hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইতিহাসের ইতিহাস

লেখকঃ গোলাম আহমাদ মোর্তজা

৫১
বঙ্গে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের ভূমিকা
পূর্ববঙ্গে মাদারীপুর গ্রামে মাওলানা শরিয়াতুল্লাহর জন্ম হয়। তার বাবা-মা যে খুব ইসলামভক্ত ছিলেন তাঁর নামই তার সাক্ষী। আঞ্চলিক পড়া শেষ করে কলকাতায় এসে মাওলানা বাশারত আলীর কাছে যুবক শরিয়তুল্লাহ উচ্চশিক্ষা নিতে থাকেন। ঐ মাওলানা সাহেবই ছিলেন হযরত আহমদ সাহেবের ভক্ত এবং একজন গুপ্তযোদ্ধা। সুতরাং জেহাদের মন্ত্র দিতে ও নিতে কারও কোন বাধা ছিল না। তারপর গুরু-শিষ্য উভয়ে মক্কা গেলেন এবং গুরু-শিষ্যের আরও উচ্চশিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে হানাফী মজহাবের বিখ্যাত পণ্ডিত তাদের সোম্বালের নিকট সুফিতত্ত্বের শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বঙ্গদেশে ঠিক ১৮১৮ খৃস্টাব্দে এসে উপস্থিত হন। ঠিক এই রকম রত্নই খোঁজ করছিলেন হযরত আহমদ ব্রেলবী বঙ্গ দেশের জন্য। ১৮২১ খৃস্টাব্দেই কলিকাতায় যোগাযোগ হয় এবং তাঁকে তাঁর পদ সম্বন্ধে সচেতন করা হয়। মাওলানা শরিয়তুল্লাহ সাহেব ইংরেজ সৃষ্ট জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করা ও ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই মনে করে শোষিত, অত্যাচারিত কৃষক, তাঁতী, কুলি প্রভৃতি অনুন্নত ও দরিদ্র শ্ৰেণীর মধ্যে আন্দোলন পরিচালনা করেন। একটা কথা খুব মনে রাখা দরকার সেটা হচ্ছে এই যে, মুসলমান জমিদারও কিছু ছিল, যারা আন্দোলনের প্রতিকূলে ছিল। তাদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। ঐ সময় হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান কৃষকদের নিকট কালীপূজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদিতে কর আদায় করতেন, যা ইসলামবিরোধী। অন্যদিকে মুসলমান প্রজাদের জন্য ঈদুল-আজহা পর্বে গরু ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছিল। মাওলানা শরিয়তুল্লাহ পূজার চাঁদা দিতে মুসলমানদের নিষেধ করেন এবং পর্বে গরু ব্যবহারের উৎসাহ প্রদান করেন।

মোটকথা তিনি ধর্ম সংস্কারকরূপে সংগ্রাম চালিয়ে সংগ্রামের বুনিয়াদ মজবুত করে ফেললেন। সেই সঙ্গে তাঁর ছেলে আলাউদ্দিন আহমাদকে (ডাকনাম দুদু মিঞা) মক্কা পাঠালেন। সেখানে বিদ্যা শিক্ষা লাভের পর বাড়ি এলেন এবং পিতার নিকট উচ্চশিক্ষা নিয়ে তিনি উপযুক্ত প্রতিনিধিতে পরিণত হলেন। ১৮৪০ খৃস্টাব্দে শরিয়তুল্লাহ দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর তিন-চার বছর আগেই দুদু মিঞা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। পিতার মৃত্যুর পরেই তিনি সংগ্রামের ধারা একটু বদল করলেন। হিন্দু-মুসলমান দরিদ্র প্রজা শ্রেণীর মানুষের কানে প্রথমে তিনিই সাম্যবাদ প্রচার করেন আর বলেন, জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি হিন্দুর ওপর অত্যাচার হয় তাহলেও ইসলাম অনুযায়ী আমাদের তাদের পাশে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাওয়া ধর্মের বিধান। যদি না যাওয়া হয় তাহলে তা অধর্মের কাজ হবে। তিনি শাসনতন্ত্র কায়েম করলেন। সশস্ত্রবাহিনী তরোয়াল, সরকি, তীর-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিত হয়। সর্বপ্রথম তিনি বিপ্লবী খেলাফত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেন পুরোপুরিভাবে। এই শাসন পদে সর্বোচ্চ পদে যিনি থাকতেন তাঁকে বলা হতো ‘ওস্তাদজি’। তাদের পরামর্শদাতারা দুজন ছিলেন খলিফা, এমনিভাবে সুপারিনটেনডেন্ট খলিফা, ওয়ার্ড খলিফা, গাঁও খলিফা প্রভৃতি নানা নামে পদের ব্যবস্থা ছিল। তিন-চারশত বিপ্লবী পরিবার নিয়ে একটি গ্রাম ইউনিট ছিল। সুপাঃ খলিফার একজন পিয়ন ও একজন পেয়াদা থাকতো তাদের দ্বারা নিম্ন হতে উপর মহলে যোগাযোগ ও নির্দেশ পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল। (দ্রঃ M.A. Khan op. cit, PP 104-112)

তাঁরা আদালত পঞ্চায়েত গঠন করেন এবং সমস্ত অঞ্চলের বিচার বিপ্লবীরাই করতে লাগলেন। মুসলমানদের জাকাত, ওশর ইত্যাদি দাতব্য অর্থ এবং সংগঠনের চাঁদা ফসল হতে তোলা, ঠিকমত তা আদায় করা, সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা, মাদরাসা-মক্তব তৈরি করা, মসজিদ তৈরি করা প্রভৃতি কাজ জাদু খেলার মত চলতে লাগল। এমন অবস্থা এল, বিপ্লবীদের সুবিচার যেটা ইংরেজ বিরোধিতার নামান্তর। অর্থাৎ পৃথিবীতে জমি জায়গা যা আছে সব ঈশ্বরের; সেখানে জমিদার বা সরকারের কর নেওয়া জুলুম বা অত্যাচার। মানুষ সব সমান, আমাদের কারো উপর তাদের কর্তৃত্ব করার অধিকার নেই।

তাই অমুসলমানরা অনেকে তাঁদের কাছেই অভিযোগ করতেন। বিচারও সূক্ষ্মভাবেই হতো। কিন্তু বিচারের রায় না মানলে তা মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা দুদু মিঞার সৈন্য বিভাগে ছিল। শেষে দুদু মিঞা তাঁর সমস্ত এলাকায় ঘোষণা করলেন, সমস্ত বিচার আমাদের স্বদেশী আদালতে হবে। যদি কেউ ইংরেজদের আদালতে বিচার প্রার্থী হয় তাহলে তাকে শাস্তি নিতে হবে। ইংরেজ ব্যবসায়ী বা নীলকরের সাহেবরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কারণ দরিদ্র শ্রমিক শ্ৰেণী মুসলমান বিপ্লবীদের হাতে। আর জমিদার শ্ৰেণীও খুব অসন্তুষ্ট হল। মুসলমানদের সহযোগিতায় তাঁদের মতে ‘গরিব ছোটলোকদের’ এত মাথায় তোলা অবিচার মাত্র। তাই এইবার ইংরেজদের স্তম্ভ জমিদার শ্রেণী হিন্দু এবং মুসলমান উভয় শ্রেণীর ওপর মুসলিম বিপ্লবীদের আক্রমণ শুরু হয় এবং তা বহুদিন পর্যন্ত চলতে থাকে। (দ্রঃ P.J.D.c.c. No 25, 29 May 1843, P. 462)

এবার ইংরেজদের ইঙ্গিতে ফরিদপুরের সিকদার ও ঘোষ পরিবার নামে দুজন বড় জমিদার মুসলমান প্রজাদের জন্য ঘোষণা করলেন, মুসলমানরা গরু কুরবানী করতে পারবে না। কালী ও দুর্গা পূজায় কর দিতে বাধ্য হতে হবে এবং দাড়ির উপর কর বসানো হয়, আর নিষেধ করা হয়, মুসলমান বিপ্লবী দলের সঙ্গে কোন সংযোগ রাখতে পারবে না। প্রথমে কিছু মুসলমান প্রজা তা অবহেলা করার ফলে জমিদারদের দ্বারা কঠোর শাস্তি পেতে বাধ্য হয়। (দ্রঃ A. R. Mallic, op, cit, M. A. Khan, op cit PP 27-28) দুদু মিঞা ১৮৪১ খৃস্টাব্দে কানাইপুরের সিকদার ও ফরিদপুরের জয়নারায়ণ জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈন্যসহ আক্রমণ করলেন এবং তাদের উভয়কে পরাজিত করলেন। খুব মনে রাখা দরকার ঐ যুদ্ধ হিন্দু-মুসলমানে নয় বরং কৃষক-জমিদারের যুদ্ধ অথবা ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে মুসলমান বিপ্লবী শোষিতদের যুদ্ধ। কানাইপুরের জমিদার দুদুর দাবি মেনে নেন এবং নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু ১৮৪২ খৃস্টাব্দে ফরিদপুরের জমিদার জয়নারায়ণ প্রবলভাবে বিপ্লবীদের বাধা দেন ফলে যুদ্ধ তুমুলভাবে রূপ নেয়। শেষে বিপ্লবীরা জমিদারের ভাই মদন বাবুকে ধরে নিয়ে চলে যায়। অনেকে বলেন, তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় এবং পদ্মা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। (দ্রঃ A, Khan, op, cit, PP, 27-29)

৮০০ জন মুসলমান বিপ্লবী ঐ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। জমিদাররা ইংরেজদের আদালতে মামলা করেন। বিচারে ২২ জনের সাত বছর করে জেল হয়।

দুদু মিঞার কোন শাস্তি হয়নি, তিনি মুক্তি পান। অবশ্য তা অনেকের মতে তাঁর শাস্তি হলে হিতে বিপরীত হতো, কেননা পুলিশি রিপোর্ট অনুযায়ী ঐ সময় দুদু মিঞার হাতে আশি হাজার লোক প্রাণ দেয়ার জন্য প্রস্তুত। (দ্রঃ P. J, D, 0c, No 99 7 April 1847, P, 146)

১৮৪১ ও ১৮৪২ এর ঘটনার পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদারগণ লড়াই করতে সাহসী হননি, তবে ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্ত সংবাদ সরবরাহ এবং পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জমিদারের সঙ্গে কৃষকদের লড়াইটিকে হিন্দু-মুসলমানের লড়াই বলে প্রমাণ করার খুব চেষ্টা করা হয়েছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমলেন্দুদের মতে জমিদারগণ অনেকাংশে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিলেন। লড়াইটিকে হিন্দু-মুসলমানদের লড়াই বলেই সাধারণ মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়েছিল।

ঐ সময় ডানলপ সাহেব কাসিমপুরে নীলকুঠির প্রভাবশালী সাহেব। ঐ ইংরেজের বিশ্বস্ত পরিচালক ছিলেন কালিপ্রসাদ কাঞ্জিলাল নামে এক গোমস্তা। ডানলপ সাহেব এবং ব্রাহ্মণ গোমস্তা আট শত সশস্ত্র লোক নিয়ে বাহাদূরপুরে দুদু মিঞার বাড়ি আক্রমণ করে বাড়ির চারজন প্রহরীকে হত্যা করেন এবং বহু ব্যক্তিকে হত্যা করে সেই বাজারে দেড় লক্ষ টাকার অর্থ সম্পদ নিয়ে বিজয়ী হয়ে বাড়ি ফেরেন। (দ্রঃ M.A. Khan op, cit. 33 এবং অধ্যাপক অমলেন্দুর লেখায়)

১৮৪৬ সালে ৫ ডিসেম্বর দুদু মিঞা প্রতিশোধ নিতে ডানলপ সাহেবের কুঠি আক্রমণ করেন এবং গোমস্তাকে বাখরগঞ্জ এলাকায় অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় আর ২৬ হাজার টাকা ক্ষতি করে দেওয়া হয়। চারজন নিহত আর দেড় লক্ষ টাকার ক্ষতির তুলনায় নিশ্চয়ই এ ক্ষতি অল্প। (দ্রঃ P, J, D, O, C No, 99, 7 April, 1847 PP, 147-148, Jwise, op cit P, 25)

সেই সময় ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট ডানলপের বন্ধু ছিলেন এবং দুজনেই ছিলেন ইংরেজ। ডানলপ কোর্টে কেস করলেন। দুদু মিঞা এবং ৬৩ জন মুসলমান বিপ্লবীকে বন্দি করা হয় বিচারে সকলের শাস্তির রায় হয়। তখন ভারতের রাজধানী কলকাতার সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করা হয়। কৌসুলি ইংরেজ সকলেই মুক্তি দেয়। ১৮৪৭ সালে মুক্তি পেয়ে দুদু মিঞা সারা ভারতে প্রত্যেক কেন্দ্রে সংবাদ পাঠান যে চারদিক হতে এক সঙ্গে ইংরেজ ধ্বংস করা অভিযান চালাতে পারলে ইংরেজকে তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হবে। ষড়যন্ত্র চলতে লাগলো, শেষে খুবই গোপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। সারা ভারতে আন্দোলন ও বিপ্লবকে ইংরেজ তার সৈন্যবাহিনী দিয়ে দমন করছে। সুতরাং সৈন্যদের কোন প্রকার ক্ষেপিয়ে তুলতে পারলেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভয়াবহ রূপ রুদ্র মূর্তি ধরার পূর্বেই সরকার টের পেল যে চতুর নেতা আলাউদ্দীন ওরফে দুদু মিঞাকে জেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই তাঁকে বন্দি করে জেলে খুব অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের ইন্ধন করা হল। শরীর দুর্বল হয়ে অসুস্থ অবস্থায় তিনি থাকলেও মন আর মস্তিষ্ক দুর্বল হয়নি একটুও। তাঁকে ছাড়া হয়েছিল ১৮৬০ সালে। তাঁকে যে শুধু ভয় করেই সরকার তাদের নিরাপত্তার জন্য বন্দি করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। (দ্রঃ J, Wise, op cit, P, 25; M. A. Khan, op cit, PP 42-43)

দু বছর তিনি জেলের বাইরে থাকলেও জেল অত্যাচারের জের টানতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। ১৮৬২ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী আলাউদ্দিন ওরফে দুদু মিঞা ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকাতে চির নিদ্রিত হলেন। আজকার নিষ্ঠুর ইতিহাস যেন ভুলে গেছে সে কথা।

দুদু মিঞার মৃত্যুর পরেই গিয়াসুদ্দিন হায়দার হাল ধরলেন বিপ্লবী দলের। কিন্তু তিনি কঠিন অসুস্থতার জন্য তাঁর ছোট ভাই আবদুল গফুর (ডাক নাম নোয়া মিঞা)-কে নেতা নির্ধারিত করেন।

আলাউদ্দিন ও দুদু মিঞার আর একজন সমসাময়িক বিপ্লবী বন্ধু ছিলেন, তিনি হচ্ছেন চব্বিশ পরগনা জেলার চাঁদপুর গ্রামের মীর নিসার আলী। ডাক নাম ছিল তেতো মিঞা। ছোটবেলায় খুব জ্বর হতো তাই তাঁকে তাঁর নানী কালমেঘ গাছগাছড়া তিক্ত ঔষধ খাওয়াতে চাইলে শিশুবীর নানীর হাত হতে অম্লান বদনে তা খেয়ে নিতেন। তাই তেঁতো, তীতা হতেই তীতু নামের উৎপত্তি। বিপ্লবী মাওলানা আলাউদ্দিন সাহেব (দুদু) হজে যাবার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অনেক গোপন আলোচনা করেন। মৌলুবী নিসার আলী বা তীতু মিঞা তাঁকে তসবীহ মালা উপহার দেন। পরে ঐ মালা তিনি তার শয্যাকক্ষে সযতনে রেখে দিয়েছিলেন। নিসার আলী ১৭৮২ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত সৈয়দ আহমদ ব্রেলবীর দেখা হয় মক্কা শরীফে হজের সময়। আগে হতেই তিনি তাঁর চিন্তাধারা বিপ্লবী পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এখন তিনি তাঁর কাছে বায়াত বা মুরীদ হলেন আর নিজের আজীবন সবকিছু তাঁর কাছে সঁপে দিলেন। আহমাদ সাহেবও শিষ্যকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক কেন্দ্র কলকাতায় তথা বাংলার বিপ্লবের ভার দিলেন। মীর নিসার আলী পীর বা গুরুর পরামর্শে প্রথমে তবলীগী অভিযান শুরু করেন, যাতে প্রত্যেক মুসলমান প্রথমে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে। তাহলে ইংরেজকে তাড়ানোর জন্য তারাই নিজেরা খেপে উঠবে, খেপানোর দরকার হবে না। ১৮২৭ খৃস্টাব্দের দিকে যখন শিখদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ জিহাদের ফতোয়া দিয়ে প্রবল যুদ্ধে লিপ্ত তখন মীর নিসার আলী ভারতের কেন্দ্রবঙ্গে শুধু ধর্ম প্রচারই করে যাচ্ছেন। তার প্রধান কারণ ইংরেজ যেন বঙ্গের ঘাঁটি চুর্ণ করার চিন্তা না করে, যেহেতু এখানে এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। কিন্তু অত্যন্ত গোপনে চাঁদা তুলে এবং আত্মবলী দিতে প্রস্তুত এমন মুসলমান যুবকদের সুদূর পাঞ্জাবের সিত্তানা অঞ্চলে পাঠাতেন আর প্রায় দলই ঐ সমস্ত সফরে যেতেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, যে লোকগুলোকে পাঠানো হতো তাদের গেরিলা যুদ্ধের সর্বপ্রকার ট্রেনিং নিসার আলী নিজেই দিতেন। যেহেতু তিনি একজন বিখ্যাত কুস্তিগীর বা ব্যায়ামবীর ছিলেন- গফুর সিদ্দিকী লিখিত শহীদ তিতুমীর ৩০-৪১ এবং A. R. Mallick op cit, PP, 76-77 দ্রঃ) তাঁর জ্বালাময়ী বাগ্মিতা শক্তি ছিল, তাই তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য সভায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জমায়েত হতো।

তীতুমীর ইসলাম ধর্মকে যেমন ভালোবাসতেন আবার তেমনি হিন্দুদের দুঃখ-দুর্দশার কথাও চিন্তা করতেন এবং তাদের বিপদে নিজে যথাসাধ্য তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। এতদসত্ত্বেও ইংরেজের পোষ্যপুত্র জমিদারগণ তার উপর রাগ করতেন এবং তাঁর ধ্বংস কামনা করতেন। এ প্রসঙ্গে একজন নিরপেক্ষ লেখকের উদ্ধৃতিস্বরূপ একাংশ তুলে ধরা হলো- “তীতু আপন ধর্মমত প্রচার করেছিল। সে ধর্মমত প্রচারে পীড়ন তাড়ন ছিল না। লোকে তার বাগবিন্যাসে মুগ্ধ হয়ে তার প্রচারে স্তম্ভিত হয়ে তার মতকে সত্য ভেবে, তাকে পবিত্রাতা মনে করে, তার মতাবলম্বী হয়েছিল এবং তার মন্ত্র গ্রহণ করেছিল। তীতু প্রথমে শোনিতের বিনিময়ে প্রচার সিদ্ধ করতে চায়নি। জমিদার কৃষ্ণদেব জরিমানার ব্যবস্থায় তার শান্ত প্রচার হস্তক্ষেপ করলেন।” (দ্রঃ বিহারলাল সরকারের ‘তীতুমীর বা নারকেল বেড়িয়ার লড়াই’, কলিকাতা ১৩০৪, পৃঃ ৪৭)

ইংরেজের বলে বলীয়ান বিখ্যাত জমিদার রামনারায়ণ বাবু (তারাগুনিয়া), কৃষ্ণদেব রায় (পুঁড়া), গৌড় প্রসাদ চৌধুরী (নগরপুর) প্রমুখ প্রখ্যাত জমিদার মিলিতভাবে নিসার সাহেবের আন্দোলন খতম করার জন্য প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন। প্রত্যেক জমিদার তার এলাকায় ৫টি বিষয়ে নোটিশ জারি করলেন।

যথাঃ “(১) যারা তীতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অহাবী হবে, দাড়ি রাখিবে, গোঁফ ছাঁটবে, তাদের প্রত্যেকে ফি দাড়ির ওপর আড়াই টাকা এবং ফি গোঁফের ওপর পাঁচসিকা খাজনা দিতে হবে। (২) মসজিদ প্রস্তুত করলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচশত টাকা ও প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য এক সহস্র টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হবে। (৩) পিতা, পিতামহ বা আত্মীয়স্বজন সন্তানের যে নাম রাখবে সে নাম পরিবর্তন করে অহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্য খারিজানা ফি পঞ্চাশ টাকা জমিদার সরকারের জমা দিতে হবে। (৪) গোহত্যা করলে হত্যাকারীর দক্ষিণ হস্ত কেটে দেওয়া হবে, যেন সে ব্যক্তি আর গোহত্যা করিতে না পারে। (৫) যে ব্যক্তি অহাবী তীতুমীরকে নিজ বাড়িতে স্থান দেবে তাকে তার ভিটা উচ্ছেদ করা হবে।” (দ্রঃ A. R. Mallick op. cit, 79-79 এবং সিদ্দিকী প্রণীত শহীদ তীতুমীর, পৃষ্ঠা ৫০-৫১)। সূক্ষ্মদর্শী অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের উপরোক্ত শর্ত পাঁচটি কত মারাত্মক এবং তাৎপর্যপূর্ণ আর সেই যুগে ঐ জরিমানার টাকার পরিমাণ মুসলমানদের জন্য কত সীমাহীন অত্যাচার তাই শুধু বিবেচ্য নয়; বরং ভারত বর্তমান পর্যন্ত ত্রিখণ্ডে খণ্ডিত হওয়ার মূল হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার গোড়াপত্তনকারী ইংরেজ সৃষ্ট জমিদার শ্ৰেণী।

সৈয়দ নিসার আলীর যা প্রস্তুতি ছিল তিনি একটা হামলা করতে পারেন কিন্তু উদ্দেশ্য তাঁর হিন্দু-মুসলমানে লড়াই নয়; বরং লড়াই হবে মুসলমান ও হিন্দুদের সঙ্গে ইংরেজদের। তাই তিনি পুঁড়ার জমিদারকে শান্তির জন্য একটি মূল্যবান পত্র দিয়েছিলেন সেই পত্রটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

“বঃ জনাব কৃষ্ণদেব রায় সমীপে- পুঁড়ার জমিদার বাড়ি। মহাশয় আমি আপনার প্রজা না হলেও আপনার স্বদেশবাসী। আমি লোক পরম্পরায় জানতে পারলাম আপনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন, আমাকে অহাবী বলে আপনি মুসলমানদের নিকট হেয় করার চেষ্টা করতেছেন। আপনি কেন এরূপ করতেছেন তা বুঝতে পারা মুশকিল। আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেউ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট কোন মিথ্যা কথায় আপনাকে উত্তেজিত করে থাকে তাহলে আপনার উচিত ছিল সত্যের সন্ধান করে হুকুম জারী করা। আমি দীন ইসলাম জারী করতেছি। মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিতেছি। এতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকতে পারে? যার ধর্ম সেই বুঝে। আপনি ইসলাম ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না, অহাবী ধর্ম বলে দুনিয়ায় কোন ধর্ম নাই। আল্লাহ মনঃপুত ধর্মই ইসলাম, ইসলাম শব্দের অর্থ হচ্ছে শান্তি। একমাত্র ইসলাম ধর্ম ব্যতীত আর কোন ধর্মই জগতে শান্তি আনয়ন করতে পারে না। ইসলামী ধরনের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছোট করা, ঈদুল-আজহার কুরবানী করা ও আকীকা কুরবানী করা মুসলমানদের আল্লার ও আল্লার রসূলের আদেশ। মসজিদ প্রস্তুত করে আল্লার উপাসনা করাও আল্লাহর হুকুম। আপনি ইসলাম ধর্মের আদেশ, বিধি নিষেধের ওপর হস্তক্ষেপ করবেন না। আশা করি আপনি আপনার হুকুম প্রত্যাহার করবেন। ফকত- হাকির ও নাচিজ সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তীতুমীর। (দ্রঃ শহীদ তীতুমীর, পৃঃ ৫০-৫১)।

সৈয়দ নিসার আলী তাঁর দাড়িওয়ালা সৎ সাহসী এবং নম্র শিষ্য মহঃ আমিনুল্লাহর হাতে পত্র দিয়ে পুঁড়ার জমিদার বাড়ি পাঠান। কৃষ্ণদেব পত্র পড়েই তাঁকে জমিদারি জেলে আবদ্ধ করতে আদেশ দেন এবং সকলের সামনে বন্দি সিংহ মারার মত বন্দি আমিনুল্লাহকে বাঁধা অবস্থায় সীমাহীন প্রহার করা হয় এবং হত্যা করা হয়। এই সংবাদ নিসারের নিকট পৌঁছালে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। তাই ব্যথিত হৃদয়ে বলেছিলেন, আমার আজাদী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আমিনুল্লাহ।

ও দিকে ইংরেজেদের চক্রান্তে কলকাতায় বড় জমিদারদের গোপন মিটিং হয় ‘লাটুবাবু’র বাসভবনে। তাতে অংশ গ্রহণ করেন গোবরা, গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, ইদুর আঁটির দুর্গাচার রায়, পুঁড়ার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরডাঙ্গার কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, নূরনগরের জমিদারের ম্যানেজার, টাকীর জমিদারের সদর নায়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, বাড়ির মালিক লাটুবাবু এবং বসিরহাট থানার ইংরেজ ভক্ত পুলিশ অফিসার রামরাম চক্রবর্তী। (দ্রঃ শহীদ তীতুমীর পৃঃ ৫২-৫৩) সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ইংরেজ পাদ্রী, ইংরেজ নীলকর ও সমস্ত জমিদার যথাসাধ্য সর্বপ্রকার সাহায্য দিয়ে জমিদার কৃষ্ণদেবকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করা হবে। অধ্যাপক অমলেন্দু দে’র মতে তারা প্রচারের মাধ্যমে হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ত্রাসের সৃষ্টি করেন।

জমিদাররা ওপরতলার ঘাঁটি মজবুত করে পুনরায় পূর্ব ঘোষিত নোটিশ অনুযায়ী মুসলমানদের নিকট কর আদায়ের অত্যাচারমূলক অভিযান শুরু করলেন এবং মুসলমানরা জরিমানা অনেকে দিল এবং অনেকে গ্রাম হতে পলায়ন করলো। কিন্তু বিপ্লবী নেতা তখনো মিলন মৈত্রীর পথই খুঁজতে লাগলেন। তিনি মোটেই চাইছেন না লড়াই হিন্দু-মুসসলমান হোক; বরং চাচ্ছিলেন ইংরেজ-মুসলমানে হোক। হিন্দু জনসাধারণ অন্তত নিরপেক্ষ থাকুক। কৃষ্ণদেবের জরিমানা আদায়ের অভিযান যখন সরফরাজপুরে আরম্ভ হল তখন সৈয়দ নিসারের সমর্থকরা বাধা দিল কিন্তু তা টিকল না। হিন্দু জমিদারের লাঠিওয়ালারা মসজিদে এবং গ্রামে পাইকারীভাবে আগুন লাগিয়ে দেওয়া আরম্ভ করে। অনেকে আগুনে ও অস্ত্রে আহত হয়। অমলেন্দুদের মতে একটি সৈন্যবাহিনীসহ সরফরাজপুর গ্রাম আক্রমণ করা হয়। নিসার সাহেব বা তীতুমীর এখনো ধৈর্য ধরতে সক্ষম হলেন। এবং কোর্টে মোকদ্দমা করলেন। বারাসাত কোট এত বড় নরহত্যা, মসজিদ পোড়ানো আর গ্রামকে শ্মশানে পরিণত করার কেস ডিসমিস করে, তখন কলকাতায় আপিল করা হয়। তাতেও কোন সুবিচার পাওয়া গেল না, তখন নিসার সাহেব ক্ষুব্ধ হলেন এবং বুঝলেন সুবিচার চাইলে অবিচারই প্রাপ্য। (দ্রঃ A. R. Mallick op, cit P-81)

বীরের ধৈর্যধারণের শেষসীমা হতেই কাপুরুষতার সীমা। তাই ‘মরি বা করি’ ভেবে নারিকেলবেড়িয়ায় একটি কেল্লা সাধ্যানুসারে তৈরি করা হলো। মৈজদ্দিনের বাড়িতে সৈয়দ নিসারের আরাম করার ও গোপন পরামর্শ করার ব্যবস্থা হলো। তারপর তার সৈন্যাধ্যক্ষ মাসুম আলী ও শেখ মিশকিন সমস্ত সৈন্যকে একত্রিত করে সৈয়দ সাহেব সকলকে প্রশ্ন করলেন এখন পাঁচজন লোকের প্রয়োজন, যারা আজ আজাদী আন্দোলনে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। নারায়ে তাকবীর ধ্বনির মধ্যে সহস্র সহস্র সৈন্য ও সমর্থক অনিয়মিতভাবে হাত নেড়ে জানালো প্রাণ দেবার প্রতিশ্রুতি। এইবার আদেশ হলো কৃষ্ণদেব বাবুর পুঁড়া আক্রমণ করতে। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সৈন্য আমিনুল্লাহ হত্যা মসজিদ ও গ্রাম জ্বালানো আর অন্যায় জরিমানা আদায়ের প্রতিশোধ নিতে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলো। জমিদারদের সেনাবাহিনী নীলকর সাহেবদের কর্মচারী এবং পাদ্রীদের সহকারী সকলে মিলে প্রতিরোধ করেও কিন্তু পরাস্ত করা সম্ভব হয় নাই। মুসলমান সৈন্যরা গরুর মাংস খাওয়ার ব্যবস্থা জমিদার বাড়িতেই করে এবং তার শোনিতাদি মন্দিরের দেওয়ালে নিক্ষেপ করে। অবশ্য এগুলো ভদ্র সমাজে নিন্দনীয় তার চেয়েও নিন্দনীয় যারা প্রথম আক্রমণকারী বা আক্রমণের কারণ হয়। কিন্তু প্রত্যেকেই অবাক হলো মাসুম সাহেবের সামরিক কায়দায় সৈন্য পরিচালনা দেখে, যা ইংরেজকেও স্তম্ভিত করে। (মিঃ হান্টারের লেখা দ্রষ্টব্য)। নদীয়া জেলায়ও একটি দাঙ্গা সংঘঠিত হয়েছিল নিসারের দলের দ্বারা। জমিদারের পক্ষে বসিরহাটের পুলিশ অফিসারের অনেক তদবীর করার জন্য পূর্ব আক্রোশে তাঁকে আক্রমণ করা হয় এবং হত্যাও করা হয়। এছাড়া আরও বড় অভিযোগ ইংরেজদের মাধ্যম ছিলেন তিনিই। অনেক মুসলমান সৈয়দ নিসারের আইন অমান্য করেন ফলে তাদেরও আক্রমণ করা হয় এবং কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির মানুষ আক্রমণের শিকার হলেও চারদিকে চক্রান্তমার্কা কথা রটে গেল, হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধ অথচ মোটেও তা নয়। মোট কথা, নারকেলবেড়িয়া অঞ্চলের মানুষ বেশ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ভবিষ্যতের ভাবনায়। (A.R. Mallick S Hunter-এর লেখায় দ্রষ্টব্য)

এইবার সৈয়দ নিসার ঘোষণা করলেন, আজ হতে ইংরেজদের সঙ্গে সর্বপ্রকার বিরোধিতা প্রকাশ্যে করতে হবে। ওদিকে জমিদারবৃন্দ, থানা, ইংরেজ অফিসার, ইংরেজ নীলকরদের সুপারিশ ওপর মহলের পরামর্শের পরে ইংরেজ সরকার একদল অশ্বারোহী সৈন্য পাঠালেন মাসুমের সৈন্যদের শায়েস্তা করতে কিন্তু সৈয়দ নিসার, মাসুম ও মিসকিনের পরিচালনা পদ্ধতি ইংরেজদের চেয়েও উন্নত ধরনের ছিল, ফলে ইংরেজ সৈন্য পরাজিত হয় এবং অনেকে মৃত্যুলীলাবরণ করে।

সেটা ছিল ১৩৮১ সাল। ওদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় নেতা যুদ্ধ করছেন ইংরেজের সঙ্গে শিখদের সম্মুখে। আর ঐ ১৩৮১ সালেই সৈয়দ নিসার সাহেবরা ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করছেন হিন্দুদের সম্মুখে। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হবে হিন্দু ও মুসলমানে এবং শিখ ও মুসলমানে যুদ্ধ, কিন্তু মোটেই না নয়। এটাই ইংরেজদের চালাকি। ১৩৮১ খৃস্টাব্দে মে মাসে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক অতর্কিত শিখ আক্রমণে শহীদ হলেন। ইতিহাস আজ নীরব কেন, জানি না। কয়েক মাস পরে সৈয়দ আহমদ ব্রেলবীর স্বর্গারোহণের সংবাদ সৈয়দ নিসারও পেয়েছিলেন কিন্তু ব্যাপকভাবে তা প্রচার করলেন না। তবে প্রিয় নেতার মৃত্যুর জন্য তিনিও উদগ্রীব হয়ে উঠছিলেন।

এদিকে নারিকেলবেড়িয়ার ইংরেজ সৈন্যের পরাজয়ের সংবাদ কলকাতায় পৌঁছবার পরেই একজন সুদক্ষ সেনাপতির অধীনে বাছাই করা সৈন্য আর উচ্চ শ্রেণীর কামান পাঠানো হলো নারিকেলবেড়িয়ার কেল্লা পতনের উদ্দেশ্যে। এবারেও সৈয়দ নিসার ওরফে তীতু মিঞা, মাসুম আলী ও মিসকিন খাঁ সৈন্যদের বললেন, “আমাদের আগ্নেয় কামান নেই হয়ত মৃত্যু হতে পারে, যাদের ইচ্ছা যুদ্ধে বিরত থাকতে পার।” কিন্তু এমন একটিও দুর্বল হৃদয় পাওয়া গেল না যে প্রাণ দিতে ভয় পায়। যুদ্ধ আরম্ভ হতেই সিংহ নিনাদে হুঙ্কার ছেড়ে ইংরেজ সৈন্যদের আক্রমণ করলো মুসলিম সৈন্য। ইংরেজ সৈন্য ছত্রভঙ্গ হওয়ার উপক্রম কিন্তু কালবিলম্ব না করে বিরাট আগ্নেয় কামান দাগা হলো। কামান পরিচালককে হত্যা করার জন্য সেনাপতি মাসুম বিদ্যুৎ গতিতে কামানের উপরে দাঁড়লেন কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পূর্বেই কামান দাগা হয়ে গিয়েছিল। অজস্র বিপ্লবী সৈন্য ইংরেজদের কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যুর কোলে ছিটকে পড়লো। মাসুম তো একবারে ইংরেজদের কোলে গিয়ে উপস্থিত। আর কয়েক সেকেন্ডে আগে লাফ দিতে পারলে হয়ত কামান মাসুমের হাতেই গর্জে উঠতো। মাসুম বন্দি হলেন, কেল্লা ধ্বংস হলো। মাসুমের বিচার হলো, প্রাণদণ্ড, ফাঁসি। অপরাধ তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর। রাঙ্গা রক্ত দিলেন শ্রদ্ধেয় শহীদ মাসুম আর সৈয়দ নিসার আলী বা তীতুমীরও কামানের আগুনের গোলায় শহীদ হলেন। কিন্তু ইতিহাস নীরব, নিঝুম। আর জীবন্ত যাদের পাওয়া গেল বিচারে তাঁদের জাহাজ ভর্তি করে ভারত হতে দূরে যাবজ্জীবন দেওয়া হলো আর আহতদের হাসপাতালে দেওয়ার নামে নদীতে নিক্ষেপ করে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কিন্তু হায়! আজ ইতিহাস কি নিষ্ঠুর, যাঁদের রাঙা রক্তে তার প্রতিটি পাতা আজ ধন্য সেই অমর শহীদ মাসুম আর তীতুমীরের নাম অনেক দূরে নিক্ষিপ্ত। কিন্তু কেন? কি অপরাধ তাঁদের? বোধ হয় অপরাধ তাঁদের মুসলমানত্ব। যাই হোক সৈয়দ আহমদ আর সৈয়দ নিসারের শহীদ হওয়ার পর ইংরেজরা ভেবেছিল স্বাধীনতা আন্দোলন বোধহয় খতম হয়ে গেল। আসলে আন্দোলন কিন্তু খতম হয়নি, খতম হয়েছিল ইংরেজদের হাতে কয়েক সহস্র মৌলবী মাওলানা আল্লাহর ফকির। আর তাদের লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী ভক্ত কামানের ফাঁসিতে, জেলে, দীপান্তরে নানাভাবে নিহত হয়েছিলেন।

এইবার যারা এগিয়ে এলেন তাঁদের মধ্যে পাটনার মাওলানা এনায়েত আলী, জওনপুরের মাওলানা কেরামত আলী, হায়দ্রাবাদের মাওলানা জৈয়নুদ্দিন, মাওলানা মহর আলী, মাওলানা ফরহাদ হুসেন প্রমুখ প্রখ্যাত আলেম ও তাঁদের অনুগামীগণ। ব্রেলীর একজন পীর সাহেব ইমাতাজিমামি যার পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মুরিদ ছিল। তিনি তাদের বলে দিয়েছেলেন এখন বেহেশত পাওয়ার সহজ পথ খ্রীস্টান ঘাঁটি খতম করে দেশকে স্বাধীন করা। বাংলায় যে মাওলানা মোল্লাহ ও ওস্তাদজীরা যুদ্ধের জন্য টাকা ও লোক সংগ্রহ করতেন, তাঁরা নিরক্ষর মানুষদের কাছে সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর কথা উহ্য রাখতেন। ঐ সময় প্রত্যেক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মুসলমান প্রচারকরা দলে দলে যুবকদের উত্তেজিত করে এবং ইংরেজদের বন্ধু শিখদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য না পাঠাতে পারে। আর মুসলমানদের যেন কোন সভা করতে দেওয়া না। হয়। মুর্শিদাবাদের লোক বেশি জেহাদে যোগ দিত, প্রাণের বিনিময়ে তারা চেয়েছিল ইংরেজ শাসনের পতন। তার প্রধান কারণ সিরাজের পতন তাদের বা তাদের পূর্ব পুরুষদের চোখের সামনে ঘটেছে। মুর্শিদাবাদের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলা তদন্ত করতে এবং বিপ্লবীদের সম্বন্ধে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য উপর মহলের আদেশ হয়। তাই জেলার শাসক তাঁর লোকজন দিয়ে জনসাধারণকে বোঝাতে চাইলেন দেশ, মা, বাবা, ছেলেমেয়ে ছেড়ে অজানা-অচেনা জায়গায় গিয়ে লড়াই করে মরা নির্বুদ্ধিতা ইত্যাদি। ১৮৪৩ খৃস্টাব্দে প্রভিন্সের সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ ডবলিউ, ডেমপিয়ার রিপোর্টে জানান, বিপ্লবীরা খুব ধর্মান্ধ এবং দারুণ একতাবদ্ধ এবং কয়েকজন বিশেষ নেতা দ্বারা পরিচালিত। তারা ব্রিটিশ শাসনেরই বিরোধী। সুতরাং তাদের ওপর খুব সাবধানতার সঙ্গে নজর রাখা দরকার। আর যদি বিদ্রোহের বিস্ফোরণ হয় তাহলে সূত্রপাত হবে এইসব ধর্মীয় গ্রুপগুলো দ্বারাই। "The Muhammedan poputalion in ...... it is from the excited religious fanaticism of this sect."

এনায়েত আলীর নেতৃত্বে ছয় শত লোকের একটি জামাত পদব্রজে রওনা হলো। তারা কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করলে এই উত্তরই পাওয়া যায় তারা সব হজযাত্রী। ছয় শত লোক ছোট ছোট দলে একেকজন নেতার নেতৃত্বে চলতে থাকে যাতে লোকের চোখে সন্দেহজনক না মনে হয়। মিঃ ডেমপিয়ার সাহেব জোনপুরের কেরামত আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কিছু কথা বের করার চেষ্টা করলেও সাহেব বেশ সুবিধা করতে পারেননি।

রিপোর্টে আরও পাওয়া যায়, মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর এলাকায় নারায়ণপুর গ্রামে অনেকগুলো গ্রামের লোক একত্রিত হয়ে একটা সীমান্তে যুদ্ধের সাহায্য ও সহযোগিতা করার ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ফলে সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ মুর্শিদাবাদ ইংরেজ বিদ্বেষের জন্য বিখ্যাত। মিঃ ডেমপিয়ার নিজে এই অঞ্চলে ঘোরেন এবং কোথাও বোঝান কোথাও বা ভয় প্রদর্শন, কোথাও বা প্রলোভন দিয়ে তার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। সবই প্রায় আয়ত্তে আসে শুধু নোয়াখালী, ফরিদপুর জেলা প্রভৃতি ছাড়া। উপরোক্ত তথ্যসমূহ Proceeding of the Judiacal Deprtment C.C. No, 21-25, 29 May, 1843 P. 454-461 দ্রষ্টব্য।

এই মুসলমান বিপ্লবী দল সারা ভারতে কয়েকটি কেন্দ্রীয় অফিস তৈরি করে, যথা- হায়দ্রাবাদ, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বাই, পেশোয়ার, আটাক রাওয়ালপিণ্ডি, থানেশ্বর, ঝিলান, অমৃতশহর, আম্বালা, দিল্লী, কানপুর, পাটনা ইত্যাদি। এই বিপ্লবী দলে দলে লোক যোগ দিতে থাকে। এমনকি হায়দ্রাবাদের শাসনকর্তার ভাইও আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর নাম মুবারেজুদ্দৌল্লাহ। তাঁর প্রভাবে বহু বিশিষ্ট লোক আন্দোলনে যোগ দেয়। ইংরেজ সরকার মুবারেজের উপর ষড়যন্ত্রকারীর অভিযোগ চাপিয়ে তার কিছু বিশেষ সঙ্গীসহ বন্দি করে। কারাগারেই মুবারেজের মৃত্যু হয়, সঙ্গীদেরও কঠিন কষ্টের সঙ্গে প্রায় এগারো বছর কারাগারে রাখা হয়। (দ্রঃ R. C. Majumdar, op cit, PP 888-849)

বিদ্রোহীদের প্রধান ঘাঁটি ছিল ‘সীতানা’ কেন্দ্র, বাংলা থেকে দূরত্ব প্রায় দু হাজার মাইল। বাঙালি মুসলিম বীরেরা ঐ দুই হাজার মাইল পদব্রজে ধর্মের জন্য ইংরেজদের মারবার জন্য অথবা তাদের হাতে মরার জন্য কেমন করে যেতেন তা শুধু পড়ার আর জানার বিষয় নয়; বরং গভীর চিন্তার বিষয়। আর ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে কেমনভাবে যোদ্ধা সংগ্রহ করা হতো, আর কেমনভাবে মা-বাবা উৎসর্গ করতেন মুত্যুর মুখে প্রিয় সন্তানকে, কেমন করে যুবতী স্ত্রী বিদায় দিত তার প্রিয় স্বামীকে, সেই দৃশ্য একটু কল্পনা করলে মনে ভক্তির তরঙ্গে জোয়ার এনে দেয়। আর ঐ মৌলুবী মোল্লা যাদের বক্তৃতা ও যুক্তিতে মানুষ পতঙ্গের মত আগুনে ঝাঁপ দিতে পারে তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে আমরা বাধ্য কিন্তু নিষ্ঠুর ইতিহাস নীরব। পুরুষেরা দান করতো ফসলের অংশ যা তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর শ্রমে ফলাতো। আর মেয়েরা তাদের অতি সাধের গহনাগুলো খুলে দিত মোল্লাদের হাতে। তাঁরা সেই টাকা কেন্দ্রে পাঠাতেন। পত্র পাঠাতেন কিন্তু সেইসব পত্রের ভাষা ছিল সাংকেতিক। দলের লোক ছাড়া বোঝা অসম্ভব ছিল। আরও কঠিন কাজ করতে হতো বিপ্লবীদের গুপ্তচর বাহিনীতে যারা সচ্ছল পরিবারের ছেলে হয়েও, শিক্ষিত হয়েও মূর্খের অভিনয় করে সাহেবদের বাড়ির চাকর হয়ে সংবাদ সরবরাহ করেছেন। (দ্রঃ ঐ পুস্তক)

ইংরেজরা শিখ সর্দার রনজিত সিং রায়ের মৃত্যুর পর ১৮৩৯ হতে একেবারে ১৮৪৭ খৃস্টাব্দে নিজেরা পাঞ্জাবের কর্তৃত্ব হাতে নেয় তখন শিখ জাতির অনেকে বুঝলো ইংরেজ জাতি শিখদের আসল বন্ধু নয়।

১৮৪৯ খৃস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রখ্যাত পরিচালক মাওলানা বেলায়েত আলী পাটনা হতে সীতানা ঘাটি রওনা হলেন এবং বিভিন্ন জেলা ও শহরে অবস্থান করে সংগ্রামের বীজ ছড়াতে ছড়াতে মানুষকে জিহাদের দিকে আকর্ষিত করতে থাকেন। এমনিভাবে দিল্লীতে পৌঁছান এবং দু মাস সেখানে থেকে দিল্লীর শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের যোগ্যতা, বীরত্ব ও মহত্বের অভাব ছিল না। কিন্তু ডানাভাঙা পাখির মত তিনি শক্তিহীন ছিলেন। সারা ভারতের শিখ ও হিন্দুদের বিরোধিতা অথবা সহযোগিতার অভাবে ইংরেজ যেন ভারতকে হাতের মুঠোর মধ্যে পুরেছে। মাওলানা বেলায়েত আলী ইংরেজদের শুধু শক্তি, পদ ও সিংহাসন থেকে নয়; বরং ভারত হতে চির বিদায় দেয়ার প্রস্তুতির ব্যাপারে বাহাদুর শাহের সাহায্যে প্রার্থনা করেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ উত্তর দিয়েছিলেন। আমি আমার প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, এই বিশ্বাসঘাতক ইংরেজ সরকারকে হটাতে যথাসম্ভব আমার সবকিছু তোমরা আশা করতে পার। তারপর মাওলানা বেলায়েত আলী সীতানায় পৌঁছালেন, সেখানে তাঁর ভাই এনায়েত আলী কর্মরত কঠিন কর্তব্যে গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। দুই ভাই-ই একই মন্ত্রে দীক্ষিত। এনায়েত আলী প্রস্তাব কবলেন ইংরেজদের সঙ্গে সামগ্রিক যুদ্ধ করার। (Total war) কিন্তু মাওলানা বেলায়েত আলী আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন মনে করে বললেন, সামগ্রিক যুদ্ধ করার অর্থ পরাজিত হওয়া। (দ্রঃ R, C, Majumdar P, 890) ১৮৫২ খৃস্টাব্দে বিখ্যাত বীর মাওলানা বেলায়েত আলী দেহ ত্যাগ করেন।

হযরত মাওলানা শাহ আহমাদ মুজাদ্দেদ সাহেবের বিষয় পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। তাঁরই স্বপ্ন সাধনা এবং বাদশাহ আলমগীরের কান্নাপুত অন্তিম মোনাজাত বা প্রার্থনার ফলস্বরূপ ফকির মাওলানা শাহ ওলীউল্লাহর রোপিত বৃক্ষের ফল মহাজের মক্কী হাজী এমদাদুল্লাহ যার সম্বন্ধেও পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি যেমন আধ্যাত্মিকতা বা তাশাউফ তত্ত্বের মুকুটমণি ছিলেন তেমনি রাজনৈতিক চেতনাতেও ছিলেন সুদূরদর্শক নেতা। তিনি স্বয়ং বিপ্লবী সৈন্যদের উৎসাহ দিয়ে যেতে লাগলেন। ১৮৫৭ সালে তাঁকে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের পরিচালক করা হলো। অপরদিকে পীর ফকির মাওলানা রসিদ আহমাদকে (র.) যুদ্ধের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। আর মাওলানা পীর মাহমদুল হাসান (র.)কে পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান হিসেবে বরণ করা হয়। হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদের (র.) রক্ত বিফল হওয়ার নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ আরও রক্ত দিতে প্রস্তুত হলো ইংরেজের বিরুদ্ধে। সামরিক কায়দায় যুদ্ধ ব্যবস্থায় তিনিই মহান নেতা, মহান শহীদ, মহান পরিচালক সন্দেহ নেই। (দ্রঃ হায়াতে মাদানী)

অনেকের ধারণা মিঃ উইলিয়াম হান্টার একজন মুসলমান দরদি ইংরেজ। অনেক হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমান তাঁর সেই লেখারই উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যেগুলোতে প্রমাণ হয় তাঁর মুসলমানপ্রীতির কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মিঃ হান্টার ইসলাম তথা মুসলমানদের চরম শত্রু এবং হিন্দুদেরও পরম শত্রু। তার 'দি ইণ্ডিয়ান মুসলমান' গ্রন্থটি হিন্দু-মুসলমান বিবাদ বা বিভেদ বৃদ্ধিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুস্তক, যা ভারত বিভাগেও সহায়ক। যেমন পবিত্র কোরআনের ওপর আঘাত হানতে মিঃ হান্টার বলেছেন, “কোরআনের বাণীর সকল অর্থ এই যে, ইসলামের অনুসারীরা সারা দুনিয়া নিজেদের অধিকারে আনবে এবং বিজিতদের শুধু ধর্মান্তর গ্রহণের কিম্বা গোলামির অবস্থা বরণের অথবা মৃত্যুবরণ করার সুযোগ দেবে। একটা আধুনিক “নেশানের” অভাব সংকট সমাধানের উপযোগী করে কোরআন লিখিত হয়নি। তা লিখিত হয়েছিল একটা স্থানীয় যুদ্ধপ্রিয় আরব গোত্রের উৎপীড়িত, আক্রমণকারী ও বিজয়ী সম্প্রদায়ের ক্রমিক ভাগ্য পরিবর্তনের ভূমিকার উপযোগী করে।” ইত্যাদি আরও অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে তার মুসলমান বিদ্বেষীতা প্রমাণ করা যায়। তবু তার পুস্তকে পাণ্ডিত্যের প্রশংসা বা স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক সত্য তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। মুলমানদের দ্বারা বারবার বিপ্লবে বিব্রত হয়ে সারা ভারতে জনগণের সামগ্রিক অসন্তুষ্টি সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান এবং তার রিপোর্ট লিখতে দিলে তিনি ঐ বিখ্যাত বইটি লিখেছেন। বইটির নামেও বোঝানো যায় ভারতীয় মুসলমানদের মর্যাদা ও গুরুত্ব কতখানি। অথচ ভারতে চিরদিনই হিন্দু জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ তবুও “দি ইণ্ডিয়ান হিন্দু” বলে কোন গ্রন্থ তিনি লিখে যাননি। স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক তথ্য হান্টারের লেখায় পাওয়া যায়।

হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী (র.) যিনি এতবড় ফকির সাধক ও দেশের জন্য মৃত্যু বরণকারী, যিনি আজ অলিখিত অপ্রকাশিত ইতিহাসে, স্বাধীনতা আন্দোলনের ধ্রুবতারা, যিনি সারা ভারতে ইংরেজ জাতিকে পশুপালের মত তাড়িয়ে নিয়ে ভারতের বাইরে রেখে আসতে চেয়েছিলেন তার জন্য মিঃ হান্টার লিখেছেন, “একজন বিখ্যাত ডাকাতের অধীনে তিনি একজন ঘোড়সওয়ার সৈন্য ছিলেন। সৈয়দ আহমাদ সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন। তিনি ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে দিল্লীর বিখ্যাত একজন মাওলানার নিকট শরীয়তের শিক্ষা গ্রহণ করেন।” “অনেক বছর ধরে দুঃসাহসী মুসলমানরা যেখানে প্রকাশ্যে রাজদ্রোহে লিপ্ত রয়েছে” “ভারতীয় মুসলমানরা হচ্ছে এদেশে বৃটিশ শক্তি বিরুদ্ধে চিরন্তন বিপদ। কোন না কোন কারণে তারা আমাদের শাসন প্রণালী থেকে দূরে সরে আছে। নম্রভাবাপন্ন হিন্দু সম্প্রদায় যেখানে আমাদের প্রবর্তিত পরিবর্তনগুলো আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছে সেখানে মুসলমানরা তাদের জন্য ভীষণ অত্যাচার হিসেবেই ধরে নিয়েছে।” “পাঞ্জাব সীমান্তে বিদ্রোহী বসতি স্থাপন করেন সৈয়দ আহমাদ।” “১৮২০ খৃস্টাব্দে সৈয়দ আহমাদ ধীরে ধীরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণ করলেন। তখন তাঁর শিষ্যরা তাঁর ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য স্মরণ করে সাধারণ চাকরের মত গোলামি করত।” এবং বহু দেশ বিখ্যাত মাওলানা গোলামের মত খালি পায়ে তাঁর পাল্কির দুধার দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে যেতেন।” উপরোক্ত তত্ত্বগুলো মুসলমানবিদ্বেষী হান্টারের লেখা হতে নিলেও আমাদের ইতিহাস তথ্যের সত্যতার পরিপূরক। তিনি আরও লিখেছেন, “১৮২২ সালে তিনি হজ করতে যান এবং পূর্বেকার ডাকাতিকে হাজী সাহেবের আল-খেল্লায় একেবারে ঢেকে দিয়ে তিনি অক্টোবর মাসে বোম্বাই শহরে উপস্থিত হন।” “কলকাতার দিকে রওনা হলেন। কলকাতার সাধারণ মুসলমানরা তার কাছে এমনভাবে দলে দলে মুরীদ বা শিষ্য হতে লাগলো যে, প্রত্যেকের হাতে হাত রেখে শিষ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। তখন মাথার পাগড়ি খুলে জনতার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললো, যে কেউ তাঁর পাগড়ি ছুঁতে পারবে সেই তার মুরিদ বা শিষ্য হবে।” “ব্ৰেলী জেলার জন্মভূমিতে এক বিরাট হাঙ্গামাবাজ অনুচরের দল তার সহযোগী হলো। ১৮২৪ সালে সে পেশোয়ার সীমান্তের জঙ্গলী পার্বত্যদের মধ্যে গিয়ে পাঞ্জাবের সম্পদশালী শিখ শহরগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন।” “১৮২৬ সালে ২১ ডিসেম্বর বিধর্মী শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ আরম্ভ হয়েছে। ইতিমধ্যে ইমাম সাহেবের (সৈয়দ আহমাদ) প্রতিনিধিরা উত্তর প্রদেশে জিহাদের বাণী তাঁর শিষ্যদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।” “১৮৩০ সালের জুন মাসে একবার পরাজিত হয়েও বিপ্লবী সৈন্যরা দুর্দান্ত বিক্রমে সমতলভূমি ছিনিয়ে নেয়। আর সেই বছর শেষ হওয়ার আগেই পাঞ্জাবের রাজধানী পেশোয়ার তারা ছিনিয়ে নেয়।” (দি ইণ্ডিয়ান মুসলমান অধ্যায়)।

সৈয়দ আহমাদ যে ইংরেজ শাসনের অবসান করতে চেয়েছিলেন তার জন্য মিঃ হান্টার লিখেছিলেন, “..... এই বাণী দিয়ে নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করেন। হিন্দু-মুসলমান জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবণতা বা পরিমাণ অনুমান করা যায় হান্টারের লেখায়- এক ইংরেজের উত্তর ভারতে অনেক বড় বড় নীলকুঠি আছে। তিনি আমায় বলেছেন তাঁর নিযুক্ত ধর্মভীরু মুসলমান জাতির নিয়মই হচ্ছে তাদের বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ নিয়মিতভাবে সিত্তানার বসতির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া। আর যারা দুঃসাহসিক প্রকৃতির তারা বিপ্লবী নেতাদের অধীনে কমবেশি সময়ের জন্য কাজ করতেও যায়। তাঁরা হিন্দু ওভারসিয়াররা যেমন সময়ে সময়ে ছুটির দরখাস্ত করে বাৎসরিক পিতৃশ্রাদ্ধ পালন করতে যায়, সেই রকম ১৮৩০ সাল হতে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত তার মূল্যবান পেয়াদারা কয়েক মাসের ছুটি নিয়েছে এই অজুহাতে যে, তাদের জিহাদে যোগদান করতে হবে।” “আমাদের কর্তব্যচ্যুতিতে আমাদের প্রজারা জিহাদী বাহিনীতে যোগ দিয়েছে আমাদের শিখ প্রতিবেশীদের ওপর।” আগেও একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে ইংরেজ ও শিখ পরস্পর একে অপরের উত্তরাধিকারীর মত ছিল বলা যায়। “আমাদের পাঞ্জাব অধিকারের পর যে ধর্মান্ধতা পূর্বে প্রচণ্ডভাবে শিখদের ওপর ফেটে পড়তো, তাই শিখদের উত্তরাধিকারীরূপে আমাদের ওপর বর্ষিত হতে লাগলো।”

সারা ভারত এমনকি বাংলা হতেও স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমান বিপ্লবীরা কেমনভাবে টাকা এবং যোদ্ধা সরবরাহ করতো তারও প্রমাণ ঐ মিঃ হান্টারের লেখা হতেই পাওয়া যায়, “বাংলাদেশ থেকে বিদ্রোহী বসতিতে নিয়মিতভাবে মানুষ ও টাকা পয়সা চালান করার জন্য তারা একটা পাকা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। ঠিক সেই সময় পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট রিপোর্ট পাঠান, পাটনা শহরে বিদ্রোহীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।” সৈয়দ আহমাদ সাহেবের ১৮৩১ খৃস্টাব্দে শহীদ হওয়ার পর অনেকে আন্দাজ করেন, মুসলমানরা বোধহয় চুপচাপ ছিল পরে একবার ১৮৩১ সালে ধুমকেতুর মত আবার বিপ্লব শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে এই যে, মুসলমান বিপ্লবীরা বারবার ইংরেজদের আক্রমণ করেছে। মিঃ হান্টার বলেছেন, “সব সময়ই জিহাদীরা সীমান্তের আদি জাতিগুলোতে ব্যস্ত রেখেছিল বৃটিশ শক্তির সঙ্গে বিরামহীন সংগ্রাম সংঘর্ষে ........ ১৮৫০ সাল থেকে ১৮৬৩ সালের মধ্যে আমরা ষোলবার যুদ্ধ চালাতে বাধ্য হয়েছি। আর তার জন্য তেত্রিশ হাজার সৈন্যের দরকার হয়েছে।” “আর ১৮৫০ থেকে ১৮৬৩ সালের মধ্যে এই যুদ্ধের সংখ্যা হলো কুড়িবার। তার জন্য দরকার হয়েছে ষাট হাজার স্থায়ী সৈন্যের। তাছাড়া অস্থায়ী এবং পুলিশ তো আছেই।” “হিংসার বশবর্তী হয়ে কেমন করে (বিপ্লবীরা) যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ জানাতে সাহসী হতে পারে এটা বোঝা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়, কিন্তু এটা বোঝা খুবই শক্ত যে একটা সুসভ্য দেশের (ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনীর সুকৌশল ও সমরনীতির বিরুদ্ধে কীভাবে তারা বহু যুগ ধরে টিকে থাকতে পারে।” (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস)

তখনকার মাওলানা ও পীরদের কাজই ছিল দলবলকে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার এবং এই জিহাদ তাদের কাছে নামাজ, রোজার মত ধর্মীয় ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য ছিল। তার প্রমাণেও হান্টার বলেছেন, “সোয়াত রাজ্যে অবস্থিত ধর্মনেতা আখন্দ সাহেবের প্রায় ছিয়ানব্বই হাজার মুরিদ বা শিষ্য ছিল আর তাদের প্রত্যেকটি লোক ইংরেজ আক্রমণের সম্ভাবনায় সজাগ ছিল। আর এই জন্যই তাদের খাটি বিশ্বাস ছিল এই বিধর্মীদের (ইংরেজেদের) সঙ্গে যখন যুদ্ধ করতেই হবে তখন একজন ইমাম সাহেবের অধীনেই থাকা যুক্তিযুক্ত। কারণ বিপ্লবী ইমাম সাহেবের পতাকার নিচে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ গেলেও ধর্ম শহীদদের মর্যাদা লাভ করা যাবে। ১৮৬৩ সালের অভিযানের সময় আমরা তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, বিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে আমাদেরকে পৃথিবীর বীরত্ব সমন্বিত বনেদি মুসলমান জাতিদের তিপ্পান্ন হাজার সম্মিলিত সৈন্যের শক্তি বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। (ঐ পুস্তকে)

মিঃ হান্টারের উপরোক্ত লিখিত মন্তব্যগুলোতে পূর্ণভাবে প্রমাণ হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবীদের শক্তি সামর্থ্য, সাহস ও সৈন্য সংখ্যার কথা। আসলে হান্টার ইংরেজ সরকারে বেতনভোগী বিশ্বাসী কর্মচারী সিভিলিয়ান, অন্তরে ভারতবিদ্বেষে ভরপুর। তাই তিনি ঐ তিপ্পান্ন হাজার সৈন্যের কথা বলেছেন। আসলে সংখ্যাটি হবে ষাট হাজার (Foreign office Records, A Maudud)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন