মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
শান্তির ধর্ম ইসলাম কি করে বলতে পারে এক হাতে তরবারি অন্য হাতে কুরআন নিয়ে ধর্ম প্রচার করত? আমাদের পূর্ব আলোচনা থেকে যতদূর বোঝা গেল তাতে ধরে নেয়া যায়, ইসলাম যারা গ্রহণ করেছিলেন বা এখনো করছেন তা শুধু তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে বা নীতির আকর্ষণেই।
ইসলাম ধর্ম যখন আর্য ধর্মের মত ভারতে এল তখন সাথে সাথে ভারত বর্ষের লাখ লাখ মানুষ আরবী ভাষা শিখে, পড়ে, বুঝে এবং ভারতীয় ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সাথে মিলিয়ে দেখে পুরাতনকে বাদ দিয়ে নতুন ধর্ম ইসলামকে হৈ হৈ করে গ্রহণ করল-একথা মোটেই সত্য নয়, আর যুক্তিসঙ্গতও নয়। কারণ তখনকার মানুষ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অশিক্ষিত। দ্বিতীয় কথা ধর্ম মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণ জাতির অধিকারে ছিল, ফলে অব্রাহ্মণরা ধর্ম সম্বন্ধে কিছু পড়বার বা মাথা ঘামাবার অধিকার পায়নি, তাই সক্ষমও হয়নি।
এটা হতে পারে, তখন হিন্দু ধর্ম এমন রক্ষণশীল ছিল যে অব্রাহ্মণ আর অনুন্নত শ্রেণীর মানুষেরা নানভাবে নির্যাতন ভোগ করে সমাজে লাঞ্ছিত হয়ে বাস করছিলেন। ঠিক এ সময়ে যাঁরাই তাদের শান্তি ও মৈত্রীর সন্ধান দিয়েছিলেন তাদের বরণ করে নেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। এরকম কথা আমার পক্ষে লেখার অনেক অসুবিধা আছে, কারণ সে লেখা বাজেয়াপ্ত হতে পারে। শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্যই মুসলমানরা ভারতে আসতেন এ কথা সর্বাংশে সঠিক নয়।
ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, “আমরা দেখেছি যে মালবার উপকূলে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির আগে থেকেই আরব বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল, বাণিজ্যের সমৃদ্ধির জন্য শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা তাঁরা বিশেষ জরুরী মনে করত এবং দেশের ভারতীয় শাসকদের এ ব্যাপারে সাহায্য করত। স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আরব বণিকদের অসম্ভাবের কোন সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। এর থেকে ধরে নেয়া যায় যে নিতান্ত বাস্তব কারণেই উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল। পরে এ আরবরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তখন থেকে তারা পরিচিত হয় মুসলমান বলে।” শ্রীগুপ্ত আরও লেখেন-“আরব বণিকরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে ইসলামকে কেরালায় নিয়ে আসে, কেরালাস্থিত তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে ইসলাম প্রচার করে তখন এ বণিকদের স্থানীয় কর্মচারীরাও, যাদের একটা বড় অংশ বণিকদের জন্য কায়িক শ্রম করত, ইসলামের আদর্শ ও বক্তব্য সম্বন্ধে জানতে পারে। তারা
জানতে পারে এমন এক শাস্ত্রের কথা, যাতে বলা হয়েছে-মানুষকে আলাদা আলাদা জাতিতে জন্ম দেয়া হয়েছে বটে কিন্তু জন্ম দিয়ে নয়, মানুষের বিচার হয় তার স্বভাব-চরিত্র দিয়ে (৪৯, ১৩-১৫)। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত কেরালার জনসাধারণ ইসলাম ধর্মের মধ্যে মানুষ হিসেবে বাঁচার ডাক শুনতে পেল।"
শ্রীগুপ্ত পরে আরও লিখেছেন, “ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলোর চাপে কেরালার জনসাধারণ যখন মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছে তখন ইসলাম ধর্মের আগমন ও আহ্বান। এ আহ্বানে তারা প্রচণ্ড উৎসাহে সাড়া দিল এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করল। তুহফাতুল মুজাহিদিন' এর লেখক জৈনুদ্দিন লিখেছেন, 'যদি কোন হিন্দু মুসলমান হত তাহলে অন্যেরা তাকে এ (নিম্নবর্ণে জন্মের) কারণে ঘৃণা করত না, অন্য মুসলিমদের সাথে যে রকম বন্ধুত্ব নিয়ে মিশত, তার সাথেও সেভাবে মিশত। মানুষের মূল্য পাবে, সমাজে মানুষের মত ব্যবহার পাবে-এটা ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ। (দ্রঃ দাশগুপ্তের ভারত বর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ১২৭ - ২৮)
অত্যন্ত মূল্যবান তথ্যাপলব্ধি করে এটা ধরনা যায় যে, একহাতে অস্ত্র আর অন্য হাতে শাস্ত্র নিয়ে বল প্রয়োগের কথাটি মুসলিম জাতির প্রতি অন্যায় প্রয়োগ মাত্র। এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে-তাহলে এ নিয়ম অব্যাহত থাকলে কেরালা ও বাংলায় সমস্ত মানুষ মুসলমান হয়ে গেলেন না কেন? তার একাধিক উত্তরের মধ্যে অন্যতম সদুত্তর হচ্ছে, এ বাংলায় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের আবির্ভাবে এ স্রোত থেমে যায়। তিনি ইসলাম ধর্মের মূলবস্তু একেশ্বরবাদ আর সামাজিক সহজ স্বাভাবিক নিয়মনীতি সামনে রেখে যে মতবাদ আনেন সেটাকে অনুন্নত অবহেলিতরা ইসলামের বিকল্প বলে মনে করে ইসলাম গ্রহণ না করেও রেহাই পাওয়ার রাস্তা পেয়ে যান। তেমনি কেরালাতে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব হয়। তিনিও ইসলাম ধর্ম সামনে রেখে সহজ মতবাদ প্রচার করেন এবং বহুদেবদেবী পূজার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন।
যদি এ কথাটি প্রামাণ্য ও সত্য হয় তাহলে চৈতন্য ও শঙ্করাচার্যের কথা মনে করে বহির্ভারত হতে ইসলাম আগমন তথা ইসলাম ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ক্রোধ এ দুটোর মধ্যে কোনটা সংযুক্ত হবে? তখন শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হয়—তিনি দেশজ ধর্মকে এতটা বিস্তৃত করেন যে ইসলাম গ্রহণের অনেক প্রয়োজনীয়তাই তাতে মিটে যায়।” ঐতিহাসিক দাশগুপ্ত আরও লিখেছেন,
অর্থাৎ মেনে নেয়া ভাল যে শঙ্করাচার্য ইসলাম ধর্মের ভিত্তি ও বিস্তারিত বক্তব্য সম্বন্ধে পরিপূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। বহুদেব-দেবীর পুজা মিথ্যা এবং ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এ কথাটা সমগ্র ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে শঙ্করাচার্য যেমন অমোঘরূপে ঘোষণা করেন তেমনটি তার আগে ও পরে আর কেহ করেন নি। তার এ আপোষহীন একেশ্বরবাদ ইসলাম ধর্মের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। এ কথা আরও বহু ধর্মে বলা হয়ে থাকলেও সে সব ধর্মের ঘোষণা নিয়ে ব্যাখ্যার অবকাশ আছে। কিন্তু ইসলামের 'একেশ্বরবাদ আর শঙ্করাচার্যের একেশ্বরবাদ এমন একাগ্র ও সুস্পষ্ট যে তাকে ব্যাখ্যার নামে
জালে আবৃত বা জটিল করার কোনও সুযোগ নেই। শঙ্করাচার্য এ সুনিশ্চিত একেশ্বরবাদ পেলেন কোথা থেকে? সঙ্গত কারণেই সন্দেহ হয় যে, এ সরল ও সুদৃঢ় একেশ্বরবাদ চার্য ইসলাম হতেই পেয়েছিলেন। শঙ্করাচার্য কথিত ঈশ্বরের সাথে ইসলামের বর্ণিত আকার ভেদ নাই, অন্তর্নিহিত সত্যে উভয়ই এক।" (এ পুস্তকের পৃষ্ঠা ১২৮,১২৯)
তাছাড়া ডঃ তারাচাদ বাবুও লিখেছেন—It may. therefore be premised without overstraining facts that, if in the development of Hindu religions in the South, any foreign elements are found which inake their appearance after the 7th century and which cannot accounted for the natural development of Hiduism itself, they may with much probability be ascribed to the influence of Islam. 6: Influence on Islam of Indian Culture by Dr. Tarachand
ভারতে পুরোহিততান্ত্রিক অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল বলে যদি কোন সংখ্যালঘু অথবা মুসলমান লেখক লিখেন তা সত্যি হলেও কলে কৌশলে তাঁর বই বাজেয়াপ্ত হতে পারে। সুতরাং কিছু অমুসলমান ও বিদেশী লেখকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বইটিকে বাঁচতে দেয়াই ভাল।। হয়ত মুসলিম অভিযানে বা কোন মুসলিম চরিত্রের প্রভাবে দলে দলে আকস্মিকভাবে ভারতীয়রা ইসলামাদর্শ গ্রহণ করে। আবার যখন নানা কারণ, যথা ধর্মের প্রতি পূর্ব মমতা অথবা স্বার্থ পূরণে ব্যর্থতা ইত্যাদির জন্য হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে সে নওমুসলিমদের আর হিন্দু ধর্মে স্থান দেয়া যেত না।
শ্রীদাশগুপ্ত লিখেছেন, “বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো। প্রথম ঝাপটা চোটে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা অনেকে পরে আবার হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে, কিন্তু ক্রমে হিন্দুধর্মে প্রবর্তাবর্তনের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে ইসলাম গ্রহণে অনেককে যেমন বলপূর্বক বাধ্য করা হয়েছিল তেমনই ইসলাম ধর্ম দু বাহু প্রসারিত করে ভারতীয়দের আপন বক্ষে আমন্ত্রণও জানিয়েছিল-ফলে হিন্দু সমাজে নবগঠিত সংকীর্ণ ও কঠোর আইন কানুনে জর্জরিত-বিশেষ করে নিম্নবর্ণের ও অস্পৃশ্য জাতিগুলো একই সাথে মানবিক ব্যবহার লাভের ও শাসক শ্রেণীতে উন্নয়নের প্রত্যাশাতে ইসলামকে বরণ করে নিতে অগ্রসর হয়েছিল, কেননা স্বধর্মাবলম্বীদের প্রতি মুসলিম সমাজ একান্তরূপে গণতান্ত্রিক ও সমদশী-আপন সমাজকে সুসংহত করার জন্য হিন্দু-নেতারা অনুশাসনাদিকে যতই সংকুচিত করতে থাকলেন ততই তাদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্যে একদল, যাদেরকে বলা হয় নির্যাতিত হিন্দু তারা আরও বেশি করে ইসলামের কাছে আশ্রয়প্রার্থী হল।” (এ পুস্তকের পৃষ্ঠা ৫৪ দ্রষ্টব্য)
ব্রাহ্মণ্যশক্তি ভারতের বৌদ্ধদের প্রতি এত বেশি অত্যাচার করত যা অতীব দুঃখের বিষয়। বৌদ্ধরা মাথা মুণ্ডন বা নেড়া করতেন। অত্যাচার যখন সহ্যসীমা অতিক্রম করে যখন তারা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধদের বলা হত নেড়ে', তাই মুসলমানদেরকে অনেক অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকেরা নেড়ে বলে থাকেন। এ নেড়ে কথাটি যতদিন থাকবে ততদিন ভারতীয় প্রাচীন হিন্দুদের বৌদ্ধদের প্রতি অত্যচারের ইতিহাসকে জীবন্ত করে রাখার সামিল হবে। এ নেড়ে তথ্যের প্রমাণ এ পুস্তকের ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠা। শুধু বৌদ্ধরা নন ভারতের আর একটা বিরাট জাতি জৈন।
তারাও অত্যাচারের বন্যায় ভেসে গেছেন এবং হয় মুসলমান হয়েছেন অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন। শ্রীদাশগুপ্ত বলেন, “বাংলার বৌদ্ধের মত দক্ষিণ ভারতের জৈনরাও রক্ষণশীল শৈব হিন্দুদের হাতে নিপীড়িত হয় এবং একবার একদিনে আট হাজার জৈনকে শূলে হত্যা করার কথা তামিল পরাণেই উল্লিখিত হয়েছে। সুস্পষ্টতই এ সময়টাতে ব্রাহ্মণ হিন্দুধর্ম পরমসহিষ্ণুতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। এ জাতীয় অসহিষ্ণুতার সব চাইতে চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত শ্রীরঙ্গমের পরম শৈবরাজা প্রথম কুলোত্তুঙ্গ স্থাপন করে গেছেন-তার প্রতাপে স্বয়ং
রামানুজ তার শিষ্যবৃন্দ সহ ১০৯৬ খৃষ্টাব্দে মহীশুরের হয়সাল রাজা বিষ্ণুবর্ধনের আশ্রয়ে পলায়ন করেন এবং তারপরে কুড়ি বছরের মধ্যে তিনি আর শ্রীরঙ্গমুখো হননি। শ্রীরঙ্গম ছেড়ে রামানুজের ১০৯৬ খৃস্টাব্দের পলায়ন ভারত বর্ষের ইতিহাসে একটি অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, কিন্তু সে তাৎপর্য উদ্ধারের চেষ্টা বিখ্যাত ঐতিহাসিকেরা অল্পই করেছেন।” (দ্রঃ ঐ পুস্তকের ৫৫ পৃষ্ঠা
পুরোহিতদের বা ব্রাহ্মণ্যবাদের কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক দাশগুপ্ত লিখেন, 'শুদ্রকে স্পর্শ করলে সবস্ত্র স্নান ও উপবাসে শুদ্ধির প্রথাও প্রচলিত করা হয়। চণ্ডাল জাতিকে প্রাচীন স্মৃতিকারগণও অস্পৃশ্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন, কিন্তু এ কালের সমাজপতিরাই আরও কয়েক পা এগিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে চণ্ডালকে দেখা বা তার সাথে কথা বলা বা তার ছায়া মাড়ানো প্রভৃতিও প্রায়শ্চিত্তযোগ্য পাতক। বোধকরি এসবের মধ্যে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এমন যে, এ টীকাকার বৈজয়ন্তী-প্রণেতা শুধু ওসবে সন্তুষ্ট হননি; বৌদ্ধ, জৈব, লোকায়তিক বা বস্তুতান্ত্রিক ও নাস্তিককেও তিনি অস্পৃশ্যদের তালিকাভুক্ত করেন।” (দ্রঃ ঐ, ৫২ পৃষ্ঠা
স্ত্রীর যেন কোন স্বাধীনতা না থাকে, গৃহকর্মের বাইরে কোনরকম মন দেয়ার সুযোগ না থাকে তার নির্দেশ ছিল। তাছাড়া বিজ্ঞানেশ্বর অপরাক ও মৃত্যার্থসার-প্রণেতার মতে স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীর আত্মদাহ (চিতায় পুড়ে মরা) অবশ্য কর্তব্য, তবে একালের সমস্ত টীকাকারই গোমাংশ ভক্ষণে গুরুত্ব পাপের পরিচয় পেয়েছেন-গোমাংস ভক্ষণ কোন কালেই ভারত বর্ষে তেমন জনপ্রিয় ছিল না অথবা বহুল প্রচলিত ছিল না, কিন্তু মুসলিম সংযোগের ফলে এ বিষয়ে বিদ্বেষ জেগেছিল বলেই মনে হয়। গম বা গমজাত খাদ্যকে স্নেহুভোজ্য অতএব অবশ্য পরিহার্য বলেছেন বৈজয়ন্তী-প্রণেতা। এর থেকে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে মুসলিম সংযোগের দরুণ হিন্দু মানসে প্রতিক্রিয়া কতদূর গিয়েছিল তা সুস্পষ্ট বোঝা যায়। বাস্তব প্রয়োজনের চাপে গম বা গমজাত খাদ্য (পাউরুটি, রুটি, লুচি, পরোটা) বর্জন করা সম্ভব হয়নি।' (দ্রষ্টব্য ঐ, পৃষ্ঠা ৫৩)
একটু আগে ঐতিহাসিক সুরজিত্যাবুর উক্তিতেও বলপ্রয়োগ' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে-কিন্তু বলপ্রয়োগের তাৎপর্য জানা দরকার। ধর্মমন ও মস্তিষ্কের একটা খোরাক। জোর করে তরবারি দেখিয়ে একজন কংগ্রেসকে বলা যেতে পারে আমি আজ হতে অকংগ্রেস, জোর করে অস্ত্র দেখিয়ে কোন কমিউনিষ্টকে বলান যেতে পারে আমি আজ হতে অকমিউনিষ্ট, জোর করে মুসলমানকে বলান যেতে পারে আমি হিন্দু কিংবা জোর করে কাউকে বলান যেতে পারে আমি মুসলমান।
কিন্তু এ মুখের কথাটুকু মনের গভীরে অথবা মস্তিষ্কের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেতে পারে কি? ' আসলে আমাদের প্রাচীন ভারতীয় অশুদ্ধ পৌরহিত্য যেমনই উদ্ভট, অসামাজিক ও অশ্লীল হোক না কেন তার বিরুদ্ধে টু শব্দ করার উপায় ছিল না হয়ত। রমেশ চন্দ্র মজুদদার লিখেছেন-“শারদীয় দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীর দিন শাবরোৎসব নামে এক প্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হত। শবর জাতির ন্যায় কেবলমাত্র বৃক্ষপত্র পরিধান করিয়া এবং সারা গায়ে কাদা মাখিয়া ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে লোকেরা অশ্লীল গান গাহিত এবং তদনুরূপ কুৎসিত
ভঙ্গী করিত। জীমূত বাহন ‘কাল-বিবেক গ্রন্থে যে ভাষায় এই নৃত্যগীতের বর্ণনা করিয়াছেন বর্তমান কালের রুচি অনুসারে তাহার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করাও আছে। অথচ নিই লিখিয়াছেন, যে ইহা না করিবে ভগবতী ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে নিদারুণ শাপ দিবেন। সর্ম পুরাণে কতিপয় অশ্লীল শব্দ সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে যে ইহা অপরের সমমুখে উচ্চারণ
কর্তব্য করা কর্তব্য নহে, কিন্তু আশ্বিন মাসে মহাপূজার দিনে ইহা উচ্চারণ করিবে-তবে মাতা, ভগিনী এবং শক্তিমন্ত্রে অদীক্ষিতা শিষ্যার সম্মুখে নহে। ইহার সপক্ষে এই পুরাণে যে যুক্তি দেওয়া হইয়াছে, শ্লীলতা বজায় রাখিয়া তাহার উল্লেখ করা যায় না।” (রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলাদেশের ইতিহাসের ১৮৯ পৃষ্ঠা)
শ্রীমজুমদার আরও লেখেন-“সে যুগের স্মার্ত পণ্ডিতগণ প্রামাণিক গ্রন্থে অকুণ্ঠিত চিত্তে লিখিয়াছেন শূদ্রাকে বিবাহ করা অসঙ্গত কিন্তু তাহার সহিত অবৈধ সহবাস করা তাদৃশ নিন্দনীয় নয়।” (পৃষ্ঠা ১৯৩) তিনি আরও লিখেছেন, “কঠোর জাতিভেদ প্রথা তখন ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য জাতির মধ্যে একটি সুদৃঢ় ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছিল।” (ঐ পৃষ্ঠা ২৩৮)
ব্রাহ্মণ্যবাদ এতই চরমসীমায় পৌঁছেছিল যে, যেটাই ঘোষিত হোত সেটাই ঈশ্বরবাক্য বলে মেনে নিতে হত সমাজকে। বিদ্রোহ, বিরোধিতা বা সমালোচনার যথেষ্ট অবকাশ ছিল বলে মনে হয় না। তাই শ্রীদাশগুপ্ত লিখেছেন, “পরে সেন রাজাদের আমলে প্রচণ্ড আগ্রহে ও প্রচারের জন্য উৎসর্গিত প্রাণের উদ্দীপনায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয় এর ফলে বাঙ্গালী সমাজে মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণদের প্রতাপ এত বেশি বেড়ে যায় যে তা অচিরে অত্যাচার হয়ে দাড়ায়-যেমন প্রায়শ্চিত্তের অতীত পাপ বলে সমুদ্রযাত্রাকে নিষিদ্ধ করা হয়।” (সুরজিৎ দাশগুপ্তের ভারত বর্ষ ও ইসলাম পুস্তকের ৯৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
তিনি লিখেছেন যে, কিন্তু তলিয়ে দেখলে মানতে হবে যে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনঃ প্রতিষ্ঠা বাঙ্গালী সমাজকে অসাড় ও জড়বৎ করে ফেলেছিল, দুর্বল করে ফেলেছিল সঙ্শক্তিকে, উপরন্তু সমাজপতিতের প্রতি জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য সংখ্যাকে বিরূপ করে তুলেছিল।” এমন বৈজ্ঞানিক মন্ত্রতন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল যদি তা আলোচনা করা হয় তাহলে আজকে মানুষ বেশ অবাক হবে।
ঐতিহাসিক দাশগুপ্ত আরও লিখেছেন, “এ সময় এরূপ বিধান দেয়া হয়েছিল যে দেশ যদি শত্রু সৈন্য কর্তৃক আক্রান্ত হয়তাহলে সাদা অপরাজিতা (গাছের) মূল ধুতুরা পাতার রসে বেটে কপালে তিলজ এঁটে মন্ত্র জা করতে হবে-ওং অং হ হলিয়া হে মহেলি বিহঞ্জহি সাহিনেহি মশা নেহিত খাহিলুঞ্চহি কিলি কিলি কালি হং ফট স্বাহা।” (পৃষ্ঠা ৯৯)
নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়া নিসন্দেহে ঐতিহাসিক ভ্রান্তি। ভারতের মুসলিম অঞ্চলগুলোর মধ্যে কেরালায় আজ এত মুসলমান কেন? সেখানে অস্ত্র দিয়ে বলপূর্বক ধর্মান্তর ঘটান হয়েছে-এটা যে নিছক বাজে কথা তা আগের আলোচনায় দেখান হয়েছে-তবুও কেরালা ও রাজস্থানের সামাজিক আলেখ্য আরও দু একটি নিয়ে আসছি।
“কেরালার নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের অমানুষিক ব্যবহার অকল্পনীয়। রাজস্থানে এ বর্ণভেদ প্রথা যে বাংলার চাইতে কত সহস্র গুণ ভয়াবহ তা আমার স্বচক্ষে দেখা-সাধারণত নিম্নবর্ণের লোকদের বর্ণ অনুসারে পৃথক পৃথক পোশাক ও গহণা আছে এবং নিম্নবর্ণ লোকের পক্ষে এমন সাজপোশাক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যা উচ্চবর্ণের লোকের উপযুক্ত সাজপোশাক-১৯৭৪ এর ডিসেম্বরে লক্ষ্য করেছি যে শহরাঞ্চলে কিংবা যোধপুর জেলার অন্তর্গত বোন্দার মত গ্রামে এসব বিধিবিচার শিথিল হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ১৯৬৫ তে এসব নিয়ম অনেক কঠোর দেখেছিলাম।
১৯৭২ এর ২৭ শে নভেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকাতে ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে উত্তর প্রদেশের এক হাজার হরিজনের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের খবর প্রকাশিত হয়, এর কিছুদিন পরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উত্তর প্রদেশের বান্দাতে ধনবান ব্রাহ্মণদের সশস্ত্র আক্রমণে গ্রামসুন্ধু হরিজনরা ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরে এসে জেলা কর্মকর্তার কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে-সে সময় দিল্লী যাওয়ার পথে এলাহাবাদ থেকে যাত্রীদের মুখে শুনি। রাঁচি-চক্রধরপুর রোডে অবস্থিত বাধগাঁওয়ের মিশনারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইকেল ভেদ্রা
আমায় বলেছিলেন, তার বাবা একবার উচ্চবর্ণের লোকদের মত হাঁটুর নিচে ধুতি পরেছিলেন, এবং তার এ স্পর্ধার জন্যে তাঁকে জমিদার বাড়ীতে ডেকে প্রচণ্ড প্রহার করা হয় এবং তারপরে তিনি খৃষ্টান হয়ে যান।” (পৃষ্ঠা ৯৪ - ৯৫)
এসব অত্যাচারিত, উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত মানুষেরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন তখন তাদের আচার-ব্যবহার পোশাক পরিচ্ছদ এবং নাম পর্যন্ত পাল্টে যেত, অর্থাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত।
“আগেই বলা হয়েছে যে, নিম্নবর্ণের লোকদের উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হত। এককালে কেরালাতে অমুকের স্ত্রী বা মেয়ে ইসলাম নিয়েছে বলা দরকারই হত না, তার বদলে শুধু 'কুপপায়ামিডুক' শব্দটি ব্যবহার করা হত-কুপপায়ামিড়ক শব্দটির অর্থ হল ‘গায়ে জামা চড়িয়েছে। অপমান-সূচক বা হীনতা-দ্যোতক এ রকম বহু আচার প্রথা ইসলামের প্রভাবে কেরালায় সমাজ থেকে দূরীভূত হয়। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের ফলে দাস প্রথাও বহুল পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত হয়।” (দ্রঃ ঐ পুস্তকের ১৩০, ১৩১ পৃষ্ঠা)
কুলীন ব্রাহ্মণ নামে যে গোষ্ঠী সেন আমল হতে শক্তিশালী হয়েছিল তাদের আচার ব্যবহার জানা থাকলে এ যুগের মানুষের অবাক হওয়ার অবকাশ আছে। মূল্যবান উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়-“কুলীন ব্রাহ্মণ হিসেবও রাখতেন না তারা কটি মেয়েকে বিবাহ করেছেন। তাদের মধ্যে কেহ কেহ অবশ্য একটি ছোট খাতায় বিয়ের ও বিয়ের পাওয়া যৌতুকের তালিকা লিখে নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্বশুরালয়ে গেলে শ্বশুররা তাদের কি কি জিনিস দিতেন তারও একটা তালিকা রাখতেন।” (অধ্যাপক শ্রীবিনয় ঘোষের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২০ পৃষ্ঠা ১৯৭৫ খৃষ্টাব্দে ছাপা)
ঐতিহাসিক অধ্যাপক শ্রীবিনয় ঘোষ লিখেছেন-“কুলীন জামাতারা যখন শ্বশুরগৃহ যান তখনই তাদের সম্মানার্থে শ্বশুরকে কিছু অর্থ বা কোনও উপহার দিতে হয়। এ প্রথার ফলে বিবাহ বেশ লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছে।
একটি ব্রাহ্মণের যদি ত্রিশটি স্ত্রী থাকে তবে প্রতি মাসে কয়েক দিনের জন্য শ্বশুরালয়ে গিয়ে থাকলেই ভাল খেয়ে ও উপহার পেয়ে এবং জীবিকা অর্জনের কোন চেষ্টা না করে তার সারা বছর কেটে যেতে পারে। বহুবিবাহ প্রথার ফলে কুলীন ব্রাহ্মণেরা এক নিষ্কর্মা, পরভুক শ্রেণী হয়ে উঠেছে এবং বিবাহের মত একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে নীতিহীনতার উৎস করে তুলেছে। শ্রীঘোষ আরও লিখেছেন, “অতএব কুলীন ব্রাহ্মণেরা জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন বহু বিবাহ করা। কুলীনরা বৃদ্ধ বয়সেও বিবাহ করে অনেক সময় স্ত্রীর সাথে তাদের সাক্ষাৎই হয় নঅথবা বড়জোর ৩/৪ বছর পরে একবারে জন্য দেখা হয়।
এমন কথা শোনা যায় যে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ এক দিনে ৩/৪টি বিবাহ করেছেন। কোনও কোনও সময় একজনের সব কয়টি কন্যার ও অবিবাহিতা ভগিনীদের একই ব্যক্তির সাথে বিবাহ দেয়া হয়। কুলীন কন্যাদের জন্য পাত্র পাওয়ার খুব অসুবিধা থাকায় বহু কুলীন কন্যাকে অবিবাহিতা থাকতে হত। কুলীনদের ঘরের বিবাহিতা বা কুমারী কন্যাদের খুব দুঃখের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। কুলীনদের এ ধরনের বহু বিবাহের ফলে ব্যভিচার, গর্ভপাত, শিশুহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির মত জঘণ্য সব অপরাধ সংঘটিত হয়। ৮০, ৭২, ৬৫, ৬০ ও ৪২ টি করে স্ত্রী আছে এমন ব্যক্তিদের কথা জানা গেছে-১৮, ৩২, ৪১, ২৫ ও ৩২ টি পুত্র সন্তান ও ২৬, ২৭, ২৫, ১৫ ও ১৬ টি কন্যা সন্তান আছে। বর্ধমান ও হুগলী জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এক এক ব্যক্তির এতগুলো করে স্ত্রীর অস্তিত্ব জানা গেছে।” (এ উদ্ধৃতিগুলো ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পুস্তকের ১১৬ এবং ১১৭ পাতা থেকে নেয়া হয়েছে)
কেহ যেন মনে না করেন এসব কাহিনী শুধু আদিম যুগের বরং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই এসব ঘটনা ঘটেছিল বলে ১৮৬৭ সনে দেশের লেফটেন্যান্ট গভর্ণরকে দরখাস্ত করা হয় যাতে আইন করে বহুবিবাহ তুলে দেয়া যায়। সে দরখাস্তে এ রকম সব তথ্যের প্রমাণ ছিল সে সাথে একথাও লেখা ছিল যে এসব রীতি নীতি হিন্দুধর্মে লেখা নাই বরং এগুলো মনগড়া আইন। তাছাড়া আরও বড় কথা, যে, ১৮৭১ ও ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর স্বয়ং বহুবিবাহ সম্বন্ধে দু'খানি বই লিখে ছিলেন।
“বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিলেন যে কৌলীন্য প্রথা এবং বাংলাদেশের কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে উচ্চবর্ণের কন্যা দানের বিশেষ রীতি আছে তার পিছনে কোন শাস্ত্রীয় বিধান নেই। তার বিরোধী পক্ষের সমস্ত যুক্তি তিনি এভাবে সম্পূর্ণরূপে খণ্ডন করলেন। কলকাতা শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী হুগলী কুলীনরা কিভাবে বহু বিবাহ করে থাকেন তার একটা তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। এসব কুলীনদের নাম এবং তাদের স্ত্রীদের একটা সংখ্যা তালিকা তার বইতে সংযোজন করেছিলেন।” (দ্রঃ শ্রীবিনয় ঘোষের ঐ বই, পৃষ্ঠা ১১৯-১২০)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই আদিম যুগের লোক নন। কারণ তাঁর জন্ম হয় ১৮২০ খৃষ্টাব্দে ২৬ সেপ্টেম্বর এবং তার মৃত্যু হয় ১৮৯১ খৃস্টাব্দের ২৯ শে জুলাই। ১৮২৬ সনে কলকাতার গোলদীঘি বা কলেজ স্কোয়ারে একটি নতুন বাড়ী তৈরি হল। এসেই একই বাড়িতে হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ স্থান পেয়েছিল। সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোন বর্ণের ছাত্র ভর্তি হত পারত না, আর মুসলমানদের ছেলে ভর্তি শ্রীবিনয় ঘোষ আরও লিখেছেন, “সুরুতে দুই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের পারস্পরিক মেলামেশা বন্ধ করার জন্য যে উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছিল তা হাস্যোদ্দীপক বলে মনে হয়।
দুই প্রতিষ্ঠানকে একটি দেয়াল দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল আর সে দেয়ালের উপর দেয়া ছিল লোহার গাদ, উদ্দেশ্য ছিল যাতে ‘দ্বিজ', শূদ্র' ছাত্ররা পরস্পর মেলামেশা না করতে পারে। এছাড়া তাদের একই ফটক-এর ভিতর দিয়ে ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল, অবশ্য তেমন চওড়া ফটকের হলে এবং ঢোকবার সময় উভয় শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি না হলে তবেই।
ভবনের মাঝের অংশকে বেড়া দিয়ে ঘিরে পাশের অংশ থেকে বিচ্ছিন্নকরে রাখা হয়েছিল যাতে এক কলেজের ছাত্ররা অন্য কলেজে প্রবেশ করতে না পারে। উপরন্তু দুই কলেজের সন্নিহিত উপগৃহ (আউট হাউস) ও দপ্তরগুলো আলাদা করে রাখা হয়েছিল যাতে ভারতীদের সুদৃঢ় বদ্ধমূল ধর্ম-বিশ্বাস ক্ষুন্ন না হয়'।” (পৃষ্ঠা ১৯)
ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক ছিলেন তিনি শুধু নিবেদন করেছিলেন কায়স্থ ছাত্রদেরও যেন এ কলেজে পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। কলেজের পণ্ডিতেরা, যারা বেশিরভাগ বিদ্যাসাগরের শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে এ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতে লাগলেন।” (পৃষ্ঠা ৪০)
তবে একটা কথা ঠিক বোঝা যায় না, ইংরেজরা বিদেশী অহিন্দু শুধু নয় ব্রাহ্মণ ও গোমাংস ভক্ষক। তবু তাদের সাথে মেলামেশা করা, তাদের সাথে মিশতে পেরে গর্ববোধ করা এবং তাদেরকে সংস্কৃত শিখিয়ে দেয়ার সময় কোন প্রকার ব্রাহ্মণ্য আইন তৈরি হয়নি।
হয়ত এও হতে পারে, ইংরেজির প্রতি উদারতা প্রদর্শন্তার অন্যতম কারণ, অথবা অন্য কিছু-এসব আলোচনায় দেশের ও দশের লাভ কি? আগেই বলা হয়েছে ভারতীয় মুসলমানদের অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মত মনে করলে ভুল করা হবে। বরং হিন্দু-মুসলমানদের সম্বন্ধ মাথা আর দেহের মত; বাকী সম্প্রদায়গুলো অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মত সুতরাং মুসলমানরা হিন্দু হতে পৃথক হয়ে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ
সৃষ্টি করে হিন্দু হৃদয়কে আঘাত করেছে-একথাটা ঠিক, নাকি হিন্দু ভাইরা নিজেদের সৃষ্ট আইন' মুসলমানদের দূরে সরিয়ে দিয়ে এবং অনুন্নত হিন্দুদের জোর করে নিজেদের সাথে মিশতে না দিয়ে মুসলমান হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সংখ্যা ও ধর্মভিত্তিক ভারত ভাগকে স্বাগত জানিয়েছেন?
মুসলমানদের জন্য অনেকে ইতিহাস পৃষ্ঠায় বলপ্রয়োগের কথা অল্প বেশি স্বীকার করেছেন-মুসলমানরা জোর করে (বলপূর্বক) কিছু অমুসলমানকে মুসলমান করেছেন। একটু আগেই লিখেছি ধর্ম মন ও মস্তিষ্কের খোরাক। তবে কি বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ মোটেই হয়নি? আমি স্বীকার করতে পারি সহজেই যে, কোথাও না কোথাও এমন ঘটেছে যা অবিশ্বাস্য নয়।
বলপ্রয়োগের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট করে না দেয়ার কারণে যে কোন সাধারণ মানুষ এটাই মনে করেন যে, এভাবেই বলা হয়েছিল হয়ত-তোমাকে মুসলমান হতে হবে, নইলে তোমার মুণ্ড কেটে নেয়া হবে। অথবা তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ না কর তাহলে তোমার জমি জায়গা সব কেড়ে নেয়া হবে ইত্যাদি। আসলে বলপ্রয়োগের ঘটনা এ রকম নয়। এটা জানতে হলে আমার চোখে দেখা অভিজ্ঞতার উল্লেখ করছি।
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাপড়াথানায় মসজিদের পাশে পাশে খৃষ্টানদের চার্চ দেখতে পেলাম। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম এখানে হঠাৎ খৃস্টানরা কিভাবে এলেন? খোঁজ নিয়ে জানলাম মাত্র কয়েক পুরুষ আগে এঁরা মুসলমান ছিলেন। এখনো বিয়ে শাদীতে একই বংশ স্মরণ করে পারস্পরিক দাওয়াত বা নেমন্তন্ন প্রথা চালু আছে এবং এদের সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিবাদ বিসম্বাদও নেই। অনেক সময় কেহ কেহ এক হুকায় ধূমপানও করে থাকেন।
অভাবের কারণেই তারা খৃস্টানও হয়েছেন, একথা এক্ষেত্রে মোটেই ঠিক নয়। কারণ বছরে দুবার ধান হওয়ার আগে নদীয়ায় এমন অভাব হয়েছিল যে বছরের পর বছর মুসলমান বাঙ্গালীরাও কতদিন ভাত খেতে পাননি। গমের আটা গামের মত তৈরি করে বেশি করে পানি দিয়ে তাই বাটি বাটি খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন। কিন্তু পাদ্রীদের বিলেতী কাপড় আর অঢেল টাকা তাদের প্রলুব্ধ করতে পারেনি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল মৌলবী বেশধারী ধার্মিক মুসলমানদের নিজেদের সৃষ্ট ধর্মীয় আইন প্রণয়ন করতে গিয়েই এ অঘটন ঘটেছে।
খৃষ্টানদের যখন চাপড়া থানায় প্রথম আগমন ঘটে তখন এ মুসলমান মৌলবীরা (?) খৃষ্টান হওয়ার কুফল বর্ণনা করে বলেন, খৃস্টানরা এত পাপী যে তারা যদি কোন ধান-জমিতে পুতু ফেরে দেয় তাহলে সে জমির ধান বা ফসল পর্যন্ত খাওয়া হারাম বা অবৈধ হবে। অবশ্য উদ্দেশ্য তাদের মহৎ ছিল। কিন্তু এত বড় ভুল যে তাঁদের অজান্তেই হয়েছিল তারা তার টেরই পাননি। পাদ্রীর। এ নির্বুদ্ধিতার সুযোগ গ্রহণ করতে বিলম্ব করলেন না। তাঁরা দল বেঁধে মাঠে মাঠে পদযাত্রা শুরু করলেন আর প্রত্যেক জমিতে থুতু ফেলতে লাগলেন এবং নিজেরাই প্রচার করতে লাগলেন-মাঠের এমন জমি নেই যেখানে আমরা থুতু ফেলিনি।
সে মওলুবীর দল তাদের পূর্ব নির্দেশ বহাল রাখলেন। তখন নিরক্ষর মুসলমান চাষীকে অর্থনৈতিক চিন্তা করতে বাধ্য হতে হল। কারো দশ কারো কুড়ি বিঘে জমি নষ্ট হয়ে গেছে খৃস্টানদের থুতু নিক্ষেপের ফলৈ। সুতরাং এ জমি যদি ভোগ করতে না পারা যায় তাহলে পরিবারের বাচ্চা-কাচ্চাদের না খেয়ে মরতে হবে। তাই শেষে তারা খৃস্টানদের মন্ত্র উচ্চারণ করে জমি রক্ষা করেন।
তারপর বহুদিন পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের নামও পরিবর্তন করেননি এবং ছেলে-ময়েদের নামও মুসলমানের মতই রেখেছিলেন। বর্তমানে এঁদের শুকরের মাংস খাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে এবং নামও পাল্টে দেয়া হয়েছে। অবশ্য এ অঞ্চলে প্রকৃত মওলুবী-মাওলানা তৈরি হয়ে যাওয়ার কারণে আর এ রকম বিভ্রান্তিকর ঘটনা আশা করা যায় না। বলপ্রয়োগে ইসলামধর্ম প্রচারের কথাটি পাইকারী ভাবে বেশিরভাগ ইতিহাসেই স্থান পেয়েছে। এ বলপ্রয়োগের পদ্ধতিকে বলা হয়েছে তুর্কানা তরিকা বা বলপ্রয়োগ পদ্ধতি'।
গরু হিন্দুদের কাছে বিশেষ ভক্তিপূর্ণ সম্পদ। তা ধর্মীয় কারণেও বটে আর রাজনেতিক কারণেও বটে। গরুকে বর্তমান ভারতে ধর্মের নিরিখে দেবতার দৃষ্টিতে দেখা হয়, সুতরাং গরু হিন্দুদের কাছে শ্রদ্ধার বস্তু। তাই গরুর দুধও পবিত্র খাদ্য। কিন্তু মাংসের বিষয় বলতে হলে পবিত্র ও অপবিত্রের উর্ধ্বের কথা বলতে হয়। যেমন পিতা ও মাতার মাংস পবিত্র হলেও তা খাদ্য হওয়া উচিত নয়। নিহত পিতা ও মাতার মাংস যদি কেহ দেখতে পান তাহলে তা কখনো সন্তানদের কাছে অপবিত্র বা বর্জনযোগ্য বস্তু হবে না বরং সে মাংসখণ্ড বুকে মুখে মাথায় স্পর্শ করে কাঁদতে থাকবেন, হায় হায় করবেন শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতার কথা স্মরণ করে।
যদি নিহত মাতা-পিতার এক টুকর মাংস পুত্রের গায়ে ঠেকিয়ে দেয়া হয় তাহলে নিশ্চয় তা পুত্রের দুঃখ ও কান্নার কারণ হবে, কিন্তু তার হিন্দুত্ব বা ধর্ম চলে যাওয়ারও কারণ হবে না। অবশ্য যদি সন্তানরা বাবা-মাকে হত্যা করে তার মাংস ছোঁয় তাহলে ধর্ম যেতে পারত। মনগড়া আইনের মত আর এক আইন তৈরি হয়েছিল সেটা হচ্ছে, যদি কোন হিন্দুর দেহে গরুর মাংস ঠেকে যায় তাহলে সে আর হিন্দু থাকবে না।
তাই যারা নতুন মুসলমান হয়েছিলেন তাদের আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের মধ্যে কোন ক্ষেত্রে ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ছলে আবার কোন ক্ষেত্রে আকস্মিক গোমাংস গায়ে ছুঁয়ে দেয়া হত ফলে সাথে সাথে আইন বলবৎ হত-তাকে আর জাতে নেয়া হবে না। তিনিও উপায়ান্তর না দেখে মুসলমান হতেন। আমার মতে এটুকু অন্যায়, তথাপি ইতিহাসে যেটুকু পাওয়া যাবে সেটা অস্বীকার করলে ঐতিহাসিকতা বলে কিছু থাকে না।
শ্রীদাশগুপ্তের উদ্ধৃতি দিচ্ছি-“ইংরেজ আমলে, বিশেষত উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাজানুগ্রহ লাভের আশায় যেমন ইংরেজি শেখার হিড়িক পড়ে যায় তেমনি মধ্যযুগের বাংলাতে বিশেষতঃ পশ্চিম বাংলায় একই কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যেও জনসাধারণের মনে প্রবল উৎসাহ সঞ্চারিত হয় বলে সন্দেহ জাগে। শাসন ক্ষমতার অধিকারী মুসলমানরাও বাংলার জনসাধারণের এ উৎসাহের সদ্ব্যবহারে কোনরূপ ত্রুটি রাখেনি এবং সত্যি সত্যি ধর্মান্তরিতরা বহু ক্ষেত্রেই উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অপেক্ষা শাসন ব্যবস্থায় উচ্চতর পদ লাভ করেছে।
এছাড়া তুর্কানা তরীকা অর্থাৎ বলপ্রয়োগ দ্বারা বহু হিন্দুকে মুসলিম করা হয়েছে। অবশ্য কোন হিন্দুকে মুসলমান করার জন্য সেকালে যা বলপ্রয়োগ করা হত তাকে আধুনিক মানদণ্ডে পর্যাপ্ত বলপ্রয়োগ বলা যাবে কিনা সন্দেহ। বলপ্রয়োগ মানে অস্ত্রপ্রয়োগ নয়, কোন মতে কারো মুখে শুধু গোমাংস স্পর্শ করিয়ে দেয়ার জন্য যেটুকু বল প্রয়োগের দরকার সাধারণত সেটুকু প্রয়োগ করা হত।”
শ্রীদাশগুপ্ত প্রমাণ করেছেন, যখন এ রকম মাংস নিয়ে স্পর্শ করিয়ে দেয়ার জন্য বলপ্রয়োগ হত তখন কিন্তু কেহই তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসত বলে মনে হয় না। কারণ কোন রকমে সাহায্যকারীরও গোমাংসের স্পর্শ লেগে যেতে পারত এবং তা লাগলেই তারও ধর্মনাশ হত-মুহূর্তের জন্যে আন্তরিকতম অনিচ্ছাতেও গোমাংস-স্পৃষ্ট হলে কারো আর হিন্দু ঘরে ফিরে যাওয়পর কোনও দরজা খোলা থাকত না।" (প্রমাণ : সুরজিৎ দাশগুপ্তের লেখা ঐ পুস্তকের ১০২ পৃষ্ঠা)
মুসলমানদের সাথে তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যাবে কোন মুসলমানকে যদি নিষিদ্ধ শূকর মাংসের দ্বারা ঢেকে দেয়া যায় তবুও তিনি মুসলমান থাকবেন। আর যদি কেহ কাউকে জোর করে শূকর মাংস খাইয়েও দেয় তবুও তার ধর্মের দরজা বন্ধ নেই। সুতরাং ভারতের দুটি মুসলমানবহুল স্থানাবঙ্গদেশ ও কেরেলার আলোচনায় সারা ভারতের অবস্থা জানতে পারা যাচ্ছে।
বর্তমানে যেকোন মানুষ জানেন যে, সাধারণ ঐতিহাসিকদের চেয়ে একজন পর্যটক ঐতিহাসিকের দাম অনেক বেশি। কিন্তু ভারতে ধর্মীয় বিধানের নামে যা চালান হয়েছিল তাতে নিজের সীমানা ছেরে কোথাও যাওয়া নিষেধ ছিল। যদি কেহ দেশ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ইত্যাদির জন্য গণ্ডি হতে বেরিয়ে পড়তেন তাহলে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। আর্যরা বঙ্গদেশের অধিবাসীদের দস্যু, ম্লেচ্ছ, পাপ ও অসুর বলতেন।
এক্ষেত্রে শ্রীদাশগুপ্ত শ্রীনীহাররঞ্জন রায়ের উদ্ধৃতি দিয়েছেন-“আর্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক উত্তর ও মধ্য ভারতের লোকেরা পূর্বতম ভারতের বঙ্গ পুন্ড্র, রাঢ়, সূক্ষ্ম প্রভৃতি কোমদের সাথে পরিচিত ছিল না, যেকালে এসব কোম্দের ভাষা ছিল ভিন্নতর, আচার-ব্যবহার অন্যতর। এ অন্যতর জাতি, অন্যতর আচার-ব্যবহার, অন্যতর সভতা ও সংস্কৃতি এবং অন্যতর ভাষাভাষী লোকদের সে জন্যেই বিজাতীয় সুলভ দর্পিত উল্লসিকতায় বলা হয়েছে দস্যু’ ‘ম্লেচ্ছ’, ‘পাপ', ‘অসুর' ইত্যাদি।” (দ্রঃ ভারত বর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ৯৭)
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে অবিভক্ত বঙ্গদেশ জয় করলেন। এটা যদিও ঐতিহাসিক সত্য তবুও অসম্ভব। আমাদের মতে ওটা যুদ্ধই ছিল না। জনসাধারণের মধ্যে রাজার প্রতি রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, অভিমান ও আক্রাশ এত বেশি পুঞ্জীভূত ছিল যে, তাদের দিক থেকে কোন বাধা পায়নি এ ঘোড়সওয়ারের দল। আর অশ্ব ব্যবসায়ী হিসেবে তারা প্রবেশ করলেই রাজার প্রজারা যোগসাজস করে সংবাদ দেয় রাজাকে ঘোড়া কেনার জন্য। রাজা কিছু টের না পেয়ে ঘোড়া দেখতে গিয়েছিলেন। ওদিকে রাজবাড়ীতে সৈন্য প্রবেশ করে। সেখানে প্রহরীদের সাথেও তেমন লড়াই হয়নি তাহলে এও হতে পারে-ব্রাহ্মণ্য শাসন, কৌলীন্য প্রথা, বর্ণ বিভাগ প্রভৃতিতে অতিষ্ঠ হয়ে দেশবাসী প্রতীক্ষায় ছিল বাইরের কোন শক্তির।
সে জন্য রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “যখন নগর রক্ষীগণের মূর্খতায় বা অন্য কোন কারণে বিনা বাধায় তুরস্ক সৈন্যগণ রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিল তখন অতর্কিতে সহসা আক্রান্ত হইয়া বৃদ্ধ রাজার পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করা ভিন্ন আর কোন উপায় ছিল না। সুতরাং ইহাকে কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত বলা যায় না।” (দ্রঃ বাংলাদেশের ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ, পৃষ্ঠা ৯৭)
পূর্ণভাবে বিচারান্তে এ কথা বললে ভুল হবে না যে-ভারতে মুসলিম আগমন ভারতের জন্য অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ। তাই শ্রীদাশগুপ্ত সুস্পষ্ট করে বলেছেন-“সামগ্রিক বিচারে মানতে হবে যে ইসলাম স্বাতন্ত্রে গৌরবান্বিত বাংলার জনসাধারণকে অজ্ঞাতপূর্ব মুক্তির স্বাদ দিল। বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণীর তথা শ্রমজীবী জনসাধারণকে দিল ব্রাহ্মণ্য নির্যাতন ও কঠোর অনুশাসনাদির থেকে মুক্তি, প্রতি পদে সামাজিক অপমানের থেকে মুক্তি, পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গের সমুদ্রস্পৃহ জনসাধারণকে দিল ভৌগোলিক বিধি-নিষেধের বন্দীদশা থেকে মুক্তি, বহু 'আয়াসসাধ্য সংস্কৃত ভাষার বন্ধন কেটে জনসাধারণকে দিল মাতৃভাষাতে আত্মপ্রকাশের 'অধিকার।” (ঐ পৃষ্ঠা ১০৭)
চঞ্জমঙ্গল কাব্য বাংলা অনার্স বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক। তাতে দেখান হয়েছে মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের কাহিনী। সরকারের সর্বদা সজাগ থাকা দরকার শিক্ষার কুফল ও সুফল সম্বন্ধে। ক্লাসে একত্রে থাকে হিন্দু মুসলমান প্রভৃতি নানা জাতির ছাত্র। মুসলমান অত্যাচার করেছিল জেনে হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে সৃষ্টি হবে উত্তেজনা! আর মুসলমান ছাত্ররা পাশাপাশি পাবে বেদনার কশাঘাত। ভারতের কি কল্যাণ আছে তাতে? রমেশচন্ত্র মজুমদারের মত নাম করা ঐতিহাসিক পর্যন্ত এগুলোর কোন সমীক্ষা না করে একরকম বিশ্বাসই করে গেছেন।
কিন্তু আধুনিককালের নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক লিখেছেন-“তবে বোনবিবির জহুরানামা'র কথা পরীক্ষার্থী-পাঠ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। সেসব ইতিহাসে পাওয়া যাবে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা 'চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কবির আত্মপরিচয় অংশে মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তকারগণ মুকুন্দরামের আত্মপরিচয়ের প্রথম থেকেই মুসলমান অত্যাচারের এক জ্বলন্ত সমকালীন দলিল আবিষ্কার করেছেন এবং তাদের এ আবিষ্কারের ভিত্তিতে রামেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিক কাব্যের মর্মে প্রবেশ না করে সমকালীন তথ্যাবলী যাচাই না করে ভাসা ভাসা ধারণার বশবর্তী হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস: মধ্যযুগ গ্রন্থে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, সাধারণ কৃষক ও প্রজাগণের দুঃখ দুর্দশার অবধি ছিল না।
ইহার অনেকগুলো কারণ ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম রাজকর্মচারীদের অযথা অত্যাচার ও উৎপীড়ন। কবিকঙ্কন চণ্ডীর গ্রন্থকার মুকুন্দরাম চক্রবর্তী দামিন্যায় ছয়-সাত পুরুষ যাবৎ বাস করিতেছিলেন-কৃষি দ্বারা জীবন-যাপন করতেন। ডিহিদার মামুদের অত্যচারে যখন তিনি পৈতৃক ভিটা ছাড়িয়া অন্যত্র যাইতে বাধ্য হইলেন তখন তিন দিন ভিক্ষার্থে জীবন ধারণের পর এমন অবস্থা হইল যে তৈল বিনা কৈল স্নান করিলু উদক পান শিশু কাঁদে ওদনের তরে'।
একই গ্রন্থে বাংলা সাহিত্য শীর্ষক পরিচ্ছেদের লেখক সুখময় মুখোপাধ্যায় ও লিখেছেন, 'ডিহিদার মামুদ বা মুহম্মদ শরিফ প্রজাদের উপর অত্যাচার করিতে থাকেন এবং মুকুন্দরামের প্রভু গোপীনাথ নন্দীকে বন্দী করেন। তখন মুকুন্দরাম হিতৈষীদের সহিত পরামর্শ করিয়া দেশ ত্যাগ করেন; অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়া এবং ঠিকমত স্নানাহার করিতে না পাইয়া তাহাকে পথ চলিতে হয়, ইত্যাদি।" (ভারত বর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ১০৪)
আমারে মনে রাখা দরকার কাব্য, উপন্যাস বা ঐতিহাসিক উপন্যাস, নাটক আর ইতিহাস পৃথক পৃথক বস্তু। তবুও ঐতিহাসিকগণ যখন কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন না তখন কাব্য, লোককথা, কিংবদন্তী যা কিছু পান তাই ইতিহাসে ঢুকিয়ে দেন। ইতিহাসে ঢোকার পরেই সে অসার পদার্থ তখন পদার্থে পরিণত হয়। ঠিক চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেরও এ অবস্থা।
অবশ্য বিশ্বভারতী পত্রিকার বর্ষ ২৫, সংখ্যা ২, কার্তিক-পৌষ ১৩৭৫ সংখ্যায় প্রকাশিত ক্ষদিরাম দামের লেখা মুকুন্দরামের গ্রামত্যাগ ও কাব্য রচনা প্রসঙ্গ’ নামে যে মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে প্রমাণ করা হয়েছে-“মুকুন্দরাম বিধর্মী শাসকের অত্যাচারে বিতাড়িত হন নাই। কিন্তু কেন্দ্র হতে নির্দিষ্ট সামগ্রিক পরিবর্তনমূলক নূতন ভূমি ও শাসন ব্যবস্থায় নানা অসুবিধা অনুভূত হওয়ায় গোপনে পালিয়েছিলেন। তিনি ব্যাক্তিগতভাবেও নিপীড়িত হন নাই।” ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো শেরশাহ' গ্রন্থে দেখিয়েছেন শেরশাহ ভূমি সংস্কার আইন এমনভাবে তৈরি করেন যাতে প্রকৃত চাষী জমির মালিক হতে পায়। ফলে তাদের উপর যারা সর্দারী করে রোজগার করত তাঁদের আঁতে ঘা লাগে।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য হচ্ছে-“তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা মুঘল শাসকরা করেছিল তা স্বভাবতই কায়েমী স্বার্থের আঁতে ঘা দিয়েছিল এবং মুকুন্দরাম কায়েমী স্বার্থকে বিপন্ন হতে দেখে স্বগ্রাম ত্যাগ করেছিলেন, কেননা তিনি নিজে পরিপুষ্ট ছিলেন কায়েমী স্বার্থের দ্বারাই এখানে বিরোধটা ছিল সম্পূর্ণতই অর্থনৈতিক এবং এ অর্থনৈতিক বিরোধকে ধর্মীয় বিরোধের রং দেয়া প্রয়াসটা এ যুগের সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির একটা প্রকাশ।” (পৃষ্ঠা ১০৬)
সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াবার জন্য বর্তমান কালের লেখকরা যাই-ই লিখেছেন তাই মেনে নেয়া যায় না। আসল সত্য এটা যে, মুসলমান আগমন ভারতীয়দের জন্য এমনকি বাংলার জন্যও ছিল একটা প্রতীক্ষিত সুযোগের মত। কারণ পুরাতন দলিলাদি যা পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে তখন যে সমস্ত কবিতা ও কাব্য রচনা করা হয়েছে তাতে মুসলমান বিজয় ভারতীয়রা বা বাঙ্গালীরা নিজেদের পরাজয় মনে না করে বিজয়ই মনে করেছিলেন। কবিতার নমুনা?
ব্রহ্মা হইল মোহাম্মদ
বিষ্ণু হইল পেগম্বর
মহেশ হইল আদম
গণেশ হইল গাজী
কার্তিক হইল কাজী
ফকির হইল মুনিগণ
তেজিয়া আপন ভেক
নারদ হইল শেখ
পুরন্দর হইল মৌলানা
চন্দ্র সূর্য আদি যত
পদাতিক হইয়া শত।
উচ্চস্বরে বাজায় বাজনা।'
হিন্দু মুসলমান মাঝে যে সাম্প্রদায়িক প্রাচীর তা পূর্ব হতে এভাবে ছিল না। তখন কবি ও কাব্যকারদের লেখার মধ্যেও মিলিত হিন্দু-মুসলমানকে মুগ্ধ করার চেষ্টার চিহ্ন থাকত। যেমন
গাজী মিঞার হাজোত সিন্নি সম্পূর্ণ হল।
হিন্দুগণ বল হরি মোমিনে আল্লা বলো।
বর্তমান ঐতিহাসিকদের মতে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য আজ ভারতের পাঠ্যপুস্তক না হয়ে জহুরনামা' কাব্যকেও তো পাঠ্যপুস্তক করা যেত, কিন্তু তা হয়নি। জহুরনামার লেখকের নাম বয়নন্দী। তাতে এভাবে কাহিনীটি সাজান আছে-বনবিবি ও তার ভাই শাহজঙ্গলী মক্কা থেকে সুন্দরবন জয় করতে আসেন।
সুন্দরবনের রাজা দক্ষিণরায় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলে তার মা নারায়ণী বললেন, যুদ্ধ তিনি নিজেই করতে চান বনবিবির সাথে। যুদ্ধ শুরু হল। কিন্তু বনবিবির শক্তি হঠাৎ আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে বেড়ে গেল। তখন নারায়ণী তাঁকে সই বলে ডাকলেন। এই রাজনৈতিক কৌশল, উদারতা ও বুদ্ধির শক্তি প্রয়োগে বনবিবি আকৃষ্টা হলেন এবং যুদ্ধ থামালেন। নারায়ণীর পুত্র দক্ষিণরায়ের সাথে বনবিবি মিলিতভাবে সুন্দরবন শাসন করতে লাগলেন।
শ্রীদাশগুপ্ত তাই ইতিহাসে আবেগ সৃষ্টি করে বলেছেন, “তবে বনবিবির জহুর নামার কথা। পরীক্ষার্থী পাঠ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না, যেসব ইতিহাস পাওয়া যাবে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কবির আত্মপরিচয় অংশে মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের কাহিনী।” (পৃষ্ঠা ১০৪)
আমরা ছোট্ট দাবী রেখেছিলাম যে-হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কুসাম্প্রদায়িকতা দূর হয়ে যেত যদি মুসলমান আক্রমণ আর আর্য আক্রমণকে এক দৃষ্টিতে দেখা যেত। ‘হিন্দুজাতি', হিন্দুধর্ম' এ শব্দগুলো নিয়ে একটু চিন্তার অবকাশ আছে। মুসলমানকে হিন্দুর শত্রু, বিদেশী, অত্যাচারী, ম্লেছ ও যবন প্রভৃতি উপাধিতে প্রচার করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, হিন্দু প্রথমে কোন জাতি ও ধর্মের নাম ছিলনা। “কেহ কেহ ভারত বর্ষকে হিন্দুস্তান বলে উল্লেখ করে থাকেন। সংক্ষেপে এ উপমহাদেশকে হিন্দ' বলাও হয়েছে।” ১৯০০ খৃস্টাব্দের পর ফারসী হিন্দুস্তান শব্দটি হিন্দি হিন্দুস্তান’ শব্দে রূপান্তরিত হয়। কেহ কেহ মনে করেন হিন্দুস্তান হিন্দুর দেশ অথবা হিন্দুস্তানে যাঁরা বাস করেন তাঁরাই হিন্দু। আবার একদল মনে করেন মুসলমান এবং আর দু-একটি জাতি ছাড়া সকলেই হিন্দু বা হিন্দুস্তানী।
কিন্তু আসল কথা হচ্ছে যাকে আগে আর্যাবর্ত বলা হত সে উত্তর ভারতকেই হিন্দুস্তান বলা হত। ১৮৫৭ সনের মহা অভ্যুত্থানের পরে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান নেতারাই ভারতীয় অর্থে হিন্দুস্তানী' শব্দ ব্যবহার করা শুরু করেছেন। এসব দৃষ্টান্ত অভ্রান্তরূপে প্রমাণ করে যে হিন্দুস্তান শব্দটির কোনও ধর্মীয় তাৎপর্য নেই, যা আছে তা বিশুদ্ধ ভৌগোলিক তৎপর্য। [ঐ পুস্তকের ২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]
পারস্যের ইরানের লোকেরা সর্বশক্তিমান উপাস্যকে বলতে অহুর। ভারতীয় জিহ্বায় অহুরের ‘হ' 'স' হয়ে অসুর হয়ে যায়। তেমনি পারিসকরা ভারতের সিন্ধু নদের স' বা ‘সিন'কে পরিবর্তন করে হ’ করে দেয়, ফলে সিন্ধু হয়ে যায় হিন্দু। এভাবে তাঁরা সিন্ধু নদের তীরবর্তী অধিবাসীদের হিন্দু বলতে শুরু করে। সিন্ধুর উচ্চারণ যেমন পারসীদের যেমন পারসীদের জিহ্বায় হিন্দু হয় তেমনই গ্রীকদের জিহ্বাতে ইন্দু এবং ইন্দু থেকেই ইন্ডিয়া শব্দটির উৎপত্তি।' হিন্দুর হিন্দুত্ব ও এ শব্দের গৌরবের সাথে পারস্য ইরান এবং আরবদের অবদান মিশে আছে। তাই রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন
As is well known. Hindu, a modified form of Sindhu, was originally a geographical term used by the western foreigners to denote, first the region round the Sindhu river, and then the whole of India. The Indians, however, never called themsclves by this name before the Muslim conquest. (The History and Culture of the Indian People : R. C, Majumder)
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে অবশ্য ভাল হওয়া চাই নতুবা ভারতের ক্ষতিরোধ করা সম্ভব হবে না। তাই মনে রাখা ভাল, শুধু আর্য, মুসলমান ও খৃস্টান জাতিই বাইরে থেকে আসেনি বরং বহু জাতিই এসেছে এই ভারতের মাটিতে। শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে বিদেশীদের আগমন ঘটেছে। এটা পৃথিবীর মানবজাতির একটি স্রোতস্বতী চিরন্তন নীতি।
ভারতের বাইরে থেকে এসেছে যেমন বৈদিক আর্য ও মুসলমান জাতি তেমনি এসেছে যবনশ্রীক, রোমান, গুর্জর, কুষাণ, হাবসী, ইহুদী, কাফ্রী, নিষাদ, দ্রাবিড়, কিরাত প্রভৃতি বা গোষ্ঠী। কিন্তু শুধু মুসলমান-হিন্দুদের মধ্যে এত গণ্ডগোল, কেন, কিভাবে তার সূত্রপাত হয়, কেমনভাবে তার লালনপালনের ব্যবস্থা হয়, তারপর তার বিকাশে ভারতের কি অবস্থা হয় তার আলোচনা এবং আগামীতে কি হতে পারে তা চিন্তায় এখনও যদি সাবধানতা অবলম্বন না
করা হয় তাহলে ইতিহাস শেখার যৌক্তিকতা কোথায়? বৈদিক আর্যদের ভারতে আগমনের পূর্বে ভারতের একটি সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল। সেই জনপদগুলো প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। যার প্রমাণ মাটির নিচে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলো ছিল অনার্য সভ্যতা। যদিও ধ্বংস হয়েছে তবু আর্যদের দ্বারাই তা হয়েছে আর এ ধ্বংসাবশেষ দেখে প্রমাণ হয় তখন ধ্বংস করার নীতি ছিল বলেই জনপদগুলো প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছিল।
আর্যরা পুরাতন বা অনার্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শক্তি ধ্বংস করতে এবং তাদের হত্যা করার দিকে খুবই অগ্রসর ছিলেন। প্রামাণ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মধ্যে ঋগ্বেদের বর্ণনা ও প্রার্থনা মিলিয়ে দেখলে সুস্পষ্ট হয় যে প্রাচীনতর ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধ্বংস করার দিকে এবং পুরের (নগরের) অধিবাসীদের হত্যা করার দিকে বৈদিক আর্যদের প্রবল প্রবণতা ছিল-এসব কাজে তারা উল্লাস ও গৌরব বোধ করত।
যারা এভাবে বৈদিক আর্যদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে তাদের নাগরিক বাসস্থানগুলো ত্যাগ করে চলে যায় তারা ভারত বর্ষের গভীরতম অঞ্চলগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে নিজেদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে রক্ষা করতে থাকে, কিন্তু আর পুর গড়ে তোলেনি সম্ভবত এ কারণে যে তাতে ধ্বংসকারী বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
অর্থাৎ সিন্ধু নদের উপত্যকা থেকে তাদেরকে উৎখাত করতে সমর্থ হলেও বিশাল ভারত বর্ষ থেকে তাদের নির্মূল করতে বৈদিক আর্যরা সফল হয়নি। অধিকৃত জনপদে যারা থেকে যায় তারা বিজয়ীদের সেবায় নিযুক্ত হয় এবং এভাবে দাস শব্দটার অর্থান্তর ঘটে, সেবার জন্য নিযুক্ত ভৃত্যের অর্থে দাস শব্দটার ব্যবহার হতে থাকে।” (দ্রঃ শ্রীদাশগুপ্তের ভারত বর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ১)
অনার্যদের মেরে ফেলা আর্য ধর্মে ছিল। আমি যদি এ তথ্য পরিবেশন করি তাহলে বিরাট আপত্তি আসতে পারে তাই ইতিহাস হতে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়-“আর রামায়ণ থেকে জানতে পাই যে, জনৈক ব্রাহ্মণ রামচন্দ্রের কাছে বলেন, তাঁর পুত্র অকালে মারা গেছে, কারণ দেশের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন গভীর অনাচার চলছে।
এরপর রামচন্দ্র অনাচার অনুসন্ধান করতে দক্ষিণ দিকে এসে বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণস্থিত শৈবলগিরির উত্তর পাশে এক বিমাল সরোবর দেখলেন, সে সরোবর তীরে অধোমুখে লম্বমান তপঃপরায়ণ তাপসকে দেখে এগিয়ে গেলেন এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক নানা সম্ভাষণ করে তাঁর জাতি জানতে চাইলেন। যেই সেই উৎকৃষ্ট তপোনিরত তপস্বী নিজেকে শুদ্র বলে পরিচয় দিলেন, অমনই রামচন্দ্র সুরুচিরপ্রভ বিমল খরগ নিষ্কাশিত করে শূদ্রের মস্তক ছেদন করলেন।
শূদ্র নিহত হলে ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু এবং ব্রহ্মা প্রভৃতি দেববৃন্দ সাধু সাধু বলে কাকুৎস্থ রামচন্দ্রের প্রশংসা করতে করতে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। রামচন্দ্রের কাছে যেমন আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের সমান হওয়ার জন্য নিম্নবর্ণের আকাক্ষা মৃত্যুযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে তেমনি বুদ্ধদেবের কাছে আর্য সমাজের বহু বিচারই ঘোর নিন্দার যোগ্য বিষয় বলে মনে হয়েছে। কিন্তু বৈদিক আর্যরা এক সময় যে কৌশলে প্রাচীনতর তথা অনার্য ধর্ম সংস্কৃতিকে গ্রাস করেছিল সেই কৌশলেই আস্তে আস্তে বিদ্রোহের থেকে উদ্ভূত মনোভঙ্গি এবং তার ধর্ম সংস্কৃতিকে গ্রাস করে।” (ঐ পুস্তকের ১০-১১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
নালন্দা মহাবিহার তুর্কী আক্রমণে ধ্বংস হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু নালন্দা ও মহাবিহারগুলো দুর্গের মত এমনভাবে প্রাচীর বেষ্টিত ছিল যে বিদেশী তুর্কীরা সেগুলোকে দুর্গ মনে করে আক্রমণ করেন এবং তার পত্তন ঘটান। কিন্তু পরে তারা জানতে পারেন ওগুলো দুর্গ ছিল না। তাই ঐতিহাসিক দাশগুপ্ত বলেন-“তুকীরা দুর্গ বলে ভুল করেই নালন্দা ধ্বংস করেছিল। অবশ্য ময়নামতী ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বীদের হাতে ভোজবর্মার শিলালিপি থেকে জানা যায় যে পরম বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সোমপুরের মহাবিহার (মন্দির) ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী' থেকে জানা যায় যে কাশ্মীরের হিন্দু রাজারা পররাজ্য জয় করার সময় বিজিত রাজ্যের মন্দির ধ্বংস করে ধন সম্পদ লুঠ করত।” (ঐ, পৃষ্টা ১২)
এসব প্রকৃত ইতিহাস যাদের জানা না থাকবে শুধু তারাই ভাববেন-মুসলমানদের কাজই ছিল শুধু হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করা। তখনকার দিনে মন্দিরগুলোকে দুর্গের মত মজবুত করে তৈরি করা হত। তার কারণ তাতে থাকত রাজা এবং প্রজদের প্রচুর ধন-সম্পদ। অর্থাৎ ধর্ম মন্দিরগুলোকে ধনাগার বা রাজনৈতিক ঘাঁটি করে রাখার ফলে সাধারণভাবে রাজনৈতিক কারণে সেগুলোর উপর আক্রমণ বা আঘাত আসত।
তাই ঐতিহাসিক গুপ্ত লিখেছেন—“এ ধর্মস্থানগুলিতে দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের ধনসম্পদ জমা রাখত অথবা ধর্মস্থানগুলো ছিল স্বকীয় মাহাত্ম্যে দেশের প্রধান ধনাগার। হরিণ যেমন নিজের মাংসের গুণে শিকারীকে প্রলুব্ধ করে তেমনি এ ধর্মস্থানগুলিও ধনাগার রূপে ব্যবহৃত হওয়ার জন্যে পরাক্রান্ত পুরুষদের প্রলুব্ধ করত এবং এর ফলে ধর্মস্থান ধ্বংসের সাথে বিদ্বেষের সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টা অন্ধ সংস্কার প্রণোদিত হয়ে যায়, যার পিছনে বাস্তবতার সমর্থন নেই।" (ঐ পুস্তক, পৃষ্ঠা ১২)
ধর্মপ্রচারক রামানুজের কথা আগেও বলা হয়েছে এখানে আরও বলা যেতে পারে—তার সহজ ধর্মমত হিন্দু রাজার কাছে এত অন্যানয় বলে বিবেচিত হয়েছিল যে, তার প্রাণদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই তাকে শিষ্যবৃন্দ নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল।
“বৈদিক আর্য ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে ভারত বর্ষে এসেছিল অনেকটা সেভাবেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও এখানে আসে, তবে বৈদিক আর্য ধর্মাবলম্বীরে সাথে ভারত বর্ষে বসবাসকারী বিভিন্ন অনার্য ধর্মাবলম্বীদের প্রথম পরিচয় ধ্বংস ও সংঘাতের মাধ্যমেই হয়েছিল মনে হয়। কিন্তু ইরানী, আরব, তুর্কী প্রভৃতি মধ্য ও পশ্চিম প্রাচ্যের অধিবাসীরা, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অনেক আগেই তাদের সাথে ভারতীয়দের পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটে ভিন্নতর মাধ্যমে।
তাছাড়া তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও তাদের সাথে ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এবং ভারত বর্ষে মুসলিম সশস্ত্র অভিযানগুলো শুরু হওয়ার আগেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী বণিকরা ভারত বর্ষের কোন কোন স্থানে, বিশেষতঃ কেরলে, একটা নিজস্ব সমাজ গড়ে তুলেছিল। যেমন মুসলিম সৈনিকদের অভিযান শুরু আগেই মুসলিম বণিকদের আসা যাওয়া শুরু হয় তেমনই উত্তর ভারতে মুসলিমদের প্রথম অনুপ্রবেশ নিরস্ত্র ও প্রমিক সুফি সাধুসন্তদের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায়। তবে অনার্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য আর্যরা যতখানি সাফল্য দাবী করতে পারে মুসলিম যোদ্ধারা ততখানি সাফল্য দাবী করতে পারে না।” (দ্রঃ ঐ, পৃষ্ঠা ১৫)
ইসলাম ও মুসলমান সম্বন্ধে অনেক ক্ষেত্রে একটা কু-ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, যা বর্তমান অদূরদর্শী ঐতিহাসিক ও লেখকদের পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ফল। যদি এ শ্রম ভেদবুদ্ধির সৃষ্টি না লাগিয়ে মিল মৈত্রীর পথে পরিচারিত হত, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায়, ভারত বর্ষ তিনভাগে ভাগ হয়ে ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হত না।
সুদীর্ঘকাল মুসলমান শাসনে ভারতে হিন্দু ধর্ম ধ্বংসও হয়নি, হিন্দু জাতিও ধ্বংস হয়নি আর ধর্মীয় কারণে আর্য ও ইংরেজদের মত ধ্বংসাত্মক ঘটনাও ঘটেনি। অবশ্য বর্তমান ইতিহাসে যা ঘটান হয়েছে তা ঘটনা নয় বরং রটনা। সুদীর্ঘকাল মুসলিম শাসনের অধীনে থাকা সত্ত্বেও ভারত বর্ষের অধিকাংশ অধিবাসী, এমনকি মুসলিম শক্তির প্রধান কেন্দ্রগুলোর অধিবাসীও হিন্দু থেকে যায়, কিন্তু ইউরোপে পেগান ধর্মের বিরুদ্ধে এমন সর্বব্যাপী অভিযান চালানো হয় যে পেগান ধর্মালম্বী ইউরোপীয়দের চিহ্নমাত্র রাখা হয়নি। মুসলমানরা যদি সত্যিই একহাতে অস্ত্র নিয়ে ধর্মপ্রচারের অভিযানে নামত তাহলে ইউরোপের মত ভারত বর্ষেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চিহ্নমাত্র থাকত না।' (দ্রঃ ঐ, পৃষ্ঠা ১৬)
খৃস্টান ধর্মেও প্রথমে এ নীতিই প্রকাশ হয় যে, ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু ধর্মের সাথে যেদিন রাজশক্তি যোগ হল সেদিন সহিষ্ণুতার মাথা খাওয়া গেল। অখৃষ্টানরা সাধারণ অপরাধীদের চেয়েও বড় অপরাধী বলে গণ্য হত।
এমনকি তাদের নিষ্পাপ কচি বাচ্চাদের জন্য বলা হয়েছিল, ওরা যদি মরে যায়, যদিও শিশু তবুও খৃষ্টান হওয়ার সুযোগ পায়নি, তাই তারা নরকের মেঝেতে অনন্তকাল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াবে। চার্চের যাজকদের মধ্যে সবচেয় নামজাদা যাজক সন্তু আগাষ্টাইন। তিনি সকলকে জোর করে খৃস্টান করার নীতির প্রতিষ্ঠাতা। ১২০০ খৃস্টাব্দের কয়েক বৎসর পূর্বে তৃতীয় ইনোসেন্ট প্রধান ধর্মযাজক হন। তারই আমল থকে ইউরোপে অখৃস্টানদের জোর করে খৃষ্টান করার অভিযান চলে।
দক্ষিণ পশ্চিম ফ্রান্সের এক ধনী জমিদার কাউন্ট তুলোস এবং তার প্রজারা অলবিজোয়া নামে অভিহিত ছিলেন। তারা খৃস্টান ছিলেন না। তাই এক হাতে অস্ত্র ও অন্য হাতে বাইবেলের নীতিও নামে যে নৃশংশভাবে শিশু-নারী সহ তাদের নিহত হতে হয়েছে তার 'ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যাবে মিঃ জে, বি, বিউরীর লেখা A History of Freedom of thought পুস্তকে। এ অভিযানে নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয় ধর্মীয় উল্লাসে। ১৯২৯ খৃস্টাব্দে কাউন্ট অব তুলোসের শোচনীয় পরিণাম থেকে প্রমাণিত হয় যে, একজন রাজার রাজা
হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারিত হবে রাজ্য থেকে খৃস্টানদের নির্মূল করার সম্মতিতে ও অর্থে এবং যে রাজা আপন রাজ্য থেকে উৎখাতে সম্মত ও সমর্থ হবে না তার রাজা হওয়ার কোনও যোগ্যতা বা অধিকার নেই।' ১২২৩ খৃষ্টাব্দে প্রধান ধর্মযাজক নবম গ্রেগরীর আদেশ অনুসারে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে অখৃষ্টানদের খুঁজে বের করার একটা অভিযান চলে, যেটা ইনকুইজিশন নামে কুখ্যাতি লাভ ছে। ১২২০ খৃস্টাব্দ হতে ১২৩৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক একটা আইন প্রবর্তন করেন। তাতে বলা হয়, যারা অখৃষ্টান তারা যদি খৃস্টান পাদ্রী বা যাজকদের মতে মত দিতে না পারে তবে তারা সমাজ বিরোধী আর যদি খৃস্টান না হওয়ার জন্য তারা অনুতপ্ত হয় তাহলে তাদের বন্দী করা হবে আর যারা স্বধর্ম ছেড়ে খৃস্টান হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করবে না তাদের জীবন্তু পুড়িয়ে মারা হবে।
১২৫২ খৃষ্টাব্দে চতুর্থ ইনোসেন্ট যাজকীয় আইন অনুসারে প্রত্যেক নগরের আবশ্যিক উন্নয়নমূলক কার্যের মধ্যের অখৃষ্টানদের নির্যাতন ও হত্যা করার নীতি প্রবর্তিত হয়। অবশ্য চার্চ বা যাজকরা নির্যাতন বা হত্যাটা স্বহস্তে করত না, কে খৃস্টান কে অখৃস্টান সেটা বিচারের পরে অপরাধীকে তুলে দেয়া হত রাষ্ট্রীয় বা পৌর কর্তৃপক্ষের হাতে। যীশুখৃষ্ট মানুষকে হত্যা করা নিষেধ করে গেছেন, তাই নর-রক্তপাত খৃস্টান ধর্মে নিষেধ। সেই জন্য বিশাল কড়াই-এ ফুটন্ত জলে অভিযুক্ত আসামীকে বেঁধে ফেলে দেয়া হত এবং সেদ্ধ হয়ে যেত।
বেশির ভাগ হত্যা আগুনে পুড়িয়েই করা হত তাতে মানুষ মারাও হত অথচ রক্তপাত হত না। এসব লোমহর্ষক ঐতিহাসিক বাস্তব ঘটনাগুলোর সাথে মুসলমানদের অভিযানের তুলনা করলে দেখা যাবে-তাদের হাতে ধর্ম ও রাষ্ট্রশক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা যে ব্যবহার ভারতের মাটিতে দেখিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। মাইকেল সার্ভেতুস একজন বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর একটি কথা বাইবেলের সাথে অমিল হওয়ার কারণে ১৫৫৩ খৃষ্টাব্দে বন্দী করা হয় এবং জজের বিচারে প্রাণদণ্ড হয়। অবশ্য রক্তপাত করা হয়নি, পুড়িয়েই মারা হয়েছিল।
ইতালির বিখ্যাত দার্শনিক জোরদানে ব্রুনোকে একই কারণে ১৬০০ খৃষ্টাব্দে হত্যা করা হয় ১৬১৯ খৃষ্টাব্দে লুসিলিও ভানিনি অবিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত হন। তার জিভ ছিড়ে ফেলা হয় এবং কিছুক্ষণ পরে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
এভাবে অভিযুক্ত হন কবি ও সাহিত্যিক মিঃ মার্লো। তার প্রাণদণ্ড হবার পূর্বেই সৌভাগ্যক্রমে তার মৃত্যু হয়। রাণী এলিজাবেথের আমলে কর্পাস ক্রিষ্টির ফেলো ফ্রানসিস কেটের মত বিজ্ঞ ব্যক্তিকেও পুড়িয়ে মারা হয়। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও একবার অভিযুক্ত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে মুক্তি পান। দ্বিতীয়বার ডায়ালগস' নামে বই লেখার জন্য প্রাণদণ্ড পাওয়ার উপযুক্ত হলে বেচারা বিজ্ঞানী প্রাণের দায়ে স্বীকার করলেন, আমার লেখা তথ্য ভুল। অথচ অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতে তার ভুল মোটই ছিল না।
এর মধ্যে পেগান ধর্মাবলম্বী অথবা ব্যক্তিগত বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় জীবন যাপন করার অপরাধে কত হাজার হাজার ইউরোপীয় নর-নারীকে আগুনে পোড়ান হয় তার সঠিক হিসেবে পাওয়া যায়নি। তবে এটা দেখা যায় যে একটা গোটা মহাদেশ থেকে পেগান ধর্মাবলম্বীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।' এক্ষেত্রে বৈদিক আর্য ও খৃষ্টানদের আলোচনার সাথে মুসলিম শাসন ও ভিযানকে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে ভারতে মুসলমানদের কারণে কোন একটি ছোট্ট সম্প্রদায়ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
সতীদাহ প্রথা, দেব-দেবী পূজা, শুকরের মাংস খাওয়া প্রভৃতি ইসলাম ধর্মে অনুমোদন না থাকলেও কোনকালে কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করার নজির নেই। মুসলমান শাসকরা ধর্মে বলপ্রয়োগ নিষেধ আছে বলেই এটাকে তুলতে পারেননি। যদি কোথাও বল প্রয়োগ হয়ে থাকে তা ধর্মের জন্য নয়, হিংস্রতা ও লালসা চরিতার্থই তার কারণ।
ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের বড় মাধ্যম ছিল মুসলিম সাধু-সন্তু সুফী আওলিয়াদের ভূমিকা, যা প্রত্যেক ঐতিহাসিক অল্প-বিস্তর স্বীকার করে গেছেন। তাঁরাও যে এক হাতে অস্ত্র এবং অন্য হাতে শাস্ত্র নিয়ে ধর্ম প্রচার করেছেন তা নয়। তারা ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের পক্ষপাতী হলেও সকলেই যে ইসলামধর্ম প্রচারের জন্যই এসেছিলেন তাও নয়। এ
মুসলমান সাধু-ফকিররা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েও এসেছিলেন। কারণ ইসলাম ধর্মে নবী, খলিফা, ইমাম ও মহাপণ্ডিতদের দেখা গেছে তাদের জীবিকার জন্য কারো মুখাপেক্ষী থাকতেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন বা নিজে বৈধ রুজী সংগ্রহ নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক আধুনিক ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন যে, “প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রচার এসব সাধু-সন্ত পীর-ফকিরদের মাধ্যমেই হয়েছে, অর্থাৎ আমীর-ওমরাহ, রাজা-বাদশাহের চাইতে ধার্মিক মুসলিমরাই ইসলামের ব্যাপক প্রচার অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন। (ঐ, পৃষ্ঠা ৩৭)
অরাজনৈতিক ইসলাম প্রচারক হিসেবে প্রথম যিনি ভারতে এসেছিলেন তিনি হচ্ছেন শেখ ইসমাইল। তারপরে এলেন শেখ আলি ওসমান ওরফে দাতা গঞ্জবখশ। এঁরা দুজনেই লাহোরে অবস্থান করেন। ১০৭২ খৃষ্টাব্দে দাতা গঞ্জবখশ পরলোক গমন করেন। লাহোরের ‘ভাটী দরোজাতে তাঁর কবর হয়। হিন্দু মুসলমান তাঁর প্রতি বিমুগ্ধ ছিলেন। তাঁর ইচ্ছাকৃত দারিদ্র এবং চরিত্রের দৃঢ়তা তাঁকে বরণীয় ও স্মরণীয় করে।
ভারত বর্ষ ভাগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে প্রত্যেক বছর শ্রাবণ মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার হিন্দু-মুসলমান এমনভাবে মিলিত হতেন যে মিলনমেলা স্মরণ করিয়ে দেয়, জোর জুলুম করে ইসলাম প্রচার করলে, তার মৃত্যুর পর হয়ত মুসলমানরা ভক্তি জানাতে পারে, হিন্দুদের পক্ষে মোটেই তা সম্ভব হত না। ঠিক এমনিভাবে গজনী থেকে হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি ১১৬১ খৃস্টাব্দে ভারতের লোহারে আসেন। কিছুদিনি এখানে অবস্থান করে তিনি আজমীরে পুষ্করের কাছে অবস্থান করেন। বিনা অস্ত্রে ও উত্তেজনায় দলে দলে হিন্দু মুসলমান তার শিষ্য হন। যেসব ব্রাহ্মণরা তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন তাঁরা পরবর্তীকালে হুসেনী ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হন। মৈনিউদ্দীনের দরগাহ (কবর) হিন্দুদের একটা বড় তীর্থ।'
এভাবে খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী, শেখ ফরিদ গঞ্জ-ই-শকর, নিজামুদ্দিন আওলিয়া ও আরও অনেকের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রত্যেক মহান মানুষের কবর আজও হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্থান। উপরোক্ত আওলিয়া দরবেশ ছাড়া জুনাইদ, মনসুর হান্নাজ, তাপসী রাবেয়া প্রভৃতির নাম উল্লেখ করে প্রমাণ করা যায় তাদের উদার আহ্বান মানুষ জাতির জন্য ছিল, শুধু মুসলমানদের জন্য নয়। কুসাম্প্রদায়িকতার সেখানে জন্মই হয়নি।
ভারত বর্ষে উপরোক্ত মহামান্য আওলিয়াগণ ছাড়া আরও বহু মুসলমান আওলিয়া-ফকিরের দ্বারা প্রেম, প্রীতি ও উদারতার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। যেমন হাজী এমদাদুল্লাহ মহাজেরে মক্কী, হযরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া, হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী প্রমুখ।
তাছাড়া শুধু অবিভক্ত বঙ্গদেশেও বহু সুফি সাধকদের দ্বারা ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। যেমন হযরত শাহ ইসমাঈল গাজী। তিনি মান্দারন, কামরূপ প্রভৃতি স্থানে বিশেষ প্রতিপত্তি ও প্রতিভার পরিচয় রেখে ১৪৭৪ খৃস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। হযরত মোজাদ্দেদ আহমাদ ফারুকী সিরহিন্দিও বিদ্যাবুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার আদর্শ পুরুষ ছিরেন। হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাকে শ্রদ্ধা ও শক্তি দিতে কুণ্ঠা করেন নি। তিনি ১০৩৪ হিজরী সনে দেহত্যাগ করেন।
হযরত হামিদ বাঙ্গালী দানেশমান্দ ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কবর বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে আছে। এমনিভাবে মখদুম শাহ গজনবী, বীরভূমের শাহ আবদুল্লাহ, ঢাকার সৈয়দ আলী তাবরেজী, সিলেটের শাহ জালাল, শেখ বাহারউদ্দিন জাকারিয়া, নূর কুতুবুল আলম, শেখ হেসামুদ্দিন, পশ্চিম দিনাজপুরের উলুগই-আজম, শাহদ্দৌল্লা ও শেখ বদরুদ্দিন সাহেব উল্লেখযোগ্য ইসলাম ধর্মপ্রচারক ছিলেন।
এছাড়াও মুহাম্মদ আতা, শাহ মোয়াজ্জাম, মখদুম জালালুদ্দিন, শরীফ জিন্দানী, শাহ কলন্দর, শাহ কুকান, শাহ মুহাম্মদ বাগদাদী, শাহ কামাল, সৈয়দ মীরন শাহ, মালেক ইয়ামিন কুতুব শাহ, শাহ আলী বাগদাদী, শাহ মান্নাহ জালাল হালবী, বদর শাহ, সেখ ফরিদ, শাহ আদাম, হাজী সালেহ সাহেব প্রভৃতি বুজুর্গ ইসলামের শান্তির দূতের মত হিন্দু মুসলমান তথা ভারতবাসীকে সাফল্য ও চরিত্র দৃঢ়তায় মুগ্ধ করেন।
আরও অনেক মুসলিম সাধকের মধ্যে শাহ সুফী আনোয়ার কুলি, সৈয়দ আব্বাস, বেগম রওশন আরা, বখান গাজী, মুবারক গাজী, শরীফ শাহ গাজী, শাহ মাহমুদ [রঃ আঃ] প্রভৃতি বিখ্যাত আল্লাহ প্রেমিক মানুষের জন্য অনেকে হিংসা অথবা অজ্ঞতাবশতঃ গুপ্তচর, পঞ্চম বাহিনী প্রভৃতি কটুক্তি করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তীব্র প্রতিবাদ করে লিখেছেন
We have no reason to hold that these warriors in the path of Allah were so degenerate as to act as fifth columinst of the Muslim State against the other. [History of Bengal Vol-2. P. 76]
অর্থাৎ আমরা এ কথার সমর্থনে কোন কারণই খুঁজে পাই না যে, আল্লাহর পথেই এ সমস্ত পরিশ্রমী সাধকেরা অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রের পঞ্চম বাহিনীর ন্যয় বিরুদ্ধবাদী। শ্রীযুক্ত বিমানবিহারী মজুমদার লিখেছেন, “হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুথানের দ্বিতীয় শত্রু হইয়াছিল মুসলমান ধর্ম। এক শ্রেণীর লোক পীর ও তাপসগণের মহান ধর্ম প্রবণতায় আকৃষ্ট হইয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়ছিল।” [দ্রঃ বৈষ্ণব সাহিত্যে সামাজিক ইতিহাসের উপকরণ (প্রবন্ধ), লেখক বিমানবিহারী মজুমদার]।
এ প্রসঙ্গে আধুনিক যুগের লেখা দিয়েই বিষয়টিকে সীমিত করতে চাইছি। “মামলুকদের শাসনকালে ত্রয়োদশ শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই মুসলিম সাধকরা ভারত বর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, রাজনীতির সাথে সম্পর্কশূন্য জনসাধারণের জীবনে উপনীত হয়েছিলেন এবং তার ফলে ভারতীয় জনসাধারণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলামকে গ্রহণ করেছিল নিতান্তই আন্তরিক আধ্যাত্মিক আকর্ষণে। (ভারত বর্ষ ও ইসলাম, পৃষ্ঠা ৪৯। ঐতিহাসিক ও লেখকদের ক্ষমতা আছে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করার, একটা ভাল মানুষকে মন্দ অথবা একজন মন্দ মানুষকে ভাল বলে চিহ্নিত করার। কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্রের ওটা মস্তবড় ডাকাতি। ইতিহাসে ঐতিহাসিকদের সৃজনশীলতা ও নিপুণতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কিন্তু তা তথ্র ও সত্যভিত্তিক হওয়া চাই।
আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন বিদেশীর মতই এবং রক্তপাতের ভিতর দিয়েই তা হয়েছিল। অথচ আলেকজান্ডারের উপর ভারতের কারো এ রকম রাগ, দুঃখ, ঘৃণা নেই যেমন আওরঙ্গজেবের উপর আছে। এরকমভাবে পর্তুগীজ নেতা ভাস্কো-ডা-গামার কথা
কে না জানে? কিন্তু কি জানে, কতটুকু জানে? যতটুকু জানান হয়েছে ততটুকুই। মোট কথা ভাস্কো-ডা-গামার উপও ভারত-জনসাধারণের কোন ক্রোধ, দুঃখ বা ঘৃণা নেই; যেহেতু তাদের প্রকৃত ইতিহাস যে কোন ইঙ্গিতে ঢেকে রাখা হয়েছে। কেরল ও মালাবার অঞ্চলে বাণিজ্যিক কারণে মুসলমান জাতি সেখানে বসতি স্থাপন করেন এবং ভারতবাসীর সাথে একান্তভাবে মিলেমিশে শুধু বসবাসই করেননি তারা ব্যবসা ও বাজার পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। সোজা কথায় বললে বলতে হয়, কেরল বা মালাবারের ব্যবসাগুলোর উপর প্রথম স্তরের কর্তৃত্ব ছিল মুসলমানদের। দ্বিতীয় স্তরে ছিল ভারতীয় অমুসলমানদের কর্তৃত্ব।
এ মুসলমানদের একটা নাম ছির মোপলা। বিভিন্ন ইতিহাসে মহাপিলাহ, মোইপিলাহ, মোপলা, মোপলাহ্ প্রভৃতি লেখা হয়েছে। তারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। শুধু ব্যবসা ও চাকরি ছাড়া ভারতীয় হিন্দুদের হাত থেকে রাজশক্তি কেড়ে নেয়ার কথা তাদের কল্পনাতেও ছিলনা। এ মোপলারা অত্যন্ত সাহসী, সৎ এবং কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন। তাই হিন্দু রাজারা তাদের সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করতেন। ভারতীয় রাজাদের কাছে সুদক্ষ সৈন্য এবং বিশ্বাসভাজন হিসেবে তারা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কিন্তু একথা স্বীকার করতে হবে যে তারা ছিলেন জন্মগতভাবেই অত্যন্ত তেজস্বী ও উগ্র বিপ্লবী। বিদেশী পর্তুগীজ নেতা ভাস্কো-ডা-গামার ভারত আগমনে এবং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিপত্তি স্থাপন করাকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় সাথে আরবদের মনোমালিন্য হয়। ভারতীয় রাজা জামোরিন ও মুসলমান মোপলাহ্ গণ সম্মিলিতভাবে বিদেশী পর্তুগীজদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন।
ইংরেজি ইতিহাসে বেশিরভাগ ইউরোপীয় লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ধর্মান্ধ মুসলমান মোপলাদের নিষ্ঠুর আক্রমণে পর্তুগীজরা অন্যান্যভাবে বিতাড়িত হন। অথচ একথা ঠিক নয়। তাই শ্রীদাশগুপ্ত ইউরোপীয়দের জন্য লিখেছেন, “তাই নিজেদের চরিত্র নিষ্কলঙ্ক রাখার জন্যে ভারতীয় ও আরবদের এ সম্মিলনকে ধর্মান্ধতার ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছে এবং যে অভিযোগের অনুক্ত তাৎপর্য হল নিজেদের ইউরোপী সাধুতা প্রমাণ করা।” কালিকটের রাজবংশকে জামোরিন বলা হত। এ জামোরিনের শক্তির উৎস ছিল তখন মুসলমান মাইপিলাহ। তাছাড়াও মালাবারের প্রত্যেক হিন্দুরাজা এ মাইপিলা বা মোপলাদের সৈন্য, দেহরক্ষী অথবা পরামর্শদাতা হিসেবে চাকরি দিয়ে রাখতেন এবং তাদের ছেলের মত ভালবাসতেন। সম্ভবতঃ এ মহাপিলাহ নামটি হিন্দুরাজাদেরই সৃষ্টি। পূর্ববঙ্গে পোলা মানে সন্তান, পশ্চিমবঙ্গেও (ছেলে) পিলে’ বা ‘পুলে’ মানে সন্তান। সুতরাং মহাপিলাহ মানে বিখ্যাত পুত্র' বা বড় ছেলে আর মাইপিলাহ অর্থে ‘দুধবেটা' বা দুগ্ধপুত্র। কারণ মাই দুধ বা স্তনের অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
‘তেমনই মালাবারের রাজারাও ইসলাম ধর্মাবলম্বী দুর্দান্ত জওয়ানদের পুষত এবং আপন আপন রাজ্যে তাদের বসবাসের সুবন্দোবস্ত করে দিত। বড় ছেলের মত এদেরকে খাতির করা হত বলে এদেরকে মইপিলহজ বা মহাপিলাহ বলা হল।' (দ্রঃ ঐ, পৃষ্ঠা ১৩২)
এসব মোপলারা ভারতীয়দের সাথে অত্যন্ত মধুর ব্যবহার করতেন। তাদের বীরত্ব চরিত্র মাধুর্যে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, অস্ত্র ও ভয় দেখিয়ে নয়। শ্রীদাশগুপ্ত লিখেছেন, “এখানকার কোন রাজবংশ ইসলাম ধর্মের আদর্শে প্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং (তারা) ইসলামের প্রচারে উদ্যোগ হয়েছে, এ বৈশিষ্ট্য ভারত বর্ষের অন্য কোনখানের ইতিহাসে দেখা যায় না। বর্ণভেদ প্রথায় জর্জরিত নিম্নবর্ণের লোকেরা মানুষের মর্যাদা পাওয়ার জন্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে।” (দ্রঃ ঐ, ১১৩ পৃষ্ঠা)
ভাস্কো-ডা-গামার নেতৃত্বে পুর্তুগীজ বাহিনী ভারত বর্ষে অশান্তির হাওয়া বয়ে আনে। পর্তুগীজরা ক্যথলিক খৃষ্টান-এরা সশস্ত্র হয়ে ধর্ম প্রচারের জন্য আসে। কিন্তু প্রথমে যিনি খৃস্টান ধর্মের বাণী এনেছিলেন তিনি হচ্ছেন সেন্ট টোমাস। সেটা ছিল ৫১ খৃস্টাব্দ ৫৯ খৃস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৪৯৮ খৃষ্টাব্দের ১২৭ই মে ভাস্কো-ডা-গামা গোলমরিচের ব্যবসা করবার নামে মাদ্রাজের কালিকটে আসেন। কালিকটের রাজা জামোরিন গোলমরিচের নতুন খরিদ্দার হিসেবে তার সম্মান দেন এবং স্বাগত জানান। সেখানকার রাজাদের ধারণা ছিল এরা মুসলমানদের মত ব্যবসা করবেন এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করবেন।
এ সময়ে বিচক্ষণ মুসলমানরা বা মোপলারা তাদের চালচলন এবং কাজকর্ম দেখে অনুমান করেন--খৃষ্টানদের ব্যবসাই উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য আরো কিছু। তাই তারা রাজাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, একটা সমৃদ্ধ জাতির সুদূর প্রাচ্যে শুধু ব্যবসার জন্য আগমন নাও হতে পারে, খবরা-খবর নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে আর সশস্ত্র রূপ নিয়ে ফিরে আসতে পারে। রাজা তাদের কথা বিশ্বাস করেন এবং সাবধান হন।
ভাস্কো-ডা-গামা ১৪৯৮ খৃষ্টাব্দের ২৯ শে আগস্ট এ দেশের মানচিত্র এবং নানা সংবাদ ও তথ্য নিয়ে স্বদেশ রওনা হলেন। ঠিক বছর দুই পর ১৫০০ খৃষ্টাব্দের ১৩ই সেপ্টেম্বর কালিকটে আর একটি পর্তুগীজ দল পৌছে নিজেদের কুঠী স্থাপন করলেন। মুসলমানদের উপর আগেকার রাগ ছিলই। তাই তারা হঠাৎ আরবদের মাল বোঝাই জাহাজ দখল করেন। ফলে আরবরাও বীরবিক্রমে তাদের কুঠি আক্রমণ করে কুঠীর অধ্যক্ষ আইরস কোরীয়াকে খতম করেন। এ ঘটনায় অভিযানের নেতা মিঃ কব্রাল ক্ষিপ্ত হয়ে কালিকটের উপর জাহাজ হতে ৪৮ ঘণ্টা গোলাবর্ষণ করেন। ফলে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়। তারপর মিঃ কব্রাল কোচিনে চলে এসে সেখানকার রাজাকে বালিকটেরও রাজা করে দেয়ার লোভ দেখালেন। এবার সে ভাস্কো-ডা-গামা ১৫০২ ষ্টাব্দে ভারতে সামরিক নৌবহর নিয়ে এসে যা করলেন তা জানলে চমকে যেতে হয়।
কালিকটে পৌঁছে রাজা জামোরিনকে আদেশ দিলেন সমস্ত মুসলমানকে দেশ হতে বের করে দিতে হবে'—অবশ্য ন্যায়পন্থী রাজা তা অস্বীকার করলেন। কারণ রাজা জানতেন মুসলমান মোপলারা সাহায্য সহযোগিতা করেছে বলেই তাদের রাগ। ফলস্বরূপ ভাস্কো-ডা-গামার জাহাজ থেকে গোলমরিচের পরিবর্তে অবিরাম গোলাবর্ষণ হতে দেখা গেল।
ভাস্কো-ডা-গামার জাহাজ থেকে গোলমরিচের পরিবর্তে অবিরাম গোলা বর্ষণ হতে দেখা গেল। বহু নিরপরাধ মানুষ ভাস্কো-ডা-গামার গোলায় মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তিনি গোটা শহরের অর্ধেকটা শ্মশান করে ছাড়লেন। ১৪৯৮ খৃষ্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামার স্বদেশে ফেরা সম্ভব হত না যদি একজন বড় রাজকর্মচারী ব্রাত্মণের সীমাহীন প্রীতি এবং পক্ষপাতিত্ব না পেতেন। এও হতে পারে, ব্রাহ্মণ বেচারা ভাস্কো-ডা-গামার চরিত্র অনুধাবন করতে পারেন নি।
এবার ভাস্কো-ডা-গামা সে ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বিনা দ্বিধায় সাক্ষাত করতে গেলেন। অতঃপর ভাঙ্কো-ডা-গামা তার হাত দুটি ও কান দুটি কেটে একটি বাক্সে ভরে রাজা জামোরিনকে একটি চিঠিতে লিখে পাঠালেন—ভাস্কো-ডা-গামার অনুরোধ, রাজা যেন এ মাংস রান্না করে খান। (দ্রঃ ঐ, পৃষ্ঠা ১২১)
উপরোক্ত চরিত্রগুলো যদিও মুসলমানদের মধ্যে এভাবে পাওয়া যায়নি তথাপি, ভাগ্যের পরিহাস, মুসলমান চরিত্রগুলোর বেশিরভাগই এ অভিযোগে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত। একটু আগেই বলা হয়েছে মিঃ কাব্রাল যেভাবে লোভ দেখিয়েছিলেন কোচিনের রাজাকে, ঠিক তেমনি কান্নানোর ও কুইলনের রাজাকেও ধোকা দিয়েছিলেন। উত্তরের রাজা চিরাক্কল এবং দক্ষিণের ত্রিবাঙ্কুর রাজার সাথেও এভাবে বন্দোবস্তের ফলে ভারতের রাজায় রাজায় লেগে গেল যুদ্ধ আর প্রত্যেক রাজার মিত্র হল পর্তুগীজরা। ১৫০০ খৃষ্টাব্দে কোচিনে তারা নিরাপদে দুর্গ এবং গীজা তৈরি করলেন-অর্থাৎ অস্ত্র ঘর এবং ধর্ম ঘর। এটাই বোধহয় একহাতে অস্ত্র আর অন্য হাতে শাস্ত্রের ভিত। ক্যাথলিক খৃস্টানরা গুপ্তচর দিয়ে খবর নিতে লাগলেন কোন সময় রাজা জামমারিন বাইরে যান। সময় উপস্থিত হল ১৫১০ খৃস্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি কালিকটে লুটপাট শুরু হল। শহরবাসীরা রুখে দাঁড়াল এবং প্রধানত আরব বণিক ও মোপলাদের বীরত্বের ফলেই পোর্তুগীজদের পালিয়ে আসতে হল।'
খৃস্টানরা বুঝতে পারলেন মুসলমানদের না হটালে খৃস্টান ধর্মের প্রচার এবং তাদের ব্যবসার প্রসার কোনটাই সম্ভব নয়। তাই প্রথমে মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে শুরু করলেন এবং ভারত বর্ষের মানুষের সাথে মুসলমানদের অনুকরণে কিছু বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করলেন। এদিকে ১৫২৪ খৃষ্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা মারা গেলেন।
ভাস্কো-ডা-গামার এত বড় কাণ্ড মোটামুটি গোপন আছে। তার উপর কু-ধারণা জন্মানোর প্রয়োজনও হয়নি। শুধু মুসলমানদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে, ভারতের বুকে দেয়া দিয়ে তিনটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়েছে। ভারত বর্ষে বঙ্গদেশ মুসলমান প্রধান হল কেন? এর উত্তরে যাদের মনে হবে এক হাতে শাস্ত্র অন্য হাতে অস্ত্র নিয়ে হিন্দুদের মুসলমান করা হয়েছে তাদের জেনে রাখা ভাল, আসল কথা তা নয়। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর অবিচার ও অত্যাচার, অপরদিকে মুসলমানদের সাম্য ও সমতাবাদ প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতেই মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি হয়ে পড়ে। তাছাড়া অভিনব তথ্য হচ্ছে, বঙ্গদেশে সাম্প্রদায়িকতা মুসলমান জাতিকে যত বেশি দূরে ঠেলে দিয়েছে তত বেশি মুসলমান সংখ্যাধিক্য হয়েছে।
কালকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী অমলেন্দু দে-র লেখা ‘রুটস অফ সেপারিটিজিম ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী বেঙ্গল' গ্রন্থে এ বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে অনেক তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে। নোটস অন দ্যা রেসেস, কাস্টস এ্যান্ড ট্রোডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল' প্রণেতা ডঃ জেমস ওয়াইজের সাক্ষ্য থেকে মিঃ দে দেখিয়েছেনPrevious to the eighteenth century the Hindu inhabitants of Bengal far exceeded the Muhammadan in numbers.
তাহলে বোঝা যাচ্ছে মুসলমানদের হাতে যখন বাদশাহী ছিল, যখন তাদের হাতে রাজনৈতিক শক্তি পুরোপুরিভাবে ছিল, তখন মুসলমানরা সংখ্যায় লঘু ছিলেন যখন তাদের হাতে রাজনেতিক শক্তি আর নেই, সে সময়ে অর্থাৎ ১৮৭১ খৃস্টাব্দে দেখা গেল মুসলিম সংখ্যা ক্রমশঃ বেড়ে এঠছে। প্রমাণিত সত্য তথ্যও হল এটা-১৮৭১ খৃস্টাব্দেরও দেখা গেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের যেখানে সংখ্যা ছিল ১৮১ লাখ পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরে সংখ্যা তখন ছিল ১৭৬ লাখ অর্থাৎ মুসলমানদের সংখ্যা যদিও বেড়ে চলেছিল তবুও এ সময় পর্যন্ত মুসলিমরা পাঁচ লাখ কম ছিলেন।
তারপর ১৮৯১ তে যখন লোক গণনা হল তখন দেখা গেল, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ১৮,৯৬৮,৬৫৫ আর অপরদিকে মুসলমানদের সংখ্যা ১৯,৫৮২,৩৪৯। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে যে মুসলমানরা পাঁচ লাখ কম ছিলেন, ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ মাত্র বিশ বছর পরে যখন লোক গণণা হল তখন মুসলমানরা সংখ্যা কম তো দূরের কথা, অনেক বেশি হয়ে গেলেন।
এ প্রসঙ্গে অমলেন্দু দে ‘সেনসাস অফ ইন্ডিয়া ১৮৯১' এর প্রণেতা সি, জে, ও, ডোনেলের যে মন্তব্য উল্লেখ করেছেন তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ডোনেল সাহেব Fercato, "The slight increase of Hindus between 1872 and 1881, amounting to only 141,135 persons or 0.8 percent, that of Musalmans being 7.1 percent, was a sufficiently noticeable fact, but from the foregoing figures it appears that nineteen years ago in Bengal proper Hindus numbered nearly half a million more than Musalmans did, and that in the space of less than tow decades, the Musalmans have not only overtaken the Hindus, but have surpassed them by a million and a half.' এখানেও দেখা যাচ্ছে মাত্র কয়েক বৎসরেই মুসলমানদের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে গেছে।
এ সাথে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, যখন বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এক নতুন উথান ও জাগরণের চেতনাতে, গৌরবে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল সে ঘটনার কালেই বাঙ্গালী মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার গৌরব অর্জন করে।
একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা কর্তব্য যে, যারা নতুন মুসলমান হয়েছিরেন তাদের দ্বারাতেই তথাকথিত অত্যাচারের শতকরা ৯৫ ভাগ ঘটেছিল। যুক্তিস্বরূপ সুরজিৎ দাশগুপ্তের একটি উদ্ধৃতি পূর্বে যদিও দেয়া হয়েছে আলোচনার জন্য আবার তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, “এখানকার কোন কোন রাজবংশ ইসলাম ধর্মের আদর্শে প্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং ইসলামের প্রচারে উদ্যোগী হয়েছে।”
সম্ভ্রান্ত হিন্দু রাজবংশের ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়া এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। যুক্তি হচ্ছে এ, যার যে বিষয়ে শক্তি আছে, তার বহিঃপ্রকাশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমবেশি পরিদৃষ্ট হয়। সুতরাং একজন রাজা, তাঁর সারা রাজ্যে বিশেষ প্রভাব থাকে। অতএব তাঁর মুসলমান হওয়াটা যে বেঠিক, তা প্রমাণ করার জন্য অথবা বিরুদ্ধবাদীদের বক্তব্য বন্ধ করার জন্য তাঁকে তাঁর পরিষদ, কর্মচারীবৃন্দ ও অনুগতদের অনুগত রাখার জন্য বুদ্ধি ও সামান্য সম্ভাব্য বলপ্রয়োগ যে করতে হয়েছে তা স্বীকার করে নেয়াই ভাল।
দ্বিতীয় কথা মানুষের রক্তের সম্বন্ধ যেখানে, অর্থাৎ যারা নিকটাত্মীয়, তাদের ত্যাগ করা অথবা ভুলে যাওয়া কখনই সহজ সম্ভব নয়। সুতরাং কোন হিন্দু রাজা মুসলমান হলেই তার প্রাণ চাইত তিনি যেন তার নিকট আত্মীয়-আত্মীয়াদের পেতে পারেন পূর্বের মতই। কিন্তু তার উপায় কি ছিল? হয় রাজাকে আবার হিন্দু হতে হয় নতুবা আত্মীয়দের মমতা বা ক্ষমতা প্রয়োগে তাদেরকে নিজেরে মধ্যে টেনে নিতে হয়। সুতরাং কাল যিনি হিন্দু ছিলেন আজ তিনি মুসলমান, এ রকম লোকের দ্বারাতেই অল্প হলেও হিন্দুরা অনেক ক্ষেত্রে ব্যথা পেয়েছেন, তা অস্বীকার করা যায় না।
উত্তরবঙ্গে রাজা যদুর কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এখন তার একটু বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি পাঠ্যপুস্তকগুলো যে সমস্ত ঐতিহাসিকদের রচনা, তাঁদের মধ্যে শ্রীবিনয় ঘোষ একজন রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।তার লেখা নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ভারতজনের ইতিহাস' পড়লে জানা যায় যে ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে রাজা জালালুদ্দিন সিংহাসন লাভ করেন। তিনি হিন্দু প্রজাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছিলেন। ঐ ইতিহাসে আরও পাওয়া যায়, তিনি ব্রাহ্মণদের জোর করে গোমাংস খেতে বাধ্য করেছিলেন। এসব তথ্য শুনলে হিন্দু ছাত্রদের মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। তাহলে কি ইতিহাস থেকে এগুলোকে বিয়োগ করতে হবে? আমাদের মতে, ভারতের কল্যাণে তথ্য সঠিকভাবে লেখা উচিত। জালালুদ্দিন ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনপ্রাপ্ত হন। তিনি নানা কারণে হিন্দুদের এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মুসলমানদের মত সমদৃষ্টিতে দেখতে পারেন নি। আর যদি ব্রাহ্মণদের জোর করে গরুর মাংস খাইয়েছিলেন লিখতেই হয় তাহলে ঘটনাটি পুরোপুরি বলতে হয়।
শ্রীবিনয় ঘোষ লিখেছেন, “জালালুদ্দিন নামে রাজা সিংহাসনে বসিয়া তিনি ব্রাহ্মণদের উপর প্রতিশোধ লইয়াছিলেন। তাঁহার হিন্দু বিদ্বেষ সারা জীবন তীব্র ছিল। তাঁহার স্ত্রী-পুত্রের দেহাবশেষ পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত একলাখী সমাধিত প্রোথিত রহিয়াছে। একলাখী সমাধির স্থাপত্যকলা বাংলার মুসলমান আমলের অন্যতম কীর্তি বলিয়া স্বীকৃত। হিন্দু দেবালয় ও বৌদ্ধ বিহারের অনেক ভগ্নাবশেষ এই সমাদি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়।” (দ্রঃ ভারতজনের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৩৫০)
তাহলে সহজেই মনে করা যেতে পারে হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মন্দির ভাঙ্গাই ছিল ইসলাম ধর্মের অন্যতম কাজ। শ্রীঘোষের লেখা যদিও ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয় তবুও তা সত্য বলে স্বীকার করা কর্তব্য। এর বিস্তারিত বললে বলতে হয়
ইতিহাসে উত্তরবঙ্গে একজন রাজার নাম পাওয়া যায় যার তিনটি নাম ছিল রাজা কংস, রাজা গণেশ এবং রাজা দনুর্জন। এ রাজা দনুর্জন মুসলমান সুফী সাধু আওলিয়াদের উপর অত্যাচার করতে শুরু করেন। তখন একজন সুফী কুতুবুল আলম নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি জৌনপুরের রাজা ইবরাহিম শাহ’র সাহায্য প্রার্থনা করে একটা পত্র পাঠান। সে সাথে আর এক মুসলমান সাধন আশরাফ জাহাঙ্গীরও একটা পত্র লেখেন। ইবরাহিমের দরবারে কুতুবুল আলাম সাহেবের সম্মান ছিল অপরিসীম। তাই তিনি একটা সুদক্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে এলেন রাজা কংসের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য।
রাজা কংস বা গণেশ চিন্তা করে দেখলেন যুদ্ধের জেতা সম্ভব নয়, তার চেয়ে কৌশল অবলম্বন করাই উত্তমতর কাজ হবে। তাই তিনি জানালেন ইসলাম ধর্ম ও ধার্মিকদের উপর আমার কোন বিরোধ নাই। আমি মুসলমান হতে চাই, আর আমার পুত্র যদুকেও মুসলমান করে তাকে সিংহাসন দিয়ে দিন। তাহলে আমাকে সিংহাসনচ্যুত করাও হল আর নতুন মুসলমানকে সিংহাসনে বসানও হল। এ পরিকল্পনা বিরুদ্ধ পক্ষ কোন কথা বলতে না পেরে তা মেনে নিলেন। কুতুবুল আলাম সাহেব যদুকে ইসলাম ধর্মের দীক্ষিত করে জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ নাম দিয়ে সিংহাসনে বসালেন।
তার ইবরাহিম শাহ সৈন্যসহ জৌনপুরে ফিরে গেলেন। রাজা গণেশ বেশ কায়দায় জয়লাভ করলেন। এবার তিনি পুরোহিত ব্রাহ্মণদের ডাকলেন এবং প্রস্তাব দিলেন যদুকে আবার হিন্দু করে নেয়ার ব্যবস্থা করতে। ব্রাহ্মণরা বললেন একটি সোনার বড় গাই তৈরি করতে হবে। স্বর্ণ ধেনু ব্রত পালন করে এ সোনার গাভীটির সমস্ত সোনা ব্রাহ্মণদের ভাগ করে দিলে তবেই যদুর হিন্দু হওয়া সম্ভব। তাই করা হল। জালালুদ্দিনকে পুনরায় হিন্দু বা যদু'-তে পরিণত করা হল।
রাজা গণেশ ১৪১৮ খৃস্টাব্দে মারা গেলেন। এবার তিনি (রাজা যদু) পুণরায় মুসলমান হতে চাইলেন। তার অন্যতম কারণ হিন্দুরা তাকে অন্তর থেকে হিন্দু বলে মেনে নিতে পারেন নি। তাই রাজা যদু আবার জালালুদ্দিন শাহ নাম নিয়ে মুসলমান হলেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের উপর তার দুঃখ হওয়ার কারণ, সোনার গরু কেটে ভাগ করে অবস্থা ফিরিয়ে নিলেন যারা, তারা পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না তাকে। সুতরাং এটা ছিল তার কাছে
অমার্জনীয় অপরাধ। তাই সেসব ব্রাহ্মণদের ডাকলেন এবং গো-মাংসের তরকারি দিয়ে তাদের আহারের ব্যবস্থা করলেন। ব্রাহ্মণরা আপত্তি জানালে তিনি তাদের মাংস খাওয়াতে বাধ্য করেন। তার যুক্তি ছিল, সোনার গরু ভাগ করে যদি খাওয়া চলে আসল গরু ব্রাহ্মণদের খেতে হবে। মিরআতুল আশরার' নামক ফার্সী পুস্তক অবলম্বনে জানা যায় সে সাধু বা কতুবুল আলামের পরলোগমন হয় ১৪১৫ খৃস্টাব্দে। আর যদু ওরফে জালালুদ্দিন শাহ মারা যান ১৪৪৭ খৃষ্টাব্দে।
এজন্য আমরা আগেও বলেছি নতুন মুসলমানদের জীবনেই কিঞ্চিত বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়, নতুবা ইসলাম-শিক্ষিত সাধু-সন্ত সুফী ও বণিক বেশে যারা এসেছিলেন তাঁদের চরিত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেম প্রীতিই পরিদৃষ্ট হয়।
প্রচলিত ইতিহাসে আমাদের শেখান হয়েছে, বহির্ভারত থেকে মুসলমান আক্রমণ হল, সাথে এল অস্ত্রশস্ত্র, হাত-ঘোড়া আর নিষ্ঠুর অত্যাচারীর দল। ভারতে তারা নাকি করলেন ভারতীয়দের হত্যা, মন্দিরগুলোর ধবংস সাধন, হিন্দুদের মুসলমান করা ইত্যাদি। আমাদের আলোচনায় প্রমাণ হল যে, ওগুলো ভিত্তিহীন, অসত্য ও কুপরিকল্পিত সম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত। এত তথ্য মনে রাখা সকলের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। শুধু ছোট্টমাত্র একটি কথা মনে রাখলেই যথেষ্ট হবে যে, যে সব রাষ্ট্র, দেশ বা দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের প্রথম প্রচারের মুহূর্তে যেখানে যায় নাই কোন সৈন্যদল, যান নাই কোন শাসক, বাদশাহ বা সুলতান, পাঠন হয়নি কোন অস্ত্রশস্ত্র অথচ সেসব জায়গা মুসলমানে ভরপুর হয়ে রয়েছে। যেমন মালয়েশিয়া, মালয়, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, আন্দামান, জাভা, হাবস, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি। এ ইন্দোনেশিয়ায় শতকরা ৯০ জন মুসলমান বর্তমান।
এমনি আরও আছে, যেমন বোর্নিও দ্বীপ—যেখানে শতকরা ১০০ ভাগই মুসলমান। বহুল প্রচারিত অসত্য বা বিকৃত ইতিহাসের বিরুদ্ধে সত্য ইতিহাসের ধারাকে খাড়া করতে যে কঠোর পদক্ষেপ তা কঠিন হলেও তার আবির্ভাবে মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যা নিষ্প্রভ হতে বাধ্য। সাধারণ উদাহরণ দিয়ে বলা যায়—১০০ বছর ধরে ইতিহাসে যা শেখান হল চিনি খুব ঝাল বা তিতা, চিনি থেকে সাবধান থেক।
কিন্তু ১০০ বছর পর চিনির কয়েকটি দানা জিভের উপর যদি ফেলে দেয়া হয় সাথে সাথে বিকৃত ইতিহাস সম্বন্ধে তার ধারণা স্পষ্ট হবে। বুঝতে পারবে চিনি সুমিষ্ট, মুখরোচক ও কল্যাণকর। তেমনই প্রকৃত বিজ্ঞান-ভিত্তিক সত্য তথ্য পৌঁছালে অসত্য বিকৃত তথ্যের উপর সত্য অনুসন্ধিৎসু মানুষের মন অপ্রসন্ন হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/492/16
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।