মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন আর ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে মারা যান। ৩৮ অব্দে জন্ম হিসেবে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে তিনি তরুণ বা পূর্ণ যুবক ছিলেন। আর সেই সময় সহস্র সহস্র যুবক স্বাধীনতা আন্দালনে ঝাঁপ দিয়ে গর্বের ইতিহাস সৃষ্টি করতে চাইছিলেন কিন্তু সেখানে বঙ্কিমের ভূমিকা নেগেটিভ না পজেটিভ তা আজ বিচার করতে বাকি নেই তবুও যতদিন সরকারি সাহায্যে বঙ্কিম একজন ঋষি, তিনি একজন সাহিত্য সম্রাট, তিনি একজন ভারতের স্বাধীনতার প্রথম শ্রেণীর জন্মদাতা বলে খ্যাতি লাভ করেছেন তাইতো তার লেখা ‘বন্দেমাতরম’ আওয়াজ ভারতের আকাশে-বাতাসে হুঙ্কার ছাড়ে।
কিন্তু ঋষি বঙ্কিম ইংরেজি শিক্ষায় এবং তাদের অন্ধ অনুকরণে উন্নতি করে একেবারে ভগবান ইশ্বর ঠাকুর দেবতা সব কিছু অস্বীকার করে নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন (শ্ৰীম শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথা মৃত খণ্ড ৫, ১৩৭১ বঙ্গাব্দ। ২১৪ পৃঃ। রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিমের কথোপকথনে বিবরণ দ্রঃ)। অবশ্য পরে তিনি আস্তিক হয়ে এবং আরও উন্নতি করে মুসলমানবিদ্বেষী হয়ে ইংরেজের অত্যন্ত অনুগত হয়ে পড়েন। ঈশ্বর গুপ্তকে লেখার দিক দিয়ে গুরু বলে মেনে নিন এবং গুরু ভাইদের মত নবীন চন্দ্র সেন, চন্দ্র নাথ বসু প্রভৃতি রক্ষণশীল হিন্দুর ‘নব জীবন’ পত্রিকায় নিজেকে যুক্ত করেন। বঙ্কিম স্বীকার না করলেও আসলে তিনিও রামমোহনের অনুসরণকারী ছিলেন। কিন্তু কাউকে নিজের গুরু বলে মেনে নেওয়ার মত উদারতা তার ছিল না। বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও যেমন তার বাধেনি, তেমনিভাবে রামমোহনের সঙ্গে তাঁর ঠাণ্ডা লড়াই হয়েছিল। বঙ্কিম বুঝেছিলেন তাঁর নাস্তিকতার পড়তা ভাল নয়। কারণ রামমোহন আস্তিক হয়ে ইংরেজ দরদি হওয়া দেশের লোকের কাছে ততটা খারাপ লাগতো না যতটা খারাপ লাগতো নাস্তিক অবস্থায় বঙ্কিমের ইংরেজপ্রেমিক হওয়া। তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন, রামমোহন মরেও অমর থাকবেন নতুন ধর্ম মত ব্ৰহ্ম ধর্মের স্রষ্টা হিসেবে। অথচ ইংরেজ সৃষ্ট ইংরেজি শ্রেণী সকলেই তখন ব্রাহ্ম ধর্মে আকর্ষণ কিন্তু প্রাচীনপন্থীগণ ঠাকুর দেবতাদের পরিত্যাগ করতে খুব দ্বিধাবোধ করছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি হিন্দু ধর্ম আর ব্রাহ্ম ধর্ম মিলিয়ে নতুন ধর্ম সৃষ্টি করলেন, যেটার নাম “অনুশীলন ধর্ম”। কিন্তু সত্য কথা বলতে হলে বলতে হয়, ওটা ব্রাহ্ম ধর্মের বাচ্চা ছাড়া কিছু নয়। (বিপিনচন্দ্র পালের “নব যুগের বাংলা ১৩৬৪, পৃঃ ১৯০)।
অনেকে বলেন বঙ্কিম আসলে অত্যন্ত সুবিধাবাদী আত্ম প্রচারক ও পরশ্রীকাতর ব্যক্তি। তাই তিনি ব্রাহ্ম ধর্মকে কাঠামো করে প্রাচীন হিন্দুদের ব্রাহ্ম ধর্মে যেসব আপত্তিকর সুর ছিল যথা-বিধবা বিবাহ, বহু বিবাহ রোধ, অস্পৃশ্যতা যনি, মূর্তি পূজার বিলোপ সাধন ইত্যাদি। এইসবের সপক্ষে ওকালতি আরম্ভ ফরলেন ফলে সেকেলে লোকগুলো সহজেই তাঁর করতলগত হয় আর আধুনিক লোকরাও চিন্তায় পড়ে গেলেন কী করা যায়। অত্যন্ত দুঃখের কথা ব্রাহ্ম ধর্মে ‘ছোট লোক’ ‘ভদ্র লোকের’ ব্যবধান দূর করে যে মিলনের পথ রচিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর আবার ছোট লোককে ছোট লোক করে বাকিদের ভদ্রলোকের পাক্কা সার্টিফিকেট ধর্ম হতেই বিতরণ করলেন (দ্রঃ সৌরেন্দ্র মোহনের বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চিন্তা পৃঃ ১০৮) রবীন্দ্রনাথ যে বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করে বলেছিলেন, “তাহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা” তিনি আরও বলেন “বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন, তৎপূর্বে বাংলা ভাষার প্রথম সূচনা হইয়াছিল কিন্তু তিনিই সর্ব প্রথমে বাংলা গদ্যে কলা নৈপুণ্যের অবতারণা করেন..... গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্বরতা উভয়ের হস্ত হইতেই উদ্ধার করিয়া তিনি ইহাকে ভদ্র সমাজের সবার উপযোগী আর্য ভাষারূপে গঠিত করিয়া গিয়েছেন।”
বঙ্কিমও তাই সুরে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর .....বাংলা গদ্য লিখিতে পারে নাই আর পরেও পারে নাই। (দ্রঃ বাংলা সাহিত্যে প্যারী চাঁদ মিত্রের স্থান-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) যে হাতে বঙ্কিম লিখলেন “আগে ও পরে পারেন নাই’ সেই হাতেই সুস্থ মস্তিষ্কে লিখলেন, “বিদ্যাসাগর কঠিন সব সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাংলা ভাষার ধাপটা খারাপ করে গেছেন।” বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত বই ‘সীতার বনবাস’-এর জন্য তিনি কান্নার জোলাপ ব্যতীত কিছুই নয় বলেছেন।
বিদ্যাসাগরের মত লোককেও তিনি মূর্খ বলতে লজ্জাবোধ করেননি। (দ্রঃ বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষ। বঙ্কিম রচনাবলী সাহিত্য সংসদ। প্রথম খণ্ড পৃঃ ২৭৯) বঙ্কিমের সাধারণ ভদ্রতা কতটুকু ছিল বিচারের জন্য আর একটি লেখা দেওয়া হচ্ছে- “ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবার বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহ দেয় সে যদি পণ্ডিত হবে তবে মূর্খ কে?” (দ্রঃ অধ্যাপক বদরুদ্দিনের ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ দ্রষ্টব্য)।
মুসলমান জাতির ক্ষতি করেও হিন্দু জাতিকে উন্নতি করতে হবে এই কথাটি কারো মগজে থাকলেও অন্তত কাগজে প্রকাশ করতে ন্যূনতম সভ্যতাতেও বাধা পড়ে। কিন্তু বঙ্কিম লিখলেন, “হিন্দু জাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গল মাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নহে। অনেক স্থানে তাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল সেখানে, তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয় করিব। অপিচ, যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটতে পারে তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে। যা হউক, আমরা সেজন্য আত্ম জাতির মঙ্গল সাধনে বিরত হইব না। পর জাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিতে হয়; তাহাও করিব।” (দ্রঃ বঙ্কিম রচনাবলী, পৃঃ ২৩৯,২ খণ্ড)।
ইংরেজ সারা ভারতের জন ও গণশক্তিতে শক্ত কঠিন হাতে ভারতীয় ষাঁড়াশি দিয়ে চেপে চেপে তিলে তিলে শোষণ করতো। ভারতীয় ষাঁড়াশি ছিল আমাদের দেশের অধিকাংশ দালাল জমিদার। কিন্তু সেই জমিদারের তথা ইংরেজদের পরম প্রিয় ঋষী মহাশয় লিখলেন, সকল জমিদার অত্যাচারী নহেন, দিন দিন অত্যাচারী জমিদারের সংখ্যা কমিতেছে। কলিকাতার সুশিক্ষিত ভূস্বামীদিগের কোন অত্যাচার নাই, যাহা আছে তা তাহাদের অজ্ঞাতে এবং অভিমত বিরুদ্ধে নায়েব গোমস্তা দ্বারা হয়।...........
“আমরা জমিদারের দ্বেষক নহি। কোন জমিদার দ্বারা কখনও আমাদের অনিষ্ট হয় নাই বরং অনেক জমিদারকে আমরা প্রশংসাভাজন বিবেচক মনে করি।” (দ্রঃ বঙ্কিম রচনাবলী, ২ খণ্ড পৃঃ ২৯২) জমিদার মহারাজাদের ভূমিকা প্রথম আযাদী আন্দোলনের আলোচনায় এক এবং সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণের বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বঙ্কিম নিজেই একজন কলিকাতার সুশিক্ষিত ভূস্বামী বা জমিদার ছিলেন (দ্রঃ অধ্যাপক বদরুদ্দিন উমরের লেখা)।
সারা ভারতের প্রকৃত গরিব দরদিরা এমনকি জমিদার বংশের সৎ সন্তানরাও প্রকৃত শিক্ষিত হওয়ার পর জমিদারি প্রথার বিরোধী হয়েছেন তার অনেক নজির আছে।
কিন্তু শিক্ষিত বঙ্কিম বললেন, “যাহারা জমিদারদিগকে কেবল মিথ্যা নিন্দা করেন আমরা তাঁহাদের বিরোধী। জমিদারদের দ্বারা অনেক সৎকার্য হইতেছে। (বঙ্কিম রচনাবলী পৃঃ ২৯৭)। জমিদারদের হাতে যতক্ষণ শক্তি থাকত ততক্ষণ খাজনা আদায়ের নামে তাদের বিলাসিতা ও ভোগবিলাসের খরচাও আদায় করা হতো। ঐ জমিদারি ইংরেজ সরকার চিরস্থায়ীভাবে জমিদারদের দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঐ ঐতিহাসিক কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে বৃহত্তম দরিদ্র শ্রেণী, শোষিত শ্ৰেণী বা প্রজাশ্রেণী সরকারের বিরুদ্ধে মৃদুমন্দ গুঞ্জন আরম্ভ করতেই বঙ্কিম বাণী অবতীর্ণ হতে বিলম্ব হলো না। “.........চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গ সমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি।”
বিশেষ যে ব্যবস্থা ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারত মণ্ডলে মিথ্যা বাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাস ভাজন হয়েন এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরেজদের দিই না। যেদিন ইংরেজদের অমঙ্গলোকাক্ষী হইব সেই দিন সেই পরামর্শ দিব।” (দ্রঃ ঐ পৃঃ ৩১০)। ইংরেজদের ইঙ্গিতে জমিদারদের প্রজা পীড়নের বিরুদ্ধেও তিনি কিছু বলতে পারতেন কিন্তু তিনি লিখেছেন উল্টো অনেক জমিদারের প্রজারাও ভাল নহে। পীড়ন না করিলে খাজনা দেয় না। সকলের ওপর নালিশ করিয়া খাজনা আদায় করিতে গেলে জমিদারের সর্বনাশ যায়।” (দ্রঃ পৃঃ ২৯৮)
উপরোক্ত তথ্যগুলোতে আধুনিক গবেষকরা প্রমাণ করতে সক্ষম হতে পারেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুসলমানবিদ্বেষী জমিদার হিসেবে জমিদারের পক্ষীয় লোক ছিলেন বা পরশ্রীকাতর বা মিথ্যাবাদী ছিলেন কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন প্রমাণিত হওয়া কঠিন। কিন্তু ঐ অপরাধই হয়ে তাঁর ঐতিহাসিক অপরাধ, অবশ্য যদি প্রমাণের অভাব না হয়।
স্বদেশী আন্দোলনে যখন চারদিকে বিলিতি জিনিসপত্র ব্যবহার করা বন্ধ করার নীতি প্রচারিত ও প্রচলিত হতে থাকে সেই সময় ইংরেজরা খুব ভীত হয়ে ওঠে, যেহেতু তাদের ব্যবসার নামে শোষণের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ওটা।
তখন ইংরেজপ্রেমিক বঙ্কিম লিখলেন, “যদি (ইংরেজরা) কাহারো ক্ষতি না করিয়া মুনাফা করিয়া থাকে তবে তাহাতে আমাদের অনিষ্ট কী? যেখানে কাহারো ক্ষতি নাই সেখানে দেশে অনিষ্ট কী? আপত্তির মীমাংসা এখনো হয় নাই, আপত্তিকারকেরা বলিবেন যে, ঐ ছয়টি টাকায় দেশী তাঁতীর কাছে ধান কিনিলে টাকা ছয়টা দেশেই থাকিত।..........স্থূল কথা, ঐ হয় টাকা যে দেশী তাঁতী পাইল না তাহাতে কাহারো ক্ষতি নাই। তার্কিক বলিবেন তাঁতীর ক্ষতি আছে। এই থানের আমদানির জন্য তাঁতীর ব্যবসা মারা গেল। তাতী থান বুনেনা ধুতি বুনে। ধুতির অপেক্ষা থান সস্তা সুতরাং লোকে থান পরে ধুতি আর পরে না। এজন্য অনেক ব্যয়সায়ী লোপ হইয়াছে।”
“উত্তর। তাহার তাঁত বুনা ব্যবসা লোপ পাইয়াছে বটে, সে অন্যকিছু করুক না কেন? অন্য ব্যবসায়ের পথ রহিত হয় নাই। তাঁত বুনিয়া আর খাইতে পারে, কিন্তু ধান বুনিয়া খাইবার কোন বাধা নেই। (দ্রঃ বঙ্কিম রচনাবলী ২ খণ্ড পৃঃ ৩১১-৩১২)
গ্রন্থে কলেরর বৃদ্ধির ভয়ে কোন বিষয়েরই পূর্ণ তথ্য পরিবেশন সম্ভব নয় তবুও বঙ্কিম ইংরেজকে শোষক মনে করতেন না তাই ইংরেজদের শোষণের একটু চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন।
১৮০০ খৃষ্টাব্দে টাকায় ১ মণ ৫ সের চাল পাওয়া যেত। ১৮১৪ সালে শোষণের ফলে টাকাপ্রতি মাত্র ৩৭ সের চাল পাওয়া যেত। ১৮২১ সালে আরও শোষণে টাকায় ৩০ সের হয়। ১৮৩৫ সালে টাকায় ২৪ সের চাল। ১৮৭৫ সালে টাকায় ১৭ সের চাল। ১৯২৫ সালে এসে দাড়ায় টাকায় সাড়ে চার সের চান মাত্র।
আমাদের দেশের কাপড় প্রস্তুত কারকদের বংশ ধ্বংস করার জন্য কি পরিমাণ আমদানি করা হয়েছে তা একটু দেখা যাক, ১৮১৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বিলেতি কাপড় খুব একটা আসেনি। কিন্তু ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে আট লক্ষ্য গজ কাপড় কলকাতায় পৌঁছায়। ১৮২১ সালে একেবারে দুই কোটি গজ। ১৮৩৫ সালে পাঁচ কোটি গজ। ১৮৭৫ সালে আনা হয় একষট্টি কোটি গজ। ১৯২৫ খৃঃ একেবারে বিলেতি কাপড়ের পাহাড় এসে পরিমাণ হয় এক অর্বুদ ছাপান্ন কোটি গজ।
এইবার ভারতকে শোষণ করে কী পরিমাণ বিলেতে নিয়ে যেত তার পরিমাণ দেখলেই বুঝতে সহজ হবে কেন বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে ৬ কোটি ৭৫ লক্ষ মণ চাল ভারত হতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ৩ কোটি ৫০ লক্ষ মণ গম আর দেড় কোটি মণ তুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাট আড়াই কোটি মণ আর চা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৩৬ লক্ষ মণ। (দ্রঃ মায়ীশাতুল হিন্দ পৃঃ ৯৫)
উপরোক্ত হিসাব ছাড়াও ভারতের বাইরে ১৯১৮ হতে ১৯১৯ খৃষ্টাব্দের মাঝে আরও ৫৬ কোটি ৫০ লক্ষ মণ চাল পাচার হয়ে যায়। (বর্ণনাকারী শ্রী দয়াশংকর দোবে, “মজলুম কিষাণ” পৃঃ ৮২)
এগুলো জানার পর এইবার মহামতি ঋষি বঙ্কিমের উপরের ওকালতিগুলো এবং নিচের উদ্ধৃতিগুলো পড়লেই অনুসন্ধিৎসুরা তাদের কর্তব্য ঠিক করবেন। বঙ্কিম বলেন, “বাণিজ্য বিনিময় মাত্র। আমরা যদি ইংল্যাণ্ডের বস্ত্রাদি লই তার বিনিময়ে আমাদের কিছু সামগ্রী ইংল্যাণ্ডে পাঠাতে হবে নইলে আমরা বস্ত্র পাব না। আমরা কি পাঠাই? অধিকাংশের বিনিময়ে আমরা কৃষিজাত দ্রব্য যথা চাল, রেশম, কার্পাস, পাট, নীল ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, যে পরিমাণের বাণিজ্য বৃদ্ধি হবে সেই পরিমাণ এই সকল কৃষিজাত দ্রব্যাদির আধিক্য আবশ্যক হইবে। সুতরাং দেশে চাষীও বাড়বে। বৃটিশ রাজ্য হইয়া পর্যন্ত এদেশের বাণিজ্য বাড়তেছে সুতরাং বিদেশে পাঠানোর জন্য বছর বছর অধিক কৃষিজাত সামগ্রীর আবশ্যক হইতেছে। অতএব এদেশে প্রতি বছর চাষ বাড়তেছে। চাষ বৃদ্ধির ফল কী? দেশের ধন বৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি।” (দ্রঃ বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড, পৃঃ ১১৩)
অতএব বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ আসলে ইংরেজদের পদ সেবার নামান্তর। ইংরেজ চেয়েছিলো কৃষক বা প্রজাদের শোষণ আর মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। তাই তাদের স্বার্থেই করতে হয়েছিল কলকাতায় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়। আর তারই ভেতর থেকে বাছাই করা ডিগ্রী পাওয়া দালাল নির্ধারণ। বঙ্কিম উচ্চ শ্রেণীর ইংরেজ প্রেমিক ও ভারতের ক্ষতিকারক হিসেবে শীর্ষ স্থানীয়রূপে উল্লেখযোগ্য কি না তা বিচার করিতে কাঠিন্য নেই।
তাই অধ্যাপক বদরুদ্দিন উমর লিখেছেন, “বঙ্কিমচন্দ্র যে শুধু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্ট ভূমি ব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার স্বার্থ ও সংস্কারের রক্ষক ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে প্রতিক্রিয়ার সর্ব প্রধান প্রতিনিধি......। এই কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য প্রচেষ্টা একদিকে যেমন নিযুক্ত ছিল কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে তেমনি তা সমান নিষ্ঠার সাথে নিযুক্ত ছিল ঈশ্বর চন্দ্রের সমগ্র চিন্তা ও সংস্কারের আন্দোলনের বিরুদ্ধে।” (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, পৃঃ ১০৫-১০৬)।
সাধারণ হিন্দুদের নিকট তিনি ঋষি উপহার পেলেও আসলে ওটা ইংরেজদেরই দেওয়া পরোক্ষ উপাধি। তিনি আসলে ইংরেজ শাসককেই দেবতা বলে জানতেন। “তাই বঙ্কিমচন্দ্রের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে যেদিন ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও শিল্প এবং ভারতবর্ষের এই নিষ্কাম ধর্ম একত্র হইবে সেই দিন মনুষ্য দেবতা হইবে। (বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, সৌরেন্দ্র, পৃঃ ১০২)
ইতিহাসে যেটাকে সিপাহী বিদ্রোহ বলা হয়েছে সেই বিপ্লবে যারা যোগ না দিয়ে বিরোধিতা করেছে তারা যদি নেতা হয় যারা নীলকরদের অত্যাচারকে সমর্থন করেছে তারা যদি নেতা হয় তাহলে দেশের শত্রু কারা তা বলা খুবই কঠিন।
সৌরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তাই ঋষি মহাশয়ের জন্য লিখেছেন, “বাংলার সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনিও সিপাহী বিদ্রোহ সমর্থন করেননি। আবার দীনবন্ধু মিত্রের একান্ত বান্ধব বঙ্কিমচন্দ্র নীলকরদের অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেও সে বিষয়ে নীরব থাকেন।” (বাঙালীর রাষ্ট্রচিন্তা, পৃঃ ১১৪)
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা উপরোক্ত “সমকালীন বুদ্ধিজীবী” বলতে কাদের বলা হয়েছে? যে কথা আগেই জানানো হয়েছে সারা ভারতের বিপ্লবের অবস্থা বা প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনে নানা স্থানের জঙ্গি ভূমিকার আত্মত্যাগের কথা, কিন্তু কলকাতা নীরব ছিল কেন? তার একমাত্র কারণ আশুতোষ, বিদ্যাসাগর প্রমুখ বিরাট প্রতিভাধারী ব্যক্তিরা শোষক সরকারের ডিগ্রিপ্রাপ্ত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সরকার চাকরি দিয়ে, উপাধি দিয়ে, বশে রেখেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকা একটি ছেলে ধরার ফাঁদ ছিল বলা যেতে পারে। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনকে ঘিরে যেসব জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ ঘটে তাঁদের মধ্যে ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, রামগতি ন্যায়রত্ন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রামদাস সেন, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, লালবিহারী দে, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমুখ চিন্তানায়ক।”
তাই বঙ্গ দর্শনের জন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বঙ্কিমের ‘বঙ্গ দর্শন’ আসিয়া বাঙ্গালীর হৃদয় একেবারে লুট করিয়া লইল।” অতএব প্রমাণ হতে বাকি নেই যে, অখণ্ডিত ভারতের রাজধানী কলকাতার বিপ্লবের বিরাট বহ্নি শিখাগুলোকে ছাই-এর মত ঢেকে রেখেছিলেন তদানীন্তন উচ্চশ্রেণীর নেতৃবৃন্দ।'( রবীন্দ্র রচনাবলী, পঃ সরকার প্রকাশিত সংস্করণ, খণ্ড ১০, পৃঃ ৫৫) বঙ্কিম যে কোন তন্ত্র অবলম্বন করেছিলেন তা এক কথায় বলা শক্ত। প্রথম জীবনে আস্তিক পরে নাস্তিক তার পরে আবার আস্তিক তারপর আবার ঋষি। তিনি একদিকে বলছেন, “সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ, ঈশ্বর ভিন্ন আর কেউ নেই। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বর আমাদের আদর্শ হতে পারেন না।” আরও বলেছেন, “জগদীশ্বর এক ছিলেন, বহু হইতে ইচ্ছে করিয়া এই জগৎ সৃষ্টি করিলেন” আবার তিনিই এই মত পোষণ করতেন যে, “ঈশ্বর এক, কিন্তু তিনটি পৃথক সত্তায় তিনি বিভক্ত। সেই ত্রিসত্তার একজন করেন সৃজন, অন্যজন পালন করেন ও অপর জন ধংস করেন।” (দ্রঃ বাঙ্গালীর রাষ্ট্রচিন্তা, সৌরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় পৃঃ ১১৬-১১৭)
আবার ঐ বঙ্কিমই যা দেখা যায় না ভাববাদ বা কল্পনাবাদ একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “প্রত্যক্ষই জ্ঞানের একমাত্র মূল, সকল প্রমাণের মূল”। আবার তাঁরই লেখা ‘ধর্মতত্ত্বে’ তিনি পাগলের প্রলাপের মত লিখলেন, “সকল জ্ঞান প্রত্যক্ষমূলক নহে”। (দ্রঃ ঐ) এই প্রলাপের ওপর প্রলেপ চড়িয়ে বলতে দ্বিধা করলেন না “এই সকল মত এখন আমি পরিত্যাগ করিয়াছি”।
কমিউনিস্টরা তাঁকে গোঁড়ার চেয়ে গোঁড়ামিতে শীর্ষস্থানীয় মনে করলেও ভারতীয় কংগ্রস কর্মীরা বোধহয় তাঁকে এক নম্বর খাঁটি কংগ্রেসী মনে করবেন তারও উপায় নেই। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেস মহলে তিনি একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন যার অর্থ কংগ্রেসীদের তিনি বিশ্বাস করতেন না যথা “.....কিন্তু যে প্রণালীতে উহার কার্য পরিচালিত হইতেছে আজ পর্যন্ত উহা সাধারণে যোগদানের উপযুক্ত হয়নি। উহার সমস্ত আন্দোলন যেন ক্ষণস্থায়ী ও অন্তসার শূন্য বলিয়া প্রতীয়মান হয়।” (দ্র: ঐ)।
ঐ বঙ্কিমই আবার ঠাকুর দেবতার কথা উল্টিয়ে দিয়ে সমাজকেই দেবতা বলেছেন, যেমন “সমাজকে ভক্তি করিবে। ইহা স্মরণ রাখিবে যে, মনুষ্যের যত গুণ আছে সবই সমাজে আছে। সমাজ আমাদের শিক্ষাদাতা, দণ্ড প্রণেতা, ভরণ-পোষণ ও রক্ষাকর্তা। সমাজই রাজা, সমাজই শিক্ষক। ভক্তিভাবে সমাজের উপকারে যত্নবান হইবে।” (বঙ্কিম রচনাবলী, ২খণ্ড পৃঃ ৬৭১ ধর্মতত্ত্ব)। কিন্তু ঋষি একথা বলার সময় হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন যে সমাজের বৃহত্তর অংশ মুসলমান জনগণ ও হরিজন।
সাম্যবাদের গতি কোন দিকে বইবে সঠিক বুঝতে না পেরে তিনি ১৮৭৩ খৃঃ হতে ৭৫ পর্যন্ত বঙ্গদর্শনে সাম্যবাদের পক্ষে অনেক বাণী দান করেন। অবশ্য মুসলমান নিধন আর ছোট লোক নির্ধারণে তার শ্রেষ্ঠ অবদান থাকলেও তিনি অনেকের কাছে সাম্যবাদী। “পরে গ্রন্থাকারে (বঙ্কিম) সেগুলো প্রকাশের পর বমিচন্দ্র লিখেছিলেন যে ঐ বিষয়ে তাঁর মতে পরিবর্তন ঘটে। তাঁর বহুরূপী চরিত্রের বিচিত্রতা বেশি হলেও ঋষি উপাধি নেওয়ার দারুণ শখ তার মনের মধ্যে ছিল তাই তিনি নিজেই তার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন, “প্রাচীন ঋষি ও পণ্ডিতগণ অতিশয় প্রতিভাসম্পন্ন এবং মহাজ্ঞানী তাঁহাদের প্রতি বিশেষ ভক্তি করিবে, কদাপি অমর্যাদা ও অনাদর করিবে না.............. আমিও সেই আর্য ঋষিদের পদারবিন্দ ধ্যান পূর্বক তাঁহাদিগের প্রদর্শিত পথেই যাইতেছি।" (দ্রঃ ঐ)
বঙ্কিম আসলে মিঃ কোঁৎ-এর মতাবলম্বী ছিলেন কিন্তু বাজারে চাহিদার সাথে তিনি ঘনঘন মত পরিবর্তনে খুব পটুতা প্রদর্শন করেছেন। মত পরিবর্তের পরিমাণ এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে ঋষির অমর্যাদা করা হলেও অন্তত অল্প বিস্তর প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু হয়, সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিম তার বাণী বর্ষণ করলেন “ আমার জীবনে আমি অনেক বিষয়ে মত পরিবর্তন করিয়াছি, কে না করে? মত পরিবর্তন বয়োবৃদ্ধি, অনুসন্ধানের বিস্তার এবং ভাবনার ফল। যাহার কখনও মত পরিবর্তন হয় না তিনি হয় অভ্রান্ত, দৈব্যজ্ঞানবিশিষ্ট, নয় বুদ্ধিহীন এবং জ্ঞানহীন।”
বিশেষত বাঙালীরা বঙ্কিমকে নানা কারণে শ্রদ্ধা করে আসছেন। কিন্তু যার বন্দেমাতরম মন্ত্র ভারতের মাটিতে সর্বত্র প্রচারিত যার ‘আনন্দ মঠ’ পুস্তক স্বাধীনতা যুদ্ধের বেদ, তার একটু ইঙ্গিত হলে ভারতের সর্ব ভারতীয় ভাষা বাংলাই হতো কিন্তু বাংলা, উর্দু, হিন্দি কোন ভারতীয় ভাষার জন্য তিনি সুপারিশ না করে ইংরেজিকেই তিনি সর্বভারতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে মত প্রকাশ করেন। (দ্রঃ বাঙালীর রাষ্ট্রচিত্তা, পৃঃ ১৪৩)।
ভারতের পলিটিক্যাল বেদ আনন্দ মঠকে অনেকে ভক্তি শ্রদ্ধার ভাষার ভারে ভারাক্রান্ত করে ঐতিহাসিক উপন্যাস ও বিপ্লবাত্মক বই বলে মনে করেন কিন্তু স্বাধীনতার প্রকৃত প্রথম বিপ্লব ১৮৫৭ তে প্রথমাঙ্ক শেষ হয়, তখন তিনি নীরব। তার আনন্দ মঠ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে।
যারা আনন্দ মঠকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলেন তারা ভ্রান্ত না বঙ্কিম ভ্রান্ত তা বোঝার সুবিধার জন্য মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ‘রাজসিংহ’ বই ‘আনন্দমঠের’ পরে প্রকাশ হয়। তাতে তিনি ভূমিকায় লিখেছেন “পরিশেষে বক্তব্য যে আমি পূর্বে কখনও ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখি নাই। ..........এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।” অন্যত্রে আরও বলেন, “ইংরেজ ভারতের পরম উপকারী। ইংরেজ আমাদিগকে নতুন কথা শিখাইতেছে যাহা আমরা কখনো জানিতাম না, তাহা জানাইতেছে। যাহা কখনো দেখি নাই, শুনি নাই, বুঝি নাই, তাহা দেখাইতেছে, শুনাইতেছে, বুঝাইতেছে; যে পথে কখনো চলি নাই, সে পথে কেমন করিয়া চলিতে হয় তাহা দেখাইয়া দিতেছে। সেই সকল শিক্ষার মধ্যে অনেক শিক্ষা অমূল্য। যে সকল অমূল্য রত্ন আমরা ইংরেজদের চিত্তভান্ডার হইতে লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুটি আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলাম স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা এবং জাতি প্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে তা হিন্দু জানিত না।” (বঙ্কিম রচনাবলী,পৃঃ ২৪০-১)
অথচ তিনি ভারতের প্রাচীন ঋষিদের পথে চলছেন বলে ঋষি উপাধি পেলেন কিন্তু তিনিই জানাচ্ছেন তাঁর নয়, তাঁদের বরং ভারতের সমগ্র হিন্দু জাতির পথপ্রদর্শক ইংরেজ জাতি।
কোন ইংরেজ আসামির বিচার ভারতীয় জজরা করতে পারতেন না এটা খুবই অসভ্য আভিজাত্য সন্দেহ নেই কিন্তু ভারতবাসী প্রতিবাদীদের প্রতিবাদে বঙ্কিম বলেছিলেন। “ভারতীয়রা ইংরেজদের বিচার করতে পারে না। কিন্তু শূদ্রেরা কি ব্রাক্ষণের বিচার করতে পারতো?”
তাই বিপ্লবের জন্য যে কলম চলে সে কলম এক কলম নয়। উপন্যাস লেখায় গাঁজার গন্ধ আর বাজার হাত করার ইচ্ছা থাকে আর বিপ্লবীর লেখায় রক্তের রঙ, গন্ধ আর প্রাণ দেওয়ার আকুতি, বিপদকে ডেকে নেওয়ার স্পষ্ট স্পর্ধা বিদ্যমান থাকে সেখানে।
স্বাধীনতার জন্য শিক্ষিত ছেলেরা যাতে মাথা না তুলে ভেড়ার মত মাথা নিচু করে থাকে তার জন্যই তিনি কি লেখেননি? “স্বাধীনতা দেশী কথা নহে, বিলাতি আমদানি, ‘লিবার্টি’ শব্দের অনুবাদ.......ইহার এমন তাৎপর্য নয় যে রাজা স্বদেশীয় হইতেই হইবে।”
বঙ্কিমের জন্য আসল তথ্য প্রকাশ করে পূর্ণভাবে লিখলে একটি চিত্তাকর্ষক স্বতন্ত্র গ্রন্থ হতে পারে আর তার জন্য আমাদের দেশে যোগ্য ছেলেও বহু আছে কিন্তু তা লিখে ‘ডক্টর’ টাইটেল পাওয়া যাবে কি? বরং তিনি ঋষি ছিলেন কি না? বিজ্ঞানী ছিলেন কি না? বিপ্লবী ছিলেন কি না? এগুলোর ‘হ্যাঁ’ উত্তরের পেছনে লেখা দিতে পারলে নামের সঙ্গে ‘ডক্টর’ শব্দ যোগ হবে এ এক রকমের গ্যারান্টি বলা যায়। মুসলমান ছাত্র ছাত্রীরা এবং নিরপেক্ষ প্রকৃত শিক্ষিত হিন্দু বা যেকোন পাঠক যার বঙ্কিম সম্বন্ধে সত্যিকার অভিজ্ঞতা আছে তিনি এক মুহূর্তও বঙ্কিমকে শ্রদ্ধা করতে পারবেন বলে আশা করা যায় না। মুসলমান জাতির বিরুদ্ধে কলম ধরে সীমা অতিক্রম করেছিলেন কি না আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, যেমন তার সহস্র সহস্র বাণীর মধ্যে দু-এক টুকরো পেশ করে শেষ করছি। “ঢাকায় দুই-চারদিন বাস করলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হবে। কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। ক্রিয়া বাড়িতে কাক আর কুকুর। আদালতে মুসলমান।” বঙ্কিম বিখ্যাত আনন্দ মঠেও লিখেছেন, “ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন তো প্রাণ পৰ্যন্তও যায়। এ নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?”
সবশেষে একথা বলা যায় ভারতবাসীকে তিনি ইংরেজের দাসে পরিণত করতে যে ‘নেমক’ খেয়েছিলেন সে নেমকের বিনিময়ে তিনি পুরো মাত্রায় কাজ করেছেন নেমক হারামি বা ইংরেজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তাই সাহিত্য সম্রাট, ঋষি, স্বাধীনতার মন্ত্রের স্রষ্টা, সেকালের শিক্ষিত ভারতবাসীর পথপ্রদর্শক বঙ্কিমের অসংখ্য বাণীর একটি মূল্যবান বাণী দিয়েই শেষ করছি “গৃহস্থ পরিবারের যে গঠন সমাজের সেই গঠন। গৃহকর্তার ন্যায়, পিতা-মাতার ন্যায় রাজা সমাজের শিরোভাগ। তাঁহার গুণে তাঁহার দণ্ডে, তাঁহার পালনে সমাজ রক্ষিত হইয়া থাকে। পিতা যেরূপ সন্তানের ভক্তির পাত্র রাজাও সেরূপ প্রজার ভক্তির পাত্র।” বঙ্কিম অবশ্যই ইংরেজ রাজত্ব রাজা ও রাণীর ক্ষেত্রে বাবা ও মার মতই শ্রদ্ধা রেখে কাজ করেছিলেন সন্দেহ নেই। আর তার দলবল ও পর পুরুষরাও তার ঐ বাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিলেন কিন্তু মুসলমান জাতি ইংরেজের প্রতি একেবারেই নেমক হারামি করেছে। অন্তত ঋষির উপদেশ ও আদেশের উপেক্ষা করে এবং শেষে দলে দলে হিন্দুরাও ইংরেজকে শোষক মনে করে হত্যা করতে দ্বিধা করেননি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/490/56
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।