hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সংক্ষেপিত ইযহারুল হক্ক

লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আহমদ আব্দুল কাদির মালকাবী

৪৭
৩. ১. ১. ১. অলৌকিক ভাষাশৈলী
কুরআনের অলৌকিকত্ব ও আল্লাহর বাণীত্বের (Divinity, Divine Authority) একটি প্রমাণ হলো, কুরআনে সর্বত্র ভাষা ও বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাহিত্য মান রক্ষা করা হয়েছে। [মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করার প্রধান মাধ্যম হলো কথা। কথা যত সুন্দর হয় মানুষের হৃদয়ে তার প্রভাবও তত গভীর হয়। কুরআন কারীম শুধু ধর্মগুরুদের জন্য ‘নিয়ম পুস্তক’ নয়। বরং প্রত্যেক বিশ্বাসী ও প্রত্যেক মানুষের পাঠের, শ্রবণের ও অনুধাবনের জন্য এই গ্রন্থ। এজন্য কুরআন কারীমে সকল বিষয়ে ভাব ও ভাষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাহিত্যমান রক্ষা করা হয়েছে। এটিই কুরআন কারীমের একমাত্র অলৌকিকত্ব নয়, তবে তার অলৌকিকত্বের একটি দিক। লক্ষণীয় যে, এটি কুরআন কারীমের একক বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থে এই বৈশিষ্ট পাওয়া যায় না। সকল ধর্মগ্রন্থেই ভালভাল বিষয় আলেচিত হয়েছে, যেগুলি পাঠ করলে বিষয় ও অর্থ মানুষের মন নাড়া দিতে পারে। তবে অর্থের পাশাপাশি শব্দ, বাক্য ও ভাষাশৈলীর মাধুর্য ও হৃদয়গ্রাহিতা কুরআনের বৈশিষ্ট্য।] আরবীতে এই সর্বোচ্চ সাহিত্য মানকে ‘বালাগাত’ বলা হয়। এর অর্থ হলো, আকর্ষণীয় সর্বোত্তম শব্দের মাধ্যমে প্রয়োজীনয় অর্থের প্রকাশ ঘটানো এবং প্রত্যেক বিষয়ের জন্য তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা। এভাবে শব্দের সৌন্দর্য, অর্থের মহত্ব ও বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য যত গভীর ও পরিপূর্ণ হয় ‘বালাগাত’-এর মানও তত পূর্ণতা পায়। বিভিন্নভাবে কুরআনের এই সর্বোচ্চ সাহিত্যমান জানা যায়:

(ক) প্রথম দিক: বিষয়বস্তুর নতুনত্ব ও সাহিত্যিক উচ্চাঙ্গতা

আরব ও অনারব কবি-সাহিত্যিকগণের সাহিত্যিক পারঙ্গমতা বা বালাগাত সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে বর্ণনার ক্ষেত্রে। উট, ঘোড়া, নারী, রাজা, তরবারীর আঘাত, তীর নিক্ষেপ, যুদ্ধক্ষেত্র, আক্রমন ইত্যাদির বর্ণনায় আরবগণ সবচেয়ে বেশি পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে সাহিত্য ও অলঙ্কারের ক্ষেত্র খুবই প্রশস্ত। কারণ অধিকাংশ মানুষের প্রকৃতি এরূপ বর্ণনা পছন্দ করে। প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন দেশে কবি ও সাহিত্যিকগণ এ সকল বিষয়ে নতুন নতুন অর্থ উদ্ভাবন করেছেন। পরবর্তী কবি সাহিত্যিকগণ সাধারণত এ বিষয়ে পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের থেকে ভাব ও ভাষা গ্রহণ করেন। যদি কোনো বুদ্ধিমান ও মেধাবী মানুষ কোনো একটি বিষয়ে সাহিত্যিক যোগ্যতা অর্জন করার মানসে দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে পূর্ববর্তী কবি সাহিত্যিকদের রচনা পাঠ ও চর্চা করেন তবে ক্রমান্বয়ে তিনি এ বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করেন।

কুরআন মূলত এ সকল কাব্যিক বা সাহিত্যিক কোনো বিষয়ের বর্ণনায় রচিত নয়, সেহেতু এ গ্রন্থে সাহিত্যিক মান রক্ষিত না হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। অথচ বাস্তবে কুরআনে সর্বোচ্চ সাহিত্যমান রক্ষা করা হয়েছে। এতে বুঝা যায়, কোনো মানবীয় চর্চা বা চেষ্টার ফলে নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিকভাবেই এর সাহিত্যিক ও আলঙ্কারিক মান রক্ষা করা হয়েছে।

(খ) দ্বিতীয় দিক: সত্যনিষ্ঠা ও সাহিত্যিক উচ্চাঙ্গতা

সাহিত্যের উচ্চাঙ্গতার সাথে কল্পনা ও মিথ্যা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যে কোনো কবি বা সাহিত্যিক যদি মিথ্যা বর্জন করে শুধু সত্যের মধ্যে নিজের সাহিত্যকর্ম আবদ্ধ রাখেন তবে তার সাহিত্যমানের অবনতি ঘটে। এরূপ সাহিত্য উন্নত সাহিত্য বলে গণ্য হয় না। এজন্য আরবী সাহিত্যে বলা হয়: ‘সবচেয়ে সুন্দর কাব্য যা সবচেয়ে বেশি মিথ্যা।’ কিন্তু কুরআন এর সম্পুর্ণ ব্যতিক্রম। মহান আল্লাহ কুরআনে সকল ক্ষেত্রে সত্যনিষ্ঠা বজায় রেখেছেন এবং মিথ্যা সর্বোতভাবে পরিহার করেছেন। সকল প্রকার মিথ্যা, অতিরঞ্জন ও বাড়িয়ে বলা থেকে বিমুক্ত থাকা সত্ত্বেও কুরআনের সর্বোচ্চ সাহিত্যমান অক্ষুন্ন রয়েছে।

(গ) তৃতীয় দিক: সর্বব্যাপিতা

মানবীয় উচ্চাঙ্গ সাহিত্য কর্মের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, একটি বৃহৎ কাব্যের মধ্যে হয়ত একটি দুইটি পংক্তি উচ্চমানের সাহিত্যকর্ম বলে গণ্য হয়। বাকি পংক্তিগুলি সাধারণ মানের হয়। পক্ষান্তরে কুরআনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, যত বৃহৎ বা দীর্ঘ কাহিনী বা বর্ণনাই হোক, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাহিত্যমান রক্ষা করা হয়েছে, যা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। কেউ যদি সূরা ইউসূফ নিয়ে একটু চিন্তা করেন তবে দেখতে পাবেন যে, এই দীর্ঘ সূরাটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই পর্যায়ের সাহিত্যিক ও আলঙ্কারিক মান রক্ষা করা হয়েছে।

(ঘ) চতুর্থ দিক: পুনরাবৃত্তির উচ্চাঙ্গতা

কোনো কবি বা সাহিত্যিক যদি কোনো বিষয় বা গল্প পুনরাবৃত্তি করেন তবে প্রথম বর্ণনা ও দ্বিতীয় বর্ণনার মধ্যে সাহিত্য মানের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। পক্ষান্তরে কুরআন কারীমে নবীগণের কাহিনী, সৃষ্টি ও পুনরুত্থানের কাহিনী, ধর্মীয় বিধিবিধান, আল্লাহর গুণাবলির বিবরণ বিভিন্ন স্থানে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কোথাও দীর্ঘ এবং কোথাও সংক্ষেপ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বর্ণনার শব্দ, বাক্য, ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনয়ন করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা দেখি যে, সকল বর্ণনায় চূড়ান্ত সাহিত্যমান রক্ষা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানের বর্ণনার মধ্যে সাহিত্যিক মানের কোনো কমবেশি লক্ষ্য করা যায় না।

(ঙ) পঞ্চম দিক: অসাহিত্যিক বিষয়ের সাহিত্যিকতা

কুরআনের আলোচ্য বিষয় মূলত উপাসনা-আরাধনা বা ইবাদত বন্দেগির নির্দেশ দেওয়া, অশ্লীল, অন্যায় ও গর্হিত কাজ নিষিদ্ধ করা, উত্তম আচরণ, লোভমুক্ত জীবন ও আখিরাতমুখিতার উৎসাহ প্রদান। এ ধরনের বিষয়ে সাহিত্যিকের সাহিত্যিক পারঙ্গমতা পরিদর্শনের সুযোগ খুবই সীমিত। কোনো সুপ্রসিদ্ধ ভাষার যাদুকর কবি বা সাহিত্যিককে যদি বলা হয়, তুমি উচ্চাঙ্গের উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও ভাষার অলঙ্কার দিয়ে দশটি ফিক্হী বিষয়ে অথবা ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে প্রবন্ধ লিখ, তাহলে তিনি তাতে পুরোপুরি সক্ষম হবেন না। পক্ষান্তরে কুরআন এই অসাহিত্যিক বিষয়গুলিতেই সর্বোচ্চ সাহিত্যমান রক্ষা করেছে।

(চ) ষষ্ঠ দিক: বিষয়বস্তুর বৈচিত্রময়তা ও সাহিত্যিক উচ্চাঙ্গতা

কোনো কবি বা সাহিত্যিক একাই সাহিত্যের সকল বিষয়ে পারঙ্গমতা দেখাতে পারেন না। প্রত্যেকেই একটি বিশেষ বিষয়ে ভাল করেন, বাকি বিষয়গুলিতে অত ভাল করতে পারেন না। পক্ষান্তরে কুরআনে সকল বিষয়েই সর্বোচ্চ সাহিত্যমান রক্ষিত হয়েছে। উদ্দীপনা প্রদান, ভয় প্রদর্শন, উপদেশ, শাসন ইত্যাদি সকল বিষয়েই আমরা তা দেখতে পাই। এখানে নমুনা হিসেবে কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। [স্বভাবতই আরবী পাঠের সাহিত্যিক মান, শব্দ প্রয়োগ ও ভাষাশৈলীর প্রভাব অনুবাদের মধ্যে রক্ষা করা যায় না। এখানে লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক বিষয়ের আলাদা ছন্দ আছে। উদ্দীপনার ছন্দ থেকে ভয়ের ছন্দ আলাদা। অনেক সময় ভাষা ভাল না বুঝলেও এই ছন্দের প্রভাব হৃদয়ে অনুভব করা যায়।]

পারলৈŠকিক জীবনের প্রতি আগ্রহ প্রদান করে কুরআনে বলা হয়েছে: ‘‘কেউই জানে না তাদের জন্য নয়ন-প্রীতিকর কী লুক্কায়িত রাখা হয়েছে।’’ [সূরা : ৩২ সাজদা, ১৭ আয়াত।]

ভয় প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এক স্থানে বলা হয়েছে: ‘‘তারা বিজয় কামনা করল এবং প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী ব্যর্থ মনোরথ হল। তাদের প্রত্যেকের পিছনে রয়েছে জাহান্নাম এবং প্রত্যেককে পান করান হবে গলিত পুঁজ। যা সে অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করবে কিন্তু তা গলাধঃকরণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। সবদিক থেকে তার কাছে মৃত্যু আসবে, কিন্তু তার মৃত্যু ঘটবে না এবং সে কঠোর শাস্তি ভোগ করতেই থাকবে।’’ [সূরা : ১৪ ইবরাহীম, ১৫-১৭ আয়াত।]

শাসন ও নিন্দাবাদের অর্থে একস্থানে বলা হয়েছে: ‘‘তাদের প্রত্যেককেই আমি তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছিলোম প্রস্তরসহ প্রচন্ড ঝটিকা, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি প্রোথিত করেছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো যুলুম করেন নি; কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করেছিল।’’ [সূরা: ২৯ আনকাবূত, ৪০ আয়াত।]

ওয়ায-উপদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ‘‘তুমি বল তো, যদি আমি তাদেরকে দীর্ঘকাল ভোগ-বিলাস করতে দেই, এবং পরে তাদেরকে যে বিষয়ে সাবধান করা হয়েছিল তা তাদের নিকট এসে পড়ে, তখন তাদের ভোগ বিলাস তাদের কোনো কাজে আসবে কি?’’ [সূরা: ২৬ শু‘আরা, ২০৫-২০৭ আয়াত।]

আল্লাহর গুণবর্ণনায় বলা হয়েছে: ‘‘আল্লাহ অবগত আছেন প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং জরায়ূতে যা কিছু কমে ও বাড়ে এবং তাঁর বিধানে প্রত্যেক বস্ত্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। যা অদৃশ্য ও যা দৃশ্যমান তিনি তা অবগত। তিনি মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।’’ [সূরা: ১৩ রা’দ, ৮-৯ আয়াত।]

(ছ) সপ্তম দিক: বিষয় পরিবর্তন ও সাহিত্যিকতা

মানবীয় কথায়, গল্পে, কাব্যে বা আলোচনায় যখন বিষয় পরিবর্তন করা হয় বা অনেক বিষয় আলোচনা করা হয় তখন বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক রক্ষা কঠিন হয়। এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে গমনের ক্ষেত্রে ভাষার গতিশীলতা বা কাব্যের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। এতে সাহিত্যকর্মের সাহিত্যিক ও আলঙ্কারিক মান ক্ষুণ্ণ হয়।

কুরআনে অতি সীমিত পরিসরে বহু বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। এক কাহিনী থেকে অন্য কাহিনী বা এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে যাওয়া হয়েছে। আদেশ, নিষেধ, সংবাদ, জিজ্ঞাসা, সুসংবাদ, শাস্তির সংবাদ, নবুয়ত প্রমাণ, আল্লাহর একত্ব প্রমাণ, আল্লাহর গুণাবলির একত্ব আলোচনা, উদ্দীপনা প্রদান, ভয় প্রদর্শন, উদাহরণ উল্লেখ, কাহিনী বর্ণনা ইত্যাদি অনেক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এগুলির মধ্যে ভাষাশৈলীর ধারাবাহিকতা ও সর্বোচ্চ সাহিত্য ও আলঙ্কারিক মান রক্ষা করা হয়েছে। আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণ যা দেখে হতবাক হয়ে যায়।

(জ) অষ্টম দিক: সংক্ষেপায়িত ব্যাপকতা

অধিকাংশ স্থানে কুরআনের বাক্যাবলি অল্প শব্দে ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে। শ্রুতিমধুর সুন্দর কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ ও ভাবের আবহ তৈরি করা হয়। নমুনা হিসেবে আমি পাঠককে কুরআনের ৩৮ নং সূরা, সূরা ‘সাদ’ পাঠ করতে অনুরোধ করছি। সূরাটির শুরুতেই অবিশ্বাসীদের সংবাদ, তাদের চরিত্র, আচরণ, অবিশ্বাসের কারণে পূর্ববর্তী জাতিগুলির ধ্বংসের সংবাদ, আরবের কাফিরগণ কর্তৃক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবিশ্বাস করার কথা, তাঁর প্রচারিত একত্ববাদের বিষয়ে তাদের বিস্ময় প্রকাশ, অবিশ্বাসের বিষয়ে তাদের ঐকমত্যের কথা, তাদের কথায় হিংসার প্রকাশ, তাদের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতার কথা, পৃথিবীতে ও পুনরুত্থানের পরে তাদের লাঞ্ছনার আগাম সংবাদ, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে অবিশ্বাসের প্রবণতা, আল্লাহ কর্তৃক অবিশ্বাসীদের শাস্তি প্রদান, কুরাইশ ও অন্যান্য অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে অনুরূপ পরিণতির ভীতি প্রদর্শন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ধৈর্য ধারণে উৎসাহ প্রদান, পূর্বের বিষয়গুলির মাধ্যমে তাঁকে সান্ত্বনা প্রদান... ইত্যাদি অনেক বিষয় অত্যন্ত চিত্তাকর্ষণীয় সুন্দর কয়েকটি মাত্র বাক্যে বিদ্ধৃত হয়েছে। এরপর দাঊদ, সুলাইমান (শলোমন), ইবরাহীম (অবরাহাম), ইয়াকূব (যাকোব) ও অন্যান্য পূর্ববর্তী নবীর জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে। আর সবকিছুই সম্পন্ন করা হয়েছে ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত কিছু বাক্যের মাধ্যমে।

কুরআনের একটি বাক্য লক্ষ্য করুন: ‘‘কিসাসের মধ্যে (হত্যার অপরাধে মৃত্যুদন্ডের বিধানে) তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে।’’ [সূরা: ২ বাকারা, ১৭৯ আয়াত।]

এ বাক্যটির মধ্যে সামান্য কয়েকটি শব্দ রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ ব্যাপক। ব্যাপক অর্থবোধক ও সাহিত্যিক মানসম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে এই বাক্যে রয়েছে শাব্দিক অলঙ্করণ, যাতে মৃত্যু ও জীবনকে একটি ছোট্ট বাক্যে পরস্পরের মুখোমুখি রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে মৃত্যু হলো জীবনের পরিসমাপ্তি, সেই মৃত্যুর মধ্যে জীবন নিহিত থাকার কথা বলে এর অর্থের মধ্যে আকর্ষণীতা ও নতুনত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে।

আরবদের মধ্যে এই অর্থে অনেক বাক্য প্রবাদরূপে প্রচলিত ছিল। কুরআনের এই বাক্যটি শব্দে ও অর্থে সেগুলির চেয়ে অনেক সুন্দর ও উন্নত। এই অর্থে আরবরা বলত: ‘‘কিছু মানুষের হত্যা সকল মানুষের জীবনদান’’, ‘‘বেশি করে হত্যা কর যেন হত্যা কমে যায়’’, ‘‘হত্যা হত্যা রোধে অধিক কার্যকর’’ ইত্যাদি। আরবদের মধ্যে প্রচলিত এই তিনটি বাক্যের মধ্যে শেষ বাক্যটিই অর্থ প্রকাশের দিক থেকে সবচেয়ে সুন্দর। আর কুরআনে বাক্যটি এই বাক্যটির চেয়েও অনেক পরিশীলিত ও অধিকতর অর্থজ্ঞাপক। নিম্নের ছয়টি দিক থেকে আমরা দুইটি বাক্যের তুলনা বুঝতে পারব:

(১) উপরের চারটি বাক্যের মধ্যে কুরআনের বাক্যটিই সংক্ষিপ্ততম। বাক্যের শুরুতে (তোমাদের জন্য) কথাটি থাকলেও, মূল অর্থ মাত্র তিনটি শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে: ‘‘মৃত্যুদন্ডের মধ্যে জীবন’’। ‘‘তোমাদের জন্য’’ কথাটি অন্যান্য বাক্যের মধ্যেও অর্থের দিক থেকে সংযুক্ত ও উহ্য রয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য বাক্যে কুরআনের বাক্যের চেয়ে এক বা একাধিক শব্দ বেশি রয়েছে।

(২) ‘হত্যা হত্যা রোধে অধিক কার্যকর’ বাক্যটি দ্বারা বাহ্যত বুঝা যায় যে, উভয় হত্যাই সমান বা যে কোনো হত্যাই হত্যা রোধ করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে কুরআনের বাক্যে রোধকারী হত্যা ও রোধকৃত হত্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে। শুধু বিশেষ প্রকারের হত্যা, অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড প্রদানই হত্যা রোধ করে।

(৩) আরবদের মধ্যে প্রচলিত বাক্য তিনটির মধ্যে সর্বোত্তম বাক্যে ‘হত্যা’ শব্দটি পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআনে তা করা হয় নি। ফলে শব্দ ব্যবহারে আলঙ্কারিক মান বৃদ্ধি পেয়েছে।

(৪) আরবদের বাক্যটি থেকে বুঝা যায় যে, হত্যা শুধু হত্যাই রোধ করে। পক্ষান্তরে কুরআনের বাক্যটি থেকে বুঝা যায় যে, কিসাস হত্যা, আঘাত ইত্যাদি জীবনের জন্য ক্ষতিকর সকল কর্মই রোধ করে। এভাবে আমরা দেখছি যে, কুরআনের বাক্যটির অর্থ ব্যাপকতর।

(৫) হত্যা রোধের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হলো, জীবন রক্ষা করা। আরবীয় বাক্যটি থেকে জীবন রক্ষার বিষয়টি সরাসরি বুঝা যায় না, বরং শুধু হত্যা রোধ করার বিষয়টিই বুঝা যায়। পক্ষান্তরে কুরআনের বাক্যটি থেকে জীবন রক্ষার বিষয়টি সরাসরি বুঝা যায়।

(৬) আরবীয় বাক্যটির অর্থ বিভ্রান্তিকর। বাক্যটি থেকে মনে হতে পারে যে, যে কোনো হত্যা হত্যা রোধ করে। যুলূম, অন্যায় বা বিনা বিচারে হত্যাকেও ‘হত্যা’ বলা হয়। এরূপ হত্যা কখনোই হত্যা রোধ করে না, বরং হত্যার প্রসার ঘটায়। আরবীয় বাক্যটি ভাল অর্থে বলা হলেও বাক্যটি থেকে ভুল বুঝার বা ভুল অর্থে ব্যবহারের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআনের বাক্যটি পরিপূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক অর্থ জ্ঞাপক।

(ঝ) নবম দিক: গাম্ভীর্য, শ্রুতিমধুরতা ও বিনম্রতার সমন্বয়

শব্দের গাম্ভীর্য-দৃঢ়তা এবং তার শ্রুতিমধুরতা ও বিনম্রতা মূলত দুটি পরস্পর বিরোধী গুণ। মানবীয় সাহিত্যকর্মে দুটি দিক একত্রিত করা কষ্টকর। বিশেষত কথা লম্বা হলে তাতে ব্যবহৃত সকল শব্দের ক্ষেত্রে এই দুটিগুণ সর্বদা রক্ষা করা মানবীয় অভ্যাসের ঊর্ধ্বে। কুরআনের সকল ক্ষেত্রে এ দুটি গুণ সমানভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনে সাহিত্য মান অলৌকিক।

(ঞ) দশম দিক: আরবী ভাষালঙ্কারের সামগ্রিক প্রয়োগ

কুরআনে অলঙ্কারশাস্ত্রের সকল শিল্প প্রয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বায়ন, রূপক, তুলনা, উৎপ্রেক্ষা, রূপালঙ্কার, শুরুর সৌন্দর্য, সমাপ্তির সৌন্দর্য, বাক্যশেষের সৌন্দর্য, অগ্রবর্তীকরণ, স্থানান্তরকরণ, প্রয়োজন অনুসারে বাক্যসমূহের সংযোজন, বিভাজন ইত্যাদি সকল আলঙ্কারিক শিল্প কুরআনের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। দুর্বল, শ্রুতিকটু, অপ্রচলিত, ব্যবহারের অনুপযুক্ত বা বাজে শব্দ থেকে তা পরিপূর্ণ মুক্ত। কোনো ভাষার যাদুকর আরব সাহিত্যিকও সবগুলি বিষয় একত্রিত করতে পারবেন না। বরং তার সাহিত্য কর্মে হয়ত দুএকটি শিল্প তিনি প্রয়োগ করতে পারবেন। কেউ যদি কোনো বড় সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে এগুলির সন্ধান করেন তবে সামান্য কিছু শৈল্পিক বিষয় তিনি খুঁজে পাবেন। পক্ষান্তরে কুরআনে সব বিষয়ই রয়েছে।

উপরে দশটি বিষয় উল্লেখ করলাম। এ বিষয়গুলি প্রমাণ করে যে, কুরআন সর্বোচ্চ পর্যায়ের শৈল্পিক ও সাহিত্যিক মান সংরক্ষণ করেছে, যা মানুষের জন্য অস্বাভাবিক ও অলৌকিক। আরবী সাহিত্যিকগণ তাদের স্বভাবজাত বিচারবুদ্ধি দিয়ে তা বুঝতে পারেন। অন্যান্য ধর্মের পণ্ডিতগণও ভাষার অলঙ্কার ও সাহিত্যে তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তা অনুধাবন করতে পারেন। আরবী ভাষা, সাহিত্য, অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে যার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যত বেশি হবে, তিনি তত বেশি কুরআনের অলৌকিক ভাষা শৈলী অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন