মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
আমাদের মধ্যে অথবা অভারতীয়দের মধ্যে বর্তমানে যদি কেহ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে চান আর যদি তাকে ভারতীয় সরকারি পাঠ্যপুস্তক পড়তে দেয়া হয় তাহলে তারা দেখবেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সমস্ত বিপ্লবীই প্রায় হিন্দু, মুসলমান জাতি যেন নীরব।
আর এ সময় হতে একেবারে স্বাধীনতা প্রাপ্তির তারিখ পর্যন্ত ১৯৪৭-এর আগস্ট পর্যন্ত সমস্ত বিপ্লবই যেন হিন্দুদের দ্বারাই সংঘটিত। সেখানেও যেন মুসলমান জাতি নীরব। শুধু সংখ্যার আধিক্য দেখিয়ে এবং সাম্প্রদায়িকতার কোন্দল কোলাহলে অমুসলমানদের যেন বিব্রত করেছে মুসলমান এবং হিন্দুদের সাথে লড়াই ও ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে আদায় করেছে দু টুকরো জায়গা যেটার নাম ছিল পাকিস্তান-এক টুকরো পূর্ব পাকিস্থান আর বড় টকরাটা পশ্চিম পাকিস্তান। অবশ্য ইতিহাসের চাকা আরও ঘুরে পূর্ব পাকিস্তান এখন হয়েছে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
অথচ আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি স্বাধীনতার পথ পরিকল্পনা ও প্রকাশ মুসলমানদের দ্বারাই সংঘটিত এবং প্রথম ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনও প্রধানতঃ মুসলমানদের দ্বারাতেই পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু অমুসলমান বা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বা তদানীন্তন অধিকাংশ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতা অথবা অসহযোগিতার কারণে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। তাতে ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষতি হয় সীমাহীনভাবে।
এক সময় মুসলমান জাতি শাসক জাতি হিসেবে গণ্য ছিল। সাংসারিক স্বাচ্ছল্য, সম্মান ও বড় বড় চাকরি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে যে কোনও জাতি বা গোষ্ঠী যদি মাত্র পঞ্চাশ বছর কোন দেশকে শাসন করে তাহলে সে জাতির প্রত্যেকে “শাসক-জাতি হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে নিতে সক্ষম হবে-এটা ঐতিহাসিক সত্য।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এ বিখ্যাত মুসলমান জাতি পৌনে এক হাজার বছর ভারত বর্ষে বিজয়ী জাতি হিসেবে বাস করেছে। অতএব তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও মর্যাদা ভারতের প্রত্যেক জাতি ও সম্প্রদায়ের চেয়ে সর্বোন্নত বা বেশি ছিল তাতে এতটুকু সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কিন্তু কিভাবে মেরুদণ্ডহীন দরিদ্র জাতিকে পরিণত হল এ ভারতীয় মুসলমানরা কিভাবে মর্যাদাহীন অশিক্ষিত ও অনুন্নত জাতিতে পরিণত হল এ মুসলমানরা তা জানতে চাইলে আজ জাতি ধর্মনির্বিশেষে শিক্ষিতদের বলতে শোনা যায়-মুসলমান জাতি পিছিয়ে গেছে নাকি উলামাদের ফতোয়া অনুযায়ী ইংরেজি শেখা হারাম করার জন্য। কিন্তু এ তথ্য অসভ্য এবং এটা যে কুপরিকল্পিত চক্রান্ত মাত্র অর্থাৎ মুসলমানদের ইংরেজি শেখার পথই যে কায়দা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তার কিছু আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে।
প্রথমে আলোচনা করা হচ্ছে-বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলিম জাতি যোগ দেয়নি, না কি তাদের সংগ্রামীদের মধ্যে যাদের হাতে নেতৃত্ব ছিল তারা হচ্ছেন তিলক, অরবিন্দ, বিপিন পাল, ব্যরিষ্টার পি, মিত্র প্রভৃতি নেতাগণ। তাদের কর্ম পদ্ধতি যেভাবে তৈরি করা হয়েছিল তাতে মুসলমানদের যাওয়ার পথ রুদ্ধ ছিল। কারণ সেটা ছিল পুরোপুরি হিন্দুধর্ম ভিত্তিক এবং ইসলামধর্ম বিরোধী। এ বক্তব্য প্রমাণ করতে একটি ঐতিহাসিক দলিলের উদ্ধৃতি দিচ্ছি : “যে সত্যকে দীক্ষা দান করা হইত, তাহাকে একবেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া ও একবেলা উপবাসী থাকিয়া পরের দিন স্নান ও বস্ত্র পরিধান করিয়া দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইত।
দীক্ষাগুরু ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য পুষ্প-চন্দনাদি সাজাইয়া বেদ ও উপনিষদের মন্ত্র পাঠ করিয়া যজ্ঞ করিতেন। যজ্ঞের পর শিষ্য প্রত্যালীঢ়সন'-এ উপবিষ্ট হইত এবং দীক্ষাগুরু শিষ্যের মাথার উপর গীতা ও তার উপর তরবারি স্থাপন করিয়া দক্ষিণ দিকে দাঁড়াইতেন। শিষ্যকে দুই হস্তে প্রতিজ্ঞা-পত্র ধারণ করিয়া এবং যজ্ঞাগ্নি সম্মুখে তাহা পাঠ করিয়া শপথ গ্রহণ করিতে হইত।” (সুপ্রকাশ রায়ঃ ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৬৪-৬৫)
অনুশীলন দলের উচ্চস্তরের নেতা পি, মিত্র এবং পুলিনদাস যেভাবে সভ্যদের প্রতিজ্ঞা করাতেন তাতে মুসলমানদের যোগ দেয়া কেন সম্ভব ছিল না সহজবোধ্যঃ “...নির্জন ‘সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে যাইয়া একটু জাকজমক করিয়াই দীক্ষা গ্রহণ দিতাম।...প্রত্যেকেই দীক্ষান্তে কালীমূর্তিকে প্রণাম করিয়া আমাকে প্রণাম করিত।" (ঐ, পৃষ্ঠা ১৬৫)
প্রতিজ্ঞাপত্রের প্রথম বিশেস প্রতিজ্ঞা'র শিরোনামে লেখা ছিল-ওঁ বন্দেমাতরম। তারপর এ প্রতিজ্ঞপত্রের ‘ঙ’র ১ নম্বরে লেখা ছিল-“স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, তাই অসৎকর্ম জানিয়াও আমরা অর্থ সংগ্রহের উপায় হিসাব ডাকাতির পথ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছি। ডাকাতিলব্ধ অর্থের একটি কপর্দকও আমরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয়
করিয়া সমুদয় অর্থ আমাদের পরিচালকের হস্তে অর্পণ করিব। আমাদের প্রত্যেকের পারিবারিক অভাব বুঝিয়া তিনি যাহা আমাদের দিবেন আমরা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিব। (সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা ১৬৪)
এখানে বোঝা যায়, তরুণের দল বাড়ি থেকে কোন সাহায্য পেত না অর্থাৎ পকেট থেকে চাঁদা দেয়ার রেওয়াজ ছিলনা। অথচ দেখা যাচ্ছে ডাকাতির ফাণ্ড হতে বাড়ি, অর্থাৎ সংসারে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল-'প্রত্যেকের পারিবারিক অভাব...' শব্দগুলোতে তা প্রমাণ হয়। এখন আন্দোলনের পদ্ধতিকে যদি কেহ মাছের তেলে মাছ ভাজা যা মন্তব্য করেন তাহলে তা কতটা ভুল হবে তা হিসেব করা কষ্ট। বিগত দিনের ইতিহাসে মুসলমান প্রধান আন্দোলনগুলোতে দেখা যায় তারা টাকা সংগ্রহ করেছেন নিজেদের সংসার হতে, গ্রামেগঞ্জে চাঁদা তুলে, জমিজমা বিক্রি করে, নিঃস্ব হয়ে তবুও ঠিক এভাবে ডাকাতি করে নয়। তাছাড়া প্রত্যেক বিপ্লবীকে সাহায্য করতেন তাদের মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-আত্মীয়া সকলেই। আরো একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হোল, মুসলমান বিপ্লবী নেতারা যে সমস্ত হিন্দু সহযোগীদের পেয়েছিলেন তাদেরকে মসজিদে নিয়ে গিয়ে ওযু করিয়ে, মাথায় কোরআন ঠেকিয়ে, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে মন্ত্র পড়িয়ে, দাড়ি রাখিয়ে, লুঙ্গি পরিয়ে, রোযা ও ইফতার করিয়ে সভ্যদের শপথ গ্রহণ করান নি। অতএব উদারতা ও সঙ্কীর্ণতার বিচারে অথবা দূরদর্শিতার প্রাচুর্যে কারা প্রশংসনীয় তার মন্তব্য নিষ্পোয়োজন।
আর একটা কথা ভুললে চলবে না-স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম বিপ্লবীরা ডাকাতির পথে না গিয়ে সামনাসামনি সংগ্রামের ময়দানে নেমেছেন, মরেছেন, মেরেছেন, ধ্বংস করেছেন এবং ধ্বংস হয়েছেন। কিন্তু আলোচ্য সন্ত্রাসবাদী দল ব্যাপকভাবে ডাকাতি এবং গুপ্ত হত্যা করেছেন। আর গুপ্ত হত্যায় নিশ্চয়ই বেশি অর্থ ও অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না। কারণ একটি রিভলভার ও একটি ছোরা সারাজীবন ধরে কাছে রেখে অনেক গুপ্ত হত্যা করা যায়।
কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে নামলে বন্দুক, কামান, ঘোড়া, হাতি সবই দরকার হয় এবং যদি পরাজিত হতে হয় তাহলে সমস্ত অস্ত্র শত্রুর হাতে চলে যায়-সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, পূর্ববর্তীদের অধিক অর্থের প্রয়োজন হয়েছিল, অপরদিকে এই হিন্দু কবলিত সন্ত্রাসবাদীদের এত অর্থের প্রয়োজন ছিল না। ডাকাতি সম্বন্ধে যদি বলা যায়, ডাকাতি করা হয়েছে বটে কিন্তু দু-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা মাত্র, তেমন বেশি টাকা সংগ্রহ হয় নি তাহলে উত্তরে বলতে হয়, প্রকৃত ইতিহাসে তাদের ডাকাতির বেশ নমুনা মজুদ আছে। কিছু নমুনা পেশ করা হয়েছে।
১৯০৩ খৃষ্টাব্দে ডাকাতি শুরু হয়। ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে এক বিধবা রমণীর বাড়ীতে ডাকাতি করতে গিয়ে সন্ত্রাসবাদী দল জানতে পারেন যে ঐগ্রামে একজন দারোগা আছেন। তাই তাঁরা নিঃশব্দে ফিরে আসেন। সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, “দারোগার উপস্থিতির সংবাদে তাঁহারা ভয় পাইয়া পলাইয়া যান" (পৃষ্ঠা ২২০)
অথচ ' পরিচ্ছদে রাজনৈতিক ডাকাতি সম্পর্কে “বিশেষ প্রতিজ্ঞাপত্রে'র ৪ নম্বর ধারায় খো ছিল প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, ডাকাতি করিতে যাইয়া আমরা কোন রমণী, শিশু, দুর্বল, রুগ্ন নিঃসহায় প্রভৃতির উপর কখনই কোন প্রকার অত্যাচার করিব না।" (ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, ১৬৪ পৃষ্ঠা, পূর্ণ তথ্যঃ ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তঃ ভারতের দ্বিতীয় সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৩১)
নারায়ণগঞ্জে ১৯০৬-এ এ ডাকাতি করা একটা লোহার আইরন সেফ নিয়ে নৌকায় চাপিয়ে সন্ত্রাসবাদী দল পালাতে চেষ্টা করলে নৌকা ডুবে যায়। সামান্য কিছু টাকা লাভ হয় অথচ গৃহস্থের সর্বনাশ হয়। ১৯০৭-এর ঢাকায় এক পাটের অফিসে ডাকাতি করতে গিয়ে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি; শুধু তাদের দোনলা বন্দুকটি লাভ হয়। ১৯০৮-এ শিবপুর ছোরা ও পিস্তল নিয়ে অনেক কিছু করে মাত্র চারশ' টাকা উদ্ধার হয়। ডাকাতি করে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তা যেভাবেই খরচ হোক না কেন কর্মীদের সংসারে বা পরিবারের জন্য টাকার ভাগ নেওয়া উপরের শর্তে প্রমাণ হয়েছে। তাহলে কি টাকা বেশী সংগ্রহ করা যায়নি? উত্তরে ‘না’ বললে ইতিহাসের বিপরীত কথা বলা হয়। যেহেতু ১৯০৮-এ একটা ডাকাতি করে বিপ্লবীরা ২৬ হাজার টাকা হাতে পান। এ বছরেই বাজিতপুরের ডাকাতিতে প্রচুর অর্থ বিপ্লবীরা নিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে বিপ্লবীরা ধরা পড়েন।
দলের নরেন গোস্বামী রাজসাক্ষী হয়ে আসামীদের নাম বলে দেয়ার জন্য তাঁকে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হতে হয়। ফরিদপুরে ৮০ হাজার টাকার সংবাদ পেয়ে ডাকাতি করা হয় কিন্তু টাকা তারা লুকিয়ে দেয়ায় বিপ্লবীদের বঞ্চিত হতে হলে তারা তিনটি দোকান লুট করেন। ১৯০৯-এ রাজেন্দ্রপুর ষ্টেশনে ট্রেন ডাকাতি করে ২৩ হাজার টাকা লুণ্ঠন করা হয়। এই লুণ্ঠন' শব্দ শুনতে খারাপ লাগলেও ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় কিন্তু ঐ শব্দই ব্যবহার করেছেন।
যাইহোক, পুলিশ তাদের অনুসরণ করে। বিপ্লবীরা ভয়ে ট্রেন হতে লাফ মারেন। পুলিশ ১২ হাজার টাকা উদ্ধার করে। বাকি টাকা বিপ্লবীরা সামলাতে সক্ষম হন। ১৬ই অক্টোবর অনুশীলন সমিতির সভ্যগণ মুখোশ, রিভলভার, ছোরা, হাতুড়ি, টর্চ দ্বারা সজ্জিত হইয়া ফরিদপুর জেলার দারিয়াপুর গ্রামে একটি ডাকাতি করিয়া ২৬ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা ২২৯)
রাজনগরের ডাকাতিতে ২৯ হাজার টাকা এবং মোহনপুর বাজারে ডাকাতি করে আরো “১৬ হাজার টাকা লুণ্ঠন করেন। ১৯১০-এ শোলগাঁতীর ডাকাতিতে ২০০ টাকা, ধূলাগ্রামে ডাকাতিতে ৬১৭৫ টাকা, নন্দনপুরে ৬৫০০০ টাকা মহীষার ডাকাতিতে ২২০৪ টাকা বিপ্লবীরা সংগ্রহ করেন (দ্রষ্টব্য Sedition Committee Report, p. 98)
ময়মনসিং-এর ডাকাতিতে ১৫০০০ টাকা, ৭ই নভেম্বর ফরিদপুরে কলারগাঁও-এর ডাকাতিতে ৪৯৩৮৬ টাকা লুণ্ঠিত হয়। ১৯১১-তে এক ডাক পিয়নের মনি অর্ডার ব্যাগ ছিনতাই করা হয় কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ৫ই জানুয়ারি অনুশীলন দল এক বাড়ি থেকে ৫৫৫০ টাকা লুণ্ঠন করেন। ২০শে ফেব্রুয়ারী গোয়াবিয়ায় নগদ ও অলঙ্কারে মোট ৭৪৫৭ টাকা লুণ্ঠিত হয়।
২২শে এপ্রিল লক্ষণকাঠি হতে ১০২০০ টাকা ডাকাতি করা হয়। ৩০শে এপ্রিল চরশশা গ্রামের ডাকাতিতে বিপ্লবীরা ২১৫০ টাকা, সিংহায়ের ডাকাতিতে ৮১৭০ টাকা, কালিয়াচকে ডাকাতিতে ৩১২৫ টাকা, বালিয়া গ্রামের ডাকাতিতে ১২১৮ টাকা এবং চাউলপালি গ্রামের ডাকাতিতে অনুশীলন দলের বিপ্লবীরা ১৯৭৭ টাকা লুট করেন। ১৯১২ খৃষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই বাইগুনতেড়িয়ায় ৩৪৭০ টাকা, ২১শে আয়নাপুরে ৭৫৯৩ টাকা, ২৩শে বিরঙ্গলে ৮০৮০ টাকা, ১১ই জুলাই পানামে ২০০০০ টাকা, ১৫ই জুলাই প্রতাপপুরে ৭০৯৫ টাকা, ১৪ই নভেম্বর ঢাকার লাঙ্গলবন্দে ১৬০০০ টাকা বিপ্লবীরা ডাকাতি করেন
অনুশীলন সমিতির সভ্য রজনী দাস ধরা পড়ে রাজসাক্ষী সেজে সব তথ্য ফাঁস করে দেন। সে মামলার নাম হয়েছিল প্রথম বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা। এভাবে ১৯১৩-তে দশটি ডাকাতিতে ৬১০০০ টাকা, ভরাকাইরে ৩৪০০০ টাকা ধুধুলিয়াতে ৯০০০ টাকা ডাকাতি করা হয়। গ্রামবাসীরা বাধা দিলে কিছু আহত ও নিহত করে বিপ্লবীরা পলায়ন করেন। কাওয়াকুরির ডাকাতিতে ৫১৩০ টাকা, কেদারপুরে ১৯৮০০ টাকা অনুশীলন দলের বিপ্লবীরা লুণ্ঠন করেন। এ ডাকাতিতে এক সাহসী গ্রামবাসী বাধা দিতে গেলে বিপ্লবীরা গুলি করে তাকে হত্যা করেন এবং আরো পাঁচ জনকে গুলিবিদ্ধ করে আহত অবস্থায় পরাজিত করে পলায়ন করেন।
এভাবে সরাচর, খরমপুর এবং পশ্চিম সিংগ্রামের ডাকাতিতে বিপ্লবীরা মোট ১৩৪৯০ টাকা লুণ্ঠন করে গ্রামবাসীদের পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে অনুশীলন সমিতির ধর্ম সংস্থাকে সার্থক করেন। কিন্তু মুসলমানরা যে এ সমিতিতে ব্যাপকভাবে নাম দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনি, সে ঘটনা দুঃখের না আনন্দের তার বিচার করবেন আজকের ও আগামী দিনের নিরপেক্ষ ইতিহাস প্রেমিক মানুষেরা। হিন্দু জাতি ও হিন্দুধর্ম প্রেমিক খাটি হিন্দু দিয়ে গঠিত এই সংগঠনের ডাকাতি ও লুণ্ঠন নিশ্চয় সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের বাড়িতে হয়নি এবং তাদের ডাকাতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অহিন্দুদের উপরেই যে হয়েছিল-এমন কথা মনে আসা কঠিন নয়।
আর সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীর মজবুত হওয়ার ক্ষেত্রে এটাও একটা অন্যতম কারণ। মুসলমানদের এ বিষয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হতে হয় যে, তারা ইংরেজের প্রত্যক্ষ অত্যাচারে জমিদারি ও জমি হারিয়েছেন, কুচক্রান্তে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা চালু হওয়ার তারা চাকরি, সরকারি মর্যাদা ও রোজগার হারিয়েছেন, এবং জাতীয় ও বংশীয় মর্যাদা হারিয়ে উপজাতি ও তপসিলী জাতির মত একটা অনুন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছেন। তারা আরো চিন্তা করতে বাধ্য হন যে, জৈন, বৌদ্ধ, ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব, সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুল, প্রভৃতি জাতি একটা বিশেষ সময় পর্যন্ত তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার পরেই মিশে গেছে হিন্দুধর্ম ও সমাজের সাথে; তারপর স্বাতন্ত্রহারা হয়ে গেছে-তাহলে মুসলমানদের ভাগ্যেও কি তাই আছে।
এরপর ভারতের সে বিখ্যাত নেতা বালগঙ্গাধর তিলক নেতৃত্ব দিলেন হিন্দুজাতির সামনে এসে। গবেষক সুপ্রকাশ রায়ের উদ্ধৃতি দিচ্ছি : “এভাবে সনাতন ধর্মকে রক্ষা করার অজুহাতে বাল্য বিবাহের সমর্থন করে প্রগতি বিরোধীদের শক্তিশালী করে তোলেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি গোরক্ষা সমিতি' স্থাপন করে হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে ‘গোমাতাকে রক্ষা করবার জন্য গোমাংসভোজীদের বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করেন। এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অর্থনীতিক যুক্তিতর্কের কথা বাদ দিলেও প্রধানতঃ ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হওয়ায় এ জাতীয় আন্দোলনের ঐক্য ও অগ্রগতি ব্যাহত করবার পক্ষে সহায়ক হয়।
কারণ এ জাতীয় আন্দোলনের অগ্রগতির পক্ষে অপরিহার্য হিন্দু-মুসলমানের মিলন সাধনের সহায়ক না হয়ে এ দু সম্প্রদায়ের বিরোধের একটি প্রধান কারণ হয়ে থাকে।... ভারতের মুসলমানগণ যে (ঐ সময় বিপ্লব প্রচেষ্টায় যোগদান করে নেই, রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুধর্মের সংমিশ্রণই তার অন্যতম প্রধান কারণ। তার ফলে ভারতের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবপ্রচেষ্টা প্রথম হতেই কেবলমাত্র হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে এবং এভাবে প্রগতিশীল চরমপন্থী জাতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে ভারতের সমগ্র জনগণের ঐক্যের বদলে বিভেদের ভিত্তি রচিত হয়।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা ১১৪) তাছাড়া হিন্দু বিপ্লবী নেতাগণ শিবাজী উৎসব ও গণপতি উৎসব পালন করেন। এটাও মুসলমানদের মনে হতাশার সৃষ্টি করে, যেহেতু তাতে মুসলমানদের প্রবেশের প্রশ্নই ওঠেনি। শিবাজীকে দেবতার মত বরণ করা তো হলই, সে সাথে ‘গণপতি'-শ্লোকে যে ভাব ও ভাষা
ব্যবহার করা হল তাও বড় মারাত্মক-“হায়! তোমাদের দাসত্বে লজ্জা নেই। তা হলে আত্মহত্যাই করা উচিত। হায়! এই কসাইরা দানবীয় নিষ্ঠুরতার সহিত গো-মাতা ও গো-বৎসদের হত্যা করে। তোমরা এ যন্ত্রণা হতে গোমাতাকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর হও”। এ সময় ১৮৯৫ খৃস্টাব্দে চাপেকার ভ্রাতৃদ্বয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক দল একত্রিত করে একটি দলের নাম দিলেন হিন্দু ধর্মের অন্তরায় বিনাশী সংঘ। মুসলমানকে ডাকার কথা কিন্তু কারও মনে ছিল না।
১৮৯৯ সনে মিত্রমেলা' নামে একটা সংগঠন হয়, তাতেও মুসলমানদের নেয়া হয়নি। আর একটি দল সৃষ্টি হল যার নাম ‘অভিনব নব্য ভারত সংঘ'-এখানেও মুসলমানরা উপেক্ষিত। ১৯০৬-এর প্রথম দিকে সৃষ্টি হয় অভিনব ভারত সংঘ', তাতেও মুসলমানের যাওয়ার উপায় ছিলনা। আবার একটি দল তৈরি হল যার নাম ‘গোয়ালিয়র নব ভারত সংঘ'। কিন্তু মুসলমান সব জায়গায় উপেক্ষিত। তারা যেন ভারতের কেউ নয়। মনে রাখার কথা, তখন কিন্তু পাকিস্তানের পরিকল্পানাই হয় নি।
তারপর হিন্দু মহামেলা’ ও ‘হিন্দুমেলা' নামে দুটি দল তৈরি হল। এভাবে নানা হিন্দু সংগঠন মুসলমানদের বাদ দিয়েই চলতে লাগল। এসব সংগঠনের কর্মী ও সভ্যরা ব্যায়ামের নাম করে অস্ত্রশিক্ষা শুরু করেন। তারা তখন ভেবেছিল তাতেই ভারতের উন্নতির চরমতম। সুফল পাওয়া যাবে। কেমনভাবে ট্রেনিং চলত সে সম্বন্ধে সুপ্রকাশ রায় এর পুস্তক হতে তুলে ধরছি : “... আর আন্দোলনের মধ্যে থাকবে আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা লক্ষ্যভেদের অভ্যাস, তরবারি শিক্ষা, বোমা ও ডিনামাইট তৈরি শিক্ষা, রিভলভার সংগ্রহের ব্যবস্থা, বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা করা এবং অপরকে শিক্ষা দেয়া।” কিন্তু দুঃখের বিষয় এ অপরকে শিক্ষা দেয়ার মধ্যে মুসলমান জাতি যেন মানুষ বলে গণ্য ছিলনা, ছিল জড় পদার্থ অথবা বিদেশী শুত্রু বা অন্য কিছু।
বঙ্কিমের আদর্শে অরবিন্দ ঘোষের বিখ্যাত বই ভবানী মন্দির' রচিত হল ১৯০৫ সনে। এতে মুসলমানরা আরও হতাশায় ডুবে গেলেন। তারা বুঝতে পারলেন তাদের সামনে শুধু অন্ধকার। তাই তারা হয়ত বাধ্য হয়েই বাঁচার পথ খুঁজলেন এবং ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে মুসলিম লীগের জন্ম দিলেন। মুসলমানরা কেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বা স্বদেশী আন্দোলনে আশানুরূপভাবে যোগ দেননি তার কারণ বলতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন : “আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয়নি, বিরুদ্ধে ছিল।
জননায়কেরা কেহ কেহ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন-ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি ওরা (যোগ্য) দেয়নি। কিন্তু কেন দেয়নি? তখন বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য। কিন্তু এতবড় আবেগ শুধু হিন্দু সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল না, মুসলমান সমাজকে স্পর্শ করল না। সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয়নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।... আমি যখন আমার জমিদারীর সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলাম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানার এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলাম? ' এ কেন?' তখন জবাব পাইলাম, যে সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায়, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক।
এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে আসছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। মুসলমানও মেনেছে। জাযিম তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তারপর ওদের ডেকে একদিন বলেছি? আমরা (তোমার) ভাই, তোমাকেও আমার সাথে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে। তখন হঠাৎ দেখি, অপরপক্ষ লাল টকটকে নতুন ফেজ মাথায় নিয়ে বলে, আমরা পৃথক। আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়? বাধা এ জাজিম তোলা আসনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোট নয়। ওখানে অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪)
ডক্টর শ্রী আম্বেদকর লিখেছেন, “বাঙালী হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করার প্রধান কারণ ছিল, পূর্ববঙ্গে বাঙালী মুসলমানেরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে সে আখাঙ্কার দরুণ। (দ্রষ্টব্য পাকিস্তান অর পার্টিশন অফ ইণ্ডিয়া-ইংরেজির অনুবাদ, পৃষ্ঠা ১১০)
ভারত বর্ষে মুসলমান সংখ্যা লঘু হলেও অবিভক্ত বঙ্গে মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ট দল। মুসলমান জাতির এ আন্দোলনে যোগ না দেয়ার কারণ শুধু এটাই নয় যে শতাধিক বছরের মুসলিম প্রভাবিত স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোতে হিন্দুরা আশানুরূপ যোগদেননি তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। বরং এ বঙ্গভঙ্গ হওয়া অনেকের মতে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল ছিল। তাই একজন আইনজীবি লেখকের উদ্ধৃতি দিচ্ছি-“এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলমান বিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এ আন্দোলনের তাগিদে যে সকল সন্ত্রাসবাদী বা বিপ্লব বাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন, তারা সকলেই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমান বিরোধী। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম' বইতে লিখেছেন? বিপ্লব বাদীরা যে শ্রেণী থেকেই আসুন না কেন প্রত্যেকেই ছিলেন মুসলমান বিরোধী। (ভারত কি করে ভাগ হলঃ বিমলানন্দ শসমল, পৃষ্ঠা ২১)
তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, কংগ্রেস দলের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের উপর মুসলমানদের আস্থা রাখা কঠিন ছিল। কারণ-“প্রকৃতপক্ষে বড় লাটের সাহায্যে সংগোপনে রচিত পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ও পরিচালনায় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ গণশক্তির, পুঞ্জীভূত ক্রোধ হতে ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করবার জন্য অস্ত্ররূপে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আয়োজন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ হতে ভারতের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার এ প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন বিপ্লবকে (কৃষক বিদ্রোহকে) পরাজিত করা, অথবা আরম্ভের পূর্বেই তা ব্যর্থ করা”। (R. P. Dutt : India Today p. 289-90)
কংগ্রেসের সভাপতি ১৮৮৫-র ২৯ ডিসেম্বর তার ভাষণে বলেছিলেনঃ “এটা বোধ হয় অনেকের কাছে নতুন সংবাদ যে ভারতীয় কংগ্রেস-যা প্রথমে সৃষ্ট হয়েছিল-এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছে-সেটি বাস্তবিক পক্ষে লর্ড ডাফরিনের দ্বারা হয়েছিল, যখন এ মহাপ্রাণ ভারতের গভর্ণর জেনারেল ছিলেন .... লর্ড ডাফরিন হিউমের সাথে এ শর্ত করেছিলেন যে, যতদিন তিনি ভারতে থাকবেন, ততদিন কংগ্রেস সম্পর্কিত তার নাম সাধারণ্যে প্রকাশিত হবেনা। তার এ শর্ত অক্ষরে অক্ষরে প্রতি পালিত হয়েছিল।” (জাস্টিস্ আঃ মওদুদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৬)
অবশ্য এ কংগ্রেস অনেক পরে ইংরেজ-বিরোধী মনোভাব সৃজন করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে কংগ্রেসের চরমপন্থী অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদী দলে যে মুসলমানদের মোটেই যাওয়া চলেনা তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। তাই বলে এ নয় যে, ১৯০৫-এর পর থেকেই মুসলমানরা সামগ্রিকভাবে ইংরেজদের সাথে সংগ্রাম বন্ধ করে দেয়, বরং ১৯২১ পর্যন্ত মুসলমানরা (মোপলা) কিভাবে বিপ্লব চালিয়েছিল তার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। ১৯২১-এর পরও ১৯৪৭ পর্যন্ত মুসলমানরা একইভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন, কোনভাবেই তাদেরকে বিপ্লব থেকে যে বিরত করা যায়নি-সে আলোচনা পরে আসছে।
বর্তমানে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য যদি কেহ প্রস্তাব করেন-মুসলমানরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, বন্ধু হবার যোগ্য, তাদের সাথে মিলনের প্রয়োজন আছে-তা মেনে নেয়া অনেকের পক্ষে অকল্পনীয়। শ্মশান হতে স্বয়ং মহাকবি রবীন্দ্রনাথ বললেও না। অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন-“মুসলমানদের চরিত্রে যে স্বাভাবিক সরলতা আছে তাহা স্বীকার করিবার উপায় নেই। তাহাদের গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি যে তাহাদিগকে জীবনযুদ্ধে বিজয় লাভের ক্ষমতা দিয়াছে, তাও নিঃসন্দেহে। যে সকল মুসলমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে
আসবার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের সকলকেই আমি ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি তাদের সংখ্যা কম নহে। আমার চিরদিনের বিশ্বাস এ যে, প্রধানতঃ মুর্খতা ও প্রাচীন যুগীয় যুক্তিহীনতাবশতই আমরা পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি এবং ঘনিষ্ঠতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব দ্বারা সেই ভেদ বিভেদ দূর করা সম্ভব।” (দ্রষ্টব্য বরীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও আম্বেদকরঃ জগদীশচন্দ্র মণ্ডল, পৃষ্ঠা ৯৭)
কোন অমুসলমান যদি বলেন, মুসলমানদের বাদ দিয়েই তখন কংগ্রেসের চরমপন্থীরা চলতে চাচ্ছিলেন তাহলে তা শ্রুতিকটুই লাগবে। কিন্তু একজন হিন্দু আইনবিদ, বিমলানন্দবাবু লিখেছেন, “চরমপন্থীরা ভেবেছিলেন, মুসলমান না এলেও ক্ষতি নেই, তারাই একা স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু গান্ধীজী দেখলেন, মুসলমানদের সমর্থন না পেলে ভারতের স্বরাজ আন্দোলন সম্পূর্ণ সফল হতে পারবে না। কি করে স্বরাজ আন্দোলনকে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যায়, তিনি তার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন ... মুসলমানদের তরফ থেকে খিলাফত কমিটি ঠিক করলেন বড় লাটের সাথে দেখা করে তাদের দাবীগুলো তার কাছে উপস্থিত করবেন,-দাবী না মানলে সারা ভারত বর্ষে আন্দোলন করা হবে।
১৯২০-র ১ আগষ্ট খেলাফত কমিটির অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবার কথা ছিল (বরাবর মুসলমান বিপ্লবীরা যেমন হিন্দুদের টানতে চেষ্টা করার ইতিহাস পিছনে রেখে এসেছেন এবারও হিন্দুদের একজনকে তাদের সাথে নিয়ে শুধু চেয়ারে বসা নেতা নয়, প্রকৃতই নেতা করার পর জনসাধারণ যদি যোগ দেন তাহলে বিপ্লব বা সংগ্রাম সার্থক হবে-সেজন্য গান্ধীজীকে দলে আনার প্রস্তাব দেন : লেখক)। গান্ধীজী এ খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব করতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু খিলাফত আন্দোলনের উদ্যোক্তারা মৌলানা মহম্মদ আলি ও মৌলানা শওকত আলির নেতৃত্বে ইংরেজের বিরুদ্ধে অসহযোগের প্রস্তাব আগেই গ্রহণ করেছিলেন।
এমনকি তারা প্রকাশ্য সভায় প্রস্তাব পাশ করে মুসলমান জনসাধারণকে ভারতস্থ ইংরেজ সেনাদল থেকে পদত্যাগ করে ভারতীয় আর্মির সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করে স্বধর্ম রক্ষার জন্য আবেদন জানালেন। এটা ছিল প্রকাশ্য রাজদ্রোহ। আলি ভ্রাতৃদ্বয় এর আগেই রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে অন্তরীণ জীবনযাপন করে এসেছিলেন। গান্ধীজীর উদ্দেশ্য ছিল, খিলাফত (মুসলমান) আন্দোলনেযোগ দিয়ে তার বৃহত্তর অসহযোগ আন্দোলনে মুসলমানদের সহযোগিতা লাভ করা। কিন্তু হিন্দু সাধারণ এবং বেশির ভাগ নেতৃস্থানীয় হিন্দু খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না এবং এর সংস্পর্শ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।” (দ্রষ্টব্য বিমলানন্দ শাসমল : ভারত কি করে ভাগ হল, পৃষ্ঠা ২৯)
কংগ্রেসীরা কিন্তু তখনও পর্যন্ত স্বাধীনতা' কি পদার্থ তা চিন্তা করতে ভরসা করতেন না। তাই বিমলানন্দবাবু বলেছেন, “কংগ্রেসের নেতারা প্রায় এক বাক্যে বললেন, ডোমিনিয়ন স্টেটাসস পূর্ণ স্বাধীনতার চেয়ে ভাল; কিন্তু খিলাফত-এর মুসলমান নেতারা বললেন, পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য।” (বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৩০)
গান্ধীজী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৯ খৃস্টাব্দে আর তার মৃত্যু ১৯৪৮-এ। তার রাজনৈতিক উন্নতির মূলে ছিল মুসলমানদের উদার আগ্রহ; তাঁরাই তাঁকে খিলাফত কমিটির নেতা করে দেয়া, মহাত্মা' উপাধি দেয়া এবং সারা ভারতে তাকে প্রদর্শন ও উপস্তিত করে মুসলমানদের মনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। গান্ধীজী মানুষ হিসেবে ছিলেন, নরম মনা, অসাম্প্রদায়িক এবং মানুষ প্রেমিক। সে জন্য চরমপন্থীদের ডাকাতি ও গুপ্তহত্যা তিনি মোটেই মেনে নিতে পারেন নি। চরমপন্থীরা সম্মুখ সমরে না গিয়ে শত্রুকে গুপ্তভাবে হত্যা করতে চাইতেন বা করতেন, অবশ্য তাকেও অনেক স্বীকৃতি দিয়েছেন। গুপ্তহত্যার কয়েকটি নমুনা দেয়া যেতে পারে-যেমন ইংরেজের গোয়েন্দা অফিসার সামসুল আলমকে হত্যা করা হয়। ময়মনসিং-এর পুলিশ অফিসার রাজকুমার নিহত হন। হরিপদ কলকাতার সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিহত হন। রতিরাল রায়, নৃপেন ঘোষ, সত্যেন সেনও নিহত হন ছোরা ও বন্দুকের
গুলিতে। এভাবে রামদাসকেও হত্যা করা হয়। যাদের হত্যা করা হত বেশির ভাগ তারা ইংরেজ কর্মচারি অথবা পার্টির বিরুদ্ধে তথ্য প্রকাশ করার অভিযোগে অভিযুক্ত। আবার এমন গুপ্তহত্যাও হয়েছে যার কারণ এ সবের মধ্যে নয়-১৯১৩ খৃষ্টাব্দের ২০ মার্চ নিমেজ গ্রামের একটি মন্দিরে ডাকাতি করতে গিয়ে মন্দিরে মোহন্তকে ভুলবশত হত্যা করা হয়। (দ্রষ্টব্য সুপ্রকাশ রায়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৮)
গান্ধী এমন চরিত্রের মানুষ ছিলেন যে, ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের নিহত হবার ঘটনা তো দূরের কথা, অত্যাচারী ইংরেজদের কারও নিহত বা আহত হবার সংবাদে তিনি আঘাত পেতেন। সুতরাং সন্ত্রাসবাদীদের সাথে আন্তরিকতার সাথে হাত মেলান তার পক্ষে কখনও সম্ভব ছিলনা। ওদিকে সন্ত্রাসবাদী দলের জনপ্রিয়তা ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগল।
এটা সত্য। যে, তখন গান্ধীজীর চেয়ে লোকমান্য তিলকের নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি ছিল। গান্ধীর বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হল-তিনি প্রকৃত হিন্দু নন, বেদ পুরাণ মানেন না এবং মুসলমানদের গো-মাংস খাওয়ার তিনি পক্ষপাতী। তখন তিনি ইয়ং ইণ্ডিয়া' পত্রিকা, ১২.১০.১৯২১-এ এ গুজবগুলোর ইংরেজিতে উত্তর দিয়ে তা খণ্ডন করলেন। ইংরেজি বক্তব্যের অনুবাদ-“আমি নিজেকে সনাতনী হিন্দু বলি যেহেতু (ক) আমি বে, উপনিষদ, পুরাণ অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্র বলতে যা কিছু বোঝায়-সুতরাং অবতারবাদ এবং পুনর্জন্মও বিশ্বাস করি; (খ) বৈদিক বিধান সম্মত বর্ণাশ্রমধর্ম আমি বিশ্বাস করি, অবশ্য প্রচলিত অবস্থায় আমার আস্থা নেই; (গ) প্রচলিত অর্থে নয় বৃহত্তর অর্থে আমি গোরক্ষা-নীতি সমর্থন করি; (ঘ) মূর্তিপূজা আমি অবিশ্বাস করিনা।” (পনরই আগষ্টঃশ্রী সত্যেন সেন, পৃষ্ঠা ১০৬) প্রথম মহাযুদ্ধের পর মাওলানা মুহাম্মদ আলির নেতৃত্বে মুসলমান জাতির গান্ধীর সাথে সহযোগীতায় হিন্দু-মুসলিমে যে মিলন সৃষ্টি হয় তাতে ইংরেজ খুব ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মাওলানা মুহাম্মদ আলি, শওকত আলি ও হোসাইন আহমদ মাদানী সাহেব প্রমুখ মনীষীগণ সৈন্যদের মধ্যে আবার বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করলে তিনজনকেই ৬ বছর করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এখানে দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, গান্ধীর চেয়ে বড় তো দূরের কথা, মাওলানা মুহাম্মদ আলীকে তাঁর সমপর্যায়েও স্থান দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, তাদের নাম সরকারি ইতিহাসে আজ অবলুপ্ত বললেও ভুল হবেনা।
আবদুল আলী খানের তরুণী পত্নীর কোলে মহাম্মদ আলী যখন 'বছরের শিশু শওকত আলীর বয়স তখন সাত বছর। তাদের এ অবস্থায় রেখে আবদুল আলী খান মারা যান। ২৭ বছর বয়সের বিবি আম্মা আবিদা বানু ছেলেদের ধর্মীয় ধারণা পাকা করে উচ্চ ইংরেজি শিক্ষা দেয়ার জন্য বিলেত পাঠান। দেশে ফিরে মহাম্মদ আলী চাকরি গ্রহণ করেন। তারপর দেশেরই প্রয়োজনে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। কমরেড' ও ‘গুপ' (GUP) নামক দুটি পত্রিকা তিনি পরিচালনা করতেন। কমরেড পত্রিকার উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দু-মুসলমানে মিলন সৃষ্টি করা। ইংরেজিতে এ দুখানা পত্রিকা ছাড়াও হামদর্দ' নামে একটি উর্দু পত্রিকাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্যতম অগ্রদূত মাওলানা মুহাম্মদ আলী ৫০০ উলামার স্বাক্ষর করিয়ে এ মর্মে ইশতেহার প্রচার করেছিলেন যে, স্কুল, কলেজ, অফিস এবং সমস্ত ব্যাপারে ইংরেজের সাথে সম্পর্ক পরিত্যাগ করতে হবে।
নেহেরু-রিপোর্টে মুসলমান স্বার্থ বিরোধী কথা দেখে তিনি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে নভেম্বর মাসে তিনি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ভারত বর্ষে থাকাকালীনই গোটা ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য তিনি অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে যক্ষাকাশে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে অবস্থাতেই তিনি সেখানে যান। আলোচনায় তিনি তার বক্তব্যের মধ্যে বলেছিলেন। স্বাধীনতা না নিয়ে গোলামের (ইংরেজ শাসিত) দেশে আর ফিরব না। হয় তোমাদেরকে ভারতের স্বাধীনতা দিতে হবে নতুবা আমাকে এখানেই কবর দিতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, আমি এখানে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন ভিক্ষা করতে আসিনি; আমার একমাত্র কাম্য পূর্ণ স্বাধীনতা এবং পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যই আমি এখানে এসেছি। তিনি আরও বললেন, জওহরলালকে স্বাধীনতার
কথা উচ্চারণ করতে দেননি মতিলাল নেহেরু। ১৯২৮ সনে যখন স্বাধীনতার জ্বলন্ত আগুন, তখন জওহরলালকে কলকাতাতে তাঁর পিতাই গলা টিপে ধরেছিলেন। জওহরলালেরও জন্য আমি বলেছিলাম, বিড়াল হয়ে জন্ম নিয়ে তবুও তোমার পিতার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ কর না। ... তখন আমি দাড়িয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী জানিয়েছিলাম। নেহেরু-রিপোর্টের যে দফায় ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর উল্লেখ ছিল সে দফার প্রতিবাদ করেছিলাম আমিই।
বক্তৃতা করতে করতে তাঁর আরও রক্তক্ষরণ হয়। ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর ঠিকপূর্ব মুহূর্তে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলন সূত্রের একটি খসড়া তৈরি করেছিলেন। সেটা আর তাকে শেষ করতে হয়নি। ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে ৪ জানুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন। খেলাফত কমিটির সাথে কংগ্রেসের বিরাট পার্থক্য ছিল যথাক্রমে পূর্ণ স্বাধীনতা ও ডোমিনিয়ন স্টেটাস বা স্বাসয়ত্তশাসন নিয়ে। ১৯২১ সনে আমেদাবাদে কংগ্রেসের অধিবেশনে সৎ সাহস কিংবা দুঃসাহস নিয়ে যে বেচারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির কথা উত্থাপন করেন তার নাম মাওলানা হযরত মোহানী।
সঙ্গে সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলে ফেললেন, “....The demand has grived me because it shows lack of responsibility." অর্থাৎ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি আমাকে বেদনা দিয়েছে, কারণ, প্রস্তাবটি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। এভাবে মুসলমানরা বারে বারে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছেন। আবার ১৯২২ খৃষ্টাব্দে লক্ষ্ণৌতেও খেলাফত এবং উলামাদের জমিয়ত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান হয় এবং প্রস্তাব নেয়া হয় যে, “ভারত বর্ষ এবং মুসলমানদের স্বার্থের খাতিরে এখন হতে কংগ্রেসের মূলমন্ত্র ‘স্বরাজের পরিবর্তে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা' হওয়া উচিত।” এবারেও কংগ্রেস এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বলল, “এতদ্বারা কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের আমুল পরিবর্তন হবে।”
“এদিকে গান্ধীজী ১৯২২ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দেন। ফলে, খিলাফত আন্দোলনের ভিতর দিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের যে মিলন-ক্রমশ দানা বেধে উঠেছিল তা ভেঙ্গে গেল।” (দ্রঃ সত্যেন সেন : পুনরই আগষ্ট, পৃষ্ঠা ১০৬)
১৯৪৬ খৃষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি বোম্বেতে তলোয়ার ট্রেনিং স্কুলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ১৯ তারিখ সকাল বেলায় বিশ হাজার জল জাহাজ কর্মী কংগ্রেসের পতাকা ও মুসলিম লীগের পতাকা উড়িয়ে বিপ্লব শুরু করতে চায়। সংবাদ পেয়ে ইংরেজ সরকার ভারতীয় সৈন্য পাঠায় তাদের গুলি করার জন্য। কিন্তু ভারতীয়রা ভারতীয়দের বুকে যখন গুলি করলেন না, তখন ইংরেজ সৈন্যই এগিয়ে এল। বিপ্লবীরা প্রস্তুত হলেন মোকাবিলা করার জন্য কিন্তু কংগ্রেস ও লীগ কেহ ‘এগিয়ে যাননি।
জনগণ হরতাল পালন করতে চাইলে কংগ্রেস নেতা সর্দার প্যাটেল তা নিষেধ করেন। শুধু তাই নয় প্যাটেল ধর্মঘটীদের ইংরেজের পদতলে আত্মসমর্পণ করতে বললেন। ইংরেজ সেনাপতি সমস্ত নৌবিভাগীয় বিপ্লবীদের খতম করার জন্য তৈরি হলেন অথবা ভয় দেখালেন। আর এদিকে সর্দার প্যাটেল একটা বিবৃতি দিয়ে বললেন, “নৌ-বাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে (ইংরেজ) প্রধান সেনাপতির অভিমতকে অভ্যর্থনা করলেন। (দ্রষ্টব্য সত্যেন সেনের পনরই আগষ্ট, পৃষ্ঠা ৪২)
বর্তমান ইতিহাসে কথিত জাতির জনক' করমচাঁদ গান্ধী ইংরেজের প্রতি বেশ দরদ রাখতেন। তাঁদের উপর বিপ্লবীদের দ্বারা কোন চাপ এলেই তিনি অহিংসা নীতি’ প্রয়োগ করতে চাইতেন। ইংরেজকে যত তাড়াতাড়ি তাড়ান যায়-কোটি কোটি মানুষের সাথে সুভাষ বোস ও চিত্তরঞ্জন দাশ পর্যন্ত যখন এ সুর তুললেন তখন হতেই এ সমস্ত নেতাদের সাথে তার মতের গরমিল ও ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়। ১৯৪৬ সনের ৭ জুলাই বোম্বাইয়ে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ মহাসম্মেলনে এ একচ্ছত্র নেতা গান্ধীজী বলেছিলেন, ইংরেজরা ভারত ছাড়বার জন্য নিজেরাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের শান্তিতেই যেতে দেয়া উচিত, আন্দোলন করে তাদের যাবার পথে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়” (দ্রষ্টব্য সত্যেন সেন পুনরই আগষ্ট, পৃষ্ঠা ৫৮)
গান্ধীজীর এ উক্তি তার দয়ালু মনের পরিচয় দেয়; কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাদের মান নির্ণয়ে এ উক্তির মূল্য ও প্রয়োজন কতটুকু তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। এমনিভাবে বিখ্যাত নেতা সর্দার প্যাটেল এ সময়ে বললেন, “ইংরেজের সাথে সংগ্রামের আর প্রয়োজন নেই। তারা ভারত বর্ষকে স্বাধীনতা দিবে বলে স্থির করেছে।” (দ্রষ্টব্যঃ সত্যেন সেন, পৃষ্ঠা ৫৯)
তখনকার প্রভাবশালী নেতা রাজাগোপালাচারী ২৬ নভেম্বর জামসেদপুরে বললেন, “আমরা তো ইতিমধ্যেই স্বাধীন হয়ে গিয়েছি।...একদল রোগী আছে-যারা আরোগ্য লাভ করেও মনে করে অসুখ সারে নাই এবং তদনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে থাকে।” এর ৫, পৃষ্ঠা ৫১।
নেতৃবৃন্দের এ রকম মনোভাবের সাথে বংশানুক্রমিকভাবে মুসলিম বিপ্লবীরা সকলেই একমত হতে পারেন নি। আবার অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদীদের হিন্দু দেব-দেবী মার্কা নীতিতেও নিজেদের যুক্ত করতে পারেন নি; তার কারণ আমরা আগে বলেছি। ঐতিহাসিক সত্যেন সেনও লিখেছেন, “ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের বিশ্বাসীর চক্ষে দেখত না। রাজত্ব হারিয়ে মুসলমানগণই প্রথমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছিল।” (দ্রষ্টব্যঃ পনরই আগষ্ট, পৃষ্ঠা ১০২)
সত্যেন সেন সত্য তথ্য লিখতে গিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভুলত্রুটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে খিয়ে দিতে এতটুকু সমীহ করেন নি। তিনি লিখেছেন, “অতঃপর তিল গোহত্যা নিবারণের উদ্দেশ্যে গোরক্ষা সোসাইটি নামে একটি সমিতি সংগঠন করলেন। এতদ্ব্যতীত শিবাজী উৎসব, হস্তীমুখো দেবতা গণেশ প্রভৃতির পূজাও মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হতে লাগল। বাংলাদেশে সুরু হল ধ্বংসের দেবতা কালীর সাধনা।..... তথাপি হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপরে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করবার ফলে জাতীয় আন্দোলনের গতিধারা সম্মুখগতি অবলম্বন না করে পশ্চাদগামী হয়ে পড়ল। কারণ গো-হত্যা নিবারণ, দেবদেবীর পূজা প্রভৃতি ধর্মানুষ্ঠান কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মসূচী হলে অপরাপর ধর্মসম্প্রদায় সে প্রতিষ্ঠানকে প্রীতির চক্ষে দেখবে-তা আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। বলাবাহুল্য, এ গোঁড়া হিন্দু মনোভাবই শেষ পর্যন্ত মুসলমান সম্প্রদায়কে জাতীয় আন্দোলন হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন বহু হিন্দুও এ গোঁড়ামি বরদাস্ত করতে পেরে চরমপন্থীদের সংস্রব ত্যাগ করেন।” (দ্রষ্টব্যঃ সত্যেন সেন পনরই আগষ্ট, পৃষ্ঠা ১০০-১০১)
অবশ্য এ সমস্ত উৎকট সাম্প্রদায়িক ধারা কেমনভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের কলমের অগ্রভাগ থেকে বেরিয়ে এসেছিল তা পরিচয় দিয়েছেন তাথ্যিক লেখক সুপ্রকাশ রায়-“এভাবে বঙ্কিমের কাছ থেকে তারা (অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদীরা) লাভ করেছিল উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা। এ শিক্ষাই তারা গ্রহণ করল তাদের জাতীয়তাবাদ রূপে।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃষ্ঠা ১২৬)
বঙ্কিমের কমবেশি প্রভাব প্রত্যেক হিন্দুনেতার উপর কেন পড়েছিল, কিভাবে পড়েছিল তার সুষম ব্যাখ্যা করা এখানে উদ্দেশ্য নয়। তবু চরমপন্থীদের কথা ছেড়ে, নরমপন্থীদের ভিতরেও সাম্প্রদায়িকতা ও ছুৎমার্গতা কেমন ছিল তার নমুনা দেখাতে বলা যায়, বিশাল ভারতের কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট তখন ছিলেন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য। সেটা ছিল ১৯৩৩ সন। জাতির কাজে জনগণের সেবায় তাকে পেশোয়ার যেতে হয়। সেখানে তিনি এক কংগ্রেস কর্মীর বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রিত ছিলেন বলে আগেই বলে দিয়েছিলেন-যে পাত্রে জীবনে কখনও মাংস রাখা হয়েছে তাতে যেন তার খাবার না পাঠান হয়।
তাই তার নিমন্ত্রণকারী বাজার থেকে কিনে আনেন সম্পূর্ণ আনকোরা ডিনার সেট। আর যেহেতু পণ্ডিতজী ছিলেন নিরামিবাশী, তাই তার নিমন্ত্রণকারী বাজার থেকে যোগাড় করলেন সর্বোকৃষ্ট ধরণের কলা ও কমলাদি। ডিনার টেবিলে প্রশ্ন উঠল তখন তাকে প্রদত্ত এসব ফল বাগান থেকে টেবিলে আসার মাঝখানে কোন মুসলমান বা অচ্ছুত অস্পৃশ্য হিন্দু ছুঁয়েছে টুয়েছে কিনা। দুর্গ্যবশতঃ নিমন্ত্রণকারী সে হিন্দু কংগ্রেস-সদস্য পণ্ডিতজীকে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেন নি। ফলে, নিমন্ত্রণকারীকে সাংঘাতিক রকমে বিব্রত করে দিয়ে পণ্ডিত মালবীয়া কিছু না খেয়েই ডিনার টেবিল থেকে উঠে যান।" (চুলে যাওয়া ইতিহাস : বারিস্টার সিনি, পৃষ্ঠা ৮৪)
এর সমাধান বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সময় দিয়েছেন খুব কম। অবশ্য সমাধান অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের মিলন কিভাবে হবে যিনি নির্ধারণ করেছিলেন তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। যিনি ১৮৭০-তে জন্মে ১৯২৫ খৃস্টাব্দে উল্কার মত ছুটে চলে গেলেন পরকালের ডাকে। মুখে ভণ্ডামি না করে কাজে পরিণত করার মহান নেতা ছিলেন তিনি। তিনিও কংগ্রেসী ছিলেন, তিনিও সন্ত্রাসবাদীদের দলে গিয়েছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত নিজেকে নিজেই সংশোধন করে মেরুদণ্ড সোজা করে পুনরায় কাজে নেমেছিলেন। ১৯২৩ সনে তিনি তৈরি করলেন ‘নিখিল ভারত স্বরাজ্য দল'। “গান্ধীজীর মত চিত্তরঞ্জনও অচীরেই বুঝতে পারলেন, যেমন বাইরে তেমনি আইন সভার ভিতরেও মুসলমানদের সাহায্য না পেলে তার সংগ্রাম সফল হতে পারবে না। .... ১৯২৩ সনে সিরাজগঞ্জ প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মিলনীতে তাঁর বিখ্যাত হিন্দু মুসলিম চুক্তি সম্পাদন করলেন।
একে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট'ও বলা হয়ে থাকে। এ চুক্তির ফলে আইন সভাগুলোতে মুসলমানদের গরিষ্ঠতার অনুপাতে সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হল এবং এ ব্যাপারে কংগ্রেস ও খিলাফত কমিটির পূর্ব সম্পাদিত সর্বভারতীয় হিন্দু মুসলিম চুক্তির শর্তগুলো অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হল।.... সরকারি চাকুরিতে মুসলমানদের ৫৫ শতাংশ ও হিন্দু ও অন্যান্যের ৪৫ শতাংশের ব্যবস্থা হয়েছিল। ধর্মীয় সহনীয়তার ক্ষেত্রে এ চুক্তি কয়েকটি সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল। তার মধ্যে প্রধান ছিল-(১) নামাযের সময় মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করা চলবে না।
(২) মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশাসনের জন্য গোহত্যা হলে তাতে বাধা দেয়া চলবে না। কিন্তু হিন্দুদের মনে আঘাত লাগে এমন স্থানে গোহত্যা করা চলবে না।.... হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির একটা আবহাওয়া সৃষ্টি হল। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং জমিদার শ্রেণীর হিন্দুরা এ চুক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ও সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্দ হলেন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দল, যাদের হাতে চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসের পরিচালনার ভার অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এমনকি গান্ধীজী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্রঘোষ পর্যন্ত প্রকাশ্য বক্তৃতায় বলেছিলেন। মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে আমরা তাদের একটার পর একটা দাবী বাড়িয়ে তুলতেই সাহায্য করছি' (২৫.৪.১৯২৭-এর ‘দি বেঙ্গলী')
চিত্তরঞ্জনের হিন্দু-মুসলমান চুক্তি সম্বন্ধে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইণ্ডিয়া ইউনস ফ্রিডম' বইতে লিখেছেনঃ এ সাহসিক ঘোষণা বঙ্গীয় কংগ্রেসের ভিত্তি পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছিল। বহু কংগ্রেস নেতা তুমুলভাবে এর বিরোধিতা করলেন এবং মিঃ দাশের বিরুদ্ধে প্রচারশুরু করে দিলেন।... এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, তিনি দেহত্যাগ করার পর তাঁর কিছু সংখ্যক শিষ্য তার আদর্শকে খর্ব করে দিলেন এবং তার এ ঘোষণাটিকে বাতিল করে দেয়া হল। ফলে এটাই হল যে, বাংলার মুসলমানেরা কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়াল এবং দেশ বিভাগের প্রথম বীজ বপন করা হল।' (মূল ইংরেজীর অনুবাদ, পৃষ্ঠা ২১)-এ তথ্য এবং উদ্ধৃতি আইনজীবী লেখক বিমলানন্দ শাসমলের ভারত কি করে ভাগ হল' পুস্তকের ৩৬-৩৮ পৃষ্ঠা হতে উদ্ধৃত।
১৯২৫-এর ২রা মে চিত্তরঞ্জন দাশ ফরিদপুরে বিশাল জনসভায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথা বলেছিলেন এবং সে সাথে আরও বলেছিলেন, ডোমিনিযন স্টেটাস অপেক্ষা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিই সঠিক। এ কথা বলার ফলে সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত কংগ্রেস কর্মীদের কাছ থেকে যে অপমান ও দুর্ব্যবহার তিনি পেয়েছিলেন তা তার বুকে সহস্রমণ ওজনের হাতুড়ির মত ধাক্কা দেয়। শেষে মর্মাহত ও সোকাহত হয়ে অপুত নয়নে সভা ছেড়ে তাঁকে নেমে যেতে হয়-“কংগ্রেস কর্মীদেরকাছে দুর্ব্যবহার লাভ করে তিনি মণ্ডপ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। সন্ধ্যা বেলায় তার জ্বর হয়। তিনি অসুস্থ ছিলেন-তা বেড়ে যায়। তার অসুখ সারে নি। ১৬ই জুন দার্জিলিংয়ে তিনি দেহ ত্যাগ করেন।” (বিমলানন্দ, পৃষ্ঠা ৩৮)
চিত্তরঞ্জনের কোন পুত্র ছিল না-দেশের ছেলেমেয়েরাই যেন তাঁর পুত্র-কন্যা ছিল। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীও ছিলেন বিদুষী রাজনীতি সচেতন মহীয়সী নারী। পূর্বের কথায় ফিরে এসে বলা যায়, মুসলিম লীগ জন্মগ্রহণ করে ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে, কিন্তু তখনো মহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকা কংগ্রেসী। যখন তিনি মুসলিম লীগে প্রবেশ করলেন তখন পাকিস্তানের কথাও ওঠেনি। চিত্তরঞ্জনের চুক্তির কবর হওয়ার সাথে সাথে বড় বড় মুসলিম নেতা কংগ্রেস হতে সরে পড়লেন-যেমন বিখ্যাত সাংবাদিক ও কতকগুলো পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আকরাম খার মত মানুষেরা।
১৯২৭-এর ২৩শে ডিসেম্বর একটা সাক্ষাতকারে জিন্নাহ জানালেন, “মুসলমানরা আর কংগ্রেসকে বিশ্বাস করেনা।" (অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৫.১১.১৯২৭) চিত্তরঞ্জনের এ প্যাক্ট-এর কবর রচনায় যে কংগ্রেসী হিন্দু নেতা বাধা দিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন ব্যারিস্টার বীরেন্দ্র শাসমল। তিনি একজন নামকরা নেতা। গান্ধীর সহকর্মী। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারের মামলার আসামী অনন্ত সিং, লোকনাথ বল ও গণেশের পক্ষে বিনা টাকায় লড়ে তাদেরকে ফাসি হতে উদ্ধার করেছিলেন। তিনিই স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদককে গুলি করে হত্যা, পেডি হত্যা, বার্জ হত্যা ও আরামবাগ ডাকাতির মামলায় সন্ত্রাসবাদী আসামীদের পক্ষে বিনা পারিশ্রমিকে লড়েছিলেন।
অথচ সন্ত্রাসবাদীরা তার প্রতি এতটুকু কৃতজ্ঞতা দেখাননি। শুধু তাই নয়, কৌশল করে তাকে রাজনীতি হতে বের করে দেয়া হয় এবং আজকের ইতিহাসে তিনি উপেক্ষিত বললেও অত্যুক্তি হয়না। বীরেন্দ্র শাসমলকে কংগ্রেসের পক্ষে দাঁড়াবার মনোনয়ন পত্র দেয়া তো হলই না, তার বিরুদ্ধে অন্য প্রভাবশালী নেতা দেবেন্দ্রলালকে দাঁড় করান হল। তবু যেহেতু বীরেন্দ্রকে পরাজিত করা সহজ ছিলনা তাই চিত্তরঞ্জনের বিদূষী স্ত্রীর পক্ষ হতে শ্রী শাসমলের বিরুদ্ধে একটি ইস্তেহার ছেপে বিলি করা হয়। অবশ্য ন্যায় ও সত্যের ঘোষিকা দেশ বন্ধুর স্ত্রী তা জানতে পেরে পরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তা জাল ছিল-সেটা মোটেই তার অনুমতি নিয়ে ছাপা হয়নি। যাই হোক, বিধান রায়ের অনুরোধে ভোটের পূর্বে এ কথা গোপন রাখা হয়েছিল। (দ্রষ্টব্যঃ বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ৯৮)
. খুবই পরিতাপের বিষয়, চিত্তরঞ্জনের নাম ইতিহাসে যেভাবে থাকা উচিত ছিল সেভাবে কিন্তু রাখা হয়নি। অন্য নেতাদের জন্ম মৃত্যুতে যেমন হৈ চৈ হয়, চিত্তরঞ্জনের ক্ষেত্রে তা কিন্তু হয়না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর মৃত্যুর জন্য বলেছেন : চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু না হলে ভারত ভাগই হতনা। আর যদি তার মৃত্যুর পরেও ভারতের স্বনামধন্য নেতারা তাঁর দাস ফরমুলার' মৃত্যু না ঘটাতেন তাহলে পাকিস্তানের জন্ম নেয়া সম্ভব ছিলনা।
ভারত ভাগ হয়েছে, কিন্তু কত নিরীহ হিন্দু-মুসলমান নিহত ও আহত হয়েছেন তার হিসেব সরকারি মতে প্রকাশ করলেও তা সঠিক নয়। কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হয়েছে-কত নারী নির্যাতিতা, কত শিশু মাতা ও পিতা হারা, কত স্বচ্ছল পরিবার অভাবের বন্যায় ভেসে গিয়ে সমাজের পরমাণু হয়ে উন্নতির শিখর হতে নিচে খসে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
ভারতের হিন্দু মুসলমানের লড়াই-এর পূর্বেই মিঃ আর্ণেষ্ট সার্টি সংবাদদাতা হিসেবে যে সংবাদ তারযোগে জানিয়েছিলেন তা হচ্ছে এটাই "Enough arms and ammunitions to equip more...by laying in stocks of food." এ সংবাদের পূর্ণ বঙ্গানুবাদ হচ্ছে-“গত কয়েক বছরে দশ লক্ষ লোককে সুসজ্জিত করবার মত পিস্তল ও টমি বন্দুক ভারত বর্ষে গোপনে আমদানি করা হয়েছে। প্রকাশ যে, মুসলীম লীগ ও কংগ্রেস উভয়েই যথাক্রমে এর অর্ধেকের অধিকারী। বিশ্বস্তসূত্রে জানা গিয়াছে যে, বহু হিন্দু ও মুসলমান নিজেদের ঘর বাড়ী ঘাঁটিরূপে প্রস্তুত করতেছে। এবং সুদীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামের জন্য (প্রয়োজন হলে) খাদ্য সংগ্রহ করে রাখছে।” (দ্রষ্টব্যঃ সত্যেন সেন পনরই আগষ্ট, পৃষ্ঠা১১৮)
জিন্না পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মেনে নিলেও একথা ভুললে চলবে না যে, তিনি একজন কংগ্রেসী রাজনীতিবিদ্ ছিলেন। কংগ্রেসের উপর যে অভিযোগে তিনি মুসলিম লীগে যান তা হল-সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্য। ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ১৯১৩ খৃষ্টাব্দ হতে ১৯৩৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হিন্দু-মুসলমানের (মৈত্রীর) জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তার জন্য তাকে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদুত’ (Ambassador of Hindu-Muslim Unity) আখ্যা দেয়া হয়।" (পাক ভারতের মুসলমানের ইতিহাস, অধ্যায়-পাকিস্তানের জন্ম, পৃষ্ঠা ৮৬)
বিলেতে পাঠরত যে ছাত্রটি PAKISTAN কথাটি সৃষ্টি করেন তার নাম রহমত আলী। P-তে পাঞ্জাব, A-তে আফগান, K-তে কাশ্মীর, S-তে সিন্ধু আর বেলুচিস্তানের Tan এ আদ্যক্ষর নিয়ে তিনি শব্দটি সৃষ্টি করেন। অবশ্য এর প্রথম পরিকল্পনা দিয়েছিলেন ভারতবিখ্যাত কবি ইকবাল। তাঁকেও ইংরেজ ‘স্যার’ টাইটেল দিয়েছিলেন। কি হিন্দু, কি মুসলমান ইংরেজ সরকার যাদের স্যার টাইটেল দিয়েছেন তার প্রতি আমার সন্দেহ আছে; সেজন্য আমি দুঃখিত। তাই বলে তাদের প্রতিভা ও সৎকর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অটুট রয়েছে এবং বর্তমান আগামীতে থাকবে।
দাস ফরমুলায় ছিল মুসলমানের নামাযের সময় মসজিদের পাশে ঢোল বাজান চলবে না -এ কথাটাকে মূল্যহীন করার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বিমলানন্দ শাসমল লিখেছেন : “এ শর্তটি অকেজো করে দেয়ার উদ্দেশ্যে বরিশালের নেতা সতীন সেন পটুয়াখালিতে এক সত্যাগ্রহ আরম্ভ করলেন, যাতে প্রতিদিন সত্যাগ্রহীরা মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে যেতেন এবং এটা যে বে-আইনি কাজ করে গ্রেপ্তার বরণ করতেন। ... এ সত্যাগ্রহ সমস্ত হিন্দু সমাজে এমন সাড়া জাগিয়েছিল যে, বিপ্লবী বীর' রাসবিহারী বসু টোকিও থেকে হিন্দুদের দান হিসেবে ৪০০ টাকা চাঁদা সত্যাগ্রহ কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ কমিটির সম্পাদক অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছাপান ইস্তেহারে ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলায় গ্রামে গ্রামে মুসলমান গুণ্ডারা যে হিন্দু নারী ধর্ষণ ও হিন্দু মন্দির অপবিত্র করছে, তারই প্রতিবাদে তারা পটুয়াখালিতে মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে সত্যাগ্রহ করছেন। ... সারা পূর্ব বাংলায় এর ফলে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়ে পড়ে।” (দ্রষ্টব্যঃ বিমলানন্দ শাসমলের ভারত কি করে ভাগ হল’র পৃষ্ঠা ১১৬)
বলাবাহুল্য, এর ফলে মুসলমানরা শোভাযাত্রায় বাধা দিলেন। গুলি চলল, তাতে ২০ জন মুসলমান নিহত হলেন। বিমলানন্দ লিখেছেন : “মুসলমানরা আরও ক্ষুব্ধ হলেন যখন সত্যাগ্রহেরজনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী পটুয়াখালিতে সত্যাগ্রহের এ প্রহসন দেখেও মৌনব্রত অবলম্বন করে মৌনীবাবা সেজে গেলেন” (বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ১১০০)
এসব ব্যাপারে জিন্নাহর সুবিধেই হল। তিনি মুসলমানদের বোঝাতে পারলেন যে, হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের একত্রে থাকা আর কখনো সম্ভব নয়। এটা প্রমাণ হতে বাকী নেই যে, দেশ ভাগ হওয়ার মূল কারণ ও মহাপাপ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি। একটি চরম কথা বিমলানন্দ বাবু বলেছেনঃ “কায়েদে-আজম জিন্নার কাছে পাকিস্তানই শেষ কথা ছিলনা। সুযোগ পেলে তিনি সম্মানজনক মীমাংসায় আসতে রাজি ছিলেন। কিন্তু হিন্দু নেতাদের একগুয়েমি এবং বাস্তব সম্বন্ধে এক বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ নেতাদের এক নিরুপায় অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় এবং যখন তারা দেখলেন, হিন্দু এবং কংগ্রেস নেতাদের সাথে কোন মীমাংসা সম্ভবপর নয় তখনই তারা দেশ-বিভাগই একমাত্র সমাধান বলে মনে করলেন। মুসলমানরা প্রথম থেকে স্বতন্ত্র স্বাধীন বাসভূমি কখনই চাননি।” (বিমলানন্দ শাসমল, পৃষ্ঠা ১৭৮)
আমাদের মতে, সত্যাগ্রহের ব্যাপারে গান্ধীজীর মৌনতার কথা বিমলানন্দ বাবু বললেও তখন তার মৌনতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় ছিলনা। আর জিন্নাহ দেশ ভাগ করার নীতি নিয়ে না চললে তার পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হওয়া যেত কি করে? সে সাথে বিরাট এক সম্মানীয় দল মন্ত্রী হতে পারতেন কি করে? সে সময় দু' দেশে যারা নেতা হলেন তারা বোধহয় তখন চিন্তা করতে সক্ষম ছিলেন না যে, নিরীহ ভারতীয়দের কত শত মণ রক্ত কত শত বছর ধরে ঝরতে থাকবে!
জিন্নাহ এবং গান্ধী একই বংশের লোক ছিলেন। গঙ্গানারায়ণ চন্দ্রের ভাষায়-“মিঃ মহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও শ্রী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর পিতামহ ছিলেন এক সম্প্রদায়ভুক্ত গুজরাটী হিন্দু। কোন বিশেষ কারণে মিঃ জিন্নার পিতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে করাচীতে বসবাস করেন। ১৮৭৬ সনে বড়দিনের মিঃ জিন্নার জন্ম। গান্ধীজীর মতই অল্প বয়সে তার বিবাহ। পনের বছর বয়সে তিনি এগার বছরের এক বালিকার পাণিগ্রহণ করেন। পরের বছর আইন পড়তে চলে যান লণ্ডন।..গান্ধীজীও তের বছর বয়সে দশ বছরের বালিকা শ্রীমতী কস্তুরাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন।" (দ্রষ্টব্য, গঙ্গানারায়ণ চন্দ্রঃ অবিস্মরণীয়, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫)
কংগ্রেস করতে করতে ১৯২০ খৃস্টাব্দে গান্ধীর সাথে জ্বিন্নার মত পার্থক্য হয় ‘অহিংসা ও আবেদন নিবেদন'-কে কেন্দ্র করে। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্ন সংগ্রাম করতে-এ প্রস্তাবে কংগ্রেস কর্মীরা তাঁকে মুসলমান' বলে, “মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত' বলে বিদ্রুপ করলেন। “গান্ধীজী এ নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপ উপভোগ করলেন, কোন প্রতিবাদ করলেন না। মিঃ জিন্না ক্ষোভে দুঃখে কংগ্রেস ছাড়লেন। তিনি বুঝলেন যে, গান্ধীজী থাকতে তিনি কোনদিনই হিন্দু কংগ্রেসে প্রাধান্য পাবেন না।” (দ্রষ্টব্যঃ গঙ্গানারায়ন, ঐ, পৃষ্ঠা ৬)
জিন্নার যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত নেতা খান আবদুল গফফার খান, ফজলুল হক, পাঞ্জাবের ফজল হোসাইন, বিহারের সৈয়দ আবদুল আজিজ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ। তাই জিন্নার মনে আবার মিলনের কথা এল। তিনি গান্ধীজীকে অনুরোধ করেছিলেন ঐক্যের জন্য- “কাজেই ১৯৩৭ সনের ২ মে মিঃ জিন্না গান্ধীজীকে অনুরোধ করলেন হিন্দু-মুসলমান-ঐক্য সমস্যার সমাধানের জন্য” (দ্রষ্টব্য গঙ্গানারায়ণ, পৃষ্ঠা ১১)
অথচ এ প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা জিন্নাকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে তাতে মনে হয়, তিনি একাই যেন পাকিস্তান করেছেন, আর বাকী সকলেই ছিলেন সাধু ও নির্দোষ। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া করে ব্যরিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৯১২-তে। তিনি গান্ধীর ভক্ত হলেও অনেক সময় পার্থক্য দেখা যেত। তবে একথা সত্য যে, জওহরলালের চরিত্রেও গান্ধীর মত সাম্প্রদায়িকতার গন্ধযুক্ত কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। গান্ধীজীর সাথে সুভাষ বসুর মত পার্থক্য ঘটে ঠিকই, কিন্তু সুভাষের জনপ্রিয়তা গান্ধীর মতই হু হু করে বেড়ে উঠেছিল।
নানা চাপে পড়েও এ অসাম্প্রদায়িক মানুষটির হিন্দু-মুসলমান তথা সারা ভারতবাসীর স্বার্থে স্বরাজ বা আধা স্বাধীনতা ডোমিনিয়ন স্টেটাস' মোটেই চাননি; তিনি চেয়েছিলেন পূর্ববর্তী নেতা ও তখনকার মুসলিম নেতাদের মত ইংরেজ বিবর্জিত পূর্ণ স্বাধীনতা। আর তাই সুভাষ বোসকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য জওহরলালের গান্ধীজীর প্রতি সীমাহীন ভক্তি ছিল বলে মূল বিষয়ে অর্থাৎ অহিংসা নীতির সাথে তার বিরোধ ছিলনা। তিনি সর্ব ভারতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন মোট পাঁচ বার। আর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য তারই হয়েছিল। তিনি লেখক হিসেবেও স্বীকৃত। তাঁর লেখা Autobiography. Glimpses of World History. Soviet Russia, Discovery of india নাম করা বই প্রথমে তিনি কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন না। একদিন সিমলার হোটেল থেকে তাকে ও তার স্ত্রী কমলা নেহেরুকে শাসক ইংরেজ অন্যায় করে বের করে দেয়। হুকুম হয়েছিল চার ঘন্টার মধ্যে
হোটেল ছাড়তে হবে, কারণ তাদের মিটিং হবে এবং তাতে ভারতীয় কেহ থাকবে না। তিনি তাই দুঃখে, লজ্জায় ও অপমানে কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দিলেন। (গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র। অবিস্মরণীয়, পৃষ্ঠা ১৭) গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র নিজেও একজন প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি লিখেছেন, গান্ধী ও সুভাষের বিরোধ যখন ঘনীভূত হয়ে উঠল সে সময় তিনি কিছুদিনের জন্য বেরিয়ে পড়লেন ইউরোপ ভ্রমণে। এটা সংগ্রামের আসন্ন প্রস্তুতি না সংকট এড়াবার উপায় লোকে তাই চিন্তা করতে লাগল।”
পরে ১৯৩৯-এ সুভাষ বসু কংগ্রেস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গান্ধীর প্রার্থী সীতারামিয়ার বিরুদ্ধে ভোট পেলেন ১৫৮০ আর বিপক্ষে ভোট পড়ল ১৩৭৫। সবাই বুঝতে পারল গান্ধীর সাথে সুভাষের পার্থক্য। গান্ধীজীও বিচলিত হয়ে বললেন : সীতারামিয়ার পরাজয়ের চেয়ে আমারই পরাজয় বেশী।” (অবিস্মরণীয়, পৃষ্ঠা ২৭) কিন্তু অবশেষে নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল বেশ বেড়ে গেল। পদলোভশূন্য সুভাস বসু ১৯৩৯-এর ২৯ এপ্রিল পদত্যাগ করলেন। সত্যিকারের নেতা সুভাষ নিজের ব্যক্তিগত মর্যাদার দিকে না তাকিয়ে গান্ধীজীর কাছে আবেদন করলেন? এটাই সুবর্ণ সুযোগ! আপনি একটু মতের পরিবর্তন করুণ, ইংরেজকে একটা বড় আঘাত হানি। কিন্তু “গান্ধীজী বললেন, ইংরেজকে ধ্বংস করে আমরা স্বাধীনতা চাই না-অহিংসা সংগ্রামের নীতি এ নয়। তার শিশু প্রতিনিধি পণ্ডিত নেহরু ২০ মে দেশবাসীকে শোনালেন যে, যে সময় ইংলণ্ড জীবন মরণ সমস্যায় উপনীত হয়েছে তখন আইন অমান্য আন্দোলন ভারতের পক্ষে হানিকর।” (অবিস্মরণীয়, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭)
গঙ্গানারায়ণবাবু ‘অবিস্মরণীয়’তে আরও লিখেন, “নিরুপায় বিপন্ন মাওলনা আজাদ বললেন, এটা আপোষের কথা-স্বাধীনতার নয়। তিনি তখন সভাপতি হিসেবে বলতে বাধ্য হলেন যে, কংগ্রেস আপোষ করা সমিতি নয়-ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সংস্থা। অনন্যোপায় হলে ভারতবাসীর অস্ত্রধারণেরও অধিকার আছে।” (গঙ্গানারায়ণ :অকিরণীয়, . ২৮) সুভাষ বসু ১৯৪১ সনে কার কথায়, কার পরামর্শে যেন ভারত ত্যাগ করে পৌঁছালেন কাবুলে। আগেই সুভাষের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয়েছিল মৌলবী জিয়াউদ্দীন-এ নাম পরিবর্তন করলেন কে?
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে লড়তে লাগল। লড়াই হল হিন্দু আর মুসলমানের; অথচ লড়াই হওয়া উচিত ছিল হিন্দু ও মুসলমান এক হয়ে শাসকের সাথে। ভারতে চলল কাটাকাটির তাণ্ডব লীলা-শুধু মরে হিন্দু আর মুসলমান।
এদিকে নেতাজী পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য ছুটছেন জার্মানী জাপান আর চেষ্টা করছেন বাইরে থেকে ভারতকে কিভাবে আক্রমণ করা যায়। জাপান সুযোগ পেল সুভাষকে দিয়ে একটা কাজ হাসিল করার। সুভাষও ভাবলেন জাপানকে দিয়ে কাজ হাসিল করে ভারতে তিনি সশস্ত্র আক্রমণ হানবেন, এগিয়ে যাবেন তার সাধের আজাদ হিন্দ বাহিনীর হিন্দু মুসলমান বীর সৈন্যেরা।
'সারা ভারতের তথা সারা পৃথিবীর হিন্দু মুসলমানের কানে কানে তার কথা পৌঁছে দেয়ার দরকার হল বলে দুটি বেতার কেন্দ্র খুললেন-কংগ্রেসকে খুশী করার জন্য। একটার নাম দিলেন কংগ্রেস রেডিও আর অফুরন্ত স্বাধীনচেতা মুসলমানদের খুশী করতে দ্বিতীয়টার নাম হল আজাদ মুসলিম রেডিও।'
সুভাষ যেন প্রাণ ছিলেন আজাদ হিন্দের; আর দেহটির মস্তকের মত তিনি যাকে নির্ধারণ করেছিলেন তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত যুদ্ধবি মেজর আবিদ হোসেন-খাকে সাথে করে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত গোপনে জার্মান সাবমেরিনে চড়ে ঘাঁটি ছাড়েন। ফাঁসির আসামীর মত
রবারের ডিঙ্গিতে কিভাবে জাপানের টোকিও পৌঁছল সে বড় বিস্ময়কর ইতিহাস। সুভাষ বসুর আরও শুধু সহকর্মী নয়, সহযোগী বীর বিপ্লবী কমাণ্ডার ও মেজর নেতাদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুর রহমান ও কর্ণেল শাহ নেওয়াজ খান। অন্যান্য বিখ্যাত বীর বিপ্লবী মুসলমানদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মির্জা এনায়েত আলী বেগ। আর্মি বিভাগের কমাণ্ডার ছিলেন আবদুর মজিদ (এ.ডি.সি)। এখানে একথা যেন মনে না করা হয় যে, শুধুমাত্র মুসলমানরাই সর্বেসর্বা ছিলেন। আসলে হিন্দু নেতাদের নামের স্বর্ণময় তালিকা প্রতি ইতিহাসেই আছে; তা সহজলভ্য। তাই যে সমস্ত দুর্লভ তথ্য চাপা আছে সেগুলোই যথাসম্ভব তুলে ধরা হচ্ছে।
নেতাজীকে যিনি পূর্ণ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন তিনি হচ্ছেন মৌলানা উবায়দুল্লা সিন্ধি; সুপ্রকাশ রায় যাকে ‘ওবেদুল্লা বলেছেন। তিনিই সুভাষ বসুকে ভারতের বাইরে নানা নামে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই সুভাষ বসুর নাম দিয়েছিলেন মৌলবী জিয়াউদ্দিন। এ বিখ্যাত বিপ্লবী মাওলানাকে যখন ভারত হতে বের করে দেয়া হয়েছিল তখন সে বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে তিনি জার্মানী, জাপান, ফ্রান্স, কাবুল প্রভৃতি স্থানে এমন কায়দায় সংগঠন করে এসেছিলেন যাতে পরবর্তীকালে প্রতিনিধি হিসেবে অন্যের যাওয়া সহজ হয়। তাছাড়া প্রত্যেকটি জায়গায় শিষ্য ও বন্ধু সৃষ্টি করে ভারতের স্বাধীনতার সাহায্য-সোপান সৃষ্টি করে এসেছিলেন।
সেখানে যাদের সাথে আলাপ করে যাদের সাথে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন তারা বেশির ভাগই ছিলেন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মী। সুভাষ বস ওরফে মওলবী জিয়াউদ্দীন নামক বাঙালীকে ইতিহাসে যদিও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্থান দেয়া হয়েছে কিন্তু সুভাষের নেতা অর্থাৎ নেতাজীর নেতা মাওলানা উবায়দুল্লাকে আমাদের বর্তমান ও ভাবী সন্তানরা যে কি করে চিনবে তার কোন উপায় রাখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মওলুবী জহীরুল হক (দ্বীনপুর)-কে উর্দুতে যে পত্রটি দিল্লী থেকে ১৯৪৭ খৃস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর লিখেছিলেন, যে বন্ধুবর মাওলানা আবদুল কাদের সাহেব কর্তৃক অনুদিত হয়ে মাওলানা মুহাম্মদ তাহের সাহেব সম্পাদিত ইনসানিয়াত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেটা উদ্ধৃত করছি
“স্নেহের মওলুবী জহীরুল হক-আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আজাদী উপলক্ষে আপনার প্রেরিত পত্রের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতিপটে ভাসে শুধু মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধির স্মৃতি। সে ঘটনা অনেক লম্বা, সংক্ষেপ করলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ১৮১৪ সনে বিশ্বযুদ্ধের সময় শাহ ওলিউল্লার (রহঃ) কাফেলার নেতা, হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহঃ) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে কাজ করার সুযোগ করেন। তন্মধ্যে জার্মানী, ফ্রান্স ও জাপানের এমন সব কর্মী নেতা সেখানে ছিলেন যারা পরবর্তীকালে শাসন ক্ষমতার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।...
২৫ বছর নির্বাসন দণ্ড ভোগ করে ১৯৩৯ সনে তিনি যখন এখানে আসেন তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্বভারতীয় সংগ্রামের প্রোগ্রাম রচনা করেন। সে সময় গান্ধীজী পর্যন্ত এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন; তাহলেও ভারত ছাড়' আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে। একদিন চায়ের মজলিসে তার সাথে আমার আলাপ হয়। তাঁর চোখ ও চেহারায় চিন্তার চিহ্ন দেখে আমার মনে অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন জাগে। আমি প্রশ্ন করতেই তিনি উত্তরে জানালেন, 'আমার ইচ্ছা সুভাষ ভারতের বাইরে যাক। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি তার বাসা উখলায় ফিরে যান ....।
দ্বিতীয় দফায় উখলা হতে দিল্লী পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোন একটি জনমানব শূন্য স্থানে তার সাথে সুভাষের সাক্ষাত সংঘটিত হয়। তার পরের সাক্ষাতটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। এখানেই তিনি সুভাষকে জাপান যাত্রার জন্য রওনা করেন। জাপান সরকারের নামে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তিনি একটি পরিচয়পত্র দেন এবং সেখানকার প্রধান সেনাপতির নামে একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তা পাঠান। তাই সুভাষ সেখানে পৌছানোর সাথে সাথে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগও তার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল। ...শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগে মাওলানা সাহেবের জীবন শেষ হয়।...
১৯৪৫ সনের ১ লা সেপ্টেম্বর পুরো এক বছর নয় দিন পর সরকারীভাবে স্বীকার করা হয় মাওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। বাস্তবিক এমনি একজন বিপ্লবীকে ওজনের তুলাদণ্ডে এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এ বিপ্লবীর সমান হয় না... আপনার সম্মানীয়া মাতার প্রতি রইল আন্তরিক সালাম। ইতি-আবুল কালাম (আজাদ)”।
শুধু সুভাষ বসুর নয়, অনেক নেতার নেতা মাওলানা উবায়দুল্লার কোন মূল্যায়ণ আজও হয়নি, মূল্যায়ন হয়নি সে মাওলানা মাহমুদুল হাসানেরও, যিনি ছিলেন উবায়দুল্লা সাহেবের রাজনৈতিক গুরু।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, আমরা এ গ্রন্থের গোড়া থেকে শুধু দেখতে পাব-ভেদবুদ্ধি আমাদের ধ্বংস করেছে, একতার অভাব আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌছতে দেয়নি। হিন্দুর সাথে মুসলমান, কংগ্রেসের সাথে অকংগ্রেস, রাজনীতিবিদদের সাথে লেখকদের অনেকক্ষেত্রে মতের অমিল থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থের জন্য অপর পক্ষের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে মিলনমঞ্চে এগিয়ে যেতে বাধা কোথায়? এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীজ্যোতি বসুও বলেছেনঃ “অন্যপক্ষে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী হলেও যদি আমরা মনে রাখি যে, শ্রেণীগত বিচারে এরা আমাদেরই সাথী এবং ওদের ভুল, বিচ্যুতি, বিরোধীতা সত্ত্বেও ওদের সাথে যোগাযোগ রাখি ওদের বোঝাবার সাথী এবং ওদের ভুল বিচ্যুতি বিরোধিতা ওদের ভুল বুঝবেই এবং আমাদের সাথে আসবেই।” (বাফ্রন্ট সরকার ও শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিক: জ্যোতি বসু-মনোরঞ্জন হালদার পূ১১)
ইংরেজের অত্যাচারে যারা জেল খেটেছেন তাদের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মুসলমান বলে, কংগ্রেস অথবা কমিউনিস্ট বলে তাদের নাম বাদ দিতে হবে, এটা কখনই প্রকৃত ঐতিহাসিকের চরিত্র হতে পারেনা। যেমন কমরেড আব্দুল হালিম-তিনি ১৯০১ খৃষ্টাব্দে জন্মে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে (১৯৬৬ খৃষ্টাব্দে) ইংরেজের অত্যাচারে শেষ হয়ে গেছেন ভারতের মাটি থেকে। তার জেল-জীবন সম্বন্ধে কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায় লিখেছেনঃ “১৯৬৬ সনে এপ্রিল মাসে মৃত্যুর মাত্র দশদিন পূর্বে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান"। (দুই পথিকৃৎ পৃ. ২৭)
এখন কোন কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী ঐতিহাসিক যদি তার সে ইতিহাস চাপা দিতে চান তাহলে ঐতিহাসিক চরিত্র নষ্ট হবেনা কি? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যে মাওলানা উবায়দুল্লা সিন্ধীর কথা আমরা উল্লেখ করেছি তার এবং এ রকম আরও শতশত বীর বিপ্লবীদের ইতিহাস কোন কারণে' এখনো যে চেপে রাখা হয়েছে এবং কেন যে এখনো পর্যন্ত তাদের মূল্যায়ন হয়নি তা অতীব পরিতাপের বিষয়।
লেখক যে পন্থীই হোন না কেন, সত্য তথ্য চাপা দেয়া বা শক্তির জোরে তার বই বাজেয়াপ্ত করার সময় অবশ্যই দেখতে হবে আলাদের অভিযোগ কতটুকু সত্য। কেননা, মিথ্যা অজুহাতে ভিন্নপন্থী লেখকের বিরোধিতা করাও বিখ্যাত মানুষদের নীতি নয়। এ প্রসঙ্গেই এম, এস, নাম্বুদিরিপাদ-এর একটি মূল্যবান উদাহরণ স্মরণযোগ্যঃ “লেনিন ছিলেন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক নেতা আর ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন সে যুগের অন্যতম সাহিত্যিক। দু'জনের মধ্যে চরম মতানৈক্য থাকলেও লেনিন তার পত্রে গোর্কিকে লিখেছিলেনঃ লেখার
শিল্প সংক্রান্ত ব্যাপারে আপনিই শ্রেষ্ট বিচারক, এ মত আমি অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করি, আপনার শিল্পীক অভিজ্ঞতা ও দর্শন ভাববাদী দর্শন হলেও, উভয়দিক থেকে এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেও আপনি একটা উপসংহারে আসতে পারেন....।” (দ্রষ্টব্য মার্কসবাদ ও সাহিত্য ই, এম, নাদিরিপাদ, পৃ. ২৬)
আবার পূর্বের কথায় ফিরে এসে বলা যায়-এটা দিবালোকের মত প্রমাণিত হল যে, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পিছনেও সে হতভাগ্য মুসলিম বিপ্লবীদের অবদানই লুকিয়ে রয়েছে, অথচ জানিনা কোন উদ্দেশ্য তাঁদের নাম আজও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
ভারতের বাইরে সুভাষ বসুর ইংরেজ-বিরোধী ষড়যন্ত্র, অপরদিকে ভারতের ভিতরে মুসলিম লীগ-কংগ্রেসে লড়াই, যেখানে সেখানে বিক্ষোভ, গুলি, অগ্নিকাণ্ড দেখে ইংরেজরা বুঝতে পারল যে তাদের ভারত বর্ষ ত্যাগ করে চলে যাওয়াই ভাল। এরপরে তারা হিন্দু-মুসলমানকে ডেকে তাদের স্বেচ্ছায় ভারত ছেড়ে চলে যাবার কথা জানান।
এদিকে জওহরলালও দেশ বিভাগে রাজি হলেন কারণ বৃদ্ধ বয়সে ক্লান্ত দেহে জেল খাটা আর ভাল লাগছিল না। গান্ধীজীও অবশেষে ভারত-ভাগ মেনে নিলেন। (ডক্টর নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যঃ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস : পৃ. ২৯০-৯১)
অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত জিন্নার দেশ বিভাগ প্রস্তাবেরই জয় হল। ঠিক সে সময় মিঃ সোহরাবর্দী ও শরৎ বসু এক নতুন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তা হল-বঙ্গবাসী ও বঙ্গভাষীদের নিয়ে অবিভক্ত বাংলাদেশের দাবী মেনে নেয়া হক। “কিন্তু তাদের এ দাবী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কোন তরফই সমর্থন করল না।" (ডঃ ভট্টাচার্য, পৃ. ২৯২)
খান আবদুল গফফার খান দেশ বিভাগের প্রস্তাব মেনে নিতে পারলেন না। সে যুগের লালকোর্তা’ (Red Shirt) ও খোদায়ী খিদমাতগার বাহিনীর নেতা খান আবদুল গফফার খান, গান্ধী, জওহরলাল তথা কংগ্রেসী নেতাদের এ আচরণে অবাক হলেন এবং হয়ে বললেনঃ আমাদের মুসলিম লীগের অনুগ্রহের উপর ছেড়ে দেয়া হল, যেটা নেকড়ের মুখে ছেড়ে দেয়ার নামান্তর। (India Wins Freedom : A.K.Aad. p. 198)
এদিকে ইংল্যাণ্ডের গোপন পরামর্শে ইংরেজদের সিদ্ধান্ত হল, ১৯৪৮ সনে ভারত পরিত্যাগ করা হবে। কেননা সরস ভারত নীরস হয়ে গেছে, শাসনের নামে শোষণের প্রহসন আর সুবিধাজনক হবে না। কিন্তু ১৯৪৭ অর্থাৎ পরিকল্পিত সময়ের এক বছর আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
খুব আশ্চর্যের কথা হল, যে দেশ স্বাধীন হয় সে দেশ লড়াই করে তাদের সাথে, যারা তাদেরকে পরাধীন করে রেখেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যায়, কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের অনেক নেতা ইংরেজ সাহেবদের তোষামোদ করতে লেগে গেলেন। উদ্দেশ্য-ভারত ভাগের অংশগুলো যেন তাদের মতের অনুকূলে এবং যথাযথ হয়। স্যার র্যাডক্লিফকে আদেশ দেয়া হল-তিনি ভারতের ম্যাপে দাগ দিয়ে দিলেন। তথাকথিক স্বাধীনতাসহ দেশ বিভাগের কাজ শেষ হল। ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ঘোষিত হল, আর ভারতের হল ১৫ই আগষ্ট। অবশ্য “১৫ ই আগষ্ট তারিখে জিন্না পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন লিয়াকত আলী খান। ১৪ই আগস্ট রাত্রে দিল্লীতে গণপরিষদের অধিবেশন বসল, এবং এ গণপরিষদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে গভর্ণর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করল। অতঃপর নেহরু এবং রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাকে (মাউন্টব্যাটেনকে) তাঁর সরকারী ভবন থেকে নিয়ে এলেন ১৫ই আগস্ট প্রত্যুষে মাউন্টব্যাটেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন, এবং তারপর জহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভাকে শপথ গ্রহণ করালেন।" (দ্রঃ ডক্টর নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ. ২৯৭)
এ কথা বলা যায় যে, আমরা ফলাও করে স্বাধীনতার ইতিহাসকে যেমন করেই বলি বা বলাই না কেন নিরপেক্ষ বিচক্ষণ মানুষ যদি এ তৃতীয় বা শেষ স্বাধীনতার ইতিহাসকে স্বাধীনতার ইতিহাস' না বলে ইংরেজের চলে যাওয়ার ইতিহাস' বা ইংরেজের (ভারত) ভিক্ষা দেয়ার ইতিহাস' বলে আখ্যা দেন তাহলে তার প্রতিবাদ করা খুব সহজসাধ্য হবেনা।
শেষ স্বাধীনতা আন্দোলন অথবা ইংরেজের চলে যাওয়ায় ইতিহাসেও হয়ত দেখা যেত মুসলমানরা অনেক বেশী রক্ত দিয়েছেন, অপর সম্প্রদায় অপেক্ষা অনেক বেশী জেল খেটেছেন এবং সর্বহারা হয়েছেন-যেমন হয়েছিলেন বিগত প্রথম ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমদের আবির্ভাবের পরে মুসলমান সম্প্রদায়ের ইংরেজ বিরোধিতা যেন খানিকটা থমকে দাড়ায়। কারণ মুসলমান বিপ্লবীরা বুঝেছিলেন যে তাদেরও ইংরেজি শিখতে হবে এবং ইংরেজের সাথে সম্পর্ক খানিকটা মধুর করতে হবে।
সৈয়দ আহমদ' একটি ঐতিহাসিক নাম। আলিগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদের প্রশংসার প্রাচীর তুলে ইংরেজ চেয়েছিল বেরেলীর সৈয়দ আহমদের বিপ্লবী নাম আড়াল করে দিতে। আর ঘটেছেও তাই-শতকরা ৮০ জন লোক যত সহজে স্যার সৈয়দ আহমদকে চেনেন এ শতকরা ৮০ জন হযরত সৈয়দ আহমদ বেরেলীকে তত সহজে চেনেন না; অথচ তিনি প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক ও অমর শহীদ। এ পুস্তুকে পূর্বেই তার সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭-তে জন্মে ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন। ইংরেজ তাকে স্যার' উপাধি দিয়েছিল। তারা তাকে দিয়ে তৈরি করছিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি একটি অনুবাদ সমিতি করেছিলেন। তার পক্ষ হতে প্রচুর বইপত্র ইংরেজের অনুকুলে উর্দুতে অনুবাদ করে ভারতে বিতরণ করা হয়েছিল। তাঁর লেখা তাফসীরুল কোরআন প্রমাণ করেছিল যে, মুসলমান জাতি ইংরেজের শত্রু নয়, যেহেতু কোরআন ও বাইবেল যথেষ্ট মিল আছে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি হাদীস ও তফসীরের প্রতিকূলেও মত প্রকাশ করেছিলেন। ফলে একটি বৃহত্তর দল তার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইংরেজের আনুগত্য লাভ করে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। তবে একথা ভুললে চলবে না যে, সে যুগে ভারতে মুসলিম বুদ্ধিজীবী তৈরির দরজা যেভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, নিঃসন্দেহে সে বন্ধ দরজা খোলার কৃতিত্ব স্যার সৈয়দ আহমদের। সে সাথে একথাও উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী এ স্যার আহমদের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবে প্রভাবিত।
তাছাড়া স্যার আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, মাওলানা আকরাম খান, কবি ইকবাল, বিচারপতি আঃ মওদুদ প্রভৃতি নেতা ও লেখকদের উপর স্যার সৈয়দের যথেষ্ট প্রভাব প্রমাণিত হবে যদি তার তফসীর, পুস্তক ও বক্তৃতামালা তলিয়ে দেখা যায়।
চলতি ইতিহাসে গান্ধী নেহেরু, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন, প্যাটেল, কৃপালিনী, সরোজিনীর নাম যেখানে আছে, সেখানে উবায়দুল্লা! মাহমুদুল হাসান, মহম্মদ আলি, সাব্বির আহমদ, হাফেজ জামেন ও গফফার খানের মত বিশিষ্ট নামগুলো বাদ গেল কেন-জনগণের এ কৈফিয়ত নেয়ার অধিকাংশ থাকাকেই গণতান্ত্রিক অধিকার বলে। শুধু আবুল কালাম আজাদের নামটুকু রেখেই দেশ নায়কেরা এড়িয়ে যাবেন?
ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকী, ভগত সিং, রামপ্রসাদ, বাদল ও দীনেশ প্রভৃতি প্রাণদাতাদের - নাম যেখানে থাকছে সেখানে কেন থাকবে না আসফাকুল্লার নাম?-যিনি ফাঁসির মঞ্চে হাসতে হাসতে বুকে কোরআন ঝুলিয়ে কোরআনের অংশ আবৃত্তি করে বীরের মত প্রাণ দিলেন। ফাঁসির আদেশে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে দেশের জন্য প্রাণ দেয়ার গর্বে যার দেহের ওজন বেড়ে গিয়েছিল।
সে রহমত আলী, যাকে ইংরেজ সরকার ফাঁসি দিলে শুধু নয়, যার সমস্ত জমি-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল তার নাম মুছে দেয়া নিশ্চয় দুঃখের বিষয়। এমনিভাবে জমাদার চিস্তি খান ও হাকিম আলি ভারতের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন অপরাধে তাদের নাম ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করা হল? হাসপাতালের কর্মচারি যে আবদুল্লা’র ১৯৩২-এর ১লা সেপ্টেম্বর দেশের জন্য ফাসি হয়েছিল তার কথা কি ইতিহাসে থাকা উচিত নয়।
১৯১৭ খৃস্টাব্দে রামচন্দ্র ভরদ্বাজকে যখন বিদ্রোহী বলে গুলি করে মারা হল তখন তার জন্য বিদ্রোহ ও বিপ্লবের যিনি ও যারা নেতৃত্ব দিলেন-সে আবদুর রহিম, আল্লাহ বখশ ও গোলাম রব্বানী শেঠির নাম কি ইতিহাসে থাকার কথা নয়? যারা গুপ্ত সমিতি তৈরি করলেন তারা যদি ইতিহাসে বেঁচে থাকেন তাদের অনুশীলন ও যুগান্তর দলের নাম যদি ইতিহাসে থাকে তাহলে মাওলানা আবুল কালামের গুপ্ত সমিতি হালিফুল্লার নাম থাকবে না কেন? আর এ ‘কেন' বলা মানেই কি সাম্প্রদায়িকতা? এ কেন বলার জন্যই কি লেখকের বই বাজেয়াপ্ত করতে হবে?
১৯১৭ খৃস্টাব্দে মুজতবা হোসেন ও আলি আহমদের ফাসি হল-তাদের নাম বর্তমান ভারতের পাঠ্য ইতিহাসে থাকা বোধ হয় অপরাধ ছিলনা। ১৯১৫ সনে রাইসুল্লার ফাঁসি হল; তার নামও আজ উহ্য রাখা হয়েছে। ১৯১৫-তে রুকনউদ্দিনেরও ফাসি হয়েছিল কিন্তু সে নামও আজ অদৃশ্য।
যারা ভারতের স্বাধীনতা আনতে বহির্ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করেছেন তারা যদি স্মরণীয় মানুষ হন তাহলে রেজা খান-যিনি মাওলানা আজাদের সহকর্মী ছিলেন তার নাম চাপা পড়ল কি করে? স্বাধীনতার জন্য উগ্র ইংরেজ বিরোধী হয়ে যদি ইতিহাসে নাম কেনা যায় তাহলে বাংলার মকসুদুদ্দিন আহমদ, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, নাসিরুদ্দিন ও রাজিয়া খাতুনের নামও ইতিহাসে থাকা উচিত ছিল। ১৯৩০ সনে কোরবান হোসেন ও আবদুর রশীদের ফাসি হয়; তাদের নাম কোন সদিচ্ছায় আজ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে? ইকবালমন্দ খাঁ ও গজনফর খা দু'জনেই ফাঁসিতে গলা দিলেন-তাদের নাম ক’জন জানেন? তাফাজ্জল হুসাইন এবং সাখাওয়াতেরও এমনিভাবে ফাসি হয়েছিল, কিন্তু সে নামও আজ ইতিহাসের পাতায় নিখোজ।
গোলাম জিলানী ২৭ বছরের এক যুবক, গান্ধীর একান্ত ভক্ত। বি.এ. পাশ করে শুধু রাজনীতিই করেছেন। ১৯৩২ সনে পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে শেষে ১০ই ফেব্রুয়ারি প্রহার ও অত্যাচারের আঘাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার উপর যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন তখন সরকার পক্ষ থেকে জানান হল-যদি লিখিত মুচলেকা দেয়া হয় তাহলে মুক্তি মিলতে পারে। তাতে শর্ত লেখা থাকবে। তার অন্যায় হয়েছে এবং ইংরেজের বিরুদ্ধে আর আন্দোলন করবে না। শেষে ইংরেজরা গোলাম জিলানীর পিতাকে জিজ্ঞেস করল, তিনি এ শর্তে ছেলের মুক্তি চান কি না? বীর পুত্রের বীর পিতা বললেন, মুচলেকা দিয়ে পুত্রের মুক্তি চাইনা। পুত্রও মন্তব্য করলেন, মুচলেকা দিয়ে মুক্তি চাইনা-কাঁদুক দেশ, স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়-স্বজন; তবু আমি মুক্তিযোদ্ধা।' বীর গোলাম জিলানী জেলেই শহীদ হলেন-এ ঘটনা কি ইতিহাসে স্থান পেতে পারেনা?
১৯২১ খৃষ্টাব্দে আসফ আলীর পিতা মৃত্যুশয্যায় বললেনঃ আমার আর লড়াই করা হল না, আমি চললাম আল্লাহর ডাকে। তবে ইংরেজের সাথে লড়াই করার জন্য আমার ছেলে আসাফ আলীকে দিয়ে গেলাম। তার সাথে দেখা হলনা, কারণ সে জেলে রয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে লড়াই চালাবে। -সে মহান আসফ আলী ও তার পিতাকে কি আমাদের ইতিহাসের পাতায় একটু স্থান দেয়া যেতনা।
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের নামের পাশে অধ্যাপক বরকতুল্লার নাম তত পরিচিত নয়, অথচ তিনিও আন্তর্জাতিক নেতা। তিনি গরীবের ছেলে ছিলেন। বহু কষ্টে শিক্ষিত হয়ে ভারতের মুক্তির জন্য বহির্ভারতে গিয়ে জার্মানী ও জাপানের সাথে যোগযোগ করেনং সর্বভারতীয় সরকার গঠন করেন। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি নিজেই। আর সাম্প্রদায়িকতার গন্ধবিহীন সতর্ক দৃষ্টি রেখে সভাপতির পদে বসালেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে। সরকার গঠনের মধ্যে রাজনিতি ছিল এ যে, প্রদানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট প্রভৃতি সাইনবোর্ড থাকলে যে কোন দেশের যে কোন রাষ্ট্র নেতার সঙ্গে দেখা করা সহজ হয়। বরকতুল্লার দল কাবুল, আঙ্কারা, দামাস্ক ও মিশরের কায়রোতে এবং বহ্ম দেশে গোপন কেন্দ্র স্থাপন করে। উদ্দেশ্য ছিল-বিশ্বজোড়া রাজনীতির ব্যবসায়ী ব্রিটিশকে চারিদিক থেকে ঘায়েল করা। ১৯২৭ সনে প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে দেশত্যাগী চাকরি ত্যাগী বিপ্লবী অধ্যাপক বরকতুল্লা প্রাণ ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ আপনি কিছু বলতে চান? উত্তরে বলেছিলেন, তার শেষ ইচ্ছা-ভারতে যেন তার কবর হয়। অবশ্য তাঁর সে শেষ অভিলাষ আজও অপূর্ণ আছে। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা সত্য এবং বাস্তব হওয়া সত্ত্বেও চলতি ইতিহাসে কি স্থান পাবেনা?
এমনি কত নামই যে চাপা পড়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, ডক্টর সাইফুদ্দিন কিচলু, নিসার আহমদ, গোলাম মোজাদ্দেদ প্রভৃতি বিখ্যাত নেতারাও আজ মুছে যেতে চলেছেন চলতি ইতিহাসের পাতা থেকে। এ ছাড়াও ১৯১৬ খৃস্টাব্দে ‘রেশমী রুমাল ষড়যন্ত্রের'র ইতিহাসে মাওলানা উবায়দুল্লা সাহেব ছাড়াও যে সব মুসলমান বিপ্লবীদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে বিপ্লবী আবদুল্লা, ফতেহ মহাম্মদ, মহম্মদ আলী প্রভৃতি নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মাওলানা মাহমদুর হাসান ও মাওলানা আনসারীর নামও সেখানে রয়েছে।
তুকরি গভর্ণর গালিব পাশার সক্রিয় সাহায্যে মাওলানা উবায়দুল্লা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালান। তাছাড়া বিপ্লবী মিঞা আনসারি ও সেখ আবদুর রহিমও বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম।
‘জাহানে ইসলাম একটি পত্রিকার নাম। যুগান্তর' যেমন একটি সংগঠন ও সে সাথে একটি পত্রিকার নাম ছিল, তেমনি এ জাহানে ইসলামকে কেন্দ্র করে বিরাট সংগঠনও চালান হয়েছিল। এটা কোন প্রাচীন কাহিনী নয়-১৯১৪ খৃস্টাব্দের ঘটনা। এ সনের মে মাসে তুরস্কের কনস্টান্টিনোপল শহর থেকে পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। উর্দু, আরবী, তুর্কী ও হিন্দী ভাষায় তাতে লেখা প্রকাশিত হত। পত্রিকায় উর্দু বিভাগের সম্পাদক ছিলেন আবু সৈয়দ নামক এক মুসলিম বিপ্লবী। এ পত্রিকা ভারতেও আসত। বিপ্লবীদের রক্ত থেতে উঠত কাগজের চড়া ও কড়া লেখনী পড়ে। অবশ্য ১৯১৪ সনেই ইংরেজ সরকার পত্রিকাটি ভারতে আসা বন্ধ করে দেয়।
তখনকার যুগান্তর পত্রিকা যদি ভারতবাসীকে ‘আন্দোলনে' যেগা দেয়াতে সহায়ক হতে পারে, স্বরাজ’ পত্রিকা যদি বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করার ভূমিকা নিতে পারে তাহলে যে পত্রিকা বিদগ্ধ ভারতবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল তার নাম আজ ইতিহাসে নেই কেন? ইতিহাসের পাতায় এ পত্রিকার পাশাপাশি এ নামটি থাকাও কি উচিত ছিলনা,
মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর মুজতাবা হোসেন কয়েকজন ‘গদর' বিপ্লবীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে সৈন্যদের মধ্যে বৈপ্লবিক প্রচারকার্য চালান। ফলে মালয় স্টেট গার্ডস' ও ‘পঞ্চম পদাতিক রেজিমেন্ট' নামক দু'টি সৈন্যদল বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত হয়। এত বড় কাণ্ড ঘটল যে ভারতীয় বিপ্লবীদের দ্বারা, তাদের নাম আজ ইতিহাসে চাপা আছে কেন?
উদার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে শেষ স্বাধীনতার ইতিহাসে ঋষি অরবিন্দ ও তিলকের নাম বিশেষভাবে উল্লিখিত। কিন্তু সুপ্রকাশ রায়ের মতে নিরপেক্ষ তাথ্যিক ইতিহাসবিদ তাঁদের যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন। আমরা আগেও বলেছি যে, অরবিন্দ জেলখানায় শাস্তি পেয়ে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে তার মত ও পথ পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন অর্থাৎ বাসুদেব দেবতার দোহাই দিয়ে নিজেও আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ালেন সে সাথে অপরকেও সরে দাঁড়াবার উপদেশ ও আদেশ দিয়ে গণ্ডিচেরি চলে গেলেন।
আর তিলকের জন্য শ্রী সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন : “১৯১৪ খৃস্টাব্দে জুন মাসে বালগঙ্গাধর তিলক কারাগার হতে বাহির হয়ে আসেন এক নতুন মানুষ হয়ে। বাইরে এসেই তিনি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবের পথ পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিয়া সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আইন-সম্মত আন্দোলন আরম্ভের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। তিলক মত ও পথ পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হলেন না, তিনি আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেও অস্বীকার করেন।” (ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস, পৃ. ৪২৩)
তিলকের এ রকম মত পরিবর্তনে ক্রুদ্ধ হয়ে ডক্টর ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন : “শ্রদ্ধেয় লোকমান্য তিলক, জনসাধারণের উপর যার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, কিন্তু যুদ্ধ বাধিলে তিনি গভর্ণমেন্টের সুরে সুর দিলেন। বার্লিন কমিটি' তাঁর নিকট লোক পাঠিয়েছিল, কিন্তু তিনি কিছু করেন নাই। ... এই জন্যই বলি, ভারতের স্বাধীনতা-যজ্ঞে বুর্জোয়ারা আসবেন না। তাঁরা ‘আধ্যাত্মিক স্বরাজ দায়িত্বপূর্ণ গভর্ণমেন্ট’, ‘হোমরুল' প্রভৃতির দাবি করবেন, কিন্তু স্বাধীনতার দাবি করবেন না। (ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত : ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃ. ১১০)
পূর্বের কথায় ফিরে এসে এক্ষেত্রে বলা যায়, মুসলমানদের বিরাট অবদান যে শেষ স্বাধীনতার ইতিহাসেও রয়েছে, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে তারাই যে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ বাস্তবকে নির্ধিধায় অস্বীকার করে তাদেরকে আজ সরকারি ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সঠিক পদক্ষেপ নয়। তাই আজ ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের মনে কথা হল-তাদের সঠিক ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও যেন তা চাপা না পড়ে, তারা যেন উপেক্ষিত না হন, সঠিকভাবে যেন তাদেরকে এবং তাঁদের ইতিহাসকে জানতে পারেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভারতবাসী।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/492/63
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।