HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদীস শিক্ষা ও মাসায়েল

লেখকঃ ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ আল-হাকীল

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদীস:

শিক্ষা ও মাসায়েল

ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ আল-হাকীল

অনুবাদ: সানাউল্লাহ নজির আহমদ

সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

কভার পেইজ থেকে
রমযানের বিষয়ভিত্তিক হাদীস : শিক্ষা ও মাসায়েল বইটিতে সিয়াম, ইতিকাফ, রমযানের কিয়াম ও লাইলাতুল কদর ইত্যাদি বিষয়ে ষাটটি দরস তৈরি করা হয়েছে, যা থেকে বিশেষভাবে দীনের দাঈ‘ ও মসজিদের ইমামগণ এবং সাধারণভাবে সকল মুসলিম উপকৃত হবেন, ইনশাআল্লাহ। প্রত্যেক দরসের ভিত্তি রাখা হয়েছে আর-কুরআন ও হাদীসের ওপর। আল্লাহ সবাইকে এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

ভূমিকা
সকল প্রশংসা দু’জাহানের পালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলার জন্য এবং দুরূদ ও সালাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলের ওপর।

অতঃপর...... রমযান মাস এ উম্মতের এক বিশেষ মাস। এ মাসে তারা ইবাদত, আমল ও কল্যাণকর কাজে মনোযোগী হয়, কুরআন, হাদীস ও উপদেশ শ্রবণ করে, তাই অনেক আলিম এতে বিশেষ দরস ও মজলিসের ব্যবস্থা করেন, যা সাধারণত ফজর ও এশার পর প্রদান করা হয়। কতক দরস হয় সংক্ষেপ, আবার কতক হয় দীর্ঘ ও বিস্তারিত। কতক দরস ওয়াজ-উপদেশে সীমাবদ্ধ থাকে, আবার কতক থাকে মাসআলা-মাসায়েলে। কতক দরস হয় শিক্ষা ও আদর্শের ওপর, আবার কতক হয় আমল ও ফযীলতের ওপর। কেউ কুরআন-হাদীসে সীমাবদ্ধ থাকেন, কেউ তাতে আরো বৃদ্ধি করেন ইত্যাদি। আমি পূর্ব থেকে সিয়াম, ই‘তিকাফ, রমযানের কিয়াম ও লাইলাতুল কদর বিষয়ে হাদীস জমা করতে ছিলাম, সাথে লিখতে ছিলাম কতক ফায়দা ও মাসায়েল, যেন বিশেষভাবে দীনের দা‘ঈ ও মসজিদের ইমামগণ এবং সাধারণভাবে সকলে উপকৃত হয়। অতঃপর এসব হাদীস, শিক্ষা ও মাসায়েলসহ সুন্দরভাবে বিন্যাস করে খুব সংক্ষিপ্ত ত্রিশটি দরস তৈরি করি, যা ফজরের পর মসজিদে পেশ করার উপযোগী। এগুলোকে আমি বেজোড় সংখ্যায় রেখেছি, যেমন ১, ৩, ৫ ও ৭নং দরসসমূহ। আর ত্রিশটি দরস তৈরি করি একটু দীর্ঘ ও বিস্তারিত, যা এশার পূর্বে মসজিদে পেশ করার উপযোগী। এগুলোকে আমি জোড় সংখ্যায় রেখেছি, যেমন ২, ৪, ৬ ও ৮নং দরসসমূহ। কারণ, মসজিদের ইমামগণ রমযানে এ দু’টি সময়ে দরস দিয়ে থাকেন। এ দরসগুলো তৈরিতে আমি নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করেছি:

এক: প্রত্যেক দরসের ভিত্তি রেখেছি কুরআন ও হাদীসের ওপর, যদি শিরোনামের অনুকূলে কোনো আয়াত পেয়েছি, তাহলে তা উল্লেখ করেছি, অতঃপর হাদীস উল্লেখ করেছি। আর শিরোনামের অনুকূলে কোনো আয়াত না থাকলে সরাসরি উক্ত বিষয়ের হাদীস উল্লেখ করেছি।

দুই: আমি নির্দিষ্ট বিষয়ে সকল হাদীস জমা করি নি, তবে সেখান থেকে পরিপূর্ণ ও উপযুক্ত হাদীস বাছাই করার চেষ্টা করেছি।

তিন: টিকাতে সংক্ষেপে হাদীসের সূত্র ও তার হুকুম উল্লেখ করেছি।

চার: হাদীস বাছাই করার ক্ষেত্রে দলীল হিসেবে পেশ করার উপযুক্ত সহীহ ও হাসান হাদীসগুলো নির্বাচন করেছি, দুর্বল হাদীস এড়িয়ে গেছি, তবে যেসব হাদীসের ক্ষেত্রে ইখতিলাফ রয়েছে, সেখানে বিশুদ্ধ অভিমত বাছাই করার চেষ্টা করেছি, যার সংখ্যা খুব কম।

পাঁচ: প্রথমে সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীস, অতঃপর তাদের একক বর্ণিত হাদীস, অতঃপর সুনানের চার কিতাবের হাদীস উল্লেখ করেছি, বিশেষ কারণ ব্যতীত এ নিয়মের বিপরীত করি নি। প্রথমে মারফূ, অতঃপর মাওকুফ, অতঃপর মনীষীদের বাণী উল্লেখ করেছি।

ছয়: হাদীস উল্লেখ করে তার থেকে নিঃসারিত শিক্ষা ও মাসায়েল উল্লেখ করেছি, যার কতক আমার নিজের গবেষণার ফল, তবে অধিকাংশ সংগ্রহ করেছি বিভিন্ন ব্যাখ্যা গ্রন্থ, ফাতওয়া ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে। ইখতিলাফী মাসআলায় আমার নিকট যেটি অধিক বিশুদ্ধ মনে হয়েছে, তাই উল্লেখ করেছি, ইখতিলাফ উল্লেখ করি নি। বিশেষভাবে সৌদি আরবের ফাতওয়ার অনুসরণ করেছি, যেন মানুষ অপরিচিত ফাতওয়া শ্রবণ করে বিভ্রান্তিতে লিপ্ত না হয়।

সাত: আলিমদের ইজতেহাদের ফসল শিক্ষণীয় বিষয় ও মাসায়েল উল্লেখ করেছি।

আট: হাদীসগুলো হরকতসহ উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি, যেন পড়তে সমস্যা না হয়, পাঠক ও শ্রবণকারী সহজে তার অর্থ উদ্ধারে সক্ষম হয়।

আল্লাহ আমাদের এ সংকলন থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।

সংকলক

ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ আল-হাকীল

সোমবার, ১৩/৭/১৪২৭ হি.

১. রমযানের পূর্বে সাওমের নিষেধাজ্ঞা
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لا يَتَقَدَّمَنَّ أحَدُكُم رَمَضَانَ بصَومِ يومٍ أو يومَينِ إلا أنْ يَكونَ رَجُلٌ كان يَصُومُ صَومَه فَليَصُمْ ذَلكَ اليَوم» .

“তোমাদের কেউ যেন একদিন বা দু’দিনের সাওমের মাধ্যমে রমযানকে এগিয়ে না আনে, তবে কারো যদি পূর্বের অভ্যাস থাকে, তাহলে সে ঐ দিন সাওম রাখবে”।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮২।]

তিরমিযীতে হাদীসটি এভাবে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لا تَقَدَّمُوا الشَّهرَ بِيَوْمٍٍ ولا بِيَومَين إلا أن يُوَافِقَ ذَلكَ صَوْماً كَانَ يَصُوُمُهُ أَحَدُكُم ...».

“তোমরা একদিন বা দু’দিনের মাধ্যমে (রমযান) মাস এগোবে না, তবে সেদিন যদি সাওমের দিন হয়, যা তোমাদের কেউ পালন করত...”‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. রমযানের সতর্কতার জন্য তার পূর্বে সাওমের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।ওলামায়ে কেরাম বলেছেন: হাদীসের অর্থ: তোমরা সাওমের মাধ্যমে রমযানের সতর্কতার নিয়তে রমযানকে এগিয়ে আনবে না। [ফাতহুল বারি: (৪/১২৮)।]

ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, “আহলে ইলমের আমল এ হাদীস মোতাবেক। তারা রমযান মাস আসার আগে রমযান হিসেবে সাওম পালন করা পছন্দ করতেন না। হ্যাঁ, কেউ যদি পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট দিন সাওম পালন করে, আর সেদিন রমযানের আগের দিন হয়, তবে এতে তাদের নিকট কোনো সমস্যা নেই”। [সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ৬৮৪।]

দুই. রমযানের পূর্বে (রমযানের সাথে লাগিয়ে) নফল সাওম পালন করা নিষেধ।‎ [ফাতহুল বারি: (৪/১২৮)।]

তিন. এ দিন যার সাওমের দিন, সে এ থেকে ব্যতিক্রম, যেমনকাফ্‌ফারা বা মান্নতের সাওম এবং যার এ দিন নফল সাওমের অভ্যাস রয়েছে। যেমন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার।

‎চার. এ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে সবচেয়ে যৌক্তিক যে হিকমত বর্ণনা করা হয়েছে তা হলো, রমযানের সাওম শর‘ঈ চাঁদ দেখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং যে শর‘ঈভাবে চাঁদ দেখারএক বা দু’দিন আগে সাওম রাখল সে শরী‘আতের এ বিধানে ত্রুটির নির্দেশ করল এবং যেসব ‘নস’ বা দলীলে চাঁদ দেখার সাথে সাওম সম্পৃক্ত করা হয়েছে, তা সে প্রত্যাখ্যান করল।‎ [ফাতহুল বারি: (৪/১২৮)।]

পাঁচ. এ হাদীসে ‘রাফেযি’ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ রয়েছে, যারা চাঁদ না দেখে সাওম পালন বৈধ বলে। [ফাহুল বারি : (৪/১২৮)।]

ছয়. এ হাদীস থেকে জানা গেল, নফল ও ফরয ইবাদতের মাঝে প্রাচীর ও বিরতি রয়েছে। যেমন, শাবানের নফল ও রমযানের ফরযের বিরতি সন্দেহের দিন সাওম পালন করা হারাম। অনুরূপ রমযানের শেষ ও শাওয়ালেরপ্রথম দিন তথা ঈদের দিন সাওম পালন করা হারাম।ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ ও একদল সলফ ফরয ও নফল সালাতের মাঝে বিরতি সৃষ্টি করা মোস্তাহাব বলেছেন। যেমন, কথাবার্তা বলা বা নড়াচড়ার করা বা সালাতের স্থানে আগ-পিছ হওয়া। [আল-ইস্তেযকার: (৩/৩৭১)।]

সাত. শরী‘আত আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব, তাতে বৃদ্ধি বা হ্রাস করা বৈধ নয়। কারণ, তা দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি অথবা দীন থেকে বিচ্যুতির আলামত। সতর্কতামূলক রমযানের আগে রমযানের নিয়তে সাওমের নিষেধাজ্ঞা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্টহয়।

২. মাসের শুরু-শেষ নির্ধারণ
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদারমযান প্রসঙ্গে বলেন,

«لا تَصُومُوا حَتَّى تَرَوا الهِلال، ولا تُفْطِروا حَتَّى تَروْهُ، فَإِنْ غُمَّ عليكُمُ فاقْدُرُوا لهُ» .

“‎তোমরা সাওম রাখবে না যতক্ষণ না হেলাল (নতুন চাঁদ) দেখ, আর সাওম ছাড়বে না যতক্ষণ না তাকে দেখ, আর যদি তোমাদের থেকে তা অদৃশ্য হয়, তাহলে মাস পূর্ণ কর”। ‎ ‎ ‎

বুখারীর অপর বর্ণনায় আছে:‎

«إِذا رَأَيتُمُوهُ فصُومُوا، وإِذا رَأَيتمُوهُ فأفطِرُوا، فَإِنْ غَمَّ عَلَيكُم فاقدُرُوا له» .

“যখন তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখ সাওম পালন কর, আর যখন তোমরা তা দেখ সাওম ভঙ্গ কর, যদি তা তোমাদের থেকে আড়াল হয়, তবে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৭; দ্বিতীয় হাদীস- সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০।]‎

জমহুরওলামায়ে কেরাম বলেন, যদি ঊনত্রিশ তারিখ চাঁদ দেখা না যায়, তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে। [শারহুন নববী আলা মুসলিম, হাদীস নং ৭/১৮৬)।] যেমন অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে:

«فَإِنْ أُغْمِىَ عَلَيْكُم فَاقْدُروا لَهُ ثَلاثِين»، ورِوايةُ : «فَعُدُّوا ثَلاثينَ» ورِوايَةُ : «فَأَكْمِلُوا العَدَدَ» وكُلُّها في صَحِيحِ مُسْلِمٍ .

“যদি চাঁদ তোমাদের থেকে আড়াল করা হয়, তাহলে তার ত্রিশ দিন পূর্ণ কর”। অপর বর্ণনায় এসেছে: “ত্রিশ দিন গণনা কর”। অপর বর্ণনায় এসেছে: “সংখ্যা পূর্ণ কর”। এসব বর্ণনা সহীহ মুসলিমে রয়েছে। [দেখুন: সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০-১০৮১।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِذا رأَيتُم الهِلالَ فصُومُوا، وإِذا رَأيتُمُوهُ فَأَفْطِروا، فإن غُمَّ عَلَيكُمْ فصُومُوا ثلاثِينَ يَوماً» .

“যখন তোমরা চাঁদ দেখ সাওম পালন কর, আবার যখন তোমরা চাঁদ দেখ সাওম ত্যাগ কর। যদি তা তোমাদের থেকে আড়াল করা হয়, তাহলে ত্রিশ দিন সিয়াম পালন কর”।

অপর বর্ণনায় আছে:

«صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ، وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِن غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاثينَ» .

“তোমরা চাঁদ দেখে সাওম রাখ ও চাঁদ দেখে সাওম ত্যাগ কর, যদি তোমাদের থেকে আড়াল করা হয়, তাহলে শাবানের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর”।

«فَإِن غَبِيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاثِينَ» .

অপর বর্ণনায় আছে: “যদি তা তোমাদের থেকে লুকিয়ে থাকে, তাহলে শাবানের ত্রিশ দিন পূর্ণকর”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮১। প্রথম দু’টি হাদীস মুসলিম থেকে ও তৃতীয় হাদীস বুখারী থেকে।]

আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«تَرَاءَى النَّاسُ الهلالَ فَأَخْبَرْتُ رَسُولَ الله صلى الله عليه وسلم أَني رَأَيْتُهُ فَصَامَهُ وأَمَرَ النَّاسَ بِصيَامِهِ» .

“লোকেরা চাঁদ দেখছিল, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ দিলাম, আমি চাঁদ দেখেছি, অতঃপর তিনি সাওম পালন করেন ও লোকদের সাওম পালনের নির্দেশ দেন”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৪৩; দারামি, হাদীস নং ১৬৯১; দারাকুতনি: (২/১৫৬; বায়হাকি: (৪/২১২); তাবরানি ফিল আওসাত, হাদীস নং ৩৮৭৭; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৪৭; হাকেম: (১/৫৮৫)। হাদীসটি সহীহ বলেছেন। হাকেম বলেছেন মুসলিমের শর্ত মোতাবেক। আল-মাজমু গ্রন্থে ইমাম নববী হাদীসটি সহীহ বলেছেন: (৬/২৭৬)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. রমযানের সাওম শর‘ঈ চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। যদি মেঘ, ধুলো, ধুঁয়া ইত্যাদি চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়, তাহলে শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করা ওয়াজিব।

‎দুই. যদি মেঘ বা ধুলোইত্যাদির কারণে চাঁদ দেখা না যায়, তাহলে সতর্কতাস্বরূপ শাবানের শেষ দিন সাওম রাখবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন: “চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সাওম পালন কর না”। আর নিষেধাজ্ঞার দাবি হচ্ছে হারাম।

তিন. যখন চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সাওম ওয়াজিব, তারপর জ্যোতিষ্ক ও গণকদেরকথায় কর্ণপাত করা যাবে না‎। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/১৭৮)।]

চার. ইসলামী শরী‘আতের সরলতার প্রমাণ যে, সাওম রাখা ও ত্যাগ করা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল করেছে, যার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হয় না, দৃষ্টি সম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তি তা দেখতে পায়, পক্ষান্তরে যদি তা নক্ষত্রের উপর নির্ভরশীল করা হত, তাহলে অনেক জায়গায় মুসলিমদের নিকট চাদেঁর বিষয়টি কঠিন আকার ধারণ করত, যেখানে গণক ও জ্যোতিষ্ক অনুপস্থিত। [শারহু ইবনুল বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/২৭)।]

পাঁচ. যে দেশে চাঁদ দেখা গেল, তার অধিবাসীদের ওপর সাওম ওয়াজিব। যে দেশে চাঁদ দেখা যায় নি, তার অধিবাসীদের ওপর সাওম ওয়াজিব নয়। কারণ, সাওমের সম্পর্ক চাঁদ দেখার সাথে। দ্বিতীয়ত চাঁদের কক্ষপথ বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন। [দেখুন: শারহু ইবনুল মুলাক্কিন: (৫/১৮১-১৮২)।]

‎ছয়. রমযানের চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে একজন বিশ্বস্ত (শরী‘আতের ভাষায় আদেল) ব্যক্তির সাক্ষীগ্রহণযোগ্য, যার প্রমাণ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎র হাদীস। কিন্তু রমযান সমাপ্তির সংবাদের জন্য দু’জন নির্ভরযোগ্য লোকের সাক্ষী অপরিহার্য। একাধিক হাদীস দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত।‎ [তিরমিযী রহ. তার জামে তিরমিযীতে: (৩/৭৪) বলেছেন: “সাওম ত্যাগ করার বিষয়ে দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সাক্ষী অপরিহার্য, এতে কোনো আলিমের দ্বিমত নেই”। ইমাম নববী শারহু মুসলিমে বলেছেন: “অর্থাৎ কতক মুসলিমের চাঁদ দেখা যথেষ্ট, সবার দেখা জরুরি নয়, তবে কমপক্ষে দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সাক্ষী অবশ্য জরুরী। বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী সাওমের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির সাক্ষী গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সাওম ভঙ্গের ক্ষেত্রে দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সাক্ষী ব্যতীত চাঁদ দেখা গ্রহণ করা যাবে না, আবু সাউর ব্যতীত সবাই এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি সাওম ভঙ্গের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির সাক্ষী যথেষ্ট মনে করেন”। মাজমু ফাতাওয়া ইবন বায: (১৫/৬২)]

সাত. যিনি দেশের প্রধান তিনি সাওম বা ঈদের ঘোষণা দিবেন। [বুলুগুল মারাম, আবু কুতাইবাহ ফিরইয়াবির টিকাসহ: (১/৪১২), আরো দেখুন: ফাতাওয়া সাদিয়া: (২১৬)।]

আট. যে চাঁদ দেখে তার দায়িত্ব দেশের প্রধান বা তার প্রতিনিধির নিকট সংবাদ পৌঁছে দেওয়া।

নয়. আধুনিক প্রচার যন্ত্র থেকে প্রচারিত রমযান শুরু বা সমাপ্তির সংবাদ বিশ্বাস করা জরুরি, যদি তা দেশের প্রধান বা তার প্রতিনিধি থেকে প্রচার করা হয়।

দশ. মাসের শুরু-শেষ জানার জন্য ত্রিশে শাবান ও ত্রিশে রমযানের চাঁদ দেখা মোস্তাহাব।‎

এগার. নারী যদি চাঁদ দেখে, তার সাক্ষী গ্রহণ করার ব্যাপারে আলিমদের দ্বিমত রয়েছে। শাইখ ইবন বায রহ. তারচাঁদ দেখার সাক্ষী গ্রহণ না করার অভিমত প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, চাঁদ দেখা পুরুষদের বৈশিষ্ট্য, এ ব্যাপারে তারা নারীদের থেকে অধিক জ্ঞানের অধিকারী। [ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীসের ওপর ভিত্তি করে যারা চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির সাক্ষী কবুল করা বৈধ বলেন, তারা এ ব্যাপারে নারী ও গোলামের সংবাদ গ্রহণযোগ্য মনে করেন, যেমন খাত্তাবি আবু দাউদের টিকা মা‘আলিমুস সুনানে উল্লেখ করেছেন: (২/৭৫৩)।]‎

৩. সাওম ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‎

«بنُيَ الإسْلامُ على خمَسْ : ٍ شهَادةِ أنَّ لا إلَه إلَّا اللهُ وأنَّ مُحمَّداً رَسُولُ الله، وإِقَامِ الصَّلاةِ، وإيتَاءِ الزَّكَاة، والحجِّ وَصَومِ رَمَضَانَ» .

“ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বস্তুর ওপর রাখা হয়েছে: সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ সম্পাদন করা ও রমযানের সাওম পালন করা”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬।]

আবু জামরাহ নসর ইবন ইমরান রহ. বলেন, “একদা আমি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎মা ও শ্রোতাদের মাঝে দোভাষীর কাজ করছিলাম। তিনি বললেন: আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি গ্রুপ রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হন, তিনি তাদের বলেন, কোন গ্রুপ বা কোনো সম্প্রদায়ের লোক? তারা বলল: আমরা রাবিয়াহ গোত্রের। তিনি বললেন: স্বাগতম প্রতিনিধি গ্রুপ বা স্বাগতম রাবিয়াহ সম্প্রদায়, তিরষ্কার ও ভর্ৎসনা মুক্ত। তারা বলল: আমরা আপনার নিকট আগমন করি অনেক দূর থেকে। আপনার ও আমাদের মাঝে রয়েছে মুদার গোত্রের কাফিরদের এ গ্রাম, এ জন্য হারাম তথা সম্মানিত ও যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস ব্যতীতআপনার কাছে আমরা আসতে পারি না। অতএব, আমাদেরকে উপদেশ দিন,যা আমরা আমাদের রেখে আসা ভাইদের নিকট পৌঁছাব এবং যার ওপর আমল করে আমরা সকলে জান্নাতে যাব। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন চারটি বিষয়ের; নির্দেশ দিলেন এক আল্লাহর ওপর ঈমানের। তিনি বললেন: তোমরা কি জান আল্লাহর ওপর ঈমান কী? তারা বলল: আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। তিনি বললেন:

«شَهَادَةُ أَنَّ لا إِله إلَّا الله وأَنَّ مُحمداً رَسُولُ الله، وإِقَامُ الصَّلاةِ، وإيتَاءُ الزَّكَاةِ، وصَومُ رَمَضَانَ، وتُعْطُوا الخُمُسَ من المَغْنَم ... قال : احْفَظُوهُ وأَخْبِرُوهُ مَنْ وَرَاءَكُم» .

“সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মা‘বুদ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানের সাওম পালন করা ও গনিমতের এক পঞ্চমাংশ দান করা... তিনি বললেন: এগুলো মনে রাখ ও ‎‎ তোমাদের রেখে আসা ভাইদের বল”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬।]

শিক্ষা ও মাসায়েল: [দেখুন: ইমাম নববী কর্তৃক মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ: (১/১৪৮)]

এক. ঈমান ও ইসলামের বর্ণনা, অর্থাৎ ঈমান হচ্ছে অন্তরের স্বীকৃতি আর ইসলাম হচ্ছে আত্মসমর্পণ ও বাহ্যিক আনুগত্য। ঈমান ও ইসলাম একসঙ্গে উল্লেখ হলে এ অর্থ প্রকাশ করে, যদি আলাদা উল্লেখ হয়, তখন একে অপরের অর্থ প্রকাশ করে।

‎দুই. মূলতঃ ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূলের সাক্ষ্য দেওয়া, তবে ইসলামের মৌলিক আমল হিসেবে সালাত, যাকাত, সাওম ও হজ তার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়।

তিন. এ পাঁচটি রোকন বা তার আংশিক ত্যাগ করা আল্লাহর অবাধ্যতা প্রমাণ করে।

চার. ইসলামে সিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই সিয়ামকে তার রোকন স্থির করা হয়েছে।

পাঁচ. দীনের গরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জানা জরুরি। ওয়াজিবের ওপর আমল করা, হারাম থেকে বিরত থাকা এবং মানুষের নিকট দীন পৌঁছে দেওয়া, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেছেন: “তোমরা এগুলো মনে রাখ ও তোমাদের রেখে আসা ভাইদের পৌঁছে দাও”।

৪. ‎রমযানের ফযীলত
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إذا دَخَلَ شَهرُ رَمَضَانَ فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَغُلِّقَتْ أَبوَابُ جَهَنَّمَ، وسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ» .

“যখন রমযান মাস আগমন করে, তখন আসমানের দরজাসমূহ খুলা হয়, জাহান্নামের ‎‎ দরজাসমূহ বদ্ধ করা হয় এবং শয়তানগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৭৯।]‎

অপর বর্ণনায় আছে:‎

«إذا كَانَ أَوَّلُ ليْلَةٍ من شَهرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّياطِينُ ومَرَدَةُ الجِنِّ، وغُلِّقَتْ أبوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ منْهَا بَابٌ، وفُتِحَتْ أَبوَابُ الجَنَّةِ فلمْ يُغْلَقْ منْها بَابٌ، ويُنَادِي مُنَادٍ : يا بَاغِيَ الخَيرِ : أَقْبِلْ، ويا بَاغِيَ الشَّر : أَقْصِرْ، ولله عُتَقَاءُ مِنَ النَّار وذَلكَ كُلَّ لَيْلَةٍ» .

‎“যখন রমযানের প্রথম রাত হয়, শয়তান ও অবাধ্য জিন্নগুলো শৃঙ্খলিত করাহয়, জাহান্নামের সকল দরজা বন্ধ করা হয়; খোলা হয় না তার কোনো দ্বার, জান্নাতের ‎‎ দুয়ারগুলো খুলে দেওয়া হয়; বদ্ধ করা হয় না তার কোনো তোরণ এবং একজন ঘোষক ‎‎ ঘোষণা করে: হে পুণ্যের অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! ক্ষান্ত হও। আর আল্লাহর জন্য রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত অনেক বান্দা, এটা প্রত্যেক রাতে হয়”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৬৮২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৪২; সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৮৮৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৪৩৫; হাকেম: (১/৫৮২), তিনি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হাদীসটি সহীহ বলেছেন। আলবানি সহীহ জামে তিরমিযীতে এ হাদীস সহীহ বলেছেন।]

হাদীসে বর্ণিত “হে পুণ্যের অন্বেষণকারী অগ্রসর হও, হে মন্দের অন্বেষণকারী ক্ষান্ত হও”। অর্থ: ‎‎ হে কল্যাণ অনুসন্ধানকারী, তুমি আরো কল্যাণ অনুসন্ধান কর। এটা তোমার মুখ্য সময়, এতে অল্প আমলে তোমাকে অধিক প্রদান করা হবে। আর হে মন্দের প্রত্যাশী,তুমি ক্ষান্ত হও, তাওবা কর, এটা তাওবা করার মোক্ষম সময়।

অপর বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদেরসুসংবাদ প্রদান করে বলেছেন:

«أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهرٌ مُبارَكٌ فَرَضَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ صِيَامَهُ، تُفَتَّحُ فيه أَبوَابُ السَّمَاءِ، وتُغْلَّقُ فِيهِ أَبْوَابُ الجَحِيمِ، وتُغَلُّ فيه مَرَدَةُ الشَّياطِينِ، لله فيهِ لَيلَةٌ خَيرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيرَهَا فَقَدْ حُرِم» .

“তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমযান এসেছে, আল্লাহ এর সাওম ফরয করেছেন। এতে জান্নাতের দ্বারসমূহ খোলা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বদ্ধ করাহয়, শিকলে বেঁধে রাখা হয় শয়তানগুলো। এতে একটি রজনীরয়েছে যা সহস্র মাস থেকে উত্তম। যে তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে প্রকৃত অর্থে বঞ্চিত হলো”। [নাসাঈ: (৪/১২৯; আহমদ: (২/২৩০), আব্দু ইবন হুমাইদ: (১৪২৯)।]

আবু হুরায়রা অথবা আবু সাইদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ لله عُتَقَاءَ في كُلِّ يَوْمٍٍ ولَيلَةٍ، لكُلِّ عَبدٍ مِنْهُم دَعوَةٌ مُستَجَابَةٌ» .

“প্রত্যেক দিনে ও রাতে আল্লাহর মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দা রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে দো‘আ কবুলের প্রতিশ্রুতি”। [আহমদ: (২/২৫৪), তাবরানি ফিল আওসাত: (৬/২৫৭), বিশুদ্ধ সনদে।]

জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إنَّ لله عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ، وذَلكَ كُلَّ لَيلَة» .

“প্রত্যেক ইফতারের সময় আল্লাহর মুক্তি প্রাপ্ত বান্দা রয়েছে, আর তা প্রত্যেকরাতে”। [ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৪৩, আলবানি ইবন মাজাহ’য় হাদীসটি হাসান ও সহীহ বলেছেন।।]‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. রমযান মাসের ফযীলত যে, এতে জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়,জাহান্নামের দরজাসমূহ বদ্ধ করা হয় ও শয়তানগুলো শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। রমযানের প্রত্যেক রাতে তা সংঘটিত হয়, শেষ রমযান পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

দুই. এসব হাদীস প্রমাণ করে যে, জান্নাত-জাহান্নাম আল্লাহর সৃষ্ট দু’টি বস্তু, এগুলোর দরজাসমূহপ্রকৃত অর্থে খোলা ও বদ্ধ করা হয়। [দেখুন: শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/২০); আল-মুফহিম: (৩/১৩৬)।]

তিন. ফযীলতপূর্ণ মৌসুম ও তাতে সম্পাদিত আমল আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ, যে কারণে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা ও জাহান্নামের দরজাসমূহ বদ্ধ করা হয়।

চার. রমযানের সুসংবাদ প্রদান ও তার শুভেচ্ছা বিনিময় বৈধ। কারণ,সাহাবীদের সুসংবাদ প্রদান ও তাদেরকে আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের এসব বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতেন। অনুরূপ প্রত্যেক কল্যাণের সুসংবাদ প্রদানবৈধ।‎

পাঁচ. অবাধ্য শয়তানগুলোকে এ মাসে আবদ্ধ করা হয়। ফলে তাদের প্রভাব কমে যায় ও মানুষ অধিক আমল করার সুযোগ পায়।

ছয়. বান্দার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের সিয়াম হিফাজত করেন, তাদের থেকে অবাধ্য শয়তানের প্রভাব দূর করেন, যেন সে তাদের ইবাদত বিনষ্ট করার সুযোগ না পায়। [যাখিরাতুল উকবা: (২০/২৫৫)।]

সাত. এসব হাদীস থেকে শয়তানের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে। তাদের শরীর রয়েছে, যা শিকলে বাঁধা যায়। তাদের কতিপয় অবাধ্য, রমযানে যাদেরকে শৃঙ্খলবদ্ধ করা হয়।‎ [যাখিরাতুল উকবা: (২০/২৫৫)।]

‎আট. রমযানের বিশেষ মর্যাদা সেসব মুমিনগণ অর্জন করবে, যারা এর যথাযথ মর্যাদায় দেয় ও এতে আল্লাহর বিধান পালন করে। পক্ষান্তরে কাফির, যারা এতে পানাহার করে, এর কোনো মর্যাদা দেয় না, তাদের জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা ও জাহান্নামের দরজাসমূহ বদ্ধ করা হয় না। তাদের শয়তানগুলো বন্দি করা হয় না, তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তির যোগ্য নয়। [দেখুন: ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম: (৫/১৩১-৪৭৪)।] অতএব, এ মাসে তাদের মৃতরা আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।

নয়. যে মুসলিম কাফিরদের সঙ্গে মিল রাখল, যেমন রমযানের মূ‌ল্য দিল না, এতে পানাহার করল, সাওম ভঙ্গকারী কাজ করল অথবা সাওমের সাওয়াব হ্রাসকারী কর্মে লিপ্ত হলো, যেমন গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ও এসব বৈঠকে উপস্থিত হওয়া, বলা যায় সে রমযানেরফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, তার জন্য জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত ওজাহান্নামের দরজাসমূহ বদ্ধ করা হবে না, তার শয়তানগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকবে না।

দশ. সুরায়ে ‘সাদ’-এর ৫০নং আয়াতে জান্নাতের প্রশংসায় বলা হয়েছে:

﴿جَنَّٰتِ عَدۡنٖ مُّفَتَّحَةٗ لَّهُمُ ٱلۡأَبۡوَٰبُ ٥٠﴾ [ص: 50]

“চিরস্থায়ী জান্নাত, যার দরজাসমূহ থাকবেতাদের জন্য উন্মুক্ত”। [সূরা সাদ, আয়াত: ৫০] এ আয়াত রমযানের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের বিপরীত নয়। কারণ, এ আয়াত জান্নাতের দরজাসমূহ সর্বদা উন্মুক্ত থাকার দাবি করে না। দ্বিতীয়ত এ আয়াত কিয়ামতের দিন সম্পর্কে।

অনুরূপ জাহান্নাম সম্পর্কে সুরা আয-যুমার ৭১নং আয়াত:

﴿حَتَّىٰٓ إِذَا جَآءُوهَا فُتِحَتۡ أَبۡوَٰبُهَا ٧١﴾ [ الزمر : 71]

“অবশেষে তারা যখন জাহান্নামের কাছে এসে ‎‎ পৌঁছবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেওয়াহবে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৭১] হতে পারে এর পূর্বে জাহান্নামের দরজাসমূহ বদ্ধ থাকবে। [যাখিরাতুল উকবা: (২০/২৫৩)।]

‎এগার. লাইলাতুল কদর ফযীলতপূর্ণ। এ রাত লাইলাতুল কদর বিহীন হাজার মাস থেকে উত্তম। এ রাতের বরকত থেকে যে মাহরুম হলো, সে অনেক কল্যাণ থেকে মাহরুম হলো।‎

‎বারো. রমযানের প্রত্যেক রাতে আল্লাহর মুক্ত করা কতিপয় বান্দা থাকে। যারা আল্লাহর মহব্বত, সাওয়াবের আশা ও শাস্তির ভয়ে সাওম রাখে, সাওম হিফাযত করে, কিয়াম করে, ইহসানের প্রতি যত্নশীল থাকে ও অধিক নেক আমল করে, তারা মুক্তির বেশি হকদার।

‎তের. জাহান্নাম থেকে মুক্ত এসব বান্দার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ কবুলেরওয়াদা রয়েছে। তারা দু’টি কল্যাণ লাভ করেছে: জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও দো‘আ কবুলের প্রতিশ্রুতি।‎

‎চৌদ্দ. মুসলিমদের উচিৎ সাওয়াব বিনষ্ট বা হ্রাসকারী কর্ম থেকে সাওম হিফাযত করা। যেমন, চোখ, কান ও জবান সংরক্ষণ করা, তাহলে ইনশাআল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ মিলবে।

‎পনের. সাওম পালনকারীর উচিৎ অধিক দো‘আ করা। কারণ, তার দো‘আ কবুলের সম্ভাবনা রয়েছে।

৫. ফরয সাওমের নিয়ত
হাফসা বিনতে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ لم يُجْمِعِ الصِّيامَ قَبلَ الفَجْرِ فَلا صِيامَ لَه»

“‎যে ফজরের পূর্বে সাওমের নিয়ত করল না, তার সাওম নেই”। ইমাম নাসাঈ এভাবে বর্ণনা করেছেন:

«مَنْ لم يُبَيِّتْ الصِّيامَ قَبْلَ الفَجْرِ فَلا صِيامَ لَهُ» .

“যে ফজরের পূর্বে রাত থেকে সাওম আরম্ভ করল না, তার সাওম নেই”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৫৪; তিরমিযী, হাদীস নং ৭৩০; নাসাঈ: (৪/১৯৬); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৭০০; আহমদ: (৬/২৮৭); সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৯৩৩, এ হাদীসটি মওকুফ ও মারফূ উভয়ভাবে বর্ণিত আছে, তবে মওকূফ বর্ণনা অধিক বিশুদ্ধ।] আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎মা বলতেন:

«لا يَصُومُ إِلَّا مَنْ أَجْمَعَ الصِّيامَ قَبْلَ الفَجْرِ» .

“সাওম রাখবে না, তবে যে ফজরের পূর্ব থেকে সাওমআরম্ভ করেছে”। [মুয়াত্তা মালেক: (১/২৮৮)।]‎

রাত থেকে সাওম আরম্ভ করার অর্থ হচ্ছে: রাত থেকে সাওমের দৃঢ় ও চূড়ান্ত নিয়ত করা, যে ফজরের পূর্বে সাওমের দৃঢ় নিয়ত করল না, তার সাওম হবে না। [তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩৫২)।]

ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, আলিমদের নিকট এ হাদীসের অর্থ হচ্ছে: রমযান মাসে ফজরের পূর্বে যে সাওম আরম্ভ করল না অথবা রমযানের কাযা অথবা মান্নতের সাওমে যে রাত থেকে নিয়ত করল না, তার সাওম শুদ্ধ হবে না।হ্যাঁ, নফল সাওমের নিয়ত ভোর হওয়ার পর বৈধ। এটা ইমাম শাফেঈ, আহমদ ও ইসহাকের অভিমত। [জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৩/১০৮)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. সিয়ামে ইবাদতের নিয়ত করা জরুরি, যদি কেউ স্বাস্থ্য রক্ষা, ডাক্তারের পরামর্শ, পানাহারের প্রতি অনীহা বা অন্য কারণে খাদ্য ও স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাকে, তার এ বিরত থাকা শর‘ঈ সাওম গণ্য হবে না, সে এ কারণে সাওয়াব পাবে না।

দুই. নিয়ত অন্তরের আমল। অতএব, যার অন্তরে এ ধারণা হলো যে, আগামীকাল সে ‎‎ সওম রাখবে, সে নিয়ত করল।

‎তিন. ওয়াজিব সাওম যেমন রমযান, মানত ও কাফ্‌ফারার ক্ষেত্রে পূর্ণ দিন তথা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাওমের নিয়তে থাকা জরুরি। যেব্যক্তি দিনের কোনো অংশে সাওমের নিয়ত করল, তার সাওম পূর্ণ দিন ব্যাপী হলো না, তাইতার সাওম শুদ্ধ হবে না। এ জন্য ওয়াজিব সাওমে সুবহে সাদিকের পূর্ব থেকে নিয়ত করা জরুরি।

চার. রাতের যে কোনো অংশে ফরয বা নফল সাওমের নিয়ত করা বৈধ। নিয়ত করার পর সাওমপরিপন্থী কোনো কাজ করলে নিয়ত নষ্ট হবে না, নতুন নিয়তেরপ্রয়োজন নেই।

৬. সিয়ামের আদব
‎আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«الصيام جنة، فإذا كان أحدكم ‏صائما فلا يرفث ولا يجهل، فإن امرؤ شاتمه فليقل : إني صائم، إني صائم» .

“সিয়াম ঢাল,সুতরাং তোমাদের কেউ সিয়াম অবস্থায় হলে সে যেন অশ্লীলতা ও মুর্খতা পরিহার করে, যদি কেউ তাকে গালি দেয়, সে যেন বলে: আমি সাওম পালনকারী,আমি সাওম পালনকারী”। [উল্লিখিত শব্দ মুয়াত্তা মালেক থেকে নেওয়া: (১/৩১০)। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।] অপর বর্ণনায় এসেছে:‎

«وإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني امرؤ صائم» .‏

“তোমাদের কারো যখন সাওমের দিন হয়, সে যেন অশ্লীলতা ও শোরগোল পরিহার করে, কেউ যদিতাকে গালি দেয় বা তার সাথে মারামারি করে, সে যেন বলে: আমি ‎‎ সাওম পালনকারী”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১)]‎

অপর বর্ণনায় এসেছে:‎

«لا تساب وأنت صائم، وإن سابك أحد فقل : إني صائم، وإن كنت قائما فاجلس» .‏

“সাওম অবস্থায় তুমি গালি দেবে না, যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় তাহলে তাকে বল: আমি সাওম পালনকারী। আর যদি তুমি দণ্ডায়মান থাক, বসে যাও”। [নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩২৫৯; তায়ালিসি, হাদীস নং ২৩৬৭; ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৯৯৪; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৮৩, হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ لَم يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ وَالجَهْلَ فَلَيسَ لله حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وشَرَابَهُ» .

“যেমিথ্যা কথা ও তদনুরূপ কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনোপ্রয়োজন নেই।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৭১০; আবু দাউদ, হাদীস নং ৩২৬২; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩২৪৫-৩২৪৮; তিরমিযী, হাদীস নং ৭০৭।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

«الصِّيامُ جُنَّةٌ مِنَ النَّار، فَمَنْ أَصْبَحَ صَائِماً فلا يَجْهَلْ يومَئِذٍ، وإِنْ امْرُؤٌ جَهِلَ عَلَيهِ فلا يَشْتُمْهُ، ولا يَسُبُّه، وَلْيَقُلْ : إِني صائِم ...».

“সিয়াম জাহান্নামের ঢাল, যে সাওম অবস্থায় ভোর করল, সে যেন সেদিন মুর্খতার আচরণ না করে। কেউ যদি তারসাথে দুর্ব্যবহার করে, সে তাকে তিরষ্কার করবে না, গালি দেবে না, বরং বলবে: আমি সাওম পালনকারী।” [নাসাঈ: (৪/১৬৭); তাবরানি ফিল আওসাত, হাদীস নং ৪১৭৯, আলবানি সহীহ নাসাঈতে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত:

«أَنَّهُ كَانَ وأَصْحَابُهُ إِذَا صَامُوا قَعَدُوا في المَسْجِدِ، وقَالَوا : نُطَهِّرُ صِيَامَنَا» .

“তিনি ও তার সাথীগণ যখন সিয়াম পালন করতেন মসজিদে বসে ‎‎ থাকতেন, আর বলতেন: আমাদের সাওম পবিত্র করছি”। [আহমদ ফিয যুহদ, হাদীস নং ১৭৮; আবু নুয়াইম ফিল হিলইয়াহ: (১/৩৮২)।]‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. সিয়াম জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়। কারণ, সে প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখে, আর জাহান্নাম প্রবৃত্তি দ্বারা আবৃত।‎

‎দুই. সাওম পালনকারীর জন্য রাফাস হারাম। রাফাস হচ্ছে অশ্লীল কথা, কখনো সহবাস ও তার আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হয়। [ফাতহুল বারি: (৪/১০৪)।] এসব থেকে সাওম পালনকারী বিরত থাকবে, তবে যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম, তার জন্য চুম্বন ও স্ত্রীর সাথে মেলামেশা বৈধ।

তিন. সাওম পালনকারীর জন্য মুর্খতাপূর্ণ আচরণ হারাম, যেমন চিৎকার ও শোরগোল করা, অযথা ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি।

চার. সাওম পালনকারী যদি করো গালমন্দ, চিৎকার ও ঝগড়ার সম্মুখীন হয়, তাহলে তার করণীয়:

(১) গালমন্দকারীকে অনুরূপ প্রতি উত্তর করবে না, বরং ধৈর্য ও সহনশীলতা অবলম্বন করবে।

(২) তার সাথে কথা পরিহার করবে, যেন সে মূর্খতার সুযোগ না পায়। কতক বর্ণনায় এসেছে:

«وإنْ شَتَمَهُ إِنسَانٌ فلا يُكَلِّمْهُ» .

“যদি কেউ তাকে গালি দেয়, তার সাথে কথা বলবে না”। [ফাতহুল বারি: (৪/১০৪)।]‎

‎(৩) তাকে বলবে: “আমি সাওম পালনকারী”। উচ্চস্বরে বলবে, যেন সে মূর্খতা থেকে বিরত থাকে ও প্রতি উত্তর না করার কারণ, বুঝতে পারে। ফরয-নফল সব সাওমের ক্ষেত্রে অনুরূপ করবে। [এ বিষয়ে আলিমদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।]

(৪) যদি সে বিরত না হয়, তবে বারবার বলবে আমি সাওম পালনকারী, আমি সাওম পালনকারী।

(৫) এ পরিস্থিতিতে যদি সে দাঁড়ানো থাকে, বসার সুযোগ হলে বসে যাবে, যেরূপ অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে, যেন গোস্বা নিবারণ হয়, প্রতিপক্ষ ও শয়তান পিছু হটে।

পাঁচ. এ সকল হাদীস থেকে এ কথা বুঝে নেওয়ার অবকাশ নেই যে, অশ্লীলতা, গালিগালাজ,মুর্খতার আচরণ, অসার ও অযথা বিতর্ক শুধু সাওম অবস্থায় নিষেধ, অন্য সময় নয়,বরং সর্বাবস্থায় এগুলো নিষেধ ও হারাম, তবে সাওম অবস্থায় এগুলোতে লিপ্তহওয়া জঘন্য অন্যায়। কারণ, এসব সাওমের মূল উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে। [আল-মুফহিম: (৩/২১৪); ফাতহুল বারি: (৪/১০৪)।]

ছয়. ইসলামী জীবন-দর্শনের পবিত্রতা, তার অনুসারীদের ভদ্র আচরণ শিক্ষা দেওয়া ও মূর্খদের এড়িয়ে চলার অভিনব কৌশল।

সাত. যদি সাওম পালনকারীর ওপর কেউ যুলুম করে, তাহলে সহজতর উপায়ে তার প্রতিকার করবে, এ থেকে সাওম পালনকারীকে নিষেধ করা হয় নি। [ফাতহুল বারি: (৪/১০৫)।]‎

আট. সত্যিকারের সিয়াম পাপ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সিয়াম, মিথ্যা ও অশ্লীলতা থেকে মুখের সিয়াম, পানাহার থেকে পেটের সিয়াম, স্ত্রীসহবাস ও যৌনতা থেকে লিঙ্গের সিয়াম। [দেখুন: আহাদিসুস সিয়াম, আব্দুল্লাহ আল-ফাওযান, হাদীস নং ৭৫।]

নয়. অধিকাংশ আলিম একমত যে, গীবত, পরনিন্দা, মিথ্যা কথা, মূর্খতাপূর্ণ আচরণইত্যাদি কাজগুলো সিয়াম ভঙ্গ করে না, তবে তার সাওয়াব অবশ্যই হ্রাস করে, এ জন্য সে গুনাহগার হবে। [ফাতহুল বারি: (৪/১০৪), উমদাতুল কারি: (১০/২৭৬)।]

‎দশ. এ থেকে প্রমাণ হলো যে, সিয়ামের উদ্দেশ্য শুধু ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করানয়, বরং মূল উদ্দেশ্য প্রবৃত্তি দুর্বল করা, গোস্বা নিবারণ করা, কু-প্রবৃত্তির চাহিদা নস্যাৎ করা ও নফসে মুতমায়িন্নার আনুগত্য করা, যদি সিয়াম দ্বারা এসব অর্জন না হয়, তাহলে সিয়াম রাখা বা না রাখার মতো। কারণ, সিয়াম তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। [বায়যাবি থেকে উদ্ধৃত, দেখুন: ফাতহুল বারি: (৪/১১৭), ফায়যুল কাদির: (৬/২২৪)।]

এগার. এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মিথ্যা কথা, মিথ্যা নির্ভর কাজ সকলঅন্যায়ের মূল। এ জন্য আল্লাহ মিথ্যাকে শির্কের সাথে উল্লেখ করেছেন:‎

﴿فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ وَٱجۡتَنِبُواْ قَوۡلَ ٱلزُّورِ ٣٠﴾ [ الحج : 30]

“সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর”। [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩০] এ আয়াতে আল্লাহ পৌত্তলিকতার অপরাধের সাথে মিথ্যাকে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে মিথ্যার ভয়াবহতা প্রতীয়মান হয়।‎ [মুনাভি আল্লামা তিবি থেকে বর্ণনা করেছেন, দেখুন: ফায়যুল কাদির: (৬/২২৪)।]

১০
৭. এক সাথে সিয়াম রাখা ও ভঙ্গ করা
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:‎

«الصَّوْمُ يَوْمَ تَصُومُونَ والفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُونَ والأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّونَ» .

“সেদিন সাওম,তোমরা যেদিন সাওম পালন করবে, সেদিন ইফতার, তোমরা যেদিন ইফতার করবে, সেদিন কুরবানি, তোমরা যেদিন কুরবানি করবে”। তিরমিযী, তিনি বলেছেন: হাদীসটি হাসান, গরীব।

‎আবু দাউদের এক বর্ণনায় আছে:

«وَفِطْرُكُمْ يَوْمَ تُفْطِرُونَ وَأَضْحَاكُمْ يَوْمَ تُضَحُّونَ» .

“তোমাদের ইফতার, যেদিন তোমরা ইফতার করবে, তোমাদের কুরবানী, যেদিন তোমরা কুরবানী করবে”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩২৪; তিরমিযী, হাদীস নং ৬৯৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৬০; দারাকুতনি: (২/১৬৪); আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৩০৪; ইসহাক, হাদীস নং ৪৯৬।]‎

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:‎

«الفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ النَّاسُ، وَالأَضْحَى يَوْمَ يُضَحِّي النَّاسُ»

“ইফতার, যেদিন মানুষ ইফতার করে, কুরবানি, যেদিন মানুষ কুরবানী করে”।‎ [তিরমিযী, হাদীস নং ৮০২, তিনি বলেছেন এ সনদে হাদীসটি হাসান, গরীব ও সহীহ। ইসহাক, হাদীস নং ১১৭২।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. এ হাদীস ইসলামি শরী‘আতের সৌন্দর্য ও সহজতার প্রমাণ বহন করে, মানুষ যা করতে পারবে না, তার ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া হয় নি। ইবাদতের সময় নির্ধারণে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি তথা চোখে দেখার উপর নির্ভর করা হয়েছে।

দুই. ইসলামী শরী‘আত একতার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে, যেমন সে মুসলিমদেরকে এক সাথে সাওম রাখা, ভঙ্গ করা ও একসাথে ঈদ উৎযাপনের নির্দেশ দিয়েছে।

তিন. চাঁদ দেখায় শর‘ঈ পদ্ধতি অনুসরণ করা অথবা চাঁদ দেখায় বাঁধার কারণে ত্রিশ দিন পূর্ণ করার পর যদি মাসের শুরু-শেষ ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে তা ক্ষমাযোগ্য। হাফেয ইবন আব্দুল-বার রহ. বলেন, “সকল ‎‎ ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, যদি যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার ভুলের কারণে দশতারিখে ওকুফে আরাফা করে, তবে তা যথেষ্ট হবে। তদ্রূপ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।আল্লাই ভালো জানেন”। [আত-তামহিদ: (১৪/২৫৬), শাইখ ইবন বায রহ. বলেছেন: “শরঈভাবে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে যদি মানুষ ভুল করে, তাহলে তারা সাওয়াব পাবে ও পুরস্কৃত হবে”। মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/১৩৩)।]‎

‎চার. এসব হাদীস প্রমাণ করে যে, ঈদ হওয়ার জন্য সবার এক হওয়া জরুরি।যদি কেউ একা ঈদের চাঁদ দেখে তার জন্য জরুরি সবার সাথে ঈদ করা। সে সবার সাথে সাওম রাখবে, ভঙ্গ করবে ও কুরবানি করবে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “এ থেকে প্রমাণিত হয়, একা চাঁদ প্রত্যক্ষকারীর ওপর চাঁদ দেখার বিধান বর্তায় না, সাওম রাখা ও ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে সে অন্যদের মতো”। [তাহযিবুস সুনান: (৬/৩১৭)।]

এ থেকে বলা যায়, কেউ যদি একা চাঁদ দেখে, তাহলে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, সে একা সাওম রাখবে না, বরং মানুষের সাথে সাওম রাখবে। তার বিধান অন্যান্য মানুষের ন্যায়, এ হাদীস থেকে তাই বুঝে আসে”। [দেখুন: ফাতাওয়া সাদিয়াহ: (২১৬), মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/৭২-৭৩)।]

১১
৮. তারাবীর সালাতের অনুমোদন
আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল কারি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “আমি উমার ইবন খাত্তাবের সাথে রমযানের রাতে মসজিদে যাই, তখন মানুষেরা পৃথকভাবে নিজ নিজ সালাত আদায় করছিল। আবার কেউ কতক লোকের সাথে জামা‘আতসহ সালাত আদায় করছিল। উমার বললেন: আমার মনে হয় এক ইমামের পিছনে তাদের সকলের সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করলে, খুব সুন্দর হবে। অতঃপর তিনি উবাই ইবন কাবের পিছনে সবাইকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে কোনো রাতে আমি তার সাথে বের হয়ে দেখি লোকেরা এক ইমামের পিছনে সালাত আদায় করছে, তখন উমার বললেন: এটা খুব সুন্দর বিদআত। তবে যারা এ সালাতে অনুপস্থিত, তারা উত্তম এদের থেকে, অর্থাৎ শেষ রাতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রথম রাতে যারা ঘুমাচ্ছে, তারা এদের চেয়ে উত্তম। তখন মানুষেরা প্রথম রাতে সালাত আদায় করত”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৬; মালেক: (১/১১৪); আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৭২৩; ইবন আবি শায়বাহ: (২/১৬৫)।]

ইমাম মালেকের এক বর্ণনায় আছে: “উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু উবাই ইবন কা‘ব ও তামিমুদ দারি রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে সবার সাথে এগারো রাকাত সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইমাম সাহেব শত আয়াতের অধিক বিশিষ্ট সূরাসমূহ তিলাওয়াত করতেন, আমরা দীর্ঘ কিয়ামের কারণে লাঠির উপর ভর করতাম, আমরা ফজরের আগ মুহূর্ত ব্যতীত বাড়ি ফিরতাম না”। [মালেক: (১/১১৫; আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৭৩০; ইবন আবি শায়বাহ: (২/১৬২)।]

ইবন খুযাইমার এক বর্ণনায় আছে: উমার বলেন, “আল্লাহর শপথ, আমার ধারণা আমি যদি এক ইমামের পিছনে তাদের সবাইকে একত্র করি, তাহলে খুব ভালো হবে। অতঃপর উমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি উবাই ইবন কা‘বকে সবার সাথে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে উমার তাদের দেখতে যান, তখন সবাই এক ইমামের পিছনে সালাত আদায় করছিল, তিনি বলেন, এটা খুব সুন্দর বিদআত। যারা এ সালাত থেকে ঘুমিয়ে আছে তারা উত্তম, (অর্থাৎ প্রথম রাতে ঘুমিয়ে যারা শেষ রাতে সালাত আদায় করে)। তখন লোকেরা প্রথম রাতে সালাত আদায় করত। তারা রমযানের শেষার্ধে কাফিরদের ওপর লা‘নত করত:

«الَّلهُمَّ قَاتِلْ الكَفَرَةَ الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِك، ويُكَذِّبونَ رُسُلَكَ، ولا يُؤْمِنُونَ بِوَعْدِك، وخَالِفْ بينَ كَلِمَتهِم، وأَلْقِ في قُلُوبِهِم الرُّعْبَ، وأَلْقِ عَلَيْهِم رِجْزَكَ وعَذَابَكَ إِلهَ الحَقِّ»

“হে আল্লাহ, তুমি কাফিরদের ধ্বংস কর, যারা তোমার রাস্তা থেকে মানুষদের বিরত রাখে, তোমার রাসূলকে মিথ্যারোপ করে, তোমার প্রতিশ্রুতির ওপর ঈমান আনে না। তুমি তাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি কর, তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার কর। হে সত্য ইলাহ, তুমি তাদের ওপর তোমার আযাব ও শাস্তি নাযিল কর”। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরূদ ও সালাম পাঠ করে মুসলিমদের জন্য কল্যাণের দো‘আ ও ইস্তেগফার করবে। তিনি বলেন, তারা কাফিরদের ওপর লা‘নত, নবীর ওপর দুরূদ ও মুমিনদের জন্য দো‘আ-ইস্তেগফার শেষে বলতেন:

«الَّلهُمَّ إِياكَ نَعْبُدُ، ولَكَ نُصَلِّي ونَسْجُدُ، وإِلَيكَ نَسْعَى ونَحْفِدُ، ونَرْجُو رَحمَتكَ رَبَّنا، ونَخَافُ عَذَابَكَ الجِدَّ، إِنَّ عَذَابكَ لمن عَادَيتَ مُلْحِق»

“হে আল্লাহ আমরা একমাত্র তোমার ইবাদত করি, তোমার জন্য সালাত আদায় করি ও সাজদাহ করি। আমরা তোমার নিকট দৌড়ে যাই ও তোমার নিকট দ্রুত ধাবিত হই। তোমার রহমত প্রত্যাশা করি হে আমাদের রব, তোমার আযাব ভয় করি, নিশ্চয় তোমার আযাব তোমার শত্রুদের নিশ্চিত স্পর্শ করবে”। অতঃপর তাকবীর বলবে ও সাজদার জন্য ঝুঁকবে”। [ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১১০০, আলবানি সহীহ ইবন খুযাইমার টিকায় হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. তারাবীর সালাত সুন্নাত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সূচনা করেন, কিন্তু মুসলিমদের ওপর ফরয হওয়ার আশঙ্কায় তিনি তা ত্যাগ করেন। লোকেরা এ সালাত একা একা আদায় করত তার ও আবু বকরের যামানায়, যখন উমারের যুগ আসে তিনি সবাইকে এক ইমামের পিছনে একত্র করেন। এভাবে তিনি নবীর সুন্নাত জীবিত করেন। তার যামানা ও তার পরবর্তী যামানার মুসলিমগণ একমত যে, তারাবীর জামা‘আত মুস্তাহাব। [একাধিক আলিম এ মতের ওপর ইজমা বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম ইমাম নববী, দেখুন: তাহযিবুল আসমা ওয়াল লুগাত: (২/৩৩২)।]

দুই. কম মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি কখনো এমন সুন্নাত জীবিত করেন, অধিক মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি যা করতে পারেন নি। যেমন মহান এ সুন্নাত জীবিত করার তাওফীক আল্লাহ উমারকে দিয়েছেন, আবু বকরকে দেন নি, অথচ তিনি উমারের চেয়ে উত্তম। সকল কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি উমারের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। উমার বলেছেন: “আল্লাহর শপথ আমি কোনো জিনিসে তার অগ্রগামী হতে পারব না”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৬১৮; তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬৭৫, তিনি হাদীসটি হাসান ও সহীহ বলেছেন।]

রমযানে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ যখন মসজিদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেন, তাতে বাতি জ্বালানো দেখে বলতেন: “আল্লাহ উমারের কবরকে নূরান্বিত করুন, যেমন তিনি আমাদের মসজিদগুলো নূরান্বিত করেছেন”। [ইবন আসাকের তার তারিখে বর্ণনা করেছেন: (৪৪/২৮০), এবং ইবন আব্দুল বার তার তামহিদ গ্রন্থে: (৮/১১৯)।] অর্থাৎ সালাতে তারাবী দ্বারা। তাই মুসলিম কোনো কল্যাণের ব্যাপারে নিজেকে ছোট বা হীন মনে করবে না, আল্লাহ তার থেকে এমন খিদমত নিতে পারেন, যা তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তিদের থেকে নেননি। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা এ অনুগ্রহ দান করেন।

তিন. মুসলিমদের জামা‘আত ও তাদের একতা বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তম। ইমামের কর্তব্য মুসলিমদের মাঝে একতা প্রতিষ্ঠা করা।

চার. সুন্নাতের ব্যাপারে ইমামের ইজতিহাদ মেনে নেওয়া অন্যদের ওপর অবশ্য জরুরি, এতে তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। যেমন, উমার যখন তাদের সবাইকে এক ইমামের পিছনে একত্র করেন, সাহাবায়ে কেরাম তা মেনে নেন ও উমারের আনুগত্য করেন।

পাঁচ. সবাই মিলে সুন্নাত জীবিত করা ও একসাথে ইবাদত আদায় করা বরকতপূর্ণ। কারণ, জমা‘আতে প্রত্যেকের দো‘আ প্রত্যেককে অন্তর্ভুক্ত করে। এ জন্য জমা‘আতের সালাত একাকী সালাতের চেয়ে সত্তরগুণ বেশি ফযীলত রাখে। সায়িদ ইবন জুবাইর রহ. বলেছেন: “আমার নিকট সূরা গাশিয়াহ পাঠকারী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা অধিক উত্তম, একাকী সালাতে আমার একশ আয়াত তিলাওয়াত করার চেয়ে”। [ইবন আব্দুল বার ফিত তামহিদ: (৮/১১৮)।]

ছয়. কারণবশতঃ কোনো আমল ত্যাগ করলে, কারণ শেষে তা পুনরায় আরম্ভ করা দুরস্ত আছ। যেমন, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ রমযানের তারাবীর জামা‘আত পুনরায় আরম্ভ করেন।

সাত. কুরআনের হাফেয ও কুরআনের অধিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যথাসম্ভব ইমামতি করবেন, যেমন উমার তাদের মধ্যে বড় ক্বারী উবাই ইবন কা‘বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এটা উত্তম কিন্তু ওয়াজিব নয়। কারণ, উমার তামিমে দারিকেও ইমামতির দায়িত্ব দিয়েছেন, অথচ তার চেয়ে বড় ক্বারী সাহাবীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।

আট. তারাবীর সালাতে অন্যান্য মুসলিমদের ন্যায় নারীরা মসজিদে উপস্থিত হতে পারবে, অনুরূপ ফিতনার আশঙ্কা না থাকলে শুধু নারীদের পুরুষ ইমামতি করতে পারবে।

নয়. ইমাম যদি ইমামতের নিয়ত না করে, তবু মুসল্লি তার পিছনে ইকতিদা করতে পারবে।

দশ. দুই সালাম অথবা চার সালাম অথবা কিয়ামের পর যদি ইমামের বিরতি নেওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে এ বিরতিতে মুক্তাদির নফল পড়া বৈধ নয়। ইমাম আহমদ এটা মাকরূহ বলেছেন, তিনজন সাহাবী থেকে তিনি তা বর্ণনা করেন: উবাদাহ ইবন সামেত, আবু দারদাহ ও উকবাহ ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু আনহুম। [আল-ইস্তেযকার: (২/৭২)।]

এগার. এক ইমামের পিছনে তারাবী শেষ করে, যদি অন্য ইমামের পিছনে তারাবীর জমা‘আতে শরীক হয়, এতে দোষ নেই। [আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ এটা বৈধ বলেছেন, ইমাম আহমদ বলেছেন এতে কোন সমস্যা নেই। দেখুন: মুগনি: (১/৪৫৭)।]

বারো. রমযানের নফল ব্যতীত অন্য নফলের জন্য ক্রমান্বয়ে একত্র হওয়া বৈধ নয়, বরং অন্যান্য নফল একসাথে আদায় করা বিদ‘আত, যেমন রাতের নফলের জন্য একত্র হওয়া অথবা নির্দিষ্ট রাতে নফল আদায়ের জন্য একত্র হওয়া ইত্যাদি। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ব্যতীত কোনো নফলে সাহাবীদের একত্র করেন নি। তিনি যেহেতু ফরয হওয়ার আশঙ্কায় ত্যাগ করেছেন, তাই পরবর্তীতে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ তা জীবিত করেন।

১২
৯. সাওম পালনকারীর গোসল ও শীতলতা অর্জন করা
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يُصْبِحُ جُنُباً ثُم يَغتَسِلُ ثم يَغْدُو إلى المسْجِدِ ورَأسُهُ يَقطُرُ ثم يَصُوم ذَلكَ اليَوم» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যুষ করতেন নাপাক অবস্থায়, অতঃপর গোসল করে মসজিদে যেতেন, তখনো তার মাথা থেকে পানি টপকাত, অতঃপর সেদিনের সাওম পালন করতেন”। [‎আহমদ: (৬/৯৯); নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ২৯৮৬; আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৪৭০৮; বায্‌যার, হাদীস নং ১৫৫২; তায়ালিসি, হাদীস নং ১৫০৩, তার সনদ সহীহ, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে আছে অন্য শব্দে।‎]

আবু বকর ইবন আব্দুর রহমান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:

«لَقَدْ رَأَيتُ رَسُولَ الله صلى الله عليه وسلم بِالعَرْجِ يَصبُّ على رَأْسِهِ الماءَ وهُو صَائِمٌ مِنَ العَطَشِ أو من الحَرِّ» .

‎আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরজ নামক স্থানে দেখেছি, তিনি সাওম অবস্থায় মাথায় পানি দিচ্ছেন, পিপাসার কারণে অথবা গরমের কারণে”। [‎আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৬৫; আহমদ: (৩/৪৭৫); মুআত্তা মালেক: (১/২৯৪), তার থেকে মুসনাদে শাফি: (১/১৫৭); হাকেম: (১/৫৯৮), হাদীসটি সহীহ বলেছেন। ইবন আব্দুল বারর ফিত তামহিদ: (২২/৪৭); হাফেয ফি তাগলিকিত তালিক: (৩/১৫৩); আইনি ফি উমদাতিল কারি: (১১/১১); আলবানি ফি সহীহ আবু দাউদ।]

ইমাম বুখারী রহ. বলেন, ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু সাওম অবস্থায় কাপড় ভিজিয়ে গায়ে রেখেছেন। ইমাম শাবি সাওম অবস্থায় গোসলখানায় প্রবেশ করেছেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, “সাওম অবস্থায় রান্নার ডেগ চেখে দেখাবা কোনো বস্তুর স্বাদ পরীক্ষা করা দোষের নয়”। হাসান রহ. বলেন, “সাওম পালনকারীর কুলি ও শীতলতা অর্জন দোষের নয়”। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, “যখন তোমাদের কারো সাওমের দিন হয়, সে ‎‎ যেন সকালে তেল দেয় ও চিরনি করে”। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, “আমার ছোট একটি হাউজ আছে, তাতে আমি ‎‎ সওম অবস্থায় ডুব দেই”। [সহীহ বুখারী (২/৬৮১); দেখুন: তাগলিকুত তালিক: (৩/১৫১)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. সাওম পালনকারীর জন্য জায়েয আছে গরম বা তৃষ্ণা হালকা করার জন্য পুরো শরীর বা কোনো অংশে পানি দেওয়া, এটা ওয়াজিব গোসল অথবা মোস্তাহাব গোসল অথবা বিনা প্রয়োজনে হতে পারে। [আউনুল মাবুদ: (৬/৩৫২)।]

‎দুই. সাওম পালনকারীর জন্য পানিতে ডুবে থাকা বৈধ, তবে সতর্ক থাকবে পেটে যেন পানি প্রবেশ নাকরে।‎ [মিরকাতুল মাফাতিহ: (৪/৪৪১)।]

তিন. ইবাদতকারীর কষ্ট হলে বৈধ উপায়ে তা লাঘব করা দোষের নয়, এটাকে অধৈর্য গণ্য করা হবে না, এর থেকে বিরত থাকা ঠিক নয়।

‎চার. মানুষ দুর্বল ও অপারগ, তার উচিৎ কষ্ট দূর করার জন্য বৈধ উপায় গ্রহণ করা।

‎পাঁচ. সাওম অবস্থায় গোসলখানায় গরম পানি ব্যবহার করা বৈধ, অনুরূপ সুগন্ধি ও তৈল ব্যবহার করা, চিরনি করা বৈধ, ঘ্রাণ জাতীয় বস্তুর কারণে সাওম নষ্ট হয় না, এগুলো সাওম পালনকারীর জন্য মাকরূহ নয়।

‎ছয়. সাওম পালনকারী ঠাণ্ডা ও পবিত্রতা অর্জনের জন্য হাউজ, ট্যাংকি, পুকুর ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে, এ কারণে সাওম নষ্ট হবে না।

সাত. প্রয়োজনে বাবুর্চি খানার স্বাদ পরীক্ষা করতে পারবে, তবে তা যেন পেটে প্রবেশ না করে। ইমাম আহমদ রহ. বলেন, “আমার কাছেপছন্দনীয় হলো সাওম অবস্থায় খাবারের স্বাদ পরীক্ষা না করা, তবে কেউ তা করলে সমস্যা নেই”। [আল-মুগনি: (৩/১৯)।]‎

‎সৌদি আরবের স্থায়ী ফাতওয়া পরিষদ সাওম অবস্থায় খাবারের স্বাদ চেখে দেখা জায়েয ফাতওয়া দিয়েছে। [ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা: ফাতাওয়া নং ৯৮৪৫) শাইখ উসাইমিন “ফাতাওয়া আরকানুল ইসলামে” তিনি অনুরূপ ফাতাওয়া দিয়েছেন, ফাতাওয়া নং (৪৮৪)।]‎

১৩
১০. সিয়াম ফরযের ধাপসমূহ
বারা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অভ্যাস ছিল, তাদের সিয়াম শেষে যখন খানা উপস্থিত হত, আর তারা খানা না খেয়ে যদি ঘুমিয়ে যেতেন, তাহলে সে রাত ও পরবর্তী দিনে তারা খেতেন না। কাইস ইবন সিরমা আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু সাওম শেষে খানার সময় স্ত্রীর কাছে এসে বললেন: তোমার নিকট খাবার আছে? উত্তরে স্ত্রী বলল: নেই, তবে আমি তোমার জন্য ব্যবস্থা করছি। সে ছিল দিনের কর্মক্লান্ত, তার দু’চোখে ঘুম এসে গেল। তার স্ত্রী এসে তাকে দেখে বলল: আফসোস আপনি বঞ্চিত হলেন। পরদিন যখন দুপুর হলো, তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি অবগত করানো হলো। অতঃপর আল্লাহতা‘আলা নাযিল করলেন:

﴿أُحِلَّ لَكُمۡ لَيۡلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآئِكُمۡۚ ١٨٧﴾ [ البقرة :187]

“সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের ‎‎ স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] তারা এ আয়াতের কারণে খুব খুশি হলেন, অতঃপর নাযিল হলো:

﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“আর আহার কর ও পান করযতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালো রেখা ‎‎ থেকে স্পষ্ট হয়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩১৪; তিরমিযী, হাদীস নং ২৯৬৮; আহমদ: (৪/২৯৫)।]

মুয়ায ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “সালাতের তিনটি ধাপ অতিক্রম করেছে, অনুরূপ সিয়ামের তিনটি ধাপ অতিক্রম করেছে... তিনি সালাতের তিন ধাপ উল্লেখ করেন। অতঃপর সিয়ামের ব্যাপারে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মাসের তিন দিন ও আশুরার সাওম পালন করতেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ١٨٣﴾ إِلى قَولِه : ﴿طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ ١٨٤﴾ [ البقرة :183-184]

“‎হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরযকরা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল ‎‎ তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরাতাকওয়া অবলম্বন কর...একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা”। সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩-১৮৪] তখন যার ইচ্ছা সাওম পালন করত, যার ইচ্ছা ইফতার করত ও প্রত্যেক দিনের বিনিময়ে একজন মিসকিনকে খাদ্য দিত। এটা তখন হালাল ছিল, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:

﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ﴾ إِلى ﴿أَيَّامٍ أُخَرَۗ ١٨٥﴾ [ البقرة :185]

“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করাহয়েছে... অন্যান্যদিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে”। এরপর থেকে যে রমযান পায়, তার ওপর সাওম ওয়াজিব হয়, মুসাফির সফর শেষে কাযা করবে, যারা বৃদ্ধ- সাওম পালনে অক্ষম, তাদের ব্যাপারে ফিদিয়া তথা খাদ্য দান বহাল থাকে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]

মুসনাদে আহমদের অপর বর্ণনায় আছে: “আর সিয়ামের ধাপ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে প্রত্যেক মাসে তিন দিন সাওম পালন আরম্ভ করেন। ইয়াযিদ ইবন হারুন বলেন, “তিনি নয় মাস তথা রবিউল আউয়াল থেকে রমযান পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে তিন দিন ও আশুরার সাওম পালন করেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর সিয়ামের ফরয নাযিল করেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣﴾ إِلى هَذِهِ الآيةِ : ﴿وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ ١٨٤﴾ [ البقرة : 183-184]

“‎হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরযকরা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল ‎‎ তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর... আরযাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া,একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৩-১৮৪] তিনি বলেন, তখন যার ইচ্ছা সাওম পালন করত, যার ইচ্ছা খাদ্য প্রদান করত, খাদ্যদান যথেষ্ট ছিল। তিনি বলেন, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াত নাযিল করেন:

﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ﴾ إِلى قَوْلِهِ ﴿فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ ١٨٥﴾ [ البقرة : 185]

“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করাহয়েছে... সুতরাং তোমাদেরমধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেনতাতে সিয়াম পালন করে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মুকিম ও সুস্থ ব্যক্তির ওপর সিয়াম জরুরি করে দেন, অসুস্থ ও মুসাফিরকে তাতে শিথিলতা প্রদান করেন। আর যে সিয়াম পালনে অক্ষম, তার ব্যাপারে খাদ্যদান বহাল থাকে। এ হলো দু’টি ধাপ। তিনি বলেন, তারা ঘুমের আগ পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রীগমন করত, যখন তারা ঘুমাইত তা থেকে বিরত থাকত। তিনি বলেন, কায়েস ইবন সিরমাহ নামক জনৈক আনসারী সাওম অবস্থায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন, অতঃপর স্ত্রীর নিকট এসে এশার সালাত আদায় করেন। অতঃপর পানাহার না করে ঘুমিয়ে পড়েন, অবশেষে সকালে উঠেন ও সাওম রাখেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখেন যে, সে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। তিনি বললেন: কী হয়েছে, তোমাকে এতো ক্লান্ত দেখছি কেন? সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমি গতকাল কাজ করেছি, অতঃপর বাড়িতে এসে শুয়ে পড়ি ও ঘুমিয়ে যাই, যখন ভোর করেছি, সাওম অবস্থায় ভোর করেছি। তিনি বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীগমন করে ছিলেন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলেন, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:

﴿أُحِلَّ لَكُمۡ لَيۡلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآئِكُمۡۚ﴾ إِلى قَوْلِه : ﴿ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ ] ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের ‎‎ স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে... অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর”। [সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. ইবাদতের এ সহজ রূপ বান্দার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কারণ, সিয়াম ফরযের ধাপগুলোতে দেখা যায়: সূর্যাস্তের পর যে ঘুমিয়ে পড়ত অথবা এশা থেকে ফারেগ হত, সে আগামীকালের সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকত, এ জন্য তারা খুব কষ্ট ও ক্লান্তির সন্মুখীন হত, যেমন উপরে এক সাহাবীর ঘটনা থেকে জানলাম। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা রমযানের রাতে পানাহার ও স্ত্রীগমন বৈধ করে তাদের ওপর সহজ করলেন, সূর্যাস্তের পর ঘুমিয়ে যাক বা জাগ্রত থাক। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত। সকল প্রশংসা আল্লাহর।

দুই. স্বামীর খেদমত করা একজন ভালো স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য ও একান্ত হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়ার আলামত।‎

‎তিন. এতে সাহাবীদের ধর্মপরায়ণতা, আল্লাহর আদেশের কাছে নতি স্বীকার করা, তাঁরবিরোধিতাকে ভয় করা এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে আল্লাহকে স্মরণ করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। কতক বর্ণনায় এসেছে: “স্ত্রী আসতে দেরী করেন, ফলে সে ঘুমিয়ে যায়। স্ত্রী এসে তাকে জাগ্রত করেন, কিন্তু সে আল্লাহ ও তার রাসূলের নাফরমানী অপছন্দ করে খানা থেকে বিরত থাকেন ও সাওম অবস্থায় সকাল করেন”। [তাবারি: (২/১৬৭)।] অপর বর্ণনায় আছে: “তিনি মাথা রেখে তন্দ্রায় যান, তার স্ত্রী খানা নিয়ে এসে বলে: খান, সে বলে: আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম। সে বলল: আপনি ঘুমান নি। অতঃপর সে অভুক্ত অবস্থায় প্রত্যুষ করে”। [তাবারি: (২/১৬৮)।]

‎চার. আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত তথা শিথিল বিধান পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করা বৈধ, এটা আযীমতের বিপরীত নয়। কারণ, উভয় আল্লাহর পক্ষ থেকে, তিনি যেরূপ রুখসত পছন্দ করেন, অনুরূপ আযীমত পছন্দ করেন।

পাঁচ. আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর রহমত যে, তিনি তাদের জন্য এমন ইবাদত রচনা করেন, যাতে রয়েছে তাদের অন্তর ও আত্মার পরিশুদ্ধতা।

ছয়. আল্লাহ অনভ্যস্ত বিষয়ে বিধান দানে বিভিন্ন ধাপ গ্রহণ করেন, যেমন তিনি সালাত ও সিয়াম তিন ধাপে ফরয করেন। অনুরূপ মদ নিষেধাজ্ঞার বিধান বিভিন্ন ধাপে এসেছে, যেন তারা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়।

সাত. সাওম ক্রমান্বয়ে ফরয হয়েছে, কারণ, ইসলামের সূচনাকালে তারা রোযায় অভ্যস্ত ছিলনা। যেমন মুয়ায থেকে বর্ণিত হাদীসের দ্বিতীয় বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, “তারা সিয়ামে অভ্যস্ত ছিল না, তাদের উপর সিয়াম খুব কষ্টকর ছিল”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ৫০৬; বায়হাকি ফিস সুনান: (৪/২০১); ফাযায়েলুল আওকাত: (৩০), আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

‎আট. তিন ধাপে সিয়াম ফরয হয়েছে:‎

১. প্রতিমাসে তিন দিন ও আশুরার সাওম।

২. রমযানে সাওম পালন বা খাদ্য দান, সিয়াম পালনে অনিচ্ছুকদের কোনো একটি বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার।

৩. রমযানের সাওম সুস্থ ব্যক্তির ওপর ফরয, সাউমার পরিবর্তে খাদ্য দানের বিধান শুধু বৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, যে সাওম পালনে সক্ষম নয়, সে রোগী এর অন্তর্ভুক্ত, যার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা নেই।

১৪
১১. তারাবীর সালাতের বিধান
যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাটাই দ্বারা একটি ছোট হুজরার ন্যায় বানিয়ে তাতে সালাত আদায়ের জন্য বের হন, লোকেরা তার পিছু নিল ও তার সাথে সালাত আদায় করতে লাগল। অতঃপর তারা পরবর্তী রাতে উপস্থিত হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলম্ব করলেন, বের হলেন না, তারা জোরে আওয়াজ দিতে লাগল ও দরজায় ছোট পাথর নিক্ষেপ করে জানান দিচ্ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট রাগান্বিত অবস্থায় বের হলেন, অতঃপর বললেন: তোমাদের এ কর্ম দেখে আমার ধারণা হচ্ছে তোমাদের ওপর এ সালাত ফরয করে দেওয়া হবে, তোমরা তোমাদের ঘরে সালাত আদায় কর, কারণ, ব্যক্তির সালাত ঘরেই উত্তম, শুধু ফরয ব্যতীত”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৭৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮১।]

অপর বর্ণনায় আছে: “আমার আশঙ্কা হচ্ছে তোমাদের ওপর এ সালাত ফরয করা হবে, আর যদি ফরয করা হয় তোমরা তা আদায় করতে পারবে না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৮৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮১।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. দুনিয়ার প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনাসক্তি, তিনি খুব নরমাল ও অনাড়ম্বর আসবাব পত্র ব্যবহার করতেন।

দুই. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক ইবাদত করতেন, অথচ তার অগ্র-পশ্চাতের সকল পাপ মোচন করা হয়েছে।

তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের প্রতি সাহাবীদের আগ্রহ।

চার. কিয়ামুল্লাইলের ফযীলত, বিশেষ করে রমযানে।

পাঁচ. মসজিদে নফল সালাত বৈধ। [শরহুন নববী আলাল মুসলিম, হাদীস নং ৬/৬৯)।]

ছয়. তারাবীর সালাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত, তিনি এর সূচনা করেছেন। অতঃপর উম্মতের ওপর ফরয হওয়ার আশঙ্কায় তা ত্যাগ করেন। পুনরায় উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ তা জীবিত করেন। [ফাতহুল বারি: (৩/১৪)।]

সাত. আমির বা মুসলিম প্রধান যখন অভ্যাসের বিপরীত কিছু করেন, তখন তার কারণ, বলে দেওয়া উচিৎ, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। [ফাতহুল বারি: (৩/১৪); তারহুত দাসরিব: (৩/৯০)।]

আট. উম্মতের ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া যে, তিনি তাদের ওপর ইবাদতের চাপ কমিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমির ও মুরুব্বিদের উচিৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদর্শ গ্রহণ করা। [ফাতহুল বারি: (৩/১৪)।]

নয়. অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার জন্য কতক স্বার্থ ত্যাগ করা বৈধ, অনুরূপ অধিক গুরুত্বপূর্ণকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। [শারহুন নববী আলা মুসলিম, হাদীস নং ৬/৬৯); ফাতহুল বারি: (৩/১৪)।]

দশ. জমা‘আতের সাথে নফল আদায়ের সময় আযান ও ইকামত নেই, যেমন তারাবীর সালাত। [ফাতহুল বারি: (৩/১৪); তারহুত তাসরিব: (৩/৯০)।]

এগার. নফল সালাত মসজিদের তুলনায় ঘরে পড়া অধিক উত্তম, তবে যে নফল জামা‘আতসহ পড়া উত্তম তা ব্যতীত, যেমন ইস্তেস্কা ও তারাবীর সালাত। [শারহুন নববী আলাল মুসলিম, হাদীস নং ৬/৭০); মিরকাতুল মাফাতিহ: (৩/৩৩৪)।]

১৫
১২. সিয়াম পাপ মোচনকারী
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‎

﴿إِنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞۚ وَٱللَّهُ عِندَهُۥٓ أَجۡرٌ عَظِيمٞ ١٥﴾ [ التغابن :15]

“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো ‎‎ কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহরনিকটই মহান প্রতিদান”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫]

﴿وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةٗۖ وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٣٥﴾ [ الأنبياء :15]

“আর ভালোও মন্দ দ্বারা আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করে ‎‎ থাকি এবং আমাদের কাছেই তোমাদেরকে ফিরেআসতে হবে”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫] আয়াতদ্বয়ে “ফিতনা” শব্দটি পরীক্ষা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর অর্থ বলেন, “আমি তোমাদেরকে সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, প্রাচুর্য-দারিদ্র, হালাল-হারাম, পাপ-পুণ্য এবং ‎‎ হিদায়াত ও গোমরাহির মাধ্যমে পরীক্ষা করব”। [তাফসিরে ইবন কাসির: (৩/২৮৬)।]

হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেছেন:

«مَنْ يَحفَظُ حَدِيثاً عَنِ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم في الفِتنَة؟ قَالَ حُذَيْفَةُ : أَنا سَمِعْتُهُ يَقُولُ : فِتنَةُ الرَّجُلِ في أَهْلِهِ ومَالِهِ وجَارِهِ تُكَفِّرُهَا الصَّلاةُ والصِّيامُ والصَّدَقَةُ»

“ফিতনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস কার মনে আছে? হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু ‎ ‎ বলেন: আমি তাকে বলতে শুনেছি, ব্যক্তির ফিতনা তারপরিবার-পরিজনে, মাল-সম্পদে ও তার প্রতিবেশীর মধ্যে, যার কাফ্‌ফারা হয় সালাত,সিয়াম ও সদকা । [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৪।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর থেকে বর্ণনা করেন:

«لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ، والصَّوْمُ لي وَأَنَا أَجْزِي به ...» .

“প্রত্যেক আমলের কাফ্‌ফারা রয়েছে, আর সাওম হচ্ছে আমার জন্য, আমি তার প্রতিদান দেব”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭১০০; আহমদ: (২/৫০৪)।]

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে:‎

«كُلُّ العَمَلِ كَفَّارَةٌ والصَّوْمُ لي وَأَنَا أَجْزِي به ...»

“প্রত্যেক আমল কাফ্‌ফারা, আর সাওম আমার জন্য, আমি তার প্রতিদান দেব”। [আহমদ: (২/৪৫৭); তায়ালিসি, হাদীস নং ২৪৮৫।]

অপর বর্ণনায় আছে:

«كُلُّ العَمَلِ كَفَّارَةٌ إِلَّا الصَّوْمَ لي وَأَنَا أَجْزِي به ...» .

“প্রত্যেক আমল কাফ্‌ফারা, তবে সাওম আমার জন্য, আমি তার প্রতিদান ‎‎ দেব”। [এ হাদীস ইবন রাহওয়েহ থেকে বর্ণিত, মাজমাউয যাওয়ায়েদে হায়সামি তা আহমদ থেকে বর্ণনা করেছেন: (৩/১৭৯), তিনি বলেছেন: এর বর্ণনাকারীগণ সহীহ গ্রন্থের বর্ণনাকারী।]

আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন:

«الصَّلَواتُ الخَمسُ، والجُمعَةُ إلى الجُمُعةِ، ورَمَضَانُ إلى رَمَضَانَ، مُكَفِّراتٌ مَا بَينَهنَّ إذا اجْتُنِبَتْ الكَبَائرُ» .

“পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমু‘আ থেকে অপর জুমু‘আ, এক রমযান থেকে অপর রমযান,মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফ্‌ফারাস্বরূপ, যদি কবীরাহ গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয়”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩৩।]

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেবলতে শুনেছি:

«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ وعَرَفَ حُدُودَهُ وتَحفَّظَ مما كَانَ يَنبَغِي لَه أَنْ يَتَحَفَّظَ فيهِ كَفَّرَ ما قَبْلَه» .

“যে রমযানের সাওম পালন করল, তার সীমারেখা ঠিক রাখল এবং যা থেকে বিরত থাকা দরকার তা থেকে সে বিরত থাকল, তার পূর্বের পাপ মোচন করা হবে”। [আহমদ: (৩/৫৫; আবু ইয়ালা, হাদীস নং ১০৫৮; বায়হাকি: (৪/৩০৪); সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৩৩।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. কল্যাণ-অকল্যাণ উভয় দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করা হয়। কল্যাণের পরীক্ষা যেমন, অধিক সম্পদ ও নি‘আমত। অকল্যাণের পরীক্ষা যেমন, বিপদ-আপদ দুঃখ -‎‎ বেদনা, রোগ-ব্যাধি লেগে থাকা।‎

‎দুই. সন্তান ও সম্পদ মানুষের জন্য পরীক্ষা। কারণ, মানুষ তাদের মহব্বত, ভালোবাসা ও হিতকামনায় আল্লাহর হক নষ্ট করে, পরকালে যা শাস্তির কারণ। তাদের দ্বারা পরীক্ষার অপর দিক হলো, শরী‘আত আমাদেরকে তাদের ওপর অনেক দায়িত্ব দিয়েছে। যেমন, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, ভরন -‎‎ পোষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা, সেসব বিষয়ে ত্রুটি করা পরকালে শাস্তির কারণ। [শারহুন নববী আলা মুসলিম, হাদীস নং ২/১৭১)।]

‎তিন. পাপ ও নাফরমানী ফিতনার অন্তর্ভুক্ত, যেমন বেগানা নারী অথবা হারাম মালে জড়িত ব্যক্তি ফিতনায় পতিত, অনেক সময় নেককার লোকেরা এতে পতিত হয়। [আত-তামহিদ লি ইবন আব্দুল বারর: (১৭/৩৯৪)।]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ إِذَا مَسَّهُمۡ طَٰٓئِفٞ مِّنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ تَذَكَّرُواْ فَإِذَا هُم مُّبۡصِرُونَ ٢٠١﴾ [ الأعراف : 201]

“নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখনতাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কুমন্ত্রণা ‎‎ স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে।তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২০১]

তিনি অন্যত্র বলেন,

﴿وَٱلَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةً أَوۡ ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ ذَكَرُواْ ٱللَّهَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ لِذُنُوبِهِمۡ وَمَن يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ إِلَّا ٱللَّهُ وَلَمۡ يُصِرُّواْ عَلَىٰ مَا فَعَلُواْ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٣٥﴾ [ آل عمران : 135]

“আর যারা কোনো অশ্লীল কাজ করলে অথবানিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণকরে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমাচায়। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারাবার বার করে না”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৫]

চার. কোনো গুনাহে যে বারবার লিপ্ত হয়, তার উচিৎ অধিক সওয়াবের কাজ করা, ‎‎ কেননা নেক কাজ গুনাহ মুছে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‎

﴿إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِۚ ١١٤﴾ [ هود : 114]

“নিশ্চয়ই ভালোকাজ মন্দকাজকে মিটিয়ে দেয়।এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ”। [সূরা হুদ, আয়াত: ১১৪] সন্দেহ নেই, অধিক পরিমাণ নেক কাজ গুনাহের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। অতঃপর আল্লাহ তার নেক আমলের কারণেতাকে খালেস তাওবা করার তাওফীক দান করেন।

পাঁচ. এসব হাদীস প্রমাণ করে সিয়াম কাফ্‌ফারা। সুতরাং আবু হুরায়রার হাদীসে বর্ণিত ‘সিয়াম কাফ্‌ফারা নয়’ এর অর্থ হচ্ছে, সাধারণ আমল শুধু কাফ্‌ফারা, কিন্তু সিয়াম কাফ্‌ফারা হওয়ার সাথে সাথে অতিরিক্ত সওয়াবও আছে। একনিষ্ঠ-ভাবে আল্লাহর জন্য সম্পাদিত সিয়ামে এ ফযীলত লাভ হবে। [ফাতহুল বারি: (৪/১১১)।]

ছয়. ইমাম নববী রহ. বলেন, “কখনো বলা হয়: অযু যদি গোনাহের কাফ্‌ফারা হয় তাহলে সালাত কিসের কাফ্‌ফারা? আর সালাত যদি কাফ্‌ফারা হয়, তাহলে জামা‘আতের সালাত,রমযানের সাওম, আরাফার সাওম, আশুরার সাওম এবং ফিরিশতাদের আমীনের সাথে বান্দারআমীনের মিল কিসের কাফ্‌ফারা? কারণ, এসব আমল সম্পর্কে বর্ণিত আছে এগুলো কাফ্‌ফারা। আলিমগণ এর উত্তরদিয়েছেন: এসব আমল কাফ্‌ফারার যোগ্য, যদি কাফ্‌ফারা করার জন্য ছোট পাপ থাকে, তাহলে তার কাফ্‌ফারা করে, যদি ছোট-বড় পাপ না থাকে, তাহলে এর দ্বারা নেকী লিখা হয় ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। আর যদি কোনো কবিরা গোনাহে লিপ্ত হয়, আশা করি এ কারণে তা হালকা হবে। [শারহুন নববী: (৩/১১৩); আদ-দিবায আলা মুসলিম, হাদীস নং ২/১৭)।]

সাত. এসব আমল দ্বারা বান্দার হক মাফ হয় না, ছোট বা বড় নেক আমলের কারণে কোনো হক মাফ হয় না, বরং তা থেকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে অথবা তার থেকে হালাল করে নিতে হবে। [তানবিরুল হাওয়ালেক: (২/৪২); তুহফাতুল আহওয়াযি: (১/৫৩৫)।]‎

আট. সিয়ামের ফলে পাপ মোচন হয়।

নয়. সিয়ামের এসব ফযীলত সে লাভ করবে, যে সাওম বিনষ্টকারী বস্তু থেকে স্বীয় সাওম হিফাযত করবে, যেমন আবু সাঈদ খুদরীর হাদীসে এসেছে:

«وعَرَفَ حُدُدَهُ وتَحَفَّظَ ممَا كَانَ ينْبَغِي لهُ أنْ يتَحَفَّظَ فِيه»

“সওমের সীমারেখা ঠিক রাখল ও সেসব বস্তু থেকে নিরাপদ থাকল, যা থেকে নিরাপদ থাকা জরুরি”।

সারকথা, মুসলিমদের উচিৎ রমযানের রাত-দিন হারাম কথা যেমন গীবত, পরনিন্দা ও হারাম দৃষ্টি থেকে নিজেকে হিফাযত করা, যা টেলিভিশন-ইন্টারনেট ও বিভিন্ন প্রচার যন্ত্রে প্রচার করা হয়, যার কুফল অন্যান্য সময়ের চেয়ে রমযানে বেড়ে যায়। আল্লাহ আমাদেরকে হিদায়াত ও সঠিক পথে থাকার তাওফীক দান করুন।

১৬
১৩. সাদা তাগা ও কালো তাগার অর্থ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ নাফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্টহয়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

আদি ইবন হাতেম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নাযিল হলো:

﴿حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [ البقرة :187]

“যতক্ষণ নাফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্টহয়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

আমি একটি কাল রশি ও একটি সাদা রশি হাতে নিই এবং তা আমার বালিশের নিচে রেখে দেই। অতঃপর আমি রাতে বারবার তাকাতে থাকি, কিন্তু আমার নিকট তা স্পষ্ট হয়নি। প্রত্যুষে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এ ঘটনার বর্ণনা দেই। তিনি বললেন: এটা হচ্ছে রাতের কালো রেখা ও দিনের সাদা রেখা”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯০।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে সাহাবীগণ ছিলেন অধীর আগ্রহী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত ওহী তারা দ্রুত বাস্তবায়ন করতেন। অপর বর্ণনায় এসেছে: আদি ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে যা বলেছেন সব বুঝেছি, তবে সাদা তাগা ও কালো তাগা ব্যতীত। আমি গত রাতে দু’টি তাগা সঙ্গে করে ঘুমাই, একবার এ দিকে, আরেক বার সে দিকে তাকাতে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন। অতঃপর বললেন: এ কালো তাগা আর সাদা তাগার অর্থ আসমানে বিদ্যমান রাত-দিনের সাদা-কালো রেখা”। [তাবরানি ফিল কাবির: (১৭/৭৯), হাদীস নং ১৭৫।] দেখার বিষয় আদি এ আয়াতের অর্থ বাস্তবায়নের জন্য বালিশের নিচে সাদা ও কালো তাগা পর্যন্ত রেখেছেন। [আল-মুফহিম: (৩/১৪৮-১৫০)।]

দুই. সাহাবায়ে কেরাম ইবাদত সংক্রান্ত বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি না হলে প্রশ্ন থেকে নিবৃত থাকতেন। বুঝার জন্য তারা যথাযথ চেষ্টা করতেন, যখন অপারগ হতেন রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করতেন। অনুরূপ প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য প্রথমে জিজ্ঞাসা না করে বুঝার চেষ্টা করা, ইবাদত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জটিলতা ব্যতীত জিজ্ঞাসা না করা।

তিন. আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ নাফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্টহয়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] এর অর্থ হচ্ছে: তোমরা খাও এবং পান কর, যতক্ষণ না দিনের সাদা রেখা রাতের কালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। আর এটা হয় সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পর”। [ইবন কাসির: (১/২২২); ফাতহুল বারি: (৪/১৩৪)।]

চার. কঠিন মাসআলা ও দুর্বোধ্য শব্দসমূহ বিজ্ঞ আলিমদের নিকট জিজ্ঞাসা করা।

পাঁচ. এ আয়াত প্রমাণ করে যে, ফজরের পরবর্তী সময় দিনের অংশ, রাতের নয়। [শারহুন নববী আলা মুসলিম, হাদীস নং ৭/২০১); ফাতহুল বারি: (৪/১৩৪)।]

ছয়. ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার বৈধ। পানাহার অবস্থায় যদি কারো ফজর উদিত হয়, আর সে মুখের খানা বের করে ফেলে, তার সাওম শুদ্ধ, খেতে থাকলে সাওম শুদ্ধ হবে না। [ফাতহুল বারি: (৪/১৩৫)।]

১৭
১৪. ঋতুবতী নারীর ইফতার ও কাযা
মুয়াযাহ বিনতে আব্দুল্লাহ আল-আদাবি রহ. বলেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলি: “ঋতুবতী কেন সাওম কাযা করে, সালাত কাযা করে না? তিনি বললেন: তুমি কি হারুরি? আমি বললাম: আমি হারুরি না, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছি, তিনি বললেন: আমাদের এমন হত, অতঃপর আমাদেরকে শুধু সাওম কাযার নির্দেশ দেওয়া হত, সালাত কাযার নির্দেশ দেওয়া হত না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৩৫।]

মুয়াযাহ থেকে ইমাম তিরমিযীর এক বর্ণনায় আছে, সে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলে: “আমাদের প্রত্যেকে কি ঋতুকালীন সালাত কাযা করবে? তিনি বললেন: তুমি কি হারুরি? আমাদের কারো ঋতুস্রাব হলে, কাযার নির্দেশ দেওয়া হত না”। [তিরমিযী, হাদীস নং ১৩০।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঋতুবতী হতাম, অতঃপর পবিত্রতা অর্জন করতাম, তিনি আমাদেরকে সাওম কাযার নির্দেশ দিতেন, কিন্তু সিয়াম কাযার নির্দেশ দিতেন না”। এ হাদীস ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন হাদীসটি হাসান। অতঃপর তিনি বলেন, “এ হাদীস অনুযায়ী আহলে ইলমের আমল, অর্থাৎ ঋতুবতী নারী সিয়াম কাযা করবে, সালাত কাযা করবে না। এ ব্যাপারে তাদের দ্বিমত সম্পর্কে জানি না”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৭৮৭।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা “তুমি কি হারুরি” বলে, এ প্রশ্নের প্রতি অনীহা ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। হারুরি খারেজি সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ। কুফার নিকটে অবস্থিত হারুরা শহরে তাদের বসতি, এ জন্য তাদেরকে হারুরি বলা হয়, সেখান থেকে তাদের উৎপত্তি। তাদের মধ্যে ছিল দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা। [ফাতহুল বারি: (১/৪২২)।] তাদের কেউ হাদীস ও ইজমার বিপরীত ঋতুবতী নারীর উপর ঋতুকালীন সালাতের কাযার নির্দেশ দিত। [দেখুন: আল-মুগনি: (১/১৮৮); হাশিয়া সিনদি আলা সুনান নাসাঈ: (৪/১৯১); উমদাতুল কারি: (৩/৩০০)।] এ জন্য তিনি বিরক্তি প্রকাশক শব্দ দ্বারা তাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, তুমি কি তাদের কেউ?

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা হারাম। কুরআন-হাদীসের সীমারেখায় অবস্থান করা ও সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। আল্লাহর দেওয়া শিথিলতা বা রুখসত গ্রহণ করা। দীনের ব্যাপারে যেরূপ বাড়াবাড়ি খারাপ, অনুরূপ বাহানা তালাশ নিন্দনীয়। মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা উত্তম, অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের ওপর আমল করা।

দুই. দীনের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপকারীদের নিষেধ করা বৈধ, যেন সঠিকভাবে শরী‘আতের বাস্তবায়ন হয় এবং কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়।

তিন. কোনো প্রশ্নের কারণে প্রশ্নকারী সম্পর্কে যদি মুফতির মনে খারাপ ধারণা জন্মায় তাহলে প্রশ্নকারীর ব্যাখ্যা দেওয়া উচিৎ যে, তিনি গোড়া নন বরং জানতে ইচ্ছুক, যেমন মুয়াযাহ বলেছেন: “আমি হারুরি নই, কিন্তু প্রশ্ন করছি” তখন মুফতির কর্তব্য দলীল দ্বারা তার প্রশ্ন দূর করা, যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা‎ করেছেন।

চার. শরী‘আতের মূল ভিত্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ। এ জন্য আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাওম কাযার নির্দেশ দিতেন, সালাত কাযার নির্দেশ দিতেন না। অর্থাৎ যদি সালাতের কাযা ওয়াজিব হত, তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তাদের কাযা করার নির্দেশ দিতেন। কারণ, তিনি ছিলেন উম্মতের সবচেয়ে হিতাকাঙ্খি, তিনি উম্মতের জন্য প্রত্যেক বিষয় স্পষ্ট করে গেছেন। [উমদাতুলকারী: (৩/৩০১)।] মুসলিমের কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশে পরিপূর্ণ সোপর্দ হওয়া, তার শরী‘আতকে সম্মান প্রদর্শন করা ও দলিলের সামনে থেমে যাওয়া। আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা, যেহেতু শরী‘আতের আদেশ, নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকবে, যেহেতু শরী‘আতের নিষেধ, কারণ, বুঝা যাক বা না যাক।

পাঁচ. ইবন আব্দুল বার রহ. বলেছেন: “ঋতুবতী নারী সিয়াম পালন করবে না, বরং কাযা করবে, তবে সালাত কাযাও করবে না। এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ। সকল মুসলিম যেখানে একমত, সেটা সঠিক ও চূড়ান্ত সত্য”। [তামহিদ: (২২/১০৭)।]

ছয়. নারীর ওপর ইসলামী শরী‘আতের ছাড় এই যে, তাদেরকে সালাত কাযার নির্দেশ দেওয়া হয় নি। কারণ, সালাত দিনে একাধিক বার, যার কাযা খুব কষ্টকর। এ জন্য নারীদের উচিৎ আল্লাহর শোকর আদায় করা।

সাত. নারী যদি ফজর উদিত হওয়ার সময় পাক হয়, তাহলে সে দিনের সাওম তার শুদ্ধ হবে না, কাযা করা জরুরি। কারণ, যখন ফজর উদিত হয়েছে, তখন সে ঋতুবতী। নারী যদি সূর্যাস্তের সামান্য আগে ঋতুবতী হয়, তাহলে তার সাওম বাতিল, কাযা করা ওয়াজিব। [ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: (১০/১৫৫), ফাতাওয়া নং ১০৩৪৩।]

নয়. নারী যদি সূর্যাস্ত যাওয়ার সামান্য পর ঋতুবতী হয়, তাহলে সে দিনের সাওম শুদ্ধ।

দশ. নারী যদি সাওম অবস্থায় রক্ত আসা অথবা তার ব্যথা অনুভব করে, সূর্যাস্তের আগে বের না হয়, তাহলে তার সাওম শুদ্ধ। [“ফাতাওয়া আল-জামেয়াহ লিল মারআল মুসলিমাহ” লি ইবন উসাইমিন: (১/৩২৫)।]

এগার. এ হাদীস থেকে বুঝায় অসুস্থ ব্যক্তি সাওম ভঙ্গ করতে পারবে, যদিও তার সাওমের ক্ষমতা থাকে, যদি রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। কারণ, ঋতুবতী নারী একেবারে দুর্বল হয় না, বরং রক্ত বের হওয়ার কারণে তার ওপর সাওম কষ্টকর, আর রক্ত বের হওয়া একটি রোগ। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/৯৭-৯৮)]

১৮
‎১৫. সাওম পালনকারীকে ইফতার করানোর ফযীলত‎
জায়েদ ইবন খালেদ জুহানি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَن فَطَّرَ صَائماً كَانَ له مِثْلُ أَجْرِهِ غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنقُصُ مِن أَجْرِ الصَّائِمِ شَيئاً»

“যে সাওম পালনকারীকে ইফতার করাল, তার সাওম পালনকারীর ন্যায় সাওয়াব হবে, তবে সাওম পালনকারীর নেকিবিন্দুমাত্র কমানো হবে না”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৭৪৬; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩৩৩০-৩৩৩১; সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২০৬৪; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪২৯। নাসাঈ আয়েশা থেকে মওকুফ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন, দেখুন: নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩৩৩২; আব্দুর রায্‌যাক আবু হুরায়রা থেকে মওকুফ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, দেখুন: আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৯০৬।] অপর বর্ণনায় আছে :

«مَنْ فَطَّر صَائماً أَطعَمَهُ وسَقَاهُ كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنقُصَ مِنْ أَجْرِهِ شَيء» .

“যে সাওম পালনকারীকে ইফতার করাল, তাকে পানাহার করাল, তার সাওম পালনকারীর সমান সাওয়াব হবে, তবে তার নেকি থেকে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না”। [আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৯০৫; তাবরানি ফিল কাবির: (৫/২৫৬), হাদীস নং ৫২৬৯।]‎

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তাকে এক মহিলা ইফতারের জন্য দাওয়াত করল, তিনি তাতে সাড়া দিলেন এবং বললেন: “আমি তোমাকে বলছি, যে গৃহবাসী কোনো সাওম পালনকারীকে ইফতার করাবে, তাদের জন্য তারঅনুরূপ সাওয়াব হবে। মহিলা বলল: আমি চাই আপনি ইফতারের জন্য আমার কাছে কিছুক্ষণ অবস্থান করুন, বা এ জাতীয় কিছু বলেছে। তিনি বললেন: আমি চাই এ নেকি আমার পরিবারহাসিল করুক।‎ [মুসান্নাফ ইবন আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৯০৮।] ‎ ‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. আল্লাহ তা‘আলার অসীম অনুগ্রহ যে, তিনি কল্যাণের নানা ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছেন। যেমন তিনি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করার আহ্বান জানিয়ে মহান সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছেন। [আরেযাতুল আহওয়াযি: (৪/২১)।]

দুই. সাওম পালনকারীকে ইফতার করানো একটি ফযীলতপূর্ণ আমল, যে সাওম পালনকারীকে ইফতারকরাবে সে তার ন্যায় নেকি লাভ করবে।

তিন. সাওম পালনকারীকে ইফতার করালে তার বদলা আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে প্রদান করেন, সাওম পালনকারীর পক্ষ থেকে নয়। অতএব সাওম পালনকারীর সামান্য নেকি হ্রাস হবে না, এটা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের আলামত। [ফায়যুল কাদির: (৬/১৮৭)।]

চার. এ থেকে বুঝা যায় ইফতারের দাওয়াত গ্রহণ করা বৈধ, বুজুর্গি দেখিয়ে বা ‎‎ নেকি কমার আশঙ্কায় তা প্রত্যাখ্যান করা বাড়াবাড়ি। কারণ, অপরের নিকটইফতার করলে সাওম পালনকারীর পুণ্য কমে না। তবে শুধু মিসকিনদের জন্য ইফতারের দাওয়াত হলে, সেখানে ধনীদের যাওয়া ঠিক নয়।

পাঁচ. আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচার ও তাদের খুশির জন্য দাওয়াতে সাড়া দেওয়া ও ইফতার করা বৈধ, যেন তাদের পুণ্য হাসিল হয়, যেমন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু করেছেন।

ছয়. যে ইফতার করাবে, সে নেকি ও অপরের প্রতি ইহসানের নিয়ত করবে, বিশেষ করে সাওম পালনকারী যদি গরিব হয়।

সাত. সাওম পালনকারীকে বাসায় নিয়ে আপ্যায়ন করা, বা খাবার প্রস্তুত করে তার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া ইফতার করানোর শামিল, তবে অপচয় না করা, বিশেষ করে রকমারি ইফতারের এ যুগে।

আট. কেউ যদি গরিবকে টাকা দেয়, যার কিছু দিয়ে সে ইফতার করল, বাকিটা সংগ্রহে রেখে দিল, বাহ্যত তা ইফতার করানোর হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হবে, অধিকন্তু সে আর্থিকভাবে উপকৃত হলো।

১৯
১৬. রমযানে উমরার ফযীলত
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ থেকে এসে উম্মে সিনান আনসারীকে বলেন, তুমি কেন হজ কর নি? সে বলল: অমুকের পিতা, অর্থাৎ তার স্বামীর কারণে। তার চাষাবাদের দু’টি উট ছিল, একটি দ্বারা সে হজ করেছে, অপরটি আমাদের জমি চাষ করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “নিশ্চয় রমযানের উমরা আমার সাথে হজের সমান”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৬৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৫৬।]

অপর বর্ণনায় আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«فإِذا جَاءَ رَمَضَانُ فاعتَمرِي فإنَّ عُمْرةً فيه تَعْدِلُ حَجَّة» .

“যখন রমযান আগমন করে উমরা কর। কারণ, তখনকার উমরা হজের সমান”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৫৬।]

উম্মে মাকাল রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন:

«اعْتَمرِي في رَمَضَانَ فإنَّها كَحَجَّة» رواه أبو داود .

“রমযানে উমরা কর। কারণ, তা হজের ন্যায়”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯৮৯; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৪২২৬; তিরমিযী, হাদীস নং ৯৩৯, তিনি বলেছেন হাদীসটি হাসান, গরিব। ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ৩০২৫ ও হাকেম: (১/৬৫৬), সহীহ বলেছেন, হাকেম বলেছেন হাদীসটি সহীহ মুসলিমের শর্ত মোতাবেক।]

অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে জাবের, আনাস, আবু হুরায়রা ও ওয়াহাব ইবন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম‎ থেকে। [দেখুন: জামে তিরমিযী (৩/২৭৬)।]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “রমযানের উমরা হজের সমান”। ইবন বাত্তাল রহ. বলেন, “এর দ্বারা বুঝা যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যে হজের কথা বলেছেন, তা নফল ছিল। কারণ, উম্মত এ বিষয়ে একমত যে, উমরা কখনো ফরয হজের স্থলাভিষিক্ত হয় না। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী “হজের বরাবর” দ্বারা উদ্দেশ্যে সাওয়াব ও ফযীলত, যা মানুষের কিয়াস ও ধারণার ঊর্ধ্বে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার অনুগ্রহ দান করেন”। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/৪২৮); দেখুন: মিনহাতুল বারি: (৪/২৩৩)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. বান্দার ওপর আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি অল্প আমলের বিনিয়ে অধিক সাওয়াব দান করেন। এ জন্য আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করি।

দুই. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন ও তাদের খবর নিতেন। আল্লাহ যাকে তার বান্দাদের দায়িত্ব দান করেন, তার উচিৎ অধীনদের সাথে দয়ার আচরণ করা, তাদের হিতকামনা করা ও খবরাখবর নেওয়া এবং তাদের দীন ও দুনিয়ার স্বার্থে কাজ করা।

তিন. ফরয হজের মোকাবেলায় যথেষ্ট নয় রমযানের উমরা। অবশ্য সাওয়াবের দিক থেকে সমান, কিন্তু এ কারণে ফরয আদায় হবে না। এ ব্যাপারে সবাই একমত। [ফাতহুল বারি: (৩/৬০৪;, তুহফাতুল আহওয়াযি: (৪/৭)।]

চার. সময়ের মর্যাদার কারণে আমলের সাওয়াব বেড়ে যায়, যেমন বেড়ে যায় একাগ্রতা ও ইখলাসের কারণে। [দেখুন: ফাতহুল বারি: (৩/৬০৪); আউনুল মাবুদ: (৫/৩২৩); ফায়যুল কাদির: (৪/৩৬১)।]

পাঁচ. এসব হাদীসের উদাহরণ, যেমন এসেছে সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান, অর্থাৎ সওয়াবের বিবেচনায়, কিন্তু সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করা পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করার সমান নয়।

ষষ্ট. রমযানের মর্যাদার কারণে উমরা হজের সমমর্যাদা লাভ করে। কারণ, রমযান মাসে উমরাকারী উমরার ফযীলত ও রমযানের ফযীলত লাভ করে। এ বরকতপূর্ণ সময় ও মক্কার পবিত্রতার কারণে উমরা হজের সমান, যে হজ যিলহজ মাসের বরকতপূর্ণ সময় ও মক্কার পবিত্র স্থানে আদায় করা হয়। [মাজমুউল ফাতাওয়া: (২৬/২৯৩)।]

দ্বিতীয়ত রমযানের উমরায় রয়েছে অধিক কষ্ট, কারণ, সাওম অবস্থায় আমল কষ্টকর, বা সফরের কারণে যদি সাওম ত্যাগ করে, তবু সফরের কষ্ট কম নয়, পরবর্তীতে আবার কাযার কষ্ট। এরূপ কষ্ট রমযান ব্যতীত অন্য মাসে হয় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরার নির্দেশ করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে‎ বলেন,

«إِنَّها عَلى قَدْرِ نَصَبِك، أَو قَالَ : عَلى قَدْرِ نَفَقَتِك» .

“ওমরা হচ্ছে তোমার কষ্ট অথবা বলেছেন: তোমার খরচ অনুপাতে”। [মুসলিম, হাদীস নং ১২১১; দেখুন: আল-মুফহিম: (৩/৩৭০)।]

সাত. রমযান মাসে উমরাকারী এ সাওয়াব অর্জন করবে, মক্কায় অবস্থান করুক বা উমরা শেষে বাড়ি ফিরুক।

আট. এ হাদীস প্রমাণ করে না যে, তানয়িম অথবা হেরেমের বাইরে গিয়ে একমাসে বারবার উমরা করা অথবা একদিনে বারবার উমরা করা বৈধ, বর্তমান যুগে প্রচলিত এ আমল সুন্নাত পরিপন্থী, সাহাবীদের আমলের বিপরীত, তাদের কারো থেকে বর্ণিত নেই যে, তারা এক সফরে একাধিক উমরা করেছেন। [মাজমুউল ফাতাওয়া: (২৬/২৯২); যাদুল মায়াদ: (২/৯৩); তাহযিবুস সুনান: (৭/৩৬)।]

নয়. রমযানে উমরাকারী ও বায়তুল্লাহ শরীফে ই‘তিকাফকারীর কর্তব্য আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিফাজত করা। কারণ, মক্কার পাপ অন্য স্থানের পাপের তুলনায় অধিক ক্ষতিকর, বিশেষভাবে যদি রমযানের মহান মাসে হয়।

দশ. পরিবার ও সন্তানসহ যে রমযান মাসে হারাম শরীফে অবস্থান করে, তার কর্তব্য পরিবার ও সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা, যেন তারা হারামে লিপ্ত না হয়, অন্যথায় সে সাওয়াবের পরিবর্তে পাপ ও গুনাসহ বাড়ি ফিরবে, যেহেতু সে তাদের প্রতি খেয়াল রাখে নি।

এগার. যখন সাওম অবস্থায় উমরার নিয়তে মক্কায় পৌঁছে, সে হয়তো সাওম ভেঙ্গে উমরা আদায় করবে অথবা সূর্যাস্তের অপেক্ষা করে ইফতারের পর তা আদায় করবে। সাওম ভঙ্গ করে উমরা আদায় করাই উত্তম। কারণ, উমরার নিয়ম মক্কায় পৌঁছা মাত্র তা আদায় করা, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন।

২০
১৭. সাহরির ফযীলত (১)
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلا تَدَعُوهُ وَلَو أَنْ يَجرَعَ أحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ ومَلائِكتَهُ يُصَلُّونَ عَلى المُتسَحِّرينَ» .

“সাহরি বরকতময় খানা, তোমরা তা ত্যাগ কর না, যদিও তোমাদের কেউ একঢোক পানি গলাধঃকরণ করে। কারণ, আল্লাহ সাহরির ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত প্রেরণ করেন ও ফিরিশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন”। [আহমদ: (৩/১২); জামে সগির: (৪৮০১) গ্রন্থে সুয়ূতি হাদীসটি সহীহ বলেছেন, আলবানি সহীহুল জামে গ্রন্থে হাদীসটি হাসান বলেছেন।]

আব্দুল্লাহ ইবন হারেস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন: “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেন, তখন তিনি সাহরি খাচ্ছিলেন, তিনি বললেন:

«إِنَّ السَّحُورَ برَكَةٌ أَعْطَاكُمُوهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فَلا تَدَعُوهَا»

“নিশ্চয় সাহরি বরকতময়, আল্লাহ তোমাদেরকে তা দান করেছেন, অতএব, তোমরা তা ত্যাগ কর না”। [আহমদ: (৫/৩৭০); নাসাঈ: (৪/১৪৫), আলবানি সহিহুল জামে: (১৬৩৬) গ্রন্থে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

আবু সূআইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى المُتسَحِّرينَ»

“হে আল্লাহ সাহরি ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন”। উবাদা ইবন নাসি বলেন, মুখেমুখে প্রচলিত ছিল: “সাহরি খাও, যদিও পানি দ্বারা হয়। কারণ, প্রসিদ্ধ ছিল: সাহরি বরকতের খানা”। [ইবন আবি আসেম ফিল আহাদ ওয়াল মাসানি, হাদীস নং ২৭৫৮; বায্‌যার, হাদীস নং ৯৭৪; তাবরানি ফিল কাবির: (২২/৩৩৭), হাদীস নং ৮৪৫, হাফেয ইবন হাজার হাদীসটি হাসান বলেছেন। দেখুন: মুখতাসার যাওয়ায়েদে মুসনাদিল বায্‌যার: (৬৯১)।]

ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إنَّ اللهَ ومَلائِكتَهُ يُصَلُّونَ عَلى المُتسَحِّرِين» .

“নিশ্চয় আল্লাহ সাহরি ভক্ষণকারীদের ওপর রহমত প্রেরণ করেন ও তার ফিরিশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন”। [সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৬৭; আবু নায়িম ফিল হিলইয়াহ: (৮/৩২০); সহীহুল জামে: (১৮৪৪) গ্রন্থে আলবানি হাদীসটি হাসান বলেছেন। সিলসিলাতুস সাহিহাহ: (১৬৫৪)।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«نِعْمَ سَحُورُ المؤْمِنِ التَّمْر» .

“খেজুর মুমিনদের উত্তম সাহরি”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৪৫; বায়হাকি: (৪/২৩৬); সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৭৫, আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. সাহরি ফযীলতপূর্ণ, সাহরি আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত ও বরকত, এ জন্য আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করব।

দুই. সাহরির বরকত যেমন আল্লাহ সাহরি ভক্ষণকারীদের ওপর দুরূদ প্রেরণ করেন ও তার ফিরিশতাগণ তাদের জন্য ইস্তেগফার করেন। আল্লাহর দুরূদ প্রেরণ করার অর্থ হচ্ছে তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করা, তাদের কর্মের মন্তুষ্টি প্রকাশ করা ও তাদের প্রশংসা করা। ফিরিশতাদের দুরূদ প্রেরণ করার অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য ইস্তেগফার করা। [দেখুন: কাসিদা ইবনুল কাইয়েম: (২০); ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার: (১১/১৫৬); ফায়যুল কাদির: (৩/১৩৭)।]

তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরি ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন, যা সাহরির গুরুত্ব প্রমাণ করে।

চার. সামান্য বস্তু দ্বারা সাহরি হয়, যদিও তা একঢোক পানি, যেমন হাদীস থেকে স্পষ্ট।

পাঁচ. খেজুর সর্বোত্তম সাহরি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন।

ছয়. মুসলিমদের উচিৎ এ সুন্নাত পালন করা।

২১
১৮. সাহরির ফযীলত (২)
আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«تَسَحَّرُوا فَإِنَّ في السَّحُور بَرَكَةً» .

“তোমরা সাহরি খাও। কারণ, সাহরিতে বরকত রয়েছে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯৫, অনুরূপ হাদীস বর্ণিত আছে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ আবু সায়িদ, জাবের, আয়েশা. আমর ইবন আস, হুযায়ফা, ইরবায, আবু লাইলা, তালক, ইয়াশ ইবন তালক, উমার, উতবা ইবন আব্দ, আবু দারদা ও সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহুম‎ প্রমুখদের থেকে। দেখুন: শারহু ইবন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/১৮৯); মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৫৪)।]

আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«فَصْلُ مَا بَينَ صِيامِنَا وصِيَامِ أَهْلِ الكِتَابِ أَكَلَةُ السَّحَر» .

“আমাদের সাওম ও আহলে কিতাবিদের সাওমের পার্থক্য হচ্ছে সাহরি ভক্ষণ করা”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৬।]

ইরবায ইবন সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন,

«دَعَاني رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم إلى السَّحُور في رَمَضَانَ فقَالَ : هَلُمَّ إلى الغَدَاءِ المُباركِ»

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানে সাহরিতে আহ্বান করে বলেন, বরকতপূর্ণ খানার জন্য আস”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৪৪; আহমদ: (৪/১২৬); নাসাঈ: (৪/১৪৫); সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৯৩৮; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৬৫, আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

মিকদাদ ইবন মা‘দি কারিব রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«عَلَيْكُمْ بِغَدَاءِ السَّحُور؛ فَإِنَّهُ هُوَ الغَدَاءُ المبَارَك» رواه النسائي .

“তোমরা সাহরি অবশ্যই ভক্ষণ কর। কারণ, তা বরকতপূর্ণ খাবার”। [নাসাঈ: (৪/১৪৬); আহমদ: (৪/১৪২), আলবানি সহীহ নাসাঈতে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. সাহরিতে বরকত বিদ্যমান। আল্লাহ যেখানে ইচ্ছা তার মাখলুকে বরকত রাখেন, তন্মধ্যে সাহরি।

দুই. সকল আলিম একমত যে, সাহরি মোস্তাহাব, ওয়াজিব নয়, তবে এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য। [দেখুন: শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/১৮৮); যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৬৬)।]

তিন. সাহরির বরকতসমূহ:

(১) সাহরি খাওয়া শরী‘আতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ দিয়েছেন, এতে রয়েছে বান্দার ইহকাল ও পরকালের সফলতা। [দেখুন: ফাতুহুল বারি: (৪/১৪০); তাওযিহুল আহকাম: (৩/১৫৫)।]

(২) সাহরিতে আহলে কিতাবের বিরোধিতা রয়েছে, তারা সাহরি খায় না। [ফাতুহুল বারি: (৪/১৪০); তাওযিহুল আহকাম: (৩/১৫৫); শারহুন নববী আলা মুসলিম (৭/২০৭)।] আর তাদের বিরোধিতা আমাদের দীনের মূল নীতি। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের সাথে মিল রাখা ও তাদের আখলাক, বৈশিষ্ট্য গ্রহণ হারাম।

(৩) সাহরির ফলে সাওম ও ইবাদতের শক্তি অর্জন হয়, ক্ষুধা ও পিপাসা থেকে সৃষ্ট খারাপ অভ্যাস দূর হয়। [ফাতহুল বারি: (৪/১৪০)।]

(৪). সাহরি ভক্ষণকারী দো‘আ কবুলের মুহূর্তে ইস্তেগফার, যিকর ও দো‘আ করার সুযোগ লাভ করে, যা ঘুমন্ত ব্যক্তির নসিব হয় না। সাহরির সময় ইস্তেগফারকারীদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন।

(৫) সাহরি ভক্ষণকারী যথাসময়ে ফজর সালাতে হাজির হয়, অনেক সময় মসজিদে আগে এসে প্রথম কাতার ও ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়ানোর সাওয়াব লাভ করে, আযানের জওয়াব দেয় ও ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত আদায়ে সক্ষম হয়, হাদীসে এসেছে দুনিয়া ও তার মধ্যে বিদ্যমান সবকিছু থেকে ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত উত্তম।

(৬) সাহরি ভক্ষণকারী ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান করে বা সাহরিতে কাউকে অংশীদার করে সদকার সাওয়াব লাভ করতে পারে। [ফাতহুল বারি: (৪/১৪০)।]

(৭) সাহরিতে রয়েছে আল্লাহর নি‘আমতের শোকর ও তার রুখসতের প্রতি সমর্থন। কারণ, আল্লাহ আমাদের জন্য সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত পানাহার বৈধ করেছেন, যা পূর্বে হারাম ছিল। [আউনুল মাবুদ: (৬/৩৩৬)।]

চার. মুসলিমদের কর্তব্য সাহরিতে বাড়াবাড়ি না করা, বিশেষভাবে যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা তা ত্যাগ কর না”। নেক নিয়তে সাওয়াবের আশায় সাহরি ভক্ষণ করা, শুধু অভ্যাসে পরিণত করা নয়। [তাওযিহুল আহকাম: (৩/১৫৬); যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৬৬)।]

পাঁচ. সাহরির দাওয়াত দেওয়া ও দাওয়াত গ্রহণ করা বৈধ। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরবায ইবন সারিয়াকে তার সাথে সাহরি খেতে ও একত্র হতে আহ্বান করেছেন। এক হাদীসে এরূপ এসেছে: “তোমরা বরকতপূর্ণ খানার জন্য আস”। [নাসাঈ: (৪/১৪৫), আলবানি সহীহ নাসাঈতে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

ছয়. ইমাম খাত্তাবি রহ. বলেছেন: “এতে প্রমাণিত হয় যে, দীন সহজ, তাতে কঠোরতা নেই। কিতাবিদের বিধান ছিল, তারা ইফতার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ফজর পর্যন্ত আর সাহরি খেতে পারত না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের থেকে তা রহিত করেছেন:

﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ নাফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্টহয়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] [মা‘আলেমুস সুনান: (২/৭৫৭); আউনুল মাবুদ: (৬/৩৩৬)।] আল্লাহর অসংখ্য নি‘আমতের জন্য আমরা তার শোকর আদায় করছি।

২২
১৯. সাহরির সময় (১)
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لا يَمْنَعَنَّ أَحَدَكُمْ أَذَانُ بِلالٍ مِنْ سُحُورِهِ فَإِنَّهُ يُؤَذِّنُ أَوْ قَالَ : يُنَادِي لِيَرْجِعَ قَائِمُكُمْ وَيُنَبِّهَ نَائِمَكُمْ وَلَيْسَ الفَجْرُ أَنْ يَقُولَ هَكَذا - وجَمَعَ يَحيَى بنُ سَعِيدٍ القَطَانُ كَفَّيْهِ - حَتَّى يَقُولَ هَكَذَا - ومَدَّ يَحيى إِصْبَعَيْهِ السَّبَابَتَينِ» .

“বেলালের আযান যেন তোমাদের কাউকে সাহরি থেকে বিরত না রাখে। কারণ, সে আযান দেয় অথবা তিনি বলেছেন: সে ডাকে যেন তোমাদের জাগ্রতরা ফিরে যায় ও ঘুমন্ত ‎‎ রা জাগ্রত হয়। ফজর এটা নয় যে এরকম হবে, (ইয়াহইয়া ইবন সায়িদ আল-কাত্তাননিজ হাতের তালুদ্বয় জড়ো করলেন (অর্থাৎ লম্বালম্বি অবস্থায় আলো প্রকাশ পেলেই তা ফজর হিসেবে ধর্তব্য হবে না, বরং তা সুবহে কাযিব) যতক্ষণ না এরকম হবে, (ইয়াহয়াহ তার তর্জনীদ্বয়প্রসারিত করলেন অর্থাৎ আলো ডানে বাঁয়ে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করলেই কেবল ফজর হিসেবে ধর্তব্য হবে, তখন তা হবে সুবহে সাদিক) [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৮২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯৩।] ‎ ‎

সাহল ইবন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি আমার পরিবারে সাহরি খেতাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ফজর সালাতের জন্য দ্রুতছুটতাম”।

বুখারীর অপর বর্ণনায় আছে: “আমার দ্রুততার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাজদায় অংশ গ্রহণ করা”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫২; দ্বিতীয় বর্ণনা সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২০ ও আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৭৫৩৩।]

যির ইবন হুবাইশ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি হুযায়ফার সঙ্গে সাহরি করলাম, অতঃপর আমরা সালাতের জন্য চললাম, মসজিদে এসে দু’রাকাত সালাত আদায় করলাম, আর ইকামত আরম্ভ হলো, উভয়ের মাঝে সামান্য ব্যবধান ছিল”। [নাসাঈ: (৪/১২৪), আলবানি সহীহ নাসাঈতে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

“যেন তোমাদের ঘুমন্তরা ফিরে যায়” অর্থ: বেলাল রাতে আযান দেয়, তোমাদের জানানোর জন্য যে, ফজর বেশি দেরি নেই। সে তাহাজ্জুদে দণ্ডায়মানকারীদের আরামের জন্য ফিরিয়ে দেয়, যেন সামান্য ঘুমিয়ে উদ্যমতাসহ সকালে উঠতে পারে অথবা বিতর পড়ে নেয়, যদি তা পড়ে না থাকে অথবা ফজরের জন্য প্রস্তুতি নেয় যদি পবিত্রতার প্রয়োজন থাকে, বা অন্যান্য প্রয়োজন সেরে নেয়, যা ফজরের সময় জানলেই সম্ভব। [শারহুন নববী আলা মুসলিম (৭/২০৪); আল-মুফহিম: (৩/১৫৩)।]

“ঘুমন্তদের জাগ্রত করে” অর্থ: ঘুমন্তরা যেন ঘুম থেকে জেগে ফজরেরপ্রস্তুতি নেয়, সামান্য তাহাজ্জুদ আদায় করে অথবা বিতর আদায় না করলে তা আদায় করে অথবা সাওমের ইচ্ছা থাকলে সাহরি খায় অথবা গোসল বা অযু সেরে নেয় অথবা অন্যান্য প্রয়োজন সেরে নেয়। [শারহুন নববী আলা মুসলিম (৭/২০৪); আল-মুফহিম: (৩/১৫৩)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

‎এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ ফজরের শেষ সময় পর্যন্ত সাহরি বিলম্ব করতেন। তাদের কেউ সময় শেষ হওয়ার আশঙ্কায় সাহরি সংক্ষেপ করতেন। অতএব, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সাহরি বিলম্ব করা সুন্নাত। [ফাতহুল বারি: (৪/১৩৮)।]

দুই. প্রয়োজনের সময় দ্রুত আহার করা জায়েয। এ ব্যাপারে ইমাম বুখারি একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন: “সেহরি দ্রুত করার অধ্যায়”, শিরোনামে।ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবন আবি বকর থেকে, সে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন: “রমযানে আমরা সালাতুল লাইল শেষে এতো দেরিতে বাড়ি যেতাম যে, খাদেমদের দ্রুত খানা পেশ করার জন্য বলতাম, যেন ফজর ছুটে না যায়”।‎ [মালেক : (১/১১৬; বায়হাকি: (২/৪৯৭)।]

২৩
২০. সাহরির সময় (২)
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ بِلالاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُنَادِيَ ابنُ أُمِّ مَكْتُومٍ ثُمَّ قَالَ : وَكَانَ رَجُلاً أَعْمَى لا يُنَادي حَتَّى يقَالَ لَهُ : أَصْبَحْتَ أَصْبَحْتَ» .

“নিশ্চয় বেলাল আযান দেয় রাতে। অতএব, ‎‎ তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম আযান দেয়। অতঃপর তিনি বলেন, সে ছিল অন্ধ, যতক্ষণ না তাকে বলা হত ভোর করেছ, ভোর করেছ সে আযান দিত না”।

সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে:

«كَانَ لِرَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم مُؤَذِّنانِ : بِلالٌ وابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ الأَعْمَى فَقَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم : إِنَّ بِلالاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ فَكُلُوا واشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُوم قَالَ : وَلم يَكُنْ بَيْنَهُما إِلاّ أَنْ يَنْزِلَ هَذا ويَرْقَى هَذَا» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’জন মুয়াজ্জিন ছিল: বেলাল ও অন্ধ আব্দুল্লাহ ইবনউম্মে মাকতুম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বেলাল রাতে আযান দেয়সুতরাং তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ না ইবন উম্মে মাকতুম আযান দেয়। তিনি বলেন, তাদের দু’জনের সময়ের ব্যবধান ছিল একজন (আযানের স্থান ‎‎ থেকে) নামতেন অপরজন উঠতেন”।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯২।] ‎ ‎

সামুরা ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদকরেন:

«لا يَغُرَّنكُمْ مِنْ سُحُورِكُم أَذانُ بِلالٍ ولا بَياضُ الأُفِقِ المسْتَطِيلِ هَكَذا، حَتَّى يَسْتَطيرَ هَكَذا» وَحَكَاهُ حَمادُ بنُ زَيْدٍ بِيَدَيْهِ، قَالَ : يَعْنِي مُعْتَرِضاً» .

“বেলালের আযান বা দিগন্তের লম্বা সাদা রেখা যেন তোমাদেরকে সাহরি থেকেবিরত না রাখে, যতক্ষণ না তা এভাবে প্রলম্বিত হয়”। হাম্মাদ ইবন যায়েদ দু’হাতে ইশারা করে তার ব্যাখ্যা দেন। তিনি ইঙ্গিত করলেন: অর্থাৎ প্রস্থের দিক থেকে প্রসারিত হওয়া। (মুসলিম)

নাসাঈর এক বর্ণনায় আছে:

«لا يَغُرَّنكُمْ أَذانُ بِلالٍ، ولا هَذَا البَيَاضُ حَتَّى يَنْفَجِرَ الفَجْرُ هَكذَا وَهَكَذا» يَعْني : مُعْتَرضاً . قَالَ أَبو دَاوُدَ الطَيالِسيُ : وَبَسَطَ بِيدَيْهِ يَمِيناً وشِمالاً مَادَّاً يَدَيْهِ» .

“বেলালের আযান এবং এ শ্রুভ্রতা যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে, যতক্ষণ না ফজর এভাবে এভাবে ছড়িয়ে পড়ে”। অর্থাৎ প্রস্থেরদিকে। আবু দাউদ তায়ালিসি বলেন, তিনি তার দু’হাত ডানে-বামে লম্বাকরে প্রসারিত করলেন”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯৪; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৪৬; তিরমিযী, হাদীস নং ৭০৬; নাসাঈ: (৪/১৪৮)।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمْ النِّدَاءَ والإِنَاءُ عَلى يَدِهِ فَلا يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِيَ حَاجَتَهُ مِنهُ»

“যখন তোমাদের কেউ আযান শ্রবণ করে, আর হাতে থাকে খানার প্লেট, সে তা রাখবে না যতক্ষণ না সেখান থেকে তার প্রয়োজন পূর্ণ করে”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫০; আহমদ: (২/৫১০); দারা কুতনি: (২/১৬৫); বায়হাকি: (৪/২১৮); হাকেম: (১/৫৮৮), তিনি মুসলিমের শর্তে সহীহ বলেছেন, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।]

ইমাম আহমদের এক বর্ণনায় অতিরিক্ত বলেছেন:

«وَكَانَ المؤَذِّنُ يُؤَذِّنُ إِذا بَزَغَ الفَجْرُ» .

“মুয়াজ্জিন আযান দিত যখন সুবহে সাদিকের আলো বিচ্ছুরিত হত”। [আহমদ: (২/৫১০); তাবারি ফি তাফসিরিহি: (২/১৭৫; বায়হাকি: (৪/২১৮)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎ [আল-মুফহিম: (৩/১৫০); শারহুন নববী: (৭/২০৪); ফাতহুল বারি: (২/৯৯০-১০০); দিবায: (৩/১৯৪)।]

এক. ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রীগমন বৈধ।

দুই. অন্ধ ব্যক্তির আযান দেওয়া বৈধ, যদি সে সময় সম্পর্কে জানে বা তাকে জানানোর কেউ থাকে।

তিন. ফজরের জন্য দু’বার আযান দেওয়া বৈধ: প্রথমবার ফজরের পূর্বে, দ্বিতীয়বার: ফজর উদয় হওয়ার পর।

চার. সাওমের নিয়তের পর সাহরি খাওয়া বৈধ, পানাহারের কারণে পূর্বের নিয়ত নষ্ট হবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার বৈধ করেছেন, অথচ ফজর উদয়ের পর নিয়ত বৈধ নয়, এ থেকে প্রমাণিত হয় নিয়তের স্থান খানার পূর্বে, তারপর পানাহারে সাওম নষ্ট হবে না। অতএব, কেউ মাঝ রাতে আগামীকালের সাওমের নিয়ত করে, শেষ রাত পর্যন্ত পানাহার করলে তার নিয়ত শুদ্ধ।

পাঁচ. ফজর উদয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলে পানাহার করা বৈধ, কারণ, রাত অবশিষ্ট আছে এটাই স্বাভাবিক। দলীল নিম্নের আয়াত:

﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“তোমরা পানাহার করতে থাক যতক্ষণ নাফজরের সাদা রেখা থেকে কালো রেখা সুস্পষ্ট আলাদা না হয়ে যায়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭] সন্দেহকারীর নিকট ফজরের সাদা রেখা সুস্পষ্ট হয়নি, তাই সে সাহরি খেতে পারবে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত:

«كُلْ مَا شَكَكَتَ حتى يَتَبَينَ لكَ»

“তোমার সন্দেহ পর্যন্ত তুমি খাও, যতক্ষণ তোমার নিকট স্পষ্ট হয়”। [ইমাম নববী বলেছেন: “যদি ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে তার জন্য পানাহার ও স্ত্রীগমন বৈধ, এতে কারো দ্বিমত নেই, যতক্ষণ না ফজর স্পষ্ট হয়”। মাজমু: (৬/৩১৩); দেখুন: যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৫৫)।]

এ বিধান তখন, যখন সে স্বচক্ষে ফজর দেখে নিশ্চিত হয়, কিন্তু সে যদি আযান অথবা ঘড়ির ওপর নির্ভর করে, তাহলে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ, তখন জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

ছয়. সাহরি খাওয়া ও তাতে বিলম্ব করা মোস্তাহাব।

সাত. “দুই মুয়াজ্জিনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান: একজন নামতেন, অপরজন উঠতেন”। ইমাম নববী রহ. বলেন, “এর অর্থ: বেলাল ফজরের পূর্বে আযান দিতেন, আযানের পর দো‘আ ইত্যাদির জন্য অপেক্ষা করতেন। অতঃপর ফজর পর্যবেক্ষণ করতেন, যখন ফজর ঘনিয়ে আসত, তিনি অবতরণ করে উম্মে মাকতুমকে খবর দিতেন। ইবনউম্মে মাকতুম ওযু, ইস্তেঞ্জা সেরে প্রস্তুতি নিতেন, অতঃপর উপরে উঠে ফজর উদিত হওয়ার সাথে সাথে আযান আরম্ভ করতেন”। [কুরতুবি এ ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন, এটাই যুক্তিযুক্ত। আল-মুফহিম: (৩/১৫১); দেখুন: শারহুন নববী: (৭/২০৪); দিবায: (৩/১৯৪)।] ‎ ‎ ‎

আট. এ থেকে প্রমাণিত হয়, ফজরের পর রাত থাকে না, বরং তা দিনের অংশ। [আল-মুফহিম: (৩/১৫১); দিবায: (৩/১৯৪); দেখুন: ফাতহুল বারি: (২/১০১)।]

নয়. ব্যক্তির জন্য মায়ের পরিচয় গ্রহণ করা বৈধ, যদি লোকেরা তার মায়ের পরিচয়ে তাকে চিনে, বা তার প্রয়োজন হয়। [ফাতহুল বারি: (২/১০১)।]

দশ. প্রথম ফজর ও দ্বিতীয় ফজরে পার্থক্য তিনটি:

প্রথম পার্থক্য: দিগন্তের উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বি সাদা রেখা দ্বিতীয় ফজরের আলামত। আর উর্ধ্ব আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সাদা লম্বা রেখা প্রথম ফজরের আলামত।

দ্বিতীয় পার্থক্য: দ্বিতীয় ফজরের পর অন্ধকার থাকে না, বরং সূর্যোদয় পর্যন্ত ফর্সা ক্রমান্বয়ে পায়। আর দ্বিতীয় ফজরে আলোর পর অন্ধকার মেনে আসে।

তৃতীয় পার্থক্য: দ্বিতীয় ফজরের সাদা রেখা দিগন্তের সাথে মিলিত থাকে। প্রথম ফজরে সাদা রেখা ও উর্ধ্ব আকাশের মাঝে অন্ধকার বিরাজ করে। [ফিকহুল ইবাদাত লি শাইখ উসাইমিন: (১৭২-১৭৩)।]

এগার. মুয়াজ্জিন যখন ফজরের আযান দেয়, তখন যদি সাওম পালনকারীর হাতে খাবার প্লেট থাকে, সে পানাহার পূর্ণ করবে, বন্ধ করবে না, হাদীসের বাহ্যিক অর্থ তাই বলে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাড়। তাঁর জন্য সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা। [“মুখতাসারে মুনযিরির” উপর শাইখ আহমদ শাকেরের টিকা: (৩/২৩৩); তামামুল মিন্নাহ লিল আলবানি: (৪১৭-৪১৮)।]

২৪
২১. আযান ও সাহরির মাঝে ব্যবধান
আনাস ইবন মালিক রহ., যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

«تَسَحَّرْنَا مَعَ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ قَامَ إِلى الصَّلاةِ، قَلْتُ : كَمْ كَانَ بَينَ الأَذَانِ والسَّحُورِ؟ قَالَ : قَدْرُ خَمْسِينَ آيَةً» .

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাহরি খেলাম, অতঃপর তিনি সালাতের জন্য দাঁড়ালেন। আমি বললাম: আযান ও সাহরির মধ্যে ব্যবধান কি ছিল? তিনি বললেন: পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯৭; তিরমিযী, হাদীস নং ৭০৩; নাসাঈ: (৪/১৩৪; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৯৪।]

সহীহ বুখারীর অপর বর্ণনায় আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণিত:

«أَنَّ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم وَزَيْدَ بنَ ثَابِتٍ تَسَحَّرا فَلَما فَرَغَا مِنْ سَحُورِهِمَا قَامَ نَبيُّ الله صلى الله عليه وسلم إِلى الصَّلاةِ فَصَلَّى، قُلْنَا لأَنَسٍ : كَمْ كَانَ بَيْنَ فَراغِهِما مِنْ سَحُورِهِمَا وَدُخُولهما في الصَّلاةِ؟ قَالَ : قَدْرُ مَا يَقْرَأُ الرَجُلُ خَمسينَ آيَةً» .

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জায়েদ ইবন সাবেত এক সঙ্গে সাহরি খান, যখন তারা সাহরি থেকে ফারেগ হলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের জন্য দাঁড়ালেন ও সালাত আদায় করলেন। আমরা আনাসকে বললাম: তাদের সাহরি ও সালাত আরম্ভের মধ্যে ব্যবধান কি ছিল? তিনি বললেন: যতটুকু সময়ে একজন ব্যক্তি পঞ্চাশ আয়াত পড়ে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫১।]

শিক্ষা ও মাসায়েল [শারহুন নববী আলা মুসলিম, হাদীস নং ৭/২০৭-২০৮), ফাতহুল বারি: (৪/১৩৮-১৩৯), তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩১৭); শারহু ইবন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (১৯৩-১৯৪); ইযাহুল মাসালেক ইলা মুয়াত্তা ইমাম মালেক, লিল কান্দলভী: (৫/৫৮); যাখিরাতুল উকবা: (২০/৩৫৭-৩৭৭)।]:

এক. সাহরিতে বিলম্ব করা সুন্নাত। এতে যেমন সাওমের শক্তি অর্জন হয়, তেমন কিতাবিদের সুস্পষ্ট বিরোধিতা‎ হয়।

দুই. সাহাবীদের সময় ইবাদতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য যায়েদ কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ দ্বারা সময়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।

তিন. শারীরিক কর্ম দ্বারা সময় পরিমাপ করা বৈধ, যেমন আরবরা বলত: বকরির দুধ দোহনের পরিমাণ, উটের বাচ্চা নহর করার পরিমাণ ইত্যাদি।

চার. সাহরি ও আযানের ব্যবধান মধ্যম গতির তিলাওয়াতে স্বাভাবিক পর্যায়ের পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ। [দেখুন: ফাতহুল বারি: (৪/১৩৮); তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩১৭)।]

পাঁচ. সাহরি বিলম্ব করা সুন্নাত, তবে সাহরির শেষ পর্যন্ত স্ত্রীগমন তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তার দ্বারা সাওমের শক্তি অর্জন হয় না, বরং তাতে কাফ্‌ফারা ওয়াজিব ও সাওম বিনষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, কখনো এমন হবে, ফজর উদিত হচ্ছে, কিন্তু সে উত্তেজনার কারণে রমন ক্রিয়া বন্ধ করতে পারছে না।

ছয়. ইলম অর্জন করা, মাসায়েল জানা, সুন্নাত অনুসন্ধান করা, ইবাদতের সময় জানা ও তদনুরূপ আমল করা জরুরি। কারণ, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: “সাহরি ও আযানের ব্যবধান কী ছিল”? যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: “পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ”।

সাত. উম্মতের ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া যে, সিয়ামের শক্তির জন্য সাহরির বিধান দেন, অতঃপর তিনি স্বেচ্ছায় তা বিলম্ব করেন, যেন সাহাবীরা এতে তার অনুসরণ করে। তিনি সাহরি না খেলে তার অনুসরণ করা তাদের জন্য কষ্টকর ছিল, আবার প্রথম রাত বা মধ্য রাতে সাহরি খেলে সাহরির অনেক উদ্দেশ্য বিফল হত।

আট. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে শিষ্টাচার ও আদব রক্ষা করা জরুরি। এখানে যেমন যায়েদ বলেছেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাহরি খেয়েছি”। তিনি বলেন নি: “আমরা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরি খেয়েছি”। কারণ, সাথীত্ব আনুগত্যের প্রমাণ বহন করে।

২৫
‎‎‎২২. সাওম পালনকারীর চুম্বন ও আলিঙ্গন করার বিধান
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُ وهوَ صَائِمٌ، ويُبَاشِرُ وَهُوَ صَائِمٌ، ولَكنَّهُ أَمْلَكُكُمْ لأَرَبِهِ» أَيْ : أَمْلَكُكُمْ لِحَاجَتِهِ» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম অবস্থায় চুম্বন করতেন, আলিঙ্গনকরতেন, কিন্তু তিনি তোমাদের চেয়ে তার চাহিদা অধিকনিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন। অর্থাৎ স্ত্রীগমনের চাহিদা।

অপর বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে সাওম অবস্থায় চুম্বন করতেন”। [সহীহ মুসলিম।]

মুসলিমের অপর বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,

«وَأَيُّكُمْ يَمْلِكُ أَرَبَهُ كَما كَانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يَمْلِكُ أَرَبَهُ» .

“তোমাদের মধ্যে কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো নিজের প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে”।

আবু দাউদের এক বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُنِي وهُو صَائِمٌ وأَنا صَائِمَةٌ» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে চুম্বন করতেন, অথচ তিনি ও আমি সাওম অবস্থায় থাকতাম”।

ইবন হিব্বানের এক বর্ণনায় এসেছে, আবু সালমা ইবন আব্দুর রহমান আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেছেন:

«كَانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُ بَعضَ نِسائِهِ وهوَ صَائِمٌ، قُلتُ لعائِشَةَ : في الفَريضَةِ والتَّطوُّعِ؟ قَالَتْ عَائِشَةُ : في كُلِّ ذَلكَ في الفَريضَةِ والتَّطَوُّع» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কতক স্ত্রীদের সাওম অবস্থায় চুম্বন করতেন। আমি আয়েশাকে জিজ্ঞেসকরলাম: ফরয ও নফলে? তিনি বললেন: উভয়ে”।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১০৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৮৪; আহমদ: (৬/৪৪), তৃতীয় বর্ণনা মুসলিমের, চতুর্থ বর্ণনা আবু দাউদ ও আহমদের, পঞ্চম বর্ণনা ইবন হিব্বানের: (৩৫৪৫)।]

হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত:

«أَنَّ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُقبِّلُ وَهُوَ صَائِم» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম অবস্থায় চুম্বন করতেন”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১০৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৮৫; আহমদ: (৬/২৮৬)।]

উমার ইবন আবু সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন: “সাওম পালনকারী কি চুম্বন করবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাকে (উম্মে সালমা) জিজ্ঞাসা কর। উম্মে সালমাতাকে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করেন। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল,আল্লাহ আপনার অগ্র-পশ্চাতের সবগুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: জেনে রেখ, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক পরহেযগার ও আল্লাহভীরু”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১০৮; মালেক: (১/২৯১)।]

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “সাওম অবস্থায় বিনোদনের ছলে আমি চুম্বন করি। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আজ এক জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছি, সাওম অবস্থায় চুম্বন করেছি। তিনি বললেন: বল দেখি সাওম অবস্থায় পানি দ্বারা কুলি করলে কী হয়? আমি বললাম: কিছু হয় না। তিনি বললেন: তাহলে কী অপরাধ করেছ”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৮৫), দারামি, হাদীস নং ১৭২৪), আব্দ ইবন হুমাইদ: হাদীস নং ২১, হাদীসটি সহীহ বলেছেন ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫৪৪। হাকেম, তিনি বলেছেন বুখারী ও মসলিমের শর্ত মোতাবেক, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন: (১/৫৯৬) ও আলবানি, সহীহ আবু দাউদে।]‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. সাওম পালনকারীর চুম্বন ও আলিঙ্গন করা বৈধ, সাওম ফরয হোক বা নফল, সাওম পালনকারী বৃদ্ধ হোক বা যুবক, রমযান বা গায়রে রমযান সর্বাবস্থায়, যদি স্ত্রীগমন অথবা বীর্যপাত থেকে নিরাপদ থাকে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।

দুই. হাদীসে আলিঙ্গন দ্বারা উদ্দেশ্য শরীরের সাথে শরীরের স্পর্শ,স্ত্রী সহবাস নয়। কারণ, স্ত্রী সহবাস সাওম ভঙ্গকারী। [তাবারি তার তাফসির গ্রন্থে বলেছেন: “আরবদের ভাষায় মোবাশারা হচ্ছে চামড়ার সাথে চামড়া মিলানো, আর পুরুষের চামড়া হচ্ছে তার বাহ্যিক শরীর”: (২/১৬৮); দেখুন: ফাতহুল বারি: (৪/১৪৯)।]

তিন. সাওম পালনকারীর স্ত্রী চুম্বন অথবা স্পর্শ অথবা আলিঙ্গনের ফলে যদি বীর্যস্খলন হয়, সাওম ভেঙ্গে যাবে, তার অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা, তাওবা, ইস্তেগফার ও পরবর্তীতে কাযা করা জরুরি। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা হাদীসেকুদসীতে বলেন,

«يَدَعُ شهْوَتَه وأَكْلَهُ وشُرْبَهُ مِنْ أَجْلي» وفي رِوايةٍ «ويَدَعُ لَذَّتَه مِنْ أَجْلي، ويَدَعُ زَوجَتَه مِنْ أَجْلي» .

“সে আমার জন্য তার প্রবৃত্তি ও পানাহার ত্যাগ করে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭০৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।] অপর বর্ণনায় আছে: “সে আমার জন্য স্বাদ ও স্ত্রীগমন ত্যাগ করে”। [সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৮৯৭; দেখুন: ফাতাওয়া ইবন বায: (২/১৬৪) এবং তার মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/৩১৫)।]

‘মজি’ বের হলে সাওম ভাঙ্গবে না, বিশুদ্ধ মতানুসারে এ কারণে তারওপর কিছু ওয়াজিব হবে না। [ফাতাওয়া ইবন বায: (২/১৬৪); তার মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/২৬৮-৩১৫); ফাতাওয়াস সিয়াম লি ইবন জাবরিন: (৫৪)।]

সাওম পালনকারীর জন্য উচিৎ যৌন উত্তেজক আচরণ থেকে বিরত থাকা, যা হারাম পর্যন্ত নিয়ে যায়।

চার. হাদীস প্রমাণ করে যে, চুম্বন শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং সমগ্রউম্মতের জন্য তা বৈধ, যদি সহবাস বা বীর্যপাতের আশঙ্কা না ‎‎ থাকে।‎ [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/৫৬); মিনহাতুল বারি: (৪/৩৬৪); তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩৫০)।]

পাঁচ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে আল্লাহ ভীরু। কারণ, তিনি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি জানতেন। [আল-মুফহিম: (৩/১৬৫)।]

ছয়. হাদীস প্রমাণ করে যে, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা নিষেধ অথবা এ বিশ্বাস করা যে, শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য স্ত্রী চুম্বন বৈধ, উম্মতের কারো জন্য তা বৈধ নয়। কারণ, এ ব্যাপারে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি স্বাভাবিকভাবে তা নেন নি, বরং তিনি বলেন,

«أمَا والله إنِّي لأَتْقَاكُم لله وأَخْشَاكُم له» وفي الحَدِيثِ الآخَرِ : «وَأَعْلَمُكُم بِحُدُودِ الله» .

“জেনে রেখ, আমি ‎‎ তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরহেযগার ও আল্লাহ ভীরু”। [শারহুন নববী আলা মুসলিম (৭/২১৯)।]

অপর হাদীসে এসেছে: “আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহর বিধান অধিক জানি”।‎

সাত. হাদীস থেকে সাহাবীদের হালাল-হারাম জানার আগ্রহ ও আল্লাহ ভীতি প্রমাণ হয়, তারা ইবাদত বিনষ্টকারী বা সাওয়াব হ্রাসকারী বস্তু থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতেন।

আট. এ হাদীসে সেসব সূফীদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা বিশ্বাস করে যে, ঈমান ও আমলে যাদের পূর্ণতা অর্জন হয়েছে, তারা শরী‘আতের বিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত! এখানে আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরী‘আতের বিধানে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন, অথচ তার ঈমান ও আমল সবার চেয়ে কামেল ও পরিপূর্ণ ছিল। এতে তাদেরও প্রতিবাদ রয়েছে, যাদের ধারণা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বাপর পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে, তাই নিষিদ্ধ কতক কাজ তার জন্য বৈধ। [অনুরূপ আরও ভুল বুঝার সম্ভাবনা রয়েছে, তৃতীয়বার পাপ থেকে তওবাকারীর হাদীস ও আল্লাহর বাণী থেকে: اعمل ما شئت فقد غفرت لك “তুমি যা ইচ্ছা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি”। মূলত: এ ভুল বুঝার সম্ভাবনা বাতিল। এর দলীল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “আমি তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেযগার ও আল্লাহ ভীরু”। উপরন্তু এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা রয়েছে যে, ব্যক্তি বুযুর্গী ও মর্যাদার যে স্তরে উপনীত হোক, শরী‘আতের বিধান তার থেকে মওকুফ হবে না”। আল-মুফহিম: (৩/১৬৪-১৬৫)।]

নয়. উমার ইবনুল খাত্তাবের হাদীসে এক বিধানের ক্ষেত্রে দু’টি বস্তুর তুলনা করা ও কিয়াসের বৈধতা প্রমাণিত হয়, যদি বস্তুদ্বয়ে সাদৃশ্য থাকে। যেমন, পানি দ্বারা গড়গড়ার ফলে গলায় ও পেটে পানি প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে, যে কারণে সাওম ভেঙ্গে যায়, অনুরূপ চুম্বনের ফলে স্ত্রীগমনের সম্ভাবনা থাকে, যে কারণে সাওম ভেঙ্গে যায়, কিন্তু যেহেতু গড়গড়ার ফলে সাওম ভাঙ্গে না, তাই চুম্বনের ফলে সাওম ভাঙ্গবে না। [আবু দাউদের টিকায় মা‘আলেমুস সুনান: (২/৭৮০)।]‎

২৬
২৩. রমযানে পানাহার করার শাস্তি‎
আবু উমামা বাহেলি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«بينَا أنَا نَائِمٌ إذْ أَتَاني رَجُلانِ فأخَذَا بضَبْعِي - أي : عَضُدِي - فَأَتَيَا بي جَبَلاً وَعْراً فَقَالَا لي : اصْعَدْ، فقلت : إني لا أُطِيقُه، فقَالَا : إنا سَنُسَهِّلُه لك، فَصَعَدتُ حتى إذا كُنتُ في سَواءِ الجَبَل إذا أنا بِأصْواتٍ شدِيدَةٍ، فَقُلْتُ : مَا هَذهِ الأَصْواتُ؟ قَالَوا : هَذا عِوى أَهْلِ النَّارِ، ثمَّ انْطُلِقَ بي فَإِذا أَنا بِقَومٍ مُعَلَّقِين بِعَرَاقِيبهِم، مُشَقَّقَةٍ أَشْدَاقُهُم تَسِيلُ أشْداقُهُم دَماً، قَالَ : قُلتُ : مَن هَؤُلاءِ؟ قَالَ : هؤُلاءِ الَّذين يُفطِرُون قَبلَ تَحِلَّة صَوْمِهِم»

“একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সহসা দু’জন লোক এসে আমার বাহু ধরে আমাকেসহ তারা এক দুর্গম পাহাড়ে আগমন করল। তারা আমাকে বলল: আরোহন কর, আমি বললাম: আমি আরোহণ করতে পারি না। তারাবলল: আমরা তোমাকে সাহায্য করব। আমি ওপরে আরোহণ করলাম। যখন পাহাড়ের চূড়ায় ‎‎ পৌঁছলাম, বিভিন্ন বিকট শব্দের সম্মুখীন হলাম। আমি বললাম: এ আওয়াজ কিসের? তারাবলল: এগুলো জাহান্নামীদের ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ। অতঃপর তারা আমাকে নিয়ে রওনা করল, আমি এমন লোকদের সম্মুখীন হলাম, যাদেরকে হাঁটুতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের চোয়াল ‎‎ ক্ষতবিক্ষত, অবিরত রক্ত ঝরছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি বললাম: এরা কারা? তারা বলল: এরাহচ্ছে সেসব লোক, যারা সাওম পূর্ণ হওয়ার আগে ইফতার করত”।‎ [নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩২৮৬; তাবরানি ফিল কাবির: (৮/১৫৭), হাদীস নং ৭৬৬৭; মুসনাদে শামিদীস নং ৫৭৭; বায়হাকি: (৪/২১৬), এ হাদীস সহীহ বলেছেন। ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৯৮৬; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৭৪৬১; হাকেম: (১/৫৯৫), তিনি বলেছেন মুসলিমের শর্ত মোতাবেক, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. এ হাদীসে কবরের আযাবের প্রমাণ রয়েছে। কবরের আযাব কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম আহমদ রহ. বলেন, কবরের আযাব সত্য, গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট ব্যতীত কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না”। [আর-রূহ লি ইব্‌নিল কাইয়্যেম: (৫৭); দেখুন: আস-সুন্নাহ, লিল লালেকায়ি: (৬/১১২৭); ইসবাতু আযাবিল কাবর লিল বায়হাকি: (১/১১০)।] ‎ ‎ ‎

দুই. কবরের আযাব শরীর ও রূহ উভয়ের ওপর ঘটে, যার স্বরূপ আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “এ উম্মতের পূর্বসূরি ও ইমামদের অভিমত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি যখন মারা যায়, ‎‎ নেয়ামত বা আযাবে অবস্থান করে, যা তার শরীর ও রূহ উভয় ভোগকরে। শরীর থেকে আলাদা হওয়ার পর রূহ আরামে বা আযাবে অবস্থানকরে। কখনো সে শরীরের সাথে মিলিত হয়, তখন সে তার সাথে আযাব বা নেওয়ামত ভোগ করে। অতঃপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন সব রূহ শরীরেফিরিয়ে দেওয়া হবে। আর তারা সবাই কবর থেকে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হবে”। [আর-রূহ লি ইবন কাইয়্যিম: (৫২); দেখুন: মাজমু ফাতাওয়া: (৪/২৮২)।]‎

তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে কবর আযাবের কতক নমুনা দেখানো হয়েছে। নবীদের স্বপ্নসত্য ও অহীর অংশ।

চার. এতে কবর আযাবের কঠিন চিত্র ফুটে উঠেছে, মুসলিমদের উচিৎ কবর আযাব ভয় করা, তার উপকরণ থেকে বেচে থাকা ও তা থেকে সুরক্ষার আসবাব গ্রহণ করা।

পাঁচ. রমযানে যে ব্যক্তি জেনে ও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কারণ ব্যতীত সময় হওয়ার পূর্বে ইফতার করে, তার জন্য কঠোর হুশিয়ারি রয়েছে এ হাদীসে। এটা কবিরা গুনাহ, যার জন্য রয়েছে কঠিনশাস্তি।‎

ছয়. সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতারে যদি এ শাস্তি হয়, তাহলে যে রমযানে সাওম রাখে না অথবা কোনো কারণ, ব্যতীত কয়েক রমযান ইফতার করে, সে এরূপ বা তার চেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে সন্দেহ নেই। অতএব যার থেকে এরূপ ঘটে তার কর্তব্য দ্রুত তওবা করা, যেন তাকে কবরের এ আযাব স্পর্শ না করে।


২৭
২৪. দ্রুত ইফতার করার ফযীলত
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

সাহাল ইবন সাদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلوا الفِطْرَ»

“লোকেরা কল্যাণ থেকে মাহরুম হবে না, যতক্ষণ তারা দ্রুত ইফতার করবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯৮।]

ইবন মাজাহ’র এক বর্ণনায় আছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الفِطرَ، عَجِّلُوا الفِطرَ فَإِنَّ اليَهودَ يُؤَخِّرُونَ» .

“লোকেরা কল্যাণে অবস্থান করবে, যাবত তারা দ্রুত ইফতার করবে। তোমরা দ্রুত ইফতার কর। কারণ, ইয়াহূদীরা বিলম্ব করে”। [সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৯৮।]

ইবন হিব্বান ও ইবন খুযাইমার বর্ণনায় আছে:

«ما يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِراً ما عَجَّلَ النَّاسُ الفطْرَ، إِنَّ اليَهودَ والنَّصارى يُؤَخِّرُونَ» .

“এ দীন বিজয়ী থাকবে, যতদিন মানুষেরা দ্রুত ইফতার করবে, নিশ্চয় ইয়াহূদী ও নাসারারা বিলম্ব করে”। [সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২০৬০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫০৩।]

অপর এক বর্ণনায় আছে:

«لا تَزَالُ أُمَّتِي على سُنَّتِي مَا لم تَنتَظرْ بفِطْرِهَا النُّجوم» .

“আমার উম্মতেরা সুন্নাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, যতক্ষণ তারা ইফতারের জন্য নক্ষত্রের অপেক্ষা না করবে”। [ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২০৬১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫২০; হাকেম: (১/৫৯৯), তিনি বলেছেন বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।]

আবুল আতিয়াহ হামদানি রহ. বলেন, আমি ও মাসরুক আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করি: হে উম্মুল মুমিনীন, রাসূলের দু’জন সাহাবী: একজন দ্রুত ইফতার ও দ্রুত সালাত আদায় করেন, অপরজন দেরিতে ইফতার ও দেরিতে সালাত আদায় করেন। তিনি বললেন: কে দ্রুত ইফতার করে ও দ্রুত সালাত আদায় করে? তিনি বলেন, আমরা বললাম: আব্দুল্লাহ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ। তিনি বললেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করতেন। আবু কুরাইব বাড়িয়ে বলেছেন: দ্বিতীয় ব্যক্তি আবু মূসা”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৯৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫৪; তিরমিযী, হাদীস নং ৭০২; নাসাঈ: (৪/১৪৪); আহমদ: (৬/৪৬)।]

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “ইফতার না করে কখনো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাত আদায় করতে দেখি নি, তা এক ঢোক পানি দ্বারাই হোক”। [আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৩৭৯২; বায্‌যার, হাদীস নং ৯৮৪; বায়হাকি: (৪/২৩৯); সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২০৬৩; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫০৪-৩৫০৫; হায়সামি মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৫৫) গ্রন্থে বলেছেন, আবু ইয়ালার বর্ণনাকারীগণ সহীহ গ্রন্থের বর্ণনাকারী।]

আমর ইবন মায়মুন আওদি রহ. বলেছেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সবচেয়ে দ্রুত ইফতার করতেন ও সবচেয়ে বিলম্বে সাহরি খেতেন”। [আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৫৯১; বায়হাকি: (৪/২৩৮); হাফেয ইবন হাজার ফাতহুল বারিতে : (৪/১৯৯), হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. চোখে দেখে অথবা নির্ভরযোগ্য সংবাদ শুনে অথবা প্রবল ধারণা হয় যে, সূর্য ডুবেছে, তাহলে দ্রুত ইফতার করা মোস্তাহাব। হাদীস তাই প্রমাণ করে, সাহাবীদের আদর্শ এরূপ ছিল। হাফেয ইব্নু আব্দুল বার রহ. বলেছেন: “সকল আলিম একমত যে, মাগরিবের সালাতের সময় হলে সাওম পালনকারীর ইফতার হালাল হয়, কি ফরয কি নফল। মাগরিব সালাত রাতের সালাতের অন্তর্ভুক্ত, এতে কারো দ্বিমত নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, [আল-ইস্তেযকার: (৩/২৮৮)।]

﴿ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

দুই. দ্রুত ইফতার যেহেতু বরকতময়, তাই বিলম্বে ইফতার বরকতহীন। [আল-ইস্তেযকার: (৩/১৫৩)।]

তিন. এ উম্মতের একটি কল্যাণ হচ্ছে তারা কিতাবি তথা ইয়াহূদী ও নাসারাদের বিপরীতে দ্রুত ইফতার করে, তারা নক্ষত্র বিকশিত হওয়ার অপেক্ষা করে। [ফাতহুল বারি: (৪/১৯৯)।] কিতাবিদের বিরোধিতা‎ আমাদের দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এটা এ উম্মতের বড় বৈশিষ্ট্য ও সকল উম্মতের ওপর তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। এ জন্য কাফিরদের সাথে মিল রাখা হারাম।

চার. সূর্যাস্তের পর ইফতার বিলম্ব করা সুন্নাত পরিহার ও বিদআত সৃষ্টির আলামত।

পাঁচ. এসব হাদীসে শিয়া-রাফেযা ও তাদের অনুসারীদের প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যারা সূর্যাস্তের পর ইফতারের জন্য স্পষ্টভাবে তারকা দেখার অপেক্ষা করে। [ফাতহুল বারি: (৪/১৯৯)।]

ছয়. ইবাদতের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের পাবন্দ হলে, গোঁড়ামি, দীন থেকে বিচ্যুতি ও শয়তানি প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত থাকা যায়, যেমন নিশ্চিত সূর্যাস্তের পর দ্রুত ইফতার করা। [আল-মুফহিম: (৩/১৫৭); তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩১৪)।]

সাত. দ্রুত ইফতারে বান্দার অপারগতা, আল্লাহর আনুগত্য ও তার রুখসতের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়। [তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩১৫)।]

আট. এ হাদীস প্রমাণ করে লাগাতার সাওম মাকরূহ। আরো প্রমাণ করে সালাতের পূর্বে ইফতার করা জরুরি, এতে ইফতার দ্রুত হয়। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৩১১)।]

নয়. সুন্নাতের অনুসরণ করা ও তার বিরোধিতা থেকে বিরত থাকা, সুন্নাত ত্যাগ করার কারণে কর্মে ফ্যাসাদ ও বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়। সাহাবীগণ কোনো কর্মে সফলতা না পেলে পরখ করত, তাদের থেকে কোনো সুন্নাত ছুটে গেছে, কোনো সুন্নাত খুঁজে পেলে ধরে নিত, এ কারণে তাদের এ সমস্যা। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৩১০-৩১১)।]

দশ. এ উম্মতের সৌভাগ্য তারা সুন্নাত লাভ করেছে, যা আল্লাহর মহব্বতকে জরুরি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١﴾ [ آل عمران : 31]

“বল, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলেআমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকেভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমাকরে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু”। সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩১]‎ [তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৩১৬)]

২৮
২৫. মুসাফির, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীর সিয়াম ভঙ্গ করা
আনাস ইবন মালিক আল-কা‘বি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহিনী আমার কাওমের উপর আক্রমণ করেছিল। তখন আমি তার নিকট এলাম, তিনি খানা খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন: কাছে আস, খাও। আমি বললাম: আমি সাওম পালনকারী। তিনিবললেন: বস, আমি তোমাকে সাওম অথবা সিয়াম সম্পর্কে বলছি। আল্লাহ তা‘আলা মুসাফির থেকে অর্ধেক সালাত হ্রাস করেছেন, মুসাফির, গর্ভবতী ও স্তন্য-দানকারী থেকে সাওম অথবা সিয়াম স্থগিত করেছেন।হায় আফসোস! সেদিন যদি আমি রাসূলের খানা থেকে কিছু ভক্ষণ করতাম! [‎আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪০৮; আহমদ: (৪/৩৪৭); তিরমিযী, হাদীস নং ৭১৫, তিনি বলেছেন, হাদীসটি হাসান। ইবন মাজাহ: ‎‎ (১৬৬৭) তাবরানি ফিল কাবির: (১/২৬৩) হাদীস নং ৭৬৫; বায়হাকি: (৪/২৩১) সহীহ আবু দাউদ লিল আলবানি। শাইখ ইবন বাযও তার ফাতাওয়ায় হাদীসটি সহীহ বলেছেন: (১৫/২২৪)।]‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. বান্দার ওপর আল্লাহর দয়া যে, তিনি অক্ষম ব্যক্তিদের থেকে কতক আহকাম স্থগিত করে দিয়েছেন,যারা তা পালনে অপারগ বা তা আদায়ে কষ্ট ও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দুই. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণ যে তিনি আনাসকে খানার জন্য আহ্বান করেছেন। তিনি উম্মতের কল্যাণে ছিলেন অতিআগ্রহী, তাই প্রয়োজনীয় জিনিস তাদের বাতলে দিতেন।

তিন. মুসাফিরের জন্য ইফতার ও কসর করা বৈধ, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রুখসত, আল্লাহ ‎‎ যেমন আজিমত পছন্দ করেন, তেমন তিনি রুখসত পছন্দকরেন।‎

চার. গর্ভবতীর জন্য আল্লাহ রমযানে সিয়াম সাধনা স্থগিত করে দিয়েছেন। কারণ, গর্ভে বিদ্যমান বাচ্চা মায়ের খাদ্য ‎‎ থেকে খাবার গ্রহণ করে, যদি মা সিয়াম পালন করে, তবে তার কষ্ট হতে পারে বা তার ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে,তাই আল্লাহ তার থেকে সিয়াম স্থগিত করে দিয়েছেন।‎

পাঁচ. স্তন্য-দানকারীর ওপর আল্লাহ সিয়াম স্থগিত করে দিয়েছেন, কারণ, স্তন্য দানকারী মায়ের বারবারখাবার গ্রহণ করা জরুরি, অন্যথায় তার বা তার বাচ্চার ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।‎

ছয়. জ্বলন্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো, পানিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা বানিষ্পাপ শিশুকে মুক্ত করার জন্য যার সিয়াম ভঙ্গ করা জরুরি হয়, সে এর অন্তর্ভুক্ত। [দেখুন: আশ-শারহুল মুমতি: (৬/৩৫০-৩৫১); মুনতাকা মিন ফাতাওয়া শাইখ ইবন বায: (৩/১৪১)।]

সাত. গর্ভবতী ও স্তন্য দানকারী যদি নিজের জানের ভয় অথবা নিজের ও বাচ্চার ক্ষতির ভয়ে সিয়াম ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের শুধু কাযা করাই যথেষ্ট, এতে কারো দ্বিমত নেই। কারণ, তারা অসুস্থ ব্যক্তিদের ন্যায়, অতএব তাদের মত তারা সুবিধা ভোগ করবে। [আল-মুগনি: (৪/৩৯৩-৩৯৪); যাখিরাতুল উকবা: (২১১/২১৪)।] আর মায়েরা যদি শুধু বাচ্চার আশঙ্কায় সাওম ভঙ্গ করে, তাহলে এতে আলিমদের দ্বিমত রয়েছে। তবে যার ওপর ফাতওয়া, ইনশাআল্লাহ তাই বিশুদ্ধ যে, তাদের শুধু কাযা করতে হবে। কারণ, তারা অসুস্থ ব্যক্তিদের ন্যায়। দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম স্থগিত করার ব্যাপারে মুসাফির ও তাদেরকে একসাথে উল্লেখ করেছেন, এটা সর্বজন বিদিত যে, মুসাফির কাযা করবে, তার উপর খাদ্যদান জরুরি নয়, অনুরূপ গর্ভবতী ও দুগ্ধ দানকারী।

২৯
২৬. সফরে সাওম ভঙ্গ করা
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত,‎

«أنَّ حَمزَةَ بنَ عَمْروٍ الأَسلَميِّ قَالَ للنَّبيِّ صلى الله عليه وسلم : أَأَصُومُ في السَّفَرِ؟ وَكَانَ كَثيرَ الصِّيامِ، فقَالَ : إنْ شِئْتَ فَصُمْ وإنْ شِئْتَ فَأَفْطِرْ» .

“হামজাহ ইবন আমর আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমি কি সফরে সাওম রাখব? তার রোযার খুব অভ্যাস ছিল। তিনি বললেন: যদি চাও রাখ, অন্যথায় ইফতার কর”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১২১।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«سَافَرَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم في رَمَضَانَ فَصَامَ حَتَّى بَلَغَ عُسْفَانَ، ثُم دَعَا بإِناءٍ مِنْ مَاءٍ فَشَرِبَ نَهَاراً لِيرَاهُ النَّاسُ، فَأَفْطَرَ حَتَّى قَدِمَ مَكَّةَ، وَكَانَ ابنُ عَباسٍ يَقُولُ : صَامَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم في السَّفَرِ وَأَفْطَر، فَمَنْ شَاءَ صَامَ ومَنْ شَاءَ أَفْطَر» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে সফর করে সাওম অবস্থায় উসফান নামক স্থানে পৌঁছেন। অতঃপর পানির পাত্র ডেকে পাঠালেন ও দিনে পান করলেন, যেন লোকেরা তাকে দেখে। তিনি ইফতার করে মক্কায় আগমন করেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলতেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে সাওম রেখেছেন ও ইফতার করেছেন। অতএব, যার ইচ্ছা সাওম রাখ, যার ইচ্ছা ইফতার কর।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪০২৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১১৩।]

আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন,‎

«كُنَّا نُسَافِرُ مَعَ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم فَلَم يَعِبِ الصَّائِمُ على المُفْطِرِ ولا المُفْطِرُ عَلى الصَّائِمِ»

“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফর করতাম, সাওম পালনকারী সাওম ভঙ্গকারীকে বা সাওম ভঙ্গকারী সাওম পালনকারীকে কোনো তিরস্কার করে নি”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১১৮।]

আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বর্ণনা করেন:‎

«كُنَّا نَغْزُو مَعَ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم في رَمَضَانَ فَمنَّا الصَّائِمُ ومنَّا المُفطِرُ، فلا يَجِدُ الصَّائمُ على المُفطِرِ، ولا المُفطِرُ على الصَّائِمِ، يَرونَ أنَّ مَنْ وَجَدَ قُوَّةً فصَامَ فَإِنَّ ذَلكَ حَسَنٌ، ويرَونَ أنَّ من وَجَدَ ضَعْفَاً فَأَفْطَرَ فَإِنَّ ذَلكَ حَسَن» .

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযানে যুদ্ধ করতাম, আমাদের থেকে কেউ হত সাওম পালনকারী, কেউ হত রোযাভঙ্গকারী। সাওম পালনকারী সাওম ভঙ্গকারীকে ও সাওম ভঙ্গকারী সাওম পালনকারীকে তিরস্কার করত না। তারামনে করত, যার শক্তি আছে সে সাওম রাখবে, এটা তার জন্য ভালো, আর যে দুর্বল সে সাওম ভাঙ্গবে, এটা তার জন্য ভালো”।‎ [মুসলিম, হাদীস নং ১১১৬; তিরমিযী, হাদীস নং ৭১৩; আহমদ: (৩/১২)।]

তার থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেন,

«سافَرْنا مَعَ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم إلى مكَّةَ ونَحْنُ صِيامٌ، فنَزَلْنَا مَنْزِلاً فَقَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم : إنَّكُم قدْ دَنَوتُم من عَدُوِّكُم والفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ، فكانَتْ رُخصَةً، فمِنَّا مَنْ صَامَ، ومنَّا مَنْ أَفطَر، ثُم نَزَلْنَا مَنْزِلاً آخَرَ فقَالَ : إِنَّكُم مُصَبِّحُو عدُوِّكُم والفِطرُ أَقْوَى لكم فأفْطِرُوا، وكَانَت عَزْمَةً فَأَفْطَرنَا، ثم قَالَ : لقَد رَأَيْتُنَا نَصُومُ مَعَ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم بَعْدَ ذَلكَ في السَّفَرِ» .

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাওম অবস্থায় মক্কার দিকে সফর করেছি, আমরাএকস্থানে অবতরণ করলাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা তোমাদেরশত্রুদের নিকটবর্তী হয়েছ, পানাহার তোমাদের শক্তির জন্য সহায়ক। এটা ছিল রুখসত। আমাদের কেউ সাওম রাখল, কেউ ভেঙ্গে ফেলল। অতঃপর আমরা অপর স্থানেঅবতরণ করলাম, তিনি বললেন: সকালে তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হবে, ইফতার তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবে। এটা চূড়ান্ত নির্দেশ ছিল, আমরা সকলে ইফতার করলাম। অতঃপর তিনি বলেন, তারপর আমরা নিজেদের দেখেছি, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে সাওম রাখতাম”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১২০; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪০৬; আহমদ: (৩/৩৫)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল [দেখুন : শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/২৬৮-২৭২); তাহযিবুস সুনান: (৩/২৮৪)।]:

এক. ইসলামের উদারতা, ইসলামি শরী‘আতের ছাড় ও তার অনুসারীদের ওপর সজাগ দৃষ্টির প্রমাণ রয়েছে এ হাদীসে।

দুই. মুসাফির সাওম রাখা ও ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে ইচ্ছাধীন, যা সহজ তার পক্ষে তাই সুন্নাত। এসব হাদীস শিথিলতা গ্রহণ করার দীক্ষা দেয়।‎

তিন. যার পক্ষে সাওম কষ্টকর, তার জন্য সাওম না রাখা উত্তম। আর যার পক্ষে কাযা কষ্টকর, সফরে সাওম কষ্টকর নয়, তার পক্ষে সফরে সাওম রাখা উত্তম।

চার. লাগাতার যে সফর করে অথবা অধিকাংশ সময় সফরে থাকে, চাকুরী বা পেশাদারী কাজের জন্য, তার পক্ষে সফরে সাওম রাখা উত্তম, যদি কষ্ট না হয়। আর যদি কাযার সময় না মিলে, যেমন যাদের সারা বছর অতিবাহিত হয় সফরে, তাদের পক্ষে সফরে সাওম রাখা ওয়াজিব।

‎পাঁচ. যতদ্রুত সম্ভব শরী‘আতের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি।

ছয়. সফরে সাওম রাখা ও ইফতার করা উভয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত, যখন যার দাবি ছিল, তিনি তখন তিনি তাই করেছেন। মুসলিমদের উচিৎ এ ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করা।

সাত. হামজাহ আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস প্রমাণ করে যে, প্রয়োজনীয় প্রত্যেক বিষয় জানা উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম এরূপ করতেন।

আট. ইমাম যখন রুখসতের নির্দেশ দেন, তখন তা আযিমত হয়ে যায়, তার বিরোধিতা করা বৈধ নয়। কারণ, তার আনুগত্য করা ওয়াজিব। এ ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা আল্লাহর অবাধ্যতায় তার আনুগত্য করা নয়।

নয়. ইমামের কর্তব্য অধীনদের সাথে নরম আচরণ করা, তাদের দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টি রাখা, ‎‎ যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে ইফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন, যেন শত্রুর মোকাবেলায় তারা শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়। অথচ তাদের মধ্যে এমন লোক ছিল, সাওম যাদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করত না, কারণ, তাদের তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু এমনও লোক ছিল, সাওম যাদের দুর্বল করে দিত, তাই দুর্বলদের প্রতি লক্ষ্য রেখে সবাইকে ইফতারের নির্দেশ দেন।

দশ. দু’টি বিধানের একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা মূলত মুসলিমের উপর শরী‘আতের উদারতা, যে কোনো একটি গ্রহণে সে তিরস্কারের উপযুক্ত হবে না। তদানুরূপ ইখতিলাফি মাসাআলা, যেখানে কারো পক্ষে দলীল স্পষ্ট নেই, সেখানেও যে কোনো একটি গ্রহণের প্রশস্ততা রয়েছে, ইনশাআল্লাহ।

এগার. রুখসত গ্রহণ বা দলীল বুঝার ক্ষেত্রে মুসলিমদের ইখতিলাফ যেন বিচ্ছেদ ও শত্রুতার কারণ না হয়।

বারো. এসব হাদীস প্রমাণ করে যে, সাহাবীদের মাঝে মহব্বত, ভ্রাতৃত্ব ও দীনের গভীর জ্ঞান ছিল। যেমন সাওম পালনকারী ও রোযাভঙ্গকারী কেউ কাউকে দোষারোপ করে নি, যেহেতু সকলে শরী‘আতের নির্দেশিত পন্থা অনুসরণ করেছে।‎

তের. রমযান মাসে সফর করা বৈধ, কারণ, ফাতহে মক্কার বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে সফর করেছেন। [আত-তামহিদ: (২২/৪৮)।]

চৌদ্দ. আগামীকাল সফরের যে নিয়ত করে, সে রাত থেকে ইফতারের নিয়ত করবে না। কারণ, নিয়ত দ্বারা মুসাফির হয় না, যতক্ষণ না সে সফর আরম্ভ করে। [আত-তামহিদ: (২২/৪৯)।]

পনের. সফরের নিয়তকারী ব্যক্তির মুকিম অবস্থায় ইফতার করা বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সফর আরম্ভ করে, বা যানবাহনে চড়ে। [আত-তামহিদ: (২২/৪৯)।]‎

৩০
২৭. সাওমের মাধ্যমে যৌন চাহিদা হ্রাস করা
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম,তিনি বলেন,

«مَنْ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْج، ومَنْ لم يَسْتَطِعْ فَعَلَيهِ بالصَّومِ فَإِنَّهُ له وِجَاء» متفق عليه .

“তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে, কারণ, তা দৃষ্টি অবনতকারী ওলজ্জাস্থান হিফাযতকারী। আর যে সামর্থ্যবান নয়, সে যেন সাওম আঁকড়ে ধরে। কারণ,তা যৌন চাহিদার জন্য ভঙ্গুরতা”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪০০।]

জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, এক যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসেনপুংসক হওয়ার অনুমতি চাইল। তিনি বললেন:

«صُمْ وسَلِ الله عَزَّ وجَلَّ مِنْ فَضْلِه» رواه أحمد .

“সাওম রাখ আর আল্লাহ নিকট তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর”। [আহমদ: (৩/৩৮২); ইবন মুবারক ফিয যুহদ: (১১০৭), তার বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য; কিন্তু জাবের থেকে বর্ণনাকারী ব্যক্তি মাজহুল ও অপরিচিত, তবে এর দু’টি শাহেদ হাদীস আছে।]‎

আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে নপুংসক হওয়ার অনুমতি দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

«خِصَاءُ أُمَّتِي الصِّيامُ والقِيام» .‎

“আমার উম্মতের খাসী করা বা নপুংসকতা হলো সিয়াম ও কিয়াম”। [আহমদ: (২/১৭৩), বগভি ফি শারহিস সুন্নাহ: (২২৩৮); হায়সামি: (৪/২৫৩), তিনি তাবরানির সূত্রে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, কতিপয়ের ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে, শাইখ আহমদ শাকের: (৬৬১২) ও আলবানি: (১৮৩০), এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন। তবে তাদের বিশুদ্ধ হাদীসে “কিয়াম” নেই। কারণ তা দুর্বল, যেমন আলবানি তা বর্ণনা করেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. সাহাবীদের মধ্যে আল্লাহর ইবাদতের আগ্রহ, তার অবাধ্যতার ভয়, দীনের যাবতীয় বিষয় অকপটে জিজ্ঞেস করা ও আখিরাতের প্রতি গভীর মনোযোগের প্রমাণ রয়েছে এ হাদীসে।

‎দুই. যৌনা চাহিদা দমন করার জন্য খাসী করা বা নপুংসক হওয়া নিষিদ্ধ। এ দ্বারাপ্রতীয়মান হয় যে, নপুংসক হওয়া বৈধ নয়।

তিন. যৌনাবেগ দমন করার জন্য ঔষধ ব্যবহার করা বৈধ, যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়ামের মাধ্যমে তা দমন করতে বলেছেন। [শারহুস সুন্নাহ লিল বগভি: (৯/৬)।]

চার. সামর্থবান ব্যক্তির জন্য বিবাহ করা মর্যাদার, এটা বান্দার ইবাদত হিসেবে গণ্য ও তার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ।

পাঁচ. যার বিবাহের সামর্থ্য নেই, তার উচিৎ আল্লাহর নিকট বিবাহের খরচ প্রার্থনা করা এবং সিয়াম পালন করা যতক্ষণ না আল্লাহ তার ব্যবস্থা করেন।

ছয়. খাদ্য, পানীয় ও স্ত্রীগমন উপভোগ করা নবীর আদর্শ। ইবাদত ও বুজুর্গি ভেবে এসব ‎‎ থেকে বিরত থাকা সুন্নাতের স্পষ্ট লঙ্ঘন।‎

৩১
২৮. তারাবীর রাকাত সংখ্যা
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান কিংবা গায়রে রমযানে এগারো রাকাতের বেশি সালাত আদায় করতেন না। তিনি চার রাকাত সালাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘকরণ সম্পর্কে তোমাকে কি বলব! অতঃপর তিনি চার রাকাত পড়তেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘকরণ সম্পর্কে তোমাকে কী বলব! অতঃপর তিনি তিন রাকাত আদায় করতেন। আয়েশা বলেন, আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বিতর পড়ার আগে ঘুমান, তিনি বললেন: হে আয়েশা আমার দু’চোখ ঘুমায় কিন্তু আমার অন্তর ঘুমায় না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৮।]

অপর বর্ণনায় আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন, তার মধ্যে বিতর ও ফজরের দু’রাকাত বিদ্যমান”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৮।]

মাসরুক রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি বলেন, সাত রাকাত, নয় রাকাত ও এগারো রাকাত, ফজরের দু’রাকাত ব্যতীত। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৮৮।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৮৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬৪।]

আব্দুর রহমান ইবন হুরমুয আল-আ‘রাজ রহ. বলেন, “আমি লোকদের দেখেছি তারা রমযানে কাফিরদের ওপর লানত করত। তিনি বলেন, কোনো কোনো ইমাম আট রাকাতে সূরা বাকারা খতম করতেন, আর যখন সূরা বাকারা দ্বারা বারো রাকাত পড়তেন, তখন লোকেরা মনে করত যে তিনি হাল্কা করেছেন”। [মুয়াত্তা মালেক: ১/১১৫; আব্দুর রায্‌যাক, হাদীস নং ৭৭৩৪; বায়হাকি: (২/৪৯৭), তার সনদ সহীহ, আব্দুর রহমান ইবন হুরমুয প্রখ্যাত তাবিয়ি, তিনি এ বর্ণনায় মদিনাবাসীদের আমল বর্ণনা করছেন। দেখুন তার জীবনী: সিয়ারে আলামিন নুবালা: (৫/৬৯।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের সালাত রমযান ও গায়রে রমযানে সমান ছিল। [আল-ইস্তেযকার: (২/৯৮)।]

দুই. নবীদের চোখ ঘুমায়, কিন্তু তাদের অন্তর ঘুমায় না, এ জন্য তাদের স্বপ্ন সত্য, এটা নবীদের বৈশিষ্ট্য। [আল-ইস্তেযকার: (২/১০১); শারহুন নববী: (৬/২১)।]

তিন. সকল আলিম একমত যে, রমযান ও গায়রে রমযানে রাতের সালাত সুন্নাত, এতে কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই, যার ইচ্ছা কিয়াম লম্বা করে রাকাত সংখ্যা কমাবে, যার ইচ্ছা কিয়াম সংক্ষেপ করে রাকাত সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। [আল-ইস্তেযকার: (২/১০২); তামহিদ: (২১/৭০)।]

চার. রাতের সালাতে কিরাত, রুকু ও সাজদাহ দীর্ঘ করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত, ছোট কিরাতে অধিক রাকাতের চেয়ে দীর্ঘ কিরাতে এগারো রাকাত অধিক উত্তম। [মাজমুউল ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম: (২৩/৬৯-৭২)।]

পাঁচ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো এগারো রাকাতের অধিক তেরো রাকাত পড়েছেন, কখনো তিনি এগারো রাকাতের কম সাত বা নয় রাকাত পড়েছেন, যেমন অন্যান্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তবে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা‎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সচরাচর সালাতের বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ এগারো রাকাত নিয়মিত পড়া। [দেখুন: ফাতাওয়া: নং (৯৩৫৩), ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ। ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার: (৩/২০); শারহুন নববী: (৬/১৮); সুবুলুস সালাম: (২/১৩)।]

ছয়. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক দু’রাকাতের পর সালাম ফিরাতেন, একসাথে চার রাকাত বা তার অধিক পড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সচরাচর আমল ও সুন্নাত পরিপন্থী। দলীল আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনা: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক দু’রাকাতের পর সালাম ফিরাতেন, এক রাকাত দ্বারা বিতর পড়তেন”। [মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৬।] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “রাতের সালাত দু’রাকাত, দু’রাকাত”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৪৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৪৯।] এটা বিতর ব্যতীত। অতএব, মুসলিম তিন অথবা পাঁচ রাকাত দ্বারা বিতর পড়বে, তবে শেষ রাকাত ব্যতীত বসবে না, যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীসে এসেছে: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত পড়তেন, তন্মধ্যে পাঁচ রাকাত দ্বারা বিতর পড়তেন, শেষ রাকাত ব্যতীত বসতেন না”। [মুসলিম, হাদীস নং ৭৩৭।]

সাত. সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী তাবেয়িগণ মদিনায় সালাতে তারাবীহ খুব দীর্ঘ করতেন, যেমন বিশিষ্ট তাবেয়ি আব্দুর রহমান ইবন হুরমুয রহ. উল্লেখ করেছেন।

আট. সালাতে তারাবীর ‘দো‘আয়ে কুনুতে’ কাফিরদের জন্য বদ-দো‘আ ও তাদের ওপর লা‘নত করা বৈধ। তারা আমাদের চুক্তির অধীনে থাক বা না-থাক, কুফুরীর কারণে তারা লা‘নতের উপযুক্ত, তবে এটা ওয়াজিব নয়। এ ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত হচ্ছে যুদ্ধবাজ কাফিরদের জন্য ধ্বংস ও শাস্তির বদ-দো‘আ করা। যাদের ইসলাম গ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের জন্য হিদায়াত লাভের দো‘আ করা। [আল-ইস্তেযকার: (২/৭৩); ইমাম বুখারী এ সংক্রান্ত (৫৮), (৯৮), (৫৯) ও (১০০) নং বাব/অধ্যায়সমূহ রচনা করেছেন।]

নয়. মদিনায় সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের রমযানের ‘দো‘আয়ে কুনুত’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘কুনুতে নাযেলা’ থেকে গৃহীত, যে কুনুতে নাযেলা তিনি রা‘ল, যাকওয়ান, বনু লিহইয়ান ও উসাইয়্যাহ সম্প্রদায়ের ওপর করেছেন, যারা কুরআনের কারীদের হত্যা করেছে। [আল-ইস্তেযকার: (২/৭৩)।] মদিনাবাসী রমযানের শেষার্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত এ বদদো‘আ করতেন।

দশ. মদিনার সাহাবীদের আমল থেকে জুমার দ্বিতীয় খুতবায় কাফিরদের ওপর বদদো‘আ করার সুন্নাত গৃহীত। হাফেয ইবন আব্দুল বার রহ. এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে বলেছেন: “আ‘রাজ সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের বড় এক জমা‘আতের সাক্ষাত পেয়েছেন, এটা মদিনার আমল ছিল”। [আল-ইস্তেযকার: (২/৭৫) ।]

৩২
২৯. মুসাফির কখন সিয়াম ভাঙ্গবে?!
জা‘ফর ইবন জাবর রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি আবু বসরা গিফারি সাহাবীর সাথে রমযানে মিসরের ফুসতাত থেকে জাহাজে চড়েছিলাম, তাদেরকে যখন জাহাজে উঠানো হলো, দুপুরের খানা পেশ করা হলো। জা‘ফর তার হাদীসে বলেন, এখনো বাড়ি-ঘরগুলো ছাড়িয়ে যায়নি, তিনি দস্তরখান হাযির করতে বললেন। তিনি বললেন: নিকটে আস। আমি বললাম আপনি কি ঘরগুলো দেখছেন না। আবু বসরাহ বললেন: তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত থেকে বিরত থাকতে চাও? জা‘ফর তার হাদীসে বলেন, অতঃপর তিনি খানা গ্রহণ করেন”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪১২; আহমদ: (৬/৩৯৮); দারামি, হাদীস নং ১৭১৩; তাবরানি ফিল কাবির: (২/২৭৯-২৮০), হাদীস নং ২১৬৯-২১৭০। শাওকানি বলেন: এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য, নাইলুল আওতার: (৪/৩১১); দেখুন: তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৪৩০); আলবানি ইরওয়া: (৪/১৬৩) গ্রন্থে হাদীসটি সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ৯২৮।]

মুহাম্মাদ ইবন কাব রহ. বলেন, “আমি রমযানে আনাস ইবন মালিকের নিকট আসি, তখন তিনি সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তার জন্য সওয়ারি প্রস্তুত করা হয়েছে, তিনি সফরের পোশাক পরিধান করেন, অতঃপর খানা আনতে বলেন, তিনি খানা ভক্ষণ করেন, আমি তাকে বললাম: এটা কি সুন্নাত? তিনি বললেন: সুন্নাত, অতঃপর সওয়ারীর উপর উঠে বসলেন”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯৯-৮০০), তিনি হাদীসটি হাসান বলেছেন। দিয়া’ ফিল মুখতারাহ: (২৬০২; দারাকুতনি: (২/১৮৭; বায়হাকি: (৪/২৪৭), আলবানি ইরওয়া: (৪/৬৪) ও সহীহ তিরমিযীতে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. সফরে ইফতার করা নবীর সুন্নাত। তার থেকে বর্ণিত: তিনি সফরে সাওম পালন করেছেন, যেমন তিনি ইফতার করেছেন। অনুরূপ সাহাবীদের থেকে বর্ণিত: তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কতক সফরে সাওম পালন করেছেন, কতক সফরে ইফতার করেছেন।

দুই. এসব হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, যদি কেউ সফর আরম্ভ করে, তার জন্য ইফতার করা বৈধ, সে নিজের শহর বা গ্রাম অতিক্রম করুক বা না-করুক। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “সাহাবায়ে কেরাম যখন সফর করতেন, তখন তারা বাড়ি ত্যাগ করার ভ্রুক্ষেপ না করে ইফতার করতেন, বলতেন এটা সুন্নাত ও নবীর আদর্শ”। [যাদুল মায়াদ: (২/৫৬), এ মাসআলাটি দ্বিমতপূর্ণ, ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত, ঘর থেকে বের হয়ে ইফতার করবে। ইসহাক বলেছেন: বরং যখন সে সফরে পা রাখবে তখন থেকে, যেমন আনাস করেছেন। দেখুন: মুগনি: (৪/৩৪৫-৩৪৮), ফাতহুল বারি: (৪/১৮০-১৮২)]

তিন. এসব হাদীস প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি দিনের মধ্যবর্তী সময়ে সাওম অবস্থায় সফর করে, তার জন্য ইফতার করা বৈধ, যদিও কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে থাকে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেছেন: “এসব হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রমযানের দিনে যে সফর করবে, তার জন্য সেদিন ইফতার করা বৈধ”। [যাদুল মায়াদ: (২/৫২); তাহযিবুস সুনান: (৭/৩৯)। এটাই শা’বি, আহমদ, ইসহাক, আবু দাউদ ও ইবন মুনযিরের ব্যক্তব্য। তবে তিন ইমাম ও ইমাম আওযায়ি এর বিপরীত মত প্রকাশ করেন, তাদের নিকট যে ব্যক্তি সাওম অবস্থায় সফর আরম্ভ করে, সে ঐ দিন ইফতার করবে না। দেখুন: মুখতাসারুস সুনান লিল মুনযিরি: (৩/২৯১)।]

৩৩
৩০. রমযানের দিনে সহবাস করা
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসে ছিলাম, এমতাবস্থায় তার নিকট এক ব্যক্তি আগমন করল, সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন: কী হয়েছে? সে বলল: সাওম অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীর ওপর উপগত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার কি গোলাম আছে? সে বলল: না, তিনি বললেন: তুমি কি দু’মাস লাগাতার সাওম রাখতে পারবে? সে বলল: না, তিনি বললেন: তুমি কি ষাটজন মিসকিনকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল: না, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরতি নিলেন। আমরা আমাদের অবস্থানে ছিলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একপাত্র খেজুর নিয়ে হাযির হলেন, অতঃপর বললেন: প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল: আমি। বললেন: তুমি এটা গ্রহণ করে সদকা করে দাও। সে বলল: আমার চেয়ে গরিব কাউকে হে আল্লাহর রাসূল? আল্লাহর শপথ আমার পরিবারের চেয়ে অধিক গরিব মদিনার আশ-পাশে আর কোনো পরিবার নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন, তার দাঁত পর্যন্ত দেখা গেল, অতঃপর বললেন: এটা তোমার পরিবারকে খাওয়াও”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১১১।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. রমযানের দিনে ওযর ব্যতীত যে স্ত্রী সহবাস করল, যেমন সফর, ভুল ও বলপ্রয়োগ, সে পাপ ও গুনাহ করল, অবশিষ্ট দিন বিরত থাকাসহ তার তাওবা করা ওয়াজিব, সে দিনের সাওম নষ্ট হয়ে যাবে, তার ওপর কাফ্‌ফারা ওয়াজিব। [ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম লি ইবন উসাইমিন: (৪৭৪), শারহুল মুমতি: (৬/৪০১), জমহুর ও অধিকাংশ আলিমগণ বলেন কাফ্ফারার সাথে কাযা করতে হবে। দেখুন: আল-মুফহিম: (৩/১৭২) শাইখুল ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন তার কাযা করতে হবে না, যদি কাযা ওয়াজিব হত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তাকে তার নির্দেশ দিতেন।]

দুই. কাফ্‌ফারা ক্রমান্বয়ে ওয়াজিব হয়, প্রথমে গোলাম আযাদ, অতঃপর লাগাতার দু’মাস সাওম পালন, যদি সামর্থ্য না থাকে তাহলে ষাটজন মিসকিনকে খাদ্য দান করা।

তিন. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রয়োজনে বলা বৈধ। [ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার: (৪/১৭৩)।]

চার. পাপীর পাপ সম্পর্কে ফতোয়া তলব করা, পাপ প্রকাশ করার অপরাধ হবে না। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/২১৫)।]

পাঁচ. ছাত্রদের সাথে নরম ব্যবহার করা, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনয়ী হওয়া, দীনের প্রতি লোকদের আগ্রহী করা, পাপের অনুশোচনা ও আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা জরুরি। [ফাতহুল বারি: (৪/১৭৩)।]

ছয়. এক পরিবারকে পুরো কাফ্‌ফারা দেওয়া বৈধ। [ফাতহুল বারি: (৪/১৭৪)।]

সাত. এ হাদীসে সাহাবীদের অন্তরের পবিত্রতা ও অন্তরকে আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাকুলতা প্রমাণ হয়। [আল-ফিরইয়াবি কর্তৃক বুলুগুল মারামের ব্যাখ্যা গ্রন্থ: (১/৪২৬)।]

আট. গরিব ব্যক্তি কাফ্‌ফারার খানা নিজে খাওয়া ও নিজ পরিবারের ওপর সদকা করা বৈধ। [আল-ফিরইয়াবি কর্তৃক বুলুগুল মারামের ব্যাখ্যা গ্রন্থ: (১/৪২৬)।]

নয়. স্বামীর ওপর পরিবারের খরচ ওয়াজিব, যদিও সে গরিব হয়। এ হাদীস দ্বারা ইমাম বুখারী একটি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন। [সহীহ বুখারী (৫/২০৫৩); দেখুন: শারহু ইবনল মুলাক্কিন: (৫/২৫৪)।]

দশ. স্ত্রীগমন করে সাওম ভঙ্গকারীর ওপর কাফ্‌ফারা ওয়াজিব, পানাহার করে সাওম ভঙ্গকরীর ওপর কাফ্‌ফারা ওয়াজিব নয়, এটাই ফাতওয়া। [হানাফি ও মালেকি মাজহাবের আলিমগণ পানাহার করে সাওম ভঙ্গকারীর ওপর কাফ্‌ফারা ওয়াজিব করেন। দেখুন: আল-মুফহিম: (৩/১৭৩)।]

এগার. অধীনদের দুনিয়াবি ও দীনি প্রয়োজন পূরণ করে ইমামের খুশি প্রকাশ করা বৈধ। [আল-ফিরইয়াবি কর্তৃক বুলুগুল মারামের ব্যাখ্যা গ্রন্থ: (১/৪২৬)।]

বারো. মানুষ নিজের অভাবের কথা এমন ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করতে পারে, যে তাকে সাহায্য করতে সক্ষম, যদি সে অভাব অভিযোগ আকারে পেশ না করে।

তের. যদি কাফ্‌ফারা আদায় না করে একাধিকবার দিনে সহবাস করে, তাহলে তার ওপর এক কাফ্‌ফারা ওয়াজিব হবে, এতে কারো দ্বিমত নেই। [আল-মাজমু: (৬/৩৪৯); আল-আশবাহ ওয়ান নাজায়ের লিস সুয়ূতি: (১২৭)।]

চৌদ্দ. যদি রমযানের দু’দিন অথবা তার চেয়ে অধিক সহবাস করে, তাহলে প্রত্যেক দিনের মোকাবেলায় একটি করে কাফ্‌ফারা দিতে হবে। [আল-মুগনি: (৪/৩৮৬); আল-মাজমু: (৬/৩৪৬); লাজনায়ে দায়েমার এটাই ফাতাওয়া। ফাতাওয়া নং ১৩৫৪৮।]

পনেরো. রমযানের কাযায় যদি সহবাস করে, তাহলে শুধু কাযা ওয়াজিব হবে কাফ্‌ফারা নয়, কারণ, বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী কাফ্‌ফারা শুধু রমযানের সম্মান বিনষ্টের কারণে ওয়াজিব হয়। [দেখুন: আল-উম্ম: (২/১০০); তাফসিরুল কুরতুবি: (২/২৮৪); আল-মুগনি: (৪/৩৭৮), লাজনায়ে দায়েমার ফাতাওয়া অনুরূপ। ফাতাওয়া নং ১৩৪৭৫।]

ষোল. সহবাস অবস্থায় যার উপর ফজর উদিত হয়, সে যদি সাথে সাথে উঠে যায়, তাহলে তার ওপর কিছু ওয়াজিব হবে না। আর যদি সে তাতে লিপ্ত থাকে, তাহলে সে গুনাহগার হবে, তার ওপর তওবা ও কাফ্‌ফারাসহ অবশিষ্ট দিন বিরত থাকা ওয়াজিব। [দেখুন: মাজমুউল ফাতাওয়া: (৬/৩১৬); রওযাতুত তালেবিন: (২/৩৬৫), আল-মুগনি: (৪/৩৭৯); কাশ্শাফুল কানা: (২/৩২৫); ইমাম বায়হাকি তার সুনান গ্রন্থে ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণনা করেন: “যদি সালাতের আযান দেয়া হয়, আর ব্যক্তি তার স্ত্রীর ওপর থাকে, তাকে সে দিনের সাওম থেকে বিরত রাখা হবে না, যদি সে সাওম রাখতে চায় উঠে গোসল করবে ও তার সাওম পুর্ণ করবে”। ইনশাআল্লাহ এটা বিশুদ্ধ।]

সতের. যদি কেউ স্ত্রীগমনের জন্য পানাহার করে সাওম ভঙ্গ করে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। কারণ, সে বিনা কারণে ইফতার করেছে ও শরী‘আতের বিপরীতে বাহানার আশ্রয় নিয়েছে, এ জন্য তার থেকে কাফ্‌ফারা মওকুফ হবে না। [মাজমুউল ফাতাওয়া: (২৫/২৬০); ইলামুল মুয়াক্কিয়িন: (৩/২৪৭)।]

আঠারো. উপরোক্ত ব্যক্তির ওপর ইসলামের উদারতা ও শিথিলতার প্রমাণ মিলে। সে রমযানে কবিরা গুনাহ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ভীতাবস্থায় এসে বলেছে: “আমি ধ্বংস হয়ে গেছি”, অন্য বর্ণনায় এসেছে: “আমি তো দেখছি আমি ধ্বংস হয়ে গেছি”। এটা তার অনুশোচনা ও তওবার প্রমাণ, ফলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কাফ্‌ফারা প্রদান করেন, সে তা নিজের পরিবারে খরচ করে, তাদের অভাবের কারণে। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসেছেন। [মিনহাতুল বারি: (৪/৩৭৯); ফাতহুল বারি: (৪/১৭১)।]

উনিশ. রমযান না জেনে যদি স্ত্রীগমন করে, তাহলে কাফ্‌ফারা ওয়াজিব হবে না। [ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়াহ: (২৫/২২৮); ইবন ইবরাহিম এর ফাতাওয়া: (৪/১৯৫)]

বিশ. ভুলে যদি কেউ সহবাস করে, তার সাওম বিশুদ্ধ, তার ওপর কাযা-কাফ্‌ফারা কিছু ওয়াজিব হবে না। [দেখুন: আল-উম্ম: (২/৯৯); আল-ইস্তেযকার: (১০/১১১); আল-মুফহিম: (৩/১৬৯); শারহু ইবন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/২১৭)।]

৩৪
৩১. জামা‘আতের সাথে সালাতে তারাবীর ফযীলত
আবুযর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযানের সাওম পালন করলাম। তিনি মাসের কোনো অংশে আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন নি, যখন সাত দিন বাকি, তিনি আমাদের নিয়ে দাঁড়ালেন, রাতের এক তৃতীয়াংশ চলে গেল। যখন ষষ্ঠদিন বাকি, তিনি আমাদের সাথে দাঁড়ালেন না। যখন পাঁচ দিন বাকি, তিনি আমাদেরনিয়ে দাঁড়ালেন রাতের অর্ধেক চলে গেল। আমি বললাম: হেআল্লাহর রাসূল, যদি রাতের বাকি অংশ আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করতেন! তিনি বললেন:

إنَّ الرَّجُلَ إذا صَلَّى مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنصَرِفَ حُسِبَ له قِيَامُ لَيلَةٍ،

“ব্যক্তি যখন ইমামের প্রস্থান পর্যন্ত তার সাথে সালাত আদায় করে, তার জন্যপূর্ণ রাতের সাওয়াব লেখা হয়”।

তিনি বললেন: যখন চতুর্থ রাত বাকি, তিনি দাঁড়ালেন না। যখন তৃতীয় রাত বাকি, তিনি নিজ পরিবার, নারী ও লোকদের জমা করে আমাদের সাথে দাঁড়ালেন, অবশেষে আমরা আশঙ্কা করলাম, আমাদের থেকে ‘ফালাহ’ নাছুটে যায়। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম: ‘ফালাহ’ কি? তিনি বললেন: সাহরি। অতঃপরমাসের অবশিষ্ট দিনে তিনি আমাদের সাথে দাঁড়ান নি”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৭৫; তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৬), তিনি বলেছেন হাদীসটি হাসান। নাসাঈ: (৩/৮৩); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৩২৭; আহমদ: (৫/১৬৩); ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২২০৫ ও ইবন হিব্বান, হাদীস নং ২৫৪৭, হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. এ হাদীস প্রমাণ করে সালাতে তারাবী সুন্নাত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূচনা ফরয হওয়ার শঙ্কায় তা ত্যাগ করেন।

দুই. মসজিদে মুসলিমদের সাথে নারীদের তারাবীহ পড়া বৈধ। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবার, স্ত্রী ও লোকদের জমা করে তাদের সাথে সালাত আদায় করেছেন।

তিন. ইমামের সাথে যে কিয়াম করল তার প্রস্থানের পূর্ব পর্যন্ত, তার জন্য পূর্ণ রাতের কিয়াম লেখা হবে। সুতরাং মুসলিমদের উচিৎ এ কল্যাণেঅলসতা না করা। রমযানের প্রত্যেক রাতে মুসলিমদের সাথে তারাবী পূর্ণ করা। ইমাম আহমদ রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “রমযানে জামা‘আতের সাথে ব্যক্তির সালাত আপনার পছন্দ, না একাকী সালাত? তিনি বলেন, জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করবে ও সুন্নাত জীবিত করবে। তিনি আরো বলেন, আমার পছন্দ হচ্ছে ইমামের সাথে সালাত আদায় করা ও বিতর পড়া”। [তুহফাতুল আহওয়াযি: (৩/৪৪৮); দেখুন: আল-মুগনি: (১/৪৫৭)।]‎

চার. রাতের প্রথমে তারাবীহ পড়া সুন্নাত, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম করেছেন। ইমাম আহমদ রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “কিয়াম (তারাবীহ) কি শেষ রাত পর্যন্ত বিলম্ব করব? তিনি বললেন: না, মুসলিমদের সুন্নাতআমার নিকট অধিক প্রিয়”। [আল-মুগনি: (১/৪৫৭)।] ‎ ‎ শাইখ ইবন বায রহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: যদি সবাই শেষ রাতে বিতর পড়তে রাজি হয়? তিনি বললেন: সবার সাথে প্রথম রাতে সালাত আদায় করা অধিক উত্তম।‎

পাঁচ. ব্যক্তি যদি নিজের মধ্যে ইবাদতের আগ্রহ ও শক্তি দেখে, তাহলেমুসলিমদের সাথে প্রথম রাতে সালাত পূর্ণ করবে, অতঃপর শেষ রাতে নিজের জন্য যত ইচ্ছা সালাত আদায় করবে। তাহলে সে দু’টি কল্যাণ জমা করল: ইমামের সাথে সালাতের কল্যাণ ও শেষ রাতে সালাতের কল্যাণ।‎

৩৫
৩২. ইফতারের সময়
উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِذا أَقْبَلَ الَّليْلُ مِنْ هَا هُنَا وَأَدْبَرَ النَّهَارُ مِنْ هَا هُنَا وَغَرَبَتِ الشَّمْسُ فَقَدَ أَفْطَرَ الصَّائِمُ» .

“যখন রাত এখান থেকে আগমন করে ও দিন এখান থেকে পশ্চাত গমন করে এবং সূর্যাস্ত যায়, তাহলে সাওম পালনকারী ইফতার হলো”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১০০।]

তিরমিযীর এক বর্ণনায় আছে:

«وَغَابَتِ الشَّمْسُ فَقَدْ أَفْطَرْتَ» .

“এবং সূর্য অদৃশ্য হলো, তাহলে তুমি ইফতার করলে”। [জামে তিরমিযী, হাদীস নং ৬৯৮, তিনি হাদীসটি হাসান ও সহীহ বলেছেন। আহমদ: (১/৩৫); দারামি, হাদীস নং ১৭০০।]

আবু দাউদের এক বর্ণনায় আছে:

«إِذا جَاءَ الَّليْلُ مِنْ هَا هُنَا، وَذَهَبَ النَّهَارُ مِنْ هَا هُنَا، وغَابَتِ الشَّمْسُ فَقَدَ أَفْطَرَ الصَّائِمُ» .

“যখন রাত এখান থেকে আসে ও দিন এখান থেকে প্রস্থান করে এবং সূর্য অদৃশ্য হয়, তাহলে সাওম পালনকারী ইফতার করল”। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫১; আহমদ: (১/৫৪); ইবন আবি শায়বাহ: (২/২৭৭)।]

আব্দুল্লাহ ইবন আবু আউফা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “কোনো এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, তিনি সাওম পালনকারী ছিলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তিনি কাউকে বললেন: হে অমুক, উঠ আমাদের জন্য ইফতার (পানীয় জাতীয়) তৈরি কর। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, যদি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে নিতেন। তিনি বললেন: আস আমাদের জন্য ইফতার তৈরি কর। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, যদি সন্ধ্যায় উপনীত হয়ে নিতেন। তিনি বললেন: আস আমাদের জন্য ইফতার তৈরি কর। সে বলল: আপনার দিন এখনো বাকি। তিনি বললেন: আস আমাদের জন্য ইফতার তৈরি কর। সে এসে তাদের জন্য ইফতার তৈরি করল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করলেন। অতঃপর বললেন: যখন তোমরা দেখ রাত এখান থেকে আগমন করেছে, তখন সাওম পালনকারী ইফতার করল”। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম।]

মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে: “তিনি নিজ হাতে পূর্ব দিকে ইশারা করেছেন”। আহমদের এক বর্ণনায় আছে: “তখন ইফতার হালাল হলো”।

আবু দাউদের এক বর্ণনায় আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলালকে বলেছেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১০১; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫২; আহমদ: (৪/৩৮২)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১০১; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫২; আহমদ: (৪/৩৮২)।]:‎

এক. সূর্যাস্ত হলেই ইফতার হালাল হয়। রাত আগমন ও দিন পশ্চাদগমন দ্বারা তাই উদ্দেশ্য, অর্থাৎ সূর্যের গোলক অদৃশ্য হওয়া, দিগন্ত বা সূর্যের কক্ষপথে আলো থাকলে তাতে সমস্যা নেই। [ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন: “এ কথা বেলাল তাকে এ জন্য বলেছে, যেহেতু সে সূর্যের আলো উজ্জ্বল দেখছিল, যদিও গোলক অদৃশ্য ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যের আলো উপেক্ষা করে, সূর্যের শরীর অদৃশ্য হওয়াকে গ্রহণ করেন। অতঃপর যে সূর্যের শরীর দেখতে পায় না, তার ইফতারের আলামত বর্ণনা করেন অর্থাৎ সে পুবদিক থেকে রাতের আগমন গণ্য করবে”। আল-মুফহিম: (৩/১৫৯)।]

দুই. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শর‘ঈ বিধানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গুরুত্বসহ বর্ণনা করেছেন ও স্পষ্ট বাক্যে তার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যেমন তিনি ইফতার আরম্ভের তিনটি আলামত বর্ণনা করেছেন: রাতের আগমন, দিনের পশ্চাৎ গমন ও সূর্যাস্ত। এ তিনটি আলমত একসাথে ঘটে, একটি প্রকাশ পেলে বাকি দু’টি অবশ্যই প্রকাশ পায়। কোনো কারণে কেউ সূর্যাস্ত দেখতে পায় না, কিন্তু সে পুবের অন্ধকার দেখতে পায়, তখন তার জন্য ইফতার করা বৈধ। এ জন্য তিনি সবক’টি নিদর্শন বর্ণনা করেছেন।

তিন. যখন সূর্যের গোলক ডুবে গেল, সাওম পালনকারী ইফতার করল, দিগন্তে বিদ্যমান লাল আভা ধর্তব্য নয়। যখন সূর্যের গোলক ডুবে যায়, তখন পূর্ব দিক থেকে অন্ধকার প্রকাশ পায়।

চার. রাতের কোনো অংশ সাওম অবস্থায় থাকা ওয়াজিব নয়, এ ব্যাপারে সকল আলিম একমত। [ইবন বাত্তাল তার বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থে এর ওপর ইজমা বর্ণনা করেছেন: (৪/১০২)] ইফতার দেরি করা মোস্তাহাব নয়, বরং হাদীস অনুসারে দ্রুত ইফতার করা মোস্তাহাব।

পাঁচ. মানুষ অজানা বিষয় দ্রুত অস্বীকার করে, যেমন বেলাল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালনে বিলম্ব করেছে। কারণ, ইফতারের সময় হয়েছে বেলালের জানা ছিল না।

ছয়. সাহাবায়ে কেরাম সতর্কতা অবলম্বন অথবা স্পষ্টভাবে জানা অথবা অধিক জানার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতেন, অতঃপর তৎক্ষণাৎ তার নির্দেশ পালনে তৎপর হতেন, যেমন বেলাল সূর্যাস্তের পর রক্তিম আভা ও উজ্জ্বলতা দেখে ভেবেছিল ইফতারের সময় হয়নি, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে জানিয়ে দিলেন, সে সাথে সাথে তা বস্তবায়ন করল।

সাত. আলিম অথবা দায়িত্বশীলকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যদি তার ভুলে যাওয়া বা অন্যমনস্ক হওয়ার আশঙ্কা হয়, তবে তৃতীয়বারের পর না বলা।

আট. কেউ যদি কোনো বিধান না জানে, তার জিজ্ঞাসা করা ও জানতে চাওয়া দোষণীয় নয়।

নয়. এ হাদীসে কিতাবি তথা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের বিরোধিতার ইঙ্গিত রয়েছে, কারণ, তারা সূর্যাস্তের পর ইফতারে বিলম্ব করে। আরো রয়েছে শিয়াদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ, যারা ইফতারের জন্য নক্ষত্র বিকশিত হওয়ার অপেক্ষা করে।

দশ. ক্ষতির আশঙ্কা না হলে সফরে সাওম বৈধ।

এগার. ইফতারের সময় মুয়াজ্জিনের জবাব দেওয়া ও আযান পরবর্তী যিকর পাঠ করা সাওম পালনকারীর জন্য বৈধ। কারণ, সাওম পালনকারী ও রোযাভঙ্গকারী সবাই দলিলের ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত। [ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/৫৩১-৫৩২)।]

বারো. সাওম রাখা, ইফতার করা ও সালাতের সময় নিরূপণে মূল হচ্ছে যমীন, যেখানে সে অবস্থান করছে অথবা যে শূন্যে সে বিচরণ করছে। অতএব, বিমান বন্দরে থাকাবস্থায় যার সূর্যাস্ত গেল অথবা সেখানে মাগরিবের সালাত আদায় করল, অতঃপর পশ্চিমের উদ্দেশ্যে বিমান উড্ডয়ন করল, ফলে সে পুনরায় সূর্য দেখল, তাহলে তার পানাহার থেকে বিরত থাকা জরুরি নয়, তার সালাত ও সিয়াম উভয় শুদ্ধ। কারণ, সে যে জমিতে ছিল তার হিসেবে ইফতার ও সালাত সম্পন্ন করেছে, তাই পুনরায় তা আদায় করতে হবে না। আর যদি সূর্যাস্তের সামান্য আগে বিমান উড্ডয়ন করে, তার সাথে দিন চলতে থাকে, তাহলে তার জন্য ইফতার ও সালাত আদায় বৈধ নয়, যতক্ষণ না তার আকাশের সূর্যাস্ত যায়, যেখানে সে ভ্রমণ করছে। আর যদি সে এমন দেশের ওপর দিয়ে গমন করে, যার অধিবাসীরা ইফতার ও সালাত আদায় করেছে, কিন্তু সে ঐ দেশের আসমানে (শূন্যে) সূর্য দেখছে, তার সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার ও সালাত বৈধ হবে না। [ফাতোয়া লাজনায়ে দায়েমা: (২২৫৪); ফাতাওয়া ইবন বায: (১৫/২৯৩-৩০০-৩২২)।]

৩৬
৩৩. সাওম পালনকারীর বমির হুকুম
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ ذَرَعَهُ قَيءٌ وهُو صَائمٌ فَليسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ وَإِن اسْتَقَاءَ فلْيَقض»

“সাওম অবস্থায় যার বমি হলো, তার ওপর কাযা জরুরি নয়। হ্যাঁ, যদি সে স্বেচ্ছায়বমি করে, তাহলে সে যেন কাযা করে”। [‎আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৮০; আহমদ: (২/৪৯৮); সহীহ ইবন খুজাইমা, হাদীস নং ১৯৬০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫১৮; সহীহহাকেম: (১/৮৫৫-৫৮৯)‎।]‎

মি‘দান ইবন তালহা রহ. থেকে বর্ণিত: “আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ তাকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বমি করার পর সাওম ভঙ্গকরেছেন। পরবর্তীতে দিমাশকের এক মসজিদে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাস সাওবানের সঙ্গে সাক্ষাত করি, আমি বললাম: আবুদ দারদা আমাকে বলেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বমি করার পর সাওম ভঙ্গ করেছেন। তিনিবললেন: হ্যাঁ, তিনি ঠিক বলেছেন। আমি তার পানি ঢেলেছি”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৮১; আহমদ: (৬/১৯); নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩২১০-৩১২৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ১০৯৭;হাকেম: (১/৫৮৮-৫৮৯)।‎]‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া যে, তার অনিচ্ছায় যেসব কাজ সংঘটিত হয়, সে জন্য তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। হ্যাঁ, বান্দার ইচ্ছাধীন কাজের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যেমন,বমি করা। অর্থাৎ আঙ্গুল ঢুকিয়ে বা গলায় কিছু প্রবেশ করিয়ে অথবা দুর্গন্ধ শুকে অথবা বিরক্তিকর ‎‎ কোনো জিনিস দেখে বা কোনো কারণে বমি করল। যদি সে ইচ্ছাকৃত এমন করে, তবে তার সিয়াম নষ্টহয়ে যাবে, অনিচ্ছাকৃত হলে সিয়াম নষ্ট হবে না।‎

দুই. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে বর্ণিত আছে, তিনি বমি করেছেন, অতঃপর সাওম ভঙ্গ করেছেন, এর অর্থ তিনি বমির কারণে দুর্বল হয়েছিলেন বিধায় সিয়াম ভঙ্গ করেছেন। বমির কারণে তিনি সাওম ভঙ্গ করেন নি। ত্বাহাবির এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«ولَكني قِئْتُ فَضَعُفْتُ عن الصَّومِ فأَفطرتُ» .

“কিন্তু আমি বমি করেছি,ফলে সাওম পালন থেকে দুর্বল হয়ে গেছি, তাই আমি সিয়াম ভঙ্গ করেছি”।‎ [তাহাবি: শরহুমাআনিল আসার: (২/৯৭); উমদাতুলকারি: (১১/৩৬)‎।]

তিন. এসব হাদীস প্রমাণ করে, স্বেচ্ছায় যে বমি করবে, তার সাওম ভেঙ্গে যাবে, হোক সে বমি তিক্ত পানি,খানা, কফ কিংবা রক্ত, কারণ, এসব হাদীসের অর্থ ও ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত। [আল-মুগনি লি ইবন কুদামাহ: (৩/২৪)।]

চার. রমযানের দিনে সাওম পালনকারীর বমি করা বৈধ নয়, কারণ, বমির কারণে তার সাওম ভেঙ্গে যাবে। হ্যাঁ, কেউ যদি অসুস্থ হয়, তাহলে রোগের কারণে অপারগ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ١٨٤﴾ [ البقرة : 184]

“তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবাসফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যাপূরণ করে নেবে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৪]অর্থাৎ সে রমযানে পানাহার করেপরে কাযা করবে।‎ [আস-সালাত লি ইবন কাইয়্যিম: (১৩৪)।‎]

পাঁচ. ইচ্ছাকৃতভাবে যে বমি করবে, তার সাওম ভঙ্গের বিধান ইসলামি শরী‘আতের ইনসাফকে প্রমাণ করে। আরো প্রমাণ করে যে, আল্লাহর প্রত্যেক বিধান বান্দার ওপর ইনসাফ ও রহমত। শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: “সাওম পালনকারীকে সেসব বস্তু থেকে বারণ করা হয়েছে, যা তার শক্তি বৃদ্ধি করে ও খাদ্যের যোগান দেয়, যেমন খাদ্য ও পানীয়। অতএব, যা তাকে দুর্বল করে ও যার ফলে তার খাদ্য বের হয়, তা থেকে তাকে বারণ করা হয়েছে। যদি তাকে এর অনুমিত দেওয়া হয়, সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও ইবাদতে সীমালঙ্গনকারী গণ্য হবে। [মাজমুউল ফাতাওয়া : (২৫/২৫০-২৫১)‎।]

৩৭
৩৪. সাওম পালনকারীর সুরমা ও মিসওয়াক ব্যবহার করা
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلى أُمَّتي لأَمَرْتُهُمْ بالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاةٍ» متفق عليه .

“যদি আমার উম্মতের ওপর কষ্ট না হত, তাহলে আমি প্রত্যেক সালাতের সময় তাদেরকে অবশ্যই মিসওয়াকের নির্দেশ দিতাম”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫২।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ عَزَّ وَجَلَّ»

“মিসওয়াক মুখ পবিত্র রাখা ও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার বস্তু”। [আহমদ: (৬/৬২); নাসাঈ: (১/১০); দারামি, হাদীস নং ৬৮৪; আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৪৯৪৬; সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৩৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ১০৬৭।]

ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ বলেছেন: “দিনের শুরু ও শেষে মিসওয়াক করবে”। [সহীহ বুখারী (২/৬৮১)।]

তিনি আরো বলেছেন:

«لا بَأْسَ أَنْ يَسْتَاكَ الصَّائِمُ بِالسِّوَاكِ الرَّطْبِ وَاليَابِسِ» .

“সাওম পালনকারী শুষ্ক বা ভেজা মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করবে এতে সমস্যা নেই”। [ইবন আবি শায়বাহ: (২/২৯৬)।]

মু‘আয রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি জানতেন মিসওয়াকের পর সাওম পালনকারীর মুখে খুলুফ থাকবে, তিনি তাদেরকে স্বেচ্ছায় মুখ দুর্গন্ধময় করতে নির্দেশ দেন নি, তাতে কোনো কল্যাণ নেই, বরং তাতে রয়েছে অনিষ্ট, তবে যে রোগে আক্রান্ত, যার থেকে মুক্তির পথ নেই সে ব্যতীত। [তাবরানি ফিল কাবির: (২০/৭০), হাদীস নং ১৩৩; মুসনাদে শামি, হাদীস নং ২২৫০। হাফেয ইবন হাজার এর সনদ জাইয়্যেদ বলেছেন: তালখিস: (২/২০২), কিন্তু হায়সামি বকর ইবন খুনাইস বর্ণনাকারীর কারণে হাদীসটি দুর্বল বলেছেন, তবে তিনি বলেছেন: ইবন মুয়িন তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/১৬৫)।]

আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, “তিনি সাওম অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৭৮; ইবন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪), এ হাদীস মওকুফ। তিরমিযী বলেছেন: এ অধ্যায়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ কোন হাদীস নেই। তিরমিযী (৩/১০৫)।]

হাসান রহ. থেকে বর্ণিত: “তিনি সাওম পালনকারী ব্যক্তির সুরমা ব্যবহারে কোনো সমস্যা মনে করতেন না”। [ইবন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪); যুহরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “সওম পালনকারীর সুরমা ব্যবহারে কোন সমস্যা নেই”। ইবন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪)।]

যুহরি রহ. বলেন, “সাওম পালনকারীর সুরমা ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই”। [ইবন আবি শায়বাহ: (২/৩০৪)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. মিসওয়াকের ফযীলত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সালাতের সময় তার নির্দেশ দেওয়ার ইচ্ছা করেছেন।

দুই. উম্মতের ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া যে, তিনি তাদের ওপর কষ্টের বিধান চাপিয়ে দেন নি।

তিন. দিনের শুরু ও শেষে সাওম পালনকারীর জন্য মিসওয়াক করা বৈধ। সাওম পালনকারী ও গায়রে সাওম পালনকারী সবার জন্য মিসওয়াক করা সুন্নাত, সবাই হাদীসের হাদীসের ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত।

চার. কাঁচা ও শুষ্ক সব মিসওয়াক সাওম পালনকারীর জন্য বৈধ। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২/৬৮২); ফাতহুল বারি: (৪/১৫৮); দেখুন: তামহিদ: (১৯/৫৮)।]

পাঁচ. মিসওয়াকের সময় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে সমস্যা নেই, সাওম নষ্ট হবে না, তবে রক্ত গলাধঃকরণ করবে না। [ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমাহ: (১০/২৬৫), ফাতাওয়া নং ৩৭৮৫।]

ছয়. সাওম পালনকারী সুরমা ব্যবহার করতে পারবে, অনুরূপ কান ও চোখের ড্রপ ব্যবহার করতে পারবে, যদিও স্বাদ অনুভব হয়, এ ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা তার ইঙ্গিত নেই, দ্বিতীয়ত এগুলো খাদ্যনালী নয়। [মাজমু ফাতাওয়া ইবন বায: (১৫/২৬০-২৬১), শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. এটা গ্রহণ করেছেন। দেখুন: ফিকহুল ইবাদাত লি ইবন উসাইমিন: (১৯১-১৯২)।]

সাত. নাকের ড্রপ যদি পেটে যায়, তাহলে সাওম ভেঙে যাবে, কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকে বেশি পানি দিতে নিষেধ করেছেন, যদি পেটে না পৌঁছে, কোনো সমস্যা নেই। [দেখুন: ফাতাওয়া ইবন বায: (১৫/২৬০); ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/৫২০)।]

আট. ইনহেলার (হাঁপানির স্প্রে) ও এ জাতীয় বস্তু যা ফুসফুসে যায়, সাওম পালনকারী ব্যবহার করতে পারবে, এতে কোনো সমস্যা হবে না। [ফাতাওয়া ইবন বায: (১৫/২৬৫); ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/৫০০)।]

নয়. ইনজেকশনে সাওম ভাঙ্গবে না, মাংস বা রগ যেখানে গ্রহণ করা হোক, হ্যাঁ খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত ইনজেকশনে সাওম ভাঙ্গবে। [মজমুউ ফাতাওয়া ও রাসায়েল লি ইবন উসাইমিন: (১৯/২১৩-২১৫)।]

দশ. সাওম পালনকারী যদি খাদ্য জাতীয় ইনজেকশন নিতে বাধ্য হয়, তাহলে অসুস্থতার জন্য সে তা নিবে ও পরে সাওমটি কাযা করবে।

এগার. যদি সাওম পালনকারী কঠিন ঘ্রাণযুক্ত তেল ব্যবহার করে, সাওম ভঙ্গ হবে না। কারণ, ঘ্রাণ যত শক্তিশালী হোক সাওম ভঙ্গের কারণ নয়। [মজমুউ ফাতাওয়া ও রাসায়েল লি ইবন উসাইমিন: (১৯/২২৫-২২৮)।]

বারো. অসুস্থতার জন্য ডুশ (সাপোজিটর) ব্যবহার করলে সাওম ভঙ্গ হবে না। অতএব, সাওম পালনকারী এটা ব্যবহার করতে পারে। [ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/২০৫)।]

তের. দাঁতের মাজন সাওম ভঙ্গকারী নয়, বরং তা মিসওয়াকের মতই, তবে পেটে যেন না যায় সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, যদি অনিচ্ছায় পেটে যায়, তবে সমস্যা নেই। [মাজমুউ ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/২০৫)।] মাজন দ্বারা রাতে দাঁত মাজাই উত্তম।

চৌদ্দ. গড়গড়ার ঔষুধের কারণে সাওম ভঙ্গ হবে না, যদি তা গলাধঃকরণ না করে, তবে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম। [মজমুউ ফাতাওয়া ও রাসায়েল লি ইবন উসাইমিন: (১৯/২৯০)।]

পনেরো. মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা বৈধ, যদি তার মূল ধাতু গলায় না পৌঁছে। [আল-মুনতাকা: (৩/১৩০)।]

ষোল. সাওম পালনকারীর থু থু গলাধঃকরণে সমস্যা নেই, কিন্তু নাকের শ্লেষ্মা বা কপ গলাধঃকরণ বৈধ নয়। কারণ, এগুলো থেকে বিরত থাকা সম্ভব। [ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমাহ: (৯৫৮৪); ফাতাওয়া ইবন বায: (৩/২৫১)।]

সতের. মলদ্বারে সিরিজ দ্বারা তরল পদার্থ প্রবেশ করালে সাওম ভাঙ্গবে না। [তুহফাতুল ইখওয়ান লি ইবন বায: (৮২)।]

৩৮
৩৫. নফল সাওমের ফযীলত
আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أتيتُ رسُولَ الله صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ : مُرْني بأَمْرٍ آخُذُهُ عَنْكَ، قَالَ : عَلَيْكَ بالصَّومِِ فَإِنَّهُ لا مِثْلَ لَه» .

“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করি, অতঃপর তাকে বলি: আপনি আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিন, যা আমি আপনার থেকে গ্রহণ করব, তিনি বললেন: তুমি সাওম আঁকড়ে ধর। কারণ, তার সমকক্ষ কিছু নেই”।

হাদীসটি অন্য শব্দে এভাবে এসেছে: আবু উমামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন:

«أَيُّ العَمَل أَفْضَلُ؟ قَالَ : عَلَيْكَ بالصَّومِِ فَإِنَّهُ لا عِدْلَ لَهُ» .

“কোন আমল সর্বোত্তম? তিনি বলেন, তুমি সাওম আঁকড়ে ধর। কারণ, তার সমকক্ষ কিছু নেই”।

অপর বর্ণনায় এসেছে: আবু উমামা বলেছেন: “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি জিনিসের নির্দেশ দিন, যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে প্রবেশ করব, তিনি বললেন: তুমি সাওম আঁকড়ে ধর।কারণ, সাওমের কোনো তুলনা নেই। বর্ণনাকারী বলেন, আবু উমামার বাড়িতে মেহমান আগমন ব্যতীত দিনে কখনো ধোঁয়া দেখা যেত না। যদি তারা ধোঁয়া দেখত, মনে করত আজ তার বাড়িতে মেহমান এসেছে”।

অপর বর্ণনায় এসেছে: আমি বললাম: “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি আমলের নির্দেশ দিন, তিনি বললেন: তুমি সাওম আঁকড়ে ধর। কারণ, তার কোনো তুলনা নেই। বর্ণনাকারী বলেন, আবু উমামা, তার স্ত্রী ও খাদেমদের সাওম ব্যতীত দেখা যেত না। তাদের বাড়িতে দিনে আগুন দেখলে বলা হত মেহমান এসেছে, কোনো আগন্তুক এসেছে। বর্ণনাকারী বলেন, এভাবে সে এক দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে। অতঃপর আমি তার কাছে এসে বলি: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাদেরকে সাওমের নির্দেশ দিয়েছেন, আশা করি আল্লাহ তাতে আমাদেরকে বরকত দান করেছেন। হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে আরেকটি আমলের নির্দেশ দেন, তিনি বলেন, জেনে রাখ, তোমার এমন কোনো সেজদা নেই, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার মর্তবা বৃদ্ধি করেন না ও তোমার পাপ মোচন করেন না”। [দেখুন: নাসাঈ: (৪/১৬৫); আহমদ: (৫/২৪৮); ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪২৫; ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৮৯৩; হাকেম: (১/৫৮২; হাফেয ইবন হাজার ফিল ফাতহ: (৪/১০৪)। প্রথম দু’টি বর্ণনা নাসাঈ থেকে নেওয়া, তৃতীয় বর্ণনা ইবন হিব্বান থেকে নেওয়া, চতুর্থ বর্ণনা আহমদ থেকে নেওয়া।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. সাহাবীদের আখিরাতের আমল জানার আগ্রহ।

দুই. সাওম সর্বোত্তম আমল, এ হাদীস তাই প্রমাণ করে, অপর হাদীসে এসেছে যে, সালাত সর্বোত্তম ইবাদত। যেমন,

«واعلَمُوا أنَّ خيرَ أعمالِكُمُ الصَّلاة»،

“জেনে রেখ, তোমাদের সর্বোত্তম আমল সালাত”।

স্পষ্টত বুঝা যায় আমলের শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের অবস্থার ওপর নির্ভর করে, কতক মানুষের পক্ষে সাওম উত্তম। কারণ, সাওম তাদেরকে হারাম প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখে, তাদের অন্তঃকরণকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য পরিশুদ্ধ করে। আবার কারো পক্ষে সালাত উত্তম, কারণ, তাদের শরীর সাওম পালনে সক্ষম নয় বা সাওমের কারণে অন্যান্য কর্তব্যে ত্রুটি হবে। ইব্‌নুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, “নারীর প্রতি যার আগ্রহ বেশি, তার জন্য সাওম উত্তম অন্যান্য ইবাদত থেকে”।

তিন. সাওম মানুষের প্রবৃত্তিকে নষ্ট করে, যা অনেক পাপ সংঘটিত করে ও ইবাদত থেকে বিরত রাখে। যেসব যুবকরা বিবাহের সামর্থ্য রাখে না, কিন্তু তারা পাপের আশঙ্কা করে, তাদেরকে সাওম পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এ দিক থেকে সাওমের কোনো তুলনা বা সমকক্ষ নেই”।

চার. আবু উমামা ও তার পরিবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাওমের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, এখান থেকে বুঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম শরী‘আতের আদেশ দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতেন।

পাঁচ. মেহমানের সম্মান করা ইসলামি বিধান, তার সম্মানে নফল সাওম ত্যাগ করা বৈধ।

৩৯
৩৬. সাওম পালনকারীর জন্য শিঙ্গা ব্যবহার করা
শাদ্দাদ ইবন আউস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে ‘বাকি’ নামক স্থানে এক ব্যক্তির নিকট আগমন করেন, যে শিঙ্গা লাগাচ্ছিল, তখন আঠারো রমযান। তিনি বললেন:

«أَفْطَرَ الحَاجِمُ والمحْجُومُ» .

“যে শিঙ্গা লাগায় আর যার লাগানো হয় উভয় ইফতার করল”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৬৯; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩১২৬; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৮১; আহমদ: (৪/১২৩), আলী ইবন মাদিনি ও বুখারী হাদীসটি সহীহ বলেছেন। দেখুন: তালখিসুল হাবির: (২/১৯৩), আব্দুল্লাহ ইবন ইমাম আহমদ তার পিতার মাসআলা সমগ্রে নকল করেন: যে শিঙ্গা লাগায় এবং যার লাগানো হয়, উভয়ের সাওম ভাঙ্গার ব্যাপারে এটা সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদীস। মাসায়েলে ইমাম আহমদ: (৬৮২); সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫৩৩; হাকেম: (১/৫৯২), মাজমু গ্রন্থে হাদীসটি ইমাম নববী সহীহ বলেছেন। তিনি বলেন: এ হাদীস ইমাম মুসলিমের শর্ত মোতাবেক: (৬/৩৫০)।]

সাওবান [দেখুন: সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত হাদীস: আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৭১; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৮০; দারামি, হাদীস নং ১৭৩১; আহমদ: (৫/২৭৬); তায়ালিসি, হাদীস নং ৯৮৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫৩২); ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৯৬২-১৯৬৩।], রাফে ইবন খাদিজ [দেখুন: রাফে ইবন খাদিজ থেকে বর্ণিত হাদীস: তিরমিযী, হাদীস নং ৭৭৪; আহমদ: (৩/৪৬৫); সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৫৩৫।] ও একদল সাহাবী থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে, এ জন্য একদল আলিম এ হাদীসকে মুতাওয়াতির বলেছেন।

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন, তিনি সাওম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন”।

আবু দাউদের এক বর্ণনা আছে: “তিনি সাওম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন”। [দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৩৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২০২; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৭২-২৩৭৪; তিরমিযী, হাদীস নং ৭৭৫-৭৭৭।]

শু‘বা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি সাবেত আল-বুনানিকে বলতে শুনেছি, তিনি মালিক ইবন আনাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: আপনারা কি সাওম পালনকারীর জন্য শিঙ্গা অপছন্দ করতেন” তিনি বললেন: না, তবে দুর্বলতার কারণে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৩৮।]

আবু দাউদের এক বর্ণনায় আনাস থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “দুর্বলতার কারণে আমরা সাওম পালনকারীর জন্য শিঙ্গা অপছন্দ করতাম”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৭৫।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. একাধিক হাদীস প্রমাণ করে যে, শিঙ্গা উভয়ের সাওম ভঙ্গ করে: যে লাগায় ও যার লাগানো হয়। আবার এর বিপরীতে অন্যান্য হাদীস রয়েছে, যা প্রমাণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। তাই শিঙ্গার ব্যাপারে আলিমদের ইখতিলাফ সৃষ্টি হয়েছে। জমহুর আলিম বলেন সাওম পালনকারীর জন্য শিঙ্গা লাগানো বৈধ। নিষেধাজ্ঞার হাদীসগুলো বৈধতার হাদীস দ্বারা রহিত ও মানসুখ। [দেখুন: আবু সাঈদ খুদরী, ইবন মাসউদ ও উম্মে সালামা থেকে বর্ণিত সাওম পালনকারীর জন্য শিঙ্গা লাগানো বৈধ। উরওয়া, সাঈদ ইবন জুবায়ের এবং প্রসিদ্ধ তিন ইমাম: আবু হানীফা, মালেক ও ইমাম শাফে‘ঈ অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আল-মুগনি: (৪/৩৫০); মুহাল্লা: (৬/২০৪-২০৫); ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার: (৪/১৭৪-১৭৮); সুবুলুস সালাম: (২/১৫৮-১৬০); নাইলুল আওতার: (৪/২৭৫)।]

ইমাম আহমদের মাযহাব হচ্ছে, শিঙ্গা সাওম ভঙ্গকারী। শাইখুল ইসলাম ও তার শিষ্য ইবনুল কাইয়্যেম এ মত গ্রহণ করেছেন। [দেখুন: যারা বলেছেন শিঙ্গার কারণে সাওম ভেঙ্গে যাবে, তাদের মধ্যে আতা ও আব্দুর রহমান ইবন মাহদি অন্যতম, ইমাম আহমদের এ মাযহাব। ইসহাক, ইবন মুনযির ও ইবন খুযাইমাহ তদনুরূপ বলেছেন। ইবন কুদামা একদল সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, তারা রাতে শিঙ্গা লাগাতেন। তাদের মধ্যে ইবন ওমর, ইবন আব্বাস, আবু মূসা ও আনাস অন্যতম। আল-মুগনি: (৪/৩৫০); মাজমুউল ফাতাওয়া: (২৫/২৫৭); রিসালা হাকিকাতুস সিয়াম: (৮১-৮৪); তাহযিবুস সুনান: (৬/৩৫৪-৩৬৮); ইলামুল ময়াক্কিয়িন: (২/৫২); ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: সাওম পালনকারীর জন্য শিঙ্গা জায়েয মন্তব্যকারীগণ চারটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া ব্যতীত এ কথা বলতে পারেন না:(১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিঙ্গা লাগিয়েছেন সুস্থ অবস্থায়, অসুস্থ অবস্থায় নয়।(২) তিনি শিঙ্গা লাগিয়েছেন মুকিম অবস্থায়, মুসাফির অবস্থায় নয়।(৩) তিনি ফরয সাওমে শিঙ্গা লাগিয়েছেন, নফল সাওমে নয়।(৪) তিনি শিঙ্গা লাগিয়েছেন নিষেধ করার পর, আগে নয়। যখন এ চারটি বিষয় প্রমাণ হবে, তখন বলা যাবে যে, রোযাদারের জন্য শিঙ্গা লাগানো বৈধ, অন্যথায় নয়”। যাদুল মা‘আদ: (৪/৬১-৬২)।]

সৌদি আরবের লাজনায়ে দায়েমা অনুরূপ ফতোয়া প্রদান করেছে। [দেখুন: ফাতাওয়াল লাজনাহ: (১০/২৬১-২৬২), ফাতাওয়া নং ১১৯১।]

সৌদি আরবের অধিকাংশ আলিম এটাই গ্রহণ করেছেন। অতএব, সাওম পালনকারীর দিনে শিঙ্গা পরিহার করাই সতর্কতা, এতে কোনো ইখতিলাফ থাকে না।

দুই. আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎র হাদীস প্রমাণ করে যে, শিঙ্গা সাওম দুর্বল করে, তাই নিষেধ করা হয়েছে। এটা শরী‘আতের এক বৈশিষ্ট্য, সে তার অনুসারীদের থেকে কষ্ট দূরীভূত করে।

তিন. শিঙ্গা শরীর দুর্বল করে, তাই সাওম ভঙ্গকারী। যে শিঙ্গা লাগায় তার সাওম ভঙ্গের কারণ, হচ্ছে, রক্ত চোষণের ফলে তার মুখে রক্ত প্রবেশ করার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। হ্যাঁ যদি সে মুখে না চোষে, আধুনিক যন্ত্র দ্বারা টেনে বের করে, তাহলে তার সাওম ভঙ্গ হবে না। [দেখুন: শারহুল মুমতি: (৬/৩৮২)।]

চার. অপারেশন দ্বারা বিষাক্ত রক্ত বের করলে সাওম পালনকারীর সাওম ভেঙ্গে যাবে, তবে ডাক্তারের সাওম ভঙ্গ হবে না। [দেখুন: ফাতাওয়ায়ে লাজনায়ে দায়েমা: (১০/২৬২), ফাতাওয়া নং ৫৪৭। এটাই শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়ার পছন্দনীয় অভিমত। মাজমুউল ফাতাওয়া: (২৫/২৬৮), শাইখ মুহাম্মদ ইবন ইবরাহিম তার ফাতাওয়াতে এ মতটি প্রধান্য দিয়েছেন: (৪/১৯১)।]

পাঁচ. মাথা হালকা করা বা কোনো কারণে স্বেচ্ছায় নাক থেকে রক্ত বের করলে সাওম ভেঙ্গে যাবে, অনিচ্ছায় অধিক রক্ত বের হলেও সাওম ভঙ্গ হবে না। [এটা শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ ফি ইখতিয়ারুল ফিকহিয়্যাহ: (১০৮); ইবন ইবরাহিম: (৪/১৯১) ও উসাইমিন: (১৯/২৪৯) প্রমুখগণের অভিমত। দেখুন: ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ: (১০/২৬৪), ফাতাওয়া নং ৩৪৫৫।] রক্ত বের হওয়ার কারণে যদি শরীর দুর্বল হয় ও সাওম ভাঙ্গার প্রয়োজন হয়, তাহলে তার অনুমতি রয়েছে, কারণ, সে অসুস্থ।

ছয়. রক্ত পরীক্ষা করলে সাওম ভঙ্গ হবে না, হ্যাঁ ইখতিলাফ এড়িয়ে থাকার জন্য এসব কাজ রাতে করা উত্তম। তবে রক্ত বেশি বের হলে সাওম ভেঙ্গে যাবে, তাই রাত ব্যতীত এসব কাজ না করা উত্তম। অসুখের জন্য প্রয়োজন হলে করবে, তবে সাওম ভেঙ্গে যাবে, পরে তা কাযা করবে। [দেখুন: ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: (১০/২৬৩), ফাতাওয়া নং ৫৬; মাজমু ফাতাওয়া ইবন বায: (৩/২৩৮-২৩৯); মাজমু ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১৯/২৫০-২৫১)।]

সাত. অনিচ্ছাকৃতভাবে সাওম পালনকারীর শরীর থেকে দুর্ঘটনা অথবা যখমের কারণে অধিক রক্ত বের হলে, সাওম নষ্ট হবে না। যদি দুর্বলতার কারণে সাওম ভাঙ্গতে বাধ্য হয়, তাহলে সে অসুস্থ ব্যক্তির ন্যায় সাওম ভাঙ্গবে ও কাযা করবে। [দেখুন: ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/৫১৪)।]

আট. দাঁত বের করার কারণে সাওম ভাঙ্গবে না, যদিও বেশি রক্ত বের হয়, কারণ, সে রক্ত বের করার জন্য তা বের করেনি, রক্ত তার ইচ্ছা ব্যতীত বের হয়েছে, কিন্তু সে রক্ত গিলবে না, যদি ইচ্ছাকৃত রক্ত গিলে ফেলে, সাওম ভেঙ্গে যাবে। [দেখুন: মাজমু ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১৯/২৪৯-২৫৩)।]

নয়. ডাক্তারি যন্ত্র দ্বারা কিডনি পরিষ্কার করে সে রক্ত বিভিন্ন কেমিক্যাল যেমন সুগার, লবন ইত্যাদি মিশিয়ে পুনরায় তা শরীরে প্রতিস্থাপন করলে সাওম ভেঙ্গে যাবে। [দেখুন: ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: (৪৪৯৯)।]

দশ. শিঙ্গার ন্যায় রক্ত দান করলে সাওম ভেঙ্গে যাবে, তাই রাত ব্যতীত এ কাজ করবে না, তবে কাউকে বাঁচানোর জন্য রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হলে দিবে, সাওম ভঙ্গ করবে ও পরে কাযা করবে। [দেখুন: ফাতাওয়া ইবন উসাইমিন: (১/৫১১)।]

এগার. খাদ্য জাতীয় ইনজেকশনের ফলে সাওম ভেঙ্গে যাবে। [দেখুন: ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: (৫১৭৬)।]

৪০
৩৭. সিয়ামের ফযীলত
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«الصِّيَامُ جُنَّة» .

“সিয়াম ঢাল”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং বুখারি: (১৭৯৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১)] মুসনাদে আহমদের এক বর্ণনায় আছে:

«الصِّيَامُ جُنَّةٌ وحِصْنٌ حَصِينٌ من النَّار» .

“সিয়াম ঢাল ও জাহান্নাম থেকে সুরক্ষার মজবুত কিল্লা”। [আহমদ: (২/৪০২)]

জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إنَّ الصِّيامَ جُنَّـةٌ يَستَجِنُّ بها العَبدُ من النَّارِ» .

“নিশ্চয় সিয়াম ঢাল, বান্দা এর দ্বারা জাহান্নাম থেকে সুরক্ষা লাভ করবে”। [আহমদ: (৩/৩৯৬)]

উসমান ইবন আবুল আস সাকাফি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«الصِّيامُ جُنَّـةٌ مِنَ النَّارِ كَجُنَّةِ أَحَدِكُم من القِتَال» .

“সিয়াম জাহান্নাম থেকে ঢাল, তোমাদের কারো যুদ্ধের ময়দানের ঢালের ন্যায়”। [আহমদ: (৪/২২); নাসাঈ: (৪/১৬৭; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৩৯; সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২১২৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৬৪৯।]

আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«الصَّومُ جُنَّـةٌ ما لم يَخْرِقْهَا» .

“সওম ঢাল, যতক্ষণ না তা ভাঙ্গা হয়”। [নাসাঈ: (৪/১৬৭); আহমদ: (১/১৯৫); তায়ালিসি, হাদীস নং ২২৭; আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৮৭৮; দারামি, হাদীস নং ১৭৩২; মুনযিরি হাদীসটি হাসান বলেছেন: (২/৯৪০), হাদীস নং ১৬৪৩, শাইখ আহমদ শাকের হাদীসটি সহীহ বলেছেন: (১৬৯০), এ হাদীসের সনদে বাশ্শার ইবন আবু ইয়াসূফ আল-জুরমি রয়েছেন, যাকে ইবন হিব্বান ব্যতীত কেউ গ্রহণ যোগ্য বলেন নি, দায়িফে সুনান নাসাঈতে আলবানি হাদীসটি দুর্বল বলেছেন, তিনি হয়তো এ কারণে হাদীসটি দুর্বল বলেছেন, তবে অন্যান্য হাদীস দ্বারা এটি শক্তিশালী হয়। ইমাম কুরতুবি সাওম সুরক্ষা ও ঢাল এর ব্যাখ্যায় বলেন:ক. সাওম প্রকৃত পক্ষে ঢাল, তাই সাওম পালনকারীর কর্তব্য এ ঢালের হিফাজত করা, এ দিকে ইশারা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «فلا يرفثْ ...».খ. সাওম উপকারিতার ভিত্তিতে ঢাল স্বরূপ, অর্থাৎ প্রবৃত্তিকে দুর্বল করে -এ হিসেবে। এদিকে ইশারা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «يذر شهوته وطعامه من أجلي» “সে তার প্রবৃত্তি ও খানা আমার জন্য ত্যাগ করে”।গ. সাওম সওয়াবের হিসেবে ঢাল স্বরূপ, এ দিকে ইশারা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «من صام يوماً في سبيل الله باعد الله وجهه عن النار سبعين خريفاً» .“আল্লাহর রাস্তায় যে একদিন সাওম পালন করল, আল্লাহ তার চেহারা জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে নিয়ে যাবেন”।]

الجُنَّةُ শব্দের অর্থ: সুরক্ষা ও পর্দা। অর্থাৎ সিয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে সুরক্ষা ও পর্দাস্বরূপ। []

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. সিয়াম কু-প্রবৃত্তিকে বশীভূত করে, যে কু-প্রবৃত্তি ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। এ জন্য সাওম জাহান্নামের ঢালস্বরূপ। ইরাকি বলেন, “সওম জাহান্নামের ঢাল, কারণ, সে প্রবৃত্ত থেকে বিরত রাখে, আর জাহান্নাম প্রবৃত্তি দ্বারা আবৃত”। [দেখুন: তারহুত তাসরিব ফি শারহিত তাকরিব: (৪/৯০)।]

দুই. সাওম ফযীলত পূর্ণ, মুসলিমদের উচিৎ অধিক পরিমাণ নফল সাওম পালন করা, যদি সে তার ক্ষমতা রাখে ও তার চেয়ে উত্তম আমলের প্রতিবন্ধক না হয়, যেমন জিহাদ ইত্যাদি।

তিন. সে সাওম জাহান্নামের ঢাল স্বরূপ, যে সাওমে সাওয়াব হ্রাসকারী বা সাওম বিনষ্টকারী কথা বা কর্ম সংঘটিত হয়নি, যেমন গীবত, নামীমা, মিথ্যা ও গালি। কারণ, আবু উবাইদার বর্ণনা এসেছে: “সওম ঢাল, যতক্ষণ না সে তা ভেঙ্গে ফেলে”। সাওম ভঙ্গ হয় হারাম কর্ম দ্বারা, অতএব, সাওম পালনকারীর উচিৎ তার সাওমকে সাওয়াব বিনষ্টকারী অথবা সাওয়াব হ্রাসকারী কর্মকাণ্ড থেকে হিফজত করা, যেন তার সাওম তার জন্য জাহান্নামের ঢাল হয়।

চার. সাওমের উদ্দেশ্য নফসকে পবিত্র করা ও অন্তর সংশোধন করা, শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা নয়।

৪১
৩৮. নাপাক অবস্থায় প্রভাতকারীর সিয়াম
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أُحِلَّ لَكُمۡ لَيۡلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآئِكُمۡۚ﴾ [ البقرة : 187]

“সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের ‎‎ স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

তিনি আরো বলেন,

﴿فَٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ﴾ [ البقرة : 187]

“অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিতহও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখেদিয়েছেন, তা অনুসন্ধান কর। আর আহার করও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখাকালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

আয়েশা ও উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রভাত কখনো হত এমতাবস্থায় যে, স্ত্রীগমনের কারণে তিনি নাপাক থাকতেন। অতঃপর গোসল করতেন ও সাওম রাখতেন”। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম।]

মুসলিমের এক হাদীসে উম্মে সালামা থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্ন দোষের কারণে নয়, বরং স্ত্রীগমনের কারণে নাপাক অবস্থায় প্রভাত করতেন, অতঃপর সাওম পালন করতেন, কাযা করতেন না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১০৯।]

মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে: আবু বকর ইবন আব্দুর রহমান রহ. বলেন, “আমি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ঘটনা বলতে শুনেছি, তিনি তার ঘটনায় বলেন, নাপাক অবস্থায় যার ভোর হয়, সে সাওম রাখবে না। আমি এ ঘটনা আবু বকরের পিতা আব্দুর রহমান ইবন হারেসকে বললাম, তিনি অস্বীকার করলেন। আব্দুর রহমান রওয়ানা করলেন, আমি তার সাথী হলাম, অবশেষে আমরা আয়েশা ও উম্মে সালামার নিকট এসে পৌঁছলাম। আব্দুর রহমান তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন: তিনি বলেন, তারা উভয়ে বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্ন দোষ ব্যতীত নাপাক অবস্থায় ভোর করতেন, অতঃপর সাওম রাখতেন। তিনি বলেন, আমরা রওনা করে মারওয়ানের নিকট পৌঁছলাম, আব্দুর রহমান তাকে ঘটনা বললেন: মারওয়ান বললেন: আমি তোমাকে বলছি তুমি অবশ্যই আবু হুরায়রার কাছে গিয়ে তার কথার প্রতিবাদ কর। তিনি বলেন, আমরা আবু হুরায়রার নিকট গেলাম, আবু বকর এসব ঘটনায় উপস্থিত ছিল। তিনি বলেন, আব্দুর রহমান তাকে এ কথা বললেন। অতঃপর আবু হুরায়রা বললেন: তারা উভয়ে তোমাকে এ কথা বলেছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আবু হুরায়রা বললেন: তারা আমার চেয়ে বেশি জানেন। অতঃপর আবু হুরায়রা এ বিষয়ে যা বলতেন, ফযল ইবন আব্বাসের বরাতে বলতেন। আবু হুরায়রা বলতেন: আমি ফযল ইবন আব্বাস থেকে শুনেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনি নি। তিনি বলেন, আবু হুরায়রা তার পূর্বের কথা থেকে ফিরে যান। আমি আব্দুল মালেককে বললাম: তারা কি রমযানের ব্যাপারে বলেছেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ, তিনি স্বপ্ন দোষ ব্যতীত নাপাক অবস্থায় ভোর করতেন, অতঃপর সাওম পালন করতেন”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১০৯। নাসাঈর এক বর্ণনায় আছে, আবু হুরায়রা এ হাদীস শুনেছেন উসামা ইবন যায়েদ থেকে। দেখুন: সুনানুল কুবরা: (২৯৩১), তাই কেউ বলেছেন: তিনি উভয় থেকে শ্রবণ করেছেন। দেখুন: শারহুন নববী: (৭/২২২); আল-মুফহিম: (৩/১৬৮); শারহু ইবনল মুলাক্কিন: (৫/১৯৭)।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফতোয়া তলবের জন্য এসেছে, তিনি দরজার আড়াল থেকে শুনতে ছিলেন, সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমার নাপাক অবস্থায় সালাতের সময় হয়, আমি কি সাওম রাখব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমারও নাপাক অবস্থায় সালাতের সময় হয়, অতঃপর আমি সাওম রাখি। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাদের মত নয়, আল্লাহ আপনার অগ্র-পশ্চাতের সকল পাপ মোচন করে দিয়েছেন। তিনি বললেন: আল্লাহর শপথ আমি তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ ভীরু এবং তাকওয়া সম্পর্কে তোমাদের চাইতে অধিক জ্ঞাত”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১১০; মালেক: (১/২৮৯); ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৯৫।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. রমযানের রাতে স্ত্রীগমন বৈধ, তা থেকে পরহেয করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের বিপরীত, তবে শেষ দশকে ই‘তিকাফকারী ব্যতীত।

দুই. রমযানের রাতে সহবাস অথবা স্বপ্ন দোষের পর ফজর উদিত হওয়ার পরবর্তী সময় পর্যন্ত যে গোসল বিলম্ব করল, সে সাওম পালন করবে, তার ওপর কিছু আবশ্যক হবে না। এ ব্যাপারে সকল আলিম একমত। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল সহীহ বুখারী (৪/৪৯), শারহুল উমদাহ লি ইব্নিল মুলাক্কিন: (৫/১৯৫); ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার: (৪/১৪৭); নাইলুল আওতার: (৪/৯১)।]

তিন. এ হাদীসে উম্মুল মুমিনীনদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর ও তার পরিবার সংশ্লিষ্ট বিশেষ জ্ঞানের ধারক ও প্রচারকারী ছিলেন।

চার. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার সংক্রান্ত জ্ঞানের ব্যাপারে উম্মুল মুমিনীনদের কথা অন্য সবার ঊর্ধ্বে।

পাঁচ. ফরয গোসল ভোর পর্যন্ত দেরি করা শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তা উম্মতের সবার জন্য প্রযোজ্য।

ছয়. উম্মে সালামার বাণী: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহবাসের কারণে নাপাক অবস্থায় ভোর করতেন, স্বপ্ন দোষের কারণে নয়”। এখানে দু’টি শিক্ষা:

(১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈধতা বর্ণনা করার জন্য রমযানে সহবাস করতেন ও ফজর উদয় পর্যন্ত গোসল বিলম্ব করতেন।

(২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহবাসের কারণে নাপাক অবস্থায় ভোর করতেন, স্বপ্ন দোষের কারণে নয়। কারণ, স্বপ্ন দোষ শয়তানের পক্ষ থেকে, তিনি ছিলেন শয়তান থেকে নিরাপদ। [দেখুন: আল-মুফহিম: (৩/১৬৭); ফাতহুল বারি: (৪/১৪৪), এ ব্যাপারে ইবন আব্বাস থেকে একটি দুর্বল বাণী বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: “কোন নবীর স্বপ্নদোষ হয় নি, নিশ্চয় স্বপ্ন দোষ হচ্ছে শয়তানের পক্ষ থেকে”। তাবরানি ফিল কাবির: (১১/২২৫), হাদীস নং ১১৫৬৪), তাবরানি ফিল আওসাত: (৮০৬২), হায়সামি বলেছেন: আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসের এ বাণীর সনদে আব্দুল আযিয ইবন আবু সাবেত জনৈক ব্যক্তি রয়েছেন, যার দুর্বলতার ব্যাপারে সবাই একমত, যাওয়ায়েদ: (১/২৬৭), ইমাম নববী প্রমাণ করেছেন যে, নবীদের স্বপ্নদোষ হয় না। এ হিসেবে হাদীসের অর্থ হচ্ছে যে, সহবাসের কারণে তিনি নাপাক অবস্থায় প্রভাত করতেন, তিনি স্বপ্ন দোষের কারনে নাপাক হতেন না, কারণ স্বপ্ন দোষ তার পক্ষে অসম্ভব। এ কথা মূলত আল্লাহর এ বাণীর ন্যায়: ﴿وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ﴾ [ البقرة :61] “এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করত”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৬১]আমরা সকলে জানি যে, নবীদের হত্যা কখনো হকভাবে হতে পারে না। শারহু মুসলিম (৭/২২২); ইবনুল মুলাক্কিন ফি শারহিল উমদাহ: (৫/২০১)।]

সাত. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক আল্লাহ ভীরু, অধিক মুত্তাকী ও তাকওয়া সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

আট. এসব হাদীস থেকে বুঝা যায়, নারী যদি মাসিক ঋতু বা নিফাস থেকে ফজরের পূর্বে পবিত্র হয়, অতঃপর ফজর উদয় পর্যন্ত গোসল বিলম্ব করে, তার সাওম বিশুদ্ধ, ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বা যে কারণে গোসল বিলম্ব করুক, যেমন নাপাক ব্যক্তি। [দেখুন: আল-ইস্তেযকার: (১০/৪৮); শারহুন নববী: (৭/২২২); শারহু ইবনল মুলাক্কিন: (৫/২০০)।]

নয়. এসব হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, নিন্দা জানানো হয়েছে চরম পন্থা, বৈধ বস্তু ত্যাগ করা ও লৌকিকতাপূর্ণ প্রশ্নকে। [দেখুন: আত-তামহিদ: (১৭/৪২০); ফাতহুল বারি: (৪/১৪৯)।]

দশ. রমযান বা গায়রে রমযান সর্বদা ফজরের পর নাপাক, হায়েস ও নেফাস থেকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের সাওম বিশুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ওয়াজিব অথবা মানত অথবা কাযা অথবা নফল সাওমে কোনো পার্থক্য নেই।

এগার. কোনো বিষয়ে দ্বিধা বা বিরোধের সৃষ্টি হলে জ্ঞানীদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি, যেমন আবু হুরায়রা বলেছেন: “তারা বেশি জানে” অর্থাৎ আয়েশা ও উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎। কারণ, তারা পারিবারিক ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে অধিক জ্ঞাত।

বারো. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত বিরোধের সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও অকাট্য দলীল।

তের. ভুল হলে ভুল স্বীকার করা ও ইলমের ক্ষেত্রে আমানতদারী রক্ষা করা জরুরি, যেমন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ স্বীকার করেছেন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ করেন নি, বরং অন্য কারো থেকে শ্রবণ করেছেন।

৪২
৩৯. ই‘তিকাফের বিধান
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥﴾ [ البقرة : 125]

“আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্বদিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকেতাওয়াফকারী, ‘ই‘তিকাফকারী ও রুকূকারী -‎ সাজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১২৫]

অন্যত্র বলেন,

﴿وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ تِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَقۡرَبُوهَاۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ ءَايَٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ١٨٧﴾ [ البقرة : 187]

“আর তোমরা মাসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় ‎‎ স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭]

আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশক ই‘তিকাফ করতেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭১।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত রমযানের শেষ দশক ই‘তিকাফ করতেন, অতঃপর তার স্ত্রীগণ তার পরবর্তীতে ই‘তিকাফ করেছেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯২২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭২।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. ই‘তিকাফ পূর্বের উম্মতে বিদ্যমান ছিল।

দুই. ই‘তিকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ই‘তিকাফ মহান ইবাদত, বান্দা এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা ই‘তিকাফ করেছেন”।

ইমাম যুহরি রহ. বলেছেন: মুসলিমদের দেখে আশ্চর্য লাগে, তারা ই‘তিকাফ ত্যাগ করেছে, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাতে আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনো ই‘তিকাফ ত্যাগ করেন নি”। [শারহুল ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/১৮১)।]

আতা আল-খুরাসানি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আগে বলা হত: ই‘তিকাফকারীর উদাহরণ সে বান্দার মত, যে নিজেকে আল্লাহর সামনে পেশ করে বলছে: হে আল্লাহ যতক্ষণ না তুমি ক্ষমা কর, আমি তোমার দরবার ত্যাগ করব না, হে আমার রব, যতক্ষণ না তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমি তোমার দরবার ত্যাগ করব না”। [শারহুল ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/১৮২)।]

তিন. মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ শুদ্ধ নয়, পাঞ্জেগানা মসজিদে ই‘তিকাফ শুদ্ধ। জুমার জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ই‘তিকাফ ভাঙ্গবে না, যদিও জুমআর সালাতে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি মসজিদ থেকে বের হোক না কেন।

চার. যার ওপর জামা‘আতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব নয়, সে এমন মসজিদে ই‘তিকাফ করতে পারবে, যেখানে জামা‘আত হয় না, যেমন পরিত্যক্ত মসজিদ, বাজারের মসজিদ ও কৃষি জমির মসজিদ ইত্যাদি। [দেখুন: শারহুল মুমতি: (৬/৫০৯)।]

পাঁচ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশক ই‘তিকাফ করতেন, অনুরূপ তার স্ত্রীগণ ই‘তিকাফ করতেন। ই‘তিকাফের মূল উদ্দেশ্য লাইলাতুল কদর তালাশ করা।

ছয়. ই‘তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীগমন বৈধ নয়, ই‘তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীগমনের ফলে ই‘তিকাফ নষ্ট হবে, তবে তার ওপর কাফ্‌ফারা বা কাযা ওয়াজিব হবে না। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, “ই‘তিকাফকারী সহবাস করলে তার ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে, পুনরায় সে ই‘তিকাফ আরম্ভ করবে”। [ইবন আবি শায়বাহ: (২/৩৩৮), আলবানি ইরওয়াউল গালিলে হাদীসটি সহীহ বলেছেন, তিনি বলেছেন: হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক। ইরওয়াউল গালিল: (৪/১৪৮)।]

সাত. ই‘তিকাফকারী ভুলক্রমে সহবাস করলে তার ই‘তিকাফ ভঙ্গ হবে না, যেমন ভঙ্গ হবে না তার সিয়াম।

৪৩
৪০. একুশে রমযান লাইলাতুল কদর তালাশ করা
আবু সালামা ইবন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আলোচনা করলাম, অতঃপর আমি আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট যাই, তিনি আমার একান্ত বন্ধু ছিলেন। আমি তাকে বললাম: চলুন না খেজুর বাগানে যাই? তিনি বের হলেন, গায়ে উলের কালো চাদর। আমি তাকে বললাম: আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ,। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযানের মধ্য দশক ই‘তিকাফ করলাম। তিনি একুশের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে খুতবা দিলেন। তিনি বললেন:

إني أُرِيتُ لَيلَةَ القَدرِ، وإنِّي نَسِيتُها أو أُنْسِيتُها، فَالتَمِسُوهَا في العَشْرِ الأَوَاخِرِ من كُلِّ وِتْرٍ، وإنِّي أُرِيتُ أَنِّي أَسْجُدُ في ماءٍ وطِين فَمن كَانَ اعْتَكَفَ مع رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم فَليَرجِع .

“আমি লাইলাতুল কদর দেখেছি, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছি অথবা আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা তা শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর। আমাকে দেখানো হয়েছে আমি মাটি ও পানিতে সাজদাহ করছি, যে রাসূলের সাথে ই‘তিকাফ করেছিল সে যেন ফিরে আসে”। তিনি বলেন, আমরা ফিরে গেলাম, কিন্তু আসমানে কোনো মেঘ দেখি নি। তিনি বলেন, মেঘ আসল ও আমাদের উপর বর্ষিত হলো, মসজিদের ছাদ টপকে বৃষ্টির পানি পড়ল, যা ছিল খেজুর পাতার। সালাত কায়েম হলো, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম পানি ও মাটিতে সাজদাহ করছেন। তিনি বলেন, আমি তার কপালে পর্যন্ত মাটির দাগ দেখেছি”। [দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৭।]

আবু সায়িদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মধ্যম দশক ই‘তিকাফ করেছি, যখন বিশ রমযানের সকাল হলো আমরা আমাদের বিছানা-পত্র স্থানান্তর করলাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আসলেন, তিনি বললেন: যে ই‘তিকাফ করছিল সে যেন তার ই‘তিকাফে ফিরে যায়, কারণ, আমি আজ রাতে (লাইলাতুল কদর) দেখেছি, আমি দেখেছি আমি পানি ও মাটিতে সেজদা করছি। যখন তিনি তার ই‘তিকাফে ফিরে যান, বলেন, আসমান অশান্ত হলো, ফলে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হলো। সে সত্ত্বার কসম, যে তাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছে, সেদিন শেষে আসমান অশান্ত হয়েছিল, তখন মসজিদ ছিল চালাঘর ও মাচার তৈরি, আমি তার নাক ও নাকের ডগায় পানি ও মাটির আলামত দেখেছি”। [দেখুন: মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৭; আরো দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৩৫।]

অপর বর্ণনায় আছে, আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মধ্যম দশক ই‘তিকাফ করতেন, যখন তিনি প্রস্থানরত বিশের রাতে সন্ধ্যা করে একুশের রাতে পদার্পন করতেন, নিজ ঘরে ফিরে যেতেন। যে তার সাথে ই‘তিকাফ করত সেও ফিরে যেত। তিনি কোনো এক রমযান মাসে যে রাতে সাধারণত ই‘তিকাফ থেকে ফিরে যেতেন সে রাতে ফিরে না গিয়ে কিয়াম (অবস্থান) করলেন, অতঃপর খুতবা প্রদান করলেন, আল্লাহর যা ইচ্ছা ছিল তাই তিনি লোকদের নির্দেশ করলেন। অতঃপর বললেন:

«كُنْتُ أُجَاوِرُ هَذِهِ العَشْرَ، ثُمَّ قَدْ بَدَا لي أَنْ أُجَاوِرَ هَذِهِ العَشْرَ الأَوَاخِرَ، فَمَنْ كَانَ اعْتَكَفَ مَعِيَ فَلْيَثْبُتْ في مُعْتَكَفِهِ، وَقَدْ أُريتُ هَذَهَ الَّليْلَةَ ثُمَّ أُنْسيتُهَا فَابْتَغُوهَا في العَشْرِ الأَوَاخِرِ، وابْتَغُوهَا في كُلِّ وِتْرٍ، وَقَدْ رَأَيْتُني أَسْجُدُ في مَاءٍ وَطِينٍ»

“আমি এ দশক ই‘তিকাফ করতাম, অতঃপর আমার নিকট স্পষ্ট হলো যে আমি ই‘তিকাফ করব এ শেষ দশক। অতএব, যে আমার সাথে ই‘তিকাফ করেছে, সে যেন তার ই‘তিকাফে বহাল থাকে। আমাকে এ রাত দেখানো হয়েছিল, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তোমরা তা তালাশ কর শেষ দশকে। আর তা তালাশ কর প্রত্যেক বেজোড় রাতে। আমি দেখেছি, আমি পানি ও মাটিতে সাজদাহ করছি”। সে রাতে আসমান গর্জন করে সৃষ্টি বর্ষণ করল। একুশের রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের জায়গায় মসজিদ ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি ফেলল। আমার দু’চোখ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছে, আমি তার দিকে দৃষ্টি দিলাম, তিনি সকালের সালাত থেকে ফিরলেন, তখন তার চেহারা মাটি ও পানি ভর্তি ছিল”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১৪।]

শিক্ষা ও মাসায়েল [আত-তামহিদ: (২৩/৫১-৬৬), শারহুন নববী আলা মুসলিম (৮/৬১); ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার: (৪/২৫৭-২৫৯); উমদাতুল কারি: (১১/১৩৩); হাশিয়া সিনদি আলান নাসাঈ: (৩/৮০); আউনুল মাবুদ: (৪/১৮২); মিরকাতুল মাফাতিহ: (৪/৫১২-৫১৩)।]:‎

এক. ইলম অন্বেষণের জন্য সফর করা এবং উপযুক্ত স্থান ও সময়ে আলিমদের জিজ্ঞাসা করা।

দুই. শিক্ষকদের কর্তব্য ছাত্রদের সুযোগ দেওয়া, যেন তারা সুন্দরভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে।

তিন. মুসল্লির চেহারায় সেজদার সময় যে ধুলা-মাটি লাগে তা দূর করা উচিৎ নয়, তবে তা যদি কষ্টের কারণ হয়, সালাতের একাগ্রতা নষ্ট করে, তাহলে মুছতে সমস্যা নেই। [বুখারী হুমাইদি থেকে বর্ণনা করেন, মুসল্লির জন্য সুন্নত হচ্ছে সালাতে চেহারা না মুছা। ইমাম নববী বলেছেন: আলিমগণ অনুরূপ বলেছেন: সালাতে চেহারা না মোছা মুস্তাহাব। শারহু মুসলিম (৮/৬১), ইবন মুলাক্কিন বলেছেন: এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। শারহুল উমদাহ: (৫/৪২৩); দেখুন; ইকমালুল মুয়াল্লিম: (৪/১৪৮)।] মাটিতে সেজদা দেওয়া ও সালাত আদায় করা বৈধ। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪২৫)।]

চার. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ, তিনি মানুষের ন্যায় ভুলে যান, তবে আল্লাহ তাকে যা পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ব্যতীত। কারণ, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তাকে ভুল থেকে হিফাযত করেন। নবীদের স্বপ্ন সত্য, তারা যেভাবে দেখেন সেভাবে তা ঘটে।

পাঁচ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লাইলাতুল কদর দেখার অর্থ তিনি তা জেনেছেন অথবা তার আলামত দেখেছেন। আবু সায়িদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন: জিবরীল তাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, লাইলাতুল কদর শেষ দশকে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৮০; মুনতাকা লিল বাজি: (২/৮২)।]

ছয়. আলিম যদি কোনো বিষয় জানার পর ভুলে যায়, তাহলে সাথীদের বলে দেওয়া ও তা স্বীকার করা। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪২৪)।]

সাত. এ হাদীস প্রমাণ করে যে, রমযানে ই‘তিকাফ করা মোস্তাহাব। তবে প্রথম দশক থেকে মধ্যম দশক উত্তম, আবার মধ্যম দশক থেকে শেষ দশক উত্তম। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪২২)।]

আট. জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ইমামের খুতবা দেওয়া ও তাদের জরুরি বিষয় বর্ণনা করা বৈধ।

নয়. এ হাদীস প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে তাদের কল্যাণের বস্তু জানানোর জন্য উদগ্রীব ছিলেন। লাইলাতুল কদর তালাশে তিনি ও তার সাহাবীগণ সচেষ্ট থাকতেন।

দশ. রমযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করার ফযীলত, বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তা ত্যাগ করেন নি।

এগার. লাইলাতুল কদর শেষ দশকে, বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে, আরো বিশেষ একুশের রাত।

বারো. সাজদায় কপাল ও নাক স্থির রাখা ওয়াজিব, যেরূপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেখেছেন।

তের. এ হাদীস প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মুসলিমগণ দুনিয়ার সামান্য বস্তু ও সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তাদের মসজিদ ছিল খেজুর পাতার, যখন বৃষ্টি হত, সালাতে থাকাবস্থায় তাদের উপর বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ত।

চৌদ্দ. একুশে রমযানের ফযীলত, এটা সম্ভাব্য লাইলাতুল কদরের রা। অতএব, এ রাতে অবহেলা করা মুসলিমদের উচিৎ নয়।

৪৪
৪১. রমযানের শেষ দশকে রাত্রি জাগরণ
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন (রমযানের) শেষ দশক উপস্থিত হত, নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন ও পরিবারের সদস্যদের জাগিয়ে তুলতেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭৪।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকেএমন মুজাহাদা করতেন, যা তিনি অন্য সময় করতেন না। [মুসলিম, হাদীস নং ১১৭৫।]‎

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে নিজ পরিবারকেজাগ্রত করতেন। [তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯৫।] ‎ ‎

হাদীসটি ইমাম আহমদ রহ. এভাবে বর্ণনা করেন: “রমযানের শেষ দশক শুরু হলে নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবারে লোকদের জাগাতেন ও লুঙ্গি উঁচু করে নিতেন। আবুবকর ইবন আইইয়াশকে জিজ্ঞেস করা হলো, লুঙ্গি উঁচু করে পরার অর্থ কী? তিনি বললেন : স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ।‎ [আহমদ: (১/১৩২)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

‎এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের জন্য অধিক পরিশ্রম করতেন, অথচ আল্লাহ তার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন, তবে অন্যান্য রাতের তুলনায় রমযানের শেষ দশকের রাতসমূহে তার পরিশ্রম অধিক ছিল।

দুই. রমযানের শেষ দশকে স্ত্রী-সঙ্গ ত্যাগ করে সালাত, যিকির প্রভৃতি ইবাদতে আত্মনিয়োগকরে বিনিদ্র রাত কাটানো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম আদর্শ।

তিন. রমযানের শেষ দশকের রাতে পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে ইবাদতের জন্য জাগিয়ে তুলাসুন্নত। যদি রমযানে তাদের রাত জাগার অভ্যাস হয়, তাহলে যেন গল্প-গুজব ত্যাগ করে সালাত ওযিকির-আযকারে লিপ্ত থাকে।

চার. গৃহকর্তা স্ত্রী-সন্তানদের ওপর নফল ইবাদত আবশ্যক ও তার চাপ প্রয়োগ করতে পারেন, এ ক্ষেত্রে তার আনুগত্য তাদের ওপর ওয়াজিব। [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৫৯); আল-মুফহিম: (৩/২৪৯)।]

পাঁচ. রমযানের শেষ দশকের রাতে সালাত ও যিকরে মগ্ন থাকা মোস্তাহাব। কারণ, তা নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরআমল, উপরের হাদীস তার প্রমাণ। আর সারারাত জাগ্রত থাকার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তার অর্থ সারা বছর রাত জাগ্রত থাকা, তবে যেসবরাতে বিশেষ ফযীলত রয়েছে যেমন শেষ দশকের রাত, তা ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা থেকে ব্যতিক্রম। [শারহুন নববী আলা মুসলিম (৮/৭১); ফাতাওয়াল কুবরা লি ইবন তাইমিয়াহ: (২/৪৯৮); দিবায: (৩/২৬৪); আউনুল মাবুদ: (৪/১৭৬); আদদুরারিল মুদিয়াহ লিশ শাওকানি: (১/২৩৪)।]

ছয়. শেষ দশকের রাতগুলো জাগার উদ্দেশ্য লাইলাতুল কদর সন্ধান করা। আল্লাহরঅশেষ অনুগ্রহ যে তিনি লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন, যদি সারা বছর তার সম্ভাবনা থাকত, তাহলে তার অনুসন্ধানে অনেকের খুব কষ্ট হত, বরং অধিকাংশ লোক তার থেকে মাহরূম থাকত। [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৫৯)।]

৪৫
৪২. লাইলাতুল কদরের আলামত
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥﴾ [ القدر : 4-5]

“‎সে রাতে ফিরিশতারা ও রূহ (জিবরীল) তাদেররবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণকরে।‎ শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত”। [সূরা আল-কাদ্বর, আয়াত: ৪-৫]

যির ইবন হুবাইশ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি উবাই ইবন কা‘বকে বলতে শুনেছি: তাকে বলা হয়েছিল: আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন, যে ব্যক্তি সারা বছর রাত জাগ্রত থাকবে, সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে। উবাই বলেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, সন্দেহ নেই লাইলাতুল কদর রমযানে। তিনি নির্দিষ্টভাবে কসম করে বলেন, আল্লাহর শপথ আমি জানি তা কোনো রাত, এটা সে রাত, যার কিয়ামের নির্দেশ আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদান করেছেন, তা হচ্ছে সাতাশের সকালের রাত, তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না”। [সহীহ মুসলিম।]

ইবন হিব্বানের এক বর্ণনায় আছে: “তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না, যেন তার আলো মুছে দেওয়া হয়েছে। [মুসলিম, হাদীস নং ৭৬২; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৬৯০।]

ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ لَيْلَةَ القَدْرِ في النِّصْفِ مِنَ السَّبْع الأَوَاخِرِ من رَمَضَانَ تَطْلُعُ الشَّمْسُ غَدَاةَ إِذْ صَافِيَةً لَيْسِ لها شُعَاعٌ، قَالَ ابنُ مَسْعُودٍ : فَنَظَرْتُ إِلَيها فَوَجَدْتُها كَما قَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم» .

“নিশ্চয় লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমযানের শেষ সাতের মাঝখানে, সেদিন সকালে শুভ্রতা নিয়ে সূর্য উদিত হবে, তার মধ্যে কোনো কিরণ থাকবে না। ইবন মাসউদ বলেন, আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেরূপ দেখেছি, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন”। [আহমদ: (১/৪০৬); ইবন আবি শায়বাহ: (২/২৫০)। আহমদ শাকির হাদীসটি সহীহ বলেছেন: (৩৮৫৭)।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেছেন:

«إِنَّها لَيْلَةُ سَابِعَةٍ أَوْ تَاسِعَةٍ وعِشْرينَ، إِنَّ المَلائِكَةَ تِلْكَ الَّليلَةَ في الأَرْضِ أَكْثَرُ مِنْ عَدَدِ الحَصَى» .

“এটা হচ্ছে সাতাশ অথবা ঊনত্রিশের রাত, সে রাতে কঙ্করের চেয়ে অধিক সংখ্যায় ফিরিশতারা পৃথিবীতে অবস্থান করেন”। [আহমদ: (২/৫১৯); তায়ালিসি, হাদীস নং ২৫৪৫; সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২১৯৪; ইবন কাসির তার তাফসিরে বলেন, এর সনদে সমস্যা নেই: (৪/৫৩৫)। হায়সামি বলেছেন: এ হাদীসটি আহমদ, বায্‌যার ও তাবরানি আওসাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, এর বর্ণনাকারী সবাই নির্ভরযোগ্য: (৩/১৭৫-১৭৬)। সহীহ ইবন খুজাইমার টিকায় আলবানি হাদীসটি হাসান বলেছেন: (৩/৩৩২), আরো দেখুন: সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহা: (২২০৫)।]

উবাদা ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ أَمَارَةَ لَيْلَةِ القَدْرِ أَنَّها صَافِيَةٌ بَلْجَةٌ - أَيْ مُسْفِرَةٌ مُشْرِقَةٌ- كَأَنَّ فِيهَا قَمَراً سَاطِعاً، سَاكِنَةٌ سَاجِيَةٌ - أَيْ فيهَا سُكُونٌ- لا بَرْدَ فيهَا وَلا حَرَّ، وَلا يَحِلُّ لِكَوْكَبٍ أَنْ يُرْمَى به فيهَا حَتى يُصْبِحَ، وإِنَّ أَمَارَتَها أَنَّ الشَّمْسَ صَبيحَتَهَا تَخْرُجُ مُسْتَويَةً لَيسَ لها شُعَاعٌ مِثْلَ القَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ، لا يَحِلُّ لِلشَّيْطَانِ أَنْ يَخْرُجَ مَعَهَا يَوْمَئِذٍ» .

“নিশ্চয় লাইলাতুল কদরের আলামত, তা হবে সাদা ও উজ্জ্বল, যেন তাতে আলোকিত চাঁদ রয়েছে, সে রাত হবে স্থির, তাতে ঠাণ্ডা বা গরম থাকবে না, তাতে সকাল পর্যন্ত কোনো তারকা দ্বারা ঢিল ছোঁড়া হবে না। তার আরো আলামত, সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সমানভাবে, চৌদ্দ তারিখের চাঁদের ন্যায়, তার কোনো কিরণ থাকবে না, সেদিন শয়তানের পক্ষে এর সাথে বের হওয়া সম্ভব নয়”। [আহমদ: (৫/৩২৪); তাবরানি ফি মুসনাদিশ শামিয়্যিন: (১১১৯); দিয়া ফিল মুখতারাহ: (৩৪২); হায়সামি ফিয যাওয়ায়েদ: (৩/১৭৫)। এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।]

জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنِّي كُنْتُ أُريتُ لَيْلَةَ القَدْرِ ثُم نَسيتُهَا وَهِيَ في العَشْرِ الأَوَاخِرِ، وَهِيَ طَلْقَةٌ بَلْجَةٌ لا حَارَّةٌ ولا بَارِدَةٌ، كَأَنَّ فيهَا قَمَراً يَفْضَحُ كَوَاكِبَهَا لا يَخْرُجُ شَيْطَانُها حَتى يَخْرُجَ فَجْرُهَا» .

“আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর তা হচ্ছে শেষ দশকে। সে রাত হবে সাদা-উজ্জ্বল, না-গরম, না-ঠাণ্ডা, যেন আলোকিত চাঁদ নক্ষত্রগুলোকে আড়াল করে আছে, ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে রাতের শয়তান বের হতে পারে না”। [ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২১৯০; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৬৮৮। আলবানি অন্যান্য শাহেদের কারণে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেন,

«لَيْلَةٌ طَلْقَةٌ لا حَارَّةٌ ولا بَارِدَةٌ تُصْبِحَ الشَّمْسُ يَوْمَهَا حَمْرَاءُ ضَعِيفَة»

“লাইলাতুল কদর সাদা-উজ্জ্বল, না গরম না ঠাণ্ডা, সে দিন ভোরে সূর্য উদিত হবে দুর্বল রক্তিম আভা নিয়ে”। [ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২১৯২।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. আলিম যদি ভালো মনে করেন, তবে জানা ইলম গোপন করা বৈধ, যেমন ইবন মাসউদ লাইলাতুল কদর গোপন করেছেন, যেন মানুষেরা অলসতা না করে ও পুরো দশ রাতের কিয়াম থেকে বিরত না থাকে।

দুই. আলিমগণ মানুষের জরুরি বিষয়গুলো বর্ণনা করবেন, যেমন উবাই ইবন কা‘ব লাইলাতুল কদর বর্ণনা করেছেন।

তিন. মুসলিমদের স্বার্থ নিরূপণে আলিমদের ইজতিহাদ ও ইখতিলাফ বৈধ, এটা নিষিদ্ধ নয়, যদি সঠিক পদ্ধতি ও সত্য অন্বেষণের জন্য হয়।

চার. লাইলাতুল কদর শেষ দশকে, এতে অধিক সম্ভাব্য রাত হচ্ছে বেজোড় রাতগুলো, এতেও অধিক সম্ভাব্য রাত হচ্ছে সাতাশের রাত, যেমন উবাই ইবন কা‘ব কসম করে বলেছেন।

পাঁচ. লাইলাতুল কদরের অনেক আলামত রয়েছে:

(১) অধিক সংখ্যায় ফিরিশতা নাযিল হন। তাদের শুরুতে থাকে জিবরিল আলাইহিস সালাম, তারা মুসল্লিদের সাথে মসজিদের জমা‘আতে অংশ গ্রহণ করেন। তাদের সংখ্যা কঙ্করকে পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়, তবে এ আলামত মানুষের নিকট প্রকাশ পায় না।

(২) সে রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অধিক পরিমাণ সালাম বর্ষিত হয়, যেহেতু বান্দাগণ তাতে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে।

(৩) সে দিন সকালে সাদা ও উজ্জ্বলতাসহ সূর্য উদিত হয়, তার কিরণ থাকে না। ওলামায়ে কেরাম এর কারণ সম্পর্কে বলেন, ফিরিশতাগণ আসমানে চড়তে থাকেন, ফলে তাদের নূর ও পাখা সূর্যের কিরণের আড়াল হয়। [দেখুন: ইকমালুল মুয়াল্লিম: (৪/১৪৮); শারহুন নববী আলা মুসলিম, হাদীস নং ৮/৬৫); আল-মুফহিম: (২/৩৯১); দিবায: (৩/২৫৯); ফায়যুল কাদির: (৫/৩৯৬)।] কারণ, সে রাতে বহু ফিরিশতা অবতরণ করেন।

(৪) এ রাত সাদা-উজ্জ্বল ও স্থির, না-গরম, না-ঠাণ্ডা, এটা তুলনামূলক বিষয়, বিভিন্ন দেশের ভিত্তিতে ঠাণ্ডা-গরম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ লাইলাতুল কদর পূর্বাপর রাতের তুলনায় বেশি ঠাণ্ডা বা বেশি গরম হবে না।

(৫) শায়তান লাইলাতুল কদরের ভোরে সূর্যের সাথে বের হতে পারে না, লাইলাতুল কদর ব্যতীত সূর্য শয়তানের দুই শিঙের মধ্য দিয়ে উদিত হয়।

ছয়. লাইলাতুল কদরের অধিকাংশ আলামত লাইলাতুল কদর শেষে জানা যায়। এর উপকারিতা হচ্ছে: যারা লাইলাতুল কদর পেয়েছে, তারা আল্লাহর শোকর আদায় করবে, আর যারা পায় নি তারা অনুতপ্ত হবে ও আগামী বছরের জন্য প্রস্তুতি নিবে।

সাত. এসব আলামত প্রত্যেক বছর লাইলাতুল কদরে প্রকাশ পায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের সাথে খাস নয়। [আল-মুফহিম: (২/৩৯১)।]

আট. মুসলিমদের উচিৎ লাইলাতুল কদর তালাশ করা, যেহেতু তাতে অনেক কল্যাণ বিদ্যমান।

৪৬
৪৩. তেইশে রমযান লাইলাতুল কদর তালাশ করা
আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস জুহানি রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أُرِيتُ لَيْلَةَ القَدْرِ ثُم أُنْسيتُها وأَرَاني صُبْحَهَا أَسْجُدُ في مَاءٍ وطِينٍ، قَالَ : فَمُطِرنَا لَيْلَةَ ثَلاثٍ وعِشرينَ، فَصَلَّى بنا رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم فَانْصَرفَ وإِنَّ أَثَرَ الماءِ والطِّينِ عَلى جَبْهَتِهِ وَأَنْفِهِ، قَالَ : وَكَانَ عَبدُالله بنُ أَنيسٍ يَقُولُ : ثَلاثٍ وعِشرينَ»

“আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি দেখেছি আমি সে রাতের সকালে পানি ও মাটিতে সেজদা করছি। তিনি বলেন, আমাদের তেইশ তারিখের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাথে সালাত আদায় করে ঘুরে বসেন, তখন তার কপাল ও নাকের ওপর পানি ও মাটির আলামত ছিল। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস বলতেন: সেটা ছিল রমযানের তেইশ তারিখ”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৮; আহমদ: (৩/৪৯৫); আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৭৯।]

ইমাম মালেকের এক বর্ণনায় আছে, আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি খুব দূরের লোক, আমাকে একটি রাতের নির্দেশ দেন যেন আমি আসতে পারি। তিনি বললেন:

«انْزِل لَيْلَةَ ثَلاثٍ وعِشْرينَ مِنْ رَمَضَانَ» .

“তুমি রমযানের তেইশের রাতে আস”। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক: (১/৩২০)।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রমযানে ঘুমিয়ে ছিলাম, আমাকে নিয়ে আসা হলো, বলা হলো: আজ কদরের রাত। তিনি বলেন, আমি তন্দ্রাসহ দাঁড়িয়ে রাসূলের তাঁবুর রশি ধরে তার নিকট আগমন করলাম, তিনি সালাত আদায় করছিলেন। তিনি বলেন, আমি লক্ষ্য করলাম সে রাত ছিল তেইশের রাত”। [আহমদ: (১/২৫৫); ইবন আবি শায়বাহ: (২/২৫০); তাবরানি ফিল কাবির: (১১/২৯২), হাদীস নং ১১৭৭৭; হায়সামি মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৩/৭৬) গ্রন্থে বলেন: “আহমদের বর্ণনাকারীগণ সহীহ গ্রন্থের বর্ণনাকারী”।]

আবু হুযায়ফা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক সাহাবী থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেছেন: “আমি লাইলাতুল কদরের সকালে চাঁদের দিকে দেখলাম, আমি তা গামলার অর্ধেক টুকরার ন্যায় দেখলাম। আবু ইসহাক সাবিহী বলেন, তেইশের রাতে চাঁদ অনুরূপ হয়”। [আহমদ: (৫/৩৬৯); নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩৪১১, তার সনদ সহীহ। আহমদ এটা হুযায়ফা সূত্রে আলি থেকেও বর্ণনা করেছেন: (১/১০১); আহমদ শাকের তা হাসান বলেছেন: (৭৯৩)।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«تَذَاكَرْنا لَيْلَةَ القَدْرِ عِنْدَ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : أَيُّكُم يَذْكُرُ حِينَ طَلَعَ القَمَرُ وَهُوَ مِثْلُ شِقِّ جَفْنَة» .

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট লাইলাতুল কদরের আলোচনা করলাম, তিনি বললেন: ‘তোমাদের মধ্যে কে স্মরণ করতে পারে সে সময়ের কথা যখন চাঁদ উদিত হয় গামলার অর্ধেক টুকরার ন্যায়?” [মুসলিম, হাদীস নং ১১৭০।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাইলাতুল কদর ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, এর হিকমত হয়তো: মানুষ যেন অলস না হয় ও অন্য রাতে ইবাদত ত্যাগ না করে।

দুই. সাহাবীদগণ ইবাদত ও যিকির করার উদ্দেশ্যে ফযীলতপূর্ণ রাত অন্বেষণ করতেন ও তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন।

তিন. তেইশের রাত ফযীলতপূর্ণ, এ রাত লাইলাতুল কদরের একটি সম্ভাব্য রাত। অতএব, প্রত্যেক মুসলিমের উচিৎ এ রাতে জাগ্রত থাকা ও অধিক ইবাদত করা।

চার. তেইশের রাতে চাঁদ বড় গামলার (অর্ধেকের) ন্যায় হয়, এসব হাদীস দ্বারা বুঝা যায় উল্লিখিত রাত সে বছর লাইলাতুল কদর ছিল।

৪৭
৪৪. লাইলাতুল কদরের ফযীলত
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ٤﴾ [ القدر : 3-4]

“নিশ্চয় আমরা এটি নাযিল করেছি বরকতময়রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। ‎ ‎ সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তঅনুমোদিত হয়”। [সূরা আল-কাদ্বর, আয়াত: ৩-৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥﴾ [ القدر : 1-5]

“নিশ্চয় আমরা এটি নাযিল করেছি ‘লাইলাতুলকদরে।তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।সে রাতে ফিরিশতারা ও রূহ (জিবরীল) তাদেররবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণকরে।‎ শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত”। [সূরা আল-কাদ্বর, আয়াত: ১-৫]‎

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ القَدْرِ إيمَاناً واحتِسَاباً غُفِرَ لهُ مَا تَقدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ» .

“লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে কিয়াম করবে, তার পূর্বের সকল পাপ মোচন করা হবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬০।]

হাদীসটি অন্য শব্দে এভাবে বর্ণিত আছে:

«مَنْ قَامَ لَيْلةَ القَدرِ إيماناً واحتِسَاباً غُفِرَ له مَا تَقَدَّمَ من ذَنبِهِ»

“লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় কিয়াম করবে, তার পূর্বের সকল পাপ মোচন করা হবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬০।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলেছেন:

«إنَّهَا لَيْلَةُ سَابعةٍ أو تَاسِعَةٍ وعِشْرِينَ إِنَّ الملائِكَةَ تِلْكَ اللَّيلةَ في الأرْضِ أَكْثَرُ مِنْ عَدَدِ الحَصَى» .

“লাইলাতুল কদর সাতাশ অথবা ঊনত্রিশের রাত, সে রাতে পৃথিবীতে ফিরিশতাদের সংখ্যা কঙ্করের চেয়ে অধিক হয়”। [আহমদ: (২/৫১৯); তায়ালিসি, হাদীস নং ২৫৪৫। ইবন খুযাইমাহ হাদীসটি সহীহ বলেছেন: (২১৯৪)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. লাইলাতুল কদরের ফযীলতের কয়েকটি দিক:

১. এ রাত আল্লাহর নিকট খুব মর্যাদাপূর্ণ।

২. এ রাত এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, যেখানে লাইলাতুল কদর নেই, যা প্রায় তিরাশি বছর চার মাসের সমপরিমাণ।

৩. এ রাতে অগণিত ফিরিশতাদের অবতরণ হয়, যাদের সংখ্যা কঙ্করের চেয়ে বেশি।

৪. এ রাতে কুরআনুল কারীম নাযিল করা হয়েছে।

৫. এ রাতে অধিক পরিমাণ আযাব থেকে নিরাপত্তা নাযিল হয়। কারণ, এতে বান্দাগণ অধিক পরিমাণ ইবাদত করে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ দান করেন।

৬. এ রাত বরকতময়। কারণ, এ রাতের ফযীলত অনেক।

৭. এ রাতে যে বিশ্বাস, আল্লাহর ওয়াদার ওপর আস্থা ও সাওয়াবের আশায় কিয়াম করবে, তার পূর্বের পাপ মোচন করা হবে।

৮. এ রাতে পূর্ণ বছরের তাকদীর লেখা হয়।

৯. এ রাতে যে কিয়াম করল ও জাগ্রত থাকল, সে অবশ্যই আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের উপযুক্ত হলো।

দুই. মুসলিমদের উচিৎ লাইলাতুল কদর তালাশ করা। এ জন্য শেষ দশকে কিয়াম, সালাত, দো‘আ ও যিকরে অধিক মশগুল থাকা। মাহরুম ও বঞ্চিত ব্যতীত কেউ ফযীলতপূর্ণ এ রাত থেকে গাফিল থাকে না। আল্লাহর নিকট দো‘আ করছি, তিনি আমাদেরকে এ ফযীলত অর্জনের তাওফীক দান করুন।

তিন. লাইলাতুল কদরের বরকতের অর্থ তাতে সম্পাদিত আমলের বরকত, কারণ, এ রাতে যে যত্নসহ আমল করবে, তার আমল হাজার মাসের আমলের চেয়ে উত্তম। এটা আল্লাহর মহান অনুগ্রহ।

চার. এ উম্মতের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে প্রতি বছর এ রাত দান করেন।

পাঁচ. লাইলাতুল কদর অন্য সকল রাত থেকে উত্তম, জুমু‘আর রাত লাইলাতুল কদর থেকে উত্তম এ কথা শুদ্ধ নয়। হ্যাঁ যদি জুমু‘আর রাতে লাইলাতুল কদর হয়, তাহলে তার ফযীলত বৃদ্ধি হয় সন্দেহ নেই।

ছয়. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে ইসরা ও মেরাজের রাত লাইলাতুল কদর থেকে উত্তম। কারণ, এ রাতে তাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এ রাতে তার সাথে তার রব কথা বলেছেন। এটা তার জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান ও মহান মর্যাদা। তবে অন্যান্য মুসলিমের বিবেচনায় ইসরা ও মি‘রাজের রাতের তুলনায় লাইলাতুল কদর মহান ও অধিক মর্যাদাশীল। [মাজমু ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়াহ: (২৫/২৮৬)।]

সাত. কতক আলিম উল্লেখ করেছেন লাইলাতুল কদর এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য, কতক দুর্বল হাদীসে এ রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এর বিপরীতে কতক হাদীসে এসেছে আমাদের পূর্বের উম্মত বা তাদের নবীদের মধ্যেও লাইলাতুল কদর ছিল, তবে এসব হাদীস দুর্বল। [আমাদের পূর্বে লাইলাতুল কদর ছিল যেসব হাদীসে এসেছে, তার মধ্যে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু‎র হাদীস অন্যতম, তাতে এসেছে: «قلت : تكون مع الأنبياء ما كانوا فإذا قبضوا رفعت أم هي إلى يوم القيامة؟ قال : بل إلى يوم القيامة» “আমি বললাম: লাইলাতুল কদর কি নবীদের যুগ পর্যন্ত থাকে, অতঃপর তা উঠিয়ে নেয়া হয়, না কিয়ামত পর্যন্ত থাকে? তিনি বললেন: বরং কিয়ামত পর্যন্ত থাকে”। আহমদ: (৫/১৭১; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩৪২৭; হাকেম: (১/৩০৭), তিনি মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হাকিম হাদীসটি সহীহ বলেছেন, ইমাম যাহাবি তার সমর্থন করেছেন। কিন্তু আলবানি ইবন খুজাইমার টিকায় তা দুর্বল বলেছেন: (২১৭০), তিনি উল্লেখ করেছেন এর সনদে মুরসিদ যামানি রয়েছে, সে মাজহুল। উকাইলি বলেছেন: তার হাদীসের কোন ‘মুতাবে’ পাওয়া যায় না।আর যেসব হাদীসে এসেছে যে, লাইলাতুল কদর এ উম্মতের সাথে খাস, যেমন ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন: «أن النبي أُريَ أعمار الناس قبله أو ما شاء الله من ذلك فكأنه تقاصر أعمار أمته ألا يبلغوا من العمل مثل الذي بلغ غيرهم في طول العمر فأعطاه الله ليلة القدر خيراً من ألف شهر» “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার পূর্বের লোকের বয়স দেখানো হয়েছে, অথবা আল্লাহ যা ইচ্ছা তাকে দেখিয়েছেন, অতঃপর তিনি নিজের উম্মতের বয়স তুচ্ছ জ্ঞান করেন যে, তারা তাদের পূর্বের উম্মতের আমলের বরাবর হতে পারবে না, ফলে আল্লাহ তাকে লাইলাতুল কদর দান করেন, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম”। মালেক ফিল মুয়াত্তা: (১/৩২১), হাফেয ইবন আব্দুর বারর বলেছেন: “আমি জানি না, এ হাদীস কেউ মুসনাদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কি-না, আমাদের জানা মতে মুয়াত্তা ব্যতীত কেউ এ হাদীস মুরসাল বা মুসানদে বর্ণনা করেন নি”। তামহিদ: (২৪/৩৭৩)।আনাস থেকে বর্ণিত হাদীস: «إن الله عز وجل وهب لأمتي ليلة القدر ولم يعطها من كان قبلكم» “নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতকে লাইলাতুল কদর দান করেছেন, যা পূর্বের কোনো উম্মতকে দান করা হয় নি”। দায়লামি, হাদীস নং ৬৪৭; দায়িফুল জামে, হাদীস নং (১৬৬৯) গ্রন্থে রয়েছে এ হাদীসটি মওজু ও বানোয়াট। ইমাম নববী লাইলাতুল কদরের বৈশিষ্ট গণনায় বলেন: “লাইলাতুল কদর এ উম্মতের সাথে খাস, আল্লাহ এ রাতের সম্মান বৃদ্ধি করুন, এ উম্মতের পূর্বে কোনো উম্মতে লাইলাতুল ছিল না... এটা বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ, আমাদের সাথী ও জমহুর আলিমদের এটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত”। মাজমু: (৬/৪৫৭-৪৫৮)]

আট. মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে:

«مَنْ يَقُمْ لَيْلَةَ القَدْرِ فَيُوَافقُها إيمَاناً واحتِسَاباً غُفِرَ لهُ»

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর জেনে ঈমান ও সওয়াবের আশায় কিয়াম করবে, তার পাপ মোচন করা হবে”। এ হাদীস তাদের দলীল, যারা বলে: লাইলাতুল কদর তার জন্যই হবে, যে জানে যে আজ লাইলাতুল কদর। কিন্তু হাদীসের বাহ্যিক শব্দ তা প্রমাণ করে না, বরং হাদীসের অর্থ হচ্ছে, যে লাইলাতুল কদরে কিয়াম করে লাইলাতুল কদরে কিয়াম করার নিয়তে, আর বাস্তবিক তা লাইলাতুল কদর হয় কিন্তু সে তা নিশ্চিত জানে না সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে”। [দেখুন: তারহুত তাসরিব: (৪/১৬৪); যখিরাতুল উকবা: (২১/৫১-৫২)।উল্লেখ্য: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত: “যে ব্যক্তি এশার সালাত জামাতে পড়ল সে লাইলাতুল কদর লাভ করল”। ইবন খুযাইমাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, আলবানি তার টিকায় তা দুর্বল বলেছেন: (৩/৩৩৩), খতিবে বাগদাদি: (৫/৩৩২) এ হাদীসটি আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন, যা বানোয়াট। দেখুন: যাওয়ায়েদে তারিখে বাগদাদ আলাল কুতুবিস সিত্তাহ লিশ শাইখ খালদুন আল-আহদাব: (৪/৫৯৪), হাদীস নং ৭৯২, মুয়াত্তায় সায়িদ ইবন মুসাইয়্যেব এর মুরসাল হাদীস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: (১/৩২১)।] অতএব, মুসলিমদের উচিৎ রমযানের শেষ দশকের প্রত্যেক রাতকে লাইলাতুল কদর জ্ঞান করে কিয়াম করা।, কারণ, সে রাত লাইলাতুল কদর হতে পারে, আর বাস্তবিক পক্ষে যদি সে রাত লাইলাতুল কদর হয়, তাহলে সে জেনে তাতে কিয়াম করল।

৪৮
৪৫. শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করা
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবীকে শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

«أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ في السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِيْها فَلْيَتَحَرَاها في السَّبْع الأَوَاخِر» .

“আমি দেখছি তোমাদের সবার স্বপ্ন শেষ সাতের ব্যাপারে অভিন্ন, অতএব যে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে চায়, সে যেন তা শেষ সাতে তালাশ করে”। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম।]

অপর বর্ণনায় আছে:

«التَمِسُوهَا في العَشْرِ الأَوَاخِر، فَإِنْ ضَعُفَ أَحَدُكُمْ أَوْ عَجَزَ فَلا يُغْلَبَنَّ على السَّبْع البَواقِي» .

“তোমরা শেষ দশে লাইলাতুল কদর তালাশ কর, যদি তোমাদের কেউ দুর্বল হয় অথবা অপারগ হয়, তবে শেষ সাতে যেন তা অন্বেষণ করা ত্যাগ না করে”। অপর বর্ণনায় আছে:

«تَحَرُّوا لَيْلَةَ القَدْرِ في السَّبْعِ الأَوَاخِر» .

“তোমরা লাইলাতুল কদর শেষ সাতে তালাশ কর”। [দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৫। শেষের দুইটি বর্ণনা মুসলিমের।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. এ উম্মতের সম্মিলিত বর্ণনা, সিদ্ধান্ত ও স্বপ্ন নির্ভুল। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে তাদের অভিন্ন স্বপ্নকে গ্রহণ করেছেন। [দেখুন: ইলামুল মুয়াক্কিয়িন: (১/৮৪); আর-রূহ: (১৩৬); ফাতহুল কাদির: (১২/৩৮০)।]

দুই. লাইলাতুল কদর তালাশ করা ও তাতে রাত জাগা জরুরি। কারণ, তাতে রয়েছে ফযীলত, বরকত ও কল্যাণ, তবে এটা ওয়াজিব নয়, সুন্নাত। [দেখুন: আল-ইস্তেযকার: (৩/৪১৬)।]

তিন. এ হাদীস স্বপ্নের গুরুত্ব প্রমাণ করে, সম্ভাব্য ঘটমান বিষয়ে তার ওপর নির্ভর করা বৈধ, যদি শরী‘আতের নির্দেশের বিপরীত না হয়। [দেখুন: ফাতহুল বারি: (৪/২৫৭); শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪১১)।] তবে স্বপ্নের ওপর অধিক নির্ভর করা ঠিক নয়, যা মূল উদ্দেশ্যে বিচ্যুত ঘটার কারণ, হয়।

চার. স্বপ্ন কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, কখনো হয় মনের ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত, আবার কখনো হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। কোনো বিষয়ে যদি মুমিনদের স্বপ্ন অভিন্ন হয়, তাহলে সেটা সত্য, যেমন তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ও বর্ণনা সত্য। কারণ, একজনের বর্ণনা অথবা সিদ্ধান্তে অসৎ উদ্দেশ্য গোপন থাকতে পারে, কিন্তু এ ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত হতে পারে না। [দেখুন: মিনহাজুজ সুন্নাহ নববীয়াহ: (৩/৫০০); মাদারেজুস সালেকিন: (১/৫১)।]

পাঁচ. এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অধিকাংশের কথার ওপর আমল করা যায়, যদি কুরআন-হাদীস, ইজমা ও স্পষ্ট কিয়াসের বিরোধী না হয়। [দেখুন: শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪১৪)।]

ছয়. সাহাবীদের স্বপ্ন এ ক্ষেত্রে অভিন্ন যে, রমযানের শেষ সাতে লাইলাতুল কদর বিদ্যমান, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বছর তাদেরকে শেষ সাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, এ রাতগুলো অধিক সম্ভাবনাময়। [ইবন বাত্তাল রহ. তার বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থে ইবন উমারের হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: “লাইলাতুল কদর শেষ সাতে তালাশ কর”। এর অর্থ: এটা সে বছরের ঘটনা, যে বছর তাদের স্বপ্ন পরস্পর অভিন্ন ছিল, অর্থাৎ তেইশের রাত। কারণ, তিনি আবু সায়িদের হাদীসে বলেছেন: “তোমরা লাইলাতুল কদর শেষ দশের বেজোড় রাতে তালাশ কর, আমি দেখছি আমি মাটি ও পানিতে সাজদাহ করছি। (আবু সাঈদ বলেন:) আমাদের উপর একুশের রাতে বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল। এ হিসেবে দেখা যায় আবু সাঈদের হাদীসে লাইলাতুল কদর শেষ সাতে ছিল না। ইমাম তাহাভি বলেন: এ ব্যাখ্যা হিসেবে হাদীসের মধ্যে কোনো বৈপরিত্ব থাকে না”।]

সাত. লাইলাতুল কদর কতককে স্বপ্নে অথবা জাগ্রত অবস্থায় দেখানো হয়, সে তার আলামত দেখতে পায় অথবা স্বপ্নে কাউকে দেখে, যে তাকে বলে: এটা লাইলাতুল কদর। কখনো আল্লাহ তার বান্দার অন্তরে এমন নিদর্শন প্রকাশ করেন, যার দ্বারা সে লাইলাতুল কদর স্পষ্ট বুঝতে পারে। [দেখুন: মজমুউল ফাতাওয়া: (২৫/২৮৬)।]

৪৯
৪৬. নারীদের ই‘তিকাফ
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করার কথা বলেন, আয়েশা তার কাছে অনুমতি চান। তিনি তাকেঅনুমতি প্রদান করেন। হাফসা আয়েশার কাছে তার জন্য অনুমতি নেওয়ার অনুরোধ করেন, তিনি তাই করেন। এ দেখে যয়নব বিনতে জাহাশ তাঁবু তৈরির নির্দেশ দেন, তার জন্য তাঁবু তৈরি করা হলো। আয়েশা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষে তার তাঁবুতে যান, তিনি সেখানে অনেক তাঁবু দেখতে পান। জিজ্ঞেস করেন, এগুলো কী? তারা বলল: আয়েশা, হাফসা ওযয়নবের তাঁবু। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “এর দ্বারাই কি তোমরা নেকির আশা করেছ?! আমি ই‘তিকাফই করব না”। তিনি ফিরে যান। অতঃপর রমযান শেষে শাওয়ালের দশ দিনই‘তিকাফ করেন”। [সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।]

মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ই‘তিকাফ করারইচ্ছা করতেন, ফজর সালাত আদায় করে ই‘তিকাফের স্থানে প্রবেশ করতেন। একদাতিনি মসজিদে তার জন্য তাঁবু টানাতে আদেশ করলেন, তাঁবু টানানো হলো, তিনিরমযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করার ইচ্ছা করে ছিলেন। যয়নব তার জন্য তাঁবু টানাতে নির্দেশ করলেন, টানানো হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীগণ তাঁবু টানাতে নির্দেশ করলেন, তাদের জন্য তাঁবু টানানো হলো। তিনি যখন ফজর সালাত আদায় করলেন, দেখলেন অনেকগুলো তাঁবু। তিনি বললেন: তোমরা কি নেকির আশা করেছ? তিনি তার তাঁবু খুলে ফেলার নির্দেশ ‎‎ দেন ও রমযানের ই‘তিকাফ ত্যাগ করেন, অতঃপর শাওয়ালের প্রথম দশে ই‘তিকাফ করেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭২।]‎

‎শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. মহিলাদের মসজিদে ই‘তিকাফ করা বৈধ, যদি ফিতনার আশঙ্কা না থাকে। [শারহুন নববী: (৮/৭০); আল-মুফহিম: (৩/২৪৮), শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪২৯); ইবন আব্দিল বার আসরাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি শুনেছি আহমদ ইবন হাম্বলকে ইতিকাফকারী নারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে? তিনি বলেন: হ্যাঁ, নারীরা ইতিকাফ করেছে”। দেখুন: আত-তামহিদ: (১/১৯৫)।]

দুই. নারী তার স্বামীর অনুমিত ব্যতীত ই‘তিকাফ করবে না, এতে কারো ইখতিলাফ নেই। [ইবনল মুলাক্কিন শারহুল উমদাহ গ্রন্থে এ ইজমা নকল করেছেন: (৫/৪২৯)।] যদি সে স্বামীরঅনুমতি ব্যতীত ই‘তিকাফ করে, তাহলে স্বামীর অধিকার রয়েছে তার ই‘তিকাফ ভঙ্গ করানো। ই‘তিকাফের অনুমতি দেওয়ার পর স্বামী যদি কোনো কারণে তার ই‘তিকাফ ভাঙ্গতে চায়, তাহলে তার অধিকার রয়েছে। [শারহুন নববী: (৮/৭০); আল-মুফহিম: (৩/২৪৫); ফাতহুল বারি: (৪/২৭৭)।]

তিন. ই‘তিকাফ আরম্ভ করে প্রয়োজন হলে তা ভঙ্গ করা বৈধ। [ইবন বায রহ. বলেছেন: “বিশুদ্ধ মতে ইতিকাফ আরম্ভ করলে ওয়াজিব হয় না এবং জুমার কারণে তা ভঙ্গ হয় না”।]‎

চার. মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ শুদ্ধ নয়, যদি অন্য কোথাও ই‘তিকাফ বৈধ হত, তাহলে নারীর জন্য বৈধ হত তার সালাতের জায়গায় ই‘তিকাফ করা। [শারহুন নববী: (৮/৬৮); ফাতহুল বারি: (৪/২৭৭)।]

পাঁচ. স্বামীর জন্য নিজ স্ত্রী ও পরিবারকে আদব শিক্ষা দেওয়া, তাদের সংশোধন করা জায়েয। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদেরই‘তিকাফের অনুমতি দেন, অতঃপর তাদের মধ্যে অনাকাঙ্খিত ঈর্ষার আশংকায় তাদেরকে তা থেকে বারণ করেন। [শারহুন নববী: (৮/৬৯); আল-মুফহিম: (৩/২৪৫); মিনহাতুল বারি: (৪/৪৬৪); হাশিয়াতুস সিনদি আলান নাসাঈ: (২/৪৫)।]

ছয়. নফল ছুটে গেলে তা কাযা করা বৈধ। [মিনহাতুল বারি: (৪/২৭৭)।]‎

সাত. অতিরিক্ত ঈর্ষা খারাপ। কারণ, তা হিংসার ফল, যা নিন্দনীয়।

আট. ভালো কাজ ত্যাগ করা বৈধ, যদি তাতে কল্যাণ থাকে। [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৮২); ফাতহুল বারি: (৪/২৭৭)।]‎

নয়. শুধু নিয়তের কারণে ই‘তিকাফ ওয়াজিব হয় না। [ইমাম নববী শারহে মুসলিমে এ ব্যাপারে ঐক্যমত নকল করেছেন: (৮/৬৮)।]

দশ. ই‘তিকাফকারী ই‘তিকাফের জন্য মসজিদের একটা অংশ নিজের জন্য খাস করে নিতে পারবে, যদি তাতে মুসল্লিদের সমস্যা না হয়। জায়গাটিনির্ধারণ করা চাই মসজিদের খালি অংশে বা শেষ প্রান্তে, যেন অন্যদের কষ্ট না হয় এবং তার নির্জনতা ও একাকীত্ব অর্জন হয়। [শারহুন নববী: (৮/৬৯)।]

‎এগার. স্ত্রীদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্দর আখলাক ও তাদের সঙ্গেচমৎকার হৃদ্যতা। যেমন, তাদেরকে তিনি ই‘তিকাফ থেকে বারণ করে, নিজেও তা ত্যাগ করেন, অথচ তিনি নিজে ই‘তিকাফ করতে পারতেন, কিন্তু আন্ত‎রিকতা, সহমর্মিতা ও তাদের আনন্দে শেয়ার করার জন্য তা করেন নি। [এটা ইমাম কুরতুবি উল্লেখ করেছেন, অতঃপর তিনি বলেছেন: “অথবা তার ইতিকাফে বহাল থাকলে এ আশঙ্কার জন্ম হত যে, ইতিকাফ শুধু তার জন্য খাস, নারীদের জন্য নয়”। আল-মুফহিম: (৩/২৪৬), ইবন বাত্তাল রহ. বলেছেন: “তিনি তাদের অন্তরকে খুশি করার জন্য ইতিকাফ পিছিয়ে দেন, যেন এমন না হয় তিনি ইতিকাফ করবেন, আর তারা ইতিাকাফ করবে না”। শারহুল সহীহ বুখারী (৪/১৬৯), শাইখ যাকারিয়া আনসারি উল্লেখ করেছেন, তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করার জন্য ইতিকাফ ত্যাগ করেছেন, অথবা মসজিদ সংকীর্ণ হয়ে যাবে আশঙ্কায়। দেখুন: মিনহাতুল বারি: (৪/৪৪)।] অনুরূপ প্রত্যেক মুসলিমের উচিৎ স্ত্রীদের আদব শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন না করা, যা প্রতিশোধ ও জেদ দমনের পর্যায় পড়ে।

‎বারো. যদি ই‘তিকাফকারী নারীর ঋতুস্রাব হয়, তাহলে ঋতুস্রাব তার ই‘তিকাফ ভেঙ্গে দিবে, সে মসজিদ ত্যাগ করবে, অতঃপর পবিত্র হয়ে পূর্বের ই‘তিকাফ শুরু করবে। [এটা জমহুরের অভিমত। যেমন, যুহরি, রাবিয়াহ, মালেক, আওযায়ি, আবু হানিফা ও শাফি, ইবন বাত্তাল তাদের থেকে এ বাণী নকল করেছেন: (৪/১৭৪); ইমাম আহমদ অনুরূপ বলেছেন: (৪/৪৮৭)।]

‎তের. যদি কেউ নফল ইবাদতের নিয়ত করে, কিন্তু এখনো তা শুরু করেনি, তাহলে সে তা একেবারে ত্যাগ করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে পরবর্তীতে আদায় করা বৈধ। [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৮৩)।]

‎চৌদ্দ. যার মধ্যে কোনো ইবাদতের রিয়া নিশ্চিত জানা যায়, তাকে সে ইবাদত থেকে নিষেধ করা বৈধ। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন: “তোমরা কি নেকি ইচ্ছা করেছ”। অর্থাৎ তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য ও তাকে পাওয়ার আশা করেছ। এ জন্য তাদের ই‘তিকাফ নিষেধ করেন ও নিজের ই‘তিকাফ পিছিয়ে দেন।‎ [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৮৩)।]

‎পনের. ই‘তিকাফে স্ত্রী, লোকজন ও অন্যদের থেকে নির্জনতা অবলম্বন করা মোস্তাহাব, তবে যখন প্রয়োজন হয় তা ব্যতীত যেমন সালাত, খানা ইত্যাদি। [শারহু ইবনুল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৩৫)।]

‎ষোল. রমযানে ইতিফাক করা সুন্নাত, এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ, এ হাদীস থেকে বুঝা যায় গায়রে রমযানে ই‘তিকাফ করা বৈধ, যেহেতু নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাওয়ালে ই‘তিকাফ করেছেন। [দেখুন: ফিকহুল ইবাদাত লি ইবন উসাইমিন: (২০৮)।]

‎সতের. মসজিদের ভেতরের রুমে ই‘তিকাফ করা বৈধ, যার দরজা মসজিদের দিকে খোলা, তার হুকুম মসজিদের হুকুম, আর যদি মসজিদের বাইরে হয়, তাহলে সেটা মসজিদের অংশ নয়, যদিও তার দরজা মসজিদের দিকে। [ফাতাওয়াল লাজনাহ: (৬৭১৮)।]‎

৫০
৪৭. বেজোড় রাতসমূহে লাইলাতুল কদর তালাশ করা
উবাদাহ ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«خَرَجَ النَّبيُّ صلى الله عليه وسلم لِيُخْبرَنا بلَيْلَةِ القَدْرِ فَتَلاحَى رَجُلانِ من المُسلِمِين، فقَالَ : خَرجْتُ لأُخْبِرَكُم بلَيْلَةِ القَدْرِ فَتلاحَى فُلانٌ وفُلان، فَرُفِعَتْ، وعَسَى أَنْ يَكُونَ خَيرَاً لَكُم، فَالتَمِسُوها في التَّاسِعَةِ والسَّابِعةِ والخَامِسَة» .

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সংবাদ দেওয়ার জন্য বের হয়েছেন, অতঃপর দু’জন মুসলিম ঝগড়ায় লিপ্ত হলো। তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সংবাদ দেওয়ার জন্য বের হয়েছি, কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়া করল, ফলে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়। খুব সম্ভব এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমরা তা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তালাশ কর”। [দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১৯; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩৩৯৪; আহমদ: (৫/৩১৩)।]

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«اعْتَكَفَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم العَشرَ الأَوسَطَ من رَمَضَانَ يَلتَمِسُ لَيْلَةَ القَدْرِ قَبلَ أَنْ تُبَانَ لَه، فلَمَّا انْقَضَينَ أَمَرَ بالبِنَاءِ فقُوِّض، ثم أُبِينَت له أنَّها في الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ، فأَمَر بالبِنَاءِ فأُعِيدَ، ثمَّ خَرَجَ على النَّاسِ فقال : يا أيُّها النَّاس : إنَّها كَانَت أُبِينَت لي لَيْلَةُ القَدْرِ، وإنِّي خَرَجْتُ لأُخبِرَكُم بها، فَجَاءَ رَجُلانِ يَحْتَقَّانِ أي : يَخْتَصِمان- مَعَهُما الشَّيطَانُ، فَنُسِّيتُها فَالتَمِسُوها في الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ من رمَضَان، فالتَمِسُوها في التَّاسِعَةِ والسَّابِعَةِ والخَامِسَة»

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদর অন্বেষণে রমযানের মধ্যম দশক ই‘তিকাফ করেন, যখন তা প্রকাশ করা হয়নি। যখন ই‘তিকাফ শেষ হয়, তিনি তাঁবু গুটানোর নির্দেশ দেন, অতঃপর তাকে বলা হয় নিশ্চয় তা শেষ দশকে, ফলে পুনরায় তিনি তাঁবু টানাতে নিদেশ দেন, পুনরায় তাঁবু টানানো হয়। অতঃপর তিনি মানুষের নিকট এসে বলেন, হে লোক সকল: আমাকে লাইলাতুল কদর বলা হয়েছিল, আমি তোমাদেরকে তার সংবাদ দিতে বের হয়েছি, ইত্যবসরে দু’জন ব্যক্তি ঝগড়া নিয়ে উপস্থিত হয়, তাদের সাথে ছিল শয়তান, ফলে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তোমরা তা রমযানের শেষ দশকে তালাশ কর। তোমরা তা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তালাশ কর। [দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৭।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. বিভেদ ও ইখতিলাফ নিষেধ। দু’জন মুসলিমের অন্যায় ঝগড়া কখনো তাদের ও অন্যদের ওপর অনিষ্ট ডেকে আনে। কল্যাণ ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যেমন এখানে লাইলাতুল কদর একরাত থেকে অপর রাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। [ইকমালুল মুয়াল্লিম: (৪/১৪৮)।] ঝগড়ার কারণে তাদের মাগফেরাত মওকুফ করা হয় এবং তাদের আমল বিবেচনাধীন রাখা হয়, যতক্ষণ না তারা আপোষ করে। [দেখুন: আল-ইস্তেযকার: (৩/৪১২)।]

দুই. এ হাদীস প্রমাণ করে, বিশেষ ব্যক্তিদের অপরাধের কারণে কখনো সাধারণ লোক তার খেসারত দেয়। [দেখুন: ইকমালুল মুয়াল্লিম: (৪/১৪৬)।]

তিন. লাইলাতুল কদর বিদ্যমান, এতে কারো দ্বিমত নেই, তবে তার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। [শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৫৭), ইবন মুলাক্কিন ফি শারহিল উমদাতে বলেন: “নির্ভরযোগ্য সকল আলিম একমত যে, লাইলাতুল সর্বদা বিদ্যমান আছে এবং পৃথিবীর শেষ বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে”। আত-তামহিদ: (২/২০০)।]

চার. লাইলাতুল কদর অনির্দিষ্ট করণে একটি কল্যাণ হচ্ছে শেষ দশকের ইবাদত। [মিনহাতুল বারি: (৪/৪৫৫); শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৫৮)।]

পাঁচ. লাইলাতুল কদরের সম্ভাব্য তারিখ শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলো।

ছয়. লাইলাতুল কদর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রথমে গোপন ছিল, অতঃপর তাকে জানানো হয়, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়।

সাত. লাইলাতুল কদর তালাশে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগ্রহ, শেষ দশকে জানার পূর্বে তিনি মধ্যম দশকে তা তালাশ করেছেন, অথচ আল্লাহ তার পূর্বাপর সকল পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আট. লাইলাতুল কদরের প্রতি গভীর আগ্রহ ও তা অন্বেষণ করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ, যা শেষ দশক জাগ্রত থাকা ব্যতীত অর্জন হয় না, বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলো।

৫১
৪৮. ই‘তিকাফকারীর জন্য যা বৈধ
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা‎ থেকে বর্ণিত:

«أنها كانت تُرَجِّلُ النبيَّ صلى الله عليه وسلم وهي حَائِضٌ وهُوَ مُعْتَكِفٌ في المَسْجِدِ وَهِيَ في حُجْرَتِهَا يُنَاوِلُها رَأسَهُ» .

“তিনি ঋতুস্রাবের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল আঁচড়ে দিতেন, যখন তিনি মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন, আর আয়েশা ঘর থেকে তার মাথা গ্রহণ করতেন”। [সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।]

মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে:

«وكانَ لا يَدخُلُ البَيتَ إلا لحَاجَةِ الإِنسَان» .

“তিনি মানুষিক প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না”।

আবু দাউদের এক বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم يَكُونُ مُعْتَكِفَاً في المَسْجِدِ فَيُنَاوِلُنِي رَأْسَهُ من خَلَلِ الحُجْرَةِ فَأَغْسِلُ رَأْسَهُ» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন, তিনি হুজরার ফাঁক দিয়ে আমার কাছে তার মাথা দিতেন, আমি তা ধুয়ে দিতাম”।

অপর বর্ণনায় আছে: “আমি ঋতুবতী অবস্থায় তার মাথা চিরুনি করতাম”। [দেখুন: মালেক: (১/৬০); সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৭; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৬৯); সর্বশেষ বর্ণনা সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯২৪; সহীহ মুসলিম (১/৩১) এর ভূমিকায় রয়েছে।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা‎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন:

«أَنَّهُ كَانَ إذَا اعْتكَفَ لم يَدخُلْ بَيتَهُ إلا لِحَاجَةِ الإنسَانِ التي لابدَّ مِنهَا» .

“যখন তিনি ই‘তিকাফ করতেন, প্রাকৃতিক জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না”। [দেখুন: মূল হাদীস সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৪১ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৭ রয়েছে, তবে এ বর্ণনা নাসাঈ ফিল কুবরা থেকে নেওয়া: (৩৩৬৯)।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

إنِّي كُنتُ لأدْخُلُ البَيتَ للحَاجَةِ والمَرِيضُ فيه فَما أَسأَلُ عَنْهُ إلاّ وأنَا مَارَّة» .

“আমি ঘরে প্রবেশ করতাম, সেখানে রোগী থাকত, কিন্তু চলন্ত অবস্থায় ব্যতীত তার সম্পর্কে আমি জিজ্ঞাসা করতাম না”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৭।]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “ইতেকাফকারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে রোগী দেখতে না যাওয়া, জানাজায় হাযির না হওয়া, স্ত্রীকে স্পর্শ বা তার সাথে সহবাস না করা, খুব জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বের না হওয়া, সাওম ব্যতীত ই‘তিকাফ শুদ্ধ নয়, অনুরূপ জামে মসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ শুদ্ধ নয়”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৭৩; দারা কুতানি: (২/২০১), তিনি বলেছেন এখানে ইমাম জুহরি রহ. এর কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বায়হাকি ফিস সুনান: (৪/৩২১), তিনি বলেছেন এটা উরওয়া রহ. এর বাণী। দেখুন: (ফাতহুল বারি: (৪/২৭৩); আত-তামহিদ: (৮/৩২০)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. ঋতুবতী নারী পাক, তার ঋতুর স্থান ব্যতীত। [আত-তামহিদ: (৮/৩২৪), তিনি এ ব্যাপারে ইজমা নকল করেছেন: (২২/১৩৭), অনুরূপ ইজমা নকল করেছেন ইমাম নববী শরহে মুসলিমে: (১/১৩৪)। আরো দেখুন: শাহরু ইবনুল বাত্তাল: (৪/১৬৪)।] অনুরূপ যার ওপর গোসল ফরয সেও পাক। [দেখুন: শাহরু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৩৭)।]

দুই. ই‘তিকাফকারী শরীরের কিছু অংশ মসজিদ থেকে বের করলে বাইরে গণ্য হবে না, ই‘তিকাফ নষ্ট হবে না, যেমন মসজিদের জানালা অথবা দরজা থেকে যদি কিছু নেওয়া অথবা গ্রহণ করার ইচ্ছা করে, তাহলে এতে সমস্যা নেই। [শারহুন নববী: (৩/২০৮); আউনুল মাবুদ: (৭/১০২)।]

তিন. ই‘তিকাফকারীর মাথা ধৌত করা, চুল আঁচড়ানো, সুগন্ধি ব্যবহার করা, মাথা ন্যাড়া করা ও সৌন্দর্য গ্রহণ করা বৈধ। [আউনুল মাবুদ: (৭/১০২)।]

চার. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল খুব ঘন ছিল।

পাঁচ. যার চুল খুব ঘন, তার উচিৎ চুল পরিষ্কার রাখা, চিরুনি করা ও চুলের যত্ন নেওয়া। পোশাক-আশাক ও শরীরের পবিত্রতা ত্যাগ করা সুন্নাত কিংবা শরী‘আত নয়। [আল-ইস্তেযকার: (১/৩৩০); শারহু ইবনল মুলাক্কিন: (৫/৪৩৮)।]

ছয়. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল চিরুনি করা থেকে প্রমাণিত হয়, মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় সকল প্রকার খাদ্য, তেল ইত্যাদি গ্রহণ করা বৈধ। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/১৬৫)।]

সাত. ই‘তিকাফকারীর স্ত্রীর দিকে তাকানো এবং স্ত্রীর কাম স্পৃহা ব্যতীত স্বামীর শরীরের কিছু অংশ স্পর্শ করা বৈধ। [শারহুন নববী: (১/১৩৪)।]

আট. স্ত্রীর জন্য স্বামীর খিদমত করা বৈধ, যেমন তার মাথা ধৌত করা, চুল আঁচড়ে দেওয়া, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি। [শারহুন নববী: (৩/২০৮)।]

নয়. মানুষিক প্রয়োজন ব্যতীত ই‘তিকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, যেমন পেশাব-পায়খানা অথবা পানাহার, যদি তা মসজিদে পৌঁছে দেওয়ার কেউ না থাকে, অনুরূপ প্রয়োজনীয় প্রত্যেক বস্তু, যা মসজিদে সম্পাদন করা সম্ভব নয়, তার জন্য বের হলে ই‘তিকাফ নষ্ট হবে না”। [আত-তামহিদ: (৮/৩২৭); তারহুত তাসরিব: (৪/১৬৯); আল-ফুরু: (৩/১৩৪); আল-মুগনি: (৩/৬৮)।]

দশ. যে ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ না করার কসম করেছে, সে যদি ঘরে মাথা প্রবেশ করে, তাহলে তার কসম ভঙ্গ হবে না। [আবু দাউদের টিকায় মাআলেমুস সুনান: (২/৮৩৪); শারহু ইবন বাত্তাল: (৪/১৬৬); শারহু ইবন মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৩৭); আউনুল মাবুদ: (৭/১০২)।]

এগার. ই‘তিকাফকারী জরুরি প্রয়োজনে বের হলে দ্রুত হাঁটা জরুরি নয়, বরং অভ্যাস অনুযায়ী হাঁটা, তবে প্রয়োজন শেষে দ্রুত ফিরে আসা ওয়াজিব। [আল-মুগনি: (৩/৬৯)।]

বারো. ই‘তিকাফকারী রোগী দেখা অথবা জানাজায় হাজির হবে না, এটা জমহুর আলিমদের অভিমত। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/১৬৬)।] তবে সে চলন্ত অবস্থায় রোগী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারবে, কিন্তু থামবে না। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৩৯)।]

তের. ই‘তিকাফকারী যদি জরুরি প্রয়োজনে বের হয়, যেমন পিতার মৃত্যু অথবা সন্তানের মৃত্যু, তাহলে প্রয়োজন শেষে নতুন করে ই‘তিকাফ করবে, যদি সে বিনা শর্তে ই‘তিকাফ করে। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/১৬৬)।]

চৌদ্দ. হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, নারী তার স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করবে, স্বামীর বাড়িতে যদিও কোনো প্রয়োজন না থাকে অথবা কোনো শরয়ী কারণে সে বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে, যেমন সফর ও ই‘তিকাফ। স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘর থেকে বের হবে না। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৪০)।]

পনের. ই‘তিকাফকারী প্রয়োজন ব্যতীত ই‘তিকাফের স্থান থেকে বের হলে ই‘তিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। [আল-মুগনি: (৩/৭০)।]

ষোল. ই‘তিকাফের জন্য সাওম ও জামে মসজিদ শর্ত কি-না এ ব্যাপারে ইখতিলাফ রয়েছে। বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী ই‘তিকাফের জন্য সাওম শর্ত নয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাওয়ালে ই‘তিকাফ করেছেন। পাঞ্জেগানা মসজিদে ই‘তিকাফ বৈধ, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জমাত হয়, কিন্তু জুমা হয় না। ই‘তিকাফকারী জুমু‘আর সালাতের জন্য জামে মসজিদে যেতে পারবে, এ জন্য তার ই‘তিকাফ নষ্ট হবে না, তবে উত্তম জামে মসজিদে ই‘তিকাফ করা। [ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা, ফাতাওয়া নং ৬৭১৮।]

৫২
৪৯. লাইলাতুল কদরের দো‘আ
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বলেছি: “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমি যদি লাইলাতুল কদর জানতে পারি, আমি তাতে কি বলব? তিনি বললেন: তুমি বলবে:

«اللَّهُمَّ إنَّك عَفُوٌّ كَريمٌ تُحبُّ العَفوَ فَاعْفُ عنِّي»

“হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, মহান দাতা-সম্মানিত, ক্ষমা করাকে তুমি ভালোবাস। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা কর”। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন এ হাদীস হাসান, সহীহ। [তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫১৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৮৫০; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ১০৭০৮; আহমদ: (৬/১৭১), হাকেম হাদীসটি সহীহ বলেছেন এবং বলেছেন: বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক: (১/৭১২)।]

ইবন মাজাহ’র শব্দ হচ্ছে: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা‎ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি দেখেছেন, আমি লাইলাতুল কদর পেলে কী দো‘আ করব? তিনি বললেন: তুমি বলবে:

«اللَّهُمَّ إنَّكَ عَفُوٌّ كَريمٌ تُحبُّ العَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي»

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. লাইলাতুল কদরের ফযীলত এবং উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার তা অন্বেষণ করা, তাতে কিয়াম ও দো‘আ করার গভীর আগ্রহ প্রমাণিত হয়।

দুই. কল্যাণকর বস্তু জানার জন্য সাহাবীদের প্রশ্ন করার আগ্রহ।

তিন. লাইলাতুল কদরের দো‘আ ফযীলতপূর্ণ এবং তা কবুলের সম্ভাবনা রাখে।

চার. ব্যাপক অর্থপূর্ণ শব্দের মাধ্যমে দো‘আ করা মোস্তাহাব। দো‘আয় লৌকিকতা ও এমন শব্দ পরিহার করা, যার অর্থ অস্পষ্ট।

পাঁচ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতলানো এ দো‘আ ব্যাপক অর্থপূর্ণ ও সবচেয়ে উপকারী। এ দো‘আতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে, কারণ, আল্লাহ যখন দুনিয়াতে কোনো বান্দাকে ক্ষমা করবেন, তিনি তার থেকে শাস্তি দূরীভূত করবেন, তার ওপর নিয়ামতরাজি বর্ষণ করবেন। আর যখন তিনি কোনো বান্দাকে আখিরাতে ক্ষমা করবেন, তিনি তাকে আগুন থেকে মুক্তি দেবেন ও জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

ছয়. এ হাদীসে আল্লাহর ‘ভালোবাসা’ গুণটি প্রমাণিত হয়, যেভাবে তার জন্য ভালোবাসা গুণটি উপযোগী। আর তিনি ক্ষমা করা ভালোবাসেন।

সাত. মানুষদের ক্ষমা করার ফযীলত। কারণ, আল্লাহ ক্ষমা করা পছন্দ করেন, অনুরূপ যারা মানুষদের ক্ষমা করে তাদের তিনি পছন্দ করেন।

আট. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতের কল্যাণ কামনা করেন ও তাদেরকে উপকারী বিষয় শিক্ষা দেন।

৫৩
৫০. ই‘তিকাফকারীর সাথে সাক্ষাত
সাফিয়্যাহ বিনতে হুইয়াই থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফে ছিলেন, আমি রাতে তাঁর সাক্ষাতের জন্য আসি। আমি তার সাথে কথা বলি, অতঃপর রওয়ানা দেই ও ঘুরে দাঁড়াই, তিনি আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। তার ঘর ছিল উসামা ইবন যায়েদের বাড়িতে। ইত্যবসরে দু’জন আনসার অতিক্রম করল, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে দ্রুত চলল,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন: থাম, এ হচ্ছে সাফিয়্যাহ বিনতে হুইয়াই। তারা আশ্চর্য হলো: সুবহানাল্লাহ হে আল্লাহ রাসূল! তিনি বললেন: নিশ্চয় শয়তান মানুষের রক্তের শিরায় বিচরণ করে, আমি আশঙ্কা করছি, সে তোমাদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে পারে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৭৫; দ্বিতীয় বর্ণনা সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৭৫।]‎

আলী ইবন হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ছিলেন, তার নিকট তার স্ত্রীগণ উপবিষ্ট ছিল, অতঃপর তারা চলে গেল। তিনি সাফিয়্যাহ বিনতে হুইয়াইকে বললেন: দ্রুত কর না, যতক্ষণ না আমি তোমার সাথে চলি। সাফিয়্যার ঘর ছিল উসামার বাড়িতে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে বেরহলেন, তার সাথে দু’জন আনসারের সাক্ষাত হলো, তারা নবীকে দেখল, অতঃপর দ্রুত চলল। তিনি তাদের দু’জনকে বললেন: এ হচ্ছে সাফিয়্যাহ বিনতে হুইয়াই। তারা বলল: সুবহানাল্লাহ! হেআল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন: নিশ্চয় শয়তান মানুষের রক্তের শিরায় বিচরণ করে, আমি আশঙ্কা করছি, সে তোমাদের অন্তরে কিছু সৃষ্টি করতে পারে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৩৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৭৫।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

‎এক. এ হাদীসে উম্মতের ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া, তাদের স্বার্থ রক্ষা করা ও তাদেরকে সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার প্রমাণ মিলে, যাতে রয়েছে তাদের আত্মা ও অন্তরের পরিশুদ্ধতা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশঙ্কা করেছেন যে, শয়তান তাদের অন্তরে তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করতে পারে, আর নবীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা কুফর, তাই তিনি তাদের সতর্ক করলেন। [শারহুন নববী: (১৪/৫৬)।]ইমাম শাফে‘ঈ রহ. বলেন, “তিনি তাদেরকে এ জন্য বলেছেন। কারণ, তিনি তাদের উপর কুফুরীর আশঙ্কা করেছেন, যদি তারা তাঁর সম্পর্কে কু-ধারণা করত, তাই তাদের অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা সঞ্চার করার পূর্বে, যা তাদের ধ্বংসের কারণ, ছিল, তিনি দ্রুত জানিয়ে দিয়ে তাদের হিত কামনা করলেন।

‎দুই. ই‘তিকাফকারীর সাথে সাক্ষাত করা বৈধ, মসজিদে স্ত্রী তার স্বামীর সাথে সাক্ষাত ও কথা বলতে পারবে রাত-দিন যে কোনো সময়, এতে ই‘তিকাফের ক্ষতি হবে না। তবেঅতিরিক্ত গমনাগমন ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, কখনো ই‘তিকাফ বিনষ্টকারী কর্মে লিপ্ত করে, তাই তা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

‎তিন. মুসলিমদের উচিৎ অপবাদ ও সন্দেহের স্থান থেকে দূরে থাকা, যখন খারাপ ধারণার আশঙ্কা হয় স্পষ্ট করে দিবে যেন তা দূরীভূত হয়ে যায়। বিশেষ করে অনুসরণীয় আলিম ও নেককার লোকদের বিষয়, তাদেরএমন কাজ করা বৈধ নয় যা মানুষের অন্তরে সন্দেহের জন্ম দেয়। অনুরূপ বিচারকের বিচার ব্যাখ্যা করে দেওয়া উচিৎ, যদি বিবাদীর নিকট তার কারণ অস্পষ্ট থাকে ও পক্ষপাত তুষ্টের ধারণা জন্মায়।

‎চার. শয়তান ও তার ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকা ওয়াজিব। কারণ, সে বনী আদমের রক্তের শিরায় বিচরণ করে।

‎পাঁচ. আশ্চর্য হয়ে সুবহানাল্লাহ বলা বৈধ। যেমন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ওপর অপবাদের ঘটনায় আছে:

﴿سُبۡحَٰنَكَ هَٰذَا بُهۡتَٰنٌ عَظِيمٞ ١٦﴾ [ النور : 16]

“তুমি অতি পবিত্র মহান, এটা এক গুরুতরঅপবাদ”। [সূরা আন-নূর, আয়াত: ১৬]

‎ছয়. ই‘তিকাফকারীর বৈধ কাজে লিপ্ত হওয়া জায়েয। যেমন, সাক্ষাতকারীকে উৎসাহ দেওয়া, তার সাথে দাঁড়ানো ও তার সাথে কথা বলা, তবে অতিরিক্ত না করা।

‎সাত. ই‘তিকাফকারীর পাঠ দান করা, শিক্ষণীয় প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করা ও দীনি বিষয় লেখা বৈধ, তবে ‎‎ বেশি পরিমাণে নয়। কারণ, ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু ইবাদতের জন্য অবসর হওয়া।

‎আট. ই‘তিকাফকারী প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে পারবে, যেমন খাবার ইত্যাদি।

‎নয়. স্ত্রীর সাথে ই‘তিকাফকারী নির্জনে মিলিত হতে পারবে, তবে স্ত্রীগমন থেকে সতর্ক থাকবে।

‎দশ. নিরাপত্তা থাকলে নারীদের রাতে বের হওয়া বৈধ।

‎এগার. যার সাথে তার স্ত্রী রয়েছে, তাকে সালাম দেওয়া বৈধ, কারণ, কতক বর্ণনায় এসেছে তারা উভয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম করেছিল, তিনি তাদের বিরত করেন নি।

‎বারো. যদি ব্যক্তির সাথে স্ত্রী বা মাহরাম থাকে, সে যে কাউকে সম্বোধন করতে পারবে, বিশেষ করে যদি তার প্রয়োজন হয়, কোনো হুকুমবর্ণনা করা অথবা কোনো অনিষ্ট দূর করা ইত্যাদি, এটা রুচি বিরোধী নয়।

‎তের. কথা বা কোনো মাধ্যমে ই‘তিকাফকারী নিজের ওপর খারাপ ধারণা দূর করতে পারবে, অনুরূপ সে হাতের দ্বারা কষ্ট দূর করতে পারবে, যদি কেউ তার উপর সীমালঙ্ঘন করতে চায়। ই‘তিকাফকারী মুসল্লির চেয়ে বেশি নয়, মুসল্লির জন্য বৈধ তার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে বাঁধা দেওয়া, অনুরূপ ই‘তিকাফকারী সে ব্যক্তিকে বারণ করতে পারবে, যে তার উপর সীমালঙ্ঘন করে, এ জন্য তার ই‘তিকাফ নষ্ট হবে না।

‎চৌদ্দ. একান্ত প্রয়োজন না হলে ধীরে কাজ করা ও দ্রুততা পরিহার করা, কারণ, নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেছেন: ‎‏ عَلَى رِسْلِكُمَا “তোমরা ধীরে চল”।

‎পনের. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফ করতেন। কেননা তাঁর স্ত্রীগণ তার ই‘তিকাফে তাকে দেখতে এসেছেন, যখন তারা যাওয়ার ইচ্ছা করেন, তিনি সাফিয়্যাহকে বললেন: তাড়াহুড়োকরোনা। সাফিয়্যাকে থাকার নির্দেশের কারণ, সম্ভবত সে অন্যদের চেয়ে দেরীতে এসেছে, তাই তাকে দেরিতে যেতে বলেছেন, যেন তার নিকট অবস্থানের সময় সবার সমান হয় অথবা তার বাড়ি অন্য স্ত্রীদের বাড়ি থেকে দূরে ছিল, তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে আশঙ্কা করেছেন। মুসলিমদের উচিৎ অনুরূপভাবে স্ত্রীদের মাঝে সমতা রক্ষা করা ও তাদের প্রতি যত্নশীল থাকা।

৫৪
৫১. সাতাশে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা
যির ইবন হুবাইশ রহ. বলেন, “আমি উবাই ইবন কা‘বকে জিজ্ঞাসা করে বলি: তোমার ভাই ইবন মাসউদ বলেন, যে ব্যক্তি সারা বছর রাতে কিয়াম করবে সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে। তিনি বললেন: আল্লাহ তার ওপর রহম করুন, তার উদ্দেশ্য মানুষ যেন অলস না হয়, অন্যথায় তিনি ভালো করে জানেন যে, লাইলাতুল কদর রমযানে, বিশেষ করে শেষ দশকে, বরং সাতাশে। অতঃপর তিনি শপথ করে বলেন, এতে সন্দেহ নেই লাইলাতুল কদর সাতাশে। আমি বললাম: আপনি তা কীভাবে বলেন, হে আবু আব্দুর রহমান, তিনি বললেন: নিদর্শন দেখে অথবা রাসূলের বাতলানো আলামত দেখে:

«أَنَّها تَطْلُعُ يَوْمَئذٍ لا شُعَاعَ لها»

“সেদিন সূর্য উদিত হবে যে, তার কিরণ থাকবে না”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬২; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৭৮; তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৫১; আহমদ: (৫/১৩০)।]

ইমাম আহমদের এক বর্ণনায় আছে:

«أَنَّ الشَّمْسَ تَطْلُعُ غَدَاةَ إِذْ كَأَنَّها طَسْتٌ لَيْسَ لَها شُعَاعٌ»

“সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে, যেন তা গামলা, যার কোনো আলো নেই”। [আহমদ: (৫/১৩০), ইবন হিব্বান এ হাদীস সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ৩৬৯০।]

তিরমিযীর এক বর্ণনায় আছে, উবাই বলেছেন: “আল্লাহর শপথ ইবন মাসউদ নিশ্চিত জানে যে, লাইলাতুল রমযানে এবং তা সাতাশে, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে সংবাদ দিতে চান নি, যেন তোমরা অলস বসে না থাক”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯৩। তিনি হাদীসটি হাসান ও সহীহ বলেছেন।]

মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لَيْلَةُ القَدْرِ لَيْلَةُ سَبْعٍ وعِشْرينَ» .

“লাইলাতুল কদর হচ্ছে সাতাশের রাত”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৮৬; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৬৮০। আলবানি তা সহীহ বলেছেন।]

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে হে আল্লাহর নবী, আমি খুব বৃদ্ধ ও অসুস্থ লোক, আমার দ্বারা দাঁড়িয়ে থাকা খুব কঠিন, অতএব আমাকে এমন এক রাতের কথা বলুন, যেন সে রাতে আল্লাহ আমাকে লাইলাতুল কদর দান করেন, তিনি বললেন: তোমার উচিৎ সাতাশ আঁকড়ে ধরা”। [আহমদ: (১/২৪০); বায়হাকি: (৪/৩১২); তাবরানি ফিল কাবির: (১১/৩১১), হাদীস নং ১১৮৩৬; হায়সামি ফি মাজমাউয যাওয়ায়েদ’: (৩/১৭৬) গ্রন্থে বলেন: হাদীসটি ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন, এর সকল বর্ণনাকারী সহীহ গ্রন্থের বর্ণনাকারী। শাইখ আহমদ শাকের হাদীসটি সহীহ বলেছেন, (২১৪৯)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. আমাদের পূর্বসূরীগণ কল্যাণের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তারা ইবাদতে মগ্ন থাকার জন্য ফযীলতপূর্ণ সময় অনুসন্ধান করতেন।

দুই. কারণবশতঃ কোনো বিষয় না বলা আলিমের জন্য বৈধ। যেমন, মানুষের অলসতা ও নেক আমলে ত্রুটির সম্ভাবনা ইত্যাদি।

তিন. নিশ্চিত জ্ঞান বা প্রবল ধারণার ওপর কসম করা বৈধ।

চার. কিরণহীন সাদা-উজ্জ্বলতা নিয়ে সকালে সূর্যের উদয় হওয়া, লাইলাতুল কদরের আলামত।

পাঁচ. মুসলিমদের উচিৎ ফযীলতপূর্ণ মৌসুমের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, যেমন লাইলাতুল কদর অন্বেষণে রমযানের শেষ দশক, যেন অল্প আমলে তার অধিক কল্যাণ অর্জন হয়।

ছয়. আলিমদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে: লাইলাতুল কদর পরিবর্তনশীল, তবে সাতাশের রাত অধিক সম্ভাবনাময়, যেমন উবাই ইবন কা‘ব শপথ করে বলেছেন।

সাত. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৃদ্ধ লোককে লাইলাতুল কদর সাতাশে বলা অন্যান্য হাদীসের পরিপন্থী নয়, যেখানে অন্যরাতে লাইলাতুল কদর বলা হয়েছে, কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সে বছরের কথা বলেছেন, যে বছর সে জিজ্ঞাসা করেছে। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে সব হাদীসের মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য এ ব্যাখ্যার বিকল্প ব্যাখ্যা নেই।

৫৫
৫২. সাওমের জন্য জান্নাতের একটি দরজা
সাহাল ইবন সা‘দ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«في الجنَّةِ ثَمَانِيَةُ أبْوَابٍ فيهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانُ لا يَدْخُلُهُ إِلاّ الصَّائِمُونَ»

“জান্নাতে আটটি দরজা, তাতে একটি দরজাকে “রাইয়ান” বলা হয়, তা দিয়ে সাওম পালনকারী ব্যতীত কেউপ্রবেশ করবে না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫৫; তিরমিযী, হাদীস নং ৭৬৫; নাসাঈ: (৪/১৬৮); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৪০; আহমদ: (৫/৩৩৫)।]‎

বুখারীর বর্ণিত শব্দে হাদীসটি এসেছে এভাবে:

«إِنَّ في الجَنَّةِ بَاباً يُقَالُ لهُ الرَّيَّانُ يَدخُلُ منهُ الصَّائِمونَ يَوْمَ القِيامَةِ لا يَدخُلُ منْهُ أحَدٌ غَيرُهُمْ، يقَالُ : أَيْنَ الصَّائِمونَ؟ فَيَقُومُونَ، لا يَدخُلُ منْهُ أَحَدٌ غَيرُهُم، فَإِذا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَم يَدخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ» .

“নিশ্চয় জান্নাতে একটি দরজা আছে, যাকে বলা হয় রাইয়ান, কিয়ামতের দিন তা দিয়ে সাওম পালনকারী প্রবেশ করবে, তাদের ব্যতীত কেউ সেখান থেকে প্রবেশ করবে না। বলা হবে: সাওম পালনকারীগণ কোথায়? ফলে তারা দাঁড়াবে, তাদের ব্যতীত কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করবে না, যখন তারা প্রবেশ করবে বন্দ করে দেওয়া হবে, অতঃপর কেউ তা দিয়ে কেউ প্রবেশ করবে না”।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৭।]

তিরমিযীর বর্ণিত শব্দ:

«إِنَّ في الجنَّةِ لبَاباً يُدعَى الرَّيَّانُ، يُدعَى لهُ الصَّائِمُونَ، فَمَنْ كَانَ مِنَ الصَّائِمِينَ دَخَلَهُ، وَمَنْ دَخَلَهُ لم يَظْمَأْ أَبَداً» .

“জান্নাতে একটি দরজা আছে, যাকে রাইয়ান বলা হয়, তার জন্য সাওম পালনকারীদেরকে আহ্বান করা হবে, যে সাওম পালনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে, সে তাতে প্রবেশ করবে, যে তাতে প্রবেশ করবে কখনো পিপাসার্ত হবে না”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৭৬৫। তিনি বলেছেন: হাসান-সহীহ-গরীব।]‎

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ أَنفَقَ زَوجَينِ في سَبيلِ الله نُودِيَ مِنْ أبْوابِ الجَنَّةِ : يا عَبدَالله : هَذَا خَيْرٌ، فَمَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الصَّلاةِ دُعِيَ مِنْ بَابِ الصَّلاةِ، ومَنْ كَانَ منْ أهْلِ الجِهادِ دُعِيَ من بَابِ الجِهادِ، ومَنْ كَانَ مِنْ أهْلِ الصِّيَامِ دُعِيَ من بَابِ الرَّيَّانِ، ومَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الصَّدَقَةِ دُعِيَ من بَابِ الصَّدَقَةِ، فقَالَ أَبو بَكْر : بِأَبي وأُمِّي يا رَسُولَ الله، مَا عَلى مَن دُعِيَ من تلكَ الأَبوَابِ مِنْ ضَرُورَةٍ فَهَلْ يُدْعَى أَحَدٌ من تِلكَ الأَبوَابِ كلِّها؟ قَالَ : نَعَم، وأَرجُو أن تَكُونَ مِنهُم» .

“আল্লাহর রাস্তায় যে দু’টি জিনিস খরচ করল, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ থেকে ডাকা হবে: হে আব্দুল্লাহ, এটা কল্যাণ। যে সালাত আদায়কারী তাকে সালাতের দরজা থেকে ডাকা হবে। যে মুজাহিদ তাকেজিহাদের দরজা থেকে ডাকা হবে। যে সাওম পালনকারী তাকে রাইয়ান দরজা থেকে ডাকা হবে। যে দানশীলতাকে সদকার দরজা থেকে ডাকা হবে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল, আমার মাথা-পিতা আপনার উপর উৎসর্গ। যাকে এক দরজা থেকে ডাকা হবে না, তার বিষয়টি পরিষ্কার, কিন্তু কাউকে কি সকল দরজা থেকে ডাকা হবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, আমি আশা করছি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত”।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২৭।]

বুখারি ও মুসলিমের অন্য শব্দে এসেছে:‎

«دعَاه خَزَنَةُ الجَنَّةِ، كُلُّ خَزَنَةِ بَابٍ : أَيْ فُلْ، هَلُمَّ» .

“জান্নাতের প্রহরী তাকে ডাকবে, প্রত্যেক দরজার প্রহরী বলবে: হে অমুক, আস”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২৭।]

ইমাম আহমাদের বর্ণিত শব্দ:

«لِكلِّ أَهْلِ عَمَلٍ بَابٌ مِنْ أَبْوَابِ الجَنَّةِ يُدْعَونَ بذَلكَ العَمَل، ولأَهْلِ الصَّيامِ بَابٌ يُدْعَوْنَ مِنهُ، يُقَالُ لَهُ : الرَّيَّان، فقَالَ أَبو بَكر : يا رَسُولَ الله، هَلْ أَحَدٌ يُدْعَى مِنْ تِلْكَ الأَبْوابِ كُلِّها؟ قَالَ : نَعَم، وأَرجُو أنْ تَكُونَ مِنهُم يا أَبا بَكْر» .

“প্রত্যেক আমলের লোকের জন্য জান্নাতে একটি করে দরজা আছে, তাদেরকে সে আমল দ্বারা ডাকা হবে। সাওম পালনকারীদের একটি দরজা রয়েছে, তাদেরকে সেখান থেকে ডাকা হবে, যাকে বলা হয় রাইয়ান। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ‎ ‎ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, কেউ কি সব দরজা থেকে ডাকা হবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, আমি আশা করছি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হে আবু বকর”। [মুসনাদে আহমদ: (২/৪৪৯)।]‎

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু‎র উদ্দেশ্য, যাকে জান্নাতের এক দরজা দিয়ে ডাকা হলো, তার জন্য এটাই যথেষ্ট, প্রত্যেক দরজা থেকে ডাকার প্রয়োজন নেই। কারণ, মূল উদ্দেশ্য জান্নাতে প্রবেশ করা, যা এক দরজা দিয়ে সম্পন্ন হয়। তারপরও কাউকে কি সব দরজা থেকে ডাকা হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হ্যাঁ বলে উত্তর দিলেন।

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. সাওমের ফযীলত যে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা থেকে একটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

দুই. “বাবে রাইয়ান” জান্নাতের একটি দরজার নাম। “রাইয়ান” الرَّيَّانِ শব্দটি ‎الرِّيِّ ধাতু থেকে নেওয়া, যা পিপাসার বিপরীত, সাওম পালনকারী যেহেতু নিজেকে পানি থেকে বিরত রাখে, যামানুষের খুব প্রয়োজন, সেহেতু তার যথাযথ প্রতিদান হিসেবে আখিরাতে তাকে পান করানো হবে, যারপর কখনো সে তৃষ্ণার্ত হবে না।

তিন. হাদীসে উল্লিখিত ইবাদত: সালাত, জিহাদ, সিয়াম ও সদকা জান্নাতের এক একটি দরজা। প্রত্যেক দরজা তার আমলকারীর জন্য খাস থাকবে, এখানে উদ্দেশ্য যার যে আমল বেশি তার জন্য সে দরজা বরাদ্ধ।

চার. জান্নাতের দরজায় ফিরিশতাদের থেকে প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে, তারা প্রত্যেক আমলকারীকে তার আমল অনুসারে তার জন্য নির্দিষ্ট দরজা থেকে ডাকবে, এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ফিরিশতারা নেককার আদম সন্তানদের মহব্বত করে ও তাদের কারণে খুশি হয়।‎ [ফাতহুল বারি: (৭/২৯)।]

পাঁচ. আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফযীলত যে, তাকে প্রত্যেক দরজা থেকে ডাকা হবে, কারণ, সে প্রত্যেক আমল করত। আবু বকরের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশা অবশ্যই সত্যে পরিণত হবে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসে এসেছে, আবু বকরকে প্রত্যেক দরজা থেকে ডাকা হবে, বরং জান্নাতের প্রত্যেক গলি ও ঘর থেকে ডাকা হবে। [সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৬৮৬৭। ইবন আব্বাসের হাদীসে দুর্বলতা রয়েছে, কিন্তু হায়সামি তাকে শক্তিশালী বলেছেন, মাজমাউয যাওয়ায়েদ: (৯/৪৬)।]‎

ছয়. হাদীস থেকে বুঝে আসে, যাদেরকে সব দরজা থেকে ডাকা হবে, তাদের সংখ্যা খুব কম। [ফাতহুল বারি: (৭/২৮)।]

সাত. হাদীস থেকে আরো বুঝে আসে যে, এখানে উদ্দেশ্য নফল আমল, ওয়াজিব নয়, কারণ, ওয়াজিব আদায়কারীর সংখ্যা প্রচুর হবে, তবে তাদের সংখ্যা খুব কম হবে, যাদের আমলনামায় অধিকহারে সর্বপ্রকার আমল থাকবে এবং যাদেরকে জান্নাতের সবদরজা থেকে ডাকা হবে। [ফাতহুল বারি: ৭/২৮-২৯)।]

আট. সামনে মানুষের প্রশংসা করা বৈধ, যদি তার উপর গর্ব ইত্যাদির আশঙ্কা না থাকে। [শারহুন নববী আলা মুসলিম (৭/১১৭)।]

নয়. যে সব আমল করে ও নিয়মিত করে, তাকে জান্নাতের সব দরজা থেকে ডাকা হবে, এটা তারপ্রতি সম্মান ও ইজ্জত প্রদর্শন স্বরূপ, তবে সে প্রবেশ করবে এক দরজা দিয়ে।

‎দশ. সাধারণত প্রত্যেক প্রকার নেক আমলের তাওফীক একজন মানুষের হয় না, যার এক আমলের তাওফিক হয়, তার থেকে অপর আমল থেকে ছুটে যায়, এটাই স্বাভাবিক। খুব কম লোকের তাওফীক হয় প্রত্যেক প্রকার আমল করা, আর সে কমের অন্তর্ভুক্ত আবু বকর। [আত-তামহিদ: (৭/১৮৪-১৮৫)।]

এগার. যার যে আমল বেশি, সে আমল দ্বারা সে প্রসিদ্ধি লাভ করে ও সে আমলের সাথে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়, দেখুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “যে সালাত আদায়কারীদের দলভুক্ত হবে”। তার উদ্দেশ্য যার যে আমল বেশি, তাকে সে আমল দ্বারা ডাকা হবে। কারণ, সব মুসলিম সালাত আদায় করে। [আত-তামহিদ: (৭/১৮৫)।]

৫৬
৫৩. যে ই‘তিকাফ করার মানত করেছে
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি জাহেলি যুগে মানত করেছি, একরাত মসজিদে হারামে ই‘তিকাফ করব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: তুমি তোমার মানত পূর্ণ কর, অতঃপর তিনি একরাত ই‘তিকাফ করেন”। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম।]

মুসলিমের এক বর্ণনায় রয়েছে, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন “জি‘রানা” নামক স্থানে, তায়েফ থেকে ফিরে। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি জাহেলি যুগে মানত করেছি মসজিদে হারামে একরাত ই‘তিকাফ করব, আপনার সিদ্ধান্ত কী? তিনি বললেন: যাও, একদিন ই‘তিকাফ কর”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৫৬।]

অপর বর্ণনায় রয়েছে, “আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি বলেছেন: তুমি তোমার মানত পূর্ণ কর”। [বায্‌যার, হাদীস নং ১৪০; বায়হাকি : (১০/৭৬৩)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. জাহেলি যুগে ই‘তিকাফ ও মানত প্রচলিত ছিল।

দুই. ইসলাম পূর্বের মানত ইসলাম গ্রহণ করার পর পূর্ণ করা বৈধ, কেউ তা পূর্ণ করা ওয়াজিব বলেছেন।

তিন. উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর জাহেলি যুগের মানত থেকে দায় মুক্ত হওয়ার আগ্রহ, এটা তার তাকওয়া ও পরহেযগারী প্রমাণ করে।

চার. ওয়াদা পূর্ণ করার গুরুত্ব, কখনো তার খেলাফ করা বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারকে তা পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, অথচ তা জাহেলি যুগের ওয়াদা ছিল। [শরহু ইবন বাত্তাল : (৪/১৬৮)।]

পাঁচ. এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, একদিন অথবা একরাত ই‘তিকাফ করা বৈধ।

ছয়. এ হাদীস তাদের দলীল, যারা বলে সাওম ব্যতীত ই‘তিকাফ বৈধ। কারণ, রাত সাওমের স্থান নয়। [ইতিকাফে যারা সাওম র্শত বলেন, তাদের মধ্যে ইবন ওমর, ইবন আব্বাস, মালেক, শাবি, আওযায়ি, সাওরি, আহনাফ এবং এটা আহমদের এক ফাতাওয়া। ইমাম কুরতুবি ও ইবনুল কাইয়্যেম এ অভিমতকে শক্তিশালী করেছেন। আর যারা বলেছেন ইতিকাফে সাওমের শর্ত করা না হলে, সাওম জরুরী নয়, তাদের মধ্যে আলি, ইবন মাসউদ, হাসান বসরি, আতা ইবন আবি রাবাহ, ওমর ইবন আব্দুল আযিয ও ইবন উসাইমিন রয়েছেন। লাজনায়ে দায়েমার ফাতাওয়া এর ওপর। দেখুন: আল-ইস্তেযকার: (১০/২৯১-২৯৩); তাহযিবুস সুনান: (৭/১০৫-১০৯); শারহুন নববী: (১১/১২৪-১২৬); আল-মুফহিম: (৪/২৪১); শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৪৬); তুহফাতুল আহওয়াযি: (১৫/১১৯); আল-ইফহাম ফি শারহি বুলুগুল মারাম: (১/৩৭২); শারহুল মুমতি: (৬/৫০৬-৫০৭); ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: (৬৭১৮)।]

সাত. যারা বলেছেন সাওম ব্যতীত ই‘তিকাফ শুদ্ধ, আলিমদের দু’ধরণের বক্তব্য থেকে তাদের কথা সঠিক। এ কারণে রোগী ই‘তিকাফ করতে পারবে, যে রোগের জন্য সাওম ভঙ্গ করছে”। [দেখুন: শারহুল মুমতি: (৬/৫০৭)।]

আট. অজানা বিষয় আলিমদের নিকট জিজ্ঞাসা করা, যেমন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তার মানত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন। অনুরূপ যাকে প্রশ্ন করা হয়, তার ওয়াজিব বলা, গোপন না করা। [শারহু ইবনল মুলাক্কিন আলাল উমদাহ: (৫/৪৪৬)।]

নয়. কেউ যদি তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও ই‘তিকাফের মানত করে, আর সেখানে পৌঁছতে দীর্ঘ সফরের প্রয়োজন হয়, তাহলে সে মানত পূর্ণ জায়েয নয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তিনটি মসজিদ ব্যতীত সফর করা যাবে না”। তবে যদি সফরের প্রয়োজন না হলে জায়েয আছে। [ফাতাওয়া সাদিয়া : (২৩১-২৩২)।]

৫৭
৫৪. মৃত্যু ব্যক্তির পক্ষ থেকে সাওম পালন করা
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:‎

«مَنْ مَاتَ وعَلَيهِ صِيامٌ صَامَ عَنْهُ وليُّهُ» .

“যে মারা গেল, অথচ তার সিয়াম রয়েছে, তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে সাওম রাখবে”।‎ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৪৭।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,

«جَاءَ رَجُلٌ إلى النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم فَقالَ : يا رَسولَ الله، إن أُمِّي ماتَتْ وعَليها صَومُ شَهْرٍ، أَفَأَقْضِيهِ عَنْهَا؟ فَقالَ عَليهِ الصَّلاة والسَّلام : لَوْ كانَ على أُمِّكَ دينٌ أَكُنْتَ قَاضِيْهِ عَنها؟ قالَ : نعم، قال : فَدَينُ الله أَحَقُّ أَنْ يُقضَى» .

“এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসল, অতঃপর সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা মারা গেছে, তার জিম্মায় এক মাসের সাওম রয়েছে, আমি কি তার পক্ষ থেকে কাযা করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যদি তোমার মায়ের ওপরঋণ থাকে, তার পক্ষ থেকে তুমি কি তা আদায় করবে? সে বলল: হ্যাঁ। তিনি বললেন: অতএব আল্লাহর ঋণ বেশি হকদার, যা কাযা করা উচিৎ”। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম।]

সহীহ বুখারী ও মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে:‎

«أنَّ امرأةً جاءَتْ إلى النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالتْ : يا رَسُولَ الله، إنَّ أُمِّي مَاتَتْ وعَلَيْهَا صَوْمُ نَذْرٍ أَفَأَصُومُ عَنْهَا؟ قالَ : أرَأَيتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمُّكِ دَيْنٌ فَقَضَيتِهِ أَكَانَ يُؤْدِي ذلكَ عنها؟ قالت : نعَم، قالَ : فَصُومِي عَنْ أُمِّكِ» .

“জনৈক নারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা মারা গেছে, তার ওপরমান্নতের সাওম রয়েছে, আমি কি তার পক্ষ থেকে সাওম রাখব? তিনি বললেন: তুমি কি মনে কর, তোমার মার ওপর যদি ঋণ থাকে, আর তুমি তা আদায় কর, তাহলে কি যথেষ্ট হবে? সে বলল: হ্যাঁ, তিনি বললেন: তোমার মায়ের পক্ষ থেকে তুমি সাওম রাখ”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৪৮। উভয় হাদীসের শব্দ মুসলিম থেকে নেওয়া। ইমাম আহমদের বর্ণনায় আছে: “আমার মা মারা গেছে, তার জিম্মায় রমযানের এক মাস রোযা রয়েছে, আমি তার পক্ষ থেকে তা কি কাযা করব? তিনি বললেন: তুমি কি লক্ষ্য করছ, যদি তার উপর ঋণ থাকত তুমি তা পরিশোধ করতে? সে বলল: হ্যাঁ, তিনি বললেন: অতএব আল্লাহর ঋণ কাযার বেশী দাবি রাখে”। মুসনাদে আহমদ: (১/৩৬২), শাইখ আহমদ শাকের হাদীসটি সহীহ বলেছেন: (৩৪২০), অতঃপর তিনি বলেছেন: “এ হাদীস স্পষ্ট করে যে, রমযানের কাযা সম্পর্কে প্রশ্ন ছিল, কিন্তু হাফেয এ কথা বলেননি, আরো স্পষ্ট যে প্রশ্ন করার ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে, একবার মানত সম্পর্কে, একবার রমযান সম্পর্কে, প্রশ্নকারী কখনো ছিল পরুষ, কখনো ছিল নারী”।আমি (লেখক) বলি: শাইখ শুআইব আরনাউতের তত্ত্বাবধানে মুসনাদে আহমদের যারা তাহকিক করেছেন, তাদের নিকট এ অতিরিক্ত ভুল, অর্থাৎ “রমযান মাস”, যদিও হাতে লেখা কতক মৌলিক কপিতে তা এসেছে, যার ভিত্তিতে তারা মুসনাদের তাহকিক করেছেন। কারণ, এসব মৌলিক কপির বর্ধিত অংশ “আতরাফে মুসনাদ” ও “ইতহাফে মাহারাতে” বিদ্যমান হাদীসের বিপরীত, তারা এ বর্ধিত অংশ ব্যতীত হাদীসকে সহীহ বলেছেন: (৩৪২০), এ বর্ধিত অংশের উপর নির্ভর করেছেন শাইখ ইবন বায তার কতক দরসে। স্পষ্ট যে তিনি এ বর্ধিত অংশকে সহীহ মনে করেছেন। যাই হোক হাদীসের ব্যাপকতা রমযানকে শামিল করে, বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী মানতের সাথে খাস নয়। অতঃপর আমি হাফেয ইবন হাজারের “ইতহাফে মাহারাহ” দেখি, যা জামেয়া ইসলামিয়াহ মদিনার সংরক্ষিত কপি, সেখানে আমি হাদীসটি দেখি বর্ধিত অংশ ব্যতীত, হাফেয যার তাখরিজ করেছেন ইবন খুযাইমাহ, আবু আওয়ানাহ, ইবন হিব্বান ও দারা কুতনি থেকে: (৭/১০১), হাদীস নং ৭৪১৯, এসব থেকে প্রমাণিত হয় বর্ধিত অংশ হাদীসে অনুপ্রবেশ করেছে, মূল হাদীসের অংশ নয়। আল্লাহ ভালো জানেন।]‎

বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«بينَا أنَا جَالسٌ عندَ رَسولِ الله صلى الله عليه وسلم إذ أتَتْهُ امرأةٌ فقالتْ : إنِّي تَصَدَّقْتُ على أمِّي بجَاريةٍ وإنها ماتتْ . قالَ : فقالَ : وجَبَ أَجرُكِ وردَّها عليكِ الميراث، قالتْ : يا رسولَ الله، إنَّه كانَ عليها صومُ شَهرٍ أفَأَصُومُ عنها؟ قال : صُومِي عنهَا، قالتْ : إنَّها لمْ تَحُجَّ قَطُ، أفَأَحُجُّ عنهَا؟ قال : حُجِّي عنها» .

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসে ছিলাম, ইত্যবসরে তার নিকট এক নারী এসে বলল: আমি আমার মাকে এক “দাসী” সদকা করেছি, কিন্তু সে মারা গেছে।

বর্ণনাকারী বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমার সাওয়াব হয়ে গেছে, তুমি তা মিরাস হিসেবে ফিরিয়ে নাও। সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল, তার জিম্মায় একমাসের সাওম ছিল, আমিকি তার পক্ষ থেকে সাওম রাখব? তিনি বললেন: তার পক্ষ থেকে সাওম রাখ। সে বলল: তিনিকখনো হজ করেননি, আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করব? তিনি বললেন: তার পক্ষ থেকে হজ কর”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১৪৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮৭৭; তিরমিযী, হাদীস নং ৬৬৭; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৬৩১৪; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৩৯৪।]‎

শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. শারীরিক ইবাদতে প্রতিনিধিত্ব হয় না এটাই মূলনীতি, তবে সিয়াম এ নীতির অন্তর্ভুক্ত নয়, যেমন নয় হজ। হাফেয ইবন আব্দুল বার রহ: বলেছেন: “সালাতের ব্যাপারে সবাই একমত যে, কেউ কারো পক্ষ থেকে সালাত আদায় করবে না, না ফরয, না সুন্নাত, না নফল, না জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে, না মৃত ব্যক্তির। অনুরূপ জীবিত ব্যক্তিরপক্ষ থেকে সিয়াম, জীবিতাবস্থায় একের সাওম অপরের পক্ষ থেকে আদায় হবেনা। এতে ইজমা রয়েছে, কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু যে মারা যায়, তার জিম্মায় যদি সিয়াম থাকে, তার ব্যাপারে পূর্বাপর আলিমদের ইখতিলাফ রয়েছে”। [আল-ইস্তেযকার: (৪/৩৪০), এ বিষয়ে ইজমা নকল করেছেন কাদি আয়াদ ফি ইকমালিল মুয়াল্লিম: (৪/৪০৪) ও কুরতুবি ফিল মুফহিম: (৩/২০৮-২০৯)।]

দুই. মৃত ব্যক্তির জিম্মায় যদি সিয়াম থাকে, তার দুই অবস্থা:

এক. কাযার সুযোগ না পেয়ে মারা যাওয়া, সময়ের সংকীর্ণতা অথবা অসুস্থতা অথবা সফর অথবা সাওমের অক্ষমতার দরুন কাযার সুযোগ পায়নি, অধিকাংশ আলিমদের মতে তার ওপর কিছু নেই।

দুই. কাযার সুযোগ পেয়ে মারা যাওয়া, এ ক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে তারঅভিভাবক তার পক্ষ থেকে সাওম রাখবে।‎

তিন. মৃত ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করা বৈধ, আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কারো পক্ষ থেকে। হাদীসে বর্ণিত «صَامَ عَنْهُ وليُّهُ» অর্থ হচ্ছে ওয়ারিশ ও উত্তরসূরী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন হয়, অন্যথায় তার পক্ষ থেকে তার নিকট আত্মীয় অথবা দূরের কারো সিয়াম পালন করা বৈধ, ঋণ আদায়ের ন্যায়। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ঋণের সাথে তুলনা করেছেন, ঋণ যে কেউ কাযা করতে পারে। অতএব, প্রমাণিত হয় যে, এটা যে কারো পক্ষ থেকে করা বৈধ, শুধু সন্তানের সাথে খাস নয়। [মাজমুউল ফাতাওয়া: (২৪/৩১১); দেখুন: আল-মুগনি: (৪/৪০০); ফাতহুল বারি: (৪/১৯৪); শারহুল মুমতি: (৬/৪৫২)।]

চার. মৃত্যু ব্যক্তির মানত কাযা করা ওয়াজিব নয়, যেমন নয় অভিভাবকদের ওপর তার ঋণ পরিশোধ করা, তবে এটা মৃত ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ। [দেখুন: আল-মুগনি: (৪/৩৯৯-৪০০); শারহুল মুমতি: (৬/৪৫০)। ওয়াজিব না হওয়ার কারণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰ﴾ [ الانعام : ١٦٤ ] “আর কোনো ভারবহনকারী অন্যের ভারবহন করবে না”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬৪], দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার তুলনা করেছেন ঋণের সাথে, আর ঋণ পরিশোধ করা অভিভাবদের ওয়াজিব নয়।]

পাঁচ. মৃতের জিম্মায় যদি অনেক সিয়াম থাকে, সে সংখ্যানুসারে তার পক্ষ থেকে কতক লোক যদি একদিন সিয়াম পালন করে, তাহলেশুদ্ধ হবে, তবে যে সাওমে ধারাবাহিকতা জরুরি তা ব্যতীত, যেমন যিহার ও হত্যার কাফ্‌ফারা, এ ক্ষেত্রে একজন ধারাবাহিকভাবে সিয়াম পালন করবে। [বুখারী হাসানের বাণী টিকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন: “যদি একদিন ত্রিশ ব্যক্তি সিয়াম পালন করে, বৈধ হবে”: (২/৬৯০), দারাকুতনি তা পূর্ণ সনদে উল্লেখ করেছেন, যেমন হাফেয ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন: (৪/১৯৩), দেখুন: শারহুল মুমতি: (৬/৩৫২-৩৫৩), শাইখ ইবন বায রহ. অনুরূপ বলেছেন। কারণ, এ ব্যাপারে হাদীসগুলো ব্যাপক। তিনি মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফ্‌ফারার সিয়াম সম্পর্কে বলেন: “এ সিয়াম এক গ্রুপের ওপর ভাগ করে দেওয়া বৈধ নয়, বরং এগুলো এক ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে পালন করব। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা অনুমোদন করেছেন”। মাজমু ফাতাওয়া ইবন বায: (১৫/৩৭৫)।]

ছয়. যদি তার পক্ষ থেকে কেউ সিয়াম পালন না করে, তবে তার অভিভাবকগণ তার পক্ষ থেকে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তেএকজন মিসকিনকে খাদ্য দিবে, তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে দেওয়া বৈধ।‎ [শারহুল মুমতি: (৬/৪৫৬)।]

সাত. ওয়ারিশগণ যদি কাউকে সাওমের জন্য ভাড়া করে, তাহলে শুদ্ধ হবে না। কারণ, নেকির বিষয়ে ভাড়া করা বৈধ নয়। [শারহুল মুমতি: (৬/৪৫৬), এ মাসআলাকে বদলি হজের ওপর কিয়াস করা যাবে না। যেমন, বর্তমান যুগে কতক লোক করে থাকে যে, তাদের অভিভাবকের পক্ষ থেকে যে হজ করবে তাকে তারা টাকা দেয়, যা তার হজ পর্যন্ত সফর খরচ, কিন্তু সে কম খরচ করে ও তা থেকে কিছু বাচিয়ে রাখে। এ জন্য আলিমগণ এমন লোককে হজে পাঠাতে নিষেধ করেছেন, যার উদ্দেশ্য শুধু অর্থ উপার্জন।]

আট. যদি মানত করে মুহাররাম মাসে সিয়াম পালন করবে, অতঃপর সে যিলহজ মাসে মারা যায়, তার পক্ষ থেকে কাযা করা হবে না, কারণ, সে ওয়াজিব হওয়ার সময় পায় নি, যেমন কেউ মারা গেল রমযানের পূর্বে। [শারহুল মুমতি: (৬/৪৫৬)।]

নয়. যার ওপর রমযানের কতক দিনের সিয়াম ওয়াজিব, সে যদি তার নিকট আত্মীয়ের কাযা অথবা কাফ্‌ফারা অথবা মান্নতের সাওম পালন করতে চায়, তার ওপর ওয়াজিব আগে নিজের সাওম পালন করা, অতঃপর তার নিকট আত্মীয়ের সাওম পালন করা। [ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমাহ: (৭৯৪২)।]

দশ. বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী কাযা সাওমে ধারাবাহিকতা শর্ত নয়, তবে ধারাবাহিকভাবে কাযা করা উত্তম। কারণ, তার সাথেআদায়ের মিল থাকে।‎ [ফাতাওয়া ইবন জাবরিন: (১২৫)।]

এগার. কাফ্‌ফারার দু’মাস সিয়ামের ধারাবাহিকতা ঈদের দিনের কারণে ভঙ্গ হবে না। [ফাতাওয়া ইবন জাবরিন: (১০২)।]

৫৮
৫৫. সাওয়াব পরিপূর্ণ যদিও মাস অসম্পূর্ণ হয়
আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:

«شَهْرانِ لا يَنْقُصَانِ : شَهْرا عِيدِ رَمضَانَ وذُو الحِجَّة» .

“‎দু’টি মাস কম হয় না: রমযানের ঈদ ও যিলহজের মাস”।

অপর বর্ণনায় আছে:

«شَهْرا عِيدٍ لا يَنْقُصَانِ : رَمضَانُ وذُو الحِجَّةَ» .

“দুই ঈদের মাস কম হয় না: রমযান ও যিলহজ”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮৯।]‎

এ হাদীসের অর্থ কেউ বলেছেন: এ দু’টি মাস: রমযান ও যিলহজ, একবছর একসঙ্গে অসম্পূর্ণ হয় না। একমাস অসম্পূর্ণ হলে অপর মাস পূর্ণ হয়। সাধারণত এমন হয়।‎

আবার কেউ বলেছেন: এ দু’মাসের সাওয়াব কম হয় না, যদিও তার সংখ্যা কম হয়।এটা অধিক গ্রহণযোগ্য। [ইকমালুল মুয়াল্লিম লিল কাদি ইয়াদ: (৪/২৪); আল-মুফহিম: (৩/১৪৫-১৪৬)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. রমযান ও যিলহজ এ দু’মাসকে ইসলাম বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছে। কারণ, এর সাথে সিয়াম ও হজ সম্পৃক্ত।‎ [ফাতহুল বারি: (৪/১২৫)।]

দুই. ঈদুল ফিতরকে রমযান মাসের সাথ সম্পৃক্ত করা বৈধ, অথচ তা শাওয়ালের প্রথম তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। ইমাম আহমদ রহ. কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে:

«شَهْرَانِ لا يَنْقُصَانِ في كُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُما عِيدٌ : رَمَضَانُ وذُو الحِجَّة» .

“দু’টিমাস অসম্পূর্ণ হয় না, যার প্রত্যেকটিতে ঈদ রয়েছে: রমযান ও যিলহজ”। [আহমদ: (৫/৪৭), আইনি উমদাতুল কারিতে এ হাদীস বিশুদ্ধ বলেছেন: (১০/২৮৫)।]

তিন. মাস আরম্ভের ক্ষেত্রে ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তবে এতে কোনো সমস্যা নেই যদি লোকেরা বৈধভাবে চাঁদ দেখে অথবা চাঁদ দেখা অসম্ভব হলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করার উপর আমল করে।

চার. রমযান ও যিলহজ মাসের ফযীলত ও বিধান বান্দাগণ অবশ্যই লাভ করবে, রমযান ত্রিশ দিন হোক অথবা ঊনত্রিশ দিনের, নবম দিন ওকুফে আরাফ হোক বা না অন্যদিনে, যদি তারা যথাযথ চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করে। [শারহুন নববী: (৭/১৯৯); ফাতহুল বারি: (৪/১২৬); উমদাতুল কারি: (১০/২৮৫)।]

পাঁচ. এ হাদীসের শিক্ষা: এসব হাদীসে তার মনের অতৃপ্তি ও অন্তরের সন্দেহ দূর করা হয়েছে, যে ঊনত্রিশ দিন সিয়াম পালন করল অথবা ভুলে গায়রে আরাফার দিন ওকুফ করল, যেমন কেউ যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার মিথ্যা সাক্ষী দিল, ফলে লোকেরা আট তারিখে ওকুফে আরাফা করল, এতে কোনো সমস্যা নেই, ইবাদত বিশুদ্ধ ও সাওয়াব পরিপূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ। [ফাতহুল বারি: (২/১২৬)।]

ছয়. এ হাদীস প্রমাণ করে যে, আমলের সাওয়াব সর্বদা কষ্টের ওপর নির্ভর করে না, বরং কখনো আল্লাহ অসম্পূর্ণ মাসকে পূর্ণ মাসের সাথে যুক্ত করে পরিপূর্ণ সাওয়াব প্রদান করেন। [হাফেয ইবন হাজার ফাতহুল বারিতে: (৪/১২৬) উল্লেখ করেছেন, কতক মালেকি আলিম এ হাদীস দ্বারা তার দলিল পেশ করেছেন।]‎

সাত. এ হাদীস তাদের দলীল, যারা বলে রমযানের জন্য এক নিয়ত যথেষ্ট।কারণ, আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণ মাসকে এক ইবাদত গণ্য করেছেন।

৫৯
৫৬. যাকাতুল ফিতর
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«فَرَضَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعَاً مِنْ تَمرٍ أَوْ صَاعاً مِنْ شَعِيرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالحُرِّ وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى وَالصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ مِنَ المسْلِمِينَ وَأَمَرَ بها أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلى الصَّلاةِ» .

“গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সকল মুসলিমের ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ‘সা’ তামার (খেজুর) অথবা এক ‘সা’ গম যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন এবং সালাতের পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৮৪।]

বুখারীর অপর বর্ণনায় আছে, নাফে রহ. বলেছেন: “ইবন উমার ছোট-বড় সবার পক্ষ থেকে তা আদায় করতেন, তিনি আমার সন্তানদের পক্ষ থেকে পর্যন্ত আদায় করতেন। যারা তা গ্রহণ করত, ইবন উমার তাদেরকে তা প্রদান করতেন, তিনি ঈদুল ফিতরের একদিন অথবা দু’দিন পূর্বে তা আদায় করতেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৪০।]

আবু সায়িদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা যাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খানা অথবা এক ‘সা’ গম অথবা এক ‘সা’ খেজুর অথবা এক ‘সা’ পনির অথবা এক ‘সা’ কিশমিশ দ্বারা”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৮৫।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “সাওম পালনকারীকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করা ও মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থা স্বরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন। সালাতের পূর্বে যে আদায় করল, তা গ্রহণযোগ্য যাকাত, যে তা সালাতের পর আদায় করল, তা সাধারণ সদকা”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৬০৯; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৮২৭, হাকেম বলেছেন হাদীসটি সহীহ, বুখারির শর্ত মোতাবেক: (১/৫৬৮), আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি হাসান বলেছেন।]

কায়স ইবন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন, যখন যাকাত ফরয হলো, তিনি আমাদের নির্দেশ দেন নি, নিষেধও করেন নি, তবে আমরা তা আদায় করতাম”। [নাসাঈ: (৫/৪৯); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৮২৮; আহমদ: (৬/৬/), হাফেয ইবন হাজার হাদীসটি সহীহ বলেছেন, ফাতুহল বারি: (৩/২৬৭)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. যাকাতুল ফিতর সকল মুসলিমের ওপর ফরয, যা ফরয হয়েছে যাকাতের পূর্বে। যাকাত ফরযের পর পূর্বের নির্দেশের কারণে তা এখনো ফরয।

দুই. প্রত্যেক মুসলিমের নিজ ও নিজের অধীনদের পক্ষ থেকে, যেমন স্ত্রী-সন্তান ও যাদের ভরণ-পোষণ তার ওপর ন্যস্ত, যাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।

তিন. স্ত্রী-সন্তান যদি কর্মজীবী অথবা সম্পদশালী হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের নিজের পক্ষ থেকে যাকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম, কারণ, তারা প্রত্যেকে যাকাতুল ফিতর প্রদানে আদিষ্ট। হ্যাঁ, যদি তাদের অভিভাবক তাদের পক্ষ থেকে আদায় করে, তাহলে জায়েয আছে, যদিও তারা সম্পদশালী।

চার. যাকাতুল ফিতরের মূল্য দেওয়া যথেষ্ট নয়, এটা জমহুর আলিমের অভিমত। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ দেন নি, তিনি এরূপ করেন নি, তার কোনো সাহাবী এরূপ করে নি, অথচ প্রতি বছর যাকাতুল ফিতর আসত। অধিকন্তু ফকিরকে খাদ্য দিলে সে নিজে ও তার পরিবার তার দ্বারা উপকৃত হয়, অর্থ প্রদানের বিপরীত, কারণ, সে অর্থ জমা করে পরিবারকে বঞ্চিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত মূল্য আদায়ের ফলে শরী‘আতের এ বিধান তেমন আড়ম্বরতা পায়না।

পাঁচ. যাকাতুল ফিতর আদায়ের প্রথম সময় আটাশে রমযান, সাহাবায়ে কেরাম ঈদের একদিন অথবা দু’দিন পূর্বে তা আদায় করতেন, সর্বশেষ সময় ঈদের সালাত, যেমন হাদীসে এসেছে।

ছয়. হকদার ফকির-মিসকিনদের এ যাকাত দিতে হবে, কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “মিসকিনদের খাদ্য স্বরূপ”। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের দেওয়া ভুল যদি তারা অভাবী না হয়, যেমন কতক লোক কুরবানি ও আকিকার গোশত-এর ন্যায় যাকাতুল ফিতর পরস্পর আদান প্রদান করে, এটা সুন্নাতের বিপরীত। কারণ, এটা যাকাত, হকদারকে দেওয়া ওয়াজিব, কুরবানি ও আকিকার গোশত-এর অনুরূপ নয়, যা হাদিয়া হিসেবে দেওয়া বৈধ। আরেকটি ভুল যে, কতক মুসলিম প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিবারকে যাকাতুল ফিতর আদায় করে, অথচ বর্তমান সে সচ্ছল হতে পারে, কিন্তু পূর্বের ন্যায় যাকাত দিতে থাকে, এটা ঠিক নয়।

সাত. নিজ দেশের অভাবীদের যাকাতুল ফিতর দেওয়া উত্তম, তবে অন্য দেশে দেওয়া জায়েয, বিশেষ করে যদি সেখানে অভাবের সংখ্যা বেশি থাকে, তাদের চেয়ে বেশি অভাবী নিজ দেশের কারো সম্পর্কে জানা না থাকে অথবা তার দেশের অভাবীদের দেওয়ার অন্য লোক থাকে।

আট. যাকাতুল ফিতরের কতক বিধান ও উপকারিতা:

(১) বান্দার ওপর আল্লাহর নিয়ামত প্রকাশ করা হয়, যেমন তিনি পূর্ণ মাস সিয়ামের তাওফীক ও রমযান শেষে পানাহারের অনুমতি প্রদান দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ١٨٥﴾ [ البقرة : 185]

“আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবংতিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন,তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবংযাতে তোমরা শোকর কর”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]

(২) এটা শরীরের যাকাত, যা আল্লাহ পূর্ণ বছর সুস্থ রেখেছেন।

(৩) যাকাতুল ফিতর বান্দার সিয়ামকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করে। যেমন, হাদীসে এসেছে, যাকাতুল ফিতর সাওম পালনকারীকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করে।

(৪) যাকাতুল ফিতর দ্বারা ফকির-মিসকিনদের প্রতি অনুগ্রহ ও তাদেরকে ভিক্ষা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, যেন ঈদের দিন তারাও অন্যান্য মুসলিমদের ন্যায় আনন্দ ও বিনোদন করতে পারে।

(৫) যাকাতুল ফিতর দ্বারা সাওম পালনকারীকে অনুগ্রহ ও অনুদানের প্রতি উৎসাহী করা হয় এবং তাকে লোভ ও কৃপণতা থেকে রক্ষা করা হয়।

নয়. এক মিসকিনকে এক পরিবার বা একাধিক ব্যক্তির সদকাতুল ফিতর দেওয়া বৈধ, যেমন বৈধ একজনের সদকাতুল ফিতর কয়েকজনকে ভাগ করে দেওয়া।

দশ. শেষ রমযানের সূর্যাস্তের ফলে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়, যদি কেউ তার পূর্বে মারা যায়, তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে না, কারণ, সে ওয়াজিব হওয়ার আগে মারা গেছে। অনুরূপ কেউ যদি সূর্যাস্তের পর জন্ম গ্রহণ করে, তার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়, তবে মোস্তাহাব।

এগার. কর্মচারী ও ভাড়াটে মজুরদের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়, তবে চুক্তির মধ্যে তাদের সাথে অনুরূপ শর্ত থাকলে আদায় করতে হবে। হ্যাঁ, অনুগ্রহ ও দয়া হিসেবে তাদের পক্ষ থেকে মালিকের আদায় করা বৈধ।

বারো. যদি সদকাতুল ফিতর আদায় করতে ভুলে যায়, ঈদের পর ছাড়া স্মরণ না হয়, তাহলে সে তখন সদকা আদায় করবে, এতে সমস্যা নেই। কারণ, ভুলের জন্য সে অপারগ।

তের. যদি কাউকে সদকাতুল ফিতর ফকিরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ঈদের আগে তার নিকট তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। তবে যদি কোনো ফকির কাউকে সদকাতুল ফিতর তার জন্য সংরক্ষণ করে রাখার দায়িত্ব দেয়, তাহলে ঈদের পর পর্যন্ত তার নিকট তা সংরক্ষণ করা বৈধ।

৬০
৫৭. সর্বশেষ রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করা
উতাইবাহ ইবন আব্দুর রহমান বলেন, আমার পিতা আব্দুর রহমান আমাকে বলেছেন: “আবু বাকরার নিকট লাইলাতুল কদর উল্লেখ করা হলো, তিনি বললেন: আমি যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, তা কখনো আমি শেষ দশদিন ব্যতীত তালাশ করি না। আমি তাকে বলতে শুনেছি: লাইলাতুল কদর তোমরা রমযানের অবশিষ্ট নয় দিনে তালাশ কর অথবা অবশিষ্ট সাতদিনে তালাশ কর অথবা অবশিষ্ট পাঁচদিনে তালাশ কর অথবা অবশিষ্ট তিনদিনে তালাশ কর অথবা সর্বশেষ রাতে তালাশ কর”। তিনি বলেন, আবু বাকরাহ রমযানের বিশ দিন সারা বছরের ন্যায় স্বাভাবিকভাবে সালাত আদায় করতেন, যখন শেষ দশক পদার্পণ করত, তখন তিনি খুব ইবাদত করতেন”। [তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯৪, তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান-সহীহ। আহমদ: (৫/৩৯); নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ৩৪০৩; বায্‌যার, হাদীস নং ৩৬৮১; তায়ালিসি, হাদীস নং ৮৮১; তাবরানি ফি মুসনাদিশ শামিয়্যিন: (১১১৯)।]

মু‘আবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা লাইলাতুল কদর সর্বশেষ রাতে তালাশ কর”। ইবন খুযাইমাহ এ সম্পর্কে একটি অধ্যায় রচনা করেন: “রমযানের শেষ রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করার নির্দেশ প্রসঙ্গে অধ্যায়, যদিও বছরের যে কোনো সময় সে রাত হতে পারে”। [আলবানির সহীহ হাদীস সংকলন: (১৪৭১), সহীহ ইবন খুজাইমা, হাদীস নং ২১৮৯।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. লাইলাতুল কদর শেষ দশকে, এর মধ্যে অধিক সম্ভাব্য হচ্ছে বেজোড় রাত, তবে অবশিষ্ট রাতের বিবেচনায় জোড় রাতে হতে পারে যদি মাস ত্রিশ দিনের হয়, এ জন্য মুসলিমদের উচিৎ শেষ দশকের প্রত্যেক রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করা।

দুই. সাহাবীদের লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা ও তাতে রাত জাগার আগ্রহ।

তিন. কখনো রমযানের সর্বশেষ রাতে লাইলাতুল কদর হতে পারে, যেমন বিভিন্ন হাদীস তার স্থানান্তর হওয়া প্রমাণ করে।

চার. ঊনত্রিশে রমযান অথবা ইমামের কুরআন খতমের পর সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও রাত জাগরণে অলসতা না করা। কারণ, মূল উদ্দেশ্য লাইলাতুল কদর, যা সর্বশেষ রাতে হতে পারে।

৬১
৫৮. চন্দ্র মাসের অবস্থা
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«الشَّهْرُ هَكَذا وَهَكَذا وَهَكَذا، يَعْني : ثَلاثينَ، ثُمَّ قَالَ : وَهَكَذا وَهَكَذا وَهَكَذا، يَعْني : تِسْعاً وعِشْرينَ، يَقُولُ : مَرَّةً ثَلاثينَ، ومَرَّةً تِسْعاً وعِشْرينَ» .

“মাস এরূপ, এরূপ ও এরূপ। অর্থাৎ ত্রিশ দিন। অতঃপর তিনি বলেন, এরূপ, এরূপ ও এরূপ। অর্থাৎ ঊনত্রিশ দিন। তিনি বলেন, কখনো ত্রিশ দিন, কখনো ঊনত্রিশ দিন”। [সহীহ বুখারী ও মুসলিম।]

সহীহ বুখারীর অপর বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّا أُمَّةٌ أُمِّيةٌ لا نَكْتُبُ وَلا نَحْسُبُ، الشَّهْرُ هَكَذا وَهَكَذا، يَعْني : مَرَّةً تِسْعَةً وَعِشْرينَ، وَمَرَّةً ثَلاثينَ» .

“আমরা উম্মী উম্মত, লেখা ও হিসাব জানি না, মাস হচ্ছে এরূপ ও এরূপ। অর্থাৎ কখনো ঊনত্রিশ ও কখনো ত্রিশ”।

সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে:

«الشَّهْرُ كَذَا وكَذَا وكَذَا، وصَفَّقَ بِيَدَيْهِ مَرَّتَين بِكُلِّ أَصَابِعْهما، ونَقَصَ في الصَّفْقَةِ الثَّالِثَةِ إِبْهَامَ اليُمْنَى أَوْ اليُسْرَى» .

“মাস এরূপ, এরূপ ও এরূপ। দুইবার উভয় হাতের পুরো আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করলেন, তৃতীয়বার ডান বা বাম হতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কম দেখালেন”।

সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে: ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ এক ব্যক্তিকে বলতে শুনেন:

«الَّليْلَةُ النِّصْفُ . فَقَالَ لَهُ : مَا يُدْرِيكَ أَنَّ الَّليْلَةَ النِّصْفُ؟ سَمِعْتُ رَسُولَ الله صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : الشَّهْرُ هَكَذا وَهَكَذا، وَأَشِارَ بِأَصَابِعِهِ العَشْرِ مَرَّتَينِ، وَهَكَذا في الثّالِثَةِ، وَأَشَارَ بِأَصَابِعِهِ كُلِّهَا، وَحَبَسَ أَوَ خَنَسَ إِبْهَامَهُ» .

“আজকের রাত মাসের অর্ধেক। তিনি তাকে বললেন: কিভাবে বললে আজকের রাতটি মাসের অর্ধেক? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: মাস এরূপ ও এরূপ, তিনি দুই বার হাতের দশ আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করেন, তৃতীয়বার এভাবে ইশারা করেন, তিনি সব আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করেন, শুধু তার বৃদ্ধাঙ্গুলি বদ্ধ রাখেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৯৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০। দ্বিতীয় বর্ণনা বুখারির: (১৮১৪), তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ণনা মুসলিমের: (১০৮০)।]

সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একহাত দ্বারা অপর হাতের ওপর আঘাত করলেন, অতঃপর বলেন, “মাস এরূপ ও এরূপ, অতঃপর তৃতীয়বার এক আঙ্গুল কম দেখান”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮৬; নাসাঈ: (৪/১৩৮)।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:

«أَتَاني جِبْريلُ عَلَيْهِ السَّلامُ فَقَالَ : الشَّهْرُ تِسْعٌ وعِشْرُونَ يَوْماً» .

“জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার নিকট এসে বলেন, মাস ঊনত্রিশ দিন”। [নাসাঈ: (৪/১৩৮), আলবানি সহীহ নাসাঈতে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«لَما صُمْنَا مَعَ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم تِسْعاً وعِشْرينَ أَكْثَرَ مما صُمْنَا مَعَهُ ثَلاثينَ»

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমরা অধিক সময় ঊনত্রিশ দিন সাওম পালন করেছি, ত্রিশ দিনের তুলনায়”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৩২২; তিরমিযী, হাদীস নং ৬৮৯; আহমদ: (১/৩৯৭); বায়হাকি: (৪/২৫০)। আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।]

ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এ অধ্যায়ে ইবন উমার, আবু হুরায়রা, আয়েশা, সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস, ইবন আব্বাস, ইবন উমার, আনাস, জাবের, উম্মে সালামা ও আবু বাকরা থেকে হাদীস বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “মাস হয় ঊনত্রিশ দিনে”। [জামে তিরমিযী (৩/৭৩)।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. চন্দ্র মাস, শরী‘আতের বিধান যার ওপর নির্ভরশীল, তা কখনো ত্রিশ, আবার কখনো ঊনত্রিশ দিনের হয়।

দুই. মাস যখন অসম্পূর্ণ হয়, সাওয়াব পরিপূর্ণ হয়। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ সংবাদ দিয়েছেন: তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অধিক সময় ঊনত্রিশ সাওম পালন করেছেন, ত্রিশ দিনের তুলনায়।

তিন. এ হাদীস জ্যোতিষ্ক ও গণকদের প্রত্যাখ্যান করে। এ হাদীস আরো প্রমাণ করে যে, শর‘ঈ বিধান সিয়াম, ফিতর ও হজ ইত্যাদি চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল, গণনার ওপর নয়।

চার. ইশারা ব্যবহার করা বৈধ, বরং এটা শিক্ষা ও ব্যাখ্যার একটি মাধ্যম। [ফাতহুল বারি: (৪/১২৭)।]

পাঁচ. দুই মাস, তিন মাস ও চার মাস পর্যায়ক্রমে ঊনত্রিশে মাস হতে পারে, তবে চার মাসের বেশি লাগাতার ঊনত্রিশ দিনে মাস হয় না। [শারহুন নববী আলাল মুসলিম (৭/১৯১)।]

ছয়. এ উম্মত উম্মী, কারণ, এদের মধ্যে শিক্ষার হার কম, অনুরূপ তাদের নবী ছিলেন উম্মী। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّ‍ۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ﴾ [ الجمعة : 2]

“তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রাসূলপাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে”। [সূরা আর-জুমু‘আ, আয়াত: ২]

অন্যত্র তিনি বলেন,

﴿وَمَا كُنتَ تَتۡلُواْ مِن قَبۡلِهِۦ مِن كِتَٰبٖ وَلَا تَخُطُّهُۥ بِيَمِينِكَۖ إِذٗا لَّٱرۡتَابَ ٱلۡمُبۡطِلُونَ ٤٨﴾ [ العنكبوت : 48]

“আর তুমি তো এর পূর্বে কোনো কিতাব তিলাওয়াতকর নি এবং তোমার নিজের হাতে তা লিখ নি যে,বাতিলপন্থীরা এতে সন্দেহ পোষণ করবে”। [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৮]

এ উম্মতের ওপর আল্লাহর মহান নি‘আমত যে, তিনি তাদেরকে এ মহান দীন দান করেছেন। তারা অপর থেকে এ কিতাব গ্রহণ করে নি, বরং তারা রাসূলের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে গ্রহণ করেছে। [উমদাতুল কারি: (১০/২৮৬)।]

সাত. এ উম্মত নিজেদের ইবাদত ও ইবাদতের সময় নির্ধারণে শিক্ষা ও গণকদের মুখাপেক্ষী নয়। কারণ, শরী‘আত তা ধার্য করেছে দেখার ওপর, যা সবার নিকট সমান। [তাফসির ইবন কাসির: (১/১১৭)।]

আট. আমাদেরকে সিয়াম, সালাত ও অন্যান্য ইবাদত সম্পাদনে শিক্ষা ও গণকের মুখাপেক্ষী হতে বলা হয় নি, তার নির্দেশ দেওয়া হয় নি, বরং আমাদের ইবাদতের সম্পর্ক প্রকাশ্য নিদর্শনের সাথে, যেখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই সমান। [শারহু ইবন বাত্তাল আলাল বুখারী (৪/৩১-৩২); আল-মুফহিম: (৩/১৩৯); উমদাতুল কারি: (১০/২৮৭)।]

নয়. যে একমাস সিয়াম পালন করার মানত বা কসম করল, যেমন রজব বা শাবান, অতঃপর যখন সিয়াম আরম্ভ করল, মাস ঊনত্রিশে শেষ হলো, তাহলে সে মানত বা কসম পুরো করল। [মাআলিমুস সুনান আলা হামিশি আবু দাউদ (২/৭৪০)।]

দশ. কেউ যদি মানত করে অথবা কসম করে একমাস সিয়াম পালন করবে, কিন্তু সে নির্দিষ্ট করেনি, সে যদি ঊনত্রিশ দিন সিয়াম পালন করে, ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট হবে। কারণ, মাস সাধারণত এরূপ হয়। [আল-মুফহিম: (৩/১৩৮); খাত্তাবি মাআলিমুস সুনান: (২/৭৪০) উল্লেখ করেছেন। তার ত্রিশ দিন পুরো করতে হবে, তবে আমার নিকট কুরতুবির অভিমত অধিক বিশুদ্ধ মনে হয়। তিনি কেন ত্রিশ বললেন সেটা আমার নিকট স্পষ্ট নয়, অথচ মাস হয় ঊনত্রিশ দিনে।]

এগার. সন্দেহের দিন শাবানের মধ্যে গণ্য, তাকে রমযান গণ্য করা ঠিক নয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদ দেখার সাথে রমযান সম্পৃক্ত করেছেন। [আল-মুফহিম: (৩/১৪০)।]

বারো. হাদীস থেকে বুঝা যায়, চাঁদের জায়গা নির্ধারণের জন্য আধুনিক যন্ত্র যেমন দূরবীন ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া দোষের নেই, চাঁদ দেখার সুবিধার্থে। এটা হাদীসে নিষিদ্ধ গণনার অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে চোখে দেখা অধিক গ্রহণ যোগ্য। [শাইখ ইবন বায রহ. কে দূরবীন দ্বারা দেখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন এটা ব্যবহার করা দোষের নয়, কারণ এটাও দেখার অন্তর্ভুক্ত, গণনার অন্তর্ভুক্ত নয়। মাজমু ফাতাওয়া ও রাসায়েল: (১৫/৬৯-৭০)।]

৬২
৫৯. শাওয়াল মাসের ছয় রোযার ফযীলত
আবু আইয়ূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتبَعَهُ سِتاً مِنْ شَوَّالَ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهرِ» .

“যে রমযানের সিয়াম পালন করল, অতঃপর তার অনুগামী করল শাওয়ালের ছয়টি, তা পুরো বছর সিয়ামের ন্যায়”। [মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৪।]

সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«صِيامُ رَمَضَانَ بِعَشرَةِ أَشْهُر، وصِيَامُ السِّتَّةِ أيَّامٍ بِشَهرَينِ فذَلك صِيَامُ السَّنَة» .

“রমযানের সিয়াম দশ মাসের সমতুল্য, ছয়দিনের সিয়াম দুই মাসের সমতুল্য, এটাই পূর্ণ বছরের সিয়াম”।

অপর বর্ণনায় রয়েছে:

«مَنْ صَامَ سِتَّةَ أيَّامٍ بَعْدَ الفِطْرِ كَانَ تَمامَ السَّنة ﴿مَنْ جَاءَ بِالحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا﴾ [ الأنعام :160]».

“যে ঈদুল ফিতরের পর ছয়দিন সিয়াম পালন করবে, তা পূর্ণ বৎসরে পরিণত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যে সৎকাজ নিয়ে এসেছে, তার জন্য হবে তার দশ ‎‎ গুণ”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬০] [আহমদ: (৫/২৮০); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৭১৫; দারামি, হাদীস নং ১৭৫৫; নাসাঈ ফিল কুবরা, হাদীস নং ২৮৬০; সহীহ ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২১১৫৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৬৩৫।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. শাওয়ালের ছয় রোযার ফযীলত প্রমাণিত হয়। প্রতি বছর রমযানের সিয়ামের সাথে যে শাওয়ালের ছয় সাওম পালন করল, সে সারা বছর সাওম রাখল।

দুই. বান্দার ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত, তিনি বান্দার অল্প আমলের বিনিময়ে অনেক সাওয়াব ও বিরাট প্রতিদান প্রদান করেন।

তিন. ঈদের পর দ্রুত শাওয়ালের ছয় সাওম পালন করা, যেন এ সাওম ছুটে না যায়, কিংবা কোনো ব্যস্ততা এসে না পড়ে।

চার. শাওয়ালের শুরু-শেষ বা মাঝে, এক সঙ্গে বা পৃথকভাবে এ সাওম রাখা বৈধ। বান্দা যেভাবে তা সম্পাদন করুক, সে আল্লাহর নিকট এর পূর্ণ সাওয়াব লাভ করবে, যদি আল্লাহ তা কবুল করেন। [ইবন কুদামার মুগনি: (৪/৪৪০); শারহুন নববী আলা মুসলিম (৮/৫৬)।]

পাঁচ. যার ওপর রমযানের কাযা রয়েছে, সে প্রথমে কাযা আদায় করবে, অতঃপর শাওয়ালের ছয় সাওম আদায় করবে। হাদীসের বাণী থেকে এমন বুঝে আসে, কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে রমযানের সাওম রাখল” অর্থাৎ পূর্ণ রমযান। যার ওপর কাযা রয়েছে, সে পূর্ণ রমযান সাওম রাখে নি। তার ওপর পূর্ণ রমযান সাওম রাখা প্রয়োগ হয় না, যতক্ষণ না সে কাযা করে। [শারহুল মুমতি: (৬/৪৬৬)।] দ্বিতীয়ত নফল ইবাদতের চেয়ে ওয়াজিব কাযা আদায় করা বেশি শ্রেয়।

ছয়. আল্লাহ তা‘আলা ফরযের আগে নফলের বিধান রেখেছেন, যেমন নফলের বিধান রেখেছেন ফরযের পর। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পূর্বাপর সুন্নাত রয়েছে, অনুরূপ রমযানের সিয়ামের পূর্বাপর সিয়াম রয়েছে। অর্থাৎ শাবান ও শাওয়ালের সিয়াম।

সাত. এসব নফল ইবাদত ফরযের মধ্যে ঘটে যাওয়া ত্রুটিসমূহ দূর করে। কারণ, এমন সাওম পালনকারী নেই যে অযথা বাক্যালাপ, কু-দৃষ্টি ও হারাম খাবার ইত্যাদি দ্বারা তার রোযার ক্ষতি করে নি।

৬৩
৬০. ঈদের বিধান
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন সেখানে দু’টি দিন ছিল, সেদিন দু’টিতে তারা আনন্দ-ফুর্তি করত। তিনি বললেন: এ দু’টি দিন কী? তারা বলল: আমরা জাহেলি যুগে এতে আনন্দ-ফুর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তোমাদের এ দিন দু’টির পরিবর্তে আরো উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন: ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১১৩৪; নাসাঈ: (৩/১৭৯); আহমদ: (৩/১০৩); আবু ইয়ালা, হাদীস নং ৩৮৪১। হাকেম হাদীসটি মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ বলেছেন: (১/৪৩৪), হাফেয ফাতহুল বারিতে সহীহ বলেছেন: (২/৪২২) আলবানি সহীহ আবু দাউদে সহীহ বলেছেন।]

আবু উবাইদ মাওলা ইবন আযহার বলেন, “আমি উমার ইবন খাত্তাবের সাথে ঈদ করেছি, তিনি বলেন, এ দু’টি দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম নিষেধ করেছেন: রমযানের সিয়াম শেষে তোমাদের ঈদুল ফিতরের দিন। দ্বিতীয় দিন হচ্ছে ঈদুল আযহা, সেদিন তোমরা তোমাদের কুরবানী থেকে খাবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৩৭।]

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু‎ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও কুরবানির ঈদের সাওম পালন নিষেধ করেছেন”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮২৭।]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা‎ থেকে বর্ণিত, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর দিনে বের হন, অতঃপর দুই রাকাত সালাত আদায় করেন, তার পূর্বাপর কোনো সালাত আদায় করেন নি”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৮৪।]

উম্মে আতিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন যুবতী, ঋতুবতী ও কিশোরীদের নিয়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে যাই, তবে ঋতুবতীরা সালাত থেকে দূরে থাকবে, তারা দো‘আ ও কল্যাণে অংশ গ্রহণ করবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৯০।]

শিক্ষা ও মাসায়েল:‎

এক. আল্লাহ তা‘আলা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দান করে এ উম্মতের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। মুসলিম উম্মাহকে তিনি এর মাধ্যমে জাহেলি ঈদ ও উৎসব থেকে মুক্ত করেছেন।

দুই. আমাদের দু’টি ঈদ কাফিরদের ঈদ ও উৎসব থেকে বিভিন্ন কারণে আলাদা ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যেমন,

(১) আমাদের ঈদ চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল, গণনার ওপর নয়, যেমন কাফিরদের উৎসবগুলো গণনার উপর নির্ভরশীল।

(২) আমাদের দু’টি ঈদ মহান ইবাদত ও ইসলামের ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, সিয়াম, যাকাতুল ফিতর, হজ ও কুরবানী।

(৩). দুই ঈদে সম্পাদিত কাজগুলো ইবাদত, যা বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য দান করে। যেমন, তাকবীর, সালাতুল ঈদ ও খুতবা ইত্যাদি, কাফিরদের ঈদ ও উৎসবের বিপরীত, যেখানে কুফর ও গোমরাহির প্রদর্শন হয়, বিভিন্ন প্রবৃত্তি ও শয়তানি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়।

(৪) দুই ঈদের দিনে অনুগ্রহ, দয়া ও পরস্পর দায়িত্বশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যেমন সদকাতুল ফিতর, হাদিয়া ও কুরবানী।

(৫) আমাদের দু’টি ঈদ ভ্রান্ত আকীদা ও কুসংস্কারের সাথে সম্পৃক্ত নয়। যেমন, নববর্ষ, নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু, কারো স্মরণ, কোনো ব্যক্তির মর্যাদা অথবা সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তার সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং এ ঈদ দু’টি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য।

আমাদের ওপর ওয়াজিব হচ্ছে এসব নি‘আমতের মোকাবিলায় আল্লাহ তা‘আলার শোকর আদায় করা, তার নির্দেশ পালন করা ও তার নিষেধ থেকে বিরত থাকা, ঈদ, খুশি ও আনন্দের দিনে।

তিন. ঈদের দিন আল্লাহর নি‘আমতের না-শোকরি হচ্ছে ফরয ত্যাগ করা, নারীদের পোশাক-আশাকে শিথিলতা অবলম্বন করা ও পুরুষদের সাথে মেলামেশা করা। পোশাক-আশাক, পানাহার ও অনুষ্ঠানে অপচয় ও গান-বাদ্য করা।

চার. ঈদের দিন সুন্নাত হচ্ছে ঈদের সালাতের জন্য গোসল করা ও সুন্দর পোশাক পরিধান করা। আমাদের সালাফে সালেহীন বা উত্তম পূর্ব পুরুষগণ অনুরূপ করতেন।

পাঁচ. ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সকালে খেজুর খাওয়া সুন্নাত, কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুরূপ করেছেন। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে ঈদের দিন দ্রুত পানাহার করা সুন্নাত।

ছয়. ঈদের সালাতে বাচ্চা ও নারীদের যাওয়া সুন্নাত, তারা সালাতে উপস্থিত হবে ও মুসলিমদের দো‘আয় অংশ গ্রহণ করবে। ঋতুবতী নারীরা সালাতের স্থান থেকে দূরে থাকবে, তারা শুধু খুতবা ও দো‘আয় অংশ গ্রহণ করবে।

সাত. ঈদের সালাতে হেঁটে যাওয়া সুন্নাত, অনুরূপ এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ও অপর রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত।

আট. সালাত শেষে খুৎবা শ্রবণ করা ও দো‘আয় আমীন বলার জন্য সালাতের স্থানে বসে থাকা উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋতুবতী নারীদের ব্যাপারে বলেছেন: ‘তারা কল্যাণ ও মুসলিমদের দো‘আয় অংশ গ্রহণ করবে”।

নয়. ঈদের সালাতে পূর্বাপর সালাত নেই, কিন্তু মুসলিম যখন মুসল্লা অথবা মসজিদে প্রবেশ করে, সে দুই রাকাত সালাতের ব্যাপারে আদিষ্ট, নিষিদ্ধ সময়ে পর্যন্ত। কারণ, তাহিয়্যাতুল মসজিদ মসজিদে প্রবেশের কারণে জরুরি হয়, যা নিষিদ্ধ সময়ে আদায় করা বৈধ।

দশ. ইমাম সাহেবের অপেক্ষার সময়ে তাকবীরে লিপ্ত থাকা উত্তম, কারণ, এটা ইবাদতের সময়, এ মুহূর্তে সে কুরআন তিলাওয়াত বা নফল সালাত আদায় করতে পারে, যদি নিষিদ্ধ সময় না হয়, তবে তাকবীরে মশগুল থাকা উত্তম।

এগার. যদি লোকেরা সূর্য ঢলার পূর্বে ঈদ সম্পর্কে জানতে না পারে, তাহলে পরদিন সালাত আদায় করবে। যদি কেউ ঈদের সালাতে ইমামের তাশাহহুদে অংশ গ্রহণ করে, সে তার সাথে বসে যাবে, অতঃপর দু’রাকাত কাযা করবে ও তাতে তাকবীর পড়বে।

বার. ঈদের সালাত ছুটে গেলে বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী তার কাযা নেই। কারণ, ঈদের সালাত কাযা করার কোনো দলীল নেই।

তের. ঈদের দিন আনন্দ করা বৈধ, যদি সীমালঙ্ঘন অথবা ওয়াজিব বিনষ্ট না হয়। মুসলিমদের উচিৎ ঈদের দিন পরিবারে সচ্ছলতার ব্যবস্থা করা। কারণ, ঈদের দিন আনন্দ করা দীনের একটি অংশ।

চৌদ্দ. ঈদের দিন খাবারে অনেক লোক একত্র হওয়া ভালো, কারণ, এতে ঈদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধন দৃঢ় হয় ও মুসলিমদের জমায়েত হয়।

পনের. ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে কোনো সমস্যা নেই, আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে বর্ণিত, ঈদের দিন সাক্ষাতের সময় তারা পরস্পরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। তারা বলতেন: تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُم . “আল্লাহ আমাদের থেকে ও আপনাদের থেকে কবুল করুন”। তবে শুভেচ্ছার শব্দ দেশ ও অঞ্চল অথবা সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, যদি হারাম শব্দ অথবা কাফিরদের সাথে সামঞ্জস্য না হয়, যেমন তাদের হারাম উৎসবে ব্যবহৃত শুভেচ্ছা পদ্ধতি গ্রহণ করা।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন