মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয়েছে। এগুলির সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। এগুলির মধ্যে রয়েছে:
(১) ইসরা ও মি’রাজ: অলৌকিকভাবে রাত্রিভ্রমন ও ঊর্ধ্বগমন
মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন: ‘‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদুল হারাম (মক্কার মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (যিরূশালেমের মসজিদ) পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।’’ [সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল), ১ আয়াত।]
এ আয়াত এবং বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করেন। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে তা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত। উপরন্তু এই আয়াতটিও তা প্রমাণ করে। কারণ ‘বান্দা’ বলতে কুরআনে সর্বত্র আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। এছাড়া আমরা জানি যে, কাফিরগণ ইসরা ও মি’রাজ (নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহ) অস্বীকার করে এবং একে অসম্ভব বলে দাবি করে। এছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিরাজের কথা বললেন তখন কতিপয় দুর্বল ঈমান মুসলিম একে অসম্ভব মনে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়তের বিষয়ে সন্দীহান হয়ে ইসলাম পরিত্যাগ করে। এ থেকে নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত অবস্থায় দৈহিকভাবে মিরাজ সংঘটিত হওয়ার কথাই বলেছিলেন। নইলে কাফিরদের অস্বীকার করার ও দুর্বল ঈমান মুসলিমদের ঈমান হারানোর কোনো কারণই থাকে না। স্বপ্নে এরূপ নৈশভ্রমন বা স্বর্গারোহণ কোনো অসম্ভব বা অবাস্তব বিষয় নয় এবং এরূপ স্বপ্ন দেখার দাবি করলে তাতে অবাক হওয়ার মত কিছু থাকে না। যদি কেউ দাবি করে যে, ঘুমের মধ্যে সে একবার পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে এবং একবার পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চলে গিয়েছে, তবে তার দেহ স্বস্থানেই রয়েছে এবং দৈহিক অবস্থার পরিবর্তন হয় নি, তবে কেউ তার এরূপ স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা অস্বীকার করবে না বা এতে অবাকও হবে না।
জ্ঞান, বিবেক বা মানবীয় বুদ্ধির দৃষ্টিতে এবং ধর্মগ্রন্থাবলির নির্দেশনার আলোকে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরের এরূপ অলৌকিক নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়।
জ্ঞান, যুক্তি ও বিবেকের দৃষ্টিতে তা অসম্ভব নয় এজন্য যে, এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা সকল যৌক্তিক ও বিবেকগ্রাহ্য কাজ করতে সক্ষম। অতিদ্রুতগতিতে কোনো প্রাণী বা জড় পদার্থকে স্থানান্তর করা জ্ঞান-বিবেকের দৃষ্টিতে অসম্ভব নয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে স্থানান্তর করা একটি যৌক্তিক ও সম্ভব বিষয় যা আল্লাহ করতে পারেন। [গ্রন্থকারের যুগে আলোর গতি, সময় ও স্থান সম্পর্কে আধুনিক তথ্যাদি আবিষ্কৃত না হওয়ায় তাকে শুধু সম্ভাবনার কথাই বলতে হয়েছে। পরবর্তী বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কার মিরাজের সত্যতা প্রমাণিত করেছে।] শুধু এতটুকু বলা যায় যে, বিষয়টি অসম্ভব নয়, তবে অস্বাভাবিক বা সাধারণ নিয়মের বাইরে। সকল অলৌকিক কর্মই অস্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক বলেই তো অলৌকিক চিহ্ন বলে গণ্য করা হয়।
ধর্মগ্রন্থাদির নির্দেশনার আলোকেও তা অসম্ভব নয়। ইয়াহূদী-খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, মানুষের জন্য সশরীরে বা জড় দেহ সহ ঊর্ধ্বলোকে বা স্বর্গে গমন সম্ভব।
(ক) আদিপুস্তক ৫/২৪: ‘‘হনোক (Enoch) ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিতেন। পরে তিনি আর রহিলেন না, কেননা ঈশ্বর তাঁহাকে গ্রহণ করিলেন (And Enoch walked with God: and he was not; for God took him)।’’ এভাবে বাইবেল সুস্পষ্টভাবে বলছে যে, হনোক ভাববাদী বা ইদরীস আলাইহিস সালাম-কে জীবিত অবস্থায় সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন।
(খ) ২ রাজাবলির ২ অধ্যায়ে রয়েছে: ‘‘১ পরে যখন সদাপ্রভু এলিয়কে (Elijah) ঘূর্ণবায়ুতে স্বর্গে তুলিয়া লইতে উদ্যত হইলেন, তখন এলিয় ও ইলীশায় (Elisha) গিল্গল হইতে যাত্রা করিলেন। ... ১১ পরে এইরূপ ঘটিল; তাঁহারা যাইতে যাইতে কথা কহিতেছেন, ইতিমধ্যে দেখ, অগ্নিময় এক রথ ও অগ্নিময় অশ্বগণ আসিয়া তাঁহাদিগকে পৃথক করিল, এবং এলিয় ঘূর্ণবায়ুতে স্বর্গে উঠিয়া গেলেন।’’ এখানেও বাইবেল সুস্পষ্টভাবে বলছে যে, এলিয় জীবিত অবস্থায় স্বর্গে উত্থিত হয়েছেন।
এ দুটি বক্তব্য খৃস্টান পাদরীগণের নিকট ঈশ্বরের বাণী ও অভ্রান্ত সত্য হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়া তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, যীশু খৃস্ট ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার তিনদিন পরে পুনরুত্থিত হন এবং সশরীরে স্বর্গে গমন করেন এবং তার পিতার দক্ষিণে বসেন। কাজেই জ্ঞান, বিবেক, যুক্তি বা ধর্মের দোহাই দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মি’রাজ অস্বীকার করার কোনো সুযোগ পাদরিগণের নেই।
(২) চন্দ্র খন্ডিত করা
মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন: ‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা কোনো নিদর্শন (অলৌকিক চিহ্ন) দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এ তো চিরাচরিত যাদু।’’ [সূরা কামার, ১-২ আয়াত।]
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইঙ্গিতে চন্দ্র বিদীর্ণ ও খন্ডিত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ক হাদীসগুলি ‘মুতাওয়াতির’ বা অতি-প্রসিদ্ধ ভাবে বর্ণিত। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে হাদীসগুলি সংকলিত। [বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা), আনাস ইবনু মালিক (রা), জুবাইর ইবনু মুতয়িম (রা) ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এই ৬ জন সাহাবী থেকে প্রায় ২০টি পৃথক সনদে এ বিষয়ক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।]
কুরআনে উল্লিখিত ও মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এই অলৌকিক চিহ্ন পাদরিগণ অস্বীকার করতে চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী বিভ্রান্তি হলো, চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি সত্যই ঘটতো, তবে পৃথিবীর কারো কাছেই তা অজ্ঞাত থাকত না এবং বিশ্বের ঐতিহাসিকগণ তা উল্লেখ করতেন।
এ বিভ্রান্তির অপনোদনে আমাদের বক্তব্য এই যে, পাদরিগণের এ মহাযুক্তি এবং সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণটি ধর্মগ্রন্থাদির নির্দেশনার আলোকে অত্যন্ত দুর্বল এবং জ্ঞান-বিবেক ও যুক্তির আলোকেও অত্যন্ত দুর্বল। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(ক) বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে নোহের জলপ্লাবন ছিল বিশ্বব্যাপী এবং অত্যন্ত বড় ঘটনা। আদিপুস্তকের ৭ম ও ৮ম অধ্যায়ে তা উল্লেখ করা হয়েছে। [বাইবেলের বিবরণ অনুসারে ইহূদী-খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, এ মহাপ্লাবন এখন (২০০৯ সাল) থেকে মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বৎসর পূর্বে সংঘটিত হয়।] অথচ ভারতী, পারসীয়, কালদীয় (Chaldeans) ও চীনা ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ এ ঘটনা কঠিনভাবে অস্বীকার করেন; কারণ তাদের ইতিহাসগ্রন্থে এর কোনোরূপ উল্লেখ নেই। পাদরিগণের স্বজাতি ইউরোপীয় নাস্তিকগণ এই মহাজলপ্লাবনের কথা অস্বীকার করেন এবং এ বিষয়ক বাইবেলীয় বর্ণনা নিয়ে উপহাস করেন।
খৃস্টান পাদরিগণ কি এসকল দেশের পণ্ডিতদের অস্বীকার বা ইউরোপীয় নাস্তিকদের উপহাসের কারণে নোহের প্লাবনের কথা অস্বীকার করবেন বা একে অবাস্তব ও অসম্ভব বলে মেনে নিতে রাজি হবেন?
(খ) যিহোশূয়ের পুস্তকের ১০ অধ্যায়ের ১২-১৩ শ্লোকে যিহোশূয় (Joshua) ভাববাদীর যুদ্ধ জয়ের জন্য পূর্ণ একদিন সূর্যকে মধ্যগগণে আটকে রাখার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। (আর আকাশের মধ্যস্থানে সূর্য স্থির থাকিল, অস্ত গমন করিতে প্রায় সম্পূর্ণ এক দিবস অপেক্ষা করিল (So the sun stood still in the midst of heaven, and hasted not to go down about a whole day)। ইয়াহূদী-খৃস্টান পণ্ডিত ও বাইবেল ব্যাখ্যাকারগণ উল্লেখ করেছেন যে, পূর্ণ ২৪ ঘন্টা সূর্য মধ্যগগণে থেমে থাকে। এ ঘটনাটি খুবই বড় ঘটনা। খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, খৃস্টের জন্মের ১,৪৫০ বৎসর পূর্বে এই ঘটনা ঘটে। যদি তা সত্যিই ঘটে থাকত, তবে বিশ্বের সকলের জন্যই তা প্রকাশ পেত। এ কথা তো স্পষ্ট যে, গভীর মেঘ থাকলেও এই ঘটনা কারো অজ্ঞাত থাকে না। আবার দূরত্বের কারণেও তা না জানার কোনো সুযোগ নেই। এ সময়ে যে সকল দেশে রাত ছিল সে সকল দেশের মানুষেরাও বিষয়টি নিশ্চিত জানতেন; কারণ কোথাও যদি ২৪ ঘন্টা রাত দীর্ঘায়িত হয় তবে তা তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে এবং তারা সকলেই তা জানবেন। অথচ এত বড় ঘটনাটি ভারতের হিন্দুদের কোনো গ্রন্থে লিখিত হয় নি। চীন ও পারস্যের মানুষেরাও তা জানতে পারে নি। আমি ভারতীয় হিন্দু পণ্ডিতদেরকে এই বিষয়টি অস্বীকার করতে শুনেছি। তারা বলেন যে, ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ভিত্তিহীন ও বাতুল। পাদরিগণের স্বজাতি ইউরোপীয় নাস্তিকগণ এই ঘটনা অস্বীকার করেন এবং এ নিয়ে উপহাস করেন। তারা এ বিষয়ক বাইবেলীয় বর্ণনার বিষয়ে বিভিন্ন আপত্তি উত্থাপন করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, কোনো ইতিহাসে উল্লেখ না থাকা, বিশ্বের কোনো মানুষের না জানা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের এ ঘটনাটি অস্বীকার করা এবং পাশ্চাত্য নাস্তিকদের উপহাস ও আপত্তির কারণে কি এ ঘটনাকে অবাস্তব, মিথ্যা ও বাতুল বলে মানতে খৃস্টান পাদরিগণ রাজি হবেন?
(গ) মথিলিখিত সুসমাচারের ২৭ অধ্যায়ে রয়েছে: ‘‘৫১ আর দেখ, মন্দিরের তিরস্করিণী (veil) উপর হইতে নিচ পর্যনত চিরিয়া দুইখান হইল, ভূমিকম্প হইল, ও শৈল সকল বিদীর্ণ হইল, ৫২ এবং কবর সকল খুলিয়া গেল, আর অনেক নিদ্রাগত পবিত্র লোকের দেহ উত্থাপিত হইল (many bodies of the saints which slept arose), ৫৩ এবং তাঁহার পুনরুত্থানের পর তাঁহারা কবর হইতে বাহির হইয়া পবিত্র নগরে প্রবেশ করিলেন, আর অনেক লোককে দেখা দিলেন (And came out of the graves after his resurrection, and went into the holy city, and appeared unto many) [এ কথা থেকে বুঝা যায় যে, কবর থেকে উত্থিত হওয়ার পরে তিন দিবস তারা কবরের নিকটেই বসে ছিলেন। যীশুর পুনরুত্থানের পরে তারা দল বেঁধে যিরূশালেমে প্রবেশ করে মানুষদেরকে দেখা দেন। আর যীশু গোপনে শুধু তার শিষ্যদেরকে সাক্ষাত দেন!]।
এখানে মন্দিরের গিলাফ বা পর্দা আগাগোড়া ছিড়ে যাওয়া, ভূমিকম্প হওয়া, পাথর বিদীর্ণ হওয়া, কবর খুলে যাওয়া, অনেক মৃত বুজুর্গের কবর থেকে জীবিত উঠে আসা, তাদের যিরূশালেমে প্রবেশ করা ইত্যাদি অনেক মহা আশ্চর্যকর মহান ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে মথির এ বর্ণনা মিথ্যা। তবে আমরা শুধু বলতে চাই যে, এ সকল ঘটনা কিছুই ইয়াহূদীদের ইতিহাসে ও রোমানদের ইতিহাসে উল্লেখ করা হয় নি। যোহনলিখিতি সুসমাচারেও এগুলির কোনো উল্লেখ নেই। মাক ও লূক শুধু পর্দা ছেড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। বাকি এত বড় অলৌকিক বিষয় কিছুই উল্লেখ করেন নি। অথচ তারা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর কান্নাকাটি ও চিৎকারের কথা ও অনেক গুরুত্বহীন কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ মৃতদের দল ধরে কবর থেকে উঠে আসা, যিরুশালেমে যেয়ে জনগণের সাথে দেখাসাক্ষাত করা ইত্যাদি বিষয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর পাথর ফেঁটে যাওয়া, কবর ফেঁটে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় ঘটার পরে তার চিহ্ন থেকে যায়।
অবাক বিষয় যে, এ সকল মৃত সাধু কবর থেকে পুনরুত্থিত হওয়ার পরে কি করলেন তা কিছুই মথি লিখলেন না! [খৃস্টানগণের দাবি অনুসারে পারলৌকিক মুক্তির জন্য কোনো কর্ম, সততা বা ধর্মপালন জরুরী নয়, বরং একটিমাত্র বিশ্বাস জরুরী, যে যীশু ঈশ্বরের পুত্র, তিনি মানুষের পাপের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর যীশুর আগমনের উদ্দেশ্যও ছিল এই উৎসর্গ। মুলত যীশু কোনো আদর্শ বা কর্ম শিক্ষা দিতে আসেন নি, বরং নিজেকে উৎসর্গ করে মানব জাতিকে মুক্তি দেওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। যদি যীশু একটু কষ্ট করে পুনরুত্থানের পরে এ সকল মৃত সাধুদের সাথে যিরূশালেমের সকলকে, বিশেষত পীলাত ও ইহূদীগণের সাথে সাক্ষাত করতেন তাহলে তার উৎসর্গের বিষয়টি তারা নিশ্চিতরূপে জানতেন এবং কোনোরূপ সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বের সকলেই তা জানতে পারতেন। মানুষের মুক্তি নিশ্চিত হতো! কিন্তু তা না করে তাঁরা কাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করলেন?] এ সকল সাধু বা পবিত্র মানুষ যিরূশালেমের মানুষদেরকে দেখা দেওয়ার পরে কি করলেন তা মথি লিখেন নি। তারা কি পুনরায় তাদের কবরে ফিরে গিয়েছিলেন? না কি তারা জীবিতই রয়ে গিয়েছিলেন? কোনো কোনো রসিক ব্যক্তি বলেন, সম্ভবত মথি একাই এ সকল ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ঘুমন্ত অবস্থায়!
উল্লেখ্য যে, লূকের বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, মন্দিরের তিরস্করিণী (veil) চিরে গিয়েছিল যীশুর মৃত্যুর পূর্বে। পক্ষান্তরে মথি ও মার্কের বিবরণ এর বিপরীত। এখন প্রশ্ন হলো, পাদরিগণ এ বিষয়গুলির কি উত্তর দিবেন?
(ঘ) মার্ক ১/১০-১১, মথি ৩/১৬-১৭ ও লূক ৩/২১-২২-এর যোহন বাপ্তাইজকের নিকট যীশুর বাপ্তাইজিত হওয়ার বিবরণে নিম্নের কাহিনীটি রয়েছে: ‘‘আর তৎক্ষণাৎ জলের মধ্য হইতে উঠিবার সময়ে দেখিলেন, আকাশ দুইভাগ হইল, এবং আত্মা কপোতের ন্যায় তাঁহার উপরে নামিয়া আসিতেছেন। আর স্বর্গ হইতে এই বাণী হইল, তুমিই আমার প্রিয় পুত্র, তোমাতেই আমি প্রীত।’’ এ মার্কের ভাষা, অন্যদের ভাষাও প্রায় একই।
এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রকাশ্য দিবালোকে আকাশ দুভাগ হয়ে গেল! কাজেই বিষয়টি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা থাকার কথা নয়। অনুরূপভাবে কপোতের নেমে আসা প্রত্যক্ষ করা এবং ঊধ্বাকাশ থেকে আগত বাণী বা শব্দ শ্রবণ করাও কারো একক বিষয় নয়। অন্তত উপস্থিত সকলেই তা দেখবেন ও শুনবেন। অথচ সুসমাচার লেখকগণ ছাড়া বিশ্বের আর কেউই এ সকল বিষয়ে কিছই লিখেন নি! আর এজন্যই পাশ্চাত্যের নাস্তিকগণ এ ঘটনা সম্পর্কে উপহাস করে বলেন: মথি আমাদেরকে অত্যন্ত বড় সংবাদ থেকে বঞ্চিত করেছেন। যখন আকাশের দরজা খুলে গেল, তখন কি আকাশের বড় দরজাগুলি খুলেছিল? না মাঝারি দরজাগুলি? না ছোট দরজাগুলি? আর এই দরজাগুলি সূর্যের এদিকে ছিল না ওদিকে? মথির এই ভুলের কারণে আমাদের পাদরিগণ দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মাথা নাড়াতে থাকেন। মথি আমাদের এই কপোতের সংবাদও দিলেন না! কপোতটিকে কি কেউ ধরে খাঁচায় ভরেছিল? নাকি সেটিকে তারা আবার আকাশে ফিরে যেতে &&দখেছিলেন? যদি ফিরে যেতে দেখেন, তবে বুঝতে হবে যে, আকাশের দরজাগুলি এই দীর্ঘ সময় উন্মুক্তই ছিল। তাহলে কি তারা এ সময়ে আকাশের অভ্যন্তরভাগ ভাল করে দেখে নিয়েছিলেন? পাদরিগণ এ সকল প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন?
উপরের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, চন্দ্র বিদীর্ণ করার বিষয়ে পাদরিগণের আপত্তি ভিত্তিহীন ও বাতিল।
(৩) অলৌকিকভাবে পানি বৃদ্ধি করা
বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র আঙুলগুলির মধ্য থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হয়েছে। আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, ‘‘আসরের সালাতের সময় ঘনিয়ে আসল। লোকজন অনুসন্ধান করেও ওযূর জন্য কোনো পানি যোগাড় করতে পারলেন না। তখন আমি দেখলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট একটি পাত্রে অল্প কিছু ওযূর পানি আনয়ন করা হলো। তিনি তার পবিত্র হস্ত সেই পাত্রের মধ্যে রাখেন এবং সকল মানুষকে নির্দেশ দেন সেখান থেকে ওযূ করার। তখন আমি দেখলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আঙ্গুলগুলির মধ্য দিয়ে ঝর্ণার মত পানি প্রবাহিত হচ্ছে। উপস্থিত মানুষেরা সেই পানি দিয়ে ওযূ করল। এমনকি সর্বশেষ মানুষটিও তা দিয়ে ওযূ করে নিলেন। এই মুজিযাটি সংঘটিত হয়েছিল মদীনার বাজারের নিকট যাওরা নামক স্থানে।
জাবির (রা) বলেন, হুদাইবিয়ার দিনে মানুষজন পিপাসার্ত হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট একটি ছোট্ট পাত্রে সামান্য কিছু পানি ছিল। তিনি সেই পানি দিয়ে ওযূ করলেন। তখন লোকজন তাঁর নিকট এসে বলেন, আপনার এই পাত্রের পানিটুকু ছাড়া আমাদের নিকট আর কোনো পানি নেই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হস্ত পাত্রটির মধ্যে রাখেন। এতে তাঁর আঙুলগুলির ফাঁক দিয়ে ঝর্ণার মত পানির ফোয়ারা বেরিয়ে আসতে লাগল। তখন উপস্থিত সকলেই সেই পানি পান করলেন এবং তা দিয়ে ওযূ করলেন। উপস্থিত মানুষদের সংখ্যা ছিল ১৪০০।
জাবির (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জাবির, তুমি ওযূর জন্য ঘোষণা দাও। তিনি বলেন শিবিরে কারো কাছে কোনো পানি ছিল না। অনুসন্ধান করে একটি চামড়ার পাত্রে তলানিতে এক ফোঁটা পানি পাওয়া গেল। এক ফোঁটা পানি সহ সেই পাত্রটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আনয়ন করা হয়। তিনি পাত্রের উপর হাত রাখলেন এবং কিছু কথা বললেন, যা আমি বুঝতে পারলাম না। এরপর তিনি বললেন, কাফেলার বড় পাত্রটি নিয়ে এস। তখন পাত্রটি এনে তাঁর সামনে রাখা হলো। তিনি তাঁর হাতটি পাত্রটির মধ্যে রাখলেন এবং আঙুলগুলি ফাঁক করলেন। জাবের তাঁর নির্দেশে এক ফোঁটা পানি তাঁর হাতের উপর ঢাললেন। তিনি বললেন, বিসমিল্লাহ। জাবির বলেন, তখন আমি দেখলাম যে, তাঁর আঙুলের মধ্য দিয়ে পানির ফোয়ারা বের হয়ে আসছে। পাত্রটি পানিতে ভরে গেল এবং পানি পাত্রের বাইরে প্রবাহিত হতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষকে নির্দেশ দিলেন পানি পান করতে। তখন সকলেই তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন। যখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে, শিবিরে আর কারোরই কোনো পানির প্রয়োজন নেই তখন তিনি পাত্রটির মধ্য থেকে তার হাত উঠিয়ে নিলেন। পাত্রটি তখনও পরিপূর্ণ ছিল। এ মুজিযাটি বুওয়াত যুদ্ধের সময় ঘটেছিল।
তাবূক যুদ্ধের বিবরণে মু‘আয ইবনু জাবাল (রা) বলেন, পানির জন্য তাঁরা তাবূকের একটি স্রোতস্বিনী বা মরুভূমির ছোট্ট ঝর্ণার (spring) নিকট গমন করেন। ঝর্ণাটি মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল এবং এর তলায় পায়ের গোড়ালি পরিমাণ সামান্য পানির প্রবাহ ছিল। তখন তাঁরা হাত দিয়ে অল্প অল্প করে কিছু পানি একটি পাত্রে জমা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই পানি দিয়ে তাঁর হাত ও মুখ ধৌত করে আবার তা উক্ত ঝর্ণার মধ্যে ফেরত দেন। তখন ঝর্ণাটি পানিতে ভরে যায়। শিবিরের সকল মানুষ সেই পানি পান করেন। ইবনু ইসহাকের বর্ণনায়, পানির গতি এমন বৃদ্ধি পেল যে, পানির মধ্য থেকে মেঘগর্জনের ন্যায় গর্জন শোনা গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মু‘আয, তোমার আয়ু দীর্ঘ হলে হয়ত তুমি দেখতে পেতে যে, এই স্থানের সব কিছু গাছপালা ও ফল-ফসলের সবুজে ভরে গিয়েছে। [এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে তাবুকের এ সকল অঞ্চল ভবিষ্যতে সবুজে ভরে যাবে। দেড় হাজার বৎসর পরে বর্তমানে তার ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। সহীহ মুসলিমে সংকলিত অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের আগে আরবদের দেশ ফল-ফসল ও নদী-ঝর্ণায় ভরে যাবে। বর্তমানে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। ক্রমান্বয়ে আরবদেশে কৃষিক্ষেত ও ফল-ফসলের বাগানে ভরে যাচ্ছে।]
উমার (রা) বলেন, তাবূকের যুদ্ধে যাত্রার সময়ে পথিমধ্যে তাঁরা পানিসঙ্কটে নিপতিত হন। দীর্ঘ কয়েকদিন যাবৎ তাঁরা পানির কোনো সন্ধান না পাওয়াতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, কেউ কেউ তার নিজের উট জবাই করে তার পেটের নাড়ি ও গোবর চিপে তা পান করছিলেন। এই কঠিন বিপদের কথা জানিয়ে আবূ বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনুরোধ করেন প্রার্থনা করার জন্য। তখন তিনি তাঁর দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন। তাঁর হস্তদ্বয় নামানোর পূর্বেই আকাশ মেঘে ভরে গেল। এরপর বৃষ্টি হলো এবং মানুষেরা নিজেদের পাত্রগুলিতে পানি ভরে নিল। এই বৃষ্টি মুসলিম সৈন্যদের শিবির অতিক্রম করে নি।
ইমরান ইবনু হুসাইয়িন (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে ছিলেন। তাঁর সঙ্গীগণ পানি সঙ্কটে নিপতিত হন ও পিপাসায় কষ্ট পেতে থাকেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দুজন সাহাবীকে বলেন, তোমরা অমুক স্থানে গমন কর। সেখানে দেখবে যে, একজন মহিলার সাথে একটি উট আছে এবং তার উপর দুটি পানির মশক (চামড়ার পাত্র) রয়েছে। তোমরা তাকে অনুরোধ করে এখানে নিয়ে আসবে। তাঁরা দুজন তথায় গমন করে বর্ণনানুসারে মহিলাকে দেখতে পান। তাঁরা তাকে অনেক অনুরোধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে আসেন। তিনি তার মশকদ্বয় থেকে কিছু পানি একটি পাত্রে ঢালেন। এরপর আল্লাহর ইচ্ছানুসারে সেই পানিতে কিছু দু‘আ পাঠ করেন। এরপর পানিটুকু পুনরায় মশকে ঢেলে দেন। এরপর মশক থেকে পানি ঢালার মুখ খুলে মানুষদেরকে নির্দেশ দেন যে, যার কাছে যত মশক বা পাত্র আছে সবাই যেন তা ভরে নেয়। মানুষেরা উক্ত মশকদ্বয় থেকে পানি নিয়ে তাদের সকলের মশক ও পাত্র ভরে নিলেন। এমনকি একটি পাত্রও খালি থাকল না। ইমরান ইবনু হুসাইন (রা) বলেন, মানুষেরা যখন তাদের মশক ও পাত্রগুলি উক্ত মশকদ্বয় থেকে পানি নিয়ে ভরছিল, তখন আমার মনে হচ্ছিল যে, উক্ত মশকদ্বয় যেন ক্রমেই পানিতে ভরে উঠছে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে উক্ত মহিলার জন্য উপহার হিসেবে খাদ্য সংগ্রহ করা হলো। এমনকি সংগৃহীত খাদ্যে তার কাপড় ভরে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি এখন যেতে পার। আমরা তোমার মশকদ্বয় থেকে এক ফোঁটা পানিও গ্রহণ করি নি, কিন্তু আল্লাহই আমাদেরকে পানি দান করেছেন।’’
(৪) অলৌকিকভাবে খাদ্য বৃদ্ধি করা
অলৌকিকভাবে খাদ্যবৃদ্ধির ঘটনাও তাঁর জীবনে অনেকবার ঘটেছে। কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি। জাবির (রা) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আগমন করে খাদ্য প্রার্থনা করে। তিনি তাকে প্রায় অর্ধ ওয়াসাক (প্রায় দেড় মণ) যব প্রদান করেন। লোকটি যব নিয়ে বাড়িতে রাখে এবং নিজের পরিবার ও আত্মীয়-মেহমান-সহ তা ভক্ষণ করতে থাকে। অনেক দিন যাবৎ এভাবে চলার পরে লোকটি হঠাৎ একদিন অবশিষ্ট যব ওজন করে। সে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সংবাদ দেয় (যে, এতদিন খাওয়ার পরেও তার যব আগের মতই রয়েছে।) তিনি তখন বলেন, তুমি যদি তা ওজন না করতে তবে আজীবনই তা থেকে তোমরা আহার করতে পারতে এবং তোমাদের মৃত্যুর পরেও তা থেকে যেত।
অন্য হাদীসে জাবির (রা) বলেন, খন্দকের যুদ্ধের সময় একটি ছাগল ছানা এবং এক সা (প্রায় আড়াই কেজি) যব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১,০০০ মানুষকে খাওয়ান। জাবির বলেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, তারা সকলেই পরিতৃপ্তির সাথে খেয়ে তা রেখে চলে গেলেন, অথচ আমাদের হাঁড়ি চুলার উপরেই ছিল এবং রুটি বানানোর জন্য মাখানো আটা তখনো শেষ হয়নি, বরং রুটি বানানোর কাজ চলছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আটা এবং হাঁড়িতে থুতু দিয়েছিলেন এবং বরকতের জন্য দু‘আ করেছিলেন।
অন্য হাদীসে জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, তাঁর পিতা মৃত্যুর সময় অনেক ঋণ রেখে যান। তাঁদের যে পরিমাণ ফল ও ফসল উৎপন্ন হয় কয়েক বছর ধরে তা প্রদান করলেও তাতে তাদের ঋণ শোধ হয় না। তিনি মূল সম্পতিই পাওনাদারদের দিতে চান, কিন্তু পাওনাদারগণ তাতে রজি হন না। বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবগত করালে তিনি তাকে খেজুর বাগানে খেজুর কর্তনের নির্দেশ দেন। এরপর কয়েকটি খেজুরগাছের নিচে সেগুলি জমা করেন। তিনি তথায় গমন করেন এবং দু‘আ করেন। তখন জাবির সেই খেজুর দিয়ে পাওনাদারদের সকল পাওনা পরিশোধ করার পরেও প্রতি বৎসর তারা যে পরিমাণ খেজুর কর্তন করতেন সেই পরিমাণ খেজুরই অবশিষ্ট থাকে।
আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ক্ষুধার্ত দেখে তিনি তার বাড়ি থেকে কয়েকটি যবের রুটি তার বগলের মধ্যে করে এনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খাওয়ার জন্য প্রদান করেন। তিনি সে রুটিগুলি দিয়ে উপস্থিত ৮০ জন সাহাবীকে পরিতৃপ্তির সাথে আহার করান।
অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, যাইনাব বিনতু জাহশ (রা)-এর সাথে বিবাহের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক মানুষের নাম বলে তাঁদেরকে দাওয়াত করতে তাঁকে নির্দেশ দেন। এত মানুষকে তিনি দাওয়াত দেন যে, নিমন্ত্রিত অতিথিগণ আগমন করলে তার বাড়ি ও বিশ্রামস্থল ভরে যায়। তখন তিনি তাদের সামনে একটি মগ এগিয়ে দেন, যে মগের মধ্যে পনির মিশ্রিত এক মুদ্দ (প্রায় অর্ধ কেজি) পরিমাণ খেজুরের ছাতু ছিল। তিনি মগটি অভ্যাগতদের সামনে রেখে তার মধ্যে নিজের তিনটি আঙুল ডুবিয়ে দেন। এরপর নিমন্ত্রিত অতিথিগণ সেই ছাতু ভক্ষণ করে প্রস্থান করেন। সকলের খাওয়ার পরেও মগের মধ্যে প্রায় আগের মতই ছাতু অবশিষ্ট থাকে।
আবূ আইউব আনসারী (রা) বলেন, (হিজরত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বাকরের মদীনায় আগমনের পরে) তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বাকর (রা)-কে দাওয়াত দেন এবং তাঁদের দুজনের পরিমাণ খাদ্য প্রস্তুত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেন, আপনি আনসারদের নেতৃস্থানীয় (অধ্যক্ষগণ) ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ৩০ জনকে ডেকে আনুন। তিনি নির্দেশ মত ত্রিশজন আনসার নেতাকে ডেকে আনেন। তারা তৃপ্তির সাথে খাদ্য গ্রহণ করে অবশিষ্ট খাদ্য রেখে চলে যান। অতঃপর তিনি বলেন, এবার ৬০ জনকে ডাকুন। তিনি এবার ৬০ জনকে ডেকে অনেন এবং তারাও অনুরূপভাবে খাদ্য গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বলেন, এবার ৭০ জনকে ডাকুন। তারাও এভাবে খাদ্য গ্রহণ করেন এবং বাকি খাবার রেখে চলে যান। যারা সেই খাদ্য ভক্ষণ করে চলে যান তারা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে বেরিয়ে যান। আবূ আইউব আনসারী বলেন, এভাবে আমার সেই খাদ্য ১৮০ ব্যক্তি ভক্ষণ করেন।
সামুরা ইবনু জুনদুব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক বাটি (bowl) মাংস আনয়ন করা হয়। সাহাবীগণ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দলে দলে তা থেকে ভক্ষণ করেন। এক দল উঠলে অন্য দল আহার করতে বসেন।
আব্দুর রাহমান ইবনু আবূ বাক্র (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আমরা ১৩০ ব্যক্তি ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কারো কাছে কি কোনো খাবার আছে? তখন এক ব্যক্তি প্রায় এক সা’ (প্রায় আড়াই কিলোগ্রাম) যবের আটা নিয়ে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি মেশ ক্রয় করে তা রান্নার জন্য প্রস্তুত করেন। আটা দিয়ে রুটি বানানো হয় এবং মেষটিকে সেঁকা (রোস্ট করা) হয়। আল্লাহর কসম, একশত ত্রিশ জনের প্রত্যেককেই সেঁকা মাংস থেকে অংশ প্রদান করা হয়। এরপর অবশিষ্ট খাদ্য দুটি বড় খাঞ্চায় রাখা হয়। আমরা সকলেই সেই খাদ্য ভক্ষণ করি। এরপরও খাঞ্চা দুটিতে খাদ্য অবশিষ্ট থাকে। আমি তা উটের পিঠে করে নিয়ে যাই।
সালামা ইবনুল আকওয়া (রা), আবূ হুরাইরা (রা) এবং উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, এক যুদ্ধের সফরে তাঁরা খাদ্যের সঙ্কটে নিপতিত হন। সকলের খাদ্য নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দেন যার কাছে যা কিছু খাদ্য অবশিষ্ট আছে তা তার নিকট জমা করতে। তখন সবাই একমুষ্টি বা তার চেয়ে সামান্য বেশি খাবার এসে জমা করেন। কেউ কেউ এক সা’ (প্রায় আড়াই কেজি) পরিমান খেজুর জমা দিলেন, যা ছিলো সর্বোচ্চ পরিমাণ। তখন সকল খাদ্য একটি চামড়ার পাটির উপরে রাখা হলো। সালামা ইবনুল আকওয়া বলেন, আমি দেখলাম যে একটি ছাগী মাটিতে শয়ন করলে যে স্থান দখল করে জমাকৃত সকল খাদ্য আনুমানিক সেই পরিমান স্থান দখল করল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে সেই খাদ্য থেকে নিজ নিজ পাত্র ভরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। পুরো শিবিরে একটি পাত্রও আর অপূর্ণ থাকল না। এরপরও সেখানে খাদ্য অবশিষ্ট রয়ে গেল।
(৫) বৃক্ষ ও পাথরের আনুগত্য, কথা বলা ও সাক্ষ্য দেওয়া
ইবনু উমার (রা) বলেন, আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। এক বেদুঈন চলার পথে আমাদের কাছে আসে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ঈমানের দাওয়াত দেন। বেদুঈন বলে, তুমি যা বলছ তার পক্ষে কে সাক্ষ্য দিবে? তিনি বলেন, মরুভূমির ঐ সবুজ গাছটি আমার কথার সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। গাছটি ছিল নিম্নভূমির অপর প্রান্তে। তখন গাছটি মাটির মধ্য দিয়ে নিজেকে টেনে নিয়ে বেদুঈন লোকটির সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকটি তিনবার গাছটিকে প্রশ্ন করে এবং তিনবারই গাছটি সাক্ষ্য প্রদান করে। এরপর গাছটি তার পূর্বস্থানে ফিরে যায়।
জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বের হন। তিনি ময়দানে আড়াল করার মত কিছুই দেখতে পেলেন না। এমন সময় তিনি লক্ষ্য করলেন যে, নিম্নভূমির প্রান্তে দুটি গাছ রয়েছে। তিনি একটি গাছের নিকট যেয়ে গাছটির একটি ডাল ধরে টান দিয়ে বললেন, আল্লাহর অনুমতিতে আমার অনুগত হও। তখন গাছটি নাকে রশি পরানো উটের ন্যায় তাঁর পিছে পিছে চলে এল। তখন তিনি অন্য বৃক্ষটির কাছে যেয়ে তাকেও অনুরূপভাবে বললেন, আল্লাহর অনুমতিতে আমার অনুগত হও। অতঃপর তিনি বৃক্ষ দুটি কাছাকাছি হওয়ার পরে তাদেরকে বললেন, আল্লাহর অনুমতিতে তোমরা উভয়ে একত্রিত হয়ে আমাকে আড়াল কর। তখন গাছ দুটি একে অপরের সাথে একত্রিত হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আড়ালে বসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রয়োজন মেটানোর পর গাছ দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ নিজ স্থানে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে যায়।
ইবনু আববাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন বেদুঈনকে বলেন, তুমি বলত, আমি যদি ঐ খেজুরগাছ থেকে তার কাঁদিটিকে ডেকে নিয়ে আসি, তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করবে যে, আমি আল্লাহর রাসূল? লোকটি বলে, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুরের কাঁদিটিকে ডাক দিলেন। কাঁদিটি লাফাতে লাফাতে তাঁর নিকট উপস্থিত হলো। তিনি বললেন, ফিরে যাও। তখন কাঁদিটি আবার তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল।
বুরাইদা ইবনুল হুসাইব (রা) বলেন, একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তাঁর নুবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ দাবি করেন। তিনি উক্ত বেদুঈনকে বলেন, ঐ গাছটিকে যেয়ে বল, আল্লাহর রাসূল তোমাকে ডাকছেন। লোকটি গাছটির কাছে যেয়ে এ কথা বলে। তখন গাছটি ডানে ও বামে ঝুকে তার শিকড়গুলি মাটি থেকে তুলে নেয়। এরপর মাটির উপর দিয়ে গুড়ি-শিকড় টেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে: আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ। তখন তিনি বেদুঈনকে বলেন, একে বল স্বস্থানে ফিরে যেতে। তখন গাছটি স্বস্থানে ফিরে যায়। বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন, আমাকে অনুমতি দিন যে আমি আপনাকে সাজদা করব। তিনি বলেন, না, আল্লাহ ছাড়া কাউকে সাজদা করা বৈধ নয়। তখন বেদুঈন বলেন, আমাকে অনুমতি দিন আমি আপনার হস্তদ্বয় ও পদদ্বয় চুম্বন করব। তখন তিনি তাকে অনুমতি প্রদান করেন।
প্রায় ২০ জন সাহাবী থেকে পৃথক পৃথক সূত্রে বর্ণিত হাদীসে তাঁরা বলেন, খেজুর গাছের গুড়ি কেটে খুঁটি বানিয়ে তার উপর মসজিদে নববীর ছাউনি দেওয়া ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুতবা দিতেন তখন এরূপ একটি গুড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। যখন তাঁর খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বার বানানো হলো এবং তিনি মিম্বারে উঠে খুতবা দিতে শুরু করলেন, তখন আমরা শুনলাম যে, নবজাতক বাচ্চা হারানো উটের মত গুড়িটি কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে গুড়িটি ফেটে যায়। তার ক্রন্দনের আওয়াজে মসজিদ কম্পিত হচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে সমবেত মানুষেরা কাঁদতে লাগলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুড়িটির কাছে এসে তার উপরে নিজের হাত রাখেন। এতে গুড়িটি শান্ত হয়ে যায়। তিনি বলেন, এতে হেলান দিয়ে আল্লাহর যিকর করতাম, এ যিকর হারানোর কারণে গুড়িটি ক্রন্দন করে। আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে স্পর্শ না করতাম তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত সে এভাবেই কাঁদতে থাকত। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে গুড়িটিকে মিম্বারের নিচে দাফন করা হয়।
খেজুরের গুড়ির ক্রন্দনের এই সংবাদ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ সংবাদ। সাহাবীদের যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগেই তা প্রসিদ্ধ ছিল। অর্থের দিক থেকে তা মুতাওয়াতির বা অতি প্রসিদ্ধ হাদীস।
ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আহার করতেন তখন তাঁর সাথে আহার্য্য খাদ্যের তাসবীহ পাঠ আমরা শুনতে পেতাম।
(৬) ইঙ্গিতে প্রতিমাসমূহের পতন
ইবনু আববাস (রা) বলেন, কাবা ঘরের চতুর্পার্শ্বে ৩৬০টি প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সকল পাথরের মুর্তির পাগুলি সীসা দিয়ে পাথুরে মেঝের সাথে আটকানো ছিল। মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে হারামে প্রবেশ করেন। তিনি তার হাতের খেজুরের ডালটি দিয়ে এ সকল প্রতিমা স্পর্শ না করে, শুধু সেগুলির দিকে ইশারা করলেন এবং বললেন ‘‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হওয়ারই।’’ [সূরা বানী ইসরাঈল (ইসরা), ৮১ আয়াত।] তিনি যখনই কোনো প্রতিমার মুখের দিকে ইশারা করলেন তখনই প্রতিমাটি চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর যখনই তিনি কোনো প্রতিমার পিঠের দিকে ইশারা করলেন, তখনই প্রতিমাটি উপুড় হয়ে পড়ে গেল। এভাবে সকল প্রতিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
(৭) তাঁর পবিত্র হস্ত, ফুঁক বা থুথুতে রোগমুক্তি ও সুস্থতা
সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) বলেন, উহদের যুদ্ধের দিন কাতাদা ইবনু নু’মান (রা) নামক সাহাবীর চোখে আঘাত লেগে চোখটি বেরিয়ে তার কপোলের উপর এসে পড়ে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখটিকে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দেন। চোখটি তখনি সুস্থ হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে তার দু চোখের মধ্যে এটিই অধিক সুস্থ ও ভাল ছিল।
উসমান ইবনু হানীফ (রা) বলেন, এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন, যেন তিনি আমাকে দৃষ্টিশক্তি দান করেন। তিনি তাকে একটি দুআ শিখিয়ে দেন। অন্ধ ব্যক্তি এভাবে দুআ করলে আল্লাহ তাকে দৃষ্টিশক্তি দান করেন এবং সে সুস্থ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে ফিরে আসে।
মুলায়িবুল আসিন্নার পুত্র বলেন, তিনি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট একজন দূত প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটু মাটি নিয়ে তাতে থুতু নিক্ষেপ করে তা উক্ত দূতকে প্রদান করেন। সে যখন মাটি নিয়ে মুলায়িবের নিকট পৌঁছায় তখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী। তাকে মাটিটুকু খাওয়ানো হলে আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দেন।
হাবীব ইবনু ফুদাইক বলেন, তার পিতার চক্ষু সাদা হয়ে যায় এবং তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চোখে ফুঁক দেন। এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। আমি দেখেছি যে, ৮০ বৎসর বয়সেও তিনি সূচের মধ্যে সূতা ঢুকাতেন।
খাইবার যুদ্ধের সময় আলী (রা) চক্ষুপ্রদাহে আক্রান্ত হন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীর (রা) চোখে থুতু দেন। এতে আলী এমনভাবে আরোগ্য লাভ করেন যেন কখনোই তাঁর চোখে কোনো অসুখ হয় নি।
সালামা ইবনুল আকওয়া খাইবারের যুদ্ধে তার ঊরুতে আঘাত পান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত স্থানে থুতু দেন এবং সালামা তৎক্ষনাৎ সুস্থ হয়ে যান।
খাস‘আম গোত্রের একজন মহিলার পুত্র নির্বোধ ও বাকশক্তিহীন ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু পানি নিয়ে পানির মধ্যে কুলি করেন এবং নিজের হস্তদ্বয় ধৌত করেন। এরপর তিনি পানিটুকু উক্ত বালককে প্রদান করে তাকে তা পান করাতে এবং তা দিয়ে তার দেহ মুছে দিতে নির্দেশ দেন। এতে বালকটি সুস্থ হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষদের চেয়েও অধিক বুদ্ধির অধিকারী হয়।
ইবনু আববাস (রা) বলেন, এক মহিলা তার এক পাগল পুত্র নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আগমন করেন। তিনি ছেলেটির বুকে হাত বুলিয়ে দেন। এতে ছেলেটি বমি করে এবং তার পেট থেকে কাল কুকুর ছানার মত কিছু বের হয়। এরপর ছেলেটি সুস্থ হয়ে যায়।
কিশোর মুহাম্মাদ ইবনু হাতিবের বাহুর উপর একটি গরম হাঁড়ি উল্টে পড়ে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে হাত বুলিয়ে দেন এবং সেখানে থুতু দেন। এতে সে তৎক্ষণাৎ সুস্থ হয়ে যায়।
শুরাহবীল আল-জু’ফীর (রা) হাতের তালুতে একটি আব (tumour) ছিল, যে কারণে তিনি ঘোড়ার লাগাম, তরবারী ইত্যাদি ধরতে পারতেন না। তিনি বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলে তার সহানুভুতি কামনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার টিউমারটি ডলতে থাকেন। এভাবে টিউমারটি মিলিয়ে যায় এবং তার কোনো চিহ্নই তার হাতে আর থাকে না।
(৮) তাঁর দুআর অলৌকিক ফল
আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, আমার মা (উম্মু সুলাইম) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার খাদেম আনাসের জন্য প্রার্থনা করুন। তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার সম্পদ ও সন্তান বেশি করে দাও এবং তাকে যা কিছু প্রদান কর সব কিছুতে বরকত প্রদান কর।’ আনাস বলেন, আল্লাহর শপথ, আমার সম্পদ অনেক। আর আমার নিজের সন্তান ও সন্তানদের সন্তানগণের সংখ্যা প্রায় এক শত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের প্রতি আহবান জানিয়ে পারস্য-সম্রাট কেসরার (Khosrau) নিকট পত্র লিখেন। পারস্য সম্রাট অত্যন্ত অভদ্রতার সাথে পত্রটি ছিঁড়ে ফেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে যেমন আমার পত্র ছিঁড়ে ফেলেছে, আল্লাহ তার সাম্রাজ্য ছিঁড়ে বিনষ্ট করবেন। ফলে অচিরেই পারস্য সাম্রাজ্যের বিনাশ ঘটে। পৃথিবীর কোথাও পারস্য সাম্রাজ্যের বা পারসিক আধিপত্যের কোনো অস্তিত্ব থাকে না।
প্রসিদ্ধ আরবী কবি নাবিগা জা’দী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সামনে কিছু কবিতা পাঠ করেন। তখন তিনি বলেন: আল্লাহ তোমার মুখ বন্ধ না করেন। নাবিগা ১২০ বৎসর আয়ূ লাভ করেন, কিন্তু তাঁর একটি দাঁতও পড়েছিল না এবং অতিবৃদ্ধ বয়সেও তার মুখটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল। কথিত আছে যে, বৃদ্ধকালে তার কোনো দাঁত পড়ে গেলে সেখানে নতুন দাঁত উঠত।
আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর দিনে মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় একজন বেদুঈন মসজিদে প্রবেশ করে অনাবৃষ্টির জন্য কষ্ট প্রকাশ করে। তখন তিনি বৃষ্টির জন্য দুআ করেন। ফলে তখনই বৃষ্টিপাত শুরু হয় এবং পরবর্তী শুক্রবার পর্যন্ত মদীনার মানুষের সুর্যের মুখ দেখতে পায় নি। পরের জুমুআয় উক্ত বেদুঈন অতিবৃষ্টির জন্য কষ্ট প্রকাশ করে। তখন তিনি আবার দুআ করেন, ফলে মেঘ কেটে যায়।
আবূ লাহাবের পুত্র উতবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালিগালাজ করত এবং অত্যন্ত কষ্টপ্রদান করত। তিনি আল্লাহর কাছে বদ-দুআ করেন, যেন আল্লাহ তাঁর একটি কুকুরকে তার পিছনে লাগিয়ে দেন। উতবা বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করে। কাফিলা রাত্রিতে একস্থানে অবস্থান করে। উতবা বলে, মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বদ-দুআর কারণে আমার ভয় লাগছে। তখন কাফিলার সাথীরা তাদের মালপত্র উতবার চারিদিকে রেখে উৎবাকে ঘিরে পাহারা দিতে থাকে। এমতাবস্থায় একটি সিংহ এসে উতবাকে তার সাথীদের মধ্য থেকে তুলে নিয়ে যায়।
এরূপ আরেক অত্যাচারী অপরাধী মুহাল্লিম ইবনু জুসামাকে তিনি বদ-দুআ করেন। লোকটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তার আত্মীয়রা তাকে কবরস্থ করে। কিন্তু লাশটি মাটি থেকে বেরিয়ে আসে। এভাবে যতবারই তারা তাকে কবর দেয় ততবারই লাশটি মাটি থেকে বেরিয়ে আসে। শেষে তারা লাশটি মাটির উপরে ফেলে রেখে চলে আসে।
একব্যক্তি বাম হাত ব্যবহার করে খাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডান হাত দিয়ে খেতে অনুরোধ করেন। লোকটি অহঙ্কার করে বলে, আমি ডান হাতে খেতে পারি না। তিনি বলেন, তুমি না পার! এরপর আর কখনো ঐ ব্যক্তি তার ডান হাত মুখে তুলতে পারত না।
এ বিষয়ক বর্ণনা এখানেই শেষ করছি। এরূপ আরো অগণিত ঘটনা সহীহ সনদে হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়েছে। এ সকল মুজিযা বা অলৌকিক চিহ্ন প্রত্যেকটি পৃথকভাবে মুতাওয়াতির রূপে বর্ণিত হয়নি। তবে এ অর্থে শতশত সাহাবী থেকে শতশত পৃথক সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক হাদীস পৃথকভাবে মুতাওয়াতির না হলেও নিঃসন্দেহে সামগ্রিকভাবে তা মুতাওয়াতির। যেমন আলীর (রা) বীরত্ব বা হাতিম তাঈর দানশীলতা বিষয়ক বর্ণনাদি। আর সামগ্রিকভাবে মুতাওয়াতির অর্থই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নুবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। [মার্ক ও লূক তাদের সুসমাচারে যে সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন সেগুলির চেয়ে একক সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীস অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। মার্ক ও লূক লোকমুখে শোনা কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কার কাছ থেকে শুনেছিলেন, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তাদের লেখা পুস্তক তাদের নিকট থেকে কেউ গ্রহণ, পাঠ বা শ্রবণ করেছেন কিনা, করলে কতটুকু করেছেন, নাকি অন্য কেউ তাদের নামে লিখে চালিয়েছেন ইত্যাদি কোনো তথ্যই সংরক্ষিত নেই। মথি ও যোহনের লেখা সুসমাচার যদি সত্যিই শিষ্য মথি ও যোহনের লেখা হয় তাহলেও তার কোনো সূত্র নেই। তাদের লেখা বই কে তাদের থেকে শুনেছেন তারও প্রমাণ নেই। পক্ষান্তরে একক বর্ণনায় বর্ণিত হাদীসগুলির সনদ বা অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরা সংরক্ষিত রয়েছে। চারটি সুসমাচারের লেখক সকলেই যে ঘটনাবলি লিখেছেন সেগুলিও একক সূত্রে বর্ণিত। এগুলির মূল্যও ‘খাবারুল ওয়াহিদ’ বা একক সূত্রে বর্ণিত হাদীসের চেয়ে বেশি কিছুই নয়।]
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/612/75
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।