মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
(১৭৫৭-১৮৫৭)১৭৫৭-তে পলাশীর যুদ্ধ বা মুসলমান শাসনের পতন হয়, আর ১৮৫৭ অর্থাৎ ১০০ বছর পর হয় মহাসংগ্রাম। সৈন্যদের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে সে বিদ্রোহ বলে তা ‘সিপাহি বিদ্রোহ' বলা হয়েছে। এ ১০০ বছরের মাঝে ছোট বড় বহু আন্দোলন, আক্রমণ, যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের ধারা কিন্তু অব্যাহত থেকেছে। তার কিছু নমুনা দেখান যাচ্ছে।
১৭৫৮-তে শাহ আলম বিহার আক্রমণ করেন। ১৭৬০ সনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পূর্নিয়ায় বিদ্রোহ করেন খাদিম হুসেন। ১৭৬১-তে উধুয়ানালায় ও ১৭৬৪-তে বক্সারে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন মীর কাশিম। দরিদ্র অশিক্ষিত শ্রমিকদের ‘চোয়াড় বলা হত; তাদের দ্বারা ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে এক বিরাট বিদ্রোহ হয়। ডঃ এন, ভট্টাচার্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস' পুস্তকে লিখেছেন, “১৭৭০ খৃষ্টাব্দে চুয়াড়েরা বৃটিশ এলাকাসমূহে রীতিমত সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল” পৃষ্ঠা ৬)
১৭৭২ খৃষ্টাব্দের একটি শোষিত শ্রেণীর সংগ্রামকে ডাকাত দলের হানা বা লুণ্ঠন বলা হয়েছে। যে ডাকাত বাহিনী হামলা করেছিল সরকারি রেকর্ডে সংখ্যা ৫০,০০০ বলে উল্লিখিত আছে।” এ বছরেই নিঃস্ব ভিক্ষুক ও ক্ষুধার্তের দল একটা বিদ্রোহ করে। তারাই ইংরেজ ক্যাপ্টেন টমাসকে নিহত করতে সক্ষম হয়। ১৭৭৩ খৃস্টাব্দে ফকীর ও সন্ন্যাসীদের দ্বারা ইংরেজরা আক্রান্ত হয় এবং তাতে ইংরেজ নেতা মেজর রেনেল গুরুতর আহত হয়ে অকেজো হয়ে যান। ১৭৭৮ ও '৭৯-তে হায়দার আলীর নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালান হয়। ইংরেজদের প্রতিনিধ দেবীসিংহের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় ১৭৮৩ তে তিন হাজার লোকের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। (দ্রষ্টব্য ডক্টর নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ৮)
১৭৮৭ তে সিলেটে প্রচণ্ড বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৭৮৮ তে বিদ্রোহীরা প্রায় তিনশ ইংরেজ ও কর্মীদের হত্যা এবং থানা দখল করেন। ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে টিপু সুলতানের সন্ধির পর হতে ছোট বড় অনেকগুলো বিদ্রোহ হয়। ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে ভিজিয়ানা গ্রামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান হয়। ১৭৯৫ সনে আসামে বিদ্রোহ হয়। ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিপ্লবের জন্য একটি জোট তৈরি হয়। তার নেতাদের নাম-টিপু সুলতান, জামান শাহ, সিন্ধিয়া, আসাদউদ্দৌলা এবং রোহিলা সর্দার গোলাম মুহাম্মদ (তথ্য : ডক্টর এন ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ১)
এ বছরেই বীর টিপু ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। বেনারসের ইংরেজ রেসিডেন্ট মিঃ চেরীকে হত্যা করা হয় এ সনেই। এ একই বছরে ওয়াজিব আলির নেতৃত্বে বেনারস, গাজীপুর ও আজমগড়ে বিদ্রোহ হয়। ডক্টর এন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওয়াজির ব্যর্থ হন, কিন্তু তাকে ঘিরে যে ঘটনাচক্র তা নিঃসন্দেহে ইংরেজ বিরোধী সর্বভারতীয় চক্রান্তের তীব্রতা ও ব্যপ্তির পরিচায়ক।” (পৃষ্ঠা ১০) ১৮০০ খৃষ্টাব্দে বিজনোরে বিদ্রোহ হয়। ১৮০১ সনে গঞ্জাম জেলায় বিদ্রোহ ঘটে। ১৮০২ খৃস্টাব্দে মালবারের বিপ্লবীরা ওয়েনাদ জেলার পানামারাম দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। ১৮০৩ হতে ১৮০৫ পর্যন্ত কর্ণটিকে বিদ্রোহ হয়। ১৮০৪-এ বঙ্গদেশে শরীয়তুল্লার নেতৃত্বে যে প্রচণ্ড বিপ্লব পরিচালিত হয় তার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮০৫-এ বুন্দেলখণ্ডে বিদ্রোহ হয়। এভাবে কম বেশি কোথাও না কোথাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে মানুষ মাথা তোলবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু উপযুক্ত ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে সেগুলো ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়েছে। ১৮০৬-এ ভেলোরে ও ১৮০৮ সনে ত্রিবাঙ্কুরে ছোট বড় বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় ১৮১০ খৃষ্টাব্দে সূরাটের আবদুর রহমান বৃটিশ প্রধানকে মুসলমান হতে বলেন এবং তার কাছ হতে করের দাবি জানান।
এত স্পর্ধা নিয়ে যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয় তা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ১৮১৩-তে সাহারানপুর জেলায় বিদ্রোহ হয় ১৮১৪ তে মুরসন ও হারাসে বিদ্রোহ দেখা যায়। ১৮১৫ সনে গুজরাটের কাথিয়াবাড় অঞ্চলে বিদ্রোহের কথা জানা যায়। ১৮১৬-তে বেরেলীতে প্রচণ্ড বিদ্রোহ হয়; কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে এর সৃষ্টি হয়েছিল। নামজাদা অনেক ইংরেজ অফিসার তাতে নিহত হন, আর বিপ্লবীদেরও সাড়ে তিনশ জন শহীদ হন। এ বিপ্লবের নেতা ছিলেন মুফতি মুহাম্মদ আয়াজ। (ডক্টর ভট্টাচার্য, ঐ, পৃষ্ঠা ১২)
১৮১৭ তে উড়িষ্যা ও ১৮১৯-এ খান্দেশে বিদ্রোহ হয়। ১৮২০ ও ২১-এ বেরেলীর সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে বিরাট আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে ধর্মভিত্তিক ও পরে তা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে বহু সঙ্গীসহ তাঁর শহীদ হওয়ার কথা পূর্বেই জানান হয়েছে। ১৮২০-৩১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে এ সর্বভারতীয় সংগ্রাম কোথাও প্রত্যক্ষ আর কোথাও পরোক্ষভাবে চলতে থাকে।
১৮৩২-এ মানভূমে, '৩৫-এ গঞ্জামে, ৩৬-এ সবন্তবদিতে ও ১৮৩৮-এ আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে সারা বঙ্গে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল। ১৮৩৮ সনে শোলারপুরেও সৈন্য বিদ্রোহ ঘটেছিল। ১৮৩৯-এ পুনা, ১৮৪০-এ বাদামি, ১৮৪২-এ বুন্দেলখণ্ড, সেকেন্দ্রাবাদ, হায়দ্রাবাদ ও মালিগাঁও-এ বিদ্রোহ হয়। ১৮৪৩ ও ৪৪-এ যথাক্রমে জব্বলপুর ও কোলাপুরের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। ১৮৪৬ সনে প্রথম ও ১৮৪৮-এ হয় দ্বিতীয় শিখযুদ্ধ। অবশ্য দুটোতেই ইংরেজদের জয় হয়। ১৮৪৯ এ নাগাল্যাণ্ডে '৫০-এ পাঞ্জাবে ও '৫২ তে খন্দেশ ও চোপদা অঞ্চল বিদ্রোহ রূপ নেয়। ১৮৫৫-৫৬ তে রাজমহল ও ভাগলপুরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। আর ১৮৫৭ তে হয় মহাবিদ্রোহ, মহাভ্যুথ্থান বা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বলা হয়েছে 'সিপাহী বিদ্রোহ।
প্রধানতঃ মুসলমান পরিচালিত আন্দোলন ও সংগ্রামগুলো ছিল ইংরেজ সরকার ও তাদের দালাল অত্যাচারী কর্মচারি এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইংরেজের স্তাবক ও পদলোভীরা সেগুলোকে শুধুমাত্র ধর্মীয় আন্দোলন বলে চালাতে চেয়েছে। আরও বলতে চেয়েছে যে, মুসলমানদের আক্রমণগুলো ছিল হিন্দুদের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ সেগুলো ছিল সাম্প্রদায়িক লড়াই। তাই ডক্টর নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “১৮৩১-এ কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহেও তারা সমান নিরপেক্ষতার সাথে হিন্দু মুসলমান ভূমি অধিকারীদের উপর হামলা চালিয়েছিল পৃষ্ঠা ১৭) অধ্যাপক অমলেন্দু দে লিখেছেন, “জমিদারদের স্বার্থ রক্ষাকারী নয় অথবা জমিদারদের বাসস্থানের সংলগ্ন এলাকায় নয় এমন হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীরা কেবলমাত্র হিন্দু হওয়ার জন্য আক্রান্ত হয়েছেন এমন কোন তথ্য সরকারী বা বেসরকারী সূত্র থেকে পাওয়া কষ্টকর।” (অমলেন্দু দে, পৃষ্ঠা ১২৯)
মনে রাখা প্রয়োজন, মুসলিম বিপ্লবীরাই (ও) সর্ব প্রথম বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংঘবদ্ধভাবে ভারত বর্ষ হতে ইংরেজ বিতাড়নের জন্য সুদীর্ঘকাল ব্যাপী এক সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। আর এ বিপ্লবকে (ও, আন্দোলন), মুসলিম কৃর্তৃত্ব পুন প্রতিষ্ঠিত করবার অভিপ্রায়ে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত ভারত বর্ষে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করা যায়।” (অমলেন্দু দে। বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিম্বিতাবাদ, ১৩১ পৃষ্ঠা)
‘বিপ্লবী (ও.) খলিফাদের প্রচারের ফলে সুদূর ত্রিপুরা সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, পাটনা, বেনারস, কানপুর, দিল্লী, থানেশ্বর, আম্বালা, অমৃতসর, ঝিলম, রাওয়ালপিণ্ডি, কটক, পেশওয়ার ইত্যাদি স্থানে এ দলের কার্যালয় স্থাপিত হয়। তাছাড়া বোম্বাই মধ্যপ্রদেশ ও হায়দ্রাবাদেও বিপ্লবী (ও.) মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে অনেকে যোগদান করে।" (ঐ পৃষ্ঠা ১১২-১৩) এ মহাবিপ্লব এমনই মারাত্মক ছিল যে, তার জন্য হরিশচন্দ্রের ‘হিত প্রাট্রিয়ট' পত্রিকাতেও লেখায়-বিপ্লব' ব্রিটিশ শক্তির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ স্বরূপ দেখা দিয়েছিল। বিদ্রোহকে দমনের জন্য ভারত ব্রিটিশ শক্তি পর্যাপ্ত ছিলনা। খোদ ইংল্যাণ্ড থেকে প্রভূত রসদের যোগান এসেছিল, সৈন্য এসেছিল পারস্য থেকে, সিঙ্গাপুর থেকে। (দ্রঃ S.R. · Sharma : The Making of Modern India 1951. p. 45-46)
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ পূর্ণতা পেতে পারেনি জমিদার আর রাজা মহারাজাদের বেঈমানি করার কারণে-“যাদের উপর নির্ভর করে ইংরেজরা সে যাত্রায় পার হয়ে গিয়েছিল তারা ছিল ইংরেজ শাসনের দ্বারা সৃষ্টি কিছু অনুগত রাজা, মহারাজা ও জমিদার। উদাহরণ স্বরূপ, বর্ধমানের মহারাজা মহাবিদ্রোহের সময় ইংরেজদের প্রভূত সাহায্য করেছিলেন।” (ডক্টর ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ২৯)
‘সিপাহী বিদ্রোহ' নয়, জনগণের মহাবিপ্লবঃ ১৮৫৭ সনের বিদ্রোহ শুধু সিপাহীদের নয়। ভারতীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিলেন সত্যিকথা, তবে সৈন্যদের বিদ্রোহ তার আগে ও পরে বহুবার হয়েছে। বস্তুতপক্ষে এ ১৮৫৭-র আন্দোলনে শুধুমাত্র সিপাহীরা নন, লাখ লাখ সাধারণ মানুষও প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র ধরে লড়াই করেছেন, কোটি কোটি মানুষ তাদের সমর্থন করেছেন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, খাদ্য ও অস্ত্র যুগিয়েছেন সাধ্যানুসারে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাধ্যাতীতভাবে।
সাতান্নর বিপ্লবকে ‘সিপাহী বিদ্রোহ' বলার প্রতিবাদে কার্ল মার্কস বলেন, “ব্রিটিশ শাসক শ্রেণীরা অভ্যুথ্থানকে কেবল সশস্ত্র সিপাহীবিদ্রোহ রূপে দেখতে চায়, তার সাথে যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক অংশ জড়িত তা লুকাতে চায় তারা।” (প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধঃ কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা ১০) বিদ্রোহের ইতিহাস যারা প্রথমে লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাদের সকলেই ছিলেন ইংরেজ, বেশির ভাগ লেখক আবার ইংরেজ রাজপুরুষ। “ইংরেজ ঐতিহাসিকরা একে বলেছেন সিপাহী বিদ্রোহ আর ভারতীয়েরা একে বলতে চান ভারত বর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।” (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসঃমণি বাগচি, থমকা, পৃষ্ঠা ১)
মুর্শিদাবাদ জেলা তখন ছিল উন্নততর জেলা এবং সেখানে ছিল মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য। সেখান থেকেই ভারতের মুসলমান শাসন হস্তান্তরিত হয়েছিল ইংরেজদের হাতে। পূর্বেই বলা হয়েছে ১৮৫৭ সনের মহাবিপ্লব মুর্শিদাবাদের বহরমপুরেই শুরু হয় সৈন্যদের বিদ্রোহের ভিতর দিয়ে। সেখান থেকে এ সংবাদ ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। তার পরের মাসে গণ্ডগোল হয় ব্যারাকপুরে। দেশের সর্বত্র মাওলানা পীর ও ফকির বেশধারী অসংখ্য মানুষ সিপাহীদের আরও বিদ্রোহী করতে সাহায্য করেন-মার্কসও একথা স্বীকার করেছেন। হট্টগোল আরো জোরদার হয়ে উঠল সৈন্যদের টোটা ব্যবহারকে কেন্দ্র করে।
প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্টে একথা পৌছে দেয়া হল যে, দাঁতে কেটে যে টোটা বন্দুকে দেয়া হচ্ছে তাতে চর্বি আছে। আর চর্বি যেখানে বিক্রি হয় সেখানে গরু, মহিষ ও শূকর প্রভৃতি পশুর চর্বি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সুতরাং আরও ঘোরতর করে রটিয়ে দেয়া হল যে, টোটাতে শুকর ও গরুর চর্বি একত্রে মেশান আছে। এ সম্বন্ধে এ উদ্ধৃতিটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়-১৮৫৭-র গোড়ার দিকে সে মাত্র প্রচলিত শূকর ও গরুর চর্বি মাখান টোটার প্রবর্তন, ফকিরেরা বলতে লাগল-ইচ্ছা করে করা হয়েছে, যাতে প্রত্যেক সিপাহী জাত খোয়ায়।...অযোধ্যা, ও পশ্চিমের প্রদেশগুলিতে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে লোকদের ওসকাতে লাগল এ ফকিরেরা।” (দ্রঃ কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা ১৯৮)
ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে মুসলমানরাই সর্বাগ্রে বিদ্রোহী হয়। কারণ মুসলমান সৈন্যরা মনে করেছিল যে তাদের ধর্মে হাত দেয়া হচ্ছে। মুসলমানদের উত্তেজিত হবার কারণ সম্বন্ধে ইংরেজরা তাদের কর্মচারি হেদায়েত আলীর কাছ থেকে যে ব্রিপোর্ট নিয়েছিল; তা এ রকম : (ক) দাড়ি কাটা বাধ্যতামূলক ছিলনা, কিন্তু পরে দাড়ি কাটতে বাধ্য করা হয়েছিল; (খ) শূকরের চর্বিযুক্ত টোটা দাঁতে কেটে ব্যবহার করতে হয়: (গ) সরকারি হাসপাতালে মেয়েদের পর্দা তুলে দেয়া হয়; (ঘ) সৈন্যদের শপথ নেয়া হয়, যেকোন দেশের সাথে বা যেকোন দূর দেশের যুদ্ধে যোগদান করতে হবে ইত্যাদি।
মুসলমান মৌলবী, মাওলানা, ফকিরেরা এবার সারা দেশে রটিয়ে দিলেন যে, ময়দাতে। হাড়ের গুঁড়া মেশান আছে। হিন্দুদের মধ্যে ছড়ান হল, ইংরেজদের তত্ত্ববধানে যে সব ময়দা তৈরি হচ্ছে তাতে গরুর হাড়ের গুঁড়া মেশান হচ্ছে। সারা দেশের কেহ আর আটা বা ময়দা কিনতে চায় না। এমনকি ভারতীয় সৈন্যরাও রুটি খেতে অস্বীকার করল। এমনিভাবে লবণে হাড়ের গুঁড়া, ঘিয়ের সাথে জন্তুর চর্বি এবং কুয়ার জলে শুকর ও গরুর মাংস ফেলে জল অপবিত্র করা হয়েছে-এমন গুজবও রটে গেল। “পাউরুটিকে তখন লোকে বলত বিলিতী রুটি আর তাদের ধারণা ছিল এ বিলিতী রুটি খেলে জাত যাবে।” (তথ্যঃ মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ৪৫) সমুদ্র পার হয়ে ভারতের বাইরে যুদ্ধে যাওয়া রীতি বিরুদ্ধ কাজ ছিল বলে ভারতীয় হিন্দু সৈন্যরাও ইংরেজদের উপর ক্ষেপে ওঠে।
সৈন্যদের রান্নার ব্যাপারে হিন্দু মুসলমান উভয়ের জন্য যে পৃথক পৃথক পাচক থাকত তা তুলে দেয়াও ক্ষোভের অন্যতম কারণ। লর্ড ডালহৌসীর সময়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে সামনে করে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করা হলে অনেকে তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ হয়েছে বলে মনে করেন। তাছাড়া লর্ড উইলিয়ম বেন্টিক সতীদাহ প্রথাকে শুধু নিষিদ্ধই করলেন না, আইন করে দিলেন যে, সতীদাহের ব্যাপারে জড়িত ব্যক্তিদের প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। শেষে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের কর্তৃত্ব ইংরেজ কোম্পানী হাতে নিলে ক্ষোভ চরমে ওঠে।
তাছাড়া তখন খৃষ্টান ধর্মপ্রচার এত ব্যাপক হচ্ছিল যে, হিন্দু মুসলমান উভয় জাতির সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা ক্ষেপে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাদ্রীরা হাট, ঘাট, বন্দর, জেল, হাসপাতাল ও স্কুল সর্বত্রই তাদের ধর্ম প্রচার করতে থাকে। প্রত্যেক স্কুলে বাইবেল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ছাত্রদের প্রশ্ন করা হত, “তোমাদের প্রভু কে এবং কে তোমাদের মুক্তিদাতা?' ছাত্ররা শেখান খৃষ্টীয় পদ্ধতিতেই তার উত্তর দিত। (দ্রঃ সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসঃ আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ১২, ১৩ ও ১৪)L COII
মিঃ হোমসের উদ্ধৃতি দিয়ে আহমদ ছফা বলেছেন, “হায়দার আলীর মত সামরিক প্রতিভার অধিকারী হলেও একজন সিপাহীকে কিছুতেই (তার) অধীনস্থ একজন ইংরেজ সেপাইর মাইনে দেয়া হবে না এ বৈষম্যের কারণে কর্তৃপক্ষের প্রতি সেপাইদের বিশ্বাস ক্রমশঃ শিথিল হয়ে আসে।" এ সম্বন্ধে তিনি আরও বলেন, ইংরেজ অফিসাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সাথে হিন্দু স্ত্রীলোক রাখতেন। অনেক সেপাইকে অর্থ ও নানা চাপ দিয়ে তাদের আত্মীয়াদের এনে দিতে বাধ্য করাতেন তাঁরা। অবশ্য দারিদ্র্যের কারণে, টাকার লোভে অনেকে আপন আত্মীয়াদেরকেও সাহেবদের দিয়ে দিত। (আহমদ ছফাঃ ঐ ২৫, ৩১)
ব্যারাকপুরের সৈন্য মঙ্গলপাণ্ডে তাঁর ধর্মে হস্তক্ষেপ হয়েছে মনে করে ইংরেজদের উপর ক্ষেপে ওঠেন। তিনি লেফটেন্যান্ট বগকে গুলি করেছিলেন। মিঃ বগও পিস্তলের গুলি ছোড়েন। অবশ্য দুজনেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। মঙ্গলপাণ্ডে তার ভবিষ্যত চিন্তা করে আত্মহত্যার জন্য নিজের বুকে গুলি করলেন। মৃত্যু হলনা, হাসপাতালে যেতে হল। পরে বিচারের নামে প্রহসনে জনসাধারণের সামনে তার ফাঁসি হয় (৮ই এপ্রিল)।
নিঃসন্দেহে তার বুকের সে রক্ত আজ ভারতের হিন্দু মুসলমান সকলের জন্য এক গৌরবময় ইতিহাস-সম্ভার। ১৮৫৭ সনের ৩১শে মে সারা ভারতে একসাথে বিদ্রোহ, বিপ্লব ও আন্দোলনের আগুন জলে অভ্যুত্থান ঘটান হবে ঠিক করা হল। আর সর্বত্র সংবাদ পাঠাবার ব্যবস্থা হল চাপাটি কটির মাধ্যমে। এ রুটির ভিতরে থাকত পত্র। সুদক্ষ বৃটিশ গুপ্তচরও তা টের পায়নি। মুসলমান ফকির মাওলানাদের এ কৌশলটি তাদের সুনপুণ বুদ্ধির পরিচয় বহন কর-বিদ্রোহের বাণী সেদিন সারা ভারতে প্রচারিত হয়েছিল এক আশ্চর্য উপায়ে-চাপাটির মারফত।...এছাড়া, মুসলমান সিপাহীদের প্ররোচিত করবার জন্য বহু মুসলমান ফকিরের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছিল” (মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ৭৩)
এদিকে ৩১শে মে আসার আগেই মীরাটে ২৫ জন ভারতীয় সৈন্যকে কঠিনভাবে শাস্তি দেয়া হয়। ফলে কর্ণেল স্মিথের উপর লোক আরও ক্ষেপে ওঠে। এত হৈ চৈ সত্বেও তিনি দিল্লি গেজেটে’ লিখলেন : দিল্লী শান্ত, বিদ্রোহীদের শাস্তি দেয়ার পর মনে হচ্ছে এখানে আর কোন বিপদ ঘটবার সম্ভাবনা নেই। তারপরেই দেখা যায়, ভারতীয় জনসাধারণ ও সৈন্যরা জেলখানার লোহার গেট ভেঙ্গে ফেলেন এবং বিপ্লবী স্বেচ্ছাসেবক ও সৈনিকদের পায়ের বেড়ি খুলে দিয়ে মুক্ত করে দেন। খবর পেয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কর্নেল ফিনিম একদল ইংরেজ সৈন্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বিপ্লবীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেদিন কিন্তু সৈন্যরা তাকে কোন সম্মান তো জানালেনই না, বরং সকলে সিংহের মত গম্ভীর হয়ে চোখের ভাষা দিয়ে জানিয়ে দিলেন-“আমরা তোমার গোলাম নই।' পলকের মধ্যেই বিপ্লবীদের বন্দুক থেকে ঝাঁকে গুলি বের হতে লাগল-কর্নেল মিঃ ফিনিশ সাথে সাথে মারা গেলেন।
সারা ভারতে বিশাল জনতা ও বিপ্লবীদের তখন যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ। তার সম্পর্কে পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। সৈন্যরা মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিতেন ‘দ্বীন দ্বীন' রবে। মুসলমান যোদ্ধারা বলতেন, “আমরা স্বধর্ম রক্ষা করার জন্য এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি।” আরও বলা হত-ইংরেজ শাসন ধ্বংস হোক, বাদশাহ দীর্ঘজীবী হোন। [দ্রঃ মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ৯৯-১০১] বাগচি মহাশয় দ্বীন’ বানান দীন লিখেছেন। কিন্তু ওটা দীন' না হয়ে দ্বীন' হবে। কারণ দীন' অর্থে দরিদ্র আর দ্বীন' বলতে ধর্মকে বোঝায়।
বিপ্লবী সৈন্যরা একদিন মীরাটের রাস্তা ধরে ঘোড়া ছটিয়ে যাচ্ছিলেন। মিঃ ফেজার ও ডগলাস তখন ক্রোধে অধীর হয়ে বিপ্লবীদের উপর উপর গুলি ছুঁড়লে অনেকেই মারা যান। তারপর সাহেবরা অবশ্য লুকিয়ে পড়েন। এর প্রতিশোধে মিঃ ফ্রেজার, মিঃ হাচিনসন, মিঃ ডগলাস, জেনিং দম্পতি ও মিস ক্লীফোর্ডকে নিহত হতে হয় বিপ্লবীদের হাতে। পরে কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল মিঃ রিপ্লে দিল্লিতে বিপ্লবীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য বাছাই করা ইংরেজ সৈন্য এবং আরও কয়েকজন বিচক্ষণ অফিসার নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেন। কিন্তু মূহুর্তের মধ্যে প্রবল গুলি বর্ষণ শুরু হলে মিঃ রিপ্লে ও চারজন অফিসার নিহত হন।
যদিও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কঠোর নিষেধ ছিল ইংরেজ শিশু ও মহিলা যেন নিহত না হয়, তবুও বিপ্লবীরা সে চরম মুহূর্তে তাঁর এ কথা পালন করতে পারেন নি। ১৬ই মে বেসামরিক অনেক খৃষ্টান নারী ও বালককে আরো ভাল বন্দীখানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বের করে লম্বা দড়ি দিয়ে বেষ্টনী দিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে নিহত করা হয়। এ সঙ্কট সময়ে একজন বুদ্ধিমতী মহিলা মিসেস আলডোয়েল বলেছিলেন, মারার আগে তাদের কি অপরাধ আছে জানিয়ে দিলে ভাল হয়, কারণ মহিলা ও শিশুরা আপনাদের তো কোন দিন কোন ক্ষতি করেনি।
উত্তরে বিপ্লবীরা ওই সময় খৃষ্টান জাতির কাউকে ছাড়বেন না বলে জানান। চতুর মহিলা বুঝলেন, জনতার বেশির ভাগই মুসলমান। তাদের মুখে আওয়াজ দ্বীন দ্বীন জিন্দাবাদ।, ইংরেজকে খতম কর ইত্যাদি। তাই মিসেস আলডোয়েল বললেন, 'আমি মুসলমান হয়েছি তবুও কি আমি রেহাই পাবনা?' এ উত্তরে বিপ্লবীরা তাঁকে ও তার তিনটি পুত্রকে অবশ্য স্পর্শ করেন নি। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসেও লেখা হয়েছে, রক্ষা পাইয়াছিল শুধু মিসেস আলডোয়েল ও তাহার তিনটি শিশু পুত্র। সে নিজেকে মুসলমান ধর্ম অবলম্বনী বলিয়া প্রকাশ করালে ঘাতকেরা তাহার জীবন সংহার করে নাই। (মণি বাগচির লেখা সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাসের ১১১ পৃষ্ঠা)
মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য ছিল এ আন্দোলন-তাই বলে কি এ সত্য তথ্যগুলো চাপা দিতে হবে, বর্তমান ও আগামী দিনের পাঠকদের জানতে না দেয়ার জন্য? মণি বাগচি লিখেছেন, “দিল্লিতে বিষাদ, মিরাটে লজ্জা। ছয় দল বিদ্রোহী ও নগরবাসী উন্মত্ত মুসলমান দল তাহাদের বাদশাহের নামে এ সংস্থার কার্য প্রবৃত্ত হইয়াছিল। শাহজাদারা বিদ্রোহী পক্ষে সহায়তা করিয়াছিলেন,” (সি, যু. ই. পৃষ্ঠা ১১২)
এতে বিপ্লবীরা নিষ্ঠুর ছিলেন বলে মনে হতে পারে কিন্তু মনে রাখা দরকার, ইংরেজরা প্রথমে যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় ইতিপূর্বে দিয়েছে তার প্রত্যুত্তর ছাড়া এগুলো অন্য কিছু নয়। ঐ মিরাটে পঞ্চাশ জন বিপ্লবী ধরা পড়লেন। তাদের বিচার না করে প্রত্যেকের হাত বেঁধে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে কামান দাগা হল, সাথে সাথে পঞ্চাশটি প্রাণ ও তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উড়ে গেল কামানের গোলায়। অবশ্য ঘটনার নায়ক মিঃ ফ্রেজারকে বিপ্লবী আবদুল কাহার গুলি করে হত্যা করেন।
. ঠিক এ সময় (৮ই জুন রাণী ভিক্টোরিয়া এক আইন পাশ করলেন : ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাছাই করা ইংরেজ অফিসারদের নিয়ে গঠিত নতুন কমিটি বিপ্লবী ও বিদ্রোহীদের ফালি, দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড দিতে পারবে। আপীল করার আর কোন রাস্তা রইল না।
বেনারসে হিন্দু সংখ্যাধিক্য। সেখানে তখন এক হাজার চারশো চুয়ান্নটি দেবমন্দির এবং দুশো বাহাত্তরটি মসজিদ ছিল। মোঘল বংশের বিপ্লবী ফিরোজ' এ সময় বেনারসে পৌছাতেই তাঁকে দেখবার জন্য হিন্দু মুসলমানের ভিড় জমে উঠল। তখন কাশীর লোকসংখ্যা মিঃ মেকলের মতে পাঁচ লক্ষ। শতকরা ৯০ জন হিন্দু। মোঘল রাজকুমারদের নেতৃত্বে সমস্ত লোককে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। ব্যবসাদারদের পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করান সম্ভব হয়েছিল (দ্রঃ মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ১৪৫)
ইংরেজদের বিরুদ্ধে মানুষকে উত্তেজিত করতে বিপ্লবীরা টোটায় চর্বি মেশানর কথাতেই বেশি সাফল্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা যে, কাশীর রাজা ইংরেজের বিপক্ষে তো গেলেনই না, বরং ইংরেজদের সর্ব প্রকার সাহায্যই করেছিলেন। মণি বাগচি লিখেছেন, “৪ঠা জুন রাত্রে কাশীর রাজা ইংরেজ মিশনারীদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দান করেছিলেন। এমনকি, অর্থ ও সৈন্য সাহায্য করতেও তিনি কৃপণতা করেন নি। শহরে জনতা, আতঙ্ক ও গোলমাল। মুসলমানেরা উড়িয়েছে সবুজ পতাকা। কয়েদীরা মুক্ত হয়েছে জেলখানা থেকে।" (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৪৯)
ইংরেজ সৈন্য নিয়ে মিঃ নীল চরম আক্রমণ করলেন বিপ্লবীদের। পরাস্ত হতে হল বিপ্লবীদের-কাশীর রাজার সাহায্য পেয়ে মিঃ নীল নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নিলেন। কাশীর বাইরে হতে আসা বিপ্লবী জনতা এবং কাশীর জনসাধারণ বহু বিশ্বসঘাতক শিখকে নিহত করলেও কিন্তু শেষ উদ্ধার হয়নি। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসে লেখা হয়েছে-“বহুলোকের ফাঁসি হইল, পল্লীতে পল্লীতে নির্মম বেত্রঘাত বেপরোয়াভাবে চলিল। সারি সারি ফাঁসিকাষ্ঠে বহু নির্দোষীর প্রাণবায়ু বহির্গত হইল। কর্নেল নীলের নির্দেশে ইংরেজ সৈনিক ও কর্মচারীরা কাশীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে প্রবেশ করিয়া সেখানকার বহু লোককে রাস্তার দুই ধারের গাছে গাছে ফাসি দিয়া লোকের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করিতে লাগিল।" (পৃষ্ঠা ১৫৭)
মাওলানা লিয়াকত আলির নেতৃত্বও সেদিন সারা দেশকে তোলপাড় করেছিল। যে কথাকে কেন্দ্র করে তিনি জনসাধারণকে উত্তপ্ত করতে পেরেছিলেন তা হচ্ছে-ইংরেজরা ছলে বলে সমস্ত মানুষকে খৃস্টান করে ফেলবে; কোরআন, পুরাণ সব খতম হয়ে যাবে। একদিকে মাওলানা লিয়াকত ছিলেন বিখ্যাত বক্তা, অন্যদিকে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ও সংগ্রামী সংগঠক। বাগচি মহাশয়ও এর সমর্থনে লিখেছেন, “ইংরেজঃ এবার স্থানীয় লোকদের জোর করে খ্রীস্টান করবে কিংবা অন্যভাবে তাদের জাত মারবে-এ নরবের মূলে ছিলেন চুম্বুবাগের এক মৌলভী। নাম লিয়াকত আলী (পৃষ্ঠা ১৫৩)
এলাহবাদেও এ আগুন চরম রূপ নিয়েছিল একদিন ইংরেজ নেতা কর্নেল সিম্পসন চমকে উঠলেন বিপ্লবীদের কামানের আওয়াজে ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমরা কেন এরকম করছ? উত্তরে সাথে সাথে বিপ্লবীরা গুলি করলেন। গুলিতে তার মাথা না উড়ে টুপি উড়ে গেল। সংবাদ পেয়ে আট জন খাস ইংরেজ সৈন্য তাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এল। কিন্তু গুলিবৃষ্টিতে সকলকেই নিহত হতে হল। এরপর বিপ্লবীরা জেলখানা ভেঙ্গে কয়েদীদের মুক্ত করে দিল। রেলের কারখানা ধ্বংস করে টেলিগ্রাফের তার কেটে দিল-“দুর্গের বাইরে যেখানে যত ইংরেজ ছিল তাদের প্রায় সবাই নিহত হল। কোতোয়ালীর মাথায় উড়ল মুসলমানদের সবুজ পতাকা। বিদ্রোহীদের তোপে তোপে রেলইয়াডেংর ইঞ্জিনগুলো চুর্ণ হয়ে যেতে লাগল। এরপর সেনাপতি মিঃ নীল ১৮ই জনু নানা প্রদেশ হতে ইংরেজ সৈন্য যোগাড় করে একটা বড় ষ্টিমারে কামান সাজিয়ে গঙ্গা নদীর দুই ধারে বেপরোয়া ভাবে গোলা বর্ষণ করতে লাগলেন। কামানের বর্ষণে নগর জনশূন্য হল, অর্থাৎ ইংরেজ প্রতিষ্ঠা করার তাদের পুনর্শাসন।
মারাঠা নেতা নানা : বাজীরাও ছিলেন মারাঠা নেতা। তার সাথে ইংরেজদের ভাব ভালবাসা ছিলে পুরো মাত্রায়। ইংরেজদের প্রেম কিন্তু বাজীরায়ের মত মৌলিক বা নির্ভেজাল ছিলনা, বরং ছিল ভণ্ডামির উপর সত্যের প্রলেপ। বাজীরাওয়ের ঔরসজাত পুত্র না থাকায় তিনি ইংরেজ নেতাদের অনুমতি ও প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে পালিত পুত্র নানাকে দত্তক নেন এবং মৃত্যুর পূর্বে একটা অনুরোধ পত্র লিখে রেখে যান। নানা সে সাহসেই রাজকীয় মর্যাদা নিয়ে ইংরেজদের সাথে সুব্যবহার করে গেছেন বরাবর। এমনকি ইংরেজদের আপদে বিপদে সৈন্য দিয়ে অর্থ দিয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করে এসেছেন। দাগারাজ ইংরেজদের দাগাবাজির ইতিহাস তার জানা ছিল। কিন্তু তাঁর পিতৃস্বত্ব উপক্ষো করা হয় তখন তিনি খুব বিপদে পড়েন।
ঠিক তখন তিনি এমন একজন খুঁজছিলেন যিনি তার পক্ষ থেকে ইংল্যাণ্ডে যাবেন সরাসরি আবেদন জানাতে অবশেষে ইতিহাসে চাপা বিখ্যাত নেতা আজিমুল্লার সাক্ষাত পেলেন। আজিমুল্লাহ খুব সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে, কিন্তু খুব দরিদ্র। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে তার মাকে চাকরানীর কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। ছেলেকে মানুষ করে গড়ে তোলা ছিল তার বুক ভরা আশা। তাই শৈশবের প্রাথমিক কাজগুলো অনেক কষ্টে তিনি সেরে রেখেছিলেন বুদ্ধিমান বালক কিন্তু পরে বুঝতে পারলেন যে, স্কুলে লেখাপড়া করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এক ইংরেজের ভৃত্যের কাজ করতে শুরু করেন। সে সাহেবটি ফারসী ভাষায় ছিলেন খুব সুদক্ষ। আর ইংরাজী তো তার মাতৃভাষা। কিছুদিনের মধ্যে আজিমুল্লাহও ইংরেজী ও ফার্সী ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন এবং সাফল্যের চিহ্ন স্বরূপ তিনি একটি স্কুলের শিক্ষক হলেন অবশ্য শিক্ষক হবার পূর্বে তিনি সাহেবের চাকরি, ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৮৫৩ খৃস্টাব্দে নানা সাহেব ইংল্যান্ড যাবার জন্য তাকে অনুরোধ জানান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আলাপী, মিষ্টভাষী, সুদর্শন যুবক। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি নানান আবেদন পেশ করেন। কিন্তু তাঁকে বিফল হতে হয়। ঠিক তখন আর একজন ভারতীয় রঙ্গ বাপুজী সেতারার রাজার আবেদন নিয়ে ইংল্যাণ্ডে পৌছান। তিনিও বিমুখ হয়ে ফিরে আসতে মনস্থ করলে আজিমুল্লাহ তার দ্বারা নানা সাহেবকে সংবাদ দেন যে, তার দেশে ফিরতে দুতিন বছর দেরী হতে পারে। সে সাথে আরও জানালেন, আমার কথায় যখন কাজ হল না তখন ইংরেজকে ভারত থেকে তাড়ানর রাস্তা করে তবেই ফিরব'। ওদিকে বিলেতে বিদ্রোহী দলের অনেক মুসলমান ইংরেজ ধ্বংশের কাজে সেখানে আসা যাওয়া ও ঘাটি তৈরীর কাজ পূর্বেই শুরু করেছিলেন।
তারা আজিমুল্লাহকে পরামর্শ দিলেন যে, নানার দ্বারা প্রত্যেক ইংরেজ প্রেমিক হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহী দরে আনতে পারলে প্রভুত ও দ্রুত সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য আজিমুল্লাহও একথা ভেবেছিলেন।
আজিমুল্লাহর মিশুকে ভাব ও সুন্দর চেহারার সুবাদে তিনি সেখানে বহু রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ও তাঁদের বাড়ির মেয়েদের সাথে আলাপ করতে সক্ষম হন। দেশে ফেরার পরেও ‘ডার্লিং আজিমুল্লাহ’ বলে তাকে অনেকে চিঠিপত্র লিখতেন-তাদের মধ্যে অনেক রাজপরিবারের ছেলেমেয়েও ছিলেন।
যেহেতু তখন সারা মুসলিম বিশ্ব তুরস্কের সুলতানকে খলিফা বলে সম্মান করত, তাই ইংল্যাণ্ড থেকে তিনি তুরস্কে গিয়েছিলেন। ওখানে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে, বৃটিশরা বিশ্বের বহু জায়গায় তাদের রাজত্বে পরাজিত হচ্ছে ও মার খাচ্ছে। ওখান থেকে তিনি রাশিয়ায় যান। টাইমস' পত্রিকার সংবাদদাতা মিঃ রাসেল রাশিয়ায় থাকতেন। আজিমুল্লাহ তার আত্মীয় আত্মীয়াদের পত্র যোগাড় করে তার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তার কাছেই থাকতে শুরু করেন। মিঃ রাসেলকে তিনি বন্ধু' বলেন এবং তাকেও বন্ধু” বলিয়ে নিলেন। রাসেলের যুক্তি ও সহায়তায় তিনি রাশিয়া থেকে মিশরে যান। ওখানে প্রয়োজনীয় প্রচার ও অপপ্রচারের কাজ সেরে শেষে ভারতে ফিরেন। আজিমুল্লাহ খানের কর্মজীবন ও মৃত্যুর সম্বন্ধে Eighteen Fifty Seven পুস্তকের ১২৬-১৪৫ পৃষ্ঠার ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন বিস্তারিত প্রামাণ্য তথ্য পেশ করেছেন।
এবার ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাই ও তাতিয়া তোপী সম্পর্কে কিছু বলছি। রাণী লক্ষীরা দাগাবাজ ইংরেজের কাছ থেকে যখন অত্যন্ত আঘাত পেলেন তখন স্বামীহারা রাণী তাঁর পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে নিজেই নেতৃত্ব দিতে সংকল্প করেন। ওদিকে তাতিয়া তোপী ছিলেন নানার নিকটাত্মীয়। বলাবাহুল্য, কানপুর-বিরের বিপ্লবে জড়িয়ে আছেন আজিমুল্লাহ, তাতিয়া তোপী, নানা সাহেব ও রাণী লক্ষ্মীবাঈ। ১৮৫৭ সনের ১৮ই মার্চ মিঃ হুইলার নির্লজ্জের মত নানার কাছে পুরাতন বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সৈন্য ও সাহায্য চেয়ে পাঠান। নানা বন্ধুর পত্র পেয়ে তিন শত অশ্বারোহী ও কয়েকটি কামান পাঠিয়ে দিলেন।
নানা বোধ হয় ভেবেছিলেন, বিপদে সাহায্য করলে পরে হয়ত তার পুরনা সম্মান ও সম্পদ ফিরে পাওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে নবাবগঞ্জে নানাসাহেবের সাথে সাক্ষাত করতে এলেন একদল ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবী। দলের নেতা শামসুদ্দিন ও মুদ্দত আলী তাকে বোঝালেন, যে, আপনি ইংরেজদের সাহায্য করে ভুল করছেন। আমরা ওদের কিছু দিনের মধ্যে তাড়িয়ে দেব-ভারতবাসীর কাছে মার খেয়ে কুকুরের মত বিদায় নেবে তারা। ইংরেজ আমাদের অস্ত্রাঘাতে হবে বিতাড়িত, তখন দেশবাসীর কাছে আপনাদের লজ্জিত হতে হবে।
যে বৃটিশ সারা পৃথিবীতে তাদের প্রভুত্ব ও রাজত্ব কায়েম করেছে, তাদের সাথেও আমরা যুদ্ধ করতে পিছপা নই। ইংরেজের মিত্র হিসেবে আপনার সাথে যুদ্ধ করতেও আমাদের বাধ্য ছিলনা। বাধ্য শুধু এটুকু যে আপনি আমাদের বিপ্লবী মহান নেতা আজিমুল্লাহর বন্ধু। নানা এবার সাথে সাথে জানিয়ে দিলেন যে, আমি আজিমুল্লাহর মতের বাইরে যাব না। আর ইংরেজদের প্রতি আমার ভালবাসা ছলনা মাত্র। আজ থেকে আমি বিপ্লবীদের সমর্থক এবং আমার সমস্ত সাহায্য ও সহযোগিতা তাদের সাথে থাকবে।' নানা শেষ কথা বললেন-“আমিও তোমাদের একজন। বললেন নানা সাহেব। (মণি বাগাচি, পৃষ্ঠা ১৭০)
তারপরেই বিদ্রোহী দল নানার সৈন্যদের সাথে মিলিত হল। ইংরেজের ধনাগার লুঠ করল। অস্ত্রাগার হস্তগত হল। তখনও মিঃ হুইলার মনে করছেন যে, নানার সৈন্যরা যথারীতি তাদের অস্ত্রাগার পাহারা দিচ্ছে। কিন্তুতার সে আশায় ছাই পড়েছিল। বিপ্লবী দল নানা সহ তার সৈন্যদের নিয়ে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কাছে যাবার মনস্থ করলেন। কিন্তু অনেক ভাবনাচিন্তা করার পর নানা কানপুর ছেড়ে যেতে চাইলেন না (ঐ, ১৭২)
কানপুরের সবেদা কুঠিতে আজিমুল্লাহ, নানা সাহেব ও তাতিয়া তোপীর পরামর্শ হল যে, ইংরেজকে ধ্বংস করা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই। সে মত আজিমুল্লাহ ও নানার স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে মিঃ হুইলারকে আত্মসমর্পণ করতে জানান হলে মিঃ হুইলার তা অস্বীকার করেন। পরেরদিন দারুণ দুঃসাহস নিয়ে আজিমুল্লাহ নানা সাহেবের প্রতিনিধি জোয়ালাপ্রসাদকে নিয়ে ইংরেজ শিবিরে গেলেন। সেখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন মুর ও ক্যাপ্টেন হুইটিং। তাঁরা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁহাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আলোচনার শেষে এটাই স্থির হল যে, ইংরেজ তাদের সঞ্চিত অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করবে এবং গঙ্গার ঘাটে নৌকা প্রস্তুত থাকবে, তাতে করে তারা সকলে পরিবারসহ চলে যাবে।
শেষে মিঃ হুইলার আজিমুল্লাহর হাত থেকে আত্নসমপর্ণের কথা লিখিত কাগজ নিয়ে তাতে সই করেন। এরপরে চুক্তিমত যথাসময়ে ইংরেজরা দলে দলে গিয়ে নৌকায় উঠল। প্রথমে তারা জানতে পারেনি যে, ঐ নৌকাগুলোকে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হবে। মণি বাগচি লিখেছেন যথা-“কিন্তু ওগুলো তো নৌকা নয়, নানা সাহেবের জাতিকল। কলে পড়বার আগের মুহূর্তেও ইদুর যেমন বুঝতে পারেনা যে ওটা ঝাতিকল-তারা দেখেছে এসব নৌকায় তোলা হয়েছে জলের কলসি, আটার বস্তা, চিনি, মাখন আরো কত কি! কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে, এ শুধু ছলনা এবং নানা সাহেবের ছলনার আয়োজনের খুঁত ছিলনা এতটুকু" (পৃষ্ঠা ১৮১)
নৌকা ছাড়া হল। মাঝিরা মাঝ পথে নৌকা ছেড়ে পালিয়ে এল। শুরু হল দু’দিন থেকে গুলি বর্ষণ। নৌকার উপরের ছাউনিতে আগুন ধরে গেল। তীব্র আক্রমণ ও অত্যন্ত গোলা বর্ষণে মাত্র চারজন ছাড়া সকলেই নিহত হল। সে চারজন নৌকা থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বিল্পপীদের শত্রু, ইংরেজের অনুরক্ত দ্বিগ্বিজয়ী সিং। (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৮৩!)
এরপর নানা পেশোয়া' নাম ধারণ করলেন। ললাটে বাজটীকা ধারণ করলেন বটে, কিন্তু প্রভুত্ব পরিচালনা করতে পারলেন না; প্রভূত্ব ও নেতৃত্ব রইল আজিমুল্লার হাতে ! দুঃখের বিষয়, ইতিহাসে নানার নাম যেভাবে চিত্রিত রয়েছে, ততটুকু সম্মান দিয়েও আজিমুল্লাকে সম্মানিত করা হয়নি। যাহোক, এ সংবাদ পেয়ে কলকাতা থেকে লর্ড ক্যানিং মেজর রেনডকে কানপুরে পাঠালেন। সাথে চারশো ইংরেজ, তিনশো শিখ, একশো অশ্বরোহী সৈন্য ও দুটো কামান। ইংরেজরা কানপুরকে শশান করার জন্য আসছে, এ সংবাদ পেয়ে নানা সাহেবের বাড়ির কাছে বিবির.এ যত ইংরেজ নারী ও পুরুষ বন্দী ছিল তাদের সকলকে হত্যা করা হল।
অবশ্য কোন ইংরেজ মহিলার সতীত্ব নষ্ট হয়নি। ইংরেজ সৈন্য পৌছে গেল কানপুরে,মিঃ হ্যাভলক তাদের নেতা। ইংরেজ সৈন্য ও তাদের সহকারী শিখ সৈন্য এক ধার থেকে দোকান, ঘর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মানুষের সর্বস্ব লুট করল। “১৭ই জুলাই হ্যাভলক কানপুর অধিকার করলেন, তবে তিনি যে হত্যাকাণ্ড করেছিলেন তা অকল্পনীয়। তাছাড়া বন্দী আসামীদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণ সুবেদারকে মানুষের রক্ত মেঝে থেকে জিভ দিয়ে চাইতে আদেশ করা হয়। ব্রাহ্মণ অস্বীকৃত হলে প্রচণ্ড বেত্রাঘাতে তাকে বাধ্য করান হয় ও শেষে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলান হয়। দ্বিতীয় আসামী এক মুসলমান। তার প্রতিও এ একই আচরণ করা হয়। এভাবে একে একে সমস্ত ভারতবাসীদের হত্যা করে নিহতদের কুয়ার মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়। (ঐঃ মনি বাগচি, পৃষ্ঠা ২০২)
নানা বীরবিক্রমে লড়াই করেছেন, ইংরেজকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পোষণ করেছিলেন এবং প্রাণ বিসর্জনও করেছেন-এজন্য তিনি সাতান্নর বিপ্লবের ইতিহাসে একজন বীরবিপ্লবী। তাঁর লড়াই ও আত্মত্যাগকে ভুললে বা অবজ্ঞা করলে সত্যকে অস্বীকার করা হয়। তিনি প্রাণ দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেয়ার সুযোগ তার হয়নি-মনের দুঃখ আত্মহত্যা করেছিলেন। ১৮ই জুলাই তারিখে রাতের অন্ধকারে নানা সাহেব বিঠুর ছেড়ে চলে গেলেনঃ তিনি গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু গুজব রটান যে তিনি অযোদ্ধা চলে গেছেন” (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসঃ আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ১৩৮)
নানার ইতিহাসে একটি কাল দিক আছে। সেটা হচ্ছে নানাকে যদিও ইংরেজরা বারবার ধাক্কা দিয়েছে তবও তার ইংরেজ প্রীতি কোন সময়েই সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়নি। সেটা ইংরেজদেরকে লিখিত নানার চিঠিপত্রে প্রমাণিত হয়। কর্নেল পিঙ্কনকে ২০,৪.১৮৫৯-এর একটি পত্রে নানা লিখেছেন, “আমি নিরুপায় হয়েই বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিয়াছিলাম। আমার দ্বারা কোন প্রকার হত্যাকার্য সাধিত হয় নাই। আপনারা বিলক্ষণ অবগত আছেন যে, আমি খুনী নহি কিংবা আমি বিদ্রোহের অপরাধে অপরাধীও নহি, তথাপি ঘোষণাপত্রে আমার সম্পর্কে কোন আদেশ দেয়া হয় নাই।... আপনি সকলের অপরাধ ক্ষমাকরিয়াছেন এবং সকলেই এখন আপনার পক্ষে যোগদন করিয়াছে।
একমাত্র আমার কথাই বিবেচনা করা হয় নাই।... মৃত্যু একদিন আসিবে অতএব তাহার জন্য আর ভয় কি?... যদি মনে করেন তাহলে আমার পত্রের উত্তর দিবেন। মুর্খ বন্ধু অপেক্ষা জ্ঞানবান শত্রু শ্রেয়। ইতি-ধুন্ধু-পন্থ নানা।" অপরটি ২২ শে রমজান, ২৬শে এপ্রিল ১৮৫৯ তারিখের পত্র, সেটা তিনি মেজর রিচার্ডসনকে দিয়েছিলেনঃ "....কিন্তু আমি এইভাবে আত্মসমর্পণ করিতে পারি না। তবে মহারাণীর (ভিক্টোরিয়া) স্বাক্ষরমযুক্ত ও শীলমোহর করা একখানি পত্র আমার নিকট যোগ্য সামরিক অফিসার মারফত যদি পৌছায় তাহা হইলে আমি পত্রে উল্লিখিত শর্তাবলী বিনা দ্বিধায় মানিয়া লইতে পারি। আপনারা হিন্দুস্থানে এ পর্যন্ত যত দাগাবাজি করিয়াছেন, তাহা জানিয়া শুনিয়া আমি কিজন্য আপনাদের সহিত যোগদান করিব?... যতদিন আমার দেহে জীবন থাকিবে ততদিন আমার ও আপনাদের মধ্যে যুদ্ধ চলিবে।
আমি নিহত হই কিংবা ধূত হই অথবা আমার ফার্সী হয়, যাহা কিছু করিনা কেন অস্ত্রের সাহায্যেই তাহা করিব। তবে মহারাণীর (ভিক্টোরিয়া) স্বাক্ষরযুক্ত পত্র পাইলে আমি আত্মসমপর্ণ করিতে প্রস্তুত আছি।” এই পত্রে বোঝা গেল, তিনি আত্মসমর্পণ করতে রাজি ছিলেন, ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিতে সম্মত ছিলেন, শুধু রাণী ভিক্টোরিয়ার আসল শীলমোহর যুক্ত পত্রের প্রতীক্ষা মাত্র। এই বঙ্গানুবাদগুলো শ্রীমণি বাগচির পূর্বোক্ত পুস্তকের পরিশিষ্ট অধ্যায়ের ১-৩ পৃষ্ঠায় আছে। অবশ্য মূল পত্রের পূর্ণ ইংরেজী অনুবাদ ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেনের Eighteen Fifty Seven পুস্তকের (১৯৫৭ ছাপা) ৩৯২-৩৯৫ পৃষ্ঠায় মজুত আছে।
ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে বলা যায়, তিনি ইংরেজ বিতাড়নের উদ্দেশ্যে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৮৫৩ সনে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়। ১৮৫৪তে লর্ড ডালহৌসী জোর করে ঝাসীকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তভূক্ত করেন। রাণীর স্বামী গঙ্গাধর রাও রাজকোষে যে ৬ লাখ টাকা রেখে গিয়েছিলেন সে টাকা ইংরেজরা আত্মসাৎ করে, তবুও তারা রাণীর ভাতা দিতে এবং গঙ্গাধরের আত্মীয়স্বজনের প্রতিপালন করতে অস্বীকার করে। অবশ্য প্রথমে মেজর এলিস যখন ঝাঁসীর অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেন তখন রাণী সদর্পে উত্তর করেছিলেন, “মেরী ঝাসী নেহী দুঙ্গী"-এ কথাটি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করেছিলেন।
ঝাসীতে ৫ই জুন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেখানেও বিপ্লবীদল উপস্থিত হন। মুসলমান বিপ্লবীরা এখানেও সে চর্বির কথা জোর প্রচার করেন। বিপ্লবীরা ক্যাপ্টেন ডানলপকে হত্যা করেন। ১৪ নম্বর গোলাদ্ধাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট ক্যাম্পবের আহত হন। ৮ তারিখে ক্যাপ্টেন গর্ডন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ঝাঁসীর রাণীর এ বিপদের সুযোগে তার ভাইপো নিজেকে ঝাসীর মহারাজাবলে ঘোষণা করেন। ইংরেজের পক্ষ থেকে রাণীকে যুদ্ধ না করে অপেক্ষা করতে বলা হল। ৮ই জানুয়ারির সংবাদে জানা যায়, করিম বখশকে রাণী চিঠি দ্বারা জানিয়েছিলেন-“তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না। ইংরেজ সেনাবাহিনী এসে পৌছালে তার অধীনে যতগুলো জেলা আছে সবগুলোর কর্তৃত্বভার তিনি ইংরেজের হাতে ছেড়ে দেবেন।” (দ্রঃ আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ২৩৮)
ইংরেজের সঙ্গে একটা বোঝাপাড়ার বিষয়ে রাণী নমনীয় হয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় বিপ্লবী নেতা শাহজাদা ফিরোজ শাহ ঝাঁসীতে এলেন। তাঁতিয়া তোপী রাণীকে সন্ধি করতে মানা করলেন। তদুপরি ফিরোজ শাহ ও তাতিয়া তোপীর পরিচালনাধীন ২০ হাজার সৈন্য ঝাঁসীতে এলেন। স্যার হাফরোজ তার সৈন্যবাহিনী দ্বারা তাতিয়াকে হটিয়ে দিলেন। তারপর ৩রা এপ্রিল হাফরোজ সর্বশক্তি দিয়ে ঝাসীর উপর প্রবল আক্রমণ চালালেন। রাণী নিজে পুরুষ সৈন্যর মত যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সৈন্য বিপ্লবীদের কোণঠাসা করে ফেলল।
ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল এবং আবালবৃদ্ধবণিতা সকলকে হত্যা করতে লাগল। রাণী রাতের অন্ধকারে পুরুষের বেশে পালিয়ে গেলেন। রাণীর বাবাও ইংরেজ সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন এবং তার প্রাণদণ্ড হয়। রাণীকে ধরার জন্য ক্যাপ্টেন ফর্বস এবং লেফটেন্যান্ট ডকারকে ৩১ নম্বর অশ্বারোহী বাহিনীসহ পাঠান হয়। রাণীর চল্লিশ জন মুসলমান দেহরক্ষী তাদের সাথে যুদ্ধ করতে শুরু করেন। এবং শেষে ৩৯ জনই শহীদ হয়ে যান। তখনও রাণী পালাবার চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু তার ঘোড়া লাফিয়ে খাল অতিক্রম করতে পারল না। সে মুহূর্তে রাণী মি; রোজের অস্ত্রাঘাতে ঘোড়া থেকে পড়ে যান এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই তার মৃত্যু হয়। তাঁর দত্তকপুত্র দামোদর রাও মৃতদেহের অবমাননার আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি পুড়িয়ে ফেলেন (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃ. ১০২)
মণি বাগচির মতে, মুমূর্ষ সংজ্ঞাহীন রাণী গঙ্গাধরের পর্ণকুটিরে প্রাণত্যাগ করেন। এ বীরাঙ্গনা লক্ষ্মীবাঈয়ের নাম ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল সম্ভার সন্দেহ নেই। ঝাঁসীর রাণী? ইতিহাসে তবুও স্থান পেয়েছেন, কিন্তু যিনি রাণীকে ইংরেজের বিরুদ্ধে সর্বদা শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন, বিপ্লবী বাহিনীকে ঝাঁসীতে আনিয়েছেন এবং নিজে গোলাবর্ষণ করে ইংরেজদের হিমশিম খাইয়েছেন-সে ইস্পাত-কঠিন ঘাওস খাঁর নাম ইতিহাসে যেন স্থানই পায়নি। শ্রী বাগচিও লিখেছেন-“অন্যদিকে সশস্ত্র ফকীরগণ নিশানহাতে নিয়ে রাণীর জয়ধ্বনি করতে লাগল। হর্ষধ্বনি ও তোপের শব্দে ঝাঁসীর দুর্গ প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। ঘাউশ খাঁ ছিলেন রাণীর প্রধান গোলন্দাজ। এ দিন ঘাউশ খা দক্ষিণ দিকের বুরুজ থেকে এমন ভীরভাবে গোলবৃষ্টি করলেন যে, তাতে ইংরেজ পক্ষের তোপ বদ্ধ হয়ে গেল।” (পৃষ্ঠা ৩৪৬)
৭ই আগষ্ট ডিলওয়ারায় সেনাপতি রবার্টসের সাথে তাতিয়া তোপীর যুদ্ধ হয়, কিন্তু তিনি পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। তারপরে আরও একটি যুদ্ধে তাতিয়া জয়লাভ করতে পারেননি। যাইহোক, তিনি চম্বল নদী পার হয়ে ঝালবার প্রদেশের রাজধানী ঝালপত্তনে পৌছালেন। পৃথ্বী সিংহ তখন সেখানকার রাজা। ইংরেজদের প্রতি তাঁর অসীম অনুরাগ। তাঁতিয়া তোপী রানার প্রাসাদ অবরোধ করেন এবং তার সৈন্যদলকে নিজের দলভুক্ত করলেন। পরদিন যুদ্ধের খরচে জন তাঁতিয়া রাণার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকাও আদায়
করলেন। ওখান থেকে প্রস্থানের সময় রাজগড়ে ইংরেজের সাথে তাতিয়ার যুদ্ধ হয়। তাতিয়ার পরম বিশ্বাসভাজন বন্ধু রাজা মানসিংহ সেনাপতি মিঃ মিডের কাছে প্রস্তাব করেন-যদি তিনি ইংরেজদের শত্রু তাতিয়া তোপীকে ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে তিনি কি তাঁর সম্পদ-সম্পত্তি ফিরে পারেন? সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা ওটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। নিবিড় অরণ্যের যে স্থানে তাতিয়া ঘুমিয়ে ছিলেন সে স্থানের সংবাদ মানসিংহ জানতেন। একদিন গভীর রাতে স্বার্থপর মানসিংহ ইংরেজ সৈন্যের সাহায্য নিয়ে তাকে বন্দী করে সেনানায়ক মিঃ মিডের হাতে ধরিয়ে দেন। সামরিক আইনে বিচারের নামে প্রহসন হল-১৮৫৯ সনের ১৮ই এপ্রিল সিপ্রীতে তার ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। বরি তাতিয়া তোপী স্বহস্তে ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় পরে নিয়েছিলেন। ইতিহাসে এ দেশপ্রেমিক তাতিয়। তোপীর নাম সগর্বে থাকার দাবী রাখে।
বিপ্লবীদের বিশেষ ইচ্ছা ছিল ইংরেজদের মূল নেতাদের নিহত করা; তার প্রমাণ আগে কিছু পাওয়া গেল আরও কিছু প্রমাণ পরে আসছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, এ সকল কাজে হতে নিরপরাধ অসামরিক ইংরেজ কিছু নিহত হলেও সেগুলো অসাবধানবশতঃ এবং উত্তেজনার মুহূর্তেই ঘটেছে। নিঃসন্দেহে সেগুলো বিপ্লবী নেতাদের মতের প্রতিকুল ছিল, যেমন দেখা গেছে অদ্বিতীয় বাহাদুর শাহের সময়ে।
মহাবিদ্রোহের সময় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন মিঃ গাবিন। তিনি মেজর গলকে ছদ্মবেশে এলাহাবাদ পাঠালে মিঃ গল বিপ্লবীদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হন। স্যার হেনরী লরেন্স অযোধ্যার এলাহাবাদ পাঠালে মিঃ গল বিপ্লবীদের হাতে ধরা পড়েন ও নিহত হন। স্যার হেনরী লরেন আযোধ্যায় সাহাগঞ্জের রাজা মানসিংহের সাহায্য চাইলে তিনি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সব রকম সাহায্য দিয়ে বিপ্লবের ক্ষতি করেন। এদিকে গুরুবখশ ও মুসলিম ভূস্বামী নবাব আলি কিন্তু সর্বশক্তি দিয়ে ইংরেজ বিতাড়নে বিপ্লবীদের সাথে যোগ দিলেন এ সময় ওখানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হচ্ছেন বরকত আহমদ ও খান আলি খান।
বিচারের নামে প্রহসনকারী বিচারবিভাগীয় বিখ্যাত ইংরেজ নেতা মিঃ এম. এম. ওমানির মস্তকে বিপ্লবীদের গুলি লাগলে তিনি নিহত হন। চীফ কমিশনার মেজর ব্যাঙ্ক ২১শে জুলাই গুলিবিদ্ধ হন। স্যার হেনরি লরেন্স রাজা মানসিংহের সহায়তায় প্রথমে বেঁচে গেলেও পরে একদিন নিজ কক্ষে বিশ্রামরত অবস্থায় জানালা দিয়ে গুলি এসে তার মাথায় লাগে। আহত অবস্থায় ডাঃ ফেরাবের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু তিনিও মারা গেলেন। গোয়েন্দা প্রধান মিঃ গাবিনস ২১শে জুলাই স্বকক্ষে আলোচনারত ছিলেন। হঠাৎ বাইরে থেকে একটা গুলি ছুটে আসে। গুলি তাকে না লেগে মিসেস ডোরিন নান্নী তার এক অতিথিকে লাগলে তিনি সাথে সাথে মারা যান। চিফ ইঞ্জিনিয়ার মেজর জেনারেল মিঃ আণ্ডারসন খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংখ্যা একলাখ। তিনি অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্য অত্যন্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন, ফলে খেয়ে না খেয়ে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়লেন। হঠাৎ হৃদরোগে তিনিও মারা গেলেন। ১৪ই মার্চ তারিখে ইংরেজ নেতা ক্যাপটেন ক্যান্টনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব কাণ্ড দেখেশুনে লেফটেন্যান্ট জেমস্ আত্মহত্যা করেন। শেষে মিঃ হ্যাভলকও আউটরাম বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে আলমবাগে পৌছালেন। দুঃখের বিষয়, যে সৈন্যরা ভারতীয়দের হত্যা করতে এসেছিল তার মধ্যে ৩৪১ জন ছিল শিখ; (দ্রষ্টব্য আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ২০১)! এভাবে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম চলতে লাগল এবং এটা
সত্য যে উভয়পক্ষই দিন দিন দুর্বল হচ্ছিল। এ দুঃসময়ে রাজা জংবাহাদুর বৃটিশ সরকারকে অর্থ ও অস্ত্র তো দিলেনই, সে সাথে দিলেন তিন হাজার গোর্খার এক সেনাবাহিনী। শুধু তাই নয়, পরে ইংরেজ নেতা স্যার কলিন ক্যাম্পবেল জেনারেল ফ্রাঙ্ক এবং আরও ইংরেজ নেতার অনুরোধে রাজা জংবাহাদুর বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে স্বয়ং দশ হাজার সেনা নিয়ে হাজির হলেন। যুদ্ধে বিপ্লবীরা বুঝতে পারলেন যে, রাজা জংবাহাদুরের হিন্দু সৈন্যের গুলিতেই তাঁদের পতন হতে চলেছে। তবুও প্রবল বিক্রমে তারা যুদ্ধ চলিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত ৮৬০ জন বিপ্লবী ভারতের মাটিতে শহীদ হলেন। ১৮ তারিখে শহরের দুর্ভেদ্য দুর্গ বৃটিশের হস্তগত হল। রাজপুতানা ও মধ্য ভারতেও বিদ্রোহের উত্তাপ অল্প ছিলনা। নিমাচের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফিরোজ শাহ, যার নাম পূর্বে বলা হয়েছে। ফিরোজ নামধারী সাতজন যুবরাজ মোঘল বংশের ছিলেন। ইনি নিজাম বখতের পুত্র।
১৮৫৬তে তিনি দিল্লি পরিত্যাগ করে মক্কা গিয়েছিলেন। ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে বিপ্লবের চরম মুহূর্তে তিনি সমগ্র ভারতে ছুটে বেড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন শাহজাদা ফিরোজ শাহের জন্য লিখেছেন। একশো বছর আগে অথবা একশো বছর পরে জন্মালে তিনি বিফল হতেন না এবং জনপ্রিয় দেশনেতা হতে পারতেন। যাহোক, তিনি জুন মাসে সীতামুণ্ডতে পৌছালেন এবং পরে তিনি মন্দিরে বৃটিশের বিরুদ্ধে ইসলামী সবুজ পাতাকা ওড়ালেন, জিহাদ ঘোষণা করলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রচণ্ড বলপ্রয়োগে শাসনকর্তা তাঁকে শহর থেকে বহিষ্কার করেন রাজপুত্র ফকিরের পোশাক পরে মসজিদে আশ্রয় নিলে সংগঠন চলতে থাকল ঐ অবস্থাতেই। অসংখ্য অনুগামী তাঁর দিকে আকৃষ্ট হল-যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। এরপর এর নবগঠিত দল পুনরায় শহর অধিকার করে শাসনকর্তা ও কোতোয়ালকে বন্দী করে। (দ্রষ্টব্য ডঃ এস, এন. সেন পৃষ্ঠা ৩১০-১১)
ফিরোজ শাহ মির্জাজী নামে আনুষ্ঠানিক ভাবে সিংহাসনে বসলেন। তারপর প্রতাপগড়, ঝাওয়ারা, সীতামুণ্ড, রাতলাম প্রভৃতি এলাকার হিন্দু-মুসলমান রাজা ও নবাবদের কাছে পত্র পাঠালেন তাকে সমর্থন করতে বা বিপ্লবীদের সাথে যোগ দিতে। কিন্তু ঝাওয়ারার শাহজাদা আবদুস সাত্তার ছাড়া (কেহই তা গ্রাহ্য করলেন না। আবদুস সাত্তাবের জন্য ডক্টর সেন পরিষ্কার ভাবে লিখেছেন, গোয়ালিয়র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ শাহজাদা, কিন্তু শেষাবধি তাঁকে পরাজিতই হতে হয়।
পাঞ্জাবের মূলতানেও এ বিদ্রোহের বহ্নিশিখা হু হু করে জ্বলে উঠল। এখানে যিনি নেতৃত্ব দিলেন সে নেতার নাম সর্দার আহমদ খাঁ। তাঁর নেতৃত্বে মেজর চেম্বারণেল ক্ষুদ্র এক সরাইয়ে বন্দী হয়ে পড়লে তার এক ইংরেজ সহযোগী কোন রকমে তাড়াতাড়ি একদল অশ্বারোহী শিখ সৈন্য পাঠিয়ে চেম্বারনেলকে মুক্ত করেন। অবশেষে সর্দার আহমদ খানের মৃত্যু হলেও বিপ্লবীরা কিন্তু সংগ্রাম থামালেন না। মীর ভাওয়াল ফতোযানা সাহেবকে বিপ্লবীরা নতুন নেতা নির্বাচন করলেন।
তার নেতৃত্বে সংগ্রাম চলল, বটে, কিন্তু অবশেষে তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়। এভাবে গুজারিয়া বিদ্রোহেরও পরিসমাপ্তি ঘটল। মনে হল যেন অযোধ্যা থেকে ইংরেজ শাসন বিলুপ্ত হয়ে ভারতীয় শাসন ফিরে এল। বিপ্লবীরা রাষ্ট্র পরিচালনার দপ্তর বন্টনের ব্যবস্থাও করলেন। বিপ্লবী শরফুদ্দৌলা হলেন প্রধানমন্ত্রী। মাম্মুখাঁন হলেন প্রধান বিচারক। আর নাবালক বীরজিস্ কাদিরের জননী হযরত মহলের হাতে সমস্ত বিভাগের কর্তৃত্ব থাকবে স্থির হল। পরিষদে যাতে সাম্প্রদীয়কতার ছোঁয়াচ না লাগে তার জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হল জয়লাল সিংকে, অর্থমন্ত্রী হলেন বালকিষণ। ( দ্রষ্টব্য আহমদ ছফা, পৃষ্ঠা ১৯৮)
ডক্টর সেন তাঁর Eighteen Fifty Seven-এ আযোধ্যার ফৈজাবাদের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, একজন নেতা “জৈজাবাদের মৌলুবী বলেই বিখ্যাত হয়ে গেলেন। কোথেকে তিনি এলেন, তার পরিচয়ই বাকি তা জানা মুশকিল ছিল। সশস্ত্র এক বাহিনী নিয়ে তিনি সারা ভারত ঘুরে বেড়ালেন। প্রকাশ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করেন। এ ভয়ঙ্কর মারাত্মক শক্তিশালী নেতাকে বঙ্গের আলাউদ্দিন সাহেবের মতই বন্দী করে ফেলা হয়েছিল। তাকে সর্বদা মিলিটারী প্রহরায় রাখা হত (পৃষ্ঠা ১৮৬)
ফৈজাবাদের বিপ্লবীরা যখন ইংরেজদের কোষাগার দখল করেছিলেন তখন স্পর্ধার সাথে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শিশু, নারী বা অসামরিক মানুষের হতাহত আমরা চাই না, আমরা চাই ইংরেজরা তাদের ফৈজাবাদের ধনসম্পদ নিয়ে দেশ পরিত্যাগ করুক। এ ঘটনায় তার দৃঢ়চরিত্র ও কঠোর নীতির পরিচয় পাওয়া যায়। আর একটি দৃষ্টান্তে এটা আরও পরিষ্কার হয়মিঃ লিনক্স (Lennox) বলেন, একদিন ফৈজাবাদের মৌলবী সাহেব তার এবং তাঁর পরিবারের শিশু ও নারীদের প্রত্যেকের জীবন রক্ষা করেন।
বিহারেও আন্দোলনের প্রাবণ কম ছিলনা। ওখানকার বিপ্লবীদলের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম একজনের নাম মুহাম্মদ নজীব। প্রচারকার্যে তিনি এত সুদক্ষ ছিলেন যে, শিখদের কাছেও তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালান এবং শিখদেরকে নিজেদের অনুকূলে আনতে চেষ্টা করেন। ঠিক সে সময় তিনি ইংরেজের হাতে ধরা পড়েন। বিচারের ভণ্ডামীতে তাকে ফাঁসি কাঠে ঝোলান হয়। যে সমস্ত নেতারা জীবিত রইলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর নেতারা হলেন মাওলানা মহম্মদ হোসেন, মাওলানা আহমদুল্লাহ ও মাওলানা ওয়াজুহুল হক।
এ নেতাদের মিঃ টেলর পরার্শম করার নামে ডেকে বন্দী করেন। মিঃ টেলর সে সাথে ঘোষণা করলেন, যার বাড়িতে যা যা অস্ত্র আছে তা জমা দিতে হবে। রাত নটার পর থেকে কার্ফও জারী করা হল। ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতায় ধর্মোন্মত্ত মুসলমানদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি হল। ৩রা জুলাই সন্ধ্যা বেলা পাটনার প্রকাশ্য রাজপথে বিদ্রোহীরা আত্মপ্রকাশ করলেন। নাকাড়া বাজিয়ে অন্য লোকেদেরও যোগদান করতে আহ্বান জানালেন। মিঃ টেবল যখন বুঝলেন যে, কাফু জারী করেও ভয় দেখান সম্ভব নয় তখন তিনি বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য ইংরেজ-অনুগত একদল শিখ সৈন্য প্রেরণ করেন। শিখ সৈন্যদের সাথে ছিল উন্নত ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র আর বিপ্লবীদের ছিল অত্যন্ত সাধারণ অস্ত্র। লড়াইয়ে অনেক হতাহত হয়। শেষে অবশ্য বিপ্লবীদের গা ঢাকা দিতে হয়েছিল।
আর একজন বিপ্লবী নেতা পীর আলীকে বিচারের নামে ভণ্ডামি করে ফাসি দেয়া হয়। ফাসির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পীর আলী বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, “আমার ফাঁসি দিতে পার, কিন্তু (মনে রেখ) আমার জায়গায় হাজার হাজার লোক দাঁড়াবে।"
এবার আর এক বীরের নাম উল্লেখ করছি, যিনি কুমার সিংহ নামে পরিচিত শ্রীমণি বাগচি ঐতিহাসিক গাবিনস-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “বিভিন্ন ইংরেজ লোক কুমার সিংহের চরিত্র বিভিন্নভাবে চিত্রিত করেছেন। কেহ তাঁকে দেখিয়েছেন একজন রাজভক্ত ভূম্যধিকারী হিসেবে, আবার কেহ তাকে দেখিয়েছে রাজবিদ্রোহী রূপে" (পৃষ্ঠা ২৯৫)
সত্যের খাতিরে বলতে হয় যে তিনি ইংরেজদের বন্ধুই ছিলেন। ইংরেজদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব এত প্রগাঢ় ছিল যে, রাজপুরুষরা প্রায়ই তার বাড়িতে সপরিবারে চিত্তবিনোদণের জন্য আসতেন। সবরকম' আপ্যয়নের খরচ সামলাতে জমিদারি বন্ধকের বদলে তাকে ঋণ করতে হয়। হঠাৎ সে টাকা এক মাসের মধ্যে শোধ করতে আদেশ দেয়া হয় এবং তা শোধ করতে না পারলে তাকে জমিদারি হতে বঞ্চিত হতে হবে বলেও জানান হয়। ইংরেজদের এ
দাগাবাজি ও কুকৌশলে তিনি অত্যন্ত ব্যথা পান। ঠিক তখনই তিনি আজিমুল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেন। কুমার সিংহ ছিলেন রাণা প্রতাপ সিংহের বংশধর। ইংরেজ জানত তার যুদ্ধ কৌশলের কথা-তাই তাঁকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে নানা সাহেবে তাকে বোঝালেন যে, দাগাবাজ ইংরেজকে বিশ্বাস না করা ভাল। কুমার সিংহ ও বিপ্লবী মাওলানা-ফকিরের দল একযোগে ইংরেজের সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ করলেন। ইংরেজরা সেবার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। অবশ্য পরেরবারে কুমার সিংহকে পরাস্ত হতে হল। তাঁর রাজধানী জগদীশপুর ইংরেজের অধিকারে চলে গেল। তার বাসভবনও ও পবিত্র দেবালয়ও ইংরেজদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলনা।
কুমার সিংহ বহু অর্থব্যয় করে একটি দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইংরেজ সেনাপতি তা বিনষ্ট করে ফেললেন। প্রতিষ্ঠিত দেবমূর্তির সাথে মন্দিরটি ধ্বংস হওয়াতে বৃদ্ধ রাজপুতের প্রাণে মর্মান্তিক বেদনা লেগেছিল।...(তারপর ইংরেজ সৈন্য কোন দিকে দিকপাত না করে তারা পল্লীদাহে, নরহত্যায় ও লুণ্ঠনে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে লাগল।' কুমার সিংহ এরপরে আজমগড় দখল করেছিলেন।
তিনি পাল্কিতে চড়ে একদিন যাচ্ছেলেন এমন সময় ইংরেজের কামান গর্জে উঠল। কুমার সিংহের একটা হাত নষ্ট হয়ে গেল। হাতটা শুধু চামড়ায় গেলে ছিল মাত্র। তিনি এত শক্ত হৃদয়ের মানুষ ছিলেন যে, অন্য হাতে অস্ত্র ধরে এ হাতটা কেটে অনুচরকে আদেশ করলেন গঙ্গায় ফেলে দিতে। আহত কুমার সিংহ একটা বৈঠকখানায় আশ্রয় নিলেন। কিন্তু তিনি আর গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারলেন না। আর তখন এত সুচিকিৎকার ব্যবস্থাও ছিলনা। ফলে এ ভারতীয় বৃদ্ধ সিংহ' চিরদ্রিায় নিদ্রিত হলেন ২৪শে এপ্রিল তারিখে (মণি বাগচিঃ সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস পৃষ্ঠা ২৯১-৯৫: Eighteen Fifty Seven. p. 262-63)
আর একটি স্বর্ণোজ্জ্বল নাম মাওলানা রহিমুল্লাহ, যাকে বিচারের সময় 'ওহাবী' বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। খান বাহাদুর খান একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ নাম। এ মুসলমান রোহিলা নেতা এত প্রভাবশালী ছিলেন যে, ইংরেজরা তাঁকে বিপজ্জনক ব্যক্তি মনে করত। তাঁর নেতৃত্বে ঝকঝক বিপ্লবী দ্বীন দ্বীন" গর্জন করতে করতে অফিসে আদালতে আগুন লাগাতেন। জেলখানার গেট ভেঙে সমস্ত কয়েদীকে মুক্ত করা হত। তারমধ্যে বিপ্লবী বন্দীরাও মুক্ত হয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করেন। মিঃ সিলড় অশ্বারোহী রেজিমেন্ট নিয়ে বীরদর্পে মোকাবিলা করতে এলেন, কিন্তু বিপ্লবীদের অভ্যর্থ গুলিতে তাঁর মস্তক গুলিবিদ্ধ হয় এবং তিনি মারা যান। নেতার আদেশে সবুজ রঙের পাতাকা উড়িয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বিপ্লবী বীর সেনানীরা।
বাহাদুর খান কামান ও অন্যান্য অস্ত্র নির্মাণের একটা কারখানাও তৈরি করলেন। সে কারখানার তৈরি কামান, বন্দুক ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠিত হয়। সমস্ত বিভাগে বিশ্বস্ত কর্মী নিয়োগ করা হয়। মোট সৈন্যের পরিমাণ ছিল চল্লিশ হাজার তিনশ ত্রিশ জন। আশপাশের রাজা, মহারাজা, জমিদাররা বেশির ভাগই ইংরেজদের বিপক্ষীয় ছিলেন না। বাহাদুর খা তাদের কাছে ইংরেজের বিরুদ্ধাবাদী হওয়ার জন্য আবেদন করেন।
যাঁরা আবেদনে সাড়া দিলেন না তাদের উপর তিনি বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তাই ইংরেজ প্রেমিক রাজা রঘুনাথ সিংকে শায়েস্তা করতে তিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। এ অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত বিজনোর, বুরাদাবাদ, পিলবিত ও শাহজাহানপুরের ভূস্বামীরা নতুন সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। কল্পান খানকে পুর্ণ শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব দেয়া হল। আর মৌলবী ইসমাইল, হাকিম সইদুল্লাহ, শেখ খাইরুল্লাহ ও গালিব আলীকে তাঁর অধীনে বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এ সময় কিছু রাজপুত্র শক্তিশালী নেতা নতুন সরকারকে মেনে নিতে না পেরে বিরোধিতা করলে মর্দান আলী নেতৃত্বে তাদের দমন করা হয়।
১৮৫৭ তে বাদাউন একটা স্বতন্ত্র জেলা ছিল। মিঃ এডওয়ার্ড দেশের গরম হাবভাব দেখে কর্ম ছেড়ে পলায়ন করেন- তখন বিপ্লবী নিজেরা শাসনভার গ্রহণ করেন। আবদুর রহমানকে নাজিম পদে ও আজমউল্লাকে বখশী পদে ভূষিত করা হয়। তফাজ্জল, কেরামতুল্লাহ ও ওয়ালীদাদ খানকে সামরিক বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় বুদ্ধিমান ইংরেজ রাজপুতদের নানা প্রলোভনে উত্তেজিত করে বিদ্রোহী করতে সক্ষম হয়। একজন রাজপুত জমিদার ‘ধাপদুশ’ উপাধি নিয়ে বাদাউন আক্রমণ করেন কিন্তু বিপ্লবীরা তাকে ও ভার সৈন্যদের পরাস্ত করেন জমিদার বিশ্বনাথকে দিয়েও নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করান হয়। অবশ্য নতুন সরকার তা সহজেই দমন করতে সক্ষম হয় (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, ২৪৮-২৫০ পৃষ্ঠা)
রোহিলাখণ্ডের আর একটি জেলা শাহজাহানপুর। এখানেও বিপ্লবের প্লাবন পৌছাল। অবশ্য আগে থেকেই বিপ্লবের ক্ষেত্র যিনি তৈরি করে রেখেছিলেন এবং চিত্ত ও বিত্ত দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তার নাম মৌলবী সরফরাজ আলী-এসব যেন চাপা পড়া ইতিহাস। বিপ্লবীরা তারপরে ওখানকার ম্যাজিস্ট্রেটকে নিহত করেন। তখন ইংরেজ পাঠাল তাদের বিশ্বস্ত শিখ রেজিমেন্টকে। এ বার শিখ সৈন্য পরাজিত হলে বিপ্লবীরা কারাগার দখল করে বন্দী-মুক্তির ব্যবস্থা করে ট্রেজারী দখল করেন। এখানে বিপ্লবী কুদরত আলী ও তার ভাই নিয়াজ আলীর নাম উল্লেখযোগ্য। কাদির খানকে জেলা প্রশাসক এবং নিজামুদ্দিন, হামিদ হাসান ও খাঁন আলীকে দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
আবদুর রউফকে করা হয় সেনাপতি। এমনিভাবে মীরপুর জেলার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন বিপ্লবী গোলাম মুহাম্মদ ও ফয়েজ মুহাম্মদ। আমরা যেন ভুলে না যাই যে, এ বিরাট কর্মকাণ্ড যার জ্ঞান বুদ্ধি ও কৌশলে ঘটছিল তিনি সে খাঁন বাহাদুর খান। পাওয়াইনের প্রভাবশালী রাজা জগন্নাথ খান বাহাদুর খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করলেন। অবশ্য তার কারণ ইংরেজদের সাথে তার ঘাড় বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু কোন একটা অজুহাতে ইংরেজ সৈন্য জগন্নাথের রাজ্যে হামলা করলে আকস্বিক আক্রমণে রাজা নগদ এক লাখ টাকা কর আর ত্রিশ হাজার টাকা নজরান দেয়ায় অঙ্গীকারে রক্ষা পান। ১৮৫৭-র জুলাই মাসেই বাহাদুর খান এক সৈন্যদল সহ এডওয়ার্ড ইউলসনের বিরুদ্ধে আবদুর রহমানকে পাঠালে। উইলসন পরাস্ত হল।
অবশেষে বিখ্যাত নেতা খান বাহাদুর খান যখন পরাজিত হলেন তখন তিনি অযোধ্যায় আত্মগোপন করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি প্রতিকুল মনে না হওয়াতে তিনি নেপাল চলে গেলেন। নেপাল সরকার তাঁকে বীরের মত সন্ধান দিয়ে আশ্বাস দিলেন, কিন্তু ভা ছিল ছলনামাত্র। বিশ্বাসঘাতকতা বশতঃ বৃটিশের সাথে যোগাযোগ করে নিষ্ঠুর ভাবে বাহাদুর খানকে ধরিয়ে দেয়া। ইংরেজ মহলে খুশীর ঢল নেমে এল-তাদের বিখ্যাত শত্রু হাতের মুঠোয়। সাথে সাথে বিচার। আর বিচার মানেই ফাসি। কোতোয়ালীর সামনে তাঁর ফাসি দেয়া হল। এসব তথ্য যেন গল্প মনে হচ্ছে অথচ এগুলোই প্রকৃত ইতিহাসের জ্বলন্ত ও সত্য অধ্যায় তা আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার।
মুসলমান-প্রধান এ বিপ্লবে রাজা, জমিদার ও চৌধুরীরা অত্যন্ত বিরোধিতা করার জন্য এ আন্দোলন বাধ্য হয়। তবুও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিপ্লবীরা মিলন ও মৈত্রীর জন্য অনেক জায়গায় কমিটি গঠন করেছিলেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, আহমদুল্লাহ খান, আহমদ ইয়ার খান, শফীউল্লাহ, আবদুর রহমান ও আহমদ শাহ এ রকম একটা পরিষদের সদস্য ছিলেন। অনেক করেও কিন্তু জমিদার চৌধুরীদের সাথে মিলনের পথ তৈরি হয়নি। বরং এর জন্য নতুন ভারতীয় অস্থায়ী সরকারকে চুড়ান্ত আঘাত হানতে চৌধুরী জমিদাররা একতাবদ্ধ হয়ে বিশাল সৈন্য বাহিনী তৈরি করেছিলেন। বাধ্য হয়েই শেষে শফীউল্লাহ ও মাহমুদ খানের
নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জমিদারও চৌধুরী বাহিনী পরাস্ত হলে তাদের নেতা শ্রীরণধীর চৌধুরী বন্দী হন। ইংরেজের সহয়োগিতা বরাবরই তাদের সাথে অর্থাৎ বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিল। তাই ইংরেজ বাহিনী সহায়তায় পরে যখন বিপ্লবীরা পরাজিত হলেন, তখন বিপ্লবী নেতা জালালুদ্দিন ও শাহদুল্লাহকে তারা গুলি করে হত্যা করেন। তেমনি ভাবে বিপ্লবী ওয়াজুদ্দিনকেও শহীদ হতে হয়েছে। আমরাহার বিপ্লবের নেতা ছিলেন গুলজার আলী। ২৪শে এপ্রিল বৃটিশ সৈন্য যখন মোরাদাবাদ দখল করলো তখন মইজুদ্দিন খাঁ সহ সমস্ত বন্দী নেতাদের বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের পুরানা পাতায় মইজুদ্দিন, আসাদ আলী, বখত্ খা প্রভৃতি আরও বহু নাম সগর্বে জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু ইতিহাসের নতুন পাতায় অজ্ঞাত চক্রান্তে এসব নাম যেন মুছে দেয়া হয়েছে।
বিপ্লবী বীর সৈয়দ আহমদুল্লাহ শাহজাহানপুরে ব্রিগেডিয়ার মিঃ জোন-এর সৈন্যদের সাথে সামনা সামনি যুদ্ধ করেন। আহমদুল্লাহর সৈন্য ছিল মাত্র দেড় হাজার। আর ইংরেজ-সৈন্য সংখ্যায় বেশি তো ছিলই, সে সাথে ছিল উন্নততর অস্ত্র, বিশেষতঃ আগ্নেয় অস্ত্রে। যুদ্ধে কিন্তু বিপ্লবীদের সঠিকভাবে পরাস্ত করা গেল না, তাই ইংরেজরা ঘাটিতে। ঘাটিতে সংবাদ দিয়ে আরো সৈন্য আনার ব্যবস্থা করল। দু পক্ষের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হল। বিপ্লবীরা বন্দুকের আঘাত দেন, বৃটিশ কামানের গোলায় তার উত্তর দেয়। শেষে পরাস্ত হতে হল বিপ্লবীদের। মাওলানা আহমদুল্লাহ তার প্রধান ঘাটি মোহাম্মদী অঞ্চল ছেড়ে গা ঢাকা দিলেন এ আশায় যে, আবার তৈরি হবেন কঠিন আঘাত হানতে। বৃটিশ সৈন্য মোহাম্মদী অঞ্চলকে কামানের গোলায় শশান বানিয়ে ছাড়ল। কি নিষ্ঠুর সে লড়াই। একদল চাইছেন শোষণ, শাসন আর অত্যাচার করতে। অন্য দল চায়, যা চলছে তাই-ই চলবে।
সৈয়দ আহমদুল্লাহ শহীদ হন খুবই মর্মান্তিকভাবে। বৃটিশের শ্রেষ্ঠ সৈয়দ আহমদুল্লাহর জন্য ঘোষণা করা হল, তাকে জীবন্ত ধরে দিতে না পারলেও শুধু তার মাথা জমা দিতে পারলেই পঞ্চাশহাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। পাওয়াইনের তালুকদার রাজা জগন্নাথ যদিও প্রথমে ইংরেজ দরদী ছিলেন, কিন্তু ইংরেজদের আক্রমণের পর থেকে তিনি যে ইংরেজের বিরুদ্ধে, তা সবাই জেনে যান। গোপনে তিনি খান বাহাদুর খানকে কিছু অর্থ সাহায্যও করেছিলেন। সুতরাং বিপ্লবীরা নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, রাজা জগন্নাথ ইংরেজদের দালাল হতে পারেন না। মাওলানা আহমদুল্লার প্রধান কাজ ছিল জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জনমত গঠন, অর্থ সংগ্রহ ও প্রাণ দেয়ার জন্য সংগ্রামী যোদ্ধা সংগ্রহ করা।
ইংরেজ বিরোধী অর্থ ও লোক সংগ্রহের কাজে রাজা জগন্নাথের অঞ্চলে সভা করার জন্য তাকে আহ্বান জানান হয়। তিনি যথানিয়মে বক্তব্য রাখলেন, অর্থ সংগ্রহ করলেন ও স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা প্রস্তুত করলেন। জনসভা ভঙ্গের পর রাজা জগন্নাথ মাওলানাকে তাঁহার প্রাসাদে ঢাকিয়া লইয়া গিয়া গুলি করিয়া হত্যা করেন। অতঃপর তাহার মস্তকটি দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া পাপিষ্ঠ জগন্নাথ স্বয়ং উহা সহ শাহজাহানপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট্রের নিকট উপস্থিত হন। উৎসাহী ম্যাজিস্ট্রেট মস্তকটি প্রকাশ্য স্থানে দুই দিন ঝুলাইয়া রাখিয়া অনিচ্ছুক জনসাধারণকে উহা দর্শন করিতে বাধ্য করিবার জন্য পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করিয়াছিলেন। সভ্যতাভিমানী বৃটিশ গভর্ণমেন্ট রাজা জগন্নাথকে সঙ্গে সঙ্গে ৬৫ হাজার টাকা এবং বিদ্রোহ প্রশমিত হবার প্রর একটি জমিদারী প্রদান করিয়াছিলেন।" (দ্রষ্টব্য আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ৯৪)
আহমদ ছফা তাঁর পুস্তকে এ ঘটনাকেই সমর্থন করেছেন। সে সাথে মাওলানার শরীর দগ্ধ করে দেহভস্ম নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল বলেও তিনি জানান। তিনি আরও লিখেছেন যে, শুধু মাওলানার মাথাটা পরে শাহাজাহানপুরে কবর দেয়া হয়। ডক্টর এস, এন, সেন তার মূল্যবান আকর গ্রন্থেও এ তথ্য লিখেছেন। তবে পুরস্কারের অঙ্ক ৬৫ হাজারের পরিবর্তে ৫০
হাজার উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা ৩৫৬)। আমাদের মনে হয়, ৫০ হাজার টাকাই পুরস্ক: ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু মহাশত্রুর মৃত্যুতে খুশীতে আত্মহারা হয়ে ইংরেজরা এ ১৫ হাজার টাকা এবং জমিদারী উদ্বুত্ত দিয়েছিল। যাহোক, এ বিখ্যাত আলেম ও ভারত জুড়ে যার প্রচুর শিষ্য সে প্রকৃত পীরের দেহ নরপিশাচরা পুড়িয়ে দেয়ার সময় এটা চিন্তা করেনি যে, নশ্বর দেহ পোড়ান যায় কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস পোড়ান যায়না। এ বিপ্লবী বীরের নাম ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বা ইতিহাসে যেভাবে থাকা প্রয়োজন তার শতকরা এক ভাগও নেই! সে শহীদ বীর হাতিতে চড়েই বেশির ভাগ যাওয়া আসা করতেন।
১৮৫৮ সনের ১৫ই জুনও একাকী হাতির পিঠে চড়ে রাজা জগন্নাথের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তিনি আর ফিরতে পারেন নি। শুধু অশ্রুপুত নয়নে থেকে গেল বাকহীন মর্মাহত তার হাতিটি। [ এ বিদ্রোহে কত মানুষ শহীদ হয়েছেন তার সঠিক হিসেব দেয়া সম্ভব নয়। যাদের কথা আরোচনা করা হচ্ছে তারা হলেন বিপ্লবের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি। এ সনেই ১০ই ফেব্রুয়ারী মৌলবী আমীর আলী শাহ শহীদ হন। এমনি ভাবে শহীদ হন বিপ্লবী ইমাম বখশ। শহীদ ইমাম বখশ ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি ও লেখক। একদিকে কলম ধরেছেন, অন্য দিকে প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্রও ধরেছেন। দিল্লীর পতনের পর মাওলানা ইমাম বখশকে তার দুই পুত্র সহ আরও ১৪০০ বিপ্লবীকে রাজঘাটে সমুদ্রের তীরে হাজির করা হয়। মাওলানা ইমাম বখশের সামনে তার দুই পুত্রকে যন্ত্রণা ও নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা করার পর সবশেষে মাওলানা ইমাম বখশুকে হাত বাঁধা অবস্থায় বন্দুকের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলা হয়।
বন্দুকের গুলি তাঁর মুখের দিকে ছোঁড়া হল, মুখমণ্ডল চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। রক্তাপুত দেহে নির্বাপিত হল বিপ্লবী মাওলানার জীবন। শহীদ ইমাম বখশের বন্ধু মুফতি সদরুদ্দিনও এক উল্লেখযোগ্য নাম। যুবক অবস্থায় তিনি ইংরেজ সরকারের অধীনে চীফ জজের পদে বহাল হন। সাতানুর বিপ্লবে তিনি ফতোয়া দিলেন যে, ইংরেজের চলাল অনেক নির্যাতন তবুও কারাগারে তার মূল্যবান লেখনী বন্ধ করেননি। নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে তাকে জেল থেকে ছাড়া হল বটে, কিন্তু চাকরি, থেকে চিরবঞ্চিত করা হল এবং তার সমস্ত সম্পদ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল। দেশের লোক বিপ্লবী মুফতী ও তাঁর স্ত্রী-পুত্র পরিজনদের অসুবিধার কথা স্মরণ করে ভয়ানক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তাই দেখে অবশেষে তার অর্ধেক সম্পত্তি ফেরত দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
আর একটি অপ্রচারিত নাম-জনাব জৈমীগরী। সাতান্নর বিপ্লবের প্রত্যক্ষ সংগ্রামী। অনেক সংগ্রাম, বিপ্লব ও আন্দোলনের ভিতর দিয়ে তিনি নিজেকে চালিত করেন। অবশেষে বৃটিশের হাতে তিনি ধরা পড়ে বিচার হয়, আর বিচার মানেই তো দাগাবাজী। সে বিচারের তার ফাঁসি হয়।
থানেশ্বরের বিপ্লবী মাওলানা জাফর একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ইনি ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী এবং ভাল পরামর্শদাতা। দুজন বিপ্লবী সহ তারা মোট তিন জন এক সাথে বন্দী হন। তিনজনকেই ফাসি ঘরে রাখা হয়েছিল। মিঃ পার্সন সাহেব যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরামর্শের কথা ফাঁস করার আদেশ দেন। তারা অস্বীকার করলে চলতে থাকে অমসৃণ চাবুকের আঘাত। মাওলানা জাফর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিঃ টলি আগামীকাল আরও শাস্তি দেয়া হবে বলে বেত্রাঘাত বন্ধ করতে বলেন। তারপর মাওলানা জাফরকে লোভ দেখান হয় যে, যদি তারা ভিতরের তথ্য ফাঁস করে তাহলে ফাসি থেকে রেহাই দেয়া হবে। এবারও তিনি অস্বীকার করলে চাবুক শুরু হল সকাল ৮টা থেকে। পালাপালি করে সে বেত্রাঘাত চলতে লাগল রাত ৮টা পর্যন্ত। সেদিনই মাওলানা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন। কারণ সেদিন তিনি রোযা রেখেছিলেন।
আব্বাস নামে জাফর সাহেবের একটি পালিত পুত্র ছিল। তাকে মাওলানার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার জন্য বিচারকের সামনে হাজির করা হল। কিন্তু বালক আব্বাস মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে মিথ্যা সাক্ষী দিতে অস্বীকার করল। এ প্রিয় পালিত পুত্র আব্বাসকে সে রাত্রে এত প্রহার করা হয়েছিল যে, তাতেই তার মৃত্যু হয়। অবশ্য ঘোষণা করা হল-অসুখ হয়ে মারা গেছে।
আর এক মর্মান্তিক ঘটনার সংবাদ মাওলানার কাছে পৌছাল। তাহল, মাওলানার নিজের এক ভাইকে প্রচণ্ড শাস্তি দিয়ে জোর করে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে। মাওলানা ভাইকে সংবাদ পাঠালেন যে, তিনি সাক্ষ্যে যা বলেছেন তাই-ই যেন বলেন-ভারও যেন ফাঁসি না হয়, মা তাহলে বেশি শোক পাবেন। এরপরে বিচারের মাওলানার ফাঁসির রায় হল। সে সাথে তার সমস্ত সম্পদ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল। মাওলানা জাফর ফাঁসির রায় হল। মাওলানা জাফর ফাঁসির রায় শুনে বিচারককে যা উত্তর দিয়েছিলেন তা এক ঐতিহাসিক বিষয়। সেটা হচ্ছে এ-প্রাণ দান আর প্রাণহরণ আল্লাহর কাজ, আপনার কোন অধিকার নেই। সম্মানের মালিক সে আল্লাহ মহাশক্তির অধিকারী-তিনি আমার মৃত্যুর পূর্বেই আপনার প্রাণ হরণ করতে পারেন।
এরপরে আশ্চর্যের বিষয়টুকু হল, মাওলানা জাফল্পের ফাঁসির পূর্বেই সে বিচারকের মৃত্যু হয়েছিল। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল, ১৬ই সেপ্টেম্বর আদালতের ডেপুটি কমিশনার একটি কাগজ হাতে করে পড়ে শোনালেন যে, তোমরা ফাসির জন্য লালায়িত শহীদের গৌরব পেতে চাও। তাই তোমাদের ফাঁসির পরিবর্তে চিরনির্বাসন দেয়া হল। মাওলানা জাফর, মোহাম্মদ শফী ও মাওলানা ইয়াহিয়ার দাড়ি ও মাথা মুণ্ডন করে দেয়া হল। পাঠিয়ে দেয়া হল আন্দামানে। মাওলানা জাফর মন্দামানে সুদীর্ঘ দিন অতিবাহিত করে ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে অনেক যন্ত্রণা ও জ্বালা সহ্য করে ভারতে প্রত্যাবর্তন করলেন। চিরনির্বাসিত করা হয়েছিল বটে, কিন্তু ইংরেজ দেখল, এ অকেজো বৃদ্ধদের কারাগারে রাখা মানে শুধু খাদ্য পানীয় বিনষ্ট করা; সে জন্যই শান্তি লাঘব করে ছেড়ে দেয়।
শহীদ আহমদ খাও একটি বিপ্লবী নাম। তাঁর দলবল মূলতান এলাকায় প্রায়ই হামলা করতেন। তাঁর বন্ধু ছিলেন সুবাদার মেজর নাহির খা। নাহির খাঁ ধরা পড়েছিলেন এবং বিচারের নামে তার হয়েছিল নিষ্ঠুর প্রাণদণ্ড। প্রত্যক্ষ সংগ্রামী সর্দার আহমদ খা-ও ইংরেজ বিতাড়ন সংগ্রামে শহীদ হয়ে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধন্য করেছেন।
হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ স্বাধীনতা আকাশের আর এক জ্যোতিষ্ক। তিনি মক্কারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ভারতের এ বিপ্লবের মুহূর্তে তিনি ভারতে পৌছে এবং বহু ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন। ১৮৫৭ সনে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে হাতে তিনি অস্ত্র ধরেছিলেন। বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি আবার মক্কায় ফিরে যান ও ১৮৬৭ খৃস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। এভাবে গাঙ্গুর মাওলানা রশীদ আহমদ ও মাওলানা মুহাম্মদ কাসিমও প্রত্যক্ষভাবে সাতান্নর আন্দোলনের ঝাপিয়ে পড়েন আলী ইমদাদুল্লাহ এবং এ মাওলানা ও তাদের অনুগামীরা এ অঞ্চলের বিরাট এলাকা জুড়ে ইংরেজদেরকে হটিয়ে দিয়েছিলেন।
শুধু তাই নয়, সেখানে দেশীয় শাসনতন্ত্রও চালু করেছিলেন। সাহারানপুর জেলার অভ্যন্তরে ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি দখল করার ভয়ে ও হতাশায় পিছু হটতে বাধ্য হন। বিপ্লবী দল যে কমিটি গঠন করেছিলেন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা হন হাজী ইমদাদুল্লাহ। মাওলানা কাসেম হন সেনাপতি আর মাওলানা রশিদ আহমদ হন প্রধান বিচারপতি (দ্রষ্টব্য হায়াতে মাদানী ও আবী আন্দোলনে আলেম সমাজ, পৃষ্ঠা ৪১৯)
মনে রাখার কথা হল, ঠিক এ রকম একটা সময়ে ফাসিতে গলা কাটা গেছে কমপক্ষে সাতশ পীর, মাওলানা-মুফতীর। আর শুধু ফাসিতে কম করে ২৮ হাজার সাধারণ মুসলমানকে শহীদ হতে হয়েছে। নিখোঁজ হওয়া, জেলখানায় প্রহৃত হয়ে শহীদ হওয়া, গুলি খেয়ে শহীদ হওয়ার বিপুল সংখ্যা এর সাথে নয়।
নবাব তোফাজ্জল হোসাইন একজন ভূস্বামী বা ছোট রাজা ছিলেন। আঠারশো সাতান্নর বিপ্লবে সৈন্য ও সম্পদ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন ইংরেজ বিতাড়নে, কিন্তু পরাজিত হন। ক্ষমার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব ইংরেজ পক্ষ থেকে দেয়া হলে নবাব তা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাকে খতম করার প্রস্তাবে ইংরেজপক্ষ হতেই আপত্তি উঠল; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করেও কিভাবে শেষ করা যায়? শেষে নবাবের সমস্ত কিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফল এ দাড়িয়েছিল যে, যিনি ছিলেন ফররোবাদের নবাব, তাকে কিছুদিন পর ফররোখাবাদেই চৌরাস্তার মোড়ে ভিক্ষা করতে করতে মৃত্যু বরণ করতে হয় (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১০৪)
মোবারকপুরের মুসলমান ভূস্বামী ইরাদত খাঁ জৌনপুরের বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন। প্রথমে ইংরেজকে উৎখাত করেছিলেন তার এলাকা থেকে, কিন্তু পরে রাজা জংবাহাদুরের সৈন্যরা চিৎ করে ফেলে বন্দুকের অগ্রভাগ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে শহীদ করে। (দ্রষ্টব্য ঐ, পৃষ্ঠা ১০৫) নবাব মেহেদী হোসেন ছিলেন একজন প্রভাবশালী নেতা। ১৫ হাজার সৈন্য তার অধীনে ছিল। সেনানায়কের নাম ছিল ফজলে আজিম। তাঁর প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল চান্দা নামক স্থানে। এখানেও নেপালের জংবাহাদুরের দেয়া সৈন্যের সাহায্যে ইংরেজরা জয়ী হয়।
আর বিপ্লবী মেহেদী হোসেনকে আন্দামানে চিরনির্বাসন দেয়া হয়। সেখানে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে তিলেতিলে শেষ হতে হয়। তাঁর সমস্ত সম্পদ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইংরেজ অনুগতদের মধ্যে বন্টন করা হয়।annaoinfernana আগ্রায় বিপ্লবীদের শ্রেষ্ঠ নেতা মুরাদ আলী। তিনি পুলিশ বাহিনীর কর্তা ছিলেন। যখন বিপ্লব শুরু হয় তখন তিনি তার অধীনস্থ সমস্ত বাধ্য পুলিশ নিয়ে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কাছে লড়াই-এর শপথ নেন। আগ্রার পতন হলে তিনি আলিগড় ও এটপাওয়ার বিপ্লবে যোগ দেন। অবশেষে বহু অনুচরসহ তিনি বন্দী হন। নিষ্ঠুর ইংরেজ মুরাদ আলীসহ প্রত্যেককে শহীদ করে।
এমনই এক সেনাপতি আবদুল গফফার। তিনি বিপ্লবীদের যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। হঠাৎ বিপক্ষীয় কামানের গোলা তাকে শহীদ করে। এমনিভাবে অনেকেই শহীদ হয়েছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে এ নামগুলো উল্লেখযোগ্য এজন্য যে, এ সমস্ত নেতাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। আর সাধারণ বিপ্লবীদের শুধু প্রাণনাশ করা হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শহীদ আবদুল গফফারের সমস্ত সম্পত্তিও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এভাবে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে সালিন্দার চৌধুরী মনসার আলি, হাশমত আলি ও জৌনপুরের গোলাম হোসেনকেও শহীদ করা হয়। গুরগাঁও জেলার বিখ্যাত বিপ্লবী আবদুল হক-যিনি দু লাখ লোকের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেনাপতি মিঃ সওয়ারস বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে তাঁকে বন্দী করতে সক্ষম হন। বিচারকের নয়, এ সেনাপতির আদেশেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ্যে তাঁকে ফাসি দিয়ে শহীদ করা হয়। (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১০১)
মৌলবী আলাউদ্দিন আর এক বিপ্লবী নেতার নাম। ইনি হায়দারাবাদে নেতৃত্ব দেন ও শেষে ধরা পড়লে এর চিরনির্বাসন দেয়া হয়, কুখ্যাত আন্দামান জেলে। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটান হয়। অবশ্য হায়দ্রাবাদের যে সকল বিশ্বাসঘাতকদের জন্য তাদের পরাজয় হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম বিশ্বাসঘাতক ছিলেন নিজাম।
ইন্দ্রোরে যিনি বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দেন তিনি শাহাদাত খান। বৃটিশ রেসিডেন্সী আক্রমণ করে তা অধিকার অধিকার করেছিলেন। কিন্তু শেষে তাকেও শহীদ হতে হয়। ওলিদাদ খানও এমনই এক বিখ্যাত নাম। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে বিপ্লবীদের নিয়ে মালগড়ের দুর্গ তিন মাস ধরে দখলে রেখেছিলেন। অবশেষে ধরা পড়েন, তাতে বন্দী হন ও ফাসি হয়। সে সাথে তাঁর যত আত্মীয়-স্বজনকে ধরা সম্ভব হয়েছিল তাদেরকেও ফাঁসি দেয়া হয়। বিপ্লবী রজব আলী ১৮৫৭-র ১৮ই নভেম্বর বিরাট দলবল নিয়ে চট্টগ্রাম ট্রেজালী দখল করেন এবং জেল দখল করে বন্দীদের মুক্তি দিয়ে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে পলায়ন করেন। সিলেট এ সংবাদ পৌছালে সেখানকার ডেপুটি কমিশনার একদল সৈন্য পাঠান।
মাঝপথে লাটুতে দু পক্ষের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে ইংরেজ ও অনেক বিপ্লবী নিহত হন। এভাবে মণিপুর অঞ্চলেও পর পর কয়েকটি যুদ্ধে অধিকাংশ বিপ্লবী শহীদ হন। রেঙ্গুনের পার্বত্য জঙ্গলেও বিপ্লবীরা পথহারা হয়ে ঘুরে খাদ্যাভাবে জরাজীর্ণ হয়ে বন্দুকের সাহায্যে শিকার করে প্রাণ ধারণ করেন। শেষে গুলি বারুদ শেষ হলে হিংস্র জন্তুদের খাদ্যে পরিণত হতে হয় সে বিপ্লবীদের। এদিকে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সংবাদ ২২শে নভেম্বর ঢাকায় পৌছালে সেখানকার অনেক বাঙালী সৈন্যদের বিপ্লবী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। ফলে বড় রকম বিদ্রোহের রূপ নেয়। বিদ্রোহীদেরকে চরম নৃশংসতার সাথে বর্তমান ঢাকার সদরঘাটই বাহাদুর শাহ পার্ক নামক স্থানে ফাঁসি দেয়া হয়। তাঁদের অন্যতম একজন নেতা পাতলা খানকে ইংরেজরা হাতির পায়ের তলায় নিষ্পেষিত করে। (দ্রষ্টব্য আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১১০-১৩)
বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা মাওলানা ইয়াহিয়ার জন্য মুসলমান বিদ্বেয়ী হান্টার লিখেছেন, “এ মহান ব্যক্তি ছিলেন পাটনার মওলবী ইয়াহইয়া আলী, ভারতীয় বিপ্লবীদের (ও) ধর্মীয় অধিকর্তা। আর গোপন উদ্দেশ্যটা ছিল মহাবনে অবস্থিত বিপ্লবী (ও) বসতিতে নতুন মুজাহিদ ও যুদ্ধ-সামগ্রী পাঠান, কারণ বৃটিশরাজের সাথে তখন তাদের প্রকাশ্যে সংঘর্ষ চলছিল।.... প্রধান খলীফা ও খতিব ইয়াহয়িয়া আলী পাটনা প্রচার কেন্দ্র সুদৃঢ় অথচ শান্তভাবে চালনা করতেন। নিম্নেবঙ্গের জিলাগুলো থেকে যে-সব নবমুজাহিদকে সফলকারী প্রচারকরা চালান দিত....ভারতীয় বিপ্লবীদের (ও) ধমীয় অধিকর্তা হিসেবে তাঁকে সমস্ত সফলকারী প্রচারকের সাথে পত্রালাপ করতে হত।... তিনি মসজিদের নামাযে ইমামতি করতেন।
মুজাহিদদের জন্য তিনি যেমন প্রত্যেকটি রাইফেল পরীক্ষা করতেন, সে রকম ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ধর্মতাত্ত্বিকতার বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন।... কিন্তু এ ষড়যন্ত্রকারীদের সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল নবমুজাহিদদেরকে পাটনা প্রচার কেন্দ্রে অর্থাৎ তাদের সাংকেতিক ভাষায়, ছোট কারখানা থেকে সীমান্তের বিদ্রোহী-বসতি অর্থাৎ বড় কারখানায় চালান দেয়া। বাঙালী মুজাহিদকে সফরকালে রাস্তায় হাজারো বিশ্রী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত। পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিমের প্রদেশগুলোর ভিতর দিয়ে তাদের প্রায় দু'হাজার মাইল অতিক্রম করতে হত...পথিপার্শ্বের খানকাহগুলির রক্ষা করা সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক, কিন্তু সকলেরই এক লক্ষ্য ছিল, তা বৃটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন।... স্যার হারবার্ট এডওয়ার্ডস যেরূপ মর্মস্পর্শী ভাষায়-এ ব্যক্তির ফাসির হুকুম দান করেন, পূর্বে কখনো সেরূপ ভাষা আদালতে আর উচ্চারিত হয়নি।
স্যার হার্বাটের ভাষায়-“বাংলাদেশে তার হিন্দু স্বদেশবাসীদের মত যুক্তি ও বিবেকের কাছে আহ্বান না জানিয়ে তিনি সরাসরি রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের মাধ্যমে মনোবাসনা সফল করতে চেয়েছেন।"" দি ইন্ডিয়ান মুসলমান পৃষ্ঠা ৮৪-৮৭। এ বীর মাওলানা ইয়াহিয়া শহীদ হয়ে ভারতবাসীকে ঋণী করে গেছেন। উচ্চ আদালতে তাঁর ফাঁসির রায় পরিবর্তন হয়ে আন্দামানে চিরনির্বাসনের দণ্ড দেয়া হয়। সে কুখ্যাত জেলেই ফাসির চেয়েও কষ্টের সাথে তিনি প্রাণ দান করেন তিনিই বিপ্লবীদের জন্য একটা সাংকেতিক ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন।
বিপ্লবীরা পশ্চিম বালার মালদহে ১৮৪০ দে একটি কেন্দ্র স্থাপন করেন। সঙ্গেীর মাওলানা আবদুর রহমান ছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠাতা। মালদহে একটা মাদ্রাসা তৈরি হয়। সেখানে পড়ান এবং জেলায় জেলায় জিহাদের বাণী ছড়ান চলতে থাকে। সে সময় বিখ্যাত বিপ্লবী ছিলেন মালদহের রফিক মণ্ডল। প্রথম দফায় তার জেল হয়, পরে মুক্তি দেয়া হয়। তারপর মালদহের মাওলানা আমীরুদ্দিন বিপ্লবী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তিনি মালদহ ছাড়া মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহীরও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার নির্দেশে এসব বিরাট এলাকা হতে মুসলমানদের যাকাত, সাদাকা, কোরবাণীর জন্তুর চামড়ার দাম বিনা বাক্যব্যয়ে পৌছত। তিনি যথাসময়ে তা সীমান্তে পাঠিয়ে দিতেন। কয়েক শত যুবককেও তিনি বাংলা হতে যুদ্ধের জন্য পাঠিয়েছিলেন। পরে এসব তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়লে তিনি বন্দী হন এবং তাঁকে আন্দামান জেলে এগার বছর রাখা হয়। (তথ্য : ঐ, পৃষ্টা ১৫৫-৫৬)
এভাবে পাটনার মামলায় বিপ্লবী পীর মহাম্মদ আমীর খান হাসমতদাদ খান, মোবারক আলী, তাবারক আলী, হাজী দীন মুহাম্মদ এবং আমিনুদ্দিনকে আসামী করা হয়। বোম্বাই, কলকাতা ও সম্রাজ্যের বড় বড় ইংরেজ ব্যরিস্টার দেয়া হয়েছিল। মামলায় আমীর খান ও হাসমত খান এ দুজনে সে বাজারে এক লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। শেষে এ দুজন বাদে বাকী পাঁচ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। (দ্রষ্টব্য আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৫৭)
আর একটি ভারতরত্নের নাম আল্লামা ফজলে হক। জন্ম ১৭৯৭ খৃস্টাব্দে। বাড়ী আমোধ্যার খয়রাবাদে বলে তাঁকে খয়রাবাদ বলা হত। তাঁর প্রথম পরিচয়-তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠতর একজন আলেম, বিখ্যাত সাহিত্যিক, কবি ও ঐতিহাসিক। " তার সম্মানময় দ্বিতীয় পরিচয় হল, তিনি ১৮৫৭-র বিপ্লবের একজন প্রত্যক্ষ সংগ্রামী। তার লিখিত গ্রন্থের মধ্যে আসসাওরাতুল হিন্দিয়া, কাসিদায়ে ফিততুল হিন্দ, তাহকিকুল ওজুদ, তাহুকীকে হাকিকাতুল আজসাম, হাশিয়া কাজী মোবারক, হাশিয়া উফুকুল মুবিন, রিসালায়ে গদর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ভারতকে স্বাধীন করতে গিয়ে ফজলে হককে বন্দী হতে হয়। বিচারের নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে তাঁর সমস্ত সম্পদ-সম্পত্তি বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং পৃথিবীর কুখ্যাত আন্দামান জেলে ছোট্ট কুঠরীতে প্রবেশ করায়। সেখানেই হযরত খয়রাবাদীকে বাকী জীবনটা কাটাতে হয়েছিল। জেলের ডেপুটি জেলার সাহেব প্রাচ্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তার কাছে অত্যন্ত পুরাতন মহামূল্যবান একটা ফার্সি পাণ্ডুলিপি ছিল। তিনি তার পাঠোদ্ধার ও মর্মোদ্ধারে পূর্ণ ক্ষমতা রাখতেন না বলে চিন্তা করছিলেন কাকে দিয়ে এ কাজ করান যায়।
হযরত ফজলে হককে এক অস্বাস্থ্যকর ঘরে রাখা হয়েছিল। তার ছাদ দিয়ে বৃষ্টি পড়ত। ফলে পায়খানার মত ছোট কামরায় পানি জমে যেত। হাফপ্যান্ট আর ছোট জামা পরতে দেয়া হয়েছিল। খাদ্য হিসেবে দেয়া হত নানা জাতের মাছ সিদ্ধ, যা ছিল অত্যন্ত দুর্গন্ধময় ও খাবার অযোগ্য। সময়ে সময়ে বালি মিশান রুটি দেয়া হত। যা হোক তাই দিয়েই ক্ষুধা নিবৃত্তি করতেন। ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে গরম পানি দেয়া হত। অবশ্য কিছুক্ষণ রাখলেই তা ঠাণ্ডা হবার কথা, কিন্তু তার উপায় ছিল না-তাড়াতাড়ি পানি না খেলে পানির পাত্র ফিরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ ছিল। প্রতিদিন নিয়মিত বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা ছিল স্যাঁতসেঁতে ঘরে থাকতে হত। রাত্রে অন্ধকারে রাখা হত। কাঁকড়া বিছেতে প্রায়ই দংশন করত, তার যন্ত্রণায় সারাক্ষণ ছটফট করতে হত। কক্ষে দ্বিতীয় কেহ ছিলনা যে তার
থেকে একটু সাহায্য ও সান্তনা পাওয়া যেতে পারে। সর্বাঙ্গ দাদ, চুলকানি ও একজিমাতে ছেয়ে গিয়েছিল। তদুপরি চিকিৎসা ও ঔষধ দেয়া ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ভারতরত্ন যত্নের অভাবে যেন নোংরা আস্তাকুড়ে চাপা ছিলেন। আরও দুঃখের কথা, হযরত ফজলে হককে দিনের বেলায় সাধারণ মেথরের মত নিজের ও অন্যান্য কয়েদীদের পায়খানা পরিষ্কার করতে হত। বন্দী বীর তাই-ই করতেন।
এদিকে ডেপুটি জেলার সাহেব তার সে ফার্সি পাণ্ডুলিপিটার যোগ্য অনুবাদক খুঁজতে গিয়ে ফজলে হকের নামই পেলেন। তাই কারাকর্তা কাগজ-কলম দিয়ে পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁর কাছে পাঠালেন। অসুস্থতা ও অস্বাভাবিক মানসিকতা সত্ত্বেও মাওলানা টীকাসহ অনুবাদের কাজ শেষ করলেন। সে সাথে তথ্যগুলো কোন লেখকের কোন্ পুস্তকের কোন খণ্ড হতে নেয়া তাও লিখে দিলেন। জেলার সাহেব সেটা পড়ে বিশ্বয়ে হতবাক হলেন এজন্য যে, বহু পুস্তকাদির সাহায্য ছাড়া এ কাজ এভাবে সম্পন্ন করা বিশ্বয়কর কঠিন।
তাই তিনি সাক্ষাৎ করতে এলেন ফজলে হকের সাথে। ঠিক তখন তিনি পায়খানা পরিষ্কার করে বিষ্টামাখা টিন ও কাটা নিয়ে অর্দ্ধোলঙ্গ পোশাক পরে ধীরে ধীরে আসছিলেন। সাহেব তাকে হাত খালি করে দাঁড়াতে বললেন। তার পর মূল্যবান পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই মাওলানাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন এবং ক্ষমা চাইলেন। ভুলবশতঃ তাকে ময়লা পরিষ্কার দায়িত্ব দেয়ার জন্য। ফজলে হক নিজেও কেঁদে ফেললেন এবং ক্ষমা করলেন। সাহেব তাকে পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কাছ থেকেই পুরস্কার নিব, মানুষের কাছ থেকে নয়।
তার মনের কিছু অন্তিম কথা তিনি কাফনের কাপড়ের উপর লিখে যেতেন। সেহেতু আগেই এ সাহেব কারাকর্তাকে বলেছিলেন, 'আমার আনা কাফনখানি আমি আমার ছেলেদের কাছে পৌছে দিতে চাই। যদি আমার এখানেই মৃত্যু হয় তাহলে আপনারা সরকার অনুমোদিত কাফন দিয়েই আমার কবর দিবেন।' এ কাপড়ের উপর কাব্য আকারে যে কাহিনী তিনি চিত্রিত করেছিলেন সেটাই আসসাওরাতুল হিন্দিয়া নামক পুস্তক। মাওলানার দু’জন পুত্র যথাক্রমে মাওলানা আবদুল হক ও মাওলানা শামসুল হক জনসাধারণের সহযোগিতা সাহায্য ও পরামর্শ নিয়ে ইংলণ্ডে গিয়ে পিতার মুক্তির দরখাস্ত করেন।
ইংরেজ কর্তৃপক্ষ রোগে শোকে দুর্বল, মৃত্যুপথযাত্রী সে বন্দীকে ছেড়ে দেয়ার অনুমতি দান করে। তারা উভয়ে এ সুসংবাদ দেশের লোককে বলতেই দেশের হিন্দু মুসলমান খুশীতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, কারণ তারা আবার দেখতে পাবে তাঁদের মহাপণ্ডিত বৃদ্ধ, প্রত্যক্ষ সংগ্রামী কারাগার ফেরতা রত্ন খয়রাবাদীকে। যথা সময়ে তাঁর পুত্রেরা বৃদ্ধ পিতাকে সাথে নিয়ে দেশে ফেরার আশায় আন্দামান পৌছালেন। কিন্তু সেখানে পৌছে জানতে পারলেন, তার পিতা কয়েক ঘণ্টা পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। অপুত নয়নে পিতার কবরে শেষ দেখা করে ফিরে এলেন খয়রাবাদে লাখ লাখ মানুষ কেঁদে ফেলল তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেল না বলে।
মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণতা ছুঁতে পারে না শিও বেলায়। আবার মানুষ বহু অন্যায়, ভেদাভেদি, পক্ষপাতিত্ব অত্যাচার করেও ক্লান্ত হয় মৃত্যুর পূর্বক্ষণে, যখন সে জানতে পারে মত্যু তার অবধারিত। সে সময় যে কথাগুলো তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো হয় বড় খাটি ও মূল্যবান্ কথা। খয়রাবাদী মৃত্যুর পূর্বে যে কথাগুলো কাফনের কাপড়ে আরবী ভাষায় লিখে গিয়েছিলেন, উর্দুতে অনুবাদ করে ভারতে যখন তার প্রচার শুরু হল, সাথে সাথে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হল। গোটা পুস্তিকা এখানে জানান সম্ভব নয় তবে তার কয়েকটি বাক্য এখানে তুলে ধরছি। অবশ্য এজন্য মুহিউদ্দিন খানের আযাদী' আন্দোলনেরও সাহায্য নেয়া হচ্ছে।
মহাবিপ্লবের সময়ে ভারতের মুসলমানদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নামায-রোযার মত জরুরী বলে তিনি ফতওয়া দিয়েছিলেন। তাঁর এ অপরাধ নাকি অমার্জনীয় ছিল। আর তাই আন্দামানে ইংরেজের চরম অত্যাচার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-“আমি এমন বিপদের মধ্যে পড়েছি যা কল্পনা প্রবণ ব্যক্তির পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়।” “এ সমস্ত নীচ প্রকৃতির লোকেরা আমার উপর নতুন নতুন নানা ধরণের অত্যাচার করায় মনের ভারসাম্য রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।.....লালমুখখা, কটাচোখে, সাদা চামড়ার চুল-কাটা অত্যাচারীদের হাতে পড়ে আমায় নিজস্ব রুচির পোশাক কেড়ে নিয়ে ছোট ছোট মোটা জঘণ্য ধরণের পোশাক পরিয়েছে।”
তার লেখায় তিনি ইংরেজদের হাতে বন্দী অযোধ্যার নবাবের ব্যক্তিগত চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, “একজন শাসনকর্তার মত দূরদৃষ্টির যথেষ্ট অভাব ছিল তার মধ্যে।" আরো লিখেছেন, তিনি “দিন রাত শুধু গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গীত ও বাদ্য ভোগ করার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকতেন।”
বিপ্লবীদের পরাজয়ের কারণ বলতে গিয়ে কিছু কুখ্যাত সংগ্রামী নেতার চরিত্র প্রসঙ্গে বলছেন “বস্তুতঃপক্ষে তারা সংগ্রাম পরিচালন বাদ দিয়ে আরাম ও ভোগবিলাসে নানা প্রকার পাপাচারে নীচতায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে।" “অস্ত্রচালনা ও শত্রুর মোকাবেলা করার কোন অভিজ্ঞতা তাদের ছিলনা। একটি আক্রমণের ঘটনায় অযোধ্যার হিন্দু বাসিন্দাদের বীরত্বের বর্ণনায় লিখেছেন, “ইংরেজ সৈন্যদের উপস্থিতির কথা শুনে সেখানকার মুর্থ সংগ্রামী নায়করা ও সর্দাররা সরে পড়ল। সাথে সাথে সংগ্রামীদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি হল। সকলেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচান ভাল মনে করল।
কিন্তু সে এলাকার কয়েক শত হিন্দুবাসিন্দা বীরত্বের সাথে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করল। অবশ্য ইংরেজ বাহিনী তাদের ধ্বংস করে দিল। বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ বলতে গিয়ে লিখেছেন, “সর্বশেষ আক্রমণের সময় হিন্দু দেশীয় রাজার বিপ্লবী বাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।” রাজা শ্রীবলদেও সিং এর জন্য লিখেছেন, “এ হিন্দু রাজা মুখে বিপ্লবী নেতা আহমাদুল্লার অনুগত হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ইংরেজদের বন্ধু। ইংরেজ সেনানায়কদের নির্দেশক্রমেই তিনি বিপ্লবীদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন। “দেশীয় রাজা বলদেও সিং চার হাজার সৈন্য নিয়ে বিপ্লবীদলের যোগ দিলেন সত্য, কিন্তু সাহায্য না করে পিছন দিক হতে বিপ্লবীদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলেন।
দু দিককার আক্রমণ সহ্য করা বিপ্লবী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়নি।” “এ সময়ে হিন্দু বণিক সম্প্রদায়, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও কিছু যুক্তিদাতা বিপ্লবী বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করায় বণিক ব্যবসাদারেরা শহরের সমস্ত মজুত খাদ্য শস্য কিনে দামে ভরে ফেলল...বিপ্লবী বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করল বণিক ব্যবসাদারেরা শহরের সমস্ত মজুত খাদ্য শস্য কিনে গুদামে ভরে ফেলল...বিপ্লবী বাহিনী ও দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হল।" “এভাবে ফাসি ও গুলিতে প্রাণ-দানকারীর সংখ্যা অসংখ্য।
হাজারে হাজারে অত্যাচারীদের বর্বর নির্যাতনের যার শিকার হয় তাদের অধিকাংশই ছিল উৎকৃষ্ট মুসলমান নাগরিক। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ চতুর্দিকে হিন্দু জমিদার ও আমলা শ্রেণীকে নির্দেশ দেয় যে, যে কোন সন্দেহজনক লোককে গ্রেফতার করে যেন দিল্লীতে যেন প্রেরণ করা হয়। এর ফলে হাজার হাজার পালায়নকারী দেশপ্রেমিক গ্রেপ্তার হয়ে গণহত্যার শিকারে পরিণত হয়।" ফজলে হক তার পুস্তিকায় জানিয়েছেন, সবশেষে ইংরেজদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে দেশবাসীর প্রত্যক্ষ সাহায্যেই তারা জয়লাভ করেছে। আর সাহায্যদাতারা বেশীর ভাগ রাজা, মহারাজা ও জমিদার শ্রেণী। আর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে তার পুস্তিকার আস্বাদ পরিবেশনের যবনিকা টানছি-“অত্যাচারী
বিচারকরা আমাকে আজীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও নির্বাসনের নির্দেশ দেয়। সে সাথে আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি, বহু পুরুষ ধরে সঞ্চিত আমার বিরাট গ্রন্থভাণ্ডার এমনকি অসহায় স্ত্রী-পুত্র পরিজনের বাস করার বাড়ী-ঘর পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে।...সবশেষে এ কাহিনী আল্লাহর প্রিয় মুহাম্মদের (সাঃ) ও তার পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীদের উপর দরুদ ও সালামের সাথে শেষ করছি। আল্লাহর উপরই নির্ভর। সমস্ত কাজের পূর্ণতা বিধান তার দ্বারাই সম্ভব।” এ মহানায়ক ভারতরত্ন মাওলানা ফজলে হক (রহঃ) যদি প্রচলিত ইতিহাসে স্থান না পান তাহলে একদিন না একদিন আমাদের এ বেঈমানীর কৈফিয়ত দিতে হবে ভবিষ্যত বংশধরদের সমালোচনার এজলাসে।
বিপ্লবী মজনু শাহ : ১৭৫৭ হতে ১৮৫৭ এ একশ বছরের বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ধারা বলতে গিয়ে এ বই-এর এ অধ্যায়ের অত্যন্ত সংক্ষেপে কিছু ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে মাত্র। সেখানে ভিক্ষুক, ক্ষুধার্ত ও ডাকাত দলের বিদ্রোহের কথা লেখা আছে। এ ফকীর, ভিক্ষুক বা সর্বহারাদের অভ্যুত্থানের যিনি নেতা তার নাম ফকীর মজনু শাহ চলতি ইতিহাসে শুধু এ টুকুই মাত্র বস্তুতঃ তিনি ছিলেন এক মহান নেতা, মহাবিপ্লবী ভারত সুহৃদ। স্বৈরাচারী হেস্টিংস এ মহান বিপ্লবকে সন্ন্যাসী ও ফকীর বিদ্রোহ বললেও তা মূলতঃ ছিল বঙ্গদেশের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। (দ্রষ্টব্য ভারতে কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা ১৭)
ফিউচার রেজাল্ট অব ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া'তে কার্লমার্কও বলেছেন এ বিদ্রোহ ছিল বিদেশী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলা ও বিহারের কৃষক বিদ্রোহ। এ তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু তালিব তার ফকীর মজনু শাহ' পুস্তকের ১২৩ পৃষ্ঠায়। তাছাড়া ১৭৬৩ হতে ১৮০০ এ ৩৭ বছর যারা একটা আন্দোলন চালায়, তারা কেমন ফকীর অনুমান করা শক্ত নয়। আরও বলা যায়, মজনু আড়াই হাজার বিপ্লবী নিয়ে যখন ঘোড়াঘাটে পৌছান তখন মিঃ পালিংকে ভীত ও সন্ত হয়ে ক্যাপন্টেন টমাসের কাছে সৈন্যের জন্য আবেদন করতে হয়। (ঐ পৃষ্ঠা ৯৭)। এ থেকেও এ বাহিনীর সুস্পষ্ট পরিচয় মিলে।
বৃটিশ আমলে ইংরেজ কর্মচারীরা ও তাদের পদলোভীরা অসৎ উপায়ে উপর্জিত অর্থকে তাড়াতাড়ি বাড়িয়ে নিত সুদ ব্যবসার মাধ্যমে। এতে শোষিত হত দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকরা বিশেষতঃ মুসলমান ও অনুন্নত হরিজনবা। ক্যাপটেন ডানকানসন চৌদ্দ হাজার নশো এক টাকা সুদে খাটিয়ে এক বছর পর মোট একুশ হাজার টাকা পেয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেন নি (দ্রষ্টব্য আমানত উল্লাহ কোচবিহারের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২২৭)
মজনু তাই গরীব জনসাধারণকে এ শোষকদের হাত হতে বাঁচাবার জন্য বিনা সুদে ঋণ দান করতেন। সে টাকা শোধ নিতে এবং বিভিন্ন সুফী সন্তদের করব দর্শনে (জিয়ারত) তারা নানা জেলায় ঘুরে বেড়াতেন। তাছাড়া ইংরেজদের দালাল অত্যাচারী জমিদারদের সরাসরি অথবা পত্রে জানিয়ে দিতেন, শান্তি স্বরূপ এত হাজার টাকা চাই; আর তা আদায় করতেন। সে টাকা বিপ্লবে ও দরিদ্রের সেবায় লাগান হত। ইংরেজ পকীয় জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কাছে পত্র মারফত ৫০ হাজার টাকা দাবী করলে তিনি ভীত হয়ে অন্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে বাসস্থান স্থানান্তরিত করেন। (অধ্যাপক আবু তালিব: পৃষ্ঠা ৬৯-৭০)
বিপ্লবী ফকীরগণ বর্তমানে আমাদের দেশের গাঁজা খাওয়া মুসলমান আউল-বাউলদের মত ছিলেন না। তারা পুরোপুরি ভাবেছিলেন মোজাহিদ। তাঁদের নিম্নাঙ্গের পোশাক ছিল আধাকমলা রঙের, আর উপর দিকের পোশাকের রঙ ছিল নীল। তাদের শিক্ষিত অশ্বারোহী। বাহিনী এমন কি উট পর্যন্ত ছিল। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা তাদের ক্যান্টনমেন্ট বা দুর্গ।
ছিল বগুড়ার মহাস্থানগড়ে এবং মালদহ সংলগ্ন জঙ্গলে। মহাস্থানগারে মজনু শাহের উপস্থিতিতে মিঃ গ্লাডউইনের মত নামজাদা লোকেরও বীত হয়ে উপর মহলে সৈন্য ও অস্ত্রের জন্য সাহায্য চাইতে হয়েছিল। উল্লেখ্য তখন বিপ্লবী মজনুর আক্রমণবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার। অধ্যাপক এ তালিব পৃষ্ঠা ৬৩.৬৫ ও ৭৪]। যামিনী মোহন ঘোষের ইংরাজী বই Sannyasi and Fakir Raiders in Bengal-এ মজনু সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তবে জমিদার লেখক ইংরেজদের ইঙ্গিত তাঁর লেখায় মজনু বাহিনীকে অত্যন্ত হেয় করে দেখিয়েছেন। যদি ধরে নেয়া যায় তারা ডাকাত ছিলেন, লুটপাট করে মানুষের ক্ষতি করতেন তাহলে তাদের ধরার ব্যাপারে গ্রামবাসীরা কোন রকম সাহায্য ও সহযোগিতা করত না কেন? উপরন্তু ফকীর বাহিনীকে বাড়ী পিছু নজরানা দিয়ে গ্রামবাসীরা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করত।
বিপ্লবী মুসাকে বন্দী করার জন্য মি: খৃষ্টী যখন গ্রামবাসীদের সাহায্য চাইলেন গ্রামবাসীরা কোনও পরিমানে সাহায্য করেনি। অপরদিকে, এক্ষেত্রেও ইংরেজ পক্ষে দালালী করেছেন একমাত্র দেশের জমিদার শ্রেণী। কারণ মি: উত্তসন যখন ফকীর বাহিনীর ব্যাপক ও প্রচণ্ড আক্রমণের ঘটনা বুঝলেন বা দেখলেন তখন তাদের দমন করার জন্য আদেশ দিলেন দিনাজপুর, রংপুর ও পূর্ণিয়ার সমস্ত অনুগত ভূস্বামী বা জমিদারদের। সরকারিভাবে সংবাদ পাঠালেন, তাঁরা যেন এ ফকীর-বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে লড়াই-এ নামেন (অধ্যাপক এ. তালিব, পৃষ্ঠা
বিপ্লবী মজনু শাহ অনেক লড়াই এবং সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শেষে কালেশ্বরের যুদ্ধে আহত হন এবং বন্দী না হয়ে আত্মগোপন করে বেশ কিছু দিন ভুগে তাঁর দায়িত্ব দেশবাসীর হাতে দিয়ে ১৭৮৭-র মার্চমাসে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে বিপ্লবী নায়ক মুসা শাহ দু'হাজার সংখ্যার এক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য যে, মজনু শাহের মৃত্যুর পর প্রায় প্রত্যেক নেতাই মজনুকে সম্মান দেখিয়ে তার নামের সাথে শাহ যোগ করেছিলেন, যেমন করীম শাহ চেরাগা শাহ, পরাগ শাহ, সুবহান শাহ্, জহীর শাহ, রমজান শাহ, শামশের শাহ্ প্রভৃতি।
‘ডাকাত দল ও লুণ্ঠনকারী দল' বলে যাদের চেপে রাখা হয়েছিল, মানুষের সামনে এখন সেগুলো তুলে ও খুলে দেয়া হচ্ছে যাতে আমাদের পরলোকগত বিপ্লবীদের আমরা স্মৃতির সিংহাসনে বসাতে পারি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/492/50
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।