hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইতিহাসের ইতিহাস

লেখকঃ গোলাম আহমাদ মোর্তজা

৭১
বিখ্যাত হয়েও অখ্যাত যারা
আগেই বলা হয়েছে, মুসলমান জাতি কোনদিনই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারেনি। এবার পরিবর্তনের পালা আরম্ভ হল। উনিশ শতাব্দীর গোড়ায় বা বিশ শতকের শুরুতে মনে হয় যেন মুসলমান আর কিছুই করেনি, কিছু করেছিল যদি সত্যই হয় তো সেই সিপাহী যুদ্ধের আগে বা সময়ে। কিন্তু তা নয়। শুধু ১৯০৬ সালে যে সমস্ত বিখ্যাত মুসলমান রাজনীতি সচেতন নেতারা নতুন ইংরেজ ভাইসরয় আর্ল অব মিন্টোকে সেন্ট্রাল মুহাম্মাডান এ্যাশোসিয়েশনের তরফ হতে অভিনন্দন করেছিলেন তারাও বেশির ভাগই মাওলানা ও মাওলানা ধাচের ব্যক্তিবৃন্দ যথা-মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ, মাওলানা সৈয়দ নাসিরুদ্দিন, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, মাওলানা বজলুল খান, মাওলানা মোস্তাফা খান, মাওলানা দেলওয়ার হুসেন, মাওলানা সিরাজুল হক খান, মাওলানা আবদুল হামিদ, মাওলানা বদরুদ্দিন, মাওলানা মির্জা মুঃ মাসুম, মাওলানা আবদুল লতিফ, মাওলানা ইবনে আহমাদ, মাওলানা সৈয়দ আশরাফুদ্দিন, মাওলানা আবদুল কাদের, মাওলানা গোলাম রহিম, মাওলানা আবদুল মজিদ, মাওলানা কাজী মমতাজুদ্দিন, মাওলানা শামশুল হুদা, মাওলানা সৈয়দ নাসিরুদ্দিন, সৈয়দ আমীর আলী এম এ, জনাব মির্জা কাদের, অনারবল নবাব মমতাজ উল্লাহ, আঃ নবাব সৈয়দ মহম্মদ, প্রিন্স হাবিবুজ্জামান, প্রিন্স আক্রাম হসেন, জনাব মুহাম্মদ হাফিজ, জনাব মুহাম্মদ ভাই, জনাব হাজী নূরমুহাম্মদ জাকারিয়া, জনাব নূরমুহাম্মদ ইসমাইল, জনাব ইসমাইল খাঁ, জনাব হসেন ভাই, হাজী শেখ বখশে ইলাহি, জনাব আলিবেগ খান, জনাব করম আলী ভাই, জনাব সরফরাজ খান, জনাব সৈয়দ বাদশাহ নবাব প্রমুখ নেতাই সেদিন এ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সরকারের সাহায্যে ভারতীয় মুসলমানদের উন্নতি সাধন করেন। (দ্রঃ অধ্যাপক অমলেন্দু বাবুর ঐ পুস্তক, পৃঃ ৩৩০)

উপরোক্ত মুসলমান নেতারা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আর যারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন তাঁদের মধ্যেও খ্যাতনামা মুসলমান নেতা যথেষ্ট ছিল যেমন-ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ রসুল, আবদুল হালিম গজনবী (পরে স্যার উপাধি পেয়েছিলেন), ইসলামাবাদের মাওলানা মনিরুজ্জামান, মাস্টার মাওলানা কাজেম আলী, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বর্ধমান জেলার কাসিয়ারা গ্রামের মৌলভী সৈয়দ আবুল কাসেম, মাওলানা আবদুল মজিদ (দি মুসলমান নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক), পাটনার জনাব আলি ইমাম, (পরে স্যার উপাধি পেয়েছিলেন) হাসান ইমাম, ব্যারিস্টার মোজাহেরুল হক, মাওলানা লিয়াকত হোসেন, ডাঃ আবদুল গফুর সিদ্দিকী প্রমুখ। (দ্রঃ ঐ পুস্তক এবং সমকালের কথা পৃঃ ৭)

কমরেড মুজাফফর আহমাদ লেখেন, “সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে প্রথম পর্যায় (১৯০৪-১৯১৭) কঠোরভাবে হিন্দু ধর্ম অনুশাসিত ছিল।... হিন্দু রাজত্বের প্রতিষ্ঠাই তাঁদের অভিপ্রেত ছিল। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের আন্দোলন শুধু হিন্দু আন্দোলন ছিল না, আসলে তা ছিল বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন। (দ্রঃ সমকালের কথা, পৃঃ ১০)

মুসলমান সামগ্রিকভাবে যখনই ইংরেজবিদ্বেষ প্রকাশ বন্ধ করল সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা মুসলমানকে সমর্থন ও হিন্দুদের বিষ নজরে দেখতে আরম্ভ করল। যুগ যুগ পরে মুসলমানরা যে অগ্নি আন্দোলন জ্বালিয়ে তুলেছিল তা সামগ্রিক হিন্দু সমাজের সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন অভাবে যেন স্তব্ধ হল। এবার ইংরেজের প্রতি আন্তর্জাতিক নানা প্রকার চাপের কারণে নিজেরাই দেশ ছেড়ে পলায়নের প্রয়োজন অনুভব করে। এই সময় হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে সাথী হিসেবে মুসলমানদের তেমনভাবে ডাকেনি আর মুসলমানেরাও একটু পালা বদলের জন্য ব্যাপকভাবে যায়নি।

রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভা স্বীকার সকলকেই করতে হবে। তিনি ভারতের বাইরে ঘুরে বেশ করে বুঝেছিলেন মুসলমান জাতি সর্ব ভারতীয় নয় বরং আন্তর্জাতিক জাতি। তাই তিনি শেষের দিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যাদের তীব্র বিদ্বেষ ও পদোন্নতিকাতরতা ছিল তাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতে গিয়ে রবীবাবু লিখেছেন, “হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ লয়ে আমাদের দেশে একটা পাপ আছে। এ পাপ অনেকদিন হতে চলে আসতেছে। তা না ভোগ করে আমাদের কোন মতেই নিস্তার নেই।”

“আর মিথ্যা লেখার প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করতেই হবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে, আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।...

“আমরা জানি অনেক স্থানে ফরাসে হিন্দু মুসলমানে বসে না-ঘরে মুসলমান এতে আজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।”

“তর্কের বেলায় বলে থাকি কি করা যায়, শাস্ত্র তো মানতে হবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করে ঘৃণা করার তো কোন বিধান দেখি না। যদি বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয়, তবে সে শাস্ত্র লয়ে স্বজাতি স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনদিন হবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করে যাদের জাতি রক্ষা করতে হবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হয়ে তাদের গতি নাই। তারা যাদিগকে ম্লেচ্ছ বলে অবজ্ঞা করতেছে সেই স্নেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করতে হবে।” (দ্রঃ রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, পৃঃ ৬২৮-৬২৯)

ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে যাঁরা বিখ্যাত হয়েও অখ্যাত অথবা অবলুপ্ত তাঁদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ই রয়েছেন। মুসলমানদের নাম চাপা দেওয়ার কারণ সাম্প্রদায়িকতা ও গোষ্ঠী সঙ্কীর্ণতা। যখন হঠাৎ নেতার দল দেখলেন মুসলমানদের পূর্বপরিকল্পিত পথে স্বাধীনতা আসবেই, তাকে আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না তখন গান্ধীজি, নেহরু, প্যাটেল প্রমুখ নেতা দেশ বিভাগ মেনে নিয়েছিলেন। একথা আগেই জানানো হয়েছে কিন্তু কেন যে নিয়েছিলেন তাঁর এক অপ্রচারিত অকাট্য, কারণ আধুনিক চিন্তাশীলরা নির্ধারিত করেছেন, সেটা হচ্ছে এই যে, যদি ভারত অখণ্ড থাকে তাহলে স্বাধীনতার ইতিহাস মঞ্চে হঠাৎ নেতার দলের বেশির ভাগই বাদ পড়ে যাবেন আর চিরদিনের বিরুদ্ধবাদী মুসলমান জাতিই হবে সর্বেসর্বা। নিজেদের নামে জয় ঢাক বাজানো আর ইচ্ছামত ইতিহাস লেখানোর সন্ধানেই আজ অখণ্ড ভারত নিষ্ঠুরভাবে আহত অথবা ত্রিখণ্ডে নিহত।

সুভাস বসু, চিত্তরঞ্জন, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখ প্রকৃত স্বাধীনতা প্রার্থী আজ উপেক্ষিত প্রায়। তাদের তো তবুও কোন প্রকারে নামটুকু জানানো হয়েছে কিন্তু অবদানের মূলায়ন হয়নি। এছাড়াও বহু হিন্দু যোদ্ধা শহীদ ও প্রবাসীর নাম হজম করা হয়েছে তার কারণ কী? যদি সাম্প্রদায়িকতাই কারণ হয় তাহলে হিন্দুদের নাম গোপন করা হয়েছে কেন? তার সত্য ও সহজ উত্তর তারা সব কমিউনিস্ট হয়ে গিয়েছিলেন তাই তাদের বিষয়ে ভালমন্দ কিছু না বলে চুপ থাকাই ভাল মনে করা হয়েছে। অবশ্য কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম হয়নি তা নয়।

ইংরেজবিরোধী সংগ্রামী, যাঁদের ইতিহাসে যথাযোগ্য স্থান নেই তাঁদের সংখ্যা সহস্র সহস্র। কিন্তু আমাদের ইতিহাস সেদিকে না গিয়ে যদি রাম, সীতা, বানর, দ্রোপদী, লাইলি মজনু আর রুস্তম পালোয়ানের নাম দিয়ে ইতিহাসকে ভরিয়ে তোলে তাহলে আর কি বা বলা যায়?

কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়, কমরেড মুজাফর আহমাদ, কমরেড শওকত উসমানী, কমরেড গুলাম হুসাইন, কমরেড শ্রীপাট অমৃত ডাঙ্গে, কমরেড সিঙ্গার ভেলু চেটিয়ার, কমরেড রামচরণ শর্মা, কমরেড শামসুদ্দিন হাসনান, কমরেড মনিলাল, ডক্টর কমরেড সম্পূর্ণনন্দ ও কমরেড সত্যভক্ত প্রমুখ নেতার নাম কানপুর ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার রেকর্ডে পাওয়া যায়। অবশ্য এদের অনেকের বিপক্ষেও বিপক্ষীয়দের বক্তব্য নেই তা নয় তবুও এঁরা হঠাৎ নেতাদের অনেকের চেয়ে বিপদকে মাথায় নিয়ে পথ চলেছেন (দ্রঃ আমার জীবন ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি, মুজাফফর আহমাদ)

যারা জেল খেটেছেন ইংরেজের বিরুদ্ধবাদী বলে তাঁদের অনেকের মধ্যে ডাঃ যদু গোপাল মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক জ্যোতিষ ঘোষ, ভূপতি মজুমদার, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত, মনোরঞ্জন গুপ্ত, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোমোহন ভট্টাচার্য, রবি সেন, অমৃতলাল সরকার, রমেশ চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তির আজও মূল্যায়ন হয়নি। এমনিভাবে ব্যারিস্টার পুলিন বিহারী দিন্দাও একজন কমরেড ছিলেন। আর ছিলেন কমরেড ক্লেমেন্স, পামদত্ত একজন নামকরা লোক। এছাড়া কমরেড সাজ্জাদ জহীর, কমঃ ডক্টর জেড এ, কমরেড মোসাম্মৎ হাজেরা বেগম, কমরেড কুমার মঙ্গলম, কমঃ পার্বতী কৃষ্ণাণ, কমঃ নিখিলনাথ চক্রবর্তী, কমঃ ইন্দ্রাজৎ গুপ্ত, কমঃ রেনুরায় ও কমঃ জ্যোতি বসু প্রমুখ ভারতীয় বিলেতে পড়তে প্রবাসী অবস্থাতেই কমিউনিস্ট পার্টিকে আদর্শ বলে মনে করেন এবং দেশে ফিরে এসে ভারতে পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত হন। এরা বেশির ভাগই দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট। “আর জ্যোতি বসু প্রমুখ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিস্ট)-এর সভ্য। বাকি সকলেই দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে রয়েছেন।” (দ্রঃ ঐ পৃঃ ৫৮১)

এমনিভাবে ভারতের বাইরে যেসব ভারতীয়র অভিযান তাঁদের মধ্যে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, মুহাম্মদ সফীক, মুহাম্মদ মাসউদ আলী শাহ, হাবীব আহমাদ, মথুরা সিং প্রমুখ কমরেডের নাম ও তাদের কর্ম ও জীবন সংগ্রাম সমীক্ষিত হয়নি। মুসলমানরা যখন হতে মোটামুটি লোক দেখানো ইংরেজপ্রীতি দেখাতে থাকেন তখনকার স্বাধীনতার চিত্রটুকুই ইতিহাসে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে মনে হয় স্বাধীনতা শুধু হঠাৎ নেতার দল ও হিন্দু ভ্রাতারাই এনেছেন আর এক-আধজন মাত্র মাওলানা আযাদের মত মুসলমান স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন। কিন্তু আসল কথা তা নয়, মুসলমান যখন বারে বারে প্রমাণ পায় তারা ছাড়া কেউ স্বাধীনতা চায় না তখন তারা সাময়িকভাবে বাহ্যিক ইংরেজ প্রীতি দেখালেও ভেতরে ভেতরে ইংরেজবিরোধী আগুন জ্বালাতে বদ্ধপরিকর হয়। সেখানেও মাওলানা উবায়দুল্লাহ (সিন্ধু), মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী (দেওবন্দ), মাওলানা আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও আরও শতশত আলেম নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে অন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমতঃ কিছু শিক্ষিত যুবককে ভারতের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যেমন ১৯২৫ খৃস্টাব্দে লাহোরের বিভিন্ন কলেজ হতে বিপ্লবী, দেশগত প্রাণ প্রচুর ছাত্রকে উধাও বা নিরুদ্দেশ হতে দেখা যায়। যাঁরা দেশান্তরে গিয়েছিলেন দেশের জন্য তাঁদের নামের আংশিক তালিকা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোক্তা মুজাফফর আহমাদ বলেছেন, “লাহোরে বিভিন্ন কলেজ হতে যে পনেরজন ছাত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কয়েকজনের নাম নিচে দিলাম।

(১) খুশী মুহাম্মদ (২) আবদুল হামিদ (৩) জাফর হাসসান (৪) আল্লাহ নওয়াজ (৫) আবদুল বারী (৬) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ (৭) আবদুর রহমান (৮) আবদুর রশীদ (৯) রহমত আলী (১০) আবদুল মজিদ। বাকি পাঁচজনের নাম আমি জানতে পরিনি।” (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৮৯) . অবশ্য ঐ সব দেশগত প্রাণ বীরদের ইংরেজের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ করার জন্যই পাঠিয়েছিলেন এ মাওলানাদেরই দল। এ কথাটির প্রমাণ ঐ বয়েতেই আছে “তবে একটি কথা এখানে বলে রাখা ভাল যে লাহোরের ছাত্রদের দেশ ত্যাগ করার বৈপ্লবিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন মৌলভী ওবায়দুল্লাহ সাহেব।... উল্লিখিত ১৫ জন ছাত্র পরে ‘পলাতক ছাত্র’ বা ‘মুজাহিদ ছাত্র’ নামে অভিহিত হয়েছেন। জিহাদ শব্দের অর্থ ধর্মযুদ্ধ। যারা ধর্ম করেন তাদের বলা হয় মুজাহিদ। পলাতক ছাত্রদের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।” (দ্রঃ ঐ, ১৮৮ পৃঃ)

আগেই বলা হয়েছে, মুসলমানরাই শুধু পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বারবার দাবি করেছেন আর কংগ্রেস নেতারা তা বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেষে মুসলমানদের খিলাফত কমিটি এবং কংগ্রেস যখন এক হয়ে যায় তখনও অনেকদিন অনেকবার ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়ে শেষে যখন পূর্ণ স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন রেজুলেশনে যে কথাটি লেখা হয়েছিল তা জানতে পারলে হঠাৎ নেতাদের প্রতি অনেকের ঘৃণা আরও বৃদ্ধি হয়। সেটি হচ্ছে এই-The best interests of India and the Moslems demand that the Congress creed the term "Swaraj" be subtituted, henceforth by the term "Complete independence," অর্থাৎ ভারতবর্ষের স্বার্থে এবং মুসলমানদের দাবিতে এখন হতে কংগ্রেসের মূলমন্ত্র “স্বরাজের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতা হওয়া উচিত।” (দ্রঃ সত্যেন সেনের পূর্বোক্ত পুস্তক, পৃঃ ১০৬) নতুন সরকার গঠনের দুঃসাহস মুসলমান নেতারা বারে বারে বিক্ষিপ্তভাবে করেছিলেন আর হিন্দু নেতাদের মধ্যে একমাত্র যিনি ঐ সাহসে সাহসী হয়েছিলেন তিনিই হচ্ছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র। ভারতের বাইরে কাবুল রাষ্ট্রে গিয়ে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ভারতের জন্য একটি সরকার গঠন করেছিলেন এবং সেই সুচিন্তিত পদক্ষেপ যে শুধু মাত্র মুসলমানী ভাবধারা ঘেঁষা ছিল তা মোটেই বলা যায় না। কারণ ঐ সরকারের কমিটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকতুল্লাহ আর স্বরাষ্ট্রপদে যোগ্যতার পূর্ণ প্রতীক মাওলানা উবায়দুল্লাহ স্বয়ং আর রাষ্ট্রপতির সম্মানীয় পদে যাকে বরণ করা হয়েছিল তিনি হচ্ছেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ। আর লাহোর হতে আগত মুসলমান যুবকগণ অন্যান্য পদ গ্রহণ করেছিলেন। (দ্রঃ মুজাফফর আহমাদের পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৮৯)

মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আসল নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পাক্কা একজন ব্রাহ্মণ। অতএব তিনি তখনকার নীতি অনুযায়ী সন্ত্রাসবাদীর দলেই ঢুকেছিলেন। “অস্ত্র সংগ্রহের তাগিদে প্রয়োজনীয় অর্থের জন্যই বিপ্লবীরা তকালে রাজনৈতিক ডাকাতিতে লিপ্ত হতেন। ১৯০৭ সালে নরেন্দ্রনাথ এক রেল স্টেশনে ডাকাতির দায়ে অভিযুক্ত হন।” (বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃঃ ৪১০) বহুবার বয়স অল্পের জন্য তিনি মুক্তি পান শেষে ১৯১০ সালে তাঁর জেল হয়। পরে জেল হতে মুক্তি পেয়ে তিনি পাকা ধার্মিক ও সন্ন্যাসী হয়ে পড়েন। পুনরায় আবার অস্ত্র সরবরাহ মামলায় অভিযুক্ত হন এবং বিদেশে পাড়ি দেন। তখন শিক্ষিত ও সাহসী যারাই বিদেশে যাবার জন্য প্রস্তুত হতেন মাওলানার দরদিদের সঙ্গে যোগাযোগ পেয়েছিলেন। তাঁকে অনেকে বিদেশে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির স্রষ্টা বলে থাকেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। অবশ্য তিনিও একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। তাই কমরেড মুজাফফর আহমাদও বলেছেন, “প্রবাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরও তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।” মানবেন্দ্রনাথের রাশিয়ার মস্কোয় পৌঁছাবার আগেই মাওলানা জ্যাকোরয়; সেখানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা সারা মস্কোকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ১৯১৯ সালের ৯ জুন তাশখন্দে অনুষ্ঠিত তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে জাকারিয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন।” (দ্রঃ আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, পৃঃ ১৯৫) পরে ঐ জাকারিয়া সাহেব পৃথিবীর নানা রাষ্ট্র ঘুরে প্যারিসে আরও পড়াশোনা করেন এবং ফরাসী ভাষায় একটি থিসিস লেখেন সেটার অর্থ হচ্ছে ‘মার্কসীয় দৃষ্টিতে ভারতের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ এবং তিনি ডক্টর উপাধি লাভ করেন।

স্বাধীনতার জন্য মাতৃভূমি ত্যাগ করে যারা ইংরেজের তোষণ, পোষণ ও আমন্ত্রণে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন তাঁদের কথা বলছি না। সুভাষচন্দ্র আর মাওলানা উবায়দুল্লার মত মানুষের কথাই এখানে আলোচ্য। জানলে অবাক হতেই হবে মুসলমান জাতির “খিলাফত আন্দোলন” হতে ‘হিজরত’ আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল।” (দ্রঃ ঐ) হিজরত মানে ধর্মের জন্য অত্যাচারিত হয়ে দেশ ত্যাগ। অতএব মাওলানার দল সাধারণ মুসলমানদের কেন যাদুতে বশ করেছিলেন, যে দলে দলে লোক ভারত হতে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছে। ডাঃ পট্টভি সীতা রামাইয়া তাঁর কংগ্রেসের ইতিহাস The History of the Indian National Congress, Vol. I.P 199 এ লিখেছে যে “আঠারো হাজার মুসলমান এই সময়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন।” এই অব্যর্থ সত্য ঘটনা মুজাফফর আহমাদও স্বীকার করেছেন আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পুস্তকে ১৯৭ পৃষ্ঠায়।

১৮,০০০ মুসলমান প্রত্যেকেই ইতিহাসখ্যাত মানুষ। তাদের ভেতর হতে ১৮ শতও দূরের কথা ১৮ জনও চলতি ইতিহাসে যথাযোগ্য স্থান পাননি। একধার হতে তাদের নাম যদি পরপর লিখে তাদের সম্বন্ধে অল্পস্বল্প করেও পরিচয় দেওয়া যায় তাহলে এক পৃষ্ঠা করে লিখলেও ১৮০০ পৃঃ হবে তাই কয়েকজন মুসলমান ও হিন্দুর নাম ইঙ্গিত হিসেবে আরও লিখছি। কমঃ আবদুল কাদীর (গুলিতে নিহত হয়েছিলেন), মুহাম্মদ আকবর খান, অবনী মুখার্জি প্রমুখ। পরে আরও কিছু ভারতীয় ইউরোপ হতে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন যেমন ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত, বীরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, সৈয়দ আবদুল ওয়াহিদ, অধ্যাপক পাণ্ডুরঙ্গ খানখোজে, হেরম্বলাল গুপ্ত, গুলাম আম্বিয়া লুহানী, আগনেশ স্মোড়লি, নলিনী গুপ্ত প্রমুখ। এছাড়াও নামজাদা অনেক তরুণ ভারতের বাইরে অনেক কাজ করেছেন, নিজামুদ্দিন, সাঈদ আহমাদ রাজ, সুলতান মাহমুদ, ফিদআ আলী, আঃ কাদের শেহরাই, হাবীব আহমাদ, রফিক আহমদ, ফিরোজুদ্দিন মনসুর ও মীর আবদুল মজিদ, আমরি হায়দার খান, কলকাতার শামসুল হুদা, অধ্যাপক ক্ষিতিশচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, ব্যারিষ্টার জীবন লাল কাপুর, মুঃ কুতুবুদ্দিন প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। মাওঃ ব্যতীত বাকি যাদের নাম করা হলো তাঁরা প্রায় সকলেই কমিউনিস্ট হয়ে গিয়েছিলেন। মাওলানা উবায়দুল্লাহ আশা করেছিলেন যাঁদের পাঠানো হচ্ছে তারা ঠিকমত নামায রোযায় অভ্যস্ত না হলেও বা পোশাক-পরিচ্ছদে খানিকটা সাহেবী গন্ধ থাকলেও ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের গাঢ়। ফলে তারা জয়ী হবে এবং পরে তাদের খুব পাকা মুসলমান বানিয়ে নিতে পারা যাবে। রাশিয়ার মস্কোতে এক বিরাট বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছিল তা প্রবাসীদের জন্য। সেখানে শুধু মাথা গুঁজবার জায়গাই ছিল না বরং ফ্রীতে খাওয়া দাওয়া থাকা আর সম্ভাব্য আরাম আয়েস ও গোলাপি বিলাসিতারও ব্যবস্থা ছিল। তার চেয়েও লোভনীয় জিনিস ছিল অন্য রাষ্ট্রে যাতায়াত বা যোগাযোগের ও রাষ্ট্রের তরফ হতে তখন করা হতো সেটির নাম ছিল "Communist Uniyecity of the Toilng East" নামে শ্রমজীবীদের প্রাচ্যের কমিউনিস্ট বিদ্যালয়। রাশিয়ায় আরো একটি IRussian's Univercity of Oriental Communism" প্রাচ্য কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। মিঃ এ, সি, ফ্রি মান যা লিখেছেন তাতে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা থাকতো বেশ বোঝা যায়-“নয়ন তপ্তিকর পোশাক পরিহিত লোকেরা এই বাড়ির ভেতরে ছিলেন, কারুকার্য খচিত টুপি পরা বুখারার দর্জিরা, ভোলা আর ক্রিমিয়ার বাদাম চোখে তাতারেরাও ছিলেন, ছিলেন ককেসাসের পার্বত্য মুসলমানরা, আরও ছিলেন ভারত, চীন, জাপান ও কোরিয়ার রাজনীতিক আশ্রিতেরা।” (দ্রঃ ঐ পৃঃ ৮৯)

এখান হতে বোঝা যায় যে পুরোপুরি অগ্নিমন্ত্রে রঞ্জিত এবং দীক্ষিত না করে বিদেশে পাঠানো ঠিক হয়নি। ওখানেই যাঁরা থাকার ছলনায় পড়েছেন ও থেকেছেন তারাই পরে কমিউনিস্ট ও কমরেড উপাধিতে ভূষিত হয়ে আমাদের কাছে নাস্তিক বলে চিহ্নিত। অথচ তাদের ধর্মীয় যশ ও হুঁশ কিছুই কম ছিল না। শুধু অভাব ছিল পূর্ণ ধর্ম শিক্ষা ও ইসলামের মতবাদ হতে বিচ্ছিন্নতা মাত্র। রাশিয়ানরা মানবেন্দ্রনাথ রায়কে একটা শিক্ষকের পোস্ট দিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের নানাভাবে দলে টেনেছিল। অথচ তাদের ইংরেজি শিক্ষা ধর্মের পূর্ণ উন্মাদনা পুরো মাত্রায় ছিল। যেহেতু মিঃ রায় লিখেছেন... Most of them transferred their fanantical allegiance from Islam to Communism... “এই অল্পসংখ্যক মুহাজির যুবকের ভেতরে ইসলাম সম্বন্ধে যতটা উম্মাদনা ছিল ঠিক ততটাই উন্মাদনা তাদের ভেতরে এসে গেল কমিউনিস্ট সম্বন্ধেও।” (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৫০) কমরেড মুজাফফর আহমাদ নিজেও একজন পূর্ণ মওলুবী না হলেও বেশ কিছু জানতেন, যেহেতু তিনি প্রথমে নোয়াখালীতে আখতারিয়া মাদ্রাসায় পড়েছিলেন এবং পরে পড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য লাইন গ্রহণ করেন। পরে তিনি কেমন করে নাস্তিক হয়ে পড়লেন তা চিন্তা করা উচিত।

এই কমিউনিজম সাধারণত গরিব শ্রেণীরই বেশি পছন্দ যেহেতু তাতে দরিদ্র শ্রেণী মোটা ভাত কাপড়ের আর অনটনের হাত হতে রেহাই পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার ভারতের মৌলানা মওলুবী ধর্মভীরু বিরাট পণ্ডিত সম্প্রদায়টি ধনী নয়, কোটি কোটি মুসলমান এখনো তাঁদের সঙ্গে বিজড়িত কিন্তু তারা কেন কমিউনিজমবিরোধী? তাহলে কি তাঁরা সেই ইজমেব প্রতীক্ষায় আছেন, যেখানে আল্লাহকে স্বীকার করে নিয়ে শান্তিবাদ ও সমতাবাদ থাকবে, সেখানে থাকবে না মানুষের মনগড়া পরিবর্তনশীল অস্থায়ী অসার আইন?

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা ঘটেছিল ১৯১৭ সালে ১৩ এপ্রিল আর কিসসাখানি বাজারে অনুরূপ আর একটা ঘটনা ঘটেছিল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৩ এপ্রিল। ১৯১৭ সালে আমেরিকায় ভারতীয় রামচন্দ্র ভরদ্বাজ ইংরেজের বিরুদ্ধে গদব পত্রিকায় লিখতেন। তাই ইংরেজরা ১৯১৭ সালে ২৩ এপ্রিল তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ঐ তারিখকে কেন্দ্র করে ১৯৩০ সালে ২৩ এপ্রিল মাওলানা আবদুর রহিম পোপলজি, আল্লাহ বখশ হরতী, গোলাম রব্বানী শেষ্ঠীর নেতৃতে একটি কাউন্সিল গঠিত হয়। বহু লোক তাদের ভাষণ শুনতে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি গাড়ি আসে এবং মাওলানাদের এ্যারেস্ট করে। জনতা বাধা দিতে গিয়ে বাধা পায়। অবশেষে পুলিশ গুলি চালায়। জনতা তখন গাড়ির প্যাট্রোলের ড্রাম ফাটিয়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে মিঃ মেটকাফ ও মিঃ গার্ডন অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যাসিনগান, কামান ও গোলাগুলি আনিয়ে নেয় তখনও জনতা নেতাদের মুক্তির দাবিতে চিৎকার করছিল। আরম্ভ হল ফায়ার সমস্ত মানুষই প্রায় আগুনে আহত হতে বাকি থাকে নাই আর অনেকেই বাজারের উপর শহীদ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে সন্ধি করলেন। ওখানে লালকোর্তা বাহিনীর বীরত্ব ভোলার নয়। যার নেতা ছিলেন সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার। তিনিও কিসসাখানিতে বন্দি হলেন। আজ গাফফার খানের অবদান হঠাৎ নেতাদের চেয়েও সহস্র সহস্র গুণে বেশি এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ। কিন্তু ইতিহাস প্রায় নীরবই বলা যায়।

আবদুল গাফফার খানের একটি বিরাট বীর বিপ্লবী দল ছিল। প্রত্যেকটি বিপ্লবী দু-চার দিন না খেয়ে তাঁরা লড়াই করতে পারতেন। তাঁরা রক্ত দিতে ও রক্ত নিতে দুটোতেই সমান সক্ষম ছিলেন। তাঁদের জামার রঙ ছিল রক্তের মত লাল, তাই “লালকোর্তা” বা রেডশার্ট এক ঐতিহাসিক শব্দ।

গান্ধীজির দুর্বল অহিংস পুতুল বিপ্লবীদের থামিয়ে রাখা সহজ ছিল কিন্তু বীর বাহিনীকে থামিয়ে রাখা তার এক বিরাট কীর্তি। যদি তিনি কংগ্রেসের খপ্পরে না পড়তেন তাহলে তাকে তার বাহিনীকে নিয়ে তিনি অন্য পথে চলতে পারতেন। মাওলানা আযাদের কথায় তাঁকে গান্ধী, জহরলাল ও প্যাটেল প্রমুখের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হয়েছিল। খান সাহেবের সৈনিক দলটির নাম ছিল খোদায়ী খেদমতগার, যার বাংলা মানে স্রষ্টাসেবক। তার ভাই, তিনিও বিখ্যাত নেতা ছিলেন, তিনিই ডাঃ খান সাহেব বলেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁদের বিরাট অবদান ঐ খান ব্রাদার্সদের ঐতিহাসিক অবদান এবং নেহরুর অনেক তথ্য নেহেরুর অবিচার ও নির্বুদ্ধিতা এবং রাজনৈতিক অনেক ত্রুটির ইতিহাস, আসল ইতিহাসে বিজড়িত। মুসলিম লীগের নেতাদের দেশপ্রেমের পরিমাণের পরিমাপ করেই তিনি কংগ্রেসে গিয়েছিলেন কংগ্রেসীদের শক্তি বৃদ্ধি করতে এবং ত্রুটি সংশোধন করতে। ফলে মুসলিম লীগ খান ভ্রাতৃদ্বয়কে খুবই ঘৃণার চোখে দেখতো। কিন্তু কংগ্রেসে যিনি বা যারা মিঃ মাউন্টব্যাটেনের দেশ ভাগের সময় পর্যন্ত সংযুক্ত ছিলেন তিনি আজ ইতিহাসে বঞ্চিত কেন? যাকে তখন সীমান্ত গান্ধী উপাধি দেওয়া হয়েছিল তার আজ গান্ধীর পাশে একটুও স্থান নেই। "Khan Abdul Gaffar Khan and his party had always supported Congress and opposed the Muslim League. The League regarded the khan brothers as mortal enemies. (hs" India wins Freedom by Azad)

খান আবদুল গাফফার খান এবং তার বাহিনী খোদায়ী খেদমতগারদের কংগ্রেস এমনভাবে ত্যাগ করে, যেমন নেকড়ে বাঘের মুখে ফেলে দেওয়া। (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৯৩)

এমনিভাবে আরও বহু বিখ্যাত মানুষের নাম আজ অজ্ঞাত যেমন ১৮৭২ সালে মিঃ লর্ড মেয়োকে হত্যা করেছিলেন মুহাম্মদ শের আলী এবং তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। ১৮৭১ সালে কুখ্যাত বিচারপতি কথায় কথায় লাল কেতাবের আইনে বিপ্লবীদের ফাঁসি দিতেন তাঁকে উপযুক্ত পুরস্কার হিসেবে খতম করেন মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে যিনি প্রথমে বিদ্রোহী শহীদ তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ রফিক মণ্ডল। এদের নাম আজও মুছে যাওয়া উচিত নয়। (দ্রঃ আজকাল পত্রিকায় প্রবন্ধ ভারতের মুক্তি সংগ্রাস ও মুসলিম সমাজ, শান্তিময় রায়। ১৯০৮ ডিসেম্বর)

১৯০৬ সালে বরিশালের সংগ্রামে যিনি নেতৃত্ব দেন তিনি হচ্ছেন আবদুল্লাহ রসুল। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন শুধু হিন্দুরাই করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু তার সঙ্গে মুসলমান উকিল, মোক্তার, তালুকদার প্রমুখ প্রচুর মুসলমান যোগ দিয়েছিলেন তার কিছু কিছু নাম বলা হয়েছে তবু তার তাথ্যিক হিসেবে কোন জেলা হতে কতগুলো নেতৃস্থানীয় মুসলমান যোগ দিয়েছিলেন বলতে হলে নোয়াখালী ৪০, বরিশালে ৮০, চট্টগ্রামে ৫০, ফরিদপুরে ৫০, ময়মনসিংহে ১১০, ঢাকায় ৭৫ ও কলকাতায় ২০০ সভা হয় তাতে মুসলমানদের সংখ্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। “এই সব জেলায় বিপুলসংখ্যক মুসলিম জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেছিলেন ও মুসলিম জননেতা এই সব সভাগুলোতে ভাষণ দিয়েছিলেন। (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩৭-৩৮) আমরা ইতিহাসে হিন্দুদের গুপ্ত সমিতির নাম পাই তা সঙ্কীর্ণ ও অসঙ্কীর্ণ যাই হোক। কিন্তু মুসলমানদের প্রচুর গুপ্ত ঘাটির নাম ইতিহাসে গুপ্তই আছে।

“অনেক মুসলিম যুবক মুসলিম গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। মৌলানা আযাদ মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, পেশোয়ার ও উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় পরিক্রমা শেষ করে কলকাতায় হালিবুল্লাহ (আল্লার দল মিসবাহুল লুগাত অভিধান দ্রঃ) নামে বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই সমিতির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে ও বাংলার বাইরে অনেক দেশপ্রেমিক মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে তার দলভুক্ত করেন।

‘জাহানী ইসলাম’ নামে একটি পত্রিকা জাহাজীরা বন্দরে বন্দরে বিলি করতেন তারা প্রায় সবই মুসলমান তার একটিতে মিসরের ইনভার পাশার একটি মন্তব্য ছিল; “হিন্দু-মুসলমান, তোমরা উভয়ে একই বাহিনীর সৈনিক। তোমরা দুই ভাই। এই নিচ ইংরেজ জাতি তোমাদের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে (জেহাদ) যোগ দিয়ে তোমরা মহত্ব লাভ কর।” (দ্রঃ ঐ)

“এই সংগঠিত প্রচেষ্টার ফলে ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১৩০ নম্বর বেলুচি রেজিমেন্ট রেঙ্গুনে, ব্যাঙ্ককে ও সিঙ্গাপুরে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ সালে ৫ নং নেটিভ লাইট পদাতিক সেনাবাহিনী (যার প্রায় গোটা সেনাবাহিনীই মুসলিম) সিঙ্গাপুরে বিদ্রোহ করে।” (শান্তিময় রায়, ঐ)

শোষক ইংরেজ বন্দুকের নল দিয়ে তা ব্যর্থ করে দুজন নেতার ফাঁসি দেয় আর বাকি প্রত্যেককে যাবজ্জীবন দীপান্তর দেয়।

১৯১৭ সালে দ্বিতীয় মান্দালয় ষড়যন্ত্র মামলায় তিনজন বিপ্লবী সৈনিকের প্রাণদণ্ড হয়। অবশ্য তাঁদের নাম প্রচলিত ইতিহাসে নেই কিন্তু সত্য ইতিহাসে খোদিত। তারা হচ্ছেন জয়পুরের মুজতবা হুসেন, লুদিয়ানার অমর সিং আর ফৈজাবাদের আলী আহমাদ।

১৯১৫ সালে বিপ্লবীদের সর্বোতভাবে সাহায্য করার জন্য এবং ধনী হয়েও বিপ্লবীদের সাহায্য করে স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ করার অপরাধে যে মহামনীষীর ফাঁসি হয় তিনি হচ্ছেন কাসেম ইসমাইল খান।

১৯১৫ সালে মার্চ মাসে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বজ্র হামলা ও বিদ্রোহের অপরাধে মুহাম্মদ রাইসুল্লা খানের ফাঁসি হয়। ইংরেজি রিপোর্টে এই নামটি রাসূলুল্লাহ আছে কিন্তু এই নামটির বানান ভুল a-এর মধ্যে একটি i বাদ গেছে বলেই মনে হয়। সুতরাং আমরা রাইসুল্লাহ লিখলাম। ঐ ১৯১৫ সালেই মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলীও বীরদর্পে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেন এবং জীবন আর সমস্ত রক্ত বিন্দু দান করেন। ঐ ১৯১৫তে রুকনুদ্দিন ফাঁসির মঞ্চ অলঙ্কৃত করেন। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা, শয়তান ইংরেজ সরকার, তার প্রাণভিক্ষার আবেদন নিবেদন করলে প্রাণদণ্ড শিথিল হতে পারে বলে জানায়। কিন্তু তারা শত্রু শাসক সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন জানানো তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। তাই হাসিমুখে মঞ্চে আরোহণ করেন।

১৯২৭ সালে বিপ্লবী বরকতুল্লাহ ভারতের বাইরেই প্রাণত্যাগ করেন, মরবার আগেই জানিয়েছিলেন একটি সাধের কথা সেটা হচ্ছে ভারতের স্বাধীনতা পাওয়া আর ভারতের মাটিতে তার কবর হওয়া।

ভারতের বিখ্যাত বীর আমীর হাইদার ভারতের বাইরে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, জাভা, সুমাত্রা, জাপান প্রভৃতি দেশে এমনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন যে কোন দিন যায় সরকার তাঁকে ধরতে পারেনি। অবশেষে তিনিও কমিউনিষ্ট হয়ে গেছেন। তাই তার অবদানও বোধহয় চাপা পড়ে গেছে।

মৌলানা আযাদের একজন অন্যতম বিপ্লবী সহকর্মী ছিলেন নাম রেজা খাঁ, অস্ত্রশস্ত্র আমদানিতে তার আবেদন আছে যথেষ্ট। তিনিও পরে কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন। এমনভাবে নেত্রকোনার মকসুদ্দিন আহমাদ, নাসিরুদ্দিন আহমাদ, মাওলানা গিয়াসুদ্দিন আহমাদ, নাসিরুদ্দিন আহমাদ এবং তাঁর কন্যা রাজিয়া খাতুন বিপ্লবী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। আরও অমর হয়ে আছেন মওলুবী আবদুল কাদের, কিশোরগঞ্জের আলী নওয়াজ, মুহাম্মদ ইসমাইল, চাঁদ মিঞা ও আলতাফ আলীর নাম বিপ্লবী দলে বিশেষভাবে বিদ্যমান। যুগান্তর দলের সঙ্গে যোগ দিতে গিয়ে নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্য নামায-রোযা বাদ দিয়েও সিরাজুল হক ও হামিদুল হক সন্ত্রাসবাদী হয়ে কাজ করেছিলেন। তাঁদের জেল হয়েছিল। ১৯৩০ সালের মে মাসে সোলারপুরের ফাসি মঞ্চে যারা গলা দিলেন, যাদের ইংরেজের পক্ষ হতে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করতে বলা হয়েছিলো, যাঁরা তাদের আবেদন পরামর্শে পদাঘাত করেছিলেন এবং ফাসি মঞ্চে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন কোরবান হুসেন ও আবদুর রশীদ।

উত্তর ভারতে বটুকেশ্বর, চন্দ্রশেখর, ভগৎ সিংহ প্রমুখ ব্যক্তিবৃন্দ “হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি” নামে একটি দল তৈরি করেছিলেন। ঐ দলেও মুসলমান মাথা গুঁজে অংশগ্রহণ করতে ভোলেনি। তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ আসফাকুল্লার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফাঁসির পূর্বে তাঁর আত্মীয়স্বজন অনেকে তাঁকে দেখতে এসে কাঁদছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন আমাদের নামাযের মধ্যে প্রতিদিন ভালদের পথে, বীরদের পথে, শহীদদের পথে চলার কথা স্মরণ করতে হয় সূরা ফাতেহার মধ্যে। তাই তোমরা কেঁদে আমাকে অশান্ত করো না।

আজ মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকের মত আমিও ভারতে স্বাধীনতার জন্য অসত্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে ফাঁসিতে যাচ্ছি তাতে আমার অনেক আনন্দ ও গর্ব আছে। এই বলে ফাঁসির রজ্জু গলায় পরে জোরে জোরে গম্ভীর কণ্ঠে তিনি কোরআনের আয়াত পাঠ করেছিলেন। (শান্তিময় রায়ের ঐ লেখা পৃঃ ৪৫)

বীর রাম প্রসাদেরও বিপ্লবের অপরাধে ফাসি হয়। উপরোক্ত তথ্যগুলো সংগৃহীত হয়েছে মৌলানা আবুল কালাম আযাদের লেখা (মহাফেজখানা) কালিচরণ ঘোষের The Rule of Honour, পেশওয়ার ষড়যন্ত্র মামলার কাগজপত্র, বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি কথা, যদু গোপাল মুখপাধ্যায়ের বিপ্লবের পদচিহ্ন, ভুপেন্দ্র দত্তের, সমকালের কথা, মুজাফফর আহমাদ প্রমুখের পুস্তক হতে।

হঠাৎ নেতাদের আবির্ভাব বা জন্মের পূর্বে মুসলমানদের কি বিরাট ভূমিকা ছিল তা বিশেষ করে বিশদভাবে দেওয়া সম্ভব হল না। যদি মন বোঝানো করে ধরেই নেওয়া যায় জাতির জনকদের জন্ম পরেই হয়েছে আর এদের পূর্বে যারা আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হয়েছেন তাঁরা জাতির জনক নন, জাতির শিশু পুত্র, তাহলেও তো হঠাৎ নেতার দলের সাথে যারা তালে তালে চলেছেন তাঁদের নাম বাদ গেল কেন?

ফররুখ আবাদের নবাব ইকবাল মন্দ খাঁ দেশের জন্য ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছেন। গজনফর হুসাইন খাঁও প্রাণ দিয়েছেন ফাঁসির নিষ্ঠুর ফাঁসে। এমনিভাবে সাখওয়াত হুসাইন ও তাফাজুজু হুসাইনকেও ক্ষুদিরামের মত ফাঁসি দেওয়া হয়।

মুনসী আবদুল করীম, কাজী মিঞাজান, শেখ রহিম বখশ ও মাওলানা ইলাহী বখশকে সারা জীবনের জন্য নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছিল যা ফাসির চেয়ে কম নয়। শুধু তাই নয়, তাঁদের যথা সম্পত্তি সমস্ত কিছু ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল।

মাওলানা জাফর এবং আলহাজ মুহাম্মদ শফী সাহেবের ফাঁসির রায় হয়। কিন্তু শহীদ হওয়ার জন্য তাদের আনন্দ ফুর্তি দেখে ইংরেজরা অবাক হয়। হয়ত ভেতরে ভয় ও দুঃখ নিয়েও উপরে বীরত্বের ভান করা যে যায় না, তা নয়। কিন্তু এদের শহীদ হওয়ার আনন্দে শরীরের ওজন বেড়ে গিয়েছিল। তাই সরকার ক্রোধে তাঁদের বীরত্বপূর্ণ হতে না দিয়ে ফাঁসির রায় বাতিল করে চির নির্বাসন দিয়েছিল। জেলখানায় নানা অত্যাচার করা হয়েছিল এমনকি ইসলামী জাতীয় প্রতীক তাঁদের শ্মশ্র ও মাথার কেশ মুণ্ডন করে দেওয়া হয়েছিল।

হযরত আহমাদুল্লাহ সাহেব শহীদ হয়েছেন ইংরেজেদের অন্ত্রে অবশ্য এদের কিছু আলোচনা পূর্বে হয়েছে। কিন্তু এরা প্রত্যেকে এত বড় বড় মানুষ যে, এদের নামে এক একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব।

এমনিভাবে পীর আলীর নাম পূর্বেই করা হয়েছে কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি ও তাঁর আর ৩১ জন সঙ্গী মুসলমান যোদ্ধাও বন্দি হন। আর ঐ ৩১ জনেরই একটি একটি করে ইংরেজ নিষ্ঠুরভাবে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।

“বিভিন্ন প্রসিদ্ধ উচ্চপদস্থ ইংরেজদের রিপোর্ট মতেও ২৭/২৮ হাজার মুসলমানকে বিনা বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এবং প্রায় সাতশত বিশিষ্ট আলেমকেও ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে।” (দ্রঃ হায়াতে মাদানী, পৃঃ ৪১-৪২) কিন্তু আসলে এটা ইংরেজদের রিপোর্ট-এর চেয়ে বহু বহু গুণ মুসলমান আলেম আর বিপ্লবীকে নিহত হতে হয়েছিল।

বহু মুসলমানকে শূকরের চামড়ায় মাথা মুখ ঢেকে জলন্ত উনান বা চুলাতে ফুটন্ত তেলের উপর ছাড়া হয়েছিল। (এ বর্ণনা মিঃ এডওয়ার্ড টমসনের। দ্রঃ ঐ)

সর্দার বিঠল ভাই মরার আগে সুভাষ বোসকে ভারতের বাইরে কাজ করার জন্য ১ লাখ টাকা দিয়ে গিয়ে ছিলেন কিন্তু সে টাকা কোন এক কঠিন চক্রান্তে তাঁকে দেওয়া হয়নি।

গান্ধীজি ১৯২৮ সন থেকে সুভাষ বাবুকে দেখে এসেছেন সন্দেহের চোখে। সুভাষ বাবুর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ কংগ্রেসের বামপন্থীদের আয়ত্তে এনে আপসহীন সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাবেন এই আশঙ্কা তাঁর ছিল। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে তখন কংগ্রেসরাই বড় দেশের কল্যাণ কিছু নয়।” (দ্রঃ অবিস্মরণীয় ২য় খণ্ড, পৃঃ ২০ শ্ৰী গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র) ১৯৪১ সালে ১ মার্চ ভারত ত্যাগ করেন সুভাষ আর দেশের নেতারা কেউ খোঁজ করেননি। ২৫ দিন পর সংবাদপত্রের প্রকাশ হয় ‘সুভাষচন্দ্র বসুকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

বিশ্বযুদ্ধ যখন জোরে চলছে, তখন ভারতবাসীকে জোর করে দলে দলে শাসক ইংরেজ সৈন্যদের দলে ভর্তি করেছে হাজারে হাজার। আর ভারতকে পিষে পিষে কোটি কোটি টাকার পণ্য চালান দিয়েছে বিদেশে। কারণ ঐ যুদ্ধে ভারত হতে ২৮,০০০ লক্ষ পাউণ্ড অর্থ ১৯৩৮ হতে ১৯৪৫ পর্যন্ত সময়ে ইংল্যাণ্ডে রপ্তানি হয়। ভারতীয় মাল পাচারের যে পরিমাণ ছিল তা আরও বেড়ে গেল। আর ভারতের জন্য যতটুকু ইংরেজরা আমদানি করতো তা ছিল শতকরা ৩০% এখন যুদ্ধের সময় তা কমিয়ে করা হয় ২০%। ফলে ভারতের লোক অনাহারে মরতে লাগলো এবং ঐ সময় আমেরিকা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ছিল তাই ১৯৪১ সালের মার্চ হতে ১৯৪৫-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমেরিকা, ভারত ও সিংহলকে ২১১৬ লক্ষ ডলার মূল্যের খাদ্য ও মালপত্র সরবরাহ করে। এইসব তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। (a) Banker. London, gamary 1946 P.I.The Eastern Economist at 21-10-49 p 633 (b) India Review of Commercial conditions (London) Aug, 1945, P 12-16 (c) Survey of current-business (Washington) March 1946 p 9)

ঐ সময় জিন্নাহ বললেন, তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধেই লড়বেন (ভারতের বিরুদ্ধে নয়) “হিন্দু মহাসভার নেতারা বললেন, তাঁরা লীগের বিরুদ্ধে লড়বেন (ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়) আর ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।” (শ্রী গঙ্গানারায়ণ চন্দ্রের লেখা ঐ পৃঃ ৫৪)

শ্রী সুভাষচন্দ্রের এক গৌরবময় ইতিহাস আছে অবশ্য তিনি ইতিহাসে স্থান পেতে একেবারে বঞ্চিত হননি কিন্তু জহরলাল কেন বলেছিলেন “সুভাষ এলে আমি রাইফেল হাতে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব।”

আসল কথা হচ্ছে এই, ইতিহাসখ্যাত হঠাৎ নেতার দলরা প্রকৃত স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষে উদিত হয়ে ইংরেজের সঙ্গে লড়াই না করে হিন্দু-মুসলমানে লড়াই করেছেন আর শাসক ইংরেজ হাসি চাপা রেখে গম্ভীর মুখে ঐ মারামারিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ আর মোড়লদের যোদ্ধা বলে টাইটেল দিয়েছেন। সুভাষকে দলে গ্রহণ না করার শ্রেষ্ঠতম কারণ হচ্ছে এই, তিনি মুসলমানদের আন্দোলনের ফরমুলা গ্রহণ করেছিলেন। আর তাঁর রাজনৈতিক গুরু মাওলানা উবাইদুল্লা সিন্ধী (সিন্ধু প্রদেশে বাড়ি ছিল তাই সিন্ধী বলা হয়)। সরকার যখন বুঝতে পারলো, উনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেখানে থাকবেন সেখানেই বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে তখন তার ওপর আইনের আদেশ চাপানো হল যে, তাঁকে চিরদিন ভারতবর্ষে প্রবেশ করা চলবে না। বাধ্য হয়েই তাকে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু ইংরেজ যদি ভারতের বাইরে তিনি কতটা সংগঠন ও বিপ্লবীদের সাহায্য এবং ভারত ত্যাগী মুজাহিদদের পথ চলার পাথেয় পরিবেশন করতে পারেন চিন্তা করতো তাহলে তাকে ভারতেই আটকে রেখে বরং বর্হিভারতে যাতায়াত বন্ধ করতো।

মাওলানা উবাইদুল্লা বৃদ্ধ বয়সে দেশে আসার অনুমতি পান। প্রথমেই তিনি আসেন ভারতের মস্তক বঙ্গে। কলকাতায় ওখানে আলেমদের ‘জমিয়তে উলামায়ের’ অধিবেশন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র আগে হতেই তাঁর যোগ্যতা, দৃঢ়তা ও ভারত প্রেমের কথা সবই জানতেন কিন্তু শিষ্য হওয়ার মত বিশেষভাবে পরামর্শ করার মত সুযোগ পাননি। সুভাষ এবার মাওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং তার পরামর্শ চাইলেন, এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেন। তিনি জানালেন, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতায় তিনিও বিশ্বাসী আর ভারতের জন্য জীবন দিতে তিনিও প্রস্তুত। মাওলানা উবাইদুল্লা তাঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং আস্তে আস্তে বললেন, আজ রাত্রে তৈয়েব ভাই জরিফের বাড়িতে গোপন আলোচনা হবে। রাত্রিতে আলোচনা হয়েছিল, অনেক গোপন কথা হয়েছিল। সেখানে ছিলেন চৌধুরী আশরাফুদ্দিন আর বর্ধমানের মৌলানা আবুল হায়াত প্রমুখ বিখ্যাত প্রকৃত নেতা। ওখানে উবাইদুল্লা তাঁকে আদেশ করেন “অত্যন্ত চুপি চুপি তুমি মাওলানা জিয়াউদ্দিন নাম নিয়ে ১৭ জানুয়ারি (১৯৪১) রওনা হও।” তারপর মাওলানা উবাইদুল্লা সাহেব নিজের হাতে অনেক চিঠিপত্র লিখে দিলেন এবং জানালেন, কোন জায়গায় কোথায় কী নাম, কী বেশে, কী পদে, কোন রাষ্ট্রে তাঁর শিষ্যভক্ত ও কর্মীরা আছেন। হয়েছিলও তাই। অতএব মুসলমানের পরামর্শ মত চললে আর ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা দাবি করলে তাকে গুলি করে মারার কথা তখনকার কংগ্রেস নেতা জহরলাল বলবেন বৈকি? তাই সুভাষ কোন দিন বিশ্বাসঘাকতা করেননি তাই তাঁর আযাদহিন্দ ফৌজে বড় নেতাদের বেশির ভাগই মুসলমান দেখা যায়। যেমন ক্যাপটেন শাহ নাওয়াজ, ক্যাপটেন বুরহানুদ্দিন, ক্যাপটেন আবদুর রশিদ, জমাদার ফাতেহ খান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ও মাওলানা উবাইদুল্লাহ সাহেব যে পরিকল্পনা ও প্রস্তাব সুভাষকে দিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব কংগ্রেস নেতাদেরও দিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতা গান্ধীজি তা অস্বীকার করেছিলেন।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু মাওলানা জহীরুল হককে যে পত্র লিখেছিলেন তার তর্জমার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি।

দিল্লি ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭

স্নেহের মওলুবী জহীরুল হক (দীনপুরী)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

আযাদী উপলক্ষে আপনার প্রেরিত পত্রের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতিপটে ভাসে শুধুই মাওলানা উবায়দুল্লার সিন্ধির (র.) স্মৃতি। সে ঘটনা অনেক লম্বা, সংক্ষেপ করলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ১৮১৪ সালে বিশ্ব যুদ্ধের সময় শাহ ওয়ালিউল্লার (র.) কাফেলার নেতা হযরত মাওলানা মাহমাদুল হাসান (র.) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মাওলানা উবাইদুল্লা সিন্ধিকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেন। তন্মধ্যে জার্মান, ফ্রান্স এবং জাপানের এমন সব কী যে ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে শাসন ক্ষমতার উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

পঁচিশ বছর নির্বাসনদণ্ড ভোগ করে ১৯৩৯ সালে তিনি যখন এখানে আসেন তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি যার নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্ব ভারতীয় সংগ্রামের প্রোগ্রাম রচনা করেন, সেই সময় গান্ধীজি পর্যন্ত ঐ পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। তাহলেও “ভারত ছাড়” আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে। একদিন চায়ের মজলিসে তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাঁর চোখ ও চেহারায় চিন্তার চিহ্ন দেখে আমার মনে অনুসন্ধিৎসুর প্রশ্ন জাগে। আমি প্রশ্ন করতেই তিনি উত্তরে জানালেন, “আমার ইচ্ছা সুভাষ ভারতের বাইরে চলে যাক।” কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি তাঁর বাসা উখলায় ফিরে যান।

দ্বিতীয় দফায় উখলা হতে দিল্লি পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোন একটি জনমানবশূন্য স্থানে তার সঙ্গে সুভাষের সাক্ষাৎ সংঘটিত হয়। তার পরের সাক্ষাৎটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। এই খানেই তিনি সুভাষকে জাপান যাত্রার জন্য রওনা করেন। জাপান সরকারের নামে একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তাও পাঠান। তাই সুভাষ সেখানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগও তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল। শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগ করে মাওলানা সাহেবের জীবন শেষ করা হয়। ১৯৪৪ সালের ২২ আগস্ট তিনি মহা মিলনে শামিল হলেন মহান মাওলা স্রষ্টার সাথে। সেদিন আকাশ হতে অশ্রু ঝরেছিল। সারা পৃথিবী শোকে মুহ্যমান হয়েছিল। (ভারতে এ সংবাদ ইংরেজ সরকার, গোপন রেখেছিল)...। অবশেষে সাধারণের ধারণা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৪৫ সালের ১ সেঃ পুরো এক বছর নয়দিন পর সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় মাওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। বাস্তবিক এমনি একজন বিপ্লবীকে ওজনের তুলাদণ্ডে এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এই বিপ্লবীর সমান হয় না। এখন রয়ে গেছে তাঁর অপরূপ স্মৃতি আর অপূর্ব বিরহ বেদনা। দুঃখ কিন্তু এ জন্য নয় যে, তিনি চলে গেছেন, এ জন্য দুঃখ যে এ জগতের মানুষ ছিলেন তা আজ প্রায় অবলুপ্ত। আমরা সেই দলেরই পশ্চাত্বর্তী কর্মী, সেই কাফেলার অনুরূপ দল আর পায় না আর পাচ্ছি না গন্তব্য স্থানের ঠিকানা। আমাদের কেউ চেনে না, আর অন্যদেরও আমরা চিনতে পারছি না। সেই শহীদদের ওপর স্বাধীনতার গৌরব অর্পিত হোক। তাঁদের কবরের ওপর আল্লাহর শান্তিধারা বর্ষিত হোক।

আলহামদুলিল্লাহ। (আল্লাহর প্রশংসা) আমি সুস্থই রয়েছি আপনার কুশল সংবাদ জানাবেন। আপনার সম্মানীয়া মাতার প্রতি রইল আন্তরিক সালাম।

ইতি-আবুল কালাম।”

পত্রটি প্রণিধানযোগ্য আজ সুভাষ বসুর ভারতের বাইরে যাওয়া ও রহস্যময় আত্মগোপনের কথা যে করেই হোক সকলের কাছে পৌঁছেছে কিন্তু কোন অপরাধে অন্তত দশগুণ যাঁকে সম্মান দেওয়া উচিত ছিল তিনি আজ নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষিপ্ত।

মাওলানা আযাদই একমাত্র লোক, যিনি সত্যিকারে রাজনীতি বুঝতেন এবং কংগ্রেসকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। তবে বহুবার প্রতিবাদ করলেও তাকে অনেক কিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো। তার কারণ অনেকে খুঁজে পান না। অনেকের ধারণা, তিনি গদির জন্য অনেক অন্যায়কারী ও অযোগ্যদের মাঝে নিজের যোগ্যতা নষ্ট করেছেন। কিন্তু না, হযরত মুহাম্মদের (সা.) প্রিয় আরব খানের একটি রত্ন আবুল কালাম আযাদ। তিনিই প্রকৃতপক্ষে ভারত বিভাগের বিরোধী ছিলেন। শেষে তাঁর কথা চললো না। দেশ বিভাগ হয়েই গেল তবুও তার কংগ্রেসে থাকার কারণ মুসলমান জাতি আর অব্রাহ্মণ হরিজনদের প্রতি দরদ। তিনি মহান গোয়েন্দার মত যদি না থাকতেন তাহলে ভারতের মুসলমানদের ওপর যারা খড়গহস্ত তারা তাদের কার্যোদ্ধার করতে হয়ত পারতেন। তাই তিনি কোটি কোটি মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তার লেখা ‘ইণ্ডিয়া উইনস্ ফ্রিডম’ বইটি প্রত্যেক ভারতবাসীর পড়া কর্তব্য, তাতে প্রত্যেকেই প্রকৃত রাজনীতি শিখতে পারবেন এবং ভারতের রাজনৈতিক গোপন তথ্য জানতে পারবেন আর তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতেও অসুবিধা হবে না। তবে তাঁর লেখা ঐ বইটি প্রথম ও দ্বিতীয় মুদ্রণের বইগুলো অবিকৃত অবস্তায় দেখা যায়। পরে তার লেখা অমৃত পুস্তকে ভেজাল দেওয়া হয়েছে। জল খাবারকে খাবার জল বললে অর্থ যেমন অনেকটা বদলে যায়, তাতেও তাই হয়েছে।

অবশ্যই ইনিও মাত্র যথাযোগ্য না হলেও কিছুটা স্থান পেয়েছেন। সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার প্রহসনের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে অথচ ইংরেজ সত্যিকারের ঐ রকম অত্যাচার করেছে ভারতের মুসলমান বিপ্লবীদের ওপর।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে মুসলমানদের মোপলা বিদ্রোহ সম্বন্ধেও কিছু বলা হয়েছে। ঐ সময় বাংলা পত্রিকা প্রবাসীতে, বাংলা ১৩৩৮ সালে পৌঁষ মাসে যে সংবাদ ছাপা হয়েছিল তা অন্ধকূপের মিথ্যা ইতিহাসকে আর একবার প্রমাণ করিয়ে দেয়। মাওলানা ও মুসলমান বিপ্লবীর ১২৬ জনের একটি দলকে একটি মালগাড়িতে চড়িয়ে ৪৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রেনের কুঠুরীতে ছিল ১৮ ফুট লম্বা ও ৯ ফুট চওড়া অর্থাৎ ১৬২ বর্গফুট। দরজায় তালা লাগানো ছিল। ছোট একটি জানালার মত ছিল তাতে তারের জাল দেওয়া ছিল। জালে আবার রঙ লাগানো ছিল ফলে জালের ছিদ্রগুলো বুজে গিয়েছিল। পথেই ৫৬ জন বন্দি পিপাসায় কাতর হয়ে শহীদ হলেন। আর বাকি বন্দিগণ ঘামে ভেজা জামা নিংরানো ঘাম পান করেন। তারা পানি পানি করে চিৎকার করেছিলেন, কিন্তু পরিবর্তে পেয়েছিলেন নিষ্ঠুর হাসি আর বিদ্রুপ। এসব ঘটনা হঠাৎ নেতাদের আবির্ভাবের আগে নয়। ঘটনাটি ঘটে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ২০ নভেম্বর। এই সব মুসলিম অবদান চিত্তরঞ্জনকে অবাক করে। তাই তিনি মুসলমানদের মর্যাদা স্মরণ রেখেই রাজ করতেন কিন্তু ১৯২৫ সালে তার মৃত্যু হয়।

ইংরেজের অতি আধুনিক গুপ্তচর বাহিনীকে এমনভাবে মুসলমান বিপ্লবীরা এড়িয়ে গেছেন যে, তাঁদের চিঠিপত্র পড়েও তার অর্থ উদ্ধার করতে পারতো না। কারণ কতকগুলো এমন শব্দ পত্রে ব্যবহার করা হত, যা একমাত্র প্রকৃত বিপ্লবীরা ছাড়া কেউ জানতেন না। যেমন... পত্রাদি আদান-প্রদানের ব্যাপারে তাহারা অভিনব উপায়ে যেরূপ গুপ্ত ও সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার করিয়াছে, তাহাকে ষড়যন্ত্রের ইতিহাসেও বিস্ময়কর বলা যাইতে পারে। তাহারা তাহাদের সঙ্কেতিক ভাষায় যুদ্ধকে মোকদ্দমা নামে, খোদাকে আইনসঙ্গত এজেন্ট, সুবর্ণ মুদ্রাকে লাল বর্ণের হীরক, অথবা দিল্লির সোনার জরির জুতা কিংবা লালবর্ণের জন্তু এবং সুবর্ণ মুদ্রার আদান-প্রদানকে লালবর্ণের দানার তসবীহ (মালা), টাকা-পয়সা আদান-প্রদানকে পুস্তক আদান-প্রদান এবং ড্রাফট ও মনি অর্ডারকে সাদা প্রস্তর এবং উহার সংখ্যাকে তসবীহ দানার সংখ্যা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছে। যেমন এক সহস্র মুদ্রা পাঠাইয়া বলা হইত-এক সহস্র দানার তসবীহ পাঠান হইল, ইত্যাদি। (দ্রঃ পাঞ্জাবের জুডিশিয়াল কমিশনারের নিকট অনুষ্ঠিত আপিল মামলার ফলাফলে নথিপত্রের ১৮৪ ও ১৮৭ প্যারা)। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ফেঃ হতে কুখ্যাত জেলখানা ভারতের বাইরে বহু দূর মাল্টার দ্বীপবন্দিখানায় মুসলমান তথা মাওলানাদের মধ্যে সেই সময় শুধু মাওলানা উবাইদুল্লাহ ঐ ইতিহাস প্রসিদ্ধ ছিলেন তা নয়; বরং আরও অনেক অনেক নেতা প্রাণ দিয়ে সংগ্রাম করতে এগিয়ে ছিলেন। মাওলানা হাজী তোরঙ্গজয়ী, মাওলানা লুৎফর রহমান, মাওলানা ফজলে মাহমুদ, মাওলানা মুহাম্মদ মিঞা, মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধি, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী (র.), মাওলানা আলী ভ্রাতৃদ্বয় সহ অনেকে। উবাইদুল্লাহ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা হয়েছে। এখন সামান্য একটু করে বর্ণনা দিলেও অনেক কিছুই বলতে হয় তবুও বলা যায় মাওলানা মাহমুদুল হাসানের (র.) নিজের এবং তাঁর ছাত্র ও শিষ্য মাওলানা হুসাইন আহমাদ (র.) ভারতের জন্য জেল খেটেছেন, অনেকের মত পুতুল খেলার মত নয়, দস্তর মত লড়াই করে বা জনতাকে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করে। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের কথা প্রচলিত ইতিহাসে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় কিন্তু যিনি তার গোড়াপত্তন করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন হযরত হুসাইন আহমাদ। অসহযোগের জন্য তিনি একটি বিখ্যাত পুস্তক লিখেছিলেন যেটির নাম ‘রেসালাতে তরকে মুআলাত’। সারা ভারতে তা এত জনপ্রিয়তা ও মনপ্রিয়তা অর্জন করে, যাতে ইংরেজ খুব ভীত হয়ে পড়ে এবং সেই বইটি বাজেয়াপ্ত হয়। (দ্রঃ হায়াতে মদনী, পৃঃ ১২৮, মাওলানা মুহাউদ্দীন খান ও মাওলানা মুঃ সফিউল্লাহ)

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ পর্যন্ত তাদের কষ্টদায়ক জেলে থাকতে হয়। সেই সিল্ক লেটার বা ‘রেশমি চিঠি’র ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি যদিও চলতি ইতিহাসে তার স্থান নেই। মাওলানা উবাইদুল্লাহ দেওবন্দ মাদরাসা হতে মাওলানা হয়ে মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে প্রথমে উদ্বুদ্ধ করেন এবং বিপ্লবে তাঁর মাদরাসার কর্তৃপক্ষ তাতে একটু বিব্রত মনে করেন। তবুও ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা হুসাইন আহমাদের ওস্তাদ মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব ১৮ সেপ্টেম্বর ভারত ত্যাগ করে আরবের হেজাজে উপস্থিত হন। (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১১৬-১১৭) তারপর আরম্ভ হয় রেশমি চিঠির আন্দোলন। একটি হলুদ বর্ণের রেশমের কাপড়ে খুবই পরিষ্কার অক্ষরের লেখা চিঠি যেটি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ৯ জুলাই হায়দ্রাবাদের শাইখ আবদুর রহিমের নামে পাঠানো হয়। লেখক মাওলানা উবাইদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে মুহাম্মদ মিঞা আনসারীরও পত্র সংযুক্ত ছিল। পত্রে ছিল তুর্কি ও জার্মানদের আগমনের কথা, জার্মানদের প্রত্যাগমন, গালেব নামার প্রচার, খোদায়ী যোদ্ধা বাহিনীর পরিকল্পনা এবং মদীনা, কাবুল, তেহরান প্রভৃতি নানা স্থানে কেন্দ্র স্থাপনের কথা।

“১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৮, ৯ ও ১০ জুলাই করাচীতে ‘নিখিল ভারত খিলাফত কমিটি’র সম্মেলন আহ্বান করা হইল। সম্মেলনে মদানী এই মর্মে এক প্রস্তাব উত্থাপন করলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোন মুসলমানের পক্ষে ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনীতে চাকরি করা বা চাকরি করিতে উৎসাহিত করা সম্পূর্ণ হারাম (বা অবৈধ) এবং প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে কর্তব্য হইল ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনীর প্রত্যেকটি মুসলিম সৈনিকের নিকট এই কথা পৌঁছাইয়া দেওয়া।’ ... ব্রিটিশ সরকার মাওলানার এই প্রস্তাবকে প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলিয়া ঘোষণা করে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০, ১৩১ ও ৫০৫ ধারা মোতাবেক মাওলানা মদানী, মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর, মাওলানা শওকত আলি, ডক্টর সাইফুদ্দিন কিচলু, কানপুরের মাওলানা নিসার আহমাদ, পীর গোলাম মুজাদ্দিদ সিন্ধী ও স্বামী শঙ্করাচার্যের বিরুদ্ধে এক মোকদ্দমা দায়ের করে।” (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৩৪)

ঐ মামলায় শ্রদ্ধেয় আসামিরা কোন উকিল নিযুক্ত করেন নাই, নিজেরাই বক্তব্য রেখেছিলেন নিজেদের। কয়েকদিন ধরে শুনানি চলেছিল। বক্তৃতার ভেতর মদানী সাহেবের ও মুহাম্মদ আলীর বক্তৃতা এত উল্লেখযোগ্য ছিল যে তা ভারতের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য তালিকা হওয়া লাভজনক।

মদানী সাহেব কুরআন, হাদিস, আইন, ইতিহাস সংবলিত বিরাট বক্তব্য রেখেছিলেন যার শেষ কথা হচ্ছে এই’, ... ভারতের তেত্রিশ কোটি হিন্দুকেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য আমি মুসলমানদের পক্ষে ইংরেজ সরকারকে সতর্ক করে দিতে পারি যে, যদি সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে তাহলে মুসলমানগণ ধর্মের খাতিরে জীবন উৎসর্গ করতে কিছু মাত্র চিন্তা করবে না এবং আমিই সকলের আগে জীবন দিতে প্রস্তুত। ইংরেজ জাতির সেদিন হৃদকম্প হল যে, স্যার সৈয়দ আহমাদ অর্থাৎ নয়া আহমাদ দ্বারা মুসলমানদের যেভাবে ঘোরানো হয়েছিল আবার মাওলানা মুহাম্মদ আলি ও মাওলানা মদানীর ভূমিকা তা উল্টে-পাল্টে দিল। যাইহোক ১৯২১ সালে ১ নভেম্বর আসামিদের ৫০৫ ও ১০৯ ধারা মতে দু’বছর করে জেল নির্ধারিত হয়।

তারপর হতেই মুসলমান জাতি সমবেতভাবে আবার ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠে। আগেই বলা হয়েছিল, ইংরেজকে মুসলমানদের সমর্থন ছিল সাময়িক লোক দেখানো মাত্র।

আমাদের উপরোক্ত আলোচনায় এ মনে করার কারণ নাই যে, হিন্দুদের কোন অবদান স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নেই। বরং অনেকে তাঁরা গান্ধীজির অহিংসনীতিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলেন তাই তাঁদের ওপর আমাদের ইতিহাস খুব রাগান্বিত।

১৯৪২ সালে ব্যাপকভাবে হিন্দু বিপ্লবী যারা বুঝলেন সেই পথই একমাত্র পথ ইংরেজকে তাড়ানোর, তা হল পূর্ণ অসহযোগ এবং অস্ত্র হাতে লড়াই করে দেশে অচল অবস্থার সৃষ্টি করা। ৯ আগস্ট হতে লুট, অগ্নিসংযোগ সরকারি অফিস, রেল, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, থানা সব কিছুর ওপর হামলা চললো। সরকার সৈন্য ও পুলিশ তলব করে কিছুই সুবিধা করতে না পেরে ইস্টার্ন রেল ওয়েজের সমস্ত ট্রেন বাতিল করল। ছাত্ররা দলে দলে মিছিল করে দেশকে কাঁপিয়ে তুলল “মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জিন্দাবাদ” আওয়াজও মিছিলে শোনা যেত। সৈন্যরা গুলি চালালে শ্রী বৈদ্য নাথ সেন ১৩ আগস্ট দেশের জন্য প্রাণ দিলেন। ১৪ আগস্ট ভবানীপুরে প্রচুর ছাত্র আহত ও দুজন নিহত হলেন। মওলুবী ফজলুল হকের অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথ্য হতে জানা যায়, আগস্টে ২০ জন নিহত, ১৫২ জন আহত ও ৩৫০০ জন বন্দি হন।

সিনেমা হলে বড় লাটকে মারার জন্য বোমা ফাটানো হয়, কিন্তু তিনি ঐ সিনেমায় আসেননি। পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেলের বাড়িতে আক্রমণ করা হয় এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র হাতে আসে। (দ্রঃ Amrita bazar patrika ladepndence Nomber 1947, P 133-34, India in Revolt-Tarini Sankar p 29)

উত্তর ভারতে ১৫টি স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হয় ১০৪টি আধপোড়া করা হয় এবং গুদাম, সরকারি ভবনগুলো প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬০,২২৯ জন বন্দি হন এবং ৯৪০ জন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। আর ১৮ হাজার বিপ্লবী আহত হন। যাঁরা যুদ্ধ করেননি সমর্থন করেছেন তাঁদের জরিমানা করা হয়। মোট টাকার পরিমাণ ২ লক্ষ ৮৩ হাজার ২০০ টাকা। (দ্রঃ ঐ, ৩১)

২০ আগস্ট বালিয়ার লোকেরা বালিয়াকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে ছিটুর নেতৃত্বে নতুন সরকার ঘোষণা করে। ২২ ও ২৩ আগস্ট সরকার সৈন্য নামায়, সৈন্যরা নির্বিচারে লুট ও গুলি বর্ষণ করে। (দ্রঃ ehru on Gandi, 2-431)

২০ আগস্ট গুলিতে মারা যান শ্রীমতি কনক লতা এবং মুকুন্দ কাকোতী। তুলেশ্বরী নামে একটি কিশোরীও গুলিতে মারা যান। আরও নিহত হন ফুলেশ্বরী নামে এক বৃদ্ধা। আর প্রাণ দিলেন তনুরায়, বলুরাম ও শ্রীলক্ষ্মীরাম। ১৯৪৩ এ ১৬ জনু শ্রী কানওয়ারের ফাঁসি হয়। শ্রী কমলা জেলেই প্রহারে প্রাণ দিলেন। বিহারে ভাগলপুরে সৈন্যের সঙ্গে সাধারণের লড়াই হয়। ২১৮ জন নিহত হন, ২৮০ জন আহত হন, পীরপন্থী ৩৩৭ জন নিহত ৬২ জন আহত, সুলতানগঞ্জ ৬৭ জন নিহত ও ১৫০ জন আহত, দ্বারভাঙ্গার ৩৮ জন নিহত এবং শতাধিক লোক আহত হন। (দ্রঃ অমৃত বাজারের ঐ স্বাধীনতা সংখ্যা)

মেদনীপুরের ১৯৪২ সালে চারদিকে বিপ্লবের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। দুহাজার বাঙালী জনতা চিৎকার করে বললো, ভারত হতে চাল-ধান বয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না চলবে না। পুলিশ গুলি চালায়। প্রচুর মানুষ মারা যায়, মৃত দেহগুলো তাদের আত্মীয়দের ফিরিয়ে না দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

শ্রী গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র লিখেছেন, “হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দলে দলে শোভা যাত্রায় চলেছেন তমলুকের দিকে।” বিরাট দল। আট হাজার লোককে শায়েস্তা করতে বহু পুলিশ ও বড় তেজী অফিসার মনীন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে পাঠানো হয়েছে। ব্যানার্জীর আদেশে লাঠিচার্জ আরম্ভ হয়। বহু লোক আহত হন, অনেকে মারা যান, তার মধ্যে আহত অবস্থায় রামচন্দ্রবেরা বুকে হেঁটে থানায় গিয়ে বললেন, থানা দখল করেছি বলেই শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। এমনিভাবে প্রাণ দান করেছেন লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, মাতঙ্গিনী, হাজরা, শ্রী নিরঞ্জন জানা, পূর্ণচন্দ্র মাইতি। ২২ সেপ্টেম্বর প্রাণ দিলেন শ্রী যামিনীকান্ত, অনন্ত কুমার, ভজহরি, শ্রী চৈতন্য, সর্বেশ্বর প্রামাণিক ও রামপ্রসাদ, শশী ভূষণ মান্না, সুরেন্দ্রনাথ কর, ধীরেন্দ্রনাথ দিড়াবেরা। ২৭ সেপ্টেম্বর নন্দীগ্রাম থানায় প্রাণ দিলেন বীরেন্দ্র মণ্ডল, ভানুরানা, ভুতনাথ সাহু ও গোবিন্দ দাস। মহীষাদল থানায় প্রাণ দিলেন ভোলানাথ মাইতি, হরিচরণ দাস, আশুতোষ কুইলা, সুধীর হাজরা, পঞ্চানন দাস, রাখালচন্দ্র সামন্ত ক্ষুদিরাম বেরা প্রমুখ বীর কেশর কেশরী বৃন্দ। কেশপুর থানায় মারা গেলেন শ্রীমতি শশীবালা, রামকৃষ্ণ ঘোষ ও আরও অনেকে। অমূল্য শাসমল, সুধীর মাইতি, কেদারনাথ জানা, মুচিরাম দাস, ভগীরথ রথ, মুরারী মোহন বেরা, বিপিন মণ্ডল, চন্দ্রমোহন দিন্দা, হরেকৃষ্ণ ধর। ভগবানপুর থানায় প্রাণ দেন যুধিষ্ঠির, বিভূতি দাস, জগন্নাথ পাত্র, নাথচ প্রধান, হরিচরণ, রামকান্ত, রঘুনাথ, পরেশচন্দ্র, কৃষ্ণমোহন চক্রবর্তী, শ্রী ভূষণ ও ধীরেন্দ্রনাথ দাস পাঠ প্রমুখ।

হাসপাতালে রোগীদের, রোগিনীদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ ও মেয়েদের ব্লাউজ ও গেলি খুলে সায়া তুলে দাঁড়াতে হত এবং ঐভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। সরকারকে অনেক আবেদন নিবেদন করা হয়। কিন্তু অবশেষে মুসলমান নারীদের জন্য শুধু ঐ আইন রদ হয়। কারণ সমস্ত মুসলমান তার জন্য প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। (দ্রঃ অবিস্মরণীয় পৃঃ ৩০)

শ্রী দামোদরের ফাঁসি হয় ১৮ এপ্রিল। বালকৃষ্ণেরও ৮ মার্চ ফাঁসি হয়। (দ্রঃ Kali Charan Ghosh, The Roll of Honour p 45) ৮ মে বাসুদেব ও রানাডের প্রাণদণ্ড হয়।

১৯৪২ এ ৯ নভেম্বর ‘হাজারীবাগ সেন্ট্রাল জেল থেকে পালালেন ৯ জন, তার মধ্যে ছিলেন স্যোসালিস্ট নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ।” “কংগ্রেস স্যোসালিস্ট দল (গান্ধীর অহিংসানীতিতে বিশ্বাসী নয় তা প্রমাণ হয়ে গেল।” (দ্রঃ গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, পৃঃ ৮৮-৮৯) এমনিভাবে অলিখিত অনেক তথ্য লুকিয়ে আছে বিস্মৃতির অতল তলে।

জহরলাল দুঃখ করে বলেছিলেন, “তারা গত কুড়ি বছর ধরে যে অহিংসনীতি প্রচার করে এলেন এক দিনেই ভুলে গেল তার প্রভাব।” (অবিস্মরণীয় ২য় খণ্ড, পৃঃ ৭০)

“কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অবশ্য স্বীকার করেছিলেন যে ১৯৪২ সালের আন্দোলনে কংগ্রেসের সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল না। (দ্রঃ ঐ)

প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনে হযরত মুজাদ্দেস আলফেসানী জীবন্ত পরিকল্পনায় যিনি প্রথমে এগিয়ে এলেন তিনি হচ্ছেন স্বাধীন ভারতের প্রকৃত জনক মাওলানা শাহ ওলিউল্লাহ, মাওলানা আবদুল কাদের (পুত্র), মাওলানা আব্দুল আজিজ (পুত্র), মাওলানা আব্দুল গনি (পুত্র), মাওলানা আবদুল হাই, (জামাতা) মাওলানা মাখসুসুল্লাহ, (ভাইপো) মাওলানা ইসমাইল, (ভাইপো) মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক, (নাতি) মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব, (নাতি) মাওলানা সৈয়দ আহমাদ ব্রেলবী, মাওলানা হোসেন আহমাদ মালিহাবাদী, মাওলানা হাসান আলী, (লাকনৌ) মাওলানা সদরুদ্দিন, জনাব গোলাম আলী, মাওলানা বশিরুদ্দিন ও মাওলানা করীমুল্লাহ প্রমুখের নাম যেমন স্বর্ণময় ইতিহাস তেমনি শেষের দিকেও মাওলানাদের অবদান উল্লেখযোগ্য সন্দেহ নেই। জনাবাবি, আম্মা গান্ধীজি ও নেহেরুর সময়েও মাওলানা মওলুবী ও মুসলমানদের যথেষ্ট অবদানের মধ্যে মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলীর নাম হঠাৎ নেতাদের অনেক উচ্চে বলে উচ্চ শ্রেণীর ঐতিহাসিকগণ মনে করেছেন।

১৯১৫ হতে ১৯১৯ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে ইংরেজবিরোধী কর্মধারা এক রকম সাফল্যবিহীনই মনে হয়েছিল। মুসলমানরাও যেন একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সারা ভারতে বিপ্লবে ভাটা পড়ার প্রধান কারণ ভারতের সিংহ শাবক দুটি মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও শওকত আলীকে সরকার কারাগারে বন্দি করে রেখেছিলেন।

১৯১৭ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, তখন বোরকা পরিহিতা একটি মুসলমান নারী সভায় প্রবেশ করলেন। সভাপতি ব্যবহারজীবী বৈকুণ্ঠ সেনকে বিদূষী রমণী পরিচয় দিলেন, তিনি আলী ভ্রাতাদের আম্মা বা মা, নাম বিআম্মা। সঙ্গে সঙ্গে সভায় ‘আল্লাহু আকবার’ আওয়াজ করা হয় এবং কংগ্রেসকি জয় বিআম্মাকি জয় ধ্বনিতে সভা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঐ সভায় ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিন পাল, বাল গঙ্গাধতিলক, মদনমোহন মালব্য, সত্যমূর্তী, চিত্তরঞ্জন দাস, ফজলুল হক, গান্ধীজি ও জিন্নাহ।

বিআম্মা তাঁর স্বল্প বচনে জানালেন, মেয়েদের জাগ্রত হতে হবে। আর বললেন, আমি পরকালে আমার ছেলেদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করবো যদি তারা সারা জীবন ইংরেজকে তাড়ানোর জন্য লড়াই না করে। যদি সংগ্রাম না চালায় তাদের আমার স্তন্য পান করানো অন্যায় হয়েছে বলে মনে করব। বিখ্যাত বীর আলী ভ্রাতাদের বীরাঙ্গনা মাতা বি-আম্মা ১৯২৪ সালে ১২ নভেম্বর দেহত্যাগ করেন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন