HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

গীবত থেকে বাঁচার উপায়

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
গীবত থেকে বাঁচার উপায় ও তওবা করার পদ্ধতি

সংকলন :

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

সম্পাদনা

মোহাম্মাদ ইমাম হোসাইন কামরুল

একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا اَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ‏ بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ اٰيَةً، وَحَدِّثُوا عَنْ بَنِي اِسْرَائِيلَ وَلَا حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهٗ مِنَ النَّارِ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, ‘‘আমার পক্ষ হতে একটি বাণী হলেও তা লোকদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। আর বনী ইসরাঈলের ঘটনা তোমরা বর্ণনা করতে পারো এতে কোন দোষ নেই। তবে যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা নির্ধারণ করে নেয়।

(বুখারী, হাদীস নং : ৩৪৬১)

হাদীসের শিক্ষা :

দ্বীন প্রচার করা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তবে দ্বীনের কথা যাচাই-বাছাই করে প্রচার করতে হবে। নবীর নামে কোন মিথ্যা হাদীস বলা যাবে না।

জ্ঞাতব্য :

দলীল হিসেবে এ বইয়ে যতগুলো হাদীস আনা হয়েছে সেগুলোর নম্বর মাক্তাবাতুশ শামেলা থেকে নেয়া হয়েছে ।

এ বইয়ের সকল হাদীস তাহকীক (যাচাই) করা। কোন যয়ীফ বা জাল হাদীস এতে আনা হয়নি।

ভূমিকা
اَلْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ

‘গীবত থেকে বাঁচার উপায় ও তওবা করার পদ্ধতি’ বইটি বের করতে পেরে মহান আল্লাহ তা‘আলার অগণিত শুকরিয়া আদায় করছি। দরূদ ও সালাম পেশ করছি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবাগণের উপর।

বর্তমান সময়ে গীবত একটি সমাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমরা কমবেশি প্রায় সকলেই এর সাথে জড়িত। মানুষ একজনের দোষ-ত্রুটি অন্য মানুষের কাছে বলে বেড়ানোতে তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে থাকে। অথচ গীবত এমন এক বদভ্যাস যা পুরো সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। গীবত এমন এক নেশার বস্তু যা মুমিনের নেক আমলকে বাতিল করে দেয়। গীবত জঘন্যতম অপরাধ। গীবত করা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান। তাই আমাদেরকে অবশ্যই গীবত বা পরচর্চা থেকে দূরে থাকতে হবে।

আর তওবা বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার এক বড় নিয়ামত। একজন লোক যত বড় পাপীই হোক না কেন, তার জন্য তওবার দরজা সর্বদাই খোলা রয়েছে। তাই কোন বান্দারই আল্লাহ তা‘আলার রহমত হতে নিরাশ হওয়ার কারণ নেই। তবে তওবার জন্য যেসব জরুরি শর্ত রয়েছে তা পূরণ করতে হবে, তা না হলে তওবা কবুল হবে না। এ বইয়ে আমরা গীবত ও তওবা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আশা করি পাঠকসমাজ বইটির মাধ্যমে অনেক উপকৃত হতে পারবেন। ইনশা-আল্লাহ!

বইটি প্রকাশনার কাজে যারা শরীক হয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা যেন সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করেন। আর যেন আমাদের এ শ্রমকে কবুল করে এর ওসীলায় দুনিয়াতে শান্তি এবং আখেরাতে মুক্তির ফায়সালা করে দেন। আমীন!!

বিনীত

মাওলানা আবদুর রহমান

চেয়ারম্যান

ইমাম পাবলিকেশন্স লিমিটেড

প্রথম অধ্যায় গীবত
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে গীবত করা এবং তা শ্রবণ করা উভয়টিই হারাম। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই গীবকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং এটাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন যা সকলের কাছে অপছন্দনীয় এবং ঘৃণীত।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন-

وَلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا اَيُحِبُّ اَحَدُكُمْ اَنْ يّأْكُلَ لَحْمَ اَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوا اللهَ اِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তোমরা একে অপরের গোপন বিষয় তালাশ করো না এবং তোমাদের মধ্যে কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে, তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে? তোমরা তো তা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা হুজরাত- ১২)

গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে উপমা দেয়ার কারণ

আল্লাহ তা‘আলা গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। এর কিছু কারণ নিম্নে আলোচনা করা হল :

১. কারো সামনে তার দোষ বর্ণনা করা হলে সে তা প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু গীবতের সময় ব্যক্তি উপস্থিত না থাকায় তা প্রতিরোধ করতে পারে না। যেমন মৃত ব্যক্তির গোশত খাওয়া হলে সে প্রতিরোধ করতে পারে না।

২. মৃত মানুষের গোশত খাওয়া যেমন নিকৃষ্ট কাজ, অনুরূপভাবে কারো গীবত করাও তেমন নিকৃষ্ট কাজ।

عَنْ اَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- « لَا تَحَاسَدُوْا وَلَا تَنَاجَشُوْا وَلَا تَبَاغَضُوْا وَلَا تَدَابَرُوْا وَلَا يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلٰى بَيْعِ بَعْضٍ وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ اِخْوَانًا . اَلْمُسْلِمُ اَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهٗ وَلَا يَخْذُلُهٗ وَلَا يَحْقِرُهٗ . اَلتَّقْوٰى هَا هُنَا . وَيُشِيْرُ اِلٰى صَدْرِه ثَلَاثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ امْرِئٍ مِّنَ الشَّرِّ اَنْ يَّحْقِرَ اَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهٗ وَمَالُهٗ وَعِرْضُهٗ »

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন- ‘‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, দোষ অন্বেষণ করো না, ক্রোধ প্রকাশ করো না, একে অপরের উপর গর্ব করো না, ক্রয়-বিক্রয়ে এক জনের দামের উপর দাম করো না। আর তোমরা সকলে আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাইস্বরূপ। কাজেই সে তার ভাইয়ের প্রতি যুলুম করবে না, তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে না এবং তাকে তুচ্ছজ্ঞান করবে না। তাকওয়া এখানে, একথা বলে তিনি নিজের বক্ষের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করলেন। (তারপর নবী ﷺ বললেন) কোন ব্যক্তি খারাপ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার অপর মুসলিম ভাইকে হেয় প্রতিপনণ করে। আর প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান অপর মুসলমানের উপর হারাম। অর্থাৎ সম্মানীত। তাই এগুলোর সম্মান রক্ষা করতে হবে।’’

(মুসলিম হা: ৬৭০৬)

কাজেই, গীবত কী? গীবত কেন হয়, কীভাবে হয়? গীবত আমাদের জন্য কী কী ক্ষতি করে? কীভাবে আমরা গীবত থেকে বাঁচতে পারি? গীবত সংক্রান্ত এসব বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল :

গীবতের সংজ্ঞা
اَلْغِيْبَةُ শব্দটি আরবি। غيب মূল অক্ষর থেকে এর উৎপত্তি। غ বর্ণে যবর দিয়ে পড়লে এর অর্থ হয়, লুকিয়ে যাওয়া, অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি। আর غ বর্ণে যের দিয়ে পড়লে এর অর্থ হয়- পরনিন্দা করা, পরের দোষ চর্চা করা, কুৎসা রটানো ইত্যাদি।

যেহেতু গীবত সম্পর্কিত আলোচনা অনুপস্থিত ব্যক্তি সম্পর্কে করা হয় তাই উক্ত আলোচনাকে গীবত বলে। আর গীবত দ্বারা পরের সমালোচনা করা হয় বিধায় তাকে পরনিন্দাও বলা হয়।

বিখ্যাত আরবি অভিধান কামুসে বলা হয়েছে-

غَابَهٗ اَيْ عَابَهُ وَذَكَرَهٗ بِمَا فِيْهِ مِنَ السُّوْءِ

‘‘কেউ কারো গীবত করল, তার মানে তার দোষ আলোচনা করল, তার মধ্যে যে সকল মন্দ অভ্যাস রয়েছে তা বর্ণনা করল।’’

গীবতের পরিচয় সংক্রান্ত হাদীস :

عَنْ اَبِى هُرَيْرَةَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَالَ « اَتَدْرُوْنَ مَا الْغِيْبَةُ » . قَالُوْا اَللهُ وَرَسُوْلُهٗ اَعْلَمُ . قَالَ « ذِكْرُكَ اَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ » . قِيْلَ اَفَرَاَيْتَ اِنْ كَانَ فِىْ اَخِىْ مَا اَقُوْلُ قَالَ « اِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدِ اغْتَبْتَهٗ وَاِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ فَقَدْ بَهَتَّهٗ »

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ উপস্থিত সাহাবাগণকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কি জানো গীবত কী? সাহাবাগণ উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূল ﷺ বললেন, ‘‘গীবত হল তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। জিজ্ঞেস করা হল, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলে এটাও কি গীবত হবে? রাসূল ﷺ বললেন, তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে সেটাই গীবত। আর তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে সেটা হবে তোহমাত। অর্থাৎ মিথ্যা অপবাদ।’’

(মুসলিম হা: ৬৭৫৮, তিরমিযী হা: ১৮৮৪, মেশকাত হা: ৪৬১৭)

এখানে ‘ভাই’ শব্দটি উল্লেখ করার বিশেষ তাৎপর্য এই যে, মানুষ সাধারণত আপন ভাইয়ের দোষ অন্য কারো কাছে প্রকাশ করে না; বরং যথাসম্ভব তা গোপন রাখতে চেষ্টা করে। তদ্রূপ অন্য মানুষের গীবত ও দোষচর্চা করাও উচিত নয়। কেননা ইসলামের সূত্রে সকলেই ভাই ভাই।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন-

ذِكْرُ الْمَرْءِ بِمَا يَكْرَهُهٗ سَوَاءٌ ذَكَرْتَهٗ بِاللَّفْظِ اَوْ بِالْاِشَارَةِ وَالرَّمْزِ

‘‘গীবত হল কোন ব্যক্তিকে এমনভাবে উল্লেখ করা যা সে অপছন্দ করে, চাই তা প্রকাশ্যে হোক বা ইশারা-ইংঙ্গিতে হোক।’’

ইমাম রাগিব (রহ.) বলেন-

هِيَ اَنْ يَّذْكُرَ الْاِنْسَانُ عَيْبَ غَيْرِهٖ مِنْ غَيْرِ مَحُوْجٍ اِلٰي ذِكْرِ ذٰلِكَ

‘‘গীবত হল বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা।’’

গীবত সম্পর্কে ভুল ধারণা
প্রচলিত সমাজে যদি কাউকে এ কথা বলে যে, তুমি অমুকের গীবত করছ কেন? তখন সে বলে, আমি যা বলছি তাতো সকলেই জানে। এমন তো নয় যে, আমি বলার কারণেই মানুষ জানতে পারছে। অতএব এটা গীবত হবে কেন? এভাবে অনেকেই গীবত সম্পর্কে ভুল ধারণা করে থাকে। আবার অনেকেই গীবতকে নিজেদের মনমত সংজ্ঞায়িত করে থাকে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলোও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-

১. কেউ বলে, যে দোষ ব্যক্তির সামনে বলা যায় তা গীবত নয়।

২. কেউ বলে, নিজের অধীনে যারা আছে তাদের দোষচর্চা গীবত নয়।

৩. কেউ বলে, যে দোষ ব্যক্তির মাঝে আছে তা বলা গীবত নয়।

এভাবে গীবতকে সংজ্ঞায়িত করা কু-প্রবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। তারা এগুলো বলে থাকে শুধুমাত্র নিজেদের মনের ধারণা অনুযায়ী, অথচ ধারণা দ্বারা সঠিক জ্ঞান লাভ হয় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَاِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِيْ مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا

‘‘ধারণা দ্বারা সঠিক জ্ঞান অর্জিত হয় না (প্রকৃত অবস্থা জানা যায় না)।’’

(সূরা নজম- ২৮)

মোটকথা, বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হবে, তাকেই শরীয়তের পরিভাষায় গীবত বা পরনিন্দা বলে। এটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন, মুখের দ্বারা, লেখনির দ্বারা, অঙ্গ-প্রতঙ্গের দ্বারা। আবার এটা মুসলিম-অমুসলিম যে কারো ব্যাপারে হতে পারে। যদি বর্ণিত দোষগুলো ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তা গীবত হবে, আর যদি তা ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান না থাকে তবে তা হবে অপবাদ। সুতরাং জায়েয ক্ষেত্র ছাড়া কারো যেকোন প্রকারের দোষ অপরের কাছে বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।

যেসব সমালোচনা গীবত নয়
যদি সৎ ও শরীয়তসম্মত উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কারো অনুপস্থিতিতে তার সমালোচনা করা জরুরী হয়ে যায় তবে তা গীবত হবে না। যেমন :

১. যালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা :

মাযলুম ব্যক্তি যালিমের বিরুদ্ধে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারক বা এমনসব ব্যক্তির কাছে অভিযোগ উপস্থাপন করতে পারবে যারা যালিমকে দমন করার শক্তি এবং মাযলুমের প্রতি ন্যায়বিচার করার ক্ষমতা রাখেন।

সুবিচার লাভের উদ্দেশ্যে শাসকদের কাছে অধিনস্ত কর্মচারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অনুমতি রয়েছে। এটা গীবত হবে না। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থেকে যুলুম মেনে নিলে নিজের হক তো নষ্ট হবেই তাছাড়া যালিমকে প্রশ্রয় দেয়ার ফলে যুলুমও বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

لَا يُحِبُّ اللهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ اِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللهُ سَمِيْعًا عَلِيْمًا

‘‘আল্লাহ কারো দোষ প্রকাশ করে দেয়া পছন্দ করেন না, তবে মাযলুম ব্যক্তি ছাড়া। (সুবিচার লাভের প্রত্যাশায় তার জন্য অত্যাচারের অভিযোগ তুলে ধরার অবকাশ রয়েছে।) আর আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং সবকিছু জানেন।’’(সূরা নিসা- ১৪৮)

২. ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা :

ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ এবং গুনাহের কাজের সুযোগ বন্ধ করার জন্য সহযোগিতা পাওয়ার উদ্দেশ্যে পরস্পর আলোচনা করা গীবত নয়। যার দ্বারা আল্লাহদ্রোহী কার্যকলাপ সংঘটিত হওয়ার আশংকা রয়েছে তার বিরুদ্ধে এভাবে বলা যে, অমুক ব্যক্তি এমন এমন কাজ করছে। তাকে শাসন করা প্রয়োজন। তবে এর উদ্দেশ্য হবে শুধুমাত্র অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা।

৩. কোন বিষয়ে ফতওয়া চাওয়া :

যিনি ফতওয়া দেয়ার ক্ষমতা রাখেন তার কাছে কোন বিষয়ের সমাধানের উদ্দেশ্যে কারো দোষ বর্ণনা করা বৈধ। এক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হল কারো নাম উল্লেখ না করে এভাবে বলা যে, কোন ব্যক্তি বা কোন স্বামী যদি এমন আচরণ করে তাহলে তার ব্যাপারে ইসলামের সমাধান কী? এভাবে কাউকে নির্দিষ্ট না করেই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। তবে কাউকে চিহ্নিত করা জরুরি হলে সে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করাও জায়েয।

৪. মুসলমানকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচানো :

কোন মুসলমানকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য কারো প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করা গীবত নয়। যেমন, বিয়ের ব্যাপারে, কোন বিষয়ে অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে, আমানত ও লেনদেনের ব্যাপারে কিংবা কাউকে প্রতিবেশী বানানোর ব্যাপারে অন্য পক্ষের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হলে তার কর্তব্য হল তাকে সঠিক কথা বলে দেয়া। এক্ষেত্রে যদি সে অন্য পক্ষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে তবে অপর মুসলিম ভাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ফাতেমা বিনতে কায়েস ؓ নবী ﷺ এর নিকট এসে পরামর্শ চেয়ে বললেন, আবু জাহাম ও মুয়াবিয়া উভয়ে আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে। তখন নবী ﷺ বললেন, নিশ্চয় মুয়াবিয়া তোমাকে কষ্ট দেবে, তার কোন মাল নেই। আর আবু জাহামের হাত থেকে কখনো লাঠি নামে না।

(মুসলিম হা: ৩৭৮৫)

অনুরূপভাবে কোন লোককে কোন বিষয়ের যিম্মাদার বা দায়িত্বশীল বানানো হলে তার কর্তব্য হল সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করা। কোন লোক যদি দায়িত্ব পালনে গড়িমসি করে অথবা সে ঐ পদের উপযুক্ত না হয় অথবা সে ফাসিক বা অলস হয় তবে কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি অবহিত করা জরুরি, যাতে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে কিংবা অন্য কোন যোগ্য লোককে দায়িত্ব দিতে পারে।

৫. হাদীস যাচাই করার জন্য বর্ণনাকারীদের সমালোচনা করা :

হাদীসের রাবী বা বর্ণনাকারীদের যেসব দোষ-ত্রুটি আছে তা যাচাই করা জরুরি। এটা শুধু জায়েযই নয়, বরং বিশেষ প্রয়োজন। কেননা এর মধ্যে মুসলমানদের বৃহত্তম স্বার্থ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ ۢبِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوْا

‘‘হে ঈমানদারগণ! কোন ফাসিক ব্যক্তি যদি তোমাদের নিকট কোন খবর নিয়ে আসে তবে তার সত্যতা যাচাই করে নাও।’’ (সূরা হুজরাত- ৬)

এ আয়াত দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, কোন ফাসিক ব্যক্তি যদি কোন সংবাদ নিয়ে আসে তবে তা গ্রহণের পূর্বে সে খবরের সত্যতা কতটুকু তা যাচাই করতে হবে। যেন সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের পর কোন বিপদে না পড়তে হয়। তাই দ্বীনের হেফাযতের উদ্দেশ্যে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের রাবীদের দোষ-ত্রুটি পর্যালোচনা করে যয়ীফ ও জাল হাদীস থেকে সহীহ হাদীস বাছাই করে থাকেন।

৬. প্রকাশ্য ফাসিক ও বিদআতীর সমালোচনা করা :

যদি কোন ব্যক্তি প্রকাশ্যে ফাসিকী ও বিদআতী কাজকর্ম করে বেড়ায় যেমন, প্রকাশ্যে মদ পান করে, মানুষের উপর যুলুম করে, কারো ধন-সম্পদ জোরপূর্বক আত্মসাৎ করে বা অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তবে ঐ ব্যক্তির কার্যকলাপের সমালোচনা করা যাবে, যাতে লোকজন সতর্ক হতে পারে।

বিদআত ইসলামে একটি হারাম কাজ। রাসূল ﷺ বলেন-

مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ اَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ

‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে যার উপর আমাদের সমর্থন নেই তা পরিত্যাজ্য।’’ (বুখারী, মুসলিম হা: ৪৫৯০)

অতএব বিদআতীদের ডাকে সাড়া দেয়া উচিত নয়। আর জনসাধারণ যাতে বিদআতীদের দ্বারা প্রতারিত না হয় সেজন্য প্রত্যেক বিদআতীকে চিহ্নিত করে দেয়া উচিত।

৭. পরিচয় দেয়া :

কোন ব্যক্তির বিশেষ উপাধি বা কোন শারীরিক ত্রুটির উল্লেখ করে তার পরিচয় দেয়া জায়েয। তবে অপমান বা অসম্মান করার উদ্দেশ্যে এসব শব্দ ব্যবহার করা হারাম। এসব ত্রুটি উল্লেখ ছাড়া অন্য কোনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে সেটাই উত্তম। কিন্তু সম্বোধিত ব্যক্তি যদি মনে কষ্ট না নেয় এবং সে এ নামেই সমাজে পরিচিত হয় তবে তাকে ঐ নামে পরিচয় দেয়া জায়েয রয়েছে।

৮. যালিম সরকারের সমালোচনা করা :

সরকারকে দায়িত্ব দেয়া হয় দেশ সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু সরকার যদি তা সুষ্ঠভাবে পরিচালনা না করে জনসাধারণের উপর যুলুম বা অত্যাচার শুরু করে দেয় তবে সে সরকারের সমালোচনা করাতে দোষ নেই। কারণ সরকারের সাথে সকলের স্বার্থ জড়িত। সরকার যখন জনগণের উপর যুলুম শুরু করে দেয় তখন সরকারের যুলুমের কথা জনগণের মাঝে তুলে ধরা বৈধ।

৯. সংশোধনের উদ্দেশ্যে :

রাসূল ﷺ বলেন-

اَلدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ

‘‘দ্বীন হচ্ছে একে অপরের কল্যাণ কামনা করা।’’ (মসলিম হা: ২০৫)

এক মুসলিম অপর মুসলিম ব্যক্তিকে ভুল করতে দেখলে তাকে সংশোধন করার দায়িত্ব তারই। কারো দোষ এমন ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করার অনুমতি রয়েছে যার দ্বারা উক্ত ব্যক্তিকে সংশোধন করা যায়। যেমন, সন্তানের কোন দোষ পিতা-মাতার কর্ণগোচর করা, ছাত্রের দোষ শিক্ষকের কাছে প্রকাশ করা ইত্যাদি। এটা উক্ত ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নয় বরং তার কল্যাণ কামনাই মুখ্য উদ্দেশ্য।

এসব ক্ষেত্র ব্যতীত পরনিন্দা করা থেকে প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

যেসব বিষয়ে গীবত সংঘটিত হয়
যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষ গীবত বা পরনিন্দায় লিপ্ত হয় তা হল :

১. কারো বংশ নিয়ে সমালোচনা করা :

তুচ্ছ ও হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কেউ যদি বলে, অমুক ব্যক্তির বংশ ভাল নয় বা অমুক ব্যক্তির গোষ্ঠি খারাপ বা অমুক নীচু বংশের লোক বা অমুক ব্যক্তির বংশের বৈশিষ্ট্যই এরকম তবে তা গীবত হবে। কারণ এভাবে বলার দ্বারা উক্ত বংশ বা গোত্রের সকলকে দোষারূপ করা হয়। আর এভাবে দোষী সাব্যস্ত করাটা ইসলামী শরীয়তে একেবারেই নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَانًا وَّاِثْمًا مُّبِيْنًا

‘‘নিশ্চয় যারা মুমিন নর-নারীকে এমন ব্যাপারে কষ্ট দেয় যে ব্যাপারে তারা দোষী নয়, তাহলে তারা মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপ অর্জন করল।’’

(সূরা আহযাব : ৫৮)

বংশ নিয়ে গর্ব করা জায়েয নয়। রাসূল ﷺ বলেন-

اِثْنَتَانِ فِى النَّاسِ هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ اَلطَّعْنُ فِى النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ »

‘‘মানুষের মধ্যে দু’টি কাজ রয়েছে যা কুফরী। একটি হচ্ছে বংশের গর্ব করা। আর অপরটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা।’’ (মুসলিম হা: ২৩৬)

- عَنِ بْنِ عُمَرَ : اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ خَطَبَ النَّاسَ يَوْمَ فَتْحِ مَكَّةَ فَقَالَ يَا اَيُّهَا النَّاسُ اِنَّ اللهَ قَدْ اَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الجَاهِلِيَّةِ وَتَعَاظُمَهَا بِاٰبَائِهَا ، فَالنَّاسُ رَجُلَانِ : بَرٌّ تَقِيٌّ كَرِيْمٌ عَلَى اللهِ ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ هَيِّنٌ عَلَى اللهِ ، وَالنَّاسُ بَنُوْ اٰدَمَ ، وَخَلَقَ اللهُ اٰدَمَ مِنْ تُرَابٍ ، قَالَ اللهُ : { يَا اَيُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَّقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقَاكُمْ اِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ মক্কা বিজয়ের দিন খুতবা প্রদানকালে বলেছিলেন, ‘‘হে লোকসকল! আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী যুগের সকল গর্ব ও অহংকার দূর করে দিয়েছেন। এখন মানুষ দুই প্রকার- এক প্রকার হচ্ছে সৎ ও পরহেযগার; তারা আল্লাহর কাছে সম্মানিত। আর এক প্রকার হচ্ছে অপরাধী ও হতভাগা। তারা আল্লাহর কাছে ঘৃণিত। আর সকল মানুষ আদম থেকে সৃষ্ট। আর আদমকে আল্লাহ মাটি থেকে বানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘হে মানুষ সকল! আমি তোমাদেরকে একই নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে ও বংশে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরিচিতি লাভ করতে পার।’’

(তিরমিযী হা: ৩২৭০)

দ্বীনদারী ও সৎকর্ম ব্যতীত কোন ব্যক্তির উপর অপর ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কাজেই নিজেকে ও নিজের বংশকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অপরের বংশের দোষ-ত্রুটি বের করে তা প্রকাশ করা বা অপরের বংশকে গালি দেয়া ইসলামে বৈধ নয়।

ইসলামে সকলেই সমান। প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলামানের ভাই। তাই কেউ কারো উপর প্রাধান্যযোগ্য নয়। কেননা প্রত্যেক মানুষ একই সত্ত্বা থেকে সৃষ্ট। প্রত্যেকেই আদম (আঃ) এর সন্তান। তবুও ইসলাম কোন কোন ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছে, তবে সেটা তাকওয়ার দিক থেকে। যে যত বেশি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান্য করবে সে তত বেশি মর্যাদা পাবে। স্বয়ং রাসূল ﷺ নিজ ক্রীতদাস যায়েদের সাথে এমন ব্যবহার করতেন যে, উভয়ের মধ্যে মনিব-ক্রীতদাস সম্পর্ক তা বুঝাই যেত না। যার কারণে সমগ্র আরবের মধ্যে তিনি যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ (মুহাম্মদের ছেলে যায়েদ) নামে পরিচিত ছিলেন।

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বিলাল (রাঃ) একজন হাবশী ক্রীতদাস হওয়া সত্ত্বেও আরবের মুসলিমরা তাকে ঘৃণা না করে নিজেদের ভাই মনে করত। উমর (রাঃ) তাকে يَا سَيِّدِيْ ‘হে আমাদের সরদার’ বলে সম্বোধন করতেন।

অনেক সাহাবী ক্রীতদাস ছিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয় এবং সমাজের বংশীয় ভেদাভেদ চিরতরে দূর করে দেয়। ধনী-গরীব, সাদা-কালো সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দেয়।

তাই কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য উচিত নয় যে, কারো বংশকে নীচু মনে করা এবং নিজের বংশকে বড় মনে করে অহংকার করা।

২. কারো শারীরিক দোষ বর্ণনা করা :

আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে নানাভাবে নানা আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ খাটো, কেউ লম্বা, কেউ মোটা, কেউ চিকন ইত্যাদি। আর আল্লাহর সৃষ্টিতে ভুল ধরা কারো জন্য বৈধ নয়। তেমনিভাবে আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে হাসি-তামাশা করাও হারাম। আর যার বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাসি-তামাশা করা হচ্ছে সে শুনলে মনে কষ্ট পাবে বলে এটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে কানা, খোরা, অন্ধ, বেটে, লম্বো, চিকনা ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে; আর এতে যদি সম্বোধিত ব্যক্তি মনে কষ্ট পায় তবে তা গীবত বলে গণ্য হবে। হাদীসে এসেছে-

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : حَكَيْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلًا . فَقَال : مَايَسُرُّنِي اَنِّي حَكَيْتُ رَجُلًا وَاَنَّ لِي كَذَا وَكَذَا . قَالَتْ : فَقُلْتُ : يَارَسُولَ اللهِ ، اِنَّ صَفِيَّةَ امْرَاةٌ ، وَقَالَتْ بِيَدِهَا هٰكَذَا كَانَّهَا تَعْنِي قَصِيرَةً ، فَقَالَ : لَقَدْ مَزَجْتِ بِكَلِمَةٍ لَوْ مَزَجْتِ بِهَا مَاءَ الْبَحْرِ لَمُزِجَ .

আয়েশা ؓ বলেন, আমি নবী ﷺ এর কাছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করলাম। তখন নবী ﷺ বললেন, অনেক কিছুর বিনিময়ে হলেও কারো সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করাটা আমাকে আনন্দিত করতে পারবে না। আয়েশা ؓ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি সাফিয়ার বেঁটে হওয়াটা অপছন্দ করেন না? তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি এমন একটি কথা বললে যা নদীর পানির সাথে মিশিয়ে দিলে তার উপরও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।

(তিরমিযী হা: ২৫০২)

শারীরিকভাবে মানুষের কিছু দোষ থাকতেই পারে। তাই কারো সেসব দোষ উল্লেখ করে তার মনে কষ্ট দেয়া কোন মুসলমানের কাজ নয়। তার চিন্তা করা উচিত, আমি যে দোষটি নিয়ে তাকে ঠাট্টা করছি তা যদি আমার মাঝে থাকত তবে কেমন হত। তাই নিজের উপর আল্লাহর রহমতের কথা চিন্তা করে তাঁর প্রশংসা করা উচিত।

বর্তমান সমাজে মানুষের বিভিন্ন শারীরিক দোষ-ত্রুটি নিয়ে রসিয়ে আলাপ করা এবং চোখ টিপে হাসাহাসি করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তখন এ কথা মনে থাকে না যে, একদিন আমাদেরকে মহান রাববুল আলামীনের দরবারে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের হিসাব দিতে হবে। সর্বদা আমলনামা লেখক ফেরেশতারা আমাদের প্রতিটি মুহুর্তের কথা ও কাজের নিখুঁত হিসাব রাখছেন।

৩. দারিদ্র্যতার কারণে কারো সমালোচনা করা :

দারিদ্র্যতার কারণে কোন মুমিনকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা ও অপরের কাছে বলে বেড়ানো এটাও এক প্রকার গীবত। সমাজে ধনী-গরীব সবধরণের লোক বসবাস করে। অনেক ধনী রয়েছে যারা সমাজের গরীব ব্যক্তিদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে থাকে। এমনকি তাদের সম্পর্কে নানা ধরণের অহেতুক সমালোচনাও করে থাকে, এটা বৈধ নয়। কেননা দারিদ্র্যতা তো আল্লাহই দিয়েছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা কিছু কিছু বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন। এ ব্যাপারে দোষ ধরা আল্লাহর সৃষ্টিতে দোষ ধরার শামিল। অপর দিকে ব্যক্তি মনে কষ্ট পাবে বলে এটা গীবতের পর্যায়েও পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّنْ قَوْمٍ عَسٰى اَنْ يَّكُوْنُوْا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّنْ نِّسَاءٍ عَسٰى اَنْ يَّكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পুরুষেরা যেন অপর পুরুষদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে যে, তারা এদের তুলনায় অনেক ভাল। আর মহিলারাও যেন অপর মহিলাদের বিদ্রূপ না করে । কেননা হতে পারে তারা এদের তুলনায় ভাল।’’ (সূরা হুজরাত : ১১)

ইসলামের প্রথম যুগের অধিকাংশ মুসলিমই দরিদ্র ছিলেন। তাদেরকে নিয়ে কাফেররা উপহাস করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُوْنَ مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَالَّذِيْنَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاللهُ يَرْزُقُ مَنْ يَّشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ

‘‘যারা কুফরী করেছে তাদের দুনিয়ার জীবনকে সুশোভিত করা হয়েছে। আর তারা মুমিনদেরকে নিয়ে উপহাস করে থাকে। অথচ মুত্তাক্বীরা কিয়ামতের দিন তাদের উপরে থাকবে। আর আল্লাহ যাকে চান অগণিত রিযিক দান করেন।’’ (সূরা বাকারা : ২১২)

৪. কারো পোষাক নিয়ে সমালোচনা করা :

প্রত্যেকেই নিজ নিজ সাধ্য ও রুচী অনুযায়ী নানা ধরণের পোষাক পরিধান করে থাকে। এতে কারো পোষাক নিম্ন মানের হয়, আবার কারো পোষাক হয় উচ্চ মানের। এক্ষেত্রে কারো পছন্দের সাথে অপরের পছন্দের মিল থাকে না। তাই কেউ কারো পোষাক সম্পর্কে অসৎ উদ্দেশ্যে সমালোচনা করা উচিত নয়। যেহেতু এ ধরণের আলোচনা মানুষের মনে কষ্ট দেয় তাই এটাও গীবতের মধ্যে গণ্য হবে।

৫. কারো বদভ্যাসের সমালোচনা করা :

সমাজ, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য কারণে মানুষের মধ্যে রুচি ও অভ্যাস বিভিন্ন রকম হয়, যা অন্যান্যদের কাছে দৃষ্টি কটু মনে হয়। কিন্তু এ নিয়ে গীবত ও দোষচর্চায় লিপ্ত হওয়া আরো গর্হিত অন্যায়। হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কাউকে তার অনুপস্থিতিতে পেটুক, বাঁচাল, ভীরু, অলস, নির্বোধ, বেয়াদব এসব বলে মন্তব্য করা গীবতের অন্তর্ভুক্ত।

৬. কারো পাপ কাজের সমালোচনা করা :

কারো পাপ কাজ নিয়ে তার অনুপস্থিতিতে সমালোচনা করাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, যদি কেউ বলে যে, অমুক ব্যক্তি এই পাপ কাজ করে বেড়ায় বা এই এই খারাপ কাজে অভ্যস্ত; তবে তাও গীবত বলে গণ্য হবে।

মানুষ হিসেবে সকলের দ্বারাই কমবেশি পাপ কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তাই পাপের কথা পাপীকে না বলে অন্য মানুষকে বলে বেড়ানো গীবত বলে গণ্য হবে। যারা গীবতের মাধ্যমে এসব পাপকাজ লোক সমাজে ছড়িয়ে দেয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اِنَّ الَّذِيْنَ يُحِبُّوْنَ اَنْ تَشِيْعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَاللهُ يَعْلَمُ وَاَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ

‘‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মান্তিক শাসিত্ম এবং আল্লাহ সবই জানেন; কিন্তু তোমরা জান না।’’ (সূরা নূর : ১৯)

মুমিন ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হওয়ার জন্য তিনটি জিনিসই যথেষ্ট।

১. মানুষের এমন দোষ আলোচনা করা যা তার নিজের মধ্যেও রয়েছে।

২. নিজের দোষ বের না করে মানুষের দোষ খুজে বের করাা।

৩. সঙ্গীকে অনর্থক কষ্ট দেয়া।

ইবলিস মানুষের শত্রু হিসেবে সর্বদা মানুষের পরকালের ক্ষতি করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যখনই সুযোগ পায় তখনই সে মানুষকে নানা ধরণের অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত করে থাকে। আর তাই মানুষের দ্বারা হাজার রকম গুনাহের কাজ সংঘটিত হয়।

কোন মানুষকে কখনও কোন পাপ কাজে লিপ্ত দেখলে তা অন্যের কাছে না বলে উচিত হল সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাকে তার পাপ কাজটি ধরিয়ে দেয়া। যাতে সে পরবর্তীতে এ পাপ কাজে লিপ্ত না হয়।

আরেকটি কথা মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে কিছু না কিছু দোষ। মানুষের গীবত ও দোষচর্চায় আমরা সুখ অনুভব করি অথচ আমাদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য দোষ-ত্রুটি। নিজেদের দোষ সম্পর্কে গাফেল থাকা আর শুধু পরের দোষ খুঁজতে থাকা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।

৮. কারো ইবাদাতের সমালোচনা করা :

ইবাদাতের মধ্যে কমবেশি প্রায় সকলের কোন না কোন ত্রুটি থেকে যায়। তা না জানার কারণেও হতে পারে অথবা অলসতার কারণেও হতে পারে। তাই বলে কারো ইবাদাতের মধ্যে কী কী ভুল-ত্রুটি রয়েছে তা তাকে না জানিয়ে অন্যের সাথে সমালোচনা করে মনে প্রশান্তি লাভের চেষ্টা করা গীবত। সুতরাং কেউ যদি কারো ইবাদাতে কোন ভুল-ত্রুটি দেখতে পায় তাহলে তার কর্তব্য হল, এটা নিয়ে নিজে পাপের সাথে না জড়িয়ে ঐ ব্যক্তিকে সংশোধন করে দেয়া।

১০. অমুসলিমের সমালোচনা করা :

অনেকে মনে করতে পারে শুধুমাত্র মুসলিমদের গীবত করা হারাম। এটি একটি ভুল ধারণা। অমুসলিমদেরও এমন দোষ অপরের কাছে বলে বেড়ানো বৈধ নয় যার ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যহত হয়। তবে ইসলামের স্বার্থে অমুসলিমদের ইসলাম বিরোধী বা সামাজিক শৃঙ্খলা বিবর্জিত কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোচনা করা যায়।

১৩. মৃত ব্যক্তির সমালোচনা করা :

জীবিত ব্যক্তিদের গীবত যেমনি হারাম তেমনি কোন মৃত ব্যক্তির দোষচর্চা করাও হারাম। রাসূল ﷺ বিভিন্ন হাদীসে এ সম্পর্কে সতর্ক

করেছেন। তিনি বলেন-

اِذَا مَاتَ صَاحِبُكُمْ فَدَعُوْهُ وَ لَاتَقَعُوْا فِيْهِ

‘‘তোমাদের কোন সাথী যখন মারা যায় তখন তাকে ছেড়ে দাও আর তার সমালোচনায় লিপ্ত হয়ো না।’’ (আবু দাউদ হা- ৪৯০১)

তাছাড়া মানুষের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিও মৃত ব্যক্তির গীবত করাকে সমর্থন করে না। যেমন-

প্রথমতঃ আমরা মৃতদের গীবত করতে পারি; কিন্তু তারা আমাদের গীবত করতে পারে না। যারা আমাদের গীবত করছে না আমরা কেন তাদের গীবত করব?

দ্বিতীয়ত ঃ মৃত ব্যক্তির দ্বারা আমরা সর্বদা উপকৃত হই। কেননা কবর আমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে। তাই তাদের এ উপকারের প্রতিদানস্বরূপ আমাদেরও উচিত মৃতদের দোষচর্চা না করে তাদের জন্য দো‘আ করা।

তৃতীয়ত ঃ মৃত ব্যক্তির গীবত স্বভাবতই তার বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের মনে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর কোন মুসলিমের পক্ষে উচিত নয় অপর মুসলিমকে কষ্ট দেয়া। এটা রাসূল ﷺ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন-

اَلْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِه وَيَدِه

‘‘মুসলিম সেই ব্যক্তি যার হাত ও জ্বিহবা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।’’ (মুসলিম হা: ১৭১)

যেভাবে গীবত হয়ে থাকে
১. যবানের মাধ্যমে গীবত :

যবানই হচ্ছে গীবত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গীবত সংঘটিত হয় এ যবান দ্বারাই। এজন্য নিজেদের যবানের হেফাযত করা প্রতিটি মুমিনের একান্ত কর্তব্য। রাসূল ﷺ বলেন-

مَنْ يَّضْمَنْ لِيْ مَا بَيْنَ لِحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ اَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ

‘‘যে ব্যক্তি তার দু’পা ও দু’চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানের দায়িত্ব নিতে পারবে অর্থাৎ মুখ ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিনদার হব।’’ (বুখারী হা: ৬৪৭৪)

অপর হাদীসে তিনি বলেন-

مَنْ صَمَتَ نَجَا

‘‘যে ব্যক্তি চুপ থাকল সে মুক্তি পেল।’’ (তিরমিযী হা: ২৫০১)

অন্য হাদীসে নবী ﷺ বলেন-

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا اَوْ لِيَصْمُتْ

‘‘যে আল্লাহ এবং পরকালকে বিশ্বাস করে সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা নিরবতা পালন করে।’’ (বুখারী হা: ৬০১৮, মুসলিম হা: ৪৭)

২. শারীরিক অভিনয়ের মাধ্যমে গীবত করা :

কোন ব্যক্তি যদি অপর কোন ব্যক্তির দোষণীয় অবস্থা বুঝাতে শরীরের কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গ ব্যবহার করে, তবে তাও গীবত বলে গণ্য হবে। যেমন কেউ কোন ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ব্যবহার করে বলল, অমুক ব্যক্তি এ রকম করে হাঁটে বা এভাবে কথা বলে। এরূপ করাটাও গীবত। রাসূল ﷺ বলেছেন-

مَا يَسُرُّنِيْ اَنِّيْ حَكَيْتُ رَجُلًا وَاَنَّ لِيْ كَذَا وَكَذَا

‘‘আমি এত এত সম্পদের বিনিময়ে হলেও অপরের অনুকরণ পছন্দ করি না।’’ (তিরমিযী হা: ২৫০২)

৩. ইশারা-ইঙ্গিতে গীবত করা :

ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে অন্যের দোষ প্রকাশ করাও গীবত। যে কোন কারণে সরাসরি নাম উল্লেখ না করে যদি এমনভাবে ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা হয় যাতে বুঝা যায় যে, সে অমুক ব্যক্তির সমালোচনা করছে তবে তা গীবত বলে গণ্য হবে। যেমন- কাল তার নিকট এই এই স্বভাবের লোক এসেছিল, আর শ্রবণকারী ব্যক্তিও চিনে নিল যে, সে কোন ব্যক্তি; তখন এটাও ঐ ব্যক্তির জন্য গীবত হয়ে যাবে। কোন মুসলমানের জন্য জায়েয নয় যে, সে তার অন্য ভাইয়ের দিকে এমনভাবে ইঙ্গিত করবে যা তাকে কষ্ট দেয়।

৪. অন্তরের মাধ্যমে গীবত করা :

কোন প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহ বা অন্য কোন কিছুর ভিত্তিতে কারো সম্পর্কে অহেতুক খারাপ ধারণা করা ইসলামী শরীয়তে হারাম। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে এটা নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِّنَ الظَّنِّ اِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ اِثْمٌ

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা এমন রয়েছে যা গুনাহ ।’’ (সূরা হুজরাত : ১২)

৫. লেখনীর মাধ্যমে :

মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে লেখনী। অনেক সময় এ লেখনীর দ্বারাও গীবত সংঘটিত হয়ে থাকে। লেখনীর দ্বারা যদি কারো দোষ বর্ণনা করা হয় তবে তা ব্যক্তির মনে বড় ধরণের প্রভাব ফেলে। লেখনীর মাধ্যমে যে গীবত করা হয় তার স্থায়িত্ব অনেক বেশি হয়। কেননা লিখিত বস্তু অনেক দিন টিকে থাকে।

৬. কানের মাধ্যমে গীবত করা :

শুধুমাত্র অন্যের দোষ বলে বেড়ানোকেই গীবত বলে না বরং অন্যের দোষ শুনে প্রতিবাদ না করাটাও এক ধরণের গীবত। গীবত করা যেমন গর্হিত কাজ তেমনি তা শ্রবণ করাও গর্হিত কাজ। কেননা গীবত শ্রবণকারী গীবত না শুনলে পাপ সংঘঠিত হত না। তাই দু’জনেই অপরাধি। মুমিনের উচিত কানের হেফাযত করা। কারণ আল্লাহ বান্দার কান সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। মহান আল্লাহ বলেন-

اِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ اُولٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُوْلًا

‘‘কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর এগুলোর প্রত্যেকটির বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’’ (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৬)

১০
গীবতের ব্যাপারে মহিলাদের সাবধানতা
গীবত হচ্ছে মহিলাদের চারণভূমি। মহিলারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিক হারে গীবতে জড়িয়ে পড়ে। যেমন- যখনই কয়েকজন মহিলা একত্রিত হয়, তখন তারা প্রায়ই সমালোচনা বা গীবতে লিপ্ত হয়ে যায়। তারা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে সমালোচনা করে। বিশেষ করে তাদের স্বামীদের ব্যাপারেও তারা নানা মন্তব্য করে থাকে। যেমন- একে অপরকে বলতে থাকে আমার স্বামী এরকম এরকম, আমাকে এটা দিয়েছে ওটা দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের গোপনীয় বিষয় পর্যন্ত বলাবলি করতে লজ্জাবোধ করে না। এ কাজের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। স্বামীর অকৃতজ্ঞ হওয়া এবং বেশি বেশি অভিশাপ দেয়া, এটা মহিলাদের জাহান্নামী হওয়ার প্রধান কারণ।

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ (রাঃ) قَالَ : خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي أَضْحًى ـ أَوْ فِطْرٍ ـ إِلَى الْمُصَلَّى، فَمَرَّ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ : يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ، فَإِنِّي أُرِيتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ ‏‏ ‏ . ‏ فَقُلْنَ : وَبِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ :" تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ، وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে গেলেন। তিনি মহিলাদের নিকট আগমন করলেন, অতঃপর তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, হে মহিলারা! তোমরা সদকা কর, কারণ তোমাদেরকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নামী হিসেবে আমাকে দেখানো হয়েছে। তখন তাঁরা আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কী কারণে আমাদের এ অবস্থা? নবী ﷺ বললেন, তোমরা বেশি বেশি লানত (অভিশাপ) কর এবং স্বামীদের অকৃজ্ঞতা প্রকাশ কর।

(বুখারী হা : ৩০৪)

বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে, মহিলা অভিভাবকরা যখন ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে স্কুলে যায় তখন তারা অনেকে একত্রে জমা হয় এবং তারা গীবতের মত জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। এভাবে তারা জীবনের অনেক মূল্যবান সময়কে গুনাহের কাজে ব্যয় করে থাকে। তাই এক্ষেত্রে মহিলাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তারা যখন অবসর পায় তখন তাদের উচিত ইসলামী বই-পুস্তক পড়ে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা এবং নেক আমলে লিপ্ত থাকা। তাহলে তারা অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারবে।

১১
গীবতে লিপ্ত হওয়ার কারণ
গীবত মূলত শয়তানের ওয়াসওয়াসা। এ কারণে মানুষ অনিচ্ছায় গীবতে লিপ্ত হয়। কিন্তু খুব কম লোকই তা ধরতে পারে। তাছাড়া মানুষ সাধারণভাবে যেসব কারণে গীবতে লিপ্ত হয়ে থাকে তা হল :

১. ক্রোধের কারণে :

গীবতের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ক্রোধ। মানুষ যখন কোন কারণে কারো উপর রাগান্বিত হয় তখনই তার গীবত শুরু করে দেয়। কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির প্রতি রুষ্ট হলে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে মনের ঝাল মিটানোর জন্য অপরের দোষচর্চা করে থাকে।

২. শত্রুতার কারণে :

শত্রুতা হচ্ছে গীবত সংঘটিত হওয়ার অন্যতম কারণ। যখন কেউ কারো উপর শত্রুতা পোষণ করে তখনই সে তার শত্রুর গীবতে লিপ্ত হয়।

৩. কাউকে অপমান করার জন্য :

যখন কোন ব্যক্তি কারো উপর নাখোশ হয় তখনই তাকে সে অপমান করার ইচ্ছা পোষণ করে। কোন ব্যক্তিকে অপমান করার উদ্দেশ্যে মানুষ গীবতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

৪. কথার তাল মিলানোর জন্য :

কাউকে গীবত করতে দেখলে অনেক সময় কথার তাল মিলাতে গিয়ে অন্যরাও গীবতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

৫. অহংকার ও আত্মগর্বের কারণে :

গীবতের আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে গর্ব ও অহংকার। অহংকারের কারণেই মানুষ নিজেকে বড় ও অন্যকে ছোট ভাবতে শুরু করে। নিজের সব কিছুকেই মনে করে গুণ, আর অন্যের সবকিছুই মনে করে দোষ। যেমন কারো এ কথা বলা যে, অমুক ব্যক্তি একবারেই মূর্খ, তার কোন বোধশক্তি নেই। এ কথার দ্বারা সে বুঝাতে চায় যে, সেই সত্যিকারের জ্ঞানী এবং অন্যরা খুব কমই জ্ঞাত। এভাবে ব্যক্তি নিজের এহেন অহংকার ও আত্মগর্বের কারণে গীবতের মত নিকৃষ্ট কাজে জড়িয়ে পড়ে।

৬. হিংসার কারণে :

হিংসার কারণেও মানুষ গীবত করে থাকে। কোন ব্যক্তির মধ্যে যখন কোন ভাল গুণ থাকে এবং এর মাধ্যমে সে সমাজে খ্যাতি লাভ করে তখন তার হিংসুকরা তার সমালোচনা শুরু করে দেয়।

৯. হাসি-তামাশা ও ঠাট্টাচ্ছলে :

হাসি-তামাশা ও ঠাট্টাচ্ছলে মানুষ গীবতে লিপ্ত হতে পারে। তবে সময় কাটানোই এর মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে।

১০. অন্যের কাজকে খারাপ মনে করার কারণে :

অন্যের কোন কাজ খারাপ লাগলে মানুষ ঐ কাজের সমালোচানা করতে গিয়ে গীবতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

১১. পার্থিব সম্মান লাভের আশায় :

কারো কাছে প্রিয় পাত্র হওয়ার জন্যও মানুষ অনেক সময় অন্যের গীবতে লিপ্ত হয়ে থাকে।

১২
গীবত করার পরিণাম
আল্লাহ তা‘আলার কাছে গীবত একটি বড় ধরণের অপরাধ। তাই এর পরিণামও বড় ভয়াবহ। এর পরিণাম উভয় জগতেই হয়ে থাকে। গীবতের কারণে ব্যক্তি যেভাবে দুনিয়ার জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরকালের জীবনেও তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষ গীবতের মাধ্যমে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। যেমন :

১. গীবতের ফলে বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়

গীবতের অন্যতম বড় কুফল হচ্ছে, এর ফলে মুসলমানদের একতা বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যেকের অন্তরে অন্যের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। ভালবাসা ও প্রীতি বিলুপ্ত হয়।

২. গীবতের কারণে গীবতকৃত ব্যক্তির প্রতি অনাস্থা জন্মে :

যার গীবত করা হয় তার দোষগুলো মানুষের মাঝে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ফলে তার প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্ম নেয়। তাছাড়া অপরের দোষ বর্ণনা করার কারণে গীবতকারীর প্রতিও মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়।

৩. গীবতকারী মানুষের নিকট আস্থা হারিয়ে ফেলে :

দুনিয়াতে গীবতের একটা বড় কুফল হচ্ছে গীবতকারী সকলের আস্থা হারিয়ে ফেলে। কেউ তার উপর আস্থা স্থাপন করতে ভরসা পায় না। কেননা সকলেই একথা মনে করে যে, আজ যেমন সে আমাদের সামনে অন্য মানুষের দোষ আলোচনা করছে তেমনি সে যে কাল অন্যের সামনে আমাদের দোষ আলোচনা করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?

যে ব্যক্তি তোমার সামনে অন্যের নিন্দা করছে তার কাছে এ আশা তুমি করো না যে, অন্যের কাছে সে তোমার সুনাম করবে। কেননা দোষচর্চা করাটাই হচ্ছে তার মজ্জাগত পেশা।

এক জ্ঞানী ব্যক্তির সামনে এক মূর্খ ব্যক্তি মানুষের গীবত ও দোষচর্চা শুরু করল। জ্ঞানী ব্যক্তিটি তখন তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘‘দেখ ভাই! মানুষের গীবত করে তুমি তোমার প্রতি আমার আস্থা নষ্ট করে দিও না।’’

৪. গীবত করলে শয়তান আনন্দিত হয় :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوًّا

‘‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাকে তোমরা শত্রুই মনে করো।’’ (সূরা ফাতির- ৬)

পাপ কাজ মাত্রই শয়তানকে আনন্দ দেয়। কিন্তু শয়তান এ কথা নিজেই স্বীকার করেছে যে, গীবতেই তাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়।

যারা গীবত করে শয়তান তাদের মুখে মধু মিশিয়ে দেয়।

৫. গীবত করলে আল্লাহ ও তার নবীর অবাধ্যতা করা হয় :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَمَا اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا

‘‘রাসূল তোমাদের নিকট যা কিছু নিয়ে আসেন তোমরা তা গ্রহণ কর, আর যা কিছু নিষেধ করেন তা হতে তোমরা বিরত থাক।’’ (সূরা হাশর- ৭)

সুতরাং যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে গীবত করা হয়, তবে তা আল্লাহর ও নবীর অবাধ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

৬. পাপের দিকে মন আকৃষ্ট হয় :

কিছু কিছু পাপ আছে যা সংঘটিত হওয়ার কারণে আরো কতগুলো পাপ সংঘটিত হয়ে পাপকে আরো শক্তিশালী করে। গীবত তার মধ্যে একটি। চারটি জিনিস হচ্ছে পাপের মূল :

(১) গীবত,

(২) মিথ্যা,

(৩) চোগলখোরি,

(৪) কোন নারীর সতীত্বের দিকে তাকানো।

৭. গীবতকারীর শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় :

গীবতকারী ব্যক্তি যতজন লোকের গীবত করে ততজন লোকের ঘৃণার পাত্র ও শত্রুতে পরিণত হয়। তাই তার শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

৮. গীবতকারী আল্লাহর অসন্তুষ্টির শিকার হয় :

আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে গীবত করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও বান্দা যদি তাঁর নিষেধ অমান্য করে গীবতের মত ঘৃণিত অপরাধ করে বেড়ায় তবে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর খুবই অসন্তুষ্ট হন।

৯. গীবত বড় ধরনের সুদ :

আমরা মনে করি যে, শুধু টাকা-পয়সাতেই সুদ রয়েছে, কিন্তু তা নয়। গীবতের মাধ্যমেও সুদের সমান অপরাধ হয়ে থাকে। নবী ﷺ বলেন-

اِنَّ مِنْ اَرْبَى الرِّبَا اَ لْاِسْتِطَالَةُ فِى عِرْضِ الْمُسْلِمِ بِغَيْرِ حَقٍّ

সবচেয়ে বড় সুদ হচ্ছে অন্যায়ভাবে কোন মানুষের মান-সম্মানের উপর আঘাত করা। (আবু দাউদ হা: ৪৮৭৮)

১০. গীবতের কারণে আমল নষ্ট হয়ে যায় :

রাসূল ﷺ একবার সাহাবাগণকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো, প্রকৃত দরিদ্র ও নিঃস্ব কে? সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো মনে করি যার কাছে অর্থ-কড়ি নেই, সে-ই নিঃসব ও দরিদ্র। তখন রাসূল ﷺ বললেন, নিঃসব ও দরিদ্র ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন অনেক নেক আমল নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু একদল লোক আল্লাহর দরবারে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবে। কারো অর্থ সে আত্মসাৎ করেছে, কাউকে গালি দিয়েছে, কারো গীবত ও দোষচর্চা করেছে। কিংবা কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়েছে ইত্যাদি। আল্লাহ সকলের মধ্যে তার নেক আমল বণ্টন করা শুরু করবেন। তার নেক আমল শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যদি অভিযোগকারীদের পাওনা শেষ না হয় তখন সকলের গুনাহ ও বদ-আমলের বোঝা তার উপর চাপিয়ে দেবেন। সে সকলের বদ-আমলের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সে-ই হল সত্যিকারের দরিদ্র ও নিঃসব ব্যক্তি।

(মুসলিম হা: ৬৭৪৪)

দুনিয়াতে কেউ বিপদে পড়লে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ছুটে আসে সাহায্যের জন্য। কিন্তু কিয়ামতের দিন তার উল্টা হবে, পিতা-মাতা সন্তান থেকে আর সন্তান পিতা-মাতা থেকে পালিয়ে যাবে। স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে দেখে পালিয়ে যাবে। প্রত্যেকেই সেদিন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। শুধু ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসী বলবে।

১২. পরকালে গীবতকারীদের করুণ পরিণতি :

عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ َ وَسَلَّمَ- « لَمَّا عُرِجَ بِى مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ اَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُوْنَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُوْرَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلاَءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِى اَعْرَاضِهِمْ

আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেন, যখন আমার প্রতিপালক আমাকে মেরাজে নিয়েছিলেন, তখন আমি এমন এক শ্রেণীর লোকদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম যাদের নখগুলো ছিল পিতলের নখের মত। যা দ্বারা তারা নিজেদের চেহারা ও বক্ষ খামচাচ্ছিল। আমি তাদের সম্পর্কে জিবরাঈল (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এরা সেসব ব্যক্তি যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত খেত এবং তাদের ইজ্জত নষ্ট করত। অর্থ্যাৎ তারা গীবত করত। (আবু দাউদ হা: ৪৮৭৮)

১৩
গীবত থেকে বাঁচার উপায়
১. রাগ ও ক্রোধকে সংযত রাখা :

সর্বাবস্থায় রাগ ও ক্রোধকে সংযত রাখতে হবে। কেননা মানুষ যখন কারো প্রতি রাগাম্বিত হয়, তখন তার সম্পর্কে এমন সব কথা বলে থাকে যার অধিকাংশই গীবতের অন্তর্ভুক্ত।

২. হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকা :

হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই মানুষ একে অপরকে ঘৃণার চোখে দেখে। আর যখন একে অপরের সাথে খারাপ মনোভাব তৈরি হয়, তখনই মানুষ গীবতে লিপ্ত হয়। অতএব আমাদের উচিত গীবতকে পরিহার করার জন্য হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিজেকে দূরে রাখা।

৩. অহংকার থেকে বিরত থাকা :

অহংকার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। কেননা আগুন যেমনিভাবে কাঠকে খেয়ে ফেলে ঠিক তেমনিভাবে অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। অহংকারের কারণে মানুষ অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এবং গীবতে জড়িয়ে পড়ে।

৪. অপরকে তুচ্ছ না ভাবা :

নিজেকে আল্লাহর নগণ্য বান্দা ভাবতে হবে এবং অপরকে বড় হিসেবে দেখতে হবে। কেননা নিজেকে বড় ভাবা এবং অপরকে ছোট ভাবা থেকে অনেক সময় গীবত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে, কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে।’’ (সূরা হুজরাত- ১১)

৫. অহেতুক ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করা :

কারো কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে ঠাট্টা, উপহাস করা থেকে দূরে থাকতে হবে। বন্ধু-বান্ধব বা অন্য কারো সাথে হাসি-ঠাট্টা করতে গিয়েও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আমি যে বিষয় নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছি তা গীবতের মধ্যে পড়ছে কি না। যদি তা গীবতের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে এবং যারা এসব করছে তাদেরকেও তা থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিতে হবে। এভাবে নিজেকেও গীবত থেকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে এবং নিজের কর্ণকেও গীবত থেকে বিরত রাখা যাবে। এ রকম চলতে থাকলে একসময় গীবত বা দোষচর্চা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইন্শা আল্লাহ!

৬. যার দোষ তাকেই বলা :

কারো কোন ভুল-ত্রুটি হতে দেখলে সাহস করে দ্রুত তাকে তা জানাতে হবে যাতে করে সে নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারে।

৭. অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা :

বেহুদা কথা ও অযথা সময় নষ্ট করা থেকেই গীবতের সূত্রপাত। তাই গীবত বা পর দোষচর্চার মত মারাত্মক অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য বেহুদা কথা ও অযথা সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বিরত রাখতে হবে। যে সময়টুকু অবসর পাওয়া যায় সে সময়টুকু আল্লাহর যিকিরে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে এর দ্বারা একদিকে নিজেকে গীবত থেকে বিরত রাখা যাবে, আবার অপরদিকে আল্লাহর যিকির করার কারণে অসংখ্য সওয়াবও অর্জিত হবে।

৮. গীবত সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা :

কুরআন-হাদীস ও ইসলামী বই-পুস্তক নিয়মিত পাঠ করতে হবে, যাতে করে কোনটা গীবত আর কোনটা গীবত না তা যথাযথভাবে নির্ণয় করা যায় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর ভয় মনে জাগ্রত করে গীবতের মত বড় অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে সাহায্য পাওয়া যায়।

৯. আত্মপ্রশংসা থেকে বিরত থাকা :

আত্মপ্রশংসা না করে নিজের অসংখ্য ভুলের বা গুনাহের কথা স্মরণ করে বার বার তাওবা করতে হবে।

১০. প্রতিটি কথা রেকর্ড হয় এ কথা মনে রাখা :

মনে রাখতে হবে যে, আমরা যাই বলিনা কেন তা আল্লাহর ফেরেশতারা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আর এ জন্য আমাদেরকে আল্লাহর নিকট হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيْدٌ - مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ اِلَّا لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ

‘‘স্মরণ রেখো! দুই ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য অতন্দ্র প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।’’ (সূরা কাফ- ১৭, ১৮)

১১. কথা কম বলা ও চিন্তা-গবেষণা বেশি করা :

কথা কম বলে চিন্তা-গবেষণা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং অতিরিক্ত হাসি-তামাশা থেকে দূরে থেকে রাসূলের চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।

সেমাক (রাঃ) বলেন, আমি জাবির বিন সামুরা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি রাসূল ﷺ এর মজলিসে উপস্থিত থাকতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ! তারপর বললেন, রাসূল ﷺ দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকতেন, অল্প হাসতেন, তাঁর সাথীরা কবিতা এবং অন্যান্য আনুসাঙ্গিক বিষয়ে আলোচনাকালীন সময়ে তিনি হাসতেন, তবে মুচকি হাসতেন। (সুনানুলকুবরা লিল বায়হাকী হা : ২১৬৪৮)

সুতরাং যারা রাসূলের উম্মত এবং রাসূল ﷺ কে ভালবাসে ও তাকে অনুসরণ করে তাদের উচিত ভাল কথা বলা, অন্যথায় চুপ থাকা।

১২. কুরআনের সাথে সময় ব্যয় করা :

বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। প্রতিদিন বুঝে বুঝে কুরআন পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং যতটুকু সম্ভব মুখস্থ করার চেষ্টা করতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন, কুরআন পাঠকারীকে বলা হবে, পড় যেভাবে দুনিয়াতে তারতিলের সাথে পড়তে। তোমার স্থান শেষ আয়াত পর্যন্ত হবে, যা তুমি পড়েছিলে। যখনই কুরআন শুনতে পাওয়া যাবে তখনই কথা না বলে তা শ্রবণ করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَاِذَا قُرِئَ الْقُرْاٰنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهٗ وَاَنْصِتُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ

‘‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগসহকারে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক, যাতে করে তোমাদের উপর করুণা বর্ষিত হয়।

(সূরা আরাফ- ২০৪)

১৩. যাচাই বাছাই করে কথা বলা :

আমাদের নিকট শুনা বা লিখিতভাবে যেসব খবর পৌঁছে থাকে তা যথাযথভাবে যাচাই বাছাই করে বৈধ পন্থায় অপরের কাছে বলার এবং পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। কেননা এতে মিথ্যা কথা হওয়ার আশংকা রয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেন-

كَفٰى بِالْمَرْءِ كَذِبًا اَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ

‘‘কোন ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তা-ই প্রচার করে।’’ (মুসলিম হা: ৭)

১৪. গীবত প্রতিহত করা এবং তা শুনা থেকে বিরত থাকা :

যখন কোন ব্যক্তি কারো গীবত শুরু করে তখনই শ্রোতার উচিত হল গীবতকারীকে গীবতের পরিণতির কথা জানিয়ে দেয়া এবং এ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া। যাতে করে গীবত শুনার অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচানো যায়। কেননা কিয়ামতের দিন গীবত শ্রবণের অপরাধেও মানুষকে পাকড়াও করা হবে।

১৪
গীবত শুনলে যা করা উচিত
যখন তোমার সামনে কেউ গীবত করতে থাকবে তখন তোমার উচিত হবে,

১. ক্ষমতা থাকলে সরাসরি বাধা দেওয়া।

২. গীবতকৃত ব্যক্তির প্রশংসা করা, যাতে গীবতকারী তার কথা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

৩. গীবতকারীকে বিশ্বাস না করা। কেননা গীবত একটি মহাপাপ। তাই গীবতকারী কখনো বিশ্বস্ত হতে পারে না।

৪. গীবতকৃত ব্যক্তির প্রতি খারাপ ধারণা না করা।

৫. গীবতের কথা শুনে এগুলো অন্যের কাছে প্রচার না করা।

১৫
গীবত প্রতিহত করার ফযীলত
অন্যায় কাজকে প্রতিহত করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত্যেরই নামান্তর। আর গীবত যেহেতু একটি বিশেষ অন্যায় কাজ, তাই তা প্রতিহত করার ফযীলতও বিশেষ ধরণের। যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইকে সাহায্য করবে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাকে সাহায্য করবেন। রাসূল ﷺ বলেন-

مَنْ رَدَّ عَنْ عِرْضِ اَخِيهِ رَدَّ اللهُ عَنْ وَجْهِهِ النَّارَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভাইয়ের ইজ্জত রক্ষা করবে অর্থাৎ গীবত হতে থাকলে তা বন্ধ করার চেষ্টা করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা করবেন।’’ (তিরমিযী হা: ২০৫৬)

রাসূল ﷺ বলেন-

مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلٰى مُعْسِرٍ فِى الدُّنْيَا يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ عَلٰى مُسْلِمٍ فِى الدُّنْيَا سَتَرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيْهِ

যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের উপর থেকে দুনিয়ার কোন কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সহজ পন্থা অবলম্বন করবে, আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার সাথে সহজ ব্যবহার করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন। আর যতক্ষণ কোন বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকবে ততক্ষণ আল্লাহ তা’আলাও তাকে সাহায্য করবেন। (তিরমিযী হা: ২০৫৫)

১৬
গীবত ত্যাগের উপকারিতা
গীবত পরিত্যাগের কিছু উপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হল :

১. কোন ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করে নিজের অন্তরাত্মাকে নির্মল ও পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে। কারণ কোন মুমিন ব্যক্তি যখন কোন গুনাহের কাজ করে তখন তার অন্তরাত্মায় একটি কালো দাগ পড়ে যায়। অতএব কোন ব্যক্তি গীবত পরিহার করলে তার অন্তর নির্মল ও স্বচ্ছ থাকে।

২. গীবত করা অপর মুসলিম ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য। অতএব যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করল সে এ অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকল।

৩. গীবতের ফলে ইবাদাত নষ্ট হয়ে যায়। অতএব যে ব্যক্তি গীবত পরিহার করল সে তার আমলকে রক্ষা করল।

৪. গীবতের মাধ্যমে অপর ব্যক্তিকে আহত করে। অতএব যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করল সে অন্যকে আহত করা থেকে বিরত থাকল।

৫. যে ব্যক্তি নিজের যবানকে নিয়ন্ত্রণ করে না সে অপমানিত হয়। অতএব গীবত ত্যাগ করলে নিজেকে অপমান থেকে বাঁচানো যায়।

৬. গীবত করলে অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি খারাপ ধারণা জন্ম নেয়। তাই গীবত থেকে বেঁচে থাকলে, অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি খারাপ ধারণা জন্মাবে না এবং মুসলিম ঐক্যে সৃষ্টি হয়।

৭. প্রত্যেক মুসলমানের নিকট অপর মুসলিম ভাইয়ের মান-সম্মান তার নিকট আমানতস্বরূপ। আর গীবত করলে সে আমানতের খিয়ানত করা হয়। অতএব গীবত না করলে অপর মুসলিম ভাইয়ের আমানত রক্ষা করা হয়।

৮. যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অন্যের দোষ প্রকাশ করবে না আল্লাহ তা‘আলাও কিয়ামতের দিন তার দোষ প্রকাশ করবেন না। অতএব যে গীবত হতে দূরে থাকবে সে কিয়ামতের দিন লজ্জিত হবে না।

৯. গীবত করলে সামাজিক শৃংখলা বিঘ্নিত হয়। তাই গীবত না করলে সামাজিক শৃংখলা অটুট থাকবে।

১০. কবরের আযাবের অন্যতম কারণ হচ্ছে গীবত। অতএব গীবত ত্যাগ করলে কবরের আযাব থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে।

১১. গীবত করলে শয়তান আনন্দিত হয় এবং সে তার প্রতি দ্রুত প্রাধান্য লাভ করে। আর গীবত ত্যাগ করলে শয়তান সে সুযোগ পায় না।

১২. গীবতকারীর শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, আর গীবত ত্যাগ করলে শত্রুতা কমে যায়।

১৭
গীবতের গুনাহ মোচনের উপায়
সব ধরণের অন্যায় থেকে নিজেকে হেফাযত রাখা মুমিনের একান্ত কর্তব্য। সুতরাং গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। অবশ্য কারো দ্বারা যদি এরূপ গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়ে যায় তবে তাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

ক্ষতিপূরণের দিক থেকে গুনাহ দুই প্রকার :

(ক) আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহ

(খ) বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ ।

(ক) আল্লাহর হক ঃ যা আল্লাহর হকের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা। এধরনের পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে এবং খাঁটিভাবে তওবা করতে হবে। তাহলে আল্লাহ ইচ্ছা করলে তা ক্ষমা করতে পারেন। আর আল্লাহ ক্ষমা না করলে তিনি যে শাস্তি দেবেন তা ভোগ করতে হবে।

(খ) বান্দার হক ঃ যে গুনাহ বান্দার হকের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে। দুনিয়াতে থাকতেই হকদারের সাথে এর মিমাংসা করে নিতে হবে। হয়ত তার হক ফেরত দিতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলা তা ক্ষমা করবেন না।

আর গীবত হল বান্দার হক। তাই যে গীবত করেছে তার উচিত হবে, সে যার গীবত করেছে দুনিয়াতে থাকতেই তার নিকট হতে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। নতুবা গীবতকারীর নেকী সে যার গীবত করেছে তাকে দিয়ে দেয়া হবে।

১৮
গীবতকারীকে ক্ষমা করা
কেউ ক্ষমা চাইলে তকে ক্ষমা করা উচিত। যেহেতু তিনটি গুণ খুবই উত্তম :

تُعْطِي مَنْ حَرَمَكَ، وَتَعْفُو عَمَّنْ ظَلَمَكَ، وَتَصِلُ مَنْ قَطَعَكَ

১. যে তোমাকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে দেবে।

২. যে তোমার প্রতি যুলুম করে তুমি তাকে ক্ষমা করবে।

৩. যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সম্পর্ক অটুট রাখবে। (বায়হাকী- ৭৫৮৪)

১৯
চোগলখোরি কাকে বলে?
‘‘চোগলখোরি হচ্ছে বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তির দোষ অপর ব্যক্তির নিকট বর্ণনা করা।’’

ইমাম নববী (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘‘ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির জন্য একের কথা অপরের নিকট পৌঁছানোকেই চোগলখোরি বলে।’’

গীবতের মত চোগলখোরিও একটি মারাত্মক অপরাধ। যে ব্যক্তি ক্ষতিসাধন ও শত্রুতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অপরজনের নিকট বলে বেড়ায় তাকে চোগলখোর বলে।

২০
গীবত ও চোগলখোরির মধ্যে পার্থক্য
গীবত ও চোগলখোরির মধ্যে পার্থক্য এই যে, কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দোষ বলে বেড়ানোকে গীবত বলে। আর দু’ব্যক্তির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অপরজনের নিকট বলাকে চোগলখোরি বলে। অতএব যেখানে চোগলখোরি হয় সেখানে গীবতও রয়েছে।

২১
চোগলখোরির ভয়াবহ পরিণাম
চোগলখোরের অনুসরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন :

যারা চোগলখোরি করে বেড়ায়, বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট বান্দা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَّهِيْنٍ ­ هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ ۢبِنَمِيْمٍ

‘‘তার অনুসরণ করো না যে কথায় কথায় শপথ করে, যে অতি নগণ্য, দোষারোপকারী ও চোগলখোরি করে বেড়ায়।’’ (সূরা কালাম- ১০, ১১)

চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না :

قَالَ حُذَيْفَةُ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ

হুযায়ফা (রাঃ) বললেন, আমি রাসূল ﷺ কে বলতে শুনেছি, চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বুখারী হা: ৫৬২১, মুসলিম হা: ২০০)

চোগলখোরির কারণে কবরে ভয়াবহ শাস্তি হবে :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ اِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ اَمَّا اَحَدُهُمَا فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنَ الْبَوْلِ ، وَاَمَّا الْاٰخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيْمَةِ ثُمَّ اَخَذَ جَرِيْدَةً رَطْبَةً فَشَقَّهَا نِصْفَيْنِ فَغَرَزَ فِي كُلِّ قَبْرٍ وَاحِدَةً قَالُوْا : يَا رَسُوْلَ اللهِ لِمَ فَعَلْتَ هٰذَا قَالَ لَعَلَّهٗ يُخَفَّفُ عَنْهُمَا مَا لَمْ يَيْبَسَا .

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, কবরের এ দু’ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে কোন মারাত্মক গুনাহের কারণে তারা শাস্তি ভোগ করছে না। তাদের একজনের অপরাধ হল, সে প্রস্রাব থেকে পর্দা করত না অথবা প্রস্রাবের ছিটা থেকে সর্তক থাকত না এবং অপরজনের অপরাধ হল, সে চোগলখোরি করে বেড়াত। অতঃপর নবী ﷺ একটি তাজা খেজুরের ডাল হাতে নিলেন এবং এটাকে দু’ভাগে ভাগ করে দু’কবরে পুঁতে দিলেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমনটি কেন করলেন? তখন তিনি বললেন, আমি আশা রাখি যতক্ষণ পর্যন্ত এ দু’টি ডাল তাজা থাকবে ততক্ষণ কবরের শাস্তি হালকা থাকবে।’’ (বুখারী হা: ২১৮)

এসব হাদীস থেকে জানা গেল যে, চোগলখোরি মারাত্মক গুনাহের কাজ। চোগলখোরির কারণে কবরেও শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত চোগলখোরি থেকে বিরত থাকা।

২২
চোগলখোর সম্পর্কে কতিপয় সাবধানতা
১. চোগলখোরকে বিশ্বাস করবে না। কেননা চোগলখোরের খবর গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন ‘‘যদি কোন ফাসিক তোমাদের নিকট কোন সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে আঘাত না কর এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত না হও।’’ (সূরা হুজরাত- ৬)

২. চোগলখোরকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে এবং তার কাজ যে খারাপ তা তাকে বুঝাতে হবে।

৩. যার সম্পর্কে চোগলখোরি করা হবে তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করা উচিত নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ اِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ اِثْمٌ

‘‘তোমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুমান হতে দূরে থাক। কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে অনুমান পাপ।’’ (সূরা হুজরাত- ১২)

২৩
যবান নিয়ন্ত্রণ করার গুরুত্ব
মানুষের ভাল-মন্দ নির্ভরশীল তার যবানের উপর। সে যদি নিজের যবানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, তবে তা তার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর হবে। সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-কাটাকাটি ও বিশৃংখলার মূল হচ্ছে এ যবান। আবার সকল প্রকার বন্ধুত্ব ও সহনশীলতার মূলও হচ্ছে যবান।

যারা মুমিন তারা বুঝে-শুনে পরিণতির কথা চিন্তা করে কথা বলবে। কারণ মহাবিচারের দিন মানুষের প্রতিটি কথা ও কাজের হিসাব নেয়া হবে। আর মানুষের কথা রেকর্ড করার জন্য আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيْدٌ مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ اِلَّا لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ

‘‘যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’’ (সূরা কাফ- ১৭,১৮)

যবান মানুষের জন্য এমন একটি হাতিয়ার যা তলোওয়ার থেকেও ধারালো। তলোওয়ার দ্বারা আঘাত করলে যতখানি ক্ষতি হয়, কথার দ্বারা আঘাত করলে তার চেয়েও হাজারগুণ বেশি ক্ষতি হয়। তাই রাসূল ﷺ প্রত্যেক মুসলিমকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন-

اَلْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِه وَيَدِه

‘‘মুসলিম সেই ব্যক্তি যার হাত ও জিহবা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’’ (মুসলিম হা: ১৭১)

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন-

اِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا يَرْفَعُ اللهُ بِهَا دَرَجَاتٍ وَاِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ

‘‘বান্দা কখনো কখনো এমন কথা বলে যাতে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি রয়েছে, অথচ সে এর গুরুত্ব জানে না, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। পক্ষান্তরে বান্দা কোন কোন সময় এমন কথাও বলে যাতে আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টি রয়েছে, অথচ সে তার অনিষ্টতা সম্পর্কে জানে না। কিন্তু ঐ কথার কারণেই সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

(বুখারী হা: ৪৬৭৮)

সকল অঙ্গের মধ্যে জিহবা সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর :

সুফিয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি বিষয়ের কথা বলুন যার উপর আমি আমল করব। তিনি বললেন, তুমি বল, আমার রব আল্লাহ, অতঃপর এর উপর অটল থাক। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কোন জিনিসের ভয় করেন? তখন রাসূল ﷺ তার জিহবা ধরে বললেন, এটা। (তিরমিযী হা: ২৪১০)

তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, কেবল সেসব কথা বলা যেসব কথার মধ্যে কল্যাণ নিহিত আছে। যদি কোন কথার মধ্যে উপকারিতা না থাকে তবে উত্তম হল সে কথা বলা থেকে বিরত থাকা। কারণ অনেক সময় জায়েয কথার মধ্য দিয়ে হারামের মধ্যে লিপ্ত হতে হয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই হয়ে থাকে।

২৪
যবান ব্যবহারের উত্তম ক্ষেত্রসমূহ
যেসব স্থানে কথা বলা উত্তম তার কয়েকটি হল :

১. শিক্ষামূলক আলোচনা বা বক্তৃতার ক্ষেত্রে।

২. পরস্পর ইলম তাকরার বা চর্চা করার ক্ষেত্রে।

৩. অপরকে ইলম শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে।

৪. পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া মীমাংসা করার ক্ষেত্রে।

৫. সৎ কাজের আদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে।

৬. অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার ক্ষেত্রে।

৭. কাউকে উত্তম পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে।

৮. মানুষকে সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে।

২৫
যবান ব্যবহারের নিষিদ্ধ ক্ষেত্রসমূহ
যেসব ক্ষেত্রে কথা বলা থেকে যবানকে হেফাযত করতে হবে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল :

১. মিথ্যা কথা বলা।

২. হাসি-ঠাট্টা করা।

৩. অশ্লীল কথা-বার্তা বলা।

৪. কাউকে গালি-গালাজ করা।

৫. পরের দোষচর্চা বা গীবত করা।

৬. কারো উপর অপবাদ দেয়া।

৭. চোগলখোরি করা।

৮. কারো গোপন বিষয় প্রকাশ করা।

৯. দু’মুখী নীতি গ্রহণ করা।

১০. পরস্পর ঝগড়া করা।

১১. অতিরিক্ত কথা বলা।

১২. হারাম আলোচনায় লিপ্ত হওয়া।

১৩. কাউকে অভিশাপ দেয়া।

১৪. কারো সামনে তার প্রশংসা করা।

১৫. মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলা।

১৬. অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

১৭ খোঁটা দেয়া।

২৬
কথা বলার আদব
কথা বলার কিছু আদব বা নিয়ম আছে যা মেনে চললে কথার মধ্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। নিম্নে এসব নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

১. যেসব কথার দ্বারা দ্বীন ও দুনিয়ার কোন লাভ নেই সেসব কথা মুখ দিয়ে বের করা উচিত নয়।

২. সর্বাবস্থায় উত্তেজনামূলক কথা পরিহার করতে হবে।

৩. কথা বলার আগে চিন্তা করে নিতে হবে যে, আমি কী বলছি আর এর প্রভাব কী হবে? কেননা, কোন কোন সময় হালকাভাবে এমন কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, যার কারণে ফাসাদ সৃষ্টি হয়। সবসময় পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে হবে।

৪. যাচাই বাছাই ও প্রমাণ ব্যতীত কোন কথা বলা উচিত নয়। কেননা এর প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারে।

৫. কোন প্রসঙ্গ বুঝাতে গিয়ে অতিরিক্ত কথা বলা পরিহার করতে হবে।

৬. কথা বলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কথা এত দীর্ঘ না হয়, যাতে শ্রোতা বিরক্ত হয় আবার এত সংক্ষিপ্ত যেন না হয় যে, শ্রোতা কথার অর্থই বুঝবে না।

৭. কথা পরিপূর্ণ ও স্পষ্ট করে বলতে হবে। যাতে অন্যরা সহজে বুঝতে পারে।

৮. কেউ কেউ কিছু কথা খুব জোরে বলে, আবার কিছু কথা আস্তে বলে। এতে কোনটা শুনা যায় আবার কোনটা শুনা যায় না, শ্রোতারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই কথার প্রতিটি অংশকেই স্পষ্ট করে বলতে হবে।

আনাস (রাঃ) বলেছেন, রাসূল ﷺ যখন কথা বলতেন তখন তিন বার পুনরাবৃত্তি করতেন (যেন সবাই বুঝতে পারে)। (বুখারী হা: ৯৪)

৯. গীবত, চোগলখোরী ও মুনাফিকী পরিহার করতে হবে।

১০. যদি কেউ গালি দেয় বা কটু কথা বলে তাহলে তার জওয়াব সেভাবে দেয়া যাবে না বরং উত্তম কথায় তার জওয়াব দিতে হবে, যাতে সে আরো উত্তেজিত না হয় এবং নিজের ভুল বুঝতে পারে।

১১. কারো সাথে অহেতুক বিতর্কে জড়ানো যাবে না। যদি প্রতিপক্ষ যুক্তিপ্রমাণ না মানে তাহলে সেখানে চুপ থাকতে হবে।

১২. কেউ কথা বলার সময় তার কথার মাঝখানে কথা বলবে না বরং শ্রবণ করবে, পরে সুন্দর ভাষায় এর উত্তর দেবে।

১৩. আস্তে কথা বলতে হবে। কেননা আস্তে কথা বলা তাকওয়ার পরিচয় বহন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ اِنَّ اَنْكَرَ الْاَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ

‘‘তোমার চলাফেরায় মধ্যম পন্থা অবলম্বণ কর এবং তোমার স্বরকে নীচু কর। নিশ্চয় স্বরের মধ্যে গাঁধার স্বরই সবচেয়ে অপছন্দনীয়।’’

(সূরা লুকমান- ১৯)

১৪. মেয়েরা পুরুষদের সাথে নরম ভাষায় কথা বলবে না। কারণ এতে ফিতনার আশংকা রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِه مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا

‘‘হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কোন সাধারণ স্ত্রীলোকের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে (পরপুরুষের সাথে) কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কন্ঠে কথা বল না যাতে যার অন্তরে (কু-প্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে সে লালায়িত হয়। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।’’ (সূরা আহযাব- ৩২)

১৫. মন্দ কথা পরিহার করতে হবে। কেননা শয়তান মন্দ কথার উস্কানি দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَقُلْ لِعِبَادِيْ يَقُوْلُوْا الَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُ اِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ اِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْاِنْسَانِ عَدُوًّا مُّبِيْنًا

‘‘আমার বান্দাদেরকে উত্তম কথা বলতে বলো। নিশ্চয় শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়; শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’’

(সূরা বনী ইসরাঈল- ৫৩)

১৬. অশ্লীল কথাবার্তা পরিহার করতে হবে। কেননা অশ্লীল কথাবার্তা বলা মুনাফিকদের কাজ। আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, লজ্জা ও কম কথা বলা ঈমানের দু’টি শাখা। আর অশলীল ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলা মুনাফিকীর দু’টি শাখা। ( তিরমিযী হা: ২০২৭)

১৭. সর্বদা সত্য কথা বলতে হবে, কখনও মিথ্যা বলা যাবে না। কেননা সকল পাপের উৎস হচ্ছে মিথ্যা। যে মিথ্যা বলতে পারে পাপের এমন কোন কাজ নেই যা সে করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ

‘‘সুতরাং তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাক।’’ (সূরা হাজ্জ- ৩০)

সর্বোপরি, কথা বলার পূর্বে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সর্বদা ভাল কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। আর এমনসব কথা বলা থেকে দূরে থাকতে হবে, যা দ্বারা আল্লাহ রাগান্বিত হন।

১৮. কানাকানি করে কথা বলবে না। কানাকানি কু-ধারণার জন্ম দেয়। তাই রাসূল ﷺ এটা নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন-

اِذَا كُنْتُمْ ثَلَاثَةً فَلَا يَتَنَاجٰى رَجُلَانِ دُوْنَ الْاٰخَرِ حَتّٰى تَخْتَلِطُوْا بِالنَّاسِ اَجْلَ اَنْ يُحْزِنَهٗ

‘‘যদি তিনজন লোক একসাথে থাকে, তবে দু’জন যেন অপরজনকে বাদ দিয়ে গোপন আলাপ না করে। তাদের উচিত হবে একত্রে মিলে কথা বলা নতুবা যাকে বিচ্ছিন্ন করা হবে সে চিন্তিত হবে।’’ (বুখারী হা: ৫৮৪৪)

অত্র হাদীসে রাসূল ﷺ কানাকানি করার ব্যাপারে সর্বনিম্ন তিনজন লোক নির্ধারণ করেছেন। সর্বোচ্চের কথা কিছুই বলেননি। তাই তিন বা তিনের অধিক সংখ্যক লোক উপস্থিত থাকা অবস্থায় দু’জন আলাদা হয়ে চুপে চুপে কথা বলা নিষেধ। কারণ, তৃতীয়জন ভাববে তারা হয়ত আমার সম্পর্কে কিছু বলছে। এতে তার কষ্ট হবে এবং তাদের প্রতি বিরূপ ধারণা করার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তৃতীয় জনের অনুমতি নিয়ে কথা বলবে।

২৭
কথা বলা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা
১. আল্লাহ তা‘আলা ভাল কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا يُصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর তোমরা সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের কাজকর্ম সংশোধন করে দেবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করল সে মহাসফলতা অর্জন করল।’’ (সূরা আহযাব- ৭০, ৭১)

২. আল্লাহ মন্দ কথা পছন্দ করেন না :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

لَا يُحِبُّ اللهُ الْجَهْرَ بِالسُّوْءِ مِنَ الْقَوْلِ اِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللهُ سَمِيْعًا عَلِيْمًا

‘‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর জুলুম করা হয়েছে সে ব্যতীত। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’’ (সূরা নিসা- ১৪৮)

৩. না জেনে কথা বলা নিষেধ :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِه عِلْمٌ اِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ اُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُوْلًا

‘‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; কর্ণ, চক্ষু, হৃদয়, তাদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’’ (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৬)

৪. ভাল কথা ছাড়া অন্য কথায় ফায়দা নেই :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

لَا خَيْرَ فِيْ كَثِيْرٍ مِّنْ نَجْوَاهُمْ اِلَّا مَنْ اَمَرَ بِصَدَقَةٍ اَوْ مَعْرُوْفٍ اَوْ اِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيْهِ اَجْرًا عَظِيْمًا

‘‘তাদের অধিকাংশের গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে- যে দান-খয়রাতের, সৎকমের্র ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেয়; আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্ক্ষায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দেব।’’ (সূরা নিসা : ১১৪)

৫. গোপন আলোচনাও আল্লাহ শুনতে পান :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

مَا يَكُوْنُ مِنْ نَجْوٰى ثَلَاثَةٍ اِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ اِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا اَدْنٰى مِنْ ذٰلِكَ وَلَا اَكْثَرَ اِلَّا هُوَ مَعَهُمْ اَيْنَ مَا كَانُوْا ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوْا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ

‘‘তিন জনের এমন কোন পরামর্শ হয় না, যাতে তিনি তাদের চতুর্থজন না হন; আর পাঁচ জনেরও এমন কোন পরামর্শ হয় না, যাতে তিনি তাদের ষষ্ঠজন না হন। অথবা তার চেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তিনি তাদের সাথে আছেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তারা যা করেছে। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুই জানেন।’’ (সূরা মুজাদালা- ৭)

৬. মন্দ কাজে কানাকানি করা যাবে না :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اِذَا تَنَاجَيْتُمْ فَلَا تَتَنَاجَوْا بِالْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُوْلِ وَتَنَاجَوْا بِالْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْ اِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কানে কানে কথা বল তখন পাপকার্য, উৎপীড়ন ও রাসূলের অবাধ্যতার বিষয়ে কানাকানি করো না বরং সৎকাজ ও তাকওয়া সম্পর্কে কানাকানি করো। আর তোমরা আললাহকে ভয় কর যার কাছে তোমাদের একত্রিত করা হবে।’’ (সূরা মুজাদালা- ৯)

৭. বাজে প্রশ্ন করা নিষেধ :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَسْاَلُوْا عَنْ اَشْيَاءَ اِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَاِنْ تَسْاَلُوْا عَنْهَا حِيْنَ يُنَزَّلُ الْقُرْاٰنُ تُبْدَ لَكُمْ عَفَا اللهُ عَنْهَا وَاللهُ غَفُورٌ حَلِيْمٌ قَدْ سَاَلَهَا قَوْمٌ مِنْ قَبْلِكُمْ ثُمَّ اَصْبَحُوْا بِهَا كَافِرِيْنَ

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করো না যা তোমাদের নিকট প্রকাশ হলে তা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে। কুরআন নাযিলের সময় তোমরা যদি সেসব বিষয়ে প্রশ্ন কর তবে তা তোমাদের নিকট প্রকাশ করা হবে। আল্লাহ সেসব ক্ষমা করেছেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সহনশীল। তোমাদের পূর্বেও এক সম্প্রদায় এ ধরণের প্রশ্ন করেছিল; অতঃপর তারা তা প্রত্যাখ্যান করে।’’ (সূরা মায়েদা- ১০১, ১০২)

৮. অনর্থক কথা ও কাজ ছাড়তে হবে :

আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের গুণ বর্ণনা করে বলেন-

وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ

‘‘যারা অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকে।’’ (সূরা মুমিনূন- ৩)

রাসূল ﷺ বলেন-

مِنْ حُسْنِ اِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهٗ مَالَا يَعْنِيْهِ

‘‘কোন মুসলিমের ইসলামের সৌন্দর্য হল- সে অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকবে।’’ (তিরমিযী হা: ২৩১৭)

৯. কেউ মন্দ কথা বললে তার উত্তরে ভাল কথা বলতে হবে :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِيْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهٗ عَدَاوَةٌ كَاَنَّهٗ وَلِيٌّ حَمِيْمٌ

‘‘ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মনদকে প্রতিহত কর উত্তম দ্বারা। তাহলে দেখবে তোমার এবং তোমার শত্রুর মাঝে ঘনিষ্টতা সৃষ্টি হয়ে যাবে।’’ (সূরা হা-মীম সিজদা- ৩৪)

১০. জিহবার হেফাযত নাজাতের ওসীলা :

عَنْ عُقْبَةَ بْنَ عَامِرٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : لَقِيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا، فَقُلْتُ : مَا النَّجَاةُ؟ قَالَ :" يَا عُقْبَةُ , اَمْسِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ، وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ، وَابْكِ عَلٰى خَطِيْئَتِكَ "

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল ﷺ কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! মুক্তির উপায় কী? তখন রাসূল ﷺ বললেন,

১. তুমি তোমার জিহবা নিয়ন্ত্রনে রাখ,

২. ঘরে অবস্থান কর এবং

৩. গুনাহের জন্য কান্না-কাটি কর। (তিরমিযী হা : ২৪০৬)

১১. মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলা ধ্বংস ডেকে আনে :

রাসূল ﷺ বলে-

وَيْلٌ لِلَّذِىْ يُحَدِّثُ بِالْحَدِيْثِ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ فَيَكْذِبُ وَيْلٌ لَهٗ وَيْلٌ لَهٗ

ধ্বংস তার জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে মানুষকে হাসায়। ধ্বংস তার জন্যই, ধ্বংস তার জন্যই। (তিরমিযী হা: ১৩১৫)

১২. সকালে সকল অঙ্গ মুখের কাছে ফরিয়াদ জানায় :

রাসূল ﷺ বলেন-

اِذَا اَصْبَحَ ابْنُ اٰدَمَ فَاِنَّ الْاَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُوْلُ اِتَّقِ اللهَ فِيْنَا فَاِنَّمَا نَحْنُ بِكَ فَاِنِ اسْتَقَمْتَ اِسْتَقَمْنَا وَاِنِ اعْوَجَجْتَ اِعْوَجَجْنَا

যখন কোন আদমসন্তান সকালে উপণীত হয়, তখন সকল অঙ্গ মুখের কাছে ফরিয়াদ করে বলে, আমাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় কর, কেননা আমরা তোমার উপর নির্ভরশীল। তুমি যদি সঠিক থাক, তবে আমরাও সঠিক থাকব। আর তুমি যদি বক্র হয়ে যাও, তবে আমরাও বক্র হয়ে যাব। (তিরমিযী হা: ২৪০৭)

১৩. মুখের কথা মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে :

عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاَصْبَحْتُ قَرِيْبًا مِنْهُ وَنَحْنُ نَسِيْرُ ، فَقُلْتُ : يَا نَبِيَّ اللهِ ، اَخْبِرْنِيْ بِعَمَلٍ يُدْخِلُنِي الْجَنَّةَ ، وَيُبْعِدُنِيْ عَنِ النَّارِ ، قَالَ : لَقَدْ سَاَلْتَ عَنْ عَظِيْمٍ ، وَاِنَّهٗ لَيَسِيْرٌ عَلٰى مَنْ يَسَّرَهُ اللهُ عَلَيْهِ ، تُقِيْمُ الصَّلَاةَ ، وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ ، وَتَصُوْمُ رَمَضَانَ ، وَتَحُجُّ الْبَيْتَ , ثُمَّ قَالَ : اَلَا اَدُلُّكَ عَلٰى اَبْوَابِ الْخَيْرِ ؟ اَلصَّوْمُ جُنَّةٌ ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيْئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ , ثُمَّ تَلَا { تَتَجَافٰى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ } حَتّٰى { يَعْمَلُوْنَ } ثُمَّ قَالَ : اَلَا اُخْبِرُكَ بِرَأْسِ الْاَمْرِ وَعَمُوْدِه وَذِرْوَةِ سَنَامِه ؟ قُلْتُ : بَلٰى يَا رَسُوْلَ اللهِ ، قَالَ : رَأْسُ الْاَمْرِ اَلْاِسْلَامُ ، وَعَمُوْدُهٗ اَلصَّلَاةُ ، وَذِرْوَةُ سَنَامِه اَلْجِهَادُ , ثُمَّ قَالَ : اَلَا اُخْبِرُكَ بِمِلَاكِ ذٰلِكَ كُلِّه ؟ قُلْتُ : بَلٰى يَا رَسُوْلَ اللهِ ، فَاَخَذَ بِلِسَانِه فَقَالَ : كُفَّ عَلَيْكَ هٰذَا , قُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ، وَاِنَّا لَمُؤَاخَذُوْنَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِه ؟ قَالَ : ثَكِلَتْكَ اُمُّكَ يَا مُعَاذُ ، وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلٰى وُجُوْهِهِمْ ، اَوْ قَالَ : عَلٰى مَنَاخِرِهِمْ ، اِلَّا حَصَائِدُ اَلْسِنَتِهِمْ ؟ .

মুয়াজ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ এর সাথে ছিলাম এবং আমি তার কাছাকাছি অবস্থান করছিলাম। আমরা তখন সফররত অবস্থায় ছিলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। তিনি বললেন, তুমি অনেক বড় একটি বিষয়ে প্রশ্ন করেছ। তবে আল্লাহ যার জন্য সহজ করে দেন সেটা তার জন্য খুবই সহজ। তুমি নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমাযান মাসে রোযা রাখবে, বাইতুল্লায় হজ্জ করবে। অতঃপর তিনি বললেন, আমি কি তোমাকে কল্যাণের দরজাসমূহের কথা বলে দেব না? তা হল,

১. সিয়াম (রোযা), এটা ঢালস্বরূপ।

২. সাদকা, এটা ঐভাবে গুনাহকে মিটিয়ে দেয় যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।

৩. রাতের গভীরে নামায পড়া।

অতঃপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন-

تَتَجَافىٰ جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا وَّمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ -- فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا اُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرَّةِ اَعْيُنٍ جَزَاءً ۢبِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ

‘‘তাদের দেহ-পার্শ্ব বিছানা থেকে এমনভাবে আলাদা হয়ে যায় যে, তারা তাদের প্রতিপালককে আহবান করতে থাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। কেউই জানে না তাদের জন্য নয়ন জুড়ানো কী কী সামগ্রী লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদানস্বরূপ?’’ (সূরা সিজদা- ১৫-১৭)

অতঃপর বললেন, আমি কি তোমাকে সকল কাজের মাথা, ভিত্তি এবং চুড়ান্ত শিখরের কথা বলব? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! বলুন। তিনি বললেন,

১. সবকিছুর মূল হচ্ছে ইসলাম।

২. আর তার ভিত্তি হচ্ছে নামায।

৩. আর তার চুড়ান্ত শিখর হচ্ছে জিহাদ।

অতঃপর তিনি বললেন, আমি কি এসব কিছুর সারকথা তোমাকে বলব? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। অতঃপর তিনি তার জিহবা ধরে বললেন, তুমি এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যেসব কথা বলি তার জন্যও কি পাকড়াও হব? তিনি বললেন, হে মুয়াজ! তোমার মায়ের সর্বনাশ হোক (এটা আক্ষেপসূচক কথা), মানুষ উপুড় হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে কেবল তার মুখের কথার কারণে।

(নাসাঈ হা: ১১৩৯৪)

২৮
দ্বিতীয় অধ্যায় তওবা
তওবা আল্লাহ তা‘আলার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় ও প্রশংসনীয় কাজ। মানুষ যখন পাপ করে আন্তরিকভাবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহ তা’আলার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তখন এটা তাকে আনন্দিত ও গর্বিত করে থাকে। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বার বার বান্দাদেরকে তওবা করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেন-

وَتُوْبُوْا اِلَى اللهِ جَمِيْعًا اَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর- ৩১)

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا تُوْبُوْا اِلَى اللهِ تَوْبَةً نَصُوْحًا

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা একান্ত খালিসভাবে আল্লাহর নিকট তওবা কর।’’

(তাহরীম- ৮)

এ কারণে তওবাটাই হচ্ছে মুমিন ব্যক্তির সর্বত্তোম গুণ। আর সাধারণত মুমিনরাই বেশি বেশি তওবা করে থাকে। কেননা মুমিনরা মনে করে যে, প্রতিদিন তার দ্বারা অনেক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اَلتَّائِبُوْنَ الْعَابِدُوْنَ الْحَامِدُوْنَ السَّائِحُوْنَ الرَّاكِعُوْنَ السَّاجِدُوْنَ الْاٰمِرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّاهُوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَالْحَافِظُوْنَ لِحُدُوْدِ اللهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ

‘‘তারা তওবাকারী, ইবাদাতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকুকারী, সিজ্দাকারী, সৎকার্যের আদেশ দানকারী, অসৎকার্যে নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা সংরক্ষণকারী; এ মুমিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।’’ (সূরা তওবা- ১১২)

২৯
তওবার পরিচিতি
‘তওবা’ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হল- ফিরে আসা। এ শব্দটি আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত হয় আবার বান্দার দিকেও সম্পৃক্ত হয়। বান্দার দিকে সম্পৃক্ত হলে এর অর্থ হয়, গুনাহের কাজ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা। এটা বান্দার তওবা। আর আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত হলে এর অর্থ হয়, পাপের কারণে আল্লাহ ঐ বান্দাকে শাস্তি দিতে চান, কিন্তু তওবা করার কারণে আল্লাহ শাস্তির দিকে না গিয়ে বান্দাকে ক্ষমা করার দিকে ফিরে আসেন।

‘তওবা’ শব্দের আরো একটি অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মনোযোগী হওয়া। যবান দ্বারা তওবার শব্দ উচ্চারণ করা হোক বা না হোক- যদি পাপী ব্যক্তি আন্তরিক লজ্জা ও অনুতাপ এবং ভবিষ্যতে আর পাপ না করার দৃঢ়-সংকল্পের সাথে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে তবেই তা তওবা বলে গণ্য হবে।

নিচের ছয়টি বিষয়ের সমন্বয়ে তওবা পূর্ণতা লাভ করে ।

১. অতীত মন্দকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।

২. যেসব ফরয তরক করা হয়েছে, সেগুলোর কাজা আদায় করা।

৩. কারো ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করে থাকলে তা ফেরত দেয়া, অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া।

৪. কাউকে হাতে বা মুখে কষ্ট দিয়ে থাকলে সেজন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়া।

৫. ভবিষ্যতে সেই গুনাহের কাছে না যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা।

৬. নিজেকে যেমন আল্লাহ তা‘আলা নাফরমানী করতে দেখেছিল, তেমনি এখন আনুগত্য করতে দেখা।

মানুষ তার নিজের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে এবং চিন্তা করবে যে, আল্লাহ তা’আলা আমার স্রষ্টা ও মালিক। তিনি আমাকে অস্তিত্তব দান করেছেন, নানা প্রকার নিয়ামত দ্বারা পুরস্কৃত করেছেন, অঙ্গ-প্রতঙ্গসমূহ দান করেছেন, সম্পদশালী করেছেন। আর আমি তাঁর নিয়ামতসমূহকে আনুগত্যের বদলে পাপকর্মসমূহে ব্যবহার করেছি! এটা কত বড় অকৃতজ্ঞতা!! তাই লজ্জার সাথে দৃঢ় সংকল্প চিত্তে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে, ভবিষ্যতে আর এসব পাপ করব না এটাই হবে যথার্থ তওবা। শুধুমাত্র যবান দ্বারা তওবা করলেই তওবা হয় না।

৩০
তওবার গুরুত্ব
বান্দা কর্তৃক পাপ সংঘটিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু পাপ সংঘটিত হয়ে গেলে লজ্জিত হয়ে আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা চেয়ে পাপ থেকে ফিরে আসতে হবে তাহলে আল্লাহ তা’আলা বান্দার সেই পাপকে ক্ষমা করে দেবেন। এজন্য তওবার গুরুত্ব অপরিসীম।

যেসব বান্দারা আল্লাহর কাছে তওবা করে না আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন না। বরং তিনি সেসব বান্দাদের বেশি ভালবাসেন, যারা সর্বদা নিজেদের ভুল স্বীকার করে এবং বেশি বেশি তওবা করে থাকে।

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন-

كُلُّ بَنِي اٰدَمَ خَطَّاءٌ ، وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ

‘‘প্রত্যেক লোকই পাপী। আর সর্বোত্তম পাপী হচ্ছে যারা বেশি বেশি তওবা করে থাকে।’’ (তিরমিযী হা: ২৪৯৯)

পাপ মোচনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে তওবা। এমন কোন পাপ নেই যা আল্লাহ তা‘আলা তওবার মাধ্যমে ক্ষমা করেন না। বান্দার পাপের পরিমাণ যদি আকাশচুম্বী হয় তবুও তিনি তওবার কারণে তাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেন-

قُلْ يَا عِبَادِيْ الَّذِيْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰى اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ اِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا اِنَّهٗ هُوْ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ

‘‘বল হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ তারা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা যুমার- ৫৩)

তওবা হচ্ছে একটি ইবাদাত। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর আদেশকে মান্য করা হয়। আর যা দ্বারা আল্লাহর আদেশ মান্য করা হয় তাই ইবাদাত।

সর্বোপরি বান্দার পাপকর্মের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তওবার গুরুত্ব অপরিসীম। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তওবা কবুলের ঘোষণা দিয়েছেন, সেহেতু প্রত্যেক মুমিন বান্দার কর্তব্য হল সবসময় তওবা ও ইস্তেগফার করা। কেননা জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। মানুষ হিসেবে তাকে যেকোন সময় মৃত্যুবরণ করতে হবে। আর সে যদি তওবা না করেই মৃত্যুবরণ করে তাহলে কবরে ভীষণ আযাব ভোগ করতে হবে।

আর পরকালেও এজন্য ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই সকল মুসলিম নর-নারীর জন্য প্রতিদিনই খালিস নিয়তে তওবা করা অতীব জরুরি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদেরকে সে তাওফীক দান করুন। আমীন!

৩১
তওবা করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ
আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَاسْتَغْفِرِ اللهَ اِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا

‘‘তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা নিসা- ১০৬)

وَاسْتَغْفِرُوْا اللهَ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’ (সূরা মুয্যাম্মিল- ২০)

فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا

‘‘অতঃপর তুমি তোমার মালিকের প্রশংসা কর এবং তাঁর কাছেই ক্ষমাপ্রার্থনা কর। অবশ্যই তিনি তওবা কবুলকারী।’’ (সূরা নাসর- ৩)

আল্লাহ ক্ষমার ওয়াদা দিয়েছেন :

وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَّاَجْرٌ عَظِيْمٌ

‘‘যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাদের জন্য ক্ষমা এবং মহাপুরস্কার রয়েছে।’’ (সূরা মায়িদা- ৯)

وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَّاَجْرًا عَظِيْمًا

‘‘এ লোকদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে আল্লাহ তাদের সাথে মাগফিরাত ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা করেছেন।’’(সূরা ফাত্হ- ২৯)

আল্লাহ মানুষকে ক্ষমার দিকে ডাকেন :

وَاللهُ يَدْعُوْ اِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِاِذْنِهٖ وَيُبَيِّنُ اٰيَاتِهٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُوْنَ

‘‘আল্লাহ স্বেচ্ছায় জান্নাত ও ক্ষমার দিকে ডাকেন। এবং তাঁর আয়াতসমূহ মানুষদের জন্য বর্ণনা করেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।’’

(সূরা বাকারা- ২২১)

৩২
তওবার মর্যাদা
তওবা একটি মহৎ কাজ। তওবার মাহাত্ম্যের ব্যাপারে রাসূল ﷺ একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন-

لَلّٰهُ اَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ اَحَدِكُمْ مِنْ اَحَدِكُمْ بِضَالَّتِهٖ اِذَا وَجَدَهَا

তোমাদের কেউ হারানো জিনিস পেয়ে যে পরিমাণ খুশি হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হন যখন কোন বান্দা তাঁর কাছে তওবা করে। (মুসলিম হা: ৭১২৯)

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন কোন বান্দা গুনাহ করে ফেলে তারপর বলে اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِىْ ذَنْبِىْ ‘‘হে আল্লাহ! আমার পাপ সমুহ্ ক্ষমা করে দাও।’’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা গুনাহ করেছে আর সে এটাও জানে যে, তার একজন রব আছেন যিনি গুনাহ ক্ষমা করে দেন! এভাবে যে বান্দা গুনাহ করে এবং আমার কাছে ক্ষমা চায় আমি আমার সে বান্দাকে ক্ষমা করে দেই। (মুসলিম হা: ৭১৬২)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তওবার মাহাত্ম্যের কারণে এর সময়সীমাও শেষ দিন পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে-

عَنْ مُعَاوِيَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ َ وَسَلَّمَ - يَقُولُ لَا تَنْقَطِعُ الْهِجْرَةُ حَتّٰى تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَلَا تَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا

মুয়াবিয়া (রাঃ) রাসূল ﷺ কে বলতে শুনেছেন যে, হিজরত বন্ধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তওবা বন্ধ না হবে। আর তওবার দরজা বন্ধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত না হবে। (আবু দাউদ হা: ২৪৮১)

আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদিনই বান্দার তওবা কবুল করেন :

عَنْ اَبِىْ مُوْسٰى رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِىِّ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ َ وَسَلَّمَ- قَالَ « اِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهٗ بِاللَّيْلِ لِيَتُوْبَ مُسِىءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهٗ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا » .

আবু মূসা (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সেসব লোকের তওবা কবুল করার জন্য রাত্রিবেলায় হাত প্রসারিত করে থাকেন, যারা দিনের বেলায় পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল এবং সেসব লোকের তওবা কবুল করার জন্য দিনের বেলায় হাত প্রসারিত করে থাকেন, যারা রাত্রিবেলায় পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল। পশ্চিম দিগন্ত হতে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (এরূপ হতে থাকবে)। (মুসলিম হা: ৭১৬৫)

৩৩
তওবা কবুলের দৃষ্টান্ত
আল্লাহ আদম (আঃ) এর তওবা কবুল করেছেন :

অভিশপ্ত শয়তান যখন আললাহর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে আদম (আঃ) কে সিজদা করল না এবং লজ্জিত ও অনুতপ্ত হল না। বরং তার পরিবর্তে যুক্তি উপস্থাপন করে সে আল্লাহ তা‘আলার আদেশকেই অশুদ্ধ প্রমাণ করতে চেয়েছিল। যার কারণে সে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হয়েছে।

পক্ষান্তরে আদম (আঃ) যখন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহ তা‘আলার নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করে ফেলেন, তখন তিনি যুক্তি প্রদর্শন করার পরিবর্তে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন। তাই আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করেছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহ তা‘আলা এ ঘটনাকে মানুষের জন্য তওবা কবুলের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন-

فَتَلَقّٰى اٰدَمُ مِنْ رَّبِّهٖ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ اِنَّهٗ هُوْ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ

‘‘অতঃপর আদম তাঁর রবের পক্ষ হতে কতিপয় বাক্য শিক্ষা করলেন (তওবা করলেন), আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করলেন, তাঁকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।’’ (সূরা বাকারা- ৩৭)

৩৪
আল্লাহই একমাত্র তওবা কবুলকারী
তওবা গ্রহণের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নেই। তওবা কবুল করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَمَنْ يَّغْفِرُ الذُّنُوبَ اِلَّا اللهُ

‘‘আল্লাহ ব্যতীত এমন কে আছে, যে পাপ মোচন করতে পারে?’’

(সূরা আলে ইমরান- ১৩৫)

غَافِرِ الذَّنْبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيْدِ الْعِقَابِ ذِيْ الطَّوْلِ لَا اِلٰهَ اِلَّا هُوْ اِلَيْهِ الْمَصِيْرُ

‘‘যিনি পাপ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী, যিনি শাস্তিদানে কঠোর ও শক্তিশালী। তিনি ব্যতীত (সত্য) কোন মাবুদ নেই। তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’’ (সূরা মু’মিন- ৩)

اَلَمْ يَعْلَمُوْا اَنَّ اللهَ هُوْ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهٖ وَيَأْخُذُ الصَّدَقَاتِ وَاَنَّ اللهَ هُوْ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ

‘‘তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং সাদকা গ্রহণ করেন? নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা তওবা- ১০৪)

وَهُوْ الَّذِيْ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُوْ عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُوْنَ

‘‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপ মোচন করেন এবং তোমরা যা কর তিনি তা জানেন।’’ (সূরা শূরা- ২৫)

يُرِيْدُ اللهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيْكُمْ سُنَنَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوْبَ عَلَيْكُمْ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ

‘‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের নিকট (সবকিছুর) বিশদভাবে বর্ণনা করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদের ক্ষমা করতে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা নিসা- ২৬)

৩৫
আল্লাহর ক্ষমাপরায়ণতা
আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তাঁর ক্ষমা ও দয়া মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَاِنْ تَعُدُوْا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا اِنَّ اللهَ لَغَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে এর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক ক্ষমাপরায়ণ ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা নাহল- ১৮)

نَبِّئْ عِبَادِيْ اَنِّيْ اَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِيْم ---- - وَاَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْاَلِيمُ ُ

‘‘আমার বান্দাদেরকে বলে দাও যে, আমি তো অধিক ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। আর নিশ্চয় আমার শাসিত্মও যন্ত্রণাদায়ক ’’ (সূরা হিজর- ৪৯)

وَاِنَّ رَبَّكَ لَذُوْ مَغْفِرَةٍ لِّلنَّاسِ عَلٰى ظُلْمِهِمْ وَاِنَّ رَبَّكَ لَشَدِيْدُ الْعِقَابِ

‘‘মানুষের সীমালঙ্ঘন সত্ত্বেও তোমার প্রতিপালক মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল এবং তোমার প্রতিপালক শাসিত্ম দানেও কঠোর।’’ (সূরা রা‘দ্- ৬)

وَرَبُّكَ الْغَفُوْرُ ذُوْ الرَّحْمَةِ لَوْ يُؤَاخِذُهُمْ بِمَا كَسَبُوْا لَعَجَّلَ لَهُمُ الْعَذَابَ بَلْ لَهُمْ مَوْعِدٌ لَّنْ يَّجِدُوْا مِنْ دُوْنِهٖ مَوْئِلًا

‘‘তোমার প্রতিপালক পরম ক্ষমাশীল ও দয়াবান। তাদের (মানুষের) কৃতকর্মের জন্য যদি তিনি তাদেরকে পাকড়াও করতে চাইতেন, তবে তিনি অবশ্যই তাদের শাসিত্ম ত্বরান্বিত করতেন। কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে এক প্রতিশ্রুতি মুহুর্ত, যা হতে তারা কখনই কোন আশ্রয়স্থল পাবে না।’’

(সূরা কাহ্ফ- ৫৮)

اِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ هُوْ اَعْلَمُ بِكُمْ اِذْ اَنْشَاَكُمْ مِنَ الْاَرْضِ وَاِذْ اَنْتُمْ اَجِنَّةٌ فِيْ بُطُوْنِ اُمَّهَاتِكُمْ فَلَا تُزَكُوْا اَنْفُسَكُمْ هُوْ اَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقٰى

‘‘তোমার প্রতিপালকের ক্ষমা অপরিসীম; তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত, যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং এক সময় তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রুণরূপে ছিলে। অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না; তিনিই ভাল জানেন কে মুত্তাকী ।’’ (সূরা নাজম- ৩২)

আল্লাহর ক্ষমা সীমাহীন :

حَدَّثَنَا اَنَسُ بْنُ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ َ وَسَلَّمَ - يَقُولُ - قَالَ اللهُ يَا ابْنَ اٰدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِى وَرَجَوْتَنِى غَفَرْتُ لَكَ عَلٰى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا اُبَالِى يَا ابْنَ اَدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِى غَفَرْتُ لَكَ وَلَا اُبَالِى يَا ابْنَ اُدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الْاَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لَاتُشْرِكُ بِى شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً

আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, হে আদমসন্তান! তুমি যতক্ষণ আমার নিকট প্রার্থনা করতে থাকবে এবং আমার প্রতি আশা পোষণ করতে থাকবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করতে থাকব। তোমার পাপের পরিমাণ যতই হোক না কেন আমি পরোওয়া করি না। হে আদমসন্তান! যদি তোমার পাপ আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, আর তুমি আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা কর তাহলেও আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। হে আদমসন্তান! তুমি যদি আমার নিকট এতবেশি পাপ নিয়ে আগমন কর যে, তার দ্বারা সমগ্র পৃথিবী ভরেও যায়, আর তুমি কাউকে আমার সাথে শরীক না কর, তা হলে আমিও পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার দিকে আসব। (তিরমিযী : ৩৫৪০)

এ হাদীসটি মুমিন বান্দাদের জন্য একটি সাধারণ ঘোষণা বিশেষ। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মাগফেরাতের জন্য এমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন যে, তারা বিনয় ও নম্রতা সহকারে তাঁর দরবারে দৃঢ় প্রত্যাশী হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এত ক্ষমা উপহার দেবেন যে, বান্দা তা কল্পনাও করতে পারবে না।

৩৬
আল্লাহ যেকোন ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে পারেন
আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা অনুযায়ী তিনি যেকোন ব্যক্তির তওবাই কবুল করতে পারেন। বান্দা যখনই নিজ অপরাধ স্বীকার করে আল্লাহর কাছে তওবা করে তখনই আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ جُنْدَبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ اَنَّ رَسُولَ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ َ وَسَلَّمَ - حَدَّثَ - اَنَّ رَجُلاً قَالَ وَاللهِ لَا يَغْفِرُ اللهُ لِفُلَانٍ وَاِنَّ اللهَ تَعَالٰى قَالَ مَنْ ذَا الَّذِىْ يَتَاَلّٰى عَلَىَّ اَن لَّااَغْفِرَ لِفُلَانٍ فَاِنِّى قَدْ غَفَرْتُ لِفُلَانٍ وَاَحْبَطْتُ عَمَلَكَ

জুনদুব (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, জনৈক ব্যক্তি কোন এক গুনাহগার ব্যক্তি সম্পর্কে বলল যে, আল্লাহর কসম! অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কে সেই ব্যক্তি যে আমার সম্পর্কে শপথ করে বলছে যে, আমি অমুক ব্যক্তিকে ক্ষমা করব না? তুমি জেনে রাখ, আমি অমুক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছি, আর তোমার আমলকে বরবাদ করে দিয়েছি। (মুসলিম হা: ৬৮৪৭)

এ হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝখানে হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। ব্যক্তি যখন বিধি মোতাবেক তওবা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন। কেউ কেউ বলে বসে যে, অমুক ব্যক্তিকে কেমন করে ক্ষমা করা হবে? এসব কথা ঈমানের পরিপন্থি। প্রত্যেকেরই তার নিজ সম্পর্কে চিন্তা করা আবশ্যক। নিজের ইবাদাত ও তাকওয়ার উপর অহংকার করা এবং স্বীয় মাগফেরাত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, আর অন্যের পাপের প্রতি দৃষ্টিপাত করা এবং এরূপ মনে করা যে, অমুক ব্যক্তিকে কেমন করে ক্ষমা করা হবে, এসব মুমিনের কাজ নয়।

৩৭
আল্লাহ যাদেরকে বেশি বেশি ক্ষমা করেন
মহান আল্লাহর ক্ষমার হাত সকলের জন্য প্রসারিত থাকার পরও কিছু কিছু বিশেষ ব্যক্তি আছেন যাদের তওবা আল্লাহ তা‘আলা আরো বেশি এবং খুব দ্রুত কবুল করে থাকেন। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হল :

যারা গুনাহের পর দ্রুত ক্ষমা চায় :

وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوْءًا اَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهٗ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا

‘‘কেউ কোন মন্দকাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করলে আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবেই পাবে।’’ (সূরা নিসা- ১১০)

যারা মুর্খতাবশত পাপ করে বসে তারপর তওবা করে নেয় :

مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوْءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْ بَعْدِهٖ وَاَصْلَحَ فَاَنَّهٗ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর তওবা করে এবং সংশোধন করে তবে তো আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’

(সূরা আন‘আম- ৫৪)

فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهٖ وَاَصْلَحَ فَاِنَّ اللهَ يَتُوْبُ عَلَيْهِ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘নিজের প্রতি অত্যাচার করার পর যে তওবা করে নেয় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, নিশ্চয় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। আল্লাহ তো অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা মায়িদা- ৩৯)

যারা পাপ থেকে বিরত থাকে :

فَاِنِ انْتَهَوْا فَاِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘অতঃপর যদি তারা (পাপ থেকে) বিরত হয় তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’’ (সূরা বাকারা- ১৯২)

যারা নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় :

اِلَّا الَّذِيْنَ تَابُوْا مِنْ بَعْدِ ذٰلِكَ وَاَصْلَحُوْا فَاِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তবে যারা পাপ করার পর তওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয়, তাদের ক্ষেত্রে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।’’ (সূরা আলে ইমরান- ৮৯)

যারা পাপ ছেড়ে নেক আমল শুরু করে দেয় :

اِلَّا مَنْ ظَلَمَ ثُمَّ بَدَّلَ حُسْنًا بَعْدَ سُوْءٍ فَاِنِّيْ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তবে যারা যুলুম করার পর মন্দকর্মের পরিবর্তে সৎকর্ম করে, তাদের প্রতি আমি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা নামল- ১১)

وَاِنِّيْ لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ وَاٰمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدٰى

‘‘আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি, যে তওবা করে, ঈমান আনে, সৎকর্ম করে ও সৎপথে অবিচল থাকে।’’ (সূরা ত্বা-হা- ৮২)

যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে :

فَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيْمٌ

‘‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।’’ (সূরা হাজ্জ- ৫০)

وَاَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ اِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذٰلِكَ ذِكْرٰى لِلذَّاكِرِيْنَ

‘‘তুমি সালাত কায়েম কর দিনের দু’প্রামত্মভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে, এটা তাদের জন্য এক উপদেশ।’’ (সূরা হূদ- ১১৪)

যাদের মধ্যে তাকওয়া আছে :

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَاٰمِنُوْا بِرَسُوْلِهٖ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَّحْمَتِهٖ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُوْرًا تَمْشُوْنَ بِهٖ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তার রাসূল ﷺ এর প্রতি ঈমান আন, তিনি তার অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন আলো, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’ (সূরা হাদীদ- ২৮)

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَّيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ ذُوْ الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ

‘‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন, আর আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়।’’

(সূরা আনফাল- ২৯)

যারা উপদেশ মেনে চলে :

اِنَّمَا تُنْذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّكْرَ وَخَشِيَ الرَّحْمٰنَ بِالْغَيْبِ فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَّاَجْرٍ كَرِيْمٍ

‘‘আপনি কেবল তাকেই সতর্ক করতে পারেন, যে উপদেশ মেনে চলে এবং না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে। অতএব আপনি তাকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন ক্ষমা ও উত্তম পুরস্কারের।’’ (সূরা ইয়াসীন- ১১)

যারা জান-মাল দিয়ে জিহাদ করে :

فَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا وَاُخْرِجُوْا مِنْ دِيْارِهِمْ وَاُوذُوْا فِي سَبِيْلِيْ وَقَاتَلُوْا وَقُتِلُوْا لَاُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَاُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللهِ وَاللهُ عِنْدَهٗ حُسْنُ الثَّوَابِ

‘‘যারা হিজরত করেছে ও তাদের ঘর-বাড়ি হতে বিতাড়িত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং হত্যা করেছে ও নিহত হয়েছে, নিশ্চয় আমি তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করব এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব যার নিচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। এটা আল্লাহর নিকট হতে প্রতিদান এবং আল্লাহর নিকট উত্তম প্রতিদান রয়েছে।’’ (সূরা আলে ইমরান- ১৯৫)

تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُوْلِهٖ وَتُجَاهِدُوْنَ فِي سَبِيْلِ اللهِ بِاَمْوَالِكُمْ وَاَنْفُسِكُمْ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ - يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِيْ جَنَّاتِ عَدْنٍ ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ

‘‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম যদি তোমরা জানতে! (আললাহ) তোমাদের পাপ রাশি ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত এবং স্থায়ী জান্নাতের উত্তম বাসগৃহে। এটাই হচ্ছে মহাসাফল্য।’’ (সূরা সাফ- ১১,১২)

যারা আল্লাহর পথে দান করে :

اِنْ تُقْرِصُوْا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعِفْهُ لَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ شَكُوْرٌ حَلِيْمٌ

‘‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তবে তিনি তোমাদের জন্য এটা বহু গুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী ও সহনশীল।’’ (সূরা তাগাবুন- ১৭)

যারা নবী ﷺ এর অনুসরণ করে :

قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তুমি বলে দাও, যদি তোমরা আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’

(সূরা আলে ইমরান- ৩১)

যারা সত্য ও সঠিক কথা বলে :

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا - يُصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। আল্লাহ তোমাদের ‘আমলগুলোকে সংশোধন করবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করবেন। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে তো মহাসাফল্য লাভ করবে।’’ (সূরা আহ্যাব- ৭০,৭১)

যারা মানুষের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেয় :

وَلْيَعْفُوْا وَلْيَصْفَحُوا اَ لَا تُحِبُوْنَ اَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘মানুষকে ক্ষমা কর এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা নূর- ২২)

যারা কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে :

اِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيْمًا

‘‘তোমাদেরকে যে সকল কবীরা গুনাহ হতে নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকলে আমি তোমাদের (অতীতের) গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।’’ (সূরা নিসা- ৩১)

৩৮
যাদেরকে তওবা ছাড়া ক্ষমা করা হয় না
এ কথা সঠিক যে, আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে-ই তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে তাকেই তিনি ক্ষমা করতে পারেন। তবে এটা হয় গুনাহের স্তর অনুযায়ী। যার গুনাহ যত বড় হবে তাকে সেভাবেই তওবা করতে হবে। কতক গুনাহ আছে নেক আমলের মাধ্যমে আপনা-আপনিই ক্ষমা হয়ে যায়। কতক গুনাহ আছে খালিস তওবা ছাড়া সেগুলো ক্ষমা হয় না। আবার এমনও গুনাহ আছে তওবা ছাড়া মারা গেলে পরকালে আল্লাহ তা‘আলা ঐ গুনাহ ক্ষমা করবেন না। যেমন-

শিরকের গুনাহ :

গুনাহের মধ্যে একটি বড় গুনাহ হচ্ছে শিরক। এটা এমন একটি গুনাহ যা আল্লাহ তা‘আলা খালিস তওবা ছাড়া ক্ষমা করেন না। কেননা এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার একত্বাবাদকে অস্বীকার করা হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা খালিস তওবা ছাড়া এটা ক্ষমা করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ اَنْ يُّشْرَكَ بِهٖ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَن يَّشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرٰى اِثْمًا عَظِيْمًا

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শিরক স্থাপনের পাপ ক্ষমা করবেন না। এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।’’ (সূরা নিসা- ৪৮)

অত্র আয়াতে আললাহ তা‘আলা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যারা তওবা না করে মৃত্যুবরণ করবে। তারা যখন শির্কের গুনাহ নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে তখন আল্লাহ তা‘আলা এ গুনাহের কারণে তাদের অন্যসব গুনাহ তিনি ক্ষমা করবেন না।

তবে মুশরিক ব্যক্তি যদি দুনিয়াতে অনুতপ্ত হয়ে খালিস নিয়তে তওবা করে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চলে এবং সৎ আমল করে তবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন।

যারা মুনাফিকী করে :

سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ اَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ اَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَن يَّغْفِرَ اللهُ لَهُمْ اِنَّ اللهَ لَا يَهْدِيْ الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ

‘‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা কর অথবা না কর, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না।’’ (সূরা মুনাফিকূন- ৬)

অত্র আয়াত আল্লাহ তা‘আলা মদীনার সবচেয়ে বড় মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কে অবর্তীন করেছেন। আয়াতটি ব্যক্তি সম্পর্কে অবতীর্ণ হলেও যারাই মুনাফিকী করবে তাদের প্রত্যেকেই এ আয়াতের আওতায় পড়বে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূল ﷺ ও মুমিনদের সাথে এমন আচরণ করত যে, তার চেয়ে বড় মুমিন আর কেউ নেই। আবার তাদের থেকে একটু আড়াল হলে কাফেরদের সাথে মিলিত হয়ে কুফুরীতে লিপ্ত হয়ে পড়ত। যার দ্বারা প্রমাণ হয় যে, সে মূলত কুফুরীতে লিপ্ত ছিল, আর উপরে উপরে মুমিন বলে পরিচয় দিত। তাই রাসূল ﷺ তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলে মহান আল্লাহ তার আবেদন নাকচ করে দেন। এমনকি এ কথাও বলে দেন যে, তুমি যদি ৭০ বার তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা কর তবুও তাকে ক্ষমা করা হবে না।

সুতরাং বুঝা গেল যে, আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকীর গুনাহ ক্ষমা করেন না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!

যারা বিদ‘আত করে :

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিদআতীর তওবা স্থগিত করে রেখেছেন, যতক্ষণ না সে তার বিদআতকে পরিত্যাগ করবে। (তাবরানী, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত্তারহীব হা: ৫৪)

এ হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, বিদআতী যতক্ষণ পর্যন্ত বিদআত পরিত্যাগ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার তওবা কবুল হবে না। বিদআত অত্যন্ত মন্দকাজ।

রাসূল ﷺ আমাদেরকে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন উপহার দিয়েছেন। সুতরাং এ দ্বীনের মধ্যে কোনকিছু কমানো বা বাড়ানোর অধিকার কারো নেই। যে ব্যক্তি কোন বিদআত প্রচলন করে, সে যেন এটা প্রকাশ করে যে, রাসূল ﷺ আমাদের নিকট পূর্ণাঙ্গ দ্বীন পৌঁছিয়ে যাননি। ইসলামের মধ্যে যে অভাব থেকে গিয়েছিল, এটাকে সে পূর্ণ করছে। (নাউযু বিল্লাহ)। এটা বিরাট গোমরাহী। এ গোমরাহীর মধ্যে অনেক লোকই লিপ্ত রয়েছে। তারা বিদআতের সাথে এমনভাবে জড়িত যে, শত বুঝালেও তারা তা থেকে ফিরে আসে না। যার কারণে তাদের তওবা করারও সুযোগ হয় না। এ জন্য তাদের কোন আমল কাজে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْاَخْسَرِيْنَ أَعْمَالًا اَلَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا

(হে নবী!) আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে আমলের দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে সংবাদ দেব? (তারা হচ্ছে) যাদের দুনিয়ার জীবনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে অথচ তারা ধারণা করছে যে, তারা উত্তম কাজ করছে। (সূরা কাহফ- ১০৩, ১০৪)

যারা ঈমান এনেও বারবার কুফরী করে :

যারা ঈমান আনার পরও কুফরী কাজে লিপ্ত হয়, এমনকি বার বার কুফরী করে আর এ অবস্থায়ই মৃত্যু বরণ করে, তাদের তওবা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بَعْدَ اِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوْا كُفْرًا لَّنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَاُولٰئِكَ هُمُ الضَّالُوْنَ

নিশ্চয় যারা ঈমান আনার পরও কুফরী করে, এরপর সেই কুফরীকে বৃদ্ধি করে তাদের তওবা কখনো কবুল করা হবে না। আর তারাই হবে পথভ্রষ্ট। (সূরা আলে ইমরান- ৯০)

اِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا ثُمَّ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا ثُمَّ ازْدَادُوْا كُفْرًا لَّمْ يَكُنِ اللهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيْهُمْ سَبِيْلًا

‘‘নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে; অতঃপর তাদের কুফরী বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে (ক্ষমার) কোন পথও দেখাবেন না।’’ (সূরা নিসা- ১৩৭)

৩৯
তওবার শেষ সময়
মৃত্যু এসে গেলে (মুমূর্ষ অবস্থায়) তওবা কবুল হয় না :

وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئَاتِ حَتّٰى اِذَا حَضَرَ اَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ اِنِّي تُبْتُ الْاٰنَ وَلَا الَّذِيْنَ يَمُوْتُوْنَ وَهُمْ كُفَّارٌ اُولٰئِكَ اَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا اَلِيْمًا

তাদের জন্য কোন তওবা নেই যারা পাপ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন তাদের কারো নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলে আমি এখন তওবা করছি এবং তাদেরও তওবা নেই যারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। এদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি। (সূরা নিসা- ১৮)

সূর্য পশ্চিম দিক হতে উদিত হলে তওবা কবুল হবে না :

সূর্য পশ্চিম দিক হতে উদিত হওয়া কিয়ামতের একটি বিশেষ আলামত। যে কারণে মৃত্যু এসে গেলে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তওবা কবুল করবেন না, ঠিক সে কারণেই তিনি সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়ার পর কারো তওবা কবুল করবেন না।

৪০
তওবা করার উপকারিতা
তওবার অনেক উপকারীতা রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তা বর্ণনা করেছেন। যেমন-

তওবাকারীদের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন :

وَالَّذِيْنَ عَمِلُوْا السَّيِّئَاتِ ثُمَّ تَابُوْا مِنْ بَعْدِهَا وَاٰمَنُوْا اِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘যারা অসৎকার্য করে তারা পরে তওবা করলে ও ঈমান আনলে তোমার প্রতিপালক তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা আরাফ ১৫৩)

ثُمَّ اِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِيْنَ عَمِلُوا السُّوْءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابُوْا مِنْ بَعْدِ ذٰلِكَ وَاَصْلَحُوْا اِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘যারা অজ্ঞতাবশত মন্দকর্ম করে অতঃপর তওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে তাদের জন্য তোমার প্রতিপালক অবশ্যই অতি ক্ষমাশীল, ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা নাহল- ১১৯)

তাদের গুনাহ আল্লাহ নেকী দ্বারা বদলে দেন :

اِلَّا مَنْ تَابَ وَاٰمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَاُولٰئِكَ يُبَدِّلُ اللهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَّكَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا

‘‘যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদের পাপসমুহ্ পুর্ণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’

(সূরা ফুরকান- ৭০)

তাদেরকে আল্লাহ মহাপুরস্কার দেবেন :

اِلَّا الَّذِيْنَ تَابُوْا وَاَصْلَحُوْا وَاعْتَصَمُوْا بِاللهِ وَاَخْلَصُوْا دِيْنَهُمْ للهِ فَاُولٰئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللهُ الْمُؤْمِنِيْنَ اَجْرًا عَظِيْمًا

‘‘যারা তওবা করে নিজেদেরকে সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনে একনিষ্ট থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনগণকে আল্লাহ অচিরেই মহাপুরস্কার দেবেন। (সূরা নিসা- ১৪৬, ১৪৭)

পাপ থেকে ফিরে আসলে আল্লাহ আযাব দেয়া থেকে ফিরে যান :

فَمَنْ تَابَ مِنْ بَعْدِ ظُلْمِهٖ وَاَصْلَحَ فَاِنَّ اللهَ يَتُوْبُ عَلَيْهِ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘অতঃপর যে তওবা করে নিজের উপর যুলুম করার পর এবং নিজেকে শুধরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। আল্লাহ তো অধিক ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’ (সূরা মায়িদা- ৩৯)

তওবাকারীরা সফল হবে

فَاَمَّا مَنْ تَابَ وَاٰمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسٰى اَنْ يَّكُوْنَ مِنَ الْمُفْلِحِيْنَ

‘‘যে ব্যক্তি তওবা করবে এবং ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, সে তো সাফল্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’’ (সূরা কাসাস- ৬৭)

তওবাকারীদের জন্য ফেরেশতারা দো‘আ করে :

اَلَّذِيْنَ يَحْمِلُوْنَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهٗ يُسَبِّحُوْنَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُوْنَ بِهٖ وَيَسْتَغْفِرُوْنَ لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَّعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِيْنَ تَابُوْا وَاتَّبَعُوْا سَبِيْلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيْمِ

‘‘যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চতুর্পাশ্বে রয়েছে, তারা প্রশংসার সাথে তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে (বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি জ্ঞান ও রহমত দ্বারা সকল কিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছেন। অতএব যারা তওবা করে এবং আপনার পথের অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’’ (সূরা মু’মিন- ৭)

তওবাকারীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে :

اِلَّا مَنْ تَابَ وَاٰمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَاُولٰئِكَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُوْنَ شَيْئًا

‘‘যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে তারা তো জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না।’’ (সূরা মারইয়াম- ৬০)

তাদের জন্য কিয়ামতের দিন বিশেষ নূর থাকবে :

يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا تُوْبُوْا اِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوْحًا عَسٰى رَبُّكُمْ اَنْ يُّكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِيْ اللهُ النَّبِيَّ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مَعَهٗ نُوْرُهُمْ يَسْعٰى بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ وَبِاَيْمَانِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا وَاغْفِرْ لَنَا اِنَّكَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা একান্ত বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর নিকট তওবা কর; এতে আশা করা যায়, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেই দিন আল্লাহ নবী ও তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন না। তাদের নূর তাদের সম্মুখে ও ডান পার্শ্বে ধাবিত হবে, তাঁরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আপনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’’ (সূরা তাহরীম- ৮)

তওবা আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি দেয় :

وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَاَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ

‘‘আল্লাহ এমন নন যে, তুমি তাদের মধ্যে থাকবে অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। আর আল্লাহ এমনও নন যে, তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করবে আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’’ (সূরা আনফাল- ৩৩)

৪১
তওবা না করার পরিণাম
তওবা আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার জন্য এক বিশেষ নিয়ামত, যা তিনি স্বেচ্ছায় নিজ বান্দাদেরকে দান করেছেন। তাই বান্দা যদি আল্লাহর দেয়া এ নিয়ামতকে গ্রহণ না করে তবে আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হন।

আর বান্দা যেহেতু ভুলের উর্ধ্বে নয়। সেহেতু সে যদি তওবা না করে তবে তার সে গুনাহ তো থেকেই যাবে এবং এজন্য তাকে পরকালে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তওবা না করার পরিণাম সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। যেমন-

যারা তওবা করে না তারা যালিম :

وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَاُولٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ

‘‘আর যারা পাপকর্ম থেকে ফিরে আসে না (তওবা করে না) তারাই যালিম।’’ (সূরা হুজুরাত- ১১)

এরা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে :

اِنَّ الَّذِيْنَ فَتَنُوْا الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوْبُوْا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيْقِ

‘‘যারা ঈমানদার নর-নারীর উপর যুলুম করেছে এবং পরে তওবাও করেনি, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব ও দহন যন্ত্রণা।’’ (সূরা বুরূজ- ১০)

তওবা না করাতে আল্লাহর তিরস্কার :

اَفَلَا يَتُوْبُوْنَ اِلَى اللهِ وَيَسْتَغْفِرُوْنَهٗ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ

‘‘তবে কি তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে না ও তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করবে না? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’

(সূরা মায়িদা- ৭৪)

اَوَلَا يَرَوْنَ اَنَّهُمْ يُفْتَنُوْنَ فِيْ كُلِّ عَامٍ مَرَّةً اَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لَا يَتُوْبُوْنَ وَلَا هُمْ يَذَّكَّرُوْنَ

‘‘তারা কি দেখে না যে, তাদেরকে প্রতি বৎসর একবার বা দু’বার বিপর্যস্ত করা হয়? এরপরও তারা তওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না।’’

(সূরা তওবা- ১২৬)

৪২
কোন গুনাহ হয়ে গেলে তা প্রচার করা ঠিক নয়
যদি কারো দ্বারা কোন গুনাহ সংঘটিত হয়ে যায়, তবে তা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করবে না।

عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يَقُوْلُ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : كُلُّ اَمَّتِيْ مُعَافًى اِلَّاَ الْمُجَاهِرِيْنَ وَاِنَّ مِنَ الْمَجَانَةِ اَنْ يَّعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلاً ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللهُ فَيَقُوْلَ يَا فُلاَنُ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهٗ وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللهِ عَنْهُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘‘আমার সকল উম্মত নিরাপদে রয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু সেসব লোক ব্যতীত যারা প্রকাশ্যে পাপ করে বেড়ায়। সে রাত্রিবেলা কোন পাপকর্ম করে তারপর সকালে বলে বেড়ায় যে, হে অমুক! আমি গত রাতে অমুক অমুক পাপকর্ম করেছি। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তার পাপ গোপন রেখেছিলেন।’’

(বুখারী হা: ৬০৬৯, মুসলিম হা: ৭৬৭৬)

অতএব কোন মুমিন বান্দার জন্য নিজ গুনাহ অন্যের কাছে প্রকাশ করা উচিত নয়। সে যদি নিজ গুনাহ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখে, তবে আল্লাহ তা‘আলাও তার গুনাহ গোপন রাখবেন।

৪৩
কোন পাপকে হালকা মনে করা যাবে না
অত্যন্ত নগণ্য ও সূক্ষ্ম গুনাহ থেকেও নিজেকে বিরত রাখা কর্তব্য। কেননা এসব গুনাহ পর্যবেক্ষণ করার জন্যও আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা নিয়োজিত আছে, যারা আমাদের গুনাহসমূহ লিখে রাখেন। অতএব আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে, আমি আজকে যেসব গুনাহকে হালকা মনে করছি তা যদি একটি একটি করে জমা হতে থাকে তবে ভবিষ্যতে বড় আকার ধারণ করবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল অনেকেই পাপকে অবহেলা করে সর্বদা বিভিন্ন ধরনের গুনাহে লিপ্ত রয়েছে। তাদেরকে যদি বলা হয়, তুমি এ কাজ করলে কেন? তখন তারা উত্তর দেয় যে, এতে খারাপের কী আছে? এটা তো সকলেই করে থাকে। এভাবে তারা পাপকে হালকা মনে করে উল্টো আরো নানা যুক্তি দাঁড় করায়।

গুনাহ ছোট হলেও এর প্রভাব মারাত্মক। যেমন-

প্রথমত ঃ

মানুষ সগীরা গুনাহকে স্বাভাবিক ব্যাপার মনে করে গুনাহ করতে থাকে। এমনকি এক সময় তার মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং তার পক্ষে এসব গুনাহ থেকে তওবা করার সুযোগ হয় না।

দ্বিতীয়ত ঃ

এসব সগীরা গুনাহ অন্য আরো কবীরা গুনাহকে আকর্ষণ করতে থাকে। যেমন, আজ যদি কোন মেয়ের সাথে নিয়মিত দেখা করা হয় তবে কাল তার হাত ধরা হবে। এরপর অন্যদিন তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু হবে। তারপর একদিন তার সাথে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যাবে। এভাবে যে গুনাহকে এক সময় ছোট মনে করা হত, তা এক সময় তাকে বড় গুনাহে লিপ্ত করে দেবে।

তৃতীয়ত ঃ

সগীরা গুনাহ করতে করতে একসময় আর তা থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয়ে উঠে না। সুতরাং প্রতিটি মুমিন বান্দার আবশ্যকীয় কর্তব্য যে, যথাসম্ভব নিজেকে সগীরা গুনাহ হতে বিরত রাখা এবং গুনাহ হয়ে গেলে নিয়মানুযায়ী তওবা করে নেয়া। আর এ কথা মনে রাখা যে, আগুন যত অল্পই হোক না কেন তা সুযোগ পেলেই বিশালাকার ধারণ করতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে গুনাহ যতই ছোট হোক না কেন তা মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পারে। পাপের ক্ষুদ্রতার দিকে না তাকিয়ে যার নাফারমানী করা হচ্ছে তাঁর শাস্তির দিকে তাকাতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকল পাপ থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!

৪৪
পাপ সম্পর্কে মুমিনের অনুভূতি
প্রতিটি মুমিনের পাপকে ভয় করা উচিত। যেকোন পাপ কাজকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। যদি পাপ সংঘটিত হয়েই যায়, তবে তার মাঝে আল্লাহভীতির অনুভূতি জাগ্রত হওয়া উচিত। কিন্তু যারা এ অনুভূতিটুকুও অনুভব করে না তারা বড় ধরনের পাপীষ্ঠ।

حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ حَدِيثَيْنِ اَحَدُهُمَا ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْاٰخَرُ عَنْ نَفْسِهٖ قَالَ اِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرٰى ذُنُوبَهٗ كَاَنَّهٗ قَاعِدٌتَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ اَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ وَاِنَّ الْفَاجِرَ يَرٰى ذُنُوبَهٗ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلٰى اَنْفِهٖ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুমিন ব্যক্তি তার পাপসমূহকে এরূপ মনে করে, যেন সে পাহাড়ের নিচে বসে আছে এবং এমন ভয় পাচ্ছে যে, পাহাড়টি ভেঙ্গে তার উপর পড়ে যায় কি না! আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার পাপসমূহকে এরূপ মনে করে, যেন তার নাকের উপর মাছি বসে আছে এবং সে এটাকে হাত দ্বারা তাড়িয়ে দিল। (বুখারী হা: ৬৩০৮)

আলোচ্য হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, পাপীষ্ঠ ব্যক্তি গুনাহকে সাধারণ বিষয় মনে করে থাকে। এটা তার মধ্যে কোন ভয় সৃষ্টি করে না। পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তির পাপ সংঘটিত হয়ে গেলে অস্থির হয়ে পড়ে এবং এত ভয় পায় যে, সে মনে করে, এখনই তার উপর পাহাড় ভেঙ্গে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে মুমিনদের গুণ এগুলোই যা সাহাবাগণের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

সাহাবাগণ যেকোন পাপকে এমনভাবে ভয় করতেন যে, তাঁদের দ্বারা যদি কোন পাপকর্ম সংঘটিত হয়েই যেত তখন তাঁরা অস্থির হয়ে পড়তেন। এমনকি তাঁরা নবী ﷺ এর কাছে গিয়ে পাপের প্রতিকার না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পেতেন না।

عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ اَنَّ رَجُلاً مِنْ اَسْلَمَ جَاءَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاعْتَرَفَ بِالزِّنَا فَاَعْرَضَ عَنْهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم حَتّٰى شَهِدَ عَلٰى نَفْسِهِ اَرْبَعَ مَرَّاتٍ قَالَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَبِكَ جُنُونٌ قَالَ : لاَ قَالَ اٰحْصَنْتَ قَالَ نَعَمْ فَاَمَرَ بِهٖ فَرُجِمَ بِالْمُصَلَّى فَلَمَّا اَذْلَقَتْهُ الْحِجَارَةُ فَرَّ فَاُدْرِكَ فَرُجِمَ حَتّٰى مَاتَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرًا وَصَلَّى عَلَيْهِ .

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আসলাম সম্প্রদায়ের এক লোক নবী ﷺ এর কাছে এসে বলল যে, সে ব্যভিচার করেছে। (এ কথা শুনে) তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সে ঘুরে গিয়ে নবী ﷺ এর সম্মুখে এসে নিজের বিরুদ্ধে চারবার (ব্যভিচারের) সাক্ষ্য দিল। তিনি লোকটিকে ডেকে বলেন, তুমি কি পাগল হয়েছ? সে বলল, না। নবী ﷺ বললেন, তুমি কি বিবাহিত? সে বলল, হ্যাঁ! অতঃপর নবী ﷺ লোকটিকে পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। যখন লোকটি মারা গেল তখন নবী ﷺ বললেন, এটাই তার জন্য মঙ্গল জনক। অতঃপর তিনি ﷺ তার জানাযা পড়লেন।

(বুখারী হা: ৬৮২০)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি কোন একজন অপরিচিতা নারীকে চুম্বন করে ফেলেন। তারপর রাসূল ﷺ এর নিকট এসে তার কৃতকর্মের কথা জানালে আললাহ তা‘আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন-

اَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ اِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذٰلِكَ ذِكْرٰى لِلذَّاكِرِيْنَ

‘‘আর তুমি দিনের দু’প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে নামায কায়েম কর, নিশ্চয় সৎকর্ম পাপকর্মকে মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটি একটি মহাউপদেশ।’’ (সূরা হূদ- ১১৪)

এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এ উপহার কি শুধু আমার জন্য? তখন রাসূল ﷺ বললেন, আমার উম্মতের সকলের জন্য। (বুখারী হা: ৪৬৮৭, মুসলিম হা: ৭১৮০)

এ হাদীসে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন একজন ঈমানদার লোক। স্বেচ্ছায় তিনি কোন পাপ কাজ করতেন না। তারপরও মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক প্রবৃত্তির তাড়নায় একদিন পথিমধ্যে একটি পাপকর্ম করে ফেলেন। এ পাপকর্ম ঘটে যাওয়ার পর তাঁর অনুভূতি ফিরে এল। তিনি তীব্র অনুশোচনা করতে লাগলেন। আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার উপায় বের করার আশায় রাসূল ﷺ এর নিকট এসে বললেন, ‘‘আমি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছি। আমার শাস্তি হওয়া চাই।’’ তাঁর পাপের বিবরণ শুনে রাসূল ﷺ সূরা হুদের এ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন। আয়াতের মধ্যে মুমিন ব্যক্তিকে দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েমের হুকুম দেয়া হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, ‘‘নিশ্চয় সৎকর্ম পাপকে মিটিয়ে দেয়।’’ এ কথা শুনার পর তাঁর মনে শান্তি ফিরে এল এবং উদ্বেগ দূর হয়ে গেল।

এ হাদীস দ্বারা এটা পরিমাপ করা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবাগণকে কত উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। যার ফলে তারা কোন পাপকাজ করে ফেললে অস্থির হয়ে যেতেন।

কতিপয় পাপের পার্থিব শাস্তি :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّه ̒ قَالَ مَا ظَهَرَ الْغُلُوْلُ فِيْ قَوْمٍ قَطُّ إِلَّا أُلْقِيَ فِيْ قُلُوْبِهِمُ الرُّعْبُ وَلَا فَشَا الزِّنَا فِيْ قَوْمٍ قَطُّ إِلَّا كَثُرَ فِيْهِمُ الْمَوْتُ وَلَا نَقَصَ قَوْمٌ الْمِكْيَالَ وَالْمِيْزَانَ إِلَّا قُطِعَ عَنْهُمُ الرِّزْقُ وَلَا حَكَمَ قَوْمٌ بِغَيْرِ الْحَقِّ إِلَّا فَشَا فِيْهِمُ الدَّمُ وَلَا خَتَرَ قَوْمٌ بِالْعَهْدِ إِلَّا سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمُ الْعَدُوَّ

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

১. কোন জাতির মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের প্রবণতা বেড়ে গেলে আল্লাহ তা‘আলা ঐ জাতির অন্তরে শত্রুর ভয় সঞ্চারিত করে দেন।

২. কোন জাতির মধ্যে যদি ব্যভিচার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তাদের মধ্যে মৃত্যু বেড়ে যায়।

৩. যখন কোন জাতি মাপে ও ওজনে কম দেয় তখন আল্লাহ তাদের রিযিক কমিয়ে দেন।

৪. যে জাতি অন্যায়ভাবে শাসন ও বিচারকার্য চালায় তাদের মধ্যে খুন বেড়ে যায়।

৫. আর কোন জাতি বিশ্বাসঘাতকতা করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের শত্রুকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন। (মুয়াত্তা মালেক হা: ১৩২৩)

৪৫
তওবা কবুলের বিশেষ বিশেষ সময়
তওবার দরজা আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্য সবসময়ই খোলা রেখেছেন। কাজেই বান্দা যেকোন সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারবে। তবে বিশেষ কিছু সময় রয়েছে যে সময় আল্লাহ সুব্হানাহু ওয়া তা‘আলা তার বান্দার প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। সে সময়গুলোতে তওবা ও ইস্তেগফার করলে কবুল হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। যেমন,

১. লাইলাতুল ক্বদরে তওবা করা :

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরে ইবাদাত বন্দেগী করে, তার গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (বুখারী হা: ১৯০১)

২. আরাফার দিনে তওবা করা :

রাসূল ﷺ বলেছেন,

مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهٗ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِى بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ

আরাফার দিন আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন এবং ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন, এ সকল মানুষ (আরাফার মাঠের) কী চায়? অর্থাৎ যা চায় তা-ই প্রদান করা হবে।

(মুসলিম হা: ৩৩৫৪, ইবনে মাজাহ হা: ২৪৫৮)

৩. রাতের শেষ ভাগে তওবা করা :

وَبِالْاَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ

‘‘রাতের শেষাংশে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করত।’’ (সূরা যারিয়াত- ১৮)

আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতী ব্যক্তিদের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন,

اَلصَّابِرِيْنَ وَالصَّادِقِيْنَ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْمُنْفِقِيْنَ وَالْمُسْتَغْفِرِيْنَ بِالْاَسْحَارِ

‘‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অগানুগত্যশীল, (আল্লাহ্র পথে) দানশীল এবং শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী।’’ (সূরা আলে ইমরান : ১৭)

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন-

يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالٰى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقٰى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْاٰخِرُ فَيَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَاَسْتَجِيبَ لَهٗ وَمَنْ يَسْأَلُنِى فَاُعْطِيَهٗ وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهٗ

‘‘প্রত্যেক রাতের যখন এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আমাদের মহান প্রতিপালক নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, কে আছে যে আমার নিকট দো’আ করবে, আমি তার দো’আ কবুল করব? কে আছে যে আমার নিকট যা চাইবে, আমি তাকে তা দান করব? কে আছে যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব?’’

(বুখারী হা: ১১৪৫, মুসলিম হা : ১৮০৮)

আলোচ্য হাদীসে রজনীর শেষাংশে দো’আ ও ক্ষমাপ্রার্থনার গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। যারা তাহাজ্জুদ নামায পড়ে থাকেন, তারা তো প্রতি রাতে এ সময়ে দো’আ করার এবং তওবা-ইস্তেগফার করার সুযোগ লাভ করে থাকেন। কিন্তু যারা তাহাজ্জুদের জন্য জাগ্রত হন না, তারাও যদি দো’আ ও তওবার জন্য মাঝে মাঝে উঠে পড়েন তবে কতই না ভাল হয়। যখন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ মর্মে আহবান পাওয়া যায় যে, এমন কে আছ যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? তাই সে বিশেষ সময়টি হাতছাড়া করা কোন মুমিনের জন্য উচিত নয়।

৪৬
তওবার শর্তাবলী
তওবা করার জন্য কিছু শর্ত অনুসরণ করতে হবে। সেগুলো হল :

১. বর্তমানে যে গুনাহে লিপ্ত রয়েছে, তা অবিলম্বে বর্জন করতে হবে।

২. অতীতের কৃত গুনাহের জন্য আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে অনুতপ্ত হতে হবে।

৩. ভবিষ্যতে আর কখনো উক্ত পাপ কাজ না করার সুদৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে।

৪. যেসব ফরজ ও ওয়াজিবের কাজা আদায় করা ওয়াজিব সেগুলোর কাজা আদায় করা।

৫. তওবাকারীর গুনাহের সাথে যদি বান্দার হক সম্পৃক্ত থাকে, তবে তার মীমাংসা করতে হবে। প্রাপক জীবিত থাকলে তাকে তার হক ফেরত দিতে হবে অথবা মাফ চেয়ে নিতে হবে। প্রাপক জীবিত না থাকলে তার ওয়ারিসদেরকে তা ফেরত দিতে হবে।

৬. কাউকে হাত বা মুখ দিয়ে কষ্ট দিয়ে থাকলে বা গালি দিয়ে থাকলে বা কারো গীবত করে থাকলে যেভাবে সম্ভব তাকে সন্তুষ্ট করে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।

৭. এসব শর্ত ছাড়াও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। আর তা হল, শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য পাপ ছেড়ে দেয়া এবং তাঁর জন্যই তওবা করা, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।

৪৭
তওবা করার পদ্ধতি
প্রতিটি কাজের কিছু নিয়ম পদ্ধতি রয়েছে, ঠিক সেভাবে তওবা করারও কিছু নিয়ম রয়েছে। নিম্নে তওবা করার পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

৪৮
তাড়াতাড়ি তওবা করা
নিজের তওবা নিজেকেই করতে হয়, আর তা করতে হয় পাপ করার পর পরই। আর তওবা হচ্ছে পাপকাজ ছেড়ে দিয়ে নেকআমল শুরু করা। যে ব্যক্তি মৃত্যুর নিকটবর্তী হয়ে যায় তার আর নেকআমল করার সুযোগ থাকে না। তাই প্রতিটি মানুষের উচিত কোন পাপ হয়ে গেলে, তাড়াতাড়ি তওবা করা এবং গুনাহের কাজ ছেড়ে দিয়ে ভাল কাজ করা। কারণ মানুষের জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই। কতদিন জীবিত থাকবে এবং কখন মারা যাবে এ সম্পর্কে সে অবগত নয়। বিধায় তার উচিত যত দ্রুত সম্ভব নিজ গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করা। কেননা সে যদি আল্লাহর হক ও বান্দার হক নিয়ে মারা যায় তবে তাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।

বান্দাকে এ পরিণতি থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাড়াতাড়ি তওবা করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন-

اِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللهِ لِلَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السُّوْءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوْبُوْنَ مِنْ قَرِيْبٍ فَاُولٰئِكَ يَتُوْبُ اللهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللهُ عَلِيْمًا حَكِيْمًا

‘‘আল্লাহ কেবল তাদের তওবাই কবুল করেন, যারা অজ্ঞতাবশত পাপ করে ফেলে, অতঃপর তাড়াতাড়ি তওবা করে নেয়। এসব লোকের তওবাই আল্লাহ কবুল করেন। আর আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা নিসা- ১৭)

তাছাড়া মৃত্যু আসার পূর্বে এবং সূর্য পশ্চিম দিক হতে উদিত হওয়ার পূর্বেই তওবা করতে হবে। কেননা, এ দু’সময় আল্লাহ তা‘আলা কারো কোন তওবা কবুল করবেন না। রাসূল ﷺ বলেছেন-

مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ اللهُ عَلَيْهِ

‘‘যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠার আগেই তওবা করবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।’’ (মুসলিম হা:৭০৩৬)

৪৯
নেক আমলের ওসীলা নিয়ে তওবা করা
যেসব গুনাহ সংঘটিত হয়ে গেছে, সেগুলোর উপর খাঁটি মনে লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে আর কোন গুনাহ না করার দৃঢ় অঙ্গীকার পোষণ করে যদি তওবা করা হয়, তাহলে আশা করা যায়, তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ হবে। তবে যদি কোন নেক আমলের ওসীলা নিয়ে তওবা করা হয়, তাহলে তওবা আরও অধিক কবুলের আশা করা যায়। যেমন বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি বিপদে পড়ে নেক আমলের ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। তাই আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে-

عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا : اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ :" ‏ بَيْنَمَا ثَلَاثَةُ نَفَرٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ يَمْشُوْنَ اِذْ اَصَابَهُمْ مَطَرٌ، فَاٰوَوْا اِلٰى غَارٍ فَانْطَبَقَ عَلَيْهِمْ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ : إِنَّهٗ وَاللهِ يَا هَؤُلَاءِ لَا يُنْجِيكُمْ إِلَّا الصِّدْقُ، فَلْيَدْعُ كُلُّ رَجُلٍ مِنْكُمْ بِمَا يَعْلَمُ اَنَّهٗ قَدْ صَدَقَ فِيهِ ‏ . ‏ فَقَالَ وَاحِدٌ مِنْهُمُ : اَللّٰهُمَّ اِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ اَنَّهٗ كَانَ لِي أَجِيرٌ عَمِلَ لِي عَلٰى فَرَقٍ مِنْ أَرُزٍّ، فَذَهَبَ وَتَرَكَهٗ وَأَنِّي عَمَدْتُ إِلٰى ذٰلِكَ الْفَرَقِ فَزَرَعْتُهٗ فَصَارَ مِنْ أَمْرِه أَنِّي اشْتَرَيْتُ مِنْهُ بَقَرًا، وَأَنَّهٗ أَتَانِي يَطْلُبُ أَجْرَهٗ فَقُلْتُ لَهٗ : اعْمِدْ إِلٰى تِلْكَ الْبَقَرِ ‏ . ‏ فَسُقْهَا، فَقَالَ لِي : إِنَّمَا لِي عِنْدَكَ فَرَقٌ مِنْ أَرُزٍّ ‏ . ‏ فَقُلْتُ لَهٗ : اعْمِدْ إِلٰى تِلْكَ الْبَقَرِ فَإِنَّهَا مِنْ ذٰلِكَ الْفَرَقِ، فَسَاقَهَا، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذٰلِكَ مِنْ خَشْيَتِكَ، فَفَرِّجْ عَنَّا ‏ . ‏ فَانْسَاحَتْ عَنْهُمُ الصَّخْرَةُ ‏ . ‏ فَقَالَ الْاٰخَرُ : اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّهٗ كَانَ لِي أَبَوَانِ شَيْخَانِ كَبِيرَانِ، وَكُنْتُ اٰتِيهِمَا كُلَّ لَيْلَةٍ بِلَبَنِ غَنَمٍ لِي، فَأَبْطَأْتُ عَنْهَا لَيْلَةً فَجِئْتُ وَقَدْ رَقَدَا وَأَهْلِي وَعِيَالِي يَتَضَاغَوْنَ مِنَ الْجُوعِ، وََكُنْتُ لَا أَسْقِيهِمْ حَتّٰى يَشْرَبَ أَبَوَاىَ، فَكَرِهْتُ أَنْ أُوقِظَهُمَا، وَكَرِهْتُ أَنْ أَدَعَهُمَا، فَيَسْتَكِنَّا لِشَرْبَتِهِمَا، فَلَمْ أَزَلْ أَنْتَظِرُ حَتّٰى طَلَعَ الْفَجْرُ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذٰلِكَ مِنْ خَشْيَتِكَ، فَفَرِّجْ عَنَّا ‏ . ‏ فَانْسَاخَتْ عَنْهُمُ الصَّخْرَةُ حَتّٰى نَظَرُوا إِلَى السَّمَاءِ ‏ . ‏ فَقَالَ الْاٰخَرُ : اَللّٰهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّهٗ كَانَ لِي ابْنَةُ عَمٍّ مِنْ أَحَبِّ النَّاسِ إِلَىَّ، وَأَنِّي رَاوَدْتُهَا عَنْ نَفْسِهَا فَأَبَتْ إِلَّا أَنْ اٰتِيَهَا بِمِائَةِ دِيْنَارٍ، فَطَلَبْتُهَا حَتّٰى قَدَرْتُ، فَأَتَيْتُهَا بِهَا فَدَفَعْتُهَا إِلَيْهَا، فَأَمْكَنَتْنِي مِنْ نَفْسِهَا، فَلَمَّا قَعَدْتُ بَيْنَ رِجْلَيْهَا، قَالَتِ : اِتَّقِ اللهَ وَلَا تَفُضَّ الْخَاتَمَ إِلَّا بِحَقِّه . ‏ فَقُمْتُ وَتَرَكْتُ الْمِائَةَ دِيْنَارٍ، فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذٰلِكَ مِنْ خَشْيَتِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا ‏ . ‏ فَفَرَّجَ اللهُ عَنْهُمْ فَخَرَجُوا ‏

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের পূর্বযুগের লোকদের মাঝে তিনজন লোক ছিল। তারা পথ চলতে চলতে হঠাৎ ঝড়বৃষ্টির মাঝে পড়ে গেল। কোন দিক নির্দেশনা না পেয়ে তারা এক গুহায় আশ্রয় নিল। গুহায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরই তাদের গুহার মুখ একটি পাথর চাপা পড়ে বন্ধ হয়ে গেল। পাথর চাপা পড়তেই তারা বিপদে পড়ে গেল, এত বড় পাথর তারা কীভাবে সরাবে। তাদের একজন অন্যদেরকে বলল, বন্ধুগণ! আল্লাহর শপথ! এখন সত্য ব্যতীত আর কিছুই তোমাদেরকে রেহাই দিতে পারবে না। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের সে জিনিসের ওসীলায় দো‘আ করা দরকার, যে ব্যাপারে জানা আছে যে, এ কাজটিতে সে সততা বহাল রেখেছে। তখন তাদের একজন এই বলে দো‘আ করতে লাগল, হে আল্লাহ! তুমি ভাল করেই জান যে, আমার একজন চাকর ছিল। সে এক ফারাক (একটি পরিমাপ) চালের বদলে আমার কাজ করে দিয়েছিল। কিন্তু সে মজুরি না নিয়েই চলে গিয়েছিল। তারপর আমি তার মজুরি দিয়ে কিছু একটা করতে ইচ্ছা করলাম এবং কৃষি কাজে লাগালাম। এতে যা উৎপাদন হয়েছে তার বদলে আমি একটি গাভী ক্রয় করলাম। অনেক দিন পর সে চাকরটি আমার কাছে এসে তার মজুরি দাবী করল। আমি তাকে বললাম, এ গাভীগুলোর দিকে তাকাও এবং তা তাড়িয়ে নিয়ে যাও। সে জবাব দিল, ঠাট্টা করবেন না। আমার তো আপনার নিকট মাত্র এক ফারাক চাল পাওনা। আমি তাকে বললাম গাভীগুলো নিয়ে যাও। কারণ তোমার সেই এক ফারাক চাল দ্বারা যা উৎপাদিত হয়েছে, তারই বদলে এটি ক্রয় করা হয়েছে। তখন সে গাভীগুলো তাড়িয়ে নিয়ে গেল। হে আল্লাহ! যদি তুমি মনে কর তা আমি একমাত্র তোমার ভয়েই করেছি, তাহলে আমাদের গুহার মুখ থেকে এ পাথরটি সরিয়ে দাও। অতঃপর পাথরটি কিছুটা সরে গেল।

দ্বিতীয় যুবক দো‘আ করল, হে আল্লাহ! তোমার ভাল করে জানা আছে যে, আমার মা-বাবা খুব বুড়ো ছিলেন। আমি প্রত্যেক রাত্রে তাঁদের জন্য আমার ছাগলের দুধ নিয়ে যেতাম। ঘটনাক্রমে এক রাতে তাদের কাছে (দুধ নিয়ে) যেতে আমি বিলম্ব করে ফেললাম। তারপর এমন সময় গেলাম, যখন তাঁরা উভয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন। আর আমার স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে ক্ষুধায় ছটফট করছে। কিন্তু আমি আমার মা-বাবাকে দুধ পান না করানো পর্যন্ত আমার (ক্ষুধায় কাতর) ছেলে মেয়েকে দুধ পান করাইনি। কারণ তাঁদেরকে ঘুম থেকে জাগানোটা আমি ভাল মনে করিনি। অপরদিকে তাঁদেরকে বাদ দিতেও ভাল লাগেনি। কারণ, এ দুধটুকু পান না করালে তাঁরা উভয়েই খুব দুর্বল হয়ে যাবেন। তাই (দুধ হাতে) আমি (সারা রাত) সকাল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাঁদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। যদি তুমি জেনে থাক যে, আমি এটা করেছি একমাত্র তোমারই ভয়ে তাহলে আমাদের থেকে (পাথরটি) সরিয়ে দাও। অতঃপর পাথরটি তাদের থেকে আরেকটু সরে গেল। এমনকি তারা আকাশ দেখতে পেল।

সর্বশেষ এক যুবক দো‘আ করল, হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার একটি চাচাত বোন ছিল। সে আমার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। আমি তার সঙ্গে (যৌন মিলনের) ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু আমি তাকে একশত দীনার না দেয়া পর্যন্ত সে রাজী হল না। তখন আমি তা সংগ্রহে লেগে গেলাম। শেষ পর্যন্ত তা অর্জনে সক্ষম হলাম। তা নিয়ে তার কাছে আসলাম এবং এ একশ’ দীনার তাকে দিয়ে দিলাম। তখন সে নিজেই নিজেকে আমার কাছে সোপর্দ করল। আমি যখন তার দু’পায়ের মাঝখানে বসলাম, তখনি সে বলে উঠল, আল্লাহকে ভয় কর এবং (শরীয়তের বিধান মতে) অধিকার লাভ করা ব্যতীত আমার সতীত্বকে নষ্ট করো না। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়েছিলাম এবং একশত দীনারও ত্যাগ করেছিলাম। তুমি যদি জান যে, আমি প্রকৃতই তোমার ভয়ে তা করেছি তাহলে তুমি পাথরটি সরিয়ে দাও। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের গুহার মুখ থেকে পাথরটি সরিয়ে দিলেন। অতঃপর তারা বেরিয়ে আসল। (বুখারী হা : ৩৪৬৫)

নামাযের ওসীলা নিয়ে তওবা করা :

قَالَ أَبُوْبَكْرٍ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَقُوْلُ مَا مِنْ رَجُلٍ يَذْنُبُ ذَنْبًا ثُمَّ يَقُوْمُ فَيَتَطَهَّرُ ثُمَّ يُصَلِّيْ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ إِلَّا غُفِرَ لَهٗ

আবু বকর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল ﷺ কে বলতে শুনেছি, ‘‘কোন বান্দা যদি কোন গুনাহের কাজ করে সাথে সাথে ওযূ করে দু’রাকাত নামায আদায় করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেবেন।’’ (তিরমিযী হা: ৩০০৬)

নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা গুনাহ ক্ষমা করে দেন :

عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ ، قَالَ : كُنْتُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَجَاءَهٗ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنِّيْ أَصَبْتُ حَدًّا فَأَقِمْهُ عَلَيَّ قَالَ وَلَمْ يَسْأَلْهُ عَنْهُ قَالَ وَحَضَرَتِ الصَّلَاةُ فَصَلّٰى مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا قَضَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ قَامَ إِلَيْهِ الرَّجُلُ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنِّي أَصَبْتُ حَدًّا فَأَقِمْ فِيَّ كِتَابَ اللهِ قَالَ اَلَيْسَ قَدْ صَلَّيْتَ مَعَنَا قَالَ نَعَمْ قَالَ فَإِنَّ اللهَ قَدْ غَفَرَ لَكَ ذَنْبَكَ

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, নবী ﷺ এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি হদ্দ যোগ্য অপরাধ (শাস্তিযোগ্য অপরাধ) করে ফেলেছি, সুতরাং আমার উপর শাস্তি প্রয়োগ করুন। এ সময় নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল। রাসূল ﷺ যখন নামায শেষ করলেন, তখন সে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি হদ্দ এর কাজ করে ফেলেছি। আমার প্রতি আল্লাহর কিতাবে নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করুন। উত্তরে রাসূল ﷺ বললেন, তুমি কি আমাদের সাথে নামায পড়নি? সে বলল, হ্যাঁ; তখন রাসূল ﷺ বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমার গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।

মু‘য়ায (রাঃ) বললেন, উমার (রাঃ) এর বর্ণনায় আছে, হে আল্লাহর রাসূল! এটি কী শুধু তার জন্যই প্রযোজ্য না সকল মানুষের জন্য? তখন তিনি বললেন, এটি বরং সকল লোকের জন্য। (বুখারী হা : ৬৪২৩, মুসলিম হা : ৭১৮৩)

৫০
পাপের জন্য ক্রন্দন করা
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا النَّجَاةُ ؟ قَالَ أمْسِكْ عَلَيْكَ لِسَانِكَ وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ وَابْكِ عَلٰى خَطِيْئَتِكَ

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল ﷺ এর সাথে সাক্ষাতের সময় আমি বললাম, নাজাতের পথ কী? তিনি বললেন তুমি তোমার জিহবাকে আয়ত্তে রাখবে, তোমার গৃহে যেন তোমার অবস্থান থাকে এবং তুমি তোমার পাপের জন্য কান্নাকাটি করতে থাকবে।

(তিরমিযী হা: ২৪০৬)

অত্র হাদীসে নবী ﷺ মানবজাতির মুক্তি লাভের কয়েকটি দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথমে তিনি গুনাহ সংঘটিত হওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম যবানকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছেন যে, যাতে করে জিহবা দ্বারা কোন রকম গুনাহ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ না থাকে।

তারপর তিনি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার একটি সুন্দর পরামর্শ দিয়েছেন। আর তা হল, সর্বদা নিজের গৃহে অবস্থান করা। কেননা বাইরে লোক সমাজে গেলেই জিহবার দ্বারা পাপ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই যদি প্রয়োজন ছাড়া বাকি সময় নিজ ঘরে অবস্থান করা হয় তবে গুনাহ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

সর্বশেষে তিনি পাপ মোচনের জন্য কান্নাকাটি করতে বলেছেন। উপরের উল্লেখিত দু’টি ব্যবস্থার পরও যদি পাপ সংঘটিত হয়ে যায়, তবে ঐ পাপ মোচনের জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতে হবে। পাপ সংঘটিত হলে কান্নাকাটি করা তওবার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে এবং পাপের দরুন কান্নাকাটি করে নিজের পাপ মার্জনা করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেন।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَقُوْلُ عَيْنَانِ لَا تَمُسُّهُمَا النَّارُ عَيْنٌ بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ وَعَيْنٌ بَاتَتْ تَحْرِسُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন, দু’টি চক্ষু এমন যে, তাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। একটি সেই চক্ষু যা আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ক্রন্দন করেছে এবং দ্বিতীয়টি সেই চক্ষু যা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় পাহারাদার হিসেবে রাত্রি অতিবাহিত করেছে।

(তিরমিযী হা: ১৬৩৯)

একদা রাসূল ﷺ নামায পড়তেছিলেন এবং তার বক্ষ হতে চাক্কি পেষার শব্দের ন্যায় ক্রন্দনের তীব্র শব্দ অনুভূত হচ্ছিল। কোন কোন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন যে, ফুটন্ত হাঁড়ি হতে যেরূপ টগবগ শব্দ শুনা যায়, তদ্রূপ শব্দ শুনা যাচ্ছিল। (নাসাঈ হা: ১২১৪)

রাসূল ﷺ তো সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ছিলেন। তা সত্ত্বেও তার কান্নাকাটির এ অবস্থা ছিল। আমাদের মত পাপীদেরকে যে কত বেশি কান্নাকাটি করতে হবে, তা আমাদের নিজেদেরই চিন্তা করা উচিত।

যে ব্যক্তি পৃথিবীতে তার গুনাহের জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবে তা মোচনের জন্য কান্নাকাটি করবে; আল্লাহ তা‘আলা তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং মৃত্যুর পর তাকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

৫১
বেশি বেশি নেক আমল করা
গুনাহ কারার পর আরেকটি বিকল্প পদ্ধতির আমল হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভাল কাজ করা, যাতে তা ঐ পাপের ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। ভাল কাজ পাপীকে পাপের জেলখানা থেকে মুক্ত করে আনুগত্যের বিশাল জগতে নিয়ে যায়। আবূ যর (রাঃ) বলেন, রাসূল ﷺ আমাকে বলেছেন-

اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَاَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ

‘‘তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করে চল। আর যখন কোন গুনাহের কাজ হয়ে যায় তখনই একটি সওয়াবের কাজ করে নাও। তা তোমার পূর্ববর্তী গুনাহকে মিটিয়ে দেবে। আর মানুষের সাথে উত্তম আচরণ কর।’’

(তিরমিযী হা: ১৯৮৭)

যদি কোন লোক শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অনেকদিন আল্লাহর হুকুম পালন করা ছেড়ে দিয়ে থাকে তাহলে তার কর্তব্য হল বিগত জীবনের ছেড়ে দেয়া আমল গুলোর জন্য বিনীতভাবে তওবা করা এবং ভবিষ্যতে আর কখনো ফরজ আমল ছেড়ে না দেয়া। বিশেষ করে বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন নফল নামায দ্বারা ফরজ নামাযের ত্রুটিসমূহ পূর্ণ করে দেবেন। রাসূল ﷺ বলেন-

إنَّ أوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهٖ صَلَاتُهٗ فَإنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أفْلَحَ وَاَنْجَحَ وَإنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسَرَ فَاِنِ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيْضَتِهٖ شَيْءٌ قَالَ الرَّبُّ عَزَّ وَ جَلَّ اُنْظُرُوْا هَلْ لِعَبْدِيْ مِنْ تَطَوُّعٍ ؟ فَيُكْمَلُ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنَ الْفَرِيْضَةِ ثُمَّ يَكُوْنُ سَائِرِ عَمَلِهٖ عَلٰى ذٰلِكَ

নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেবেন। যদি তার নামায সঠিক হয় তবে সে সফল হবে এবং মুক্তি লাভ করবে। আর যদি তার নামায নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে ব্যর্থ হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি তার ফরজ নামাযের মধ্যে কোন ত্রুটি ধরা পড়ে তবে আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বলবেন, ‘‘দেখ, আমার এ বান্দার আমলনামায় কোন নফল নামায আছে কি না।’’ যদি থাকে তবে সেই নফল নামাযের দ্বারা ফরজের ঘাটতি পূর্ণ করে দেয়া হবে। এভাবে সকল আমলের হিসাব নেয় হবে। (তিরমিযী হা: ৪১৩)

৫২
ক্ষমাপ্রার্থনার কতিপয় দো‘আ
এমন কতগুলো দো‘আ রয়েছে যেগুলো উচ্চারণ করার মাধ্যমে তওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা খুশি হন। যেমন-

رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا اِنْ نَسِيْنَا اَوْ اَخْطَأْنَا رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا اِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهٗ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهٖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا اَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ

‘‘হে আমাদের রব! যদি আমরা ভুল করি অথবা ভুলে যায় তবে আমাদেরকে পাক্ড়াও করো না। হে আমাদের রব! আমাদের উপর এমন বোঝা চাপিয়ে দেবেন না যা আমাদের পূর্ববর্তীদের দিয়েছেন। আর আমাদের উপর এমন ভার দেবেন না যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদেরকে মুক্তি দান করুন, ক্ষমা করুন এবং দয়া করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আমাদেরকে কাফিরদের উপর সাহায্য করুন।’’ (সূরা বাক্বারা- ২৮৬)

رَبَّنَا اِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يَّنَادِيْ لِلْاِيْمَانِ اَنْ اٰمِنُوْا بِرَبِّكُمْ فَاٰمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْاَبْرَارِ

‘‘হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা এক আহবানকারীকে আহবান করতে শুনেছিলাম যে, তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তাতেই আমরা ঈমান এনেছি; হে আমাদের রব! অতএব আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করুন আর আমাদের গুনাহগুলো মুছে দিন এবং পুণ্যবানদের সাথে আমাদেরকে মৃত্যুদান করুন।’’ (সূরা আলে ইমরান- ১৯৩)

رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَاَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ

বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! ক্ষমা কর ও দয়া কর, তুমিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সূরা মু’মিনূন- ১১৮)

আদম ও হাওয়া (আ:) যে দো‘আ করে ক্ষমা চেয়েছিলেন :

رَبَّنَا ظَلَمْنَا اَنْفُسَنَا وَاِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ

তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ (সূরা আ‘রাফ- ২৩)

মহানবী ﷺ বলেন, কোন ব্যক্তি নিম্নোক্ত বাক্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করলে তিনি তার গুনাহসমূহ মাফ করেন, এমনকি তা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের মতো গুনাহ হলেও।

اَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لَاِ الٰهَ اِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَاَتُوْبُ اِلَيْهِ

‘‘আসতাগফিরুল্লাহাল্লাযী লা-ইলা-হা ইল্লা- হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যূম ওয়া আতূবু ইলাইহি।’’

‘‘আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করি, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর নিকট তওবা করি।’’

(আবু দাউদ হা: ১৫১৯, তিরমিযী হা: ৩৫৭৭)

৫৩
তওবার উপর অটল থাকার পদ্ধতি
১. সর্বদা পাপের প্রতি ঘৃণাবোধ জাগ্রত রাখা।

২. পাপ ও তার কুফলের কদর্যতা অনুভব করা।

৩. তাহাজ্জুদের নামায পড়ে সর্বদা আল্লাহর কাছে দু‘আ করা, যাতে করে পুনরায় পাপে জড়িয়ে না পড়তে হয়।

৪. হারাম দ্রব্যাদি যা সংগ্রহে আছে তা নষ্ট করে ফেলা। যেমন, মাদকদ্রব্য, বাদ্যযন্ত্র, মূর্তি ও প্রাণীর ছবি এবং ইসলাম বিরোধী সাহিত্য ও ভাস্কর্য ইত্যাদি। এগুলো ভেঙ্গে ফেলা, নষ্ট করা অথবা পুড়িয়ে ফেলা জরুরি।

৫. ভাল ও উপকারী কাজে নিজের সময় ব্যয় করা- যাতে শয়তানী কাজের সুযোগ হাতে না থাকে।

৬. সৎপথে অবিচল থাকার জন্য সহায়ক বন্ধু নির্বাচন করা- যারা দুষ্ট বন্ধুদের বিকল্প হবে।

৭. যে পাপ কাজে সহযোগিতা করে বা উৎসাহ দেয় তার থেকে দূরে থাকা। কেননা যে পাপ কাজে সহযোগিতা করে সে কখনো প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। মূলত সে-ই হচ্ছে প্রকৃত শত্রু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

اَ لْاَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الْمُتَّقِيْنَ

‘‘পরহেযগার বন্ধু ছাড়া অন্য সকল বন্ধু সেদিন শত্রু হয়ে যাবে।’’

(সূরা যুখরূফ- ৬৭)

এসব বন্ধুরা কিয়ামতের দিন একে অপরকে অভিশাপ দেবে আর উক্ত সৎ বন্ধুদের দেখে আফসোস করবে। অতএব আল্লাহর পথের পথিক হিসেবে আমাদের উচিত সেসব বন্ধুদের অনিষ্ট থেকে নিজেকে যথাসম্ভব বিরত রাখা এবং অপরকে সতর্ক করা। সম্ভব হলে তাদেরকে সংশোধন করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। আর শয়তানের প্ররোচণা থেকে সতর্ক থাকা। কেননা অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেকে পুরনো বন্ধুর সাথে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে আবার পাপের পথে ফিরে গেছে।

৫৪
বান্দার হক সম্পর্কে কতিপয় সতর্কবাণী
সমাজে এমন কিছু নীতির প্রচলন রয়েছে, যা সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী। আরো একটু যাচাই করলে দেখা যাবে তা মানবতা বিরোধী। কিন্তু সমাজে এমনভাবে এগুলোর প্রচলন হয়েছে যে, মানুষ এগুলেকে গুনাহ হিসেবে মনে করে না। যার কারণে তারা নিজেদের এসব ভুল বুঝতে পারছে না এবং এসব গুনাহ থেকে ফিরে আসারও প্রয়োজন মনে করছে না; অথচ এ বিষয়গুলো মারাত্মক গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা হল :

৫৫
চাঁদার টাকা
সমাজে এমন কিছু লোক রয়েছে যাদের হাতে জনকল্যাণমূলক কিছু ফান্ড বা তহবিল রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজ করার জন্য মানুষের নিকট থেকে চাঁদা তুলে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় তারা সে ফান্ডের কিছু অংশ নিজেদের প্রয়োজনেও ব্যবহার করছে, যা মোটেই শরীয়ত সম্মত নয়।

যারা কোন মসজিদ-মাদরাসা অথবা কোন ওয়াকফ্ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাদেরকে নিজেদের কাজকর্মে স্বচ্ছতা বজায় রাখা অতীব জরুরি। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনেকেই জেনে বা না জেনে উদাসীনতা করে থাকেন এবং হিসাবে গরমিল করে ফেলেন। এটা তাদের জন্য পরকালের শাস্তির কারণ হবে।

আবার কেউ কেউ প্রতিনিধিরূপে মসজিদ-মাদরাসার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে থাকেন। এক্ষেত্রে অনেক লোক টাকা-পয়সা দিয়ে দেন; কিন্তু প্রতিনিধিদের ধর্মপরায়ণতার উপর নির্ভর করে তারা প্রমাণস্বরূপ কোন রসিদ চান না। এ প্রক্রিয়ায় যে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, তা হতে আত্মসাৎ করা খুবই সহজ। যদি কারো পরকালের জবাবদিহির দৃঢ় বিশ্বাস না থাকে তাহলে প্রবৃত্তি ও শয়তান আত্মসাৎ করিয়েই ছাড়ে।

আবার অনেককেই দেখা যায় চাঁদার টাকা ও নিজের টাকা এক করে ফেলেন এবং তা হতে খরচ করতে থাকেন। কত টাকা চাঁদা থেকে খরচ হল আর কত টাকা নিজের থেকে খরচ হল তারা তা ভাবেন না। যখন হিসাব করা হয় তখন কাট-ছাট করে মিলিয়ে নেন। চাঁদা গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননা এসব পদ্ধতির দ্বারা বান্দার হক নষ্ট হচ্ছে, অথচ বান্দা তা জানতে পারছে না। বান্দার কাছ থেকে সহজেই নজর এড়ানো যাচ্ছে। কিন্তু যিনি সর্বদ্রষ্টা বা সবকিছু দেখেন তার চোখ এড়ানো যায় না। তিনি একে ঠিকই ধরে ফেলবেন।

এ ধরনের খেয়ানত কোন একক ব্যক্তির অর্থসম্পদ আতমসাৎ করা থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর। কেননা একক ব্যক্তির নিকট হতে ক্ষমা চেয়ে নেয়া অথবা আদায় করে দেয়া সহজ, কিন্তু সর্বসাধারণের প্রদত্ত চাঁদা আত্মসাৎ করার পর ক্ষতিপূরণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যদি আল্লাহ তা‘আলা তওবার তাওফীক দেন তবুও হকদারগণের নাম অজ্ঞাত থাকার কারণে তাদের নিকট তাদের হক পৌঁছানোর কোন উপায় থাকে না। তাই এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা একান্ত জরুরি।

৫৬
এতিমের মাল
এতিমের মাল ভক্ষণ করা এবং শরীয়তের নীতিমালা লঙ্ঘন করে তাদের মাল স্বীয় মালিকানাভুক্ত করে নেয়া হারাম এবং অত্যন্ত কঠিন গুনাহ। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে-

اِنَّ الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ اَمْوَالَ الْيَتَامٰى ظُلْمًا اِنَّمَا يَأْكُلُوْنَ فِي بُطُوْنِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيْرًا

‘‘নিশ্চয়, যেসব লোক অন্যায়ভাবে এতিমদের মাল গ্রাস করে, তারা মূলত আগুন দ্বারাই নিজেদের উদর পূর্ণ করে এবং অতি শীঘ্রই তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।’’ (সূরা নিসা : ১০)

অনেকে মনে করেন যে, এতিমের মাল ভক্ষণ করার পাপ সেসব লোকদেরই হতে পারে, যারা এতিমখানা চালাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। যেকোন ব্যক্তি এতিমের মাল গ্রাস করলে সে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে এতিম সন্তানদের চাচা বা অন্যান্য অভিভাবকরা নামমাত্র তাদের উপকার করে থাকেন। আর বাকি সম্পদ তারা নিজেরা ভোগ করেন। আবার কেউ কেউ এতিমদের উপর কিছুই খরচ করে না; বরং সবটুকু সম্পত্তি নিজেই গ্রাস করে ফেলে। যখন এ এতিম বাচ্চারা প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তারা পিতৃ-সম্পত্তি হতে কিছুই পায় না। এসবই এতিমের মাল ভক্ষণ করার অন্তর্ভুক্ত। যারা এসব কাজে জড়িত তাদেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে এবং এতিমদের মাল তাদের কাছে ফেরত দিতে হবে, নতুবা আখেরাতের আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

৫৭
বিধবার মাল
অনেকে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হতে তার স্ত্রীকে কোন অংশ প্রদান করে না। এটা বড় ধরনের অন্যায়। বিধবার মাল আত্মসাৎ করলে পরকালের শাস্তি হতে রেহাই পাওয়া যাবে না।

৫৮
কন্যা সন্তানদের অংশ
বিভিন্ন এলাকায় রেওয়াজ আছে যে, মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে তার কন্যা সন্তানদেরকে অংশ প্রদান করা হয় না; বরং ভাইয়েরাই সব ভোগ করে থাকে। এটা সম্পূর্ণ যুলুম ও হারাম। কেউ কেউ বলেন যে, বোনেরা তাদের অংশ দাবি করে না এবং ক্ষমা চেয়ে নিলে ক্ষমা করে দেয়।

জেনে রাখা প্রয়োজন যে, হক না চাওয়া হক ছেড়ে দেয়ার দলীল হতে পারে না। অন্যসব মিথ্যা ক্ষমার ন্যায় এটাও এক প্রকার মিথ্যা ক্ষমা। কেননা যেসব বোনেরা জানে যে, তারা নিজেদের সম্পত্তি পাবে না তারা নিজেদের হক দাবী করা হতে চুপ থাকে। যদি তাদের অংশ বণ্টন করে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং বলা হয় এই তোমাদের অংশ নিয়ে যাও, তারপরও যদি তারা না নেয়, তাহলে তা বিবেচনাযোগ্য। প্রচলিত পন্থায় ক্ষমা করিয়ে নেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।

কেউ কেউ নিজের মনকে বলে যে, সারাজীবন বোনদেরকে তাদের শ্বশুরালয় হতে আনতে থাকব। তারা সন্তান নিয়ে আসবে, খাবে। এটা দ্বারা তাদের হক আদায় হয়ে যাবে। তাদের এসব দাবি আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ,

প্রথমত ঃ তাদের উপরে এত খরচ করা হয় না, যত সম্পত্তি তাদের পাওনা থাকে।

দ্বিতীয়ত ঃ যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হয় তাহলে নিজের পয়সা দ্বারা করতে হবে। বোনদের পয়সা তাদের জন্য খরচ করলে এটা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা হতে পারে না।

তৃতীয়ত ঃ বোনদেরকে তাদের অংশ থেকে বঞ্চিত করে ভাইয়েরা তা ভোগ করে থাকেন এতে কি বোনেরা সন্তুষ্ট রয়েছে? ভাইয়েরা কি তা ভেবে দেখেন কখনো? এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের আত্মসাৎ। যদিও বোনেরা লজ্জার কারণে তাদের হক আদায় করতে পারে না। কিন্তু আখেরাতের আদালতে যখন সবাই উপস্থিত হবে তখন কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। সেদিন ভাইয়েরা লজ্জিত হবে এবং তাদের নেকীগুলো বোনদেরকে দিয়ে দিতে বাধ্য হবে। অথবা বোনদের গুনাহের বোঝা নিজেদের বহন করতে হবে। তাই যারা এসব কাজ করেন তাদের উচিত আজই বাবার সম্পক্তি হতে বোনদের অংশ বুঝিয়ে দেয়া।

৫৯
মোহরানা
মোহরানা স্ত্রীর হক। তাই সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা ধার্য করা এবং তা পরিশোধ করা স্বামীর একান্ত দায়িত্ব। বিয়ের সময়ই মোহরানার টাকা স্ত্রীর হাতে দিয়ে দেয়া উচিত। না হলে বিয়ের প্রথম রাত্রে তা পরিশোধ করবে। কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে মোহরানার টাকা ক্ষমা চেয়ে নেয়, এটা মোটেই উচিত নয়। এটা এক প্রকার ধোঁকা। প্রথম রাত্রে লাজুক স্ত্রী ক্ষমা করলেও বাস্তবে তা ক্ষমা হয় না। আবার অনেকেই এ দেনা পরিশোধ না করে হজ্বে যায়। যা একেবারেই অনুচিত। সন্তুষ্টচিত্তে স্ত্রীর মোহরানা আদায় করে দেয়া ফরজ। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন-

وَاٰتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَاِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوْهُ هَنِيْئًا مَرِيْئًا

‘‘নারীদেরকে তাদের মোহরানা সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দাও। যদি তারা সন্তুষ্টিচিত্তে তা থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তাহলে তোমরা তা নিঃসঙ্কোচে খেতে পার। (সূরা নিসা- ৪)

এ ব্যাপারেও পদ্ধতি এটাই অবলম্বন করতে হবে যে, তাদের মোহরানা তাদের হাতে দিয়ে দিতে হবে। অতঃপর তারা সন্তুষ্টচিত্তে তা সম্পূর্ণ বা কিছু অংশ যদি স্বামীকে দিয়ে দেয় তবে তা নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু বাধ্য করে তা গ্রহণ করা যাবে না।

প্রচলিত প্রথায় স্ত্রীর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়ার দ্বারা ক্ষমা হয়ে যায় না, যতক্ষণ না সে অন্তরের সন্তুষ্টির সাথে ক্ষমা করে দেয়। যদি সে এ মনে করে মৌখিকভাবে ক্ষমা করে দেয় যে, আমি ক্ষমা করি বা না করি কোনভাবেই তো তা পাব না, তাহলে এ ক্ষমা গ্রহণযোগ্য নয়। স্ত্রীর মোহরানা আদায় না করে কেউ মারা গেলে সেজন্য সে অপরাধী সাব্যস্ত হবে।

কন্যা সন্তানদেরকে বিবাহ দিয়ে তাদের মোহরানা কোন অভিভাবক আদায় করে নেয়। যদি মেয়ের হক সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয় তবে অভিভাবকরা তা করবেন। কিন্তু কন্যাকে জিজ্ঞেস করা ছাড়াই তার সম্পদ নিজের কাজে ব্যবহার করা এবং নিজের মনে করে নেয়া মোটেই জায়েয নয়।

৬০
অনুমতি না নিয়ে কারো জিনিস ব্যবহার করা
কেউ কেউ বিষয়টি হালকা মনে করে কারো জিনিসপত্র নিয়ে যায়, পরে ফেরত দেয় না। অথচ জিনিসটির মালিক সন্তুষ্টচিত্তে তা প্রদান করতে ইচ্ছুক নয়। এভাবে কারো কোন জিনিস গ্রহণ করা হারাম। যদিও এর মালিক ভদ্রতার খাতিরে নীরব থাকেন।

عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَحِلُّ مَالُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ اِلَّا بِطِيْبِ نَفْسِهٖ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন, কোন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের মাল ভোগ করা হালাল নয় যতক্ষণ না সে মনের খুশিতে তা দিতে প্রস্তুত হয়। (সুনান দার কুতনী হা: ২৮৮৫)

৬১
মান-সম্মানের হক
মান-সম্মানের হক সম্পর্কিত ক্ষতিপূরণের অর্থ এই যে, কেউ কাউকে বিনা দোষে প্রহার করে থাকে, গালি দিয়ে থাকে, অথবা পরনিন্দা করে থাকে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকে, অথবা যেকোন প্রকারে দৈহিক অথবা মানসিক কষ্ট দিয়ে থাকে। কেউ এমনটি করে থাকলে প্রতিপক্ষের নিকট হতে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করিয়ে নেয়া কর্তব্য। নতুবা কিয়ামতের দিন তার নেকী পাওনাদাররা নিয়ে যাবে আর সে নিঃস্ব ব্যক্তিতে পরিণত হবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ اَبِى هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ اَنَّ رَسُولَ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَالَ « اَتَدْرُوْنَ مَا الْمُفْلِسُ » . قَالُوا اَلْمُفْلِسُ فِيْنَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهٗ وَلَا مَتَاعَ . فَقَالَ « اِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ اُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هٰذَا وَقَذَفَ هٰذَا وَاَ كَلَ مَالَ هٰذَا وَسَفَكَ دَمَ هٰذَا وَضَرَبَ هٰذَا فَيُعْطٰى هٰذَا مِنْ حَسَنَاتِهٖ وَهٰذَا مِنْ حَسَنَاتِهٖ فَاِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهٗ قَبْلَ اَنْ يُقْضٰى مَا عَلَيْهِ اُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ »

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী ﷺ জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কি জান গরীব কে? সাহাবাগণ উত্তরে বললেন, আমরা তো সে লোককেই গরীব মনে করি, যার নিকট দিরহাম অথবা মাল-সামানা নেই। তখন নবী ﷺ বললেন (না), নিশ্চয় আমার উম্মতের মধ্যে সে লোক (প্রকৃত) গরীব, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আগমন করবে। অর্থাৎ সে নামায পড়েছে, রোযা রেখেছে এবং যাকাতও আদায় করেছে; কিন্তু সে হাশরের ময়দানে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাত করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে।

(আর কিয়ামতের দিন তার ফায়সালা এভাবে করা হবে যে,) যাকে সে কষ্ট দিয়েছিল অথবা যার হক মেরে খেয়েছিল, তাদের মধ্যে তার নেকী বণ্টন করে দেয়া হবে। তারপরও যদি মানুষের হক আদায় হওয়ার পূর্বেই তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তবে হকদারদের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম হা: ৬৭৪৪)

উক্ত হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, শুধুমাত্র টাকা-পয়সা মেরে দেয়ার নামই যুলুম নয়। বরং গালি দেয়া, মিথ্যা অপবাদ দেয়া, অনর্থক প্রহার করা, সম্মান নষ্ট করা- এগুলোও যুলুম এবং হক নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত। অনেক লোক মনে করে যে, তারা ধর্মপরায়ণ অথচ এসব বিষয় হতে আদৌ বিরত থাকে না। এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হক তওবা ও ইস্তেগফার দ্বারা ক্ষমা করেন কিন্তু বান্দার হক তখনই ক্ষমা হবে যখন তা আদায় করে দেয়া হবে অথবা ক্ষমা চেয়ে নেয়া হবে।

৬২
পরকালে টাকা-পয়সার বিনিময় চলবে না
হাদীসে রয়েছে, নবী ﷺ বলেছেন-

مَنْ كَانَتْ عِنْدَهٗ مَظْلَمَةٌ لِأَخِيْهِ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهَا ، فَإِنَّهٗ لَيْسَ ثَمَّ دِيْنَارٌ ، وَلَا دِرْهَمٌ مِنْ قَبْلِ اَنْ يُؤْخَذَ لِأَخِيْهِ مِنْ حَسَنَاتِه فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهٗ حَسَنَاتٌ اُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ اَخِيْهِ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ .

নবী ﷺ বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের উপর অত্যাচার করেছে, (যেমন তার সম্মান নষ্ট করেছে অথবা তার হক নষ্ট করেছে) সে যেন সেদিন আসার পূর্বেই নিজেকে মুক্ত করে নেয় অর্থাৎ তার হক আদায় করে দেয় অথবা ক্ষমা চেয়ে নেয়, যেদিন দিনার অথবা দিরহাম অর্থাৎ টাকা-পয়সা কোন কাজে আসবে না। যদি তার কোন নেক আমল থাকে তাহলে অত্যাচার পরিমাণ তার নিকট হতে কেটে নেয়া হবে। আর যদি তার কোন নেকী না থাকে তাহলে অত্যাচারিত ব্যক্তির পাপ এনে তার মাথায় চাপিয়ে দেয়া হবে।’’ (বুখারী হা: ৬৫৩৪)

وَذَكِّرْ بِه اَنْ تُبْسَلَ نَفْسٌ ۢبِمَا كَسَبَتْ لَيْسَ لَهَا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَلِيٌّ وَّلَا شَفِيْعٌ وَّإِنْ تَعْدِلْ كُلَّ عَدْلٍ لَّا يُؤْخَذْ مِنْهَا

‘‘এ কুরআন দ্বারা ভয় দেখাতে থাকুন যাতে মানুষ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয় যে, আল্লাহ ছাড়া তার কোন সাহায্যকারী নেই এবং কোন সুপারিশকারীও নেই। আর আযাব থেকে বাঁচার জন্য বিনিময় হিসেবে যাই দেবে কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না।’’ (সূরা আনআম- ৭০)

إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَمَاتُوْا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْ اَحَدِهِمْ مِلْءُ الْاَرْضِ ذَهَبًا وَّلَوِ افْتَدٰى بِه اُولٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ وَّمَا لَهُمْ مِّنْ نَاصِرِيْنَ

‘‘যারা কুফরী করে এবং কাফির অবস্থায় মারা যায় তারা এ পৃথিবীর সমপরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহকে দিয়ে যদি বলে এর বিনিময়ে আমাকে শাস্তি থেকে মুক্তি দিন তবুও একজনের পক্ষ থেকেও তা গ্রহণ করা হবে না। তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থাকবে। আর তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না।’’ (সূরা আলে ইমরান- ৯১)

اِنَّ اللهَ يَقُوْلُ لِاَهْوَنِ اَهْلِ النَّارِ عَذَابًا لَوْ اَنَّ لَكَ مَا فِي الْاَرْضِ مِنْ شَيْءٍ كُنْتَ تَفْتَدِيْ بِه قَالَ نَعَمْ قَالَ فَقَدْ سَأَلْتُكَ مَا هُوَ اَهْوَنُ مِنْ هٰذَا وَاَنْتَ فِيْ صُلْبِ اٰدَمَ اَنْ لَّا تُشْرِكَ بِيْ فَأَبَيْتَ اِلَّا الشِّرْكَ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন সবচেয়ে হালকা শাস্তির উপযুক্ত যে হবে তাকে আল্লাহ তা’আলা বলবেন, হে বান্দা! দুনিয়ার সবকিছু যদি তোমার হত তাহলে এ আযাব থেকে বাঁচার জন্য তা দিতে রাজি হবে কি? সে বলবে, হ্যাঁ। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি আদমের হাড্ডির ভেতরে থাকতে আমি তোমার কাছে তার চেয়ে হালকা জিনিস চেয়েছিলাম যে, তুমি আমার সাথে শিরক করবে না। কিন্তু তা অমান্য করেছ। (বুখারী হা : ৩৩৩৪)

সে দিন কোন বন্ধু পাবে না, কোন সুপারিশকারীও পাবে না :

مَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ حَمِيْمٍ وَّلَا شَفِيْعٍ يُّطَاعُ

‘‘যালিমদের জন্য কোন আপন বন্ধু থাকবে না আর এমন কোন সুপারিশকারীও থাকবে না যার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয়।’’ (সূরা মুমিন- ১৮)

يَقُوْلُ الَّذِيْنَ نَسُوْهُ مِنْ قَبْلُ قَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ فَهَلْ لَّنَا مِنْ شُفَعَاءَ فَيَشْفَعُوْا لَنَا اَوْ نُرَدُّ فَنَعْمَلَ غَيْرَ الَّذِيْ كُنَّا نَعْمَلُ قَدْ خَسِرُوْا اَنْفُسَهُمْ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَّا كَانُوْا يَفْتَرُوْنَ

যারা দুনিয়াতে আযাবের কথা ভুলে গিয়েছিল তারা বলবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলগণ আমাদের কাছে সত্য নিয়ে এসেছিলেন। অতএব এখন আমাদের জন্য কোন সুপারিশকারী আছে কি? অথবা আমরা পুনরায় দুনিয়াতে যাওয়ার সুযোগ পাব কি? যাতে খারাপ কাজের পরিবর্তে ভাল কাজ করতে পারি। আসলে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর তাদের সকল মিথ্যা প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে। (সূরা আরাফ- ৫৩)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন