hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইতিহাসের ইতিহাস

লেখকঃ গোলাম আহমাদ মোর্তজা

১৭
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব
একপক্ষ বলেন, আওরঙ্গজেব গোঁড়া, হিন্দু বিদ্বেষী এবং অত্যাচারী। অত্যাচারের প্রমাণস্বরূপ ভ্রাতাদের হত্যা করা, বৃদ্ধ জন্মদাতাকে বন্দি করা এবং হিন্দু প্রজাদের ধর্মের নামে অত্যাচার করা যথা জিজিয়া কর গ্রহণ, হিন্দুদের মন্দির অপবিত্র করা বা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি অনেক কিছুর উদাহরণ পেশ করেন।

আর অপরপক্ষ বলেন, আওরঙ্গজেব বা আলমগীর সমস্ত মুসলমান নৃপতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম, নিষ্ঠাবান, ধার্মিক, সমগ্র কুরআন শরীফ কণ্ঠস্থকারী (হাফিজ) আলেম (বিজ্ঞ), সাধক, নিরপেক্ষ, উদার, দূরদর্শী এবং উপযুক্ত আদর্শ বাদশাহ ছিলেন। তিনি ‘জিন্দাপীর’ বলেও গণ্য হতেন।

প্রথম পক্ষের বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির সাধারণ ইতিহাস যথেষ্ট। আমাদের অনেকের মগজে এবং কাগজে তার প্রমাণের প্রাচুর্য অব্যর্থভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয়পক্ষের উক্তি প্রমাণে বহু দলিল ও ঐতিহাসিক সমর্থন এবং বিজ্ঞানপূর্ণ যুক্তি তর্ক ছাড়া মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া উচিতও নয়।

স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি এ তিনটিই আমাদের শিক্ষা ঘর। তন্মধ্যে মধ্যপন্থা অবলম্বন হিসেবে কলেজের ইতিহাস ঐ ভারতজনের ইতিহাস হতেই উদ্ধৃতি রাখছি। ভারতের হাজার হাজার পাঠ্য পুস্তক ইতিহাসের উদ্ধৃতি দেওয়াও যেমন সম্ভব নয় তেমনি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য ইতিহাসের সমস্ত কথা বাদ দেওয়াও যায় না।

এখানে প্রসঙ্গত হৃদয় ফলকে গেঁথে নেয়ার মত একটা কথা হচ্ছে এই যে, শিশু অবস্থায় শিশুর কচি মনের কোমল স্মৃতিপটে যে ছবি আঁকা যায় তা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টতর ও আরও গভীর হয়ে মস্তিষ্ক পর্যন্ত আলোকিত অথবা সংক্রমিত করে তোলে। শিশুর মা যেমন শিশুকে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, ঠাকুর-দেবতা, মন্দির মসজিদ অথবা ভূত-প্রেতের প্রতি যে ধারণা জন্মিয়ে দেন শিশু সাধারণত বয়োপ্রাপ্ত হয়েও সেই প্রভাবে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। তেমনি স্কুলের ইতিহাসগুলো যদিও সংক্ষেপ তবুও তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব শিক্ষাদাতা ও শিক্ষাদাত্রী এবং শিক্ষাগ্রহীতা ও গ্রহীত্রীকে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। স্কুলে যদি মাথায় এ কথাটুকু প্রবিষ্ট হয় যে, “আকবরকে মহামতি বলা হয়। তিনি হিন্দু মুসলমানকে সমান চোখে দেখতেন। আর আওরঙ্গজেব ছিলেন খুব ধর্মভীরু পণ্ডিত। কিন্তু তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন, হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বৃদ্ধ পিতাকে বন্দি ও ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন” ইত্যাদি। তাহলে সাধারণ ক্ষেত্রে তারপর আরও বহু ইতিহাস পড়লেও বাল্যকালের ঐ প্রভাবটুকু কাটিয়ে ওটা কত কঠিন তা আজ নিরপেক্ষ চিন্তাশীল পাঠক-পাঠিকাদের চিন্তা করে দেখার দিন এসেছে এবং দেখতে হবে।

বর্তমানে ঐ ভারতজনের ইতিহাসে শ্ৰী ঘোষ বলেছেন, “শাহজাহানের মৃত্যুর আগেই আওরঙ্গজেবের রাজ্যাভিষেক হয় (জুলাই ১৬৫৮ ও জুন ১৬৫৯)। তাঁর মৃত্যুর পর তৃতীয়বার আওরঙ্গজেব মহাসমারোহে আগ্রার দুর্গের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন (মার্চ ১৬৬৬)। তিনবার অভিষেক কোন মুঘল সম্রাটের হয়নি। কিন্তু আওরঙ্গজেব যে মুঘল সম্রাটের মধ্যে বহুদিক দিয়ে অদ্বিতীয় হবেন, একাধিক অভিষেক হতে তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল।”

‘রাজপুত্রদের প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়, আওরঙ্গজেব মারওয়াড় দখল করেন এবং নানা স্থানে মুঘল ফৌজ নিযুক্ত করেন। তাঁর আদেশে হিন্দু দেবালয় ধ্বংস করে বহু মসজিদও প্রতিষ্ঠিত হয়।” (ভাঃ জঃ ইঃ)

“১৬৭৯ খৃস্টাব্দে আওরঙ্গজেব জিজিয়া কর পুনঃ প্রবর্তন করেন।” (ভাঃ জঃ ইঃ)

“ইসলাম ধর্মের আদেশ অনুসারে মুসলমান রাষ্ট্র ভিন্ন ধর্মের কোন স্থান হতে পারে না। পাঠান ও মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যারা ভিন্ন ধর্মীদের প্রতি বিশেষ করিয়া হিন্দুদের প্রতি উদার ব্যবহার করেছেন তাঁরা ব্যক্তিগত মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন সত্য, কিন্তু ইসলামের আদর্শ সেবক বলে গোঁড়া মুসলমানদের কাছে শ্রদ্ধা ও প্রশংসা লাভ করতে পারেননি। আওরঙ্গজেব নিজেকে ইসলাম ধর্মের আদর্শ সেবক বলে মনে করতেন এবং রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে তিনি ইসলামের অনুশাসন বর্ণে বর্ণে পালন করার চেষ্টা করতেন। সেই জন্য তাঁর রাষ্ট্রনীতিতে মুসলমান ছাড়া কোন ধর্মাবলম্বীর দাবি বা অধিকার স্বীকৃত হত না। বিধর্মীর অধিকার স্বীকার করা ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ।” (ভাঃ জঃ ইঃ)

এ সমস্ত সাংঘাতিক কথায় এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আওরঙ্গজেব পূর্ণভাবে ইসলাম মেনে চলতেন। আর ইসলাম মেনে চললেই ঠিক তাকে পশু প্রকৃতির বর্বর, অনুদার এবং হিন্দু বিদ্বেষী হতেই হবে। তারপর আরও যা লেখা হয়েছে তা খুব গভীর চিন্তার বিষয়। ঐ ইতিহাসে আরও আছে-“চিন্তামন মন্দিরে গোহত্যা করে তিনি সাড়ম্বদের তা মসজিদে পরিণত করেছিলেন। সেই সময় গুজরাটে আরও বহু হিন্দু দেবালয় তিনি ধ্বংস করেছিলেন।” আরও লেখা আছে, “তিনি বিধর্মী হিন্দুদের সমস্ত টোল, চতুষ্পঠ দেব দেউল ধ্বংস করতে বলেন। সেই আদেশ অনুসারে হিন্দুদের বড় বড় তীর্থস্থানে বিখ্যাত দেব মন্দির ধ্বংস করেছেন-”।

আরও লেখা হয়েছে-“গুজরাটে হিন্দুদের সমস্ত সম্পত্তি তাঁর আদেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়” এ বিখ্যাত ইতিহাসে লেখক আরও লিখেছেন-“আগেই বলেছি যে, ইসলাম ধর্ম অনুসারে মুসলমান রাষ্ট্রে বিধর্মীর বসবাসের কোন অধিকার নেই।” ঐ ইতিহাসে আরও লেখা হয়েছে-“অর্থাৎ বিধর্মী বলে মুসলমানী ভারত রাষ্ট্রে তাদের বাস করার অধিকার নেই তা সত্ত্বেও হিন্দুদের বাস করতে দেওয়া হচ্ছে বলে মুসলমান সম্রাটরা হিন্দুদের মাথাপিছু জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করতেন। তার পরই ঐ ইতিহাসে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজিত করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে বলে অনেকের অনুমান। যেমন লেখক বলেছেন, “ভারতবর্ষ যাদের চিরকালের মাতৃভূমি সেই হিন্দুদের পরদেশবাসীর মতো অপমান ও অত্যাচার সহ্য করে লক্ষ লক্ষ টাকা জিজিয়া কর দিতে হত এ দেশে বাস করার জন্য।” ইতিহাস এত বড় নিষ্ঠুর পরিহাস সহ্য করে না। এছাড়া ঐ ইতিহাসে আরও বলা হয়েছে-“নতুন করে জিজিয়া প্রবর্তনের পর দিল্লির বিক্ষুব্ধ জনতা সম্রাটের কাছে এটা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেব তাতে বিচলিত হননি উপরন্তু তিনি জনতার উপর দিয়ে হাতি চালিয়ে তাদের পদদলিত করে মারার আদেশ দিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অসহায় হিন্দুদের জোর করে মুসলমান করা।”

“হিন্দুরা মুসলমান হলে তাদের হাতির পিঠে বসায়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হত।” এতদ্ব্যতীত আরও লেখা হয়েছে-“আওরঙ্গজেবের ধর্মান্ধনীতির ফলে রাজপুত্র শক্তি ও মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল।” “দাক্ষিণাত্যের বিরাট হিন্দু পুনরভ্যুত্থান হয়েছিল মারাঠা বীর শাহজী শিবাজী শম্ভুজীর নেতৃত্বে।”

লেখক উপযুক্ত বাক্যগুলো স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যাই লিখেছেন লেখার আসল নায়ক যিনি বা যাঁরা তাঁদের আজ সমাজের কাছে ভুল প্রচারের অপরাধজনিত কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হচ্ছে এবং হবেও। কারণ ইসলাম ধর্মে কোথাও বলা হয়নি যে, “বিধর্মীদের অধিকার স্বীকার করা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ” বরং হযরত মুহাম্মদের (সা.) ইতিহাস এ কথাই স্মরণ করে দেয় যে, তিনি অমুসলমানদের পাশাপাশি বাস করছেন এবং মিলেমিশে থাকার জন্য ঐতিহাসিক সন্ধিস্থাপন করেন। আজও আরবে বহু ধর্মের মানুষ বাস করছেন। সারা পৃথিবীতে কোন মুসলমান রাষ্ট্রে ঐ অলীক আজগুবি অবান্তর আলেখ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি।

এমনিভাবে চিন্তামন মন্দিরে গোহত্যা করাও কুচিন্তা বা কুকল্পনার নামান্তর। ‘হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস’, ‘সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত’, ‘জোর করে মুসলমান করা’ ইত্যাদি কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তা একজন অমুসলিম ঐতিহাসিকের বর্ণনায় পরিষ্কার হয়ে উঠবে। বাবু নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুস্তকে লিখেছেন, ভোগ ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করে কেবলমাত্র পার্থিব জীবনের সার্থকতা সম্পাদন করতে মুসলমান নরপতিগণ অভ্যস্ত ছিলেন না। তাঁরা সহস্র কাজে লিপ্ত হয়েও কখনো বিস্মৃত হননি যে, তাদেরকে একদিন আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে কার্যাকার্যের কৈফিয়ত দিতে হবে। ইসলামের মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাদশাহগণ ন্যায়ের সীমার মধ্যে অবস্থিতি করে তাদের অধীন সমস্ত প্রজাবৃন্দকে সমচক্ষে দেখতেন। নরপতির ন্যায় বিচারে প্রজার সন্তোষ এবং সন্তোষের ওপর রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তাদের অন্তঃকরণে এ সত্য যেন সুবর্ণ অক্ষরে খচিত ছিল।” ধর্মান্তর গ্রহণ সম্বন্ধে কেউ কখনও বলপ্রয়োগ করেছেন-এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। মুসলমান বাদশাহদের যদি সে উদ্দেশ্য থাকত-তা হলে এতদিন রাজত্ব করার পর হিন্দুস্থানে হিন্দুর সংখ্যা কখনও মুসলমানের চর্তুগুণ হত না। হিন্দু ও মুসলমান একই দেশে একই পল্লীর ভেতর এ সুদীর্ঘকালব্যাপী মুসলমান রাজত্বের মধ্যে পরম সুখে পরম শান্তিতে বসবাস করছিল। বিদেশী স্বার্থান্ধ ঐতিহাসিকগণের কাল্পনিক চিত্রে অঙ্কিত মুসলিম নরপতিগণের স্বেচ্ছাচারিতা, নৃশংসতা ও ধর্মান্তরতার বিষয় পাঠ করে এবং কতিপয় স্বার্থপর বিদ্বেষপরায়ণ লোকের প্রচারিত জনরবের ওপর আস্থা স্থাপন করে এখনও সেসব মহানুভব নরপতিগণের নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করে থাকেন। রাজকার্যে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ করে মুসলমান শাসনকর্তাগণ ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতেন। এমনকি হিন্দু বিদ্বেষী বলে অভিহিত সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দুকেই প্রধান সেনাপতি পদে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাজকার্যে যোগ্য ব্যক্তি তার নিকট বিশেষ রূপে সমাদৃত হত। সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের কলঙ্ক কেউ তার ওপর আরোপ করতে পারেনি। রাজ্যে শুভাশুভের দায়িত্ব হিন্দুগণের ওপর ন্যস্ত ছিল। তার রাজত্বকালে দুজন অমুসলমান কর্মচারি রাজস্ব বিভাগে অতি উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

কয়েকজন ধর্মান্ধ তাঁর নিকট অভিযোগ করেছিল রাজস্ব বিভাগে হিন্দুকে এরূপ বিশ্বাস করা অনুচিত। সম্রাট তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন তিনি শরীয়তের (ধর্মনীতির) বিধি প্রতিপালন করে যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য পদে নিযুক্ত করেছেন। পবিত্র কোরআনে উক্ত হয়েছে যারা বিশ্বাসের উপযুক্ত তাদের ওপরেই বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং ন্যায়ের ওপর ভিত্তিস্থাপন করে বিচারকার্য সম্পাদন করবে।

এক একজন বাদশাহের ত্যাগের দৃষ্টান্ত পাঠ করলে শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারা অনেক সময় রাজভাণ্ডার মুক্ত করে দান করতেন। কি দীন-দুঃখী কী অভাবগ্রস্ত কখনো বিফল মনোরথ হত না। কোন কোন বাদশাহ প্রাচীন যুগের খলীফাগণের অনুকরণে বিলাসবর্জিত অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং কায়িক পরিশ্রম দ্বারা তাদের পোষ্যবর্গকে প্রতিপালন করতেন।

বাদশাহ ফিরোজশাহ তোঘলক বগু জনহিতকর কার্যে রাজকোষ হতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন, কৃষি কার্যে সুবিধার্থে তিনি পঞ্চাশটি জাঙ্গান (বাঁধ), চল্লিশটি মসজিদ, ত্রিশটি শিক্ষালয়, শতাধিক পান্থশালা, ত্রিশটি তড়াগ, শতাধিক দাতব্য চিকিৎসালয়, একশত স্নানাগার এবং শতাধিক সেতু ও বহু জনহিতকর কার্য করে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব তার কায়িক পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দ্বারা তাঁর সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করতেন। তিনি টুপি সেলাই ও পবিত্র কোরআন শরীফ লিখে তাঁর শেষ জীবনে আটশত পাঁচ টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। তার মধ্যে মাত্র চার টাকা আট আনা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য রেখে অবশিষ্ট অর্থ দীন-দুঃখীকে দান করার জন্য উইল করে গিয়েছিলেন।....

সম্রাট বাবর তার উপাসনা বলে বিশ্ব নিয়ন্তাকে হৃদগত করে তার নিজের জীবনের পরিবর্তে জীবনাধিক পুত্র হুমায়ুনের জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। যে সমস্ত ঐতিহাসিক কী ঔপন্যাসিক মুসলিম বাদশাহদের অন্তঃপুরে সুরার তরঙ্গ প্রবাহিত করছিলেন তাঁদের মিথ্যা উক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা ঐতিহাসিক লেনপুল প্রণীত “আওরঙ্গজেব” পাঠ করতে পাঠকবর্গকে অনুরোধ করছি। সম্রাট নিজে কখনও মদ্য স্পর্শ করেননি এবং আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবগণ সুরা পান করতে কখনও প্রশ্রয় দেননি। ধর্মপরায়ণ আওরঙ্গজেব তার প্রজাবর্গের ভক্তি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন।”

অতএব নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সচ্চরিত্রের ওপর যারা কলঙ্কের কালিমা লেপন করে ইতিহাসের পাতাকে দূষিত করেছে প্রকৃত ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।

যারা আজ আকবরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাদের চমক ভাঙার সময় হয়েছে। ইংরেজদের শত শত বছর ভারত শাসন অথবা শোষণের ইতিহাস, হিন্দু-মুসলিম প্রভৃতি জাতীয় ভারতীয়দের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা তথা স্বাধীনতার গ্লানির বীজ আকবরের সময়েই অঙ্কুরিত হয়েছিল। তিনিই প্রথমে ইংরেজ পাদ্রিদের রাজদরবারে স্থান দেন এবং ইংরেজ মহিলা হেরেমে স্থান দেন। তারপর উদারতার নামে রাজনীতির খেলা শুরু করেন। কিন্তু ব্যভিচার প্রবণতার জন্যই আকবর ইংরেজদের মতলব বুঝেও না বোঝা হয়ে কাটিয়ে দিলেন। তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর যখন বাবার প্রতিনিধি হয়ে দিল্লির সিংহাসনে আসীন হলেন তখনই ইংরেজ জাতি ব্যবসার তুলাদণ্ড হাতে নিয়ে জাহাঙ্গীরের হাতের সহি রাজকীয় মোহরযুক্ত পত্রে অনুমতিপ্রাপ্ত হন। আর এই অনুমতিই ভারতের শোষণশাসনের অনুপ্রবেশদ্বার- ঐ অনুমতিই পরমাণু হয়ে শেষে ইংরেজদের পরমায়ু এবং পারমাণবিক বিস্ফোরণে বিবর্তিত হয়েছে। মধ্যপায়ী বিলাসী জাহাঙ্গীর বোঝেননি একটা সই বা টিপের মধ্যে কত হত্যা, মিথ্যা আর ষড়যন্ত্রের ইতিহাসি লুকিয়ে থাকতে পারে।

যাইহোক, শ্ৰী ঘোষের লেখা ঐ পাঠ্য পুস্তক ইতিহাসে আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে যত বিষাক্ত কথাই থাক তবুও এটুকু দ্বিধাহীনচিত্তে স্বীকার করা হয়েছে যে, “ভারতবর্ষ যদি ইসলাম ধর্মের দেশ হতো তাহলে সম্রাট আওরঙ্গজেব হয়ত ধর্মপ্রবর্তক মুহাম্মদের বর পুত্ররূপে পূজিত হতেন। বাস্তবিক তাঁর মত সচ্চরিত্র, নিষ্ঠাবান মুসলমান ইসলামের জন্মভূমিতে দুর্লভ।” এতে আরো লিখা হয়েছে “সম্রাট বলতেন বিশ্রাম ও বিলাসিতা রাজার জন্য নহে।” আরো লেখা হয়েছে “বাস্তবিক বিলাসিতার অভ্যাস আওরঙ্গজেবের একেবারে ছিল না। বাদশাহদের বিলাসিতা তো দূরের কথা, সাধারণ ধনীর বিলাস ও স্বচ্ছন্দও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এড়িয়ে চলতেন। লোকে তাঁকে রাজবেশী ‘ফকির’ ও ‘দরবেশ’ বলত। তা স্তুতি নহে, সত্য। পোশাক-পরিচ্ছদে ও আহারে-বিহারে তিনি সংযমী ছিলেন, সুরা-নারী-বিলাস তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।”

শ্রী ঘোষ আরও লিখেছেন- “কিন্তু, আওরঙ্গজেব বিদ্যানুরাগী তো ছিলেনই, নিজেও বিদ্বান ও পণ্ডিত ছিলেন।”

“তিনি আরবী-ফারসি ছাড়া তুর্কী ও হিন্দি ভাষাতেও বেশ সহজে কথা বলতে পারতেন। ভারতবর্ষে মুসলমান, আইনগ্রন্থ প্রণয়নে ফতোয়া-ই-আলমগীরীর রচয়িতা হিসেবে তাঁর কীর্তি শ্রদ্ধার সহিত স্মরণীয়।” এমনিভাবে সম্রাটের নিজের উদর পূরণ ও উদারতার উদাহরণ স্থাপনে নিজ হাতে টুপি সেলাই আর নিজ হাতে লেখা কুরআন শরীফ পরিবেশন রাজা-বাদশাহের ইতিহাসে আশ্চর্যতম ঘটনা। শ্রী ঘোষের ইতিহাসে আরও আভাস আছে “নিজের হাতে তিনি কোরআন কপি করেছেন।”

আলমগীরের জন্য লেখা হয়েছে তাঁর ভাইদের মধ্যে তিনিই ছিলেন যোগ্যতম। অথচ ঐ ইতিহাসেই আছে- বড় ভাই দারাশিকোর জন্য বলা হয়েছে- “কিন্তু পিতার অত্যধিক স্নেহের ছায়ায় মানুষ হয়ে তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রায় অনভিজ্ঞ ছিলেন বলা চলে।” দ্বিতীয় পুত্র সুজার জন্য বলা হয়েছে- “কর্মবিমুখ (অকেজো) ও অলস। তাঁর চরিত্রের প্রধান দোষ ছিল- স্থিরভাবে কোন কাজ করার ক্ষমতা তাঁহার ছিল না। তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের চরিত্র ছিল ঠিক এর বিপরীত। যেমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, স্থিরবীর ও হিসেবী। কর্মক্ষম ও তৎপরও ছিলেন তিনি যথেষ্ট। রাজনীতির জটিলতা সম্বন্ধে তার যে অভিজ্ঞতা ছিল তা আর কারো ছিল না। শাহজাহানের পারিষদরা জানতেন যে, এ তৃতীয় পুত্ৰই সিংহাসনের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী এবং অন্তদ্ধন্দে হয়ত শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হবেন। চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসক, কোন দিক দিয়া তিনি ঔরঙ্গবীরের সমকক্ষ ছিলেন না।”

আশ্চর্যের কথা, যে মুখে বলা হয়েছে ‘ক’ সারা জীবন চির কুমার ছিলেন আবার সেই মুখেই বলা হচ্ছে ‘ক’ দুই সন্তানের পিতা ছিলেন। এর নাম কী ইতিহাস না পরিহাস? এর নাম ইতিহাস না উপন্যাস? এর দ্বারা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা না হিংস্রতার তালিম দেয়া? সেসব সঠিক সমীক্ষা সমাজেরই দায়িত্ব।

মুসলমানদের নিকট বড় অপরাধ হলেও যাকে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) বরপুত্ররূপে পূজিত হইতেন বলে লিখতে দ্বিধা করা হয়নি, আবার সেই কলমেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে হিন্দুদের জোর করে মুসলমান করে হাতির পিঠে চাপিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে শোভাযাত্রা বের করতেন। অথচ সকলেই স্বীকার করেন যে, মুহাম্মাদ (সা.) বিলাস ভোগের জন্য বাজনা একেবারে নিষিদ্ধ করেছেন। আলমগীরও মুসলমানদের মধ্যে বাজনাগীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। অতএব ব্যান্ড বাজিয়ে কী করে বরপুত্রের দ্বারা নবদীক্ষিত মুসলমানদের নিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় মিছিল বের হতে পারে?

বিশ্ব ইতিহাসকে স্বীকার করতেই হবে। ইসলাম ধর্মে শাস্তি বিধান আছে নর হত্যার বদলে প্রাণদণ্ড। প্রাণদণ্ড বলতে শিরোচ্ছেদ। আর ব্যভিচারের প্রমাণে প্রাণদণ্ড এবং চোরের জন্য হস্তকর্তন ও চাবুক প্রয়োগ প্রভৃতি। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আইনে বা তার সমাগ্রিক জীবনে কাউকে শূলে চড়িয়ে, না খেতে দিয়ে, বিষ প্রয়োগ করে অথবা কোন ভারী বস্তুর চাপ দিয়ে শাস্তি দেওয়ার নিয়ম ছিল না বা আজও নেই। অতএব জিজিয়া করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হিন্দু জনতার উপর হাতি চালিয়ে দেবার হুকুম দিতে পারেন কি মুহাম্মদের (সা.) ভক্ত ও বরপুত্র (ঘোষ মহাশয়ের কথায়) আলমগীর তথা আওরঙ্গজেব?

অনেকের ধারণা এই প্রকার ঐতিহাসিকতা শুধুমাত্র আওরঙ্গজেবের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার অপকৌশলই নয় বরং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্বন্ধেও কুৎসিত ধারণা জন্মিয়ে দিয়ে শিক্ষিত সমাজকে ইসলামবিমুখ করে দেবার এক উকট প্রচেষ্টা এবং জঘন্য ষড়যন্ত্র। অতএব হযরত মুহাম্মদের ভক্ত সারা বিশ্ব মুসলিম এরূপ চক্রান্তপূর্ণ ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতাকে শ্রদ্ধার চক্ষে ক্ষমা করতে পারে, পারা উচিতও না। অবশ্য আকবরের জিজিয়া প্রথার বিলোপ সাধন আর আওরঙ্গজেবের জিজিয়া করের পুনঃ প্রচলন কথাটুকু সত্য হলেও জিজিয়া কাদের জন্য, কতটুকু পরিমাণে কেন নেওয়া হতো তার আলোচনা কিছু পরেই করা হবে। ঐতিহাসিক শ্রী ঘোষ ঐ বিখ্যাত ইতিহাসের পাতায় লিখেছেন, “আওরঙ্গজেব কেবল আলমগীর নহেন, জিন্দাপীরও। আবার সেখানেই লিখেছেন, “সৎনামী জাদুমন্ত্র জানে মনে করিয়া তিনি নিজের হাতে বাণী লিখিয়া জাদুমুর্তি আঁকিয়া দিলেন মুঘল সৈন্যদের পতাকাতে আঁটিয়া দিবার জন্য।”

আলমগীর যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একনিষ্ঠ ভক্তই হলেন অর্থাৎ শ্রী ঘোষের উক্তিতে তিনি যদি মুহাম্মদের বরপুত্রই হলেন এবং ইসলাম ধর্মের অনুসরণকারীই হলেন, তাহলে ইসলাম ধর্মে জাদু করা একেবারে হারাম বা অবৈধ। অতএব ‘জাদুমূর্তি আঁকা কথাটা গভীর চিন্তার বিষয়। জাদুরূপী কোন নর বা নারী মূর্তি অথবা কোন জীবজন্তুর ছবি অঙ্কন ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। সুতরাং জাদুর প্রয়োগ এবং মূর্তি অঙ্কন এ অপবাদ দুটি যৌক্তিক না অযৌক্তিক, মিথ্যা না সত্য তার ওপর দেবে নতুন সমাজ নতুন শতাব্দী।

এমনিভাবে ‘আওরঙ্গজেব’কে বাংলায় লেখা হয়েছে ঔরঙ্গজীব। ‘জীব’ মানে ‘জন্তু’। হয়তো ঔরঙ্গজীব বলেই অনেকে শান্তি পেয়েছেন বা পান। তাই শান্তির ধারা সারা ভারতে ছড়াবার জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু আরবী, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি ইতিহাস হতে বাংলায় অনুবাদ করতে হলে ‘ঔরঙ্গজীব’ হতে পারে না বরং ‘আওরঙ্গজেব’ হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু মুসলমানদের নামগুলো উল্টে-পাল্টে পড়তে একটু মজাই লাগে বোধ হয়। কিছু দিন পূর্বেও শত-সহস্র বাংলা বই পুস্তকে আওরঙ্গজেবই লেখা হত কিন্তু কালের চক্রে চারিত্রিক উন্নতি বিকাশের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমান অনেক লেখকই ‘ঔরঙ্গজীব’ লিখতে শুরু করেছেন।

এছাড়া আওরঙ্গজেব বা আলমগীরের ওপর আরও বহু অভিযোগ আছে। যথা (১) তিনি কাকেও বিশ্বাস করতেন না। (২) তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন তাই হিন্দু কর্মচারীদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, (৩) হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, (৪) বৃদ্ধ পিতাকে বন্দি ও ভাইদের হত্যা করেছিলেন (৫) কেবল হিন্দুদেরই ওপর জিজিয়া কর চাপিয়েছিলেন (৬) তাঁর অযোগ্যতাই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ।

এসবের উত্তরে শুধু কিছু বলা যায় বা লেখা যায় তাই নয় বরং প্রত্যেকটির বিষয়ের ওপর সুবিস্তৃত আলোচনা করলে দশ খণ্ড করে এক একটা ইতিহাস লেখা যায়। তাই বাহুল্য মনে করে প্রামাণ্য ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে উপাদেয় তথ্য সংক্ষেপে সমাজের চিন্তা ধারার গতি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশন করা হল (১) “তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না” একথাই যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি কখনই বা এত নামায পড়তেন, আর কখনইবা টুপি সেলাই করতেন আর কখনই কোরআন নকল করতেন আর কখনই তিনি রাত্রে এত উপাসনা করতেন আর কি করেইবা আকবর অপেক্ষা বিরাট বিচিত্রময় ভারতবর্ষ শাসন করতেন আর সামলাতেন? আর যদি তিনি কাউকে বিশ্বাস না করতেন তবে নিশ্চয়ই সকলেই তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন; আর অসন্তুষ্ট কর্মচারী ও চাকরদের নিয়ে ধমকে ধমকে কিছু দিন বা কয়েক মাস অথবা কোন প্রকারে কয়েকটা বছর গোজামিল দিয়ে কাটানো যেতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তিনি পাঁচ-দশ বছর নয় অর্ধ শতাব্দীকাল বা পঞ্চাশটি বছর রাজত্ব করেছেন। এর দ্বারা কি প্রমাণ হয় না যে, রাজকর্মচারী কেউ-ই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন না অর্থাৎ তিনি কাউকে অবিশ্বাস করতেন না।

যে যশোবন্ত সিংহ একবার নয়, কয়েকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তবুও দয়ালু সম্রাট তাঁকে প্রত্যেক বার ক্ষমা করেছিলেন যদিও যশোবন্তু সিংহ মুসলমান ছিলেন না। শুধু ক্ষমা নয়, উদারতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপনে তাঁকে কাবুলের শাসনকর্তা পর্যন্ত করতেও দ্বিধা করেননি।

মারাঠা নেতা শিবাজী শুধু অমুসলমানই ছিলেন না, রাষ্ট্রদ্রোহীও ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাকে তিনি বিশ্বাস করে পাঠিয়েছিলেন তিনি ছিলেন একজন অমুসলমান ‘জয়সিংহ’। শিবাজী যখন আওরঙ্গজেবের দরবারে ক্ষমা চাইলেন বা আত্মসমর্পণ করলেন তখন তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। ইচ্ছা করলে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে অথবা অনেক মুঘল সৈন্যকে রাতের অন্ধকারে এবং অতর্কিত আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগে হত্যার অপরাধে প্রাণদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে পরম ও চরম শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও তাঁকে ক্ষমা করে মহানুভব বাদশাহ্ ক্ষমা ধর্মের অত্যুজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করেন। শিবাজীকে একবার নয়, কয়েকবার বন্দি করেছিলেন ও ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা শিবাজীর দেখাশোনার ভার দিয়েছিলেন ঐ জয়সিংহের ওপর বিশ্বাস করে। যখন তিনি তার ধর্মের দোহাই দিয়ে মিষ্টান্ন পাঠাবার অনুমতি চাইলেন, সম্রাট তাও দিলেন। আজ বিশ্বে কোন এমন রাষ্ট্র আছে, যেখানে জেলখানায় কয়েদিকে আত্মীয়দের মিষ্টি পাঠাবার অনুমতি দেন? তাও এক এক ঝুড়িতে দু-এক মণ করে মিষ্টি। এক কিলো দু কিলো মিষ্টির ঝুড়িতে ঢুকে পলায়ন নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। শিবাজীর পলায়নের পর এটাই স্বাভাবিকই ছিল যে, জয়সিংহকে সন্দেহ করা। যেহেতু তাঁরই রক্ষণাবেক্ষণ সত্ত্বেও শিবাজীর পলায়ন সম্ভব হয়েছিল। আজ অনেকেই মনে করেন, জয়সিংহের সাথে শিবাজীর গুপ্ত যোগাযোগ ছিল। বাইরে যতটা যুদ্ধ হয়েছে সেটা বাহ্যিক, ভেতরে ভেতরে যুক্তি ও চুক্তি ছিল অন্য রকম। সে যাইহোক, সম্রাট আলমগীর নিঃসন্দেহে সন্দেহ করতে পারতেন, কেননা শিবাজী ও জয়সিংহ উভয়েই ছিলেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। তবুও কোন অধিকারে আমরা বলতে পারি যে, সম্রাট কাউকে বিশ্বাস করতেন না?

(২) তিনি হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন’ কী না তার উত্তর প্রথম নম্বরেই বেশ কিছুটা অনুমেয়। তবুও আজ আমরা ঐতিহাসিকদের কৃপায় জানতে পারছি তিনি নাকি হিন্দু কর্মচারীদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের স্থানে মুসলমান কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। এই কথাগুলোর অসত্যতা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই শুধু পাশাপাশি সত্যের আলোকবর্তিকা আনলেই মিথ্যার অন্ধকার নিমেষে বিদূরিত হবে।

মুসলমান বিদেশী কোন রাজা অমুসলমান মন্ত্রী বা সেনাপতি রাখতে পারে, তেমনি হিন্দু বিদ্বেষী কোন মুসলমান সম্রাটের পক্ষেও হিন্দু সেনাপতি নিয়োগ সম্ভব নয়। কেননা তাতে সেনাপতির দ্বারা সামরিক অভ্যুত্থানের আশংকা সততই লেগে থাকবে। কিন্তু আওরঙ্গজেব তাঁর সেনাপতি পদে বরণ করেছিলেন অমুসলমান জয়সিংহ এবং যশোবন্ত সিংহকে। শুধু তাই নয়, রাজা ভিম সিং, যিনি উদয়পুরের মহারাজা রাজসিংহের পুত্র ছিলেন তিনিও আলমগীরের উচ্চমানের বিশ্বাসী কর্মী ছিলেন। তাঁর অধীনে পাঁচ হাজার সৈন্য ছিল। ইন্দ্ৰসিংহের মর্যাদাও আওরঙ্গজেবের কাছে অল্প ছিল না।

রাষ্ট্রদ্রোহী শিবাজীর আপন জামাতা ‘অচলাজী’ পাঁচ হাজারী পদের অধিকারী ছিলেন। আর্জজী ইনিও শিবাজীর আত্মীয় ছিলেন। তাঁকে ‘দুই হাজারী’ পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। এখন যদি আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, শিবাজীর মত সামান্য একজন সৈনিককে আওরঙ্গজেবের অঙ্গুলি হেলনেই নিঃশেষ করা যেত, তাই তিনি এত লোককে এত বেশি বিশ্বাস করতেন এমনকি বিধর্মী এবং শত্রুর আত্মীয়স্বজনের হাতেও এত ক্ষমতা দিয়েছিলেন, যার জন্য তাদের স্নেহ, মমতা, স্বজনপ্রীতির পরিপ্রেক্ষিতে আওরঙ্গজেবকে কষ্ট পেতে হয়েছে, তাহলে আসল ইতিহাসটাই বাদ পড়ে গেল। আসল কথা হচ্ছে এই যে, আলমগীর নিজে ছিলেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী তাই তিনি কাউকে বিনা প্রমাণে সন্দেহ করাকে কল্পনা করতেও পারতেন না। কিন্তু ধন্য আমাদের সৌভাগ্য। আর ধন্য আমাদের ঐতিহাসিকতা। আমরা আসল ইতিহাসটাকে হজম করে উল্টে লিখেছি “তিনি কাহাকেও বিশ্বাস করতেন না।”

(৩) “তিনি হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করেছিলেন” বলে যে অপবাদটি নিরপরাধ আওরঙ্গজেবের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা যদি সত্য হয় তবে বলতে হয় আওরঙ্গজেব ইসলাম ধর্মের আইন মানতেন না। অথচ সমস্ত ইতিহাসে শত্রু ও মিত্র ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন যে, তিনি কুরআনের নীতি মেনে চলতেন। অতএব আজ আমরা তুলে ধরছি আওরঙ্গজেবের আদর্শের উৎস ঐ কুরআনের বাণীর মর্মার্থ। যথা “ধর্মে জবরদস্তি নেই”। আবার কুরআনে অনত্র হযরত মুহাম্মদকে (সা.) বলতে বলা হয়েছে- “হে অমুসলমানগণ! তোমরা যার উপাসক আমরা তার নই... তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম।” তাছাড়া হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোন মন্দির ভেঙ্গে ছিলেন বা ভাঙ্গিয়েছিলেন সে কথা আদ্যাপি কোন মুসলিম অমুসলিম কেউ-ই প্রমাণ করতে পারেননি। আজও প্রাচীনতম উপাসনা মন্দির মক্কার কাবা ঘর তার জীবন্ত সাক্ষী।

এছাড়া সারা বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান রাষ্ট্রের কম বেশি অমুসলমান বরাবর ছিল বা আজও আছে। সৌদি আরবে অনেক বিধর্মী রয়েছেন এবং নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। শুধু কাবাঘর এবং মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠতম ও তৎসংলগ্ন মসজিদ আর তার চারপাশের কতকটা স্থান অমুসলমানদের জন্য যাওয়া নিষিদ্ধ। কারণ সারা বিশ্বের মানুষ যখন হজ করতে আসেন তখন সেই উপাসনার দৃশ্য দেখলে মনে হয় এই সীমারেখা আরও প্রশস্ত হলে বোধ হয় ভাল হতো। কেননা ঐ স্থানে চব্বিশ ঘণ্টার একটা সেকেন্ডও ‘তওয়াফ’ (প্রদক্ষিণ করা) উপাসনা বন্ধ থাকে না। অতএব কোন নীতিতেই গ্রহণযোগ্য নয় যে ঠিক নামাযের সময় মসজিদে, পূজার সময় মন্দিরে, উপাসনা করার সময় গীর্জায়, অপ্রয়োজনে অ-উপাসকদের অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে।

বড়ই পরিতাপের বিষয় আমাদের ভারতবর্ষের মস্তিষ্কস্বরূপ বঙ্গদেশেও কয়েক বছর আগে স্কুলের পাঠ্য ইতিহাসে অনেক কিছু বেশি সত্য তথ্যের সন্ধান পাওয়া যেত। প্রমাণস্বরূপ মাত্র সেদিন ১৯৪৬ সালে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ১, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা প্রাপ্তিস্থান হতে এবং হিন্দুস্থান প্রেস ১০ রমেশ চন্দ্রদত্ত স্ট্রিট, কলিকাতা হতে মুদ্রিত ইতিহাস পরিচয় বই হতে কিছুটা অংশ তুলে ধরছি-“ জোর করিয়া মন্দির জিয়া মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যই যদি আওরঙ্গজেবের থাকিত, তবে ভারতে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্থিত্বই বোধহয় থাকিত না। সেইরূপ করা তো দূরের কথা, বরং বেনারস, কাশ্মীর ও অন্যান্য স্থানের বহু মন্দির এবং তৎসংলগ্ন বহু দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি আওরঙ্গজেব নিজের হাতে দান করিয়া গিয়াছেন; সে সকল ‘সনদ’ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।”

স্কুলের ঐ পাঠ্য পুস্তকে আরও লেখা আছে, “আওরঙ্গজেব সুদীর্ঘ ৫০ বছর রাজত্বের মধ্যে এমন কোন প্রমাণ রাখিয়া যান নাই যে, তিনি কোথাও কোন হিন্দুকে জোর করিয়া মুসলমান করিয়াছেন। এমনকি, শিবাজীর পৌত্র শাহুকে তিনি আট বছর কাল মুঘল দুর্গে বন্দি করিয়া রাখিয়াও কোন দিন তাহাকে মুসলমান করেন নাই; হিন্দুবেশেই শাহু মারাঠা দিগের মধ্যে ফিরিয়া গিয়াছিলেন।”

পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ঐ পুস্তকে আরো লেখা আছে, “মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদিগকে উত্তেজিত করিবার জন্য যে সমস্ত মন্দিরে ব্রাহ্মণগণ প্রচার কার্য চালাইয়াছিলেন কেবল মাত্র সেই গুলিই আওরঙ্গজেব ধ্বংস করিতে আদেশ করিয়াছিলেন। মন্দির তলে সমবেত হইয়া বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করিলে দেবতার আশীর্বাদ লাভ করা যাইবে, এই প্রলোভন দেখাইয়া কুচক্রীগণ কোন কোন মন্দিরকে রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করিয়াছিল। কাজেই তাহাদের ধ্বংসের প্রয়োজন হইয়াছিল।” কিন্তু আজকের স্কুল কলেজের ইতিহাসের ধারা বিপরীত। তাই শ্রীঘোষ তার ইতিহাসে লিখেছেন, “তিনি ইসলামের অনুশাসন বর্ণে বর্ণে পালন করিতেন। সেই জন্য তাঁহার রাষ্ট্রনীতিতে মুসলমান ছাড়া অন্যকোন ধর্মাবলম্বীর দাবি বা অধিকার স্বীকৃত হইত না। বিধর্মীর অধিকার স্বীকার করা ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ।” “... চিন্তা মন মন্দিরে গোহত্যা করিয়া তিনি সাড়ম্বরে তাহা মসজিদে পরিণত করিয়াছিলেন।” “... ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে জানাইয়াছিলেন যে, ইসলামী বিধান অনুযায়ী তিনি কোন নতুন দেবালয় নির্মাণের অনুমতি দিতে পারেন না।” “.... তারপর আরও একটি আদেশ জারি করিয়া তিনি বিধর্মী হিন্দুদের সমস্ত টোল ও চতুম্পঠী দেব দেউল ধ্বংস করিতে বলেন।” ইত্যাদি আরও অনেক অবান্তর ও অবাস্তব কথা।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শ্রীঘোষের ঐ ‘ভারত জনের ইতিহাস’ ভারতে মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ কর্তৃক নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণীর জন্য ১৯৬২ সালে লেখা, আর পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য ঐ “ইতিহাস পরিচয়” বইখানি ১৯৪৬ সালে লেখা। মাত্র ষোল বছরে আমাদের ঐতিহাসিকতার এত উন্নতি অথবা এত অবনতি।

যাইহোক, সত্য সিদ্ধান্তে এটাই গ্রহণযোগ্য যে, হিন্দুদের ধর্মে হস্তক্ষেপ বা মন্দির ধ্বংস আওরঙ্গজেবের নীতি ছিল না। তবে কিছু মন্দির তার সময়ে ভাঙা গিয়েছিল অবশ্য তার পশ্চাতে কিছু কারণও ছিল। প্রথমত মন্দিরগুলো রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, যেটা পূর্ব আলোচনাতেই উদ্ধৃতিসহ প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত আকবরের সময় অনেক মসজিদ ভেঙে সেই স্থানে মন্দির তৈরি করা হয়েছিল এবং অনেক মসজিদকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেও মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। যেমন- ‘মুনতাখাবুওয়াবিক’ ও ‘মোকতুবাতে ইমামে রব্বানী’ নামক দুইটি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ হতে পাওয়া যায়।

"Mosques and prayer-rooms were changed into store rooms and into Hindu guardrooms"

"A number of mosques were destroyed by Hindus and temples erected in there place."

আওরঙ্গজেবের সময়ে সৎনামী দল নামে হিন্দুদের এক দুর্ধর্ষ সন্ন্যাসী দল বিদ্রোহ ঘোষণা করে অনেক বাদশাহী সৈন্যকে নিহত করে এবং অনেক মসজিদ ধ্বংস করে। এই দলের নায়করা প্রচার করত যারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করবে তারা মরবে না, আর যদি ভাগ্যচক্রে মরেই যায় তবে এক এক জনে রক্তে আশিজন করে লোক তৈরি হবে। তাদের পোশাক ছিল অসভ্য ও অদ্ভুত। দাড়ি গোঁফ এমনকি চোখের ঐ পর্যন্ত মুণ্ডিত থাকত, তাই তাদের আর এক নাম ছিল মুণ্ডিত। এদের পরিচয় শ্রীঘঘাষের লেখা ইতিহাসেও কিছু পাওয়া গেছে। যথা-“দিল্লি হইতে প্রায় ৭৫ মাইল দূরে নারলোন জেলায় সত্নামী সম্প্রদায়ের প্রধান ঘাঁটি ছিল।”

“যদি কোন বীর সৎনামীর মৃত্যু হয় তাহা হইলে তাহার রক্ত হইতে আরও ৮০ জন বীরের উৎপত্তি হইবে। দেখিতে দেখিতে প্রায় পাঁচ হাজার সৎনামী অস্ত্রশস্ত্র লইয়া প্রস্তুত হইল। স্থানীয় ফৌজদারকে বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করিতে হইল, শহরও সৎনামীরা দখল করিয়া লুটতরাজ করিল। মসজিদ ধ্বংস করিল এমনকি শাসন ব্যবস্থাও চালু করিয়া ফেলিল।’ (ভাঃ জঃ ইঃ)

অতএব নিরুপায় আওরঙ্গজেব কয়েক হাজার সৈন্য পাঠিয়ে তাদের রক্তে ৮০ জন করে লোক তৈরি হওয়ার ধোকাপ্রদক অপপ্রচারকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেন এবং তাদেরই অত্যাচারে ধ্বংস হওয়া মসজিদগুলো পুনঃনির্মাণ করেন ও তাদের প্রবর্তিত নতুন শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটান। কিন্তু আজ ঐ রাজদ্রোহী দল সৎনামীদের কোন অত্যাচার অনাচার নিরপেক্ষ মানুষদের কাছে নিন্দনীয় হওয়ার কোন কারণ নেই অথচ শ্রীঘঘাষের ইতিহাসে লেখা হয়েছে, মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে সৎনামীরাও বীরের মতো যুদ্ধ করিয়া হাজারে হাজারে নিহত হইল।”

তৃতীয়ত, যারা স্বেচ্ছায় নব মুসলমান হয়েছিল তারা অনেকে কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রাক্তন ধর্মের ওপর কত বিরাগী এবং নতুন ধর্মে কত আস্থাশীল তা প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মন্দিরেরও ক্ষতি সাধন করেছিল। যেমন উত্তরবঙ্গে নব মুসলমান রাজা যদুর গোঁড়ামির কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু মহানুভব সম্রাট সেগুলোর সংস্কার সাধন করে যে উদারতার পরিচয় প্রদান করেছেন তা আজকের বাজারের ইতিহাসে দারুণভাবে দুর্লভ বলা যায়।

(৪) আওরঙ্গজেবের প্রতি আর এক অপবাদ আরোপ করা হয়েছে, “তিনি বৃদ্ধ পিতাকে বন্দি ও ভাইদের হত্যা করেছিলেন।”

পিতাকে বন্দি করা নিঃসন্দেহে দোষণীয়। কিন্তু বন্দি কাকে বলে, তার স্বরূপ কী, বন্দি কেন করা হয় এবং তার উদ্দেশ্যই বা কী ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার, নচেৎ আমরা বন্দি শাহাজাহানকে ঠিক চিনতে পারব না।

বীরত্ব প্রকাশের অভিলাষে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বীকে শৃঙ্খলিত করে কারারুদ্ধ করার নাম বন্দি। বন্দি সাধারণত নানা কষ্টের মধ্যে উপলব্ধি করে তার পরাজয় ও প্রতিপক্ষের জয়ের দাপট বন্দিদের খাওয়া, শোয়ার ব্যবস্থার পরিবর্তে থাকে অব্যবস্থা। কিন্তু শাহজাহান বন্দি কোথায় হয়েছিলেন? তেপান্তরের মাঠেও নয় আর অন্ধকূপ বা রুদ্ধ কক্ষেও নয়, বরং সেই সুরক্ষিত সুসজ্জিত অট্টলিকায়, যা ছিল আকবর, হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর, মমতাজ প্রমুখ খ্যাতনামা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের আরাম কক্ষ, কর্মক্ষেত্র ও গার্হস্থ্য ক্ষেত্র। যেখানে ছিল শাহী পালঙ্ক, শাহী কোমল পালকের গদি-ইয়ামেনী চাদরে ঢাকা। যেখানে তাঁর খাওয়া-দাওয়া, সেবা-শুশ্রুষার জন্য ২৪ ঘন্টা ভৃত্যেরা হাজির থাকত। শাহজাহানের পিতা জাহাঙ্গীর নেই, স্নেহময়ী মাতাও নেই আর স্ত্রী মমতাজ তো বিদায় নিয়ে চলে গেছেন তাজমহলের নিচে। তারা থাকলে হয়ত তারাও থাকতেন ঐ ঐতিহাসিক পরিবেশে। আছেন শুধু তার অত্যন্ত স্নেহ সিঞ্চিতা কন্যা আর আত্মীয়স্বজন। প্রায় সমস্ত আত্মীয়স্বজনই শাহজাহানের সাথে সাক্ষাৎ ও অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া প্রতি মুহূর্তে পিতার খেদমতে বা সেবায় নিয়োজিতা ছিলেন। শুধু তাই নয়, আওরঙ্গজেব সারা দিন রাত্রে অন্তত একবারও রাজকার্য সেরে স্বহস্তে পিতার পদসেবা করতেন, যা আজ প্রত্যেকের মস্তিষ্কে শিহরণের পুলক সৃষ্টি করে।

শাহজাহানের জন্য যখন চারদিকে রব উঠে যায় শাহজাহান পরলোক গমন করেছেন তখন পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। তারপর সর্বশেষে যখন আওরঙ্গজেবের জয় হয় তখন দেখা গেল শাহজাহান মৃত নন বরং মৃত্যুর হাত হতে ভগ্নদেহ শাহজাহান প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। ঐ অবস্থায় তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পিতার অন্ধ স্নেহ বড় দারাশিকোকেই তিনি রাজ্য দিতে মনস্থ করেন। এদিকে বেশির ভাগ হিন্দু প্রজা দারার সমর্থক আর মুসলমানরা আওরঙ্গজেবের সমর্থক। তবুও তিনি গভীর চিন্তাসহ সমাধানের পথ খুঁজতে যাচ্ছিলেন। ঐ অবস্থায় তাকে রাজনীতি করতে দেওয়ার অর্থ জোর করে মৃত্যুপথে নিক্ষেপ করার নামান্তর। অতএব এক্ষেত্রে পিতার পৃথক অবস্থান আধুনিক এবং পৌরাণিক বিচক্ষণ ঐতিহাসিকদের মতে অনুপযুক্ত কর্ম নয়।

দ্বিতীয় কথা শাহজাহানের সঙ্গে সকলেই সাক্ষাৎ করতে পেলেও তার রাজপ্রাসাদের বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। তাই একদিন তিনি আলমগীরকে ডেকে বললেন, “আলমগীর! তোর মত হাফেজ সন্তানের নিকট আমি কি বন্দি?” উত্তরে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন, “আপনি সারা জীবন রাজনীতি করে অন্তরের প্রকৃত শান্তি কি পেয়েছেন?” উত্তরে তিনি বললেন, “ কোনও দিন পাইনি আর আজও পাচ্ছি না। তার ওপর মমতাজও নেই।” আওরঙ্গজেব তখন বললেন, “আল্লাহ তাঁর পবিত্র কুরআনে জানিয়েছেন, “অন্তরের শান্তি আল্লাহর স্মরণেই সম্ভব।” অতএব আমি চাই না যে, আপনি এই বৃদ্ধ বয়সে অশান্তির রাজনীতি করুন। বরং আপনার উপাসনা, আরাধনা আর আল্লাহর স্মরণের জন্যই এই পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা। শাহজাহানের কণ্ঠস্বর আরও কর্কশ হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, “তাহলে আমার প্রিয়া, তোর মা মমতাজের স্মৃতিসৌধ তাজমহল কি আমি আমার ইচ্ছামত দেখতে পাব না?” আওরঙ্গজেব উত্তরে খুব বিনম্রভাবে নিবেদন করেছিলেন, “আব্বাজান! সত্যই কি আপনার তাজমহল দেখার সাধ, নাকি তাজমহল দেখার নামে অন্য কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে?” শাহজাহান অশ্রুপ্লুত নয়নে বলেছিলেন, যেমন করে হোক আমাকে অন্তত একবার করে প্রতিদিন তোমার মায়ের স্মৃতিসৌধটা দেখতে দাও, আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই।” উত্তরে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন, “যদি এখানে আপনার শয়নকক্ষের মধ্যে থেকেই আপনার ইচ্ছামত তাজমহল দেখতে পান তাহলেও আপনাকে বাইরে যেতে হবে?” শাহজাহান বলেছিলেন, “বৎস, বাইরে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়, শুধু চোখে দেখতে চাই তাজমহল।” তখন টেলিভিশন ছিল না, শাহজাহানের ধারণা ছিল বাইরে না গিয়ে তাজমহল দেখা অসম্ভব। কিন্তু আওরঙ্গজেব পৃথিবীর এক মূল্যবান মণি বিজ্ঞানময় কৌশলে দেওয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত করিয়ে দিলেন তার মধ্যে দৃষ্টি দিলে দূরের তাজমহল স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যেত। এখন ইংরেজ তা খুলে নিয়ে চলে গেছে। তবুও নকল যে পাথরটি বিকল্পভাবে লাগিয়েছে। তাতেও তাজমহল দৃষ্ট হয়।

আসল সত্য আরও উহ্য হয়ে আছে অনেকের কাছে। যেমন শাহজাহান ভয়াবহ মৃত্যুপীড়া হতে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন বটে কিন্তু বিশুদ্ধ বিবেক ও জ্ঞান প্রায় নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল; আর মমতাজের গর্ভ হতে গর্ভস্থ শিশুর কান্নার স্বর শোনা গিয়েছিল। (কারো মতে পেটের ভেতরে পীড়াজনিত শব্দ- শিশুর ক্রন্দন নয়)। সমস্ত চিকিৎসক ও সাধারণের কাছে ওটা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ঐ উপসর্গই মমতাজের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। তখন শাহজাহান শিশুর মত কেঁদে বলেছিলেন, “হে আল্লাহ! আমার অর্থবল, জনবল, মনবল সবকিছুর বিনিময়েও মমতাজকে ফেরাবার কোন উপায় নেই। কারণ তোমার শক্তির সামনে আমাদের অস্তিত্ত্ব কত অসাড়, কত অকেজো।” তাই মমতাজের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সে যুগে বিশ কোটি বার লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাইশ বছর ধরে বহু লোকের পরিশ্রমে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য তাজমহল তৈরি হয়েছিল। ফলে রাজকোষ প্রায় অর্থশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাতেও বৃদ্ধ শাহজাহান মানসিক অসুস্থতা হেতু শান্তি পাননি। তুষার শুভ্র আকাশছোঁয়া তাজমহল যথেষ্ট নয় মনে করে আর একটি ভ্রমর কালো কৃষ্ণ পাথরের তাজমহল তৈরি করতে মনস্থ করলেন। ভেতরে থাকবে পান্না-হীরা-চুন্নি, পদ্মরাগ মণি প্রভৃতি অমূল্য ধাতুর অদ্ভুত সংস্থাপন। আর শুভ্র ও কৃষ্ণ তাজমহলের মাটির নিচ দিয়ে থাকবে সংযোগ রাস্তা। শাহজাহান বিশেষ কোন প্রস্তুতি এবং পরামর্শ না করে কাজ শুরু করেছিলেন বলে কিছু ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। আওরঙ্গজেব বুঝেছিলেন, আবার যদি দ্বিতীয় তাজমহল সৃষ্টি হয় তাহলে দিল্লির রাজদরবার অর্থনৈতিক পতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। তার ওপর পুত্রদের কলহ বিবাদের কারণে মমতাজের মৃত্যুশোকের প্রভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি মুহুর্তে মুহূর্তে মত পরিবর্তন করতে এবং ভুলক্রমে বহু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের ওপর অনুমতি দান এবং প্রয়োজনীয় বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিতে দ্বিধা করতেন না। তার অন্যতম কারণ ছিল, শারীরিক ও মানসিক দৌর্বল্যের জন্য তিনি তদন্ত বা সমীক্ষার পরিবর্তে সংবাদদাতা যা প্রথমে শোনাতেন তাই তাঁর মনে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হয়ে যেত। তারপর তা মুছে ফেলা এবং আসল কথা বোধগম্য করানো বেশ কষ্টকর ছিল। শাহজাহানের জ্যৈষ্ঠ পুত্র দারা শাহজাহানকে সেবার নামে পরনিন্দা এবং নিজের পিতার প্রতি আনুগত্য এবং সারা ভারতে দারার কত জনপ্রিয়তা ও মনপ্রিয়তা আছে তা বারবার তুলে ধরে পিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, অথচ গোটা ভারতবর্ষের মুসলিম জাতি বিশেষ করে মুসলমান মন্ত্রী, সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দারার প্রতি দারুণ অনাস্থা আর অবিশ্বাস ছিল। যেহেতু তিনি তাঁদের ধর্মত্যাগী বলে বিবেচিত হতেন। সুতরাং দারাকে সিংহাসনে দিলেই বিদ্রোহের দাবানল হু হু করে জ্বলে উঠতো। সারা দেশে একাধিক বিদ্রোহ দমন করা সহজ কিন্তু নিজের দরবারের বিদ্রোহ দমন করা মোটেই সহজসাধ্য নয় বরং অসাধ্য। অতএব নানা দিক দিয়ে চিন্তা করে দেখলেন, এ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে হয় যে, যদি শাহজাহানের বন্দি-মার্কা বিশ্রামের ব্যবস্থা না করা হতো তাহলে অবস্থা যা হতো তা লোমহর্ষক। তাই বিচক্ষণ ইতিহাস বিজ্ঞানীদের মতে শাহজাহানকে আরাম কক্ষে আটকে রক্তনদীর স্রোতস্বিনী গতিকে স্তব্ধ ও বন্দী করা হয়েছে। বন্দি হবার পূর্বে শাহজাহান এক দুঃসাহসিক কুৎসিত পদক্ষেপ নিতে গিয়েছিলেন যা তার সদগুণ ও সুনাম যশের মৃত্যু ঘটাতো যদি না তিনি অসুস্থ, অতিবৃদ্ধ এবং স্ত্রীর বিয়োগ ব্যথায় মস্তিষ্ক বিকৃত রোগী বলে গণ্য না হতেন। তবুও তা সত্যের খাতিরে উল্লেখ করা প্রয়োজন।

আওরঙ্গজেব যখন দিল্লি হতে দূরে ছিলেন তখন তাঁরই পুত্র মুহম্মদকে সিংহাসন দেবার লোভ দেখিয়ে বাচ্চা বয়স্ক শিশুকে বিদ্রোহী করতে চরম চেষ্টা করেছিলেন শাহজাহান। কিন্তু শাহজাহানের ঐ চক্রান্ত সফল হয়নি। আওরঙ্গজেবের সুনাম ও সদগুণাবলীর কারণে দেশ-বিদেশে, ঘরে-বাইরে তিনি ‘ফকীর’, ‘জিন্দা পীর’, ‘দরবেশ’, ‘আলমগীর এবং মহিউদ্দীন’ এমন বহু নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ছিল বজ্রের মত বিশেষত নারীর প্রতি আকর্ষণ হেতু তিনি কোন দিনও নমনীয় ছিলেন না। তাই দারা এবং তার সমর্থকদের পরামর্শে আওরঙ্গজেবকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। তবে, পরামর্শ দাতারা তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নতুন অগ্নি বিপ্লব ও বিদ্রোহ যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে তা তারা বুঝতে পেরে ঠিক করেছিলেন আওরঙ্গজেবকে রাজদরবারে বা হেরেমে আসতে বলা হবে। তাঁর আসার সাথে সাথেই দুর্ধর্ষ তাতার যুবতীরা তাকে জোর করে মদ্যপান করার চেষ্টা করে সকলে মিলে হত্যা করবে। পরে রটিয়ে দেয়া হবে তিনি বাইরে মদ্যপান এবং ব্যভিচারের বিরোধী ছিলেন বটে কিন্তু হেরেমে তিনি স্বয়ং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে তার রমণীদের ব্যভিচারে বাধ্য করতে গিয়ে নিহত হন। এর ফলে প্রমাণ হবে আওরঙ্গজেবকে হত্যা করা হয়েছে ঠিকই হয়েছে। হয়ত কেউ কোন প্রতিবাদ না করে এটাই মেনে নেবে যে, “চকচক করলেই সোনা হয় না।” সমস্ত চক্রান্ত ঠিকঠাক। শাহজাহানকে শুধু শোনানো হয়েছিল যে, আওরঙ্গজেব পিতৃ হত্যার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন কিন্তু তাঁর সুযোগ্য পুত্র দারা এবং তাঁদের অনুচরবর্গের দ্বারা তা ব্যর্থ হয়। অতএব নিজে নিহত হবার পূর্বেই আওরঙ্গজেবের উপযুক্ত দণ্ডের প্রয়োজন আছে।

আওরঙ্গজেবকে শাহজাহানের স্বাক্ষর করা পত্র পাঠানো হল। তিনি সেদিন অসুস্থতা সত্ত্বেও পিতার আদেশে আগমন করতে প্রস্তৃত হলেন। রাজদরবারে পৌঁছেও পিতার আদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে কোন ত্রুটি হয়নি যদিও কুপরামর্শ দাতাদের পরামর্শে তিনি আওরঙ্গজেবের প্রতি অনেকবার পক্ষপাতিত্ব ও অবিচার করেছেন। কিন্তু তবুও সমস্ত কিছু ভুলে পিতার পদপ্রান্তে হাজির হয়ে শুভাশিস নেবেন আওরঙ্গজেব আর প্রত্যক্ষ শুভাশিস নেবেন বিখ্যাত বিদূষী ভগ্নি জাহানারার। যিনি সমস্ত কোরান কণ্ঠস্থ করেছিলেন এই সত্যের প্রতিচ্ছবি বোনদেরই কাছ হতে।

যারা আজও মৌলিক ইতিহাসে চরিত্র দৃঢ়তায় স্বচ্ছ সুন্দর তারকার ন্যায় অমর হয়ে আছেন সেই পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী রওশনআরা চক্রান্তের সংবাদ অবগত ছিলেন। তবুও তাঁর সহনশীলতার সীমান্ত অতিক্রম করে গিয়েছিল। যখন বুঝতে পারলেন আওরঙ্গজেবের মৃত্যু অবধারিত তখন তিনি বিশ্বস্ত দূত দ্বারা আওরঙ্গজেবকে সংবাদ পাঠালেন এবং সমস্ত চক্রান্তের ধারা জানিয়ে দিলেন। আওরঙ্গজেব চক্রান্তকারীদের ওপর অতিশয় দুঃখিত হলেন এবং সেই সঙ্গে তাদের দমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

প্রতিনিয়ত পিতার ঘন ঘন ভুল-ভ্রান্তির অবসান ঘটানোর একটা পথ ছিল পিতাকে হত্যা করা অথবা বন্দি করা। কিন্তু পিতৃহত্যা আওরঙ্গজেবের প্রাণপ্রিয় ধর্মের বিপরীত এবং মানবতাবিরোধী, যা তার পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে সমস্ত ফিতনা-ফাসাদের মূলোৎপাটনের জন্য সহজ-সরল স্বাভাবিক পথে সম্মানজনক ও আরামদায়কভাবে আটক রাখার ব্যবস্থা করলেন। আর এরই নাম নাকি বন্দি।

এবার কিঞ্চিৎ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন এত সাধু, সন্ন্যাসী, ফকির, জিন্দাপীর, সত্যের প্রতীক বিখ্যাত পণ্ডিতের পক্ষে কীরূপে সম্ভব হয়েছিল সিংহাসনকেন্দ্রিক কোন্দল? কীরূপে সম্ভব হয়েছিল ভাইদের সঙ্গে যুদ্ধ? আর এ কথা কী সত্য যে, তিনি তাঁর ভাইদের হত্যা করেছিলেন?

এবার আসুন সমীক্ষান্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাক। আওরঙ্গজেব ছোট বেলাতেই সমগ্র কোরআন শরীফ কণ্ঠস্থ করেছিলেন। ত্রিশ অধ্যায় যুক্ত সমগ্র কোরআন মুখস্থ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি একজন পূর্ণ আলেম, মোল্লা ও মাওলানা হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আওরঙ্গজেব সারা দিন রাতে খুব বেশি কোরআন পাঠ করতেন, তার প্রমাণ মূল ইতিহাস। আর যুক্তি হচ্ছে তিনি নিজ হাতে কোরআন কপি করতেন। তখন প্রেস ছিল না, অতএব অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও জোরালো স্মরণ না রাখলে তা অনর্গল লেখা যায় না, অথচ তার শুধু একটি অক্ষর নয় বরং একটি ‘জবর’ ‘জের' অর্থাৎ আ-কার ই-কার পর্যন্ত গোলমাল হলে সেই কোরআন বাতিল বলে গণ্য হয়।

আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন, তিনি রাজ্য রাজনীতি ত্যাগ করে শুধুই সাধনা উপাসনা ও কৃচ্ছ্ব সাধনের মধ্য দিয়ে কাটাবেন কিন্তু শাহজাহান জানতেন ভাইদের মধ্যে আওরঙ্গজেবই একমাত্র যোগ্য। সেজন্য পিতা-পুত্রে যৌবনের পদার্পণের পর হতেই ঐ বিষয়ে মৃদু উপদেশ, আদেশ আর তিরস্কারের কষাঘাত সহ্য করতে হয়েছে আওরঙ্গজেবকে অনেকবার। শেষে জয় হলো পিতা শাহজাহানের। পিতার শেষ যুক্তি ছিল এই- “তুমি আমার চেয়ে ধর্মের দিকে শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর। সুতরাং পিতার সেই আদেশ শিরোধার্য, যদি সেই আদেশ ধর্মের প্রতিকূল না হয়। অতএব রাজনীতি করা ধর্মে অনুমোদিত না নিষিদ্ধ তুমিই ঠিক করে নিও। আমার দ্বিতীয় কথা- আমা অপেক্ষাও তুমি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বেশি ভক্ত বলে আমার ধারণা। অতএব তিনি ঘরসংসার স্ত্রীপুত্র পরিজন সমাজ ত্যাগ করে ধার্মিকতা প্রদর্শন করেছেন না সমস্ত কিছুর ভারসাম্য বজায় রেখে ধার্মিকতার শ্রেষ্টতম কৃর্তি স্থাপন করেছেন? এই সুচিন্তিত এবং সূক্ষ্ম অথচ তীব্র প্রশ্নের উত্তরে আওরঙ্গজেবকে পরাস্ত হতে হয় এবং পার্থিব জনকল্যাণকর বিষয়ে তাঁকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হতে হয়।

সেই সময়ে ভারত বিখ্যাত একজন মুসলমান ফকির এবং খুব উচ্চপর্যায়ের সাধকের দরবারে তার দোয়া নেবার জন্য অনেকেই যেতেন। বাল্যকালে আওরঙ্গজেব স্বয়ং তার পর্ণকুটিরে পদার্পণ করে তাঁকে দেখে অবাক হলেন। ছিন্ন তালি দেওয়া বস্ত্র, নির্ভয় চিত্ত। প্রফুল্লাবন উদাসভাবে আর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে অবিলম্বে উত্তর দান যেন পাগল, শিশুর উত্তর প্রদানের মত।

আওরঙ্গজেব তাকে সালামপূর্বক বললেন- “আমার কিছু বক্তব্য আছে।” সাধক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “আগে বস তারপর কথা।” ছেড়া পুরাতন মখমলের উপর তার পাশে বসলেন এবং বললেন- “আমি দিল্লির সিংহাসনের জন্য দোয়া নিতে এসেছি, যেন সাড়া ভারত জুড়ে অশান্তি আর রক্তপাত না হয় আর আমার মধ্যে যেন রাজকার্য পরিচালনা করার যোগ্যতা থাকে।” উত্তরে তিনি বললেন, “কেন? তুমি তো দিল্লির সিংহাসন পেয়ে গেছ তার ওপরে তো তুমি বসে আছ।” তারপর তার সেই ময়লা মখমলে হাত চাপড়ে বললেন- “দেখ, এটাই হলো দিল্লির সিংহাসন।”

দারা, সুজা, মুরাদ একে একে ঐ জীবন্ত দরবেশের কাছে হাজির হলেন। প্রত্যেকেই যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনপূর্বক দিল্লির বাদশাহী পাবার অনুকূলে দোয়া প্রার্থনা করলেন। স্বনামধন্য দরবেশ প্রত্যেককে বসতে বললেন। তখন সকলেই মাটির উপর বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর দরবেশ বললেন- “তোমরা তোমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে নিয়েছ।” তখন সকলেই একবাক্যে উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন তাদের ভাগ্য ফল। দরবেশ বললেন, “মাটিতে যারা বসেছ তারা বাদশাহী পাবার যোগ্য নয়।”

আওরঙ্গজেব অত্যন্ত যোগ্য ছিলেন বলেই সম্রাট শাহজাহান তাঁকে অনেকবার জোর তাগিদে যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্রোহ দমনে, প্রশাসনকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন। ঐতিহাসিকরা একমত যে, দীর্ঘদিন যাবৎ আদিল শাহের সঙ্গে শাহজাহানের যুদ্ধ চলছিল। শাহজাহান শিবাজীর পিতা শাহজী ও আদিল শাহের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে সম্রাট সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেন। দাক্ষিণাত্য সম্রাটের করতলগত হল। এ শত্রুভাবাপন্ন দুধর্ষ দাক্ষিণাত্যের শাসনভার কোন শাহজাদাকে দেয়া যায়, অনেক চিন্তা-ভাবনার পর আওরঙ্গজেবের ওপর দাক্ষিণাত্যের প্রশাসন ভার ন্যস্ত হয়। অতএব এখানে অন্য ভাইদের তুলনায় আওরঙ্গজেবের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পাওয়া গেল। শাহজাহান অন্য পুত্রদেরও দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দারা, সুজা একেবারে মাতাল ও অপদার্থ ছিলেন। অবশ্য মুরাদের মধ্যে কিছু যোগ্যতার আভাস পাওয়া যেত। ১৬৪৬ খৃস্টাব্দে আল মর্দান নামে একজন সুদক্ষ বীর সেনাপতি মুরাদের অধীনে বলখ বিজয়ে পাঠালেন। সম্রাট শাহজাহান মুরাদের ত্রুটি বিচ্যুতি সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন তা সত্ত্বেও যুদ্ধে অধ্যবসায়ী ও দুরদর্শী হওয়ার মানসে সম্রাট শাহজাহান এ সমরায়োজন করেছিলেন। আলি মর্দানের যুদ্ধ কৌশলে বলখ মুঘলদের দখলে আসে। আয়েসী মুরাদ পার্বত্য প্রদেশে থাকতে চাইলেন না। সুষ্ঠু মোঘল প্রশাসন কায়েম না করে মোঘল হেরেমে ফিরে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে উজবেগগণ শক্তিশালী হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করল, বলখ মুঘলদের হাত হতে চলে গেল। সম্রাট শাহজাহান তখন তিরস্কার করে বললেন, “আমার আদেশ অগ্রাহ্য করে ফিরে এসে যে অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে তাতে আমার চেয়ে তোমারই ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়েছে”।

যাইহোক পুনরায় তিনি আওরঙ্গজেবকে পাঠালেন বলখ বিজয়ে। আওরঙ্গজেব পিতার আদেশে দুরাকাত নামায অন্তে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে রওয়ানা হলেন। এখন বলখ হাতছাড়া, আবার নতুন করে বিদ্রোহ করে বলখ দখল সহজসাধ্য নয়, তবুও আওরঙ্গজেবের উৎসাহ ও আত্মপ্রত্যয়ের অভাব নেই। ১৬৪৭ খৃস্টাব্দে যে তিনি বীরবিক্রমে পুনরায় বলখ অধিকার করলেন এবং বিদ্রোহের মূলোচ্ছেদ করে দেশে আবার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন।

এদিকে আবার বুখরা হতে আবদুল আজিজ এক বিরাট সৈন্যদল নিয়ে আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করলেন। আওরঙ্গজেব আবার দুরাকাত নামায শেষে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে এক উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণে সৈন্যদের অপরাজেয় মনোবলের অধিকারী করে তুললেন। ঐ আক্রমণকারী দলকে প্রতিহত করে তিনি তৈমুরাবাদের দিকে সসৈন্য ধাবিত হলেন। ঐ সময় তাঁর বীরত্ব বুদ্ধিমত্তা রণনিপুণতা ও দুরদর্শিতায় ভীত বা প্রভাবিত হয়ে বুখারার সুলতান সন্ধির প্রস্তাব দেন।

ঠিক ওই সময়ে মুঘল বাহিনী ভারতে ফিরে যেতে চাইলে বিচক্ষণ আওরঙ্গজেব মেনে নিয়ে ভারত অভিমুখে যাত্রা করে ১৬৪৭ খৃঃ কাবুলে এসে পৌঁছলেন। ভারত সীমান্ত পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশের ঐ বিপদসংকুল স্থানে আওরঙ্গজেবের অভিযানের কারণ সম্রাট শাহজাহান এক সময় পুত্রদের কাছে তৈমুরের বাসভূমি ও পূর্বপুরুষদের অধিকৃত সমরখন্দ দখলের অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন। পিতার ঐ মনস্কামনা পূরণের জন্য আওরঙ্গজেব মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে সৎ সাহস ও পিতৃআনুগত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সৈন্য বাহিনী দীর্ঘকাল বিদেশে কাটানোর ফলে যুদ্ধবিমুখ হয়ে দেশে ফিরতে চাইলে আওরঙ্গজেব এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। উপরোক্ত আলোচ্যাংশে মুরাদের অযোগ্যতা আর পিত্রাদেশ অবহেলা সবিশেষ লক্ষণীয়। অপরদিকে আওরঙ্গজেবের যোগ্যতা, ধর্মপ্রবণতা এবং পিতৃভক্তির আদর্শ প্রণিধানযোগ্য। মধ্য এশিয়ায় দ্বিতীয় শাহ আব্বাস কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলে এবারেও দূরদর্শী যুদ্ধনীতি বিশারদ আওরঙ্গজেবকেই যেতে হল মৃত্যুর মুখোমুখি হতে। ১৬৪৮ খৃস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে আওরঙ্গজেব প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে বিজয়ী হয়ে শাহজাহানকেই শুধু নয় বরং সর্বজন মনে আকর্ষিত হন।

আওরঙ্গজেবের এত বীরত্ব ও খ্যাতি অপর ভাইদের চিন্তিত করে তুলেছিল; বিশেষ করে দারাকে। তাই শাহজাহানের কানে নানাভাবে বিষবর্ষণ শুরু করেছিলেন। ঠিক ঐ সময়ে এক নতুন ঘটনা ঘটে যায়। ১৬৪৯ খৃঃ ১৬ মে আওরঙ্গজেব পারসিকদের সঙ্গে যুদ্ধে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পরাজিত হন। অমনি অপরের প্ররোচনায় শাহজাহান আওরঙ্গজেবের ওপর ক্রোধান্বিত হয়ে পত্র লেখেন— “পত্র পাঠ প্রত্যাবর্তন কর, আমার আদেশ এটাই। কারণ তোমার ত্রুটিতেই পরাজয় হয়েছে।”

আওরঙ্গজেব কোন দুঃখ অভিমান ক্রোধ প্রদর্শন না করে পিতার পদপ্রান্তে উপস্থিত হলেন। সিংহাসন, বিজয়মালা, নেতৃত্ব কিছুই রাজপুত্রের যেন প্রয়োজন নেই, শুধু চান উপাসনা করার সুযোগ, পড়ার আর লেখার ফুরসত।

সম্রাট লোকের কথা শুনে যে ভুল করেছিলেন একথা তাঁকে কেউ হয়তো বলেনি কিন্তু ঠিক তার পরেই সম্রাট নিজেও চেষ্টা করলেন একবার। কিন্তু পরাজিত হলেন। আবার তৈরি হয়ে আক্রমণ করলেন। তিনবার আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে মুখে স্বীকার করলেও বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, আওরঙ্গজেব ত্রুটিমুক্ত। আর জয়ের সাথে পরাজয়ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, যেমন করে আলোকের পাশে অন্ধকার থাকে সম্পর্কযুক্তভাবে।

যাইহোক, যখন সম্রাটের মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ রটিয়ে দেয়া হলো সেই সময়ে আসলে সম্রাট সত্তর বছরের বৃদ্ধ শয্যাগত কঠিন মুমূর্ষ রোগী। তার মৃত্যুর কথা রটিয়ে দারা দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন। এ ঘটনাটি ঘটেছিল ১৬৫৭ খৃস্টাব্দে।

শ্রীঘোষ তার ইতিহাসে দারার প্রতি দারুণ দরদ থাকা সত্ত্বেও লিখেছেন, “কিন্তু পিতার স্নেহের ছায়ায় মানুষ হয়ে তিনি যুদ্ধবিগ্রহ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রায় অনভিজ্ঞ ছিলেন বলা চলে।” দ্বিতীয় পুত্র সুজার জন্য লিখেছেন, “কর্মবিমুখতা ও আলস্য তাঁর চরিত্রের প্রধান দোষ ছিল।” আরও লিখেছেন, ‘স্থির হয়ে কোন কাজ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।” অন্যদিকে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লেখক বহু প্রকার অশ্লীল অসংযত অপবাদ সৃষ্টি করলেও দু-একটি ইতিহাসে যা বলা আছে তা বিশ্বাস করলে লেখকের নিজের লেখা অভিযোগগুলো মিথ্যায় পরিণত হয়। আর আওরঙ্গজেব সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন শ্ৰী ঘোষ লিখেছেন, “আওরঙ্গজেবের চরিত্র ছিল এর ঠিক বিপরীত। যেমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তেমনি স্থির বীর ও হিসাবী, কর্মক্ষম ও তৎপর ছিলেন তিনি যথেষ্ট। রাজনীতির জটিলতা সম্বন্ধে তাঁর যে প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়তো শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হবেন।” তিনি মুরাদের জন্য লিখেছেন, “কোন দিক দিয়ে তিনি আওরঙ্গজেবের সমকক্ষ ছিলেন না।”

মোটকথা, বিবাদ, ঝগড়া, কাটাকাটি হত্যা লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা নিঃসন্দেহে দোষণীয়। কিন্তু রাজাদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, অশোকের নরহত্যা, ভাতৃ হত্যা ও দেশকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস সাধারণ দৃষ্টিতে মন্দ হলেও রাজা-বাদশাহের ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। বিগত ও বর্তমানের হতভাগ্য ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করছে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও ঐ দোহাই দিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার ওকালতি করে তার উজ্জ্বল ইতিহাসকে অনুজ্জ্বল না করাই শ্রেয়।

শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার পরাজয় ও মৃত্যুর জন্য দায়ী যশোবন্তসিং এবং রাজপুতগণের বিশ্বাসঘাতকতা। প্রথমে দারার বিরুদ্ধে তিন ভাই-ই একমত হলেন যে, দারাকে কোন মতেই দিল্লির সিংহাসনে রাখা যাবে না। আওরঙ্গজেব সিংহাসনলোভী ছিলেন না বরং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেককে অকল্যাণ হতে রক্ষা করতেই তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। অবিভক্ত বঙ্গে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ইতিহাস পরিচয় যা ১৯৪৬ সালের সেই পুস্তক এবং ইংরেজ ঐতিহাসিক Lanepole, Analas of Rajas than, প্রফেসর যদুনাথ সরকারের 'History of Auranjeb' এবং ১৯৬৩ সালে ছাপা প্রফেসর H. R. Chaudhury A. B. Siddique প্রমুখ পণ্ডিতদের বই পুস্তক এবং 'তারিখে আলমগীর' ইত্যাদি পুস্তক হতে কিছু আলোচনা করা হচ্ছে।

“দারার চঞ্চল স্বভাব এবং রুক্ষ মেজাজের জন্য দরবারের অনেকেই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁর মতবাদ (হিন্দুবাদ) অনেকের মনে বিরুদ্ধভাব এবং ঘৃণার উদ্রেক করেছিল। তার হিন্দুদের সঙ্গে মিত্রতা বরং শিয়া মতবাদের প্রতি অনুরাগ সিংহাসন লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয় পুত্র বাংলার শাসনকর্তা সুজা বুদ্ধিমান এবং কৌশলী শাসক ছিলেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত আমোদপ্রিয় ছিলেন এবং মদ্যপানের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি তাঁর অনেক সদগুণ নষ্ট করেছিল।”

শ্রী ঘোষের ইতিহাসে উদ্ধৃতি উপরে দিয়েছি তাতে তিনি যে মদ্যপানের চূড়ান্ত মাতাল ছিলেন এটা গোপন রাখা হয়েছে। আর শেষের উদ্ধৃতির মধ্যে তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা, নারীলোলুপতা ও ব্যভিচার দোষ গোপন করে শুধু লেখা হয়েছে আমোদপ্রিয় ছিলেন।

তারপর অধ্যাপক চৌধুরীদের ইতিহাসে ঠিক তার পরেই লেখা আছে-“সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসনকর্তা। তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়েছিলেন। তিনি চরিত্রহীন এবং ঘোর মদ্যপায়ী ছিলেন। শাসকদের যে সমস্ত গুণ থাকা দরকার তার মধ্যে অভাব ছিল।” অতএব রাজপুত্র চরিত্রহীন মদ্যপায়ী হলে রাজ্যের সুন্দরী সতীদের কী পরিণতি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একজন খুব ধনী বিত্তবান ধনকুবের মদ্যপায়ী ও চরিত্রহীন হলে বাড়ির চাকরানীর ও অধীনস্থ নরনারীর ভাগ্যে কী ভয়াবহ দুর্ভোগ নেমে আসে তা অনেকের জানা আছে। অতএব আওরঙ্গজেব মাথা তুললে ভারতের ভাগ্যাকাশে সৌভাগ্য সূর্যের মত উদিত না হলে অন্যায়ের অন্ধকার ভারতের নির্মল নীলকাশের গায়ে জমাটবদ্ধ রূপ নিত এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

দারা তার পিতার স্নেহের সুযোগে আওরঙ্গজেবের ওপর যে অত্যাচারের ষ্টীমরোলার চালিয়ে ছিলেন তার সংক্ষিপ্ত নমুনা দেয়া হচ্ছে মাত্র।

(ক) ১৬৪৪ খৃস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য হতে আওরঙ্গজেবকে আকস্মিক অপসারণ যা অন্য কোন রাজকুমারের পক্ষে সহ্য করা সহজসাধ্য ছিল না।

(খ) কান্দাহারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার যুদ্ধের পূর্ণ আয়োজন করে আক্রমণ করার ঠিক পূর্বাহ্নে হঠাৎ সংবাদ পৌঁছলে নিষেধাজ্ঞার। তাও তরুণ শাহজাদা মুখ বুজে সহ্য করলেন।

(গ) মুলতান শাসনের সময় সৈন্যদের খরচপত্রের জন্য পিতার কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন পেশ করলেন। কিন্তু অসহায় অবস্থায় তাঁকে কোন সাহায্য করা হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হল। আওরঙ্গজেব তাও মুখ বুজে সহ্য করলেন।

(ঘ) আওরঙ্গজেব নিজের পুত্রের সাথে সুজার একটা সতী সুন্দরী কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেয়ার মনস্থ করেন কিন্তু তাতেও তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন।

ইতিহাস আজও মজুত আছে ঐ সমস্ত অপকর্মের মূলে দারার কারসাজি ছিল সাংঘাতিকভাবে। যেমন প্রফেসর এইচ চৌধুরীদের ইতিহাসে লেখা আছে-“আওরঙ্গজেবের প্রতি শাহজাহানের এই ব্যবহারের মূলে দারার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রকট।” ‘পাক ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস’ পুস্তকের ২৮৬ পৃষ্ঠা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি।

‘দারা তাঁর ভকিলগণের (vokil) নিকট হতে এই মর্মে আশ্বাস লাভ করেছিলেন যে, দূর প্রদেশে অবস্থানরত শাহজাদাদের নিকট তাঁরা সম্রাট অথবা দরবারের কোন সংবাদ পাঠাবেন না। কেন্দ্রের সাথে সকল যোগাযোগ তিনি বিচ্ছিন্ন করেছিলেন এবং পথিকগণ যাতে কেন্দ্রের কোন খবর প্রচার করতে না পারে তার জন্য বাংলা, গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর ভকিলদের সম্পত্তি পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের অধীনে বিজাপুরে সংগ্রামরত কর্মচারীদের তিনি রাজধানীতে ফিরে আসার জন্য আদেশ দান করেছিলেন। শাহজাদাগণ রাজধানীতে প্রবেশের পূর্বেই তাঁদের আক্রমণ করার জন্য তিনি সৈন্যদের আদেশ দিয়েছিলেন। দারা শিকোর এই কার্যাবলি ভ্রাতৃসংগ্রামকে উদ্দীপ্ত করেছিল।” দারা শিকোর ভেতরের এত নোংরামি, অবিচার, অন্যায় ইতিহাসে না জানিয়ে শুধুমাত্র আওরঙ্গজেবের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রুদের বীর এবং সজ্জন বলে মানুষের মনে মনস্তাত্ত্বিক ধারণা জন্মিয়ে দিতে কাজ শেষ করে গেছেন অনেকেই, কিন্তু এখন সমস্ত চক্রান্ত শিক্ষিত উদারচেতা মানুষদের কাছে আস্তে আস্তে ধরা পড়ছে এবং আরও ধরা পড়তে থাকবে।

আওরঙ্গজেবের ওপর এত অবিচার আর অপমানজনক অলীক অনাচার প্রয়োগ সত্ত্বেও তিনি কোন চরিত্রের মানুষ ছিলেন তা জানার জন্য বিখ্যাত ইতিহাস ‘আদব-ই-আলমগীরী’ হতে আওরঙ্গজেবের নিজের হাতের লেখা একটি মূল্যবান পত্র যা তার বোন হাফেজা জাহানারাকে তিনি লিখেছিলেন। সেটির অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে-“যদি সম্রাট তাঁর সমস্ত চাকরদের মধ্যে কেবল আমারই অবমাননার জীবনযাপন এবং অগৌরবময় মৃত্যুবরণ দেখতে ইচ্ছা করেন, তাতেও আমি পিতার বিরুদ্ধে যেতে পারব না।... কাজেই সম্রাটের অনুমতিক্রমে যাতে রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি না হয় এবং অন্য লোকের (দারার) মনে শান্তি ব্যাহত না হয় সেই জন্য এ বিরক্তিকর জীবনযাপন হতে মুক্তি নেয়াই উত্তম। দশ বছর পূর্বে আমি এ সত্য উপলব্ধি করেছিলাম এবং জীবন বিপদাপন্ন বুঝতে পেরেই অন্য লোকের (দারার) ক্ষতির কারণ না হবার জন্যই পদত্যাগ করতে ইচ্ছে করেছিলাম।”

শাহজাহান মৃত্যু ব্যাধি হতে মুক্তি লাভ করে নভেম্বর মাসেই সুস্থ হয়ে উঠেন। কিন্তু তার আগেই দারা পিতার এত অন্ধ ভালবাসা পেয়েও সিংহাসন দখল করে নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেছিলেন। মুরাদও লোভ সংবরণ করতে পারলেন না। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই আহমদাবাদে রাজমুকুট ধারণ করে নিজেকে হিন্দুস্তানের বাদশাহ বলে ঘোষণা করলেন। সুজাও সোজাসুজি পথ ধরলেন অর্থাৎ তিনিও বাংলাদেশের স্বাধীন রাজা বলে নিজেকে ঘোষণা করলেন। আওরঙ্গজেব তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়; শুধু ভাবছিলেন এ অপদার্থ ভাইদের হাতে সিংহাসন যাওয়া মানেই বাচ্চা ছেলেদের হাতে ধারাল অস্ত্র তুলে দেয়া। তাই তিনি ইস্তেখারার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে তাঁকে বলা হলো ‘তুমি তোমার লক্ষস্থানে পৌঁছার চেষ্টা কর, তোমার সাধুতা ও রাজ্য পরিচালনা দুই-ই এক সঙ্গে সম্ভব হবে।’

তিনি এবার সসৈন্যে মীরজুমলাকে সেনাপতি করে অগ্রসর হলেন। ১৬৫৮ খৃস্টাব্দে মার্চ মাসে উজ্জয়িনীতে তিনি সৈন্যসামন্তসহ মুরাদের সাথে মিলিত হলেন। ঐ সময় সাধারণভাবে এটা অসম্ভব ছিল না যে, মুরাদকে যুদ্ধে নিহত করে পথ নিষ্কন্টক করা। কিন্তু কোন যুদ্ধই হলো না বরং মিলনের কথাই হলো।

এদিকে দারার সঙ্গে সসৈন্যে যুদ্ধ হলো ১৬৫৮ খৃঃ ১৪ মার্চ সুজার। সুজা পরাজিত হলেন কিন্তু মুরাদ আর আওরঙ্গজেবের বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য দারার সেনাপতি যশোবন্ত সিং এবং কাসেম খাঁ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ১৬৫৮ খৃঃ ১৫ এপ্রিল তুমুল যুদ্ধ হয় উজ্জয়িনীর নিকট ধর্মাট নামক স্থানে। যুদ্ধে দারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, চরম মুহূর্তে রাজপুত সেনাপতি যশোবন্ত সিংয়ের বিশ্বাসঘাতকতা। মিঃ ঘোষও তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন-“মোঘল শিবিরে হিন্দু সেনাপতি যশোবন্ত সিং ও মুসলমান সেনাপতি কাসেম খার মধ্যে মতবিরোধের ফলে আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়ী হন।” এই সময় যশোবন্ত সিং পলাতক দারার দরদে দরদি হয়ে পত্র পাঠালেন, “যদি তিনি আজমীরে আসতে পারেন তবে তিনি এবং অন্য রাজপুতেরা তাকে সাহায্য করবেন। এই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে দারা আজমীরে এসে উপনীত হলেন। কিন্তু ইত্যবসরে যশোবন্ত সিং আওরঙ্গজেবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আওরঙ্গজেবের পক্ষ ও ভক্ত হয়ে পড়লেন; কাজেই দারা আজমীরে এসে প্রতারিত হলেন।” (ভাঃ জঃ ইঃ)

এরচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ইতিহাসে আর কী হতে পারে? সাহায্য তো দূরের কথা, একেবারে শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে চরম মুনাফেকী প্রদর্শন করে ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করেছেন। এই অবস্থায় সৈন্য নিয়ে আর বিনা যুদ্ধে পলায়নও সম্ভব নয়। তাই যুদ্ধ হলো আওরঙ্গজেবের সাথে। কিন্তু দারাকে পরাজিত হয়ে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে বাধ্য হতে হলো। ঠিক দারার এই দারুণ সংকট সময়ে দারার যাবতীয় ধনরত্ন ও মাল সামগ্রী রাজপুতগণ লুট করে দারার প্রতি মানবতাবিরোধী বিশ্বাসঘাতকতা প্রদর্শন করা হয়।

উপরোক্ত তথ্যগুলো ১৯৪৬ সালে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক ঐ ইতিহাস পরিচয় হতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রফেসর যদুনাথ সরকার তার History of Aurangjeb নামক গ্রন্থে যা বলেছেন তাও গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে পরিবেশিত হলো

"of all the actors in the drama of the war of Succession jasamant emerges from it with the worst reputation; he hed run away from a fight where he commanded in chief, he had treacherusly attacked an unsuspecting friend and he abandoned an-ally whom he had plighted his word to support and whome he hed lured into danger by his promises, unhappy was the man who put faith in Jasamant Singh, lord of marwar and chieftion of the Rather clan"

দারা গুজরাটে পলায়ন করলেন। মুরাদ এতদিন পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের পক্ষের লোক ছিলেন। হঠাৎ তাকে বিশেষ বিশেষ পক্ষ হতে প্রলোভন ও উৎসাহ দেয়া হলো। আওরঙ্গজেব তাকে মোটেই অবিশ্বাস করতে পারেননি। এই সুযোগে যদি তিনি আওরঙ্গজেবকে নিহত বা পরাজিত করতে পারেন তাহলে জনগণের কাছে প্রমাণিত হবে, মুরাদ আওরঙ্গজেবের চেয়েও সুযোগ্য। সুতরাং তার ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল। মদের মাতাল মুরাদ এই বিরাট ভুলকে এক অপূর্ব সুযোগ মনে করে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। আওরঙ্গজেব অবাক হলেন বটে, কিন্তু কাল বিলম্ব না করে সাহস ও নিপুণ কৌশলে মুরাদের দুঃসাহস ব্যর্থ করে তাকে বন্দি করেন এবং গোয়ালিয়র দুর্গে পাঠিয়ে দিলেন।

ওদিকে ভ্রাতা সুজা সুলেমানের নিকট পরাজিত হয়ে পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে আওরঙ্গজেবের ওপর সসৈন্যে আক্রমণ করলেন। খাজোয়া নামক স্থানে দুপক্ষের তুমুল সংঘর্ষ হলো। এবারে এ যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সেনাপতি হয়ে এসেছেন সেই বিশ্বাসঘাতক আওরঙ্গজেবের ক্ষমাপ্রাপ্ত যশোবন্ত সিং। এবার যশোবন্ত সিংহের নতুন কীর্তি ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। যদিও তা যবনিকার অন্তরালে বিরাজমান। ইতিহাস পরিচয় থেকে তুলে দিচ্ছি-“কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যশোবন্ত সিং গোপনে সুজার সঙ্গে যোগ দিয়ে একদিন রাত্রিকালে আওরঙ্গজেবের শিবির আক্রমণ করে বসলেন। এইরূপ বিপদের মধ্যে আওরঙ্গজেব বিচলিত হলেন না। শিগগিরই তিনি যশোবন্ত সিংকে পরাজিত করলেন। তখন যশোবন্ত সিং প্রাণ ভয়ে পলায়নপূর্বক পরিত্রাণ পেলেন। আর সুজা আরকানে আশ্রয় নিলেন। এরপর হতেই তাকে আর রাজনীতির মধ্যে দেখা যায়নি। শোনা যায়, আরকানে আততায়ীর হাতে তারা সপরিবারে নিহত হন। তার মৃত্যুর জন্য আওরঙ্গজেবের ওপর দোষারোপ শুধু নির্ভেজাল মিথ্যা তথ্য পরিবেশন নয়; বরং ইতিহাস না জানার না বোঝার তথা অযোগ্যতার চরম পরিচায়ক।

যশোবন্ত সিংয়ের আসল উদ্দেশ্য কী ছিল তা গবেষক, ঐতিহাসিক সমীক্ষার বিষয়। এত অপরাধ করার পর যশোবন্ত সিং আওরঙ্গজেবের নিকট ক্ষমা পাওয়ার আশা না করেও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আওরঙ্গজেব সঙ্গে সঙ্গে তার পবিত্র কোরআনের আদর্শে ও হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) বাণী স্মরণ করে ক্ষমা করলেন। এ সব নতুন তথ্য খুব আশ্চর্যজনক এবং কারো কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জে এন সরকারের লেখা হতে উদ্ধৃতি দেয়া হচ্ছে, “এরপরও যশোবন্ত সিং আওরঙ্গজেবের ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি পুনরায় ক্ষমা করেন এবং শাসনকর্তারূপে তাঁকে কাবুলে পাঠিয়ে দেন।” আজ বোঝার দিন এসেছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শুধু মৌখিক ক্ষমা নয়, আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ কাবুলের শাসনকর্তা করে পাঠানো অন্তত একজন হিন্দুকে কোন হিন্দু বিদ্বেষী গোঁড়া মুসলমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার যে, তাকে হিন্দু বিদ্বেষী ও তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না, হিন্দুদের রাজকর্ম হতে অপসারণ করতেন প্রভৃতি কথা যারা বলেছেন আজ তারাই বরং ইতিহাসের “মাছি মারা কেরানী” প্রতিপন্ন হয়ে হয়তো কোটি কোটি হৃদয় রাষ্ট্রে কলঙ্কিত হয়ে আছেন। তবে কাঁচা লেখক, অজানা না জানার কারণে যা করেছেন তা ক্ষমা পাওয়ার দাবি রাখতে পারে।

আর মুরাদকে হত্যার সহজ অপবাদ আওরঙ্গজেবের ওপর যেভাবে বারবার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাতে ঐ তথ্য অনেকের কাছে সত্য বলে মনে হয়েছে। কিন্তু মূল ইতিহাস, যুক্তিতর্ক, বুদ্ধি ও বিবেকের কষ্টি পাথরে যাচাই না করলে ইতিহাস স্থায়ী মর্যাদা পায় না। আমাদের মনে রাখা উচিত, আওরঙ্গজেব কুরআন ও হাদীসপন্থী সহজ, সরল, সত্যবাদী ও সদাচারী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি কাজী বা মুফতি পদে ছিলেন না। বরং বিচার, ফাতওয়া, মীমাংসা, সমাধান, ইজমা ও কিয়াসের জন্য কাজী, মুফতি আল্লামা ও উলামা কমিটি প্রস্তুত ছিল। তাদেরই কাজ ছিল বিচার ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করা। আর মুরাদের মৃত্যুও ছিল এই বিচারকদের বিচারের পরিণাম ফল।

আওরঙ্গজেবের সময়ে একজন সাধারণ প্রজা তার আত্মীয়কে হত্যা করার অভিযোগে মুরাদের বিরুদ্ধে বাদশাহর কাছে যথাযোগ্য বিচার প্রার্থনা করেন। বাদশাহ নিজে বিচার করার যোগ্যতা রাখলেও নীতি অনুসারে বিচার বিভাগীয় প্রধান বিচারপতির কাছে মুরাদের বিচার হলো এবং সাক্ষী ও প্রমাণে অন্যায় হত্যা বলে বিবেচিত হলো। ইসলাম ধর্মে আইনানুসারে প্রাণনাশের শাস্তি প্রাণনাশ, অবশ্যই তা প্রমাণের পূর্বাহ্নে নয়। আজ ইতিহাসে সোজাসুজি আওরঙ্গজেব কর্তৃক মুরাদের নিহত হওয়ার সম্পূর্ণ তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। কিন্তু আসলে সত্য কথা হচ্ছে এই যে, বিচারকের বিচারে প্রাণনাশের অপরাধে তার প্রাণদণ্ড হয়েছিল। যাঁকে মুরাদ হত্যা করেছিলেন তার নাম ইতিহাসের পাতায় সুস্পষ্টভাবে সংরক্ষিত। সেই বিশিষ্ট নিহত রাজকর্মচারীর নাম ছিল ‘আলী নকী খাঁ’।

আওরঙ্গজেব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারাকে হত্যা করেছিলেন- এ রকম কথাই হেটো ইতিহাসে খুচরো পাইকারি দরে পাওয়া যায়। দারার বিরুদ্ধে একটা ঐতিহাসিক অভিযোগ ছিল, যার শাস্তি প্রাণদণ্ড। তাঁর রাজদ্রোহিতা, গুপ্তচর বৃত্তি, শত্রু রাষ্ট্রের সাথে আঁতাত প্রভৃতি আরও অনেক অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ছিলেন। ইসলামের আইনে কিন্তু যখন তখন মনগড়া কোন শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা নেই। যেমন বৈদ্যুতিক আঘাত দেয়া বরফের উপর দাঁড় করানো, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা, জলে ডুবিয়ে কিংবা গরম জলে বা তেলে সিদ্ধ করা, মলদ্বারে লৌহ শলাকা প্রবিষ্ঠ করে মাথা অবধি তা পৌঁছে দেয়া, বিষপান করানো ইত্যাদি শাস্তি নিষিদ্ধ। ইসলামের আইনে প্রাণনাশ করলে, বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে এবং স্বধর্ম ত্যাগ করলে তার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা আছে। দারারও প্রাণদণ্ড হয়েছিল আওরঙ্গজেবের আদেশে নয় বরং আইনের অনুকূলে জজের বিচারে। মদ্যপান বা ব্যভিচার ও স্বধর্ম ত্যাগ একাধিক কারণে প্রাজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য পাঠক-পাঠিকাদের অনুসন্ধিৎসা থাকা স্বাভাবিক যে, দারা সত্যই ধর্মত্যাগী ছিলেন কিনা?

হিন্দু রাজপুত্র জাতি যেমন আকবরকে বেশ বশ করে মুসলমান নামধারী হিন্দু অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ হিন্দুতে পরিণত করেছিলেন, যুবক অবস্থায় জাহাঙ্গীরের অবস্থাও অনুরূপ ছিল এবং পরবর্তী সময়ে দারাও তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঐ পথের পথিক হয়েছিলেন। দারা ছিলেন আকবরের মত বাইরের কাঠামোধারী ছদ্মবেশী। দারা সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য দুর্লভ নামী দামি ইতিহাস সংগৃহীত কিছু তথ্য পেশ করা হচ্ছে দারারও ধারণা হয়েছিল ভারতে হিন্দু জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং তাদের হাতে রাখার অর্থই হচ্ছে দিল্লির সম্রাট হওয়া। অতএব আকবরের নীতি অনুসরণ করে দারার নিজের ভূমিকা আরও হৃদয়গ্রাহী করতে ‘দীনে ইলাহি’র ন্যায় তিনি এক নতুন ফরমূলা আবিষ্কার করেন। এছাড়া একটি ধর্মগ্রন্থও লিখলেন। বইটির নাম ‘মুজমুয়াল বাইরাইন’। এর অর্থ হচ্ছে ‘সাগড়দ্বয়ের মিলন'- অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্ম দুটি যেন দুটি সাগর আর সেই দুটির সন্ধি ঘটিয়ে খিচুড়ি তৈরি করাই ছিল দারার কল্পনা। দারা দস্তুর মত “সংস্কৃত সাহিত্যে” বিশেষত উচ্চপর্যায়ের হিন্দু শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন।

একজন হিন্দু পণ্ডিত মুসলমান বেশ ধারণ করে দারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তিনি নিজের নাম মাওলানা ফকির বলে পরিচয় দেন। বলাবাহুল্য, ঐ পণ্ডিতমশাই দারাকে বিভ্রান্ত করার জন্য মুসলমানদের কিছু বইপত্র পড়ে অল্প স্বল্প মুন্সীয়ানা হাসিল করেছিলেন। তিনি সম্রাট দারাকে উপনিষদ শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করেন। ফকির মাওলানার কথায় তিনি বেনারস হতে কয়েকজন বিজ্ঞ সুপণ্ডিতকে আহ্বান করেন এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে উপনিষদ শিক্ষা করেন। এখান থেকেই দারার হৃদয়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণের বীজ রোপিত হয়। মাত্র ছয় মাসের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ রাষ্ট্র ভাষা ফারসিতে উপনিষদের অনুবাদ করে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন ও হিন্দু জাতির প্রিয়পাত্র হতে সক্ষম হন। বইটি শুধু উপনিষদের অনুবাদমাত্রই ছিল না, তাতে ছিল তাঁর নিজের সৃষ্ট ধর্মের নানা টীকা টিপ্পনি। আর উপনিষদও তার সাগরদ্বয়ের মিলন গ্রন্থকে প্রমাণিত করতে গিয়ে কষ্ট কল্পনা করে কুরআন ও হাদীসের বিকৃত ব্যাখ্যা করতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর ‘মুজমুয়াল বাইরাইন’ গ্রন্থের অনুবাদ করেন ফারসি কবি ‘মুসাআকতাই দুর্পেয়া’।

যুবরাজ দারা সিংহাসন দখলের জন্য লড়াইয়ের পূর্বে সমাজের নেতৃস্থানীয় হিন্দু নেতাদের সহযোগিতা ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন; তাঁরা তাকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। দারার প্রতি যাতে বিশ্বাস আরও গাঢ় হয় সেই অভিপ্রায়ে হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্র মথুরায় একটি মন্দির করেছিলেন। মথুরার মন্দিরে বহু মূল্যবান কারুকার্য খচিত পাথরের রেলিং স্থাপন করেন। দারার দ্বারা সেই সজ্জিত মন্দির এখন গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল, যার ভয়াবহ একটা দিক ছিল হিন্দুদের তীর্থস্থানে হিন্দু তীর্থ যাত্রীর ভিড় তেমন কিছু নতুন নয়। কিন্তু দারার সাহায্যপুষ্ট কেশব রায়ের মন্দির, গুজরাটের মন্দিরগুলোকে কেন্দ্র করে অনেক আশ্চর্য অলীক গল্প প্রচারিত হয়েছিল। যেমন বৃদ্ধ শাহজাহান একবার খুব অসুস্থ হলে দারা ঠাকুর দেবতার শরণাপন্ন হন এবং এক ঠাকুরের বরে বৃদ্ধ শাহজাহান আবার সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই দেবতার শক্তিতে অভিভুক্ত হয়ে তিনি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে মূর্তিপূজা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু সম্রাট দারার অর্ঘের ঘনঘটার বহন লক্ষ্য করে সদাসিধে রোগগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত নর-নারীর এমন সমাবেশ হতে থাকে যে, তীর্থকেন্দ্রগুলো মুসলমান ও হিন্দুদের যুগ্ম তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং এখান থেকে দারার পক্ষ হতে রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হত ঐ সমস্ত ধর্মীয় পুরোহিতের দ্বারা। আওরঙ্গজেব সম্রাট হওয়ার অনেক দিন পরে কাজী মুফতির দরবারে দারার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা হয়। সেই মোকদ্দমায় স্বহস্তে লিখিত পত্র, সনদযুক্ত লেখা এবং তার পুস্তক প্রভৃতি প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্যে দ্বারা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। সেই রায় প্রকাশের সংবাদে আওরঙ্গজেব বলে পাঠিয়ে দিলেন আপনাদের রায়ের ওপর কোন প্রতিবাদ করার স্পর্ধা আমার নেই। কোরআন-হাদীসের আলোয় বিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলার অর্থ হচ্ছে ইসলাম ধর্মে হস্তক্ষেপ করা।

আজ উপন্যাসমার্কা সস্তা হেটো ইতিহাসে ‘সিংহাসনের জন্য ভাইদের হত্যা করেছিলেন’ বলে যে মতটি বহুল প্রচারিত একটু গভীর চিন্তা করলেই তার অসাড়তা প্রমাণ হবে। কারণ সিংহাসনের জন্য হত্যা করলে তা সিংহাসন পাবার পূর্বেই করা হতো। কিন্তু তার সিংহাসন পাওয়ার পরে যখন তিনি সম্রাট হয়ে সিংহাসনে সম্পূর্ণ অধিষ্ঠিত এবং প্রতিদ্বন্দ্বী যখন হাতের মুঠোয় বন্দি তখন এত কলাকৌশল করে হত্যা করার প্রহসন সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল না। এমনি রোগগ্রস্ত হয়ে মারা গেছে বললেই যথেষ্ট ছিল। অতএব সিংহাসনের জন্য ভাইদের হত্যা করার প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ঐতিহাসিক চরিত্রের শিক্ষাহীনতা, নীতিহীনতা অথবা অদুরদর্শিতার পরিচায়ক। ঐতিহাসিক হতে হলে তাঁকে সত্যবাদী হওয়া যেমন প্রধান শর্ত তেমনি জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনার যোগ্যতা থাকাও দ্বিতীয় শর্ত। ঐতিহাসিক মাছিমারা কেরানী নয় আর ইতিহাসকে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা মুখরোচক উপন্যাসে পরিণত করা দেশ ও দশের কত ক্ষতিকারক তা অবশ্যই বিবেচ্য।

(ঙ) কেবল হিন্দুদেরই ওপর জিজিয়া কর চাপিয়েছিলেন বলেও যে অপবাদটি ব্যাপক প্রচারিত তা নিঃসন্দেহে সম্রাট আলমগীরের সুনির্মল চরিত্রের ওপর এক জঘন্যতম আক্রমণ। অবশ্য সুবিস্তারিত আলোচনার পরেই তা প্রকট হয়ে উঠবে।

আকবর, জাহাঙ্গীর প্রমুখ বাদশাহ জিজিয়া তুলে দিয়েছিলেন। সহজেই মনে হয় তা উদারতার কারণ। আর আওরঙ্গজেব আবার তা পুনঃপ্রবর্তন করে যেন হিন্দু বিদ্বেষের পরিচয় দিয়েছিলেন। আসল কথা আকবর ও জাহাঙ্গীরের জিজিয়া প্রথার বিলোপ সাধন ছিল গুরুতর ইসলামবিরোধী কর্ম। আওরঙ্গজেব যদি তা পুনঃপ্রচলন না করতেন তাহলে তাও হতো ইসলাম ধর্মের পরিবর্জন নীতি অবলম্বন। তাই তাঁকে জিজিয়া কর ধার্য করতে হয়েছিল। কিন্তু জিজিয়া শুধু হিন্দুদের দিতে হতো, কোন মুসলমানকে নয়। তার আসল কারণ হচ্ছে এই যে, জিজিয়া একটি সামরিক কর মাত্র, এটি মাথাগনতি কর নয়। কোন হিন্দু মহিলা, বালিকা, বালক, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু, অন্ধ, খঞ্জ, ভিক্ষুক ও সন্ন্যাসীকে ঐ কর দিতে হতো না। অমুসলমানদের মধ্যে যারা যুদ্ধ করার শক্তি রাখতেন সক্ষম অথচ যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক শুধু তাদেরই দিতে হতো এই জিজিয়া। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে জোর করে যুদ্ধ করার জন্য অথবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধাদের সাহায্যে ও সেবা শুশ্রুষা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। অপরপক্ষে ইসলাম ধর্মে এরূপ কোন সংবিধান নেই, যে জোর করে কোন হিন্দুকেও যুদ্ধে যোগদান করানো যাবে।

এছাড়া মুসলমানদের জন্য মাল বা অর্থের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ একটা কর বাধ্যতামূলক ছিল। তার নাম 'যাকাত'। এতদ্ব্যতীত উৎপন্ন ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ ‘ওশর, ফেতরা, খুমুস’, সদকা, ফিদিয়া এবং ‘খারাজ’সহ আরও ছোট বড় অনেক কর মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এ সমস্ত কর কোন অমুসলমানদের জন্য নয়- এটা ইসলামের বিধি ব্যবস্থা। তাই হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত কর রেহাই দেয়া ছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে এই যে, হিন্দু প্রজাদের নিকট যে জিজিয়া নেওয়া হতো তা তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ-সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্বের ভিত্তিতেই হতো। প্রফেসর যদুনাথ সরকার লিখিত "Mughal Administration" গ্রন্থে পাওয়া যায় আওরঙ্গজেব ৬৫ প্রকার কর তুলে দিয়েছিলেন। অপর ঐতিহাসিক অনেকেই বলেছেন, যিনি ৮০টি করের বিলোপ সাধন করলেন তখন প্রশংসা পাননি কিন্তু শুধু একটি করের জন্য চারদিকে কলরব ধ্বনি।

J. D. A. S-এর লেখা "Vindication of Aowrangzeb" 453 OTTO- "When Aowrangzeb abolished eighty taxes no one thanked him for his generosity. But when he imposed only an at not heavy at all, people began to show their displeasure.

এই জিজিয়া শুধু ভারতেই মুসলমান বাদশাহ কর্তৃক হিন্দুরে ওপর ধার্য হয়েছিল তা নয়; বরং বহির্ভারতেও এই কর অমুসলমানদের নিকট হতে নেওয়া হতো শুধু যিনি যুদ্ধে যেতে সক্ষম অথচ অনিচ্ছুক তাঁদেরই উপর ছিল এই কর। অতএব জিজিয়া একটি হিন্দু বিদ্বেষী কর মনে করা সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছু নয়।

জিজিয়া একটি War tax বা যুদ্ধ কর মাত্র। এই জিজিয়া কোন দিন অত্যাচার ও উৎপীড়নমূলক আদায় করা হয়নি। সম্রাট হিন্দুদের সাথে পরামর্শক্রমে এই কর আদায় করতেন। তাই স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর Mughal Administration গ্রন্থে লিখেছেন, Asses there revenue in such a why that the roy to at large mayget there dues and the government money may be collected at the right time and no yoat may be opperessed".

কোন ঐতিহাসিক বা লেখক কি প্রমাণ করতে পারবেন যে, কোন সুস্থ-সবল হিন্দু সৈন্যকেও কর দিতে হয়েছিল? অতীতেও পারেননি আর বর্তমানেও কেউ পারবেন না, তবে আগামীতে ঐতিহাসিকতার নামে ঔপন্যাসিকতা কতদূরে গিয়ে পৌঁছবে তা চিন্তা করে অনেকে শিউরে উঠছেন।

আরও মনে রাখার কথা, আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসেই প্রথম বছরে হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর চাপাননি বরং ১৬ বছরের মধ্যে ৮০ প্রকার কর তুলে দিয়ে তারপর সামান্য জিজিয়া ধার্য করেছিলেন। আর তাই নিয়ে ইতিহাসে এত হৈ চৈ, এত আয়োজন। বোধহয় আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু। যাকে ‘ইসলামী কোর্ড’ বলা হয় সেই আরবী ‘হেদায়া’ আইন গ্রন্থেরই অনুবাদ বা ছায়ালম্বিত। তাতে লেখা আছে- জিজিয়া কর প্রবর্তনের কারণ, এই কর সেই সাহায্যের পরিবর্তে, যা অমুসলিম জীবন, ধন ও মান সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে নিয়েছেন। উক্ত গ্রন্থের অন্যত্র আরও আছে- “যদি তারা জিজিয়া গ্রহণ করা মঞ্জুর করলেন তো তাঁদের হেফাজত এরূপভাবেই করা উচিত, যেমন মুসলমানদের করা হয়। তাঁদের জন্য সেই আইন প্রবর্তিত হবে, যা মুসলমানদের প্রতি হয়। কারণ হযরত আলী (রাঃ) বলে গেছেন, অমুসলিম জিজিয়া এই জন্য দান করে থাকেন যে, তাঁদের রক্ত মুসলিমদের রক্ত এবং তাঁদের ধন সম্মান মুসলিমদের ধন সম্মানের সমান।” “খলীফা হযরত ওসমান গনির (রা.) রাজত্বকালে হাবিব বিন সালমী জিজিয়াকে জয় করে নিলেন, তখন অমুসলিমগণ সৈন্যে যোগদান করে সামরিক সাহায্য করলেন তখন তাঁদের জন্য জিজিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।”

যদুনাথ সরকারও তাঁর ইতিহাসে আওরঙ্গজেব সম্বন্ধে লিখেছেন, সমস্ত প্রকার কর আলমগীর তুলে দেয়ার জন্য সম্রাটের পাঁচ কোটি টাকার ওপর ক্ষতি হয়েছিল। He Aurangzeb abolished all taxes that were not santioned Islam the exchequer this last about five millions sterling a year.

তাই ফ্রান্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক পণ্ডিত ডাঃ গাস্তা ওলিবান লিখেন, ‘ইসলামের খলীফারা ভালভাবে বুঝেছিলেন যে, ইসলামকে তরবারির জোরে প্রচার করা সম্ভব নয়। কাজেই দেখা গেছে যেখানেই মুসলমানরা বিজয়ী হয়ে প্রবেশ করেছেন সেখানেই পরাজিত নগরবাসীদের প্রতি খুবই নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করেছেন এবং তাদের সুখ-শান্তিতে রাখার সর্বপ্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করে তার বিনিময়ে যতকিঞ্চিৎ কর (জিজিয়া) গ্রহণ করতেন। অমুসলিমগণ পূর্বের রাজাকে যে কর দান করতো তার তুলনায় জিজিয়া কর অতি নগণ্য ছিল।” এ অতি সামান্য কথা যে, দুনিয়াতে এরূপ সংযমী ভদ্র রাজাবিজেতা পূর্বে কোনকালে জন্মেনি এবং এরূপ নম্র ও দয়ালু জাতি ইতোপূর্বে কখনও দেখা যায়নি।”

ডাঃ জে কে কান্তি মহাশয়া তাঁর স্পেনের ইতিহাস গ্রন্থে যা লিখেছেন তাতে জিজিয়া সম্বন্ধে কুধারণার পরিবর্তে সুধারণারই সৃষ্টি হয়। যেমন-“ সেই সত্য যা পরাজিত জাতির নিকট জয়ী মুসলমানদের তরফ হতে আদায় করা হতো। তা এরূপ ছিল যে, এতে তাদের কোনরূপ কষ্টের পরিবর্তে বরং তাহাদের মনে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করিত। সুতরাং পরাজিত জাতি নিজের ভাগ্যকে যা পূর্বে ছিল তা বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে তারা বুঝতে পারল যে, মুসলিমদের স্পেনে আসা নিজেদের সৌভাগ্যের কারণ হয়েছে। ধর্ম কর্ম তারা স্বাধীনভাবে পালন করত এবং তারা নিজের ধন, মান, জীবন ও গীর্জাগুলোর রক্ষার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে শান্তিতে জীবনযাপন করত। তাদের এসব সুখ বিজয়ীনীতির অনুগত হওয়ার ফলস্বরূপ ছিল এবং তাদের নিকট হতে যে জিজিয়া কর নেওয়া হতো তা খুবই সামান্য ছিল। কাজেই স্পেনের সর্ব অমুসলিমদের মনে আরবীয়গণের প্রতি এ বিষয়ে পূর্ণ আস্থা জন্মিয়েছিল যে, “তারা ন্যায় ও সত্যের দৃঢ় প্রতিষ্ঠাতা এবং বিচারের সময় তারা পক্ষপাতশূন্যভাবে ন্যায় বিচার করে।”

ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পণ্ডিত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দুঃখ করে লিখেছেন, “পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস পড়াশোনার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভারতের হিন্দু জনসাধারণ অনেকে ‘জিজিয়া কর’কে বিরাট ভুল বুঝেছেন। আসলে এটা আসল তথ্যের অজ্ঞতা”। (সুলতানাতে দেহলী মে গায়ের মুসলিম গ্রন্থে ৬৮ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।“ফারসিতে 'Gajiat' শব্দের অর্থ খেরাজ, যা থেকে জিজিয়া শব্দের উৎপত্তি। ইসলাম ধর্ম চৌদ্দশত বছর মাত্র জিজিয়ার কথা বলেছে তা নয় বরং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বহু পূর্ব হতে বহু দেশে নানা ভাষায় জিজিয়া করের উল্লেখ পাওয়া যায়।” (তারিখি শত্তাহেদ গ্রন্থে দ্রঃ),

কনৌজের গহরাওয়ার বংশে জিজিয়ার প্রচলন ছিল সে দেশের ভাষায় তার নাম ছিল ‘তুরশকী জনডা' (Medieval Hindu India lll, p-2ii)। তাছাড়া ভারতে ইসলাম আসার আগে রাজপুতদের মধ্যে ‘ফীকস’ কর আদায় হতো ( Early Histoty of India by smith গ্রন্থ দ্রঃ) ডাঃ ত্রিপাটির ধারণা, ফ্রান্সে যে জিজিয়া ছিল তার নাম ছিল Host tax, আর জার্মানীতে যে জিজিয়া ছিল তার নাম Commonpiny এবং ইংল্যাণ্ড এক প্রকার জিজিয়া সম কর ছিল তার নাম ছিল 'Scontage' (some Aspects of Muslim Administration by Sir, Tripathy গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)

নজরানাবাসীদের জিজিয়া দেবার আগ্রহ এত বেশি ছিল যে, জিজিয়া দিতে না পারলে তারা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে লজ্জাবোধ করতেন।

অনেকে বলেছেন-জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করে আওরঙ্গজেব অসহায় হিন্দু জাতির ওপর নির্মম অত্যাচার করেছেন। কিন্তু আমাদের বক্তব্য অন্য। হিন্দু প্রজাদের ওপর অত্যাচার করার উদ্দেশ্যই যদি আওরঙ্গজেবের থাকত তবে তার দীর্ঘ ৫০ বছর ভারতে রাজত্ব করার পর একটি হিন্দুরও অস্তিত্ব থাকত কিনা সন্দেহ। সে কথা আগেই বলেছি। তাছাড়া শুধু আওরঙ্গজেবই নন বরং মুসলমান রাজা-বাদশাহ শত শত বছর বা প্রায় সহস্র বছর ধরে রাজত্ব করে গেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন একটা জাতি তাদের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। অপর পক্ষে এই ভারতে এক ধর্মের চাপে অপর ধর্ম, এক সম্প্রদায়ের চাপে অপর সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন প্রায় হয়ে গেছে। যেমন-হিন্দু ধর্মের চাপে বৌদ্ধধর্ম আজ বিলুপ্ত প্রায়। তাছাড়া অনেকের মতে ভারতের বহু স্বতন্ত্র জাতির অস্তিত্ব আজ লোপ পেয়েছে বা পেতে চলেছে-এমনকি তাঁরা নিজেদের হিন্দু বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ জৈন, বৈষ্ণব, ব্রাহ্ম, সাঁওতাল প্রভৃতি সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। অতএব আওরঙ্গজেব অত্যাচারী ছিলেন অর্থাৎ তিনি হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন একথা নির্ভেজাল মিথ্যা। সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক কাফি বলেছেন, “আকবরের রাজত্বকাল অপেক্ষাও তাঁর (আওরঙ্গজেব) সময়ে হিন্দু রাজকর্মচারী সংখ্যায় বেশি ছিল। এছাড়া আরও বহু প্রমাণ ইতোপূর্বে পেশ করা হলেও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রেও কিছু কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ করা গেল। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ ভাগে ‘আলেকজান্ডার হ্যামিলটন’ ভারতবর্ষ পরিদর্শন করতে এসে ভারতে আওরঙ্গজেবের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সূক্ষ্ম শাসন, পদ্ধতি দেখে যা বলেছিল তা হচ্ছে এই- "Every one is free to serve and worship God in his own way" অর্থাৎ প্রত্যেক স্বাধীনভাবে কাজকর্ম এবং নিজস্ব নিয়মে ঈশ্বরের উপাসনায় স্বাধীন। আরও প্রমাণস্বরূপ আলমগীরের দরবারে বড় বড় পদে ও মর্যাদায় স্থান পেয়েছিলেন যথাক্রমে রাজা রাজরূপ, কবীর সিংহ, অর্ঘনাথ সিং, প্রেমদেব সিংহ, দিলীপ রায় প্রমুখ হিন্দু ব্যক্তি। রাজা রাজরূপ সিংহকে বাদশাহ এত বিশ্বাস করতেন যে, শ্রীনগরের রাজার বিরুদ্ধে গোটা যুদ্ধটাই তাঁর অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। কবীর সিং ছিলেন সম্রাটের খাস লোক। আসামের যুদ্ধের জন্য প্রেমদেব সিংহকেই আওরঙ্গজেব বাছাই করেছিলেন। দিলীপ রায় ছিলেন আওরঙ্গজেবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি। এতদ্ব্যতীত পুলিশ বিভাগ, গুপ্তচর বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ প্রভৃতি বিভাগে হিন্দু রাজ কর্মচারীর সংখ্যা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হতো। রাজস্ব বিভাগে মুন্সীর পদগুলো হিন্দুদের একচেটিয়া ছিল বলা যায়। তার কারণও এই একই ছিল যে, কর আদায়ের নামে যেন হিন্দু সম্প্রদায় অত্যাচারিত না হয়। "Most of the Munsts were Hindus and the proportion rapidly inereassed The Hindus had made a monopoly of the lower ranks of the Revenue depertment, “রসিকদাস ক্রোরী ছিলেন সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি এবং রাজস্ব বিভাগে সর্বোচ্চমানের পদাধিকারী।”

শুধু তাই নয়, বরং এমন কোন বিভাগ ছিল না যে বিভাগে সম্ভব সত্ত্বেও হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করা হয়নি। এমনকি বাদশাহ আলমগীর আইনজারী করেছিলেন যে, প্রত্যেক বিভাগে হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করা আবশ্যক। অতএব আলমগীর সত্যিই শুধু উদার নয় বরং উদারতম মহান নৃপতি ছিলেন এটাই আধুনিক বিশেষজ্ঞদের এবং পুরাতন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত।

একটা প্রশ্ন থেকে যেতে পারে, তাহলে কী আওরঙ্গজেবের ওপর সকলে সন্তুষ্ট ছিলেন? তার উত্তরে পরিস্কারভাবেই বলা যেতে পারে যে, সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার কারণও অবশ্য বিদ্যমান। রাজদরবারে যে সমস্ত গর্হিত বেআইনি কাজ চলে আসছিল এবং আকবর, জাহাঙ্গীর প্রমুখ বাদশাহ কর্তৃক যে সমস্ত বিষয়বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল, যার ফলে সারা ধর্মের নামে, আভিজাত্যের নামে, সংস্কৃতির নামে যত আগাছা গজিয়েছিল আওরঙ্গজেব একাধারে তা উৎপাটন করতে যাদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে তারাই অভিযোগ করেছেন। অবশ্য পরে নিজেদের ভুল বুঝে সর্বভারতীয় উন্নতি ও শান্তি দেখে অনেককেই লজ্জা ও অনুতাপের ইন্ধন হতে হয়েছিল।

বাদশাহদের দরবারে 'নওরোজ' বলে একটা কুপ্রথা প্রবর্তিত ছিল, যা শুধু বিলাসিতা ও অহঙ্কার প্রদর্শনের নামান্তর ছিল আর রাজদরবারে রাজ কর্মচারীদের মধ্যে মদের মর্যাদা এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল, যা চীনের আফিং খাওয়ার মতো ভারতকে ধ্বংস হতে হতো, যদি না আওরঙ্গজেব কঠিন হস্তে তা দমন করতেন। পক্ষান্তরে মন্দির তৈরি করার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এক এক জায়গায় যেখানে একটি মন্দিরই যথেষ্ট সেখানে গায়ে গায়ে লাগানো দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশত করে মন্দির তৈরি হতে লাগল, আর ধর্মের ঐ বাড়াবাড়ি দৃষ্টিকটু লাগারই কথা। মসজিদের ক্ষেত্রেও সম্রাটের মত ছিল, বিনা প্রয়োজনে মসজিদ তৈরি অথবা যেখানে মসজিদ আছে যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই মসজিদে স্থান সংকুলান হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে মসজিদ সৃষ্টি করা নিষেধ। যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুর্শিদাবাদ জেলায় বাদশাহ নবাবদের স্মৃতি স্মরণ করতে করতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় শুধু চার দিকে মসজিদ। আমাদের মতে এত মসজিদ দরকার ছিল না। যদি কেউ যুক্তি দেখান যে, স্থান সংকুলান হতো না বলেই হয়তো সে যুগে এত মসজিদের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু আমরা বলবো অবশ্যই তা নয়; কারণ, স্থান সংকুলান না হলে মসজিদকে বাড়িয়ে যথা প্রয়োজন লম্বা ও চওড়া করলেই তো চলতে শুধু সংখ্যায় ছোট ছোট মসজিদ আর কারুকার্যের ছড়াছড়ি বা বাড়াবাড়ির কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। অনুরূপভাবে মন্দিরও এই পশ্চিমবঙ্গে একস্থানে দু-চারটা নয় এমনকি আমাদের বর্ধমান শহরের পাশে ছোট ছোট গায়ে গায়ে লাগানো ১০৮টি মন্দির আমরা দেখেছি। মন্দিরের ক্ষেত্রে স্থান সংকুলানের তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কারণ মন্দিরের ভেতরে পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ ছাড়া জনসাধারণের প্রবেশাধিকার পূর্বেও ছিল না আর এখনও নেই, পরে কী হবে বলা যায় না।

বেনারসের শানসকর্তা আওরঙ্গজেবকে গোপনে একটা পত্র পাঠিয়েছিলেন তাতে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল, বেনারস একটা হিন্দুদের ধর্মীয় ঘাটি, উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণী প্রত্যেকে মনে করে, সমস্ত উন্নতির কুজ্ঞী ঐ মন্দিরেই দেবতার হাতে আছে আর মন্দিরের নিত্য নতুন নির্মাণ ব্যবস্থা বিদ্যামান এবং বহু অর্থব্যয়ে তাতে কারুকার্য করা চলতেছে যেন শেষ নেই, আর এক মন্দির অপর মন্দিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিততে চায়। যদি এখানে এই মন্দিরের পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের ওপর কিছু শক্তি প্রয়োগ করা হয় তা ঠিক হবে কি না? তবে এখানে কেউ কেউ মনে করেন, ব্রাহ্মণদের উপাসনাভিত্তি শিথিল করতে পারলে লোকে আমাদের ইসলাম ধর্মের দিকে আকর্ষিত হতে পারে...।”

তার উত্তরে আওরঙ্গজেব যে পত্র দিয়েছিলেন তা উল্লেখযোগ্য এবং প্রণিধানযোগ্য। “... প্রজাদের উপকার সাধন এবং নিম্ন সকল সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধন আমাদের দৃঢ় উদ্দেশ্য সে জন্য আমাদের পবিত্র আইন অনুসারে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, পুরাতন মন্দিরগুলো বিনষ্ট করা হবে না কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টি করা চলবে না। কোন লোক অন্যায়ভাবে ব্রাহ্মণ অথবা তাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ অথবা তাদের ওপর কোন হামলা করতে পারবে না। তারা যেন পূর্বের ন্যায় স্ব স্ব কার্যে নিযুক্ত থাকতে পারে অথবা আমাদের আল্লাহ প্রদত্ত সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য সুস্থ মনে প্রার্থনা করতে পারে।” (জেএএসবি এবং ‘ওয়াকারে আলমগীর’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)

আওরঙ্গজেব সিংহাসন আরোহণের পূর্বে ধর্ম ধ্বংসী মিথ্যা দীন-ইলাহী ধর্মকে নিষিদ্ধ করেন ফলে যারা গোঁড়া মুসলমানবিদ্বেষী হিন্দু তারাও দুঃখিত হলেন। তারা বেশ বুঝতে পারলেন আকবর জাহাঙ্গীর যে পথের পথিক ছিলেন ইনি সে পথের পথিক নন। তাই তারা চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবের পরিবর্তের দারা শিকোকে আকবরের পথে পরিচালিত করার। কিন্তু তাদের সেই সিদ্ধান্ত সার্থক হয়নি।

যা হোক, এভাবে সম্রাট আলমগীরকে জিজিয়া করের পুনঃপ্রবর্তনকারী গোঁড়া হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমান বলে চিত্রিত করে যারা ইতিহাসের পাতাকে কলঙ্কিত করেছেন, ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না। প্রকৃত ও গৌরবমণ্ডিত উপকার একে বুকে ধরেই সে চিরকাল ছুটেছিল আজও যেমনি ছুটে যাবে চলমান গতি সমুদ্রের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আর এরই নাম ইতিহাস।

(৬) তাঁর অযোগ্যতাই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বলে যে অভিযোগটি বা অপবাদটি নিরপরাধ আওরঙ্গজেবের স্কন্ধে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার অসাড়তা পূর্বাহ্নেই প্রমাণিত হয়েছে যে, আওরঙ্গজেব অযোগ্য তো ছিলেনই না বরং তাঁর যোগ্যতাই দ্রুত পতনোন্মুখ মুঘল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেছে। অতএব মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কারণ আওরঙ্গজেবের অযোগ্যতা নয় বরং কারণ অন্যবিধ। নিচের আলোচনায় তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

সম্রাট আওরঙ্গজেবকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বহু তথ্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু মুঘল যুগের সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ তাঁকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেন না। বরং আওরঙ্গজেবকে মুঘল সাম্রাজ্যের দ্রুত পতন রোধ করেছেন এ রকম মন্তব্য পাওয়া যায়। নিম্নোক্ত তথ্যগুলো আওরঙ্গজেবকে নির্দেষ প্রমাণ করে।

অমিতব্যয়

পূর্ববর্তী সম্রাটদের আমলে সৈন্যবাহিনীর ভেতর দুর্নীতি ও বিলাসিতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। মহামতি বলে অভিহিত সম্রাট আকবর ছিলেন নারী লোলুপ, জাহাঙ্গীর ছিলেন ব্যভিচারী মদ্যপ সম্রাট, শাহাজাহান ছিলেন আড়ম্বর প্রিয়। অবাঞ্ছিত হেরেমের ব্যয় বহন, মদ্যপান ও শাহজাহানের আড়ম্বর প্রিয়তার ফলে জলের মত অর্থ ব্যয়িত হয়। সম্পদের ও অর্থের অপব্যবহার এ দুষ্ট ব্যাধি সম্রাটের হেরেম পেরিয়ে আমির ওমরাহ তথা সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সংক্রমিত হল। ইউরোপীয় পর্যটকগণ লিখেছেন-মুঘল সৈন্য শিবিরগুলো ছিল এক একটা বিলাসী শহর। বিপুল অর্থরাশি এভাবে ব্যয়িত হওয়ায় সাম্রাজ্যের আর্থিক অসচ্ছলতা দেখা দিল আর মুঘল সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে। সম্রাট আওরঙ্গজেব কোরআন-হাদীসমাফিক সাম্রাজ্যের জন্য ব্যয় নীতিগ্রহণ করেন। এর ফলে পূর্ববর্তী সম্রাটদের শূন্য রাজকোষ পূর্ণ হয়ে মুঘল সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়। (উইলিয়াম হকিন্স, স্যার টমাস রোর ভ্রমণ কাহিনী দ্রঃ)

অনুদারনীতি

সম্রাট আকবর উদারনীতি গ্রহণ করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রিয়মাত্র হতে চাইলেন। এমনকি সকল ধর্মের সারমর্ম নিয়ে নতুন ধর্ম প্রবর্তন করবেন ‘দীন-ইলাহী’। যুবরাজ দারাও আকবরের পদাঙ্ক অনুকরণ করে দরবারের রাজপুত্র রাজা ও বিভিন্ন গোষ্ঠী অধিপতিগণের সাহায্য ও সমর্থনপুষ্ট হওয়ার জন্য লিখলেন ‘মুজমুয়াল বাহরাই’। যার অর্থ ‘সাগরদ্বয়ের মিলন’ সম্রাট আকবর ও যুবরাজ দারার উদারনীতি নিছক শঠ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ধর্মে এ উদারনীতি বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যকে পতনের মুখে ঠেলে দেয়। সম্রাট আকবর ও যুবরাজ দারার উর্বর মস্তিষ্কে স্থান পেল যে, সকল ধর্মে কিছু সার থাকে এবং বাকি সবকিছু অসাড় বস্তু। এভাবে এ উদারনীতির দ্বারা হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলে। তাই প্রাক আওরঙ্গজেব যুগে ব্যভিচার, মদ্যপান, উৎকোচ গ্রহণ সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি দুষ্ট ব্যাধি সম্রাট-ওমরাহ দরবার থেকে শুরু করে প্রজাবৃন্দ পর্যন্ত সকলের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে।

সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজে একজন বড় আলেম এবং ধর্মে আস্থাশীল ছিলেন। দরবারে আমির-ওমরাহ ও গোষ্ঠীপতিদের মদ্যপান, ব্যভিচার, অমিতব্যয় প্রভৃতি পরিহারের জন্য ধর্মীয় বিধি চালু করেন।

আওরঙ্গজেবের কট্টর সমালোচকগণও স্বীকার করেন যে, আওরঙ্গজেব নিষ্ঠাবান মুসলমান, নিরলস কর্মী, অভিজ্ঞ কুটনীতিবিদ এবং ক্ষমতাশালী শাসক ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কঠোরভাবে ইসলামের অনুশাসন পালন করেছিলেন। ঐতিহাসিক মূল্যসম্বলিত ফতোয়া-ই-আলমগীরী তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়েছিল। একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান কখনও অনুদার বা পরধর্ম অসহিষ্ণু হতে পারেন না। কট্টরপন্থী ঐতিহাসিকদের বর্ণিত আওরঙ্গজেবের ‘অনুদারনীতি’ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী নয়। কারণ তাঁর সময়ে ধার্মিক চরিত্রবান হয়ে জাতিকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।

ইউরোপীয় আগমন

ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ ইউরোপীয় জাতির আগমন। ভারতে ইংরেজ তথা ইউরোপীয় জাতির আগমনের বীজবপন করে গেছেন। আকবর আর জাহাঙ্গীর সেই বীজের চারাগুলোকে শক্তিশালী করতে তার যথার্থ ভূমিকা নিয়েছেন আর আওরঙ্গজেব চারাগুলোকে নির্মূল করতে যথাযোগ্য চেষ্টা করে গেছেন। যদি এ কথাটুকু প্রমাণ হয় তাহলে আকবরকে ভারতবাসী ক্ষমা করে মহামতি বলে মেনে নেবেন কিনা তা পাঠকবৃন্দের দায়িত্বে আর আওরঙ্গজেবের ভূমিকা সত্যিই যদি ফুটে ওঠে তাহলে তার দিকে চিন্তাশীল নব্য ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া স্বাভাবিক।

তাই কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ হতে মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করছি। ইসলামী বিধান মতে অমুসলমান নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে হলে প্রথমেই তাকে ধর্মান্তরিত করতে হবে এবং এটা খুব স্বাভাবিক। তাই স্ত্রীকে সহধর্মিণী বলা হয়। কিন্তু সহধর্মিণী যদি অন্য ধর্মিণী হয় তাহলে তাকে সহধর্মিণী না বলে পরধর্ধিণী বলতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু সারা ভারতে নয়, পৃথিবীর প্রথম রাজা প্রথম বাদশাহ আকবর যিনি ইসলাম ধর্মের এই নীতির ওপর নিষ্ঠুর উপেক্ষা প্রদর্শন ও অনাদর্শ স্থাপন করেন। খ্রিস্টান মহিলা বিবাহ করা এবং তাকে তার ধর্ম পালন এবং প্রচার ও প্রসারে সহযোগিতা করার পূর্ণ অধিকার প্রদর্শন আকবরের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটা উদারতা না বর্বরতা তা প্রত্যেক ঐতিহাসিক ও ইতিহাস অনুরাগীব চিন্তার বিষয়।

এ বিবাহকে কেন্দ্র করেই ইংরেজ ভারতে রাজ্য বিস্তারের পথ সুগম করে। রাজ দরবারে মদ্যপানের আমন্ত্রণ ইংরেজ রাজনীতিবিদগণ প্রায়ই পেতেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সমাধি রচনার কাজ আকবর শুরু করেন এবং তার মদ্যপ পুত্র জাহাঙ্গীর স্যার টমাস রো ও তার মূল পুরোহিত অক্সফোর্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত চতুর, কূটনীতিবিদ রেভারেণ্ড-ই-ফেবীকে অতি মাত্রায় প্রশ্রয়দান করে এ সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেন। আকবরের সময় ইংরেজরা নিজেদের সুরাট বন্দরে প্রতিষ্ঠিত করে। তিন বছর ক্রমাগত মুঘল দরবারে তদবির করে স্যার টমাস রো জাহাঙ্গীরের নিকট হতে তার সকল দাবি দাওয়া মঞ্জুর করে নিতে সক্ষম হয়। ইংরেজরা অবশ্য কাজ গুছানোর তাগিদে মদ খেতেন কিন্তু তিনি ও তাঁর পুত্রগণ শুধু মদ খেতেন বলে সঠিক হবে না বরং বলা যায় মদই তাদের খেত।

খ্রিস্টানদের মুখে তাদের বীরত্বগাথা এবং প্রত্যক্ষ কিছু লক্ষ্য করে আকবর ও জাহাঙ্গীর ইংরেজ শক্তির ওপর ভীত হয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, ইংরেজরা সুন্দরী রমণী দিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন বা পরাস্ত করে দিয়েছিলেন তার চেতনাকে। সে যাইহোক তারা ধীরে ধীরে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে চললেন এবং দেশের ভেতরে ইউরোপীয় ঘাঁটি তৈরি করতে তাদের অনুমতি ও সাহায্য দিলেন। তার ফলস্বরূপ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে উদীয়মান ইউরোপীয় শক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। সুতরাং মুঘল সাম্রাজ্যের পতন তথা ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার জন্য দায়ী আওরঙ্গজেব নয়, দায়ী মহামতি আকবর ও জাহাঙ্গীর। (এনসাইক্লোপিডিয়া দ্রঃ)

এছাড়া ভারতের বিশালতাও তার পতনের আর এক কারণ। তখনকার যুগে তার বেতার বা টেলিভিশনের কোন আড়ম্বর ছিল না। ফলে এক স্থান হতে অন্য স্থানের যোগাযোগ রক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হতো। তাই বিশাল ভারতের কোন স্থানে বিদ্রোহ ঘোষিত হলে তা দমন করে আরেক স্থানে গমন করতে যে পরিমাণ সময়ের ব্যবধান হতো তাতে অন্য কোন স্থানে আবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে বাধা ছিল না। কিন্তু তবুও সম্রাট আলমগীর যেভাবে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে এক এক করে বিদ্রোহের অনল নিভিয়ে গেছেন তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় বিরল। অতএব পূর্বপুরুষদের পর্বতপ্রমাণ অপকীর্তির প্রভাবে টলায়মান মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি এক অনিবার্য প্রাকৃতিক কারণেই ধসে পড়েছিল। নিরপরাধ ও নিরুপায় আলমগীর এর জন্য দায়ী নন।

সর্বশেষে দুজন প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের দুটি মূল্যবান উদ্ধৃতি (যাতে মুঘল ও সাম্রাজ্যের পতনের কারণ পরিষ্কাররূপে ফুটে উঠেছে) দিয়েই এ প্রসঙ্গের যবনিকা টানছি।

ঐতিহাসিক প্রিঙ্গল কেনেডি তাঁর "History of Mughals" পুস্তকে লিখেছেন, "The weakness of Akbar's empire was really military stoping the influx fresh blood from beyond the north western hills and acting on the principle of India for the Indians, he was the indirected that when the impire built by him was challenged by a hostile power, if turned out to be in capable of protecting itself." অর্থাৎ আকবরের গঠিত সাম্রাজ্যের দুর্বলতা তাঁর সামরিকনীতির মধ্যেই নিহিত। তিনি উত্তর-পশ্চিম পার্বত্য অঞ্চলের ওপার হতে সতেজ সকল স্বজাতীয় সৈন্য আমদানি বন্ধ করে এবং ভারত ভারতীয়দের জন্য নীতির অনুসরণ করে তাঁর সাম্রাজ্যের (অর্থাৎ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী হয়েছেন। তাঁর গঠিত সাম্রাজ্য যখন বিজাতীয় প্রতিকূল শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তখন তাঁর আর আত্মরক্ষা করার শক্তি ছিল না।”

লাহোরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল্লাহ আনোয়ার বেগ এমএ এলএলবি তাঁর "Since our ball" পুস্তকে লিখেছেন, “আত্মপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকামী তেজস্বী সাহসী শক্তিশালী মুসলিম বীরগণ সমস্ত উত্তর ভারত অধিকার করে এশিয়ার হৃৎপিণ্ড আফগানিস্তানকে নিজেদের নিরাপদ সৈন্য সংগ্রহের ক্ষেত্র করেছিলেন। তাঁদের সংহতি ও সহযোগিতার কারণে তারা সর্বত্রই সাফল্য লাভ করতেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয় (৭১১) হতে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু সময় (১৭০৭) পর্যন্ত মুসলিমগণ ছিলেন প্রধানত মহা তেজস্বী, মহা সাহসী, মহা শক্তিশালী, মহা কর্মী, আত্মপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকামী যুগ নায়ক, যুগ শাসক, মহা বীরের জাতি। তার পরবর্তী হচ্ছে মুসলিমের জাতীয় চরিত্রের অধঃপতনের যুগ, মুসলিম জাতির পতনের যুগ। এমনকি এর পূর্বেই ভবিষ্যৎ অমঙ্গলের দুর্লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হয়েছিল। শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহ সম্রাট হলে খুব সম্ভব অতি সত্বরই অবস্থান্তর বা পতন ঘটত। মুঘল সাম্রাজ্যের এ পতন স্থগিত রাখতে কৃতকার্য হয়েছিলেন ইসলামীয় নীরের শেষ তীর আলমগীর বা আওরঙ্গজেব। দারা ছিলেন আকবরের মত বিজাতীয় ভাবাপন্ন। বলা বাহুল্য, আকবরই (মুঘল সাম্রাজ্যের) পতনের বীজ বপন করেন। ইসলাম অনুরাগী মুহিউদ্দিন আলমগীর, আওরঙ্গজেব বিজাতীয় প্রভাব ও দুর্নীতিসমূহ হতে সাম্রাজ্যকে সংস্কার ও সংশোধন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য তিনি কারও সন্তোষ বা অসন্তোষ কিছু মাত্র গ্রাহ্য করেননি। তাঁর চেষ্টা অনেকটা ফলবতী হয়েছিল বলেই ভারতে ইসলাম এবং জাতি হিসেবে মুসলমান এখনও টিকে আছে বা বেঁচে আছে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এরূপ অসাধারণ শক্তিশালী আদর্শ চরিত্র কোন ব্যক্তি আর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেননি। এটাই ভারতস্থিত তৈমুর বংশীয় সাম্রাজ্যের ধ্বংসের প্রকৃত কারণ-(যশোরের চিন্তাশীল লেখক শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন প্রণীত আলমগীর দ্রষ্টব্য।)

অতএব এত দীর্ঘ আলোচনার পর একথা ভুললে চলবে না যে, আধুনিক সহজলভ্য ইতিহাসে যা আছে তাই-ই অমৃতের বারিধারা বর্ষণ নয়। প্রকৃত ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং যুক্তি বা সত্যের মাপকাঠিতে যা গ্রহণযোগ্য তা অবশ্যই স্মরণীয় ও বরণীয়। বাকি অংশ পরিত্যাজ্য বা পরিহার্য।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন