HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

শিরক

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
শিরক সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও পরিণাম

সংকলন :

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

সম্পাদনা :

মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল

ইমাম পাবলিকেশন্স লিঃ, ঢাকা

শিরক কি?
اَلشِّرْكُ (আশ শিরকু) শব্দের আভিধানিক অর্থ- অংশীদারিত্ব, অংশীবাদ, মিলানো, সমকক্ষ করা, অংশীদার স্থির করা, সমান করা, ভাগাভাগি, সম্পৃক্ত করা। ইংরেজীতে এর প্রতিশব্দ হচ্ছে, Poytheism (একাধিক উপাস্যে বিশ্বাস), Share, Partner, Associate. সুতরাং কোন বস্ত্ত বা বিষয় দুই বা ততোধিক ব্যক্তির জন্য সাব্যস্ত হওয়াকেই শিরক বলা হয়। তবে ইসলামী পরিভাষায় শিরক বলতে একটি বড় ধরনের গুনাহকে বুঝানো হয়, যা কোন বিষয়ে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করার মাধ্যমে সাব্যস্ত হয় এবং আল্লাহ তা‘আলা এর গুনাহ একনিষ্ঠ তওবা ছাড়া ক্ষমা করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَا تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ﴾

আল্লাহর সাথে শরীক করো না; নিশ্চয়ই শিরক চরম যুল্ম।

(সূরা লুক্মান ৩১:১৩)

অপর আয়াতে বলেন,

﴿إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ﴾

নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার গুনাহ ক্ষমা করেন না। এটি ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে তো মহাপাপে লিপ্ত হল। (সূরা নিসা ৪:৪৮)

প্রথমোক্ত আয়াতে শিরককে সবচেয়ে বড় জুলুম বলা হয়েছে। আর জুলুম মানে হল, কোন জিনিষ অপাত্রে স্থাপন করা অথবা একজনের জিনিষ অন্যকে দেয়া। অতএব শিরক নামক জুলুমের মানে হল, আল্লাহর জিনিষ আল্লাহকে না দিয়ে অন্যকে দেয়া।

আলেমগণ এর পরিচয় দিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন-

১. আল্লামা রাবি ইবনু হাদী আল-মাদখালী (রহ.) বলেন: শিরক হচ্ছে আল্লাহর এমন কোন সমকক্ষ স্থীর করা, যাকে আল্লাহর মতই ডাকা হয়, ভয় করা হয়, তার কাছে আশা করা হয়, আল্লাহর মতই তাকে ভালোবাসা ও নিবেদন করা হয় এবং তার কোন প্রকারের ইবাদাত করা হয়।

২. ড: ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মদ আল-বুরাইকান তাঁর ‘আল-মাদখাল’ নামক গ্রন্থে বলেন, শিরকের দুটো অর্থ রয়েছে। প্রথমত: আম বা সাধারণ অর্থ। আর তা হচ্ছে, আল্লাহর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসমূহ তথা রূবুবিয়্যাত, উলুহিয়্যাত, আসমাউস সিফাত এর মধ্যে গায়রুল্লাহকে আল্লাহর সমান মনে করা। এখানে সমান মনে করা অর্থ হল, গায়রুল্লাহকে যে কোন একটি অংশ- চাই তাতে আল্লাহ গায়রুল্লাহর সমান হন কিংবা তাঁর চেয়ে বড় অংশের অধিকারী হন। দ্বিতীয়ত: খাছ বা নির্দিষ্ট অর্থ। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকে ইবাদত ও আনুগত্যের উপযুক্ত সাব্যস্ত করা। এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন-সুন্নাহ ও সালফে-সালেহীনের বক্তব্যের মধ্যে শিরকের এ অর্থটিই সচরাচর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। শিরক বলতে সাধারণত তারা ইবাদতের শিরককেই বুঝিয়ে থাকেন।

৩. ইমাম কুরতুবী বলেন, শিরক হল আল্লাহর নিরংকুশ প্রভূত্বে কারো অংশীদারিত্বের আক্বীদা পোষণ করা।

৪. কেউ কেউ বলেন, যেসব গুণাবলী কেবল আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত সেসব গুনে অন্য কাউকে গুণান্বিত ভাবা বা এতে অন্য কারো অংশ আছে বলে মনে করাই শিরক।

এক কথায়, শিরক হচ্ছে আল্লাহর সাথে এমন বিষয়ে সমকক্ষ স্থীর করা যেটা আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যেমন- আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো নিকট আশা করা, আল্লাহর চাইতে অন্য কাউকে বেশী ভালোবাসা, অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতের কোন একটি অন্যের দিকে সম্বোধন করা।

উল্লেখ্য যে, যেহেতু অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে দুই শরীকের অংশ সমান হওয়া আবশ্যক নয়, বরং শতভাগের একভাগের অংশীদার হলেও তাকে অংশীদার সাব্যস্ত করা হয়, সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এর হকের সামান্যতম অংশও অন্য কাউকে দিলে তা শিরকে পরিণত হবে। এতে আল্লাহর অংশটি যত বড়ই রাখা হোক না কেন।

শিরকের ভয়াবহতা
উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহ হতে অনুধাবন করা গেল, শিরক হচ্ছে একটি অত্যন্ত মারাত্মক গোনাহ। এর মাধ্যমে মানুষের চুড়ান্ত ধ্বংস অনির্বায্য। কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে এর ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো :

১। শিরক একটি বড় ধরনের অপরাধ ও জুলুম :

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

وَاِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِاِبْنِهٖ وَهُوَ يَعِظُهٗ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِؕ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ

স্মরণ করো, যখন লুক্বমান স্বীয় ছেলেকে বলেছিলেন, হে আমার ছেলে! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয় শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুলুম। (সূরা লুক্বমান- ৩১:১৩)

২। শিরকে্র গুনাহ আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করবেন না :

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿اِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ اَنْ يُّشْرَكَ بِهٖ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَن يَّشَآءُ﴾

নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক স্থাপন করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন। (সূরা নিসা- ৪:৪৮)

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَغْفِرُ لِعَبْدِهٖ مَا لَمْ يَقَعْ الْحِجَابُ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا وُقُوْعُ الْحِجَابِ قَالَ أَنْ تَمُوْتَ النَّفْسُ وَهِيَ مُشْرِكَةٌ

জাবির বিন আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন- বান্দার জন্য সর্বদাই ক্ষমা রয়েছে যতক্ষন পর্যন্ত হিযাব বা পর্দা পতিত না হয়। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! হিযাব বা পর্দা কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক্ করা। (মুসনাদে আহমদ ২১৫২৩; ইবনে কাছীর ১ম খন্ড ৬৭৮পৃ:)

৩। শিরক করলে জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায় :

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ إِنَّهُ ُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ ﴾

হে বনী ইসরাইল! তোমরা আমার রব এবং তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর। কেউ আল্লাহর শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।

(সূরা মায়েদা ৫:৭২)

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ ابْنِ نُمَيْرٍ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ - - يَقُوْلُ مَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ

ইবনে নুমাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক্ করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, সে জাহান্নামে যাবে। (সহীহ মুসলিম ২৭৮)

৪। শিরক করলে সব আমল বাতিল হয়ে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় :

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই এই ওহী হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক কর, তাহলে তোমার আমল নিস্ফল হয়ে যাবে এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার ৩৯:৬৫)

সূরা আন‘আমের ৮৩-৮৭ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ১৮ জন নবীর নাম নিয়ে তাদের ব্যাপারে বলেছেন:

﴿وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

যদি তারা শিরক করতো, তবে তাদের কৃতকর্ম নিস্ফল হয়ে যেত।

(সূরা আন‘আম ৬:৮৮)

৫। শিরক্কারী ধ্বংসে এবং বিপর্যয়ে পতিত হয় :

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

﴿وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ﴾

যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ল, কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। (সূরা হাজ্জ ২২:৩১)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ اِجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্ত্ত থেকে বেঁচে থাকবে। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সেগুলো কি? রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেলেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং যাদু করা, আল্লাহ যাতে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং সতী-সাধবী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা। (সহীহ বুখারী ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম ২৭২)

৬। শিরক্কারী মুশরিক ও অপবিত্র :

মুশরিকদের জন্য দোয়া করা যাবে না, কেননা এরা সৃষ্টির অধম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّمَا الْمُشْرِكُوْنَ نَجَسٌ﴾

নিশ্চয় মুশরিকরা অপবিত্র। (সূরা তাওবাহ ৯:২৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اَنْ يَّسْتَغْفِرُوْا لِلْمُشْرِكِيْنَ وَلَوْ كَانُوْاۤ اُولِيْ قُرْبٰى مِنْ ۢبَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ اَنَّهُمْ اَصْحَابُ الْجَحِيْمِ﴾

আত্মীয়স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়, যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তারা নিশ্চিত জাহান্নামী।

(সূরা তাওবা- ৯:১১৩)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿اِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِيْنَ فِي ْنَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِيْنَ فِيْهَاؕ اُوْلٰٓئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ﴾

আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফির, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে; আর তারাই সৃষ্টির সবচেয়ে অধম। (সূরা বায়্যিনাহ- ৯৮:৬)

শিরক না করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ কি?
আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন:

وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًا

আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। (সূরা নিসা ৪:৩৬)

﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحٰى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖ أَحَدًا﴾

বল, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি এই ওহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। (সূরা কাহফ ১৮:১১০)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا وَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ﴾

আর এটা এই যে, তুমি একনিষ্ঠভাবে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনও মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হইও না। (সূরা ইউনুস ১০:১০৫)

মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন,

﴿لَا تُشْرِكْ بِاللهِ شَيْئًا وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتَ﴾

আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক্ করো না, যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় কিংবা পুড়িয়ে মারা হয়। (মুসনাদে আহমাদ ২২০৭৫)

শিরকের ক্ষতিকর দিক ও বিপদসমূহ কি কি?
শিরকে অনেক অনিষ্টকর দিক আছে। ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ জীবনে তার ক্ষতিকর প্রভাবগুলো তুলে ধরা হলো:

শিরক মানবতার জন্য অবমাননাকর; এটি মানুষের সম্মানকে ধূলায় লুন্ঠিত করে ও তার সামর্থ্যকে নিচু করে দেয়।

শিরকের কারণে সমস্ত আজেবাজে কুসংস্কার ও বাতিল রুসূমাত মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে ।

শিরক সবচেয়ে বড় যুলুম।

শিরক হচ্ছে সমস্ত কল্পনা ও ভয়ের মূল কারণ। শিরককারীর মাথায় কুসংস্কার বাসা বাঁধতে শুরু করে এবং সমস্ত আজেবাজে কথা ও কাজকে সে গ্রহণ করতে থাকে, ফলে সমস্ত দিক থেকেই সে ভয় পেতে শুরু করে।

শিরকের কারণে নেক আমলগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

শিরক উম্মতকে টুকরো টুকরো করে দেয়।

শিরক না করার ফযীলত কি?
শিরক না করলে আল্লাহ তা‘আলা নিরাপত্তা দান করেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَلَمْ يَلْبِسُوْا إِيْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُوْنَ﴾

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করে নাই, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়েত প্রাপ্ত। (সূরা আন‘আম ৬:৮২)

শিরক না করলে আল্লাহ তা‘আলা শাস্তি দিবেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন:

عَنْ مُعَاذٍ قَالَ كُنْتُ رِدْفَ النَّبِيِّ عَلٰى حِمَارٍ يُقَالُ لَهٗ عُفَيْرٌ فَقَالَ يَا مُعَاذُ هَلْ تَدْرِيْ حَقَّ اللهِ عَلٰى عِبَادِهٖ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ قُلْتُ اللهُ وَرَسُوْلُهٗ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَّعْبُدُوْهُ وَلَا يُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًا وَّحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ أَنْ لَّا يُعَذِّبَ مَنْ لَّا يُشْرِكُ بِهٖ شَيْئًا فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَلَا أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ قَالَ لَا تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوْا

মুয়ায (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উফাইর নামক একটি গাধার পিঠে নাবী ﷺ এর পেছনে বসেছিলাম। নাবী ﷺ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান বান্দার নিকট আল্লাহর হক্ কি? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন: বান্দাহর নিকট আল্লাহর হক্ হল বান্দাহ তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর বান্দাহর নিকট আল্লাহর অধিকার হলো তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করলে আল্লাহ তাকে শাস্তি প্রদান করবেন না। (সহীহ বুখারী ২৬৪৬)

শিরক না করলে জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন,

عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ أَتَانِي اٰتٍ مِنْ رَبِّيْ فَأَخْبَرَنِي أَوْ قَالَ بَشَّرَنِيْ أَنَّهٗ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِيْ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْأً دَخَلَ الْجَنَّةَ قُلْتُ وَإِنْ زَنٰى وَإِنْ سَرَقَ قَالَ وَإِنْ زَنٰى وَإِنْ سَرَقَ

আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী ﷺ বলেছেন, জিব্রাঈল এসে আমাকে সুসংবাদ দিলেন, আল্লাহর সাথে শরীক্ স্থাপন না করে যে ব্যক্তি মারা যায় সে জান্নাত লাভ করবে। আবু যর বললেন, যদি সে চুরি করে এবং ব্যভিচার করে তবুও কি? নাবী ﷺ বললেন, হ্যাঁ- যদি সে চুরি করে এবং ব্যভিচার করে তবুও। (সহীহ বুখারী ১২৩৭)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ جَابِرٍ قَالَ أَتَى النَّبِىَّ - - رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا الْمُوْجِبَتَانِ فَقَالَ : مَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নাবী ﷺ এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করল, জান্নাত এবং জাহান্নাম ওয়াজিবকারী বস্ত্ত দু‘টি কি কি? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার না বানিয়ে মৃত্যুবরণ করল সে জান্নাতী। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বানিয়ে মারা গেল সে জাহান্নামী। (সহীহ মুসলিম ১৭৭)

শিরকের কারণগুলো কি কি?
কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে আমরা এখানে শিরকের ৪ টি কারণ উপস্থাপন করছি, যেন সকলে এগুলো জেনে শিরক থেকে বেঁচে থাকতে পারে। কারণগুলো হলো :

১। আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা ও খারাপ মনোবৃত্তি পোষণ করা:

মন্দ ধারণাই শিরকের নেপথ্য কারণ। যে কোন শিরকের পেছনে আল্লাহ সম্পর্কে কোন না কোন দোষ-ত্রুটি ও মন্দ ধারণা কাজ করে। ভালোবাসার বিপরীত এই মন্দ ধারণা পোষণ করার কারণেই মানুষ আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করে। গাইরুল্লাহকে তার জন্য আল্লাহর চেয়ে অধিক দয়ালু ও কল্যাণকামী মনে করে। আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা মহা পাপ। এর জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। আল্লাহ বলেন:

﴿وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِيْنَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِيْنَ وَالْمُشْرِكَاتِ الظَّآنِّيْنَ بِاللهِ ظَنَّ السَّوْءِؕ عَلَيْهِمْ دَآئِرَةُ السَّوْءِؕ وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَاَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَؕ وَسَآءَتْ مَصِيْرًا﴾

আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদেরকে শাস্তি দেবেন, যারা আল্লাহর সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখে। তারা নিজেরাই মন্দের খপ্পরে পড়ে গেছে। আল্লাহ তাদের ওপর রাগ করেছেন এবং তাদের ওপর লানত বর্ষণ করেছেন। আর তাদের জন্য জাহান্নামের ব্যবস্থা করেছেন, যা বড়ই মন্দ ঠিকানা। (সূরা ফাতাহ ৪৮:৬)

মুশরিকদের এই মন্দ ধারণার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে তাওহীদের ইমাম ইবরাহিম (আঃ) তাঁর চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র ও মূর্তিপূজারী জাতির সামনে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন; পবিত্র কুরআনে তা এভাবে উদ্বৃত হয়েছে-

﴿إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهٖ مَاذَا تَعْبُدُوْنَ أَئِفْكًا اٰلِهَةً دُوْنَ اللهِ تُرِيْدُوْنَ فَمَا ظَنُّكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ ﴾

তোমরা কিসের পূজা করছ? তোমরা কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ মিথ্যা অলীক মা’বুদগুলোকে চাও? তাহলে বিশ্ব জাহানের রব সম্বন্ধে তোমাদের কি ধারণা? (সূরা সাফফাত ৩৭ : ৮৫-৮৭)

এ কথার মর্ম হলো, তোমরা রাববুল আলামীনের মধ্যে কী ধরনের দোষ ত্রুটি ও মন্দের ধারণা পোষণ করছ? যার ফলে তাঁকে পরিত্যাগ করেছ এবং তাঁর পরিবর্তে এতসব মা‘বুদ ও দেবতা বানিয়ে নিয়েছ? আল্লাহর সত্তা তাঁর গুণাবলী ও কার্যাবলী সম্পর্কে তোমরা কি ধরনের খারাপ মনোবৃত্তি পোষণ করছ? কী ধরনের দোষ-ত্রুটি তাঁর মধ্যে আছে বলে ধারণা করছ? কী ধরনের অক্ষমতা, অপারগতা, করুণার অভাব তাঁর মধ্যে আছে বলে তোমরা মনে করছ? যার ফলে সরাসরি তার ইবাদত না করে মাধ্যমের পূজা করছ? তাদের কাছেই কল্যাণের প্রত্যাশা করছ এবং অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য তাদের শরণাপন্ন হচ্ছ?

বস্ত্তত মুশরিকরা মনে করে যে, আল্লাহ তাদেরকে দয়া করবেন না। এজন্যই তারা মাধ্যম ও ভায়া মা‘বুদের ইবাদত করে। আল্লাহর নিকট এসব ভায়া মা‘বুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে বলে বিশ্বাস করে। আল্লাহ তাদেরকে ভাল না বাসলেও ভায়া মা‘বুদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের কল্যাণ করতে বাধ্য। ভায়া মা‘বুদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের কল্যাণ করতে বাধ্য।** ভায়া মা‘বুদরা সুপারিশ করলে সে সুপারিশ আল্লাহ তা‘আলা বাতিল করতে পারেন। এর জবাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَاۤ أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَهٗ إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ لَنْ يَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّلَوِ اجْتَمَعُوْا لَهٗ وَإِنْ يَّسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَا يَسْتَنْقِذُوْهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوْبُ مَا قَدَرُوا اللهَ حَقَّ قَدْرِهٖ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ ﴾

হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল। তারা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দেয় না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাক্ষমতাবান ও মহাপরাক্রমশালী।

(সূরা হজ্জ ২২:৭৩-৭৪)

যারা সম্মিলিত শক্তি দিয়ে একটি মাছি সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। মাছি তাদের কিছু ছিনিয়ে নিলে তা উদ্ধার করতেও সক্ষম নয়। তারা তোমাদের জন্য কি কল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে অথবা তোমাদের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছ থেকে নিজ ক্ষমতাবলে কিইবা উদ্ধার করে আনতে পারে? মাছির কাছে যারা পরাজিত, মহাশক্তিধর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে তারা কীভাবে বিজয়ী হতে পারে? আল্লাহর কাছ থেকে কিছু উদ্ধার করে আনা তো দূরের কথা, তাঁর সন্তুষ্টি ও অনুমোদন ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতাও কারো নেই।

আল্লাহর ‘রহমান’ নামের অর্থ হল- স্বভাবগত দয়ালু, করুণায় পরিপূর্ণ সত্তা। যাঁর দয়া পাবার জন্য কোন ভায়া বা মাধ্যমের সুপারিশের কোনই প্রয়োজন নেই। তিনি স্বভাবগতভাবেই তাঁর সৃষ্টিকে দয়া করেন। পবিত্র কুরআনে তিনি বলেন:

﴿وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ﴾

আমার অনুগ্রহ প্রত্যেক বস্তুর উপর বিস্তৃত। (সূরা আ‘রাফ ৭:১৫৬)

নবী ও পুন্যবানদের যে সুপারিশ আল্লাহ তাঁর তাওহীদবাদী বান্দাদের জন্য অনুমোদন করেছেন, তা তো নবী ও পুন্যবানদের রহমত ও করুণা নয় বরং কেবলমাত্র তাঁরই করুণার বহি:প্রকাশ। যার মাধ্যমে নবী ও পুন্যবানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

আল্লাহর ‘ক্বারীব’ নামের অর্থ হল নিকটবর্তী। যিনি জ্ঞান, শ্রবন, দর্শন, হেদায়াত, সাহায্য-সহযোগিতায় বান্দাদের সরাসরি নিকটে। বান্দা ও তাঁর মধ্যে কোন প্রহরী-দারোয়ান ও পরিষদবর্গ দিয়ে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়নি। তিনি তো দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের মত নন যে, প্রহরী-দারোয়ান ও পরিষদবর্গের অন্তরায় ডিঙ্গিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে যেতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَاِذَا سَاَلَكَ عِبَادِيْ عَنِّيْ فَاِنِّي قَرِيْبٌؕ اُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ ﴾

আর যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে তখন তাদেরকে বলে দাও, নিশ্চয় আমি নিকটেই রয়েছি। কোন আহবানকারী যখনই আমাকে ডাকে, তখনই আমি তার আহবানে সাড়া দেই।

(সূরা বাকারা ২:১৮৬)

ভায়া বা মাধ্যম গ্রহণের কোনই প্রয়োজন নেই। এমনকি তাঁকে ডাকতে বড় শব্দ করে ডাকারও প্রয়োজন নেই। যাকে তোমরা ডাক, তিনি বধির নন, দূরবর্তীও নন। তিনি তো সর্ব শ্রোতা, সন্নিকটবর্তী। আল্লাহকে এমন মনে করা মস্ত বড় মন্দ ধারণা করার শামীল। আর আল্লাহর সাথে কোন মন্দ ধারণা করাই শিরক ও ধ্বংসের নেপথ্য কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَذٰلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِيْ ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ اَرْدَاكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ مِّنَ الْخَاسِرِيْنَ﴾

তোমাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। (সূরা ফুসসিলাত ৪১:২৩)

ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন,

আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর মধ্যে মাধ্যমের অনুপ্রবেশ ঘটানো হল তাঁর একত্ববাদ, মা‘বুদ হওয়ার বৈশিষ্ট্য ও তাঁর প্রতিপালনের অধিকার ক্ষুন্ন করা এবং তাঁর সাথে দোষ-ত্রুটি ও মন্দ ধারণা পোষণ করার নামান্তর। (আল জাওয়াবুল কাফী ১/১৫১)

২। সৃষ্টিকে স্রষ্টার সমতুল্য করা :

আল্লাহর সাথে শিরকের অন্যতম কারণ হচ্ছে, সৃষ্টিকে স্রষ্টার সমতুল্য করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

﴿لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌۚ وَّهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ﴾

কোনকিছুই তাঁর সাদৃশ্য নয়, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরা ৪২:১১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

﴿وَلَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ﴾

তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (সূরা ইখলাস ১১২:৪)

অন্যত্র তিনি বলেন:

﴿فَلَا تَجْعَلُوْا لِلّٰهِ اَنْدَادًا ﴾

তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। (সূরা বাকারা ২:২২)

তিনি আরো বলেন:

﴿ هَلْ تَعْلَمُ لَهٗ سَمِيًّا﴾

আপনি কি তাঁর সমমান সম্পন্ন কাউকে জানেন? (সূরা মারইয়াম ১৯:৬৫)

কিভাবে সৃষ্টিকে স্রষ্টার সমতুল্য করা হয়
১. যে ব্যক্তি তার দু‘আ, ভয়, আশা-ভরসা সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত করল, সে এসব কাজে সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সমতুল্য করে ফেলল।

২. যে ব্যক্তি তার প্রণয়-বিনয়, দাসত্ব-আনুগত্য সর্বশক্তিমান আল্লাহকে না দিয়ে শক্তিহীন, নিঃস্ব, মুখাপেক্ষী, ব্যক্তিগতভাবে সর্বহারা ও সর্বগুণহীন দাস-দাসীকে দিল সে ঐ দাস-দাসীকে আল্লাহর সমতুল্য করে নিল।

সার্বভৌম ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ মালিকানার অধিকারী, স্বয়ং সম্পূর্ণ, সর্বগুণে গুণান্বিত, সকল দোষ-ত্রুটি হতে পবিত্র, উপমাহীন, তুলনাহীন, সমকক্ষহীন, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন রাববুল আলামীনের সাথে গাভী, তুলসী গাছ, মাটি ও খড়কুটোর তৈরী মূর্তি, সৃজিত ও লালিত-পালিত দাসানুদাসদেরকে তুলনা করা কত বড় কদর্য, কুৎসিত, বিশ্রী ও মন্দ তুলনা তা কি আর ভাষায় ব্যক্ত করা যায়?

৩. নবী, ফেরেশতা, জ্বীন, ওলী-আউলিয়া, পোপ-ফাদার, পুরোহিত, পীর বাবা, খাজা বাবা, দয়াল বাবা, উলঙ্গ ফকির, কবর-মাজারস্থ মৃত ব্যক্তি, মূর্তি ও দেবতার কাছে মানুষের লাভ-ক্ষতি, দান ও বঞ্চনার ক্ষমতা আছে বলে যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল, সে এসব বিষয়ে তাদেরকে আল্লাহর সমতুল্য করল।

৪. যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করল সে তাকে আল্লাহর সমতুল্য করল।

৫. যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপর ভরসা করল সে ব্যক্তি তাকে আল্লাহর সমতুল্য করল।

৬. যে ব্যক্তি সশ্রদ্ধভাবে আল্লাহ ছাড়া কারো নামে শপথ করল সে তাকে আল্লাহর সমতুল্য করল।

৭. সে ব্যক্তি অহংকার করল, মানুষকে তার প্রশংসা ও তার সামনে বিনয় প্রকাশ করার জন্য বলল, নিজেকে মানুষের আশা-ভরসাস্থল বলে প্রকাশ করল, মুক্তিদাতা, উদ্ধারকর্তা বলে দাবি করল, আল্লাহর আইন-বিধান পরিবর্তন করে নিজেই আইন-বিধান তৈরী করল, সে নিজেকে আল্লাহর সমতুল্য করল।

৮. যে ব্যক্তি নিজেকে শাহানশাহ (রাজাধিরাজ), মালিকুল আমলাক, সুলতানুস সালাত্বীন, আমীরুল উমারা, আহকামুল হাকিমীন, কাজীউল কুজাত নামকরণ করল সে নিজেকে আল্লাহর সমতুল্য করল। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رِوَايَةً قَالَ أَخْنَعُ اِسْمٍ عِنْدَ اللهِ وَقَالَ سُفْيَانُ غَيْرَ مَرَّةٍ أَخْنَعُ الْأَسْمَاءِ عِنْدَ اللهِ رَجُلٌ تَسَمّٰى بِمَلِكِ الْأَمْلَاكِ قَالَ سُفْيَانُ يَقُوْلُ غَيْرُهٗ تَفْسِيْرُهٗ شَاهَانْ شَاهْ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলার কাছে সর্বাধিক নিকৃষ্ট নাম হলো- সুফইয়ান (রহঃ) একাধিকবার বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট সে ব্যক্তির নাম যে দুনিয়ায় ‘রাজাধিরাজ’ নাম ধারণ করে। সুফইয়ান (রহঃ) বলেন, অন্যেরা এর ব্যাখ্যায় বলেন যে, এর মানে ‘শাহানশাহ’।

(সহীহ বুখারী ৬২০৬; ভারতীয় ছাপা ২য় খন্ডের ৯১৬ পৃষ্ঠার ৩নং টিকা সহ দ্রষ্টব্য)

৯. যে ব্যক্তি আব্দুল কাদের জীলানীকে ‘গাওছুল আযম’ (সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা) বলল, সে তাকে আল্লাহর সমতুল্য করল এবং তাঁর চেয়েও বড় সাব্যস্ত করল।

১০. যে ব্যক্তি কাউকে বলল, مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ (যা আল্লাহ চেয়েছেন এবং আপনি চেয়েছেন) সে তাকে আল্লাহর সাথে সমতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত করল। রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে এক ব্যক্তি এ কথাটি বললে তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমতুল্য করে ফেললে? বরং এক আল্লাহ যা চান (তাই সংঘটিত হয়)।

অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ লোকদেরকে এ কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন: مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ شِئْتَ অর্থাৎ ‘‘যা আল্লাহ চেয়েছেন অতঃপর আপনি চেয়েছেন’’। (সুনানে নাসায়ী ৩৭৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ ২১১৭)

শিরককারীদের এসব অমর্যাদাকর সমতুল্যকরণ বাতিল করার উদ্দেশ্যে কুরআনুল কারীমের মধ্যে মহান আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য দুটো উপমা উপস্থাপন করেছেন:

প্রথম উপমা:

﴿ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا عَبْدًا مَّمْلُوْكًا لَّا يَقْدِرُ عَلٰى شَيْءٍ وَّمَنْ رَّزَقْنَاهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا فَهُوَ يُنْفِقُ مِنْهُ سِرًّا وَّجَهْرًاؕ هَلْ يَسْتَوُوْنَؕ اَلْحَمْدُ لِلّٰهِؕ بَلْ اَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ﴾

আল্লাহ উপমা দিচ্ছেন অপরের অধিকারভুক্ত এক দাসের, যে কোনকিছুর ওপর ক্ষমতা রাখে না এবং এমন এক ব্যক্তির, যাকে তিনি নিজের পক্ষ হতে উত্তম রিযিক দান করেছেন। অতঃপর সে তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে; তারা কি একে অপরের সমান? সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য; অথচ তাদের অধিকাংশই তা জানে না। (সূরা নাহল- ১৬:৭৫)

দ্বিতীয় উপমা:

﴿وَضَرَبَ اللهُ مَثَلًا رَّجُلَيْنِ اَحَدُهُمَاۤ اَبْكَمُ لَا يَقْدِرُ عَلٰى شَيْءٍ وَّهُوَ كَلٌّ عَلٰى مَوْلَاهُ اَيْنَمَا يُوَجِّهْهُّ لَا يَأْتِ بِخَيْرٍؕ هَلْ يَسْتَوِيْ هُوَ وَمَنْ يَّأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَهُوَ عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ﴾

আল্লাহ আরো দু’জন ব্যক্তির উপমা দিচ্ছেন- তাদের একজন বোবা, যে কোনকিছুরই শক্তি রাখে না এবং সে তার মনিবের বোঝা হয়ে থাকে। তাকে যেখানেই পাঠানো হোক না কেন সে ভালো কিছুই করে আসতে পারে না। সে কি ঐ ব্যক্তির সমান হবে, যে ন্যায়ের নির্দেশ দেয় এবং যে আছে সরল পথে?

(সূরা নাহল- ১৬:৭৬)

প্রথম উপমাটি সম্পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আর দ্বিতীয় উপমাটি তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ মাল ও জ্ঞানে তাঁর সাথে সৃষ্টির কোন তুলনাই চলে না, যেমনিভাবে চলে না অন্য কোন ক্ষেত্রেও। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে তাদেরই অবস্থা দিয়ে নিজের মর্যাদা ও সমতুল্যহীন হওয়ার বিষয়টি কত সুন্দরভাবেই না বুঝালেন।

মানব সমাজে অক্ষম ও সম্পূর্ণ নিঃস্ব কোন ক্রীতদাস এবং ধনবান, বিত্তশীল দানবীর ব্যক্তিকে মর্যাদার দিক থেকে কেউই এক সমান মনে করে না। যেমন- মূক, অক্ষম, অপরের উপর বোঝা, কল্যাণকর কাজে যোগ্যতাহীন, মূর্খ-আহমক কোন ব্যক্তিকে একজন সুশিক্ষিত, ন্যায়-নীতিবান জ্ঞানী ব্যক্তির সমান কেউ মনে করে না। মানব সমাজে কি কখনো কোন ব্যক্তি নিঃস্ব, হতদরিদ্র কাঙ্গালের দুয়ারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে কিছু পাওয়ার আশায় যায়? অথবা কখনো কি কেউ কোন বোবা ও বধির, মূর্খ ও জ্ঞানহীন নাদানের নিকট জ্ঞান শেখার আশায় ধর্ণা দেয়? তাই যদি হয় তোমাদের নিজেদের অবস্থা, তবে কীভাবে সকল সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক, সকল জ্ঞানের একচ্ছত্র অধিকারী, সর্ববিষয়ে ন্যায়নীতিবান মহান আল্লাহকে তাঁর সৃজিত, লালিত-পালিত, নিঃস্ব, জাত মূর্খ, জাত কাঙ্গাল দাসানুদাসাদেরকে তাঁর সমতুল্য করছ? কীভাবে নিঃস্ব, কাঙ্গাল, জাত ফকিরদেরকে দু‘আ ইবাদাত নিবেদন করছ? আমাকে ছেড়ে নিষ্প্রাণ লক্ষ্মীর কাছে ধন আর স্বরস্বতীর কাছে জ্ঞান প্রার্থনা করছ। কীভাবে আমার প্রাপ্য মূর্তিকে দিচ্ছ? এই কি তোমাদের ন্যায় বিচার! এটাই কি তোমাদের জ্ঞানের পরিচয়। এটা কি তাঁর আত্মমর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী নয়? এটা কি সবচেয়ে বড় জুলুম ও অবিচার নয়?

সৃষ্টিকে আল্লাহর সমতুল্য করা শিরকে আকবার। তাওবা না করে মৃত্যু বরণ করলে যার পরিণাম চির জাহান্নাম। এহেন শিরকে লিপ্ত ব্যক্তিরা জাহান্নামে পতিত হয়ে যে উক্তি করবে কুরআনে তা এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে:

﴿تَاللهِ إِنْ كُنَّا لَفِيْ ضَلَالٍ مُّبِيْنٍ إِذْ نُسَوِّيْكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ﴾

আল্লাহর কসম! আমরা (জাহান্নামবাসী) সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিলাম। যখন আমরা তোমাদেরকে (পূজিত) রাববুল আলামীনের সমতুল্য করেছিলাম।

(সূরা শুয়ারা ২৬:৯৭-৯৮)

৩। আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা না দেয়া :

শিরক মানে আল্লাহর সমস্ত মর্যাদাকে অস্বীকার করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَا قَدَرُوا اللهَ حَقَّ قَدْرِهٖ وَالْاَرْضُ جَمِيْعًا قَبْضَتُهٗ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّماوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ ۢبِيَمِيْنِهٖؕ سُبْحَانَهٗ وَتَعَالٰى عَمَّا يُشْرِكُوْنَ﴾

তারা আল্লাহকে যথাযথ সম্মান করে না। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুষ্টিতে এবং আকাশমন্ডলী থাকবে ভাঁজকৃত- তাঁর ডান হাতে। অতএব তারা তাঁর সাথে যাকে শরীক করে তিনি তার থেকে অনেক পবিত্র ও মহান। (সূরা যুমার- ৩৯:৬৭)

৪। আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মুর্খতা :

শিরকের কারণসমূহের মধ্যে এটি হল অজ্ঞতা ও মুর্খতা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿قُلْ أَفَغَيْرَ اللهِ تَأْمُرُوْنِّيْ أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُوْنَ﴾

বলুন, হে মূর্খরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে আদেশ করছ? (সূরা যুমার ৩৯:৬৪)

শিরক কয় প্রকার ও কি কি?
শিরকে বেশ কয়েকটি দিক থেকে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন-

১. ক্ষেত্র হিসেবে শিরকের প্রকারভেদ :

যেসব ক্ষেত্রে শিরক সংঘটিত হয়, সেগুলো নিমেণাক্ত তিন প্রকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ :

(ক) اَلشِّرْكُ فِى الرُّبُوْبِيَّةِ (আশ্শিরকু ফির-রুবূবিয়্যাহ) :

শিরক ফির রুবুবিয়্যাহ হচ্ছে আল্লাহর কর্তৃত্ব, ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্বে কাউকে তার সমকক্ষ করা। এই প্রকারের প্রচলিত শিরকগুলো হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বিধানদাতা হিসেবে মানা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটদানের মাধ্যমে কাউকে বিধানদাতা নির্বাচন করা, যাদু করা, তাবিজ-কবজ ব্যবহার করা, শুভ-অশুভ সংকেত গ্রহণ করা, কাউকে কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক অথবা বিপদাপদ ও রোগ-শোক থেকে মুক্তিদাতা অথবা সন্তান দিতে পারে বলে মনে করা, আল্লাহর স্ত্রী বা সন্তান আছে বলে মনে করা ইত্যাদি।

(খ) اَلشِّرْكُ فِى الْاَسْمَاءِ وَالصِّفَاتِ (আশ্শিরকু ফিল আসমাই ওয়াস সিফাত) :

তা হচ্ছে আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর ক্ষেত্রে শিরক করা। আল্লাহর গুণাবলীর সাথে সৃষ্টির গুণাবলীর তুলনা করা। যেমন একথা বলা যে, আল্লাহর হাত আমাদের হাতের মত। তাছাড়া আল্লাহর গুণ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির আছে বলে বিশ্বাস করা। যেমন- ভাগ্য গণনা, রাশিচক্রে বিশ্বাস, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইলমুল গায়েব বা অদৃশ্য জানে বলে বিশ্বাস করা।

(গ) اَلشِّرْكُ فِى الْاُلُوْهِيَّةِ (আশ্শিরকু ফিল উলূহিয়্যাহ) :

তা হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে কাউকে শরীক করা। যেমন- আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দু‘আ করা, সিজদা করা, অন্যের নামে নজর মানা, অন্যকে আল্লাহর মত ভয় করা, ভালোবাসা, আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য আইনের কাছে বিচার চাওয়া ইত্যাদি।

২. স্তর হিসেবে শিরকের প্রকারভেদ :

স্তর হিসেবে শিরক সাধারণত দুই প্রকার। যেমন-

(ক) اَلشِّرْكُ الْاَكْبَرِ (আশ্শিরকুল আকবার) বড় শিরক :

এটা হলো, আল্লাহর সাথে কাউকে সমকক্ষ স্থির করে আল্লাহর মতো তার ইবাদাত করা ও আনুগত্য করা। এ প্রকার শিরক যে কাউকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।

(খ) اَلشِّرْكُ الْاَصْغَرِ (আশ্শিরকুল আসগার) ছোট শিরক :

এটা হচ্ছে, আমল ও মুখের কথায় গায়রুল্লাহকে আল্লাহর সাথে শরীক করা। এ শিরক অনেক বড় কবীরা গোনাহ, কিন্তু এটি ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। এটি মুখের কথার দ্বারা হতে পারে আবার কর্মের দ্বারাও সংঘটিত হতে পারে। যেমন- এরূপ কথা বলা যে, আপনি চাইলে আর আল্লাহ চাইলে এ কাজটি হবে, আল্লাহ আর আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই, এটি আল্লাহ এবং আপনার দান, আল্লাহ আর আপনার উপর ভরসা করছি ইত্যাদি।

৩. আকৃতিগত দিক থেকে শিরকের প্রকারভেদ :

(ক) اَلشِّرْكُ الْجَلِيْ (আশ্শিরকুল জালী) প্রকাশ্য শিরক :

এটা হচ্ছে প্রকাশ্যভাবে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা। যেমন- মূর্তিপূজা করা, চন্দ্র অথবা সূর্যের ইবাদাত করা ইত্যাদি। এটি সর্বদা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।

(খ) اَلشِّرْكُ الْخَفِيْ (আশ্শিরকুল খফী) গোপন শিরক :

এটা হচ্ছে, হৃদয়ের এমন গোপন ইচ্ছা ও মুখের এমন অসতর্কমূলক কথা, যার মাধ্যমে আল্লাহকেও গায়রুল্লাহর সমান করা হয়। এটি কখনো বড় শিরক আবার কখনো ছোট শিরক হতে পারে। গোপনীয়তার কারণে এ শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে তা নির্ণয় করতে পারে না। নবী ﷺ বলেন,

اَلشِّرْكُ أَخْفٰى مِنْ دَبِيْبِ النَّمَلِ عَلَى الصَّخْرَةِ السَّوْدَاءِ فِي اللَّيْلَةِ الظُّلْمَاءِ

অন্ধকার রাতে কালো পাথরে যেভাবে পিপিলিকার অবস্থান গোপন থাকে, শিরক তোমাদের মধ্যে ঐভাবে গোপন থাকে। [মুসনাদে রাবী‘ ইবনে হাবীব, হা/৮৭৯।]

১০
বড় শিরক এর প্রকারভেদ
শিরকে আকবার এর প্রকার বর্ণনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, শিরকুল আকবার বা বড় শিরক চার প্রকার-

প্রথম প্রকার: اَلشِّرْكُ فِي الدَّعْوَةِ (আশ-শিরকু ফিদ্-দাওয়াত) বা আহবানে শিরক :

আল্লাহকে ডাকার মত গায়রুল্লাহকে ডাকা। সে ডাক কোন প্রাপ্তি বা মুক্তির জন্য হোক কিংবা শুধু ইবাদত বা বিনয় প্রকাশার্থে হোক। এ দু‘আ তিনটি শর্তে শিরক হবে-

ক) রূপক কোন অর্থ উদ্দেশ্য না করে বাস্তব অর্থে ডাকলে।

খ) প্রার্থিত বিষয়টি আল্লাহ ছাড়া আর কারও অধিকারে না থাকলে।

গ) প্রার্থনাকারী প্রার্থিত ব্যক্তির সামনে উপস্থিত না থাকলে অথবা মৃত হলে। যেমন-

* জীবিত পীর, খাজা, গাউস-কুতুবের কাছে সন্তান, রোগ নিরাময়, ব্যবসায় উন্নতি, বিপদ হতে পরিত্রান ও পরলৌকিক সুপারিশ ও মুক্তির প্রার্থনা করা।

* কোন মৃত, কবরস্থ কিংবা অনুপস্থিত পীর দরবেশের নিকট কোন কিছু প্রার্থনা করা। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَإِذَا رَكِبُوْا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُوْنَ﴾

যখন তারা নৌকায় আরোহন করে তখন একনিষ্ঠচিত্তে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন তাদের মুক্তি দিয়ে ডাঙ্গায় নিয়ে যান, তখনই তারা শিরক করে। (সূরা আনকাবুত ৩৯:৬৫)

দ্বিতীয় প্রকার: اَلشِّرْكُ فِي الْاِرَادَةِ (আশ-শিরকু ফিল ইরাদাহ) বা নিয়্যাত, ইচ্ছা ও সংকল্পে শিরক :

নিজের আমল দ্বারা সংক্ষেপে ও সবিস্তারে গায়রুল্লাহকে উদ্দেশ্য করা। এ শিরক আক্বীদাহ বিশ্বাসের মাঝে বিরাজ করে। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, এ শিরক হচ্ছে এমন এক সাগর, যার কোন কুল কিনারা নেই। অনেক অল্প মানুষই এ থেকে পরিত্রান পেয়ে থাকে। যে ব্যক্তি নিজ আমলের দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নৈকট্য কামনা করবে, তার কাছে বিনিময় প্রত্যাশা করবে অথবা শুধু পার্থিব কল্যাণের উদ্দেশ্যেই আমল করবে, সে ব্যক্তি ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে শিরকে লিপ্ত হবে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী :

﴿مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِيْنَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيْهَا وَهُمْ فِيْهَا لَا يُبْخَسُوْنَ أُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْاٰخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِيْهَا وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ﴾

যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি দুনিয়াতেই তাদেরকে পুরোপুরিভাবে তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ কারিয়ে দেব এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হবে না। এরাই হল সেসব লোক আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ হয়ে গেছে, আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বাত্বিল বলে গণ্য হয়েছে। (সূরা হূদ ১১:১৫-১৬)

তৃতীয় প্রকার: اَلشِّرْكُ فِي الطَّاعَةِ (শিরক ফিত তা‘আহ) বা আনুগত্যের শিরক :

হুকুম বা বিধান প্রবর্তনের ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করা; অথচ বিধান প্রনয়ণ বা হুকুম প্রদান করা আল্লাহর হক বা অধিকার সমূহের অন্তর্ভুক্ত।

* কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী মানব রচিত আইনের আনুগত্য উপরোক্ত প্রকারের শিরকে আকবারের অন্তর্ভুক্ত।

* সুফীবাদের শিরকযুক্ত তরীকাহসমূহে কুরআন-সুন্নাহর দলীল প্রমাণ ব্যতীত পীরের সমস্ত কথাকে মেনে নেয়াকে অপরিহার্য করা হয়। এসবগুলোই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿اِتَّخَذُوْاۤ اَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ وَالْمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَۚ وَمَاۤ اُمِرُوْاۤ اِلَّا لِيَعْبُدُوْاۤ اِلٰهًا وَّاحِدًاۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ سُبْحَانَهٗ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ﴾

তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের আলিম ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের প্রভু হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহ্কেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। (কেননা) তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি কতই না পবিত্র। (সূরা তাওবা- ৯:৩১)

চতুর্থ প্রকার : اَلشِّرْكُ فِي الْمَحَبَّةِ (আশ-শিরকু ফিল মুহাববত) বা ভালোবাসার ক্ষেত্রে শিরক :

আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকে এমনভাবে ভালোবাসা যে, বান্দাহ গায়রুল্লাহর (আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর) সামনে বিনীত, বিগলিত ও তার দাস হয়ে যায়, চাই সে ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার সমান হোক বা কম-বেশী হোক। যেমন-

* মূর্তিপূজারী সম্প্রদায় কর্তৃক তাদের বিভিন্ন মূর্তির প্রতি ভালোবাসা।

* কিছু নামধারী মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক গাউস, কুতুব, পীর ফকির, খাজা, দরগাহ- মাজার ইত্যাদির প্রতি ভালোবাসা।

* অপর কিছু সম্প্রদায় কর্তৃক আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির প্রতি অন্ধ ভালোবাসা।

* তরুন-তরুণী সম্প্রদায় কর্তৃক গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, শিল্পীদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা।

* পার্থিব জীবন, ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ভোগ-বিলাসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা, যা আল্লাহ ও পরকালকে ভুলিয়ে দেয়। এগুলো এই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّيْنَارِ وَالدِّرْهَمِ وَالْقَطِيْفَةِ وَالْخَمِيْصَةِ إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ وَإِنْ لَّمْ يُعْطَ لَمْ يَرْضَ

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ধ্বংস হোক স্বর্ণমুদ্রার দাস, ধ্বংস হোক রৌপ্যমুদ্রার দাস, ধবংস হোক মোলায়েম চাঁদর ও মোটা চাঁদরের দাস। যদি তাকে এগুলো দেয়া হয়, তাহলে সে খুশি; আর যদি না দেয়া হয়, তাহলে অসন্তুষ্ট হয়।

(সহীহ বুখারী ৬৪৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ৪১৩৫)

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللهِ اَنْدَادًا يُّحِبُّوْنَهُمْ كَحُبِّ اللهِؕ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اَشَدُّ حُبًّا لِّلّٰهِ﴾

মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমনও রয়েছে, যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছুকে তাঁর সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা তাদেরকে তেমনি ভালোবাসে যেমনটি কেবল আল্লাহকেই ভালোবাসা উচিত। আর যারা (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়ন করে, তারা তো তাঁকেই সর্বাধিক ভালোবাসবে। (সূরা বাক্বারা- ২:১৬৫)

আবুল বাকা আল-হানাফী

আবুল বাকা আল-হানাফী তার ‘কুল্লিয়্যাতে’র মধ্যে শিরককে অন্য আরো ছয় ভাগে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ:

১. شِرْكُ الْاِسْتِقْلَالِ (শিরকুল ইস্তেকলাল) :

এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুজন ভিন্ন ভিন্ন বা স্বতন্ত্র মালিকানা সম্পন্ন শরীক সাব্যস্ত করা; অথবা আল্লাহর পাশাপাশি আরো দু’জন স্বয়ংসম্পূর্ণ শরীক থাকার ধারণা পোষণ করাকে ‘শিরকুল ইস্তেকলাল’ বলা হয়। যেমন- অগ্নিপূজকদের শিরক; তারা যাবতীয় কল্যাণের বিষয়াদিকে ‘ইয়াজদান’ নামক দেবতার কাজ বলে মনে করতো, আর যাবতীয় অকল্যাণমূলক কাজকে ‘আহরমন’ নামক দেবতার কর্ম বলে মনে করতো। অথবা তারা আলোকে কল্যাণের স্রষ্টা ও অন্ধকারকে অকল্যাণের স্রষ্টা মনে করতো।

২. شِرْكُ التَّبْعِيْضِ (শিরকুত তাবয়ীদ) :

একাধিক মা‘বুদের সমন্বয়ে এক মা‘বুদ হওয়ার বিশ্বাস করাকে ‘শিরকুত তাবয়ীদ’ বলা হয়। যেমন- খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদের শিরক। তারা বিশ্বাস করে আল্লাহ, ঈসা (আঃ) ও মারইয়াম (আঃ) এর দ্বারা সমন্বিত একটি সত্তাই হচ্ছে মা‘বুদ। মুসলিম দাবীদার হয়েও যারা মুহাম্মাদ ﷺ কে আল্লাহর জাতি নূর দ্বারা তৈরী অথবা আল্লাহর সত্তার অংশ অথবা তাঁর রুহানী সত্তা মনে করে, তারাও উক্ত শিরকে আক্রান্ত। যেমন: বেরেলভী ও পীর-সূফীদের একাংশের বিশ্বাস।

৩. شِرْكُ التَّقْرِيْبِ (শিরকুত তাকরীব) :

আল্লাহ তা‘আলা এর নিকটবর্তী করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে গায়রুল্লাহর উপাসনা করাকে ‘শিরকুত তাকরীব’ বলা হয়। যেমন: প্রাচীন জাহেলী যুগের মূর্তিপূজারিদের শিরক, পোপ পূজারী খৃষ্টানদের শিরক, পুরোহীত পূজারী হিন্দুদের শিরক এবং পীর-মাশায়েখ পূজারী মুসলমানদের শিরক। কেননা এরা সকলেই যাদের পূজা করে তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য পাইয়ে দিবে- এই আশায় পূজা করে। আরবের মুশরিকরা বলতো:

﴿مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُوْنَا إِلَى اللهِ زُلْفٰى﴾

আমরা দেবতাদের উপাসনা কেবল এ জন্যই করছি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে। (সূরা যুমার ৩৯:৩)

৪. شِرْكُ التَّقْلِيْدِ (শিরকুত তাকলীদ) :

অন্যের অন্ধ অনুসরণে গায়রুল্লাহর উপাসনা করাকে ‘শিরকুত তাকলীদ’ বলা হয়। যেমন- আরব জনগণের শিরক, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণে মূর্তি পূজা করতো। অতএব যারা বর্তমানেও পূর্বপুরুষদের দোহাই দিয়ে পীর-পূজা ও মাজার পূজা ইত্যাদিতে লিপ্ত, তারাও এই প্রকার শিরকে আক্রান্ত।

৫. شِرْكُ الْأَسْبَابِ (শিরকুল আসবাব) :

কোন বিষয় আল্লাহর কারণে সংঘটিত হয়েছে এমনটি না বলে অপর কোন বস্ত্তর প্রভাবে সংঘটিত হয়েছে বলে বিশ্বাস করা বা বলাকে ‘শিরকুল আসবাব’ বলা হয়। যেমন- জড়বাদী ও প্রকৃতিবাদীদের শিরক, যারা যে কোন কল্যাণকে প্রকৃতির দান ও অকল্যাণকে প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া বলে বিশ্বাস করে। এ জগত সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য আল্লাহর পরিকল্পনাকে স্বীকার না করে প্রকৃতিকেই এর পরিচালক বলে মনে করে।

৬. شِرْكُ الْأَغْرَاضِ (শিরকুল আগরায) :

সম্পূর্ণ গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কাজ করাকে ‘শিরকুল আগরাদ’ বলা হয়। যেমন: প্রকৃত মুনাফিকদের সালাত, যা তারা কেবলমাত্র মানুষকে দেখানোর জন্যই আদায় করে থাকে।

শায়খ মুবারক ইবন মুহাম্মদ আল-মীলী শিরকে আকবারকে ভিন্নভাবে চার প্রকারে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :

১. شِرْكُ الْاِحْتِيَازِ (শিরকুল এহতিয়ায) অর্থাৎ স্বতন্ত্র মালিকানা ও স্বত্তাধিকারের শিরক :

এর সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো কোন অণু পরিমান বস্ত্তর উপর স্বয়ংসম্পূর্ণ মালিকানা রয়েছে বলে বিশ্বাস করাকে ‘শিরকুল এহতিয়ায’ বলা হয়। কেননা আসমান-যমিনে অনু পরিমান বস্ত্তর মধ্যেও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পূর্ণ মালিকানা নেই।

২. شِرْكُ الشِّيَاعِ (শিরকুশ শিয়া’) অর্থাৎ যৌথ মালিকানার শিরক :

এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ জগতের কোন বস্ত্ততে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো একচ্ছত্র মালিকানা না থাকলেও কোন কোন বস্ত্ততে আল্লাহর সাথে অন্যের যৌথ মালিকানা রয়েছে। যদিও উভয়ের মাঝে অবস্থান ও মর্যাদার দিক থেকে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহর সাথে এ ধরণের শরিকানাও অসম্ভব।

৩. شِرْكُ الْإِعَانَةِ (শিরকুল এ’য়ানত) অর্থাৎ সাহায্য সহযোগিতার শিরক :

এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ জগতের কোন কিছুতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো মালিকানা বা শরিকানা না থাকলেও এর কোন কোন বিষয়াদি পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যকারী রয়েছে বলে মনে করা। এ ধরনের আক্বিদা পোষণ করাও শিরক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সর্ব শক্তিমান, অমুখাপেক্ষী।

৪. شِرْكُ الشَّفَاعَةِ (শিরকুশ শাফা’আত) অর্থাৎ শাফাআতের শিরক :

এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাঁর বান্দাদের মাঝে এমন কতিপয় বান্দাও রয়েছেন, যারা তাঁদের মর্যাদার বদৌলতে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তাঁর পূর্ব অনুমতি ছাড়াই নিজস্ব শাফা‘আতের মাধ্যমে নিজ নিজ ভক্তদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে নাজাত দিতে সক্ষম; অথচ এ আক্বিদাহ পোষণ করাও শিরক। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নির্দেশ ব্যতিত কেউ নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদা বলে কারো জন্য সুপারিশ করতে পারবে না।

শায়েখ মুবারক ইবনুল মুহাম্মদ তাঁর এ চার প্রকার শিরক প্রমাণের জন্য পবিত্র কুরআনের নিম্ন বর্ণিত আয়াতটি উপস্থাপন করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:

﴿قُلِ ادْعُوا الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ لَا يَمْلِكُوْنَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيْهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَّمَا لَهٗ مِنْهُمْ مِّنْ ظَهِيْرٍ وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهٗ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهٗ

বলুন, তোমরা তাদেরকে আহবান কর, যাদেরকে উপাস্য মনে করতে আল্লাহ ব্যতীত। তারা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের অনু পরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়। এতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহ্র সহায়কও নয়। যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্য ব্যতীত আল্লাহ্র কাছে কারও শাফা’আত কারো জন্য উপকারে আসবে না। (সূরা সাবা ৩৪:২২-২৩)

তিনি এ আয়াতটি উদ্ধৃত করে বলেন, এ আয়াত থেকে শিরকের কোন প্রকারই বাদ পড়ে যায়নি। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে এ প্রকারগুলো আল্লামা আবুল বাকা ও ইমাম ইবনুল কাইয়িম বর্ণিত প্রকার সমূহের সাথে সামাঞ্জস্যশীল। পার্থক্য শুধু ভাষা ও বর্ণনায়।

একটি গুরুত্বপূর্ণ ফায়দা:

উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, উপকার একমাত্র তার কাছ থেকেই পাওয়া যায়, যার মধ্যে নিমেণাক্ত চারটি গুণের একটি হলেও বিদ্যমান আছে।

১. ইবাদতকারী তার কাছে যা আশা করে তার স্বতন্ত্র মালিক হওয়া।

২. স্বতন্ত্র মালিক না হলেও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যেকোন ভাবে মালিক হওয়া।

৩. অংশীদার না হলেও সে জিনিষের ব্যাপারে মালিকের সাহায্যকারী হওয়া।

৪. সাহায্যকারীও না হলে অন্ততপক্ষে মালিকের কাছে কারো জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখা। আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে শিরকের এই চারটি স্তরকেই ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যে,

﴿لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الْأَرْضِ﴾

তার সার্বভৌমত্ব ও রাজত্বে অন্য কারো মালিকানা নেই।

দ্বিতীয় অংশে বলেছেন,

﴿وَمَا لَهُمْ فِيْهِمَا مِنْ شِرْكٍ﴾

অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেও অন্য কারো মালিকানা নেই।

তৃতীয় অংশে বলেছেন,

﴿وَمَا لَهٗ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ﴾

তার কোন সাহায্য ও সহায়তাকারীও নেই।

চতুর্থাংশে বলেছেন,

﴿وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهٗ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهٗ﴾

তার কাছে তাঁর অনুমতি ব্যতিত কারো জন্য সুপারিশ করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও কারো নেই। নবী-রাসূল ও পূণ্যবানদের সে সুপারিশ সাব্যস্ত করেছেন সেটা তার অনুমতিক্রমে হয় বলে তাতে মুশরিক ও অংশীবাদির কোন অংশ নেই। কারণ নাবী-রাসূল ও পূণ্যবানদের সুপারিশ তাওহীদবাদি বান্দা ছাড়া অন্য কেউ পাবে না।

১১
ছোট শিরকের প্রকারভেদ
শিরকে আসগার বা ছোট শিরককে নিম্নোক্ত প্রকারসমূহে ভাগ করা যায়। যথা-

১. اَلشِّرْكُ الْاَصْغَرُ الْقَوْلِيُّ তথা কথাগত ছোট শিরক :

যা মুখের কথার দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে। যেমন- গায়রুল্লাহর (আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর) নামে শপথ করা, আপনি চাইলে আর আল্লাহ চাইলে এ কাজটি হবে, আমি আল্লাহ এবং আপনার উপর ভরসা করছি, আমি আল্লাহ এবং আপনার হেফাজতে রয়েছি, আল্লাহ আর আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই, এটি আল্লাহ এবং আপনার দান, কুকুরটি না হলে আজ ঘরে চোর ঢুকত, মাঝি বড় দক্ষ ছিল তাই আজ জীবন রক্ষা পেল, ড্রাইভারের দক্ষতায় বাসটি রক্ষা পেল, যেমন সার দিয়েছি তেমন ধান হয়েছে ইত্যাদি। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا حَلَفَ أَحَدُكُمْ فَلَا يَقُلْ مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ . وَلٰكِنْ لِيَقُلْ مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ شِئْتَ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন শপথ করবে, তখন সে যে ‘‘আল্লাহ এবং আপনি যা চান’’ (বাক্যটি) না বলে; বরং সে যেন বলে- ‘‘আল্লাহ যা চান, তারপর তুমি যা চাও’’। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২১১৭; সুনানে নাসায়ী ৩৭৮২)

২. اَلشِّرْكُ الْاَصْغَرُ الْعَمَلِيُّ তথা কার্যগত ছোট শিরক :

অর্থাৎ এমন ছোট শিরক, যা কর্মের দ্বারা সংঘঠিত হয়। যেমন- যাত্রাকালে ঘরের দুয়ারে ভিখারী দেখে তাকে কুলক্ষণ মনে করা, কাক মাথার উপর উড়ে যাওয়াকে কোন অকল্যাণের পূর্বাভাস মনে করা, ভুতুম পেঁচার ডাককে কোন বিপদ বা মৃত্যুর দুঃসংবাদ মনে করা, ভাগ্য গণনার উদ্দেশ্যে গণকের কাছে যাওয়া, চোর ধরার জন্য বাটি, লাঠি ও বাঁশ চালান দেয়া, হারানো বস্ত্তর সন্ধান লাভে মাটিতে রেখা অংকন, আয়না ও তৈল পড়াতে বিশ্বাস করা, চোর সনাক্ত করার জন্য রুটি পড়া বা চাল পড়া খাওয়ানো, হারানো বস্ত্তর সন্ধান লাভের জন্য পীর-ফকির, দরবেশ, জ্বীন ও খনারের কাছে যাওয়া- এ ধরণের আরো অন্যান্য প্রচলিত কার্যাবলী শিরকের অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ - - قَالَ : اَلطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ . ثَلَاثًا

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করে বলেন, কুলক্ষন গ্রহণ করা শিরক। এ কথা তিনি তিনবার বললেন। (সুনানে আবু দাউদ ৩৯১২ )

৩. اَلشِّرْكُ الْقَلْبِيُّ তথা হৃদয়গত শিরক :

যেমন- লৌকিকতা, সুনাম ও যশ লাভের আশা, কোন আমল করে তার দ্বারা শুধু দুনিয়া কামনা করা। যথা:

* সক্ষম হওয়া সত্বেও বুজুর্গী প্রকাশের উদ্দেশ্যে দূর্বল ভঙ্গিমায় চলা, লম্বা তাসবীহ সারা দিন হাতে রাখা, তালিওয়ালা ও ছেড়া-ফাড়া পোশাক পরিধান করা।

* ক্রেতার কাছে বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য দোকানে বসে উচ্চঃস্বরে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ইত্যাদি ঘন ঘন পাঠ করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

مَنْ صَامَ رِيَاءً فَقَدْ أَشْرَكَ ، وَمَنْ تَصَدَّقَ رِيَاءً فَقَدْ أَشْرَكَ ، وَمَنْ صَلَّى رِيَاءً فَقَدْ أَشْرَكَ

যে ব্যক্তি অপরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করলো সে শিরক করল, যে ব্যক্তি অপরকে দেখানোর জন্য দান করল সে শিরক করল, যে ব্যক্তি অপরকে দেখানোর জন্য সালাত আদায় করলো সে শিরক করল।

(মুসনাদে বায্যাজ ২৬৬৩)

১২
আশ্-শিরকুল খফী বা গোপন শিরক বলতে কি বোঝায়?
গোপন শিরক হচ্ছে হৃদয়ের এমন ইচ্ছা বা মুখের এমন কথা, যাতে আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ সমান হয়ে যায়। অথচ সে ইচ্ছা বা কথা এমন সংগোপনে বিরাজ করে যে, তাকে সহজে শিরক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। এ শিরক কখনো ‘শিরকে আকবার’ আবার কখনো ‘শিরকে আসগার’ হয়ে থাকে। গোপনীয়তার কারণে এ শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে তা নির্ণয় করতে পারে না। তাই বড় শিরক হওয়া সত্বেও তাকে ছোট শিরক মনে করে। আবার ছোট শিরক হওয়া সত্বেও তাকে বড় শিরক মনে করে।

প্রকৃতপক্ষে এ প্রকারটি ‘শিরকে আকবার’ ও ‘শিরকে আসগার’ এর মধ্যে দোদুল্যমান একটি প্রকার, যা গোপন ও দুর্বোধ্য; আর তা অতি সংগোপনে অতি সন্তপর্নে ইচ্ছা ও কথার মধ্যে মিশে থাকে। এ প্রকারের শিরক কঠিন কালো পাথরের উপর কালো পিপড়ার গুটি গুটি পায়ে চলার চেয়েও সূক্ষ্ম ও গোপন হয়ে থাকে। (আশ্ শিরকু ওয়া মাজাহিরুহু ৬৩)

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ فَقَالَ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِيْ مِنْ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلٰى فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُوْمَ الرَّجُلُ يُصَلِّيْ فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهٗ لِمَا يَرٰى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ

আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের নিকট আসলেন- যখন আমরা দাজ্জালের বিষয়ে আলোচনা করছিলাম এবং বললেন, আমি কি তোমাদেরকে ঐ বিষয় সম্পর্কে জানাব না, যাকে আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় করি, এমনকি দাজ্জালের ফিৎনা থেকেও অধিক? এটা হলো লুকানো শিরক। এক ব্যক্তি সালাতের জন্য দাঁড়ায় এবং তার সালাত সুন্দর করে; কারণ সে মনে করে যে, লোকজন তাকে দেখছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ- ৪২০৪)

১৩
اَلرِّيَاءُ (আর-রিয়া) তথা লোক দেখানো আমল
اَلرِّيَاءُ (আর-রিয়া) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- লোক দেখানো, অবলোকন করানো, দৃশ্যমান করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ‘রিয়া’ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন আমল করার অভিনয় করা; অথচ নিয়্যত থাকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি অর্জন করা। হতে পারে নিয়্যতটি সম্পূর্ণ মিথ্যা নিয়্যত, যেথায় যে ব্যক্তি আমলটি করছে আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে তার কোন চেতনা নাই; অথবা হতে পারে এটা আংশিকভাবে মিথ্যা নিয়্যত, যেথায় ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ্ আছে, কিন্তু এই সময়ে অন্য মানুষের প্রশংসা পাওয়ার ইচ্ছা করে। এই সংজ্ঞা হতে দেখা যায় যে, ‘রিয়া’ অন্তরে সৃষ্টি হয়।

১৪
আমলের ক্ষেত্রে শিরকমুক্ত ও বিশুদ্ধ নিয়্যাতের গুরুত্ব
আমলের ক্ষেত্রে শিরকমুক্ত ও বিশুদ্ধ নিয়্যাত খুবই জরুরি। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ عَلَى الْمِنْبَرِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَّا نَوٰى

উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি মিম্বারের উপর দন্ডায়মান হয়ে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় প্রত্যেক আমল নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকের জন্য তাই হবে, যার সে নিয়্যাত করেছে। (সহীহ বুখারী ১; সহীহ মুসলিম ৫০৩৬; সুনানে আবু দাউদ ২২০৩)

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ:) বলেন, ইসলামের ভিত্তি তিনটি হাদীসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। (১) উমর (রাঃ)-এর হাদীস, নিয়্যাত অনুযায়ী আমল করা, (২) নু’মান ইবনু বশীরের হাদীস : اَلْحَلَالُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ অর্থাৎ হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট; এই দুই মাঝখানে রয়েছে সাদৃশ্যতা। (সহীহ বুখারী ২০৫১) (৩) আয়িশা (রাঃ) হাদীস: مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هٰذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমাদের ব্যাপারে (ইসলাম) নতুন কিছু প্রচলিত (বিদআত) করে, যা এর সংশ্লিষ্ট নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।

(সহীহ বুখারী ২৬৯৭)

প্রত্যেক ব্যক্তি তাই অর্জন করবে, যা সে নিয়্যাত করেছে। তার পুরস্কার অর্জন নির্ভর করে সে যা নিয়্যাত করেছে তার উপর। এক্ষেত্রে যদি নিয়্যাতটি ভাল কাজের জন্য হয়, কিন্তু একজন গ্রহণযোগ্য ওজরের কারণে কাজটি সম্পন্ন করতে সমর্থ না হয়, তাহলে ব্যক্তিটি অবশ্যই কাজটির কল্যাণ অর্জন করবে। অপরদিকে কেউ যদি আমল করে আল্লাহর পাশাপাশি অন্যের সন্তুষ্টি বা প্রশংসা চায়, তাহলে সে পুরষ্কারের পরিবর্তে শাস্তিযোগ্য হবে।

১৫
‘রিয়া’ এর ভয়াবহতার ব্যাপারে সতর্কবাণী
‘রিয়া’ এর ক্ষতিসমূহ অনেক। সুতরাং নবী ﷺ উম্মাহর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং উদ্বেগের কারণে, অন্য কিছুর চেয়ে এর ভয়াবহতাকে বেশী ভয় করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ مَحْمُوْدِ بْنِ لَبِيْدٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوْا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ

মাহ্মুদ ইবন লাবীদ হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের জন্য যে বিষয়টিকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই তা হলো ছোট শিরক। সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কি? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: রিয়া। (মুসনাদে আহ্মাদ ২৩৬৩০)

অন্য হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ فَقَالَ أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِيْ مِنْ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلٰى فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُوْمَ الرَّجُلُ يُصَلِّيْ فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهٗ لِمَا يَرٰى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ

আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের নিকট আসলেন- যখন আমরা দাজ্জালের বিষয়ে আলোচনা করছিলাম এবং বললেন, আমি কি তোমাদেরকে ঐ বিষয় সম্পর্কে জানাব না, যাকে আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় করি, এমনকি দাজ্জালের ফিৎনা থেকেও অধিক? এটা হলো লুকানো শিরক। এক ব্যক্তি সালাতের জন্য দাঁড়ায় এবং তার সালাত সুন্দর করে; কারণ সে মনে করে লোকজন তাকে দেখছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ- ৪২০৪)

১৬
‘রিয়া’ এর ক্ষতিকর দিকসমূহ
নিমেণ ‘রিয়া’ এর কিছু ক্ষতিকর দিকসমূহ আলোচনা করা হলো:

১। ঈমান এবং তাওহীদ দূর্বল করে :

‘রিয়া’ এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্যকে নষ্ট করে, অর্থাৎ সত্যিকারভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের পরিবর্তে সে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাতের ভান করে।

২। ছোট আকারের শিরক :

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

اَلشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُوْمَ الرَّجُلُ يُصَلِّيْ فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهٗ لِمَا يَرٰى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ

গোপন শিরক হলো- এক ব্যক্তি সালাতে দাঁড়ায় এবং সে তার সালাতকে সুন্দর করে; কারণ সে দেখছে যে লোকজন তাকে লক্ষ্য করছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৪২০৪)

৩। পথভ্রষ্টতা বৃদ্ধি পায় :

কোন সন্দেহ নেই যে, যে ব্যক্তি ‘রিয়া’ করে তার অন্তরে রোগ আছে এবং যদি এই রোগ থেকে আরোগ্য না হয়, তাহলে এটা পরবর্তীতে সমস্যা সৃষ্টি করবে।

৪। কল্যাণমূলক কাজ থেকে বঞ্চিত হওয়া :

হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِىَ غَيْرِىْ تَرَكْتُهٗ وَشِرْكَهٗ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি সকল অংশীদার থেকে নিজেই সম্পূর্ণ যথেষ্ট, আমার কোনও অংশীদারের প্রয়োজন নেই। যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে, যার মধ্যে সে আমার সাথে অন্যকে অংশীদার করে, আমি তাকে এবং তার শিরককে প্রত্যাখ্যান করি। (সহীহ মুসলিম ৭৬৬৬)

৫। আল্লাহ্ কর্তৃক অবমাননা ও লাঞ্চনা :

হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ سَمَّعَ النَّاسَ بِعَمَلِهٖ سَمَّعَ اللهُ بِهٖ سَامِعَ خَلْقِهٖ وَحَقَّرَهٗ وَصَغَّرَهٗ

আবদুল্লাহ ইবন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা বিচার দিবসে তাঁর সকল সৃষ্টিলোকের সম্মুখে তাকে হীন ও অপদস্থ করবেন। (মুসনাদে আহমদ ৭০৮৫)

৬। জাহান্নামের আগুনে প্রবেশের জন্য প্রথম কারণ :

সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ : إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضٰى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِىَ بِهٖ فَعَرَّفَهٗ نِعَمَهٗ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا قَالَ قَاتَلْتُ فِيْكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ . قَالَ كَذَبْتَ وَلٰكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُّقَالَ جَرِىءٌ . فَقَدْ قِيْلَ . ثُمَّ أُمِرَ بِهٖ فَسُحِبَ عَلٰى وَجْهِهٖ حَتّٰى أُلْقِىَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهٗ وَقَرَأَ الْقُرْاٰنَ فَأُتِىَ بِهٖ فَعَرَّفَهٗ نِعَمَهٗ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهٗ وَقَرَأْتُ فِيْكَ الْقُرْ اٰنَ . قَالَ كَذَبْتَ وَلٰكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ . وَقَرَأْتَ الْقُرْ اٰنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ . فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهٖ فَسُحِبَ عَلٰى وَجْهِهٖ حَتّٰى أُلْقِىَ فِى النَّارِ . وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهٖ فَأُتِىَ بِهٖ فَعَرَّفَهٗ نِعَمَهٗ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيْلٍ تُحِبُّ أَنْ يُّنْفَقَ فِيْهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيْهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلٰكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ . فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهٖ فَسُحِبَ عَلٰى وَجْهِهٖ ثُمَّ أُلْقِىَ فِى النَّارِ

আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি: ক্বিয়ামাতের দিন প্রথম এক শহীদ ব্যক্তির ব্যাপারে ফয়সালা দেয়া হবে। হাশরের ময়দানে তাকে পেশ করা হবে। আল্লাহ তা’আলা তাকে দেয়া তার সকল নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। ফলে তার এসব নিয়ামতের কথা স্মরণ হয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে বললেন, তুমি এসব নিয়ামত পাওয়ার পর তার কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কী কী কাজ করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার রাস্তায় (কাফিরদের বিরুদ্ধে) লড়াই করেছি, এমনকি আমাকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি লড়াই করেছো এজন্য যে, যাতে তোমাকে বীর বাহাদুর বলা হয়; এমনকি তা বলাও হয়েছে (তাই তোমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে)। তখন তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি যে জ্ঞানার্জন করেছে, অন্যকে জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন পড়েছে, তাকে উপস্থিত করা হবে। তারপর তাকে দেয়া সব নিয়ামত তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। ফলে এসব নিয়ামত তার স্মরণ হবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এসব নিয়ামতের জন্য তুমি কি শোকর আদায় করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি ‘ইলম অর্জন করেছি, মানুষকে ইলম শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার জন্য কুরআন পড়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তোমাকে যাতে আলিম অথবা ক্বারী বলা হয়, এজন্য তুমি এসব কাজ করেছো; এমনকি দুনিয়াতে তোমাকে এসব বলাও হয়েছে। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং মুখের উপর উপুড় করে টেনে হেচঁড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তৃতীয় ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন ধরনের মাল দিয়ে সম্পদশালী করেছেন। তাকেও আল্লাহর সামনে আনা হবে। তখন আল্লাহ তাকে দেয়া সব নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। ফলে এসব তারও মনে পড়ে যাবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি এসব নিয়ামতের শুকরিয়া কি আমল দিয়ে আদায় করেছ? সে ব্যক্তি উত্তরে বলবে, আমি এমন কোন খাতে খরচ করা বাকী রাখিনি, যে খাতে খরচ করাকে তুমি পছন্দ কর। আল্লাহ তা’য়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি খরচ করেছ এজন্য যে, যাতে মানুষ তোমাকে দানবীর বলে; এমনকি দুনিয়াতে তুমি সে খিতাব পেয়েও গেছো। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম ৫০৩২)

৭। আল্লাহ তা‘আলা-কে সিজদা করতে অক্ষম :

এটি লাঞ্চনার অন্য একরূপ। যারা লোক দেখানো ইবাদত করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাঁকে সিজদা করা থেকে বিরত রাখবেন- যখন তারা তা করতে চাইবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُوْلُ يَكْشِفُ رَبُّنَا عَنْ سَاقِهٖ فَيَسْجُدُ لَهٗ كُلُّ مُؤْمِنٍ وَّمُؤْمِنَةٍ فَيَبْقٰى كُلُّ مَنْ كَانَ يَسْجُدُ فِي الدُّنْيَا رِيَاءً وَّسُمْعَةً فَيَذْهَبُ لِيَسْجُدَ فَيَعُوْدُ ظَهْرُهٗ طَبَقًا وَّاحِدًا

আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ যখন তার পেন্ডুলিকে (পায়ের নিম্নাংশ) প্রকাশ করবেন তখন সকল মু’মিন পুরুষ ও মহিলারা আল্লাহকে সিজদা করবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি ব্যতিত, যে দুনিয়াতে মানুষদের দেখানোর জন্য সিজদা করত। অতঃপর সে সিজদা করতে চেষ্টা করবে, কিন্তু তার পিঠ শক্ত তখতার ন্যায় হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী ৪৯১৯)

৮। অভিশপ্ত কাজ :

হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ إِذَا تَزِيْنُ الرَّجُلُ لِعَمَلِ الْاٰخِرَةِ وَهُوَ لَا يُرِيْدُهَا وَلَا يَطْلُبُهَا لَعَنَ فِيْ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِيْنَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি পরলৌকিক আমলের ভূষণে ভূষিত হয়; অথচ পরলৌকিক কল্যাণ তার অভিষ্ট নয় বা পরকাল সে চায়ও না, আসমানে ও যমীনে তাকে অভিসম্পাত করা হয়। (মু’জামূল আউসাত ৪৭৭৬)

১৭
‘রিয়া’ এর কারণ
‘রিয়া’ এর প্রাথমিক কারণ হলো ঈমানের দূর্বলতা। এই ঈমানের দূর্বলতা একজন ব্যক্তিকে পরকালের কল্যাণ ও পুরষ্কারের প্রতি অজ্ঞ করে তোলে এবং দুনিয়ার যশ ও সম্মান পাওয়ার ইচ্ছাকে বৃদ্ধি করে। এই ইচ্ছার কারণে একজন ব্যক্তি ‘রিয়া’য় লিপ্ত হয়।

তিনটি লক্ষণ দ্বারা ‘রিয়া’কে চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং এই লক্ষণগুলোকে এড়িয়ে চলা একজন ঈমানদারের জন্য অতীব জরুরী।

১. প্রশংসার প্রতি ভালোবাসা :

প্রথম তিন ব্যক্তি, যারা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে; ঐ আলেম ব্যক্তি, ঐ শহীদ এবং ঐ ব্যক্তি, যে সম্পদ দান করেছে। এই তিন ব্যক্তি সকলেই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির চেয়ে মানুষের প্রশংসাকে কামনা করেছিল। যে ব্যক্তি মানুষকে প্রশংসা কামনা করে, সে অবশ্যই মনে মনে নিজেকে নিয়ে গর্বিত হয়। এজন্য যে, সে মনে করে সে এই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

২. সমালোচনার ভয় :

যে ইসলামের আদেশ মান্য করে, তবে তা আল্লাহ তা‘আলা জন্য নয় বরং সমালোচনার ভয়ে। কারণ সে ভয় পায় লোকজন তাকে লক্ষ্য রাখছে এবং তাকে সমালোচনা করবে- যদি সে না করে।

৩. লোকজনের বিত্তবিভবের প্রতি লোভ :

পদবী, অর্থ অথবা ক্ষমতার মালিক হওয়া প্রবলভাবে কামনা করা ‘রিয়া’র কারণ হিসেবে চিহ্নিত।

১৮
‘রিয়া’ এর ধরনসমূহ
‘রিয়া’ কোন আমল করার পূর্বে, করার সময় এবং করার পরে সংঘটিত হতে পারে। প্রত্যেক পর্যায়ে, শয়তান সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যে, কোন কল্যাণময় নেক আমলকে ‘রিয়া’র মাধ্যমে যেন ধ্বংস করে দেয়া যায়।

কৃত আমলের পূর্বে :

প্রশংসা পাওয়ার জন্য একটি নেক আমল করার মনস্থ করা। নিঃসন্দেহে এটা রিয়ার সবচেয়ে জঘন্যতম অবস্থা। এ ধরনের নেক আমল আল্লাহ তা‘আলা কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটা মুনাফিকী নামক আত্মিক রোগের একটি শক্ত পূর্ব লক্ষণ।

যখন আমলটি করা হয় :

এমতাবস্থায়, একজন ব্যক্তি আন্তরিকভাবে শুধু আল্লাহর জন্য আমল শুরু করে; কিন্তু যখন সে খেয়াল করে যে, লোকজন তাকে দেখছে তখন সে অধিক ধার্মিক হিসেবে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে আমলগুলো আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করে। যেমন- কোন ব্যক্তি মসজিদে কুরআন তিলাওয়াত করা শুরু করেছে। অতঃপর যখন সে জানতে পারল যে, লোকজন তার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, তখন সে তাদের জন্য তার কণ্ঠকে সুন্দর করবে এবং খুবই আবেগ দেখানোর চেষ্টা করে।

আমলটি করার পর :

এ ধরনের ‘রিয়া’ সর্বশেষ পর্যায়ে ঘটে- যখন একজন ব্যক্তি আন্তরিকভাবে আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে ইবাদত করে, তখন লোকজন এটার জন্য তার প্রশংসা করা শুরু করে। সে তখন এই আমলের জন্য গর্ব অনুভব করতে শুরু করে এবং প্রশংসা পেয়ে খুশী হয়, যা মানুষদের থেকে পায়। কতিপয় আলেম লিখেছেন- এটা সম্ভব যে, একজন আবেদ ‘রিয়া’কে এড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে, কিন্তু যখন অন্যান্য লোকজন তার আমলকে উল্লেখ করে এবং তার প্রশংসা করে, এ ধরনের প্রশংসার ক্ষেত্রে সে অস্বস্তি এবং অপছন্দ সূচক কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বরং খুশী হয় এবং ভাবে যে, এ ধরণের প্রশংসা তার জন্য তার ইবাদাতকে সহজ করে দিবে। এই অনুভূতি লুকানো শিরকের খুবই সুক্ষ অভিব্যক্তি।

১৯
‘রিয়া’ থেকে বাঁচার উপায়
আমরা জানতে পেরেছি যে, ‘রিয়া’ করার মূল কারণ হচ্ছে ঈমানের দূর্বলতা। তাই যে সকল আমলের দ্বারা একজন ব্যক্তির ঈমান বৃদ্ধি পায়, ঐ সকল আমলের দ্বারাই ‘রিয়া’ এর প্রভাব কমানো সম্ভব। এর মধ্য থেকে কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলো-

১. জ্ঞান বৃদ্ধি করা :

তাওহীদ সম্পর্কে ইলম বৃদ্ধি করা, ‘রিয়া’ এর ক্ষতিকর দিকগুলো চিন্তা করা, আর মনে মনে এ ধারণা করা যে, আল্লাহ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন।

২. দু’আ করা :

একদা সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, শিরক যখন পিপড়ার চলার চেয়েও সূক্ষ্ম, তাহলে আমাদের জন্য তার থেকে বাঁচার উপায় কি? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন তোমরা আল্লাহর কাছে এই দু‘আ কর :

اَللّٰهُمَّ إِنَّا نَعُوْذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُّشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهٗ وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ

হে আল্লাহ! আমাদের জানা অবস্থায় তোমার সাথে শিরক থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থণা করছি। আর অজানা অবস্থায় (শিরক) হয়ে গেলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (মুসনাদে আহমেদ ১৯৬০৬)

৩. ভালো আমল গোপন রাখা :

আহলে সুন্নাহর কিছু আলেমগণ বলেছেন, আমাদের পূর্বের লোকেরা এমনভাবে ইবাদত করতে পছন্দ করতেন যে, তাদের স্ত্রী অথবা ঘনিষ্ট বন্ধুরাও এ বিষয় জানতে পারত না।

৪. নিজের দোষ ত্রুটির ব্যাপারে অনুতপ্ত হওয়া :

৫. জ্ঞানী বা আল্লাহ্ভীরু ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা তাওবা ৯:১১৯)

২০
‘আস-সাদেকূন’ বা সত্যবাদী কারা?
সত্যবাদীদের পরিচয় আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে জানিয়ে দিচেছন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿ اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِه ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوْا وَجَاهَدُوْا بِاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفُسِهِمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِؕ اُولٰٓئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ﴾

তারাই সত্যিকার মুমিন, যারা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করেছে, এরপর এতে কোন সন্দেহ পোষণ করেনি এবং আল্লাহর পথে তাদের জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্যবাদী।

(সূরা হুজুরাত ৪৯:১৫)

অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,

﴿اَلَّذِيْنَ اُخْرِجُوْا مِنْ دِيَارِهِمْ وَاَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَّيَنْصُرُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗؕ اُولٰٓئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ﴾

যারা নিজেদের ঘর-বাড়ী ও সম্পত্তি হতে বহিষ্কৃত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। তারাই তো সত্যবাদী। (সূরা হাশর- ৫৯:৮)

২১
اَرْبَابٌ (আরবাব) এর পরিচয়
اَرْبَابٌ (আরবাব) শব্দটি رُبُوْبِيَّةٌ (রুবুবীয়াহ) শব্দ থেকে এসেছে। আর رب (রব) এর বহুবচন হচ্ছে اَرْبَابٌ (আরবাব)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের একমাত্র রব। আল্লাহ্র (সুব:) রুবুবিয়্যার কোন অংশ যদি কেউ দাবী করে, তাহলে সে মিথ্যা রুবুবিয়্যাহ দাবী করল। সুতরাং তাকে একজন আরবাব হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে। আর তার এ দাবী যদি কেউ মেনে নেয়, তাহলে সে তাকে একজন রব হিসেবে গ্রহণ করল।

মূলকথা, আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র রব, তাঁর কাজগুলো অন্যরাও করতে পারে- এই বিশ্বাসে যাদের কাছে যাওয়া বা চাওয়া হয় অথবা এসবের অংশ যাদেরকে দেওয়া হয় তাদেরকেই ‘আরবাব’ বলে। আল্লাহ্ রাববুল আ‘লামীন আল-কুরআনে বলেন:

﴿اِتَّخَذُوْاۤ اَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ وَالْمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ﴾

তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের আলিম ও সংসারবিরাগীদেরকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও। (সূরা তাওবা- ৯:৩১)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَدِىِّ بْنِ حَاتِمٍ قَالَ : أَتَيْتُ النَّبِىَّ - - وَفِىْ عُنُقِىْ صَلِيْبٌ مِّنْ ذَهَبٍ قَالَ فَسَمِعْتُهٗ يَقُوْلُ اِتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ، قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّهُمْ لَمْ يَكُوْنُوْا يَعْبُدُوْنَهُمْ . قَالَ : أَجَلْ وَلٰكِنْ يُحِلُّوْنَ لَهُمْ مَا حَرَّمَ اللهُ فَيَسْتَحِلُّوْنَهٗ وَيُحَرِّمُوْنَ عَلَيْهِمْ مَا أَحَلَّ اللهُ فَيُحَرِّمُوْنَهٗ فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ لَهُمْ

আদী বিন হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কাছে আসলাম এমতাবস্থায় যে, আমার গলায় রৌপের ক্রশ ঝুলছিল। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি তাকে এই আয়াতটি-

﴿اِتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ﴾

তথা ‘‘তারা তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব বানিয়েছে’’ পাঠ করছিলেন। তখন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! তারা তো তাদের ইবাদত করে না, (তাহলে তাদেরকে কীভাবে রব হিসেবে গ্রহণ করা হলো?) তিনি বললেন, হ্যাঁ- কিন্তু তারা কি আল্লাহ তাদের জন্য যা হারাম করেছেন তা হালাল এবং যা তাদের জন্য হালাল করেছেন তা হারাম করে না? এটাই হলো তাদের ইবাদত করা।

(সুনানে বায়হাকী ২০৮৩৭; সুনানে তিরমিজি ৩০৯৫)

যারা মানবরচিত সংবিধানের মাধ্যমে আল্লাহর হারাম করা জিনিসগুলোকে হালাল করছে, যেমন- সুদ, জুয়া, মদ, লটারী, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন, আর সংবিধানের মাধ্যমে এগুলোকে বৈধ বা হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। আর মানুষ তাদেরকে মেনে নিয়ে আল্লাহর পাশাপাশি আরবাব হিসেবে গ্রহণ করছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন:

﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾

বল, হে আহলে কিতাবগণ! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারও ইবাদত না করি, কোন কিছুকেই তাঁর শরীক না করি এবং আমাদের কেউ যেন কাউকে আল্লাহ ব্যতীত রব (আরবাব) হিসেবে গ্রহণ না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে লয় তবে বল তোমরা সাক্ষী থাক, অবশ্যই আমরা মুসলিম।

(সূরা আল ইমরান ৩:৬৪)।

২২
اٰلِهَةٌ আলিহা কি?
ইলাহ্ শব্দের বহুবচন ‘আলিহা’। আল্লাহই আমাদের একমাত্র ইবাদত যোগ্য ইলাহ। এখন কেউ যদি আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা আল্লাহর পাশাপাশি কারও ইবাদত করে তাহলে তাকে সে আলিহা বানাল।

সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে আল্লাহর রুবুবিয়্যার ধারণা অনেকটা সঠিক থাকলেও উলুহিয়্যা অর্থাৎ ইবাদাত করার ব্যাপারে সমস্যাটি প্রকট। কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলাকে রব হিসেবে মানলেও ইবাদাত করার ক্ষেত্রে অন্যকে শরীক করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বর্তমান সমাজের অনেক ব্যক্তিই মাযারে গিয়ে মান্নত করে, মৃত ব্যক্তির কাছে সন্তান ইত্যাদি চাওয়ার মত শিরকে লিপ্ত হয়।

জাহেলিয়াত যুগের মুশরিক আরবরাসহ প্রাচীন জাতিসমূহের এসব ধারণা খন্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللهِ آَلِهَةً لِيَكُونُوا لَهُمْ عِزًّا﴾

তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সব ইলাহ এজন্য গ্রহণ করেছে যাতে তারা (আলিহারা), তাদের শক্তির কারণ হতে পারে। (সূরা মারইয়াম ১৯:৮১)

অপর আয়াতে বলা হয়েছে:

﴿وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللهِ آلِهَةً لَعَلَّهُمْ يُنْصَرُونَ﴾

তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সব ইলাহ এজন্য গ্রহণ করেছে যাতে তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৭৪)

উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে আলিহা শব্দ দুটো শক্তির কারণ এবং সাহায্যকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মক্কার মুশরিকরা মুর্তিগুলোকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সুপারিশকারী হিসেবে মনে করতো। অথচ তারা স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহকে মানতো।

রুবুবিয়্যার ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা থাকলেও সকল সমস্যা দেখা যায় উলুহিয়্যার ব্যাপারে। সূরা ইউসুফের ৪০ নং আয়াত অনুযায়ী বিধান দেওয়ার মালিক শুধুমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই। অথচ বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ঈমানের দাবীদার বেশকিছু লোকেরাও জেনে অথবা না জেনে অহরহ মানুষের দেওয়া কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী বিধান মেনে চলছে। আবার কাউকে বলতে শুনা যে, দেশের আইন মানা ফরজ। অথচ তারা জানে না যে, কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক পরিচালিত দেশের আইন মানা ফরজ। কুফুরি ও মানব রচিত আইন বিধান দিয়ে পরিচালিত দেশের আইন মানা মোটেই ফরজ নয়। আবার ধর্মীয় দিক থেকে তারা কতিপয় পীর, অলী, বুজুর্গ, গাউস, কুতুব, দরবেশদাবীদার, এমনকি কবর, মাজার, গাছ-পাথরকে তাদের ভয়, মানত, সেজদা সহ অনেক ইবাদত নিবেদন করে আলিহা রূপে গ্রহন করছে।

মানুষ তার নফসকেও ইলাহরূপে গ্রহন করতে পারে। কারণ মানুষকে গোমরাহ করার মত যত জিনিস আছে তার মধ্যে মানুষের নফসই হচ্ছে তার সর্বপ্রধান পথভ্রষ্টকারী শক্তি। যে ব্যক্তি নিজের খাহেশাতের দাসত্ব করবে, আল্লাহ্্র বান্দাহ হওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কারণ যে কাজে টাকা পাওয়া যাবে, যে কাজ করলে সুনাম ও সম্মান হবে, যে জিনিসে অধিক স্বাদ ও আনন্দ লাভ করা যাবে, কেবল সে কাজই করতে সে প্রাণ-পণ চেষ্টা করবে। সেসব কাজ করতে যদি আল্লাহ্্ নিষেধও করে থাকেন, তবুও সে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না। এমতাবস্থায় একথা পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে যে, সে আল্লাহ্্ তাআলাকে তার ইলাহ রূপে স্বীকার করেনি বরং তার নফসকেই সে তার একমাত্র ইলাহের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কাজেই এমন ব্যক্তি কোন প্রকারে আল্লাহ্্র হেদায়াত লাভ করতে পারে না। পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,

﴿أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلٰهَهٗ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُوْنُ عَلَيْهِ وَكِيْلًا اَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُوْنَ أَوْ يَعْقِلُوْنَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيْلًا﴾

(হে নবী!) যে ব্যক্তি নিজের নফসের খাহেশাতকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, তুমি কি তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ? তুমি কি এ ধরনের মানুষের পাহারাদারী করতে পার? তুমি কি মনে কর যে, এদের মধ্যে অনেক লোকই (তোমার দাওয়াত) শোনে এবং বুঝে? কখনও নয়। এরা তো একেবারে জন্তু-জানোয়ারের মত বরং এরা তার চেয়েও নিকৃষ্ট। (সূরা ফুরকান ২৫:৪৩-৪৪)

২৩
اَنْدَادٌ (আনদাদ) কি?
اَنْدَادٌ (আনদাদ) অর্থ সমকক্ষ অথবা আরো সুনির্দিষ্টভাবে এমন কোনকিছু যাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো হয়েছে। এটা যে কোন আকারে হতে পারে যেমন- সম্পদ, পরিবার, সমাজ, নেতৃত্ব ও অন্যান্য কোনকিছুকে ভালোবাসা স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ যদি এই জিনিসগুলোকে আল্লাহর জন্য তার যে ভালোবাসা সেই পরিমান অথবা তার চেয়ে বেশী ভালোবাসে, তাহলে সেটা আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِينَ اٰمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلّٰهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلّٰهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ ﴾

আর কোন লোক এমনও রয়েছে, যারা অন্যান্যকে আল্লাহর আনদাদ (সমকক্ষ) সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালোবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী। আর কতইনা উত্তম হত যদি এ যালেমরা পার্থিব কোন কোন আজাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিত যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই এবং আল্লাহর আজাবই সবচেয়ে কঠিনতর। (সূরা বাক্বারা ২:১৬৫)

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন:

﴿قُلْ إِنْ كَانَ اٰبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾

হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রীরা এবং তোমাদের আত্মীয়-স্বজন তোমাদের সেই ধন-সম্পদ, যা কিছু তোমরা উপার্জন করেছ, সেই ব্যবসায় যার মনদা হওয়াকে তোমরা ভয় কর, আর তোমাদের সেই ঘর যাকে তোমরা খুবই পছন্দ কর- এগুলো তোমাদের নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়েও বেশি প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা অপেক্ষা কর- যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা তোমাদের সামনে পেশ করেন। আর আল্লাহ তো ফাসেক লোকদের কখনই হেদায়াত করেন না। (সূরা তাওবা ৯:২৪)

সবকিছুর প্রতি আমাদের ভালোবাসা অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রাসূল ﷺ এর প্রতি আমাদের ভালোবাসার পরে আসতে হবে। এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য সব ধরনের আনদাদ ত্যাগ করতে হবে।

২৪
প্রচলিত কতিপয় শিরক যাদু করা
যাদু বিদ্যার মাধ্যমে যাদুকর নিজের এমন মিথ্যা ক্ষমতা প্রদর্শন করে, যে ক্ষমতা রব হিসেবে একান্তই আল্লাহর রয়েছে। যাদুমন্ত্র নিজেই মূর্তিপূজার একটি শাখার প্রতিনিধিত্ব করে। যাদুমন্ত্রের মাধ্যমে ভাগ্যের ভাল-মন্দ, কল্যান-অকল্যানের বিষয়টি এর উপর নিহিত করা হয় যে কর্তৃত্ব রয়েছে একমাত্র আল্লাহর। যাদু বিদ্যার মাধ্যমে কোন কোন সময় শয়তানের পছন্দ করে এমন সব কুফরী ও শিরকী কাজ করতে হয়, যার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে শয়তান যাদুকরের জন্য কাজ করে দেয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَاتَّبَعُوْا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِيْنُ عَلٰى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلٰكِنَّ الشَّيَاطِيْنَ كَفَرُوْا يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوْتَ وَمَارُوْتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتّٰى يَقُوْلَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُوْنَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُوْنَ بِهٖ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهٖ وَمَا هُمْ بِضَارِّيْنَ بِهٖ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللهِ وَيَتَعَلَّمُوْنَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوْا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهٗ فِي الْاٰخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهٖ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ﴾

তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফর করেনি; শয়তানরাই কুফর করেছিল। তারা মানুষকে যাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন যাদু শিখত, যদ্দবারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহ্র আদেশ ছাড়া তদ্দবারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে। তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ যাদু অবলমবন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ যদি তারা জানত। (সূরা বাক্বারাহ ২:১০২)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوْبِقَاتِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ ......

আবু হুরাডরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্ত্ত থেকে বেঁচে থাকবে। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেগুলো কি? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং যাদু ....।’’ (সহীহ বুখারী ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম ২৭২)

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ عَقَدَ عُقْدَةً ثُمَّ نَفَثَ فِيْهَا فَقَدْ سَحَرَ وَمَنْ سَحَرَ فَقَدْ أَشْرَكَ وَمَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে গিরা দিল অতঃপর তাতে ফুঁক দিল, সে যেন যাদুই করল। আর যে যাদু করল সে অবশ্যই শিরক করল অর্থাৎ মুশরিক হয়ে গেল। (সুনানে নাসয়ী ৪০৯০)

২৫
প্রচলিত গণতন্ত্র
Democracy এমন একটা পদ্ধতি, যেখানে জনগণ তাদের নিজেদের জন্য আইন তৈরী করে তাদের নিয়োগকৃত স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা। এই কাজটি হয় কোন সভা অথবা সংসদে। আর এই পদ্ধতি স্থাপন করা হয়েছে ঐ সকল আইন ও নীতিমালাসমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য, যেখানে সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছার পূর্ণ প্রতিফল ঘটে। মানুষকে মানুষের ‘রব’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে এই গণতন্ত্র। এটি মানুষকে আইন প্রণয়নকারীর স্তরে পৌঁছে দেয়। অথচ একমাত্র আইন প্রণয়নকারী হলেন আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَٱللهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهٖ وَهُوَ سَرِيْعُ ٱلْحِسَابِ﴾

আল্লাহ্ হুকুম দেন, তাঁর হুকুমকে পশ্চাতে নিক্ষেপকারী কেউ নেই এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণ করেন। (সূরা রা‘দ ১৩:৪১)

তিনি আরও বলেন:

﴿أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُواْ لَهُمْ مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ ٱللَّهُ﴾

ওদের কি এমন কতগুলো মা‘বুদ আছে, যারা ওদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ্ দেননি? (সূরা শূরা ৪২:২১)

মুহাম্মদ আল-আমিন আশ-শানক্বিতি (রহ.) বলেন: আর কুরআনের এই আয়াতগুলো যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তা দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রণীত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মুখ থেকে নিঃসৃত আইনের পরিবর্তে শয়তান ও তার সাহায্যকারীদের মুখ থেকে নিঃসৃত স্বরচিত আইনের আনুগত্য স্পষ্ট কুফর এবং শিরক। এতে কোন সন্দেহ নেই।

(আদ্বওয়া আল-বাইয়ান, ৪র্থ খন্ড, পৃ:৮২-৮৫)

সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কোন অস্তিত্বই থাকবে না নির্বাচন ব্যতীত। জনগণ যদি নির্বাচন পদ্ধতিতে অংশ গ্রহণ না করে, তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।

শা্ইখ আবু বাসির মুস্তফা হালিমাহ বলেন: প্রথমত: যে নীতির উপর গণতন্ত্র স্থাপিত তাহল জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এই ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা, সাধারণ জনগণের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন, যে প্রতিনিধিরা আইন তৈরী ও প্রণয়নের কাজ করবে। অন্য কথায় গণতন্ত্রে যে আইন প্রণয়নকারী এবং যার আনুগত্য করা হয় আসলে সে আল্লাহ্ নয় বরং একজন সাধারণ মানুষ। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, আইন প্রণয়ন ও বৈধ-অবৈধ নির্ধারণের ক্ষেত্রে যার ইবাদত অথবা আনুগত্য করা হয় সেও একজন জনগণ, একজন মানুষ, একজন সৃষ্টি, সে আল্লাহ্ নয়। এটাই হল কুফর, শিরক এবং পথভ্রষ্টতার মূল অস্তিত্ব এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ ও তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। এভাবেই দুর্বল এবং অজ্ঞ লোকেরা শাসন-কর্তৃত্ব ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহ্র একক ইলাহিয়্যাতের সাথে শরীক করে।

(হুকুম আল ইসলাম ফী আদ্-দিমুক্রাতিয়্যাহ আত-তা’দ্দুদিয়্যাহ আল-হিযবিয়্যাহ, পৃ:২৮)

শাইখ আব্দুল কাদির ইবনে আব্দুল আজিজ বলেন: জনসাধারণ ভোট দিয়ে সাংসদ সদস্যদেরকে অনুসরণ করছে। ভোঁটাররা বস্তুত তাদের পক্ষে শিরকের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করছে। কারণ এই প্রতিনিধিরাই আল্লাহ্র পাশাপাশি আইন-প্রণয়নের কাজে হাত দেয়। আর এভাবেই ভোঁটাররা সংসদ সদস্যদেরকে আল্লাহ্র পাশাপাশি আইন প্রণয়নকারী প্রভু হিসেবে গ্রহণ করে।

আমরা যদি একবারের জন্যও ভোঁটারদের কার্যকলাপ এবং যখন কোন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় তার কার্যকলাপকে একত্রিত করি, তাহলে তাদের উভয়ের দ্বারা কৃত কুফর বা শিরকের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না।

২৬
তাবিজ-কবজ ব্যবহার করা
একমাত্র আল্লাহই ভাল ভাগ্য ও মন্দ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, রোগ থেকে মুক্তিদাতা, সন্তানদাতা। তাবিজ কবজ ব্যবহার করে এসব কিছুর ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত এগুলোর উপর নির্ভর করা হয়, যা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে,

إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ

ঝাড়ফূঁক, তাবিজ-কবজ এবং যাদুটোনা ব্যবহার করা শিরক।

(সুনানে আবু দাউদ ৩৮৮৫, সুনানে ইবনে মাজাহ ৩৫৩০; মুসনাদে আহমদ ৩৬১৫)

আবদুল্লাহ বিন উকাইম থেকে মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে,

وَمَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ

যে ব্যক্তি কোন জিনিস (অর্থাৎ তাবিজ- কবজ) লটকায় সে উক্ত জিনিসের দিকেই সমর্পিত হয় (অর্থাৎ এর কুফল তার উপরই বর্তায়)।

(সুনানে নাসায়ী ৪০৯০; মুসনাদে আহমাদ ১৮৭৮১; সুনানে তিরমিজি ২০৭২)

যেসব ঝাড়ফুঁক শিরকমুক্ত তা দলিলের মাধ্যমে খাস করা হয়েছে। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ চোখের দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্ছুর বিষের ব্যাপারে ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন।

২৭
বালা-মুসীবত দূর করার উদ্দেশ্যে রিং, তাগা (সূতা) ইত্যাদি পরিধান করা
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهٖ﴾

(হে রাসূল) আপনি বলে দিন, তোমরা কি মনে করো, আল্লাহ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে চান তাহলে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাকো, তারা কি তাঁর (নির্ধারিত) ক্ষতি হতে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? (সূরা যুমার ৩৯:৩৮)

হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ أَنَّ النَّبِيَّ أَبْصَرَ عَلٰى عَضُدِ رَجُلٍ حَلْقَةً أُرَاهُ قَالَ مِنْ صُفْرٍ فَقَالَ وَيْحَكَ مَا هٰذِهٖ قَالَ مِنْ الْوَاهِنَةِ قَالَ أَمَا إِنَّهَا لَا تَزِيْدُكَ إِلَّا وَهْنًا اِنْبِذْهَا عَنْكَ فَإِنَّكَ لَوْ مِتَّ وَهِيَ عَلَيْكَ مَا أَفْلَحْتَ أَبَدًا

ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত। (তিনি বলেন) একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ এক ব্যক্তির বাহুতে রৌপের একটি রিং দেখতে পেলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ওহে হতভাগা! এটা কি? সে বললো, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, এটা খুলে ফেলো। কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকেই শুধু বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তুমি কখনো সফলকাম হবে না।

(মুসতাদরাকে হাকেম ৭৫০২; সহীহ ইবনে হিববান ৬০৮৫)

একটি ‘‘মারফু’’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عن عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيْمَةً فَلَا أَتَمَّ اللهُ لَهٗ وَمَنْ تَعَلَّقَ وَدَعَةً فَلَا وَدَعَ اللهُ لَهٗ

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলায় (পরিধান করে) আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। যে ব্যক্তি কড়ি, শঙ্খ বা শামুক ঝুলায় আল্লাহ যেন তাকে রক্ষা না করেন। (মুসনাদে আহমাদ ১৭৪০৪; মুসনাদে আবী ই‘য়ালা ২৯৬)

২৮
শুভ-অশুভ লক্ষণ বা সংকেত গ্রহণ করা
শুভ-অশুভ সংকেত গ্রহণ করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এর কারণসমূহ হলো :

১) ইবাদতের প্রক্রিয়া যাকে নির্ভরশীলতা (তাওয়াক্কুল) বলা হয় তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য দিকে পরিচালিত করা হয়, এবং

২) ভাল ও মন্দ আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করার এবং আল্লাহ প্রদত্ত নিয়তি এড়ানোর ক্ষমতা মানুষের অথবা সৃষ্ট জিনিষের উপর অর্পন করা হয়। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنِ بْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَسَحَّرَ اَوْ تَسَحَّرَ لَهٗ أَوْ تَكَهَّنَ أوْ تَكَهَّنَ لَهٗ أَوْ تَطَيَّرَ أَوْ تَطَيَّرَ لَهٗ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: যে যাদু করলো বা যার জন্য যাদু করা হলো, যে ভবিষ্যৎ বর্ণনা করে এবং যার উদ্দেশ্যে করা হয়, যে তিয়ারা বা অশুভ লক্ষণ গ্রহণ করলো বা যার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করলো তারা কেউ আমাদের মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত নয়।

(তাবরানী ৪২৬২; বাইহাকী ১১৭৬)

এখানে ‘‘আমাদের’’ বলতে মুসলিম জনগোষ্ঠী বুঝানো হয়েছে। সুতরাং তিয়ারা এমন একটি কাজ, যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলে উক্ত ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِىِّ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أُمُوْرًا كُنَّا نَصْنَعُهَا فِى الْجَاهِلِيَّةِ كُنَّا نَأْتِى الْكُهَّانَ . قَالَ ্র فَلاَ تَأْتُوا الْكُهَّانَ গ্ধ. قَالَ قُلْتُ كُنَّا نَتَطَيَّرُ . قَالَ ্র ذَاكَ شَىْءٌ يَجِدُهُ أَحَدُكُمْ فِى نَفْسِهِ فَلاَ يَصُدَّنَّكُمْ গ্ধ.

মুআবিয়া ইবনে হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললাম, আমরা জাহেলী যুগে কতগুলো কাজ করতাম যেমন গণক, জ্যৌতিষিদের কাছে যেতাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, না- জ্যোতিষীদের কাছে যেও না। আমি বললাম, আমরা পাখি উড়িয়ে শুভ-অশুভ সংকেন নির্ধারণ করতাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: এটা তোমরা নিজেরাই তৈরী করেছ, এটা যেন তোমাদের কোন কাজ থেকে বিরত না রাখে।

(সহীহ মুসলিম ৫৯৪৯)

অর্থাৎ তুমি যা করতে চাও এটা যেন তোমাকে তা করতে বাধা না দেয়। কারণ এসব সংকেত মানুষের কল্পনাপ্রসূত বানানো গল্প, যার কোন বাস্তবতা নেই।

বর্তমানে কাঠে টোকা দেয়া, লবণ উল্টে পড়া, আয়না ভাঙ্গা, ভাঙ্গা ঝারু, খালি কলসি, তের নম্বর সংখ্যা ইত্যাদি বাতিল শিরকী আক্বিদা মানুষের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। অথচ হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ - قَالَ : اَلطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ . ثَلَاثًا

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তিয়ারা শিরক, তিয়ারা শিরক, তিয়ারা শিরক। তিন বার বললেন।

(সুনানে আবু দাউদ ৩৯১২; সুনানে ইবনে মাজাহ ৩৫৩৮)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ مَا كَفَّارَةُ ذٰلِكَ قَالَ أَنْ يَّقُوْلَ أَحَدُهُمْ اللّٰهُمَّ لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُكَ وَلَا طَيْرَ إِلَّا طَيْرُكَ وَلَا إِلٰهَ غَيْرُكَ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি তিয়ারার (‘কুলক্ষণ বা দুর্ভাগ্যের ধারনার) কারণে কিছু করা থেকে বিরত হল, সে শিরক করল। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, এর প্রায়শ্চিত্ত কি? তিনি বললেন, বলো! হে আল্লাহ, তুমি প্রদত্ত মঙ্গল ব্যতীত অন্য কোন মঙ্গল নাই এবং তুমি প্রদত্ত অমঙ্গল ব্যতীত কোন অমঙ্গল নেই এবং তুমি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নাই। (মুসনাদে আহমদ ৭০৪৫)

২৯
‘আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন’ বলা
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ قُتَيْلَةَ امْرَأَةٍ مِنْ جُهَيْنَةَ أَنَّ يَّهُوْدِيًّا أَتَى النَّبِيَّ فَقَالَ إِنَّكُمْ تُنَدِّدُوْنَ وَإِنَّكُمْ تُشْرِكُوْنَ تَقُوْلُوْنَ مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ وَتَقُوْلُوْنَ وَالْكَعْبَةِ فَأَمَرَهُمْ النَّبِيُّ إِذَا أَرَادُوْا أَنْ يَّحْلِفُوْا أَنْ يَّقُوْلُوْا وَرَبِّ الْكَعْبَةِ وَيَقُوْلُوْنَ مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ شِئْتَ

জুহাইনা গোত্রের জনৈক মহিলা সাহাবী কুতাইলা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। (তিনি বলেন) একদা এক ইয়াহুদী রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বললো, আপনারাও তো আল্লাহর সাথে শিরক করে থাকেন। কারণ আপনারা বলে থাকেন যে, আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন। আপনারা আরো বলে থাকেন যে, কাবার কসম (এগুলোতো স্পষ্ট শিরক)। এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, যখন তোমরা কোন ব্যাপারে কসম বা হলফ করতে চাইবে, তখন বলবে- ‘কাবার রবের কসম’। আর বলবে- ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন’। (সুনানে নাসায়ী ৩৭৮২)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ أَجَعَلْتَنِيْ وَاللهَ عَدْلًا بَلْ مَا شَاءَ اللهُ وَحْدَهٗ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উদ্দেশ্যে বললো, আপনি এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন (তাই হয়েছে)। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেললে? বরং আল্লাহ যা এককভাবে ইচ্ছা করেছেন (তাই হয়েছে)।

(মুসনাদে আহমদ ১৮৩৯; সুনানে বায়হাকী ৫৬০৩)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنِ الطُّفَيْلِ أَخِىْ عَائِشَةَ قَالَ قَالَ رَجُلٌ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ لِرَجُلٍ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ نِعْمَ الْقَوْمُ أَنْتُمْ لَوْلَا أَنَّكُمْ تَقُوْلُوْنَ مَا شَاءَ اللهُ وَشَاءَ مُحَمَّدٌ . فَسَمِعَ النَّبِىُّ فَقَالَ : لَا تَقُوْلُوْا مَا شَاءَ اللهُ وَشَاءَ مُحَمَّدٌ وَلٰكِنْ قُوْلُوْا مَا شَاءَ اللهُ ثُمَّ شَاءَ مُحَمَّدٌ

আয়েশা (রাঃ) এর ভাই তুফায়েল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একদা একজন মুশরিক একজন মুসলিমকে উদ্দেশ্য করে বললো, তোমরা কতই না ভাল সম্প্রদায় যদি ‘‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন এবং মুহাম্মদ ﷺ যা ইচ্ছা করেছেন’’- একথা না বলতে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ‘‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন এবং মুহাম্মদ (স:) যা ইচ্ছা করেছেন’’- একথা তোমরা বলো না; বরং তোমরা বলো, ‘‘এককভাবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন, তারপর মুহাম্মদ ﷺ যা ইচ্ছা করেন’’। (সুনানে দারমী ২৭৫৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ২১১৮)

৩০
বাক্যের মধ্যে ‘যদি’ শব্দের ব্যবহার শিরকের দরজা খুলে দেয়
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْ لُ اللهِ .... اِحْرِصْ عَلٰى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلَا تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّىْ فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا . وَلٰكِنْ قُلْ قَدَرُ اللهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে জিনিস তোমার উপকার সাধন করবে, তার ব্যাপারে আগ্রহী হও এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, আর কখনো অক্ষমতা প্রকাশ করো না। যদি তোমার উপর কোন বিপদ এসে পড়ে, তবে এ কথা বলো না, ‘‘যদি আমি এরকম করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো’’। বরং তুমি এ কথা বলো, ‘‘আল্লাহ যা তাকদীরে রেখেছেন এবং যা ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে’’। কেননা ‘যদি’ কথাটি শয়তানের জন্য কুমন্ত্রণার পথ খুলে দেয় (যদি শব্দটি শয়তানের চাবি)। (সহীহ বুখারী ৬৯৪৫; সুনানে ইবনে মাজাহ ৭৯; মুসনাদে আহমদ ৮৭৯১)

৩১
মিলাদে কি ধরনের শিরক প্রচলিত রয়েছে?
একদল মানুষ নাবী ﷺ এর নামে মিলাদ নামক বিদ‘আত অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং ধারণা করে যে, নাবী ﷺ এর রুহ মোবারক মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত হয়ে থাকে- তাই দাঁড়াতে হয়। অথচ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ لِلّٰهِ مَلَائِكَةً سَيَّاحِيْنَ فِي الْأَرْضِ يُبَلِّغُوْنِيْ مِنْ أُمَّتِيْ السَّلَامَ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর একদল খাস ফেরেশতা রয়েছে, যারা পৃথিবীময় বিচরণ করে আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমার কাছে সালাম পৌঁছায়। (সুনানে নাসায়ী ১২৮১; সুনানে তিরমিজি ৩৬০০)

এই হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ মিলাদ মাহফিলসহ অন্য কোথাও হাজির হন না। কেননা সর্বত্র যিনি তাঁর ইলম ও জ্ঞানের মাধ্যমে হাজির-নাজির তিনি হচ্ছেন শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কেও হাজির-নাজির জ্ঞান করা আল্লাহর সিফাতের ভিতরে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিজেদের জান-মাল, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু থেকে ভালোবাসা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবদ্দশায় স্বশরীরে কোন মজলিশে আগমন করলেও দাঁড়াতেন না। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ এটা পছন্দ করতেন না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ أَنَسٍ قَالَ مَا كَانَ شَخْصٌ أَحَبَّ إِلَيْهِمْ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ وَكَانُوْا إِذَا رَأَوْهُ لَمْ يَّقُوْمُوْا لِمَا يَعْلَمُوْا مِنْ كَرَاهِيَتِهٖ لِذٰلِكَ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবীদের কাছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেয়ে আর বেশী প্রিয় কেউ ছিল না। অথচ তারা যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ কে দেখতেন তখন দাঁড়াতেন না। কেননা তারা জানতেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তা পছন্দ করেন না। (সুনানে তিরমিজি ২৭৫৪; মুসনাদে আহমদ ১২৩৪৫; মেশকাত ৪৬৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২৫৫৮৩)

সুতরাং প্রচলিত মিলাদ একটি স্বীকৃত বিদ‘আত। আর এতে রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং বা তার রুহু উপস্থিত হয় বিশ্বাস করা শিরক। কারো সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে থাকা রাসূলুল্লাহ ﷺ একদম পছন্দ করতেন না। এজন্য তিনি কঠোরভাবে হাদীসে ঘোষণা করেছেন:

عَنْ أَبِيْ مِجْلَز قَالَ خَرَجَ مُعَاوِيَة , فَقَامَ عَبْد اللهِ بْن الزُّبَيْر وَابْنِ صَفْوَانَ حِيْنَ رَأَوْهُ فَقَالَ اِجْلِسَا , سَمِعْت رَسُوْل الله يَقُوْلُ مَنْ سَرَّهٗ أَنْ يَّتَمَثَّلَ لَهُ الرِّجَالُ قِيَامًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهٗ مِنْ النَّار

আবু মিজলায (রহ.) হতে বর্ণিত। একদা মুআবিয়া (রাঃ) বের হলে তাঁকে দেখে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এবং ইবনে সফওয়ান (রাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন মুআবিয়া (রাঃ) বললেন, তোমরা বসে পড়ো। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি চায় তার জন্য লোকেরা মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকুক, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল।

(সুনানে তিরমিজি ২৭৫৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২৫৫৮২)

সুতারাং রাসূলের মুহাববাতের নামে মিলাদ নামক শিরক ও বিদআতযুক্ত জঘন্য কাজ থেকে বিরত থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ যে দ্বীন নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, যে দ্বীন কায়েমের জন্য রক্ত দিয়েছেন সে দ্বীন কায়েমের জন্যই সর্বাত্মক চেষ্টা করে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সত্যিকার মাহাববাতের প্রমাণ দেওয়া উচিত।

মিলাদে রাসূলুল্লাহ ﷺ উপস্থিত হন- এই ধারণার মাধ্যমে আরো একটি জঘন্য শিরক করা হয়। আর তা হলো: ইলমূল গায়েবের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আল্লাহর অংশীদার বানানো। কেননা মিলাদে হাজির হতে হলে তাকে জানতে হবে পৃথিবীর কোথায় কোথায় মিলাদ হচ্ছে, কখন তথাকথিত তাওয়াল্লুদ পড়া হবে, আর তখনই তাঁকে হাজির হতে হবে। অথচ ইলমুল গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। নবী-রাসূল, জ্বীন-ফেরেশতা, ওলী-আওলিয়া কেহই আলেমুল গায়েব নন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

﴿قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ ﴾

(হে নবী) বলুন! আসমান ও জমীনে আল্লাহ ব্যতীত কেউ গায়েবের ব্যাপারে জানে না। (সূরা নামল ২৭:৬৫)

অতএব গায়েবের ইলম একমাত্র আল্লাহই জানেন। এ ইলম নবী ﷺ এর সাথে সম্পৃক্ত করলে আল্লাহর সাথে শিরক হবে। নবী-রাসূলগণ শুধুমাত্র ততটুকুই ইলম রাখেন, যতটুকু ইলম আল্লাহ তা‘আলা দান করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰى غَيْبِهٖۤ احَدًا اِلَّا مَنِ ارْتَضٰى مِنْ رَّسُوْلٍ

তিনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী, তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। (সূরা জিন- ৭২: ২৬, ২৭)

তাই আল্লাহ তা‘আলা যেই অর্থে আলেমুল গায়েব অর্থাৎ নিজের থেকে নিজে সবকিছু জানেন, ** কোন ভায়া-মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না সে অর্থে অন্য কেউ আলেমুল গায়েব হতে পারে না। বরং তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা যতটুকু জানান ততটুকুই জানেন।

৩২
পীর-দরবেশ, ওলী-আউলিয়া এবং কবরে শায়িতদের নিকট দোয়া-প্রার্থনা করা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلَا تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِيْنَ﴾

আল্লাহ ব্যতীত অন্য এমন কাউকে ডাকবে না, যে তোমার উপকার করতে পারবে না ও অপকারও করতে পারবে না। যদি তুমি অন্যকে ডাক, তাহলে তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা ইউনুস ১০:১০৬)

এ আয়াতে জালিম বলতে ‘মুশরিক’ হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। কেননা পবিত্র কুরআনে শিরককে সবচেয়ে বড় জুলুম বলে ঘোষণা করা হয়েছে (বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে)। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيْبُ لَهٗ إِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوْا لَهُمْ أَعْدَاءً وَّكَانُوْا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِيْنَ ﴾

যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্ত্তকে ডাকে যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? তারা তাদের ডাকা সম্পর্কে খবরও রাখে না। যখন মানুষকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হবে এবং তাদের ইবাদতের কথা অস্বীকার করবে। (সূরা আহকাফ ৪৬: ৫-৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَالَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖ مَا يَمْلِكُوْنَ مِنْ قِطْمِيْرٍ إِنْ تَدْعُوْهُمْ لَا يَسْمَعُوْا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوْا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيْرٍ﴾

আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খেজুর আঁটির মালিকও নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের সে ডাক শুনে না। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয় না। কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরকের কথা অস্বীকার করবে। বস্ত্তত আল্লাহর ন্যায় তোমাদেরকে কেউ অবহিত করতে পারবে না। (সূরা ফাতির ৩৫:১৩-১৪)

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ النَّبِيُّ كَلِمَةً وَقُلْتُ أُخْرٰى قَالَ النَّبِيُّ مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَدْعُو مِنْ دُوْنِ اللهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ وَقُلْتُ أَنَا مَنْ مَاتَ وَهُوَ لَا يَدْعُو لِلّٰهِ نِدًّا دَخَلَ الْجَنَّةَ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ একটি কথা বললেন, আর আমি তার সাথে আরেকটি কথা যোগ করলাম। নবী ﷺ বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ডাকে, আর এ অবস্থায় মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে আল্লাহর শরীক হিসেবে না ডেকে মারা গেল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহ বুখারী ৪৪৯৭)

কবরবাসীরা জীবিতদের ডাকে সাড়া দিতে অক্ষম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتٰى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِيْنَ﴾

আপনি মৃতদেরকে শোনাতে পারবেন না, আর শোনাতে পারবেন না বধিরকেও কোন প্রকার আহবান, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়।

(সূরা নামল ২৭: ৮০)

যারা কথা শুনে না তারা কীভাবে অপরকে সাহায্য করবে? অপরকে সান্তনা দিবে, অপরের মাকসুদ পূর্ণ করবে? বরং তারা নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।

৩৩
কবর-মাযার-দরগায় দান বা ভোগ দেয়া
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ سَلْمَانَ ، قَالَ : دَخَلَ رَجُلٌ الْجَنَّةَ فِي ذُبَابٍ وَدَخَلَ رَجُلٌ النَّارَ فِي ذُبَابٍ , مَرَّ رَجُلَانِ عَلٰى قَوْمٍ قَدْ عَكَفُوْا عَلٰى صَنَمٍ لَهُمْ وَقَالُوْا : لَا يَمُرُّ عَلَيْنَا الْيَوْمَ أَحَدٌ إِلَّا قَدَّمَ شَيْئًا , فَقَالُوْا لِأَحَدِهِمَا : قَدِّمْ شَيْئًا , فَأَبٰى فَقُتِلَ , وَقَالُوْا : لِلْاٰخَرِ : قَدِّمْ شَيْئًا , فَقَالُوْا : قَدِّمْ وَلَوْ ذُبَابًا ، فَقَالَ : وَأَيْشٍ ذُبَابٌ , فَقَدَّمَ ذُبَابًا فَدَخَلَ النَّارَ ، فَقَالَ سَلْمَانُ : فَهٰذَا دَخَلَ الْجَنَّةَ فِي ذُبَابٍ , وَدَخَلَ هٰذَا النَّارَ فِي ذُبَابٍ

সালমান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একটি মাছির কারণে এক ব্যক্তি জান্নাতে গিয়েছে এবং একটি মাছির কারণে এক ব্যক্তি জাহান্নামে গিয়েছে। (ঘটনাটি হলো) দু’ব্যক্তি এক গোত্রের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল, আর তাদের একটি মূর্তি ছিল, সে মূর্তিকে কিছু না দিয়ে কেউ অতিক্রম করতে পারত না। (মূর্তির খাদেমরা) প্রথম ব্যক্তিকে বলল: তুমি কিছু দিয়ে যাও। লোকটি অস্বীকার করলো, ফলে তারা তাকে হত্যা করে ফেললো (ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করল)। তারপর তারা (মূতি পূজকরা) দ্বিতীয়জনকে বলল, কিছু দিয়ে যাও। (সে বললো: আমার নিকট কিছুই নেই, যা আমি পেশ করব।) তারা তাকে বলল: একটি মাছি হলেও দিয়ে যাও। সে বললো, মাছি কি? পরিশেষে সে একটি মাছি দান করল, ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করল। আর এটি হলো ‘‘প্রথম ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জান্নাতে প্রবেশ করলো আর দ্বিতীয় ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করলো’’- এর মূল ঘটনা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৩৩৭০৯; বায়হাকী ফী শুআবিল ঈমান ৭৩৪৩; ইমাম নাসীরুদ্দীন আলবানী র. বলেছেন হাদীসটি সহীহ)

এ হাদীস থেকে বুঝা গেল গাইরুল্লাহর নামে কোন কিছু দান করা বা ভোগ দেয়া শিরক।

৩৪
মাযারে, ওরসে পীর-ফকিরদের উদ্দেশ্যে যবেহ করা, দান করা
পশু যবেহ করা, দান-সাদাকা করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এগুলো যখন আল্লাহর নামে করলে আল্লাহর ইবাদত হয় তখন আল্লাহকে বাদ দিয়ে গাইরুল্লাহর নামে করলে সেই গাইরুল্লাহর ইবাদত হয়। আল গাইরুল্লাহর ইবাদত শিরক। কেননা সকল প্রকার ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই সংরক্ষিত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,

﴿قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴾

বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ (সবই) আল্লাহ রাববুল আলামীনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, যার কোন শরিক নেই।

(সূরা আনআম : ১৬২)

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

﴿فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ﴾

আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে সালাত পড়ুন এবং কুরবানী করুন।

(সূরা কাউসার ১০৮:২)

হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ أَبِى الطُّفَيْلِ قَالَ قُلْنَا لِعَلِىِّ بْنِ أَبِى طَالِبٍ أَخْبِرْنَا بِشَىْءٍ أَسَرَّهُ إِلَيْكَ رَسُوْلُ اللهِ - فَقَالَ مَا أَسَرَّ إِلَىَّ شَيْئًا كَتَمَهُ النَّاسَ وَلٰكِنِّىْ سَمِعْتُهٗ يَقُوْلُ : لَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ اَوٰى مُحْدِثًا وَلَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَيْهِ وَلَعَنَ اللهُ مَنْ غَيَّرَ الْمَنَارَ

আবু তুফাইল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ)-কে অনুরোধ করলাম যে, আপনি আমাদেরকে এমন কিছু সম্পর্কে বলুন, যা শুধুমাত্র আপনাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ গোপনে দান করেছেন। আলী (রাঃ) বললেন, না! আমাকে রাসূলুল্লাহ ﷺ গোপনে এমন কিছু বলেননি, যা অন্যের থেকে গোপন করেছেন। তবে আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে (চারটি বিষয়ে) বলতে শুনেছি- (ক) যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে (পশু) যবেহ করে তার উপর আল্লাহর লানত। (খ) যে ব্যক্তি কোন বিদআতীকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লানত। (গ) যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লানত। (ঘ) যে ব্যক্তি জমির সীমানা (চিহ্ন) পরিবর্তন করে তার উপর আল্লাহর লানত। (সহীহ মুসলিম ৫২৪০)

পূর্বে উল্লেখিত দু’ব্যক্তির হাদীসটি যাদের একজন জাহান্নামে গিয়েছিল মূর্তিকে মাছি দেয়ার কারণে, এটিও এ বিষয়ের একটি দলীল।

৩৫
গাইরুল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া শিরক
‘আল ইস্তি‘আযা’ বা আশ্রয় কামনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাকে আশ্রয় দেয়ার মালিক। এ জন্য সূরা নাস এবং ফালাকে তাঁর কাছেই আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর আশ্রয়ের পরিবর্তে অন্য কারো আশ্রয় কামনা করে, সে আল্লাহর সাথে অন্যকে অংশীদার বানালো। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট আশ্রয় চাওয়ার নিন্দা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

﴿وَأَنَّهٗ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوْذُوْنَ بِرِجَالٍ مِّنَ الْجِنِّ فَزَادُوْهُمْ رَهَقًا ﴾

মানুষের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক কতিপয় জ্বিনের কাছে আশ্রয় চাইছিল, এর ফলে তাদের (জ্বিনদের) গর্ব ও আহমিকা আরো বেড়ে গিয়েছিল। (সূরা জ্বীন ৭২:৬)

হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

عَنْ خَوْلَةَ بِنْتِ حَكِيْمٍ السُّلَمِيَّةِ أَنَّهَا سَمِعَتْ رَسُوْلَ اللهِ - يَقُوْلُ : إِذَا نَزَلَ أَحَدُكُمْ مَنْزِلًا فَلْيَقُلْ أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ . فَإِنَّهٗ لَا يَضُرُّهٗ شَىْءٌ حَتّٰى يَرْتَحِلَ مِنْهُ

খাওলা বিনতে হাকীম আস-সুলামিয়্যাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে শুনেছেন যে, যে ব্যক্তি কোন বাড়িতে প্রবেশ করে বললো- ‘‘আমি আল্লাহ তা‘আলা এর পূর্ণাঙ্গ কালামের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির সকল অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাই’’- তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ মঞ্জিল ত্যাগ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না।

(সহীহ মুসলিম ৭০৫৪)

৩৬
নেককার ব্যক্তিদের কবরের ব্যাপারে সীমালংঘন গাইরুল্লাহর ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়
ইমাম মালেক (রহ.) মুয়াত্তায় বর্ণনা করেন,

عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ اللّٰهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِيْ وَثَنًا يُعْبَدُ اِشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلٰى قَوْمٍ اِتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ

আত্বা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করে বলেন, হে আল্লাহ! আমার কবরকে এমন মূর্তিতে পরিণত করো না, যার ইবাদত করা হয়। সেই জাতির উপর আল্লাহর কঠিন গজব নাযিল হয়েছে, যারা নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে।

(মুয়াত্তা মালেক ৪১৪; মুসনাদে আহমদ ৭৩৫৮)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ - زَائِرَاتِ الْقُبُوْرِ وَالْمُتَّخِذِيْنَ عَلَيْهَا الْمَسَاجِدَ وَالسُّرُجَ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ কবর যিয়ারতকারী মহিলাদেরকে এবং যারা কবরকে মসজিদে পরিণত করে ও (কবরে) বাতি জ্বালায় তাদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। (সুনানে তিরমিজি ৩২০; সুনানে আবু দাউদ ৩২৩৮; সুনানে নাসায়ী ২০৪২; শায়খ আলবানী র. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)

৩৭
বরকত হাসিলের জন্য গাছের নিকট ভোগ দেয়া
হ্যাঁ! বরকত হাসিলের জন্য গাছের নিকট ভোগ দেয়া, সুতা বাঁধা শিরক। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِيْ وَاقِدٍ اللَّيْثِيِّ أَنَّهُمْ خَرَجُوْا عَنْ مَكَّةَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ إِلٰى حُنَيْنٍ قَالَ وَكَانَ لِلْكُفَّارِ سِدْرَةٌ يَّعْكُفُوْنَ عِنْدَهَا وَيُعَلِّقُوْنَ بِهَا أَسْلِحَتَهُمْ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ قَالَ فَمَرَرْنَا بِسِدْرَةٍ خَضْرَاءَ عَظِيْمَةٍ قَالَ فَقُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ قُلْتُمْ وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهٖ كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوْسٰى ﴿ اِجْعَلْ لَّنَا إِلٰهًا كَمَا لَهُمْ اٰلِهَةً﴾ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُوْنَ إِنَّهَا لَسُنَنٌ لَتَرْكَبُنَّ سُنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ سُنَّةً سُنَّةً

আবু ওয়াকেদ আল লাইছী থেকে বর্ণিত। (তিনি বলেন) একদা সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে মক্কা থেকে বের হয়ে হুনাইনে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কাফিরদের জন্য একটি বড়ই গাছ ছিল; তারা (বরকতের জন্য) গাছটির নিকট অবস্থান করত এবং তাতে অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। সেটাকে ‘যাতে আনওয়াত’ বলা হতো। (বর্ণনাকারী বলেন) অতঃপর আমরা একটি সবুজ বড় বরই গাছের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য একটি ‘যাতে আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, (সুবহানাল্লাহ) ঐ সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কথাটি মুসা (আঃ) এর সম্প্রদায়ের অনুরূপ। আর তা হলো- ‘‘আপনি আমাদের জন্য মা’বুদ বানিয়ে দিন, যেমনিভাবে তাদের মা’বুদ রয়েছে।’’ তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, নিশ্চয় এটি (মানুষের) একটি নীতি। তোমরা এমন নীতির অনুকরণ করবে, যে নীতির উপর তোমাদের পূর্ববর্তীরা ছিল। (সুনানে তিরমিজি ২১৮০; মুসনাদে আহমদ ২১৮৯৭; )

৩৮
আল্লাহ ব্যতীত বাপ-দাদা, পীর-দরবেশ কিংবা অন্যকিছুর নামে কসম করা শিরক
এ সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَا تَحْلِفُوْا بِالطَّوَاغِىْ وَلَا بِاٰبَائِكُمْ

আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা তাগুতের নামে ও বাপ-দাদার নামে কসম করো না।

(সহীহ মুসলিম ৪৩৫১; সুনানে ইবনে মাজাহ ২০৯৫)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَا تَحْلِفُوْا بِاٰبَائِكُمْ وَلَا بِأُمَّهَاتِكُمْ وَلَا بِالْأَنْدَادِ وَلَا تَحْلِفُوْا إِلَّا بِاللهِ وَلَا تَحْلِفُوْا بِاللهِ إِلَّا وَأَنْتُمْ صَادِقُوْنَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার নামে, মা-নানীর নামে এবং প্রতিমার নামে কসম করো না। আর তোমরা আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কোন নামে শপথ করো না এবং তোমরা আল্লাহর নামে সত্য কসম ব্যতীত কসম করো না।

(সুনানে আবু দাউদ ৩২৫০; সুনানে নাসায়ী ৩৭৭৮)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ سَعْدِ بْنِ عُبَيْدَةَ قَالَ سَمِعَ ابْنُ عُمَرَ رَجُلًا يَحْلِفُ لَا وَالْكَعْبَةِ فَقَالَ لَهُ ابْنُ عُمَرَ إِنِّى سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ - يَقُوْلُ : مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ أَشْرَكَ

সা‘দ ইবনে উবায়দা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা ইবনে উমর (রাঃ) এক ব্যক্তিকে এই বলে কসম করতে শুনলেন, ‘‘না! কাবার কসম!’’ তখন ইবনে উমর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে কসম করল সে অবশ্যই শিরক করল। (সুনানে তিরমিজি ১৫৩৫, সুনানে আবু দাউদ ৩২৫৩; মুসনাদে আহমদ ৬০৭২)

৩৯
নবী ﷺ-কে নূরের তৈরী মনে করা শিরক
এক শ্রেনির মানুষ বলে থাকে যে, নবী ﷺ-কে তৈরী না করলে আল্লাহ তা‘আলা কিছুই সৃষ্টি করতেন না। এ ব্যাপারে তারা যে হাদীসটি বলে তা একটি জাল বা বানোয়াট হাদীস। তারা আরও বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা নাবী ﷺ-কে তাঁর নিজের নূর দিয়ে তৈরী করেছেন; সুতরাং নাবী ﷺ নূরের তৈরী। আর নবী ﷺ এর নূরে সমস্ত জগত তৈরী। সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলা নাবী ﷺ-কে তাঁর নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তারা আল্লাহর সাথে শিরক করে থাকে। কারণ, এতে আল্লাহর সত্ত্বার সাথে সৃষ্টির সংমিশ্রণ ঘটানো হয়, যা তাওহীদুল আসমাই ওয়াস সিফাতের ক্ষেত্রে শিরকের অন্তর্ভুক্ত। অথচ সহীহ হাদীসে রয়েছে, আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে লিখতে বলেন। যেমন-

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ اُكْتُبْ فَقَالَ مَا أَكْتُبُ قَالَ اُكْتُبْ الْقَدَرَ مَا كَانَ وَمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الْأَبَدِ

উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কলমকে বললেন, লিখ! কলম বলল, কি লিখব? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তাকদীর লিখ, যা সংঘটিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে তা সবকিছু লিখ। (সুনানে তিরমিজি ৩৩১৯)

আর রাসূলুল্লাহ ﷺ যে মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحٰى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ ﴾

বলুন! আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট অহী আসে যে, নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ। (সূরা কাহফ ১৮: ১১০)

আলোচ্য আয়াতে মুহাম্মদ ﷺ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। তবে পার্থক্য এই যে, আমার নিকট অহী আসে। নিমেণ এ ব্যাপারে আরো কিছু দলীল তুলে ধরা হলো-

প্রথম প্রমাণ : মুহাম্মদ ﷺ অন্যান্য মানুষের মতই একজন আদম সন্তান ছিলেন। মানুষ যেমন পানাহার করে, অনুরূপভাবে তিনিইও পানাহার করতেন। অন্যান্য মানুষের যেমন সন্তানাদি ছিল, তেমনি রাসুল ﷺ এরও সন্তানাদি ছিল ও স্ত্রীও ছিল। তিনি বলেছেন,

﴿إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ أَنْسٰى كَمَا تَنْسَوْنَ فَإِذَا نَسِيْتُ فَذَكِّرُوْنِىْ﴾

নিশ্চয় আমি মানুষ, আমি তোমাদের মত ভুলে যাই। যদি আমি ভুলে যাই তবে অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেবে। (সহীহ মুসলিম ১৩০২; সুনানে আবু দাউদ ১০২২)

দ্বিতীয় প্রমাণ : অন্যান্য মানুষের মত রাসূলুল্লাহ ﷺ এরও বংশ তালিকা ছিল- একথা সকলেই জানেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ যে একজন মানুষ ছিলেন কুরাইশ বংশে জন্ম গ্রহণ তার বিরাট প্রমাণ। নিম্নে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বংশতালিকা পেশ করা হলো :

মুহাম্মদ ﷺ আবদুল্লাহর পুত্র, তিনি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, তিনি হাশেমের পুত্র, হাশিম কুরাইশ বংশের, কুরাইশ কেনানা বংশের, কেনানা আরব বংশোদ্ভুত, আরবগণ ইসমাইলের বংশধর, ইসমাইল ইবরাহিম (আঃ) এর বংশধর, ইবরাহিম নূহ (আঃ) এর বংশধর, নূহ (আঃ) আদম (আঃ) এর বংশধর, আর আদম (আঃ) হলেন মাটির তৈরী। অতএব মুহাম্মদ ﷺ নিজেও মাটির তৈরী মানুষ। আর সর্বোত্তম মানব বংশেই তাঁর জন্ম। মানব পিতা-মাতার মানব শিশু হিসেবেই তিনি দুনিয়াতে আগমন করেছেন। মাটির তৈরী মানুষের জন্য মাটির তৈরী রাসূল প্রেরণই ছিল মহান আল্লাহ তা‘আলা এর চিরাচরিত নীতি। মানব জাতির জন্য প্রেরিত কোন রাসূলই মানব জাতির বাহির থেকে আসেননি। এ হচ্ছে কুরআন সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি আক্বিদাহ। যার বিরোধিতা করা সুস্পষ্ঠ কুফ্র। মুহাম্মদ ﷺ যে মানব ছিলেন সে ব্যাপারে আল্লামা আবদুর রউফ মুহাম্মদ ওসমান ইজমা নকল করেছেন:

إِنَّ مِنَ الْعَقَائِدِ الثَّابِتَةِ الَّتِيْ أَكَّدَتْهَا نُصُوْصُ الشَّرْعِ وَأَجْمَعَتْ عَلَيْهَا الْأُمَّةُ أَنَّ رُسُلَ اللهِ أَجْمَعِيْنَ بَشَرٌ مِنْ جِنْسٍ الْمُرْسَلِ إِلَيْهِمْ . كَمَا جَرَّتْ بِذٰلِكَ سَنَةُ اللهِ فِيْ الْمُرْسَلِيْنَ ﴿وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللهِ تَبْدِيْلًا﴾ وَإِنَّ الرَّسُوْلَ لَمْ يَكُنْ بِدْعًا مِّنَ الرُّسُلِ بَلْ كَانَ بَشَرًا مِثْلُهُمْ يُوْحٰى إِلَيْهِ . وَبَشَرِيَّةُ الرَّسُوْلِ أَمَرٌ وَاضِحٌ لِكُلِّ مَنْ قَرَأَ الْقُرْاٰنَ أَوْ تَصْفَحَ السُّنَّةَ أَوْ قَلَِّبَ نَظْرَهٗ فِيْ سِيْرَتِهٖ وَأَحْوَالِهٖ

এ আক্বিদা-বিশ্বাস শরীয়ার বাণীসমূহ দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও যার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা তথা সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত হয়েছে যে, রাসূলগণ যে জনগোষ্ঠির প্রতি প্রেরিত হয়েছেন, তারা তাদেরই জাতিভুক্ত ছিলেন। রাসূলগণের ব্যাপারে এই হলো আল্লাহর সুন্নাহ (নীতিমালা)। আর আল্লাহর নীতিমালায় কোন পরিবর্তন নেই। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللهِ تَبْدِيْلًا﴾

তুমি আল্লাহর সুন্নাহ তথা নীতিতে কোন ব্যতিক্রম পাবে না। (সূরা আহযাব ৩৩:৬২)

রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন নতুন রাসূল ছিলেন না; বরং পূর্ববর্তী রাসূলগণের মত তিনিও অহী প্রাপ্ত মানুষই ছিলেন। কুরআন, সুন্নাহ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সিরাত ও জীবনী সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান আছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মানব বংশোদ্ভুত হওয়ার বিষয়টি তার কাছে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট।

(মুহাববাতুর রাসূল ১ম খন্ড, ২০৬ পৃষ্ঠা)

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ . . . قَالَ رَسُوْلُ اللهِ . .. أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهٗ وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُوْنِي فَوْقَ مَنْزِلَتِي الَّتِي أَنْزَلَنِي اللهُ عَزَّ وَجَلَّ

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আল্লাহর কসম! আমি এটি ভালোবাসি না যে, তোমরা আমাকে ঐ মর্যাদার উর্ধ্বে তুলে দাও, যেই মর্যাদায় আল্লাহ আমাকে আসীন করেছেন। (মুসনাদে আহমদ ১২৫৫১)

অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عُمَرَ يَقُوْلُ عَلَى الْمِنْبَرِ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُوْلُ لَا تُطْرُوْنِيْ كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارٰى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهٗ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهٗ

উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি মিম্বারের উপর (খুৎবা প্রদাকালে) বলেন, আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, তোমরা আমার প্রশংসা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে সেরূপ বাড়াবাড়ি করো না, যেরূপ বাড়াবাড়ি করেছিলো খ্রিস্টান জাতি ঈসা ইবনে মারইয়ামের ব্যাপারে [তারা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে আখ্যায়িত করেছিলো]। বরং আমি হচ্ছি আল্লাহর বান্দা; সুতরাং তোমরা আমার ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলো যে, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

(সহীহ বুখারী ৩৪৪৫; মুসনাদে আহমদ ১৫৪)

তৃতীয় প্রমাণ : মুহাম্মদ ﷺ অন্যান্য মানুষের মত পানাহার করতেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ পানাহার করতেন এজন্য কাফেররা উপহাস করতো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন:

﴿وَقَالُوْا مَالِ هٰذَا الرَّسُوْلِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِيْ فِي الْأَسْوَاقِ﴾

তারা বলতো, মুহাম্মদ কেমন রাসূল যে পানাহার করে, আবার বাজারে চলাফেরা করে। (সূরা ফুরকান ২৫:৭)

এ কথাটি মক্কাবাসী পৌত্তলিকদের। তৎকালীন কাফেরদের ও তাদের বর্তমান অনুসারীদের এ প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: **

﴿وَمَا جَعَلْنَاهُمْ جَسَدًا لَا يَأْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَمَا كَانُوْا خَالِدِيْنَ ﴾

আর আমি তাদেরকে এমন দেহবিশিষ্ট করিনি যে, তারা খাদ্য গ্রহণ করত না, আর তারা স্থায়ীও ছিল না। (সূরা আম্বিয়া : ৮)

অর্থাৎ যেহেতু সমস্ত নবী খাদ্য গ্রহণ করতেন, সেহেতু মুহাম্মদ ﷺ-ও একজন খাদ্য গ্রহণকারী রাসূল ছিলেন। এটা তাঁর মানুষ হওয়ার অন্যতম প্রমাণ।

চতুর্থ প্রমাণ : রাসূল অন্যান্য নবীদের মত মৃত্যুবরণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে,

﴿وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلٰى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَّنْقَلِبْ عَلٰى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللهُ الشَّاكِرِيْنَ﴾

আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসূল। তার পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসূল বিগত হয়েছে। যদি সে মারা যায় অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন। (সূরা আল ইমরান ৩:১৪৪)

অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:

﴿إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُوْنَ﴾

নিশ্চয় তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারা সকলে মৃত্যু বরণ করবে। (সূরা যুমার ৩৯:৩০)

রাসূলুল্লাহ ﷺ অতি মানব ছিলেন না যে, তিনি মৃত্যুবরণ করবেন না। বরং তিনি ছিলেন মানুষ নবী, তাই তাঁর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল। উল্লেখিত প্রমাণাদি দ্বারা একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, মুহাম্মদ ﷺ একজন মানুষ নবী ছিলেন।

সকল নবী-রাসূলগণ মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের রাসূল ﷺ যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন বিষয়টি অনেকের কাছেই অস্পষ্ট ছিল। এমনকি উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) তরবারী হাতে ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি বলবে মুহাম্মদ ﷺ মরে গেছে, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিব। এ কারণে রাসূল ﷺ এর মৃত্যু নিয়ে একটি ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছিল। অতঃপর যখন আবু বকর (রাঃ) এসে আয়েশার হুজরায় গেলেন, তখন চাঁদর উত্তোলন করে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে চুমু খেলেন। তারপর বললেন, আপনার প্রতি আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা দুইবার মৃত্যু দিবেন না। যে মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য বরাদ্দ ছিল তা আপনি গ্রহণ করেছেন। একথা বলে আবু বকর (রাঃ) পুনরায় চাঁদর দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়ে জনসম্মুখে এলেন এবং নিম্নের ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করলেন-

عَنْ عَائِشَةَ ..... فقَالَ أَمَّا بَعْدُ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللهَ فَإِنَّ اللهَ حَيٌّ لَا يَمُوْتُ قَالَ اللهُ تَعَالَى ﴿وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ﴾ إِلَى ﴿الشَّاكِرِيْنَ﴾ وَاللهِ لٰكَأَنَّ النَّاسَ لَمْ يَكُوْنُوْا يَعْلَمُوْنَ أَنَّ اللهَ أَنْزَلَ حَتّٰى تَلَاهَا أَبُوْ بَكْرٍ فَتَلَقَّاهَا مِنْهُ النَّاسُ فَمَا يُسْمَعُ بَشَرٌ إِلَّا يَتْلُوْهَا

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। আবু বকর (রাঃ) বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা মুহাম্মদ ﷺ এর ইবাদত করতে তারা জেনে রাখ মুহাম্মদ ﷺ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে তারা জেনে রাখ যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা চিরঞ্জীব, তার কোন মৃত্যু নেই। এরপর তিনি কুরআন মাজিদের নিম্মোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন:

﴿وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ ...... الشَّاكِرِيْنَ ﴾

আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসূল। নিশ্চয় তার পূর্বে অনেক রাসূল বিগত হয়েছে। যদি সে মারা যায় অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন। (সূরা আল ইমরান ৩:১৪৪)

এ আয়াত শোনা মাত্র সকলের কাছে মনে হলো যে, তারা ইতিপূর্বে এ আয়াত কখনো শুনেন নাই। আবু বকর থেকেই প্রথম শুনলেন এবং সকলের মুখে মুখে এ আয়াত উচ্চারিত হতে লাগলো। (সহীহ বুখারী ১২৪১) **

অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,

﴿وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُوْنَ﴾

আর তোমার পূর্বে কোন মানুষকে আমি স্থায়ী জীবন দান করিনি; সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে তারা কি অনন্ত জীবনসম্পন্ন হয়ে থাকবে ? [সুরা আম্বিয়া ৩৪।]

তাছাড়া একথা কীভাবে গ্রহণ করা যায় যে, তিনি নূরের তৈরী; অথচ আললাহ তা‘আলা তাকে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য অনুসরণীয় একমাত্র আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করেছেন। নূরের তৈরী সৃষ্টির প্রকৃতি, চাল-চলন তো হবে ভিন্ন, তাকে কীভাবে মানুষ পুরোপুরি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তার যথাযথ অনুসরণ করবে। আশা করি বিবেকবান পাঠকের নিকট বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

৪০
অসীলার ক্ষেত্রে শিরকী দিকসমূহ
মৃতদের মাধ্যমে অসিলা খোঁজার নামে বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে যেমন- তাদের কাছে কোন প্রয়োজনীয় জিনিস চাওয়া, সাহায্য চাওয়া, পরকালীন মুক্তি কামনা করা ইত্যাদি সবকিছুই শিরকের অন্তর্ভুক্ত গোনাহ। কেননা অসিলার অর্থ হল, আল্লাহ্র নিকটবর্তী হওয়া, যা কেবল ঈমান এবং নেক কাজের দ্বারা সম্ভব। অন্যদিকে মৃতদের কাছে দোয়া করা আল্লাহ্ হতে মুখ ফিরানোর নামান্তর, এমনকি তা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহ্ (সুব) বলেন:

﴿وَلَا تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِيْنَ ﴾

আল্লাহ্ ছাড়া এমন অন্যের কাছে দোয়া কর না, যারা না পারে তোমার উপকার করতে এবং না পারে তোমার ক্ষতি করতে। যদি তা কর তবে নিশ্চয় তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ইউনুস ১০: ১০৬)

৪১
নবী ﷺ এর সম্মানের অসিলা খোঁজা
অনেকেই আল্লাহর কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে নবী ﷺ এর সম্মানের অসিলা অনুসন্ধান করে থাকে। যেমন- বলে থাকে যে, হে আমার রব! রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অসিলায় আমাকে রোগমুক্ত কর। এটা স্পষ্ট বিদ’আত। কারণ সাহাবীরা কেউ এটা করেননি। তবে খলীফা উমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর চাচা আববাস (রাঃ)-এর অসিলায় দোয়া করেছিলেন। কিন্তু সেটা করেছেন কেবলমাত্র তার জীবিত অবস্থায়; মৃত অবস্থায় নয়। হাদীসটি নিম্নরূপ:

عَنْ أَنَسٍ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি দেখা দিত, তখন উমর (রাঃ) আববাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) এর মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য দোয়া করাতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আমরা তোমার নবীর মাধ্যমে ওসীলা করে দোয়া করতাম; অতঃপর তুমি আমাদেরকে বৃষ্টি দিতে। আর এখন আমরা ওসীলা করছি আমাদের নবীর চাচা আববাস (রাঃ) এর মাধ্যমে। সুতরাং তুমি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর। আনাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর বৃষ্টি বর্ষিত হত। (সহীহ বুখারী ১০১০)

৪২
তাগুতের কাছে বিচার ফয়সালা চাওয়া শিরক এবং কুফরী
প্রথম প্রমাণ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ يَزْعُمُوْنَ أَنَّهُمْ اٰمَنُوْا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيْدُوْنَ أَنْ يَّتَحَاكَمُوْا إِلَى الطَّاغُوْتِ وَقَدْ أُمِرُوْا أَنْ يَّكْفُرُوْا بِهٖ وَيُرِيْدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُّضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيْدًا﴾

আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে, আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে (তার প্রতিও ঈমান এনেছি) তারা বিবাদপূর্ণ বিষয়কে (মীমাংসার জন্য) তাগুতের দিকে নিয়ে যেতে চায়; অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ হয়েছে, যাতে তারা তাকে (তাগুতকে) মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করতে চায়। (সূরা আন নিসা ৬০)

শাইখ সুলাইমান বিন আবদুল্লাহ তাঁর ‘‘তাইসীরুল আজিজিল হামীদ’’ নামক গ্রন্থের ৪১৯ পৃষ্ঠায় বলেন: এ আয়াতটির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কুরআন সুন্নাহ বাদ দিয়ে তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়ার কাজটি পরিত্যাগ করা ফরজ এবং যে ব্যক্তি তাগুতের কাছে বিচার ফয়সালার জন্য যাবে সে মুমিন তো নয়ই, এমনকি সে মুসলিমও নয়।

আল্লামা জামালউদ্দিন আল-কাসেমী তাঁর বিখ্যাত মাহাসিনুত তাবীল নামক কিতাবে সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন: আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: ‘‘তারা চায় বিচার ফয়সালা তাগুতের কাছে নিয়ে যেতে, অথচ তাকে অস্বীকার করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ হয়েছে।’’ তাগুতের নিকট বিচার ফয়সালা চাওয়াকে তাগুতের প্রতি ঈমান পোষণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তাগুতের প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থই আল্লাহকে অস্বীকার করা, ঠিক যেমনটি তাগুতকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।

শাইখ আবদুর রহমান বিন হাসান فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ ...... - আল্লাহর এ বাণী উল্লেখ করে বলেন: তাগুতের কাছে বিচার ফয়সালা চাওয়ার অর্থই হচ্ছে তাগুতের প্রতি ঈমান আনা। (ফাতহুল মাজিদ)

আয়াতের শেষাংশে বর্ণিত ‘‘শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে গোমরাহীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে চায়’’ আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে বর্ণনা করেছেন যে, বিচার ফায়সালা চাওয়ার কাজটি শিরকে আকবার (বড় শিরক), যা জঘণ্যতম গোমরাহী এবং পথভ্রষ্টতা। যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়ত (বা বিধান) ছাড়া অন্য কোন বিধানের মধ্যে বিচার ফয়সালা প্রার্থনা করলো, সে মারাত্মক গোমরাহীতে পতিত হলো। কেননা আল্লাহর বিধানকে বাদ দিয়ে বিচার ফয়সালা চাওয়া বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয় প্রমাণ: আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلّٰهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوْا إِلَّا إِيَّاهُ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ ﴾

বিধান দেয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করো না। এটাই সঠিক দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না। (সূরা ইউসুফ- ৪০)

আল্লাহই একমাত্র রব এবং তিনিই একমাত্র বিধানদাতা- এ অধিকার শুধুমাত্র তাঁরই। আল্লাহ-ই (সুব:) বিধানদাতা এ বিশ্বাসের অপরিহার্য দাবী হচ্ছে, বিচার ফয়সালা চাওয়া নামক ইবাদতও তাঁরই উদ্দেশ্যে করা। এ ইবাদত যদি আল্লাহর আইন ও শরীয়তকে বাদ দিয়ে করা হয়, তাহলেও এটা হবে শিরকে আকবার বা বড় ধরনের শিরক।

শাইখ আবদুর রহমান আস্ সা‘দী কিতাবুত তাওহীদের উপর লেখা তাঁর বই ‘কাওলুন সাদীদ’ এ সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতের ব্যাখা প্রসংগে বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বাদ দিয়ে বিচার ফয়সালা (অন্য কোনো বিধান বা ব্যক্তির কাছে) চায়, তাহলে সে ঐ প্রার্থীত ব্যক্তি বা মতাদর্শকে রব বানিয়ে নিয়েছে এবং তাগুতের কাছে বিচার ফয়সালা চেয়েছে।

৪৩
নিছক পার্থিব স্বার্থে কোন আমল করা শিরক
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

﴿مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِيْنَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيْهَا وَهُمْ فِيْهَا لَا يُبْخَسُوْنَ أُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْاٰخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِيْهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ﴾

যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করে, আমি সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল পুরোপুরি দিয়ে দেই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরাই তারা, আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই এবং তারা সেখানে যা করে তা বরবাদ হয়ে যাবে। আর তারা যা করত, তা সম্পূর্ণ বাতিল। (সূরা হুদ ১১:১৫-১৬)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ تَعِسَ عَبْدُ الدِّيْنَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ وَعَبْدُ الْخَمِيْصَةِ إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيْكَ فَلَا انْتَقَشَ طُوْبٰى لِعَبْدٍ اٰخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهٖ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَشْعَثَ رَأْسُهٗ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ إِنْ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করে বলেন, দীনার ও দিরহাম অর্থাৎ টাকা-পয়সার পূজারীরা ধ্বংস হোক। রেশম পূজারী (পোষাক-বিলাসী) ধ্বংস হোক। তাকে দিতে পারলেই খুশী হয়, না দিতে পারলে রাগান্বিত হয়। সে ধ্বংস হোক, তার আরো খারাপ হোক, কাটা-ফুটলে সে তা খুলতে সক্ষম না হয় (অর্থাৎ সে বিপদ থেকে উদ্ধার না পাক) সে বান্দা সৌভাগ্যের অধিকারী যে আল্লাহর রাস্তায় তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছে, মাথার চুলগুলোকে এলো-মেলো করেছে, আর পদযুগলকে করেছে ধূলোমলিন। তাকে পাহারার দায়িত্ব দিলে সে পাহারাতেই লেগে থাকে। সেনাদলের শেষ ভাগে তাকে নিয়োজিত করলে সে শেষ ভাগেই লেগে থাকে। (অথচ জনসাধারণের কাছে তাদের কোন মূল্য নেই) সে অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। সে যদি কারো ব্যাপারে সুপারিশ করে তাহলে তার সুপারিশ গৃহীত হয় না। (কিন্তু আল্লাহর কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য)। (সহীহ বুখারী ২৮৮৭; বায়হাকী ফী শুআবিল ঈমান ৪২৮৯)

৪৪
‘‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’’ এ ধারনাটি বাতিল এবং শিরক
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান এই বিশ্বাস অতিশয় বিপজ্জনক; মূর্খতা এই কারণে যে, এই বিশ্বাস আল্লাহর সৃষ্টির ইবাদত করার মত সবচেয়ে বড় পাপকে উৎসাহিত করা হয় যুক্তিসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করে। এটা ‘তাওহীদ আল আসমাই ওয়াস সিফাত’ বিশ্বাসের বিপরীত শিরকের একটি রূপ। কারণ এটা স্রষ্টার জন্য এমন এক বিশেষণ দাবি করে যা তাঁর নয়। কুরআন অথবা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবনীতে আল্লাহর এই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে কুরআন এবং সুন্নাহ এই বক্তব্যের বিপরীত।

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন, বরং তিনি আরশে সমাসীন বিষয়টির প্রমাণ হচ্ছে-

১। কুরআন থেকে প্রমাণ : আল্লাহ তার সৃষ্টির উর্ধ্বে আরশে সমাসীন কুরআনে এরূপ প্রচুর আয়াত আছে। এইগুলো কুরআনের প্রায় প্রতি সূরাতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর সমাসীন- এই আয়াতটি পবিত্র কুরআনে সাত বার উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান রয়েছে এরূপ বিশ্বাসকারী কাফের এবং ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত। বস্ত্তত আল্লাহ তা‘আলা মর্যাদা ও পরাক্রমে, জাত ও সত্তাগতভাবে যেমন সবার উর্ধ্বে তেমনি তিনি অবস্থানের দিক থেকেও সকল সৃষ্টির উর্ধ্বে। আল কুরআনের প্রায় এক হাজার আয়াত দ্বারা আল্লাহর উর্ধ্বে অবস্থান করার গুণটি বুঝা যায়। আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর সমাসীন থেকেই সবকিছু দেখেন ও শুনেন। আরশের উপর সমাসীন হওয়ার সাতটি আয়াত নিম্নে প্রদত্ত হলো।

﴿إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর সমাসীন হয়েছেন। (সূরা আ‘রাফ ৭:৫৪)

﴿ إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِيْ سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘‘নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। (সূরা ইউনুস ১০:৩)

﴿ اللهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

আল্লাহ, যিনি খুঁটি ছাড়া আসমানসমূহ উঁচু করেছেন, যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন। (সূরা রা‘দ ১৩:২)

﴿اَلرَّحْمٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى ﴾

তিনি রহমান, আরশের উপর সমাসীন। (সূরা ত্বাহা ২০:৫)

﴿اَلَّذِي ْخَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمٰنُ فَاسْأَلْ بِهٖ خَبِيْرًا﴾

যিনি আসমান, যমীন ও উভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি রহমানের আরশে সমাসীন হয়েছেন। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে যিনি জানেন, তুমি তাকেই জিজ্ঞাসা কর। (সূরা ফুরকান ২৫:৫৯)

﴿اَللهُ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ﴾

আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীন এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন।

(সূরা আলিফ লাম মীম সাজদাহ ৩২:৪)

﴿هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ﴾

তিনিই আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন। (সূরা হাদীদ ৫৭:৪)

এ আয়াতগুলোতে বর্ণিত اِسْتَوٰي ‘অধিষ্ঠিত হয়েছে’ এটি فِعْلِيْ وَجُوْدِيْ صِفَت ‘ফে‘লি ওজুদী সিফাত’ বা ক্রিয়াগত ইতিবাচক গুণ। এ ধরণের গুণগুলো আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সংশ্লিষ্ট। যখন ইচ্ছে এগুলো করেন, আবার যখন চান এগুলো পরিহার করেন। আরশ সৃষ্টির পূর্বে اِسْتَوٰي বা অধিষ্ঠান ক্রিয়াটি পরিত্যাক্ত ছিল। এ ধরনের গুণগুলো قَدِيْمَةُ النَّوْعِ حَادِثَةُ الْاَحَادِ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা অনাদীকাল থেকেই এগুলো দ্বারা গুণান্বিত ছিলেন এবং অনন্তকাল ব্যাপী গুণান্বিত থাকবেন। তবে এগুলো তার ইচ্ছাধীন হওয়ায় তিনি যখন চাইবেন প্রকাশ করবেন। আর যখন চাইবেন পরিত্যাগ করবেন। যেমন- হাঁসি-খুশি, বিস্ময়, কিয়ামত দিবসে আগমন- এসব যখনই ইচ্ছে তখনই তিনি করেন। (আল মাদখাল ৯১-৯২)

اِسْتَوٰي শব্দটি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আরশের উপর অধিষ্ঠিত হওয়ার গুণটি প্রকাশ করেছেন। তিনি আরশের উপরই বিরাজমান। সত্তাগতভাবে তিনি সর্বত্র বিরাজমান নন। ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, এ শব্দটির ব্যাখ্যায় সালাফে সালেহীন থেকে চারটি শব্দ বর্ণিত হয়েছে।

১. اِسْتَقَرَّ (ইস্তাকার্রা) তথা অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

২. عَلَا (আলা) তথা সমুন্নত হয়েছেন।

৩. اِرْتَفَعَ (ইরতাফা‘আ) তথা ‘সমুচ্চ হয়েছেন।

৪. صَعُدَ (সায়িদা) অর্থ আরোহন করেছেন।

এ সব অর্থই একথা প্রকাশ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর অধিষ্ঠিত।

কুরআনে আরেকটি আয়াত : **

﴿تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهٗ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ﴾

ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে, যা পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বৎসরের সমান। (সূরা মাআরিজ ৭০:৪)

সুতরাং যারা গভীরভাবে চিন্তা করে, কুরআন নিজেই তাদের স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, আল্লাহ তার সৃষ্টির অনেক ঊর্ধ্বে আরশে সমাসীন এবং কোন ভাবেই এর ভিতরে অথবা এর দ্বারা পরিবেষ্টিত নয়। যদি আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমাসীন না হন, তাহলে ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় কি করে?

মিরাজ থেকে প্রমাণ: মদীনায় হিজরত করার দুই বৎসর পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা হতে জেরুজালেমে অলৌকিক রাত্রি ভ্রমণ (ইসরা) করেন এবং সেখান হতে মিরাজে ভ্রমন করেন অর্থাৎ সাত আসমানের উপর সৃষ্টির সর্বোচ্চ সীমায় গমন করেন। আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমাসীন অধিষ্ঠিত হওয়ার উপর যদি অন্য কোন দলীল-প্রমাণ নাও থাকতো, তবুও আল্লাহ তা‘আলা আরশে আছেন তা প্রমাণ করার জন্য শুধুমাত্র মিরাজের ঘটনাটিই যথেষ্ট ছিল। মিরাজের ঘটনা হাদীস ও তাফসীরের গ্রহণযোগ্য সকল কিতাবেই বিশুদ্ধ সনদে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত রয়েছে। তিনি যাতে সরাসরি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে পারেন এ জন্য তাকে এই অলৌকিক ভ্রমন করানো হয়েছিল। সেখানে সপ্তম আসমানের ঊর্ধ্বে দিনে পাঁচবার সালাত (আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা) আদায় করা বাধ্যতামূলক করা হয়। সেখানে আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে কথা বলেন এবং সূরা বাক্বারার শেষ আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। (বুখারীতে বিস্তারিতভাবে বর্নিত আছে)

যদি আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান হতেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে কোথাও যেতে হত না। তিনি নিজের বাড়ীতে সরাসরি আল্লাহর সম্মুখে হাজির হতে পারতেন। সুতরাং এই ঘটনাটি একটি প্রমাণ যে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন, তিনি আরশে সমাসীন।

২। হাদিস থেকে প্রমাণ: রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিবরণের মধ্যে প্রচুর প্রমাণ রয়েছে, যেগুলি পরিস্কারভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহ পৃথিবী অথবা তার সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান নন। যেমন-

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِي كِتَابِهٖ فَهُوَ عِنْدَهٗ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِيْ غَلَبَتْ غَضَبِيْ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন আল্লাহ সৃষ্টি সমাপ্ত করলেন, তখন তিনি একটি কিতাব লিখলেন, যা আরশের উপর তার নিকট রয়েছে। (সেখানে লিখা রয়েছে যে) নিশ্চয় আমার করুনা আমার ক্ষোভ হতে অগ্রগামী হবে। (সহীহ বুখারী ৩১৯৪; মুসনাদে আহমদ ৮১২৭)

অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِىِّ قَالَ قُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ جَارِيَةٌ لِىْ صَكَكْتُهَا صَكَّةً . فَعَظَّمَ ذٰلِكَ عَلَىَّ رَسُوْلُ اللهِ - فَقُلْتُ أَفَلَا أُعْتِقُهَا قَالَ : اِئْتِنِىْ بِهَا . قَالَ : فَجِئْتُ بِهَا قَالَ : أَيْنَ اللهُ . قَالَتْ : فِى السَّمَاءِ . قَالَ : مَنْ أَنَا . قَالَتْ : أَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ . قَالَ : أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ

মু‘আবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার একটি বাঁদি আছে, আমি তাকে একটি ধপ্পর মেরেছি। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার এই কাজটিকে বড় অন্যায় হিসেবে দেখলেন। অতঃপর আমি বললাম, তাহলে আমি কি তাকে স্বাধীন করে দেব? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আমি তাকে নিয়ে আসলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে (দাসীকে) জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে উত্তর দিল, আল্লাহ তা‘আলা আকাশে। রাসূলুল্লাহ ﷺ মেয়েটিকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? সে উত্তর দিল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, তাকে মুক্তি দাও, কারণ নিশ্চয় সে একজন সত্যিকার মুমিন।

(সহীহ মুসলিম ১২২৭; সুনানে আবু দাউদ ৯৩১; মুসনাদে আহমদ ১৭৯৪৫)

অপর হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষভাগে প্রথম আকাশে অবতরণ করেন। আর এ কথা সকলেরই জানা আছে যে, অবতরণ বলা হয় উপর থেকে নিচে নামাকে। যদি আল্লাহ তা‘আলা সত্তাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান থাকেন। তাহলে আবার কোথা থেকে প্রথম আকাশে অবতরণ করেন? হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالٰى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقٰى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْاٰخِرُ فَيَقُوْلُ مَنْ يَّدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهٗ مَنْ يَّسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَّسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهٗ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে প্রথম আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি আহবান করতে থাকেন, কে আছ! আমাকে ডাকবে, যার ডাকে আমি সাড়া দেব? কে আছ! আমার কাছে আবেদন করবে, যার আবেদনে আমি দান করবো? কে আছ! আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যাকে আমি ক্ষমা করবো? (সহীহ বুখারী ৭৪৯৫; সহীহ মুসলিম ১৮১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ ১৩৮৮)

সুতরাং ইসলাম এবং এর প্রধান তত্ত্ব তৌহিদ অনুসারে নিরাপদে বলা যায় যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি হতে সর্ম্পূণ আলাদা। কোন প্রকার সৃষ্টিই তাঁকে বেষ্টিত করে নেই অথবা তাঁর ঊর্ধ্বে বিদ্যমান নেই। আল্লাহ সকল বস্তুর ঊর্ধ্বে। ইসলামের মূল সূত্র হিসেবে আল্লাহ সম্বন্ধে এটাই হল সঠিক মতবাদ। এটা খুব সহজ ও দৃঢ়। **

৪৫
আল্লাহ তা‘আলা তো নিরাকার, তিনি আরশে সমাসীন হন কিভাবে?
আল্লাহ তা‘আলা নিরাকার এ কথাটি নাস্তিকতার নামান্তর। তিনি নিরাকার নন; বরং তিনি অজানা আকারবিশিষ্ট। তাঁর চেহারা, হাত, পা, চোখ, আঙ্গুল ইত্যাদি আছে। তবে এগুলো তার বিশেষণ। তাঁর সত্তার রূপরেখা কেমন এটা যেমন তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না; তেমনি তার চেহারা, হাত, পা, চোখ, আঙ্গুল কেমন তাও তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানেন না। তাঁর সত্তার আকৃতি জানা থাকলে তাঁর বিশেষণ জানা সম্ভব হতো। তাঁর সত্তার রূপ যেহেতু তিনি ছাড়া আর কারো জানা নেই, সেহেতু তাঁর বিশেষণের আভিধানিক অর্থ ব্যতীত এর কোন রূপরেখা তিনি ছাড়া আর কারো জানা নেই। এগুলোর রূপরেখা জানা সৃষ্টির ক্ষুদ্র জ্ঞানের বহু-বহু উর্ধ্বে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا يُحِيطُوْنَ بِهٖ عِلْمًا﴾

তারা তাকে জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ব করতে পারে না। (সূরা ত্বহা ২০:১১০)

এগুলো কুরআন ও সুন্নাহতে আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে বর্ণনা করেছেন ঠিক সেভাবে বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর কোন আকৃতি-প্রকৃতি বর্ণনা করা যাবে না। সৃষ্টি জগতের কোন কিছুর সাথে কিছুতেই তুলনা করা যাবে না। এগুলোর আভিধানিক অর্থের বাইরে কোনরূপ অর্থগত বা শব্দগত বিকৃতি করা যাবে না। এগুলোকে অর্থহীনও করা চলবে না। কুরআন ও সুন্নাহতে এগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, এগুলোর উপর ঠিক সেভাবেই ঈমান আনা ফরজ। এগুলো কেমন সে প্রশ্ন করা বিদআত ও ভ্রান্তিকর। আক্বিদার কিতাবসমূহে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে:

اِسْتِوَائُهٗ مَعْلُوْمٌ وَكَيْفِيَتُهٗ مَجْهُوْلٌ وَالْاِيْمَانُ بِهٖ وَاجِبٌ وَالسُّوَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ

অর্থাৎ আল্লাহর আরশে সামসীন হওয়া, এমনিভাবে আরশ থেকে প্রথম আসমানে অবতরন করা, আল্লাহর হাত, পা, চোখ, চেহারা ইত্যাদি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জানা, এগুলোর ধরণ-ধারণ ও রূপরেখা অজানা, এগুলোর উপর ঈমান রাখা ফরজ, প্রশ্ন করা বিদআত ও বিভ্রান্তি। **

৪৬
আল্লাহর অজানা আকার তথা চেহারা, হাত, পা, চোখ, আঙ্গুল ইত্যাদি থাকার প্রমাণ
আল্লাহর চেহারা :

আল্লাহর চেহারা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ مُوْسٰى قَالَ قَامَ فِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ - بِخَمْسِ كَلِمَاتٍ فَقَالَ ... حِجَابُهُ النُّوْرُ لَوْ كَشَفَهٗ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهٖ مَا انْتَهٰى إِلَيْهِ بَصَرُهٗ مِنْ خَلْقِهٖ

আবু মুসা আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের মাঝে পাঁচাটি কথা বলার জন্য দাঁড়ালেন। অতঃপর তিনি বললেন, ....... তাঁর (আল্লাহর) পর্দা হলো নূর বা জ্যোতী। যদি তিনি এ পর্দা খুলে দেন, তবে তার চেহারার জ্যোতীসমূহ তাঁর দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত তথা গোটা সৃষ্টি জগতকে জ্বালিয়ে দিবে। (সহীহ মুসলিম ৪৬৩; সুনানে ইবনে মাজাহ ১৯৫)

আল্লাহর হাত :

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ﴾

আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। (সূরা ফাতাহ ৪৮:১০)

আল্লাহর চোখ :

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿وَلِتُصْنَعَ عَلٰى عَيْنِيْ﴾

যাতে তুমি (মূসা) আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও। (সূরা ত্বাহা ২০:৩৯)

আল্লাহর পা :

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ النَّبِيُّ لَا تَزَالُ جَهَنَّمُ ﴿ تَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَّزِيْدٍ﴾ حَتّٰى يَضَعَ رَبُّ الْعِزَّةِ فِيْهَا قَدَمَهٗ فَتَقُوْلُ قَطْ قَطْ وَعِزَّتِكَ

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, (কিয়ামতের মাঠে) জাহান্নাম বলতে থাকবে, আরো কিছু আছে কি? শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামে তাঁর পা রাখবেন। অতঃপর জাহান্নাম বলবে, যথেষ্ট! যথেষ্ট। (সহীহ বুখারী ৬৬৬১; সহীহ মুসলিম ৭৩৫৬; সুনানে তিরমিজি ৩২৭২)

আল্লাহর আঙ্গুল :

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ يُكْثَرُ أَنْ يَّقُوْلَ يَا مُثَبِّتَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰى دِيْنِكَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ اٰمَنَّا بِكَ وَبِمَا جِئْتَ بِهٖ فَهَلْ تَخَافُ عَلَيْنَا قَالَ نَعْمْ إِنَّ الْقُلُوْبَ بَيْنَ اَصْبِعَيْنِ مِنْ اَصَابِعِ اللهِ يُقَلِّبُهَا

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এই দোয়াটি বেশী বেশী বলতেন, ‘‘হে অন্তরসমূহকে স্থীরকর্তা! তুমি আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থীর রাখ’’। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার প্রতি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি। তবে কি আপনি আমাদের ব্যাপারে কোন আশংকা বোধ করছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হ্যা! নিশ্চয় সব অন্তরগুলো আল্লাহর আঙ্গুলসমূহ থেকে দুই আঙ্গুলের মধ্যে। তিনি ওগুলোকে উলট-পালট করেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২৯১৯৬)

৪৭
ভাগ্য গণনা করা শিরক
মানবজাতির মধ্যে অনেকে আছে, যারা অদৃশ্য এবং ভবিষ্যত সম্বন্ধে জ্ঞানের অধিকারী বলে দাবী করে। তারা বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- গণক, ভবিষ্যৎ-বক্তা, পূর্ব-পরিজ্ঞেয়ক, দৈবজ্ঞ, যাদুকর, পূর্বাভাষদাতা, দৈববাণী প্রকাশক, জ্যোতিষী, হস্তরেখা বিশারদ ইত্যাদি। গণকরা বিভিন্ন পদ্ধতি এবং মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্যাদি বের করে আনার দাবী করে, যার মধ্যে রয়েছে- চায়ের পাতা পড়া, রেখা অংকন করা, সংখ্যা লেখা, হস্তরেখা-পড়া, রাশিচক্র পরীক্ষা করা, স্ফটিক বলের প্রতি দৃষ্টিপাত এবং হাড়গোড়, ছড়ি-ছোড়া, লাঠি চালনা, বাটি চালান ইত্যাদি।

গুপ্ত বিদ্যা পেশাজীবিগণ যারা অদৃশ্যের বিষয় প্রকাশ করতে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম বলে দাবী করে তাদেরকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে :

১. যাদের সত্যিকার কোন জ্ঞান বা গুপ্ত বিষয় সম্পর্কে জানা নেই। তারা প্রায়ই অনেকগুলি অর্থহীন আচারানুষ্ঠান করে খরিদ্দারদের ধোঁকা দেয়। তারপর তারা পরিকল্পিতভাবে সাধারণ অনুমানগুলিই বলে। তাদের কিছু কিছু অনুমান সাধারণতার কারণে সচরাচর সত্য হয়ে যায়। বেশীর ভাগ লোকের গুটিকয়েক ভবিষ্যদ্বাণী, যা সত্য হয় সেগুলি স্মরণ রাখার প্রবণতা দেখা যায় এবং যেগুলি সত্য হয় না তার বেশীরভাগই তাড়াতাড়ি ভুলে যায়।

২. দ্বিতীয় দলভুক্ত তারা, যাদের সঙ্গে জ্বীনের যোগাযোগ রয়েছে। এই দলটি সবচেয়ে গুরুতর। কারণ এর সঙ্গে সাধারণত শিরক এর মত মারাত্মক গুনাহ জড়িত। যারা এই কাজে জড়িত তাদের তথ্যাদি অতি নির্ভূল হয় এবং এইভাবে মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ের মধ্যে একইভাবে সত্যিকার ফিত্না (প্রলোভন) সৃষ্টি হয়।

অপবিত্র বিশ্বাস জড়িত থাকার কারণে ইসলাম ভাগ্য গণনার প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। যে কোন প্রকারের গণক দর্শন সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ ﷺ পরিস্কারভাবে নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

عَنْ صَفِيَّةَ عَنْ بَعْضِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ - عَنِ النَّبِىِّ - قَالَ : مَنْ أَتٰى عَرَّافًا فَسَأَلَهٗ عَنْ شَىْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهٗ صَلَاةٌ أَرْبَعِيْنَ لَيْلَةً

সাফিয়্যা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কতক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, যদি কেউ গণকের কাছে যায় এবং তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে ৪০ দিন রাত পর্যন্ত তার সালাত গৃহীত হবে না।

(সহীহ মুসলিম ৫৯৫৭; মুসনাদে আহমদ ১৬৬৩৮)

এই হাদীসের বর্ণিত শাস্তি শুধুমাত্র গণকের কাছে যাওয়ার এবং তাকে কৌতুহলবশত কোন কিছু জিজ্ঞেস করার করণেই।

আর গণক অদৃশ্য এবং ভবিষ্যতের খবর জানে এই বিশ্বাস নিয়ে যে কেউ গণকের কাছে যায় সে কুফরি করলো। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَالْحَسَنِ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ مَنْ أَتٰى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهٗ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلٰى مُحَمَّدٍ

আবু হুরায়রা এবং হাসান (রাঃ) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, যে গণকের নিকট যায় এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করে সে মুহাম্মদ এর উপর যা নাজিল হয়েছে তা অবিশ্বাস করল। (মুসনাদে আহমদ ৯৫৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ ৬৩৯;)

এই ধরণের বিশ্বাস আল্লাহর অদৃশ্য এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীয় জ্ঞানকে সৃষ্টির উপর আরোপ করে। ফলে এটি ‘তাওহীদুল আসমাই ওয়াস সিফাত’কে ধ্বংস করে। আর এটি তাওহীদের ক্ষেত্রে এক ধরণের শিরকের বাস্তব নমুনা। গণকদের লেখা জিনিস (বই, পত্রিকা ইত্যাদি) পড়া এবং তাদের কথা রেডিওতে শোনা অথবা টেলিভিশনে দেখাটাও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ অদৃশ্য সম্পর্কে জানে না, এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ-ও না। ইরশাদ হচ্ছে:

﴿وَعِنْدَهٗ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ﴾

অদৃশ্যের কুঞ্জি (চাবিসমূহ) তাঁরই নিকট রয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। (সূরা আন‘আম ৬:৫৯)

অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,

﴿قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوْءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيْرٌ وَّبَشِيْرٌ لِقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ﴾

বল! আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজস্ব ভালমন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নাই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমি প্রভূর কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। তবে আমি তো মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য কেবল ভয়প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদ প্রদানকারী মাত্র। (সূরা আ’রাফ ৭:১৮৮)

৪৮
রাশিচক্র সম্বন্ধে ইসলামের রায়
ইসলামের দৃষ্টিতে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা শুধু হারামই নয়; বরং কোন জ্যোতিষবিদের কাছে যাওয়া এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী শোনা, জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর বই কেনা অথবা কারো কোষ্ঠী যাচাই সম্পূর্ণ নিষেধ। হাদীসে এসেছে,

عَنْ صَفِيَّةَ عَنْ بَعْضِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ - عَنِ النَّبِىِّ - قَالَ : مَنْ أَتٰى عَرَّافًا فَسَأَلَهٗ عَنْ شَىْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهٗ صَلَاةٌ أَرْبَعِيْنَ لَيْلَةً

সাফিয়্যা (রাঃ) নবী ﷺ এর কতক স্ত্রীর কাছ থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, যদি কেউ গণকের কাছে যায় এবং তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে ৪০ দিন রাত পর্যন্ত তার সালাত কবুল করা হবে না।

(সহীহ মুসলিম ৫৯৫৭; মুসনাদে আহমদ ১৬৬৩৮)

এই হাদীসের বর্ণিত শাস্তি শুধুমাত্র গণকের কাছে যাওয়ার এবং তাকে কৌতুহলবশত কোন কিছু জিজ্ঞেস করার করণেই।

জ্যোতিষের বক্তব্যের সত্যতায় সন্দিহান হওয়া সত্ত্বেও একজনের শুধু তার কাছে যাওয়া এবং প্রশ্ন করার শাস্তি এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যদি কেউ জ্যোতিষ সংক্রান্ত তথ্যাদির সত্য মিথ্যায় সন্দিহান হয়, তবে সে আল্লাহর পাশাপাশি অন্যরাও হয়তো অদৃশ্য এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানে বলে সন্দেহ পোষণ করলো। এটা এক ধরনের শিরক। কেউ তার রাশিচক্রে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করলে সে সরাসরি কুফরি (অবিশ্বাস) করলো। কারণ হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَالْحَسَنِ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ مَنْ أَتٰى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهٗ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلٰى مُحَمَّدٍ

আবু হুরায়রা এবং হাসান (রাঃ) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, যে গণকের নিকট যায় এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করে সে মুহাম্মদ এর উপর যা নাজিল হয়েছে তা অবিশ্বাস করল। (মুসনাদে আহমদ ৯৫৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ ৬৩৯)

পূর্বে বর্ণিত হাদীসের মত এই হাদিসে শাব্দিকভাবে গণকের সম্বন্ধে উল্লেখ করা হলেও জ্যোতিষবিদদের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। উভয়ই ভবিষ্যতের জ্ঞানের অধিকারী বলে দাবি করে। কোন পুরুষ অথবা মহিলা কর্তৃক খবরের কাগজের রাশিচক্রের কলাম পড়া অথবা পড়তে শোনাও সম্পূর্ণ নিষেধ।

৪৯
জাহেলী যুগের শিরক ও বর্তমান সমাজে প্রচলিত শিরকের তুলনামূলক আলোচনা
জাহেলী যুগের মানুষের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের সাথে বর্তমান বাংলাদেশের মুসলিমদের কী পরিমাণ মিল বা অমিল রয়েছে, তা সর্ব সাধারণের নিকট যেন সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়, সেজন্য নিম্নে উভয় সময়ের শিরকী কর্মকান্ডের একটি তুলনামূলক বর্ণনা প্রদান করা হলো :

১. জাহেলী যুগের লোকেরা কাহিনী বা গণকদের দ্বারা ভাগ্য জানার চেষ্টা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম গণক, টিয়া পাখি ও বানরের মাধ্যমে ভাগ্য জানার চেষ্টা করে।

২. জাহেলী যুগের লোকেরা আররাফ বা ভবিষ্যদ্বাণীকারকদের গায়েব সম্পর্কীয় কথায় বিশ্বাস করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম জিন সাধকদের গায়েব সম্পর্কীয় কথায় বিশ্বাস করে। তারা আরো মনে করে যে, নবী ও ওলীগণ গায়েব জানেন।

৩. জাহেলী যুগের লোকেরা পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের মঙ্গল ও অমঙ্গল জানার চেষ্টা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম টিয়া পাখি ও বানরের সাহায্যে ভাগ্য জানার চেষ্টা করে।

৪. জাহেলী যুগের লোকেরা ওয়াদ, সুয়া‘আ, ইয়াগুস ইত্যাদি নামে নির্মিত মূর্তিসমূহ প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করত। আর বর্তমান সময়ের মুসলিমরা ওলীগণ বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করে।

৫. জাহেলী যুগের লোকেরা বিশ্বাস করত যে, দেবতারা ইহকালীন কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূর করতে পারে। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের মধ্যকার গাউছ ও কুতুবগণ দুনিয়া পরিচালনা করেন এবং মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করে।

৬. জাহেলী যুগের লোকেরা ওলী ও ফেরেশতাদের নামে নির্মিত মূর্তি ও দেবতাসমূহ আল্লাহর কাছে মানুষের জন্য শাফাআত করতে পারে বলে বিশ্বাস করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীগণ নিজস্ব মর্যাদায় আল্লাহর কোন পূর্বানুমতি ব্যতীত তাদের ভক্তদের জন্য শাফাআত করে তাদেরকে মুক্তি দিতে পারবেন বলে বিশ্বাস করে।

৭. জাহেলী যুগের লোকেরা মালাইকা/ফেরেশতা ও ওলীদের নামে নির্মিত দেবতাদের/উপাস্যদের সাধারণ মানুষদের জন্য আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার ওসীলা/মাধ্যম হিসেবে মনে করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম মৃত ওলীদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার ওসীলা/মাধ্যম মনে করে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, মৃত ওলীগণ ভক্তদের সমস্যার সমাধানে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

৮. জাহেলী যুগের লোকেরা ‘উয্যা’ ও ‘যাতে আনওয়াত’ নামের গাছ সর্বস্ব দেবতা যুদ্ধে বরকত ও বিজয় এনে দিত বলে বিশ্বাস করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের কবরের/মাজারের উপর অথবা পার্শ্ববর্তী স্থানে উৎপন্ন বা লাগানো গাছের শিকড়, ফল ও পাতার মাধ্যমে বরকত ও বিবিধ কল্যাণ লাভ করা যায় বলে মনে করে। তারা কবরের/মাজারের পুকুর ও কূপের পানি পান করে এবং মাছ, কচ্ছপ ও কুমীরকে খাবার দিয়ে রোগ মুক্তি ও বরকত কামনা করে।

৯. জাহেলী যুগের লোকেরা উপত্যকার জিন সর্দারের নিকট আশ্রয় কামনা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম কাঠ ও মধু সংগ্রহকারীদের দ্বারা জঙ্গলের জিন ও হিংস্র প্রাণীর অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য জঙ্গলের জিন সর্দারের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। বিল ও জলাশয়ের মাছ ধরার জন্য পানি সেচের পূর্বে ‘কাল’ নামক জিনকে শিরনী দিয়ে সন্তুষ্ট করে।

১০. জাহেলী যুগের লোকেরা পৃথিবীর ঘটনা প্রবাহের উপর তারকা ও নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম মানুষের ভাগ্যের উপর গ্রহ ও তারকার প্রভাবে বিশ্বাস করে।

১১. জাহেলী যুগের লোকেরা গোত্রীয় নেতাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী গোত্র শাসন করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম মানবরচিত বিধানের আলোকে দেশ শাসন করে। আল্লাহর পরিবর্তে দেশের জনগণকে ক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমে সর্বময় ক্ষমতার মালিক মনে করে।

১২. জাহেলী যুগের লোকেরা দাদ ও প্লেগ রোগকে নিজ থেকে সংক্রামক রোগ বলে বিশ্বাস করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম কলেরা, বসন্ত, দাদ, এজমা, যক্ষা, প্লেগ ও এইডস রোগকে নিজ থেকে সংক্রামক রোগ বলে মনে করে।

১৩. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদের দিকে মুখ করে দু‘আ করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম দু‘আ গৃহীত হওয়ার জন্য মুরশিদ, পীর ও ওলীদের কবরের/মাজারের দিকে মুখ করে দু‘আ করে।

১৪. জাহেলী যুগের লোকেরা, ছোট ছোট ব্যাপারে দেবতারা সাহায্য করতে পারে- এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের নিকট তা কামনা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম মৃত ওলীগণ সাহায্য করতে পারেন মনে করে তাদের নিকট সাহায্য চায়।

১৫. জাহেলী যুগের লোকেরা ওলীদের মূর্তির সামনে বিনয়ের সাথে দাঁড়াত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের কবর ও পীরের সামনে বিনয়ের সাথে দাঁড়ায়।

১৬. জাহেলী যুগের লোকেরা ভাল-মন্দ সর্বাবস্থায় মূর্তির নিকট সাহায্য চাইত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের নিকট সাহায্য কামনা করে।

১৭. জাহেলী যুগের লোকেরা ওয়াদ, সুয়া‘আ ইত্যাদি ওলীগণের প্রথমত কবর এবং পরে তাদের মূর্তির সামনে অবস্থান গ্রহণ করে আল্লাহর উপাসনায় মনোযোগ দিত ও তার নিকটবর্তী হতে চাইত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের কবরে অবস্থান গ্রহণ করে তাদের বাতেনী ফয়েয হাসিল করতে চায় এবং তাদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চায়।

১৮. জাহেলী যুগের লোকেরা চাঁদ ও সূর্যকে সেজদা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম পীর/ওলীদের কবরে/মাজারে সেজদা করে।

১৯. জাহেলী যুগের লোকেরা বিপদাপদ দূর করার জন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে নযর-নিয়াজ ও মান্নত করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ওলীদের কবরে মান্নত করে।

২০. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদেরকে আল্লাহর চেয়ে অধিক ভালোবাসত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম আল্লাহর হুকুমের উপরে পীরের হুকুমকে প্রাধান্য দেয়।

২১. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদের নিকট প্রয়োজন পেশ করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের নিকট প্রয়োজন পূর্ণ করে দেয়ার জন্য আবেদন করে।

২২. জাহেলী যুগের লোকেরা উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দেবতাদের উপর ভরসা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ওলীদের উপর ভরসা করে।

২৩. জাহেলী যুগের লোকেরা ধর্ম যাজকদেরকে হারাম ও হালাল নির্ধারণকারী বানিয়ে নিত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম শরীয়ত পালনের ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের উপর পীর ও নিজস্ব মাযহাবের মতামতকে প্রাধান্য দেয়।

২৪. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদের সাথে সম্পর্কিত কথিত বরকতপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করতে যেত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের কবর ও তাঁদের সাথে সম্পর্কিত স্থানসমূহ দূর-দূরান্ত থেকে যিয়ারত করতে যায়।

২৫. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদের মূর্তির গায়ে হাত বুলিয়ে বরকত হাসিল করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম ওলীদের কবর/মাজার, কবরের দেয়াল, গিলাফ ও তাদের স্মৃতিসমূহ স্পর্শ করে বরকত হাসিল করে।

২৬. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতা ও বাপ-দাদার নামে শপথ গ্রহণ করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম আগুন, পানি, মাটি, বিদ্যা ইত্যাদির নামে শপথ করে।

২৭. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদের নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানাদির নাম রাখত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম কোন ওলীর নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানাদির নাম রাখে।

২৮. জাহেলী যুগের লোকেরা বরকত হাসিলের জন্য সন্তানদেরকে দেবতাদের কাছে নিয়ে যেত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম বরকত লাভ ও রোগ মুক্তির জন্য সন্তানদেরকে ওলীদের কবরে নিয়ে যায়।

২৯. জাহেলী যুগের লোকেরা শিরকী পন্থায় অসুখ নিবারণের জন্য চেষ্টা করত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্রের মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করে।

৩০. জাহেলী যুগের লোকেরা চোখের কুদৃষ্টি থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য গলায় ঝিনুক থেকে আহরিত মালা পরাত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম কারো চোখ লাগা থেকে শিশুদেরকে রক্ষার জন্য তাদের গলায় মাছের হাড়, শামুক ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখে।

উপরোক্ত তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, জাহেলী যুগের মুশরিকদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের সাথে আমাদের দেশের অনেক মুসলিমদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তাদের মধ্যে এমনও অনেক শিরকী কর্ম রয়েছে, যা জাহেলী যুগের মুশরিকদের মধ্যে ছিল না। জাহেলী যুগের লোকেরা নৌকা যোগে কোথাও যাওয়ার প্রাক্কালে ঝড় ও তুফানের কবলে পতিত হলে তারা বিপদ থেকে মুক্তির জন্য একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকেই স্মরণ করে তাঁকে আহবান করত বলে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে। [ সূরা ইউনুস ১০:২২ ]

অথচ দেখা যায়, বর্তমানে অনেক মুসলিম রয়েছে যারা অনুরূপ বিপদে পতিত হলে সাহায্যের জন্য একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে আহবান না করে ওলীদেরকে সাহায্যের জন্য আহবান করে থাকে। এতে প্রমাণিত হয় যে, জাহেলী যুগের লোকেরা যতটুকু শয়তানের শিকারে পরিণত হয়েছিল আমাদের দেশের অনেক নামধারী মুসলিম এর চেয়েও মারাত্মকভাবে তার শিকারে পরিণত হয়েছে। [শিরক কী ও কেন? ড. মুহাম্মাদ মুযযাম্মিল আলী। ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ২৫৯-২৭২ (ঈষৎ পরিমার্জিত)]

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন