মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, আর্যগণের মতই মুসলমানগণ এসেছিলেন বহির্ভারত হতে তৌহিদের (একেশ্বরবাদ) বাণী বহন করে।
আমরা আদি ইতিহাস আলোচনা করে দেখব যে, ভারতের আদি ইতিহাস বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এবং পুঁথিপত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেগুলোর অধিকাংশ সম্বন্ধে নানাজনের নানা মত। অবশ্য বিরোধীপক্ষ বা শত্রুপক্ষ অনেক কিছু বলতে পারেন কিন্তু মিত্রপক্ষ যা বলেন তা অগ্রাহ্যের নয় অবশ্যই।
ইতিহাস আর ধর্মগ্রন্থ দুটিকে পৃথক বিষয় মনে করা উচিত। কারণ ধর্মের ছায়ালম্বনে কোন এক ধর্মাবলম্বী জাতি পরিচালিত হয় আর ইতিহাস পরিচালিত হয় মানবজাতির বুদ্ধি বিদ্যাপ্রসূত অভিজ্ঞতার ছায়ায়। যদি বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতকে ধর্মগ্রন্থ বলে সম্মান প্রদর্শন করা হয় তবে সেগুলোকে ইতিহাস গ্রন্থ বলে ছোট করতে অবশ্যই আপত্তি আছে। যেমন মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফ। এটা স্বয়ং আল্লাহ প্রেরিত সংবিধান, তাতে ইতিহাসের ইন্ধন মিললেও কোন ক্রমেই তা শুধুমাত্র ইতিহাস নয়।
বেদ, পুরাণ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, কোরআন শরীফ প্রভৃতি যদি নির্ভুল ঐশীগ্রন্থই হয়, তাহলে ইতিহাস শ্রেণীতে অন্যান্য পুস্তক দাঁড় করাতে হয়। কিন্তু আমাদের প্রাচীন ভারতে সঠিক প্রাণবন্ত ইতিহাস বলতে তেমন কিছু ছিল না; বরং আমাদের তথা ভারতবাসীর চেয়ে আরববাসীগণ ইতিহাস সৃষ্টিতে শতগুণে শ্রেয় বলে বিবেচিত। কারণ তারিখ ধরে সবকিছু লেখা বা গদ্য, পদ্য অথবা কাব্যগ্রন্থ ইত্যাদি মুখস্থ করার কারবার আরবে অতি জোরদার ছিল, এমনকি বাড়ির সামান্য ঘোড়ার ইতিহাস পর্যন্ত তারা লিখে রাখত। তাই ইতিহাসকে তারা তারিখ বলতো বা আজও বলে।
আমাদের ভারতে ইতিহাস শাস্ত্র আজ বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট বিষয় সন্দেহ নেই; কিন্তু আমাদের দেশে ইতিহাস জানা পণ্ডিত বা ঐতিহাসিকগণ এবং ইতিহাস বইগুলো বেশির ভাগই ইংরেজ ঐতিহাসিক আর ইংরেজি ইতিহাসেরই প্রসবিত সন্তান। আবার ইংরেজরা কিন্তু ভারতেরও ইতিহাস জানার এবং ভারতে তা অপরিচ্ছন্ন হাতে পরিবেশনের পরিপ্রেক্ষিতে আরব ও পারস্যদের লেখা মূল ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করে বহু কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকার করে আরবী, ফারসি ও উর্দু ভাষা শিখে অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছে।
আজ মনে রাখতে হবে যে, ভারতের মূল ইতিহাস যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা জানতে পেরেছি তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। কিন্তু আফসোস আর দুঃখের বিষয়, আমরা অনেকেই তাদের নাম পর্যন্ত জানি না। সাধারণ মানুষের কথা যদি ছেড়েই দেওয়া যায় তবু বলব, আজ আমরা যারা কেবল ইতিহাসকেই মাধ্যম করে জীবনের উন্নতির পথ বেছে নিয়েছি তারাই বা কয়জন তাঁদের অতুলনীয় অবদানের কথা জানি। তাই পাঠকবৃন্দের অবগতির জন্য কতিপয় মুসলিম বিশ্বের স্বনামধন্য ঐতিহাসিকের নাম উল্লেখ করা গেল। অসংখ্য ঐতিহাসিকের মধ্যে জনাব আল-বিরুনী, জনাব ইবনে খালদুন, জনাব ইবনে বতুতা, জনাব অলি বিন হামিদ, জনাব বাইহাকী, জনাব উৎবী, জনাব কাজী মিনহাজুদ্দিন সিরাজ, জনাব মুহীউদ্দীন, জনাব মুহাম্মদ ঘুরী, জনাব জিয়াউদ্দিন বারণী, জনাব আমীর খসরু, জনাব সামসী সিরাজ, জনাব বাবর, জনাব ইয়াহিয়া বিন আহমাদ, জনাব জওহর, জনাব আব্বাস শেরওয়ান, জনাব আবুল ফজল, জনাব বাদানি, জনাব ফেরিতা, জনাব কাফি খাঁ, জনাব মীর গোলাম হোসেন, জনাব গোলাম হোসেন সালেমী, জনাব সাঈয়েদ আলি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
আজ যখন আমাদের ছেলেরা পাঠশালা, স্কুল বা কলেজে পড়ে তখন উপযুক্ত মহাপরিশ্রমী ঐতিহাসিকদের কত জনকেই বা তারা জানে অথবা জানতে পারে। তার ওপরে ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করলে বা ইতিহাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ ডিগ্রি নিতে হলে যে ইংরেজি ইতিহাস পড়তে হয় তাতে সামান্য সামান্য অস্পষ্টভাবে অথবা টীকায় ঐসব ইতিহাস বা ঐতিহাসিকের নাম এমনভাবে জানানো হয়েছে, যা অন্তরে বিশেষভাবে দাগ কাটতে পারে না। অথচ মুসলমান ঐতিহাসিকদের ইতিহাস বিশ্বের প্রাজ্ঞমণ্ডলীকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয় এবং এ গ্রন্থগুলো পৃথিবীর যেকোন ইতিহাসের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে শুধুমাত্র শীর্ষস্থানীয় নয় বরং পিতৃস্থানীয়। এক কথায়, এই সমস্ত ইতিহাস বা ঐতিহাসিকরাই জগতের ইতিহাসের জন্মদাতা। উদাহরণস্বরূপ মুসলিম জ্ঞান ভাণ্ডার হতে সামান্য কয়টি মহা মনীষীর রচিত ইতিহাসের নাম উল্লেখ করা হল।
তারিখি সিন্ধু (তারিখি মাসুমি) নামে বিখ্যাত ইতিহাসটি ১৬০০ খৃস্টাব্দে ঐতিহাসিক জনাব মীর মুহাম্মদ মাসুম কর্তৃক লিখিত। ভারতে আরবীয় অভিযান হতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যু পর্যন্ত সঠিক তথ্য সম্ভার সম্বলিত এটি এক মহামূল্যবান গ্রন্থ।
চাচানামা - চাচানামা এক অত্যন্ত অভিজাত শ্রেণীর ইতিহাস। এটি লিখেছেন জনাব মুহাম্মদ আলি বিন বকর। সিন্দু দেশে আরব জাতির বিজয় কাহিনীই হল-এর বিষয়বস্তু, গ্রন্থখানিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নাম ও ঘটনাবলি বিশদভাবে বর্ণিত আছে। তাছাড়া এটি সেই সময়কার সিন্দু দেশ তথা ভারতবর্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐতিহাসিক তথ্যের ও নির্ভরযোগ্য সংবাদদাতা। বইটি ফারসি ভাষায় লিখিত।
কিতাবুল ইয়ামিনি- গ্রন্থটি ঐতিহাসিক জনাব উৎবীর রচনা। বইটির মধ্যে ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে সাথে সাহিত্য সৃজনতারও বন্যা বয়ে গেছে পর্যাপ্ত পরিমাণে।
তারিখি মাসুদী- ইতিহাসটি লিখেছেন জনাব আবুল ফজল মুহাম্মদ বিন হাসেন আল বাইহাকী। উচ্চমানের এই ইতিহাসটি নানা ঐতিহাসিক তথ্যে পরিপূর্ণ।
বিশেষ করে সুলতান মামুদ সমন্ধে সঠিক আলোচনায় আর প্রকাশনায় ইতিহাসটি প্রশংসার দাবিদার।
তারিখি ফিরোজ শাহী-এর লেখক ঐতিহাসিক জনাব জিয়াউদ্দিন বারণী। বইটিতে বলবনের রাজত্বকাল হতে ফিরোজ তুঘলকের সময় পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জী সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। খিলজী ও তুঘলক বংশের ওপর সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উপাদান এই পুস্তকখানি। ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে এটি রচিত। কলিকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক গ্রন্থখানি পুনরায় ছাপা হয়েছে।
তৈন-উল-আখতার- ইতিহাস গ্রন্থটি লিখেছেন ঐতিহাসিক জনাব আবু সঈদ। নিখুঁত তারিখ উল্লেখে এবং সঠিক সংবাদ পরিবেশনে প্রামাণ্য হিসেবে পুস্তকটি সুপ্রশংসিত।
তারিখুল হিন্দ (তাহকিকে হিন্দ)-সুবিখ্যাত ইতিহাসটি প্রখ্যাত পর্যটক ও ঐতিহাসিক জনাব আবু রাইহান আলবিরুনীর লেখা। গ্রন্থটির মূল ভাষা আরবী। পরে এর ফারসিতে অনুবাদ করা হয়। গ্রন্থখানির ইংরেজি অনুবাদও করা হয় ডক্টর সাচ্চু মহাশয়ের তৎপরতায়। ভারতে হিন্দু জাতি, হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতি জানবার এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম মূল গ্রন্থ। আমাদের দেশের ঐতিহাসিক ডক্টর সুনীতি কুমার মুখার্জি তাই মনীষী আলবিরুনীকে ‘সভ্যতার আলোকবাহী’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
তা-জুম্মসির- বিখ্যাত ইতিহাসটির রচয়িতা ঐতিহাসিক জনাব হাসান নিজামী। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ হতে ১২৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ের এটি তথ্যবহুল এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। কুতুবুদ্দিন আইবক, মুহাম্মদ ঘোরী প্রমুথ বাদশাহদের বিশদ বিবরণ আছে এই গ্রন্থে, যা সমীক্ষিত, সঠিক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
তবকাৎ -ই নাসিরী- ইতিহাসটি লিখেছেন ঐতিহাসিক জনাব মিনহাজুদ্দিন আবু ওমর বিন সিরাজ। ১২৬০ সালে এটি রচিত। ইতিহাস মঞ্চে সর্বস্বীকৃত মূল্যবান এই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন মিঃ রেভারটি। মুসলমান রাজা বাদশাহদের জানতে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্রন্থ।
খাজেনুল ফতোয়া- ইতিহাসটি ভারতের ‘তোতা পাখি’ উপাধিপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক জনাব আমীর খসরুর লেখা। নিঃসন্দেহে এটি একটি সত্য তথ্যযুক্ত সুন্দর পুস্তক। আমাদের পরবর্তী দেশীয় ঐতিহাসিক এ.এল.শ্রী বাস্তব মহাশয় লেখকের খুব প্রশংসা করেছেন। মিথ্যার মিশ্রণ নেই বলেই ভাল ইতিহাসের কোঠায় এর এত বড় মর্যাদা। অধ্যাপক হাবিব সাহেব ইংরেজিতে এর অনুবাদ করেছেন।
ফতোয়া উস সালাতিন- ইতিহাসটির লেখক জনাব খাজা আবু মালিক ইমামী। বইটি শিক্ষিত সমাজে খুবই সমাদৃত।
কিতাবুর রাহলাব- এই বিখ্যাত ইতিহাসটি ভ্রমণ কাহিনী সংবলিত সুন্দর সৃষ্টি। এটি রচনা করেছেন জনাব ইবনে বতুতা।
তারিখে মুবারক শাহী- এর লেখক ছিলেন জনাব ইয়াহিয়া বিন আহমেদ।
তারিখে সালাতিনে আফগান- গ্রন্থের লেখক আহমদ ইয়াদ গা। তারিখে শেরশাহী তোহফা এ আকবার শাহী- লেখক হচ্ছেন আব্বাস শেরওয়ানী। মাখজান এ আফগান-এর লেখক হলেন নিয়ামতুল্লাহ।
এছাড়া আরও বহু মুসলমান ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস গ্রন্থ আজ ইতিহাস জগতে জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর ভূমিকায় চির ভাস্বর হয়ে আছে। যথা তারিখে দাউদী’র লেখক হলেন জনাব আবদুল্লাহ। জনাব আবুল ফজলের লেখা ‘আকবরনামা; ‘আইনি আকবরী; জনাব বাদায়ুনির মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ জনাব নিজামুদ্দীনের লেখা ‘তাবাকাত-ই আকবার’ জনাব হিন্দুবেগ (ছদ্মনাম) সাহেবের লেখা ‘ফেরিস্তা’, জনাব ফেরিস্তা লিখিত তারিখে হিন্দুস্থান, জনাব কাফি খাঁ লিখিত মুনতাখাবুল লুবাব’, জনাব ফৈজি সাহেব লিখিত ‘আকবর নামা’ ও ‘মসনভী’, জনাব আবদুল বাকী সাহেব লিখিত মাসির-ই রহিমী; জনাব এনায়েত খাঁ লিখিত ‘শাহজাহান নামা’ জনাব দারাশেকো লিখিত ‘সফিনাৎ আল আউলিয়া’ ও ‘ইকবালনামা-ই-জাহাঙ্গিরী’ প্রমুথ জগদ্বিখ্যাত ইতিহাস ও ঐতিহাসিকের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বলাবাহুল্য, মুসলমান জাতির রক্তে রক্তে ইতিহাস লেখা, পড়া তথা ইতিহাসে সর্বপ্রকার আকর্ষণ যেন স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। অবশ্য বর্তমানে ইংরেজদের বিষ খাওয়া হিন্দু ও মুসলমান জাতির কথা স্বতন্ত্র।
আজ ভারতীয় হিন্দু ঐতিহাসিকদের নাম লিখলেও অনেকগুলো নামই সগর্বে লেখা যায়, যেমন ঐতিহাসিক শ্রী রমেশ মজুমদার, শ্রী যদুনাথ সরকার, শ্রী ঈশ্বরী প্রসাদ, শ্রীপ্রভাত বাবু, শ্রী কিরণ বাবু, শ্ৰী হিরেন বাবু, শ্রী চন্দ্রশেখর বাবু, শ্রী নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী অক্ষয় কুমার বাবু, শ্রী নৃপেন্দ্রচন্দ্র বাবু, শ্রী অশোক মেহতা বাবু, শ্রী সখারাম বাবু, শ্রী গনেশ বাবু, শ্ৰী ডাঃ কালিদাসনাথ বাবু, শ্রী হেমেন্দ্র কুমার বাবু, শ্রী কিরণ চৌধুরী, শ্রী বিনয় ঘোষ প্রমুখ ঐতিহাসিকদের নাম বিশেষ প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, ঐ সমস্ত অমুসলমান ঐতিহাসিকের নামই আজ ইতিহাসের পাতায় যথেষ্ট নয় বরং এমন অসংখ্য মুসলমান ঐতিহাসিকের নামও উল্লেখ করা যেতে পারে, যা আজকের আধুনিক শিক্ষিত-শিক্ষিতাদের বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না।
মোটকথা আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যেও মুসলমান ঐতিহাসিকগণ সংখ্যায় নগণ্য নন মোটেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ জনাব খোদাবখশ সাহেব এম এ বি সি আই, বিএল; ব্যারিস্টার সালাহ উদ্দিন সাহেব, জনাব মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেব প্রমুখ পণ্ডিতবরের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁরা বহু পুস্তক-পুস্তিকা ও গ্রন্থ লিখে গেছেন। তাছাড়া ‘মুসলিম বিক্রম’ ‘বাংলায় মুসলিম রাজত্ব’ ইতিহাস বই দুটি লিখেছেন হুগলি জেলার শ্রী রামপুরের জনাবা নূরুন্নেসা খাতুন। ‘পারস্য প্রতিভা’ লিখেছেন জনাব বরকত উল্লাহ সাহেব এম এ বি এস, বি সি এস, 'Musalmon Culture' লিখেছেন জনাব শহীদ সোহাওয়াদ সাহেব এমএ। 'Islam and the modern world' এবং 'Short cultural History of the Arabs' ইতিহাস দুটি লিখেছেন জনাব কে আলি এম এ সাহেব। জনাব সৈয়দ আলি হাসান সাহেব লিখেছেন 'Our Heritage', এম এন রায়ের 'Historical Rule of Islam'-এর বঙ্গানুবাদ ইসলামে ঐতিহাসিক অবদান আর বৈশিষ্ট্য লিখেছেন জনাব মোহাঃ আবদুল হাই এম এ। H.A.R Gilb ইংরেজ লেখকের 'Mohamme danism-and Historica survey' গ্রন্থের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা বাংলায় লিখেছেন জনাব মতিউর রহমান সাহেব, জনাব মোঃ ইসহাক এম এ লিখেছেন ইসলামের অভিনব ইতিহাস ও পাক ভারতের ইতিহাস। জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী সাহেব এম এ লিখেছেন ‘ইসলামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এবং ‘পাক ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাস’। খ্রিষ্টান ফিলিপ, কে, হিট্টি সাহেবের 'The Arabs, A short History'r বঙ্গানুবাদ ‘আরব জাতির ইতিহাস’ লিখেছেন প্রিন্সিপাল জনাব ইব্রাহিম সাহেব এম এ বি,এল। এছাড়া আরও অনেক ইতিহাস বই তিনি লিখেছেন, যেমন A needets from Islam; আনোয়ার পাশা কামাল পাশা’ প্রমুখ। 'A brief survey of Muslim rule in India' পুস্তকখানি লিখেছেন জনাব মোহাঃ মোহর আলি এম এ। ‘ইসলাম ও আধুনিক জগত' এবং 'An Introduction to the History of Muslim culture' পুস্তক দুটি লিখেছেন জনাব মোহাঃ মিজানুর রহমান সাহেব এমএ। জনাব মোঃ ওলিউল্লাহ সাহেব লিখেছেন, ‘সেকাল ও একাল'। জনাব কাজী ইমদাদুল হক বি এ বি টি লিখেছেন ‘ঐতিহাসিক গ্রন্থমালা'। জি এইচ রহমান এম এ লিখেছেন তিন খানি অতি মূল্যবান ইতিহাস বই 'Out lines of History of Islam', 'History of Indo Pakistan' FmÄ ÈOut lines of Modern Europe'। জনাব মুহঃ আবদুর রহিম সাহেব এম এ লিখেছেন ‘আরব জাতির ইতিহাস'। জনাব সিরাজ সাহেব লিখেছেন ‘মুসলিম সভ্যতা’; ‘তুরস্ক ভ্রমণ’, ‘মহানগরী কর্ডোভা’ প্রভৃতি ইতিহাস। মজিবুর খাঁ এবং আহসানুল্লাহ খান বাহাদুর লিখেছেন ‘আমাদের ইতিহাস’। জাস্টিস জনাব সৈয়দ আমীর আলি লিখেছেন 'History of the Saracenes', আবার এটাকে আরব জাতির ইতিহাস নাম দিয়ে বাংলায় প্রকাশ করেন জনাব রিয়াজুদ্দিন সাহেব। তদানীন্তন স্কুল ইনস্পেক্টর জনাব আবদুল করিম সাহের লিখেছেন “ভারতে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত’। নোয়াখালীর জনাব ডক্টর আবদুল কাদের সাহেব লিখেছেন ‘সুলতান মাহমুদ’, তারপর লিখেছেন ‘বাবর’, ‘হায়দার আলি’ ও ‘টিপু সুলতান’। তাছাড়া আরও কয়টি ইতিহাস তিনি লিখেছিলেন, যা মুসলিম প্রতিভার জীবন্ত সাক্ষীস্বরূপ চিরউজ্জ্বল হয়ে আছে। যেমন ‘তুরস্কের ইতিহাস’ ‘স্পেনের ইতিহাস’, ‘ক্রুসেডের ইতিহাস’, ‘সালাহউদ্দিন’; ‘মুর সভ্যতা’, ‘কামাল পাশা’ ও ‘মুসলিম কীর্তি’ ইত্যাদি। এছাড়া আরও অনেক ইতিহাস ডক্টর সাহেবের অক্ষয় কীর্তির পরিচায়করূপে বেঁচে থাকলেও প্রকৃষ্ট প্রমাণের অভাবে তা এখানে উল্লেখ করা গেল না। খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার কালিগঞ্জ থানার নলতা গ্রামের খান বাহাদুর জনাব আহসান উল্লাহ এম এ অবিভক্ত বঙ্গে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। তিনি লিখে গেছেন ‘মুসলিম জগতের ইতিহাস’ এবং ‘ইসলামের ইতিবৃত্ত’।
এছাড়া আরও বহু মুসলমান ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস আজও বেঁচে আছে, যা মুসলিম বিশ্বের অবিস্মরণীয় কীর্তির বাহক। যেমন হুগলী জেলার বাগনানের ডাঃ সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেব, খুলনার কাজী আকরাম হোসেন ইত্যাদি বহু ইতিহাস রচয়িতার নাম পাওয়া যায়। বর্ধমান জেলার জনাব আবুল হায়াত সাহেবের ইংরেজি ইতিহাসটিও চিত্তাকর্ষক বই সন্দেহ নেই। তাছাড়া বর্ধমান জেলার জনাব গোলাম রব্বানী সাহেব, কাটোয়ার জনাব এম, আঃ রহমান সাহেব, বর্ধমানের ওয়ারী গ্রামের আবদুল মওদুদ সাহেব এম এ প্রভৃতি ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ইতিহাসে কম বেশি ছাপ রেখে গেছেন। কিন্তু মাঝখানে কিসের যেন হতাশা; কিসের যেন অমনোযোগ অবহেলা, কিসের যেন অবশ অলস নিদ্রা। লেখদের লেখনীসমুদ্রে পড়ল ভাটা। প্রবাহিত হল অমনোযোগিতার স্রোতধারা। আবার এক সময় আচম্বিতে প্রবল জোয়ারের ন্যায় দুকূল প্লাবিত করে অলস ঘুমে অচেতন লেখকদের চেতনার সঞ্চার করতে অমনোযোগিতার যবনিকা টানতে তথা ইনকেলাব আনতে ধূমকেতুর মত আত্মপ্রকাশ করল ‘পুস্তক সম্রাট’এর মত আরও কিছু জাতীয় ইতিহাস। তবে উপরের পুস্তক-পুস্তিকা ও গ্রন্থাদির দ্বারা একথা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, প্রতিটি শিক্ষিত মানুষেরই অধিকাংশ লেখা আরব, ইসলাম ও মুসলমান কীর্তি কলাপকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কেন? এর অন্যতম প্রধান কারণ, শিক্ষিত মুসলমানগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজের বিষবৃক্ষ ফলে-ফুলে মজবুত হয়ে ভারতের মাটিতে শিকড় গেড়েছে। হিন্দু ভ্রাতা মহোদয়গণ দিন দিন যেন বুঝতে শিখছেন যে, মুসলমান বিদেশী আর তারা হিন্দুদের শত্রু। অতএব শত্রুর বীরত্ব, বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও কৃতিত্বকে বিকৃত বা চাপা দেওয়া স্বাভাবিক অথচ এই বিষাক্ত প্রতিকূল আবহাওয়াকে অনুকূলে পরিণত করাও প্রতিবেশী মুসলমানদের শক্তির বাইরে। সুতরাং দ্বিতীয় পথই তারা বেছে নিলেন; নিজেদের ঐতিহ্য ইতিহাসকে সঠিকভাবে বাঁচাতে নিজেরাই কলম ধরেছিলেন শক্ত আঙুলে। এক্ষণে ধর্মগ্রন্থগুলোতে কতটুকু ইতিহাসের ইন্ধন মিলতে পারে, সে সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।
বেদ সম্বন্ধে হিন্দু ভাই-বোনদের বিশ্বাস যে, “ইহা আদিগ্রন্থ, ইহার কোন পরিবর্তন বা বিকার আজ পর্যন্ত সংঘটিত হয় নাই। বেদ মন্ত্রগুলো দীর্ঘকাল ধরিয়া আর্য মুনিঋষিগণের কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হইয়া আসিয়াছে এবং শিক্ষার্থী গুরুগৃহে অবস্থান করিয়া, তাহার বর্ণিত ঐ মন্ত্রগুলো কণ্ঠস্থ করিয়া আনিয়াছে।” কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিত গবেষণান্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, আসল বেদের অস্তিত্ব আমাদের দেশে নেই বরং যেটুকু যেখানে আছে তা বাড়তে বাড়তে মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে বড় রকমের ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে।
এক্ষেত্রে বিরোধীপক্ষ কোন ব্যক্তির বক্তব্যের অবতারণা না করে স্বয়ং ঋগ্বেদের ভাষ্যকার পণ্ডিত শ্ৰী মহেন্দ্র চন্দ্র রায় তত্ত্বনিধি বিদ্যাবিনোদ মহাশয়ের ভাষ্য হতে কিছু অংশ তুলে ধরা হল- “এতদৃশ মূল্যবান বেদের আজ কেন এত অল্প প্রচার একটু প্রণিধান করিলেই বোধগম্য হইবে। কুরুক্ষেত্রের মহা সমরে ভারত মহাশ্মশানে পরিণত হইয়াছিল। মহাযুদ্ধের সহিত আর্য গৌরব রবি (বেদ বা ধর্ম গ্রন্থগুলো) যে চিরতরে অস্তাচলে গমন করিয়াছিল সে বিষয়ে বোধ হয় মতদ্বৈধ নাই।” তিনি আরও বলেন, “দুঃখের সহিত বলতে হইতেছে, প্রবল পরাক্রান্ত মগধের রাজ বংশীয় মহানন্দীসুত, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যাভিষেক হইতেই আর্য রাজ্য বিলোপ হইয়া ক্ষত্রিয় ধর্ম ভারত হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে।” রায় মহাশয় আরও লিখেছেন, “পরবর্তীকালে বঙ্গে তান্ত্রিক ধর্ম প্রচারের পৃষ্টপোষক মহারাজাধিরাজ বল্লাল সেনের নিয়োজিত আগমোক্ত শাস্ত্র বাণী কলিতে বৈদিক মন্ত্রশক্তি লোপ পাইয়াছে, বেদ মন্ত্র কার্যকরী নহে; যাগযজ্ঞ নিষ্ফল ইত্যাদি প্রবচনে বেদের আলোচনা একেবারে রহিত হইয়া গেল। স্বধর্ম নিরত নিষ্ঠাবান বৈদিক ব্রাহ্মণগণ বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মের আবরণে প্রাণপণে যে গ্রন্থগুলো অতি সংগোপনে রক্ষা করিয়াছিলেন তাও গ্রীক, রোমান, পারসিক, তুরান, আফগান প্রভৃতি বৈদেশিকগণের বারংবার আক্রমণে বিলুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হইয়া বিলুপ্ত প্রায় হইয়াছিল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।”
বেদের মধ্যে ঋগ্বেদই সর্বাপেক্ষা অধিক নির্ভরযোগ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর আসল রচয়িতা কে কারা তা মানুষের কাছে নানা পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের ঘুরপাক আজও অবধি অজ্ঞাত থেকে গেছে। যেমন
ক। “হে হরি! আমরা তোমার উদ্দেশে নতুন স্তোত্র রচনা করিয়াছি।” (১০ম-১৬/২১)।
খ। “হে ইন্দ্র! তোমার স্তুতির জন্য গৌতম বংশীয় কবিগণ মন্ত্র রচনা করিয়াছিল। (১/৯/৬৩)।
গ। “গৌতম এই নতুন বেদমন্ত্র রচনা করিয়াছেন।” (১ম, ৩৩/৬২)
ঘ। “হে ইন্দ্র! তুমি আমাদের রচিত নতুন উবাথে (মন্ত্রে) সন্তুষ্ট হয়ে, আমদিগকে ক্ষমা করো।” (১ম-১০/১৩০)
ঙ। “এই স্তুতি বিষয়ক বেদমন্ত্র আমি মান্দার্য ঋষির রচিত।” (১ম-৩৩/৬২)
চ। “পুরুভুজ ঋষি এই বেদমন্ত্র রচনা করিয়াছেন।” (৮ম-১০৮)
ছ। “হে ইন্দ্র! বিমদ বংশীয় ঋষিগণ তোমার উদ্দেশে এই বেদমন্ত্র রচনা করিয়াছেন।” (৭/৯/২২)
জ। “হে ইন্দ্র! কি পূর্বাকালীন প্রাচীন ঋষিগণ কি একালের ঋষিগণ সেই সকল, “বিপ্ররাই” হইতেছে বেদমন্ত্রের রচয়িতা।” (৭/৯/২২)
উপযুক্ত ‘ক’ হতে ‘জ’ পর্যন্ত উক্তিগুলো একটু মনযোগ সহকারে পড়লেই মন হতাশায় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে এবং ঋগ্বেদের স্বরূপ ও প্রতি আমাদের সামনে পরিষ্কার ও পরিস্ফুট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, A Spirations from a fresh world, by Shakuntala Rao Shastri (P. P. 1-2) হতে পাওয়া যায়-“ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে, বেদের মন্ত্রগুলো বহুদিন যাবৎ ভারতে বসতি স্থাপনকারী আর্যদের মধ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক এই মন্ত্রগুলো রচনা করেছেন এবং তাদের বংশধর ও শিষ্যগণ উহা সংরক্ষণ করিয়াছেন। যখন মন্ত্রগুলোর সঙ্গে সঠিক পরিচয় করে আসিয়াছে, এমনই এক অন্ধভক্তির যুগে উহাকে ঐশী বাণী বলে গ্রহণের প্রবণতার উৎপত্তি হইয়া থাকিবে।
এইসব যুক্তিতর্ক ছাড়াও স্বয়ং বেদের মন্ত্রগুলিই মানুষের দ্বারা রচিত হওয়ার প্রমাণ বহন করতেছে। বহু মন্ত্র রচনাকারী তার নাম মন্ত্রের সহিত যোগ করে দিয়েছেন। মন্ত্র রচনাকারী ঋষিগণের স্বগতোক্তি হইতেছে-আমরা বহু পরিশ্রমে এবং নিজেদের জ্ঞান ও সাধ্যানুসারে এই শ্লোকগুলি রচনা করিয়াছি।”
সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ঋগ্বেদেব প্রথম মণ্ডলে (১ম-৩৪/১১) দেবতাগণের স্তুতিতে দেবগণের সংখ্যা মাত্র তেত্রিশটি দেখা যায়, কিন্তু দশম মণ্ডলে (১০-৫/ ৬) সেই সংখ্যা বর্ধিত হয়ে ৩ হাজার ৩০৯ জনে পরিণত হয়েছে।'
অতএব নীতি অনুসারে মানুষের রচিত একটিই ইতিহাসে একাংশের একই বক্তব্য অন্যাংশে বিপরীতে রূপধারণ করলে তাকে যদি ইতিহাস বলে গ্রহণ না করা যায়, তবে নিঃসন্দেহে এই প্রকার গ্রন্থের বিচার ধর্মগ্রন্থরূপে অনাবশ্যক হলেও বিজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে অন্তত ইতিহাস হিসেবে এগুলো গ্রহণ করানো যায় না মোটেই।
অনুরূপ রামায়ণ ও মহাভারতকেও হিন্দু ধর্মের পবিত্র পুস্তক বা ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলা হয়। কিন্তু নিরপেক্ষ সূক্ষ্ম সমালোচক এবং প্রতিভাদীপ্ত ঐতিহাসিকগণ ঐ দুটি গ্রন্থকে ইতিহাস বলে স্বীকার করেননি। উদাহরণস্বরূপ বিখ্যাত ঐতিহসিক শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ সেন এমএ পিএইচডি আরএস ডিলিট মহোদয় বলেন, “রামায়ণ ও মহাভারত কিন্তু কাব্যের বই ইতিবৃত্ত নহে। সত্য সত্যই রাম ও যুধিষ্ঠির নামে কোন রাজা ছিল কি না তা বলা যায় না।”
এমনিভাবে ধর্মীয় পবিত্র পুরাণ সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। পুরাণ যে একটা ইতিহাস এবং তা যে নির্ভুল একথা ঐতিহাসিকগণ এবং বিশ্ববরেণ্য হিন্দু পণ্ডিতগণ অনেকেই স্বীকার করেন না। ভারতের বিখ্যাত মনীষী এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতি পণ্ডিত স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “স্মৃতি পুরাণাদি সামান্য বুদ্ধি মানুষের রচনা; ভ্ৰম, প্রমাণ, ভেদবুদ্ধি ও দ্বেষবুদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তার যেটুকু উদ্ধার ও প্রীতিপূর্ণ তাই গ্রাহ্য, অপরাংশ ত্যাজ্য”- (স্বামী বিবেকানন্দ ‘পত্রাবলী ৩য় ভাগ ৭৪ পৃষ্ঠা।)
স্বামী বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন এরূপ ধর্মগ্রন্থকে সম্বল করে বা তাকে সঠিক ইতিহাস বলে ভারত তথা হিন্দু জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। বরং রক্ষা করা যেতে পারে যদি ইসলাম ধর্মকে বৈদিক ধর্মের সাথে মেশানো হয় তবেই। প্রমাণস্বরূপ বিবেকানন্দ বলেছেন, “আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামী দেহ একমাত্র আশা। আমার মাতৃভূমি যেন ইসলামীয় দেহ এবং বৈদান্তিক হৃদয়রূপ এই দ্বিবিধ আদর্শের বিকাশ করিয়া কল্যাণের পথে আশ্রয় হয়েন।” (দ্রষ্টব্য, বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৮ম খণ্ড)
এবার আসুন প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের সম্বন্ধে বিশ্ব মনীষীদের অমূল্য বক্তব্যকে নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা করা যাক।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক মিঃ ব্রাউন বলেছেন, “আরবীয়ানরা বিশ্বকে সর্বপ্রথম ইতিহাস লিখন শিক্ষা দেয়। তাহাদের ইতিহাস লেখার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, প্রকৃত ঘটনার সাথে কাল ও অবস্থা সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞাত হওয়া যেত। যেহেতু তাহাদের ইতিহাসের মত উপযুক্ত ইতিহাস কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপেও পরিদৃষ্ট হয় নাই।”
আর একটি মূল্যবান উদ্ধৃতি খুবই উল্লেখযোগ্য বলা যেতে পারে- “অতি বাস্তব ও প্রকৃত ঘটনা এই যে, মুসলমানরাই বিশ্বের সর্বপ্রথম ইতিহাস লেখার সূত্রপাত করে। ইহার পর এরূপ ত্বরিত গতিতে উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে যে, ইউরোপ অদ্যাবধি উহার সমপর্যায়ে আসতে সক্ষম হয় নাই। কারণ মুসলমানেরা ইতিহাস লিখনে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করতঃ প্রকৃত ও সত্য বিষয়বস্তু বিনা স্বার্থে, সত্যের অপলাপ না করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু বর্তমান ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের ইতিহাস উল্লিখিত দোষসমূহ হইতে মুক্ত হইতে পারে নাই।” (কোঃ প্রঃ পঃ)
R. A. Nicholson বলেন–
The sacred book offered many difficulties both to the Arabs and especially to persians and other Muslims of foreign extraction. For their right understanding of the Holy Quran, a knowledge of Arabic grammer and philosophy was assential and this involved the study of ancient pre-Islamic poems. The study of those poems entaild researches into genealogy and history, which in course of time become independent branches of learning.
অর্থাৎ- পবিত্র গ্রন্থ (কুরআন) আরববাসীগণ এবং বিশেষ করে পারস্যবাসীগণ ও বিদেশী বংশের অন্য মুসলমানদের বহু অসুবিধার মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। পবিত্র কুরআনের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝবার জন্য আরবী ব্যাকরণ ও দর্শনে জ্ঞান লাভ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিল এবং তজ্জন্য প্রাচীন প্রাগৈসলামিক কবিতা সকল পাঠ করতে হত। ঐ কবিতাবলি পাঠের নিমিত্ত বংশ বিবরণ ও ইতিবৃত্ত পাঠ করার প্রয়োজন হত, যার ফলে কালক্রমে ইতিহাস বিদ্যা এক বিশেষ ও স্বতন্ত্র শাখাতে পরিণত হয়েছিল।
Mr. Draper বলেন - In Whatever direction we look, we meet in vaious parsuil of peace and war, of letters and science, saracenic vestiges.
অর্থাৎ- আমরা যেদিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন যুদ্ধ ও শান্তির বিভিন্ন কার্যকলাপে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন সাধনায় আরবীয় পদচিহ্ন বা নিদর্শনসমহ দেখতে পাই।
আমরা নানা মনীষীর মতবাদকে নিয়ে গবেষণা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হব যে, মুসলমান তথা আরববাসীরাই বিশ্বে ইতিহাসের সূত্রপাত করেছে। এদের পূর্বে জগতে ইতিহাস লেখার কোন সুনিয়মিত ব্যবস্থা ছিল না। বলা বাহুল্য, ইসলাম গগনে এমন অসংখ্য মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে, যাঁরা দেদীপ্যমান নক্ষত্ররাজির ন্যায় জগতের বিভিন্ন মণ্ডলকেই প্রভা বিকিরণ করেছেন। মুসলিম জগতে বহু স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক ও ইতিহাসের জন্ম হয়েছে যাদের নাম আমরা পূর্বেই কিছু কিছু উল্লেখ করেছি। এবং এখানেও কিছু খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসের নাম লিপিবদ্ধ করছি।
বিখ্যাত মুসলমান ঐতিহাসিক বেলাজুবী দুখানি বৃহৎ ইতিহাস লিখে গেছেন। একটি ‘ফাতহুল বুলদান’ এবং দ্বিতীয়টি ‘আনসাবুল আশরাফ ওয়া আখবারোহ’ নামে বিখ্যাত। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে কাতীবাহ একখানি বিখ্যাত ইতিহাস লিখে গেছেন যার নাম ‘ওয়ুনুল আখইয়ার’। আহম্মদ বিন আবু ইয়াকুব বিন জাফর ‘তা-রিখি ইয়াকুবী’ নামক এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস লিখে গেছেন যার মধ্যে ৯৬৯ সালের পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণিত আছে। ইতিহাসটি কতটুকু প্রশংসার দাবি রাখে তা প্রমাণের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, লন্ডনে বিভিন্ন প্রকাশক দ্বারা বার বার এটি ছাপা হয়েছে। সর্বশেষ ছাপা হয় ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে লন্ডনেই। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই-এর আংশিক অনুবাদ করা হয়েছে, কিন্তু পূর্ণভাবে অনুবাদ করা হয়েছে নিশ্চিত সূত্রে পঁচিশটি ভাষায়। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবু হানিফা আহমদ দিনাওয়ারী তাঁর রচিত “কিতাবুল আখবারিত্তি ওয়াল’ নামক গ্রন্থে পারস্য দেশের সুবিস্তৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক হযরতের জীবনী রচনা করে সর্বপ্রথম ইতিহাস লেখার দ্বারোদঘাটন করে বিশ্বকে ইতিহাস রচনার প্রতি অনুপ্রাণিত করেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম তাবারী বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ইতিহাস লেখক। তিনি ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। তাঁর লেখা “তারিখে তাবারী” মোট বার খণ্ডে ছাপা হয়েছিল। বইটির পাতা ছিল বার খণ্ডে আট হাজারেরও বেশি। তিনি “আখবারুর রসূল ওয়াল মুলুক” নামক বিখ্যাত ও সুবৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থখানিতে বিশ্বের সৃষ্টি হতে ৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস লিখে গেছেন। এই বার খণ্ড বইও ইংল্যাণ্ডে ছাপা হয়েছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক মাসয়ুদী একজন বড় ভূগোলজ্ঞ ছিলেন এবং ভূ-পর্যটকও ছিলেন। তিনটি বৃহদাকার ইতিহাস তাঁকে অমর করে রেখেছে। ১। ‘আখবারুজ্জামান’, (২) ‘মারওয়াজুজ জাহাব’ ও (৩) ‘তানবিহুল আশরাফ’ তিনটি বই-ই খুব সুখ্যাতি অর্জন করেছে তন্মধ্যে ২নং বইটি পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ‘কামিল’ নামক সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস (১২৩১ খৃঃ পর্যন্ত) রচয়িতা ইবনুল আসীর ত্রয়োদশ শতাব্দীর সুবিখ্যাত ঐতিহসিকরূপে খ্যাতি লাভ করেন।
প্রায় ৭৫০০ জন সাহাবার (হযরতের অনুচরবর্গ) জীবন চরিত অবলম্বনে তিনি ‘উসদুল গাবাহ’ নামে এক অভিনব ইতিহাস প্রণয়ন করেন। আসসওলী লিখিত বিখ্যাত ‘আখবারুল আব্বাস’ এক অতি বিশেষ বিশ্বাস্য ইতিহাস। তার দ্বিতীয় সৃষ্টি ‘কিতাবুল ফিদ-আ’ যা একটি প্রামাণ্য এবং প্রাণবন্ত ইতিহাস। ইবনে তাইমিয়া নামক স্বনামধন্য ও সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ১২৬২ খ্রিস্টাব্দে জন্মে ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। তাঁর সমগ্র জীবনে সর্বমোট ৫৯১ খানা গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে তিনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তথা জগতের আসরে এক অক্ষয় কীর্তি ও এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে গেছেন। ইবনে খালদুন নামক বিখ্যাত স্পেনীয় ঐতিহাসিক জগতের ইতিহাসে ইতিহাস রচনায় এক নতুন প্রণালী প্রবর্তন করেন। তাঁর মত রহস্য উদঘাটনকারী ও গভীর অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ঐতিহাসিক দার্শনিক পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। Prof. Hitti তার সম্বন্ধে বলেনঃ Ibn Khaldun was the greatest historical philosopher Islam producted and one of the greatest of all times. প্রাচ্যের একজন প্রখ্যাত ভুগোলজ্ঞ ‘মুয়াজামুল বুলদান’ নামে যে ভৌগোলিক বিশ্বকোষ রচনা করেন তাতে ইতিহাস পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ইতিবৃত্ত এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আলোচিত হয়েছে।
এমনিভাবে আননাদিম আলরাজি, আবুল ফারজ, ইবনে মাসবুক, ইবনে হেজম, ইবনে আসাকীর, আলজাওজির প্রমুখ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বিশ্বের বই পুস্তকে বেঁচে থাকলেও আমাদের হৃদয়দুর্গে প্রবেশ করতে পারেন নাই। কেন, সে কারণ অদূরেই অনুমেয়।
এই অবসরে আমাদের সাধের ভারতের ইতিহাসের অবস্থাটা একটু পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাক।
ভারতবর্ষ প্রাচীন যুগ হতেই ইতিহাসের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। অবশ্য পুঁথি, উপন্যাস ও কাব্যের কথা বলছি না। কিন্তু এই যুগে ইতিহাস লেখার লেখক ডজন ডজন শহরে, পল্লীতে পাওয়া যাচ্ছে, যারা কাগজে কালি দিয়ে অবিরত লিখে যাচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাজারে। কিন্তু আগেই বলেছি, আবার বলছি, কাগজের উপর লেখা সুন্দর হবে শুধু কাগজ পরিষ্কার থাকলেই নয় বরং মগজ পরিষ্কার থাকলে তবেই। অথচ মগজে এখনও বেশির ভাগ ইংরেজের পঙ্কিল প্রভাব পরিছন্ন। তদুপরি অনেকেরই যোগ্যতার অভাবও অস্বীকার করা যায় না।
এবারে আসুন উপযুক্ত মন্তব্যের সাক্ষীস্বরূপ সুবিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, সমালোচক এবং ইতিহাসবিদ শ্রী হেমেন্দ্র কুমার রায় মহাশয়ের লেখা হতে কিছু অংশ তুলে দেওয়া হোক-“ভারতবাসীরা ইতিহাস রচনার জন্য খ্যাতি লাভ করেনি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস দুর্লভ। মুসলমানরা এদেশে এসে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করেন বটে এবং তাঁদের দেখাদেখি অল্প কয়েকজন হিন্দুও কিছুকিছু ঐতিহাসিক রচনা রেখে গেছেন। কিন্তু সে রচনাগুলি প্রায়ই নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। এদেশে নিয়মিতভাবে ইতিহাস রচনার সূত্রপাত করেন পাশ্চাত্য লেখকরাই। যদিও সেসব হচ্ছে বিজেতার লিখিত বিজিত দেশের ইতিহাস। তবু তাঁদের মধ্যে অল্পবিস্তর পাওয়া যায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং প্রচুর মূল্যবান তথ্য এবং একথা বললেও ভুল বলা হবে না, বাঙালিরা ইতিহাস রচনা করতে শিখেছে ইংরেজদের কাছ থেকেই।” আমরা কিন্তু ইতিহাসের বাজারে খুবই নতুন লোক। তাই হেমেন্দ্র বাবু পরেই বলেছেন-“বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথম শুরু বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের দিকে বাঙালীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তার যুগেই বাঙালিরা বিশেষভাবে ইতিহাস রচনায় নিযুক্ত হন। কিন্তু আমাদের ইতিহাস রচনায় প্রাথমিক প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য হয়েছিল বলে মনে হয় না। অনেকেরই সম্বল ছিল কেবল ইংরেজদের লিখিত ইতিহাস। অনেকের রচনা হচ্ছে অনুবাদ। অনেকে স্বাধীন চিন্তাশক্তির পরিচয় দিতে পারেননি। অনেকের ভেতর ছিল না সত্যিকার ঐতিহাসিক সুলভ মনোবৃত্তি। অনেকেই নন নিরপেক্ষ সমালেচিক। অনেকে অল্প বা বিনা পরিশ্রমে হতে চাইতেন ঐতিহাসিক।”
তারপর শ্রী হেমেন্দ্র বাবু আরও বলেছেন-“বঙ্কিমোত্তর যুগে বাংলার ঐতিহসিক সাহিত্য ধীরে ধীরে উন্নত হতে লাগলো। কিন্তু সে উন্নতিকে সর্বোতভাবে আশাপ্রদ বলা যায় না। সে সময়ে এমন ঐতিহাসিক ছিলেন, যিনি মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত এবং গুপ্ত বংশীয় চন্দ্রগুপ্তকে অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে করেছেন। ঐতিহাসিক নিখিল চন্দ্র রায়ের নাম সুপরিচিত। কিন্তু তিনি ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেননি এবং তার রচনাও ভুরিভুরি ভ্ৰম প্ৰমাদে পরিপূর্ণ।” তিনি আরও অগ্রসর হয়ে বলেছেন-“সত্য কথা বলতে কি, আমাদের মাতৃভাষায় আজ পর্যন্ত নিখুঁত ইতিহাস রচিত হয়নি। মাতৃভাষায় যা হয়নি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে একজন বাঙালি ঐতিহাসিকের দ্বারা সেই দুরূহ কাজটি সম্পাদিত হয়েছে। স্যার যদুনাথ সরকার হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক।” (‘যদুনাথ সরকার’ দ্রষ্টব্য)
অতএব এত আলোচনার পর একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আজ জগতের ইতিহাসে যত বড় বড় ইতিহাস আর ঐতিহাসিকের নামই থাকুক না কেন, মুসলমান ঐতিহাসিকরাই প্রকৃত ইতিহাসের জন্মদাতা বা দাত্রীর ভূমিকায় চির ভাস্বর হয়ে আছেন ও থাকবেন। শুধু তাই নয়, মুসলমানেরাই ইতিহাসের আবিষ্কারক, নিয়ামক ও স্রষ্টারূপে বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় বরণীয়, স্মরণীয় ও গ্রহণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল একথা আজ একটু তমসাচ্ছন্ন বোধ হলেও অদূর ভবিষ্যতে তা প্রকাশ্য দিবালোকের মত পরিস্ফুট হয়ে যাবে অবশ্যই।
হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতির মধ্যে ভেদবুদ্ধি ও শত্রুতার প্রচার ও প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ এক নতুন চাল চেলেছিল। সেটি হচ্ছে এই যে, ‘আদালতে পার্সি ভাষার চালচলন এবং চিঠিপত্র, বই পুস্তক ও কাব্য কবিতায় হিন্দুদের মুসলমানদের মত আরবী ও ফারসি ব্যবহার করার পদ্ধতিটা সহ্য করা ঠিক নয়। তোমরা উর্দু ভাষা অঞ্চলে উর্দুর যত প্রভাবই থাক মৃতপ্রায় হিন্দি ভাষার ওপর জোর দাও, আমরা পেছনে তোমাদের সাহায্যকারী।' এইভাবে ভারতের বুক থেকে নিরপরাধ উর্দু ভাষাটার গলাটিপে তার স্থলে সংস্কৃত ভাষার প্রবর্তনের জন্য আমাদের হিন্দু ভাইদের নানা প্রলোভনে এবং যুক্তিতর্কে উত্তেজিত করা হতে লাগল। অবশ্য পরিপূর্ণ কৃতকার্যতা লাভ করলেও পরিশেষে ভাষার রূপ যা দাঁড়ালো তা একটু পরেই অনুধাবন করা যাবে। প্রসঙ্গত একটি কথা অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উর্দু ভাষা কোন বিদেশী ভাষা নয়। অবশ্য আরবী, ফারসি ভাষা ভারতের বাইরে হতে এসেছে কিন্তু উর্দু ভাষা মুসলমান রাজারা ভারতের হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের সাথে পরামর্শক্রমে নিজেদের আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য নানা ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি করেছিলেন। ইংরেজরা ভারতের হিন্দু ভ্রাতাদের শুধু একথাই মনে করিয়ে দেয়নি যে, আর্য জাতি ও আর্য ভাষা সবই ভারতের বাইরে হতে আমদানি।
যাহোক, খ্রিস্টান সাহেবরা অবিভক্ত বাংলাদেশের বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের আঁচে ঢেলে সাজানোর মত করে চালু করার ব্যবস্থা পুরাপুরি গ্রহণ করলো। এক কথায় ভারতের হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে যুগ যুগ ধরে যে শব্দগুলি ব্যবহার করছি তাতে ‘তৎসম’ আর ‘তদ্ভব’ শব্দ দিয়ে আরবী বা ফারসি শব্দের চিরতরে মৃত্যু ঘটানোর চক্রান্ত চললো। হিন্দি ভাষাটিতে মোটামুটি ‘তদ্ভব’ আর ‘তৎসম’ সংস্কৃত শব্দ মিলিয়ে দিলেই প্রায় বাংলা-হিন্দি সমান হয়ে যাবে। অবশ্য উর্দুতে ক্যারতা হ্যায়, ক্যারেগা শব্দগুলোর ‘হ্যায়’, ‘গা’ প্রভৃতি লেজগুলো থাকবে আর দেহটি থাকবে শুদ্ধ বাংলার মানেই “তৎসম” ও “তদ্ভব” ছাপ মারা সংস্কৃত শব্দ। আজ ইংরেজদের সেই স্বপ্নসাধ ফলপ্রসূ হয়েছে।
বাংলাদেশের দিকে ইংরেজরা এত খেয়াল দিয়েছিল কেন? পাঠক মনের এই স্বাভাবিক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যেতে পারে যে, বিশ্বনিয়ন্তা এদেশের অধিকাংশ লোককে এত স্বাধীনচেতা, স্বতন্ত্র বিশ্বাসী, বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন বীর এবং কূটনীতিপরায়ণ এক কথায় এত বিভিন্নমুখী প্রতিভাধারীরূপে সৃষ্টি করেছেন যে, এদের চলন্ত, দূরন্ত ও ছুটন্ত গতিকে যেদিকেই মুখ ঘুরিয়ে দেয়া হবে সেই দিকেই দুর্বার গতি নিয়ে ছুটবে। হারবে, জিতবে, মরবে, বাঁচবে পরোয়া নাই তবু ছোটা চাই। তাই দেখা গিয়েছিল ইংরেজদের অনুশাসনকালেও এই বঙ্গ দেশই ছিল ভারতের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ কলকাতাই ছিল ভারতের রাজধানী। অতএব এই অবিভক্ত বাংলার বিরাটসংখ্যক মুসলমান জাতিকে দুর্বল করার চক্রান্ত শুরু হয়ে গেল। সৃষ্টি হলো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ আর তার কেন্দ্র হল শ্রীরামপুরের মিশন। ১৮০০ সালে মে মাসে শ্রীরামপুরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্ম হলো। ফোর্ট মানে দুর্গ। সত্যিই মুসলমান শক্তিকে দুর্বল করার জন্য ঐ ফোর্টে বহু সৈন্য তৈরি হতে লাগল, যাদের হাতিয়ার হবে কামান, গোলা নয়; বিষাক্ত কাল কালি আর সরকাঠি অথবা পালকের কলম।
ইংরেজ চক্রান্তকারীদের সর্দার মিঃ কেরী হলেন বাংলা আর সংস্কৃত বিষয়ের প্রধান অর্থাৎ যাকে বলে Head of the department. বাকি প্রফেসার সাহেবদের মধ্যে ছিলেন মিঃ ওয়ার্ড, মিঃ মার্শম্যান, মিঃ বার্নস্ ডন প্রমুখ এবং ঐ সঙ্গে টাকায় কেনা কিছু আমাদের দেশীয় বাঙালি ভ্রাতা। মিঃ কেরী সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ বই তৈরি করলেন যেটা দেখলেই বোঝা যায় যে কড়া পাকের সন্দেশ।
মিঃ কেরী সাহেবের চক্রান্ত প্রমাণের জন্য তাঁর এই বাংলা ব্যাকরণের প্রথম সংস্করণের ভূমিকা থেকে কিছু অংশ আমার বিচক্ষণ ও জ্ঞানসম্পন্ন সূক্ষদশী পাঠক-পাঠিকাবৃন্দের উদার দৃষ্টির সামনে তুলে ধরা হলো, যা থেকেই তাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের যথেষ্ট পরিচয় মিলবে।
"The language in which the classical books of the Hindoos are written is principally derived from Sanskrit. This is called pure Bengali, but multitudes of words, originally Persian or Arabic, are not constantly empoyed in common converstaion, which perhaps ought to be considered as enriching rather than corruption the language."
অর্থাৎ - হিন্দু সমাজের উচ্চ শ্রেণীর পুস্তকাদি যে ভাষায় লেখা হত তা প্রধানত সংস্কৃত ভাষা হতেই উৎপত্তি সিদ্ধ এবং এটাকেই বিশুদ্ধ বাংলা বলে অভিহিত করা হত। কিন্তু ফারসি অথবা আরবীয় কোন শব্দ সমষ্টিকে সাধারণ কথোপকথনে অবিরতভাবে ব্যবহার করা হত না, হয়তো এগুলো ভাষাকে উর্বর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বলে বিবেচিত হত। বরং সত্য বলতে কি এগুলো ছিল ভাষাকে দূষিত কারক।
এদিকে আরবী ও ফারসি বিভাগও খোলা হলো, উদ্দেশ্য শুধু সর্বনাশ সাধন, কারণ সেখানে কোন মুসলমান পণ্ডিতরা মাথা গলিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। তবে ইংরেজ সত্যিই বাহাদুর। তারা এই ভূমিকা নেবার আগেই বহু বিখ্যাত লোক বহু বছর ধরে বহু শ্রম সাধনা করে আরবী, ফারসি ও উর্দু শিখেছিল, সেই সঙ্গে বাংলা ও সংস্কৃত। তবে খুব ভালভাবে শেখা যে তাদের হয় নাই প্রমাণ একটু পরেই আসছে। তাতেই তাদের বাংলা ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যাবে। তবে তারা ছিল শাসক সম্প্রদায়। প্রচুর টাকা-পয়সার বিনিময়ে ভাড়াটে লোক এনে যে পুস্তক যে ভাষার প্রয়োজন হয়েছে অনুবাদ করে কাজ সমধা করে নিয়েছে। আসলে তো আর তাদের বাংলাপ্রীতি ছিল না অথবা বাংলা ভাষায় পুত্র, কন্যা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সাথে প্রাণের কথা, প্রণয়ের কথা, গোপন কথাও তারা বলত না, শুধুমাত্র শাসন আর শোষণের জন্য এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচার প্রসারের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু মাত্র।
যাহোক, তের-চৌদ্দ বছরের মধ্যেই ইংরেজরা এ ব্যাপারে কৃতকার্যতা লাভ করলো। প্রমাণস্বরূপ, প্রফেসর শ্রী বিনয় সরকারের লেখার আংশিক তুলে ধরছি- “পাদ্রি কেরী, মার্শম্যান প্রমুখের সহায়তায় হিন্দু পণ্ডিতবর্গ সংস্কৃত মেশানো বাংলা গদ্য ভাষা সৃষ্টি করিয়া গদ্য গ্রন্থ প্রণয়নে যত্নবান হইলেন। নব আবিষ্কৃত এই গদ্য ভাষায় মুসলমানগণ সহসা প্রবেশ করিতে পারেন নাই। ফলে প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল তাদের লেখনী অচল হইয়া রহিল। সুদীর্ঘ ছয়-সাত বৎসরকাল যে মুসলমান বাংলা তথা ভারতবর্ষ শাসন করিয়া আসিয়াছে তাহারা অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজ্যচ্যুত হইয়া একেবারে দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছিল। এই সময়ে নানা দিক হইতে আক্রমণাত্মক আঘাত-সংঘাতে মুসলিম সমাজ জর্জরিত হইয়া উঠিয়াছিল। ফলে সমাজের ভিত্তি মূল অনেকখানি শিথিল হইয়া পড়িল।”
আজ যে হিন্দি রাষ্ট্র ভাষা তাও ইংরেজদের কারখানার কল্যাণে। বিহারে ইংরেজ সরকারের মোটা মাইনের চাকরিপ্রাপ্ত শ্রীযুক্ত ভূদেব মুখোপাধ্যায় ওপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন যে, হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। প্রমাণস্বরূপ একজন হিন্দি সমর্থক ভ্রাতা ভূদেব বাবুর জন্য যা লিখেছেন তাই তুলে দিচ্ছি এখানে–
“একদা তিনি বিহার প্রদেশে শিক্ষা বিভাগে কর্ম করিতেন। সেখানে তিনি দেখিলেন, হিন্দি অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের উর্দু ভাষা চলিতেছে- তাঁহার নিপুণ হস্তক্ষেপের ফলে তাহা উঠিয়া গেল। বিহারে হিন্দি ভাষা চালু হইল। এজন্য বিহারের গ্রাম্য কবিগণ তাঁহাকে প্রশংসা করিয়া কত গান লিখিয়াছিলেন। আজ হইতে বহু দিন পূর্বে তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন হিন্দি ভাষাই ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হইবার উপযুক্ত।”
অথচ আগেই বলেছি যে হিন্দি ভাষার অর্ধেকটা সংস্কৃত মার্কা বাংলা আর অর্ধেকটা উর্দুর ‘হ্যায়’, ‘গা’, ‘গি’ প্রভৃতি। তবে বিরুদ্ধবাদীদের আনন্দ শুধু এতটুকুই যে, হিন্দির অক্ষরগুলো আর সংস্কৃতের অক্ষরগুলো প্রায় একই। অন্তত আরবী, ফারসি ও উর্দুর অক্ষর ‘আলিফ’, ‘বে’ হতে পরিত্রাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আর একটু ভুল থেকে গেছে। বোধ হয় চোখে পড়েনি অনেকের। ভাষার নামটি ‘হিন্দি’ না দিয়ে ‘ভারতী’ দিলেই ভাল হত। কেননা ঐ ‘হিন্দি’ শব্দটিও মুসলমানদের সৃষ্টি, তাঁদেরই দেওয়া নাম। ‘সিন্ধু’, ‘হিন্দু’ প্রভৃতি তাঁদেরই রাখা স্নেহের নাম। আজকের বাংলা অভিধান খুললেই পাওয়া যাবে ‘হিন্দি’ মানে জাতি বিশেষ, হিন্দু, বৈদিক ধর্মাচারী ভারতবর্ষবাসী। ফার্সী (<সিন্ধু)। বি।'
এমনিভাবে শ্রীযুক্ত বিদ্যাসাগর মহাশয় এবং শ্রীযুক্ত মৃতঞ্জয় বাবু প্রমুখ লেখক ঐ রাস্তাতেই চলতে লাগলেন। কিন্তু শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে বিরোধিতা করেছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখার বিরুদ্ধে, মতের বিরুদ্ধে এবং তাঁর সুখ্যাতির বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিম বাবু যা বলেছেন হুবহু তাই উদ্ধৃতি দিচ্ছি। বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, “বিদ্যাসাগর কঠিন সব সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাংলা ভাষার ধাপটা খারাপ করে গেছেন।”
তাছাড়া শ্ৰী সজনীকান্ত দাস মহাশয়ের লেখার দিকে তাকালেই আরও প্রমাণ হবে প্রবহমান পর্যালোচনা। দাস বাবু লিখেছেন, “১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হালহেড এবং পরবর্তীকালে হেনরি পিট ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরী বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত জননীর সন্তান ধরিয়া আরবী-ফারসির অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি করিয়াছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই তিন ইংলণ্ডীয় পণ্ডিতের যত্ন ও চেষ্টায় অতি অল্পদিনের মধ্যে বাংলা ভাষা সংস্কৃতি হইয়া উঠিয়াছে।”
১৭৭৩ সালে ইংরেজদের নিয়ামক আইন (Regulating act) সৃষ্টি ও কার্যকরী হবার পরেই আরবী ফারসি হত্যার খড়গ তথা হিন্দু মুসলমানদের মৈত্রী ছেদনে অস্ত্র তৈরির কারখানা ঐ দুই প্রতিষ্ঠান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও শ্রীরামপুরের মিশন ও তার সঙ্গে বিলেতী প্রেসটির চাকা ঘুরিয়ে আমাদের মগজ গুঁড়িয়ে পরিবেশ যখন অনুকূল হয়ে উঠল তখনই ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে আইনের সাহায্যে দেশময় ঘোষণা করা হল যে, সরকারি আদালত শহর বা গ্রামে কোন স্থানেই পারসি ভাষার ব্যবহার চলবে না। ব্যবহার চলবে ইংরেজি আর বাংলার, কিন্তু মাতৃহারা সন্তানেরা যে অবস্থা হয় পারসিকে হারিয়ে নবোদ্ভূত বাংলার অবস্থাও হল তদ্রুপ শ্রীহীন। অবশ্য একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইংরেজরা শত চেষ্টা করেও পারসিকে বাংলার হৃদয় থেকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারেনি। আর বাস্তাবিক তা পারা সম্ভবও নয়। আজ আমাদের সাধের বাংলায় অসংখ্য পারসি শব্দ এখানে ওখানে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ইংরেজ বাহাদুররা তা বোঝেনি তাই পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে যে ধরনের বাংলার সৃষ্টি করেছিল তাতেও অনিচ্ছা সত্ত্বেই বহু আরবী, পারসি, উর্দু শব্দ থেকে গিয়েছিল। ফলে ইংরেজি ডিজাইন আর আরবী, পারসির সংমিশ্রণে নতুন বাংলা ভাষা যে রূপ পরিগ্রহ করেছিল তা সত্যই অনুধাবনযোগ্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিচে সাহেবদের হাতের নতুন বাংলার কিছু নকল দেওয়া হলো “আমি এই অবধি বুঝিয়াছি বিশয়ের সহিত। যেকোন কেতাব অদ্যাবদি প্রকাশ না পাইয়াছে সিখাইতে তোমাদিগকে ইঙ্গরাজি কথা আর অনায়াসে তাহতে লউয়েছে আমারে সংগ্রহ করিয়া তরজমা করিতে এই কেতাব।”
শুধু লেখনীর জগতেই নয় অনুবাদের জগতেও আমাদের ইংরেজ বাহাদুরের কতদূর অবদান ছিল তারও কিছু নমুনা নিম্নে দেওয়া হলো–
"Now the wages of sin is death-but the gift of God is eternal life. Throuth Jesus christ our lord."
বঙ্গার্থঃ “গোনার মাহিনা মিতু কিন্তু খোদর দেওয়া চির প্রমাই জিজছ ক্রাইস্ট হইতে।”
এগুলো সব ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের আইন প্রণয়নের পূর্বের নমুনা। ১৭৮৩ খ্রিঃ পর্যন্ত এনবি এডমন সাহেব যখন ইংরেজ সরকারের ফারসি অনুবাদকের পদে ভূষিত হলেন তখন তাঁর নিজের হাতের তর্জমা বা অনুবাদের নমুনা দেখুন তাতে। কত ফারসি ও আরবীর সংমিশ্রণ! পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার্থে আরবী ও ফারসি শব্দগুলোর নিচে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হল।
সেওয়ায় মহালাত মুতালুকে সহর মুরসিদাবাদ ও আজিমাবাদ ও জাহাগির নগর জে এই তিন মকামে আদালতের সিরিস্তা আলাহিদা মোকারর হইল আর এই তিন এলাকার সরঙ্গ সাহেব জেলাদিগের তজবিদ মতে হইবে মঞ্জুর হইল। এবং সেওয়ার সহর কলিকাতা জে বড় আদালতের তাবে আছে জারি থাকিবেক।”
আসুন আরও একটা দৃষ্টান্তের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি- “আমার সন্তান রহিত- অন্তেষ্টিক্রিয়া তগদি করাইয়া সাকীম তফশীল জমি আবাদ তবদুদ করিয়া ও শিষ্য সেবক বহাল রাখিয়া পুত্র পৌত্রাদিক্রমে পরম সুখে ভোগ করিয়া ইহার দান বিক্রয়ের সত্তাধিকার তোমার। আমি কিংবা আর কেহ দাওয়া করে সে ঝুটা ও বাতিল।” ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক দৃষ্টান্তের অবতারণা করা যায় কিন্তু বাহুল্য জ্ঞানে তা পরিত্যাগ করলাম।
যাহোক, আগেই বলেছি হিন্দু, মুসলমান একে অপরের ভাব ভাষায় মিলনমৈত্রীর পরিপ্রেক্ষিতে সংকীর্ণতার দৃষ্টি না দিয়ে নিজেদের ভাষাকে পরস্পরের মধ্যে খাপ খাইয়ে নিয়ে এক অপরূপ নতুন ভাষার আবিষ্কার করেছিল। যার জোয়ারে ভারতীয় জনজীবন নতুন আস্বাদে প্লাবিত হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ মনিবদের কল্যাণে বঙ্গ ভাষায় সংস্কৃত মিশে প্রথমে যা সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল তা সংস্কৃতের মত সমাজে ব্যবহার অনুপযুক্ত। শ্রী মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যা লঙ্কার মহাশয়ের ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা’র একটু অংশ তুলে ধরলেই এ সত্য প্রমাণিত হবে।
“কোকিল কলালাপ বাচলে যে মলয় নিল সে উচ্ছলচ্ছী কয়াত্যচ্ছ নিঝরাষ্টঃ কনাচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে।”
একটি পত্র পাওয়ার পর প্রত্যত্তর লিখবার বহরখানা কেমন ছিল তাও এক উৎকট উদাহরণ লিপিবদ্ধ করা হল “পরম প্রণয়ার্ণব গভীর নীর তীর নিবসিত কলেবরাঙ্গ সম্মিলিত নিতান্ত প্রণয়শ্রিত শ্ৰী অঙ্গমোহন দেব শৰ্মনঃ ঝটিত ঘটিত বাঞ্ছিতান্ত বরণের বিজ্ঞপণাঞ্চাদৌ শ্ৰী মতীর শ্রী করকমলাঞ্চিত কমল পত্রী পঠিত মাত্র শুভম্ভিশেষ।” (প্রাচীন শিশু বোধকের ভাষা)।
আমাদের শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ও ঐ সংস্কৃতি রঙে রঞ্জিত করেছেন তার গদ্যকে। কিন্তু গড়ার পরে তা হয়ে গেছে সংস্কৃতমাখা পদ্য। নমুনাস্বরূপঃ “রে পাষাণ্ড মৃণ্ড এই প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড দেখিয়াও কাণ্ডজ্ঞান শূন্য হইয়া বকাণ্ড প্রতাশ্যার ন্যায় লণ্ড ভণ্ড হইয়া ভণ্ড সন্ন্যাসীর ন্যায় ভক্তি ভাণ্ড ভঞ্জন করিতেছে এবং গবা পণ্ডের ন্যায় গণ্ডে জমিয়া গণ্ডকীস্থ গণ্ডশীলার গণ্ড না বুঝিয়া গণ্ডগোল করিতেছে।”
বাবু বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, “সংস্কৃত প্রিয়তা এবং সংস্কৃতানুকারিতা হেতু বাঙালা সাহিত্য অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন দুর্বল এবং বাঙালি সমাজে অপরিচিত হইয়া রহিল।”
কিন্তু লজ্জা ও দুঃখের কথা, সাহিত্য সম্রাটের ব্যবসাদারী মনোভাব নিজের নীতি হতে তাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তিনি বুঝিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষা মিশিয়ে কঠিন শব্দ সৃষ্টি করলে সকলে বুঝুক বা না বুঝুক প্রশংসা পাওয়া যাবে যথেষ্ট। কারণ মূর্খ অর্ধমূর্খের সংখ্যই সমাজে অধিক। তারা যা জানে না বা বোঝে না তারই ওপর তাদের দাবি- তারা সব জানে সব বোঝে। ভাল না লাগলেও তারাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। পক্ষান্তরে শিক্ষিতগণ মনে করবেন, এঁরা আমাদের চেয়েও শিক্ষিত বেশি। কারণ এই কঠিন দুর্বোধ্য বিষয়ের রহস্য আর আনন্দের পরিচয়ে তারা আমাদের অপেক্ষা বিপুলভাবে অগ্রণী ও জয়যুক্ত। তাই শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথেই পাড়ি দিলেন অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ দিয়ে বাংলা ভাষাকে তিনি কঠিন করে তুললেন। উদাহরণ তার লেখার পাতায় পাতায় বিদ্যমান। এখানে শুধুমাত্র নমুনাস্বরূপ সামান্য একটু অংশ তুলে ধরছি।
“সোম প্রকাশ” পত্রিকার সম্পাদক শ্রী দারকানাথ বিদ্যাভূষণ বঙ্কিম বাবু ও তার অনুসরণকারীদের উপহাস করে সমালোচনা করতেন “শব পোড়া-মরাদাহের দল” বলে। আর বঙ্কিম বাবু প্রতিপক্ষ দলকে গালি দেবার সাথে বলতেন ‘ভট্টাচার্যের চানা’।
তাই সর্বশেষে বলব, আমরা প্রত্যেকটি মানুষ সারা দিনে আমাদের ভাষার মধ্যে যেমন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি তাতে আভিজাত্য ও শিক্ষাসুলভ পরিচয় বহন করে, তেমনি আরবী, ফারসি ও উর্দুর বেলাতেও তাই-ই হওয়া উচিত ছিল। তাই কবি ভারতচন্দ্র মুসলমানদের ভাল চক্ষে না দেখলেও মুসলমান সাহিত্যের ধারাকে বর্জন করতে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন–
“না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি ভাষা যবনি মিশালা”
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/490/9
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।