hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

চেপে রাখা ইতিহাস

লেখকঃ গোলাম আহমাদ মোর্তজা

৫৭
হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দীনবন্ধু ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
এ গ্রন্থটি কবি-সাহিত্যিকদের শুধু জীবনী নিয়ে নয়-১৮৫৭-র আন্দোলন, বিপ্লব বা অভুত্থানের বুদ্ধিজীবী কলমদারদের মানসিকতার নমুনা পরিবেশন করে দেখান যেতে পারে কেমন করে ভারতের এ স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল এবং হিন্দু-মুসলমানের মাঝে বিভেদের প্রাচীর কিভাবে উঁচু হয়েছিল। কবি হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়-এর কথাই বলি। ১৮৩৮-এ তার জন্ম এবং ১৯০৩ সনে তাঁর মৃত্যু। তার বীরবাহু কাব্যে তিনি লিখেছেন:-

“শোন রে পাপিষ্ঠ মুসলমান

বাল্যে বিনামিয়া পতি মোর কৈলি এই গতি

মম বাক্য না হইবে আনা...

জগতে পবিত্র স্থান গিয়াছে তাহার নাম,

সে পুরীও পদ অপবিত্র করেছে।...

ম্লেচ্ছ মহদম্ম ডাকে হরহ হিন্দু হাঁকে

মহাক্রুধে দুই দল সমবেতে মাতিল।

আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর।

পোড়াবে যবন-রক্তে শমন-খর্পর।

সাক্ষাতে হেরিলি কার কত বাহুবল

এবে রে ববনরাজ্য গেল রসাতল।

যতদিন ম্লেচ্ছহীন না হইবে দেশ।

ততদিন না ছড়িবে সংগ্রামের বেশ।...

হরিবল ববন দল হিন্দু পক্ষ কোলাহল।...

বিজয় হুঙ্কার নাদে চরাচর পুরিল।...

পুনঃ হিন্দুরাজগণে ম্লেচ্ছ পরাজিবে রণে

পুনর্বার এই রাজ্য কতল করিবে।”

নবাব সিরাজউদৌলার জন্য কবি লিখেছেন:-

গর্ভবতী রমণীর জঠর খন্ডিয়া

দেখিত জরায়ু পিণ্ড জীবিত জীবের দণ্ড'

করিত অশেষরুপ দুর্মদে ডুবিয়া।”

অবশ্য সিরাজউদ্দৌলা সম্বন্ধে তার আগেই কবি নবীনচন্দ্র সেনের 'পলাশীর যুদ্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে বললে অত্যুক্তিহবে না যে, কবি ও সাহিত্যিকরা এ একটা মূল বিষয়ে প্রায় একতাবদ্ধ।

নাট্যকার ও কবি দীনবন্ধু মিত্র বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধু ছিলেন এবং বলাবাহুল্য, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্য ছিলেন। তিনি আওরঙ্গজেবের নিন্দায় লিখেছেন

অপকৃষ্ট আওরঙ্গীব রাজা দুরাচার

প্রজার মনের ভাব না করি বিচার...

ভাঙ্গিয়া মন্দির তার মসজিদ গঠিল

প্রস্থর বিগ্রহে ধরে দূরে ফেলাইল।

ওরে দুষ্ট আওরঙ্গজীব নীচাত্না কেমনে

নাশিলি এমন কীর্তি! ছিলনা কি তোর

কিহমাত্র পূর্বকির্তি অনুরাগ জোর!”

সিরাজউদ্দৌলার জন্য ইনি লিখেছেন:-

..কৌতুক দেখিতে আর নদী মধ্যস্থলে,

“মানব পুরিত তরী না ডুবায়ে জলে,

“দেখিত উদরে সুত কিরূপে বিহরে

“নাহি আর গর্ভিনীর উদর বিদরে।

অবশ্য দীনবন্ধুর বিরাট বৈশিষ্ট্য যে তিনি নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সমর্থন করেননি; যেটা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, রামমোহন প্রমুখ মনীষীবৃন্দ। এ সম্বন্ধে পরে আলোচনা করার অবকাশ রইল।

নবীনচন্দ্র ১৮৪৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন আর ১৯০৯-এ তাঁর মৃত্যু হয়। এর লেখাতেও ইংরেজ বিরোধিতা এবং মুসলমানদের প্রতি উদারতার কত অভাব তা অনুমান করা কঠিন নয়। তার লেখনীর কিছু নমুনা পেশ করছি মাত্র

“জানি আমি যবনের ইংরাজের মত

ভিন্নজাতি, তবু ভেদ আকাশ পাতাল।

যবন ভারত বর্ষে আছে অবিরত

সার্দ্ধ পঞ্চশত বর্ষ। এই দীর্ঘকাল..

একই ভরসা মিরজাফর যবন।

যবনেরা যেইরূপ ভীরু প্রবঞ্চক..

কৃষ্ণচন্দ্র ও উমিচাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা সুকৌশলে স্বীকার করে লিখেছেন

“ধিক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রঃ ধিক উমিচাঁদ

যবন-দৌরাত্মা যদি অসহ্য এমন,

না পাতিয়া এই হীন ঘৃণাপদ ফাদ

সমুখ সমরে করি নবাবে নিধন,

ছিড়িলে দাসত্ব পাশ, তবে কি এখন

হ'ত তোমদের নামে কলঙ্ক এমন!”

আন্দোলনে মুসলমান বিপ্লবীদের পরাজিত হওয়ার পরে দেশবাসীর জন্য তিনি লিখলেন

“ভারতেরো নহে আজি অসুখের দিন

আজি হতে যবনেরা হল হতবল

কিবা ধনী মধ্যবিত কিবা দীন হীন

আজি হতে নিদ্রা যাবে নির্ভয়ে সকল।...

জানি আমি যবনের পাপ অগণিত;

জানি আমি ঘোরতর পাপের ছায়ায়

প্রতিচ্ছত্রে ইতিহাস আছে কলঙ্কিত। ..

নবীনচন্দ্র সেন শুধু কবি ও কাব্যকার ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইংরেজ সরকারের একজন বাছাই করা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এ পদ পাওয়ার আগে তিনি মিঃ হেয়ারের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

ভারতের স্বাধীনতাকামী বীর বিপ্লবী আলাউদ্দিনের ইতিহাস আমরা এই পুস্তকে পূর্বেই আলোচনা করেছি। তার সুবিখ্যাত সন্তান আবদুর গফুর ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী বিপ্লবী নেতা। তার গেঁয়ো নাম ছিল 'নোয়ামিয়া'। ইংরেজ সরকার তাকে শায়েস্তা করতে না পেরে নবীনচন্দ্রকে সেখানে পাঠান। নবীনচন্দ্র বিপ্লবী আলাউদ্দীনের ইংরেজ বিরোধী কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করার পর শেষে লিখেছেন-“আইন প্রমাণের অধীন। নোয়ামিয়ার কার্যাবলী প্রমাণের বাহির। তাহার প্রতিকূলে কার্য নহে। ইহার জন্য অন্য বিধি অবলম্বন করিতে হইবে।” (দ্রষ্টব্য নবীনচন্দ্র সেনঃ আমর জীবন, তৃতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা ১৪৯-৫০)

বিপ্লবী বীর মাওলানা আবদুল গফুর সাহেব এবং বিখ্যাত পণ্ডিত-প্রবর মাওলানা কেরামত আলির মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে একটি বিতর্ক সভা হয়েছিল। সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। সে ঘটনাকে নবীনচন্দ্র সেন এমন বিকৃত করেছেন এবং মুসলমান মাওলানাদের সম্বন্ধে, তাদের দাড়ি, পাগড়ি ও তাদের শুদ্ধ আরবী বলার ভঙ্গিমাকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা থেকে মুসলমান জাতির প্রতি তার মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

তাঁরা ইংরেজের একনিষ্ঠ প্রতিনিধি নবীনচন্দ্র সেনের সাথে নাকি উর্দুতে কথা বলেছিলেন। তাই ইংরেজের সত্যনিষ্ঠ কর্মচারী সে সত্য উর্দু উদ্ধৃতিগুলো তুলে দিয়েছেন। এখন জনসাধারণের বিচারে নির্ধারিত হবে তার লেখা সে ঘটনার গুরুত্ব ও সত্যবাদিতার আলেখ্য। সে ঘটনার বর্ণনা তাঁর নিজের ভাষায় যেভাবে করেছেন তা হুবহু তুলে দিচ্ছি-“এক প্রকাণ্ড সামিয়ানাতলে ফরিদপুর অঞ্চলের সমস্ত আবক্ষচুম্বিত-শশ্মশ্রু (অর্থাৎ বুক পর্যন্ত দাড়িওয়ালা) মৌলবীগণ বড় বড় মুড়াচ্ছা' (পাগড়ি) বাধিয়া অধিষ্ঠিত হইলেন।...নিন্দ্রান্তে পাঁচটার সময়ে গিয়া দেখিলাম সবডিভিসন ভাঙ্গিয়া যেন সমস্ত কাছাবিহীন বিরাটমূর্তি বিপ্লবীগণ (ফা) সমবেত হইয়াছে।

মৌলবী যুগলকে আমি সভার দুই প্রান্তে বসাইয়াছিলাম। এখন দেখিলাম, তাহারা পশ্চাৎদেশ (অর্থাৎ পাছা) ঘর্ষণ করিতে করিতে প্রায় সম্মুখীন হইয়াছেন, এবং আর কিছু বিলম্ব করিলে বিতণ্ডা ঘন বিলোড়িত জিহ্বা ও ঘন আন্দোলিত শ্মশ্রুজাল হইতে বাহু চতুষ্টয়ে সঞ্চালিত হইবে, এবং তখন প্রায় পাঁচ সহস্র মুসলমানের সেখানে একটা করবল্লা' (অর্থাৎ কারবালা) হইবে। আমি কিছুক্ষণ অতিশয় গম্ভীরভাবে সেই কণ্ঠতালু ও মূর্দ্ধা হইতে অপূর্বরূপে উচ্চারিত আরব্য শব্দাবলী শ্রবণ করিয়া তাহাদের অপরিজ্ঞাত অর্থে আপ্যায়িত হইয়া বলিলাম-আপনারা উভয়ে বিখ্যাত মৌলবী; তাহারা উভয়ে প্রসন্ন হইয়া আমাকে সেলাম করিলেন-আপনাদের এই তর্ক আজ যে শেষ হইবে বোধ হইতেছে না।

কারণ বিষয় বড় গুরুতর; তাহারা উঠিয়া আবার আমাকে সুপ্রসন্নভাবে সেলাম করিলেন...নোয়ামিয়া তাহার পরদিন বুক কুটিতে কুটিতে আমার কাছে সহচর-শূন্যভাবে উপস্থিত। 'হাম এক দমছে বরাবাত গেয়া। হমারা লাগো রুপেয়াকা ইজ্জত গিয়া ইত্যাদি শোকসূচক বাক্যাবলী উদগীরণ করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন...তিনি তাঁহার বজরা হইতে কোরান আনাইয়া অতিশয় সন্তুষ্টির সহিত এ প্রতিজ্ঞা করিলেন। এবং আমার অনেক প্রশংসা করিয়া লিখেন-“এতদিনে মাদারিপুরে একজন বিচক্ষণ লোক আসিয়াছে। অতঃপর আমার কোন কার্যে অপ্রীত হইবার আপনি কোনও কারণ পাইবেন না। আমি ঠিক আপনার একজন তাবেদারের মত কার্য করিব।” (দ্রষ্টব্য নবীনচন্দ্র সেনঃ আমার জীবন, ৩য় ভাগ, পৃষ্ঠা ১৪৯-৫৫)

যারা বংশানুক্রমিকভাবে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন, রক্ত দিলেন, প্রাণ বিসর্জন করলেন তারা ইংরেজ অনুগত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কোরআন নিয়ে শপথ করলেন এ কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? কোরআন কি এতই সহজ বস্তু যে, বজরা থেকে নিয়ে এসেই অমনি তাঁর সামনে এক সামান্য বিষয়ে হলপ করে ফেললেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য তাঁদের সেই আলোচনা বা তসভা ছিল-ভারত বর্ষে ‘দারুল হারব যুদ্ধক্ষেত্র না দারুল ইসলাম এই বিষয়ে। একপক্ষ বলেছিলেন, এটাকে দারুল হারব বা যুদ্ধক্ষেত্র বলে মনে করতে হবে, তাই

এখানে জুমার নামায পড়া আবশ্যিক নয়। অপর পক্ষের বক্তব্য ছিল গোটা ভারত বর্ষকে দারুল হারব মনে না করে যতদিন না দেশে স্বাধীন হয় ততদিন জুমার নামায পড়া হোক। -এখানে লাখো রুপেয় নষ্ট হবার কোন গল্পই আসে না। এটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অতিরঞ্জিত ও লেখক কর্তৃক উল্লিখিত উর্দু বক্তব্য যে অশুদ্ধ তা প্রাথমিক উর্দু জানা বালকও সহজে বুঝতে পারবে।

কোন ব্যক্তি মুসলমান-বিরোধী প্রমাণিত হলেও তিনি ইংরেজ বিরোধীও হতে পারেন; অর্থাৎ ইংরেজের স্তাবক নাও হতে পারেন। কিন্তু নবীনচন্দ্র সেনের ইংরেজ বিতাড়নের বা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা ছিল বলে আমরা কোন তথ্য এখনো পাইনি। তবে চাপা পড়া যে তথ্য পেয়েছি তা হচ্ছে এই :

মহারথী ভিক্টোরিয়ার প্রথম পুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস ভারত ভ্রমণ উপলক্ষে যখন এখানে আসলেন তখন ভারতের বিপ্লবী ও ইংরেজ বিরোধীরা চিন্তা করছিলেন কিভাবে তা রোখা যায়। অবশ্য শক্তিতে না কুলালেও ভাবনা চিন্তা করতে তো কোন বাধ্য ছিল না। অথচ ঠিক সেই সময় নবীনবাবু সুন্দর একটি উপহার ঐ রাজপুত্রের হাতে দিলেন-সেটা ছিল তার স্বরচিত মানপত্র। তাতে ছিল ইংরেজের স্তবস্তুতি ও জয়গাথা প্রাচুর্য। শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘ভারত উচ্ছাস'। বড় খুশী হলেন ইংরেজ জাতি তথা রাণী ভিক্টোরিয়া এবং রাজকুমার স্বয়ং। আগামীতেও এই উৎসাহ বজায় রাখার জন্য নবীন সেন পঞ্চাশটি স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার পেলেন। পরে আবার রাণী ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র ডিউক অব এডিনবোরা'র হাতেও একটি কবিতা উপহার দিয়ে প্রমাণ করে দেন যে, মুসলমান শাসনে অশেষ যন্ত্রণা ভোগের পর বাঙ্গালী হিন্দুরা ইংরেজদের সমাদরের সঙ্গে আহ্বান করে আনে।" (দ্রষ্টব্য ডক্টর মনিরুজ্জামান; আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, পৃষ্ঠা ৪২)

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ১৮৬৩ -তে জন্ম ও ১৯১৩ - তে মৃত্যু হয়। তিনি আর্য সন্তানের বেদনায় লিখেছেন–

বিশ্ব মাঝে নিঃস্ব মোরা, অধম ধূলি চেয়ে

চৌদ্দশত পুরুষ আছি পরের জুতো খেয়ে..

লজ্জা নাই। আর্য' বলি চেঁচাই হাসি মুখে।..."

(দ্বিজেন্দ্রলাল গ্রন্থাবলী, পৃষ্ঠা ৩৮৮)

সিরাজদ্দৌলার জন্য লিখেছেন–

ইংরাজ করে নি সিরাজ তোমায় কভু পরাজিত,

মীরজাফরও করেনি তোমায় আজি দমন;

দিবারাতি প্রজাদিগের এত বেশী খেয়েছে যে

জীর্ণ হয়নি, সে সব আজি কর্ত্তে হল রমন।”

আরও লিখেছেন–

“বিলাসের সে চরম সীমা-নারী নিয়ে খেলা

মনে কর আজি সে সব-জীবন ত ভোগ করে নেছ,

কিসের দুঃখ, উঠে যারা তাদেরই হয় পতন..."

সিরাজউদ্দৌলাকে দুর্নাম প্রায় প্রত্যেকেই যে করেছেন এ সম্বন্ধে নিশ্চয় বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, সিরাজউদ্দৌলাকে যত দুর্নামের পোশাক পরানো যাবে ততই প্রমাণ হবে-কাল শাসক সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে ভাল শাসক ইংরেজের আবির্ভাব সত্যই সৌভাগ্য ছাড়া আর কিছু ছিলনা।

দীনবন্ধু মুসলমানদের সম্বন্ধে যে ধারণাই পোষণ করে থাকুন না কেন, একটা বিষয়ে সেকালের বুদ্ধিজীবী বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তারও গুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের তিনি বিরোধিতা করতে পিছপা হননি-সেটা হচ্ছে নীলবিদ্রোহ। এখন মনে হতে পারে যে, নীলকর সাহেব কারা বা কেমন ছিল? সংখ্যায় কত জনই বা ছিল? কাদের উপর কেন এবং কিভাবে অত্যাচার করেছিল? তথ্য না জানা থাকলে মনে হবে যে এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ দিক নয়। আর সে উদ্দেশ্যেই এগুলো চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং হচ্ছে যাতে সত্য ইতিহাসের স্বরূপ প্রকাশিত না হয়। তাই নীলচাষ সম্বন্ধে এবং বিশাল ভারত বর্ষে সে প্রচণ্ড অত্যাচারের কাহিনী সম্বন্ধে কিছু তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজন আছে।

১৮৫৭-র মহাবিপ্লব ইংরেজ হানাদারা কাগজে কলমে দমন করলেও বিপ্লবের স্রোতস্বতী গতি কিন্তু থামানো যায়নি। ১৮৫৯ হতে ১৮৬১ পর্যন্ত আর একটি বিপ্লবের কথা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য-সেটা হচ্ছে নীলবিদ্রোহ। ডক্টর নরেন্দ্রনাথ ভট্টচার্যও তাঁর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস' পুস্তকে এ কথা স্বীকার করেছেন (পৃষ্ঠা ৩২)

পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ' পুস্তকে গবেষক মেসবাহুল হক এ নীল বিদ্রোহকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ইংরেজবিরুদ্ধ আন্দোলন ও সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান বেশি বললে অনেকের কাছে তা সুস্বাদু হবে না। আমাদের দেশের মুসলমান-প্রধান কৃষক সমাজ লড়েছে, ইংরেজরা তাদের মেরেছে আর জমিদার শ্রেণী নিজেদের শুধু গড়েছে-তারা তেমন কোন সহযোগিতা সংগ্রামীদের সাথে করেন নি-এ কথা প্রমাণের জন্য এক প্রখ্যাত সন্ত্রাসবাদী নেতার উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ “এ কাজে (সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিতে) সরকারী ছোট-বড় কর্মচারীদের মধ্যে এমনকি পুলিশের কাছেও সাড়া পাওয়া গিয়েছিল; কিন্তু জমিদার শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে কম সাড়া পেয়েছি।" (হেমচন্দ্র কানোন গোঃ বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা দ্রষ্টব্য)

নীল চাষ পৃথিবীতে বহু রাষ্ট্রে হয়ে থাকে কিন্তু অনেকের মতে ভারতের নীল সব দেশে অধিক জনপ্রিয়। বঙ্গদেশে বোনার্দ নামে একজন বিদেশী লোক সর্বপ্রথম নীলচাষ করেন। হুগলী জেলার তালডাঙ্গায় প্রথম নীলকুঠি তৈরি হয়। পরে চন্দন নগরের কাছে গোন্দল পাড়ায় কুঠি সরিয়ে আনা হয়। এ সময় শোষক ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ নায়করা বঙ্গদেশে ব্যাপক নীলচাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মিঃ ক্যাবেল কম দাবী করেন যে তিনি এ লাভজনক ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা। (The Economic History of Bengal : N.K. Sinha, P. 207)

বঙ্গদেশে সাহেবেরা এত বেশি নীলকুঠি তৈরি করল যে তাতে মনে হোল, ধান ও পাটের চাষ বন্ধ করে শুধু নীল চাষই করতে চায় শ্বেতাঙ্গের দল। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নীলকুঠি তৈরি হল। যে জেলায় হত নীল চাষ হয়েছে সে জেলার চাষীরা ততে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে। আর দুর্ভিক্ষে, অনশনে, অর্ধাশনে মারা গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। কিন্তু কিভাবে তারা চাষীদের জমি দখল করেছিল? ইংল্যাণ্ড হতে তারা খালি হাতে এসে বড় কর্তাদের সহায়তায় জোর করে জমি চিহ্নিত করত এবং জোর করে নীল চাষ করাতে বাধ্য করত।

অত্যাচার করবার জন্য একদল মারকুণ্ড বাহিনী বা লাঠিয়াল পোষা হত, তাদের কাজ ছিল ইংরেজদের আদেশে চাষীদের উপর অত্যাচার করা (দ্রষ্টব্য Bengal Peasant Life; lal Behar Dey, p. 327। জোর করে তারা গরীব চাষীকে দাদন দিত; দাদন মানে চাষ করতে সাহায্য বাবদ অগ্রিম ঋণ। দাদন না নিলে বেঁধে চাবকান হত। চাষীরা তাদের ইচ্ছামত চাষ করবার অধিকার হারালো। ঐ অত্যাচারের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করে কিছু করা যেত না, বরং বিপরীত ফলই হত। কারণ যারা কুঠির মালিক ছিল তারা কেউ ম্যাজিস্ট্রেটের 'শালা, কেহ ভাই, কেহ ভগ্নিপতি কেহ পিসে, কেহ জ্ঞাতি, কেহ

কুটুম্ব, কেহ গ্রামস্থ কেহ সমধ্যায়-এভাবে পরস্পরের সহিত সম্পর্ক আছে। পুলিশ দারোগারা পর্যন্ত গরীব চাষীদের পক্ষে ছিল না। কারণ তাদের মনিবদেরকে নারাজ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই তারাও সত্য রিপোর্ট দিতে সাহসী হয় নি। (দ্রষ্টব্য ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ঃ সংবাদপত্র সেকালের কথা, পৃষ্ঠা ১০৮-১০৯)

একবার কোন রকমে দাদন দিতে পারলে চাষীকে সারাজীবন বাধ্য হতে হত নীলচাষ করতে। ঐ দাদন শোধ করবার শক্তি ও ইচ্ছা থাকলেও কোন উপায় ছিল না। (দ্রষ্টব্য নীলবিদ্রোহঃ প্রমোদ সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১৭)

প্রজাদের গরু-ছাগল জমির কাছে গেলে তা আর ফিরে আসত না-হয় মেরে ফেলা হত অথবা খেতে না দিয়ে আধমরা অবস্থায় রেখে মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় নিয়ে তবে তা ফেরত দিত ইংরেজরা।

যশোর জেলার ফুলে গ্রামের আসাদুল্লা, গোলাপ মণ্ডল, জাকের মণ্ডল, তোতাগাজী ও আকবর দফাদার প্রভৃতিদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল তার প্রতিবাদে মুসলমান ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল লতিফ হেনরী ম্যাকেজীর নিকট লিখিত প্রতিবাদ পাঠান (মেসবাহুল হক, পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ, পৃষ্ঠা ১৪৮)

ইংরেজদের দেখাদেখি অনেক দেশী জমিদারও নীলকুঠি করেছিলেন, যেমন রাণাঘাটের জমিদার জয়চাঁদ পাল। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তাঁর কাছে এ প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছিল যে, এত অত্যাচার সহ্র করেও চাষীরা কেন নীল চাষ করল? উত্তরে জমিদার বললেন, “প্রহার, কয়েদ, ঘর জ্বালান প্রভৃতি অত্যাচারের ফলে এবং ভয়ে” (ঐ, পৃষ্ঠা ১৫৬)

এ নীল লাভজনক ব্যবসা ছিল কুঠিয়ালদের জন্য, আর চাষীদের জন্য ছিল ধ্বংস হওয়ার কারণ। একমণ নীলের দাম পরত দুশ' টাকা। তার মধ্যে সমস্ত খরচ-খরচা বাদ যেতে ৭০ টাকা। মোট লাভ হত মণ প্রতি প্রায় ১৩০ টাকা। কিন্তু আসলে লাভ হত আরও বেশী-২০০ টাকা। খরচ করে যে নীল উৎপন্ন হোত তাতে কুঠিয়ালদের লাভ হতো প্রায় ১৯৫০ টাকা। আর যদি উৎপাদন করচা ২০০ টাকা ধরা যায় তাহলেও ১৭৫০ টাকা লাভ, যা কল্পনা করা যায় না। আর এজন্যই নীলকরদের লোভ ও চাষীদের উপর অত্যাচার চরম সীমায় পৌছেছিল (দ্রষ্টব্য নীল বিদ্রোহ সেনগু, পৃষ্ঠা ৪৬) তখন এক বিঘা জমিতে নীলচাষ করতে খরচা হত তিন টাকা চৌদ্দ আনা অর্থাৎ চার টাকার কিছু বেশি। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হল নীলচাষে চাষীর ‘লাভের পরিবর্তে লোকসান হোত এক টাকা চৌদ্দ আনা আর এ জমিতে ধান চাষ করলে লাভ হত খরচ খরচা বাদ দিয়ে পাঁচ টাকা পনের আনা বা কিছু কম হ' টাকা। তখন ধানের দর ছিল এক টাকা মণ। তবুও চাষীদের ধানের মত এ রকম লাভজনক চাষ করতে দেয়া হত না।

। সে সময় দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বঙ্গের তিন ভাগের এক ভাগ লোক মারা যাবার অন্যতম কারণ ছিল নীল চাষের জন্য ধান চাষের ক্ষতি। তাছাড়া নীলের সব লাভটুকুই চলে যায় ইংল্যান্ডে। অতএব নীল চাষ দুর্ভিক্ষের জন্য কায়েমী আসন পেতে বসেছিল। অথচ সত্য তথ্য প্রমাণ করে যে, এ সময় নীলকরদের অত্যাচারে জমিদাররা ইংরেজকেই সাহায্য করে গেছেন। [Indigo Commission Report-Evidence, p. 9]। নীলকরদের ব্যবসা ব্যক্তিগত হলেও সরকারি সহযোগিতা প্রত্যক্ষভাবেই তারা পেয়েছিলেন।

বিপ্লবীরা এবারেও মাথা তুললেন। মুনিম, কুতুবুদ্দিন, শাহেদুল্লা, প্রভৃতিরা সশস্ত্রে রুখে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে লাঠিয়াল বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো বিপ্লবীদের উপর। তিনজন নেতাই আহত হলেন। কিন্তু পরে মুনিম শহীদ হলেন [Letter from Mr. L. s. Jackson, Judge of Rajshahi to Registerer, Nijamat Adalat. P. নদীয়া মুসলমান প্রদান জেলা ছিল। সেখানকার চাষীদের জোর করে নীল চাষ করান হয়-যেমন মেলেপোতা, পাথরঘাটা, গোবিন্দপুর প্রভৃতি গ্রামে। (মেসবাহুল হক, ঐ, পৃষ্ঠা, ১৮১)

নদীয়া জেলায় যখন চাষীদের সর্বনাশ করা হয় তখন ইংরেজ সরকার প্রকাশ্যভাবে পুলিশ দিয়ে নীলকরদের সাহায্য করে (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৫৮, ৬০)

বিদ্রোহী বিপ্লবী ও আপত্তিকারীদের সমস্ত জমির ফসল কেটে নেয়া হত, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেয়া হোত এবং চাবকাতে চাবকাতে মেরে ফেলত তারা। সপরিবারে সইতে হত অত্যাচারের ধাক্কা। বিপ্লবী বিষ্ণু ঘোষকে সাহেবরা হত্যা করে তার লাস ভাসিয়ে দেয়। মামলা করা হয় কিন্তু তাতে রায় হয়-ও কেস সাজান এবং মিথ্যা। তার পরেও আপীল করা হলে তা নামঞ্জুর হয়। মিঃ ডাম্বাল একটা গোটা গ্রাম আক্রমণ করে বেশির ভাগ লোককে আহত করেন।

ডালের ছেলের গুণ্ডামীই বেশি ক্ষতি করেছিল। এক্ষেত্রেও মামলা করা হলে মিঃ ডাম্বল বেকসুর খালাস হন। আর পুত্র তো কোর্টে হাজিরই হননি। অবশ্য কিছু আসামীর এক বছর করে জেল ও একশত টাকা জরিমানা হয়। কিন্তু সব চোরে চোরে মাসতুত ভাই। যেমনি আপীল করা হল অমনি সব বেকসুর খালাস। কারণ সব যে ভদ্রলোক আসামী। (দ্রষ্টব্য Indigo Commission Report, Appendix ll) জামালপুরের কালু নীল চাষ করতে অস্বীকার করেন। মিঃ ব্রুস ঘোড়ায় চড়ে চাবুক হাতে করে হাজির। কিন্তু কালু একটা মোটা লাঠি দিয়ে সাহেবকে কুকুর পেটান করলেন। তার কিছুদিন পর বৃন্দাবনপুরে ইউসুফ মিঃ হিলস-এর নীলকুঠি আক্রমণ করে ধ্বংস করে ফেলেন। (গোলাম মোহাম্মদের লেখা জালালপুরে গণ ইতিবৃত্ত' হতে উদ্ধৃতি দিয়ে মেসাবাহুল হক, পৃষ্ঠা ২৫)

ইংরেজরা মেরে ধরে জেলে ভরে অত্যাচার করে যেভাবে ভারতবাসীকে সন্ত্রস্ত করেছিল তাতে মানুষ বোবার মত, বাকহীন পশুর মত সহনশীল হয়ে উঠেছিল। তা না হলে এক একটা কুঠিতে যা শ্রমিক থাকত তা বিস্ময়কর। যেমন রুদ্রপুরে নীলকুঠির সংখ্যা ছয়। তাতে কাজ করত ৭৩৮৩৯ জন। ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে এ এলাকার কাঠগড়ায় বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠতে বাধ্য হয়েছিল। [মেসবাহুল হক, ঐ, ২০৭। তবে সবচেয়ে দুঃখের কথা “দেশীয় জমিদারগণ সাধারণতঃ শ্রেণীগতভাবে নীলকরদের বিরোধী ছিল না” দ্রষ্টব্য Buckland: Bengal Under the Lt. Governors, Vol-1, p. 248]। আর একটা লাড়াই হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে, তাতে ইংরেজ নায়ক ছিলেন মিঃ আর্চিবল হিল। আর আমাদের দেশীয় নায়কের নাম করম আলী। করম আলী ইংরেজদের অত্যাচারকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়েছিলেন (হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ১২ই মে, ১৮৬০)

নদীয়া জেলার গাছা গ্রামের বিপ্লবী বিশ্বনাথ ইংরেজদের বেশ মার দেন এবং হিমশিম খাওয়ান। অবশ্য শেষে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তার ভাল নাম চেপে তারা তাকে বিশে ডাকাত' বলে উল্লেখ করেছে। তবে দুঃখের বিষয় যে, আমাদের দেশীয় লেখকরাও তাঁকে বিশে ডাকাত’ বলেই উল্লেখ করেছেন (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম : সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা ২১২-১৩)

নীল চাষ ও নীলকরদের অত্যাচার শহীদ নিসার আলীর সময়েও ছিল। বলাবাহুল্য, তার মহান সংগ্রাম ছিল এ অত্যাচারেরই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ স্বরূপ। আর সেই জন্যই তিনি ইংরেজ ও তাঁদের দালাল জমিদারদের একসাথে আক্রমণ করেছিলেন। যদিও এর সাথে তার আন্দোলন বিজড়িত, তবুও যেহেতু তার সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে সে জন্য এখানে আর পুনরুল্লেখ করা হল না।

বিপ্লবের হাওয়া বইতে থাকে। শিবনাথ, সাদেক মোল্লা, গয়রুল্লা, ফকীর মামুদ, খান মামুদ, আফাজুদ্দিন, রামচন্দ্র ও চন্দ্রকান্ত সকলে মিলে বেনীর ছত্রিশখানা নীল ও চিনির নৌকা ডুবিয়ে দেন। এমনিভাবে ৫০ লাখ চাষী একতাবদ্ধ হয়ে ঘোষণা করে যে তাঁরা নীল আর বুনবেন না। Calcutta Review পত্রিকাতেও যা ঘোষিত হোল তার মর্মার্থ হল, বাংলার কৃষকদেরকে নির্বাক যন্ত্র মনে করতাম; এখন তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন, জেগে উঠেছেন তারা-তারা আর নীল চাষ করবেন না। নদীয়া, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, ফরিদপুর, ২৪ পরগণা শেষে গোটা বঙ্গের চাষীরা প্রতিজ্ঞা করলেন যে তারা নীল বুনবেন না; ভিক্ষা করে খাবেন সেও স্বীকার। (দ্রষ্টব্য নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ প্রমোদ সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৮৭)

ওদিকে শ্বেতাঙ্গ হানাদারদের চিন্তা বাড়ল। ফলে সিদ্ধান্ত হোল, অত্যাচারের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। গ্রামের পর গ্রাম পোড়ান হতে লাগল। পুরুষদের ধরে বন্দীখানায় অমানুষিক অত্যাচার করা হতে লাগল। স্ত্রীলোকদের জোর করে ধরে তাদের উপর পাশবিক পাপাচার করা হল। ধানের গোলা ধ্বংস করা হল। তবুও বিপ্লবী চাষীরা মাথা নত করেননি। (হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ১৯শে মে, ১৮৬০)

রফিক মণ্ডলের নেতৃত্বের কথা হান্টারও স্বীকার করেছেন। মাষ্টার আবদুর রহমান রফিক মণ্ডলকে একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে দেন তিনি সরকারি মর্যাদা পেয়ে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন বলে তাঁর কঠিন শাস্তি হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নীল বিপ্লবে যোগ দেন। তিনি ব্যক্তিগত পুঁজি চাকরি করে ও চাষ করে যা সংগ্রহ করেছিলেন তা অকাতরে চাষীদের বা বিপ্লবীদের বিপদে খরচ করে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। পুত্র-পরিজনেরও তিনি সঠিকভাবে খোঁজ নিতে পারেননি, শুধু সংগ্রাম নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি খাজনা-ট্যাক্স সব বাকী থেকে যাবার কারণে গরীব দরদী বিপ্লবীর জমিজমা সব নিলাম হয়ে যায়-তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। (দ্রষ্টব্য ভারত বর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস : ডঃ যদুগোপাল মুখোপাধ্যায়)

নীলবিপ্লবের আর এক উজ্জ্বল নাম রহীমুল্লা। মিঃ মোরেল ছিলেন খুব প্রভাবশালী ইংরেজ। নিজের নামানুসারে একটি জায়গার নাম রাখেন মোড়েলগঞ্জ। তাঁর ইচ্ছা ছিল, বিপ্লবী নেতা রহীমুল্লাকে দিয়ে নীল চাষ করাতে পারলে নেতার অবস্থা দেখে সকলেই ভয় পেয়ে যাবে এবং নীল চাষ করতে কেহ আর আপত্তি করতে পারবে না। কিন্তু রহীমুল্লা সাহেবের আদেশ পেয়েও গর্বভরে তা অস্বীকার করলে শুরু হয় সংগ্রাম। ১৮৬১-র ২৬শে নভেম্বর গভীর রাতে ঘেরাও করা হল রহীমুল্লার গ্রাম বারুইখালি। অবরোধকারীদের হাতে বন্দুক ও নানা অস্ত্রশস্ত্র। দলনেতা হয়ে এসেছিলেন মিঃ হিলি।

যাইহোক, অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে গ্রামের জোয়ানরা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রহীমুল্লা বন্দুক নিয়ে সেনাপতির কায়দায় যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোরেলের অনেক লোক নিহত ও আহত হল। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা হল, রহীমুল্লার স্ত্রীও স্বামীর পাশে পাশে থেকে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা গুলি এসে রহীমুল্লার পায়ে লাগে। এক পায়ে লাফ দিয়ে বন্দুকে ভর দিয়ে তিনি বাড়ী এলেন। স্ত্রী ক্ষিপ্রগতিতে নিজের শাড়ী ছিড়ে ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছিলেন।

রহীমুল্লা তখনো স্ত্রীকে বলছিলেন, আরো তাড়াতাড়ি কর, আজ মোরলের কাউকে জ্যান্ত রাখব না। স্ত্রী বলছেন, একটু থাম, আমিও তোমার সাথে থাকবো। ওদিকে গুলি চলছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। হঠাৎ আর একটা গুলি এসে রহীমুল্লার বুকের মাঝে লেগে বুকটাকে বিদীর্ণ করে ফেলল। বীরাঙ্গনা স্ত্রী স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কোলে শুইয়ে নিতেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। রহীমুল্লার মৃত্যুতে তার দল শোকাহত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়। মিঃ হিলি বিজয়ী হয়ে মৃতদেহ নিয়ে যান এবং পুরুষ মহিলা অনেকের সাথে রহীমুল্লার স্ত্রীকেও বেঁধে নিয়ে যেতে লজ্জাবোধ করেন নি। (বঙ্কিম জীবনী : শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১৩৩৮, পৃষ্ঠা ৯০-৯৩)

এর পরে বিচারে ৩৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও বাকী প্রত্যেকের নানা মেয়াদে জেল আর চৌকিদার দৌলতের ফাসি হয়। কিন্তু নরঘাতক হিলির কোন শাস্তি হয়নি, কারণ তিনি যে ছিলেন শ্বেতাঙ্গ শোষকদের দলভুক্ত।

মিঃ ফেল্টনকে রাস্তায় খাল করে রেখে আহত করা হয়। সাহেবের পা ভেঙ্গে যায়। মিঃ ফেল্টন একদল পল্টন নিয়ে গ্রাম শায়েস্তা করতে এলে রইস খা, গুলজার খা ও জাহানদার খা এমন প্রতি আক্রমণ চালালেন যে পশু-পেটা হয়ে তাদের পালাতে হয়। এমনিভাবে চলনবিল এলাকায় নাড়ী-বুড়ির বিক্ষুদ্ধ জনতা নীলকর সাহেবকে পিটিয়ে হত্যা করে। (দ্রষ্টব্য দৈনিক আজাদ, ১৭ই আগষ্ট, ১৮৬৭)

উত্তরবঙ্গে পিয়ারী গ্রামে ৫২ খানা গ্রামের লোক একত্রে ক্ষেপে ওঠে এবং ম্যাজিস্ট্রেট সাহবেকে আক্রমণ করে। অবশ্য তাঁর বিপদ ঘোড়র উপর দিয়ে যায় অর্থাৎ ঘোড়াটা আহত হয়। এ দল হতে বন্দুকের ব্যবহারও হয়েছিল বলে জানা যায় (প্রমোদ সেনগুপ্ত, পূর্বোক্ত পুস্তক, ৮৬ পৃষ্ঠা)

মল্লিকপুরের মীরগঞ্জে ইংরেজ বিরুদ্ধ আন্দোলন পাঁচু শেখ শহীদ হন। বগুড়ায় বিপ্লবীরা কৃষ্ণপ্রসাদের নেতৃত্বে মিঃ ফার্গুসনের নীলকুঠি আক্রমণ করে ফার্গুসনকে হত্যা করেন। এ ঘটনার পর বগুড়া জেলায় অত্যাচারের পরিমাণ কমে যায়। (বগুড়ার ইতিহাসঃ প্রভাতচন্দ্র সেন দেবশর্মা, পৃষ্ঠা ২৪৮)

ইংরেজরা এবার ভীত হয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করেন। তাতে ছিলেন মোট পাঁচজন সদস্য, চারজন ইংরেজ ও একজন বাঙ্গালী-চমোহন চ্যাটার্জি। এ চ্যাটার্জি মশায় ছিলেন পোশাক পরিচ্ছেদ একেবারে সাহেব। সেটাই বড় কথা নয়, বড় কথা হল, তিনি ছিলেন বাঙালী বিদ্বেষী। তার প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যে ব্লাক বিল পাশ হয় তা একজন মাত্র বাঙালীই সমর্থন করেন-তিনিই হচ্ছেন চন্দ্রমোহন চাট্যার্জি। আর তাই এ কমিশন গঠন করা সত্তেও বিপ্লবীরা খুশী হননি (নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ ও সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১২৯)

নীল বিদ্রোহের সঠিক মুহুর্তে যে হিন্দু নেতারা ইংরেজ বিরোধী সত্য তথ্য বেশি করে তুলে ধরেছিলেন তাঁদের অন্যতম দুজন হচ্ছেন হরিশচন্দ্র ও শিশিরকুমার। হরিশচন্দ্র নীলকরদের অনাচারের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে বা বিপ্লবীদের পক্ষে কাজ করতে করতে শেষে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তাই তার ইতিহাস সকলের কাছে শ্রদ্ধার সামগ্রী। ৩৭ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

ঠিক এমনি আর এক নাম দীনবন্ধু মিত্র। যদিও তিনি সরকারি কর্মচারি ছিলেন, যদিও রায়বাহাদুর' খেতাব নিয়েছিলেন তবুও নীলকরদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন চিরদিন। যদি এটুকু তিনি না করতেন তাহলে তাঁর পোপ্টমাস্টার জেনারেল এবং পরে ডাইরেক্টর জেনারেল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিলনা। অবশ্য এ উক্তি করে গেছেন হুশিয়ার হিসেবী সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।

বীরভূম জেলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুজন বিখ্যাত বিপ্লবী কৃষক নেতা। যাঁরা ছিলেন পুর্বোল্লিখিত বিপ্লবী মাওলানা আলাউদ্দিনের দীক্ষায় দীক্ষিত। তাঁদের একজন হলেন বিপ্লবী শেখ রাজন, অপরজন হচ্ছেন বিপ্লবী করিম খাঁ। অবশ্য পরে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয় এবং ইংরেজের ন্যায়বিচারে দেশদরদী দুই নেতার নিষ্ঠুর ভাবে ফাঁসি হয়। এ সমস্ত বিপ্লবীদের বিশেষতঃ বীরভূম জেলার এ বীরদের নাম ইতিহাস যেন ভুলে যেতে চায়। এমনিভাবে মেদিনীপুরের বিপ্লবী নেতা মীরজন্ধু ও শেখ জমিরুদ্দিনের কারাগারের অভ্যন্তরে তিলে তিলে ধ্বংস নেমে আসে। এ নীলকর সাহেবের যারা সমর্থন করেছেন অথবা প্রতিবাদ করেননি তারা অনেকের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হলেও বহু মানুষের কাছে তারা দেশের শত্রু।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন