hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইতিহাসের ইতিহাস

লেখকঃ গোলাম আহমাদ মোর্তজা

৫৩
১৫৮৭ খৃস্টাব্দে সৈন্য বিক্ষোভের ধারাবাহিকতা
আগেই বলা হয়েছে কয়েক বছর আগে নানা জায়গায় নানাভাবে বারবার বিদ্রোহ করেছিল ভারতের মুসলমান ধর্মীয় নেতা ও তাদের সমর্থকরা।

বঙ্গের পরিবেশ এমনভাবে বিষিয়ে উঠেছিল যে, জানুয়ারি মাসে হঠাৎ আগুন লেগে যায় ব্যারাকপুরে। অবশ্য অনেকের মতে সেখানেও মুসলমান ছিন্ন পরিচ্ছদ পরিহিত ফকির ও গুপ্তচরদের হাত ছিল। তারা ভিক্ষুক সেজে ক্যান্টনমেন্টে লোহার তার বাঁধা গোল টিন নিয়ে খাবার সময় উচ্ছিষ্ট ভাত, তরকারি ও রুটির টুকরো সংগ্রহের জন্য লালায়িত হয়ে লাইন দিয়ে বসে থাকতেন আর বাড়ি জিজ্ঞাসা করলে কেউ বলতেন মিরাট, কেউ বলতেন লাক্ষ্ণৌ ইত্যাদি। তারপরেই টুকটুক করে সেখানকার সৈন্যদের বিদ্রোহ আর ইংরেজদের কুকীর্তির কথা শোনাতেন। আর বলতেন ইংরেজদের তাদের রাজ্য হারাতে আর দেরি নাই ইত্যাদি ভবিষ্যদ্বাণীও করতেন। মুসলমান ফকিররা হিন্দু সন্ন্যাসীর পোশাক পরে ইংরেজের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতেন আর হিন্দু সৈন্যরাও সাধুদের কথা খুব মন দিয়ে শুনতেন।

প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহ বলতে যা বোঝা যায় বা দেখা যায়, তা হয়েছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি বহরমপুরে। কলকাতা হতে কাল নতুন টোটা এসেছে তাতে নাকি শূকর ও গরুর চর্বি আছে আগে হতেই শোনা ছিল। অযোধ্যা নবাবের রাজ্য গ্রাস করার সময় ইংরেজ সরকার বাছাই করা বাঙালি সৈন্য নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। আর ওখানে ছিল বিপ্লবী দলের প্রচারকদের প্রাধান্য আর গুজবের ঘাঁটি। ইংরেজের অযোধ্যা দখল করা হলো বটে কিন্তু বাংলার প্রায় প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্ট হতে যে সমস্ত সৈন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের সঙ্গে অনেক অযোধ্যার পদচ্যুত বেকার সৈন্যদের সঙ্গে আলাপ হয় আর ফকিরদের অর্থাৎ মৌলবীদের অভিযানও চলতে থাকে। ফলে যখন বাঙালি সৈন্যরা বাংলার ডেরায় ফিরে আসেন সেই সঙ্গে নিয়ে আসেন বিদ্রোহের বীজ। তাই বহরমপুর মুসলমান ও হিন্দু সৈন্যরা টোটা দাঁতে নিতে অস্বীকার করেন। এ্যাডজুট্যান্টের মুখে এই সংবাদ পেয়ে মিঃ মিচেল দেশীয় অফিসারদের নিয়ে জামাদার, হাবিলদার ও সুবেদারদের আদেশ দিলেন কোয়াটার গার্ডের সামনে সমস্ত সৈন্যকে হাজির হবার জন্য। তারপর তিনি কঠিন কণ্ঠে বললেন, “শিখ সুবেদার মোহন সিংকে বলে দাও টোটা ব্যবহার না করলে মারাত্মক শাস্তি দেওয়া হবে এবং চীন কিংবা ব্ৰহ্মদেশে চালান দেওয়া হবে, যেখানে গেলেই মানুষ মরে।” মিঃ মিচেলের হুঙ্কার সৈন্যদের সন্ত্রস্ত বা বিগলিত করতে পারল না। ১৯ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ রাত্রে সৈন্যরা বিকট চিৎকার ও কলরবে বিদ্রোহের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। মিঃ মিচেল গোলন্দাজ নেতাদের জানালেন যেন তাঁরা যুদ্ধ কামান সৈন্যদের সামনে সাজিয়ে প্রস্তুত রাখে। কোন প্রকারে বিপ্লবীরা একটু শান্ত হলেন। কলকাতা হতে সংবাদ এল যেন ১৯ নং রেজিমেন্টদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়। চারদিকে ছড়িয়ে গেল এই সংবাদ। ব্যারাকপুরেও সংবাদ এল। এখানেও সমস্ত সৈন্যদের এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে মিঃ হিয়ার্স কঠিন কণ্ঠে নয় কোমল ও মধুর সুরে সৈন্যদের বোঝালেন- যার সারমর্ম হচ্ছে চর্বি, হাড়ের গুঁড়ো প্রভৃতির কথা কল্পনামাত্র। কোন সৈন্য যেন ইংরেজ সরকারকে ভুল না বোঝে। সৈন্যরা একটু শান্ত হয়েছেন মাত্র এমন সময় তাঁরা সংবাদ পেলেন রেঙ্গুন হতে জাহাজ ভর্তি ইংরেজ সৈন্য কলকাতায় পৌঁছেছে। আর একটা খবর এল বহরমপুর বিদ্রোহীদের ব্যারাকপুরে এনে তোপের সামনে দাঁড় করিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে। এই সংবাদে আবার সৈন্যগণ খেপে উঠলেন। হট্টগোল হল। একজন অফিসারকে তাঁরা ভীষণভাবে আহত করলেন। এদিকে বহরমপুরে বাছাই করা বিপ্লবীদের বন্দি করে বারাসাতে আনা হল। তারপর কলকাতা কিংবা ব্যারাকপুরে নিয়ে যাওয়া হবে অফিসাররা ঠিক করে নিল। ব্যারাকপুরে বিদ্রোহের গোড়া পত্তন বলে যারা দাবি করেন তা যে ঠিক নয় এবং গোড়া পত্তন যে অনেক আগেই হয়েছিল তার সম্বন্ধে কিছু আলোচনা পূর্বে হয়েছে। তবুও আমরা জানি ৮ এপ্রিল মঙ্গলপাড়ের ফাঁসি হয় আর ২৯ মার্চ ইংরেজ অফিসার আহত হন। মধ্যে এই ৮-৯ দিনের ব্যবধানে একটা ফাঁসির কেস শেষ হওয়া সন্দেহজনক। তবে বাঙালি সৈন্য ইংরেজ মিঃ বগকে আক্রমণ করেছেন মাত্র। মিঃ বগ মারাও যাননি। তবুও ফাসি হয়েছে যেহেতু সাহেবের আহত হওয়া ভারতীয়দের নিহত হওয়ার চেয়েও বড় কথা।

এদিকে বহরমপুর হতে আনীত হিন্দু-মুসলমান সৈন্যদের সামনে মিঃ হিয়ার্স একটা বক্তৃতা করলেন, যার সারমর্ম হচ্ছে এই-তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পরিহিত পোশাক খুলে নেওয়া হল না এবং প্রত্যেকের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা খরচা এবং বকেয়া বেতন শোধ করে দেওয়া হল যেহেতু তারা পথে আসতে কোন প্রকার উত্তেজনা বা বিদ্রোহমূলক অসভ্যতা প্রদর্শন করেনি।

আসলে ওপর মহল হতে আগেই পরামর্শ হয়েছিল, যদি রাস্তা খরচা দিয়ে আর বেতন না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে কলকাতায় বিক্ষোভ ও প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু হতে পারে। কারণ অসংখ্য বিপ্লব সমর্থক সাধারণ মানুষ ও বিত্তবান মানুষ সেই সুযোগের প্রতিক্ষায় আছে। মিঃ ক্যানিং সৈন্যদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার সংবাদে খুশি হলেন। আবার বলতে হচ্ছে মঙ্গলপাড়ে হিন্দু ছিলেন, তাই তার নাম দিয়ে মুসলমান ফকীররা হিন্দু মহল্লায় প্রচার করতে লাগলেন, পৈতেওয়ালা সাধু গোছের সৈন্যকে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারী সাহেবদের ফাঁসি দেওয়ার কথা। ইংরেজ পক্ষের দেশীয় বুদ্ধিমান দালালরা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, মঙ্গলের সঙ্গে একই সাথে জামাদারের তাহলে ফাঁসি হলো কেন? আসলে তাদের অন্য অপরাধ ছিল। তার উত্তরে প্রচারক দল প্রচার করল, মঙ্গল পাড়ে যখন মিঃ বগকে অস্ত্র চালান তখন তিনি বাধা দেননি তাই তাঁকেও বিদ্রোহী হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। পল্টনের জমাদার মুসলমান ছিলেন বলে কিছু লোকের মত। অথচ তার নাম মঙ্গলের নামের সঙ্গে সমভাবে মর্যাদা পায়নি। তিনি যে জাতিরই হন ভারতীয় সৈন্য নিঃসন্দেহে। পাঞ্জাবের কাছেই আম্বালা আর ঐ আম্বালাতেই কাগজ তৈরির প্রধান ঘাঁটি। অথচ ঐ এলাকাতেই মুসলমানের সেই বিখ্যাত ঘাঁটি সিত্তানা। তাই ওখান হতেও রটাতে সুবিধা হয়েছে শূকর ও গরুর চর্বির কথা। সুতরাং মিঃ আনসন গভর্নর জেনারেলকে জানালেন, গোলযোগ দেখে মনে হয়, আম্বালার রাইফেল ডিপো তুলে দেওয়া ভালো, কেননা টোটা অপেক্ষা টোটার কাগজেই সিপাহীদের বেশি আপত্তি।” ...পত্রের উত্তরে গভর্নর জেনারেল জানালেন, “রাইফেল চালানো স্থগিত রাখার আমি বিরোধী।... প্রকৃত কথা টোটা নহে, জনরব।”...

মিরাটের বিরাট বিদ্রোহের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের সবচেয়ে বৃহত্তম সেনানিবাস। ওখানে মুসলমানরা সংখ্যাতে খুব বেশি। পাঁচ হাজার সৈন্য সব সময় সরগরম করে রেখেছে গোটা ক্যান্টনমেন্ট। এর ভেতরেই কারখানা। আর এই কারখানাতেই তৈরি হয় ঐ চর্বি টোটা। অতএব সর্ব প্রথম চর্বির কথা এখানে ওঠে তাই ইতিহাস প্রসিদ্ধ চর্বিযুক্ত টোটার ঘটনার জন্মদাতা মিরাট ক্যান্টনমেন্ট অথবা সেই শহরে সুকৌশলী বিখ্যাত প্রচারকবৃন্দ। তবে সেখানেও মৌলবী-মুবাল্লিগ ও ফকিরদের অবদান নিষ্ঠুর ইতিহাসে একেবারে হজম করে নাই। যেমন একটি অত্যন্ত মূল্যবান উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে, “মিরাটে এক সময় একটা ঘটনা ঘটে। একদিন সকালে দেখা গেল কোথা থেকে এক মুসলমান ফকির এসে হাজির হয়েছে মিরাটে, তার সঙ্গে অনেক চেলা। কি একটা হাতির উপর চড়ে ঐ ফকিরকে পরপর কদিনই ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। ফকির সেখানে কী করতে গিয়েছিল, তা কেউ-ই জানে না। পুলিশের হুকুম এল তার ওপর দলবল নিয়ে মিরাট থেকে এখনি চলে যাবার জন্য। ফকির হুকুম পালন করলো বটে, কিন্তু অনেকের বিশ্বাস ফকির মিরাট ছেড়ে যায়নি। সে ২০ নং রেজিমেন্টের সিপাহী দলের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।” (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস পৃঃ ৪৫০ দ্র:)।

হাতির উপর চড়ে থাকা ফকিরটি কে ছিলেন এবং দলবলেও কারা ছিলেন জানতে খুব গভীর চিন্তার প্রয়োজন নেই। মিরাটের বাজারের প্রত্যেক মুসলমান ও হিন্দুর শুধু জাত গেল রব। ২৩ এপ্রিল সৈন্যদের রুদ্র মূর্তি দেখে ২৪ এপ্রিল প্যারেড হবে ঘোষণা করলেন। সৈন্যদের দাঁড় করিয়ে পেছনে গুলি ভরা কামান সাজিয়ে কর্নেল টোটা নেয়ার আদেশ করলেন। কিন্তু সকলেই আদেশ অমান্য করলেন। কিন্তু সৈন্যগণ বল প্রয়োগ করলেন না তাহলে কামানের গোলার আত্মহত্যার নামান্তর হবে। ভারতীয় সৈন্যদের বন্দি করা হল। মিঃ হিউয়েট ও মিঃ স্মিথ সামরিক আদালতে বিচার করিয়ে বিপ্লবী সৈন্যদের হাতে পায়ে লোহার কড়ি পরিয়ে সর্বসাধারণের সম্মুখে দু-মাইল হাঁটিয়ে একটি জেলে পাঠানো হল। তাতে বিদ্রোহী সৈন্যরা ভয় পেলো না বরং আরও মরিয়া হয়ে উঠলো। ৬ মে ব্যারাকপুরে ৩৪ নং সৈন্য দলকে দাঁড় করানো হল। পেছনে ইংরেজ সৈন্য কামান নিয়ে প্রস্তুত। লেঃ মিঃ পামার শাস্তির সংবাদ পড়ে শোনালেন। প্রত্যেকের বন্দুক ও ইউনিফর্ম কেড়ে নিয়ে চাকরি হতে পদচ্যুত করা হল। এখানে মনে রাখা দরকার যে, এই যে এখানে ৩৪ নং সৈন্যদল আর বহরমপুরের ১০ নং সৈন্য দলকে পদচ্যুত করা হল, এই দল দুটিও ডালহৌসির অযোধ্যা আক্রমণের সময়ে লক্ষ্মৌতে উপস্থিত ছিল আর ওখান হতেই বিদ্রোহের তালিম শুরু হয়। আরও জেনে রাখার কথা যে, ঐ ১৯ নং সৈন্য দলে সাত শত সৈন্য ছিলেন যাঁদের বাড়ি অযোধ্যা আর তাদের বেশির ভাগই জাতিতে মুসলমান, ফকির সাহেবদের অনুগত।

পদচ্যুত হওয়া ঐ সাত শত অযোধ্যার সৈন্য সারা ভারতে কাগজের পত্রে বা ‘চাপাতি রুটির পত্রে’ চাকরিতে নিয়োজিত সৈন্যদের ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার জন্য অনুরোধ করেন। এই তথ্য লর্ড ক্যানিংকে লেখা মিঃ হেনরি লরেন্স-এর পত্রে পাওয়া যায়। হেনরি লরেন্স অযোধ্যার সৈন্য শিবিরেও পঞ্চাশজন বিদ্রোহী দলপতিকে হঠাৎ রাত্রি বেলায় বন্দি করে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করে গুরুতর দণ্ড দিলেন। তার একজন হিন্দু গুপ্তচরকে বহু সৈন্য শিবিরে পাঠিয়ে সংবাদ আনালেন। মুসলমানদের অবস্থা তো আমরা জানি কিন্তু হিন্দু সৈন্যদের অবস্থা কেমন? সংবাদ যা এল তা নৈরাশ্যজনক। এ প্রসঙ্গে একটা উদ্ধৃতি খুবই যথোপযুক্ত ‘জামাদারটি ব্রাহ্মণ বয়স চল্লিশের ওপর। ভারতে বহু সেনানিবাসে ঘুরে সে এখন অযোধ্যায় এসেছে। বহু অভিজ্ঞ জমাদারটির সঙ্গে আলাপ করে হেনরি লরেন্স বুঝলেন যে, নানা কারণে দেশীয় সৈন্যদের মনে অসন্তোষ এতদূর বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বর্তমানে একমাত্র তাদের আনুগত্যের উপর নির্ভর করে রাজ্য শাসন আর সম্ভব নয়।” (দ্রঃ সিঃ যু, ইঃ, শ্রী মনি বাগচি, পৃঃ ৫৫)

মিঃ জুন লরেন্স, মিঃ হেনরি, জেঃ হিয়ার্স, মিঃ ক্যানিং প্রমুখ বিচক্ষণ ব্যক্তিরা বুঝলেন বিলেত বা ভারতের বাইরের সৈন্য না আনলে আর ভারতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। চীন অভিযান বন্ধ করে সমস্ত সৈন্য ভারতে আনা এবং যেখানে যত ইংরেজ সৈন্য আছে সেখানে কাজ চলাগোছের রেখে সব ভারতে পাঠানোর চূড়ান্ত কথাটি মিলিটারীর সেক্রেটারীও অনুমোদন করলেন এবং পাহাড়ি, নেপালি, গুর্খা প্রভৃতি সৈন্য আমদানির কথা পাকাপাকি হয়। লর্ড ক্যানিং বেশ বুঝতে পারলেন এতদিন হিন্দু সৈন্য, তাদের বাধ্য ছিল এখন তাও হাত ছাড়া হচ্ছে। তাই তিনি তাড়াতাড়ি মিঃ লরেন্সকে পত্র পাঠালেন শিখ সৈন্য বৃদ্ধির কথা জানিয়ে, কারণ শিখদের বরাবর বিশ্বাস করে ফল পাওয়া গেছে। তারা বরাবরই ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করে এসেছে। ক্যানিং তার পত্রে বিশেষভাবে লিখলেন হিন্দু সৈন্যরা বিদ্রোহ করলেও হিন্দু জাতি তত মুসলমানদের মত বিশ্বাসঘাতক নয় সুতরাং পাতিয়ালার মহা রাজা ও ঝিন্দের মহারাজার কাছে সৈন্য সাহায্য পাঠাতে যেন ইতস্তত না করেন। (দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৫৯)

মোটকথা শোষক ইংরেজের কিছু ভয় হলো। তাই দুখানি ঘোষণাপত্র প্রচার করা হলো

(ক) ভারতে কারো জাতি ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে না বা ধর্ম সংস্কারে আঘাত দেওয়া হবে না।

(খ) কোম্পানীর অধীনস্থ সৈন্যগণ তাদের শপথ অনুযায়ী কাজ করলে কোম্পানী হতে উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করা হবে। যারা প্রতিজ্ঞা ও বিশ্বাস ভূলে বিপরীত পথে চলবে, অবাধ্য হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তাদের জন্য কঠিন সাজার (শাস্তির) ব্যবস্থা বিদ্যমান।

১৮৫৭ সালের ৩১ মে রবিবার ভারতে একসঙ্গে চারদিকে বিপ্লবের আগুন জ্বালানো হবে বলে দিন ঠিক করা হয়েছিল। আর সংবাদ চাপাতি রুটির মারফত গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের নির্ধারিত দায়িত্বপ্রাপ্ত সভ্যকে চাপাতি পৌঁছে দিলেই বাকি কোথায় পৌঁছাতে হবে তা তিনি নিজেই ঠিক করে নিতেন। “বিদ্রোহের বাণী সেদিন সারা ভারতে প্রচারিত হয়েছিল এক আশ্চর্য উপায়ে-চাপাতির মারফত। এছাড়া মুসলমান সিপাহীদের প্ররোচিত করার জন্য বহু মুসলমান ফকিরের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছিল।” (সি: যু: ই:, মনি বাগচি, পৃঃ ৭৩)

দিল্লীর দরবারে তখন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ। বাহাদুর শাহের স্ত্রীর নাম ছিল জান্নাত মহল। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে বীর ও বীরাঙ্গনার খ্যাতির দাবিদার। সেই সময় মিঃ ডালহৌসি ছিলেন বাংলার গভর্নর। ঐ সময় তাঁর পদে এলেন লর্ড ক্যানিং। ১৭৫৭ সালে পলাশীর পুতুল খেলার যুদ্ধে ইংরেজ ভারতের সর্বময় কর্তা হয়ে পড়লেও গোপন কাপুরুষতা ও ভীরুতা অথবা দুরদর্শিতা প্রভৃতি যেকোন কারণে ইংরেজ নিজেদের নামে পূর্ণভাবে মুদ্রা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। আকবর শাহের মৃত্যুর দুবছর আগে অর্থাৎ ১৮৩৫ সালে ইংরেজ হিম্মত করে নিজেদের নামে টাকা বা মুদ্রায় মুসলমানদের বাদশাহদের প্রাচীন ঐতিহ্য যুক্ত স্মৃতি মুছে ফেলে। ৭৮ বছর পর ইংরেজদের প্রচলিত মুদ্রায় মুসলমানদের মনে আরও ক্রোধের সঞ্চয় হয়। ৩১ মে বড় রকমের একটা কিছু হরার আগেই মিরাটে পঁচাশিজন ভারতীয় সৈন্যকে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়। প্রথমত নিষ্ঠুর ও প্রকাশ্য অত্যাচার অবশেষে কারাগারে দীর্ঘ মেয়াদি জেল। ফলে ৩১ তারিখ আসার আগেই ১০ মে সহস্র সহস্ৰ সৈন্যের, ক্রোধ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ বিস্ফোরিত হয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়লো। কর্নেল স্মিথ শুধু সৈন্য বিভাগেরই লোক ছিলেন না সেই সঙ্গে সুদক্ষ সাংবাদিকও। তাদের সাংবাদিকতায় শুধু বিপ্লবীদের বিপ্লবকে ছোট করে দেখানো আর ‘সব শান্ত’ ‘সব আয়ত্তাধীন’ লেখাই অভ্যাস তবু কিছু কিঞ্চিৎ প্রকাশ যে হয়নি তা নয়।

কর্নেল স্মিথ লিখেছেন, ‘দিল্লী গেজেট পত্রিকার জন্য- “দিল্লী শান্ত। বিদ্রোহীদের শাস্তি দেয়ার পর মনে হচ্ছে এখানে আর কোন বিবাদ ঘটবার সম্ভাবনা নাই।” রবিবার সূর্যাস্তের পর বিখ্যাত পাদ্রী মিঃ নর্টন গার্জার ঘণ্টার শব্দ শুনে সপরিবারে গীর্জায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন অমনি একজন গুপ্তচর সংবাদ দেয় আজ ভারতীয় সৈন্যরা প্রতিশোধ নেবে। পাদ্রী বিশ্বাস করলেন না বটে কিন্তু স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিজেই গেলেন গীর্জায়। গীর্জার কাছে দেখলেন বন্দুক-তলোয়ার আরও নানা অস্ত্র হাতে সৈন্যরা মারকাট রবে গুলি করতে করতে হুঙ্কার ধ্বনি দিতে দিতে জেলখানায় পৌঁছলেন। তারপর জেলের বদ্ধ কয়েদিদের সব মুক্ত করে বিপুল হর্ষ নিনাদে চারদিক আলোড়িত করে তুললেন। ঐ সময় উদ্ধত বিপ্লবীদের বাধা দেয়ার সাহস কারো ছিল না। সেখানে ছিল ২০ নং পল্টনের কয়েকজন সৈন্য মাত্র। তবুও জেলখানার লোহার দরজা-জানালা ভেঙে প্রত্যেকের পায়ের-হাতের বেড়ি খুলে দিয়ে জেলের কয়েদিদের সঙ্গে নিয়ে মিরাট শহরকে লাল কাল আগুন আর ধোঁয়ার আগ্নেয়গিরিরূপে রাঙিয়ে তুললেন ভারতীয় বীর সৈন্যরা। ক্যান্টনমেন্টে সংবাদ যাওয়া মাত্র ইংরেজ কর্ণেল মিঃ ফিনিস বাছাই করা কয়েকজন সৈন্য নিয়ে সকলের সামনে সামনে ঘোড়া ছুটিয়ে একবারে বিপ্লবীদের কাছে এসে ঘোড়া লাগাম টেনে ধরলেন। বিপ্লবীরা যাকে এতদিন দেখলে সম্মান জানাতেন, ভয়ে জড়সড় হয়ে পুতুলের মত তার আদেশ ও উপদেশ শুনতেন। সেই মিঃ ফিনিস আজও তিরস্কার করলেন আর উপদেশের সঙ্গে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা করা ঠিক হয়নি বোঝাতে চাইলেন। অমনি একটি বন্ধুক গর্জে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটি আহত হয়ে বসে গেল। কর্নেল ফিনিস রেগে উঠে দাঁড়ালেন অমনি আর একটি বন্দুক গর্জে উঠলে গুলি বক্ষ ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মিঃ ফিনিসের জীবনও ওখানে ফিনিস হয়ে গেল। তখন ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি হতে লাগলো। বিপ্লবীদল সাহেব, মেম, বৃদ্ধ, শিশু কাউকে ছাড়লেন না। সব বন্দুক বেয়নেট তরবারির তলে তলিয়ে যেতে লাগলো। শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের প্রতিশোধের ধারা ইতিহাসের স্তরে স্তরে এমনিভাবে সাজানো আছে। (দ্রঃ ঐতিহাসিক মিঃ ম্যালিসনের লেখায়) মিঃ কেয়ী লিখেছেন, “শিকারের গন্ধ পেয়ে হিংস্র বাঘের দল যেমন গর্ত হতে বের হয়ে পড়ে, প্রত্যেকে প্রকাশ্যে রাস্তা, গলিপথ, আবর্জনাপূর্ণ শহরতলী হতে সেইরূপে তারা বের হতে লাগলো।”

ক্যাপটেন সেজে ইংরেজদের পাইকারীভাবে শেষ করা হয় আবার, সেনানিবাসের বাইরে ইংরেজ অফিসারদের সালামও দেয়া হয়, যেন ভেতরে কিছুই ঘটেনি। রাত্রে চাদ উঠল তখন দেখা গেল ইংরেজদের বাসভবনগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। বহুদিনের সঞ্চিত অত্যাচারের ফল যেন অগ্নিশিখা আর তাণ্ডবলীলায় পরিবর্তিত হয়েছে। ১১ মে সকালবেলায় সহস্র সহস্র মৃতদেহ জীবন্ত সাহেবরা দেখে ভাবতে লাগলো অনেক কিছু। দেখা গেল না শুধু বিদ্রোহী বিপ্লবীদের। তারা কোথায় গেলেন? চাঁদের আলোয় তারা দ্রুত মৌন মার্চ করে সারারাত ধরে দুই হাজার সৈন্য সারিবেঁধে চলেছেন দিল্লীর পথে। মাঝে মাঝে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘দ্বীন ইসলাম জিন্দাবাদ' ধ্বনি দেওয়া হচ্ছিল। যমুনার ধারে প্রথমেই পৌঁছালেন অশ্বারোহী সৈন্য তার পরেই পদাতিক। বুকে বিপ্লবের বিপুল বাসনা। ভয়-ভীতি যদিও নেই, তবে মিরাট হতে সম্মিলিত বিলেতি সৈন্য গোলন্দাজ বাহিনী যদি পেছনেই এসে পড়ে তাহলে মোকাবিলার জন্য বিপ্লবীদের কামান বা গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবস্থাই নেই। আগে হতেই চাপাতির রুটির সংবাদে যমুনার প্রচুর নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই নৌকার সৈতু তৈরি করে তার উপর দিয়ে নির্জন নদী অতিক্রম করলেন বিপ্লবী দল। ভিড়ের মধ্যে একজন ইংরেজ গুপ্তচর বিপ্লবী সৈন্যদের সঙ্গে সেতু অতিক্রম করছিল। জাতিতেও ছিল ইংরেজ কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব হলো না। সেতুর উপর হতে মাথাটা গড়িয়ে পড়ল যমুনার জলে। শুধু একটি তরবারীর আঘাত মাত্র।

দিল্লীতে প্রবেশ করেই প্রভাত সূর্যালোকে চকমকিয়ে উঠলো শাণিত ক্ষুধার্ত অস্ত্র গুলি ও বিদ্রোহীরা আকাশ- বাতাস কম্পিত করে “হামারে দ্বীন- জিন্দাবাদ” “হামারী বাদশাহী জিন্দাবাদ” প্রভৃতি স্লোগানে দিগন্ত মুখরিত করে তুললো। বাংলায় দিন মানে দিবস আর দীন মানে দরিদ্র আর আরবীতে ধর্মকে বলা হয় দ্বীন। বাংলায় তাই দ,ব,ঈ,ন নিয়ে দ্বীনকে ‘দিন’ ও ‘দীন’ থেকে পৃথক করা হয়েছে। যাইহোক মিঃ বাগচী মহাশয় এই উক্তির সমর্থনে লিখেছেন, “তারপর দিল্লীর রাজপথ মুখরিত হয়ে উঠলো বিদ্রোহীদের অশ্ব খুরের শব্দে। প্রভাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে “দীন দীন” রবে আকাশ বাতাস কাপিয়ে বিদ্রোহীদের একদল এসে দাঁড়াল লালকেল্লার বাদশাহী প্রাসাদের বাতায়ন তলে।” (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃঃ ৯৯, মনি বাগচি) বাগচি মহাশয় তাঁর পুস্তকে দ্বীন না লিখে দীন লিখেছেন। মুসলমানরা যে বিপ্লব করেছেন ধর্মভিত্তিক তা ঐ “দীন দীন” শব্দে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত।

তারপর সৈন্য দলের একটা অংশ ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটলো। দিল্লীর কেল্লায় বা সেনানিবাসে মিরাটের কোন সংবাদ আসেনি কারণ তার আগেই টেলিগ্রাফের তার কেটে দেওয়া হয়েছিল। এবার আরামরত ইংরেজ সৈন্যরা সংবাদ পেল মিরাটের হাজার দুই বিদ্রোহী সৈন্য নাকি দিল্লী আক্রমণ করেছে কিন্তু তাহলে নিশ্চয়ই মিরাটের ইংরেজ সৈন্য পেছনে পেছনে ধাওয়া করত। তবে হয়ত গুজবও হতে পারে বলে মনে করল ইংরেজ বড় কর্তারা। ৫৪ নং পল্টনের কমাণ্ডিং অফিসার মিঃ কর্নেল রিপ্লে শহরে গোলমাল শুনে সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের সাজতে বললেন এবং আদেশ দিলেন মার্চ টু টাউন শহরের দিকে চল।

এদিকে দিল্লীর সৈন্যরা আগে হতেই প্রতীক্ষায় ছিলেন তারা বজ্র কঠিন কন্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘দ্বীন ইসলাম জিন্দাবাদ’ ‘ফিরিঙ্গি লোগুকো খতম করো’ বলতে বলতে মিরাটের সৈন্যদের সঙ্গে দেখা করলেন আর কর্নেল রিপ্লে দুদল সৈন্যকে গোলন্দাজ সৈন্যের সঙ্গে পাঠালেন এবং নিজে দিল্লী শহরে কাশ্মীরি গেটের দিকে পৌঁছালেন।

শহরের মেন গার্ড ছিলেন উত্তর দিকে ৩৮নং পল্টনের সৈন্যরাই প্রধান প্রহরী। তারা আগে থেকেই বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, যেহেতু তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রেঙ্গুন পাঠানো হয়েছিল। রাস্তার মধ্যে উভয় বিপ্লবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও অভিবাদন হলো। সম্মিলিত কণ্ঠে গর্জে উঠলো- ইংরেজ শাসন ধ্বংস হোক। বাহাদুর শাহ জিন্দাবাদ। দিল্লির লোক আবার তুমুল কণ্ঠনিনাদে হাঁকলো ফিরিঙ্গি রোগুকো মারো।

হতভম্ব মিঃ রিপ্লে সৈন্যদের বললেন, “এসব কী হচ্ছে? গুলি ভর।” এদিকে মেন গার্ডের কমান্ডার ক্যাপটেন ওয়ালেস বিদ্রোহীদের গুলি করার জন্য ৩৮ নং সৈন্যদের আদেশ করলেন, কিন্তু সৈন্যরা কেউ বন্দুক তুললো না। সব চুপচাপ। দুজন ইংরেজভক্ত গর্ধভ মার্কা সৈন্য উপর দিকে নল উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি করল। মিঃ রিপ্লে অত্যন্ত রেগে আগুন হয়ে দুজন বিদ্রোহীকে গুলি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিঃ রিপ্লের দেহের উপর মুহূর্তের মধ্যে বন্দুজ গর্জে উঠল। মিঃ রিপ্লে আহত হয়ে ভূলুণ্ঠিত হলেন সেই সঙ্গে আরও চারজন অফিসারকেও বন্দুক দিয়ে শেষ করা হল।

মিরাটের বীর বিপ্লবীরা শাসক ও শোষক ইংরেজদের বহু হতাহত করে ভারতকে স্বাধীন করার পথে আর এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। শ্রীমনি বাগচি তাঁর পুস্তকে অনেক সত্য তথ্য প্রকাশ করলেও তাঁর জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে এমন অনেক কথা লেখা হয়েছে, যাতে মুসলমান বিপ্লবীদের অনেককে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে। এমনকি বাহাদুর শাহ যিনি সবংশে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়ে গেলেন তাঁকেও অত্যন্ত ছোট করে দেখা হয়েছে। যাক তবুও তাঁর লেখার উদ্ধৃতি দিতে আমরা আনন্দ ও গর্ববোধ করি। তিনি মিরাটের বিপ্লবী সৈন্যদের মিলনের শেষাংশ বর্ণনা করে লিখেছেন, “দেশপ্রেমের চেতনাকে এভাবে ইংরেজের রক্তে রঞ্জিত করে নিয়ে মিরাটের বিদ্রোহী অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নামল এবং দিল্লির সিপাহিদের প্রাণভরে আলিঙ্গন করল। ঠিক সেই সময় কাশ্মীর গেট উন্মুক্ত হয়েছে। উন্মুক্ত সেই তোরণ পথে প্রবেশ করল বিদ্রোহী সৈন্যরা “দীন দীন রবে।” বাদশাহ খোবন্দ’, ‘সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন। এই পদ্ধতিতে মুসলমানদের মুখ্য ভূমিকার পরিচয় উপরোক্ত স্লোগানেই প্রমাণ হয়। বাদশাহ খোদাবন্দ অর্থাৎ বাদশা ঈশ্বর একথা নিশ্চয়ই হিন্দু বিপ্লবী সৈন্যদের কথা। কারণ মানুষকে দিল্লিশ্বর, জগদ্বীশ্বর উপাধি দেওয়ার ইতিহাস ইতিহাসের আছে, কিন্তু মুসলমানদের আল্লাহ, ঈশ্বর, খোদা মাত্র একজনই, যিনি স্রষ্টা।

যাইহোক, দিল্লির রাজ প্রাসাদে অজস্র বিদ্রোহী সৈন্য সশস্ত্র উপস্থিত ছিলেন। বাহাদুর শাহ নামে মাত্র বাদশাহ হয়েও আসলে অভাবী, বন্দি, ইংরেজের পেনশনভোগী খাঁচার সিংহের মতো নরসিংহ। রাজপ্রাসাদে ইংরেজেদেরই নিযুক্ত ইংরেজ সৈন্যরা প্রহরী হয়ে পাহারা দেয়। তাদেরই নেতা ক্যাপটেন ডাগলাস।

ডাগলাস বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহীদের ধমক দেয়ার চেষ্টা করলেন। বারান্দায় দাড়িয়ে জানালেন, বাদশাহ আপনাদের সাক্ষাৎ চান না। সদরগেট খোলা না পেলে বিদ্রোহী সৈন্য ও গণবিপ্লবীরা রাজঘাটের ফটকে গিয়ে হাজির হলেন। বাহাদুর শাহ আর ইংরেজদের অনুমতি নেওয়ার কথা চিন্তা না করে গেট খুলে দিলেন, সৈন্যদল জলস্রোতের মত ভেতরে প্রবেশ করলেন। এবার আরম্ভ হলো ইংরেজ নিধনের পালা। সম্রাট সামান্য ভিক্ষুকের মত মিটমিটে আলোয় জীর্ণ তক্তপোষে সামান্য ভেঁড়া তোষকে শয়ন করেন আর ভাবেন, ভাগ্যের পরিহাস কত বিচিত্র। মুদ্রাতে এতদিন প্রহসন হলেও সম্রাটের নাম থাকত তাও আজ নেই। আত্মীয়স্বজনের খরচা ইংরেজ সরকার দিত, তাও বন্ধ করেছে। ভাবর হতে বাহাদুর পর্যন্ত ইংরেজী দেশী বিলেতী দর্শনার্থী সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে অনুমতি নেওয়া হতো এবং হাদিয়া সম্মানজকভাবে নজরানা দেওয়া হতো। এখন এই বাহাদুর শাহের সময়ে তাও বন্ধ করা হয়েছে এবং বছরে মাত্র এক লক্ষ টাকা খরচা দেওয়া হতো তাও কমিয়ে শেষ করে আনা হয়েছে। অথচ আজও সম্রাটদের দয়া দাক্ষিণ্য অব্যাহত রাখতে বাধ্য হতে হয়েছে। সাধারণ মানুষ সম্রাটের কাছে হাত পাতে সম্রাট মনে করেই। কিন্তু তিনি যে নিঃস্ব তা কয়জনই বা জানে? আবার ইংরেজ ঘোষণা করেছে, এরপর থেকে সম্রাটের আর কোন ছেলেকে বাদশাহ বা রাজা উপাধি নিতে দেওয়া হবে না। শাহজাদা বা রাজার ছেলে বলা হবে। তারপরেই মুছে যাবে সম্রাট বংশের শেষ চিহ্নটুকু।

যাদের কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ মুদ্রা, হীরা, পান্না, জহরত, মতি, ইয়াকুত ও মূল্যবান ধনের ধনাগার ছিল সে ধনাগার আজ গড়ে উঠেছে ইংল্যান্ডে। যাদের পূর্ব পুরুষদের তাজমহল, লালকেল্লা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, মতি মসজিদ প্রভৃতি প্রাসাদ তৈরি করা তাদের বংশধর বাহাদুর শাহকে এখন বিহারে মুঙ্গির জেলায় একটি নতুন ঘরে রেখে আসা হবে, এখানে তার ঠাঁই নেই। শুধু এখানেই শেষ নয়, যেখানে হতো কুরআন পাঠ, পবিত্র নামাজ সম্পাদনা সেই মতি মসজিদে সাহেবরা মেমদের নিয়ে গাল ভরা হাসি কেক, মাংস ও মদ পান করে শুধু বিজয়ীর স্বাদ গ্রহণের জন্য আর ভারতবাসীকে হত্যা কেমনভাবে করা হয়েছে তা গুছিয়ে লিখলে এক বিরাট গ্রন্থ হবে।

ঐতিহাসিক মিঃ কেয়ী বলেছেন, তারা (বিদ্রোহীরা) শুনেছিল কমিশনার ফ্রেজার সাহেব প্রাসাদরক্ষী দলের ক্যাপটেন ডাগলাস এবং আরো বড় বড় ইংরেজকে সেখানে দেখতে পাবে। উৎসাহে “দীন দীন” ধ্বনি করতে করতে তারা সেই ফটকের দিকে দ্রুত বেগে অশ্ব চালালো।.... ঘন ঘন চিৎকার করতে লাগলো- জয় বাহাদুর শাহের জয়। ফিরিঙ্গি লোকো খতম করো। ফ্রেজার ও ডাগলাস বাঁচার চেষ্টা করলেন। থানায় আশ্রয় নিতে গেলেন, সেখানেও সুবিধা হল না। একজন প্রহরীর হাত হতে বন্দুক নিয়ে ফ্রেজার দেশীয় আক্রমণকারী অগ্রবর্তীকে হত্যা করলেন। পরক্ষণেই বিদ্রোহীদল তাদের টুকরো টুকরো করে শেষ করে। ঐ রাজপ্রাসাদে সারা ভারতে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার ও প্রসারে প্রচারক পাদ্রীদের প্রায় আসতে হতো আজও পাদ্রী মিঃ জিনিং তার কন্যা মিস জিনিং আর একজন সুন্দরী যুবতী মেম বান্ধবী হাচিনসন ও মিঃ ক্লিফোর্ড প্রাসাদ হতে দূরবীক্ষণ দিয়ে দৃশ্য দেখছিলেন। পরস্পরে প্রত্যেককেই বিপ্লবী দল খতম করলেন। তাছাড়া ডাগলাস মৃত্যুর আগে পড়ে গিয়ে আহত অবস্থায় সম্রাটকে তাঁদের মেয়ে ছেলেদের সঙ্গে যে মেম সাহেবদের রাখা হয়। বাহাদুর শাহ নারীদের রক্ষা করার আদেশ ও অনুরোধ করলেন কিন্তু দুঃখের বিষয়, উন্মত্ত জনতা তার আগেই তাদের শেষ করে দিয়েছিল।

বিশাল জনতা বাহাদুর শাহকে অনুরোধ জানাল, যদিও আপনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই এই বিপ্লবে পক্ষপাতিত করেছেন, সাহায্য-সহযোগিতা সম্ভাব্য সব কিছু দিয়েছেন। তবু চাই, আপনি আমাদের প্রকাশ্য ঘোষিত ভারত সম্রাট হবেন। আমরা মিরাটে ইংরেজদের পরাজিত করেছি, দিল্লিও আয়ত্তে আনতে চলেছি, এখন সারা ভারতে ভারাল ও ধারাল নেতা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে আপনি ছাড়া আমাদের নজরে দ্বিতীয় কেউ নেই। সুতরাং নিজে হাতে ইসলামের সেরা সুন্দর রঙ সবুজের রঙে পতাকা নিজ হাতে তুলে দিন।

সম্রাট বাহাদুর বললেন, “আমার প্রিয় সন্তানেরা, আমি তো তোমাদের সম্পদশূন্য সুলতান। অতএব কিসে থেকে তোমাদের বেতন দেব?” বিপ্লবীরা জানালেন, “ধনাগার লুট করব, আপনাদের নিয়ে যেখানে যা জমিয়েছে অত্যাচারী ইংরেজ, আবার আপনার কাছে তা আনবো।” বাদশাহ বাহাদুর শাহ পাঞ্জা গ্রহণ করলেন এবং বললেন, “আজ হতে আমি বিপ্লব চালনার জিম্মাদারী (দায়িত্ব) নিলাম।” বাদশা নিজে হাতে সবুজ পতাকা উড়িয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল সহস্র সহস্র বীরের সমগ্র কণ্ঠের চিৎকার আর উল্লাস।

ওখান হতে দিল্লির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হানা দিলেন। সমস্ত ইংরেজ কর্মচারীকে শেষ করে সমস্ত টাকা ও সোনা নিয়ে নেওয়া হলো। ম্যানেজার ভয়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ছাদের উপর আশ্রয় নিলেন কিন্তু তিনি সপরিবারে খতম হলেন। তারপর ইংরেজদের দিল্লি গেজেটের ছাপাখানা, গীর্জা ও বাসগৃহ বিপ্লবীরা গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেললেন। চারদিকে মার মার রব। রাজপ্রাসাদের কাছেই কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগার। এটার দিকে সবার লক্ষ্য। অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন কেলটন্যান্ট জর্জ উইলোবি। আর তার সঙ্গে তেমনি মোগা বিশজন সৈন্য সহকারী হিসেবে।

বাহাদর শার পরামর্শ, আগে অস্ত্রাগার হাত কর। তাই তিনি অফিসারকে পত্র পাঠালেন অস্ত্রাগারে আমার সৈন্যদের ঢুকতে দেওয়া হোক এবং আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। কোন উত্তর এলো না। বিপ্লবীরা প্রাচীর টপকে প্রবেশের চেষ্টা করতেই ইংরেজ সৈন্য গুলি করল। প্রাচীর থেকে মৃতদেহ পর পর পড়তে লাগল প্রাচীরের গায়ে। শেষে দলে দলে উঠতে লাগল বিদ্রোহী দল। তখন নিরুপায় হয়ে মিঃ উইলোবী বারুদের স্কুপে আগুন দিতে আদেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফাটানো শব্দ আর আগুনের বিরাট লেলিহান শিখা বারে বারে গগন চুম্বন করতে লাগলো আর কালো ধোঁয়া চারদিক অন্ধকার করে ফেললো। বারুদের বিস্ফোরণে রাজপথের নিরীহ পথিক ও কুটিরবাসী পাঁচ-ছয় শতজনকে প্রাণ ত্যাগ করতে হয়েছিল।

বিদ্রোহীরা যাকে যেখানে পান শেষ করেন, তাই শহরের শেতাঙ্গ তাদের ছেলেমেয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অপথে বন জঙ্গলের উপর দিয়ে পলায়নের পন্থাই ভাল মনে করল। পথে অনেক ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, ক্লান্তিতে মারা গেল। বহু ব্যবসায়ী ইংরেজ দিল্লির একটা বড় বাড়িতে শেষ আশ্রয় নিয়েছিল। ১৬ মে তাদের ভাল বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে বলে বের করে সবাইকে হত্যা করার কাজ চলতে থাকে। শুধু “ফিরিঙ্গি লোগুকো খতম কর” শব্দ। যেন মনে হল মুসলমান শাসন বুঝি এসেই গেল। শুধু একজন মহিলাকে মারা হলো না। তিনি বললেন, আমি আমার তিনটি সন্তানসহ মুসলমান হতে চাইছি, কোন বিপ্লবী কাউকে বলেননি যে মুসলমান হও। শুধু মারা আর মরা ছাড়া বিপ্লবীরা কিছু বোঝেন না। কিন্তু এই খ্রিস্টান মহিলাটি যা বলছেন তাকে তথায় মারা যায় না। কারণ দেশ ও ধর্ম রক্ষা করাই তো সংগ্রামের উদ্দেশ্য। তাই তিনি রেহাই পেলেন। তাঁর নাম মিসেস আলডোয়েল। হত্যাকাণ্ডের পর মুদাফরাসেরা গরুর গাড়িতে মৃতদেহ বোঝাই করে যমুনার জলে নিক্ষেপ করে।

(দ্রঃ History of the Indian Mutiny, Mallason)

দিল্লির সংবাদ সারা ভারতে পৌঁছে গেল। সমস্ত দুর্গ ও সেনানিবাসে ইংরেজ জানিয়ে দিল সতর্ক থাক, সজ্জিত হও।

এখনো কলকাতা ভারতের রাজধানী। এখানে মাত্র গভর্নর জেনারেলের অধীনে দুই দল ইংরেজ সৈন্য। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ৫৩নং আর রেঙ্গুন হতে প্রত্যাগত এই দুটি দল। এই দুই দল বঙ্গদেশ রক্ষার জন্য খুবই দরকার কিন্তু চারদিক হতে খবর আসছে দিল্লি বাঁচাতে ইংরেজ সৈন্য পাঠাও, মীরাট বাঁচাতে ইংরেজ সৈন্য পাঠাও। কলকাতা তখন সারা ভারতের হৃৎপিণ্ড। ইছাপুরে বারুদ কারখানা, কাশীপুরে বন্দুক কারখানা, দমদমে বন্দুক শিক্ষাগার ও অস্ত্র নির্মাণের কারখানা, কলকাতায় মুদ্রা তৈরির টাকশাল, ধনাগার, ব্যাংক, আলিপুরে বিখ্যাত জেল, যেখানে ভারতের বিখ্যাত বাঘারে বাঘারে বন্দি আছেন। ২৪ মে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন, কলকাতায় রটে গেছে “হিন্দুরা যে পুকুরে স্নান সেরে গভর্নর জেনারেল সেই সব পুকুরে নাকি গরুর মাংস ফেলার হুকুম দিয়েছেন আর রানীর জন্মদিনে বাজারে সমস্ত চাল ও আটার দোকান বন্ধ রাখা হবে হিন্দুরা অপবিত্র নিষিদ্ধ খাদ্য ভোজনে বাধ্য হবে।” (দ্রঃ সিঃ যুঃ ইঃ পৃঃ ১২০) রানীর জন্মদিন মুসলমানের ঈদের দিনেই হয়েছিল। মিঃ ক্যানিং প্রতি বছরের মত এবারও রাতে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করলেন কিন্তু আমন্ত্রিত অতিথি অত্যন্ত অল্প এসেছিলেন। কারণ তাঁদের ভয়, এত খৃস্টান এক জায়গায় জড় হওয়া মানে ঈদের আনন্দে হয়তো খৃষ্টানদের সর্বনাশ হবে।

মোট কথা, কলকাতায় অবস্থা অপেক্ষাকৃত থমথমে। কারণ ইংরেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃস্থানীয় অনেক মানুষ সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন না, অথচ তারা তদানীন্তন যুগে নামীদামি লোক ছিলেন। ঐ দামি লোকদের মধ্যে কিন্তু কিছু মুসলমান মনীষীও ছিলেন। সেই আলোচনা পরে করা যাবে।

সারা ভারতে ব্যাপক বিদ্রোহে ইংল্যান্ডে খুব ভাবনা চিন্তা। শোষণের ভাল রসাল স্পঞ্জে ভারতবর্ষ হাতছাড়া হলে বিলেতের রসে ভাটা পড়বে। তাই মিঃ ক্যানিং সংবাদ পাঠালেন, মাদ্রাজ ও রেঙ্গুন হতে মোট দু-দল সৈন্য আনাচ্ছি। পারস্য হতে একটা দল বোম্বেতে এলেই কলকাতার জন্য আনিয়ে নিচ্ছি। স্যার জন লরেন্সের জন্য করাচী হতে একদল সৈন্য ফিরোজাপুরে রাখার ব্যবস্থা করেছি, সিংহলে স্যার হেনরী ওয়ার্ডকে কিছু সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছি। চীনের জন্য প্রেরিত সৈন্যদের আগে ভারতে পাঠানোর জন্য মিঃ এলথিনকে লিখেছেন।

২৫ মে হাতছাড়া দিল্লি দখল করার জন্য জেনারেল আনসন আম্বালা থেকে কর্নাল যাত্রা করলেন। প্রস্তুতির অসুবিধা, তবুও বহু কষ্টে পাঁচশত গরুর গাড়ি, দুই হাজার উট ও দুই হাজার কুলী সংগৃহীত হলো আর ৩০ হাজার মণ রসদও মজুদ হয়ে গেল। আর পথে দেখা হবে মিরাট আম্বালা সৈন্যদের সঙ্গে। তারপর একসঙ্গে হবে দিল্লি উদ্ধার।

ওদিকে রুডকী টাউন হতে দেশীয় সৈন্যসহ মিরাটের দিকে রওয়ানা হলেন মিঃ ফ্রেজার। মিরাটে পৌঁছে ফ্রেজার ভারতীয় সৈন্য দলকে আদেশ করলেন, “সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোমপ্রুফ ঘরে রাখা হবে তোমরা এ অস্ত্র ত্যাগ করে।” সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদল আপত্তি করলেন কেন? কেন? তারপর তারা মাল বোঝাই গাড়ি আটকালেন। ইংরেজ অফিসার ফ্রেজার খুব ডাঁট দেখিয়ে শাসালেন। সঙ্গে সঙ্গে পাঠান সৈন্য আবদুল কাহার চিৎকার করে বলে উঠলেন, “বেঈমান ফ্রেজার লে-লো” সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক হতে গুলি একেবারে ফ্রেজারের বুকের মাঝে বিদ্ধ হল, সঙ্গে সঙ্গে বিনা শব্দে ফ্রেজার লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। তারপর আরও গুলি চালালেন বিপ্লবী বিদ্রোহী সৈন্যরা। অনেক হতাহত হয়। বিদ্রোহীগণ যেদিকে সেদিকে গা ঢাকা দিলেন। তার মধ্যে পঞ্চাশজন বিদ্রোহী বীর ধরা পড়লেন, তাদের হাত বেঁধে তোপের সামনে পিঠে পিঠে এক লাইনে দাঁড় করা হলো, কামানদাগা হল, ৫০ জন অলিখিত ভারতীয় বীর শহীদ হলেন। বলাবাহুল্য ভারত আজ তাদেরই তাজা রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার গর্বে সমুন্নত।

অনেক আগেও বলা হয়েছে, একটু পূর্বেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ভারতের জমিদার বড় হিন্দু রাজা মহারাজা প্রায় সকলেই ইংরেজদের বান্ধব ছিলেন। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে পরপর কয়েকটি স্বাধীনতা সংগ্রাম পণ্ড হয়েছে। অবশ্য খুবই অল্প মুসলমান নবাব যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেননি, তবে সরাসরি সৈন্য দিয়ে ইংরেজের পক্ষে লড়াই করার ইতিহাস দুর্লভ। যেমন কর্নালের নবাব ঐ সময় ইংরেজের পক্ষের লোক বলে জানিয়ে ছিলেন কিন্তু তা নেহায়েত মৌখিক। কিন্তু মিঃ জনলয়েন্সের অনুরোধে হিন্দু মহারাজাগণ প্রত্যক্ষভাবে ঢালাও সাহায্য করলেন। যেমন পাতিয়ালা, নাভা ও জিন্দের মহারাজা। জিন্দের রাজা ইংরেজ সৈন্যদের গাড়ির ব্যবস্থা করলেন; শুধু তাই নয়, তাদের খাদ্যাদি ও রসদের সুব্যবস্থা করতেও তার বিবেকে বাধেনি। আর পাতিয়ালার মহারাজা ঢালাওভাবে বাছাই সৈন্যদল দান করে উদারচিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। মিঃ জনলরেন্স সেই সৈন্যদের থানেশ্বর ও লুধিয়ানায় পাঠালেন। ফরিদপুরের রাজাও তার সৈন্য দিয়ে ইংরেজের প্রশংসা পাবার যোগ্যতা অর্জন করলেন। আর ইংরেজ কোম্পানির পুরাতন সুহৃদ শিখ সর্দাররা ইংরেজের পক্ষ অবলম্বন তো করলেনই, সেই সঙ্গে জীবন ও রক্ত দেওয়ার গ্যারান্টি দিয়েও ইংরেজকে চাঙ্গা করে তুললেন। দিল্লি হাতছাড়া হওয়ার অন্যতম অঙ্কুর রোপিত হয়ে গেল। এটাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থ করতে ভারতীয় বিশ্বাসঘাতকদের বিষাক্ত পদক্ষেপ।

২৬ মে জেনারেল আনসনের কলেরা হয়, তাতে তিনি জেনারেল বারনাডকে তার সৈন্যদের দায়িত্ব দিয়ে মারা গেলেন। ৩০ মে সামনাসামনি লড়াই। একপক্ষে শুধু ভারতীয় মুসলমান আর ভারতপ্রিয় হিন্দু বিদ্রোহী অপর পক্ষে ইংরেজের অল্প সৈন্য আর তার সঙ্গে যুক্ত ইংরেজের ভারতীয় দালাল ও তাদের গোলামরা। উভয়পক্ষে হতাহত হল অনেক। কিন্তু বিপ্লবীরা বুঝতে পারলেন, পরাজয়ের কালো মেঘ হয়তো সামনেই আসছে, কারণ ভারতবাসী আজও বেঈমান ইংরেজকে চিনতে ভুল করছে। ইংরেজরা আশান্বিত আর আনন্দিত হলো কিন্তু মিঃ উইলসন ভাবলেন, যদি আগামীকাল বিদ্রোহীদের সাথে সৈন্য আরও যোগ দেয়, তাহলে ইংরেজ সৈন্যের পরাজয় হবে। কারণ ইংরেজ সৈন্য এতে কমতেই পারে, বাড়বে কোত্থেকে। পরের দিন সৌভাগ্যক্রমে ক্রাপটেন রীড প্রেরিত পাঁচশত গুর্খা সৈন্য পৌঁছলো। তবুও বিদ্রোহীরা নির্ভয়ে চালিয়ে যেতে চান অব্যর্থ অভিযান। সমস্ত বিদ্রোহী সরাই-এ জমা হলেন। ৮ জুন বিদ্রোহীরা প্রথম পুরস্কার দিল কামানের গোলা। ইংরেজ ও ভারত ঘাতক সৈন্যরাও উত্তর দেয়। ইংরেজ সৈন্য বহু হতাহত হয়। ওপক্ষেও আহত-হিত হয় অনেক, কিন্তু তা অপেক্ষাকৃতভাবে কম। যুদ্ধে ইংরেজেরই জয় হলো কিন্তু অনেক নামজাদা নেতার মধ্যে প্রধান সেনাপতির পুত্র ক্যাপটেন বারনাডও খতম হন। ইংরেজ সৈন্য একসঙ্গে চারদিক হতে আক্রমণ করলো। রাজশক্তি তাদের হাতে অতএব প্রকাশ্য প্রস্তুতিতে বাধা নেই। কিন্তু বিপ্লবীরা যা করেন অত্যন্ত গোপনে তাও আবার দেশীয় বিশ্বাসঘাতকরা অর্থের লোভে ইংরেজকে অনেক সংবাদ জানিয়ে দেয়। তাই তেইশটি কামান ইংরেজরা পেয়ে যায়। বিদ্রোহীদের সামান্য মূলধন হতে।

তখনকার বারানসীতেও হিন্দুর সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে বেশি ছিল। ওখানে একদল ফকির মৌলবী গিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বীজ ছড়িয়ে বেশ সুবিধা করতে পারেননি। তাই বাহাদুর শাহের বংশীয় রাজপুত্রগণ ও নিকটাত্মীয়গণ বেনারসে পৌঁছালেন। তখন তাদের দেখার জন্য ভিড় হয় এবং তাদের কথা জনসাধারণ আগ্রহ সহকারে শুনতে থাকেন এবং তাদের দেওয়া জমি, যা বেনারসের মন্দিরে দেওয়া ছিল, দলিলপত্রে এখনো হাতের পাঞ্জার ছাপ মারা বাদশাহী চিহ্ন সংরক্ষিত। জনসাধারণের মন গলে যায় এবং সেথানে বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয় এবং পরক্ষণে অঙ্কুরিত হয় ১৮৫৭ সালে মার্চ মাসে। ঐ মিছিলে ইংরেজবিরোধী কিছু মহারাষ্ট্রীয় এবং পাঞ্জাবীও ছিল। টোটার চর্বির চটকদার কথাতে ধর্মভীরু কাশীবাসী উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। বেনারসের উত্তর-পশ্চিম কোণে সিকলোল সেখানে সেন্যাগার আদাল, জেলখানা, গীর্জা, গোরস্থান, মিশনারি স্কুল সবই মজুত আছে। তাছাড়া বড় বড় ইংরেজ নেতা সেখানে আছেন যেখানে বিগ্রেডিয়ার পনসনবি, বিচারপতি ফ্রেডারিক গ্যাবিন, ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ লিণ্ড ও কমিশনার মিঃ হেনরি ট্যকা প্রভৃতি। তবু সকলে ভয়ে শঙ্কিত, শুধু মনে হয় মিরাটের মত যদি সব নিহত হতে হয়। ইংরেজ অফিসারদের মত নারী ও শিশুদের চুনার দুর্গে রেখে আসা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু মিঃ লিণ্ড প্রস্তাব বাতিল করলেন। কারণ তাহলে ইংরেজ নেতাদের ওপর সকলে আস্থাহীন হয়ে পড়বে ফলে বিপদকে আরও ডেকে আনা হবে।

কমিশনার কলকাতায় কমিশনারকে লিখলেন, “কলকাতা ও দানাপুর হতে এখানে কি সৈন্য পৌঁছাবে না? ইংরেজ সৈন্য চায়।” কনেপুর হতে ঘন ঘন সংবাদ আসছে কত করুণ! কত উকণ্ঠপ্রদ! “ঈশ্বরের দোহাই কিছু ইংরেজ সৈন্য পাঠিয়ে দিন।” আবার কানপুর হতে বেনারসে খবর আসছে, “কিছু ইউরোপীয় সৈন্য পাঠান বিপ্লবীরা গোপনে গোপনে কাশী, কানপুর ও আজিমগড় ক্যান্টমেন্টের সঙ্গে সংযোগ যথাযথভাবে অব্যাহত রেখে চলেছেন।”

৩ জুন আজমগরে বিদ্রোহী বিপ্লবীরা কোম্পানির সাত লক্ষ টাকা হস্তগত করতে সক্ষম হলেন। ঐ টাকা ইংরেজ অশ্বারোহী সৈন্যরা আনছিল গোরক্ষপুর হতে পাঁচ লাখ আর আজমগড়ের দুলাখ। বিপ্লবী ও বিদ্রোহী সৈন্যদের মিলিত শক্তিতে অভিযান চলছিল। ইংরেজ কাউকে যেন পাওয়া গেল না সব আগে হতেই সরে পড়েছে। যাদের পাওয়া গেল জীবন্ত পরক্ষণেই তারা মৃত্যুর কোলে লুকিয়ে গেল।

মিঃ কর্নেল নীল একদল মাদ্রাজী সৈন্য নিয়ে কাশী বা বেনারসে এলেন। ওদিকে দানাপুর হতে একদল ইংরেজ সৈন্য এসে পৌঁছেছে। তাই নীলের খুব সাহস বেড়ে গেল স্বাভাবিকভাবেই। মিঃ নীল সমস্ত ভারতীয় সৈন্য দাঁড় করালেন অহঙ্কারপূর্ণ আস্ফালন করতে লাগলেন। পেছনে কামান প্রস্তুত আর ইংরেজ সৈন্যরা এমন অবস্থায় আছে, শুধু একটু হুকুম দিলে আর রক্ষা নেই। ভারতীয় সৈন্যদের বুকের রক্ত রাগে টগবগ করতে লাগলো, তাই অসহ্য হয়ে গুরুম গুরুম করে গুলি ছুড়লেন তারা। সঙ্গে দশ-বারজন ইংরেজ সৈন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে মাটির উপর ছটফট করতে লাগলো। ইংরেজ কামানও পেছন হতে গর্জে উঠল। এক লাইনে অনেক বিদ্রোহী শহীদ হলেন। মৃত্যু যন্ত্রণায় রক্তমাখা মুখে শেষ কথা শোনা গেল’ বেইমান ইংরেজ দূর হটো “আল্লা! আল্লাহ!”

যাইহোক হৈ হট্টগোলে বিদ্রোহীগণ অস্ত্র ফেরত না দিয়ে যেদিকে সেদিকে পলায়নের চেষ্টা করলেন কিন্তু গেটে প্রহরীদের সঙ্গে সংগ্রাম ছাড়া উপায় নেই। তার আগেই মুসলমান ছেঁড়া কম্বল কাঁধে ফকিরের দল কম্বল ভিজিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন আর প্রচুর দড়িতে ইটের টুকরো বেঁধে ওদিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। ওদিক হতে বিদ্রোহী বিপ্লবী ফকিরদের শক্ত কব্জির টানে ক্যানটনমেন্ট হতে বিদ্রোহী বিপ্লবী আসতে সক্ষম হলেন। আর বাকি সৈন্য গেটে লড়াই করে অনেকে শহীদ হয়েছেন এবং বেশির ভাগই বাইরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। বিপ্লবীরা নম্বর মারা নেতা ইংরেজদের না পেয়ে ফৈজাবাদের দিকে ছুটলেন।

আজকের দিনে যেখানে ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম মুহূর্ত, সেখানে ইংরেজের বড় প্রিয় বিশ্বাসী শিখ প্রহরীরা প্রহরা দিচ্ছে শাসক প্রভুর মাল-সম্পত্তি, অফিস, গুদাম ইত্যাদি।

তারচেয়েও দুঃখ ও বেদনার কথা, কাশীর যিনি শক্তিশালী সম্মানীয় রাজা তিনি ইংরেজের সমর্থক। আরও আশ্চর্যের কথা, রাজা মশাই আজ ৪ জুন ইংরেজের পক্ষে সরাসরি নেমে পড়লেন লড়াইয়ের ময়দানে অর্থাৎ সৈন্য সাহায্য, অর্থ সাহায্য সবই চলতে লাগল। এছাড়া ইংরেজপ্রেমিক রাজা ইংরেজ পাদ্রিদের ও সর্দার নেতাদের নিয়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। তার কারণ বোধহয় এই যে, মুসলমান বিপ্লবে যেখানে আল্লাহু আকবার স্লোগান দীন ইসলাম জিন্দাবাদ ধ্বনি সেখানে গোখাদক মুসলমানকে সাহায্য করার চেয়ে তাদের চিরশত্রু ইংরেজের পক্ষ অবলম্বন করাই শ্রেয়।

উপরোক্ত বক্তব্যের প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে একটি মূল্যবান উদ্ধৃতি পেশ করা গেল-“৪ঠা জুন রাত্রে কাশীর রাজা ইংরেজ মিশনারীদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দান করেছিলেন। এমনকি অর্থ ও সৈন্য সাহায্য করতেও তিনি কৃপণতা করেননি। শহরে জনতা, আতঙ্ক ও গোলমাল মুসলমানরা উড়িয়েছে সবুজ পতাকা।” এই মূল্যবান উদ্ধৃতিটি কোন মুসলমান লেখকের নয়; বরং শ্রী, মণিবাগচির পূর্ব উল্লিখিত বইয়েরই বাক্য, (পৃঃ ১৪৯)

এই ফয়জাবাদের কথা মনে করলেই স্মরণ হয় বিখ্যাত বিপ্লবী মাওলানা লিয়াকত আলীর কথা, যার সংগঠন ক্ষমতা ছিল সারা ভারতে বৈদ্যুতিক তারের মত। যেখানেই সংগঠন শৈথিল্য দেখা দিয়েছে সেখানেই হাজির হয়েছেন মাওলানা লিয়াকত আলী। কিন্তু তাঁর জীবনের ত্যাগ, বীরত্ব, শ্রমশীলতা ও চাতুর্যের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসে তাঁকে স্থান দেওয়া হয়নি। দোষ ইতিহাসের না ঐতিহাসিকের তা সুস্থবুদ্ধি পাঠক-পাঠিকার বিবেচনাধীন। এমনিভাবে জৈনপুর, ফিরোজপুর, আলীগড়, মৈপুরী, এটোয়া প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহীরা বিপ্লব বাধিয়েছিলেন। কলকাতায় যেমনি ইংরেজ সৈন্য এসে পৌঁছেছিল অমনি ক্যানিং সেগুলো উত্তর প্রদেশে পাঠাচ্ছিলেন গরুর গাড়ি করে। পাঠানো আরম্ভ হয়েছিল ব্যাপকভাবে ৩ জুন হতে।

৬ জুন এলাহাবাদ এলাকায় বিদ্রোহের বহ্নি ভীষণভাবে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। এখানে বেশির ভাগই মুসলমান। হিন্দু বা অপর জাতির সংখ্যা খুবই কম। আগে হতেই কর্নেল সিম্পসন এখানে দুদল সৈন্য আনিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু শুধু বিদ্রোহী সৈন্যরাই সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে সমস্ত মুসলমান জনসাধারণ। আর সমস্ত নষ্টামির মূলে হচ্ছে একটি মৌলবি। তিনিই হচ্ছেন মাওলানা লিয়াকত আলী। মাওলানা লিয়াকত আলী শিখ নেতাদের বোঝালেন ইংরেজদের পক্ষে সারাজীবন শিখজাতি যুদ্ধ করে এসেছে কিন্তু বুতো ইংরেজরা পাঞ্জাব দখল করেছে। শুধু তাই নয়, বেনারসে মিঃ নীল সাহেব প্রকাশ্য রাস্তায় গাছে গাছে অজস্র সাধারণ মানুষকে ফাঁসি দিয়েছে। সে কথা আজ ভুললে চলবে না। একদল শিখ সৈন্যকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গুলি করে মারা হয়েছে। মাওলানা লিয়াকত আলী আরও বললেন, এ কথা ভোলা ঠিক নয় যে, নির্বাসিতা রানী ঝিন্দনের মুকুটের বহু মূল্যবান মণিরত্ন ছিনিয়ে এনে ঐ ইংরেজরাই তাদের ধনাগার পূর্ণ করেছে। দেশ আজ বিদ্রোহী আর আপনারা তাদের একান্ত বিশ্বাসী গোলামের মত ধনাগারে পাহারা দেবেন, এ অসম্ভব। মুসলমানদের সঙ্গে আপনাদের যে যুদ্ধ হয়েছিল হযরত আহমাদ ব্রেলবীর সময় আসলে সেটাও ইংরেজের চাল। আমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই লাগিয়ে আমাদেরও শহীদ করেছে আর তাঁদের কাজ মিটে যাওয়ার পর আপনাদের স্বাধীনতাও ছিনিয়ে নিয়েছে।

মাওলানার যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শিখদের বুকে যেন ডিনামাইটের মত আঘাত হানলো। শিখরা এখন উত্তপ্ত, উগ্র, হিংস্র, বিদ্রোহী, তাই জৌনপুরের কমাণ্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট ম্যারা শিখ সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় মুক্ত হাওয়া খাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন, আসলে এরা বেশি নিরক্ষর তাই এখনো এদের আমাদের গোলামি করানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু তিনি জানেন না যে, শিখরা চারদিকে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্তপ্রাপ্ত। শিখদের বন্দুক হুঙ্কার ছাড়লো। মিঃ ব্যারা মারা গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। জয়েন্ট মেজিষ্ট্রেট চ্যাপেজ সাহেব জেল পরিদর্শন করতে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় বুলেটের আঘাতে তাকেও ধরাশায়ী করলেন বিদ্রোহীরা। শিখরা ট্রেজারি লুট করতেও ভুললেন না। শহরবাসী বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় বিদ্রোহীই বড়ই মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করলো। তিন লাখ টাকা হাতে এলো। মাওলান লিয়াকত জানতেন একতার মূল্য কত। অযোধ্যায় যতবার মুসলমান বিপ্লবীরা মাথা তুলেছেন ততবারই হিন্দুদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত তো হয়েছিলেনই; বরং বিরোধিতাও করতেন তারা। মাওলানা লিয়াকত হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত জনতার সামনে বক্তৃতা করলেন আর সমস্ত মানুষকে বিপ্লবের বহ্নিতে ক্ষেপিয়ে তুললেন। শ্ৰী বাগচী মহাশয়ের লেখাতেও এ কথার প্রমাণ মেলে-“ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাই ভেবেছিলেন যে, এখানে হিন্দু-মুসলমান একত্র হয়ে কখনই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না। কিন্তু এলাহাবাদের বিদ্রোহ নির্মমভাবেই তাদের সে ধারণা ভঙ্গ করে দিল। চারদিকে অগ্নি সংযোগ, গুলি, কামানের গোলা আর তরবারির চাকচিক্য যেন বিভীষিকা সৃষ্টি করলো। টেলিগ্রাফের তার কাটা হল, জেলখানা ভাঙা হল, হাজার কয়েদি রণ-মূর্তিতে রাক্ষস পালের মত শহরে তাণ্ডবলীলা শুরু করলো। ইংরেজ আবালবৃদ্ধবনিতা মারা পড়তে লাগলো। ইংরেজ বেশ বুঝতে পারলো ভারতে রাজত্ব করা আর সম্ভব নয়। অবশ্য আমাদের দেশের বিশ্বাসঘাতকদের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারলে বোধহয় ইংরেজের মনে এ ধরনের চিন্তা স্থান পেত না।

যাইহোক, মধ্যে মধ্যে দীন ইসলাম জিন্দাবাদ। আরেজি হুকুমাত খতম ক্যারো স্লোগান আর সামনে উড়ছে মুসলমানদের পছন্দমত সবুজ পতাকা। শ্ৰী বাগচী মশায়ও লিখেছেন, “দুর্গের বাইরে যেখানে যত ইংরেজ ছিল তাদের প্রায় সবই নিহত হলো। কোতোয়ালির মাথায় উড়ল মুসলমানদের সবুজ পতাকা। বিদ্রোহীদের তোপে তোপে রেল ইয়ার্ডের ইঞ্জিন চূর্ণ হয়ে যেতে লাগলো।” (দ্রঃ সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃঃ ১৫৮)।

পরের দিন ট্রেজারী আক্রমণ ও ত্রিশ লক্ষ টাকা করায়ত্ত করা হয়। ইংরেজরা ভয়ানক বিপদে পড়ে। কেন্দ্র কলকাতা হতে মিঃ ক্যানিং কাশীর মিঃ নীলকে টেলিগ্রাম করলেন সসৈন্যে এলাহাবাদ রওনা হওয়ার জন্য। ১৮ জুন তিনি সসৈন্যে এলাহাবাদ পৌঁছান কিন্তু ইংরেজ সৈন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন সব ফাঁসির আসামি। আকাশে শকুন উড়ছে, নর মাংসের গন্ধে তারাও সুযোগ পেয়েছে। মিঃ নীলের মুখও নীল হয়ে গেল সেখানকার কাণ্ড কারখানা দেখে। কিন্তু ইংরেজদের মত এত কামান তো আর নেই বিদ্রোহীদের হাতে। তাই কামান দেগে শহরটাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার উপক্রম হলে বিদ্রোহীরা টিকতে পারলো না, সরে পড়ল। মিঃ নীল দুর্গ হতে শিশু মহিলাদের কামান সজ্জিত স্টিমারে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। স্টিমার চলতে লাগলো আর পথের দুপাশের গ্রামগুলিতে গোলাবর্ষণ করে সহস্র সহস্র ভারতবাসীকে হত্যা করে গর্ববোধ করতে লাগলো ইংরেজরা।

১৬ মে কানপুরের অন্তর্গত বিটুরে একটি গোপন বৈঠক হয়। মারাঠা বংশের ‘নানা’, 'বাজীরাও' এর পালিত পুত্র। পরামর্শ করার জন্য ডেকেছেন তার দুই ভাইকে ‘বাবা’ ও ‘বালা’ কে আর ভাগিনেয় ‘রাও সাহেব’ আর আছেন ঝাসীর রানী ‘লক্ষ্মীবাঈ' এবং সাহসী ‘তাতিয়াটোপী’ প্রমুখ।

রানী লক্ষ্মীবাঈ জানালেন যে, ইংরেজকে বারে বারে আমরা সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়েছি বা এখনো অনেকে দিয়ে যাচ্ছি তাতে লাভ কিছু হয়নি বরং ভারত স্বাধীন হতে চলেছে পরে আমাদের বংশ কলঙ্কিত হবে। আমাদের প্রত্যেকের বংশ মর্যাদায় এবং ধন সম্পত্তিতে পর্যন্ত আঘাত দিয়েছে। এক্ষেত্রে কিসের জন্য আমরা এখনো তাদের তাবেদারি করবো? তাতিয়াটোপী বললেন, নানা সাহেবের মতই আমার মত। কিন্তু আমার মনে হয় মুসলমানরা ঠিকই বুঝেছে, ইংরেজ এক এক করে সকলকে গ্রাস করবে। বাবা ও বালা মত দিলেন, দাদা যা করবেন তাতেই মত। নানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার পিতা যেভাবে ইংরেজকে প্রাণপণ সাহায্য করেছেন ইংরেজ তার বিনিময়ে তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁকে লাঞ্ছিত করেছে এবং নিঃস্ব করার ব্যবস্থা করেছে। তাঁর করুণ আবেদন অগ্রাহ্য করেছে। আমিও নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত মারাঠা শক্তিকে ইংরেজের পক্ষে লাগিয়েছি, কত গোপন পরামর্শ আমার যে হয় তা তোমাদের কাউকে জানাইনি কোন দিন। কত গোপন উপকার করেছি, যা তোমাদের সামনে প্রকাশ করলে তোমরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক বা দালাল মনে করবে। কিন্তু আমার সঙ্গে তারা খুবই খারাপ ব্যবহার করলো। এখানে অনেক আবেদন-নিবেদন করে যখন কোন ফল হল না, তখন এমন কোন ইংরেজ বন্ধু পেলাম না যে আমারই খরচে একবার আমার তরফ হতে প্রতিনিধি হয়ে ইংলণ্ড গিয়ে আবেদন পেশ করে। ভারতের হিন্দু, মারাঠা, শিখ কাউকে পেলাম না; অবশ্য এমন লোকের দরকার ছিল, যে ভাল ইংরেজি জানে। শেষে তাদের চিরশত্রু মনে করি সেই মুসলমান জাতের আজিমুল্লা খানকে অনুরোধ করি। তিনি আগ্রহের সঙ্গে বিলেতে গেলেন এবং বহু আবেদন করলেন। তাতেও কিছু ফল হল না। এখন ইংরেজদের ওপর আমার খুব ভক্তি বা বিশ্বাসের কোন কথা নেই। তবে একটা কথা ভাবছি, ইংরেজ সত্যিই যদি ভারত হতে চলে যায় তাহলে তো আবার সেই মুসলমান রাজতৃই স্থাপন করা হবে। কারণ শুনছি এখন বাহাদুর শাহ-ই নাকি সারা ভারতের সুলতান। সকলেই চিন্তিত হলেন, পরামর্শে সিদ্ধান্ত হল, নানা সাহেবের একবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা দরকার, যুদ্ধের অবস্থা কেমন। যদি দেখা যায় ইংরেজকে ভারত ছাড়তেই হবে, তাহলে বীরবিক্রমে শেষ প্রতিশোধ নেওয়া হবে। আর যদি দেখা যায়, সামান্য কিছু হিন্দুস্থানী সৈন্যের উত্তেজনা মাত্র, তাহলে পরক্ষণেই প্রতিশোধের শিকার হতে হবে আমাদের।

বিপ্লবী আজিমুল্লা খান ছোটবেলা হতেই ইংরেজবিরোধী ছিলেন। তাই অল্প বয়স থেকেই বিপ্লব করতে গিয়ে তার লেখাপড়ার যথেষ্ট ক্ষতি হয়। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার আকাক্ষা থেকে যায়। তার ইংরেজি শিক্ষার আগ্রহ ছিল। চেহারা ছিল অতি সুন্দর। এক ইংরেজের বাবুর্চি বিভাগে চাকরি করতে থাকেন। ইংরেজটি, ফারসি ভাষায় সুদক্ষ ছিলেন আর তো তাঁর মাতৃভাষা ছিলই। কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজটির সাহচর্যে তিনি ইংরেজি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করলেন। এইবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানপুরে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলেন। এত মেধাবী ছিলেন, প্রতি বছর তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে পড়া শেষ করেন। পরে তাঁকে ইংরেজ সরকার ঐ স্কুলেরই শিক্ষকরূপে বরণ করে নেয়। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। অতঃপর নানার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়, নানাও ছিলেন একজন ভারতীয় রাজা। আর ভারতের প্রায় সব রাজাই ইংরেজভক্ত ছিলেন তা ভক্তিতেই হোক আর ভয়েই হোক। তাই আজিমুল্লা বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ রেখে নানার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এই আজিমুল্লাহ খানই রাজা নানা সাহেবের পক্ষ হতে ১৮৫৩ খৃস্টাব্দে ইংলণ্ড যান এবং নানার আবেদন পেশ করেন, কিন্তু সফলকাম হননি। তখন তিনি ফিরে এলেন। ইংলণ্ডে আর একজন ভারতীয় রঙ্গ বাপুজী সেতারা রাজার আবেদন নিয়ে এসেছিলেন। তাঁকেও বিমুখ হতে হয়। আজিমুল্লা সাহেব তার দ্বারা নানাকে জানালেন, তাঁর ফিরতে দু-তিন বছর বিলম্ব হতে পারে। আমার কথায় যেমন কাজ হল না এখন ইংরেজকে শক্তি প্রয়োগ করে ভারত থেকে তাড়ানোর রাস্তা করে তবে ফিরব।

এদিকে বিলেতে বিদ্রোহী দলের অনেক মুসলমান ইংরেজ ধ্বংসের কাজে আসা যাওয়া ও ঘাটি করার কাজ আগেই শুরু করেছিলেন। সকলে আজিমুল্লাকে এই পরামর্শই দিলেন যে, নানার দ্বারা প্রত্যেক ইংরেজ প্রেমিক হিন্দু রাজাকে বিদ্রোহী দলে টানার কথা। আজিমুল্লার মনেও ঐ একই কথাই ছিল।

আজিমুল্লা খুব ভাল প্রচারক ও মিশুকে লোক ছিলেন, আর স্বাস্থ্য ও চেহারা ছিল খুব সুন্দর। তাই অনেক রাজনৈতিক নেতার বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে তার আলাপ করতে অসুবিধা হয়নি। অনেকে তাকে ভালবেসে ফেলেছিলেন, কিন্তু বিপ্লবীর লক্ষ্য বিপ্লবই। যখন তিনি দেশে ফেরেন তখন প্রচুর পত্র আসতে ডারলিং আজিমুল্লা বলে। কিন্তু আজিমুল্লা খান ঐ ফাঁকে অনেক গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন, যা কেউ বের করতে পারেনি।

১৮৫৭-এর বিপ্লবে ইংলণ্ড হতে তিনি তুরস্ক যান এবং সেই সময়ে তুরস্কের বাদশাহ মুসলিম দুনিয়ার খলিফা বলে খ্যাত ছিলেন। ইংরেজ বিশ্বে বহু জায়গায় পরাজিত হচ্ছে সে খবর পেলেন আজিমুল্লা খান। যেমন সিবাস্তপোলের যুদ্ধ। ওখান হতে তিনি গেলেন রাশিয়া। ওখানে লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা মিঃ রাসেল রাশিয়াতে থাকতেন, তাঁর আত্মীয়-আত্মীয়াদের পরিচয় ও পত্র দেখিয়ে তিনি তাঁর তাবুতেই থাকলেন। তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে। আজিমুল্লা সংবাদ পেলেন রাশিয়ার সৈন্যরা ইংরেজ ও ফরাসি সৈন্যের মিলিত শক্তিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এইবার তিনি মিঃ র্যাসেলকে বন্ধু বলে তাঁকেও বন্ধু বলিয়ে নিলেন। তার যুক্তি ও সহায়তায় তিনি রাশিয়া হতে মিসরে যান, ওখানে প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রচার ও অপপ্রচারের রাজনৈতিক পর্ব শেষ করে ভারতে ফিরলেন।

কানপুরের ক্যান্টনমেন্ট খুবই বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা চিন্তিত, এখানেও যে বিদ্রোহের আগ্নেয়গিরি উদগীরিত হবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে বিঠুরে নানা সাহেব যুগ যুগ ধরে ইংরেজের হাতের লোক। এখনও যদি তাকে এ ভিন দিয়ে কাজ বাগানো যায়, তাহলে বিদ্রোহের বিপদ হতে বাঁচা যেতে পারে। ১৮৫৭'র ১৮ মার্চ জেনারেল হুইলার নানার নিকট পুরাতন বন্ধুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে সহযোগিতা ও সাহায্য তথা তার সৈন্য বাহিনী চেয়ে পাঠালেন। কারণ নানার সৈন্য, ইংরেজ সৈন্য ও শিখ সৈন্য ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করা যায় না তবে শিখ যদিও পুনরায় আমাদের কথামত চলছে কিন্তু কিছুদিন আগে তাদের কয়েকটি বিশ্বাসঘাতকতার কথা হুইলার চিন্তা করলেন।

নানা চির বন্ধু ইংরেজের পত্র পেয়ে বাছাই করা পদাতিক ও অশ্বারোহী তিনশত সৈন্য এবং কয়েকটি কামানও পাঠালেন। মিঃ হুইলার একটি সাময়িক দুর্গ মাটির দেওয়াল আর চারদিকে কামান বসানো ঘাটি তৈরি করালেন তাতে প্রায় এক মাসের মত খাদ্য পানীয় নিয়ে নিলেন আর ইংরেজ মহিলা ও শিশুদের সেখানে স্থানান্তরিত করলেন।

৪ জুন মাতাল অবস্থায় এক ইংরেজ অফিসার একজন ভারতীয় অশ্বারোহীকে গুলি করে হত্যা করে। ভারতীয় সৈন্যরা সুযোগ খুঁজছিলেন। তাঁরা বিচার চাইলেন। বিচারে এই রায় হয়, সে নির্দোষ কারণ ইচ্ছাকৃত নয় অনিচ্ছাকৃতভাবেই এই গুলি। ভারতীয়রা আগে হতেই জানতেন কেমন রায় হতে পারে। সৈন্যরা ঘোষণা করলেন, আমাদের হাত হতেও মনের ভুলে গুলি বেরিয়ে গেলে আমরাও নিশ্চয় নির্দোষী হব। সেই রাতেই ভারতীয় সৈন্য ফটাফট গুলি করল কয়েকজন ইংরেজ অফিসারকে। কিছু হতাহত হল। কিন্তু মরতে ও মারতে ভয় নেই তারা যে বিপ্লবী। কানপুরের অশ্বারোহী বাহিনীটি এক রকম মুসলমান সৈন্য নিয়েই গঠিত হয়েছিল। তাঁরাই প্রথম নারায়ে তকবীর ধ্বনি দিয়ে আল্লাহু আকবর বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তখন সৈন্যদের সুবেদার মোটা পুরস্কারের আশায় সৈন্যদের বোঝালেন, “তোমরা ক্ষান্ত হও। আমিও হিন্দুস্থানী তোমরাও হিন্দুস্থানী, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” বিদ্রোহী দল তাকে ভারতীয় বলে হত্যা করতে মায়া করেন, কিন্তু তরবারির উল্টো দিকের আঘাতে আহত করে ব্যারাক থেকে বের করেছেন। ধনাগার, অস্ত্রাগারের দিকে ছুটতে লাগলো, মুখে স্লোগান-হামারে দীন জিন্দাবাদ! আঙ্গরেজি হুকুমাত খতম ফ্যারো।

নবাবগঞ্জে নানা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন একদল ভারতীয় বিপ্লবী। দলের নেতা শামসুদ্দিন আর সরকারি মুদ্দত আলী। নানা সাহেব স্বাস্থ্যে খুবই সুদর্শন ছিলেন কিন্তু শামসুদ্দিন আর মুদ্দত আলীর চেহারা যেন নানার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দণ্ডায়মান। শামসুদ্দিন নানাকে বললেন, “সারা ভারত আজ ইংরেজকে তাড়াতে চায় আর আপনি এখনো আপনার সৈন্য নিয়ে শয়তান শোষক ইংরেজদের ধনাগারের পাহারা দিচ্ছেন? মনে রাখবেন, ইংরেজের হাতে যদিও এখনো রাজক্ষমতা, তবুও তাদের সারা ভারতে মেরে শেষ করে ফেলছি আর তারা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু আপনাদের মত বিশ্বাসঘাতকদের জন্য তারা আজও টিকে আছে। যে আঘাত হানা শুরু হয়েছে তাতে আজ না হলেও কাল তাদের মার খাওয়া কুকুরের মত পালাতেই হবে। আমরা আপনাদের মত রাজার বিরুদ্ধে যদি অস্ত্র ধরি, এক সপ্তাহের মধ্যে কোন বিশ্বাসঘাতক রাজার অস্তিত্ব থাকবে না। আপনার সঙ্গে আমাদের লড়াই-এর ইচ্ছাই ছিল, কিন্তু আপনি নাকি আমাদের বিখ্যাত বিপ্লবী বিলেত হতে প্রত্যাগত আজিমুল্লার বন্ধু। তাই তাঁর অনুরোধে আপনি শেষ সুযোগ নিন। হয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন অথবা ভারতের জন্য যুদ্ধ করুন আপনার দুশমনের সাথে।” নানা সাহেব একটু হাসলেন এবং বললেন, ‘আপনাদের চেয়ে আমার ক্ষতি বেশি করেছে ইংরেজ। আমি ইংরেজদের সাথে যে দহরম মহরম করি তা আমার ছলনা মাত্র। জেনে রাখবেন, আজিমুল্লার আদেশ ও নিষেধের বাইরে আমি যাব না। তিনি আমার পরিচালক মনে করতে পারেন।’ শামসুদ্দিন এবং মুদ্দত আলী ছুটে এসে তার সাথে করমর্দন করলেন। তার পরের দিনই আজিমুল্লা খান দেখা করলেন নানার সঙ্গে। নানা বললেন, ‘আমি আপনার মতের বাইরে চলতে চাইনি।’ আজিমুন্না নানাকে এখন দুটি পরামর্শ দিলেন। একটি হচ্ছে, আজ হতে পূর্ণভাবে বিদ্রোহী দলে যোগদান। আর হিন্দু রাজাদের কাছে আপনার পক্ষ হতে বিদ্রোহী দলে সাহায্যের জন্য পত্র প্রেরণ। নানার কপালে অনেকগুলি রেখার সঞ্চালন হলো, পরক্ষণেই বললেন, ‘তবে তাই হোক। কিন্তু আমাদের বংশের সম্মানীয় পেশোয়া পদ বজায় রাখা হবে তো?’ আজিমুল্লা জানালেন, ‘নিশ্চয়ই। আপনি আজ হতেই পেশোয়া পদ পেয়েছেন, বলে মনে করুন। পদ দেবে কে? ইংরেজ? তাকেই তো হটাতে চাই আমি, আপনি সকলে।’ নানা সাহেব তাঁর সৈন্যদের জানিয়ে দিলেন, তিনি এখন বিদ্রোহীদের দলে অর্থাৎ আজিমুল্লার সঙ্গী। বিদ্রোহী সৈন্যরা নানার সৈন্যের নিকটবর্তী হলেন। নানার সৈন্য ধনাগারে প্রবেশ করতে দিলেন বিদ্রোহীদের, নানা সৈন্য জেলেরও ফটক খুলে দিলেন এবং সকলেই বিজয় উল্লাসে অর্থ আয়ত্তে মন দিলেন। সারা কানপুরে তোলপাড়। ইংরেজ অবাক! ভারতবাসী কত যেন বিশ্বাসঘাতক। তারা ইংরেজকে শোষণ, পীড়ন ও প্রভুত্ব প্রদর্শন করতে দেবে না। এটাই তাদের কাছে বিরাট অপরাধ।

পরের দিন দিল্লি যাওয়ার পালা। সমস্ত বিদ্রোহী দল, নানার সৈন্য ও অর্থসহ বাহাদুর শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আরও সাহায্য ও শক্তি নিয়ে আবার যোদ্ধাভিযান চালাবেন। নানা দিল্লি যেতে রাজি হলেন বটে, কিন্তু মন মোটেই মানে না। পরের দিন ক্লান্ত দেহে কানপুরে রাত কাটিয়ে সকালে নানা দিল্লি গেলেন না। অনেকে বোঝালেন কিন্তু তিনি অনেক কিছু চিন্তা করলেন। তার জীবনে বহু যুদ্ধ, আক্রমণ চক্রান্ত, যত কিছু হয়েছে তা ভারতবাসীর বিপক্ষে আর বেশির ভাগই ইংরেজের পক্ষে। সুতরাং বাহাদুর শাহ যদি ক্ষমা না করে শাস্তি দেন বা অবজ্ঞা করেন। যাইহোক, আজিমুল্লা খান ও নানা সাহেবের সাথে ঘুরে এলেন কারণ নানাকে চালনা করতেই তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল।

নানা ও আজিমুল্লা দুজনে এসেই বিপুল বিক্রমে আক্রমণের আয়োজন করলেন। ২৩ জুন মিঃ হুইলারের পুত্র লেফটেন্যান্ট হুইলার আহত হলেন। তারপর তাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে গোলা ছোড়া হল। পুত্রের মাথাটা বিচূর্ণ হয়ে গেল। হিলাসডনকেও শেষ করা হল। তার স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গিনী হলেন। কর্নেল স্টুয়ার্ড আহত হয়ে তিনদিন পর মারা গেলেন। ক্যাপটেন হ্যালিডে তাঁর স্ত্রীর জন্য একটু খাবারের সন্ধানে যাচ্ছিলেন। একটি নিখুঁত গুলি হ্যালিডের মাথা জড়িয়ে দেয়। নামী ও দামি লোকদের তো এমনি অবস্থা; তাছাড়া সাধারণ ইংরেজ সৈন্য যে কত মরছিল তার সঠিক হিসাব নেই। হুইলার মনের দুঃখ চিন্তায় একটা কূপ তৈরি করালেন তাতেই প্রত্যেকটি মৃত দেহকে ফেলে কূপটিকে একটা মহা কবরে পরিণত করা হয়েছিল। কানপুরের এমন অবস্থার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। খাবার শেষ তাই পথের কুকুর-বিড়াল ধরে তারই মাংস সুখাদ্যের মত গ্রহণযোগ্য হল ইংরেজদের। সবচেয়ে সমস্যা হল জলের। জল আনতে বাইরে গেলেই মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে লাগলো। যে যায় আর ফেরে না।

আজিমুল্লা হুইলারকে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব দিয়ে পত্র পাঠালেন। পত্রে জানানো হল, যদি তারা কামান গোলা ও অর্থাদি ছেড়ে দিতে রাজি হন তাহলে তাদের নিরাপদ স্থানে এলাহাবাদে পৌঁছে দেওয়া হবে। পত্রের শেষে আজিমুল্লার স্বাক্ষর। জেঃ হুইলার রেগে বললেন; নো, আই স্যাল নেভার সারেণ্ডার। কিন্তু ক্যাপটেন মুর অত্মসমর্পণ সমর্থন করে বললেন, উই কাট হোন্ড এনি লংগার, বেটার উই স্যারেণ্ডার। আত্মসমর্পণ করাই সাব্যস্ত হল। ২৭ জুন সতীচৌরা ঘাটে নানা সাহেব অনেক নৌকা প্রস্তুত রেখেছিলেন। প্রত্যেকের ওপর খড়ের চাল যাতে সাহেব মেমদের সূর্যের তাপ না লাগে। দলে দলে উঠতে লাগলো নৌকায় সাহেব মেমের দল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকা ছাড়বে কিন্তু নদীর দুই ধার হতে কামানের গোলা ছোড়া হতে লাগলো। খড়ের চাল আগে হতেই ছিল উপরে আগুন পাশে কামান বন্দুক আর নিচে নদীর জল উনচল্লিশটি নৌকা চূর্ণ হয়ে গেল আর শুধু একটি নৌকা বেঁচেছিল, যাতে আগুন লাগানো হয়নি তাতে ছিলেন মেজর ভাইরাট, ক্যাপটেন টমসন ও মিঃ মুর আর তাদের সঙ্গীরা। ভাঙা নৌকাগুলো ভাসতে ভাসতে গিয়ে এক জায়গায় আটকে যায়। কয়েকজন আহত হয়ে বেঁচে ছিল তখনো। তারা একটি মন্দিরে আশ্রয় নেয়। নানা সংবাদ পেয়ে নির্দেশ দিলেন তাদের মেরে ফেরতে। তাদের তাড়া করা হয় এবং পেছন হতে গুলি করা হয়। প্রায় সবই প্রাণ হারায় কিন্তু দু-একজন যারা তার মধ্যেও বেঁচে ছিল।

তারা অযোধ্যার রাজা দিগিজয়ীর বাড়িতে আশ্রয় পায়। কলকাতায় মিঃ ক্যানিং খুব চিন্তিত হয়ে বিখ্যাত বীর শ্রীরাম-লুরের পাক্কা পাদ্রী মাসমানেব জামাতা হেনরী হ্যাভলককে কানপুর উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দেন। আজিমুল্লা খান ও নানা হ্যাভলক আসার সংবাদ পেলেন এবং ঠিক করলেন ঘরে বন্দি ইংরেজদের সব শেষ করা হবে তাদের আসার আগেই। তাই করা হল, তরবারি দিয়ে প্রত্যেককে হত্যা করা হয় এবং তাদের মৃতদেহ গর্তের মধ্যে দিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

হ্যাডলকের সঙ্গে আছে ইংরেজ সৈন্য আর শিখ সৈন্য। শিখরা একবার মাত্র বিদ্রোহ করে পরে বুঝে দেখেছে সারা জীবন তারা ইংরেজের তাবেদারি করে এসেছে শেষ সময়ে বিদ্রোহ করে বিশ্বাসঘাতক নাম না নিয়ে বরং ইংরেজকে সন্তুষ্ট রেখে বিপ্লবের শেষে বড় পুরস্কারকে হাত ছাড়া করে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই আবার শিখ সৈন্য আর ইংরেজ সৈন্য যেন মার পেটের ভায়ের মত মিলে গেল।

হ্যাডলক বিপুল আয়োজনে ইংরেজ ও শিখ সৈন্য পাঠালেন ফতেপুরে। সেখানে নানাও অকুতোসাহসে বিপ্লবীদের নিয়ে এগিয়ে চললেন। নানার সঙ্গে আছে দেড় হাজার সৈন্য ও দেড় হাজার বিপ্লবী জনসাধারণ। মারাত্মক যুদ্ধ হল। নানার মরণের ভয় নেই। যুদ্ধে নানা জয় লাভ করলেন। শেষে অজস্র কামান, আমদানি করলো ইংরেজরা। এইবার নানার সৈন্য ও বিপ্লবীরা গোলার আঘাতে টিকতে পারলেন না। অবশেষে নানা ও আজিমুল্লাকে পরাজয়ই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু বীরত্বের বিচারে নানা যা করেছেন তাতে ইংরেজরা নিজেরাই উপলব্ধি করেছে যদি বিপক্ষগণ সমান সৈন্য সামান অস্ত্র নিয়ে লড়তে পেত তাহলে এক সপ্তাহেই সারা ভারত হতে ইংরেজকে বিতাড়িত হতে হত। নানা সাহেবের বীরত্ব প্রদর্শনে ফতেপুর পঁয়ত্রিশ দিন নানা ও আজিমুল্লার হাতে ছিল।

কানপুরের দুদল মুসলমান বিপ্লবী কিছুদিন আগেই ফতেপুর পৌঁছেছিলেন। তাদের সঙ্গে দেশীয় বিদ্রোহী ও সৈন্য মিলে ইংরেজ নিধন যেভাবে চালানো হয়েছিল এবং ধনাগার, কোর্ট কাছারি, জেলখানা যেভাবে দখল করা হয়েছিল তার প্রতিশোধে তোপের মুখে ঘরবাড়ি পর্যন্ত ধ্বংস করতে ইংরেজের বিলম্ব হয়নি। আর শিখ সৈন্য ইংরেজের আদেশে প্রতি বাড়িতে ঢুকে যেভাবে লুণ্ঠন ও পৈশাচিক কর্ম করেছ তাতে তেমন কেউ অবাক হয়নি। কারণ সারা জীবনে তারা শিখদের যা দেখেছে এটা তার পুনরাবৃত্তিই মাত্র।

হ্যাভলক কানপুরে বিপুলসংখ্যক শিখ সৈন্য ও ইংরেজ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। নানাও নির্ভয়ে ১৬ জুলাই সৈন্য ও বিপ্লবী প্রায় পাঁচ হাজার আর সাতটি কামান নিয়ে রওনা হলেন। নানা, আজিমুল্লা ও মাওলানা লিয়াকত আলীকে বললেন, যদি শিখ সৈন্য আর ভারতীয় হিন্দু রাজাদের সৈন্য সাহেবরা না পেত তাহলে দেখিয়ে দিতাম যুদ্ধ কাকে বলে। নানা আড়াই ঘণ্টা ধরে সম্মুখসমরে লড়লেন। অবশেষে নিজের সৈন্যদের জানিয়ে দিলেন যদি পরাজিত হও তাহলে পলায়ণের পূর্বে আমাদের বারুদে আগুন লাগিয়ে দিও, যেন আমাদেরই বারুদে আমার দেশবাসীকে মারতে না পারে। শেষে তাই হল সৈন্যরা বারুদে আগুন দিয়ে সরে পড়লেন। নানাও সরে গেলেন।

নানাকে জীবন্ত ও মৃত অবস্থায় ইংরেজরা পেলে পৈশাচিক আনন্দ পেত বেশি কিন্তু নানা চিরদিনের মত নিখোঁজ হলেন। ভারতের জন্য তাঁর উৎসর্গ ভারতবাসীর জীবনে নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক গর্ব। কিন্তু ইতিহাসে তাঁর নাম যদিও আছে কিন্তু আজিমুল্লা, লিয়াকত আলী, সামসুদ্দিন, মুদ্দত আলীর নাম নানার সমপর্যায়েও স্থানে পায়নি। তার কারণ অবশ্য উহ্য।

তিনজন বড় কর্তা মিঃ নীল, হ্যাভলক ও আউট্রাম একসঙ্গে লাক্ষ্ণৌ দখলের জন্য গেলেন, সঙ্গে সেই শিখ সৈন্যের সারী আর ইংরেজ সৈন্য। একজন বিদ্রোহী বহুদূর হতে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করলেন। নাম তার আবদুল জাব্বার। অব্যর্থ লক্ষ্য গুলি মিঃ নীলের মাথা ভেদ করল। ঘোড়া হতে সেই যে গড়িয়ে পড়লেন আর কোন কথা তিনি বলতে পারেননি। অবশ্য ইংরেজরা নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নিল। বিপ্লবীরা পতাকা নামিয়ে দিয়ে নিজেদের পতাকা তুললো। বিঠুরের রাজার তৎপরতায় নানার রাজবাড়ি আক্রমণ করা হল। কিন্তু বন্ধু আজিমুল্লার সুনিপুণ সম্পাদনায় কোন ছেলেমেয়ে, অলঙ্কার বা টাকাকড়ি ঘরে ছিল না। ঘর খালি। কিছু বই আর সামান্য বিছানা ইত্যাদি মাত্র। হ্যাডলক নানার প্রসাদ ধ্বংস করলেন (দ্রঃ কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস পৃঃ ২০১)

এমনিভাবে লাহোরে বিদ্রোহের পূর্বাভাস ইংরেজ জানতে পারে। হিন্দু-মুসলমানের গোপন ষড়যন্ত্র যিনি ফাস করেছিলেন তিনি হলেন ইংরেজের বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ গুপ্তচর নাম দৌবে। শ্ৰীমনি বাগচির লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে এ উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করা যায়।-

“দৌবে জাতিতে ব্রাক্ষণ। অযোধ্যার লোক.......তাকে গোয়েন্দা নিযুক্ত করলো। প্রভুভক্তির বশম্বদ অযোধ্যাবাসী সেই ব্রাহ্মণ সুচারুরূপে তার কর্তব্য সাধন করলো। ........তাদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব কতখানি বুঝলে? জিজ্ঞাসা করলেন ক্যাপটেন লরেন্স। ব্রাহ্মণ তার গলা পর্যন্ত হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে এতখানি।”

৪ জুলাই হেনরী লরেন্সের মৃত্যু হয়। কলকাতায় মিঃ ক্যানিং তাঁর ও হুইলারের মৃত্যু সংবাদের সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন। শুধু পুরুষরাই পৌঁরুষ দেখিয়েছেন বিপ্লব করে তাই নয়, নারীদেরও ভূমিকা ছিল। অযোধ্যায় নবাব ওয়াজেদ আলী যখন কলকাতায় বন্দি তখন তার বেগম হজরত মহল নিজেই বিদ্রোহের বা বিপ্লবের সাথে যুক্ত ছিলেন। জুলাই মাসে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দিল্লির বাহাদুর শাহকে এই সংবাদ দিয়ে পাঠান। সম্রাটের স্ত্রী জিন্নত মহল তাকে পত্র মারফত ধন্যবাদ জানিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কিন্তু চারদিকেই ইংরেজরা ভারতীয় শিখ সৈন্য মারাঠা, রাজপুত ও হিন্দু রাজামহারাজাদের সাহায্যে আবার যেন মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়াতে সক্ষম হচ্ছিল। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ পুরুষের পোশাকে বিপ্লবীদের সাথে যোগ দিয়ে ঝাসি রক্ষার চেষ্টা করলেন। বীর তাতীয়াতোপীও তার সৈন্য সমর্থকদের নিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিলেন। বিপুল বিক্রমে তারা যুদ্ধ করলেন কিন্তু স্যার হিউবোজ কাপুরুষের মত পেছন হতে আক্রমণ করে তাদের অগ্রগতির রোধ করেন। তাঁতিয়াতোপী ও রানী গোয়ালিয়ার পলায়ন করেন। ওখানকার রাজা সিন্ধিয়া বিশ্বাসঘাতক ইংরেজদের পক্ষের দালালিতে ওস্তাদ ছিলেন। রানী এবং তাঁতীয়াভোপী সিন্ধিয়াকে আক্রমণ করেন। তার পূর্বেই ফকিরদল বা মৌলবিদের জনমত তৈরি করার কাজ সমাধা করে রেখেছিলেন। তাই রাজার সমস্ত লোকজন সিন্ধিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে বিপ্লবীদের সমর্থন করে। রাজাকে তাড়া করে হত্যা করতে চাইলে তিনি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হন। এখানে কার্ল মার্কসের আর একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি-“২ জুন নবীন সিন্ধিয়া (ইংরেজদের পোষা কুকুর) কঠিন লড়াইয়ের পর নিজের সৈন্যদল কর্তৃক গোয়ালিয়র থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রাণভয়ে পালালেন আগ্রায়; গোয়ালিয়র যাত্রা করলেন রোজ; বিদ্রোহীদের পরিচালনা করে ঝাঁসির রানী এবং তাঁতীয়াতোপী তাঁর সঙ্গে-” (দ্রঃ কার্ল মার্কস্ ফ্রেডারিক এঙ্গেলস্ পৃঃ ২০৫)।

তাঁতীয়াতোপী ছিলেন রাজা নানার খুল্লতাত ভ্রাতা। তিনি কল্পি হতে এসে ১ এপ্রিল যুদ্ধ করলেন বটে কিন্তু পরাজিত হন। কালমার্কসের মতে, “১৮৫৯-এয় গোড়ার দিকে তাঁস লুকিয়ে থাকার স্থান (এক ভারতীয় বিশ্বাঘাতক মান সিংহের সংবাদ জানিয়ে দেওয়ার কালে) ধরা পড়ে গেল তার বিচার এবং প্রাণদণ্ড হয়।” বিচারের নামে অবিচার করা হয় মাত্র। আসল তথ্য এই যে ১৮৫৯ সালের ৭ এপ্রিল তাতিয়া ধরা পড়েন। ৮ তার সামরিক আদালতে বিচার হয়। তিনটি অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়-(ক) ইংরেজের ওপর আনুগত্যের অভাব (খ) বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা (গ) নিরপরাধ ইংরেজ নারী ও শিশুদের হত্যা করা। তাঁতিয়া প্রতিবাদমূলক উত্তর দিয়েছিলেন তাই শেষের অভিযোগ বাতিল হয়। আর দুটি অভিযোগের কারণে ইংরেজের আইনে তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। তাতিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, “যারা আমার বিচার করছেন তাদেরও প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত তাদের বিরুদ্ধেও ভারতবাসী অভিযোগ করতে পারে; পর রাজ্য গ্রাসের অভিযোগ, কুশাসনের অভিযোগ, প্রজার সম্পত্তি লুণ্ঠনের অভিযোগ ও ভারতবাসীকে হত্যা করার অভিযোগ। আমি যা কিছু করেছি আমার নেতা নানার আদেশে করেছি। নরহত্যা আমি করি, তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। মৃত্যুদণ্ড নিতেও আমি প্রস্তুত আছি, তবে তোপের মুখে আমাকে মারতে অনুরোধ করি। সত্যিই অমুসলমানদের মধ্যে দেশের জন্য নানা,তাঁতীয়া ও ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ-এর প্রাণ বলিদানকে অস্বীকার করলে সত্যকে অস্বীকার করা হয়।

ঝাঁসির রানীর কথাও ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। কিন্তু যিনি রানীকে সাহস দিয়েছিলেন এবং নিজে প্রাণ দেয়ার ভরসা দিয়েছেলেন, যিনি বিপ্লবী পার্টিতে যোগাযোগ করে মৌলবী বা ফকির বাহিনীকে ঝাঁসিতে আনিয়ে ছিলেন, যিনি রানীর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন সেই বিখ্যাত লৌহ মানব পাঠান বীর গউস খাঁর নাম আমরা ভুলে গেছি। ঐতিহাসিক মেলিসনের মতে, রানীর সৈন্য ছিল ১১ হাজার। কিন্তু এ কথা যথার্থ নয় যে সৈন্য অল্প ছিল। যারা সৈন্যের মত যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিলেন তারা আন্দোলনের সেচ্ছাসেবক বিপ্লবী ফকিরদের দল এবং হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ তাদের হৃদয়ে ছিল দেশপ্রেম ও বাহুতে ছিল ইস্পাতকঠিন শক্তি। কিন্তু উপযুক্ত অস্ত্র তাদের ছিল না। যুদ্ধের আবহাওয়া যখন রানীর প্রতিকূলে বইছিল তখন গউস খাঁ একটা কামান নিয়ে যেভাবে ইংরেজ সৈন্যকে ঘায়েল করেছিলেন, তাতে যুদ্ধের গতি আবার উল্টাদিকে ফিরে যায় এবং গউস খাঁর বীরত্বময় বাহাদুরিতে ১৩ দিন পর্যন্ত যুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আজ অজ্ঞাত, অপ্রকাশিত ও উপেক্ষিত কেন জানি না। শ্রী বাগচী মহাশয় ও তার ইতিহাসে এই গউস খাঁর মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন, অন্য দিকে সশস্ত্র ফকির নিশান হাতে নিয়ে রানীর জয়ধ্বনি করতে লাগলো। হর্ষধ্বনি ও তোপের শব্দে ঝাঁসির দুর্গ প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। ঘাউশ খাঁ ছিসেন রানীর প্রধান গোলন্দাজ। এই দিন ঘাউশ খাঁ দক্ষিণ দিকের বুরুজ থেকে এমন তীব্রভাবে গোলা বৃষ্টি করলেন যে, তাতে ইংরেজ পক্ষে তোপ বন্ধ হয়ে গেল।” ঐ ঘাউশ খাঁ-ই আসলে গউস খাঁ। (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস 'দ্রঃ)

বিহারেও বিদ্রোহী ও বিপ্লবীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকায় মুসলমান ও মাওলানা বা ফকিরদের প্রাধান্য ছিল। অযোধ্যা ইংরেজ অধিকৃত হওয়ায় বিপ্লবীরা ঘর-সংসার নিয়ে পাটনায় পালিয়ে যান। ওখান হতে দানাপুর, পাটনা, গয়া, ছাপরা, সারণ, আরা, মজফরপুর ও মতিহারী সব জায়গায় মুসলমান ফকির ও মৌলবির দল বিদ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে তুললেন। বিশেষ করে ঐ সময় তিনজন আলেম ইংরেজ সরকারকে তথা মিঃ টেলর সাহেবকে ভাবিয়ে তুললেন। তারা হচ্ছেন মাওলানা আহমাদুল্লা, মাওলানা ওয়াজউল হক আর একজন শাহ মহম্মদ হসেন। এঁদের প্রত্যেকের হাজার হাজার শিষ্য ও সমর্থক ছিল। তারা প্রকাশ্যে বক্তৃতা করতেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ফলে মিঃ টেলর জনতার মাঝে এ্যারেষ্ট করতে সাহস করতে পেলেন না। শেষে তাদের আমন্ত্রণ জানালেন নিজের বাসায়। উদ্দেশ্য বিদ্রোহ সম্বন্ধে আলোচনা করা। অসম্ভব সাহসী তিনজন আলেমই টেলরের বাসায় এলেন। টেলর পূর্ব প্রস্তুতির পরিপ্রেক্ষিতে সৈন্য দিয়ে বন্দি করে তাঁদের সার্কিট হাউসে পাঠালেন।

এই বিশ্বাসঘাতক শাসক ইংরেজের সহজসুলভ স্বভাব হলেও ইংরেজ ঐতিহাসিক ফরবেস-মিচেল পর্যন্ত নিন্দা করে লিখেছেন, “সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের বন্ধু ভাবে আমন্ত্রণ করে যে ঐ রকম ব্যবহার করতে পারে তাকে বিশ্বাসঘাতকের মত না বলে পূর্ণ বিশ্বাসঘাতক বলাই ভাল। (দ্রঃ সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস, ২৮৩ পৃঃ)

মাওলানাদের বন্দি করার পর বিদ্রোহের আগুন আরও তীব্রতর হয়ে উঠলো। বিদ্রোহীরা প্রায় শতকরা সারে নিরানব্বই ভাগ মুসলমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইংরেজরা ওহাবীরা আসলে ‘মুসলমান নয়’ বলে অপপ্রচারের চেষ্টা করল কিন্তু বিফল হল তাদের কুৎসিত মতলব। এই সম্বন্ধে শ্রীবাগচী মহাশয়ের একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে-“মৌলবিদের গ্রেফতারে শহরে শান্তি স্থাপিত হলো না। পাটনায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। বিদ্রোহীদের বেশির ভাগই ওহাবী মুসলমান। মৌলবিদের আটকের পর পাটনা অধীবাসীদের নিরস্ত করার চেষ্টা করা হয়। এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অনেকেই অস্ত্রশস্ত্র গোপন করে ফেললো। ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতা ধর্মোন্মত্ত মুসলমানদের মনে তুমুল উত্তেজনার সঞ্চার করলো। ৩ জুলাই সন্ধ্যাবেলায় মুসলমান বিদ্রোহীরা দীন ইসলাম জিন্দাবাদ, আল্লাহু আকবার আওয়াজে আকাশ-বাতাস কম্পিত করে পতাকা উড়িয়ে যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়ে জনসাধরণকে জিহাদের দিকে আহ্বান করতে লাগলেন। তখন মিঃ টেলর তাঁদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত একদল শিখ সৈন্য নিয়ে বিপ্লবীদের আক্রমণ করলেন। বহু বিপ্লবী শহীদ হলেন। ইংরেজদেরও অনেক আহত-নিহত হলো, বিদ্রোহীদের গুলিতে একজন ইংরেজ ডাক্তারেও মৃত্যু হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম। (সি.যু. ই)

পাটনায় বিপ্লবীদের নেতা ছিলেন পীর আলী। তিনি পীর ছিলেন না তবে তার নামই ছিল ঐ। ইংরেজদের ধারণা হয়েছিল ঐ লোকটির দ্বারাই পাটনা শহর শুধু নয় গোটা বিহারে বিপ্লবের দাবানল জ্বলে উঠেছে। তাই তাঁকে প্রকাশ্যে ২৩ জুলাই ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। জনতার মধ্যে বীর বিপ্লবী ধীরস্থিরভাবে ইংরেজ কর্তাদের বললেন -“ওহে বেইমান ইংরেজ শোষকেরা, তোমরা আমার ফাঁসী দিতে পার কিন্তু আমার মত হাজার হাজার পীর আলী আরও তৈরি আছে যারা আমার পরে আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমাদের শায়েস্তা করবে।” পীর আলী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হয়তো। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর ফাঁসির হুকুম দেওয়া হয়। হাসিমুখে ফাঁসি কাষ্ঠে মৃত্যুবরণ করে অমর বিপ্লবী হাজার হাজার ভারতবাসীর সামনে এক অক্ষয় আদর্শ স্থাপন করে গেলেন। এই দৃশ্যে বিপ্লবীদের বা বিদ্রোহীদের ভয় হওয়ার পরিবর্তে দ্বিগুণ শক্তিতে সাহসী হয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চললো।

দানাপুরে ২৪ জুলাই শহীদ পীর আলীর মৃত্যুদণ্ডের কথা এসে পৌঁছাতেই দানাপুরের সেনা নিবাসের ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দু সৈন্য উত্তেজিত হয়ে ইংরেজদের ওপর তীব্র আক্রমণ করার জন্য রাতেই শাহাবাদ জেলার আরাতে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে কুমার সিংহ নামে এক বৃদ্ধ বিপ্লবীদের দলে যোগ দিলেন। তিনিও একজন রাজা বা জমিদার ছিলেন। সারা জীবন তিনি ইংরেজের তোষণ পোষণ করেই আসছিলেন। ইংরেজদের তিনি বন্ধুই মনে করতেন। সুতরাং ইংরেজের শত্রুদের তিনি শক্তই মনে করতেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার কুমার সিংহকে ছলে বলে কলে কৌশলে তাকে এমন ফাঁদে ফেলেছেন, যাতে তাঁদের কাছে বিশ লাখ টাকা ঋণ করতে হয়। হঠাৎ তার ওপর আদেশ হয়, এক মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে তাঁকে জমিদারি হতে বঞ্চিত করা হবে। সেই বাজারে কুড়ি লাখ টাকা সংগ্রহ তিনি করতে পারলেন না। তবে মাত্র আর কয়েকদিন সময় দিলেই তিনি তা পরিশোধ করতে ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে সে সময় না দিয়ে বরং জমিদারি হতে বঞ্চিত করা হয়। তখন শোকে-দুঃখে ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতার তিনি সীমাতিরিক্ত বিদ্রোহী হতে চাইলেন। সেই সময়ে তাঁর পুত্রের মৃত্যু হয়। তাই তিনিও মরার জন্য প্রস্তুত হলেন। ঠিক সেই সময়েই চলছিল সাতান্নর বিপ্লব। তাই তিনি বীরের মত মরার জন্য বিদ্রোহী দলে মিশে পড়লেন। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে, ঠিক এই সময়ে রাজা নানা সাহেবের পত্র এসে তার উৎসাকে আরও বৃদ্ধি করে। তাই এখানে নানার পত্র আর আজিমুল্লার সংগঠন ক্ষমতা স্মরণ রাখার মত ঐতিহাসিক সম্ভার। কুমার সিংহ ছিলেন রাণাপ্রতাপ সিংহের বংশধর।

৩০ জুলাই মিঃ ভিনসেন্ট আয়ার একদল ইংরেজ ও শিখ সৈন্য নিয়ে দানাপুরে আসেন। বিদ্রোহীদের হাতে বন্দুক, বর্শা বা তরবারী, শাসকদের হাতে বড় বড় কামান। তাই ২ আগষ্ট তুমুল যুদ্ধে কুমার সিংহ ও বিপ্লবীদের দল ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়। ইংরেজরা মুসলমানদের আগে হতেই জানে যে, মুসলমান জাতি সারা ভারতে তাদের শত্রুতা করেছে। অতএব তারা তাদের চিরশত্রু কিন্তু যে কুমার সিং চিরদিন তাদের সঙ্গে এত দহরম মহরম রেখে এ সে এত বড় বেইমান বা বিশ্বাসঘাতক হয়ে বিদ্রোহী দলে কেন যোগ দিয়েছে। অতএব তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার।

জগদীশপুরে কুমার সিংহের বাড়ি ও তার ভাই দয়াল সিংহ এবং অমর সিংহের বাড়ি আক্রমণ করা হয়। তারা নানা সাহেবের মত আগে হতেই মেয়েছেলে সরিয়ে ফেলেছিলেন। ইংরেজরা রাজপুতদের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত ধ্বংস করেছিল। এ প্রসঙ্গে একটা উদ্ধৃতি খুবই প্রণিধানযোগ্য-“পবিত্র দেবালয় ইংরেজদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেল না। কুমার সিংহ বহু অর্থ ব্যয়ে একটি দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইংরেজ সেনাপতি তা বিনষ্ট করে ফেললেন। প্রতিষ্ঠিত দেবমূর্তির সঙ্গে মন্দিরটি ধ্বংস হওয়াতে বৃদ্ধ রাজপুতের প্রাণে মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিল।” (দ্রঃ সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস, পৃঃ ২৯১)। যুদ্ধ করতে গিয়ে কুমার সিংহের একটি হাত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জগদীশপুরের যুদ্ধে মিঃ লেগ্রাণ্ড রাজপুত ও বিল্পবীদের প্রচণ্ড আক্রমণে নিহত হলেন। উভয় পক্ষের অনেক হতাহত হয়। কুমার সিংহ আহত হয়ে আর সেরে উঠলেন না। চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হলেন। তাঁর মৃত্যু ভারতের নরনারীর কাছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

অবশ্য ইতিহাসে কুমার সিংহের নাম স্থান পেয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরও যাঁদের অনেক বেশি ঐতিহাসিক অবদান যেমন মাওলানা শাহ মুহাম্মদ হুসেন, মাওলানা আহমাদুল্লাহ, ওয়াজহুল হক এবং পীর আলীর কথা সহজ সাধারণ ইতিহাসে ঠাই পায়নি। তার বড় কারণ কী জানি না, তবে অনেকে অনুমান করেন ভারতের জন্য ঐ সমস্ত প্রাণদাতা শহীদদের বড় অপরাধ ছিল তারা মুসলমান।

একটি নম্র মেজাজের মৌলবি সাহেব পলাতক বিদ্রোহীদের মধ্যে অন্যতম। তিনিও অনেকের মত বেগম কুটিতে বাস করছিলেন। তিনি নামাজ পড়তেন তার প্রার্থনায় প্রায় কাঁদতেন। লোকে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী কিন্তু এখন আল্লাহর কাছে চাই দিল্লির বুকে সম্রাটের বাচ্চাদের হত্যাকারী হডসনকে যেন আমি আমার বন্দুকে গুলি করতে পারি।

১০ মার্চ যেদিন পিশাচ মিঃ হডসন বেগমকুঠি আক্রমণ করেন তখন ঐ মাওলানা সাহেব হডসনের মস্তক লক্ষ করে গুলি করলেন। হডসন মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ঐ মৌলবি সাহেবের নাম সঠিকভাবে রিপোর্টে না পাওয়ার জন্য এখানে জানানো সম্ভব হলো না। কার্লমার্কস, মিঃ হান্টার প্রমুখ খ্রীষ্টানের পুস্তকেও অনেক মাওলানার নামের ইঙ্গিতও উল্লেখ আছে। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের পেছনে পেছনে এতবড় স্বর্ণোজ্জ্বল ঐতিহাসিক উপাদনে আছে, যার দ্বারা পৃথক পৃথক পুস্তক হওয়া সম্ভব। সে বিষয়ে আজকের এবং আগামী কালের অনুসন্ধিৎসু লেখক-লেখিকার প্রতি দ্বায়ীত্ব নেওয়ার প্রতি আশা রাখি। যেমন মাওলানা আহমাদুল্লাহ। সাতান্নর বিপ্লবে তাঁর নেতৃত্ব এক প্রাণবন্ত ভূমিকা, যার কাটা মাথার জন্য সহস্র সহস্র টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। মুসলমানদের এক প্রতিদ্বন্দ্বী এক ইংরেজের লেখার দু-একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “ইংরেজদের প্রতি মৌলবি আহমাদুল্লার যেমন বিদ্বেষ ভাব ছিল; ইংরেজের ক্ষমতা নাশে তিনি তেমনি বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। ধর্মের নামে তিনি উত্তেজিত সিপাহিদের আরও উত্তেজিত করে তুলে ছিলেন। মুসলমানগণ তাঁর উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা শুনে স্বধর্ম রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গে কাতর হননাই। কথিত আছে তাহার হাতে একটি কোরআন থাকিত। তিনি যুদ্ধস্থলে এই কোরআন হস্তে নিয়ে সিপাহিদের উত্তেজিত করে তুলিতেন।” (দ্রঃ My Diary in India, by russell)

ঐ মৌলবির সাথে মিলে ছিলেন লস্কর শাহ নামে এক ফকির। এই দুজনের থেকে বিদ্রোহীরা সাহস ও বল দুইই পেয়েছিল। ইংরেজ সৈন্য ২১ মার্চ মৌলবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে।

তিনি তখন সাদতগঞ্জে প্রতিপক্ষের সামনে মৌলবি সাহেব এমন দৃঢ়তা ও সাহস প্রদর্শন করেন যে, সেনানায়ক লুগার্ড তাতে অতিমাত্রায় বিস্মিত হন। ইংরেজের প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে তার দলের অনেক সৈন্য নিহত ও অনেকে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অবশেষে মৌলবির দল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইংরেজ সৈন্য এদের পিছু তাড়া করে। মৌলবি স্বয়ং অক্ষত শরীরে প্রস্থান করেন। বহু সৈন্য নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন প্রধান সেনাপতি (ইংরেজ)। মোহমদীর দুর্গ ধ্বংস করে মৌলবি আবার এলেন শাহজাহানপুরে। সমগ্র নগর মৌলবির পদানত হলো। তারপর ১৮টি কামান যথাস্থানে সন্নিবেশিত করে ৩ থেকে ১১ মে তিনি প্রতিপক্ষের দিকে তীব্রভাবে গোলা বৃষ্টি করতে থাকেন। শাহজাহানপুরের ইংরেজ সৈন্যের অধিনায়ক তখন জেলখানায় আত্মরক্ষা করছেন। সংবাদ পেয়ে অবরুদ্ধ সেনানায়কের সাহায্যের জন্য সৈন্য পাঠালেন প্রধান সেনাপতি। তবু মৌলবির পরাজয় সুসাধ্য হলো না। অশ্বারোহী সৈন্যে তিনি অধিক বলসম্পন্ন ছিলেন।....... পানাহাটের রণক্ষেত্রে কোন পক্ষেরই জয়-পরাজয় স্থির হলো না। অবশেষে জুন মাসের প্রথম ভাগে পোয়াইনের রাজা জগন্নাথ সিংহের ভায়ের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ইংরেজের মহাত্রাস এই মৌলবির মৃত্যু হয়। গভর্ণমেন্ট সেই সময়ে এই বিদ্রোহীর মাথার দাম ধার্য করে ছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। বিশ্বাসঘাতক রাজা মৌলবির ছিন্ন মস্তকের বিনিময়ে শাহজাহানপুরের মাজিষ্ট্রেটের কাছ থেকে এই পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ফৈজাবাদের মৌলবী আহমদউল্লার মৃত্যু হলো। তার বীরত্ব ও স্বদেশপ্রেমের প্রশংসা ইতিহাসে পূর্ণ মাত্রায় অথবা অর্ধ মাত্রায় তো দূরের কথা একেবারে নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না।

ভারতের উত্তর প্রদেশে রোহিলাখণ্ড বলে এক জায়গা আছে, যার মধ্যে একটি বড় শহরের নাম হচ্ছে বেরেলী। ইংরেজরা যখন রোহিলাখণ্ড দখল করে তখন মুসলমান পাঠানদের পুরুষদের ওপরই শুধু অত্যাচার করেনি, নারীদের ওপরও হস্তক্ষেপ করেছিল। তাই কোনদিন সে কথা পাঠানরা ভোলেনি। হাফেজ রহমত সাহেবের নেতৃত্বে একবার রোহিলাখণ্ড মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিল কিন্তু ইংরেজদের শোষণ আর পোষণের ঠাঁড়াশিতে ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দের কাত্রার যুদ্ধে বিপ্লবী হাফেজ রহমতকে শহীদ হতে হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে আর একবার রোহিলারা বিদ্রোহী হয়ে বিপ্লব সৃষ্টি করে। কিন্তু ইংরেজদের নিষ্ঠুর অত্যাচার ঐ অভ্যুত্থানকে দমন করতে সক্ষম হয়।

আবার ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩১ মে রবিবার সেই শহীদ হাফেজ রহমতের বংশধর খাঁ বাহাদুর খাঁ নামক নেতার নেতৃত্বে সারা দেশকে কঠিন একতার বন্ধনে বেঁধে শুধু বিদ্রোহই করা হয়নি বরং ইংরেজ রাজত্বকে অস্বীকার করে নিজেদের শাসনতন্ত্র চালু করা হয়। রোহিলায় যদিও সব মুসলমান, তবুও সেখানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মোটামুটি হিন্দু। তাই তারা সংখ্যায় অল্প হলেও প্রভাবশালী ছিলেন। ঐ রহিলার মুসলমান ও হিন্দু সকলের নির্বাচিত ও সমর্থিত নতুন শাসনকর্তা ঘোষিত হলেন খাঁ বাহাদুর খাঁ। খাঁ সাহেবের নির্দেশে ইংরেজদের বাংলোগুলোতে আগুন ধরানো হলো। কোন ইংরেজকে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করার পর্ব রীতিমত শুরু হয়ে গেল। সরকার অবাক হয়ে যায় রোহিলাদের পূর্ব পরিকল্পনার ব্যবস্থাপনা দেখে। খাঁ সাহেব প্রচুরসংখ্যক বন্দি ইংরেজের বিচার করে ফাঁসি দেন। মনে হলো ছয় ঘন্টার মধ্যেই ইংরেজ শাসন বিলুপ্ত হয়ে ভারতীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। মুসলমানী পতাকা উড়িয়ে আল্লাহু আকবার শব্দে প্রকাশ্যে বখত খাঁকে বিদ্রোহীরা সমস্ত সৈন্যের নায়ক নির্ধারণ করেন। এইবার দিল্লির বাহাদুর শাহকে পত্র লিখে জানালেন তিনি স্বাধীন হয়েছেন।

রোহিলাখণ্ডের সহিত মোরাদাবাদ, শাহজানপুর, বাদায়ুন প্রভৃতি স্থানেও বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠল। মোরাদাবাদ শহরের জর্জ ছিলেন মিঃ উইলসন। তাঁকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সিভিলিয়ান মিঃ উইলসন জনসাধারণকে বিদ্রোহের বিপক্ষে খুব বোঝাতে চেষ্টা করলেন কিন্তু একজন মুসলমান প্রাক্তন মুনসেফ সারা মোরাদাবাদে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর ভাব ভাষাও জনসাধারণকে ভীষণ উত্তেজিত করে তোলে। মুসলমান ও ইংরেজ প্রভাবের লড়ায়ে উইলসন পরাজিত হলেন। বাইরে হতে একটি গুপ্ত বিদ্রোহী দল আনিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি স্থানীয়দের ডাকলেন। তখন বাইরের ও ভেতরের দুই দল এক হয়ে ইংরেজের শক্ত শক্তিকে প্রকম্পিত করে তোলে। ঐ বিখ্যাত নেতার নাম নিজামাত উল্লাহ সাহেব। তিনিও বিখ্যাত বীর ও বক্তা ছিলেন। জেলখানার সমস্ত কয়েদিকে মুক্ত করে দিয়ে তাদেরও ইংরেজবিরোধী কাজে লাগিয়ে ছিলেন। তখন মৌলবি বা ফকির দলের যে পরিমাণ ত্যাগ বা অবদান ছিল তা আজ ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত। তাই শহীদ হাফেজ রহমত খাঁ, বাহাদুর খাঁ, নিজামাত উল্লাহ প্রমুখ প্রতিভা যারা আজ যুগে যুগে জীবন্ত হয়ে থাকার কথা তাদের আজ ইতিহাসের মানুষ বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন কিংবদন্তী বা কল্পনা মাত্র। এমনি ভাবে রাশিয়ার ঐতিহাসিকদের ইতিহাসে বিশেষত মিঃ কার্ল মার্কসের লেখাতেও যাদের নাম বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি তাদের সম্বন্ধেও আমরা আমাদের স্বদেশের ইতিহাসের কোন সন্ধান পাইনি। উদাহরণস্বরূপ মিঃ মার্কসের লেখা হতে কিঞ্চিৎ মাত্র উদ্ধৃতি দেওয়া হোল-“মামু খাঁ ১৮৫৭-৫৯ সালের জাতীয় মুক্তি অভুত্থানের সময় লক্ষ্ণৌ এলাকায় অযোধ্যা বিদ্রোহীদের দলপতি।” “মৌলভী আহমদ শাহ (১৮৫৮) ভারতীয় ১৮৫৭-৫৯ সালের জাতীয় মুক্তি অভ্যুত্থানের একজন বিশিষ্ট নেতা, জনস্বার্থের প্রবক্তা, অযোধ্যা বিদ্রোহে নেতৃত্ব করেন; লক্ষ্ণৌ রক্ষায় একনিষ্ঠ বীরের মত দাঁড়ান, বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নিহত হন ১৮৫৮ সালের জুনে।” (দ্রঃ কার্ল মার্কস ফ্রেডারিক এঙ্গেলস প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৮৫৭-১৮৫৯, পৃঃ ২৫৬)।

বেরিলীর ত্রিশ মাইল দূরে বদায়ূনের ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টর এডওয়ার্ডস সাহেব সংবাদ পেলেন “২৫ মে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে মুসলমানরা গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধাচরণে উদ্যত হবে। (সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃ ৩০৩, দ্রঃ)।

সংবাদ জানাজানি সত্ত্বেও ইংরেজরা রোধ করতে পারেনি সেই বিপ্লবের আকস্মিক আগ্নেয়গিরিকে। ইংরেজরা যেমন শিখ জাতিকে কলা-কৌশল ও লোভ দেখিয়ে স্বপক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছিল তেমনি হিন্দু জনসাধারণকেও বহু লোক মারফত এবং নিজেরা তাদের বাড়িতে গিয়ে বা কাউকে ডেকে এনে বুঝিয়ে প্রলোভন প্রদর্শন করে নিজ পক্ষে টানতে চাইলেন। ফলে হিন্দুরা দোটানা চিন্তায় পড়লেন। ঠিক সেই সময় খাঁ বাহাদুর খাঁ ইংরেজ ফিরিঙ্গিদের বিরুদ্ধে একটি লিখিত বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। সেটা ছিল এই রকম-“ফিরিঙ্গিরা যদি তোমাদের পুরস্কার দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাহাদের মতের পোষকতা করতে অনুরোধ করে, তাতে তোমরা বিশ্বাস করিও না। ফিরিঙ্গিরা অঙ্গীকার পালন করতে জানে না। তারা বিদেশী, তারা প্রতারক, তারা বিশ্বাসঘাতক। তাদের পরামর্শ শুনলে তোমাদের নিয়েই অনিষ্ট হবে।” (দ্রঃ সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃঃ ৩০৫)। এই ইস্তেহার প্রচারিত হওয়ার পরই হিন্দু জনতা ইংরেজ পক্ষ অবলম্বন করা হতে বিরত হয়। এবার বিপ্লবী মারাত্মকভাবে ইংরেজদের আক্রমণ করেন এবং জেলখানা ভেঙে বন্দিদের মুক্তি দেন, ট্রেজারি দখল করেন।

বিদ্রোহীরা এবং ইংরেজ ও শিখ সৈন্যের গুলিতে অনেকে প্রাণ ত্যাগ করলেন।

এমনিভাবে ফরাক্কা বাদেও ভারতের বিপ্লবীদের শহীদ হওয়ায় সংবাদ এসে পৌঁছালো। একজন বিখ্যাত নেতার নেতৃত্বে সারা অঞ্চল উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তাদের কিছু করার আগেই ইংরেজরা রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই বহু ভারতীয় মানুষকে নিহত করে নৌকাযোগে দুজন কর্নেল ও একজন মেজরের তত্ত্বাবধানে পলায়নের ব্যবস্থা করে। তখন ভাগিরথী নদীতে বান ছিল। হঠাৎ একটি নৌকা বিকল হয়ে যায়। ইংরেজরা তখন বুঝল তাদের ভাগ্যই এখন বক্র। তাই ঐ নৌকার আরোহীরা অন্য নৌকায় চড়ে ক্ষিপ্রগতিতে নৌকা চালনা করা হলো। কিন্তু বিপ্লবী নদীর নেতার নেতৃত্বে ভুল হয়নি। একদল বন্দুকধারী বিপ্লবী নদীর ধারে নৌকার পাশে এসে হাজির। সাহেবরা তাড়াতাড়ি নৌকা নদীর মাঝে দিয়ে চালানোর চেষ্টা করলো কিন্তু বিপ্লবীদের তিনশত বন্দুক বারুদের আঘাত হানল বজ্রাঘাতের মত। দলে দলে নদীতে ঝাপ দিয়ে কেউবা নৌকার উপরই প্রাণ ত্যাগ করে এবং কিছু বন্দি হতে বাধ্য হয়। বন্দিদেরও পরে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়।

এই বিদ্রোহের নায়ক আজ আমাদের কাছে এক অজানা মানুষ হলেও প্রকৃত ইতিহাসের পাতায় তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ও থাকবে চিরকালধরে। তিনি হচ্ছেন অধিনায়ক সুলতান খাঁ। সুলতান খাঁ ফরক্কাবাদের আর একজন বিচক্ষণ বিপ্লবী ব্যক্তি তাহফুজুল হোসেনকে ফরক্কার নবাব নির্ধারণ করেন। (দ্রঃ A History of the Sepoy war, by Kaye)

প্রধান, প্রধানতর আর প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি সম্বন্ধে এখনো তথ্য প্রকাশ করতে বাকি রয়েছে। স্থানগুলো যথাক্রমে আগ্রা, দিল্লি আর ভারতের রাজধানী কলকাতা। ১৫ মে সকালবেলায় মিঃ কলভিন সমস্ত সৈন্যকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে বক্তৃতা দিলেন আর ইংরেজ সৈন্যদের এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে বক্তৃতা দিলেন আর ইংরেজ সৈন্যদের বললেন, যেখানে যাইহোক আগ্রায় তা হবে না, কারণ আমরা ভারতীয় মুসলমান হিন্দু ও শিখ সৈন্যদের ভালবাসি আর সমস্ত সৈন্যও আমাদের ওপর ভরসা রাখে। কলভিনের বক্তৃতায় ভারতীয় সৈন্যরা কলভিনের দিকে এমনভাবে অগ্নিবর্ষক ভঙ্গিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, যাতে কলভিনের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, বিস্ফোরণে বিলম্ব নেই। পরক্ষণেই কলভিনের ইঙ্গিতে ইংরেজ নর-নারী দলে দলে দিল্লির দিকে ছুটল।

২ জুলাই নিমচ হতে বিদ্রোহী দল ফতেপুর সিক্রীতে উপস্থিত হলো। তাদের বাধা দেওয়ার জন্য কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্য পাঠানো হলো। সৈন্যরা হঠাৎ অফিসারদের গুলি করে বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়ে নিজের আসল রূপ ধারণ করেন। এই সংবাদে মিঃ কলভিন স্বয়ং দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ইংরেজরা ভয়ে ভীত হয়ে ভাবতে লাগলো সারা দেশ বুঝি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তখন ইংরেজদের পরম বন্ধু ভারতপুরের হিন্দু রাজা তিনশত অশ্বারোহী, কয়েকটি কামান এবং আরও কিছু সমরোপকরণ নিয়ে ইংরেজের পক্ষে যোগ দিলেন। শাহাগঞ্জে যুদ্ধ হল। সামনাসামনিভাবে এক দিকে আজাদী আন্দোলনের বিপ্লবী দল আর এক দিকে ইংরেজ শিখ, আর হিন্দু রাজার সশস্ত্র সৈন্য। যুদ্ধে বিদ্রোহী দল অসীম বিক্রমে যুদ্ধ করে অনেক আহত-নিহত হওয়ার পর জয়লাভ করলেন। ইংরেজরাও বহু আহত-নিহত হয়ে দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। অতঃপর বিদ্রোহীরা দিল্লির দিকে প্রস্থান করে। এই সময় মতি মসজিদকে ইংরেজরা সেদিন হাসপাতালে পরিণত করেছিল।” (দ্রঃ সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস, মনিবাগচি, পৃঃ ৩১১)

বিপ্লবীরা আগ্রায় চলে গেলেও ইংরেজদের আতঙ্ক কমেনি। মুসলমান অনেকের সেই সময় কাল পোশাক পরার প্রচলন ছিল। আর ঐ কাল পোশাক দেখলেই ইংরেজের হৃদয় ভয়ে শুকিয়ে যেত। উদ্ধৃতিতে দেখা যায়, “মুসলমানদের কাল রঙের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখলেই ইংরেজদের ভয় করত। বিদ্রোহের সময় কাল রঙের পরিচ্ছদ ইংরেজদের মনে বিভীষণ জাগিয়ে তুলেছিল” (দ্রঃ ঐ পুস্তক, পৃঃ ৩১১)

কলকাতার মিঃ ক্যানিং এই পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে ব্রিগেডিয়ার পলজোয়েলকে পদচ্যুত করে তার জায়গায় কর্ণেল কটনকে নিয়োগ করার ব্যবস্থা করলেন।

মোঘল আমল থেকে দিল্লি ভারতের রাজধানী ছিল। যদিও এখন কলকাতার গুরুত্ব বেশি তবুও দিল্লির পুরাতন ঐতিহ্য ঐতিহাসিক আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই। তাই সেনাপতি উইলসন দিল্লি উদ্ধারে উদগ্রীব হলেন। কিন্তু বিপ্লবীদের সঙ্গে সরকারি সৈন্যদের অবিরাম যুদ্ধের ফলে ইংরেজ সৈন্য ও শিখ সৈন্য সংখ্যায় খুবই কম হয়ে গেছে আর গোলা গুলি রসদ প্রায় শেষ হতে চলেছে। তারচেয়েও বড় জিনিস মনোবল ভেঙে গেছে। শুধু ক্ষীণ আশা হিন্দু রাজা মহারাজা, রাজপুত, মারাঠা প্রভৃতি ভারতবাসীরা যদি সকলেই শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী না হয়ে ইংরেজের পক্ষে যোগ দেন তাহলে হয়তো আবার শোষক সরকারের মনের কোণের ক্ষীণ কল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে। দিল্লিতে পাঁচজন সেনানায়ক উপস্থিত আছে মিঃ চেম্বারলেন, লিঃ নিকলসন, উইলসন, আলেকজাণ্ডার, টেলর, ও মিঃ রেয়ার্ড স্মিথ।

চল্লিশটি বলদে টানতে পারে এরকম দারুণ ভারী ভারী কামান, গোলা, বারুদ, সৈন্য নিয়ে রাতের অন্ধকারে দিল্লিকে সজ্জিত করা হল। ১৩ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা শুরু করল কামান হতে মুষলধারে গোলা বর্ষণ। চারদিকে আগুনের হালকা সাদা কারো ধূয়া বক্ৰশিখা আর বজ্র বর্ষণের মত শব্দেও বিপ্লবীরা সব যেন চুপচাপ। ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজেরা প্রস্তুত হয়ে নিল। সকালবেলায় ইংরেজ সৈন্যের বিপুল সমাবেশ দেখা গেল। তিন জাতীয় সৈন্য ইংরেজ আর শাসকপ্রিয় শিখ আর গুর্খা সৈন্য। নিকলসন একদল সৈন্য নিয়ে কাশ্মীর গেট দখল করলেন তারপর আর একদল সৈন্য দিল্লির কাবুল গেট দখল করলেন।

বিদ্রোহী সৈন্য ও বিপ্লবীদের নেতা ক্যাপটেন বখত খান ঠিক প্রতিক্ষীত সময়ে গোলাবর্ষণ করালেন তাঁর পূর্ব পরিকল্পিত ব্যবস্থায়। বিপ্লবীদের স্ত্রীরা ছাদে তুলে রাখা ইট ও পাথর বর্ষণ শুরু করলেন। ইংরেজ শিখ ও গুর্খা সৈন্যরা আকস্মিক আক্রমণে আহত আর নিহত হয়েছিল হাজারে হাজার। পাঁচজন নেতার দুইজন বেয়ার্ড স্মিথ ও চেম্বারলেন আহত হলেন। আর সত্তরজন বড় অফিসারকে প্রাণ হারাতে হলো সেই আক্রমণে। ছ'দিন ধরে যুদ্ধ চললো। ইংরেজরা হটাতে পারলো না ভারতীয় বীরদের। মাঝে মাঝে দীন ইসলাম জিন্দাবাদ, আল্লাহু আকবর শব্দে দিল্লি থরথর করে কাঁপতে লাগল।

মুসলমান নেতাদের অনেকের নামাজ পড়ার অবসর নেই শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। তাই ঐ রকম কর্মব্যস্ত নেতাদের মাথায় একটা মতলব এল, যদি প্রত্যেক দোকানে দামি দামি কড়া মদের সুদৃশ বোতল রাখা যায় তাহলে সৈন্যরা লুটপাট করার সময় ঐ মদ পান করবে আর নেশা অবস্থায় তাদের শিশু ঠেঙ্গানোর মত শায়েস্তা করা যেতে পারে। অনেকে আপত্তি করলেও তখন কিছুটা শৃঙ্খলার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এখানে বড় রকমের আরও দুটি ভূল হয়েছিল, প্রথমত - নিজেদের মধ্যে একতাবদ্ধ না হওয়া; দ্বিতীয়ত- মুসলমানদের মদ খাওয়াও যেমন অপরাধ অপরকে মদ খাওয়ানোও তেমনি অপরাধ। অথচ মদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। যাইহোক, ১৫ সেপ্টেম্বরের যুদ্ধে ইংরেজ যথাযথভাবে দোকান লুট করতে গিয়ে মদের মনোলোভা বোতল গ্রহণ করে এবং পান করে ফলে নেশাগ্রস্থ হয়ে সেনাপতিদের আদেশ যথাযথভাবে পালন করতে অবহেলা করে। অনেকে আরও অপঘটন ঘটায়। ফলে ১৬ তারিখে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একেবারে মদ্য পান নিষিদ্ধ করা হয় এবং ছোট বড় সমস্ত সৈন্যের সংরক্ষিত মদ রাজপথে ঢেলে দেওয়া হয়। এটা যেন অনেকটা ইসলামী পদক্ষেপের মত।

এবার ইংরেজ সৈন্য ঠাণ্ডা মাথায় সুচিন্তিত পদক্ষেপে ১৮ তারিখে প্রবলভাবে আক্রমণ চালালো লাহোর গেট দখল করার অভিপ্রায়ে, কিন্তু পারল না। অবশেষে ২০ তারিখে ইংরেজ, শিখ, গুরখা ও রাজা মহারাজাদের প্রেরিত সাহায্যে লাহোর গেট, আজমির গেট, জুমআ মসজিদ ইংরেজরা দখল করে। ক্রমে ভারতের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের রাজ প্রাসাদেও ইংরেজদের পতাকা উঠানো সম্ভব হয়। যদিও ইংরেজদের হাতে রাজশক্তি তবুও চার মাস ধরে বহু লোক ক্ষয় আর অর্থ ব্যয়ে দিল্লির রাজপ্রাসাদ ভারতের ইংরেজপ্রিয় বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতায় দখলে আসে। আজ তারা আনন্দে আত্মহারা। এখনো তাদের আশা যতদিন ভারতে রাজা মহারাজা, শিখ, শুর্খা রাজপুতরা তাদের দলে থাকবে ততদিন তারা শোষণ চালাতে পারবে। তাই দেওয়ানি খাসে চলল মদ্যপানের আনন্দোচ্ছাস। তখনো খাঁটি ঈমানদার মুসলমান বিপ্লবী অনেক প্রহরী বন্দুক নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে প্রহরায় নিযুক্ত।

দিল্লির বিপ্লবীদের বীর নেতা বখত খাঁ বুঝতে পাললেন পলায়নই এখন একমাত্র পথ। অবশ্য সর্বভারতীয় সর্বজননির্ধারিত সম্রাট বাহাদুর শাহকে দিল্লি হতে সরিয়ে নিয়ে কোন গোপন ঘাঁটি হতে তিনি পূর্ণোদ্যমে বিপ্লব পরিচালনা করবেন। তাই গভীর রাতে তিনি বাহাদুরশাহকে তার প্রস্তাব পেশ করতেই তিনি বললেন, “আমার প্রাণ প্রিয় বিপ্লবীরা লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে মারা গেল আর আমার এখন বেঁচে থাকা কি শোভা পায়? তাছাড়া বাইরে গিয়ে পরিশ্রম করার দৈহিক শক্তি আমার নেই, আমি বার্ধক্যের জন্য অত্যন্ত দুর্বলতাবোধ করছি। অতএব তোমরা কেউ আমার দায়িত্ব পালন করতে সম্মত হলে আমার বাইরে যেতে আপত্তি নেই।” বখত খাঁ বললেন, “আপনার বেঁচে থাকাতে ভারতের মাটিতে আপনার পরিবর্তে কারো পক্ষে সম্ভব নয় যে সম্রাট হয়ে নেতৃত্ব দেওয়া।” সম্রাট আর উত্তর না দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে বললেন, “নিজে নিজের মৃত্যু ঘটানো তো মুসলমানদের কল্পনাতেই আসে না, তবুও আমার মনে হয় আমার চলে যাওয়া মানে প্রাণের দায়ে পলায়ন। সেটা মনে চাইছে না বরং শহীদ হওয়াই ভাল। শোন বখত খাঁ, আমাদের পরাজয় হতে চলেছে কেন জানো, তোমাদের বীরত্বের অভাব নেই শুধু ভারতবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা। এই শেষ সময়ে যদি অন্তত আমার প্রিয় দেশবাসী হিন্দু রাজা মহারাজারা বিপক্ষদের সাহায্য না করত তাহলে.............। আমি মরে গেলে আমার বড় দুঃখ থাকবে কি জান? সেটা হচ্ছে মাত্র কয়েক দিন আগেও আমি হিসাব করে দেখেছিলাম ওদের সৈন্য মরতে মরতে অনেক কমে গেছে কিন্তু উদয়পুরের রাজপুত রাজা, জয়পুরের রাজা, যোধপুরের রাজা যেভাবে সৈন্য অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সাহায্য করল তার শোক আমায় আহত করেছে। দেখ বখত খাঁ, আজমীর হতে সৈন্য আনার জন্য যখন রাজপুতানায় সংবাদ যায় সে খবর পেয়ে আমি নির্দেশ দিলাম সেখানে হতে সৈন্য আনা মানেই রাজপুতানা বা আজমীর ইংরেজশূন্য হওয়া। ঠিক ঐ সময়ে আজমীর তোমার আক্রমণ করলেই আমাদের হাতে এসে যেত। ইংরেজদের ভারত হতে তাড়ানোর জন্য অস্ত্র কামান, অর্থ ও সামান। কিন্তু সৈন্য দিল্লিতে পাঠানো হল বটে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিশ্বাসঘাতক বিরাটসংখ্যক সৈন্য তাদের জায়গায় প্রহরীর মত দাঁড়ালো। এ দুঃখ ভোলার নয়। ঐ মনে কর গোয়ালিয়রের রাজপুত রাজাকে কত সানুরোধে পত্র পাঠালাম। আট হাজার সৈন্য আর ছাব্বিশটি বড় বড় কামানের মালিক তিনি। আমার মত বৃদ্ধ নন, ২৩ বরের যুবক। অথচ ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে সেই সুসজ্জিত সৈন্য আর কামান গুলি আমার ভারতীয় হিন্দু মুসলমান প্রজাদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে প্রয়োগ করল। এই দুঃখ ভোলার নয়। ইন্দোরের রাজায় সমস্ত সৈন্য ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাইলে তিনি তা নিষেধ করলেন। বোম্বাই-এর গভর্ণর এলিফিন টোনের কাছ হতে সাহায্য চাইলেন তাঁর ভারতীয় ভাইদের হত্যা করার জন্য। তিনি সাহায্য পেলেন এক হাজার বন্দুক, তিনশত পিস্তল আর লাখ লাখ টোটা তাই নিয়ে তিনি বিদ্রোহীদের হত্যা করালেন। এসব রিপোর্ট আমার কাছে রয়েছে। অথচ মহারাজা তুকাজীরাও যে সাহায্য পেলেন তা আসলে ইংরেজের সাহায্য নয়, আমারই প্রিয় ভারতের রাজা হোরকারের পক্ষ হতেই ঐ সব সরঞ্জাম। আর মূর্খ শিখরা যদি নিরপেক্ষও থাকতো তাহলেও চলতো কিন্তু নিজেরাও মরল বিপ্লবীদেরও মারল। তুমি যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ রাখ আর আমি সারা ভারতের নানা সংবাদ পাই এবং অবাক হই। রাজা জঙ্গবাহাদুর কি বিপুল পরিমাণে সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আর অর্থ দিয়ে সাহায্য করলেন যে দুঃখ বার বার আয় আঘাত দেয়। আবার মাত্র সেদিন (১০ মার্চ) তিন হাজার সৈন্য দিয়ে ইংরেজের হাতকে শক্ত করলো।” বলতে বলতে বাহাদুর শাহ, দেশ প্রেমিক ভারত সম্রাট বাহাদুর শাহ অবোধ শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন। তারপর কোন রকমে চোখ মুছে বললেন, “বখত খাঁ, তুমি চলে যাও, তোমার মত লোকের বাঁচার প্রয়োজন আছে। আর আমার মৃত্যু হোক ইংরেজদের হাতে, যেমন করে আমার প্রিয় প্রজা ‘মুসলিম গাইর মুসলিম’ শহীদ হয়েছে।” বাহাদুর শাহ মদ, মাংস, গীত, বাদ্য উম্মত্ত নৃত্যে কলুষিত পরাধীন পরিবেশ হতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন হুমায়ুনের সমাধি বাগানে।

এদিকে মিঃ হডসন রাজ প্রাসাদে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সম্রাটের সাক্ষাৎ পেলেন না। সারা ভারতের বিপ্লবীদের নেতা বাহাদুর শাহ তখন এলাহি বখশের পরামর্শেই সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইংরেজরা গুপ্তচর মারফত এ সংবাদ জানতে পেরে তাঁর বাড়িতে পৌঁছালো এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “আমি বলতে পারবো না সম্রাট কোথায়; অবশ্য আমি জানি।” ইংরেজরা ভয় দেখালো তবুও তিনি উত্তরে বললেন, “আমার শেষ শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয় তাও নিতে রাজি কিন্তু সম্রাটকে হত্যা করার জন্য তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারবো না।” শেষে বিরাট আর্থিক প্রলোভন প্রদর্শন করা হল।

তাতেও তিনি বললেন, শুধু অর্থ নয় বরং পৃথিবীর বাদশাহীর পরিবর্তেও আমি এতে প্রস্তুত নই। মিঃ হডসনের কাছে সংবাদ পৌঁছালে তিনি বললেন, “যদি তোমাদের পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ করে বলি যে, বাদশার ক্ষতি করবো না তাহলে বিশ্বাস করা চলবে কি না।” তাতে এলাহি বখশ বললেন, শুধু কোরআন নয় বাইবেল ছুঁয়েও শপথ করতে হবে। তাই হোল। হডসন কোরআন ছুঁয়ে শপথ করলেন তারপর একটি বাজে বই বাইবেল বলে ছলনা করে শপথ করার পর ইলাহী বখশ হডসনকে সম্রাটের সন্ধান বলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। ভাবলেন সম্রাটের বোধহয় আর কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এলাহি বখশ যে সম্রাটের সংবাদ জানতেন এই খবর যিনি জানতেন তিনি বাহাদুর শাহের একজন কেরানী বা মুন্সী শ্রী রাম জীবন।

হডসন একটা পালকী নিয়ে তাতে সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী জিন্নত মহলকে চড়তে বললেন। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী পালকীতে উঠলেন। সামনে পেছনে ইংরেজ সৈন্য বুক ফুলিয়ে চলেছে সকলের সামনে আছেন মিঃ হডসন। এর পেছনে গরুর গাড়িতে দীনহীন দরিদ্রের মত সম্রাটের সন্তানদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তার আগে ইংরেজ সৈন্য সারা দিল্লিতে রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল তার উল্লেখ ইতিহাসে নেই। তবুও দিল্লির জনসাধারণ রাস্তার দুই ধারে সশস্ত্র দাঁড়িয়ে, চোখে অশ্রু। দিল্লির সহস্র সহস্র নারী বোরকা পরে রাস্তায় সন্তানের বা পিতার মৃতদেহকে শেষ বিদায় দেওয়ার মত কান্নার রোলে ভরিয়ে তুলল।

মিঃ হডসন বাহাদুর শাহ আর বেগমকে সৈন্যদের মাঝে রওনা করে দিয়ে একটু পিছিয়ে এলেন। তারপর শাহজাদা মির্জা খিজির, সুলতান মির্জা মোগল ও মির্জা আবু বকরকে গোগাড়ি হতে নামতে বললেন। শাহজাদারা নামতেই প্রকাশ্য রাজপথে তাঁদের দাঁড় করানো হলো তারপর হাতগুলি পেছন দিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। অতঃপর হডসন নিজে তাদের বুকের সামনে বন্দুক উঠিয়ে ধরে বললেন, “বিদ্রোহের মূলে তোমাদের বাবা আর তোমরা। সারা ভারতে আমাদের শেষ করবার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছ তোমরাই। তাই এই তোমাদের স্বাধীনতার পুরস্কার!” তার পরেই শব্দ। পর পর প্রত্যেকের বুকে গুলি করে হডসন যে শব্দ সৃষ্টি করলেন তার চেয়েও এক মারাত্মক শব্দ শুরু হল মিলিত হিন্দু-মুসলমান নর-নারীর কান্নার রোল। তারপর নিষ্ঠুর নর পিশাচ হডসন স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্রাট বংশের শেষ প্রদীপগুলি নিভিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি তাদের মৃত দেহগুলি প্রকাশ্যে টাঙ্গিয়ে দিলেন যাতে দিল্লির লোক ভবিষ্যতে আর কখনও বিপ্লব না করে।

বাহাদুর শাহের জন্য একটি কাঠের পায়ের শয়ন খাট, একটি পুরাতন ময়লা মখমলের বিছানা, একটি ছিন্ন ময়লা বালিশ আর অসময়ে অর্ধাহারে রেখে ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে ২৭ জানুয়ারি বিচারের নামে প্রহসন পর্ব সমাধা হলো। বিচারে জজদের রায় প্রকাশ হল চিরজীবন নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হল সেই অস্বাস্থ্যকর রেঙ্গুনে। কারণ তিনি ছিলেন ভারতে বিপ্লবী ও বিদ্রোহীদের প্রধানতম নেতা। তার স্ত্রীকেও সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু পরে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। খাঁ বাহাদুর খাঁও বন্দি ছিলেন। তাঁরও বিচার হলো। বিচার হল ফাঁসি। সবই যেন মনে হচ্ছে নতুন কথা। কল্পলোকের গল্পের মত।

৮৪ বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসকে গোপন করে রাখা হয়েছে আর তাঁর মৃত্যুর জন্য বিশ্বাসঘাতক বলে বর্ণনা করা হয়েছে ইলাহি বখশ সহ কয়েকজন মুসলমানকে। এও ইংরেজের এক সুকঠিন ষড়যন্ত্র। সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে, ইলাহী বখশের বিরুদ্ধে পাঠকের কোনও অভিযোগ থাকবে না যদি মনে রাখা হয় যে ইলাহী বখশ ছিলেন জিন্নত মহলের পিতা অর্থাৎ সম্রাট বাহাদুর শাহের শ্বশুর।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন