hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

চেপে রাখা ইতিহাস

লেখকঃ গোলাম আহমাদ মোর্তজা

৫৪
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১৮৩৮ খৃস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন, আর পরলোক গমন করেন ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে। বাল্যকাল হতেই তার হৃদয়ে ঠাকুর দেবতার উপর বক্তির বীজ অঙ্কুরিত হয়। কিন্তু পরে কয়েকবছর তিনি নাস্তিকও হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য পরিণত জীবনে সধু-সন্ন্যাসীদের সংসর্গে এসে তিনি পূর্ণ আস্তিক হয়ে ওঠেন (দ্রষ্টব্য সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়: বাঙালী রাষ্ট্রচিন্তা, পৃষ্ঠা ১০৭)

পূর্বেই জানান হয়েছে যে, তিনি ঈশ্বরগুপ্তের প্রথম শ্রেণীর একজন শিষ্য ছিলেন। বিলেতী ভাবধারায় স্পেনসার, ডারউইন, কোৎ প্রভৃতি বিদেশী পণ্ডিতদের প্রভাবেও তিনি বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। যার কারণেই তিনি সমাজ ও জীবনের প্রতিটি দিকে নতুন মূল্যবিচারে প্রবৃত্ত হন।

রামমোহনের ব্রাহ্ম ধর্ম ও হিন্দু ধর্মকে সামনে রেখে তিনি অনুশীলন ধর্ম" নামে একটি নূতন ধর্মের সৃষ্টি করেন। বিপিনচন্দ্র পালের মতে, “তাহার অনুশীলন-ধর্ম ব্রাহ্ম ধর্মেরই নামান্তর মাত্র” (নবযুগের বাংলাঃ বিপিনচন্দ্র পাল, পৃষ্ঠা ১৯০) রাজা রামহোমন রায়ের ব্রাহ্মধর্মের বিরুদ্ধে তার যে সংহত লড়াই চলেছিল তা অস্বীকার করা যায়না। লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিধবা বিবাহ বন্ধ, বহুবিবাহ রোধ, অস্পৃশ্যতা বর্জন প্রভৃতি সমাজ সংস্কারের তিনি নিষ্ঠুর ভাবে বিরোম্বিতা করেছিলেন (সৌরেন্দ্রমোহন, ঐ, পৃষ্ঠা ১০৮)

প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও প্রগতিবাদী। পরিণত বয়সে তিনি হয়ে পড়েন প্রাচীনতার পক্ষপাতী। নবীণ বয়সে মিল ও বেন্থামের প্রভাবে তিনি সাম্য' গ্রন্থ রচনা করেন। এমনকি অধিকার-ভেদ স্বীকার করে বলেন, সকলে তুল্যরূপে মোক্ষাধিকারী নহে'। নারী-পুরুষের সমান অধিকারেও তাঁর অনুমোদন ছিল না। (ঐ, পৃষ্ঠা ১১০) যখন তিনি নাস্তিক হয়েছিলেন তখন তার ধর্মবিরোধী মতামত থাকা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু পরে তাঁর মতিগতি বদলাবার পর তিনি বলেন-“ব্ৰহ্ম ও পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার একত্রই মুক্তি। জীবাত্মার পরমাত্ম লীন হাওয়াই মুক্তি। ব্রহ্ম জ্ঞানই মুক্তির পথ। এ ব্রহ্মকে জানিলেই মুক্তি লাভ হয়।" সৌরেন্দ্রমোহন তাই বলেন, “রামমোহনের মত তিনিও ব্রহ্মকে খণ্ডন কিন্তু নিরাকার জ্ঞান করতেন। কারণ সাকার তার মতে সর্বব্যাপী হতে পারেনা। স্রষ্টাকে নিরাকার বলার পর মত পরিবর্তন করে পুনরায় বললেন, “সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ, ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বর আমাদের আদর্শ হইতে পারেন না।

..... অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সে আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই রকম দুমুখো কথার জন্য তিনি নিজেই স্বীকার করে বলেছেন, “আমার জীবনে আমি অনেক বিষয়ে মত পরিবর্তন করিয়াছি-কে না করে? মত পরিবর্তন-বয়োবৃদ্ধি, অনুসন্ধানের বিস্তার এবং ভাবনার ফল। (দ্রষ্টব্য ঐ, পৃষ্ঠা ১৩২)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় পরিপুষ্টি সাধনে একজন অন্যতম শিল্পী ও নায়ক বঙ্কিমচন্দ্র তার জন্য যে কলমে লিখেলেন-“বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তার পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই, এবং তাহার পরেও কেহ পারে নাই” (সমালোচনা সংগ্রহ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-১৯৫৫. পৃ. ২৪২)

এ বঙ্কিমচন্দ্রই অন্যত্র আবার লিখলেন-“বিদ্যাসাগর কঠিন সব সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাঙ্গালা ভাষার ধাপটা খারাপ করে গেছেন। বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত রচনা সীতার বনবাস'-এর জন্যও লিখলেন-সেটা বঙ্কিমচন্দ্রই অন্যত্র আবার লিখলেন-“বিদ্যাসাগর কঠিন সব সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাঙ্গালা ভাষার ধাপটা খারাপ করে গেছেন। বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত রচনা সীতার বনবাস'-এর জন্যও লিখলেন-সেটা কান্নার জোলাপ ব্যতীত কিছুই নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে সমালোচনার অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু তার পাণ্ডিত্যকে অস্বীকার করা পণ্ডিতের কাজ না মুখের কাজ তা ভেবে পাওয়া মুশকিল। বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন, “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন। তিনি আবার একখানি বিধবার বিবাহের বই বাহির করিয়াছে। যে বিধবার বিবাহ দেয় সে যদি পণ্ডিত হতে তবে মুর্খ কে?” [অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমরের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী : জষ্টব্য)

বঙ্কিমবাবু যে কলমে লিখেছিলেন, “পর-সমাজের অনিষ্টসাধন করি আমার সমাজের ইষ্ট সাধন করিব না, এবং আমার সমাজের অনিষ্টসাধন করাি কাহাকেও আপনার সমাজের ইষ্টসাধন করিতে দিবনা। ইহাই যথার্থ সমদর্শন”। আবার সেই কলমেই লিখলেন, “হিন্দু জাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গল মাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সব নহে। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয় করিব। অফিচ, যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘাটিতে পারে তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল ঘাটিতে পারে। হয় হউক, আমরা সেইজন্য আত্মজাতির মঙ্গল সাধনে বিরত হইব না। পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিত হয়, তাহাও করিব। (বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৯)

সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, 'সাম্যের পূজারীরূপে বঙ্কিমচন্দ্র সুপরিচিত। এ সম্পর্কে লেখাগুলি তার বঙ্গদর্শণে ১৮৭৩-৭৫ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে সেগুলি প্রকাশের পর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন যে, ঐ বিষয়ের তার মতের পরিবর্তন ঘটে” (সৌরেন্দ্রমোহন; বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃষ্ঠা ১২৮)

“সাম্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার নিরসনকল্পে পূর্বেই তিনি তাঁর সাম্য' নিবন্ধে উপসংহারে লিখেছিলেনঃ আমরা সাম্যনীতির এরূপ ব্যাখ্যা করি না যে, সকল মনুষ্য সমান্যবস্থাপন্ন হওয়া আবশ্যক বলিয়া স্থির করিতে হইবে। তাহা কখনো হইতে পারেনা। যেখানে বুদ্ধি, মানসিক শস্তি, শিক্ষা, বল প্রভৃতির স্বাভাবিক তারতম্য আছে, সেখানে অবশ্য অবস্থার তারতম্য ঘটিবে-কেহ রক্ষা করিতে পারিবে না (বঙ্কিম রচনাবলী-উপসংহার সাম্য,পৃষ্ঠা ৪০৬)

সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমের ক্ষেত্র না হলে এ রকম দ্বিমুখী লেখাকে পাগলের প্রলাপ বলতে অনেকের আটকাত না। ঋষি বঙ্কিমের ঋষিত্ব সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এ 'ঋষি' উপাধি কে বা কারা কিভাবে দিলেন এবং কেন দিলেন? দেয়া সঠিক হয়েছে না বেঠিক?

ঋষি বলতে বোঝায়, যারা সাংসারিক বিষয় হইতে বিরত হইয়া ধর্ম চিন্তায় মনোনিবেশ করেন এরূপ ব্যক্তি। পুরাণ মতে ঋষির অর্থ, যাহা হইতে বিদ্যা, সত্য, তপ ও শ্রুতি এই সকলসম্যক রূপে নিরূপিত হয়, অথবা যিনি স্বয়ং উৎপন্ন হন, তাহার নাম ঋষি; নীতিশাস্ত্র মতে যিনি পরমার্থে সম্যক দৃষ্টি স্থাপনপূর্বক সর্বতোভাবে প্ররোপকার করেন, তিনিই ঋষি।” ঋষি সাত প্রকার যথা শ্রুতর্ষি, কাণ্ডুর্ষি, পরমর্ষি, মহর্ষি, রাজর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি।” ব্রহ্মর্ষি শব্দের দ্বিতীয় অর্থ, “শান্ত প্রণেতা সুত্রকৃৎ আচার্য; গোত্র প্রবর্তক মুণি। তৃতীয় অর্থ চামার জাতিবিশেষ”। (দ্রষ্টব্য আশুতোষ দেবঃ নূতন বাঙ্গালা অভিধান, ১৩৬১ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ২৮৮)

এত প্রকার ঋষির মধ্যে তিনি কোন ধরণের ঋষি ছিলেন তার ব্যাখ্যা সাধারণের আজও বোধগম্য হয়নি। তবে সাধারণ মানুষ ঋষি বলতে বোঝেন-তিনি হবেন নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে পরোপকারী, অপরের কল্যাণে প্রাণ উৎসর্গকারী ইত্যাদি।

বঙ্কিমচন্দ্র কি নিজেই চেয়েছিলেন যে লোকে তাকে ঋষি বলুক? তাই কি তিনি অনুশীলন ধর্ম নাম দিয়ে একটি নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছিলেন বঙ্কিম রচনাবলীর সংসদ সংস্করণের দ্বিতীয় খণ্ডের ৬৬৬ পৃষ্ঠায় ধর্মতত্ত্বে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তিনি লিখেছিলেন-“প্রাচীন ঋষি এবং পণ্ডিতগণ অতিশয় প্রতিভাসম্পন্নএবং মহাজ্ঞানী। তাঁহাদের ও প্রতি বিশেষ ভক্তি করিবে, কদাপি অমর্যাদা ও অনাদর করিবে না...আমিও সেই আর্য সন ধ্যানপূর্বক তাহাদিরে প্রদর্শিত পথেই যাইতেছি। তার আদেশ মত এই উক্তিতে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারি যা বঙ্কিমচন্দ্রকে ভক্তি করতে হবে, অমর্যাদা ও অনাদর করা চলবে না-যেহেতু তিনি ধ্যান পূর্বক আর্য ঋষিদের অনুসরণেই চলেছেন।

কিন্তু তিনি কতটুকু কিসের জন্য ধ্যান করেছেন তা বিশ্লেষণ করে দেখলে ক্ষতি কোথায়? শহীদ ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, প্রফুল্লচাকী, বিণয়, বাদল, দীনেশ, ভগত সিং আসফাকউল্লা, নিসার আলী, মাসুম আলী, মিসকিন খাঁ, পীর মাহাম্মদ, খান বাহাদুর খান, সৈয়দ আহমদ বেলবী, আহমদুল্লাহ এঁরা সকলেই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ভারতের মাটিতে। এরা কেহ চাকরিও পাননি, চাকরির পদোন্নতিও হয়নি, অথবা ঘৃণাভরে ইংরেজের চাকরির চেষ্টা বা পরোয়া করেননি।

আর একদিকে দেখা যায়, মহম্মদ আলী, শওকত আলী, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাস বসু, আবুল কালাম আজাদ প্রভৃতি নেতারা কেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন আবার কেহ ইংরেজের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন এবং বিনা দ্বিধায় জেল খেটেছেন। উপরোক্ত এ মনীষীরা কোন রকম সরকারি উপাধি বা পুরস্কারে পুরস্কৃত হন নি। অবশ্য তারা পুরস্কার পাবার কল্পনাও করেন নি। সরকারি অনুরোধে অথবা আদেশে অথবা চাপে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে হয়ত উপরোক্ত নেতাদের মত সম্মান প্রদর্শন করব কিংবা তাদেরও উপরে উচ্চাসন দিয়ে সম্রাটের মত শ্রদ্ধাস্পদ মনে করব-সেটা ঠিক বা বেঠিক যাই-ই-হোক, তার জীবন-ইতিহাস কিন্তু লুকিয়ে রাখার উপায় নেই। তাতেই প্রমাণ হবে তার জীবনের আলো অথবা কাল দিকের রূপরেখা।

অনেক ক্ষেত্রে পিতার মহত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়ে স্তানের উপর। অন্যদিকে পিতার চৌর্যবৃত্তি পাপাচার, গোলামি ও দালালি করার ছাপ পড়াও অস্বাভাবিক নয়। বঙ্কিমচন্দ্র সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজ সরকারের ডেপুটি কালেক্টর পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরে ইংরেজ সরকার তার কাজে খুশী হয়ে তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট করে দিয়েছিলেন। সেকালে ভারতীয়দের পক্ষে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পদটি পাওয়া খুব সহজ ছিল না-সরকারের অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত না হলে এ পদ পাওয়া যেত না। বঙ্কিমচন্দ্রের বড় ভাই শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ও ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হতে পেয়েছিলেন। বঙ্কিমের আর এক ভাই সঞ্জীবচন্দ্রও হন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। বঙ্কিমচন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন এ ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। সুণীল কুমার বসু তাঁর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুস্তকে লিখেছিলেন, একই পরিবারে এতগুলো ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সদস্য দেখা যায় না। সেদিনের বিদেশী শাসনের যুগে ভারতীয়রা ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটর চেয়ে উচ্চতর পদ পাওয়ার আশা করতে পারতে না। (পৃষ্ঠা ১৩)

তাঁর জীবনকাল (১৮৩৮-'৯৪) সংক্ষেপে সমীক্ষা করলেই দেখা যাবে, ইংরেজের করুণায় অথবা ক্রোধরোষে তার কতটা উন্নতি বা অবনতি হয়েছে। ১৮৪৪ সনে মেদিনীপুরে তিনি ইংরেজী স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৪৯ সনে হুগলী কলেজে প্রবেশ করেন এবং এ'সনেই তিনি পাঁচ বছরের একটি বালিকাকে বিবাহ করেন ৫২ তে তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দরচন্দ্র গুপ্তের সাংবাদ প্রভাকরে" লিখতে শুরু করেন। ১৮৫৬ তে প্রেসিডেন্সী কলেজে আইন পড়ার জন্য প্রবেশ করেন। ১৮৫৭ তে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৫৮ অর্থাৎ প্রথম স্বাধীনতা বিপ্লবের পরের বছর তিনি বি. এ. ডিগ্রী লাভ করেন। কিন্তু ইতিহাস লুকিয়ে লাভ নেই-তার প্রতিভা স্বীকার করে ও তার উন্নতিতে শ্রদ্ধা রেখে জানাতে অসুবিধা নেই যে, তিনি বি. এ. পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। অবশ্য ইংরেজ সরকারের পক্ষ হতে সুব্যবস্থার প্রশ্রয় নেয়া হয়েছিল অর্থাৎ সাত নম্বর প্রেস দিয়ে তাকে পাশ করিয়ে দেয়া হয়। এর পূর্ণ তথ্য পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম দৈনিক “আজকাল পত্রিকায় ১৭৬.৮৪ তারিখে ‘যে প্রশ্নে বঙ্কিম ফেল করেছিলেন শিরোনামে ছাপা হয়েছে।

এ ১৮৫৮ তেই তিনি বাবা, দাদা ও ভায়ের মত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। ১৮৫৯-এ প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলে ১৮৬০ সনে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। ১৮৬৩ সনে তার বেতন বৃদ্ধি হয়। অবশ্য ভারতীয় বলে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন। ১৮৬৪ সনে ইংরেজদের জনপ্রিয় পত্রিকা ইণ্ডিয়ান ফিল্ডে ইংরেজী উপন্যাস Rajmohans's Wife ধারাবাহিক ভাবে লিখতে শুরু করেন। এর ফলে উনি যে একজন বিখ্যাত লেখক তা ইংরেজরা আঁচ করতে পারে ও তাকে কি কাজে লাগান যায় তা সরকারের হিসেব করতে বিলম্ব হয়নি। ১৮৬৬ খৃস্টাব্দে তার চাকরি পদ চতুর্থ শ্রেণী হতে তৃতীয় শ্রেণীতে উন্নত হয়।

১৮৬৭ তে সরকারের মন্ত্রীসভার কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির বিদ্রোহ থামাবার জন্য একটি কমিশন গঠিত হয়, বঙ্কিমচন্দ্র সে কমিটির সেক্রেটারী হন। ১৮৬৯-তে আইন পরীক্ষায় পাশ করেন। এ সময় তিনি বহরমপুরে বদলী হন। ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স এ্যাসেসিয়েশন'-এর সভাব তাঁর লেখা ইংরেজী প্রবন্ধ পড়ে শোনান। তাতে ইংরেজরা মুগ্ধ হয় এবং আনুগত্যের পরিচয় পায়। ১৮৭০ তে বেঙ্গল সোশ্যাল এ্যাসোসিয়েশনের অপর এক সাহেবী অধিবেশনে তার লেখা 'এ পপুলার লিটারেচার ফর বেঙ্গল' নামে একটি ইংরজী প্রবন্ধ পাঠ করেন। আগেই চতুর্থ শ্রেণী হতে তৃতীয় শ্রেণীতে তার পদোন্নতি হয়, এবারে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে তিনি উন্নীত হন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, রাজা রামমোহন রায়ের হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধ অভিযানে তখনকার আধুনিক ইংরেজী শিক্ষিত 'ইয়ং বেঙ্গল দল ইংরেজের প্রভাবে সনাতন ধর্মে আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

তখন ইংরেজের অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি যে, হিন্দুধর্ম সুসংস্কার মুক্ত হলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ইংরেজী শিক্ষিত হলে তাদের পক্ষে তা মরণফাঁদ হবে। সুতরাং হিন্দুদের কুসংস্কার জিইয়ে রাখতে হলেও সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনতে হলে ভারতীয় কিছু ভাল লেখক ও সংগঠকের প্রয়োজন। ১৮৭১ সনে তাঁকে রাজশাহী বিভাগের কমিশনারের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নিযুক্ত করা হয়। এ সনেই 'বেঙ্গলী লিটারেচার অ্যাণ্ড বুদ্ধিজিম' ও 'দি সংখ্যা ফিলজফি' নামে দুটি ইংরেজী প্রবন্ধ "ক্যালকাটা রিভিউ' পত্রিকার বেনামীতে প্রকাশিত হয়েছিল। সুনীলকুমার বসু এ দুটি বঙ্কিমের রচনা বলে উল্লেখ করেছেন (দ্রঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায়’, পৃষ্ঠা ২৩৪)

১৮৭২ সনে 'মুখার্জীস ম্যাগাজিন' নামক ইংরেজী পত্রিকার ‘দি কনাফেশাসন অব এ ইয় বেঙ্গলী নামেও একটি ইংরেজী প্রবন্ধ বেনামীতে প্রকাশিত হয়। সুনীলকুমার বসুর মতে ওটাও বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা। ১৮৭২ তে বঙ্গদর্শন' পত্রিকা শুরু হয়। দামী ও নামী লেখক কবিরা তাতে সংযুক্ত হন। বঙ্গ দর্শণই ছিল ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনার প্রথম মুখপত্র। অনেকের মতে, সমালোচনার প্রথম প্রবর্তক হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। অবশ্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশিত (১৯৫৫) সামালোচনা সংগ্রহ" পুস্তকে সম্পাদক শীঅমরেন্দ্র নাথ রায় তা অস্বীকার করে বলেন, কিন্তু ইতিহাসসের সাক্ষ্য গ্রহণ করিলে এ প্রচলিত মতকে সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না। সে সাথে তিনি এও বলেছেন যে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র বঙ্গদেশে সমালোচনামূলক লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বেই শুরু করেছিলেন। অমরাবাবু আরও জানান, ইওরোপীয় সাহিত্য সমালোচনার অনুকররণেই এর সৃষ্টি হয়েছে। ১৮৭৩ তে মুখার্জীস ম্যাগাজিনে বঙ্কিমচন্দ্র দি স্টাডি অব হিন্দু ফিলজফি নামে আর একটি প্রবন্ধ লেখেন। ১৮৭৫ সনে তাকে সুদীর্ঘ ছুটি দেয়া হয়। এ সময় তিনি লেখায় বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৮৭৩-৭৫ সনের মধ্যেই বিষবৃক্ষ', 'যুগলাঙ্গুলীয়',

লোকরহস্য, বিজ্ঞানরহস্য", চন্দ্রশেখর ও কমলাকান্তের দপ্তর' প্রকাশিত হয়। অবশ্য তার বেশ কয়েক বছর পূর্বে দুর্গেশনন্দিনী, 'কপালকুণ্ডলা ও মৃণালিনী" প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবে ১৮৭৭-৭৯-র মধ্যে রজনী, উপকথা, কৃষ্ণকান্তের উইল', 'প্রবন্ধ পুস্তক' ও 'সাম্য প্রকাশিত হয়। এদিকে সরকার কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের কাজের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করতে ভোলেননি। ১৮৮১ সালে বঙ্গ সরকারের অ্যাসিস্টপ্যান্ট সেক্রটারী পদে তাকে নিযুক্ত করা হয়। ১৮৮২ তে কলকাতায় বঙ্কিম প্রায়ই হিনদুধর্ম বিষয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করতেন। (সুনীল কুমার, পৃষ্ঠা ২৩৫)

কোন্ নির্দেশে হঠাৎ তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা বলা মুশকিল। এ বছরেই তিনি রাজসিংহ’ ও ‘আনন্দমঠ প্রকাশ করেন সেই বই দুটির কারণে অবিভক্ত বঙ্গের মুসলমান তাঁর কলমের আঘাতে আহত হন। ১৮৮৪ তে তার 'সীতারাম', কৃষ্ণচরিত্র', হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু দেব-দেবীদের নিয়ে লিখিত প্রবন্ধাবলী, দেবতত্ত্ব ও হিন্দু ধর্ম' নামে পুস্তক ও শ্রীমদ্ভাগবত গীতা প্রচার পত্রিকাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছিল। সুনীলকুমার বসু লিখেছেন, 'প্রচার নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় বঙ্কিমের আনুকুল্যে' (পৃষ্ঠা ২৩৫)

এ সনেই প্রগতিবাদী রামমোহনের ব্রাহ্মধর্মের সাথে তিনি বাদানুবাদ শুরু করেন ফলে রামমোহনের কাজে ভাটা পড়ে। ১৮৮৫ তে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের ‘ফেলো' নিযুক্ত হন। এ সনেই তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ সম্পাদনা করেন। তাতে একটি চিত্তাকর্ষক ভুমিকা লেখেন। ১৮৮৭-র মধ্যে ছোট বড় আরও কিছু বই প্রকাশিত হয়। ১৮৮৮ তে তিনি অনুমীলন পত্রিকায় ধর্মতত্ত' প্রকাশ করেন। ইংরেজ সরকারের বুঝতে অসুবিধা ছিলনা যে, বঙ্কিমের গতি এখন হিন্দুধর্মের দিকে এবং মুসলমান জাতির বিরুদ্ধে মোড় নিয়েছে।' ১৮৯১-এ ইংরেজের মনোনীত লিটারারি সেকশান অব দি সোসাইটি ফর দি হায়ার ট্রেনিং অব ইয়ং মেন' বা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট' নামে বিখ্যাত সংস্থার প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৮৯২-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রাস পরীক্ষার পাঠ্য 'বেঙ্গলি সিলেকশানস'-এর সম্পাদকের পদ পান।

এ সনেই ইংরেজ সরকার তাঁকে রায়বাহাদুর খেতাব দান করেন। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে মুসলিম মানস আঘাতকারী রাজসিংহ' বইটি সংশোধিত ও পরিবর্ধিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৮৯৪ খৃস্টাব্দে ‘সোসাইটি ফর দি হায়ার ট্রেনিং অব ইয়ং মেনে দুটি ভাষণ দেন, সরকার তাতে খুব মুগ্ধ হন। এ সনে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার তাঁকে বিখ্যাত সি. আই. ই. খেতাব দান করেন এবং ঐ ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটে। ইংরেজ সরকারের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল এখানে তা প্রমাণিত হল। সাধারণ পাঠক সব কিছু তলিয়ে না দেখে মনে করতে পারেন যে, সি, আই.ই, উপাধি বোধ হয় তার ইংরাজী বা বাংলায় পাণ্ডিত্যের জন্য দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু যারা একটু গভীরে চিন্তা করতে জানেন বা পড়াশোনার উপর গবেষণা করেন তারা সহজেই বুঝতে পারবেন যে, এ সি, আই, ই. খেতাবটি তখন সরকারের কোন শ্রেণীর লোককে দেয়া হত। c.l.E, পুরো কথাটা হল Companion of the Indian Empire-যার বঙ্গার্থ দাঁড়ায় ভারত সাম্রাজ্যের সহযোগী। বলাবাহুল্য, তখন ভারত ছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের হাতের মুঠোয়। সে সময়ে এ খেতাব যাঁকে দেওয়া হয়েছে তাকে দালাল ও পদলোভী বলতে অনেকেরই দ্বিধা নেই। অবশ্য সাধারণ মানুষ বঙ্কিমচন্দ্রকে সে অভিযোগে অভিযুক্ত করেন কি না, এ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই।

সাহিত্যে যে তিনি সম্রাট ছিলেন এতে হিন্দু মুসলমান সকলেই একমত। তাঁর লেখনী প্রতিভা সকলের কাছে অনস্বীকার্য। তিনি যে প্রচণ্ড ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলেন তাতেও সকলে একমত। কিন্তু তিনি যদি ইংরেজের শ্রেষ্ঠতম অনুগত প্রমাণিত হন তাহলে ভারতের শ্রেষ্টতম সম্মান-স্বাধীনতা আন্দোলোনের নায়ক তাকে বলা যাবে কি না এবং ঋষি নামের তিনি প্রকৃত অধিকারী কি না সে আলোচনা স্তব্ধ করে দেবার অবকাশ নেই। তাঁর লেখনী সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট না অসাম্প্রদায়িকতার গুণে পরিপুষ্ট তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। শ্মশ্রুধারী বা দাড়িওয়ালা মুসলমানদের প্রশংসা অথবা হেয় করার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “ভারত বর্ষের নগরে নগরে কংগ্রেসের দোষোদঘাটন উপলক্ষে শ্বেত কৃষ্ণ হরিং কপিল নানা বর্ণের দাড়ি একত্রিত হইয়া বদ্ধা আন্দোলিত....হইয়াছিল।

সেই সকল ছিন্ন অছিন্ন এবং বিচ্ছিন্ন শত্রুরাজির গতি, প্রক্রিয়া, বেগ আবেগ, সদ্বেগ ও উদ্বেগ সন্দর্শনে ভারত বর্ষে এই সিদ্ধান্ত হইয়াছে যে, মুসলমান কংগ্রেসে আসিতে চাহে না।... এক্ষণে শুনিতেছি, চাচাদিগের কোনই দোষ নাই। তাহারা সম্পূর্ণ স্বাধীন নহেন। বালক কলের পুতুল লইয়া খেলা করে দেখিয়াছি। সেগুলির কল টিপিলেই দাড়ি নাড়ে শুনিয়াছি। পাহাড়ে বনিয়া বড় বড় লোকে নাকি কল টিপিতেছে, তাই ইহারা দাড়ি নাড়িতেছেন।" (২৩ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪১, দৈনিক বসুমতী, ভুলে যাওয়া ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫) সাহিত্য সম্রাটের মুসলমান প্রীতির অথবা অপ্রীতির বিচারে মুসলমান জাতির উপর কী ধারণা ছিল তা জানার তার আর একটি লেখার নমুনা দেওয়া যেতে পারে-“ঢাকাতে দুইচারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে-কাক কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতিদুর্দম, অজেয়। ক্রিয়াবাড়ীতে কাক আর কুকুর, আদালতে মুসলমান।" (বাংলা ১২২৭ সালের অগ্রহায়ণের বঙ্গদর্শনের পৃষ্ঠা ৪০১ দ্রষ্টব্য)

বঙ্কিম দেশের কল্যাণে ‘আনন্দমঠ' রচনা করেছেন। তাতে বঙ্কিম লিখেছেন, “মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইল, হিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই ডাকিয়া রাজ্যে বসাইল। হিন্দু সিপাহি ইংরাজের হইয়া লড়িল। হিন্দুরা রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিন্ন জাতীয় বলিয়া কোন দ্বেষ নাই। আজিও ইংরাজের অধীন ভারত বর্ষে (হিন্দু) অত্যন্ত প্রভুভক্ত।”

একথা বললে বোধ করি অন্যায় হবে না যে, এ লেখার সাথে লেখকের পুরস্কারদাতা গুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের লেখার দারুণ মিল আছে। বঙ্কিমের যুগের সংবাদপত্রওয়ালা যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে ঈশ্বরগুপ্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ওপর কোঠার লোক। আর বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার প্রভাব শুধু বাংলা পত্রিকা নয়, ইংরেজী পত্রিকাতেও পূর্ণমাত্রায় ছিল। তাই তখন অন্যান্য পত্র-পত্রিকাগুলো এ দুই মহান লেখক ও সম্পাদকের অনুসরণ ও অনুকরণের প্রয়োজন অস্বীকার করেনি। তাতে জাতি ও দেশ কতটুকু উপকৃত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিচার্য বিষয়।

১৮৫৭-র মহাবিপ্লব বা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় (১৮ই জুন) সংবাদ ভাস্করের বাংলা সংস্করণে যা ছাপা হল তা থেকে কলকাতার হিন্দু-মুসলমানের অবস্থা, বড় ছোট জমিদারদের অবস্থা প্রশাসনের ব্যবস্থা, ইংরেজ সরকারের অবস্থা এবং পত্রিকার পরিচালকদের মানসিকতার পরিমাপ করা কঠিন কাজ নয়। ঐ পত্রিকাতে ছাপা হোল-“নগরীর ধনী মহাশয়েরা মেট্রোপলিটন কলেজে এবং ভারত বর্ষীর সভায় যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, গভর্ণমেন্টের সাহায্য কার্যে প্রাণপণ সে প্রতিজ্ঞানুরূপ যুদ্ধসজ্জা করিয়াছেন,

কলিকাতার উত্তর সিতিব। পপালের উত্তরাংশে পাইকপাড়া রাজবাড়ী অর্থাৎ শ্রীযুক্ত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর ও শ্রীযুক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুর আপনাদিগের বাড়ীর সম্মুখে রাজপথে নূন্যাদিক দুই সহস্র অস্ত্রধারী লোক নিযুক্ত রাখিয়াছেন। তাহাদিগের মধ্যে ৪০/৫০ জন গোরা, আমরা এতদ্দেশীয় লোক, গোরাদিগের হস্তে গুলিপোরা বন্দুক রহিয়াছে, দেশীয় সৈন্যরা ঢাল, তলবার, বন্দুকাদি লইয়া চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিতেছে, কলিকালের মধ্যে শোভাবাজারীয় উভয় রাজবাটিতে সিপাহি সকল বন্দুক লইয়া খাড়া রহিয়াছে মঙ্গলানিবাসী দত্তবাবুদিগের এবং জানবাজার নিবাসিনী শ্রীমতী রাণী রাসমণির বাটীতে গোরা সৈন্যসকল বন্দুক সৃহিত হৈ হৈ থৈ থৈ করিতেছে, নগরে মধ্যস্থল কলুটোলা অবধি বাগবাজার পর্যন্ত সেন, শ্রী দত্ত, মল্লিক, ঠাকুর, সিংহ ঘোধ মিত্র, বসু দেবাদি প্রত্যেক ধনীর বাড়ী দেশীয় সৈন্য ও গোরা সৈনারা যুদ্দোধ্যমে বাদোদ্যম করিতেছে, আমরা তাদৃশ ধনি নহি অথচ ঢাল, তলবার শড়কী বল্লম ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রধারী কয়েকজন দেশীয় পাইক রাখিয়াছি, এইরূপ যিনি যেমন মনুষ্য তিনি সেই প্রকার সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছেন।

সকল (হিন্দু) প্রজার বাড়ীতেই-ছাদের উপর ঝামা ইট, কাড়ি কাড়ি সাজাইয়াছে, ধনী দরিদ্র সাধারণ সকলে বাজপক্ষে হইয়াছেন, ধনী লোকেরা কেহ অশ্বারোহণে কেহ সকটারোহনে কেহ পদক্ষেপণে সমস্ত রাত্রি নগর ভ্রমণ করেন, অতএব নগর মধ্যে শত্রু প্রভেশ করিতে পরিবেক না, নগর মধ্যস্থ কলিঙ্গাদি যা সাহেবরাও দাড়িঝাড়া দিয়া উঠিয়াছিলেন, গভর্ণমেন্ট প্রত্যেক যবন পাড়ায় গোরা খাড়া করিয়া তাহাদিগের কান মলিয়া দিয়াছেন, আর নেড়ে ভায়ারা দাড়ি নাড়িয়া বাক্যলাপ করিতে পারেন না, তাহাদিগের একজন প্রধান অযোধ্যর বাদশা ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গমধ্যে কোট মার্শাল বিচারে আসিয়াছেন, দিল্লীস্থানীয় বঙ্গভঙ্গ বাদশাহ গৌরাঙ্গ রঙ্গ দর্শন করিয়া শয্যাগত হইয়াছেন।”

ইংরেজরা দিল্লী পুনর্দখন করলে ঐ ১৮৫৭-র অগ্নিবৎসরের ডিসেম্বর মাসে অবিভক্ত বিশাল বঙ্গের ২৫০০ ভাগ্যবান জমিদার ও নামী দামী হিন্দুর সই করা এক অভিনন্দন পত্র বর্ধমানের মহারাজার নেতৃত্বে তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেলের নিকট পাঠান হয়। তাতে লেখা

-"My Lord.-we, the undersigned Rajahs, Zemindars, falookdars, Merchants and other Natives of the province of Bengal take the earliest opportunity, on the retaking of Delhi, to offer your Lordship in council our warmest congratulation on the signal success which has attended the British armis. under circumstances unparalleled in the annals of British India....We have derived sincere consolation from the reflection that in Bengal proper there has been no disturbances, not even a symtom ol disaffection; but that on the contrary. the people have maintained that loyalty and devotion to the British Government whichled their ancestors to hall, and as far as they could to facilitate, the rising ascendancy of that power." (Bengaless' Address to the Governor-General of India, December 1857)

অর্থাৎ-হে প্রভু, আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী রাজা, জমিদার, তালুকদার, ব্যবসা এবং বাংলা মুলুকের অন্যান্য অধিবাসী আপনার সেনাবাহিনী দিল্লী পুনরুদ্ধার করে যে স্মরণীয় সাফল্য লাভ করেছে। যা ব্রিটিশ ভারতে অতুলনীয়। তার প্রতি আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন পাঠাবার সত্বর সুযোগ গ্রহণ করছি।-আমাদের গভীর সান্ত্বনা যে আমাদের এই বাংলায় কোন রকম গোলযোগ হয়নি, এমনকি (ইংরেজের প্রতি সামান্য আনুগত্যহীনতাও নয়। বরং জনগণ সেই আনুগত্য ও অনুরাগ দেখিয়েছে যা তাদের পূর্বপুরুষরা প্রদর্শন করে। তারা এই উদীয়মান ক্ষমতার প্রতি পত্তিকে সহজ করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।

ওদিকে সংবাদ ভাস্করে' লেখা হোল, হে পাঠক, সকলে উর্ধ্ববাহু হইয়া পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর, শত্রুরা দিল্লী দুর্গ অধিকার করিয়াছে দিলীর বাইরে মোটা করিয়া তোপ রাখিয়াছে, নানা স্থানে তাবু ফেলিয়া সমর মুখে রহিয়াছে, গাজীউদ্দিন স্থানে রাজকীয় সৈন্যদিগের উপরে কয়েকবার আক্রমণ করিয়াছিল, তাহারদিগের ইত্যাদি আক্রমণের কথা তোমরা শুনিয়াছ, এইক্ষণে জয়ধ্বনি কর। আমাদিগের প্রধান (ইংরেজ) সেনাপতি মহাশয় সসজ্জ হইয়া দিল্লী প্রদেশে প্রভেশ করিয়াছেন....। রাজসৈন্যরা ন্যুনধিক ৪০ তোপ এবং শিবিরাদি কাড়িয়া লইয়াছে হতাবশিষ্ট পাপিষ্ঠেরা দুর্গ প্রবিষ্ট হইয়া কপাট রুদ্ধ করিয়াছে আমারদিগেও-----দিল্লির প্রাচীরের উপর উঠিয়া নত্য করিতেছে, সম্বাদ পাইয়াছি পরদিনই দুর্গ লইবে, কি মঙ্গলসমাচার, পাঠকসকল জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর, হিন্দু প্রজাসকল দেবালয়ে সকলে পূজা দেও, আমারদিগের রাজ্যেশ্বর শক্রজয়ী হইলেন। (সংবাদ ভাস্কর, ২২.৬, ১৮৫৭: ভুলে যাওয়া ইতিহাস। (পৃষ্ঠা ৪৯)

ইংরেজের সঙ্গে সহায়তা প্রসঙ্গে অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর ‘চতুরঙ্গ' পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ) লিখেছেনঃ ইংরেজ ঐতিহাসিকরা বার বার উল্লেখ করেছেন, দেশের সর্বত্রই মধ্যবিত্ত সমাজ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ইংরেজ রাজশক্তির সহায়তা করেছে। Eighteen Fifty Seven-এর ডক্টর S.N.Sen বলেছেন; কলিকাতার শিক্ষিত দ্র নাগরিকগণ এবং মাদ্রাজের ন্যায় বাংলার তাবৎ ভূমাধিকারী অভিজাত সম্প্রদায় এ বিদ্রোহের ও বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যভাবে নিন্দা করেছেন। (পৃষ্ঠা ৪০৮)

Autobiography of Debendranath Tagore-এ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, কলিকাতার নব্য সম্প্রদায়, যেটি পাশ্চাত্য প্রভাবজাত, সেদিন সে-সম্প্রদায় শুধু চুপ করে থাকেনি, সক্রিয়ভাবে ইংরেজ রাজশক্তির প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছে।-এ বক্তব্যের সমর্থনে প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের এ উক্তিটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য-"if we were to be asked what Government we would prefer English or any other. we would one and all reply: English by all means-even, in preference to the Hindu Government." (Daily Reformer. July. 1931] are আমাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, আমরা ইংরেজ অথবা অন্য সরকার-কাকে বেশি পছন্দ করি, তাহলে একবাক্যে বলব যে, সবরকম ভাবে আমরা ইংরেজ সরকারেকই পছন্দ করি-এমনকি যদি হিন্দু সরকার হয় তার থেকেও।

“নেটিভ-বৃটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট রাজা রাধাকান্ত দেব কলকতার টাউন হলে ইংরেজীতে যে বক্তব্য রাখেন তাও উল্লেখযোগ্য; 'The Ilindus in this part of India. I am happy to observe have always been the most loyal subjects of the British Crown, evinced deep interest in its prosperity and were greatly instrumental in procuring for it. its earliest terrtorial acquisition in India." অর্থাৎ-এ মন্তব্য করতে আমি আনন্দ বোধ করছি যে, ভারতের এ অংশের হিন্দুরা বরাবরই ইংরেজ রাজ্যের সর্বাপেক্ষা অনুগত প্রজা হয়ে থেকেছে, আর সমৃদ্ধির ব্যাপারে সংশয়াতীত আগ্রহ দেখিয়েছে ও সমৃদ্ধি ঘটাবার চেষ্টা করেছে, এবং ভারতে ইংরেজের প্রাথমিক রাজ্য দখলের ব্যাপারে খুব সহায়ক হয়েছে।

হিন্দু পেট্রিয়ট'-এর সম্পাদক হরিশ মুখার্জ এ বিদ্রোহ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছে, “সিপাহী বিদ্রোহই কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহীদের কর্ম মাত্র। দেশের প্রজাবর্গের সহিত তাহার কোন যোগ নাই। প্রজাকুল ইংরেজ গভর্ণমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে।”

“সংবাদ ভাস্কর, সংবাদ প্রভাকর', হরকরা’, ‘রিফর্মার,' 'ফ্রেণ্ডস্ অব ইণ্ডিয়া' প্রভৃতি সংবাদপত্রগুলোর লক্ষ্যও বিপ্লব-বিরুদ্ধ ছিল। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য ছিল, প্রধানতঃ মুসলমানদের এ অভ্যুথ্থান ও আন্দোলন ব্যর্থ হোক। অবশ্য এ সম্পর্কে বহির্ভারতীয় নিরপেক্ষ চিন্তাবিদ লেখক কার্লমার্কস জানিয়েছে, “অভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ভারতীয় জনগণ, অসহনীয় পীড়নের বিরুদ্ধে তারা সংগ্রামে নামে। বৃটিশ শাসক শ্রেণীরা (এ) অভ্যুত্থানকে কেবল সশস্ত্র সিপাহী বিদ্রোহরূপে দেখাতে চায় তার সাথে যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক অংশ জড়িত তা লুকাতে চায় তারা...” (প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ-১৮৫৭-১৮৫৯, পৃষ্ঠা ১০)

অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের সৃষ্টি করা জমিদার শ্রেণীর নির্যাতনেও শোষণে দেশ কিভাবে ধ্বংস হয়েছে তা ইতিহাসে স্বীকৃত; সে বিষয়ে পূর্বেও আলোচনা হয়েছে। সারা দেশ যখন অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে এবং অস্ত্র ধরেছে তখন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন, “সকল জমিদার অত্যাচারী নহেন। দিন দিন অত্যাচার পরায়ণ জমিদারের সংখ্যা কমিতেছে। কলিকাতাস্থ সুশিক্ষিত ভূস্বামীদিগের কোন অত্যাচার নাই-যাহা আছে, তাহা তাহাদের অজ্ঞাতে এবং অভিমত বিরুদ্ধে নায়েব গোমস্তাগণের দ্বারা হয়।.... আমরা জমিদারের দ্বেষক নহি। কোন জমিদার কর্তৃক কখনো আমাদিগের অনিষ্ঠ হয় নাই। বরং অনেক জমিদারকে আমরা প্রশংসাভাজন বিবেচক মনে করি।" (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯২, ২৯৭)

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই একজন কলিকাতাস্থ সুশিক্ষিত ভূস্বামী বা জমির মালিক ছিলেন। (বদরুদ্দিন উমরঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ)। 'জমিদারদের সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র আরও লিখলেন, “যাঁহারা জমিদারদিগকে কেবল মিথ্যা নিন্দা করেন আমরা তাহাদের বিরোধী। জমিদারদের দ্বারা অনেক সৎকার্য হইতেছে।" (দ্রঃ বঙ্কিম রচনাবলী)

কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বৃহত্তর দরিদ্র শ্রেণী অর্থাৎ শোষিত ও প্রজাশ্রেণী সরকারের বিরুদ্ধে যখন গুমরে উঠল তখন ইংরেজের সমর্থনে বঙ্কিমচন্দ্র দেশবাসীর জন্য সুচিন্তিত যে বাণী দান করেছিলেন তা হচ্ছে এ-“চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধ্বংসে বঙ্গ সমাজের ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরাজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরাজদিগকে দিই না। যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্কী হইব সেই দিন সে পরামর্শ দিব।” (বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৩০৯-১০) ইংরেজের নির্দেশে কর আদায়ের নামে জমিদারদের যে অত্যাচার চলছিল সে প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজ অথবা জমিদার-যে কোন এক পক্ষের সমর্থনে লিখলেন, “অনেক জমিদারীর প্রজাও ভাল নহে। পীড়ন না করিলে খাজনা দেয় না। সকলের উপর নালিশ করিয়া খাজনা আদায় করিতে গেলে জমিদারের সর্বনাশ হয়।” (ঐ, পৃ-২৯৮)

এ সময় ইংরেজদের শোষণ বন্ধ করার প্রতিবাদে বিলেতী জিনিস ব্যবহার বয়কট করার ঝড় চলতে থাকে। মুনাফা লুটার পরিমাণ কমে যাবে বলে ইংরেজরা তাতে সন্ত্রস্ত হয়। সেই সময় ঋষি' দেশের কোন এক কল্যাণে সুচিন্তিত বাণী দান করলেন-“যদি (ইংরেজরা) কাহারও ক্ষতি না করিয়া মুনাফা করিয়া থাকে, তবে তাহাতে আমাদের অনিষ্ট কি? যেখানে কাহারও ক্ষতি নাই, সেখানে দেশের অনিষ্ঠ কি? আপত্তির মীমাংসা এখনও হয় নাই।

আপত্তিকারকেরা বলিবেন যে, ঐ ছয়টি টাকায় দেশী তাতীর কাছে থান কিনিলে টাকা ছয়টা দেশে থাকিত।....শুলকথা, ঐ ছয় টাকা যে দেশী তাঁতী পাইল না, তাহাতে কাহারও ক্ষতি নাই।....তার্কিক বলিবেন তাতীর ক্ষতি আছে। এ খানের আমদানির জন্য তাতীর ব্যবসায় মারা গেল। তাতী থান বুনে না ধূতি বুনে। ধুতির অপেক্ষা থান সস্তা, সুতরাং লোকে থান পরে, ধুতি আর পরে না। এজন্য অনেক তাঁতীর ব্যবসায় লোপ পাইয়াছে।

উত্তর। তাহার তাঁতবুনা ব্যবসায় লোপ পাইয়াছে বটে, কিন্তু সে অন্য ব্যবসা করুক না কেন? অন্য ব্যবসায়ের পথ রহিত হয় নাই। তাঁত বুনিয়া আর খাইতে পায় না, কিন্তু ধান বুনিয়া খাইবার কোন বাধা নাই।" (বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১১-১২)

চাপা পড়া সত্য ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে ইংরেজ শাসনকালে ১৮০০ খৃষ্টাব্দে টাকায় একমন পাঁচ সের চাল মিলত। ১৮১৪ সনে অর্থনৈতিক অবনতি হয়ে টাকায় ৩৭ সের চাল হল। ১৮২১-এর আরও অবনতি হয় টাকায় ৩০ সের হয়। ১৮৩৫-এ তা নেমে এসে ২৪ সেরে দাঁড়ায়। ১৮৭৫ সনে কমতে কমতে টাকায় ১৭ সেরে পৌছায়।

ভারত বর্ষের বিশ্ববিখ্যাত তাঁতশিল্প ধ্বংস করার জন্য সুবিখ্যাত তাঁত শিল্পীদের বুড়া আঙ্গুল কেটে দেয়া হয়েছিল-এ তথ্য প্রচলিত ইতিহাসে না থাকলেও চাপা পড়া ইতিহাসে মজুত আছে। ১৯৭২ তে ছাপা S. D. Sawant সংকলিত Our Freedom Movement নামক সচিত্র ইংরেজী ইতিহাসের ৩ পৃষ্টায় গোলটুপি পরা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মুসলমান তাঁতশিল্পীর বুড়া আঙ্গুল কাটা অবস্থায় শোকাহত স্ত্রী এবং ক্ষুধায় লুটিয়ে পড়া শায়িত বাচ্চা সন্তানের ছবি মুদ্রিত হয়েছে। ছবিটির নির্দেশমুলক বক্তব্যে লেখা আছে-"The British even cut the thumbs of expert artisans."m

দেশী কাপড়কে অচল করার জন্য ১৮১৩-১৪ খৃষ্টাব্দে ৮ লাখ গজ বিদেশী কাপড় কলকাতায় আনা হয়। ১৮২১ সনে বিলেত থেকে একেবারে ২৫ গুণ অর্থাৎ ২ কোটি গজ বিলেতী কাপড় এসে পৌছয়। সুতরাং সুস্পষ্ট বোঝা যায়, ১৮১৪-২১ পর্যন্ত বস্ত্রশিল্পের কতটা অবনতি হয়েছিল। ১৮৩৫-এ ৫ কোটি গজ কাপড় আনা হল। ১৮৭৫ তে আনা হল ৬১ কোটি গজ। ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে আসে ১ অর্বুদ ৫৬ কোটি গজ কাপড়। বিলেতী মাল এনে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার নমুনা দেখার সাথে সাথে ভারতীয় সম্পদ কিভাবে পাচার করা হয়েছে তার নমুনা দেখাতে বলা যায় ১৯১৩ খৃষ্টাব্দেই শুধু ৬ কোটি ৭৫ লাখ মণ চাল আর ৩ কোটি ৫০ লাখ মণ গম ভারত থেকে বিদেশে চালান করা হয়েছে। সে সাথে ১ কোটি ৫০ লাখ মণ তুলা ও ২ কোটি ৫০ লাখ মন পাট পাচার করা হয়েছে। এ একই বছরে চা ভারত থেকে বিদেশে পাঠান হয়েছে ৩৬ লাখ মন (মায়ীশাতুল হিন্দ পৃষ্ঠা ৯৫)

১৯১৮ থেকে ১৯১৯ এর মাঝে একটা হিসেবে পাওয়া যায়, ভারত থেকে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ মণ চাল বিদেশে পাঠান হয়েছে। (শ্রীদয়াশঙ্কর দোবে? মজলুম কিষাণ, পৃষ্ঠা ৮২)

পূর্ব আলোচনায় দেখান হযেছে, তাছাড়া দেশি বিদেশি বেশির ভাগ ঐতিহাসিকই এ বিষয়ে একমত যে, তাঁতীদের ধংস করে দেয়া হয়েছে, তাদের বুড়া আঙ্গুল কেটে দেয়া হয়েছে এবং 'Drain Theory' অনুযায়ী দেশের ধনসামগ্রী স্রোতের মত প্রবাহিত হয়ে জমা হয়েছে ইংল্যাণ্ডে। অবশ্য মহাজ্ঞানী বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা, তাতীরা তাদের নিজের দোষেই ধ্বংস হয়েছে। তার মতে তাঁত শিল্প ধ্বংস হয়ে যাক বা ক্ষতিগ্রস্থ হোক-তারা তাদের জাতব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা অর্থাৎ চালু করুক না কেন! তাঁর ভাষায় “চাষীর সংখ্যা বাড়িলে তাহাদের লাভ কমিবে না। অতএব বাণিজ্য হেতু যাহাদের পূর্বব্যবসায়ের হানি হয়,

নূতন ব্যবসায়াবলম্বনে তাহাদের ক্ষতিপূরণ হয়। তাহা হইলে বিলাতী থান খরিদে তাঁতী ক্ষতি নাই। তাঁতীরও ক্ষতি নাই, ক্রেতাদিগেরও ক্ষতি নাই। তবে কাহার ক্ষতি? কাহারও নহে। যদি বণিক থান বেচিয়া যে লভ্য করিল, তাহাতে এ দেশীয় কাহারও অর্থক্ষতি হইল

, তবে তাহারা ইংরেজরা) এ দেশের অর্থভাণ্ডার লুঠ করিল কিসে? তাহার (ইংরেজের) লভ্যের জন্য এ দেশের অর্থ কমিতেছে কিসে?" (বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১২) আমাদের মনে হয়, মহান বঙ্কিমের এটা মনের কথা হলেও এরকম উক্তি সৃষ্টি করে ইতিহাসের ইন্ধন বাড়াতে তাঁর দ্বিধা থাকা উচিত ছিল।

আমরা ভক্তিতে অথবা আতঙ্কে যদি মেনেই নিই যে, ইংরেজের কোন অত্যাচার ছিল, শুধুই তারা ভারতীয়দের ধনবৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি সাধনে নিয়োজিত ছিলেন, তাহলে পুরাতন দলিল-দস্তাবেজ পত্র-পত্রিকা, সরকারী রেকর্ডস, ভারতীয় ও অভারতীয় লেখকদের লেখা এখন অবিশ্বাস করা অথবা সম্রাট ও ঋষির সম্মানে তা নষ্ট করা ছাড়া উপায় কি?

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ডিসকাভারী অফ ইণ্ডিয়া' গ্রন্থে তখনকার কর্মহারা অসহায় বেকার ভারতীয় শিল্পীদের জন্য লিখেছেনঃ তাদের কি গতি হবে? পুরান পেশা তাদের বন্ধ হয়ে গেল, নতুন পেশার দ্বার উন্মুক্ত নেই। তাদের অবশ্য মৃত্যুর পথ খোলা ছিল, এবং তারা লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করল। ভারতের ইংরেজ গভর্ণর লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮৩৪ সনের রিপোর্টে বলেছিলেন; তাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনীর কোনও তুলনা নেই বাণিজ্যের ইতিহাসে। তাঁতীদের অস্থিতে ভারতের পথ প্রান্তর শুভ্র হয়ে উঠেছে। (পৃষ্ঠা ৩৫২) বঙ্কিমচন্দ্র সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজকে ভারত বর্ষ থেকে তাড়াবার নায়ক ছিলেন-একথা যদিও জোর করে মানতে এবং দেশের ছেলেদের মানাতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু তার লেখনীকে কিভাবে অস্বীকার করা যাবে? তাঁর মতামত সমর্থিত লেখনীই প্রমাণ করবে তার উদ্দেশ্যে কথা। যেমন তিনি লিখেছেন; “ইংরেজ ভারত বর্ষের পরম উপকারী। ইংরেজ আমাদিগকে নতুন কথা শিখাইতেছে, যাহা আমরা কখন জানিতাম না, তাহা জানাইতেছে; যাহা কখন দেখি নাই, শুনি নাই, বুঝি নাই, তাহা দেখাইতেছে, শুনাইতেছে, বুঝাইতেছে; যে পথে কখন চলি নাই, সে পথে কেমন করিয়া চলিতে হয়, তাহা দেখাইয়া দিতেছে।

সেই সকল শিক্ষার মধ্যে অনেক শিক্ষা অমূল্য যে সকল অমুল্য রত্ন আমরা ইংরেজদের চিত্রভাণ্ডার হইতে লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুইটির আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলাম-স্বাতন্ত্রপ্রিয়তা এবং জাতিপ্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে, তাহা হিন্দু জানি না।” (বঙ্কিম রচনাবলী, পৃষ্ঠা ২৪০-৪১) ইংরেজ বিচারপতিরা ভারতীয় প্রত্যেকের বিচার করার অধিকার রাখতেন, কিন্তু অত্যন্ত অন্যায় এবং আশ্চর্য ব্যাপার যে ভারতীয় বিচারপতিরা কোনক্রমেই কোন ইংরেজ আসামীর বিচার করার অধিকার পাননি। এ বৈষম্যমূলক আচরণে শিক্ষিত গ্রুপ বিক্ষোভের ঝড় তুলবেন জেনে ভারতপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেনঃ ভারতীয়রা ইংরেজদের বিচার করতে পারে না কিন্তু শূদ্রেরা কি ব্রাহ্মণদের বিচার করতে পারত?' তিনি (দেশবাসীর নিকট) প্রশ্ন করেছেন যে, দ্বারকানাথ মিত্র হাইকোর্টের একজন জজ, রামরাজ্যে তার স্থান কোথায় ছিল? প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের ছিল দোর্দণ্ড দাপট, কিন্তু ইংরেজ আমলে এরূপ শ্রেণীর জোরে কেহ আধিপত্যের অধিকারীর নয়।' (বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃষ্ঠা ১৩৬-৩৭)

ভারতীয় মুসলমানরা যখন ইংরেজ বিতাড়ন ও দেশীয় শাসনতন্ত্র কায়েম করতে "যত্নবান হলেন তখন অনেক অমুসলমানও বুঝতে পারলেন-বিদেশী শাসন উচ্ছেদ করে দেশ শাসক দ্বারা স্বদেশীয় শাসন প্রবর্তিত হলে বোধ হয় ভালই হয়। ঠিক তখন নেতা ঋষি বঙ্কিম লিখলেন, “স্বাধীনতা দেশী কথা নহে, বিলাতী আমদানী লিবার্টি' শব্দের অনুবাদ,...ইহার এমন তাৎপর্য নয় যে, রাজা স্বদেশীয় হইতেই হইবে।”

ইতিহাসের সত্য তথ্য একথা প্রমাণ করে যে ভারতীয় কোন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্রের যোগাযোগ ছিল না, এমনকি ইংরেজের বিরুদ্ধে যে তিনি লেখালেখি করছেন সে প্রমাণও দুর্লভ। তাই সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যয় লিখেছেন, “তাছাড়া সরকারী চাকুরে হওয়ার ফলে পাছে সরকারে রোষা নজরে পড়েন সে আশঙ্কায় রাজনীতি সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে লিখতেও দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন।" [বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃষ্ঠা ১১৩]

তখনকার বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীদের মত তিনিও ১৮৫৭-র বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন না। এমনকি তার বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে লেখনীকেও তিনি সমর্থন করতে পারেন নি। সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ও এ বক্তেব্যের সমর্থন লিখেছেন-“বাংলার সমকালীন বুদ্ধি জীবীদের মতো তিনিও সিপাহি বিদ্রোহকে সমর্থন করেন নি। আবার দীনবন্ধু মিত্রের একান্ত বান্ধব বঙ্কিমচন্দ্রে নীলকরদের অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেও সে বিষয়ে নীরব থাকেন।' (বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃষ্ঠা ১১৪)

মহাভারতকে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাস বলে তিনি দাবী করেছেন এবং প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তিনি মহাভারত বিভক্ত ঋষি, তা সত্ত্বেও তিনি কেন দেশবাসীর স্বার্থে সর্বভারতীয় ভাষা সংস্কৃতর জন্য, অন্ততপক্ষে বাংলা ভাষার জন্যও সুপারিশ করলেন না? উপরন্তু সর্বভারতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষারই তিনি পক্ষপাতী ছিলেন। (বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃষ্ঠা ১৬৬.১৪৩)

ভারত-ঋষি সংস্কৃত ভাষার কথা যে ভুলে যাননি তার প্রমাণ মেলে তাঁরই ভাষায়-“ভারত বর্ষীয় নানা জাতি একমত, একপরামী একোদ্যোগী না হইলে ভারত বর্ষের উন্নতি নাই। এই মতৈক্য একপরামর্শীত্ব একোদ্যম কেবল ইংরেজীর দ্বারা সাধনীয়; কেন না এখন সংস্কৃত লুপ্ত হইয়াছে। বাঙ্গালী, মহারাষ্ট্রী, তৈলজী, পাঞ্জাবী ইহাদের সাধারণ মিলন-ভূমি ইংরাজি ভাষা। এই রজ্জুতে ভারতীয় ঐক্যের গ্রন্থি বাধিতে হইবে।" (বঙ্কিম রচনাবলী, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৬-১৭-যোগেশচন্দ্র বাগল লিখিত ভূমিকায় উদ্ধৃত)

ইংরেজ শাসকের অধীনে ভারতবাসীকে অনুগত করার জন্য অথবা ইংরেজকে ভারতবাসীর পদানত করার জন্য-যে কোন একটি কারণে তিনি লিখেছেন, “গৃহস্থ পরিবারে যে গঠন সমাজের সেই গঠন। গৃহকর্তার ন্যায় পিতা-মাতার ন্যায় রাজা সমাজের শিরোভাগ। তাহার গুণে, তাঁহার দণ্ডে তাঁহার পালনে সমাজ রক্ষিত হইয়া থাকে। পিতা যেরূপ সন্তানের ভক্তির পাত্র, রাজাও সেরূপ প্রজার ভক্তির পাত্র।" ইংরেজের শাসনের নামে শোষণের দৃশ্য শিক্ষিত নিরক্ষর সকলকেই অবাক করে .. একদল সাহসী হয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত, আহত প্রহৃত অথবা কারাগারে নির্বাসিত হন; তারা ভারতবাসীর শ্রদ্ধাস্পদ ঐতিহাসিক উপাদান।

আর যাঁরা বেদনায় মর্মাহত হয়ে চুপ করে সহ্য করে গেছেন, সাধ্য হয়নি তা রুখবার-তারাও জাতির কাছে অশ্রদ্ধার পাত্র নন। কিন্তু যারা অপশাসন আর শোষণের স্বপক্ষে ওকালতি করেছেন, কলম ধরেছেন এবং হৃদয় দিয়ে সমর্থন করেছেন, তাদেরকে দেশের শত্রু বলতে কেহ লজ্জা করবে না। ঋষি, সাহিত্য সম্রাট, ভারতের স্বাধীনতার স্রষ্টা বলে কথিত বঙ্কিমচন্দ্রকে

সরকারের প্রচারযন্ত্রে নিষ্পেষণে শ্রেষ্টতম সম্মানের আসনে বসাতে গিয়ে ভাবতে হয় কি করে তিনি একথা লিখতে পেরেছিলেন-“উষ্ণতাজনিত শারীরিক শৈথিল্য, পরিশ্রমে নিস্পৃহতা ও ভিন্নদেশে গমনেচ্ছার ভবে দেশের (ভারতের) ধনোৎপাদন যথোচিত বর্ধিত হয়নি:”-এখানে বুঝতে বেশি সুবিধা হবে না যে, তিনি অবনতির কারণ হিসেবে ইংরেজকে বাদ দিয়ে ভারতবাসীকেই অভিযুক্ত করেছেন।

আমাদের ভারতে রামমোহন হতে দাদাভাই নৌরজী পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক নামকরা নেতারা দেখিয়েছেন ভারতের ধন-ঐশ্বর্ষ কিভাবে ইংল্যাণ্ডে স্রোতের মত চলমান গতিতে বয়ে গিয়ে জমা হয়েছে, যেটা ড্রেইন থিওরী (drain theory) নামে পরিচিত। কিন্তু মহাভাগ্যবান, বহু খ্যতি, খেতাব ও পুরস্কারপ্রাপ্ত বঙ্কিমচন্দ্র লিখেলেন : “এই সকল তত্ত্ব যাহারা বুঝিতে যত্ন করিবেন, তাহারা দেখিবেন যে কি আমদানিতে কি রপ্তানিতে, বিদেশীয় বণিকেরা আমাদের টাকা লইয়া যাইতেছেন না এবং তন্নিবন্ধন আমাদিগের দেশের টাকা কমিতেছেন না।

বরং বিদেশীয় বাণিজ্য কারণ আমাদিগের দেশের ধন বৃদ্ধি হইতেছে। যাহারা মোটামুটি ভিন্ন বুঝিবেন না, ভাঁহারা একবার ভাবিয়া দেখিবেন, বিদেশ হইতে কত অর্থ আসিয়া এদেশে ব্যয় হইতেছে।" (দ্রষ্টব্য বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খ, পৃষ্ঠা ৩১৩) বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের এসব কথাগুলো সত্য ও সঠিক বলে বিশ্বাস করতে গিয়ে যদি শত শত পণ্ডিত ঐতিহাসিক ও লেখকের লেখাকে মিথ্যা বলতে হয় তাও ভাল, তবুও সরকারি কৃপায় যে শিক্ষা পাওয়া যায় সে শিক্ষা বজায় রাখতে বঙ্কিমকে ভারতের স্বাধীনতার স্রষ্টা এবং ঋষি বলতে ক্ষতি কি? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দায়িত্ব কারো একার নয়, সমগ্র চিন্তাশীল জাতির।

অত্যাচারী ইংরেজের সপক্ষে প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁদের অত্যাচারের কাহিনী ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ব্যরিষ্টার মিঃ ফুলার তাঁর ভারতীয় চাকরকে সামান্যতম ক্রটিতে লাথি মেরে হত্যা করেন। ইংরেজ-আদালতে জরিমানা হয় মাত্র ৩০ টাকা। ত্রিবাঙ্কুরের দুজন ইংরেজ নীলকর সাহের তাঁদের সুজন চাকরকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে বিদালোকে মাটিতে পুঁতে ফেলেন বিচারে অবশ্যই ফসি অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মাত্র তিন বছর বিনা শ্রমে কারাদণ্ড দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কানপুরে এক ইংরেজ অফিসার ভারতীয় শ্রমিককে লাথি মেরে হত্যা করেন।

শ্বেতাঙ্গ জজের বিচারে তার মাত্র ২০০ টাকা জরিমানা হয়। ইংরেজ এজেন্টরা ভারতীয় শ্রমিকদের প্রকাশ্যে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করত, অথচ বলত, নেটিভকে (ভারতীয়কে) বেত্রাঘাত করার অধিকার আছে, তার জন্য শাস্তি হয় না....আসামের চীফ কমিশনার কটন ইংরেজদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন নেটিভদের বেত্রাঘাত, জখম ও খুন করর। দ্রষ্টব্য জাস্টিস্ এ. মওদুদ); স্বাধীনতা দিয়েছিলেন নেটিভদের বেত্রাঘাত, জখম ও খুন করার। (দ্রষ্টব্য জাস্টিস এ মওদুদ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ; সংস্কৃতির রুপান্তর, পৃষ্ঠা ১৮০)

এসব ঘটনাগুলো যদিও বঙ্কিম এর জানা ছিল তবুও তার ধৈর্যও সহনশীলতার প্রশংসাই করছি। তার নিজের একটি ঘটনা উদ্ধৃত কছি-“হরমপুরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট থাকা কালে ১৮৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুর ক্যান্টনমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার কর্ণেল ডাফিন কর্তক অপ্রত্যাশিতভাবে প্রহৃত হন। মুর্শিদাবাদ পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, বাবু বঙ্কিমচন্দ্র পাঙ্কি চেপে কোর্ট থেকে বাড়ী যচ্ছিলেন একটি ক্রিকেট খেলার মাঠের উপর দিয়ে। তখন ডাফিনসহ ইউরোপীয়রা মাঠ ক্রীড়ারত ছিল। ডাফিন (সাহেব) বাবুর বেয়াদবিতে ক্রুদ্ধ হন এবং বাবুকে প্রহার করেন ও কয়েকটি ঘুষি মারেন।” (দ্রষ্টব্য জাষ্টিস এ. মওদুদ: মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃষ্ঠা ১৮০)

বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাজসিংহ' নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রকৃত মুসলমানকে যে বেদনা নিবেই তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, হিন্দু জাতি যেমন সীতা, সাবিত্রী প্রভৃতি মহিলাদের শ্রদ্ধা করেন, তেমনি মুসলমানদের কাছে তাপসী রাবেয়া, মহীয়সী জেবুন্নেসা এ রকম শ্রদ্ধার পত্রী। যে জেবনে কলঙ্কমুক্ত চন্দ্রের মত প্রভাময়ী, তাঁকে কুলটার মত ভ্রষ্টার চরিত্র নামিয়ে এনে মোবারক খানের প্রণয়ী সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য সম্রাট'। এ রাজসিংহ ভারত স্বাধীন হবার পরে আজও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হওয়া উচিত নয়। অতএব এ রাজসিংহের প্রেমিকদের ও স্তাবকদের প্রতিও প্রকৃত মুসলমানের শ্রদ্ধা রাখা মুশকিল। হিন্দু মুসলমানের মৈত্রীর পথে ফাটল ধরাতে রাজসিংহের ভুমিকা উল্লেখযোগ্য।

‘আনন্দমঠ, পুস্তকটিও মুসলিম মানলে ব্যথাদায়ক। সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে, পরাধীনভারত বর্ষে স্বাধীনতার জন্য যারা কলম ধরেন বা ধরেছেন তাদের কলম, অগ্নিবর্ষণ করেছে শাসকের বিরুদ্ধে, কিন্তু ঋষি ও সম্রাট বঙ্কিমের কলম শোষিত, দরিদ্রক্লিষ্ট উপেক্ষিত মুসলমানদের বিরুদ্ধেই চালিত হয়েছে কিনা তা চিন্তাশীলদের কাছে হজেই অনুমেয়।

মজার কথা হল, যে “আনন্দমঠ' মুসলমানদের বিরুদ্ধে কলম ধরে বঙ্কিমচন্দ্র হিরো হয়ে গেলেন সেই ঘটনা যে ঐতিহাসিক তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সেটা মজনুশাহ ও তাঁর অনুগামীদের ঘটন-যে মজনুশাহের কথ্য এ পুস্তকে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। সম্রাট সেখানে মুসলমানদেরকে ফকিরের পরিবর্তে সন্নান বা সন্তান দল সৃষ্টি করে ফকির সন্ন্যাসীদের ইংরেজ-বিরুদ্ধ সংগ্রামকে তিনি তার কলমের নিপুণতা হিন্দু-মুসলমানের লডা়ই বলে চিত্রিত করতে চেয়েছেন। তার এ শিল্পনিপুণতা নাম্প্রতিকতার জন্ম দিয়েছে ও দেশ বিভাগের ক্ষেত্র তৈরি করেছে-একথা যে অসত্যতা শপথ করে বলা যায় ন। অধ্যাপক মুহাম্মদ আবু তালিব লিখিত ফকীর মজনুশাহ' পুস্তক পড়লে এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টি হবে ! প্রকৃত ইতিহাসের চাপা পড়া পাতায় এত জীবন্ত তথ্য থাকতেও আমরা ভারতবাসী বঙ্কিমচন্দ্রের গুণ গেয়ে গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছি। এসবের কি তাহলে কেহ খবর রাখেন না? নাকি খবর রাখা সত্ত্বেও সত্যের অপলাপ করেন? একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে বলা যায়, আইনস্টাইন, ফ্যারাডেও নিউটনের মত বৈজ্ঞানিক যদি কোন অখ্যাত লোকের জন্যও লেখেন যে তিনি বিজ্ঞানী-সেখানে প্রখর চিন্তাশক্তি থাকা সত্ত্বেও মানুষ সত্যাসত্য নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করতে যাবে না।

এখানে মনে পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, যিনি বিলেত থেকে নোবেল প্রাইজ এবং ইংরেজের কাছ থেকে নাইট' উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি যদি বলে থাকেন অথবা বলান হয়ে থাকে যে বঙ্কিমচন্দ হিমালয়ের মত উচু ছিলেন-সেখানে সাধারণ মানুষ জানবার চেষ্টাই করবে না যে তিনি বস্তুতঃ পর্বত ছিলেন, না উইটিপি। ভারতবিখ্যাত তথা বিশ্ববিখ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জন্য লিখেছেন-“যেখানে মাতৃভাষায় এত অবহেলা, সেখানে মানবজীবনের এক শূন্যতা, দৈন্য কেহই দূর করিতে পারেনা।

এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিত শ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সঙ্কুচিত বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন। তিনি আর লিখেছেন, “কিন্তু বঙ্কিম সাহিত্যে কর্মযোগী ছিলেন।... বঙ্কিমের ন্যায় তেজস্বী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহই লোকাচার দেশাচারের বিরুদ্ধে এরূপ নির্ভীক সুস্পষ্ট উচ্চারণে আপন মত প্রকাশ করতে সাহ করিত ন! কিন্তু সহিত মহারথী বঙ্কিম দক্ষিণে বামে উভয় পক্ষের প্রতিইঃ তিক্ষ্ন শরচালন করিয়া অকুণ্ঠভাবে অগ্রসর হইয়াছেন।...তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গসাহিত্যে ভাবমন্দাকিনীর অবতারণ করিয়াছেন।...এই কথা স্মরণে মুদ্রত করিয়া সেই বাংলা লেখকদিগের গুরু, বাংলা পাঠকদিগের সুহৃদ এবং সুজলামুফল মলয়জশীগুলো বঙ্গভূমির মাতৃবৎসল প্রতিভাশালী সন্তানের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করি।”

তাহলে দেখা গেল বিশ্বকবি নিজেই বঙ্কিমচন্দ্রের জন্য লিখলেন, “শিক্ষিত শ্রেষ্ঠ', সাহিত্যে কর্মযোগী', সাহিত্য-মহারথী', 'ভগীরথের ন্যায় সাধনাকারী', বাংলা লেখকদিগের গুরু' ইত্যাদি। অবশ্য সেকালে নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক হিন্দু লেখক যে ছিলেন না তা নয়। তারা বঙ্কিমের বিরুদ্ধে যে কলম ধরেননি তাও নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমের তুলনায় তাঁরা ছিলেন অতীব দুর্বল ও ক্ষীণ।

অবশ্য রবীন্দ্রনাথও যেটুকু একেবারে অস্বীকার করেন নি-যেমন তিনি লিখেছেন, “যে কালে বঙ্কিমের নবীনা প্রতিভা লক্ষ্মীরূপে সুধাভাণ্ড হস্তে লইয়া বাংলাদেশের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন তখনকার প্রাচীন লোকের বঙ্কিমের রচনাকে সসম্মান আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা করেন নাই।” আরও লিখেছেন, "মনে আছে বঙ্গদর্শনে যখন তিনি সমালোচক পদে আসীন ছিলেন, তখন তাহার ক্ষুদ্র শত্রুর সংখ্যা অল্প ছিলনা। শত শত অযোগ্য লোক তাকে ঈর্ষা করিত এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িত না। (দ্রষ্টব্য বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা-সমালোচনা সংগ্রহ, ১৯৫৫, পৃষ্ঠা ২৪৪-৫৫)

আমাদের মতে, কিছু শক্তিশালী স্বাধীনচেতা মানুষ আগেও ছিলেন, আজও আছেন, আগামীতেও থাকবেন যারা নিজস্ব বিবেচনা ক্ষমতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। প্রচলিত ধারণায় মনে করা হয়ে থাকে, বঙ্কিমচন্দ্র একজন ঋষি, নিরপেক্ষ, উদার, মহান, ভারতের উন্নতির মন্ত্রের স্রষ্টা, প্রথম শ্রেণীর আর্য সন্তান, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ধর্মীয় পুস্তকাদির পৃষ্ঠাপোষক এবং উন্নতির পথপ্রদর্শক। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যাবে অন্যরকম-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্য তিনি লিখেছেন, “বিদ্যাসাগর কঠিন সব সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাংলা ভাষার ধাপটা খারাপ করে গেছেন।

প্যারীচাঁদ মিত্রের সমালোচনায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “আমি নিজে বাল্যকালে ভট্টাচার্য অধ্যাপকদিগকে যে ভাষায় কথোপকথন করিতে শুনিয়াছি, তাহা সংস্কৃত-ব্যবসায়ী ভিন্ন অন্য কেহই ভাল বুঝিতে পারিতেন না। তাহারা কদাচ খয়ের বলিতেন না-খদির' বলিতেন; কদাচ চিনি বলিতেন না-শর্করা বলিতেন। ঘি' বলিলে তাহাদের রমনা অশুদ্ধ হইত-আজই বলিতেন, কদাচিৎ কেহ ঘৃতে নামিতেন। চুল' বলা হইবে

-কেশ বলিতে হইবে। কলা বলা হইবে না-রম্তা' বলিতে হইবে। ফলাহারে বসিয়া দই চাহিবার সময় দধি' বলিয়া চিৎকার করিতে হইবে...পণ্ডিতদিগের কথোপকথনের ভাষাই যখন এইরূপ ছিল, তখন তাঁহাদের লিখিত বাঙ্গালা ভাষা আরও কি ভয়ঙ্কর ছিল তাহা বলা বাহুল্য। এরূপ ভাষায় কোন গ্রন্থ প্রণীত হইলে তাহা তখনই বিলুপ্ত হইত; কেন না কেহ তাহা পড়িত না। কাজেই বাঙ্গালা সাহিত্যের কোন শ্রীবৃদ্ধি হইত না।" (ঐ, পৃষ্ঠা ২৪১)

এরকম ঐতিহাসিক দলিল ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকারি সাহায্য ও উৎসাহে যদি তার বিপরীত শেখান হয় তাহলে তাতে ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষিত হল না ভক্ষিত হল এখনই সে বিচারে আমরা যাচ্ছি না।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন