HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আলোচিত রাত-দিন

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
ইসলামের দৃষ্টিতে আলোচিত রাত-দিন

ফযীলত, তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়

সংকলন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

সম্পাদনা

মোহাম্মাদ ইমাম হোসাইন কামরুল

ইমাম পাবলিকেশন্স লিঃ, ঢাকা

অবতরণিকা
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَه  ‐ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّانَبِىَّ بَعْدَه  ‐ وَعَلٰى اٰلِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য, দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক ঐ নবীর উপর, যাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবায়ে কেরামের উপর।

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا يُصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْؕ وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। (তাহলে) আল্লাহ তোমাদের আমলগুলো সংশোধন করবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে তো মহাসফলতা লাভ করবে। (সূরা আহযাব - ৭০, ৭১)

বৎসরে বারটি মাস আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত :

বৎসরে বারটি মাস রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এগুলো আকাশ ও জমিন সৃষ্টির পরপরই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِيْ كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ﴾

যেদিন আল্লাহ তা‘আলা আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসসমূহের সংখ্যা বারটি। এটা আল্লাহর কিতাবে লিখিত। (সূরা তাওবা- ৩৬)

এ বারটি মাসের মধ্যে কোন কোন মাসের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। আবার ঐসব মাসের মধ্যে এমন কিছু দিন ও রাত রয়েছে, যা বিশেষ ফযীলতপূর্ণ।

বার চাঁদের মনগড়া ফযীলত :

আরবি মাসসমূহ চাঁদের উপর নির্ভরশীল। প্রতিটি মাস নতুন চাঁদ উদয় হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়ে থাকে। অনেক লোক রয়েছে, যারা কতিপয় যঈফ ও জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দিন ও মাসের বিভিন্ন ধরনের ফযীলত বর্ণনা পূর্বক অনেক মনগড়া ইবাদাত তৈরি করে নিয়েছে। এসব আমলকে তারা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আমলসমূহ থেকেও অধিক গুরুতব দিয়ে থাকে।

আবার কিছু পুসত্মক ব্যবসায়ী রয়েছে, যারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নামধারী আলেমদের দ্বারা এ সম্পর্কে বই প্রকাশ করে থাকে। তারপর এগুলোর অ্যাড দিয়ে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে এবং সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। ফলে সাধারণ পাঠক এসব বই পড়ে ধোঁকার মধ্যে পড়ে যায়। কেননা তারা ইবাদাতের ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতন নয়। আর তারা জানে না যে, ইসলামে কোন্ কোন্ দিবস পালন করা বৈধ রয়েছে এবং তা কীভাবে পালন করতে হবে। আর তারা এটাও জানে না যে, সমাজে যেসব দিবস ধুমধাম করে পালন করা হয়, ইসলামে তার বৈধতা কতটুকু। কোন সচেতন মুসলিমের জন্য এসব বিষয়ে অজ্ঞ থাকা একেবারেই ঠিক নয়।

আমাদের কর্তব্য :

এখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বৎসরের কোন্ কোন্ দিনে কী কী করণীয় ও কী কী বর্জনীয়- তা সহীহ দলীলের আলোকে জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।

মূলত এ বইটিতে এসব বিষয় নিয়েই বিসত্মারিত আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- বৎসরের কোন্ কোন্ দিন অথবা কোন্ কোন্ রাতে কী ধরনের ইবাদাত করা ইসলামে বৈধ রয়েছে এবং কী ধরনের ইবাদাত করা বৈধ নয়, আর মানুষ ইসলামের নামে দিন অথবা রাতকে কেন্দ্র করে কী কী ভ্রামিত্মতে পড়ে রয়েছে ইত্যাদি।

এ বইটি রাত-দিন সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রামিত্মর অবসান ঘটাতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করবে- ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের থেকে সকল প্রকার ভ্রামিত্ম দূর করে নির্ভেজাল ইসলামী মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করুন। আমীন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

মোবা : ০১৯১২-১৭৫৩৯৬

ঢাকা- ১১/০৬/২০১৬ ইং بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

ইবাদাত বা নেক আমলের গুরুত্ব
ইবাদাত বা নেক আমলের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদাত করার জন্য। কুরআন মাজীদে তিনি বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْاِنْسَ اِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ﴾

আমি জিন ও মানুষকে এজন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমারই ইবাদাত করবে। (সূরা যারিয়াত- ৫৬)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى يَاْتِيَكَ الْيَقِيْنُ﴾

(হে নবী!) যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে নিশ্চিত বিষয় (মৃত্যু) না আসবে, ততক্ষণ পর্যমত্ম তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদাত করতে থাকো। (সূরা হিজর- ৯৯)

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنَّ اَرْضِيْ وَاسِعَةٌ فَاِيَّايَ فَاعْبُدُوْنِ﴾

হে আমার মুমিন বান্দাগণ! নিশ্চয় আমার পৃথিবী প্রশস্ত; সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদাত করো। (সূরা আনকাবূত- ৫৬)

এসব আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আমাদেরকে অবশ্যই ইবাদাত করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য বিভিন্ন ইবাদাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যাতে করে এসবের মাধ্যমে আমরা তাঁরই দাসত্ব প্রকাশ করতে পারি।

মানুষের উপর আল্লাহর হক বা অধিকার হচ্ছে কোন প্রকার শিরক না করে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা। হাদীসে এসেছে, নবী ﷺ বলেন,

فَاِنَّ حَقَّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ اَنْ يَعْبُدُوْهُ وَلَا يُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًا‏

বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো, তারা তাঁর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক (অংশীদার স্থাপন) করবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/১৫৪।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : بَادِرُوْا بِالْأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِىْ كَافِرًا أَوْ يُمْسِىْ مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيْعُ دِيْنَهٗ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা আমলের ব্যাপারে দ্রুতগামী হও- অন্ধকার রাতের মতো ঘনিয়ে আসা ফেতনা আগমনের পূর্বে। তখন কোন ব্যক্তি সকাল করবে মুমিন অবস্থায় এবং সন্ধ্যা করবে কাফির অবস্থায়। আবার সন্ধ্যা করবে মুমিন অবস্থায় এবং সকাল করবে কাফির অবস্থায়। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের কারণে সে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দেবে। [সহীহ বুখারী, হা/২৫৫০; সহীহ মুসলিম, হা/৩২৮/১৭১৮; আবু দাউদ, হা/৩৯২; ইবনে মাজাহ, হা/৭।]

যাচাই-বাছাই করে আমল করতে হবে
প্রতিটি বান্দার জন্য আমল হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা পরকালের ভালো-মন্দ আমলের উপরই নির্ভরশীল। যার ভালো আমলের পরিমাণ যতবেশি হবে, সে তত সহজেই মুক্তি লাভ করতে পারবে। সুতরাং প্রতিটি বান্দাকে অবশ্যই আমলের প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং যাচাই-বাছাই করে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো আমল করতে হবে। নতুবা সকল আমল বাতিল হিসেবে গণ্য হবে, যা পরকালে বান্দার জন্য কোন কাজে আসবে না। আমল কবুল হওয়ার শর্তাবলি সম্পর্কে সামনে আলোচনা করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

দলীলবিহীন আমল গ্রহণযোগ্য নয় :

আমল করতে হবে কুরআন ও হাদীসের সহীহ দলীলভিত্তিক। অন্যথায় উক্ত আমল বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : مَنْ اَحْدَثَ فِيْ اَمْرِنَا هٰذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনে নতুন কিছু সংযোজন করবে, যা মূলত তাতে নেই, সেটি পরিত্যাজ্য। [সহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৮৯; আবু দাউদ, হা/৪৬০৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬০৩৩।]

সর্বক্ষেত্রে বাপ-দাদার অনুসরণ করা যাবে না :

আমাদের সমাজে এমন অনেক আমল চালু আছে, যা কেবল বাপ-দাদারা করতেন বলেই করা হয়ে থাকে। অথচ এ ধরনের কোন ইবাদাত ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং কুরআন মাজীদে এ ব্যাপারে বার বার সতর্ক করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَاِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلْفَيْنَا عَلَيْهِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَلَوْ كَانَ اٰبَآؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَّلَا يَهْتَدُوْنَ﴾

যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ করো, তখন তারা বলে- বরং আমরা তাঁরই অনুসরণ করব যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি। যদি তাদের পিতৃপুরুষরা না বুঝে থাকে এবং তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত না হয়ে থাকে (তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে)? (সূরা বাকারা- ১৭০)

অতএব ইবাদাতের ক্ষেত্রে বাপ-দাদাদের অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ইবাদাত করতে হবে স্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে কেবলমাত্র আল্লাহর সমত্মুষ্টির উদ্দেশ্যে।

অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ করা যাবে না :

আমাদের সমাজে আরো একটি ভ্রামিত্ম চালু আছে যে, অধিকাংশ মানুষ যা করে আমরা সেটিকেই সঠিক হিসেবে ধরে নেই। অথচ এরূপ মানদন্ড সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী। কেননা অধিকাংশ লোক নির্ভুল জ্ঞানের পরিবর্তে অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। তাদের আকীদা-বিশ্বাস, দর্শন, চিন্তাধারা ও জীবনযাপনের মূলনীতি সবকিছুই ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। কুরআন মাজীদে এ ব্যাপারেও কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَاِنْ تُطِعْ اَكْثَرَ مَنْ فِى الْاَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِؕ اِنْ يَّتَّبِعُوْنَ اِلَّا الظَّنَّ وَاِنْ هُمْ اِلَّا يَخْرُصُوْنَ اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعْلَمُ مَنْ يَّضِلُّ عَنْ سَبِيْلِهٖۚ وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ﴾

আর যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথা অনুযায়ী চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করে দেবে। কেননা এরা নিছক অনুমানের উপর ভিত্তি করে চলে এবং (অধিকাংশ ব্যাপারে) মিথ্যা ছাড়া অন্য কিছুই বলে না। আর তোমার প্রতিপালক (এ কথা) ভালো করেই জানেন যে, কে তাঁর পথ ছেড়ে বিপথগামী হচ্ছে। তাছাড়া তিনি হেদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কেও ভালো জানেন। (সূরা আন‘আম- ১১৬, ১১৭)

অতএব আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, কোন আমল করার পূর্বে সেটি যাচাই-বাছাই করে নেয়া এবং এ ক্ষেত্রে বাপ-দাদা অথবা সমাজের রসম-রেওয়াজের অনুসরণ না করা। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহর কাছে আমাদের আমল গ্রহণযোগ্য হবে - ইনশাআল্লাহ।

ইবাদাত কবুলের শর্ত
আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, সবকিছুই তাঁর ইবাদাত করে থাকে। আর প্রত্যেকের ইবাদাতের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং ইবাদাত করা প্রত্যেকটি মানুষের উপর আবশ্যক। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যদি এ শর্ত থেকে কোন একটি ভঙ্গ করা হয়, তাহলে কারো ইবাদাত গ্রহণযোগ্য হবে না। সেগুলো হলো :

১. ঈমান :

মুমিন ছাড়া অন্য কারো সৎকর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যক্তি যতই সৎকর্ম করুক না কেন যদি তার মধ্যে সঠিক ঈমান না থাকে, তবে তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَنْ يَّكْفُرْ بِالْاِيْمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهٗؗ وَهُوَ فِى الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ﴾

আর যে ব্যক্তি ঈমান প্রত্যাখ্যান করবে, তার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা মায়েদা- ৫)

২. ইখলাস :

ইখলাস হচ্ছে, সকল ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং তা কেবল আল্লাহর জন্যই নিবেদন করা, আল্লাহর দাসত্বের সাথে অন্য কাউকে শরীক না করা। কারণ নির্ভেজাল আনুগত্য পাওয়ার অধিকার কেবল আল্লাহর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَاۤ اُمِرُوْاۤ اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ ۚ حُنَفَآءَ وَيُقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَۚ وَذٰلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ﴾

তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই করা হয়েছে যে, তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। আর এটাই সঠিক ধর্ম। (সূরা বায়্যিনাহ- ৫)

অপর আয়াতে তিনি বলেন,

﴿فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا﴾

যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে। (সূরা কাহফ- ১১০)

আর হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهٖ وَمَنْ رَاءٰى رَاءَى اللهُ بِهٖ

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কৃতকর্মের সুনামের জন্য লোকসমাজে তা ইচ্ছাপূর্বক প্রচার করে বেড়ায়, আল্লাহ তা‘আলাও (কিয়ামতের দিন) তার কৃতকর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদেরকে জানিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ও প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে কোন সৎকাজ করবে, আল্লাহও (কিয়ামতের দিন) তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকদের মাঝে প্রকাশ করে দেবেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৭৬৬৭; সুনানুল কুবরা, হা/১১৬৩৬।]

৩. নবী ﷺ এর সুন্নাতের অনুসরণ করা :

যেকোন আমল অবশ্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাত অনুযায়ী হতে হবে। তিনি যে আমলটি যখন যেভাবে করেছেন আমাদেরকেও সে আমলটি হুবহু সেভাবেই করতে হবে। এতে কোনরূপ কম-বেশি করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ ؕ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾

বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমার অনুসরণ করো, ফলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

(সূরা আলে ইমরান- ৩১)

এ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর ভালোবাসা পাওয়াকে নবী ﷺ এর আনুগত্যের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসবে, আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করবে এবং জান্নাতে যেতে চাইবে তাকে অবশ্যই নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে।

নবী ﷺ এর সুন্নাতের অনুসরণ না করলে আমল বাতিল হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اَطِيْعُوا اللهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَلَا تُبْطِلُوْاۤ اَعْمَالَكُمْ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলো বিনষ্ট করো না।

(সূরা মুহাম্মাদ- ৩৩)

এ আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী বুঝা যায় যে, আল্লাহর ইবাদাত করতে হবে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর তরীকা বা সুন্নাহ অনুযায়ী।

বিদআত থেকে সাবধান
বিদআত হচ্ছে, শরীয়তে নব আবিষ্কৃত ঐ সকল ইবাদাত, যার কোন ভিত্তি নেই। [মির‘আতুল মাফাতিহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, ১৬৫ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।]

দ্বীন পরিপূর্ণ, সুতরাং তাতে কোন জিনিস বৃদ্ধি করা বা কোন নতুন বিষয়কে দ্বীনের অংশ মনে করে তদানুযায়ী আমল করা এবং আমল করলে সওয়াব হবে বলে মনে করাই হচ্ছে বিদআতের মূল কথা। আর সকল বিদআতই গোমরাহী। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ .. قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَاِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَاِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَاِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

ইরবায বিন সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে, তোমরা প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী। [আবু দাউদ, হা/৪৬০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৩২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৪৪।]

বিদআত থেকে দূরে থাকার জন্য নবী ﷺ কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَآءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ فَتَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَاِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْاُمُوْرِ

তোমাদের উপর আবশ্যক হলো, আমার সুন্নাত ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে ধারণ করা। তোমরা একে শক্তভাবে ধারণ করো এবং তোমাদের মাড়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরো। সাবধান! সকল নব উদ্ভাবিত কাজ থেকে বিরত থাকো। [আবু দাউদ, হা/৪৬০৭; সুনানে বায়হাকী আল কুবরা, হা/২০১২৫; দারেমী, হা/৯৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩২৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৪৫।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ مَالِكٍ ... اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ تَرَكْتُ فِيْكُمْ اَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهٖ

মালেক (রহ.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সে দুটি জিনিস কড়ে ধরবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কিছুতেই পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি জিনিস হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৫৯৪; মিশকাত, হা/১৮৬।]

সুতরাং সমাজে যেসব ইবাদাত চালু আছে এবং আলেম, বুযুর্গ, পীর সাহেব, মুরববী সাহেব যেসব ইবাদাত করতে বলেন, তা অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত মাপকাঠি দ্বারা যাচাই করতে হবে। তারপর যদি তা সঠিক হয় তাহলে তা মানতে হবে; আর যদি সঠিক না হয়, তাহলে তা কোনভাবেই মানা যাবে না।

বিদআতীরা নেক আমল করা সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রসত্ম :

সাধারণত বিদআতীরা মনে করে যে, তারা সৎকর্মই করে যাচ্ছে এবং উক্ত কর্মের মাধ্যমে তারা অনেক সওয়াব অর্জন করছে। অথচ একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, মক্কার মুশরিকরাও তাদের আমলের ব্যাপারে অনুরূপ ধারণা পোষণা করত। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে বলেন,

﴿قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْاَخْسَرِيْنَ اَعْمَالًا اَلَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا﴾

(হে নবী) বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে আমলের দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রসত্মদের সম্পর্কে সংবাদ দেব? তারা তো ঐসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে; অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্মই করছে। (সূরা কাহফ- ১০৩, ১০৪)

অতএব সৎকর্ম করলেই যে সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- এরূপ ধারণা করা ঠিক নয়। কেননা অনেক আমল নিজেদের অজ্ঞতার কারণে বিদআত হিসেবেও গণ্য হতে পারে। আর যদি এরূপ হয় তাহলে সকল আমল বাতিল হিসেবে গণ্য হবে এবং ক্ষতিগ্রসত্মদের কাতারে পতিত হতে হবে। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই সর্বদা বিদআত থেকে সতর্ক থাকতে হবে এবং বিশুদ্ধ আমলের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

আলোচিত রাত ও দিনসমূহ
প্রতিটি জাতির মধ্যেই বিশেষ কিছু রাত ও দিন রয়েছে, যেগুলো তারা বিশেষভাবে পালন করে থাকে। যেমন- খ্রিস্টানদের জন্য রয়েছে শনিবার, বড় দিন, থার্টি ফাস্ট নাইট ইত্যাদি। ইয়াহুদিদের জন্য রয়েছে রবিবার, আশুরায়ে মুহাররম ইত্যাদি। মুসলিমদের জন্য রয়েছে শুক্রবার দিন, ঈদের দিন, আরাফার দিন ইত্যাদি। পৃথিবীতে এ তিনটি জাতিই হচ্ছে আসমানী কিতাবপ্রাপ্ত। কিন্তু ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের দ্বীনকে বিকৃত করে ফেলেছে। সুতরাং তারা যেসব দিবস গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে, সেগুলো তাদের বিকৃত ধর্মের ভিত্তিতেই। ফলে সেগুলো বিভিন্ন ধরনের বেহায়াপনা ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। কোন মুসলিমের জন্য সেগুলোতে অংশগ্রহণ করা বৈধ নয়। মুসলিমদের জন্য কেবল সেসব দিন ও রাতগুলো বিশেষভাবে পালন করা বৈধ রয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নিম্নে এসব গুরুত্বপূর্ণ দিন ও রাতসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

ইয়াওমুল জুমু‘আ বা শুক্রবার
يَوْمٌ শব্দের অর্থ হচ্ছে দিন, আর اَلْجُمُعَةُ শব্দের অর্থ হচ্ছে একত্রিত হওয়া। সুতরাং يَوْمُ الْجُمُعَةِ শব্দের অর্থ হচ্ছে একত্রিত হওয়ার দিন। যেহেতু মুসলিমগণ সপ্তাহের মধ্যে এ দিনটিতে একত্রিত হয়ে থাকে, তাই এ দিনটিকে يَوْمُ الْجُمُعَةِ বলা হয়। আর এ কারণে একে মুসলিমদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিনও বলা হয়। বাংলা ভাষায় এ দিনটি শুক্রবার হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া কুরআন মাজীদে ‘‘সূরা জুমু‘আ’’ নামে একটি সূরাও রয়েছে।

জুমু‘আর দিনটি হচ্ছে মুসলিমদের জন্য সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আল্লাহ তা‘আলা এ দিনটির মধ্যে অনেক ফযীলত ও তাৎপর্য একত্রিত করেছেন। নিম্নে এ ব্যাপারে বিসত্মারিত আলোচনা করা হলো :

জুমু‘আর দিনের গুরুত্ব ও বিশেষত্ব
আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাপ্তাহিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হচ্ছে জুমু‘আর দিন। এ দিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব রয়েছে, যা জেনে রাখা এবং এর উপর ভিত্তি করে আমল করে যাওয়া প্রত্যেক মুসলিমের উপর অত্যাবশ্যক। যেমন,

জুমু‘আর দিন সবচেয়ে উত্তম দিন :

সপ্তাহের সাতটি দিনের মধ্যে জুমু‘আর দিনটি হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম দিন। এ দিনে অনেক বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং হবে। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ - قَالَ : خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ فِيْهِ خُلِقَ اٰدَمُ وَفِيْهِ أُدْخِلَ الْجَنَّةَ وَفِيْهِ أُخْرِجَ مِنْهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, যেসব দিনে সূর্য উদিত হয় সেগুলোর মধ্যে জুমু‘আর দিনটি হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম। এ দিনে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিনেই জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৫৪; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২৪১; আবু দাউদ, হা/১০৪৮; বায়হাকী, হা/৫৭৯৮; তিরমিযী, হা/৪৮৮; নাসাঈ, হা/১৩৭২; শু‘আবুল ঈমান, হা/২৯৭০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২০৭।]

সাপ্তাহিক উত্তম দিন হিসেবে জুমু‘আর দিনটি কেবল মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট :

জুমু‘আর দিনটিকে সাপ্তাহিক বিশেষ দিন হিসেবে প্রাপ্ত হওয়াটা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّه سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ نَحْنُ الْاٰخِرُوْنَ السَّابِقُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بَيْدَ أَنَّهُمْ أُوْتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِنَا ثُمَّ هٰذَا يَوْمُهُمُ الَّذِيْ فُرِضَ عَلَيْهِمْ فَاخْتَلَفُوْا فِيْهِ فَهَدَانَا اللهُ فَالنَّاسُ لَنَا فِيْهِ تَبَعٌ الْيَهُوْدُ غَدًا وَالنَّصَارٰى بَعْدَ غَدٍ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, দুনিয়াতে আমরা (অন্যসব জাতির) পরে এসেছি, কিন্তু হাশরের দিন আমরা হব সকলের অগ্রবর্তী, যদিও আমাদের আগে অন্যদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে। আর এই জুমু‘আর দিনটির সম্মান করা অন্যদের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল কিন্তু তারা তাতে মতভেদ করেছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিলেন। সুতরাং অন্যান্য সকল জাতিই এ ব্যাপারে আমাদের পেছনে রয়ে গেছে। যেমনিভাবে ইয়াহুদিরা শনিবারকে তাদের পবিত্র দিন মনে করে এবং খ্রিস্টানরা রবিবারকে তাদের পবিত্র দিন মনে করে। [সহীহ বুখারী, হা/৮৭৬; সহীহ মুসলিম, হা/২০১৮; নাসাঈ, হা/১৩৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩৯৩; জামেউস সগীর, হা/১১৬৯৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৭৮৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৭২০; মিশকাত, হা/১৩৫৪।] অর্থাৎ পবিত্র দিনের ব্যাপারে তাদের মধ্যেই ঐক্য নেই।

আল্লাহ তা‘আলা এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত করবেন :

এ দিনটিতে অনেক বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আর বিশ্ব পরিমন্ডলে সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ ঘটনাটিও এই দিনে ঘটবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ فِيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ فِيْهِ خُلِقَ اٰدَمُ وَفِيْهِ أُهْبِطَ وَفِيْهِ تِيْبَ عَلَيْهِ وَفِيْهِ مَاتَ وَفِيْهِ تَقُوْمُ السَّاعَةُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সূর্যোদয়ের মাধ্যমে যেসব দিনের সূচনা হয়, তার মধ্যে জুমু‘আর দিনই সর্বোত্তম। কারণ এ দিনেই আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিনেই তাকে পৃথিবীতে নামানো হয়েছে, এ দিনেই তার তওবা কবুল করা হয়েছে, এ দিনেই তার মৃত্যু হয়েছে এবং এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২৪১; তিরমিযী, হা/২০১৪; আবু দাউদ, হা/১০৪৮; তিরমিযী, হা/৪৮৮; নাসাঈ, হা/১৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৩৯৯; মিশকাত, হা/১৩৫৬।]

এ দিনে কিয়ামতের ভয়ে প্রত্যেক জীবজমত্মু চিৎকার করে থাকে :

কিয়ামত জুমু‘আর দিনেই সংঘটিত হবে। যার কারণে সকল জীবজমত্মু শুক্রবারের দিন ফিরে আসলেই চিৎকার করে থাকে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - ..... وَفِيْهِ تَقُوْمُ السَّاعَةُ وَمَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا وَهِىَ مُسِيْخَةٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ مِنْ حِيْنَ تُصْبِحُ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ شَفَقًا مِنَ السَّاعَةِ إِلَّا الْجِنَّ وَالْإِنْسَ وَفِيْهِ سَاعَةٌ لَا يُصَادِفُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ يُصَلِّىْ يَسْأَلُ اللهَ حَاجَةً إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,.......এ দিনেই (জুমু‘আর দিনে) কিয়ামত সংঘটিত হবে। জিন ও মানব ছাড়া প্রতিটি জীবই শুক্রবারের দিন সকালে কিয়ামতের ভয়ে চিৎকার করে থাকে। এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, যদি বান্দা ঐ সময় সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে কিছু চায়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে তা দান করবেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২৪১; তিরমিযী, হা/২০১৪; আবু দাউদ, হা/১০৪৮; তিরমিযী, হা/৪৮৮; নাসাঈ, হা/১৩৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৩৯৯; মিশকাত, হা/১৩৫৬।]

এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে থাকেন :

আল্লাহ তা‘আলা এ দিনে অনেক মুমিন বান্দার বিশেষ করে যারা জুমু‘আর হক আদায় করে থাকে তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - قَالَ الصَّلَاةُ الْخَمْسُ وَالْجُمُعَةُ إِلَى الْجُمُعَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُنَّ مَا لَمْ تُغْشَ الْكَبَائِرُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং এক জুমু‘আ থেকে আরেক জুমু‘আ উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত গুনাহের কাফফারাস্বরূপ- যখন কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৮৮৩; আবু দাউদ, হা/১১১৩; দারেমী, হা/১৫৪১।]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ يَحْضُرُ الْجُمُعَةَ ثَلَاثَةُ نَفَرٍ رَجُلٌ حَضَرَهَا يَلْغُوْ وَهُوَ حَظُّه مِنْهَا وَرَجُلٌ حَضَرَهَا يَدْعُوْ فَهُوَ رَجُلٌ دَعَا اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِنْ شَاءَ أَعْطَاهُ وَإِنْ شَاءَ مَنَعَه وَرَجُلٌ حَضَرَهَا بِإِنْصَاتٍ وَسُكُوْتٍ وَلَمْ يَتَخَطَّ رَقَبَةَ مُسْلِمٍ وَلَمْ يُؤْذِ أَحَدًا فَهِىَ كَفَّارَةٌ إِلَى الْجُمُعَةِ الَّتِىْ تَلِيْهَا وَزِيَادَةُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ وَذٰلِكَ بِأَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُوْلُ مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَه عَشْرُ أَمْثَالِهَا

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, জুমু‘আর দিন তিন ধরনের লোক উপস্থিত হয়। একদল লোক জুমু‘আয় উপস্থিত হয়ে অনর্থক কাজ করে এবং সে অনুরূপ ফল পেয়ে থাকে। আরেকদল লোক জুমু‘আয় উপস্থিত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাদেরকে তা দান করেন এবং ইচ্ছা করলে বঞ্চিত করেন। আর আরেকদল লোক জুমু‘আয় উপস্থিত হয়ে নীরবতা পালন করে এবং চুপ থাকে। আর তারা মুসলিমদেরকে ডিঙ্গিয়ে সামনে অগ্রসর হয় না এবং কাউকে কষ্টও দেয় না। ফলে এটা তার জন্য উক্ত জুমু‘আ থেকে পরের জুমু‘আ পর্যমত্ম এবং আরো অতিরিক্ত তিনদিনের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে ব্যক্তি সৎ আমল নিয়ে উপস্থিত হবে, তার জন্য দশ গুণ সওয়াব রয়েছে। [আবু দাউদ, হা/১১১৫; বায়হাকী, হা/৫৬২২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭০০২; মিশকাত, হা/১৩৯৬।]

জুমু‘আর দিন দু‘আ কবুলের একটি বিশেষ সময় রয়েছে :

জুমু‘আর দিন দু‘আ কবুল হওয়ার দিন। এ দিন আল্লাহ তা‘আলা বান্দার দু‘আ কবুল করে থাকেন। কেননা এ দিনে দু‘আ কবুলের একটি বিশেষ সময় রয়েছে- যদি বান্দা ঐ সময় কোন দু‘আ করে, তাহলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ذَكَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ فِيْهِ سَاعَةٌ لَا يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّيْ يَسْأَلُ اللهَ تَعَالٰى شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَأَشَارَ بِيَدِه يُقَلِّلُهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ জুমু‘আর দিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এ দিনের মধ্যে এমন একটি বিশেষ সময় রয়েছে, কোন মুসলিম বান্দা যদি সালাতরত অবস্থায় সে বিশেষ সময়টি পায় এবং আল্লাহর কাছে কোন কল্যাণ প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তাকে তা দান করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ হাত দিয়ে ইশারা করে দেখান যে, মুহূর্তটি খুবই সংক্ষিপ্ত। [সহীহ বুখারী, হা/৯৩৫; সহীহ মুসলিম, হা/১১৮২; তিরমিযী, হা/৪৯১; নাসাঈ, হা/১৪৩৫।]

অত্র হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ কেবল দিনটির দিকে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। কিন্তু সময়টির ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কোন কিছু বলেননি। তবে সালফে সালেহীনগণ এ ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যেমন-

১. একদল বলেন, জুমু‘আর দিনের সেই বিশেষ সময়টি হচ্ছে, ইমামের মিম্বরে বসার পর থেকে সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত।

২. আবার আরেকদল বলেন, উক্ত সময়টি হচ্ছে, আসরের সালাত আদায়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

১০
জুমু‘আর সালাত আদায় করার হুকুম
জুমু‘আর সালাত আদায় করা প্রত্যেক বালিগ মুসলিম পুরুষের উপর ফরয। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَؕ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ فَاِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِى الْاَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! জুমু‘আর দিন যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম- যদি তোমরা জানতে। অতঃপর যখন সালাত শেষ হয় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। আর তোমরা আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা জুমু‘আ- ৯, ১০)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ حَفْصَةَ عَنِ النَّبِىِّ - قَالَ : عَلٰى كُلِّ مُحْتَلِمٍ رَوَاحُ الْجُمُعَةِ

হাফসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, প্রত্যেক সাবালক পুরুষের জন্য জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। [নাসাঈ, হা/১৩৭১; আবু দাউদ, হা/৩৪২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৭২১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১২২০; বায়হাকী, হা/৫৩৬৭; জামেউস সগীর, হা/৭৪৮৪।]

তবে ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালক ও অসুস্থ ব্যক্তির উপর জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হওয়া আবশ্যক নয়। কেননা হাদীসে এসেছে,

عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ عَنِ النَّبِىِّ -- - قَالَ الْجُمُعَةُ حَقٌّ وَاجِبٌ عَلٰى كُلِّ مُسْلِمٍ فِىْ جَمَاعَةٍ إِلَّا أَرْبَعَةً عَبْدٌ مَمْلُوْكٌ أَوِ امْرَأَةٌ أَوْ صَبِىٌّ أَوْ مَرِيْضٌ

তারেক ইবনে শিহাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, জামা‘আতের সাথে জুমু‘আর সালাত আদায় করা প্রতিটি মুসলিমের উপর আবশ্যক। তবে চার প্রকার লোক ব্যতীত। তারা হলো- ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালক ও অসুস্থ ব্যক্তি। [আবু দাউদ, হা/১০৬৯; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/১০৬২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৫৭৮৭।]

১১
জুমু‘আর নামায পরিত্যাগ করার পরিণতি
জুমু‘আর নামায আদায় না করলে অমত্মরে মোহর পড়ে যাবে :

যেহেতু জুমু‘আর নামায অন্যান্য নামাযের মতই ফরয। সুতরাং যদি কেউ জুমু‘আর নামায পরিত্যাগ করে, তাহলে অন্যান্য ফরয নামায পরিত্যাগ করার মতই তার উপর হুকুম প্রযোজ্য হবে। যদি সে তা বিশ্বাসগতভাবে ছেড়ে দেয়, তাহলে সে কাফির হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি অলসতার কারণে কোন কোন জুমু‘আ ছেড়ে দেয়, তাহলে সে ফাসিক হিসেবে গণ্য হবে এবং তার অমত্মরে মোহর পড়ে যাবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ وَأَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّهُمَا سَمِعَا رَسُوْلَ اللهِ - - يَقُوْلُ عَلٰى أَعْوَادِ مِنْبَرِه  : لَيَنْتَهِيَنَّ أَقْوَامٌ عَنْ وَدْعِهِمُ الْجُمُعَاتِ أَوْ لَيَخْتِمَنَّ اللهُ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ ثُمَّ لَيَكُوْنُنَّ مِنَ الْغَافِلِيْنَ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তারা শুনেছেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেছেন, লোকেরা যেন অবশ্যই জুমু‘আ ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকে। নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে অবশ্যই মোহর মেরে দেবেন। অতঃপর তারা অবশ্যই উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৬৫; নাসাঈ, হা/১৩৭০; ইবনে মাজাহ, হা/৭৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৯০।]

عَنْ أَبِى الْجَعْدِ الضَّمْرِىِّ - .. - أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : مَنْ تَرَكَ ثَلَاثَ جُمَعٍ تَهَاوُنًا بِهَا طَبَعَ اللهُ عَلٰى قَلْبِه

আবু জা‘দ যামরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা ওজরে তিনটি জুমু‘আ ত্যাগ করল, আল্লাহ তার অন্তরে অবশ্যই মোহর মেরে দেবেন। [আবু দাউদ, হা/১০৫২; তিরমিযী, হা/৫০০; নাসাঈ, হা/১৩৭২।]

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - قَالَ : مَنْ تَرَكَ الْجُمُعَةَ ثَلَاثًا مُتَوَالِيَاتٍ مِنْ غَيْرِ ضَرُوْرَةٍ طَبَعَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلٰى قَلْبِه

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি বিনা ওজরে ধারাবাহিকভাবে তিনটি জুমু‘আ ছেড়ে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অমত্মরে মোহর মেরে দেবেন। [বায়হাকী, হা/৬২০০; ইবনে মাজাহ, হা/১১২৬।]

১২
জুমু‘আর দিন করণীয়
জুমু‘আর দিনের অনেক করণীয় রয়েছে, যেগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। নিম্নে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. সুগন্ধি ব্যবহার করা :

জুমু‘আর দিন সুগন্ধি ব্যবহার করা উত্তম। রাসূলুল্লাহ ﷺ এই দিনে সুগন্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহ দিতেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : إِذَا كَانَ يَوْمُ الْجُمُعَةِ اغْتَسَلَ الرَّجُلُ وَغَسَلَ رَأْسَه ، ثُمَّ تَطَيَّبَ مِنْ أَطْيَبِ طِيْبِه  .....

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন জুমু‘আর দিন আসবে, তখন গোসল করবে, মাথা ধৌত করবে, তারপর সামর্থানুযায়ী সুগন্ধি ব্যবহার করবে। [বায়হাকী, হা/৬১৬৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮০৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭০৫।]

২. উত্তম পোশাক পরিধান করা :

জুমু‘আর দিন হচ্ছে মুসলিমদের সাপ্তাহিক ঈদের দিন। সুতরাং এ দিনে উত্তম পোশাক পরিধান করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ ﷺ এই দিনে উত্তম পোশাক পরিধান করতেও উৎসাহ দিতেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ وَأَبِىْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَا سَمِعْنَا رَسُوْلَ اللهِ - - يَقُوْلُ : مَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاسْتَنَّ ، وَمَسَّ مِنْ طِيْبٍ إِنْ كَانَ عِنْدَه وَلَبِسَ أَحْسَنَ ثِيَابِه ثُمَّ جَاءَ إِلَى الْمَسْجِدِ .....

আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন গোসল করবে, মিসওয়াক করবে, সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং উত্তম পোশাক পরিধান করবে। তারপর মসজিদে গমন করবে......। [বায়হাকী, হা/৬১৭০।]

عَنْ اِبْنِ عُمَرَ : أَنَّ عُمَرَ كَانَ يَجْمِرُ ثِيَابَه لِلْمَسْجِدِ يَوْمَ الْجُمْعَةِ

ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উমর (রাঃ) জুমু‘আর দিন মসজিদে গমন করার জন্য পোশাক পরিষ্কার করতেন। [জামেউল আহাদীস, হা/২৯০৬৮; কানযুল উম্মাল, হা/২৩৩৩৮।]

৩. জুমু‘আর দিনে পরিধানের জন্য কাপড় নির্দিষ্ট করে রাখা :

শুধুমাত্র জুমু‘আর দিনে পরিধান করার জন্য কোন কাপড় নির্দিষ্ট করে রাখাতে কোন দোষ নেই। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ اَنَّ النَّبيَّ خَطَبَ النَّاسَ يَوْمَ الجُمُعَةِ . فَرَاٰى عَلَيْهمْ ثِيَابَ النِّمَارِ . فَقَالَ : رَسُوْلُ الله مَاعَلٰى اَحَدِكُمْ ، اِنْ وَجَدَ سَعَةً ، اِنْ يَّتَّخِذَ ثَوْبَيْنِ لِجُمُعَتِه سِوٰى ثَوْبَيْ مِهْنَتِه

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ জুমু‘আর খুতবা প্রদান করতেন। একদিন তিনি লোকদের গায়ে ময়লা কাপড় দেখতে পেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ব্যবহৃত কাপড়ের বাইরে জুমু‘আর দিনে পরিধান করার জন্য দুটি কাপড় নির্দিষ্ট করে রাখে, তাহলে তার কোন দোষ নেই। [ইবনে মাজাহ, হা/১০৯৬; আবু দাউদ, হা/১০৮০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৭৭৭; মিশকাত, হা/১৩৮৯।]

৪. মিসওয়াক করা :

মিসওয়াক করাটা একটি উত্তম অভ্যাস। এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অন্যতম মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ ﷺ এ দিনে মিসওয়াক করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ السَّبَّاقِ أَنَّ النَّبِىَّ - - قَالَ فِىْ جُمُعَةٍ مِنَ الْجُمَعِ : يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِيْنَ إِنَّ هٰذَا يَوْمٌ جَعَلَهُ اللّٰهُ عِيْدًا لِلمُسْلِمِيْنَ فَاغْتَسِلُوْا ، وَمَنْ كَانَ عِنْدَه طِيْبٌ فَلَا يَضُرَّه أَنْ يَّمَسَّ مِنْهُ وَعَلَيْكُمْ بِالسِّوَاكِ

ইবনে সাববাক (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা এক জুমু‘আর খুতবায় নবী ﷺ বলেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! এটি হচ্ছে এমন একটি দিন, আল্লাহ তা‘আলা এ দিনটিকে মুসলিমদের জন্য ঈদ হিসেবে নির্বাচন করেছেন। অতএব এ দিনে তোমরা গোসল করো এবং সুগন্ধি ব্যবহার করো। আর তোমরা মিসওয়াক ব্যবহার করো। [বায়হাকী, হা/৫৭৫২; সহীহুল জামে, হা/২২৫৮।]

৫. নখ কাটা ও গোঁফ ছোট করা :

নখ কাটা ও গোঁফ ছোট করাও হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার একটি আলামত। সাহাবীগণ এ দিনে এ আমলটি করতেন। যেমন-

عَنْ نَافِعٍ : أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يُقَلِّمُ أَظْفَارَه ، وَيَقُصُّ شَارِبَه فِىْ كُلِّ جُمُعَةٍ

নাফে (রহ.) হতে বর্ণিত। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) জুমু‘আর দিন নখ কাটতেন, গোঁফ ছোট করতেন। [বায়হাকী, হা/৬১৭৬।]

৬. জুমু‘আর দিন গোসল করা :

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে গোসল। রাসূলুল্লাহ ﷺ জুমু‘আর দিনে গোসল করা আবশ্যক করে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمُ الْجُمُعَةَ فَلْيَغْتَسِلْ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন জুমু‘আর সালাতে আসবে, তখন সে যেন গোসল করে। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২৩১; সহীহ বুখারী, হা/৮৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১৯৮৮; আবু দাউদ, হা/৩৪০; তিরমিযী, হা/৪৯২; নাসাঈ, হা/১৩৭৬; ইবনে মাজাহ, হা/১০৮৮; মিশকাত, হা/৫৩৭।]

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : غُسْلُ يَوْمِ الْجُمُعَةِ وَاجِبٌ عَلٰى كُلِّ مُحْتَلِمٍ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, জুমু‘আর দিন গোসল করা সকল সাবালক মুসলিমের উপর ওয়াজিব। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২২৮, ২৩০; সহীহ বুখারী, হা/৮৫৮, ৮৭৯, ৮৫৯; সহীহ মুসলিম, হা/১৯৯৪; আবু দাউদ, হা/৩৪১; নাসাঈ, হা/১৩৭০; ইবনে মাজাহ, হা/১০৮৯; মিশকাত, হা/৫৩৮।]

৭. জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হওয়া :

জুমু‘আর দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَؕ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ فَاِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِى الْاَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! জুমু‘আর দিন যখন সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম- যদি তোমরা জানতে। অতঃপর যখন সালাত শেষ হয় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। আর তোমরা আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা জুমু‘আ- ৯, ১০)

৮. জুমু‘আর দিন হেঁটে মসজিদে উপস্থিত হওয়া :

জুমু‘আর দিন পায়ে হেঁটে মসজিদে উপস্থিত হওয়ার বিশেষ নেকী রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَوْسِ بْنِ أَوْسٍ الثَّقَفِىُّ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ - - يَقُوْلُ : مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ ثُمَّ بَكَّرَ وَابْتَكَرَ وَمَشٰى وَلَمْ يَرْكَبْ وَدَنَا مِنَ الْاِمَامِ فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ كَانَ لَه بِكُلِّ خُطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا

আওস ইবনে আওস আস-সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন উত্তমভাবে গোসল করল, তারপর তাড়াতাড়ি মসজিদে গমন করল এবং বাহন বাদ দিয়ে পায়ে হেঁটে গমন করল, ইমামের কাছাকাছি অবস্থান করল, তারপর খুতবা শুনল এবং অনর্থক কোন কথা বা কাজ করল না, তাহলে তার জন্য রয়েছে প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে এক বছরের রোযা এবং রাত জাগরণের সওয়াব। [আবু দাউদ, হা/৩৪৫; ইবনে মাজাহ, হা/১০৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬২১৮; মিশকাত, হা/১৩৮৮।]

৯. জুমু‘আর দিন সকাল সকাল মসজিদে যাওয়া :

জুমু‘আর দিন যতটুকু সম্ভব সকাল সকাল মসজিদে উপস্থিত হওয়া উত্তম। এতে অনেক সওয়াব রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ غُسْلَ الْجَنَابَةِ ثُمَّ رَاحَ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَدَنَةً وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّانِيَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَقَرَةً وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الثَّالِثَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ كَبْشًا أَقْرَنَ وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الرَّابِعَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ دَجَاجَةً وَمَنْ رَاحَ فِي السَّاعَةِ الْخَامِسَةِ فَكَأَنَّمَا قَرَّبَ بَيْضَةً فَإِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ حَضَرَتِ الْمَلَائِكَةُ يَسْتَمِعُوْنَ الذِّكْرَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন ফরয গোসলের ন্যায় গোসল করল, অতঃপর মসজিদের দিকে রওয়ানা দিল এবং প্রথম পর্যায়ে মসজিদে প্রবেশ করল, সে যেন একটি উট কুরবানী করার সওয়াব পেল। এরপর যে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করল, সে যেন একটি গরু কুরবানী করার সওয়াব পেল। এরপর যে তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করল, সে যেন একটি ভেড়া কুরবানী করার সওয়াব পেল। অতঃপর যে চতুর্থ পর্যায়ে প্রবেশ করল, সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করার সওয়াব পেল। অতঃপর যে ব্যক্তি পঞ্চম পর্যায়ে প্রবেশ করল, সে যেন একটি ডিম দান করার সওয়াব পেল। অতঃপর যখন ইমাম (খুতবা দেয়ার উদ্দেশ্যে) বের হন, তখন ফেরেশতাগণ (লেখা বন্ধ করে) খুতবা শুনতে থাকেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২২৭; সহীহ বুখারী, হা/৮৮১; সহীহ মুসলিম, হা/২০০১; তিরমিযী, হা/৪৯৯।]

১০. খুতবার সময় তন্দ্রা আসলে স্থান পরিবর্তন করা :

অনেক সময় খুতবা শুনতে শুনতে তন্দ্রা এসে যায়। সুতরাং এ সময় স্থান পরিবর্তন করে বসা উচিত। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ  , قَالَ : قَالَ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ : إِذَا نَعَسَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِىْ مَجْلِسِه  , فَلْيَتَحَوَّلْ مِنْ مَجْلِسِه ذٰلِكَ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, জুমু‘আর দিন তোমাদের মধ্যে কারো যদি তন্দ্রা আসে, তাহলে সে যেন তার জায়গা পরিবর্তন করে নেয়। [তিরমিযী, হা/৫২৬; বায়হাকী, হা/৬১৩৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮১৯; মিশকাত, হা/১৩৯৪।]

১১. তাহিয়্যাতুল মসজিদের সালাত আদায় করা :

তাহিয়্যাতুল মসজিদ হচ্ছে মসজিদের হক। মসজিদে প্রবেশ করেই এই নামায আদায় করতে হয়। জুমু‘আর দিন মসজিদে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই এ কাজটি সেরে নেয়া উচিত। হাদীসে এসেছে,

عَنْ سَلْمَانَ الْفَارِسِيِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَتَطَهَّرَ بِمَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ ثُمَّ ادَّهَنَ أَوْ مَسَّ مِنْ طِيْبٍ ثُمَّ رَاحَ فَلَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ اثْنَيْنِ فَصَلّٰى مَا كُتِبَ لَه ثُمَّ إِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ أَنْصَتَ غُفِرَ لَه مَا بَيْنَه وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرٰى

সালমান ফারসী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে লোক জুমু‘আর দিন গোসল করে এবং যথাসম্ভব অধিক পরিমাণে পবিত্রতা অর্জন করে, তারপর তেল মেখে (চুল-দাড়ি পরিপাটি করে) নেয় অথবা সুগন্ধি লাগায়। এরপর (মসজিদে) চলে যায়, সেখানে দু’জনের মধ্যে ফাঁক করে তাদের মাঝখানে বসে পড়ে না এবং তার ভাগ্যে যে পরিমাণ (নফল নামায) নির্ধারিত হয়েছে সে পরিমাণ নামায পড়ে অতঃপর ইমাম যখন (খুতবার উদ্দেশ্যে নিজের ঘর হতে) বের হন তখন চুপ থাকে, তাহলে তার এ জুমু‘আ এবং পরবর্তী জুমু‘আর নামাযের মধ্যবর্তী যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৯১০; ইবনে মাজাহ, হা/১০৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৫৭৯; মিশকাত, হা/১৩৮১।]

১২. মানুষের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে না যাওয়া :

মানুষের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে যাওয়াটা হচ্ছে মুসল্লিদের কষ্টের কারণ। তাছাড়া এ কারণে খুতবা শ্রবণ করা হতে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং জুমু‘আর দিন মসজিদে উপস্থিত হয়ে শৃঙ্খলা বজায় রেখে কাউকে না ডিঙ্গিয়ে যেখানে জায়গা পাওয়া যায় সেখানেই বসে পড়া উত্তম। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُسْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ : جَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطّٰى رِقَابَ النَّاسِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِيُّ يَخْطُبُ، فَقَالَ النَّبِيُّ : اِجْلِسْ فَقَدْ اٰذَيْتَ وَاٰنَيْتَ

আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ জুমু‘আর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে লোকদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে যাচ্ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তুমি বসে পড়ো। কারণ তুমি মানুষকে কষ্ট দিচ্ছ। [আবু দাউদ হা/১১২০; নাসাঈ, হা/১৩৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৭৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮১১।]

১৩. খুতবা চলাকালে নীরবতা পালন করা এবং মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা :

খুতবা হচ্ছে জুমু‘আর দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং এ সময় নীরবতা পালন করে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শ্রবণ করা আবশ্যক। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ إِذَا قُلْتَ لِصَاحِبِكَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَنْصِتْ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَقَدْ لَغَوْتَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ইমাম খুতবা দেয়া অবস্থায় যদি তুমি তোমার সাথিকে বল যে, ‘তুমি চুপ থাকো’ তাহলে তুমি ভুল করলে। [সহীহ বুখারী, হা/৭৩৪; সহীহ মুসলিম, হা/৮৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৮৬; আবু দাউদ, হা/১১১৪; ইবনে মাজাহ, হা/১১১০; বায়হাকী, হা/৫৬১৫; সুনানে দারেমী, হা/১৬০১; নাসাঈ, হা/১৪০১।]

১৪. ‘ইহতেবা’ অবস্থায় না বসা :

‘ইহতেবা’ হচ্ছে দু’হাঁটু খাড়া করে, দু’রান পেটের সাথে লাগিয়ে নিতম্বের উপরে বসা। রাসূলুল্লাহ ﷺ এ ধরনের বসা হতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ مُعَاذِ بْنِ أَنَسٍ الْجُهَنِيِّ قَالَ : نَهٰى رَسُوْلُ اللهِ عَنِ الْحِبْوَةِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ

মুয়ায ইবনে আনাস আল জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ খুতবা চলাকালে ইহতেবা অবস্থায় বসতে নিষেধ করেছেন। [আবু দাউদ, হা/১১১২; বায়হাকী, হা/৫৭০৪; তিরমিযী, হা/৫১৪; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১০৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৬৩০; মিশকাত, হা/১৩৯৩।]

১৫. জুমু‘আর দিন বেশি বেশি দু‘আ করা :

জুমু‘আর দিনটি হচ্ছে দু‘আ কবুলের দিন। এ দিনে একটি বিশেষ সময় রয়েছে, সে সময় দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তা কবুল করেন। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং জুমু‘আর দিন বেশি বেশি দু‘আ করা উচিত।

১৬. জুমু‘আর রাতে সূরা কাহফ পাঠ করা :

জুমু‘আর রাতে সূরা কাহফ পাঠ করার অনেক ফযীলত রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ اَنَّ النَّبِىَّ قَالَ مَنْ قَرَأَ سُوْرَةَ الْكَهْفِ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ أَضَاءَ لَه مِنَ النُّوْرِ فِيْمَا بَيْنَه وَبَيْنَ الْبَيْتِ الْعَتِيْقِ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি জুমু‘আর রাতে সূরা কাহফ পাঠ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার এবং কাবা ঘরের মধ্যে যে পরিমাণ দূরত্ব রয়েছে তত পরিমাণ নূর দান করবেন। [মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৩৯২; বায়হাকী, হা/৫৭৯২; জামেউস সগীর, হা/১১৪১৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৭৬; মিশকাত, হা/২১৭৫।]

১৭. জুমু‘আর দিন বেশি বেশি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি দরূদ পাঠ করা :

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর দরূদ পাঠ করা এমনিতেই একটি বড় ধরনের সওয়াবের কাজ। তারপরও রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের পক্ষ থেকে জুমু‘আর দিন তাঁর উপর দরূদ পাঠ করার ব্যাপারে তাকিদ দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَوْسِ بْنِ أَوْسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - إِنَّ مِنْ أَفْضَلِ أَيَّامِكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِيْهِ خُلِقَ اٰدَمُ وَفِيْهِ قُبِضَ وَفِيْهِ النَّفْخَةُ وَفِيْهِ الصَّعْقَةُ فَأَكْثِرُوْا عَلَىَّ مِنَ الصَّلَاةِ فِيْهِ فَإِنَّ صَلَاتَكُمْ مَعْرُوْضَةٌ عَلَىَّ . قَالَ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَكَيْفَ تُعْرَضُ صَلَاتُنَا عَلَيْكَ وَقَدْ أَرِمْتَ يَقُوْلُوْنَ بَلِيْتَ . فَقَالَ : إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ حَرَّمَ عَلَى الْاَرْضِ أَجْسَادَ الْاَنْبِيَاءِ

আওস ইবনে আওস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে জুমু‘আর দিনটি হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম। এ দিনে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এ দিনেই তার মৃত্যু হয়েছে। আর এ দিনেই শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে, এ দিনেই বিকট আওয়াজ হবে। কাজেই তোমরা ঐ দিন আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ করো। কারণ আমার নিকট তোমাদের দরূদগুলো উপস্থাপন করা হয়। বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট আমাদের দরূদ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, আপনিতো তখন মাটির সাথে মিশে যাবেন? জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহ নবীদের শরীরকে জমিনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন অর্থাৎ মাটি কখনো নবীদের শরীর খেতে পারবে না। [আবু দাউদ, হা/১০৪৯, ১৫৩৩; নাসাঈ, হা/১৩৭৪; ইবনে মাজাহ, হা/১০৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬২০৭; জামেউস সগীর, হা/৩৯৭৫; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৫২৭; মিশকাত, হা/১৩৬১।]

১৩
জুমু‘আর সালাত আদায় করার পদ্ধতি
১. জুমু‘আর সালাতে আগমনকারী ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমে দু’রাকআত ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ আদায় করে নেবে। এরপর ইমামের খুতবা শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যত ইচ্ছা নফল সালাত আদায় করতে পারবে।

২. জুমু‘আর সালাতের পূর্বে ‘‘কাবলাল জুমু‘আ’’ নামে এক সালামে ৪ রাকআত নামায পড়ার নিয়ম নবী ﷺ থেকে প্রমাণিত নয়।

৩. জুমু‘আর ফরয সালাত হচ্ছে দু’রাকআত। জুমু‘আর খুতবা শেষ হওয়ার পর ইমাম সাহেব মুসল্লীদেরকে নিয়ে দু’রাকআত জুমু‘আর ফরয সালাত আদায় করবেন।

৪. জুমু‘আর ফরয আদায়ের পর ৪ রাকআত সুন্নাত পড়বে। এ ৪ রাকআত সালাত একসাথে আদায় না করে দুই সালামে আদায় করা উত্তম।

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مُصَلِّيًا بَعْدَ الْجُمُعَةِ فَلْيُصَلِّ أَرْبَعًا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমু‘আর পরে সালাত আদায় করতে চায় সে যেন ৪ রাকআত আদায় করে। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৮১; আবু দাউদ, হা/১১৩৩; তিরমিযী, হা/৫২৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৭৪।]

৫. যদি কেউ মসজিদে সুন্নাত আদায় না করে বাড়িতে গিয়ে আদায় করে তবে সে দু’রাকআত আদায় করবে।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يُصَلِّيْ قَبْلَ الظُّهْرِ رَكْعَتَيْنِ وَبَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ وَبَعْدَ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ فِي بَيْتِه وَبَعْدَ الْعِشَاءِ رَكْعَتَيْنِ وَكَانَ لَا يُصَلِّيْ بَعْدَ الْجُمُعَةِ حَتّٰى يَنْصَرِفَ فَيُصَلِّيْ رَكْعَتَيْنِ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ যোহরের পূর্বে দু’রাকআত, যোহরের পর দু’রাকআত, মাগরিবের পর নিজের ঘরে দু’রাকআত এবং এশার পর দু’রাকআত সালাত আদায় করতেন। আর জুমু‘আর দিন নিজের ঘরে না যাওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করতেন না। অতঃপর ঘরে ফিরে দু’রাকআত সালাত আদায় করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/৩৯৮; সহীহ বুখারী, হা/৯৩৭; সহীহ মুসলিম, হা/২০২৭; আবু দাউদ, হা/১২৫৪; নাসাঈ, হা/৮৭৩।]

৬. আখেরী যোহর নামে জুমু‘আর সালাতের পরে পুনরায় যোহরের চার রাকআত পড়া বিদআত। কেননা জুমু‘আর পর যোহর পড়ার কোন দলীল নেই। যে ব্যক্তি জুমু‘আর সালাত আদায় করে, তার উপর থেকে যোহরের ফরযিয়াত উঠে যায়।

৭. যদি কেউ ইমামকে সিজদা অবস্থায় অথবা শেষ বৈঠকে পায় তাহলে সে পূর্ণ চার রাকআত যোহরের সালাত আদায় করবে। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২৩৮; তিরমিযী, হা/৫২৪; বায়হাকী, ৩/২০৪; মিশকাত হা/১৪১২।]

৮. বিশেষ ওজরের কারণে জুমু‘আর সালাত পড়তে না পারলে যোহরের সালাত পড়ে নেবে। [ফিকহুস সুন্নাহ ১/২২৬-২৭।]

১৪
জুমু‘আর সালাতে যেসব সূরা পড়া সুন্নাত
১. জুমু‘আর সালাতে ইমাম সাহেব প্রথম রাকআতে সূরা জুমু‘আ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকূন অথবা প্রথম রাকআতে সূরা আ‘লা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ পাঠ করবেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/২৪৫; সহীহ মুসলিম, হা/২০৬৫; আবু দাউদ, হা/১১২৪; তিরমিযী, হা/৫৩৩; ইবনে মাজাহ, হা/১১২০; মিশকাত, হা/৮৪০।] হাদীসে এসেছে,

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيْرٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يَقْرَأُ فِى الْعِيْدَيْنِ وَفِى الْجُمُعَةِ بِ ﴿سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلٰى﴾ وَ ﴿هَلْ أَتَاكَ حَدِيْثُ الْغَاشِيَةِ﴾ قَالَ وَإِذَا اجْتَمَعَ الْعِيْدُ وَالْجُمُعَةُ فِىْ يَوْمٍ وَاحِدٍ يَقْرَأُ بِهِمَا أَيْضًا فِى الصَّلَاتَيْنِ

নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ দু’ ঈদের সালাতে ও জুমু‘আর সালাতে ‘‘সাবিবহিসমা রবিবকাল আ‘লা-’’ ও ‘‘হাল আতা-কা হাদীসুল গ-শিয়াহ’’ সূরাদ্বয় পাঠ করতেন। বর্ণনাকারী বলেন, ঈদ ও জুমু‘আ একই দিনে হলেও তিনি উভয় সালাতে ঐ সূরাদ্বয় পাঠ করতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৭৮; নাসাঈ, হা/১৪২৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩৮৭; মিশকাত, হা/৮৪০।]

২. জুমু‘আর দিন ফজরের ১ম রাকআতে ইমাম সূরা সিজদা ও ২য় রাকআতে সূরা দাহর পাঠ করবেন। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৩২৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/৫৩৩; মিশকাত, হা/৮৩৮।]

তবে অন্য সূরাও পড়া যাবে। তবে এগুলো পাঠ করা সুন্নাত। কেননা এগুলো রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রায়ই পাঠ করতেন।

১৫
জুমু‘আ সম্পর্কিত কিছু মাসআলা
১. যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন মসজিদে প্রবেশ করে দেখবে যে ইমাম খুতবায় দাঁড়িয়ে গেছেন, সে প্রথমে দু’রাকআত সালাত আদায় করে নেবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللّٰهِ قَالَ : جَاءَ سليك الْغَطَفَانِيُّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ . وَرَسُوْلُ اللّٰهِ يَخْطُبُ، فَجَلَسَ . فَقَالَ لَه يَا سُلَيْكُ قُمْ فَارْكَعْ رَكْعَتَيْنِ . وَتَجَوَّزْ فِيْهِمَا ثُمّ قَالَ : إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ وَلْيَتَجَوَّزْ فِيْهِمَا

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সালিক আল-গাতফানী জুমু‘আর দিন মসজিদে আসলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লেন। তখন নবী ﷺ বললেন, হে সালিক! তুমি দাঁড়াও এবং সংক্ষেপে দু’রাকআত সালাত আদায় করো। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৫০২; বায়হাকী, হা/৫৪৮৩।]

২. জুমু‘আর দিন খুতবার আযানের পর ক্রয়-বিক্রয় করা হারাম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেছেন, জুমু‘আর দিন যখন আযান হয়, তখন ক্রয়-বিক্রয় ছেড়ে দিয়ে জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হও।

৩. জুমু‘আর দিন ঠিক দুপুরের সময় সালাত আদায় করা নিষেধ নয়।

৪. নবী ﷺ শুধুমাত্র জুমু‘আর দিনকে খাস করে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُوْلُ لَا يَصُوْمَنَّ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ إِلَّا يَوْمًا قَبْلَه أَوْ بَعْدَه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের কেউ যেন শুধুমাত্র জুমু‘আর দিনকে খাস করে রোযা না রাখে। সে যেন আগে অথবা পরে একদিন মিলিয়ে নেয়। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৮৫; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৪৫।]

তবে জুমু‘আর দিন যদি আরাফা অথবা অন্য কোন বিশেষ দিন হয়, তাহলে সেদিন রোযা রাখাতে কোন অসুবিধা নেই।

ইমামের সাথে পূর্ণ এক রাকআত না পেলে কী করবে :

কোন ব্যক্তি যদি জুমু‘আয় উপস্থিত হয়ে দেখে যে, ইমাম দ্বিতীয় রাকআতের রুকূ থেকে দাঁড়িয়ে গেছেন, তাহলে সে সালাম ফিরানোর পূর্ব পর্যমত্ম যতটুকু জামা‘আত পায় তাতে শরীক হয়ে যাবে। তবে তা তার জুমু‘আর সালাত হিসেবে গণ্য হবে না। অতঃপর সে ইমামের সালাম ফিরানোর পর যোহরের চার রাকআত সালাত আদায় করে নেবে। তবে কেউ যদি জুমু‘আর সালাত ইমামের সাথে এক রাকআত পায়, তাহলে বাকি এক রাকআত পড়ে দু’রাকআত পূর্ণ করে নেবে।

১৬
খতীব সাহেবের করণীয়
১. খতীব সাহেব মিম্বরে বসার সময় প্রথমে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান করবেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ قَالَ : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - إِذَا صَعِدَ الْمِنْبَرَ سَلَّمَ

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মিম্বরে আরোহণ করতেন তখন সালাম প্রদান করতেন। [ইবনে মাজাহ, হা/১১০৯; বায়হাকী, হা/৫৫৩২; শারহুস সুন্নাহ, হা/১০৬৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২০৭৬।]

২. জুমু‘আর দিন খতীবের জন্য সুন্নাত হলো, মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে দু’টি খুতবা প্রদান করা।

৩. আযান শেষ না হওয়া পর্যমত্ম মিম্বরে বসে থাকবেন। আযান শেষ হওয়ার পর দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করবেন।

৪. হাতে একটি লাঠি নেবেন এবং এর উপর ভর দিয়ে খুতবা দেবেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৮৮৯।]

৫. দুই খুতবার মাঝখানে একবার বসবেন। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৩২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৯১৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৯৫২; বায়হাকী, হা/৫৫৬৪; দারেমী, হা/১৫৫৯; মিশকাত হা/১৪০৫।]

৬. মুসল্লীদের দিকে তাকিয়ে খুতবা প্রদান করবেন এবং একটু পর পর ডানে ও বামে মুখ ফেরাবেন।

৭. খতীব সাহেব প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করবেন, তারপর নবী ﷺ এর প্রতি দরূদ পাঠ করবেন, অতঃপর মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে তাকওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে নসীহত করবেন, ২য় খুতবায় হামদ ও দরূদসহ সকল মুসলিমের জন্য দু‘আ করবেন এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ দেবেন। [নাসাঈ, হা/১৪১৭-১৮; তিরমিযী, হা/৫০৬।]

৮. খুতবা উচ্চ আওয়াজে হওয়া সুন্নাত। নবী ﷺ উচ্চ আওয়াজে খুতবা প্রদান করতেন।

৯. খতীবের উচিত হলো, খুতবায় সকল মুসলিম ও মুসল্লীর জন্য তাদের কল্যাণের বিষয়ে দু‘আ করা।

১০. খুতবা থেকে অবসর হওয়ার পর কোন ওজর না থাকলে খতীব নিজেই জুমু‘আর সালাতের ইমামতি করবেন।

১১. খুতবা শেষ হওয়ার পর নামায শুরু করতে বেশি সময় দেরি না করা।

১২. খুতবা প্রদানকালীন অনর্থক কাজে জড়িয়ে না পড়া।

১৩. খতীবের জন্য জায়েয আছে যে, খুতবার শুরুতে অথবা পরে কিংবা খুতবায় বসাকালীন সময়ে কোন প্রয়োজনীয় কথা বলা।

১৪. দ্বিতীয় খুতবা কেবল দু‘আ দ্বারা সমাপ্ত না করে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশ প্রদান করে তারপর খুতবা শেষ করা।

১৫. খুতবায় কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস দ্বারা দলীল উপস্থাপন করা।

১৬. খুতবার মধ্যে যঈফ ও মাওযূ হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা।

১৭. খতীব সাহেব খুতবা বেশি লম্বা করবেন না। আবার এমন সংক্ষিপ্তও করবেন না যে, খুতবার হক আদায় হবে না এবং মুসল্লীগণ এর থেকে কোন ফায়দা পাবে না।

عَنْ وَاصِلِ بْنِ حَيَّانَ قَالَ قَالَ أَبُوْ وَائِلٍ خَطَبَنَا عَمَّارٌ فَأَوْجَزَ وَأَبْلَغَ فَلَمَّا نَزَلَ قُلْنَا يَا أَبَا الْيَقْظَانِ لَقَدْ أَبْلَغْتَ وَأَوْجَزْتَ فَلَوْ كُنْتَ تَنَفَّسْتَ . فَقَالَ إِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ - يَقُوْلُ إِنَّ طُوْلَ صَلَاةِ الرَّجُلِ وَقِصَرَ خُطْبَتِه مَئِنَّةٌ مِنْ فِقْهِه فَأَطِيْلُوا الصَّلَاةَ وَاقْصُرُوا الْخُطْبَةَ وَإِنَّ مِنَ الْبَيَانِ سِحْرًا

ওয়াসিল ইবনে হাইয়ান (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু ওয়ায়িল (রহ.) বলেছেন, একদা আম্মার (রাঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে একটি ভাষণ প্রদান করলেন। তারপর যখন তিনি মিম্বর থেকে নামলেন তখন আমরা বললাম, হে আবুল ইয়াকযান! আপনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহুল ভাষণ প্রদান করেছেন, তবে যদি তা কিছুটা দীর্ঘ করতেন (তাহলে ভালো হতো)। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, কোন ব্যক্তির দীর্ঘ সালাত ও সংক্ষিপ্ত ভাষণ তার প্রজ্ঞার পরিচায়ক। অতএব, তোমরা সালাতকে দীর্ঘ করো এবং ভাষণকে সংক্ষিপ্ত করো। অবশ্যই কোন কোন ভাষণে যাদুকরি প্রভাব থাকে। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩১৭; বায়হাকী, হা/৫৯৭৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৭৯১; মিশকাত, হা/১৪০৬।]

১৭
মাতৃভাষায় খুতবা দেয়া উচিত
খতীবের জন্য উচিত হলো, এমন ভাষায় খুতবা প্রদান করা, যাতে উপস্থিত লোকজন বুঝতে পারে। খুতবা মাতৃভাষায় এবং অধিকাংশ মুসল্লীর বোধগম্য ভাষায় হওয়া জরুরি। কেননা ‘‘খুতবা’’ অর্থ ভাষণ। আর ভাষণ সেই ভাষায় দিতে হবে যে ভাষা অধিকাংশ শ্রোতা বুঝতে পারে। অন্যথায় উক্ত ভাষণের উদ্দেশ্য ব্যহত হয়।

সকল নবী-রাসূলই তাদের জাতির কাছে তাদেরই ভাষা অনুযায়ী প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِه لِيُبَيِّنَ لَهُمْ﴾

আমি সকল রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে সে তাদেরকে (আল্লাহর দ্বীন) ব্যাখ্যা করে দেয়। (সূরা ইবরাহীম- ৪)

আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ-ও সে অনুযায়ী প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর মাতৃভাষা ছিল আরবি এবং তিনি যাদেরকে শিক্ষা দিতেন তাদের ভাষাও ছিল আরবি। তাই তিনি আরবি ভাষায় খুতবা দিতেন।

আর আলেমরা যেহেতু তাঁর উত্তরাধিকারী, সেহেতু প্রত্যেকের উচিত অধিকাংশ শ্রোতা যে ভাষা বুঝতে পারে সে ভাষায় খুতবা প্রদান করা। অন্যথায় খুতবার উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।

বিভিন্ন মসজিদে কেবল আরবি খুতবা পাঠের যে প্রচলন রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে খুতবার উদ্দেশ্য বিরোধী।

বর্তমানে মূল খুতবার পূর্বে মিম্বরে বসে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার মাধ্যমে যে তৃতীয় আরেকটি খুতবা চালু করা হয়েছে তা সুন্নাতের খেলাফ। কেননা জুমু‘আর জন্য নির্ধারিত খুতবা হলো- দুটি; তিনটি নয়। তাছাড়া মূল খুতবার পূর্বের সময়টি মুসল্লীদের নফল সালাতের সময়।

১৮
জুমু‘আর দিন মানুষের ভুল-ভ্রামিত্মসমূহ
১. জুমু‘আর দিনের গুরুত্ব না দেওয়া।

২. এ দিনে খেল-তামাশায় মশগুল হওয়া।

৩. জুমু‘আর রাতে বেশি জাগ্রত থাকা, যার ফলে জুমু‘আর দিন ফজরের সালাত কাযা হয়ে যায়।

৪. জুমু‘আর সালাত পরিত্যাগ করা।

৫. জুমু‘আর দিন গোসল না করা।

৬. খুতবা চলাকালে দু‘আ করার সময় হাত উত্তোলন করা।

৭. খুতবার মধ্যে যালিম শাসকের প্রশংসা করা।

৮. খুতবার সময় উচ্চ আওয়াজে দু‘আ করা অথবা আমীন বলা। এ ক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে মুক্তাদীরা খুতবা শুনবে এবং যদি যিকির বা দু‘আ জাতীয় কোন কিছু করতে হয়, তাহলে আসেত্ম আসেত্ম বলবে।

৯. ইমামকে বিদআতী অথবা পাপী মনে করে জুমু‘আ ছেড়ে দেয়া।

১০. খুতবার আযানের পর ক্রয়-বিক্রয় করা।

১১. খুতবার সময় মসজিদে প্রবেশ করে মুসল্লীদেরকে সালাম দেয়া।

১২. সামনে জায়গা থাকা সত্ত্বেও পেছনের কাতারে বসে পড়া।

১৩. মসজিদের কোন স্থানকে নির্ধারণ করে নেয়া।

১৪. মানুষকে ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে সামনে যাওয়া।

১৫. জুমু‘আর দিনে কবর যিয়ারত করাকে সুন্নাত মনে করা।

১৬. কোন জুমু‘আকে বিশেষ নামে নামকরণ করা। যেমন- রমাযানের শেষ জুমু‘আকে জুমু‘আতুল বিদা বলা।

১৯
মহিলাদের জুমু‘আয় উপস্থিত হওয়ার বিধান
মহিলারাও জুমু‘আয় যেতে পারবে। তবে এর জন্য কয়েকটি শর্ত আছে, যেমন-

১. মসজিদে আসা-যাওয়ার পথে যেন কোন ফেতনার আশঙ্কা না থাকে।

২. মহিলারা যেন পর্দার সাথে আসে।

৩. তারা যেন কোন ধরনের সুগন্ধি লাগিয়ে না আসে।

৪. এতে যেন তার স্বামীর অনুমতি থাকে।

স্বামীর জন্যও উচিত হলো, তার স্ত্রী যদি মসজিদে যেতে অনুমতি চায় তাহলে তাকে বাধা না দেয়া। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগেও মহিলাগণ মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করতেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كُنَّ نِسَاءُ الْمُؤْمِنَاتِ يَشْهَدْنَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَاةَ الْفَجْرِ مُتَلَفِّعَاتٍ بِمُرُوْطِهِنَّ ثُمَّ يَنْقَلِبْنَ إِلٰى بُيُوْتِهِنَّ حِيْنَ يَقْضِيْنَ الصَّلَاةَ لَا يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ مِنَ الْغَلَسِ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুমিন মহিলারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ফজরের সালাত আদায় করার জন্য দেহে চাদর জড়িয়ে হাযির হতেন। অতঃপর সালাত শেষ হলে তারা নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেতেন, তখন অন্ধকারের কারণে তাদেরকে কেউ চিনতে পারত না। [সহীহ বুখারী, হা/৫৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৪৯১; আবু দাউদ, হা/৪২৩; তিরমিযী, হা/১৫৩; ইবনে মাজাহ, হা/৬৬৯।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ - - لاَ تَمْنَعُوا النِّسَاءَ مِنَ الْخُرُوْجِ إِلَى الْمَسَاجِدِ بِاللَّيْلِ

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যদি তোমাদের স্ত্রীরা রাত্রে মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তাহলে তোমরা তাদেরকে বাধা দিও না। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৪২; আবু দাউদ, হা/৫৬৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৫৬৯।]

উপরোক্ত হাদীসগুলোতে নবী ﷺ মহিলাদেরকে মসজিদে উপস্থিত হয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করার অনুমতি দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিষেধ করতে বারণ করেছেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে এটা বুঝা যায় যে, মহিলাদের মসজিদে যাওয়াতে এবং জামা‘আতে শরীক হওয়াতে কোন দোষ নেই। বিশেষ করে জুমু‘আর সালাতে উপস্থিত হলে মহিলারা খুতবা এবং অন্যান্য দ্বীনী আলোচনা শ্রবণ করার সুযোগ পায়। এতে তাদের ঈমান ও আমলের উন্নতি হয়।

কিন্তু অনুতাপের বিষয় হলো, মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সহীহ হাদীস ও অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে মহিলাদেরকে মসজিদ ও ঈদগাহে যাওয়া এবং মুসলিমদের দু‘আ, দ্বীন শিক্ষা ও ওয়াজ-নসীহত শ্রবণ করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয় না।

২০
সোমবার ও বৃহস্পতিবারের আমল
সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। আর তা হচ্ছে এ দু’টি দিনে বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে পৌঁছানো হয়। এজন্য নবী ﷺ সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখাকে পছন্দ করতেন। হাদীসে এসেছে,

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন,

تُعْرَضُ الْأَعْمَالُ يَوْمَ الْإِثْنَيْنِ وَالْخَمِيْسِ فَأُحِبُّ أَنْ يُّعْرَضَ عَمَلِيْ وَأَنَا صَائِمٌ

সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলসমূহ আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। তাই আমি এটা পছন্দ করি যে, আমার আমল আল্লাহর কাছে রোযা অবস্থায় পেশ করা হোক। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৭১১; তিরমিযী, হা/৭৪৭; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৯৯; জামেউস সগীর, হা/৫২৭০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৪১; মিশকাত, হা/২০৫৬।]

অতএব আমাদের উচিত, আমরাও যেন এ হাদীসের উপর ভিত্তি করে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের দিন রোযা রাখি।

২১
আইয়ামে বীয
প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের দিনগুলোকে আইয়ামে বীয বলা হয়। এ দিনগুলোর বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এ তিনটি দিনে রোযা রাখা অনেক সওয়াবের কাজ। একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আবু যর (রাঃ)-কে বললেন,

يَا أَبَا ذَرِّ إِذَا صُمْتَ مِنَ الشَّهْرِ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ وَخَمْسَ عَشْرَةَ

হে আবু যর! তুমি যখন প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখবে তখন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখো। [তিরমিযী, হা/৭৬১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২১২৮; বায়হাকী, হা/৮২২৮; জামেউস সগীর, হা/৬৭৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৩৮; মিশকাত, হা/২০৫৭।]

আবু যর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখল সে যেন সারা বছরই রোযা রাখল। এর সত্যতাস্বরূপ তিনি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের এ আয়াতটি পাঠ করেন,

﴿مَنْ جَآءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهٗ عَشْرُ أَمْثَالِهَا﴾

যে ব্যক্তি একটি নেক আমল করবে, এর বিনিময়ে সে দশটি নেকী পাবে। (সূরা আনআম- ১৬০)। [তিরমিযী, হা/৭৬২; ইবনে মাজাহ, হা/১৭০৮; নাসাঈ, হা/২৭১৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৫৯।]

একদিন দশদিনের সমান এবং তিনদিন এক মাসের সমান। এভাবে প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখলে পূর্ণ ১ বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব পাওয়া যায়।

২২
মুহাররম মাস আশুরায়ে মুহাররম
عَاشُوْرَاءُ (আশুরা) শব্দটি عَشْرٌ (আশরুন) শব্দ থেকে গঠিত, যার অর্থ হচ্ছে দশ। যেহেতু এ দিবসটি মুহাররম মাসের ১০ম তারিখে পালন করা হয়, তাই এটিকে عَاشُوْرَاءُ (আশুরা) বলা হয়।

২৩
এ দিনের গুরুত্ব
প্রাচীনকাল থেকেই এ দিনটি ছিল অত্যমত্ম গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত একটি দিন। জাহেলী যুগের লোকেরাও এ দিনটিকে গুরুত্ব দিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাসের রোযা ফরয হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ দিনে বাধ্যতামূলকভাবে রোযা রাখতেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখতে বলতেন। [সহীহ বুখারী, হা/২০০২; আবু দাউদ, হা/২৪৪৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৮১৯২; তিরমিযী, হা/৭৫৩; সুনানে দারেমী, হা/১৭৬৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬২১; মুস্তাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪২৩০।] আর ইয়াহুদিরা এ দিনকে প্রতি বছর ঈদ হিসেবে পালন করত এবং রোযা রাখত। [সহীহ মুসলিম, হা/১১৩১; বায়হাকী, হা/৮১৯৭।] অতঃপর যখন মুসলিমদের উপর রমাযান মাসের রোযা ফরয হয়ে যায়, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এ দিনের রোযা রাখতে কাউকে বাধ্য করতেন না। ফলে এরপর থেকে যারা নফল হিসেবে এ দিনের রোযা রাখতে চাইতেন, তারা রোযা রাখতেন; আর যারা চাইতেন না তারা ছেড়ে দিতেন।

২৪
আশুরার রোযার উদ্দেশ্য
আশুরা উপলক্ষে প্রধান করণীয় হচ্ছে, সঠিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আশুরার রোযা রাখা। আশুরার রোযার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। কেননা এদিন আললাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে ফিরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফিরাউনকে নীলনদে নিমজ্জিত করেছিলেন। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ - رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا - أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَدِمَ الْمَدِيْنَةَ فَوَجَدَ الْيَهُوْدَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ - مَا هٰذَا الْيَوْمُ الَّذِىْ تَصُوْمُوْنَه فَقَالُوْا هٰذَا يَوْمٌ عَظِيْمٌ أَنْجَى اللهُ فِيْهِ مُوْسٰى وَقَوْمَه وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَه فَصَامَه مُوْسٰى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُه . فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلٰى بِمُوْسٰى مِنْكُمْ فَصَامَه رَسُوْلُ اللهِ - - وَأَمَرَ بِصِيَامِه

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। (তিনি বলেন) যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ (হিজরত করে) মদিনায় আগমন করলেন, তখন তিনি ইয়াহুদিদেরকে আশুরার দিবসে রোযা রাখতে দেখলেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনে কী হয়েছে যে এতে তোমরা রোযা রাখছ? তখন তারা বলল, এটি মহান দিন। এদিন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায়কে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়কে নিমজ্জিত করেছিলেন। ফলে মূসা (আঃ) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এদিন রোযা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এদিনে রোযা রাখছি। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আমরা তো তোমাদের থেকে মূসা (আঃ) এর অধিক নিকটবর্তী এবং অধিক হকদার। অতঃপর (পরবর্তী বছর) রাসূলুল্লাহ ﷺ সেদিনে রোযা রাখলেন এবং রোযা রাখার জন্য সকলকে নির্দেশ দিলেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১১৩০; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৮৬৫৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৩৪; মিশকাত, হা/২০৬৭।]

২৫
আশুরার রোযার ফযীলত
রমাযানের রোযার পরেই আশুরার রোযার অবস্থান :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ -  - قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, রমাযানের পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে মুহাররম মাসের রোযা (আশুরার রোযা) এবং ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হচ্ছে রাতের (নফল) নামায। [সহীহ মুসলিম, হা/১১৬৩; নাসাঈ, হা/১৬১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৫৩৪; মিশকাত, হা/২০৩৯।]

আশুরার রোযা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারাস্বরূপ :

عَنْ أَبِىْ قَتَادَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَه

আবু কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আশুরার দিনের রোযা সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশা রাখি যে, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ (কাফফারাস্বরূপ) মিটিয়ে দেবেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১১৬২; মুস্তাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৪৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৩২।]

২৬
আশুরার রোযা রাখার নিয়ম
আশুরার রোযা তার পূর্বের অথবা পরের একদিনের সাথে মিলিয়ে রাখা উচিত :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : صُوْمُوْا يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَخَالِفُوْا فِيْهِ الْيَهُوْدَ صُوْمُوْا قَبْلَه يَوْمًا أَوْ بَعْدَه يَوْمًا

আবদুললাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা আশুরার দিন রোযা রাখো এবং এ ক্ষেত্রে ইয়াহুদিদের বিপরীত করো। তোমরা আশুরার সাথে তার পূর্বে একদিন অথবা পরে একদিন মিলিয়ে রোযা রাখো। [বায়হাকী, হা/৮১৮৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৫৪। অত্র বর্ণনাটি মারফূ হিসেবে সহীহ নয়, তবে মাওকূফ হিসেবে সহীহ।]

আশুরার রোযা তার পূর্বের দিনের সাথে মিলিয়ে রাখা উত্তম :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ - رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا - يَقُوْلُ حِيْنَ صَامَ رَسُوْلُ اللهِ - - يَوْمَ عَاشُوْرَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِه قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّه يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارٰى فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ - إِنْ شَاءَ اللهُ - صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتّٰى تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ -

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আশুরার দিন যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ রোযা রাখতেন এবং (লোকদেরকেও) রোযা রাখার ব্যাপারে আদেশ দিতেন তখন একদিন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ দিনটিকে তো ইয়াহুদি ও নাসারারা সম্মান করে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ইনশাআল্লাহ- আমরা আগামী বছর ৯ম তারিখেও রোযা রাখব। বর্ণনাকারী বলেন, কিন্তু আগামী বছর আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ ﷺ মৃত্যুবরণ করেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১১৩৪; আবু দাউদ, হা/২৪৪৭; বায়হাকী, হা/৮১৮৪।]

২৭
আশুরা উপলক্ষে অন্যান্য করণীয়
১. ফিরাউনের কবল থেকে মূসা (আঃ) এর মুক্তির ঘটনা স্মরণ করা :

আশুরার দিনে যেহেতু মূসা (আঃ) ও ঈমানদারদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, তাই সেই মুক্তির ঘটনাটি স্মরণ করা এবং আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

২. আশুরার শিক্ষাকে কার্যকর করা :

আশুরার প্রধান শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোন প্রকার তাগুতী শক্তির কাছে মাথানত না করা। কেননা মূসা (আঃ) ফিরাউনের কাছে মাথানত করেননি বিধায় আল্লাহ তা‘আলা তাকে এবং তার অনুসারীদেরকে নিজ অনুগ্রহে মুক্তি দিয়েছিলেন।

৩. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা :

আশুরার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে সর্বদা আল্লাহর অনুগ্রহের উপর শুকরিয়া আদায় করা, যেমনিভাবে মূসা (আঃ) ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তির পর করেছিলেন। সুতরাং এভাবে আল্লাহ তা‘আলা যখনই আমাদেরকে কোন বিপদাপদ থেকে মুক্তি দিবেন, তখনই আমাদেরকে যথাসাধ্য শুকরিয়া আদায় করা একান্ত কর্তব্য।

৪. আল্লাহর আযাবকে ভয় করা :

ফিরাউন ছিল খুবই অহংকারী, সে তার প্রজাদের উপর খুবই যুলুম-নির্যাতন চালাত। এমনকি সে নিজেকে রব বলে দাবি করেছিল। অপরদিকে মূসা (আঃ) ছিলেন আল্লাহর নবী ও রাসূল। তিনি সর্বদা আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতেন। এতে ফিরাউন মূসা (আঃ) এর উপর খুবই রাগান্বিত হয় এবং তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাস্তিস্বরূপ নীলনদে নিমজ্জিত করেন।

সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা আল্লাহর আযাবকে ভয় করা এবং তাঁর দ্বীন প্রচারে বাধা সৃষ্টি না করা।

৫. আল্লাহর দ্বীন প্রচারে সর্বাত্মক চেষ্টা করা :

পৃথিবীতে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনবিধান হচ্ছে ইসলাম। মূসা (আঃ) এ দ্বীন প্রচারের জন্যই ফিরাউনের আক্রোশে পতিত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি এ পথ থেকে কোনভাবেই পিছপা হননি। আর এ কারণেই ফিরাউন মূসা (আঃ) ও তাঁর সাথিদেরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। সুতরাং আমাদেরও উচিত আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করা।

৬. ইয়াহুদি ও নাসারাদের অনুসরণ না করা :

আশুরার অন্যতম একটি শিক্ষা হচ্ছে, কোন সময় ইয়াহুদি ও নাসারাদের অনুসরণ করা যাবে না এবং তাদের সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন কোন কাজও করা যাবে না। আশুরার রোযা একদিন রাখলে ইয়াহুদি ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, তোমরা ইয়াহুদি ও নাসারাদের বিপরীত করো অর্থাৎ আগে বা পরে ১ দিন মিলিয়ে রাখো।

৭. সাহাবীদের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা :

সাহাবীরা হলেন মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠ পূর্বপুরুষ। তাদের ব্যাপারে কোনরূপ মন্দ ধারণা রাখা খুবই নিন্দনীয় বিষয়। অথচ আশুরার বিকৃত ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকেই বিশিষ্ট কিছু সাহাবীর উপর দোষারূপ করে থাকে।

৮. হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানা :

হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বর্তমানে এ ঘটনাটি অনেক বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে এবং এটিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ অনেক বিভ্রান্তিতে রয়েছে। আর এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল আশুরার দিনেই। সুতরাং আশুরা উপলক্ষে হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানা খুবই জরুরি। এ সম্পর্কে সামনে আলোচনা করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

২৮
আশুরার নামে প্রচলিত শিরক ও বিদআতসমূহ
১. হুসাইন (রাঃ) এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রোযা রাখা :

বর্তমান বিশ্বের শিয়া সমাজসহ অনেকেই আশুরার দিনে হুসাইন (রাঃ) এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রোযা রেখে থাকে। এমনকি বিষয়টি বিভিন্ন মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারও করা হয়ে থাকে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে- অধিকাংশ মানুষের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, আশুরার রোযা হুসাইন (রাঃ) এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষেই রাখা হয়। কিন্তু যারা আশুরার দিন এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রোযা রাখবে, তারা পাপী হবে।

২. তাজিয়া বা শোক মিছিল করা :

প্রতি বছর মুহাররম মাস আসার সাথে সাথেই শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে তাজিয়া তথা শোক মিছিল বের করে। অতঃপর তারা ১০ই মুহাররম রাতে বিশেষ কিছু অনৈতিক ও বিবেকবর্জিত কার্যাবলি সম্পাদনের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘোষণা করে।

অথচ ইসলামে কোন দিবসকে কেন্দ্র করে শোক মিছিল বের করা তো দূরের কথা বরং নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ব্যতীত শোক পালন করারই কোন বিধান নেই। হাদীসে এসেছে,

عَنْ زَيْنَبَ بِنْتِ أَبِيْ سَلَمَةَ قَالَتْ لَمَّا جَآءَ نَعْيُ أَبِيْ سُفْيَانَ مِنَ الشَّامِ دَعَتْ أُمُّ حَبِيْبَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا بِصُفْرَةٍ فِي الْيَوْمِ الثَّالِثِ فَمَسَحَتْ عَارِضَيْهَا وَذِرَاعَيْهَا وَقَالَتْ إِنِّيْ كُنْتُ عَنْ هٰذَا لَغَنِيَّةً لَوْلَاۤ أَنِّيْ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُوْلُ لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلٰى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلَاثٍ إِلَّا عَلٰى زَوْجٍ فَإِنَّهَا تُحِدُّ عَلَيْهِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَّعَشْرًا

যায়নাব বিনতে আবু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, শাম (সিরিয়া) হতে আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর খবর পৌঁছলে [আবু সুফিয়ানের কন্যা তথা নবী ﷺ-এর স্ত্রী] উম্মে হাবীবা (রাঃ) তৃতীয় দিনে কিছু সুগন্ধি চেয়ে নিলেন। অতঃপর তা নিজের দুই পাঁজর ও দুই বাহুতে মেখে বললেন, আমার এতটুকুও করার প্রয়োজন ছিল না, যদি না আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনতাম, যে মহিলা আল্লাহ তা‘আলা ও কিয়ামতের ওপর বিশ্বাস রাখে তার উপর স্বামী ব্যতীত অন্য কোন মৃতের জন্য তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ করা বৈধ নয়। তবে সে স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। [সহীহ বুখারী, হা/১২৮০; সহীহ মুসলিম, হা/৩৭৯৮; আবু দাউদ, হা/২৩০১; তিরমিযী, হা/১১৯৫।]

সুতরাং যারা এ ধরনের শোক মিছিল করে থাকে এবং এটাকে তাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে মনে করে, নিঃসন্দেহে তারা বিদআতের গুনাহে পতিত হবে।

৩. মাতম করা, নিজেদের শরীরে আঘাত করা এবং চিৎকার করা :

শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা মুহাররম মাস আসলেই হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতবরণ উপলক্ষে শোক পালন করার পাশাপাশি মাতমও করে থাকে। এ সময় তারা বুক চাপড়ায়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে, নিজেদের শরীরে ছুরি দ্বারা আঘাত করে, পিঠে চাবুক মারে, হায় হোসেন! হায় হোসেন!! বলে চিৎকার করে থাকে, রক্তের নামে লাল রং ছিটানোসহ আরো অনেক ধরনের কর্মকান্ড করে থাকে। অথচ ইসলামে এসব কার্যক্রম বৈধ হওয়া তো দূরের কথা কোন ধরনের মাতম করারই অনুমোদন নেই। বরং এ ধরনের কর্মকে ইসলামে কুফরী কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - اِثْنَتَانِ فِى النَّاسِ هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ اَلطَّعْنُ فِى النَّسَبِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মানুষের মধ্যে দুটি কাজ এমন রয়েছে, যা কুফরী। (১) বংশের খোঁটা দেয়া এবং (২) মৃতের জন্য বিলাপ করা। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৭; মুস্তাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৪৩৪।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ مَالِكِ الْأَشْعَرِىِّ حَدَّثَه أَنَّ النَّبِىَّ - - قَالَ أَرْبَعٌ فِىْ أُمَّتِىْ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لَا يَتْرُكُوْنَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الْأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الْأَنْسَابِ وَالْاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُوْمِ وَالنِّيَاحَةُ وَقَالَ النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ

আবু মালেক আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, আমার উম্মতের মাঝে চারটি কাজ হলো জাহেলিয়াতের প্রথা, যা তারা ত্যাগ করবে না। সেগুলো হলো- (১) বংশ নিয়ে গর্ব করা, (২) বংশের খোঁটা দেয়া, (৩) নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির আশা করা এবং (৪) (মৃতের জন্য) বিলাপ করা। তিনি আরো বলেন, আর বিলাপকারী মহিলা যদি মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে গলিত (উত্তপ্ত) তামার পায়জামা (সেলোয়ার) ও চুলকানিদার (অথবা দোযখের আগুনের তৈরি) কামীস পরা অবস্থায় পুনরুত্থিত করা হবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৯৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৯০৩; বায়হাকী, হা/৬৯০২; মিশকাত, হা/১৭২৭।]

৪. যারা গাল ও বুক চাপড়ায় তারা নবী ﷺ এর উম্মত নয় :

জাহেলী যুগের নারীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা শোক প্রকাশকরণার্থে নিজেদের গাল আঁচড়াত, বুক চাপড়াত, চুল ছিঁড়ত এবং এ ধরনের আরো অনেক অদ্ভুত ধরনের আচরণ করত। যার কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ উম্মতকে এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ করে গেছেন এবং যারা এতে লিপ্ত হবে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করেছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُوْدَ وَشَقَّ الْجُيُوْبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করে বলেন, ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি গাল চাপড়ায়, বুকের কাপড় ফেড়ে ফেলে এবং জাহেলী যুগের মতো ডাক ছেড়ে বিলাপ করে। [সহীহ বুখারী, হা/১২৯৭-৯৮, ৩৫১৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬৫৮; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫২৫২; নাসাঈ, হা/১৮৫৯; বায়হাকী, হা/৭৩৬৬; মিশকাত, হা/১৭২৫।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ بُرْدَةَ بْنِ أَبِيْ مُوْسٰى قَالَ وَجِعَ أَبُوْ مُوْسٰى وَجَعًا فَغُشِيَ عَلَيْهِ وَرَأْسُه فِيْ حِجْرِ امْرَأَةٍ مِّنْ أَهْلِه فَصَاحَتِ امْرَأَة ٌ مِّنْ أَهْلِه فَلَمْ يَسْتَطِعْ أَنْ يَرُدَّ عَلَيْهَا شَيْأً فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ أَنَا بَرِيْءٌ مِمَّنْ بَرِئَ مِنْهُ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ بَرِئَ مِنْ الصَّالِقَةِ وَالْحَالِقَةِ وَالشَّاقَّةِ

আবু বুরদা ইবনে আবু মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আবু মূসা (রাঃ) অসুখের যন্ত্রণায় দুর্বল হয়ে গেলেন। সে সময় তার কোন এক স্ত্রীর কোলে তার মাথা রাখা ছিল। সে তখন সুর ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। সে অবস্থায় আবু মূসা (রাঃ) তাকে বাধা দিতে সক্ষম ছিলেন না। কিন্তু যখন তিনি পূর্ণ জ্ঞান ফিরে পেলেন তখন তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, যার হতে রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঐ মহিলা হতে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন, যে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করে, মাথার কেশ মুন্ডন করে এবং নিজের পরিহিত কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। [সহীহ বুখারী, হা/১২৯৬; সহীহ মুসলিম, হা/১০৪; বায়হাকী, হা/৭৩৭০।]

অতএব হুসাইন (রাঃ) হোক অথবা অন্য যেকোন বড় মর্যাদাবান ব্যক্তিই হোক, কারো মৃত্যুকে উপলক্ষ করে বিলাপ করা বৈধ নয়। যারা এসব কাজ করবে তারা কবীরা গুনাহকারী হিসেবে বিবেচিত হবে।

৫. হুসাইন (রাঃ) এর রূপক কবর তৈরি করা :

আশুরার দিবসকে কেন্দ্র করে শিয়ারা হুসাইন (রাঃ) এর রূপক কবর তৈরি করে থাকে। তারপর তারা এ কবরকে উপলক্ষ করে নানা ধরনের শিরকী ও বিদআতী কর্মকান্ড সম্পাদন করে থাকে।

অথচ ইসলামে এ ধরনের রূপক কবর তৈরি করা তো দূরের কথা কোন বাসত্মব কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করাও নিষেধ। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهٰى رَسُوْلُ اللهِ - - أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنٰى عَلَيْهِ

জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে কবর পাকা করতে, এর উপর বসতে এবং এর উপর সৌধ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৯৭০; মিশকাত, হা/১৬৭০।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِى الْهَيَّاجِ الْأَسَدِىِّ قَالَ قَالَ لِىْ عَلِىُّ بْنُ أَبِىْ طَالِبٍ أَلَّا أَبْعَثُكَ عَلٰى مَا بَعَثَنِىْ عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ - - أَنْ لَّا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَه وَلَا قَبْرًا مُّشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَه

আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, আমি কি তোমাকে ঐ কাজের জন্য প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? আর তা ছিল ছবি ও মূর্তিকে ধ্বংস করে দেয়া এবং এ সবের কোন কিছু অবশিষ্ট না রাখা; আর সমস্ত উঁচু কবরকে মাটির সাথে সমান করে দেয়া। [সহীহ মুসলিম, হা/৯৬৯; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/১৩৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪১; মিশকাত, হা/১৬৯৬।]

এমনকি কোন কবরের মধ্যে শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তণ ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করাও নিষেধ। কেননা এ ধরনের কর্মকান্ড ইয়াহুদি-খ্রিস্টানদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। আর হাদীসে তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا لَا تَشَبَّهُوْا بِالْيَهُوْدِ وَلَا بِالنَّصَارٰي

আমর ইবনে শু‘আইব (রহ.) তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া অন্য কারো সাদৃশ্যতা গ্রহণ করল সে আমাদের দলভুক্ত নয়। আর তোমরা ইয়াহুদি ও নাসারাদের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করো না। [তিরমিযী, হা/২৬৯৫; আল-জামে, হা/৫৪৩৪; মিশকাত, হা/৪৬৭৯; ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন, তবে শাইখ আলবানী হাদীসটিকে হাসান মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।]

তাছাড়া এ ধরনের রূপক কবর তৈরি করা এবং তা যিয়ারত করাটা মূর্তি পূজার সাথে অধিক সাদৃশ্য রাখে।

৬. রূপক কবরে হুসাইন (রাঃ) এর রূহ হাযীর হয় বলে ধারণা করা :

শিয়াদের মধ্যে একটি দল ধারণা করে থাকে যে, হুসাইন (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে এ ধরনের মাতম করতে করতে এক সময় হুসাইন (রাঃ) এর রূহ হাযীর হয়। তখন তারা এসব শিরকী কর্মকান্ড আরো বৃদ্ধি করে দেয়।

অথচ হুসাইন (রাঃ) তো দূরের কথা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ক্ষেত্রেও এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করাটা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন আমাদের বই ‘‘মুহাম্মাদ ﷺ সম্পর্কে ভুল ধারণা’’।

৭. হুসাইন (রাঃ) এর রূপক কবরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা :

আশুরাকে কেন্দ্র করে শিয়াদের আরো একটি মারাত্মক শিরক হচ্ছে উক্ত কবরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা। অথচ একমাত্র কাবাঘর ছাড়া বিশ্বের অন্য কিছুকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلْيَطَّوَّفُوْا بِالْبَيْتِ الْعَتِيْقِ﴾

আর তারা যেন সংরক্ষিত গৃহে তাওয়াফ করে। (সূরা হজ্জ- ২৯)

৮. হুসাইন (রাঃ) এর রূপক কবরকে সিজদা করা :

আশুরাকে কেন্দ্র করে শিয়া সম্প্রদায়ের বড় একটি শিরক হচ্ছে উক্ত রূপক কবরকে সিজদা করা। তারা এসব কবরের কাছে গিয়ে সিজদা করে এবং হুসাইন (রাঃ) এর অসিলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে থাকে। আবার অনেকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে কেবল হুসাইন (রাঃ) এর কাছে প্রার্থনা করে থাকে।

অথচ এসব কর্মকান্ড হচ্ছে শিরক। সমস্ত নবী-রাসূল সারা জীবন এ ধরনের শিরকের বিরুদ্ধেই লড়াই করে গেছেন। যারা এসব করবে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। তাদের সকল ভালো আমল বাতিল হয়ে যাবে এবং পরকালে তাদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّهٗ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَاْوَاهُ النَّارُؕ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ﴾

যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (ফলে) তার আবাস হবে জাহান্নাম। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা– ৭২)

৯. বিশেষ কেক ও পাউরুটি তৈরি করা :

আশুরাকে কেন্দ্র করে শিয়ারা বিশেষ ধরনের কেক, পাউরুটিসহ নানা ধরনের খাবার তৈরি করে থাকে এবং এসব খাবার তৈরি করাকে তারা খুবই বরকতময় মনে করে থাকে। অথচ কুরআন ও হাদীসে এ ধরনের কোন ইঙ্গিতও নেই। সুতরাং এসব কাজকে বরকতময় মনে করে পালন করাটা স্পষ্ট বিদআত।

১০. হুসাইন (রাঃ) এর নামে পুকুরে মোরগ ছেড়ে দেয়া :

আশুরাকে কেন্দ্র করে শিয়ারা হুসাইন (রাঃ) এর নামে পুকুরে মোরগ ছেড়ে দেয়। তারপর যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ মোরগ ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করে। আর তারা এ মোরগকে বরকতময় মোরগ মনে করে। অথচ এ ধরনের কোন কর্মকান্ড ইসলামে বৈধ নয়।

১১. বিশিষ্ট সাহাবীদেরকে গালি দেয়া :

শিয়ারা মূলত নিজেদেরকে আলী (রাঃ) এর অনুসারী হিসেবে দাবি করে থাকে। আর তাকে কেন্দ্র করে তারা অনেক বড় বড় সাহাবীকেও গালি দিয়ে থাকে। যেমন- আবু বকর, উমর, উসমান, মু‘আবিয়া, মুগীরা ইবনে শু‘বা (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীবৃন্দ।

অথচ সাহাবীগণ হলেন উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-ও তাদেরকে ভালোবাসতেন। তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। অথচ সাহাবীদেরকে গালি দেয়া নিষেধ। এ মর্মে হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَه

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিয়ো না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ পরিমাণ ব্যয়ের সমান সওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৩; সহীহ মুসলিম, হা/৬৬৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৫১৬; আবু দাউদ, হা/৪৬৬০; তিরমিযী, হা/৩৮৬১; মিশকাত, হা/৫৯৯৮।]

১২. আয়েশা (রাঃ) এর নামে বকরীকে আঘাত করা :

শিয়ারা মনে করে যে, আয়েশা (রাঃ) এর পরামর্শক্রমেই আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অসুস্থতার সময় জামা‘আতে ইমামতি করেছিলেন এবং পরে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে আলী (রাঃ) খলীফা হতে পারেননি (নাউযুবিল্লাহ)। আর এ কারণেই শিয়ারা আয়েশা (রাঃ) এর প্রতি বিরাট আক্রোশ পোষণ করে থাকে। ফলে আশুরার দিন তারা আয়েশা (রাঃ) এর নামে একটি বকরী নির্বাচন করে। তারপর তারা সেটিকে বেত্রাঘাত করে এবং অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে।

অথচ আয়েশা (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সবচেয়ে প্রিয়তম স্ত্রী এবং স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক পবিত্র ঘোষিত একমাত্র নারী। আর সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। এ ধরনের উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ নারীর বিরুদ্ধে আক্রোশ পোষণ করা এবং তাকে গালিগালাজ করাটা স্পষ্ট ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

২৯
আশুরা উপলক্ষে বর্জনীয় বিষয়সমূহ
১. আশুরা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে না যাওয়া :

বর্তমান সমাজে আশুরাকে কেন্দ্র করে যেসব আচার-অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে, সেগুলোতে কোনভাবেই অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। এমনকি দর্শক হিসেবেও নয়। কেননা ইসলামে এ দিনে কেবল রোযা রাখার বিধানই সাব্যস্ত রয়েছে। এছাড়া অন্য কোন আমল বা কোন অনুষ্ঠানের কথা কুরআন ও হাদীসের কোথাও উল্লেখ নেই।

২. আশুরার অনুষ্ঠান আয়োজনে কোনরূপ সহযোগিতা না করা :

যেহেতু আশুরা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো পাপকর্মের অমত্মর্ভুক্ত। সুতরাং এ ব্যাপারে কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা করাও উচিত নয়। যেমন- আশুরার অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করা, আশুরার অনুষ্ঠান সাজিয়ে দেয়া, রান্না-বান্না করে দেয়া ইত্যাদি।

৩০
আশুরা উপলক্ষে বিদআতের সূচনা ও তার ক্রমবিকাশ
আশুরা উপলক্ষে বিদআতের সূচনা হয় ৩৫১ হিজরীতে বাগদাদে আববাসীয় খলীফা মুতী বিন মুকতাদিরের শাসনামলে। সে সময় শিয়ারা অনেক ক্ষমতার অধিকারী ছিল। তাদের নেতা ছিল আহমাদ ওরফে মুইযযুদ্দৌলা। সে-ই সর্বপ্রথম উসমান (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের দিনকে ঈদের দিন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে এটি পরবর্তীতে শিয়াদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করে এবং তাদের কাছে এ দিনটি ঈদুল আযহার দিন থেকেও বেশি গুরুত্ব পায়।

অতঃপর সে খলীফার সমর্থন নিয়ে পরের বছর তথা ৩৫২ হিজরীর শুরুতে হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের দিন তথা ১০ই মুহাররমকে শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেয়; এমনকি মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করে। শহর ও গ্রামের সর্বত্রই সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেয়। এতে শিয়ারা খুশি মনে এই নির্দেশ পালন করতে থাকে। কিন্তু সুন্নীরা এ সময় নীরবতা অবলম্বন করেন। পরে সুন্নীদের উপর এই ফরমান জারি করা হলে তারা এর বিরোধিতা করে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়।

তারপর ধীরে ধীরে সেটি ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ তৈমুর লং এর শাসনামলে উপমহাদেশে প্রবেশ করে। সেই সাথে বিকৃতি ঘটে এর প্রকৃত ইতিহাসের। আর এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অনেক জাল ও বানোয়াটি হাদীসও প্রণয়ন করা হয়। এমনকি বর্তমানে বিষয়টি সারা বিশ্বের শিয়া গোষ্ঠীসহ উপমহাদেশেও সেভাবেই চালু আছে।

৩১
হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের ঘটনা
নিঃসন্দেহে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের বিষয়টি ছিল খুবই মর্মান্তিক। হুসাইন (রাঃ) ছিলেন ফাতেমা (রাঃ) এর গর্ভজাত সন্তান এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর খুবই আদরের নাতী। যার কারণে সাহাবীগণও তাকে খুবই ভালোবাসতেন এবং তাকে মান্য করতেন। সুতরাং মুয়াবিয়া (রাঃ) এর পর তিনিই ছিলেন খিলাফাতের প্রধান হকদার।

কিন্তু যখন মুয়াবিয়া (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার পুত্র ইয়াযীদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন এবং লোকদের কাছ থেকে বাই‘আত গ্রহণ করতে থাকেন। এদিকে লোকেরা দলে দলে তার হাতে বাই‘আত প্রদান করতে থাকে, এমনকি ইসলামী বিশ্বের সকল কেন্দ্রীয় নেতাসহ সে সময়ে জীবিত প্রায় সাহাবীই তার হাতে বাইআত প্রদান করেন। বাকি রইলেন কেবল ৪ জন বিশিষ্ট সাহাবী। তারা হলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ও হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ)। কিন্তু মুসলিমদের বৃহত্তম স্বার্থের কথা চিমত্মা করে কিছু দিন পর আবদুল্লাহ ইবনে উমর এবং আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-ও ইয়াযীদের হাতে বাইআত প্রদান করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বাইআত প্রদান থেকে বিরত থাকা অবশিষ্ট দু’জন সাহাবীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘‘আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন! মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না’’। কিন্তু এরপরও তারা নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর অটল রইলেন এবং উভয়ে মদিনা থেকে মক্কায় চলে গেলেন।

এদিকে কূফাবাসীরাও ইয়াযীদকে খলীফা হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না। কেননা তারা ইতিপূর্বে ইয়াযীদের পিতা মুয়াবিয়া (রাঃ) এর প্রতি সমত্মুষ্ট ছিল না। ফলে তারাও বাইআত প্রদান করা থেকে বিরত ছিল। অতঃপর কূফাবাসীরা যখন জানতে পারল যে, হুসাইন (রাঃ) এখনও বাইআত প্রদান করা হতে বিরত আছেন, তখন তারা তাঁর হাতে বাইআত প্রদান করতে আগ্রহী হয়ে উঠল। ফলে তারা হুসাইন (রাঃ)-কে ইরাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার বার চিঠি প্রেরণ করতে থাকল। অবশেষে দেখা গেল যে, তাদের প্রেরিত চিঠির সংখ্যা হয়েছিল ৫০০ এরও অধিক।

কূফাবাসীর পক্ষ থেকে বারবার চিঠি পাওয়া সত্ত্বেও হুসাইন (রাঃ) কিছুতেই সেখানে গমন করতে রাজি হচ্ছিলেন না। কেননা ইতিপূর্বে তার পিতা আলী (রাঃ) এর সাথে তারা যেসব আচরণ করেছিল সেগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি তাদের উপর আশ্বসত্ম হতে পারছিলেন না। তাছাড়া তাঁর সকল হিতাকাঙ্ক্ষীও তাকে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি কূফাবাসীর প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ)-কে কূফায় প্রেরণ করেন।

অতঃপর মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ) যখন কূফায় গমন করেন, তখন কূফাবাসীরা হুসাইন (রাঃ) এর হাতে বাইআত প্রদান করতে খুবই আগ্রহ প্রকাশ করে। এমনকি তারা গোপনে হুসাইন (রাঃ) এর পক্ষ থেকে মুসলিম (রাঃ) এর হাতেই বাইআত প্রদান করে ফেলে। আর তাদের সংখ্যা হয়েছিল ১২ থেকে ১৮ হাজার।

কূফাবাসীদের থেকে এত বেশি ইতিবাচক সাড়া পেয়ে মুসলিম (রাঃ) হুসাইন (রাঃ)-কে কূফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। সে সময় কূফার গভর্নর ছিলেন নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ)। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জনগণকে ডেকে বিশৃঙ্খলা না করার জন্য নির্দেশ দেন। এদিকে কেন্দ্রীয় শাসক ইয়াযীদ যখন বিষয়গুলো জানতে পারলেন, তখন তিনি সুষ্ঠভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার লক্ষে নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ)-কে পদচ্যুত করে বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। আর তাকে শুধুমাত্র এ নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন কূফাবাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইন (রাঃ) এর সাথে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন।

অতঃপর উবাইদুল্লাহ দ্রুত কূফায় পৌঁছে বিষয়টি ভালোভাবে তদমত্ম করেন। এমনকি তিনি নিশ্চিত হলেন যে, হানী বিন উরওয়ার ঘরে হুসাইন (রাঃ) এর পক্ষে মুসলিম বিন আকীল (রাঃ) এর হাতে বাইয়াত প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে মুসলিম (রাঃ) পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে চার হাজার সমর্থক নিয়ে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করেন। ফলে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এসে একটি ভাষণ প্রদান করলেন। এতে তিনি কূফাবাসীদেরকে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে অনেক ভীতি প্রদর্শন করলেন। ফলে লোকেরা খুবই প্রভাবান্বিত হলো এবং ধীরে ধীরে সবাই পলায়ন করতে লাগল। এমনকি দিন শেষে মুসলিম (রাঃ) এর সাথে কেবল তিন জন লোক অবশিষ্ট রইল।

এ সুযোগে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ মুসলিম বিন আকীল (রাঃ)-কে বন্দী করে ফেলেন এবং তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। মুসলিম (রাঃ) যখন কূফাবাসীদের এহেন নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করলেন এবং নিজের মৃত্যুদন্ডের বিষয়টি নিশ্চিত হলেন, তখন তিনি উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে আবেদন করলেন যে, তাকে যেন হুসাইন (রাঃ) এর নিকট একটি চিঠি পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। ফলে উবাইদুল্লাহ তাকে অনুমতি প্রদান করলেন। হুসাইন (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে মুসলিম (রাঃ) কর্তৃক প্রেরিত চিঠির বক্তব্য ছিল এরূপ যে, ‘‘হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কূফাবাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।’’ অতঃপর জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে আরাফা দিবসে মুসলিম বিন আকীল (রাঃ) এর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

এদিকে হুসাইন (রাঃ) জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে কূফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। এ সময় অনেক সাহাবীই তাকে বাধা প্রদান করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। এসব সাহাবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আববাস, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর এবং মুহাম্মাদ ইবনে হানাফীয়্যাহ (রাঃ) প্রমুখ।

যাত্রাকালে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হুসাইন (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীস শোনাব। একদা জিবরাঈল (আঃ) আগমন করে নবী ﷺ-কে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যেকোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ফলে তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছিলেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবে না। তোমাদের ভালোর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। কিন্তু হুসাইন (রাঃ) তাঁর প্রসত্মাব প্রত্যাখ্যান পূর্বক যাত্রা বিরতি করতে অস্বীকার করেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হুসাইন (রাঃ) এর সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং তিনি বিচ্ছেদ বেদনায় কেঁদে দিলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হুসাইন (রাঃ)-কে বলেছিলেন, মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড় ধরে যাত্রা করা থেকে বিরত রাখতাম।

কিন্তু হুসাইন (রাঃ) সকলের বাধা উপেক্ষা করে নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে কূফার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) হুসাইন (রাঃ)-কে বলেছিলেন, হুসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?

তারপর হুসাইন (রাঃ) যখন কূফার একেবারেই কাছাকাছি চলে আসেন, তখন মুসলিম (রাঃ) এর উক্ত চিঠিটি তাঁর হাতে পৌঁছে। তখন তিনি সাথে সাথেই কূফার পথ ত্যাগ করে ইয়াযীদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হন।

এদিকে খবর পেয়ে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের সেনারা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রামত্মরে হুসাইন (রাঃ) এর গতিরোধ করে। অতঃপর হুসাইন (রাঃ) তাদেরকে আল্লাহর শপথ করে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রসত্মাব পেশ করেন। সেগুলো হলো-

১। আমাকে ইয়াযীদের হাতে হাত রেখে বাই‘আত প্রদানের সুযোগ দেয়া হোক।

২। মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক।

৩। আমাকে সীমান্তের কোন এক স্থানে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক।

কিন্তু উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ তাঁর সকল প্রসত্মাবই প্রত্যাখ্যান করেন এবং হুসাইন (রাঃ)-কে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করেন। সে সময় হুসাইন (রাঃ) এর সৈন্যসংখ্যা ছিল উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের বাহিনী থেকে খুবই কম। সুতরাং যুদ্ধটি ছিল একেবারেই অসম।

হুসাইন (রাঃ) যখন শত্রুপক্ষের মনোভাব বুঝতে পারলেন, তখন তিনি যুদ্ধ করার সিদ্ধামত্ম গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হুসাইন (রাঃ) এর সাথিগণ বেশ বীরত্বের সাথেই যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সৈন্য সংখ্যার বিশাল ব্যবধানে তাদের আর টিকে থাকা সম্ভব হলো না। ফলে হুসাইন (রাঃ) এর সাথিদের মধ্যে একে একে সকলেই শাহাদাত বরণ করতে থাকল। অবশেষে কেবলমাত্র তিনিই অবশিষ্ট রইলেন। শত্রুপক্ষের প্রতিটি সৈন্যই কামনা করছিল যে, সে ছাড়া অন্য কেউ হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করুক, যাতে তার হাত রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দৌহিত্রের রক্তে রঙ্গীন না হয়। অবশেষে সীমার বিন যুল জাওশান নামক এক নিকৃষ্ট ব্যক্তি হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করতে উদ্যত হয় এবং বর্শা দিয়ে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলে। বলা হয়ে থাকে যে, এই সীমারই হুসাইন (রাঃ) এর মাথা দেহ থেকে আলাদা করেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, সিনান বিন আনাস আন-নাখঈ নামক এক ব্যক্তি তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করেছে।

মৃত্যুকালে হুসাইন (রাঃ) এর বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। আর সেটি ছিল ৬১ হিজরীর মুহাররম মাসের ১০ তারিখ।

পর্যালোচনা :

হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতবরণের ঘটনাটি ছিল নিতান্তই রাজনৈতিক মতবিরোধের একটি দুঃখজনক পরিণতি। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য মূলত দায়ী ছিল বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসীরা ও নিষ্ঠুর গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ। কেননা ইয়াযীদ কেবলমাত্র হুসাইন (রাঃ) এর আনুগত্য চেয়েছিলেন, তার খুন চাননি। হুসাইন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রসত্মুত ছিলেন। ইয়াযীদ স্বীয় পিতার অসিয়ত অনুযায়ী হুসাইন (রাঃ)-কে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন। ইতিপূর্বে হুসাইন (রাঃ) ও আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) অন্যান্য সাহাবীগণের সাথে ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে ৪৯ মতান্তরে ৫১ হিজরীতে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছেন, যা ছিল মুসলিমদের প্রথম সমুদ্র অভিযান। যে যুদ্ধের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আমার উম্মতের নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রথম সেনাদলের জন্য বেহেশত ওয়াজিব হয়ে গেছে। [সহীহ বুখারী, হা/১৯২৪; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৮৬৬৮।]

যখন হুসাইন (রাঃ) এর ছিন্নমস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হয়, তখন তিনি কেঁদে উঠে বলেছিলেন, উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের উপর আল্লাহ তা‘আলা লানত বর্ষণ করুন। আল্লাহর কসম! যদি হুসাইনের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহলে সে কিছুতেই তাকে হত্যা করত না। তিনি আরো বলেন যে, হুসাইনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাজি করাতে পারতাম। [ইবনু তাইমিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ (রিয়াদঃ মাকতাবতুল কাওছার ১ম সংস্করণ ১৪১১/১৯৯১) ১ম খন্ড পৃঃ ৩৫০; একই মর্মে বর্ণনা এসেছে, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮ম খন্ড ১৭৩ পৃঃ।]

অতঃপর হুসাইন (রাঃ) এর পরিবারের স্ত্রী-কন্যা ও শিশুগণ ইয়াযীদের প্রাসাদে প্রবেশ করলে প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইয়াযীদ তাদেরকে প্রচুর সম্মান করেন ও মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সসম্মানে মদিনায় প্রেরণ করেন। [মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ১ম খন্ড পৃঃ ৩৫০।]

উল্লেখ্য যে, হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতবরণকে কেন্দ্র করে বর্তমান সমাজে অনেক বানোয়াট ও উদ্ভট কথার প্রচলন রয়েছে। আমাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

৩২
সফর মাস আখেরী চাহার শোম্বা
‘আখেরী চাহার শোম্বা’ শব্দটি ফারসী ভাষার শব্দ। বাংলা ভাষায় এর অর্থ হয় শেষ বুধবার। প্রচলিত অর্থে সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরী চাহার শোম্বা নামে অভিহিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে নাকি রাসূলুল্লাহ ﷺ রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।

এ আকীদা পোষণ করে মুসলিম সমাজের অনেক লোক এ দিনটিকে একটি পালনীয় দিন হিসেবে নির্ধারণ করে অনেক কিছুই করে থাকে। যেমন- আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা, জাঁকজমকের সাথে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করা, শিরনী বিতরণ করা, গরীব-মিসকীনকে খাওয়ানো, দু‘আ ও দরূদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইত্যাদি।

অতএব আখেরী চাহার শোম্বা পালনের সঠিক ইতিহাস ও কোন দলীল নেই। নবী ﷺ এর সবচেয়ে কাছের মানুষ যারা ছিলেন অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম, তাঁরাও এই দিনকে কোন সময় পালন করেছেন মর্মে কোন দলীল পাওয়া যায় না। সুতরাং এ দিনকে কেন্দ্র করে ইবাদাত হিসেবে যা কিছু করা হবে, তা বিদআতে পরিণত হবে।

৩৩
রবিউল আওয়াল মাস ১২ই রবিউল আওয়াল/ঈদে মিলাদুন নবী
ঈদ শব্দের অর্থ হচ্ছে খুশি। আর মিলাদ শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্মবৃত্তান্ত। সুতরাং ঈদে মিলাদুন নবীর অর্থ হচ্ছে জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আনন্দ অনুষ্ঠান পালন করা। প্রচলিত অর্থে প্রতি বৎসর ১২ই রবিউল আওয়াল নবী ﷺ এর জন্মদিনকে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে পালন করাকে ঈদে মিলাদুন নবী বলা হয়। অনেকে এ দিবসকে ‘নবী দিবস’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে।

ঈদে মিলাদুন নবী মুসলিম সমাজের কিছু কিছু জায়গায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিদআতীরা এ দিনকে কেন্দ্র করে মারাত্মক ধরনের বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনকি তারা এমন অনেক কাজ করে, যেগুলো স্পষ্ট শিরকের মধ্যে পড়ে যায়।

মিলাদ অনুষ্ঠানে নবী ﷺ এর জন্মবৃত্তামত্ম আলোচনা করতে গিয়ে অনেক বাড়াবাড়ির আশ্রয় নেয়া হয়। সেখানে অনেক বিদআতী দরূদ পাঠ করা হয় এবং নবী ﷺ এর শানে এমন অনেক গজলও গাওয়া হয়, যার মধ্যে অনেক শিরকী কথা রয়েছে।

আবার এই মিলাদের মধ্যে কিয়াম করা হয়। অর্থাৎ দরূদ পাঠ করতে করতে নবী ﷺ এর সম্মানার্থে হঠাৎ সকলেই দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় তারা ধারণা করে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ উক্ত অনুষ্ঠানে হাযির হয়েছেন।

কিছু পেটপূজারী আলেম পয়সা কামানোর জন্য এসব অনুষ্ঠানের অনেক গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। অতএব মুসলিম সমাজকে এসব অনুষ্ঠান থেকে সাবধান থাকতে হবে।

তাছাড়া ইসলামে ঈদ হচ্ছে দুটি। একটি হলো, ঈদুল আযহা এবং অপরটি হলো, ঈদুল ফিতর। তৃতীয় কোন ঈদের অবস্থান কুরআন ও হাদীসে নেই; এমনকি সাহাবীদের আমল থেকেও এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

নবী ﷺ এর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে যদি কোন বাৎসরিক অনুষ্ঠান ইসলামে থাকত, তাহলে এর সবচেয়ে বেশি হকদার ছিলেন সাহাবীরা। কারণ তারা নবী ﷺ-কে সরাসরি দেখেছেন, নবী ﷺ এর সাথে চলাফেরা করেছেন এবং তাঁর কথা শুনেছেন। তারা তাঁকে নিজেদের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তারপরও তারা কোন দিন নবী ﷺ এর জন্মদিন পালন করেননি। সাহাবায়ে কেরামের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ হচ্ছেন, তাবেঈগণ। তাদের যুগেও এসব অনুষ্ঠানের কোন অসিত্মত্ব পাওয়া যায় না।

খ্রিস্টানরা যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালন করে থাকে। মুসলিমরা তাদের থেকেই এই কালচার আমদানী করেছে। সুতরাং এসব অনুষ্ঠান হচ্ছে বিজাতীদের অনুসরণ। আর যে ব্যক্তি বিজাতীর রীতিনীতির অনুসরণ করবে, সে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উম্মত হিসেবে গণ্য হবে না।

৩৪
সর্বক্ষেত্রে সুন্নাতের অনুসরণই নবী ﷺ এর ভালোবাসার নিদর্শন
রবিউল আওয়াল মাস নবী ﷺ এর জন্মের মাস। এ মাসে মুসলিমদের যদি কিছু করারই থাকে, তাহলে এমন কিছু করতে হবে, যাতে শিরক ও বিদআত নেই। এ মাসে নবী ﷺ এর জীবন চরিত নিয়ে আলোচনা করা যায়, তবে এতে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। সঠিকভাবে যা প্রমাণিত আছে, তাই আলোচনা করতে হবে এবং এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নবী ﷺ এর আদর্শকে বাসত্মবায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ‘‘ইয়া নাবী সালামু আলাইকা’’ এ ধরনের বাক্য বলে নবী ﷺ এর প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি দেখিয়ে অনুষ্ঠান শেষে মিষ্টি খেয়ে আনন্দ-ফূর্তি করলে নবী ﷺ-কে সত্যিকারের ভালোবাসা হয় না। বরং নবী ﷺ-কে সত্যিকারার্থে ভালোবাসতে হলে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যমত্ম সর্বক্ষেত্রেই নবী ﷺ এর আদর্শ বাসত্মবায়ন করতে হবে। চলা-ফেরা, উঠা-বসা, ঘুম-নিদ্রা, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন ইত্যাদি সবকিছুতেই নবী ﷺ এর সুন্নাতের পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। এটাই হচ্ছে নবী ﷺ এর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ ؕ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾

বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান- ৩১)

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْاٰخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا﴾

তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের দিনকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব- ২১)

৩৫
রজব মাস শবে মিরাজ
মিরাজের পরিচয় :

শব ( شَبْ ) শব্দটি ফারসী, যার অর্থ হচ্ছে রাত। আর মিরাজ ( مِعْرَاجٌ ) শব্দটি আরবি, যার অর্থ হচ্ছে সিঁড়ি, এখানে ঊর্ধ্বাকাশে পরিভ্রমণ করাকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং ‘শবে মিরাজ’ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ঊর্ধ্বাকাশে পরিভ্রমণের রাত। ইসলামী পরিভাষায়, যে রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ মসজিদে আকসা হতে সপ্তম আকাশের ঊর্ধ্বে স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় বিশেষ বাহনের উপর আরোহণ করে বিভিন্ন নিদর্শন পরিদর্শন করার মাধ্যমে যে মু‘জিযা লাভ করেন, সে রাতকেই শবে মিরাজ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা এর সত্যতা প্রমাণ করে বলেন,

﴿اَفَتُمَارُوْنَهٗ عَلٰى مَا يَرٰى وَلَقَدْ رَاٰهُ نَزْلَةً اُخْرٰى عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهٰى عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوٰى - إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشٰى مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغٰى لَقَدْ رَاٰى مِنْ اٰيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرٰى﴾

সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সঙ্গে বিতর্ক করবে? নিশ্চয় সে তাকে আরো একবার দেখেছিল সিদরাতুল মুনতাহার নিকট, যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা’ওয়া। যখন সিদরাতটি যা দিয়ে ঢাকার তা দ্বারা ঢাকা ছিল। তার দৃষ্টি ভ্রষ্ট হয়নি এবং দৃষ্টি সীমালঙ্ঘনও করেনি। অবশ্যই সে তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল। (সূরা নাজম : ১২-১৮)

কুরআনুল কারীমে এ ঘটনাটিকে বুঝাতে ইসরা ( اَلْاِسْرَاءُ ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উক্ত রাতে ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণের পূর্বে মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যমত্ম জিবরাঈল (আঃ) এর সাথে বিশেষ বাহনের মাধ্যমে জাগ্রত অবস্থায় ভ্রমণ করানো হয়, তাই এ রাতকে লাইলাতুল ইসরাও বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿سُبْحَانَ الَّذِيْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَى الْمَسْجِدِ الْاَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهٗ لِنُرِيَهٗ مِنْ اٰيَاتِنَاؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ﴾

পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যমত্ম, যার চারপাশকে করে দিয়েছিলাম বরকতময়। যাতে করে তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি; নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনী ইসরাঈল- ১)

মিরাজ স্বশরীরে হয়েছিল না স্বপ্নযোগে হয়েছিল :

মিরাজ স্বশরীরে হয়েছিল না স্বপ্নযোগে হয়েছিল এটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, স্বপ্নযোগে হয়েছিল। তবে এ ধারণা সঠিক নয়। অধিকাংশ আলেম, ফকীহ ও মুহাদ্দিসের অভিমত হলো, নবী ﷺ এর জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল।

৩৬
মিরাজের তারিখ
মিরাজ হচ্ছে একটি সুপ্রসিদ্ধ ঘটনা এবং এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, মিরাজ নবুওয়াতের পরে এবং হিজরতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কায় থাকা অবস্থাতেই সংঘটিত হয়েছিল। তবে সেটি কোন্ বছরে, কোন্ মাসে এবং কোন্ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল- এ ব্যাপারে আলেমগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। যেমন-

কারো মতে ১ম নববী বর্ষে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল।

কারো মতে ৫ম নববী বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল।

কারো মতে ১০ম নববী বর্ষের রজব মাসের ২৭ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল।

কারো মতে ১২তম নববী বর্ষের রমাযান মাসে সংঘটিত হয়েছিল।

কারো মতে ১৩তম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে সংঘটিত হয়েছিল।

কারো মতে ১৩তম নববী বর্ষের রবিউল আওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল। [আর-রাহীকুল মাখতূম, রাসূলুল্লাহ # এর মিরাজ অধ্যায়।]

উপরোক্ত ছয়টি মতের মধ্যে প্রথম চারটি গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও তৃতীয় মতটিই উপমহাদেশে প্রচলিত আছে। কেননা এ ব্যাপারে বিদ্বানগণ একমত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রী খাদীজা (রাঃ) পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর তারা এ ব্যাপারেও একমত যে, খাদীজা (রাঃ) এর মৃত্যু হয়েছিল ১০ম নববী বর্ষের রমাযান মাসে।

এখন বাকি থাকে শেষের তিনটি মত। এগুলোর মধ্যে কোন একটিকে নিশ্চিতভাবে প্রাধান্য দেয়া যায় না। তবে এটা নিশ্চিত যে, মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মদিনায় হিজরতের খুবই নিকটবর্তী সময়ে।

৩৭
মিরাজ উপলক্ষে করণীয়
মিরাজের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বের দাবিদার। সুতরাং এ উপলক্ষে অবশ্যই কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন-

১. মিরাজের ঘটনার প্রতি ঈমান আনা :

মিরাজের ঘটনাটি জানার সাথে সাথে আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে এর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান আনয়ন করা, যেমনিভাবে আবু বকর (রাঃ) এনেছিলেন। কেননা এ ঘটনাটি কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। সুতরাং এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা যাবে না।

২. আল্লাহ আরশের উপরে আছেন এর প্রতি ঈমান আনা :

মিরাজের ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর সমাসীন আছেন। তিনি সেখান থেকেই সৃষ্টিজগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সুতরাং আমাদের উচিত, এ বিষয়ে পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সত্তাগতভাবে তাকে সর্বত্র বিরাজমান মনে না করা।

৩. জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনা :

মিরাজের ঘটনা থেকে এটাও জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ জান্নাত ও জাহান্নাম প্রদর্শন করেছিলেন। সেখানে তিনি জান্নাতের অনাবিল সুখ ও জাহান্নামের কঠিন শাসিত্ম নিজ চোখে অবলোকন করেছিলেন। প্রত্যেক মানুষকে তার কর্মফল অনুযায়ী হয় জান্নাতে নতুবা জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয়ের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক।

৪. মিরাজের রাতে ফরযকৃত ইবাদাত পালনে সচেষ্ট হওয়া :

মিরাজের রাত্রিতে ফরযকৃত একমাত্র ইবাদাত হচ্ছে সালাত। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে তাঁর উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা আবশ্যক করে দিয়েছিলেন। সুতরাং আমাদের উচিত যথাযথভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা।

৩৮
শবে মিরাজ উপলক্ষে বিদআতী আমলসমূহ
শবে মিরাজ উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ ﷺ অথবা সাহাবীদের থেকে নির্দিষ্ট কোন আমল প্রচলিত না থাকলেও বর্তমানে আমাদের সমাজে নানা ধরনের আমলের প্রচলন রয়েছে। যেমন- বিশেষ সালাত আদায় করা, বিশেষ রোযা রাখা, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা, রাত্রি জাগরণ করা, আনন্দোৎসব করা, শিরনী বিতরণ করা, ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা, মসজিদ আলোকসজ্জা করা ইত্যাদি।

যেহেতু এ দিবস উপলক্ষে ইসলামে কোন আমলের কথা উল্লেখ নেই, সুতরাং এগুলো বিদআতী আমল হিসেবে গণ্য হবে। নিম্নে বিশেষ কয়েকটি আমলের পর্যালোচনা করা হলো :

১. সালাতুর রাগায়িব আদায় করা :

আমাদের সমাজে সালাতুর রাগায়িব নামে এক প্রকার সালাতের প্রচলন রয়েছে। এটি মূলত রজব মাসকে কেন্দ্র করে আদায় করা হয়ে থাকে। তবে মিরাজের রাত্রিতে এটি বিশেষভাবে আদায় করা হয়ে থাকে। অথচ ইসলামে এর কোন ভিত্তি নেই। কিছু জাল হাদীসের ভিত্তিতে কিছু বিদআতী লোক এসব পালন করে থাকে। এটি সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ৪৮০ হিজরী সনে ফিলিসিত্মনে। [আল হাওয়াদিস ওয়াল বিদা- ১২২ পৃঃ।]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন,

صَلَاةُ الرَّغَائِبِ بِدْعَةٌ بِإِتِّفَاقِ اَئِمَّةِ الدِّيْنِ لَمْ يُسَنَّهَا رَسُوْلُ اللهِ وَلَا أَحَدٌ مِّنْ خُلَفَائِه وَلَا أسْتَحَبَّهَا أَحَدٌ مِّنْ أَئِمَّةِ الدِّيْنِ كَمَالِكٍ وَالشَّافِعِيْ وَأَحْمَدَ وَأَبِيْ حَنِيْفَةَ وَالثَّوْرِىِّ وَالْأَوْزَاعِىْ وَاللَّيْثِ وَغَيْرِهِمْ وَالْحَدِيْثُ الْمَرْوِيُّ فِيْهَا كَذِبٌ بِإِجْمَاعِ أَهْلِ الْمَعْرِفَةِ بِالْحَدِيْثِ

সকল ইমামের ঐক্যমতে সালাতুর রাগায়িব বিদআত। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বা তার কোন খলীফার মধ্যে কেউই এটা চালু করেননি এবং ইমামদের মধ্য হতে কোন ইমাম যেমন- ইমাম মালিক, শাফেঈ, আহমাদ, আবু হানীফা, সাওরী, আওযাঈ, লায়স ইত্যাদি কেউই এটা পছন্দ করেননি। আর এ সম্পর্কিত যে হাদীসগুলো বর্ণনা করা হয় সেগুলো মুহাদ্দিসগণের ঐক্যমতে মিথ্যা ও বানোয়াট। [মাজমু ফাতাওয়া ২৩/১৩৪ পৃঃ।]

২. শবে মিরাজ উপলক্ষে রোযা রাখা :

শবে মিরাজকে কেন্দ্র করে যেসব রোযা পালন করা হয়, সেগুলোও বিদআতী আমলের অমত্মর্ভুক্ত। কেননা এ ধরনের কোন আমল রাসূলুল্লাহ ﷺ অথবা সালফে সালেহীনদের থেকে প্রমাণিত নেই। এ সংক্রামত্ম যত হাদীস রয়েছে সেগুলো মুহাদ্দিসগণের মতে মিথ্যা ও বানোয়াট। ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহ.) বলেন,

لَمْ يَرِدْ فِىْ فَضْلِ شَهْرِ رَجَبَ ، وَلَا فِىْ صِيَامِه ، وَلَا فِىْ صِيَامِ شَيْئٍ مِنْهُ مُعَيَّنٌ ، وَلَا فِىْ قِيَامِ لَيْلَةٍ مَخْصُوْصَةٍ فِيْهِ حَدِيْثٌ صَحِيْحٌ يُصْلِحُ لِلْحُجَّةِ

রজব মাসের ফযীলত এবং সে মাসে রোযা রাখার ফযীলত বর্ণনায় অথবা এ মাসের কোন নির্দিষ্ট দিনে রোযা রাখা বা রাত্রি জাগরণ সম্পর্কে দলীল উপস্থাপনের উপযুক্ত কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি। [আল-বিদা আল-হাওলিয়া- ২১৪ পৃঃ।]

৩. শবে মিরাজ উপলক্ষে অনুষ্ঠান পালন :

শবে মিরাজ উপলক্ষে যেকোন অনুষ্ঠান তথা মসজিদ আলোকসজ্জা করা, খাওয়া-দাওয়া করা, জনসভার আয়োজন করা ইত্যাদি আমলসমূহ ইসলামে অবৈধ। শাইখ ইবনে বায (রহ.) বলেন, কোন মুসলিমের জন্য মিরাজের রজনীকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বৈধ নয়। কারণ নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ মিরাজের রাতকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার অনুষ্ঠান পালন করেননি এবং বিশেষ কোন ইবাদাতও করেননি। অতএব এগুলো যদি প্রকৃতপক্ষেই শরীয়তসম্মত কোন কাজ হত, তাহলে অবশ্যই নবী ﷺ স্বীয় উম্মতের জন্য তার কথা বা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন এবং সাহাবীগণ তা বর্ণনা করতেন। যেহেতু এ সকল অনুষ্ঠান বা ইবাদাতের সাথে তাঁদের কোন সম্পর্ক নেই, সুতরাং এটা এক নিকৃষ্ট বিদআত, যা হতে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। [আল-বিদা ওয়াল মুহদাসাত- ৫৮৯-৯০।]

৩৯
শবে মিরাজ উপলক্ষে বর্জনীয়
রাসূলুল্লাহ ﷺ অথবা সাহাবীগণ এ দিবস উপলক্ষে বিশেষ কোন ইবাদাত অথবা আমল চালু করে যান নাই। উপরমত্মু এটি কবে সংঘটিত হয়েছিল, তাঁরা সে সম্পর্কেও সঠিক ধারণা দিয়ে যান নাই। যার কারণে এর তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে এ দিবসটিকে খুব জাঁকজমক সহকারে পালন করা হচ্ছে। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এ রাতকে কেন্দ্র করে যেসব শরীয়তবিরোধী কাজ হয় সেগুলো সর্বদা বর্জন করে চলা। যেমন,

১. বিশেষ ইবাদাত না করা :

ইতিপূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে যে, শবে মিরাজ উপলক্ষে যেসব ইবাদাত পালন করা হয়, সেগুলো বিদআত। সুতরাং আমাদের উচিত সেসব ইবাদাত বর্জন করা।

২. পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা :

রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন জাহান্নাম দেখেছিলেন তখন তিনি কিছু কিছু পাপীর শাসিত্ম দেখতে পেয়েছিলেন। যেমন- চুরির শাসিত্ম, মিথ্যা বলার শাসিত্ম, যিনার শাসিত্ম ইত্যাদি। সুতরাং আমাদের করণীয় হচ্ছে এসব পাপকাজসহ অন্যান্য সকল পাপকাজ থেকে বিরত থাকা। যাতে করে আমরা জাহান্নামের আযাব থেকে বেঁচে থাকতে পারি।

৩. তারিখ নির্দিষ্ট না করা :

মিরাজ কবে সংঘটিত হয়েছিল- এ ব্যাপারে যেহেতু নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, সুতরাং এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে কোন ধরনের তারিখ নির্দিষ্ট করা ঠিক নয়।

৪. আনুষ্ঠানিকতা না করা :

ইতিপূর্বে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শবে মিরাজ উপলক্ষে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা বিদআত। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো সেসব আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করা।

৪০
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মিরাজ যেভাবে ঘটেছিল
একদিন এশার নামাযের পর রাসূলুল্লাহ ﷺ চাচাতো বোন উম্মে হানীর ঘরে শয়ন করেছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল (আঃ) সেখানে প্রবেশ করলেন। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) বুরাক নামক এক আশ্চর্য ধরনের বাহন নিয়ে আসেন। যা ছিল গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট একটি সাদা রঙের জমত্মু। তার চলার গতি ছিল দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যমত্ম অর্থাৎ দৃষ্টি যতদূর পর্যমত্ম যেত সে এক পদক্ষেপে ততদূর পর্যমত্ম চলতে পারত।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উক্ত বাহনের উপর আরোহণ করিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস গমন করেন। সেখানে গিয়ে প্রথমে তিনি বাহনটি একটি খুঁটির সাথে বাঁধলেন, যে খুটির সাথে ইতিপূর্বে অন্যান্য নবীগণ তাদের বাহনগুলো বাঁধতেন। তারপর তারা উভয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং দু’রাকআত সালাত আদায় করেন এবং বের হয়ে যান। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সামনে দুটি পাত্র পেশ করেন। একটির মধ্যে ছিল শরাব তথা মদ; আর অন্যটির মধ্যে ছিল দুধ। রাসূলুল্লাহ ﷺ উভয়টির মধ্যে দুধের পাত্রটিই গ্রহণ করলেন। তখন জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বললেন, আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং প্রথম আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা আদম (আঃ)-কে দেখতে পান। আর তারা এও দেখতে পান যে, আদম (আঃ) এর ডানে ও বামে দুটি দল রয়েছে। তিনি যখন ডান দিকে তাকাচ্ছিলেন তখন হাঁসছিলেন এবং যখন বাম দিকে তাকাচ্ছিলেন তখন কাঁদছিলেন। জিবরাঈল (আঃ)-কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তার ডান দিকের লোকগুলো হলো জান্নাতী, তাই তিনি হাঁসছেন এবং তার বাম দিকের লোকগুলো হলো জাহান্নামী, তাই তিনি কাঁদছেন। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ আদম (আঃ)-কে সালাম দিলেন। তখন আদম (আঃ) সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং দ্বিতীয় আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাঁকে আনতে কি আপনাকে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ)-কে দেখতে পান। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে সালাম দিলেন। তখন তারা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং তৃতীয় আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা ইউসুফ (আঃ)-কে দেখতে পান। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে সালাম দিলেন। তখন তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং চতুর্থ আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা ইদরীস (আঃ)-কে দেখতে পান। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে সালাম দিলেন। তখন তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং পঞ্চম আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা হারূন (আঃ)-কে দেখতে পান। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে সালাম দিলেন। তখন তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং ষষ্ঠ আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা মূসা (আঃ)-কে দেখতে পান। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে সালাম দিলেন। তখন তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম। এ সময় মূসা (আঃ) কেঁদে ফেললেন। তখন তাকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আমার পরে এমন এক আদম সন্তানকে নবী করে প্রেরণ করা হয়েছে, যার উম্মত আমার উম্মতদের থেকে অধিক হারে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গমন করলেন এবং সপ্তম আসমানের দরজার সামনে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি উক্ত আসমানের দারোয়ানকে দরজা খুলতে বললেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আমি জিবরাঈল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথে কে? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, মুহাম্মাদ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি তাঁকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দরজা খুলে দেন। ফলে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে তারা ইবরাহীম (আঃ)-কে দেখতে পান এমতাবস্থায় যে, তিনি ‘‘বাইতুল মা‘মূর’’ এর সাথে পিঠ লাগিয়ে বসে রয়েছেন। আর বাইতুল মা‘মূর হচ্ছে ঐ মসজিদ যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা ইবাদাত করার সুযোগ পান। আর যারা সেখানে একবার ইবাদাত করার সুযোগ পান, তারা পুনরায় সেখানে ফিরে আসার সুযোগ পান না। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ ইবরাহীম (আঃ)-কে সালাম দিলেন। তখন তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, সৎ সমত্মান ও সৎ নবীর জন্য স্বাগতম।

তারপর জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় গমন করেন। সেখানে রয়েছে একটি বরই গাছ। সে গাছের পাতাগুলো হাতির কানের মতো এবং ফলগুলো বড় বড় মটকার মতো। আর এটাই হচ্ছে ফেরেশতাদের ঊর্ধ্ব গমনের শেষ সীমা। ফেরেশতাগণ এর উপরে গমন করতে পারেন না। এ সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ জিবরাঈল (আঃ)-কে তার মূল আকৃতিতে ৬০০ পাখাবিশিষ্ট অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন।

সিদরাতুল মুনতাহায় রাসূলুল্লাহ ﷺ চারটি নদীও দেখতে পেয়েছিলেন, যার মধ্যে দুটি হচ্ছে গোপন এবং অপর দুটি হচ্ছে প্রকাশ্য। গোপন দুটি নদী হচ্ছে জান্নাতের এবং প্রকাশ্য দুটি নদী হচ্ছে নীল নদ ও ফুরাত নদী।

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ সেখানে জান্নাত ও জাহান্নামও নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি জান্নাতে প্রবেশ করে দেখেন যে, এর মাটিগুলো মিশকে আম্বরের ন্যায় সুবাসিত। তারপর সেখানে তিনি মাকামুম মাহমুদও দেখতে পান। আর এটিই হচ্ছে জান্নাতের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের বাসস্থান। এটি কেবল রাসূলুল্লাহ ﷺ-ই প্রাপ্ত হবেন। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ সেখানে হাউজে কাওসার পর্যবেক্ষণ করেন, যা আল্লাহ তা‘আলা তাকে দান করেছেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ জাহান্নাম পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন প্রকার অপরাধের জন্য বিভিন্ন ধরনের শাসিত্মও দেখতে পান। তিনি দেখতে পান যে, একদল লোক নিজেদের নখ দ্বারা নিজেদের চেহারা ও বক্ষ হতে গোশত খামচিয়ে ছিড়ছে। আর তাদের নখগুলো ছিল তামার তৈরি এবং বিশাল আকৃতির ও খুব ধারালো। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিবরাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো ঐসব লোক, যারা অন্যের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানহানি ঘটাত। অর্থাৎ তারা গীবত-পরনিন্দা ও পরের সমালোচনায় মগ্ন থাকত।

সেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো দেখতে পান যে, আগুনের কেচি দিয়ে কিছু লোকের ঠোঁট কেটে নেয়া হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিবরাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? তাদের এ করুণ অবস্থা কেন? তিনি বললেন, এরা আপনার উম্মতের সেসব বক্তা ও আলোচক, যারা মানুষকে কল্যাণের আদেশ দিত, কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভুলে যেত। অর্থাৎ তারা মানুষকে উপদেশ দিত ঠিকই, কিন্তু নিজেরা আমল করত না।

তারপর সেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো দেখতে পান যে, এক লোক সাগরে সাঁতার কাটছে। সে যখনই তীরে ভিড়ছে, তখনই একটি ফেরেশতা তার উপর পাথর নিক্ষেপ করছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিবরাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হচ্ছে সুদখোর।

আর সিদরাতুল মুনতাহা হলো এমন একটি জায়গা যেখানে জিবরাঈল (আঃ) এরও যাওয়ার অনুমতি নেই। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ রফরফ নামক অন্য একটি বিশেষ বাহনের মাধ্যমে একাকীই আরো উর্ধ্বে একেবারে আল্লাহ তা‘আলার সন্নিকটে গমন করেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহ তা‘আলার এতই নিকটবর্তী হয়েছিলেন যে, উভয়ের মধ্যে মাত্র দুই ধনুক পরিমাণ বা তার চেয়ে কম জায়গার ব্যবধান ছিল। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহ তা‘আলার সাথে সরাসরি কথা-বার্তা বললেন এবং আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর যা কিছু ওহী করার তা করলেন। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ৫০ ওয়াক্ত নামায উপহার দেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ উক্ত ৫০ ওয়াক্ত নামায নিয়ে নিচে অবতরণ করতে থাকেন। কিন্তু যখন তিনি মূসা (আঃ) পর্যমত্ম আসলেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার প্রতিপালক আপনার উপর কী নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। তিনি বললেন, আপনার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যান এবং একে আরো সহজ করার আবেদন করুন। কেননা আপনার উম্মত এ নির্দেশ পালনে সক্ষম হবে না। আমি বনী ইসরাঈলকে পরীক্ষা করেছি এবং তাদের বিষয়ে আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। ফলে তিনি পুনরায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে গেলেন এবং সহজ করার জন্য আবেদন জানালেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা আরো ১০ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন।

অতঃপর যখন তিনি মূসা (আঃ) পর্যমত্ম আসলেন, তখন তিনি আবারও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুরূপ উত্তর দিলেন এবং মূসা (আঃ)-ও পুনরায় আল্লাহর কাছে গমন করে সহজ করার পরামর্শ দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ আবারও আল্লাহর কাছে গমন করেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আরো ১০ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দেন।

অতঃপর যখন তিনি মূসা (আঃ) পর্যমত্ম আসলেন, তখন তিনি আবারও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুরূপ উত্তর দিলেন এবং মূসা (আঃ)-ও পুনরায় আল্লাহর কাছে গমন করে সহজ করার পরামর্শ দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ আবারও আল্লাহর কাছে গমন করেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আরো ১০ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দেন।

অতঃপর যখন তিনি মূসা (আঃ) পর্যমত্ম আসলেন, তখন তিনি আবারও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুরূপ উত্তর দিলেন এবং মূসা (আঃ)-ও পুনরায় আল্লাহর কাছে গমন করে সহজ করার পরামর্শ দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ আবারও আল্লাহর কাছে গমন করেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আরো ১০ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দেন।

অতঃপর যখন তিনি মূসা (আঃ) পর্যমত্ম আসলেন, তখন তিনি আবারও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুরূপ উত্তর দিলেন এবং মূসা (আঃ)-ও পুনরায় আল্লাহর কাছে গমন করে সহজ করার পরামর্শ দেন। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ আবারও আল্লাহর কাছে গমন করেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আরো ৫ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দেন এবং বলেন, হে মুহাম্মাদ! যাও দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্ধারণ করা হলো। প্রতি ওয়াক্ত সালাতে দশ ওয়াক্ত সালাতের সমান সওয়াব রয়েছে। এভাবে (পাঁচ ওয়াক্ত হলো) পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সমান। (আল্লাহ তা‘আলা আরো বললেন,) যে ব্যক্তি কোন নেক কাজের নিয়ত করল এবং তা কাজে পরিণত করতে পারল না, আমি তার জন্য একটি সওয়াব লিখব; আর তা কাজে পরিণত করলে তার জন্য দশটি সওয়াব লিখব। পক্ষান্তরে যে কোন মন্দ কাজের নিয়ত করল অথচ তা কাজে পরিণত করল না, তার জন্য কোন গুনাহ লিখা হয় না। আর তা কাজে পরিণত করলে তার উপর একটি মাত্র গুনাহ লিখা হয়।

অতঃপর যখন তিনি মূসা (আঃ) পর্যমত্ম আসলেন, তখন তিনি আবারও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুরূপ উত্তর দিলেন এবং মূসা (আঃ)-ও পুনরায় আল্লাহর কাছে গমন করে সহজ করার পরামর্শ দেন। এবার রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এ বিষয়টি নিয়ে বার বার আমি আমার প্রতিপালকের নিকট আসা-যাওয়া করেছি, এখন আবার যেতে লজ্জা হচ্ছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মূসা (আঃ)-কে অতিক্রম করে ফিরে আসছিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, আমি আমার ফরয পূর্ণ করেছি এবং আমার বান্দাদের উপর সংক্ষিপ্ত করেছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ ফিরে আসেন এবং নিজেকে তিনি ঐ স্থানেই দেখতে পান, যেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

এ ঘটনাটি ছিল একটি বড় পরীক্ষা। কারণ প্রকৃত ঈমানদার ব্যতীত এটা মেনে নেয়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে যে রাতে এ ঘটনাটি ঘটেছিল সেদিন সকালে তিনি যখন মানুষের কাছে বিসত্মারিত বর্ণনা করলেন, তখন কাফিররা তো বিশ্বাস করলই না; বরং অনেক মুসলিমও বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করছিলেন। তবে একমাত্র আবু বকর (রাঃ) এসব কথা শোনামাত্রই সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন। ফলে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে সিদ্দীক তথা সত্যবাদী উপাধীতে ভূষিত করেন। [বুখারী-মুসলিম মে‘রাজ অধ্যায়। মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৪৪০৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩০৬।]

তাছাড়া এ ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নানা ধরনের প্রশ্ন করেছিল এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদের প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর যথাযথভাবে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও মুশরিকরা কোনভাবেই বিশ্বাস স্থাপন করেনি।

৪১
শাবান মাস শবে বরাত
শব ( شَبْ ) শব্দটি ফারসী, যার অর্থ হচ্ছে রাত। আর বরাত ( بَرَاءَةٌ ) শব্দটি আরবি ও ফারসী উভয় ভাষা থেকেই ব্যবহৃত হয়। আরবি হলে এর অর্থ হবে সম্পর্কচ্ছেদ করা অথবা মুক্তি লাভ করা। সুতরাং শবে বরাত এর অর্থ হবে সম্পর্কচ্ছেদের রাত বা মুক্তি লাভ করার রাত। আর যদি বরাত শব্দটি ফারসী ভাষা থেকে ধরা হয়, তাহলে শবে বরাত এর অর্থ হবে সৌভাগ্যের রাত। প্রচলিত অর্থে শাবান মাসের ১৫ তারিখে উদযাপিত দিবসকেই শবে বরাত বলা হয়।

৪২
ইসলামে শবে বরাতের অবস্থান
শবে বরাত নামটি কুরআনের কোন আয়াতে বা কোন হাদীসে নেই। তবে অনেকেই সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতকে শবে বরাতের আয়াত হিসেবে সাব্যসত্ম করার চেষ্টা করে। এতদ্বসংক্রামত্ম আলোচনা সামনে পেশ করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

আর হাদীসে শাবান মাসের মধ্য রাত্রিকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি হাসান পর্যায়ের হাদীস ব্যতীত এতদ্বসংক্রামত্ম সকল হাদীসের সনদই যঈফ অথবা জাল। উপরমত্মু যেসব হাদীস হাসান সেগুলো দ্বারা কোন আমল সাব্যসত্ম হয় না। অথচ আমাদের সমাজে এ দিনকে কেন্দ্র করে অনেক প্রকার আমলের প্রচলন রয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।

৪৩
সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতের পর্যালোচনা
শবে বরাতের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতটি কেউ কেউ আলোচনায় নিয়ে আসেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿حٰمٓ وَالْكِتَابِ الْمُبِيْنِ اِنَّاۤ اَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ اِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ اَمْرٍ حَكِيْمٍ اَمْرًا مِّنْ عِنْدِنَاؕ اِنَّا كُنَّا مُرْسِلِيْنَ﴾

হা-মীম, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের; আমি এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। আর আমিই হলাম সতর্ককারী। এ রাতে আমার আদেশক্রমে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ফায়সালা হয়। নিশ্চয় আমিই রাসূল প্রেরণ করে থাকি। (সূরা দুখান, ১-৪)

কতক আলেমের দাবি হচ্ছে, এখানে বরকতময় রাত বলতে শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে।

পর্যালোচনা :

এ আয়াত দ্বারা কোনভাবেই শবে বরাত সাব্যসত্ম হয় না। কেননা এখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা একটি বরকতময় রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন। অপর আয়াতে তিনি বলেন,

﴿اِنَّاۤ اَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ - وَمَاۤ اَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ -– لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ﴾

আমি একে (কুরআনকে) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আর তুমি কি জানো, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হলো, হাজার মাসের চেয়েও উত্তম (একটি রজনী)। (সূরা কদর, ১-৩)

আর এ কথা স্পষ্ট যে, লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমাযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাত্রিগুলোতে। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, রমাযান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْۤ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ﴾

রমাযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক, হেদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন এবং ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)। (সূরা বাকারা- ১৮৫)

কুরআনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ তাফসীর হচ্ছে কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর করা। আর এখানে কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত হলো যে, লাইলাতুল কদরে কুরআন নাযিল হয়েছে। আর লাইলাতুল কদর রয়েছে রমাযান মাসে। সুতরাং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুন মুবারাকাতুন’ দ্বারা রমাযানের লাইলাতুল কদরকে বাদ দিয়ে অন্য কোন রাত্রিকে বুঝানোর চেষ্টা করা কুরআন বিকৃতির নামামত্মর। এ ধরনের বিকৃত অর্থ করা থেকে আল্লাহ তা‘আলা আলেমদেরকে হেফাযত করুন। আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের কাজের ব্যাপারে মানবজাতিকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿اِنَّ الَّذِيْنَ يُلْحِدُوْنَ فِيْۤ اٰيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَاؕ اَفَمَنْ يُّلْقٰى فِى النَّارِ خَيْرٌ اَمْ مَّنْ يَّاْتِيْۤ اٰمِنًا يَّوْمَ الْقِيَامَةِؕ اِعْمَلُوْا مَا شِئْتُمْ اِنَّهٗ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ﴾

যারা আমার আয়াতসমূহকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচরে নয়। শ্রেষ্ঠ কে, যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে, নাকি যে কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে সে? সুতরাং তোমরা যা ইচ্ছা তা আমল করে যাও। (জেনে রেখো) তোমরা যা কর, তিনি তার দ্রষ্টা। (সূরা হা-মীম সাজদা- ৪০)

আয়াতে উল্লেখিত يُلْحِدُوْنَ শব্দটি اِلْحَادٌ (ইলহাদ) থেকে নির্গত। যার অর্থ ফিরে যাওয়া, সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথের দিকে যাওয়া, বক্রতা অবলম্বন করা ইত্যাদি। সুতরাং কুরআনের ক্ষেত্রে ইলহাদ করার অর্থ হবে, আল্লাহর আয়াতসমূহের সঠিক অর্থ গ্রহণ না করে ভুল অর্থ গ্রহণ করা। মক্কার কাফিররা কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহ ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য যে চক্রান্ত করেছিল তার মধ্যে ছিল, তারা কুরআনের আয়াত শুনে কোন আয়াতকে পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অথবা কোন আয়াতের শাব্দিক বিকৃতি ঘটিয়ে ভুল অর্থ গ্রহণ করে নানা রকমের প্রশ্ন উত্থাপন করত।

কোন ব্যক্তি যদি কোন আয়াতের ভুল অর্থ গ্রহণ করে থাকেন, তবে তা সকলের জন্য দলীল হয়ে দাঁড়াবে- এমন কোন কথা শরীয়তে নেই। চাই তিনি যত বড় বুযুর্গ বা যত বড় আলেমই হোন না কেন।

৪৪
শবে বরাত প্রসঙ্গে আলোচিত হাদীসগুলোর পর্যালোচনা
হাদীসে শবে বরাতকে لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ (লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান) শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রামত্ম হাদীসগুলো পর্যালোচনাসহ উল্লেখ করা হলো :

১ নং হাদীস :

عَنْ أَبِيْ مُوْسَى الْأَشْعَرِيِّ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ إِنَّ اللهَ لَيَطَّلِعُ فِيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيْعِ خَلْقِه إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ

আবু মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে মনোনিবেশ করেন এবং তাঁর সমসত্ম বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে শিরককারী ও হিংসুককে ক্ষমা করেন না। [ইবনে মাজাহ, হা/১৩৯০; জামেউল আহাদীস, হা/৭০৮৫।]

২ নং হাদীস :

عَنْ أَبِيْ ثَعْلَبَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا كَانَ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ اِطَّلَعَ اللهُ إِلٰى خَلْقِه فَيَغْفِرُ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَ يُمْلِيْ لِلْكَافِرِيْنَ وَ يَدَعُ أَهْلَ الْحِقْدِ بِحِقْدِهِمْ حَتّٰى يَدَعُوْهُ

আবু সালাবা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত এসে যায়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুমিনদেরকে ক্ষমা করেন, কাফিরদের শাসিত্ম বাড়িয়ে দেন এবং হিংসুকদের অবকাশ দেন, যেন তারা হিংসা ছেড়ে দেয়। [শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৮৩২; জামেউস সগীর, হা/৭৭১।]

পর্যালোচনা :

শাইখ আলবানী (রহ.) উপরোক্ত হাদীস দুটিকে হাসান বলেছেন। তবে এগুলো ছাড়া নির্ভরযোগ্য সূত্রে সনদ ও মতনের শাব্দিক ভিন্নতায় আরো কয়েকটি হাদীস রয়েছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, এসব হাদীস দ্বারা উক্ত রাত্রির কেবল ফযীলত প্রমাণিত হয়; কিন্তু কোন প্রকার ইবাদাত প্রমাণিত হয় না।

৩ নং হাদীস :

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ فَقَدْتُ رَسُوْلَ اللهِ ذَاتَ لَيْلَةٍ فَخَرَجْتُ فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ رَافِعٌ رَأْسَه إِلَى السَّمَاءِ فَقَالَ لِي أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَّحِيْفَ اللهُ عَلَيْكِ وَرَسُوْلُهُ قَالَتْ قُلْتُ ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ فَقَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাতে আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বিছানায় না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। অতঃপর আমি তাকে বাকী নামক কবরস্থানে আকাশের দিকে মাথা উত্তোলনরত অবস্থায় পেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমাণের চেয়েও অধিক পরিমাণ লোকদেরকে ক্ষমা করে দেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬০১৮; তিরমিযী, হা/৭৩৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৩৮৯; মিশকাত, হা/১২৯৯।]

পর্যালোচনা :

এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, আয়েশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের এ বর্ণিত সনদ ছাড়া অন্য কোনভাবে জানি না। আমি মুহাম্মাদ (ইমাম বুখারী)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। ইমাম তিরমিযী (রহ.) আরো বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর উরওয়া থেকে হাদীস শুনেননি। আর ইমাম মুহাম্মাদ (ইমাম বুখারী) বলেন, হাজ্জাজ ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি।

অতএব প্রতীয়মান হয় যে, উপরোক্ত হাদীসটি একেবারেই দুর্বল এবং মুনকাতি। তাছাড়া উক্ত হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত। আর শাইখ আলবানীও হাদীসটিকে যঈফ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং এ হাদীসটি কোনভাবেই দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

৪ নং হাদীস :

عَنِ الْعَلَاءِ بْنِ الْحَارِثِ أَنَّ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَامَ رَسُوْلُ اللهِ مِنَ اللَّيْلِ يُصَلِّيْ فَأَطَالَ السُّجُوْدَ حَتّٰى ظَنَنْتُ أَنَّه قَدْ قُبِضَ فَلَمَّا رَأَيْتُ ذٰلِكَ قُمْتُ حَتّٰى حَرَّكْتُ إِبْهَامَه فَتَحَرَّكَ فَرَجَعْتُ فَلَمَّا رَفَعَ رَأْسَه مِنَ السُّجُوْدِ وَ فَرَغَ مِنَ صَلَاتِه قَالَ يَا عَائِشَةُ أَوْ يَا حُمَيْرَاءُ أَظَنَنْتِ أَنَّ النَّبِيَّ قَدْ خَاسَ بِكِ قُلْتُ لَا وَ اللهِ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَ لٰكِنَّنِيْ ظَنَنْتُ أَنَّكَ قُبِضْتَ لِطُوْلِ سُجُوْدِكَ فَقَالَ أَتَدْرِيْنَ أَيَّ لَيْلَةٍ هٰذِه ؟ قُلْتُ : اَللهُ وَ رَسُوْلُه أَعْلَمُ قَالَ هٰذِه لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَ جَلَّ يَطَّلِعُ عَلٰى عِبَادِه فِيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِلْمُسْتَغْفِرِيْنَ وَ يَرْحَمُ الْمُسْتَرْحِمِيْنَ وَ يُؤَخِّرُ أَهْلَ الْحِقْدِ كَمَا هُمْ

আলা ইবনে হারিস (রহ.) হতে বর্ণিত। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সে সময় সিজদা এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি মনে করলাম, তিনি ইমেত্মকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, এতে তা নড়ে উঠল। ফলে আমি চলে এলাম। অতঃপর যখন তিনি সিজদা হতে মাথা উত্তোলন করলেন এবং সালাত শেষ করলেন তখন তিনি বললেন, হে আয়েশা! অথবা বললেন, হে হুমায়রা! তুমি কি ধারণা করেছ যে, আল্লাহর নবী তোমার সাথে খেয়ানত করেছেন? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল, (আমি এরূপ ধারণা করিনি) বরং আপনার দীর্ঘ সিজদার কারণে আমি ধারণা করেছি যে, আপনি ইমেত্মকাল করেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি বললেন, এটা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। অতঃপর তিনি ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদেরকে ক্ষমা করেন এবং রহমতপ্রার্থনাকারীদেরকে রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। [শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৮৩৫।]

পর্যালোচনা :

এ হাদীসের সনদ সম্পর্কে ইমাম বায়হাকী বলেন, হাদীসটি সম্পূর্ণভাবে মুরসাল। সম্ভাবনা রয়েছে যে, আলা ইবনে হারেস মাহকূল থেকে হাদীসটি গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। তাছাড়া এই অধ্যায়ের অনেক পরিত্যক্ত হাদীস রয়েছে। এসব হাদীসের বর্ণনাকারীরা অপরিচিত ব্যক্তি।

৫ নং হাদীস :

عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِيْ طَالِبٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا فَإِنَّ اللهَ يَنْزِلُ فِيْهَا لِغُرُوْبِ الشَّمْسِ إِلٰى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُوْلُ أَلَا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِيْ فَأَغْفِرَ لَه أَلَا مُسْتَرْزِقٍ فَأَرْزُقَه أَلَا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَه أَلَا كَذَا أَلَا كَذَا حَتّٰى يَطْلُعَ الْفَجْرُ

আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত্রি আগমন করে, তখন তোমরা সেই রাত্রিতে জাগরণ করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সেদিনের সূর্য অসত্ম যাওয়ার পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; কোন রিযিকপ্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে রিযিক প্রদান করব এবং কোন বিপদগ্রসত্ম ব্যক্তি আছে কি, আমি তাকে উদ্ধার করব। অতঃপর এভাবে তিনি ফজর পর্যমত্ম বলতে থাকেন। [ইবনে মাজাহ, হা/১৩৮৮; সিলসিলা যঈফাহ, হা/২১৩২।]

পর্যালোচনা :

প্রথমত : সনদের দিক দিয়ে হাদীসটি যঈফ। কেননা এ হাদীসের সনদে ইবনে আবু সাবুরাহ নামে বর্ণনাকারী রয়েছে, যাকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীস জালকারী হিসেবে জানেন। তাছাড়া শাইখ আলবানী (রহ.) এ হাদীসের সনদটিকে মাওযূ হিসেবে গণ্য করেছেন।

দ্বিতীয়ত : অন্য একটি সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। যেমন,

عَنْ أَبِى ْهُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالٰى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلٰى سَمَآءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقٰى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْاٰخِرُ فَيَقُوْلُ مَنْ يَّدْعُوْنِىْ فَأَسْتَجِيْبَ لَه مَنْ يَّسْأَلُنِىْ فَأُعْطِيَه مَنْ يَّسْتَغْفِرُنِىْ فَأَغْفِرَ لَه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আমাদের প্রতিপালক প্রত্যেক রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন যে, কোন আহবানকারী আছে কি, আমি তার ডাকে সাড়া দেব; কোন প্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে দান করব এবং কোন ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। [সহীহ বুখারী, হা/১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৮০৮; আবু দাউদ, হা/১৩১৭; তিরমিযী, হা/৪৪৬; নাসাঈ, হা/৭৭৬৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৯২০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৩১৩; মিশকাত, হা/১২২৩।]

৬ নং হাদীস :

عَنْ عُثْمَانَ بْنِ أَبِي الْعَاصِ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ إِذَا كَانَ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَإِذَا مُنَادٍ هَلْ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ فَاَغْفِرَ لَه هَلْ مِنْ سَائِلٍ فَأُعْطِيَه فَلَا يَسْأَلُ أَحَدٌ إِلَّا أُعْطِيَ إِلَّا زَانِيَةٌ بِفَرْجِهَا أَوْ مُشْرِكٌ

উসমান ইবনে আবুল আস (রাঃ) এর সূত্রে নবী ﷺ হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেন যে, কোন ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; কোন প্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে দান করব। অতঃপর মুশরিক ও লজ্জাস্থান দ্বারা ব্যভিচারী ব্যক্তি ব্যতীত সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। [শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৮৩৬; সিলসিলা যঈফাহ, হা/৭০০০।]

পর্যালোচনা :

উক্ত হাদীসের সনদ সম্পর্কে শাইখ আলবানী বলেন, এর সনদটি যঈফ।

সুতরাং উপরের হাদীসগুলো দ্বারা এ রাতের কোন বিশেষ আমল প্রমাণ করা ঠিক হবে না। তাই মুসলিমদের উচিত এ রাতটি অন্যান্য রাতের মতই অতিবাহিত করা এবং বিশেষ কোন আয়োজন না করা। কেননা এ রাত উপলক্ষে যদি সত্যিই কোন করণীয় থাকত, তাহলে তা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ অথবা সালফে সালেহীনদের থেকে প্রমাণিত থাকত।

৪৫
শবে বরাতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে শবে বরাত নামে পৃথক কোন ইবাদাতের কথা উল্লেখ নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনে, এমনকি সাহাবীদের যুগেও এ ধরনের কোন দিবস পালনের কথা প্রমাণ পাওয়া যায় না। এটি সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ৪৪৮ হিজরীতে মসজিদে আকসায়। তৎকালীন কিছু দুনিয়ালোভী ইমাম শবে বরাতের এই রীতি তাদের মসজিদগুলোতে চালু করে। উদ্দেশ্য ছিল মসজিদে বেশি লোক উপস্থিত করে নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা। এ উদ্দেশ্যে তারা উক্ত রাতে উপস্থিত লোকদের সামনে অনেক ফযীলতপূর্ণ ওয়াজ ও জাল-যঈফ হাদীস উপস্থাপন করতে থাকে। ফলে অনেক অজ্ঞ লোক সেসব ওয়াজ শোনার জন্য মসজিদগুলোতে ভিড় জমাতে থাকে। অতঃপর ধীরে ধীরে এর সাথে আরো অনেক ধরনের বিদআতী আমল সংযুক্ত হতে থাকে।

তাছাড়া সে সময়ের বাদশাহ ছিলেন ধর্মের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। তিনি সর্বদা ঐসব ইমামদেরকে কাছে রাখতেন, যারা সাধারণত মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আর যেহেতু শবে বরাতের মাধ্যমে ইমামদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেত, তাই দুনিয়াপূজারী সেসব ইমাম নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্য এ পথটিই বেছে নেয়। আর বাদশার সমর্থন থাকায় বিষয়টি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

এদিকে সে যুগের হকপন্থী আলেমগণ এ নতুন বিদআতের বিরুদ্ধে নিজেদের সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। আবার অনেকে আল্লাহর আযাবের ভয়ে জঙ্গলে পলায়ন করেন। কিন্তু অজ্ঞ লোকেরা হকপন্থী আলেমদের কথা না শুনে বিদআতীদের অনুসরণ করতে থাকে।

অবশেষে এ বিদআতটি ৩৫২ বছর চালু থাকে। তারপর তা জেরুজালেম, সিরিয়া, মিশর, ইরাকসহ প্রায় সকল দেশেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অজ্ঞাতভাবে ইরানের কিছু অঞ্চলে তা চালু থাকে। তারপর যখন ভারতবর্ষ মুসলিমদের কাছে চলে আসে, তখন যেকোনভাবেই হোক ভারতীয় কিছু নওমুসলিম তা গ্রহণ করে। যেহেতু ইতিপূর্বে তাদের পূর্বপুরুষরা ছিল হিন্দু এবং শবে বরাতটিও ছিল হিন্দুদের দীপালী পূজার অনুরূপ, সুতরাং তারা এটিকে খুব সহজেই গ্রহণ করে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে তা ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি সেটি আজ পর্যমত্ম কেবল এখানেই চালু আছে। [মিরকাত, ৪/৪৪৬-৪৭।]

৪৬
শবে বরাত পালন সম্পর্কে আলেমগণের অভিমত
শাইখ আবদুল্লাহ বিন বায (রহ.) এর অভিমত :

শাইখ আবদুল্লাহ বিন বায (রহ.) শবে বরাত সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে প্রচলিত বিদআতসমূহের মধ্যে একটি বিদআত হচ্ছে শবে বরাত পালন করা ও এ দিনে সিয়ামরত থাকা। কিছু সংখ্যক লোক ধর্মের নামে এটা চালু করে দিয়েছে অথচ এর সমর্থনে যেসব হাদীস পেশ করা হয়, তার কোনটার উপরই নির্ভর করা যায় না। এর মধ্যে অনেকগুলোই বানোয়াট ও জাল হাদীস।

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে যে আকীদাগত বিভ্রামিত্মর সৃষ্টি হয়েছে তা আরো মারাত্মক।

সামাজিকভাবে শবে বরাতকে একটি উৎসবে পরিণত করে বাড়ি, মসজিদ ও কবরস্থান আলোকসজ্জা করা, ঘরে ঘরে হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করা, পটকাসহ বিভিন্ন ধরনের আগুনের খেলায় মেতে ওঠা, দলবদ্ধভাবে কবরস্থান যিয়ারত করা, কুরআন খতম করা ইত্যাদি আয়োজন সবই অন্ধ অনুকরণ, সীমালঙ্ঘন, ব্যয়বহুল ও অনাচার। [আত-তাহযীরুল মিনাল বিদআত, হাফেয মুঃ মাওঃ রুহুল আমীন কর্তৃক বাংলা অনুবাদকৃত বই এর ১৯ ও ২৬ পৃঃ ; সাপ্তাহিক আরাফাত ৩১ বর্ষ ৩০তম সংখ্যা।]

শাইখ মুহাম্মাদ বিন জামিল যাইনু (রহ.) এর অভিমত :

শাইখ মুহাম্মাদ বিন জামিল যাইনু (রহ.) বিদআতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, মিলাদ পড়া, শবে মিরাজ ও ১৫ই শাবানের রাতে ইবাদাত বন্দেগী করে কাটানো (এগুলো বিদআত)। [ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনে ইসলামী দিক নির্দেশনা ৪৬ পৃঃ।]

৪৭
শবে বরাত উপলক্ষে ভ্রামত্ম আকীদাসমূহ
১. আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন :

অনেক লোক এ আকীদা পোষণ করে যে, শাবান মাসের মধ্য রাত্রিতে আল্লাহ তা‘আলা সূর্যাসেত্মর পর থেকেই দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। অথচ সহীহ হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত আছে যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাত্রের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। ইতিপূর্বে এতদ্বসংক্রামত্ম হাদীস ও তার বিসত্মারিত পর্যালোচনা করা হয়েছে।

২. মৃত মানুষের রূহ আগমন করে :

অনেকে ধারণা করে যে, শবে বরাতের রাতে মৃত মানুষের রূহ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। অথচ এ কথার কোন ভিত্তি নেই।

৩. এ রাত্রে ভাগ্য লেখা হয় :

যারা শবে বরাত পালন করে থাকে তাদের অনেকেই এই ভ্রামত্ম আকীদা পোষণ করে যে, এ রাত্রে মানুষের ভাগ্য বণ্টন করা হয়, আয়ু ও রুযী বৃদ্ধি করা হয়, সারা বছরের জন্ম-মৃত্যু ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর স্বপক্ষে কুরআন-হাদীসে কোন দলীল নেই। বরং কুরআন-হাদীসে ভাগ্য বণ্টনের বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

আর ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সূরা দুখান এর ১-৫ আয়াতগুলো লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত। সুতরাং এ রাতকে ভাগ্য রজনী হিসেবে গণ্য করা যাবে না।

৪৮
শবে বরাতের বর্জনীয় বিষয়সমূহ
শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে অনেক আমল চালু রয়েছে, যা থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। কেননা সওয়াবের নিয়তে এ রাতকে কেন্দ্র করে যেসব আমল করা হয়ে থাকে, সেগুলো বিদআত। আর বিদআত যে কত জঘন্য অপরাধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আমরা এগুলো থেকে দূরে থাকব এবং মানুষকেও দূরে রাখার চেষ্টা করব। যেমন,

১. এ রাতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা,

২. সারা রাত্রি জাগরণ করা,

৩. এ রাতে আনন্দোৎসব পালন করা,

৪. এ উপলক্ষে শিরনী বিতরণ করা,

৫. এ রাতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা,

৬. এ রাতে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা,

৭. মসজিদ আলোকসজ্জা করা :

আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, শবে বরাত আসলেই মসজিদগুলোকে আলোকসজ্জা করা হয়। অথচ এটি কোনভাবেই শরীয়তসম্মত নয়।

৮. হালুয়া-রুটি খাওয়া :

শবে বরাত উপলক্ষে সমাজে প্রচলিত অন্যতম একটি বিদআত হচ্ছে বিশেষ বিশেষ আকৃতিতে রুটি বানানো এবং সবাই মিলে ভক্ষণ করা। অথচ এমন রীতি ইসলামের সোনালী যুগে ছিল না।

৪৯
শবে বরাতের নামায
সালাতুল আলফিয়া :

আলফ অর্থ হচ্ছে হাজার। সুতরাং সালাতুল আলফিয়া অর্থ হচ্ছে হাজারী সালাত। যেহেতু এ সালাতে সূরা ইখলাস এক হাজার বার তিলাওয়াত করা হয়, তাই এটাকে সালাতুল আলফিয়া বলা হয়।

এ সালাতের নিয়ম হচ্ছে, ১৪ই শাবান দিনের শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সূর্যাসেত্মর সাথে সাথে গোসল করে ১০০ রাকআত সালাত পড়া, যার প্রত্যেক রাকআতে ১০ বার করে সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয়।

প্রকৃতপক্ষে কুরআন ও সহীহ সুন্নায় এ ধরনের কোন সালাতের কথা উল্লেখ নেই। কিছু আলেম শবে বরাতকে কেন্দ্র করে এ ধরনের সালাতের প্রচলন করেছেন। তবে হকপন্থী আলেমগণ এর প্রতিবাদও জানিয়েছেন। এ সম্পর্কে মিরকাতের লেখক মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন,

وَاعْلَمْ أَنَّ الْمَذْكُوْرَةَ فِي اللَّاٰلِىْ أَنَّ مِائَةَ رَكْعَةٍ فِيْ نِصْفِ شَعْبَانَ بِالْاِخْلَاصِ عَشْرَ مَرَّاتٍ فِيْ كُلِّ رَكْعَةٍ مَعَ طُوْلِ فَضْلِه لِلدَّيْلَمِيِّ وَغَيْرِه مَوْضُوْعٌ ، وَفِيْ بَعْضِ الرَّسَائِلِ قَالَ عَلِيُّ بْنُ إِبْرَاهِيْمَ وَمِمَّا أُحْدِثَ فِيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ اَلصَّلَاةُ الْألْفِيَّةُ مِائَةَ رَكْعَةٍ بِالْإِخْلَاصِ عَشْرًا عَشْرًا بِالْجَمَاعَةِ وَاهْتَمُّوْا بِهَا أَكْثَرَ مِنَ الْجُمَعِ وَالْأَعْيَادِ لَمْ يَأْتِ بِهَا خَبْرٌ وَلَا أَثَرٌ إِلَّا ضَعِيْفٌ أَوْ مَوْضُوْعٌ وَلَا تَغْتَرَّ بِذِكْرِ صَاحِبِ الْقُوْتِ وَالْأِحْيَاءِ وَغَيْرِهِمَا وَكَانَ لِلْعَوَامِّ بِهٰذِهِ الصَّلَاةِ اِفْتِتَانٌ عَظِيْمٌ حَتَّى الْتَزَمَ بِسَبَبِهَا كَثْرَةُ الْوَقِيْدِ وَتَرَتَّبَ عَلَيْهِ مِنَ الْفُسُوْقِ وَانْتَهَاكَ الْمُحَارِمُ مَا يُغْنِيْ عَنْ وَصْفِه ، وَأَوَّلُ حُدُوْثِ هٰذِهِ الصَّلَاةِ بِبَيْتِ الْمَقْدَسِ سَنَةَ ثَمَانٍ وَّأَرْبَعِيْنَ وَأَرْبَعِمِائَةٍ قَالَ قَدْ جَعَلَهَا جَهَلَةُ أَئِمَّةِ الْمَسَاجِدِ مَعَ صَلَاةٍ لِرَغَائِبَ وَنَحْوِهِمَا شَبَكَةً لِجَمْعِ الْعَوَامِّ وَطَلَبًا لِرِيَاسَةِ التَّقَدُّمِ وَتَحْصِيْلِ الْحِطَامِ

তুমি জেনে রেখো! ‘লাআ-লী’ নামক পুসত্মকে উল্লেখিত মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত নামাযে প্রত্যেক রাকআতে ১০ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠসহ লম্বা করে পাঠের বর্ণনা বানোয়াট।

কিছু পুসত্মকে উল্লেখ আছে যে, আলী ইবনে ইবরাহীম বলেন, মধ্য শাবানের রাতে কৃত বিদআতসমূহের অন্যতম হচ্ছে সালাতে আলফিয়ার ১০০ রাকআত সালাত। যার প্রত্যেক রাকআতে ১০ বার করে সূরা ইখলাস পাঠপূর্বক জামা‘আতের সাথে পড়া হয় এবং এটিকে জুমু‘আ ও দু’ঈদের নামাযের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কিছু দুর্বল বা বানোয়াট বর্ণনা ছাড়া এতদ্বসংক্রামত্ম কোন হাদীস অথবা আছার (সাহাবীর বিবরণ) আসেনি। আর এ হাদীসগুলো ইহইয়াউল উলূম এবং কিতাবুল কুত ও অন্য কোন কিতাবে বর্ণিত হওয়ার কারণে তুমি প্রতারিত হবে না। সাধারণ জনগণ এই সালাতকে কেন্দ্র করে বিরাট ফেতনায় পতিত হয়েছে এবং বাধ্যতামূলকভাবে আহারের ব্যবস্থা করেছে, যাতে নানা ধরণের অন্যায় কাজ সংঘটিত হয় এবং শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন হয়- যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৪৪৮ হিজরী সনে বায়তুল মুকাদ্দাসে সর্বপ্রথম এ বিদআত আবিষ্কৃত হয়। অন্যান্য নামাযের সাথে যুক্ত করে জনগণকে একত্রিত করার ফন্দি হিসেবে মসজিদের জাহিল ও অজ্ঞ ইমামগণ এর প্রবর্তন করে। এর দ্বারা ইমামগণের নেতৃত্ব ও উদরপূর্তি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। [মিরকাত, ৪/৪৪৬ পৃঃ।]

৫০
শবে বরাতের রোযা
শবে বরাত উপলক্ষে সমাজে বহুল প্রচলিত একটি আমল রয়েছে। আর তা হলো, শাবান মাসের ১৫ তারিখে রোযা রাখা। খাসভাবে এ দিনটিতে রোযা রাখার ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল নেই। আর যে আমলের সহীহ কোন ভিত্তি নেই, সেই আমল করা শরীয়ত অনুমোদন করে না। সুতরাং নির্দিষ্টভাবে এ দিনে রোযা রাখা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

এ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা নিতামত্ম দুর্বল অথবা বানোয়াট- যার উপর আমল করা যায় না। এতদ্বসংক্রামত্ম হাদীসের পর্যালোচনা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে যে ব্যক্তি নিয়মিত আইয়ামে বীযের রোযা রাখে সে শাবান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখতে পারবে।

৫১
শবে বরাতের করণীয় বিষয়সমূহ
এ উপলক্ষে মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকের উপর কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন-

১. শবে বরাত সম্পর্কে জানা :

যেকোন ইবাদাতের উপর আমল করার জন্য প্রধান করণীয় হচ্ছে সে সম্পর্কে আগে জানা। কেননা কোন বিষয়ে জানা না থাকলে সে বিষয়ে বিভ্রামিত্মতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর শবে বরাতের বিষয়টি এমনিতেই বিতর্কিত। সুতরাং এ সম্পর্কে জানা অত্যাবশ্যক।

২. শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা :

প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে, সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করা। সুতরাং যেসব লোক শবে বরাত পালন করবে তাদেরকে এ ব্যাপারে যথাসাধ্য সতর্ক করতে হবে। যাতে করে মুসলিম সমাজ থেকে শবে বরাতে সংঘটিত বিদআতসমূহ দূর হয়ে যায়।

৩. শাবান মাসের করণীয় বিষয়সমূহ পালন করা :

শবে বরাত যেহেতু শাবান মাসেই পালন করা হয়, সুতরাং আমাদের উচিত শাবান মাসের সুন্নাত ইবাদাতসমূহ পালন করা। যাতে করে এর অসীলায় অশেষ সওয়াব অর্জন করা যায়। সামনে শাবান মাসের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

৫২
শাবান মাসের করণীয়
১. বেশি বেশি রোযা রাখা :

শাবান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হচ্ছে বেশি বেশি সিয়াম পালন করা। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাস ব্যতীত এ মাসেই সবচেয়ে বেশি নফল রোযা রাখতেন। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ سَلَمَةَ قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ فَقُلْتُ أَخْبِرِيْنِىْ عَنْ صِيَامِ رَسُوْلِ اللهِ قَالَتْ كَانَ يَصُوْمُ حَتّٰى نَقُوْلَ قَدْ صَامَ وَيُفْطِرُ حَتّٰى نَقُوْلَ قَدْ أَفْطَرَ وَلَمْ يَكُنْ يَصُوْمُ شَهْراً أَكْثَرَ مِنْ شَعْبَانَ كَانَ يَصُوْمُ شَعْبَانَ إِلَّا قَلِيْلًا كَانَ يَصُوْمُ شَعْبَانَ كُلَّه

আবু সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর রোযা সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন। তখন তিনি বললেন, তিনি কোন সময় এমনভাবে রোযা রাখা শুরু করতেন যে, আমরা বলতাম- তিনি রোযা রাখতেই থাকবেন। আবার কোন সময় তিনি এমনভাবে রোযা ছেড়ে দিতেন যে, আমরা বলতাম- তিনি আর রোযা রাখবেন না। আর তিনি শাবান মাসের চেয়ে অধিক সংখ্যক রোযা অন্য কোন মাসে রাখতেন না। তিনি শাবানের কিছুদিন বাদ দিয়ে বাকি দিনগুলো রোযা রাখতেন। [নাসাঈ, হা/২১৭৯; সহীহ বুখারী, হা/১৯৭০; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৪১৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০২৪।]

উল্লেখ্য যে, এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করা যাবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ কখনো এরূপ করেননি। সুতরাং যদি এরূপ করা হয় তাহলে সেটা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হবে।

২. শাবান মাসের শেষ তারিখে রোযা না রাখা :

শাবান মাসের পরের মাসই হচ্ছে রমাযান মাস। সুতরাং রমাযান মাসের প্রসত্মুতির মাস হচ্ছে শাবান মাস। অপরদিকে রমাযান মাসের রোযা রাখা হচ্ছে ফরয এবং শাবান মাসের রোযা রাখা নফল। সুতরাং ফরয ও নফল যেন মিলে না যায় এবং ফরযকে নফল থেকে পার্থক্য করা যায়- এ কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাসের আগের দিন তথা শাবান মাসের শেষ দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ لَا يَتَقَدَّمَنَّ أَحَدُكُمْ رَمَضَانَ بِصَوْمِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ إِلَّا أَنْ يَّكُوْنَ رَجُلٌ كَانَ يَصُوْمُ صَوْمَهُ فَلْيَصُمْ ذٰلِكَ الْيَوْمَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন একটি বা দু’টি রোযা রেখে রমাযান মাসকে স্বাগত না জানায়। তবে তার কথা ভিন্ন, যে সেদিনে রোযা রাখায় অভ্যস্ত। [সহীহ বুখারী, হা/১৮১৫; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৭০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২৭২; মিশকাত, হা/১৯৭৩।]

যেমন- কেউ প্রতি সোমবার রোযা রাখে। সুতরাং রমাযানের আগের দিন সোমবার হলে সে রোযা রাখতে পারে।

৩. আইয়ামে বীযের রোযা রাখা :

যে ব্যক্তি নিয়মিত আইয়ামে বীযের রোযা রাখে তার জন্য শাবান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখা দোষণীয় নয়। বরং নিয়মিত আমল হিসেবে সে পরিপূর্ণ সওয়াব অর্জন করবে। কারণ আইয়ামে বীযের রোযার ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ ذَرٍّ يَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ يَا أَبَا ذَرٍّ إِذَا صُمْتَ مِنَ الشَّهْرِ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ وَخَمْسَ عَشْرَةَ

আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, হে আবু যর! তুমি যখন প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখবে তখন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখবে। [তিরমিযী, হা/৭৬১; বায়হাকী, হা/৮২২৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৩৮; মিশকাত, হা/২০৫৭।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ مِلْحَانَ الْقَيْسِىِّ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يَأْمُرُنَا أَنْ نَّصُوْمَ الْبِيْضَ ثَلَاثَ عَشْرَةَ وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ وَخَمْسَ عَشْرَةَ

ইবনে মিলহান আল-কাইসী (রহ.) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে বীযের দিনগুলোতে অর্থাৎ প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন। [আবু দাউদ, হা/২৪৫১; বায়হাকী, হা/৮৭০৩; নাসাঈ, হা/২৭৩৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৩৯।]

অতএব যারা নির্দিষ্ট করে এ দিনগুলোতে রোযা রাখতে অভ্যসত্ম, তারা শাবান মাসের এ দিনগুলোতেও রোযা রাখতে পারবে। আর এ কারণে সে অনেক সওয়াবও অর্জন করতে পারবে।

৪. নিয়মিত আমলসমূহ পালন করা :

আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হচ্ছে ঐ আমল, যা সর্বদা পালন করা হয়। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّهَا قَالَتْ سُئِلَ النَّبِيُّ أَيُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ وَقَالَ اكْلَفُوْا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيْقُوْنَ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বললেন, যে আমলটি সর্বদা পালন করা হয়- যদিও তা পরিমাণে কম হয়। তিনি আরো বলেছেন যে, তোমরা ঐ পরিমাণ আমল করতে থাকো, যা করতে তোমরা সক্ষম। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩১৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩১৭৪; বায়হাকী, হা/৪৭৪৭; মিশকাত, হা/১২৪২।]

সুতরাং যে ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে সে ব্যক্তি শাবান মাসের মধ্য রাত্রিতেও তাহাজ্জুদের সালাতসহ অন্যান্য ইবাদাত করতে পারবে। আর নফল সালাতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সালাত হচ্ছে তাহাজ্জুদের সালাত। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ - -قَالَ سُئِلَ اَىُّ الصَّلَاةِ اَفْضَلُ بَعْدَ الْمَكْتُوْبَةِ وَاَىُّ الصِّيَامِ اَفْضَلُ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ فَقَالَ اَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ الْمَكْتُوْبَةِ الصَّلَاةُ فِى جَوْفِ اللَّيْلِ وَاَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ صِيَامُ شَهْرِ اللهِ الْمُحَرَّمِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, ফরয সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত কোনটি এবং রমাযান মাসের সিয়ামের পর সবচেয়ে উত্তম সিয়াম কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন, ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো মধ্য রাতের সালাত। আর রমাযান মাসের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম হলো মুহাররম মাসের সিয়াম। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮০১৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১১৩৪।]

৫৩
রমাযান মাস
রমাযান মাস ফযীলতের মাস- এতে কোন সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যথেষ্ট বর্ণনা রয়েছে। পুরো রমাযান মাসে রোযা রাখা আল্লাহ তা‘আলা ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা বাকারা- ১৮৩)

৫৪
রমাযান মাসের করণীয়
রমাযানের পুরো মাস রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। এছাড়াও এ মাসের মধ্যে আরো অনেক আমল রয়েছে, যার অনেক সওয়াব ও ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন-

১. কুরআন পাঠ করা,

২. তারাবির নামায পড়া,

৩. রমাযান মাসে উমরা করা,

৪. রমাযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা,

৫. মানুষকে ইফতার করানো,

৬. বেশি বেশি দান-সাদাকা করা ইত্যাদি।

অতএব যার যতটুকু সামর্থ হয় সে অনুযায়ী এসব আমল করে যাওয়া উচিত। রমাযান মাসের বিসত্মারিত আলোচনা করা হয়েছে আমাদের ‘সিয়াম ও যাকাত’ বইয়ের মধ্যে।

৫৫
রমাযান মাসে মানুষের ভুলসমূহ
১. রমাযানের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা :

অধিকাংশ মানুষই রমাযানের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে জানে না। আবার অনেকে জানলেও তা বাসত্মবায়ন করে না। অথচ রমাযান মাস হচ্ছে বিশেষ ফযীলতের মাস এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। সুতরাং মানুষের উচিত হলো, এ মাসটিকে গনীমত মনে করে এর রাত ও দিনগুলোকে নেক কাজের মাধ্যমে অতিবাহিত করা।

২. রমাযান আসলে মন খারাপ করা :

অনেক লোক আছে, যারা রমাযান মাস আসলে মন খারাপ করে থাকে। কারণ আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং আল্লাহর দ্বীন পালনের ইচ্ছা দুর্বল। শয়তান তাদেরকে সবসময় পাপে জড়িয়ে রাখে। এজন্য রমাযান মাসে তারা পাপ কাজ করতে কিছুটা হলেও বাধাগ্রসত্ম হয়। যেমন- অনেক ধূমপায়ী আছে, যারা রামাযান মাসে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে পারে না। এজন্য তারা রমাযান মাসকে ঘৃণা করে। কিন্তু প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হলো এ মাসটিকে স্বাগত জানানো এবং কৃত অপরাধ থেকে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।

৩. অলসতা করা ও অধিক ঘুমানো :

অনেক মানুষ রয়েছে, যারা রমাযান মাসে বেশি বেশি ঘুমায়। সাহরী খাওয়ার পর অনেকে দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু এমনটি করা উচিত নয়। যেহেতু রমাযানের সময়গুলো অত্যমত্ম মূল্যবান। তাই সে সময়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

৪. রাতে দেরিতে ঘুমানো :

অনেক মানুষ রয়েছে, যারা রমাযান মাসে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। অনেকে তারাবির নামাযের পরও গল্পগুজব করে অনেক সময় কাটিয়ে দেয়। যার ফলে রাতে তাদের ঘুম কম হয়। এজন্য তাদের আমলেও ব্যাঘাত ঘটে। তাই উচিত হলো, তারাবির নামাযের পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া এবং শেষ রাতে উঠে তওবা-ইসেত্মগফার করা এবং সাহরী খাওয়া।

৫. সময় নষ্ট করা :

অনেক মানুষই সময়ের মূল্য দিতে জানে না। বিশেষ করে রমাযানের মতো এত মূল্যবান একটি মাসেও তারা সময়কে অবহেলায় কাটিয়ে দেয়। সামনের বছর এমন একটি ফযীলতপূর্ণ মাস জীবনে আর নাও আসতে পারে। তাই সময়কে অবহেলায় না কাটিয়ে নেক আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করার চেষ্টা করা সকলের কর্তব্য।

৬. বেশি খাওয়া দাওয়া করা :

রমাযান মাস হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাস। পেটকে ক্ষুধার্ত রেখে আত্মাকে উন্নত করার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের লক্ষে সিয়াম সাধনা করা উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, রমাযান মাসে খাওয়া-দাওয়ার ধুমধাম আরো বেড়ে যায়। ইফতারিতে কত আইটেম করা যাবে এ নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। আবার সাহরীর সময়ও অনেকে এত বেশি আহার করে যে, শরীর অলস হয়ে পড়ে। যার ফলে কাজকর্ম ও আমলে বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং রমাযান মাসে পরিমিত আহার করা উচিত। যাতে করে রোযার উদ্দেশ্য সফল হয়।

৭. অযথা সফর করা :

রমাযান মাসটি হচ্ছে নেক আমল ও আত্মশুদ্ধির মাস। সুতরাং এ মাসে অযথা ভ্রমণ না করে সময়গুলোকে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা উচিত।

৮. পরিবারকে সালাতের জন্য না জাগানো :

রমাযান মাসে পরিবারের লোকজনকে সৎকর্মের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা উচিত। বিশেষ করে রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে ইবাদাত বন্দেগীতে কাটানো উচিত। নবী ﷺ এ সময় তার পরিবারকে রাত্রে জাগিয়ে দিতেন।

৯. গীবত করা :

অনেক মানুষ রয়েছে, যারা রমাযান মাসেও মানুষের গীবত করে। অথচ আল্লাহর নবী ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং মিথ্যা আমল ছাড়তে পারবে না তার রোযা রাখাতে কোন লাভ হবে না। সুতরাং সব সময় আমাদের উচিত গীবত, সমালোচনা, মিথ্যা ও চোগলখোরী থেকে নিজেদেরকে হেফাযত করা।

১০. গান শ্রবণ করা :

অনেক লোক এমনিতেই গান-বাজনা শুনতে অভ্যসত্ম। এমনকি তারা রমাযান মাসেও এসব পাপ কাজে লিপ্ত থাকে। সুতরাং তাদের উচিত হলো, এসব পাপ কাজ থেকে তওবা করে বাকি জীবন এরূপ কর্ম থেকে বেঁচে থাকা।

১১. দেরিতে ইফতার করা :

অনেক মানুষ সময় হওয়ার পর দেরিতে ইফতার করে থাকে। অথচ সূর্য ডুবার সাথে সাথে ইফতার করা সুন্নাত।

১২. রমাযান মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা :

সালমান ফারসী (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, যেখানে বলা হয়েছে রমাযান মাসের প্রথম দশ দিন রহমতের, মাঝখানের দশ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ দশদিন নাজাতের। [ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৮৭; শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৬০৮; সিলসিলা যঈফাহ, হা/৮৭১; মিশকাত, হা/১৯৬৫। ইমাম আ‘যামী (রহ.) বলেন, হাদীসের সনদটি যঈফ।]

এ সংক্রামত্ম হাদীসটির সনদ সহীহ নয়। আর সত্যিকার অর্থে আল্লাহ তা‘আলার রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত সর্বদা উন্মুক্ত। যখনই কোন বান্দা তাঁর কাছে তওবা করে তিনি ইচ্ছা করলে তখনই তাকে মুক্তি দিতে পারেন। এজন্য আল্লাহ তা‘আলার এই অপূর্ব গুণাবলিসমূহকে কয়েকটি দিনে নির্দিষ্ট করে নেয়া উচিত নয়।

৫৬
লাইলাতুল কদর
আরবি ভাষায় لَيْلَةٌ (লাইলাতুন) অর্থ হলো রাত। আর ক্বাফ বর্ণে যবর ও দাল বর্ণে সাকিন দিয়ে اَلْقَدْرُ ‘আলক্বাদ্র’ শব্দের অর্থ হলো- সম্মান ও মর্যাদা। এদিক থেকে লাইলাতুল কদর এর অর্থ হলো সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী।

আবার দাল বর্ণে যবর দিয়ে ‘ক্বাদারুন’ শব্দের অর্থ হলো পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা। এ হিসেবে লাইলাতুল কদর অর্থ হলো, ভাগ্য রজনী, তাকদীরের ফায়সালা করার রাত ইত্যাদি।

কদরের রাত আল্লাহ তা‘আলার এক বিশেষ নিয়ামত। এ রাতের রয়েছে বিশেষ সম্মান ও ফযীলত। এ রাতের নামে পবিত্র কুরআনে একটি সূরা রয়েছে।

৫৭
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফযীলত
এ রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে :

এ রাতেই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মর্যাদাপূর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ إِنَّاۤ أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ﴾

নিশ্চয় আমি এটাকে (আল-কুরআনকে) কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি।

(সূরা কদর- ১)

এ রাতে কুরআন নাযিলের ধারা শুরু হয়, পরে প্রয়োজন অনুপাতে পর্যায়ক্রমে তা নবী ﷺ এর উপর নাযিল হতে থাকে। দীর্ঘ তেইশ বছরে তা পূর্ণতা লাভ করেছে।

এ রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম :

এ রাতের মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَاۤ أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ﴾

তুমি কি জান কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

(সূরা কদর- ২, ৩)

এখানে হাজার মাস বলতে কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বেশি বুঝানোটাই এর উদ্দেশ্য। তার মানে এ রাতটি হাজার হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

উত্তম কথাটির দু’টি ব্যাখ্যা আছে এবং উভয়টিই সঠিক। যথা-

১. কদরের রাতটি এমন ফযীলতপূর্ণ যে, এ রাতের ইবাদাত-বন্দেগী হাজার মাসের ইবাদাত-বন্দেগীর চেয়ে উত্তম। নবী ﷺ বলেছেন,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমাযান মাসে কিয়ামুল লাইল করবে তার পেছনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/২৪৯; সহীহ বুখারী, হা/২০০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৭৫; আবু দাউদ, হা/১৩৭৩; তিরমিযী, হা/৮০৮।]

২. এ রাতটি এদিক দিয়ে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম যে, এ রাতে বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করে মানুষের এত কল্যাণ সাধন করা হয়েছে, যা মানব জাতির ইতিহাসে হাজার মাসেও করা হয়নি। কারণ এ কুরআন একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে তাদেরকে সভ্য, ভদ্র ও চরিত্রবান করে উন্নতি ও কল্যাণের চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। কুরআনের বাণী শুনে পাথরের মতো কঠিন অন্তরগুলো পানির মতো নরম হয়ে গিয়েছিল, এর মুজিযা ও মাধুর্যের সামনে সারা বিশ্ব অবাক, হতভম্ব ও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সূরা দুখানে এ কথাটি এভাবে বলা হয়েছে,

﴿ إِنَّاۤ أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ﴾

আমি একে এক বরকতময় রাত্রে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা দুখান- ৩)

এখানে কদরের রাতকে বরকতময় বলা হয়েছে। যেহেতু এ রাতে কল্যাণ ও বরকতের এমন ধারা শুরু হয়েছিল, যা সারা দুনিয়ায় এখনো পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

এ রাতে অনেক ফেরেশতা নাযিল হয় :

কদরের রাতের বিশেষত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿تَنَزَّلُ الْمَلَآئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِّنْ كُلِّ أَمْرٍ﴾

এ রাতে জিবরাঈল ও অন্যান্য ফেরেশতারা তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। (সূরা কদর- ৪)

এ রাত্রে অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন। হাদীসে এসেছে,

إِنَّ الْمَلَائِكَةَ تِلْكَ اللَّيْلَةِ أَكْثَرَ فِي الْأَرْضِ مِنْ عَدَدِ الْحَصٰى

কদরের রাতে ফেরেশতাদের সংখ্যা পৃথিবীর সমুদয় কংকরের চেয়েও বেশি হয়। [সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২১৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৭৪৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯৪৪৭; জামেউস সগীর, হা/৯৬০৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২২০৫।]

এই অসংখ্য ফেরেশতারা এ রাতে ইবাদাতকারীদের জন্য দু‘আ করে থাকেন।

এ রাতেই ভাগ্যের ফায়সালা হয় :

এ রাতে বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করা হয়। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

﴿فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ﴾

এই রাতে সব ব্যাপারে জ্ঞানগর্ভ ফায়সালা হয়ে থাকে। (সূরা দুখান- ৪)

﴿سَلَامٌ هِيَ حَتّٰى مَطْلَعِ الْفَجْرِ﴾

এ রাতটি ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি শান্তিময়। (সূরা কদর- ৫)

অর্থাৎ এ রাতে শুধু শান্তি আর শান্তি, মঙ্গল আর মঙ্গল। এতে অনিষ্টের নাম গন্ধও নেই। অনাবিল শান্তিপূর্ণ এ রজনীর অফুরন্ত শান্তি ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

৫৮
লাইলাতুল কদরে করণীয়
১. বেশি বেশি ইবাদাত করা :

কদরের রাতে বেশি করে নফল ইবাদাত করা জরুরি। নবী ﷺ রমাযানের শেষ দশক আসলে ইবাদাতের দিকে অত্যধিক মনোনিবেশ করতেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهٗ وَأَحْيَا لَيْلَهٗ وَأَيْقَظَ أَهْلَهٗ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযানের শেষ দশকের রাতগুলোতে কোমর কষে বাঁধতেন। তিনি নিজে জাগতেন এবং পরিবারের লোকদেরকেও জাগাতেন। [সহীহ বুখারী, হা/২০২৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪২২; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৮২৯; মিশকাত, হা/২০৯০।]

২. লাইলাতুল কদরের বিশেষ দু‘আ পড়া :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি নবী ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তবে কী পড়ব? তিনি বলেন- এ দু‘আ পড়বে,

اَللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউউন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী।

অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি বড়ই ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি ভালোবাস। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। [তিরমিযী, হা/৩৫১৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩৮৫০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪২৩; মিশকাত, হা/২০৯১।]

যেসকল আমল কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে সেসকল আমল যার যতটুকু সামর্থ হয় পালন করে যাবে। যেমন-

 কুরআন তিলাওয়াত করা।

 তাসবীহ পাঠ করা।

 নবী ﷺ এর প্রতি দরূদ পাঠ করা।

 দ্বীনী ইলম চর্চা করা।

 নফল সালাত আদায় করা।

নফলজাতীয় ইবাদাতের মধ্যে নফল নামাযের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ নামায এমন এক ইবাদাত, যার মধ্যে অনেক ইবাদাতের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। যেমন- নামাযের মধ্যে তিলাওয়াত আছে, তাসবীহ আছে, দরূদ আছে, দু‘আ আছে এবং রুকূ, সিজদা ও কিয়াম আছে।

হাদীসেও নবী ﷺ বেশি বেশি নফল সালাত আদায়ের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ رَبِيْعَةَ بْنِ كَعْبٍ اَلْأَسْلَمِىِّ يَقُوْلُ كُنْتُ أَبِيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ - فَأَتَيْتُه بِوُضُوْئِه وَبِحَاجَتِه فَقَالَ سَلْنِىْ فَقُلْتُ مُرَافَقَتَكَ فِى الْجَنَّةِ قَالَ أَوَغَيْرَ ذٰلِكَ قُلْتُ هُوَ ذَاكَ قَالَ فَأَعِنِّىْ عَلٰى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُوْدِ

রাবি‘আ ইবনে কাব আসলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে রাত কাটালাম। তখন আমি তাঁর জন্য অযু ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানি নিয়ে আসলাম। তখন তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে (যা খুশি) চাও। তখন আমি বললাম, আমি আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। তারপর নবী ﷺ বললেন, (এটা ছাড়া) তোমার অন্য কিছু চাওয়ার আছে কি? আমি বললাম, না- বরং এটাই চাই। তখন তিনি বললেন, তাহলে তুমি তোমার ব্যাপারে বেশি বেশি সিজদা দ্বারা আমাকে সহযোগিতা করো। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৮৯; আবু দাউদ, হা/১৩২২; বায়হাকী, হা/৪৩৪৪; নাসাঈ, হা/১১৩৭; মিশকাত, হা/৮৯৬।]

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ أَقْرَبُ مَا يَكُوْنُ الْعَبْدُ مِنْ رَّبِّه وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয়, যখন সে সিজদায় থাকে। অতএব তোমরা অধিক পরিমাণে দু‘আ করো। [সহীহ মুসলিম, হা/১১১১; আবু দাউদ, হা/৮৭৫; নাসাঈ, হা/১১৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৪২; মিশকাত, হা/৮৯৪।]

এসব হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, নফল নামাযের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই আমাদের উচিত সর্বদা নফল নামাযের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। বিশেষ করে যে নামাযগুলো হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, তার দিকে খেয়াল রাখা। যেমন-

১. তাহাজ্জুদ,

২. সালাতুয যুহা ,

৩. সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা ইত্যাদি।

এছাড়াও অনির্দিষ্টভাবে যেকোন সময় সামর্থানুযায়ী নফল সালাত আদায় করা যায়। বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করা যাবে। স্বাভাবিক নামাযের ন্যায় দু’রাকআত দু’রাকআত করে যেকোন সূরা দিয়ে যত রাকআত সামর্থ হবে পড়তে থাকবে।

৫৯
লাইলাতুল কদরে বর্জনীয়
২৭ তারিখকে নির্দিষ্ট করা :

সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে লাইলাতুল কদরের কোন নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া না গেলেও অনেকে রমাযান মাসের ২৭ তারিখকে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। ফলে অনেক সাধারণ জনগণের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় যে, তারা কেবল এই তারিখকেই লাইলাতুল কদর হিসেবে পালন করে থাকে। অতএব আমাদের উচিত লাইলাতুল কদরকে ২৭ তারিখের সাথে নির্দিষ্ট না করা। তাহলে লাইলাতুল কদরের অন্যান্য রাত্রির গুরুত্বও বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষ আমলের প্রতি বেশি মনোযোগী হবে।

বিদআতী আমল করা :

রমাযান মাসের শেষ রাতসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাত। এ রাতগুলোতে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ আমলের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিতেন। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন নিয়মের কথা প্রমাণিত নয়। কিন্তু এরপরও বর্তমান সমাজে লাইলাতুল কদর উপলক্ষে নানা ধরনের বানোয়াটী ইবাদাত প্রচলিত রয়েছে। এ রাতে নামায আদায় করতে গিয়ে কোন বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না। যেমন- সূরা ফাতিহার পর সূরা কদর এত বার পড়তে হবে, অমুক সূরা এত বার পড়তে হবে ইত্যাদি। এসব কথা অনেক বই-পুসত্মকে পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। নামাযী ব্যক্তি কুরআন মাজীদের যেখান থেকে ইচ্ছা সেখান থেকে তিলাওয়াত করবে। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন,

﴿فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ﴾

কুরআন হতে যতটুকু সহজসাধ্য হয়, তা-ই পাঠ করো। (সূরা মুয্যাম্মিল- ২০)

৬০
লাইলাতুল কদরের তারিখ
কদরের রাত কোন্ তারিখে- তা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে এ রাতটি রমাযান মাসে হওয়ার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। যেমন সূরা কদরের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘কুরআন কদরের রাতে নাযিল হয়েছে।’’ আবার সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘রমাযান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে।’’ সুতরাং এ আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে এটা নির্দিষ্ট হয়ে গেল যে, কদরের রাতটি রমাযান মাসেই রয়েছে।

এখন কথা হলো, রমাযান মাসের কোন্ রাতটি লাইলাতুল কদর? এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, লাইলাতুল কদরকে তোমরা রমাযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে খোঁজ করো। [সহীহ বুখারী, হা/২০১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪৮৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৬১৬; মিশকাত, হা/২০৮৩।]

এ হাদীস দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এ রাতটি রমাযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোতে রয়েছে। আবার এ রাতটি পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ এ বেজোড় তারিখগুলোর মধ্যে একেক বছর একেক তারিখে হতে পারে।

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ কদরের রাতের তারিখ জানানোর জন্য বের হলেন, তখন মুসলিমদের দু’ব্যক্তি বিতর্কে লিপ্ত হলো, ফলে নবী ﷺ-কে এ রাতটি ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬৯৬; সহীহ বুখারী, হা/৪৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৫৯২।]

তবে এ রাতটি নির্দিষ্ট না করার মধ্যে বিরাট কল্যাণ ও হিকমত রয়েছে। এটি নির্দিষ্ট থাকলে কেবল ঐ তারিখেই মানুষ আল্লাহর ইবাদাত করত। এখন অনির্দিষ্ট থাকাতে শেষ দশকের বেজোড় পাঁচটি রাতেই আললাহর বান্দারা বেশি বেশি ইবাদাত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পাবে।

৬১
শাওয়াল মাস ঈদের দিন
عِيْدٌ (ঈদ) শব্দটি عَوْدٌ (আওদুন) শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে, বার বার ফিরে আসা। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার এ দু’টি দিন প্রতি বছর একবার করে ফিরে আসে বিধায় এ দু’টি দিনকে ঈদের দিন বলা হয়েছে। তাছাড়া ঈদের অন্য অর্থ হচ্ছে, আনন্দ, উৎসব ইত্যাদি। মুসলিম সমাজ এ দু’টি দিনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে এবং আনন্দ করে, তাই এ দিনগুলোকে ঈদের দিন বলা হয়।

মুসলিমদের ঈদ হলো দু’দিন :

মুসলিমদের ঈদ হলো দু’দিন। সুতরাং ঈদে মীলাদুন নবী বা অন্য কোন নামে আরো ঈদ প্রচলন করা নিঃসন্দেহে বিদআত, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

ঈদের প্রবর্তন :

মহানবী ﷺ মদিনায় হিজরত করার পর দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে প্রথম ঈদের সালাত আদায় করেন। নবী ﷺ বলেছেন,

يَا أَبَا بَكْرٍ إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيْدًا وَهٰذَا عِيْدُنَا

হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতিরই আনন্দোৎসব রয়েছে। আর আমাদের আনন্দোৎসব হচ্ছে এটা (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা)। [সহীহ বুখারী, হা/৯৫২; সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৯৮; মিশকাত, হা/১৪৩২।]

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ মদিনায় এলেন, তখন সেখানকার অধিবাসীদের দুটি উৎসব ছিল, যাতে তারা আনন্দ করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে প্রশ্ন করেন, এই দু’দিনে তোমরা কী কর? তারা বলল, আমরা ইসলাম আগমনের পূর্বে এ দু’দিন আনন্দোৎসব করতাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ওগুলোর পরিবর্তে আরো উত্তম কিছু দান করেছেন। একটি হলো রোযা ভাঙ্গার আনন্দের দিন ‘‘ঈদুল ফিতর’’ এবং অপরটি হলো কুরবানীর দিন ‘‘ঈদুল আযহা’’। [নাসাঈ, হা/১৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৮৫০; বায়হাকী, হা/৫৯১৮।]

মদিনাবাসীগণ শুধু খেলাধুলা ও আমোদ-ফূর্তির জন্য যে দুটি দিন নির্ধারণ করে নিয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা তা পরিবর্তন করে এমন দুটি দিন দান করলেন যে দিন দুটিতে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর যিকির ও তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফূর্তি, সাজ-সজ্জা ও খাওয়া-দাওয়া করা হয়।

৬২
ঈদের দিনে করণীয়
১. ঈদের দিন সকালে গোসল করা :

ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মুসত্মাহাব। কেননা এ দিন সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। যে কারণে জুমু‘আর দিন গোসল করা মুসত্মাহাব সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে গোসল করা মুসত্মাহাব। হাদীসে এসেছে,

عَنْ نَافِعٍ أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يَغْتَسِلُ يَوْمَ الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ يَغْدُوَ إِلَى الْمُصَلّٰى

নাফে‘ (রহ.) হতে বর্ণিত। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৪২৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৩৪৪; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৫৭৫৩।]

২. শালীনতা বজায় রেখে যথাসম্ভব উত্তম পোশাক পরিধান করা :

আল্লাহর নিয়ামতের প্রকাশ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করণার্থে ঈদের দিন সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা ভালো। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - إِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ يُّرٰى أَثَرُ نِعْمَتِه عَلٰى عَبْدِه

আমর ইবনে শু‘আইব (রহ.) তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। [তিরমিযী, হা/২৮১৯; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৭১৮৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২৯০; মিশকাত, হা/৪৩৫০।]

৩. ঈদুল আযহার দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া :

عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ - لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّٰى يَطْعَمَ وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ الْأَضْحٰى حَتّٰى يُصَلِّىَ

বুরায়দা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না এবং ঈদুল আযহার দিন সালাত আদায় না করে কিছু খেতেন না। [তিরমিযী, হা/৫৪২; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৫৬; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১০৮৮; মিশকাত, হা/১৪৪০।]

৪. ঈদুল ফিতরের দিন কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত :

عَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ لَا يَغْدُوْ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّٰى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ وَفِىْ رِوَايَةٍ وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ‘ঈদুল ফিতর’ এর দিন কিছু খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি তা বেজোড় সংখ্যায় খেতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৯৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২২৯০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৮১৪; মিশকাত, হা/১৪৩৩।]

৫. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া :

عَنْ عَلِىِّ بْنِ أَبِىْ طَالِبٍ قَالَ مِنَ السُّنَّةِ أَنْ تَخْرُجَ إِلَى الْعِيْدِ مَاشِيًا وَأَنْ تَأْكُلَ شَيْئًا قَبْلَ أَنْ تَخْرُجَ قَالَ أَبُوْ عِيْسٰى هٰذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ وَالْعَمَلُ عَلٰى هٰذَا الْحَدِيْثِ عِنْدَ أَكْثَرِ أَهْلِ الْعِلْمِ يَسْتَحِبُّوْنَ أَنْ يَّخْرُجَ الرَّجُلُ إِلَى الْعِيْدِ مَاشِيًا وَأَنْ يَّأْكُلَ شَيْئًا قَبْلَ أَنْ يَّخْرُجَ لِصَلَاةِ الْفِطْرِ قَالَ أَبُوْ عِيْسٰى وَيُسْتَحَبُّ أَنْ لَّا يَرْكَبَ إِلَّا مِنْ عُذْرٍ

আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সুন্নাত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং (ঈদগাহের উদ্দেশ্যে) বের হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া। ইমাম তিরমিযী (রহ.) হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান। তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ আলেম এ অনুযায়ী আমল করেন এবং তাদের মত হলো, পুরুষরা ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাবে এবং ঈদুল ফিতরের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে কিছু খেয়ে নেবে। ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, মুসত্মাহাব হচ্ছে, গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহণ করবে না। [তিরমিযী, হা/৫৩০।]

৬. ঈদগাহে আসা-যাওয়ার সময় পথ পরিবর্তন করা :

عَنْ جَابِرٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيْدٍ خَالَفَ الطَّرِيْقَ

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ ঈদের দিন রাসত্মা পরিবর্তন করতেন অর্থাৎ এক পথে যেতেন এবং অন্য পথে আসতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৯৮৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১১০৮; জামেউস সগীর, হা/৮৯০৭; মিশকাত, হা/১৪৩৪।]

৭. ঈদের দিন তাকবীর পাঠ করা :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ﴾

আল্লাহ তা‘আলা চান তোমরা রোযার দিনগুলো (রমাযানের সংখ্যা) পূর্ণ করো এবং আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করো, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিখিয়েছেন। তাহলে আশা করা যায়, তোমরা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবে। (সূরা বাকারা- ১৮৫)

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) এ আয়াতের প্রেক্ষিতে বলেন, প্রত্যেক রোযাদারের কর্তব্য হচ্ছে, শাওয়াল মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাকবীর বলতে থাকা- যতক্ষণ না ঈদগাহ থেকে ফিরে আসে। [ফাত্হুল বায়ান ১ম খন্ড ২৩৯ পৃষ্ঠা।]

ঈদুল ফিতরের দিন তাকবীরের প্রথম এবং শেষ সময় :

তাকবীর আরম্ভ হয় ঈদের জন্য বের হওয়ার সাথে সাথে এবং ঈদের সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার সময় শেষ হয়ে যায়। এক হাদীসে এসেছে,

عَنِ الزُّهْرِيِّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ فَيُكَبِّرُ حَتّٰى يَأْتِيَ الْمُصَلّٰى وَحَتّٰى يَقْضِيَ الصَّلَاةَ فَإِذَا قَضَى الصَّلَاةَ قَطَعَ التَّكْبِيْرَ

যুহরী (রহ.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল ফিতরের দিনে বের হতেন এবং ঈদগাহে পৌঁছা পর্যমত্ম তাকবীর দিতে থাকতেন। তারপর সালাত সমাপ্ত করতেন। অতঃপর যখন তিনি সালাত সমাপ্ত করতেন, তখন তাকবীর দেয়া বন্ধ করতেন। [সনদ মুরসাল : মুসান্নাফ ইবনু আবি শায়বা, হা/৫৬৬৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭১।]

নিচের বাক্যগুলোর মাধ্যমে তাকবীর পড়তে হয় :

اَللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ لَا اِلٰهَ إِلَّا اللهُ اَللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ وَ لِلّٰهِ الْحَمْدُ

উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হামদ।

অর্থ : আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন উপাস্য নেই, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। [উমদাতুল কারী ১০/৩১০।]

৬৩
মহিলারাও ঈদগাহে যাবে
আমাদের সমাজে মহিলাদের ঈদগাহে উপস্থিত হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয় না। অথচ মহিলারা ঈদগাহে যাওয়ার শুধু অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, আল্লাহর নবী তাদেরকে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নির্দেশও দিয়েছেন। নিচে এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো :

মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নির্দেশ :

عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ أَنْ نُخْرِجَهُنَّ فِي الْفِطْرِ وَالْأَضْحٰى اَلْعَوَاتِقَ وَالْحُيَّضَ وَذَوَاتِ الْخُدُوْرِ فَأَمَّا الْحُيَّضُ فَيَعْتَزِلْنَ الصَّلَاةَ وَيَشْهَدْنَ الْخَيْرَ وَدَعْوَةَ الْمُسْلِمِيْنَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِحْدَانَا لَا يَكُوْنُ لَهَا جِلْبَابٌ قَالَ لِتُلْبِسْهَا أُخْتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا

উম্মে আতিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, যেন আমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন সাবালিকা, ঋতুবতী এবং পর্দাশীল নারীদেরকে নিয়ে বের হই। অতঃপর ঋতুবতী নারীরা সালাত আদায় করা হতে পৃথক থাকতেন। কিন্তু তারা অন্যান্য উত্তম কাজসমূহ ও মুসলিমদের দু‘আয় অংশগ্রহণ করতেন। একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে এমন অনেক নারী আছে, যাদের কোন চাদর নেই। তখন তিনি বললেন, তাদের বোন যেন তাদেরকে চাদর ধার দেয়। [সহীহ বুখারী, হা/৩২৪; সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৮১৮।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَأْمُرُ بَنَاتَهٗ وَنِسَاءَهٗ أَنْ يَخْرُجْنَ فِي الْعِيْدَيْنِ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তার কন্যা ও স্ত্রীদেরকে দুই ঈদে বের হওয়ার নির্দেশ দিতেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৫৪; জামেউস সগীর, হা/৯০১৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২১১৫।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - خَرَجَ يَوْمَ أَضْحٰى أَوْ فِطْرٍ فَصَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَمْ يُصَلِّ قَبْلَهَا وَلَا بَعْدَهَا ثُمَّ أَتَى النِّسَاءَ وَمَعَهٗ بِلَالٌ فَأَمَرَهُنَّ بِالصَّدَقَةِ فَجَعَلَتِ الْمَرْأَةُ تُلْقِىْ خُرْصَهَا وَتُلْقِىْ سِخَابَهَا

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুলস্নাহ ﷺ একবার ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের দিন বের হলেন এবং দু’ রাকআত সালাত আদায় করলেন এবং এর পূর্বে ও পরে কোন সালাত আদায় করলেন না। অতঃপর তিনি মহিলাদের নিকট আসলেন। এ সময় তাঁর সাথে বিলাল (রাঃ) ছিলেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে সাদাকা করার আদেশ দেন। ফলে মহিলারা নিজ নিজ কানের রিং ও গলার হার সাদাকা করতে লাগল। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৪; বায়হাকী, হা/৬০২০; আবু দাউদ, হা/১১৬১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩৩।]

عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ كُنَّا نُؤْمَرُ أَنْ نَخْرُجَ يَوْمَ الْعِيْدِ حَتّٰى نُخْرِجَ الْبِكْرَ مِنْ خِدْرِهَا حَتّٰى نُخْرِجَ الْحُيَّضَ فَيَكُنَّ خَلْفَ النَّاسِ فَيُكَبِّرْنَ بِتَكْبِيْرِهِمْ وَيَدْعُوْنَ بِدُعَائِهِمْ يَرْجُوْنَ بَرَكَةَ ذٰلِكَ الْيَوْمِ وَطُهْرَتَهٗ

উম্মে আতিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ঈদের দিন আমাদের বের হওয়ার আদেশ দেয়া হতো। এমনকি আমরা কুমারী মেয়েদেরকেও অন্দর মহল হতে বের করতাম এবং ঋতুবতী মেয়েদেরকেও। তারা পুরুষদের পেছনে থাকত এবং তাদের তাকবীরের সাথে তাকবীর বলত ও তাদের দু’আর সাথে দু’আ করত। আর তারা সে দিনের বরকত এবং পবিত্রতার আশা করত। [সহীহ বুখারী, হা/৯৭১।]

উপরোক্ত হাদীসগুলো হতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ প্রাপ্তবয়স্কা, গৃহবাসিণী এবং ঋতুবতী মহিলাদেরকেও উভয় ঈদে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদেরকেও দুই ঈদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আরো প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ মহিলাদেরকে ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, যদি কোন মহিলার ওড়না/চাদর না থাকে তাহলে তাকে তার অপর বোনের চাদর ধার নিয়ে হলেও ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, ঋতুবতী মহিলারা নামাযের সময় নামায পড়া হতে বিরত থাকবে এবং অন্যান্য কল্যাণকর কাজে ও মুসলিমদের দু‘আয় শরীক হবে।

কিন্তু বড় অনুতাপের বিষয় হলো এই যে, মহিলাদের মসজিদে ও ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সহীহ হাদীস ও অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে অনেক মুসলিম সমাজে মহিলাদেরকে মসজিদ ও ঈদগাহে যাওয়া এবং মুসলিমদের দু‘আ, দ্বীন শিক্ষা ও ওয়াজ-নসীহত শ্রবণ করার ব্যবস্থা নেই।

৬৪
ঈদের সালাতের পূর্বে কোন ওয়াজ-নসীহত বা খুতবা নেই
ঈদের সালাত আদায়ের পরই ইমাম সাহেব খুতবা দেবেন। সালাত আদায়ের পূর্বে কোন খুতবা নেই। হাদীসে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন। ঈদগাহে প্রথমে সালাত শুরু করতেন। সালাত শেষে মানুষের দিকে ফিরে খুতবা দিতেন। এ খুতবাতে তিনি তাদের ওয়াজ করতেন, উপদেশ দিতেন, বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। আর এ অবস্থায় মানুষেরা তাদের কাতারে বসে থাকত। [সহীহ বুখারী, হা/৯৫৬; বায়হাকী, হা/৫৯২৯; মিশকাত, হা/১৪২৬।]

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ঈদের সালাতের পূর্বে কোন ওয়াজ-নসীহত বা খুতবা দেয়া যাবে না। ইমাম সাহেব ঈদগাহে এসে প্রথমে সালাত শুরু করে দেবেন। অতঃপর লোকদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ-নসীহত বা খুতবা প্রদান করবেন।

উল্লেখ্য যে, ঈদগাহে মাইকে ডাকাডাকি করা, সালাতের পূর্বে বিভিন্ন জনের বক্তব্য দেয়া সুন্নাতের খিলাফ।

৬৫
ঈদের সালাতের পর খুতবা হবে
ঈদের সালাতের পর ইমাম খুতবা দেবেন। সে খুতবায় তিনি আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রশংসা, গুণগান ও অধিক পরিমাণে তাকবীর পাঠ করবেন এবং দ্বীনি শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা করবেন। মুসল্লীরা মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনবেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ قَالَ شَهِدْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ - - الْعِيْدَ فَلَمَّا قَضَى الصَّلَاةَ قَالَ إِنَّا نَخْطُبُ فَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يَجْلِسَ لِلْخُطْبَةِ فَلْيَجْلِسْ وَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يَذْهَبَ فَلْيَذْهَبْ

আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ঈদে উপস্থিত হলাম। অতঃপর যখন তিনি (ঈদের) সালাত আদায় করা শেষ করলেন তখন বললেন, নিশ্চয় আমরা খুতবা দেব। অতএব খুতবা (শ্রবণ) এর জন্য যে বসা পছন্দ করে সে যেন বসে থাকে এবং যে চলে যেতে ইচ্ছা করে সে যেন চলে যায়। [আবু দাউদ, হা/১১৫৭; ইবনে মাজাহ, হা/১২৯০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১০৯৩; জামেউস সগীর, হা/৪০৫৩।]

ঈদের খুতবা শেষে সমবেতভাবে হাত উঠিয়ে দু‘আ করা সুন্নাতের খিলাফ :

ঈদের খুতবা শেষে সমবেতভাবে হাত উঠিয়ে দু‘আ করা সুন্নাত বিরোধী কাজ। নবী ﷺ ও সালফে সালেহীনের যুগে এর কোন প্রচলন ছিল না।

৬৬
ঈদের দিন কীভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করবে
ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো জায়েয আছে। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) জুবায়ের ইবনে নফী (রহ.) এর থেকে হাসান হওয়ার যোগ্যতা রাখে এমন সূত্রে বর্ণনা করেন, সাহাবীগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন,

تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। [ফাতহুল বারী, ২/৪৪৬ পৃঃ।]

‘‘ঈদ মুবারক’’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবীগণ এ বাক্য ব্যবহার করতেন এবং এতে রয়েছে পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছে দু‘আ।

মুআনাকা করা :

ঈদের দিন মুআনাকা করার কোন দলীল নেই। তবে সুন্নাত মনে না করে এবং সওয়াবের আশা না করে যদি কেউ মুআনাকা করে তাতে কোন অসুবিধা নেই। সাহাবীগণ পরস্পর সাক্ষাৎ করলে মুসাফাহা করতেন এবং সফর থেকে ফিরে আসলে মুআনাকা করতেন। [সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬৪৭।]

৬৭
ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া উচিত
আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সকল প্রকার মনোমালিন্য দূর করার জন্য ঈদ একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়। এসময় তাদের খোঁজ-খবর নেয়া উচিত। কেননা সম্পর্কচ্ছেদ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - قَالَ تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْاِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيْسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا إِلَّا رَجُلًا كَانَتْ بَيْنَه وَبَيْنَ أَخِيْهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ أَنْظِرُوْا هٰذَيْنِ حَتّٰى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوْا هٰذَيْنِ حَتّٰى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوْا هٰذَيْنِ حَتّٰى يَصْطَلِحَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে তাকে ব্যতীত সে দিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। কিন্তু ঐ দু’ভাইকে ক্ষমা করা হয় না, যাদের মাঝে হিংসা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে- যতক্ষণ না নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে নেয়। বলা হয়ে থাকে, এ দু’জনকে অবকাশ দাও, যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়। এ দু’জনকে অবকাশ দাও, যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়। এ দু’জনকে অবকাশ দাও, যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৬১৮; সহীহ মুসলিম, হা/৬৭০৯; আবু দাউদ, হা/৪৯১৮; তিরমিযী, হা/২০২৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০০০৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৭৬৬; মিশকাত, হা/৫০২৯।]

সুতরাং ঈদের সময় মাতা-পিতা, ভাই-বোন, খালা-ফুফু, চাচা-মামা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নেয়া উচিত। প্রয়োজনে তাদের সাথে সারাসরি দেখা করার উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িতে যাওয়া অথবা তাদেরকে নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা উচিত।

৬৮
ঈদের রাতের ফযীলত সংক্রামত্ম হাদীস সহীহ নয়
ঈদের রাতের ফযীলত সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণনা করা হয়ে থাকে। অথচ হাদীসটি সহীহ নয়। হাদীসটি হলো :

عَنْ أَبِيْ أُمَامَةَ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ مَنْ قَامَ لَيْلَتَيِ الْعِيْدَيْنِ مُحْتَسِبًا لِلّٰهِ لَمْ يَمُتْ قَلْبُه يَوْمُ تَمُوْتُ الْقُلُوْبُ

আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করে বলেন, যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় দুই ঈদের রাত্রি জাগরণ করবে, যেদিন সকল মানুষের অমত্মর মরে যাবে সেদিন তার অমত্মর মরবে না। [ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮২। শাইখ আলবানী হাদীসটিকে মাওযু বলেছেন (যঈফ ইবনে মাজাহ, হা/১৭৭২)]

৬৯
ঈদের দিন বর্জনীয় কাজসমূহ
১. ঈদের দিন খাস করে কবর যিয়ারত করা :

কবর যিয়ারত করা শরীয়ত সমর্থিত একটা নেক আমল। তবে এর কোন নির্দিষ্ট দিন নেই। সুতরাং ঈদের দিন কবর যিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরীয়তসম্মত নয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَا تَجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ قُبُوْرًا وَلَا تَجْعَلُوْا قَبْرِىْ عِيْدًا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা তোমাদের ঘরসমূহকে কবরে পরিণত করো না এবং আমার কবরে ঈদ উদযাপন করো না। [আবু দাউদ, হা/২০৪৪; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১১৫৯; মিশকাত, হা/৯২৬।]

২. কাফিরদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ করা :

মুসলিম সমাজের অনেকে চাল-চলনে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অথচ হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। [আবু দাউদ, হা/৪০৩৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৯৬৬; মু‘জামুল আওসাত, হা/৮৩২৭; জামেউস সগীর, হা/১১০৯৪; মুখতাসার ইরওয়ালুল গালীল, হা/২৩৮৪; মিশকাত, হা/৪৩৪৭।]

এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হলো, যে কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে কাফির হয়ে যাবে।

৩. পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ করা :

পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলার পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিন এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُتَشَبِّهِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঐ সকল পুরুষকে অভিশম্পাত করেছেন, যারা মহিলার বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল মহিলাকেও অভিশম্পাত করেছেন, যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫; আবু দাউদ, হা/৪০৯৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৯০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩১৫১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৬৮; মিশকাত, হা/৪৪২৯।]

৪. পর্দা লঙ্ঘন করা :

মহিলাদের খোলামেলা ও অশালীন পোশাকে রাসত্মাঘাটে বের হওয়া ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - ..... وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيْلَاتٌ مَائِلَاتٌ رُءُوْسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুললাহ ﷺ বলেছেন, অচিরেই এমন একদল মহিলার আগমন ঘটবে, যারা পোশাক পরিধান করেও যেন উলঙ্গ থাকবে। তারা অন্যদেরকে আকৃষ্ট করবে এবং তারাও অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার ঘ্রাণও পাবে না। যদিও তার ঘ্রাণ এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৭০৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৩৩৮৬; জামেউস সগীর, হা/৭২৪৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৩২৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৪৪; মিশকাত, হা/৩৫২৪।]

অনেককে দেখা যায় অন্যান্য দিনের চেয়ে ঈদের দিন গুনাহের কাজ বেশি করে। নিকটাত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা শরীয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : إِيَّاكُمْ وَالدُّخُوْلَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা মেয়েদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে। আনসারী সাহাবীদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! দেবর-ভাসুরের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? তিনি উত্তরে বললেন, দেবর-ভাসুর তো মৃত্যুর সমতুল্য। [সহীহ বুখারী, হা/৫২৩২; সহীহ মুসলিম, হা/৫৮০৩; তিরমিযী, হা/১১৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩৮৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৯১৭২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৯০১; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৩২৬১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪১৮১; শারহুস সুন্নাহ, হা/২২৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৫৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১৭৯৫৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৯০৮; মিশকাত, হা/৩১০২।]

এমনসব আত্মীয়, যারা স্বামীর সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম যেমন- স্বামীর আপন ভাই, চাচা, চাচাতো ভাই, মামা, মামাতো ভাই, খালু, খালাতো ভাই প্রমুখ তাদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করার কারণ হলো, এসকল আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমেই বেপর্দাজনিত বিপদ বেশি ঘটে থাকে। অথচ এ বিষয়ে আমাদের সমাজ খুবই অসতর্ক।

৫. গান-বাজনা করা :

বর্তমান সময়ে মানুষের কাছে গান-বাজনা অতি সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এটি একটি বড় ধরনের গুনাহের কাজ। আর ঈদের দিন এ গুনাহের কাজটা আরো বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। দেখে মনে হয় যেন এটি কোন মুসলিম সমাজের ঈদ নয়; বরং অন্য কোন ধর্মের অথবা জাতির আনন্দোৎসব। অথচ ইসলামী শরীয়তে গান ও বাদ্যযন্ত্রের নিষিদ্ধতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْزِّنٰى وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দলের আবির্ভাব ঘটবে, যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৫৯০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬৭৫৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৩১৭; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৩৩৩৯; জামেউস সগীর, হা/৯৫৯৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৬৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯১; মিশকাত, হা/৫৩৪৩।]

আল্লাহ তা‘আলা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দান করে মুসলিম উম্মাহকে এর মাধ্যমে জাহেলী ঈদ-উৎসব থেকে মুক্ত করেছেন। মুসলিমদের ঈদ হলো ইবাদাত, যা বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য দান করে। আর কাফিরদের ঈদ হলো এর বিপরীত; কেননা সেখানে কুফর ও গোমরাহী প্রদর্শন করা হয় এবং বিভিন্ন শয়তানী কর্মকান্ড সংঘটিত হয়। তাই বছরের অন্যান্য দিনের মতো ঈদের দিনও শয়তানী কর্মকান্ড বর্জন করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

৭০
শাওয়াল মাসের বিশেষ আমল
রমাযান মাসের পরের মাস হচ্ছে শাওয়াল মাস। এ মাসের প্রথম দিন হচ্ছে ঈদের দিন। ঈদের দিনের বিধিবিধান ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তবে শাওয়াল মাসে আরো একটি বিশেষ আমল রয়েছে। যার উপর আমাদের প্রত্যেকেরই আমল করা উচিত। আর তা হলো - এ মাসে ছয়টি রোযা রাখা। কেননা এ ছয়টি রোযার বিনিময়ে সারা বছর রোযা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِىِّ - - أَنَّهٗ حَدَّثَهٗ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهٗ سِتًّا مِّنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ

আবু আইয়ূব আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে রোযা রাখল এবং শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন সারা বছর রোযা রাখল। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮১৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/২৮৭৯; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৩৮১১; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৮০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০০৬; মিশকাত, হা/২০৪৭।]

এ হাদীসটির উপর আমল করা সকলের উচিত। একটি নেক আমলের প্রতিদানে সর্বনিম্ন দশটি নেকী দেয়া হয়। তাই রমাযানের ত্রিশটি রোযা ৩০০ দিন আর শাওয়ালের ৬টি রোযা ৬০ দিনের সমান হয়। এতে ৩৬০ দিন পূর্ণ হয়ে যায়, যা একবছরের বেশি হয়; কারণ আরবি বছর ৩৫৪ দিনে হয়ে থাকে। এ রোযাগুলো শাওয়াল মাসের যেকোন দিন রাখা যায়, একসাথে না রেখে ভেঙ্গে ভেঙ্গেও রাখা যায়। অতএব সারা বছর রোযা রাখার সওয়াব অর্জন করার এই সুযোগটি যথাযথভাবে গ্রহণ করা উচিত।

৭১
জিলহজ্জ মাস জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের বিশেষ ফযীলত
চন্দ্র বৎসরের ১২তম মাসের নাম জিলহজ্জ। কুরআন ও হাদীস দ্বারা এ মাসের প্রথম দশ দিনের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য প্রমাণিত। রমাযানের শেষ দশ রাত যেমন অতীব গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যপূর্ণ, তেমনি জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন খুবই ফযীলতপূর্ণ।

অনেকে জিলহজ্জের প্রথম দশকের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানে না। ফলে তারা ঐ দিনগুলোকে হেলায়-খেলায় কাটিয়ে দেয় এবং অনেক নেকী থেকে বঞ্চিত হয়। যারা এ মাসে হজ্জ করতে পারে না তারা ঘরে বসে বসে এ দিনগুলোতে সাধ্যমতো ইবাদাত করে অশেষ নেকী অর্জন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে দশটি রাতের কসম করে বলেন,

﴿وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ﴾

শপথ ফজরের এবং শপথ দশ রাতের। (সূরা ফাজর- ১, ২)

অনেক মুফাস্সির এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এখানে দশ রাত দ্বারা জিলহজ্জের প্রথম দশ রাতকে বুঝানো হয়েছে।

হাদীসে এসেছে,

৯৬৯ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِيِّ أَنَّه قَالَ ‏مَا الْعَمَلُ فِيْ أَيَّامِ الْعَشْرِ أَفْضَلُ مِنْهَا فِيْ هٰذِه ‏. ‏ قَالُوْا وَلَا الْجِهَادُ؟ قَالَ ‏‏وَلَا الْجِهَادُ إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ يُخَاطِرُ بِنَفْسِه وَمَالِه فَلَمْ يَرْجِعْ بِشَىْءٍ

ইবনে আববাস (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, জিলহজ্জের প্রথম দশকের দিনগুলোর আমলের চেয়ে উত্তম কোন আমল নেই। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধও (কি উত্তম) নয়? নবী ﷺ বললেন, যুদ্ধও (উত্তম) নয়। তবে সে লোকের কথা স্বতন্ত্র, যে নিজের জান ও মাল বাজি রেখে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায় এবং কোন কিছুই নিয়ে ফিরে না আসে। [সহীহ বুখারী, হা/৯৬৯; আবু দাউদ, হা/২৪৪০; তিরমিযী, হা/৭৫৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৭২৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৬৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩২৪;; বায়হাকী, হা/৮১৭৫; মিশকাত, হা/১৪৬০।]

জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন ফযীলতপূর্ণ হওয়ার কারণ :

১. এ দিনগুলোতে কৃত নেক আমল আল্লাহ তা‘আলার কাছে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ-এর চেয়েও প্রিয় ও পছন্দনীয়।

২. এ দিনগুলো বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এ দশ দিনের এত ফযীলতের প্রকৃত কারণ হচ্ছে, এ দিনগুলোতে যাবতীয় বড় বড় ইবাদাত একত্রিত হয়ে থাকে।

৩. এ দিনগুলোর মধ্যেই রয়েছে মহান দিবস ইয়াওমুল আরাফা বা আরাফার দিন।

৪. এ দিনগুলোতে বেশি বেশি নেক আমল করার জন্য নবী ﷺ উৎসাহ দিয়েছেন।

৫. এ দিনগুলোর মধ্যেই রয়েছে ঈদুল আযহা।

৬. এ দিনগুলোর মধ্যেই রয়েছে কুরবানী।

৭. এ দিনগুলোর মধ্যেই ইসলামের অন্যতম মৌলিক ইবাদাত হজ্জব্রত পালন করা হয়।

৭২
জিলহজ্জের প্রথম দশকে করণীয় আমলসমূহ
১. কুরবানী দাতার নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা :

জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে ১০ দিন পর্যমত্ম কুরবানী দাতার জন্য নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা উচিত। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ‏ إِذَا دَخَلَتِ الْعَشْرُ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعَرِه وَبَشَرِه شَيْئًا

উম্মে সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, যখন (জিলহজ্জ মাসের) প্রথম দশ দিন উপস্থিত হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন তার চুল ও নখের কিছুই স্পর্শ না করে (কর্তন না করে)। [সহীহ মুসলিম, হা/৫২৩২; নাসাঈ, হা/৪৩৬৪; ইবনে মাজাহ, হা/৩১৪৯; মিশকাত, হা/১৪৫৯।]

২. বেশি বেশি নফল ইবাদাত করা :

নফল ইবাদাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি বিশেষ মাধ্যম। বান্দা যতবেশি নফল ইবাদাত করবে ততবেশি সে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে।

৩. বেশি বেশি যিকির করা :

জিলহজ্জের ১ম দিন থেকে ১৩ তারিখ পর্যমত্ম আল্লাহ তা‘আলা যিকির করার জন্য বিশেষ হুকুম প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاذْكُرُوا اللهَ فِيْۤ أَيَّامٍ مَّعْدُوْدَاتٍ﴾

আর আল্লাহকে স্মরণ করো নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনে। (সূরা বাকারা- ২০৩)

৪. বেশি বেশি তওবা করা :

প্রত্যেক মানুষ কোন না কোনভাবে পাপ করে থাকে। এজন্য সকলের উচিত হলো ঐ সকল পাপ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। আল্লাহ তা‘আলা সবসময় বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন। তিনি বলেন,

﴿وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوْٓءًا اَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهٗ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا﴾

আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে, তারপর সে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তাহলে সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবেই পাবে। (সূরা নিসা- ১১০)

৫. বেশি বেশি তাকবীর পাঠ করা :

জিলহজ্জের প্রথম দশকে বেশি বেশি তাকবীর পাঠ করা অনেক সওয়াবের কাজ। সাহাবীগণ এ আমলটিকে খুব গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। ইমাম বুখারী (রহ.) তার সহীহ গ্রন্থে তা‘লীক সূত্রে বর্ণনা করেন, ইবনে উমর (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) জিলহজ্জের প্রথম দশকের দিকে বাজার অভিমুখে বের হতেন এবং তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করতেন। আর জনগণও তাদের তাকবীরের সাথে তাকবীর দিত।

৬. নফল নামায আদায় করা :

নফল নামাযের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এ দিনগুলোতে নফল নামায আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা উচিত। একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দনীয় আমলের কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমার উচিত আল্লাহর (সমত্মুষ্টির) উদ্দেশ্যে বেশি বেশি সিজদা করা। কেননা তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করবে, তখনই আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তোমার মর্যাদা একধাপ বৃদ্ধি করে দিবেন এবং একটি গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১১২১; ইবনে মাজাহ, হা/২০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৪৩১; মিশকাত, হা/৮৯৭।]

৭. নফল রোযা রাখা :

রমাযান মাস ছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ে কিছু কিছু রোযা রাখার অভ্যাস থাকা খুবই ভালো এবং বিরাট সওয়াবের কাজ। কেননা নফল ইবাদাতগুলোর মধ্যে রোযাই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ أُمَامَةَ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ دُلَّنِيْ عَلٰى عَمَلٍ قَالَ عَلَيْكَ بِالصَّوْمِ فَإِنَّه لَا عِدْلَ لَه

আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী ﷺ-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কোন আমলের কথা বলে দিন। নবী ﷺ বললেন, তুমি অবশ্যই রোযা রাখবে, কেননা এর সমতুল্য অন্য কিছুই নেই। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৩৩; নাসাঈ, হা/২২২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৩৩০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৯৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৮৬; জামেউস সগীর, হা/৭৪৯২।]

বছরের যেকোন সময়ই নফল রোযা রাখা যায়। তবে জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় এ দিনগুলোতে নফল রোযা রাখা অতি সওয়াবের কাজ।

৭৩
আরাফার দিনের গুরুত্ব ও ফযীলত
জিলহজ্জ মাসের ৯ম তারিখকে আরাফার দিন বলা হয়। এ দিনটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ একটি দিন। কেননা এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা অনেক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيْهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّه لَيَدْنُوْ ثُمَّ يُبَاهِىْ بِهِمُ الْمَلَائِكَةَ فَيَقُوْلُ مَا أَرَادَ هٰؤُلَاءِ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় আরাফার দিন আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন এবং তিনি বান্দাদের নিকটবর্তী হন। তারপর ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করে বলেন, (আরাফার মাঠের) এসকল মানুষ কী চায়? (অর্থাৎ যা চায় তা-ই প্রদান করা হবে)। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫৪; নাসাঈ, হা/৩০০৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩০১৪; মিশকাত, হা/২৫৯৪।]

৭৪
আরাফার দিন রোযা রাখার ফযীলত
জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক অনেক ফযীলতপূর্ণ। এর মধ্যে আরাফার দিনটিতে রোযা রাখার বিশেষ ফযীলত হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। এ দিনে রোযা রাখলে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ব ও পরের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أِبِيْ قَتَادَةَ قَالَ : - قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّيْ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِيْ قَبْلَهٗ وَالسَّنَةَ الَّتِيْ بَعْدَهٗ

আবু কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি ধারণা করি যে, আরাফার দিনের রোযা গত বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮০৩; তিরমিযী, হা/৭৪৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৩০; মিশকাত, হা/২০৪৪।]

৭৫
আইয়ামে তাশরীকের বিশেষ ফযীলত
কুরবানীর পরবর্তী তিন দিন অর্থাৎ জিলহজ্জ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখকে আইয়ামুত তাশরীক বলা হয়। তাশরীক শব্দের অর্থ হচ্ছে, শুকানো। মানুষ এ দিনগুলোতে গোশত শুকাতে দিয়ে থাকে বলে এ দিনগুলোর নাম আইয়ামুত তাশরীক বা গোশত শুকানোর দিন নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ দিনগুলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট এমন কিছু দিন, যে দিনগুলোর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার যিকির ও তাঁর শুকরিয়া আদায় করা হয়।

আইয়ামুত তাশরীকের দিনগুলোতে বেশি করে তাকবীর পাঠ করা জরুরি :

বিশেষ করে প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীর পাঠ করা জরুরি। এ তাকবীর শুরু হয় আরাফার দিবসের সকাল থেকে এবং এটা শেষ হয় তাশরীকের দিনগুলোর শেষ দিন আসরের নামাযের পর। [ফিকহুস সুন্নাহ, ১/২৮৪।]

অর্থাৎ ৯ই জিলহজ্জ আরাফার দিন ফজর থেকে শুরু করে ১৩ই জিলহজ্জের আসর পর্যমত্ম তাকবীর বলতে হবে।

তাকবীরের বাক্য :

اَللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ لَا اِلٰهَ إِلَّا اللهُ اَللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ وَ لِلّٰهِ الْحَمْدُ

উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হামদ।

অর্থ : আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। [উমদাতুল কারী, ১০/৩১০।]

৭৬
বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান খাতনা উৎসব
خَتَنٌ - এর আভিধানিক অর্থ হলো, কর্তন করা। পরিভাষায় পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ আবৃতকারী চামড়া ও নারীর যৌনাঙ্গের পর্দা কেটে ফেলাকে খাতনা বলে।

খাতনা করা মুসলিমদের নিদর্শন। এটা মুসলিমদেরকে ইয়াহুদি-খ্রিস্টান থেকে পৃথককারী স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া খাতনা হচ্ছে মানুষের দশটি ফিতরাতের মধ্যে একটি, যা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত হিসেবে পরিচিত। যেমন- হাদীসে এসেছে,

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, দশটি কাজ ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত। আর তা হলো, ১) গোঁফ খাটো করা, ২) দাড়ি লম্বা করা, ৩) মিসওয়াক করা, ৪) পানি দিয়ে নাক ঝাড়া, ৫) নখ কাটা, ৬) আঙ্গুলের গিরাসমূহ ধোয়া, ৭) বগলের পশম উপড়ে ফেলা, ৮) নাভির নিচের পশম মুন্ডন করা, ৯) এবং পানি দ্বারা ইস্তেঞ্জা করা।

যাকারিয়া বলেন, হাদীসের বর্ণনাকারী মুস‘আব বলেছেন, দশমটির কথা আমি ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। কুতায়বা আরো বাড়িয়ে বলেন, ওয়াকী বলেছেন, (দশমটি হচ্ছে) اِنْتِقَاصُ الْمَاءِ অর্থাৎ ইস্তেঞ্জা করা। [সহীহ মুসলিম, হা/৬২৭; আবু দাউদ, হা/৫৩; তিরমিযী, হা/২৭৫৭; ইবনে মাজাহ, হা/২৯৩।]

ইবনে কুদামা বলেন, খাতনা করা পুরুষের জন্য ওয়াজিব, আর মহিলাদের জন্য সম্মানজনক। এটা তাদের জন্য ওয়াজিব নয়। [মুগনি (১/৮৫)]

একদা এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন,

أَلْقِ عَنْكَ شَعْرَ الْكُفْرِ وَاخْتَتِنْ

অর্থাৎ তুমি তোমার দেহ থেকে কুফরীর চিহ্ন দূর করো এবং খাতনা করো। [আবু দাউদ, হা/৩৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৪৭০; বায়হাকী, হা/৭৮১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৯৭৭।]

অতএব খাতনার কাজটি যেকোন বয়সেই করা যায়, তবে যথাসম্ভব নাবালক থাকা অবস্থাতেই সেরে ফেলা উত্তম। কেননা এ সময় খাতনা করলে কষ্ট কম হয় এবং নৈতিক দিকটিও সুরুচিপূর্ণ থাকে।

আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকে এটির অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কেননা গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাতনা মানুষকে অনেক প্রকার যৌনরোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে সাহায্য করে এবং নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনকে পরিতৃপ্ত করে।

ইসলামে খাতনার ব্যাপারে কেবল এতটুকু অথবা এর অনুরূপ বিধানই দেয়া হয়েছে। সুতরাং এর সীমালঙ্ঘন করা কোনভাবেই বৈধ নয়। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কোন প্রমাণ নেই। তারপরও অনেক মুসলিম সমাজেই এরূপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার রীতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে কেবল দাওয়াতই নয়, বরং অনেক প্রকার অনৈসলামিক কর্মকান্ডও সংঘটিত হয়। যেমন- নাচ-গান করা, রং মাখামাখি করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা করা, রাসত্মায় র‌্যালি বের করা ইত্যাদি। অথচ ইসলামে এসব কর্মকান্ড হারাম হিসেবে বিবেচিত।

সুতরাং যেকোন মুসলিম সমাজে এরূপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা কুসংস্কার ও গুনাহের কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যদি এর মধ্যে কোনরূপ পুণ্যের আশা করা হয়, তাহলে সেটা স্পষ্ট বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।

৭৭
জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী
অনেকে তার পিতা-মাতা বা কোন জ্ঞানীগুণী আত্মীয়-স্বজন অথবা কোন পীর আউলিয়া বা কোন রাজনৈতিক নেতার জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী খুব ধুমধামের সাথে পালন করে থাকে। এসব দিনকে কেন্দ্র করে কুরআন পাঠ, দু‘আ অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির আয়োজনও করা হয়। অথচ ইসলামে তিন দিনের বেশি শোক পালনের বিধান নেই। তাই এসব দিবস পালন করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

৭৮
ওরশ অনুষ্ঠান
কোন মৃত অলী-আউলিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে তার কবরের পার্শ্বে ওরশ পালন করার প্রথা আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। এসব অনুষ্ঠানে পশু জবেহ করে বিরাট ধুমধামের সাথে খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়। অনেক মদখোর, গাজাখোর, ভন্ডপীর, নেংটাপীর এবং দরবেশ এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করে থাকে। কোন মৃত পীর বা অলীকে কেন্দ্র করে তার কবরের পার্শ্বে লোকজন জড়ো হয়ে এমনসব কাজ করে থাকে, যা সুস্পষ্টভাবে শিরকের পর্যায়ে পড়ে।

অতএব এসব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মুসলিম সমাজকে সাবধান হতে হবে। এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করা ও খাবার গ্রহণ করা এবং কোন রকম সহযোগিতা করা যেমন- গাড়ি, মাইক, ডেকোরেশন সামগ্রী ভাড়া দেয়া ইত্যাদি কোন মুসলিমের জন্য জায়েয নয়। কেননা এর দ্বারা শিরকী কাজে সহযোগিতা করা হয়। আর পাপ কাজে সহযোগিতা করতে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾

তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর। (সূরা মায়েদা- ২)

৭৯
পূজা অনুষ্ঠানে যোগদান
আমাদের দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পূজা অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে হাতের তৈরি মূর্তি বানিয়ে ঐ মূর্তিকে সম্মান দেয়া হয় এবং তার পূজা করা হয়। অথচ মূর্তিপূজা করা হারাম এবং স্পষ্ট শিরক। ইবরাহীম (আঃ) সারাটি জীবন মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। যখন মক্কা বিজয় হলো তখন কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। আল্লাহর নবী ﷺ সবগুলো মূর্তি ভেঙে দিয়েছিলেন।

মুশরিকদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّهٗ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَاْوَاهُ النَّارُؕ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ﴾

যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। (ফলে) তার আবাস হবে জাহান্নাম। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা– ৭২)

এসব অনুষ্ঠান বিজাতীরা পালন করে থাকে বলে কোন মুসলিমের জন্য এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করা এবং এতে কোন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করা জায়েয নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা পাপ কাজে সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন। যদি শিরক ও বিদআত সংক্রামত্ম কোন অনুষ্ঠানের পাশ দিয়ে মুমিনকে যেতে হয়, তাহলে সে নিজের সম্মান বজায় রেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা এমনি হয়ে থাকেন। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ لَا يَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ وَاِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا﴾

যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন তারা কোন অযথা বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে যায়, তখন একান্ত ভদ্রতার সাথে সেখান থেকে কেটে পড়ে।

(সূরা ফুরকান- ৭২)

৮০
কুসংস্কারপূর্ণ দিবস পালন
এমন কিছু দিবস আছে, যেগুলো বিজাতীরা খুব গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে এবং এসব দিবসে তারা শরীয়ত বিরোধী নানা ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। যেমন- নাচ-গান, খেল-তামাশা, যুবক-যুবতীদের আড্ডা, আতশবাজী, রং মাখামাখী ইত্যাদি। এসব দিবসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১. পহেলা বৈশাখ,

২. ভালোবাসা দিবস,

৩. এপ্রিল ফুল,

৪. থার্টি ফাস্ট নাইট,

৫. জন্ম দিবস,

৬. মৃত্যু দিবস,

৭. বিবাহ দিবস ইত্যাদি।

এসব দিবস পালনে অনেক নর-নারী জড়ো হয় এবং নানা ধরনের অনৈসলামিক কাজে লিপ্ত হয়। অনেক নারীরা নানা ধরনের অশালীন পোশাক পরিধান করে থাকে।

সুতরাং এসব দিবসকে কেন্দ্র করে যা কিছু করা হয়, তা অন্য কোন জাতির জন্য মানানসই হলেও মুসলিম জাতির জন্য মানানসই নয়। অতএব এসব দিবস পালন করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي بِنِعْمَتِه تَتِمُّ الصَّالِحَاتُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন