HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল-গিরাস চিন্তার উন্মেষ ও কর্মবিকাশের অনুশীলন (১ম খন্ড)

লেখকঃ তাওফীক বিন খলফ বিন আবদুল্লাহ বিন আল-রেফায়ী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আল-গিরাস

চিন্তার উন্মেষ ও কর্মবিকাশের অনুশীলন (১ম খন্ড)

মূল

তাওফীক বিন খলফ বিন আবদুল্লাহ বিন আল-রেফায়ী

অনুবাদ

কাউসার বিন খালিদ

প্রথম প্রকাশ: আগস্ট ২০০৮

প্রকাশনায়

আল-বায়ান ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

কেন্দ্রীয় অফিস: বাড়ী নং ৫৬, গরীবে নেওয়াজ এভিনিউ

সেক্টর ১৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০

ফোন. (০৩৪১) ৬৪৫৪৫,৬২০১১

E-mail: albayaninstt@gmail.com

সূরা : আহযাব-৪৫-৪৬
হে নবী, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ হিসেবে।

[সূরা : আহযাব-৪৫-৪৬]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ এই দীনে এমন বপন করবেন যে বপনে তার আনুগত্যের মাধ্যমে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত মানুষকে কাজে লাগিয়ে রাখবেন’’।

প্রকাশকের কথা
বাংলাদেশে মুসলিম সমাজের ইতিহাস যতটা পুরোনো, ঠিক ততটাই নতুন তার ইসলামী সামাজিক ইতিহাস, ইসলামিক পরিগঠন। ইসলাম এ দেশে ছিল, জাতিগত উন্মেষের সেই আদিকাল থেকে, কিন্তু, সেই অর্থে প্রকৃত ইসলামের অনুশীলন ও চর্চা ছিল না, ছিল না তার প্রতি নিষ্ঠা, অন্য সব কিছু থেকে তাকে আলাদা করে বুঝবার প্রেরণা। হিন্দু কালচারের উলটো পিঠ হয়ে তার পথ চলার কী ভয়াবহ পরিণতি ইতিহাস আজো বয়ে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য। সে কারণেই ইসলামকে সামাজিক ধর্মের পোশাক পড়িয়ে সমাজের কাছে হাজির করার ফলে, তার আকীদা, বিশ্বাসের ভিত্তি, স্বাতন্ত্র্য, আচার পদ্ধতি- ইত্যাদি সঠিক অর্থে ব্যাপকতা পায়নি।- আমরা এ দেশে কাজের সূচনা করার পর সমাজের এ দিকটির প্রতি আমাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। আমরা এর বিপদ ও ভয়াবহতার কথা ভাল করেই উপলব্ধি করছিলাম।

‘আল-গিরাস’ অসাধারণ একটি বই, এক ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজ ও সমাজের মনোভাব ও মানসিকতা কীভাবে আমূল পালটে দেয়া যেতে পারে, তার অকৃত্রিম ও সফল প্রতিচিত্র। লেখক তাওফীক বিন খলফ বিন আবদুল্লাহ আল-রেফায়ী, বিখ্যাত এক ব্যক্তিত্ব, দাওয়াতের ইতিমধ্যে স্মরণীয় ও বরণীয় এক অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। বইটিতে তিনি মৌলিক কিছু ধারনা প্রদানের মাধ্যমে আমাদেরকে যেখানে উপনীত করার প্রয়াস চালিয়েছেন, তা মূলত আমাদেরকে একটি সুস্থ, সঠিক কাঠামোবদ্ধ ইসলামী সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের স্তরে উন্নীত করবে।

বইটি জুড়ে তিনি মুমিনের চিন্তাকে নাড়া দিতে চেয়েছেন, দাওয়াতের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ও সেই আকাঙ্ক্ষাজাত প্রেরণাকে জাগিয়ে তোলা তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য। দাওয়াতী কর্ম, সামাজিকভাবে তা পালনের পদ্ধতিগত উদ্ভাবন, নতুন নতুন চিন্তা হাজির করে তাকে কর্মে পরিণত করা, দাওয়াতী ও সামাজিক যে কোন কর্মের চিন্তানৈতিক পাটাতন ইসলামের মূল জায়গা থেকে নির্মাণ- ইত্যাদি তিনি অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। যারা আমাদের দেশে সামাজিকভাবে ইসলামী কর্মকান্ডকে আমূল পালটে দিতে চায়, তাকে করে তুলতে চায় মৌলনির্ভর, আমি মনে করি, বইটি তাদের অবশ্য পাঠ্য।

বইটি অনুবাদ করেছেন আমার স্নেহাস্পদ কাউসার বিন খালিদ। কঠোর পরিশ্রম করে একে মুদ্রিত অক্ষরে উপস্থিত করার উপযুক্ত করে তুলেছেন নুমান আবুল বাশার। তাদেরকে অনেক অনেক সাধুবাদ। অন্যান্য যারা এর সাথে জড়িত ছিলেন, পরামর্শ ও শ্রম দিয়ে একে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হতে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।

বইটি এ দেশের দাওয়াতী আন্দোলনের সাথে জড়িতদের বিন্দুমাত্র উপকার করলেই আমরা আমাদের উদ্যোগ ও পরিশ্রমকে সার্থক মনে করব।

২৫-৮-২০০৮

নূর মোহাম্মাদ নূর বাদী‘

চেয়ারম্যান : আল-বায়ান ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে।

প্রবেশিকা
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম

বইটির সূচনায় পাঠকের সামনে আমি কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই।

এই বইটি- একটি অভূতপূর্ব চিন্তার প্রবর্তনা কিংবা নতুন প্রস্তাবনার ইশতেহার হিসেবে- নতুন কিছু বহন করছে কি? কিংবা আমাদের লক্ষ্য ও তার উপায়গুলো অনুসন্ধানের ব্যাপারে এর কিছুমাত্র কি ভূমিকা রয়েছে? নাকি তা কেবল বাকপটুত্ব সর্বস্ব জাবরকাটার ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি? না-কি তা এমন কিছু উপস্থাপন করছে, যা ইতিপূর্বেই ইসলামী সাহিত্যের এলাকায় স্থান করে নিয়েছে?

বইটি কি তোমার জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গে, সানুপুঙ্খে, তোমার বিশ্বস্ত সঙ্গী হবে? তোমার গৃহে, আড্ডায় বান্ধব পরিবেষ্টিত অবস্থায় তোমার যাপন-সঙ্গী হবে? কিংবা যখন তুমি প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছ, অথবা কর্মতৎপরতায় মুখর সময় যাপন করছ, মৃত্যু শয্যায় শায়িত অথবা কবরের নি:সীম অন্ধকারে নিমজ্জমান- এমন সব কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে কি বইটি তোমার সঙ্গী হবে?

বইটি কি তোমার আত্মশক্তিতে সঞ্চার করবে এমন এক অভূতপূর্ব মনোবল, ফলে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অনুষঙ্গে, তুমি সক্ষম হবে ইসলামের সজীবতার স্পন্দন ছড়িয়ে দিতে?

বইটি কি তোমার অর্জন-ইন্দ্রিয় জাগিয়ে তুলবে? ফলত তুমি কুরআন ও নববী বাণী এমন এক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আয়ত্ব করবে যে, বছর গড়িয়ে-এমনকি কখনো কখনো তাৎক্ষণিক কিছু মুহূর্ত অতিক্রম করে- জন্ম দিবে গঠনমূলক, কল্যাণকর এবং কিয়ামত দিবস অবধি অব্যাহত কিছু কাজের?

জগৎ ও পার্থিবের সঙ্কট তোমাদের উপর যতই চেপে বসুক, অক্টপাস হয়ে ঘিরে ধরুক নিকোষ অন্ধকার, এবং সৌভাগ্য ও সফলতার সকল দরজা বন্ধ হয়ে যাক তোমাদের জন্য- বইটি তারপরও কি তোমাদের জন্য একটি কল্যাণকর বিবর্তন সৃষ্টির মন্ত্রে উজ্জীবিত করবে?

কালের এমন ক্রান্তিকালে বইটি কি তোমার মাঝে এই অভূতপূর্ব বিশ্বাস সঞ্চার করবে যে, দীনের নতুন উপস্থাপনে- কপর্দক ও ন্যুনতম অবস্থান শূন্য হয়েও- তুমি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে?

আমার প্রিয় ভাই ! আমার এ যাত্রায় সঙ্গী হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত কি তোমার ধৈর্য অব্যাহত থাকবে?

সূচনা বক্তব্যের এই অভাবিত রীতি ও কিছুটা প্রথাবিরোধিতায় তুমি হয়ত অবাক হচ্ছো। সন্দেহ নেই, অন্যান্য গ্রন্থের শুরুতে যে রীতিতে ভূমিকা লিখা হয়, এ তার চেয়ে ব্যতিক্রম। এ কেবল তারই সচেতন ইঙ্গিত যে, বইটি হাজির অন্যান্য বইয়ের তুলনায় রীতিবিরুদ্ধ করে উপস্থাপন করা হবে। এ হচ্ছে বই ও তার লেখকের তাৎক্ষণিক ও কর্মতৎপরতামূলক বিচার-বিশ্লেষণ, এবং ইসলামী গ্রন্থগারে নতুন নতুন যে গবেষণা-প্রকাশনার সংযোজন হচ্ছে এ তার মাঝে মৌলিকত্ব নিয়ে হাজির হবে। জ্ঞানগত চিন্তা-গবেষণা ও কর্মতৎপরতা এবং বিতর্কের মতবাদের এলাকায় বইটি নিজেকে উপস্থাপন করবে একটি সম্পূর্ণ নতুন আবেদন ও আহবান নিয়ে। এবং ইসলামী ধ্যান-ধারণা সমাজের আপামর স্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চার-নীতি মালা হতে পাঠক কতটা উপকৃত হচ্ছেন, এটি তারও একটি নিপাট বিচার হবে।

এই উদ্যানের- ইসলামী মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঞ্চারের- প্রতিটি নীতিমালা সানুপুঙ্খে অধ্যয়নের পর, এই ভূমিকা তুমি পুন:অধ্যয়ন করে নিবে। যদি এই অংশের ভূমিকা নামটি যথার্থ হয়ে থাকে, তবে আশা করি, আমার অনুরোধ তুমি ফেলবে না।

আমি সচেতনভাবে তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, এই বইটি পাঠ শেষে তোমার কাছ থেকে আমার আকাঙ্ক্ষা কেবল এটুকুই নয় যে, তুমি পরিণত হবে একজন বিশুদ্ধ সংস্কারক ব্যক্তিত্বে, অঢেল দানে তুমি ভরিয়ে দিবে তোমার আশপাশ, কিংবা নিজেকে তুমি উন্নীত করবে তাকওয়ার অতুলনীয় এক উচ্চতায় ; বরং, আল্লাহর কাছে আমাদের কায়মনোবাক্য প্রার্থনা থাকবে যে, এর পাঠ শেষে তুমি পরিণত হবে সকল ইমামদের ইমামে, বরিত হবে মুত্তাকীদের অগ্রগণ্যরূপে।

وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا .

‘আমাদের পরিণত করুন মুত্তাকীগণের ইমামে।’ [সূরা ফুরকান : আয়াত ৭৪]

তুমি এ বইয়ের কোথাও, কোন ছত্রে, এমন কিছু খুঁজে পাবে না, প্রথাগত ভাষায় যাকে বলা হয় অসত্যের সাথে সত্যের বিতর্ক, কিংবা নিরেট বিশুদ্ধ কালচার, নির্জীব চিন্তা ও জ্ঞানের চর্চা ; বরং, এ হচ্ছে সদা কল্যাণে ধাবমান এক জীবনময়তা, কিংবা বলো, জীবনের প্রতিটি পরতে কল্যাণের বিস্তার। অথবা, সদা প্রবাহিত সাদাকায় জীবনকে অনন্ত প্রবাহে বিধৌত করণ। এই বই ও তার আলোচনার- সূচনা হতে সমাপ্তি অবধি- এই হচ্ছে একমাত্রিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যদিও তোমার বিবেক ও অনুভূতির সীমান্তে তা নাড়া দিবে প্রবলভাবে, মুহুর্মূহ আবেদনে কাঁপিয়ে দিবে তাকে, তবে তার একান্ত লক্ষ্য থাকবে কর্মের এলাকায় চিন্তার সচেতন নিরীক্ষা এবং জীবনের সদা তৎপরতায় কর্মের বিশুদ্ধকরণ।

আমি তো আশা রাখি, তোমার জীবনে তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কথা বলে উঠবে, দিক নির্দেশক উচ্চারণে ভরিয়ে তুলবে তোমার জীবন, তার উচ্চারণ হবে সাদাকায়ে জারিয়ার উচ্চারণ ; যেদিন তুমি তোমার রবের দরবারে হাজির হবে-বিনত হয়ে তার সামনে দন্ডয়মান হবে, সেদিন যেন এগুলো তোমার পক্ষে সাক্ষী হয়ে উচ্চারণ করতে পারে। এমন উচ্চারণ, যা তোমার দু চোখকে শীতল করবে, এক পরম পাওয়ায় তোমার চোখ জুড়িয়ে দিবে।

য়াসীরা নাম্নী জনৈকা মুহাজির নারী বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘তোমাদের দায়িত্ব তাসবীহ, তাহলীল ও আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা। আর তোমরা আঙ্গুলগুলো বেঁধে রাখ, কারণ, সেগুলোকে প্রশ্ন করা হবে, এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এবং তোমরা গাফিল থেক না, ফলে রহমতের কথা ভুলে বস না।’ [তিরমিযী : ৩৫৮৩]

ভূমিকা
চিন্তা ও বিশ্বাস সঞ্চারের উপলব্ধি তিন উপায়ে

প্রথমত : সুকুমার কর্মের পূর্বে স্বচ্ছ চিন্তার উদ্রেক

দ্বিতীয়ত : সুশীতল ছায়াময়তার পূর্বে চাষ ও কর্ষণ

তৃতীয়ত : স্থায়ী উদ্যানের পূর্বে সেচ প্রবাহ

আমি পাঠকের কাছে সবিনয় নিবেদন করব যে, আলোচ্য তিনটি বিষয় পাঠের পূর্বে একান্তে, নিজেকে নিজে কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে নিন। প্রশ্ন তিনটি হচ্ছে-

কেন সুকুমার কর্মের পূর্বে স্বচ্ছ চিন্তার উদ্রেক?

সুশীতল ছায়াময়তার পূর্বে চাষ ও কর্ষণ-এর কী তাৎপর্য?

স্থায়ী উদ্যানের পূর্বে সেচ প্রবাহরই বা অর্থ কী?

এর উত্তর হচ্ছে : চাষ ও তার স্তর বিন্যাসের অনুসারে একে সাজানো হয়েছে। কারণ, পতিত জমির কোন ইয়ত্তা নেই। এই সব পতিত জমির কর্ষণ ও চাষ শুরু হয় একটি চিন্তার মাধ্যমে, কর্মের সূচনার পূর্বে যা কর্তার চিন্তায় উদিত হয়। এই বিবেচনাতেই প্রথম বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে। এর সাথেই ‘কর্মের পূর্বে চিন্তার উদ্রেক’- এর বিষয়টি জড়িত। কর্তার চিন্তাদোয়ের পর, তাকে অবশ্যই চাষ ও কর্ষণের মাধ্যমে বিষয়টির বাস্তাবায়ন করতে হবে। এ কারণেই দ্বিতীয় ছত্রে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ‘সুশীতল ছায়াময়তার পূর্বে চাষ ও কর্ষণ।’ চাষবাসে এরপর, পানি সিঞ্চন, সেচ ও ফল লাভের অপেক্ষা ব্যতীত আর কিছুই করার থাকে না। এরই সূত্র ধরে সর্বশেষ শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘স্থায়ী উদ্যানের পূর্বে সেচ প্রবাহ।’

উপস্থাপিত স্তর বিন্যাস ক্রম অনুসারে এই বইয়ের প্রতিটি ‘সঞ্চার নীতিমালা’ আবর্তিত হবে এবং আল্লাহ চাহে তো ফলে ও ফুলে শোভিত হয়ে উঠবে।

বিষয়টি একটি উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করে তোলার লক্ষ্যে আমরা বলতে পারি :- কোন স্কুল কিংবা কল্যাণ ও সংস্কারমূলক সংস্থা অথবা দাতব্য প্রজেক্ট কখনোই বাস্তবায়িত হয় না চিন্তার সচেতন আশ্রয় ছাড়া, যা কর্মপরিকল্পনার পূর্বে কর্তার মনে উদয় হয়। মন ও উপলব্ধিতে উদিত চিন্তা মাত্রই যে সৎ ও বিশুদ্ধ, তা নয় ; একে অবশ্যই কিতাব, সুন্নাহ তথা শরীয়তের নীতিমালার আলোকে পরিশ্রুত করে নিতে হবে। উক্ত চিন্তার বিশুদ্ধতার প্রমাণের জন্য অবশ্যই শরয়ী সূত্রের উল্লেখ আবশ্যক।

এই স্তরক্রমের অনুবর্তনের পর, উক্ত চিন্তা তোমার কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ কর্ম কাঠামো আকারে হাজির হবে। ধরা দিবে বিস্তারিত প্রজেক্ট রূপে, যা আল্লাহ চাহে তো এই বইয়ের যথাস্থানে উপস্থাপন করা হবে। এই সংক্ষিপ্ত সারাৎসার পূর্ণ আলোচনার পর, বিষয়টি অবশ্যই আরো সবিস্তার উল্লেখের দাবি রাখে, যাতে প্রতিটি আলোচনার গুরুত্ব তুলে ধরা হবে। পাঠক, তোমার দুয়ারে সেই সবিস্তার আলোচনা কড়া নাড়ছে, দুয়ার উন্মুক্ত কর, দেখ এবং গ্রহণ কর মনের মাধুরী মিশিয়ে।

প্রথমত : সুকুমার কর্মের পূর্বে স্বচ্ছ চিন্তার উদ্রেক
তোমার ভিতরে জন্মেছে অনেক অনন্যসাধারণ সৃষ্টিশীল চিন্তা, যখন তুমি যাপন করছিলে নির্মল মুহূর্ত, কিংবা কখনো কখনো যাপন করছিলে দিবস ও রজনীর ব্যস্ততম সময়... যানবাহনে, শয়নে, কিংবা বিশেষ-অবিশেষ যে কোন অবস্থানে। কিন্তু তুমি তাকে অবহেলা করেছ, কিংবা তাকে বিস্মৃত হয়েছ। এভাবে কেটে গেছে অনেক দিন। এরই মাঝে আকস্মিক চিন্তার বিদ্যুৎ চমক, অনন্য সাধারণ ভাবনার শিহরণ এসে কড়া নেড়েছে তোমার ভাবনার দরজায়। ...তারপর?

তারপর হঠাৎ তুমি কখনো দেখতে পাবে যে, কোন বক্তা, কিংবা সমাজ সংস্কারক বা লেখক তোমার অবহেলায় হারিয়ে ফেলা সেই চিন্তাকেই বিবৃত করছে, তাকে বিন্যাস দিয়ে মানুষের কাছে হাজির করছে। ফলে তা পরিণত হচ্ছে প্রভাববিস্তারকারী কোন বক্তৃতায়, কিংবা লেখায় অথবা শক্তিশালী কোন নিবন্ধে। এবং তা মানুষের অন্তরে স্থান করে নিচ্ছে। অত:পর তা একসময় চিন্তার গন্ডি পেরিয়ে কর্মের...সক্রিয় কোন প্রজেক্টের...বা নতুন জীবনের গন্ডিতে গিয়ে উপনীত হচ্ছে। ফলত, সেই ক্ষুদ্র চিন্তার বদৌলতে তার জন্য কিয়ামত দিবস অবধি লেখা হচ্ছে স্থায়ী কোন চিন্তার সাদাকায়ে জারিয়া।

এ বিষয়টি কী প্রমাণ করে?
এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা হয়তো কোন একদিন তোমার জন্য চিন্তার এই অমিয় ধারা উন্মুক্ত করেছিলেন, কিন্তু তুমি তার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করনি। তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করনি কোনভাবে। হয়তো তার সামনে তুমি তোমার চিন্তার কপাট আটকে দিয়েছ, তোমার কর্মের, উত্থানের পথ বন্ধ করে দিয়েছ। তাই তোমার থেকে সেই চিন্তা হারিয়ে গিয়েছে, সে অবস্থান নিয়েছে অন্য কোথাও, অন্য কারো কাছে। দেখা যাবে, তোমার কাছ থেকে ফিরে গিয়ে যার কাছে সে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানেও তার স্থায়ী আবাস হয়নি। এভাবে চিন্তা জনে জনে পরিভ্রমণ করে। অবশেষে তা হাজির হয় এমন ব্যক্তির কাছে, আল্লাহ যার জন্য উক্ত চিন্তাকে নির্ধারণ করেছেন কিংবা যাকে উক্ত চিন্তার জন্য নির্ধারণ করেছেন। এবং তাকে তার জন্য প্রমাণ স্বরূপ বানিয়ে দেন।

সেই চিন্তা গ্রহণকারীর মাঝে এক অভাবিত তাড়নার জন্ম নেয়। ফলে সে তা অত্যন্ত গরুত্বের সাথে গ্রহণ করে, তাকে বিন্যাস দেয়, শৃঙ্খলাবদ্ধ করে নেয়। সবশেষে তাকে কর্মে রূপ দেয়। সেই কর্ম নিয়ে সে মানুষের জন্য হাজির হয় সুনির্ধারিত এমন কোন প্রজেক্ট নিয়ে, যা জীবনের সর্বময় স্পন্দনে স্পন্দিত। এটি তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ের জন্য সাদাকায়ে জারিয়াতে পরিণত হয় :

وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ﴿৬৪﴾

‘আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত’। [সূরা আনকাবূত : ৬৪]

যদি তুমি হিসাব কর, দেখবে কত অসংখ্য চিন্তার উদ্রেক ঘটেছে তোমার ভিতর, অতপর যেভাবে এসেছে, হারিয়ে গিয়েছে সেভাবেই...দেখবে তার সংখ্যা অগণিত-অসংখ্য। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ-শুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে পরীক্ষা করেন, অথচ তুমি তাকে অবহেলা কর। এমনকি এক চিন্তার সূত্র ধরে নতুন যে চিন্তার উদয় ঘটে, তাকেও অবহেলা কর। এভাবে একের পর এক চিন্তা তোমার পাশ কেটে চলে যায়। এক সময় আল্লাহ তোমাকে তার কাছে উঠিয়ে নেন, তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে হাজির হয় রাশি রাশি শুদ্ধ চিন্তার স্ত্তপ, যেগুলোকে তুমি অবহেলা করেছ। আল্লাহ যা রহমত স্বরূপ তোমার কাছে পাঠিয়েছিলেন, যা এসেছিল তোমার জন্য উদ্ধারকারী হয়ে, সাদাকা জারিয়া হয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল যা তোমার দিকে। সেগুলোই হত সুকর্ম, যার সাথে তৈরী হত তোমার সাথে এক অসম্ভব মেলবন্ধন।

এইভাবে অবহেলায় কেটে যায় যদি তোমার দিন-ক্ষণগুলো, তাহলে একসময় তোমার অবস্থা এমন হবে যে, তুমি পরিণত হবে আল্লাহ তাআলার পাঠানো কল্যাণকর চিন্তা সমূহের পাশ কাটিয়ে যাওয়া বিন্দুতে, চিন্তাসমূহ যাকে অবহেলাভরে কেবল অতিক্রম করে যাবে, স্থির হবে না যাতে। আমি মনে করি না যে, কল্যাণকর ধারাবাহিক চিন্তাসমূহ বার বার তোমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে। হয়তো তার স্থানে দখল করবে অন্য চিন্তা। কে জানে, কল্যাণের ধারা হয়তো তোমাকে ছেড়ে অন্য কারো দিকে গমন করবে, সে তাকে গ্রহণ করবে পরিপূর্ণ আদরে, তাকে লালন করবে, পরিণত করবে সাদাকায়ে জারিয়ায়। ফলে চিন্তা তোমাকে বিস্মৃত হবে। বসে বসে অসহায় আত্মসমর্পণ ব্যতীত তোমার কোন কাজই থাকবে না তখন।

সুতরাং, তুমি নিজের প্রতি রহম কর, তোমার দুর্বলতার প্রতি দয়াশীল হও। প্রতারণা দিবসের জন্য (কিয়ামত দিবস) যথার্থ বন্ধুত্ব গ্রহণ কর। মুসলমানদের জন্য, বরং তোমার নিজের জন্য এক নতুন জীবনের বীজ বপন করে জীবন-সঞ্চারক তৈরী কর। কুরআনে এসেছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اسْتَجِيبُوا للهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ ﴿২৪﴾

‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দাও; যখন সে তোমাদেরকে আহবান করে তার প্রতি, যা তোমাদেরকে জীবন দান করে। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন। আর নিশ্চয় তাঁর নিকট তোমাদেরকে সমবেত করা হবে’। [সূরা আনফাল : ২৪]

নিয়ত শুদ্ধ করা, দৃঢ় প্রত্যয়ে নিজেকে বলীয়ান করা এবং তোমার মাঝে কল্যাণের যে চিন্তারই উদ্রেক হবে, তাকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করার প্রবল মানসিকতা ব্যতীত, সুতরাং, কোন পথ নেই। তোমার আশপাশে যে বস্ত্তরাশি ছড়িয়ে আছে, যে ব্যক্তিগণ হাজির আছে তোমার চারপাশে, তাদের থেকে, তাদের কর্মকান্ড থেকে চিন্তার স্ফূরণ কাম্য। তবে, আল্লাহ চাহে তো, তুমি চিন্তার অবশ্যম্ভাবি ফল থেকে কোনভাবেই বঞ্চিত হবে না।

যে কোন কল্যাণের সূচনা, সাধারণত, একটি চিন্তার মাধ্যমে হয়, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সেই চিন্তা-সৌভাগ্যে অভিষিক্ত করেন।

হেরার সেই সুনিবিড়, নিভৃত একাকীত্বে, নির্জনতায় ওহীর সূচনা হয়েছিল। সন্দেহ নেই, নবুয়্যত আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ ফযীলত এবং তার একক নির্বাচন, চিন্তা কিংবা অন্য কোন উপায়ে যার আবির্ভাব ও প্রাপ্তি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবে, আল্লাহ তাআলা তার নবীকে একটি ব্যাপক ও বিশ্বময় বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের জন্য প্রস্ত্তত করার লক্ষ্যে, নির্জনতা, নিভৃত একাকীত্ব এবং চিন্তাকে মৌল ভিত্তির মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন।

ইসলামী ইতিহাসের সেই সূচনাকালে, বিজিত এলাকা ও ক্রম বিস্তারমান বিজয় রথের সূচনা হয়েছিল এই চিন্তার লালন ও তার উদ্রেকের ফলেই। বিহার এলাকার বিজয়ের সূচনাও ছিল একটি চিন্তার মাধ্যমে। এ ক্ষুদ্র বাতায়ন বেয়েই, চিন্তা ও জ্ঞানের বিদগ্ধ এলাকায় ঘটে যায় বৈপ্লবিক ওলটপালট, ইতিহাস ভূষিত হয় অতুলনীয় সব উপঢৌকনে, বাস্তব দুনিয়ার সাথে সমান্তরাল যাত্রা বজায় রাখা কিংবা ইতিহাসের গতি আমূল পরিবর্তন করে দেওয়ার মন্ত্রও তৈরি হয় এখান থেকে। সূচনা হতে সমাপ্তি পর্যন্ত এ আল্লাহ তাআলারই দান, যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি এ দানে ভূষিত করেন।

বলকানের দুর্গগুলো ঘিরে মুসলিম বাহিনী দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ের মত, দুর্গের দেয়াল ভেদে ঝাঁপিয়ে পড়ার যাবতীয় উপায় রহিত, কনকনে শীতে জড়সর সকলে, শত্রুপক্ষের ব্যুহ অতিক্রম কোনভাবেই সম্ভব নয়, এদিকে যুদ্ধের সরবরাহও বন্ধ...এমন কঠিন মুহূর্তগুলোয় জয়ের কারণ ছিল একটি মাত্র চিন্তার উদ্রেক।

চিন্তা, যা উদিত হয়েছিল কোন এক সাধারণ মুসলিম মুজাহিদের অন্তরে, তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সেনাপতির নিকটে, বলেছিলেন : দুর্গে প্রবেশ করবার পথ সম্পর্কে আপনি কোন বন্দীকে জেরা করুন। নিশ্চয় কোন উপায় বেরুবে। তিনি জেরা করলে বন্দী জানিয়েছিল, দুর্গে প্রবেশ করবার পথ হচ্ছে পানি প্রবাহের নালা। যখন রাতের অবসান হল, দেখা দিল ঊষার রক্তিম পূর্বাভাস, তখন সেই নালা দিয়ে মুসলিম মুজাহিদগণ প্রবেশ করলেন। এভাবেই বিজয় সূচিত হয়, ইসলাম প্রবেশ করে বলকানের বিস্তৃত এলাকায়, যা আজো দুর্দান্ত গতিতে অব্যাহত আছে। আল্লাহ চাহে তো কিয়ামত অবধি এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এ বিজয়ও ছিল চিন্তার উদ্রেকের এক সুনিশ্চয় ফলশ্রুতি।

মহান ব্যক্তিত্বদের পথপ্রাপ্তির কারণ যদি অনুসন্ধান কর, বৃহৎ এলাকাগুলোর বিজয়ের আড়ালের উপলক্ষ্য যদি তালাশ কর, তবে দেখতে পাবে এভাবে আচম্বিত চিন্তার স্ফূরণ ও উদ্রেকই মূলত বিজয় ও পথ প্রাপ্তির এই শিহরণ ছড়িয়ে দিয়েছিল তাদের মাঝে।

চিন্তার সহজ উদ্রেক, সন্দেহ নেই, হেদায়েতের পথকেও সহজ ও সুগম করে দেয়। এই সহজতা সর্বার্থেই আল্লাহ তাআলার দান বৈ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এ কারণেই, সর্বদা তা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করতেন।

রাসূলের দুআ ছিল :-

رب أعني و لا تعن علي، وانصرني و لا تنصر علي، وامكر لي و لا تمكر علي، واهدني و يسر الهدى لي وانصرني على من بغى علي، رب اجعلني لك شكارا، لك ذكارا , لك رهابا، لك مطواعا، لك مخبتا، إليك أواها منيبا، رب تقبل توبتي واغسل حوبتي، وأجب دوعتي، وثبت حجتي، وسدد لساني، واهد قلبي، واسلل سخيمة صدري .

‘হে রব ! আমাকে সহযোগিতা করুন, আমার বিরুদ্ধে (কাউকে) সহযোগিতা করবেন না। আমাকে সাহায্য করুন, আমার বিরুদ্ধে (কাউকে) সাহায্য করবেন না। আমার পক্ষে কৌশল অবলম্বন করুন, আমার বিপক্ষে কৌশল করবেন না।

আমাকে পথ দেখান, এবং হিদায়াতকে আমার জন্য সহজ করে দিন। যে আমার বিপক্ষে দ্রোহ করবে, তার বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন। হে রব ! আমাকে আপনার জন্য কৃতজ্ঞ করুন, আপনার যিকিরকারী ও ভীত করুন, আপনার অনুগত ও বিনয়াবনত করুন আমাকে। আমাকে আপনার জন্য অধিক প্রার্থনাকারী ও আপনার প্রতি ধাবিত করুন।

হে রব ! আমার তওবা কবুল করুন, বিধৌত করুন আমার পাপসমূহ। আমার দুআয় সাড়া দিন, আমার প্রমাণকে দৃঢ় করুন, আমার ভাষা-কন্ঠকে সঠিক রাখুন, হিদায়াত করুন আমার অন্তরকে। এবং আমার অন্তরকে বিদ্বেষমুক্ত করুন।’ [তিরমিযী : ৩৫৫১]

হে আল্লাহ আমাদেরকে হিদায়াত করুন, এবং হিদায়াতকে সহজ করে দিন।

প্রিয় পাঠক ! তুমি হয়ত একটি আলোকবর্তিকা ও দিপাধার সন্ধান করবে, যা তোমাকে আলোয় উদ্ভাসিত করবে, কিংবা কামনা করবে কোন চিন্তার, যা প্রদান করবে অপরিমেয় পরিশ্রুতি, অথবা উদগ্রীব হবে কোন কর্মের সূচনার জন্য, যাকে বিশ্লিষ্ট করা ও পৌঁছে দেয়া তোমার একান্ত কাম্য।

তোমার জন্যই, এই বইয়ে ধারাবাহিকভাবে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের অবতারণা হবে।- আলোকবর্তিকা, চিন্তা ও কর্ম।

সুতরাং, তুমি কি পাঠে ক্ষান্ত দিবে?

দ্বিতীয়ত : সুশীতল ছায়াময়তার পূর্বে চাষ ও কর্ষণ
আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴿৬৫﴾

‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেব এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে ও তাদের পা সে সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে যা তারা অর্জন করত।’ [সূরা ইয়াসীন : ৬৫]

এগুলো হচ্ছে কাফিরদের হাত, যে পাপ তারা করেছে, সে ব্যাপারে তাদের হাতগুলো স্বীকৃতি দিবে। সুতরাং, তুমি কি তোমার হাতকে তোমার স্বপক্ষে কল্যাণের স্বীকৃতিদাতায় পরিণত করবে না? তোমার এই হাত, তার নির্জীব আঙুলগুলো কিয়ামত দিবসে কথা বলে উঠবে, তাকে কথা বলার শক্তি প্রদান করা হবে।

হায় আশ্চর্য ! হায় আফসোস ! বড় বড় জ্ঞানী ও দায়ীগণ কিংবা সর্বস্ব নিয়োগ করে যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে জ্ঞানের পথে, ইলমের রাহে, এমন তালিবে ইলমগণ একটি মাত্র কিতাব লেখার অনুপ্রেরণা বোধ করছে না, বরং, কয়েক ছত্র বা একটি নিবন্ধ লিখবার উৎসাহও পাচ্ছে না, যাতে থাকবে কল্যাণের দাওয়াত, মন্দ প্রথার বিরোধিতা কিংবা যে অন্যায় ছড়িয়ে গিয়েছে চারদিকে, যে হীন কুফরির জাল ঘিরে রেখেছে মানব সমাজকে- যাতে থাকবে তার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হওয়ার অকুতোভয় প্রেরণা।

সন্দেহ নেই, লিখবার পরিপূর্ণ শক্তিই তাদের রয়েছে, কিংবা তাদের নিকট এমন কেউ রয়েছে, যে তাদের পক্ষ থেকে লিখে দেবে। অবস্থা ভেদে যে কোন পন্থাই তারা গ্রহণ করতে সক্ষম। তাদের সামনে ব্যাপকভাবে ইসলামের অসহায়ত্ব পরিদৃষ্ট হচ্ছে, বিশেষভাবে জ্ঞান কীভাবে অসহায়-অর্বাচীন হয়ে পড়ছে, সেটিও তাদের নিকট অবিদিত নয়, অথচ তারা তাকে সাহায্য করছে না। কুফরি দিকে দিকে ছড়িয়ে গিয়েছে, অথচ তারা তার বিরোধিতায় উপনীত হচ্ছে না। অন্যায় পাপাচার গ্রাস করে নিচ্ছে সব কিছু, কিন্তু এতে তারা বাধা প্রদান করছে না।

সহীহ হাদীসে আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

فضل العالم على العابد كفضلي على أدناكم .

‘আবিদের উপর আলিমের শ্রেষ্ঠত্ব এমন, যেমন আমার শ্রেষ্ঠতব তোমাদের সাধারণতর ব্যক্তির উপর।’

অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

إن الله و ملائكته و أهل السماوات و الأرضين حتى النملة في جحرها و حتى الحوت ليصلون على معلم الناس الخير .

‘নিশ্চয় আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ এবং আসমান ও যমীনের অধিবাসীরা সকলে, এমনকি গর্তের ক্ষুদ্র পিপীলিকা ও মাছ মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য দুআ করে।’ [তিরমিযী : ২৬৭৫]

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন :

معلم الخير يستغفر له كل شيئ حتى الحيتان في البحر .

‘সব কিছু কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, এমনকি সমুদ্রের মাছও।’ [বাযযার। আলবানী বলেছেন : হাদীসটি সহীহ লিগায়রিহী।]

ইমাম শাফিয়ী রহ. বলেছেন : ‘ইলমের অনুসন্ধান নফল সালাত হতেও উত্তম।’ তিনি আরো বলেছেন : ‘যে পার্থিব জগত কামনা করবে জ্ঞানার্জন তার কর্তব্য। আর যে অপার্থিব জগত- আখিরাত কামনা করবে তারও কর্তব্য জ্ঞানার্জন।’ অপর স্থানে তার মন্তব্য ছিল : ‘ফরজ আমলের পর জ্ঞানার্জনের তুলনায় আল্লাহর নৈকট্যদানকারী শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই।’ [তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত। ইমামন নববী : ১/৭৫]

এখন প্রশ্ন হচ্ছে : জ্ঞানার্জনকারী এই শ্রেণীর নিকট বিপুল জ্ঞানভান্ডার থাকা সত্বেও যদি তারা মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা না দেন, তাহলে কি আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী করুণা লাভ করবে? ফেরেশতা ও জগতের দুআ তাদের জন্য কাজে লাগবে?

উত্তর হচ্ছে : না।

তাছাড়া, মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীদেরও রয়েছে বিভিন্ন স্তরক্রম।

আলেম যদি এমন হন যে, তিনি একই সাথে শরীয়তের গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেম তৈরী করবেন, এবং গড়ে তুলবেন যোগ্য ছাত্রদের একটি শ্রেণী। সাথে সাথে রচনা করবেন মূল্যবান বইপত্র, যাতে থাকবে নতুন আবেদন, কল্যাণকর নতুন উপস্থাপনা, তবে সন্দেহ নেই, এ হবে সমাজের জন্য খুবই কল্যাণকর একটি দৃষ্টান্ত।

আমরা কখনো কখনো দেখতে পাই, কেউ কেউ লেখালেখির ব্যাপারে অজুহাত দেখাচ্ছেন, কিন্তু সকলেই কি অজুহাত দেখাবে? এতো হতে পারে না ! কিংবা যে তার বিষয়ে যোগ্য সে কি করে অজুহাত দেখায়?

এদের কারো কারো ক্ষেত্রে এমন হুকুম প্রদান করা যায় যে, লেখালেখির মাধ্যমে দাওয়াত তাদের জন্য ওয়াজিবে আইনী। কারণ, দাওয়াতের ক্ষেত্রে নীতিমালা হচ্ছে শরীয়ত ; কারণহীনভাবে নিজের স্বপক্ষে অজুহাত, অক্ষমতা দেখিয়ে নির্দোষ পিছু হটে যাওয়া, কিংবা লোক দেখানো বিনয়ী আচরণ- ইত্যাদি নয়। ‘আমি ব্যতীত অন্য কেউ করুক’ তাদের এ কথার চেয়ে ‘আমার থেকে উৎসারিত অথবা আমার কৃত’ এই কথা, সন্দেহ নেই, অনেক উত্তম।

দাওয়াতের এই মহতী ময়দান থেকে কারণহীন পিছু হটে যাওয়া আলেমের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। তন্মধ্যে আমি কিছু আলেমের কথা উল্লেখ করব। যারা আমার সমাজেরই বাসিন্দা। যাদেরকে হয়তো আমি প্রত্যক্ষভাবে চিনি ও যাদের সাথে আমার রয়েছে গাঢ় বন্ধুত্ব। তবে পাঠক যদি একে নির্দিষ্ট কারো প্রতি ইঙ্গিতসূচক না ধরে ক্যাটাগরি হিসেবে গ্রহণ করে, তবে সেটা হবে কল্যাণকর ও আমাদের উদ্দেশ্যের অধিক নিকটতর।

একজন মালিকী আলেম : যিনি তার মাযহাবের ব্যাপারে ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন, ঋদ্ধ হয়েছেন পঠন ও পাঠনে। তার মাযহাবের অনুসারীদের মাঝে তিনি তার দেশে বিশেষ অবস্থান লাভ করেছেন। এবং এমন কিছু সূক্ষ্ম তত্ত্ব আবিস্কারে সক্ষম হয়েছেন, যা একই সাথে শক্তিশালী প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত মাযহাব বিরোধী। এ সমস্ত সূক্ষ্ম তত্ত্বের সমাধানে তার মাযহাবের অনুসারীগণ নিতান্ত অক্ষম। কিন্তু তিনি কোন কিতাবকে কেন্দ্র করে টীকা সংযোজন অথবা স্বতন্ত্র কোন গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে লেখালেখি হতে বিরত থেকেছেন, এ ব্যাপারে আমি তার মাঝে কোন উদ্যোগ দেখছি না।

তার মাযহাবের অনুসারীগণও, তাই, রয়ে গিয়েছে সেই ধারাবাহিকতায়, যা কিনা সিদ্ধ নয় এবং যা সহীহ ও স্পষ্ট নসের বিরোধী। তার ব্যাপারে আমরা কি বলব? আমি বলছি না যে, তাকে উক্ত মাযহাবকে ধ্বসিয়ে দিতে হবে। কিন্তু, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে তিনি যে সত্য উন্মোচনে সক্ষম হয়েছেন, সেই বরাতে তাকে তো অবশ্যই তার মাযহাবের অনুসারীদেরকে রক্ষা করতে হবে এবং স্পষ্ট ও সহীহ নসের বিরোধিতা থেকে তাদেরকে বাধা প্রদান করতে হবে। আমি তাকে আহবান করব এবং করেও যাচ্ছি, একই সাথে সমান্তরালভাবে তার মাযহাব ও এর মৌলিক গ্রন্থগুলোকে পক্ষ-বিপক্ষ প্রমাণের দ্বারা পুষ্ট করে তুলতে। এর মাধ্যমে তিনি সক্ষম হবেন মাযহাব, তার ইমাম ও অনুসারীগণকে অনৈতিক ভুল থেকে রক্ষা করে সঠিক পথের দিকে নিয়ে আসতে।

সন্দেহ নেই, মাযহাবের বাইরে থেকে সমালোচনার তুলনায় ভিতর থেকে সমালোচনা অনেক উত্তম ও ফলপ্রসু।

কোন প্রকার পরিবর্তন বা কর্তন ব্যতীত ইমামের কথাকে প্রতিষ্ঠিত করা তার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ ছিল। ইমামের পক্ষ হতে বর্ণিত ও সমাধানকৃত এমন অনেক মাসআলা পাওয়া যাবে, যাতে তারই কর্তৃক বিবৃত একাধিক মত পাওয়া যায়। সাথে সাথে এমন অনেক মাসআলার অবতারণা লক্ষ্য করা যায়, যার সঠিক মর্মার্থ এমনকি ব্যাখ্যাকারগণও উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। যে মর্মার্থ পরবর্তীগণ শুধরে দেন এবং অনুসারীগণকে সঠিক বিষয়টি ধরিয়ে দেয়। এ হচ্ছে একটি সচল প্রক্রিয়া, যা ক্রমান্বয়ে একটি মতকে অধিকতর শুদ্ধ ও স্পষ্ট করে তোলে। উক্ত আলেম যদি এ ধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হতেন, তবে সন্দেহ নেই, তা হত আমাদের সকলের জন্য অধিক কল্যাণকর।

অন্ধ প্রতিবন্ধিতা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, সমকালীন অধিকাংশ মাযহাবের অনুসারীগণ মনে করে- হোক সে ছাত্র কিংবা শিক্ষক- সত্য কেবল তার অনুসৃত মাযহাবেই ধরা দিয়েছে, অন্যান্য যে মাযহাবই এর বিরোধী, তা অসত্য, সুতরাং অগ্রহণযোগ্য।

এভাবে, একটি সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের জ্ঞানচর্চার সম্ভাবনাকে কেন্দ্রিভূত করে ফেলা এবং অন্যান্য মাযহাবকে ধ্বসিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তি নিয়ে গ্রন্থ রচনা ও যে কারো জন্য ইজতিহাদের বৈধতা দান কোনভাবেই সুস্থ সিদ্ধান্তের পরিচায়ক হবে না। অভ্যন্তরীন সংস্কার কি কখনো ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে?

মাযহাব ও মাযহাবী এই সব বিষয়-আশয় সংক্রান্ত একটি তুলনা আমার কাছে অত্যন্ত চমকপ্রদ মনে হয়, যখনিই তুমি মাযহাবের বড় কোন আলেমের মুখোমুখি হবে এবং তাকে মাযহাবের প্রচলিত মাসআলার বাইরে কিছু জিজ্ঞেস করবে, উদ্ভুদভাবে তুমি দেখতে পাবে যে, তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আকাশ-পাতাল ভেবে অস্থির হচ্ছেন। যেন সমুদ্রের অথৈ জলরাশির অভ্যন্তর থেকে কোন মাছ ধরে এনে শুকনোয় ছেড়ে দিয়েছ।

দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হিসেবে একজন শাফেয়ী আলেম-এর কথা উল্লেখ করব। তিনি তার মাযহাবের গন্ডিতে খুবই যোগ্য পন্ডিত। অসাধারণ তার পান্ডিত্ব। শরীয়তের যে কোন ক্ষেত্রেই তার রয়েছে সরব পদচারণা। তালিবে ইলমদেরকে তিনি ক্লান্তিহীনভাবে মাযহাবী গ্রন্থের পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার ছাত্রদের সামনে এমন এমন সূক্ষ্ম তত্ত্বের অবতারণা করছেন, যা কোন কিতাবেই বিরল। এবং সাথে সাথে তিনি তাদেরকে এমন হাদীসের বিশদ ব্যাখ্যা করছেন, যাকে কেন্দ্র করে আহকাম ও তার সূত্র নির্ধারিত হয়, এবং যাকে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মতবিরোধের জন্ম নিয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে সমকালীন আলেম সমাজে বিশেষ অবস্থানে ভূষিত হয়েছেন, ঘরে-বাইরে, মসজিদে-মজলিসে একটির পর একটি কিতাবের পাঠ দিয়ে চলেছেন তিনি।

এত কিছু সত্ত্বেও, এ শাফেয়ী আলেম গ্রন্থ রচনার ব্যাপারে ভয়ানক রকমের ক্লান্তি বোধ করেন। এ বিষয়ে তার ভীষণ রকম অস্বীকৃতি। ডায়াবেটিস রোগের কারণে ক্রমে তিনি স্বাস্থ্যে ক্ষয়ে যাচ্ছেন। আমি আল্লাহর কাছে এ রোগ থেকে তার জন্য শেফা কামনা করি। তবে, সুখের কথা হচ্ছে, অবশেষে তিনি লেখালেখিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। আশা রাখি, অচিরেই আহলে ইলম তার মাধ্যমে ব্যাপক কল্যাণের দেখা পাবেন।

আমি এক পরিপক্ক বৃদ্ধকে জানি, যিনি পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের সান্বিধ্যে ক্রমান্বয়ে ইলম অর্জন করেছেন, শরীয়া বিদ্যার অধিকাংশেরই তিনি পাঠ নিয়েছেন মনযোগ সহকারে ; এসব ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা সুবিস্তৃত এবং যে ইলম তিনি অর্জন করেছেন, আদায় করেছেন তার যাকাত- ইতিপূর্বে যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছেন, তার পাঠদানে তিনি ব্যাপৃত হয়েছেন অত্যন্ত সার্থকতার সাথে।

আমি যতটুকু জানি, তার সম্পর্কে আমার এ লেখার পূর্বেই তিনি ‘নায়লুল আওতার’ গ্রন্থের পূর্ণ পাঠদান ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন। একবার নয়, বহুবার দিয়েছেন। বারংবার এই পাঠদানের মাঝখানে তিনি অনেক অস্পষ্ট বিষয়কে স্পষ্ট করে তুলেছেন, অনেক সূক্ষ্মতত্ত্ব তার কাছে ধরা দিয়েছে। এত কিছু সত্বেও, এখন পর্যন্ত, তার নিকট উন্মোচিত সে বিষয়গুলো সম্পর্কে- জ্ঞানচর্চার সফরে পাঠকমাত্ররই যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- একটি মাত্র অক্ষরও লিপিবদ্ধ করেননি।

এ বিষয়টি তিনি কেন ঘটতে দিচ্ছেন, আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টির প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ ছিল তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের উল্লেখিত ভদ্রলোক কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে তার প্রচেষ্টার কারণে স্বতন্ত্র ও একক স্থান দখল করে আছেন। সমাজের ধনী ও বিত্তশালীদের কাছ থেকে তিনি অর্থ সংগ্রহ করে পৌঁছে দেন দরিদ্রের কাছে, ব্যয় করেন তাদের কল্যাণে। এ ক্ষেত্রে তার রয়েছে অদ্ভুত ও কার্যকরী সব অভিজ্ঞতা।

তোমরা এমন এমন দরিদ্রকে দেখে থাকবে, যাদের দারিদ্র্য অন্ধকারে ঢেকে থাকে, মুখ ফুটে না বলার কারণে ধনীরা যাদের মনে করে অঢেল ধন-সম্পদের অধিকারী অথবা স্বচ্ছল। কত অস্বচ্ছল ব্যক্তি আছে, দীর্ঘ দিন-মাস-বৎসর যাদের কেটে যাচ্ছে দারিদ্রে্যর পেষণে, কোথাও অন্ধকার রাতে কাউকে হয়তো তার গৃহ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বকেয়া ভাড়ার অজুহাত দেখিয়ে, কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কারো বাড়ী-ঘর ধ্বসে পড়েছে...কিন্তু এমন কিছু কল্যাণময় ব্যক্তি সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, সকাল হতে না হতেই দেখবে তিনি উক্ত দুর্যোগ ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন, এবং পূর্বে তারা যে অবস্থায় ছিল তাদের প্রচেষ্টার ফলে তার চেয়ে উত্তম অবস্থায় এখন দিন কাটাচ্ছে।

মুখ ফুটে না বলার কারণে ধনীরা যাদেরকে অস্বচ্ছল বলে শনাক্ত করতে পারে না, এবং যাদের পাশে গিয়ে দাড়ায় না, তাদেরকে চিনতে পারা এবং শনাক্ত করতে পারা এক প্রকার যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য। যাদেরকে আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণ করা এবং তাদের অন্তরে পৌঁছতে পারা ভিন্ন প্রকার জ্ঞান ও দক্ষতা। আর শরয়ী কোন সমস্যা অথবা বিপর্যস্ত কোন এলাকার ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ- সন্দেহ নেই এ সবই দক্ষতার দাবী রাখে।

এমনিভাবে সাদাকা সত্যিকার হকদারের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং যে কোন কল্যাণমূলক কর্মকান্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং তাকে একটি ধারাবাহিক সফলতায় পরিণত করা- সত্যিই অসাধারণ জ্ঞান ও শিল্প, আল্লাহ বিশেষ বান্দাদেরকেই এ গুণে ভূষিত করেন।

উক্ত ভদ্রলোককে আমি অনেকবার বলেছি, কেন আপনি আপনার এ অভিজ্ঞতা ও তার সারনির্যাস লিপিবদ্ধ করছেন না, এবং তাকে স্থায়ী গঠনমূলক রূপে উন্নীত করছেন না? প্রতিবারই এর উত্তরে তিনি আমাকে বলেছেন : আমি সুন্দর করে লিখতে পারি না। কর্মতৎপরতার বাইরে এই সব লেখাজোকায় আমার দক্ষতা নেই।

এ ধরণের চিন্তা ও মনোভাবের ফলেই যে কোন কর্মের স্রষ্টাকেই অকালে নি:শেষ করে দেয়, সুতরাং তিনি ও তার কর্ম এবং সেই কর্মের বিশাল অভিজ্ঞতা কালের গর্ভে হারিয়ে যায় আমাদের সবার অজান্তে। এবং প্রজন্মান্তরে অন্যান্য দায়ীদের নিকট এ অভিজ্ঞতার নির্যাস পৌঁছতে পারে না, মাঝ পথেই কেটে যায় তার যোগসূত্র।

তুমি কি তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া মহান ঘটনা এবং দুর্লভ অভিজ্ঞাতাগুলো তোমার ভাষায় ব্যক্ত করতে পার না? নিশ্চয় ! তবে কেন অন্যত্র ছড়িয়ে থাকা দায়ীদের জন্য তোমার গল্পগুলো কলমের কালিতে লিপিবদ্ধ করছ না? তুমি তোমার অভিজ্ঞাতা ও নিরীক্ষাগুলো লিপিবদ্ধ কর, প্রয়োজনবোধে নিজের নাম তা থেকে উঠিয়ে দাও।

লিখ, এবং এর মাধ্যমে উত্তম আদর্শের সঞ্জীবন উদ্দেশ্য কর, মিটিয়ে দাও মন্দ প্রথা।

লিখ, আমাদের রব তাআলা, কারণ, লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের কথা, যারা তাকে ভালোবেসে ভুখাদেরকে খাবার দিয়েছে, লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের কথা, যারা প্রয়োজন ও দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও নিজেদের উপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছে। তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন সৎ বান্দাদের সততা সম্পর্কে, মুফাসসিরগণ এ সমস্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন, শানে নুযূল উল্লেখ করেছেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের নামগুলো।

লিখ, কারণ, হতে পারে এ লেখার ফলে তুমিই হবে তার প্রথম উপকারিতা ভোগকারী। এর ফলে তোমার মাঝেই হয়তো প্রথম শুদ্ধতা ও বিশুদ্ধতার উন্মেষ ঘটবে। স্বত:স্ফূর্ত আলোক জ্বলে উঠবে।

সারকথা হচ্ছে : জ্ঞান ও কর্মের যে কয়জন মহান ব্যক্তির উল্লেখ করেছি, এ উম্মতে তারাই একমাত্র দৃষ্টান্ত নন। বরং, দৃষ্টান্ত হিসেবে যখনই তাদের উল্লেখ করা হবে, তুমি দেখতে পাবে, এদের প্রতি জনের ছায়ায় তাদেরই মত বিরাট একটি দল জমায়েত হয়ে গিয়েছেন, যারা একই ব্যর্থতায় ভুগছেন। জ্ঞান ও কর্মের অন্যান্য এলাকাতে- হোক শরয়ী বা টেকনোলজিক্যাল, জ্ঞান ও কর্মের- তাদের দৃষ্টান্ত বিরল নয় মোটেই।

সুতরাং, চিন্তা ও কর্মের ঐতিহাসিক উন্মেষের এই প্রচেষ্টায় তাদের সুপ্ত ক্ষমতার কি প্রকাশ ঘটবে? তারা কি জেগে উঠার প্রেরণা খুঁজে পাবেন? কেঁপে উঠবে জীবনের সঞ্জীবন? পার্থিব জীবন মহাকালের অন্ধকারে লুপ্ত হওয়ার পূর্বেই কি তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন তাদের এই বিষয়গুলো?!

১০
তৃতীয়ত : স্থায়ী উদ্যানের পূর্বে সেচ প্রবাহ
‘আবু হুসাইন’ আমাকে এক চিন্তায় ভূষিত করেছেন, এবং চিন্তার উদ্রেকের মাধ্যমে তিনি এই উদ্যানে নতুন কিছু বপনের সৌভাগ্যে ভূষিত হয়েছেন। আল্লাহ তাকে চিন্তার উন্মেষ ও বপনে সর্বদা ভূষিত করুন ! আমি বইটির প্রাথমিক খসড়া প্রদর্শনের পর তিনি আমাকে এই বলে প্রস্তাব দিলেন যে, প্রতিটি বিষয়ের সাথে আপনি যদি বিষয় সংশ্লিষ্ট নস বা কুরআন-হাদীসের বর্ণনাগুলো উল্লেখ করে দিতেন, তাহলে অবশ্যই ভাল হত।

আমি তাকে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বললাম, দাওয়াত ও সাদাকায়ে জারিয়া সংক্রান্ত রচিত অধিকাংশ রচনাই কেবল নস উল্লেখের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যা ঘটেছে, তাহল, উল্লেখিত নসগুলোর শব্দের ব্যাখ্যা, তাফসীর ইত্যাদি দ্বারা বিষয়টি আরো বেশি স্পষ্ট করে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছে। কখনো কখনো আমাদের মহান সালফে সালেহীনের শ্রেষ্ঠকর্ম, ঘটনাবহুল দৃষ্টান্ত হাজির করা হয়েছে। ইতিপূর্বের রচনাকারদের এই ছিল অনুসৃত পদ্ধতি। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। আবু হুসাইনের সাথে আমার আলোচনা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তবে এ চিন্তার উদয়ের ক্ষণকাল পরেই, আমি আমার সুহৃদ ভাইয়ের নসীহত ও উপদেশকে কর্মে রূপান্তরিত করবার প্রয়াস চালালাম। আমি যা লিখেছি, এবং সে আমাকে যে উপদেশ দিয়েছে তাতে সমন্বয় ও বাস্তবায়নে প্রবৃত্ত হলাম। গ্রন্থাকারে উপস্থিত আমার এই উদ্যানের প্রতিটি পরিচ্ছেদের সূচনাতে উপস্থাপন করলাম প্রবাহিত ঝর্ণাধারা বা নসসমূহ যা উক্ত উদ্যানের বৃক্ষের শিকড়ে, লতায় পাতায় সিঞ্চন করবে। তাকে উদ্ভাসিত করবে সবুজের বর্ণচ্ছটায়। চিন্তার এ পর্যায়টিকে আমরা নামকরণ করেছি ‘বপনের ঝর্ণাধারা’ নামে। গ্রন্থরূপী এই উদ্যান কি বপন নয়?

সুতরাং, উক্ত উদ্যানের জন্য চাই অঢেল পানি, যা তাতে সিঞ্চন করবে ঝর্ণাধারা, যা তাকে ভিজিয়ে দিবে জীবনের প্রাণস্পন্দনে। এখানে যে ঝর্ণাধারার উল্লেখ করেছি, তাই মূলত: কিতাব ও সুন্নাহর নসসমূহ। আর স্থায়ী কর্মসমূহ নামে আমরা এখানে যা উল্লেখ করেছি বা করব, তা বিগত মহান ব্যক্তিবর্গের কর্মসমূহ। বুখারীতে আছে, উসমান বিন মাজঊন রা.-এর স্ত্রী উম্মুল আলা মৃত্যুর পর তাকে স্বপ্নে দেখতে পেলেন। তিনি বলেন : আমি স্বপ্নে উসমানের জন্য একটি ঝর্ণা দেখতে পেলাম। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উক্ত স্বপ্ন বর্ণনা করলে তিনি বললেন : ‘সেটি তার আমল, যা তার জন্য প্রবাহিত হচ্ছে।’ [বুখারী : ৭০৮১]

বুখারী রহ. একে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন, যার নামকরণ করেছেন এভাবে : ‘স্বপ্নে প্রবাহিত ঝর্ণাধারার পরিচ্ছেদ’। যদি তা প্রবাহিত ও উৎসারিত ঝর্ণা নাও হত, তবে সেটিও হত কল্যাণকর। কারণ, পরিশ্রম ও ক্লান্তি ব্যায়ে যদি পানি নেওয়া হত, তাহলেও তা হত এক সর্বব্যাপী কল্যাণ, ব্যাপক করুণাধারা এবং এমন অনন্ত কর্মের সূচনা, যা পৌঁছে যেত সর্বত্র এবং হত দীর্ঘস্থায়ী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত অধ্যায় ইমাম বুখারী রহ. আরম্ভ করেছেন এভাবে : ‘কুয়ো থেকে পানি তুলে মানুষকে তৃপ্ত করার পরিচ্ছেদ’। তাতে তিনি আব্দুল্লাহ বিন উমর হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাতে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

أريت كأني أنزع بدلو بكرة على قليب فجاء أبو بكر فنزع ذنوبا أو ذنوبين فنزع نزعا ضعيفا و الله تبارك و تعالى يغفر له، ثم جاء عمر فاستقى فاستحالت غربا فلم أر عبقريا من الناس يفري فريه حتى روى الناس ...

‘মনে হল যেন আমি এক সকালে কোনো কূপে বালতি ফেলে পানি তুলছি। তখন আবু বকর এসে এক কিংবা দুই বালতি পানি তুলল। সে খুব দুর্বলভাবে পানি তুলল। আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন। তারপর ওমর এসে পানি নিল। এরপর তা বড় বালতিতে পরিণত হল। আমি এমন শক্তিশালী কাউকে দেখিনি, যে অভীষ্ট লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছে। এমনকি মানুষ তৃপ্ত হয়ে গেল...’। [বুখারী : ৩৬৮২]

সুতরাং, হে পাঠক, উদ্যানে প্রবেশের পূর্বে তুমি এই ঝর্ণাধারাগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাও। ‘ঝর্ণাধারা’ হচ্ছে নসসমূহ, ‘বপন’ হচ্ছে সাদাকায়ে জারিয়ার চিন্তা, যা ঝর্ণাধারার সিঞ্চনে উৎসারিত-পল্লবিত। আর এ সবের সমন্বয়েই হল উদ্যান। তাই পাঠক এই লেখাগুলো পাঠ করতে গিয়ে আয়াত ও নির্বাচিত হাদীসসমূহ পাবে, যার রয়েছে বিশেষ ইঙ্গিত, যার নির্বাচনের অন্তর্নিহিত কারণ সহজে ধরা দিবে না। আমি এ ধরনের নসগুলো প্রতিটি উদ্যানের সূচনার পূর্বে উল্লেখ করেছি। পাঠক যখন পুরো বইটি সমাপ্ত করে পূনরায় আয়াত ও হাদীসগুলো পাঠ করবে, তখন অবশ্যই এগুলোর অন্তর্নিহিত কারণ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। হাদীসগুলো উল্লেখের কারণ সে ধরতে পারবে এবং এর মর্মও তার কাছে উদ্ভাসিত হবে।

সুতরাং যে চিন্তাই এই ঐশী ধারার সিঞ্চন গ্রহণ না করবে, তার বপন ও চিন্তার উদ্রেক হবে মন্দ উদ্রেক। তার ফল হবে নষ্ট। অপর পক্ষে কুরআন সুন্নাহর ঝর্ণাধারা হবে আকাশ হতে বর্ষিত সে বৃষ্টি হতে উৎসারিত। আল্লাহ তাআলা বলেন :

أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَالَتْ أَوْدِيَةٌ بِقَدَرِهَا فَاحْتَمَلَ السَّيْلُ زَبَدًا رَابِيًا وَمِمَّا يُوقِدُونَ عَلَيْهِ فِي النَّارِ ابْتِغَاءَ حِلْيَةٍ أَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِثْلُهُ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْحَقَّ وَالْبَاطِلَ فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ ﴿১৭﴾

‘তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এতে উপত্যকাগুলো তাদের পরিমাণ অনুসারে প্লাবিত হয়, ফলে প্লাবন উপরস্থিত ফেনা বহন করে নিয়ে যায়। আর অলংকার ও তৈজসপত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে তারা আগুনে যা কিছু উত্তপ্ত করে তাতেও অনুরূপ ফেনা হয়। এমনিভাবে আল্লাহ হক ও বাতিলের দৃষ্টান্ত দেন। অতঃপর ফেনাগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়, আর যা মানুষের উপকার করে, তা যমীনে থেকে যায়। এমনিভাবেই আল্লাহ দৃষ্টান্তসমূহ পেশ করে থাকেন।’ [সুরা রাদ : ১৭]

আবু মূসা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

مثل ما بعثني الله به من الهدى و العلم كمثل الغيث أصاب أرضا فكانت منها نقية قبلت الماء فأنبتت الكلأ و العشب الكثير، و كانت منها أجادب أمسكت الماء فنفع الله بها الناس فشربوا و سقوا و زرعوا، و أصابت منها طائفة أخرى إنما هي قيعان لا تمسك ماء و لا تنبت كلأً، فذلك مثل من فقه في دين الله و نفعه ما بعثني الله به فعلم و علم، و مثل من لم يرفع بذلك رأسا و لم يقبل هدى الله الذي أرسلت به .

‘আল্লাহ আমাকে যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে বৃষ্টির মত, যা কোন জমিতে পতিত হয়েছে। জমির কিছু রয়েছে উর্বর, যা পানিকে শুষে নেয়। ফলে তা বিপুল ঘাস-তৃণলতা উৎপন্ন করে। আর কিছু রয়েছে অনুর্বর, যা পানিকে ধরে রাখে। ফলে আল্লাহ তার মাধ্যমে মানুষকে উপকৃত করেন। তারা তা পান করে, সেচ দেয় ও কৃষি উৎপাদন করে। আর এক প্রকার, যাতে বৃষ্টি পতিত হয়, যা সমতলভূমি, পানি ধরেও রাখতে পারে না, কিংবা ঘাস-তৃণও উৎপন্ন করে না। এটিই হচ্ছে তাদের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর দীনে জ্ঞানার্জন করেছে এবং আমাকে আল্লাহ যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তা তার কাজে এসেছে এবং তাদের দৃষ্টান্ত যারা তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করেনি এবং আমি যে হিদায়াত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তা গ্রহণ করেনি।’ [বুখারী : ৭৯]

আমরা যদি শরয়ী নসসমূহকে আমাদের কর্মে ও কর্মক্ষেত্রে এভাবে স্থাপন করি, তবে অবশ্যই জীবন এক সবুজ উদ্যানে রূপান্তরিত হয়ে যাবে, এবং ইসলামের স্তম্ভ হবে সেই উদ্যানের ভিত্তি।

যতক্ষণ এই প্রবাহ অব্যাহত থাকবে, সৎ সঙ্গী উর্বরতা দিয়ে যাবে, ততক্ষণ বপনে সক্ষম কেউ বপনের ব্যাপারে অজুহাত দেখাতে পারবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

إن قامت الساعة و في يد أحدكم فسيلة فإن استطاع أن لا تقوم حتى يغرسها فليغرسها .

‘যদি কিয়ামত এসে পড়ে আর তোমাদের কারো হাতে কোন অঙ্কুর থাকে তবে সে যদি এ সুযোগ পায় যে, কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই সে তা বপন করতে পারবে, তবে সে যেন তা বপন করে নেয়।’ [বুখারী, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]

সুতরাং, হে পাঠক ! হাদীসটিতে গভীর মনযোগ প্রদান কর এবং আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে তার সংশ্লেষ খুঁজে নাও।

إن قامت الساعة এ বাক্যাংশে إن শব্দটি শর্তসূচক, তবে এখানে তা আকস্মিকতার অর্থ দিচ্ছে। সুতরাং আকস্মিকভাবে যে কিয়ামত সংগঠনের মুখোমুখি হবে, তার উচিৎ হল এ আকস্মিক সময়টিতেও বপনের সুযোগ হাতছাড়া করবে না।

فليغرسها বপন দ্বারা এখানে শাব্দিক অর্থই উদ্দেশ্য। অঙ্কুর বপনে ব্যক্তির সার্থকতা হচ্ছে যেন ঐ ব্যক্তির মত যে তার ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যদিও এস্থলে কেবল বপনের মাধ্যমে ব্যক্তির আসল কল্যাণ লাভ হবে না। ব্যক্তি মূলত এই অবস্থায় দুটি কাজই করতে পারে। প্রথমত: সে হয়তো তার হাত থেকে অঙ্কুরটি ফেলে দিবে ফলে তা নির্জীব হয়ে যাবে, সাথে সাথে তারও জীবন নি:শেষ হয়ে যাবে। কিংবা দ্বিতীয়ত: সে তা জমিনে বপন করে দিবে। যে ব্যক্তিই কিছু বপন করে, তার আশা থাকে যে, তা একদিন বড় হবে, ফুলে-ফলে শোভিত হবে। এখানে ব্যক্তি যা বপন করবে, যদিও পার্থিব জীবনে তার ফললাভ হবে না, কিন্তু আখিরাতে অবশ্যই তা প্রাপ্ত হবে। কিন্তু সে যদি পার্থিব জীবন নি:শেষ হতে চলেছে, এই ভেবে তা ফেলে দেয়, তবে কী ফল সে লাভ করবে?

وبيد أحدكم فسيلة রাসূল যেহেতু এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তোমাদের হাতে কোন অঙ্কুর থাকবে...সুতরাং তা হবে ছোট ও আকারে ক্ষুদ্র। তার ক্ষুদ্রত্ব হচ্ছে এই যে, তার ফললাভের সময় এখনো অনেক দূরবর্তী।

فليغرسها বপন ও ফেলে দেয়ার সময়ের মাঝে পার্থক্য কতটুকু? বপনকারীর জন্য কয়েক কাজ সমাধা করা জরুরী : মাটি খোঁড়া, স্থাপন, অঙ্কুরটি পুতে দেয়া এবং পানি দেয়া। কিন্তু সময় এতই স্বল্প যে, যদি বপন করতে যায়, তাহলে হয়তো পানি দেয়ার সময় থাকবে না।

কিংবা পানি দিলেও হয়তো বপনকর্মটির শেষ পর্যন্ত সে উপনীত হতে সে সক্ষম হবে না। এত ধরনের সম্ভাবনা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। তিনি বলেছেন, সে যেন অবশ্যই তা বপন করে যায়। কে জানে, হয়তো অন্য কেউ এসে বপন-করা সে অঙ্কুরে পানি দিবে। কিংবা আল্লাহ অন্য কিছু ঘটাবেন, ফলে সে যা ভাবেনি, তাই ঘটবে?

فليغرسها যদি বপনের চেয়ে উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ থাকত, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন। জীবন সায়া ‎‎ হ্নর এই মুহূর্তে আমরা কি কল্পনা করি?

অবশ্যই এ অবশ্যই ব্যক্তি তার হাত থেকে অঙ্কুরটি ফেলে দিবে, হাত ঝেড়ে মুছে অজুর জন্য প্রস্ত্ততি নিবে, কায়মনোবাক্যে সালাতে নিমগ্ন হবে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এ কাজের নির্দেশ দেননি, বলেছেন, তুমি অবশ্যই তোমার হাতের অঙ্কুরটি মাটিতে পুতে দিবে।

কারণ, সে যদি সালাত ও দুআয় নিমগ্ন হয়, তবে এর কল্যাণ শুধু সেই ভোগ করবে, কিন্তু অঙ্কুরটি বপন করলে একই সাথে তা তার ও অপরের কল্যাণ বয়ে আনবে।

দুআ তার মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু বপনের ফলে একটি কল্যানের ধারা তার জন্য অব্যাহত থাকবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, মুত্যুর এমন কঠিন মুহূর্তেও তার জন্য অঙ্কুরটি বপন করা জরুরি বা ওয়াজিব ; অজু, সালাত কিংবা দুআ নয়। যদি বপন ত্যাগ করে সালাতে নিমগ্ন হয়, তবে হয়তো দেখা যাবে তৃতীয় কোন কাজ উপস্থিত হয়ে তাকে সালাত থেকে হটিয়ে দিবে, ফলে সে সেদিকেই ঝুঁকে যাবে।

এই হচ্ছে সেই গুঢ় রহস্য, যার কারণে আমি আমার এই রচনায় বপনের পূর্বে ঝর্ণাধারা অর্থাৎ চিন্তার পূর্বে সংশ্লিষ্ট নস উল্লেখ করেছি। উক্ত হাদীসে বপন সংক্রান্ত এ বর্ণনাও আমাদের উপর আল্লাহর এক অপার করুণার ইঙ্গিত- সন্দেহ নেই।

এই বপনের ফলে জন্ম হবে যে বৃক্ষের, শরীয়তের নসসমূহে তার উপকারিতার উল্লেখের কোন স্বল্পতা নেই। জীবন ও সঞ্জীবনের অপরিমেয় প্রামাণ্যতায় তা ভূষিত ও উদ্ভাসিত। প্রতি অংশ জুড়েই তার রয়েছে কল্যাণ ও উপকারিতা।

এই সেই বৃক্ষ, যার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে উমর রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বলেছেন ‘নিশ্চয় তা মুমিনের বৃক্ষ’।

এই সেই বৃক্ষ, রাসূল যার শাখা-প্রশাখার সবুজ বিস্তারকে কবরবাসীর জন্য আযাবের লঘুকারক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এই সেই বৃক্ষ, যার ফলকে আল্লাহ তাআলা মারইয়াম আ.-এর জন্য প্রথম খাবার হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। ঈসা আ.-কে প্রসবের পর যখন তিনি বৃক্ষতলায় বসে ছিলেন। কুরআনে এসেছে :

وَهُزِّي إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا ﴿২৫﴾ فَكُلِي وَاشْرَبِي وَقَرِّي عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنْسِيًّا ﴿২৬﴾

‘আর তুমি খেজুর গাছের কান্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, তাহলে তা তোমার উপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে।অতঃপর তুমি খাও, পান কর এবং চোখ জুড়াও। আর যদি তুমি কোন লোককে দেখতে পাও তাহলে বলে দিও, আমি পরম করুণাময়ের জন্য চুপ থাকার মানত করেছি। অতএব আজ আমি কোন মানুষের সাথে কিছুতেই কথা বলব না।’ [সূরা মারইয়াম : ২৫-২৬]

এই সেই বৃক্ষ, যার উৎপাদিত খাদ্যকে আল্লাহ তাআলা নবজাতকের জন্য নতুন জগতের প্রথম খাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, নির্ধারণ করেছেন রোজাদার ও তার পাকস্থলীর প্রথম আহার হিসেবে, দীর্ঘ অনাহারের পর যা উদরকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিবে। ঈদুল ফিতরের খুশীতে উৎফুল্ল ব্যক্তির জন্যও এই বৃক্ষের খাদ্য প্রথম খাদ্য।

এমনিভাবে, পবিত্র ভূমি...মদীনা মুনাওয়ারা ছিল খেজুর বৃক্ষের ভূমি ; সেই ভূমি, যা রাসূল হিজরতের পূর্বেই স্বপ্নে দেখেছিলেন। আবু বুরদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন :

رأيت في المنام أني أهاجر من مكة إلى أرض بها نخل، فذهب وهلى إلى أنها اليمامة أو هجر، فإذا هي المدينة يثرب، ورأيت في رؤياي هذه أني هززت سيفا فانقطع صدره، فإذا هو ما أصيب من المؤمنين يوم أحد، ثم هززته أخري فعاد أحسن ما كان، فإذا هو ما جاء الله به من الفتح و اجتماع المؤمنين، ورأيت فيها بقراً و الله خير، فإذا هم المؤمنون يوم أحد، و إذا الخير ما جاء الله به من الخير و ثواب الصدق الذي آتانا الله بعد يوم بدر .

‘স্বপ্নে দেখি আমি মক্কা থেকে খেজুর বৃক্ষ ছাওয়া একটি স্থানে হিজরত করছি। সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল স্থানটি ইয়ামামা কিংবা হাজার। কিন্তু পরে দেখা গেল তা মদীনা। আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি একটি তরবারী ঝাকাচ্ছি, হঠাৎ তা মাঝ থেকে ভেঙ্গে গেল। সেটা ছিল উহুদে মুসলমানদের আক্রান্ত হওয়ার প্রতিকীচিত্র।

এরপর তরবারীটি দ্বিতীয়বার ঝাকাতে তা পূর্বের চেয়ে ভাল হয়ে গেল। তার অর্থ আল্লাহর সাহায্যে মুসলমানদের পুনরায় সমবেত হয়ে পুনর্বিজয় অর্জন। তারপর আমি একটি গাভী ও তাতে অনেক কল্যাণ দেখতে পেলাম।

গাভীর মানে উহুদের মুমিনগণ, আর কল্যাণ হচ্ছে বদর দিবসের পর আল্লাহ আমাদের যে পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণ দান করলেন তা।’ [বুখারী : ৩৬২২]

আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে, তা হচ্ছে দু পাহাড়ের মধ্যবর্তী খেজুর বৃক্ষ অধ্যুষিত এলাকা।’ [বুখারী।]

উত্তম ভূমি সেই ভূমি...।

উত্তম গুণ সেই গুণ...।

এই পৃথিবীতে কি এমন কোন ভূমি আছে, যা মদীনা মুনাওয়ারার তুলনায় উত্তম ফলদান করেছে?

আল্লাহর কাছে আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন গ্রন্থরূপী এই উদ্যান, তার বপন ও তার পাঠকের জন্য করুণা ধারা প্রবাহিত করেন।

দীর্ঘ এক ভূমিকার পর, এখন সময় হয়েছে, আমরা মগ্ন হব এর অধ্যায়গুলোয়, যার প্রতিটি অধ্যায়ে বপনের প্রচেষ্টা রয়েছে। আমি একে বাইশটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছি। প্রতিটি অধ্যায়ই একটি পরিপূর্ণ উদ্যান, ফল আহরণকারীদের জন্য যার ফলগুলো ঝুঁকে আছে, যার শাখা-প্রশাখা ক্রম বিস্তারমান হয়ে সকলকে ছায়াতলে নিয়ে নিতে উদ্যত হয়ে আছে।

১১
প্রথম বপন: চেতনার বপন
مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآَخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ ﴿২০﴾

‘যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না।’ [সূরা শুরা : ২০]

উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

اللهم إني أسألك أن تبارك لي في نفسي، و في سمعي، و في بصري، و في روحي، و في خلقي، و في خُلُقي، و في أهلي، و في محياي، و في مماتي، و في عملي، فتقبل حسناتي، و أسألك الدرجات العلى من الجنة آمين .

‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা জানাচ্ছি, আপনি আমার অন্তরে, শ্রবণে, দৃষ্টিতে, আত্মায়, গঠনে ও চরিত্রে, পরিবার-পরিজনে, জীবনে-মৃত্যুতে এবং আমার কর্মে বরকত দিন। অএতএব, আপনি আমার সুকর্মগুলো কবুল করুন। আর আমি আপনার নিকট জান্নাতের উচ্চ স্থান কামনা করছি। আমীন!’ [হাকেম : ১৯১১]

জনৈক আল্লাহর বান্দা আমাকে একদিন তার গল্প শোনালেন এভাবে : আমি গতকাল এক দোকানে গেলাম ফুল ও গাছ কেনার উদ্দেশ্যে, সেখানে অনেক ঘুরলাম। দীর্ঘক্ষণ ফুল-বৃক্ষ দেখে আমি বের হওয়ার মনস্থ হলাম।

যখন আমি দরজা দিয়ে বের হচ্ছিলাম, তখন উক্ত দোকানে কর্মরত এক ফিলিপিনী যুবক এসে আমাকে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমার ইচ্ছা যে, আপনি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানান।

তাই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, আধ ঘন্টা যাবৎ আমি বিভিন্ন বিষয়ে বললাম। অত:পর সে আমাকে বলল, আমি ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ সন্তোষ লাভ করেছি।

আমি তাকে বললাম, তবে কেন তুমি ইসলাম গ্রহণ করছ না? এমনও হতে পারে যে, অমুসলিম অবস্থায় মৃত্যু এসে তোমার দরজায় উপস্থিত হবে?

কিন্তু সে বলল, এখন নয়।

তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, কোন সমস্যা আছে, যুবকটি হয়তো তা দূর হওয়ার অপেক্ষা করছে। আমি পিছনে ফিরে দেখলাম, তার পিতা আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তখন আমি তার পিতাকে লক্ষ্য করে বললাম, এখন আপনার বয়স কত? বলল, সত্তর...বয়সের ভারে ন্যুব্জ কপালের অসংখ্য ভাজ নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমি তাকে বললাম, দীর্ঘ সত্তর বছর যে ধর্মে কাটিয়েছ, তা তোমাকে কী দিয়েছে?

তা কি তোমাকে কোন প্রকার সৌভাগ্য এনে দিয়েছে?

কিংবা বুদ্ধি ও চিন্তার সন্তোষ লাভে তুমি ধন্য হয়েছ?

মনে অন্ধকার এলাকায় যে সমস্ত জটিলতা ঘুরে বেড়ায়, সে কি তার সমাধান হাজির করেছে?

জীবনের সত্তুর বছর অতিক্রান্তের পর যে আবাসের দিকে তুমি পা বাড়িয়েছ, তার ব্যাপারে সে কি তোমাকে সন্তোষজনক কিছু দিয়ে ধন্য করেছে?

সে বলল, না।

তবে, জীবনের যে ক্ষণকাল তোমার অবশিষ্ট আছে, তাকে কেন ইসলামে নিবিষ্ট করছ না?

এভাবে কিছুটা সময় তার সাথে আমি আলাপে অতিবাহিত করলাম। আমার আলোচনার ধারাবাহিকতায় তার কপালের ভাজ ধীরে ধীরে কমে আসছিল, সেখানে ফুটে উঠছিল উন্মোচনের আলোকছটা। অত:পর আমি তাদেরকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম, আমাদের মাঝে সৌহার্দ্য ও মতবিনিময় অব্যাহত আছে। আমি আশাবাদী যে, অচিরে তারা আল্লাহ চাহে তো ইসলামে প্রবেশ করবে।

এই গল্প শেষ করে আমার বন্ধু স্মিতহাস্যে আমাকে সম্বোধন করে বলল, তুমি কী মনে করছ?

আমি তাকে বললাম, ভাই ! আমি তোমাকে তাই বলছি, যেমন বলেছেন বড় বড় আলেম ও জ্ঞানীরা : শরীয়তের নীতিমালার অনুরূপ জগত পরিচালনার জন্য আল্লাহর রয়েছে কিছু অলৌকিক নীতিমালা, সেই নীতিমালার আওতায় তিনি তার বান্দাদের যাকে ইচ্ছা তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। হয়তো এ ঘটনাটি ছিল তোমার জন্য সেই অলৌকিক নীতিমালার শিক্ষাস্বরূপ।

সে বলল, কীভাবে?

বললাম, তুমি যখন দোকানে প্রবেশ করেছিলে, তখন তোমার একক চিন্তা ছিল ফুল দেখা ও ক্রয় করা। অন্য কোন চিন্তা ছিল না। তুমি ক্ষণস্থায়ী ফুলের ব্যাপারে চিন্তা করছিলে, আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে নয়, কিংবা স্থায়ী পরকাল-জান্নাতের ব্যাপারেও নয়।

যখন তোমার পরিদর্শন শেষ হল, তুমি বের হওয়ার উপক্রম হলে, ভুলে যাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ স্বয়ং তোমাকে তোমার দায়িত্ব সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাই বের হওয়ার দরজায় কুফর স্বয়ং তোমাকে এই বলে সম্বোধন করল যে, তুমি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত কর।

এভাবেই, যখন অন্তরের কম্পন ও দৃষ্টির লক্ষ্য আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি নিবদ্ধ হয়, তখন জীবনের মোড় ঘুরে যায়, সে অভিমুখী হয় মৌলের প্রতি, দাওয়াত, দীন ও ইবাদাতের প্রতি ; যদিও চোখ সেই পুরোনো চোখ, এবং তা স্থিত থাকে তার পুরোনো স্বভাবে। যে পার্থক্যটুকু ঘটে যায়, তা হচ্ছে তার ভিতরগত স্বভাবে এক নতুন কম্পন সৃষ্টি হয়, যা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় দাওয়াত ও বপনে।

দাওয়াতী চিন্তার ইন্দ্রিয়গত প্রেরণা হচ্ছে কর্ষণকারী প্রেরণা, যা চিন্তা-চেতনায় নিত্য-নতুন ভাব জাগিয়ে তোলে, যে তার প্রতিবেশ, আশপাশকে, তার ঘটনাপরম্পরাকে এক নতুন অভাবিত অর্থে গ্রহণ করে। যদিও তা হয় সাধারণের মতই, অন্যান্য মানুষ তাকে যেভাবে দেখে, তার দেখা এর চেয়ে অন্যভাবে সাধিত হয় না। তাতে ছড়িয়ে আছে যে সৌন্দর্যের বিভা, সাধারণের মত সেও তা দর্শন করে। কিন্তু পার্থক্য ঘটে যায় তখন, যখন সে তাকে দাওয়াতের পথে নিয়ে যায়, দীনের কাজে তাকে নিয়োজিত করে। যে দৃষ্টি দিয়ে ইবরাহীম খলীলুল্লাহ তার আশপাশে নজর বুলিয়েছেন, তার সাথে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির কি পার্থক্য ছিল? কুরআনে এসেছে :

وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِينَ ﴿৭৫﴾

‘আর এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব দেখাই এবং যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’ [সূরা আনআম : ৭৫]

তারকা, চাঁদ ও সূর্যের প্রতিবন্ধকতায় তার কওম আটকে গিয়েছিল, ইবরাহীম সেই প্রতিবন্ধকতা হটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ইয়াকীন বা নিশ্চয়তার স্তরে, আল্লাহর একত্বের বিশ্বাসে। কুরআনে এসেছে :

فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ ﴿৭৮﴾

‘ অতঃপর যখন সে সূর্য উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখল, বলল, ‘এ আমার রব, এ সবচেয়ে বড়’। পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, ‘হে আমার কওম, তোমরা যা শরীক কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে মুক্ত।’ [সূরা আনআম : ৭৮]

এটিই হচ্ছে চিন্তানৈতিক উল্লম্ফন ও বপনের বড় লক্ষ্য। কুরআনে এসেছে :

لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا ﴿১৮﴾

‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেছিল; অতঃপর তিনি তাদের অন্তরে কি ছিল তা জেনে নিয়েছেন, ফলে তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করলেন নিকটবর্তী বিজয় দিয়ে।’ [সূরা ফাতাহ : ১৮]

সুতরাং, তোমার উপর আল্লাহর প্রশান্তির অবতরণ, তোমার হাতে অন্তরসমূহের উন্মোচন, আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহের পর, মূলত: সম্পৃক্ত তোমার অন্তরস্থিত কর্ষণের দৃঢ় ইচ্ছা ও বপনের নিয়তের সাথে।

তোমার অন্তরের এই বৃত্তি সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই অবগত আছেন...সুতরাং দোকানের ফুল অথবা পার্থিব জীবন ও তার ক্ষণস্থায়ী শোভা যেন তোমাকে বিমুখ না করে। তোমার অন্যান্য বৈষয়িক চিন্তা যেন কোনভাবে ইসলামের চিন্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।

এভাবে যদি আপন চিন্তা ও চিন্তাবৃত্তিকে সাজিয়ে নিতে সক্ষম হও, তবে নিশ্চিত থাক, প্রশান্তি তোমার উপর নাযিল হবেই, আল্লাহ তোমার হাতে অসংখ্য অন্তরের বদ্ধ কপাট খুলে দিবেন, যদিও তোমার জ্ঞান ও বুদ্ধি হয় স্বল্প, তোমার কলমের শক্তি হয় ক্ষীণ, অসীম জড়তায় তোমার ভাষা যদিও হয় বাধাগ্রস্ত।

ফুলের দোকানে আমার সে বন্ধুর ঘটনাটি, সন্দেহ নেই, একটি ক্ষুদ্র ঘটনা, যা ঘটেছিল একটি ক্ষুদ্র পরিসরে, কিন্তু তার সাথে যদি কর্মের যোগ ঘটানো হয়, তবে তা অনেক বড় এক সত্য বহন করছে।

ঘটনাটি ছিল ছোট, কিন্তু দায়ী, তালিবুল ইলম ও দাওয়াতের ময়দানে নিয়োজিতদের জন্য তা এক অবশ্য পাঠ্য ওয়াজীফা, যার অনুবর্তন বান্দাকে সার্বিক সাফল্যে উন্নীত করে। যদিও এটি একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ, কিন্তু যদি একে ও এর অনুরূপ অন্যান্য উদাহরণগুলো আমরা আমাদের কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট করে নিতে পারি, তবে আশা করি, আমরা জীবনকে শাসন করতে পারব, জীবন আমাদের শাসন করবে না।

এ এক ক্ষুদ্র উদাহরণ, যাতে মানুষের অনেক বৃত্তির মধ্যে একটি বৃত্তির প্রতি অবহেলার দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে, তা হচ্ছে দৃষ্টি। আমার বন্ধু দৃষ্টি প্রদানে অবহেলা করেছে। সুতরাং, যদি মানুষের অন্যান্য অঙ্গ ও বৃত্তিগুলো শুদ্ধতা লাভ করে, স্বচ্ছ হয়ে যায় চোখের দৃষ্টি, উন্মোচিত হয় তার পরদা, শ্রবণ সঠিক অর্থে ঘটনা পরম্পরাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়, যে ব্যাখ্যায় সে তা গ্রহণ করছে, তা যদি হয় সঠিক, মানুষের হাত, পা, চুল ও ত্বক যদি সুস্থ থাকে তবে কেমন হবে? কি বিপুল সচেতনা তার মাঝে সঞ্চারিত হবে? তখনি প্রেরণা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর রঙ ধারণ করবে, তার ইন্দ্রিয় সৃষ্টিশীল ইন্দ্রিয়ে রূপান্তরিত হবে। আমরা কখন এ অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হব? কখন আসবে আমাদের সে সুসময়? হাদীসে এসেছে :

كنت سمعه الذي يسمع به، و بصره الذي يبصر به، و يده التي يبطش بها , و رجله التي يمشي بها .

‘আমি হয়ে যাই তার শ্রবণযন্ত্র, যা দিয়ে সে শ্রবণ করে, এবং তার দৃষ্টি যার মাধ্যমে সে দেখে, তার হাত যার মাধ্যমে সে ধরে এবং তার পা, যার মাধ্যমে সে হাঁটে।’ [বুখারী : ৬৫০২]

আমরা কখন এ স্তরে উপনীত হতে সক্ষম হব?

ফুলের দোকানে যেই চিন্তার উদয় হয়েছে, ইন্দ্রিয় যেভাবে জেগে উঠেছে, তার ফলই যদি এই হয়, তবে ভেবে দেখ, আল্লাহ ও তার রাসূলের বাণী যদি সত্যিকার অর্থে আমাদের মাঝে সঞ্চারিত হয়, তবে কি অতুলনীয় ফল বয়ে আনবে তা? চিন্তার এলাকায় কি বিপুল সাড়া ফেলবে তা? মানুষের চিন্তায় ও ইন্দ্রিয়ে আয়াত কীভাবে সাড়া ফেলে, একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আমি বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলার প্রয়াস পাব।

ব্যক্তি, যে কুরআনের এ আয়াতটি পাঠ করছে :

مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ ﴿১৮﴾

‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে।’ [সূরা কাফ : ১৮]- তখন পিছনে ফিরে যায়, এমন কিছু চিন্তা ও কল্পনা আকলের গভীরে জন্ম দিতে, অসংখ্য হয়ে যা মানুষের জ্ঞানের-চিন্তার গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। যাতে, যে প্রক্রিয়ার অনুবর্তী করে আল্লাহ তাকে প্রকাশে আসার ফায়সালা করে দিয়েছেন, সে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, এবং তা ভাষায় প্রকাশ পায়। চিন্তার অদৃশ্য লোকের গভীর থেকে উৎসারিত হয়ে তা মুখে চলে আসে, শব্দে রূপ ধারণ করে। প্রকাশের এই পর্যায়ে এসেই মানুষের ঈমানী চেতনা কিংবা সর্বশেষ যাচাই শক্তি দখল দেয় এবং যথেচ্ছ শব্দ বা বাক্যের প্রকাশ থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। মানুষের ঈমানী শক্তি, এক্ষেত্রে, যতটা শক্তিশালী, ঠিক ততটাই বাধা প্রদানে তার শক্তির বহি:প্রকাশ ঘটে।

সুতরাং, যখন এই শক্তি ও চেতনা, যা মানুষের চিন্তা ও কল্পনার আধার থেকে বেরোনো শব্দের যথেচ্ছ প্রকাশে প্রতিরোধ করে, যতটা শক্তিশালী হবে, ঠিক ততটাই অনর্থক শব্দের প্রকাশে বাধা প্রদান করবে। এভাবে, একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে যখন এই চেতনা ও শক্তি বৃদ্ধি পায়, তখন মানুষের চৈতন্য সর্বদা এমন শব্দকেই প্রকাশে ছাড়পত্র দেয়, যা কল্যাণকর ও শুভ, দুনিয়া আখিরাতে ফলদায়ক। আর যা অকল্যাণকর, অশুভ তাকে বাধা প্রদান করে, এমনকি তাকে চিন্তা ও কল্পনাতে হাজির হতেই দেয় না। কল্পজগতের গভীরে যে কোন ভাবকে শব্দে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই সে সর্ব শক্তি নিয়ে হাজির হয় এবং তাকে মৌলিক কল্যাণকর চিন্তায় রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে।

এ হচ্ছে বাস্তব এক প্রতিচ্ছবি, ব্যক্তি যা অনুভব করে সচেতনভাবে, প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ঘন্টায়, প্রতি দিনে, এমনকি যে কোন শব্দ উচ্চারণকালে। কিংবা যখনই সে চিন্তার এলাকায় কোন ভাব নিয়ে খেলা করে।

এ বাস্তব প্রতিচ্ছবি, যদিও ফিল্ম নির্মাতাগণ একে সেল্যুলয়েডের ফিতায় বন্দি করতে সক্ষম নয়। কিংবা মানুষের চিন্তা যাকে ব্যাখ্যাত করে হাজির করতে পারে না।

আমরা যখন, উক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে, শব্দ তৈরীর অভ্যন্তরীন ইন্দ্রিয়, চেতনা ও কর্মপ্রক্রিয়াকে চি ‎‎ হ্নত করতে সক্ষম হব, এবং সক্ষম হব তাকে উপলব্ধি করতে, তখন অবশ্যই তা আরো গভীরে হানা দিবে, আমাদের ভাব, চিন্তা ও চিন্তার প্রক্রিয়া আত্মস্থকরণ আরো সহজ হবে এবং আমরা চিন্তার বিনির্মাণেই সক্রিয় হতে পারব। যখন আমরা ইন্দ্রিয় ও চিন্তায় কর্ষণ করতে আরম্ভ করব, তখন এমন স্থান থেকে আমাদের কর্ষণ ও চিন্তা চাষ আরম্ভ করবে, যা মূলত: কেন্দ্র ও যা থেকে চিন্তার যাত্রা হয়।

যখন আমরা ক্রোধে ফেটে পড়ি, তখন ইন্দ্রিয়ের কোথা থেকে এর যাত্রা হয়, যদি আমরা তা চি ‎‎ হ্নত করতে সক্ষম হই, তবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার এ বাণীর অর্থ ও মাহাত্ম বুঝতে সক্ষম হব। কুরআনে এসেছে :-

وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ .

‘যারা ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।’ [সূরা আলে ইমরান : ১৩৪]

ক্রোধকালীন ঈমানী ইন্দিয়ের বিবর্তন ও পর্যায়গুলো তুমি গভীর মনোযোগে ভেবে দেখ। প্রথমে তা ক্রোধের উৎসারণ ক্ষেত্র থেকে ফেটে পড়ে, তারপর ঈমানী চেতনা ও ইন্দ্রিয় তাকে প্রশমিত করে। এভাবে যখন বান্দার মাঝে ঈমানী শক্তির বৃদ্ধি পেতে থাকে, ক্রমান্বয় উন্নতি ঘটে, তখন বান্দা তার প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করে দেয়। বান্দা সক্রিয় সাধনার ফলে যদি আরো শক্তিশালী হয়, তবে সে একটি স্থির অবস্থানে ফিরে আসে...এটিই হচ্ছে উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত ইহসান।

একইভাবে তুমি কুরআনের এ আয়াতে চিন্তা করে দেখ-

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ ﴿২০১﴾

‘নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়।’ [সূরা আরাফ : ২০১]

১২
দ্বিতীয় বপন: আকাঙ্ক্ষার বপন
أَمْ لِلْإِنْسَانِ مَا تَمَنَّى ﴿২৪﴾

‘মানুষের জন্য তা কি হয়, যা সে চায়?’ [সূরা নাজম : ২৪]

وَأَنَّ إِلَى رَبِّكَ الْمُنْتَهَى ﴿৪২﴾

‘আর নিশ্চয় তোমার রবের নিকটই হলো শেষ গন্তব্য।’ [সূরা নাজম : ৪২]

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آَثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا ﴿৬﴾

‘হয়তো তুমি তাদের পেছনে পেছনে ঘুরে দুঃখে নিজকে শেষ করে দেবে, যদি তারা এই কথার প্রতি ঈমান না আনে।’। [সূরা মারইয়াম : ৬]

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : ما يسرني أن لي أحدا ذهبا تأتي علي ثالثة، و عندي منه دينار، إلا دينارا أرصد لدين علي .

‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : উহুদ পাহাড় পূর্ণ স্বর্ণ হয়ে যাবে এবং আমার মালিকানায় আসবে, অত:পর তিন দিন পার হয়ে যাওয়ার পর আমার কাছে ঋণ আদায়ের জন্য রাখা কিছু দিনার ছাড়া আমার নিকট তার একটি দিনারও অবশিষ্ট থাকবে- এই ভাবনাটা আমাকে আনন্দ দেয় না’ [মুসলিম : ৯৯১]

১৩
একটি চিন্তার উদ্রেক : সংক্ষিপ্ত সময় ও অবস্থানে
একটি ক্ষুদ্র স্থান এবং সংক্ষিপ্ত ও সীমাবদ্ধ সময়ে একবার আমি আমার চিন্তাকে নতুন কোন সাদাকায়ে জারিয়া সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় নিয়োজিত করলাম। কিন্তু আমার চিন্তা আমাকে ঘিরে থাকা দেয়ালে হোঁচট খেল। তাই, আমি আমার সঙ্গী ‘ইয়াসির’-এর মাঝে চিন্তাটি ছড়িয়ে দিলাম। তাকে প্রশ্ন করলাম। লিফট দুবাই ব্যাংকের নীচ তলা থেকে আমাদেরকে পঞ্চম তলায় নিয়ে যাচ্ছিল। ...আমি তাকে লক্ষ্য করে বললাম, এইমন ক্ষুদ্র স্থানে, ক্ষুদ্র পরিসরের লিফটে তুমি কি চিন্তার সাদাকায়ে জারিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম?

আমার সঙ্গী দৃষ্টি ঝুকিয়ে, লিফটের মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে অত:পর দৃষ্টি তুলে বলল : এই লিফটে? এমন সময়ে? অসম্ভব !

আমি বললাম : আমিও এমন সময়ে সাদাকায়ে জারিয়া সৃষ্টির মত কোন চিন্তা ধারণ করছি না। তবে তুমি হতাশ হবে না, তোমার নিয়ত যদি হয় সত্য, ইচ্ছা হয় দৃঢ় এবং সঠিক উপায়ে তুমি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর, তিনি অবশ্যই তোমাকে কোন নতুন অভাবিত চিন্তায় অভিষিক্ত করবেন, এমনকি তুমি যদি কোন পাথর খন্ডেও দাঁড়িয়ে থাক।

এমন কোন পাথর কি নেই, যা থেকে পানি ও নদ প্রবাহিত হয়? বনী ইসরাইলের বারটি দলের জন্য পাথর থেকে এক আঘাতে বারটি ঝর্ণাধারা উৎসারিত হয়নি কি?

তুমি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, এবং হতোদ্যম হয়ো না...।

তোমার পক্ষে এটা কি সম্ভব নয় যে, তুমি লিফটের দেয়ালে কয়েকটি দুআ লিখে দিবে, যা পড়ে মানুষ আমল করবে?

সর্বদা মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এমন কয়েকটি ভুল চি ‎‎ হ্নত করে তা সংশোধনের জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিতে পার না?

এমন কি সম্ভব নয় যে, তুমি কোন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে তারা এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিবে এবং বিজ্ঞপ্তি আকারে এ সমস্ত স্থানগুলোতে টানিয়ে দিবে?

কিংবা তুমি কি ছোট্ট কোন অডিও তৈরী করতে পার না, যা হবে খুবই কল্যাণকর এবং যা এই লিফটগুলোতে স্থাপন করা হবে? আমরা লিফট থেকে নামলাম।

আমার বন্ধু দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকল। আমার অনুভব ও চিন্তা তার মাঝে কাজ করছিল। সে নানাভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবছিল, এক-একটি চিন্তা ও পরিকল্পনা আমার কাছে নিয়ে আসছিল, আমি অন্য ভালো কোন চিন্তা উদ্রেকের অপেক্ষায় সেগুলো বাতিল করে দিচ্ছিলাম। অত:পর যখন খাবারের সময় হল, আমরা খাবার গ্রহণের জন্য প্রস্ত্তত হলাম, সে বলল : পেয়েছি ! আমরা একটু পরে খাবার গ্রহণ করি। আমি বললাম, বলো !

সে বলল : লিফটের দেয়ালগুলো বিজ্ঞপ্তি আকারে কিছু প্রকাশের জন্য উত্তম স্থান, সন্দেহ নেই। মানুষ যতটা সময় লিফটে কাটায়, তা একটি পুরো বিজ্ঞপ্তি পড়ে শেষ করার জন্য যথেষ্ট। নগরের বিলবোর্ডগুলো যতটা কার্যকরী, তার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী ও দৃষ্টি আকর্ষণকারী হবে এগুলো। প্রতিটি লিফটে নিদেনপক্ষে তিনটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা যায়। কিন্তু আমরা একটি ঘোষণা বা নির্দেশনা দিব। এতে অধিক দৃষ্টি পড়বে।

আমরা যখন- উদাহরণত:, জানতে পারলাম যে, কুয়েতী ব্যাংকের পঞ্চাশটিরও অধিক স্থাপনা রয়েছে, এর অধিকাংশ স্থাপনায় রয়েছে দুটি করে লিফট, তখন আমাদের এ চিন্তা কী পরিমাণ ফল বয়ে আনার সম্ভাবনা তৈরি করবে তা ভেবে শিহরিত হলাম। সুতরাং যদি আমরা এই চিন্তাকে কোন সাংগঠনিক রূপ দিতে পারি, তবে তা কী বিপুল ফল বয়ে আনবে তা নি:সন্দেহ হলাম।

পাঠক ! এটি ছিল আমাদের একটি ক্ষুদ্র চিন্তা, যা একটি ক্ষুদ্র সময়ে আমাদের চিন্তার এলাকয় উদয় হয়েছে।

সুতরাং, যখন তুমি তোমার চারপাশে নজর বুলাও, তখন হেলায় দৃষ্টি দিয়োনা, দৃষ্টির সেই ক্ষণগুলোকে অবহেলাভরে নষ্ট হতে দিয়ো না। কিছুই যেন তোমার আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে না দেয়, এবং সাদাকায়ে জারিয়ার সৃষ্টিতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।

উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা চিন্তানৈতিক একটি বড় পরিবর্তনের দিকে যেতে পারি, আমরা এই ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বড় পরিসরে যাত্রা করতে পারি। আমরা আশা করব, তুমি আরো বড় করে ভাববে, তুমি নিজেকে ছড়িয়ে দিবে আরো বৃহৎ অবস্থানে। সম্ভাব্য সর্বস্ব নিয়োগ করে তুমি কোন দাওয়াতী প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করবে, আমরা অধীর হয়ে এই আশাই করব।

কল্পনা কর, তুমি দাঁড়িয়ে আছ মানচিত্রের গোলকের সামনে, যা নির্মিত হয়েছে নগন্য প্লাস্টিকের মাধ্যমে। তুমি সত্য ও স্থির মনে আল্লাহর প্রতি রুজু কর। সেই আল্লাহর আশ্রয়, আসমানসমূহ ও যমীনে যা রয়েছে, তার একক রাজত্ব যার, সেই আল্লাহর আশ্রয়, ভূতলের যাবতীয় বিষয় যার অধীনে।

হয়তো তিনি তোমাকে এমন কোন চিন্তায় ভূষিত করবেন, যা হবে পুরো বিশ্ব ব্যাপী। যার মাধ্যমে তিনি বিশ্বের তাবৎ অধিবাসীদের অন্তর সিঞ্চিত করবেন, যারা সেই মহান ব্যক্তিত্বের অনুসারী, যার ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ তাআলা এই ঘোষণা দিয়েছেন :-

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ﴿১০৭﴾

‘আর আমি তো তোমাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ [সূরা আম্বিয়া : ১০৭]

আমি এ ব্যাপারে অবগত আছি যে, এ যুগের অধিকাংশ লোকই এই ধারণা ও চিন্তাকে অসার মনে করবে, খুবই অর্থহীন ভেবে একে উড়িয়ে দিবে।

এমন যুগেও যারা আকাঙ্ক্ষায় দৃঢ়, প্রখর বিশ্বাসী, তাদের মাঝে ন্যুনতম প্রভাব সৃষ্টির জন্য আমি বলব :

অস্তিত্বময় এ জগতে যে কোন অস্তিত্বেরই রয়েছে এক ধরনের প্রভাব, বস্ত্তর অস্তিত্ব, বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা অনুসারে তার প্রভাব সৃষ্টি হয়। কিন্তু মৌলিক কথা হচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছায়, এই পৃথিবীতে আমাদের মাঝে যে ব্যক্তি কল্যাণের ধারা তৈরী করবে, সে আমাদেরই মত একজন হবে, এর বাইরে নয়। সে বরং, তার চারপাশের সাথে চুড়ান্তভাবে সংশ্লিষ্ট হবে। এভাবেই, এই পৃথিবীর শেষ অবধি কল্যাণ ও কল্যাণকর ব্যক্তিদের ধারা অব্যাহত থাকবে।

তোমার নিকট যদি পানি ভরা কোন পাত্র থাকে, আর তুমি তাতে লাঠি দিয়ে আঘাত কর, তবে ফল এই দাঁড়াবে যে, পাত্রের পানিগুলো নড়ে উঠবে, যখন লাঠিটি বের করবে, তখন আবার নড়বে। তখন তোমার স্থির বিশ্বাস দাঁড়াবে যে, লাঠির আঘাতের ক্রিয়া কেবল পানি ও তার আশপাশেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এমনিভাবে, লাঠির ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়, যখন পাত্র কিংবা লাঠির আকার বড় হয়। আমাদের চারপাশে, দৃষ্টির প্রান্ত জুড়ে যে জগত ছড়িয়ে আছে, তা ঐ পাত্রের মত, আর আমাদের ঊর্ধ্বে যে শূন্য তার বিশাল অস্তিত্ব বিস্তার করে আছে, তা পানির মত।

এ হচ্ছে প্রাকৃতিক যুক্তি, ঈমানী যুক্তির ক্রিয়া-বিক্রিয়া, এই জগতে, আরো অনেক বড় ও মহান, পাত্রে যে পরিমাণে ক্রিয়া করে একটি লাঠি, তার সাথে এর কোন তুলনা চলে না।

জগতের এই অস্তিত্বে মুমিনের উপস্থিতি তার প্রভাব ছড়িয়ে দেয়, যেমন অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি অণু-পরমাণুতে। আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আলোকিত দ্বীপাধার বলে অবহিত করেছেন। কুরআনে এসেছে :

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ﴿৪৫﴾ وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا ﴿৪৬﴾

‘হে নবী, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে,আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ হিসেবে। ’ [সূরা আহযাব : ৪৫-৪৬]

জগতসমূহের উপর রাসূলের প্রভাবের বিস্তৃতি তুমি কি দেখ না? তুমিও সেই মহৎ ও উজ্জ্বল দ্বীপাধারের অংশ। কুরআনে এসেছে :

أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَنْ مَثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِنْهَا كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْكَافِرِينَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿১২২﴾

‘যে ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য নির্ধারণ করেছি আলো, যার মাধ্যমে সে মানুষের মধ্যে চলে, সে কি তার মত যে ঘোর অন্ধকারে রয়েছে, যেখান থেকে সে বের হতে পারে না? এভাবেই কাফিরদের জন্য তাদের কৃতকর্ম সুশোভিত করা হয়।’ [সূরা আনআম : ১২২]

উম্মতের সেই মহান খুলাফায়ে রাশিদীন, তাদের কথা কি তুমি ভুলে গিয়েছ?

আবু হানীফা, মালিক, শাফেয়ী ও আহমদ- উম্মতের এমন মহান অনুসৃতগণের কথা কি তুমি বিস্মৃত হয়েছ? তারা তাদের কালে কীভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে আছেন, তা কি তোমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে? এমনকি, তারা তাদের কাল ছাপিয়ে আমাদের কাল অবধি নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে আছেন, কিয়ামত অবধি, আল্লাহ চাহে তো তাদের এই প্রভাব অব্যাহত থাকবে।

উম্মতের সেই যাত্রাকাল থেকে আজ অবধি যে সকল মহাপুরুষ অতিক্রান্ত হয়েছেন, এবং তাদের প্রভাব আমাদের মাঝে এখনো অটল আছে, তুমি তাদের কথাও ভুলে যেয়ো না।

পার্থিব ও বস্ত্তগত সীমার মাধ্যমে যে উক্ত প্রভাবে দৃষ্টি দিবে, সে নিশ্চয় এ আলোচনার কোন যৌক্তিক সার খুঁজে পাবে না। সে নিশ্চয় আমাদের আলোচনায় হতাশ হবে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর সাথে অঙ্গিভুত করে নিবে, যার হাতে প্রতিটি বস্ত্তর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এবং কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করবে যে, আসমানসমূহ ও যমীনের নূর হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা, মানুষের অন্তরগুলো আললাহ তাআলার পবিত্র অঙ্গুলিসমূহের দু’ অঙ্গুলি মাঝে অবস্থিত, যেমন ইচ্ছা তিনি তাকে পরিবর্তিত করেন এবং তিনি এ ধরনের প্রভাব ও ক্রিয়াকে সকল মানুষের অন্তরের মাঝে বিস্তৃত করে দিতে সক্ষম, সে অবশ্যই এই দৃঢ় ধারণায় উপনীত হবে যে, আল্লাহ যদি বিষয়টি সহজ করে দেন, তবে তা খুবই সহজ। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ বিরল নয়।

তুমি অন্তরকে স্মরণ করিয়ে দিবে, তার সামনে তুলে ধরবে সেই মহান ব্যক্তিত্বদেরকে, যারা ইতিপূর্বে বিগত হয়েছেন, নিজেদের শারীরিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও এখনো যারা আমাদের অন্তরজুড়ে আছেন এবং তোমার বুদ্ধির সামনে একটি যৌক্তিক কাঠামো তুলে ধরবে, যাতে যুক্তির এলাকায় সে বরাভয় খুঁজে পায়।

চিন্তার পরিপুষ্টতার এই সুযোগ তুমি কোনভাবেই হাতছাড়া করো না, কারণ, তুমি জান না, জীবনের কতটা সময় তোমার অবশিষ্ট আছে। এ জীবন সূতোর মত, যে কোন সময় তা ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।

১৪
তৃতীয় বপন: মুমিনের বৃক্ষ
وَهُزِّي إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا ﴿২৫﴾

‘আর তুমি খেজুর গাছের কান্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, তাহলে তা তোমার উপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে।’ [সূরা মারইয়াম : ২৫]

عن ابن مسعود رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لقيت إبراهيم ليلة أسري بي، فقال : يا محمد أقرئ أمتك مني السلام، و أخبرهم أن الجنة طيبة التربة عذبة الماء، و أنها قيعان، و أن غراسها سبحان الله و الحمد لله و لا إله إلا الله و الله أكبر .

ইবনে মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে রাতে আমাকে ভ্রমণ করানো হল (মিরাজের রাত্রিতে) সে রাতে ইবরাহীমের সাথে আমার সাক্ষাত হল। সে বলল, হে মুহাম্মাদ, আমার পক্ষ থেকে তুমি তোমার উম্মতকে সালাম জানিয়ো। এবং তাদেরকে এ সংবাদ প্রদান কর যে, জান্নাতের মাটি হবে উর্বর, পানি হবে মিষ্ট এবং তা হবে লেকবিশিষ্ট। তার বপন হল ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’। [তিরমিযী : ৩৪৬২]

আমি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই সাদাকায়ে জারিয়া সম্পর্কে গাফিল ছিলাম, এটি আমাকে ভীষণ অবাক করেছে। আমি প্রতি দিন আমার আবাস থেকে অফিসে যাতায়াত করতাম, আমার আসা-যাওয়ার পথের দুপাশে ছিল সারি সারি খেজুর বৃক্ষ। প্রতিদিন দৃষ্টির সামনে এগুলো ছিল যদিও, কিন্তু আমি ছিলাম গাফিল, এগুলো থেকে কোন সাদাকায়ে জারিয়ার চিন্তা আমার চিন্তাজগতে হানা দেয়নি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল, একদিন ‘আবু মুহাম্মাদ’- একজন দরিদ্র ব্যক্তি, যে তার দারিদ্রে্যর কথা কখনো মুখ ফুটে বলে না- আমাকে সচেতন করে তুলল।

আমি বললাম, সুবাহানাল্লাহ ! এই সারি সারি খেজুর বৃক্ষগুলোর মাঝে লুকিয়ে আছে কত সাদাকায়ে জারিয়ার সম্ভাবনা, প্রতিদিন সকাল-বিকাল এই পথ দিয়ে আমরা হেঁটে যাই, কিন্তু এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করি না। আমাদের দেশে খেজুর গাছের সংখ্যা চল্লিশ মিলিয়নেরও অধিক। পথের পাশে ফলদার যে বৃক্ষগুলো ছড়িয়ে আছে তার সংখ্যা প্রায় এক মিলিয়ন, যার দেখভালের দায়িত্ব সরকারের। যখন তা ফল দেয়, পথচারীদের জন্য তা রেখে দেয়া হয়, পথচারীগণ ইচ্ছা মত সেখান থেকে নিয়ে যায়, এবং নিয়ে যাওয়ার পরও এতটা বাকি থাকে যে, মনে হয়, এ থেকে কিছুই নেয়া হয়নি। ফল থাকা অবস্থাতেই সেগুলো শুকিয়ে যায়, ফলে তা আগুনে জ্বালিয়ে নি:শেষ করে দেয়া হয়। এভাবেই প্রতি বছরের রীতি চলে আসছে।

বিষয়টি আমার চিন্তায় ভালভাবে জেকে বসার পর আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম, এবং অনেকের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে আরম্ভ করলাম। তারা আমার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিল না। এর পর থেকে যখনি আমি এই পথ দিয়ে কোথাও গিয়েছি, আমার চিন্তা ছিল কীভাবে এই শুকনো ডাল-পালা থেকে জন্ম দেয়া যায় কোন সাদাকায়ে জারিয়ার।

অবশেষে আমি কয়েকটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছি, আমি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা জানাচ্ছি, যে ব্যক্তি একে বাস্তব সাদাকায়ে রূপ দেয়ার প্রয়াস চালাবে, তিনি যেন তাকে উত্তম সহায়তা দেন।

১৫
প্রথম প্রক্রিয়া : খেজুর আহরণ
এই বরকতময় বৃক্ষ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতার ফলে আমরা দেখতে পাব, এর উৎপাদিত ফল খুবই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, বিশাল সম্ভাবনাময় ও অঢেল। মাঝারি মানের একটি খেজুর গাছ যদি দশ থোকা খেুজর ফলন দেয়, প্রতিটি থোকায় থাকে দশ কিলোগ্রাম খেজুর- সাধারণত যার দ্বিগুণ ফলন হয় আমাদের দেশের খেজুর গাছগুলোতে- তাহলে কয়েকশ টন খেজুর কেবল আমাদের পথের পাশের খেজুর বৃক্ষগুলো থেকে উৎপাদন সম্ভব। যদি বৃক্ষের সংখ্যা অধিক হয় এবং ফল হয় আরো অধিক, তবে কী পরিমাণ খেজুর পাওয়া যাবে- একবার ভেবে দেখ !

যখন এই খেজুরগুলো নির্দিষ্ট হারে টিনজাত করা হবে, যার কিছু থাকবে বিক্রির জন্য, কিছু থাকবে দরিদ্রদের মাঝে সাদাকা করার জন্য কিংবা রোজাদারদেরকে ইফতার করানোর জন্য, তখন এর অপার সম্ভাবনা দেখে আমরা রীতিমত শিহরিত হব, সন্দেহ নেই। লাখ লাখ দরিদ্রের খাদ্য সংস্থান হবে এ থেকে, অসংখ্য রোজাদারকে এর মাধ্যমে ইফতার করানো যাবে। এবং অন্যান্য সহায়তামূলক কর্মকান্ডের ফান্ড সংগ্রহ করা যাবে এ থেকে, আমরা এর ব্যবসায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অর্থ আয় করতে সক্ষম হব। খেজুর বৃক্ষ কেন বরকতময়, এ থেকেই স্পষ্ট হয়।

খেজুর বৃক্ষ অনেক অনেক সাদাকায়ে জারিয়ার জন্মদাতা...।

এ প্রক্রিয়াটি সচল হল অনেক কৃষীজীবি খুঁজে পাব, যারা আখিরাতের সওদার জন্য আমাদের সাথে শরিক হবে, হয়তো তাদের কেউ কেবল প্রয়োজন পরিমাণ রেখে নিজের উৎপাদিত সকল খেজুর আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিবে।

অত্যন্ত দু:খজনক হল, আমরা প্রতি বছরই এই অঢেল সম্ভাবনাময় বস্ত্তকে হেলায় নষ্ট করে দিচ্ছি, নিআমতের না-শুকরি করছি। পৃথিবীর নানাস্থানে মানুষ যে খাদ্য সংকটের কারণে মারা যাচ্ছে, যাপন করছে মানবেতর জীবন, এর জন্য প্রকারান্তরে আমরাও দায়ী হচ্ছি। আমরা কি একে নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তরে, যেখানে মুসলিমরা না-খেয়ে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি না?

১৬
দ্বিতীয় প্রক্রিয়া : খেজুরের রস উৎপাদন
রাতের আধারে খেজুর রসের ধারা সশব্দে পাত্রে পড়ছে সেই স্মৃতি আমার এখনো স্মরণে আছে। খেজুরের রস সংগ্রহের মৌসুমে সকলে তৎপর থাকত, একটি টিন রসে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে সাথে সাথে আরেকটি টিন স্থাপন করা হত। এভাবে রাতভর এবং দিনেও রসের ধারা অব্যাহত থাকত। কয়েক দিন তা অব্যাহত থেকে একসময় তা ক্ষীণ হয়ে যেত। আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়ে যেত। শেষ হওয়া অবধি দেখা যেত, দশটি বিশাল বিশাল পাত্র পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

খেজুর বিক্রি করে যে পরিমাণ অর্থ আয় হত, রস বিক্রির আয় তার চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। যে বাগানে আমরা খেজুর ও তার রস চাষ করতাম, তা ছিল ছোট, সারা দেশের কেবল পথের যে গাছ রয়েছে, তার সামনে এগুলো কিছুই না। যদি আমরা পথের খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করি, তবে তা কি পরিমাণ ফলদায়ক হবে, তা বলাই বাহুল্য।

১৭
তৃতীয় প্রক্রিয়া : আসবাবপত্র তৈরীকরণ
খেজুর হচ্ছে মুমিনের বৃক্ষ, যার কল্যাণের ধারা কখনো সঙ্কুচিত হয় না, এবং যার বরকত অবিচ্ছিন্ন। খেজুর বৃক্ষ থেকে আমরা আর যা যা তৈরী করতে সক্ষম তা হচ্ছে তার আঁশ থেকে নৌযানের রশি, পাতা থেকে পাটি ও মাদুর এবং মাছ ধরার জাল- ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরোয়া আসবাপত্রও অনায়াসে এ বৃক্ষ থেকে তৈরী করা যেতে পারে।

১৮
চতুর্থ প্রক্রিয়া : গৃহ নির্মাণ
ইট-কাঠ-লোহার গৃহের পূর্বে আমরা যে ধরনের গৃহে বসবাস করতাম, এই বরকতময় বৃক্ষ ব্যবহার করে আমরা অনুরূপ গৃহ নির্মাণ করতে পারি। খেজুর গাছের পাতা, আঁশ ও ডাল থেকে এমন লোকদের জন্য আমরা গৃহ নির্মাণ করতে পারি, মাথা গোজার মত যাদের কোন ঠাঁই নেই। সাধারণ লোকের ব্যবহৃত তাঁবুর তুলনায় এটি কোন অংশেই খারাপ হবে না। এটি হবে পরদার অধিক নিকটতর, শীতে উষ্ণ, গ্রীস্মে শীতল, বৃষ্টিতে পানি ঝরবে না এবং মজবুত হওয়ার ফলে বাতাসে হেলবে না এবং এটি দীর্ঘদিন অনায়াসে ব্যবহার করা যাবে।

দশটি খেজুর বৃক্ষ ব্যবহার করে দু রুমের একটি গৃহ নির্মাণ করা যাবে। এই গাছগুলোকে ডাস্টবিনে কিংবা জ্বালিয়ে ফেলার তুলনায় দরিদ্রদের জন্য তা দিয়ে গৃহ নির্মাণ কি উত্তম নয়? একটি দেশে যদি চল্লিশ মিলিয়নের তুলনায় অধিক খেজুর গাছ থাকে, তবে প্রতি বছর তার অধীনে দরিদ্রদের পুনর্বাসনের জন্য কতগুলো গৃহ নির্মাণ সম্ভব?! এ অকল্পনীয় সুযোগ আমরা হেলায় হারাচ্ছি, অথচ এ ব্যাপারে আমরা মোটেও সচেতন নই।

এই সহজ ও স্বল্পব্যয়ী মাধ্যমটি ব্যবহার করে দরিদ্র ও অসংখ্য গৃহহীন মুসলমানকে গৃহের ব্যবস্থা করতে পারি। অসংখ্য নব দম্পতিকে গৃহ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি এবং ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে যে বিস্তৃত ভূমি অব্যবহৃত পড়ে আছে, মরুভূমি হয়ে ছড়িয়ে আছে নানা দেশে, গৃহহীন হয়ে আছে অগণিত মানুষ, হয়তো কোন তাঁবু, ছেঁড়া বসন ও নূন্যতম আশ্রয় নিয়ে মানবেতরভাবে টিকে আছে আমরা তাদেরকে সামান্য স্বচ্ছলতা দিয়ে হলেও সহযোগিতা করতে পারি। নগরের ফুটপাতে, ওভারব্রীজের নিচে যারা জীবনের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে যাচ্ছে, বনে বাদারে, পাহাড়ে ও মরুভূমিতে কঠিন যাতনা ভোগ করছে, এবং এমন দৃষ্টান্তও আছে যে, মানুষ বসবাসের স্থান না পেয়ে ভাঙ্গা ও পরিত্যাক্ত কবরে রাত কাটাচ্ছে, আমরা এর মাধ্যমে, এ প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারি।

এ প্রক্রিয়াটি কোন এক বছরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং যতদিন খেজুর বৃক্ষ আমাদের দেশে উৎপন্ন হবে, ততদিন এই মাধ্যমটি এবং এর মাধ্যমে বরকতের ধারা অব্যাহত থাকবে।

হয়তো প্রক্রিয়াটিকে আরো বিজ্ঞান সম্মত ও শক্তিশালী টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আরো দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হব, যা হবে স্বাভাবিকের তুলনায় আরো টেকসই, যা অন্যান্য গৃহের মত দ্রুত ক্ষয়ে যাবে না, নষ্ট হবে না। বৃষ্টিতে ও আগুনে বিধ্বস্ত হবে না। যে সমস্ত মরুভূমিতে পানির ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই, সেখানে এ সমস্ত আবাস ব্যবহার করে নতুন নতুন গ্রাম ও নগরী গড়ে তোলা যাবে।

১৯
পঞ্চম প্রক্রিয়া : সিরকা তৈরী
খেজুরগুলো ব্যবহার করে আমরা অনায়াসে সিরকা তৈরী করতে পারি, এমনকি যেগুলো নিম্নমানের, যা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করার মত নয়, সেগুলোকেও সিরকা বানিয়ে বাজারজাত করা সম্ভব।

খেজুর বৃক্ষ ও তার ফলন নিয়ে আরো গবেষণা আমাদেরকে নতুন নুতন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিবে, আমরা আমাদের এই ক্ষুদ্র কলেবরে সংক্ষেপে কিছু আলোচনার প্রয়াস চালিয়েছি। গবাদিপশুর খাদ্য ও কাগজ ইত্যাদি বানান সম্ভব খেজুরের আটি থেকে- অনেকের সাথে আলোচনা করে যা আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

খেজুর বৃক্ষ- সন্দেহ নেই, খুবই বরকতময় একটি বৃক্ষ।

কল্যাণকর অনেক কিছুর উদ্ভাবন সম্ভব এ বৃক্ষ থেকে, কিন্তু তাকে অবশ্যই একটি শৃঙ্খলায় নিবিষ্ট করতে হবে, যাতে তার কল্যাণ অব্যাহত একটি কল্যাণের রূপ লাভ করে এবং দীর্ঘ সময় তা অব্যাহত থাকে। কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ যদি তার নামকরণ করে ‘মুমিনের বৃক্ষ’ নামে কিংবা এ ধরনের নাম যদি সে পছন্দ করে, অত:পর মাঠ পর্যায়ে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা চালায় এবং দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য মাধ্যমটি কী কী উপকার বয়ে আনতে সক্ষম সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে অবহিত করে, তাহলে তা হবে কার্যকরী ও ফলপ্রসু একটি কাজ।

এর মাধ্যমে আল্লাহর নিআমত নষ্ট হওয়া বন্ধ হবে। যেভাবে এ উপকার আমরা বিনষ্ট করছি, এক সময় তা আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে সন্দেহ নেই। আমরা কেন এই বৃক্ষগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছি?

অধিক হারে এই গাছ রোপন করলে আমাদের রিযকে প্রসস্ততা আসবে এবং আল্লাহ চাহে তো বৃষ্টির নিআমতে আমরা বিধৌত হব। কে জানে, হয়তো আমরা এ গাছের প্রতি অধিক যত্নশীল নই বলেই আমরা বৃষ্টির নিআমত থেকে সব সময় বঞ্চিত হচ্ছি।

এর ফলে রাষ্ট্র ও জনগণ অধিক হারে এ বৃক্ষটির প্রতি নজর দিবে, ফলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে, পরিচ্ছন্নতা আসবে এবং ফলনশীলতা বহুগুণে বাড়বে।

রাষ্ট্র ও সরকার- বর্তমানে যে এ গাছগুলোর রক্ষাবেক্ষণ ও দেখভালের দায়িত্ব পালন করে, তাকে সহযোগিতা করা হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্বে কেবল পানি দেয়া, রোপন করা ইত্যাদি। কিন্তু উক্ত সংস্থা এর বাইরে আরো কিছু দায়িত্ব পালন করবে। গাছগুলো পরিচ্ছন্ন করবে, কাটবে এবং ফলন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে যাবে।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। প্রয়োজনগ্রস্ত অনেক কৃষক ও কৃষক পরিবারকে এভাবে আমরা অন্ন ও বস্ত্র সংস্থানে সহযোগিতা করতে পারব। প্রতি শ্রমিককেই তার প্রয়োজনমত পারিশ্রমিক- খেজুরের আয় থেকে দেয়া সম্ভব হবে। এটি তাদের জন্য, সন্দেহ নেই, বিরাট সহযোগিতা, দারিদ্র্য দূরিকরণের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।

এ প্রক্রিয়াটি সচল করার পাশাপাশি আমরা এমন আরো অনেক প্রজেক্টের সূচনা করতে পারি, যা বিপুল অর্থ আয় করতে সক্ষম। যেমন, অন্যান্য ইসলামী দেশ ও রাষ্ট্রগুলোতে কৃষি সম্প্রসারণ, প্রাকৃতিক মধু উৎপাদন কিংবা খেজুরের মাধ্যমে যে আয় হবে, তার মাধ্যমে অন্যান্য এলাকায় কৃষি সহযোগিতা প্রদান ইত্যাদি।

যে সমস্ত দেশে মুসলিম কৃষকরা দরিদ্র অবস্থায় জীবন যাপন করছে, অর্থের অভাবে কৃষির প্রসার ঘটাতে পারছে না, আমরা এর মাধ্যমে তাদেরকে ভাতা ইত্যাদি প্রদানের দ্বারা স্বাবলম্বি করে তুলতে পারি।

সর্বশেষ আমি বলব : ‘আবু মুহাম্মাদ’ যদি তার দারিদ্রে্যর কারণে আমাদেরকে এই চিন্তা ও তার বপনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে তুলতে পারে, এবং আমরা যদি প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র ব্যক্তিদের অনুভূতি নিয়ে ভাবি, তাকে বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে সন্দেহ নেই, আমরা তাদেরকে আর বেশি দিন দরিদ্র হয়ে থাকতে দিব না।

আবু মুহাম্মাদ যদি তার দারিদ্রে্যর কারণে এই চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়, তাহলে আমরা কেন আল্লাহর কালাম এবং তার প্রেরিত রাসূলের উক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হই না? তা থেকে নতুন নতুন চিন্তার অনুসন্ধান করি না? আল্লাহ তাআলার কালাম, রাসূলের উক্তির ছত্রে ছত্রে ভরে এই ধরণের চিন্তার খোরাক। কিন্তু কে এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবে? কে সেগুলোকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসবে?

আমরা এখানে খেজুর বৃক্ষ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছি, যাতে পরিবর্তনটি এমন এক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়, যা হবে বাস্তব ও সুষ্ঠু পদ্ধতিগত এক পরিবর্তন, যা আমাদের ও অন্যান্য মুসলিম দেশে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে।

কৃষি এমন এক সম্পদ, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই যে সম্পদে সম্পদশালী। প্রয়োজনের সময় যারা আমাদের প্রতি ওৎ পেতে থাকে, এ সম্পদের সুষ্ঠু চর্চার ফলে আমরা অনায়াসে তাদের থেকে অমুখাপেক্ষী হতে সক্ষম হব।

এ এমন এক সম্পদ, যা অন্য অনেক সম্পদের শিরোনাম, যা থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক শিরোনামের জন্ম হয়।

জৈব সম্পদ, তার প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পানি সম্পদের মূলেই হচ্ছে কৃষি সম্পদ।

আমাদের প্রয়োজন কোন একটি নিরাপদ সংস্থা, যাকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে বিশেষ এই কাজের জন্য, এর জন্যই যাকে নিবেদিত করা হবে, এবং তাকে পরিচালিত করবে এমন এক ব্যক্তি যিনি এ ব্যাপারে পারদর্শী। এবং যিনি একে একটি সম্পদশালী ও ফলদায়ক বীজে পরিণত করতে সক্ষম হবেন।

যিনি মরুভূমিকে সবুজ বরকতময় উদ্যানে রূপান্তরিত করতে পারবেন। ফেলে দেয়ার বস্ত্তকে পরিপূর্ণ কল্যাণে নিয়োজিত করবেন, এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিতে মৃত্যুকে রূপান্তরিত করবেন জীবনময়তায়।

পদ্ধতিগত রূপান্তর ও পরিবর্তনের সূচনা হতে হবে আমাদের ভিতরগত পরিবর্তনের মাধ্যমে।

আমাদের চিন্তায় যখন বাক্যাবায়ব ধরা দেয়, তখন কীভাবে তাকে আমরা গ্রহণ করছি, কীভাবে তার মুখোমুখি হচ্ছি এবং পরবর্তীতে তা কীভাবে আমাদের কাজে-কর্মে প্রভাব বয়ে আনে, আমাদের গতি ঠিক করে দেয়, তা অনেক কিছু নির্ভর করে।

এ পরিবর্তন ও রূপান্তরের মূলমন্ত্র হবে ‘কৃষি উৎপাদনের পদ্ধতি’- ‘কৃষি সৌন্দর্যের পদ্ধতি’ নয়।

সৌন্দর্য প্রয়োজন নেই- এমন মত আমরা কখনোই পোষণ করি না। কিন্তু সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যের চর্চাই একমাত্রিক লক্ষ্য ও ধ্যানজ্ঞান করার পুরোপুরি বিরোধিতা আমরা করি। এটি খুবই ক্ষতিকর একটি বিষয়। কারণ, এটি কোন ভাল সুসংবাদ বয়ে আনে না। সৌন্দর্য চর্চা করতে গিয়ে মানুষ অঢেল অপচয় ও বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত অহরহ খুঁজে পাওয়া যায়।

২০
চতুর্থ বপন: ইমাম
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ ﴿২৪﴾

‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।’ [সূরা সিজদা : ২৪]

عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : إنما جعل الإمام ليؤتم به .

আনাস বিন মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আনুগত্যের জন্যই ইমামকে নির্ধারণ করা হয়েছে।’ [বুখারী : ৭২২]

২১
একজন ইমাম...অনুসারীগণ যার পরিচয় জানে না
আমি তার পাশে বসা ছিলাম, বসে তার আলোচনা শুনছিলাম, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসছিল, আমি অভিভূত হচ্ছিলাম। আমি তার সত্য ও দৃঢ় বক্তব্য শুনছিলাম, সে যা বলছিল তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল অনেক অনেক কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা, অনেক কিছু সে চেপে যাচ্ছিল, যখন সে নিজের সম্পর্কে বলছিল।

আমি ইতিপূর্বে বেশ কিছু কল্যাণমূলক কাজ নিয়ে অনেক ভেবেছি, বয়সে ত্রিশের কোঠায় পৌছে আমার ধারণা হয়েছিল, আমি মনে হয় কাঙ্ক্ষিত একটি স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। অথচ আমি অবাক হলাম, যখন জানতে পারলাম যে, সে পনেরো বছর বয়সেই সেই স্তরে পৌছে গিয়েছে, সে এই কল্যাণমূলক কাজ নিয়ে বিস্তৃত ভেবেছে। মাধ্যমিক ক্লাসে থাকাকালিন সে এমন কিছু ভাবতে আরম্ভ করেছে এবং মনে মনে ছক কষেছে, যা আমার কাছে অকল্পনীয়। সে তখনি ইসলামী আইন নিয়ে একটি স্কুল চালুর ছক এঁকেছে, কুরআন হিফযের জন্য একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য কী কী প্রয়োজন তা নিয়ে প্রগাঢ় ভেবেছে, যুবকদের আত্মিক ও পারত্রিক উন্নতির জন্য কার্যকরী কিছু করার প্রেরণা বোধ করেছে ইত্যাদি।

হয়তো আল্লাহ তাআলা তার সততা কবুল করেছেন, তাকে ইমামদের ইমাম হওয়ার তাওফীক দিয়েছেন, যাতে তিনি ইমামাতের স্তরকে উজ্বল ও সুউচ্চ করে তুলতে পারেন। আমি, নি:সন্দেহে, তাকে একজন সত্য ইমাম মানি, আমার এ ধারণা কতটা সত্য তা আল্লাহই ভাল জানেন।

তুমি কি এমন মুসলিম দেশের নাম বলতে পার, প্রাতিষ্ঠানিক কল্যানমূলক দাতব্য কাজে যে কুয়েতের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। আরব ভূমিতে, কিংবা বলা যায়, পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক দাতব্য কাজে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ কুয়েত। কুয়েতের পর মানুষ ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো কাকে অনুসরণ করবে? আল্লাহই ভাল জানেন এ উত্তম ধারা এই দেশ ও এই সময়ে কে চালু করেছে।

‘ফুহাইহীল’ দাতব্য সংস্থা ছিল সে সময়ের অন্যতম ও আদর্শ একটি সংস্থা, কুয়েতে যে সমস্ত দাতব্য সংস্থা কাজ করছে, এটি ছিল তার প্রথম দিককার। কিন্তু অদ্ভুত হচ্ছে যে ব্যক্তি এই কাজটির সূচনার প্রথম চিন্তা করেছিল এবং প্রতিষ্ঠা করেছিল, কুয়েতবাসী আজ অবধি তাকে চেনে না।

এই হচ্ছে সেই অদ্ভুদ ও অচেনা ব্যক্তি, যার কথা আমি এখন তোমাদেরকে শোনাচ্ছি। প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কাজের সে ছিল উৎস, যদি সে মন্দ মনে না করত, এবং কষ্ট না পেত, তবে অবশ্যই তার নাম আমি এস্থলে উল্লেখ করে দিতাম, যে নাম আজ অবধি কেউ জানে না।

এই মহান ব্যক্তিত্ব আমাকে বলছিল : কুয়েক ত্যাগের দীর্ঘ কয়েকটি বছর পর আমি একবার সে সংস্থা পরিদর্শনে গেলাম। তখন আমার ভিতর নানা স্মৃতিচারণ মধুর হয়ে কাজ করছিল। আমি ‘ফুহাইহীল’ এ গেলাম, সংস্থার অফিসে গেলাম। দেখলাম, এক বিপুল কর্মচাঞ্চল্য ও তৎপরতা বিরাজ করছে। দেখে আমার অন্তর জুড়িয়ে গেল, আমি আল্লাহর প্রশংসা করলাম, ভীষণ অভিভূত হলাম।

অফিসের এক নীরব কোণে দাঁড়িয়ে আমি স্মৃতি চারণ করছিলাম, তখন একজন কর্মকর্তা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি প্রয়োজন আছে, আমরা তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? তুমি চাও যে, আমরা তোমার ব্যাপারে বিবেচনা করি?’ আমি বললাম, ‘না, আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন !’ অত:পর আমি সে জায়গা থেকে সরে গেলাম। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালে আমার সহযোগী ছিল, এমন একজন আমাকে দেখে ফেলল, সে আনন্দে চিৎকার করে বলল, ‘হে আবু আব্দুল্লাহ !’ তাই, আমি ফিরে এলাম, আমরা উভয়ে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করলাম, যে সুন্দর সময়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সে সুন্দর সময়টি আমাদের মাঝে নতুন প্রাণ নিয়ে ফিরে এল। এ বিপুল ফলাফলের জন্য আমরা আল্লাহর প্রশংসা করলাম।

আমাদের আলোচিত এই ব্যক্তি মদীনা মুনাওরায় শিক্ষা-দীক্ষা করেছে। শিক্ষা সমাপ্তির পর সে আপন দেশে গিয়ে একজন দায়ীর জীবন গ্রহণে ইচ্ছা করল। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও অর্থায়ন না হওয়ায় তার সে ইচ্ছা পূরণ হল না। কারণ, উভয় দেশের মাঝে কূটনীতিক সম্পর্ক ভাল ছিল না। তাই মিডলইষ্টের একটি দেশেই সে নিজের কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিল। নতুন দেশে যখনি তার পা পড়েছে, সে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে, প্রথমে সে একজন যুবককে দীনের পথে নিয়ে এলো। অত:পর এক মসজিদে অবস্থান নিল। ধীরে ধীরে তার অবস্থানস্থল মসজিদে যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, একসময় তাদের সংখ্যা দশে উপনীত হল। অত:পর সে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করল, ছাত্রদের সংখ্যাও ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকল। এভাবে ক্রমান্বয়ে সে একটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করল।

অবগতির জন্য বলছি যে, এটিই আজ অবধি এ দেশের একমাত্র মাদরাসা, যা ছাত্রদের যাবতীয় ব্যয় বহন করে। এর অধিকাংশ ছাত্র দরিদ্র, ইয়াতীম এবং সমাজের এমন শ্রেণী যারা সরকারী ও বেসরকারী মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে সঙ্গতি রাখে না।

সে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে, যা এখন সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার অপেক্ষা করছে। প্রতি বছর তার নেতৃত্বে একদল হাজি হজ করতে যান এবং বছরে কয়েক বার সে উমরার জন্য অনেককে পবিত্র নগরীতে নিয়ে যায়। আমি এ আলোচনায় তার যে সমস্ত কর্ম উল্লেখ করেছি, তার সবগুলোই তার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাজ, সে এর জন্য কোন পারিশ্রমিক কিংবা টাকা নেয় না। যে সমস্ত টাকা এ কাজে ব্যয় হয়, তার একটি দিরহামও তার পকেটস্থ হয় না।

দাতব্য এ কাজের দীর্ঘ অব্যাহততা এবং ক্রম উন্নতির কারণে সে এর জন্য যারা নিয়োজিত থাকে, তাদেরকে স্বপ্রণোদিত কর্মী হিসেবে থাকতে বলেনি, বরং তাদের জন্য নির্দিষ্ট মাসোহারা ও ভাতা নির্ধারণ করেছে। অদ্ভুদ ব্যাপার হচ্ছে, যে দেশে সে কাজ করছে, তার অধিবাসী না হয়েও কীভাবে এতগুলো লোকের মাসোহারা, বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করল? এ এক অবাক ব্যাপার ! এমনকি সে যখন উক্ত দেশে আগমন করে, তখন কেবল দু পাটি জুতা, পরিধানের কাপড় এবং হাতে একটি প্রত্যয়নপত্র নিয়ে এসেছিল।

তার পক্ষে কীভাবে এটি সম্ভব হয় যে, সে কোন হাজী অথবা উমরাকারীর কাছ থেকে কোন প্রকার টাকা না নিয়ে তাদেরকে পবিত্র নগরীতে নিয়ে যায়? কেমন করে সম্ভব হল যে, সে ইতিপূর্বেই রাশিয়া, হিন্দুস্থান, ইরান ও অন্যান্য দূর দেশ থেকে শত শত হাজীকে হজ করানোর ব্যবস্থা করেছে?

আমি যা বিশ্বাস করি, সে অনুসারে এর উত্তর হচ্ছে, সে যখনই কোন নতুন কর্মক্ষেত্রের সূচনা করেছে, দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, কিংবা মসজিদ ও মারকায নির্মাণ করেছে, তখন তার এ নির্মাণের অলক্ষ্যে প্রেরণা হয়ে কাজ করেছিল তাকওয়া, আল্লাহ-ভীতি ও তার সন্তুষ্টি।

তার নির্মিত-প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার ইতিমধ্যেই দুটি শাখা করা হয়েছে, অচিরে আল্লাহ চাহে তো তৃতীয় শাখার কাজ উদ্ভোধন করা হবে। প্রতিটি শাখার রয়েছে দুটি শাখা- ছেলে ও মেয়েদের আলাদা আলাদা শাখা। মক্কা ও মদীনায় তার নির্মিত দুটি ভবন রয়েছে, হাজী ও উমরাকারীগণ মক্কা-মদীনায় গমন করে সেখানে অবস্থান করে। সে ইতিমধ্যে তার নির্মিত মাদরাসাটিকে বিস্তৃত করার প্লান নিয়েছে।

যে দেশে সে অবস্থান করছে, সেখানে সে সতেরোটি জামে মসজিদ ইতিমধ্যেই নির্মাণ সম্পন্ন করেছে, প্রতিটি মসজিদে তার ছাত্রদের মধ্য থেকে একজনকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যাকে আলাদাভাবে থাকার ও মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আল্লাহ তাকে এত বিপুল নিআমত দিয়েছেন যে, সে অন্যান্য মুসলিম দেশে তিন শ মসজিদ নির্মান করেছে। সে কেবল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত থাকে না, বরং, তাতে একজন তালিবুল ইলম ও একজন দায়ী নিয়োগ করে থাকে, যাদের মাধ্যমে উক্ত মসজিদটি ইলম ও দাওয়াতের কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠে। আল্লাহ তার মাধ্যমে অসংখ্য লোকালয়, দেশ ও মানুষের অন্তর মৃত অবস্থা থেকে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছেন।

‘সে নির্মাণ করে ব্যক্তিত্ব, অন্যেরা নির্মাণ করে লোকালয়

ব্যক্তিত্ব নির্মাণ আর লোকালয় নির্মাণের মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য।’

আমি এ উদাহরণটি আহলে ইলম ও তালিবুল ইলমদের সামনে পেশ করছি, যাতে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারি :

ইলম ও দাওয়াতের মাঝে কি বিস্তর কোন পার্থক্য আছে?

আমাদের আলোচিত উক্ত ব্যক্তিত্ব যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, তা কি তার জন্য অসম্মানজনক ছিল, যেমন অসম্মানজনক হত যদি সে চাকুরীকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করত? নাকি সে এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে নিজের ঘুম হারাম করে দিয়েছে, বিশ্রামকে বিলুপ্ত করেছে এবং নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে?

পার্থিব জগতের ব্যক্তিগত দারিদ্র্য কি দরিদ্রদেরকে মহতি কোন অবস্থানে পৌঁছতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

নিজ দেশ ব্যতীত ভিন্ন কোন দেশে অবস্থান কি তোমার পক্ষে কোন প্রমাণ হতে পারে? নিজেকে হীন করা, সত্য গোপন করা এবং দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করার বিপক্ষে এ কি শক্তিশালী কোন ওজর?

মহান কোন অবস্থানে উন্নীত হওয়া কি অসম্ভব, যদি আল্লাহ তোমার কিংবা তোমাদের সঙ্গী হন?

ইলমের অধিকারীগণ তাদের ইলম নিয়ে দীর্ঘ সফর করবে কিন্তু তা তাদের ততটুকুই কাজে আসবে, যতটা তারা তাদের ইলম অনুসারে শিক্ষা দিবে এবং বিশ্বাস করার পর তার মাধ্যমে কর্মের উপকার লাভের প্রয়াস চালাবে।

আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে আহলে ইলমকে এ প্রশ্ন করবেন না যে, অমুক ফিকহী মাসআলার কী হুকুম? কিংবা এ ব্যাপারে ফতোয়া কি? অমুক আয়াতের তাফসীর কি? কিংবা এ মতটি কি শুদ্ধ?

বরং, সতদেরকে তাদের সততা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, রাসূল ও তাদের অনুসারীদেরকে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া সম্পর্কে জানতে চাইবেন। তিনি বলবেন:

لِيَسْأَلَ الصَّادِقِينَ عَنْ صِدْقِهِمْ وَأَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا أَلِيمًا ﴿৮﴾

‘সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। আর তিনি প্রস্ত্তত করে রেখেছেন কাফিরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব।’ [সূরা আহযাব : ৮]

এমন কত বৃহৎ ইঙ্গিত রয়েছে চুড়ান্ত হিসেবে যা বিলীন হয়ে যাবে, কত ইশারা ধ্বসে পড়বে, দেখতে বিশাল ও মহান অনেক কিছু চুড়ান্ত ওজনের দিন শূন্য ওজনের হয়ে যাবে। আমরা যাকে পার্থিবের বিচারে ক্ষুদ্র ভাবছি, যার প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করছি না, হয়তো আল্লাহ তাকে স্মরণীয় করে দিবেন, করে নিবেন তাকে নিকটের কোন আপনজন। সুতরাং চুড়ান্ত হিসেবে দিন তার স্থান হবে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে, তাদের হিসাব হবে ভারি, কল্পনার চেয়েও বড়। আল্লাহর দরবারে তাদের চেহারাগুলো হবে উজ্বল আলোয় উদ্ভাসিত। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহর বাণীর অনুরূপ হবে তাদের অবস্থা :

أولئك الذين أردت، غرست كرامتهم بيدي، و ختمت عليها، فلم تر عين و لم تسمع أذن، ولم تخطر على قلب بشر .

‘এদের আমি নির্বাচন করেছি, আমি নিজ হাতে তাদের সাদকা বপন করেছি এবং তার উপর মহর মেরে দিয়েছি। কোনো চোখ তা দেখেনি, কোনো কান তা শোনেনি এবং কোনো মানুষের মনে তার ভাবনার উদয় হয়নি।’ [মুসলিম : ১৮৯]

কোন মিডিয়া কিংবা সংবাদপত্রে আমাদের আলোচিত উক্ত ইমামের আলোচনা আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন অনবরত, অবিশ্রাম।

আমরা কেবল তার সুমহান কর্মের পুনরাবৃত্তিরই আকাঙ্ক্ষী নই, বরং আমরা এর চেয়েও বড় কিছুর আকাঙ্ক্ষী। আমরা এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্বের আগমনের আশা রাখি, যারা ইমামের সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখবেন, তাদের এই কর্মের মাধ্যমে ইসলামের দীনহীনতা কেটে যাবে, আধারের মাঝে আলোর উদ্ভাস হবে।

আল্লাহ তাআলা কখনো কখনো কাউকে এমন হিদায়াত দান করেন, যিনি ইলম ও হিদায়াতের ক্ষেত্রে এমন এমন আমল করেন, যার ফলে অনেক ইমামের কর্ম একজনের আমলনামায় লেখা হয়ে যায়।

এমন ব্যক্তিত্বের কর্মের সূচনা হয় একটি চিন্তার মাধ্যমে...এমন চিন্তা যা প্রথমে উদিত হয় অন্তরের অন্দর মহলে, অত:পর তা বৃষ্টির মত ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের আনাচ-কানাচে, বীজের মত ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের কোমল মাটিতে, অত:পর তা ফলবান হয়। এক সময় তা নিজেই বীজ দিতে আরম্ভ করে। এভাবে একটি পরম্পরা তৈরি হয়, যা কখনো শেষ হয় না।

এ বিষয়টিকেই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বিশ্লেষ করেছেন। বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿261﴾

‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা বাকারা : ২৬১]

এটি হচ্ছে একটি শীষ ও বীজ, এ যুগের এক ইমামের মাঝে যার বিস্তৃত আমরা লক্ষ্য করেছি এবং আমি আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। সে দৃশ্য কী উত্তম হবে যার ক্ষেত্রে এ বীজটি পল্লবিত হয়ে প্রকাশ পাবে হিদায়াতের ঝান্ডা হয়ে, আলোর মহৎ দীপাধার হয়ে? যদি সে মহান ব্যক্তিত্ব পার্থিব জীবনের মাঝে এক অলৌকিক ও বাস্তব জীবন সঞ্চার করতে সক্ষম হন, তবে তা কতটা কল্যাণকর হবে?

এমন ইমাম ও মহান ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্বের গুঢ় রহস্য।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মহান ব্যক্তিত্বদেরকে রেখে গিয়েছিলেন, তারা কেবল ইমামই ছিলেন না, বরং তাদের প্রতিটি সদস্য ছিলেন মুত্তাকীদের ইমাম, ইমাম সৃষ্টির পদ্ধতি তাদের জানা হয়ে গিয়েছিল।

তাদেরকে আত্মিক শিক্ষাদানের বিষয়টি ব্যক্তি উন্নয়নের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যকে ইমামরূপে তৈরি, বরং, ছিল তাদের শিক্ষার একান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের বপন ছিলেন তাবেয়ীগণ, তারাই তাদের কর্মের ও সৃষ্টির উত্তম দৃষ্টান্ত।

ইমাম সৃষ্টি ছিল নবীগণের প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব। কুরআনে এসেছে :

وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ فَلاَ تَكُنْ فِي مِرْيَةٍ مِنْ لِقَائِهِ وَجَعَلْنَاهُ هُدًى لِبَنِي إِسْرَائِيلَ ﴿23﴾ وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ ﴿24﴾

‘আর আমি তো মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, অতএব তুমি তার সাক্ষাতের ব্যাপারে সন্দেহে থেকো না। আর আমি ওটাকে বনী ইসরাঈলের জন্য হিদায়াতস্বরূপ করেছিলাম।

আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।’ [সূরা সিজদা : ২৩-২৪]

এ হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান, আল্লাহ তাআলা নবীদের অনুসারীদের যাকে ইচ্ছা তা দান করেন।

২২
পঞ্চম বপন: শয়তানের মসজিদে
روى الطبراني من حديث أبي أمامة مرفوعا و موقوفا عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : لما أهبط إبليس قال : يا رب لعنتني فما عملي؟ قال : السحر، قال : فما قرآني ؟ قال : الشعر، قال : فما كتابي ؟ قال : الوشم، قال : فما طعامي ؟ قال : كل ميتة و ما لم يذكر اسم الله عليه، قال : فما شرابي ؟ قال كل مسكر، قال : فأين مسكني ؟ قال الأسواق، قال : فما صوتي ؟ قال : المزامير، قال فما مصايدي ؟ قال : النساء .

‘তাবরানী বর্ণনা করেন, আবু উমামা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, যখন ইবলীসকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করা হল, সে বলল, হে আমার রব, আমাকে লা’নত করেছেন। সুতরাং এখন আমার কাজ কি হবে? তিনি বললেন, জাদু করা। সে বলল, আমার কুরআন কি? তিনি বললেন, কবিতা। সে বলল, আমার কিতাব কি? তিনি বললেন, উলকি। সে বলল, আমার খাদ্য কি? তিনি বললেন, এমন মৃত জন্তু, যাকে জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি। সে বলল, আমার পানীয় কি? তিনি বললেন, নেশাদ্রব্য। সে বলল, তবে আমার বসবাস কোথায় হবে? তিনি বললেন, বাজারে। সে বলল, আমার কণ্ঠ কি হবে? তিনি বললেন, বাশি। সে বলল আমার ফাঁদ কি হবে?। তিনি বললেন, নারী।’ [তাবরানী : ১১১৮১]

وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا ﴿7﴾

‘আর তারা বলে, ‘এ রাসূলের কী হল, সে আহার করে এবং হাটে-বাজারে চলাফেরা করে; তার কাছে একজন ফেরেশতা পাঠানো হল না কেন, যে তাঁর সাথে সতর্ককারী হত?’ [সূরা ফুরকান : ৭]

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه و سلم مر على صبرة طعام، فأدخل يده فيها، فنالت أصابعه بللاً، فقال : ما هذا يا صاحب الطعام ؟ قال : أصابته السماء يا رسول الله ! قال : أفلا جعلته فوق الطعام كي يراه الناس ؟ من غش فليس مني .

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার খাবারের স্ত্তপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি তাতে তার হাত প্রবেশ করালেন। তার আঙুলে কিছু ভেজা ভেজা অনুভূত হল। তিনি বললেন, হে খাবারওয়ালা, এগুলো কি? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, তাতে বৃষ্টি পড়েছিল। তিনি বললেন, তুমি ভেজাগুলো উপরে রাখতে পারলে না, যাতে মানুষ তা দেখতে পায়? যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ [মুসলিম : ১০২]

জিলহজের আট তারিখ সকালে আমি আমার ছেলে আব্দুল্লাহকে নিয়ে বাজারে হাঁটছিলাম, ঈদের দিনের কিছু কাপড় কেনার জন্য। আমরা একটি দোকানে প্রবেশ করলাম। দোকানদার রেডিও চালিয়ে রেখেছিল, বড় স্পিকারে গান বাজছিল।

হঠাৎ আমার সন্তান আমাকে বলল, আমি কি তাকে রেডিও বন্ধ করার জন্য বলব?

আমি বললাম, বল, আল্লাহ তোমার মাঝে বরকত দিন।

সে দোকানদারের দিকে এক কদম এগিয়ে গেল, কিন্তু সে দাঁড়িয়ে গেল, যেন সে আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। সে নিজের দিকে তাকাল, যার বয়স এখনো সাত অতিক্রম করেনি, অত:পর তাকাল আফগানী দোকানীর দিকে, বিশাল বপু লোকটির পাশে সে নিজেকে অসহায় বোধ করল। তাই সে ভয় পেয়ে গেল। সে আমার কাছে ফিরে এল, আমি তাকে বললাম, যাও এবং তাকে রেডিওটি বন্ধ করতে বল।

সে বলল, বাবা, তুমি বল।

তখন আমি লোকটিকে বললাম, তুমি কি জান না, এখন হারাম (সম্মানিত) দিন অতিবাহিত হচ্ছে? এবং এই গান যে কোন সময়েই হারাম, এই সময়ে তার পাপ আরো অধিক?

সে তাচ্ছিল্য ভরে বলল, এ তো দেশী রেডিও।

বললাম, যা বিনামূল্যের, তাই কি হালাল?

সে বলল, না।

বললাম, গান তো বাজছে তোমার দোকানে, সুতরাং এখানে দেশের কথা আসছে কেন? দেশের দায়িত্বশীলদের এখানে টেনে আনার কী অর্থ? দেশ কি তোমাকে এটি চালিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে? নাকি না চালালে তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে? আর কেনই বা আমরা এমন অনেক দোকানদারকে দেখি যারা সারা দিন কুরআন তিলাওয়াত চালিয়ে রাখে? আর কেউ কেউ তো কিছুই চালায় না?

সে বলল, সবাই তো গান চালিয়ে রাখে।

বললাম, ঠিক আছে, তারা সকলে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে। তুমিও কি তাদের সাথে সাথে ধ্বংসের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে আছো?

লোকটি গোঁয়াড়ের মত বলল, হা।

আমি বুঝে নিলাম লোকটি সত্যি বলছে না। তার উদ্দেশ্য সকলের সাথে ধ্বংস হওয়া নয়। মানুষ সাধারণত এ ধরনের উক্তি জেনে বুঝে করে না, মনের অজান্তে অসচেতনভাবে করে ফেলে। সুতরাং আমি তাকে লক্ষ্য করে বললাম, শোন, জগতে দু রকমের মানুষ আছে, একজন যার পিছনে অসংখ্য লোক পড়িমড়ি করে ছুটছে। আরেকজন, যার পিছনে প্রথম জনের তুলনায় অনেক কম অনুসারী। তুমি কি প্রথম জনের পিছনে ছুটবে, না দ্বিতীয় জনের পিছনে?

সে বলল, দ্বিতীয় জনের পিছনে।

বললাম, প্রথম জন হচ্ছে ইবলীস, সে তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় জন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তিনি তার অনুসারীদেরকে জান্নাতের দিকে পরিচালিত করছেন।

লোকটি তখন তার উক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হল, বলল, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তাই সে গিয়ে গান বন্ধ করল, আমার ছেলে তখন আনন্দিত হয়ে গেল।

জ্ঞান পিপাসু হে আমার ভাই ! আমি অনেকটা শব্দে শব্দে ঘটনা ও আমাদের আলোচনাটি উল্লেখের প্রয়াস পেয়েছি। প্রতিটি দায়ীর দাওয়াতী জীবনে এমন ঘটনা ঘটে, তাই, একে উদাহরণ হিসেবে তোমার সামনে তুলে ধরা ছিল উদ্দেশ্য। তোমার পক্ষে কি এমন সম্ভব নয় যে, দোকানে প্রবেশ করার পর দাওয়াতের ক্ষুদ্র কোন আমল করা ব্যতীত তা থেকে কোন কিছু ক্রয় করবে না? দোকানে যদি কেউ মন্দ কাজে লিপ্ত থাকে, তাহলে তাকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ব্যতীত তুমি অন্য কোন আলাপ ও কেনাকাটায় ব্যপৃত হবে না?

দাওয়াতকালে কেউ অস্বীকার ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের ফলে কি তুমি দাওয়াত থেকে বিরত থাকবে?

অধিকাংশ যুবক, দেখা যায়, এ অবস্থায় অস্বীকৃতির কথা ভেবে বিরত থাকে। কেন তারা বিরত থাকে? তারা কি আল্লাহ তাআলার এ বাণী শুনেনি? কুরআনে এসেছে :

كِتَابٌ أُنْزِلَ إِلَيْكَ فَلاَ يَكُنْ فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِنْهُ لِتُنْذِرَ بِهِ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ ﴿2﴾

‘এটি কিতাব, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তার সম্পর্কে তোমার মনে যেন কোন সংকীর্ণতা না থাকে। যাতে তুমি তার মাধ্যমে সতর্ক করতে পার এবং তা মুমিনদের জন্য উপদেশ’। [সূরা আ’রাফ : ২]

তুমি কীভাবে বিরত থাকবে, অথচ রাসূল এ অবস্থায় দাওয়াতের কাজ হতে বিরত থাকেননি?

তোমার এ বিরত থাকায় তুমি কি দায়ীদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে চাও?

বিরত থাকার মাধ্যমে মন্দকাজের অপসারণ সম্ভব?

একজন বিক্রেতার সামনেই যদি তোমার এমন অবস্থা দাঁড়ায়, তবে বড় কোন কর্তা ব্যক্তির সামনে তোমার কি অবস্থা দাঁড়াবে? কিংবা সে যদি হয় ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তি, যার সামনে ন্যয়ের স্বপক্ষে কথা বলার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়?

তুমি তাকে, এমন অবস্থায়, নি:সংশয়ে সৎকাজের আদেশ প্রদান কর, মোটেও লজ্জাবোধ কর না, প্রজ্ঞার সাথে হাটে-বাজারের মন্দকাজ দূর করার প্রচেষ্টা চালাও, পিছু হটে যেও না। তোমার বিরোধীরা সংখ্যায় যদি বিপুল হয়, তবে আল্লাহর এ বাণী স্মরণ কর :

قَالَ لاَ تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ﴿46﴾

‘তিনি বললেন, ‘তোমরা ভয় করো না। আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’। [সূরা তাহা : ৪৬]

তুমি কি এটা পছনদ করো না যে, শয়তানের প্রজ্বলিত আগুন তোমার কারণে নিভে নি:শেষ হয়ে যাবে, বন্ধ হবে তার কূটকৌশল? যেখানেই মন্দের আবির্ভাব ঘটবে, সেখানেই তুমি দাওয়াত নিয়ে হাজির হবে? যদি তুমি এমন করে নিজেকে গড়তে পার, তবে সন্দেহ নেই, তুমি উত্তম ও আদর্শ এক সংস্কারক। কুরআনে এসেছে :

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴿33﴾

‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’?’। [সূরা ফুসসিলাত : ৩৩]

তুমি কার্যকরী ও সঠিক উপায়ে উক্ত দাওয়াতী কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হও, তবে শয়তানের প্রিয় স্থান বাজার তার জন্য সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে, সে উক্ত স্থানে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বিব্রত বোধ করবে। মানুষের অন্তরে সৎ প্রেরণার উদ্ভব ঘটবে, স্থান-কাল নির্বিশেষে সকলে ভালো কাজের আগ্রহ বোধ করবে।

বাজারে দাওয়াতী কাজ ও উত্তম বীজ বপনের বিষয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভের জন্য আমাদের আর যা করণীয় তা পরিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য আমি তোমাকে উক্ত ঘটনাটি শুনিয়েছি। তুমি নিশ্চয় এতে উপলব্ধি করেছ যে, মানুষের অন্তরে ভালো কিছুর বপন খুবই সম্ভব ও সহজসাধ্য- যদি আল্লাহ তা সহজ করে দেন। বাজারের মত এমন ঘৃণিত স্থানেই যদি দাওয়াত ও ভাল কিছুর উদ্ভাবন এতটা সহজ হয়, তবে যে সকল স্থান তার চেয়ে ভাল ও উত্তম তাতে কাজটি কী পরিমাণ সহজসাধ্য হবে, তা বলাই বাহুল্য।

সিডি ও ভিসিডি দোকানের মালিকের সাথে একবার আমার একান্তে কথা হল, আমি দেখলাম সে একজন মুসলমান এবং নামাজী ব্যক্তি। আমি তাকে বললাম, তুমিই কি এ দোকানের মালিক? সে বলল, হা।

বললাম, তুমি কি জান, তুমি যা করছ তা হারাম?

সে বলল, হা, কিন্তু এটি আমার ও আমার পরিবারের আয়ের উপায়।

বললাম, তুমি কি বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ তোমার কাছ থেকে হিসাব গ্রহণ করবেন এবং তোমাকে জেরা করবেন? তুমি কি জান, তোমার কাছ থেকে যে ব্যক্তি গান বা ফিল্মেরে সিডি কিনে নিয়ে যায়, তার পাপের অংশীদার তুমিও? বরং, সে যে পরিমাণ পাপ করে, তোমার আমলনামাতেও সে পরিমাণ পাপ লেখা হয়? তুমি কি এ ব্যাপারে সচেতন যে, যে পরিমাণ সিডি ও ভিসিডি তুমি বিক্রয় করছ, ঠিক সে পরিমাণ ব্যক্তির পরিপূর্ণ পাপের অংশীদার হচ্ছো তুমি?

মাসে যদি তুমি এক হাজার সিডি বিক্রয় কর, তবে তোমার নামে এক হাজার ব্যক্তির পাপ লেখা হচ্ছে। তুমি এত পাপ বহন করতে সক্ষম?

তুমি কি জান যে, তুমি তোমার অজান্তে শয়তানের কাজ করে যাচ্ছ, তার পাপের আহবান মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছ? যিনার আমন্ত্রণ জানাচ্ছো সবাইকে? (কারণ, গান প্রকারান্তরে মানুষকে যিনায় উৎসাহী করে তুলে) এভাবে তোমাকে ঘিরে পাপের বিস্তৃত একটি বলয় গড়ে উঠছে, অথচ এ ব্যাপারে তুমি মোটেও সচেতন নও?

এ কেমন ব্যাবসা তুমি গ্রহণ করলে?

যেদিন তোমার ব্যবসা অধিক হয়, সেদিন প্রকারান্তরে পাপও বেশি হয়। যেদিন তুমি ভাববে যে, তুমি ব্যবসায় সফল, সেদিন মূলত তুমি জাহান্নামের আরো নিকটবর্তী হয়ে গেলে।

তুমি মরে যাবে, কিন্তু এ পাপের বলয় কখনো শেষ হবে না, অব্যাহত থাকবে তার ধারা, যতক্ষণ না তুমি তওবার মাধ্যমে এ ধারাকে তোমার জীবন থেকে নি:শেষ করে দাও। দেখ, কুরআনে আল্লাহ কী বলছেন :

لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُونَ ﴿25﴾

‘ফলে কিয়ামত দিবসে তারা বহন করবে তাদের পাপভার পূর্ণ মাত্রায় এবং পাপভার তাদেরও যাদেরকে তারা অজ্ঞতার কারণে বিভ্রামত্ম করেছে। দেখ, তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট’। [সূরা নাহল : ২৫]

আমার আলোচনার ফলে- আলহামদুলিল্লাহ- লোকটি মাঝে পরিবর্তন ঘটল, সে তার দোকানে গানের সিডির বদলে দাওয়াতের সিডি বিক্রয় করতে আরম্ভ করল।

একবার আমি বাজারে হাঁটছিলাম, দেখলাম সরকারী সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল দোকানে দোকানে ঘুরছে, আমি মনে মনে ভাবলাম, এটি একটি উত্তম সুযোগ, আমি তার মাধ্যমে কোন সাদাকায়ে জারিয়ার জন্ম দিতে পারি। এবং বাজারে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক পাপের অবসান ঘটাতে পারি।

আমি তাকে সালাম জানিয়ে বললাম, দোকানের প্রবেশ পথে ও দেয়ালে যে অশ্লীল ছবি টানানো আছে, সেগুলোর ব্যাপারে তোমার কি মত? কাপড়ের দোকানে, ছবির শো রুমে, ভিডিও স্টোরে যে সমস্ত ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেগুলোকে তুমি সমর্থন কর?

সে বলল, এটি তাদের পেশার সাথে সম্পৃক্ত, তাদের কাজের ধর্মই এটা।

বললাম, তুমি মনে কর যে, যদি তারা ছবির পরিবর্তে হাতে লিখে রাখে, এবং ছবিগুলোকে এলবামে ভরে রাখে তবে রাষ্ট্রীয় আইন ও পেশার বিরোধী হয়ে যাবে?

সে বলল, না।

বললাম, তবে এ ধরনের ছবি টানিয়ে রাখা শরীয়তের দৃষ্টিতে হালাল নাকি হারাম? এগুলো কি মানুষের স্বভাব ও লজ্জাশীলতার বিরোধী নয়? তুমি তোমার যুবতী কন্যার জন্য এগুলো পছন্দ করবে?

সে বলল, এগুলো হারাম।

বললাম, তাহলে কি তুমি তাদেরকে এ আদেশ দিতে সক্ষম নও যে, এগুলো নামিয়ে ফেল, কারণ, তাতে আইন ও শরীয়ত লঙ্ঘন হচ্ছে এবং এগুলো হারাম?

সে বলল, হা।

বললাম, তবে তোমাকে তা করতে বাধা দিচ্ছে কিসে? এগুলোর বিরোধিতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট নয় কি যে, এগুলো আল্লাহর আইনের বিরোধী, হারাম এবং মানুষের স্বাভাবিক লজ্জাশীলতার পরিপন্থী? নাকি এগুলো নামিয়ে ফেলা কিংবা নামানোর নির্দেশ প্রদান রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধী?

উক্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমাকে বলল, আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। সৎকর্মের প্রতি ইঙ্গিতকারীও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। এই নাও আমার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার, আল্লাহ চাহে তো, আমি অবশ্যই তোমার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখব।

বললাম, আমি তোমার নিকট এর চেয়েও বড় কিছু আকাঙ্ক্ষা করি।

সে বলল, কী সেটা?

বললাম, তোমার মত অন্যান্য দায়িত্বশীলদের মাঝেও তুমি এ প্রেরণা ছড়িয়ে দাও।

বলল, আমি অবশ্যই তা করতে চেষ্টা করব।

বললাম, আমি তোমার নিকট আরো কিছু আশা করছি।

বলল, কী?

বললাম, তুমি অবশ্যই তা করবে প্রজ্ঞার সাথে। তোমাকে এমনভাবে উক্ত কাজ শেষ করতে হবে, যেন তা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকে এবং পরিশুদ্ধভাবে তা সম্পন্ন হয়।

বলল, যতটা সম্ভব, ইনশাআল্লাহ, আমি সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।

তার সাথে আলোচনা শেষে মাগরিবের সালাতের সময় ঘনিয়ে এল। আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম, আমার স্ত্রী আমার সঙ্গেই ছিল। সে মেয়েদের সালাতের স্থানে প্রবেশ করল। আমি দেখতে পেলাম স্থান সঙ্কটের কারণে কাতার মসজিদের বাহির পর্যন্ত চলে এসেছে। অন্যদিকে ইমাম মেহরাবের কাছে দুই কাতার ছেড়ে তার জায়নামাজ বিছিয়েছে। কারণ, মেহরাবের ভিতরে অত্যন্ত গরম। সালাতের পর আমি গিয়ে নিকটস্থ দোকান থেকে পাখা কিনে নিয়ে এলাম, সেটি মেহরাবের অভ্যন্তরে স্থাপন করার জন্য তাদেরকে দিলাম। এভাবে মুসল্লীদের জন্য দুটি কাতার বৃদ্ধি পেল। অত:পর মসজিদ নির্মাতার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে তাকে আমার সাথে যোগাযোগের জন্য বললাম, মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি এবং কয়েকটি বাথরুম সংযোজনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিলাম। এভাবে আমি একটি ভাল কাজের সাথে সম্পৃক্ত হলাম, তারা আমাকে উত্তম প্রতিশ্রুতি দিল।

এদিকে আমার স্ত্রী নারীদের মাঝে দেখতে পেল, সালাত ও সালাতের আদবের ব্যাপারে তারা নানারকম অজ্ঞতায় ডুবে আছে। তারা উচ্চস্বরে কথা বলছিল, তাদের কাতার সোজা ছিল না। সে আমাকে এ ব্যাপারে অবগত করলে আমি ইমামকে প্রয়োজনীয় মাসআলা শিক্ষাদানের জন্য অনুরোধ করলাম। প্রতি সালাতের সময় মাইক্রোফনের মাধ্যমে তাদেরকে নসীহত করার জন্য বললাম।

সালাতের পর আমি আমাদের কেনাকাটা সম্পন্ন করার জন্য পুনরায় বাজারে প্রবেশ করলাম। আমার সন্তানরা ক্ষুধা অনুভব করল। খাবারের দোকানে বার্নারে মুরগির গোশত ঝলসানো হচ্ছিল। আমি খাবারের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোথা থেকে মুরগি সংগ্রহ কর?

বলল, ব্রাজিল থেকে।

বললাম, আমাকে কি কার্টনটি দেখানো যাবে?

দোকানদার সেটি নিয়ে এলে জিজ্ঞেস করলাম, এর দাম কত?

বলল, প্রতি কিলো পাঁচ দেরহাম ও পঁচিশ পয়সা।

বলল, ভাই, তুমি একজন মুসলিম। সুতরাং নিশ্চয় সর্বদা হালাল খাদ্যের প্রতি তুমি আগ্রহী, এবং মানুষকেও হারাম খাদ্য প্রদানে তোমার কুণ্ঠা রয়েছে? আর এই মুরগি, যদিও তার কার্টনে হালাল শব্দটি লেখা আছে, কিন্তু এর মাধ্যমে কেবল তাদের পণ্যের প্রসারই উদ্দেশ্য, এদের প্রক্রিয়াটিই এমন যে, তা কখনো হালাল হতে পারে না। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় তারা এর প্যাক করে এবং তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমার কাছে এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে- লিখিত ও ভিডিও আকারে আমরা এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করেছি।

বলল, তাহলে এর সমাধান কি?

বললাম, তোমার কি এমন কোন মাধ্যমে আছে, যার থেকে তুমি বৈধ উপায়ে জবেহ করা মুরগি পাবে এবং যা জবেহ করেছে মুসলিম, মুসল্লীগণ? এবং পণ্যমূল্য যার কম?

সে বলল, হা।

তবে কেন অধিক মূল্য দিয়ে হলেও তা ক্রয় করছ না?

আমার আলোচনার পর উক্ত দোকানদার সেদিন থেকে হালাল মুরগি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিল। আমি আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম।

প্রিয় পাঠক ! আমাদের মাঝে কেউ কি এমন আছে, যে বাজারে গমন করে না? বাজারে কি তার দৃষ্টি অনেক অনৈতিক কাজ দৃষ্টিগোচর হয় না? বাজারে গিয়ে কি ভাল কিছু বপনের মত সুযোগ লাভ করে না? সুতরাং আল্লাহ তাআলা যে দায়িত্ব আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, কেন আমরা তা পালন করছি না, কী বাধাকে আমরা ভয় পাচ্ছি?

সুতরাং, হে জান্নাতের বাজারের অনুসন্ধনীগণ, এগিয়ে যাও, এমন সওদা কর, যার দৃষ্টান্ত দুর্লভ। কুরআনে এসেছে :

هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلاَّ الإِحْسَانُ ﴿60﴾

‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?’। [সূরা রহমান : ৬০]

ইলমের অনুসন্ধিৎসু হে আমার প্রিয় ভাই, এটিই হচ্ছে প্রকৃত উত্তম কর্ম। আমাদের প্রত্যেকে যদি এ কাজে আগ্রহী হতাম, সঠিক উপায়ে তা সম্পাদনে এগিয়ে আসতাম, তবে সন্দেহ নেই, সৎকাজের আদেশে আমরাই হতাম সর্ব বৃহৎ দল। পাপাচার দূর হয়ে যেত আমাদের থেকে, পবিত্রতা ও নৈকট্যের এক অনাবিল আবহ আমাদের মাঝে সর্বাঙ্গিনভাবে ছড়িয়ে যেত।

আমরা যদি তা পালন করতাম, তবে আমাদের প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে দূরন্ত সাহস ও সত্যের দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা। ঘুমন্ত এমন অনেক অন্তর ঘুম থেকে জেগে উঠত, মন্দের পঙ্কিল নর্দমায় যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে, তার অসচেতনতায় তার অন্তর মৃতের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য মানুষ আমাদের প্রচেষ্টার ফলে আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী আযাব থেকে রক্ষা পেত।

এই অভিজ্ঞতার পর আমার কাছে নতুন এক চিন্তা ধরা দিল। এমন দোকানদার ও বাজারের লোকদের জন্য একটি চটি বই লেখার অনুপ্রেরণা বোধ করলাম, যা একাধিক ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করা হবে, যাতে বাজারের লোকদের সম্বোধন করে তাদেরকে সত্য পথে আহবান জানানো হবে। সাথে সাথে একটি অডিও সিডি প্রকাশ করে আরবদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হবে, যার শিরোনাম হবে ‘প্রচলিত পাপাচার’।

বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে, যদি আমরা পবিত্র বাজার তৈরি করতে চাই, কিংবা যারা পবিত্রতা অবলম্বনকারী, তাদের জন্য কোন বাজার তৈরী করতে চাই। বাজারকে যদি আমরা ধীরে ধীরে, ক্রমান্বয় পরিবর্তনের ধারায় উন্নীত করতে প্রয়াসী হই, তাহলে সন্দেহ নেই, এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া, যাতে প্রোজ্বল হয়ে ধরা দিবে সততা, আমানত, শরীয়তের নীতিমালার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য, এমন একদল ব্যবসায়ী শ্রেণী, যারা আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে অবগত, যাতে ইসলামী নীতিমালা পরিপূর্ণ অনুসরণ করা হবে।

বিষয়টি, সন্দেহ নেই, খুবই গুরুতেবর দাবী রাখে, সাহসীরাই কেবল এর সংশোধনে অবদান রাখতে সক্ষম।

২৩
ষষ্ঠ বপন: তালিবুল ইলমের জামাআত
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لاَ أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا ﴿60﴾

‘আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার সহচর যুবকটিকে বলল, আমি চলতে থাকব যতক্ষণ না দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে উপনীত হব কিংবা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেব।’। [সূরা কাহফ : ৬০]

عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم بني الإسلام على خمس : شهادة أن لا إله إلا الله، و أن محمدا رسول الله، و إقامة الصلاة، و إيتاء الزكاة، و الحج، و صوم رمضان .

‘ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পাঁচটি ভিতের উপর ইসলামকে নির্মাণ করা হয়েছে : এই সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ ও রমজানের রোজা রাখা।’ [বুখারী : ৮, মুসলিম : ১৬]

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : من أتى هذا البيت فلم يرفث و لم يفسق، رجع كما ولدته أمه .

‘আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে এই ঘরে আগমন করবে এবং কোন অর্থহীন কাজ করবে না এবং অশালীন কিছু করবে না, সে সেদিনের মত ফিরে আসবে, যেদিন তাকে তার মা জন্ম দিয়েছে।’ [বুখারী : ১৮১৯, মুসলিম : ১৩৫০]

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : المرء على دين خليله، فلينظر أحدكم من يخالل .

‘আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ বিচার্য তার বন্ধুর ধর্মের অনুসারে। সুতরাং তোমদের সাবাই যেন লক্ষ্য রাখে সে কাকে বন্ধু বানাচ্ছে’। [আহমদ : ৮৪১৭]

আমাদের নতুন চিন্তা হচ্ছে কীভাবে স্কুল, উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদেরকে জামাআতবদ্ধ করে হজের সফরে শরীক করা যায়?

২৪
এই চিন্তার লক্ষ্য ও গুরুত্ব
প্রথমত: হজের জন্য এভাবে পদক্ষেপ নেয়া এবং এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা, বলা যায়, এক অর্থে বিরল। বিশেষত দেশের বাইরে থেকে হাজী হিসেবে এই শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি তো কারো চিন্তাতেই হানা দেয় না। সাধারণত, যাদেরকে হাজীর সফরে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাদের অধিকাংশই থাকে বয়স্ক নারী-পুরুষ। কিন্তু যুবক-যুবতীদেরকে নিয়ে হাজীদের জামাআতের চিন্তা, গুরুত্ব থাকা সত্বেও, সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত: এমন একদলকে হজের ফরজ আদায়ে সহযোগিতা করা, যাদের উপর শরীয়তের আইন মোতাবেক হজ ফরজ হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে অবহেলা, হজের ফরজ আদায়ে অযথা বিলম্বকরণ, সক্ষম ও বালেগ হওয়া সত্বেও ‘এখনো সময় হয়নি’- এই ধারণার বশবর্তী হওয়া ইত্যাদি কারণে ছাত্ররা সাধারণত হজের ব্যাপারে আগ্রহী থাকে না। সাধারণের মাঝে প্রচলিত আরেকটি ধারণা হল, হজের পূর্বে অবশ্যই বিবাহ করতে হবে, কিংবা হজের আগে পড়াশোনা পাট চুকাতে হবে। এটি খুবই দুর্লভ যে, শিক্ষা সমাপ্তির পূর্বে কিংবা বিবাহের পূর্বে কেউ হজ সম্পন্ন করেছে।

মানুষের ধারণা, হজ যথাসম্ভব বিলম্বে আদায় করতে হবে। যেন ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ রুকনটি বালেগ হওয়া ও সক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত নয়।

এ ধরনের হজের সফরের ফলে ন্যূনতম যে ফললাভ হবে, তা হল, এমন একদল ছাত্রদের পক্ষে হজের ফরজ আদায় করা হবে, যাদের উপর হজ ফরজ হয়ে গিয়েছে।

তৃতীয়ত: ছাত্রদেরকে যদি ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, এবং হজে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তা তাদের অন্তরে কী কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সে ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সহজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যদি তাদেরকে সঠিক উপায়ে তালিম তরবিয়ত দেয়া হয় তবে অবশ্যই তা তাদের হৃদয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

মাধ্যমিক স্কুল থেকে একবার আমরা পনেরো জনের একটি গ্রুপ নিয়ে হজে গিয়েছিলাম। এই সফরের ফলে তাদের মাঝে এক অভূতপূর্ব ক্রিয়া দেখতে পেলাম, যেন তাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়ে গিয়েছিল। এমনকি এদের কেউ কেউ ইহরাম শুরু করার কালে তালবিয়া পাঠের সময় উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠছিল, কেউ আমাদেরকে রাসূলের সাহাবীদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, যখন তারা জিবরাইলের প্রতিউত্তরে রাসূলের ডাকের অনুসরণ করছিল। সালাতে তাদের অগ্রগামিতা, ইতিকাফ এবং আল্লাহর আনুগত্যে অসীম ধৈর্য- তাদের এ বিষয়গুলোর সামনে আমাদের নিজেদেরকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। আমরা ছিলাম অভিভূত।

আরাফা দিবসে এদের অন্য একটি অভূতপূর্ব আচরণ আমাদেরকে নাড়া দিল। আরাফায় আসবাবপত্র রেখে আমরা যখন এক সাথে যোহর ও আছরের সালাত আদায় করলাম, তাদের অধিকাংশই দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত আরম্ভ করল, সূর্য হেলে যাওয়ার পর তাদের সে দুআর সূচনা হয়েছিল, সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের তা শেষ হয়নি। কেউ কেউ খাবার ও পুনরায় ওজু করার জন্য কেবল মাঝে ক্ষণকাল বিরতি দিয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বর্ণিত হয়েছে, তারা কান্নায়, অশ্রুতে এবং আল্লাহভীতিতে নিজেদেরকে এবং আমাদেরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

ঈমানের এই অভূতপূর্ব প্রস্রবনই ছিল আমাদের সে সফরের প্রাপ্তি, সন্দেহ নেই, এমন যে কোন সফরেরই একই চিত্র পাওয়া যাবে। এটুকু প্রাপ্তিই, আমি মনে করি, এ ধরনের সফরের আয়োজনের প্রেরণার জন্য যথেষ্ট।

চতুর্থত: ইসলামী আচার ব্যবহারের পুনর্জীবন। সাধারণত, হাজীরা তাদের সফরে দায়িত্ব পালন করে এমনভাবে, যেমনভাবে একজন চাকুরিজীবি তার দায়িত্ব পালন করে যায়, সেখানে আত্মিক আচরণীয় দিকগুলো ততটা কার্যকরী হয় না। তাদের মাঝে অনেক আচরণীয় বৈপরীত্ব দেখা দেয়। কিন্তু ছাত্রদের মাঝে এ দিকটি অন্যভাবে আমরা লক্ষ্য করি। এরা অন্যান্য হাজীদেরকে সেবার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশা করে, সে লক্ষ্যে কাজ করে। এরা কেবল ততটা ইবাদাতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না, যতটা হজের নিয়মের অধীনে রাখা হয়েছে। তারা কেবল সালাত, যিকর-আযকার ও কুরআন তিলাওয়াতেই মগ্ন থাকে না, বরং তারা একটি সর্বাঙ্গীন আচরণীয় জীবন গঠনে নিজেকে তৈরি করে। আমরা যে আচরণীয় উৎকর্ষের আলোচনা করেছি, তা কেবল কল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং, এ জন্যে প্রয়োজন অনর্থক বিতন্ডা পরিহার, অকার্যকর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া : যেমন- অনর্থক কথা, দৃষ্টি, শ্রবণ ও কাজ পরিহার করা।

পঞ্চমত: ভ্রাতৃত্বের নির্মাণ। যুবকরা সাধারণত বিক্ষিপ্তভাবে মিলিত হলেও, খুব কমই তারা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বাস্তবতায় মিলিত হয়। তাই, তুমি দেখবে, তারা একত্রে মিলিত হলেও তাদের মাঝে এক ধরনের বিক্ষিপ্ততা মানসিক অনৈক্য কাজ করে। তারা আদব ও স্বভাবের বিরোধী অনেক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ভ্রাতৃত্বের বহির্ভূত অনেক আচরণ তাদের এ বিক্ষিপ্ততার মূল কারণ। কিন্তু হজে তাদের মাঝে সাধারণ যে পরিবেশ বিরাজ করে, তা ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ, বিনয় ও বিনম্রতার পরিবেশ। তখন তারা অপরের প্রতি ছাড় দেয়ার মানসিকতা ধারণ করে, অপরের সেবায় তারা বিপুল আনন্দ লাভ করে। এই পরিবেশ থেকে তারা যে আচরণীয় উৎকর্ষ লাভ করে, তা তাদেরকে নতুন করে জীবনকে শোভাময় করে তুলে।

হজের ঈমানী ও চারিত্রিক শোভাময় পরিবেশ এই যুগ ও সময়ের ব্যাধীর উত্তম প্রতিশেধক। কারণ, এই প্রতারণার যুগে পবিত্র ও পবিত্রতা আনয়নকারী পরিবেশ হজের সময় সকলের মাঝে বিরাজ করে।

অপর মুসলিম ভাইয়ের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়া এ সময়ের অন্যতম একটি সমস্যা ও ভয়াবহ দিক। এই সময়ের চরিত্র এমন, যা মানুষকে এক কোণে ঠেলে দেয়, ফলে মানুষ অপরের কথা ভুলে নিজেকে চুড়ান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটিই এখনকার সাধারণ অবস্থা। সুতরাং হজের সফরের সুযোগে যদি আমরা এ পরিবেশ ও মানসিকতা পরিবর্তনের সুযোগ গ্রহণ করি, এবং তাকে একটি সুস্থ, সবল ভিতের উপর স্থাপন করি, তবে সন্দেহ নেই, তা আমাদের জন্য অতি উত্তম হবে। হজে তাদেরকে এই আচরণীয় দিকটির প্রতি প্রবলভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে, তাদেরকে এ ব্যাপারে দীর্ঘ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

হজ একটি সফর, সফর মানুষকে তার জমে যাওয়া স্থান ছেড়ে দূরে অন্য এক স্থানে পৌঁছতে সাহায্য করে। হজের সফর মানুষকে পৃথিবীর পবিত্রতম স্থানসমূহে নিয়ে যায়, যা তার আত্মা ও শরীরকে এক অনির্বচনীয় পবিত্রতায় বিধৌত করে। শরীয়ত বিরোধী যে সমস্ত নেতিবাচক আচরণ যুব সমাজকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, এ সুযোগে তাদেরকে তা থেকে সরিয়ে আনা খুব সহজ- সন্দেহ নেই।

হজের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তাদের মাঝে জন্ম নেয় যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও আচরণীয় উৎকর্ষ, তা তাদের জীবনব্যাপী অব্যাহত থাকবে- এটি খুবই সম্ভব। যারা এই সফরের সঙ্গী হবে, তারা বাকি জীবন এই সুখময় ও পবিত্র স্মৃতি দ্বারা তাড়িত ও অনুপ্রাণিত হবে, বিশেষত যখন বছর ঘুরে হজের মৌসুম ঘনিয়ে আসবে তখন তাদের মাঝে কেঁপে উঠবে সেই পুরোনো স্মৃতি, আরো কিছু ভালো সময় অতিবাহিত করার জন্য তা তাদের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকবে।

হজের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ অনুসারে- গ্রীস্ম ও বসন্তকালীন ছুটিতে কিংবা রমজান মাসে ছাত্রদেরকে উমরার সফরে নিয়ে যাওয়া যায়।

ষষ্ঠত: সঠিক উপায়ে হজ পালন। অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যে হজ বিষয়ে কোন মূর্খ ব্যক্তির সাথে হজে গমন করবে, সেই মূর্খ লোকের মূর্খামী তার ভিতর সংক্রমিত হওয়ার পর পরবর্তীতে দেখা যাবে এটি তার সন্তানের মাঝেও সংক্রামিত হবে। কারণ, সঠিক জেনে সে পুরো জীবন এরই চর্চা অব্যাহত রাখবে। অসচেতনভাবে সে এর পক্ষ হয়ে লড়ে যাবে। এই অবস্থা বর্তমানে সচরাচর ঘটতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন ছাত্র যদি হজ ও হজ বিষয়ক মাসআলা মাসাইল সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত কোন আলেমের সাথে হজের সফর করে, তবে তার মাঝেও উক্ত জ্ঞাত ব্যক্তির চর্চা ও জ্ঞান অনায়াসে তার আয়ত্ব হয়ে যায়। সচেতন ব্যক্তির কাছ থেকে হজ বিষয়ক তার জ্ঞান অবশ্যই পূর্বের উদাহরণের তুলনায় হবে ভিন্ন রকম। ছাত্ররা তার কর্মকান্ড ও আচর আচরণ গভীর মনোযোগে বিশ্লেষণ করবে, তার কাছে প্রশ্ন করবে জেনে নেয়ার জন্য।

এ বিষয়টি তার মাঝে হজ বিষয়ক সঠিক জ্ঞান প্রদানের জন্য যথেষ্ট, এটি তার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকবে। আশা করা যায়, আল্লাহ চাহে তো, এটি কখনো তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে না। সাধারণত, একজন ছাত্রের মাঝে মুখস্ত করা ও হওয়ার সর্ববিধ কারণ উপস্থিত থাকে, যেমন : শ্রবণ, দেখা, চর্চা, পঠন, অনুসরণ, আলোচনা-পর্যালোচনা, ভুল কাজ ও বক্তব্যের প্রতি সতর্ক থাকা ইত্যাদি। এ সবই পর্যায়ক্রমে ও আলোচনা প্রসঙ্গে তৈরি হয়ে যায়।

তবে, ছাত্রদের নিয়ে গঠিত এ ধরনের নামসর্বস্ব একটি গ্রুপ তৈরি করলেই আমরা সঠিক ফল পেয়ে যাব, তা ভাবার মোটেই অবকাশ নেই। বরং, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সহযোগিতার সাথে এটি সম্পৃক্ত এমন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও ব্যক্তিগণ ও পদ্ধতির সাথে, যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অভাবিত। যে কোন দেশ থেকেই এভাবে ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হাজী দলকে হজের সফরে পাঠাতে পারে, যাদের দায়িত্বশীল হবে কোন নির্ভরযোগ্য শিক্ষক বা ইমাম এবং যাদেরকে সার্বিক তত্বাবধান দিবে কোন সংস্থা, সঠিক পন্থা ও পদ্ধতিতে সফরটি সম্পন্ন করার যাবতীয় ব্যবস্থা যারা নিবে। এমনিভাবে, পারিবারিক ভাবেও তাদেরকে হজে পাঠানো যেতে পারে। যদি কয়েকটি পরিবারকে হজের সফরে একত্রিত করা যায়, তবে ছাত্রকে তার পরিবারের সাথে হজে পাঠানো যেতে পারে।

২৫
সপ্তম বপন: কার্যকরী বিকল্প তৈরির যুক্তি
إِنَّ فِي ذَلِكَ لَذِكْرَى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ ﴿37﴾

‘নিশ্চয় এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার রয়েছে অন্তর অথবা যে নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে। [সূরা কাফ : ৩৭]

وَخُذْ بِيَدِكَ ضِغْثًا فَاضْرِبْ بِهِ وَلاَ تَحْنَثْ إِنَّا وَجَدْنَاهُ صَابِرًا نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ ﴿44﴾

‘আর তুমি তোমার হাতে এক মুঠো তৃণলতা নাও এবং তা দিয়ে আঘাত কর। আর কসম ভংগ করো না। নিশ্চয় আমি তাকে ধৈর্যশীল পেয়েছি। সে কতই না উত্তম বান্দা! নিশ্চয়ই সে ছিল আমার অভিমুখী।’ [সূরা সাদ : ৪৪]

ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ ﴿42﴾

‘[আমি বললাম], ‘তুমি তোমার পা দিয়ে (ভূমিতে) আঘাত কর, এ হচ্ছে গোসলের সুশীতল পানি আর পানীয়’। [সূরা সাদ : ৪২]

عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا معشر الشباب ! من استطاع الباءة فليتزوج، فإنه أغض للبصر، و أحصن للفرج، و من لم يستطع فعليه بالصوم فإنه له وجاء .

‘হে যুবসমাজ ! তোমাদের মধ্যে যে ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে পারে সে যেন বিয়ে করে ফেলে। কারণ তা দৃষ্টিকে অবনত এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষিত রাখে। আর যার সে সক্ষমতা নেই সে যেন রোজা রাখে। কারণ রোজাই হচ্ছে তার রক্ষাকবচ।’ [বুখারী : ৫০৬৬]

কোন মুসলিমের চিন্তা ও বোধে ছোট্ট একটি পরিবর্তন তার জীবনের মোড় ও গতিকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। বদলে যেতে পারে তার শক্তির জায়গাগুলো। এই পরিবর্তন হচ্ছে যে কোন ক্ষেত্রে ইতিবাচক বিকল্প তৈরিতে সার্থকতা লাভ করা।

এ হচ্ছে মানসিক প্রস্ত্ততি, যা ব্যক্তিকে তার শত্রুর সামনে এক রহস্যময় ধূর্ত প্রহেলিকারূপে হাজির করে, এবং ব্যাপক ও বিশেষ যে কোন বিপদের সামনে নিজ সম্প্রদায়ের জন্য বরাভয় হয়ে দাঁড়ায়। এই ইতিবাচক বিকল্প তৈরির মানসিকতার চর্চার ফলে মানুষ কোন বিপদের সামনেই আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠে না, অন্যের তৈরি ফাঁদে পা দেয়ার দুশ্চিন্তা তাকে আর পূর্বের মত শঙ্কিত করে না। এর চেয়ে বড় কথা হল, এই মানসিক চর্চার ফলে ব্যক্তি তার উপর আপতিত বিপদের মুখ শত্রুর দিকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়, সক্ষম হয় তার দীন ও উম্মতকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন করতে, এভাবে সে তার ইহকাল ও পরকাল- উভয়টি রক্ষার প্রয়াস পায়।

বিপদ আসে অন্ধকার এলাকায় শকুনের মত পাখা মেলে, চারদিক বিস্তৃত থাকে তার শক্তি, ব্যাপক ভয়ানক আগুনের মত ধেয়ে আসে, কিন্তু ব্যক্তি, এই চর্চার ফলে, প্রথম ধাক্কা সহজে সামলে উঠে। সুতরাং সে বিপদের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করে না, তার কপালে ফুটে উঠে না চিন্তার রেখা, সে বিষণ্ণ হয়ে উঠে না।

সে শান্ত ও স্থির থাকে, নীরবতা অবলম্বন করে, তার অন্তর সদা তার প্রতিই ধাবিত ও সম্পৃক্ত থাকে, যিনি যাবতীয় আদেশ ও নিষেধের মালিক। আর তার চিন্তা গভীর থেকে গভীরে হাতড়ে বেড়ায় মানসিক কোন পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি বিকল্প তৈরি করতে, যাতে বিপদকে নিআমতে পরিবর্তন করা যায়।

সে বুঝতে পারে এই বিপদকে নিআমতে রূপান্তরের সূচনা হবে চিন্তায় ছোট্ট একটি পরিবর্তনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই এক ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে, এক বাস্তব বিবর্তনের সূচনা হবে। এটি হচ্ছে রেডিও ওয়েভের মত, ছোট্ট একটি ওয়েভের ফলে দেশে দেশে একটি সংবাদ অনায়াসে পৌঁছে যায়। আল্লাহর কাছে, সন্দেহ নেই, যে কোন বিষয়ই অনায়াসসাধ্য।

আমরা সচেতনভাবে নিজেদের প্রতি লক্ষ্য করলে অবাক হয়ে যাই। অসংখ্য বিপদ আমাদের আক্রান্ত করে, বিপদে আমরা হেস্তনেস্ত হয়ে যাই। এক সময় মনে হয়, এ বিপদ থেকে মুক্ত হওয়া আমাদের বুদ্ধির ঊর্ধ্বের বিষয়। তখন চারদিক ও ভবিষ্যত অন্ধকার মনে হয়। অত:পর যখন সেই দু:সহ দিনগুলো কেটে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু আগের মত হয়ে যায়, জীবন গতিময় হয়ে উঠে। বিপদের অভ্যন্তরে বীজ হয়ে লুকিয়ে থাকে অনেক কল্যাণ, অঢেল রিযক।

মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে অপবাদের তুলনায় বড় কোন বিপদ আছে?

মানুষের মান-মর্যাদা ও সম্মান যতটা গুরুত্বপূর্ণ ও বড় ব্যাপার ঠিক ততটাই বড় ব্যাপার নিজেকে নিস্কলুষ রাখা, যাবতীয় অপবাদ থেকে মুক্ত রাখা। এ সত্বেও, আল্লাহ তাআলা আয়িশা রা.-কে অপবাদ প্রদানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন :

إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالإِفْكِ عُصْبَةٌ مِنْكُمْ لاَ تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ مَا اكْتَسَبَ مِنَ الإِثْمِ وَالَّذِي تَوَلَّى كِبْرَهُ مِنْهُمْ لَهُ عَذَابٌ عَظِيمٌ ﴿11﴾

‘নিশ্চয় যারা এ অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর মনে করো না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে, যতটুকু পাপ সে অর্জন করেছে। আর তাদের থেকে যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে মহা আযাব।’। [সূরা নূর : ১১]

প্রতিবার বিপদে আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা বলি, এই শেষ, আমি আর কখনো এবারের মত এতটা কেঁপে উঠব না, বিপদের সম্মুখে দিশাহারা হয়ে যাব না। কিন্তু এই শেষ আর কখনো আসে না, প্রতিবার তার পুনরাগমন দেখে দেখে আমরা অস্থির হয়ে যাই।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীতে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, তবে দেখতে পাব কার্যকরী কোন বিকল্প তৈরি করা এবং বিপদের মোড় ঘুরিয়ে তাকে নিআমত করে নেয়ার জন্য তিনি সর্বদা সজাগ হয়ে আছেন। আমরা বর্তমানে যে বিপদেই আক্রান্ত হচ্ছি, রাসূলের জীবন তার কোন উদাহরণ পাব, যা এর চেয়েও ভয়াবহ বিপদ হিসেবে তার জীবনে এসেছিল। দেখতে পাই কীভাবে রাসূল বিপদ হতে বের হওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছেন, বিপদ হওয়া সত্বেও তাকে কীভাবে নিআমতে রূপান্তরিত করছেন।

কষ্ট যাতনা ও অন্যের দ্বারা শাস্তিভোগ কি মানুষের জীবনে সবচেয়ে কঠিন বিষয় নয়? জীবনী শক্তির অধিকাংশই কি এখানে নি:শেষ হয়ে যায় না? কিন্তু এই কষ্ট যাতনাই রাসূল ও তার সাহাবীদের জীবনে এমন পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল, যার উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় বিরল। তিনি মক্কার লোক দ্বারা দীর্ঘদিন কষ্টভোগের পর তার অনুসারীদেরকে হাবশায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন, যেখানে তারা রাজার পক্ষ থেকে কোন দুর্ভোগের শিকার হবে না। এই নির্দেশ ও হিজরতই ছিল প্রথম বিজয়, আজ পর্যন্ত যা বপনের আলোকিত ধারাকে অব্যাহত রেখেছে, এবং তাওহীদের অমীয় ধারায় আমাদেরকে বিধৌত করছে। ইসলাম তার দাওয়াতকে এই হিজরতের মাধ্যমে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দিয়েছে, মানুষ যুগ ও বংশ পরম্পরায় তাকে কিয়ামত অবধি নিয়ে যাবে।

দেশান্তর কি দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করার মত কোন বিপদ নয়?

কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিপদ থেকে উদ্ভাবন করলেন এমন এক বিজয়, আশ্রয় ও মুক্ততা যা তাকে ও তার দাওয়াত পৃথিবী ব্যাপী ব্যপকতা দান করেছে, এবং কিয়ামত অবধি টিকে থাকার মজবুত ভিত এনে দিয়েছে। তিনি মদীনার মত এক পবিত্র নগরীকে পেয়েছিলেন।

মদীনা ছিল আল্লাহর নির্বাচন, নির্বাচনের যাবতীয় ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর কাছেই রক্ষিত। আল্লাহ তাআলা রাসূলকে মদীনার পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূল অপেক্ষা করছিলেন কোন বিকল্পের, তাই তিনি বিভিন্ন মৌসুমে অন্যান্য গোত্রের সাথে নানাভাবে মিলিত হচ্ছিলেন। এভাবে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য সর্বোত্তম এলাকা নির্বাচন করলেন।

প্রতিটি নবী- যে তার সম্প্রদায়কে মন্দ কাজ, কুফরী ও শিরকে বাধা প্রদান করেছেন- আপন সম্প্রদায়ের সম্মুখে প্রয়োজনীয় বিকল্প পেশ করেছেন। কুরআন এর উত্তম সাক্ষী।

নূহ তার সন্তানকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন :

يَا بُنَيَّ ارْكَبْ مَعَنَا .

‘হে আমার পুত্র, আমাদের সাথে আরোহণ কর’। [সূরা হূদ : ৪২] কাফির কওমের সাথে ডুবে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি রক্ষা পাওয়ার জন্য এই বিকল্প প্রস্তাব করেছিলেন। অপর দিকে লূত আ. তার কওমকে বলছেন :

هَؤُلاَءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ .

‘হে আমার কওম, এরা আমার মেয়ে, তারা তোমাদের জন্য পবিত্র।’ [সূরা হূদ : ৭৮] অশ্লীল কর্মে বিকল্পরূপে তিনি তার কন্যা সন্তানদেরকে বিয়ে করে তাদের সাথে বৈধভাবে যৌনাচার করার প্রস্তাব করেছিলেন। ইউসূফ আ. মিসরবাসীকে আসন্ন দূর্ভিক্ষের প্রতিরোধে পথ বাতলে দিয়ে বলেছিলেন :

فَمَا حَصَدْتُمْ فَذَرُوهُ فِي سُنْبُلِه .

‘অতঃপর যে শস্য কেটে ঘরে তুলবে তা শীষের মধ্যে রেখে দেবে’। [সূরা ইউসূফ : ৪৭] কুরআনে এ ছাড়া আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে।

পাঠক, বিপদ যেমনি হোক না কেন, অবশ্যই তা থেকে বের হওয়ার কোন পথ আছে। বিপদ কঠিন হোক কিংবা সহজ, ছোট্ট একটি পরিবর্তনের মাঝে লুকিয়ে আছে তার মুক্তি। তুমি দেখতে পাবে, কুরআন অনেক বড় বড় বিপদের উল্লেখ করে তা বান্দাদের সামনে তুলে ধরেছে, যা ভাল কোন বিকল্পে রূপ পেয়েছে। লাঠির আঘাতে বৃহৎ শিলাখন্ড থেকে পানির স্বচ্ছ ধারা প্রবাহিত হয়েছে, কিংবা আল্লাহর ভয়ে তা থেকে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ প্রস্রবন। আগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকে ঝরেছে বৃষ্টির ধারা, যা যমীনকে উদ্ভাসিত করেছে নতুন জীবনে। বজ্রের অগ্নুৎপাতের অভ্যন্তরে আল্লাহ তাআলা লুকিয়ে রেখেছিলেন এই পৃথিবীর সজিবতা। কে জানত, একদিন পানির ঢল থেকে বিদুৎ আবিস্কৃত হবে? ভয়ংকর বন্যার পরই কেন পলি মাটির স্তর জমে যমীনকে ফলে-ফুলে শোভিত করে তুলে?

এগুলো নিশ্চয় কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এ হচ্ছে কুরআনের পদ্ধতি, যা রাসূল সুবিন্যস্ত আকারে মানুষের সম্মুখে হাজির করেছেন। জীবনকে বুঝবার ও গঠন করবার এ এক নতুন পদ্ধতি, যা ব্যাপকভাবে মানুষের চিন্তা ও বিশেষভাবে মুসলিমদের চিন্তা ও বোধে ভাস্বর করে দেয়া হয়েছে।

জগত সৃষ্টি নিশ্চয় মানুষের সৃষ্টির চেয়ে বৃহৎ কোন ঘটনা, জগতের মাঝে লুকিয়ে আছে এমন অনেক শক্তির আভাস, যা বুঝা ও আয়ত্ব করা মানুষের শক্তিরও ঊর্ধ্বে। কিন্তু যখনি আমরা এ শক্তি ও বিশালতায় দৃষ্টি দিব, তখনি আমাদেরকে নতুন একটি বিষয় চিন্তায় সংযোজন করতে হবে, যাতে পুরো বিষয়টি আমাদের উপকারে ব্যয় হয়। জগত সম্পর্কিত আমাদের জ্ঞান ও কর্মের মূলমন্ত্রই হবে এই যে, জগতকে আমাদের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে, আমাদের শত্রু করে নয়।

এই পরিবর্তনের ধারা, আল্লাহ চাহে তো অবশ্যই, বিকল্প সন্ধানের মাধ্যমেই আমরা পাব। মানুষ ভয়ে যে আর্তরব করে উঠে, আমরা তাকে পরিবর্তন করে সতর্কতামূলক চিৎকারে পরিবর্তিত করে নিতে পারব। এ চিন্তা অনুসরণের ফলে কঠিন শত্রুতাও আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ ভ্রাতৃত্বে পরিণত হবে। আল্লাহ তাআলা একে বর্ণনা করেছেন, বর্ণনা করেছেন এর উপায়, উৎসাহ দিয়েছেন এর প্রতি। কুরআনে বলেছেন :

وَمَا يُلَقَّاهَا إِلاَّ الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلاَّ ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ ﴿35﴾

‘আর এটি তারাই প্রাপ্ত হবে যারা ধৈর্যধারণ করবে, আর এর অধিকারী কেবল তারাই হয় যারা মহাভাগ্যবান’। [সূরা ফুসসিলাত : ৩৫]

ইউসূফকে হারিয়ে ইয়াকূব আ. ভীষণ মনোকষ্টে পতিত হয়েছিলেন, বিপদ তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। কিন্তু, ইউসূফের জামায় রক্তের দাগ তার মৃত্যুর বার্তা না হয়ে জীবনের সুসংবাদ হয়ে উঠেছিল। ইউসূফের বন্দীদশা তার দাওয়াত প্রচার ও প্রসারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, অন্যান্য বন্দীরা তার প্রচেষ্টার ফলে তার দাওয়াতে সারা দিয়েছিল। তার ভাইয়েরা বিনইয়ামীনকে হারিয়ে যে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল, ইয়াকূবের কাছে তাই ছিল আশার বাণী, নতুন করে সব ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত। দ্বিতীয় সন্তানকে হারিয়ে ইয়াকূব বলেছিলেন :

يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِنْ يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلاَ تَيْئَسُوا مِنْ رَوْحِ اللهِ إِنَّهُ لاَ يَيْئَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ ﴿87﴾

‘হে আমার ছেলেরা, তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের খোঁজ খবর নাও। আর তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, কেননা কাফির কওম ছাড়া কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না’। [সূরা ইউসূফ : ৮৭]

পরিশেষে, ইউসূফের প্রথম স্বপ্ন এমন বাস্তব হয়ে দেখা দিল, যা ছিল পৃথিবীর বুকে এক অভূতপূর্ব ঘটনা :

وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا وَقَالَ يَا أَبَتِ هَذَا تَأْوِيلُ رُؤْيَايَ مِنْ قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّي حَقًّا وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُمْ مِنَ الْبَدْوِ مِنْ بَعْدِ أَنْ نَزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي إِنَّ رَبِّي لَطِيفٌ لِمَا يَشَاءُ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ ﴿100﴾

‘আর সে তার পিতামাতাকে রাজাসনে উঠাল এবং তারা সকলে তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং সে বলল, ‘হে আমার পিতা, এই হল আমার ইতঃপূর্বের স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার রব তা বাস্তবে পরিণত করেছেন আর তিনি আমার উপর এহসান করেছেন, যখন আমাকে জেলখানা থেকে বের করেছেন এবং তোমাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করার পর। নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা করেন, তাতে তিনি সূক্ষ্মদর্শী। নিশ্চয় তিনি সম্যক জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’।’। [সূরা ইউসূফ : ১০০]

খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননকালে একটি শিলাখন্ড কেউ সরাতে পারছিল না, রাসূল গিয়ে সেটি সরালেন, যখন তিনি তাতে আঘাত করছিলেন, তা থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছিল, তা দেখে রাসূল ইরশাদ করলেন :

ضربت ضربتي الأولى فبرق الذي رأيتم، فأضاء لي منها قصور الحيرة و مدائن كسرى كأنها أنياب الكلاب، و أخبرني جبريل أن أمتي ظاهرة عليهم، ثم ضربت ضربتي الثانية فبرق لي الذي رأيتم، أضاء لي قصور الحمر من أرض الروم كأنها أنياب الكلاب، و أخبرني جبريل أن أمتي ظاهرة عليها، ثم ضربت ضربتي الثالثة فبرق لي الذي رأيتم، أضاء لي معها قصور صنعاء كأنها أنياب الكلاب، و أخبرني جبريل أن أمتي ظاهرة عليها يبلغهن النصر فأبشروا .

‘আমি প্রথম আঘাত করতেই আলো জ্বলে ওঠল, সেটা তো তোমরা দেখেছ। সেই আলোয় আমি হিরার প্রাসাদ ও কেসরার শহরগুলো দেখতে পেলাম, কুকুরের দাঁতের মত জ্বল-জ্বল করছে এবং জিবরাইল আমাকে বললেন আমার উম্মত তাদের উপর জয়ী হবে। আমি দ্বিতীয়বার আঘাত করতেও আলো জ্বলে ওঠল, যা তোমারা দেখেছ। তাতে আমার সামনে রোমের লাল প্রাসাদগুলো কুকুরের দাঁতের মত ভেসে ওঠল এবং জিবরাইল আমাকে বললেন আমার উম্মত তাদের উপর বিজয়ী হবে। অত:পর আমি তৃতীয়বার আঘাত করলাম এবং তাতে আলো জ্বলে ওঠল, যা তোমরা দেখেছ। সেই আলোয় আমার সামনে সানআর প্রাসাদগুলো ভেসে ওঠল কুকুরের দাঁতের মত। জিবরাইল আমাকে বললেন, আমার উম্মত তাদের উপর বিজয়ী হবে। সুতরাং তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর’। [ইবনে জারীর তার তাফসীর গ্রন্থে হাদীসটির সনদ বর্ণনা করেছেন : ১০/২৬৯]

খন্দকের যুদ্ধের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পরিপূর্ণ পরিবর্তনের ঘোষণা দিলেন, তিনি বললেন, ‘এখন আমরা তাদের দিকে ধেয়ে যাব, তারা আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে না।’ [বুখারী : ৪১১০]

এ এক মহান পন্থা, যখন অন্ধকারের মজ্জায় তা বিকীর্ণ হয়, তখন অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোকিত হয় আশপাশ, এবং মুসলমানদের এক বাস্তব বিজয়ের সূচনা করে। বিপদ ঠিক যতটা বড় হবে, প্রাপ্তিও হবে তত বড়, বিপদের সময়কাল হিসেবে ফলপ্রাপ্তির সময়কালও নির্ধারিত হবে।

উচ্চতর শিক্ষায় ব্যাপৃত কারো পক্ষে আমাদের এ আলোচনাকে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণার রূপ দান করা সম্ভব, তিনি জ্ঞান ও তৎপরতার সংমিশ্রনে একটি গবেষণা সন্দর্ভ হাজির করবেন আমাদের সম্মুখে, যাতে সাধারণভাবে সকল মুসলমানের জন্য, এবং বিশেষভাবে দায়ীদের জন্য এমন এক রূপান্তর দেখানো হবে, যা তাদের মানসিকতা ও বাস্তবতায় ব্যাপক ক্রিয়া করবে। গবেষকের সামনে থাকবে আল্লাহ তাআলার কালাম পবিত্র কুরআন, যা জুড়ে আছে বিকল্প তৈরির নানা উদাহরণ, এবং হাদীসের মহান ভান্ডার। আমি তাকে প্রাথমিক কিছু ইঙ্গিত করার জন্য এখানে কুরআন ও হাদীস থেকে কিছু উদাহরণ টানবার প্রয়াস চালাব।

২৬
প্রথম উদাহরণ :
حَتَّى إِذَا أَتَوْا عَلَى وَادِ النَّمْلِ قَالَتْ نَمْلَةٌ يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسَاكِنَكُمْ لاَ يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لاَ يَشْعُرُونَ ﴿18﴾

‘অবশেষে যখন তারা পিপড়ার উপত্যকায় পৌঁছল তখন এক পিপড়া বলল, ‘ওহে পিপড়ার দল, তোমরা তোমাদের বাসস্থানে প্রবেশ কর। সুলাইমান ও তার বাহিনী তোমাদেরকে যেন অজ্ঞাতসারে পিষ্ট করে মারতে না পারে’। [সূরা নামল : ১৮]

পিপীলিকার দল ভয়াবহ বিপদে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই নিজেদের জন্য একটি বিকল্প পথ আবিস্কার করে নিয়েছে।

২৭
দ্বিতীয় উদাহরণ :
وَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُمْ بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنْتُمْ فِي أَنْفُسِكُمْ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُونَهُنَّ وَلَكِنْ لاَ تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلاَّ أَنْ تَقُولُوا قَوْلًا مَعْرُوفًا وَلاَ تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّى يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنْفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ ﴿235﴾

‘আর এতে তোমাদের কোন পাপ নেই যে, তোমরা নারীদেরকে ইশারায় যে প্রস্তাব করবে কিংবা মনে গোপন করে রাখবে। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা অবশ্যই তাদেরকে স্মরণ করবে। কিন্তু বিধি মোতাবেক কোন কথা বলা ছাড়া গোপনে তাদেরকে (কোন) প্রতিশ্রুতি দিয়ো না। আর আল্লাহর নির্দেশ (ইদ্দত) তার সময় পূর্ণ করার পূর্বে বিবাহ বন্ধনের সংকল্প করো না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তা জানেন। সুতরাং তোমরা তাকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।’ [সূরা বাকারা : ২৩৫]

স্বামীর মৃত্যুতে ইদ্দত পালনকারী নারীর কাছে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করা থেকে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন, বিকল্প হিসেবে ইঙ্গিতে বলবার অধিকার দিয়েছেন।

২৮
তৃতীয় উদাহরণ :
وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلاَّ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ كِتَابَ اللهِ عَلَيْكُمْ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآَتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً وَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُمْ بِهِ مِنْ بَعْدِ الْفَرِيضَةِ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا ﴿24﴾

‘আর (হারাম করা হয়েছে) নারীদের মধ্য থেকে সধবাদেরকে। তবে তোমাদের হাত যাদের মালিক হয়েছে তারা ছাড়া। এটি তোমাদের উপর আল্লাহর বিধান এবং এরা ছাড়া সকল নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে চাইবে বিবাহ করে, অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে নয়। সুতরাং তাদের মধ্যে তোমরা যাদেরকে ভোগ করেছ তাদেরকে তাদের নির্ধারিত মোহর দিয়ে দাও। আর নির্ধারণের পর যে ব্যাপারে তোমরা পরস্পর সম্মত হবে তাতে তোমাদের উপর কোন অপরাধ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা নিসা : ২৪]

যুদ্ধে কাফিরদের স্ত্রীরা বন্দী হয়ে এলে তাদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার তিনটি সম্ভাবনা থাকে, হয়তো তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠানো হবে আর এর মাধ্যমে কেবল তাদের শক্তিই বৃদ্ধি পাবে। অথবা মুসলিম স্বাধীন নারীর মতই তাদের সাথে আচরণ করা হবে, এতে কাফির নারীদের সম্মান জানানো হবে এবং অসম্মান জানানো হবে মুসলিম নারীদের প্রতি। কিংবা তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করা হবে এবং তার উপর প্রযোজ্য হবে প্রচলিত আহকাম, যা প্রকারান্তরে এক সময়ে তাকে স্বাধীন নারীতে পরিণত করে। এটিই হল কঠিনতম সমস্যা সর্বোত্তম বিকল্প, উক্ত আয়াত নাযিল হওয়া অবধি মানব সমাজ যে সমাধান কোনভাবেই হাজির করতে সক্ষম হয়নি।

২৯
চতুর্থ উদাহরণ :
وَخُذْ بِيَدِكَ ضِغْثًا فَاضْرِبْ بِهِ وَلاَ تَحْنَثْ إِنَّا وَجَدْنَاهُ صَابِرًا نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ ﴿44﴾

‘আর তুমি তোমার হাতে এক মুঠো তৃণলতা নাও এবং তা দিয়ে আঘাত কর। আর কসম ভংগ করো না। নিশ্চয় আমি তাকে ধৈর্যশীল পেয়েছি। সে কতই না উত্তম বান্দা! নিশ্চয়ই সে ছিল আমার অভিমুখী’। [সূরা সাদ : ৪৪]

৩০
পঞ্চম উদাহরণ :
لاَ يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ﴿89﴾

‘আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যাপারে, কিন্তু যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করেন। সুতরাং এর কাফফারা হল দশ জন মিসকীনকে খাবার দান করা, মধ্যম ধরনের খাবার, যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস-দাসী মুক্ত করা। অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটা তোমাদের কসমের কাফ্ফারা, যদি তোমরা কসম কর, আর তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত কর। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।’ [সূরা মায়িদা : ৮৯]

যে ব্যক্তি শপথ করেছিল যে, কোন কল্যাণ কাজ করবে না, তার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি বিকল্প হতে পারত? সে একই সাথে দুটি কল্যাণ করার সুযোগ পাচ্ছে, প্রথম কিছু কুরবানী করার মাধ্যমে শপথ থেকে মুক্ত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত: তওবার মাধ্যমে কল্যাণজনক কাজে ফিরে আসছে।

৩১
ষষ্ঠ উদাহরণ :
فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ﴿40﴾

‘অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপোস নিস্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ যালিমদের পছন্দ করেন না। ’। [সূরা শূরা : ৪০]

৩২
সপ্তম উদাহরণ :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لاَ تَقْرَبُوا الصَّلاَةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ إِنَّ اللهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا ﴿43﴾

‘হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা থেকে আসে কিংবা তোমরা স্ত্রী সম্ভোগ কর, তবে যদি পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটিতে তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখমন্ডল ও হাত মাসেহ কর। নিশ্চয় আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।’ [সূরা নিসা : ৪৩]

৩৩
অষ্টম উদাহরণ :
وَاللاَّتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلاَ تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا ﴿34﴾ وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلاَحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا ﴿35﴾

‘আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান। আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।’ [সূরা নিসা : ৩৪-৩৫]

৩৪
নবম উদাহরণ :
وَإِذْ قُلْتُمْ يَا مُوسَى لَنْ نَصْبِرَ عَلَى طَعَامٍ وَاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُخْرِجْ لَنَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ مِنْ بَقْلِهَا وَقِثَّائِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَا قَالَ أَتَسْتَبْدِلُونَ الَّذِي هُوَ أَدْنَى بِالَّذِي هُوَ خَيْرٌ اهْبِطُوا مِصْرًا فَإِنَّ لَكُمْ مَا سَأَلْتُمْ وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِنَ اللهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿61﴾

‘আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা এক খাবারের উপর কখনো ধৈর্য ধরব না। সুতরাং তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দো‘আ কর, যেন তিনি আমাদের জন্য বের করেন, ভূমি যে সব্জি, কাঁকড়, রসুন, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করে, তা’। সে বলল, ‘তোমরা কি যা উত্তম তার পরিবর্তে এমন জিনিস গ্রহণ করছ যা নিম্নমানের? তোমরা কোন এক নগরীতে অবতরণ কর। তবে নিশ্চয় তোমাদের জন্য (সেখানে) থাকবে, যা তোমরা চেয়েছ’। আর তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য এবং তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হল। তা এই কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করত। তা এই কারণে যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত।’ [সূরা বাকারা : ৬১]

৩৫
দশম উদাহরণ :
বনী ইসরাইলের জীবন ও জীবনব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করলে দেখা যায়, বিকল্প গ্রহণে তারা ছিল খুবই মন্দ পন্থা অবলম্বনকারী। কারণ, তারা সর্বদা মন্দকেই গ্রহণ করত, কিংবা বিপদের মুখোমুখি হলে তারা অসন্তোষে ফেটে পড়ত। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :

مَا نَنْسَخْ مِنْ آَيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿106﴾

‘আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।’ [সূরা বাকারা : ১০৬]

৩৬
একাদশ উদাহরণ :
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ ﴿216﴾

‘তোমাদের উপর লড়াইয়ের বিধান দেয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’ [সূরা বাকারা : ২১৬]

৩৭
দ্বাদশ উদাহরণ :
وَلاَ تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلاَ تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ وَيُبَيِّنُ آَيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ﴿221﴾

‘আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে এবং মুমিন দাসী মুশরিক নারীর চেয়ে নিশ্চয় উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। আর মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে দিয়ো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। আর একজন মুমিন দাস একজন মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে।

তারা তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহবান করে, আর আল্লাহ তাঁর অনুমতিতে তোমাদেরকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন এবং মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।’ [সূরা বাকারা : ২২১]

৩৮
ত্রয়োদশ উদাহরণ :
قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللهِ وَاللهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ ﴿15﴾

বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়েও উত্তম বস্ত্তর সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অর্জন করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর পবিত্র স্ত্রীগণ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি’। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।’ [সূরা আলে ইমরান : ১৫]

৩৯
চতুর্দশ উদাহরণ :
وَأَذَانٌ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ فَإِنْ تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللهِ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿3﴾

‘আর মহান হজ্জের দিন মানুষের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষণা, নিশ্চয় আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও। অতএব, যদি তোমরা তাওবা কর, তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি তোমরা ফিরে যাও, তাহলে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না। আর যারা কুফরী করেছে, তাদের তুমি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।’ [সূরা তাওবা : ৩]

৪০
পঞ্চদশ উদাহরণ :
وَلَمَّا جَهَّزَهُمْ بِجَهَازِهِمْ قَالَ ائْتُونِي بِأَخٍ لَكُمْ مِنْ أَبِيكُمْ أَلاَ تَرَوْنَ أَنِّي أُوفِي الْكَيْلَ وَأَنَا خَيْرُ الْمُنْزِلِينَ ﴿59﴾

‘আর সে যখন তাদেরকে তাদের রসদসামগ্রী প্রস্ত্তত করে দিল, তখন বলল, ‘তোমরা তোমাদের পিতার পক্ষ হতে তোমাদের এক ভাইকে আমার কাছে নিয়ে আস, তোমরা কি দেখ না, আমি পরিমাপে পূর্ণমাত্রায় দেই এবং আমি উত্তম অতিথিপরায়ণ?’ [সূরা ইউসূফ : ৫৯]

৪১
ষষ্ঠদশ উদাহরণ :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ﴿9﴾

‘হে মুমিনগণ, যখন জুমআর দিন তোমাদেরকে সালাতের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং বিক্রি ত্যাগ কর। এটি তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জেনে থাক’। [সুরা জুমআ : ৯]

৪২
সপ্তদশ উদাহরণ :
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَلَوْ آَمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ ﴿110﴾

‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত। তাদের কতক ঈমানদার। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক।’ [সূরা আলে ইমরান : ১১০]

৪৩
অষ্টাদশ উদাহরণ :
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِمَنْ فِي أَيْدِيكُمْ مِنَ الأَسْرَى إِنْ يَعْلَمِ اللهُ فِي قُلُوبِكُمْ خَيْرًا يُؤْتِكُمْ خَيْرًا مِمَّا أُخِذَ مِنْكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ﴿70﴾

হে নবী, তোমাদের হাতে যে সব যুদ্ধবন্দী আছে, তাদেরকে বল, ‘যদি আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহে কোন কল্যাণ আছে বলে জানেন, তাহলে তোমাদের থেকে যা নেয়া হয়েছে, তার চেয়ে উত্তম কিছু দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন, আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’। [সূরা আনফাল : ৭০]

৪৪
উনিশতম উদাহরণ :
وَلْيَسْتَعْفِفِ الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ نِكَاحًا حَتَّى يُغْنِيَهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَالَّذِينَ يَبْتَغُونَ الْكِتَابَ مِمَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَكَاتِبُوهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ فِيهِمْ خَيْرًا وَآَتُوهُمْ مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِي آَتَاكُمْ وَلاَ تُكْرِهُوا فَتَيَاتِكُمْ عَلَى الْبِغَاءِ إِنْ أَرَدْنَ تَحَصُّنًا لِتَبْتَغُوا عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَنْ يُكْرِهُّنَّ فَإِنَّ اللهَ مِنْ بَعْدِ إِكْرَاهِهِنَّ غَفُورٌ رَحِيمٌ ﴿33﴾

‘আর যাদের বিবাহের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে। আর তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায় তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর, যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে জানতে পার এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দাও। তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের কামনায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করো না। আর যারা তাদেরকে বাধ্য করবে, নিশ্চয় তাদেরকে বাধ্য করার পর আল্লাহ তাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ [সূরা নূর : ৩৩]

৪৫
বিশতম উদাহরণ :
طَاعَةٌ وَقَوْلٌ مَعْرُوفٌ فَإِذَا عَزَمَ الْأَمْرُ فَلَوْ صَدَقُوا اللهَ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ ﴿21﴾

‘আনুগত্য ও ন্যায়সঙ্গত কথা (তাদের জন্য) উত্তম। অতঃপর যখন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, তখন যদি তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা সত্যে পরিণত করত, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত।’ [সূরা মুহাম্মাদ : ২১]

হাদীস থেকে বিকল্প তৈরি এ পন্থার সমর্থনে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমরা তা থেকে কয়েকটি মাত্র নিম্নে তুলে ধরার প্রয়াস পাব।

عن ابن عمر قال : أتى رسول الله صلى الله عليه و سلم رجل فقال : يا رسول الله إني أذنبت ذنبا كبيرا فهل لي توبة ؟ فقال له رسول الله صلى الله عليه و سلم ألك والدان ؟ قال : لا، قال فلك خالة ؟ قال نعم : فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم فبِرَّها إذاً .

‘ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক লোক এসে বলল : হে আল্লাহর রাসূল ! আমি একটা পাপ করেছি, আমার জন্য কি তওবার সুযোগ আছে? তিনি বললেন তোমার কি পিতা-মাতা আছে? সে বলল : না। তিনি বললেন, তাহলে তোমার কি কোনো ফুফু আছে? সে বলল : হা। তখন রাসূল বললেন : তাহলে তার সেবা কর’। [আহমদ : ৪৬২৪]

عن أبي سعيد قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من نام عن وتر أو نسيه فليصله إذا ذكره .

‘আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : কেউ যদি বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে বা ভুলে যায় তাহলে সে যেন যখন মনে পড়ে তখন তা পড়ে নেয়’। [আবূ দাঊদ : ১৪৩১]

عن عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها قالت : استأذنت النبي صلى الله عليه و سلم في الجهاد فقال : جهادكن الحج .

‘উম্মুল মোমেনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিহাদের অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, তোমাদের জিহাদ হচ্ছে হজ।’ [বুখারী : ২৮৭৫]

عن ابن عباس : أن النبي صلى الله عليه و سلم قال لامرأة من الأنصار يقال لها أم سنان : ما منعك أن تكوني حججت معنا ؟ قالت : ناضحان كان لأبي فلان ( زوجها ) حج هو و ابنه على أحدهما و كان الآخر يسقي غلامنا قال : فعمرة في رمضان تقضي حجة، أو حجة معي .

‘ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সিনানা নাম্নী এক আনছারী মহিলাকে বললেন : আমাদের সাথে হজ করতে তোমার কোনো সমস্যা আছে? সে বলল : আমাদের দুটি উট ছিল, একটি অমুকের পিতার (তার স্বামী) কাছে আছে। সে ও তার সন্তান তাতে হজ করার জন্য নিয়ে গিয়েছে। অপরটি আমাদের সন্তানকে পানি পান করায়। রাসূল বললেন, তবে রমজানে উমরা আদায় হজ কিংবা আমার সাথে হজের কাযা হয়ে যাবে।’ [মুসলিম : ১২৫৬]

عن عائشة رضي الله عنها : أن رجلا قال للنبي صلى الله عليه و سلم إن أمي افتلتت نفسها، و أظنها لو تكلمت تصدقت فهل لها أجر إن تصدقت عنها ؟ قال ( نعم ).

‘আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললামকে বলল, আমার মা হঠাৎ মারা গিয়েছেন। আমার ধারণা কিছু বলে যাওয়ার সুযোগ পেলে তিনি সাদাকা করে যেতেন। এখন আমি যদি তার পক্ষ থেকে সাদাকা করি তাহলে কি তিনি তার প্রতিদান পাবেন? তিনি বললেন : হা।’ [বুখারী : ১৩৮৮]

عن ابن عباس قال : كان ناس من الأسرى يوم بدر لم يكن لهم فداء فجعل رسول الله صلى الله عليه و سلم فداءهم أن يعلموا أولاد الأنصار الكتابة، قال : فجاء غلام يوما يبكي إلى أبيه، فقال : ما شأنك ؟ قال : ضربني معلمي . قال : الخبيث، يطلب بذحل بدر ! و الله لا تأتيه أبداً .

‘ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বদরের বন্দিদের অনেকের মুক্তিপণ দেওয়ার মত কিছুই ছিল না। রাসূল আনসারদের বাচ্চাদের লেখা শিখানোকে তাদের মুক্তি হিসেবে নির্ধারণ করলেন। তিনি বলেন, তখন এক ছেলে এক দিন কাঁদতে কাঁদতে তার বাবার কাছে আসলে বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমার শিক্ষক আমাকে মেরেছে। সে বলল : বদমাশটা বদরের শোধ নিচ্ছে। তোমার আর তার কাছে যাওয়ার দরকার নাই। ’ [আহমদ : ২২১৬]

عن أبي هريرة : فقال رسول الله : من حلف على يمين فرأى غيرها خيرا منها فليأتها و ليكفر عن يمينه .

‘কেউ যদি কোনো ‘ইয়ামীন’ করে, পরে অন্য কোনো বিষয়কে তার চেয়ে ভাল মনে হয় তাহলে সে যেন তাই করে এবং ‘ইয়ামীন’-এর কাফ্ফারা দিয়ে দেয়।’ [মুসলিম : ১৬৫০]

عن ربيعة بن كعب الاسلمي قال : كنت أبيت مع رسول الله صلى الله عليه و سلم فأتيته بوضوئه و حاجته، فقال لي : ( سل ) فقلت : أسألك مرافقتك في الجنة قال : ( أو غير ذلك ) ؟ قلت : هو ذلك قال : فأعني على نفسك بكثرة السجود .

‘রাবিআ বিন কাআব আছলামী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রাত যাপন করতাম। একদিন তার ওজুর পানি নিয়ে এলে তিনি বললেন : ‘চাও’। আমি বললাম, জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই। তিনি বললেন, আর কিছু চাও? আমি বললাম, না পূর্বে যা চেয়েছিলমা তাই। তিনি বললেন : তাহলে বেশী বেশী সালাত আদায় করে আমাকে সহযোগিতা কর।’। [মুসলিম : ৪৮৯]

عن عبد الله بن مسعود، قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : إذا شك أحدكم في صلاته فليتحر الصواب، فليتم عليه ثم ليسلم، ثم يسجد سجدتين .

‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : কারো যদি সালাতের ভেতর সন্দেহ হয় তাহলে সে যেন চিন্তা করে সঠিকটা বের করার চেষ্টা করে এবং তার উপর ভিত্তি করে সালাত শেষ করে সালাম ফিরিয়ে নেয় তারপর দুই সিজদা দেয়।’ [বুখারী : ৪০১]

عن الحسن قال : بلغنا أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : رحم الله عبدا تكلم فغنم أو سكت فسلم .

‘হাসান রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাদের নিকটা এমন পৌছেছে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ ওই ব্যক্তির উপর রহম করুন যে কথা বলে উপকৃত হয় বা চুপ থেকে নিরাপদ থাকে’ [বাইহাকী : ৪৫৮৫]

ইসলামী ফিকহের পরিচ্ছেদগুলো তুমি চষে দেখতে পার, তাতে ছড়িয়ে আছে শরীয়তের মৌলিক শুদ্ধ প্রমাণের উপর ভিত্তি করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের বৈধতা, আইনী বিতর্কের মারপ্যাচে সেগুলোকে প্রমাণ করতে হয়নি কোনভাবে। শরীয়াভিত্তিক রাজনৈতিকতার এমন কোন পরিচ্ছেদ পাবে না, যাতে ছড়িয়ে নেই অসংখ্য বিকল্প।

এমনিভাবে, কেউ যদি গভীরভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত অধ্যয়ন করে, এবং মুসলমানদের উপর যে সমস্ত বিপদাপদ নেমে এসেছিল, তাতে দৃষ্টি দেয়, দেখতে পাবে, কীভাবে সুনিপুন উপায়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ভালো কোন বিকল্প উদ্ভাবন করেছেন, রাসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে মৃত্যু অবধি রাসূলের এ কর্মধারা অব্যাহত ছিল।

খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগগুলো যদি আমরা বিবেচনা করি, সেখানেও একই দৃশ্য দেখতে পাব। রাসূলের ওফাতের পর থেকে আলী রা.-এর মৃত্যু পর্যন্ত তারা এ কর্মপন্থা অত্যন্ত সার্থকতার সাথে অবলম্বন করেছেন। ইসলামের যে কালগুলোতে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে, তাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। যখন মানুষ কুরআন ও হাদীসের বাণীকে বিস্মৃত হয়েছে, তখন বিকল্প গ্রহণ করলেও তার কোন অর্থ থাকেনি। মূলকে পরিত্যাগ করে বিকল্পকে আকড়ে তার কী-ইবা অর্থ থাকতে পারে?

যে সমস্ত বিপদাপদ সচরাচর মানুষকে আক্রান্ত, হানা দেয় তাদের সুখী জীবনের এলাকায়, তুমি সেগুলোকে নিরীক্ষকের দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখতে পার, দেয়ালের আড়ালে থেকে তুমি পর্যবেক্ষণ কর, আল্লাহর উপর ভরসা করে গভীর দৃষ্টিতে দেখ। দেখবে, চতুর্দিক থেকে তোমার নিকট বিকল্প গ্রহণের সুযোগ ধরা দিচ্ছে। সেই বিকল্পের প্রতি মানুষকে আহবান কর, তাদেরকে শিক্ষা দাও এবং বিকল্পের এই মহোত্তম উপায়গুলো তাদের সামনে তুলে ধর। কেউ আক্রান্ত হয়ে আছে বিবাহ সংক্রান্ত ঝামেলায়, কেউ তালাক নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, সঙ্গ, ব্যবসা, রাজনীতি, সম্পদ ও তার ব্যবহার ইত্যাদি চতুর্মুখী বিপদে মানুষ অহরাত্র তটস্থ হয়ে আছে, সেগুলো সমাধান ও বিকল্প গ্রহণে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ কর।

এ ব্যাপারে তুমি তোমার প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলন গ্রহণ কর, পারিবারিক ও পরিবার গঠন সংক্রান্ত সমস্যায় তুমি এর চর্চা কর। তোমার প্রাত্যহিক জীবন বিকল্প গ্রহণের যুক্তির পক্ষে উত্তম ক্ষেত্র, এখান থেকেই সূচিত হোক এ বৃহৎ পাঠের দীর্ঘ যাত্রা।

বিশেষ অবিশেষ কোন বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই ভেবে হাল ছেড়ে দিও না যে, এখন আর কোন উপায় নেই, বিকল্প কোন পথই আর উন্মুক্ত হয়ে ধরা দিবে না, সুতরাং আমাকে আত্মসমর্পন করতে হবে। কিংবা কোথাও এসে বাধা প্রাপ্ত হয়ে ক্ষান্ত দিয়ে বসে পড় না।

রাসূল বিশেষভাবে আল্লাহর কাছ থেকে যা থেকে পানাহ চেয়েছেন, তা হচ্ছে পিছু হটা। তিনি বলেছেন : পিছু হটা ও অলসতা থেকে আমি তোমার পানাহ চাচ্ছি। যে ব্যক্তি চিন্তা থেকে পিছু হটে, সে হচ্ছে সবচেয়ে অথর্ব লোক।

হে আমার প্রিয় ভাই, তুমি তোমার গত জীবনকে একবার মেপে দেখ, দেখবে, পিছু হটা তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে তুমি মন্দকে ভালোয় পরিবর্তন করতে অপরাগ হয়েছ। কেন তুমি বিকল্প কিছুর অনুসন্ধান করনি? আমার ও তোমার জীবনে এমন উদাহরণ অঢেল...সন্দেহ নেই।

তুমি হয়তো তোমার সন্তানকে বিয়েতে সম্মত করতে পারছ না। কিন্তু সে যা কল্পনা করে রেখেছে, তার চেয়ে উত্তম কোন বিকল্প- সতী সাধ্বী নারীকে যদি তুমি তার সামনে উপস্থাপন করতে, তবে সন্দেহ নেই, শুধুই বকাঝকার চেয়ে তা হত কল্যাণকর।

হয়তো কাউকে তুমি লেখালেখিতে নিয়োজিত করতে পারছ না, অথচ যথেষ্ট যোগ্যতা তার রয়েছে। এ জন্য চাপপ্রয়োগ নিশ্চয় সুস্থ কোন ফল বয়ে আনবে না, বরং তুমি তার সামনে কোন প্রয়োজনীয় উপাদান উপস্থাপন কর, দেখবে, এক সময় পরিশ্রম সার্থক হবে।

এমনিভাবে অনর্থক প্রেসারের বদলে যদি ছাত্রদের সামনে গভীর মনোযোগে পাঠে নিমগ্ন হওয়ার পন্থা তুলে ধর, দেখবে, তারা জ্ঞানের সাগরে নিজেদেরকে বিলীন করে দিয়েছে।

তুমি যদি তোমার সন্তানকে বাড়ীতে অধ্যয়নের জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় বেধে দিতে, এবং সে সময়টুকু তার দেখাশোনা করতে তাহলে অবশ্যই তা হত তোমার জন্য উত্তম পন্থা। অবহেলার নাম করে তাকে তোমার বাধ্য করতে হত না।

বিকল্প গ্রহণের পদ্ধতি মানুষকে কোন সীমায় বেধে ফেলতে পারে না, সে পিছু হটে না শত্রুর ভয়ে কিংবা হারিয়ে যায় না অন্ধকার অলি গলিতে।

আমাদের মহান ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মাঝে পুরো একটি জাতি বিধৌত হওয়ার মত বিদগ্ধতা ছিল, কারাগারের অন্ধকার প্রোকোষ্ঠে তাকে আটকে রাখার সময় তিনি বিকল্প গ্রহণের সেই মহোত্তম উক্তিটি করেছিলেন : ‘শত্রুরা আমার কী এমন ক্ষতি করবে? আমার জান্নাত তো আমার বুকে, আমার কারাগার প্রবল একান্ততা, আমাকে নিগৃহিত করতে আমি উন্মুক্ত প্রান্তরে হেঁটে বেড়াই আর আমাকে হত্যা করা হলে সেটি হবে শাহাদাত।’

খলীফা উমর ফারুক রা.-কে শহীদ করার জন্য আঘাত করা হলে তিনি সাথে সাথে বিকল্প পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। বলেছিলেন, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি এমন ব্যক্তির হাতে আমাকে শহীদ করেছেন, যে আল্লাহকে একবারও সিজদা করেনি।’ অত:পর জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ছয় সাহাবীকে তার বিকল্প নিয়োগ করেন।

এভাবে, বিকল্প গ্রহণের বিষয়টি ছিল সর্বস্বীকৃত একটি বিষয়।

৪৬
অষ্টম বপন: খতীব সংঘ
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ﴿2﴾

‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর।’। [সূরা মায়িদা : ২]

يَا عِبَادِ فَاتَّقُونِ ﴿16﴾ وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ ﴿17﴾ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿18﴾

‘হে আমার বান্দারা, তোমরা আমাকেই ভয় কর’। আর যারা তাগূতের উপাসনা পরিহার করে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয় তাদের জন্য আছে সুসংবাদ; অতএব আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দাও। যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে অতঃপর তার মধ্যে যা উত্তম তা অনুসরণ করে তাদেরকেই আল্লাহ হিদায়াত দান করেন আর তারাই বুদ্ধিমান।’ [সুরা যুমার : ১৬-১৭-১৮]

وَلَقَدْ وَصَّلْنَا لَهُمُ الْقَوْلَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ ﴿51﴾

‘আর আমি তো তাদের কাছে একের পর এক বাণী পৌঁছে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’। [সূরা কাছাছ : ৫১]

قَالَتْ نَمْلَةٌ يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسَاكِنَكُمْ لاَ يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ وَهُمْ لاَ يَشْعُرُونَ ﴿18﴾ فَتَبَسَّمَ ضَاحِكًا مِنْ قَوْلِهَا وَقَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ ﴿19﴾

‘এক পিপড়া বলল, ‘ওহে পিপড়ার দল, তোমরা তোমাদের বাসস্থানে প্রবেশ কর। সুলাইমান ও তার বাহিনী তোমাদেরকে যেন অজ্ঞাতসারে পিষ্ট করে মারতে না পারে’। তারপর সুলাইমান তার কথায় মুচকি হাসল এবং বলল, ‘হে আমার রব, তুমি আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ তার জন্য আমাকে তোমার শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দাও। আর আমি যাতে এমন সৎকাজ করতে পারি যা তুমি পছন্দ কর। আর তোমার অনুগ্রহে তুমি আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর।’ [সূরা নামল : ১৮-১৯]

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه و سلم قال : إذا قلت لصاحبك يوم الجمعة : أنصت، و الإمام يخطب، فقد لغوت .

‘আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুমার দিন তুমি যদি তোমার পাশের ব্যক্তিকে বল, ‘চুপ থাক’, আর ইমাম খুতবা দিতে থাকেন, তাহলে তুমি অসার কাজ করলে।’ [বুখারী : ৯৩৪]

৪৭
কেন এই সংঘ?
এই সংঘের কয়েকটি মহান লক্ষ্য রয়েছে, যদি আল্লাহ না চান, তাহলে এই সংঘ ব্যতীত কোনভাবে অর্জিত হবে না। আমরা নিম্নে সে লক্ষ্যগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরব।

৪৮
প্রথমত: খতীবদেরকে সহায়তা প্রদান
ইসলামী বিশ্বের যেখানেই খতীবগণ তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, মূলত তারা হয়ে আছেন একঘরে, একাকী সৈনিক, সমস্ত লড়াইয়ের দায়ভার একাই তারা বহন করছেন। স্থান-কাল নির্বিশেষে সকলে কেবল পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে তাদের কথা শ্রবণ করে যায়, কোথাও এগিয়ে যায় না। কিংবা ভাল সময় উপস্থিত হলে সাধুবাদ জানিয়ে দায়িত্ববোধের চরম পারাকাষ্ঠা দেখানো হয়েছে ভেবে তৃপ্তি লাভ করে। যারা তাদের পক্ষের বলে নিজেরা দাবী করে, তাদের অধিকাংশই বিষয়টি স্বীকার করে, কর্মে এর কোন বাস্তবতা দেখায় না। সামাজিক জীবনের অনুরূপ উক্ত খতীবের পারিবারিক জীবনেও একই অবস্থা বিরাজ করে, নিরন্তর দারিদ্রে্যর ঘানি টেনে যেতে হয় তাকে, অঢেল ঋণের বোঝা সর্বদা তাকে তটস্থ করে রাখে। সামাজিকভাবে এ বয়কট যাপন ব্যতীত কখনো কখনো তাকে ভোগ করতে হয় কারাগারের নি:সঙ্গ একাকীত্ব, চরম নিগ্রহ, কখনো কখনো তা শারীরিক শাস্তিভোগ ও হত্যা পর্যন্ত গড়ায়। ফলে খতীব তার অনুপস্থিতিতে রেখে যান অসহায় এক পরিবার, সহায়-সম্বলহীন ইয়াতীম সন্তান-সন্ততি, ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে যারা ক্রমাগত ভেঙ্গে পড়তে থাকে, তার স্ত্রীকে দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

এমন কঠিন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময় চেপে রাখা ব্যতীত আমাদের কিছুই করার থাকে না। তবে, এত কিছুর পরও সমাজের এমন অনেক লোকের উপস্থিতি আমাদের চোখে পড়ে, যারা সত্যবাদী আলিমদেরকে মান্য করেন সর্বান্তকরণে, যদি তারা নবীর যুগে হত কিংবা নবী তাদের যুগে আসতেন, তবে অবশ্যই তারা তাকে মানত। তারা বিশ্বাস করেন, আলিমগণ নবীগণের উত্তরসূরী। কুরআনে এসেছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللهِ فَآَمَنَتْ طَائِفَةٌ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَتْ طَائِفَةٌ فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَى عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا ظَاهِرِينَ ﴿14﴾

‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারইয়াম পুত্র ঈসা হাওয়ারীদেরকে বলেছিল, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে? হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। অত:পর বনী ইসরাঈলের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল। তখন যারা ঈমান এনেছিল, তাদের শত্রুদের মুকাবিলায় তাদেরকে শক্তিশালী করলাম, ফলে তারা বিজয়ী হল’। [সূরা ছাফ : ১৪]

হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইতেন। সুতরাং খতীব যদি তার নিজের জন্য সহযোগিতা কামনা করেন, কিংবা সাহায্য প্রার্থনা করেন অন্যান্য আলিম, খতীবদের জন্য, তবে কী প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা তাকে অসিদ্ধ বলে দাবী করব? বিশেষত: যখন তারা চূড়ান্ত প্রয়োজনগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তখন এ ধরনের তর্কের কোন মানে হয় না। আমরা কি এ অপেক্ষায় বসে থাকব যে, দেখা যাক উক্ত খতীব বা আলিম একাকী কতটা যেতে সক্ষম হন? সামাজিক এ হীন অবস্থার শিকার আলিম ও খতীব সমাজকে কি আমরা নির্দয় সমাজের হাতে ছেড়ে দিব? কুরআনে এসেছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا ﴿71﴾ وَإِنَّ مِنْكُمْ لَمَنْ لَيُبَطِّئَنَّ فَإِنْ أَصَابَتْكُمْ مُصِيبَةٌ قَالَ قَدْ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيَّ إِذْ لَمْ أَكُنْ مَعَهُمْ شَهِيدًا ﴿72﴾

‘হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন কর। অতঃপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল হয়ে বেরিয়ে পড় অথবা একসাথে বের হও। আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যে অবশ্যই বিলম্ব করবে। সুতরাং তোমাদের কোন বিপদ আপতিত হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না’।’। [সূরা নিসা : ৭১-৭২]

অপর স্থানে এসেছে :

وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً وَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ كَانَ بِكُمْ أَذًى مِنْ مَطَرٍ أَوْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَنْ تَضَعُوا أَسْلِحَتَكُمْ وَخُذُوا حِذْرَكُمْ إِنَّ اللهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا ﴿102﴾

‘কাফিররা কামনা করে যদি তোমরা তোমাদের অস্ত্র-শস্ত্র ও আসবাব-পত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও তাহলে তারা তোমাদের উপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর যদি বৃষ্টির কারণে তোমাদের কোন কষ্ট হয় অথবা তোমরা অসুস্থ হও তাহলে অস্ত্র রেখে দেয়াতে তোমাদের কোন দোষ নেই। আর তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন করবে। নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন লাঞ্ছনাদায়ক আযাব।’ [সূরা নিসা : ১০২]

আমাদের আলিমদের জীবন ও আমাদের খতীবদের সম্মান ও মর্যাদা আমাদের সহায় সম্পত্তি রক্ষার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- সন্দেহ নেই। যদিও, পৃথিবীব্যাপী দাওয়াত পৌঁছে দেয়া, মানুষের উপর দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার প্রমাণ সাব্যস্ত করা এবং ঘরে ঘরে রিসালাতের বাণী ছড়িয়ে দেয়া এমন এক অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব, সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সাহায্য না পেলেও তা পালন করে যেতে হবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন :

الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالاَتِ اللهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلاَ يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ وَكَفَى بِاللهِ حَسِيبًا ﴿39﴾

‘যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয় ও তাঁকে ভয় করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না, [এ বাক্যটি পূর্বোল্লিখিত নবীদের বিশ্লেষণ।] আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট’। [সূরা আহযাব : ৩৯]

পাপিষ্ঠ একদল লোকের সামনে লূত আ. যখন চরম একাকীত্বে আক্রান্ত হলেন, তখন তিনি এই বলে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন যে,

لَوْ أَنَّ لِي بِكُمْ قُوَّةً أَوْ آَوِي إِلَى رُكْنٍ شَدِيدٍ ﴿80﴾

‘সে বলল, ‘তোমাদের প্রতিরোধে যদি আমার কোন শক্তি থাকত অথবা আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় নিতে পারতাম’!’। [সূরা হূদ : ৮০]

লূত ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত নবী। মুসলিম উম্মাহর উপর এটা কি অবশ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য নয় যে, তারা সঙ্গ দেয়ার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তরাধীকারদের পাশে দাঁড়াবে?

‘পাশে দাঁড়ানো’, এমনকি, জাহিলী যুগেও একটি সামাজিক নিয়ম হিসেবে পালিত হত। বিশেষত: যখন তাদের কেউ বিপদে নিপতিত হত। আবু দাগনা আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যখন তিনি মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এ আশ্রয়ে আবু বকর আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করলেন। কাফিরদের অনেকে, এভাবে, মাজলুম সাহাবীদেরকে সাহায্য করেছিলেন।

দুরন্ত সাহসী খালিদ বিন ওয়ালীদ যখন শত্রু ব্যুহে ঢুকে তছনছ করে দিতেন, কিংবা এককভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন, তখনো তিনি বিশেষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন এবং তাদেরকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে রাখতেন। যুদ্ধ নায়কদের নিকট এ ছিল যুদ্ধনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সুতরাং, খতীবদের জন্য আমরা একটি সংঘ তৈরি করব, এবং তার মাধ্যমে তাদেরকে সহায়তা করব- এটি নতুন কিছু নয় এবং এতে তাদের জন্য খুব বেশি কিছুও করা হবে না।

৪৯
দ্বিতীয়ত : দাওয়াত ও বক্তব্যে ঐক্য
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মদীনা মুনাওরায় একটি মাত্র মসজিদ ছিল, সেই মসজিদের নববীতেই একমাত্র খুতবা প্রদান করা হত। প্রথম দুই খলীফা এবং উসমান রা.-এর যুগে এই ধারা অব্যাহত থাকে, যদিও ইতিমধ্যে মদীনার আয়তন ও লোকসংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছিল।

অনেক বিদগ্ধ আলিমের মতে, একটি রাষ্ট্রে বা একটি জনপদে একের অধিক জুমার আয়োজন বৈধ নয়, যদি না অবশ্যম্ভাবী কোন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেমন, মসজিদে মুসল্লীদের স্থান সংকুলান না হওয়া, কিংবা রাষ্ট্র ও জনপদের আয়তন এত বড় হয়ে যাওয়া যে, এক স্থানে সকল অধিবাসীর একত্রিত হওয়া নিতান্ত অসম্ভব হয়ে উঠে।

এ নীতিমালার ফলে সবচেয়ে বেশি যে উপকার লাভ হয়, তা হচ্ছে একই স্থানে সকল মুসলমান একত্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ফলে সকলের মাঝে একক ঐক্য মত গড়ে উঠে, যে কোন ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সকলের জন্য সহজ হয়ে যায়।

খিলাফতের আমলে মুসলমানগণ, পরস্পরের মাঝে দূরত্ব ও খিলাফতের বিস্তৃতি সত্বেও, জুমায় তারা একত্রিত হতেন। ফলে তাদের মাঝে এক অনবদ্য ঐক্য সর্বদা কাজ করত। আল্লাহ তাআলা যখন ব্যক্তির জন্য কল্যাণ ইচ্ছা করেন, তখন তাকে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করেন, একক ধ্যানে নিমগ্ন করেন তাকে। একই চিত্র দেখা যায়, যখন তা ব্যক্তির গন্ডি পেরিয়ে সমাজের গন্ডিতে গিয়ে হাজির হয়।

ইসলামের প্রাথমিক সময়ে মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী যখন দূর কোন দেশ অবরোধ করত, জুমায় সমবেত মুসল্লীগণ তাদের জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে দুআ করত, তাদের বিজয় কামনা করে প্রার্থনা জানাত। এর ফল কি হত, ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আমাদের সামনে হাজির আছে।

তখন এই নীতিমালা অতি সহজে পালিত হত, কারণ, খিলাফত ব্যবস্থা তাদেরকে এক সূতোয় বেধে রেখেছিল। কিন্তু খিলাফতের সে ধারা আর নেই, কিন্তু আমাদেরকে সেই ধারার ফলাফল এখনো অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সুতরাং ঐক্য সম্ভব এমন যে কোন বিষয়ে ঐক্য মত বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

এই চিন্তা থেকেই খতীবদেরকে নিয়ে একটি সংঘ করার পরিকল্পনার জন্ম নিয়েছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকবে, এর মাধ্যমে সঠিক অর্থে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য গড়ে উঠবে, তাদের অন্তরগুলোকে এক সূতোয় বেধে রাখা যাবে। ভিন্ন ভিন্ন কর্মে নিয়োজিত থাকলেও তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে এক এবং বিভিন্ন রঙের ও বর্ণের হলেও তাদের কাতার হবে এক কাতার, যে দৃঢ় কাতার নবীর উত্তরাধীকারদেরকে রক্ষা করতে হবে বদ্ধপরিকর।

সঠিক উপায়ে এ চিন্তা বাস্তবায়িত হলে আমরা এক আমূল পরিবর্তন দেখতে পাব, দেহগত অনৈক্য সত্ত্বেও তাদের মাঝে দেখা দিবে এক অনাবিল আত্মিক ঐক্য ও সম্প্রীতি। প্রাথমিকভাবে যে কয়টি বিষয়ে তারা একক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে, তা এই :

দুর্যোগ আক্রান্ত যে কোন মুসলিম এলাকাগুলোকে সহযোগিতার জন্য প্রচেষ্টা চালানো।

একটি দিনকে নির্দিষ্ট করে কোন মুসলিম দেশের সহযোগিতার জন্য প্রচারণা চালান।

প্রচলিত কোন মন্দ দূর করার জন্য জনমত গড়ে তোলা। প্রচলিত যে মন্দ বিষয়, যা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করে দেয়া হয়েছে, তার শুরুটা হয় মানুষের সেন্টিম্যান্টকে আঘাত করার দ্বারা। এর মাধ্যমে তাদের প্রেরণা যাচাই করা হয়, পরে তা আইন করে সকলের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। অধিকাংশ সামাজিক বিকৃতি, যা আজ মানুষের কাছে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার শুরুটা এভাবেই হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি যেমন :

রাষ্ট্রীয় অফিস আদালতে নারীদের নেকাব ছাড়া মুখ খুলে চাকুরী ও প্রবেশ করা, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা, প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ছেলে-মেয়েদের সহশিক্ষা, ছেলেদের স্কুলে মেয়ে শিক্ষক নিয়োগ।

এমনিভাবে, যে সমস্ত সামাজিক পাপাচার আজ আমাদের চোখ সয়ে গিয়েছে, তার সূচনাটা হয়েছে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিম্যান্টকে আঘাত ও যাচাই করার মানসিকতা নিয়ে। ক্রমান্বয়ে, পরবর্তীতে তাতে প্রচারের আলো ফেলা হয়েছে, তাকে ব্যাপকভাবে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, উপস্থাপন করা হয়েছে আকর্ষণীয়রূপে, সবশেষে আইন করে সকলের উপর তা চাপিয়ে দেয়া হয়ে।

সূদী ব্যাংকের প্রচলন, মাদক ও নেশার বিস্তৃতি, জুয়া, নারীদের একাকী ভ্রমণে বের হওয়া, সহশিক্ষা, খৃষ্টান মিশনারী স্কুলের শিক্ষার প্রচলন- এ সব কিছুই একই সূত্রে গাথা।

ইসলামী বিশ্বাস ও শরীয়া ব্যবস্থার উপর শত্রু পক্ষের হামলার প্রতিরোধের জন্য জনসাধারণকে প্রস্ত্তক করা। হোক সে হামলা সশস্ত্র, অর্থনৈতিক, কালচারাল এ্যক্টিভিটির মাধ্যমে। নানা সময়ে পুরোনো বিষয় নতুন পোশাকে আমাদের সামনে হাজির হয়, আমরা তাকে সঠিক রূপে চিনতে ভুল করি, তাই, এ ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন করতে খতীবদেরকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

৫০
তৃতীয়ত: শত্রুর আক্রমণ থেকে খতীবকে রক্ষা করা
অনেক খতীব আছেন, যারা মিডিয়ার দুষ্টচক্রে আক্রান্ত হয়েছেন নিজেদের অনবধানে, এবং হাজার হাজার মুসলমানকে ভ্রান্তিতে নিপতিত করেছেন। অপরদিকে বিভিন্ন সৎ ও নিষ্ঠাবান খতীবকে হেনস্থা করার উদ্দেশ্যে বিছানো হয়েছে ষড়যন্ত্রের জাল, তাকে পড়ানো হয়েছে শরীয়তের কাপড়, অত:পর এর মাধ্যমে উক্ত খতীবকে আক্রমণ করা হয়েছে, এবং এতে বিভ্রান্ত হয়েছে অনেক নতুন খতীব, যারা এখনো মিডিয়া সন্ত্রাসের এ সকল ষড়যন্ত্রের সাথে মোটেই পরিচিত নয়।

মিডিয়াতে, আমরা দেখি, হঠাৎ কোন অর্বাচীন ব্যক্তিকে বিশাল কিছু বানিয়ে হাজির করা হচ্ছে, তাকে একজন মহান ব্যক্তিত্ব ও খতীব হিসেবে হাজির করা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছে ইনিই একমাত্র খতীব, যাকে নির্দ্বিধায় মান্য করা হয়, দ্বিধাহীনভাবে যার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা যায়। কিন্তু যখনি মিডিয়ার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়, এই পরগাছা খতীবগুলো হারিয়ে যায় কোথায়, কেউ জানে না। তাদেরকে ছুড়ে ফেলা হয় মিডিয়ার আস্তাকুড়ে। সুতরাং, আমাদের উক্ত সংঘের মাধ্যমে প্রধানত: খতীবদেরকে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে যুগোপযুগী শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত করে গড়ে তুলতে হবে, যারা একই সাথে ধর্মীয় ও পার্থিব মৌলিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবেন, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের ঘটনা পরম্পরা সম্পর্কে অবহিত থাকবেন এবং এ ব্যাপারে মানুষকে একটি ইতিবাচক ধারণা দিতে প্রয়াস চালাবেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন :

وَكَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ وَلِتَسْتَبِينَ سَبِيلُ الْمُجْرِمِينَ ﴿55﴾

‘আর এভাবেই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি। আর যাতে অপরাধীদের পথ স্পষ্ট হয়ে যায়।’ [সূরা আনআম : ৫৫]

অপর আয়াতে এসেছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَأٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ ﴿6﴾

‘হে মুমিনগণ, যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যেন না জেনে কোন সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বস এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়’। [সূরা হুজুরাত : ৬]

এভাবে, খতীবদেরকে শয়তান ও তার অনুসারীদের নিফাক থেকে রক্ষা করা যাবে, এবং ফলশ্রুতিতে রক্ষা পাবে দেশ ও উম্মত।

৫১
চতুর্থত: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মূল্যবোধের পূনর্জাগরণ
এটি আমাদের সংঘ প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্য, যতটা সম্ভব এ লক্ষ্য পূরণ আমাদের জন্য ওয়াজিব। এ লক্ষ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার অদম্য আগ্রহ ঠিক যতটা আমাদের অন্তরে ও বাস্তবে জাগরুক থাকবে, ঠিক ততটাই অন্যান্য ইসলামী মূল্যবোধ বিধ্বংসী ধ্যান-ধারনা লুপ্ত হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, বর্ণবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি জাহিলী শ্লোগান থেকে আমরা মুক্ত থাকব।

দুর্যোগগ্রস্ত মুসলিম রাষ্ট্র ও জনগণকে বাস্তব সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এ লক্ষ্যকে কর্মে রূপান্তরিত করা, একই সাথে, আমাদের জন্য আবশ্যক। অন্যথায়, এটি কোন বাস্তব ফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে না। এভাবে, এ কর্ম প্রক্রিয়ার ফলে, মুসলমানগণ সার্বিকভাবে এ সংঘমুখী হবে, এবং একটি ব্যাপক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে মুসলিম উম্মাহর সামনে।

৫২
খতীব সংঘে অন্তর্ভুক্তির প্রাথমিক শর্ত ও নীতিমালা
যে ব্যক্তিই এই প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে আগ্রহী, তাকে কয়েকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্যে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তাকে অবশ্যই ‘ইমামত’ বা নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে হবে, তাকে পালন করতে হবে অনুসরণীয় অগ্রজের ভূমিকা। আমি কুরআনের উদ্ধৃতির মাধ্যমে তাদের এ সমস্ত গুণাবলী বর্ণনা করতে প্রয়াস পাব।

যারা পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখে এই বক্তব্য দিবে যে :

قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿162﴾

‘বল, ‘নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব’। [সূরা আনআম : ১৬২]

যারা বলবে :

وَيَا قَوْمِ لاَ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مَالًا .

‘আর হে আমার কওম, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোন সম্পদ চাই না।’ [সূরা হূদ : ২৯]

যারা-

لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا .

‘যারা যমীনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না।’ [সূরা কাছাছ : ৮৩]

যারা বলে :

الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالاَتِ اللهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلاَ يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ وَكَفَى بِاللهِ حَسِيبًا ﴿39﴾

‘যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয় ও তাঁকে ভয় করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না, আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট।’ [সূরা আহযাব : ৩৯]

যারা আল্লাহর এ বাণীর অনুসরণ করে :

وَلاَ يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِينَ لاَ يُوقِنُونَ ﴿60﴾

‘আর যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে না তারা যেন তোমাকে অস্থির করতে না পারে।’ [সূরা রূম : ৬০]

যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ ﴿24﴾

‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।’। [সূরা সিজদা : ২৪]

যারা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী জ্ঞান ও বোধের অধিকারী। কুরআনে যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে :

الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴿18﴾

‘যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে অতঃপর তার মধ্যে যা উত্তম তা অনুসরণ করে তাদেরকেই আল্লাহ হিদায়াত দান করেন আর তারাই বুদ্ধিমান।’। [সূরা যুমার : ১৮]

যারা আল্লাহর নির্দেশ ও তার অসিয়ত দৃঢ়ভাবে আকড়ে থাকে :

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا ﴿21﴾

‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ [সূরা আহযাব : ২১]

সেই আল্লাহভীরু ব্যক্তিগণ, যাদের ব্যাপারে আল্লাহর এ বাণী প্রযোজ্য :

وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ ﴿79﴾

‘বরং সে বলবে, ‘তোমরা রববানী হও। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিতে এবং তা অধ্যয়ন করতে’।’ [সূরা আলে ইমরান : ৭৯]

এ কথায় যে মানুষের মাঝে সর্বোত্তম :

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴿33﴾

‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’?’ [সূরা ফুসসিলাত : ৩৩]

যারা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা করে যে :

قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي ﴿25﴾ وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي ﴿26﴾ وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي ﴿27﴾ يَفْقَهُوا قَوْلِي ﴿28﴾

‘সে বলল, ‘হে আমার রব, আমার বুক প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আর আমার জিহবার জড়তা দূর করে দিন যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’। [সূরা ত্বাহা : ২৫-২৮]

যার এমন বলার পরিপূর্ণ প্রস্ত্ততি রয়েছে :

فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا ﴿72﴾

‘সুতরাং তুমি যা ফয়সালা করতে চাও, তাই করো। তুমিতো কেবল এ দুনিয়ার জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার’।’ [সূরা ত্বাহা : ৭২]

যারা নিজেদের পরিচয় গড়েছে এভাবে :

إِنْ أُرِيدُ إِلاَّ الْإِصْلاَحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيقِي إِلاَّ بِاللهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ ﴿88﴾

‘আমি আমার সাধ্যমত সংশোধন চাই। আল্লাহর সহায়তা ছাড়া আমার কোন তওফীক নেই। আমি তাঁরই উপর তাওয়াক্কুল করেছি এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাই।’ [সূরা হূদ : ৮৮]

৫৩
সংঘের পরিধি ও কাঠামো
প্রথমে এই চিন্তাকে দাওয়াত ও খতীবী পেশার সাথে সম্পৃক্ত কোন বিদগ্ধ আলেমের মাধ্যমে শুদ্ধ করে নিতে হবে, পরবর্তীতে একে কেবল চিন্তার পরিসর পেরিয়ে নিয়ে আসতে কর্মের পরিসরে। কোন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলিমকে দায়িত্ব দেয়া হবে, তিনি এই চিন্তার লিখিত রূপকে বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখাবেন। আলিম, খতীব ও বক্তাদের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বদের নিকট একে গৃহীত করে তোলার প্রচেষ্টা চালাবেন। প্রতিটি দেশে ন্যূনতম একজন খতীবকে এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রতি ছয়মাসে তারা এক স্থানে মিলিত হবেন, তাদের আওতায় প্রত্যেকের দেশে ন্যূনতম দশজন সদস্যের একটি গ্রুপ করা হবে, যারা এ সংঘের কার্যক্রমে নিজেদেরকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে নিবেন। এভাবে, সংঘের পরিধি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে, এর শেকড় ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে।

৫৪
মৌলিক কর্ম
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের চিন্তা সামনে রেখে সংঘটি এগিয়ে যাবে :

চিন্তা ও কাজের পরিধি অনুসারে সকল খতীবকে এক স্থানে নিয়ে আসা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে হলেও, তাদের পরস্পরের মাঝে ঐক্য, সম্প্রীতি ও যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করা।

পরবর্তী জুমার জন্য আলোচ্য বিষয় হিসেবে একটি শিরোনাম নির্ধারণ করে শনিবারেই সকলকে অবহিত করে দেয়া।

নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বাৎসরিক বক্তব্য ও কর্ম রুটিন ঠিক করে দেয়া।

একটি মৌলিক ও ব্যাপক পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা, যা প্রত্যেক খতীবকে বিভিন্ন বিষয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ খুতবা প্রদানে সহযোগিতা দিবে। খতীবদের কেউ হয়তো তথ্য সংগ্রহের জন্য এমন অহরহ বই-পত্র সংগ্রত ও ক্রয় করতে সক্ষম নন, কেউ হয়তো নতুন আলোচিত বিষয় সম্পর্কে অবগত নন,-এভাবে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদেরকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা প্রদান সম্ভব হবে।

খতীব, আলিম ও তাদের পরিবার পরিজন এবং তাদের নিকট আগত মেহমানদেরকে আপ্যায়নের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান।

ইসলামী বিশ্বের আনাচে কানাচে যে সমস্ত জনপ্রিয় খুতবা প্রদান করা হয় বা হয়েছে, তার এক কপি সিডি প্রদান করা এবং গবেষণা অভিসন্দর্ভ প্রদান করে এ ধরনের ইলমী কর্মে উৎসাহ প্রদান।

আলিম ও ধর্মীয় লোকদের ব্যাপারে সমাজের মূল্যায়নের পুনর্গঠন : তাদেরকে এ মনোভাবে গড়ে তোলা যে, সম্পদশালী বা বড় কোন পদের অধিকারী নয়, সমাজে অধিক সম্মানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ হচ্ছে ধর্মীয় ও আলিম ব্যক্তিবর্গ।

যে কোন ধরনের প্রতি আক্রমণ থেকে খতীবদেরকে নিরাপত্তা প্রদান।

এমন তত্ত্ব, তথ্য ও বই-পত্র দিয়ে তাকে সহায়তা প্রদান করা, যা তার বোধ ও জ্ঞানের পরিধিকে বৃদ্ধি করবে।

তাদের প্রস্তাবনা শোনা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট তা পৌঁছে দেয়া।

বিভিন্ন স্তরে খতীব প্রশিক্ষণ ইনসটিটিউট গড়ে তোলা।

৫৫
অনুকরণীয় একটি খুতবা
কোন বিদগ্ধ আলিম যখন খুতবা প্রদান করেন, তাতে অবশ্যই এমন কিছু থাকে, যা বীজ হয়ে কাজ করে, তাতে থাকে চিন্তার উন্মোচন ও নতুন চিন্তার উপাদান ; এমন খুতবার উদাহরণ আমরা অহরহ দেখি। কিন্তু, দু:খজনক ব্যাপার হল, সে সমস্ত খুতবার প্রতি আমাদের দৃষ্টি পড়ে না বলে তা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে, সময়ের বিস্মৃতিতে। এভাবে একটি নতুন উন্মোচন ঢাকা পড়ে যায় অন্ধকারে, বিচ্যুত হয় সাদাকায়ে জারিয়ার প্রবাহ থেকে। এক জুমার পর অন্য জুমা আসে, কেটে যায় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কিন্তু আমরা সচেতন নই বলে চিন্তার সেই জমাট অন্ধকার আর কাটে না। কল্যাণের শীষে, সুতরাং, কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না, মানুষ কল্যাণকর কোন বপনের সন্ধান পায় না।

‘আব্দুল আজীজ’ এমনই একজন খতীব, আমি তার খুতবায় এক অসাধারণ আলো দেখতে পেয়েছি। তার খুতবায় থাকে চিন্তার বীজ, যা পত্র পল্লবে শোভিত হয়ে এক সময় মানুষের চিন্তায় শোভা পায়, তাতে আশ্রয় খুঁজে পায় অনেক যুবক ও বৃদ্ধ, কালের বিভ্রান্তিতে যারা নিজেদের কালচার ও সভ্যতা খুইয়ে ফেলছিল। আমি তোমার নিকট তার একটি খুতবার নমুনা তুলে ধরার প্রয়াস পাব।

সে তার খুতবার সূচনা করে স্থির গমগমে স্বরে, ক্রমান্বয়ে তা একটি জায়গা তৈরি করে খোলস মুক্ত করে, বপন করে চিন্তার বীজ। তার একটি খুতবার শিরোনাম ছিল ‘যুবক বয়সের শুদ্ধতা’। হামদ ও সালাতের পর সে যে খুতবা পেশ করেছিল, জনৈক শ্রোতার মারফত আমি তা উদ্ধৃত করছি তোমাদের সামনে।

‘আজ তোমার যে সন্তান ছোট্ট, মায়ের কোলে খেলা করার বয়স যাপন করছে, সে অবশ্যই এক সময় বয়সে তার চেয়ে বড়দের এলাকায় প্রবেশ করবে, তাদেরকে দেখার, জানার ও বুঝার সুযোগ পাবে। বাইরের উন্মুক্ত জগত একসময় তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে- সেই উন্মুক্ত পরিবেশে তার চোখ কীসে নিবদ্ধ হবে?

সে দৃষ্টি দিবে তার ডানে, দেখবে, এ পাশ জুড়ে আছে যুবকদের মিলনমেলা, যার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সার্বক্ষণিক আলোচনা বিষয় হল নতুন নুতন উদ্ভাবন ও বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব সব সৃষ্টি।

সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে বামে, দেখবে, এখানে কিছু যুবক সর্বদা মজে আছে ব্যায়াম, শরীর গঠন ইত্যাদি নিয়ে। সম্মুখে তাকিয়ে দেখবে একদল যুবক শয়তানের দাসত্ব করে জীবনকে হেলায় হারাচ্ছে। আকণ্ঠ যৌনতায় যাদের জীবন ও যৌবন সমর্পিত। প্রেমই যাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। গায়ক ও গায়ীকারা যাদের কাছে জীবনের সর্বোত্তম আদর্শ।

পিছনে তাকিয়ে এমন এক শ্রেণী সম্পর্কে সে অবগত হবে, যারা নেশার হাতে নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছে। এই অন্ধকার জগতে, সে দেখবে, যুবকরা একে অপরকে আপন করে নিয়েছে, নেশা দ্রব্যের আদান প্রদানে যারা একে অপরকে বন্ধু করে নিয়েছে।

সে কি চার দেয়ালের অভ্যন্তরে নিজেকে গুটিয়ে নিবে? কীভাবে? কেননা, এখানেও তাকে বাইরের জগতের কুৎসিতরূপ দেখে দেখে কাটাতে হয়। টেলিভীশন ও ইন্টারনেট কি এর চেয়ে ভাল কিছু আমাদেরকে উপহার দিচ্ছে?

সুতরাং, তোমার যে ছোট্ট শিশু চোখ মেলে তাকাচ্ছে জগতের দিকে, সে কোথায় যাবে? সে অবশ্যই তার চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ঘর থেকে বের হবে, পিতা-মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য ও নিজস্ব জগত নির্বাচন করবে নিজের জন্য। আজকে তোমার যে শিশুকে নির্দিষ্ট শারীরিক অবয়বে দেখতে পাচ্ছ, এক সময় সে অন্ধকার এক এলাকায়, মায়ের পেটে কাটিয়েছে, অত:পর মায়ের কোল জুড়ে কাটিয়েছে শৈশবের পবিত্র কয়েকটি দিন। পর্যায়ক্রমে সে হাঁটতে শিখেছে, নিজেকে চিনবার, আবিস্কার করবার সুযোগ পেয়েছে। সে চিরকাল তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে এই চিন্তা করা নিতান্ত মূর্খতা। স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে তার জগত গড়ে উঠবে, সেই জগতে তুমি এক সময় অনাহূত হয়ে পড়বে। সেখানে তোমার আগের অবস্থান থাকবে না। সুতরাং, হে পিতা, তুমি ভেব না, তোমার সন্তান পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে মুক্ত হয়ে অন্ধকার ঘরে কাটাবে।

কেউ কেউ বলে, ছেড়ে দাও ! যুবকদেরকে তাদের মত করে কিছুটা সময় কাটাতে দাও। আমরাও এ সময় অতিবাহিত করে এসেছি। আমরা তো এখন ভালোই আছি।

ঠিক আছে, সময় কেটে যাবে, বিভিন্ন স্তরে স্তরে মানুষ তাদের এ সময়গুলো কাটিয়ে থাকে। কিন্তু একবারও কি ভেবেছ তোমার যুবক সন্তান কীভাবে এ সময় অতিবাহিত করবে? কীভাবে সুস্থ প্রক্রিয়ায় সে তা পার করবে? যেভাবে তোমরা তোমাদের কাল অতিক্রম করে এসেছ, এ নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম? দু কালের মাঝে পার্থক্য অনেক, দুস্তর।

সন্দেহ নেই, তাদের সময় কেটে যাবে, কিন্তু কালের ঘোড়া তোমার সন্তানকে ছেঁচে দিয়ে যাবে, রক্তাক্ত করে দিবে তাকে। সময়ের জ্বলন্ত উনুনে ভস্ম হবে তার দেহ, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে তার চিন্তা ও ধ্যানের জগত। নেশায় মত্ত এই পথ মাড়িয়ে, তুমি কি ভেবেছ, সে সুস্থ ও সবল থাকবে?

কী এর সমাধান?

সমাধান হচ্ছে আমাদের সন্তানদের জন্য এ সময়ের কোন বিকল্প তৈরি করতে হবে, তার চলাচল, উঠাবসা ও মেলামেশার নতুন কোন জগত তৈরি করতে হবে, যেখানে তাকে ছেড়ে আমরা নিশ্চয়তা বোধ করব। এবং যা মানসিকতায় ন্যূনতম ব্যাঘাত তৈরি করবে না।

আমাদেরকে যুবকদের জন্য প্রস্ত্তত করতে হবে এমন এক এলাকা, যা একই সাথে পবিত্র ও পবিত্রতা আনয়নকারী ; শুদ্ধ ও বিশুদ্ধতা আনয়নকারী। যা প্রকাশ্য, যাতে গোপনীয়তা ও লুকোচুরির কিছু থাকবে না।

মুমিনদেরকে একত্রিত করার এবং মুসলিমদের যূথবদ্ধ সমাজ তৈরির এটিই ইসলামী নীতিমালা। অন্যথায়, ইসলামে কেন হিজরতের প্রবর্তনা হয়েছিল? বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদেরকে কেন একটি এলাকায় ও একটি সংস্কৃতির আওতায় আনা হয়েছিল?

কেনই বা হিজরতে অব্যবহিত পরে মুহাজির ও আনসারদের মাঝে এমন অতুলনীয় ভ্রাতৃত্বের জন্ম নেয়? সালাতের সময় হয়ে এলে কেন মুসলমানদেরকে মসজিদে গমনের নির্দেষ দেয়া হয়েছে, কেন এক সাথে সালাত আদায় করতে হয়? তিন জন এক সাথে সালাত আদায়কে কেন অধিক বিশুদ্ধ বলা হয়েছে? এ হচ্ছে নতুন সমাজ ব্যবস্থা তৈরির গুঢ় রহস্য, যা জিহাদের ময়দানে মুসলমানদেরকে এক কাতারে সমবেত করেছে, ইয়াতীমের প্রতি সকলকে সহমর্মী করে তুলেছে, প্রতিবেশ আত্মীয়তার প্রতি করে তুলেছে প্রগাঢ় বন্ধনে পরিপূর্ণ। এবং জামাআতে বহু দূর হতে আগতের জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে অঢেল সাওয়াবের।

আমি তোমাদেরকে একটি গল্প শোনাচ্ছি, গল্পটি কমবেশি সবার জানা যদিও, কিন্তু আমরা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একে বিচার করব।

একজন আবিদ ও একজন আলিমের সামনে একটি অপরাধ তুলে ধরা হল। আবিদ, যে তার জীবনের অধিকাংশ সময়ে অন্ধকার ইবাদখানায় কাটিয়েছে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজেকে মিশিয়ে দেয়নি, তার কাছে অপরাধটি অকল্পনীয় মনে হল, সে ভাবতেই পারছিল না মানুষ কীভাবে এমন অপরাধ করতে পারে? সুতরাং, অপরাধকারীর মুখের উপর সে দরজা দিয়ে দিল। অপরাধকারী, অবশেষে, উক্ত আবেদকে হত্যার মাধ্যমে তার একশতম হত্যা পূরন করল। এই আবিদের মত বাস্তব জগত সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা নিজের জীবনকে শেষ করে দেয়।

পক্ষান্তরে আলিম ব্যক্তি তাকে প্রতিউত্তরে এমন সমাধান দিল, যা অপরাধী ও অপরাধপ্রবণ সমাজের জন্য কল্যাণকর। সে তার সামনে উপস্থাপন করল এমন এক বিকল্প, অপরাধীর জন্য যা আশাব্যাঞ্জক মনে হল। বলল, তুমি তোমার এলাকা ছেড়ে অমুক এলাকায় গমন কর, কারণ, তাতে কিছু মহৎ ব্যক্তি আছে, যারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদাতে মিমগ্ন থাকে।

এ হচ্ছে আলিমের দূর দৃষ্টি, যদি অপরাধীকে সে বলে দিত, আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করে তোমাকে ক্ষমা করে দিবেন, তবে কি সে সত্য পথে অটল থাকত?

আমাদের দেশে যুবকদের জন্য উত্তম মিলনক্ষেত্র কবে প্রতিষ্ঠা করা হবে? যুবকদেরকে বিশেষভাবে সময় দেয়ার জন্য আমাদের মহান ব্যক্তিবর্গ আদৌ কি সতর্ক হবেন? ইসলামী আচর ব্যবস্থা পূনর্গঠনে মাদরাসা ও স্কুলগুলো সক্রিয় কোন ভূমিকা রাখবে? আমরা মসজিদভিত্তিক যুবকদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি না?

সন্দেহ নেই, বিষয়টি প্রজন্ম ও তার ভবিষ্যতের সাথে সম্পৃক্ত, কেবল একটি এলাকার যুবকদের রক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আমরা কি একে প্রথমে নির্দিষ্ট এলাকা, অত:পর এলাকার গন্ডি অতিক্রম করে দেশ ও পুরো উম্মতকে কেন্দ্র করে ভাবতে পারি না?’

এটি ছিল তার প্রথম খুতবার সারাংশ, দ্বিতীয় যে খুতবা দ্বারা আমি চমৎকৃত হয়েছি, তা হচ্ছে এই :

‘হে মুসিলম, সৎ সহচর ও সঙ্গী গ্রহণ কর। একদিন তোমাকে এই সঙ্গ ও সাহচর্য ত্যাগ করে যেতে হবে, যেমন সাহাবীদের পবিত্র সাহচর্য ত্যাগ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন। জিবরাইল আ. তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন :

يا محمد ! عش ما شئت فإنك ميت، و أحبب من شئت فإنك مفارقه، و اعمل ما شئت فإنك مجزى به، و اعلم أن شرف المؤمن قيامه بالليل، و عزه استغناؤه عن الناس .

হে মুহাম্মাদ, যাপন করুন যতটা ইচ্ছা। আপনি তো অবশ্যই মৃত্যু বরণ করবেন। ভালোবাসুন যাকে ইচ্ছা, একদিন অবশ্যই তার সাথে আপনার বিচ্ছেদ হবে। যা ইচ্ছা করুন, অবশ্যই তার প্রতিদান আপনাকে দেয়া হবে। জেনে রাখুন, মুমিনের মর্যাদা হচ্ছে তার রাতের সালাত, এবং তার সম্মান হচ্ছে মানুষ থেকে মুখাপেক্ষিহীন থাকা। [তাবরানী : ৪২৭৮]

মৃত্যু একে অপর থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে, এই চিন্তা কি মানুষকে পার্থিবের ব্যাপারে বিস্বাদগ্রস্ত করে দেয় না?

তুমি তোমার ইচ্ছা মত, ভেবে চিন্তে সঙ্গী গ্রহণ কর, কারণ, সেই হবে হাশরের ময়দানে তোমার সঙ্গী : কুরআনে এসেছে-

احْشُرُوا الَّذِينَ ظَلَمُوا وَأَزْوَاجَهُمْ وَمَا كَانُوا يَعْبُدُونَ ﴿22﴾

‘(ফেরেশতাদেরকে বলা হবে) ‘একত্র কর যালিম ও তাদের সঙ্গী-সাথীদেরকে এবং যাদের ইবাদাত তারা করত তাদেরকে।’ [সূরা সাফফাত : ২২]

কুরআনে আরো এসেছে :

وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا ﴿27﴾

‘আর সেদিন যালিম নিজের হাত দু’টো কামড়িয়ে বলবে, ‘হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে কোন পথ অবলম্বন করতাম’! [সূরা ফুরকান : ২৭]

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا رَبَّنَا أَرِنَا الَّذَيْنِ أَضَلاَّنَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ الْأَسْفَلِينَ ﴿29﴾

‘আর কাফিররা বলবে, ‘হে আমাদের রব, জিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দিন। আমরা তাদের উভয়কে আমাদের পায়ের নীচে রাখব, যাতে তারা নিকৃষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’ [সূরা ফুসসিলাত : ২৯]

হে যুবক, ভেবে চিন্তে তুমি সঙ্গী গ্রহণ কর এবং জেনে রাখ, ধর্ম ও মানবিকতার অধিকারী সঙ্গী কখনো বিপদে বন্ধুকে ফেলে চলে যায় না। আখিরাতের সেই ভয়াবহ সময়ে বন্ধু ও সঙ্গীর প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি। বুখারীর এক হাদীসে এসেছে :

فما أنتم بأشد لي مناشدة في الحق

‘হকের অনুসন্ধানে তোমরা কেউ আমার চেয়ে অধিক কঠোর নও’। [বুখারী : ৭৪৩৯]

এরচেয়ে উত্তম ও মূল্যবান কোন শাফাআতের সন্ধান তুমি পেয়েছ? এ হচ্ছে জাহান্নামের লকলকে আগুন থেকে বেরিয়ে জান্নাতের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ, আযাবের পেষণ থেকে সুখময় জান্নাতে প্রবেশ।‘

৫৬
উক্ত খুতবার ফলাফল
উক্ত খুতবার ফলে ইতিমধ্যেই যুবকদের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। আশাব্যঞ্জক সারা পাওয়া গিয়েছে, যুবক ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সকল শ্রেণীর পক্ষ থেকে একে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। প্রথম বৈঠকটি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়, নিয়মিত আয়োজনের জন্য সকলের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে সে বৈঠকেই।

৫৭
নবম বপন: মালিক ও ধনীক শ্রেণীর মাঝে
أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَةُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ ﴿32﴾

‘তারা কি তোমার রবের রহমত ভাগ-বণ্টন করে? আমিই দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপর জনের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরকে অধিনস্থ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আর তারা যা সঞ্চয় করে তোমার রবের রহমত তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট’। [সূরা যুখরুফ : ৩২]

عن أبي هريرة رضي الله عنه : أن فقراء المهاجرين أتوا رسول الله صلى الله عليه و سلم فقالوا : ذهب أهل الدثور بالدرجات العلى و النعيم المقيم فقال : ( و ما ذاك ؟ ) قالوا : يصلون كما نصلي، و يصومون كما نصوم، و يتصدقون و لا نتصدق، و يعتقون و لا نعتق، فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( أفلا أعلمكم شيئا تدركون به من سبقكم، و تسبقون به من بعدكم؟ و لا يكون أحد أفضل منكم إلا من صنع مثل ما صنعتم ؟ ) قالوا : بلى يا رسول الله، قال : ( تسبحون و تكبرون و تحمدون دبر كل صلاة ثلاثا و ثلاثين مرة ) ، فرجع فقراء المهاجرين إلى رسول الله صلى الله و عليه و سلم فقالوا : سمع إخواننا أهل الأموال بما فعلنا ففعلوا مثله : فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء .

‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত : অসচ্ছল মুহাজিররা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল : বিত্তশালীরা তো উঁচু মাকাম ও স্থায়ী নিয়ামত সব নিয়ে যাচ্ছে ! তিনি বললেন : কীভাবে? তারা বললেন তারা আমাদের মত সালাত রোজা করে কিন্তু তারা সাদকা করে আমরা সাদকা করতে পারি না, তারা গোলাম আজাদ করে আমরা আজাদ করতে পারি না। তখন রাসূল বললেন : আমি কি তোমাদের সে উপায় শিখিয়ে দিব যার দ্বারা তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধরে ফেলতে পারবে এবং পরবর্তীদের থেকে এগিয়ে থাকবে, এবং তোমাদের অনুরূপ এই আমল করা ছাড়া কেউ তোমাদের চেয়ে উত্তম হতে পারবে না? তারা সবাই বললেন, অব্যশই হে আল্লাহর রাসূল !

প্রতি সালাতের পর তেত্রিশ বার সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আলহামদু লিল্লাহ বলবে। এরপর দরিদ্র মুহাজিররা ফিরে এসে বললেন, ধনী মুহাজিররা আমাদের আমলের কথা জানতে পেরে অনুরূপ আমল শুরু করে দিয়েছে? রাসূল বললেন :- এটা আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তা যাকে ইচ্ছা দান করেন। [মুসলিম : ৫৯৫]

যার অধীনে আল্লাহ তাআলা অনেক শ্রমিক ও মজুরকে নিয়োগ দিয়েছেন, এবং অধীনতার ফলে শ্রমিক ও মজুররা যার কথা মান্য করে, সে নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক অনুগ্রহ লাভ করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ অবশ্যই কিয়ামত দিবসে প্রশ্ন করবেন, অনেকের দায়িত্বশীল হিসেবে তার কাছ থেকে হিসেব চাওয়া হবে। সুতরাং, তুমি সতর্ক হও, পার্থিবে যাকে তুমি অনেক সহযোগিতা করেছ, আখিরাত দিবসে তার কারণে নিজের ধ্বংস ডেকে এনো না।

শ্রমিক শ্রেণীর মাধ্যমে তুমি যে সাদাকায়ে জারিয়ার সূচনা করতে পার, তা নিয়ে ভাবার পূর্বে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার উপর তাদের কী কী হক রয়েছে। প্রথমে এই ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতা এনে অত:পর তোমাকে অন্য ক্ষেত্র নিয়ে ভাবতে হবে। অনেক শ্রমিক অভিযোগ করে যে, তাদেরকে পারিশ্রমিক যথাসময়ে প্রদান করা হয় না, অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল :

‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তুমি তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ [ইবনে মাজা : ২৪৪৩]

কোন কোন মালিক নির্দিষ্ট কোন কাজের অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের ঘোষণা প্রদান করেন, কিন্তু কাজ শেষে তা আদায় করেন না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টরূপে ঘোষণা দিয়েছেন :

وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ وَلاَ تَنْقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا وَقَدْ جَعَلْتُمُ اللهَ عَلَيْكُمْ كَفِيلًا إِنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ ﴿91﴾

তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর এবং আল্লাহকে তোমাদের যামীন করে শপথ করার পর তা ভঙ্গ কর না। আর তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা জানেন’। [সূরা নাহল : ৯১]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াদা ভঙ্গকে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং ওয়াদা ভঙ্গ, পারিশ্রমিক প্রদান না করা, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ এবং অত:পর মজলুমের বদদুআ...এত কিছু যদি এক সাথ হয়, তবে তা কী ভয়াবহ ফল বয়ে আনবে তা বলাই বাহুল্য।

ইসলামের প্রাথমিক সময়ে সামাজিক নানা চাপের ফলে কোন কোন মালিক শ্রেণী শ্রমিককে বাধ্য করত কুফরি কার্যকলাপ ও বিশ্বাস বজায় রাখতে, কুরআনে এসেছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ ﴿2﴾ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ ﴿3﴾

‘হে মুমিনগণ, তোমরা যা কর না, তা কেন বল? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসমেত্মাষজনক’। [সূরা ছাফ : ২-৩]

অপর দিকে কিছু মালিক শ্রেণী অনেক শ্রমিককে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছে, তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে অন্যান্য মুসলমানদের জন্য আদর্শ হয়ে আছে। তুমি হয়তো বলবে, আমি ক্ষতির আশংকায় শ্রমিকদের সাথে উত্তম আচরণ করতে ভয় পাই। আমি তাকে বলব, নিম্ন বর্ণিত হাদীসের প্রতি তুমি লক্ষ্য কর :

عن شداد بن أوس قال : ثنتان حفظتهما عن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : ( إن الله كتب الإحسان على كل شيئ، فإذا قتلتم فأحسنوا القتلة، و إذا ذبحتم فأحسنوا الذبح، و ليحد أحدكم شفرته، و ليرح ذبيحته ).

‘শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে দুটি জিনিস শিখেছি। তিনি বলেছেন : ‘আল্লাহ সব কিছুর উপর ইহসান করা ফরজ করেছেন। হত্যা করার সময় ভাল করে হত্যা কর, জবেহ করার সময় ভাল করে জবেহ কর, যে জবেহ করতে চায় সে যেন তার ছুরি ধার দিয়ে নেয় এবং পশুকে কষ্ট না দেয়।’ [মুসলিম : ১৯৫৫]

বলতে পার, আমি যদি তাদের প্রতি অধিক দয়ার্দ্র হয়ে যাই, তবে তারা তো আমাকে দরিদ্র ভাববে। আমি বলব, নিম্নোক্ত হাদীসটির প্রতি লক্ষ্য কর :

عن عائشة رضي الله عنها عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : إن الرفق لا يكون في شيئ إلا زانه، و لا ينزع من شيئ إلا شانه .

‘আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নম্রতা সব কিছুকেই সুন্দর করে আর অনমনীয়তা সব জায়গাতেই দোষণীয়’। [মুসলিম : ২৫৯৪]

তুমি বলতে পার, ‘আমি যদি তাদের প্রতি রুক্ষ না হই, তাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন না করি, তবে আমার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি তাদের নিকট একই রকম মনে হবে এবং তারা আমাকে তাদেরই একজন মনে করবে।’ তবে আমি তোমাকে এই হাদীসটির প্রতি দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করব :

ما استكبر من أكل معه خادمه .

‘যার সাথে তার ভৃত্য আহার করে, সে অহংকারী নয়!’ [বাইহাকী : ৭৮৩৯]

শ্রমিকের প্রতি কঠোরতা এবং তার ইহসানের মাঝে কোন প্রকার তুলনা টেনে এনো না, কাজ ও শ্রমিকের মাঝে তুলনা টেনে কেন নিজের ক্ষতি ডেকে আনবে?

তুমি কি দাওয়াত ও তোমার অন্যান্য কর্মের মাঝে কোন দেয়াল তুলে রেখেছ? তোমার দাওয়াতের সফলতার তুলনায় ব্যবসার সফলতা কি অধিক গুরুত্বপূর্ণ? জেনে রাখ, এই উভয় বস্ত্তর সফলতাই আল্লাহর হাতে, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সাফল্য দান করেন।

তুমি কিছুটা সচেতন হলেই তোমার পার্থিব উপার্জন সম্পৃক্ত কর্মের মাধ্যমে অনেককে তোমার আখিরাত ও পরকালের জন্য কাজে লাগাতে পার। তুমি কি তোমার কর্মক্ষেত্রে, কারখানায় একটি ছোট্ট মসজিদ নির্মাণে সক্ষম নও? নিদেনপক্ষে একটি সালাতের স্থান? যদি প্রশস্ত স্থান নাও থাকে, তাহলেও তুমি আবাসস্থলে ও কর্মক্ষেত্রে একটি সালাতের স্থান নির্ধারণ করে নাও।

তুমি তোমার কর্মক্ষেত্রে একজন দায়ী নিয়োগ কর, যাকে অন্যান্যদের মতই বেতন প্রদান করা হবে। যার দায়িত্ব হবে সকলের মাঝে দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। যারা অমুসলিম, তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান, মুসলিমদেরকে প্রয়োজনীয় মাসআলা মাসায়িল, কুরআন ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া। একটি কোম্পানী তৈরি করে তার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলে তুমি নিশ্চয় একজন দায়ীকে নিয়োগ দেওয়ার তাওফীক রাখ?

মুসলিমদেরকে বাদ দিয়ে তুমি অমুসলিমদেরকে কর্মে নিয়োগ দিচ্ছ কেন, মুসলমানগণ কি তোমার থেকে অমুখাপেক্ষী হয়ে গেছে? তোমার কি মনে হয় তাদের কাজের প্রয়োজন নেই? কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের আবশ্যক শর্তগুলো থেকে কেন ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’র শর্ত কেটে দিয়েছ? তুমি কি জান, এভাবে তুমি অমুসলিম শক্তিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শক্তির যোগান দিয়ে যাচ্ছ?

মনে কর, মুসলিম অমুসলিম সকলে কাতারে দাঁড়িয়ে আছে, চাকরীতে নিয়োগের অপেক্ষা করছে। যে মুসলমান, সে এ ব্যাপারে মোটেই সন্দেহ করছে না যে, তুমি তাকে নিয়োগ দিবে, কারণ, তুমি তার মুসলিম ভাই। অত:পর তুমি এলে, এসে অমুসলিমকে নিয়োগ দিয়ে দিলে, মুসলিমদের প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করলে না। মুসলিমদের কারো কি এ নিয়োগের প্রয়োজন ছিল না, তবে কেন তুমি অমুসলিমকে নিয়োগ দিলে? অমুসলিম যখন তোমার দেশে পৌঁছবে, তার উপাস্য হবে আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কেউ, সে তাওহীদের ভূমিতে গায়রুল্লাহর ইবাদাত করবে, এই ভূমি কি তাকে এবং সেই সূত্রে তোমাকে অভিশাপ দিবে না? কারণ, তুমি যদি তাকে নিয়োগ না দিতে, তবে নিশ্চয় একজন মুসলিম তার স্থলে আল্লাহর ইবাদাতে নিজেকে নিমগ্ন করত !

সুতরাং, শরীয়তের হুকুম পুনরায় পাঠ কর, আখিরাতের আমলনামা খুলে দেখ, তাতে তুমি ইতিপূর্বে কী কী লেখে রেখেছ।

কর্মক্ষেত্র ছুটিতে বা স্থায়ীভাবে যখন কেউ দেশে ফিরে যায়, তখন তুমি তাকে কিছু হাদিয়া দিয়ে দাও, হতে পারে তা তার ভাষায় লিখিত ইসলামী পুস্তক, সিডি বা এ জাতীয় কিছু।

যদি উক্ত শ্রমিক মুসলিম হয়, তবে তাকে ইসলামী বিশ্বাস সংক্রান্ত পুস্তক হাদিয়া দাও, যাতে শুদ্ধ আকীদা, তার রুকুন, ওয়াজিব, সুন্নত ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তৃত অথবা সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে।

তুমি তোমার ব্যাবসার লভ্যাংশ থেকে নির্দিষ্ট একটি অংশ দীনের কাজে ব্যয় করতে পার। ইসলাম বিষয়ে মাসিক বা সাপ্তাহিক কোন পত্রিকার এজেন্ট হয়ে তার কপি বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দাও বিনামূল্যে বিতরণের জন্যে।

হে ব্যাবসায়ী ভাই, তোমাকে এক বড় বিপদ সম্পর্কে আমি হুশিয়ারি করছি, সূদ কী পরিণতি বয়ে আনতে পারে, কুরআন হাদীস অধ্যয়ন করে অবশ্যই তা তোমাকে উপলব্ধি করতে হবে।

কন্ট্রাক্টর ও আয়কারীদের অনেকে শয়তানের পিছনে ছুটে বেড়ায়, নতুন নতুন প্রজেক্টের সূচনা ও তাকে বাড়িয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারা বলে, প্রজেক্টটি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলে লোন নেয়া বন্ধ করে দিব। কিন্তু অবস্থা তাই দাঁড়ায়, আল্লাহ পবিত্র কুরআনে যেমন বলেছেন :

يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ .

‘শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়’। [সূরা বাকা : ২৭৫]

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যখনি তাদের প্রজেক্ট শেষ হয়, নতুন প্রজেক্ট লোভনীয় হয়ে তার সামনে হাজির হয়। প্রজেক্ট যতই বড় হবে, ততই ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে সূদ। তুমি কি ভাব যে, শয়তান তোমাকে ছেড়ে দিবে, সে তোমাকে একের পর এক আঘাত করে যাবে।

নাকি তুমি শয়তানের হাত ধরে তাওবা করতে চাও? তুমি কি আল্লাহকে মোটেও ভয় পাচ্ছ না? আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সূদ ও সূদী কারবারকে তার সাথে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। কুরআনে এসেছে :

{ فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ }

‘তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও’। [সূরা বাকারা : ২৭৯]

সুতরাং, যদি তুমি আল্লাহর সাথে যুদ্ধের শক্তি রাখ, তবে এগিয়ে যাও। আর যদি বল, তোমার সে শক্তি নেই, তবে দ্রুত এই ময়দান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নাও, আল্লাহর কাছে ছুটে যাও লজ্জিত ও ক্রন্দনরত হয়ে :

فَفِرُّوا إِلَى اللهِ إِنِّي لَكُمْ مِنْهُ نَذِيرٌ مُبِينٌ ﴿50﴾

‘অতএব তোমরা আল্লাহর দিকে ধাবিত হও। আমি তো তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী।’ [সূরা যারিয়াত : ৫০]

কেন তুমি একে ক্ষুদ্র পাপ হিসেবে বিবেচনা করছ? এ ব্যাপারে যারা তোমাকে সতর্ক করছে, তাদের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করছ না? এর বিপদের প্রতি দৃষ্টিপাত করছ না? যেন তুমি দেখা ও শ্রবণ হতে বিরত থাকলে কোন পাপ হবে না !

তুমি কি যিনাকে ছোট পাপ মনে কর?

সন্দেহ নেই, তোমার উত্তর হবে, না।

তবে কি তোমার ধারণা আছে যে, সর্বনিম্ন সূদের হারও যিনার চেয়ে ভয়াবহ পরিণতিবাহী? আব্দুল্লাহ বিন হানজালা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

درهم رباَ يأكله الرجل و هو يعلم، أشد من ستة و ثلاثين زينة .

‘সচেতনভাবে সূদের এক দেরহাম ভোগ করা ছত্রিশবার যিনা থেকেও কঠিন’। [আহমদ : ২১৯৫৭]

তুমি কি ঐ হাদীস সম্পর্কে অবগত আছ, যেখানে রাসূল সূদকে সাতটি ভয়ানক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করেছেন, এবং ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণের উপরে তাকে স্থান দিয়েছেন?

হাদীসে এসেছে, সূদখোর তার কবরে রক্তের নহরে ভাসবে, আগুনের পাথর তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে যাবে, যতক্ষণ না কিয়ামত প্রতিষ্ঠা হয়। এই হাদীস সম্পর্কে কি তুমি বে-খবর?

কিয়ামতের দিবসে সূদখোরের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন :

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لاَ يَقُومُونَ إِلاَّ كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ .

‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়।’ [সূরা বাকারা : ২৭৫]

যারা আয়কারবার ও ব্যাবসার ক্ষেত্রে সূদকে হালকাভাবে নিচ্ছে, তারা যেন রাসূলের এ উক্তির প্রতি লক্ষ্য রাখে :

الربا ثلاثة و سبعون بابا أيسرها مثل أن ينكح الرجل أمه، و إن أربى الربا عرض الرجل المسلم .

‘সূদের তেহাওুরটি দরজা রয়েছে। তার সবচেয়ে সহজতরটাও মায়ের সাথে ব্যাভিচারের মত জঘন্য আর সবচেয়ে কঠিন সূদ মুসলমানের সম্মান দীর্ণ করা।’ [বাইহাকী : ৫১৩১]

و في رواية عن أبي هريرة رضي الله عنه ( الربا سبعون بابا، أدناها كالذي يقع على أمه )

‘আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আরেকটি বর্ণনায় এসেছে : সূদের সত্তরটি দরজা রয়েছে তার সবচেয়ে নিম্ন স্তরেরটা আপন মায়ের সাথে ব্যাভিচার করার মত’। [বাইহাকী : ৫১৩২]

و في رواية عن البراء بن عازب قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم الربا اثنان و سبعون بابا، أدناها مثل إتيان الرجل بأمه، و إن أربى الربا استطالة الرجل في عرض أخيه .

‘বারা ইবনে আজেব রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি বর্ণনায় আছে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : সূদের বাহাত্তরটি দরজা রয়েছে, তার সাধারণতরটা আপন মায়ের সাথে ব্যাভিচারের মত। সবচেয়ে কঠিন সূদ ভাইয়ের মান হানি করা’। [তাবরানী : ৭১৫১]

সুতরাং, কি এমন লাভের সন্ধান পেয়েছ যে, অনায়াসে এ পাপ করে যাচ্ছ? তুমি যদি দারিদ্রে্যর ভয় কর, তবে আল্লাহ বাণীর প্রতি দৃকপাত কর :

الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿268﴾

‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রতার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা বাকারা : ২৬৮]

যদি বল, তুমি সূদের ব্যবহার ব্যতীত জীবন ধারণ করতে পারবে না, তবে আমি তোমাকে প্রশ্ন করব : তোমার জন্য কি মৃত জন্তু ভক্ষণ হালাল করে দেয়া হয়েছে? তুমি নিশ্চয় উত্তরে বলবে : না।

তবে কি তুমি বলবে, সূদ এখনকার সমাজ ব্যবস্থায় একটি প্রয়োজনী বিষয়? তাহলে আমি বলব, কোথা থেকে এ প্রয়োজনের উৎপত্তি? এটি একটি প্রয়োজনী বিষয়- এই ফতওয়া তোমাকে কে দিল?

এত দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই, কেবল দুটি বাক্যই এই বিতর্কের সমাপ্তি টানার জন্য যথেষ্ট। কুরআনে এসেছে :

وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا .

‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে করেছেন হারাম’। [সূরা বাকারা : ২৭৫]

আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿275﴾

‘অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওয়ালায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে’। [সূরা বাকারা : ২৭৫]

হয়তো তুমি উদাহরণ টেনে বলবে, অমুক আলিম তার ফতওয়ায় এমন বলেছেন ...। আমি বলব, তুমি যদি সত্যিই আলিমদের অনুসরণ করে থাক, তাহলে আলিম, মুফতি বোর্ড ও সংস্থা সকলের সম্মিলিত মত হচ্ছে সূদ হারাম, বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে যেভাবে সূদী লেনদেন হচ্ছে, তা কোনভাবেই হালাল হতে পারে না।

তুমি নিজেকে প্রশ্ন কর : কেন তুমি একজনের ফতওয়ার উপর ভিত্তি করে হরদম সূদ খেয়ে যাচ্ছ, সকল আলিমের সম্মিলিত মতকে উপেক্ষা করে একজনের মতকে গ্রহণ করার মাধ্যমে কেবল তোমার চাতুরিই প্রকাশ পাচ্ছে না?

সত্যিই যদি তুমি শরয়ী কোন প্রমাণের সন্ধান কর, তবে প্রথমেই আমি সর্বোত্তম প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। তুমি একান্তে, আল্লাহকে সামনে রেখে নিজেকে প্রশ্ন কর, তোমার অন্তরই তোমার সর্বোত্তম হিসাব রক্ষক। তোমার অন্তর অবশ্যই তোমাকে এ উত্তর দিবে যে, সূদ পরিত্যাগই তোমার জন্য উত্তম, তোমার আখিরাতের জীবনের জন্য অধিক ফলদায়ক।

সূদ সংক্রান্ত অসংখ্য মাসআলা রয়েছে, যার সবগুলো তোমার পাঠ করে দেখার প্রয়োজন নেই, যে কোনটির অনুসরণই তোমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিবে।

তোমার উপর প্রয়োজনী ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দায়িত্ব রয়েছে।

যেহেতু তুমি ব্যবসাকে নিজের জীবন ধারনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছ, সুতরাং, তোমাকে অবশ্যই ব্যবসা ও মুআমালা সংক্রান্ত শরীয়তের মাসআলা মাসায়েল পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে হবে। তুমি এমন মুআমালায় অংশগ্রহণ করবে না, যার শরীয়তী আহকাম তোমার জানা নেই। ব্যক্তিগতভাবে যদি জেনে নেওয়া সম্ভব না হয়, তবে জ্ঞাত কোন আলিমের শরনাপন্ন না হওয়া অবধি সে কাজে কোনদিন অংশগ্রহণ করবে না। এমন আলিমেরই শরনাপন্ন হবে, যার মাঝে অবশ্যম্ভাবী দুটি শর্ত বিদ্যমান : ইলম ও তাকওয়া।

মনে রাখবে, আল্লাহ তোমাকে অনেক লোকের দায়িত্ব দিয়েছেন, যাদের উপর তোমার রয়েছে পার্থিব কর্তৃত্ব। সুতরাং, তুমি তোমার হাতকে ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ’ তথা আল্লাহ রাস্তায় ব্যয়ের মাধ্যমে উঁচু কর। এভাবে দুনিয়া ও আখিরাত- উভয় স্থানেই তোমার হাত উঁচু হবে। ইয়াতীমদের দায়িত্ব গ্রহণ কর, মসজিদ নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন কর, ইলমী কাজে সহায়তা প্রদান কর ; সর্বোপরি এমন কাজে সশরীরে হাজির থাক, যা আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করে এবং মিটিয়ে দেয় কুফরের অশ্লীল উচ্চারণ।

এতটুকু পাঠ শেষ করে তুমি পুরো লেখাটি পুনরায় অধ্যয়ন কর, একজন পাঠকের ভূমিকা ত্যাগ করে সক্রিয় হওয়ার সাধনা কর, এ কাজের সাথে নিজেকে আত্মনিয়োগ কর।

আজ তোমার হাতে যা সুযোগ হয়ে আছে, কাল যেন তাই তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়ে হাজির না হয়।

৫৮
দশম বপন: মুহাজির
وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِي اللهِ مِنْ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَلأَجْرُ الآَخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ﴿41﴾

‘যারা অত্যাচারিত হওয়ার পর আল্লাহর পথে হিজরত করেছে আমি অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়ায় উত্তম আবাস দেব ; এবং আখিরাতের পুরস্কার তো শ্রেষ্ঠ, হায় যদি তারা জানত।’ [সূরা নাহল : ৪১]

وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللهِ يَجِدْ فِي الأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَكَانَ اللهُ غَفُورًا رَحِيمًا ﴿100﴾

‘আর যে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করবে, সে যমীনে বহু আশ্রয়ের জায়গা ও সচ্ছলতা পাবে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে মুহাজির হয়ে নিজ ঘর থেকে বের হয় তারপর তাকে মৃত্যু পেয়ে বসে, তাহলে তার প্রতিদান আল্লাহর উপর অবধারিত হয়। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [সূরা নিসা : ১০০]

عن خباب رضي الله عنه قال : ( هاجرنا مع النبي صلى الله عليه و سلم نلتمس وجه الله، فوقع أجرنا على الله، فمنا من مات لم يأكل من أجره شيئا، منهم مصعب بن عمير، و منا من أينعت له ثمرته فهو يهدبها ..)

‘খাববাব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হিজরত করলাম। আমাদের মধ্যে অনেকে তার কোনো ফল ভোগ না করেই মারা গেল, যেমন মুছআব ইবনে উমায়ের। আবার অনেকেই তার পরিপক্ব ফসল ভোগ করার সুযোগ পেল।’। [বুখারী : ১২৭৬]

শরীয়ত এবং ইতিহাসের বিবর্তনের দীর্ঘ পরম্পরা এ ব্যাপারে স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে, হিজরতের মাধ্যমে এমন অনেক পরিবর্তন ও ওলটপালট ঘটে যায়, এমন বিজয় সূচিত হয়, নিরন্তর পরিশ্রম ও দীর্ঘ সাধনার পরও যা মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবং যা ছিল মানুষের কল্পনার ঊর্ধ্বে। হিজরত ও হিজরতের পূর্বের অবস্থা, এ দুই কালের মূল্যবোধের বিস্তর ফারাক- এগুলো বিবেচনা করলেই আমাদের সামনে হিজরতের অবশ্যম্ভাবী ফল স্পষ্ট হয়ে দেখা দিবে।

ইবরাহীম খলীল দীর্ঘদিন তার সম্প্রদায়ের মাঝে অবস্থান করেছেন, তার ইচ্ছানুসারে বিজয় ধরা দেয়নি, মানুষের অন্তর বা রাষ্ট্র- কোথাও তিনি সারা পাচ্ছিলেন না। তার পিতা যখন বললেন :

لأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا ﴿46﴾

‘অবশ্যই আমি তোমাকে পাথর মেরে হত্যা করব। আর তুমি চিরতরে আমাকে ছেড়ে যাও’। [সূরা মারইয়াম : ৪৬]

তিনি হিজরতের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ইরাক ভূমি থেকে একাকী বেরিয়ে পড়লেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَآَمَنَ لَهُ لُوطٌ وَقَالَ إِنِّي مُهَاجِرٌ إِلَى رَبِّي إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿26﴾

‘অতঃপর লূত তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করল। আর ইবরাহীম বলল, ‘আমি আমার রবের দিকে হিজরত করছি। নিশ্চয় তিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। [সূরা আনকাবূত : ২৬]

হিজরতের পর কল্যাণ ধারা তার পদতলে লুটিয়ে পড়ল। আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطًا إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِينَ ﴿71﴾ وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ نَافِلَةً وَكُلًّا جَعَلْنَا صَالِحِينَ ﴿72﴾ وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ ﴿73﴾

‘আর আমি তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে সে দেশে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি। আর আমি তাকে দান করেছিলাম ইসহাক ও ইয়াকূবকে অতিরিক্ত হিসেবে; আর তাদের প্রত্যেককেই আমি সৎকর্মশীল করেছিলাম। আর তাদেরকে আমি নেতা বানিয়েছিলাম, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে সঠিক পথ দেখাত। আমি তাদের প্রতি সৎকাজ করার, সালাত কায়েম করার এবং যাকাত প্রদান করার জন্য ওহী প্রেরণ করেছিলাম। আর তারা আমারই ইবাদাত করত।’ [সূরা আম্বিয়া : ৭১-৭৩]

এভাবে ইবরাহীম খলীল আ.-এর হিজরতের ফল কিয়ামত অবধি স্থিরতা লাভ করল। হিজরতের পূর্বে কি তিনি কা’বা নির্মাণ করেছিলেন? মক্কা থেকে ফেরার পর শামে হিজরতের পূর্বে কি তিনি মাসজিদে আকসা নির্মাণ করেছিলেন, যেমন আমরা দেখতে পাই বুখারীতে বর্ণিত আবু জর-এর হাদীসে?

ইবনে কাসীর বলেন : ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে তিনি তার সম্প্রদায়ের সঙ্গ ত্যাগ করলেন, তাদেরকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় মনস্থ হলেন- তার স্ত্রী ছিল বন্ধ্যা নারী, তার সন্তান হচ্ছিল না, তাদের সাথে ছিল ভ্রাতুস্পুত্র লূত বিন হাযিন বিন আযর। এরপর আল্লাহ তাকে সৎ পুত্র দান করলেন, তার সন্তানদের মধ্যে নবুয়্যত ও কিতাব দেয়া হল। তার পরবর্তী সময়ে যে নবীই এসেছিলেন, তিনি ছিলেন তার বংশের। তার পরবর্তীতে প্রতিটি কিতাবই তার বংশধর কোন নবীর উপর নাযিল হয়েছে। তিনি তার স্বদেশ ও স্বজাতি ত্যাগ করে এমন এক দেশে হিজরত করেছিলেন যেখানে নির্দ্বিধায় আল্লাহর ইবাদাত করা যায় এবং মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদান করা যায়।’ [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১৫০/১]

মূসা আ.-এর জন্যও ভালো সময়ের সূচনা হয়েছিল, যখন তিনি প্রথমবার মিসর থেকে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় হিজরত করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ ﴿২১﴾ وَلَمَّا تَوَجَّهَ تِلْقَاءَ مَدْيَنَ قَالَ عَسَى رَبِّي أَنْ يَهْدِيَنِي سَوَاءَ السَّبِيلِ ﴿২২﴾

তখন সে ভীত প্রতীক্ষারত অবস্থায় শহর থেকে বেরিয়ে পড়ল। বলল, ‘হে আমার রব, আপনি যালিম কওম থেকে আমাকে রক্ষা করুন’। আর যখন মূসা মাদইয়ান অভিমুখে রওয়ানা করল, তখন বলল, ‘আশা করি আমার রব আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন।’ [সূরা কাছাছ : ২১-২২]

এ হিজরতের প্রাথমিক ফল এই ছিল যে, তিনি অত্যাচারী সম্প্রদায় থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, তার ভীতি দূর হয়ে গিয়েছিল, লাভ করেছিলেন নিরাপত্তা। শুয়াইবের মত একজন সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তা পেয়েছিলেন, বিয়ে করেছিলেন তার কন্যাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি যখন প্রথমে তাকে সব খুলে বলেছিলেন, তখন শুয়াইব তাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন :

لاَ تَخَفْ نَجَوْتَ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ ﴿25﴾

‘ভয় পেয়ো না, তুমি যালিম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি পেয়েছো’। [সূরা কাছাছ : ২৫]

তিনি সেখানে কিছু দিন কাটিয়ে দ্বিতীয় হিজরতে বের হলেন। কুরআনে এসেছে :

فَلَمَّا قَضَى مُوسَى الأَجَلَ وَسَارَ بِأَهْلِهِ آَنَسَ مِنْ جَانِبِ الطُّورِ نَارًا قَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آَنَسْتُ نَارًا لَعَلِّي آَتِيكُمْ مِنْهَا بِخَبَرٍ أَوْ جَذْوَةٍ مِنَ النَّارِ لَعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ ﴿29﴾ فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ مِنْ شَاطِئِ الْوَادِ الأَيْمَنِ فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ مِنَ الشَّجَرَةِ أَنْ يَا مُوسَى إِنِّي أَنَا اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ﴿30﴾

‘অতঃপর মূসা যখন মেয়াদ পূর্ণ করল এবং সপরিবারে যাত্রা করল, তখন সে তূর পর্বতের পাশে আগুন দেখতে পেল। সে তার পরিবার পরিজনকে বলল, ‘তোমরা অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখতে পেয়েছি, সম্ভবত আমি তা থেকে তোমাদের কাছে আনতে পারব কোন খবর, অথবা একটি জ্বলন্ত অংগার; যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার’। অতঃপর যখন মূসা আগুনের নিকট আসল, তখন উপত্যকার ডান পার্শে পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত বৃক্ষ থেকে তাকে আহবান করে বলা হলো, ‘হে মূসা, নিশ্চয় আমিই আল্লাহ, সৃষ্টিকুলের রব’। [সূরা কাছাছ : ২৯-৩০]

এই হিজরতেই মূসা আ. কালীমুল্লাহ’র উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন, নবুয়্যত লাভ করেছিলেন তার ভাই হারূন আ.। এই হিজরতের পরই তিনি ফিরআউনের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার বিশেষ সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছিলেন। জাদুকর ও মিসরবাসীর একদল তার দাওয়াতে ঈমান এনেছিল। সর্বোপরি ফিরআউনের জুলুম থেকে বনী ইসরাইল মুক্তি লাভ করেছিল।

দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে হিজরতের ফলে তিনিই লাভ করেছিলেন প্রভূত জ্ঞান, যখন তিনি খিজর আ. এর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। কুরআনে এসেছে :

وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لاَ أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا ﴿60﴾

‘আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার সহচর যুবকটিকে বলল, আমি চলতে থাকব যতক্ষণ না দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে উপনীত হব কিংবা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেব।’ [সূরা কাহফ : ৬০]

সুলাইমান আ.-এর হিজরতের পরই কেবল বিলকীস ও তার সম্প্রদায় তার প্রতি ঈমান এনেছিল। জিহাদের সাথে সাথে যদি হিজরত না করতেন জুল কারনাইন, তবে তিনি এমন মর্যাদায় ভূষিত হতেন না। আসহাবে কাহফ বা গুহার অধিবাসীগণ যদি হিজরত না করে সম্প্রদায়ের সাথে থেকে যেতেন, তবে তাদের দীন রক্ষা সম্ভব হত না, কিয়ামত অবধি পঠিত পবিত্র কুরআনে তাদের ঘটনা সংরক্ষিত হত না।

ইতিহাসে হিজরত ও তার পরবর্তী ফল নিয়ে অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। তবে, ইতিহাসের মহত্তম হিজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল। রাসূল হিজরতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন পুরোপুরিভাবে, তাই তিনি প্রথমেই তার অনুসারীদেরকে হিজরতে নির্দেশ দিলেন, তারা হাবশায় গমন করে তথায় ইসলামের প্রচারে নিয়োজিত হলেন। রাসূল নিজেও হিজরতের ইচ্ছা করছিলেন, হজের মৌসুমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে তিনি কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এক হাদীসে আছে : ‘জাবের রা. থেকে আবু যুবাইর বর্ণনা করেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় সাত বছর ছিলেন। ওকায, মিজান্না এবং মিনার মৌসুমগুলোর সময় মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। বলেছেন : আমার রবের রিসালাত পৌঁছানোতে কে আমাকে সহযোগিতা করবে? এক সময় এমন হল যে, ইয়ামান বা মিশর থেকে কোনো লোক আসলে লোকেরা তাকে গিয়ে বলত কুরাইশের এই যুবক সম্পর্কে সতর্ক থেক, সে যেন তোমাকে প্ররোচিত করতে না পারে। তিনি যখন তাদের কাফেলার মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন তারা তার দিকে অঙ্গুলী তুলে ইশারা করত।

এই সময়ই ইয়াসরিব থেকে আল্লাহ আমাদেরকে পাঠালেন এবং আমরা তাকে আশ্রয় দিলাম, তাকে বিশ্বাস করলাম। মানুষ তার কাছে যেতে লাগল। তার কথা শুনে তার প্রতি ঈমান আনতে লাগল। কেউ কেউ তার মুখ থেকে কুরআন শুনে পরিবারের নিকট ফিরে যেত এবং তার পরিবারের লোকেরাও তার মত ইসলাম গ্রহণ করত। এক সময় দেখা গেল আনসারদের প্রতিটি ঘরে, যারা প্রকাশ্যে ইসালাম পালন করে- এমন এক দল মুসলমান রয়েছে। এক দিন আমরা সবাই সমবেত হয়ে বললাম : আর কতদিন আমরা নবীকে সন্ত্রস্ত অবস্থায় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুড়ে বেড়াতে দিব? তাই আমাদের সত্তুর জন লোক মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। হজের মৌসুমে তারা তার নিকট গিয়ে উপস্থিত হল এবং আমরা তার বাইআতে আকাবার ব্যাপারে সম্মত হলাম। একজন দুইজন করে গিয়ে আমরা সবাই একত্র হলাম।

আমরা বললাম : হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কিসের উপর আপনার হাতে বাইআত হব? তিনি বললেন, তোমরা আমার হাতে বায়াত হবে, উদ্যম ও আলস্য সর্বাবস্থায় আনুগত্যের উপর, স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতা সর্বাবস্থায় দানের উপর, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের উপর এবং এর উপর যে, সত্য বলবে অকুতোভয়ে, আল্লাহর ক্ষেত্রে কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় না করে এবং আমাকে সাহায্য করবে এবং প্রায়োজন হলে যে সব বিষয় থেকে নিজেদের এবং স্বজনদের রক্ষা কর তা থেকে আমাকেও রক্ষা করবে এবং এই সবের বিনিময়ে তোমাদের জন্য থাকবে জান্নাত।

তখন আমরা উঠে গিয়ে তার হাতে বাইআত হলাম। তাদের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি আসাদ বিন যারারাহ তাঁর হাত ধরে বলল : একটু দাঁড়াও হে ইয়াসরিববাসী, উটের পেট চাপড়ে আমরা যখন আসছি তখন আমরা কিন্তু জানতাম যে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তাকে বের করে নেওয়া মানে সমস্ত আরবের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া এবং তোমাদের উত্তম লোকগুলো নিহত হওয়া এবং তোমাদের উপর তরবারি ছেয়ে যাওয়া। এখন হয় ধৈর্য ধরতে পার, যার জন্য আল্লাহ কাছে প্রতিদান পাবে, কিংবা কাপুরুষতা করে নিজেদের নিরাপত্তার আশংকায় পিছিয়ে পরতে পার, তিনি তোমাদের ওজর গ্রহণ করে নিবেন। তখন তারা বলল : ঠিক আছে আল্লাহর রাসূল, আমরা কখনো এই বাইআত ভঙ্গ করব না।

তখন আমরা উঠে গিয়ে তার হাতে বাইআত হলাম। তিনি আমাদের বাইআত গ্রহণ করলেন এবং এর বিনিময়ে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিলেন।’

হাবশার বাদশা নাজ্জাসী মুহাজিরদের দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। রাসূলের ওফাতের পর যে দেশই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে, ইসলামের বিশ্বাসে দীক্ষিত হয়েছে, সেখানে অবশ্যই কোন সাহাবীর হিজরতের ঘটনা ঘটেছে। ইউরোপে ইসলাম প্রবেশ করেছে স্পেনে গমনকারী আব্দুর রহমানের মাধ্যমে। দীর্ঘ সত্তর বছর বাইতুল মুকাদ্দাস ছিনতাই হয়ে থাকার পর ইরাক থেকে সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর হিজরতের ফলে তা আবার মুসলমানদের হাতে এসেছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইসলাম অমুসলিম দেশগুলো থেকে এক প্রকার বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, মুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানগণ বিপর্যস্ত সময় যাপন করছিলেন। ধীরে ধীরে ইসলাম আবার তার বাহু প্রসারিত করেছে, বিভিন্ন নগর, গ্রাম, কেন্দ্র, সংস্থা এবং হাজার হাজার অমুসলিমের ইসলামে দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সেই প্রসারের ব্যপ্তি দেখা যাচ্ছে। এ সবই হয়েছে আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ ও হিজরতের মাধ্যমে।

বিভিন্ন ইসলামী ও অনৈসলামী দেশ থেকে যখন ছাত্ররা মূল কেন্দ্র থেকে শিক্ষা নিয়ে অত:পর দেশে ফিরে যায়, ছড়িয়ে দেয় ইসলামের শিক্ষা, বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা, তখন তা ইসলামের প্রসারের জন্য অভূতপূর্ব কাজ করে, দূর হয় ইসলাম সম্পর্কিত অনর্থ মূর্খামী, ইসলামের সঠিক জ্ঞানে তারা সঞ্জীবিত হয়, তাদের বিশ্বাসের গভীরে ইসলামী আক্বীদা প্রোথিত হয়।

এভাবে হিজরতের ফলে অনেক অভাবিত বিজয় সূচিত হয়, এমনকি হিজরতকারীদের যারা এখনো ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত, নানা বিদআতে জর্জরিত তারাও উপকৃত হয়। তার বিশ্বাসের জগতে এক ব্যাপক বিশুদ্ধতার সূচনা হয়।

হিজরতের মাধ্যমেই আমেরিকার আবিস্কার হয়েছিল, আজ আমেরিকা বিশ্বব্যাপী যে শক্তির বিস্তার করেছে, তার সূচনাও হয়েছিল হিজরতে মাধ্যমে। পৃথিবীর আনাচ কানাচ থেকে টেনে হিঁচরে ইহুদীদেরকে নিয়ে এসে গঠিত হয়েছিল ইসরাইল রাষ্ট্র।

কেউ প্রশ্ন করতে পারে, এ যুগে হিজরতের সঠিক কোন উপকার কি আমরা লাভ করতে পারব? কিংবা কি প্রক্রিয়ায় এখন হিজরত সম্পন্ন হলে তা আমাদের জন্য সহায়তা বয়ে আনবে?

এর উত্তর খোঁজার জন্য আমাদেরকে যেতে হবে প্রথম যুগের হিজরতকারীদের কাছে, তাদের হিজরত কী কী ফল বয়ে এনেছিল, ইতিহাস কি আমাদেরকে সে ব্যাপারে জানাচ্ছে না? কিংবা এ যুগেও যারা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে প্রবাসে থাকছে, দাওয়াত ভিন্ন অন্য কোন উদ্দেশ্য যাদের নেই, তাদের বিশ্বাস, বোধ আমাদেরকে কি সঠিক পথ দেখাচ্ছে না? যারা আমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে হিজরত করে দীন প্রচারে রত আছেন এবং তাদের সাথে সাথে ইসলামও সে দেশে পাখা মেলছে তাদেরকে আদর্শ মেনে আমরা এর উত্তর খুঁজে নিতে পারি। ইসলাম সে দেশগুলোতে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রতিদিন একটু একটু করে তার পরিধি বাড়ছে। বর্তমান যুগে জায়োনিষ্টরা ইসলামের উপর যেভাবে হামলে পড়ছে, তার অন্যতম ও প্রধান কারণ হচ্ছে হিংসা ও পৃথিবীব্যাপী এই আলোর ধারার বিস্তার। তারা একে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। মধ্য ইউরোপ ও ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তা বলার অপেক্ষা করছে না, এ ফলাফলের সূচনা নিশ্চয় ছিল কিছু নির্মোহ হিজরত।

এ সময়ে, পৃথিবীব্যাপী ইসলামের প্রসার, প্রচারের জন্য প্রয়োজন কিছু লোকের নির্মোহ হিজরত, দাওয়াত ভিন্ন অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়, যারা হিজরত করবেন ইসলামের সুমহান দাওয়াত দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দেয়ার মানসে।

কোন একক ব্যক্তির পক্ষে এ হিজরতের মহান দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় ; এর জন্য প্রয়োজন বিস্তৃত ঐতিহাসিক পাঠ, শরীয়ত ও ফিকাহকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অধ্যয়ন, যা গঠন করা হবে মাঠ পর্যায়ে তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহের মাধ্যমে, ভৌগলিক ও স্ট্রাটেজিক গবেষণা যা এক ফলপ্রসু পূর্ব ধারণা বয়ে আনবে।

৫৯
একাদশ বপন: সাধারণ দরিদ্র শ্রেণী
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ ﴿2﴾

‘তিনিই সে সত্বা, যিনি নিরক্ষরদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যে তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট ভ্রামিত্মতে ছিল’। [সূরা জুমআ : ২]

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : يدخل فقراء المؤمنين الجنة قبل أغنيائهم بخمس مئة عام .

‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, দরিদ্র মুমিনরা ধনী মুমিনদের পাঁচ শ’ বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [আহমদ : ৭৯৪৬]

আবু আলী (আল্লাহ তাকে রহম করুন) একজন সাধারণ লোক, আমি তাকে সৎ হিসেবে জানি, যে তার দীনের উপর অটল থাকতে পেরে অত্যন্ত গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করে। সে দুবাই নগরীর অন্তর্ভুক্ত হাতা এলাকার অধিবাসী। খুবই সাধারণ একজন ব্যক্তি, লিখন পঠন সম্পর্কে তার ছিটেফোটা জানাশোনা না থাকলে তাকে অনায়াসেই অশিক্ষিত বলা যেত।

ধবধবে সাদা দাড়ি, সুঠাম তামাটে দেহ, দরিদ্র আবু আলী আমাদের কাছ থেকে মধু ইত্যাদি ক্রয় করত, পরে খুচরা মূল্যে তা বিক্রি করে কিছু লাভ করত, এতেই তার জীবন চলত। তার সাথে আমাদের সম্পর্কের এই ছিল সূত্র।

আমাদের সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই তার মাঝে ইসলাম সম্পর্কে অসাধারণ এক বোধ দেখে আসছি, মাঝে মাঝে উদাহরণ ও প্রমাণ আকারে আমাদের সামনে যা হাজির করত, যদিও অধিকাংশ সময়েই সে পূর্ণ করতে পারত না, তাতেই তার গভীর বোধের প্রকাশ পেত।

আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, এ যুগে দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত অনেকের তুলনায় তার কথা আমার কাছে ছিল প্রিয় ও মধুর। একদিন সে আমার কাছে এল, কিছু সময় পর সে বলল, ‘আপনারা ইলমের পথের পথিক, আপনাদের বিষয়টি অন্যরকম, আপনাদের আমানতদারী অতুলনীয়।’

অত:পর বলল, ‘একবার কোন এক সাময়িকীতে আমি পড়েছি, এক পাকিস্তানী মুসলমান জনৈকা ইহুদী যুবতীকে ইসলাম গ্রহণের পর বিয়ে করেছে। ইহুদী সে মেয়েটি ইসলামকে হৃদয়ঙ্গম করেছে অতুলনীয়ভাবে। পাকিস্তানী মুসলিমের সাথে সে পরবর্তীতে পাকিস্তানে চলে আসে। সে দেশে গিয়ে সে ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে, পরিস্কার বোঝাবুঝির স্তরে সে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়। অত:পর ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত উপকারী বারোটি গ্রন্থ রচনা করে।’

আমি যদিও এই লেখিকাকে জানি না, কিন্তু এই গল্প আমাকে অত্যন্ত আকর্ষণ করল, গল্পটি আমার মনে গেঁথে গেল। আমি আমার হারিয়ে যাওয়া সময়গুলোর দিকে তাকালাম, তাকালাম সেই লেখিকার প্রতিভা ও কর্মের দিকে। নিজেকে খুব ছোট মনে হল।

আবু আলী মুসলমানদের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক কিছু উল্লেখ করল, তার কথায় আমাদের হতাশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেল।

আমি তাকে বললাম, হে আবু আলী, তুমি যা বল, তার অধিকাংশই সত্য ও বাস্তব। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে এখনো কল্যাণ টিকে আছে। এই কল্যাণ কখনো শেষ হবার নয়। বর্তমান সময়ে মুসলমানদের জন্য যা অতীব প্রয়োজন, তাকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি।

প্রথমত: দীনের ব্যাপারে প্রতিটি মুসলমানের অর্পিত দায়িত্ব সকলে ন্যূনতম পক্ষে পালনের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। আমাদের চোখে এমন কোন মুসলমান নেই, যে পরিপূর্ণ অক্ষম, কর্মশক্তিশূন্য ও মূর্খ, যে কিছুই জানে না, এবং কিছু করার ক্ষমতা রাখে না।

তুমি দেখবে, কেউ হয়তো সালাতের ওয়াজিবগুলো সম্পর্কে অবগত, অপর কেউ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ সম্পর্কে এবং তা প্রয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে, অন্য কেউ হয়তো দীনের কিছু কিছু জ্ঞান রেখে নিজের জানার পরিধিকে বাড়িয়ে নিয়েছে। এদের প্রত্যেকে যদি তার ভূমিকা যথাযথ পালন করে, আপন ক্ষমতা অনুসারে কাজ করে যায়, তবে অবশ্যই চারদিকে সৎ আবহের প্রসার ঘটবে। সুতরাং, নিজেকে কখনো ছোট ভাবার কোন কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত: পৌঁছে দেয়া। এটি ছিল রাসূলদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। তাদের পর এ দায়িত্ব অর্পিত হয় আলিম সমাজ ও যারা জ্ঞাত তাদের উপর। হাদীসে এসেছে : আবু কাবশা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে পেঁŠছে দাও, এমনকি একটি বাণী হলেও। বনী ইসরাঈল থেকে তোমরা বর্ণনা কর, কোন সমস্যা নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে যে আমার উপর মিথ্যা বলবে, সে যেন জাহান্নামে তার অবস্থান ঠিক করে রাখে।’ [বুখারী : ৩৪৬১]

আরো স্পষ্ট করে বলবে, এ হচ্ছে এমন ব্যক্তির জন্য দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া, যে তার দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে মোটেও জ্ঞাত নয়। কখনো কখনো হয়তো তোমার নিকট এমন কিছু উন্মোচিত হয়ে যাবে, যা তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানীর নিকটও উন্মোচিত হবে না।

হে আবু আলী, তুমি এখন আমাকে আহলে ইলমের আমানতদারী সম্পর্কে বলছ, এবং সে নারীর গল্প শোনাচ্ছ, যে ইসলাম গ্রহণ করে সে সম্পর্কে লেখালেখি করেছে, প্রভূত সেবা করেছে। এগুলো, সন্দেহ নেই, আমার ভিতর প্রেরণা হয়ে কাজ করবে। হাটে-বাজারে যে সকল লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের সম্পর্কে আমাকে জানিয়ে তাদের দায়িত্বের কথা তুলছ। যদি তুমি এই চিন্তাকে লালন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিকট নিয়ে যেতে কিংবা এমন কোন সংস্থার নিকট নিয়ে যেতে যারা অমুসলিমদেরকে দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত, অবগত করতে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে, যে ভাষায় তুমি আমাকে এগুলো বলেছ, ঠিক সে ভাষাতেই, তবে তা অবশ্যই তোমার জন্য সৎকাজের প্রতি ইঙ্গিতকারীর সওয়াব বয়ে আনত।

হে আবু আলী, অধিকাংশ মানুষের মনে, যখন তারা এই সমস্ত বাজারী লোকদের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করে, দুটি বিষয় হামলে পড়ে, তৃতীয় কোন বিষয় তাদের মনে, এমনকি, উঁকিও মারে না। বিষয় দুটি হচ্ছে : ব্যবসা এবং লাম্পট্য। কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদেরকে দাওয়াত প্রদান? নিশ্চিত থাক, এই কথা তাদের কারো মনেই আসে না।

আবু আলী, কি এমন ক্ষতি হত, যদি এই অবার্চীন লোকদের জন্য আমরা জ্ঞানমূলক কোন বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম? যদি তাদের সামনে ইসলাম সম্পর্কে আরো অবগতির জন্য কোন অডিও বা ভিডিও উপস্থাপন করা হত, তবে কি মোটেও লাভ হত না? যদি তাদের মাঝে ইসলামের প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে লিখিত কোন পুস্তক বিতরণ করা হত, তাহলে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে যেত?

কী এমন ক্ষতি হত?

এগুলো কি তাদের বিপুল কল্যাণ বয়ে আনত না?

হাটে-মাঠে-বাজারে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া ছিল আমাদের দায়িত্ব, বাজারগুলোতে আমরা বিভিন্ন ঘোষণা টানিয়ে দিতে পারতাম, পারতাম বিমান বন্দরগুলোতে দাওয়াতী লিফলেট বিতরণ করতে।

হে আমার দরিদ্র ভাই, আমি জানি, তুমি ফতওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখ না, কোন কিছু না জেনে আল্লাহ ও আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত সম্পর্কে উক্তি করতে তোমার অনেক ভয়। কিন্তু এগুলো দায়িত্ব এড়ানোর মত কোন যুক্তি না, এই মহান দায়িত্ব থেকে তা তোমাকে কোনভাবেই মুক্তি দিবে না। তোমার পক্ষে কি এতটুকু সম্ভব নয় যে, প্রতিদিন যেখানেই যাও, কল্যাণকর কোন বিষয়ের আলোচনা উত্থাপন করবে এবং এ ব্যাপারে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করবে?

হাঁ, এটি তোমার পক্ষে সম্ভব, কিন্তু পদ্ধতি কি হবে?

তুমিই তোমার আচরিত পদ্ধতি ঠিক করবে, তবে অবশ্যই আল্লাহর ইচ্ছাকে সম্মুখে স্থাপন করে, বিষয়টির ফলাফল নিরূপন করে। তোমাকে জানতে হবে, সাধারণ লোক সমাগমের এলাকায় কোন নির্দিষ্ট আলোচ্য বিষয় থাকে না, যে ব্যক্তিই প্রথমে প্রসঙ্গ তুলবে, সেই হবে উক্ত আলোচনার প্রধান ব্যক্তি। এমনিভাবে প্রসঙ্গ বদলানোও সেখানে অতীব সহজ একটি কাজ। হিকমত বা কান্ডজ্ঞান যাই বলো না, কেবল তা থাকলেই চলবে।

তুমি কি খুব সাধারণ কেউ? তবে তোমাকে বলছি, তোমার পক্ষে কি এমন সম্ভব নয় যে, তুমি তোমার বাড়ীতে একটি অডিও আর্কাইভ গড়ে তুলবে, যাতে অসংখ্য প্রয়োজনীয় ও উপকারী সিডি থাকবে। কিছু থাকবে পিতা-মাতার সাথে অসদাচারণ ও তার পরিণতি সংক্রান্ত, কিছু থাকল আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা সম্পর্কে, তৃতীয় একটি থাকল, যাতে থাকবে মন্দের সামনে চুপ থাকার পরিণতি সম্পর্কে- ইত্যাদি ইত্যাদি।

তুমি এ থেকে কাউকে কাউকে শুনতে দিবে, তাকে প্রয়োজনীয় সিডি দিয়ে সহযোগিতা করবে। এতে দেখা যাবে, একদিন তুমি আলিমদের কথা শ্রবণ করে নিজেই একজন ভালো বক্তা হয়ে যাবে, বরং তুমি তোমার কর্মে অনেক আলিমকে একত্রে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে।

এ স্তরে পৌঁছতে সক্ষম না হলেও, নিদেনপক্ষে তুমি এই সব বিষয় সম্পর্কে অবগতি লাভ করবে, প্রয়োজনগ্রস্ত কারো কাছে এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে।

৬০
আলিম ও দায়ীদেরকে উপস্থিত করা
তোমার পক্ষে কি এটা সম্ভব নয় যে, তুমি আলিমদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করবে, তাদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবে এবং তোমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন কল্যাণকর বিষয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করবে? তুমি এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতে পার, এতে নিশ্চয় বিপুল সওয়াবের অধিকারী হবে।

তোমাদের মসজিদে সাপ্তাহিক বৈঠকের আয়োজন করতে পার। নিয়ত, পরিশ্রম, উপকার অর্জন, উপস্থিতি এমনকি কেবল বৈঠক প্রস্ত্ততের মাধ্যমে তুমি সওয়াবের অধিকারী হবে, সন্দেহ নেই। হাদীসে এসেছে :

عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه، قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( الأعمال بالنية، ولكل امرئ ما نوى، فمن كانت هجرته إلى الله و رسوله فهجرته إلى الله و رسوله، و من كانت هجرته لدنيا يصيبها أو امرأة يتزوجها فهجرته إلى ما هاجر إليه .

‘উমর ইবনে খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আমল বিচার্য নিয়ত অনুসারে, যে যা নিয়ত করবে তাই পাবে, যে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের জন্য হিজরত করবে সে আল্লাহ ও অল্লাহর রাসূলের দিকেই হিজরত করল আর যে পার্থিব কোনো স্বার্থ হাসিল করা বা কোনো নারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করল সে যে জন্য হিজরত করেছে তাই পাবে।’ [বুখারী : ৫৪]

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাওফীক দান করেন, বাড়িয়ে দেন যাকে ইচ্ছা তাকে। তোমার কী ধারণা, যদি এই বৈঠক অব্যাহত থাকে, এখান থেকে জ্ঞানের ধারা ছড়িয়ে পড়ে তা কি তোমার ইহকাল ও পরকালে সৌভাগ্য বয়ে আনবে না?

যার প্রয়োজন রয়েছে এবং যে উপকার লাভে আগ্রহী, তাকে তুমি প্রয়োজনীয় সাময়িকী ও ইসলামী পত্রিকা দিয়ে সহযোগিতা করতে পার। আমি এমন অনেক ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে অবগত আছি, যাতে কোন ইসলামী পত্রিকা পৌঁছে না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রজনিত সমস্যার কারণে এমন ঘটে। হয়তো যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করা হয় না, কিংবা তাদের কাছে এই আবেদনই পেশ করা হয় না।

তুমি এমন কারো সন্ধান বের করো, যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কারো কাছে উক্ত পত্রিকা ও সাময়িকীগুলো হাদিয়া হিসেবে পেশ করবে। যখন সে তা পাঠ করবে, এবং তা থেকে উপকার লাভ করবে, সে অবশ্যই মন্ত্রীর কাছে তা তুলে ধরবে, এভাবে তার থেকে অনুমোদন আদায় করা যাবে।

হে আমার ভাই, সাধারণ বলে তুমি নিজেকে হীন ও ছোট মনে কর না। হয়তো তুমি তোমার নিয়তের শুদ্ধতার ফলে আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবে, তিনি তোমাকে এমন সাওয়াব দান করবেন, যা কখনো কখনো আলিম ও দায়ীর ভাগ্যে জুটে না।

আমি তোমাকে একটি গল্প শোনাচ্ছি, বিশ্বস্ত একজনের মারফত এ সত্য গল্পটি আমি শুনেছি। ঘটনাটি ভারতের, ঘটেছে ১৯৯২ সালে।

একবার আগ্রহী কয়েকজন দায়ী দীনের দাওয়াত নিয়ে ভারতে গমন করল। একদিন তারা হিন্দুদের মন্দীরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের একজন পাহাড়ী লোক দাঁড়িয়ে কথা বলতে আরম্ভ করল। সেখানে উপস্থিত এক হিন্দু এগিয়ে এসে তার সাথে বিতন্ডা শুরু করল, ফলে পুলিশ এসে উপস্থিত হল। বিষয়টি, এমনকি, আদলত পর্যন্ত গড়াল। চারদিকে খবর ছড়িয়ে গেলে অনেক লোক এসে জড়ো হল। পত্রিকার সাংবাদিকরা এসে পড়ল, এভাবে রীতিমত একটি জমায়েত হয়ে গেল আদালত অভ্যন্তরে। এ খবর পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। সে এলাকার মুসলমাগণ এগিয়ে এলো, তারা উক্ত দায়ীর পক্ষে উকীল নিয়োগ দিল। উক্ত উকীল ছিলেন একজন দায়ী, ফকীহ ও দোভাষী। দায়ী সাধারণ কথা বললেও তিনি তাকে বাগ্মী ভাষায়, প্রমাণসহ কাজীদের জন্য অনুবাদ করছিলেন, একে তিনি অমুসলিমদের জন্য দাওয়াত হিসেবে পেশ করছিলেন। সংবাদপত্রে এ খবরগুলো বিস্তারিত আকারে ছাপা হয়েছিল। এর ফল কী দাঁড়িয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে কী সম্ভব তা সেদিন প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল।

সেটি ছিল তালাবদ্ধ অনেক অন্তরের জন্য উন্মোচন- সত্যের উদ্ঘাটন। হিন্দু ধর্ম থেকে হাজার হাজার লোক এ দাওয়াতের ফলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

তুমি হয়তো বলবে, আমরা তো মুসলিমদের পত্র-পত্রিকায় এ সংবাদ পাইনি।

আমি বলব, তুমি তাতে এ ধরনের কোন সংবাদই পাবে না, কিন্তু আল্লাহ তাআলা উক্ত সাধারণ ব্যক্তির পক্ষ এ পরিশ্রম ও আবেগটুকু কবুল করেছেন, বরং কবুল করেছেন তার নিয়ত। আল্লাহ যদি কোন কিছু ইচ্ছা করেন, তবে তা অবশ্যই সংঘটিত করেন।

সাধ্যমত ইলমের অনুসন্ধান থেকে তুমি কখনো মুক্ত হবে না। তবে, ইলমের অনুসন্ধানের পূর্বে ও মধ্যবর্তী সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে তোমাকে অবশ্যই যা জেনেছ, তা পৌঁছে দিতে হবে। আল্লাহর ইচ্ছাই তোমার জন্য তাওফীকের বন্দোবস্ত করে দিতে পারে। অন্তরের অন্তস্তল থেকে তুমি আল্লাহর জন্য ইখলাস ও সততা, দৃঢ়তা ও অটল মনোবল পেশ কর, আল্লাহ তোমাকে মানুষের মাঝে অবস্থান দান করবেন। বরং, তোমাকে তোমার অবস্থানে স্পষ্ট বিজয় ও মহা সাফল্য দিবেন। তুমি কি আল্লাহর সে বাণী পড়নি? কুরআনে এসেছে-

إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ ﴿1﴾

‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এল’। [সূরা নাছর : ১]

আমি কেবল অশিক্ষিত সাধারণ লোকদের প্রতিই ইঙ্গিত করছি না, কারণ, এমন অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক আছেন, যারা জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ধর্মীয় ও শরয়ী জ্ঞানে অশিক্ষিত ও মূর্খ...তার স্ত্রী যদি তাকে তার বিশেষ অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করে এবং শরীয়তে মাসআলা সম্পর্কে জানতে চায়, কিংবা সন্তান তাকে বালিগ হওয়ার হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তবে সে তাদেরকে কিছুই বলতে পারবে না।

এই সাধারণ শ্রেণীর প্রতি আমাদেরকে আরো মনোযোগি হতে হবে, তারা তো আমাদেরই পিতা কিংবা মাতা।

৬১
দ্বাদশ বপন: ডাক্তার
وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ ﴿80﴾

‘আর যখন আমি অসুস্থ হই, তখন তিনিই সুস্থতা দান করেন’। [সূরা শুআরা : ৮০]

وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا .

‘আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল।’ [সূরা মায়িদা : ৩২]

يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآَ × يَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ﴿69﴾

‘তার উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয় ; যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। অবশ্যই এতে এমন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিমত্মা করে’। [সূরা নাহল : ৬৯]

عن أم الدرداء رضى الله عنها، عن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : إن الله خلق الداء و الدواء، فتداوا، و لا تتداوا بحرام .

‘উম্মে দারদা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আল্লাহ ব্যধি এবং তার সাথে ঔষধও সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তোমরা ঔষধ গ্রহণ কর এবং কোনো হারাম জিনিস ঔষধ হিসেবে ব্যবহার কর না’। [তাবরানী : ৬৪৯]

عن ابن مسعود رضي الله عنه، أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : ما أنزل الله داء إلا قد أنزل له شفاء، علمه من علمه و جهله من جهله .

‘ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আল্লাহ যে সব ব্যধি নাযিল করেছেন, তার সাথে তার নিরাময় ব্যবস্থাও রেখেছেন। কেউ তা জানে অনেকে জানে না’। [মুসনাদ : ৩৫৭৮]

একটি মাত্র সংস্থা, যা গঠিত হবে ডাক্তারদের নিয়ে, তাদের সম্পর্কে এ লেখার সার্থকতার জন্য যথেষ্ট। ডাক্তারদের নিয়ে গঠিত এই দাওয়াতী সংস্থা অবশ্যই হবে এক মহান সাদাকায়ে জারিয়া, যা তোমাকে দীর্ঘ পথ চলতে এবং আপন লক্ষ্যে উপনীত হতে সাহায্য করবে। এই সংস্থার একক লক্ষ্য হবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন, ইসলামের সাহায্য ও তাকে রক্ষার ফলপ্রসু পদ্ধতি অবলম্বন, মুসলমানদের স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর আশ্রয় লাভ। নির্দিষ্ট একটি কর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি সম্পন্ন হতে পারে। নিম্নে আমরা এর কিছু অবস্থা তুলে ধরার প্রয়াস পাব :

ইসলামে চিকিৎসার মৌলিক বোধকে শরীয়তের বিধানের আলোকে বিশুদ্ধ করণ, চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে আছে যে বিভ্রান্তি ও ভুল বিশ্বাস তা দূর করার জন্য কার্যকরী কর্মপন্থা গ্রহণ, উন্নত চিকিৎসার অধিকারী কেবল অমুসলিমগণ, মুসলমানগণ তা কখনো পেতে পারে না, এই ফ্যাসিষ্ট আচরণকে সামাজিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

চিকিৎসা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের নানাবিধ নীতিমালাকে শরয়ী ভিত্তি প্রদান, এর জন্য সর্ব প্রথম যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্রে ইতিপূর্বে যা যা লিখিত হয়েছে তা একত্রিত করা এবং গবেষণা সংস্থা, ইসলামী আইন বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চতর গবেষণা বিভাগগুলোকে পাশাপাশি সহায়তা প্রদান করা।

অন্যান্য চিকিৎসা সংগঠনগুলোর প্রতিরোধ করা, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে চিকিৎসার পোশাক চড়িয়ে ইসলামী দেশে ইসলাম বিরোধী বিশ্বাসের বীজ বপন।

বিপন্ন মুসলিমদেরকে চিকিৎসাসেবা দান।

ইসলামী রাষ্ট্রে চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো কীভাবে মুসলমানদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, পঙ্গু করে দিচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সে সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি করা।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলো চিকিৎসাসেবা বিস্তারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ; হয়তো তা নতুন মুসলিম ডাক্তার তৈরির জন্য বিস্তৃত ভবিষ্যত পরিকল্পনার মাধ্যমে হতে পারে, কিংবা অমুসলিম ডাক্তারদেরকে ইসলামের আহবান এবং মুসলিম করে নেয়ার মাধ্যমেও হতে পারে।

চিকিৎসা পেশাকে দাওয়াত ইলাল্লার কাজে ব্যবহার করা। রোগীদের মাঝে তারা ছড়িয়ে দিবে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ভরসার মানসিকতা। আল্লাহর ইচ্ছায় এটিই হবে তাদের রোগমুক্তির সর্বোত্তম ও মৌলিক উপায়।

দরিদ্র মুসলিম দেশগুলোতে হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, এটি স্থায়ী বা অস্থায়ী- যে কোন ধরনের হতে পারে। অধিকাংশ দেশে ঔষধ, পর্যবেক্ষণ ও ঔষধকেন্দ্রের অভাবে স্বাস্থ্য সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে।

স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্য সচেতনা প্রকল্পে বিশেষ সহায়তা প্রদান। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর জন্য কয়েকটি বিষয় প্রয়োজন : যেমন-

প্রথমত: শরীয়তের বিচারে ইসলামী আকীদা, বিশ্বাস ও বোধ বিরোধী বিষয়গুলো থেকে স্কুলের পাঠ সিলেবাসকে পুনর্বিন্যাসে সহায়তা প্রদান।

দ্বিতীয়ত: স্কুলের পাঠ সিলেবাসের প্রাকটিক্যাল বিষয়গুলোকে ইসলামী আইনের মৌলনীতিমার আলোকে যাচাই ও বিন্যাস প্রদান, যাতে ধর্মনিরেপক্ষ কোন শিক্ষক ছাত্রদের মাঝে অপবিশ্বাস ছড়াতে না পারে।

তৃতীয়ত: পাঠ সিলেবাসের সাথে সমঞ্জস্য করে এমন কিছু পুস্তিকা রচনা করা, যাতে চিকিৎসা শাস্ত্রের মৌলিক ও প্রাথমিক নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা থাকবে, এবং যার মাধ্যমে ছাত্রদের মানসিকতা, বিশ্বাস দৃঢ় ও বিশুদ্ধ হবে। পাঠ সিলেবাসে এটি হবে একটি নতুন পুস্তক এবং অন্যান্য শাস্ত্রের বিচারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

চতুর্থত: প্রাকটিক্যাল বিষয়গুলোতে তারা একাডেমিক গবেষকদেরকে সহায়তা প্রদান করবেন এবং তাদের উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ ব্যাপারে একটি নতুন পাঠ সিলেবাস তৈরি হবে।

নিম্নে আমি কয়েকটি কর্মপদ্ধতি তুলে ধরছি, পাঠক, যে এগুলো বাস্তবায়ন করবে কিংবা যার সাথে তুমি এগুলো বাস্তবায়ন করবে, তুমি তাকে এগুলো পৌঁছে দিতে পার।

প্রথমত: কুরআনে এসেছে :

سَنُرِيهِمْ آَيَاتِنَا فِي الْآَفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ﴿53﴾

‘বিশ্বজগতে ও তাদের নিজদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, এটি (কুরআন) সত্য; তোমার রবের জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কি যে, তিনি সকল বিষয়ে সাক্ষী?’ [সূরা ফুসসিলাত : ৫৩]

শাইখ আব্দুল্লাহ যানদানীর তিনটি ভিডিও আমার নজরে পড়েছে, আল্লাহ তাকে উত্তম জাযা দান করুন। ভিডিও তিনটিতে সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ, তার গুঢ় রহস্য ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে আল্লাহর একত্বের প্রমাণ বহন করে। অমুসলিম বিশিষ্ট কয়েক বিজ্ঞানীর সাথে টেলিভিশনে তার আলোচনা ও কথোপকথন দেখেছি, এ বিজ্ঞানীগণ প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি তাদেরকে বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট কোন বিষয় বা সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন, তারা এর উত্তর দিত। সূত্রগুলো বিজ্ঞাসম্মত এ পর্যায়ে পৌঁছতে গবেষণার ইতিহাসের কী কাঠখর পোহাতে হয়েছে, তার প্রশ্নের বিষয়বস্ত্ততে এটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। অত:পর তিনি তাদেরকে দেখিয়ে দিতেন, কুরআন বহু আগেই এই সূত্রের প্রতি ইঙ্গিত করেছে, তাদের ধারণার আগেই কুরআন তা জ্ঞান আকারে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে। উপস্থিত জ্ঞানীরা তাকে এর প্রামাণ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কুরআনের আয়াত উল্লেখ করে তা ব্যাখ্যা করে দিতেন। এ আলোচনার ফলে তাদের কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করত, কেউ বিষয়টি মেনে নিত। এবং যারা শ্রোতা, বৃদ্ধি পেত তাদের ঈমান ও বিশ্বাসের ভিত্তি।

এটি একটি মাত্র ক্ষেত্র ডাক্তার ও চিকিৎসকগণ যে ক্ষেত্রে সক্রিয় অবদান রাখতে পারেন। আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরা এই সেবা দিতে কোনভাবেই অক্ষম নন, বরং, তারা একে অধিক পরিশুদ্ধ ও পরিস্রুত আকারে হাজির করতে পারবেন, তাদের উপস্থাপন হবে আরো কার্যকর। এমনিভাবে, এ ময়দানে আলোচিত অন্যান্য মহান ব্যক্তিদের থেকে তারা উপকৃত হতে পারেন ; শাইখ আব্দুল মাজীদ, ডক্টর আহমাদ শাওকী ইবরাহীম এবং ডক্টর আল্লামা যগলুল নাজ্জার ইত্যাদি মহান ব্যক্তিগণ হতে পারেন তাদের জন্য উত্তম আদর্শ।

‘কুরআন ও বিজ্ঞান’ শিরোনামে কুয়েতী টেলিভিশনে প্রচারিত ডক্টর আহমাদ শাওকীর প্রোগামগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং দর্শকদের ঈমান ও বিশ্বাসের বৃদ্ধিতে তা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

এগুলো ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও পরিশ্রমের ফসল, আল্লাহ তাদেরকে উত্তম জাযা দান করুন।

সুতরাং, যদি চিকিৎসকদের আগ্রহী দল সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেন, তবে কী ফল দাঁড়াবে, তা বলাই বাহুল্য। তারা বিশ্বব্যাপী দাওয়াতী প্রোগ্রামের কার্যক্রম হাতে নিতে পারেন, যা বিভিন্ন ভাষায় পরিচালিত হবে এবং বিজ্ঞানের আলোকে নির্মিত হওয়ার ফলে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যা অন্যান্য কাজে আমাদেরকে সহায়তা দিবে।

দ্বিতীয়ত: সুন্নাত ও শরীয়তসম্মত চিকিৎসার পুন: অনুশীলন ও সামাজিকভাবে তাকে প্রতিষ্ঠাকরণ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকরদের সাথে আমি বেশ কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হয়েছি। হাদীসনির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারীতার ব্যাপারে তারা আমাকে অবহিত করেছেন, এবং এ ব্যাপারে তাদের নিশ্চয়তার কথা আমাকে জানিয়েছেন। বিষয়টি, সন্দেহ নেই, খুবই চমকপ্রদ একটি ব্যাপার।

হাদীসনির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি এক সময় মানুষের কাছে চর্চার বিষয় ছিল, তারা একে জ্ঞান আকারে লালন করত, কিন্তু ক্রমে, কাল ও সভ্যতার বিবর্তনের ফলে এবং মুসলমানদের অবহেলার দরুন তা হারিয়েছে তার চর্চা এবং মানুষ ভুলতে বসেছে এর ব্যবহার ও কার্যকারণ পদ্ধতি।

আমাদের চিকিৎসক বন্ধুগণ একে পুনরায় আলোতে নিয়ে আসতে পারেন, একটি ব্যাপক বিস্তৃত গবেষণা, পূর্নপঠন ও বিন্যাসের মাধ্যমে তারা একে আবার সমাজের সামনে হাজির করতে পারেন। সন্দেহ নেই, সেবার পাশাপাশি এটি তাদের জন্য দাওয়াতের সুফল বয়ে আনবে।

চিকিৎসকরদের জন্য সময় উচ্চকণ্ঠে সাহসের এমন কথা বলবার, যা দ্ব্যর্থহীন সত্যের প্রকাশ করবে এবং সত্যের বাণীকে সুমহান করে তুলবে। বৃদ্ধি পাবে মুমিনের বিশ্বাস, স্তব্ধ করে দিবে পরশ্রীকাতর ইসলাম বিরোধী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও প্রপাগান্ডা।

বিশ্বে নানা চিকিৎসাপদ্ধতি আছে, চীনা ন্যাচারাল ট্রিটম্যান্টের আদলে অকুপেশন পদ্ধতিকে এক প্রকার শাস্ত্রীয় রূপ প্রদান করা হয়েছে, অথচ তাদের সমাজিকভাবে ঐতিহাসিক চর্চা ব্যতীত এর কোন ভিত্তি নেই। আর আমাদের ইসলামী চিকিৎসাপদ্ধতি ওহী দ্বারা সত্যায়িত, কোন ভিত্তি ছাড়া যার একটি উচ্চারণও নেই।

সেঁক পদ্ধতি, শিঙ্গা, কালোজিরা, মধু, উটের মূত্র ও দুধ ইত্যাদি সবই হাদীসের চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। এ সবের ব্যাপারে লিখিত গবেষণাগুলো কোথায়? এ সবের ভিত্তি করে যে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছে, তা কি কাজে লেগেছে? হাসপাত, বরং, স্কুলগুলো এ সব পদ্ধতির প্রতি কি মোটেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়? ইসলামী চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়, তাদের দৃষ্টিতে এগুলো কি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়? সুতরাং, হে চিকিৎসক বন্ধুরা, তোমরা ব্যতীত এ মহান দায়িত্ব কেউ পালন করবে না।

তৃতীয়ত: আমি মনে করি, চিকিৎসক বন্ধুদের সাথে সংবাদপত্র ও মিডিয়া সেকশনের যোগাযোগ অতীব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়, যাতে মুসলিম শিশুদেরকে ভিকটিম বানিয়ে যে সমস্ত নিরীক্ষা চালানো হয়, তা সকলের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া যায়। নতুন যে দায়ীগণ দাওয়াতের ময়দানে আত্মনিয়োগ করেছেন, জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ হলেও তাদের উদ্দেশ্য বিশুদ্ধ ও আল্লাহর জন্য নিবেদিত, চিকিৎসকগণ তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেবে এবং একটি ফলপ্রসু ধারাবাহিকতা আনয়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

চিকিৎসা সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ ও শাস্ত্রসম্মত কার্যক্রম তোমরা কেন হাতে নিচ্ছো না, যা একই সাথে টেলিভিশন, প্রচার মাধ্যম, সংবাদপত্র, বই-পত্র প্রকাশনা, অডিও ও ভিডিও ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিস্তৃত থাকবে?

তোমাদের কাছে এমন কোন আর্কাইভ নেই কেন, যাতে ইসলামী চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর সত্যতা ও তার প্রায়োগিক শুদ্ধতার আলোচনা থাকবে, যেমন মিসওয়াকের ব্যবহার? এ ব্যাপারে বিপুল পরিমাণে লেখা হয়েছে, এগুলো তোমাদের সংগ্রহে থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

চতুর্থত: ব্যাপকভাবে মানুষের মাঝে এবং বিশেষভাবে মুসলমানদের মাঝে যাদু ও ভেলকিবাজির প্রতি নির্ভরতা ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি তা চিকিৎসা পদ্ধতি ও শরীয়ত প্রবর্তিত চিকিৎসা ব্যবস্থা মিশে যাচ্ছে। বিপদের ব্যাপার হচ্ছে : মানুষ একে ইসলামের নামে গ্রহণ করছে এবং তাকে ভাবছে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। এর পক্ষ হয়ে সোৎসাহে তারা লড়ছে।

এরা দু দলে বিভক্ত হয়ে মানুষের কাছে হাজির হয়, একদল শরীয়তের পোশাক পড়ে, শরীয়তের বিচারে যাদের অসারতা খুবই সিদ্ধ ও প্রমাণিত ; অপর দল ডাক্তারের পোশাক চড়িয়ে, যাদের ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীর মাঝে কেবল নেতিবাচক প্রভাবই বৃদ্ধি পায়। তুমি কেন বিষয়টি নিয়ে তোমার চিকিৎসক বন্ধুদের কাছে যাচ্ছ না, তাদেরকে বিষয়টি বোঝাতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছো না?

আমি বলছি না যে, এখুনি ইসলামের চিকিৎসা সেবার পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন হাসপাতাল প্রস্ত্তত করতে হবে। কারণ, আমরা এখনো পথের সূচনাতে রয়েছি।

হে আমার ডাক্তার বন্ধুরা, যদি তোমরা দেখতে পাও যে, তোমাদের সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত এ কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে, এবং এই ময়দানে ইসলামের দাওয়াতী কাজ সহজে পূর্ণ হচ্ছে, তবে তোমরা এ পথ ছেড়ে দাও, আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তোমরা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ, এ বিষয়টি একান্তভাবেই তোমাদের সাথে সংশ্লিষ্ট, সুতরাং যে ব্যাপারে তোমাদেরকে ইলম প্রদান করা হয়েছে, তার সঠিক প্রয়োগের ব্যাপারে তোমরা অবহেলা কর না, বিনষ্ট কর না আল্লাহর পথে দাওয়াতের সুযোগ। মুসলিম সমাজ তোমার নিকট অনেক কিছুর আশা করে আছে।

প্রথমে আমরা আল্লাহর কাছে, পরবর্তীতে তোমাদের কাছে আমাদের আশা থাকবে যে, তোমরা ইসলামী দেশগুলোতে পুনরায় চিকিৎসা ব্যবস্থার বিন্যাসে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে, আন্তর্জাতিক মানসম্যত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সেবার বিপুল সুযোগ করে দিবে।

৬২
ত্রয়োদশ বপন: মায়েদের মাঝে
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ﴿23﴾

‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।’ [সূরা ইসরা : ২৩]

وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ ﴿14﴾

‘আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।’ [সূরা লুকমান : ১৪]

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : جاء رجل إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال : من أحق الناس بحسن صحابتي ؟ قال : أمك . قال : ثم من ؟ قال : ثم أمك . قال : ثم من ؟ قال : ثم أمك . قال ثم من ؟ قال : ثم أبوك .

‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : একজন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল : আমার ভাল আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশী হকদার কে? তিনি বললেন তোমার মা। সে বলল : তারপর কে? তিনি বললেন তোমার মা। সে বলল : তারপর কে? তিনি বলেন : তোমার মা। সে বলল : তারপর কে? তিনি বললেন : তোমার বাবা।’ [বুখারী : ৫৯৭১]

মা, সাদাকায়ে জারিয়ার অনন্ত উৎস। উত্তম আদর্শ তৈরির ক্ষেত্র। হৃদয়বৃত্তির প্রশস্ত আঙ্গিনা। তিনি এ ব্যাপারে এক ও একক। তার হৃদয়ের সবুজ শ্যামল আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য অঙ্কুর, প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, এগুলো কর্ষণ করে তুমি হয়ে উঠতে পার অবিস্মরণীয় কিছু। কেন নয়? তিনিই তো তোমাকে দুগ্ধ পান করিয়েছেন, তার কোল জুড়ে তুমি তোমার প্রথম আলো দেখার দিনগুলো কাটিয়েছ, তিনিই সর্বপ্রথম তোমার মাঝে হৃদয়বৃত্তির উন্মেষ ঘটিয়েছেন। তোমার জীবনের সেই আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত তিনিই মুকুটহীন শাসক, এর সূচনা-সমাপ্তির অনেক কিছুই হাতে গড়া। তিনিই প্রথম ও শেষ কণ্ঠস্বর, যার সাড়ায় সন্তান জেগে উঠে ও প্রশান্তির ঘুমে তলিয়ে যায়, মাঝে জীবনের রঙিন কিছু ফানুস উড়তে দেখে।

মা, তুমি যদি তোমার সন্তানকে সত্যিই ভালোবাস, ভালোবাস তোমার স্বামী ও পরিবার, তাদেরকে একত্রে দেখতে পছন্দ কর, তবে জেনে নাও ঐক্যের সূত্র, যে ঐক্যের পরে কোন বিচ্ছেদ নেই, জান্নাতের সুখময় আবাস অবধি যে ঐক্যের পরিধি বিস্তৃত। কুরআনে এসেছে :

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ ﴿21﴾

‘যারা ঈমান আনে এবং তাদের সমত্মানরা ঈমানে তাদের অনুগামী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সমত্মানদেরকে এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কর্মের জন্য দায়ী’। [সূরা তূর : ২১]

দুনিয়ার জীবনের বিচ্ছেদ ও তার সমাপ্তি অবশ্যই ঘটবে, জিবরাঈল আ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে তার ওসিয়তে যেমন বলেছিলেন। নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষ্য কর :

فعن سهل بن سعد صلى الله عليه و سلم قال : جاء جبريل إلى النبي صلى الله عليه و سلم فقال : يا محمد عش ما شئت فإنك ميت , و أحبب من شئت فإنك مفارقه , و اعمل ما شئت فإنك مجزي به , و اعلم أن شرف المؤمن قيام الليل , و عزه استغناؤه عن الناس .

‘সাহাল ইবনে সাআদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : জিবরিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন : মুহাম্মাদ ! যত ইচ্ছে বেঁচে থাকুন কারণ একদিন আপনি অবধারিতভাবে মারা যাবেন, যাকে ইচ্ছে ভালবাসুন, একদিন আপনার তাকে ছাড়তেই হবে। যা ইচ্ছে আমল করুন, আপনাকে তার প্রতিদান দেওয়া হবে এবং জেনে রাখুন মুমিনের মর্যাদা রাত জাগায় এবং সম্মান অন্যদের থেকে অমুখাপেক্ষী থাকায়’। [তাবরানী : ৪২৭৮]

সুতরাং দুনিয়ার জীবনকে উপলক্ষ্য করে কি মতবিরোধ ও খুনোখুনি কোনভাবেই উত্তম ও ফলপ্রসু কিছু? এ কি কারো জীবনের লক্ষ্য ও শেষ উদ্দেশ্য হতে পারে?

সাদাকায়ে জারিয়ার বপন সংক্রান্ত আলোচনার সূচনার পূর্বে তোমার জেনে নেয়া উচিৎ, যতক্ষণ না পিতা ও মাতা এক আত্মা হয়ে সন্তানের সামনে নিজেদেরকে উপস্থিত করে, সততা ও তাকওয়ার উপর শপথ করে, ততক্ষণ তাদের মাঝ থেকে ভালো কিছুর জন্ম নেয় না, বরং, তাদের একে অপরকে ক্রমাগত শেষ করে যায়। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকর যে বিষয়টি, তা হচ্ছে, তালাক ও বিচ্ছেদ ব্যতীতই একই বাড়ীতে, একই ছাদের তলায় থেকে মা বাবা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। অধিকাংশ সময়েই তাদের পরস্পরের বিরোধের আসল কারণ থাকে সন্তান।

এ পথে তোমার যাত্রার সূচনা হবে শরীয়ত ও ইসলাম বিরোধী প্রতিটি বিষয় ত্যাগ করার মাধ্যমে। সুতরাং তুমি পার্থিবের পিছনে অনর্থক ছুটে বেরিয়ো না, বল্গাহীন সাজ-সজ্জা করে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, কারণ, বাহ্যিক প্রকাশের প্রতি লালায়িত হয়ে তুমি যতটাই দিকহারা হবে, ততটাই আখিরাতের প্রতি তোমার মনোযোগ বিনষ্ট হবে। কুরআনে এসেছে :

يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآَخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ ﴿7﴾

‘তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে তারা গাফিল।’ [সূরা রূম : ৭]

অপর স্থানে এসেছে :

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا ﴿28﴾

‘আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে। তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। আর ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার যিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে।’। [সূরা কাহফ : ২৮]

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا ﴿28﴾ وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآَخِرَةَ فَإِنَّ اللهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا ﴿29﴾

‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে বল, ‘যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা কর তবে আস, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালীন নিবাস কামনা কর, তবে তোমাদের মধ্য থেকে সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহ অবশ্যই মহান প্রতিদান প্রস্ত্তত করে রেখেছেন’। [সূরা আহযাব : ২৮-২৯]

সন্তান প্রতিপালন ও পরিবার পরিচালনার মাধ্যমে তুমি যে সাদাকায়ে জারিয়ার সূচনা করতে পার, তার কয়েকটি চিত্র ও পদ্ধতি আমরা নিম্নে তুলে ধরছি।

প্রথমত: সন্তানকে পিতার অনকূল করে গড়ে তোলা। তাকে শিক্ষা দিবে যেন সে পিতার আনুগত্য করে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছা ও সন্তোষের অনুভূতির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে, তার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করে, তার হাত ও মস্তকে চুম্বন করে তার প্রতি আবেগের বহি:প্রকাশ ঘটায়- ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই শিক্ষার মাধ্যমে সন্তান অবশ্যই তোমার প্রতিও যত্নশীল হয়ে উঠবে।

সঠিকরূপে সন্তান প্রতিপালনের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, কোন ভাল কাজ করলে তার স্বীকৃতি প্রদান করা, যেমনই হোক, প্রশংসা করে তাকে এ কাজে আরো উৎসাহ দেয়া। ছোট্ট একটি চুম্বন কিংবা ক্ষুদ্র একটি পয়সার হাদিয়া হলেও একে কখনো অবহেলার দৃষ্টিতে দেখবে না।

দ্বিতীয়ত: নীতিবাচক ও ক্ষতিকর যে কোন বিষয় সন্তান থেকে দূরে রাখা। যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় মা তার সন্তান লালন পালন করবে, তা অবশ্যই মজবুত ও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ইতিপূর্বে খুবই শক্তিশালী ও সুন্দর ছিল, এখন অবস্থা পাল্টে গিয়েছে। বাহিরের জগতের সাথে শিশুর চলাফেরা, রাস্তায় ঘোরাফেরা, স্কুলে গমন, বাজার, সিনেমা- অধিকাংশ সময়- এগুলো শিশুর জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।

পক্ষান্তরে, টেলিভিশন, সংবাদপত্র স্রোতের মত সকলকে এক ভয়াবহ স্থানে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কেবল ওয়াজ-বক্তৃতা ও নসীহত এ স্রোতকে কখনো বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হবে না। এর জন্য প্রয়োজন সত্যিকার কর্মপরিকল্পনা, মা যাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ করবে। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময় ও পরিশ্রম, ক্রমাগত সাধনাই এ ব্যাপারে সন্তানের জন্য উত্তম ফল বয়ে আনতে পারে।

তৃতীয়ত: নিম্নোক্ত কর্ম পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান প্রতিপালন :

পড়াশোনার অনুরূপ জামাআতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে সন্তানকে সর্বদা উৎসাহিত করা।

উত্তম সাহচর্য নির্বাচনের মাধ্যমে মন্দ সঙ্গ থেকে সন্তানকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে পিতার গাইড অধিক আবশ্যক।

উপযুক্ত ও উপকারী অডিও ও ভিডিও নির্বাচন।

গল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অধুনা বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারগুলো সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা।

পুরো পরিবারকে নিয়ে সম্ভব হলে বেড়াতে যাওয়া।

আলাপ আলোচনায় পিতা-মাতার সাথে গোপনীয়তা এড়িয়ে স্বত:স্ফূর্ত থাকার অভ্যাস শিক্ষা দেয়া। এটি খুবই কল্যাণকর একটি বিষয়। সন্তানের সাথে পিতা-মাতা কখনো এমন আলাপচারিতায় সময় দেবে, যখন সে তাদের সামনে তার একান্ত কথাগুলো স্বত:স্ফূর্ত বলে দিবে। বাড়ী কখনো স্কুল নয়, এবং মা-ও স্কুলের টিচার নয়- এ বিষয়টি যেন কোন মা-ই ভুলে না যায়।

বাড়ীতে সর্বদা দীনের ব্যাপারে প্রতিযোগিতামূলক আবেগ বজায় রাখবে।

এভাবে, নোট আকারে যদি তোমাকে সব কিছু দিয়ে দেই, তবে বিশাল কলেবরের হয়ে যাবে। তুমি, বরং, এগুলোর উপর ভিত্তি করে আরো যোগ করে নিতে পার।

চতুর্থত: হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি বিষয় পুনরুদ্ধার এবং কিছু নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন। মায়েদের মাঝে যে সমস্ত ভালো গুণ ছিল, তার অধিকাংশই এখন হারিয়ে গিয়েছে, সে জায়গায় জন্ম নিচ্ছে না সম্পূরক কিছু। এগুলোর পুন:চর্চা ও উদ্ভাবন খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। যে সমস্ত ক্ষেত্রে আরো যত্নবান হতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে হারিয়ে যাওয়া পুরানো আচার, নিম্নে তার কয়েকটি তুলে ধরা হল।

৬৩
লেখালেখি
আমি বলছি না যে, লেখালেখির জন্য মা-কে অত্যন্ত যোগ্য, জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান হতে হবে। শরীয়ত ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাকে বিস্তৃত জানাশোনার অধিকারী হতে হবে। বরং, যেটুকু লেখালেখি তার জন্য প্রয়োজনীয় ও ফলপ্রসু, তার জন্য পড়তে জানা এবং নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করতে পারার আগ্রহ থাকলেই যথেষ্ট। মনের ভাব ব্যক্ত করার জন্য অবশ্যই চর্চা ও পড়াশোনা প্রয়োজন। মায়েরা কী কী বিষয় লেখালেখি করতে পারে, নিম্নে তার তালিকা প্রদান করা হল :

ইতিবাচক হোক কিংবা নেতিবাচক- উপকারী যে কোন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা। ব্যক্তিগত কিংবা অন্য যে কোন অভিজ্ঞতাই তার লেখার আওতাভুক্ত হতে পারে। তবে অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে কোনভাবেই কাউকে হেয় করা কিংবা প্রতিবেশীর মনে কষ্ট দেয়া সমীচীন হবে না। বাস্তব কোন অভিজ্ঞতা যদি সুন্দর ভাষায়, আকর্ষণীয় বর্ণনায় তুলে ধরা হয়, তবে তা কি অতুলনীয় হবে তা বলাই বাহুল্য। গল্প আকারে যে সমস্ত অভিজ্ঞতাগুলো তারা তুলে ধরতে পারে, তা হল, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, সালাত ত্যাগ, অবাধ যৌনাচারের ফল- ইত্যাদি।

আচরণ ও অভ্যাসগত বিষয়গুলো হতে পারে মায়ের লেখার উত্তম বিষয়। আচরণীয় দিকগুলো নিয়ে আলোচনা, সন্দেহ নেই, মায়েদের জন্য অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী একটি ব্যাপার, একে তারা অত্যন্ত সুচারুরূপে বর্ণনা করতে পারেন, তাদের পক্ষ থেকে এ ক্ষেত্রে কাজ করা খুবই প্রয়োজনীয়। নারীদের ক্ষেত্রে গল্প করে বলা যে কোন বিষয় অত্যন্ত কার্যকরী। এটি তাদের মনে গেঁথে যায় জীবনের জন্য। সুতরাং, পূণ্যবতী নারীদের জীবন গাঁথা নিয়ে মায়েরা লেখালেখি করেন, তবে সন্দেহ নেই, তা আরো কার্যকরী হবে। যে সমস্ত গল্প তাদের লেখার প্রতিপাদ্য হতে পারে, তা নিম্নরূপ :

কোন নারীর ধৈর্য ও সমত্মান-সমত্মতি এবং স্বামীকে একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করা।

পার্থিব প্রয়োজন সত্বেও যে কোন প্রলোভন এড়িয়ে কোন নারীর পবিত্র থাকার গল্প, যে এই পথে নানা বিপদ আপদ সহ্য করে চলেছে।

শাসিত্মপ্রয়োগ ও তাকে এবং স্বামী-সমত্মানকে নিগ্রহ করা সত্বেও যে নারী পার্থিব বিপদ আপদে প্রবল ধৈর্য ধরে আছে, সে হতে পারে তোমার গল্পের উত্তম উদাহরণ।

স্বামীর ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ সত্বেও সমত্মানকে সততায় গড়ে তোলা অত:পর স্বামীকে হিদায়াতের জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে যাওয়া নারীর গল্প।

৬৪
সেবিকা
এই ক্ষেত্রটির নারীর জন্য অত্যমত্ম গুরুত্বপূর্ণ। এর মৌলিক অনেক কিছুই এই যুগের নারীরা পরিত্যাগ করে আছে। সেবিকাদেরকে সঠিক উপায়ে শিক্ষা প্রদান ও দীনী দাওয়াতের মাধ্যমে আমরা এ ক্ষেত্রটিতে সফল করে তুলতে পারি।

অনেকে আমাকে তাদের ঘরোয়া গল্প শোনায়, আমি তাদের গল্প শুনে দু:খে ভারাক্রামত্ম হয়ে পড়ি। তাদের বাড়ীর সেবিকা ও ড্রাইভার কী কী আপত্তিকর আচরণ করে, তা শুনে আমি রীতিমত ভীত হয়ে পড়ি। সেবিকারা কখনো কখনো বাসর রাতের বধূর মত সেজে গুজে হেঁটে বেড়ায়, অন্যকে প্রলুব্ধ করতে চায়, সাজ-সজ্জা করে একাকী বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়ে। এমনকি বাড়ীর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে অচেনা যুবককে নিয়ে রাত কাটায়।

এটি আমাকে ভীষণ মর্মাহত করেছে, এবং যখন শুনেছি আমাদের অনেক সম্মানিত দায়ী একই অভিযোগ করছেন, মুসলিম হওয়া সত্বেও তাদের সেবক-সেবিকা ও ড্রাইভাররা এই অনৈসলামিক কর্মকান্ড নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে।

আমি এর একমাত্র সমাধান যা মনে করতাম, তা হচ্ছে এই ধরণের দূরাচার সেবক-সেবিকাদেরকে তৎক্ষণাৎ কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তাদেরকে হসত্মামত্মর করা হবে কিংবা যে এজেন্সির মাধ্যমে তাদেরকে এ দেশে আনা হয়েছে, তাদের হাতে তাদেরকে তুলে দেয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমি যখন বিষয়টি নিয়ে কয়েকজনের সাথে আলোচনা করলাম, তারা আমাকে বলল, ‘ভাই, এটি তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা, তারা এমনই হবে।’ এই বক্তব্য শুনে আমার চোখ খুলে গেল, অন্য কোন বিকল্প চিমত্মা করিনি বলে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল।

এটাই বাসত্মব, তাদের কাছে এটি হারাম কিছু নয়। কেউ কেউ হারাম মনে করলেও একে যুবক বয়সের গোপন স্বভাবের বাইরে বড় কোন পাপ হিসেবে গণ্যই করে না। একে তারা নিজেদের আয়-রোজগার ও জীবন জীবিকার অংশ ভাবে। তারা তো এ সব দেশে কেবল জীবিকার অন্বেষণেই আসে।

আমি, তাই, এমন একটি পুসত্মকের সন্ধান করলাম, যাতে বিসত্মারিত আকারে এই সব বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে এবং কোন সমাধানের প্রসত্মাব হাজির করা হয়েছে। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে যা আমাদের সেবক-সেবিকাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে, কিন্তু এমন কিছুই আমার চোখে পড়ল না।

আমি মনে মনে বললাম, আমরা কি এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে পাপের সম্প্রসারণে সহায়তা করছি না? পাপ তার দরজা-কপাট খুলে অনায়াসে তাতে যুবকদেরকে লালায়িত করছে। সুতরাং, সেবিকাদেরকে পাকড়াও করে যার যার দেশে পাঠিয়ে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আমরা তাদেরকে শিক্ষা দেইনি, অভ্যাস ও আচরণের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান তাদের সামনে হাজির করে তাদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার প্রসত্মাব করিনি, সুতরাং কিয়ামতের দিন তাদেরকে দোষী করে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপন কি সম্ভব? আমরা আল্লাহর হুকুম তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে গড়ে তুলিনি দায়ী রূপে। সুতরাং, এই পাপাচারে তারা যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী আমরা।

আমি মনে করি, এ ব্যাপারে মায়েরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ‘সেবিকাদেরকে সততার শিক্ষা’ ইত্যাদি শিরোনামে তারা বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করতে পারে। সেবিকাদেরকে সংশোধনের মাধ্যমে তাদের উপর প্রমাণ সাব্যসত্ম করা যাবে। এর মাধ্যমে, মূলত:, আমাদের শিশু সমত্মানদেরকেও সঠিকভাবে প্রতিপালন সহজ হয়ে উঠবে। আমাদের গৃহ ও সম্পদ হিফাযতে থাকবে।

সেবিকাদের নিয়ে এই বৈঠকে যে বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখা হবে, তা এই :

শিক্ষা, এই ক্ষেত্রে সকল দায়ীদেরকে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের আহবান। জ্ঞানী ও লেখক শ্রেণীকে এ ব্যাপারে লেখালেখি ও মনোযোগ প্রদানের জন্য বিশেষভাবে আহবান জানাতে হবে, সরাসরি সেবক-সেবিকা শ্রেণীকে সম্বোধন করে লেখা হবে, গৃহের কর্তা ও কর্ত্রীর মাধ্যমে তাদেরকে সৎ পথে আনার পদ্ধতি পুরোনো, এতে এই কঠিন সময়ে আশাব্যাঞ্জক কোন ফল হবে বলে মনে হয় না। অন্য ভাষা-ভাষীদের জন্য তা অনুবাদ করে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

গৃহের পরিবেশকে এমনরূপে গড়ে তোলা, যাতে সেবক-সেবিকাদেরকে সঠিক শিক্ষা প্রদান করা যায়।

মুসলিম সেবিকাদেরকে মাসআলা মাসাইল শিক্ষা দান, তাদেরকে প্রথমে তাওহীদের জ্ঞান দান করতে হবে, পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিষয়ের ব্যাপারে অবগত করানো হবে, এমনকি ঈমানের সর্বশেষ সত্মর ‘পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরানো’-এর ব্যাপারে তাদেরকে জানাতে হবে। এর জন্য ছোট আকারে কোন সংস্থা বা প্রশক্ষিণ কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং সেবক-সেবিকাদের ভাষায় প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষিকা নিয়োগ দিতে হবে। এ সবই আমাদের জন্য অনায়াস সম্ভব, যদি আমরা আমাদের অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকি।

তাদের মাঝে যারা অধিক যোগ্য ও বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী, তাদেরকে আলাদা করে চি ‎‎ হ্নত করে বিশেষ লক্ষ্য প্রদান করা। যাতে তারা দায়ী হয়ে অন্যান্যদের মাঝে দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে পারে, এবং স্বদেশে ফিরে গিয়ে ইসলামের বাণী সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

মায়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে নারীদের অজ্ঞতা দূর করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ। ব্যক্তিগত উদ্যোগ এর জন্য যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, উদ্দেশ্য সাধনে সকলের সমান আগ্রহ ও প্রচেষ্টা।

যে কোন ব্যক্তিই প্রতিদিন নতুন নতুন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে, এবং তাদের কাছে নারীদের অজ্ঞতা ধরা দিচ্ছে নিত্য নতুন চেহারা নিয়ে। মুসলিম সমাজে নারীরা এমন অজ্ঞাতায় বিভ্রামত্ম হয়ে আছে, যা কোনভাবেই আমাদের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনতে পারে না। এই চিত্রটি সাধারণভাবে সকল মুসলিম এলাকায় এবং বিশেষভাবে আরবে সমানভাবে দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু নগরের বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আরো কঠিন অবস্থা পরিদৃষ্ট হচেছ, গ্রামে ও উপশহরগুলোতে, আরব অনারব যে কোন দেশে এই অজ্ঞতা গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে, জাহিলী যুগের সাথে তার দীর্ঘ পরম্পরা এখনো ছিন্ন হয়নি। আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে, নারীরা একে ক্ষতিকর তো মনে করছেই না, বরং, এর স্বপক্ষে যুক্তি হাজির করে সকলকে এর প্রতি আহবান করছে, এর প্রতি অটল থাকার জন্য একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীরা একে নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবে সমাদর করছে।

এই কারণে, প্রতিটি দেশে ও এলাকায় নারীদের নিয়ে এ ধরনের বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে জাহিলী যুগের এ পরম্পরা ছিন্ন করে নারীদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসা যায়।

এই বৈঠকের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে হবে, যারা তাদেরকে শরীয়তের আবশ্যকীয় জ্ঞান দিয়ে সহযোগিতা করবেন, এবং তাদের আলোচ্য প্রতিটি বিষয়কে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় শুদ্ধতা এনে দিবেন।

নারীদের মাঝে প্রচলিত সাধারণ কিছু বিভ্রামিত্ম ও অজ্ঞতা উল্লেখের মাধ্যমে আমি আলোচ্য বিষয়ের একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করতে প্রয়াস পাব। নিম্নে তার কিছু তুলে ধরা হল :

প্রথম বিভ্রামিত্ম : শিশুদের প্রতিপালনে তাদের সাথে আচরণ কেমন হবে, এ ব্যাপারে নারীদের মাঝে ব্যাপক অজ্ঞতা ও বিভ্রামিত্ম দেখা যায়। নারীরা তাদেরকে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পন্ন করা, পাক পবিত্র থাকা, সতর ঢেকে রাখা, এবং কয়েকজন একই বিছানায়, একই কম্বলের নীচে ঘুমানো ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক ধারণা ও শিক্ষা প্রদান করে না। এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার।

দ্বিতীয় বিভ্রামিত্ম : সালাতের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর যদি নারীর স্রাব আরম্ভ হয়, তাহলে সাধারণত, তারা সে ওয়াক্তের সালাত ত্যাগ করে, এবং পবিত্র হওয়ার পর তা আদায় করে না। এটি তাদের বিভ্রামিত্ম। অধিকাংশ আলিমের মতে এটি ভুল।

তৃতীয় বিভ্রামিত্ম : নারীরা বাজারে প্রবেশ করার পর যদি আছরের ওয়াক্ত চলে আসে, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা আছরের সালাত আদায় করে না। সালাত ত্যাগের এমন অভ্যাস মুসাফির নারীর মাঝে অধিকহারে লক্ষ্য করা যায়। তারা মুসাফির এই যুক্তিতে বিভিন্ন ওয়াক্তের সালাত এক ওয়াক্তে আদায় করে। নারীরা ফজরের সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে অনুরূপ উদাসীন, তাই অধিকাংশ সময় দেখা যায়, তারা সূর্য উদয়ের পর সালাত আদায় করছে।

চতুর্থ বিভ্রামিত্ম : অধিকাংশ নারীই সূরা ফাতিহা শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে পারে না, ফলে তাদের কোন সালাতই শুদ্ধভাবে আদায় হয় না। প্রয়োজনীয় সূরা ও কুরআনের আয়াত শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করা যেতে পারে। বয়স্ক হয়েও কুরআন শিক্ষা করা যায়, এব ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অধিকাংশ নারীই ন্যূনতম তিলাওয়াত ও সূরা ফাতিহা পাঠে সক্ষম নয় বলে, তাদের সালাত শুদ্ধরূপে আদায় হয় না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যে কুরআনের সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না, তার কোন সালাত নেই।’ [বুখারী : ৭৫৬]

পঞ্চম বিভ্রামিত্ম : নারীদের অধিকাংশই, সক্ষম ও ফরজ হওয়ার যাবতীয় শর্ত উপস্থিত হওয়া সত্বেও হজব্রত পালন না করে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।

ষষ্ঠ বিভ্রামিত্ম : নারীদের বিশেষ বিশেষ মাসআলার ব্যাপারে অজ্ঞতা। কারো সাথে নিভৃতে সময় কাটানো, দেবরের সাথে সম্পর্ক, সফরের আহকাম, কী কী অঙ্গ কী পরিমাণ প্রকাশ করা যাবে, এবং কী প্রকাশ যাবে না ইত্যাদি ব্যাপারে অজ্ঞতার ফলে তারা নিত্য হারামে লিপ্ত হচ্ছে ও ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের বিপদ ডেকে আনছে।

সপ্তম বিভ্রামিত্ম : কোন বিপদ হলেই নারীরা সাধারণত মৃত্যু কামনা করতে আরম্ভ করে, স্বাভাবিক কারণে অযথা রাগে ফেটে পড়ে, সমত্মান-সমত্মতি ও স্বামীকে বদ-দুআ করে। তাদের আরেকটি রোগ হচ্ছে, তারা অধিক হারে লা’নত করে, প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হয় না এবং যখন আনন্দে থাকে, শরীয়তের বিধি বিধানের প্রতি তোয়াক্কা না করে বল্গাহীন ফূর্তিতে মেতে উঠে।

অষ্টম বিভ্রামিত্ম : শরীয়তের খুব জানা বিষয়কেও, তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলে অস্বীকার করে বসে। এর অন্যতম ও প্রধান উদাহরণ হচ্ছে একাধিক বিবাহ। এ সংক্রামত্ম বিসত্মারিত আলোচনার স্থান এটি নয়, আমি জানি, এ আলোচনার উত্থাপনের ফলে অনেক নারী আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন। এটিই প্রমাণ করবে, মন্দ ও হারাম বিষয়গুলো এড়ানোর ব্যাপারে তারা অজ্ঞ। কোন বিতর্কের জন্যে নয়, আমরা এ প্রাক্টিক্যাল বিষয়টিকে আকীদাগত বিষয় হিসেবে আলোচনা করছি।

মৌলিকভাবেই, কোন কোন নারী একাধিক বিবাহের বৈধতাকে অস্বীকার করে। স্বামী যদি তার সাথে অন্য নারীকে বিয়ে করে, তবে ক্রোধে ফেটে পড়ে, এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, ফলত সতীনকে তালাকের জন্য স্বামীকে বাধ্য করে। কেউ কেউ স্বামীর প্রতি জেদ ধরে সমত্মানকে নষ্ট হতে প্ররোচিত করে।

আত্মসম্মান কী উপায়ে প্রয়োগ করবে, এ ব্যাপারে অজ্ঞতার ফলে অনেক নারী এই ধরনের ভয়াবহ পাপে জড়িয়ে পড়ে, তারা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যায়। এ ভুলে পা দেয়া নারীদের সংখ্যা সমাজে বেশি। অধিকাংশ নারীই শরীয়তের ব্যাপারে অজ্ঞ ও জেদের ফলে এ পাপে নিজেকে জড়িয়ে নেয়।

নবম বিভ্রামিত্ম : সর্বদা সাদাকা প্রদানে উৎসাহী না হওয়া। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন : তোমরা সাদাকা কর, কারণ, আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের অধিবাসীদের অধিক দেখতে পাচ্ছি। [বুখারী : ৩০৪]

দশম বিভ্রামিত্ম : স্বামীর শোকে অতিরঞ্জন করা এবং জাহিলী এমন কিছু প্রথা পালন করা, যার ব্যাপারে শরীয়তের কোন সমর্থন নেই।

নারীদের ব্যাপারে বর্তমানে ভাল যা কিছু হচ্ছে, তার সবটুকুই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এ কারণেই, বিষয়টি চূড়ামত্ম কোন সাফল্যের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয়, নারীদের বিষয়টি সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগ ও মনোযোগ প্রয়োজন।

৬৫
গল্প-কাহিনী
বাসত্মব ও জানা-প্রয়োজন এমন অনেক গল্প তোমার নিশ্চয় জানা আছে। হে মা, স্ত্রী ও কন্যা, তুমি কেন সেগুলো দাওয়াতের কাজে লাগাচ্ছো না, অন্যকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে সকলকে তা জানিয়ে দিচ্ছো না? বিন্যসত্ম আকারে সকলের জন্য যদি প্রকাশ কর, তবে তা অবশ্যই ফলদায়ক একটি ব্যাপার হবে। উদাহরণ :

সেবিকাদের চক্রামত্ম। অনেক সেবিকা অদ্ভুদ উপায়ে বাড়ীর কর্ত্রীকে কষ্ট দেয়, তাকে হেনসত্মা করতে উদ্যত হয়। এমনকি কখনো কখনো তা প্রাণ হরণের পর্যায়ে চলে যায়। বিষ প্রয়োগ, খাবারে মূত্র ত্যাগ ইত্যাদি ঘটনাও অনেক বাড়ীতে ঘটে।

শিশুদেরকে ঈশ্বর পূজা শিক্ষা দেওয়ার ঘটনা খুবই সত্য একটি ব্যাপর, এভাবে সেবিকা বেশে ধর্মীয় মিশন নিয়ে হয়তো তোমার গৃহে কেউ ওৎ পেতে আছে। এ ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য অনেক বাসত্মব ঘটনা সকলের সামনে তুলে ধরা যায়।

অনেকে সেবিকা বেশে গুপ্তচরবৃত্তি করে, এ ব্যাপারে সতর্কতার জন্য কিছু করা যেতে পারে।

অনেক সেবিকা বাড়ীর কর্তাকে তার প্রতি প্রলুব্ধ করে, স্বামীও হয়তো তার প্রলোভনে পরে তার পাতা ফাঁদে পা দেয়, ফলে স্বামী স্ত্রীর মাঝে তালাকের মত ঘটনাও ঘটে যায়। এই বিচ্ছেদের মূলে কাজ করে সেবিকা। কখনো বালিগ সমত্মানদেরকেও তারা প্রলুব্ধ করে।

শিশু সমত্মানরা দীর্ঘ দিন সেবিকাদের সাথে থাকার ফলে তার প্রতি শিশুর সহজাত ভালোবাস তৈরি হয়, ফলে একে পুজি করে সেবিকা অনেক অঘটন ঘটায়।

অধিক সেবক-সেবিকা রাখার ফলে সমাজ ও পরিবারের জন্য কী কী বিপদ ঘটে- তা প্রমাণ করার জন্য তুমি কয়েকটি বাসত্মব উদাহরণ পেশ করতে পার।

একই বাড়ীতে অনেক সেবক-সেবিকা এক সাথে থাকার ফলে তাদের মাঝে পাপাচার ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে সতর্কতা মূলক কিছু করা যেতে পারে।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর সাথে জড়িত এমন যে কোন বাসত্মব ঘটনা তুমি সকলের জন্য তুলে ধরতে পার, ফলে তারা সতর্ক হবে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে।

৬৬
দাওয়াত
এস্থলে এমন কিছু ক্ষেত্রের উল্লেখ করব, যাতে মায়েরা দীনের দাওয়াত নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং কার্যকরী ফল আনয়নে সক্ষম হয়েছে। আমি নিম্নে এরূপ কিছু উদাহরণ পেশ করছি।

‘উম্মে মুহাম্মাদ’ দাওয়াতের একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে, সে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকলের মাঝে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখে সর্বদা। শরীয়তের বিভিন্ন মাসআলা মাসায়েল নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন প্রোগ্রাম, সিডি, ভিসিডি, ক্যাসেট ইত্যাদি সংগ্রহ করে এবং কপি করে অন্যান্যদের মাঝে বিতরণ করে। বিশেষত: শরীয়তের যে সমসত্ম হুকুম আহকাম নারীদের সাথে সম্পৃক্ত, সে সংক্রামত্ম ক্যাসেটগুলো তার অতি প্রিয়।

অপর একজন মা, যিনি তার অধীনস্থ সেবিকাদেরকে দায়ীরূপে গড়ে তুলেছেন। যতদিন তারা তার কাছে ছিল, তিনি তাদের জন্য পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জন আবশ্যক করে দিয়েছিলেন, যখন তারা আপন আপন এলাকায় ফিরে যায়, বয়ে নিয়ে যায় হিদায়াতের আলো। তাদের মাধ্যমে অনেক নারীর হিদায়াত হয়েছে, অনেককে তারা ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে এসেছে।

৬৭
চতুর্দশ বপন: শিশুদের মাঝে
قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ﴿35﴾

‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, ‘হে আমার রব, আমার গর্ভে যা আছে, নিশ্চয় আমি তা খালেসভাবে আপনার জন্য মানত করলাম। অতএব, আপনি আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ’।’ [সূরা আলে ইমরান : ৩৫]

عن عمر بن أبي سلمة رضى الله عنهما، قال : كنت غلاما في حجر رسول الله صلى الله عليه و سلم، و كانت يدي تطيش في الصحفة، فقال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا غلام سم الله، و كل بيمينك، و كل مما يليك . فما زالت تلك طعمتي بعد .

‘উমর বিন আবু সালামা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ছিলাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোলের বালক। খাবারের সময়ে আমার হাত বর্তনের এদিক সেদিক ঘুরত। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে বালক, আল্লাহর নাম নাও, ডান হাতে আহার কর এবং তোমার সামনের দিক থেকে খাবার গ্রহণ কর।’ সেদিন থেকে আমার খাবারের পদ্ধতি এমনই আছে।’ [বুখারী : ৫৩৭৬]

عن ابن عباس قال : كنت خلف رسول الله صلى الله عليه و سلم يوما فقال : يا غلام إني أعلمك كلمات (( احفظ الله يحفظك، احفظ الله تجده تجاهك , إذا سألت فاسأل الله , و إذا استعنت فاستعن بالله , واعلم أن الأمة لو اجتمعت على أن ينفعوك بشيئ لم ينفعوك إلا بشيئ قد كتبه الله لك , ولو اجتمعوا على أن يضروك بشيئ لم يضروك إلا بشيئ قد كتبه الله عليك , رفعت الأقلام و جفت الصحف .

‘ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ছিলাম, তিনি আমাকে বললেন : হে বালক, আমি তোমাকে কয়েকটি বাণী শিখাচ্ছি। ‘তুমি আল্লাহর দীনের হিফাযত কর, তিনি তোমাকে হিফাযত করবেন। তুমি আললাহর দীনের হিফাযত কর, তাহলে তাকে সহায় হিসেবে সম্মুখে পাবে। যখন চাও, তখন আল্লাহর কাছে চাও। যখন সাহায্য চাও, তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। জেনে রাখ, যদি সকলে তোমার কোন উপকারের জন্য একত্রিত হয়, তারা তোমার সে উপকারই করতে সক্ষম হবে, আল্লাহ যা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি সকলে একত্রিত হয়ে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায়, তারা তোমার তাই ক্ষতি করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং আমললিপি শুকিয়ে গিয়েছে।’ [তিরমিযী : ২৫১৬]

বাবা তার আদরের সমত্মান হামিদকে নিয়ে সকালে হাঁটতে বের হলেন। পথে বাবা তাকে বললেন :

এই সাত সকালে পথে ঘাটে মানুষের ঢল দেখ ; দেখ কেমন ভীর করে আছে গাড়ী ও যানবাহন। ছুটছে চাকুরীজীবিরা, ছুটছে যার যার কর্মক্ষেত্রে। তাকিয়ে দেখ, পাখীরাও বসে নেই, সকালের মুক্ত আকাশে ছুটছে খাবারের সন্ধানে, কিংবা শূন্যে কোথাও। তুমি তোমার আশপাশে তাকাও, এবং, তাকাও নিজের অভ্যমত্মরে, তোমার অমত্মর ধুক ধুক করছে, রগে রগে বয়ে যাচ্ছে রক্তের ধারা। মনে একের পর এক হানা দিচ্ছে চিমত্মা ও কল্পনা। চোখ, কান, গলা কিছুই বসে নেই, যে যার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে চলেছে।

এই পথচলা মৃত্যু ব্যতীত কখনো থামবে না। এটাই হচ্ছে জীবনের প্রকৃতি ও ধর্ম। জীবিত মানুষের এই হচ্ছে জীবনময়তা...কিন্তু তুমি নিজেকে প্রশ্ন কর :

এ সব কিছু, যা শূন্যে ও যমীনে বিচরণ করছে, তার নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য রয়েছে, যার দিকে নিরমত্মর ছুটে চলেছে সে। সুতরাং, আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি?

পূণ্য অর্জন তুমি তোমার লক্ষ্য বানিয়ে নাও, অত:পর ছুটে চল তোমার কর্মক্ষেত্রে, বিচরণ কর উপকারী বিচরণ।

আমরা অফিসে যাব ; অফিসে ঢুকেই যদি তুমি উদাসীর মত চেয়ারে বসে থাক, কোন কাজে মনোযোগ না দাও, তবে তোমাকে জীবিতই গণ্য করা হবে না। কারণ, এটি জীবনের ধর্মের বিরোধিতা ; আমরা ইতিপূর্বে চারদিকে যে অবাধ জীবনময়তার দেখা পেলাম তা প্রমাণ করে, জীবনের নির্দিষ্ট একটি ধর্ম রয়েছে, সেই ধর্মের অনুসরণ ব্যতীত কখনোই জীবন পরিপূর্ণ জীবন হয়ে উঠে না।

তুমি উঠে গিয়ে চায়ের কাপ রাখার স্থানে যাও, সেগুলো ধোও এবং নিজেকে প্রশ্ন কর, কেন আমি এমন করলাম?

এভাবে, এক স্থান থেকে অপর স্থানে গমনের উদ্দেশ্য কি?

বল, আমার লক্ষ্য পূণ্য অর্জন, কারণ, তা আমার জন্য উপকারী, কল্যাণবাহী, এতে আমার বাবা সন্তুষ্ট হবেন। আমার অফিসটি পরিচ্ছন্ন থাকবে, আমার অমত্মর শামিত্ম পাবে।

কিংবা তুমি ঝাড়ু নিয়ে ঘরটি ঝাট দাও, তেপায়াটি পরিস্কার কর, গ্লাসটি ভাল মত মুছে দাও। এবং নিজেকে প্রশ্ন কর, কেন আমি এমন করলাম?

এ কাজে আমার উদ্দেশ্য কি?

আমি এ কাজের মাধ্যমে ভাল কোন পূণ্যফল অর্জন করতে চাই।

অফিসে যদি কাউকে কিছু অনুসন্ধান করতে দেখ, তাহলে তুমি এগিয়ে যাও, বলার আগেই তাকে বিষয়টি হাজির করে দাও।

কাজ শেষে প্রশ্ন কর, কেন এমন করছি?

কারণ, তুমি তোমার প্রকৃতি অনুসারে বিচরণ করছ। সুতরাং তোমার এ বিচরণকে কেন এমন এক সফলতায় পর্যবসিত করবে না, যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এবং তোমার পূণ্য অর্জন হয়?

এভাবে প্রতিটি কাজে নিজেকে প্রশ্ন কর, এবং এগিয়ে যাও।

সমত্মানের দায়িত্বশীল হে পিতা, তুমি যদি তোমার সমত্মানের কর্মকান্ডের মাঝে শুদ্ধ নিয়তের সঞ্চার করতে সক্ষম হও, তবে নিশ্চিত থাক, তুমি তার জীবনে সফলতার সূচনা করতে সক্ষম হয়েছ।

হে মুসলিম বালক, আজ আমি তোমার সাথে একটু একটু করে পথ চলব, তোমাকে দেখাব এমন অনেক ক্ষেত্র, যাতে তুমি উত্তম কিছু অনায়াসে বপন করতে সক্ষম হবে।

তুমি তোমার বাড়ীতে একাধিক সিন্দুক স্থাপন কর, তার মাধ্যমে সাদাকায়ে জারিয়ার সূচনা কর। প্রতিটি শিশু তার প্রাত্যহিক ব্যয়ের কিছু অংশ সেখানে জমা করবে। এর মাধ্যমে শিশুর উদ্দেশ্য থাকবে পূণ্যলাভ। তার সামনে প্রয়োজনগ্রসত্ম মুসলমান, ইয়াতীমদের অবস্থা ও তাদের প্রয়োজন তুলে ধরবে।

তুমি প্রতিদিনই মা-বাবার সাথে নিত্য নতুন ভাষায় ও ভঙ্গিতে ভাল আচরণ কর, সালাম দিয়ে তাদের মাথায় চুমু খাও, সহাস্যমুখে তাদের সাথে কথা বল। তোমার হাস্যমুখ যে কোন সুবাসিত উদ্যানের তুলনায় তাদের কাছে অধিক প্রিয় মনে হবে।

প্রতিদিন একাধিক আয়াত মুখসত্ম কর, প্রতি সকালে কুরআনের কিছু অংশ তিলাওয়াত কর।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অনেক প্রয়োজনীয় দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। এ সংক্রামত্ম একটি পুসিত্মকা সংগ্রহ করে তুমি তা থেকে প্রতিদিন কিছু কিছু মুখসত্ম করতে পার। দেখা যাবে মাস অতিক্রামত্ম হওয়ার পূর্বেই তার পুরোটা বা অধিকাংশই মুখসত্ম হয়ে যাবে।

প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে একটি ইসলামী বই অধ্যয়ন কর। আমি একজন বালককে জানি, যে প্রতি দিন-বাসত্মবেই প্রতিদিন-একটি কিংবা দুটি বই পাঠ করে। প্রতিটি বই-ই সাধারণত সর্বনিম্ন পঞ্চাশ পৃষ্ঠার হয়।

তুমি নিয়ম করে কম্পিউটার শিখতে পার, তাতে লিখা, টাইপ করা এবং পড়ার অভ্যাস কর।

বাবাদের কেউ কেউ মনে করেন, শরীয়তের অবশ্য পাঠ্য বিষয়গুলো কেবল ছেলেদের আত্মস্থ করলেই চলবে, সুতরাং কোন নারী এ বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করবে, এটি তারা ধারণাই করতে সক্ষম নয়। কিন্তু বাসত্মবতা হল, এই ধারণা খুবই জাহিলী ধারণা, এর আড়ালে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা লুকিয়ে আছে। লোখ দেখানোর হীন ইচ্ছা কার্যকর আছে এর পশ্চাতে। কারণ, ছেলেদের শিক্ষার মাধ্যমেই লোকদেখানোর হীন ইচ্ছা চরিতার্থ হয়।

প্রকৃতপক্ষে বাসত্মবতা হচ্ছে, নারীদের মাঝে ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানী গড়ে উঠা আমাদের ও আমাদের বর্তমান সমাজের কল্যাণের জন্য অত্যমত্ম প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। নারীরা সমাজের সংশোধনের ও ভালো অবস্থায় ফিরে আসার মূলে অবস্থান করছে- এই সত্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা বলতে পারি সমাজের অর্ধেক অংশকেই তারা সৎপথে নিয়ে আসতে সক্ষম। আয়িশা রা., তার অবস্থান, ইসলামের যাত্রাকালে তার ভূমিকা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা স্পষ্টরূপে অনুভব করতে সক্ষম হব, একজন বিজ্ঞ নারী সমাজের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।

রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন আয়িশা রা. এর বয়স ছিল আঠার। তার ওফাতের পর তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন, মানুষ তার কাছ থেকে দীনের প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছে। আবু মূসা আশআরী রা. বলেন, ‘আমাদের- রাসূলের সাহাবীদের কাছে- যখনি কোন হাদীস দুর্বোধ্য হয়েছে, আমরা আয়িশা রা.-এর কাছে তার সমাধান পেয়েছি।’ [তিরমিযী : ৩৮৮৩]

মূসা বিন তালহা তার ব্যাপারে বলেন, ‘আমি আয়িশা রা.-এর থেকে উত্তম কোন সুভাষিণী দেখিনি।’ [তিরমিযী : ৩৮৮৪]

আল্লাহ তাকে অসাধারণ মেধায় ভূষিত করেছিলেন, তার ছিল অতুলনীয় স্মৃতিশক্তি, দ্রুত আত্মস্থ করার ক্ষমতা। তিনি বলেন : ‘রাসূলের যুগে আমাদের উপর আয়াত নাযিল হত, আমরা তার হালাল-হারাম, নির্দেশ-নিষেধগুলো মুখসত্ম করে নিতাম।’

আবু মূসা আশআরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশা রা. সম্পর্কে এক হাদীসে বলেন : ‘পুরুষের মাঝে অনেকে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে, নারীদের মাঝে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে কেবল মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া ; অন্যান্য নারীদের উপর আয়িশার শ্রেষ্ঠত্ব যাবতীয় খাবারের উপর ‘সারীদ’ (এক প্রকার অভিজাত খাদ্য)-এর মত।’ [বুখারী : ৩৭৬৯]

শিশু কিংবা তুমি যে সাদাকায়ে জারিয়ার সূচনা করবে, তার অন্যতম হচ্ছে ইসলামী জ্ঞান অনুসারে তার মানসিক ও জ্ঞানগত পরিগঠন। শিশুকে উত্তম রূপে প্রতিপালন এবং তাকে একটি সুস্থ সবল জীবনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়াই হচ্ছে একজন পিতা ও মাতার জীবনের চরম সার্থকতা। এ এক বিরাট সাদাকায়ে জারিয়া, যখন তুমি মৃত্যু বরণ করবে, পরজগত হবে তোমার আবাস, যখন কোন প্রকার আমলে নিজেকে ধনী করবার সুযোগ রহিত হয়ে যাবে, তখন তোমার সমত্মান তোমার কাজে আসবে।

হে সমত্মান, তুমিও নিজেকে নানা প্রকার সাদাকায়ে জারিয়ার মাধ্যমে ভূষিত করতে পার। তোমার পিতা যদি ধূমপানে অভ্যসত্ম হয়, তবে তুমি শালীন পন্থা অবলম্বন করে তাকে এ ব্যাপারে বলতে পার। কিংবা তাকে সম্বোধন করে একটি ছোট পুসিত্মকা লিখতে পার, যা হাদিয়ার মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছে দিবে। তা নিশ্চয় তার উপর প্রভাব ফেলবে।

হে সমত্মান, বাড়ীতে যখনি কোন সমস্যা দেখা দিবে, তুমি অত্যমত্ম ভদ্রতার আচরণ করে বিষয়টির সমাধানে ভূমিকা রাখতে পার। বিশেষত, সমস্যা যদি হয় পিতা-মাতার মাঝে, তবে তোমাকে বলা ব্যতীতই তুমি এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখ। তাদের বলার অপেক্ষা কর না।

তুমি যদি তোমার বাবার সাথে বাজারে যাও, তবে তাকে স্মরণ করিয়ে দাও, তিনি যেন তোমার মায়ের জন্য উপঢৌকন স্বরূপ কিছু নিয়ে যান, অনুরূপ তুমি যদি তোমার মায়ের সাথে বাজারে যাও, তাকে বাবার জন্য কিছু নিয়ে যেতে স্মরণ করিয়ে দিয়ো।

নিজেকে প্রশ্ন কর, তোমার সাথীদের কে কে সালাতে অবহেলা করে, তাদেরকে সালাতের পথে নিয়ে আসা তোমার পক্ষে সম্ভব কি না, কে কে আল্লাহর আদেশ নিষেধের ব্যাপারে কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না, ভালো আচরণের বদলে মন্দ আচরণ কার অধিক প্রিয়, অশ্লীল ও গর্হিত কথা কার মুখের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে,- তাদেরকে চি ‎‎ হ্নত করে তুমি তাদেরকে এ ব্যাপারে অত্যমত্ম শালীনতার সাথে উপদেশ দিতে পার।

হে প্রিয় সমত্মান, তুমি কি নিজেকে কখনো এ প্রশ্ন করে দেখেছ, কেন তুমি পড়াশোনা করছ? ভবিষ্যতে ভাল বেতনে চাকরী করবে এই কি তোমার উদ্দেশ্য? নাকি কোন বড় পদের প্রতি তোমার মোহ রয়েছে? তুমি কি পড়াশোনার আড়ালে পার্থিব কোন আকাঙ্ক্ষা লালন কর?

নাকি তুমি পড়ছ তোমার দীনকে সহযোগিতা করতে, তোমার কাজ ও পদ ইসলামের সাহায্যের জন্য নিবেদিত করতে? আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে? তুমি তোমার দীনের ব্যাপারে সর্বদা কেন নেতিবাচক পন্থা অবলম্বন করছ? তোমার ব্যক্তিগত ধর্মচর্চাকে অন্য যাবতীয় ক্ষতিকর সংস্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে, এতটুকুই কি তোমার দায়িত্ব? অপরকে সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ এবং উত্তম উপদেশ প্রদানের জন্য এগিয়ে যাচ্ছ না কেন?

আমি কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে এ সংক্রামত্ম আলোচনার সমাপ্তি টানতে চাচ্ছি :

কীভাবে আমরা আমাদের শিশুদেরকে এমন অভ্যাসে গড়ে তুলতে পারি, যার ফলে সে একক নয়, গড়ে উঠবে সমাজের অংশ হয়ে, কেবল পরিবারের সাথেই নয়, তার যোগাযোগ থাকবে সমাজ ও সমাজের বাসত্মবতার সাথে?

সঠিক কল্পনা, শুদ্ধ চিমত্মা ও বোধ এবং দূরকল্পনার অধিকারী করে কীভাবে আমরা তাদেরকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারি?

জ্ঞানগত উৎকর্ষের পাশাপাশি আমরা তাদেরকে কীভাবে এমন অভ্যাসের অনুবর্তী করে তুলতে পারি, যার ফলে তার মাঝে কর্মতৎপরতার অতুলনীয় আগ্রহ ও উদম্য ইচ্ছার জন্ম নিবে? তার প্রতিবেশ, পরিবেশ ও সমাজে সে সক্রিয় হয়ে অংশগ্রহণ করবে- হোক তারা মুসলমান কিংবা কাফির, হোক তারা পরিচিত কিংবা অপরিচিত।

উন্নত আচরণ ও অভ্যাসের আলোকে কীভাবে আমরা তাদেরকে জীবনের রাজপথে তুলে আনতে পারি? সাধারণ ও ব্যাপক সামাজিক চর্চার মাধ্যমে, হয়তো, আমরা তাদের মাঝে এই বীজ বপন করতে পারি।

কী পদ্ধতি অনুসরণের ফলে তাদের মাঝে ইসলামের জ্ঞানগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি পাবে, তা আমাদেরকে অবশ্যই আবিস্কার করতে হবে। শুদ্ধ ও শক্তিশালী মানসিক গঠন এবং বিশেষ কোন ক্ষেত্রে জ্ঞানগত উৎকর্ষই তাদেরকে এ পথে সফল করে তুলবে।

৬৮
পঞ্চদশ বপন: সুপারিশ ও পৃষ্ঠপোষকতা
مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا وَكَانَ اللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقِيتًا ﴿85﴾

‘যে ভাল সুপারিশ করবে, তা থেকে তার জন্য একটি অংশ থাকবে এবং যে মন্দ সুপারিশ করবে তার জন্যও তা থেকে একটি অংশ থাকবে। আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের সংরক্ষণকারী।’ [সূরা নিসা : ৮৫]

عن أبي الزبير أنه سمع جابر بن عبد الله يقول : أرخص النبي صلى الله عليه و سلم في رقية الحية لبني عمرو . قال أبو الزبير : و سمعت جابر بن عبد الله يقول : لدغت رجلا منا عقرب، و نحن جلوس مع رسول الله صلى الله عليه و سلم، فقال رجل يا رسول الله ! أرقي ؟ قال : من استطاع منكم أن ينفع أخاه فلينفع .

আবু যুবাইর থেকে বর্ণিত, তিনি জাবের বিন আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছেন : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী আমরকে সাপ কাটার ঝাড়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। আবু যুবাইর বলেন, এবং আমি জাবের বিন আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, আমাদের এক ব্যক্তিকে বিচ্ছু দংশন করল, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বসা ছিলাম। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! আমি কি ঝাড়ব? তিনি বললেন, তোমাদের যে তার ভাইয়ের উপকার করতে সক্ষম, সে যেন তা করে।’ [মুসলিম : ২১৯৯]

মানুষের প্রয়োজন খোলা দরজার মত, যা পুরোপুরি বন্ধ করা কখনোই সম্ভব নয়। সে ব্যক্তি খুবই ভাগ্যবান, যাকে আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজন পুরণে সুযোগ দান করেছেন এবং অন্যের ভাল করার সম্মানে ভূষিত করেছেন। মুসলমানদের আবাস ও অবস্থান এবং তাদের দেশ পৃথিবীর বিশাল একটি অংশ জুড়ে আছে, একে অপরের পরিচয় ও ভরসা খুবই দুর্লভ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন একক ব্যক্তি বা কয়েক ব্যক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে তাদের প্রয়োজন ও সমস্যার সমাধান এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

আমরা যদি প্রতিটি দেশে, নগরে, গ্রামে ও এলাকায় এমন প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করি, যা মানুষের প্রয়োজনগুলো চি ‎‎ হ্নত করবে এবং যথাসাধ্য তা পুরণে প্রচেষ্টা চালাবে, তা খুবই কল্যাণকর একটি বিষয় বলে বিবেচিত হবে। আমরা একে নাম দিতে পারি ‘সুপারিশকারী সংস্থা’ বা ‘কল্যানের সুপারিশকারী’ কিংবা পার্থিবের সুপারিশকারী’ ইত্যাদি।

এর জন্য নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব, যার কাজ হবে প্রয়োজনগ্রসত্ম মানুষের আবেদন গ্রহণ করা এবং সেগুলো যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রথমে সেগুলো যাচাই করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করা হবে, পরবর্তীতে সদস্যদের মতামত অনুসারে তিনটি পদ্ধতির যে কোন একটি অনুসরণ করা যেতে পারে। যথা :

সংস্থার পক্ষ থেকে সুপারিশ করে প্রয়োজনগ্রসত্ম ব্যক্তিকে স্বয়ং তার অবস্থানস্থলে পাঠিয়ে দেয়া।

চিঠি পত্রের যোগাযোগের মাধ্যমে তার প্রয়োজন পুরণ করা।

কিংবা সরাসরি সংস্থার প্রতিনিধি তার সাথে গিয়ে বিষয়টি চাক্ষুস দেখবে এবং তার দাবী পুরণে প্রচেষ্টা চালাবে।

মোট কথা, যে কোনভাবেই হোক, একে পুরণের সাধ্যমত ব্যবস্থা নিবে।

৬৯
এর নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে :
প্রথমত :

সংস্থার পক্ষ থেকে যদি প্রয়োজনগ্রসত্ম ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদান করা হয়, তবে তাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না, ফলে সমাজের যারা সম্মানিত ও দুর্যোগগ্রসত্ম, অন্যের কাছে হাত পেতে তাদেরকে হেনস্থা হতে হবে না।

দ্বিতীয়ত :

যে সকল সংস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্য লোক প্রয়োজন তাদেরকে এর মাধ্যমে লোকবল দিয়ে সহযোগিতা করা যাবে। কারণ, যারাই চাকরীর আবেদন করবে, তারা পূর্বের যোগাযোগের ফলে এই সংস্থার আস্থাভাজন হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ পাবে।

তৃতীয়ত :

সহযোগিতা চাওয়ার ফলে এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি ইসলামী সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে, এর নানাবিধ কুপ্রভাব রয়েছে। যে সমসত্ম যুবক মোটেই ভিক্ষাবৃত্তিতে অভ্যসত্ম ও প্রস্ত্তত নয়, অন্যের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার ফলে সকলে ভাবে সে ভিক্ষা চাচ্ছে। সংস্থার সক্রিয় সহযোগিতার ফলে এই ধরনের সামাজিক হীনতা ক্ষয় পাবে।

চতুর্থত :

এর কারণে এমন অনেক লোকের দীন রক্ষা পাবে, যারা অমুসলিম কর্মকর্তা ও মালিকের অধীনে চাকুরী করে। অমুসলিমের অধীনে চাকরী করার ফলে অনেক নতুন মুসলিম তার চাকরী হারায়, ফলে এক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতে হয়। পথই হয়ে পড়ে তার গৃহ। আমি এমন অনেককে দেখেছি, প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে আশপাশের লোকের অব্যাহত চাপের ফলে তাকে পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে হয়েছে। এভাবে মুরতাদ হওয়ার কারণে তার দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে।

এই ব্যবস্থার ফলে আমরা এমন অনেককে সহযোগিতা করতে পারব, হঠাৎ বিপদে আক্রামত্ম হওয়ার ফলে যারা হতবুদ্ধি হয়ে যায়। সহায় সম্পত্তি বিক্রয় করে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার পরিশ্রম করে। অনেক নারী-পুরষকে নিজের সম্ভ্রম বিক্রয় করে এমন হঠাৎ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যায়।

পঞ্চমত :

সুপারিশ বিষয়ক হাদীসগুলো আমরা গভীরভাবে চিমত্মা করলে দেখতে পাব, তা মানুষকে উত্তম পন্থায় সমস্যার মুকাবিলা করার শিক্ষা দিচ্ছে। আমরা এমন মহান ক্ষেত্র গড়ে তুলতে পারি, যা অন্যের প্রয়োজন পুরনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তা কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানর রূপে হতে পারে।

একে অপরকে সহযোগিতা বিষয়ক অসংখ্য হাদীস আমরা দেখতে পাই। কি মূলনীতিমালার আলোকে মানুষ একে অপরকে সহযোগিতা করবে, হাদীসে সেটিও উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে :

عن رجل من أهل المدينة قال : كتب معاوية إلي عائشة رضي الله عنها أن اكتبي لي كتابا توصيني فيه، و لا تكثري علي , فكتبت عائشة رضي الله عنها إلي معاوية : سلام عليك , أما بعد , فإني سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول : من التمس رضاء الله بسخط الناس , كفاه الله مؤنة الناس , و من التمس رضاء الناس بسخط الله , و كله الله إلي الناس , و السلام عليك .

মদীনার জনৈক অধিবাসী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুআবিয়া রা. আয়িশা রা.-এর নিকট পত্র পাঠালেন যে, আমাকে অসীয়ত করে একটি পত্র লিখুন এবং আমার উপর অধিক চাপিয়ে দিবেন না। আয়িশা রা. প্রতিউত্তরে মুআবিয়াকে এই পত্র দিলেন :

‘সালাম, আম্মা বাদ, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলছেন : যে মানুষের অসন্তুষ্টি উপেক্ষা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চাইবে, মানুষের চাপের সামনে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টি সত্বেও মানুষের সন্তুষ্টি চাইবে, আল্লাহ তাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দিবেন। সালাম।’ [তিরমিযী : ২৪১৪]

و في رواية لابن حبان : و لفظه : قالت : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : من التمس رضا الله بسخط الناس , رضي الله عنه و أرضى الناس عنه , و من التمس رضا الناس بسخط الله , سخط الله عليه , و أسخط عليه الناس .

‘ভিন্ন রেওয়ায়েতে ইবনে হিববান থেকে বর্ণিত হয়েছে, আয়িশা রা. বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মানুষের অসন্তুষ্টি সত্বেও যে ব্যক্তি আল্লাহর সমত্মষ্টি চাইবে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দিবেন।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টি সত্বেও মানুষের সন্তুষ্টি চাইবে, আল্লাহ তার প্রতি ক্রদ্ধ হন এবং মানুষকেও তার প্রতি ক্রদ্ধ করে দেন।’ [ইবনে হিববান : ২৭৬]

নিম্নে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি, যার আলোকে অপরকে সহযোগিতা করার বিষয়টি হাদীসে কতটা গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। যথা :

عن ابن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : المسلم أخو المسلم لا يظلمه و لا يسلمه , و من كان في حاجة أخيه كان الله في حاجته , و من فرج عن مسلم كربة فرج الله عنه كربة من كربات يوم القيامة , و من ستر مسلما ستره الله يوم القيامة .

‘ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মুসলমান মুসলমানের ভাই, সে তাকে অত্যাচার করবে না এবং তাকে পরিত্যাগ করবে না। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে থাকবে, আল্লাহ তার প্রয়োজনে থাকবেন। যে ব্যক্তি মুসলমানের বিপদ দূর করবে, কিয়ামতের বিপদ থেকে আল্লাহ তাকে উদ্ধার করবেন। যে ব্যক্তি মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিবসে তার দোষ গোপন রাখবেন।’ [বুখারী : ২৪৪২]

عن ابن عمر رضي الله عنهما , عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال : إن لله تعالى أقواما يختصهم بالنعم لمنافع العباد , و يقرها فيهم ما بذلوها , فإذا منعوها , نزعها منهم , فحولها إلى غيرهم .

‘ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ কিছু মানুষকে মানুষের কল্যাণার্থে বিপুল নিআমতে ভূষিত করেছেন, যতক্ষণ তারা তা ব্যয় করবে, ততক্ষণ তিনি তা তাদের মাঝে বহাল রাখেন। যখনি তারা তা বন্ধ করে দেয়, আল্লাহ তা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন এবং অন্যের নিকট তা অর্পণ করেন।’ [হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে আবিদুনইয়া, আলবানী একে হাসান বলেছেন, দ্রষ্টব্য : সিলসিলাতুল আহাদীস : ১৬৯২]

عن عبد الله بن عمرو رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إن لله عند أقوام نعما أقرها عندهم ما كانوا في حوائج المسلمين ما لم يملوهم , فإذا ملوهم نقلها من عندهم إلى غيرهم .

‘আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : অনেকের কাছে আল্লাহর বিপুল নিআমত রয়েছে, তিনি তা তাদের কাছে বহাল রাখেন, যতক্ষণ তারা বিরক্তিহীনভাবে মানুষের প্রয়োজনে থাকে, যখনি তারা তাদের প্রতি বিরক্ত হয়, তিনি তা তাদের থেকে নিয়ে অন্যকে দিয়ে দেন।’ [তাবরানী : আওসাত ৮৩৫০]

عن ابن عباس مرفوعا , ما من عبد أنعم الله عليه نعمة فأسبغها عليه، ثم جعل شيئا من حوائج الناس إليه فتبرم , فقد عرض تلك النعمة للزوال .

‘ইবনে আববাস হতে বর্ণিত, যে বান্দাকে আল্লাহ বিপুল নিআমত দান করেছেন অত:পর তার প্রতি কিছু মানুষের প্রয়োজন অর্পণ করেছেন কিন্তু সে বিরক্ত হয়েছে, ফলে আল্লাহ উক্ত নিআমতকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছেন।’ [তাবরানী : আওসাত :৭৫২৯]

و لأن أمشي مع أخ في حاجة أحب إلى من أن أعتكف في هذا المسجد-يعني مسجد المدينة-شهراً .

তার থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে : ‘কোন ভাইয়ের প্রয়োজনে তার পাশে থাকা আমার নিকট এই মাসজিদে- অর্থাৎ মদীনার মসজিদে এক মাস ইতিকাফ করার চেয়ে উত্তম।’ [তাবরানী : কাবীর : ১৩৬৪৬]

عن أبي بردة بن أبي موسى عن أبيه رضي الله عنه قال : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا جاءه السائل أو طلبت إليه حاجة قال : اشفعوا تؤجروا , و يقضي الله على لسان نبيه صلى الله عليه و سلم ما شاء .

‘আবু বুরদা বিন আবু মূসা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোন প্রার্থনাকারী আসত কিংবা কোন প্রয়োজনে তার কাছে কিছু চাইত, তিনি বলতেন : তোমরা সুপারিশ কর, তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। আর আল্লাহ তার নবীর কথায় যা ইচ্ছা তা ফায়সালা করেন।’ [বুখারী : ১৪৩২]

عن ابن المنكدر يرفعه إلي النبي صل الله عليه و سلم : من أفضل العمل إدخال السرور على المؤمن تقضي عنه دينا , تقضي له حاجة , تنفس عنه كربة .

‘ইবনে মুনকাদির হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : শ্রেষ্ট কর্ম হচ্ছে মুমিনের অমত্মরে আনন্দের সঞ্চার। তুমি তার ঋণ আদায় করে দিবে, তার প্রয়োজন পুরণ করবে কিংবা তার বিপদ দূর করবে।’ [বাইহাকী : ৭২৭৪]

عن عمر بن الخطاب أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : إن من عباد الله لأناسا ما هم بأنبياء و لا شهداء , يغبطهم الأنبياء و الشهداء يوم القيامة بمكانهم من الله تعالى , قالوا : يا رسول الله , تخبرنا من هم ؟ قال : هم قوم تحابوا بروح الله , على غير أرحام بينهم , و لا أموال يتعاطوها , فو الله إن وجوههم لنور , و إنهم على نور , لا يخافون إذا خاف الناس , و لا يحزنون إذا حزن الناس و قرأ هذه الآية :

أَلاَ إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿62﴾

উমর বিন খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহর বান্দাদের এমন কেউ কেউ আছে, যারা নবী কিংবা শহীদ নয় ; কিয়ামতের দিবসে আল্লাহর নিকট তাদের অবস্থানের কারণে নবী ও শহীদগণ তাদেরকে ঈর্ষা করবেন।

সকলে বলল, হে আল্লাহ রাসূল ! আমাদেরকে কি বলবেন, তারা কারা?

তিনি বললেন, এমন সম্প্রদায়, যারা আল্লাহর অনুগ্রহে, পরস্পরের মাঝে রক্তের সম্পর্ক ও সম্পদের বিনিময় না থাকা সত্বেও একে অপরকে ভালোবেসেছে। আল্লাহর শপথ, তাদের মুখমন্ডলগুলো হবে আলো, তারা আলোর উপর থাকবে। মানুষ যখন ভীত হবে, তখন তারা ভীত হবে না। মানুষ যখন দু:খিত হবে, তখন তারা দু:খিত হবে না। তিনি এ আয়াতটি পাঠ করলেন : ‘শুনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই, আর তারা পেরেশানও হবে না।’ [সূরা ইউনূস : ৬২] [আবু দাঊদ : ৩৫২৭]

এ হাদীসগুলো পাঠ করে কেউ যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই কাজ আরম্ভ করে, তার চেয়ে অনেক ফলদায়ক ও কল্যাণকর হবে যদি যৌথ ও সম্মিলিত উদ্যোগে আমরা এর সূচনা করি।

৭০
ষষ্ঠদশ বপন: সংস্কারমূলক সংগঠন
আমি ভালভাবেই জানি যে, অনেকের কাছে আমার এ আলোচনা অসার ও গুরুত্বহীন মনে হবে। আমরা যা নিয়ে আলোচনা করব, যদি তা সঠিক অর্থে পালিত হয়, তবে তার যে ফল দাঁড়াবে তাতেই আমাদের এ আলোচনার সার ও গুরুত্ব প্রমাণ হয়ে যাবে। যে তার দেয়ালে টানানো বৃক্ষের ছবির দিকে তাকিয়ে প্রশামিত্ম অনুভর করে, আর যে নিজের রোপিত গাছের ছায়ায় বসে অনাবিল প্রশামিত্ম উপভোগ করে, তারা উভয়ে কি সমান? আমি এ আলোচনাকে এমনই মনে করি ; যে তা পাঠ করবে, নিজের জীবনে উদ্ভাসিত করার প্রয়াস চালাবে, সে অবশ্যই ছবি ও বাসত্মবতার পার্থক্য বুঝতে পারবে।

ছোট ছোট অনেক কারণের বাইরে তিনটি মূল কারণে আমরা সংস্কারমূলক সংগঠনের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছি। নিম্নে কারণ তিনটি তুলে ধরার প্রয়াস পাব :-

৭১
প্রথম কারণ : শরয়ী উপাদান
عن سهل بن سعد رضي الله عنه قال : بلغ رسول الله صلى الله عليه و سلم أن بني عمرو بن عوف بقباء كان بينهم شيئ فخرج يصلح بينهم في أناس من أصحابه فحبس رسول الله صلى الله عليه و سلم و حانت الصلاة فجاء بلال إلى أبي بكر رضي الله عنهما فقال يا أبا بكر إن رسول الله صلى الله عليه و سلم قد حبس و قد حانت الصلاة فهل لك أن تؤم الناس قال نعم إن شئت فأقام بلال الصلاة و تقدم أبو بكر رضي الله عنه فكبر للناس و جاء رسول الله صلى الله عليه وسلم يمشي في الصفوف يشقها شقا حتى قام في الصف فأخذ الناس في التصفيح-قال سهل : التصفيح هو التصفيق-قال و كان أبو بكر رضي الله عنه لا يلتفت في صلاته . فلما أكثر الناس التفت فإذا رسول الله فأشار إليه يأمره أن يصلي فرفع أبو بكر رضي الله عنه فحمد الله ثم رجع القهقرى وراءه حتى قام في الصف , و تقدم رسول الله صلى الله عليه و سلم فصلى للناس , فلما فرغ أقبل على الناس فقال : يا أيها الناس ما لكم حين نابكم شيئ في الصلاة أخذتم بالتصفيح إنما التصفيح للنساء , من نابه شيئ في صلاته فليقل : سبحان الله , ثم التفت إلى أبي بكر رضي الله عنه فقال يا أبا بكر ما منعك أن تصلي للناس حين أشرت إليك , قال أبو بكر : ما كان ينبغي لابن أبي قحافة أن يصلي بين يدي رسول الله صلى الله عليه و سلم .

‘ছাহাল বিন সাআদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খবর পেলেন যে, কুবার বানি আমর ইবনে আউফের মাঝে বিবাদ দেখা দিয়েছে। তিনি তাদের বিবাদ মিটানোর উদ্দেশ্যে বের হলেন। তিনি সেখানে আটকে গেলেন। এদিকে নামাজের সময় হয়ে এল। তখন বেলাল আবু বকর রা. এর কাছে এসে বলল : আবু বকর ! রাসূল তো আটকে গেছেন এদিকে নামাজের সময় হয়ে এসেছে আপনি কি নামাজ পড়াতে পারবেন? তিনি বললেন : তুমি চাইলে পারব। তখন বেলাল ইকামাত দিলেন এবং তিনি এগিয়ে গিয়ে তাকবির দিলেন এবং তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাতারের মাঝখান দিয়ে কাতার ফাঁক করে এগিয়ে এসে সামনের কাতারে গিয়ে দাঁড়ালেন। মানুষ তালি দিতে লাগল। তিনি বলেন : আবু বকর কখনো সালাতে এদিক সে দিক তাকাতেন না। মানুষ যখন বেশী তালি বাজাতে লাগল তখন তিনি পিছনে ফিরে রাসূলকে দেখতে পেলেন, তিনি ইশারা করে তাকে সালাত চালিয়ে যেতে বললেন, তখন আবু বকর হাত তুলে হামদ বললেন অত:পর পিছনে সড়ে এলেন এবং কাতারে এসে দাঁড়ালেন। রাসূল এগিয়ে গিয়ে নামাজ শেষ করলেন নামাজ শেষ করে মানুষদের দিকে ফিরে তিনি বললেন : হে মানুষ ! নামাজে তোমাদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে তোমরা তালি বাজাও কেন? তালি তো নারীদের জন্য। নামাজে কারো কোনো সমস্যা দেখা দিলে সে যেন বলে ‘‘সুবাহানাল্লাহ’’। অত:পর আবু বকরের দিকে ফিরে বললেন আমি ইশারা করার পরও তুমি ইমামতি করলে না কেন? আবু বকর বললেন : রাসূলের উপস্থিতিতে আবু কুহাফার ছেলের পক্ষে ইমামতি করা শোভনীয় নয়।

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لا تقاطعوا , و لا تدابروا , و لا تباغضوا , و لا تحاسدوا , و كونوا إخوانا كما أمركم الله .

আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘তোমরা পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন কর না, পরস্পর ঝগড়া কর না, বিদ্বেষে জড়িও না, একে অপরকে হিংসা কর না। বরং আল্লাহ তোমাদের যেমন আদেশ করেছেন, সেভাবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারতেন, এ সমসত্ম যুক্তি ও প্রমাণ তো পূর্বেই ছিল, কিন্তু আমাদের মহান সালাফ তো এর এমন প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা দেননি। কারণ, তারা জানতেন, এ বিষয়টি ব্যক্তিগত উদ্যোগে করার বিষয়, সম্মিলিত ও সাংগঠনিক কোন বিষয় নয়।

আমরা একে দুভাবে উত্তর দিতে পারি।

প্রথমত : সংস্কারের ব্যাপারে সমানভাবে সকলে আদিষ্ট। শরীয়ত প্রণেতা একে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যরূপে ঘোষণা দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে :

فَأَصْلَحَ بَيْنَهُمْ فَلاَ إِثْمَ عَلَيْهِ .

‘অতঃপর তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তাহলে তার কোন পাপ নেই।’ [সূরা বাকারা : ১৮২]

أَنْ تَبَرُّوا وَتَتَّقُوا وَتُصْلِحُوا بَيْنَ النَّاسِ .

‘ভালো কাজ করবে, তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং মানুষের মধ্যে সংশোধন করবে।’ [সূরা বাকারা : ২২৪]

وَالْعَصْرِ ﴿1﴾ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ ﴿2﴾ إِلاَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴿3﴾

‘যুগের কসম, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিতে রয়েছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে। আর পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ [সূরা আছর]

দ্বিতীয়ত: সংস্কারের উদ্দেশ্যে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার নজীর অনেক আছে। স্বামী স্ত্রী যদি পরস্পর মনোমালিন্য করে বিচ্ছিন্ন থাকতে আরম্ভ করে, তবে সম্মিলিত আকারে তাদের মাঝে বিষয়টির ফায়সালার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আমর বিন শুআইব হতে বর্ণিত হাদীসে আছে :

কুরআনে এসেছে :

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلاَحًا يُوَفِّقِ اللهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا ﴿35﴾

‘আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।’ [সূরা নিসা : ৩৫]

৭২
দ্বিতীয় কারণ : বাসত্মব অবস্থা
মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক ঝগড়া এ সময়ের সব চেয়ে বড় সমস্যা বলে চি ‎‎ হ্নত। শুদ্ধ নিয়ত নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যদিও এর বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালানোও হয়, কোনভাবেই এর শেষ হবে না এবং সুরাহার পন্থা উদ্ভাবন করা যাবে না।

বিবাহ জনিত মতবিরোধ কিংবা রাষ্ট্রীয় ভূমির আওতা নিয়ে বিরোধ- মুসলিম সমাজের বর্তমান বিরোধের রূপ এই ধরনের নিরেট ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেই। তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর জন্য বহু রক্তারক্তি ও খুনোখুনি চলছে ইসলামী বিশ্ব জুড়ে। কোন ব্যক্তি এককভাবে এই সব সমস্যার মুকাবিলা করবে, এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য একাকী ময়দানে নেমে পড়বে- এটি আর কখনোই সম্ভব নয়। এমনকি, যাদের পক্ষ থেকে সংস্কার ও সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ ছিল, সেই দায়ী ও আলিমদের মাঝেও এই মরণঘাতি মতবিরোধ সর্বদা মাথা চাড়া দিয়ে থাকে।

একদিন আমার এক প্রিয় ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত হল, ইসলামী দলগুলোর মাঝে মতবিরোধ নিরসনে তার ভূমিকার জন্য সে সকলের মাঝে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। একদিন সে আমার কাছে এসে চরম হাতাশা প্রকাশ করল, আরব এলাকার দুটি দলের মাঝে তিনি ইতিমধ্যে মতবিরোধ নিরসনের জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সেই প্রচেষ্টা নিতামত্ম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে তার হাতাশা চরমে উঠে। সে আমাকে বলল, আমি কয়েকবার তাদের উভয় দলের নেতৃবর্গকে একত্র করতে সক্ষম হয়েছি। আমি ভেবে দেখেছি, তাদের মাঝে বিরোধের মৌলিক কোন কারণ নেই। তাই তাদের ঐক্যের ব্যাপারে আমি ছিলাম পরিপূর্ণ আশাবাদী। কিন্তু যখনি তাদের মাঝে ঐক্যের ন্যূনতম সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তখনি একজন চি ‎‎ হ্নত পরিচিত ব্যক্তি তা ভাঙ্গার হীন খেলায় মেতে উঠেছে। তাই আমার প্রচেষ্টা আর আলোর মুখ দেখল না।

তিনি আমাকে যে ঘটনা শোনালেন, পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম দেশে এই দৃশ্য প্রাত্যহিক হয়ে গিয়েছে। তারা পারস্পরিক বিরোধ মিটিয়ে কোনভাবেই একত্রে বসে সমাজের জন্য নিজেদেরকে নিয়োজিত করছেন না। কেউ কেউ নিরেট নেতৃত্বের মোহের কারণে একই মতের অনুসারী দুটি দলকে একত্রে কাজের সুযোগ দিচ্ছেন না।

৭৩
তৃতীয় কারণ : ক্রমশ প্রকট আকার ধারণকারী মতবিরোধ
মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণের দ্বারা আমরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছি, সর্বোচ্চ শ্রেণী থেকে সর্বনিম্ন শ্রেণীর সকল মুসলমানই এ ভয়াবহ মতবিরোধ ক্রমশ আক্রামত্ম হয়ে পড়ছেন। ক্রমেই তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৭৪
সপ্তদশ বপন: ওয়াক্ফ বপনের দৃষ্টিভঙ্গি
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿261﴾

‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা বাকারা : ২৬১]

عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما , أن النبي صلى الله عليه وسلم قال لعمر بن الخطاب لما استنصحه في أرضه بخيبر : إن شئت حبست أصلها وتصدقت بها .

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের নিকট খায়বারে তার জমির ব্যাপারে উপদেশ চাইলে রাসূল উমরকে বললেন : ‘তুমি চাইলে তার মূলটা রেখে তা সাদাকা করে দিতে পার।’ [বুখারী : ২৭৩৭, মুসলিম : ১৬৩২]

বর্তমান যুগে ওয়াক্ফ হতে পারে বিভিন্ন রূপে এবং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

যেমন নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে সমষ্টিগত ওয়াক্ফ। উদাহরণত হাজীদের জন্য একটি ওয়াক্ফ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তার রূপটা এমন হতে পারে : এক শ’ দিরহাম বা এক দিনারের কূপন ছাড়া হবে এবং কূপন বিক্রির টাকায় কোনো দালান ক্রয় করা হবে অত:পর তার বাৎসরিক আয় দিয়ে যারা কখনো হজ বা ওমারা করেনি তাদের হজ-ওমরা করানো হবে।

এই ধরনের ওয়াক্ফ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা যেতে পারে, কূপ খননের জন্য, দায়ীদের ব্যায়ভার গ্রহণের জন্য, অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়দেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াতের কাজে ব্যয়ের জন্য বা কুরআন বা অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তকাদি ছাপানোর কাজে ব্যয়ের জন্য।

সাদাকায়ে জারিয়ার জন্যও এই ধরনের কিছু করা যায়। যেমন আকীদা প্রচারের জন্য ওয়াক্ফ হতে পারে। অর্থাৎ সে ফাউন্ডেশনের অর্থ ব্যয় করা হবে আকীদা বিশেষজ্ঞ তৈরী, এই বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রদের ব্যয়ভার গ্রহণ এবং এই সংক্রান্ত প্রকাশনায় খরচ ইত্যাদি কাজে। এভাবে এই ধরনের আরেকটি ওয়াক্ফ হতে পারে কুরআন ও উলুমূল কুরআন বা কুরআনতত্ত্ব প্রচারের কাজে ব্যয়ের জন্য, হাদীস ও হাদীসতত্ত্ব প্রচারের জন্য, ফিকাহ ও ফিকাহ শাস্ত্র প্রচারের জন্য...ইত্যাদি।

কিংবা ওয়াক্ফ হবে ফকীর-মিসকীনদের জন্য, বা মুসাফিরদের জন্য কিংবা যাকাতের অন্য ব্যয়ক্ষেত্রে যে কোনো প্রকারের জন্য।

ওয়াক্ফে উৎসাহিত করার জন্য আমি এখানে ওয়াক্ফ সংক্রান্ত দলীলগুলো উল্লেখ করেছি। যারা ওয়াক্ফ করতে চান তারা নিশ্চয় এতে উদ্বুদ্ধ হবেন। কুরআনে এসেছে :

مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿261﴾

‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা বাকারা : ২৬১]

وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ ﴿39﴾

‘আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিয্কদাতা।’ [সূরা সাবা : ৩৯]

وَمَا تُنْفِقُونَ إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لاَ تُظْلَمُونَ ﴿272﴾

‘আর তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যয় কর এবং তোমরা কোন উত্তম ব্যয় করলে তা তোমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। আর তোমাদের প্রতি যুল্ম করা হবে না।’ [সূরা বাকারা : ২৭২]

الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿268﴾

‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রতার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা বাকারা : ২৬৮]

হাদীসে এসেছে :

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : " قال الله تبارك وتعالى : يا ابن آدم أنفق أنفق عليك " وقال : " يمين الله ملآى وقال ابن النمير : مللآن سحاء , لا يغيضها شيء الليل والنهار "

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন : হে আদম সন্তান খরচ কর, তাহলে আমি তোমার জন্য খরচ করব’। তিনি আরো বলেন : ‘আল্লাহর হাত সদা ঋদ্ধ।’ [মুসলিম : ৯৯৩]

وعن عقبة بن عامر رضي الله عنه قال صلى الله عليه وسلم : كل امرئ في ظل صدقته حتى يفصل بين الناس .

‘উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘কিয়ামতের দিন সব মানুষের ফায়সালা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সাদকাকারীরা তাদের সাদাকার ছায়ায় থাকবে’।’ [আহমদ : ১৭৩৩৩]

আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদান লাভের আশায়, তার কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের জন্য, তার ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য, যেদিন বন্ধ হয়ে যাবে আমার জীবন ও কর্ম, সেদিনের জন্য সঞ্চয় করে রাখার উদ্দেশ্যে, পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানদের সেবা করার উদ্দেশ্যে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - যিনি, তার কাছে তার খায়বরস্থ যমীন সম্পর্কে জানতে চাইলে উমরকে বলেছিলেন : ইচ্ছে হলে তার আসলটা রেখে দিয়ে সাদাকা করে দিতে পার’- তার সুন্নাত অনুকরণ করার জন্য, নিম্নে দস্তখত প্রদানকারী আমি নিন্মোক্ত জবানবন্দী দিচ্ছি : আমার মালিকানাধীন, .... স্থানে অবস্থিত, ... নং জমিটি আল্লাহর নিকট প্রতিদানের আশায় ওয়াক্ফ করে দিচ্ছি। তা নিয়ে কখনো কোনো বিবাদ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতই হবে নির্ধারক ফায়সালাকারী, আল্লাহর এই বাণী অনুসারে :

فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ .

‘কোনো বিষয়ে যদি তোমরা বিবাদে লিপ্ত হও তাহলে তাকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে যাও’। [সূরা নিসা : ৫৯]

আর বিষয়টি যদি ইজতিহাদ সাপেক্ষ হয় তাহলে ফায়সালা নেওয়া হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত অনুসারে। এ ক্ষেত্রে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া ওয়াক্ফ তত্ত্বাবধায়কদের সাথে, বিজ্ঞ-বিশ্বস্ত, সমাজের বিচার আচার করেন, এমন একজন উপদেষ্টা থাকবেন। এই বিবাদ নিরসনের ক্ষেত্রে তিনিও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিনিয়োগ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তার পরামার্শ নেওয়া হবে।

৭৫
ওয়াক্ফের বিধিমালা
ওয়াক্ফ সংরক্ষণের প্রতি যত্নবান থাকা। ওয়াক্ফের সংরক্ষণের ব্যয়ভার গ্রহণ করা হবে তার মুনাফার অংশ থেকে। ব্যয় থেকে সংরক্ষণের বিষয়টি সবসময় অগ্রাধিকার পাবে।

ওয়াক্ফের সম্পত্তির ৩০% ভাগ বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে রাখা। এবং মূল ওয়াক্ফ সম্পত্তির মত এই সম্পদ ও তার লভ্যাংশও ওয়াক্ফ হয়ে যাবে।

আমার জীবদ্দশায় আমি নিজেই ওয়াক্ফ তত্ত্বাবধান করব। তবে ওয়াকফের কল্যাণের স্বার্থে আমি যদি আমার কোনো ছেলে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে তার দায়িত্ব দেই তাহলে সে-ই তা পালন করবে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হচ্ছে সে এই দায়িত্ব পালন করবে নিছক আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য, কোনো বিনিময় ছাড়া। তবে যদি তার জন্য ওয়াক্ফের লভ্যাংশ থেকে তার কাজের কোনো বিনিময় নির্ধারণ করা হয় তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এই বিনিময়, যে কাজ করছে তার লভ্যাংশের ৫০% এর বেশী হতে পারবে না কোনোভাবেই। আমার কোনো সন্তান না থাকলে বা তাদের কাউকে এই কাজের জন্য না পাওয়া গেলে এই ক্ষেত্রে আমি অন্য কোনো বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ব্যাক্তির সাহায্য নিতে পারি।

ওয়াক্ফের তত্ত্বাবধায়কগণ যদি মূল ওয়াক্ফ সংরক্ষণ বা উৎপাদনমূলক খাতগুলোতে কোনো কর্মচারী নিয়োগ দিতে চান তাহলে তারা তা করতে পারবেন এবং ওয়াক্ফের লভ্যাংশ থেকে তাদের বেতন-ভাতা দিতে পারবেন

ওয়াক্ফের সম্পত্তি কোনো সূদী ব্যাংকে রাখা যাবে না। এবং হারাম কিংবা ইন্স্যুরেন্স জাতীয় সন্দেহজনক খাতে তা বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। কারণ আল্লাহ উত্তম তাই তিনি উত্তম ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلاَ تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآَخِذِيهِ إِلاَّ أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ ﴿267﴾

‘হে মুমিনগণ, তোমরা ব্যয় কর উত্তম বস্ত্ত, তোমরা যা অর্জন করেছ এবং আমি যমীন থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে এবং নিকৃষ্ট বস্ত্তর ইচ্ছা করো না যে, তা থেকে তোমরা ব্যয় করবে। অথচ চোখ বন্ধ করা ছাড়া যা তোমরা গ্রহণ করো না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।’ [সূরা বাকারা : ২৬৭]

এর সাথে সাথে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ওয়াকফের তত্ত্বাবধায়করা সবসময় শরীয়ত অনুগত নির্দেশনাগুলো মেনে চলবেন, তার প্রতি যত্নবান থাকবেন।

কারণ, শুধু মাদরাসা, মসজিদ, ইসলামী মারকায নির্মাণ করাই ওয়াকফের লক্ষ্য না। বরং মাদরাসার সিলেবাস কী, কেমন, তা ইসলাম শরীয়ত সম্মত কি না, অনুরূপ মসজিদের ইমাম, মসজিদে প্রদানকৃত দারসগুলো এবং তার সাথে সংযুক্ত পাঠাগার.. এই সব সম্পূর্ণ শরীয়ত মুওয়াফিক কিনা সে দিকেও নজর রাখতে হবে।

ওয়াকফের সম্পত্তি বিলি-বন্টনের ক্ষেত্রে শরীয়ত আদিষ্ট শর্তগুলো মানতে হবে। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে কাউকে দান, কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।

যা সাদাকা বাতিল করে দেয় বা তার সাওয়াব কমিয়ে দেয়, তত্ত্বাবধায়কদেরকে সতর্কভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لاَ تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ .

‘হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদাকা বাতিল করো না। সে ব্যক্তির মত, যে তার সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বাস করে না আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি।’ [সূরা বাকারা : ২৬৪]

৭৬
ওয়াকফের ব্যয়ক্ষেত্র
বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য ৭০% বরাদ্দ থাকবে, সন্তানরা সরাসরি তার তত্ত্বাবধান করুক বা নির্ভরযোগ্য কারো তত্ত্বাবধানে তা ছেড়ে দিক, সর্বাবস্থায়।

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেন, এমন যে কোনো বিষয়, পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ওয়াকফের ব্যয়ক্ষেত্র হতে পারে।

কল্যাণকর খাতের কোনো শেষ নেই। তবুও আমি কুরআন-হাদীস দ্বারা সুপ্রমাণিত, ওয়াক্ফের এমন কয়েকটি ব্যয়ের কথা উল্লেখ করছি। তত্ত্বাবধায়কগণ তা অনুসরণ করতে পারেন :

সাওয়াবের আশায় মসজিদ নির্মাণ বা তার নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করা। যেমন হাদীসে এসেছে :

عن أبي ذر رضي الله عنه قال , قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من بنى لله مسجدا ولو كمفحص قطاة بنى الله له بيتا في الجنة .

আবু যর রা. বর্ণনা করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর জন্য কাতা পাখীর বাসার সমান একটা মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে বাড়ি নির্মাণ করবেন’। [ইবনে হিববান : ১৬১০]

মসজিদ পুনর্গঠন, মেরামত মসজিদ নির্মাণের মতই।

দীনী ছাত্রদের লেখাপড়ার ব্যয় গ্রহণ করা, তাদের সহযোগিতা করা। হাদীসে এসেছে :

عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من سلك طريقا يلتمس فيه علما سهل الله به طريقا إلى الجنة .

‘আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের পথে বের হয় আল্লাহ তার জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করে দেন’। [মুসলিম : ২৬৯৯]

আমি আশা করি, ইলম অন্বেষণ, শিক্ষাদান ও ইলম অনুসারে আমল করার ফলে তাদের জান্নাতের পথ সুগম হওয়ার এই যে সুসংবাদ, তাদের সহযোগিতা করার মাধ্যমে আমরাও তার অন্তর্ভূক্ত হতে পারব। কারণ হাদীসে এসছে :

عن ابن مسعود رضي الله عنه أنه قال : الدال على الخير كفاعله .

ইবনে মাসঊদ রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘ভাল কাজের নির্দেশনা দানকারী তা আদায়কারীর মতই’। [আহমদ : ২২৩৬০]

নানা বিপদ-আপদ মুকাবিলায় মুসলমানদেরকে সহযোগিতা করা। এই আশায় যে, আল্লাহ আমাদেরকে মহা বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। হাদীসে এসেছে :

عن أبي هريرة رضي الله عنه : يقول الرسول صلى الله عليه وسلم : من نفس عن مؤمن كربة من كرب الدنيا نفس الله عنه كربة من كرب القيامة .

আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘যে ব্যক্তি মুমিনের পার্থিব কোনো সংকট দূর করবে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের একটি সংকট থেকে মুক্তি দিবেন’। [মুসলিম : ২৬৯৯]

মুসলিম ইয়াতীম শিশুদের দায়িত্বভার গ্রহণ করা। কারণ তাতে আমরা জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গ পাব। যেমন হাদীসে এসেছে :

أنا وكافل اليتيم في الجنة هكذا . وأشار بالسبابة والوسطى وفرج بينهما شيئا .

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলী তুলে এবং দুয়ের মাঝে একটু ফাঁক রেখে বললেন : আমি ও ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এই পরিমাণ নিকটে থাকবে’। [বুখারী : ৫৩০৪]

আফ্রীকার বনাঞ্চল এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যারা আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের কাজ করছেন, তাদের দায়িত্ব নেওয়া। এটা সর্বোত্তম আমলগুলোর অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ .

‘তার চেয়ে উত্তম আমলকারী কে আছে, যে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয় এবং সৎ আমল করে এবং বলে যে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত?’ [সূরা ফুসসিলাত : ৩৩]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

لأن يهدي الله بك رجلا واحدا خير لك من أن يكون لك حمر النعم .

‘আল্লাহ তোমার মাধ্যমে একজন লোক হিদায়াত দেওয়া, তোমার এক পাল লাল উট থাকার চেয়েও উত্তম।’ [বুখারী : ৩৭০১]

আল্লাহর কিতাবের খেদমত করা। কুরআন ছাপা ও বিতরণের কাজে ব্যায় করা এবং শিক্ষা ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করা। হাদীসে এসেছে :

عن عقبة بن عامر عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : أفلا يغدو أحدكم إلى المسجد فيعلم أو يقرأ آيتين من كتاب الله عز وجل خير له من ناقتين , وثلاث خير له من ثلاث , وأربع خير له من أربع , ومن أعدادهن من الإبل .

উকবা বিন আমের রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘তোমাদের কেউ সকালে মসজিদে গিয়ে কিছু ইলম শিখা বা কুরআনের দুই আয়াত পড়া দুটি উটের চেয়ে উত্তম, তিন আয়াত তিন উটের চেয়ে, চার আয়াত চার উটের চেয়ে উত্তম।’ [মুসলিম : ৮০৩]

সাওয়াবের আশায় মুসলমানদের ইফতার খাওয়ানো। কারণ হাদীসে এসেছে :

من فطر صائما , كان له مثل أجره , غير أن ينقص من أجر الصائم شيئا . وفي رواية عن زيد بن خالد , أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من فطر صائما أو جهز غازيا فله مثل أجره .

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার দান করবে সে- তার সাওয়াবের কোনো হ্রাস না করেই- তার সমপরিমাণ প্রতিদান পাবে।’ [তিরমিযী : ৮০৭]

যায়েদ বিন খালিদ থেকে বর্ণিত অন্য আরেকটি বর্ণনায় এসেছে :

রাসূল সাল্লাল্লাহু বলেন : ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার দান করবে বা কোনো যোদ্ধার সামান যোগান দিবে সে তার সমপরিমাণ প্রতিদান পাবে।’ [বাইহাকী : ৩৬৬৭]

রমজান বা অন্য যে কোনো সময়ে মুসলমানদের আহার দান করা। তবে অবশ্যই সাওয়াবের আশায়। যেমন হাদীসে এসেছে :

إن الله يقبل الصدقة ويأخذها بيمينه فيربيها لأحكم كما يربي أحدكم مهره , حتى إن اللقمة لتصير مثل أحد .

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ বান্দার সাদাকা গ্রহণ করেন ডান হাতে এবং মানুষ যেমন তার অশ্বশাবকের পরিচর্যা-প্রতিপালন করে তেমনি তিনি তার প্রতিপালন করতে থাকেন। এমনকি এক সময় এক লোকমা আহার উহুদ পর্বত পরিমাণ হয়ে যায়।’ [তিরমিযী : ৬৬২]

যদি ওয়াক্ফের খাবার দানের ক্ষেত্রে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন, মানে সাদকায়ে জারিয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে সেটা হবে সর্বোত্তম। উদাহরণত: কৃষি-পশু-মৎস খামার ইত্যাদি মুসলমানদের নামে ওয়াক্ফ করে দেওয়া যেতে পারে।

বিভিন্ন ইসলামী প্রকল্প, কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কুরআনে এসেছে :

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلاَ تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ

‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।’ [মায়িদা : ২]

নানা ধরনের সাদকায়ে জারিয়া গড়ে তোলায় উৎসাহিত করা। উদাহরণত: মুসলমানদের জন্য কূপ খনন করা। সাআদ বিন উবাদা রা. বলেন :

عن سعد بن عبادة رضي الله عنه قال . قلت : يا رسول الله إن أم سعد ماتت فأي الصدقة أفضل ؟ قال : الماء . فحفر بئرا , وقال : هذه لأم سعد .

‘আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল ! সাআদের মা মারা গিয়েছেন তার জন্য কি সাদাকা করলে সবচেয়ে ভাল হয়? তিনি বললেন : ‘পানি’। তা শুনে তিনি একটি কূপ খনন করে বললেন : এটি সাআদের মায়ের জন্য। [আবু দাঊদ : ১৬৭১]

সমত্মানদের কারো যদি-আল্লাহ না করুন-ওয়াকফের মুনাফা থেকে সম্পদ প্রয়োজন পরে তাহলে তারাই হবে তখন তার সবচেয়ে বেশী হক্বদার। বিশেষত তাদের যদি আবাসনের দরকার পরে তাহলে তারা বিনামূল্যে আবাসন পাবে।

কোনো বিষয়ে সমত্মানরা যদি মনে করে যে, তাতে আমাদের মঙ্গল আছে তাহলে তারা তা করতে পারে। উদাহরণত: মুমূর্ষ কোনো রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো কিংবা বিবাহে অসমর্থ কোনো নেককারের বিয়ের ব্যাবস্থা করা। সাময়িক প্রয়োজন সবসময় তার পরিমাণ অনুসারেই আদায় করা হবে।

আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা তিনি আমার এসব কর্ম ভালভাবে গ্রহণ করবেন, তার ভাল ফলন ফলিয়ে দিবেন এবং আমার জন্য তাকে সাদকায়ে জারিয়া বানিয়ে রাখবেন এবং তাকে একটি সুন্নাতে হাসানা বানিয়ে দিবেন, যুগ যুগ ধরে মুমিনগণ যা অনুসরণ করে যাবে।

আমি এই ওয়াক্ফ করছি। যারা তার বিরোধিতা করবে, তা ব্যর্থ করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে আমি একমাত্র আল্লাহর কাছে অভিযোগ করছি, তিনি তাদের উপযুক্ত এবং দ্রুত শাসিত্ম দিবেন, কঠোরভাবে তাদের পাকড়াও করবেন। তিনিই সর্বোত্তম ও ক্ষমতাবান অভিভাবক। হে আল্লাহ! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পরিবার পরিজন ও সাথীদের উপর দরুদ পাঠান।

তারিখ : ......... হি, মুতাবেক : .................. ইং

প্রথম সাক্ষী : ..................................

দ্বিতীয় সাক্ষী ......................

নাম : .......................

নাম : .....................

স্বাক্ষর : ..........................

স্বাক্ষর : ................

ওয়াক্ফকারী : .................

স্বাক্ষর : ..............

আমি আশা করি এমন অনেক মানুষ আছেন আল্লাহ যাদের এই তাওফীক দিয়েছেন যে, তারা কয়েকটি নাম দিয়ে এই ঘরগুলো পুরণ করবেন। আর যাদের আল্লাহ সেই তাওফীক দেননি তারা যাদের সামর্থ্য আছে তাদের উদ্বুদ্ধ করবে এবং তার সমপরিমাণ প্রতিদান পাবে। কারণ সৎ কাজে উৎসাহদানকারী তা সম্পন্নকারীর মতই।

৭৭
অষ্টাদশ বপন: দাওয়াতী মারকায
قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿108﴾

‘বল, ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’।’ [সূরা ইউসূফ : ১০৮]

عن سهل بن سعد رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال لعلي رضي الله عنه : فو الله لأن يهدي الله بك رجلا واحدا خير لك من أن يكون لك حمر النعم .

সাহল বিন সাআদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহর তোমার মাধ্যমে একজন লোককে হিদায়াত দেওয়া, তোমার এক পাল লাল উট থাকার চেয়েও উত্তম।’ [বুখারী : ৩৭০১]

وعن أبي موسى رضي الله عنه قال : كان رسول الله صلى ا لله عليه وسلم إذا بعث أحدا من أصحابه في بعض أمره قال : بشروا ولا تنفروا , ويسروا ولا تعسروا .

আবু মূসা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার সাহাবীদের কাউকে কোন কাজে প্রেরণ করতেন, বলতেন, সুসংবাদ প্রদান কর এবং বীতরাগ কর না ; সহজ কর, কঠিন কর না। [মুসলিম : ১৭৩২]

যে কোনো ধরনের দাওয়াতী তৎপরতায় দাওয়াতী কেন্দ্র হবে সবচেয়ে অগ্রগামী- এটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। কারণ, তার সর্বপ্রথম দায়িত্বই হচ্ছে মানুষকে ব্যাপক অর্থে সময় ও স্থান উপযোগী সাদকায়ে জারিয়া গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ করা। এটাই তো নিজস্ব এলাকা। তারপরও আমি, দাওয়াতী কেন্দ্র যাতে অবদান রাখতে পারে- এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।

৭৮
প্রথমত : প্রকাশনা
দাওয়াতী কেন্দ্র, বিভিন্ন ধরনের ও কাল ও স্থান উপযোগী সাদকায়ে জারিয়ায় উৎসাহমূলক প্রকাশনা ও তার ব্যাপক প্রচারের প্রকল্প হাতে নিতে পারে। এই ক্ষেত্রে দাওয়াতী কেন্দ্রগুলো, অন্যান্য মুসলিম দেশের বা তার দেশের মুসলিম ও অমুসলিম এই জাতীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা নিতে পারে। শরীয়তী, সমাজিক, আর্থিক ইত্যাদি নানা দিক থেকে পরীক্ষিত বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে তার প্রকাশনা ও প্রচারণার ব্যবস্থা করতে পারে বা ব্যক্তিগত অথবা সমষ্টিগতভাবে ডোনারের কাছে তা উপস্থাপন করতে পারে।

তবে এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই প্রকল্পগুলোয় বৈচিত্র্য থাকা উচিৎ। নানা ধরনের প্রকল্প, যাতে সর্বসত্মরের মানুষ তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারে। যারা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে না তারা পরোক্ষভাবে তাতে অংশগ্রহণ করবে। উদাহরণত তার প্রচরণার জন্য কাজ করবে। নানা উপায়ে মানুষকে তাতে উদ্বুদ্ধ করবে।

৭৯
দ্বিতীয়ত : দায়ী প্রশিক্ষণ
এমন অনেক দেখা গেছে যে, ইসলামী বিশ্বে বা অনৈসলামী বিশ্বে অনেক ইসলামী মারকায গড়ে উঠেছে অত:পর তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিংবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই সব সংগঠনগুলোর কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল কিছু পুস্তিকা প্রকাশ এবং তা প্রচার, স্থানীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি ক্ষুদ্র পরিসরের কর্মকান্ডের সাথে।

অথচ তাদের অবশ্য কর্তব্য ছিল, সত্যিকার সক্ষম একটি দায়ী টিম গঠন করা, যারা স্বতন্ত্রভাবে, কারো পক্ষ-বিপক্ষ না নিয়ে নিখাদ আল্লাহর জন্য কাজ করে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন :

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿108﴾

‘বল, ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’।’ [সূরা ইউসূফ : ১০৮]

যাদের জ্ঞানগত প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয়েছে এমন এক দল দায়ী...

যে স্থানে সংগঠনটি কাজ করছে সে দেশ ও এলাকার স্থানীয় লোকদের মধ্যে এক দল দায়ী তৈরী করা, যারা উক্ত মারকায সেখান থেকে ওঠে গেলেও, তাদের জাতির মাঝে তাদের ভাষায় দাওয়াতী তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে।

৮০
তৃতীয়ত : অমুসলিমদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়া
ইসলামী দাওয়াতী কেন্দ্রগুলোতে যে জিনিসগুলো সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ তার প্রধানতম, অমুসলিমদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। আমি এখানে প্রথমে এই বিষয়ের গুরুত্ব অত:পর তার কর্ম-শৈলী নিয়ে আলোচনা করব।

৮১
(ক) অমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াতের গুরুত্বসমূহ :
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা.-কে বলেছিলেন :

انفذ على رسلك حتى تنزل بساحتهم ثم ادعهم إلى الإسلام وأخبرهم بما يجب عليهم من حق الله فيه , فو الله لأن يهدي الله بك رجلا واحدا خير لك من أن يكون لك حمر النعم .

‘তুমি তোমার গতিতে তাদের এলাকায় গিয়ে প্রথমে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে এবং ইসলামে তাদের উপর আল্লাহর কি কি হক রয়েছে তা জানাবে। আল্লাহর শপথ তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন লোকের হিদায়াতের ব্যবস্থা করেন তাহলে তা তোমার জন্য তোমার মালিকানায় এক পাল লাল উট থাকার চেয়েও উত্তম হবে।’ [বুখারী : ৩৭০১]

তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে দায়িত্ব তা থেকে মুক্ত হওয়া। কারণ আমাদের মাঝে থাকার পরও যদি আমরা তাদেরকে দাওয়াত না দেই, ধর্মীয় সহযোগিতা না করে শুধু পার্থিব সহযোগিতা করে যাই, পার্থিব কোনো কসুর করলে তাদের নিন্দা করি কিন্তু আমরা যে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করছি সে ক্ষেত্রে নিজেদের আত্মসমালোচনা না করি, তাহলে কিয়ামতের দিন তারা তো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে।

অন্যান্য অমুসলিম দেশে যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী পাঠানো। এর সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে অমুসলিম দেশের যে সব কাফিররা আমাদের নিকটে এসে ইসলাম গ্রহণ করে তাদেরকেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার দায়ী হিসেবে সে দেশে পাঠানো... এই কাজ যদি বাস্তবিকেই করা যায় তাহলে তো রীতিমত বিপ্লব হয়ে যাবে।

যারা আমাদের দেশে এসে আমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, আমাদের প্রতি অবিচার করেছে, বরং অনেক মুসলিম দেশে আমাদের সংখ্যালঘু বানিয়ে রেখেছে, তাদের ধর্মপ্রচার তৎপরতার মুকাবেলা করা। আমরা যদি তাদের লোকদেরকেই ইসলামের দায়ী বানিয়ে তাদের দেশে পাঠাতে পারি তাহলে তা অবশ্যই খুব কার্যকরী ব্যাপার হবে।

৮২
(খ) দাওয়াতের কর্ম-শৈলী
দাওয়াতী কার্যক্রমের ইসলামী দাওয়াতী মারকাযগুলোর ঐতিহ্যবাহী এবং বেশ সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি :

সময় এবং প্রতিটি জাতি-সম্প্রদায় উপযোগী দাওয়াতী শৈলী তৈরি করা।

অমুসলিমদের কাছে, তাদের কর্মক্ষেত্র, বাড়িঘর এবং সমাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেরাই যাওয়া, তারা ইসলামী মারকাযগুলোতে এসে সাক্ষাৎ করবে- সেই অপেক্ষায় না থাকা।

বিভিন্ন উপায়ে এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ইসলামী দাওয়াতী প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই এই বিষয়ে অনেক ওয়াকেফহাল। আমি শুধু নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করছি :

মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি দাওয়াতের কর্মে নিয়োজিত করা। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি মুসলিম নারী-পুরুষ তার ধর্মকে ভালোবাসে, তা নিয়ে গর্ব বোধ করে, তার হাতে কোনো কাফির মুসলমান হোক- নিখাদভাবে তা কামনা করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে : দাওয়াতী মারকাযগুলো কি মুসলমানদের মনে এই প্রাকৃতিক, স্বভাবজাত আশাকে কার্যকরী ও ফলপ্রসু একটা জায়গায় নিতে পারবে?

উত্তর হচ্ছে হাঁ ! এবং ইনশাল্লাহ খুব সহজেই তা পারা যায়।

এর সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে মসজিদভিত্তিক তৎপরতা। মারকাযগুলোকে মসজিদের ইমাম খতীবদের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে। তারা তাদের খুতবা-বয়ান-সালাত পরবর্তী তালিমের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে সচেতন করে তুলবেন, তাদের প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করবেন এবং তাদের মনের স্বভাবজাত সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে এক বিশাল দাওয়াতী কার্যক্রমে পরিণত করবেন। এরপর মারকায আসবে সুসংবাদের মত... এই স্বেচ্ছা দায়ীদের যাবতীয় ব্যয়ভার গ্রহণ করবে .. মারকায তাদের কাছে যা দাবী করবে তা হচ্ছে এই কাজে তাদের অব্যাহত থাকা, তারা যদি থাকতে না পারেন অন্তত মারকাযকে তা চালিয়ে যেতে অনুমতি দেওয়া।

হাঁ, ব্যাপারটা এত সহজ .. এই ক্ষেত্রে মারকাজের কাজ হচ্ছে সূচনার উদ্বোধন ঘটানো.. যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়া।

মাঠে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলো, ইসলাম গ্রহণ করতে চাই, ইসলাম বিষয়ে জানতে আগ্রহী, ইসলাম নিয়ে সংলাপ করতে চাই.. ইত্যাদি নানা ক্যাটাগরী দিয়ে কূপন তৈরি করতে পারে, যার সাথে থাকবে আগ্রহী ব্যক্তির নাম ঠিকানা। পরে কূপনগুলো মসজিদের মাধ্যমে সেচ্ছা দায়ীদের মাঝে বিলি করা হবে এবং তারা তা পূর্ণ করে মারকাজে পৌছে দিবে বা জুমার সময় মসজিদে নিয়ে এলে মারকাজের কর্মীরা গিয়ে নিয়ে আসবে।

তাছাড়া মারকায এই ধরনের সেচ্ছা দায়ীদের এবং ব্যাপক অর্থে মুসলানদেরকে নানা কর্মে স্থায়ী নিয়োগ দিতে পারে। কাদের কীভাবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে- সে ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা দিচ্ছি :

বিভিন্ন সামাজিক-ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী প্রধান : এই ধরনের লোকেরা সাধারণত তাদের ব্যবসা বা বস্ত্ত স্বার্থের দিকটাই দেখে থাকেন। তাদের অধীনে কর্মরত শ্রমিকদের ধর্মের ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ থাকে না। বরং দায়ীরা যদি কর্মকালীন সময়ে দাওয়াত নিয়ে যান তাহলে তারা বিরক্ত হন এবং মনে করেন যে, দায়ীরা তাদের অনেক ক্ষতি করছেন।

তাই দায়ীদেরকে মিল-ফ্যাক্টরীতে না গিয়ে, অমুসলিমদের ঘরে ঘরে যেতে হবে। দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে নিয়ে দায়ীরা তাদের কাছে তাদের বিশ্রামের সময় গিয়ে হাজির হতে পারেন। এভাবে একটা পর্যায়ে দায়ীরা তাদের সাথে মারকাযের একটা ভাল এবং স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করে নিতে পারেন।

গৃহিণী : আমার মনে হয় বাড়ীর গৃহিণীরা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশী সিরিয়াস ও আগ্রহী। তাদের আগ্রহ তাদের চেয়ে অনেক বেশী প্রজ্বলিত।

বিষয়টা মোটেও কঠিন কিছু নয়। মারকায যদি সচেতন মুসলিম নারীদেরকে এই কাজের দায়িত্ব দেন তাহালে তারা খুবই আগ্রহের সাথে এই কাজ করে যাবেন বলে আমার বিশ্বাস। এবং তারা এর জন্য কোনো পারিশ্রমিকও আশা করে না। এভাবে মহিলা দায়ীদের মাধ্যমে অতিসহজে অধিকাংশ ঘরে ঢুকে পড়া যাবে। প্রতিটি অমুসলিম ঘরে ইসলাম ঢুকে পড়বে এবং প্রতিটি মুসলিম ঘর হয়ে ওঠবে দাওয়াতী কেন্দ্র।

পর্যটক দাওয়াত : এই কার্যক্রম শুরু হবে ইয়ারপোর্ট থেকে ছড়িয়ে পড়বে হোটেল-মার্কেটে এবং শেষ হবে মারকাযে এসে।

পর্যটকরা তো মূলত আসে সেই দেশের নতুন সব জিনিস দেখতে : নতুন অপরিচিত সব স্থাপত্য সংস্কৃতি পরিদর্শন করতে। তাহলে এই সুযোগে তাদের সেই নতুনের পিপাসার মুখে আমরা ইসলামকে হাজির করি না কেন?

নানা দেশ থেকে অনেক মুসলিম পর্যটকও আসেন। তাদের নিয়ে মারকায এই ক্ষেত্রে সবসবময় বা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়ে নানা ভাষায় সেমিনারের আয়োজন করতে পারে। এভাবে তাদের সাথে স্থায়ী একটা সম্পর্ক গড়ে তাদের নিয়ে দেশে দেশে দাওয়াতী কার্যক্রমের উদ্বোধন করা যেতে পারে।

দায়ী বিনিময় : ফিলিপাইনে দাওয়াতের কাজ করেন এবং তার হাতে অনেক অমুসলিম মুসলমান হয়েছেন- এমন একজন দায়ীর সাথে ব্যক্তিগত আলাপকালে আমি তার কর্মসাফল্যে সত্যিকার অর্থেই মুগ্ধ হই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা এই মানের দায়ীদেরকে আমাদের দেশে পাঠাতে পারেন না? তিনি বলেলেন সেটা খুবই সম্ভব। আমাদের দায়ীরা এই কাজে খুবই পারদর্শী এবং তারা প্রশিক্ষন দিয়ে এমন মানের পুরুষ-নারী গড়ে তুলতে সক্ষম।

আমাদের জানা মতে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার দায়ীদেরও একই অবস্থা। আমরা এই ধরনের লোকদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দিয়ে দাওয়াতী ক্ষেত্রে ব্যাপক আশাব্যঞ্জক ফল লাভ করতে পারি।

মিশনারিগুলোর কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ এবং তাদের গোমড় উন্মোচন : দাওয়াতী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকার করুক বা না করুক, দেশে বিদেশে তাদের এই কাজের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে এই সব মিশনারিগুলো। তাদের দায়িত্ব তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ ও তাদের গোমড় উন্মোচন করা এবং তাদের প্রতারণা সম্পর্কে মানুষজনকে সতর্ক করে তোলা। তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ডিংয়ে নানা পদ্ধতি ব্যাবহার করা যেতে পারে।

রাত-দিন সর্বক্ষণ দাওয়াতী কর্মকান্ড অব্যাহত রাখা : আল্লাহ তাআলা বলেন :

قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا .

‘হে আমার রব, আমি আমার সম্প্রদায়কে দাওয়াত দিচ্ছি রাতে ও দিনে।’ [সূরা নূহ : ৫]

রাত-দিন দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যেতে পারে নানাভাবে। উদাহরণত দায়ীকে চবিবশ ঘন্টা খোলা থাকবে, এমন একটা মোবাইল সেটের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে যে কোনো সময় কোনো ব্যক্তির কিছু জানার দরকার হলে তার কাছে ফোন করে জেনে নিতে পারবে। এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে যদি মানুষের চাহিদা এমন ব্যাপক বিস্তৃত রূপ নেয়।

যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদেরকে দায়ী বানিয়ে দেওয়া : অনেক দাওয়াতী সংগঠনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে তারা অমুসলিমদেরকে কালিমায়ে শাহাদাত পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে এবং তার সার্টিফিকেট দিয়েই ছেড়ে দেয়। এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল না। তিনি বরং যারা ইসলাম গ্রহণ করত তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে দায়ী বানিয়ে স্বদেশে প্রেরণ করতেন। তিনি তাদের তাৎক্ষণিক আবেগকে সাথে সাথে কাজে লাগাতেন। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দানকালে কাতারের পিছন থেকে ডাকতে ডাকতে এক লোক এল :

انتهيت إلى النبي صلى الله عليه وسلم وهو يخطب , قال فقلت : يا رسول الله رجل غريب جاء يسأل عن دينه لا يدري ما دينه , قال فأقبل علي رسول الله صلى الله عليه وسلم وترك خطبته حتى انتهى إلي فأتي بكرسي حسبت قوائمه حديدا , قال فقعد رسول الله صلى الله عليه وسلم وجعل يعلمني مما علمه الله ثم أتي خطبته فأتم آخرها .

‘আমি নবীর কাছে পৌঁছে গেলাম। তিনি খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল ! একজন ভিনদেশী অজ্ঞ লোক তার দীন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, এই কথা শুনে রাসূল খুতবা ছেড়ে আমার দিকে আসতে লাগলেন। তিনি আসলে তাকে চেয়ার দেয়া হল, মনে হয় তর পা’গুলো ছিল লোহার। তিনি বলেন, তারপর রাসূল সেই চেয়ারে বসে আমাকে বুঝাতে লাগলেন। আমাকে বুঝানো শেষ করে ফিরে গিয়ে তিনি খুতবা শেষ করলেন। [মুসলিম : ৮৭৬]

নতুন অতিথিদের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা : অধিকাংশ সময় দেখা যায় নব্য মুসলমানগণ কর্মসংস্থানহীনতা বা পূর্বে যে সব অমুসলিম প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতেন তাদের বিরক্তির মুখে পড়েন। এটা নব্য মুসলমানদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। মারকাযের এই লোকগুলোর কর্ম সংস্থানের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কমপক্ষে তাদের কাজের জন্য মারকায সুপারিশ করতে পারে।

ক্রিড়া ক্লাব : দাওয়াতের ময়দানে ক্রিড়াক্লবগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। ক্রিড়া ক্লাবগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সেই ভিত্তিতে কার্যকরী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। যে সব কারণে এই দিকটা এতগুরুত্বপূর্ণ তার অন্যতম :

ক. স্কুল-মাদরাসার সময় ছাড়া অন্যান্য সময় যুবকরা যেখানে সবচেয়ে বেশী ভিড় করে তা এই ক্লাবগুলো।

গ. দাওয়াতী সংগঠনগুলোর সবচেয়ে অবহেলিত স্থান হচ্ছে এই ক্লাবগুলো।

গ. এই ক্লাবগুলোতে নানান ধরনের ভয়ংকর নাফরমানি হয়ে থাকে।

ঘ. ক্রিড়া ক্লাবগুলোর ছেলেরা হয় সবল-শক্তিশালী। তাদের এই সক্ষমতাকে যদি ভাল কাজে লাগানো যায় তাহলে তার অনেক ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

এই প্রসঙ্গে আমি এই ময়দানের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় অনাহুত কোনো ধরনের নাক গলাতে চাইনি। মৌলিকভাবে আমি মনে করি দাওয়াতী সংগঠনগুলোর কাজই হচ্ছে এই মাঠের লোকদেরকে নানাভাবে, বর্তমানের সময় ও কালের উপযুক্ত করে এই কালে ইসলাম-প্রচার-প্রসারের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

আল্লাহ তাওফীক দান করুন।

৮৩
উনবিংশতিতম বপন: ইসলামী পাঠাগার
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ﴿1﴾

পড়, তোমার রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। [সূরা আলাক : ১]

وَمَا قَدَرُوا اللهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِذْ قَالُوا مَا أَنْزَلَ اللهُ عَلَى بَشَرٍ مِنْ شَيْءٍ قُلْ مَنْ أَنْزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَى نُورًا وَهُدًى لِلنَّاسِ تَجْعَلُونَهُ قَرَاطِيسَ تُبْدُونَهَا وَتُخْفُونَ كَثِيرًا وَعُلِّمْتُمْ مَا لَمْ تَعْلَمُوا أَنْتُمْ وَلاَ آَبَاؤُكُمْ قُلِ اللهُ ثُمَّ ذَرْهُمْ فِي خَوْضِهِمْ يَلْعَبُونَ ﴿91﴾

‘আর তারা আল্লাহকে যথার্থ সম্মান দেয়নি, যখন তারা বলছে, আল্লাহ কোন মানুষের উপর কিছুই নাযিল করেননি। বল, ‘কে নাযিল করেছে সে কিতাব, যা মূসা নিয়ে এসেছে মানবজাতির জন্য আলো ও পথনির্দেশস্বরূপ, তোমরা তা বিভিন্ন কাগজে লিখে রাখতে, তোমরা তা প্রকাশ করতে আর অনেক অংশ গোপন রাখতে; আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল যা জানতে না তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষ’? বল, ‘আল্লাহ’। তারপর তাদেরকে ছেড়ে দাও, তারা তাদের অযাচিত সমালোচনায় খেলতে থাকুক।’ [সূরা আনআম : ৯১]

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال , قال عليه الصلاة والسلام : اكتبوا لأبي شاه .

‘আবু শাহকে লিখে দাও’। [বুখারী : ২৪৩৪, মুসলিম : ১৩৫৫]

ইসলামী পাঠাগারের বিকাশ-উত্তরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারণ ইসলামী পাঠাগার হচ্ছে দাওয়াতের মারকায আর দাওয়াত নির্দিষ্ট একটি কর্ম-শৈলী ও পদ্ধতির নাম। অনুরূপ ইসলামী পাঠাগর চলতি বাজারের অংশও বটে। তাই বাজার ধরা ও বাজারজাত করার জন্য পাঠাগার কর্তৃপক্ষের নানা কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এই কালে মানুষ যখন পার্থিবমুখী এবং আখিারাত বিমুখ হচ্ছে তখন ইসলামী পাঠাগার দিয়ে পাঠক ধরা ব্যাপারটা সহজ কোনো কর্ম নয়। তাই ইসলামী পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে আরো অনেক বেশী সতর্ক ও কৌশলী হতে হবে।

পাঠাগার কর্তৃপক্ষ বা যারা পাঠাগার চালান তারা এই সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন- এই ধারণাটা ঠিক না। পাঠাগার ভিজিট করলেই যে কেউই বিষয়টা অতিসহজে টের করতের পারবেন। প্রশ্ন করলেই বুঝতে পারবেন অনেক দিন যাবত পাঠাগারে নতুন কোনো সংযোজন নেই।

তবে আমার মতে আমরা এই সব সমালোচনা করে, নতুন বই দিয়ে, পাঠাগারে শ্রী বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করে...ইত্যাদি নানাভাবে পাঠাগারে বিকাশ উন্নয়নে সযোগিতা করতে পারি।

ইসলামী চিন্তার প্রচার প্রসার সমাজে বদ্ধমূল করার ক্ষেত্রে ইসলামী পাঠাগারের কোনো বিকল্প নাই। সুতরাং এই বিষয়টি আমলে আনতেই হবে। কোনো অজুহাত দাঁড় করিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

ইসলামী পাঠাগারের জন্য আমরা অনেক কিছুই করতে পারি, তেমনি ইসলামী পাঠাগার আমাদের অনেক কিছুই দিতে পারে। ইসলামী পাঠাগারের সফলতার উপর অনেকটা নির্ভর করে ইসলামী দাওয়াতের সফলতা।

ইসলামী পাঠাগারের বিকাশ-উত্তরণের জন্য আমি এখানে একটা কর্ম তালিকা দিচ্ছি :

ইসলামী আকীদা বিরোধী বই-পুস্ত্তক এবং সিডি থেকে পাঠাগারকে পুত-পবিত্র রাখা।

উম্মাহর পূনর্জাগরণ ও আকীদার উন্মেষ ঘটায়- এমন সাহিত্যকে প্রমোট করা।

ইসলামী শরীয়ার ক্ল্যাসিক ও উদ্ধৃতিমূলক গ্রন্থগুলোর জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ রাখা এবং সেখান থেকে শর্তসাপেক্ষে বই নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা। এতে আগ্রহী হয়ে ক্লাসিক বড় বড় গ্রন্থগুলো সংগ্রহে অসমর্থ তরুণ গবেষকরা অনেক উপকৃত হবে। এই ক্ষেত্রে ইসলামী পাঠাগার অন্যান্য জেনারেল পাঠাগারের সাথে সহযোগিতা বিনিময় করতে পারে।

এই এলাকার ইসলামী চিন্তাবিদদের প্রমোট করা। সে ক্ষেত্রে পাঠাগার তাদের দিয়ে এই সংক্রান্ত বিষয়ে পাঠ ও কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। তাদের লেখা বইপুস্তকগুলো প্রচার করতে পারে। সেগুলো কিনে প্রতীকী একটা মূল্য ধরে তা বিক্রি করতে পারে বা কোনো ডোনার ধরে তাকে দিয়ে খরিদ করিয়ে বিনামূল্যে তাদের বইগুলো বিতরণ করতে পারে।

পাঠাগারের প্রশাসনিক প্যাডে ও সিলসহ পত্রে সময়ের মূল ধারার গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। তাদের প্রকাশনার খোঁজখবর রাখা। তাদের নতুন কোনো প্রকাশনা প্রমোট করার মত হলে প্রমোট করা কিংবা বিরোধিতা করার মত হলে সেটা করা।

প্রবীণ (অর্থাৎ বাস্তবে প্রবীণ) ও নবীন (অর্থাৎ চিন্তার সৃষ্টি হিসেবে নবীন) বুদ্বিজীবিদের খুঁজে বের করা।

একবার পাকিস্তানের রাওলপিন্ডিতে আমার কিছু আলিমের সাথে পরিচয় ঘটে। তারা সবাই বেশ বিজ্ঞ আলিম। কিন্তু জানা গেল তারা নান গ্রাম বা মফস্বলের অধিবাসী। তাই তাদের কেউ চিনে না, তেমন গুরুত্ব পায় না এবং এক সময় দেখা যাবে এইভাবেই অন্য অনেকের মত তারাও হারিয়ে যাবেন।

আমার বিশ্বাস ইসলামী পাঠাগার এই ধরনের ব্যক্তিত্বদের খুঁজে বের করে তাদের প্রমোট করতে পারে, তাদের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারে। দ্বিতীয় খন্ডের শেষের দিকে আমি এই বিষয়ে, স্বতন্ত্র একটি অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করব।

প্রতিভাবান কিছু ছাত্রকে- একজন হলেও- সহযোগিতা করা। পাঠাগার, অর্থ দিয়ে, বইপুস্তক দিয়ে, পড়াশোনার আসবাব কিনে দিয়ে... ইত্যাদি নানানভাবে তাদের সহযোগিতা করতে পারে। পাঠাগার তার মুনাফার অংশ থেকে এই খাতে ব্যয় করবে।

বিদ্যমান দেশের অমুসলিম বুদ্ধিজীবি বিশেষত প্রাচ্যবিদদের মাঝে ইসলাম প্রচার, ইসলামের সঠিক ধারণা পৌঁছানোর জন্য পাঠাগারের বিশেষ একটি বিভাগ থাকতে পারে।

বিষয়টি অনেক বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ হলেও খুব স্বল্প পরিশ্রমে ও ব্যয়ে তা আদায় করা সম্ভব। এই বিভাগটাতে যা যা থাকা জরুরী তা হচ্ছে :

পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে অন্যান্য দেশের ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ করে ইংরেজীতে দক্ষ গবেষক ও দায়ীদের আনানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

ইসলামী দাওয়াতের সাথে সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী বইপুস্তক অডিও ভিডিও সিডি সংগ্রহ করা।

পাঠাগারের পাশে বা ভিতরে বা মসজিদ থাকলে মসজিদের কামরায় এই জাতীয় ভিডিওগুলো প্রদর্শনের জন্য একটি অডিটরিয়াম বানানো।

আরব বা অনারব ইসলামী বুদ্ধিজীবি গবেষকদের সাথে যোগাযোগ করা, তাদেরকে সেমিনার, পাঠশালা, কর্মশালা পরিচালনার জন্য দাওয়াত করে আনা।

আমি আশা করি এভাবে এবং এই মানের পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা গেলে ইসলামী দাওয়াতী মিশনে তা অনেক বড় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাই ইসলামী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা-বিকাশ-উত্তরণে সবার মনযোগী হওয়া উচিৎ। এই ক্ষেত্রে ডোনারদের এগিয়ে আসা উচিৎ।

সবশেষে আমি এই সংক্রান্ত প্রশ্নের একটা তালিকা দিচ্ছি, যা দ্বারা পরীক্ষা করা যাবে ইসলামী পাঠাগারের বিকাশ-উত্তরণ। প্রশ্নগুলোকে পাঠাগার বিকাশ-উন্নতির পরিমাপ যন্ত্র বলা যায়। :

প্রশ্ন : ইসলামী পাঠাগার কি তার প্রকাশনা প্রচারের ক্ষেত্রে, টেলিভিশন, ইন্টারনেট .. ইত্যাদি আধুনিক উপায়গুলো গ্রহণ করেছে?

প্রশ্ন : ইসলামী দাওয়াতের প্রচার প্রসার ও বানিজ্যিক ক্ষেত্রে ইসলামী পাঠাগারগুলো কি পরস্পর সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে?

প্রশ্ন : পাঠাগার, নার্সারী, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্যমাধ্যমিক... সব পর্যায়ের মাদরাসাগুলোয় কাজ করছে?

প্রশ্ন : পাঠাগার কি কারাগার, মাদকাসাক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র... নারী কারাগার... ইত্যাদি স্থানগুলোতে ঢুকতে পেরেছে? মূলত এই স্থানগুলো হচ্ছে তওবার জায়গা, পড়াশোনা ও উপদেশ গ্রহণের জন্য খুবই উর্বর স্থান।

প্রশ্ন : পাঠাগার কি বিভিন্ন সম্মেলন কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চ .. ইত্যাদি জায়গাগুলোয় ঢুকতে পেরেছে? মূলত এই সব জায়গায় ঢুকতে পারা খুব জরুরী

প্রশ্ন : পাঠাগার কি সেনা অনুশীলনকেন্দ্রগুলোতে ঢুকতে পেরেছে?

প্রশ্ন : পাঠাগার কি তার কর্মকান্ড ও গৃহীত দাওয়াতী ও বাণিজ্যিক প্রকল্পগুলোর নিখুঁত কোনো হিসাব করে রেখেছে? অনুরূপ তার মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করা নব্য মুসলিম, হিদায়াত পাওয়া ও তাওবা করা মুসলমানদের কোনো হিসাব, সে অনুসারে তার পরবর্তী দায়িত্বগুলোর কোনো পরিস্যংখ্যান আছে তার কাছে?

প্রশ্ন : পাঠাগার, যে সব ইসলামী প্রকাশনা বিরল সেখানে শাখা খুলতে পেরেছে, কিংবা প্রত্যক্ষ শাখা খোলা সম্ভব না হলে অন্য কোনো উপায়ে সেখানে ইসলামী প্রকাশনা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে?

প্রশ্ন : পাঠাগার ইন্টারন্যাশনাল যোগাযোগ সংস্থাগুলোর সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে?

প্রশ্ন : পাঠাগার মূল বই বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে শো-রুম নিতে পেরেছে, যাতে ইসলামী প্রকাশনা সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রহ-নাগালের মধ্যে থাকে, সর্বস্তরের মানুষের কাছে তা সহজে পৌঁছতে পারে?

প্রশ্ন : পাঠাগার স্থায়ী কোনো বই মার্কেট গড়তে পেরেছে?

আমরা স্বীকার করছি যে ইসলামী পাঠাগারকে সবসময়ে সব স্থানে মূল ধারার মুকাবিলা করে চলতে হয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ইসলামী পাঠাগার যেন কখনোই খরাক্রান্ত না হয়। মুসলিম দেশগুলোতে তো সাধারণত বই অনেক কম পঠিত হয়। বই তেমন গুরুত্ব পায় না। মানুষজন নানান অযথা কাজে সময় নষ্ট করে। অথচ পাশ্চাত্যে দেখা যায় ওয়েটিংরুম, বাসের যাত্রী আসন.. সবস্থানে মানুষ বই হাতে নিয়ে বসে আছে। মুসলিম শিশু অন্য সব উপহার পেলেও খুব কম সময়েই বই উপহার পেয়ে থাকে।

এটা একটি কমন সমস্যা। একাডেমিক ছাত্ররা তাদের একাডেমিক বইপত্র ছাড়া তেমন পড়াশোনা করে না, ডাক্তাররা তাদের পুরানো জ্ঞান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, ইঞ্জিনিয়ার সৃষ্টিশীল এই কালটাতে কোনোভাবেই আন্তরিকভাবে যাপন করতে পারে না এবং ছাত্র-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার জুমার সময় মসজিদে এসেই টের পান যে তাদের খতীবের কাছে দেবার মত নতুন কিছু নাই।

অথচ এই উম্মাহর ধর্মগ্রন্থই কিনা শুরু হয়েছে ‘ইকরা’ ‘পড়’ বাক্য দ্বারা।

তার উৎস ক্ষেত্রের নাম ‘কিতাব’ ‘বই’।

তার রব সর্বজ্ঞানী

তার নবী ‘মানুষকে কল্যাণ শিক্ষাদানকারী’ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

৮৪
বিংশতিতম বপন: দাওয়াতী গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ
قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآَنًا عَجَبًا ﴿1﴾

‘বল, আমার নিকট অহী এসেছে যে, জিনদের একটি দল শুনেছে অত:পর বলেছে নিশ্চয় আমরা একটি অদ্ভুদ কুরআন শুনেছি’। [সূরা জিন : ১]

فَمَكَثَ غَيْرَ بَعِيدٍ فَقَالَ أَحَطتُ بِمَا لَمْ تُحِطْ بِهِ وَجِئْتُكَ مِنْ سَبَإٍ بِنَبَإٍ يَقِينٍ ﴿22﴾

‘তারপর অনতিবিলম্বে হুদহুদ এসে বলল, ‘আমি যা অবগত হয়েছি আপনি তা অবগত নন, আমি সাবা থেকে আপনার জন্য নিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি’।’ [সূরা নামল : ২২]

عن ابن عباس رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لما بعث معاذا إلى اليمن قال : إنك ستأتي قوما من أهل الكتاب , فإذا جئتهم فادعهم إلى أن يشهدوا أن لا إله إلا الله , وأن محمدا رسول الله , فإن هم أطاعوا لك بذلك فأخبرهم أن الله قد فرض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة .

‘ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআয রা.-কে যখন ইয়ামানের গভর্নর করে পাঠান তখন বলেছিলেন : ‘তুমি যাচ্ছ এক আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকট। তাদের নিকট পৌঁছে সর্বপ্রথম তাদেরকে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’- এ কথার প্রতি দাওয়াত দিবে। তারা যদি তোমাকে মেনে নেয় তাহলে তাদের জানাবে আল্লাহ প্রতি দিবস-রাতে তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন।’ [বুখারী : ১৪৫৮, মুসলিম : ১৯]

আমার বন্ধু আনওয়ার বাধ্য হয়ে পোল্যান্ডে নির্বাসনে থাকে। পাঁচ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে সে দেশে ফিরে এলে একদিন আমরা দুজন এক সাথে হাঁটছিলাম। হঠাৎ আজানের শব্দ শোনা গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার দু চোখ ভরে পানি ঝরছে..

নানা আলাপচারিতার পর দেখা গেল আমাদের প্রবাসী এই বন্ধু নানা পরস্পর বিরোধী কঠিন কিছু চিন্তা বয়ে বেড়াচ্ছে : সামাজতান্ত্রিক চিন্তা..পুঁজিবাদী মতাদর্শ এবং ইসলামী চিন্তার জন্মগত ঐতিহ্য তার সাথে আছে সংঘাতমুখী বিভিন্ন তত্ত্ব। কিন্তু আমাদের এই বন্ধু অদ্ভুতভাবে এই সব কিছুতে একটা ইসলামী রঙ মাখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে শেষে আমার মনে হয়েছে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পর আমাদের সাথে তার এই সাক্ষাতের পর সে তার এই চিন্তার ও জীবন যাপনের ফাঁক ও খাদের জায়গাটা ধরতে পেরেছেন।

এই সাক্ষাতের মাধ্যমে আমি কি একজন উদভ্রান্ত মানুষের মনে স্বস্তি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছি? একটা সাদকায়ে জারিয়া মহিরুহের বীজ বপন করতে পেরেছি?

এই ঘটনাটা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে :

আমরা বুঝতে পারি মুসলিম দেশগুলোতে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলো এবং অমুসলিম দেশে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরস্পর মিলে সমন্বিত কাজ করা উচিত।

আমরা যদি, দেশে দেশে ইসলামী দাওয়াতের কি অবস্থা, তার শক্তি ও সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলো কি, তাদের কর্ম পলিসি কি হওয়া উচিত .. ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানোর জন্য কোনো ইসলামী দাওয়াতী গবেষণা ও অনুসন্ধান কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারি তাহলে দেখব আমাদের সামনে কাজের এক বিশাল ময়দান খুলে যাচ্ছে, তাহলেই আমরা ইসলামের বাণী এমন দেশে পৌঁছে দিতে পারব, আল্লাহর বিশেষ রহমত ছাড়া যেখানে ইসলাম পৌঁছা অকল্পনীয় ছিল।

এই কেন্দ্র যে সব দেশে দাওয়াতী কাজ চলছে বা চালানো উচিৎ তার সামাজিক-চিন্তানৈতিক অবস্থান, সংস্কৃতি, জীবনযাপন রীতিনীতি এবং সেই জায়গা থেকে সে দেশে ইসলামের ভবিষ্যত.. ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক ও সিদ্ধান্তমুখী গবেষণা করতে পারে। এবং দায়ীদেরকে এই সব তথ্য সরবরাহ করতে পারে। এইভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি দাওয়াতের ক্ষেত্রে একটি উপদেষ্টা সংগঠন হয়ে ওঠতে পারে।

অনেকের কাজে প্রকল্পটিকে অতিরিক্ত ও অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে।

কিন্তু যে সব দেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে, তাতে ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্বগুলো পর্যবেক্ষণ করলে, সে সব দেশে ইসলামের সূর্যোদয়, ইসলামের প্রথম জাহাজের নোঙর ফেলার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, তাতে ইসলামের সূচনা হয়েছে কোনো ব্যক্তির- ইতিহাস যাকে কখনো মুহাজির কখনো বিতাড়িত, কখনো ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করছে- একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

তার সূচনাটা ছিল এমন কোনো ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র দলের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। তাতে আল্লাহ বরকত দিয়েছেন এবং সেই ক্ষুদ্র বীজ এক সময় মহিরুহতে পরিণত হয়।

বন্ধু আনওয়ারের কাছে শুনলাম পোল্যান্ডের কিছু কিছু এলাকায় পোল্যান্ডিয়ান অনেক মুসলিম আছেন। তবে তারা প্রকৃত ইসলামের কিছুই জানে না। তারা জানে না সালাতের কিছু রুকন আছে, ফরজ আছে। যাকাত নামে কিছু আছে ইসলামে...।

আর পোশাক আশাক? তারা জানে না ইসলামী শরীয়ত ঘাড়-পেট-উরু খোলা পোষাক পরার অনুমতি দেয় না।

ইসলাম বিশেষজ্ঞ কোনো দায়ী বা দায়ী দলের কি এই লোকদের কাছে পৌঁছা উচিৎ নয়? .. এই জায়গাতেই হচ্ছে এই গবেষণা সংস্থাটির কর্ম ক্ষেত্র। তারা এমন জায়গা সম্পর্কে গবেষণা করে সে তথ্য প্রচার করতে পারেন এবং দায়ীদের সেখানে গিয়ে কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।

পাঠক আপনার পক্ষে ব্যক্তিগভাবে যদি এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অসম্ভব হয় তাহলে আপনি তো অনেককে নিয়ে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতেও এমন একটি গবেষণা ও অনুসন্ধান সংস্থা গড়ে তুলতে পারেন।

আমি মনে করি মুসলিম দেশগুলোর দূতাবাসগুলোর উচিৎ সর্বাগ্রে মুসলিম অমুসলিম দেশে এই দায়িত্ব পালন করা। দূতাবাসগুলো যদি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা নাও করতে পারে তাহলে তাদের উচিৎ তাতে অন্তত পরক্ষভাবে সহযোগিতা করা। ইচ্ছে করলে উপায় বের হয়ে যায়।

হে আল্লাহ তোমার নবীর রিসালাত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমরা যে অবহেলা করছি তার জন্য আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও।

৮৫
একবিংশতিতম বপন: মা’হাদ
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ﴿122﴾

‘আর মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।’ [সূরা তাওবা : ১২২]

عن أنس رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم : أتاه رعل وذكوان وعصية وبنو لحيان فزعموا أنهم قد أسملوا , واستمدوه على قومهم , فأمدهم النبي صلى الله عليه وسلم بسبعين من الأنصار , قال أنس : كنا نسميهم القراء يحطبون بالنهار , ويصلون بالليل فانطلقوا بهم حتى بلغوا بئر معونة غدروا بهم وقتلوهم , فقنت شهرا يدعو على رعل وذكوان وبني لحيان .

‘আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাআল যাকওয়ান, আছিয়া ও বনু লাহয়ান গোত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তারা তাদের কওমের বিরুদ্ধে তার নিকট সাহায্য চাইল। রাসূল তাদের সাহায্যের জন্য সত্তুর জন আনসার দিলেন। আনাস বলেন : আমরা তাদের ‘কুররা’ বলে ডাকতাম। তারা দিনে কাঠ কাটতেন আর রাতে সালাত আদায় করতেন। তারা বি’রে মাউনায় পৌঁছলে তারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল এবং তাদের হত্যা করে ফেলল। তখন রাসূল এক মাস দুআয়ে কুনুত পড়ে রাআল, যাকওয়ান ও বনু লাহয়ানের উপর অভিশাপ দিলেন।’ [বুখারী : ৩০৬৪]

৮৬
প্রথম প্রকার : বৃহৎ মা’হাদ :-
কাফির এবং মুসলিম দেশগুলোতে খৃষ্টান মিশনারি কাজ করছে- এমন লোকদের উপর খুবই ক্ষিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে আগ্রহী একজনের সাথে আমার সেদিন দেখা হল। তিনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন... এমন অনেকের সাথে প্রায়ই দেখা হয়...

মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়া পাপাচার নিয়ে খুবই শংকিত এবং তা প্রতিরোধের জন্য কাজ করতে আগ্রহী-এমন লোকদের সাথে আমার প্রায় সাক্ষাৎ হয়...

এমন অনেক ছাত্রের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, যারা বলে মসজিদে খুতবার সুযোগ পেলে তারা তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা মানুষের মনে ঢেলে দিত...

এইভাবে এই আগ্রহী-উদ্দীপ্ত ব্যক্তিগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। তারা পরিকল্পিত কোনো কাজের অংশ হয়ে তাদের মেধা উদ্দীপনাকে কাজে লাগাতে পারছে না।

কিন্তু কতদিন নষ্ট হবে এই সব নিখাদ আবেগ ও বিরল প্রতিভাগুলো?

কতদিন? একটি দীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক প্রশ্ন ....

আমাদেরকে এই প্রশ্নের সমাধান বের করতেই হবে, তাদের প্রতিভা ও আবেগকে একটা গঠনমূলক কাজে লাগাতে হবে.. অসঠিক পথে গিয়ে তাকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

ব্যক্তিগতভাবে অনেকে কাফিরদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য খুব আগ্রহী হতে পারে এবং আল্লাহর তৌফিক থাকলে তার হাতে অনেক অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতেও পারে।

ব্যক্তিগতভাবে অনেকে সৎ কজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে।

শরীয়তের বিধানাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তিদের আগ্রহ থাকতেই পারে যে, তারা মিম্বারে চড়ে মানুষদেরকে দীনের কথা শোনাবেন, খতীব হবেন ... !

শরীর চর্চা বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী হয়ে মুসলিম যুবকদের শরীর চর্চায় সময় দিতে পারেন।

কিন্তু এই সব আগ্রহ-উদ্দীপনাগুলো কি অচিরেই ঝিমিয়ে পড়বে না? একদিন নিসেত্মজ হয়ে যাবে না? যদি এই উদ্দীপনাগুলোকে টিকিয়ে রাখা যেত তাহলে কি তা আরো অনেক বেশী ফলদায়ক হত না?

এই সব ব্যক্তিগত প্রতিভা, আগ্রহ ও চিন্তাগুলোকে যদি একটি সঠিক পদ্ধতিঋদ্ধ তৎপরতায় নেওয়া যায়, সংগঠন, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিরূপে আরো বড় পরিসরের কর্মতৎপরতায় জড়ানো যায় তাহলে কি তা আরো অনেক বেশী ফলদায়ক ও স্থায়ী হবে না?

তাই বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মাঝে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র, নানা সম্প্রদায়ের দায়ী প্রশিক্ষণকেন্দ্র, নানা সম্প্রদায়ের মাঝে সংলাপ কেন্দ্র কিংবা নানান সম্পদ্রায়ের সংস্কৃতি বিনিময় কেন্দ্র- এই পাঁচটি চিন্তা ও পরিকল্পনার একটি খসড়া নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করছি।

কেন্দ্রের লক্ষ্য হবে, অমুসলিম নারী-পুরুষদেরকে ইসলমের দাওয়াত দিতে সক্ষম এক দল দায়ী তৈরি করা।

পাঠকাল : পাঠকাল হবে দুই শিক্ষাবর্ষ। ছয় মাসও হতে পারে। সফলভাবে এই শিক্ষাকাল শেষ করতে পারলে শিক্ষার্থীকে দাওয়াতী প্রশিক্ষণের উপর ডিপ্লোমার সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।

সিলেবাস :

প্রথমত : কুরআন

ছাত্রকে সম্পূর্ণ কুরআনের সঠিক কিরাআত শিক্ষা দেওয়া

সম্ভব হলে শিক্ষার্থীকে ২৮, ২৯, ৩০ এই তিন পারা হিফজ করানো

সূরা বাকারা, আলে ইমরানের তাফসীর এবং যাদের পক্ষে মুখস্ত করা সম্ভব, তাদের জন্য বিভিন্ন ধর্ম, সংলাপ, দাওয়াতের সাথে সম্পর্কিত আয়াতগুলোর তাফসীর এবং সাথে ছাবাবে নুযূলের পাঠ।

দ্বিতীয়ত : আকীদা : অর্থাৎ ইসলামী আকীদার মৌলিক বিষয়গুলো, বিশেষত যে সব ক্ষেত্রে অন্যান্য বিকৃত ধর্মের সাথে ইসলামী আকীদার সংঘাত রয়েছে।

তৃতীয়ত : হাদীস: অমুসলিমদের দাওয়াত দেওয়া ওয়াজিব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী... ইত্যাদি সম্পর্কিত সহীহ হাদীসগুলো বিশদ ব্যাখ্যার সাথে পাঠদান।

চতুর্থত : ফিকাহ : আহলে কিতাব ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান কি? এই সব বিষয়ে ফিকাহর মূল বিষয়গুলোর পাঠ দান।

পঞ্চমত : দাওয়াতী পদ্ধতির পরিভাষা শিক্ষা দান এবং সাথে প্রেক্টিক্যাল প্রশিক্ষণ।

ষষ্ঠত : নানা ধর্মের সংলাপ নিয়ে লিখিত অমুসলিমদের গ্রন্থগুলো-উদাহরণত: লাকির বাতরছুন ও জোসেফ জারিনী লিখিত ‘উৎসাহী সংলাপ’- গ্রন্থ কিভাবে মুকাবেলা করবে তা শিক্ষা দান।

সপ্তমত : ধর্মের ইতিহাস।

অষ্ঠমত : তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব।

নবম : ‘কেন আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম’ ‘কি বিষয় এই লোকদেরকে, অন্যান্য ধর্ম গ্রহণ না করে ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করল?’ ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা।

দশম : কুরআন ও সুন্নার বৈজ্ঞানিকতা।

একাদশতম : ইসলাম সম্পর্কে সংশয় ও তার নিরসন।

দ্বাদশ : অন্যান্য মতাদর্শ ও ধর্মের দুর্বলতার জায়গাগুলো চি ‎‎‎‎ হ্নত করা।

ত্রয়দশ : গ্রাজুয়েশন থিসিস।

চতুর্থদশ : ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাওয়াতী তৎপরতা।

পঞ্চদশ : অমুসলিমদের সাধারণ পাঠ দান।

এই মা’হাদের ফলাফল :

প্রথমত : ব্যক্তিগত উদ্দীপনা ও দাওয়াতী তৎপরতাগুলোকে একটি পদ্ধতিসম্মত দাওয়াত বা একটি দাওয়াতী পদ্ধতি ও সমষ্টিগত তৎপরতায় রূপান্তরিত করা। এইভাবে এই ক্ষেত্রে মা’হাদের ভূমিকা অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ পদ্ধতিগত দাওয়াতের ব্যবস্থা না করা গেলে আসলে তেমন ভাল ফলাফল আশা করাও মুশকিল। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা দায়ী মুসলিম ও দাওয়াতকৃত অমুসলিমের মাঝে একটা ব্যক্তিগত ফলাফলহীন বিতর্কই থেকে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে তা ঝগড়াঝাটিতেও অবসিত হয়।

কিন্তু দায়ীর যদি অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস বিশ্বাস সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকে এবং তিনি সংলাপের মূলনীতি ও পদ্ধতি সম্পর্ক সম্যক অবগত হন তাহলে সংলাপ দ্রুত একটা আশা ব্যাঞ্জক ফলাফল তৈরি করবে। তিনি খুব সহজেই তার হৃদয়ে ও মনের অন্দর মহলে ঢুকে পড়তে পারবেন।

দ্বিতীয়ত : গ্রাজুয়েটদেরকে বাস্তব মাঠে নামানো। এই ক্ষেত্রে অমুসলিম কোম্পানী বা যে সব কোম্পানীগুলোতে অমুসলিম শ্রমিকরা কাজ করে, তার মালিক পক্ষের সাথে একটা চুক্তিতে আসা যেতে পারে কিংবা তাদের সাথে একটা বুঝাবুঝির জায়গায় গিয়ে সেখানে অমুসলিমদের মাঝে কাজ করা যেতে পারে। এইভাবে যখন তারা শ্রমিকদের আচরণ-নৈতিকতায় তাদের দাওয়াতের সুফল দেখতে পাবে তখন তাদের উদ্দীপনা আরো বৃদ্ধি পাবে।

কিংবা দায়ীদেরকে অমুসলিমদের বসবাস অঞ্চলগুলোতে দাওয়াতী সফরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

তৃতীয়ত : অমুসলিমদের দাওয়াত বিষয়ে সমৃদ্ধ প্রকাশনা তৈরি করা। এই ক্ষেত্রে যে সব প্রকাশনা আছে তা মূলত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফল এবং তা অনেকটা প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু আমরা যে প্রকাশনার চিন্তা করছি তা হবে বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের লোকদের জন্য, তাদের চিন্তাগত স্তরের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে। তাছাড়া তার চরিত্র প্রতিরক্ষামূলক না হয়ে হবে সম্প্রসারণমূলক। যেমন কুরআনে এসেছে :

وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا ﴿81﴾.

‘আর বল, ‘হক এসেছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় বাতিল বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল’। [সূরা বনী ইসরাইল : ৮১]

এই মা’হাদ পরিকল্পনা মূলত, অমুসলিমদের দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সবার যে একটা দায়িত্ব আছে, অনেককে সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে।

এভাবে একটি মা’হাদ প্রতিষ্ঠিত হলে তার থেকে এবং তাকে কেন্দ্র করে এই ধরনের আরো অনেক মা’হাদ তৈরি হবে এবং প্রতিটি মাহাদই আমাদেরকে এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে।

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার দাওয়াত, খুতবা দানের সাথে এমন পরিকল্পিত দাওয়াতী তৎপরতা, মা’হাদ প্রতিষ্ঠা করে তার একটা স্থায়ী রূপের ব্যবস্থা করার সাথে কোনো তুলনা হয়?

৮৭
উপসংহার :
মাহাদ গিরাস এই দুটি মাহাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়.. মাহাদ তো বরং একটি সমাজ ও সুস্থ্য সমাজ ব্যবস্থা, সঠিক বিকাশ ও সঠিক জ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগততার শিরনাম।

৮৮
দ্বিতীয় প্রকার : ক্ষুদ্র মা’হাদ :-
অনেক বছর ধরে আমি আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন আহমাদকে চিনি। চিনি বলতে জুমার খুতবা শেষ করে বের হলে তিনি অন্যান্য মুসল্লীদের মত আমাকে সালাম দেন। ব্যাস। তিনি তার চেয়ে বেশী আমার মনোযোগ কাড়তে পারেননি। এর মধ্যে হঠাৎ আমার ছেলে আহমাদ অসুস্থ হয়ে পড়ল, তিনি তাকে দেখতে হাসাপাতাল এলেন। আমি তাকে মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে দেখলাম জুমার খুতবার পর সালাম ছাড়া তার সংগ্রহে আর কিছু নেই। আমি তাকে নাস্তা-টাস্তা দিলে তিনি খেলেন না। আমি অবাক হলে তিনি বললেন : তার আশংকা হয় এভাবে খাবার খেলে এর মধ্য দিয়ে তিনি অসময়ে তার কাজের মূল্য নিয়ে নিতে পারেন। যাই হোক ধীরে ধীরে তিনি আমার সাথে সহজ হয়ে এলে আমি তাকে জানার সুযোগ পেলাম। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব। আমি গোপন ভান্ডারের সন্ধান পেলাম যেন। বর্তমানে তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তারপরও গত একুশ বছর ধরে তিনি নিয়মিত সপ্তায় চারদিন করে দুবাই হাসপাতালে রোগী দেখছেন।

সুবহানাল্লাহ ! কি উদ্দীপনা, কি নিষ্ঠা !

আবু আব্দুল্লাহ রোগী দেখেন অনেক মনযোগ দিয়ে এবং নিষ্ঠার সাথে। আমি মনে মনে ভাবলাম কি ভাগ্য তার। সকাল বিকাল ফেরেশতারা তাকে সালাম করে যাচ্ছে। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে :

ما من مسلم يعود مسلما غدوة إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يمسي وإن عاده عشية إلا صلى عليه سبعون ألف ملك حتى يصبح , وكان له خريف في الجنة .

‘কোনো মুসলমান যদি সকালে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায় তাহলে সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার উপর সালাত পাঠ করতে থাকে। সন্ধ্যায় যদি সে আবার রোগী দেখতে যায় তাহলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দুআ করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য রয়েছে ফল-ফলাদি।’ [তিরমিযী : ৯৭৯]

অন্য আরেকটি হাদীসে এসেছে :

من عاد مريضا لم يزل في خرفة الجنة حتى يرجع .

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘যে ব্যক্তি রোগী পরিদর্শনে যায় তার ফিরে আসা অবধি সে জান্নাতের ফল-ফলাদি ভোগ করতে থাকে। [মুসলিম : ২৫৬৮]

অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছ :

إن الله عزل وجل يقول يوم القيامة يا ابن آدم مرضت فلم تعدني ؟ قال : يا رب كيف أعودك وأنت رب العالمين ؟ قال : أما علمت أن عبدي فلانا مرض فلم تعده أما علمت أنك لو عدته لوجدتني عنده ؟ .

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমা বলেন : ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন : হে আদমের সন্তান আমি অসুস্থ হয়ে ছিলাম তুমি আমাকে সেবা করতে যাওনি, তখন বান্দা বলবে হে রব ! আমি আপনাকে সেবা করব? আপনি তো রাববুল আলামীন? তিনি বলবেন : তুমি জানতে না আমাব অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, তারপরও তার খোঁজ নিতে যাওনি। তুমি জানতে না যদি তুমি তাকে দেখতে যেতে তাহলে তার কাছে আমাকেই পেতে?’ [মুসলিম : ২৫৬৯]

এইভাবে কয়েকদিন আব্দুল্লাহর সাথে হাসপাতালে ঘুরে, রোগীদের সাথে তার আন্তরিক ব্যবহার দেখে, তাদের প্রতি সমবেদনা ও একনিষ্ঠ সেবা দেখে আমি তো মুগ্ধ প্রায়।

কিন্তু বেশ কিছুদিন তার সাথে থাকার পর আবিস্কৃত হল তার জীবনের আরেকটি অধ্যায়। তিনি ইসলামী বিষয়াদি বেশ পড়াশোনা করা লোক। এবং তিনি নানাভাবে.. ইসলামী সাহিত্য, বই পুস্তক পড়িয়ে শিক্ষিত অমুসলিমদের মুসলমান বানান। এবং তার হাতে বেশ অনেক অমুসলিম মুসলমান হয়েছে।

এই সময়েই ‘দাওয়াতী বিশেষজ্ঞতা পাঠ’ এর চিন্তাটি আমার মাথায় আসে। আমরা কি দাওয়াতী বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জনের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান ও কোর্সের ব্যবস্থা করতে পারি না, যাতে আবু মুহাম্মাদের মত লোকজন তৈরি হবে?

প্রিয় পাঠক, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আপনি অনেক সাধারণ মানুষকে বিশেষজ্ঞ দায়ী বানিয়ে ফেলতে পারবেন, যাদের হাতে ইসলামী দাওয়াতের মহান মহান কাজ হবে।

আছেন কোনো আগ্রহী যিনি ইসলামী বা অনৈসলামী দেশে এই বীজ, ইসলামী দাওয়াতী কোর্সের মা’হাদ’ এর বীজ বপন করবেন?

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন