HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কিতাবুল ইলম

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কিতাবুল ইলম

সংকলন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

সম্পাদনা

মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল

ভূমিকা
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ

‘কিতাবুল ইলম’ বইটি বের করতে পেরে মহান আল্লাহর অগণিত শুকরিয়া আদায় করছি। দরূদ ও সালাম পেশ করছি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর উপর।

ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য একটি ফরয কাজ। কারণ, কোন মুসলিম যদি শরীয়ত সম্পর্কে জ্ঞান না রাখে, তাহলে সে শরীয়ত পালন করতে সক্ষম হবে না। না জেনে শরীয়ত পালন করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া অনেকের সহীহ আমল সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তারা বিদআতী আমলে জড়িয়ে পড়ে। আবার আমল করতে গিয়ে ঐ আমলের সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে ভুল পদ্ধতির অনুসরণ করে। এজন্য যতটুকু ইলম না শিখলে একজন মানুষ মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে পারে না ততটুকু ইলম অর্জন করা তার জন্য বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোন ভেদাভেদ নেই। এটা সকলেরই দায়িত্ব।

শরীয়তের ইলম অর্জন করতে গিয়ে একটি বিষয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর তা হলো, বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে একাধিক মতামত পাওয়া যায়। এসব ভিন্ন ভিন্ন মতামত দেখে একজন পাঠক চিমত্মায় পড়ে যায় যে, শরীয়তের উৎস তো একই- তাহলে এত মতভেদ হবে কেন? তারপর তার চিমত্মা হয়- ঐ মতামতসমূহের মধ্যে কোন্ মতটি সে গ্রহণ করবে। তারপর যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো, ইমামদের নামে যেসকল মাযহাব তৈরি হয়েছে ঐ সকল মাযহাবের কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাব মানার জন্য কেউ বাধ্য কি না। যদি বাধ্য না হয়ে থাকে তাহলে ইমামদের ব্যাপারে তার আকীদা কেমন হওয়া উচিত? ইমামদের কোন ফতওয়ার বিপরীতে যদি এর চেয়ে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় তাহলে এ ক্ষেত্রে কী করতে হবে। এ বিষয়গুলো বর্তমান সময়ের সকলের কাছে আলোচনার বিষয় এবং এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার আগ্রহ সবার মধ্যে বিরাজমান।

এ ক্ষুদ্র গ্রন্থটিতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি পাঠকসমাজ কিছুটা হলেও উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারবেন এবং ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যেসব ভুল-ভ্রামিত্ম রয়েছে সেসব বিষয়ে সঠিক সিদ্ধামেত্ম উপনীত হতে পারবেন। ইনশা-আল্লাহ

মা‘আস্সালাম

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

বিশেষ কথা
কোন সহীহ হাদীসের উপর আমল করতে গিয়ে যদি ঐ হাদীস কোন মাযহাবের বিপরীত হয়ে যায়, তবে ঐ হাদীসের উপর আমলকারীকে ঘৃণা করা বা তাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা কোনভাবেই সমীচীন নয়। কেননা সকল মাযহাবের ইমামগণ সহীহ হাদীসের উপর আমল করার জন্য উম্মতকে উপদেশ দিয়ে গেছেন। সহীহ সনদে প্রমাণিত হওয়ার পর কোন হাদীসের উপর আমল করাকে অপছন্দ করা বা ঘৃণাপোষণ করা বড় ধরনের অন্যায়। এমনকি এটা ঈমান ভঙ্গেরও কারণ। যেহেতু নবী ﷺ থেকে বর্ণিত হাদীসগুলোও এক প্রকার ওহী। আর যে ব্যক্তি ওহীর কোন বিষয়কে অবহেলা করে অথবা এর উপর আমলকারীকে নিয়ে উপহাস করে, তবে সে পরোক্ষভাবে ঐ হাদীসকেই অস্বীকার করে। এমন ব্যক্তির আমল বরবাদ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَتَعْسًا لَّهُمْ وَاَضَلَّ اَعْمَالَهُمْ ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوْا مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَأَحْبَطَ اَعْمَالَهُمْ﴾

আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য ধ্বংস এবং আল্লাহ তাদের আমল নিষ্ফল করে দিয়েছেন। কারণ, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অপছন্দ করেছে; তাই আল্লাহ তাদের আমল বরবাদ করে দিয়েছেন। (সূরা মুহাম্মাদ- ৮, ৯)

ইলমের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
ইলম অর্থ জ্ঞান তথা কোন জিনিসকে জানা। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় ইলম ঐ জ্ঞানকেই বুঝায়, যা ওহীর মাধ্যমে পাওয়া যায়।

উৎসের দিক থেকে ইলম দু’প্রকার :

১. ইলমে হুসুলী বা কসবী তথা অর্জিত জ্ঞান : চর্চা বা অধ্যয়নের মাধ্যমে যে জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে ইলমে হুসুলী বা ইলমে কসবী বলা হয়।

২. ইলমে ওয়াহবী : যে ইলম সরাসরি আল্লাহর পক্ষ হতে ওহীর মাধ্যমে পাওয়া যায় তাকে ইলমে ওয়াহবী বলা হয়।

ইলমে ওয়াহবী আবার দু’ভাবে অর্জিত হতে পারে। প্রথমত, ফেরেশতার মাধ্যমে ওহী দ্বারা। দ্বিতীয়ত, ইলহাম [আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার অমত্মরে সৎ সিদ্ধামত্ম জাগ্রত হওয়াকে ইলহাম বলে।] দ্বারা।

হুকুমগত দিক থেকে ইলম আবার দু’প্রকার :

১. ফরযে আইন : যা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অপরিহার্য তাই ফরযে আইন। যেমন- ঈমান, সালাত, সিয়াম প্রভৃতির ইলম। বালেগ হওয়ার পর প্রত্যেকের জন্য কালিমা ও ঈমান সম্পর্কিত জরুরি বিষয়গুলো সম্পর্কে ইলম অর্জন করা ফরয। অতঃপর যখনই দ্বীনের যে বিষয় সামনে আসবে সে বিষয়ের জ্ঞান লাভ করা ফরয।

২. ফরযে কিফায়া : যে ইলম সকলের পক্ষ থেকে একজন অর্জন করলেই যথেষ্ট হয় তাকে ফরযে কিফায়া বলে। যেমন- কুরআন ও হাদীস হতে আহকাম বের করার মতো জ্ঞান লাভ করা। এছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেসকল জ্ঞানের প্রয়োজন হয় তা অর্জন করাও ফরযে কিফায়া। যেমন- চিকিৎসা বিদ্যা, আবশ্যকীয় শিল্প বিদ্যা ইত্যাদি।

শরীয়ত সম্পর্কিত ইলম অর্জন করা ফরয
শরীয়ত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর উপর ফরয।

- عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلٰى كُلِّ مُسْلِمٍ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ইলম বা জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয। [ইবনে মাজাহ, হা/২২৪; মুসনাদুল বাযযার, হা/৬৭৪৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭২; মিশকাত, হা/২১৮; জামেউস সগীর, হা/৭৩৬০।]

এখানে মুসলিম শব্দ দ্বারা সাধারণভাবে সকল মুসলিম নারী-পুরুষকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। সুতরাং নারী-পুরুষ, স্বাধীন-ক্রীতদাস, যুবক-বৃদ্ধ, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মুসলিমের উপর ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন করা ফরয।

একজন ব্যক্তির উপর সর্বপ্রথম ফরয হলো, ঈমান সম্পর্কে ইলম অর্জন করা। কারণ ঈমানই হচ্ছে সবকিছুর মূল। ঈমান যদি সঠিক না হয়, তাহলে সারা জীবন নেক আমল করেও কোন লাভ হবে না। এজন্য ঈমান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়, ঈমানের ক্ষতি সাধনকারী বিষয়, বিশেষ করে ঈমান ভঙ্গের কারণ কী- তা জানা ফরয।

ঈমানের পর একজন মানুষের উপর আল্লাহর বিধান পালন করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এজন্য তার উপর আল্লাহর কী কী বিধান রয়েছে অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তার উপর কোন্ কোন্ কাজ করতে আদেশ করেছেন এবং কোন্ কোন্ কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তা জানা ফরয। এসব বিষয় জেনে আল্লাহর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা এবং নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা একজন মুসলিমের মৌলিক দায়িত্ব।

আল্লাহর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোন্ কাজটি কীভাবে সম্পন্ন করতে হবে- সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা ফরয। যেমন- ঈমানের পর একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। আর সালাত আদায় করার পূর্বে নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন করা একটি মৌলিক শর্ত। তাই অযু, গোসল, ও তায়াম্মুম সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল জানা তার উপর ফরয। এ সম্পর্কে বিসত্মারিত আলোচনা রয়েছে আমাদের ‘‘কিতাবুস সালাত’’ বইয়ের শুরুতে।

পবিত্রতা অর্জনের পর যখন কেউ সালাত আদায় করতে যাবে তখন নবী ﷺ যে পদ্ধতিতে সালাত আদায় করেছেন সে পদ্ধতিতে তাকে সালাত আদায় করতে হবে। এজন্য সালাতের সঠিক নিয়ম-কানুন জানা ফরয।

এভাবে যখনই কেউ ইসলামের কোন বিধান পালন করতে যাবে তখনই তাকে ঐ বিষয়ের জ্ঞান লাভ করতে হবে।

যখন কেউ সিয়াম পালন করবে তখন তাকে এ সংক্রান্ত মাসআলা জেনে নিতে হবে।

যখন কেউ হজ্জ পালন করবে তখন তাকে হজ্জ সংক্রান্ত মাসআলা জেনে নিতে হবে।

যখন কারো উপর যাকাত ফরয হবে তখন তাকে যাকাত সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল জেনে নিতে হবে।

যখন জিহাদে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে তখন জিহাদ সংক্রান্ত মাসআলা জেনে নিতে হবে।

অনুরূপভাবে আচার-আচরণ, লেনদেন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ইসলামের যেসব নীতিমালা রয়েছে তা জানা ফরয।

ইসলাম হালাল রুজি-রোজগার করতে নির্দেশ দিয়েছে। তাই যে যেভাবে রোজগার করে সেটা হালাল হচ্ছে কি না সে সম্পর্কে তার জ্ঞান থাকতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

এভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা যেসকল কাজ করতে নিষেধ করেছেন সেসকল কাজের ক্ষতিকর দিক ও তার ভয়াবহতা জেনে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে এবং এসব অন্যায় কাজে জড়িত লোকদেরকে বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আর এ কাজটিও একজন মুসলিমের উপর ফরয।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে এমন লোকের সংখ্যাই বেশি, যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে। অথচ ঈমান ও ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণাই নেই। যার ফলে গোটা সমাজব্যবস্থা আজ কুফরী আদর্শের উপর পরিচালিত হচ্ছে।

তাছাড়া অনেকে আবার ইসলামী জ্ঞানার্জন করতে গিয়ে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। তারা দলীলবিহীন বিভিন্ন বিষয়কে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকে এবং অনেকে মনগড়া ইবাদাত তৈরি করে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে বিদআতের মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আবার অনেকে আল্লাহর ইবাদাত করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে শিরকের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জন করা একটি মৌলিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন নবী-রাসূলগণ
বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন নবী ও রাসূলগণ। যুগে যুগে মানুষ তাঁদের মাধ্যমেই প্রকৃত ইলম প্রাপ্ত হয়েছে। নবী ও রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন মুহাম্মাদ ﷺ। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে মনোনীত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿هُوَ الَّذِيْ بَعَثَ فِى الْاُمِّيِّيْنَ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيَاتِهٖ وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَۗ وَاِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِيْ ضَلَالٍ مُّبِيْنٍ﴾

তিনিই উম্মীদের (নিরক্ষর জাতির) মধ্য হতে একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দান করেন; যদিও ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গুমরাহীতে লিপ্ত ছিল। (সূরা জুমু‘আ- ২)

লেখাপড়া, বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞান অনুশীলনের জন্য কিতাব বা গ্রন্থ অপরিহার্য। তাই আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে এ কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন,

﴿كِتَابٌ اَنْزَلْنَاهُ اِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ اِلَى النُّوْرِ بِاِذْنِ رَبِّهِمْ اِلٰى صِرَاطِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ﴾

আমি এ কিতাব তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যেন তুমি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আনতে পার; মহাপরাক্রমশালী ও প্রশংসিত আল্লাহর পথে। (সূরা ইবরাহীম- ১)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ اِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيَاتِه وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَۚ وَاِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِيْ ضَلَالٍ مُّبِيْنٍ﴾

নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের নিজেদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও বিজ্ঞান শিক্ষা দান করেন। অথচ তারা (সবাই) ইতিপূর্বে প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিল। (সূরা আলে ইমরান- ১৬৪)

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আগমনের প্রকৃত কারণই ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি জাতিকে ইসলামী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আলোর রাজ্যে প্রবেশ করানো। ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য না করে উভয়কে সমভাবে জ্ঞানার্জনের আদেশ দিয়েছে। কুরআনের নির্দেশও তাই। কুরআন সকল পাঠককেই আদেশ করেছে পড়তে, চিমত্মা করতে এবং অনুধাবন করতে। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি। ফলে ইসলামে পুরুষের মতো নারীদেরকেও জ্ঞানার্জনের পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এর উপর ভিত্তি করেই সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

আদম (আঃ) কে আল্লাহ জ্ঞান শিখিয়েছিলেন
আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম আদম (আঃ) কে জ্ঞান দান করেন :

﴿وَعَلَّمَ اٰدَمَ الْاَسْمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَآئِكَةِ فَقَالَ اَنْۢبِئُوْنِيْ بِاَسْمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ قَالُوْا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمْتَنَاؕ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَلِيْمُ الْحَكِيْمُ﴾

তিনি আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দিলেন, অতঃপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থিত করলেন এবং বললেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে আমাকে এসব বস্তুর নাম সম্পর্কে সংবাদ দাও। তারা বলেছিল, আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাক্বারা– ৩১, ৩২)

আল্লাহ আদম (আঃ) কে ফেরেশতাদের উপর সম্মান দিয়েছেন :

﴿قَالَ يَاۤ اٰدَمُ اَنْۢبِئْهُمْ بِاَسْمَآئِهِمْۚ فَلَمَّاۤ اَنْۢبَاَهُمْ بِاَسْمَآئِهِمْ قَالَ اَلَمْ اَقُلْ لَّكُمْ اِنِّيْۤ اَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِ وَاَعْلَمُ مَا تُبْدُوْنَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ﴾

আল্লাহ তা‘আলা বললেন, হে আদম! তুমি তাদেরকে ঐসব বস্তুর নাম জানিয়ে দাও। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে ঐসব বস্তুর নাম জানিয়ে দিলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আকাশসমূহ ও জমিনের অদৃশ্য বিষয়াবলি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত আছি? (তাছাড়া) তোমরা যা প্রকাশ কর এবং যা গোপন কর, তাও আমি জানি। (সূরা বাক্বারা– ৩৩)

এভাবে আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম পরীক্ষায় আদম (আঃ) কে উত্তীর্ণ করলেন এবং ফেরেশতামন্ডলীর উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন। আর এ শ্রেষ্ঠত্বের মূল চাবিকাঠি ছিল ইলম তথা জ্ঞান- যা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই আদম (আঃ) কে শিখিয়েছিলেন।

কুরআনের প্রথম আদেশ ‘‘পড়ো’’
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর সর্বপ্রথম যে ওহী নাযিল হয়েছিল তা ছিল জ্ঞানার্জন করার আদেশ সম্পর্কিত। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে বান্দাদেরকে জ্ঞানার্জন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন,

﴿اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ - – خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ - اِقْرَاْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ - اَلَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ﴾

পড়ো, তোমার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ঝুলন্ত রক্তপিন্ড হতে। পড়ো, তোমার পালনকর্তা অতি সম্মানিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন। শিক্ষা দান করেছেন মানুষকে, যা সে জানত না। (সূরা আলাক্ব : ১-৫)

যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সর্বপ্রথম বাণী হচ্ছে, পড়ো অর্থাৎ জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করো। সেহেতু বলা যায় যে, জ্ঞানান্বেষণ বা বিদ্যার্জনকে বলা হয় ইসলামের মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন মানুষ যেমন বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে ইলম বা জ্ঞানার্জন ছাড়া কোন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে তার নিজেকে মুসলিম দাবি করা অনর্থক হয়ে পড়ে।

জ্ঞান মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ
নর-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য জ্ঞানান্বেষণ করা অপরিহার্য। কেননা এছাড়া মানুষের পূর্ণতা লাভের জন্য অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। সুতরাং এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশি তা আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يُؤْتِى الْحِكْمَةَ مَنْ يَّشَآءُۚ وَمَنْ يُّؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ اُوْتِيَ خَيْرًا كَثِيْرًاؕ وَمَا يَذَّكَّرُ اِلَّاۤ اُولُو الْاَلْبَابِ﴾

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হিকমত দান করেন। আর যাকে হিকমত দান করা হয় সে প্রচুর কল্যাণ লাভ করে। (কিন্তু) শুধুমাত্র জ্ঞানী লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা বাক্বারা- ২৬৯)

حِكْمَةٌ (হিকমত) অর্থ হচ্ছে, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার শক্তি। হিকমত বা প্রজ্ঞা যার কাছে থাকবে সে কখনো শয়তানের দেখানো পথে চলবে না। বরং সে আল্লাহর দেখানো পথ অবলম্বন করবে।

জ্ঞান আল্লাহর একটি রহমত :

আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেছেন। আর সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতের জন্য তিনি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর কুরআন নাযিল করেছেন। অতএব নিঃসনেদহে এটা বান্দার প্রতি তাঁর একটি অসীম করুণার নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

﴿اَلرَّحْمٰنُ -‐ عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ خَلَقَ الْاِنْسَانَ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ﴾

পরম দয়ালু আল্লাহই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন। (সূরা আর রহমান : ১-৪)

জ্ঞানী ও মূর্খ ব্যক্তি সমান নয় :

যারা সঠিক জ্ঞানার্জন করে, কেবল তারাই সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। তারা অনেক অজানা বসত্মুকে জানতে পারে। আর যারা সঠিক জ্ঞানার্জন করে না, তারা এ থেকে বঞ্চিত হয়। কাজেই জ্ঞানী ও মূর্খ কখনো সমান হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَّقَآئِمًا يَّحْذَرُ الْاٰخِرَةَ وَيَرْجُوْا رَحْمَةَ رَبِّهٖؕ قُلْ هَلْ يَسْتَوِى الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَؕ اِنَّمَا يَتَذَكَّرُ اُولُو الْاَلْبَابِ﴾

কাফিররা কি ঐ ব্যক্তির সমান যে ব্যক্তি রাতে সিজদারত অবস্থায় এবং দাঁড়িয়ে ইবাদাত করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বলো, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? নিশ্চয় জ্ঞানী ব্যক্তিরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা যুমার- ৯)

জ্ঞানীরা আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য বুঝতে পারে :

যারা শিক্ষা অর্জন করে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হয়, তাদের সম্মুখে সৃষ্টির রহস্যাবলির দ্বার উন্মোচিত হয়। একমাত্র বিদগ্ধ পন্ডিত ব্যক্তিরাই এর সন্ধান পেয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেন,

﴿اِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْاَ رْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَاٰيَاتٍ لِّاُولِى الْاَلْبَابِ﴾

নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টির মধ্যে এবং দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শন। (সূরা আলে ইমরান- ১৯০)

﴿وَمِنْ اٰيَاتِه خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَ رْضِ وَاخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَاَلْوَانِكُمْؕ اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيَاتٍ لِّلْعَالِمِيْنَ﴾

আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন। (সূরা রূম- ২২)

﴿فَتِلْكَ بُيُوْتُهُمْ خَاوِيَةً ۢبِمَا ظَلَمُوْاۤ اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيَةً لِّقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ﴾

এই তো তাদের ঘরবাড়ি, যা তাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। নিশ্চয় এতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। (সূরা নামল– ৫২)

﴿هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَآءً وَّالْقَمَرَ نُوْرًا وَّقَدَّرَهٗ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَالْحِسَابَؕ مَا خَلَقَ اللهُ ذٰلِكَ اِلَّا بِالْحَقِّۚ يُفَصِّلُ الْاٰيَاتِ لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ﴾

তিনিই সূর্যকে দীপ্তমান ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর (চন্দ্রের) কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা বৎসর গণনা ও (সময়ের) হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এটা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি; তিনি এসব নিদর্শন জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করেন। (সূরা ইউনুস- ৫)

জ্ঞানীগণ আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষী :

কুরআন মাজীদ ও অন্যান্য আসমানী কিতাবসমূহে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে যে শাহাদাত বা সর্বশ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে, তাতে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই এর একত্ববাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। ফেরেশতামন্ডলীও এ সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাথে সাথে সর্বযুগের জ্ঞানীগণও সত্যনিষ্ঠভাবে এ সাক্ষ্য প্রদানে শরীক হয়েছেন। এ মর্মে আললাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَهِدَ اللهُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ وَالْمَلَآئِكَةُ وَاُولُو الْعِلْمِ قَآئِمًا ۢبِالْقِسْطِؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ﴾

আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ছাড়া প্রকৃত কোন মাবুদ নেই। (এ বিষয়ে আরো সাক্ষ্যদানকারী হচ্ছেন) ফেরেশতামন্ডলী ও জ্ঞানীগণ। তিনি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা আলে ইমরান- ১৮)

জ্ঞানার্জনের দু‘আ :

আললাহ তা‘আলা মানবজাতিকে জ্ঞানামেবষণের জন্য নানাভাবে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করার পর তাদেরকে জ্ঞান লাভের জন্য তার কাছে প্রার্থনা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,

﴿ رَبِّ زِدْنِىْ عِلْمًا﴾

হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন। (সূরা ত্বা-হা- ১১৪)

১০
নারীদের জ্ঞানার্জন
শরীয়ত জ্ঞানার্জনের জন্য নারীকেও উৎসাহিত করেছে। যাতে এর মাধ্যমে তারা নিজেরা উপকৃত হতে পারে এবং সমাজেরও উপকার সাধন করতে পারে। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামের প্রথম যুগে শিক্ষার যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে নারী শিক্ষারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। বহু মুসলিম নারীগণ জ্ঞানী, কবি, লেখিকা এবং শিক্ষিকা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এই যে, এই শিক্ষার মাধ্যমে সে আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মাতা এবং আদর্শ গৃহিণীরূপে গড়ে উঠবে। তাছাড়া তার জন্য ঐ সকল বিদ্যা শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে, যা মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে, চরিত্র গঠন করতে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রশসত্ম করতে সাহায্য করে। এ ধরনের শিক্ষা প্রত্যেক নারীর জন্য অপরিহার্য। এরপর কোন নারী যদি অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মানসিক যোগ্যতার অধিকারিণী হয় এবং এসকল মৌলিক শিক্ষার পরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চায়, তাহলে তা তার জন্য আরো ভালো।

ইসলামের শিক্ষার আলোকে পুরুষদের মধ্য হতে যেমনিভাবে আবু বকর, উমর, উসমান (রাঃ) এবং হাসান বসরী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম রাযী ও ইমাম গাযযালী (রহ.) এর মতো মহাপুরুষগণের আবির্ভাব ঘটেছিল; ঠিক তেমনিভাবে আয়েশা, হাফসা, শিফা বিনতে আবদুল্লাহ, আকারীমা বিনতে মিকদাদ, উম্মে কুলসুম (রাঃ) এবং রাবেয়া বসরী (রহ.) এর মতো মহিয়সী নারীরও আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। মোটকথা ইসলামের নির্ধারিত সীমা ও গন্ডির মধ্যে অবস্থান করেই সে যুগের মহিলাগণ আত্মসংশোধন এবং জাতির সেবার উদ্দেশ্যে দ্বীনী শিক্ষা লাভ করতেন এবং নিজ সমত্মানদেরকে এমন আদর্শবান করে গড়ে তুলতেন, যাতে তারা নিজেদের যুগে জাতির মধ্যে শামিত্ম প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারেন।

নারীদেরকে জ্ঞানার্জন করার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। পুরুষদের জন্য জ্ঞানার্জন করাকে যেরূপ জরুরি করা হয়েছে, মহিলাদের জন্যও তেমনি আবশ্যক করা হয়েছে। পুরুষরা যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট হতে জ্ঞানার্জন করত, তেমনিভাবে মহিলারাও জ্ঞানার্জন করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি সময় নির্ধারিত করতেন। অতঃপর সে সময় তিনি তাদেরকে তালীম দিতেন। উম্মুল মুমিনীনগণও ছিলেন মহিলাদের শিক্ষিকা। কিন্তু আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) কেবল নারীদের নয়, বরং পুরুষদেরও বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। অনেক বড় বড় সাহাবীও তাঁর কাছে হাদীস, তাফসীর এবং ফিকহের জ্ঞান অমেবষণ করতেন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ দাসীদেরকেও জ্ঞান লাভ করার সুযোগ দানের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন :

ইসলামে কেবল সম্ভ্রামত্ম মহিলাদেরকেই নয়, বরং দাসীদেরকেও শিক্ষা প্রদান করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে,

عَنْ أَبِيْ مُوْسٰى اَلْأَشْعَرِيِّ ، قَالَ النَّبِيُّ أَيُّمَا رَجُلٍ كَانَتْ لَهٗ جَارِيَةٌ فَأَدَّبَهَا فَأَحْسَنَ تَأْدِيْبَهَا وَأَعْتَقَهَا وَتَزَوَّجَهَا فَلَهٗ أَجْرَانِ وَأَيُّمَا عَبْدٍ أَدَّى حَقَّ اللهِ وَحَقَّ مَوَالِيْهِ فَلَهٗ أَجْرَانِ

আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, যার নিকট কোন দাসী আছে এবং সে তাকে শিক্ষা দান করে, ভালোভাবে সুশিক্ষার ব্যবস্থা করে, ভদ্রতা ও শালীনতা শিক্ষা দেয় এবং এটা খুব সুন্দররূপে আঞ্জাম দেয়, অতঃপর তাকে মুক্ত করে এবং বিয়ে করে স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দান করে, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ প্রতিদান। [সহীহ বুখারী, হা/২৫৪৪, ২৫৪৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৯৫৬; নাসাঈ, হা/৩৩৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৫৮২, ১৯৭২৭; শারহুস সুন্নাহ, হা/২৫; মিশকাত, হা/১১।]

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ :

আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদেরকে জ্ঞান চর্চার নির্দেশ দান করে বলেন,

﴿وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلٰى فِيْ بُيُوْتِكُنَّ مِنْ اٰيَاتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِؕ اِنَّ اللهَ كَانَ لَطِيْفًا خَبِيْرًا﴾

তোমাদের বাড়িতে আল্লাহর যে আয়াতসমূহ ও জ্ঞানের কথা পাঠ করা হয় তা স্মরণ রাখো। নিশ্চয় আল্লাহ খুবই সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ। (সূরা আহযাব- ৩৪)

এর তাৎপর্য হলো, হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা যা কিছু শোন এবং দেখ তা বর্ণনা করতে থাকো। কারণ তোমাদের ছাড়া ইসলামী বিধান অন্য লোকদের জানা সম্ভব হবে না। এ আয়াতগুলোতে নবী ﷺ এর স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখানে কেবল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়নি, বরং অন্যান্য সকল মুসলিম গৃহের মহিলাদেরকেও উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদেরকে দেখেই তারা ইসলামী জ্ঞান অর্জন করবে এবং সে অনুযায়ী আমল করতে উৎসাহিত হবে।

নারী সাহাবীগণ জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন :

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে নারী সমাজের মধ্যে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার এমন উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল যে, সেজন্য তারা দিনরাত সবসময় ব্যসত্ম থাকত। জ্ঞান আহরণের পথে কোন প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে নিরাশ ও নিরোৎসাহিত করতে পারত না। আনসারী মহিলাদের সম্পর্কে আয়েশা (রাঃ) বলেন,

نِعْمَ النِّسَاءُ نِسَاءُ الْأَنْصَارِ لَمْ يَمْنَعْهُنَّ الْحَيَاءُ أَنْ يَتَفَقَّهْنَ فِي الدِّيْنِ

আনসারী মহিলারা কতই না ভালো- দ্বীনের বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে লজ্জা-শরমও তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। [সহীহ বুখারী, ইলম অর্জনে লজ্জা করা অধ্যায়, ১/৪৪ পৃঃ; সহীহ মুসলিম, হা/৭৭৬; আবু দাউদ, হা/৩১৬; ইবনে মাজাহ, হা/৬৪২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫১৮৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪৮; বায়হাকী, হা/৮১৯।]

১১
ইলম অর্জনকারীদের মর্যাদা
ইলম অর্জনকারীদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ﴾

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা আরো উন্নত করে দেবেন। (সূরা মুজাদালা- ১১)

যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান নয় :

﴿قُلْ هَلْ يَسْتَوِى الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَؕ اِنَّمَا يَتَذَكَّرُ اُولُوا الْاَلْبَابِ﴾

বলো, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? শুধুমাত্র জ্ঞানী লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা যুমার- ৯)

জ্ঞান হলো জীবন, আর মূর্খতা মৃত্যুর সমান :

﴿اَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَاَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهٗ نُوْرًا يَّمْشِيْ بِهٖ فِى النَّاسِ كَمَنْ مَّثَلُهٗ فِى الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِّنْهَا﴾

যে ব্যক্তি মৃত ছিল, অতঃপর তাকে আমি জীবিত করেছি এবং তাকে মানুষের মধ্যে চলার জন্য আলো দিয়েছি- সে কি ঐ ব্যক্তির মতো, যে অন্ধকারে রয়েছে এবং সেখান থেকে সে বের হতে পারছে না? (সূরা আনআম- ১২২)

যার মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে তিনিই প্রকৃত আলেম :

﴿اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَآءُ ﴾

নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানী ব্যক্তিরাই তাঁকে ভয় করে থাকে। (সূরা ফাতির- ২৮)

বিদ্বান ব্যক্তি আল্লাহ ও আল্লাহর সম্মান এবং তাঁর বড়ত্ব সম্পর্কে বেশি জানার কারণে ঐ বিদ্যা তার অন্তরে ভয় সঞ্চার করে এবং ভয় তাকওয়ার জন্ম দেয়। পরিশেষে তাকওয়া ব্যক্তিকে মর্যাদাবান করে।

আল্লাহ যার মঙ্গল কামনা করেন, তাকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করেন :

عَنْ مُعَاوِيَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ يُرِدِ اللّٰهُ بِه خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّيْنِ وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللّٰهُ يُعْطِيْ

মু‘আবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করেন। বসত্মুত আমি শুধু বণ্টনকারী। আর আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দান করেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩১১৬, ৭৩১২; সহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৯; তিরমিযী, হা/২৬৪৫; ইবনে মাজাহ, হা/২২১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৬১০৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১৯৫; মিশকাত, হা/২০০।]

আল্লাহ তা‘আলা ইলম অর্জনকারীর জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন :

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ إِنَّ اللهَ عَزَّوَجَلَّ أَوْحٰى إِلَيَّ أَنَّ مَنْ سَلَكَ مَسْلَكًا فِيْ طَلَبِ الْعِلْمِ سَهَّلْتُ لَه طَرِيْقَ الْجَنَّةِ وَمَنْ سَلَبْتُ كَرِيْمَتَيْهِ أَثَبْتُه عَلَيْهِمَا الْجَنَّةَ وَفَضْلٌ فِيْ عِلْمٍ خَيْرٌ مِّنْ فَضْلٍ فِيْ عِبَادَةِ وَمِلَاكُ الدِّيْنِ الْوَرَعُ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা আমার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন, যে ব্যক্তি ইলম অর্জনে জন্য কোন পথ ধরবে, আমি তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেব। আর যে ব্যক্তির দুই চোখ আমি নিয়ে নিয়েছি, তার বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত দান করব। ইবাদাতের পরিমাণ বেশি হওয়ার চেয়ে ইলমের পরিমাণ বেশি হওয়া উত্তম। দ্বীনের মূল হলো তাকওয়া তথা হারাম ও সন্দেহের বিষয় হতে বেঁচে থাকা। [জামেউস সগীর, হা/২৬০৭; শু‘আবুল ঈমান, হা/৫৩৪৭; মিশকাত, হা/২৫৫।]

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِّنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَّسَّرَ عَلٰى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِى الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَاللهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيْهِ وَمَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهٗ بِه طَرِيْقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُوْنَهٗ بَيْنَهُمْ إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِيْنَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهٗ وَمَنْ بَطَّأَ بِه عَمَلُهٗ لَمْ يُسْرِعْ بِه نَسَبُهٗ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, দুনিয়ায় যে ব্যক্তি কোন ঈমানদারের মুসীবত দূর করে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার থেকে মুসীবত দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবী ব্যক্তির অভাব দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাব দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি লুকিয়ে রাখবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি লুকিয়ে রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাইয়ের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগিতা করতে থাকেন। যে লোক জ্ঞানার্জনের জন্য বের হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন। যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহসমূহের কোন একটি গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং একে অপরের সাথে মিলে (কুরআন) অধ্যয়নে লিপ্ত থাকে তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকটবর্তীদের (ফেরেশতাগণের) সাথে তাদের কথা আলোচনা করেন। আর যাকে তার কৃতকর্ম পেছনে সরিয়ে দেবে, তার বংশমর্যাদা তাকে অগ্রসর করতে পারবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/৭০২৮; তিরমিযী, হা/২৯৪৫; ইবনে মাজাহ, হা/২২৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩২১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৯; জামেউস সগীর, হা/১১৫২৩; মিশকাত, হা/২০৪।]

কোন সম্প্রদায় যদি আল্লাহর সমত্মুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্মিত মসজিদ, মাদরাসা কিংবা কোন মাহফিলে বসে পরস্পরের মধ্যে দ্বীনী ইলম চর্চা করে, আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, তাহলে তাদেরকে আল্লাহর রহমত ঢেকে নিবে এবং তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হবে। তাদের উত্তম কাজের জন্য তাদের উপর ফেরেশতারা অবতীর্ণ হবেন।

ইলম অর্জনকারীর জন্য সবকিছু দু‘আ করে :

عَنْ كَثِيْرِ بْنِ قَيْسٍ قَالَ كُنْتُ جَالِسًا مَعَ اَبِي الدَّرْدَاءِ فِيْ مَسْجِدِ دِمَشْقَ فَجَاءَهُ رَجُلٌ فَقَالَ يَا اَبَا الدَّرْدَاءِ اِنِّيْ جِئْتُكَ مِنْ مَدِيْنَةِ الرَّسُوْلِ لِحَدِيْثٍ بَلَغَنِىْ اَنَّكَ تُحَدِّثُهٗ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ مَا جِئْتُ لِحَاجَةٍ قَالَ فَانِّىْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَّطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَلَكَ الله بِه طَرِيْقًا مِّنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَاِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ اَجْنِحَتَهَا رَضِىً لِّطَالِبِ الْعِلْمِ وَاِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهٗ مَنْ فِى السَّمٰوٰتِ وَمَنْ فِى الْاَرْضِ وَالْحِيْتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ وَاِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَاِنَّ الْعُلمَاءَ وَرَثَةُ الْاَنْبِيَاءِ وَاِنَّ الْاَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَاِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ اَخَذَهٗ اَخَذَ بِحَظٍّ وَّافِرٍ

কাসীর বিন ক্বায়স (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি দামেশকের মসজিদে আবু দারদা (রাঃ) এর সাথে বসে ছিলাম। এমন সময় তার নিকট একজন লোক এসে বলল, হে আবু দারদা! আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শহর মদিনা থেকে শুধু একটি হাদীস জানার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি শুনেছি আপনি নাকি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যে আমি আপনার কাছে আসিনি। তার এ কথা শুনে আবু দারদা (রাঃ) বললেন, (হ্যাঁ) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে আমি এ কথা বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি (কুরআন ও হাদীসের) ইলম সন্ধানের উদ্দেশ্যে কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহের একটি পথে পৌঁছে দেবেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম অনুসন্ধানকারীর সমত্মুষ্টি ও আরামের জন্য তার যাত্রাপথে তাদের পালক বা ডানা বিছিয়ে দেন। অতঃপর আলেমদের জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দু‘আ করে থাকে, এমনকি পানির নিচের মাছসমূহও (ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে)। আলেমদের মর্যাদা মূর্খ ইবাদাতকারীর চেয়ে অনেক বেশি। যেমন পূর্ণিমা চাঁদের মর্যাদা তারকারাজির উপর। আর আলেমগণ হচ্ছে নবীদের ওয়ারিস। নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম (ধনসম্পদ) মীরাস (উত্তরাধিকারী) হিসেবে রেখে যান না। তাঁরা মীরাস হিসেবে রেখে যান শুধু ইলম। তাই যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে। [সহীহ মুসলিম, হা/২২৩; আবু দাউদ, হা/৩৬৪৩; তিরমিযী, হা/২৬৮২; দারেমী, হা/৩৪২; শারহুস সুন্নাহ, হা/১২৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৮৮; জামেউস সগীর, হা/১১২৪৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭০; মিশকাত, হা/২১২।]

عَنِ الْحَسَنِ قَالَ سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ عَنْ رَجُلَيْنِ كَانَا فِيْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ أَحَدُهُمَا كَانَ عَالِمًا يُصَلِّي الْمَكْتُوْبَةَ ، ثُمَّ يَجْلِسُ فَيُعَلِّمُ النَّاسَ الْخَيْرَ , وَالْاٰخَرُ يَصُوْمُ النَّهَارَ وَيَقُوْمُ اللَّيْلَ أَيُّهُمَا أَفْضَلُ , قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : فَضْلُ هٰذَا الْعَالِمِ الَّذِيْ يُصَلِّي الْمَكْتُوْبَةَ ، ثُمَّ يَجْلِسُ فَيُعَلِّمُ النَّاسَ الْخَيْرَ عَلَى الْعَابِدِ الَّذِيْ يَصُوْمُ النَّهَارَ وَيَقُوْمُ اللَّيْلَ كَفَضْلِيْ عَلٰى أَدْنَاكُمْ رَجُلًا

হাসান (বসরী) (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে বনী ইসরাঈলের দু’জন লোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তাদের একজন ছিলেন আলেম, যিনি ফরয সালাত আদায় করার পর বসে বসে মানুষকে তালীম দিতেন। আর দ্বিতীয়জন দিনে সিয়াম পালন করতেন এবং গোটা রাত ইবাদাত করতেন। (রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করা হলো) এ দু’ব্যক্তির মধ্যে মর্যাদার দিক দিয়ে কে উত্তম? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ফরয সালাত আদায় করার পর বসে বসে যে ব্যক্তি তালীম দেয়- সে ব্যক্তি যে দিনে সিয়াম পালন করে ও রাতে ইবাদাত করে তার চেয়ে এমন বেশি মর্যাদাবান যে, তোমাদের একজন সাধারণ মানুষের উপর আমার মর্যাদা। [সুনানে দারেমী, হা/৩৪০; মিশকাত, হা/২৫০। আলবানী বলেন, এর সনদ হাসান সহীহ, তবে হাদীসটি মুরসাল।]

যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য বের হলো সে যেন আল্লাহর পথেই বের হলো :

وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ حَتّٰى يَرْجِعَ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য বের হয়েছে, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথেই রয়েছে। [তিরমিযী, হা/২৬৪৭; মু‘জামুস সগীর, হা/৩৮০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮৮; মিশকাত, হা/২২০।]

১২
ইলম অর্জনকারীরা তৃপ্ত হন না
ইলম বা জ্ঞান এমন একটি বিষয়, যার আহরণকারীরা যতই আহরণ করুক না কেন, তারা কখনো তৃপ্ত হয় না। বরং তারা আরো ইলম শিখার জন্য আগ্রহী থাকে। যেমন- সম্পদ আহরণকারীরা যতই সম্পদ লাভ করে ততই আরো সম্পদ আহরণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। হাদীসে এসেছে,

عَنِ الْحَسَنِ قَالَ : مَنْهُوْمَانِ لَا يَشْبَعَانِ , مَنْهُوْمٌ فِي الْعِلْمِ لَا يَشْبَعُ مِنْهُ , وَمَنْهُوْمٌ فِي الدُّنْيَا لَا يَشْبَعُ مِنْهَا , فَمَنْ تَكُنِ الْاٰخِرَةُ هَمَّه وَبَثَّه وَسَدَمَه يَكْفِي اللهُ ضَيْعَتَه وَيَجْعَلُ غِنَاهُ فِيْ قَلْبِه ، وَمَنْ تَكُنِ الدُّنْيَا هَمَّه وَبَثَّه وَسَدَمَه يُفْشِي اللهُ عَلَيْهِ ضَيْعَتَه وَيَجْعَلُ فَقْرَه بَيْنَ عَيْنَيْهِ ، ثُمَّ لَا يُصْبِحُ إِلَّا فَقِيْرًا ، وَلَا يُمْسِيْ إِلَّا فَقِيْرًا

হাসান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, দুই ধরনের লোভী ব্যক্তি কখনো তৃপ্ত হয় না : ১. ইলম অর্জনকারী, সে কখনো তৃপ্ত হয় না এবং ২. দুনিয়ার লোভী, সেও কখনো তৃপ্ত হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা হবে পরকাল এবং তার সকল কাজ পরকালকেন্দ্রিক হবে, তার দুনিয়ার প্রয়োজনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যথেষ্ট হবেন এবং তাকে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন। আর যার আকাঙ্ক্ষা হবে দুনিয়া এবং তার সকল প্রচেষ্টা দুনিয়াকেন্দ্রিক হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অভাবকে বিস্তৃত করে দেবেন এবং সে সবসময় মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সুতরাং সে সকাল করে মুখাপেক্ষী অবস্থায় এবং সন্ধ্যাও করে মুখাপেক্ষী অবস্থায়। [সুনানে দারেমী, হা/৩৩১।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : مَنْهُومَانِ لَا يَشْبَعَانِ طَالِبُ عِلْمٍ وَطَالِبُ دُنْيَا

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। দুই ধরনের লোভী ব্যক্তি কখনো তৃপ্ত হয় না। (১) জ্ঞান অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি, (২) দুনিয়া অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি। [মুসনাদে দারেমী, হা/৩৪৬; মুসনাদুল বাযযার, হা/৪৮৮০; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১০২৩৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২৬৬৪২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/২০৪৭৮; জামেউস সগীর, হা/১১৫৭০।]

উপরোক্ত হাদীসদ্বয় দ্বারা দ্বীনী জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রেরণা জাগানো হয়েছে, পক্ষান্তরে দ্বীনের সকল হুকুম-আহকাম পালনের পর বৈধভাবে প্রয়োজন অনুপাতে দুনিয়া অর্জন করতে দোষ নেই।

জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে ঈর্ষা করা বৈধ :

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله لَا حَسَدَ اِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ اٰتَاهُ اللّٰهُ مَالًا فَسَلَّطَهٗ عَلٰى هَلَكَتِه فِي الْحَقِّ وَرَجُلٌ اٰتَاهُ اللّٰهُ الْحِكْمَةَ فَهُوَ يَقْضِيْ بِهَا وَيُعَلِّمُهَا

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো ব্যাপারে হিংসা করা ঠিক নয়। প্রথম ব্যক্তি- যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন, সাথে সাথে তা সত্যের পথে (ফী সাবীলিল্লাহ) বা সৎকাজে ব্যয় করার জন্য তাকে তাওফীকও দিয়েছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি- যাকে আললাহ তা‘আলা হিকমত অর্থাৎ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং সে এ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগায় এবং (লোকদেরকে) তা শিখায়। [সহীহ বুখারী, হা/৭৩; সহীহ মুসলিম, হা/১৯৩৩; ইবনে মাজাহ, হা/৪২০৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬৫১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৯০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫০৭৮; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৩৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৫; মুসনাদে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক, হা/৬০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১৯৪; মিশকাত, হা/২০২।]

এ হাদীসে حَسَدٌ দ্বারা হিংসা উদ্দেশ্য নয় বরং غِبْطَةٌ বা ঈর্ষা উদ্দেশ্য। গিবতা বলা হয় অন্যের সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা না করে অন্যের সম্পদের ন্যায় নিজেরও সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করা। এটা জায়েয আছে।

১৩
দ্বীনী ইলম দ্বারা দুনিয়া অর্জনকারীর পরিণাম
দ্বীনী ইলম শিক্ষা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আখিরাতের চিরস্থায়ী কল্যাণ অর্জন করা। আর প্রত্যেক ইলম অর্জনের মূল উদ্দেশ্য এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু প্রত্যেক যুগে একদল লোক থাকে, যারা ইলম অর্জন করে দুনিয়া অর্জনের জন্য। তাদের এ কর্মের মধ্যে আখিরাতের কোন উদ্দেশ্য থাকে না। তাদের ইলম তাদেরকে কোন উপকার করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে বলেন,

﴿فَخَلَفَ مِنْ ۢبَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَّرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُوْنَ عَرَضَ هٰذَا الْاَدْنٰى وَيَقُوْلُوْنَ سَيُغْفَرُ لَنَاۚ وَاِنْ يَّأْتِهِمْ عَرَضٌ مِّثْلُهٗ يَأْخُذُوْهُؕ اَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِّيثَاقُ الْكِتَابِ اَنْ لَّا يَقُوْلُوْا عَلَى اللهِ اِلَّا الْحَقَّ وَدَرَسُوْا مَا فِيْهِؕ وَالدَّارُ الْاٰخِرَةُ خَيْرٌ لِّلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَؕ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ﴾

অতঃপর অযোগ্য উত্তরাধিকারীরা একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো এবং (আল্লাহর) কিতাবেরও উত্তরাধিকারী হলো। তারা এ তুচ্ছ দুনিয়ার সম্পদ করায়ত্ত করত এবং (মূর্খের মতো) বলত, আমাদেরকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যদি (পরবর্তীতে আবারও অর্জিত সম্পদের) অনুরূপ সম্পদ তাদের নিকট আসত, তবে তারা তাও হস্তগত করে নিত। তাদের নিকট থেকে কি কিতাবের ব্যাপারে এ অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ছাড়া অন্য কিছুই বলবে না? আর তারা তো সে কিতাব (বহু বার) অধ্যয়ন করেছে। সুতরাং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পরকালীন ঘরবাড়িই হচ্ছে উত্তম নিবাস; তবুও কি তোমরা (এ বিষয়ে) অনুধাবন করবে না? (সূরা আ‘রাফ- ১৬৯)

দ্বীনী ইলম দ্বারা দুনিয়া অর্জনকারীরা জানে, এ কাজটি করা গোনাহ; তবুও তারা এ আশায় কাজটি করে যে, কোনভাবে তাদের গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। কারণ তারা মনে করে, তারা আল্লাহর প্রিয় পাত্র এবং তারা যত কঠিন অপরাধই করুক না কেন তাদেরকে ক্ষমা করা হবে। এ ভুল ধারণার ফলে কোন গোনাহ করার পর তারা লজ্জিত হয় না এবং তওবাও করে না। বরং তারা একই ধরনের গোনাহ বারবার করতে থাকে। অথচ তারা এমন একটি কিতাবের উত্তরাধিকারী ছিল, যা তাদেরকে দুনিয়ায় নেতৃত্বের পদে সমাসীন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের হীনমন্যতার ফলে তারা এর সাহায্যে তুচ্ছ পার্থিব সম্পদ আহরণ করার চেয়ে বড় কোন জিনিস অর্জনের ইচ্ছাই করল না। তারা দুনিয়ায় ন্যায়-ইনসাফ, সত্য ও সততার পতাকাবাহী এবং কল্যাণের পথপ্রদর্শক হওয়ার পরিবর্তে নিছক দুনিয়াদারী হয়েই রইল।

দুনিয়াপূজারী এক আলেমের কাহিনী :

﴿وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَاَ الَّذِيْۤ اٰتَيْنَاهُ اٰيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَاَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِيْنَ﴾

তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শোনাও, যাকে আমি নিদর্শন দিয়েছিলাম, কিন্তু সে তা বর্জন করে। অতঃপর শয়তান তার পেছনে লাগে এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা আ‘রাফ- ১৭৫)

দুনিয়ায় লোভী হওয়াতে তাকে কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়েছে :

﴿وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلٰكِنَّهٗۤ اَخْلَدَ اِلَى الْاَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُۚ فَمَثَلُهٗ كَمَثَلِ الْكَلْبِؕ اِنْ تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ اَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَثْؕ ذٰلِكَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِاٰيَاتِنَاۚ فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ﴾

আমি ইচ্ছা করলে এর দ্বারা তাকে উচ্চমর্যাদা দান করতে পারতাম, কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তার অবস্থা কুকুরের ন্যায়, যাদের উপর বোঝা চাপালেও হাঁপাতে থাকে এবং না চাপালেও হাঁপায়। সুতরাং যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনাবলিকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের অবস্থাও এরূপ। অতএব তুমি এ ঘটনা বর্ণনা করে যাও, যেন তারা চিন্তা করে। (সূরা আ‘রাফ- ১৭৬)

এখানে যে ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, সে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞানের অধিকারী ছিল। তার উচিত ছিল, ভুল কর্মনীতি থেকে দূরে থাকা এবং সঠিক কর্মনীতি অবলম্বন করা। কিন্তু সে কেবল পার্থিব স্বার্থ ও আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রবৃত্তির লালসার মোকাবেলা করার পরিবর্তে সে এর সামনে নতজানু হয়ে পড়ে। তার বিবেক যেসব সীমানা রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিল, সে সেগুলো লঙ্ঘন করেছিল। তারপর যখন সে নিজের নৈতিক দুর্বলতার কারণে জেনে-বুঝে সত্যকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলল, তখন ওঁৎ পেতে থাকা শয়তান তার পেছনে লেগে গেল এবং অনবরত তাকে অধঃপতনের অতল গভীরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। এরপর আল্লাহ এ ব্যক্তির অবস্থাকে এমন একটি কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন, যার জিভ সবসময় ঝুলে থাকে এবং এ ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালা ঝরতে থাকে। যেভাবে আমরা পার্থিব লালসায় অন্ধ ব্যক্তিকে দুনিয়ার কুকুর বলে থাকি, ঠিক তেমনিভাবে এ বিষয়টিকে এখানে উপমা হিসেবে পেশ করা হয়েছে। কুকুরের স্বভাব হলো, চলাফেরার পথে তার নাক সবসময় মাটি শুঁকতে থাকে, হয়তো কোথাও কোন খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে এ আশায়। তার গায়ে কেউ পাথর ছুঁড়ে মারলেও তার মনে সন্দেহ জাগে যে, যে জিনিসটি তার দিকে ছুঁড়ে মারা হয়েছে সেটি হয়তো কোন হাড় বা রুটির টুকরা হবে। পেটপূজারি কুকুর দৌড়ে গিয়ে সেই নিক্ষিপ্ত পাথরটিও কামড়ে ধরে। সে তার পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। কোথাও যদি কোন বড় লাশ পড়ে থাকে, তবে তা কয়েকটি কুকুরের পেট ভরার জন্য যথেষ্ট হলেও একটি কুকুর তার মধ্য থেকে কেবলমাত্র তার নিজের অংশটি নিয়েই ক্ষান্ত হয় না বরং সম্পূর্ণ লাশটিকে নিজের দখলে রাখার চেষ্টা করে এবং অন্য কোন কুকুরকে তার ধারে কাছেও আসতে দেয় না। এ পেটের লালসার পর যদি দ্বিতীয় কোন বস্তু তার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে যৌন লালসা। সারা শরীরের মধ্যে কেবলমাত্র লজ্জাস্থানটিই তার কাছে আকর্ষণীয়। ফলে সে সেটিরই ঘ্রাণ নিতে থাকে এবং সেটিকেই চাটতে থাকে। কাজেই এখানে এ উপমা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যে, দুনিয়াদারী ব্যক্তি যখন জ্ঞান ও ঈমানের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে প্রবৃত্তির লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করে চলতে থাকে, তখন তার অবস্থা পেট ও যৌনাঙ্গ পূজারি কুকুরের মতো হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

দ্বীনের ইলম দ্বারা দুনিয়া অর্জনকারীর পরকালের অবস্থা :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضٰى عَلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُوْتِيَ بِه فَعَرَّفَه نِعَمَه فَعَرَفَهَا؟ فَقَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا قَالَ قَاتَلْتُ فِيْكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ قَالَ كَذَبْتَ وَلٰكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُّقَالَ جَرِيءٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِه فَسُحِبَ عَلٰى وَجْهِه حَتّٰى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَه وَقَرَأَ الْقُرْاٰنَ فَأُوْتِيَ بِه فَعَرَّفَه نِعَمَه فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُه وَقَرَأْتُ فِيْكَ الْقُرْاٰنَ قَالَ كَذَبْتَ وَلٰكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ اِنَّكَ عَالِمٌ وَقَرَأْتَ الْقُرْاٰنَ لِيُقَالَ اِنَّكَ قَارِئٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِه فَسُحِبَ عَلٰى وَجْهِه حَتّٰى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللّٰهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّه فَأُتِيَ بِه فَعَرَّفَه نِعَمَه فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيْلٍ تُحِبُّ أَنْ يُّنْفَقَ فِيْهَا اِلَّا أَنْفَقْتُ فِيْهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلٰكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ فَقَدْ قِيْلَ ثُمَّ أُمِرَ بِه فَسُحِبَ عَلٰى وَجْهِه ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথমে এক শহীদ ব্যক্তির ব্যাপারে বিচার হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে হাশরের ময়দানে পেশ করবেন এবং তাকে তার সকল নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। ফলে তার এসব নিয়ামতের কথা স্মরণ হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি এসব নিয়ামত পেয়ে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দুনিয়াতে কী কাজ করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার (সমত্মুূষ্টির) জন্য তোমার পথে (কাফিরদের বিরুদ্ধে) লড়াই করেছি, এমনকি শেষ পর্যন্ত আমাকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য লড়াই করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বীরপুরুষ বলবে। আর বাসত্মবেও তা বলা হয়েছে (তাই তোমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে)। অতঃপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর দ্বিতীয়ত এমন একজন ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হবে, যে নিজে জ্ঞানার্জন করেছে, অন্যকেও তা শিক্ষা দিয়েছে এবং সে কুরআনও পাঠ করেছে। তারপর তাকে দেয়া সব নিয়ামতের কথা আল্লাহ তা‘আলা তাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন। ফলে এসব নিয়ামত তার স্মরণ হবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কী এসব নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেছ? সে উত্তরে বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছি, মানুষকে ইলম শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার সমত্মুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি এসব কাজ এজন্য করেছ যে, তোমাকে আলেম বলা হবে এবং ক্বারী বলা হবে। আর তোমাকে দুনিয়ায় এসব বলাও হয়েছে। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর তৃতীয়ত এমন একজন ব্যক্তিকে আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে, যাকে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন ধরনের মাল দিয়ে সম্পদশালী করেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে দেয়া সব নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। ফলে এসব তার মনে পড়ে যাবে। তখন আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি এসব নিয়ামত পেয়ে কী আমল করেছ? সে ব্যক্তি উত্তরে বলবে, আমি এমন কোন খাতে খরচ করা বাকি রাখিনি, যে খাতে খরচ করাকে তুমি পছন্দ কর। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি খরচ করেছ, যাতে মানুষ তোমাকে দানশীল বলে। আর সে খেতাব তুমি দুনিয়ায় অর্জনও করেছ। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫০৩২; নাসাঈ, হা/৩১৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮২৬০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩৬৪; বায়হাকী, হা/১৮৩৩০; জামেউস সগীর, হা/৩৭৭৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৫১৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২২; মিশকাত, হা/২০৫।]

এ হাদীস হতে বুঝা যায় যে, আমলের ক্ষেত্রে নিয়ত স্বচ্ছ থাকা আবশ্যক, যা আল্লাহর বাণী কর্তৃকও প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿وَمَاۤ أُمِرُوْاۤ إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَآءَ وَيُقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذٰلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ﴾

তাদেরকে এছাড়া অন্য কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। আর এটাই হচ্ছে সঠিক ধর্ম। (সূরা বায়্যিনাহ- ৫)

عَنْ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِه وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللّٰهُ النَّارَ

কা‘ব ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করে আলেমদের উপর গৌরব করার জন্য অথবা মূর্খদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। [তিরমিযী, হা/২৬৫৪; জামেউস সগীর, হা/১১৩২৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৬; মিশকাত, হা/২২৫।]

যে বিদ্যা অন্বেষণকারী ব্যক্তি আল্লাহর সমত্মুষ্টির লক্ষ্য বাদ দিয়ে মানুষের সামনে নিজের ইলম প্রকাশের জন্য বিদ্বান ব্যক্তির সাথে তর্কে লিপ্ত হবে অথবা অজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে সন্দেহে লিপ্ত করার জন্য অথবা সম্পদ ও সম্মান অর্জনের উদ্দেশ্যে অথবা জনসাধারণের দৃষ্টিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করবে, তাহলে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغٰى بِه وَجْهُ اللهِ لَا يَتَعَلَّمُهُ اِلَّا لِيُصِيبَ بِه عَرَضًا مِنْ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِي رِيْحَهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন জ্ঞান অর্জন করে, যা দ্বারা আল্লাহর সমত্মুষ্টি অর্জন করা যায়। আর সে তা কেবল পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে অর্জন করে, তাহলে কিয়ামতের দিন সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪৩৮ আবু দাউদ, হা/৩৬৬৬ ইবনে মাজাহ, হা/২৫২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৫; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হ/২৮৮; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৬৩৭৩; জামেউস সগীর, হা/১১১০৪; মিশকাত, হা/২২৭।]

এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর সমত্মুষ্টি ছাড়া দুনিয়ার সম্পদের ইচ্ছা করবে সে জান্নাতের কাছাকাছিও যেতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ ৭০ হাজার মাইল দূর থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। তবে কেউ যদি তা দ্বারা আল্লাহর সমত্মুষ্টির উদ্দেশ্য করে, অতঃপর দুনিয়ার সম্পদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, সে ব্যক্তি হাদীসে উল্লেখিত শাস্তির আওতাভুক্ত হবে না।

১৪
শেষ যামানায় ইলম বা জ্ঞানকে উঠিয়ে নেয়া হবে
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُه مِنَ الْعِبَادِ وَلٰكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتّٰى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوْا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوْا وَأَضَلُّوْا

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, (শেষ যুগে) আল্লাহ তা‘আলা ইলম বা জ্ঞানকে তাঁর বান্দাদের অমত্মর হতে টেনে বের করে উঠিয়ে নিবেন না, বরং আলেমদেরকে দুনিয়া হতে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম বা জ্ঞানকে উঠিয়ে নিবেন। তারপর (দুনিয়ায়) যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবে না, তখন লোকজন অজ্ঞ লোকদেরকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। অতঃপর তাদের নিকট (মাসআলা-মাসায়েল) জিজ্ঞেস করা হবে। তখন তারা বিনা ইলমেই ফতওয়া দেবে। ফলে নিজেরাও ভ্রান্তির মধ্যে পড়বে এবং অন্যদেরকেও ভ্রান্ত করবে। [সহীহ বুখারী, হা/১০০; সহীহ মুসলিম, হা/২৯৭১; তিরমিযী, হা/২৬৫২; ইবনে মাজাহ, হা/৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫১১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/২০৪৭৭; মুসনাদে দারেমী, হা/২৪৫; মুসনাদে ইবনে মুবারক, হা/২৬; মুসনাদে ইবনে জাদ, হা/২৬৭৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৫৭১; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৪২২; মিশকাত, হা/২০৬৯।]

উপরোক্ত হাদীসে শেষ যামানার দিকে ইঙ্গিত করে আলেমদের মৃত্যুর মাধ্যমে ইলমে ওহী উঠিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর মূর্খদেরকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হতে সতর্ক করা হয়েছে এবং বিনা ইলমে ফতওয়া দাতাদের নিন্দা প্রকাশ পেয়েছে।

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ فَشَخَصَ بِبَصَرِهِ إِلَى السَّمَاءِ ثُمَّ قَالَ هٰذَا أَوَانٌ يُخْتَلَسُ الْعِلْمُ مِنَ النَّاسِ حَتّٰى لَا يَقْدِرُوا مِنْهُ عَلٰى شَيْءٍ

আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বললেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টি উঠালেন, অতঃপর বললেন, এটা এমন সময় যখন মানুষের নিকট হতে ইলমকে (দ্বীনী বিদ্যাকে) ছিনিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তারা ইলম হতে কিছুই রাখতে পারবে না। [তিরমিযী, হা/২৬৫৩; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩৩৮; সুনানে দারেমী, হা/২৮৮; মিশকাত, হা/২৪৫।]

عَنْ زِيَادِ بْنِ لَبِيدٍ قَالَ ذَكَرَ النَّبِيُّ شَيْئًا فَقَالَ ذَاكَ عِنْدَ أَوَانِ ذَهَابِ الْعِلْمِ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَذْهَبُ الْعِلْمُ وَنَحْنُ نَقْرَأُ الْقُرْاۤنَ وَنُقْرِئُه أَبْنَاءَنَا وَيُقْرِئُه أَبْنَاؤُنَا أَبْنَاءَهُمْ إِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَقَالَ ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ زِيَادُ إِنْ كُنْتُ لَاَرَاكَ مِنْ أَفْقَهِ رَجُلٍ بِالْمَدِينَةِ أَوَلَيْسَ هٰذِهِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارٰى يَقْرَءُونَ التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ لَا يَعْمَلُونَ بِشَيْءٍ مِمَّا فِيهِمَا

যিয়াদ ইবনে লাবীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী ﷺ একটি বিষয় বর্ণনা করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, সেটা ইলম উঠে যাওয়ার সময় সংঘটিত হবে। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কিরূপে ইলম উঠে যাবে? অথচ আমরা তো কুরআন শিক্ষা করছি, আমাদের সন্তানদেরকেও কুরআন শিক্ষা দিচ্ছি। আমাদের সন্তানগণ কিয়ামত অবধি তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতে থাকবে! তিনি বললেন, যিয়াদ! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক। [এটি আরবে প্রচলিত একটি পরিভাষা, বদ্দোয়া নয়।] আমি তো তোমাকে মদিনার একজন বিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তি বলেই মনে করতাম। এসব ইয়াহুদি ও নাসারাগণ কি তাওরাত ও ইঞ্জীল পড়ছে না? কিন্তু তারা তদানুযায়ী কাজ করছে না এমন নয় কি? [ইবনে মাজাহ, হা/৪০৪৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৯৪৮; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩৩৯; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৫১৫৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩০৮২৫; মিশকাত, হা/২৭৭।]

এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমল না করাকে সমাজ থেকে ইলম চলে যাওয়া ও পৃথিবীতে মূর্খতা প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ- কেউ যদি জ্ঞানার্জন করার পর সে অনুযায়ী আমল না করে, তাহলে তা মূর্খতারই নামান্তর। অতএব একজন মূর্খ ব্যক্তি ও শিক্ষিত আমলহীন ব্যক্তি উভয়ই সমান।

এছাড়াও হাদীসটিতে উদাহরণ হিসেবে তখনকার যুগের ইয়াহুদি ও নাসারাদের আচরণকে পেশ করা হয়েছে। কেননা যুগে যুগে তাদের মধ্য হতে অনেক নবী ও রাসূল প্রেরিত হয়েছে, তাদের নিকট বাকি তিন আসমানী কিতাবসহ অনেক অযীফাও নাযিল করা হয়েছে। আর তারা এগুলো সম্পর্কে অবগত। তাদের আলেমরা এগুলো নিয়মিত চর্চা করত এবং এখনো করছে। অথচ তারা এখনো ভ্রষ্টতার মধ্যেই রয়েছে গেছে এবং তারা তাদের কিতাবসমূহকে বিকৃত করে ফেলেছে। আর তারা সে বিকৃতি কিতাব অনুযায়ীই আমল করে যাচ্ছে। আর এভাবে তাদের মাঝ থেকে ইলম উঠে গেছে। সুতরাং এখনো যদি উম্মতে মুহাম্মাদীর আলেমগণ তাদের অনুসরণ করে তাহলে তাদের থেকেও অনুরূপভাবে ইলম উঠে যাবে।

১৫
ইলম প্রচার করা আলেমদের দায়িত্ব
ইলম অর্জন করে মানুষকে ইলম শিক্ষাদান করা আলেমগণের একটি বড় দায়িত্ব। আলেমগণ ইলমের প্রচার না করলে জনগণ মূর্খ থেকে যাবে। যার ফলে সমাজ থেকে দ্বীন বিলুপ্ত হবে এবং অন্যায়-অপরাধ বিসত্মার লাভ করবে। এজন্য ইলম প্রচারকারীর অনেক ফযীলতও বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِى الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْاۤ اِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَ﴾

তাদের প্রত্যেক দল থেকে এমন একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জন করতে পারে। আর যখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে আসবে তখন তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করবে, যাতে করে তারা সতর্ক হয়ে যায়। (সূরা তওবা- ১২২)

অত্র আয়াতে প্রত্যেক গ্রাম অথবা গোত্র থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকদেরকে বের হতে বলা হয়েছে। যারা আপ্রাণ চেষ্টা করে হলেও জ্ঞান আহরণ করবে, এমনকি এজন্য তারা বহু দূর-দূরামেত্মর পথ অতিক্রম করবে। অতঃপর তারা নিজেদের জাতির কাছে ফিরে যাবে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনী জাগরণ সৃষ্টিতে তৎপর হবে, তাদেরকে ইলম শিক্ষা দেবে এবং প্রয়োজনে তাদেরকে নেতৃত্ব দেবে। তারা নিজেরা সর্বদা শিরক ও বিদআত থেকে সতর্ক থাকবে এবং সমাজের সকল সত্মর থেকেও এগুলো দূরীভূত করার জন্য সক্রিয় হবে। তারা সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। সর্বোপরি তারা তাদের জাতির মাঝে কুরআন ও সুন্নার নির্দেশিত জীবনধারাকে ছড়িয়ে দেবে।

আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন :

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّوَجَلَّ يَبْعَثُ لِهٰذِهِ الْأُمَّةِ عَلٰى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের (কল্যাণের) জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাদের দ্বীনকে সংস্কার করবেন। [আবু দাঊদ, হা/৪২৯৩; মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/১০০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৮৫৯২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১১১৮; জামেউস সগীর, হা/২৭৫৫; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৫৯৯; মিশকাত, হা/২৪৭।]

প্রত্যেক হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্নে আল্লাহ এমন ব্যক্তি পাঠাবেন, যিনি নতুন আবিষ্কৃত জিনিসগুলোর মূলোৎপাটন করে কিতাব এবং সুন্নার আমল ও এগুলোর দাবি অনুপাতে যে সমস্ত নির্দেশ রয়েছে তা পুনরুজ্জীবিত করবেন। বক্তব্য, লেখনী, পাঠদান বা অন্যান্য পদ্ধতিতে বিদআতকারীদেরকে প্রতিহত করবেন। তবে এ মুজাদ্দিদ ব্যক্তির সমসাময়িক যুগের আলেমগণ তার বিভিন্ন অবস্থা ও তার ইলম কর্তৃক মানুষের উপকৃত হওয়ার পরিমাণ দেখে তাকে চিনতে পারবে। কেননা মুজাদ্দিদ ব্যক্তির প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দ্বীনের বিধান সম্পর্কে জ্ঞানবান হওয়া আবশ্যক এবং তিনি হবেন সুন্নাতের সাহায্যকারী ও বিদআতের মূলোৎপাটনকারী। আর দ্বীনের সংস্কার কেবল প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে হবে। সেসময় সুন্নাতের বিলুপ্তি ঘটবে এবং বিদআত প্রকাশ পাবে। ফলে তখন দ্বীনের সংস্কারের প্রয়োজনে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্য হতে পরবর্তী প্রজন্ম থেকে এক বা একাধিক মুজাদ্দিদ নিয়ে আসবেন। কারণ দ্বীনের সংস্কারের জন্য বিভিন্ন গুণাবলি সম্পন্ন আলেমের প্রয়োজন।

একদল আলেম সর্বদা দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা করবেন :

عَنْ إِبْرَاهِيْمَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ يَحْمِلُ هٰذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُوْلُه يَنْفُوْنَ عَنْهُ تَحْرِيْفَ الْغَالِيْنَ وَانْتَحَالَ الْمُبْطِلِيْنَ وَتَأْوِيْلَ الْجَاهِلِيْنَ

ইবরাহীম ইবনে আবদুর রহমান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, প্রত্যেক আগত জামা‘আতের মধ্যে নেক, তাকওয়াসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য মানুষ (কিতাব ও সুন্নার) এ জ্ঞান গ্রহণ করবেন। আর তিনিই এ জ্ঞানের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘনকারীদের রদবদল, বাতিলপন্থীদের মিথ্যা অপবাদ এবং অজ্ঞদের ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে দূরীভূত করবেন। [মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৪২৩; বায়হাকী, হা/২০৭০০; মিশকাত, হা/২৪৮।]

প্রত্যেক শতাব্দীর বিদ্বানগণ কিতাব ও সুন্নার জ্ঞানকে বহন করবেন ও তার প্রতি নিজেরা আমল করবেন ও মৃত হুকুম-আহকামগুলোকে সমাজে জীবিতকরণে সদা সচেষ্ট হবেন। তারা কুরআন-সুন্নাকে এর উদ্দেশিত অর্থের পরিবর্তনকারীদের থেকে, বাতিলপন্থীদের অগ্রহণযোগ্য কথা থেকে এবং মূর্খদের ভুল ব্যাখ্যা থেকে মুক্ত রাখবেন। এভাবে তারা সর্বদা ইসলামের উপর সকল আঘাত নিরলসভাবে প্রতিহত করে যাবেন।

১৬
ইলম শিক্ষা দেয়া সাদাকায়ে জারিয়া
মানুষ মারা যাওয়ার পর তার আর আমল করার কোন সুযোগ থাকে না। তাই তার আমলনামায় আর কোন সওয়াব লেখা হয় না। কিন্তু হাদীসে এমন কয়েকটি আমলের কথা উল্লেখ রয়েছে, যার সওয়াব বান্দার মৃত্যুর পরও জারি থাকে। সেই কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কাজ হলো দ্বীনের ইলম প্রচারের ব্যবস্থা করে যাওয়া। যেমন, হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ اِنْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُه اِلَّا مِنْ ثَلَاثَةِ أَشْيَاءَ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِه أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সমসত্ম আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে : (১) সাদাকায়ে জারিয়া, (২) জ্ঞান- যার থেকে মানুষ উপকৃত হতে থাকে এবং (৩) সুসন্তান- যে তার জন্য দু‘আ করে। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৩১০; আবু দাউদ, হা/২৮৮২; তিরমিযী, হা/১৩৭৬; নাসাঈ, হা/৩৬৫১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৩১; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৬৪৫৭; আদাবুল মুফরাদ, হা/৩৮; বায়হাকী, হা/১২৪১৫; জামেউস সগীর, হা/৭৯৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৮; সুনানে দারেমী, হা/৫৫৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৩৯; মিশকাত, হা/২০৩।]

নিশ্চয় মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমলনামায় আর সওয়াব লেখা হয় না। কেননা সওয়াব মূলত তার আমলের বদলা, আর ব্যক্তি মারা যাওয়ার সাথে সাথে সে সুযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে সর্বদা ঐসব কল্যাণকর ও উপকারী কাজের বদলা চলতে থাকে, যা সে জীবিত অবস্থায় করে গিয়েছিল এবং তার ফল এখনো দুনিয়াতে চালু আছে। যেমন- কোন কিছু ওয়াকফ করে যাওয়া অথবা বই লিখে যাওয়া অথবা দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে যাওয়া অথবা দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা করে যাওয়া অথবা সৎ সন্তান রেখে যাওয়া। সৎ সন্তান মূলত আমলেরই আওতাভুক্ত। কেননা পিতাই মূলত সন্তানের অস্তিত্বের কারণ ও তাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে সদ্ভাবে গড়ে তোলার মাধ্যম। সন্তান ছাড়া অন্য কেউ যদি মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করে তাহলে মৃত ব্যক্তির জন্য ঐ দু‘আ কাজে আসবে, তবুও হাদীসে সন্তানকে নির্দিষ্ট করার কারণ হচ্ছে সন্তানকে দু‘আর ব্যাপারে উৎসাহিত করা। তাছাড়া সাধারণত পিতার মৃত্যুর পর তার কল্যাণের জন্য সকল কার্যক্রম সৎ সমত্মানগণই করে থাকে। যেমন- পিতার জন্য দু‘আ করা, সাদাকা করা, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা ইত্যাদি।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِه وَحَسَنَاتِه بَعْدَ مَوْتِه عِلْمًا عَلَّمَه وَنَشَرَه وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَه أَوْ مُصْحَفًا وَرَّثَه أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِه فِي صِحَّتِه وَحَيَاتِه تَلْحَقُه مِنْ بَعْدِ مَوْتِه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মুমিনের ইন্তেকালের পরও তার যেসব নেক কাজের সওয়াব তার নিকট সবসময় পৌঁছতে থাকবে, সেগুলো হলো- (১) ইলম বা জ্ঞান- যা সে শিখেছে এবং প্রচার করেছে; (২) সৎ সন্তান- যাকে সে দুনিয়ায় রেখে গেছে; (৩) কুরআন- যা উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে গেছে; (৪) মসজিদ- যা সে নির্মাণ করে গেছে; (৫) মুসাফিরখানা- যা সে পথিক-মুসাফিরদের জন্য নির্মাণ করে গেছে; (৬) কূপ বা ঝর্ণা- যা সে খনন করে গেছে মানুষের পানি ব্যবহার করার জন্য এবং (৭) দান-খয়রাত- যা সুস্থ ও জীবিতাবস্থায় তার ধনসম্পদ থেকে দান করে গেছে। মৃত্যুর পর এসব নেক কাজের সওয়াব তার নিকট পৌঁছতে থাকবে। [ইবনে মাজাহ, হা/২৪২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪৯০; জামেউস সগীর, হা/৩৯৯৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৭; মিশকাত, হা/২৫৪।]

হাদীসের শেষের দিকে বলা হয়েছে, ব্যক্তি জীবিত ও সুস্থাবস্থায় তার সম্পদ হতে যা সাদাকা হিসেবে দিয়ে থাকে তার সওয়াব তার মৃত্যুর পর তার আমলনামাতে লিপিবদ্ধ হয়। উল্লেখিত হাদীসাংশ দ্বারা সুস্থাবস্থায় দান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে তার এ সাদাকাটি তার জীবনের সর্বোত্তম সাদাকাতে পরিণত হতে পারে।

عَنْ أَبِيْ مَسْعُوْدٍ الْأَنْصَارِيِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ فَقَالَ إِنَّه أُبْدِعَ بِيْ فَاحْمِلْنِيْ فَقَالَ مَا عِنْدِيْ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَنَا أَدُلُّه عَلٰى مَنْ يَّحْمِلُه فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ دَلَّ عَلٰى خَيْرٍ فَلَه مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِه

আবু মাসঊদ আল আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সওয়ারী চলতে পারছে না, আপনি আমাকে একটি সওয়ারীর ব্যবস্থা করে দিন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এ সময় তো আমার নিকট তোমাকে দেবার মতো কোন সওয়ারী নেই। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে এমন এক লোকের সন্ধান দিতে পারি, যে তাকে সওয়ারীর ব্যবস্থা করে দিতে পারে। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, যে ব্যক্তি কাউকে কোন কল্যাণের দিকে পথপ্রদর্শন করে, সে উক্ত কার্য সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫০০৭; আবু দাউদ, হা/৫১৩১; তিরমিযী, হা/২৬৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৬৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৬৬৮; আদাবুল মুফরাদ, হা/২৪২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪০৪৮; বায়হাকী, হা/১৭৬২১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/২০০৫৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১১৫; মিশকাত, হা/২০৯।]

যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে কথা, কাজ, ইশারা-ইঙ্গিত বা লিখনীর মাধ্যমে পূণ্যময় কোন কাজ বা ইলমের দিক-নির্দেশনা দেবে, সেও দিক-নির্দেশনাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতো সওয়াব লাভ করবে। এতে দিক-নির্দেশনাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সওয়াবে কোন ঘাটতি হবে না।

ইমাম নববী বলেন, ‘‘দিক-নির্দেশক দিক-নির্দেশনাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতো সওয়াব লাভ করবে’’- এ উক্তির উদ্দেশ্য হলো, দিক-নির্দেশনাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেমন সওয়াব লাভ করবে দিক-নির্দেশক ব্যক্তিও তেমন সওয়াব লাভ করবে, এতে উভয়ের সওয়াব সমান হওয়া আবশ্যক নয়।

ইমাম কুরতুবী বলেন- গুণে ও পরিমাণে উভয়ের সওয়াব সমান। কেননা কাজের উপর যে সওয়াব দেয়া হয়, তা আল্লাহর পক্ষ হতে অনুগ্রহ; আল্লাহ যাকে ইচছা তা দান করেন।

عَنْ جَرِيْرٍ قَالَ كُنَّا فِيْ صَدْرِ النَّهَارِ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ فَجَاءَهُ قَوْمٌ عُرَاةٌ مُجْتَابِي النِّمَارِ أَوِ الْعَبَاءِ مُتَقَلِّدِي السُّيُوْفِ عَامَّتُهُمْ مِنْ مُضَرَ بَلْ كُلُّهُمْ مِنْ مُضَرَ فَتَمَعَّرَ وَجْهُ رَسُوْلِ اللهِ لِمَا رَأٰى بِهِمْ مِنْ الْفَاقَةِ فَدَخَلَ ثُمَّ خَرَجَ فَأَمَرَ بِلَالًا فَأَذَّنَ وَأَقَامَ فَصَلّٰى ثُمَّ خَطَبَ فَقَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ إِلٰى اٰخِرِ الْاٰيَةِ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا وَالْاٰيَةَ الَّتِيْ فِي الْحَشْرِ اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ تَصَدَّقَ رَجُلٌ مِنْ دِيْنَارِه مِنْ دِرْهَمِه مِنْ ثَوْبِه مِنْ صَاعِ بُرِّه مِنْ صَاعِ تَمْرِه حَتّٰى قَالَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ قَالَ فَجَاءَ رَجُلٌ مِنْ الْأَنْصَارِ بِصُرَّةٍ كَادَتْ كَفُّه تَعْجِزُ عَنْهَا بَلْ قَدْ عَجَزَتْ قَالَ ثُمَّ تَتَابَعَ النَّاسُ حَتّٰى رَأَيْتُ كَوْمَيْنِ مِنْ طَعَامٍ وَثِيَابٍ حَتّٰى رَأَيْتُ وَجْهَ رَسُوْلِ اللهِ يَتَهَلَّلُ كَأَنَّه مُذْهَبَةٌ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَه أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَه مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِه مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ

জারীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমরা দিনের শুরুতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট ছিলাম। এমন সময় কাঁধে তরবারি ঝুলিয়ে একদল লোক রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে আসলো। তাদের শরীর ছিল প্রায় উলঙ্গ; তারা তাদের শরীর কালো ডোরা রঙের চাদর দিয়ে কোন রকমে ঢেকে রেখেছিল। তাদের অধিকাংশ লোক, বরং সকলেই ছিল মুযার গোত্রের। তাদের চেহারায় ক্ষুধার লক্ষণ প্রকাশ পেতে দেখে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল এবং তিনি খাবারের খুঁজে ঘরে প্রবেশ করলেন। তারপর কিছু না পেয়ে বেরিয়ে আসলেন এবং বিলাল (রাঃ) কে নির্দেশ দিলে তিনি আযান ও ইকামত দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ সকলকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি খুৎবা দিলেন এবং এ আয়াত পড়লেন,

﴿ يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَّنِسَآءً وَّاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْ تَسَآءَلُوْنَ بِه وَالْاَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا ﴾

হে মানুষেরা! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি তা হতে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন, এরপর এ জোড়া হতে বহু নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা পরস্পর (নিজেদের অধিকার) দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কেও সতর্ক থাকো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা- ১)

অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ সূরা হাশরের এ আয়াত পাঠ করলেন :

﴿ يَاۤ اََيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ﴾

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের প্রত্যেকে ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য (কিয়ামতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে।

(সূরা হাশর- ১৮)

(অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমাদের) প্রত্যেকেরই দীনার, দিরহাম, কাপড়-চোপড়, গম ও খেজুরের ভান্ডার হতে দান করা উচিত। অবশেষে তিনি বললেন, যদি খেজুর এক টুকরাও হয়।

জারীর (রাঃ) বলেন, এটা শুনে আনসারদের এক ব্যক্তি একটি থলে নিয়ে এলো, যা সে বহন করতে পারছিল না। অতঃপর লোকেরা একের পর এক জিনিসপত্র আনতে লাগল। এমনকি আমি দেখলাম, শস্য ও কাপড়-চোপড়ের দু’টি সত্মুপ হয়ে গেছে এবং দেখলাম, (আনন্দে) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর চেহারা ঝলমল করছে, যেন তা স্বর্ণে জড়ানো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ইসলামে যে ব্যক্তি কোন নেক কাজ চালু করল সে তা চালু করার সওয়াব তো পাবেই, তার পরের লোকেরা যারা এ নেক কাজের উপর আমল করবে তাদেরও সমপরিমাণ সওয়াব সে পাবে। অথচ এদের সওয়াব কিছু কমবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতির প্রচলন করল, তার জন্য এ কাজের গোনাহ তো আছেই। এরপর যারা এ মন্দ রীতির উপর আমল করবে তাদের সমপরিমাণ গোনাহও তার ভাগে আসবে, অথচ এতে আমলকারীদের গোনাহ কম করা হবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/১০১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৯৭; মুসনাদুল বাযযার, হা/৪২০৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২২৬২; বায়হাকী, হা/৭৫৩১; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৬৬১; মুসনাদে ইবনে জাদ, হা/৫১৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯৮৯৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৬১; মিশকাত, হা/২১০।]

হাদীসে কল্যাণকর বিষয় সূচনার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে সমাজে তার ধারা চলতে থাকে। পক্ষান্তরে অকল্যাণকর কাজ সমাজে প্রসার ঘটবে এ আশঙ্কায় অকল্যাণকর কাজ চালু করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আর সন্তোষজনক সুন্নাত চালু করা উপকারী ইলমেরই আওতাভুক্ত। সমেত্মাষজনক সুন্নাত তথা ভালো কাজের প্রচলন বলতে এমন কাজসমূহকে বুঝানো হয়, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাতের বহির্ভূত নয়। অতএব, কেউ যদি দুনিয়াতে ইলম প্রচারের উদ্দেশ্যে কোন উদ্যোগ বাসত্মবায়ন করে তাহলে পরবর্তীতে এর মাধ্যমে যতজন লোক উপকৃত হবে তার সমপরিমাণ সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে।

সুযোগ অনুযায়ী মানুষকে নসীহত করতে হবে :

عَنْ عِكْرِمَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ حَدِّثِ النَّاسَ كُلَّ جُمُعَةٍ مَرَّةً فَإِنْ أَبَيْتَ فَمَرَّتَيْنِ فَإِنْ أَكْثَرْتَ فَثَلَاثَ مَرَّاتٍ وَلَا تُمِلَّ النَّاسَ هٰذَا الْقُرْاۤنَ وَلَا أُلْفِيَنَّكَ تَأْتِي الْقَوْمَ وَهُمْ فِي حَدِيثٍ مِنْ حَدِيثِهِمْ فَتَقُصُّ عَلَيْهِمْ فَتَقْطَعُ عَلَيْهِمْ حَدِيثَهُمْ فَتُمِلُّهُمْ وَلَكِنْ أَنْصِتْ فَإِذَا أَمَرُوكَ فَحَدِّثْهُمْ وَهُمْ يَشْتَهُونَه وَانْظُرْ السَّجْعَ مِنَ الدُّعَاءِ فَاجْتَنِبْهُ فَإِنِّي عَهِدْتُ رَسُولَ اللهِ وَأَصْحَابَه لَا يَفْعَلُونَ ذٰلِكَ

তাবেঈ ইকরিমা (রহ.) থেকে বর্ণিত। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেছেন, হে ইকরিমা! প্রত্যেক সপ্তাহে মাত্র একদিন মানুষকে ওয়াজ-নসীহত শোনাবে। যদি একবার ওয়াজ-নসীহত করা যথেষ্ট মনে না কর, তাহলে সপ্তাহে দু’বার। এর চেয়েও যদি বেশি করতে চাও, তাহলে সপ্তাহে তিনবার ওয়াজ-নসীহত করো। তোমরা এ কুরআনকে মানুষের নিকট বিরক্তিকর করে তুলো না। কোন জাতি যখন তাদের কোন ব্যাপারে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত থাকে তখন তোমরা সেখানে পৌঁছলে তাদের আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে তাদের কাছে ওয়াজ-নসীহত করতে আমি যেন তোমাদেরকে না দেখি। এ সময় তোমরা চুপ করে থাকবে। তবে তারা যদি তোমাদেরকে ওয়াজ-নসীহত করার জন্য বলে, তখন তাদের আগ্রহ পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে হাদীস শোনাও। কবিতার ছন্দে দু‘আ করা পরিত্যাগ করবে এবং এ বিষয়ে সতর্ক থাকবে। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণকে দেখেছি, তারা এরূপ করতেন না। [সহীহ বুখারী, হা/৬৩৩৭; মিশকাত, হা/২৫২২।]

সপ্তাহের প্রতিদিন মানুষকে নসীহত করা আল্লাহর কিতাবকে ও নবী ﷺ এর হাদীসকে তাদের সামনে বিরক্তিকর হিসেবে উপস্থাপনের শামিল। অনুরূপভাবে কোন সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে তাদের আলাপরত অবস্থাতে নসীহত করাও বিরক্তিকর হিসেবে উপস্থাপনের শামিল।

উপদেশ দিতে গিয়ে মানুষকে বিরক্ত করা যাবে না :

عَنْ شَقِيْقٍ قَالَ كَانَ عَبْدُ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ يُذَكِّرُ النَّاسَ فِي كُلِّ خَمِيْسٍ فَقَالَ لَه رَجُلٌ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمٰنِ لَوَدِدْتُ أَنَّكَ ذَكَّرْتَنَا فِي كُلَّ يَوْمٍ قَالَ أَمَا إِنَّه يَمْنَعُنِيْ مِنْ ذٰلِكَ أَنِّي أَكْرَه أَنْ أُمِلَّكُمْ وَإِنِّي أَتَخَوَّلُكُمْ بِالْمَوْعِظَةِ كَمَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَتَخَوَّلُنَا بِهَا مَخَافَةَ السَّاۤمَةِ عَلَيْنَا

তাবেঈ শাকীক (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) প্রত্যেক বৃহস্পতিবার লোকজনের সামনে ওয়াজ-নসীহত করতেন। একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে বললেন, হে আবু আবদুর রহমান! আমরা চাই, আপনি এভাবে প্রতিদিন আমাদেরকে ওয়াজ-নসীহত করুন।

তখন আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বললেন, এরূপ করতে আমাকে এ কথাই বাধা দিয়ে থাকে যে, আমি প্রতিদিন (ওয়াজ-নসীহত) করলে তোমরা বিরক্ত হয়ে উঠবে। এ কারণে আমি মাঝে মধ্যে ওয়াজ-নসীহত করে থাকি, যেমনিভাবে আমাদেরকে ওয়াজ-নসীহত করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ লক্ষ্য রাখতেন, যাতে করে আমাদের মধ্যে বিরক্তির ভাব সৃষ্টি না হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৭০; সহীহ মুসলিম, হা/৭৩০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪০৬০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৫২৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫১৩৭; মিশকাত, হা/২০৭।]

হাদীসটিতে ওয়াজ-নসীহতের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, যাতে মানুষ বিরক্তবোধ না করে এবং ওয়াজ-নসীহতের মূল উদ্দেশ্য ছুটে না যায়। সুতরাং নসীহত করার ক্ষেত্রে সময়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে ও মানুষের অবস্থা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) প্রত্যেক বৃহস্পতিবার মানুষকে নসীহত করতেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এ থেকে ইমাম বুখারী মাসআলা সাব্যস্ত করেছেন- নসীহতের জন্য উস্তাদ কর্তৃক সপ্তাহের কোন দিন ধার্য করা জায়েয।

কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে :

عَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلَاثًا حَتّٰى تُفْهَمَ عَنْهُ وَإِذَا أَتٰى عَلٰى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلَاثًا

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ যখন কোন কথা বলতেন (অধিকাংশ সময়) তিনবার বলতেন, যাতে মানুষ তাঁর কথাটা ভালো করে বুঝতে পারে। এভাবে যখন তিনি কোন সম্প্রদায়ের কাছে যেতেন তখন তাদেরকেও সালাম করতেন। আর তখন তিনি তাদেরকে তিনবার করে সালাম করতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩২৪৪; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৩২০; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৪১; জামেউস সগীর, হা/৮৮২৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৪৭৩; মিশকাত, হা/২০৮।]

হাদীসে বর্ণিত এ কাজটি রাসূলুল্লাহ ﷺ অবস্থা অনুপাতে করতেন, অর্থাৎ- উপস্থাপিত শব্দ যদি কঠিন হতো অথবা শ্রোতাদের কাছে অপরিচিত হতো অথবা শ্রোতাদের সংখ্যা অধিক হতো, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এমন করতেন, সর্বদা নয়। কেননা বিনা প্রয়োজনে কথার পুনরাবৃত্তি করা বালাগাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ হাদীস থেকে আরো বুঝা যায়, প্রয়োজনীয় স্থানে একজন শিক্ষকের জন্য উচিত হবে, তার কথাকে একাধিকবার বলা। এমনিভাবে কোন ব্যক্তি যখন একবার কোন কথা শোনার পর মুখস্থ করতে পারবে না বা বুঝতে পারবে না, তখন বক্তা/শিক্ষক তার কথা বুঝিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে বা মুখস্থ করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে একাধিকবার বলতে পারবেন। হাদীসের শেষাংশে রয়েছে, ‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন কোন সম্প্রদায়ের কাছে গমন করতেন, তখন তিনবার সালাম দিতেন’’ এ কথার তাৎপর্য হলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রথম সালাম দিতেন অনুমতির জন্য, দ্বিতীয় সালাম দিতেন ঘরে প্রবেশের জন্য এবং তৃতীয় সালাম দিতেন বিদায়ের মুহূর্তে- এ প্রত্যেকটিই সুন্নাত।

১৭
ইলম শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কবাণী
মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করা যাবে না :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ بَلِّغُوْا عَنِّى وَلَوْ اٰيَةً وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِيْ اِسْرَائِيْلَ وَلَا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَؤَّا مَقْعَدَه مِنَ النَّارِ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার পক্ষ হতে (মানুষের কাছে) একটি আয়াত (কথা) হলেও তা পৌঁছে দাও। আর তোমরা বনী ইসরাঈল হতে শোনা কথা বলতে পার, এতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু (জেনে রেখো) যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে, সে যেন তার বাসস্থান জাহান্নামে প্রসত্মুত করে নিল। [সহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১; তিরমিযী, হা/২৬৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৪৮৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৫২৫; মু‘জামুস সগীর, হা/৪৬২; সুনানে দারেমী, হা/৫৪২; মুসান্নাফে আবদুর রযযাক, হা/১০১৫৭; জামেউস সগীর, হা/৫১৪৮; মিশকাত, হা/১৯৮।]

এ হাদীসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ তার উম্মতকে ব্যাপকভাবে ইলম প্রচার করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। এমনকি কারো সামান্য পরিমাণ ইলম থাকলেও তা অপরের কাছে প্রচার করতে বলেছেন। চাই তা কুরআনের ছোট একটি আয়াত হোক বা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সাধারণ একটি হাদীস হোক। সাথে সাথে তিনি কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস বিকৃত করা বা এসব বিষয়ে মিথ্যারোপ করা থেকে সতর্ক করে দিয়েছেন। আর এর মাধ্যমে সেসব আলেমদের যুক্তিও খন্ডন করা হয়েছে যারা বলে থাকেন যে, দ্বীনের জন্য উৎসাহ প্রদান করা এবং আল্লাহর প্রতি ভয় প্রদর্শন করার জন্য মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করা জায়েয।

অতঃপর এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বনী ইসরাঈলের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করার অনুমতি দিয়েছেন। কেননা ইতিপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলের মাঝে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। ফলে তাদের মাঝে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার কিছু কিছু ঘটনা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। আবার কিছু কিছু ঘটনা বনী ইসরাঈলদের বংশ পরম্পরা থেকে লোকশ্রুতির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর অধিকাংশই প্রকৃত ঘটনার বিকৃত রূপ। কখনো কখনো এসব ঘটনা মানুষদেরকে খুবই আশ্চর্যান্বিত করে এবং এগুলো তাদেরকে অনেকটাই প্রভাবান্বিত করে। আর কুরআনে এসব ঘটনাবলির মধ্য হতে এমন সব ঘটনাই বর্ণনা করা হয়েছে, যেগুলো কুরআনের অনুসারীদের জন্য শিক্ষণীয়। আর হাদীসে বাকি ঘটনাগুলোর ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। যাতে এসব ঘটনা নিয়ে মানুষ বাড়াবাড়ি না করে এবং ফেতনায় জড়িয়ে না পড়ে।

অতএব, যেসব ঘটনা কেবল কুরআন ও হাদীসের সমর্থক সেগুলো বর্ণনা করাই উত্তম। অন্যথায় সেগুলো বর্ণনা না করাই ভালো। যাতে করে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কোন ধরনের বিকৃতি বা পরিবর্তন-পরিবর্ধন না ঘটে।

দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে দ্বীন প্রচার করতে হবে :

﴿وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌؕ اِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ اُولٰٓئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُوْلًا﴾

যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়- তাদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৬)

এ আয়াতে আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সব ধরনের ধারণা, কল্পনা ও কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে এবং ঈমানদারদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রদত্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রমাণিত বিষয়সমূহ মেনে নেয়ার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। লোকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধারণা ও অনুমানের পরিবর্তে জ্ঞানের অনুসরণ করবে- ইসলামী সমাজে এ ধারাটি ব্যাপকভাবে নৈতিক ব্যবস্থা, আইন, রাজনীতি, দেশ শাসন, শিক্ষাব্যবস্থা তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। জ্ঞানের পরিবর্তে অনুমানের পেছনে চলার কারণে মানুষের জীবনে যে অসংখ্য ভ্রান্ত মত সৃষ্টি হয়, তা থেকে চিন্তা ও কর্মকে মুক্ত করা হয়েছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে কুধারণা থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং অনুমান করে কারো বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।

عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ وَالْمُغِيْرَةِ بْنِ شُعْبَةَ قَالَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ حَدَّثَ عَنِّيْ بِحَدِيْثٍ يُّرَاى اَنَّه كَذِبٌ فَهُوَ اَحَدُ الْكَاذِبِيْنَ

সামুরা ইবনে জুনদুব ও মুগীরা ইবনে শু‘বা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার পক্ষ হতে এমন হাদীস বর্ণনা করে, অথচ সে জানে যে এটা মিথ্যা- তবে সেও দু’জন মিথ্যাবাদীদের একজন। [সহীহ মুসলিম, হা/১; তিরমিযী, হা/২৬৬২; ইবনে মাজাহ, হা/৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮২৬৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৫; জামেউস সগীর, হা/১১১৪৪; মিশকাত, হা/১৯৯।]

কোন একটি হাদীস তৈরি করার পর যদি তা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দিকে সম্বন্ধ করা হয় এবং এ বিষয়টি পরিষ্কার জানার পরও কোন ব্যক্তি যদি তা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস বলে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে, তাহলে সে ব্যক্তিও হাদীস তৈরিকারীদের অমত্মর্ভুক্ত হবে। তবে হাদীস উল্লেখের পর যদি বলে দেয় এ হাদীসটি তৈরিকৃত অথবা এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামে মিথ্যাচার, তবে ঐ ব্যক্তির হুকুম আলাদা।

কুরআন-সুন্নার আলোকে মতভেদের মীমাংসা করতে হবে :

﴿فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِؕ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّاَحْسَنُ تَأْوِيْلًا﴾

যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ ঘটে, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের নিকট উপস্থাপন করো; যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। আর এটাই উত্তম পন্থা ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা- ৫৯)

﴿وَمَاۤ اَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ اِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِى اخْتَلَفُوْا فِيْهِ وَهُدًى وَّرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ﴾

আমি তো তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যারা মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। আর এটি (অবতীর্ণ করেছি) মুমিনদের জন্য পথনির্দেশ ও রহমতস্বরূপ। (সূরা নাহল- ৬৪)

কুরআন-সুন্নার সিদ্ধান্তের উপর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের অধিকার কারো নেই :

﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَّلَا مُؤْمِنَةٍ اِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهٗۤ اَمْرًا اَنْ يَّكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ اَمْرِهِمْؕ وَمَنْ يَّعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِيْنًا﴾

কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য এ অবকাশ নেই যে, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কিছুর নির্দেশ দেন, তখন সে বিষয়ে তাদের কোন নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। যদি কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, তবে সে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় পতিত হয়। (সূরা আহ্যাব- ৩৬)

কোন হালালকে হারাম করা যাবে না :

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُحَرِّمُوْا طَيِّبَاتِ مَاۤ اَحَلَّ اللهُ لَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوْاؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ﴾

হে মুমিনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যেসব পবিত্র বস্তুসমূহকে হালাল করে দিয়েছেন, সেগুলোকে তোমরা হারাম করো না এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা মায়েদা- ৮৭)

এ আয়াতে দু’টি কথা বলা হয়েছে। (এক) তোমরা নিজেরাই কোন জিনিস হালাল ও হারাম সাব্যস্ত করার অধিকারী হয়ে বসো না। আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হালাল এবং যা হারাম করেছেন তা হারাম। (দুই) খ্রিস্টান, সন্ন্যাসী, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ভন্ডদের মতো বৈরাগ্যতা, সংসার বিমুখতা ও দুনিয়ার বৈধ স্বাদ পরিহার করার পদ্ধতি অবলম্বন করো না। ধর্মীয় মানসিকতাসম্পন্ন লোকদের মধ্যে সাধারণভাবে এ প্রবণতা দেখা গেছে যে, শরীর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করাকে তারা আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্তরায় মনে করে।

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোন এক সময় তিন ব্যক্তির একটি দল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীদের কাছে তাঁর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। অতঃপর তাদেরকে নবী ﷺ এর ইবাদাত সম্পর্কে জানানো হলে তারা বুঝল যে, নবী ﷺ এর আমলের তুলনায় তাদের আমলের পরিমাণ খুবই কম। অতঃপর তারা বলল, আমরা নবী ﷺ এর সমকক্ষ হব কী করে? যাঁর আগের-পরের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের একজন বলল, আমি আজীবন রাতভর সালাত আদায় করতে থাকব। দ্বিতীয়জন বলল, আমি সারা বছর সিয়াম পালন করব এবং কখনো বিরতি দেব না। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, আমি সর্বদা নারী বিবর্জিত থাকব এবং কখনো বিয়ে করব না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদের নিকট এসে বললেন, তোমরা কি সেসব ব্যক্তি যারা এমন এমন কথা বলেছ? তিনি আরো বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহর প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশি অনুগত এবং তাঁকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি। তা সত্ত্বেও আমি সিয়াম পালন করি আবার বিরতিও দেই। রাত্রে নিদ্রাও যাই এবং মহিলাদেরকে বিয়েও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি অনীহা প্রকাশ করবে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। [সহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩১৭; বায়হাকী, হা/১৩২২৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৯১৮; মিশকাত, হা/১৪৫।]

১৮
ওহীর জ্ঞান গোপন রাখা যাবে না
আল্লাহর বিধান গোপন রাখলে অভিশাপ পড়বে :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَاۤ اَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدٰى مِنْ ۢ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِى الْكِتَابِ اُولٰٓئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُوْنَ﴾

আমি যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও হেদায়াত নাযিল করেছি সেগুলোকে কিতাবের মধ্যে মানুষের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা ঐসব বিষয়গুলোকে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে লানত করেন এবং লানতকারীগণও তাদেরকে লানত করে থাকে। (সূরা বাক্বারা- ১৫৯)

ইয়াহুদি আলেমদের বড় অপরাধ ছিল এই যে, তারা আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান সর্বসাধারণের মাঝে প্রচার করার পরিবর্তে একটি সীমিত ধর্মীয় পেশাদার গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা ইয়াহুদি জনতাকেও এ জ্ঞানের স্পর্শ থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। সাধারণত অজ্ঞতার কারণে জনগণ যখন ব্যাপকভাবে ভ্রষ্টতার শিকার হলো, তখন ইয়াহুদি আলেমসমাজ জনগণের চিন্তা ও কর্মের সংস্কার সাধনে নিয়োজিত হয়নি। বরং উল্টো জনগণের মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয়তা অব্যাহত রাখার জন্য যে ভ্রষ্টতা ও শরীয়তবিরোধী কর্ম জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত, তাকে তারা নিজেদের কথা ও কাজের সাহায্যে অথবা নীরব সমর্থনের মাধ্যমে বৈধতার ছাড়পত্র দান করত। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হতো এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করত। এ কারণে মুসলিমদেরকে এ ধরনের প্রবণতা ও কর্মনীতি অবলম্বন না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সমগ্র বিশ্ববাসীকে হেদায়াত করার গুরুদায়িত্ব যে উম্মতের উপর সোপর্দ করা হয়েছে, সে হেদায়াতকে কৃপণের ধনের মতো আগলে না রেখে বেশি করে সম্প্রসারিত করাই হচ্ছে আলেমগণের কর্তব্য।

ওহীর জ্ঞান গোপন রাখা বড় ধরনের যুলুম :

﴿وَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ كَتَمَ شَهَادَةً عِنْدَهٗ مِنَ اللهِؕ وَمَا اللهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ﴾

যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য গোপন করেছে, তার চেয়ে বড় অত্যাচারী আর কে হতে পারে? আর তোমরা যা করছ আল্লাহ তা হতে অমনোযোগী নন। (সূরা বাক্বারা- ১৪০)

আল্লাহ সত্যকে গোপন করতে নিষেধ করেছেন :

﴿وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَاَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ﴾

তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করো না। (সূরা বাক্বারা- ৪২)

সত্য গোপন করা ইয়াহুদিদের কাজ :

﴿وَاِنَّ فَرِيْقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ﴾

তাদের একদল জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করেছে। (সূরা বাক্বারা- ১৪৬)

বর্তমান সমাজে যত প্রকার কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে এবং বাতিল রীতিনীতি ও অর্থহীন বিধি-নিষেধের যেসব নতুন নতুন শরীয়ত তৈরি হয়েছে- সেগুলোর জন্য দায়ী হচ্ছে সেই আলেমসমাজ, যাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ছিল, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায়নি। তারপর অজ্ঞতার কারণে লোকদের মধ্যে যখন ভুল পদ্ধতির প্রচলন হতে থাকে, তখনো তারা মুখ বন্ধ করে বসে থেকেছে এবং আল্লাহর কিতাবের বিধানের উপর আবরণ পড়ে থাকাটাই নিজেদের জন্য লাভজনক বলে মনে করেছে।

সত্য গোপনের জন্য আল্লাহ ইয়াহুদিদেরকে তিরস্কার করেছেন :

﴿يَاۤ اَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَلْبِسُوْنَ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَاَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ﴾

হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করছ এবং সত্য গোপন করছ? অথচ তোমরা জান। (সূরা আলে ইমরান- ৭১)

কিতাবের শিক্ষা গোপন না করার জন্য আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছেন :

﴿وَاِذْ اَخَذَ اللهُ مِيْثَاقَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهٗ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُوْنَهٗ فَنَبَذُوْهُ وَرَآءَ ظُهُوْرِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهٖ ثَمَنًا قَلِيْلًاؕ فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُوْنَ﴾

আর যখন আল্লাহ কিতাবধারীদের থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, অবশ্যই তোমরা এটা লোকদের মধ্যে প্রকাশ করবে এবং কোন কিছুই গোপন করবে না। কিন্তু তারা এটাকে তাদের পশ্চাতে নিক্ষেপ করল এবং অল্প মূল্যে বিক্রি করে দিল; অথচ তারা যা ক্রয় করেছিল তা খুবই নিকৃষ্টতর। (সূরা আলে ইমরান- ১৮৭)

পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর বিধান গোপন রাখার ভয়াবহ পরিণতি :

﴿اِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُوْنَ بِهٖ ثَمَنًا قَلِيْلًا اُولٰٓئِكَ مَا يَأْكُلُوْنَ فِيْ بُطُوْنِهِمْ اِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيْهِمْۚ وَلَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ اُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدٰى وَالْعَذَابَ بِالْمَغْفِرَةِۚ فَمَاۤ اَصْبَرَهُمْ عَلَى النَّارِ﴾

আল্লাহ কিতাবে যা নাযিল করেছেন যারা তা গোপন করে এবং অল্প মূল্যে বিক্রি করে দেয়, তারা নিজেদের পেটে আগুন ভর্তি করে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না; সুতরাং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারাই সুপথের বিনিময়ে গুমরাহী এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং কীভাবে তারা জাহান্নামের আযাব সহ্য করবে? (সূরা বাক্বারা- ১৭৪, ১৭৫)

ইলম গোপনকারীকে পরকালে আগুনের লাগাম পরানো হবে :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ عَلِمَه ثُمَّ كَتَمَه أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তিকে এমন কোন জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যা সে জানে, অথচ সে তা গোপন রাখে (না বলে), কিয়ামতের দিন তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেয়া হবে। [আবু দাঊদ, হা/৩৬৬০; তিরমিযী, হা/২৬৪৯; ইবনে মাজাহ, হা/২৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫৬১; জামেউস সগীর, হা/১০৬৫০; মিশকাত, হা/২২৩।]

কোন ব্যক্তি যদি কোন বিদ্বানকে দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং জিজ্ঞাসাকারী ঐ বিষয়ে ইলম ধারণ করার যোগ্যতা রাখে এবং জিজ্ঞাসার বিষয় যদি দ্বীনের আবশ্যকীয় কোন বিষয় হয় যেমন- ইসলাম, সালাতের শিক্ষা, হারাম ও হালাল তাহলে অবশ্যই সম্ভাব্যতা অনুযায়ী জিজ্ঞাসু ব্যক্তিকে উত্তর দিতে হবে। যদি জিজ্ঞাসাকারীকে উত্তর দেয়া না হয়, তাহলে কিয়ামত দিবসে বিদ্বান ব্যক্তিকে বাকশক্তিহীন চতুষ্পদ জমত্মুর মতো মুখে আগুনের লাগাম লাগিয়ে উপস্থিত করা হবে। পক্ষান্তরে যদি দ্বীনের কোন নফল বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির এ বিষয়ে উত্তর দেয়া বা না দেয়া ইচ্ছাধীন।

আলেমের পদস্খলন ইসলাম ধ্বংসের একটি মূল কারণ :

عَنْ زِيَادِ بْنِ حُدَيْرٍ قَالَ قَالَ لِي عُمَرُ هَلْ تَعْرِفُ مَا يَهْدِمُ الْإِسْلَامَ؟ قُلْتُ لَا قَالَ يَهْدِمُه زَلَّةُ الْعَالِمِ وَجِدَالُ الْمُنَافِقِ بِالْكِتَابِ وَحُكْمُ الْأَئِمَّةِ الْمُضِلِّيْنَ

তাবেঈ যিয়াদ ইবনে হুদায়র (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উমর (রাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বলতে পার, ইসলাম ধ্বংস করবে কোন্ জিনিসে? আমি বললাম, আমি বলতে পারি না। তখন তিনি [উমর (রাঃ)] বললেন, আলেমদের পদস্খলন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে মুনাফিকদের ঝগড়া-বিবাদ বা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া এবং পথভ্রষ্ট শাসকদের শাসনই ইসলামকে ধ্বংস করবে। [সুনানে দারেমী, হা/২১৪; মিশকাত, হা/২৬৯।]

অত্র হাদীসে ‘কিতাব’ শব্দ দ্বারা কুরআনকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। হাদীসে কুরআনকে খাসভাবে বর্ণনা করার কারণ হলো- যেহেতু কুরআন নিয়ে বাদানুবাদ করা সর্বাধিক মন্দকাজ। কেননা এটা মানুষকে কুফ্রীর দিকে ঠেলে দেয়।

অত্র হাদীসে ইসলাম ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে আলেমদের পদস্খলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আলেমদের পদস্খলন বলতে যেসব বিষয় বুঝায় সেগুলো হলো- আলেমদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী ফতওয়া দেয়া এবং তা মানার জন্য জোর জবরদসিত্ম করা, ইসলামের কোন সাধারণ বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া এবং এজন্য প্রতিযোগিতা করা, আলেমদের কর্তৃক বিদআতী আমলকে সমর্থন দেয়া, মাসআলা দানের ক্ষেত্রে দলীয় শক্তির দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়া, সৎ কাজের আদেশ না দেয়া এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ না করা, কোন অপরাধ সংঘটিত হতে দেখে চুপ থাকা, কুফর ও ইসলামকে মিশ্রণ করে দেয়ার অপচেষ্টা করা, কাফির ও মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব করা, অধিকাংশ মানুষের রায় অনুযায়ী কুফরী মতবাদকে মেনে নেয়া, ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে অপব্যাখ্যা করে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করা ইত্যাদি। যখন আলেমদের মধ্যে এসব বিষয় লক্ষ্য করা যাবে তখনই ইসলাম ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলদের মাঝে তাই সংঘটিত হয়েছিল। তাদের আলেমদের মধ্যে বিচ্যুতি ঘটেছিল। ফলে তারা বারবার আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হয়েছিল।

কোন বিষয় জানা না থাকলে জানি না বলে উত্তর দিতে হবে :

عَنْ عَبْدِ اللهِ يَا أَيُّهَا النَّاسُ مَنْ عَلِمَ شَيْئًا فَلْيَقُلْ بِه وَمَنْ لَمْ يَعْلَمْ فَلْيَقُلْ اللّٰهُ أَعْلَمُ فَإِنَّ مِنَ الْعِلْمِ أَنْ يَّقُوْلَ لِمَا لَا يَعْلَمُ اللّٰهُ أَعْلَمُ قَالَ اللّٰهُ تَعَالٰى لِنَبِيِّه ﴿ قُلْ مَاۤ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَّمَاۤ أَنَا مِنَ الْمُتَكَلِّفِيْنَ﴾

আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে লোকসকল! যে যা জানে সে যেন তা-ই বলে। আর যে জানে না সে যেন বলে, আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। কারণ যে ব্যাপারে তোমার কিছু জানা নেই সে ব্যাপারে ‘‘আল্লাহই অধিকতর জ্ঞাত আছেন’’ এ কথা ঘোষণাই তোমার জ্ঞান। (কুরআনে) আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেছেন, ‘‘আপনি বলুন, আমি (দ্বীন প্রচারের বিনিময়ে) তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিক চাই না। আর আমি লৌকিকতাকারীও নই’’ (সূরা সোয়াদ- ৮৬)। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮০৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭২৪৪; তিরমিযী, হা/৩২৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১০৪; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৮৯৫০; সুনানে দারেমী, হা/১৭৩; মুসনাদে হুমাইদী, হা/১২৩; মিশকাত, হা/২৭২।]

না জেনে ফতওয়া দেয়া যাবে না :

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ أُفْتِيَ بِغَيْرِ عِلْمٍ كَانَ إِثْمُه عَلٰى مَنْ أَفْتَاهُ وَمَنْ أَشَارَ عَلٰى أَخِيْهِ بِأَمْرٍ يَعْلَمُ أَنَّ الرُّشْدَ فِي غَيْرِه فَقَدْ خَانَه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তিকে বিনা ইলমে (ভুল) ফতওয়া দেয়া হয়েছে, এর গোনাহ তার উপর বর্তাবে যে তাকে ফতওয়া দিয়েছে। আর যে ব্যক্তি তার কোন ভাইকে (অপরকে) কোন কাজের পরামর্শ দিয়েছে, অথচ সে জানে যে, এর কল্যাণের পথ অন্যটি, তাহলে নিশ্চয় সে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। [আবু দাঊদ, হা/৩৬৫৯; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩৫০; জামেউস সগীর, হা/১১০১৩; বায়হাকী, হা/২০১৪০; মিশকাত, হা/২৪২।]

হাদীসে বিনা ইলমে ফতওয়া দেয়া নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি ফতওয়াদানকারী যদি তার ইজতিহাদে ঘাটতি রেখে ভুল ফতওয়া দেয়, তাহলে তার অনেক গোনাহ হবে। হাদীসে আরো বলা হয়েছে, জেনে-শুনে কাউকে ভুল দিক-নির্দেশনা দেয়াও খিয়ানতের শামিল।

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّه قَالَ سَمِعَ النَّبِيُّ قَوْمًا يَتَدَارَءُوْنَ فِي الْقُرْاٰن فَقَالَ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِهٰذَا ضَرَبُوْا كِتَابَ اللهِ بَعْضَه بِبَعْضٍ وَإِنَّمَا نَزَلَ كِتَابُ اللهِ يُصَدِّقُ بَعْضُه بَعْضًا فَلَا تُكَذِّبُوْا بَعْضَه بِبَعْضٍ فَمَا عَلِمْتُمْ مِنْهُ فَقُوْلُوْا وَمَا جَهِلْتُمْ فَكِلُوهُ إِلٰى عَالِمِه .

আমর ইবনে শু‘আইব (রহ.) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নবী ﷺ একটি দল সম্পর্কে শুনলেন, তারা পরস্পর কুরআন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয় তোমাদের পূর্বের লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। তারা আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের দ্বারা বাতিল করার চেষ্টা করছিল। অথচ আল্লাহর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তার এক অংশ অপর অংশের পরিপূরক হিসেবে ও সত্যতা প্রমাণ করার জন্য। তাই তোমরা এর এক অংশকে অপর অংশের দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করো না, বরং তোমরা তার যতটুকু জান শুধু তা-ই বলো, আর যা তোমরা জান না তা কুরআনের আলেমের নিকট সোপর্দ করো। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৭৪১; ইবনে মাজাহ, হা/৮৫; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/২০৩৬৭; শারহুস সুন্নাহ, হা/১২১; মিশকাত, হা/২৩৭।]

১৯
ইলম প্রচারকারীর মর্যাদা
عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ نَضَّرَ اللّٰهُ امْرَأً سَمِعَ مَقَالَتِي فَحَفِظَهَا وَوَعَاهَا وَأَدَّاهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ غَيْرُ فَقِيهٍ وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلٰى مَنْ هُوَ أَفْقَه مِنْهُ ثَلاَثٌ لَا يُغِلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ مُسْلِمِ إِخْلَاصُ الْعَمَلِ لِلّٰهِ وَالنَّصِيْحَةُ لِلْمُسْلِمِيْنَ وَلُزُوْمُ جَمَاعَتِهِمْ فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيْطُ مِنْ وَّرَائِهِمْ

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ সে ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন, যে আমার কোন কথা শুনেছে, অতঃপর এ কথাকে স্মরণ রেখেছে ও সংরক্ষণ করেছে এবং যা শুনেছে হুবহু তা মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছে। কারণ জ্ঞানের অনেক বাহক এমন আছে, যারা নিজের তুলনায় বড় জ্ঞানীর নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। তিনটি বিষয়ে মুসলিমের অন্তর বিশ্বাসঘাতকতা (অবহেলা) করতে পারে না : (১) আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিষ্ঠার সাথে কাজ করা, (২) মুসলিমদের কল্যাণ কামনা করা এবং (৩) মুসলিমের জামা‘আতকে আঁকড়ে ধরা। কারণ মুসলিমদের দু‘আ বা আহবান তাদের পরবর্তী (মুসলিমদেরকেও) শামিল করে রাখে। [তিরমিযী, হা/২৬৫৮; ইবনে মাজাহ, হা/৩০৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৩৭৪; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২৯৪; মু‘জামুল আওসাত, হা/৫১৭৯; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৯৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪০৪; মিশকাত, হা/২২৮।]

হাদীসের প্রথমাংশ থেকে বুঝা যায়, দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের পর তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াই মূল লক্ষ্য। অনেক জ্ঞানী এমন আছে, যারা নিজেদের অর্জিত জ্ঞান থেকে তেমন উপকৃত হতে পারে না। পক্ষান্তরে এমন অনেক ব্যক্তি আছে, যাদের কাছে জ্ঞান পৌঁছে দেয়া হলে, তারা সে জ্ঞান দ্বারা নিজেরাও উপকৃত হয় এবং যারা তার নিকট জ্ঞান পৌঁছে দিয়েছে, তারাও উপকৃত হয়। তারপর তাদের থেকে পরবর্তী লোকেরাও উপকৃত হয়।

হাদীসের শেষে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, যার উপর একজন মুমিন ব্যক্তিকে সদা অটল থাকতে হবে। তিনটি বৈশিষ্ট্যের মাঝে তৃতীয় নম্বর বৈশিষ্ট্যে বলা হয়েছে, মুসলিমদের জামা‘আত বা দল আঁকড়ে ধরতে হবে। অতএব মুসলিমকে অন্যান্য মুসলিমের সাথে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক বিশ্বাসে, সৎ আমলে, সালাত আদায়ে, জুমু‘আর সালাত আদায়ে, দু’ঈদের সালাত আদায়ে এবং মুসলিম নেতাদের আনুগত্যে ও অন্যান্য বিষয়ে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হবে। ফলে সে শয়তানের চক্রান্ত ও পথভ্রষ্টতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে।

- عَنْ أَبِيْ أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ قَالَ ذُكِرَ لِرَسُوْلِ اللهِ رَجُلَانِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالْاٰخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِيْ عَلٰى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ اللهَ وَمَلَائِكَتَه وَأَهْلَ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرَضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِيْ جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّوْنَ عَلٰى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ

আবু উমামা আল বাহেলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট দুই ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। এদের একজন ছিলেন আবিদ (ইবাদাতকারী), আর দ্বিতীয়জন ছিলেন আলেম (জ্ঞান অনুসন্ধানকারী)। তিনি বললেন, আবিদের উপর আলেমের মর্যাদা হলো যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের একজন সাধারণ ব্যক্তির উপর। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতামন্ডলী এবং আকাশমন্ডলী ও জমিনের অধিবাসীরা, এমনকি পিঁপড়া তার গর্তে ও মাছ পর্যন্ত ইলম শিক্ষাকারীর জন্য দু‘আ করে। [তিরমিযী, হা/২৬৭৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৭৮৩৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮১; দারেমী, ১/৯৭-৯৮; মিশকাত, হা/২১৩।]

এ হাদীসে দ্বীনী বিদ্যা শিক্ষাদানের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। হাদীস থেকে বুঝা যায় দ্বীনী বিদ্যা শিক্ষাদানকারীর মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। যার জন্য মানুষ, জিন, ফেরেশতা এমনকি গর্তের ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়া এবং সমুদ্রের অতল তলের মাছসহ সকল প্রাণী দু‘আ করে থাকে।

২০
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে ইলম চর্চা
নবী ﷺ ছিলেন, মুসলিম জাতির শিক্ষক। সাহাবায়ে কেরাম তার কাছ থেকেই দ্বীনের ইলম শিক্ষা গ্রহণ করতেন। আল্লাহর কিতাবকে ব্যাখ্যা করে মানুষকে বুঝিয়ে দেয়া ছিল নবী ﷺ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বর্ণনা করেন,

﴿وَاَنْزَلْنَاۤ اِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ﴾

আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে তুমি তাদের (মানুষদের) কাছে যা পাঠানো হয়েছে তা তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিতে পার। হয়তো তারা চিন্তা-ভাবনা করবে। (সূরা নাহল- ৪৪)

রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর যুগ ছিল ইসলামের স্বর্ণ যুগ। সাহাবীগণ রাসূলুলস্নাহ ﷺ কে যা কিছু করতে দেখতেন এবং রাসূলুলস্নাহ ﷺ থেকে যা কিছু শুনতেন, তাই যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করতেন। যখন যে সাহাবী রাসূলুলস্নাহ ﷺ কে যেভাবে কাজ করতে দেখেছেন, পরবর্তীতে সেভাবেই তা পালন করে গেছেন। সাহাবীগণ যখনই নতুন কোন সমস্যায় পড়তেন, তখনই তারা সে বিষয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। সাহাবীগণ রাসূলুলস্নাহ ﷺ কে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুযায়ী প্রশ্ন করতেন। আর তিনি সেসব প্রেক্ষাপট অনুযায়ী জবাব দিতেন। কোন সংশয় দেখলে তা নিরসন করতেন, কেউ ভালো করতে দেখলে তার প্রশংসা করতেন এবং মন্দ কাজ করতে দেখলে বাধা দিতেন। তিনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্নভাবে দিতেন। এভাবে রাসূলুলস্নাহ ﷺ যা করতেন এবং বলতেন সেগুলো সাহাবীগণ মনে রাখতেন। এভাবেই তারা রাসূলুলস্নাহ ﷺ থেকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতেন।

আর নবী ﷺ দ্বীনের ব্যাপারে যা কিছু বলতেন, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলতেন। কুরআন মাজীদে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে,

﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰى اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْيٌ يُّوْحٰى﴾

তিনি প্রবৃত্তি হতে কোন কথা বলেন না। এটা তো এক ওহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা নাজম- ৩, ৪)

এ সময় ইসলামী আইনের একমাত্র উৎস ছিল ওহী; অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ।

তিনি মানুষের মনগড়া কথা শুনতেন না :

﴿قُلْ لَّاۤ اَتَّبِعُ اَهْوَآءَكُمْ قَدْ ضَلَلْتُ اِذًا وَّمَاۤ اَنَا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ﴾

(হে নবী) বলো, আমি তোমাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করি না, যদি করতাম তবে আমি বিপথগামী হয়ে যেতাম এবং সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকতাম না। (সূরা আনআম- ৫৬)

মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুওয়াতের শুরু থেকে ১১ হিজরীতে (৬৩২ সাল) তাঁর ইমেত্মকাল পর্যমত্ম প্রায় ২৩ বছর ধরে কুরআনের আয়াতগুলো পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ মক্কা ও মদিনায় যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হতেন, সেগুলোর সমাধানে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত অবতীর্ণ হতো। কুরআনের কিছু আয়াতে মুসলিম ও অমুসলিমদের উত্থাপিত প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া হয়েছে। অনেকগুলো আয়াত শুরু হয়েছে ‘‘তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে’’ এ ধরনের বাচনভঙ্গি দিয়ে। যেমন,

﴿ يَسْاَلُوْنَكَ عَنِ الْاَنْفَالِ ﴾

লোকেরা তোমাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। (সূরা আনফাল- ১)

﴿ وَيَسْاَلُوْنَكَ عَنْ ذِى الْقَرْنَيْنِ ﴾

লোকেরা তোমাকে যুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। (সূরা কাহফ- ৮৩)

﴿ وَيَسْاَلُوْنَكَ عَنِ الْمَحِيْضِ ﴾

(হে নবী!) তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে। (সূরা বাক্বারা- ২২২)

﴿ يَسْاَلُوْنَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ ﴾

লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে। (সূরা বাক্বারা- ২১৫)

﴿ وَيَسْاَلُوْنَكَ عَنِ الْيَتَامٰى ﴾

তারা তোমাকে ইয়াতীমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। (সূরা বাক্বারা- ২২০)

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে সংঘটিত বিশেষ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের বেশ কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। সাহাবী হেলাল ইবনে উমাইয়া (রাঃ) এর ঘটনাটি এমনই একটি উদাহরণ। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে নিজ স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, তোমাকে প্রমাণ আনতে হবে, নতুবা তোমাকে নির্দিষ্ট শাসিত্ম ভোগ করতে হবে।

হেলাল (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কেউ যদি অন্য পুরুষকে তার স্ত্রীর উপর দেখে তাহলে কি সাক্ষী খুঁজতে যাবে?

কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রমাণ আনার দাবিরই পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন। এরপর জিবরাঈল (আঃ) নিম্নোক্ত ওহী নিয়ে অবতীর্ণ হলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ يَرْمُوْنَ اَزْوَاجَهُمْ وَلَمْ يَكُنْ لَّهُمْ شُهَدَآءُ اِلَّاۤ اَنْفُسُهُمْ فَشَهَادَةُ اَحَدِهِمْ اَرْبَعُ شَهَادَاتٍ ۢبِاللهِ اِنَّهٗ لَمِنَ الصَّادِقِيْنَ وَالْخَامِسَةُ اَنَّ لَعْنَتَ اللهِ عَلَيْهِ اِنْ كَانَ مِنَ الْكَاذِبِيْنَ وَيَدْرَاُ عَنْهَا الْعَذَابَ اَنْ تَشْهَدَ اَرْبَعَ شَهَادَاتٍ ۢبِاللهِ اِنَّهٗ لَمِنَ الْكَاذِبِيْنَ وَالْخَامِسَةَ اَنَّ غَضَبَ اللهِ عَلَيْهَاۤ اِنْ كَانَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ﴾

যারা নিজেদের স্ত্রীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং নিজেরা ব্যতীত তাদের অন্য কোন সাক্ষী না থাকে, তাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য এ হবে যে, সে আল্লাহর নামে চারবার শপথ করে বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চমবার বলবে যে, সে যদি মিথ্যাবাদী হয় তাহলে যেন তার উপর আল্লাহর লানত নেমে আসে। তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে যদি সে চারবার আল্লাহর নামে শপথ করে সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্বামীই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবার বলে যে, তার স্বামী যদি সত্যবাদী হয় তবে তার নিজের উপর যেন আল্লাহর গযব নেমে আসে। (সূরা নূর : ৬-৯)

সুন্নাহ তথা হাদীসের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। এর অধিকাংশ বিষয় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর বা কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিভিন্ন বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, একবার এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সমুদ্রে ভ্রমণ করি। সে সময় মিঠা পানি দিয়ে অযু করলে আমাদের তৃষ্ণার্ত থাকতে হবে। আমরা কী করব? তখন তিনি বললেন, সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং এর মৃত জীবগুলো হালাল। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/৪১; আবু দাউদ, হা/৮৩; তিরমিযী, হা/৬৯; নাসাঈ, হা/৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৭২০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১২৪৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩৮৬; সুনানে দার কুতনী, হা/৮০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪৮০; মুসনাদে দারেমী, হা/৭৫৬; মিশকাত, হা/৪৭৯।]

উল্লেখ্য যে, ওহীর যুগে একটি আইন একবারে প্রয়োগ না করে, কয়েকটি পর্যায়ে ধাপে ধাপে প্রয়োগ করা হয়েছে।

২১
সাহাবীদের যুগে ইলম চর্চা
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করেন এবং দ্বীনের ইলমকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন। আর তারা এভাবেই দ্বীন প্রচারের কাজ আঞ্জাম দেন। তারা ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুসারী। তারা নবী ﷺ এর আদর্শে আদর্শিত হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا بِه وَعَزَّرُوْهُ وَنَصَرُوْهُ وَاتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِيْۤ اُنْزِلَ مَعَهٗۤ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ﴾

যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে ও তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৭)

বিদায় হজ্জের ভাষণে আল্লাহর নবী ﷺ মুসলিম উম্মাহকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নসীহত করেন। নসীহত শেষে তিনি উপস্থিত জনতাকে এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করেন যে, যারা এখানে উপস্থিত রয়েছে, তারা যেন ইসলামের শিক্ষাকে অনুপস্থিত লোকের কাছে পৌঁছে দেয়। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

فَلْيُبْلِغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ لَا تَرْجِعُوْا بَعْدِيْ كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ

এখানে উপস্থিতরা যেন অনুপস্থিতদের কাছে আমার এ বাণী পৌঁছে দেয়। আর তোমরা আমার পরে পরস্পরকে হত্যা করে কাফির হয়ে যেও না।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর এই উপদেশ সাহাবায়ে কেরাম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন এবং তারা ইসলামের শিক্ষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর ইসলামের দাওয়াত নিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এ সময় তাদের মাঝে বিভিন্ন ঘটনার উদ্ভব হয় এবং মাসআলা-মাসায়েলের প্রয়োজন পড়ে। ফলে তারা নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন এবং কুরআন ও সুন্নাহ হতে প্রাপ্ত জ্ঞান অনুযায়ী এর সমাধান দেন। যদি এতেও সম্ভব না হতো, তাহলে তারা ইজতিহাদ করে ফতওয়া দিতেন। অতঃপর রাসূলুলস্নাহ ﷺ যে বিষয়ের যে হুকুম দিয়েছেন, তার কারণ জানার চেষ্টা করতেন। যদি কোন সাহাবী কোন বিষয় সম্পর্কে না জানতেন, তখন তা অন্যান্য সাহাবীদের সাথে আলোচনা করে জেনে নিতেন এবং এ ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করতেন না। তারা সর্বাবস্থায় রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীসকে প্রাধান্য দিতেন। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে দ্বীনের কোন বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলেও তারা বড় ধরনের কোন ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়ে অন্যান্য সাহাবীর সাহায্য নিতেন। কোন সময় নিজের ভুল বুঝতে পারলে সাথে সাথেই তারা কুরআন হাদীসের দিকে ফিরে আসতেন। আর এভাবেই তারা রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর মৃত্যুর পরবর্তী যুগ অতিবাহিত করেন।

এ পর্যায়ের প্রথম বিশ বছরে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা অতি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছিল। এ সময়েই সিরিয়া, জর্দান, মিশর, ইরাক ও পারস্য প্রভৃতি অঞ্চল ইসলামী সাম্রাজ্যের অমত্মর্ভুক্ত হয়। এর ফলে মুসলিম জাতি সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনধারা, সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহারের সংস্পর্শে আসে এবং নতুন নতুন এমন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেগুলোর জন্য শরীয়তে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান ছিল না। এসব নতুন সমস্যা মোকাবেলার জন্য খুলাফায়ে রাশেদাগণ বিজ্ঞ সাহাবীদের ঐক্যমত ও ইজতিহাদের উপর নির্ভর করতেন। তারা এসব পরিস্থিতিতে সাধারণত নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতেন :

১. প্রথমে তারা কুরআনে সমস্যাটির সমাধান খুঁজতেন।

২. কুরআনে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান খুঁজে না পেলে হাদীসে অনুসন্ধান করতেন।

৩. হাদীসেও সমাধান না পাওয়া গেলে বিশিষ্ট সাহাবীদের বৈঠক ডেকে সমস্যাটির সমাধানের ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধামেত্ম পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন। আর এ ধরনের ঐক্যমতকে ইজমা নামে অভিহিত করা হতো।

৪. মতৈক্যে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে, তারা অধিকাংশ সাহাবীর সিদ্ধামত্মকে গ্রহণ করতেন।

৫. তবে ব্যাপক মতপার্থক্যের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত নিরূপণ করা কঠিন হয়ে গেলে খলীফা নিজেই ইজতিহাদ করতেন। ফলে তা আইনে পরিণত হতো।

২২
কোন বিষয়ে মতভেদ হলে সাহাবীগণ কী করতেন
কোন কোন বিষয়ে সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য থেকে যেত। কিন্তু পরবর্তীতে এ ব্যাপারে যদি তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস জানতে পারতেন, তাহলে সব মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে সাথে সাথে তা মেনে নিতেন। দৃষ্টামত্মস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ইমেত্মকালের পর তাঁকে কোথায় দাফন করা হবে- এ নিয়ে সাহাবীগণ বিভিন্ন মতামত দিতে লাগলেন। তখন আবু বকর (রাঃ) তাঁদের সামনে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, নবীগণ যেখানে মারা যান, সেখানেই সমাহিত হন। এ কথা শোনামাত্র সাহাবীগণ ব্যক্তিগত মতামত প্রত্যাহার করে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) এর গৃহে তাঁর কবর খনন করলেন।

কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া না গেলে এবং সাহাবীদের মধ্যেও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হলে, তারা একে অপরের মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। তারা কখনই কারো উপর বিশেষ কোন একটি মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন না।

২৩
সাহাবীদের মধ্যে কোন দলাদলি ছিল না
যদিও সাহাবীগণ কোন কোন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন, তবে তাঁদের মতপার্থক্য পরবর্তী যুগের মতো ব্যাপক অনৈক্য ও দলাদলির জন্ম দেয়নি। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর কারণে সর্বাবস্থায় তাঁদের ঐক্যের বন্ধন অটুট ছিল :

১. সাহাবীগণ কোন সিদ্ধামত্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে খলীফার সিদ্ধামত্ম গ্রহণ করতেন।

২. প্রথম দিকের খলীফাগণ বিশিষ্ট সাহাবীদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে বেশি দূরে বসবাসের অনুমতি দিতেন না। তাই খুব সহজেই তাঁদেরকে নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা যেত।

৩. সাহাবীগণ বিনয়ের কারণে অধিক ফতওয়া প্রদান করতে অনাগ্রহী ছিলেন। নিজেরা উত্তর না দিয়ে জটিল প্রশ্নগুলোকে তারা নিজেদের থেকে অধিকতর জ্ঞানী সাহাবীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।

৪. তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে যেসব শব্দে হাদীস শ্রবণ করতেন ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ যে কাজ যেভাবে করেছেন তা ঠিক সেভাবেই করতেন। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করা বা কোন অতিরিক্ত শব্দের মাধ্যমে হাদীসের ভাষ্য বুঝিয়ে দেয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতেন। এর মূল কারণ ছিল- রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীসের সঠিক প্রয়োগ কিংবা বর্ণনায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা। কারণ, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার নামে কোন মিথ্যা কথা বলে, সে যেন নিজেই জাহান্নামকে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নিল। [সহীহ বুখারী, হা/১০৭-১১০; সহীহ মুসলিম, হা/৩-৫; আবু দাউদ, হা/৩৬৫৩; তিরমিযী, হা/২৬৫৯; ইবনে মাজাহ, হা/৩০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৮৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩১; মিশকাত, হা/১৯৮।]

মতবিরোধ করা সত্ত্বেও তারা তাদের ঐক্যের ভাবমূর্তি খুব শক্তভাবে সংরক্ষণ করতেন, যার মধ্যে কখনো ফাটল ধরত না। আর যেসকল কথার কারণে তাদের ঐক্য বিনষ্ট হতো, সে সমসত্ম কথা থেকে সাহাবীগণ সম্পূর্ণ দূরে থাকতেন।

২৪
তাবেঈদের যুগে ইলম চর্চা
তাবেঈগণ যেহেতু সাহাবীদের কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা অর্জন করতেন, তাই তারা সাহাবীদের মতামতও আয়ত্ত করতেন। অতঃপর তারা রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীস ও সাহাবীদের মতামত থেকে যা শুনেছেন তা মুখস্থ করে নিতেন এবং তা সর্বদা মনে রাখতেন। তারা সাহাবীদের মতামতগুলোকে সমন্বয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।

এসব তাবেঈ সাহাবীগণের কাছ থেকে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীস, সাহাবীদের ফতওয়া ও মতবাদ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞানার্জন করেছেন এবং সে অনুযায়ী সমাজে নব উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধান করে গেছেন।

আলস্নাহ তা‘আলা তাদের হৃদয়কে ইলম ‘দ্বারা সিক্ত করেছেন। তারা ইলমী তৃষ্ণায় মন নিবন্ধন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাবেঈগণ সাহাবীদের ফতওয়া, মতবাদ ও হাদীসের বিভিন্ন বিশেস্নষণ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

তাবেঈগণের মধ্যে যারা জ্ঞানী ছিল তারা যে বিষয়গুলোর উপর ঐক্যমত পোষণ করতেন, সেটিকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করতেন। আর যখন তারা কোন বিষয়ে মতপার্থক্যে পতিত হতেন তখন তারা সবচেয়ে শক্তিশালী ও বেশি প্রাধান্যযোগ্য মতকেই গ্রহণ করতেন।

২৫
তাবেঈদের পরবর্তী যুগে ইলম চর্চা
আলস্নাহ তা‘আলা তাবেঈদের পরবর্তী যুগে ইলম বহনকারী একটি দল সৃষ্টি করলেন। তারা তাবেঈদের কাছ থেকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করলেন।

তারা রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীসের সনদ গ্রহণ করেছেন এবং সাহাবী ও তাবেঈদের মতামত দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। মূলত তারা এ কথা জানতেন যে, সাহাবী ও তাবেঈ থেকে যে জ্ঞানার্জন করা হয় তা নিশ্চিত রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীস থেকেই গৃহীত ও সংরক্ষত অথবা তারা যে মাসআলাটি উদঘাটন করেছেন তা শরয়ী দলীল থেকেই গ্রহণ করেছেন। তারা ছিলেন অনেক বিশুদ্ধ মতবাদের অধিকারী এবং জ্ঞান অর্জনে অত্যমত্ম তৎপর। এসময় যারা সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেন তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তামত্ম নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

২৬
১. ইমাম আবু হানীফা (রহ.) :
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ৮০ হিজরী সনে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫০ হিজরীতে ইমেত্মকাল করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ইলমুল কালাম বা দর্শন বিদ্যার মাধ্যমে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। এরপর তিনি ফিকহ ও হাদীস শাস্ত্রে জ্ঞানার্জন করেন। হাম্মাদ ইবনে যায়েদ ছিলেন তার প্রধান শিক্ষক। হাম্মাদ ছিলেন ঐ সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশেষজ্ঞ। তার তত্ত্বাবধানে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ১৮ বছর অতিবাহিত করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তার অসাধারণ প্রজ্ঞার কারণে উমাইয়া শাসকদের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তারা তাকে কুফা নগরীতে বিচারক পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রসত্মাব দেন। কিন্তু তিনি এতে রাজি হননি। যার ফলে তার উপর অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। অনুরূপভাবে আববাসী শাসনামলেও তাকে সরকারি পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি তাতেও অসম্মতি জানান। এর ফলে খলীফা আবু জাফর আল মানসুর এর আদেশে তাকে বাগদাদে কারাবদ্ধ করা হয়। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে সমাধান উপস্থাপন করতেন। যে কোন বিষয়ে ঐক্যমতে উপনীত হতে পারলে তা লিপিবদ্ধ করতে বলতেন। ভবিষ্যতে সংঘটিত হতে পারে এমনসব বিষয়ে শরীয়তের কী সমাধান হতে পারে তাও বের করার চেষ্টা করতেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর প্রধান প্রধান ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন, ইমাম যুফার (রহ.) (১১০-১৫৮ হিজরী), ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) (১১৩-১৮২ হিজরী) ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) (১৩২-১৮৯ হিজরী) প্রমুখ।

২৭
২. ইমাম মালিক (রহ.) :
ইমাম মালিক (রহ.) ৯৩ হিজরীতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীস অধ্যয়নের দিকে অধিক মনোনিবেশ করেন। এজন্য তিনি হাদীসের উপর মুয়াত্তা গ্রন্থ রচনা করেন। আববাসীয় শাসকদের একটি আইন ছিল- কোন ব্যক্তি খলীফার আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করলে তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। ইমাম মালিক (রহ.) এ আইনের বিরোধিতা করেন। এর ফলে তার উপর মারাত্মক নির্যাতন করা হয় এবং তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। বর্ণিত আছে যে, ঐ আঘাতের ফলে তিনি সালাত আদায়ের সময় বুকে হাত রাখতে পারতেন না। তাই তিনি হাত ছেড়ে দিয়ে সালাত আদায় করতেন। ইমাম মালিক (রহ.) ৪০ বছর যাবৎ মদিনায় হাদীস শিক্ষা দানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

ইমাম মালিক (রহ.) এর প্রধান ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন, আবু আবদুর রহমান, আবু আবদুল্লাহ, ইমাম শাফেয়ী (রহ.) প্রমুখ।

মদিনাবাসীদের মধ্যে ইমাম মালিক (রহ.)-ই ছিলেন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী। হাদীসের সনদ যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। তিনিই ছিলেন সাহাবীদের রায় ও তাদের অনুসারীদের মতবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবগত। তিনি রেওয়ায়াত ও ফতওয়ার জ্ঞানে বেশ অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর নিকট যখন কোন সমস্যার সমাধান চাওয়া হতো তখন তিনি রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ফতওয়া প্রদান করতেন।

২৮
৩. ইমাম শাফেয়ী (রহ.) :
তিনি ১৫০ হিজরীতে শামের গাজা শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০৪ হিজরী সনে ইমেত্মকাল করেন। তিনি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে মদিনায় চলে যান এবং সেখানে তিনি ইমাম মালিক (রহ.) এর কাছে ইলম শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর তিনি ইমাম মালিক (রহ.) এর লিখিত মুয়াত্তা কিতাব ভালোভাবে অধ্যয়ন করেন। ১৭৯ হিজরীতে ইমাম মালিক (রহ.) এর মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম তার নিকট অবস্থান করেন। এরপর তিনি ইয়ামানে সফর করেন এবং সেখানে ইলম শিক্ষাদান কার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৮৯ হিজরীতে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আনা হয়- এ মর্মে যে, তিনি শিয়াদের আকীদায় বিশ্বাস করেন। এ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে ইয়ামান থেকে ইরাকে আনা হয় এবং খলীফা হারুনুর রশীদের নিকট উপস্থাপন করা হয়। এরপর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি মুক্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইরাকেই অবস্থান করেন এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) এর নিকট জ্ঞান চর্চা করেন। এরপর তিনি ইমাম লাইস (রহ.) এর নিকট থেকে জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে মিশরে চলে যান। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তিনি দেখতে পেলেন যে, ইমাম লাইস (রহ.) মারা গেছেন। তবুও তিনি সেখানে অবস্থান করেন এবং ইমাম লাইস (রহ.) এর ছাত্রদের কাছে অধ্যয়ন করেন। তারপর তিনি মৃত্যু পর্যমত্ম মিশরেই অবস্থান করেছিলেন।

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ফকীহদের মধ্যে একটি দলকে দেখতে পেলেন যে, তারা কিয়াসের মাধ্যমে এমন কিছু রায়কে মিশ্রণ করে ফেলেছে, যা মোটেই শরীয়ত সম্মত নয়। এর অধিকাংশই এমনসব বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী, যেগুলো তাদের নিকট পৌঁছেনি। ফলে তিনি তাদের ক্রটিপূর্ণ মতবাতগুলোকে পরিত্যাগ করেন এবং বলেন, ‘‘তারাও মানুষ আমরাও মানুষ।’’

আর তখনই তিনি ইলমে ফিকহের মূলমন্ত্রের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং নিয়মনীতি ও শাখাপ্রশাখা সম্বলিত কিছু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যাতে করে মুসলিম জাতি উপকৃত হতে পারে। তিনি জ্ঞান চর্চা করে ‘কিতাবুল উম্ম’ নামক একটি কিতাব রচনা করেন। তৎকালীন সময়ের ফকীহগণ তার এসব নীতিমালার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

২৯
৪. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) :
তিনি ১৬৪ হিজরীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর বিখ্যাত ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) এর কাছে হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং তিনি ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর তত্ত্বাবধানেও ফিকহ ও হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তার সময় অনেক লোক মু‘তাজিলাদের আকীদায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এমনকি তখনকার শাসন ব্যবস্থাতেও এ আকীদার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কিন্তু তিনি মু‘তাজিলা আকীদার বিরোধিতা করেন। ফলে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয় এবং এভাবে তাকে দু’বছর বন্দি করে নির্যাতন করা হয়। এরপর তিনি মুক্তি পেয়ে আবার বাগদাদে ইলম শিক্ষাদান চালিয়ে যান। কিন্তু পুনরায় তার উপর নির্যাতন শুরু হয়। এর ফলে তিনি পাঠদান বন্ধ করে দেন এবং প্রায় পাঁচ বছর পর্যমত্ম আত্মগোপনে থাকেন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সে যুগের আলেমদের মধ্যে একজন প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। তিনি হাদীসশাস্ত্র ও ফিকহশাস্ত্রে খুবই পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর ছাত্র। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) তাকে বলতেন, তোমরা আমাদের তুলনায় সহীহ সনদ সম্পর্কে বেশি অবগত হচ্ছো। সুতরাং কোন সহীহ খবর পেলে অবশ্যই আমাকে জানাবে। কুফা, বসরা, সিরিয়ার যে কোন স্থানে হোক না কেন আমি সেখানে গিয়ে তা সংগ্রহ করব।

৩০
মুহাদ্দিসগণের আবির্ভাব
পরবর্তী যুগে আলস্নাহ তা‘আলা ইলম বহনকারী একটি দল সৃষ্টি করলেন। রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীস বর্ণনা করাই ছিল তাদের একমাত্র কাজ। ফলে ইসলামী শহরগুলোতে হাদীস ও আছারের গ্রন্থ রচনা করার প্রবণতা অনেক হারে বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন পান্ডুলিপি ও বই লেখার কাজ শুরম্ন হয়। এজন্য তারা তৎকালীন যুগে বড় বড় আলেমদের সাক্ষাৎ লাভের জন্য হিজাজ, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, ইয়ামান ও খোরাসানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন। এভাবে তারা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা হাদীসগুলোকে একত্র করে পান্ডুলিপি ও গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার কাজে দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে যান। যেখানেই তারা কোন হাদীসের সন্ধান পেতেন সেখানেই তারা সফর করে সে হাদীসটি সংগ্রহ করে নিতেন। ফলে তাদের কাছে এত পরিমাণ হাদীস একত্র করা সম্ভব হয়েছিল যে, ইতিপূর্বে কারো জন্য তা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

এ সময় প্রত্যেক অঞ্চলের ফকীহ সাহাবী ও তাবেঈদের যেসব আছার সে অঞ্চলের আলেমদের কাছে গোপন ছিল তাও প্রকাশ পেয়ে যায়। অথচ ইতিপূর্বে কারো পক্ষ নিজ এলাকার সাথিদের হাদীস সংকলন ছাড়া দূরবর্তী কোন এলাকায় গিয়ে হাদীস সংকলন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এভাবে ব্যাপকহারে হাদীস ও আছার একত্রিত করার কারণে বিভিন্ন উপায়ে হাদীসের সনদগত অস্পষ্টতা দূর করা সম্ভব হয়। এছাড়াও এ যুগের আলেমগণ হাদীসশাস্ত্রের জন্য আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন। যেমন-

১. হাদীস যাচাই-বাছাই করার কাজ করেন।

২. প্রতিটি হাদীস থেকে যেসব বিধান পাওয়া যায় তা নির্ধারণ করার প্রতি মনোযোগী হন।

৩. এমন কতগুলো হাদীসের উপযুক্ত ব্যাখ্যা প্রদানের কাজও শুরম্ন করেন, যে হাদীসগুলো তখন পর্যমত্ম কোন ব্যাখ্যা বিশেস্নষণ করা হয়নি।

আর এ ক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন তারা হলেন, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইমাম আবু ইয়াল, ইমাম দারা কুতনী, ইমাম আবদ ইবনে হুসাইন, ইমাম দারেমী, ইমাম ইবনে হিববান, ইমাম ইবনে খুযায়মা, ইমাম হাকেম ও ইমাম বায়হাকী (রহ.) সহ আরো অনেকেই।

৩১
মাযহাব সৃষ্টির ইতিহাস
হিজরীর প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে মুসলিমরা কোন মতবাদের অন্ধ অনুকরণ করতেন না। নির্দিষ্ট একটি মতবাদের উপর লক্ষ করে ফতওয়া দেয়া, তার উপর ভিত্তি করে অভিমত গ্রহণ করা এবং সর্বাবস্থায় উক্ত মতবাদের উদ্ধৃতি দেয়া- এসব বিষয় এ শতাব্দীর মানুষের মাঝে বিন্দুমাত্র বিদ্যমান ছিল না। আর এ সময় পর্যমত্ম পূর্ববর্তী কোন ব্যক্তির তাকলীদ করারও অসিত্মত্মত্ব ছিল না।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে তিনি নিজেই ছিলেন মুসলিম জাতির ইমাম। আর তাদের সকলের পথ ছিল একটিই। আর তা হলো ইসলাম। কোন ব্যক্তি বা দলের নামে কোন মাযহাব রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে ছিল বলে কুরআন-হাদীসে কোন উল্লেখ নেই।

সাহাবায়ে কেরামের যুগেও তারা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী এবং যে ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নার সরাসরি দলীল নেই সেক্ষেত্রে ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে সমাধান দিতেন। তাদের কারো নামে কোন দল বা কোন মাযহাব ছিল না।

এর পরবর্তী সময়ে তাবেঈদের যুগেও অনেক আলেম ছিলেন, তারাও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শে আদর্শিত হয়ে ইসলামের জ্ঞানার্জন করতেন এবং এর শিক্ষাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতেন। তারাও কারো নামে কোন মাযহাব বা দল প্রতিষ্ঠা করেননি।

তাবেঈদের পর যারা ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেন এবং ইজতিহাদ করেছেন তাদের মধ্যে অনেক আলেমের নামে মাযহাব তৈরি হয়। বিশেষ করে চার ইমামের নামে চারটি মাযহাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বনী উমাইয়াদের শাসনের অবসানকালে কোন মুসলিম নিজেকে হানাফী বা শাফেয়ী বলতেন না। আববাসী খলীফাদের শাসন আমলের মাঝামাঝি সময় প্রত্যেকে নিজেদের জন্য একটি করে নাম বাছাই করে নেন। আর তারা আপন মাযহাবভুক্ত গুরুদের কথা না পাওয়া পর্যন্ত কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ মেনে চলা বাদ দিলেন। কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে এই যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এরপর সে মতভেদগুলো মাযহাবের ভিত্তিতে পরিণত হয়। আরব রাজত্বের অবসানের পর (৬৫৬ হিঃ) মুসলিমগণ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লে তারা প্রত্যেকেই আপন আপন মাযহাবের যতটুকু খেয়াল রাখতে পেরেছেন তাকেই মাযহাবের ভিত্তি রূপে গ্রহণ করলেন। এই দুঃখজনক পরিণতিতে প্রকৃত সুন্নাত নয় এমন অনেক কিছু সুন্নাতের স্থান দখল করে নেয়।

৩২
বিভিন্ন মাযহাব
প্রসিদ্ধ চার মাযহাব ছাড়াও আরো অনেক ইমামের নামে মাযহাব তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে মাযহাবের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে চারটিতে নেমে আসে। আওয়াই, সুফইয়ান সাওরি, ইবনে আবি লাইলা, আবু সাওর এবং আল লাইস ইবনে সাদ এর মতো বিখ্যাত ইমামদের মাযহাবগুলো হারিয়ে গিয়ে কেবল ইমাম আবু হানীফা, মালিক, শাফেয়ী ও আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব টিকে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় এই মাযহাবগুলো এতটাই প্রভাব বিসত্মার লাভ করে যে, সাধারণ মানুষ জানেই না- অন্য কোন মাযহাব আদৌ ছিল কি না।

হানাফী মাযহাব :

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর নামে এ মাযহাবের নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিসত্মান, আফগানিসত্মান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কে হানাফী মাযহাবের অনুসারী বেশি।

মালিকী মাযহাব :

ইমাম মালিক (রহ.) এর নামানুসারে এ মাযহাবের নামকরণ করা হয়। মিশর, সুদান, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকায় মালিকী মাযহাবের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি।

শাফেয়ী মাযহাব :

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর নামানুসারে এ মাযহাব পরিচিতি লাভ করে। মিশর, দক্ষিণ আরব, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি।

হাম্বলী মাযহাব :

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর নামানুসারে এ মাযহাবের নামকরণ করা হয়। ফিলিসিত্মন ও সৌদি আরবে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি।

এসব মাযহাবের অনুসারীরা নিজ নিজ মাযহাবের নামে নিজেদের পরিচয় দেয়ার প্রথা চালু করে।

প্রত্যেকটি মাযহাবের বিশেষজ্ঞগণ নিজ নিজ মাযহাবের ইমামদের সব সিদ্ধামত্ম পর্যালোচনা করে সেগুলোর মূলনীতিগুলো বের করে লিপিবদ্ধ করেন। পরিশেষে মাযহাবের ইমামদের মূলনীতিভিত্তিক ইজতিহাদকে বজায় রাখার স্বার্থে স্বাধীন ইজতিহাদ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য হয়। এ সময় মাযহাবী ইজতিহাদ নামে নতুন একটি ধারা চালু হয়। এর মূল কাজ ছিল বিশেষ মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রণীত মূলনীতি অনুযায়ী সমকালীন সমস্যা সমাধানের জন্য আইন উদ্ভাবন করা।

মাযহাবের ইমামগণ ও তাঁদের ছাত্রবৃন্দ অনেক ক্ষেত্রে তাদের পূর্বের মত পরিবর্তন করতেন। ফলে অনেক বিষয়ে একই মাযহাবের মধ্যেও মতের ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দুটি মতই সংরক্ষিত আকারে মাযহাবের ভিন্নমুখী সিদ্ধামত্ম হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছে।

মাযহাবের প্রথম দিকের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থেকেও মতের ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মাযহাবের বিশেষজ্ঞগণ তারজীহ তথা অগ্রাধিকার নীতি ব্যবহার করেছেন। এ নীতির মাধ্যমে তারা কোন একটি বিষয়ে মাযহাবের কোন বিশেষজ্ঞের মতকে একই মাযহাবের অন্যান্য বিশেষজ্ঞের মতের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।

৩৩
মাযহাব নিয়ে দলাদলি
৬৫৮ হিজরীতে সুলতান আবু মালিকুশ বেবরস মিশরের সিংহাসনে আরোহণ করার পর মিশর ও কায়রোতে হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী এই চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক কাজী নিযুক্ত করেন। অতঃপর ৬৬৫ হিজরী হতে এই রীতি সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে ইসলামী বিশ্বের সব জায়গায় মাদরাসা ও খানকাগুলোতে ঐ সকল রীতি ও প্রচলিত মতবাদগুলো চালু করা হয়।

যারা সুলতান ও কাজীদের জারিকৃত মাযহাব বাদ দিয়ে অন্য কোন মাযহাব মেনে চলার ইচ্ছা করত, তাদের বিরোধিতা করা হতো এবং তারা ভুল পথে চলছে বলে প্রচার করা হতো।

এদিকে ফকীহগণ ফতওয়া জারি করলেন যে, প্রচলিত চার মাযহাবের মধ্যে শুধু একটির অনুসরণ করা ওয়াজিব এবং চার মাযহাবের বহির্ভূত অন্য কোন উক্তি ও সিদ্ধান্ত স্পষ্ট কুরআন ও বিশ্বসত্ম হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলেও তা অনুসরণ করা হারাম।

এসব মতবাদের চরম পরিণতিস্বরূপ ৮০১ হিজরীতে সুলতান ফরহ বিন বর্কুক সরকেশী (৭৯১-৮১৫ হিঃ) পবিত্র কাবা গৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য চারটি ভিন্ন ভিন্ন মুসল্লা নির্দিষ্ট করে দিলেন। ফলে তখন হতে মুসলিম জাতির কেন্দ্র চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

অতঃপর সাড়ে ৫ বৎসর পর সউদী আরবের সম্রাট সুলতান আবদুল আযীয আস-সাউদের রাজত্বকালে ১৩৪৩ হিজরীতে কাবা হতে এ বিদআত মূলোৎপাটিত হয়। সুলতান আবদুল আযীয এসব মাযহাবী মুসল্লা ভেঙ্গে দিয়ে সকলকে এক মুসল্লার আওতায় সালাত আদায়ের রীতি পুনরায় চালু করেন।

৩৪
মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ ও অবনতি
তাকলীদ বা মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ ও দলাদলির এই চরম অবক্ষয়ের কারণে সব ধরনের ইজতিহাদ পরিত্যাজ্য হয় এবং মাযহাবগুলো সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক ধর্মীয় গোষ্ঠীরূপে আত্মপ্রকাশ করে।

বিশেষজ্ঞগণ সব ধরনের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করেন। এমনকি ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ ইজতিহাদ না করে সেজন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি আইন জারি করেন। তারা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, ইতিমধ্যে সম্ভাব্য সকল সমস্যার সমাধান বের করা হয়ে গেছে। অতএব এখন নতুন কোন ইজতিহাদের প্রয়োজন নেই। এই পদক্ষেপের ফলে ইলম চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারণা জন্ম নেয়। আর তা হলো, কোন ব্যক্তির ইলম চর্চা বৈধ হতে হলে তাকে অবশ্যই চারটি মাযহাবের যে কোন একটির অনুসরণ করতে হবে।

সময় পরিক্রমায় এ ধারণাটি সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞ মহল- উভয় শ্রেণির মধ্যেই বদ্ধমূল হয়ে যায়। এর ফলে গোটা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বিদ্যমান চারটি মাযহাবের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি মাযহাবকে ঐশীভাবে নির্দেশিত ইসলামেরই এক একটি রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে। এসব মাযহাবের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এদের সবগুলোকেই সম্পূর্ণ সঠিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এমনকি এ প্রতিষ্ঠিত চারটি মাযহাবের বাইরে যাওয়াকে ধর্মত্যাগের সমতুল্য অপরাধ মনে করা হয়।

কেউ মাযহাব মানতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ধর্মত্যাগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। এ পর্যায়ের অতি সংরক্ষণশীল আলেমগণ আরো একধাপ এগিয়ে রায় দিয়েছিলেন যে, নিজ মাযহাব পরিবর্তন করে অন্য মাযহাবে প্রবেশ করার দায়ে কোন ব্যক্তি ধরা পড়লে স্থানীয় বিচারকের ফায়সালা অনুযায়ী তিনি তাকে যে কোন ধরনের শাসিত্ম দিতে পারেন।

তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ ইত্তেবা তথা যুক্তিসঙ্গত অনুসরণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বসত্মুত প্রথম যুগের আলেমদের ব্যাখ্যাগুলোকে যথাযথভাবে অনুসরণ করার ফলেই ইসলামের বাণী এখন পর্যমত্ম অবিকৃত রয়েছে। কারণ, প্রথম দিকের আলেমদের ব্যাখ্যার ভিত্তি ছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি অবতীর্ণ ওহী এবং তার জীবন পদ্ধতি। তিনি নিজেই বলেছেন- সর্বোত্তম প্রজন্ম তার প্রজন্ম, তারপর তার পরবর্তী প্রজন্ম এবং তারপর তার পরের প্রজন্ম। [সহীহ বুখারী, হা/৩৬৫০; সহীহ মুসলিম, হা/৬৬৩২-৩৬; আবু দাউদ, হা/৪৬৫৯; তিরমিযী, হা/২২২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭১৩২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬৭২৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯৫৩৩; জামেউস সগীর, হা/৫৬১২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৮৩৯; মিশকাত, হা/৬০০১।]

তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ ছাড়া অন্য কারো সিদ্ধামত্মই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই যাচাই-বাছাই ব্যতীত কারো সিদ্ধামত্ম অন্ধভাবে অনুসরণ করা উচিত নয়। স্পষ্ট ভুল দেখা সত্ত্বেও অন্ধভাবে বিশেষ কোন মাযহাবের মতকে অনুসরণ করা কখনই সঠিক হতে পারে না।

৩৫
মাযহাবের অন্ধ অনুসরণের কারণ
১. মাযহাবগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া :

মাযহাবগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল এবং সব খুঁটিনাটি মাসআলা প্রণয়ন করা হয়ে গিয়েছিল। অনুমাননির্ভর সমস্যার সমাধানকল্পে গড়ে উঠা ফিকহশাস্ত্রের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে- ঘটেছে এবং ঘটতে পারে এমন সব কিছুর আইন বের করে তার সমাধান লিপিবদ্ধ করা হয়ে গিয়েছিল। তাই মৌলিক ইজতিহাদের প্রয়োজন খুব একটা অবশিষ্ট থাকেনি। এ কারণেই মাযহাবগুলো প্রথম দিকের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও গ্রন্থগুলোর উপর অতিমাত্রায় নির্ভর করার একটি প্রবণতা গড়ে ওঠে।

২. রাষ্ট্রীয়ভাবে মাযহাব অনুসরণের বাধ্যবাদকতা :

আববাসী সম্রাজ্য বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেকটি নতুন রাষ্ট্র নিজের পছন্দমতো মাযহাব অনুসরণ করতে শুরু করে। দৃষ্টামত্মস্বরূপ, মিশর শাফেয়ী মাযহাব, স্পেন মালিকী মাযহাব এবং তুরস্ক ও ভারত হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করতে থাকে। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কেবল রাষ্ট্রীয় মাযহাবের অনুসারীদের মধ্য থেকে তাদের শাসক, কার্যনির্বাহক ও বিচারক নিয়োগ দিত। তাই যেসকল বিশেষজ্ঞ বিচারক হতে চাইতেন, তাদেরকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় মাযহাব অনুসরণ করতে হতো।

৩. ইজতিহাদের দ্বার বন্ধ করে দেয়া :

কিছু অযোগ্য ব্যক্তি দ্বীনকে নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী পরিবর্তনের অসৎ উদ্দেশ্যে ইজতিহাদ করতে শুরু করে। অন্যদিকে বেশ কিছু বিষয়ে কতিপয় অযোগ্য আলেমের সিদ্ধামেত্ম জনগণ বিভ্রামত্ম হয়ে পড়ে। এসবের হাত থেকে শরীয়তকে সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে সে যুগের খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞগণ ইজতিহাদের দ্বার বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেন। ফিকহশাস্ত্র ও মাযহাবগুলোর ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে বিভিন্ন মাযহাবের মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে দলাদলি চরম আকার ধারণ করে। এক সময় তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তৎকালীন বিশেষজ্ঞগণ ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে চারটি মাযহাবের যে কোন একটির অনুসরণ করাকে সাধারণ মুসলিমদের উপর বাধ্যতামূলক করে দেন।

৪. ইজতিহাদের উপর কঠোর শর্তারোপ করা :

এ যুগের ফিকহশাস্ত্রের মূলনীতি তথা উসূলে ফিকহ এর উপর কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। এসব গ্রন্থে ইজতিহাদের সঠিক পদ্ধতি ও তা প্রয়োগের শর্তাবলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। তবে এসব গ্রন্থে যেসকল শর্তারোপ করা হয় তা এতই কঠোর ছিল যে, কেবল তাদের সমসাময়িক বিশেষজ্ঞগণই নয়, পূর্বেকার ইজতিহাদ চর্চাকারী বিশেষজ্ঞের অনেকের মধ্যেও এসব শর্ত পূরণের যোগ্যতা ছিল না।

৫. আলেমগণের ফিকহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া :

এ যুগের আলেমগণ ফিকহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ কারণে বিশেষজ্ঞগণ পূর্ববর্তীদের গ্রন্থগুলোকে পর্যালোচনা ও সম্পাদনা করার মধ্যে নিজেদের সৃজনশীল ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। পূর্ববর্তী বিশেষজ্ঞদের ফিকহ গ্রন্থগুলো ছিল সংক্ষিপ্ত; সেগুলোকে সহজে মুখস্থ করার সুবিধার্থে এদের অনেকগুলোকে ছন্দাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়। এক সময় এই সারাংশগুলো সমকালীন শিক্ষার্থীদের জন্য ধাঁধায় পরিণত হয়। এরপর বিশেষজ্ঞদের পরবর্তী প্রজন্ম আবার সেসব সারাংশ ও কাব্যের ব্যাখ্যা লিখতে শুরু করেন। তার পরবর্তী বিশেষজ্ঞগণ উপরোক্ত ব্যাখ্যাগুলোর ভাষ্য রচনা করেছেন। কেউ কেউ আবার সেসব ভাষ্যের উপর টীকা সংযোজন করেছেন।

৬. ইসলামী শিক্ষায় মাযহাবি দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব :

ইসলামী শিক্ষায় মাযহাবি দৃষ্টিভঙ্গি হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রের গতিশীলতাকে অনেকটা সীমিত করে দিয়েছে। এর ফলে ইসলামী আইনের পাঠ্যসূচীতে অমত্মর্ভুক্ত ফিকহের সবগুলো মৌলিক কোর্সই মাযহাব অনুযায়ী শেখানো হতো। তবে বর্তমান সময়ে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ মাযহাবকে অন্য মাযহাবের উপর প্রাধান্য দেয়া হয় না। বরং সরাসরি কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে সকল মাযহাবের সমন্বয়ে পাঠ দান করা হয়।

৭. আলেমদের মধ্যে সত্যানুসন্ধানের আগ্রহ না থাকা :

আলেমগণ যতদিন পর্যমত্ম সত্যের অনুসরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, দলীয় চিমত্মা-ভাবনা, গোঁড়ামি ও ব্যক্তিগত সুখ্যাতির লোভে বিপথে যাননি; ততদিন পর্যমত্ম ইসলামের মৌলিক চেতনা তাদের মধ্যে সংরক্ষিত ছিল। আলেমদের মধ্যে সংকীর্ণতা আসার পূর্ব পর্যমত্ম সত্যানুসন্ধানের নিরলস প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মাযহাবকেন্দ্রিক চিমত্মার কারণে অনেক আলেমের মধ্যে সত্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে অনীহা সৃষ্টি হয়। ফলে তারা চার মাযহাবের কোন এক মাযহাবের তাকলীদ করাতেই সমত্মুষ্ট থাকে।

৮. সকল মাযহাবই সম্পূর্ণ সঠিক বলে ধারণা করা :

বিদ্যমান মাযহাবের মধ্যে অসংখ্য মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এগুলোর প্রত্যেকটিকে সম্পূর্ণ সঠিক বলে বিবেচনা করা হয়। অথচ এসব মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমামগণ নিজেরাই এমন মতপার্থক্য অপছন্দ করতেন এবং তারা কখনই অন্ধ অনুসরণকে সমর্থন করতেন না।

অনেক মানুষ মাযহাবের মতের বিপরীত হলে অনেক ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ হাদীস পরিত্যাগ করাকেও বৈধ মনে করে। কারণ, ঐ হাদীসটিকে মেনে নেয়ার মানেই হলো এ কথা স্বীকার করে নেয়া যে, তার মাযহাবের ইমাম সিদ্ধামত্ম প্রদানের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। আর তাদের মতে এরূপ চিমত্মাধারা বেয়াদবি। অথচ তারা এ বিষয়টি অনুধাবন করে না যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বক্তব্যের উপর তাদের ইমামের মতকে প্রাধান্য দেয়া স্বয়ং তাদের ইমামদের অবস্থানেরই সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। এর নাম اَلشِّرْكُ فِى تَوْحِيْدِ الْاِتِّبَاعِ অর্থাৎ প্রশ্নাতীত আনুগত্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে কাউকে শরীক করা।

৩৬
সংস্কারক
উল্লেখিত অবক্ষয় সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা তাকলীদের বিরোধিতা করে ইজতিহাদের ধারাকে পুনরায় চালুর চেষ্টা করেছেন। তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে ইসলামী আইনের সঠিক উৎসগুলোর উপর নির্ভর করার আহবান জানিয়েছেন। এরূপ কয়েকজন মহান সংস্কারক ও তাদের অবদান নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. ইমাম আহমাদ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) :

সংস্কারকগণের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছেন ইমাম আহমাদ ইবনে তাইমিয়া (৬৬১-৭২৮ হিজরী মোতাবেক ১২৬৩-১৩২৮ সাল)। তৎকালীন প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রামত্ম আকীদা-বিশ্বাস ও আচার-আচরণের বিরুদ্ধে তিনি প্রবলভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সমসাময়িক স্বার্থান্বেষী মহলের অনেকেই তাঁকে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) আখ্যায়িত করে শাসকশ্রেণির মাধ্যমে বারবার কারারুদ্ধ করিয়েছে। এরপরও ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তার সময়ের একজন শ্রেষ্ঠতম বিদ্বান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। প্রথমদিকে তিনি হাম্বলী মাযহাব অনুযায়ী ফিকহ অধ্যয়ন করলেও নিজেকে এ মাযহাবের গন্ডির মধ্যে আটকে রাখেননি। তিনি ইসলামী আইনের উৎসগুলোকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে তৎকালীন ইসলামী জ্ঞানের সব কয়টি শাখায় ব্যাপক জ্ঞান লাভ করেন।

ইসলাম থেকে বিচ্যুত বিভিন্ন উপদলের লেখনীগুলো এবং ইয়াহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করে তিনি এগুলোর উপর বিশাল সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেন। সে সময় মঙ্গোলরা সাবেক আববাসী সাম্রাজ্যের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো দখল করে নেয় এবং মিশর ও উত্তর আফ্রিকাকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদেও অংশগ্রহণ করেছেন।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর ছাত্রবৃন্দও ছিলেন তাদের সময়ের সেরা ইসলামী বিশেষজ্ঞ। তিনি ইজতিহাদ ও ইসলামের বিশুদ্ধ উৎসগুলোর দিকে ফিরে আসার যে আহবান জানিয়েছিলেন তার ছাত্রবৃন্দই তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সফলভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফিকহ ও হাদীসশাস্ত্রের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ইমাম ইবনে কাইয়িম (রহ.), হাদীসশাস্ত্রের অসাধারণ বিশেষজ্ঞ ইমাম আয-যাহাবী (রহ.) এবং তাফসীর, ইতিহাস ও হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.)।

২. মুহাম্মাদ ইবনে আলী আশ-শাওকানী (রহ.) :

ইয়েমেনের শাওকান শহরে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মাদ ইবনে আলী শাওকানী (১১৭১-১২৫০ হিজরী মোতাবেক ১৭৫৭-১৮৩৫ সাল) এ যুগের সংস্কারকদের অন্যতম। ইমাম শাওকানী যাইদী মাযহাব অনুযায়ী ফিকহ অধ্যয়ন করে এ মাযহাবের একজন অসাধারণ বিশেষজ্ঞে পরিণত হন। তারপর তিনি হাদীস শাস্ত্রের গভীর অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন এবং তার সময়ের সর্বাধিক খ্যাতিমান হাদীস বিশারদে পরিণত হন। এ পর্যায়ে তিনি নিজেকে নির্দিষ্ট মাযহাব থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে ইজতিহাদের চর্চা শুরু করেন। তিনি ফিকহ ও উসূলে ফিকহ এর উপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থে বিভিন্ন বিষয়ে সকল মাযহাবের মতকে পর্যালোচনা করে বিশুদ্ধ প্রমাণ ও সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য যুক্তির ভিত্তিতে সমাধান দেয়া হয়েছে।

ইমাম শাওকানির মতে, তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ হারাম। তিনি এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো, اَلْقَوْلُ الْمُفِيْدُ فِىْ حُكْمِ التَّقْلِيْدِ (আল কাওলুল মুফীদ ফী হুকমিত তাকলীদ)। এ কারণে তিনিও সমকালীন অনেক তাকলীদপন্থী লোকদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। [মুহাম্মাদ ইবনে আলী আশ-শাওকানী, নাইলুল আওতার, ১/৩-৬।]

৩. শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী (রহ.) :

সংস্কারকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন আহমাদ ইবনে আবদুর রহীম (১১১৪-১১৭৬ হিজরী; ১৭০৩-১৭৬২ সাল)। তিনি শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী নামে সর্বাধিক পরিচিত। তার জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশে; আর সেখানেই তাকলীদের চর্চা ছিল সবচেয়ে বেশি। ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানার্জনের পর তিনি ইজতিহাদের দ্বার পুনরায় উন্মুক্ত করে মাযহাবগুলোকে একীভূত করার আহবান জানান।

ইসলামী আইনশাস্ত্রের মূলনীতিগুলো পুনঃনিরীক্ষণ ও বিভিন্ন মাযহাবের সিদ্ধামত্মগুলোর প্রমাণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রহ.) হাদীস গবেষণায় নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি প্রচলিত মাযহাবগুলোকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, কোন বিশেষ ক্ষেত্রে মাযহাবের সিদ্ধামেত্মর বিপরীতে অধিকতর বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রত্যেকেরই নিজ মাযহাবের পরিপন্থী মত গ্রহণের স্বাধীনতা আছে।

৪. আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) :

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ সংস্কারক। মহান আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে হাদীস যাচাই-বাছাই ও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে পৃথিবীর মুসলিমদের সম্মুখে ইসলামের সঠিক শিক্ষা উপস্থাপন করার তাওফীক দিয়েছেন তাদের মধ্যে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার পুরো নাম আবু আবদুর রহমান মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.)।

তিনি ১৩৩৩ হিজরী (১৯১৪ ঈসায়ী) সনে পূর্ব ইউরোপের আলবেনিয়ার রাজধানী কুদরাহতে জন্মগ্রহণ করেন। আলবেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করার কারণে তিনি আলবানী নামে পরিচিত হন।

সে দেশে পর্দা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে তার পিতা তাকে নিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামেশকে হিজরত করেন।

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী তার শিক্ষা জীবন দামেশকেই সমাপ্ত করেন। হানাফী ফিকহ শিক্ষার প্রতি পিতার উপদেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি হাদীস শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন।

যৌবনের প্রথম দিকে তিনি ঘড়ি মেরামত করে জীবিকা অর্জনের পথ বেছে নিলেও অধিকাংশ সময় তিনি হাদীস অধ্যয়ন ও গবেষণা এবং বই লেখার কাজে ব্যয় করতেন। ফলে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী সিরিয়ায় তাওহীদ ও সুন্নার দিকে দাওয়াত দেন। ফলে সিরিয়ার অনেক আলেম উলামা তার সাক্ষাতে আসেন এবং তিনিও ঐ সকল আলেমদের মাঝে তাওহীদের বিভিন্ন মাসআলা, কুরআন-সুন্নার অনুসরণ, মাযহাবী গোঁড়ামি, বিদআত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। তিনি তখনকার প্রচলিত সকল শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। যার কারণে মাযহাবের অন্ধভক্ত গোঁড়াপন্থী, বিদআতী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন একশ্রেণির নামধারী আলেমদের পক্ষ থেকে তিনি প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। তারা সাধারণ লোকদেরকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। তাকে পথভ্রষ্ট ও ওহাবী বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং জনসাধারণকে তার থেকে সতর্ক করতে থাকে।

অপরপক্ষে তার দাওয়াতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন দামেশকের স্বনামধন্য হকপন্থী উলামাগণ। তারা তাঁকে তার দাওয়াতের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন।

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী সিরিয়ার ক্ষমতাসীনদের নজরদারীতে পড়েন। তিনি দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন। প্রথমবার ১৯৬৮ সালের আগে দামেশকের কেল্লা কারাগারে এক মাস বন্দী ছিলেন, যেখানে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) কেও বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এ বছর যুদ্ধের সময় সিরিয়ার সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্ত করে দিলে তিনিও মুক্ত হন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে পুনরায় কারাবরণ করতে হয়। তারপর তিনি সিরিয়া ছেড়ে জর্ডানে পাড়ি জমান এবং রাজধানী আম্মানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মৃত্যু পর্যমত্ম তিনি সেখানেই অবস্থান করেন।

১৯৯৯ ঈসায়ী সনের ২ অক্টোবর আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ৮৬ বছর বয়সে ইমেত্মকাল করেন।

৩৭
ইমামগণ তাদের তাকলীদ করতে নিষেধ করেছেন
প্রথম যুগের বিশেষজ্ঞ ইমামগণ আল্লাহর বিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতাসহ অন্যান্য আরো অনেক কারণে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্যও ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে অন্যদের সিদ্ধামত্ম কুরআন-সুন্নার অধিক নিকটতর মনে হলে তারা নিজেদের মত পরিত্যাগ করে তা মেনে নিতে মোটেও কুণ্ঠিত হতেন না।

বর্তমান যুগের অধিকাংশ মুসলিমই প্রথম যুগের মহান ইমামদের চিমত্মা-চেতনা ও তাদের মাযহাবের বর্তমান অবস্থার মধ্যকার অসংগতির ব্যাপারে অসচেতন।

ইমামগণ তাদের তাকলীদ (দলীলবিহীন অনুসরণ) না করার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। রাসূলুলস্নাহ ﷺ ব্যতীত অন্য মানুষের কথা গৃহীত হতে পারে আবার পরিত্যাজ্যও হতে পারে। সুতরাং যদি কেউ এমন মতামত পেশ করে যা সহীহ হাদীস বিরোধী, তাহলে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। তাই তাকলীদ এর ব্যাপারে ইমাম ও তাদের ছাত্রবৃন্দের বক্তব্যগুলোর প্রতি আরেকটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করা উচিত। এ ব্যাপারে ইমামগণের পক্ষ থেকে যেসব মতামত পাওয়া যায় তার কিছু অংশ এখানে উলেস্নখ করা হলো :

(১) ইমাম আবু হানীফা (রহ.)

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তার ছাত্রদেরকে তার ব্যক্তিগত মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করতে নিরুৎসাহিত করতেন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোর ভিত্তি ছিল কিয়াস। তবে তার ছাত্রদের সকলে মিলে ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে যেসব ব্যাপারে ঐক্যমতে উপনীত হয়েছিলেন, সেগুলোর ক্ষেত্রে তিনি এমনটি করেননি। তার সাথিগণ তার অনেক কথা বিভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করেছেন, সব কয়টি কথা একই বিষয়ের প্রতি নির্দেশ করে। আর তা হচ্ছে, হাদীসকে আঁকড়ে ধরা ও এর বিপরীতে ইমামগণের কথা পরিহার করা ওয়াজিব। কথাগুলো হচ্ছে,

إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ

হাদীস যখন সহীহ হবে সেটাই হবে আমার মাযহাব অর্থাৎ যখন কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যাবে তখন সেটাই আমার মতামত বলে বিবেচিত হবে। [রাদ্দুল মুহতার, ১/৪৬২ পৃঃ; ফতওয়ায়ে শামী, ১/৪৬ পৃঃ।]

لَا يَحِلُّ لِاَحَدٍ اَنْ يَّأْخُذَ بِقَوْلِنَا مَا لَمْ يَعْلَمْ مِّنْ أَيْنَ أَخَذْنَاهُ

আমরা কোথা থেকে কথাটি নিলাম এটা না জানা পর্যমত্ম কারো জন্য আমাদের কথা গ্রহণ করা বৈধ নয়। [বাহরুর রায়িক ৬/২৯৩ পৃঃ, মুকাদ্দমাতুল হেদায়াহ, ১/৯৩ পৃঃ।]

অপর বর্ণনায় রয়েছে,

حَرَامٌ عَلٰى مَنْ لَّمْ يَعْرِفْ دَلِيْلِيْ اَنْ يُّفْتِيَ بِكَلَامِيْ

যে আমার কথার প্রমাণ জানে না তার পক্ষ আমার কথার দ্বারা ফতওয়া প্রদান করা হারাম। [আস সালাফিয়্যুন ওয়াল আইম্মাহ, ১/২৯ পৃঃ; হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, হা/১/৩৩১।]

অপর বর্ণনায় রয়েছে,

وَيْحَكَ يَا يَعْقُوْبُ ( هُوَ أَبُوْ يُوْسُفَ ) لَا تَكْتُبْ كُلَّ مَا تَسْمَعُ مَتٰى فَإِنِّيْ قَدْ أَرٰى الرَّأْيَ الْيَوْمَ وَأَتْرُكُهٗ غَدًا وَأَرٰى الرَّأْيَ غَدًا وَأَتْرُكُهٗ بَعْدَ غَدٍ

হে হতভাগা ইয়াকুব! (আবু ইউসুফ) তুমি আমার থেকে যা শোন তা লেখো না, কেননা আমি আজ এক মত পোষণ করি আর আগামীকাল তা পরিহার করি। আবার আগামীকাল এক মত পোষণ করি আর পরশুদিন তা পরিত্যাগ করি। [সুনানে দারেমী, হা/১৯৭; তারীখে বাগদাদ ৭/৪০৩ পৃষ্ঠা।]

اِذَا قُلْتُ قَوْلًا يُخَالِفُ كِتَابَ اللهِ تَعَالٰى وَخَبَرَ الرَّسُوْلِ فَاتْرُكُوْا قَوْلِيْ

যখন আমি এমন কথা বলি, যা আলস্নাহ তা‘আলার কিতাব ও রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর হাদীস বিরোধী তাহলে তোমরা আমার কথা পরিত্যাগ করবে। [ইকাযু হুমামি উলিল আবসার- ১/৬২।]

سُئِلَ اَبُوْ حَنِيْفَةَ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالٰى اِذَا قُلْتَ قَوْلًا وَكِتَابُ اللهِ يُخَالِفُهٗ قَالَ اَتْرُكُوْا قَوْلِيْ بِكِتَابِ اللهِ فَقِيْلَ اِذَا كَانَ خَبْرُ الرَّسُوْلِ اللهِ يُخَالِفُهٗ قَالَ اُتْرُكُوْا قَوْلِيْ بِخَبْرِ رَسُوْلِ اللهِ فَقِيْلَ اِذَا كَانَ قَوْلُ الصَّحَابَةِ يُخَالِفُهٗ قَالَ اُتْرُكُوْا قَوْلِيْ بِقَوْلِ الصَّحَابَةِ

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কে বলা হলো আপনি যখন কোন কথা বলেন, আর পবিত্র কুরআন তার বিরোধী হয় তাহলে কী করা হবে? তিনি উত্তরে বললেন, আপনারা কুরআনের মোকাবেলায় আমার কথা প্রত্যাখ্যান করুন। তারপর বলা হলো, আপনার কথা যদি হাদীসের বিরোধী হয়? তখন উত্তর দিলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীসের মোকাবেলায় আমার কথা পরিহার করুন। তারপর জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার কথা যদি সাহাবীগণের কথার বিরোধী হয়? তখন উত্তর দিলেন, সাহাবীগণের কথার মোকাবেলায় আমার কথা পরিত্যাগ করুন। [ঈকদুল জীদ, ৫৩ পৃঃ।]

اِذَا قُلْتُ قَوْلًا فَاَعرِضُوْا عَلٰى كِتَابِ اللهِ رَسُوْلِه فَاِنْ وَافَقَهُمَا فَاقْبَلُوْهُ وَمَا خَالَفَهُمَا فَرُدُّوْهُ وَاضْرِبُوْا بِقَوْلِيْ عَرَضَ الْحَائِطِ

আমি যখন কোন কথা বলি তা পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীসের সাথে যাচাই করো। যদি ঐ দুটির সাথে আমার কথা মিলে, তাহলে গ্রহণ করো। আর যদি বিরোধী হয়, তাহলে প্রত্যাখ্যান করো ও দেয়াল পৃষ্ঠে নিক্ষেপ করো। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/১৬৩ পৃঃ ; মীযানে কুবরা, ১/৫৭ পৃঃ।]

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর নিকট কোন সমস্যার সমাধানের জন্য গেলে তার নিকট সে বিষয়ের হাদীস বিদ্যমান না থাকলে তিনি ফতওয়া দিয়ে বলতেন,

هٰذَا رَأْيُ النُّعْمَانِ بْنِ ثَابِتٍ يَعْنِيْ نَفْسَهُ وَهُوَ أَحْسَنُ مَا قَدَرْنَا عَلَيْهِ فَمَنْ جَاءَ بِأَحْسَنَ مَنْهُ فَهُوَ أَوْلٰى بَالصَّوَابِ

এটা নু‘মান বিন সাবিতের সিদ্ধামত্ম। আমাদের ক্ষমতা অনুসারে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট উক্তি। কিন্তু যদি কেউ এটা অপেক্ষা অধিক বলিষ্ঠতার সিদ্ধামেত্ম উপনীত হতে সক্ষম হয় তাহলে সে সিদ্ধামত্মই সঠিক। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১৬২ পৃঃ ; মীযানুল কুবরা, ১/৬০ পৃঃ।]

তিনি আরো বলতেন, যদি দলীল পেশ হয়ে যায় তাহলে তোমরা তদানুযায়ী কথা বলবে। [রাদ্দুল মুহতার, ১/৪৭ পৃঃ।]

وَاَصْحَابُ اَبِيْ حَنِيْفَةَ رَحِمَهُ اللهُ مُجْمِعُوْنَ عَلٰى اَنَّ مَذْهَبَ اَبِيْ حَنِيْفَةَ اَنَّ ضَعِيْفَ الْحَدِيْثِ عِنْدَهٗ أَوْلٰى مِنَ الْقِيَاسِ وَالرَّأْيِ

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর সকল অনুসারীরা এ ব্যাপারে একমত যে, যঈফ বা দুর্বল হাদীস ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর কাছে কিয়াস ও তাঁর অভিমতের চেয়েও অনেক উত্তম। [ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন- ১২/৮২ পৃঃ।]

اِيَّاكُمْ وَالْقَوْلَ فِيْ دِيْنِ اللهِ بِالرَّأْيِ وَعَلَيْكُمْ بِاتِّبَاعِ السُّنَّةِ فَمَنْ خَرَجَ عَنْهَا ضَلَّ

সাবধান! তোমরা আল্লাহর দ্বীনে নিজেদের অভিমত প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকো। সকল অবস্থাতেই সুন্নার অনুসরণ করো। যে ব্যক্তি সুন্নাহ থেকে বের হবে, সে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। [মীযানুল কুবরা, ১/৯ পৃঃ।]

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর এ মনোভাব ছাত্রদেরকে তার মতের অন্ধ অনুসরণ করা থেকে বিরত রেখেছে এবং নিজেদের পাশাপাশি অপরের মতামতকেও শ্রদ্ধা করার মানসিকতা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তার নিজের ও তার ছাত্রদের মতামত অন্ধভাবে অনুসরণ করার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তিনি ও তার ছাত্রবৃন্দ কোন মূলনীতি বা প্রমাণের আলোকে মত দিয়েছেন তা না জেনে তিনি সে মতের অন্ধ অনুসরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

আবু হানীফা (রহ.) তার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সব সময়ই সজাগ ছিলেন। তাই তিনি তার ছাত্রবৃন্দ ও অন্যদের কাছে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন যে, সঠিক ও ভুলের চূড়ামত্ম মানদন্ড হলো কুরআন ও সুন্নাহ। যা কিছু এর সাথে সংগতিপূর্ণ তা-ই সঠিক, আর যা কিছু সংগতিপূর্ণ নয় তা-ই ভুল।

(২) ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ.)

ইমাম মালিক (রহ.) নিজের সিদ্ধামেত্মর বিপরীত কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পেলে তিনি জনসম্মুখে দেয়া কোন সিদ্ধামত্ম পরিবর্তন করতেও কখনো দ্বিধা করতেন না।

ইবনে ওহাব (রহ.) বলেন, আমি ইমাম মালিক (রহ.) কে অযুতে পদযুগলের আঙ্গুলিসমূহ খিলাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে শুনেছি। তিনি উত্তরে বলেন, লোকদেরকে তা করতে হবে না। ইবনে ওহাব (রহ.) বলেন, আমি লোকসংখ্যা কমে আসা পর্যমত্ম অপেক্ষা করলাম। অতঃপর বললাম, আমাদের কাছে এ বিষয়ে হাদীস রয়েছে। তিনি বললেন, সেটা কী? আমি বললাম, আমাদেরকে লাইস ইবনে সাদ, ইবনে লহীয়া ও আমর ইবনে হারিস ইয়াযীদ ইবনে আমর আল মু‘আফিরী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَدْلُكُ بِخِنْصِرِه مَا بَيْنَ أَصَابِعِ رِجْلَيْهِ

অর্থাৎ আমি রাসূলুলস্নাহ ﷺ কে দেখেছি যে, তিনি তাঁর কনিষ্ঠাঙ্গুলি দ্বারা পদযুগলের আঙ্গুলিগুলোর মধ্যভাগ মর্দন করেছেন। [বায়হাকী, হা/৩৬৫; শারহুল মা‘আনিল আছার, হা/১৭১; সিফাতু সালাতুন নাবী ﷺ, ১/২৮ পৃঃ।]

তখন ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, এ হাদীসটি হাসান, তবে আমি ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। ইবনে ওহাব (রহ.) বলেন, এরপর হতে ইমাম মালিক (রহ.) কে ঐ প্রশ্ন করা হলে তিনি উক্ত হাদীসের আলোকে আঙ্গুল খিলাল করার নির্দেশ দিতেন। [মুকাদ্দামাতুল জারহ্ ওয়াত্ তা‘দীল- ৩১, ৩২ পৃঃ।]

আববাসীয় খলীফা আবু জাফর আল মানসুর ও হারুনুর রশীদ ইমাম মালিকের আল মুয়াত্তা নামক হাদীস সংকলনকে গোটা ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানে পরিণত করার জন্য তার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই প্রসত্মাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছিলেন, সাহাবীগণ ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রামেত্ম ছড়িয়ে পড়েছেন এবং তাদের থেকে বর্ণিত অনেক হাদীসই তার এ সংকলনে নেই।

এভাবে ইমাম মালিক (রহ.) নিজ মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মাযহাবে পরিণত করার সুযোগ পেয়েও তা নাকচ করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি এমন একটি অপূর্ব দৃষ্টামত্ম স্থাপন করেছেন, যা নিঃসন্দেহে সকলের জন্য অনুকরণীয়।

ইবনে আবদুল বার (রহ.) বর্ণনা করেছেন, ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ.) বলেন,

اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ اُخْطِئُ وَأُصِيْبُ فَانْظُرُوْا فِيْ رَأْيِىْ فَكُلٌّ مَا وَافَقَ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ فَخُذُوْهُ وَكُلٌّ مَا لَمْ يُوَافِقُ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ فَاتْرُكُوْهُ

আমি একজন মানুষ, আমি ভুল করতে পারি। আবার কখনো সঠিক সিদ্ধামেত্মও উপনীত হতে পারি। সুতরাং আমার মতামতগুলোকে যাচাই করে দেখবে। অতঃপর যা কিছু কুরআন-সুন্নার সাথে সংগতিপূর্ণ তা গ্রহণ করবে, আর যা কিছু সাংঘর্ষিক তা প্রত্যাখ্যান করবে। [ফতওয়ায়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ২/৩৮৪।]

এ বক্তব্য প্রমাণ করে যে, ইমাম মালিক (রহ.) নিজে অন্য সবকিছুর উপর কুরআন ও সুন্নাহকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি কখনো চাননি যে, অন্ধভাবে তার মতামতের অনুসরণ করা হোক।

তিনি আরো বলতেন,

لَيْسَ أَحَدٌ بَعْدَ النَّبِىِّ اِلَّا وَيُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِه وَيَتْرُكُ اِلَّا النَّبِىِّ

অর্থাৎ নবী ﷺ ব্যতীত অন্য যে কোন লোকের কথা গ্রহণীয় এবং বর্জনীয়, কিন্তু নবী ﷺ এর সকল কথা গ্রহণীয়। [আল জামি- ২/৯১ পৃঃ ; উসূলুল আহকাম- ৬/১৪৫, ১৭৬ পৃঃ।]

তিনি আরো বলতেন,

مَنِ ابْتَدَعَ بِدْعَةً يَرَاهَا حَسَنَةً فَقَدْ زَعَمَ اَنَّ مُحَمَّدًا خَانَ الرِّسَالَةَ لِاَنَّ اللهَ تَعَالٰى يَقُوْلُ : اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِىْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامِ دِيْنًا

যে ব্যক্তি কোন বিদআত চালু করে এবং মনে করে যে, এটা ভালো কাজ, সে যেন এ দাবি করে যে, মুহাম্মাদ ﷺ রিসালাতের খিয়ানত করেছেন - (না‘ঊযুবিল্লাহ)। কেননা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবদ্দশায় বিদায় হজ্জের ভাষণদান কালে বলেন, আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে পছন্দ করে নিলাম। [তা‘লীকাতুল আলবানী আলা সিরাতিল মুসত্মাকীম, ১/৩ পৃঃ।]

(৩) ইমাম শাফেয়ী (রহ.)

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) তার শিক্ষক ইমাম মালিকের মতোই স্পষ্টভাষায় বলেছেন যে, তার সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত সকল হাদীস সম্পর্কে জানা বা প্রাপ্ত সব হাদীস মুখস্থ রাখা কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। তৎকালীন আলেমগণের কারো কারো কাছে কিছু হাদীস না পৌঁছার কারণে কিছু বিষয়ে তারা ভুল সিদ্ধামত্ম প্রদান করেছেন। তাই ভুল-শুদ্ধ নিরূপণের সর্বাবস্থায় নির্ভরযোগ্য একমাত্র মানদন্ড হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ।

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) থেকে এ মর্মে অনেক চমৎকার কথা উদ্ধৃত হয়েছে। তার অনুসারীগণ তার এসব কথায় অধিক সাড়া দিয়েছেন এবং উপকৃতও হয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতো ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-ও বলতেন,

اِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ وَاِذَا رَأَيْتُمْ كَلَامِيْ يُخَالِفُ الْحَدِيْثَ فَاعْمَلُوْا بِالْحَدِيْثِ وَاضْرِبُوْا بِكَلَامِيْ الْحَائِطِ

কোন বিষয়ে যখন কোন সহীহ হাদীস পাবে, জেনে রেখো, সেটাই আমার মাযহাব বা মত। তোমরা যদি আমার কোন উক্তি হাদীসের বিপরীত দেখতে পাও, তাহলে হাদীসের অনুসরণ করো এবং আমার উক্তি প্রাচীরের বাইরে ফেলে দাও। [মীযানুল কুবরা, ১/৫৭ পৃঃ ; ঈকাযুল হিমাম, ১০৭ পৃষ্ঠা; হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/১৬৩ পৃঃ।]

তিনি আরো বলতেন,

مَا مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَتَغِيْبُ عَنْهُ سُنَّةٌ لِرَسُوْلِ اللهِ وَتَغِيْبَ فِيْهِمَا قُلْتُ مِنْ قَوْلٍ أَوْ أَصَلْتُ مِنْ أَصْلٍ فِيْهِ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ خِلَافَ مَا قُلْتُ فَالْقَوْلُ مَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَهُوَ قَوْلِيْ

আমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সব সুন্নাহ সম্পর্কে জানেন বা কোন কিছুই ভুলে যাননি। তাই, আমি যে মূলনীতি বা যে আইনই প্রণয়ন করি না কেন, তাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নার খেলাফ কিছু থাকাটাই স্বাভাবিক। অতএব রাসূলুল্লাহ ﷺ যে বিধান দিয়েছেন তাই একমাত্র সঠিক বিধান এবং সেটাই আমার প্রকৃত মাযহাব। [ফিকহুল ইবাদাহ, ১/১৬।]

اَجْمَعُ الْمُسْلِمُوْنَ عَلٰى اَنْ اِسْتَبَانَ لَهٗ سُنَّةٌ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ لَمْ يَحِلُّ لَهٗ اَنْ يَّدْعَهَا لِقَوْلِ أَحَدٍ

অর্থাৎ মুসলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যার কাছে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সুন্নাহ (হাদীস) পরিষ্কারভাবে প্রকাশ হয়ে যায় তার পক্ষ অন্য কারো কথায় তা বর্জন করা বৈধ নয়। [ইকাযু হুমামি উলিল আবসার- ১/৫৮।]

إِذَا وَجَدْتُّمْ فِيْ كِتَابِيْ خِلَافَ سُنَّةِ رَسُوْلِ اللهِ فَقُوْلُوْا بِسُنَّةِ رَسُوْلِ اللهِ وَدَعُوْا مَا قُلْتُ وَفِيْ رِوَايَةٍ : فَاتَّبِعُوْهَا وَلَا تَلْتَفِتُوْا اِلٰى قَوْلِ اَحَدٍ

তোমরা যখন আমার কিতাবে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সুন্নাহ বিরোধী কিছু পাবে তখন আমি যা বলেছি তা বাদ দিয়ে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সুন্নাহ অনুসারে ফতওয়া দাও। [মহিউদ্দীন নববী, আল মাজমূ, ১/৬৩ পৃঃ।] অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ অনুসরণ করো, অন্য কারো কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করো না। [যাম্মুল কালাম- ১/৪৭ পৃঃ ; ইহতিজাজ বিশ শাফেঈ- ২/৮ পৃঃ ; ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘য়ীন- ২/৩৬১ পৃঃ।]

অপর বর্ণনায় রয়েছে,

فَاتَّبِعُوْهَا وَلَا تَلْتَفِتُوْا اِلٰى قَوْلِ اَحَدٌ

অর্থাৎ তোমরা তারই (সুন্নাতের) অনুসরণ করো এবং অন্য কারো কথার প্রতি ভ্রম্নক্ষেপ করো না। [মু‘লিমু উসূলুল ফিকহ্ ইনদা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত- ১/১৪৫।]

اَنْتُمْ اَعْلَمُ بِالْحَدِيْثِ وَالرِّجَالِ مِنِّيْ فَاِذَا كَانَ الْحَدِيْثُ الصَّحِيْحَ فَأَعْلِمُوْنِيْ بِه اَيَّ شَيْئٍ يَكُوْنُ : كُوْفِيًا أَوْ بَصْرِيًا أَوْ شَامِيًا حَتّٰى أَذْهَبَ إِلَيْهِ إِذَا كَانَ صَحِيْحٌ

অর্থাৎ আপনারাই (এখানে আহমাদ ইবনে হাম্বলকে সম্বোধন করা হয়েছে) হাদীস বিষয়ে ও তার রিজালের (বর্ণনাকারীদের) ব্যাপারে আমার অপেক্ষা অধিক জ্ঞাত। তাই সহীহ হাদীস পেলেই আমাকে জানাবেন, চাই তা কুফাবাসীদের বর্ণনাকৃত হোক অথবা বসরাবাসীদের হোক অথবা শাম (সিরিয়া) বাসীদের হোক- বিশুদ্ধ হলে আমি তাই গ্রহণ করব। [ঈকাযুল হিমাম, ১০২ পৃঃ।]

كُلُّ مَسْأَلَةٍ صَحَّ فِيْهَا الْخَبَرُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ عِنْدَ أَهْلِ النَّقْلِ بِخِلَافِ مَا قُلْتُ فَأَنَا رَاجِعٌُ عَنْهَا فِيْ حَيَاتِيْ وَبَعْدَ مَوْتِىْ

আমার জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর যে সমসত্ম মাসআলায় আমার ফতওয়ার বিপরীতে মুহাদ্দিসগণের নিকট সহীহ হাদীস প্রমাণিত হয়েছে ঐসব মাসআলায় আমার মত প্রত্যাহার করে হাদীস গ্রহণ করে নিলাম। [হুলিয়্যাহ ৯/১০৭ পৃষ্ঠা; আদাবুশ্ শাফেঈ, ৯৩ পৃঃ; সিফাতুস সালাতিন্নাবী, ৫২ পৃঃ।]

اِذَا رَأَيْتُمُوْنِىْ أَقُوْلُ قَوْلًا وَقَدْ صَحَّ عَنِ النَّبِىِّ خِلَافَهٗ فَاعْلَمُوْا اَنَّ عَقْلِىْ قَدْ ذَهَبَ

যখন তোমরা দেখবে যে, আমি এমন কথা বলছি, যার বিরম্নদ্ধে নবী ﷺ থেকে বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে তবে জেনে রেখো যে, আমার বিবেক হারিয়ে গেছে। [ইকাযু হুমামি উলিল আবসার- ১/১৩০ পৃঃ।]

كُلُّ مَا قُلْتُ فَكَانَ عَنِ النَّبِىِّ خِلَافَ قَوْلِىْ مِمَّا يَصِحُّ فَحَدِيْثُ النَّبِىِّ أَولٰى فَلَا تُقَلِّدُوْنِىْ

আমি যা কিছুই বলেছি তার বিরম্নদ্ধে নবী ﷺ থেকে সহীহ সূত্রে হাদীস এসে গেলে নবী ﷺ এর হাদীসই হবে অগ্রাধিকারযোগ্য। অতএব তোমরা আমার অন্ধ অনুসরণ করো না। [ঈকদুল জীদ, ৫৪ পৃঃ।]

كُلُّ حَدِيْثٍ عَنِ النَّبِىِّ فَهُوَ قَوْلِىْ وَإِنْ لَّمْ تَسْمَعُوْهُ مِنِّىْ

নবী ﷺ এর প্রত্যেক হাদীসই আমার বক্তব্য, যদিও তোমরা আমার মুখ থেকে তা না শুনে থাক। [আল খুলাসাতু ফী আসবাবিল ইখতিলাফিল ফুকাহা, ১/১৭০ পৃঃ; আল মুকাদ্দীসী, ১/৮৫ পৃঃ।]

নিঃসন্দেহে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর এ বক্তব্য তাকলীদের মূলে আঘাত করে। তাকলীদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে মাযহাবের মতকে সুন্নার উপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়; এমনকি মাযহাবের মতকে সমর্থন করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।

তাকলীদের বিপক্ষে এ মহান ইমামের অবস্থান ছিল একেবারেই আপসহীন। তিনি বাগদাদে অবস্থানকালে নিজ মাযহাবের সারাংশ হিসেবে ‘আল হুজ্জা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এরপর মিশর ভ্রমণ করে ইমাম আল লাইস ইবনে সাদ (রহ.) এর মাযহাব অধ্যয়ন করার পর তিনি অনেক বিষয়ে তার পূর্বের মত পরিবর্তন করেন। এরপর তিনি ‘আল উম্ম’ নামক একটি নতুন গ্রন্থ রচনা করেন।

(৪) ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)

ইমাম আহমাদ তার ছাত্রদের অমত্মরে ইসলামের মূল উৎসগুলোর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। কারো ব্যক্তিগত মতের অন্ধ অনুসরণের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার মাধ্যমে ইমাম আহমাদ (রহ.) তার শিক্ষক ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য ইমামদের অনুসৃত রীতি অব্যাহত রেখেছিলেন। আগের ইমামদের কিছু কিছু অনুসারীর মধ্যে তাকলীদের প্রবণতা দেখা দেয়ায় ইমাম আহমাদ (রহ.) আরো বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তার ছাত্রদেরকে তার ব্যক্তিগত মতামত লিপিবদ্ধ করতে শুধু নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ (রহ.) আরো একধাপ এগিয়ে তার ব্যক্তিগত মতামত লিপিবদ্ধ করার উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তাই তার ছাত্রদের যুগের পূর্বে তার মাযহাব লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়নি।

ইমাম আহমাদ (রহ.) হাদীসকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি কিয়াসের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধামেত্মর উপর একটি দুর্বল হাদীসকেও প্রাধান্য দিতেন। তিনি আল মুসনাদ নামে ৩০,০০০ এর অধিক হাদীস সম্বলিত একটি গ্রন্থ সংকলন করেছেন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ উম্মতের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমার কাছ থেকে তোমরা যা শুনেছ তা পৌঁছে দাও, এমনকি তা যদি একটি আয়াতও হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১; তিরমিযী, হা/২৬৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৪৮৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৫২৫; মু‘জামুস সগীর, হা/৪৬২; সুনানে দারেমী, হা/৫৪২; মুসান্নাফে আবদুর রযযাক, হা/১০১৫৭; জামেউস সগীর, হা/৫১৪৮; মিশকাত, হা/১৯৮।]

মূলত কিয়ামত পর্যমত্ম গোটা মানবজাতির কাছে হেদায়াতের বাণী পৌঁছে দেয়াই ছিল এ নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য। এ কারণে, ইমাম আহমাদ (রহ.) সকলের কাছে হেদায়াত পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রত্যেকটি বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ এত বেশি ছিল যে, কেউ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি হাদীসকেও অবজ্ঞা করার দুঃসাহস দেখালে তিনি তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতেন। তিনি বলেছেন,

لَاتُقَلِّدُوْنِيْ وَلَا تُقَلِّدُوْا مَالِكًا وَلَا أَبَا حَنِيْفَةَ وَلَا الشَّافَعِىْ وَلَا الْاَوْزَاعِىَّ وَلَا الثَّوْرِىَّ رَحِمَهُمُ اللهُ تَعَالٰي وَخُذُوْا مِنْ حَيْثُ أَخَذُوْا مِنْ قِلَّةٍ فِقْهِ الرَّجُلِ اَنْ يُّقَلِّدَ دِيْنَهُ الرِّجَالُ

তোমরা আমার তাকলীদ করবে না। ইমাম মালিক (রহ.) এর তাকলীদ করবে না এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.), শাফেয়ী (রহ.), আওযাঈ (রহ.), সুফইয়ান সাওরী (রহ.) সহ কারো তাকলীদ করবে না। বরং দ্বীনের মাসআলা সেখান থেকে সংগ্রহ করবে, যেখান থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন। কোন ব্যক্তির নির্বুদ্ধিতার পরিচয় হলো তার দ্বীনের ব্যাপারে মানুষের রায় গ্রহণ করা। [আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ ফিল কুতুবিন নাজদিয়্যাহ, ১৫/৮০ পৃঃ।]

অপর বর্ণনায় রয়েছে,

لَا تُقَلِّدْ دِيْنَكَ أَحَدًا مِّنْ هٰؤُلَاءِ مَا جَاءَ عَنِ النَّبِىِّ وَأَصْحَابِه فَخُذْ بِه ثُمَّ التَّابِعِيْنَ بَعْدُ الرَّجُلُ فِيْهِ مُخَيَّرٌ

তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে এদের কারো অন্ধ অনুসরণ করবে না। নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীদের থেকে যা কিছু আসে তা গ্রহণ করো, অতঃপর তাবেঈদের। তাদের পরবর্তীদের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির জন্য যে কারো নিকট থেকে গ্রহণ করার স্বাধীনতা রয়েছে। [মাজাল্লাতু বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ, ৪৭/২১৬।]

আবার কোন সময় বলেছেন,

اَلْاِتِّبَاعُ اَنْ يَّتَّبِعَ الرَّجُلُ مَا جَاءَ عَنِ النَّبِىِّ وَعَنْ اَصْحَابِه ثُمَّ هُوَ مِنْ بَعْدِ التَّابِعِيْنَ مُخّيَّرٌ

ইত্তেবা হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীদের থেকে যা আসে তার অনুসরণ করবে আর তাবেঈদের পর থেকে সে (যে কারো অনুসরণে) স্বাধীন থাকবে। [মাসায়েলে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, ২৭৬-২৭৭ পৃঃ।]

رَأْيُ الْاَوْزَاعِىِّ وَرَأْيُ مَاِلِكٍ وَرَأْيُ أَبِيْ حَنِيْفَةَ كُلُّهٗ رَأْيٌ وَهُوَ عِنْدِىْ سَوَاءٌ وَإِنَّمَا الْحُجَّةُ فِى الْاٰثَارِ

ইমাম আওযাঈ, ইমাম মালিক ও ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর সিদ্ধামত্মগুলো কেবল তাদের মতামত হিসেবেই বিবেচ্য। আমার কাছে তাদের সকলের মর্যাদা সমান। এক্ষেত্রে সঠিক ও ভুল নিরূপণের প্রকৃত মানদন্ড হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ। [আল জামি, ৩/১৪৯ পৃঃ।]

مَنْ رَدَّ حَدِيْثَ رَسُوْلِ اللهِ فَهُوَ عَلٰى شَفَا هَلَكَةٍ

যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি বিশুদ্ধ হাদীস প্রত্যাখ্যান করে, সে ধ্বংসের দ্বারপ্রামেত্ম অবস্থান করছে। [আল-মানাকিব, পৃঃ ১৮২।]

عَجِبْتُ لِقَوْمٍ عَرَفُوْا الْأِسْنَادَ وَصِحَّتَهٗ يَذْهَبُوْنَ إِلٰى رَأْيِ سُفْيَانَ، وَاللهُ تَعَالٰى يَقُوْلُ : ﴿فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِه أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ﴾

আমি আশ্চর্য হই তাদের আচরণে, যারা সহীহ হাদীস জানা সত্ত্বেও ইমাম সুফইয়ান (রহ.) এর অভিমত গ্রহণ করতে চায়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, অতএব যারা তাঁর আদেশের অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীসের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা যেন সতর্ক হয় যে, তাদেরকে ফেতনা পেয়ে যাবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব গ্রাস করবে। [আল ইবানাহ কুবরা, ১/২৬০ পৃঃ ই‘লাম- ২/২৭১ পৃঃ।]

لَا تُقَلِّدْ دِيْنَكَ الرِّجَالَ فَاِنَّهُمْ لَنْ يَّسْلِمُوْا مِنْ اَنْ يَّغْلِطُوْا

তুমি তোমার দ্বীনের বিষয়ে নবী-রাসূল ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির অন্ধ অনুকরণ করো না, কারণ তারা কখনো ত্রুটিমুক্ত নয়। [ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল মাজমূ‘- ২০/২১২ পৃঃ।]

এসব হলো ইমামগণের বক্তব্য, যাতে হাদীসের উপর আমল করার ব্যাপারে নির্দেশ রয়েছে এবং অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কথাগুলো এতই স্পষ্ট যে, এগুলো কোন তর্ক বা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

৩৮
ইমামগণের ছাত্ররা কী করতেন
মহান ইমামগণ তাদের ছাত্রদেরকে অন্ধ অনুসরণের ব্যাপারে কাঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ কারণে তারা কোন বিষয়ে নতুন কোন হাদীস জানতে পারলে নিজ শিক্ষকের মতের বিপরীত সিদ্ধামত্ম গ্রহণ করতে কখনো দ্বিধা করতেন না। কারণ ইমামগণ তাদের এমনটি করারই নির্দেশ দিয়েছিলেন। হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানীফার সাথে তারই ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সিদ্ধামেত্মর ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। [আল-হাশিয়্যাহ, ১/৬২ পৃঃ।]

ইমাম ইবনে ইউসুফ আল বালাখি ছিলেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আল-হাসানের ছাত্র এবং আবু ইউসুফের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই আবু হানীফা ও তার এই দুই ছাত্রের সিদ্ধামত্ম থেকে ভিন্নমত দিয়েছেন। কারণ কিছু বিষয়ের প্রমাণ তাদের কাছে পৌঁছায়নি, কিন্তু পরবর্তীকালে ইবনে ইউসুফ আল বালাখি সেগুলো জানতে পেরেছিলেন। [রাসমুল মুফতী, ১/২৭ পৃঃ।]

একইভাবে আল মুযানি ও অন্যান্য ছাত্রবৃন্দ অনেক সিদ্ধামেত্মর ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষক ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

প্রধান চার ইমাম ও তাদের ছাত্রবৃন্দ সুন্নার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের দাবি করেছেন এবং তাদের ব্যক্তিগত মতের অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। তাদের বক্তব্য একেবারেই স্পষ্ট এবং যুক্তিযুক্ত। এগুলোর অপব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই।

সুন্নার অনুসরণ করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে কোন ইমামের মতের বিপরীত হয়ে যেতে পারে। এর দ্বারা কেউ ইমামের বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। কেবল ইমামদের মতের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে নির্ভরযোগ্য হাদীসকে পরিত্যাগ করা হলে তা হবে স্বয়ং ইমামদের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। অধিকমত্মু নির্ভরযোগ্য হাদীস প্রত্যাখ্যান সরাসরি আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধাচরণের নামামত্মর। [সিফাতু সালাতুন্নাবী, মুখবন্ধ, পৃ: ৩৪-৩৫।]

৩৯
ইমামদের ব্যাপারে আমাদের আকীদা কেমন হবে
চার ইমাম ও অন্যান্য ইমামের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হবে, তারা যে জ্ঞান ও তাকওয়ার অধিকারী ছিলেন- এজন্য আমরা তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করব, তাদেরকে সম্মান করব, তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করব, তাদের প্রশংসা করব এবং তাদের জন্য দু‘আ করব। কিতাব ও সুন্নার প্রতি আমলের ক্ষেত্রে আমরা তাদের আনুগত্য করব। কুরআন ও সুন্নার উপর তাদের মতামতকে কখনো অগ্রাধিকার দেব না। তবে কুরআন ও সুন্নাহকে সঠিকভাবে জানার ক্ষেত্রে তাদের অভিমতগুলোর সাহায্য নেব। এক্ষেত্রে যেগুলো কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী তা পরিত্যাগ করব। আর যেসব মাসআলার ক্ষেত্রে কুরআন সুন্নার সরাসরি কোন দলীল পাওয়া যায় না, সেসব ক্ষেত্রে তাদের ইজতিহাদের দিকেও দৃষ্টি দেব।

আমাদেরও লক্ষ রাখতে হবে যে, আমরা যেন কুরআন সুন্নার অধিকতর নিকটবর্তী মতামতগুলো গ্রহণ করি এবং সন্দেহযুক্ত মতামত থেকে দূরে থাকি। কারণ ইমামগণ নিষ্পাপ নন। প্রত্যেক ইমামের উপর বিভিন্ন মাসআলার ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তারা আলস্নাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যে বিধান এসেছে সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অতঃপর তাদের সামর্থ্যানুযায়ী ইজতিহাদ করেছেন। সুতরাং যার ইজতিহাদ সঠিক হবে তিনি ইজতিহাদ করার জন্য ও ইজতিহাদ সঠিক হওয়ার জন্য দু’টি নেকী পাবেন। আর যার ইজতিহাদ ভুল হবে তিনি কেবল ইজতিহাদের জন্য নেকী পাবেন। আর ভুলের কারণে ওজর রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّه سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ يَقُولُ إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ

আমর ইবনে আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছেন, কোন বিচারক (হাকিম) গবেষণায় সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার। পক্ষান্তরে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্যও রয়েছে একটি পুরস্কার। [সহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৮৪; আবু দাউদ, হা/৩৫৭৬; ইবনে মাজাহ, হা/২৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৮০৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫০৬০; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৫৭৬; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫৯০৩; দার কুতনী, হা/৪৪৭৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৬১৮; জামেউস সগীর, হা/৪৯৪; মিশকাত, হা/৩৮৩২।]

৪০
ইমামদের প্রকৃত অনুসারী কে
যে ব্যক্তি সুস্পষ্ট হাদীস আঁকড়ে ধরতে গিয়ে ইমামদের কিছু কথার বিরম্নদ্ধে গেলেন তিনি ইমামদের বিরোধী হবেন না। বরং তিনি হবেন তাদের প্রত্যেকের অনুসারী। তিনি হবেন শক্ত হাতল মজবুতভাবে ধারণকারী, যে হাতল ছিন্ন হবার নয়। পক্ষামত্মরে যে ব্যক্তি শুধু ইমামদের মতভেদের কারণে সুস্পষ্ট হাদীস প্রত্যাখ্যান করে তার অবস্থা এমনটি নয়, বরং সে এর মাধ্যমে তাদের অবাধ্য হলো এবং তাদের পূর্বোক্ত কথাগুলোর বিরোধিতা করল। আলস্নাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ حَتّٰى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوْا فِۤيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا ﴾

তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক মানবে। অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা সমত্মুষ্টচিত্তে মেনে নিবে। (সূরা নিসা- ৬৫)

তিনি আরো বলেন,

﴿فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهۤ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ﴾

তাই যারা তাঁর আদেশের বিরম্নদ্ধাচরণ করে তারা যেন ভীতিগ্রসত্ম থাকে (কুফর, শিরক বা বিদআত দ্বারা) ফেতনায় আক্রামত্ম হওয়ার অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাসিত্ম প্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে। (সূরা নূর- ৬৩)

যে কারো নিকট রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর পবিত্র নির্দেশিকা পৌঁছে যাবে, তিনি সে হাদীসের মর্মও উপলব্ধি করবেন। তার উপরই আবশ্যিক হবে যে, এ হাদীসটিকে জাতির সামনে বিসত্মারিতভাবে বর্ণনা করা। উম্মতের কল্যাণ কামনা করা ও রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর আদেশ পালন করার নির্দেশ প্রদান করা। যদিও হাদীসটি বড় কোন ইসলামী ব্যক্তিত্বের মতবাদের বিরোধী হয়। রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর যে কোন হাদীস তথা আদেশ বা নিষেধ ইসলামে কোন বড় ব্যক্তিতেবর অভিমতের তুলনায় সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ও অনুসরণযোগ্য, যার সাথে কোন বড় ব্যক্তিত্বের তুলনা নেই। বড় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি কোন সময় ভুলবশত রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর নির্দেশের বিরোধিতা করে থাকেন। সেহেতু সাহাবী ও পরবর্তীগণ সহীহ হাদীসের বিরোধিতাকে প্রতিবাদ করেছেন। কোন সময় প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক কঠোরতা অবলম্বন করেছিলেন। আলস্নাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল হলেন সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয়তম। তার নির্দেশ পালন করা সকল সৃষ্টিকুলের কর্তব্য।

তাই যখন রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর নির্দেশ ও অন্য কোন বড় ব্যক্তির নির্দেশের মাঝে বিরোধ দেখা দেবে, তখন রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর নির্দেশ প্রাধান্য পাবে, সবচেয়ে বেশি পালনীয় ও অনুসরণযোগ্য হবে।

ইমামগণ তাদের অনুসারীদেরকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমার মতামতের বিরোধী কোন হাদীস পাওয়া গেলে সে হাদীসই আমার মতামত। তারা সকলে স্বীয় অনুসারীদেরকে সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক মতবাদগুলোকে পরিহার করা ওয়াজিব করেছেন।

সুতরাং আমাদের কর্তব্য হবে সুন্নাতবিরোধী মতবাদগুলো ইমামদের দিকে জড়িয়ে দেয়ার মিথ্যাচার না করা।

আগেকার অনুসারীরা ইমামদের সকল মতবাদকে গ্রহণ করতেন না। তাদের অনেক কথাকেই ছেড়ে দিয়েছেন।

ইমাম ইছাম বিন ইউসুফ আল বালাখী (রহ.), যিনি ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) এর সাথি ছিলেন তিনি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতামতের সম্পূর্ণ উল্টো অনেক ফতওয়া প্রদান করেছেন। কেননা এ সমসত্ম কথাগুলোর দলীল ইমাম আবু হানীফা (রহ.) জানতে পারেননি; অথচ অন্যদের থেকে স্পষ্ট দলীল প্রকাশ পেয়েছে- বিধায় তিনি সে দলীলের উপর ফতওয়া দিতেন। যার ফলে তিনি রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ থেকে উঠার সময় দু’হাত উত্তোলন করতেন। যেহেতু এ ব্যাপারে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর থেকে মুতাওয়াতির হাদীস এসেছে। ইমামদের মতামত তাকে এ হাদীসের প্রতি আমল করতে বাধা দেয়নি। এমন আদর্শের উপরই প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর অটল থাকা আবশ্যক।

প্রসিদ্ধ চার ইমাম ও অন্যান্যদের মতামত এ মর্মেই প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইমামদের অনুসারী হলো ঐ ব্যক্তি, যে কোন কিছুকে কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নার উপর প্রাধান্য দেয় না। আর যারা কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নার উপর কোন ব্যক্তির মতামতকে প্রাধান্য দেয়, মূলত তারাই ইমামদের বিরম্নদ্ধাচরণকারী।

৪১
তাকলীদ করা যাবে না, ইত্তেবা করা যাবে
তাকলীদ বলতে বুঝায় কোন দলীল-প্রমাণের অনুসন্ধান ছাড়াই কারো মতামত গ্রহণ করা। আর ইত্তেবা হচ্ছে দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে কারো মতামত গ্রহণ করা। এ দুটি জিনিসের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, অন্ধ অনুসরণ। এভাবে কারো অন্ধ অনুসরণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। কেননা ইসলামী শরীয়ত দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত।

সুতরাং যে ক্ষেত্রে দলীল প্রমাণের উপর বিধান প্রতিষ্ঠিত পাওয়া যাবে সেখানে কেবল ইত্তেবা সাব্যসত্ম হবে। ইত্তেবা শব্দটি কুরআনে বর্ণিত একটি ইসলামী পারিভাষিক শব্দ। পরিভাষায় ইত্তেবা বলা হয়, রাসূলুলস্নাহ ﷺ ও সাহাবী (রাঃ) এর থেকে আগত বিষয়কে অনুসরণ করা।

ইত্তেবা করা শুধু জায়েযই নয়, বরং এ ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আর এটা শুধু আমাদের নবীর ক্ষেত্রে নয়, বরং পূর্ববর্তী নবীরাও ইত্তেবা করেছিলেন। দ্বীনের অনুসরণের ক্ষেত্রে ইউসুফ (আঃ) তার পূর্বপুরুষদের ইত্তেবা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে এসেছে,

﴿وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ اٰبَآئِىْۤ اِبْرَاهِيْمَ وَاِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ﴾

আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকূবের মতবাদ অনুসরণ করি। (সূরা ইউসুফু ৩৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاتَّبِعْ سَبِيْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَيَّ ثُمَّ اِلَيَّ﴾

যে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অনুসরণ করবে। (সূরা লুক্বমান- ১৫)

অর্থাৎ যারা আল্লাহ অভিমুখী হয়েছে এখানে তাদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

ওহীভিত্তিক আমলই ইত্তেবা। কুরআন মাজীদে এসেছে,

﴿اِتَّبِعْ مَاۤ اُوْحِيَ اِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَۚ لَا ۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ وَاَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ﴾

তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা ওহী হয় তুমি তারই অনুসরণ করো; (কেননা) তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই। আর তুমি মুশরিকদের হতে মুখ ফিরিয়ে নাও। (সূরা আনআম- ১০৬)

৪২
মাযহাব মানা ফরয নয়
এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ মুসলিম জাতিকে প্রচলিত কোন মাযহাবকে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করেননি। সুতরাং মুসলিমদের জন্য কোন মাযহাব মানা ফরয নয়। প্রচলিত এসব মাযহাব নবী ﷺ এর যুগে ছিল না। আর ইমামগণও কেউ বলেননি যে, মাযহাব মানা ফরয অথবা তোমরা অন্ধভাবে আমার মতামত অথবা অমুকের মতামতকে গ্রহণ করো।

আলস্নাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের উপর যা আবশ্যক করে দিয়েছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু আবশ্যক বিষয় হতে পারে না। আর আলস্নাহ ও তাঁর রাসূল মাযহাব মানা আবশ্যক করে এরকম কিছু বলেননি যে, তোমরা ইমামদের মধ্য হতে যে কোন একজন ইমামের সব কথা অনুসরণ করবে। আর অন্যের সব মতামত বর্জন করবে। আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিম উম্মাহকে কেবল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সুন্নার দিকে ফিরে আসতে বলেছেন এবং এটাকেই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন।

সুতরাং যে ব্যক্তি দলীল-প্রমাণ অনুসরণ করে চলছে সে স্বীয় ইমামসহ সকল ইমামের কথাই অনুসরণ করেছে এবং কুরআন ও সুন্নার অনুগত হয়েছে। আর যে ব্যক্তি ইমামদের দলীলবিহীন মতামতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে ও মেনে নিয়েছে সে ব্যক্তি স্বীয় ইমামসহ সকল ইমামের মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং কুরআন ও সুন্নাহকে অবজ্ঞা করেছে। কেননা ইমামরা যখন দুর্বল কোন হাদীসের পরিবর্তে সহীহ হাদীস পেতেন তখন তারা সেই সহীহ হাদীসই অনুসরণ করতেন।

ভুল ধারণা :

১. অনেকেই ধারণা করে যে, ইমামদের সকল মতামতই সত্য এবং সঠিক। এজন্য তারা চার মাযহাবকেই হক মনে করে। অথচ এ ধারণা সঠিক নয়।

২. যারা ইমামদের তাকলীদ করে তাদের বিশ্বাস যে, তাদের ইমাম রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সকল হাদীস সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন। তিনি হাদীস ব্যতীত ফতওয়া দিতে পারেন না। সেহেতু যে হাদীস ইমামদের মতবাদের উল্টা প্রমাণিত হয় সন্দেহাতীতভাবে তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের ইমাম এ আয়াত ও হাদীসের অর্থ সম্পর্কে অবশ্যই অবগত আছেন। অথচ এ ধারণাটি সন্দেহাতীতভাবে ভুল।

৩. অনেকে বলে যে, ইমামগণ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাই আমরা তার অনুসরণ করি। অথচ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেই যে তার প্রত্যেক কথাকে গ্রহণ করতে হবে এমনটি আবশ্যকীয় নয়। আলস্নাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ اَ لَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ اَحْسَنَهٗؕ اُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ هَدَاهُمُ اللهُ وَاُولٰٓئِكَ هُمْ اُولُو الْاَ لْبَابِ﴾

যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর তার মধ্যে যা উত্তম তার অনুসরণ করে। এরাই ঐসব লোক যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন; আর তারাই জ্ঞানের অধিকারী। (সূরা যুমার- ১৮)

৪. অনেকে মনে করে যে, কোন বিধানের ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব যদি ভুল করেন এবং এ ভুলের উপর তাকলীদ করা হয় তাহলে তারাও অপারগ সাব্যসত্ম হবেন। অথচ এরূপ ধারণা করা সম্পূর্ণ ভ্রামত্ম ও বাতিল। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজ নিজ আমলের জন্য কেবল তাকেই ধরবেন, অন্য কাউকে নয়। ইমামগণ যদি কোন ভুল করে থাকেন এবং তা সহীহ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও যারা মানবে না, আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ অপরাধের জন্য উক্ত ইমামগণকে ধরবেন না, বরং যিনি আমল করেছেন তাকেই ধরবেন। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। ইমামগণ তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা কুরআন ও হাদীস থেকে বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। সুতরাং আমাদেরও উচিত হবে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে তাদের ঐসকল মতামতগুলো কুরআন ও হাদীসের আলোকে পর্যবেক্ষণ করা। অতঃপর যে মতটি কুরআন ও হাদীসের সাথে মিলবে, সে মতটি গ্রহণ করা এবং বাকিগুলো বাদ দেয়া।

৪৩
কুরআন ও সুন্নার উপর আমল করা ফরয
সকলের উপর ফরয হলো, একতাবদ্ধ হয়ে কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর উপর আমল করা। কুরআন ও সুন্নাহে এর অনেক দলীল রয়েছে। যেমন, আলস্নাহ তা‘আলা বলেন-

﴿اِتَّبِعُوْا مَاۤ اُنْزِلَ اِلَيْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوْا مِنْ دُوْنِه ۤ اَوْلِيَآءَؕ قَلِيْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ﴾

তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তোমাদের নিকট যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কোন অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। (সূরা আ‘রাফ- ৩)

‘‘আলস্নাহ তোমাদের উপর যা অবতীর্ণ করেছেন’’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ‘কুরআন’ এবং এর ব্যাখ্যাকারী গ্রন্থ ‘হাদীস’। কেননা এ উভয়টিই ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে।

﴿وَاتَّبِعُوْاۤ اَحْسَنَ مَاۤ اُنْزِلَ اِلَيْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ يَّاْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَّاَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ﴾

তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে উত্তম যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করো- তোমাদের উপর হঠাৎ করে শাস্তি আসার পূর্বে, যে ব্যাপারে তোমাদের কোন খবরও থাকবে না। (সূরা যুমার- ৫৫)

নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কুরআন হলো সর্বোত্তম কিতাব, যা আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর সুন্নাহ হলো, কুরআনের ব্যাখ্যাকারী। আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যে উত্তম কিতাব আমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে, যারা তার অনুসরণ করবে না আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতের মাধ্যমে তাদেরকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দেন।

আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে বলেন,

﴿وَاَطِيْعُوا اللهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَاحْذَرُوْاۚ فَاِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوْاۤ اَنَّمَا عَلٰى رَسُوْلِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ﴾

তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং সতর্ক হও। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রেখো, স্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের দায়িত্ব। (সূরা মায়েদা- ৯২)

অন্য আয়াতে বলেন,

﴿فَاتَّقُوا اللهَ وَاَصْلِحُوْا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَاَطِيْعُوا اللهَ وَرَسُوْلَهٗۤ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ﴾

আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হও।

(সূরা আনফাল- ১)

কুরআন ও সুন্নার আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত হেদায়াত :

﴿قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَّا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوْهُ تَهْتَدُوْا وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِيْنُ﴾

বলো, তোমরা আলস্নাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে তিনি শুধু তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর তবে তোমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর রাসূলের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া। (সূরা নূর- ৫৪)

কুরআন ও সুন্নার আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে রহমত :

﴿وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاٰتُوا الزَّكَاةَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ﴾

তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার। (সূরা নূর- ৫৬)

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য করার নির্দেশ :

﴿وَمَاۤ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُۚ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْاۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾

রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে খুবই কঠোর। (সূরা হাশর- ৭)

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ :

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْاٰخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا﴾

তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের দিনকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব- ২১)

এখানে اُسْوَةٌ অর্থ اِقْتِدَاءٌ তথা অনুসরণ করা। সুতরাং প্রতিটি মুসলিমের উচিত রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর আদর্শে জীবন গঠন করা। আর এটাই হবে তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আদেশ-নিষেধ মানা ঈমানের পরিচায়ক :

﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ حَتّٰى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوْا فِيْ ۤأَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا﴾

তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক হিসেবে মানবে। অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা সমত্মুষ্টচিত্তে মেনে নিবে। (সূরা নিসা- ৬৫)

আলস্নাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে কসম করে বলছেন যে, তারা ততক্ষণ পর্যমত্ম মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিতর্কিত বিষয়ের ফায়সালা রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর মাধ্যমে গ্রহণ করবে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুসরণ না করলে মানুষ বিভ্রামত্ম হয়ে যাবে :

﴿فَاِنْ لَّمْ يَسْتَجِيْبُوْا لَكَ فَاعْلَمْ اَنَّمَا يَتَّبِعُوْنَ اَهْوَآءَهُمْؕ وَمَنْ اَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللهِؕ اِنَّ اللهَ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ﴾

তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবে যে, তারা কেবল নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথনির্দেশকে অগ্রাহ্য করে নিজ খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (সূরা ক্বাসাস- ৫০)

যে নিজেই আল্লাহর দিকে ধাবিত হয় না এবং তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাকে জোর করে সত্য ও সঠিক পথ দেখানো আল্লাহর রীতি নয়। এ ধরনের লোকেরা সত্য ও সঠিক পথ পরিত্যাগ করে বিভ্রান্তের মতো যেসব ভুল পথে ঘুরে বেড়াতে চায় আল্লাহ তাদেরকে সেসব পথে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেন। একজন সত্য সন্ধানী লোকের জন্য যেসব মাধ্যম সত্যপথ লাভের ব্যাপারে সহায়ক হয়, একজন অসত্য ও ভ্রান্ত পথ প্রত্যাশী ব্যক্তির জন্য সেগুলো বিভ্রান্তি ও গুমরাহীর কারণ হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ কেবল ওহীর অনুসরণ করতেন :

রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন আমাদের মতোই একজন মানুষ। অন্যান্য মানুষের মতো তার উপরও শরীয়তের বিধান প্রযোজ্য ছিল। তিনি শরীয়তের বিষয়ে নিজের থেকে কোন কিছু বলতেন না। বরং তিনি ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হতে যা কিছু নির্দেশ পেতেন তাই বর্ণনা করতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ مَا يَكُوْنُ لِۤيْ اَنْ اُبَدِّلَهٗ مِنْ تِلْقَآءِ نَفْسِيْۚ اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا يُوْحٰۤى اِلَيَّۚ اِنِّۤيْ اَخَافُ اِنْ عَصَيْتُ رَبِّيْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ﴾

(হে নবী! তাদেরকে) বলো, নিজ হতে এটা বদলানো আমার কাজ নয়। আমার প্রতি যা ওহী করা হয়, আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করলে অবশ্যই আমি মহাদিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি। (সূরা ইউনুস- ১৫)

তিনি আরো বলেন,

﴿قُلْ لَّاۤ اَقُوْلُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ وَلَاۤ اَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَاۤ اَقُوْلُ لَكُمْ اِنِّيْ مَلَكٌۚ اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا يُوْحٰۤى اِلَيَّ﴾

বলো, আমি তোমাদেরকে এটা বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভান্ডার আছে। আর অদৃশ্য সম্বন্ধেও আমি কোনকিছু জানি না। আমি তোমাদেরকে এটাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা; তবে আমার প্রতি যা ওহী করা হয় আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। (সূরা আনআম- ৫০)

তিনি অন্য আয়াতে আরো বলেন,

﴿قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِّنَ الرُّسُلِ وَمَاۤ اَدْرِيْ مَا يُفْعَلُ بِيْ وَلَا بِكُمْؕ اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا يُوْحٰۤى اِلَيَّ وَمَاۤ اَنَا اِلَّا نَذِيْرٌ مُّبِيْنٌ﴾

(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, আমি তো রাসূলদের মধ্যে নতুন নই। আর আমি জানি না যে, আমার সাথে ও তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করা হবে। আমি তো শুধু তা-ই মেনে চলছি, যা আমার উপর ওহী করা হয়। আর আমি একজন স্পষ্ট সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নই। (সূরা আহকাফ- ৯)

অন্য আয়াতে আলস্নাহ তা’আলা আরো বলেন

﴿قُلْ اِنَّمَاۤ اُنْذِرُكُمْ بِالْوَحْيِ وَلَا يَسْمَعُ الصُّمُّ الدُّعَآءَ إِذَا مَا يُنْذَرُوْنَ﴾

বলো, আমি তো তোমাদেরকে কেবল ওহী দ্বারাই সতর্ক করে থাকি। কিন্তু যারা বধির তাদেরকে যখন সতর্ক করা হয়, তখন তারা সে আহবান শুনে না। (সূরা আম্বিয়া- ৪৫)

﴿قُلْ اِنْ ضَلَلْتُ فَاِنَّمَاۤ اَضِلُّ عَلٰى نَفْسِيْۚ وَاِنِ اهْتَدَيْتُ فَبِمَا يُوْحِيْۤ اِلَيَّ رَبِّيْؕ اِنَّهٗ سَمِيْعٌ قَرِيْبٌ﴾

বলো, যদি আমি পথভ্রষ্ট হই, তবে তো নিজেরই ক্ষতি করব; আর যদি আমি সরল-সঠিক পথের উপর থাকি, তবে তা এজন্য সম্ভব হচ্ছে যে, আমার প্রতিপালক আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ করেন। নিশ্চয় তিনি সবকিছু শুনেন এবং তিনি অতি নিকটবর্তী। (সূরা সাবা- ৫০)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা গেল যে, ওহীর পথই হলো হেদায়াতের পথ এবং রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর পথ হলো ওহীর অনুসরণ করা। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য করতে আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের উপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য করা আবশ্যক।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্যই আল্লাহর আনুগত্য :

রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন আল্লাহর পক্ষ হতে মানবজাতির জন্য একজন শিক্ষক। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে যখন যা কিছু করতে বলেছেন, তখন তিনি তাই করেছেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য করা আল্লাহর আনুগত্যেরই নামামত্মর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَنْ يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ اَطَاعَ اللهَۚ وَمَنْ تَوَلّٰى فَمَاۤ اَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا ﴾

যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল এবং যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিল তবে (মনে রেখো) তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রেরণ করিনি। (সূরা নিসা- ৮০)

আলস্নাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْؕ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾

তাদেরকে বলে দাও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তবে আমার অনুসরণ করো। (যদি কর) তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান- ৩১)

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণকারীদের মর্যাদা :

﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَاُولٰٓئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ اَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّالِحِيْنَۚ وَحَسُنَ اُولٰٓئِكَ رَفِيْقًا﴾

যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তারা সকলেই নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত; তারা নিয়ামতপ্রাপ্তদের সাথে থাকবে এবং তারাই একে অপরের উত্তম সঙ্গী হবে। (সূরা নিসা– ৬৯)

একমাত্র ওহীর অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে সঠিক পথ :

﴿فَاِمَّا يَاْتِيَنَّكُمْ مِّنِّيْ هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقٰى﴾

পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎপথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না এবং দুঃখ-কষ্টও পাবে না। (সূরা ত্বা-হা- ১২৩)

অত্র আয়াতটি প্রমাণ করে যে, যারা ওহীর অনুসরণ করবে তারা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না এবং পরকালে হতভাগাদের অমত্মর্ভুক্ত হবে না। তাছাড়া এ আয়াত এটাও প্রমাণ করে যে, কোন আলেমের অন্ধ অনুসরণ করা পথভ্রষ্টতার অমত্মর্ভুক্ত। কারণ কোন আলেমই নিষ্পাপ নন, তাদের মাধ্যমেও ভুল সংঘটিত হয়। সুতরাং তাদের থেকে আগত সব কথাই ওহীভিত্তিক বা ওহীর সঠিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী হবে- এটাও নিশ্চিত নয়।

কুরআন ও সুন্নার অনুসারীরাই সফলকাম :

﴿اَ لَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ اَحْسَنَهٗؕ اُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ هَدَاهُمُ اللهُ وَاُولٰٓئِكَ هُمْ اُولُو الْاَ لْبَابِ﴾

যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর তার মধ্যে যা উত্তম তার অনুসরণ করে। এরাই ঐসব লোক, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সৎপথে পরিচালিত করেছেন; আর তারাই জ্ঞানের অধিকারী। (সূরা যুমার- ১৮)

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন ব্যক্তির মতামতের চেয়ে কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূলুলস্নাহ ﷺ অতি উত্তম।

আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন,

﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا﴾

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে তো মহাসাফল্য লাভ করবে। (সূরা আহযাব- ৭১)

কুরআন ও সুন্নার অনুসরণ করা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য :

﴿اِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ اِذَا دُعُوْاۤ اِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهٖ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ اَنْ يَّقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَاَطَعْنَاؕ وَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَآئِزُوْنَ﴾

মুমিনদের উক্তি তো এই- যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও আনুগত্য করলাম। মূলত তারাই সফলকাম। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই কৃতকার্য। (সূরা নূর- ৫১, ৫২)

﴿وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيَآءُ بَعْضٍ يَّاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗؕ اُولٰٓئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُؕ اِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ﴾

মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, এরা সৎ কাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; অচিরেই আল্লাহ এদেরকে দয়া প্রদর্শন করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা তওবা- ৭১)

কুরআন ও সুন্নার অনুসরণ না করা মুনাফিক ও কাফিদের বৈশিষ্ট্য :

﴿وَاِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا اِلٰى مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ وَاِلَى الرَّسُوْلِ رَاَيْتَ الْمُنَافِقِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًا﴾

যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তুমি মুনাফিকদেরকে তোমার নিকট হতে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবে। (সূরা নিসা- ৬১)

এ আয়াত এ কথাই প্রমাণ করছে যে, যখন কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার আহবান জানানো হয়, তখন তা থেকে যে বিমুখ হয় তার চরিত্র সম্পূর্ণ মুনাফিকের মতো।

﴿قُلْ اَطِيْعُوا اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِيْنَ﴾

বলো, তোমরা আলস্নাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আলস্নাহ কাফিরদেরকে ভালোবাসেন না।

(সূরা আলে ইমরান- ৩২)

যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তথা কুরআন ও হাদীসের অনুসরণ করে না অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কাফির হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

কুরআন ও সুন্নার অনুসরণের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি :

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اَطِيْعُوا اللهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَاُولِى الْاَمْرِ مِنْكُمْ فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَى اللّٰهِ وَالرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِؕ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّاَحْسَنُ تَاْوِيْلًا﴾

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তাদের আনুগত্য করো, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী। অতঃপর তোমাদের মাঝে যদি কোন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, তাহলে সে বিষয়টি ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করে থাক; এটাই উত্তম এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অধিকতর উপযুক্ত। (সূরা নিসা- ৫৯)

আলস্নাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হলো, তাঁর কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আর রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হলো তাঁর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

আর এ বিষয়টিকে ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত করে বলা হচ্ছে যে, اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ অর্থাৎ যদি তোমরা আলস্নাহর প্রতি ঈমান রাখ তথা দ্বন্দ্ব নিরসনের ক্ষেত্রে কিতাবুলস্নাহ ও সুনণাতে রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর, তাহলে সেটাই হলো প্রকৃত ঈমানের পরিচয়। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, যদি কেউ দ্বন্দ্ব নিরসনে কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে সে ঈমানদার নয়।

এ আয়াতটি ইসলামের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি। এখানে নিম্নলিখিত মূলনীতিগুলো স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হয়েছে।

(এক) ইসলামী জীবনব্যবস্থায় আসল আনুগত্য লাভের অধিকারী হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। একজন মুসলিমের সর্বপ্রথম পরিচয় হচ্ছে, সে আল্লাহর বান্দা; এরপর অন্য কিছু। মুসলিমের ব্যক্তিগত জীবন ও সমাজব্যবস্থা উভয়ের কেন্দ্র ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। অন্যান্য আনুগত্য ও অনুসরণ কেবল তখনই গৃহীত হবে, যখন তা আল্লাহর আনুগত্যের বিপরীত না হবে। কারণ স্রষ্টার নাফরমানী করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।

(দুই) ইসলামী জীবনব্যবস্থার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য। এটি কোন স্বতন্ত্র আনুগত্য নয়; বরং আল্লাহর আনুগত্যের বাস্তব ও কার্যকর পদ্ধতি। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর কোন আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নবী ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে মূলত আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করল সে মূলত আল্লাহরই নাফরমানী করল। [সহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/৪৮৫২-৫৮; নাসাঈ, হা/৪১৯৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৪৩; জামেউস সগীর, হা/১০৯৮৮; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/২০৬৭৯; মুসনাদে হুমাইদী, হা/১১৭৪; মিশকাত, হা/৩৬৬১।]

(তিন) উপরোক্ত দু’টি আনুগত্যের পর তৃতীয় আরো একটি আনুগত্য মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। সেটি হচ্ছে, ‘উলিল আমর’ তথা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির আনুগত্য করা। মুসলিমদের সামষ্টিক কার্যাবলির ক্ষেত্রে দায়িত্বসম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরাই ‘উলিল আমর’-এর অন্তর্ভুক্ত। তাদের মধ্যে রয়েছেন মুসলিমদের নেতৃত্বদানকারী উলামায়ে কেরাম, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দেশের শাসনকার্য পরিচালনাকারী প্রশাসকবৃন্দ, আদালতে রায় প্রদানকারী বিচারপতি এবং সামাজিক বিষয়ে নেতৃত্বদানকারী নেতাগণ। মোটকথা যে ব্যক্তিই মুসলিমদের নেতৃত্বদানকারী হবেন, তিনিই আনুগত্য লাভের অধিকারী হবেন। তার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে মুসলিমদের সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, তাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হতে হবে। নবী ﷺ বলেছেন, আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানির ক্ষেত্রে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য করতে হবে শুধুমাত্র ‘মারূফ’ বা বৈধ ও সৎকাজে। [সহীহ বুখারী, হা/৭২৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/৪৮৭১; আবু দাউদ, হা/২৬২৭; নাসাঈ, হা/৪২০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭২৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৫৬৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৮০; মিশকাত, হা/৩৬৬৫।]

(চার) এ আয়াতের চতুর্থ মূলনীতি হচ্ছে, ইসলামী জীবনব্যবস্থায় আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের সুন্নাহই হচ্ছে মৌলিক আইন ও চূড়ান্ত সনদ। মুসলিমদের মধ্যে অথবা মুসলিম সরকার ও প্রজাদের মধ্যে কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসার জন্য কুরআন ও সুন্নার দিকে ফিরে আসতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহ এ ব্যাপারে যা ফায়সালা দেবে তা মেনে নিতে হবে। আর এটা ইসলামী জীবনব্যবস্থার এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা তাকে কুফরী জীবনব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। যে ব্যবস্থায় এ জিনিসটি অনুপস্থিত থাকে সেটি হবে অনৈসলামী জীবনব্যবস্থা।

কাফিররা নিজেদের তৈরি মূলনীতি ও বিধানের মাধ্যমে তাদের যাবতীয় বিষয়ের মীমাংসা করে। এসব মূলনীতি ও বিধানের ক্ষেত্রে কোন দলীলের সমর্থন ও স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করে না। অপরপক্ষে মুসলিমরা তাদের প্রতিটি ব্যাপারে সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে যায়। সেখান থেকে কোন নির্দেশ পেলে তারা তার অনুসরণ করে। আর কোন নির্দেশ না পেলে কেবল এ অবস্থায়ই স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে। এ ব্যাপারে শরীয়ত প্রণেতার পক্ষ থেকে কোন বিধান না দেয়াই এ কথা প্রমাণ করে যে, তিনি এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রদান করেছেন।

নিঃসন্দেহে বিদ্বানদের মতে, উলেস্নখিত আয়াতসমূহ দ্বারা এবং ওহী সংক্রামত্ম অন্যান্য আয়াত দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, আলস্নাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য করা কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর প্রতি আমল করার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

সুতরাং কুরআন ও সুন্নার দলীলসমূহ প্রমাণ করছে যে, ওহীর ব্যাপারে চিমত্মা-ভাবনা করা, তা নিয়ে গবেষণা করা এবং সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন ও তার প্রতি আমল করা আবশ্যক। সাহাবীগণ কোন ব্যক্তির কথার কারণে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সুন্নাত পরিত্যাগ করেননি। সে যে মাপেরই লোক হোক না কেন।

৪৪
বিভিন্ন মাসআলায় মতভেদের কারণ
১. অর্থের ব্যাপকতা :

কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত আরবি এমন অনেক শব্দ রয়েছে, যার একাধিক অর্থ রয়েছে। কেউ একটি অর্থ গ্রহণ করেছেন। আবার কেউ অপর অর্থ গ্রহণ করেছেন। এর ফলে দ্বিমত দেখা দেয়। যেমন- তালাকপ্রাপ্তা নারী কতদিন পর্যমত্ম ইদ্দত পালন করবে- এ ব্যাপারে বিধান দিতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوْٓءٍ﴾

আর তালাকপ্রাপ্তা মহিলারা তিন কুরূ পর্যমত্ম অপেক্ষা করবে। (সূরা বাক্বারা- ২২৮)

এখানে قُرُوْءٍ শব্দটি অভিধানে পবিত্রতা এবং হায়েয উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন কেউ এর অর্থ নিয়েছেন হায়েয। আবার কেউ এর অর্থ নিয়েছেন পবিত্রতা।

ক) ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আহমাদ সিদ্ধামত্ম দিয়েছেন যে, কুরূ মানে পবিত্র অবস্থা।

খ) ইমাম আবু হানীফা (রহ.) রায় দিয়েছেন যে, কুরূ শব্দের অর্থ হলো ঋতুস্রাব।

২. আক্ষরিক ও রূপক অর্থ :

কুরআন ও সুন্নাহতে ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দের আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থই রয়েছে। দৃষ্টামত্মস্বরূপ, لَمْسٌ (লামছুন) শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো হাত দ্বারা স্পর্শ করা অথবা দুটি বসত্মুর সংস্পর্শে আসা। এর রূপক অর্থ হলো, দৈহিক মিলন। এর ফলে ইমামগণ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের অর্থ প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রদান করেছেন :

﴿وَاِنْ كُنْتُمْ مَّرْضٰۤى اَوْ عَلٰى سَفَرٍ اَوْ جَآءَ اَحَدٌ مِّنْكُمْ مِّنَ الْغَآئِطِ اَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَآءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَآءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَاَيْدِيْكُمْؕ اِنَّ اللهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُوْرًا﴾

যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে যাও অথবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ শৌচাগার হতে আস অথবা তোমরা নারী-সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও এবং মুখমন্ডল ও হাত মাসাহ্ করো, নিশ্চয় আল্লাহ পাপ মোচনকারী এবং ক্ষমাশীল। (সূরা নিসা- ৪৩)

অযু ভাঙার কারণ প্রসঙ্গে উপরোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে।

ক) ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর অধিকাংশ ছাত্র মত দিয়েছেন যে, لَمْسٌ (লামছুন) শব্দের অর্থ হলো হাতের স্পর্শ অথবা দৈহিক সংস্পর্শ। অতএব কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলক্রমে কোন নারীর ত্বকে স্পর্শ করে অথবা কোন নারী যদি পুরুষের ত্বক স্পর্শ করে তাহলে উভয়ের অযু ভেঙে যাবে।

খ) ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতে, আলোচ্য আয়াতে لَمْسٌ (লামছুন) শব্দের অর্থ হলো দৈহিক মিলন। অতএব আনন্দানুভূতি হোক বা না হোক কোন নারীকে শুধু স্পর্শ করলে অযু বাতিল হবে না। [বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১/৩৩-৩৪।]

৩. ব্যাকরণগত অর্থ :

কিছু কিছু আরবি শব্দের ব্যাকরণিক গঠনের মধ্যেও কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। যেমন-

اِلٰى (ইলা) অব্যয়টির সরল অর্থ হলো, পর্যমত্ম। কিন্তু এর অর্থ সহকারে নয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী-

﴿ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ﴾

রাত পর্যমত্ম সিয়ামকে পূর্ণ করো । (সূরা বাক্বারা- ১৮৭)

সিয়ামের সময় হলো মাগরিব পর্যমত্ম। অর্থাৎ রাতের শুরু পর্যমত্ম, তবে রাত সিয়ামের অমত্মর্ভুক্ত নয়।

আবার اِلٰى (ইলা) অব্যয়টি অনেক সময় পর্যমত্ম ও সহকারে অর্থও বোঝায়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী-

﴿وَنَسُوْقُ الْمُجْرِمِيْنَ إِلٰى جَهَنَّمَ وِرْدًا﴾

আর আমি অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত পশুর মতো জাহান্নামের দিকে (পর্যমত্ম ও ভেতরে) হাঁকিয়ে নিয়ে যাব। (সূরা মারইয়াম- ৮৬)

অযুর নিয়ম সম্পর্কে বলা হয়েছে :

﴿فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ﴾

আর তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও দুই হাত কনুই পর্যমত্ম ধৌত করবে।

(সূরা মায়েদা- ৬)

আয়াতটির অর্থ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞগণ দুটি মত প্রদান করেছেন,

ক) ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর ছাত্র ইমাম যুফার, ইমাম দাউদ জাহিরী এবং ইমাম মালিকের কয়েকজন ছাত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী উপরোক্ত আয়াতে اِلٰى (ইলা) অব্যয়ের অর্থ কনুই পর্যমত্ম, তবে কনুইসহ নয়। [নায়লুল আওতার, ১/১৬৮।]

খ) অন্যদিকে চার ইমামের সকলেই মত দিয়েছেন যে, উপরোক্ত আয়াতের অর্থ হলো কনুই পর্যমত্ম এবং কনুইসহ।

৪. ভুলে যাওয়া :

একজন একটি বিষয়ে একটি সিদ্ধামত্ম নিয়েছেন। পরে তিনি ভুলে গিয়ে অন্য কোন সিদ্ধামত্ম নিতে পারেন অথবা কেউ কোন দলীল ভুলে যাওয়ার কারণে একটি সিদ্ধামত্ম দেয়ার পর পরবর্তীতে উক্ত দলীল স্মরণ হওয়ার ফলে অন্য সিদ্ধামত্ম দিতেন। ফলে তার সিদ্ধামেত্ম মতভেদ দেখা দেয়।

৫. অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা :

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর সাহাবীগণ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে ইলমও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেক বিশেষজ্ঞই অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের থেকে দূরে অবস্থান করতেন। আর তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল খুবই নাজুক। এ কারণে পারস্পরিক পরামর্শের সুবিধা থেকে তাঁরা অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে অঞ্চলভেদে তাদের মতের মধ্যে বিভিন্ন রকম পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

৬. হাদীস না পাওয়া :

অনেক হাদীস অনেক বিশেষজ্ঞ আলেমের কাছে পৌঁছেনি। কেননা দাওয়াতের কাজ নিয়ে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীগণ ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাদের কাউকে রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেই বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়েছিলেন, আবার কাউকে পরবর্তী খলীফাগণ পাঠিয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ নিজের উদ্যোগেই স্থানামত্মরিত হয়েছিলেন। তাছাড়া হিজরী তৃতীয় শতাব্দির মাঝামাঝি ও চতুর্থ শতাব্দির প্রথমাংশের আগে হাদীসের বিশুদ্ধ ও বিশাল সংকলনগুলো রচিত ছিল না। ফলে যে আলেমের কাছে যে হাদীস থাকত, তিনি তার উপর ভিত্তি করেই ফতওয়া দিতেন। যদি তার কাছে কোন হাদীস না থাকত, তিনি ইজতিহাদ করতেন। ফলে অনেক সময় দেখা গেছে যে, তিনি যে সিদ্ধামত্ম দিয়েছেন তার চেয়েও বিশুদ্ধ সিদ্ধামত্ম হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।

৭. বিশ্বসত্ম সূত্রে হাদীস না পৌঁছা :

অনেক সময় দেখা গেছে যে, একজন একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি সে হাদীসটির দুর্বলতার কথা জানতেন না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল যে, অপর কোন আলেম উক্ত হাদীসটির দুর্বলতার কথা জানতে পেরেছেন এবং তিনি অন্য সূত্রে এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ হাদীস সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এভাবে তাদের উভয় পক্ষের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়।

৮. হাদীসের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারা :

সকল মানুষের জ্ঞান সমান নয়। কোন বিষয়ে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী জ্ঞান গ্রহণ করে থাকে। অনুরূপভাবে হাদীসের উদ্দেশ্য বুঝার ক্ষেত্রে একই বিষয়ে আলেমগণ বিভিন্ন সিদ্ধামেত্ম উপনীত হয়েছেন। এভাবে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে।

৯. হাদীসের পরস্পরবিরোধী মতন :

অনেক সময় হাদীসের মতন তথা মূল কথার মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। অর্থাৎ কোন হাদীসে যদি দেখা যায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এটা বলেছেন অথবা করেছেন, তবে অন্য হাদীসে পাওয়া যায় তিনি এটার বিপরীতটা বলেছেন অথবা করেছেন। আবার কোন সময় দেখা যায় কোন সাহাবী একটি আমল এক পদ্ধতিতে করেছেন, কিন্তু অন্য কোন সাহাবী একই আমল ভিন্ন পদ্ধতিতে করেছেন। হাদীসের মতনের এসব ভিন্নতাও মতপার্থক্যের অন্যতম কারণ।

এ ক্ষেত্রে কতিপয় বিশেষজ্ঞ তারজীহ তথা প্রাধান্য দেয়ার পন্থা বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ একই বিষয়ে বিদ্যমান বিভিন্ন হাদীস পর্যালোচনা করে তারা একটিকে আরেকটির উপর প্রাধান্য দিতেন।

আবার কোন সময় বিশেষজ্ঞরা জমা তথা সমন্বয়ের পন্থা অবলম্বন করতেন। এ ক্ষেত্রে তারা একটি হাদীসকে সাধারণ অর্থে ধরে নিয়ে বাকিগুলোর সাথে সমন্বয় সাধন করতেন। যেমন- একটি বিশুদ্ধ হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বিশেষ কিছু সময়ে সালাত আদায় করতে নিষেধ করে বলেন, ফজর সালাতের পর সূর্যোদয় পর্যমত্ম আর আসর সালাতের পর সূর্যাসত্ম পর্যমত্ম কোন সালাত নেই। [সহীহ বুখারী, হা/৫৫৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৮০৫; আবু দাউদ, হা/১২৭১।]

তবে কিছু সমমানের সহীহ হাদীসে সময়ের কোন উল্লেখ ছাড়াই সর্বাবস্থায় কিছু সালাতের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন- তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তার উচিত বসার আগেই দু’রাকআত সালাত আদায় করা। [সহীহ বুখারী, হা/৪৩৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৪০; আবু দাউদ, হা/৪৬৭।]

ইমাম আবু হানীফা এ ক্ষেত্রে তারজীহ এর পন্থা বেছে নিয়েছেন। তিনি প্রথম হাদীসকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধামত্ম প্রদান করেছেন যে, নিষিদ্ধ সময়ে সব ধরনের সালাতই নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ (রহ.) হাদীস দুটির সমন্বয় সাধন করে সিদ্ধামত্ম দিয়েছেন যে, প্রথম হাদীসটি সাধারণ এবং তার সম্পর্ক হলো নফল সালাতের সাথে। অন্য দিকে দ্বিতীয় হাদীসটি সুনির্দিষ্ট, যেখানে সাধারণত নিষিদ্ধ সময়েও মুসত্মাহাব বা বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদানকৃত সালাতের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

১০. কিছু মূলনীতির গ্রহণযোগ্যতা :

ইমামগণের কেউ কেউ এমন কিছু মূলনীতি তৈরি করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধামত্ম প্রদান করেছিলেন, যেগুলো সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে সেসব সিদ্ধামত্ম ও মূলনীতি উভয়টিই বিশেষজ্ঞদের মতবিরোধের উৎসে পরিণত হয়। যেমন- অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ সাহাবীগণের পরের যুগের আলেমদের ইজমাকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এর সংঘটনের সম্ভাব্যতা নিয়ে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং ইমাম আহমাদ (রহ.) সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

একইভাবে, ইমাম মালিক (রহ.) মদিনার প্রথাকে আইনের একটি উৎস মনে করতেন, কিন্তু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই এ নীতি গ্রহণ করতে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন।

আবার ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ইমাম আবু হানীফার ইসিত্মহসান ও ইমাম মালিক (রহ.) এর ইসিত্মসলাহ- উভয় নীতি গ্রহণের অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

১১. কিয়াস :

আলেমগণ কিয়াস প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসকল পন্থা অবলম্বন করেছেন, সেগুলোই তাদের মতপার্থক্যের সর্বপ্রধান উৎস। তাঁদের কেউ কেউ কিয়াস ব্যবহারের জন্য কিছু পূর্বশর্ত আরোপের মাধ্যমে এর পরিধিকে সংকীর্ণ করে দিয়েছেন। পক্ষামত্মরে অন্যরা ব্যাপক হারে কিয়াসের নীতি প্রয়োগ করেছেন। অন্যান্য নীতির তুলনায় কিয়াসের নীতিটি অধিক মাত্রায় ব্যক্তিগত মতভিত্তিক হওয়ায় এ নীতি প্রয়োগের জন্য তেমন কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। আর এ কারণেই ব্যাপক মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। [আল মাদখাল, পৃঃ ২০৯-১০।]

৪৫
আমাদের করণীয় কী
তাকলীদ নিষিদ্ধ মানে এ নয় যে, প্রত্যেককেই প্রতিটি কাজ করার পূর্বে মূল প্রমাণ গবেষণা করে দেখতে হবে। এর অর্থ এও নয় যে, প্রথম দিকের বিশেষজ্ঞ ইমামদের অবদানকে প্রত্যাখ্যান কিংবা উপেক্ষা করতে হবে। তা সম্পূর্ণ বাসত্মবতার পরিপন্থী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসম্ভব। তবে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে তাদের উচিত সেসকল বিশেষজ্ঞের মতামতের দিকে দৃষ্টিপাত করা। জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে একজন আলেমকে অবশ্যই উদার মানসিকতার অধিকারী হতে হবে; নতুবা তার সিদ্ধামত্মগুলো পক্ষপাত বা দলীয় দোষে দোষী সাব্যসত্ম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে, আইনের মূলনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও পূর্বসূরী বিশেষজ্ঞদের মহান কীর্তিগুলোর উপর নির্ভর করতে হবে। ফিকহশাস্ত্র সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চিমত্মা করা একেবারেই অসম্ভব এবং এই অপচেষ্টা করাও অনুচিত। কারণ তা নির্ঘাত বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে। কোন বিশেষ বিষয়ে সত্যপন্থী বিশেষজ্ঞগণ হয় আগের কোন বিশেষজ্ঞের সিদ্ধামত্ম অনুসরণ করবেন, নতুবা তাদের প্রণীত নীতিমালার উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনে নতুন কোন সিদ্ধামত্ম গ্রহণ করবেন। এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আগের ইমামদেরই অনুসরণ করবেন। তবে এ ধরনের অনুসরণকে স্বয়ং ইমামদের দ্বারা নিষিদ্ধ তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ আখ্যা দেয়া যায় না। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ইত্তেবা। এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য হাদীসগুলো সকল মতামতের উপর প্রাধান্য লাভ করবে, যেমনটি ইমাম আবু হানীফা ও শাফেয়ী (রহ.) বলেছেন- কোন সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে, তা-ই আমার মাযহাব।

এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আমরা কার অনুসরণ করব? মানুষ কি কোন ইমামের এমন অনুসরণ করবে যে, তার কথার বাইরে যাবে না, যদিও হক অন্যের সাথে থাকে? নাকি তার কাছে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলীলের অনুসরণ করবে, যদিও তা তার অনুসারী ইমামের মতের বিরোধী হয়? দ্বিতীয়টিই এর সঠিক জবাব। সেজন্য যিনি দলীল জানতে পারবেন তার উপর সেই দলীলের অনুসরণ করা আবশ্যক- যদিও তা ইমামের বিরোধী হয়। তবে তা যেন ইজমার বিরোধী না হয়ে যায়।

আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ব্যতীত অন্য কারো কথা সর্বাবস্থায় এবং সব সময় অবশ্য পালনীয়, সে মূলত অন্য কারো জন্য রিসালাতের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করল। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ব্যতীত অন্য কারো কথার বিধান এমনটা হতে পারে না এবং অন্য কারো কথা সর্বদা অনুসরণীয় হতে পারে না।

ইলমের দিক দিয়ে মানুষ তিন ধরনের-

প্রথম শ্রেণি : প্রকৃত আলেম- যাকে আল্লাহ ইলম ও উপলব্ধি দুটোই দান করেছেন। এ প্রকার ব্যক্তি শরয়ী বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারেন এবং মত পেশ করতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَعَلِمَهُ الَّذِيْنَ يَسْتَنْۢبِطُوْنَهٗ مِنْهُمْ﴾

তবে যারা অনুসন্ধান করে তারা জানতে পারত। (সূরা নিসা- ৮৩)

মূলত এ শ্রেণির আলেমগণই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে হুকুম-আহকাম উদঘাটনের অধিকারী।

দ্বিতীয় শ্রেণি : জ্ঞান পিপাসু- যাকে আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞান দিয়েছেন, কিন্তু তিনি প্রথম শ্রেণি পর্যমত্ম পৌঁছতে পারেননি। যদি তিনি সাধারণ বিষয়গুলো এবং তার কাছে যে জ্ঞানটুকু পৌঁছেছে তার অনুসরণ করেন, তার জন্য কোন দোষ নেই। তবে তিনি তার চেয়ে বড় আলেমকে জিজ্ঞেস করার ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন করবেন না।

তৃতীয় শ্রেণি : যার কোন ইলম নেই। তার জন্য আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। যেসব সাধারণ মানুষ পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে না তাদের দায়িত্ব হলো, তাদের যতটুকু জ্ঞান আছে সে অনুযায়ী আমল করা, সত্যকে মেনে নেয়ার জন্য নিজেদের মন উন্মুক্ত রাখা এবং যতদূর সম্ভব নির্ভরযোগ্য আলেমদের কাছে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَاسْأَلُوْاۤ أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ﴾

অতএব জ্ঞানীদেরকে দলীল-প্রমাণ সহকারে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে। (সূরা নাহল- ৪৩, ৪৪)

মাসআলার ব্যাপারে কাকে জিজ্ঞেস করবে :

যারা ইসলাম সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখে না, তারা এ সম্পর্কে যারা জানে তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেবে। কিন্তু আলেম তো অনেক আছেন- তাদের মধ্যে কাকে জিজ্ঞেস করবে?

সাধারণ ব্যক্তির উপর তার এলাকার সবচেয়ে বিশ্বসত্ম আলেমকে জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। কেননা মানুষের শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেমন সে সবচেয়ে ভালো ডাক্তার খুঁজে। তেমনি এ ক্ষেত্রেও তাই করবে। কারণ জ্ঞান হলো মনের ঔষধ। মানুষের শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেমন ভালো ডাক্তার নির্ণয় করতে হয়, তেমনি জ্ঞানের অসুস্থতার জন্য ভালো আলেম নির্ণয় করতে হবে। সে দ্বীনদারিতায় ও জ্ঞানে তুলনামূলক উত্তম ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে।

তবে অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি জ্ঞানী ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন মাসআলায় ভুল করতে পারেন এবং তুলনামূলক কম জ্ঞানী ব্যক্তি সঠিক ফতওয়া দিতে পারেন। সুতরাং অগ্রগণ্যতার দিক থেকে জ্ঞানী, আল্লাহভীতি ও দ্বীনদারিতায় অধিকতর সঠিকতার নিকটবর্তী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা উচিত।

যে আলেম নির্দিষ্ট কোন দল বা মাযহাবের অনুসরণ করেন, তাদের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলে অনেক সময় সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। কেননা মূলনীতি হচ্ছে, যদি কোন মাসআলায় মতভেদ দেখা দেয় তবে অধিকতর সহীহ দলীলের ভিত্তিতে গৃহীত মতটি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু যিনি নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অনুসরণ করেন তিনি মাযহাব কর্তৃক গ্রহণীয় মতামতের বাইরে যাবেন না। মাযহাবে যেটি আছে সেটির ভিত্তিতেই ফতওয়া দেবেন। অথচ হক জিনিসটা ভিন্ন মতের মধ্যেও থাকতে পারে।

এজন্য সকল মুজতাহিদ ইমামের কথাগুলো পর্যালোচনা করে যার কথা অধিক শুদ্ধ হবে এবং সহীহ দলীলের কাছাকাছি হবে তার কথা মেনে নেয়ার মানসিকতা যাদের রয়েছে তারাই কেবল সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।

৪৬
ইসলামের সঠিক জ্ঞান কোথায় পাব
১. আল্লাহর কালাম তথা কুরআন :

ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম সিলেবাস হচ্ছে কুরআন অধ্যয়ন করা। কেননা কুরআন হচ্ছে এমন এক নির্ভুল গ্রন্থ, যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। কুরআন থেকে যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করবে সে সঠিক জ্ঞানই অর্জন করবে।

কুরআন পড়লে কোন্টি সত্য, কোন্টি মিথ্যা, কোন্টি হক, কোন্টি বাতিল এবং কোন্টি ভালো ও কোন্টি মন্দ তা জানতে পারবে। আল্লাহর এ বাণীসমূহ মানুষকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসে। কেননা এ কুরআন হলো হেদায়াতের কিতাব। যেমন- কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿ يَهْدِيْۤ إِلَى الْحَقِّ وَإِلٰى طَرِيْقٍ مُّسْتَقِيْمٍ ﴾

এটা মানুষকে সঠিক এবং সোজা পথ দেখিয়ে দেয়। (সূরা আহকাফ- ৩০)

﴿ إِنَّ هٰذَا الْقُرْاٰنَ يَهْدِيْ لِلَّتِيْ هِيَ أَقْوَمُ ﴾

নিশ্চয় এ কুরআন নির্ভুল ও সোজা পথটি দেখিয়ে দেয়। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৯)

কুরআনই হেদায়াত লাভের মূল উৎস :

কুরআনের হেদায়াতই হচ্ছে আসল হেদায়াত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

تَرَكْتُ فِيْكُمْ اَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهٖ

‘‘আমি তোমাদের কাছে দু’টি জিনিস রেখে গেলাম। যতদিন পর্যন্ত তোমরা এ দু’টিকে আঁকড়ে ধরবে ততদিন পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাত।’’ [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৫৯৫; মিশকাত, হা/১৮৬; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৯৯৩; দার কুতনী, হা/৪৬০৬।]

আবু শুরাইহ (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমরা কি এ সাক্ষ্য দাও না যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল? আমরা বললাম, হ্যাঁ। এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন,

اِنَّ هٰذَا الْقُرْاٰنَ سَبَبٌ طَرْفُهٗ بِيَدِ اللهِ وَطَرْفُهٗ بِاَيْدِيْكُمْ فَتَمَسَّكُوْا بِهٖ فَاِنَّكُمْ لَنْ تَضِلُّوْا وَلَنْ تُهْلِكُوْا بَعْدَهٗ اَبَدًا

এ কুরআন হলো একটি রশি। এর এক মাথা হচ্ছে আল্লাহর হাতে, আর অপর মাথা হচ্ছে তোমাদের হাতে। সুতরাং তোমরা এটাকে আঁকড়ে ধরো। তাহলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না এবং ধ্বংসও হবে না। [সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১২২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৭৯৪২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১২২; মুসান্নাফে ইবনে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩০৬২৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৮।]

কুরআনের মধ্যে রয়েছে পূর্ববর্তীদের ইতিহাস, রয়েছে ভবিষ্যতের সংবাদ, এটা ফায়সালাদানকারী। এটাকে বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি অন্য কোথাও হেদায়াত অনুসন্ধান করবে আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন। এটা আল্লাহর এক মজবুত রশি এবং জ্ঞানময় উপদেশ। আর এটাই হলো সিরাতে মুস্তাকীম বা সোজা পথ। এর আশ্চর্যকারিতা কখনো শেষ হয় না। জ্ঞানার্জনকারীরা এর থেকে কখনো বিমুখ হয় না। এটা বার বার পাঠ করলেও বিরক্তি আসে না। জিনেরা এটা শোনার পর একথা না বলে পারেনি যে, আমরা এমন এক আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথের সন্ধান দেয়। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। [সূরা জিন- ১, ২।] যে ব্যক্তি কুরআন দিয়ে কথা বলবে সে সত্য বলবে। যে কুরআনের উপর আমল করবে সে এর প্রতিদান পাবে। যে এর মাধ্যমে বিচার করবে সে ইনসাফ করবে। যে এটাকে আঁকড়ে ধরবে সে সঠিক পথের সন্ধান পাবে। [দারেমী, হা/৩৩৭৪; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৩৬; তিরমিযী, হা/২৯০৬।]

২. রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস :

কুরআন যেহেতু সংক্ষিপ্ত কিতাব, তাই এর ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এবং এর বাস্তব প্রয়োগ দেখিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ কে মানবজাতির কাছে প্রেরণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বাস্তব শিক্ষার মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামকে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ইন্তেকালের পর তাঁর এই শিক্ষাগুলো হাদীস গ্রন্থসমূহের মাঝে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাই একজন মুসলিমের দ্বিতীয় সিলেবাস হলো হাদীস অধ্যয়ন করা।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীসসমূহ হচ্ছে ইসলামের দ্বিতীয় মূলভিত্তি। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ইসলামের ব্যাপারে যা কিছু করতেন এবং বলতেন সবই আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত ওহীর মাধ্যমে করতেন এবং বলতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوٰى وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰى - اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْيٌ يُّوْحٰى﴾

তোমাদের সাথি পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিভ্রান্তও হয়নি। তিনি প্রবৃত্তি হতে কথা বলেন না। এটা তো এক ওহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা নাজম : ২-৪)

রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের পক্ষ হতে দ্বীনের মধ্যে কোন কম-বেশি করেননি এবং এটা তার জন্য করার সুযোগও ছিল না। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার উপর যে কিতাব নাযিল করেছেন এর হেফাযতের দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَاِنَّا لَهٗ لَحَافِظُوْنَ﴾

আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর- ৯)

দ্বীনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ যদি নিজের মনগড়া কিছু বলতেন বা নিজের থেকে কুরআনের সাথে কোন কিছু সংযোজন করতেন, তবে তিনিও আল্লাহর পাকড়াও থেকে রেহাই পেতেন না। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা অনেক কঠিন সতর্কবাণী দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيْلِ لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِيْنِ ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِيْنَ فَمَا مِنْكُمْ مِّنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِيْنَ ﴾

যদি রাসূল নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিত, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম এবং কেটে দিতাম তার শাহরগ। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকত না, যে তার থেকে আমাকে বিরত রাখতে পারে। (সূরা হা-ক্কাহ : ৪৪-৪৭)

নবীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা যত বিধিবিধান বান্দাদের উপর আরোপ করেছেন সেসব বিধিবিধান বাসত্মবায়ন করার জন্য সকল মুসলিম বাধ্য। কেননা নবীর নির্দেশগুলোও মূলত আল্লাহরই নির্দেশ। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আনুগত্য করে সে মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَنْ يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ اَطَاعَ اللهَۚ وَمَنْ تَوَلّٰى فَمَاۤ اَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا ﴾

যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল এবং যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিল তবে (মনে রেখো) তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রেরণ করিনি। (সূরা নিসা- ৮০)

নবীর নির্দেশকে মেনে চলার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ মর্মে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-

﴿وَمَاۤ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُۚ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْاۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾

রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে খুবই কঠোর। (সূরা হাশর- ৭)

অতএব উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পক্ষ থেকে ইসলামের ব্যাপারে যত কথা এবং কাজ আমরা জানতে পেরেছি তার উপর আমল করা এবং তা মেনে চলা মূলত আল্লাহরই নির্দেশ। এজন্য নবী ﷺ এর যত সহীহ হাদীস রয়েছে সেসকল সহীহ হাদীস অধ্যয়ন করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর অবশ্য কর্তব্য।

৩. সাহাবায়ে কেরামের আছার :

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পক্ষ থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা নবী ﷺ এর কাছ থেকে ইসলামের ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়ের বিধিবিধান সরাসরি শিখেছেন। এজন্য সাহাবায়ে কেরামের আছার তথা তাদের থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহও আমাদের জন্য অনুসরণীয়। তাদের কথাগুলোও বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে। এসকল হাদীসকে উসূলে ফিকহের পরিভাষায় মাওকূফ হাদীস বলা হয়।

আর সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ এরও নির্দেশ রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

42 - عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ يَقُوْلُ : قَامَ فِينَا رَسُوْلُ اللهِ ذَاتَ يَوْمٍ ، فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ، وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ ، وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ ، فَقِيلَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ، وَعَظْتَنَا مَوْعِظَةَ مُوَدِّعٍ ، فَاعْهَدْ إِلَيْنَا بِعَهْدٍ ، فَقَالَ : عَلَيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ ، وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا ، وَسَتَرَوْنَ مِنْ بَعْدِي اخْتِلاَفًا شَدِيدًا ، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي ، وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ ، عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ ، وَإِيَّاكُمْ وَالأُمُورَ الْمُحْدَثَاتِ ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ .

ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের মাঝে দন্ডায়মান হলেন। অতঃপর হৃদয়স্পর্শী একটি ভাষণ দিলেন। যার মাধ্যমে হৃদয় কেঁপে উঠল এবং চক্ষু থেকে অশ্রু প্রবাহিত হলো। এরপর তাঁকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন ভাষণ দিলেন, মনে হচ্ছে যে, তা শেষ ভাষণ। সুতরাং আপনি আমাদেরকে কিছু উপদেশ দিন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহকে ভয় করবে। খলিফার আদেশ শ্রবণ করবে এবং তার আনুগত্য করবে, যদিও সে একজন কালো গোলাম হয়। অচিরেই তোমরা আমার পর অনেক মতবাদ দেখতে পাবে। তাই তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাতকে এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। (আমার এবং আমার সাহাবীদের আদর্শকে) তোমরা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। সাবধান! অবশ্যই তোমরা বিদআত থেকে অর্থাৎ নব আবিষ্কৃত আমল থেকে দূরে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত আমল গুমরাহী। [ইবনে মাজাহ, হা/৪২; জামেউস সগীর, হা/৪৩১৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৭৩৫; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩২৯।]

একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন যে, অনেক লোক আল্লাহর নবীর নামে মনগড়া হাদীস তৈরি করেছে। এজন্য হাদীস গ্রন্থসমূহে অনেক বানোয়াট এবং দুর্বল হাদীস রয়েছে। এসব হাদীসগুলোকে যাচাই-বাছাই করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা কিছু লোককে তৈরি করেছেন। তারা হাদীসের সনদ (হাদীসের বর্ণনা সূত্র) যাচাই-বাছাই করে সহীহ হাদীসসমূহ নির্বাচন করেছেন। এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর নবীর সহীহ হাদীসসমূহ জানা এবং এগুলোর উপরই আমল করা। আর যেসকল বানোয়াট এবং দুর্বল হাদীস সমাজে প্রচলিত রয়েছে এবং যেগুলোর উপর আমল চলছে তা থেকে মানুষকে সতর্ক করা।

৪. কুরআন ও সুন্নার সহীহ দলীল সম্পন্ন বই-পুস্তক :

বিভিন্ন যুগে আল্লাহ তা‘আলা এমন অনেক লোক তৈরি করেছেন, যারা ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য এবং ইসলামের নামে যতসব বিভ্রান্তি সমাজে চালু আছে তা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য কাজ করে গেছেন। তারা আজীবন পরিশ্রম করে দ্বীনের সঠিক দাওয়াত মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তারা কুরআন ও সুন্নার আলোকে অনেক বই-পুস্তকও রচনা করেছেন। সুতরাং সহীহ ইলম ও আকীদা সম্পন্ন আলেমগণের বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত বই-পুস্তক পড়ে আমাদেরকে ইসলামের জ্ঞানার্জন করতে হবে।

অনেকে ইসলামের নামে দলীলবিহীন অনেক বই-পুস্তক রচনা করেছেন। আবার অনেকে হাদীস যাচাই-বাছাই করা ছাড়াই বানোয়াট ও দুর্বল হাদীস দিয়ে বই-পুস্তক রচনা করেছেন। এসব বই-পুস্তক থেকে আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে। আবার অনেক ভ্রামত্ম আকীদার বই বাজারে আছে। এসব থেকেও আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে।

৪৭
সঠিক লোকের কাছ থেকে দ্বীন শিখতে হবে
وَعَنِ ابْنِ سِيْرِيْنَ قَالَ إِنَّ هٰذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ فَانْظُرُوْا عَمَّنْ تَأْخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ

তাবেঈ ইবনে সীরীন (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় এ (সনদের) ইলম হচ্ছে দ্বীন। অতএব তোমরা লক্ষ্য রাখবে যে, তোমাদের দ্বীন কার নিকট হতে গ্রহণ করছ। [সহীহ মুসলিম, হা/২৬; সুনানে দারেমী, হা/৪২৪; মিশকাত, হা/২৭৩।]

উল্লেখিত আছার থেকে বুঝা যায় যে, দলীল-প্রমাণাদি ছাড়া দ্বীনের কোন বিষয় গ্রহণযোগ্য নয়। এক সময় এমন ছিল মানুষ সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না, অতঃপর যখন ফেতনা সংঘটিত হলো অর্থাৎ- সুফিবাদী ও অন্যান্য ইসলাম বিধ্বংসীরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নামে মিথ্যা হাদীস তৈরি করতে শুরু করল, তখন মুহাদ্দিসগণের কাছে কোন ব্যক্তি হাদীস বর্ণনা করলে তারা সে হাদীসের রাবীদের নাম উল্লেখ করতে বলতেন। অতঃপর রাবীদেরকে সুন্নাতের অনুসারী পেলে তাদের হাদীস গ্রহণ করতেন আর বিদআতী হিসেবে পেলে তাদের হাদীস প্রত্যাখ্যান করতেন। আর তারা মানুষদেরকে হাদীসের সনদের প্রতি খেয়াল করতে উৎসাহিত করতেন ও সতর্ক করতেন।

মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রহ.) ছিলেন একজন বিখ্যাত তাবেঈ। স্বপ্নের ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ। তার এ উক্তির উদ্দেশ্য হলো, ইলমে হাদীস দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। আর দ্বীন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এর উপর মানুষের নীতি-আদর্শ নির্ভর করে। কারো দ্বীন সঠিক না হলে সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব, দ্বীন গ্রহণ করার পূর্বে লক্ষ্য করতে হবে, যার নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করা হচ্ছে, তিনি মুত্তাকী এবং হকপন্থী কি না? যে কারো থেকে দ্বীন গ্রহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ উস্তাদের আকীদা, আমল ও আখলাকের প্রভাব ছাত্রের উপর পড়াটা স্বাভাবিক।

পথভ্রষ্টদের অনুসরণ করা যাবে না :

وَعَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ يَا مَعْشَرَ الْقُرَّاءِ اسْتَقِيمُوا فَقَدْ سَبَقْتُمْ سَبْقًا بَعِيدًا فَإِنْ أَخَذْتُمْ يَمِينًا وَشِمَالًا لَقَدْ ضَلَلْتُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا

হুযায়ফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি (তাবেঈদের উদ্দেশ্যে) বলেন, হে কুরআনধারী (আলেম) গণ! সহজ-সরল পথে চলো। কেননা (প্রথমে দ্বীন গ্রহণ করার কারণে পরবর্তীদের তুলনায়) তোমরা অনেক অগ্রসর হয়েছ। অপরপক্ষে তোমরা যদি (সরল পথ বাদ দিয়ে) ডান ও বামের পথ অবলম্বন কর, তাহলে পথভ্রষ্ট হয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হবে। [সহীহ বুখারী, হা/৭২৮২; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৯৫৬; মুসনাদে ইবেন আবি শায়বা, হা/৩৫৯৪৭; মিশকাত, হা/২৭৪।]

৪৮
মুসলিম জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
কুরআনের নির্দেশ হলো لَا تَفَرَّقُوْا (লা- তাফার্রাকূ) তোমরা বিভক্ত হয়ো না। [সূরা আলে ইমরান- ১০৩।] অথচ আমরা পবিত্র কুরআনের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ অমান্য করে বিভিন্ন দলে ও মতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের সংহতিকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেছি। লক্ষ লক্ষ ইট দিয়ে যে ঘর তৈরি হয় আর সে ঘরের বিভিন্ন স্থানে যদি ফাটল ধরে, তাহলে সে ঘরের যে অবস্থা হয়, আমাদের অবস্থাটাও ঠিক তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ مُوسٰى ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : إِنَّ الْمُؤْمِنَ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهٗ بَعْضًا وَشَبَّكَ أَصَابِعَهٗ

আবু মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য একটি প্রাচীরের ন্যায়। তারা একে অপরের দ্বারা শক্তি অর্জন করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে প্রবেশ করালেন। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮১, ২৪৪৬, ৬০২৬; সহীহ মুসলিম, হা/৬৭৫০; তিরমিযী, হা/১৯২৮; নাসাঈ, হা/২৫৬০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৬৪১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৩১; মুসনাদুল বাযযার, হা/৩১৮২; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৭৩২১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১০৪০; বায়হাকী, হা/১১২৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩০৯৮৫; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৮০৮।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : مَثَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ فِيْ تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكٰى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعٰى لَه سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمّٰى

নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়ার্দ্রতা ও সহানুভূতির দিক থেকে মুমিনদের উদাহরণ একটি মানব দেহের ন্যায়- যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয় তখন তার সমস্ত দেহ জ্বর ও অনিদ্রা ডেকে আনে। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৭৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৪০৪; মুসনাদে তায়ালুসী, হা/৮২৭; মু‘জামুস সগীর, হা/৩৮২; বায়হাকী, হা/৬২২৩; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৪৫৯; মুসনাদে ইবনে জাদ, হা/৬০৫; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৯৬১; জামেউস সগীর, হা/১০৭৮৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১০৮৩।]

মানুষের শরীরের কোন অঙ্গে আঘাত লাগলে যেমনিভাবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গও ব্যথিত হয়, ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বের যে কোন জায়গা থেকেই হোক না কেন একজন মুসলিম অপর মুসলিমের কষ্টে ব্যথিত হবে। এমনকি সামর্থ্যানুযায়ী সর্বশক্তি দিয়ে তার দুঃখ মোচনের জন্য এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা কি তা করি? ব্যথিত হওয়া তো দূরের কথা, উপরমত্মু কেমন করে সে আরো বিপদে পড়বে সে কামনাই করে থাকি। মনে মনে আনন্দবোধ করি। একজনের উন্নতি দেখে অন্যজন হিংসায় জ্বলে যাই। অথচ মুখে গর্ব করে বলি যে, আমরা মুসলিম। আমরা সবাই ভাই ভাই।

কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় একদল অন্য দলকে উচ্ছেদ করতে চায়। লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্ত নিয়ে খেলতে হয় খেলবে, লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে গৃহহারা করতে হয় করবে। লক্ষ লক্ষ বোনের ইজ্জত নষ্ট করতে হয় করবে, অসংখ্য প্রতিভাকে চিরতরে বিদায় দিতে হয় দেবে। স্বামীহারা নারীর আর্তচিৎকারে, পুত্রহারা জননীর বুক ফাটা ক্রন্দনে, বাচ্চাদের করুণ আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কেঁপে যায় যাক, তবুও গদী দখল করতেই হবে অথবা পৃথিবীর উনণত শহরে একটা বাড়ি কিনতেই হবে। এসবই হচ্ছে বিশ্বের বর্তমান অবস্থা।

এ পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে সব দলের মূলে আছেন একজন করে রাজনৈতিক নেতা। ধর্মের নামেও যত দল তৈরি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে এগুলোর মূলেও আছেন এক একজন করে ধর্মীয় নেতা। ধর্মীয় নেতারা কুরআন ও হাদীসকে কেন্দ্র করে বিভিন্নরূপে ও বিভিন্ন ঢঙে নিজেদের মতবাদ প্রচার করেছেন বলেই এত ধর্মীয় দল তৈরি হয়েছে।

সর্বপ্রথম মাযহাবী দলাদলির সৃষ্টি হয় মহামতি ইমামদেরকে কেন্দ্র করে। কোন ইমামই প্রিয় নবী ﷺ এর ২৩ বছরের সমগ্র হাদীস সংগ্রহ করতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে কিয়াসের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। যিনি যত কম হাদীস সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁকে ততবেশি কিয়াস করতে হয়েছিল। অবশ্য প্রত্যেক ইমাম বলে গেছেন যে, আমাদের এই কিয়াসগুলোকে আল্লাহর নবীর হাদীসগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখো। যদি মিলে যায় তবে উত্তম, আর যদি না মিলে, তাহলে আমাদের অভিমত বাদ দিয়ে আল্লাহর নবীর সিদ্ধান্তকেই গ্রহণ করবে। কিন্তু পরবর্তী যুগে তা আর হলো না। ইমামগণের তিরোধানের পর তাঁদের অনুসারীরা যখন পৃথক পৃথকভাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন দেখা গেল যে, অতিভক্তির কারণে তারা আপন আপন উস্তাদের সিদ্ধান্তগুলোকে সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে আলেম তৈরির কারখানাও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল।

ধর্মের নামে পরবর্তী যুগে শত শত দল সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এ সবের মূলে যে শিক্ষার অভাব- তা নয়। শিক্ষিতের হার আমাদের মধ্যে বেড়েই চলেছে। এ সবের পরও দলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তার একমাত্র কারণ শিক্ষিত ব্যক্তিরা এক একটি দলের মাথা হিসেবে কাজ করেন। আর এর ফলস্বরূপ মুসলিম জাতি থেকে ভ্রাতৃত্ববোধ উঠে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে বহু গণ্য-মান্য আলেমকে দেখা যায়, সারা জীবন ধরে তাঁরা অন্য দলের বিরুদ্ধে বই-পুস্তক লিখে কলমের কালি ক্ষয় করে গেছেন। কোন্ দলের আলেমের পেছনে সালাত হবে না, কোন্ মুহাদ্দিসের কাছে হাদীস পড়া হারাম, কোন্ দলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়া যাবে না, কোন্ দলের দাওয়াত গ্রহণ করা যাবে না ইত্যাদি নিয়েই তাদের মাথা ব্যথা বেশি।

আলেম সমাজ যদি মাযহাবী ঝগড়া বাদ দিয়ে পবিত্র, কুরআন ও হাদীসের মৌলিক নীতিতে এক হয়ে মুসলিম ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁদের পান্ডিত্যকে কাজে লাগাতেন, তাহলে এত দলাদলি থাকত না। এই দলাদলিই যে আমাদেরকে অধঃপতনের অতল তলে নিক্ষেপ করেছে তা সহজেই বুঝা যায়।

৪৯
মুসলিম জাতির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা
ইসলাম বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব চায়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহবান করেছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

﴿ وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا ﴾

আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০৩)

আল্লাহর রশি বলতে তাঁর দ্বীনকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনকে রশির সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে- এটি এমন একটি সম্পর্ক, যা একদিকে আল্লাহর সাথে ঈমানদারদের সম্পর্ক জুড়ে দেয়। অন্যদিকে সমস্ত ঈমানদারদেরকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে জামাআতবদ্ধ করে। এ রশিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার তাৎপর্য হচ্ছে, মুসলিমরা দ্বীনকেই আসল গুরুত্বের অধিকারী মনে করবে, সে ব্যাপারেই আগ্রহ পোষণ করবে, তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে এবং পরস্পরের সহযোগিতা করবে। যেখানেই মুসলিমরা দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে এবং তাদের সমগ্র দৃষ্টি খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেখানেই অনিবার্যভাবে তাদের মধ্যে দলাদলি ও মতবিরোধ দেখা দেবে, যা ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীর উম্মতকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছনার গর্তে নিক্ষেপ করেছিল।

ঐক্যবদ্ধ না হলে দুশমনদের মোকাবেলায় বিজয় লাভ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-

﴿ وَاَطِيْعُوا اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَلَا تَنَازَعُوْا فَتَفْشَلُوْا وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ وَاصْبِرُوْاؕ اِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ ﴾

তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, নতুবা তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। অতএব তোমরা ধৈর্যধারণ করো; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা আনফাল- ৪৬)

এ আয়াতে বলা হয়েছে পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হলে তা কাপুরুষ ও হীনমন্যতা সৃষ্টি করে এবং শত্রুদের অমত্মর থেকে মুসলিমদের প্রভাব দূর হয়ে যায়। এ কারণেই পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে মুসলিম জাতির মধ্যে বিভক্তি ও দলাদলি সৃষ্টি করার কঠোর প্রতিবাদ করা হয়েছে।

ইসলামে যে কারো নামে কারো জন্য কোনরূপ দল উপদলে বিভক্ত হওয়া নিষিদ্ধ। কুরআনে বলা হয়েছে-

﴿ اِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍؕ اِنَّمَاۤ اَمْرُهُمْ اِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ ﴾

নিশ্চয় যারা দ্বীনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে পড়েছে, তাদের উপর তোমার কোন দায়িত্ব নেই; তাদের বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন। (সূরা আনআম- ১৫৯)

দ্বীনের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা মুশরিকদের কাজ, কোন মুমিনের কাজ নয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

﴿ وَلَا تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ مِنَ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًاؕ كُلُّ حِزْبٍ ۢبِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُوْنَ ﴾

তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা তাদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করে নিয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর প্রত্যেক দলই নিজ নিজ অনুসৃত নিয়ম নিয়েই উল্লাসিত। (সূরা রূম- ৩১, ৩২)

এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তোমরা মুশরিকদের অমত্মর্ভুক্ত হয়ো না, যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। কেননা বিচ্ছিন্ন হওয়াটা মুশরিকদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর অনুপ্রবেশ যাতে মুসলিমদের মাঝে না ঘটে সেজন্যই এ আদেশ করা হয়েছে।

এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে, যখন বিভিন্ন দল তৈরি হয়ে যায়, তখন প্রতিটি দলই নিজেদেরকে সঠিক মনে করে। বাসত্মবেও তাই। আমরা দেখি, যখন কোন ফিরকা তৈরি হয়, তখন প্রত্যেক ফিরকা নিজেদেরকে সঠিক ও অন্যদেরকে বেঠিক প্রমাণ করার জন্য বিভিন্নভাবে কুরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা করে থাকে। আর এ কাজগুলো কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যাদের কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে জ্ঞান আছে, তাদেরই একটি বিভ্রামত্ম অথবা স্বার্থবাদী দল এ কাজটি করে থাকে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

﴿ وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتَابَ اِلَّا مِنْ ۢبَعْدِ مَا جَآءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ ﴾

যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও তাদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল। (সূরা বায়্যিনাহ- ৪)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿ وَمَا تَفَرَّقُوْاۤ إِلَّا مِنْ ۢبَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا ۢبَيْنَهُمْ ﴾

তাদের নিকট (তাওহীদের জ্ঞান) আসার পরও শুধুমাত্র পারস্পরিক বাড়াবাড়ির কারণে তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। (সূরা শূরা- ১৪)

অর্থাৎ বিভেদের কারণ এ ছিল না যে, আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠাননি এবং কিতাবও নাযিল করেননি। তাই সঠিক পথ না জানার কারণে মানুষ নিজেদের জন্য আলাদা-আলাদা ধর্ম ও জীবনাদর্শ আবিষ্কার করে নিয়েছে। বরং তাদের মধ্যে এই বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান আসার পর। তাই সেজন্য আল্লাহ দায়ী নন, বরং সেসব লোক নিজেরাই দায়ী, যারা দ্বীনের সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ থেকে দূরে সরে গিয়ে নতুন নতুন ধর্ম ও পথ বানিয়ে নিয়েছে। এই মতভেদ আল্লাহর বান্দাদের একটি বড় অংশকে দ্বীনের সুস্পষ্ট রাজপথ থেকে সরিয়ে বিভিন্নভাবে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। এমনকি এর ফলে রক্তপাতও ঘটছে।

এ দু’টি আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যুগে যুগে কারা কী জন্য আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনকে বিভক্ত করেছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকেও কঠোরভাবে সাবধান করেছেন যাতে আমরা তাদের মতো জেনে-বুঝে দলাদলি না করি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

﴿ وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ ۢبَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْبَيِّنَاتُؕ وَاُولٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ ﴾

তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আসার পরও মতভেদে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা আলে ইমরান- ১০৫)

এখানে পূর্ববর্তী নবীদের এমনসব উম্মতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা সত্য দ্বীনের সরল ও সুস্পষ্ট শিক্ষা লাভ করেছিল; কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর দ্বীনের মূল বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে দ্বীনের সাথে সম্পর্কবিহীন অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়াবলির ভিত্তিতে নিজেদেরকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। তারপর অবান্তর ও অহেতুক কথা নিয়ে এমনভাবে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, আল্লাহ তাদের উপর যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার কথা তারা ভুলেই গিয়েছিল এবং বিশ্বাস ও নৈতিকতার যেসব মূলনীতির উপর মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, তার প্রতি কোন আগ্রহই তাদের ছিল না।

আরো অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম জাতিকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার জন্য আদেশ করেছেন। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলিম জাতিকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ اللهَ يَرْضٰى لَكُمْ ثَلَاثًا وَيَكْرَهُ لَكُمْ ثَلَاثًا فَيَرْضٰى لَكُمْ أَنْ تَعْبُدُوْهُ وَلَا تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا وَأَنْ تَعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلَا تَفَرَّقُوْا وَيَكْرَهُ لَكُمْ قِيْلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তিনটি কাজ পছন্দ করেছেন এবং তিনটি কাজ অপছন্দ করেছেন। তোমাদের জন্য যে তিনটি কাজ পছন্দ করেছেন সেগুলো হলো :

১. তোমরা তাঁরই ইবাদাত করবে,

২. তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না এবং

৩. তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জু মজবুতভাবে ধারণ করবে ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।

আর তিনি তোমাদের জন্য তিনটি কাজ অপছন্দ করেছেন, সেগুলো হলো :

১. নিরর্থক কথাবার্তা বলা,

২. অধিক প্রশ্ন করা এবং

৩. সম্পদ বিনষ্ট করা। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৭৮; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৭৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৭০৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৭০৯৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/১০১]

৫০
ঐক্যের ভিত্তি
যারা ইসলামকে ভালোবাসেন তারা সকলেই ঐক্য চান। কিন্তু ঐক্যের ভিত্তি কী? সেক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নিম্নের আয়াতটিকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلْ يَاۤ اَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا اِلٰى كَلِمَةٍ سَوَآءٍ ۢبَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ اَلَّا نَعْبُدَ اِلَّا اللهَ وَلَا نُشْرِكَ بِه شَيْئًا وَّلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوا اشْهَدُوْا بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ ﴾

বলো, হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন একটি কালিমার দিকে আসো, যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে সমান। আর তা হলো, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করব না এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক স্থাপন করব না; আর আমাদের কেউ অপর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবে না। এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম। (সূরা আলে ইমরান- ৬৪)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঐক্যের মূলনীতি ঘোষণা করেছেন। আর তা হলো আকীদার ক্ষেত্রে শিরক না থাকা। আর যদি শিরক থাকে তাহলে তাদের সাথে ঐক্য হতে পারে না। এ বক্তব্যের সারনির্যাস হচ্ছে, এক আল্লাহকে ইলাহ্ ও রব বলে মেনে নাও। আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি, ক্ষমতা ও অধিকারে কাউকে শরীক করো না। আল্লাহর সামনে নিজেকে জবাবদিহি করতে হবে মনে করে আখিরাতের প্রতি ঈমান আনো। আল্লাহ তাঁর রাসূলদের ও কিতাবসমূহের মাধ্যমে যে মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন সে অনুযায়ী জীবনযাপন করো। এগুলোই চিরকাল আসল দ্বীন হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে এবং এখনো যথার্থ দ্বীন বলতে এগুলোকেই বুঝায়। জন্মের প্রথম দিন থেকে প্রত্যেক মানুষকে এ দ্বীনই দেয়া হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন যুগের লোকেরা তাদের নিজস্ব চিন্তা ও মানসিকতার ভ্রান্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাহায্যে অথবা নিজেদের প্রবৃত্তির প্রভাবে এ আসল দ্বীনকে বিকৃত করে বিভিন্ন প্রকার মতবাদ গড়ে তুলেছে। এ দ্বীনের মধ্যে তারা নতুন নতুন কথা মিশিয়ে দিয়েছে। নিজেদের কুসংস্কার, বিলাসিতা, আন্দাজ-অনুমান ও নিজেদের দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আকীদা বিশ্বাসে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে এবং কাটছাঁট করে তাকে পুরোপুরি বিকৃত করে দিয়েছে। অনেক নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে তার বিধানসমূহের সাথে জুড়ে দিয়েছে। মনগড়া আইন রচনা করেছে। আইনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে অযথা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। ছোটখাটো বিষয়গুলো নিয়ে মতবিরোধ করার ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। গুরুত্বপূর্ণকে গুরুত্বহীন ও গুরুত্বহীনকে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে দিয়েছে। যেসব নবী-রাসূল এ দ্বীন প্রচার করেছেন এবং যেসব মনীষীগণ এ দ্বীন প্রতিষ্ঠায় জীবনপাত করে গেছেন, তাদের কারো কারো প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করেছে; আবার কারো কারো প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং তাদের বিরোধিতা করেছে। এভাবে অসংখ্য ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেই চলছে। এদের প্রত্যেকটি ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব মানবসমাজকে কলহ, বিবাদ ও পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। এভাবে মানবসমাজ বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَإِنَّ بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلٰى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِىْ عَلٰى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوْا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, বনী ইসরাঈলরা ৭২টি দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে। আর একটি দল ছাড়া বাকি সবগুলোই জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? তিনি বললেন, আমি এবং আমার সাথিগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছি তারা। [তিরমিযী, হা/২৬৪১; জামেউস সগীর, হা/৯৪৭৪; মিশকাত, হা/১৭১।]

সুতরাং যে ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন ও সহীহ হাদীসকেই মূল ভিত্তি হিসেবে ঠিক করে নেয়, সে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম বিভাজনে বিশ্বাস করে না। ইসলাম সর্বদা সকলকে এক কাতারে দেখতে চায়।

তাই আমাদের উচিত কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ থাকা। সকল মত তথা মানুষের বানানো মনগড়া পথ ছেড়ে আল্লাহর নবীর দেখানো পথে এসে গেলে ইসলামে আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না।

৫১
আমাদের পরিচয় হলো আমরা মুসলিম
মানবজাতির ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই যারা তাওহীদ, আখিরাত ও রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আসছেন, তারা সকলেই মুসলিম ছিলেন। এ সত্য মিল্লাতের অনুসারীদেরকে কোন দিন ‘নূহী’ ‘ইবরাহিমী’ বা ‘মাসীহী’ ইত্যাদি বলা হয়নি বরং তাদের নাম ছিল ‘মুসলিম’ এবং আজও সবাই মুসলিম। তবে অতি দুঃখের বিষয় যে, আজকের মুসলিমরা তাদের এ প্রকৃত পরিচিতিমূলক নামটি ব্যবহার না করে ভিন্ন ভিন্ন নামে তাদের পরিচয় প্রকাশ করছে, যার ফলে গোটা মুসলিম উম্মাহ বিভক্ত হয়ে গেছে। ফলে সবাই মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে হিংসা-বিবাদ ও হানাহানি লেগেই আছে।

আমাদের পরিচয় আমরা মুসলিম। এর বাইরে আমাদের আর কোন পরিচয় নেই। কুরআন থেকে আমরা আমাদের মূল পরিচয় এটাই পাই। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ مِلَّةَ اَبِيْكُمْ اِبْرَاهِيْمَؕ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِيْنَ مِنْ قَبْلُ وَفِيْ هٰذَا ﴾

এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত। তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন ‘মুসলিম’ এবং এ কিতাবেও। (সূরা হাজ্জ– ৭৮)

এ আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, আমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে নামকরণ করেছেন। আর সেজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনে তা ঘোষণা করে দিয়েছেন এবং মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়াটাই পছন্দ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَمَنْ اَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّنْ دَعَاۤ اِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَّقَالَ اِنَّنِيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ﴾

কথায় ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।

(সূরা হা-মীম সাজদা- ৩৩)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেয়াকে পছন্দ করেছেন এবং মুসলিম অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهٖ وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)

আদম (আঃ) থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ ﷺ এর পূর্ব পর্যমত্ম সকল নবী-রাসূলগণ মুসলিম ছিলেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা তাদের কারো কারো পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তাদেরকেও মুসলিম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

নূহ (আঃ) মুসলিম ছিলেন :

﴿ وَاُمِرْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ﴾

{নুহ (আঃ) বলেছিলেন} আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যই আদিষ্ট হয়েছি। (সূরা ইউনুস- ৭২)

ইবরাহীম (আঃ) মুসলিম ছিলেন :

﴿ مَا كَانَ اِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَّلَا نَصْرَانِيًّا وَّلٰكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًاؕ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ ﴾

ইবরাহীম ইয়াহুদি বা নাসারা কিছুই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্তও ছিলেন না। (সূরা আলে ইমরান- ৬৭)

ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) মুসলিম হওয়ার দু‘আ করেছিলেন :

﴿ رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَاۤ اُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكْ وَاَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَاۚ اِنَّكَ اَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ ﴾

হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে মুসলিম বানিয়ে দিন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য হতেও আপনার অনুগত একদল লোক সৃষ্টি করে দিন। আর আমাদেরকে ইবাদাতের আহকাম বলে দিন এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন, নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (সূরা বাক্বারা- ১২৮)

ইয়াকূব (আঃ) এর সমত্মানরা মুসলিম ছিলেন :

﴿ وَوَصّٰى بِهَاۤ اِبْرَاهِيْمُ بَنِيْهِ وَيَعْقُوْبُؕ يَا بَنِيَّ اِنَّ اللهَ اصْطَفٰى لَكُمُ الدِّيْنَ فَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾

ইবরাহীম ও ইয়াকূব স্বীয় সন্তানদেরকে এ সদুপদেশ প্রদান করেছিল যে, হে আমার বংশধর! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে (জীবনব্যবস্থা হিসেবে) মনোনীত করেছেন। অতএব তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা বাক্বারা- ১৩২)

ইউসুফ (আঃ) মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার জন্য দু‘আ করেছিলেন :

﴿ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِؕ اَنْتَ وَلِيِّيْ فِى الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِۚ تَوَفَّنِيْ مُسْلِمًا وَّاَلْحِقْنِيْ بِالصَّالِحِيْنَ ﴾

হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! ইহকাল ও পরকালে তুমিই আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করো। (সূরা ইউসুফ- ১০১)

লূত (আঃ) এর পরিবারও মুসলিম ছিলেন :

﴿ فَاَخْرَجْنَا مَنْ كَانَ فِيْهَا مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ فَمَا وَجَدْنَا فِيْهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ الْمُسْلِمِيْنَ ﴾

সেখানে যারা মুমিন ছিল আমি তাদেরকে বের করে নিলাম। কিন্তু সেখানে লূত এর পরিবার ব্যতীত অন্য কোন মুসলিম পাইনি। (সূরা যারিয়াত- ৩৫, ৩৬)

মূসা (আঃ) মুসলিম ছিলেন :

﴿ وَقَالَ مُوْسٰى يَا قَوْمِ اِنْ كُنْتُمْ اٰمَنْتُمْ بِاللهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوْاۤ اِنْ كُنْتُمْ مُّسْلِمِيْنَ ﴾

মূসা বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাক এবং যদি তোমরা মুসলিম হও, তবে তোমরা তাঁর উপরই নির্ভর করো। (সূরা ইউনুস- ৮৪)

ঈসা (আঃ) মুসলিম ছিলেন :

﴿ وَاِذْ اَوْحَيْتُ اِلَى الْحَوَارِيِّيْنَ اَنْ اٰمِنُوْا بِيْ وَبِرَسُوْلِيْۚ قَالُوْاۤ اٰمَنَّا وَاشْهَدْ بِاَنَّنَا مُسْلِمُوْنَ ﴾

স্মরণ করো, যখন আমি হাওয়ারীদেরকে এ আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করো। তখন তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম। (সূরা মায়েদা- ১১১)

মুহাম্মাদ ﷺ ও মুসলিম ছিলেন :

﴿ اِنَّمَاۤ اُمِرْتُ اَنْ اَعْبُدَ رَبَّ هٰذِهِ الْبَلْدَةِ الَّذِيْ حَرَّمَهَا وَلَهٗ كُلُّ شَيْءٍ وَّاُمِرْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ﴾

নিশ্চয় আমি আদিষ্ট হয়েছি এ নগরীর প্রতিপালকের ইবাদাত করার জন্য, যিনি তাকে সম্মানিত করেছেন এবং সমস্ত কিছু তাঁরই জন্য। আর আমি আরো আদিষ্ট হয়েছি- যেন আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হই। (সূরা নামল- ৯১)

এখন কোন ব্যক্তি যদি প্রশ্ন করে- আপনি কে? তার উত্তরে আপনার বলা উচিৎ- আমি একজন মুসলিম। কেউ যদি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ.), অথবা ইমাম মালিক (রহ.) অথবা ইমাম শাফেয়ী (রহ.) অথবা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করে তবে কোন আপত্তি নেই । যদি কেউ কখনো ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর কথা গ্রহণ করে, কখনো আবু হানিফা (রহ.) এর মত গ্রহণ করে, তাতেও কোন আপত্তি নেই। কিন্তু একজন ঈমানদার ব্যক্তির মূল পরিচয় হলো সে একজন মুসলিম।

কিন্তু বর্তমানে আপনি যদি কিছু মুসলিমকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী? তখন কেউ বলে, আমি হানাফী, আমি শাফেয়ী, আমি মালিকী অথবা কেউ বলে আমি হাম্বলী। আমাদের প্রিয় নবী ﷺ ও তার সাথিগণ কী ছিলেন? তিনি কি শাফেয়ী ছিলেন? তিনি কি হাম্বলী ছিলেন? তিনি কি মালিকী ছিলেন? নাকি তিনি হানাফী ছিলেন? বরং তিনি ছিলেন একজন মুসলিম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَبِذٰلِكَ أُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ﴾

আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন অংশিদার নেই, আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম। (সূরা আনআম- ১৬২, ১৬৩)

কুরআন প্রমাণ করেছে যে, নূহ (আঃ) একজন মুসলিম, ইবরাহীম (আঃ) একজন মুসলিম, মূসা (আঃ) একজন মুসলিম, ঈসা (আঃ) একজন মুসলিম, মুহাম্মাদ ﷺ একজন মুসলিম। সকল যুগের সকল নবী-রাসূলগণ মুসলিম নামে পরিচয় দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصّٰى بِهٖ نُوْحًا وَّالَّذِيْۤ اَوْحَيْنَاۤ اِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهٖۤ اِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسٰى وَعِيْسٰۤى اَنْ اَقِيْمُوا الدِّيْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ﴾

তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন ঐ দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যে ব্যাপারে আমি তোমাকে ওহী করেছিলাম। আর যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা এ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে মতভেদ করো না। (সূরা শূরা- ১৩)

৫২
সঠিক পথ কোনটি
সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব আল্লাহর :

বান্দাকে হেদায়াত দানের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর। কেননা তিনি নিজেই এ দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করে থাকেন। তিনি বলেছেন,

﴿وَعَلَى اللهِ قَصْدُ السَّبِيْلِ وَمِنْهَا جَآئِرٌ وَّلَوْ شَآءَ لَهَدَاكُمْ اَجْمَعِيْنَ﴾

সরল পথ দেখানো আল্লাহর কাজ, কিন্তু পথগুলোর মধ্যে (অনেক) বক্র পথও রয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকেই সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন। (সূরা নাহল- ৯)

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ কথাও বলে দিলেন যে, পথের সংখ্যা অনেক। কিন্তু সবগুলো পথ সঠিক ও সরল নয়। যে পথটি তিনি বান্দাদেরকে প্রদর্শন করে থাকেন, কেবল সে পথটিই সঠিক পথ।

সঠিক পথ একটিই :

﴿وَاَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُۚ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهٖؕ ذٰلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ﴾

এ পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করো এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করো না, নতুবা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা আনআম- ১৫৩)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ خَطَّ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ خَطًّا ، ثُمَّ خَطَّ عَنْ يَمِيْنِه ، وَعَنْ شِمَالِه خُطُوْطًا ، ثُمَّ قَالَ : هٰذَا سَبِيْلُ اللهِ وَهٰذِهِ السُّبُلُ عَلَى كُلِّ سَبِيْلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُوْ إِلَيْهِ ﴿وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ ، وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِه ﴾

আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে (সিরাতে মুসত্মাকীম বুঝানোর জন্য) প্রথমে একটি সোজা দাগ দিলেন। আর বললেন এটা হলো আল্লাহর রাসত্মা। অতঃপর ডানে-বামে অনেকগুলো দাগ দিলেন এবং বললেন, এই রাসত্মাগুলো শয়তানের রাসত্মা। এ রাসত্মাগুলোর প্রতিটি রাসত্মার মুখে মুখে একটি করে শয়তান বসে আছে। তারা ঐ রাসত্মার দিকে মানুষদেরকে ডাকে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের কথার প্রমাণে উপরোল্লেখিত আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১৪২; তিরমিযী, হা/২৪৫৪; নাসাঈ, হা/১১১৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬, ৭; মুসনাদুল বাযযার, হা/১৬৭৪; মুসনাদুত তায়ালুসী, হা/২৪১; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩২৪১; সুনানে সা‘দ ইবনে মানসূর, হা/৯৩৫; দারেমী, হা/২০২; শারহুস সুন্নাহ, হা/৯৬; মিশকাত, হা/১৬৬।]

আমাদের দায়িত্ব :

বর্তমানে আমাদের মাঝে অনেক দল ও মতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ফলে সাধারণ মানুষও ফেতনায় পতিত হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন করে বসছে যে, এতগুলো দল ও মতের মধ্যে আমরা কোন দল বা মতের অনুসরণ করব? কিন্তু এ ধরনের অজুহাতে পরকালে মুক্তি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ স্পষ্টভাবেই এগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন এবং এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ ، قَالَ : صَلّٰى بِنَا رَسُوْلُ اللهِ - - ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً ۢبَلِيْغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَأَنَّ هٰذِه مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ : أُوصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّه مَنْ يَّعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখোমুখি হয়ে এমন একটি ভাষণ দিলেন, যা ছিল অত্যমত্ম হৃদয়স্পর্শী। এ ভাষণের ফলে চোখ অশ্রু প্রবাহিত করেছে এবং হৃদয় বিগলিত হয়েছে। তখন শ্রোতাদের মধ্যে একজন বলল, হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে এটি বিদায়ী ভাষণ। সুতরাং আপনি আমাদেরকে কিছু নসীহত করুন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার পর জীবিত থাকবে সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার তরীকা ও খোলাফায়ে রাশেদীনের তরীকা শক্তভাবে ধারণ করবে। মাড়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরবে। সাবধান! তোমরা নতুন নতুন আবিষ্কৃত ইবাদাত থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা নব আবিষ্কৃত সকল ইবাদাতই বিদআত। আর সকল বিদআতই গুমরাহী। [আবু দাউদ, হা/৪৬০৯; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩২৯; বায়হাকী, হা/২০১২৫; দারেমী, হা/৯৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/১০২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৭৩৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৭; জামেউস সগীর, হা/৪৩১৪; মিশকাত, হা/১৬৫।]

অন্য হাদীসে বলা হয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَيَأْتِيَنَّ عَلٰى أُمَّتِىْ مَا أَتٰى عَلٰى بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتّٰى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتٰى أُمَّه عَلَانِيَةً لَكَانَ فِىْ أُمَّتِىْ مَنْ يَصْنَعُ ذٰلِكَ وَإِنَّ بَنِىْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلٰى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِىْ عَلٰى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوْا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِىْ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের উপর ঐসকল অবস্থা অতিক্রম করবে, যা বনী ইসরাঈলদের উপর আবর্তিত হয়েছিল, যেভাবে (উভয় পায়ের) একটি জুতা আরেকটি জুতার সঙ্গে বরাবর হয়। এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ নিজের মায়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে যিনায় লিপ্ত হয়ে থাকে। তাহলে আমার উম্মতের মধ্যেও এমন লোক পাওয়া যাবে, যে ঐ কাজ করবে। আর নিশ্চয় বনী ইসরাঈল ৭২টি ফিরকায় বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত ৭৩টি ফিরকায় বিভক্ত হবে। তারা সকলেই জাহান্নামে যাবে, শুধুমাত্র একটি মিল্লাত (দল) ব্যতীত। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে মিল্লাত কোনটি? তিনি বললেন, তা হচ্ছে ঐ মিল্লাত, যার উপর আমি এবং আমার সাহাবীগণ প্রতিষ্ঠিত রয়েছি। [তিরমিযী, হা/২৬৪১; মুসত্মাদরাকে হাকেম হা/৪৪৪; জামেউস সগীর, হা/৯৪৭৪।]

এই হাদীসে আমাদের প্রতি পূর্ণ দিক-নির্দেশনা রয়েছে যে, যখনই বিভিন্ন দল, মত, ফিরকা, তরীকা ইত্যাদি দেখা দেবে তখনই সবকিছু বর্জন করে কেবল রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামের পথ অনুসরণ করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে তাদের কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। সুতরাং আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আমরা বর্তমানে কোন পথে আছি। আমাদের অনুসৃত পথটি কি রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তার সাহাবীদের পথ? নাকি নব উদ্ভাবিত অন্য কোন পথ। আমরা যে দল, মত বা পথের অনুসরণ করছি সেটা কি রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীদের যুগে ছিল? যদি না থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে সেগুলো বর্জন করতে হবে।

৫৩
হক পথ কোন্টি তা আমরা কীভাবে জানব
রাসূলুল্লাহ ﷺ তার বিদায় হজ্জের ভাষণে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ مَالِك أَنَّهٗ بَلَغَهٗ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّه

মালিক ইবনে আনাস (রহ.) হতে বর্ণিত। তার নিকট সংবাদ এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা শক্তভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো ‘কিতাবুল্লাহ’ (আল্লাহর কুরআন) ও নবী ﷺ এর সুন্নাহ (হাদীস)। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৩৩৩৮; সহীহ মুসলিম, হা/৩০০৯; মিশকাত, হা/১৮৬।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : إِنِّي قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ شَيْئَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُمَا : كِتَابَ اللهِ وَسُنَّتِيْ ، وَلَنْ يَتَفَرَّقَا حَتَّى يَرِدَا عَلَيَّ الْحَوْضَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে এমন দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ পর্যমত্ম তোমরা এ দু’টি জিনিস শক্তভাবে ধারণ করবে ততক্ষণ পর্যমত্ম গুমরাহ হবে না। সে দু’টি জিনিস হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও আমার সুন্নাহ (হাদীস)। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/২৬৪০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩১৯; জামেউস সগীর, হা/৫২৪৮।]

সুতরাং যদিও আমাদের মাঝে রাসূলুল্লাহ ﷺ বা সাহাবীদের কেউ উপস্থিত নেই, কিন্তু আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাত আমাদের মাঝে অবশ্যই বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ঐ দুটি কিতাব থেকেই ফায়সালা গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَى اللّٰهِ وَالرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِؕ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّاَحْسَنُ تَاْوِيْلًا﴾

অতঃপর তোমাদের মাঝে যদি কোন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, তাহলে সে বিষয়টি ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করে থাক; এটাই উত্তম এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অধিকতর উপযুক্ত।

(সূরা নিসা- ৫৯)

এ আয়াতে ‘আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও’ বলতে কুরআনুল কারীমকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও’ বলতে সহীহ হাদীসকে বুঝানো হয়েছে। অতএব কুরআন ও সুন্নার সহিত যার কথা মিলবে না তার কথা মানা যাবে না- সে যত বড় ব্যক্তিই হোক না কেন। আমরা কুরআন-সুন্নাহ দিয়ে আলেম-বুযুর্গ, মুরুববী, পীর-মাশায়েখ, ওলী-আওলীয়াদের পরিমাপ করব; ওলী-বুযুর্গদের দিয়ে কুরআন-সুন্নাহকে নয়। সমাজের মধ্যে দেখা যায় যে, মানুষদেরকে যখন কুরআন ও সুন্নার দিকে আহবান করা হয়, তখন তারা কুরআন ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে পীর-বুযুর্গ বা মুরুববীদেরকে অনুসরণ করে। আর বলে, এত বড় বড় আলেমরা কি কম বুঝেছেন? তারা কি ভুল করেছেন? ইত্যাদি। সাবধান! এ ধরনের কথা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং নির্দ্বিধায় কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসরণ করতে হবে। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে সে কথাই অসিয়ত করে গেছেন।

সিরাতুল মুসত্মাকীম বা সঠিক পথ চেনার অনেক উপায় রয়েছে। আমরা যদি সে পথের পরিচয় না জেনে বলি যে, সঠিক পথ পেলাম না, তবে সেটা আমাদের ভুল। এর দায় আমাদের উপরই বর্তাবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺও আমাদেরকে তা দেখিয়ে গেছেন। সূরা ফাতিহার মধ্যে আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট গুরুত্বপূর্ণ একটি আবেদন পেশ করে থাকি। আর তা হচ্ছে,

﴿اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ﴾

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিন। (সূরা ফাতিহা- ৬)

এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক পথ পাওয়ার জন্য দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে যে, সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার মালিক হচ্ছেন, আল্লাহ তা‘আলা। তিনি আমাদেরকে এ দু‘আ শিখিয়ে পরের আয়াতে সেই সঠিক পথটি কাদের এবং কারা সে পথে গত হয়েছে এবং বর্তমানে কারা সে পথে চলছে- এ বিবরণও দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّآلِّيْنَ﴾

তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন, যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ পতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়। (সূরা ফাতিহা- ৭)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, সঠিক পথ হচ্ছে তাদের পথ, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। এখন আমাদের প্রশ্ন থাকতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা কাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন? এ প্রশ্নের উত্তরও আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَاُولٰٓئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ اَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّالِحِيْنَۚ وَحَسُنَ اُولٰٓئِكَ رَفِيْقًا﴾

যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করবে, সে তো নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ এবং যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন তাদেরই সঙ্গী হবে। আর তারা কতই না উত্তম সঙ্গী! (সূরা নিসা- ৬৯)

صِدِّيْقٌ (সিদ্দীক) বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যে পরম সত্যনিষ্ঠ ও সত্যবাদী। তার মধ্যে সততা ও সত্যপ্রিয়তা পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করে। নিজের আচার-আচরণ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বদা সুস্পষ্ট ও সরল পথ অবলম্বন করে। সে সবসময় স্বচ্ছ মনে হক ও ইনসাফের সহযোগী হয়। সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী যে কোন বিষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সামান্যতম দুর্বলতাও দেখায় না। সে এমনই পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হয় যে, তার আত্মীয় অনাত্মীয়, বন্ধু-শত্রু, আপন-পর কেউই তার কাছ থেকে নিখুঁত সত্যপ্রীতি, সত্যের সমর্থন ও সত্যের সহযোগিতা ছাড়া আর কিছুরই আশঙ্কা করে না।

شَهِيْدٌ (শহীদ) শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে সাক্ষী। শহীদ বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যে নিজের জীবনের সমগ্র কর্মকান্ডের মাধ্যমে তার ঈমানের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। আল্লাহর পথে লড়াই করে প্রাণ উৎসর্গকারীকে এ কারণেই শহীদ বলা হয় যে, সে প্রাণ উৎসর্গ করে এ কথা প্রমাণ করে দেয় যে, সে যে জিনিসের উপর ঈমান এনেছিল তাকে যথার্থই সত্য মনে করত। তার কাছে দ্বীন এত বেশি প্রিয় ছিল যে, তার জন্য নিজের প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। আবার এমন ধরনের সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরকেও শহীদ বলা হয়, যারা এতই নির্ভরযোগ্য হয় যে, তারা কোন বিষয়ে সাক্ষ্য দিলে তাকে নির্দ্বিধায় সত্য ও সঠিক বলে স্বীকার করে নেয়া হয়।

صَالِحٌ (সালেহ) বা সৎকর্মশীল বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যে তার নিজের চিন্তাধারা, আকীদা-বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্য ও সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং নিজের জীবনে সৎ ও সুনীতি অবলম্বন করে।

এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, সঠিক পথে কারা হেটেছেন। সুতরাং আমাদেরকে তাদের পথেই হাটতে হবে। তাহলে আমরা সঠিক পথের সন্ধান পাব- ইনশাআল্লাহ।

৫৪
সঠিক পথ পাওয়ার উপায়
সঠিক পথ পাওয়ার জন্য কেবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেই হবে না, বরং সে পথ অনুসন্ধান করতে হবে এবং সকল উপায় উপকরণ অবলম্বন করতে হবে। যেমন- দুনিয়াতে আমরা দেখি যে, কেউ যদি ডাক্তার হতে চায় তবে সে ইচ্ছা করলেই ডাক্তার হতে পারে না। এজন্য তাকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারদের থেকে শিক্ষা অর্জন করতে হয়। তারপর চিকিৎসার যাবতীয় উপায়-উপকরণের ব্যবহার শিখতে হয়। তারপর সে রোগীর চিকিৎসা করতে পারে। অনুরূপভাবে কেউ যদি আল্লাহর সঠিক পথ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে এবং সঠিক পথ পাওয়ার যত মাধ্যম রয়েছে যেমন- কুরআন-সুন্নার জ্ঞান অর্জন করা, সঠিক আকীদা সম্পন্ন আলেম-উলামাদের থেকে দ্বীনের বিষয়ে পরামর্শ নেয়া, আল্লাহর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি অবলম্বন করলে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সঠিক পথ দেখাবেন। এ ওয়াদা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই করেছেন। যেমন, কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

﴿وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾

আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন। (সূরা আনকাবূত- ৬৯)

এ আয়াতে আমার পথসমূহ বলতে ইবাদাতের বিভিন্ন প্রকার যথা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত, ঈমান, ইসলাম, ইহসান, জিহাদ, কিতাল ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গ্রহণযোগ্য তাফসীরের কিতাবসমূহ থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো :

তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা আমার দ্বীনের সাহায্যার্থে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথসমূহ দেখাব অর্থাৎ তারা যে বিষয়ে যুদ্ধ করছে তার উপর অটল রাখব অথবা অবশ্যই তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দেব; যেভাবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, আর যারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে আল্লাহ তাদের হেদায়াত আরো বৃদ্ধি করেন। অথবা আমি তাদেরকে সঠিক পথ চেনার তাওফীক দান করব।

আইসারুত তাফসীর কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা আকীদা-বিশ্বাসকে বিশুদ্ধ করার জন্য, আত্মাকে শুদ্ধ করার জন্য ও উত্তম চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে; অতঃপর ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সকল কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার দিকে পথপ্রদর্শন করব অর্থাৎ আমার মুহাববত ও সমত্মুষ্টি অর্জনের সঠিক পথ চিনার তাওফীক দান করব এবং তা অর্জনের জন্য সাহায্য করব।

তাফসীরে রহুল মা‘আনীতে উল্লেখ করা হয়েছে, যারা শুধুমাত্র আমার পথে আমাকে সমত্মুষ্ট করার জন্য সকল প্রকার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে চলার ও আমার পর্যমত্ম পৌঁছানোর রাসত্মাসমূহ বাতলে দেব। অর্থাৎ সৎপথে চলা ও ভালো কাজ করার তাওফীক দান করব। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন, আর যারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে আল্লাহ তাদের হেদায়াত প্রাপ্তি আরো বৃদ্ধি করে দেন এবং তাদেরকে তাকওয়া প্রদান করেন।

তাফসীরে ইবনে আববাস- এ উল্লেখ করা হয়েছে, যারা নিজের ইলম অর্থাৎ জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে আমি অবশ্যই তাদের অজানাকে জানিয়ে দেব। অথবা অবশ্যই তাদের ঈমানের দৃঢ়তা, ঈমানের স্বাদ-আস্বাদন করানোর মাধ্যমে সম্মান করব। অথবা আমার আনুগত্যের তাওফীক দান করব।

৫৫
হকের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন দল বর্তমানে আছে কি
আল্লাহর নবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী কিয়ামত পর্যমত্ম একদল লোক হকের উপরে থাকার কথা রয়েছে। যেহেতু এই ভবিষ্যদ্বাণী রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, সেহেতু এ কথার সত্যতার মধ্যে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। সুতরাং সঠিক দল বা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত দল অবশ্যই পৃথিবীতে রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ قُرَّةَ ، عَنْ أَبِيهِ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ مَنْصُورِيْنَ ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ

মুআ‘বিয়া ইবনে কুররা (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল কিয়ামত পর্যমত্ম সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে, তাদের বিরোধীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হা/৬; তিরমিযী, হা/২১৯২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬১; মুসনাদুত তায়ালুসী, হা/১১৭২; জামেউস সগীর, হা/১৩২৪৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪০৩; মিশকাত, হা/৬২৮৩।]

এছাড়াও আরো অনেক হাদীসে বলা হয়েছে যে, কিয়ামত পর্যমত্ম একটি দল আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে। তারা কাউকে পরোয়া করবে না।

মুহাদ্দিসীনগণ এই দলটিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।

ইমাম বুখারী বলেন :

وَهُمْ أَهْلُ الْعِلْمِ

এরা হলেন ‘আহলুল ইলম’ অর্থাৎ উলামায়ে কেরাম। [সহীহ বুখারী, ‘‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বদা একটি দল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে যুদ্ধ করবে’’ নামক অধ্যায়।]

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেন :

إِنْ لَمْ يَكُوْنُوْا أَهْلَ الْحَدِيْثِ فَلَا أَدْرِيْ مَنْ هُمْ وَقَالَ الْقَاضِيْ عِيَاضُ أَرَادَ أَحْمَدُ أَهْلَ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ وَمَنْ يَّعْتَقِدُ مَذْهَبَ أَهْلِ الْحَدِيْثِ

এরা যদি হাদীসের অনুসারীরা না হয় তাহলে এরা কারা তা আমি জানি না।’’ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন, ‘‘ইমাম আহমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত এবং যারা হাদীসের অনুসারীদের মতানুযায়ী আকীদা পোষণ করে। [ফাতহুল বারি, ১/১৬৪।]

ইমাম নববী বলেন :

قُلْتُ وَيَحْتَمِلُ أَنَّ هٰذِهِ الطَّائِفَةَ مُتَفَرِّقَةٌ بَيْنَ أَنْوَاعِ الْمُؤْمِنِيْنَ مِنْهُمْ شُجْعَانٌ مُقَاتِلُوْنَ وَمِنْهُمْ فُقَهَاءُ وَمِنْهُمْ مُحَدِّثُوْنَ وَمِنْهُمْ زُهَّادٌ وَاٰمِرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَنَاهُوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَمِنْهُمْ أَهْلُ أَنْوَاعٍ أُخْرٰى مِنَ الْخَيْرِ وَلَا يَلْزَمُ أَنْ يَّكُوْنُوْا مُجْتَمِعِيْنَ بَلْ قَدْ يَكُوْنُوْنَ مُتَفَرِّقِيْنَ فِى أَقْطَارِ الْأَرْضِ

এটা হতে পারে যে, ইসলামের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এই দল ছড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী যোদ্ধা, ন্যায়বিচারকগণ, হাদীস বিশারদগণ। আরো রয়েছে এমন লোকেরা যারা গভীর ইবাদাতে মগ্ন এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার জন্য নিজেদেরকে পার্থিব জীবনের সামগ্রী থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং তাদের মাঝে অন্যান্য ভালো প্রকৃতির মানুষও রয়েছে। আর এটা আবশ্যক নয় যে, তাদেরকে একসাথে থাকতে হবে, বরং হতে পারে যে, তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়েও থাকবে। [শরহে নববী আলাল মুসলিম, ১৩/৬৭ পৃঃ।]

হকের উপর প্রতিষ্ঠিত দলের বিশেষ লক্ষণ :

হাদীসে এই দলটির বিশেষ একটি পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তা হলো তারা ‘যুদ্ধ’ করবে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ عَنِ النَّبِىِّ - - أَنَّهٗ قَالَ : لَنْ يَبْرَحَ هٰذَا الدِّيْنُ قَائِمًا يُقَاتِلُ عَلَيْهِ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ حَتّٰى تَقُوْمَ السَّاعَةُ

জাবির বিন সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, এই দ্বীন কিয়ামত পর্যমত্ম প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মুসলিমদের একটি দল সর্বদা দ্বীনের পথে যুদ্ধ করতে থাকবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১০২৩; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৬০৩৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৮৯৮; শারহুস সুন্নাহ, হা/৪০১২; জামেউস সগীর, হা/৯৩৫১, ৩৮০১।]

এ হাদীস থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, যদিও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন শ্রেণির লোকেরা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন, সেই হিসেবে তারা নাজাতপ্রাপ্ত দলের অমত্মর্ভুক্ত হয়ে পরকালে নাজাতপ্রাপ্তও হবেন। কিন্তু ‘আত তায়েফাতুল মানসুরাহ’ দ্বারা তাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর রাসত্মায় যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।

এ মর্মে হাদীসে আরো এসেছে,

حَدَّثَنَا يَزِيْدُ بْنُ الْأَصَمِّ قَالَ سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ بْنَ أَبِىْ سُفْيَانَ ذَكَرَ حَدِيْثًا رَوَاهُ عَنِ النَّبِىِّ لَمْ أَسْمَعْهُ رَوٰى عَنِ النَّبِىِّ - - عَلٰى مِنْبَرِه حَدِيْثًا غَيْرَه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : مَنْ يُّرِدِ اللّٰهُ بِه خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّيْنِ وَلَا تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ يُقَاتِلُوْنَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ عَلٰى مَنْ نَاوَأَهُمْ إِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

ইয়াযীদ ইবনে আসাম (রহ.) বলেন, আমি মু‘আবিয়া ইবনে আবূ সুফ্ইয়ান (রাঃ) কে এমন একটি হাদীস নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যা ছাড়া নবী ﷺ এর বরাতে অন্য কোন হাদীস মিম্বারের উপর থেকে বলতে তাঁকে আমি শুনিনি। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দিয়ে থাকেন। আর মুসলিমদের একটি দল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে লড়াই করবে। যারা তাদের প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করবে তাদের উপর তারা কিয়ামত পর্যমত্ম বিজয়ী থাকবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫০৬৫; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৬০৪১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৮৯৫।]

অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ --: لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِىْ يُقَاتِلُوْنَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ عَلٰى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتّٰى يُقَاتِلَ اٰخِرُهُمُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ

ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সর্বদা হকের পক্ষে যুদ্ধ করতে থাকবে। যারা তাদের বিরোধীদের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদেরই সর্বশেষ দলটি মাসিহে দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। [আবু দাউদ, হা/২৪৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৯৩৪; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২৩৯২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪৬৪৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৯৫৯; জামেউস সগীর, হা/১৩২৫০; মিশকাত, হা/৩৮১৯।]

অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنِ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ يَقُوْلُ سَمِعْتُ النَّبِىَّ - - يَقُوْلُ : لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِىْ يُقَاتِلُوْنَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ إِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ - قَالَ - فَيَنْزِلُ عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ - فَيَقُوْلُ أَمِيْرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا . فَيَقُوْلُ لَا . إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلٰى بَعْضٍ أُمَرَاءُ . تَكْرِمَةَ اللهِ هٰذِهِ الْأُمَّةَ

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের একটি দল হকের উপর যুদ্ধ করতে থাকবে, কিয়ামত পর্যমত্ম তারা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অতঃপর ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) অবতীর্ণ হবেন। মুসলিমদের আমীর বলবেন, সামনে আসুন এবং ইমামতি করুন। ঈসা (আঃ) বলবেন, না! বরং তোমরা একে অপরের ইমাম হবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এ উম্মতের জন্য সম্মানস্বরূপ। [সহীহ মুসলিম, হা/৪১২; বায়হাকী, হা/১৮৩৯৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬৮১৯; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৫; মুসনাদে উমর ইবনে খাত্তাব, হা/১১৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৭৬২; মু‘জামুল আওসাত, হা/৯০৭৮।]

উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে পরিষ্কারভাবে ‘আত তায়েফাতুল মানসুরাহ’ তথা সাহায্যপ্রাপ্ত দলের একটি বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে, তারা যুদ্ধ করবে এবং এরাই শেষ পর্যমত্ম ঈসা (আঃ) এর সঙ্গে মিলিত হয়ে দাজ্জালকে হত্যা করবে।

৫৬
সঠিক পথের অনুসারীদের সংখ্যা কম কেন
পৃথিবীতে হক পথের অনুসারীদের সংখ্যা কমই হবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পবিত্র কুরআনে হকের পক্ষে অল্প সংখ্যক লোক থাকবে বলে জানানো হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত তুলে ধরা হলো :

﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلَّا وَهُمْ مُّشْرِكُوْنَ﴾

তাদের অধিকাংশ লোক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্ত্বেও মুশরিক (অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে মুমিন মনে করলেও আসলে তারা মুশরিক)। (সূরা ইউসুফ- ১০২)

﴿بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يُؤْمِنُوْنَ﴾

বরং তাদের অধিকাংশই ঈমান রাখে না। (সূরা বাক্বারা- ১০০)

﴿وَلٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ﴾

কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। (সূরা আনআম- ৩৭)

﴿وَلٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ يَجْهَلُوْنَ﴾

কিন্তু তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ। (সূরা আনআম- ১১১)

﴿فَلَا يُؤْمِنُوْنَ اِلَّا قَلِيْلًا﴾

ফলে তাদের অল্প সংখ্যকই ঈমান আনয়ন করে থাকে। (সূরা নিসা- ৪৬)

﴿وَلَوْلَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهٗ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيْلًا﴾

আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত না থাকত, তাহলে অবশ্যই অল্প কয়েকজন ছাড়া তোমরা সকলেই শয়তানের অনুসরণ করতে। (সূরা নিসা- ৮৩)

﴿وَمَا ۤاٰمَنَ مَعَهٗۤ إِلَّا قَلِيْلٌ﴾

আর তার{নূহ (আঃ) এর} সাথে অল্পসংখ্যকই ঈমান এনেছিল। (সূরা হুদ- ৪০) এসকল আয়াত এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, যুগে যুগে হকের পক্ষে অল্প সংখ্যক লোকই অবস্থান নিয়েছে। আর বেশির ভাগ লোক তাদের অবজ্ঞা করেছে ও তাদের বিরোধিতা করেছে।

﴿وَإِنْ وَّجَدْنَاۤأَكْثَرَهُمْ لَفَاسِقِيْنَ﴾

তাদের অধিকাংশ লোককে আপনি ফাসিক (পাপাচারী) হিসেবেই পাবেন।

(সূরা আরাফ- ১০২)

﴿ أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُوْنَ أَوْ يَعْقِلُوْنَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيْلًا ﴾

তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ লোক শোনে অথবা বুঝে? তারা কেবল পশুর মতো বরং তারা আরো অধিক পথভ্রষ্ট। (সূরা ফুরকান- ৪৪)

উপরোক্ত আয়াতগুলো দ্বারা বুঝা গেল যে, লোকসংখ্যা বেশি হওয়া বা দলে ভারী হওয়া কোন সত্যের মাপকাঠি নয়।

হকের উপর প্রতিষ্ঠিত লোকের সংখ্যা কম হবে- এ মর্মে নবী ﷺ থেকে বর্ণিত হাদীস রয়েছে। যেমন-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - : بَدَأَ الْإِسْلَامُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَمَا بَدَأَ غَرِيْبًا فَطُوْبٰى لِلْغُرَبَاءِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ইসলাম অপরিচিত আগমত্মুকের অবস্থায় ফিরে যাবে। কতইনা সৌভাগ্য সেই ‘গোরাবাদের’ (অপরিচিত আগমত্মুকদের)। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৮৯; তিরমিযী, হা/২৬২৯; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯০৪২।]

৫৭
যেসব কারণে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়
কালক্রমে মানুষের হৃদয়ে বিভিন্নভাবে শিরক প্রবেশ করেছে এবং অধিকাংশ লোক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। যেসব কারণে মানুষ গুমরাহ হয় তার কিছু কারণ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :

১. কোন ব্যক্তির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা বা ভক্তি প্রদর্শন :

নূহ (আঃ) এর জাতির সীমালঙ্ঘনমূলক সম্মান প্রদর্শনের পরিণতিতে সর্বপ্রথম মানব ইতিহাসে একত্ববাদের অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্মে গৌতম বুদ্ধ এবং খ্রিস্টধর্মে ঈসা (আঃ) কে অনুরূপ উপাসনার বসত্মুতে পরিণত করা হয়েছে। অতিরিক্ত মর্যাদা দেখাতে গিয়ে মানুষ সৃষ্টিকে সঠিক স্থান থেকে উচ্চে তুলে ধরে এবং এক পর্যায়ে তার উপাসনা শুরু করে দেয়।

ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হচ্ছে, সব ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা ও সীমালঙ্ঘন না করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ ধর্মীয় ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন বা অতিরঞ্জন করা থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন,

يَا اَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ ، فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِي الدِّينِ

হে লোকসকল! তোমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে, তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জন করা থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধর্মের ব্যাপারে অতিরঞ্জনের কারণেই ধ্বংস হয়েছে। [ইবনে মাজাহ, হা/৩০২৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩২৪৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৫১৪০।]

অপর হাদীসে রয়েছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ سَمِعَ عُمَرَ ، يَقُولُ عَلَى الْمِنْبَرِ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُولُ لَا تُطْرُوْنِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهٗ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি উমর (রাঃ) কে মিম্বারে দাঁড়িয়ে বর্ণনা করতে শুনেছেন যে, আমি নবী ﷺ কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমার প্রশংসা করতে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আঃ) সম্পর্কে করেছিল নাসারারা। আমি একমাত্র আল্লাহর দাস। সুতরাং তোমরা বলবে, আল্লাহর দাস ও তাঁর রাসূল। [সহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৪; মুসনাদুত তায়ালুসী, হা/২৪; দারেমী, হা/২৭৮৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৮১; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১৫৩; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৩০; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/২০৫২৪।]

কোন ব্যক্তির উপর মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার ফলাফল তার মৃত্যুর পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কবরের উপরই প্রকাশ পায়। ভক্তরা তার কবরকে উপাসনার স্থান বানিয়ে নেয়, এমনকি একসময় তারা তার নিকট সিজদা করা, কুরবানী করা, প্রার্থনা করা ইত্যাদি শিরকী কাজসমূহ করতে শুরু করে। এভাবে এটি একটি ইবাদাতে রূপ নেয়। মৃতের প্রতি প্রদর্শিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি যাতে ইবাদাতে রূপ না নেয় সেজন্য ইসলাম এ সংক্রামত্ম সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যেমন- কবরের উপর মসজিদ বা কোন কাঠামো তৈরি করা ইত্যাদি। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ ، قَالَ : نَهٰى رَسُوْلُ اللهِ أَنْ يُّبْنٰى عَلَى الْقَبْرِ ، أَوْ يُجَصَّصَ ، أَوْ يَقْعُدَ عَلَيْهِ ، وَنَهٰى أَنْ يُكْتَبَ عَلَيْهِ

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে কবরের উপর সৌধ নির্মাণ করতে, কবরকে পাকা করতে এবং তার উপর কিছু লিখতে নিষেধ করেছেন। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৩৬৯; নাসাঈ, হা/২০২৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৫৭৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩১৬৩।]

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, নবী ﷺ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর স্ত্রীদের একজন মারিয়া নামক একটি গীর্জা বা উপাসনালয়ের কথা তাঁকে বললেন, যা তিনি (নবী ﷺ এর স্ত্রী) হাবশাহ্ দেশে দেখেছিলেন। (তাঁর স্ত্রীদের মাঝে) উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা হাবশায় গিয়েছিলেন। তাঁরা দু’জনই এ গীর্জার সৌন্দর্য ও চাকচিক্য এবং ভেতরের চিত্রসমূহের বর্ণনা দিলেন। (এসব কথা শুনে) নবী ﷺ তাঁর মাথা তুলে বললেন, ঐসব (হাবশাবাসী) লোকদের মাঝ থেকে কোন সৎলোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করতো এবং তাদের ছবি নির্মাণ করে এর মাঝে রাখত। ঐসব ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। [সহীহ বুখারী, হা/১৩৪১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩১৭১; শারহুস সুন্নাহ, হা/৫০৯।]

২. প্রতিমা ও প্রতিকৃতি নির্মাণ :

সর্বপ্রথম শিরকের সূচনা হয়েছিল মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে প্রতিমা তৈরির মাধ্যমে। এরপরেও নির্দোষ শিল্পকলার নামে অংকিত ও খুদাইকৃত প্রতিকৃতির হাত ধরে পৌত্তলিকতা ও শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এসব কারণে ইসলামে জীবের প্রতিকৃতি নির্মাণ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُوْنَ

কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সেসব লোকই সর্বাপেক্ষা শাস্তি ভোগ করবে, যারা প্রতিমা নির্মাণ করেছে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৯৫০; সহীহ মুসলিম, হা/৫৬৫৯; নাসাঈ, হা/৫৩৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৫৫৮; মুসনাদুল বাযযার, হা/১৯৬৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫১০৭; বায়হাকী, হা/১৪৩৪৪; জামেউস সগীর, হা/২৪৪৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৫৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২৫৭১৯; মুসনাদে হুমাইদী, হা/১২৪; মিশকাত, হা/৪৪৯৭।]

অংশীবাদীদের কর্মের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত বলে মুসলিম গৃহে প্রতিকৃতির প্রদর্শনীয়ও নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

أَنَّ الْمَلاَئِكَةَ لاَ تَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ صُورَةٌ

যে গৃহে ছবি বা প্রতিকৃতি রয়েছে, সেখানে আল্লাহর রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। [সহীহ বুখারী, হা/৩২২৪, ৩৩৫১; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৭৩৪; সহীহ মুসলিম, হা/৫৬৩৯; আবু দাউদ, হা/৪১৫৭; তিরমিযী, হা/২৮০৫; নাসাঈ, হা/৪২৮১; ইবনে মাজাহ, হা/৩৬৫০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৮৫০; মুসনাদুল বাযযার, হা/৫২৩; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫২১; বায়হাকী, হা/১৪৩৬০; জামেউস সগীর, হা/৩৭২৬।]

৩. পূর্ব পুরুষদের নীতি ও প্রথার অন্ধ অনুসরণ :

অতীত ও বর্তমানের অসংখ্য লোক পূর্ব পুরুষদের ভিত্তিহীন নিয়ম-নীতির অন্ধ অনুসরণ করে ভ্রান্তিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সত্যকে জানা ও বুঝার পরও অনেক মানুষই পিতৃপুরুষ ও সমাজে প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি আবেগজনিত দুর্বলতার কারণে ভুল বিশ্বাস ও প্রথা আঁকড়ে থাকতে পছন্দ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ إِبْرَاهِيْمَ إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِه مَا تَعْبُدُوْنَ قَالُوْا نَعْبُدُ أَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِيْنَ قَالَ هَلْ يَسْمَعُوْنَكُمْ إِذْ تَدْعُوْنَ أَوْ يَنْفَعُوْنَكُمْ أَوْ يَضُرُّوْنَ قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا كَذٰلِكَ يَفْعَلُوْنَ ﴾

তাদের সম্মুখে ইবরাহীম (আঃ) এর বৃত্তান্ত বর্ণনা করো। সে যখন তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা কিসের উপাসনা কর? তারা বলল, আমরা প্রতিমার উপাসনা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে তাদের পূজায় লিপ্ত থাকি। সে বলল, তোমরা প্রার্থনা করলে তারা কি শুনে? অথবা তারা কি তোমাদের কোন উপকার কিংবা অপকার করতে পারে? তারা বলল, না- তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছি। (সূরা শু‘আরা : ৬৯-৭৪)

﴿وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَاۤ أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَاۤ أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ اٰبَآءَنَاۤ أَوَلَوْ كَانَ اٰبَآؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَّلَا يَهْتَدُوْنَ﴾

আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ করো। তখন তারা বলে, বরং আমরা তাঁরই অনুসরণ করব, যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি; অথচ যদিও তাদের পিতৃপুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিল না এবং তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না। (তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে?)। (সূরা বাক্বারা- ১৭০)

৪. ধর্মীয় ক্ষেত্রে মানবকর্তৃক সংযোজন-বিয়োজন :

যুগে যুগে নবী-রাসূলদের প্রচারিত সৃষ্টিকর্তার সত্যধর্ম বিকৃত হওয়ার নেপথ্যে মানুষের হস্তক্ষেপ ও সংযোজন-বিয়োজন বড় ভূমিকা পালন করেছে। খ্রিস্ট ধর্মে যীশুর জন্মদিন উদযাপন ও ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ক্রুশ এর প্রচলন, গীর্জায় ক্রুশ এর আবির্ভাব ইত্যাদি খ্রিস্ট ধর্মের নবোদ্ভাবিত বিষয়, যা ঈসা (আঃ) এর প্রচারিত মূল শিক্ষায় অনুপস্থিত। নিজ ধর্মের ইতিহাসের সাথে পরিচিত আজকের অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীই তা স্বীকার করে। খ্রিস্ট ধর্মের মূল কিতাব ইঞ্জীল হতে যেমন তারা অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, বর্তমানে কুরআনুল কারীম থেকেও মুসলিমরা দূরে সরে পড়ে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

মুসলিমদেরকে যদি বলা হয়, সকল তরীকা, সকল মত, সকল পথ বর্জন করে একমাত্র নবীর তরীকা ধরে কুরআনুল কারীম ও সুন্নাতের অনুসরণ করো, তাহলে প্রতুত্তরে তারা বলে, বাপ-দাদার থেকে যা পেয়েছি তাই মান্য করে যাব। আমাদের হাজার হাজার আলেম রয়েছেন, হাজার হাজার মুফতী রয়েছেন, তারা কি সবাই ভুল করে যাচ্ছেন? তারা কি কুরআন হাদীস পড়ে না? ভাষাজ্ঞান কি তাদের নেই? আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি কম। আলেম সমাজ যা বলেছেন, সে অনুযায়ীই আমরা আমল করে যাচ্ছি।

আফসোস! আজকের বিশ্বে সকল কিছুরই যাচাই-বাছাই হচ্ছে। অথচ মানুষ ঈমান ও আমল যাচাই করতে চায় না।

৫. বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য স্থাপন ও তাদের অনুকরণ :

যুগে যুগে মানুষ বিধর্মী জাতির অনুকরণ করতে গিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ তার উম্মতকে বিজাতির অনুসরণ না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ شِبْرًا شِبْرًا وذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتّٰى لَوْ دَخَلُوْا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوْهُمْ قُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارٰى قَالَ فَمَنْ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের পন্থাগুলো (এমনভাবে) অনুসরণ করবে যে, এক এক বিঘত এক এক হাত পরিমাণও ব্যবধান হবে না। এমনকি তারা যদি গুই সাপের গর্তেও ঢুকে থাকে, তাহলে তোমরাও তাতে ঢুকবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইয়াহুদি ও নাসারাদের? তিনি বললেন, তবে আর কারা হবে? [সহীহ বুখারী, হা/৭৩২০; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৮১৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৩৪৮।]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে। [আবু দাউদ, হা/৪০৩৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৯৬৬; মু‘জামুল আওসাত, হা/৮৩২৭।]

অতি আফসোসের বিষয় হলেও সত্য যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর এত সতর্কবাণী থাকার পরও বর্তমান যুগের অধিকাংশ মুসলিম পশ্চিমা বিশ্বের ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের অনুসরণ করতে শুরু করেছে। তারা তাদের উঠাবসা, চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতিনীতি, আইনকানুন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। অবস্থা দেখে মনে হয়, যেন তারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। যার ফলস্বরূপ আজ মুসলিমগণ ধীরে ধীরে আল্লাহ থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। তাদের সকল কাজে আল্লাহর প্রতি ভরসা উঠে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম স্থান করে নিয়েছে। তাদেরকে সৎ উপদেশ দিলেও তারা যুক্তি দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

অতএব, সময় থাকতে এখনই আমাদের সাবধান হতে হবে। অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য হয় এমন সবকিছু থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সর্বদা মুসলিমদের সংস্কৃতির দিকে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন!

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন