ... অথবা ... অথবা তাঁদের পরের যুগের অন্য কোনো ভাববদী। সবই ভিত্তিহীন প্রমাণবিহীন কাল্পনিক দাবি মাত্র। [সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা যদি কোনো সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তনের কোনোরূপ ওজর বা ব্যাখ্যা পেশ করতে না পারেন, তবে তাকে বিকৃতি বলে স্বীকার করে ভুলটি ‘অনুলিপিকারের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। আর যেখানে এরূপ সংযোজন, বিয়োজন বা বিকৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো ভুল ধরা পড়ে না সেখানে তাঁরা এই সংযোজনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট ভাববাদী বা কোনো একজন ‘ঐশ্বরিক প্রেরণাপ্রাপ্ত’ ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। এর উল্টো কেন হলো না তা আমরা বুঝি না। কেউ যদি দাবি করেন যে, সবগুলিই লিপিকারদের বা সবগুলিই ভাববাদিগণের কর্ম, তবে তা ভুল প্রমাণ করা হবে কিভাবে? আর ভাববাদিগণের বা ‘ঐশ্বরিক প্রেরণাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের’ নির্ভুলতারই বা প্রমাণ কোথায়? যে ইয্রার নাম তাঁরা বারংবার বলেন তিনি আরো দুইজন ভাববাদীর সহযোগিতায় যে ‘বংশাবলি’ পুস্তক রচনা করেছেন তার মধ্যেও অনেক ভুল রয়েছে বলে আমরা দেখেছি। এছাড়া তোরাহ বা পবিত্র পুস্তকগুলি কি ভাববাদিগণ বা যাজকগণ ছাড়া কেউ লিখতেন বা অনুলিপি করতেন? আর কোনো অনুলিপিকার যদি ভুল করেই ফেলে তাহলে পরবর্তী ভাববাদিগণ ও যাজকগণ তা সংশোধন করলেন না কেন? ভাববাদিগণ পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপুস্তকের মধ্যে এভাবে বিভিন্ন কথা সংযোজন করতে পারলেন, কিন্তু পবিত্র পুস্তকের মধ্যে অনুলিপিকারদের এত সব বিকৃতি সংশোধন করতে পারলেন না?]
এখানে দ্বিতীয় বিবরণের ৩৪ অধ্যায়ের কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করছি, যেন পাঠক অবস্থা ভালভাবে অনুধাবন করতে পারেন:
‘‘(১) পরে মোশি মোয়াবের তলভূমি হইতে নবো পর্বতে.. উঠিলেন। আর সদাপ্রভু তাঁহাকে সমস্ত দেশ, দান পর্যন্ত গিলিয়দ... দেখাইলেন (৪) আর সদাপ্রভু তাঁহাকে কাহিলেন.... (৫) তখন সদাপ্রভুর দাস মোসি সদাপ্রভুর বাক্যানুসারে সেই স্থানে মোয়াব দেশে মরিলেন। (৬) আর তিনি মোয়াব দেশে বৈৎপিয়োরের সম্মুখস্থ উপত্যাকাতে তাঁহাকে কবর দিলেন; কিন্তু তাঁহার কবরস্থান অদ্যাপি কেহ জানে না। (৭) মরণকালে মোশির বয়স এক শত বিংশতি বৎসর হইয়াছিল....। (৮) পরে ইস্রায়েল সন্তানগণ মোশির নিমিত্ত মোয়াবের তলভূমিতে ত্রিশ দিন রোদন করিল। ... (১০) মোশির তুল্য কোন ভাববাদী ইস্রায়েলের মধ্যে আর উৎপন্ন হয় নাই।’’
মূসা আলাইহিস সালাম-এর উপর অবর্তীর্ণ কিতাবে কি মূসার মৃত্যু, শেষকৃত্য, কবর, অনুসারীদের কান্নাকাটি, তার কবর নিশ্চিহ্ন হওয়া, তাঁর পরে তাঁর মত আর কোনো নবীর আবির্ভাব না হওয়া ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত থাকবে?
আমরা মুসলিমগণ নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করি যে, মূসার তাওরাত বলে কাথিত ৫ পুস্তকের সর্বশেষ অধ্যায়, দ্বিতীয় বিবরণের ৩৪ অধ্যায়টি মূসা আলাইহিস সালাম-এর রচিত নয়। শুধু তাই নয়, আমরা আরো বিশ্বাস করি যে, মূসা আলাইহিস সালাম-এর নামে প্রচলিত এ পাঁচটি পুস্তক কখনোই তাঁর লেখা নয়। এগুলিকে তার লেখা বা তার প্রদত্ত তাওরাত বলে দাবি করা বৈধ নয়। এগুলির মধ্যে বিদ্যমান অগণিত বিকৃতি, সংযোজন, ভুলভ্রান্তি আমাদের এ বিশ্বাসের অকাট্য প্রমাণ। কোনো নবীর উপরে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ কোনো আসমানী গ্রন্থে এরূপ কোনো ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে না। এরূপ ভুলভ্রান্তিময় একটি গ্রন্থকে কোনো নবীর নামে চালানোর অর্থ উক্ত নবীকে অপবাদ দেওয়া। অনেক ইয়াহূদী-খৃস্টান পণ্ডিতও অবিকল মুসলিমদের মতই এ সকল প্রমাণাদির ভিত্তিতে দাবি করেছেন যে, এ সকল পুস্তকের কোনোটিই মোশির লেখা বা মোশির দেওয়া তাওরাত নয়।
৯- ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ইঞ্জিলের বিকৃতি:
যোহনের প্রথম পত্রের ৫ম অধ্যায়ের ৭-৮ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘(৭) কারণ স্বর্গে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করেন: পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা; এবং তাঁহারা তিন একই। ৮. এবং পৃথিবীতে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহার সাক্ষ্য প্রদান করেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই। (For there are three that bear record in heaven, the Father, the Word, and the Holy Ghost; and the three are one. 8. And there are three that bear witness in earth, the spirit, and the water, and the blood: and these three agree in one.) [বাংলা বাইবেলে ও ইঞ্জিল শরীফে এই বাক্যগুলি নেই। ইংরেজি ও আরবী বাইবেলের অনুসরণে অনুবাদ করা হয়েছে।]’’
খৃস্টান পণ্ডিতগণ উল্লেখ করেছেন যে, উপরের শ্লোকদ্বয়ের এতসব কথার মধ্যে মূল বাক্যগুলি ছিল নিম্নরূপ: ‘‘বস্তুত তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন, আত্মা, ও জল, ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।’’ [বাংলা বাইবেলে এতটুকই উল্লেখ করা হয়েছে।]
এরপর ত্রিত্বে বিশ্বাসিগণ মূল পাঠের মধ্যে অতিরিক্ত সংযোজন করেন: ‘‘স্বর্গে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করেন: পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা; এবং তাঁহারা তিন একই। ৮. এবং পৃথিবীতে তিন জন রহিয়াছেন...।’’ ত্রিত্ববাদী খৃস্টানদের ত্রিত্ববাদ প্রমাণের জন্য একথাগুলিই মূল দলিল। আর এগুলি যে জাল ও অতিরিক্ত সংযোজন সে বিষয়ে কোনোরূপ সন্দেহ নেই। ত্রিত্ববাদী গোঁড়া খৃস্টান পণ্ডিতগণও স্বীকার করেছেন যে, এ বাক্যগুলি অতিরিক্ত সংযোজন এবং এগুলিকে মুছে দেওয়া আবশ্যক। হেনরি ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংকলকগণ হর্নের এই কথাকে সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন। আদম ক্লার্কও এই বাক্যগুলিকে সংযোজিত বলে গণ্য করার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। ক্রীসবাখ ও শোলয্, হর্ন, আদম ক্লাক, হেনরি ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংকলকগণ ও আরো অনেকেই এ বাক্যগুলিকে জাল বলে এগুলি বাইবেল থেকে বাদ দেওয়ার দাবি করেছেন।
চতুর্থ-পঞ্চম খৃস্টীয় শতাব্দীর ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন সেন্ট অগাস্টাইন (St. Augustine)। এখন পর্যন্ত ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ তাঁর মতের উপরেই নির্ভর করেন। তিনি যোহনের এ পত্রটির আলোচনায় দশটি পত্র লিখেছেন। এ দশটি পত্রের একটি পত্রেও তিনি এ বাক্যগুলির কথা উল্লেখ করেন নি। তিনি ছিলেন ত্রিত্বে বিশ্বাসী। আলেকজেন্দ্রিয়ার প্রসিদ্ধ খৃস্টান ধর্মগুরু আরিয়াসের (Arius) অনুসারিগণ যাঁরা ত্রিত্বে বিশ্বাস করতেন না বা একেশ্বরবাদী ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে অগাস্টাইন বিতর্ক করতেন। তাঁর সময়ে যদি উপরের এই শ্লোকদ্বয় এভাবে যোহনের পত্রের মধ্যে থাকত তবে নিশ্চয় ত্রিত্ববাদ (trinity) প্রমাণ করার জন্য তিনি সেগুলির উদ্ধৃতি দিতেন ও সেগুলিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করতেন।
শুধু তাই নয়, অগাস্টাইন ত্রিত্ববাদ প্রমাণ করার জন্য উপরে উল্লিখিত ৮ম শ্লোকটি: ‘‘বস্তুতঃ তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন, আত্মা, ও জল, ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই’’ এই কথাটির অদ্ভুত একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: এখানে জল দ্বারা পিতাকে বুঝানো হয়েছে, রক্ত দ্বারা পুত্রকে বুঝানো হয়েছে এবং আত্মা দ্বারা পবিত্র-আত্মাকে বুঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যাটি খুবই দুর্বল ও অবাস্তব ব্যাখ্যা। একথা স্পষ্ট যে, উপরে উল্লিখিত ৭ম শ্লোকটি যদি যোহনের পত্রে সত্যিই থাকত তাহলে তিনি এইরূপ অবাস্তব ও দুর্বল ব্যাখ্যার স্মরণাপন্ন হতেন না। আমার মনে হয়, যখন ত্রিত্ববাদীরা দেখলেন যে, এই ব্যাখ্যাটি অত্যন্ত দুর্বল- যা দিয়ে ত্রিত্ববাদ প্রমাণ করা কঠিন- তখন তারা উপরের বাক্যগুলি তৈরি করে সেগুলিকে এই পত্রের মধ্যে সংযোজন করে দেন, যাতে সেগুলি দিয়ে তাঁদের ত্রিত্ব প্রমাণ করা সহজ হয়।
১২৭০ হিজরী সালে (১৮৫৪ খৃস্টাব্দে) ইযহারুল হক্কের প্রণেতা আল্লামা শাইখ রাহমাতুল্লাহর সাথে ড. ফান্ডার (Carl Gottaleb Pfander) ও তার সহযোগী পাদ্রী মি. ফ্রেঞ্চ (T. V. French)-এর যে প্রকাশ্য বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়, সে বিতর্কের সময় উপস্থিত সকল মানুষের সামনে পাদ্রীদ্বয় স্বীকার করেন যে, এই বাক্যগুলি বিকৃত। তাঁরা আরো স্বীকার করেন যে, বাইবেলের মধ্যে ৭/৮ স্থানে বিকৃতি ঘটেছে।
এই বাক্যটির আলোচনায় পণ্ডিত হর্ন ১২ পৃষ্ঠা লিখেছেন। হেনরি ও স্কটের ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংকলক হর্নের সার-সংক্ষেপকে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। আমি এখানে তাঁদের সার-সংক্ষেপের সার-সংক্ষেপ উদ্ধৃত করছি। হেনরি ও স্কটের পুস্তকের সংকলকগণ বলেন:
‘‘হর্ন উভয় পক্ষের দলিল প্রমাণাদি আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি পুনরায় তার আলোচনার সার-সংক্ষেপ উল্লেখ করেছেন। তার আলোচনার সার-সংক্ষেপ থেকে জানা যায় যে, যারা এই বাক্যগুলিকে মিথ্যা ও জাল বলে প্রমাণ করেন তাঁরা নিম্নের বিষয়গুলির উপর নির্ভর করেন:
(১)১৬শ শতাব্দীর পূর্বে লিখিত কোনো গ্রীক পাণ্ডুলিপিতে এই বাক্যগুলির অস্তিত্ব নেই।
(২) প্রথম যুগে পরিপূর্ণ যত্ন ও গবেষণা সহকারে যে সকল বাইবেল মুদ্রণ করা হয়েছে সেগুলিতেও এই বাক্যগুলির অস্তিত্ব নেই।
(৩) একমাত্র ল্যাটিন অনুবাদ ছাড়া অন্য কোনো প্রাচীন অনুবাদে এই বাক্যগুলির অস্তিত্ব নেই।
(৪)অধিকাংশ প্রাচীন ল্যাটিন পাণ্ডুলিপিতেও এই কথাগুলি নেই।
(৫)কোনো প্রাচীন খৃস্টান পণ্ডিত বা চার্চের ঐতিহাসিক এই কথাগুলিকে প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করেন নি।
(৭)প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের নেতাগণ ও ধর্মের সংস্কারকগণ এই কথাগুলিকে ফেলে দিয়েছেন অথবা তার উপরে সন্দেহের চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, খৃস্টানগণ যখনই প্রয়োজন মনে করতেন তখনই তাদের ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সংযোজন-বিয়োজন করে বিকৃতি সাধন করতেন। মুদ্রণ-যন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে বাইবেলের মধ্যে বিকৃতির দরজা ছিল উন্মুক্ত। লিপিকারগণ ও বিভিন্ন দল-উপদলের খৃস্টানগণ অতি সহজেই সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন করতে পারতেন। মজার কথা হলো মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পরেও এ বিকৃতির ধারা থামে নি।
প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের প্রথম গুরু ও খৃস্টধর্ম সংস্কারের মূল নেতা মি. লুথার যখন এ ধর্মের সংস্কারের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করলেন, তখন তিনি জার্মান ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেন যেন তাঁর অনুসারিগণ তা থেকে উপকৃত হতে পারেন। তিনি তাঁর অনূদিত বাইবেলের মধ্যে যোহনের পত্রের এ বাক্যগুলি উল্লেখ করেন নি। তাঁর জীবদ্দশাতেই কয়েকবার তাঁর অনুবাদ মুদ্রিত হয়। যখন তিনি বৃদ্ধ হলেন এবং বুঝতে পারলেন যে তাঁর আয়ূ শেষ হয়ে আসছে, তখন তিনি ১৫৪৬ সালে পুনরায় অনুবাদটির মুদ্রণ শুরু করেন। ধর্মগ্রন্থের বিকৃতির বিষয়ে ইয়াহূদী-খৃস্টানগণের অভ্যাস, বিশেষত খৃস্টানগণের অভ্যাসের সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। এজন্য তিনি এই অনুবাদের ভূমিকায় তাঁর অন্তিম নির্দেশনা প্রদান করেন: ‘‘কেউ যেন আমার এই অনুবাদটি বিকৃত না করেন।’’
কিন্তু এ অন্তিম নির্দেশনাটি ছিল খৃস্টান সম্প্রদায়ের চিরাচরিত অভ্যাসের বিপরীত, এজন্য তাঁরা তা রক্ষা করেন নি; বরং লুথারের মৃত্যুর পরে ত্রিশ বৎসর পার না হতেই তাঁরা এই জাল ও বানোয়াট বাক্যটিকে তাঁর অনুবাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। লূথারের অনুবাদের এই বিকৃতি সর্বপ্রথম সাধিত হয় ফ্রাঙ্কফুর্টবাসীদের দ্বারা। ১৫৭৪ সালে যখন তাঁরা এই অনুবাদটি মুদ্রণ করেন তখন তাঁরা এই জাল বাক্যটিকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু এরপর তাঁরা আবার মানুষের নিন্দার ভয়ে পরবর্তী মুদ্রণগুলিতে এ বাক্যগুলি ফেলে দেন।
ত্রিত্ববাদীরের জন্য এই বাক্যগুলি বাদ দেওয়া খুবই কঠিন ছিল। এজন্য ওটিনবুর্গের বাসিন্দারা ১৫৯৬ ও ১৫৯৯ সালে মুদ্রিত লুথারের এই অনুবাদের মধ্যে এই বাক্যগুলি ঢুকিয়ে দেন। অনুরূপভাবে হামবুর্গবাসিগণ ১৫৯৬ সালে একই কাজ করেন। এরপর ওটিনবুর্গবাসিগণ ফ্রাঙ্কফুর্টবাসিগণের মত মানুষের নিন্দার ভয় পান। ফলে পরবর্তী মুদ্রণের সময় বাক্যগুলি ফেলে দেন।
লূথারের অনুসারী ত্রিত্ববাদী প্রটেস্টান্ট খৃস্টানগণের জন্য এই বাক্যটিকে বাদ দেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তখন লূথারের নিজের অন্তিম নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর অনুবাদের মধ্যে এ বাক্যটি উল্লেখ করা হয়।
এ যদি হয় আধুনিক যুগের অবস্থা, তাহলে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে, যখন বাইবেলের কপি ও পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল খুবই কম [বাইবেলের পঠন ও পাঠন সাধারণ খৃস্টানদের জন্য মূলত নিষিদ্ধ ছিল। এর পাণ্ডুলিপির সংখ্যাও ছিল খুবই কম।], তখন তাঁরা কি করেছেন তা সহজেই অনুমেয়।
প্রসিদ্ধ দার্শনিক আইজ্যাক নিউটন ৫০ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা লিখেছেন। এই পুস্তিকাতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, যোহনের পত্রের উপরের বাক্যগুলি বিকৃত ও সংযোজিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, আধুনিক অনেক সংস্করণে উপর্যুক্ত জাল বাক্যগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলা বাইবেলগুলিতেও এ বাক্যগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। বা টীকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
১০- যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র বানানোর জন্য বিকৃতি:
প্রেরিতগণের কার্যবিবরণের ৮ম অধ্যায়ের ৩৭ শ্লোকটি নিম্নরূপ: ‘‘ফিলিপ কহিলেন, সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত যদি বিশ্বাস করেন, তবে হইতে পারেন। তাহাতে তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, যীশু খৃস্ট যে ঈশ্বরের পুত্র ইহা আমি বিশ্বাস করিতেছি (I believe that Jesus Christ is the Son of God)।’’ [ইংরেজি ও আরবী বাইবেলে এই শ্লোকটি মূল পাঠের মধ্যে রয়েছে। বাংলা ‘ইঞ্জিল শরীফে’ এ কথাগুলি একেবারে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর বাংলা বাইবেলে কথাগুলি পাদটীকায় লেখা হয়েছে এবং বলা হয়েছে: ‘‘কোনো কোনো প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এখানে এই কথাগুলি পাওয়া যায়।’’]
এ বাক্যগুলি পরবর্তীকালে সংযোজিত। কোনো একজন ত্রিত্ববাদী ‘যীশু খৃস্ট যে ঈশ্বরের পুত্র ইহা আমি বিশ্বাস করিতেছি’ এ কথার দ্বারা খৃস্টের ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করার জন্য এই বাক্যটি বাইবেলের মধ্যে সংযোজন করেছেন। ক্রীসবাখ ও শোলয একমত যে, বাক্যটি পরবর্তী সংযোজন। লক্ষণীয় যে, ইংরেজি রিভাইয্ড স্টান্ডার্ড ভার্সন (Revised Standard Version: RVS)-এ এ শ্লোকটি মূল পাঠ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং টীকায় মন্তব্য করা হয়েছে। উইলিয়াম কেরি অনূদিত বাংলা বাইবেলেও এভাবে ৩৭ শ্লোকটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং টীকায় বলা হয়েছে: ‘‘কোনো কোনো প্রাচীন অনুলিপিতে এখানে এই কথাগুলি পাওয়া যায়’’ ... এ কথা বলে উপরের জাল শ্লোকটি উল্লেখ করা হয়েছে।
১১-যাকোবের পুত্র রুবেনের ব্যভিচারের কাহিনীতে বিকৃতি:
আদিপুস্তকের ৩৫ অধ্যায়ের ২২ শ্লোকটি হিব্রু সংস্করণে নিম্নরূপ: ‘‘সেই দেশে ইস্রায়েলের (যাকোবের) অবস্থিতি কালে রূবেন (যাকোবের প্রথম পুত্র) গিয়া আপন পিতার বিল্হা নাম্মী উপপত্নীর সহিত শয়ন করিল, এবং ইস্রায়েল (যাকোব) তাহা শুনিতে পাইলেন।’’
এখানে কিছু কথা বিয়োজনের মাধ্যমে বিকৃতি সাধান করা হয়েছে। হেনরি ও স্কটের ভাষ্যগ্রন্থের সংকলকগণ বলেন: ইয়াহূদীগণ স্বীকার করেন যে, এ শ্লোক থেকে কিছু কথা বাদ পড়ে গিয়েছে। গ্রীক অনুবাদে এ অপূর্ণতা নিম্নরূপে পুরণ করা হয়েছে: ‘‘এবং তাঁহার দৃষ্টিতে তা অন্যায় হইল।’’
তাহলে ইয়াহূদীরাও স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, কিছু কথা বাদ পড়েছে। হিব্রু তোরাহ থেকে একটি পুর্ণ বাক্য বাদ পড়ে যাওয়া বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াও ইয়াহূদী-খৃস্টানগণের নিকট কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়। তাহলে দুই একটি শব্দের বিষয়ে আর কি কথা থাকতে পারে। আর যেহেতু ‘‘ঈশ্বরের গ্রন্থের মধ্যে’’ এরূপ রদবদল তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক কাজেই কেন তারা এখানে এরূপ বিয়োজন করলেন তা প্রশ্ন করে আর কী লাভ?
১২- ইউসূফ-ভাতৃগণের চুরির ঘটনা বর্ণনায় বিয়োজন:
ইউসূফ আলাইহিস সালাম-এর ভাইয়ের ছালার মধ্যে তাঁর বাটি রাখা ও পরে তা বের করা ঘটনার বর্ণনায় আদিপুস্তকের ৪৪ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘আমার প্রভু যাহাতে পান করেন ও যদ্বারা গণনা করেন, এ কি সেই বাটি নয়? এ কর্ম করায় তোমরা দোষ করিয়াছ।’’
এখানে কিছু কথা বিয়োজন করা হয়েছে বা বাদ পড়ে গিয়েছে। বাইবেল ব্যাখ্যাকার হার্সলি বলেন: ‘‘এ শ্লোকের শুরুতে নিম্নের বাক্যটি সংযোজিত করতে হবে: ‘‘তোমরা কেন আমার বাটি চুরি করিলে?’’ গ্রীক অনুবাদ থেকে এই বাক্যটি নিয়ে হিব্রু পাঠে যোগ করতে হবে।’’
১৩- মূসা আলাইহিস সালাম-এর মাতা ও ভগ্নির নাম-পরিচয় বিকৃতি:
যাত্রাপুস্তকের ৬ অধ্যায়ের ২০ শ্লোকে রয়েছে: ‘‘অম্রম (Amram) আপন পিসি যোকেবদকে বিবাহ করিলেন, আর ইনি তাঁহার জন্য হারোণকে ও মোশিকে প্রসব করিলেন।’’
নিঃসন্দেহে এখানে বিয়োজন-জনিত বিকৃতি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে পুরাতন নিয়মের নিয়ম সকল সন্তানের নাম উল্লেখ করা। এ শ্লোক থেকে বুঝা যায় যে, অম্রমের মাত্র দুটি পুত্রসন্তানই ছিল; অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের একজন কন্যাসন্তানও ছিল। শমরীয় সংস্করণ থেকে এ বিকৃতি বুঝা যায়। শমরীয় সংস্করণে এবং গ্রীক অনুবাদে রয়েছে: ‘‘আর ইনি তাঁহার জন্য হারোণকে, মোশিকে ও তাঁহাদের ভগিনী মরিয়মকে প্রসব করিলেন।’’
তাহলে ‘‘ও তাঁহাদের ভগিনী মরিয়মকে’’ কথাগুলি হিব্রু তোরাহ থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে। আদম ক্লার্ক শমরীয় ও গ্রীক সংস্করণ থেকে উপর্যুক্ত কথাগুলি উদ্ধৃত করার পরে বলেন: ‘‘কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় গবেষক পণ্ডিত মনে করেন যে, হিব্রু পাঠেও এই কথাগুলি ছিল।’’
এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, ইয়াহূদীগণ একান্তই ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে তাদের তাওরাত থেকে কয়েকটি শব্দ বাদ দিয়েছেন। শমরীয়দের তাওরাতের বিকৃতি প্রমাণ করতে অথবা খৃস্টানদের গ্রীক অনুবাদের বিকৃতি প্রমাণ করতে তারা এরূপ করেছেন।
এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। এ শ্লোক থেকে নিশ্চিত জানা যায় যে, মূসা আলাইহিস সালামের পিতা আপন ফুফুকে বিবাহ করেছিলেন। মূসার পিতা অম্রম (ইমরান)। অম্রমের পিতা কহাৎ। কহাতের পিতা লেবী। আর মূসার পিতা অম্রম বিবাহ করেন তার পিতা কহাতের ভগ্নি যোকাবেদ বিনত লেবীকে। উপরের শ্লোকে তা সুস্পষ্টত বলা হয়েছে। [এছাড়া গণনাপুস্তকের ২৬ অধ্যায়ের ৫৯ শ্লোকে বলা হয়েছে: ‘‘ঐ কহাতের পুত্র অম্রাম। অম্রামের স্ত্রীর নাম যোকাবেদ, তিনি লেবির কন্যা, মিসরে লেবির ঔরসে তাহার জন্ম।’’ এখানেও অতি স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে যে, যোকেবদ লেবীর ঔরসজাত কন্যা। আর কহাৎ লেবির পুত্র। কাজেই তিনি অম্রামের আপন ফুফু।] এ শ্লোকের ইংরেজি, আরবী, ফারসী, উর্দু, বাংলা বিভিন্ন ভাষার অনুবাদেও স্পষ্টত তা উল্লেখ করা হয়েছে।
মূসা আলাইহিস সালাম-এর শরীয়ত বা ব্যবস্থা মতে ফুফুকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ। লেবীয় পুস্তকের ১৮/১২ ও ২০/১৯ শ্লোকে তা বলা হয়েছে। এজন্য খৃস্টানগণ এ পরিচয় গোপন করতে বিকৃতির আশ্রয় নেন। ভ্যাটিকানের পোপ অষ্টম উর্বান (Urban) [১৫৬৮ সালে ইটালিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬২৩ সালে পোপের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১৬৪৩/১৬৪৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সময়ে ইউরোপব্যাপী ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের মধ্যে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ হয়। ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইডেন প্রভৃতি দেশের রাজাগণ প্রটেস্টান্টদের সাহায্যে বড় বড় সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। দেখুন, মতিওর রহমান, ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ১৭২-১৭৫।]-এর সময়ে অত্যন্ত যত্ন সহকারে বাইবেলের যে আরবী সংস্করণটির অনুবাদ ও সম্পাদনা করা হয় এবং ১৬২৫ খৃস্টাব্দে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় সে সংস্করণে এ শ্লোকটি নিম্নরূপ লেখা হয়েছে: ‘‘অম্রম আপন পিসির কন্যা যোকেবদকে বিবাহ করিলেন।’’
এখানে ‘‘পিসি’’ বা ‘‘ফুফু’’ শব্দটিকে বিকৃত করে ‘‘পিসির কন্যা’’ (ফুফাতো বোন) বানানো হয়েছে। পরবর্তী বিভিন্ন আরবী সংস্করণে এরূপ পিসির বদলে পিসির কন্যা লেখা হয়েছে। এভাবে তারা নিজেদের মনমর্জি মত কিছু রদবদল বা পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো কোনো সংস্করণ বিকৃত করেছেন।
১৪- গীতসংহিতায় বিয়োজন বা সংযোজন করে বিকৃতি:
গীতসংহিতার ১৪ গীতের ৩য় শ্লোকের পরে- ৩ ও ৪ শ্লোকের মাঝখানে- ল্যাটিন, ইথিওপিয়, আরবী অনুবাদে এবং গ্রীক অনুবাদের ভ্যাটিকানের পাণ্ডুলিপিতে নিম্নের বাক্যগুলি রয়েছে: ‘‘তাহাদের কণ্ঠ অনাবৃত কবরস্বরূপ; তাহারা জিহবাতে ছলনা করিতেছে; তাহাদের ওষ্ঠাধরের নিম্নে কালসর্পেব বিষ থাকে; তাহাদের মুখ অভিশাপ ও কটুকাটব্যে পূর্ণ; তাহাদের চরণ রক্তপাতের জন্য ত্বরান্বিত। তাহাদের পথে পথে ধ্বংস ও বিনাশ; এবং শান্তির পথ তাহারা জানে নাই; ঈশ্বর-ভয় তাহাদের চক্ষুর অগোচর।’’
এ বাক্যগুলি হিব্রু বাইবেলে নেই। কিন্তু এ কথাগুলি রোমীয়দের প্রতি প্রেরিত পৌলের পত্রের ৩/১৩-১৮ শ্লোকে রয়েছে। পৌল পুরাতন নিয়মের বক্তব্য হিসেবে এ কথাগুলিকে উদ্ধৃত করেছেন। এখানে দুটি বিষয়ের একটি অবশ্যই ঘটেছে। হয়তবা ইয়াহূদীরা মূল হিব্রু বাইবেল থেকে এ শ্লোকগুলি ফেলে দিয়েছেন। নতুবা খৃস্টানগণ তাঁদের মহাপুরুষ পৌলের বক্তব্যকে প্রমাণিত করার জন্য তাঁদের অনুবাদের মধ্যে এই কথাগুলি সংযোজন করেছেন। প্রথম সম্ভাবনা স্বীকার করলে বাইবেলে বিয়োজনের মাধ্যমে বিকৃতি প্রমাণিত হয়। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা স্বীকার করলে বাইবেলে সংযোজন ও বৃদ্ধির মাধ্যমে জালিয়াতি প্রমাণিত হয়। সর্বাবস্থায় এখানে দু প্রকারের জালিয়াতির এক প্রকার মানতেই হবে।
১৫- লূকলিখিত সুসমাচারে বিয়োজন-জনিত বিকৃতি
যীশু খৃস্ট তার শিষ্যদেরকে কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের আগমন সম্পর্কে ও সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ সম্পর্কে কিছু উপদেশ প্রদান করেন বলে মথি, মার্ক ও লূক উল্লেখ করেছেন। লূকের বর্ণনায় কিছু কথা বাদ দেওয়া হয়েছে। লূকলিখিত সুসমাচারের ২১/৩২-৩৪ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘(৩২) আমি তোমাদেরকে সত্য বলিতেছি, যে পর্যন্ত সমস্ত সিদ্ধ না হইবে সেই পর্যন্ত এই কালের লোকদের লোপ হইবে না। (৩৩) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩৪) কিন্তু আপনাদের বিষয়ে সাবধান থাকিও, পাছে ভোগপীড়ায় ও মত্ততায় এবং জীবিকার চিন্তায় তোমাদের হৃদয় ভারগ্রস্ত হয়, আর সেই দিন হঠাৎ ফাঁদের ন্যায় তোমাদের উপর আসিয় পড়ে।’’
হর্ন তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন: ‘‘লূকলিখিত সুসমচারের ২১ অধ্যায়ের ৩৩ ও ৩৪ শ্লোকের মাঝখানে একটি পূর্ণ শ্লোক পড়ে গিয়েছে। মথিলিখিত সুসমাচারের ২৪ অধ্যায়ের ৩৬ শ্লোক অথবা মার্ক লিখিত সুসমাচারের ১৩ অধ্যায়ের ৩২ শ্লোক থেকে কথাটি নিয়ে লূকের সুসমাচরের উপর্যুক্ত শ্লোকদ্বয়ের মাঝে সংযোজন করতে হবে।’’
এরপর টীকায় বলেন: ‘‘এখানে যে বড় রকমের বিয়োজন ও বিকৃতি ঘটেছে সে বিষয়টি সকল গবেষক ও ব্যাখ্যাকার এড়িয়ে গিয়েছেন। সর্বপ্রথম হেলস-ই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’’
এ ঘটনা বর্ণনায় মথির বিবরণ (মথি ২৪/৩৪-৩৬) নিম্নরূপ: ‘‘(৩৪) আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, এই কালের লোকদের লোপ হইবে না, যে পর্যন্ত না এ সমস্ত সিদ্ধ হয়। (৩৫) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইব না। (৩৬) কিন্তু সেই দিনের ও সেই দন্ডের কথা কেহই জানে না, স্বর্গের দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।’’
একই ঘটনা বর্ণনায় মার্ক বলেন (মার্ক ১৩/৩০-৩২): ‘‘(৩০) আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, যে পর্যন্ত এ সমস্ত সিদ্ধ না হইবে, সে পর্যন্ত এ কালের লোকদের লোপ হইবে না। (৩১) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩২) কিন্তু সেই দিনের বা সেই দন্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না, স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।’’
তাহলে হর্ন-এর স্বীকৃতি অনুযায়ী লূকের সুসমাচার থেকে একটি পূর্ণ শ্লোক বাদ পড়ে গিয়েছে, যে শ্লোকটি পুনঃসংযোজন অত্যাবশ্যক। আর সে শ্লোকটি হলো: ‘‘কিন্তু সেই দিনের বা সেই দন্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না, স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।’’ [বাহ্যত ইচ্ছাকৃতভাবেই এ শ্লোকটি লূকের সুসমাচার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ এ শ্লোকটি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, যীশুখৃস্ট ঈশ্বর ছিলেন না বা ঈশ্বরের সত্ত্বার অংশ ছিলেন না। আর এজন্যই একইরূপ জালিয়াতি করা হয়েছে মথির বর্ণনার ক্ষেত্রে। ‘‘পুত্রও জানেন না’’ কথাটুকু ফেলে দেওয়া হয়েছে; যেন যীশুর ঈশ্বরত্ব দাবি করার কোনো বাধা না থাকে। কিং জেমস ভার্সন বা অথরাইজড ভার্সন (KJV/AV)-এ এ শ্লোকটি নিম্নরূপ: (But of that day and hour knoweth no man, no, not the angels of heaven, but my Father only)। এখানে ‘‘পুত্রও না (neither the Son)’’ কথাটি ফেলে দেওয়া হয়েছে। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্সনে কথাটি সংযোজন করা হয়েচে।]
১৬- ইয়াহূদী ও খৃস্টানগণের বিদ্বেষপ্রসূত বিকৃতি:
মথিলিখিত সুসমাচারের ২য় অধ্যায়ের ২৩ শ্লোকটি নিম্নরূপ: ‘‘এবং নাসরৎ নামক নগরে গিয়া বসতি করিলেন; যেন ভাববদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন।’’
‘‘যেন ভাববাদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন’’- এই কথাগুলি মথির সুসমাচারের অন্যতম ভুল। কারণ ভাববাদিগণের নামে প্রচলিত ও পরিচিত পুরাতন নিয়মের কোনো পুস্তকেই এ কথাটি নেই। এখানে দুটি বিষয়ের একটি স্বীকার করতেই হবে। হয় খৃস্টানগণ ইয়াহূদীদের প্রতি বিরোধিতা ও বিদ্বেষের কারণে এ বাক্যগুলি তাদের সুসমাচারের মধ্যে সংযোজন করেছেন ইয়াহূদীদের বিকৃতি প্রমাণ করতে। তাহলে তা সংযোজনজনিত বিকৃতি বলে গণ্য হবে। অথবা ইয়াহূদীগণ তাদের ভাববাদিগণের পুস্তক থেকে এ কথাগুলি মুছে দিয়েছেন খৃস্টানদেরকে বিভ্রান্ত প্রমাণ করতে। এক্ষেত্রে তা বিয়োজন জনিত বিকৃতি বলে গণ্য হবে।
এখানে প্রাচীন খৃস্টান ধর্মগুরু ও পণ্ডিত ‘‘ক্রীযস্টম (John Chrysostom: 347–407) ও অন্যান্য খৃস্টান পণ্ডিতগণ দাবি করেছেন যে, মথির উদ্ধৃত এ কথাটি যে সকল পুস্তকে বিদ্যমান ছিল সে সকল পুস্তক সব বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভাববাদিগণের অনেক পুস্তক হারিয়ে ও বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ, ইয়াহূদীগণ তাঁদের অবহেলার কারণে- বরং তাঁদের ধর্মহীনতা ও অসততার কারণে- অনেক পুস্তক হারিয়ে ফেলেছে। কিছু পুস্তক তাঁরা ছিড়ে ফেলেছে এবং কিছু পুস্তক তাঁরা পুড়িয়ে ফেলেছে। তাঁরা যখন দেখলেন যে, যীশুর প্রেরিত শিষ্যগণ এ সকল পুস্তকের কথা দিয়ে খৃস্টধর্মের বিভিন্ন বিষয় প্রমাণ করছেন, তখন তাঁরা যীশুর পক্ষের প্রমাণ বিনষ্ট করতে এ কাজ করেন। এ থেকে জানা যায় যে, মথি যে সকল পুস্তক থেকে এ কথাটি উদ্ধৃত করেছেন ইয়াহূদীরা সে পুস্তকগুলি বিনষ্ট করে ফেলেছে।
‘‘এজন্য ট্রিফোনের (Tryphon) সাথে বিতর্কের সময় জাস্টিন (Justin) [দ্বিতীয় খৃস্টীয় শতাব্দীর একজন প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু ও দার্শনিক। ইহূদী ট্রিফোন খৃস্টান ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। জাস্টিন তাকে পত্র লিখেন। দেখুন: Eusebius Pamphilus, The Ecclesiastical History, p 135, 150-155.] বলেন: ‘ইয়াহূদীরা পুরাতন নিয়ম থেকে অনেক পুস্তক বাদ দিয়েছে, যেন প্রকাশ পায় যে, নতুন নিয়মের কথাবার্তা পুরাতন নিয়মের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
খৃস্টান গবেষকগণের এ সকল বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, এরূপ বিকৃতি সেযুগে খুবই সহজ ছিল। শুধু ধর্মীয় শত্রুতা ও মতপার্থক্যের কারণে কিভাবে ইয়াহূদীরা এ সকল ধর্মগ্রন্থ ছিড়ে, পুড়িয়ে বা নষ্ট করে ফেলল এবং পুস্তকগুলিকে বিনষ্ট করার ফলে কিভাবে সেগুলি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল! বিয়োজনের মাধ্যমে বিকৃতির এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় তাঁদের প্রবৃত্তির তাড়নায় অথবা অন্য একটি ধর্মের বিরোধিতার জন্য ঈশ্বরের বাণী ও ঐশ্বরিক প্রেরণা-লব্ধ কিছু পুস্তক একেবারে গুম করে দিলেন! এত বড় বিকৃতি কি আর হতে পারে?
ইয়াহূদীরা যদি খৃস্টধর্মের অসারতা প্রমাণের জন্য নিজেদের ধর্মগ্রন্থ বিকৃতি করতে বা গুম করে দিতে পারে এবং খৃস্টানরা যদি ইয়াহূদীদের বিরোধিতার জন্য নিজেদের ধর্মগ্রন্থে বিকৃতি করতে পারে তাহলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াত বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণীগুলি বিনষ্ট বা বিকৃত করা কি তাদের জন্য অসম্ভব বিষয়? বরং ইসলাম, মুসলিম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতায় তাদের যে উগ্রতা তাতে আমরা জোর দিয়েই দাবি করতে পারি যে, মুসলিমদের পক্ষে যে সকল পুস্তক বা কথাবার্তা ছিল সেগুলিও তাঁরা এভাবে বিনষ্ট বা বিকৃত করেছেন। কোনো যুক্তি, বিবেক বা লিখিত প্রমাণ কি এ দাবির বিরোধিতায় পেশ করা যাবে??
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/612/20
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।