HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের সমাধান

লেখকঃ আশরাফুল ইসলাম

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কুরআন, হাদীস ও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে

সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের সমাধান

আশরাফুল ইসলাম

স্নাতক (সম্মান), দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ,

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

ই-মেইল: ashrafulkst3@gmail.com

সম্পাদনা

কামাল আহমাদ

ভূমিকা
نحمده ونصلى على رسوله الكريم اما بعد ـ

এই বইটির মাধ্যমে আমরা আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক লিখিত ‘‘সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের পদ্ধতি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কেন?’’ - পুস্তিকাটির পর্যালোচনা করব। উদ্দেশ্য এ সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের গবেষণার সাথে লেখকের গবেষণার মিল ও অমিলগুলো মুসলিম জনগণকে জানিয়ে দেয়া। আশা করি মুসলিম পাঠক পর্যালোচনাটি পাঠ করে - মাসআলাটি সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন, ইনঁশাআল্লাহ।

- আশরাফুল ইসলাম

শালিকা, মেহেরপুর। ই-মেইল: ashrafulkst3@gmail.com

যে বইটির আমরা পর্যালোচনা করব সেটার কভারের পরবর্তী ভেতরের পৃষ্ঠার তথ্যগুলো নিম্নরূপ:

“সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের পদ্ধতি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কেন?”

লেখক: আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাযযাক

ই-মেইল: abdur-razzaque@live.com

ফোন: ০১৭১১ ৩৮৭ ৩৮৭

প্রকাশনায়: মেডিশপ ৭৯/ক, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪। প্রকাশকাল: সফর ১৪৩৭ হিজরী ডিসেম্বর ২০১৫ ঈসায়ী প্রাপ্তিস্থান: মেডিশপ ৭৯/ক, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪

পুস্তিকাটির অভিমত বনাম জুমহুর মুহাদ্দিসগণের অভিমত
পুস্তিকাটির অভিমত:

অভিমত

بسم الله الرحمن الرحيم

অভিমত সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামীনের জন্য। তিনি ব্যতীত এবাদতের যোগ্য প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। দরূদ ও সালাম আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর যিনি গোটা মানবজাতির জন্য আদর্শ ও রহমতরূপে প্রেরিত হয়েছেন।

সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের পদ্ধতি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কেন? পুস্তকটি আলোচ্য বিষয়ে সৃষ্ট মতভেদ ও বিতর্ক অবসানে ভুমিকা রাখবে এ প্রত্যাশা করছি।

পরিশেষে, হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে সিরাতে মুসতাকীমের ওপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন। “আমীন”

মুহাম্মাদ মুস্তাফা বিন বাহুরুদ্দীন আস্ সালাফী

অধ্যক্ষ

মাদ্রাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া ৭৯/ক,

উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪

অভিমত পর্যালোচনা: মুহতারাম মুহাম্মাদ মুস্তাফা বিন বাহরুদ্দীন আস্ সালাফী - তাঁর নিজের পক্ষ থেকে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে বইটির দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেননি। তবে তাঁর নিকট লেখকের এই পুস্তিকাটির দ্বারা আলোচ্য মাসআলাটির ক্ষেত্রে বিতর্ক নিরসণ হবে - মর্মে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

এ জন্যে প্রথমে আমরা এ মাসআলাটিতে জুমহুর (অধিকাংশ) ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের অভিমত জেনে নেব:

১) আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ)-এর অভিমত:
ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর না পাঠ করার অভিমত এবং ইমাম শাফেঈ (রহ)-এর সর্বাবস্থায় পাঠের মতামত উল্লেখ করার পর আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ) লিখেছেন:

ومنهم من يأمر بالقراءة فى صلاة السر وفى حال سكتات الامام فى صلاة الجهر والبعيد الذى لا يسمع الامام وأما القريب الذى يسمع قراءة الامام فيأمرونه بالانصات لقراءة امامه اقامة للاستماع مقام التلاوة وهذا قول الجمهور كمالك وأحمد وغيرهم

‘‘আলেমদের (অপর) একটি পক্ষ সির্রি (চুপের) সালাতে ক্বিরাআতের নির্দেশ দিয়েছেন। আর জাহরি সালাতে ইমামের সাকতা করা অবস্থায় পড়তে বলেছেন। আর (তাদেরকেও) যারা দূরে থাকায় ইমামের ক্বিরাআত শুনতে পায় না। পক্ষান্তরে যারা কাছে থেকে ইমামের ক্বিরাআত শুনতে পায়, তাদেরকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা ইমামের ক্বিরাআতের সময় সেটা শোনাটা তার জন্য (সালাত) ক্বায়েমের অন্তর্ভুক্ত। এটা জমহুরের (অধিকাংশ আলেমের) মত, যেমন - ইমাম মালেক (রহ), ইমাম আহমাদ (রহ) প্রমুখ।’’ [মাজমাউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৩/৩২৭ পৃ.]

২) ইমাম তিরমিযী (রহ)-এর অভিমত
ইমাম তিরমিযী (রহ) উবাদাহ (রা) ও আবূ হুরায়রা (রা)-এর পরস্পর বিরোধী হাদীসের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে লিখেছেন:

واختار أكثر أصحاب الْحديث أن لا يقرأ الرجل إذا جهر الإمام بالقراءة وقالوا يتتبع سكتات الإمام

‘‘অধিকাংশ আসহাবুল হাদীস (হাদীসবেত্তাগণ) ইমাম জোরে ক্বিরাআতকালে মুক্তাদির ক্বিরআত না করার মত গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বলেন: ইমামের ক্বিরাআতের সাকতাতে বা চুপ থাকার সময়ে তা করা হবে।’’

[তিরমিযী - কিতাবুস সালাত - باب ماجاء في ترك القراءة خلف الإمام إذا جهر الإمام بالقراءة (অনুচ্ছেদ: ইমাম যখন জাহরি ক্বিরাআত করেন তখন তাঁর পিছনে মুক্তাদির ক্বিরাআত না করা)]

তেমনি সুনানে তিরমিযীতে সাহাবী সামুরাহ (রা) বর্ণিত দু’টি সাকতার হাদীস বর্ণনার পর উল্লিখিত হয়েছে:

قال أبو عيسى حديث سمرة حديث حسن وهو قول غير واحد من أهل العلم ستحبون للإمام أن يسكت بعد ما يفتتح الصلاة وبعد الفراغ من القراءة وبه يقول أحمد و إسحق وأصحابنا

‘‘আবূ ঈসা (তিরমিযী রহ.) বলেন: সামুরাহ (রা)‎-এর হাদীসটি হাসান। একাধিক আলিম এই কথা বলেছেন। তাঁরা সালাত শুরুর পর এবং ক্বিরাআত শেষে কিছুক্ষণ নীরব থাকা ইমামের জন্য মুস্তাহাব বলে মত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম আহমাদ, ইসহাক্ব ও আমাদের উস্তাযগণের অভিমত এ-ই। [তিরমিযী ‘কিতাবুস সালাত’ باب ما جاء في السكتتين ]

৩) আহলেহাদীস মুহাদ্দিস আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহ)-এর অভিমত
فنحن نقرأ خلف الإمام في الصلوات السرية وفي الجهرية أيضا عند سكتات الإمام فإن الآية لا تدل على المنع إلا إذا جهر قال الإمام البخاري في جزء القراءة قيل له احتجاجك بقول الله تعالى فاستمعوا وأنصتوا أرأيت إذا لم يجهر الإمام يقرأ خلفه فإن قال لا بطل دعواه لأن الله تعالى قال فاستمعوا له وأنصتوا وإنما يستمع لما يجهر مع أنا نستعمل قول الله تعالى فاستمعوا له نقول يقرأ خلف الإمام عند السكتات انتهى

‘‘সুতরাং আমরা সির্রি সালাতে ইমামের পিছনে (সূরা ফাতিহা) পড়ি, অনুরূপ জাহরি সালাতেও ইমামের সাকতাতে। কেননা (সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং) আয়াতে (চুপ থাকার দাবি ক্বিরাআত) জাহরি হওয়া ছাড়া নিষেধ করা হয়নি। ইমাম বুখারী (রহ) তাঁর ‘জুযউল ক্বিরাআতে’ বলেছেন: (মহান আল্লাহর বাণী:) ‘‘যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন মনোযোগের সাথে শোনো ও চুপ থাকো’’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪) দ্বারা যখন দলিল নেয়া হয়। তখন বলা হবে, যখন ইমাম প্রকাশ্যে পড়ে না তখন যে তার পিছনে পড়ে তার ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? যদি সে বলে: (পড়বে) না। তবে তার দাবি বাতিল হবে। কেননা মহান আল্লাহর বাণী: ‘‘তোমরা শোনো ও চুপ থাকো।’’ এই শোনাটা তখন হয় যখন (ইমামের) জাহরি ক্বিরাআত হয়। এতদসত্ত্বেও আমরা আমল করি আল্লাহর এ কথার فاستمعوا ‘‘তোমরা মনোযোগের সাথে শোনো।’’ আমরা বলবো সাকতাসমূহের সময় ইমামের পিছনে পড়া হবে। (ইমাম বুখারীর বক্তব্য) শেষ।’’ [তুহফাতুল আহওয়াযি (শামেলা সংস্করণ: ২/২৩৯. অন্য সংস্করণ ২/২০৭)]

আমরা পরবর্তী আলোচনার বিভিন্ন স্থানে উপরের মুহাদ্দিসগণ ছাড়া আরও কয়েকজন প্রথম সারির মুহাদ্দিসণের অভিমত উল্লেখ করব। যাঁরা জাহরি সালাতের ক্ষেত্রে ইমামের পিছনে সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠকে এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর বিরোধ নিরসণের পদ্ধতি হিসেবে অভিমত দিয়েছেন, তাঁরা হলেন:

৪) ইমাম বুখারী (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-১০, ১৪, ১৬];

৫) ইমাম বায়হাক্বী (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-৫, ১৩, ১৬, ১৮, ৩২];

৬) হাফেয ইবনে হাজার (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-৩, ১৬];

৭) হাফেয নববী (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-৩২];

৮) মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-১];

৯) আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষ্নভি হানাফি (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-১];

১০) শায়খ আলবানী (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-৪, ১০, ১৩, ১৬];

১১) শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-৩, ৭, ১৫, ১৬, ২১];

১২) শায়খ ইরশাদুল হক্ব আসারি (হাফি.) [দ্র: পর্যালোচনা-৩, ৫];

১৩) মুফতি রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি দেওবন্দি (রহ) [দ্র: পর্যালোচনা-১] - প্রমূখ।

বুঝা যাচ্ছে, পুস্তিকাটির অভিমতদাতা ও লেখক ‘অহেতুক বিতর্ক’ বলে যা লিখে প্রচার-প্রচারণাতে লিপ্ত আছেন, তা জুমহুর বা অধিকাংশ ইমাম, মুহাদ্দিস ও শায়খদের উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণ, ব্যাখ্যা, দলিলসমূহের বিরোধ সমন্বয় পদ্ধতি এবং তাঁদের বুঝের বিরোধিতার নামান্তর।

পুস্তিকাটির মূল অংশের পর্যালোচনা
এখন আমরা আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক লিখিত বইটির মূল অংশের পর্যালোচনা করব।

মাযহাবপন্থী বনাম সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১: (পৃ. ৩)

পরম করুণাময় অতীব দয়ালু আল্লাহর নামে

শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে যে সকল ইখতিলাফ রয়েছে তন্মধ্যে একটি হলো ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ নিয়ে। এ বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে দুটি মত লক্ষণীয়। এক পক্ষে রয়েছে মাযহাবপন্থী আলেমগণ। তাদের মতে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ সিদ্ধ নয়। তারা দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন আল কুরআনের সুরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত যেখানে বলা হয়েছে “যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবন কর ও চুপ থাক”। মাযহাবপন্থী জনগণের মধ্যেও তদনুযায়ী আমল বিদ্যমান রয়েছে।

পর্যালোচনা - ১: আমরা আল্লামা ইবনে তাইমিয়া, ইমাম তিরমিযী ও আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহ)-এর উদ্ধৃতি থেকে জেনেছি, তাঁরা যেটিকে জমহুরের (অধিকাংশ আলেমের) মতামত বলে উল্লেখ করেছেন, সেটার প্রতি আমলের দ্বারা সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতটির সঠিক দাবি পূরণ হয়। কেননা সির্রি সালাতে (যোহর ও আসরে) ইমামের কুরআন পাঠ শোনা যায় না। ফলে তখন সূরা ফাতিহা পাঠ করাতে আয়াতটি দ্বারা দলিল উপস্থাপন করা যায় না। তেমনি জাহরি ক্বিরাআতের সালাতে ইমামের সাকতাতে সূরা ফাতিহা পড়লেও আয়াতটির কোনো বিরোধিতা হয় না।

পুস্তিকাটির লেখক লিখেছেন উক্ত আয়াতটি মাযহাবপন্থীদের দলিল। অথচ শাফেঈ ও হাম্বলি মাযহাব আয়াতটি দ্বারা ঐভাবে দলিল নেন না, যেভাবে হানাফি মাযহাব (সির্রি ও জাহরি উভয় সালাতে) দলিলটি গ্রহণ করেন। এখন হানাফি মাযহাবপন্থীদের মধ্যে কয়েকজনের অভিমত উল্লেখ করছি, যারা জুমহুর মুহাদ্দিসগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন:

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি হানাফি (রহ)-এর অভিমত
... ويجهر الإِمَام فِي الْفجْر وأولي الْمغرب وَالْعشَاء، وَإِن كَانَ مَأْمُوما وَجب عَلَيْهِ الانصات وَالِاسْتِمَاع فَإِن جهر الإِمَام لم يقْرَأ إِلَّا عِنْد الإسكاته، وَإِن خَافت فَلهُ الخيره، فَإِن قَرَأَ فليقرأ الْفَاتِحَة قِرَاءَة لَا يشوش على الإِمَام، وَهَذَا أولى الْأَقْوَال عِنْدِي،

‘‘...আর ইমাম ফজরের সালাতে এবং মাগরিব ও ‘ঈশার সালাতে প্রথমাংশে (প্রথম দু’ রাক‘আতে) জাহরি ক্বিরাআত করবে। আর মুক্তাদির জন্য ওয়াজিব হল, তখন চুপ থাকবে ও মনোযোগের সাথে শুনবে। কেননা, যদি ইমাম জাহরি ক্বিরাআত করেন তখন মুক্তাদি কেবল সাকতাতে পড়বে। আর যদি (ইমাম) খফী (চুপে) পড়েন, তবে মুক্তাদি (সূরা ফাতিহা পাঠের) সুযোগ নেবে। সুতরাং যদি পড়ে তবে এমনভাবে পড়বে যেন ইমামকে সমস্যার মধ্যে না ফেলে। আমার কাছে এটাই সর্বোত্তম।’’ [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (দেওবন্দ: মাকতাবাহ থানভি, ১৯৮৬) ২/১৮ পৃ.] [. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাভি (রহ) সূরা ফাতিহার পরের সাকতা সম্পর্কে বলেন: ‘‘এ সম্পর্কে আসহাবে সুনান যা বর্ণনা করেছেন তা স্পষ্ট নয় যে, ঐ মুহূর্তে ইমাম মুক্তাদির জন্য সাকতা করবে। কেননা জাহরি মর্ম হল, এই ‘সাকতা’ আমীন বলার জন্য, সির্রি ভাবে (নিচুস্বরে)। অপর একটি দিক হল, এই সাকতা সূরা ফাতিহা ও আমীনের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। যেন কুরআন ও যা কুরআন নয় এর মধ্যে সংমিশ্রণ না হয়।’’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ২/১৮) উল্লেখ্য সূরা ফাতিহার পরের সাকতা ও সির্রীভাবে আমীন বলা সম্পর্কিত হাদীসগুলো যঈফ। পক্ষান্তরে রুকু‘র পুর্বের সাকতার হাদীস সহীহ।]

১০
আব্দুল হাই লাক্ষ্নভি হানাফি (রহ)-এর অভিমত
روي عن محمد انه استحسن قراءة الفاتحة للمؤتم في السرية ومثله عن أبي حنيفة صرح به في الهداية والمجتبى شرح مختصر القدري وغيرهما وهذا هو مختار كثير من مشائخنا وعلى هذا فلا ينكر استحسانها في الجهرية اثناء سكتات الإمام بشرط أن لا يخل بالسمع

‘‘ইমাম মুহাম্মাদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, সির্রি সালাতে মুক্তাদির জন্য সূরা ফাতিহা পড়া উত্তম। [. আব্দুল হাই লাক্ষ্নভি (রহ) এটাও সুস্পষ্ট করেছেন যে, ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) থেকে উক্ত বর্ণনাটি রেওয়ায়াতের দিক থেকে যঈফ। কিন্তু দেরায়াতের দিক থেকে শক্তিশালী। যেমন তিনি (রহ) বলেছেন: إنه كان ضعيفا لكنه قوي دراية ‘যদিও উক্তিটি যঈফ কিন্তু দেরায়াতের দিক থেকে শক্তিশালী।’’ [আত-তা‘লিকুল মুমাজ্জাদ পৃ. ৯৪]] অনুরূপ ইমাম আবূ হানিফা (রহ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। যেভাবে ‘হেদায়া’ ও ‘মুজতাবা শরহে মুখতাসার কুদুরিতে’-তে বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই আমাদের মাশায়খদের অধিকাংশের কাছে পছন্দনীয়। সুতরাং জাহরি সালাতের সময় ইমামের সাকতাতে ফাতিহা পড়াকে অস্বীকার করা হয়নি। শর্ত হলো, (মুক্তাদির জন্য ইমামের ক্বিরাআত) শোনার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটবে না।’’ [উমদাতুর রিয়াআহ পৃ. ১৭৩]

১১
রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি দেওবন্দি (রহ)-এর অভিমত
اگر سکتات میں پڑھا جاوے تو مضائقہ نہیں چنانچہ بعض روایات میں آیا ہے " هذًّاً نقراً " یعنی جلدی جلدی پڑھتے ہیں، آپ کی شروع قراءت سے پہلے اور سکتات میں ...

‘‘যদি সাকতাতে পড়া হয় তবে কোনো সমস্যা নেই। কেননা কিছু বর্ণনাতে هذًّاً نقراً তথা তাড়াতাড়ি পড়ার কথা বর্ণিত হেয়ছে। অর্থাৎ তাঁর (স) ক্বিরাআতের শুরুতে ও সাকতাতে।...’’ [তা‘লিফাতে রশিদিয়াহ (লাহোর: ইদারাহ ইসলামিয়াহ ১৯৯২/১৪১২) পৃ. ৫১১]

সম্মানিত পাঠক! মাযহাবিদের মধ্যে কমপক্ষে এ মাসআলাটিতে যাঁরা চরমপন্থী মুক্বাল্লিদ নন, তাঁরাও জুমহুর মুহাদ্দিসের পথ অবলম্বন করেছেন। অর্থাৎ সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের সাথে সহীহ হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান দিয়েছেন, সাকতার মাধ্যমে। কেননা এ সম্পর্কিত সবগুলোই ইসলামের দলিল ও আমলযোগ্য। কোনো মাযহাবের পক্ষে আছে আয়াতের দলিল, আর তাদের বিরোধীদের রয়েছে হাদীসের দলিল। একি আল্লাহ প্রদত্ত শরিআত উপস্থাপনা, নাকি শরিআত নিয়ে ছেলেখেলা ?!

১২
সূরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াতের ভুল দাবি গ্রহণ
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২: (পৃ. ৩)

 অপর দিকে রয়েছে সুন্নাতে নববীর অনুসারী আলেমগণ। তাদের মতে ইমামের পিছনে চুপে চুপে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ অবশ্য কর্তব্য। তারা দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন আল-কুরআনের সূরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াত যেখানে বলা হয়েছে “অতঃপর তোমরা পড় কুরআন থেকে যা সহজ মনে কর” ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস, যেখানে বলা হয়েছে “যে ব্যক্তি সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না, তার সালাত হলো না”। সুন্নাতে নববীর অনুসারী মুসলিমগণের মধ্যেও তদনুযায়ী আমল বিদ্যমান রয়েছে। 

পর্যালোচনা - ২: পুস্তিকাটির লেখক সূরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াত ও পরবর্তী হাদীসটি দ্বারা মুক্তাদির জন্য সূরা ফাতিহা পাঠকে অবশ্য কর্তব্য বা ফরয হিসেবে গণ্য করেছেন। অথচ আয়াতটি ফরয হওয়ার দলিল নয়, বরং পাঠের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকার দলিল। পক্ষান্তরে হাদীসটি নিশ্চিত ফরয হওয়ার দলিল।

এক্ষণে হাদীসের ব্যাখ্যা নিলে আয়াতটিতে বর্ণিত স্বাধীনতাটি সূরা ফাতিহার জন্য নয় বরং পরবর্তী ক্বিরাআতের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য হয়। যেমন:

নবী (স) ভুল সালাত আদায়কারীকে বলেছিলেন:

اِذَا قُمْتُ اِلَى الصَّلوةِ فَأَسْبِغِ الْوُضُوْءَ ـ ثَمَّ اسْتَقْبِلِ الْقِبْلَةَ فَكَبِّرْ ـ ثُمَّ اقْرَأَ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ

‘‘তুমি যখন সালাতে দাঁড়াও (প্রস্ত্ততি নাও) তখন পরিপূর্ণভাবে অযু করে নেবে। তারপর ক্বিবলামুখী হয়ে তাকবীর বলবে। এরপর কুরআনের যে অংশ তোমার কাছে সহজ মনে হয় সেখান থেকে ক্বিরাআত করবে।’’ [.সহীহ: ইবনে মাজাহ - কিতাবুস সালাত باب اتّمام الصلاة ...। এর বর্ণনাকারীগণ সিক্বাহ [তাক্বরীব, মিনহাজুল মুসলিমীন (করাচী) পৃ. ১৭০]। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বসহ ইবনে মাজাহ হা/৮৬২]।]

অন্য বর্ণনায় আছে:

إذا استقبلت القبلة فكبر ثُم اقرأ بأم القرآن ثُم اقرأ بِما شئت

‘‘যখন তুমি কেবলামুখী হও তখন তাকবির বল। অতঃপর উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড় এবং তোমার যতটুকু ইচ্ছা ক্বিরাআত কর।’’ [.হাসান: আহমাদ, ইবনে হিব্বান। আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন (সহীহ জামেউস সগীর হা/৩২৪ )। শু‘আয়েব আরনাউতও হাদীসটির সনদকে শক্তিশালী ( قوي ) বলেছেন। (তাহক্বীক্বকৃত সহীহ ইবনে হিব্বান ৫/৮৮/১৭৮৭)]

১৩
মনগড়া দলিল উপস্থাপন
হাদীস দু’টিকে পরস্পরের ব্যাখ্যা হিসেবে নিলে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর বাণী: فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ‘‘সুতরাং পড়ুন, কুরআন থেকে যা আপনার পক্ষে সহজতর’ (সূরা মু্যযাম্মিল: ২০)-এর দাবি সূরা ফাতিহা পাঠ করা বা না করার স্বাধীনতা নয়। বরং পরবর্তী ক্বিরাআত পাঠের পরিমাণ সম্পর্কিত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা সূরা ফাতিহা পাঠ বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে যতটুকু ইচ্ছা বলার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে অন্য দীর্ঘ ক্বিরাআত পাঠের ক্ষেত্রে ‘সহজসাধ্য বা যতটুকু ইচ্ছা’ বাক্যগুলো প্রযোজ্য। কেননা সূরা ফাতিহা পাঠের ক্ষেত্রে ‘যতটুকু সহজ বা ইচ্ছা’ বাক্যটি প্রয়োগ করা হয় - তা হলে সূরা ফাতিহা সম্পূর্ণ পাঠ করা ফরয থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে সূরা মুযযাম্মিলের আয়াতটি একাকী, ইমাম বা মুক্তাদি প্রত্যেক মুসল্লির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর সূরা আ‘রাফের আয়াতটি জামাআতের সালাতে মুক্তাদির প্রতি খাস নির্দেশ। এ সম্পর্কে নবী (স), সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা) ও ইবনে মাসউদ (রা)-এর বর্ণনা সামনে আসবে ইনঁশাআল্লাহ। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-৭’]

১৪
সাকতার আমলটিকে সাম্প্রতিক মতামত বলে অপবাদ প্রদান
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৩: (পৃ. ৩)

অতি সম্প্রতি সুন্নাতে নববীর অনুসারী আলেমগণের মধ্য হতে অধিকতর হকপন্থী দাবিদার কতিপয় আলেমের মতে সালাতে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠের প্রচলিত পদ্ধতি সঠিক নয়। তাদের মতে, যেহেতু সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতে কুরআন পাঠকালে নীরব থাকার নির্দেশ রয়েছে, আর হাদীসে বলা হয়েছে “ইমাম যখন কিরাআত করেন তখন তোমরা চুপ থাক”। সেহেতু “ইমাম সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়ার পর রুকুতে যাবার পূর্বে সাকতা বা নীরবতা পালন করবেন এবং সেই অবসরে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পড়ে নিবে।

পর্যালোচনা - ৩: এটা কোনো ‘অতি সাম্প্রতিক মতামত’ নয়। বরং এ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন - ইমাম আহমাদ (রহ), ইমাম বুখারী (রহ), ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ), শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস (রহ) - যা আমরা ইতঃপূর্বে জেনেছি। এ আমলটি সাহাবী ও তাবেঈদের যুগ থেকে প্রমাণিত। যেমন,

১৫
সাহাবী যুগে সাকতার আমল
১) আবূ সালামাহ (রহ) আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন:

للإمام سكتتان ، فاغتنموا القراءة فيهما بفاتحة الكتاب

‘‘ইমামের জন্য দু’টি সাকতা আছে। ফাতিহাতুল কিতাবকে দু’সাকতার মধ্যে তোমরা গণিমত মনে করো।’’ [ইমাম বুখারীর জুযউল ক্বিরাআত হা/২৭৫, মুহাদ্দিস যুবায়েরআলী যাঈ লিখেছেন, হাদীসটির সনদ হাসান (নাসরুল বারী পৃ. ২৯২)]

শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে মওকুফ (সাহাবীর উক্তি) হিসেবে হাসান বলেছেন। [সিলসিলাহ যঈফাহ হা/৫৪৬]

২) সাহাবী সামুরাহ (রা)-এর দুই সাকতার হাদীস। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-৪’-এর পূর্বের হাদীসটি]

৩) আমর বিন শুআয়েবের বর্ণনাতে - সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) কর্তৃক নবী (স)-এর পিছনে তাঁর আমলের বর্ণনা:

أنه كان يقرأ خلف رسول الله إذا أنصت فإذا قرأ لم يقرأ ، فإذا أنصت قرأ وكان رسول الله يقول : كل صلاة لا يقرأ فيها بفاتحة الكتاب فهي خداج .

‘‘তিনি নবী (স)-এর পিছনে তখন ক্বিরাআত করতেন, যখন তিনি (স) চুপ থাকতেন। আর যখন তিনি (স) পড়তেন, তখন তিনি (রা) পড়তেন না। আবার যখন তিনি (স) চুপ থাকতেন তখন তিনি (রা) পড়তেন। আর রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: সমস্ত সালাত যাতে সূরা ফাতিহা পড়া হয় না তা ত্রুটিযুক্ত।’’ [কিতাবুল ক্বিরাআত ১০৫, অন্য সংস্করণে ১২৬ পৃ., শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ হাদীসটির প্রত্যেক রাবিকে সিক্বাহ বলেছেন। (শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ, আল-কাওয়াকিবুদ দারিয়াহ ফি উজুবিল ফাতিহা খলফাল ইমামি ফিস সালাতির জাহরিয়্যাহ, পৃ: ৬৭)]

এখানে যে চুপ (আনসাত) থাকার কথা বলা হয়েছে সেটাই পূর্বের হাদীসগুলোতে সাকতা হিসেবে ব্যক্ত হয়েছে। কেননা আরবি অভিধানে সাকতা ও আনসাত একই। [.বিশ্ববিখ্যাত আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ বর্ণিত হয়েছে:... والإِنْصاتُ هو السكوتُ والاسْتِماعُ .... إِذا سَكَتَ سُكوتَ مُسْتَمع وقد أَنْصَتَ وأَنْصَتَه إِذا أَسْكَته فهو لازم ومُتَعَدٍّ ‘‘ইনসাত বলা হয়, সুকূত (চুপ থাকা) ও ইস্তিমা‘ (মনোযোগের সাথে কথা শোনা)। ... (পক্ষান্তরে), যখন সাকতা (চুপ থাকা) হয়, (তখন সেটা) শ্রোতার সুকূত (চুপ থাকা), তখন এতে আনসাতের অর্থ থাকে। যেমন - তাকে ‘আনসাত’ (চুপ) করানো হল, যখন তাকে ‘সাকতা’ করানো হয়। এ বিষয়টি আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী লাযেম (অকর্মক) ও মুতা‘আদ্দি (স্বকর্মক)। [লিসানুল ‘আরব ১২/১৯২]সুস্পষ্ট انصت ও সাকতা শব্দ দু’টি সমার্থক হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। যেভাবে হাদীসের শব্দগুলোতেও প্রমাণ রয়েছে।ইমাম রাযী (রহ) বলেন: والانصات سكوت مع الاستماع ‘‘আনসাত হল - سكوت مع الاستماع (মনোযোগের সাথে সাকতা করা বা চুপ থাকা)।’’ [তাফসিরে কাবীর, সূরা ত্ব-হা ২৫-৩৫ নং আয়াত তাফসীর দ্র:]ইমাম জাওহারি (রহ) লিখেছেন: الانصات السكوت والاستماع للحديث ‘‘আনসাত হল, সুকুত (চুপ) হওয়া ও কথাকে মনোযোগসহ শোনা।’’ [আস-সিহাহ ১/২৬৮ পৃ.]এখন সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতটি পড়ুন: وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا لَه وَأَنْصِتُوَا ـ ‘‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সাথে শোনো ও চুপ (আনসাত) থাকো।’’]

বুঝা যাচ্ছে, সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতে উল্লিখিত আনসাত বা চুপ থাকার দাবিসহ মুক্তাদির সূরা ফাতিহা পাঠের পদ্ধতি সাহাবীদের যুগ থেকে প্রমাণিত।

১৬
তাবেঈ যুগে সাকতার আমল
ইমাম বুখারীর ‘জুযউল ক্বিরাআত’ বইটিতে আবূ হুরায়রা (রা)-এর (হা/২৭৫) দুই সাকতার বর্ণনাটির পূর্বে (হা/২৭৪) অনুরূপ মর্মে তাবেঈ আবু সালামাহ (রহ)-এর বক্তব্য রয়েছে। সেটাকেও শায়খ আলবানী তাবেঈর উক্তি হিসেবে হাসান বলেছেন। [ঐ]

আর শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) ‘সহীহ’ বলেছেন। [দ্র: নাসরুল বারী হা/২৭৪]

শায়খ আলবানী (রহ) লিখেছেন:

قال الحافظ : دليل استحباب تطويل هذه السكتة حديث أبي سلمة بن عبد الرحْمن أن للإمام سكتتين

‘‘হাফিয ইবনে হাজার (রহ) বলেছেন: দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকা মুস্তাহাব হওয়ার দলিল হচ্ছে আবূ সালামাহ ইবনু আব্দির রহমানের হাদীসে - ইমামের জন্য দু’টি সাকতা।’’[সিলসিলা যঈফাহ ২য় খণ্ড, হা/৫৪৬]

অপর একজন তাবেঈর বর্ণনা লক্ষ্য করুন, সা‘ঈদ বিন জুবায়ের (রহ) বর্ণনা করেন:

لا بد أن تقرأ بأم القرآن مع الإمام ولكن من مضى كانوا إذا كبر الإمام سكت ساعة لا يقرأ قدر ما يقرؤن أم القرآن

‘‘ইমামের সাথে তুমি অবশ্যই উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়বে। কিন্তু সালাফদের (সাহাবীদের) আমল ছিল, যখন ইমাম তাকবীর বলতেন তখন কিছুক্ষণ সাকতা করতেন এবং কিছু পড়তেন না, যেন মুক্তাদি উম্মুল কুরআন পাঠ করতে পারে।’’

[কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৬৯, ৮৭, জুঝউল ক্বিরাআত পৃ. ৬, ২৯, আব্দুর রাজ্জাক্ব ২/১৩৪,১৩৫ পৃ., শব্দগুলো ‘আব্দুর রাজ্জাকের]

পাকিস্তানি আহলেহাদীস রিজালশাস্ত্রবীদ শায়খ ইরশাদুল হক্ব আসারি (হাফি) বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন। [তাওযিহুল কালাম পৃ. ৫৮১-৫৮২]

অপর একজন পাকিস্তানি আহলেহাদীস রিজালশাস্ত্রবীদ শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) লিখেছেন: এই সনদটি হাসান লিযাতিহি। সাঈদ বিন জুবায়ের (রহ) জলিল ক্বদর তাবেঈ ছিলেন। তিনি সমস্ত সালফে সালেহীন থেকে এভাবেই বর্ণনা করতেন যে, তারা জাহরি সালাতের ক্ষেত্রে ইমামের সাকতাতে (ফাতিহা) পড়ে নিতেন। [নাসরুল বারি ফি তাহক্বীক্বে জুযউল ক্বিরাআত লিলবুখারী হা/২৭৩ - এর তাহক্বীক্ক]

সম্মানিত পাঠক! এরপরেও কি আপনি বলবেন: সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠের উক্ত পদ্ধতিটি সাম্প্রতিক মতামত? যেভাবে লেখক আবূ আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন!? নাকি এটা সুস্পষ্ট হয়, লেখক (আবূ আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক) মুহাদ্দিসগণের ঐকমত্য সিদ্ধান্ত - যার ফলে কুরআন ও সহীহ হাদীস উভয়টির মধ্যে আমল হয়, কোনো দলিলের সাথে কোনোটির বিরোধ থাকে না - সেই পরিপূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করছেন।

১৭
মুহাদ্দিসগণের যুগ থেকে বর্তমান সময়ে
আমরা শুরুতেই জেনেছি, ইমাম আহমাদ (রহ), ইমাম বুখারী (রহ) থেকে ইবনে তাইমিয়া (রহ) এবং বর্তমান জামানার মুহাদ্দিস শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী ও শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) - এঁরা সবাই সূরা ফাতিহা পাঠের আলোচ্য পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছেন ও যা জমহুরের (অধিকাংশ মুহাদ্দিসের) সিদ্ধান্ত হিসেবে ইমাম তিরমিযী ও ইবনে তাইমিয়া (রহ) উল্লেখ করেছেন।

বুঝা যাচ্ছে, উক্ত পদ্ধতি কোনো সাম্প্রতিক পদ্ধতি নয়। বরং মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক এ মাসআলাটিতে কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যকার বিরোধ নিরসনের স্বীকৃত পদ্ধতি।

১৮
সাহাবী সামুরাহ ইবনে জুনদুব (রা)-এর দুই সাকতার বর্ণনা
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৪: (পৃ. ৩-৪)

তাদের মতে সাহাবীগণ (রা) এ ভাবেই জেহেরী সালাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন এবং দলিল হিসেবে তারা যা পেশ করে থাকেন তা নিম্নরূপ:

عن الحسن قال قال سمه حفظ سنتين في الصلاة سكتة إذا كثر الإمام حتى يقرا وسكتة إذا فرغ من فاتحة الكتاب وسورة عند الركوع

(১) সামুরা ইবনে জুনদুব (রা) এর বর্ণনা। তিনি বলেন, সালাতের মধ্যে যে দুই স্থানে চুপ থাকতে হয় তা আমি মনে রেখেছি। প্রথমত ইমাম যখন তাকবীরে তাহরীমা বলে তখন হতে কিরাআত শুরু করা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়ত ইমাম সূরা ফাতিহা ও কিরাআত পাঠ শেষে রুকুতে যাবার পূর্বে....(আবু দাউদ হা/৭৭৭-৭৭৮)

পর্যালোচনা - ৪: শায়খ আলবানী (রহ) রুকু’র পূর্বের সাকতাকে সহীহ বলেছেন। যেমন তিনি (রহ) বলেছেন: ‘‘নবী (স) কিরাআত শেষে একটু বিরাম নিতেন।’’ [আবূ দাউদ, হাকিম - তিনি একে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবি তাতে একমত পোষণ করেছেন। (আল-বানীর ‘নবী (স)-এর সালাত সম্পাদনের পদ্ধতি (ঢাকা: তাওহিদ প্রেস, অক্টো-২০০২) পৃ. ১১৭]

আবার তিনি নিজেই তাঁর তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ও চারটি সুনানে যঈফ বলেছেন। অবশ্য তাঁর তাহক্বীক্ব মিশকাত ও সিলসিলাহ যঈফার বক্তব্য থেকে উভয় সিদ্ধান্তের সমন্বয় করা যায়:

তাহক্বীক্ব মিশকাত থেকে

ثم ان الرواية اضطربوا فى متنه عليه , فبعضهم جعل السكنة الثانية بعد (... ولا الضالين ) كما فى هذه الرواية , وبعضهم جعلها بعد الفراغ من القراءة كلها قبل الركوع . كما فى رواية لأبى داود , وهى الأرجع عندنا , وهو الذى صححه ابن تيمية وابن القيم رحمهما الله تعالى

‘‘তাছাড়া বর্ণনাটির মতনে ইযতিরাব (স্ব-বিরোধিতার আপত্তি) আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সাকতাটি বলা হয়েছে ‘‘... ولا الضالين ’’-এর পর, যেমন আলোচ্য বর্ণনাটি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা হয়েছে সম্পূর্ণ ক্বিরাআত শেষে তথা রুকুর পূর্বে। যেভাবে আবূ দাউদ বর্ণনা করেছেন। আমাদের কাছে এটিই প্রাধান্যপ্রাপ্ত। ইবনে তাইমিয়াহ ও ইবনে ক্বাইয়েম (রহ)-এর নিকট এটি সহীহ।’’ (মিশকাত হা/৮১৮, টীকা: ৪)

সিলসিলাহ যঈফাহ থেকে

তিনি (রহ) লিখেছেন:

فيه أنها قبل الركوع بعد الفراغ من القراءة كلها لا بعد الفراغ من الفاتحة

দ্বিতীয় সাকতার ব্যাপারে সঠিক হচ্ছে এই যে, সেটি হবে রূকুর পূর্বে সকল কিরাআত হতে মুক্ত হওয়ার পর, সূরা ফাতিহার শেষে নয়। [যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ২/পৃ-৯৫]

এছাড়াও তিনি (আলবানী রহ.) উক্ত বইয়ের ৪৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন:ৃ

والذي نراه أقرب إلى الصواب في هذه المسألة مشروعية القراءة وراء الإمام في السرية دون الجهرية ، إلا إن وجد سكتات الإمام

‘‘…আমি যেটি সঠিকের নিকটবর্তী মনে করি সেটি হচ্ছে এই যে, ইমামের পিছনে সির্রী রাকআত গুলোতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা শরীয়তসম্মত, জাহরি রাকাআতগুলোতে নয়। তবে যদি ইমামের পক্ষ থেকে সাকতা পাওয়া যায় (নিশ্চুপ থাকেন) তা হলে পড়া যেতে পারে।...’’ [যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৭]

শেষোক্ত উদ্ধৃতিটির পরবর্তী অংশে শায়খ আলবানী (রহ) আমলটি ওয়াজিব না হওয়ার মতামত দিয়েছেন। যা বাংলা অনুবাদক উল্লেখ করেননি। আমাদের কাছে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। তিনি নিজের স্ববিরোধী গবেষণার জবাব নিজেই দিয়েছেন। তিনি (রহ) নিজের ‘তালখিস সিফাতে সালাতুন নাবিয়্যি’ (বৈরুত: আলমাকতাবুল ইসলামি ১৪০৪/১৯৮৪, পৃ. ১৮)-এ লিখেছেন:

قراءة الْمقتدي لَها : ٥٤- ويُجب على الْمقتدي أن يقرأها وراء الإمام في السرية، وفي الْجهرية أيضا إن لَم يسمع قراءة الإمام، أو سكت هذا بعد فراغه منها سكتة ليتمكن فيها الْمقتدي من قراءتِها، وإن كنا نرى أن هذا السكوت لَم يثبت في السنة

‘‘অনুচ্ছেদ: মুক্তাদীর জন্য ক্বিরাআত: ৫৪ - মুক্তাদীর উপর ওয়াজিব হল, ইমামের পিছনে সির্রি (চুপের) সালাতে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করবে। আর জাহরি সালাতেও অনুরূপ (ক্বিরাআত) করবে - যদি সে ইমামের ক্বিরাআত শুনতে না পায়। কিংবা সাকতাতে (পড়বে), যখন ইমাম তার ক্বিরাআত থেকে ফারেগ (অবসর) হয়ে সাকতা করেন - যেন মুক্তাদী সেখানে তার ক্বিরআত করতে পারে। যদিও আমি পূর্বে বুঝেছিলাম এই সাকতা সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়।’’ [. বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইটির অনুবাদে চরম ভুল করা হয়েছে। সেখানে وإن كنا نرى أن هذا السكوت لَم يثبت في السنة অংশটির অনুবাদ করা হয়েছে: ‘‘যদিও আমরা এরূপ চুপ থাকার প্রমাণ হাদীসে পায় না।’’ [সংক্ষিপ্ত: রসূলুল্লাহ (স)-এর সালাতের নিয়মাবলী, মূল: নাসিরুদ্দীন আলবানী, (ঢাকা: হুসাইন আল-মাদানী প্রকাশনী) পৃ. ৩৪] অনুবাদটিতে চিহ্নিত শব্দগুলোর অনুবাদ করা হয়নি। যার তরজমা হবে: ‘(পুর্বে) আমাদের দৃষ্টিতে ছিল’। বাক্যটির পূর্ণাঙ্গ ভাবানুবাদ হবে: ‘‘যদিও আমি পূর্বে বুঝেছিলাম এই সাকতা সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়।’’]

শেষোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝা যায়, রুকু‘র পূর্বের সাকতাকে শায়খ আলবানী (রহ) কর্তৃক তাঁর ‘সিফাতে সালাতে’ সহীহ হিসেবে কেন উল্লেখ করেছেন।

১৯
সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা)-এর হাদীস
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৫: (পৃ.৪)

قد ذكر البيهقي في أقاويل الصحابة بإسناده عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده أنهم كانوا يقرؤن خلف رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا أنصت ، فإذا قرأ لم يقرءوا وإذا أنصت قرؤوا وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : كل صلاة لا يقرأ فيها بأم القرآن فهي خداج .

(২) আবু আব্দুল্লাহ আল... আবূ মূ’আবিয়াহ, ইবনু উমার, আমর ইবনু শু’আয়িব নিজের পিতা থেকে তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তারা অর্থাৎ সাহাবীগণ (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে তখন কিরাআত করতেন যখন তিনি চুপ থাকতেন। আর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিরাআত করতেন তখন তারা কিছুই পড়তেন না। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থাকতেন তখন তারা কিরাআত করতেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন (এমন) সকল সালাত যার মধ্যে সূরা ফাতিহা পড়া হয় না তা অসম্পূর্ণ।” (বায়হাকী কিতাবুল কিরাআত)

তদনুযায়ী তারা ও তাদের শুভানুধ্যায়ীগণ আমল শুরু করে দিয়েছে এবং এর স্বপক্ষে প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে। ফলশ্রুতিতে মুসলিম সমাজে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। 

পর্যালোচনা - ৫: মূলত ‘পর্যালোচনা-৩’-এ উল্লিখিত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদীসটিকে মূল ধরে এই হাদীসটিকে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মূল হাদীসটি দ্বারা সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠের যাঁরা দলিল নিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন:

ক) ইমাম বায়হাক্বী তাঁর ‘কিতাবুল ক্বিরাআতে’।

খ) পাকিস্তানী আহলেহাদীস রিজালশাস্ত্রবীদ শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) তাঁর ‘মাসআলাহ ফাতিহা খলফাল ইমাম’ (পৃ. ৬৭)-এ হাদীসটি উল্লেখ করে সমস্ত বর্ণনাকারীদেরকে সিক্বাহ তথা হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

গ) পাকিস্তানের অপর রিজালশাস্ত্রবীদ শায়খ ইরশাদুল হক্ব আসারি (হাফি) তাঁর ১০৩২ পৃষ্ঠার কিতাব ‘তাওযিহুল কালাম ফি উজুবিল ক্বিরাআত খলফাল ইমাম’-এর ৫৭৩-৯৬ পৃষ্ঠাতে। তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। তা ছাড়া হাদীসটির ব্যাপারে আপত্তির জবাবগুলোও সুন্দরভাবে খণ্ডন করেছেন।

ঘ) অপর একজন মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া গোন্ধালাভি (রহ) তাঁর ‘খয়রুল কালাম ফি উজুবিল ফাতিহাহ খলফাল ইমাম’-এ (পৃ. ৮৮-৯১)। তিনি হাদীসটির উপর হানাফিদের অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। (পৃ. ৮৮)।

বুঝা যাচ্ছে, উক্ত হাদীসগুলোকে সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠের সমর্থনে দলিল উপস্থাপন ‘আহলেহাদীস’ মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক স্বীকৃত। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে আহলেহাদীসদের যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ার অধ্যক্ষের অভিমতসহ আলোচ্য পুস্তিকাটির লেখক মাসআলাটির প্রতি আমলকারীদের প্রতি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন (পৃ. ৩): ‘‘অতি সম্প্রতি সুন্নাতে নববীর অনুসারী আলেমগণের মধ্যে অধিকতর হকপন্থী দাবিদার ...।’’

প্রকৃতপক্ষে মাসআলাটির সাথে কুরআন, সহীহ হাদীস, সাহাবীদের আমল ও উক্তি, তাবেঈদের উক্তি ও আমল এবং ইমাম বুখারী (রহ), ইমাম বায়হাক্বী (রহ)-সহ জুমহুর মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত জড়িত। যাকে পুস্তিকাটির লেখক মুসলিম সমাজে সৃষ্ট বিতর্ক বলে উল্লেখ করেছেন।

২০
মতপার্থক্য নিরসণে নীতিমালা
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৬: (পৃ. ৪)

যেহেতু শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী এ বিতর্কের অবসান হওয়া অত্যন্ত জরুরি, সেহেতু আমার মতে এ বিতর্ক অবসানকল্পে প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন এবং সাহাবীগণ (রা) যা করেছেন তা অনুধাবন করা । 

পর্যালোচনা - ৬: মতপার্থক্য নিরসণে আমাদের আক্বীদা নিম্নরূপ:

ক) কুরআন ও সহীহ হাদীস পরস্পরের বিরোধী নয়: কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:

اَفَلاَ يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْانَ ط وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوْا فِيْه اخْتِلاَفًا كَثِيْرًا

‘‘তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে নাযিল হত, তাহলে অবশ্যই এতে বৈপরীত্য (ইখতিলাফ) দেখতে পেতো।’’ [সূরা নিসা, ৮২ আয়াত]

খ) কিতাবের কিছু অংশ মানা ও কিছু অংশ না মানা কুফর: এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন:

أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ  

‘‘তোমরা কি কিতাবে কিছু অংশ বিশ্বাস করো আর কিছু অংশের প্রতি কুফরি করো।’’ [সূরা বাক্বারাহ: ৮৫ আয়াত]

গ) মতপার্থক্য নিরসণে আয়াত ও হাদীসকে পারস্পরিক বিরোধ দুর করা জরুরি। সমাধানকল্পে বিজ্ঞদের স্মরণাপন্ন হতে হবে। এ মর্মে নিচের হাদীসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

‘আমর ইবনে শুআয়িব তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন:

سَمِعَ النَّبِيُّ قَوْمًا يَّتَدَارَؤُنَ فِي الْقُرْانِ فَقَالَ اِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِهذَا ضَرَبُوْا كِتَابَ اللهِ بَعْضَه بِبَعْضٍ وَّ انَّمَا نَزَلَ كِتَابُ اللهِ يُصَدِّقُ بَعْضُه بَعْضًا فَلاَ تُكَذِّبُوْا بَعْضَه بِبَعْضٍ فَمَا عَلِمْتُمْ مِّنْهُ فَقُوْلُوْا وَمَا جَهِلْتُمْ فَكِلُوْهُ اِلي عَالِمِه

‘‘নবী (স) একদল লোককে কুরআনের বিষয়ে বিতর্ক করতে শুনলেন। তখন তিনি বললেন: তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা এ কারণেই হালাক (ধ্বংস) হয়েছে। তারা আল্লাহর কিতাবের একঅংশকে অপরঅংশ দ্বারা বাতিল করার চেষ্টা করেছিল। অথচ কিতাবুল্লাহ নাযিল হয়েছে এর একঅংশ অপরঅংশের সমর্থক হিসাবে। সুতরাং তোমরা এর একঅংশকে অপরঅংশ দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবে না। বরং যা তোমরা জান কেবল তা-ই বলবে। আর যা জান না তা যে জানে তার কাছে সোপর্দ করবে।’’ [. হাসান: আহমাদ, মিশকাত [ঢাকা: এমদাদিয়া লাইব্রেরী] ২য় খণ্ড হা/২২১। নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন- আলবানীর তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ১/২৩৮ পৃ.।]

গ) ইলমের অধিকারী মু’মিনদের মতপার্থক্য নিরসণে জমহুরের (সংখ্যাধিক্যের) সাক্ষ্য প্রাধান্যপ্রাপ্ত। কমসংখ্যক তথা দুর্বল সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রত্যাখ্যাত। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهَدى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نَوَلِّه مَا تَوَلّى وَنُصْلِه جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا

‘‘আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কত মন্দ আবাস।’’[সূরা নিসা: ১১৫ আয়াত]

আল্লাহ তাআলা বলেন: اِلاَّ مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ ‘‘তবে তারা ছাড়া যারা ‘ইলমের ভিত্তিতে সত্যের সাক্ষ্য দেয়।’’ [সূরা যুখরুফ: ৮৬ আয়াত]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: وَاتَّبِعْ سَبِيْلاَ مَنْ اَنَابَ اِلَىَّ ‘‘যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অনুসরণ কর।’’ [সূরা লুকমান: ১৫ আয়াত]

তিনি অন্যত্র বলেন:

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ

‘‘বলুন! যারা জানে, আর যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তাভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।’’ [সূরা যুমার: ৯]

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন: هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ‘‘বলুন! অন্ধ ও চুক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা করবে না।’’ [সূরা আনয়াম: ৫০]

২১
কেনো জুমহুর মুহাদ্দিসগণের সাক্ষ্য প্রাধান্যপ্রাপ্ত?
মতপার্থক্য নিরসণে অন্যতম উদাহরণ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম। তাঁরা উভয়েই ঐসব হাদীস সঙ্কলন করেছেন যেসবগুলোর ব্যাপারে অধিকাংশ বা জুমহুর মুহাদ্দিসগণের ঐকমত্য ছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস (রহ) বলেছেন:

أما الصحيحان فقد اتفق المحدثون على أن جميع ما فيهما من المتصل المرفوع صحيح بالقطع وأنهما متواتران إلى مصنفيهما، وأن كل من يهون أمرهما فهو مبتدع متبع غير سبيل المؤمنين

‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সম্পর্কে সমস্ত মুহাদ্দিসের ইজমা হয়েছে যে, এ দু’টির সমস্ত মুত্তাসিল ও মারফু‘ হাদীস নিশ্চিত সহীহ। যা এ দু’টি কিতাবের লেখক পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পৌঁছেছে। যে এ দু’টিকে তুচ্ছ-সাধারণভাবে নেয় সে বিদআতি ও মু’মিনদের বিরোধী পথের অনুসারী।’’ [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৩৪ (আরবি), ২/১২৬ (ঢাকা: রশিদ বুক হাউদ, ডিসেম্বর ২০১২)]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) লিখেছেন:

لم يقلد أئمة الحديث فيه البخاري و مسلما بل جمهور ما صححاه كان قبلهما عند أئمة الحديث صحيحا متلقي بالقبول و كذلك في عصرهما و كذلك بعدهما

‘‘হাদীসের ইমামগণ এক্ষেত্রে বুখারী ও মুসলিমের তাক্বলীদ করেননি। বরং তাঁরা দু’জন যে সমস্ত হাদীসগুলোকে সহীহ গণ্য করেছেন, সেগুলির অধিকাংশই তাঁদের পূর্বের ইমামগণের নিকট সহীহ ও আমলযোগ্য ছিল। একই অবস্থা তাদের দু’জনের যুগে এবং তাঁদের পরবর্তী যুগেও ছিল।’’ [মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/৫৯ পৃ.]

বুঝা যাচ্ছে, হাদীস সহীহ-যঈফ নির্ণয় ও মাসআলা ইস্তিম্বাতের ক্ষেত্রে জুমহুর মুহাদ্দিসের সাক্ষ্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য। অল্প সংখ্যকের সাক্ষ্য দুর্বল বিধায় পরিত্যাজ্য।

আমাদের আলোচ্য মাসআলাটিও অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে স্বল্প সংখ্যক মুহাদ্দিস এর দুর্বল সমালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আহলেহাদীসদের অবস্থান জুমহুর মুহাদ্দিসগণের বিপরীত।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৭: (পৃ. ৫)

জেহেরী সালাতে রুকুর পূর্বের সাকতায় মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ সংক্রান্ত সৃষ্ট বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে; সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতের নির্দেশনা ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকস্বরূপ কি না?, সালাতে ইমামের সাকতা ও সে সময়ে করণীয় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণ কর্তৃক ইমামের পিছনে পাঠ সংক্রান্ত নির্দেশনাসমূহ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো। 

পর্যালোচনা - ৭: আমরা নিচে লেখকের পরবর্তী বিশ্লেষণের সাথে রসূলুল্লাহ (স), সাহাবী (রা) ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের বিশ্লেষণের একটি তুলনামূলক পার্থক্য উপস্থাপন করবো। যা থেকে লেখকের বুঝের সাথে কুরআন, সহীহ হাদীস, সাহাবী (রা) ইলমের ধারক-বাহকদের (রহ) বুঝের পার্থক্য সুস্পষ্ট হবে, ইনঁশাআল্লাহ।

২২
আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা এবং ‘আম ও খাস নীতিমালা সম্পর্কে অজ্ঞতা
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক:

প্রসঙ্গ: সূরা আ'রাফের ২০৪ নং আয়াত

কুরআন পাঠের সময় তা মনোযোগ দিয়ে শোনার নির্দেশ দিয়ে সূরা আ'রাফের ২০৪ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا “যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর ও চুপ থাক” । আল্লাহ তাআলার এই নির্দেশটি “আম”। উক্ত নির্দেশটি সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য।

লক্ষণীয়: লেখকের দাবি আয়াতটি ‘আম। অর্থাৎ আয়াতটি সালাতে ও এর বাইরে উভয় অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে হাদীস দ্বারা আয়াতের হুকুমটি সালাতের জন্য খাসভাবেও প্রযোজ্য। যেমন-

২৩
রসূলুল্লাহ (স) থেকে সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতে উল্লিখিত ‘আনসাতের’ ব্যাখ্যা
রসূলূল্লাহ (স) বলেছেন:

إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا وَإِذَا قَالَ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ وَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوا

‘‘অনুসরণ করার জন্যই তো ইমাম নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং যখন তিনি তাকবীর বলেন, তখন তোমরা তাকবীর বলবে। আর যখন তিনি ক্বিরাআত পাঠ করবেন তখন তোমরা চুপ (আনসাত) থাকবে। আর যখন তিনি বলবেন: غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ তখন তোমরা বলবে: ‘‘আমীন’’। আর যখন তিনি রুকু করেন, তখন তোমরা রুকু করবে।.....’’ [শায়খ আলবানী হাদীসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন (তাহক্বীক্ব ইবনে মাজাহ হা/৮৪৬); শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) বলেছেন: হাদীসটি সহীহ। হাদীসটি আবু দাউদ (হা/৬০৪) বর্ণনা করেছেন। যা আবু খালিদের হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম মুসলিম (রহ) এটিকে সহীহ বলেছেন। এই হাদীসটি দ্বারা ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ বর্জনের দলিল হয় না। (তাহক্বীক্বকৃত উর্দু আবু দাউদ হা/৮৪৬)]

হাদীসটি সুস্পষ্ট করে, খাসভাবে সূরা ফাতিহা পাঠের সময় মুক্তাদিকে চুপ থাকতে হবে। কেননা তাকবীরে তাহরীমার পর ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ করেন। আর হাদীসটিতে তখনই চুপ থাকতে বলা হয়েছে।

ইমাম নাসাঈ নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদের অধীনে উপরে বর্ণিত হাদীসটি এনেছেন:

تأويل قوله عز و جل : وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا لَه وَأَنْصِتُوَا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

‘‘আল্লাহ তাআলা’র বাণী: ‘‘যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং চুপ (আনসাত) থাকবে। আশা করা যায়, তাতে তোমরা রহমপ্রাপ্ত হবে’’ -(সূরা আ‘রাফ-২০৪) আয়াতের ব্যাখ্যা।’’

বুঝা যাচ্ছে, ইমাম নাসাঈ (রহ)-এর নিকট হাদীসটি সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের তাফসির। কেননা আয়াতের ন্যায় হাদীসেও আনসাত বা চুপ থাকার নির্দেশ রয়েছে।

২৪
সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা) ও সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতটির ইসতিমা‘ (মনোযোগের সাথে শোনা)-এর ব্যাখ্যা
ইমাম বায়হাক্বী (রহ) বর্ণনা করেছেন. ইবনে ‘আব্বাস (রা) বলেন:

عن ابن عباس رضي الله عنه قال : الْمؤمن في سعة من الاستماع إليه إلا في صلاة مفروضة أو المكتوبة أو يوم جمعة أو يوم فطر أو يوم أضحى يعني ( وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا (

‘‘অর্থাৎ আল্লাহর বাণী: (যখন কুরআন পড়া হয় তখন মনোযোগের সাথে শোন ও চুপ থাকো) - এর দাবি ইসতিমা‘ (মনোযোগের সাথে শোনা) মানতে মু’মিনের অবকাশ আছে (ইচ্ছাধীন), কিন্তু (জাহরি সালাত যেমন -) ফরয সালাত, জুমু‘আর সালাত, ‘ঈদুল ফিতর বা ‘ঈদুল আযহার সালাত ছাড়া (অর্থাৎ জাহরি সালাতে শোনার হুকুমটি বাধ্যতামূলক)।’’ [কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ১০৭, হা/২৫৩; যুবায়ের আলী যাঈ এই বর্ণনাটিকে হাসান বলেছেন (নাসরুল বারী ফি তাহক্বীক্বে জুযউল ক্বিরাআত পৃ. ৬৬, হা/১৮-এর ব্যাখ্যা)]

সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা)-এর নিকট আয়াতটির দাবি সরবে পাঠ করা হয় - এমন সালাতের ক্ষেত্রে উক্ত হুকুমটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সালাতের বাইরের মু’মিনের জন্য অবকাশ আছে - সে নাও শুনতে পারে। যা আমাদের লেখকের বুঝের ঠিক বিপরীত।

২৫
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) ও সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াতটির ‘আনসাত’ শব্দের প্রয়োগ
ইমাম বুখারী (রহ) বর্ণনা করেছেন:

وقال أبو وائل عن ابن مسعود ، ্র أنصت للإمام .

আবূ ওয়ায়েল বর্ণনা করেছেন, সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন: أنصت للإمام ‘‘ইমামের (তিলাওয়াত শোনার) জন্য তোমরা চুপ (আনসিত) থাকো।’’ [হাদীসটি সহীহ - তাহক্বীক্ব জুযউল ক্বিরাআত (তাওহিদ পাবলিকেশন্স) হা/২৮]

শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) বলেন: এই আসারটি

أنصت للقرآن ( كما أمرت ) ؛ فإن في القراءة لشغلا وسيكفيك ذلك الإمام

‘‘কুরআনের জন্যে চুপ (উনসাত) থাকো [যেভাবে তোমাদেরকে (কুরআনে) নির্দেশ দেয়া হয়েছে], কেননা অবশ্যই ক্বিরাআতের জন্য জরুরি হল মনোযোগী হওয়া। আর ঐ ইমামই তোমার জন্যে যথেষ্ট হবে’’ - বাক্যে বায়হাক্বীর সূনানুল কুবরাতে (২/১৬০, কিতাবুল ক্বিরাআত হা/২২৫) বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাতে (১/৩২৭ হা/৩৭৮০) বর্ণিত হয়েছে। এর সনদটি সহীহ। এই আসারটি জাহরি সালাতে সূরা ফাতিহার সাথে সম্পৃক্ত।’’ [নাসরুল বারি ফি তাহক্বিকে জুযউল ক্বিরাআত লিলবুখারী হা/২৮-এর ব্যাখ্যা দ্র:। كما أمرت শব্দটি বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআতে (হা/২২৫, অন্য সংস্করণ: হা/২২৪) আছে। যা শায়খ উল্লেখ করেননি। ইমাম আব্দুল বার (রহ) বলেন: أنصت للقرآن يدل على أن ذلك في الجهر دون السر ‘‘কুরআনে জন্য চুপ থাকো - এই দলিলটি জাহরি সালাতের জন্য সির্রি সালাতের জন্য নয়।’’ (আত-তামহিদ হা/১৬৭৭)]

বুঝা যাচ্ছে, সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা)-এর বক্তব্যটি সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতটিরই ব্যাখ্যা।

২৬
ইমাম শাফেঈ (রহ) ও সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত
ইমাম মুনযিরি (রহ) বর্ণনা করেন:

وَقَدْ كَانَ الشَّافِعِيُّ إِذْ هُوَ بِالْعِرَاقِ يَقُولُ : وَمَنْ كَانَ خَلْفَ الْإِمَامِ فِيمَا يَجْهَرُ فِيهِ الْإِمَامُ بِالْقِرَاءَةِ فَإِنَّ اللهَ عز وجل يَقُولُ :  وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا  [ الأعراف : ٢٠٤ ] ، فَهَذَا عِنْدَنَا عَلَى الْقِرَاءَةِ الَّتِي يَسْمَعُ خَاصَّةً، فَكَيْفَ يُنْصِتُ لِمَا لَا يَسْمَعُ؟ .

‘‘যখন ইমাম শাফেঈ ইরাক্বে ছিলেন তখন (ইরাক্বীদের/হানাফীদের জবাবে) বলতেন: যে ইমামের পিছনে আছে আর ইমাম তাতে জাহরি ক্বিরাআত করেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখন কুরআন পড়া হয় তখন মনোযোগের সাথে শোনো ও চুপ থাকো।’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪) আমাদের নিকট ক্বিরাআত শোনার বিষয়টি এখানে খাস (সুনির্দিষ্ট)। তা হলে যখন সে (কুরআন তিলাওয়াত) শুনতে পায় না, তখন কিভাবে চুপ থাকবে ?’’ [আল-আওসাত লিলমুনযিরি (শামেলা) ৩/২৬১। অথচ আমাদের এই পর্যালোচনাকৃত পুস্তিকাটির লেখক আবূ আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাকের কাছে আয়াতটির দাবি ‘আম।]

২৭
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ) ও সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের পুত্র আব্দুল্লাহ (রহ) লিখেছেন:

٢٥٤ - حَدثنَا قَالَ قلت لابي فاقرأ فِي نَفسِي الْحَمد قَالَ لَا وَقَالَ : وَإِذا قرئَ الْقُرْآن فَاسْتَمعُوا لَهُ وأنصتوا .

‘‘২৫৪ - আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করে বলেছেন: আমি (আব্দুল্লাহ) আমার আব্বাকে (আহমাদ বিন হাম্বল রহ.)-কে বললাম: মনে মনে কি ‘আল-হামদু পড়ব? তিনি বললেন: না, কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখন কুরআন পড়া হয়, তখন মনোযোগের সাথে শোনো ও চুপ থাকো’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪)’’। [মাসায়েলে ইমাম আহমাদ লি ইবনিহি আব্দুল্লাহ’ (বৈরুত: মাকতাবাহ ইসলামি, ১৪০১/১৯৮১)পৃ. ৭১, নং: ২৫৪]

২৮
ইমাম ইবনে কাসির (রহ) ও সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত
ইমাম ইবনে কাসির (রহ) আয়াতটির তাফসিরে লিখেছেন:

لَما ذكر تعالى أن القرآن بصائر للناس وهدى ورحمة، أمر تعالى بالإنصات عند تلاوته إعظامًا له واحترامًا، لا كما كان يعتمده كفار قريش الْمشركون في قولِهم : لا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ [ فصلت : ٢٦ ] ولكن يتأكد ذلك في الصلاة الْمكتوبة إذا جهر الإمام بالقراءة كما ورد الْحديث الذي رواه مسلم فِي صحيحه، من حديث أبِي موسى الأشعري رضي الله عنه قال : قال رسول الله ﷺ: " إنّما جعل الإمام لِيُؤْتَمَّ به، فإذا كبر فكبّروا، وإذا قرأ فأنصتوا "

‘‘যখন আল্লাহ জানালেন, নিশ্চয় কুরআন মানুষের জন্য উপদেশ, হিদায়েত ও রহমত। তখন আল্লাহ তাআলা-ও নির্দেশ দিলেন যে, কুরআন তিলাওয়াতের সময় এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার জন্য আনসাত (চুপ) কর।। এরকম হওয়া উচিৎ নয় যেভাবে কুফফারে কুরাইশগণ বলত: ‘‘এই কুরআন শুনবে না এবং পাঠের সময় গোলযোগ সৃষ্টি কর (তাহলে তোমরা বিজয়ী হবে)।’’ [. সূরা হামীম আস-সাজদাহ: ২৬ আয়াত। এটি মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। পক্ষান্তরে মু’মিনদের প্রতি নির্দেশ হল: ‘‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন মনোযোগের সাথে শোনো এবং চুপ থাকো। যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়।’’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪) সুতরাং মুসলিমদের দায়িত্ব হবে কাফেরদের গোলযোগ করার বিপরীত তথা চুপ থাকা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সহীহ হাদীসের অনুসারী দাবিদার বন্ধুরা কাফেরদের আমলটির ন্যায় চুপচাপ থাকতে নারাজ। যা ইমাম কর্তৃক মুক্তাদিকে ক্বিরাআত শোনানোর দাবিকে অর্থহীন করে।] বরং এই তাক্বিদ বা জোর দেয়া হয়েছে যখন ফরয সালাতে ইমাম জাহরি ক্বিরাআত তিলাওয়াত করেন। যেভাবে ইমাম মুসলিম তাঁর ‘সহীহ মুসলিমে’ আবূ মূসা আশ‘আরি (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূলূল্লাহ (স) বলেছেন: ‘‘অনুসরণের জন্যেই ইমাম নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং যখন তিনি তাকবীর বলেন তখন তাকবীর বল। আর যখন তিনি ক্বিরাআত পড়েন তখন চুপ থাকো।’’ [তাফসিরে ইবনে কাসির, আলোচ্য আয়াতের তাফসির দ্র:] [. বাংলাদেশে তাফসিরে ইবনে কাসিরের ‘সংশোধিত সংস্করণে’ ইমাম ইবনে কাসিরের (রহ) উক্ত বক্তব্য ও সহীহ মুসলিমের হাদীসটি বাদ দিয়ে নিম্নোক্ত যঈফ বর্ণনাকে রেখে দেয়া হয়েছে:ইবনে মাসউদ (রা) বলেন: আমরা সালাতের মধ্যে একে অপরকে سلام عليك বলতাম। এ জন্যে এ আয়াত অবর্তীণ হয়। [তাফসিরে ইবনে কাসির, তথ্য ও উপাত্ত সংযোজন: ইউসুফ ইয়াসিন, ৮-১১ খণ্ড-র পৃ. ৫০২]বর্ণনাটি সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার (রহ) বলেন: এর সনদ মুনক্বাতে। [ফতহুল বারী ৬/৩৬৪]মুহাক্কিক্ব আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (রহ) লিখেছেন: এর সনদ মুনক্বাতে‘। [উমদাতুত তাফসির ২/৯৩]সহীহ হাদীস ছেড়ে যঈফ হাদীসের প্রতি এ ঝোঁক-প্রবণতা কেন?। আল্লাহ এহেন ষড়যন্ত্র থেকে আমাদেরকে হেফাযত করুন, আমিন।]

বুঝা যাচ্ছে, আয়াতটি ফরয সালাতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যা নবী (স), সাহাবী (রা) ও ইমামগণ থেকে প্রমাণিত। যা পুস্তিকাটির লেখকের দাবির বিরোধী।

২৯
সূরা মুযযাম্মিলের আয়াতগুলোর সম্মিলিত দাবি সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের অনুরূপ
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৮: (পৃ. ৫)

অন্যদিকে সালাতে কুরআন পাঠের নির্দেশ সম্বলিত আয়াতে বলা হয়েছে: قاروا ما تيسر من القراني “অতঃপর তোমরা পড় কুরআন থেকে যা সহজ মনে কর”। (সূরা মুয্যাম্মিল-২০) আল্লাহ তাআলার উক্ত নির্দেশটি সালাতের জন্য “খাস”। উক্ত নির্দেশ অনুযায়ী সকলের জন্য সকল প্রকার সালাতে প্রতি রাকাআতে কুরআন পাঠ ফরয।

পর্যালোচনা - ৮: বুঝা গেলো, পুস্তিকাটির লেখকের নিকট সূরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াতটি সালাতে কুরআন পাঠের খাস নির্দেশ। পক্ষান্তরে সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতটি সালাতের জন্য খাস বা সুনির্দিষ্ট নয়। যা তার দলিলবিহীন উপস্থাপনা। পূর্বে প্রমাণিত হয়েছে, খাস না মানার দাবিটি নবী (স), সাহাবী (রা) ও ইমামদের ব্যাখ্যার বিরোধী। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-২’]

প্রকৃতপক্ষে সূরা মুযযাম্মিলের আয়াতটির দাবি হলো, কুরআন থেকে অতটুকু পাঠ করা, যতটা তিলাওয়াতকারী ও শ্রোতা উভয়ের জন্য কষ্টকর না হয়। কেননা, দীর্ঘসময় তিলাওয়াত শ্রবণ করা সবার পক্ষে সহজ নয়। এই তাফসির আয়াতটির পরবর্তী অংশে রয়েছে। যা নিম্নরূপ:

فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ   ۚ عَلِمَ أَن سَيَكُونُ مِنكُم مَّرْضَىٰ   ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ   ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ   ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ

‘‘কাজেই কুরআনের যতুটুকু তোমাদের জন্য সহজ ততটুকু পাঠ করো। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। কাজেই তোমরা কুরআন হতে যতটুকু সহজসাধ্য ততটুকু পড়।’’ [সূরা মুযযাম্মিল: ২০]

আয়াতটি শুরুর অংশসহ পড়লে আরও জানা যায়, উক্ত হুকুমটি বিশেষভাবে রাতের বিভিন্ন অংশে (তাহাজ্জুদ সালাতে) দীর্ঘ ক্বিরাআত, সালাতের আদব ও সহজীকরণ প্রসঙ্গে নির্দেশনা। আবার সূরাটির শুরুতে তাহাজ্জুদ সালাতে তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে: [সূরা মুযযাম্মিল: ৬]

إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا

‘‘নিশ্চয় রাতে ওঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল।’’

সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা) বলেন:

وِطَاءً قَالَ مُوَاطَأَةَ الْقُرْآنِ أَشَدُّ مُوَافَقَةً لِسَمْعِهِ وَبَصَرِهِ وَقَلْبِهِ

‘‘ وَطْئًا শব্দের অর্থ হলো - কুরআনের অনুকূল। অর্থাৎ তার কান, চোখ এবং হৃদয়ের অধিক অনুকূল এবং তা কুরআনের মর্ম অনুধাবনে অধিকতর উপযোগী।’’ [সহীহ বুখারী - তাহজ্জুদের বিবরণ بَاب قِيَامِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِاللَّيْلِ وَنَوْمِهِ وَمَا نُسِخَ مِنْ قِيَامِ اللَّيْلِ ; হা/১১৪১ নং-এর পূর্বের অনুচ্ছেদ]

অন্যত্র ইবনে আব্বাস (রা) সূরা মুযযামিলের ৬ নং আয়াতটির শেষাংশ وَأَقْوَمُ قِيلًا সম্পর্কে বলেন: هُوَ أَجْدَرُ أَنْ يُفْقَهَ فِى الْقُرْآنِ ‘‘গভীর চিন্তা-ভাবনা ও মনোনিবেশসহ কুরআন পাঠের জন্য এটা অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত সময়।’’ [আবু দাউদ হা/১৩০৪ ; শায়খ আলবানী ও যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) তাঁদের স্ব স্ব তাহক্বীকে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।]

সম্মানিত পাঠক! এখন পুনরায় সূরা মুযযাম্মিলের ১ নং থেকে ৫ নং আয়াতগুলো তরজমাসহ পড়ুন। এ পর্যায়ে ২০ নং আয়াতটির তাফসির সুস্পষ্ট হবে যে, আয়াতটির সাথে সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের দাবি ‘কুরআন পাঠের সময় চুপ থেকে মনোযোগের সাথে শোনার’ কোনো বিরোধ নেই। আয়াতগুলোর দাবি ও দাওয়াত একই। অর্থাৎ সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত ও সূরা মুযযাম্মিলের আয়াতগুলো পরস্পরের ব্যাখ্যা।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৯: (পৃ. ৫)

এ অবস্থায় “কুরআন পাঠের সময় মনোযোগ দিয়ে শোনা ও চুপ থাকার” নির্দেশটি ইমামের পিছনের মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক স্বরূপ কি না তা বুঝতে হবে “ওহীয়ে গায়ের মাতলু” অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসের আলোকে। কেননা কুরআন নাযিল হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর। তিনিই কুরআনের ব্যাখ্যাকারী। (সূরা নাহল-৪৪)

পর্যালোচনা - ৯: আমরা এ সম্পর্কিত আয়াতগুলোর তাফসির সম্পর্কে একই ধরনের শব্দ ও বাক্য সম্বলিত হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছি, নবী (স), সাহাবী (রা) এবং ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ আলোচ্য আয়াত ও হাদীসের কী দাবি বুঝেছিলেন। যেমন - কুরআন বলা হয়েছে: فاستمعوا له وأنصتوا ‘‘মনোযোগের সাথে শোনে ও চুপ থাকো’’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪)। তেমনি সহীহ হাদীসে নবী (স) মুক্তাদিকে খাসভাবে বলেছেন: وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا ‘‘যখন ইমাম পাঠ করেন, তখন চুপ থাকো।’’ [বিস্তারিত কিছুপূর্বে গত হয়েছে।]

কিন্তু লেখকের উপস্থাপিত পরবর্তী একটি হাদীসেও এই ‘আনসাত বা চুপ থাকার’ কোনো বর্ণনা বা ব্যাখ্যা নেই। বরং বাহ্যিক দৃষ্টিতে বুঝা যায় বিরোধিতা আছে। এখন আমরা লেখকের দলিলগুলোর তুলামূলক পর্যালোচনা উপস্থাপন করব, ইনঁশাআল্লাহ:

আবু আব্দুল্লাহ আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থাপিত দলিল (পৃ. ৬):

সালাতে ইমামের উচ্চস্বরে কুরআন পাঠ অবস্থায় মুক্তাদির করণীয় সম্পর্কে আনাস (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন:

عن أنس بن مالك : أنَّ النَّبيَّ صلَّى بأصحابِه فلمَّا قضى صلاتَه أقبَل عليهم بوجهِه فقال :( أتقرَؤونَ   في   صلاتِكم خَلْفَ الإمامِ والإمامُ يقرَأُ ؟ ) فسكَتوا فقالها ثلاثَ مرَّاتٍ فقال قائلٌ أو قائِلونَ : إنَّا لَنفعَلُ قال : ( فلا تفعَلوا ولْيقرَأْ   أحَدُكم   بفاتحةِالكِتابِ   في   نفسِه  )

‘‘তোমরা কি ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় কিছু পাঠ করে থাকো। বরং কেবলমাত্র সূরা ফাতিহা চুপে চুপে পড়বে... (সংক্ষেপিত অনুবাদ)। (সহীহ ইবনে হিব্বান হা/১৮৪৪, বুখারী জুযউল ক্বিরআত হা/২৫৫)

ইমামের উচ্চস্বরে কিরআত পাঠ অবস্থায় মুক্তাদিকে চুপে চুপে কেবল সূরা ফাতিহা পাঠের অনুমতি সংক্রান্ত রসূলুল্লাহ (স)-এর উক্ত নির্দেশ নিঃসন্দেহে ওহী দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট তাঁর নিজের থেকে নয়। (সূরা নজম: ৩-৪)

পর্যালোচনা: পূর্বোক্ত আরবি উদ্ধৃতির দাগানো অংশগুলোর অনুবাদ হলো: নবী (স) প্রশ্ন করেছিলেন:

‘‘তোমরা তোমাদের সালাতে ইমামের পিছনে পাঠ করো কি, আর ইমামও তখন পড়েন?... এমনটি কোরো না। তোমাদের কেউ ফাতিহাতুল কিতাব মনে মনে পড়বে।’’

বুঝা যাচ্ছে, ইমামের সাথে সাথে ক্বিরাআত করা যাবে না। অথচ লেখক তার বিপরীত বুঝেছেন। এখানে ফাতিহা মনে মনে পড়া ও ফাতিহা ক্বিরাআত করার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে।

৩০
নিজের ভুল বুঝকে আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য করা
পুস্তিকাটির লেখকের (আবূ আব্দুল্লাহ আব্দুর রাজ্জক্বের) করা হাদীসের তরজমাটি ভুল এবং তাঁর বুঝ সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের বিরোধী। তিনি ঐ ভুল বুঝকে সূরা নজমের ৩ ও ৪ নং আয়াত দ্বারা নবী (স)-এর ব্যাখ্যা তথা ওহি হিসেবে দাবি করেছেন। যা অপব্যাখ্যা মাত্র। কেননা আয়াতটির দাবি হলো, কুরআন পাঠের সময় চুপ থাকতে হবে ও মনোযোগী হতে হবে। তেমনি হাদীস দু’টির দাবিও ইমামের সাথে সাথে ক্বিরাআত পাঠ করা যাবে না। অর্থাৎ আয়াত ও হাদীস লেখকের বুঝের বিপরীত।

আমাদের উপস্থাপিত দলিল

(ইমামের সূরা ফাতিহা পাঠের সময় চুপ থাকা ও সাকতাতে তা পাঠের হাদীস পূর্বে বর্ণিত হয়েছে)

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ انْصَرَفَ مِنْ صَلاَةٍ جَهَرَ فِيهَا بِالْقِرَاءَةِ فَقَالَ هَلْ قَرَأَ مَعِى أَحَدٌ مِنْكُمْ آنِفًا . فَقَالَ رَجُلٌ نَعَمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ ্র إِنِّى أَقُولُ مَا لِى أُنَازَعُ الْقُرْآنَ . قَالَ فَانْتَهَى النَّاسُ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ فِيمَا جَهَرَ فِيهِ النَّبِىُّ بِالْقِرَاءَةِ مِنَ الصَّلَوَاتِ حِينَ سَمِعُوا ذَلِكَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ

‘‘আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একবার রসূলুল্লাহ (স) জাহরি ক্বিরাআত বিশিষ্ট সালাত আদায়ের পর বললেন: তোমাদের কেউ কি আমার সাথে পড়ছিলে? তখন একজন বললেন: হাঁ, ইয়া রসূলাল্লাহ! তিনি (স) বললেন: ‘‘নিশ্চয়ই আমি বলছিলাম, আমার কুরআন পাঠের সময় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।’ বর্ণনাকারী বলেন: অতঃপর লোকেরা বিরত হল রসূলুল্লাহ (স)-এর সাথে ক্বিরাআত করার ব্যাপারে ঐ সমস্ত সালাতে যেখানে নবী (স)-এর ক্বিরাআত তারা শুনতে পেত।’’ [আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহ: আবূ দাউদ হা/৮২৬), শায়খে যুবায়ের আলী যাঈও তাঁর তাহ: আবু দাউদে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (হা/৮২৬)।

পর্যালোচনা: আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, সাহাবীগণ জাহরি সালাতে ইমামে সাথে সাথে ক্বিরাআত করা ত্যাগ করেন। পুস্তকের লেখক উপস্থাপিত আনাস (রা) হাদীসের সাথে এর কোনো বিরোধ নেই। কেননা আবু হুরায়রা (রা)-এর অপরাপর হাদীসের মনে মনে পড়া ও সেটা সাকতাতে পড়ার বিষয়টি নিশ্চত করা হয়েছে। ফলে হাদীসগুলো পরস্পরে ব্যাখ্যা। ইমাম বুখারী, ইমাম হাম্বল, ইমাম তিরমিযী, আল্লামা ইবনে তাইমিয়া, শায়খ আলবানী (রহ) এ পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছেন।

৩১
যেভাবে মুহাদ্দিসগণ সমাধান করেছেন
ইমাম তিরমিযী (রহ) উভয় বক্তব্য সম্বলিত হাদীসের প্রতি বিরোধ নেই বলে দাবি করেছেন। তিনি নিম্নোক্তভাবে উভয় হাদীসের মধ্যে আমল কার্যকরী বলে উল্লেখ করেছেন:

وليس في هذا الْحديث مايدخل على من رأي القراءة خلف الإمام لأن أبا هريرة هو الذي روى عن النبي هذا الْحديث وروى أبو هريرة عن النبي أنه قال من صلى صلاة لَم يقرأ فيها بأم القرآن فهي خداج فهي خداج غيْر تَمام فقال له حامل الْحديث إني أكون أحيانا وراء الإمام ؟ قال اقرأ بِها في نفسك وروى أبا عثمان النهدي عن ٍأبي هريرة قال أمرني النبي أن أنادي أن لاصلاة إلا بقراءة فاتِحة الكتاب واختار أكثر أصحاب الْحديث أن لا يقرأ الرجل إذا جهر الإمام بالقراءة وقالوا يتتبع سكتات الإمام

‘‘যারা ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করার মত পোষণ করেন এই (আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত ক্বিরাআত বর্জনের) হাদীসটিতে তাঁদের ক্ষতি হওয়ার মত কোনো কিছু নেই। কেননা, যে আবূ হুরায়রা (রা) এই হাদীসটির বর্ণনাকারী, তিনিই বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স) এরশাদ করেন: কেউ যদি তার সালাতে উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পাঠ না করে তবে তার সালাত লেজকাটা ও অসম্পূর্ণ বলে গণ্য হবে। হাদীসটির রাবি তখন আবূ হুরায়রা (রা)- কে বললেন: ‘‘আমি অনেক সময় ইমামের পিছনেও তো থাকি? তিনি বললেন: তখন তোমরা মনে মনে তা পড়ে নিবে।’’ আবূ উসমান নাহদি রিওয়ায়াত করেন যে, আবূ হুরায়রা (রা) বলেছেন: ‘‘সূরা ফাতিহা পাঠ ব্যতিরেকে সালাত হয় না।’’ এই কথার ঘোষণা দেওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ (স) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।’’(ইমাম তিরমিযী (রহ) বলেন:) অধিকাংশ আসহাবুল হাদীস (হাদীসবেত্তাগণ) ইমাম জোরে ক্বিরাআতকালে মুক্তাদি ক্বিরআত না করার মত গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বলেন: ইমামের সাকতাতে বা চুপ থাকার সময়ে তা করা হবে।’’

[তিরমিযী - কিতাবুস সালাত - باب ماجاء في ترك القراءة خلف الإمام إذا جهر الإمام بالقراءة (অনুচ্ছেদ:ইমাম যখন জেহরী ক্বিরাআত করেন তখন তাঁর পিছনে মুক্তাদির ক্বিরাআত না করা)]

সুস্পষ্ট হল, ইমাম তিরমিযী (রহ)-এর কাছে আবূ হুরায়রা (রা) থেকে ক্বিরাআত বর্জনের হাদীসটিতে কোনো সমস্যা নেই। তিনি এই হাদীসের দাবি অন্যান্য হাদীসের দাবির ভিত্তিতে সাকতার মাধ্যমে সমাধান দিয়েছেন।

আবূ হুরায়রা (রা)-এর হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রহ) যে অনুচ্ছেদের অধীনে এনেছেন, তা নিম্নরূপ:

باب مَنْ كَرِهَ الْقِرَاءَةَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ إِذَا جَهَرَ الإِمَامُ

‘‘অনুচ্ছেদ: যারা (মুক্তাদির জন্য) ফাতিহাতুল কিতাবের ক্বিরাআত করা মাকরুহ বলেন, যখন ইমাম জাহরি (ক্বিরাআতের সালাত) পড়েন।’’ [তাহক্বীক্ব আবূ দাউদ অনুচ্ছেদ নং: ১৩৭, আওনুল মা‘বুদ শরহে আবূ দাউদ অনুচ্ছেদ নং: ১৩৬]

অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীসটি থেকে ইমামের সাথে সাথে সূরা ফাতিহা পাঠ মাকরুহ হওয়া সম্পর্কে - মুহাদ্দিসগণের একটি পক্ষের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ কারণে যেসব হাদীস থেকে ইমামের সাথে সাথে পাঠ করার দাবি করা হয়, তাদের উত্তরে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) লিখেছেন:

بِخلَافُ وُجُوبِهَا فِي حَالِ الْجَهْرِ , فَإِنَّهُ شَاذٌّ حَتَّى نَقَلَ أَحْمَدُ الْإِجْمَاعَ عَلَى خِلَافِهِ

‘‘জাহরি সালাতরত অবস্থায় (বা সাথে সাথে মুক্তাদির ক্বিরাআত পাঠ) ওয়াজিব হওয়া কুরআনের বিরোধী। কেননা এটা শায (কুরআন ও সহীহ হাদীস বিরোধী)। এমনকি ইমাম আহমাদ এর বিরোধী ইজমা‘ উল্লেখ করেছেন।’’ [ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়াহ ২/১৪৯]

শায়খ আলবানী (রহ) জাহরি সালাতে মুক্তাদির ইমামের সূরা ফাতিহা পাঠকে মানসুখ বলেছেন। তিনি তাঁর ‘‘সিফাতে সালাতুন নাবিয়্যি’’ বইটিতে লিখেছিলেন:

نسخ القراءة وراء الامام فى الْجهرية

‘‘সরব ক্বিরাআতের সালাতে ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পড়ার বিধান মানসুখ (রহিত)।’’

আমাদের নিকট হাদীসের দ্বন্দ নিরসণে উপরের প্রতিটি বিশ্লেষণ সঙ্গত। কেননা, যে হাদীসগুলোতে বাহ্যিকভাবে ইমামের সাথে সাথে সূরা ফাতিহা পাঠের অর্থ নেয়া হয় - তার হুকুম কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা মানসুখ বুঝা যায়। সাথে সাথে হাদীসের নীতিমালাতে সেগুলো শায হয় (কুরআন ও পরিপূরক সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে)। ফলে ইমামের সাথে সাথে পড়াটা মাকরুহ হয়। পক্ষান্তরে ইমামের সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করলে মানসুখ, মাকরুহ ও শায বলার অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে সূরা ফাতিহা পাঠের মৌলিক নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়।

৩২
মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে (সূরা ফাতিহা) ‘মনে মনে পাঠ’
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১০: (পৃ. ৬-৭)

তাছাড়া সূরা আ'রাফের ২০৪ নং আয়াতের “কুরআন পাঠের সময় চুপ থাকার নির্দেশটি যে ইমামের পিছনের মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক স্বরূপ নয়, সে সংশয় নিরসন করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। যেমন:

فإني سمعت رسول الله -صلى الله عليه وسلم - يقول « قال الله تعالی قسمت الصلاة بيني وبين على يقين ولعييري ما سأل فإذا قال العبد ( الحمد لله رب العين ). قال الله تعالی مدنی عبدي وإذا قال الرحمن الرحيم ). قال الله تعالى أثنى على غيري، وإذا قال ( مالك يوم الدين ). قال مدنی عبدی - وقال مرة فؤض إلى عبدی - فإذا قال ( إياك نعبد وإياك نستعين ). قال هذا بيني وبين عبدي ولعبدي ما سأل، فإذا قال راهدنا الصراط المستقيم صراط الذين أنعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين ). قال هذا لعبدي ولعبدي ما سأل

আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত (হাদীসে কুদসী) তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সালাতকে (অথাৎ সূরা ফাতিহাকে) আমার ও আমার বান্দার মাঝে অর্ধেক করে ভাগ করেছি। এর অর্ধেক আমার জন্য, আর বাকী অর্ধেক আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দা আমার নিকট যা কামনা করে তাই তাকে দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমারা সূরা ফাতিহা পাঠ কর। আল্লাহ বলেন, যখন আমার বান্দা বলে: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। অতঃপর বান্দা যখন বলে: আর-রাহমানির রাহীম, তখন আল্লাহ বলেন: আমার বান্দা আমার গুণগান করেছে। বান্দা যখন বলে: মালিকি ইয়াওমিদ্দীন, তখন আল্লাহ বলেন: আমার বান্দা আমাকে সম্মান প্রদর্শন করেছে। অতঃপর যখন বান্দা বলে: ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন, তখন আল্লাহ বলেন: এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে সীমিত এবং আমার বান্দা যা প্রার্থনা করল তাই তাকে দেয়া হয়। অতপর বান্দা যখন “ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকীম, সীরাতাল্লাযীনা আনআমতা আলাইহিম, গাইরিলমাগদূবি আলাইহিম ওয়াল্লাদ্দাল্লীন” বলে, তখন আল্লাহ বলেনঃ এ সমস্তই আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দা যা কিছু প্রার্থনা করেছে তাও প্রাপ্ত হবে। (মুসলিম হা/৭৬২, আবু দাউদ হা/৮২১, ইবনে মাজাহ হা/৮৩৮) 

পর্যালোচনা - ১০: হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বায়হাক্বী (রহ) বর্ণনা করেন:

قال البخاري : وقال أبو السائب عن أبي هريرة : اقرأ بها في نفسك قال البخاري : ولو صح لكان يحتمل أن يكون سوى فاتحة الكتاب وأن يقرأ فيما يسكت الإمام

‘‘ইমাম বুখারী (রহ) বলেন: আবূ সায়েব আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘‘মনে মনে পড়।’’ যদি এটা সহীহ হয়, তবে সম্ভবত ফাতিহাতুল কিতাবকে এখানে পৃথক করা হয়েছে। আর এটা পড়া হবে ইমামের সাকতাতে।’’ [কিতাবুল ক্বিরাআত. পৃ. ৯১]

ইমাম তিরমিযী (রহ)-ও হাদীসটি সাকতাতে পাঠের অর্থ নিয়েছেন। [দ্র: ‘পর্যালোচনা -৯’]

কেননা, আবূ হুরায়রা (রা) নিজেই বলেছেন:

للإمام سكتتان ، فاغتنموا القراءة فيهما بفاتحة الكتاب

‘‘ইমামের জন্য দু’টি সাকতা আছে। ফাতিহাতুল কিতাবকে দু’সাকতার মধ্যে তোমরা গণিমত মনে করো।’’ [ইমাম বুখারীর জুযউল ক্বিরাআত হা/২৭৫, মুহাদ্দিস যুবায়েরআলী যাঈ লিখেছেন, হাদীসটির সনদ হাসান (নাসরুল বারী পৃ. ২৯২)]

শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী বর্ণনাটিকে মওকুফ (সাহাবীর উক্তি) হিসেবে হাসান বলেছেন। [সিলসিলাহ যঈফাহ হা/৫৪৬]

অন্যত্র আবু হুরায়রা (রা) বলেন:

اقرأوا إذا سكتوا ، واسكتوا إذا قرأوا ؛ فإن الصلاة المخدجة التي لا قراءة فيها

‘‘যখন ইমাম সাকতা করেন তখন তোমরা পড়, আর যখন ইমাম পড়েন তখন তোমরা সাকতা করো। কেননা সালাত ত্রুটিযুক্ত থাকে যখন সেটা (ফাতিহা) তাতে (সালাতে) পড়া হয় না।’’ [বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৬৬, এর সনদ হাসান]

আমাদের কাছে আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীসগুলো পরস্পরের ব্যাখ্যা।

এ কারণে ইমাম বুখারী (রহ)-এর ন্যায় শায়খ আলবানী (রহ)-ও বলেছেন:

قلت : فيه دليل على أبي هريرة في " مسلم ": " اقرأ بِها في نفسك يا فارسي " إنَما يعنِي قراءتِها في سكتات الإمام إن وجدت . وهذه فائدة هامة . فخذها شاكرا الله تعالى

‘‘আমি (আলবানী) বলছি: এর স্বপক্ষে দলিল হল, আবূ হুরায়রা (রা)-এর সহীহ মুসলিমের বর্ণনা: ‘‘হে পারস্যবাসী! মনে মনে পাঠ কর’’ - নিঃসন্দেহে এই পাঠটি হবে ইমামের সাকতা’র সময়, যদি তুমি সুযোগ পাও। এটা খুবই উপকারী ফায়দা। সুতরাং আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য তা গ্রহণ কর।’’ [. সিলসিলাতুল আহাদীসুয যঈফাহ ওয়াল মাওযু‘আহ (রিয়াদ: মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১১৯২/১৪১২) ২/২৪ পৃষ্ঠা, হা/৫৪৬ এর টিকা দ্রষ্টব্য। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে - বাংলা ভাষায় এই কিতাবটির অনুবাদক ইমাম আলবানী (রহ)’র টিকায় সংযুক্ত উক্ত উপকারী কথাটি উল্লেখ করেননি!!]

বুঝা গেল, আবু হুরায়রা (রা) থেকে ইমামের পিছনে মনে মনে সূরা ফাতিহা পাঠের ব্যাপারে তিনি (রা) নিজে ও মুহাদ্দিসগণ কি বুঝেছিলেন। হাদীসটি সম্পর্কে পুস্তিকাটির লেখকের বুঝ ও উপস্থাপনা আংশিক, অসম্পূর্ণ এবং নিতান্তই ব্যক্তিগত। কেননা তিনি আবূ হুরায়রা (রা) থেকে প্রমাণিত সাকতার হাদীস দ্বারা ‘মনে মনে পড়ার’ ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে নারাজ। অথচ মুহাদ্দিসগণ আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত সাকতার হাদীস তাঁরই ‘মনে মনে পড়ার’ হাদীসটি দ্বারা ব্যাখ্যা নিয়েছেন। পক্ষান্তরে পুস্তিকাটির লেখক বর্জন করে সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াত ও একই মর্মে বর্ণিত হাদীসগুলোর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মুহাদ্দিসগণের সমন্বয় পদ্ধতিতে লেখকের উল্লিখিত হাদীসগুলোর মূল দাবি ‘ইমামের পিছনে ফাতিহা পাঠের’ আমলটিও হয়ে যাচ্ছে। আর এটাই মু’মিনদের পথের (সূরা নিসা: ১১৫) অনুসরণের ফায়দা।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১১: (পৃ. ৭)

পাঠকগণ লক্ষ্য করুন! যেহেতু এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা। সূরা ফাতিহাকেই সালাত বলেছেন, সেহেতু সূরা ফাতিহা সালাতের। অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়তের নির্দেশনা, সালাতে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক স্বরূপ নয় বরং সূরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াত ও আবু হুরায়রা (ভন্ন বর্ণিত উপরিউক্ত হাদীসে কুদসীর নির্দেশনা অনুযায়ী সূরা ফাতিহা সকল প্রকার সালাতে প্রতি রাকআতের জন্য এবং আল্লাহর বান্দা হিসেবে ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য অবশ্যই পঠনীয়।

পর্যালোচনা - ১১: আমরা সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতটিতে উপস্থাপিত ‘চুপ থাকার’ ব্যাখ্যা নবী (স), সাহাবী (রা) ও মুহাদ্দিসগণ থেকে উল্লেখ করেছি। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-৭] কিন্তু লেখক আয়াতে বর্ণিত ‘আনসাত বা চুপ থাকার’ এমন কোনো ব্যাখ্যা উল্লেখ করেননি, যা থেকে প্রমাণিত হয় ইমামের ক্বিরাআত চলাকালে তা অগ্রাহ্য করে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। লেখকের ব্যাখ্যার সাথে না কুরআনের আয়াতের দাবি পূরণ হয়, না সহীহ হাদীসের মধ্যকার দ্বিধা-দ্বন্দের অবসান হয়। পক্ষান্তরে ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের বিশ্লেষণে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উভয় দাবির প্রতি আমল করা সম্ভব হয়। তা ছাড়া আমরা শুরুতেই প্রমাণ করেছি, পুস্তিকাটির লেখক সূরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াতটি বুঝতে পারেননি [দ্র: ‘পর্যালোচনা-৮]। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা) থেকে প্রমাণিত হয়েছে, সূরা আ‘রাফের ২০৪ ও সূরা মুযযাম্মিলের তাহাজ্জুদ সালাত সম্পর্কিত আয়াতগুলোর দাবিই সালাতে ক্বিরাআতের প্রতি মনোযোগ। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষভাবে জাহরি সালাতে ইমামের ক্বিরাআত শোনা অবস্থায় মুক্তাদি চুপ থাকবে ও মনোযোগী হবে। [দ্র: ‘পর্যালোচনা - ৭’]

সূরা ফাতিহা যে জাহরি ও সির্রি সালাতে অবশ্যই পঠনীয় তাতে আমাদের কোনো সংশয় নেই। যেভাবে নবী (স), সাহাবী (রা), তাবেঈ, ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ (রহ) থেকে বর্ণনা গত হয়েছে। সাহাবী আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীসগুলোর সম্মিলিত দাবিও এটাই। [দ্র: ‘পর্যালোচনা - ১০’]

৩৩
ক্বিরাআত পাঠ বনাম মনে মনে পাঠ
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১২: (পৃ. ৮)

প্রসঙ্গ: “ইমাম যখন কিরাআত করেন তখন তোমরা চুপ থাক” সংক্রান্ত হাদীস

ইমাম যখন কিরাআত করেন তখন তোমরা চুপ থাক” কথাটি “আম”। কিন্তু ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের নির্দেশটি “খাছ”। যেমনঃ ইমামের উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠ অবস্থায় মুক্তাদীকে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠের নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

  أتقرؤون في صلاتكم خلف الإمام والإمام يقرأ ؟ فلا تفعلوا

ইমামের কিরআত অবস্থায় কিছু পাঠ করে থাক? এটা করবে না। বরং وليقرأ أحدكم بفاتحة الكتاب في نفسه কেবলমাত্র সূরা ফাতিহা চুপে চুপে পড়বে। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা/১৮৪৪, বুখারী জুযউল কিরআত হা/২৫৫)।

পর্যালোচনা - ১২: লেখক যে হাদীসটি দ্বারা ব্যাখ্যা নিয়েছেন সেখানেও ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় পাঠ করতে নিষেধ করা হয়েছে। লেখকের তরজমাটিও সেটাই বলে। লেখক نفسه -এর অর্থ করেছেন ‘চুপে চুপে’। অথচ ‘মনে মনে’ তরজমা হওয়াটাই বেশি সঙ্গত। [. আল্লাহ তাআলা বলেন: وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَاهُ ‘‘যা আপনি অন্তরে গোপন করেছেন আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন।’’ [সূরা আহযাব: ৩৭] অন্যত্র আল্লাহ তাআলাকে বলেন: وَاذْكُر رَّبَّكَ فِي نَفْسِكَ ‘‘তোমার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, সশংকচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়।’’ [সূরা আ‘রাফ: ২০৫]ইমাম বগভী (রহ) শেষোক্ত আয়াতটির তাফসিরে লিখেছেন: قال ابن عباس : يعني بالذكر : القراءة في الصلاة، يريد يقرأ سرا في نفسه ‘‘ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: আয়াতে ذكر অর্থ হলো - সালাতে ক্বিরাআত করা। উদ্দেশ্য হলো, পাঠ করতে হবে সির্রিভাবে (গোপনে) মনে মনে।’’ [তাফসিরে বগভী, তাফসিরে মাযহারি, তাফসিরে খাযেন - আলোচ্য আয়াতের তাফসির দ্র:]বুঝা যাচ্ছে, শব্দটির সঠিক দাবি লেখক বুঝেননি। তবে শেষোক্ত আয়াতটির পরবর্তী অংশের দাবি ও সাহাবি ইবনে আব্বাসের (রা) ব্যাখ্যার সমন্বিত দাবি হলো; একাকী সালাত, সির্রী সালাত ও সালাতের বাইরে আল্লাহর যিকরের ÿÿত্রে নীচুস্বরে পড়তে হবে।রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالإِثْمُ مَا حَاكَ فِى نَفْسِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ ‘‘পুণ্য হলো উত্তম চরিত্র, পাপ হলো যে কাজ তোমার অন্তরে সংশয় সৃষ্টি করে এবং তুমি ঐ কাজটি মানুষের নিকট প্রকাশ হওয়া অপছন্দ করো।’’ [সহীহ মুসলিম باب تَفْسِيرِ الْبِرِّ وَالإِثْمِ হা/৬৬৮৪]এ বর্ণনাগুলোতে ব্যবহৃত আলোচ্য نفس শব্দটি কখনই বাংলা ‘ফিস ফিসমূলক চুপে চুপে’র সমার্থক নয়।] কেননা বাংলা ভাষায় ‘চুপে চুপে’ বলতে ‘ফিস ফিস করে’ বলাকেও বুঝায়। [দ্র: ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বাংলা একাডেমী-১৯৯২)]

তা ছাড়া ফাতিহা মনে মনে পড়ার দাবি আবূ হুরায়রা (রা)-এর হাদীসেও এসেছে। যা আবূ হুরায়রা (রা)-এর অপারপর হাদীসের দাবির ভিত্তিতে সাকতার সময় উক্ত হুকুমটি প্রযোজ্য। যা ইমাম বুখারী (রহ), শায়খ আলবানী (রহ) প্রমুখ থেকে প্রমাণিত। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-১০]

তাবেঈ হিশাম তার পিতা উরওয়াহ বিন যুবায়ের (রহ) থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেছেন:

يا بني اقرءوا فيما يسكت الإمام واسكتوا فيما جهر ولا تتم صلاة لا يقرأ فيها بفاتحة الكتاب فصاعدا ، مكتوبة ومستحبة

‘‘হে আমার পুত্র! ইমামের সাকতাতে (সূরা ফাতিহা) তিলাওয়াত করো, এবং যখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে তিলাওয়াত করবেন, তখন চুপ থাকবে। সূরা ফাতিহা ব্যতীত সালাত পূর্ণাঙ্গ নয়, তবে (যে) অতিরিক্ত (পড়ে)। হোক সেটা ফরয বা মুস্তাহাব সালাত।’’ [তাহক্কীক জুয-আল কিরাআত (বাংলা) হা/২৭৬, শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) বর্ণনাটিকে সহীহ বলেছেন। (পৃ. ২৫৬, টীকা: ৪৫২) ]

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের পুত্র আব্দুল্লাহ (রহ) লিখেছেন:

٢٥٤ - حَدثنَا قَالَ قلت لابي فاقرأ فِي نَفسِي الْحَمد قَالَ لَا وَقَالَ وَإِذا قرئَ الْقُرْآن فَاسْتَمعُوا لَهُ وأنصتوا

‘‘২৫৪ - আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করে বলেছেন: আমি (আব্দুল্লাহ) আমার আব্বাকে (আহমাদ বিন হাম্বল রহ.)-কে বললাম: মনে মনে কি ‘আল-হামদু পড়ব? তিনি বললেন: না, কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখন কুরআন পড়া হয়, তখন মনোযোগের সাথে শোনো ও চুপ থাকো’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪)’’। [মাসায়েলে ইমাম আহমাদ লি ইবনিহি আব্দুল্লাহ’ (বৈরুত: মাকতাবাহ ইসলামি, ১৪০১/১৯৮১)পৃ. ৭১ নং ২৫৪]

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৩: (পৃ. ৮)

তাছাড়া “ইমাম যখন কিরাআত করেন তখন তোমরা চুপ থাক” হাদীসটির বর্ণনাকারী সাহাবী আবু হুরায়রা (হে নিজেই ইমামের পিছনে মুক্তাদীকে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমনঃ আবুস-সায়ীব এই) আবু হুরায়রা ও হতে বর্ণনা করেন,

  عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من صلى -صلاة لا يقرأ فيها بأم الكتاب فهي خداج ثم هي خداج غیر تمام ثلاثا قلت يا أبا هريرة رضي الله عنه كيف أصنع إذا كنت مع الإمام وهو يجهر بالقراءة قال ويلك ...

আবু হুরায়রা (রা) বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল (অথচ) তাতে উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পাঠ করল না, সে সালাত হবে অসম্পূর্ণ, এ কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বলেছেন। তখন (বর্ণনাকারী) | আবু হুরায়রা (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন আমি যদি ইমামের পিছনে থাকি এবং ইমাম যদি উচ্চস্বরে কিরাআত করেন তখনো কি ফাতিহা পড়বে? আবু হুরায়রা (রা) বললেন, হে ফারসি, তখন তা চুপে চুপে পড়।... (বুখারী জুযউল কিরআত হা/৭৩)

পর্যালোচনা - ১৩: হাদীসটির في نفسك -এর দাবি সম্পর্কে ইমাম বায়হাক্বী (রহ) বর্ণনা করেন:

قال البخاري : وقال أبو السائب عن أبي هريرة : اقرأ بها في نفسك قال البخاري : ولو صح لكان يحتمل أن يكون سوى فاتحة الكتاب وأن يقرأ فيما يسكت الإمام

‘‘ইমাম বুখারী (রহ) বলেন: আবূ সায়েব আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘‘মনে মনে পড়।’’ যদি এটা সহীহ হয়, তবে সম্ভবত ফাতিহাতুল কিতাবকে এখানে পৃথক করা হয়েছে। আর এটা পড়া হবে ইমামের সাকতাতে।’’ [কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৯১]

ইমাম বুখারী (রহ)-এর ন্যায় শায়খ আলবানী (রহ)-ও বলেছেন:

قلت : فيه دليل على أبي هريرة في " مسلم ": " اقرأ بِها في نفسك يا فارسي " إنَما يعنِي قراءتِها في سكتات الإمام إن وجدت . وهذه فائدة هامة . فخذها شاكرا الله تعالى

‘‘আমি (আলবানী) বলছি: এর স্বপক্ষে দলিল হল, আবূ হুরায়রা (রা)-এর সহীহ মুসলিমের বর্ণনা: ‘‘হে পারস্যবাসী! মনে মনে পাঠ কর’’ - নিঃসন্দেহে এই পাঠটি হবে ইমামের সাকতা’র সময়, যদি তুমি সুযোগ পাও। এটা খুবই উপকারী ফায়দা। সুতরাং আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য তা গ্রহণ কর।’’ [. সিলসিলাতুল আহাদীসুয যঈফাহ ওয়াল মাওযু‘আহ (রিয়াদ: মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১১৯২/১৪১২) ২/২৪ পৃষ্ঠা, হা/৫৪৬ এর টিকা দ্রষ্টব্য। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে - বাংলা ভাষায় এই কিতাবটির অনুবাদক ইমাম আলবানী (রহ)’র টিকায় সংযুক্ত উক্ত উপকারী কথাটি উল্লেখ করেননি!!]

আবু হুরায়রা (রা) বললেন: في نفسك -এর অর্থ লেখক করেছেন: ‘চুপে চুপে পড়ো।’ অথচ বেশি সঙ্গত তরজমা হলো ‘মনে মনে’। [দ্র: ‘পর্যালোচনা -১২’]

কেবল আবূ হুরায়রা (রা) নয়, সাহাবী আবূ মূসা (রা)-ও হাদীসটির বর্ণনাকারী। তিনি (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ বলেছেন:

إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَلْيَؤُمَّكُمْ أَحَدُكُمْ وَإِذَا قَرَأَ الْإِمَامُ فَأَنْصِتُوا

‘‘যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াও তখন তোমাদের একজন ইমাম হবে। যখন সে ক্বিরাআত করে তখন চুপ থাকো।’’

[মুসনাদে আহমাদ, মুহাক্কেক্ব শুআয়েব আরনাউত বলেন: এর সনদটি সহীহ, সবাই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনাকারী কেবল আলী বিন আব্দুল্লাহ ছাড়া। তিনিও সহীহ বুখারীর বর্ণনাকারী। (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ ৪/৪১০/১৯৭৩৮), শায়খ আলবানী (রহ) হাদীসটির সনদ সহীহ বলেছেন। (আসলি সিফাতে সালাত ১/৩৫২)]

এই হাদীসটিতে সূরা ফাতিহা পাঠের নিষেধ বর্ণিত হয়নি। কেবল ইমামের ক্বিরাআতের সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّهُ سَأَلَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ الإِمَامِ فَقَالَ لاَ قِرَاءَةَ مَعَ الإِمَامِ فِى شَىْءٍ

‘‘আতা বিন ইয়াসার (রহ) সাহাবী যায়েদ বিন সাবিত (রা)-কে ইমামের সাথে (মুক্তাদির) ক্বিরাআত করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি (রা) বললেন: ইমামের সাথে কোনো কিছুই পড়বে না।’’ [সহীহ মুসলিম - কিতাবুস সালাত باب سُجُودِ التِّلاَوَةِ ]

এই হাদীসটিতে ‘ইমামের সাথে সাথে’ ( مَعَ الإِمَامِ ) নিষেধ করা হয়েছে। ‘ইমামের পিছনে’ ( خلف الإمام ) পড়তে নিষেধ করা হয়নি।

শায়খ আলবানী (রহ) বলেন:

أخرج البيهقي بسند صحيح عن عطاء بن يسار أنه سأل زيد بن ثابت عن القراءة مع الإمام فقال : لا أقرأ مع الإمام في شيء ، وقال : " أخرجه مسلم ، وهو محمول على الجهر بالقراءة مع الإمام ، والله أعلم "

‘‘এটি বায়হাক্বীও সহীহ সনদে আতা বিন ইয়াসার বর্ণনা করেছেন। তিনি যায়েদ বিন সাবেত (রা)-কে ইমামের সাথে পাঠ করার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন? তিনি বললেন: আমি ইমামের সাথে কিছুই পাঠ করিনা। অতঃপর তিনি বলেছেন: ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন। তিনি [. উদ্ধৃতিটি ছিল ইমাম বায়হাক্বী (রহ)-এর। অর্থাৎ ইমাম বায়হাক্বী বলছেন: ইমাম মুসলিম এটিকে জাহরি সালাতের জন্য প্রযোজ্য করেছেন। অথচ বইটির অনুবাদক লিখেছেন: তিনি (বায়হাক্বী) এটিকে জাহরি সালাতের জন্য প্রযোজ্য হিসেবে ব্যাখ্যা নিয়েছেন।’’ যা ভুল অনুবাদ।] এটিকে ইমামের সাথে জাহরি সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। [যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ২/৪৭৮ পৃ.]

হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা এসেছে আবু হুরায়রা (রা)-এর অপর হাদীসে, তিনি বলেন:

اقرأوا إذا سكتوا ، واسكتوا إذا قرأوا ؛ فإن الصلاة المخدجة التي لا قراءة فيها

‘‘যখন ইমাম সাকতা করেন তখন তোমরা পড়, আর যখন ইমাম পড়েন তখন তোমরা সাকতা করো। কেননা সালাত ত্রুটিযুক্ত থাকে যখন সেটা (ফাতিহা) তাতে (সালাতে) পড়া হয় না।’’ [বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৬৬, এর সনদ হাসান]

হাদীসগুলো পরস্পরের পরিপূরক। যেখানে ইমামের সূরা ফাতিহা পাঠের সময় চুপ থাকার খাস নির্দেশ রয়েছে ও সাকতাতে ফাতিহা পড়তে বলা হয়েছে।

৩৪
সাকতার হাদীসের প্রয়োগ
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৪: (পৃ. ৯)

সালাতে ইমামের সাকতা বা নীরবতা পালন ও সে সময়ে করণীয়

সালাতে সাকতা বা নীরবতা পালন সম্পর্কিত যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  بين التكبير وبين القراءة إشگاه حدثنا أبو هريرة قال كان رسول الله يشك قال أخيه قال هنية فقلت بأبي وأمي يا رسول الله إشكاك بين التكبير والقراءة ما تقول قال أقول اللهم باعد بيني وبين خطاياي كما باعدت بين المشرق والمغرب اللهم تقي من الخطايا كما ينقى الثوب الأبيض من الدنس اللهم اغسل خطاياي بالماء والثلج والبرد  

(১) আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকবীরে তাহরীমার পর কিরাআত শুরু করার পূর্বে কিছু সময় চুপ থাকতেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি কুরবান হােন! আপনি তাকবীর ও কিরাআতের মধ্যবর্তী সময়ে চুপ থাকেন তাতে কী বলেন? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন; আমি বলি “আল্লাহুম্মা বায়েদ বাইনী,..। (বুখারী হা/৭০৮ ও মুসলিম হা/১২৩০)।

পর্যালোচনা - ১৪: এই হাদীসটিতে মুক্তাদির করণীয় বিষয় সম্পর্কে কিছু বর্ণিত হয়নি। বরং মুনফারেদ (একাকী সালাত আদায়কারী) ও ইমামের করণীয় বিষয় আলোচিত হয়েছে। আবূ হুরায়রা (রা)-এর অপর বর্ণনাতে ঐ সাকতাতে মুক্তাদির করণীয় বিষয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে নিঃশব্দে:

للامام سكتتان فاغتنموا القراءة فيهما بفاتِحة الكتاب

‘‘ইমামের দু’টি সাকতা রয়েছে, এতে সূরা ফাতিহা পড়ার সুযোগ গ্রহণ (গণীমত মনে) করো।’’ [জুঝউল ক্বিরাআত, পৃ. ৬২। আলবানী (রহ) আবূ হুরায়রা (রা) পর্যন্ত সনদটিকে হাসান বলেছেন (আয-যঈফাহ ২য় খণ্ড হা/৫৪৬)।]

এই হাদীসটিতে সাকতাতে মুক্তাদির করণীয় বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তা ছাড়া সহীহ ইবনে হিব্বানে প্রথম সাকতা ছাড়া অপর একটি সাকতা মুস্তাহাব হওয়ার মর্মে অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

ذِكْرُ مَا يُسْتَحَبُّ لِلْمَرْءِ أَنْ يَسْكُتَ سَكْتَةً أُخْرَى عِنْدَ فَرَاغِهِ مِنْ قِرَاءَةِ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ

‘‘বিবরণ: ব্যক্তির জন্য মুস্তাহাব অপর একটি সাকতা করা সেটা হলো সূরা ফাতিহা থেকে ফারেগ হওয়ার পর।’’

অথচ ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ) সমস্ত ক্বিরাআতের শেষের বর্ণনাটি এনেছেন। যা নিম্নরূপ:

عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ قَالَ : سَكْتَتَانِ حَفِظْتُهُمَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِعِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ فَقَالَ : حَفِظْنَا سَكْتَةً فَكَتَبْنَا إِلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ بِالْمَدِينَةِ فَكَتَبَ إِلَيَّ أَنَّ سَمُرَةَ قَدْ حَفِظَ . قَالَ سَعِيدٌ : فَقُلْنَا لِقَتَادَةَ وَمَا هَاتَانِ السَّكْتَتَانِ؟ قَالَ : إِذَا دَخَلَ في صلاته وإذا فرغ من القراءة

‘‘সামুরাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রসূলুল্লাহ (স) থেকে দু’টি সাকতা হেফয করেছি। এটি ইমরান ইবনে হুসাইনের নিকট উল্লেখ করা হলে, তিনি বলেন: আমি একটি সাকতা হেফয করেছি। তখন আমরা মদীনাতে উবায় ইবনে কা‘বের কাছে লিখলাম। তিনি (রা. জবাবে) লিখলেন: সামুরাহ হেফয করেছে। সাঈদ বলেন। আমরা ক্বাতাদাকে বললাম, সাকতা দু’টি কোথায়। তিনি (রহ) বললেন: যখন সালাতে প্রবেশ করে, আর যখন ক্বিরাআত থেকে ফারেগ হয়।’’ [. সহীহ ইবনে হিব্বান - ذِكْرُ مَا يُسْتَحَبُّ لِلْمَرْءِ أَنْ يَسْكُتَ سَكْتَةً أُخْرَى عِنْدَ فَرَاغِهِ مِنْ قِرَاءَةِ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘‘বিবরণ: ব্যক্তির জন্য মুস্তাহাব অপর একটি সাকতা করা সেটা হলো সূরা ফাতিহা থেকে ফারেগ হওয়ার পর’’। ইবনে হিব্বান ‘সূরা ফাতিহা পাঠের পরে’ অর্থ নিয়েছেন। অথচ হাদীস বর্ণনা করেছেন ‘ক্বিরাআতের শেষে।’ আর অধিকাংশ রাবির বর্ণনা থেকে এটাই প্রসিদ্ধ। এ পর্যায়ে একজন সচেতন মুসলিমের দায়িত্ব হলো, সহীহ হাদীসের মতনের উপর আমল করা।]

বুঝা যাচ্ছে, অনেক সাহাবী (রা) একটি সাকতার কথা জানতেন। কিন্তু অপর সাকতাটিও প্রমাণিত। আর এ প্রশ্নোত্তরের সমাধানটি আসে মদীনাতে অবস্থানরত সাহাবী উবায় ইবনে কা‘ব (রা)-এর সাক্ষ্য থেকে। ফালিল্লাহিল হামদ।

ইমাম বায়হাক্বী (রহ) লিখেছেন:

وقال البخاري : وقال أبو هريرة : كان النبي يسكت بين التكبير والقراءة قال الإمام أحمد رحِمه الله وفي حديث سَمرة : كان يسكت قبل القراءة وبعدها قال البخاري : فإذا قرأ في سكتة الإمام لَم يكن مُخالفا لِحديث أبي خالد لأنه يقرأ في سكتات الإمام ، فإذا قرأ أنصت

‘‘ইমাম বুখারী (রহ) বলেন: আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী (স) তাকবীর ও ক্বিরাআতের মাঝে সাকতা করতেন। ইমাম আহমাদ (রহ) সামুরার (রা) হাদীসটি সম্পর্কে বলেন: নবী (স) ক্বিরাআতের পূর্বে ও পরে সাকতা করতেন। ইমাম বুখারী (রহ) বলেন: যখন ইমামের সাকতাতে পড়া হবে তখন তা আবূ খালিদের হাদীসের বিরোধী হয় না। কেননা তিনি ইমামের দু’টি সাকতাতে পড়তেন, আর যখন ইমাম পড়তেন তখন চুপ ( أنصت ) থাকতেন।’’ [কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৯১]

বুঝা যাচ্ছে মুহাদ্দিসণের নিকট সাকতার হাদীগুলোর দাবি হলো, সাকতা হবে দু’টি এবং তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ হাদীসগুলোর বিরোধ নিরসণ করে।

সম্মানিত পাঠক! আমরা সাকতার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে সেটার গ্রহণযোগ্যতা ও আমল সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের সাক্ষ্যও উপস্থাপন করেছি। যদি সেটাকে শরিআত হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়া হয় - তবে সেটা প্রকারান্তরে শরিআতকে অস্বীকার করা। মু’মিনদের সত্য সাক্ষ্যকে অমান্য করা।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৫: (পৃ. ৯-১০)

عن الحسن أن سمرة بن جندب وعمران بن حصين تذاكرا فحدث سمرة بن جندب أنه حفظ عن رسول الله -صلى الله عليه وسلم - سكتتين سكتة إذا كبر و سكتة إذا فرغ من قراءة ) غير المغضوب عليهم ولا الضالين

(২) আল-হাসান এল সূত্রে সামুরা ইবনু জুনদুব (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সালাতে দুটি নীরবতার স্থান স্মরণ রেখেছেন। প্রথম নীরবতা তাকবীরে তাহরীমা বাধার পর, এবং দ্বিতীয় নীরবতা হচ্ছে “গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম ওলাদ্দাল্লীন পাঠের পর (আবু দাউদ হা/৭৭৯-৭৮০)।

عن الحسن قال قال حفظت سكتتين في الصلاة إذا كبر الإمام حتى ځين في الصلاة مره حتى يقرأ وسكتة إذا فرغ من فتحة الكتاب وسورة عند الركوع .

(৩) ইয়কুব ইবনে ইব্রাহীম........আল হাসান হতে বর্ণিত, তিনি বলেন সামুরা (রা) বলেন, সালাতের মধ্যে যে দুই স্থানে চুপ থাকতে হয় তা আমি স্মরণ রেখেছি। প্রথমতঃ ইমাম যখন তাকবীরে তাহরীমা বলে তখন হতে কিরাআত শুরু করা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়তঃ ইমাম সূরা ফাতিহা ও কিরাআত পাঠের পর রুকুতে যাবার পূর্বে। (আবু দাউদ হা/৭৭৭)

পর্যালোচনা - ১৫: সম্মানিত পাঠক! উক্ত ৭৭৯ ও ৭৮০ নং হাদীসের পূর্বে ভিন্ন শব্দে ইমাম আবু দাউদ আরও দু’টি হাদীস (৭৭৭ ও ৭৭৮ নং) উল্লেখ করেছেন। যেখানে দ্বিতীয় নীরবতা বা সাকতা রুকু‘র পূর্বে বা ক্বিরাআতের শেষে বর্ণিত হয়েছে। যার একটি লেখক ৩ নং-এ উল্লেখ করেছেন।

‘কিরাআত শেষে বা রুকুর পূর্বের’ দ্বিতীয় সাকতার (হা/৭৭৭ ও ৭৭৮) বর্ণনাতে ক্বাতাদাহ নেই। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় সাকতাটি ‘গায়রিল মাগযুবি ... ওলাদ্দাল্লীন’ পাঠের পর হওয়ার বর্ণনা দু’টিতে ক্বাতাদাহ আছেন। তিনি মুদাল্লিস।

ক্বাতাদার বর্ণনা দু’টিকে শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) যঈফ বলেছেন। ... (কেননা) ক্বাতাদাহ হাদীসটি আন দ্বারা বর্ণনা করেছেন। [তাহ: উর্দু আবু দাউদ হা/৭৭৯]

পক্ষান্তরে রুকু‘র পূর্বের বা ক্বিরাআতের শেষে দ্বিতীয় সাকতার বর্ণনা দু’টি ইউনুস ও আশআস বর্ণনা করেছেন। তাদের প্রতি তাদলিসের অভিযোগ না থাকায় হাদীস দু’টি শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) সহীহ বলেছেন। [তাহ: উর্দু আবু দাউদ হা/৭৭৭-৭৮]

বুঝা যাচ্ছে, লেখক আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক্ব যঈফ হাদীসকে আগে সাজিয়েছেন এবং সহীহ হাদীসকে পরে রেখেছেন। যা ইমাম আবু দাউদের সাজানোর বিপরীত।

এখন এর জবাব শুনুন পাকিস্তানি আহলে হাদীস মুহাদ্দিস ও রিজালশাস্ত্রবীদ ইরশাদুল হক্ব আসারির লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন:

بعض حجرت نے اس پر اعتراض بھی کیا ہے کہ متن میں اعتراض ہے ۔ بعض میں فاتحہ کے بعد اور بعض میں قراءت سورۃ کے بعد سکتہ کا ذکر ہے ۔ لیکن یہ اختلاف صحیح نہیں ۔ جب کہ یہ اختلاف قتادۃ رح کی روایت میں ہے۔ قتدۃ رح کے علاوہ اشعث رح ، یونس رح ، حمید رح الطویل حضرۃ حسن رح سے قراءۃ کے بعد ہی سکتہ کا ذکر کر تے ہیں ۔ لہذا قتادہ رح کی اس روايت کا اعتبار ہوگا جو جماعت موافق ہے ...

‘‘কেউ কেউ সাকতার হাদীসের মতনে ইযতিরাবের (স্ব-বিরোধীতার) অভিযোগ করেছেন। কোনোটিতে সাকতার বর্ণনা সূরা ফাতিহার শেষে এবং কোনোটিতে সম্পূর্ণ ক্বিরাআত শেষে সাকতার কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগও সহীহ নয়। কারণ মতপার্থক্যের কেন্দ্র হল, ক্বাতাদাহ (রহ)-এর বর্ণনা। অথচ ক্বাতাদাহ (রহ) ছাড়াও এটি (হাসান বসরির অন্যান্য ছাত্র) আশ‘আস (রহ), ইউনুস (রহ), হুমায়িদ (রহ) থেকে সম্পূর্ণ ক্বিরাআত শেষে সাকতা করার বর্ণনা আছে। সুতরাং ক্বাতাদাহ’র (রহ) ঐ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে যা জামাআতের (অধিকাংশ রাবীর) বর্ণনার পরিপূরক। ...’’ [বিস্তারিত: তাওযিহুল কালাম পৃ. ৫৭৮, অনুরূপ ইউনুসের বর্ণনার স্ববিরোধিতার জবাবও তিনি দিয়েছেন। সেখানেও অধিকাংশ বর্ণনাকারী থেকে ক্বিরাআতের পরের সাকতা করার প্রমাণ দ্বারা সেটাই গ্রহণযোগ্যতা পায়।]

৩৫
সাকতার হাদীসগুলো মুহাদ্দিসগণের নিকট পারস্পরিক ব্যাখ্যা
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৬: (পৃ. ১০)

 উপরিউক্ত হাদীসসমূহ পাঠে “প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পারলাম যে, সালাতে ইমামের সাকতা রয়েছে তিনটি। যথাক্রমে:

(ক) আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত (১ নং) হাদীস অনুযায়ী শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরীমা ও সূরা ফাতিহা পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে।

 (খ) সামুরা ইবনু জুনদুব (রা) বর্ণিত (২ নং) হাদীস অনুয়ায়ী দুটি সাকতা অর্থাৎ প্রথমবার তাকবীরে তাহরীমা ও সূরা ফাতিহা পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে, দ্বিতীয়বার সূরা ফাতিহা পাঠের পর। 

(গ) সামুরা (রা) বর্ণিত (৩ নং) হাদীস অনুযায়ী দুটি সাকতা অর্থাৎ প্রথমবার তাকবীরে তাহরীমা ও সূরা ফাতিহা পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে, দ্বিতীয়বার সূরা ফাতিহা ও অন্য কিরাআত পাঠের পর, রুকুতে যাবার পূর্বে। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি বর্ণনাতেই তাকবীরে তাহরীমা ও সূরা ফাতিহা পাঠের মধ্যবর্তী সময়ের সাকতার কথা উল্লেখ রয়েছে। 

হাদীস তিনটির পর্যালোচনা: আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের হওয়ায় তা নিঃসন্দেহে সহীহ। এই হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী সালাতে সাকতা রয়েছে একটি মাত্র সময় তাকবীরে তাহরীমার পর সূরা ফাতিহা পাঠের পূর্বে। করণীয়ঃ “আল্লাহুম্মা বায়েদ বাইনী”...........পাঠ করা। আর সামুরা (রা) বর্ণিত দুই সাকতা সম্পর্কিত হাদীস দুটিই যঈফ। (তাহকীক আলবানী) 

পর্যালোচনা - ১৬: ক) আবু হুরায়রা (রা) থেকেই দু’টি সাকতার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যা স্বয়ং আলবানী (রহ)-এর কাছে হাসান। (আয-যঈফাহ ২য় খণ্ড হা/৫৪৬)

সেখানে আবু হুরায়রা (রা) নিজেই দু’টি সাকতাতে সূরা ফাতিহা পড়তে বলেছেন। সুতরাং লেখকের ১নং আবু হুরায়রা (রা)-এর হাদীস ও তাঁরই দু’টি সাকতার হাদীস পরস্পরের ব্যাখ্যা। তেমনি সামুরা (রা)-এর হাদীসটির দাবিও। এগুলোর সমন্বয়ে মুহাদ্দিসগণ মাসআলা নির্ণয় করেছেন। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-১৪’]

লেখকের আবূ হুরায়রা (রা)-এর একটি হাদীস নিয়েছেন অপরটি ছেড়ে দিয়েছেন। যা দলিলহীনভাবে ছেড়ে দেয়াটা কুফর। কেননা অন্যান্য সাহাবীদের থেকে একটি সাকতার থাকার সংশয়টি নিম্নোক্তভাবে দূর হয়:

খ) সূরা ফাতিহার পরের সাকতার হাদীসটি যঈফ।

গ) রুকুর পূর্বের সাকতা স্বয়ং আলবানী (রহ)-এর কাছে গ্রহণযোগ্য। তিনি (রহ) লিখেছেন: দ্বিতীয় সাকতার ব্যাপারে সঠিক হচ্ছে এই যে, সেটি হবে রূকুর পূর্বে সকল কিরাআত হতে মুক্ত হওয়ার পর, সূরা ফাতিহার শেষে নয়। (যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ২/পৃ-৯৫) এছাড়াও তিনি (আলবানী রহ.) উক্ত বইয়ের ৪৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ... ‘‘আমি যেটি সঠিকের নিকটবর্তী মনে করি সেটি হচ্ছে এই যে, ইমামের পিছনে সির্রী রাকআত গুলোতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা শরীয়ত সম্মত, জাহরি রাকাআতগুলোতে নয়। তবে যদি ইমামের পক্ষ থেকে সাকতা পাওয়া যায় (নিশ্চুপ থাকেন) তাহলে পড়া যেতে পারে। (যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ, ২য় খণ্ড, পৃ.৪৭৭)

শায়খ আলবানী (রহ) নিজের স্ববিরোধী গবেষণার জবাব নিজেই দিয়েছেন। তিনি তাঁর লিখিত ‘‘তালখিস সিফাতে সালাতুন নাবিয়্যি’’(বৈরুত: আলমাকতাবুল ইসলামি ১৪০৪/১৯৮৪, পৃ. ১৮) -এ লিখেছেন:

قراءة الْمقتدي لَها : ٥٤- ويُجب على الْمقتدي أن يقرأها وراء الإمام في السرية، وفي الْجهرية أيضا إن لَم يسمع قراءة الإمام، أو سكت هذا بعد فراغه منها سكتة ليتمكن فيها الْمقتدي من قراءتِها، وإن كنا نرى أن هذا السكوت لَم يثبت في السنة

‘‘অনুচ্ছেদ: মুক্তাদীর জন্য ক্বিরাআত: ৫৪ - মুক্তাদীর উপর ওয়াজিব হল, ইমামের পিছনে সির্রি (চুপের) সালাতে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াৎ করবে। আর জাহরি সালাতেও অনুরূপ (ক্বিরাআত) করবে - যদি সে ইমামের ক্বিরাআত শুনতে না পায়। কিংবা সাকতাতে (পড়বে), যখন ইমাম তার ক্বিরাআত থেকে ফারেগ (অবসর) হয়ে সাকতা করেন - যেন মুক্তাদী সেখানে তার ক্বিরাআত করতে পারে। যদিও আমি পূর্বে বুঝেছিলাম এই সাকতা সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়।’’

৩৬
সাকতার হাদীসকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাসান বলেছেন
তা ছাড়া শায়খ আলবানী (রহ)-এর এককভাবে হাদীসটিকে যঈফ বলার মোকাবেলায় রয়েছে ব্যাপক সংখ্যক মুহাদ্দিস কর্তৃক হাদীসটি সহীহ ও হাসান বলার স্বীকৃতি।

(১) সুনানে তিরমিযীতে হাদীসটি বর্ণনার শেষে উল্লিখিত হয়েছে:

قال أبو عيسى حديث سمرة حديث حسن وهو قول غير واحد من أهل العلم ستحبون للإمام أن يسكت بعد ما يفتتح الصلاة وبعد الفراغ من القراءة وبه يقول أحمد و إسحق وأصحابنا

‘‘ইমাম তিরমিযী (রহ) বলেন: সামুরাহ (রা)‎-এর হাদীসটি হাসান। একাধিক আলিম এই কথা বলেছেন। তাঁরা সালাত শুরুর পর এবং ক্বিরাআত শেষে কিছুক্ষণ নীরব থাকা ইমামের জন্য মুস্তাহাব বলে মত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম আহমাদ (রহ) ও আমাদের উস্তাযগণের অভিমত এ-ই। [তিরমিযী ‘কিতাবুস সালাত’ باب ما جاء في السكتتين ]

অন্যত্র ইমাম তিরমিযী (রহ) বলেছেন: وسِماع الْحسن عن سَمرة صحيح

‘‘হাসান বসরি (রহ)-এর সামুরাহ (রা) থেকে শোনা সহীহ।’’ [তিরমিযী, কিতাবুল বুয়ূ‘ باب ما جاء في كراهية بيع الحيوان بالحيوان نسيئته ]

(২) ইমাম আবু দাউদ (রহ) বলেন: হাসান বসরি (রহ) থেকে সামুরাহ (রা) বর্ণিত হাদীসের সনদ সম্পর্কে ইমাম আবূ দাউদ (রহ) বলেন: هَذِهِ الصَّحِيفَةُ عَلَى أَنَّ الْحَسَنَ سَمِعَ مِنْ سَمُرَةَ . ‘‘এ সহীফাটি ঐ কথাই প্রমাণ করে যে, হাসান বসরী (রহ) সামুরাহ (রা) থেকে হাদীস শুনেছেন।’’ [আবূ দাউদ, কিতাবুস সালাত - باب التشهد في الصلاة ]

সুস্পষ্ট হল, ইমাম আবূ দাউদের (রহ) কাছেও সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বসরি (রহ) বর্ণিত হাদীসটি সহীহ। কেননা তিনি এক্ষেত্রে কিতাব থেকে বর্ণনা করতেন।

(৩) এ কারণে শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) লিখেছেন: ‘‘হাসান বসরি (রহ)-এর সামুরাহ (রা) থেকে রেওয়ায়াত সহীহ। কেননা, তিনি সামুরাহ (রা)-এর কিতাব থেকে বর্ণনা করতেন। সুতরাং ‘সামুরাহ থেকে হাসান’ সনদের ধারাবাহিকতায় ‘আন‘আনাহ থাকাটা ত্রুটি নয়।’’ [দ্র: নায়লুল মাক্বসুদ হা/৩৫৪]

(৪) হাফেয ইবনে হাজার (রহ)‎ বলেন:

قال يَحيى القطان وآخرون هي كتاب وذلك لا يقتضي الإنقطاع وفي مسند أحْمد حدثنا هشيم عن حميد الطويل وقال جاء رجل إلى الحسن فقال إن عبدا له أبق وإنه نذر أن يقدر عليه أن يقطع يده فقال الْحسن حدثنا سَمرة قال قل ما خطبنا رسول الله خطبة إلا أمر فيها بالصدقة ونَهى عن الْمثلة وهذا يقتضي سِماعه منه لغيْر حديث العقيقة وقال أبو داود عقب حديث سليمان بن سَمرة عن أبيه في الصلاة دلت هذه الصحيفة على أن الْحسن سَمع من سَمرة قلت ولَم يظهر لي وجه الدلالة بعد

‘‘ইয়াহইয়া আল-ক্বত্তান বলেন, শেষাবাধি তাঁর কাছে (সামুরার) কিতাব ছিল। আর এটা ইনক্বিতা‘ (বিচ্ছিন্নতার) প্রমাণ করে না। আর মুসনাদে আহমাদে হাশীম হাদীস বর্ণনা করেছেন হুমায়িদ আত-তাওয়িল থেকে, তিনি বলেন: একজন ব্যক্তি হাসানের কাছে আসল। সে বলল, তার কৃতদাসটি পালিয়ে গেছে। আর সে তার হাত কেটে শাস্তি প্রদানের মানত করেছে। তখন হাসান (বসরি) বললেন: সামুরাহ (হাদ্দাসানা বা) আমাদের কাছে হাদীস বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (স) আমাদের সম্বোধন করে খুব কম এমন খুতবা দিয়েছেন, যেখানে দান সাদাক্বার নির্দেশ এবং মুসলাহ (অঙ্গবিকৃতি) নিষেধ করেননি।’’ এই হাদীসটি প্রমাণ করে হাসান সামুরাহ (রা) থেকে আক্বীক্বাহ ছাড়া আরও হাদীস শুনেছেন। ইমাম আবূ দাউদ বলেন: সালাত অধ্যায়ে সুলায়মান ইবনে সামুরাহ তাঁর পিতা কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের পরে বলেন, ‘‘এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, নিশ্চয় হাসান (রহ) সামুরাহ (রা) থেকে শুনেছেন। আমি (ইবনে হাজার) বলছি: এরপরে আর কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই।’’ [তাহযিব: ৪৮৮]

অর্থাৎ কিতাব থেকে বর্ণনা করার কারণে তাঁদের মধ্যে সাক্ষাৎ না হওয়া বা না শোনার আপত্তি দূর হয়ে যায়। এটাও সুস্পষ্ট হল, সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বসরি (রহ) আক্বীক্বার হাদীস ছাড়াও অন্য হাদীস শুনেছেন।

(৫) এ কারণে ইমাম হাকিম (রহ) বলেছেন:

وحديث سَمرة ( رضـي الله عنه ) لا يتوهم متوهم ان الْحسن لَم يسمع من سَمرة ( رضـي الله عنه ) فانه قد سَمع منه

‘‘সামুরাহ (রা)‎-এর হাদীস সম্পর্কে কোনো সন্দেহ পোষণকারীর এ সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, হাসান বসরি (রহ) সামুরাহ (রা) থেকে হাদীস শোনেননি। কেননা, এটা নিশ্চিত যে, সামুরাহ (রা) থেকে হাসান (রহ) (হাদীস) শুনেছেন।’’ [আল-মুস্তাদরাক ১/২১৫]

(৬) ইমাম বুখারী (রহ) حسن عن سَمرة [সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বর্ণিত] হাদীসকে দলিল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ইমাম হাকিম (রহ) বলেছেন:

قد احتج البخاري بالْحسن عن سَمرة ( رضـي الله عنه ) ـ

‘‘ইমাম বুখারী (রহ) حسن عن سَمرة [সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বর্ণিত] হাদীসকে দলিল হিসাবে নিয়েছেন।’’ [আল-মুস্তাদরাক ২/৩৫পৃ.]

(৭) ইমাম আলী ইবনে মাদিনি (রহ) বলেন:

سِماع الْحسن عن سَمرة ( رضـي الله عنه ) صحيح ـ

‘‘হাসান থেকে সামুরার শোনা সহীহ।’’ [তিরমিযী, কিতাবুস সালাত - باب ما جاء في الصلاة الوسطي انها العصر ]

(৮) ইমাম শওকানী (রহ) বলেছেন:

فقد صحح الترمذي حديث الْحسن عن سَمرة في مواضع من سننه

‘‘ইমাম তিরমিযী নিজের সুনানের বিভিন্ন স্থানে حسن عن سَمرة [সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বর্ণিত] হাদীসকে সহীহ বলেছেন।’’ [নায়লুল আওতার ১/৬০ পৃ.]

(৯) ইমাম বায়হাক্বী (রহ) حسن عن سَمرة [সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বর্ণিত] হাদীস সম্পর্কে বলেছেন: هذا اسناد صحيح ‘‘এর সনদ সহীহ।’’ [বায়হাক্বি, কিতাবুল বু‘য়ূ - باب بيع اللحم بالحيوان ]

(১০) শায়খ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহ) ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’-তে সামুরাহ (রা) থেকে হাসান বসরি (রহ)‎-এর শোনার বিষয়ে তিনটি মতের তর্ক-বিতর্ক উপস্থাপনের শেষে নিম্নোক্ত বক্তব্য দ্বারা আলোচনা শেষ করেছেন:

وقال البخاري قال علي بن الْمدينِي سِماع الْحسن من سَمرة صحيح، ومن أثبت مقدم على من نفى انتهى

‘‘ইমাম বুখারী (রহ) বলেছেন, ‘আলী ইবনুল মাদিনি (রহ) বলেছেন: হাসানের সামুরাহ থেকে শোনাটা সহীহ। আর হাঁ-বোধক না-বোধকের উপরে প্রাধান্যপ্রাপ্ত (আলোচনা শেষ)।’’ (তুহফাতুল আহওয়াযী بابُ مَا جَاءَ فِي صَلاَةِ الْوُسْطَى أَنّهَا الْعَصْرُ ) - تلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ

সুস্পষ্ট হলো, জুমহুর মুহাদ্দিস কর্তৃক হাসান (রহ) থেকে সামুরা (রা)-এর শোনাটা স্বীকৃত এবং সাকতার হাদীসও গ্রহণযোগ্য। এ পর্যায়ে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) স্ববিরোধী মতামতের সেটাই গ্রহণযোগ্য যা জুমহুর মুহাদ্দিসগণের পরিপূরক। তাঁর অন্য মতামত তথা ‘হাসান বসরি সামুরা থেকে শোনেননি’ - সুস্পষ্ট বাতিল।

৩৭
ইমামের ক্বিরাআত পাঠের সময় চুপ থাকার দাবি - কৌশলে লঙ্ঘন
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৭: (পৃ. ১০-১১)

তাছাড়া দুই সাকতা সম্পর্কি হাদীস দুটির ভাষ্যনুযায়ী একথা প্রমাণিত নয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রুকুর পূর্বে সাকতায় মুক্তাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পাঠের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর সাহাবীগণ প্রায় সে সাকতায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন। তথাপি যারা ইমামের রুকুর পূর্বের সাকতায় সূরা ফাতিহা পাঠের পক্ষে অভিমত পোষণ করে এবং এর সমর্থনে যে সব প্রমাণ পেশ করে থাকেন তন্মধ্যে একটি হলো:

قد ذكر البيهقي في أقاويل الصحابة بإسناده عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده أنهم كانوا يقرون خلف رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا أنصت ، فإذا قرأ لم يقرءوا وإذا أنصت قرؤوا وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : كل صلاة لا يقرأ فيها بأم القرآن فهي خداج

আবু আব্দুল্লাহ আল...আবু মু'আবিয়াহ, ইবনু উমার, আমর ইবনু শু’আয়িব নিজের পিতা থেকে তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা। অর্থাৎ সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে তখন কিরাআত করতেন যখন তিনি চুপ থাকতেন। আর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিরাআত করতেন তখন তারা কিছুই পড়তেন না। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থাকতেন তখন তারা কিরাআত করতেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন (এমন) সকল সালাত যার মধ্যে সূরা ফাতিহা পড়া হয় না তা অসম্পূর্ণ । (বায়হাকী কিতাবুল কিরাআত)।

পর্যালোচনা - ১৭: আমরা পূর্বেই বলেছি হাদীসটি সাক্ষ্যমূলকভাবে উপস্থাপিত হয়। [দ্র: পর্যালোচনা-৩ ও ৫] ইমাম বায়হাক্বী (রহ) উদ্ধৃত হাদীসটি বর্ণনার পর, পরবর্তী সাহাবী ও তাবেঈদের বর্ণনা থেকে যা উপস্থাপন করেছেন। মুহাদ্দিসগণ দুই সাকতার হাদীসগুলো থেকে সেটাই বুঝেছেন। অথচ পুস্তিকাটির লেখক অস্বীকার করেছেন। আর এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত সঠিক। কেননা, সাকতা দু’টির স্থান সামুরাহ (রা) থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। আর তাতে সূরা ফাতিহা পাঠের বিষয়টি আবূ হুরায়রা (রা) ও আমর বিন শুআয়েবের হাদীসটি থেকে প্রমাণিত। তা ছাড়া শেষোক্ত হাদীসটি সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের ‘আনসাত’ ব্যাখ্যা সমৃদ্ধ। কেননা সেখানেও ইমামের ক্বিরাআতের সময় ‘আনসাত’ বা চুপ থাকার আমলটি এসেছে। পুস্তিকাটির লেখক সেগুলোর বিরোধিতা করছেন এমনসব হাদীস দ্বারা যেখানে আনসাত বা চুপ থাকা সম্পর্কে আলোচনাই নেই। তা হলে কিভাবে পুস্তিকার লেখকের দাবিনুযায়ী তার উপস্থাপিত দলিলগুলো সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা হতে পারে? বরং বিরোধী হওয়া শায কিংবা মানসুখ। যেভাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ) ও শায়খ আলবানী (রহ) বলেছেন।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৮: (পৃ. ১১)

 হাদীসটির পর্যালোচনা: “সাহাবীগণ এ পড়তেন যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থাকতেন” আর যখন “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিরাআত করতেন তখন তারা (সাহাবীগণ) কিছুই পড়তেন না" । এর অর্থ এই নয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকুর পূর্বে চুপ থাকতেন আর তখন সাহাবীগণ সূরা ফাতিহা পড়তেন। কেননা ওপরে। বর্ণিত হাদীসটিতে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখন চুপ থাকতেন, আর কখন সাহাবীগণ পড়তেন। সূরা ফাতিহা পড়া যায় এরূপ দীর্ঘ সাকতা যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকুর পূর্বে করতেন, আর সে সাকতায় সাহাবীগণ যদি সূরা ফাতিহা পড়তেন, তাহলে অবশ্যই তা অন্যান্য সাহাবীগণ একা কর্তৃক সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়ে আসত। যেরূপ বর্ণিত হয়েছে তাকবীরে। তাহরীমা ও কিরাআতের মধ্যবর্তী সময়ের সাকতা সম্পর্কে। 

পর্যালোচনা - ১৮: ঐ চুপ থাকার দাবি হলো, ইমামের ক্বিরাআত চলাকালীন সময় মুক্তাদির চুপ থাকা ও মনোযোগী হওয়া। যা পুস্তিকার লেখক কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করলেন। রুকু‘র পূর্বে সাকতা করার ব্যাখ্যা অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ নিয়েছেন। [দ্র: পর্যালোচনা-১৭] হাদীসের মধ্যকার দ্বন্দ নিরসনের নীতিমালা অনুযায়ী মুহাদ্দিসগণের উপস্থাপনাটি সঠিক।

ইমাম বায়হাক্বী তাঁর ‘কিতাবুল ক্বিরাআতে’ আলোচ্য হাদীসটি দ্বারা সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠের দলিল নিয়েছেন। তিনি (রহ) লিখেছেন:

حديث السكتتين أثبت من كل حديث يَحتج به من يقول : بترك القراءة خلف الإمام في جَميع الصلوات عند أهل الْمعرفة بالْحديث ، وذهب إلى هذا الْمذهب في الْجمع بيْن الإنصات عند قراءة الإمام وقراءة الفاتِحة عند سكوت الإمام من سَميناهم في الْجزء قبله من الصحابة والتابعين ومن بعدهم

‘‘হাদীসের বিশেষজ্ঞদের নিকট দুই সাকতার হাদীস ঐসব হাদীস থেকে বেশি প্রমাণিত যা তাদের বিরুদ্ধে দলিল হিসাবে উপস্থাপিত হয় যারা বলে, সব সালাতেই ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পাঠ ত্যাগ করবে। এই মতটি (পক্ষে-বিপক্ষের দলিলগুলোর) সামগ্রিক দাবি (সমন্বয়) করে - ইমামের ক্বিরাআতের সময় আনসাত (চুপ) থাকা, আর ইমামের সাকতাতে সূরা ফাতিহা পড়ার মাধ্যমে। যা এই পুস্তিকার শুরুতে সাহাবী (রা), তাবেঈন (রহ) ও পরবর্তীর্দের থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। [বায়হাক্বী, কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৮৫]

আমরা পূর্বে আরও কয়েকজন মুহাদ্দিস কর্তৃক হাদীসটি দ্বারা ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের অভিমত উল্লেখ করেছি। [দ্র: ‘পর্যালোচনা - ৫’]

সুস্পষ্ট হলো, অভিধানবীদ ও মুহাদ্দিস উভয়ের নিকট হাদীসটির দাবি সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ১৯: (পৃ. ১২)

আমর ইবনু শু'আয়িব বর্ণিত উপরিউক্ত হাদীসটি যে, ইমামের রুকুর পূর্বের সাকতায় মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ সংক্রান্ত হাদীস নয় তা অনুধাবনে। নিম্নে বর্ণিত হাদীসসমূহ মনোযোগ সহকারে দেখুন: 

(১) আনাস (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

  عن أنس بن مالك : أن النبي صلى الله عليه و سلم صلى بأصحابه فلما قضی صلاته أقبل عليهم بوجهه فقال : ( أتقرؤون في صلاتكم خلف الإمام والإمام يقرأ ) ؟ فسكتوا فقالها ثلاث مرات فقال قائل أو قائلون : إنا لنفعل قال : فلا تفعلوا وليقرأ أحدكم بفاتحة الكتاب في نفسه  

তোমরা কি ইমামের কিরাআত অবস্থায় কিছু পাঠ করে থাক? এটা করবে। । বরং কেবল মাত্র সূরায়ে ফাতিহা চুপে চুপে পড়বে...... (সংক্ষেপিত অনুবাদ)। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা/১৮৪৪, বুখারী জুযউল কিরআত হা/২৫৫)

পর্যালোচনা - ১৯: লেখক আমর বিন শুআয়েবের হাদীসটি অনুধাবনে ৭টি বর্ণনা এনেছেন। যার কোনোটিই আমর বিন শুআয়েবের বর্ণনার মূল দাবি ‘যখন রসূলুল্লাহ (স) পড়তেন তখন আমরা পড়তাম না, আর যখন তিনি চুপ থাকতেন তখন আমরা পড়তাম’- বক্তব্যের পরিপূরক নয়, বরং বিরোধী। কেবল তা-ই না, সূরা আ‘রাফ: ২০৪ নং আয়াত, সূরা মুযযাম্মিল: ২০ নং এবং এদের সমর্থিত হাদীসে রসূল (স), সাহাবীদের (রা) বর্ণনা, তাবেঈদের বর্ণনা ও মুহাদ্দিসগণের বুঝের বিরোধী। লেখকের উল্লিখিত হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত, যেমন - ‘এমনটি (ক্বিরাআত) করো না, মনে মনে ফাতিহা পড়’, কোনটিতে ‘সরবে ফাতিহা পড়া’, কোনটিতে বুঝা যায় না কিভাবে ফাতিহা পড়তে হবে। যার ফলে হাদীসগুলোর সনদ সহীহ বা হাসান হলেও মতন মুযতারাব হওয়াতে যঈফ হাদীস হয়। বিশেষভাবে যখন তা কুরআন ও পরিপূরক সহীহ হাদীসের বিরোধিতায় উপস্থাপন করা হয়। পক্ষান্তরে যখন সাকতার হাদীস দ্বারা ব্যাখ্যা নেয়া হয়, তখন হাদীসগুলোর মৌলিক দাবি সূরা ফাতিহা পড়ার হুকুমও পালন হয়।

আনাস (রা)-এর হাদীসেও নবী (স)এর প্রশ্ন ছিলো:

أتقرَؤونَ   في   صلاتِكم خَلْفَ الإمامِ والإمامُ يقرَأُ ؟

‘‘তোমরা কি খলফাল ইমাম (ইমামের পিছনে) পাঠ করো আর ইমাম পড়তে থাকেন।’’ যখন সাহাবীগণ স্বীকার করলেন তখন নবী (স) বললেন:

فلا تفعَلوا ولْيقرَأْ   أحَدُكم   بفاتحةِالكِتابِ   في   نفسِه  

‘‘এটা করো না, তোমাদের কেউ মনে মনে ফাতিহাতুল কিতাব পড়বে।’’

অর্থাৎ সাধারণভাবে ইমামের পড়া অবস্থায় মুক্তাদির ক্বিরাআত করা নিষিদ্ধ হলো, কেবল মনে মনে সূরা ফাতিহা পাঠের সুযোগ থাকলো। যার পদ্ধতিটি আমর বিন শুআয়েবের হাদীসটিতে সুস্পষ্ট হয়।

আমরা হাদীসটির ঐ অর্থই গ্রহণ করি, যা ইমাম বুখারী, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম তিরমিযী (রহ) ও আরবি অভিধানবীদগণ করেছেন। সূরা ফাতিহা ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় নয়, বরং সাকতা বা আনসাতের সুযোগে পাঠ করাটাই সঠিক। কেননা আলোচ্য আনসাতের দাবি পবিত্র কুরআন, সহীহ হাদীসে রসূল (স) ও সাহাবীদের (রা) বর্ণনা থেকে প্রমাণিত।

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘‘যখন আমি তা পাঠ করি, তখন আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন।’’ [সূরা ক্বিয়ামাহ: ১৮ আয়াত]

ইবনে আব্বাস (রা) আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন: فَاسْتَمِعْ لَهُ وَأَنْصِتْ ‘‘অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুনুন ও চুপ থাকুন।’’ [সহীহ বুখারী - কিতাবুল অহী হা/৫, আরও দ্র: হা/৭৫২৪]

মূলত এটি সূরা আ‘রাফের ২০৪ নং আয়াতের চুপ থাকা বা আনসাতেরই ব্যাখ্যা। যা সাহাবী আবূ হুরায়রা (রা) ও আবূ মূসা (রা) থেকেও মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

৩৮
মনে মনে পাঠ বনাম পাশ্ববর্তী ব্যক্তিকে শুনিয়ে পাঠ
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২০: (পৃ. ১২)

(২) উবাদা বিন সামিত প্রশ্ন হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

  عن عبادة بن الثاني قال كنا خلف رسول الله -صلى الله عليه وسلم- في صلاة الفجر فقرا رسول الله -صلى الله عليه وسلم- فقفلت عليه القراءة فلما فرغ قال « لعلكم تقرون خلف إمام» . قلنا نعم هذا یا رسول الله . قال «لا تفعلوا إلأ بفاتحة الكتاب فإنه لا صلاة لمن لم يقرأ بها  

“একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ফযরের জামাতে শরীক ছিলাম, সালাতে কুরআন পাঠের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পাঠ তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন সম্ভবতঃ তােমরা ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ করছ? আমরা বলি হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তখন তিনি বলেন, তোমরা সূরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য কিছু পাঠ করবে না। কেননা যে ব্যাক্তি সূরা ফাতিহা পড়বে না, তার সালাত হবে না। (সহীহ ইবনে হিব্বান হা/১৮৪৮, বুখারী। জুযউল কিরাআত হা/২৫৭-৫৮, মিশকাত হা/৮৫৪)

পর্যালোচনা - ২০: এই হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, খলফাল ইমাম (ইমামের পিছনে থাকা) অবস্থায় কোন ক্বিরাআত করা যাবে না, তবে সূরা ফাতিহা পড়া যাবে। কিন্তু একথা বর্ণিত হয়নি, ফাতিহা মনে মনে পড়বে, না সাধারণভাবে ক্বিরাআত করবে। উবাদাহ (রা)-এর পরবর্তী হাদীস (দ্র: ‘পর্যালোচনা-২২’) প্রমাণ দেয় - তিনি (রা) ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়লে পাশ্ববর্তী ব্যক্তি তা শুনতে পেতো। এ পর্যায়ে জাহরি সালাতে ইমামের ক্বিরাআত করা অবস্থায় প্রত্যেক মুক্তাদির ক্বিরাআত পার্শ্ববর্তী মুসল্লি শুনতে পারবে এবং ইমামের ক্বিরাআত শোনা থেকে বঞ্চিত হবে। যা কুরআনের আয়াত ‘‘যখন কুরআন পড়া হয় তখন মনোযোগের সাথে শোন ও চুপ থাক।’’ (সূরা আ‘রাফ: ২০৪)-এর বিরোধী হয়। পূর্বে নবী (স) ও সাহাবীদের তাফসির থেকে প্রমাণিত হয়েছে: ঐ কুরআন তিলাওয়াত জাহরি সালাতে ইমামের তিলওয়াতকে বুঝানো হয়েছে।

তা ছাড়া এভাবে প্রত্যেকে মুক্তাদি সূরা ফাতিহা পাঠ করলে ইমাম বা মুক্তাদি প্রত্যেকের অসুবিধা হবে। পক্ষান্তরে লেখকের উদ্ধৃত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত পূর্বের হাদীসটিতে বর্ণিত হয়েছে:

فلا تفعَلوا ولْيقرَأْ   أحَدُكم   بفاتحةِالكِتابِ   في   نفسِه  

‘‘তোমরা এটা (ক্বিরাআত) কোরো না, তোমাদের কেউ মনে মনে ফাতিহাতুল কিতাব পড়বে।’’

অর্থাৎ ক্বিরাআত করা যাবে না কিন্তু মনে মনে কেবল সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। বুঝা গেলো, উবাদা (রা) বর্ণিত হাদীসটি আনাস (রা)-এর হাদীসের বিরোধী। আবার আনাস (রা)-এর হাদীসটির দাবি আমর ইবনে শুআয়েবের হাদীসের বর্ণনা:

أِنَّهُمْ كَانُوْا يَقْرَءُوْنَ خَلْفَ رَسُوْلِ اللهِ إِذَا أنْصَتَ فَاِذَا قَرَأَ لَمْ يَقْرَءُوْا وَإِذَا انْصَتَ قَرَءُوْا

‘‘তাঁরা অর্থাৎ সাহাবাগণ রসূলুল্লাহ (স)-এর পিছনে তখন পড়তেন যখন তিনি চুপ থাকতেন। আর যখন রসূলুল্লাহ (স) পড়তেন তখন তাঁরা পড়তেন না। অতঃপর যখন রসূলল্লাহ (স) চুপ থাকতেন তখন তাঁরা পড়তেন। [. সহীহ : বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৬৯ ; এর সনদ সহীহ [কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৫৫, তাফসীরে কুরআনে ‘আযীয ১/৮৫ পৃ.]।]

উক্ত ব্যাখ্যা গ্রহণ ছাড়া ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ)-এর ব্যাখ্যাই প্রাধান্য পায় যে, লেখকের হাদীসটি কুরআন ও সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ায় শায। কিংবা শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) ব্যাখ্যা ‘‘ইমামের সাথে সাথে ফাতিহা পড়ার হাদীসগুলো মানসুখ।’’ শায়খ আলবানী (রহ)-এর সমর্থন রয়েছে লেখকের পরবর্তী উবাদাহ (রা) হাদীসে [দ্র: ‘পর্যালোচনা - ২২’]

আমাদের কাছে, সাকতা বা আনসাতের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ করলে লেখকের হাদীসগুলো পরস্পরের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণযোগ্য। অন্যথায় ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) ও শায়খ আলবানী (রহ)-এর বিশ্লেষণ লেখকের দলিলগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

৩৯
মানসুখ ও শায হাদীস
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২১: (পৃ. ১৩)

عن عبد الله بن السائب قال صلى لنا النبي صلى الله عليه وسلم الصبح بمكة فاستفتح سورة المؤمنين حتى جاء ذكر موسى وهارون أو ذكر عيسى محمد بن عباد يشك أو اختلفوا عليه أخذت النبي صلى الله عليه وسلم سعلة فركع  

(৩) আব্দুল্লাহ ইবনুস সাইব (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় আমাদের নিয়ে ফযরের সালাত আদায় করলেন এবং সুরা মু'মিনুন শুরু করলেন। যখন মূসা প্রাণি ও হারুন গল্প অথবা ঈসা মণি এর নামের উল্লেখিত আয়াত পর্যন্ত পৌছলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাশি আসল। তিনি রুকুতে গেলেন। (মুসলিম হা/৯০৪)

পর্যালোচনা - ২১: এই ঘটনাটি মক্কার। আব্দুল্লাহ ইবনে সাইব কুরাইশী (রা) মক্কাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সূরা মু’মিনীন মাক্কী সূরা। পক্ষান্তরে আবূ হুরায়রা (রা), সামুরাহ (রা) উভয়েই মদীনাতে হিজরতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। [রিজালশাস্ত্রের কিতাব দ্র:]

সামুরাহ (রা)-এর সাকতার হাদীসটি প্রমাণ দেয় ইমরান বিন হুসাইন (রা)-এর সাথে তাঁর কথোপকথন হয়েছিল, অর্থাৎ নবী (স)-এর মৃত্যুর পরে। আর সাহাবী উবাই ইবনে কা‘ব আনসারি (রা) সামুরার স্মরণ থাকার কথা স্বীকার করলেন মদীনাতে। অর্থাৎ লেখকের উল্লিখিত ‘কাশি আসার’ বর্ণনাটি সাকতার হুকুমের অনেক পূর্বের বর্ণনা।

সাকতার হাদীসগুলোর বিরোধিতার জবাবে শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) লিখেছেন: ‘‘আবূ হুরায়রা (রা) মাদানি, আবূ সালামাহ আব্দুর রহমান আত-তাবেঈ (রহ) আল-মাদানী - এঁরা কি এই ‘আমলটি মদীনা থেকে বাইরে গিয়ে করতেন!!??’’ [নাসরুল বারি ফি তাহক্বীক্বে জুযউল ক্বিরাআত হা/২৭৫ নং এর ব্যাখ্যা দ্র:]

লেখকের পরবর্তী হাদীসটি প্রমাণ দেয়, ক্বিরাআত করা সম্পর্কিত কোনো কোনো হুকুম মানসুখ হয়েছে।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২২: (পৃ. ১৩)

 (৪) ফজরের জামাতে ইমামের কিরাআত পাঠ অবস্থায়ই উবাদা বিন সামিত কে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে শুনে, ইবনে রাবিয়াহ আল-আনসারি । সালাত শেষে উবাদা বিন সামিত কে প্রশ্ন করলেন, আমি শুনেছি আপনি সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন, উবাদা বিন সামিত (রা) বললেন:

  نعم صلى بنا رسول الله -صلى الله عليه وسلم - بعض الصلاة التي يجهر فيها بالقراءة ، فقال : لا يقرأ أحد ثم إذا جرت بالقراءة إلا بأم القرآن |

 হ্যা, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উচ্চস্বরে কিরাআত | পাঠ করা কতক সালাত শেষে বলেছেন, যখন সালাতে উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠ করা হয়, তখন সূরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য কিছু পাঠ করবে না। (বুখারী জুযউল কিরাআত হা/৬৫)

পর্যালোচনা - ২২: এই হাদীসটি প্রমাণ দেয়, তখন সাহাবীগণ ইমামের পিছনে মনে মনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন না। বরং পাশ্ববর্তী অপর মুক্তাদিও তা শুনতে পেতেন। অথচ লেখক নিজেই আনাস (রা) থেকে উল্লেখ করেছেন:

فلا تفعَلوا ولْيقرَأْ   أحَدُكم   بفاتحةِالكِتابِ   في   نفسِه  

‘‘এটা কোরো না, তোমাদের কেউ মনে মনে ফাতিহাতুল কিতাব পড়বে।’’

বুঝা যাচ্ছে, উবাদা (রা)-এর হাদীসের হুকুমটি মানসুখ। আবার এভাবেও বলা যায়, ইমামের ক্বিরাআতে সময় চুপ থেকে মনোযোগী না হয়ে পড়তে থাকার বর্ণনাগুলো পরস্পর বিরোধী হওয়ায় শায। যেভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেছেন।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৩: (পৃ. ১৩-১৪)

  یزید بن شريك أنه سأل عمر عن القراءة خلف الامام فقال اقرأ بفاتحة الكتاب قلت وان كنت انت قال وان كنت انا قلت وان جهرت قال وان جهرت  

(৫) ইয়াযীদ ইবনু শারীক এলাকায় ইমামের পিছনে কিরআত পাঠ সম্পকে উমর শে-কে প্রশ্ন করলে উমার ও বললেন, তুমি সূরা ফাতিহা পড়। আমি বললাম আপনি যদি ইমাম হন? তিনি বললেন, আমি ইমাম হলেও আমার পিছনে পড়বে। আমি বললাম, আপনি যদি উচ্চস্বরে কিরআত পাঠ করেন তাহলে? তিনি বললেন আমি উচ্চস্বরে কিরআত পাঠ করলেও তুমি সূরা ফাতিহা পড়বে। (বায়হাকী সুনানুল কুবরা হা/৩০০৫ ও ৩০০৭, বুখারী জুযউল কিরাআত হা/৫১, সুনানে দারাকুতনী হা/১১৯৭-৯৮) 

পর্যালোচনা - ২৩: এই হাদীসটিতে ইমামের ক্বিরাআত পাঠের সময় চুপ থাকা সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসের বাহ্যিকভাবে বিরোধিতা দেখা যায়। এ পর্যায় হাদীসটির বাহ্যিক অর্থ কুরআন ও তার পরিপূরক হাদীসের বিরোধী হওয়ায় ইবনে তাইমিয়া (রহ) উক্ত মর্মের হাদীসগুলোর দাবিকে শায বলেছেন। আর শায়খ আলবানী (রহ) মানসুখ বলেছেন। পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুহাদ্দিস সাকতার হাদীস দ্বারা উক্ত মর্মের হাদীসগুলোকে ব্যাখ্যামূলক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিরোধীপক্ষের দলিলের উপস্থাপনার জবাবে আমাদের কাছে উক্ত উপস্থাপনাগুলো হাদীসের নীতিমালার আলোকে যথোপযুক্ত। আল্লাহ তাআলা সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।

তা ছাড়া পূর্বে উল্লিখিত আমর বিন শুআয়েবের হাদীসের দাবি: ‘যখন নবী (স) পড়তেন, তখন পড়তেন না। আর যখন নবী (স) চুপ থাকতেন তখন পড়তেন।’’ অর্থাৎ ইমামের পিছনে (খলফাল ইমাম) পড়তে হবে কিন্তু ইমামের সাথে সাথে নয়। যা কুরআনের আয়াত, রসূলের (স) হাদীস, আসারে সাহাবী (রা), তাবেঈ (রহ) ও মুহাদ্দিসগণ (রহ) থেকে প্রমাণিত।

৪০
একটি বর্ণনা অপর বর্ণনার ব্যাখ্যা
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৪: (পৃ. ১৪)

عن بن عباس قال لا تدع أن تقرأ خلف الإمام بفاتحة الكتاب جهر أو لم يجهر

(৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কি বলেন, ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া ছেড়ে দিও না, চাই ইমাম উচ্চস্বরে কিরআত পড়ক বা আস্তে পড়ক। (ইবনু আবূ শায়বাহ ১/৩৭৩ পৃ.)।

পর্যালোচনা - ২৪: ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার দাবিকে আমরাও মানি। কিন্তু সেটা ইমামের ক্বিরাআত করা অবস্থায় নয়। যেভাবে ইবনে আব্বাস (রা)-এর নিম্নোক্ত বর্ণনাতে এসেছে:

عن ابن عباس رضي الله عنه قال : الْمؤمن في سعة من الاستماع إليه إلا في صلاة مفروضة أو المكتوبة أو يوم جمعة أو يوم فطر أو يوم أضحى يعني ( وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا (

‘‘অর্থাৎ আল্লাহর বাণী (সূরা আ‘রাফ: ২০৪): ‘যখন কুরআন পড়া হয় তখন মনোযোগের সাথে শোন ও চুপ থাক’ - এর দাবি ইসতিমা‘ (মনোযোগের সাথে শোনা) মানতে মু’মিনের অবকাশ আছে (ইচ্ছাধীন), কিন্তু (জাহরি সালাত যেমন -) ফরয সালাত, জুমু‘আর সালাত, ‘ঈদুল ফিতর বা ‘ঈদুল আযহার সালাত ছাড়া (অর্থাৎ জাহরি সালাতে শোনার হুকুমটি বাধ্যতামূলক)।’’ [কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ১০৭, হা/২৫৩; যুবায়ের আলী যাঈ এই বর্ণনাটিকে হাসান বলেছেন (নাসরুল বারী ফি তাহক্বীক্বে জুযউল ক্বিরাআত পৃ. ৬৬, হা/১৮-এর ব্যাখ্যা)]

যদি কেউ বলেন, ইবনে আব্বাসের উক্তিগুলো পরস্পর বিরোধী। আমরা বলবো, বরং ব্যাখ্যা। তা ছাড়া বিরোধের সময় কুরআন ও সুন্নাহর দিক ফেরার নির্দেশ আছে (সূরা নিসা: ৫৯)। এ পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ ‘‘যখন আমি তা পাঠ করি, তখন আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন।’’ [সূরা ক্বিয়ামাহ: ১৮ আয়াত]

ইবনে আব্বাস (রা) আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন: فَاسْتَمِعْ لَهُ وَأَنْصِتْ ‘‘অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শুনুন ও চুপ থাকুন।’’ [সহীহ বুখারী - কিতাবুল অহী হা/৫, আরও দ্র: হা/৭৫২৪]

এক্ষণে কুরআন ও ইবনে আব্বাস (রা)-এর অধিকাংশ তাফসিরই কুরআন পাঠের সময় শোনা ও চুপ থাকার হুকুম দেয়। এর বিপরীত মর্মে আলোচ্য আসারটি কুরআন ও ইবনে আব্বাস (রা)-এর অধিকাংশ আসারের বিরোধী তথা শায বিধায় পরিত্যাজ্য।

৪১
ইমামের সানার স্থানে মুক্তাদির সূরা ফাতিহা পাঠ
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৫: (পৃ. ১৪)

  عن ابي هريرة قال : اذا قرأ الإمام بأم القرأن فاقرأ بها واسبقه فإنه اذا قال ولا الضالين قالت الملائكة امين من وافق قمن أن يستجاب لهم

(৭) আবু হুরায়রা (রা) বলেন, ইমাম যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করে তখন তুমিও তার সঙ্গে সঙ্গে পাঠ কর এবং তা আগে শেষ কর। কেননা ইমাম যখন “ওয়ালাদ দ্বলীন" বলে তখন ফিরিশতারা আমীন বলে। যার আমীন বলা তাঁদের আমীনের সাথে মিলে যাবে তা কবুল হওয়ার জন্য সহায়ক হবে। (বুখারী জুযউল কিরআত হা/২৩৭) 

পর্যালোচনা - ২৫: লেখকের তরজমাটি গ্রহণ করলে হাদীসটির দাবি হয়, ইমামের সূরা ফাতিহা পাঠের সময় মুক্তাদির সূরা ফাতিহা পাঠ করবে, কিন্তু শেষ করবে ইমামের পূর্বে। যা আবু হুরায়রা (রা)-এর বর্ণিত মারফু‘ হাদীস তথা নবী (স)-এর নির্দেশের বিরোধী হয়। সেখানে নবী (স) বলেছেন:

إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا وَإِذَا قَالَ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ وَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوا

‘‘অনুসরণ করার জন্যই তো ইমাম নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং যখন তিনি তাকবীর বলেন, তখন তোমরা তাকবীর বলবে। আর যখন তিনি ক্বিরাআত পাঠ করবেন তখন তোমরা চুপ থাকবে। আর যখন তিনি বলবেন: غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ তখন তোমরা বলবে: ‘‘আমীন’’। আর যখন তিনি রুকু করেন, তখন তোমরা রুকু করবে।.....’’ [শায়খ আলবানী হাদীসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন (তাহক্বীক্ব ইবনে মাজাহ হা/৮৪৬); শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) বলেছেন: হাদীসটি সহীহ। হাদীসটি আবু দাউদ (হা/৬০৪) বর্ণনা করেছেন। যা আবু খালিদের হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম মুসলিম (রহ) এটিকে সহীহ বলেছেন। এই হাদীসটি দ্বারা ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ বর্জনের দলিল হয় না। (উর্দু তাহক্বীক্বকৃত আবু দাউদ হা/৮৪৬)]

হাদীসটি সুস্পষ্ট করে, সূরা ফাতিহা পাঠের সময় মুক্তাদিকে চুপ থাকতে হবে। আবূ হুরায়রা (রা) আরও বলেন:

اقرؤا اذا سكتوا واسكتوا اذا اقرؤا ـ

‘‘যখন ইমাম চুপ থাকেন তখন তোমরা পড়ো, আর যখন ইমাম ক্বিরাআত করেন তখন তোমরা চুপ থাকো।’’ [বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআত পৃ. ৬৬, এর সনদ হাসান]

প্রথম হাদীসটির মর্মে আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণনাটি নিম্নরূপ:

রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,

إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَلْيَؤُمَّكُمْ أَحَدُكُمْ وَإِذَا قَرَأَ الْإِمَامُ فَأَنْصِتُوا

‘‘যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াও তখন তোমাদের একজন ইমাম হবে। যখন সে ক্বিরাআত করে তখন চুপ থাকো।’’ [মুসনাদে আহমাদ, মুহাক্কেক্ব শুআয়েব আরনাউত বলেন: এর সনদটি সহীহ, সবাই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনাকারী কেবল ‘আলী বিন ‘আব্দুল্লাহ ছাড়া। তিনিও সহীহ বুখারীর বর্ণনাকারী। (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ ৪/৪১০/১৯৭৩৮), শায়খ আলবানী (রহ) হাদীসটির সনদ সহীহ বলেছেন। (আসলি সিফাতে সালাত ১/৩৫২)]

সহীহ মুসলিমে কাতাদার সনদে বর্ণিত হয়েছে: وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا ‘‘আর যখন ক্বিরাআত করে তখন চুপ থাকো।’’ [সহীহ মুসলিম - ঐ, মিশকাত ২/৭৬৯]

বুঝা যাচ্ছে, একাধিক সাহাবী নবী (স) থেকে ইমামের সাথে সাথে সূরা ফাতিহা ও ক্বিরাআত পড়া নিষেধ হওয়ার হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুতরাং আমাদের নিকট আবু হুরায়রা (রা)-এর আলোচ্য হাদীসটির তরজমা হবে:

إذا قرأ الامام بام القران فاقرأ بِها واسبقه ـ

‘‘যখন ইমাম সূরা ফাতিহা পাঠ করেন তখন তোমরাও সূরা ফাতিহা পাঠ করো আর তার পূর্বে পাঠ কর।’’ [বুখারীর জুযউল ক্বিরআত হা/২৮৩]

শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ তাঁর ‘নাসরুল বারী তাহক্বীক্বে জুযউল ক্বিরআতের’ ২৮১ নং হাদীসে বলেছেন: ২৮৩ নং হাদীসটি সানার সময় সূরা ফাতিহা পড়া সম্পর্কিত। [দ্র: তাহক্বীক্ব জুযউল ক্বিরাআত (বাংলা) ২৮১ নং হাদীসের টীকা, টীকা নং ৪৫৭]

ইমাম আহমাদের ছাত্র ইমাম আবূ দাউদ (রহ) লিখেছেন:

سَمعت احْمد سئل عن القران خلف الامام قال اقرأ فيها ولا تَجهر قيل له ففيها الْجهر قال لا يقرأ الا ان تبتدره فتقرأ بفاتِحة الكتاب قبل ان يقرأ

‘‘আমি ইমাম আহমাদ (রহ) থেকে শুনেছি, তাঁকে ইমামের পিছনে কুরআন পাঠ করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি (রহ) জবাবে বলেন: ‘‘পড়ো, কিন্তু উঁচু আওয়াজে পড়ো না।’’ তাঁকে ইমামের জাহরি সালাতে ক্বিরাআত করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন: ‘‘ পড়ো না, তবে ইমামের পূর্বে সূরা ফাতিহা পড়া ছাড়া।’’ [আল-মাসায়েল, পৃ. ৩১]

সানার সময় সূরা ফাতিহা পাঠ করার সমর্থনে আবু হুরায়রা (রা)-এর অপর একটি হাদীস হলো:

للإمام سكتتان ، فاغتنموا القراءة فيهما بفاتحة الكتاب

‘‘ইমামের জন্য দু’টি সাকতা আছে। ফাতিহাতুল কিতাবকে দু’সাকতার মধ্যে তোমরা গণিমত মনে করো।’’ [ইমাম বুখারীর জুযউল ক্বিরাআত হা/২৭৫, মুহাদ্দিস যুবায়েরআলী যাঈ লিখেছেন, হাদীসটির সনদ হাসান (নাসরুল বারী পৃ. ২৯২)]

আর সামুরাহ (রা)-এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী (স) তাকবীরের পরে ও রুকুর পূর্বে সাকতা করতেন। হাদীসগুলো পরস্পরের ব্যাখ্যা।

এই অর্থ গ্রহণ করলে আবু হুরায়রা (রা)-এর নিজের বক্তব্যটি গ্রহণযোগ্য হয়। অন্যথা আবু হুরায়রা (রা) থেকে নবী (স)-এর বক্তব্যটি দ্বারা লেখক যে অর্থে হাদীসটি নিয়েছেন, তা মানসুখ বা শায হয়। যেভাবে ইমামের ক্বিরাআত না শুনে মুক্তাদির সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে আলবানী ও ইবনে তাইমিয়া (রহ) দাবি করেছেন।

৪২
সানাতে সূরা ফাতিহা পাঠের সমর্থনে সাক্ষ্যমূলক মারফু‘ হাদীস
ইমাম বায়হাক্বী (রহ) বর্ণনা করেছেন:

وأنبأني أبو عبد الله الحافظ ، أنا أبو علي الحافظ ، أنا الحسن بن سفيان ، نا هشام بن عمار ، نا صدقة ، نا المثنى يعني ابن الصباح ، عن عمرو بن شعيب ، عن أبيه ،

عن عبد الله بن عمرو ، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم خطب الناس فقال : « من صلى صلاة مكتوبة أو سبحة فليقرأ فيها بأم القرآن ... ومن كان مع الإمام فليقرأ بأم القرآن قبله إذا سكت ... »

‘‘... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেন: রসূলুল্লাহ (স) খুতবাতে বলেছেন: যে কেউ ফরয বা নফল সালাত পড়ে সে যেন তাতে উম্মুল কুরআন পড়ে।... আর যার সাথে ইমাম আছে, সে যেন উম্মুল কুরআন পড়ে তার (ইমামের) পূর্বে যখন সে সাকতা করে।...’’ [বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআত, পৃ. ৫৪]

অভিযোগ: এই সনদটিতে মুসান্না আছেন। হাদীসগুলিয়ে ফেলার জন্য তার হাদীস ইমাম বুখারী, ইবনুল ক্বাত্তান প্রমুখ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তিনি সালেহ ছিলেন, কেবল বৃদ্ধ বয়সে গুলিয়ে ফেলতেন। [নিহায়াতুল ইগতিবাত ১/৩০১ পৃ. ৮৮ নং, টীকাসহ (সংক্ষেপিত), অনুরূপ: আলবানী যঈফাহ হা/৯৯২-এর বিশ্লেষণ]

জবাব: উক্ত অভিযোগের জবাব দিয়েছেন ইবনুল কিয়াল। তিনি লিখেছেন:

قال البخاري : قال يحيى القطان : لم يترك المثنى من أجل عمرو بن شعيب ونقل ابن أبي حاتم عن يحيى القطان قال : لم نتركه من أجل حديث عمرو بن شعيب ولكن كان اختلاطا منه في عطاء وقال أحمد لا يساوي حديثه شيئا مضطرب الحديث

‘‘ইমাম বুখারী (রহ) বলেছেন, ইমাম ইয়াহইয়া আল-ক্বত্তান বলেন: আমর বিন শু‘আবের কারণে মুসান্নার হাদীস ত্যাগ করা হয় না। আর ইবনে আবি হাতেম ইয়াহইয়া আল-ক্বত্তান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রহ) বলেন: আমরা আমর বিন শু‘আয়েবের কারণে তার হাদীস ত্যাগ করিনি, তার ইখতিলাত (বর্ণনার কমবেশি হওয়া) হলো আতার ব্যাপারে। আর ইমাম আহমাদ বলেছেন: তাকে মুযতারাবুল হাদীস হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। [আল-কাওকিবুন নিরাত ১/৫০৬ পৃ. শামেলা সংস্করণ]

উক্ত উদ্ধৃতি থেকে জানা গেল, মুসান্না থেকে আমর বিন শু‘আয়েবের বর্ণনাতে সমস্যা নেই। আর আমাদের উল্লিখিত সনদটিও সেটাই। তা ছাড়া মুসান্নার ভুল ও যঈফ হওয়াকে মেনে নিলেও সমস্যা নেই। কেননা, ইবনে লিহইয়াহ একই মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তিনি হলেন সহীহ মুসলিমের রাবি। যাকে অন্যান্য বর্ণনাকারীদের সমর্থনসহ ইমাম মুসলিম হাদীস গ্রহণ করেছেন। সনদসহ বর্ণনাটি নিম্নরূপ:

وأنبأني أبو عبد الله الحافظ ، نا أبو علي الحافظ ، أنا أبو يعلى الموصلي أنا كامل بن طلحة ، نا ابن لهيعة ، نا عمرو بن شعيب ، عن أبيه ، عن جده ، :

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم خطب الناس فقال : من صلى صلاة مكتوبة فليقرأ بأم القرآن ... ومن كان مع الإمام فليقرأ قبله إذا سكت ، ومن صلى صلاة فلم يقرأ فيها فهي خداج فهي خداج ثلاث مرات

‘‘আমর বিন শুআয়েব আন আবিহি আন জাদ্দিহি থেকে বর্ণিত: রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: যে ফরয সালাত পড়ে সে যেন উম্মুল কুরআন পড়ে ...। আর যার ইমাম আছে, সে যেন ইমামের পূর্বে পড়ে যখন সে সাকতা করে। আর যে সালাত পড়ে কিন্তু (উম্মুল কুরআন) পড়ে না, তবে তা ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ, তিনবার বললেন।’’ [বায়হাক্বীর কিতাবুল ক্বিরাআত, পৃ.৫৪]

তাহক্বীক্ব: পাকিস্তানি আহলেহাদীস আলেম ইরশাদুল হক্ব আসারি লিখেছেন:

ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ) নিজের সনদে এই বর্ণনাটি ابن لَهيعة قال حدثنا عمرو بن شعيب শব্দে রেওয়ায়াত করে ইবনে লাহিয়াহ কর্তৃক ‘আমর ইবনে শু‘আয়েব থেকে শোনাটা সুস্পষ্ট করেছেন। এই সবকিছু تنوير الْحوالك (২/১১৮ পৃ.) প্রভৃতিতে উল্লেখ আছে।

আলোচ্য বর্ণনাটিতে কখনো نا عمرو বলেছেন, সুতরাং শোনার ব্যাখ্যা আর কী দ্বারা হবে? অবশ্য ইমাম আহমাদ (রহ) বলেছেন: ইবনে লাহিয়াহ (রহ) মুসান্না বিন সাবাহ’র মধ্যস্ততায় বর্ণনা করতেন। অতঃপর মুসান্না বিন সাবাহ’র মধ্যস্ততায় তা মৌলিকভাবে বর্ণনা করতে থাকেন। (তাহযিব প্রভৃতি)

.... তাছাড়া ইমাম বায়হাক্বী (রহ) লিখেছেন:

مُحمد بن عبد الله بن عبيد بن عمير وإن كان غير مُحتج به وكذلك بعض من تقدم مِمن رواه عن عمرو بن شعيب فلقراءة الْمأموم فاتِحة الكتاب في سكتة الإمام شواهد صحيحة عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده خبرا عن فعلهم

‘‘মুহাম্মাদ বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন ‘উবায়েদ ও অন্যান্যরা ‘আমর বিন শু‘আয়েব থেকে যা বর্ণনা করেছেন - যদিও তা গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু ‘আমর বিন শু‘আয়েব ‘আন আবীহি ‘আন জাদ্দিহি থেকে সাহাবা (রা)-দের আমলের সহীহ সনদের বর্ণনাটি এর সাক্ষ্য।’’

তা ছাড়া হাবিবুর রহমান আল-আ‘যামি (রহ) লিখেছেন:

اخرج هق ( اى البَيهقى ) فى كتاب الْقراءة ( صـ ٦٩ ) من طريق عبيد الله بن عمر بن عمرو بن شعيب ما يقرب من هذا .... الْخ ( حاشية الْمصنف صـ  ج )

‘‘ইমাম বায়হাক্বী  ‘কিতাবুল ক্বিরাআতে’ (পৃ. ৬৯) عبيد الله بن عمر بن عمرو بن شعيب সনদে যা বর্ণনা করেছেন তা এই ( مُحمد بن عبد الله بن عبيد الله الْمثنى প্রমুখের) বর্ণনাটির নিকটবর্তী।’’

সুতরাং এর মারফু‘ বর্ণনার ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেয়া উসূলী দিক থেকে সহীহ নয়। । [ ইরশাদুল হক্ব আসারি, তাওযিহুল কালাম পৃ. ৫৮১]

এ পর্যায়ে ইবনে উমায়েরের সনদে অপর একটি বর্ণনা আছে। কিন্তু তার হাদীস সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয় না বিধায় উপস্থাপন যোগ্য নয়। কিন্তু শায়খ আলবানী (রহ) পূর্ববর্তী বর্ণনা দু’টির প্রতি যে অভিযোগ করেছেন (আলবানীর ‘যঈফাহ’ হা/৯৯২), তার জবাবে শায়খ ইরশাদুল হক্ব আসারির (হাফি) উপরের উপস্থাপনাই যথেষ্ট মনে করছি।

উপরোক্ত পর্যালোচনার আলোকে সুস্পষ্ট হয়, সাহাবী আবূ হুরায়রা (রা) থেকে সানাতে সূরা ফাতিহা পড়ার সমর্থনে হাসান সনদের মারফু‘ হাদীস রয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ।

৪৩
আলোচনার পুনরাবৃত্তি
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৬: (পৃ. ১৪)

উপরিউক্ত হাদীস ও আসারসমূহের পর্যালোচনা

উবাদা বিন সামিত হয় হতে বর্ণিত হাদীসটি পাঠে আমরা জানতে পারলাম, ফযরের জামাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কিরআত পাঠ অবস্থায়ই মুক্তাদীগণ স্বরবে কিরআত পাঠ করতেন। যে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কিরআত পাঠে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্তাদীগণকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা যেন ইমামের উচ্চস্বরে কিরআত পাঠ করা সালাতে কেবল মাত্র সূরা ফাতিহা পাঠ করে। আর ওপরে উল্লেখিত আনাস (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে মুক্তাদীগণকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেনঃ ইমামের উচ্চস্বরে কিরআত পাঠ করা সালাতে وليقرأ أحدكم بفاتحة الكتاب في نفسه কেবল। মাত্র সূরায়ে ফাতিহা চুপে চুপে পড়তে। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা/১৮৪৪, বুখারী জুযউল কিরাআত হা/২৫৫) যাতে ইমামের কিরআতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।

পর্যালোচনা - ২৬: লেখক উবাদাহ (রা) থেকে দু’টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার কোনোটি থেকেই প্রমাণিত হয় না, জাহরি বা প্রকাশ্য ভাবে সূরা ফাতিহা পাঠ পরবর্তী সময়ে নিষেধ। বরং উবাদাহ (রা)-এর হাদীস দু’টি পরস্পরের ব্যাখ্যা নিলে এটাই প্রমাণিত হয়, ক্বিরাআত করা যাবে না তবে, সূরা ফাতিহা জাহরি (সরবে) পাঠ করা যাবে।

পক্ষান্তরে আনাস (রা)-এর হাদীস থেকে বুঝা যায়, কোনো ধরনের ক্বিরাআত করা যাবে না, কেবল সূরা ফাতিহা মনে মনে পড়া যাবে। এখানে ক্বিরাআত করা ও মনে মনে পড়ার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। চুপে চুপে পড়ার যে অর্থ লেখক করেছেন, তার দাবি উবাদাহ (রা)-এর হাদীস (দ্বারা নিলে এটাই হয় যে, পার্শ্ববর্তী অন্য মুক্তাদির পাঠ শোনা যাবে এভাবে পাঠ করতে হবে। এই অর্থ অনুযায়ী প্রত্যেক মুক্তাদি এভাবে পাঠ করলে জামাআতের সালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতেই থাকবে।

পুস্তিকাটির লেখকের উল্লিখিত হাদীসগুলো বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত, যেমন - ‘এমনটি (ক্বিরাআত) কোরো না, মনে মনে ফাতিহা পড়’, কোনোটিতে ‘সরবে ফাতিহা পড়া’, কোনোটিতে বুঝা যায় না কিভাবে ফাতিহা পড়তে হবে। যা হাদীসগুলোর সনদ সহীহ বা হাসান হলেও মতন মুযতারাব হওয়াতে যঈফ হাদীস হয়। বিশেষকরে যখন তা কুরআন ও পরিপূরক সহীহ হাদীসের বিরোধিতায় উপস্থাপন করা হয়। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৭: (পৃ. ১৫)

অন্যদিকে আব্দুল্লাহ ইবনুস সাইব তে বর্ণিত মুসলিমের হাদীসটি পাঠে আমরা জানতে পারলাম যে, ফযরের জামাতে কিরআত শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাকতা না করেই রুকুতে গেলেন। (মুসলিম হা/৯০৪)।

পর্যালোচনা - ২৭: পূর্বে প্রমাণ করা হয়েছে (‘পর্যালোচনা-২১), এই হাদীসটি মাক্কী। পক্ষান্তরে সাহাবী আবু হুরায়রা, সামুরাহ (রা) প্রমুখের বর্ণিত সাকতার হাদীসটি মাদানি। তাঁদের সমর্থনে রয়েছে আমর বিন শু‘আয়েবের হাদীস ও ব্যাপক সংখ্যক তাবেঈ ও মুহাদ্দিসগণের সমর্থন। কাজেই হাদীসটির দাবি মানসুখ।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৮: (পৃ. ১৫)

আর মুক্তাদীর জন্য ইমামের রুকুর পূর্বের সাকতায় সূরা ফাতিহা পাঠের সময় নির্ধারিত থাকলে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাকতা না করে (অর্থাৎ মুক্তাদীগণকে সূরা ফাতিহা পাঠের সুযোগ না দিয়ে) রুকু। করতেন না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই বলেছেন:

  لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب  

“যে ব্যক্তি সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না, তার সালাত হলো না”। (বুখারী হা/৭২০ ও মুসলিম হা/৭৬০) । 

তাছাড়া ইমামের রুকুর পূর্বের সাকতায় সূরা ফাতিহা পড়ার প্রচলন থাকলে: (ক) উবাদা বিন সামিত প্রশ্ন ফজরের জামাতে ইমামের উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠ অবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন না। 

পর্যালোচনা - ২৮: পূর্বে সামুরাহ (রা) থেকে প্রমাণিত হয়েছে, নবী (স) দু’টি সাকতা করতেন। [দ্র: পর্যালোচনা-১৬]

আবু হুরায়রা (রা) দু’টি সাকতাতে সূরা ফাতিহা পড়ে নিতে বলেছেন। [দ্র: পর্যালোচনা-১০]

সূরা ফাতিহা পাঠ ছাড়া সালাত হবে না - সেটা আমরাও মানছি। স্বয়ং সাহাবীগণ (রা) রসূলুল্লাহ (স)-এর ক্বিরাআত অবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন না। পড়তেন বিরতিতে (সাকতা বা আনসাতে)। যেভাবে আমর বিন শুআয়েবের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। [দ্র: পর্যালোচনা - ১৮]

উবাদা বিন সামিত (রা) থেকে ইমামের পিছনে সরবে পাঠের বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, সাহাবীদের এভাবে পাঠের হুকুম মানসুখ হয়েছে। [দ্র: পর্যালোচনা - ২২, আরও দ্র: ‘পর্যালোচনা-৯’-এর দলিল]

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ২৯: (পৃ. ১৫)

(খ) উমার (কা ইয়াযীদ ইবনু শারীককে বলতেন না “আমি উচ্চস্বরে করাআত পাঠ করলেও তুমি সূরা ফাতিহা পড়বে।” (বায়হাকী সুনানুল কুবরা হা/৩০০৫ ও ৩০০৭, বুখারী জুযউল কিরাআত হা/৫১, সুনানে দারাকুঙ্গী হা/১১৯৭-৯৮) 

গ) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস দিলে বলতেন না “ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া ছেড়ে দিও না, চাই ইমাম উচ্চস্বরে পড়ুক বা আস্তে পড়ুক”। ইবনু আবূ শায়বাহ ১/৩৭৩ পৃ.) 

ঘ) আবু হুরায়রা ( একথা বলতেন না যে, “ইমাম যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করে তখন তুমিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে পাঠ কর এবং তা আগে শেষ কর”। (বুখারী জুযউল কিরআত হা/২৩৭)। 

পর্যালোচনা - ২৯: এগুলোর দাবি ও দাওয়াহ পূর্বে উপস্থাপন করা হয়েছে। [দ্র: পর্যালোচনা - ২৩, ২৪ ও ২৫]

আমরা সমস্ত হাদীসগুলো পরস্পরের ব্যাখ্যা নিচ্ছি। যার দাবি হলো, ইমামের ক্বিরাআত পড়া অবস্থায় মুক্তাদি তা শুনতে পেলে অবশ্যই মনোযোগের সাথে শুনবে। অতঃপর সাকতা বা আনসাতে পড়বে।

পক্ষান্তরে লেখকের উপস্থাপনাতে কুরআন ও হাদীসের আংশিক দাবি পূরণ হয় এবং আংশিক দাবি ছেড়ে দেয়া হয়। যা কুরআন ও সহীহ হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। বরং পরস্পর ব্যাখ্যা নেয়াটাই নবী (স)-এর নির্দেশ। এ মর্মে ‘মতপার্থক্য নিরসণে নীতিমালা’ / ‘পর্যালোচনা- ৫’-এ দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এই সুন্নাহ প্রদর্শিত পথে উম্মাতের ঐক্য নিহীত রয়েছে।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৩০: (পৃ. ১৫)

ওপরে উল্লেখিত হাদীস ও আসারসমূহের পর্যালোচনায় আমরা আরও জানতে পারলাম যে, ইমামের কিরআত পাঠ অবস্থায়ই মুক্তাদীগণ চুপে চুপে সূরায়ে ফাতিহা পড়বে, এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ। আর উবাদা বিন সামিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ অনুযায়ীই ইমামের কিরাআত পাঠ অবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন এবং উমার (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) ও আবু হুরায়রা (রা) মুক্তাদীগণকে অনুরূপ নির্দেশ দিয়েছেন।

পর্যালোচনা - ৩০: লেখকের দাবি মোতাবেক আমরাও বলছি, তবে এটা অবশ্যই আংশিক দাবি পূরণ হয়। কিন্তু কুরআনের আয়াত ও পরিপূরক সহীহ হাদীস বর্জন হয়। সাথে সাথে যে হাদীসগুলো দ্বারা সমন্বয় সম্ভব সেগুলো বাদ চলে যায়। যা মুহাদ্দিসগণের উপস্থাপনা নয়। যেমন - উবাদাহ (রা) ও আবু হুরায়রা (রা)-এর পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের সমাধানে ইমাম তিরমিযী (রহ) লিখেছেন:

وليس في هذا الْحديث مايدخل على من رأي القراءة خلف الإمام لأن أبا هريرة هو الذي روى عن النبي هذا الْحديث وروى أبو هريرة عن النبي أنه قال من صلى صلاة لَم يقرأ فيها بأم القرآن فهي خداج فهي خداج غيْر تَمام فقال له حامل الْحديث إني أكون أحيانا وراء الإمام ؟ قال اقرأ بِها في نفسك وروى أبا عثمان النهدي عن ٍأبي هريرة قال أمرني النبي أن أنادي أن لاصلاة إلا بقراءة فاتِحة الكتاب واختار أكثر أصحاب الْحديث أن لا يقرأ الرجل إذا جهر الإمام بالقراءة وقالوا يتتبع سكتات الإمام

‘‘যারা ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করার মত পোষণ করেন এই (আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত ক্বিরাআত বর্জনের) হাদীসটিতে তাঁদের ক্ষতি হওয়ার মত কোন কিছু নেই। কেননা, যে আবূ হুরায়রা (রা) এই হাদীসটির বর্ণনাকারী, তিনিই বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স) এরশাদ করেন: কেউ যদি তার সালাতে উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পাঠ না করে তবে তার সালাত লেজকাটা ও অসম্পূর্ণ বলে গণ্য হবে। হাদীসটির রাবী তখন আবূ হুরায়রা (রা)-কে বললেন: ‘‘আমি অনেক সময় ইমামের পিছনেও তো থাকি? তিনি বললেন: তখন তোমরা মনে মনে তা পড়ে নিবে।’’ আবূ উসমান নাহদী রিওয়ায়াত করেন যে, আবূ হুরায়রা (রা) বলেছেন: ‘‘সূরা ফাতিহা পাঠ ব্যতিরেকে সালাত হয় না।’’ এই কথার ঘোষণা দেওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ (স) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।’’(ইমাম তিরমিযী (রহ) বলেন:) অধিকাংশ আসহাবুল হাদীস (হাদীসবেত্তাগণ) ইমাম জোরে ক্বিরাআতকালে মুক্তাদি ক্বিরাআত না করার মত গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বলেন: ইমামের ক্বিরাআতের সাকতাতে বা চুপ থাকার সময়ে তা করা হবে।’’ [তিরমিযী - কিতাবুস সালাত - باب ماجاء في ترك القراءة خلف الإمام إذا جهر الإمام بالقراءة (অনুচ্ছেদ: ইমাম যখন জেহরী ক্বিরাআত করেন তখন তাঁর পিছনে মুক্তাদির ক্বিরাআত না করা)]

অনুরূপ বলেছেন: (১) ইমাম বুখারী (রহ), ২) ইমাম বায়হাক্বী (রহ), ৩) ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ), ৪) শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ), ৫) শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)।

আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৩১: (পৃ. ১৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ এবং তাঁর। সাহাবীগণের ভিন্ন আমল ও পরামর্শসমূহকে পাশ কাটিয়ে ইমামের রুকুর পূর্বের সাকতায়ই মুক্তাদীগণকে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে বলে যারা অভিমত পোষণ করে তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য, ইমামের কিরআত পাঠ অবস্থায় মুক্তাদীকে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পাঠের নির্দেশ সম্বলিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসসমূহ কি অগ্রহণযোগ্য? উবাদা বিন সামিত (রা) ইমামের কিরাআত পাঠ অবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করে। ভুল করেছেন? আর উমার (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) ও আবু হুরায়রা (রা) মুক্তাদীগণকে ভুল পরার্মশ দিয়েছে কি? 

পর্যালোচনা - ৩১: বরং লেখকই কুরআনের আয়াতের পরিপূরক হাদীস, সাহাবীদের আসার, তাবেঈদের বর্ণনা ও মুহাদ্দিসগণের অধিকাংশের সিদ্ধান্ত বর্জন করেছেন। তাঁরা কুরআন ও পরিপূরক সহীহ হাদীসের দাবির সাথে অপর কিছু সহীহ হাদীসের বিরোধ নিরসণে সমন্বয় করেছেন মাত্র। হাদীসগুলোকে পারস্পরিক ব্যাখ্যা হিসেবে নিয়ে কুরআনের দাবিকে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। অন্যথায় বিরোধী হাদীসগুলো শায বা মানসুখ। যেভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) ও শায়খ আলবানী (রহ) বলেছেন। মূলত তারা এ ব্যাপারে পূর্বসূরী মুহাদ্দিসগণের নীতিমালা অনুসরণ করেছেন। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।

৪৪
পুস্তিকাটির লেখক যাদেরকে বিদআতি বললেন
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৩২: (পৃ. ১৬)

সাকতা এবং ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের নির্দেশ সম্বলিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনায় এটা সুস্পষ্ট যে, রুকুর পূর্বে সূরা ফাতিহা পড়া। যায় এরূপ দীর্ঘ সাকতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করতেন। না, সাহাবীগণও এরূপ সাকতায় সূরা ফাতিহা পড়েননি এবং অন্যদেরকে এরূপ সাকতায় সূরা ফাতিহা পড়তে পরার্মশ দেননি। তাই রুকুর পূর্বে সূরা ফাতিহা পড়া যায় এরূপ দীর্ঘ সাকতা শরীয়তসম্মত নয়। বরং এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, এরূপ সাকতা বিদআত।

পর্যালোচনা - ৩২: দু’টি সাকতার হাদীস নবী (স) ও সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত। যার একটি রুকু‘র পূর্বে। আবু হুরায়রা (রা) থেকে হাসান সনদে বর্ণনা এসেছে। যা শায়খ আলবানী (রহ) ও শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) গ্রহণ করেছেন। যা মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক স্বীকৃত। এখন আহলে বিদআতের মূলে কুঠারাঘাতকারী ইমামদের মন্তব্য জেনে নিন:

৪৫
ইমাম আহলে সুন্নাত আহমাদ বিন হাম্বল (রহ)
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের পুত্র আব্দুল্লাহ (রহ)-এর সঙ্কলিত ‘কিতাবুস সুন্নাহ’-তে বর্ণিত হয়েছে:

٢٧١- حَدثنَا قَالَ سَأَلت ابي عَن السكتتين فَقَالَ اذا افْتتح الصَّلَاة سكت واذا فرغ من السُّورَة سكت سكتة اخرى قيل لَهُ اذا قَرَأَ الْحَمد قَالَ اذا قَرَأَ سُورَة بعد الْحَمد سكت

‘‘২৭১ - আমাদেরকে বর্ণনা করে বলেছেন: আমি (আব্দুল্লাহ) আমার পিতা (আহমাদ বিন হাম্বল রহ.)-কে দু’টি সাকতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন: সালাতের শুরুতে একটি সাকতা, আর অপর সাকতাটি হলো, সূরা থেকে ফারেগ হওয়ার পর। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এতে কি আল-হামদু’ পাঠ করবো? তিনি (রহ) বললেন: তখন পড়ো (যখন) আল-হামদুর পরের সূরাতে সাকতা করা হয়।’’ [মাসায়েলে ইমাম আহমাদ লি ইবনিহি আব্দুল্লাহ’ (বৈরুত: মাকতাবাহ ইসলামি, ১৪০১/১৯৮১)পৃ. ৭৫-৭৬ নং ২৭১]

৪৬
ইমাম শাফেঈ (রহ)
ইমাম বায়হাক্বী (রহ) লিখেছেন:

أخبرنا أبو سعيد بن أبي عمرو قال : حدثنا أبو العباس قال : أخبرنا الربيع قال : قال الشافعي رحمه الله :র لا تجزئ صلاة المرء ، حتى يقرأ بأم القرآن في كل ركعة إماما ، كان أو مأموما ، كان الإمام يجهر ، أو يخافت ، فعلى المأموم ، أن يقرأ بأم القرآن ، فيما خافت الإمام ، أو جهر قال الإمام الربيع : وهذا آخر قول الشافعي رضي الله عنه سماعا منه ، وقد كان قبل ذلك يقول :র لا يقرأ المأموم خلف الإمام ، فيما يجهر الإمام فيه ، ويقرأ فيما يخافت فيه গ্ধ ، زاد على هذا في كتاب البويطي ، فقال : وأحب إلي ، أن يكون ذلك في سكتة

‘‘আমাদেরকে আবু সাঈদ বিন আবি আমর বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে আবুল আব্বাস হাদীস বলেছেন, তিনি বলেন: আমাদেরকে কাছে রবি‘ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: ইমাম শাফেঈ (রহ) বলেছেন: সালাত জায়েয হয় না, যতক্ষণ না তার প্রত্যেক রাকআতে উম্মুল কুরআন পড়া হয়। সে ইমাম হোক বা মুক্তাদি। জাহরি সালাত হোক বা চুপের সালাত - মুক্তাদি অবশ্যই উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়বে, যখন সে ইমামের পিছনে থাকে এমনকি জাহরি সালাতেও। ইমাম রাবি‘ বলেছেন: এটাই শাফেঈর শেষ উক্তি যা আমি তাঁর থেকে শুনেছি। আর তার পূর্বের উক্তি ছিলো: মুক্তাদি ইমামের পিছনে পড়বে না, যখন ইমাম জাহরি ক্বিরাআত করে। সে পড়বে চুপের সালাতে। আর ‘আল-বুয়ুতি’র কিতাবে এটা অতিরিক্ত আছে যে, তিনি বলেছেন: আমাদের কাছে পছন্দনীয় হলো, মুক্তাদি এটা (জাহরি সালাতে) সাকতাতে পড়বে।’’ [বায়হাক্বী’র ‘মাআরেফুস সুনান পৃ. ২/৫৮ পৃ., আহকামুল কুরআন লিশ-শাফেঈ পৃ. ৭৭]

শাফেঈ মাযহাবে অপর একজন প্রসিদ্ধ ইমাম নববী (রহ) লিখেছেন:

فان الْمأموم لا يشرع له قراءتِها وهذا للتأويل متعين ليحمل قوله على موافقة الأحاديث الصحيحة ... يقرأ الْمأموم الفاتِحة فلا يَحصل قراءته مع قراءة الإمام بل في سكتته

‘‘নিশ্চয় মুক্তাদির জন্য ইমামের সাথে ক্বিরাআত করা শরিআতসম্মত না। এজন্য এভাবে তাবীল (ব্যাখ্যা) করা জরুরি, যেন সহীহ হাদীসগুলোর দাবি পূরণ হয়। ... (কিংবা এর ব্যাখ্যা হবে,) মুক্তাদি ফাতিহা পড়বে। তবে সে ইমামের ক্বিরাআতের সাথে ক্বিরাআত করবে না, বরং তার সাকতাতে পড়বে।’’ [শরহে মুসলিম নববী - কিতাবুস সালাত باب سُجُودِ التِّلاَوَةِ ]

৪৭
ইবনে রুশদ মালেকী (রহ)
وقد ذهب قوم إلى استحسان سكتات كثيرة في الصلاة، منها حين يكبر، ومنها حين يفرغ من قراءة أم القرآن، وإذا فرغ من القراءة قبل الركوع، وممن قال بهذا القول الشافعي، وأبو ثور، والاوزاعي ... وسبب اختلافهم : اختلافهم في تصحيح حديث أبي هريرة أنه قال : كانت له عليه الصلا والسلام سكتات في صلاته حين يكبر ويفتتح الصلاة، وحين يقرأ فاتحة الكتاب، وإذا فرغ من القراءة قبل الركوع .

‘‘(আলেমদের) একটি পক্ষ সালাতে কয়েকটি সাকতাকে উত্তম বলেছেন। সেগুলো হলো, (প্রথম) তাকবীরের পর। উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) শেষ করার পর ও রুকুর পূর্বে ক্বিরাআত শেষে। এটা ইমাম শাফেঈ, আবূ সাওর, আওযাঈ প্রমূখের অভিমত। ... [. তাঁদের বিরোধী অভিমতগুলো অল্প সংখ্যকের বিধায় আমরা সেগুলো উল্লেখ করলাম না। কেননা, দলিল ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সেগুলো দুর্বল। আলোচনাটিতে সাকতার ধরন ও উদ্দেশ্যের বিবরণ নেই। পূর্বের অভিমতগুলোর আলোকে ইবনে রুশদের উপস্থাপনা ব্যাখ্যাযোগ্য।] মতপার্থক্যের কারণ হলো, আবূ হুরায়রা (রা)-এর হাদীস: নবী (স) সাকতা করতেন যখন সালাতের শুরুতে তাকবীর দিতেন, যখন ফাতিহা পড়া (শেষ করতেন) ও যখন রুকু‘র পূর্বে ক্বিরাআত করা শেষ করতেন।’’ [. মূলত আবূ হুরায়রা (রা) ও সামুরাহ (রা)-এর সাকতার সহীহ ও যঈফ বর্ণনাগুলো একত্রের দাবি ইবনে রুশদ (রহ) বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে সূরা ফাতিহার পরের সাকতাটি যঈফ ও অধিকাংশ বর্ণনাকারীর বর্ণনার বিরোধী বিধায় প্রত্যাখ্যাত।] [বিদাআতুল মুজতাহিদ (শামেলা সংস্করণ ১/১০১-০২ পৃ., উর্দু তরজমা - ১৯৩ পৃ.)]

৪৮
শায়খ ইবনে বায (রহ)
শায়খ ইবনে বায (রহ) লিখেছেন সাকতাতে সূরা ফাতিহা পাঠকে বিদআত বলা জুমহুর আলেমদের খেলাফ। তিনি লিখেছেন:

الثابت في الأحاديث سكتتان : إحداهما : بعد التكبيرة الأولى , وهذه تسمى سكتة الاستفتاح , والثانية : عند آخر القراءة قبل أن يركع الإمام وهي سكتة لطيفة تفصل بين القراءة والركوع . وروي سكتة ثالثة بعد قراءة الفاتحة , ولكن الحديث فيها ضعيف , وليس عليها دليل واضح فالأفضل تركها , أما تسميتها بدعة فلا وجه له ؛ لأن الخلاف فيها مشهور بين أهل العلم

‘‘হাদীসে দুই সাকতা প্রমাণিত। এর একটি হলো: প্রথম তাকবীরের পর। যাকে শুরুর সাকতা বলা হয়। দ্বিতীয়টি হলো: ক্বিরাআত শেষে রুকুর পূর্বে, যা ক্বিরাআত ও রুকুর মধ্যে পৃথকীকরণ। আর তৃতীয় সাকতা সূরা ফাতিহার পরে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এটি যঈফ। এর স্বপক্ষে স্পষ্ট দলিল নেই, তাই এখানে (ফাতিহার পরের সাকতা) বর্জন করাটাই আফযাল। সুতরাং একে বিদআত সম্বোধন সঙ্গত নয়। কেননা এটি মাশহুর (প্রসিদ্ধ) আলেমদের খেলাফ।’’ [মাজমু‘ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাত ইবনে বায (শামেলা সংস্করণ) ১১/১৬৯ পৃ., (রিয়াদ: দারুল ক্বাসেম ১৪২০ হি,) ১১/৮৪ পৃ.]

সম্মানিত পাঠক! লেখক কাদেরকে বিদআতি বলছেন ? যারা কুরআন ও সহীহ হাদীস উভয়টির সমন্বয় করেছেন এবং বিরোধ নিরসনের জন্য সমস্ত আয়াত ও হাদীসকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তা ছাড়া তাবেঈগণ (রহ) সাকতা না করাটাকেই বিদআত বলেছেন। যেমন - ইমাম বুখারী (রহ) তাঁর ‘জুযউল ক্বিরাআতে’ লিখেছেন:

আব্দুল্লাহ বিন উসমান বিন খাসীম (রহ) সাঈদ বিন জুবাইর (রহ) তাবিঈকে জিজ্ঞাসা করলেন: আমি কি ইমামের পিছনে ক্বিরাআত করব? সাঈদ (রহ) বললেন:

نعم وان سَمعت قراءته انّهم قد أحد ثوا ما لَم يكونوا يصنعونه إن السلف كان إذا أم احدهم الناس كبر ثُم أنصت حتى يظن إن من خلفه قرأ فاتحة الكتاب ثُم قرأ

‘‘হাঁ, যদিও তুমি ইমামের ক্বিরাআত শুনতে পাও। নিশ্চয় ঐসব লোক বিদআত করছে (যারা সাকতা করে না), সালাফগণ (সাহাবীগণ) এ কাজ করতেন না। অবশ্যই সালাফদের (সাহাবীদের) মধ্যে থেকে কেউ যখন লোকদের ইমামতি করতেন তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চুপ থাকতেন। ততক্ষণ পর্যন্ত যখন তিনি নিশ্চিত হয়ে যেতেন যে, সব মুক্তাদি সূরা ফাতিহা পাঠ করে নিয়েছেন। এরপর ইমাম ক্বিরাআত শুরু করতেন, তখন মুক্তাদিগণ চুপ থাকতেন।’’ [বুখারীর জুঝউল ক্বিরাআত পৃ. ৬২; সিকাহ বর্ণনাকারী ও এর সনদ হাসান। আর আব্দুর রাজ্জাক সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন - মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৪]

৪৯
কুরআন, হাদীস ও মু’মিনদের পথ বনাম বিদআতি মতামত
আবু আব্দিল্লাহ আব্দুর রাজ্জাক - ৩৩: (পৃ. ১৬)

এ অবস্থায় ইমামের রুকুর পূর্বের সাকতায়ই মুক্তাদীকে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে বলে অভিমত করা বা এর স্বপক্ষে প্রচারণায় লিপ্ত থাকাকে “মুসলিম সমাজে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন দল ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করারই উপসর্গ গণ্য করা যায়”।

হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে বিদআত থেকে সতর্ক হওয়ার ও সুন্নাতে রাসূলকে আঁকড়ে থাকার তাওফীক দান কর। (আমীন)

পর্যালোচনা - ৩৩: কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যকার বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে বিরোধ নিরসণে পূর্ববর্তী মু’মিনদের বিশ্বস্ত ইলমের অধিকারী ব্যক্তিদের ঐক্যবদ্ধ (ইজমা‘) সিদ্ধান্ত অবশ্যই গ্রহণ করতে যে কোনো মুসলিম বাধ্য। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهَدى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نَوَلِّه مَا تَوَلّى وَنُصْلِه جَهَنَّمَ ـ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا

‘‘আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা কত মন্দ আবাস।’’[সূরা নিসা: ১১৫ আয়াত]

আমাদের বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে, লেখক যে আমলটিকে বিদআত বলেছেন - সেটা কুরআন, সহীহ হাদীস, সাহাবীদের আসার ও আমল, তাবেঈদের বক্তব্য ও আমল এবং মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত। যে আমলটি কুরআন ও সহীহ হাদীসের বিরোধ নিরসণ করে - সেটাকে কিভাবে বিদআত বলা যেতে পারে। আমাদের কাছে সাকতার দ্বারা সমন্বয় করার পদ্ধতিটিকে অস্বীকার করাটাই বিদআত - যেভাবে তাবেঈদের থেকে সাহাবীদের আমলের কথা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। [দ্র: ‘পর্যালোচনা-৩২’]

আমরা দেখেছি, সাকতার মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠ কুরআনের সূরা আ‘রাফের: ২০৪ আয়াত, সূরা ক্বিয়ামাহ: ১৮ নং আয়াত, নবী (স)-এর হাদীস - ইমামের পাঠের সময় চুপ থাকার বিভিন্ন বর্ণনা, যার কোনো কোনোটি সূরা ফাতিহাকেও সুনির্দিষ্ট করে, সাহাবীদের নবী (স)-এর পাঠের সময় চুপ থাকা ও বিরতিতে সূরা ফাতিহা পড়া, সাকতার বিভিন্ন মারফু ও মওকুফ হাদীস, তাবেঈদের সেগুলোর প্রতি আমল এবং ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের ঐকমত্য সিদ্ধান্ত সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতটির দাবি পূরণ করে। কেননা, এই সিদ্ধান্তে লেখকের দাবিকৃত মূল মাসআলা সূরা ফাতিহা পাঠের মৌলিক সিদ্ধান্তটি আমল হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে লেখকের সিদ্ধান্তটি কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যে বিরোধ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার একটি মতামত মাত্র। যা মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি ও বিভেদ স্থায়ী রাখার সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন। আমীন!!

এই বইয়ের মাসআলাটির সাথে সম্পর্কিত আরও দু’টি মাসআলা:

1) ইমামের ক্বিরআত মুক্তাদির ক্বিরাআত

2) রুকু‘ পেলে রাকআত পাওয়া হবে কি?

বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন ‘ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ ও মাসায়েলে সাকতা’ - অনুবাদ ও সঙ্কলন: কামাল আহমাদ (ঢাকা: আতিফা পাবলিকেশন্স)। যা পাঠকের উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সন্দেহ নিরসণে যথেষ্ট হবে, ইনঁশাআল্লাহ।

৫০
পরিশিষ্ট: ১
‘‘ইমামের ক্বিরা‘আত মুক্তাদির ক্বিরা‘আত’’ - হাদীসের তাহক্বীক্ব

-মুহাম্মাদ ইশতিয়াক্ব

এই অংশটি মুহাম্মাদ ইশতিয়াক্বের ‘‘তাহক্বীক্বে সালাত বা জওয়াবে নামাযে মুদাল্লাল’’ (করাচী: জামা‘আতুল মুসলিমীন) পৃ. ১৩১-১৩৮ থেকে উদ্ধৃত হল। (অনুবাদক)

من كان له إمام فقراءته له قراءة ‘‘যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত’’- বাক্যে বর্ণিত হাদীসটি কয়েকজন সাহাবা থেকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সমস্ত বর্ণনাই যঈফ। ইমাম শওকানী (রহ) লিখেছেন:

وقد روي مسندا من طرق كلها ضعاف والصحيح أنه مرسل

‘‘(হাদীসটি) বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যার প্রত্যেকটি যঈফ। তবে সহীহ কথা হল হাদীসটি মুরসাল (সূত্রছিন্ন)।’’ (নায়লুল আওতার ২/২৪৩/৫)

উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

হাদীস - ১

حدثنا علي بن مُحمد حدثنا عبيد الله بن موسى عن الْحسن بن صالِح عن جابر عن أبي الزبير عن جابر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم .

এই সনদের হাদীসটি ইবনে মাজাহ (হা/৮৫০) বর্ণনা করেছেন। এর একজন রাবী জাবির (আল-জু‘ফী) মিথ্যাবাদী। (তাহযিবুত তাহযিব) সুতরাং হাদীসটি মিথ্যা।

.... ইমাম যায়লাঈ (রহ) বলেছেন:

وقد رواه سفيان الثوري وأبو الأحوص وشعبة وإسرائيل وشريك وأبو خالد الدالاني وسفيان بن عيينة وجرير بن عبد الْحميد وغيرهم عن موسى بن أبي عائشة عن عبد اللّه بن شداد عن النبي مرسلاً وهو الصواب

‘‘এই হাদীসটি সুফিয়ান সাওরী, আবূল আহওয়াস, শু‘বাহ, ইসরাঈল, শরীক, আবূ খালিদ আদ-দালানী, সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ ও জারীর বিন ‘আব্দুল হামীদ প্রমুখ থেকে মূসা বিন আবী ‘আ‘‘য়শাহ, তিনি ‘আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ থেকে তিনি নবী (স) থেকে মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আর এটাই (হাদীসটির) সঠিক (মান)।’’ (নাসবুর রায়াহ ২/৯)

অতঃপর যায়লাঈ বলেন, ইমাম বায়হাক্বী ‘আল-মা‘রেফাতে’ বলেছেন:

وقد روى السفيانان هذا الْحديث وأبو عوانة وشعبة وجَماعة من الْحفاظ عن موسى ابن أبي عائشة فلم يسندوه عن جابر، ورواه عبد اللّه بن الْمبارك أيضاً عن أبي حنيفة مرسلاً وقد رواه جابر الْجعفي وهو متروك وليث بن أبي سليم وهو ضعيف عن أبي الزبيْر عن جابر مرفوعاً ولَم يتابعهما عليه إلا من هو أضعف منهما

‘‘নিশ্চয় এই হাদীসটি দুই জন সুফিয়ান (সুফিয়ান সাওরী ও সুফিয়ান বিন ‘উয়াইনাহ), আবূ ‘আওয়ানাহ, শু‘বাহ হাফেযদের একদল থেকে, তিনি মূসা ইবনে আবী আ‘‘য়শাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি জাবের (রা) থেকে (মারফু‘) সনদে বর্ণনা করেন নি। তেমনি ‘আব্দুল্লাহ বিন মুবারক মুরসাল বর্ণনা করেছেন আবূ হানিফা থেকে। জাবির বিন জু‘ফী মাতরুক (প্রত্যাখ্যাত), লাইস বিন আবি সুলাইম - তিনি যঈফ, তিনি আবূ যুবায়ের থেকে, তিনি জাবির (রা)-এর মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। (হাদীসটির ব্যাপারে) তাদের উভয়কে কেউ অনুসরণ করেন নি, কেবল তাদের থেকে বেশি যঈফ ঐ দু’জন ছাড়া।’’ (নাসবুর রায়াহ ২/৯)

অতঃপর ইমাম বায়হাক্বী (রহ) লিখেছেন:

أخبرنا أبو عبد اللّه الْحافظ، قال : سَمعت سلمة بن مُحمد الفقيه، يقول : سألت أبا موسى الرازي الْحافظ عن حديث : " من كان له إمام، فقراءة الإِمام له قراءة " فقال : لَم يصح عن النبي فيه شيء

‘‘আমাদেরকে খবর দিয়েছেন আবূ ‘আব্দুল্লাহ হাফিয, তিনি বলেন: আমি সালামাহ বিন মুহাম্মাদ আল-ফাক্বীহকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: আমি আবূ মূসা আর-রাযী আল-হাফিযকে ‘‘যার ইমাম আছে, তার ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত’’ সম্পর্কীত হাদীসটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন: এ ব্যাপারে নবী (স) থেকে কিছুই সহীহ নেই।’’ (নাসবুর রায়াহ ২/৯)

সুতরাং জাবির (রা)-এর সাথে সম্পৃক্ত বর্ণনাটি যঈফ।

হাদীস - ২:

عن سهل ابن العباس الترمذي حدثنا إسْماعيل بن عليه عن أيوب عن أبِي الزبير عن جابر، قال : قال رسول اللّه ﷺ " من كان له إمام، فقراءة الإِمام له قراءة "

‘‘সাহল বিন ‘আব্বাস তিরমিযী থেকে বর্ণিত, আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন ইসমাঈন বিন আইয়ূব, তিন আবূ যুবায়ের থেকে তিনি জাবির (রা) থেকে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত।’’ (দারে কুতনী [. দারে কুতনীর (১/৪০২/১) মূল মতনটি হল من صلى خلف الإمام فقراءة الإمام له قراءة ], নাসবুর রায়াহ ১/১০)

ইমাম যায়লাঈ (রহ) লিখেছেন:

قال الدارقطني : هذا حديث منكر، وسهل بن العباس متروك، ليس بثقة وقال الطبراني : لَم يرفعه أحد عن ابن علية إلا سهل بن العباس

‘‘ইমাম দারা কুতনী (রহ) বলেছেন: এই হাদীসটি মুনকার। সাহাল বিন ‘আব্বাস মাতরুক, সে সিক্বাহ নয়। আর তাবারানী (রহ) বলেছেন: ইবনে ‘আলিইয়্যাহ থেকে কেবল সাহল বিন ‘আব্বাস ছাড়া কেউই হাদীসটিকে মারফু‘ সূত্রে উল্লেখ করেন নাই।’’ (নাসবুর রায়াহ ২/১০)

হাদীস - ৩: ইমাম যায়লাঈ (রহ) বলেন:

من طريق مالك عن وهب بن كيسان عن جابر بن عبد اللّه مرفوعاً نَحوه، سواء، قال الدارقطني : هذا باطل لا يصح عن مالك . ولا عن وهب بن كيسان، وفيه عاصم بن عصام لا يعرف

‘‘ইমাম মালিকের (রহ) সূত্রে ওয়াহাব বিন কায়সান বর্ণনা করেছেন, তিনি জাবির বিন ‘আব্দুল্লাহ থেকে মারফু‘ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম দারা কুতনী (রহ) বলেন: এই সূত্রটিও বাতিল। (হাদীসটি) না মালিক থেকে, আর না ওয়াহাব বিন কায়সান থেকে (প্রমাণিত)। এই সনদটিতে ‘আসিম বিন ‘ইসাম অপরিচিত।’’ (নাসবুর রায়াহ ২/১০, আরো দ্র: জুঝউল ক্বিরাআত পৃ. ১৮ ও ২০)

হাদীস - ৪: ইমাম যায়লাঈ (রহ) বলেন:

عن جابر بن عبد اللّه عن النبي صلى الله عليه وسلم " من كان له إمام، فقراءة الإِمام له قراءة " ، ولكن في إسناده ضعف

‘‘জাবির বিন ‘আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি রসূলুল্লাহ (স) থেকে বর্ণনা করেন: ‘যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত।’ -কিন্তু হাদীসটির সনদ যঈফ।’’ (মালিক, মুসনাদে আহমাদ সূত্রে নাসবুর রায়াহ ২/১০)

হাদীস - ৫: ইমাম যায়লাঈ (রহ) দারা কুতনী থেকে বর্ণনা করেন:

عن محمد بن الفضل بن عطية عن أبيه عن سالِم بن عبد اللّه عن أبيه عبد اللّه بن عمر عن النبي قال : " من كان له إمام فقراءته له قراءة " ، انتهى . قال الدارقطني : مُحمد بن الفضل متروك

‘‘মুহাম্মাদ বিন ফাযল বিন ‘আতীয়াহ থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি সালিম বিন ‘আব্দুল্লাহ থেকে, তিনি তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন উমার থেকে, তিনি নবী (স) থেকে বর্ণনা করেন- তিনি (স) বলেছেন: ‘যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত।’’ বর্ণনাটি শেষ। ইমাম দারা কুতনী (রহ) বলেন: মুহাম্মাদ বিন ফাযল মাতরুক। (দারা কুতনী ১/৩২৫/৬, নাসবুর রায়াহ ২/১০)

ইবনে হাজার (রহ) বলেন: মুহাম্মাদ বিন ফাযল বিন ‘আতীয়াহকে আলেমগণ মিথ্যুক বলেছেন।’’ (তাক্বরীবুত তাহযীব ২/১২৩)

সুতরাং হাদীসটি মিথ্যা।

হাদীস - ৬: ইমাম যায়লাঈ (রহ) বর্ণনা করেনঃ

عن أبي سعيد الخدري، قال : قال رسول اللّه ﷺ: " من كان له إمام فقراءة الإِمام له قراءة "

‘‘আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: ‘‘যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত।’’ বর্ণনাটি শেষ। ইবনে ‘আদীর ‘কামেলে’ বর্ণিত হয়েছে। (তাবারানী তাঁর ‘আওসাতে’ ২/১১১, নাসবুর রায়াহ ২/১১)

এই হাদীসটিও মিথ্যা। আবূ হারুন ‘আবদী মিথ্যুক। অপর একটি সনদেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। সেখানে ইসমাঈল বিন ‘আমর বিন নাজীহ যঈফ। (নাসবুর রায়াহ ২/১১) ইসমাঈলের অনুসারী নাযর বিন ‘আব্দুল্লাহ ও নাযর বিন ‘আব্দুল্লাহ আল-আযদী মাজহুল। (তাকবরীব ও মীযান)

হাদীস - ৭: উক্ত বর্ণনাটি আবূ হুরায়রা (রা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম যায়লাঈ লিখেছেন:

قال الدارقطني : لا يصح هذا عن سهيل، تفرد به مُحمد بن عباد الرازي، وهو ضعيف

‘‘দারা কুতনী (রহ) বলেন: সাহীল (বিন আবী সালেহ) থেকে হাদীসটি সহীহ নয়। কেননা মুহাম্মাদ বিন ‘ইবাদ আর-রাযী এক্ষেত্রে একক। আর তিনি যঈফ।’’ (নাসবুর রায়াহ ২/১১)

জ্ঞাতব্যঃ ‘নাসবুর রায়াহ লিআহাদীসিল হিদায়াহ’-এর সূত্র এই জন্য উল্লেখ করা হল যে, এটা হানাফীদের নিজস্ব কিতাব।

হাদীস - ৮: ইবনে ‘আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী (স) বলেছেন:

يكفيك قراءة الإمام خافت أو قرأ

‘‘ইমামের ক্বিরাআত তোমাদের জন্য কাফী (যথেষ্ট), (ক্বিরাআত) গোপনে হোক কিংবা (প্রকাশ্য) পাঠ হোক।’’ (দারা কুতনী ১/৩৩৩/৩৩, নাসবুর রায়াতে (২/১১) আছে: خافَت أو جهر ‘‘গোপন বা প্রকাশ্য’’)

ইমাম দারা কুতনী (রহ) বলেন:

قال أبو موسى قلت لأحْمد بن حنبل في حديث بن عباس هذا في القراءة فقال هكذا منكر

‘‘আবূ মূসা বলেন, আমি আহমাদ বিন হাম্বল (রহ)-কে ইবনে আব্বাস (রা)-এর এই ক্বিরাআত সম্পর্কীত হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: এটি মুনকার।’’ (সূত্রঃ পূর্বোক্ত)

হাদীস- ৯: আনাস বিন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী (স) বলেছেন:

من كان له إمام، فقراءة الإِمام له قراءة

‘‘যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত।’’ (ইবনে হিব্বানের ‘কিতাবুয যু‘য়াফা, নাসবুর রায়াহ ২/১১)

ইমাম যায়লাঈ (রহ) বলেন: গনীম (বিন সালিম)-এর জন্য হাদীসটি মা‘লুল (ত্রুটিযুক্ত)। (নাসবুর রায়াহ ২/১১)

ইবনে হিব্বান (রহ) বলেন: ‘‘তিনি আজব ও মাওযু‘ বর্ণনা করেন।’’ (মিযানুল ই‘তিদাল ৩/৩৩৬)

ইমাম যাহাবী (রহ) বলেন:

قلت : الظاهر أن هذا هو غنيم بن سالِم أحد الْمشهورين بالكذب

‘‘আমি বলছি, গানীম বিন সালিম প্রসিদ্ধ মিথ্যুকদের একজন।’’ (মিযানুল ই‘তিদাল ৩/৩৩৭)

সুতরাং من كان له إمام، فقراءة الإِمام له قراءة ‘‘যার ইমাম আছে, সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআতই তার ক্বিরাআত’’ বাক্যে হাদীসটি রসূলুল্লাহ (স) থেকে প্রমাণিত নয়। সুতরাং তা প্রত্যাখ্যাত। তাছাড়া যদিওবা আমরা হাদীসটি সহীহ হিসাবে মেনে নিই, তাহলেও হাদীসটি ইমামের সাকতাতে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠের বিরোধী হয় না। সাকতার পদ্ধতিতে যখন ইমাম ক্বিরাআত করে, তখন মুক্তাদী চুপ থেকে ইমামের ক্বিরাআত শুনবে। সেক্ষেত্রে ইমামের ক্বিরাআত মুক্তাদীর ক্বিরাআত গণ্য হবে। তাছাড়া وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْانُ فَاسْتَمِعُوْا لَه وَأَنْصِتُوَا ‘‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সাথে শোন ও চুপ থাক’’ (সূরা আ‘রাফ, ২০৪) আয়াতটিরও বিরোধী হয় না।.... [.অতঃপর লেখক ‘ইমামের ক্বিরাআত মুক্তাদীর ক্বিরাআত’ মর্মে কিছু সাহাবীর  উক্তি হিসাবে যা উপস্থাপন করা হয়- সেগুলোও খণ্ডন করেছেন। প্রয়োজন সাপেক্ষে আমরা পরবর্তীতে তা প্রকাশ করব। (অনুবাদক)]

৫১
পরিশিষ্ট: ২
من كان له إمام، فقراءة الإِمام له قراءة হাদীসটির তাহক্বীক

শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ

প্রশ্ন: নিম্নোক্ত বর্ণনাটির ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যামূলক দলীল ও শক্তিশালী তাহক্বীক্বের জন্য আপনার কিছুটা কষ্ট দিতে চাই। .... ইমাম মুহাম্মাদ বর্ণনা করেছেন,

أخبرنا أبو حنيفة قال حدثنا أبو الْحسن موسى بن أبِي عائشة عن عبد الله بن شداد بن الْهاد عن جابر بن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : من صلى خلف الإمام فإن قراءة الإمام له قراءة

....উক্ত বর্ণনাটির তাহক্বীক্ব আপনার ‘মাসিক আল-হাদীস’ পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ করে কৃতজ্ঞ করবেন।

জবাবঃ এই من صلى خلف الإمام فإن قراءة الإمام له قراءة হাদীসটি মর্মে ও শব্দে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।

(১) সুনানে ইবনে মাজাহতে (হা/৮৫০) বর্ণিত হয়েছেঃ

حديث جابر الْجعفى عن أبي الزبير عن جابر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم

জাবির আল-জু‘ফী:মাতরুক।

( كتاب الكنى والاسماء للامام مسلم قـ ٩ ۶ كنيته : ابو محمد، الضعفاء والمتروكين للامام نسائ ٩٨ )

ইমাম যাহাবী (রহ) লিখেছেন: كذبه أيضا أيوب وزائدة ‘‘এতে আইয়ুব (আস-সাখতিয়ানী) ও যায়েদকে মিথ্যুক বলা হয়। (নাসবুর রায়াহ ১/৩৪৫)

(২) ইবনে ‘আদীর কামেলে (১/৫২৪) বর্ণিত হয়েছে:

حديث أبى هارون العبدى عن أبى سعيد الْخدرى رضي الله عنه إلْخ .....

আবূ হারুন - মাতরুক। দেখুন: ইমাম নাসায়ীর (রহ) ‘কিতাবুয যু‘য়াফা ওয়াল মাতরুকীন’ (৭৪৬)।

আবূ হারুন সম্পর্কে যায়লাঈ হানাফী (রহ) হাম্মাদ বিন যায়েদের মন্তব্য উল্লেখ করেছেন: كان كاذابا ‘‘সে মিথ্যুক ছিল।’’ (নাসবুর রায়াহ ৪/২০১ পৃ:)

(৩) দারা কুতনী (১/৪০২ হা/১৪৮৬) বর্ণনা করেছেন:

حديث سهل بن عباس الترمذى بسنده إلْخ ........

দারা কুতনী বলেন: এই হাদীসটি মুনকার, আর সাহল বিন ‘আব্বাস মাতরুক।

উসূলে হাদীসে উল্লেখ আছে, মাতরুক প্রভৃতি চরমভাবে আপত্তিযুক্ত বর্ণনাকারীদের রেওয়ায়াত মারদুদ (প্রত্যাখ্যাত)। যেমন হাফেয ইবনে কাসির (রহ) লিখেছেনঃ

لأن الضعف بتفاوت فمنه مالا يزول بالْمتابعات يعنى لا يؤثر كونه تابعا او متبوعا كرواية الكذابين والْمتركين

‘‘কেননা যঈফ বিভিন্ন ধরণের। কিছু যঈফ সমর্থনমূলক হিসাবেও কার্যকরী হয় না। যেমন - মিথ্যুক ও মাতরুকদের বর্ণনাসমূহ। এগুলো না সহযোগীমূলক আর না স্বয়ং সম্পূর্ণ।’’(ইখতিসারে উলূমুল হাদীস পৃ. ৩৮)

এই ভূমিকার পর এখন প্রশ্নে উল্লিখিত من كان له امام الْخ ... হাদীসের সনদগুলোর বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করছি। এরই উপর বিরোধী পক্ষ ‘ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়ার’ ব্যাপারে ভিত প্রতিষ্ঠিত রেখেছে। والله موافق بالله

প্রথম বর্ণনাঃ মুয়াত্তা মুহাম্মাদ আশ-শায়বানী (৯৮ পৃ. হা/১১৭)

مُحمد بن الْحسن شيبانِى : أخبرنا أبو حنيفة قال حدثنا أبو الْحسن موسى بن أبي عائشة عن عبد الله بن شداد بن الْهاد عن جابر بن عبد الله الْخ ....

বর্ণনাটিতে ‘আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ ও জাবির (রা)-এর মধ্যে ‘আবূল ওয়ালীদ’-এর মধ্যস্থতা আছে। দ্র: আবূ ইউসূফের, কিতাবুল আসার (১১৩), সুনানে দারা কুতনী (১/৩২৫ হা/১২২৩ - দারা কুতনী বলেন: আবূল ওয়ালীদ: মাজহুল), বায়হাক্বীর ‘কিতাবুল ক্বিরাআত’ (পৃ. ১২৫ হা/৩১৪, পৃ. ১২৬-২৭; অন্য সংস্করণে হা/৩৩৯, ৩৪১)।

সুস্পষ্ট হল, বর্ণনাটি আবূল ওয়ালিদের (মাজহুল) কারণে যঈফ। এই মাজহুল বর্ণনাকারী কথা কোন কোন সনদে উল্লেখ নেই। যা থেকে স্পষ্ট হয়, যেখানে তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই বর্ণনাটি প্রাধান্যপ্রাপ্ত অনুল্লেখ বর্ণনার চাইতে।

এই বর্ণনাটির অপর একটি ত্রুটি হল, স্বয়ং ইমাম আবূ হানিফাই (রহ) বর্ণনাটিকে বাতিল মনে করতেন। আবূ ‘আব্দুর রহমান আল-মুক্বর্রায়ি (রহ) বলেন:

كان أبو حنيفة يُحدثنا فإذا فرغ من الْحديث قال : هذا الذى سَمعتم كله ريح وباطل

‘‘আবূ হানিফা (রহ) আমাদেরকে হাদীস শুনাতেন। যখন হাদীস বর্ণনা শেষ করতেন তখন বলতেন: তোমরা যেসব হাদীস শুনেছ তা হাওয়া ও বাতিল।’’ (কিতাবুল জারাহ ও তা‘দিল লিইবনে আবী হাতিম ৮/৪৫০, এর সনদ সহীহ)

অপর একটি বর্ণনাতে ইমাম আবূ হানিফা (রহ) বলেন: عامة ما أحدثكم خطأ ‘‘আমি তোমাদেরকে ‘আমভাবে যে হাদীস বলি, তা ত্রুটিযুক্ত।’’ (আল-‘ঈলালুল কাবীর লিত-তিরমিযী ২/৯২২ পৃ. এর সনদ সহীহ, আল-কামিল লি-ইবনে ‘আদী ৭/২৪৭৩, তারীখে বাগদাদ ১৩/৪২৫)

অপর একটি বর্ণনাতে আবূ হানিফা (রহ) নিজের বর্ণনা সম্পর্কে বলেন:

والله ما أدرى لعله الباطل الذى لا شك فيه

‘‘আল্লাহর কবসম! আমি (এর সত্যতা) জানি না। হয়তো এটা এমন বাতিল, যার ব্যাপারে কোন সংশয় নেই।’’ (ইমাম ইয়া‘কুব বিন সুফিয়ান আল-ফারসী’র ‘কিতাবুল মা‘রিফাহ’ ২/৭৮২ পৃ., এর সনদ হাসান)

সুতরাং এখন এটা সাধারণ মানুষও সহজেই বুঝতে পারবে যে, ইমাম আবূ হানিফা নিজের বর্ণিত হাদীস ও কিতাবের ব্যাপারে পরবর্তীদের থেকে বেশি জানতেন। আর এটা সম্ভব যে, আবূ ওয়ালিদের (মাজহুলের) কারণে ইমাম সাহেব নিজের বর্ণনাকে বাতিল গণ্য করেছেন। والله أعلم وعلمه أتم

দ্বিতীয় বর্ণনাঃ মুসনাদে আহমাদ (আল-মাওসিয়াতুল হাদীসিয়্যাহ) ১২/২৩ হা/১৪৬৪৩ - এ বর্ণিত হয়েছে:

حدثنا أسود بن عامر : أخبرنا حسن بن صالِح عن أبى الْزبير عن جابر ... الْخ

এই বর্ণনাটি যঈফ।

প্রথমত, আবূ যুবায়ের আল-মাক্কী মুদাল্লিস। উসূলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মুদাল্লিসের (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ছাড়া) ‘আন ( عن ) দ্বারা বর্ণিত হাদীস যঈফ।

( مقدمه ابن الصلاح مع التقييد والايضاح صـ ٩٩، والنسخة مجققة صـ ١ ۶١)

দ্বিতীয়ত, হাসান বিন সালেহ ও আবূ যুবায়েরের মধ্যে জাবের (আল-জু‘ফী) মাতরুক মধ্যস্ততাকারী। [দ্র: মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৩৯ হা/১৪৬৯৮, তাহক্বীক্ব ফি ইখতিলাফিল হাদীস লিইবনে জাওযী ১/৩২০ হা/৫২৭]

জ্ঞাতব্যঃ এটা খুবই আফসোসের বিষয় যে, ইবনে তুর্কীমানী হানাফী (রহ) ইবনে যুবায়েরের ভয়ানক তাদলীসের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও - এই যঈফ ও মাতরুক বর্ণনাকে ‘‘ هذا سند صحيح ’’ (এই সনদটি সহীহ) লিখেছেন। [দ্র: জাওয়াহিরুল নাক্বী ২/১৫৯ সূত্রে: ইবনে আবী শায়বাহ ১/৩৭৭ হা/৩৮০২]

শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) দলীল-প্রমাণের সাথে ইবনে তুর্কীমানীর বক্তব্যকে জোরদারভাবে রদ (খণ্ডন) করেছেন। (দ্র: ইরওয়াউল গালীল ২/২৭০ পৃ. হা/৫০০)

তৃতীয় বর্ণনাঃ

أحمد بن منيع : ثنا إسحاق الأزرق : ثنا سفيان وشريك عن موسى ابن أبى عائشة عن عبد الله بن شداد عن جابر رضي الله عنه .... الْخ ( اتّحاف الْخيرة الْمبرة للبوصيرى ۶/۲۲ ٥ حـ١٥ ۶٧)

এই বর্ণনাটি দু’টি কারণে যঈফ।

প্রথমত, সুফিয়ান সওরী মুদাল্লিস (‘উমদাতুল কবারী লিল‘আয়নী ৩/১১২ باب الوضوء من غير حديث ; জাওয়াহিরুন নাক্বী ৮/২৬২)। তাছাড়া এটি ‘আন ( عن ) দ্বারা বর্ণিত হাদীস। শরীক (আল-কাযী)-ও মুদাল্লিস। (তাবাক্বাতুল মুদাল্লিসীন: ২৪, জামে‘উত তাহসীল লিল‘ঈলায়ী পৃ. ১০৭, মুদাল্লিসীন লিলআবী যার‘আহ বিনুল ‘ইরাকবী: ২৮, মুদাল্লিসীন লিসসুয়ূতী: ২৪, মুদাল্লিসীন লিলহালাবী পৃ. ৩৩)।

দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী আলোচনাতে এসেছে - ‘আব্দুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ও জাবির (রা)-এর মাঝে আবূ ওয়ালিদ (মাজহুল) মধ্যস্থতাকারী।

সার-সংক্ষেপঃ এই বর্ণনাটির সমস্ত সনদ যঈফ। সুতরাং শায়খ আলবানী (রহ) কর্তক হাদীসটিকে ‘হাসান’ (ইরওয়াউল গালীল ২/২৬৮) এবং আল-মাওসু‘আতুল হাদীসিয়্যাহ-এর টিকাতে ‘‘ حسن بطرقة وشواهده ’’ (বিভিন্ন সূত্র ও সাক্ষ্যে ভিত্তিতে হাসান) বলাটা সহীহ নয়। হাদীসটিকে হাফেয ইবনে হাজার মা‘লুল বা ত্রুটিযুক্ত (তালখীসুল হাবীর ২/২৩২ হা/৩৪৫) এবং কুরতুবী যঈফ বলেছেন। (তাফসীরে কুরতুবী ১/১২২, সূরা ফাতিহা باب الثانى فى نزولِها واحكامها )

আমাদের শায়খ ইমাম বাদীউদ্দীন শাহ আর-রাশেদী এই হাদীসটির যঈফ প্রমাণে ( اظهر البرأة عن حديث : من كان له إمام فقرأة الإمام له قرأة ) কিতাব লিখেছেনে। ফালিল্লাহিল হামদ। [. শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ, ফাতাওয়া ‘ইলমিয়্যাহ আল-মা‘রফ তাওযীহুল আহকাম ১ম খণ্ড, পৃ.৩২৬-৩৩০।]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন