HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কিতাবুন নিসা

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কিতাবুন নিসা

একজন নারী কীভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে জীবনে

সফলতা অজর্ন করবে সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গাইডলাইন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

আরবি প্রভাষক :

আলহাজ্জ মোহাম্মদ ইউসুফ মেমোরিয়াল দারুল হাদীস মাদরাসা

৮-৯ লুৎফর রহমান লেন, সুরিটোলা, ঢাকা- ১১০০।

সম্পাদনা

মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল

ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ইমাম পাবলিকেশন্স লিঃ

ভূমিকা
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ

‘কিতাবুন নিসা’ বইটি প্রকাশ করতে পেরে মহান আল্লাহর কাছে অগণিত শুকরিয়া আদায় করছি। দরূদ ও সালাম পেশ করছি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবায়ে কেরামের উপর।

মানব সমাজের এক বিরাট অংশ হচ্ছে নারী। আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষদের যেমন রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা অনুরূপভাবে নারীদেরও রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা। নারীদেরকে অবহেলা করা ও তাদের প্রতি যুলুম করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, সর্বযুগে নারীরা নানাভাবে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

এর কারণ হচ্ছে, ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ইসলামের বিধান পালন না করা। আরো বড় কারণ হচ্ছে, সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকা। অপর দিকে অধিকাংশ নারীদের অবস্থা এই যে, তারা তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে অসচেতন। ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ নারীই অবহেলা প্রদর্শন করে থাকেন। এসব কারণে একদিকে তারা দুনিয়াতে নির্যাতিত হচ্ছেন অপরদিকে পরকালের আযাবের দিকে ধাবিত হচ্ছেন।

এজন্য প্রত্যেক নারীর কর্তব্য হচ্ছে, তার উপর যেসব দায়িত্ব রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা পালন করা। তাহলেই নারীরা তাদের প্রকৃত মর্যাদা ও সম্মান ধরে রাখতে পারবে।

এ বইটিতে নারীদের ঈমান ও আকীদা বিষয়ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ তুলে ধরার পাশাপাশি নারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া নারীদের পবিত্রতা অর্জনের মাসআলাসমূহও তুলে ধরা হয়েছে। নারীদের উপরও দ্বীনের পথে দাওয়াত প্রদান করা আবশ্যক। এজন্য এ বইটিতে নারীদের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের সঠিক দিকনির্দেশনা পেশ করা হয়েছে। বইটি একজন মুসলিম নারীর গাইডলাইন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- ইনশাআল্লাহ

বইটি প্রকাশনার কাজে যাদের সহযোগিতা রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা যেন সকলকে উত্তম বিনিময় দান করেন এবং এ প্রচেষ্টাকে পরকালে মুক্তির ওসীলা বানিয়ে দেন। আমীন

মা‘আস্সালাম

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

০১৯১২-১৭৫৩৯৬

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
হে মুসলিম মা-বোন! আল্লাহ তা‘আলার অশেষ কৃপায় আপনি একজন মুসলিম নারী হতে পেরেছেন- এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। কেননা পৃথিবীর কোন ধর্মেই নারীর যথাযথ মূল্যায়ন ছিল না। ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা, যাতে নারীকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং নারীর উপযুক্ত অধিকার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَاَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ اِنَّ عَذَابِيْ لَشَدِيْدٌ﴾

যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তবে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে নিয়ামত বৃদ্ধি করে দেব। আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, (তবে জেনে রেখো) নিশ্চয় আমার শাস্তি খুবই কঠোর। (সূরা ইবরাহীম- ৭)

﴿ وَمَنْ يَّشْكُرْ فَاِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهٖۚ وَمَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ﴾

যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো তা নিজেরই কল্যাণের জন্য করে। আর যে অকৃতজ্ঞ হয় (সে নিজেরই ক্ষতিসাধন করে); নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত ও প্রশংসিত। (সূরা লুকমান- ১২)

﴿ مَا يَفْعَلُ اللّٰهُ بِعَذَابِكُمْ اِنْ شَكَرْتُمْ وَاٰمَنْتُمْؕ وَكَانَ اللهُ شَاكِرًا عَلِيْمًا﴾

তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর ও ঈমান আনয়ন কর, তবে তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহর কী লাভ? আল্লাহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী ও সর্বজ্ঞ।

(সূরা নিসা- ১৪৭)

বিভিন্ন জাতির মধ্যে নারীর অবস্থান
বিভিনণ জাতির মধ্যে নারীজাতির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তারা নানাভাবে অবহেলিত হতো। যেমন :

চীন জাতির মধ্যে নারীরা কখনো কোন সম্পত্তির অধিকারী হতে পারত না। এমনকি নিজ সন্তানদের উপর তাদের কোন অধিকার ছিল না। স্বামী যখন ইচ্ছা তখনই স্ত্রীকে তালাক দিতে পারত এবং তাকে অপরের উপপত্নীরূপেও বিক্রয় করতে পারত।

বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা হলো, নারীর সাহচর্যে কল্যাণ লাভ করা চলে না। বিবাহ ও এর আনুষঙ্গিক যাবতীয় কার্যকলাপ বৌদ্ধ ধর্মের চরম লক্ষ্যের পরিপন্থী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর মতে, নারী হলো সকল অসৎ প্রলোভনের ফাঁদ।

ইয়াহুদি সমাজে নারীরা চাকরদের চেয়েও নিম্নস্তরের বলে গণ্য হতো। ভাই থাকলে সে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারত না এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কা অবস্থায় কন্যাকে বিক্রয় করার পূর্ণ অধিকার পিতার ছিল। বিবাহিতা স্ত্রীর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হতো স্বামী।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব সমাজে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক ছিল। কন্যাসন্তানের জন্ম এক চরম অভিশাপ হিসেবে গণ্য হতো। নারীদের সাথে পশুর ন্যায় ব্যবহার করা হতো। তারা নারীদেরকে পণ্যদ্রব্যের মতো বেচা-কেনা করত।

নবজাত কন্যাসন্তান হত্যার রীতি বহুলভাবে প্রচলিত ছিল। তাদেরকে বিভিন্নভাবে হত্যা করা হতো। কেউ গর্ত খনন করে তাতে পুঁতে ফেলে হত্যা করত, কেউ উঁচু স্থান হতে নিচে নিক্ষেপ করে হত্যা করত, আবার কেউ পানিতে ডুবিয়ে মারত অথবা গলা কেটে হত্যা করত। তাদের এসব চিত্র তুলে ধরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمْ بِالْاُنْثٰى ظَلَّ وَجْهُهٗ مُسْوَدًّا وَّهُوَ كَظِيْمٌ يَتَوَارٰى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْٓءِ مَا بُشِّرَ بِهٖؕ اَيُمْسِكُهٗ عَلٰى هُوْنٍ اَمْ يَدُسُّهٗ فِى التُّرَابِؕ اَ لَا سَآءَ مَا يَحْكُمُوْنَ﴾

যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় আক্ষেপে ক্লিষ্ট হয়। তাদেরকে যে বিষয়ে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার কারণে মনের কষ্টে সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও তাকে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে দেবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কতই না নিকৃষ্ট। (সূরা নাহল- ৫৮, ৫৯)

মুহাম্মাদ ﷺ এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত নারীদের উপর এরূপ অমানুষিক নির্যাতন চলত। কোন পুরুষ তার স্ত্রী রেখে মৃত্যুবরণ করলে এবং বিধবা স্ত্রী সুন্দরী হলে তাকে কোন আত্মীয় বিবাহ করে নিত। আর সে সুন্দরী না হলে, তাকে যাবজ্জীবন কারাগারে রাখা হতো। সে যুগে কোন পুরুষ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের ইচ্ছা করলে প্রথম স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করত। ফলে সে তাকে প্রদত্ত সকল সম্পদ স্বামীকে দিয়ে তার নিকট হতে নিস্তার লাভ করত। তারপর এই সম্পদ সে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের জন্য ব্যবহার করত।

ইসলামে নারীর অবস্থান
মানবিক সম্মান ও মর্যাদার বিচারে নারী ও পুরুষের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। নারীকে শুধু নারী হয়ে জন্ম নেয়ার কারণে পুরুষের তুলনায় হীন ও নীচ মনে করা সম্পূর্ণ জাহেলী ধ্যান-ধারণা। এরূপ চিন্তাভাবনা ইসলাম স্বীকার করে না।

ইসলাম আগমনের পূর্বে নারীরা বেঁচে থাকার সর্বনিম্ন অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। কিন্তু কুরআন ঘোষণা করেছে, মানুষের বাঁচার মতো মানমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার নারীদেরও আছে, যা কেউ হরণ করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ এই উপেক্ষিত ও বঞ্চিত নারী সমাজের অবস্থার উন্নয়ন এবং তাদেরকে সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা প্রসঙ্গে যে উন্নত মানের শিক্ষা পেশ করেছেন, নারীমুক্তির কোন উচ্চকণ্ঠ সমর্থকই আজ পর্যন্ত সে মানের শিক্ষা পেশ করতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوْقَ الْأُمَّهَاتِ وَوَأْدَ الْبَنَاتِ

নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য চিরতরে হারাম করে দিয়েছেন মায়েদের নাফরমানী করা এবং মেয়ে সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা। [সহীহ বুখারী, হা/২৪০৮; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৮০; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/১১৭৮৪; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫১৪২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৭২৮৮; বায়হাকী, হা/১১১২২; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৪২৬; জামেউস সগীর, হা/২৬৩০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫০৭; মিশকাত, হা/৪৯১৫।]

রাসূলুল্লাহ ﷺ অন্য হাদীসে বলেন,

حُبِّبَ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيِّبُ

দুনিয়ার জিনিসগুলোর মধ্য থেকে নারী ও সুগন্ধিই আমার নিকট প্রিয়তর বানিয়ে দেয়া হয়েছে। [নাসাঈ, হা/৩৯৩৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৩১৫; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৩৫৩০; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৩২৪৮; মু‘জামুল আওসাত, হা/৫২০৩।]

নারীর প্রতি ঘৃণাপোষণ, নারী বর্জন এবং পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধি এড়িয়ে যাওয়া আল্লাহভীতির প্রমাণ বা লক্ষণ নয়। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম ঈমান, তাঁর সাথে সম্পর্কের দৃঢ়তা ও মজবুতি, আল্লাহর ভয় ও আনুগত্যই হলো তাকওয়া। নারীর সাথে বৈধ সম্পর্ক রাখা তাকওয়াবিরোধী কাজ নয়। এসব করেও আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া সম্ভব। শুধু সম্ভবই নয়, এসবের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সমত্মুষ্টি অর্জন করাই ইসলামের দেখানো পথ।

ইসলাম নারীদেরকে সকল দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ মর্যাদা প্রদান করেছে।

সৎকর্মের পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান :

﴿فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ اَنِّيْ لَاۤ اُضِيْعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنْكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ اَوْ اُنْثٰىۚ بَعْضُكُمْ مِّنْ ۢبَعْضٍ﴾

অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের আহবানে সাড়া দিলেন যে, আমি তোমাদের পুরুষ অথবা নারীদের মধ্য হতে কোন আমলকারীর আমল নষ্ট করব না, তোমরা পরস্পর এক। (সূরা আলে ইমরান- ১৯৫)

নারীদের প্রতি অন্যায় করতে নিষেধ করা হয়েছে :

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا يَحِلُّ لَكُمْ اَنْ تَرِثُوا النِّسَآءَ كَرْهًا﴾

হে ঈমানদারগণ! জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হওয়া তোমাদের জন্য হালাল নয়। (সূরা নিসা- ১৯)

নারীদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার তথা বিয়ে এবং তালাক গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, অন্য কেউ তাদের সিদ্ধান্ত নারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবে না। এ পর্যায়ে যা কিছু করা হবে, তা করতে হবে তাদের মতামতের ভিত্তিতে।

নারী-পুরুষ উভয়কেই একে অপরের সহযোগী ও দায়িত্বশীল করা হয়েছে :

﴿وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيَآءُ بَعْضٍۘ يَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗؕ اُولٰٓئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُؕ اِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ﴾

মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, এরা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। অচিরেই আল্লাহ এদের প্রতি দয়া করবেন; নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা তওবা- ৭১)

ইসলামী সমাজের ভালো-মন্দ ও লাভ-ক্ষতির ব্যাপারে মুসলিম নারীরা কখনো নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। কেননা সমাজের ভাঙ্গা-গড়া, উন্নতি-অবনতি ও কল্যাণ-অকল্যাণের সাথে নারী-পুরুষ সকলেরই নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজের কোন ক্ষতি সাধিত হলে তা থেকে নারীরা বাঁচতে পারে না। আবার সমাজের কল্যাণ সাধিত হলে তার সুফল নারীসমাজও ভোগ করে। এমতাবস্থায় নারীরা সমাজের কল্যাণ সাধনের কাজ থেকে কিছুতেই দূরে সরে থাকতে পারে না। কল্যাণময় কাজের সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলে সর্বপ্রথম অন্যায়, অসত্য ও অকল্যাণের প্রতিবাদ করতে হবে। এসব কাজে আত্মনিয়োগ করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের রয়েছে।

জীবনের যেসব ব্যাপারে নারীরা অন্যদের তুলনায় অধিক জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ সেসব ব্যাপারে তাদের থেকে যথাযথ উপকার গ্রহণ করতে হবে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রায়ই তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। যেমন-

হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল, এ বছর মুসলিমরা উমরা না করেই ফিরে যাবে। তাই রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-কে হুদায়বিয়াতেই ইহরাম খুলে ফেলার এবং সঙ্গে করে নিয়ে আসা পশুগুলো যবেহ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাহাবীগণ যেহেতু এই সন্ধির শর্তসমূহ দেখে বিশেষভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন, সে কারণে তারা কেউ এ নির্দেশ পালনে কোন তৎপরতাই দেখালেন না। এরূপ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ ﷺ উম্মে সালামা (রাঃ) এর নিকট দুঃখ প্রকাশ করলেন। উম্মে সালামা (রাঃ) সাহাবীদের মনস্তত্ত্ব লক্ষ্য করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা সহকারে পরামর্শ দিলেন যে, কাউকে কিছু না বলে যা কিছু করার আপনি নিজেই অগ্রসর হয়ে করে ফেলুন; দেখবেন, সকলেই আপনার দেখাদেখি সব কাজই করবে, তখন আর কেউ আপনার আদেশ পালনে বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠিত হবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ এ পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করলেন এবং যখনই তিনি করণীয় সব কাজ করলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)ও তাঁর অনুসরণ শুরু করে দিলেন। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১০৩৬৯।]

এভাবে উম্মে সালামা (রাঃ) এর যথার্থ ও সুচিন্তিত পরামর্শ উপস্থিত অচলাবস্থা দূর করতে সক্ষম হয় এবং এটা প্রমাণিত হয় যে, মহিলাদেরও যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি আছে এবং তাদের পরামর্শ জীবনের অনেক সমস্যারই সমাধান করতে সক্ষম।

নারীরা যা উপার্জন করবে তাতে তাদের অধিকার রয়েছে :

﴿ لِلرِّجَالِ نَصِيْبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُوْاؕ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيْبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ﴾

পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য।

(সূরা নিসা- ৩২)

অর্থনৈতিক ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ইসলামী শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে শ্রম-সাধনা করার অনুমতি রয়েছে। প্রত্যেকেই আপন শ্রমের মজুরি লাভ করার অধিকারী। এমনকি স্বামীও পারে না নিজ স্ত্রীর মালিকানাধীন ধন-সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে এবং স্ত্রীও পারে না স্বামীর সম্পত্তি নিজ ইচ্ছামতো ব্যয় করতে।

নারীরা উত্তরাধিকার পাওয়ার হকদার
নারীর জন্যও উত্তরাধিকারের অংশ নির্দিষ্ট রয়েছে :

﴿وَلِلنِّسَآءِ نَصِيْبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْاَقْرَبُوْنَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ اَوْ كَثُرَؕ نَصِيْبًا مَّفْرُوْضًا﴾

নারীদের জন্যও পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পদে অংশ রয়েছে। কম হোক বা বেশি হোক, এসব অংশ নির্ধারিত। (সূরা নিসা- ৭)

পুরুষরা যেমন উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে, তেমনি নারীর জন্যও উত্তরাধিকারের অংশ নির্দিষ্ট রয়েছে। তবে বিশেষ কারণে এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অংশ সমান রাখা হয়নি। পুরুষের তুলনায় নারীর অংশ পরিমাণে কম নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহর নির্ধারিত এ আইনটিকে নিয়ে কিছু স্থূল বুদ্ধির লোক ইসলামের অর্থ-বণ্টন রীতির সমালোচনা করতে গিয়ে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। কিন্তু ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পরিবারব্যবস্থা বিবেচনা করে দেখলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। আসলে নারীর কতিপয় স্বভাবগত দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত মজবুত ও নির্ভরযোগ্য করে দেয়া হয়েছে; যদিও পুরুষের আর্থিক অবস্থা সর্বাবস্থায় ও সর্বক্ষণই অনিশ্চিত ও অনির্ভরযোগ্য। ইসলামী বিধান অনুযায়ী নারীর উত্তরাধিকার অংশ পুরুষের তুলনায় অর্ধেক। তবে তার এ ঘাটতি অন্যভাবে পূরণ করে দেয়া হয়েছে। স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে মোহরানা পায়। কিন্তু পুরুষরা এ ধরনের কোন কিছু কারো নিকট থেকে পায় না। তাছাড়া গোটা পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব পুরুষদের উপরই ন্যস্ত; নারীরা তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মেয়েরা বিয়ের পূর্বে অভিভাবকের এবং বিয়ের পর স্বামীর নিকট থেকে নিশ্চিতভাবে ভরণ-পোষণ পেয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় নারীকে পুরুষের সমান উত্তরাধিকার দান করা সুবিচার নয়, বরং এটি অবিচারের নামান্তর। আর ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সর্বপ্রকার অবিচার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

অনেক অঞ্চলেই তাদের রীতি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে তার কন্যাসন্তানদেরকে কোন অংশ প্রদান করা হয় না; বরং ভাইয়েরাই সব ভোগ করে থাকে। এটা সম্পূর্ণ যুলুম ও হারাম। কেউ কেউ বলেন যে, বোনেরা তাদের অংশ দাবি করে না এবং ক্ষমা চেয়ে নিলে ক্ষমা করে দেয়। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, হক না চাওয়া হক ছেড়ে দেয়ার দলীল হতে পারে না। যেসব বোনেরা জানে যে, তারা নিজেদের সম্পত্তি পাবে না তারা নিজেদের হক দাবি করা হতে বিরত থাকে। যদি তাদের অংশ বণ্টন করে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তারপরও যদি তারা না নেয় তাহলে ভিন্ন কথা।

উহুদ যুদ্ধের পর সা‘দ (রাঃ) এর স্ত্রী তাঁর দু’টি শিশু সন্তানকে নিয়ে নবী ﷺ এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা সা‘দের মেয়ে। এদের পিতা আপনার সাথে উহুদ যুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। আর এদের চাচা তার সমস্ত সম্পত্তি নিজের আয়ত্তাধীন করে নিয়েছে। এদের জন্য একটি দানাও রাখেনি। এখন বলুন, কে এ (সহায় সম্পত্তিহীনা) মেয়েদেরকে বিয়ে করবে? তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়,

﴿يُوْصِيْكُمُ اللهُ فِۤيْ اَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْاُنْثَيَيْنِۚ فَاِنْ كُنَّ نِسَآءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَۚ وَاِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ﴾

আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে এ বিধান দিয়েছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। তবে যদি কন্যা দু’জনের বেশি হয় তাহলে তারা পরিত্যক্ত সম্পদের তিন ভাগের দু’ভাগ পাবে। আর যদি কন্যা একজন হয়, তবে সে অর্ধেক পাবে। (সূরা নিসা- ১১)

নারী মোহরানা পাওয়ার হকদার
বিবাহ বন্ধন উপলক্ষে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদত্ত মালকে মোহর বলে। যা স্ত্রীর নিজ সম্পত্তিরূপে গণ্য হয়।

বিয়ে-শাদীতে মোহর অপরিহার্য শর্ত। অথচ মোহর নিয়ে আমাদের সমাজে নানা অজ্ঞতা বিরাজমান। ফলে নারীরা প্রতিনিয়তই প্রবঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। জাহেলী যুগে নারী কোন সম্পদের মালিক হতে পারত না। এমনকি তার প্রাপ্ত মোহর হতেও কিছুই পেত না। তৎকালীন সমাজে বিবাহের সময় বরপক্ষ হতে যে মোহর প্রদান করা হতো তা কনের অভিভাবক তথা পিতা, ভাই অথবা যে আত্মীয়ের অভিভাবকত্বে সে থাকত তার হাতে প্রদান করা হতো। আর তারা এটাকে বিনিময় হিসেবে গ্রহণ করত; নারীর অধিকার হিসেবে নয়।

মোহর কেন দিতে হবে :

যদিও বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে। তবুও দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষের উপর ইসলাম অধিকতর দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করেছে। একদিকে যেমন স্বামী স্বীয় স্ত্রী ও সন্তান-সমত্মতির ভরণ-পোষণ, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে আইনগত ও নীতিগতভাবে বাধ্য, অপরদিকে সারা জীবনের জন্য স্ত্রীকে একান্তভাবে তার জন্য হালাল এবং অপরের জন্য হারাম করে নেয়া এ বৈবাহিক সম্পর্কের বিনিময়ে একটি যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ মোহররূপে স্ত্রীকে প্রদান করতেও স্বামী বাধ্য থাকে। কুরআন মাজীদ নারীকে যেসকল অধিকার প্রদান করেছে তন্মধ্যে মোহর অন্যতম।

মোহরানা আদায় করা স্বামীর উপর ফরয :

﴿فَاٰتُوْهُنَّ اُجُوْرَهُنَّ فَرِيْضَةً﴾

তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদেরকে দিয়ে দেবে। (সূরা নিসা- ২৪)

অধিকাংশ লোক এ বিষয়টিকে গতানুগতিক ধারায় গ্রহণ করে। এ জন্য ফরয মনে করে মোহর আদায়ের প্রক্রিয়া সচরাচর দেখা যায় না। ফলে নারী সমাজ স্রষ্টা নির্ধারিত একটি হক থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।

সহবাসের আগে তালাক দিলেও অর্ধেক মোহর দিতে হবে :

﴿وَاِنْ طَلَّقْتُمُوْهُنَّ مِنْ قَبْلِ اَنْ تَمَسُّوْهُنَّ وَقَدْ فَرَضْتُمْ لَهُنَّ فَرِيْضَةً فَنِصْفُ مَا فَرَضْتُمْ﴾

যদি তোমরা মোহর ধার্য করার পর সহবাসের পূর্বেই তালাক দিয়ে দাও, তবে যা (মোহর হিসেবে) নির্ধারণ করেছ (স্ত্রী) তার অর্ধেক পাবে। (সূরা বাকারা- ২৩৭)

সম্পর্ক স্থাপন করার পর তা ভেঙ্গে দেয়ার কারণে স্ত্রীলোকের অবশ্যই কিছু না কিছু ক্ষতি হয়ে যায়। সাধ্যমতো এ ক্ষতিপূরণ করার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা এ নির্দেশ দিয়েছেন।

মোহরানার পরিমাণ :

সকল মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সমান নয়। তাই ইসলামী শরীয়ত মোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করেনি। এটাই যুক্তিসঙ্গত। যার বেশি দেয়ার সামর্থ্য আছে সে বেশি দেবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاِنْ اَرَدْتُّمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَّكَانَ زَوْجٍ وَّاٰتَيْتُمْ اِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا فَلَا تَأْخُذُوْا مِنْهُ شَيْئًا﴾

আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও এবং তাদের কাউকে অঢেল সম্পদও দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছুই গ্রহণ করবে না।

(সূরা নিসা- ২০)

এ আয়াতে অঢেল মোহরের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং কারো যদি সামর্থ্য থাকে এবং সে প্রচুর মোহরানা স্ত্রীকে প্রদান করে তাতে কোন আপত্তি নেই।

অপরপক্ষে যার সামর্থ্য কম সে যতটুকু পারে ততটুকু মোহরানা দেবে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় এক সাহাবীর মোহরানা হিসেবে দেয়ার মতো কিছুই ছিল না। তারপর তিনি কুরআন শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে ঐ সাহাবীর বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। হাদীসে উল্লেখ রয়েছে,

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، قَالَ أَتَتِ النَّبِيَّ امْرَأَةٌ فَقَالَتْ إِنَّهَا قَدْ وَهَبَتْ نَفْسَهَا لِلّٰهِ وَلِرَسُوْلِ اللهِ فَقَالَ‏ : ‏ مَا لِي فِي النِّسَاءِ مِنْ حَاجَةٍ ‏‏ . ‏ فَقَالَ رَجُلٌ زَوِّجْنِيْهَا‏ . ‏ قَالَ‏ : ‏ أَعْطِهَا ثَوْبًا ‏‏ . ‏ قَالَ لَا أَجِدُ‏ . ‏ قَالَ : ‏أَعْطِهَا وَلَوْ خَاتَمًا مِنْ حَدِيْدٍ ‏‏‏ . ‏ فَاعْتَلَّ لَه ‏. ‏ فَقَالَ : ‏ مَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْاٰنِ ‏‏‏ . ‏ قَالَ كَذَا وَكَذَا‏ . ‏ قَالَ : ‏ فَقَدْ زَوَّجْتُكَهَا بِمَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْاٰنِ ‏‏‏ .‏

সাহল ইবনে সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক মহিলা নবী ﷺ এর কাছে এসে বলল যে, সে নিজেকে আল্লাহ এবং রাসূলের জন্য উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (এ কথা শুনে) নবী ﷺ বললেন, কোন মহিলার নিকট আমার কোন দরকার নেই। তখন এক ব্যক্তি বলল, তাহলে আপনি তাকে আমার কাছে বিবাহ দিয়ে দিন। নবী ﷺ তাকে বললেন, তুমি তাকে একটি কাপড় দাও। তখন সে বলল, আমি তা দিতে সক্ষম নই। নবী ﷺ বললেন, তুমি তাকে একটি লোহার আংটি হলেও দাও। কিন্তু লোকটি এবারও পূর্বের ন্যায় অপারগতা প্রকাশ করল। অতঃপর নবী ﷺ তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি কিছু কুরআন মুখস্থ আছে? সে বলল, কুরআনের অমুক অমুক অংশ আমার মুখস্থ আছে। তখন নবী ﷺ বললেন, যে পরিমাণ কুরআন তোমার মুখস্থ আছে এর বিনিময়ে এ মহিলাটিকে তোমার নিকট বিয়ে দিলাম। [সহীহ বুখারী, হা/৫১৪৯; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১০৯২; সহীহ মুসলিম, হা/৩৫৫৩; আবু দাউদ, হা/২১১৩; তিরমিযী, হা/১১১৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৮৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪০৯৩; নাসাঈ, হা/৩২৮০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৫০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৭৫২২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৪৭৪৮; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৩৩৬৮; সুনানে দারেমী, হা/২২০১; সুনানে দার কুতনী, হা/৩৬১১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৫৬৪৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/২৩০২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/১২২৭৪; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৯৭৪; মিশকাত, হা/৩২০২।]

স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে মোহরানা চেয়ে নিতে পারে :

আমাদের সমাজের অনেক নারীর ধারণা হলো, স্বামীর কাছে মোহর চাওয়া যাবে না। আবার অনেকে ভাবেন যে, বিবাহ বিচ্ছেদের সাথে এটা সম্পৃক্ত। এরূপ ধারণা একান্তই অমূলক। স্ত্রী তার পাওনা হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে মোহর চেয়ে নিতে পারে, এতে দোষের কিছু নেই। স্ত্রীর চাওয়ার আগে দিয়ে দেয়া স্বামীর জন্য উত্তম। মোহর আদায়ের সর্বোত্তম নিয়ম হলো, সামর্থ্যের মধ্যে তা নির্ধারণ করে নগদ আদায় করা। প্রাপ্তবয়স্কা নারী নিজেই মোহর গ্রহণ করার অধিকার রাখে। অপ্রাপ্তবয়স্কা হলে পিতা অথবা তার নিকটতর অভিভাবক মোহর গ্রহণ করতে পারবে।

মোহর একটি মেয়ের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সঙ্কটকালে সে যেন এ সম্পদ ব্যবহার করে সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা।

মোহরানা মাফ চেয়ে নেয়া ঠিক নয় :

আমাদের সমাজে মোহর নিয়ে নানা রকম কুসংস্কার চালু আছে। এর একটি হচ্ছে, স্ত্রীর কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে মাফ চেয়ে নেয়া। দেশের কোন কোন অঞ্চলে এ কুপ্রথা চালু আছে যে, বিয়ের রাতেই স্বামী স্ত্রীর কাছ থেকে মোহর মাফ করিয়ে নেয়। মেয়ে যেহেতু মোহরের গুরুত্ব সম্পর্কে জানে না এবং প্রথম প্রথম সে মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। এহেন অবস্থায় সে তার স্বামীকে মাফ করবে না- এ কথা বলতে পারে না। মোহরানা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত স্ত্রীর একান্ত একক অধিকার। এটা স্বামীর কোন করুণা নয়। ছলে-বলে-কৌশলে বা অজ্ঞতার সুযোগে তা মাফ করিয়ে নিলে, সেটা মাফ না হয়ে যুলুম ও প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে।

দেশের কোন কোন অঞ্চলে এমন অবস্থাও বিরাজমান যে, স্বামী-স্ত্রীর হয়তো মিল হচ্ছে না। এক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে তার বাপের বাড়িতে দিয়ে বসে থাকে এবং বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। মনে করে আমি অগ্রসর হয়ে তালাক দিলে মোহর দিতে হবে। এটা বড় অন্যায়।

নারীর মর্যাদা কিসে
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ অতীব সম্মানিত ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। সর্বোপরি মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা। ইসলাম জন্মগতভাবে মানুষকে এ মর্যাদা দিয়েছে। তবে মানুষ নিজেই যদি নিজের চরিত্র ও কার্যকলাপের ফলে জানোয়ার থেকেও নিচে নেমে যায় তবে তা স্বতন্ত্র কথা।

মানবজাতির নারী-পুরুষদের মধ্যে যে কেউই উত্তম স্বভাব-চরিত্র ও কাজ কর্মের ধারক হবে, সেই প্রকৃতপক্ষে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে নারী বা পুরুষ যে-ই তার আমলনামাকে কলুষিত করবে, সে-ই চরমভাবে ব্যর্থ হবে। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কোনরূপ পার্থক্য করা হবে না।

﴿وَمَنْ يَّعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ اَوْ اُنْثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَاُولٰٓئِكَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُوْنَ نَقِيْرًا﴾

মুমিন অবস্থায় পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে যারা সৎকাজ করে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণুপরিমাণও যুলুম করা হবে না।

(সূরা নিসা- ১২৪)

নারীকে আল্লাহ অনর্থক সৃষ্টি করেননি
ইসলাম আগমনের পূর্বে নারীকে অকেজো ও অকল্যাণকর মনে করে তাদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছিল। ইসলাম এই অবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে, মানব জীবনধারা সমানভাবে নারী ও পুরুষ উভয়েরই মুখাপেক্ষী। নারীকে সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশরূপেই সৃষ্টি করা হয়েছে। পুরুষকে যেমন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, নারীদেরকেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। উভয়ের জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়াই স্রষ্টার ইচ্ছা।

১০
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আমরা এ পৃথিবীতে নিজে নিজে আসিনি। বরং আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি আমাদেরকে অহেতুক সৃষ্টি করেননি। তিনি বলেন,

﴿أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَّأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُوْنَ﴾

তোমরা কি মনে করেছ যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি; আর তোমরা আমার দিকে ফিরে আসবে না? (সূরা মু’মিনূন- ১১৫)

মানুষ যদি কল্যাণ পেতে চায় তবে তাকে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার সেই উদ্দেশ্যকে জানতে হবে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনকে সামনে রেখে নারী-পুরুষ সকলকেই তার জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো :

১. আল্লাহর দাসত্ব করা :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ﴾

আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদাত করার জন্য।

(সূরা যারিয়াত- ৫৬)

ঈমান এনে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি উপাসনামূলক কাজগুলো পালন করার সাথে সাথে আল্লাহর যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ হতে দূরে থাকতে হবে এবং সকল আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে। আর জীবনের সকল কাজকে এমনভাবে সম্পাদন করতে হবে, যাতে তা ইবাদাতে পরিণত হয়।

২. আমল সুন্দর করা :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿تَبَارَكَ الَّذِيْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ اَلَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ﴾

বরকতময় সেই সত্তা যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব; তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে সর্বোত্তম? (সূরা মুলক- ১, ২)

মানুষ তার রবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর প্রেরিত জীবনবিধানকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করছে কিনা এ পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এর উপর ভিত্তি করেই মৃত্যুপরবর্তী জীবনে তার জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারণ করে রেখেছেন।

৩. মানুষের কল্যাণ সাধন করা :

আল্লাহ তা‘আলা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন,

﴿كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ﴾

তোমরা হচ্ছ শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে। (সূরা আলে ইমরান- ১১০)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন যে, মানুষের কল্যাণ সাধন, ন্যায় কাজের বাস্তবায়ন এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য।

৪. খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা :

আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন তার খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। পৃথিবীতে এসে আইন বা বিধান তৈরি করার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপর ন্যসত্ম করেননি। বরং আল্লাহ নিজেই বিধান তৈরি করে মানুষের কাছে দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহর সেই বিধান পৃথিবীতে বাসত্মবায়িত করা। দাউদ (আঃ)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا دَاوُوْدُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيْفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوٰى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنَّ الَّذِيْنَ يَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيْدٌ ۢ بِمَا نَسُوْا يَوْمَ الْحِسَابِ﴾

হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলীফা (প্রতিনিধি) করেছি। অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়ভাবে বিচার-মীমাংসা করো এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়- হিসাবের দিন ভুলে যাওয়ার কারণে তাদের জন্য রয়েছে ভীষণ শাস্তি। (সূরা সোয়াদ- ২৬)

১১
মুসলিম নারীকে জ্ঞানার্জন করতে হবে
ইসলাম নারীকে যে সম্মান দান করেছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো ইসলাম নারীর জন্য শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ নির্ধারণ করেছে। কুরআনের প্রথম আদেশ ‘‘পড়ো’’ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর সর্বপ্রথম যে ওহী নাযিল হয়েছিল তা ছিল জ্ঞানার্জন করার আদেশ সম্পর্কিত। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে বান্দাদেরকে জ্ঞানার্জন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন,

﴿اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ - – خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ - اِقْرَاْ وَرَبُّكَ الْاَكْرَمُ - اَلَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ - عَلَّمَ الْاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ﴾

পড়ো, তোমার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ঝুলন্ত রক্তপিন্ড হতে। পড়ো, তোমার পালনকর্তা অতি সম্মানিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষাদান করেছেন। শিক্ষাদান করেছেন মানুষকে, যা সে জানত না। (সূরা আলাক, ১-৫)

ইলম অর্জনকারীদের মর্যাদা বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ﴾

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা আরো উন্নত করে দেবেন। (সূরা মুজাদালা- ১১)

যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ هَلْ يَسْتَوِى الَّذِيْنَ يَعْلَمُوْنَ وَالَّذِيْنَ لَا يَعْلَمُوْنَؕ اِنَّمَا يَتَذَكَّرُ اُولُوا الْاَلْبَابِ﴾

বলো, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? শুধুমাত্র জ্ঞানী লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সূরা যুমার- ৯)

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ জ্ঞানার্জনের অনেক গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, দুনিয়ায় যে ব্যক্তি কোন ঈমানদারের মুসীবত দূর করে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার মুসীবত দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবী ব্যক্তির অভাব দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাব দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাইয়ের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে, আল্লাহ ততক্ষণ পর্যমত্ম তার সহযোগিতা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য বের হয়, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন। যখন কোন সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহসমূহের কোন একটি গৃহে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং একে অপরের সাথে মিলে (কুরআন) অধ্যয়নে লিপ্ত থাকে তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং ফেরেশতাগণ তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকটবর্তীদের (ফেরেশতাগণের) সাথে তাদের কথা আলোচনা করেন। আর যাকে তার কৃতকর্ম পেছনে সরিয়ে দেবে, তার বংশমর্যাদা তাকে অগ্রসর করতে পারবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/৭০২৮; তিরমিযী, হা/২৯৪৫; ইবনে মাজাহ, হা/২২৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩২১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৯; জামেউস সগীর, হা/১১৫২৩; মিশকাত, হা/২০৪।]

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْاٰنَ وَعَلَّمَه

তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। [সহীহ বুখারী, হা/৫০২৭; আবু দাউদ, হা/১৪৫৪; তিরমিযী, হা/২৯০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫০০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১১৮; মুসনাদুল বাযযার, হা/৬৯৮; সাদ ইবনে মানসূর, হা/২১; শারহুস সুন্নাহ, হা/১১৭২; মুসনাদে ইবনে জা‘দ, হা/৪৭৪; জামেউস সগীর, হা/৫৬৩০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১৭৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪১৫; মিশকাত, হা/২১০৭।]

অনেক মুসলিম নারী ইসলামের জ্ঞানার্জনের জন্য অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন- উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ), যিনি ছিলেন জ্ঞান অন্বেষণকারী নারীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন অধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে একজন। অনেক মাসআলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সাহাবীদের আশ্রয়স্থল। কখনো কখনো তিনি কোন কোন সাহাবীর দেয়া ফতওয়ার ভুল সংশোধন করে দিতেন। মোটকথা মুসলিম নারীদের জন্য তিনি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

তিনি ছাড়াও আরো অনেক মহিলা সাহাবী জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যেমন- উম্মে সালামা (রাঃ), মায়মুনা (রাঃ) ও আসমা (রাঃ) প্রমুখ মহিলা সাহাবী।

ইসলাম জ্ঞানার্জনের জন্য নারীকে উৎসাহিত করেছে। যাতে এর মাধ্যমে নিজেরা উপকৃত হতে পারে এবং সমাজেরও উপকার সাধন করতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীদের শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এই যে, এই শিক্ষার মাধ্যমে সে আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মাতা এবং আদর্শ গৃহিণীরূপে গড়ে উঠবে। তাছাড়া তার জন্য ঐ সকল বিদ্যা শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে, যা মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে, চরিত্র গঠন করতে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রশসত্ম করতে সাহায্য করে। এ ধরনের শিক্ষা প্রত্যেক নারীর জন্য অপরিহার্য। এরপর কোন নারী যদি অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মানসিক যোগ্যতার অধিকারিণী হয় এবং এসকল মৌলিক শিক্ষার পরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চায়, তাহলে তা তার জন্য আরো ভালো।

ইসলামের নির্ধারিত সীমা ও গন্ডির মধ্যে অবস্থান করেই নারীগণ আত্মসংশোধন এবং জাতির সেবার উদ্দেশ্যে দ্বীনী শিক্ষা লাভ করবে এবং নিজ সমত্মানদেরকে এমন আদর্শবান করে গড়ে তুলবে, যাতে তারা জাতির মধ্যে শামিত্ম প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট হতে যেমনিভাবে পুরুষরা শিক্ষা গ্রহণ করত, তেমনিভাবে মহিলারাও শিক্ষা গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি সময় নির্ধারণ করতেন। অতঃপর সে সময় তিনি তাদেরকে তালীম দিতেন। উম্মুল মুমিনীনগণও ছিলেন মহিলাদের শিক্ষিকা। তবে আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) কেবল নারীদের নয়, বরং পুরুষদেরও বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। অনেক বড় বড় সাহাবীগণও তাঁর কাছ থেকে হাদীস, তাফসীর এবং ফিকহের জ্ঞান অর্জন করতেন।

নারী সাহাবীগণ জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন :

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে নারীসমাজের মধ্যে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার এমন উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল যে, সেজন্য তারা সবসময় ব্যসত্ম থাকত। জ্ঞান আহরণের পথে কোন প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে নিরাশ ও নিরোৎসাহিত করতে পারত না। আনসারী মহিলাদের সম্পর্কে আয়েশা (রাঃ) বলেন,

نِعْمَ النِّسَاءُ نِسَاءُ الْأَنْصَارِ لَمْ يَمْنَعْهُنَّ الْحَيَاءُ أَنْ يَتَفَقَّهْنَ فِي الدِّيْنِ

আনসারী মহিলারা কতই না ভালো- দ্বীনের বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে লজ্জাশরমও তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। [সহীহ বুখারী, ইলম অর্জনে লজ্জা করা অধ্যায়, ১/৪৪ পৃঃ; সহীহ মুসলিম, হা/৭৭৬; আবু দাউদ, হা/৩১৬; ইবনে মাজাহ, হা/৬৪২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫১৮৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪৮; বায়হাকী, হা/৮১৯।]

সুতরাং প্রতিটি মুসলিম নারীকে অবশ্যই জ্ঞানার্জন করতে হবে যে, কীভাবে ঈমান আনতে হয়, কীভাবে ইবাদাত করতে হয়, কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়, কীভাবে নামায আদায় করতে হয়, কীভাবে রোযা রাখতে হয়, কীভাবে তার স্বামীর হক আদায় করতে হয়, কীভাবে পিতামাতার সেবা করতে হয়, কীভাবে তার সন্তানদেরকে লালনপালন করতে হয়, কীভাবে আল্লাহর হক আদায় করতে হয় এবং কীভাবে বান্দার হক আদায় করতে হয় ইত্যাদি। আর এগুলো এমন জ্ঞান, যা ব্যতীত ইসলামী ধারায় জীবন পরিচালনা করা যায় না।

১২
মুসলিম নারীকে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে
আত্মার পবিত্রতা রক্ষা করা মানুষের একটি প্রধান কর্তব্য। এজন্য ‘তাযকিয়াতুন নফস’ বা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন করা ইসলামের মৌলিক একটি বিষয়। আর তাই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বার বার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যেমন তাকিদ দিয়েছেন তেমনি এটা অর্জনের উপরই মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতাকে নির্ভরশীল করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا﴾

যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। (সূরা শামস- ৯)

﴿قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰى﴾

নিশ্চয় যে পরিশুদ্ধতা অবলম্বন করে সে সফলতা লাভ করে। (সূরা আ‘লা- ১৪)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

أَلَا وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّه وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّه أَلَا وَهِىَ الْقَلْبُ

সাবধান! মানুষের দেহের মধ্যে একটি মাংসপিন্ড রয়েছে, যদি তা পরিশুদ্ধ হয় তবে সমস্ত দেহই পরিশুদ্ধ হয়, আর যদি তা দূষিত হয়ে যায় তবে সমস্ত দেহই দূষিত হয়ে যায়। সেটা হলো কল্ব বা অন্তর। [সহীহ বুখারী, হা/৫২; সহীহ মুসলিম, হা/৪১৭৮; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৮৪; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৪৪৩৬; মু‘জামুস সগীর, হা/৩৮২; বায়হাকী, হা/১০১৮০; সুনানে দারেমী, হা/২৫৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২২৪৩৫; জামেউস সগীর, হা/৫৫০৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৩১; মিশকাত, হা/২৭৬২।]

যে অন্তর তার প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তাঁর আনুগত্যে সুস্থির হয়েছে, তাঁর স্মরণে ও ভালোবাসায় প্রশান্তি অর্জন করেছে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবকিছুই তাঁর উপর সমর্পণ করেছে, তাঁর সাক্ষাৎ ও প্রতিশ্রুতির উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছে এবং একমুহূর্তের জন্যও তার প্রতিপালকের জিম্মাদারী থেকে বিচ্যুত হয় না, যে আত্মা গোনাহের কাজে ভয় পায় এবং ভালো কাজে খুশি হয় এরূপ আত্মাকে নফসে মুতমাইন্নাহ বা প্রশামত্ম আত্মা বলা হয়। এরূপ আত্মাকে কিয়ামতের দিন বলা হবে,

﴿يَاۤ أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ -‐ اِرْجِعِيْۤ إِلٰى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً - فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ - وَادْخُلِيْ جَنَّتِيْ﴾

হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি সন্তুষ্ট এবং সন্তোষভাজন হয়ে তোমার প্রতিপালকের দিকে ফিরে আসো। অতঃপর আমার (নেক) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো। (সূরা ফাজর, ২৭-৩০)

১৩
আত্মশুদ্ধি লাভের উপায়
১. পাপকাজ বর্জন করা :

যাবতীয় পাপ, অন্যায় ও অপবিত্র কাজ থেকে মুক্ত হওয়া। যেমন- শিরক, রিয়া, অহংকার, স্বার্থপরতা, হিংসা, ঘৃণা, কৃপণতা, ক্রোধ, গীবত, কুধারণা, দুনিয়ার মোহ, আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়া, অসচেতনতা, অর্থহীন কাজ করা প্রভৃতি।

২. উত্তম গুণাবলি অর্জন করা :

উত্তম গুণাবলি দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধন করা অর্থাৎ প্রশংসনীয় গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে পরিত্যাগকৃত বিষয়গুলোর শূন্যস্থান পূরণ করা। যেমন- তাওহীদ, ইখলাস, ধৈর্য, তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর প্রতি ভরসা, তওবা, শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা, আল্লাহভীতি, লজ্জাশীলতা, বিনয়-নম্রতা, মানুষের সাথে উত্তম আচরণ, পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা ও স্নেহ প্রদর্শন, মানুষের প্রতি দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন, পরোপকার এবং ন্যায় কাজের আদেশ দেয়া ও অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করা ইত্যাদি।

আত্মাকে সর্বোতভাবে পরিশুদ্ধ করার জন্য যাবতীয় পাপকাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে এবং উত্তম চরিত্র অর্জন করতে হবে। নিয়মিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে একসময় তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾

যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে রয়েছেন। (সূরা আনকাবূত- ৬৯)

আত্মশুদ্ধি লাভের দু‘আ :

اَللّٰهُمَّ اٰتِ نَفْسِيْ تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা আ-তি নাফসী তাক্বওয়া-হা, ওয়া যাক্কিহা, আনতা খাইরু মান যাককা-হা আনতা ওয়ালিয়্যুহা ওয়া মাওলা-হা।

অর্থ : হে আল্লাহ! আমার আত্মাকে সংযমতা দান করুন এবং তাকে পরিশুদ্ধ করুন। আত্মা পবিত্রকারীদের মধ্যে আপনিই উত্তম, আপনিই তার মালিক এবং অভিভাবক। [যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি তোমাদের নিকট তেমনই বলব যেমনটি রাসূলুল্লাহ # বলতেন। তিনি এ দু‘আটি পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম, হা/৭০৮১; নাসাঈ, হা/৫৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৩২৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪০০৫; মিশকাত, হা/২৪৬০)]

১৪
মুসলিম নারীর ঈমান
মুসলিম নারীকে যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনতে হবে সেসব বিষয়ের ব্যাপারে অন্তরে এ বিশ্বাস থাকতে হবে যে, এ বিষয়গুলো একেবারে সত্য। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আর যখন সে ঈমানের বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং মুখেও এর স্বীকৃতি দেবে তখন তার উপর এ দায়িত্ব বর্তাবে যে, সে ঈমানের সকল দাবি পূর্ণ করে চলবে।

১৫
ঈমানের ৬টি মৌলিক বিষয়
১. আল্লাহর প্রতি ঈমান :

একজন মুসলিম নারী ঈমান আনবে যে, আল্লাহ তা‘আলা হলেন সকল কিছুর মালিক, পরিচালনাকারী, সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা।

একজন মুসলিম নারী ঈমান আনবে যে, আল্লাহ তা‘আলা হলেন একমাত্র মাবুদ। তাঁকেই একমাত্র ইবাদাতের উপযুক্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং সকল প্রকার ইবাদাত আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলার উদ্দেশ্যেই করতে হবে। সুতরাং সে নামায পড়বে আল্লাহর জন্য, পবিত্রতা অর্জন করবে আল্লাহর জন্য, পিতামাতার আনুগত্য করবে আল্লাহর জন্য, স্বামীর আনুগত্য করবে আল্লাহর জন্য, পর্দা করবে আল্লাহর জন্য, বন্ধুত্ব করবে আল্লাহর জন্য এবং সম্পর্কচ্ছেদও করবে আল্লাহর জন্য। সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে না। আর সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যেসকল কাজ করবে তাতে অন্য কাউকে শরীক করবে না।

মুসলিম নারী আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করবে সকল সুন্দর নামসমূহ এবং মহৎ গুণাবলি। মুসলিম নারী এসব সুন্দর নামসমূহ এবং মহৎ গুণাবলির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাত করবে। সে স্বীকৃতি দেবে যে, আল্লাহ হলেন দয়াময় ও পরম দয়ালু। তাই সে তাঁর নিকট রহমত কামনা করবে। তিনি হলেন রিযিকদাতা ও পরম শক্তির অধিকারী। তাই সে তাঁর নিকট রিযিকের জন্য আবেদন করবে। তিনি হলেন রোগ নিরাময়কারী। সুতরাং সে তাঁর নিকট রোগ থেকে মুক্তির জন্য আবেদন করবে। তিনি হলেন ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তাই সে তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করবে।

২. ফেরেশতার প্রতি ঈমান :

মুসলিম নারী বিশ্বাস স্থাপন করবে যে, আল্লাহ তা‘আলার অনেক ফেরেশতা রয়েছে। যারা রাত-দিন অক্লান্তভাবে তাঁর দাসত্ব করে আসছে। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ফেরেশতা আছেন, যারা আল্লাহর সৃষ্টিকুল পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। আবার তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাদের নাম ও গুরুত্ব আমাদের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- জিবরাঈল (আঃ), যিনি ওহীর দায়িত্বে নিয়োজিত। ইসরাফীল (আঃ), যিনি সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত। মালাকুল মাউত, যারা সকল প্রাণীর মৃত্যুর কাজে নিয়োজিত আছেন। আর বান্দাদের কর্মতৎপরতা লিপিবদ্ধ করার জন্য আরো অনেক ফেরেশতা রয়েছেন। এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে দু জন করে ফেরেশতা রয়েছেন, যারা ঐ ব্যক্তির প্রতিটি কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করেন, তাদেরকে ‘কিরামান কাতিবীন’ বলা হয়।

৩. রাসূলদের উপর নাযিলকৃত কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান :

আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য কিতাব ও সহীফা নাযিল করেছেন। একজন মুসলিম নারীকে অবশ্যই সেসব কিতাবের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং এগুলোর কোন একটির উপরও সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। আর এগুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে আল্লাহর কিতাব ও বিশুদ্ধ সুন্নার আলোকে। আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বের প্রথম মানব আদম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ পর্যন্ত যতগুলো কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তন্মধ্যে কুরআনুল কারীমে চারটি কিতাবের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- তাওরাত, যা মূসা (আঃ) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। ইঞ্জীল, যা ঈসা (আঃ) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। যাবূর, যা দাঊদ (আঃ) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল কুরআন, যা মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। আর কুরআন হলো সর্বশেষ কিতাব, যার মাধ্যমে কিতাব অবতীর্ণের ধারায় পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং এর মাধ্যমে বাকি সকল কিতাবের বিধানকে রহিত করে দেয়া হয়েছে।

৪. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রেরিত রাসূলদের প্রতি ঈমান :

মুসলিম নারীকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ﷺ এর পূর্বে প্রত্যেকটি জাতির প্রতিই এক বা একাধিক রাসূল প্রেরণ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করতেন এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করতেন। তারা মানুষকে সুসংবাদ দিতেন, সতর্ক করতেন এবং সৎকাজের আদেশ দিতেন ও অসৎকাজ হতে নিষেধ করতেন। ঐসব রাসূলদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যাদের নাম কুরআন ও হাদীসের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। আবার অনেকেই রয়েছেন, যাদের নাম আলোচিত হয়নি। সুতরাং প্রতিটি মুসলিম নারীকে অবশ্যই তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং তাদের কাউকে অস্বীকার করা যাবে না।

৫. আখিরাতের প্রতি ঈমান :

মানুষের এই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মাধ্যমে। তারপর কবর, পুনরুত্থান, হাশর, হিসাব, প্রতিদান ও পুলসিরাত এবং সবশেষে জান্নাত ও জাহান্নাম। একজন মুসলিম নারীকে এগুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। সে উপরোক্ত বিষয়গুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং এগুলোর কথা মাথায় রেখে পার্থিব জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করবে। সুতরাং সে পার্থিব জীবনে এমন কাজ করবে না, যার জন্য আখিরাতের জীবনে দুর্গতি নেমে আসে।

৬. তাকদীরের প্রতি ঈমান :

মুসলিম নারীকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সৃষ্টিজগত তৈরির বহু পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যৎ ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পেছনে বসেছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হে বালক! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিক্ষা দেব। (সেগুলো হলো) তুমি আল্লাহর হেফাযত করবে অর্থাৎ আল্লাহর বিধান মেনে চলবে, তাহলে আল্লাহ তোমার হেফাযত করবেন। যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন কোন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করবে। আর জেনে রেখো! গোটা জাতি যদি কোন বিষয়ে তোমার উপকার করার জন্য একত্র হয়, তবে তারা সকলে মিলে ততটুকুই উপকার করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে গোটা জাতি যদি কোন বিষয়ে তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্র হয়, তবে সকলে মিলে তোমার ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলম তুলে রাখা হয়েছে এবং (তাকদীর লিখিত) কিতাব শুকিয়ে গেছে। [তিরমিযী, হা/২৫১৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৬৯; মিশকাত, হা/৫৩০২।]

১৬
মুসলিম নারীর আকীদা
মানুষ যার সাথে নিজের অন্তরের সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করে, যে আদর্শ ও বিশ্বাসকে লালন করে মানুষ তার সমগ্র জীবন পরিচালনা করে, যে বিশ্বাস ও কর্মধারার প্রতি ব্যক্তির মনে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকে না তাকে ‘আকীদা’ বলা হয়।

সঠিক আকীদা পোষণের অপরিহার্যতা :

আকীদা দ্বীনের মৌলিক বিষয়। আকীদা সঠিক হওয়ার উপরই ঈমান ও আমলের যথার্থতা নির্ভরশীল। তাই আকীদার বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা একজন মুসলিমের অপরিহার্য দায়িত্ব। কেননা হাজারো মতাদর্শের মধ্যে সত্যের সন্ধান পাওয়া এবং সত্য ও স্বচ্ছ দ্বীনের দিকে ফিরে আসা বিশুদ্ধ আকীদা অবলম্বন ব্যতীত সম্ভব নয়।

বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা ব্যতীত কোন ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুসলিম হতে পারে না। প্রতিটি কথা ও কর্ম যদি বিশুদ্ধ আকীদা ও বিশ্বাস থেকে নির্গত না হয় তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَنْ يَّكْفُرْ بِالْإِيْمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُه ̒ وَهُوَ فِي الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ﴾

যে ব্যক্তি ঈমানকে অস্বীকার করবে তার শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রসত্ম হবে। (সূরা মায়েদা- ৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ﴾

(হে নবী!) আমি তোমাকে এবং তোমার পূর্ববর্তীদেরকে প্রত্যাদেশ করেছি যে, যদি তুমি আমার শরীক স্থাপন কর তবে তোমার যাবতীয় আমল বিফলে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রসত্মদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার- ৬৫)

মানুষ যুগে যুগে পথভ্রষ্ট হয়েছে মূলত আকীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ঘটার কারণে। এজন্য বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে জানা অপরিহার্য।

বিশুদ্ধ আকীদা বিশুদ্ধ ঈমানের মাপকাঠি, যা বাহ্যিক আমলকেও বিশুদ্ধ করে। যখন আকীদায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় তখন ঈমানও বিভ্রান্তিপূর্ণ হয়ে যায়। আকীদার সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ তথা শিরক এমন ধ্বংসাত্মক পাপ যে, পাপী তওবা না করে মারা গেলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।

আকীদা সঠিক না থাকলে সৎকর্মশীলকেও জাহান্নামে যেতে হবে। যেমন একজন মুনাফিক বাহ্যিকভাবে ঈমান ও সৎকাজ করার পরও অন্তরে কুফরী পোষণের কারণে সে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيْرًا﴾

মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নস্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনো কোন সাহায্যকারী পাবে না। (সূরা নিসা- ১৪৫)

একজন কাফির সারাজীবন ভালো আমল করলেও কিয়ামতের দিন সে তার দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না। কেননা তার বিশ্বাস ছিল ভ্রান্তিপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَدِمْنَاۤ إِلٰى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَآءً مَّنْثُوْرًا﴾

সেদিন আমি তাদের কৃতকর্মের দিকে মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলো বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় রূপান্তরিত করব। (সূরা ফুরকান- ২৩)

কবরে আকীদা সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে। সেদিন আমল সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন করা হবে না। যেমন- তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কী? তোমার নবী কে? এখান থেকেই মানুষের জীবনে আকীদার গুরুত্ব অনুভব করা যায়।

বিভ্রান্ত মতাদর্শের অনুসারী মুনাফিক, বিদআতী এবং ভিন্ন ধর্মানুসারী ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও নাস্তিকদের থেকে আত্মরক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এজন্য সঠিক আকীদা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতেই হবে। আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিম ভাই-বোনকে সঠিক আকীদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত স্বচ্ছ ঈমানের উপর অটল থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!!

১৭
ইসলামের সঠিক আকীদাসমূহ
১. একজন মুসলিম নারীর আকীদা হবে, মহান আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, জীবন দানকারী ও জীবন গ্রহণকারী, পুনরুত্থানকারী, সমসত্ম ভালো ও ক্ষতি করার অধিকারী। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ আমরা মানি না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَا شَرِيْكَ لَهٗۚ وَبِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ﴾

তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি; আর আমিই প্রথম মুসলিম। (সূরা আন‘আম- ১৬৩)

তিনি মহিমান্বিত এবং সুউচচ, তাঁর কোন সাদৃশ্য, পুত্র, অংশীদার বা প্রতিযোগী নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ اَللهُ الصَّمَدُ - لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ﴾

বলো, তিনি আল্লাহ একক। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর থেকে কেউ জন্ম নেয়নি এবং তিনিও কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (সূরা ইখলাস)

২. মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কোন কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির কোন কিছুর মতো নন। তিনি অনাদিকাল থেকে অনমত্মকাল বিদ্যমান রয়েছেন। তিনি তাঁর গুণাবলি ও নামসমূহ সহ অনমত্মরূপে বিদ্যমান। তাঁর নাম ও বিশেষণের মধ্যে কোন নতুনত্ব বা পরিবর্তন ঘটেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌۚ وَّهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ﴾

কোনকিছুই তাঁর সাদৃশ্য নয়, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা- ১১)

৩. মহান আল্লাহর সকল বিশেষণই মাখলুক তথা সৃষ্ট প্রাণীদের বিশেষণের বিপরীত বা ব্যতিক্রম। তিনি জানেন তবে তাঁর জানা আমাদের মতো নয়। তিনি ক্ষমতা রাখেন তবে তাঁর ক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার মতো নয়। তিনি দেখেন তবে তাঁর দেখা আমাদের দেখার মতো নয়। তিনি কথা বলেন তবে তাঁর কথা আমাদের কথার মতো নয়। তিনি শুনেন তবে তাঁর শোনা আমাদের শোনার মতো নয়।

৪. একমাত্র মহান আল্লাহই ইবাদাতের যোগ্য, ভয়, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা ও আত্মসমর্পণ, সাহায্য ও আরোগ্য, অনুরোধ, নির্ভরতা, উৎসর্গ, সিজদা ও ইবাদাতের অন্যান্য সকল উপায় তাঁর কাছেই সমর্পণ করতে হবে।

৫. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য সিজদা করা যাবে না। যে কেউই এর কোন একটি কাজ সম্পাদন করে, সে শিরকে লিপ্ত হয়।

৬. আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে শরীক করা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বিধানের কাছে বিচার চাওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই এবং তিনিই বিচার করেন, আদেশ দেন, নিষেধ করেন, রায় দেন এবং আইন প্রণয়ন করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী এবং সর্বজামত্মা। যে কেউই আল্লাহর আইনের উপর আইন প্রণয়ন করে এবং তাঁর আইন অন্য কারো আইন দ্বারা পরিবর্তন করে সে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়।

৭. আল্লাহর ঐ সমসত্ম গুণাবলি সমর্থন করতে হবে যা তিনি তাঁর নিজের জন্য ঘোষণা করেছেন এবং মুহাম্মাদ ﷺ স্বীকার করেছেন, যেমন- আল্লাহর হাত আছে, মুখমন্ডল আছে, সত্তা আছে ইত্যাদি। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ ক্ষমতা বা নিয়ামত। এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ বাতিল করে দেয়া।

৮. এ বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَلرَّحْمٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى﴾

দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর সমাসীন। (সূরা ত্বা-হা- ৫)

সমাসীন হওয়ার বিষয়টি জানা; কিন্তু এর পদ্ধতি বা স্বরূপ অজানা। আর এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বাড়াবাড়ি এবং বিশ্বাস করা জরুরি।

৯. তাকদীরের ভালো-মন্দ উভয়ই আল্লাহ কর্তৃক গৃহীত হয়। পৃথিবীতে সমসত্ম কিছুই তাঁর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হবে এবং যা ইচ্ছা করেন না তা হবে না এবং আল্লাহ তার বান্দার প্রতি কখনো অন্যায় করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ বিন্দুমাত্রও অত্যাচার করেন না। (সূরা নিসা- ৪০)

১০. আল্লাহ তাই করেন তিনি যা ইচ্ছা করেন এবং যখন যেভাবে ইচ্ছা করেন। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি আনন্দিত হন, হাসেন, ভালোবাসেন, ঘৃণা করেন, সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং ক্রোধান্বিত হন। তাঁর কর্মে তিনি তাঁর কোন সৃষ্টির সদৃশ নন এবং কীভাবে এসব কর্ম সম্পাদিত হয় তা সকল মাখলুকের অজানা।

১১. ফেরেশতা, নবী এবং রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। রাসূলদের উপর নাযিলকৃত কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে রাসূলদের মধ্যে কোন পার্থক্য করা যাবে না।

১২. এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা এবং সর্বশেষ নবী। তিনি আলিমুল গায়েব তথা অদৃশ্যের জ্ঞাতা নন, আল্লাহর নূরের তৈরি নন, অতিমানব বা আল্লাহর কোন অংশও নন। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তবে তার প্রতি অহী নাযিল করা হতো। তাকে সজাগ অবস্থায় এবং স্বশরীরে মক্কার হারাম হতে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং যতটা উঁচুতে আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন ততটা উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

১৩. কিয়ামতের আলামত বিশ্বাস করতে হবে। দাজ্জাল (মিথ্যা মসীহ) এর আবির্ভাব, চতুর্থ আসমান হতে ঈসা (আঃ) এর অবতরণ, পশ্চিম দিকে সূর্যোদয়, জমিন হতে অদ্ভুত জমত্মুর আবির্ভাব এবং কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত অন্যান্য আলামতের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।

১৪. এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কবরে দুই ফেরেশতা মুনকার এবং নাকীর কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রত্যেককে তার রব, তার দ্বীন এবং তার নবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

১৫. মৃত্যুর পর কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুনরুত্থানে বিশ্বাস রাখতে হবে। শেষ বিচারের দিন, আমলনামা পাঠ, মানদন্ড (যার উপর আমল পরিমাপ করা হবে), সীরাত (জাহান্নামের আগুনের উপর স্থাপিত পুল) এবং শাসিত্ম ও পুরস্কারে বিশ্বাস রাখতে হবে।

১৬. কবরের আযাবে বিশ্বাস রাখতে হবে। কবর হয় জান্নাতের একটি সবুজ বাগানস্বরূপ নতুবা জাহান্নামের আগুনের একটি গর্তস্বরূপ এবং প্রতিটি বান্দা তাই পায় সে যার উপযুক্ত।

১৭. হাউযে কাওসারে বিশ্বাস রাখতে হবে, যা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সম্মানস্বরূপ কিয়ামতের দিন প্রদান করবেন, যাতে করে তার উম্মতগণ পিপাসা মিটাতে পারে।

১৮. এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়ই সত্য। সকল জান্নাতবাসী কোন প্রকার পরিবেষ্টন ছাড়া খালি চোখেই তাদের রবের সরাসরি সাক্ষাৎ লাভ করবে। সেদিন কোন কোন মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে।

১৯. এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তার বান্দাদের অবাধ্য হতে আদেশ দেন না এবং তিনি এরকম ব্যক্তিদের উপর সমত্মুষ্ট নন। তিনি তার বান্দাদের অকৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন না।

২০. রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাহাবীদেরকে ভালোবাসতে হবে। তারা সকল উম্মতের শ্রেষ্ঠ উম্মত। তাদের প্রতি ভালোবাসা রাখা ঈমানের অংশ। তাদেরকে ঘৃণা করা মুনাফিক এবং অবিশ্বাসীদের কাজ।

২১. আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে প্রথম খলীফা হিসেবে সমর্থন করতে হবে। তারপর উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ), তারপর উসমান বিন আফফান (রাঃ), তারপর আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ)-কেও সমর্থন করতে হবে। তারা হলেন সত্যের অনুসারী খলীফা এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃবৃন্দ যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তোমাদেরকে অবশ্যই আমার সুন্নাতের এবং সত্যের অনুসারী খলীফাগণের সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে, এটি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে। [আবু দাউদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনে মাজাহ, হা/৪২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৪২০১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৫০২১; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩২৯; সুনানে দারেমী, হা/৯৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/১০২; মিশকাত, হা/১৬৫।]

১৮
তাওহীদের সারমর্ম
তাওহীদের মূল বাণী হচ্ছে, لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ (লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) তথা আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। ‘লা-ইলা-হা’ অর্থ হলো সকল গায়রুল্লাহ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। আর ‘ইল্লাল্লাহ’ অর্থ হলো শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। ‘লা-ইলা-হা’ মানে সকল বাতিল ইলাহকে বর্জন করা, আর ‘ইল্লাল্লা-হ’ মানে শুধু আল্লাহকে গ্রহণ করা।

অন্তরের সকল ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনা মুছে ফেলে অন্তরটাকে খালি করে সেখানে কেবল তাওহীদের ধারণা ও বিশ্বাস স্থাপন করাই তাওহীদের মূল কথা। একজন তাওহীদবাদী মুসলিম আল্লাহর সাথে অন্য কোন বস্তুকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। তাওহীদের এ কালিমাকে স্বীকার করার অর্থ হচ্ছে নিম্ন বর্ণিত বিষয়গুলোকে মেনে নেয়া :

১. আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করা।

২. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, জীবন-মৃত্যুর মালিক এবং রক্ষাকারী হিসেবে বিশ্বাস না করা।

৩. একমাত্র আল্লাহকেই সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করা।

৪. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই গায়েব তথা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী মনে করা।

৫. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপকার-অপকার ও লাভ-ক্ষতির মালিক মনে না করা।

৬. আল্লাহ তা‘আলাকেই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে বিশ্বাস করা।

৭. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে রব, আইন প্রণয়নকারী ও বিধানদাতা বলে বিশ্বাস না করা।

৮. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাস বা বান্দা হয়ে না থাকা।

৯. জীবনের প্রত্যেক ব্যাপারে আল্লাহর বিধানকে একমাত্র ভিত্তি বলে মানা এবং সে অনুযায়ী আমল করা।

১০. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট দু‘আ এবং সাহায্য প্রার্থনা না করা।

১১ . আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর নির্ভর না করা।

১২. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট আশা পোষণ না করা।

১৩. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করা।

১৪. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে বেশি প্রিয় না জানা।

১৫. কোন মানুষ, দল, সমাজ বা শাসন কর্তৃপক্ষকে আল্লাহর আইন পরিবর্তন বা সংশোধনের অধিকারী বলে স্বীকার না করা।

১৬. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সকল প্রয়োজন পূরণকারী হিসেবে মনে না করা।

১৭. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ক্ষমার অধিকারী এবং হেদায়াত দানকারীরূপে বিশ্বাস না করা।

১৮. নবী-রাসূল, জিন-ফেরেশতা, ওলী-আওলিয়া, পীর-বুযুর্গ ও সাধু-স্বজনকে ইলাহী ব্যবস্থাপনার মধ্যে পরিবর্তন ও সংযোজন করার অধিকারী বলে বিশ্বাস না করা।

১৯. কাউকে আল্লাহর সন্তান, আত্মীয়, অংশীদার বা শরীক হিসেবে বিশ্বাস না করা।

মোটকথা ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন- সর্বক্ষেত্রে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর বিধিবিধান মেনে নেয়াই হচ্ছে لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ (লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) এর মর্মকথা।

১৯
মুসলিম নারীকে সৎকর্মশীল হতে হবে
প্রতিটি মুসলিমই তার নিজ নিজ কর্মকান্ডের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। সুতরাং প্রত্যেকটি নারীও তার কর্মকান্ডের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। তার কাজের হিসাব নেয়া হবে এবং তাকে প্রতিদান দেয়া হবে।

প্রত্যেক নারীকেই জিজ্ঞেস করা হবে, সে আল্লাহর হুকুম পালন করেছে কিনা, সে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে কিনা, স্বামীর আমানত হেফাযত করেছে কিনা, স্বামীর আনুগত্য করেছে কিনা, পিতামাতার সেবা করেছে কিনা, কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সন্তান লালনপালন করেছে কিনা, সন্তানদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছে কিনা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেছে কিনা, আল্লাহর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছে কিনা অথবা এসব দায়িত্ব সে কতটুকু পালন করেছে। সে যদি এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে থাকে তবে সে এর যথাযথ প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَكَرٍ اَوْ اُنْثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهٗ حَيَاةً طَيِّبَةً وَّلَنَجْزِيَنَّهُمْ اَجْرَهُمْ بِاَحْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ ﴾

মুমিন থাকাবস্থায় পুরুষ ও নারীদের মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে, নিশ্চয় আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। (সূরা নাহল- ৯৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَكَرٍ اَوْ اُنْثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَاُولٰٓئِكَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُوْنَ فِيْهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾

পুরুষ কিংবা নারীদের মধ্যে যারা মুমিন হয়ে সৎ আমল করে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে তারা অসংখ্য রিযিক পাবে। (সূরা মু’মিন- ৪০)

ফরয আমলে অবহেলা করা যাবে না :

মুসলিম নারীর উপর আবশ্যক হলো সৎ আমল করা। যদি তা ফরয কাজ হয়, যেমন- ফরয নামায, ফরয যাকাত, রমাযান মাসের রোযা, সামর্থ্যবান হলে জীবনে একবার হজ্জ করা, তবে তার উপর কর্তব্য হচ্ছে কোন প্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি ও অবহেলা ছাড়াই তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।

নফল আমলেরও গুরুত্ব দিতে হবে :

যদি কোন আমল নফল ও মুস্তাহাব হয়, যা করার অনুমতি দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে করুণা করেছেন, তাহলে তার উচিত হবে সে কাজগুলো থেকে পূর্ণ সওয়াব গ্রহণ করা। কারণ, ফরযসমূহ পালনের ক্ষেত্রে যে ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে, এই নফল কাজসমূহ তার ক্ষতিপূরণ করবে। তা ঐসব অপকর্ম ও গোনাহসমূহ ক্ষমা করার ব্যবস্থা করবে, যে অপরাধ তার জীবনে সংঘটিত হয়েছে এবং তা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করবে। আর এর মাধ্যমে সৎকর্মশীল পুরুষ ও নারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে এবং ঈমানের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।

হুরাইস ইবনে কাবীসা (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি মদিনায় আগমন করলাম। অতঃপর বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে একজন উত্তম সঙ্গী দান করুন। অতঃপর আমি আবু হুরায়রা (রাঃ) এর নিকট গিয়ে বসলাম এবং বললাম, আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছি যে, তিনি যেন আমাকে উত্তম সঙ্গী দান করেন। সুতরাং আপনি এমন একটি হাদীস বর্ণনা করুন, যা আপনি নবী ﷺ হতে শুনেছেন। আমি আশা রাখি আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা আমাকে উপকৃত করবেন। এরপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন বান্দার সকল আমলের মধ্যে প্রথমে নামাযের হিসাব নেয়া হবে। যদি তার নামায সঠিক হয়, তবে সে মুক্তি পাবে এবং সফলতা লাভ করবে। আর যদি তার নামায সঠিক না হয়, তবে সে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি ফরয নামাযের মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বলবেন, দেখো! আমার বান্দার আমলের মধ্যে নফল নামায আছে কিনা। যদি আমলের মধ্যে নফল নামায থাকে তবে তা দিয়ে ফরযের ঘাটতি পূর্ণ করে দেয়া হবে। এরপর তার সকল আমলের হিসাব এভাবেই নেয়া হবে। [তিরমিযী, হা/৪১৩; নাসাঈ, হা/৪৬৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৪২৬; জামেউস সগীর, হা/৩৭৮৩।]

মুসলিম বুদ্ধিমতী নারী হলো ঐ নারী, যে তার জন্য নামায, রোযা, সাদাকা, হজ্জ, উমরা, দাওয়াত, সৎকাজের আদেশ, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ, সততা, পরোপকার ইত্যাদি নফল ইবাদাতের কিছু অংশ বরাদ্ধ রাখে।

তার উচিত হবে, সে যেন বিভিন্ন প্রকারের নফল কাজ করার ব্যাপারে যত্নবান হয়। সুতরাং সে নফল কর্মসমূহ থেকে এমন কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে, যার ফায়দা বা উপকারিতা তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং এমন কাজ করার উদ্যোগও গ্রহণ করবে, যার ফায়দা অপরাপর ব্যক্তিদের দিকেও ধাবিত হবে।

আর যখন বিভিন্ন প্রকার নফল কাজ তার সামনে উপস্থিত হবে, এমতাবস্থায় সে ঐ আমলটিকেই প্রাধান্য দেবে, যার উপকারিতা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। যেমন- অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়া।

মুসলিম নারীর আবশ্যকীয় কাজ হলো সে তার দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক কর্মকান্ডের জন্য একটি কর্মসূচী তৈরি করবে। অতঃপর তার জন্য একটা সম্ভাব্য ছক তৈরি করবে, যাতে সে তার কাজগুলোর অনুশীলন, বাস্তবায়ন ও এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।

যেসব কাজ নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত হবে :

১. নামায পড়া। সুতরাং একজন নারী প্রতিদিন পাঁচ বার সময়মতো নামায পড়বে। তার শর্ত ও ওয়াজিবসমূহ এবং যথাসম্ভব তার মুস্তাহাবসমূহও যথাযথভাবে আদায় করবে।

২. যাকাত প্রদান করা। সুতরাং তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তার সম্পদকে পবিত্র করবে। এমনকি তার কাছে সংরক্ষিত গয়নাসমূহেরও যাকাত প্রদান করবে।

৩. রোযা রাখা। সুতরাং সে রমাযান মাসের ফরয রোযাসমূহ পালন করবে এবং যথাসম্ভব অন্যান্য মাসেও নফল রোযা রাখবে। তবে অন্যান্য মাসের বিশেষ রোযাসমূহের প্রতিও গুরুত্বারোপ করবে। যেমন- শাওয়াল মাসের রোযা, মহররমের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখের রোযা, আরাফা দিবসের রোযা ইত্যাদি।

৪. হজ্জ পালন করা। সুতরাং সে সামর্থ্যবান হলে জীবনে একবার হজ্জ পালন করবে। আর দ্বিতীয়বার সামর্থ্যবান হলে অসমর্থ্য ব্যক্তিকে আর্থিকভাবে হাদিয়া প্রদানের মাধ্যমে তাকে হজ্জ পালন করার সুযোগ করে দেবে। এতে তারা উভয়েই লাভবান হতে পারবে।

৫. স্বামীর আনুগত্য করা। সুতরাং সে যথাসম্ভব স্বামীর আনুগত্য করবে এবং স্বামীর আমানতের হেফাযত করবে। সর্বদা স্বামীর আদেশ মেনে চলবে। তবে আল্লাহর আদেশের বিপরীত কোন আদেশ সে মানতে বাধ্য থাকবে না।

৬. পর্দা করা। একজন মুসলিম নারী শরীয়ত কর্তৃক ফরযকৃত পর্দা যথাযথভাবে মেনে চলবে। আর তা হলো, সে গাইরে মাহরাম তথা যাদের থেকে পর্দা করতে হয় না তাদেরকে ছাড়া অন্যদের থেকে তার চেহারা ও সম্পূর্ণ শরীরকে ঢেকে রাখবে। অনুরূপভাবে সে লজ্জাশরম ও সচ্চরিত্রের হেফাযত করবে।

৭. বেশি বেশি নফল আমল করা। সুতরাং সে সকল প্রকার নফল ও মুস্তাহাব আমলসমূহ যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করবে। এতে তার ঈমান দৃঢ় হবে। যেমন- কুরআন পাঠ করা অথবা তা অপরের কাছ থেকে শোনা, মাসনূন যিকিরসমূহ পাঠ করা, নফল নামায পড়া, নফল রোযা রাখা এবং নফল দান-সাদাকা করা ইত্যাদি।

৮. উত্তম গুণাবলি অর্জন করা। সুতরাং সে সর্ব ক্ষেত্রে আদব-কায়দা ও শিষ্টাচারিতায় উত্তম পন্থা অবলম্বন করবে, যা আয়ত্ত করা প্রত্যেক মুসলিম নারীর জন্য আবশ্যক। যেমন- কথায় ও কাজে সত্যবাদিতা অবলম্বন করা, মিথ্যা না বলা, ধৈর্যধারণ করা, উত্তম ব্যবহার করা, কথার সময় বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করা, সাক্ষাতের সময় প্রফুল্ল থাকা এবং চলাফেরায়, পানাহারে, ঘুমানোর সময়, কথাবার্তা, উঠাবসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রাখা।

৯. অপরকে সাহায্য করা। সুতরাং সে সর্বদা এমন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করবে, যার দ্বারা অন্যজনও উপকার লাভ করতে পারে। যেমন- দারিদ্রকে দান করা, অভাবী ও বিপদগ্রস্তকে সহযোগিতা করা, ইয়াতীম ও বিধবাকে সাহায্য করা, অপরের দুঃখ-কষ্ট দূর করা ইত্যাদি।

১০. লজ্জাস্থান ও জিহবার হেফাযত করা। সুতরাং সে যে কোন মূল্যে নিজ লজ্জাস্থান ও জিহবা (ভাষা)-কে হেফাযত করবে এবং দৃষ্টি অবনমিত রাখবে।

১১. স্বামীর অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করা। বস্তুত এই অধিকারসমূহ বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বারোপ করেছেন। এমনকি তিনি আল্লাহ তা‘আলার হক তথা অধিকারসমূহের পর স্বামীর হককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

১২. সাদাকায়ে জারিয়ামূলক কর্মসমূহ সম্পাদন করা। সুতরাং যেসব কাজ সাদাকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত সে সেগুলো পালন করার জন্য সচেষ্ট হবে। যেমন- ইলম বা জ্ঞান শিক্ষা দেয়া, কুরআন শিক্ষা দেয়া, উপদেশ দেয়া, সৎকর্মের আদেশ দেয়া, মুসাফিরখানা নির্মাণ করা, মসজিদ নির্মাণ করা, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের উপকারের উদ্দেশ্যে গাছ লাগানো, রাস্তা বানিয়ে দেয়া, ইসলামী জ্ঞান সমৃদ্ধ বই-পুস্তক রচনা করা, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা, সাপ্তাহিক/মাসিক/ত্রৈমাসিক/বাৎসরিক হারে ইসলামিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা, ইসলামিক বই-পুস্তক ফ্রি বিতরণ করা এবং যারা ইসলামিক কাজ করে তাদেরকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি।

২০
মুসলিম নারীকে পাপ থেকে দূরে থাকতে হবে
একজন মুসলিম নারীর দায়িত্ব হলো সে সর্বদা নিজেকে অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে রক্ষা করবে। যেমন-

১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পর্কিত ইবাদাতের নির্দেশের ব্যাপারে শৈথিল্যতা প্রদর্শন করা থেকে সতর্ক থাকা।

২. আত্মার দুর্বলতা ও আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আস্থাহীনতা থেকে সতর্ক থাকা।

৩. যাদুকর, ভেল্কিবাজ, ভন্ড ও প্রতারক, জ্যোতিষী, ভবিষ্যদ্বাণী পাঠকারী প্রমুখের মতো কাফির, ফাসিক ও পথভ্রষ্টদের থেকে সতর্ক থাকা। আফসোসের বিষয় হলো, ঐসব ব্যক্তিদের নিকট গমনকারীদের অধিকাংশই হলো নারী।

৪. পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার প্রবণতা থেকে সতর্ক থাকা, যা অধিকাংশ নারীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে তারা খাটো, হালকা-পাতলা, বাহু নগ্নকারক, দৃষ্টি আকর্ষক ও কাফির নারীদের অনুকরণীয় পোশাক পরিধান করতে শুরু করেছে।

৫. বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে কাফির নারীদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা থেকে সতর্ক থাকা। তাদের কর্মকান্ডে বিমুগ্ধ হওয়া থেকে সতর্ক থাকা। কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ নারী চুল, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং আচার-আচরণ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কাফির ও মুশরিক নারীর অনুসরণ করতে শুরু করেছে। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا

যে ব্যক্তি বিজাতির অনুসরণ করে সে আমাদের অর্থাৎ মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। [তিরমিযী, হা/২৬৯৫; মু‘জামুল আওসাত, হা/৭৩৮০; জামেউস সগীর, হা/৯৫৬৫; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২১৯৪; মিশকাত, হা/৪৬৪৯।]

অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে। [আবু দাউদ, হা/৪০৩৩; জামেউস সগীর, হা/১১০৯৪; মিশকাত, হা/৪৩৪৭।]

৬. গীবত করা, চোগলখুরী করা, কুৎসা রটনা করা, মিথ্যা কথা বলা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কাজসমূহ থেকে সতর্ক থাকা। কেননা এসব কাজের প্রবণতা বর্তমান সমাজের নারীদের মাঝেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। অথচ এসব কাজ করলে ধীরে ধীরে তার সকল আমল নষ্ট হয়ে যাবে। অবশেষে শূন্য হাতে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হতে হবে।

৭. অমুসলিম মিশনারীতে চাকুরি নেয়া থেকে সতর্ক থাকা। কেননা তারা তাদের দ্বারা চাকুরির দোহাই দিয়ে এমন কিছু কাজ করিয়ে নেয়, যা পরবর্তীতে মুসলিম জাতির জন্য বিরাট বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- নারীদেরকে ঘর থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে আসা, ধর্মান্তরিত করা, মুসলিম সমাজে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, নারী স্বাধীনতার নামে নারীদের দ্বারা শরীয়তবিরোধী কাজকর্ম করতে বাধ্য করা, মুসলিম শিশুদেরকে ইসলামী শিক্ষার পরিবর্তে অনৈসলামিক শিক্ষা প্রদান করা ইত্যাদি।

৮. অমুসলিম মিশনারীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে লেখাপড়া করার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা। কেননা এর মাধ্যমে তারা মুসলিম নারীদেরকে খুব সহজেই ইসলাম থেকে বিমুখ করে দিতে পারে।

এসব থেকে মুসলিম নারীর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। যেমনিভাবে শরীয়তের নিয়ম-কানুনের আনুগত্য করলে সওয়াব হয়, ঠিক তেমনিভাবে অন্যায়-অপরাধ পরিত্যাগ করার কারণেও নেকী হয়। সুতরাং আনুগত্যের কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে তার যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে অন্যায়-অপরাধ পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রেও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বড়।

২১
মুসলিম নারীকে পর্দা করতে হবে
১. পর্দার উদ্দেশ্য হলো নারী-পুরুষের চরিত্রকে পবিত্র রাখা :

﴿ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَقُلُوْبِهِنَّ﴾

এটা তোমাদের অন্তরের জন্য এবং তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্র উপায়। (সূরা আহযাব- ৫৩)

২. নারীরা জাহেলী যুগের নারীদের মতো ঘুরাফেরা করবে না :

﴿وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُوْلٰى﴾

তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাথমিক অজ্ঞতার যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। (সূরা আহযাব- ৩৩)

৩. নিজের চোখ নিয়ন্ত্রণে রাখবে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করতে হবে :

﴿وَقُلْ لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ﴾

আর মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। (সূরা নূর- ৩১)

নারীরা যাদের সামনে যেতে পারবে তাদের আলোচনা নিচের আয়াতে এসেছে,

﴿وَلَا يُبْدِيْنَ زِيْنَتَهُنَّ اِلَّا لِبُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اٰبَآئِهِنَّ اَوْ اٰبَآءِ بُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اَبْنَآئِهِنَّ اَوْ اَبْنَآءِ بُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اِخْوَانِهِنَّ اَوْ بَنِيْۤ اِخْوَانِهِنَّ اَوْ بَنِيْۤ اَخَوَاتِهِنَّ اَوْ نِسَآئِهِنَّ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَيْمَانُهُنَّ اَوِ التَّابِعِيْنَ غَيْرِ اُولِى الْاِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفْلِ الَّذِيْنَ لَمْ يَظْهَرُوْا عَلٰى عَوْرَاتِ النِّسَآءِ ﴾

নারীরা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারী, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্য থেকে যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপনাঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সূরা নূর- ৩১)

৪. কোমল কণ্ঠে পরপুরুষের সাথে কথা বলা যাবে না :

﴿يَا نِسَآءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا﴾

হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কোন সাধারণ স্ত্রীলোকের মতো নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে (পরপুরুষের সাথে) কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কণ্ঠে কথা বলবে না, যাতে যার অন্তরে (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে সে লালায়িত হতে পারে। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। (সূরা আহযাব- ৩২)

৫. নারীরা মাথা ও বুকের ওপর ওড়না ঝুলিয়ে দেবে :

﴿وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰى جُيُوْبِهِنَّ﴾

তারা যেন তাদের গলদেশ ও বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে নেয়।

(সূরা নূর- ৩১)

৬. এমনভাবে চলাফেরা করবে না, যাতে সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়ে:

﴿وَلَا يَضْرِبْنَ بِاَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِيْنَ مِنْ زِيْنَتِهِنَّؕ وَتُوْبُوْاۤ اِلَى اللهِ جَمِيْعًا اَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾

তারা যেন তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর- ৩১)

জাহেলী যুগের মহিলাদের সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকত। এতে গলা ও বুকের উপরের দিকের অংশটি পরিষ্কার দেখা যেত। বুকে জামা ছাড়া আর কিছুই থাকত না। পেছনের দিকে দু’তিনটা খোঁপা দেখা যেত। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মুসলিম মহিলাদের মধ্যে ওড়নার প্রচলন শুরু হয়। এ ওড়না বর্তমান মেয়েদের মতো ভাঁজ করে পেঁচিয়ে গলার মালা বানিয়ে ফ্যাশন করার উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, যাতে করে এর দ্বারা কোমর, বুক ইত্যাদি আকর্ষণীয় অঙ্গসমূহ ভালোভাবে ঢেকে নেয়া যায়।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, সূরা নূর নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মুখ থেকে তা শুনে লোকেরা ঘরে ফিরে আসে এবং নিজেদের স্ত্রী, মেয়ে ও বোনদেরকে তা শোনায়। ফলে আনসারী মেয়েদের মধ্যে এমন একজনও ছিল না যে وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰى جُيُوبِهِنَّ (তারা যেন তাদের মাথার ওপর ওড়না ঝুলিয়ে দেয়) বাক্যাংশ শোনার পর নিজের জায়গায় বসে ছিল। বরং প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং এ আদেশ পালন করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। অনেকে নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে, আবার অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সাথে সাথে ওড়না বানিয়ে ফেলেন এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে নেন। পরদিন ফজরের নামাযের সময় যতজন মহিলা মসজিদে নববীতে হাযির হয়েছিলেন তাদের সবাই ওড়না পরা ছিলেন। এ সম্পর্কিত অন্য একটি হাদীসে আয়েশা (রাঃ) আরো বিস্তারিত বর্ণনা করে বলেন, মহিলারা পাতলা কাপড় পরিত্যাগ করে মোটা কাপড় বাছাই করে তা দিয়ে ওড়না তৈরি করে। [ইবনে কাসীর, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪৪ পৃ:]

৭. রাস্তায় বের হওয়ার সময় সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে নেবে :

﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ الْمُؤْمِنِيْنَ يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيْبِهِنَّؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤى اَنْ يُّعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَؕ وَكَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا﴾

হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার কন্যাদেরকে এবং মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদর নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, এতে সহজেই তাদের পরিচয় পাওয়া যাবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (সূরা আহযাব- ৫৯)

جِلْبَابُ (জিলবাব) বলা হয় বড় চাদরকে। আর يُدْنِيْنَ (ইউদনীনা) শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে, নিকটবর্তী করা ও ঢেকে নেয়া। কিন্তু যখন তার সাথে عَلٰى (আলা) অব্যয় বসে তখন তার অর্থ হয় উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া। আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, নারীরা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে তার একটি অংশ নিজেদের ওপর ঝুলিয়ে দেয়, সাধারণভাবে যাকে বলা হয় ঘোমটা। এখানে আল্লাহ মহিলাদেরকে হুকুম দিয়েছেন যে, যখন তারা কোন কাজে ঘরের বাইরে বের হবে তখন চাদরের একটি অংশ নিজেদের ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়ে বের হবে। যাতে করে নিজেদের বক্ষদেশ, গলা, চুল ও মুখ ঢাকা পড়ে যায় এবং রাস্তা চেনার জন্য শুধুমাত্র চোখগুলো খোলা থাকে। এ আয়াতটিতে যুবতী মেয়েদের চেহারা অপরিচিত পুরুষদের থেকে লুকিয়ে রাখার হুকুম দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন জানতে পারে যে, এরা দুশ্চরিত্রা মেয়ে নয়। কারণ যে মেয়েটি নিজের চেহারা ঢাকবে, অথচ চেহারা সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার কাছে কেউ এ আশা করতে পারে না যে, সে নিজের সতর অন্যের সামনে খুলতে সম্মতি হবে। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি জানবে, এ মেয়েটি পর্দাশীল, একে যিনার কাজে লিপ্ত করার আশা করা যেতে পারে না। এভাবে সে বখাটেদের হাতে উত্যক্ত ও লাঞ্ছিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এ বিধানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে চাদর দিয়ে ঢাকার যে হুকুম দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, অপরিচিতদের থেকে সৌন্দর্য লুকানো। আর এ কথা সুস্পষ্ট যে, এ উদ্দেশ্য তখনই পূর্ণ হতে পারে যখন চাদরটি হবে সাদামাটা। একটি উন্নত নকশাদার ও দৃষ্টিনন্দিত কাপড় জড়িয়ে নিলে এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। তারপর আল্লাহ নিজেই এ হুকুমটির কারণ বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, এটি এমন একটি সর্বাধিক উপযোগী পদ্ধতি, যা থেকে মুসলিম মহিলাদেরকে চিনে নেয়া যাবে এবং তারা উত্যক্ত হওয়া থেকেও বেঁচে যাবে।

এসব জানার পরও যে ব্যক্তি পর্দার বিরুদ্ধাচরণ করবে সে এ কথা মেনে নিয়েই করবে যে, হয় সে কুরআনবিরোধী কাজ করছে অথবা কুরআনের নির্দেশনাকে ভুল মনে করছে। আল্লাহর এ বিধান জানার পর যারা নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে, আশা করা যায় আল্লাহ তাদের অতীতের ভুলসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যারা কুরআনের বিধান লঙ্ঘন করছে, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যেদিন তাদের চেহারা আগুনে উলটপালট করা হবে তখন তারা বলবে, হায়! যদি আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতাম! কিন্তু তখন তাদের এ আফসোস কোন কাজে আসবে না।

২২
উত্তম কন্যা হও
হে বোন! তুমি উত্তম কন্যা হওয়ার চেষ্টা করো। কন্যা হিসেবে মাতাপিতার প্রতি তোমার যেসকল দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো জেনে ঐ সব দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করো। যাতে করে মাতাপিতা তোমার প্রতি সমত্মুষ্ট হন এবং তোমার জন্য দু‘আ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَوَصَّيْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِۚ حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰى وَهْنٍ وَّفِصَالُهٗ فِيْ عَامَيْنِ اَنِ اشْكُرْ لِيْ وَلِوَالِدَيْكَؕ اِلَيَّ الْمَصِيْرُ﴾

আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। কেননা তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তাকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করিয়েছে। সুতরাং আমার কৃতজ্ঞ হও এবং তোমার মাতাপিতার (কৃতজ্ঞ হও)। অবশেষে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। (সূরা লুকমান- ১৪)

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ কন্যাদেরকে দেখা যায়, তারা এই আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীন। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পিতামাতার চাইতে বান্ধবীদের অনুসরণ করে এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। এটা ছেলেমেয়ে উভয়েরই বড় ধরনের অন্যায়।

মায়ের বিভিন্ন কর্তব্যে সাধ্যমতো সহযোগিতা করো :

বিভিন্নভাবে মায়ের কাজে সহযোগিতা করা কন্যাদের একামত্ম কর্তব্য। যেমন-

১. রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করা। সম্পূর্ণভাবে কাজের মহিলার উপর নির্ভর না হওয়া। কারণ এই নির্ভরতা মেয়েকে এক অদক্ষ বা অলস ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। ফলে সেই মেয়ে ভবিষ্যতে তার ঘর-সংসারের কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হয়ে পড়ে।

২. ছোট ভাই ও বোনদের লালনপালন এবং নৈতিকতা ও উন্নত চারিত্রিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে মাকে সার্বিক সহযোগিতা করা।

৩. মা মূর্খ হলে তাকে শিক্ষা দেয়া। বিশেষ করে এমন বিষয়গুলো শিখিয়ে দেয়া, যাতে তারা দ্বীন পালন করতে পারেন। যেমন- নামায এবং নামাযের মধ্যে পঠিত কুরআন ও যিকির-আযকারের প্রশিক্ষণ দেয়া অথবা অবসর সময়ে তার নিকট এমন কিছু শিক্ষণীয় বিষয় পাঠ করা, যা তার উপকারে আসে।

২৩
উত্তম বোন হও
বোন হলো তার ভাইয়ের নিকট সকল আত্মীয়ের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম ও ঘনিষ্ঠ। আর তাদের উভয়ের জন্য যৌথ হক বা অধিকার রয়েছে। যেমন :

১. তার চেয়ে বয়সে বড় ভাই ও বোনদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া। কারণ বড় বোন হলেন মায়ের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত এবং বড় ভাই হলেন পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাদের জন্য আত্মীয়তার সম্পর্কজনিত অধিকার রয়েছে। সুতরাং তার উপর কর্তব্য হলো, তাদের কেউ সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হলে সহযোগিতা করা। যেমন- তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করা, তাদের বিপদ-আপদের সময় পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি।

২. ছোট ভাইবোনদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেয়া ও শাসন করা।

৩. ছোট ভাইবোনকে লালনপালনের ক্ষেত্রে পিতামাতাকে সহযোগিতা করা।

২৪
আদর্শ ছাত্রী হও
আদর্শ ছাত্রী হিসেবে একজন মুসলিম মেয়ের কর্তব্য হলো :

১. জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ত করা। অর্থাৎ তার জ্ঞান অর্জনের আসল উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ তা‘আলাকে সমত্মুষ্ট করা। সুতরাং সে জ্ঞান অন্বেষণ করবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আর এই জ্ঞানার্জন দ্বারা সে তার দ্বীন, আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং সুস্পষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহর ইবাদাত করবে ।

২. ছাত্রী জ্ঞানার্জনের আদব কায়দা রপ্ত করার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার অর্জন করবে। যেমন- অধ্যবসায়, উৎসাহ-উদ্দীপনা, পরস্পর পাঠক্রম আলোচনা, বার বার পাঠ ও সুন্দর চালচলন। বিশেষ করে শিক্ষিকাগণ ও বান্ধবীদের সাথে আচার-আচরণ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে।

৩. জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে চিন্তা-গবেষণা করা। সুতরাং সে পাঠ্য বিষয়সমূহ ব্যাখ্যা-বিশেলষণের ক্ষেত্রে শিক্ষিকাকে অনুসরণ করবে, মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবে। অতঃপর বাসায় এসে সেগুলো বার বার পর্যালোচনা করবে এবং সর্বোপরি তার সকল আবশ্যকীয় দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করবে।

৪. শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্মান ও মর্যাদা দেয়া।

৫. বান্ধবীদের সাথে কোন প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতা, কঠোরতা, কটু কথা বা কঠোর শব্দ উচ্চারণ না করা এবং তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা। কারণ সে হলো তার বোন, বান্ধবী ও সহপাঠী।

৬. প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে যা উত্তম চরিত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রকাশভঙ্গি, আকার-আকৃতি ও বেশ-ভূষার সাথে সম্পর্কিত। যদি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ শরীয়তবিরোধী না হয় তবে প্রতিষ্ঠানের নির্দেশগুলো সে বাস্তবায়ন করবে।

৭. সিলেবাস বহির্ভূত তৎপরতায় অংশগ্রহণ করা। যাতে সে এমন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে, যে জ্ঞান পাঠকক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যেমন- সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা, হাদীস মুখস্থ করা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বই-পুসত্মক অধ্যয়ন করা, হাতের কাজ তথা সেলাই করা, রান্নাবান্না করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহ আয়ত্ত করে নেয়া ইত্যাদি।

৮. সহপাঠী তথা বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে সময়-সুযোগ অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষে বক্তব্য পেশের মাধ্যমে সংশোধন ও দিকনির্দেশনামূলক উপদেশ প্রদান করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।

৯. তার চালচলন, আচার-আচরণ, আলোচনা-পর্যালোচনা, অনুধাবন, শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে তার সহপাঠী ও বান্ধবীদের জন্য আদর্শস্বরূপ হতে হবে।

২৫
দ্বীনদার পাত্রী হও
বর্তমান সময়ে দ্বীনদার পাত্রীর বড়ই অভাব। তাই একজন মুসলিম মেয়ে হিসেবে তুমি দ্বীনদার পাত্রী হওয়ার চেষ্টা করো। যাতে করে তোমার মাধ্যমে একটি পরিবারে ইসলামের আলো জ্বলতে পারে। দ্বীনদার পাত্রী হওয়ার জন্য যেসকল গুণাবলি অর্জন করার দরকার সেসকল গুণাবলি অর্জন করো।

কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ বিভিন্ন হাদীসে দ্বীনদার পাত্রীর গুণাবলির উল্লেখ রয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সে স্ত্রীই সর্বোত্তম, যাকে দেখলে তোমার মন আনন্দে ভরে যায়। তুমি তাকে কোন আদেশ করলে সে তোমার আনুগত্য করে। তুমি ঘরে না থাকলে সে তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার ধনসম্পদের ও তার নিজের হেফাযত করে। [মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৫৩৭; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২৬৮২; সুনানে নাসাঈ কুবরা, হা/৮৯৬১; জামেউস সগীর, হা/৫৬০৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৮৩৮।]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿عَسٰى رَبُّهٗۤ اِنْ طَلَّقَكُنَّ اَنْ يُّبْدِلَهٗۤ اَزْوَاجًا خَيْرًا مِّنْكُنَّ مُسْلِمَاتٍ مُّؤْمِنَاتٍ قَانِتَاتٍ تَآئِبَاتٍ عَابِدَاتٍ سَآئِحَاتٍ ثَيِّبَاتٍ وَّاَبْكَارًا ﴾

যদি নবী ﷺ তোমাদের সকলকে পরিত্যাগ করেন তবে তার প্রতিপালক তাকে তোমাদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর স্ত্রী দিতে পারেন, যারা আনুগত্যকারিণী, তওবাকারিণী, ইবাদাতকারিণী, সিয়াম পালনকারিণী, তালাকপ্রাপ্তা এবং কুমারী (ইত্যাদি গুণের অধিকারী)। (সূরা তাহরীম- ৫)

নবী ﷺ এর পবিত্র স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলার অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে এসব গুণাবলি ছিল না বরং এর অর্থ হলো, তোমাদের ত্রুটিপূর্ণ আচরণের কারণে নবী ﷺ এর যে কষ্ট হচ্ছে তোমরা তা পরিত্যাগ করো এবং এসব গুণাবলির প্রতি মনোনিবেশ করো।

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّ الْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِيْنَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِيْنَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِيْنَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِيْنَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّآئِمِيْنَ وَالصَّآئِمَاتِ وَالْحَافِظِيْنَ فُرُوْجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِيْنَ اللهَ كَثِيْرًا وَّالذَّاكِرَاتِ اَعَدَّ اللهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَّاَجْرًا عَظِيْمًا﴾

নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনয়ী পুরুষ ও বিনয়ী নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সিয়াম পালনকারী পুরুষ ও সিয়াম পালনকারী নারী, স্বীয় লজ্জাস্থান হেফাযতকারী পুরুষ ও স্বীয় লজ্জাস্থান হেফাযতকারী নারী এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী- এদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা ও বিরাট প্রতিদান। (সূরা আহ্যাব- ৩৫)

আল্লাহর নিকট কোন্ কোন্ গুণাবলিকে মর্যাদা দেয়া হয় এ আয়াতে তা বলে দেয়া হয়েছে। এগুলো ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ। একটি বাক্যে এগুলোকে একত্রে সংযোজিত করে দেয়া হয়েছে। এ মূল্যবোধগুলোর ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয়ের কর্মক্ষেত্র আলাদা; কিন্তু এসব গুণাবলি যদি উভয়ের মধ্যে সমান থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে উভয়ের মর্যাদা সমান এবং উভয়ের প্রতিদানও সমান হবে।

মুমিন কারা : যারা নিজেদের জন্য ইসলামকে জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এ বিধানের অনুসারী হওয়ার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অন্য কথায়, যাদের মধ্যে ইসলাম প্রদত্ত জীবনধারার বিরুদ্ধে কোন রকমের বিরোধিতা নেই। বরং তারা তার পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের পথ অবলম্বন করেছে। যাদের এ আনুগত্য বাহ্যিক নয় বরং মন থেকেই তারা ইসলামের নেতৃত্বকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। চিন্তা ও কর্মের যে পথ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল দেখিয়েছেন, সেটিই সোজা ও সঠিক পথ এবং তারই অনুসরণের মধ্যে প্রকৃত সাফল্য নিহিত, এটিই তাদের ঈমান। যে জিনিসকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভুল বলে দিয়েছেন তারা সেটাকে ভুল মনে করে। আর যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ সত্য বলে দিয়েছেন তাদের নিজেদের মন-মস্তিষ্কও তাকে সত্য বলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে।

মুসলিম কারা : যারা ঈমান আনার পর বসে থাকে না, বরং কার্যত আনুগত্য করে। তাদের অবস্থা এমন নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে কাজের হুকুম দিয়েছেন তাকে সত্য বলে মেনে নেবে; কিন্তু কার্যত তা পালন করবে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন সেগুলোকে খারাপ মনে করবে কিন্তু নিজেরা সেগুলোই করে যেতে থাকবে।

সত্যবাদী কারা : যারা নিজেদের কথায় যেমন সত্য তেমনি ব্যবহারিক কার্যকলাপেও সত্য। মিথ্যা, প্রতারণা, অসৎ উদ্দেশ্য ও ছলনা তাদের জীবনে পাওয়া যায় না। তাদের বিবেক যা সত্য বলে জানে মুখে তারা তাই উচ্চারণ করে। যে কাজ সত্য ও সততা অনুযায়ী হয় সেই কাজই তারা করে থাকে। যার সাথেই তারা কোন কাজ করে বিশ্বস্ততা ও ঈমানদারীর সাথেই করে।

ধৈর্যশীল কারা : যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ Gi নির্দেশিত সত্য পথে চলা ও আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে যেসব বাধা ও বিপদ আসে এবং যে সমস্ত ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় তারা দৃঢ়ভাবে তার মোকাবেলা করে। কোন কিছুই তাদেরকে এ পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারে না।

দানশীল কারা : যারা আল্লাহর পথে উন্মুক্ত হৃদয়ে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে। তারা আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করার ব্যাপারে নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী প্রচেষ্টা চালাতে ত্রুটি করে না; কোন ইয়াতীম, রুগ্ন, বিপদাপন্ন, দুর্বল, অক্ষম ও অভাবী ব্যক্তি সাহায্যের সম্মুখীন হলে তাকে বঞ্চিত করে না। আর তারা আল্লাহর দ্বীনকে সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে কখনো কার্পণ্য করে না।

লজ্জাস্থান হেফাযতকারী কারা : যারা উলঙ্গপনাকে এড়িয়ে চলে এবং যিনা থেকে দূরে থাকে। এর সাথে এটাও বুঝে নিতে হবে যে, শুধুমাত্র পোশাক না পরে উলঙ্গ হয়ে থাকাকে উলঙ্গপনা বলে না; বরং এমন পোশাক পরাও উলঙ্গপনার অন্তর্ভুক্ত, যা এতটা পাতলা হয় যে, তার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় অথবা এমন আঁটসাঁট হয়, যার ফলে দেহের উঁচু-নিচু অঙ্গ স্পষ্ট হয়ে উঠে।

আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী কারা : যারা জীবনের সকল কাজকর্মে- এমনকি সকল ব্যাপারেই সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করে। কারো মনে আল্লাহর চিন্তা পুরোপুরি ও সর্বব্যাপী আসন গেড়ে না বসা পর্যন্ত এ ধরনের অবস্থা তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। মানুষের মনের গভীরে যখন আল্লাহর চিন্তা ঢুকে যায় তখন তার অবস্থা এমন হয় যে, সে কোন কথা বললে বা কোন কাজ করলে তার মধ্যে আল্লাহর নাম অবশ্যই এসে যাবে। সে আল্লাহকে স্মরণ করে ঘুমাবে এবং ঘুম থেকে উঠেও আল্লাহর নাম নেবে। কথাবার্তায় তার মুখে বার বার بِسْمِ اللهِ (বিসমিল্লাহ), اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ (আলহামদুলিল্লাহ), إِنْشَآءَ اللهُ (ইনশাআল্লাহ), مَاشَآءَ اللهُ (মাশাআল্লাহ) এ ধরনের শব্দ উচ্চারিত হতে থাকবে।

প্রত্যেক কাজে বার বার আল্লাহর সাহায্য চাইবে। প্রত্যেকটি নিয়ামত লাভ করার পর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। প্রত্যেকটি বিপদ আসার পর তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হবে। কোন খারাপ কাজের সুযোগ এলে তাঁকে ভয় করবে। কোন ভুল বা অপরাধ করলে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে। প্রত্যেকটি প্রয়োজন ও অভাবের মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে। মোটকথা উঠতে-বসতে এবং দুনিয়ার সমস্ত কাজকর্মে সে আল্লাহকে স্মরণ করবে। এ জিনিসটিই আসলে ইসলামী জীবনের প্রাণ। অন্য যে কোন ইবাদাতের জন্য কোন না কোন সময় নির্ধারিত থাকে এবং তখনই তা পালন করা হয়। আর তা পালন করার পর পরই মানুষ তা থেকে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু এ ইবাদাত তথা আল্লাহর যিকির সর্বক্ষণ জারী থাকে এবং এটিই আল্লাহর সাথে মানুষের জীবনের স্থায়ী সম্পর্ক জুড়ে রাখে।

২৬
দ্বীনদার স্বামী নির্বাচন করো
নারীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটি হলো তার স্বামী বাছাইয়ের ধাপটি। যে কেউ তাকে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেই সে তা গ্রহণ করবে না। বরং রাসূলুল্লাহ ﷺ গ্রহণযোগ্য স্বামী নির্বাচনের জন্য যে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তার অনুসরণ করবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যখন তোমাদের নিকট এমন কোন ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার চরিত্র ও দ্বীনদারীতে তোমরা সমত্মুষ্ট, তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। যদি তোমরা তা না কর তবে পৃথিবীর মধ্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে। [তিরমিযী, হা/১০৮৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৯৬৭।]

সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে খারাপ ছেলেকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন না করা একজন মুসলিম মেয়ের কর্তব্য। খারাপ ছেলে খারাপ মেয়ের সাথে এবং ভালো ছেলে ভালো মেয়ের সাথেই জুটি বাঁধবে। এ ব্যাপারে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

﴿اَلْخَبِيْثَاتُ لِلْخَبِيْثِيْنَ وَالْخَبِيْثُوْنَ لِلْخَبِيْثَاتِۚ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِيْنَ وَالطَّيِّبُوْنَ لِلطَّيِّبَاتِۚ اُولٰٓئِكَ مُبَرَّءُوْنَ مِمَّا يَقُوْلُوْنَؕ لَهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَّرِزْقٌ كَرِيْمٌ﴾

দুশ্চরিত্র নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য, দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্র নারীর জন্য, সচ্চরিত্র নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্র নারীর জন্য (নির্ধারিত)। লোকে যা বলে তারা তা হতে পবিত্র, এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা। (সূরা নূর- ২৬)

﴿اَلزَّانِيْ لَا يَنْكِحُ اِلَّا زَانِيَةً اَوْ مُشْرِكَةًؗ وَالزَّانِيَةُ لَا يَنْكِحُهَاۤ اِلَّا زَانٍ اَوْ مُشْرِكٌۚ وَحُرِّمَ ذٰلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ﴾

ব্যভিচারী পুরুষ ব্যভিচারী নারী অথবা মুশরিক নারী ব্যতীত অন্য কাউকে বিবাহ করে না এবং ব্যভিচারী নারীও ব্যভিচারী পুরুষ অথবা মুশরিক পুরুষ ব্যতীত অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। মুমিনদের জন্য এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (সূরা নূর- ৩)

এ আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা বলা যে, যিনা একটি চরম নিকৃষ্ট কুকর্ম। যে ব্যক্তি মুসলিম হয়েও এ কাজ করে সে মুসলিম সমাজের সৎ ও পবিত্রদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।

মানদন্ড হলো তিনটি বিষয় :

মানদন্ড হলো তিনটি বিষয়; দ্বীন, চরিত্র ও আকল। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ এর বিপরীতে ধনসম্পদের আধিক্য অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অথবা সরকারি চাকুরি অথবা সামাজিক মর্যাদা অথবা চেহারা ও যশ-খ্যাতি ইত্যাদির আলোকে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করে থাকে। অথচ এ ধরনের সকল মানদন্ড রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মানদন্ডের বিপরীত।

বেদ্বীন স্বামীর কারণে স্ত্রী যুলুমের শিকার হবে। আর তার সন্তানগণ হবে ধ্বংস ও বিচ্যুতির শিকার। স্বামীর নৈতিকতার অভাবে স্ত্রী তার দুর্ব্যবহারের শিকার হবে। স্বামীর নির্বুদ্ধিতার কারণে স্ত্রী অশান্তি ও দুর্বিসহ জীবনের অধিকারী হবে। আর তার সন্তানগণ হবে অস্থিরতার শিকার। ধার্মিক, চরিত্রবান ও বুদ্ধিমান পিতা তার সন্তানদেরকে প্রতিপালন করবেন ও শিক্ষা দেবেন আর তাদেরকে উত্তম চরিত্র ও আচার-আচরণের ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন।

২৭
মুসলিম মেয়েদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ
১. এমন কাজে সময় অতিবাহিত করো না, যাতে কোন উপকার নেই :

অহেতুক কাজ যেমন- বিভিন্ন প্রকার মিডিয়ার কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে বিনোদন উপভোগ করা অথবা অন্যান্য এমনসব বিষয়ে আত্মনিয়োগ করা, যার মধ্যে কোন উপকার নেই অথবা তাতে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। এতে বহু সময় খেল-তামাশা ও অনর্থক কাজে নষ্ট হয়। অথচ মানুষকে তার সময়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। সময়ই তার বয়স ও জীবন, আর তা জগতের সবচেয়ে দামী জিনিস। যখন এসব অহেতুক কাজে ব্যয় করবে, তখন তা হবে তার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য চরম পরিণতির মূল কারণ। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ মেয়ের সময়গুলো বরাদ্দ থাকে এসব মিডিয়া, খারাপ বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মারা, মার্কেটে যাওয়া এবং টেলিফোনে কথা বলা ইত্যাদি অহেতুক কাজের মধ্যে। যার ফলে অনেক সময় অপচয় হয়ে যাচ্ছে, অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্যও বাকি থেকে যাচ্ছে এবং আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২. বান্ধবী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করো :

একজন মেয়েকে তার বান্ধবী নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা খারাপ বান্ধবী জ্বলন্ত আগুনের মতো। এ যুগের অধিকাংশ মেয়েই খারাপ বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে নিজেদের ক্যারিয়ার ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। যা প্রতিটি মুসলিম পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতির মূল কারণ হিসেবে দাঁড়ায়। সুতরাং জীবনের সকল পরিস্থিতিতে খারাপ বান্ধবীদেরকে বর্জন করতে হবে এবং যথাসম্ভব সৎ বান্ধবীদেরকে গ্রহণ করতে হবে। খারাপ বান্ধবীদেরকে চেনা যাবে এভাবে যে, তারা অন্যদের জন্য খারাপ জিনিস ও উপায়-উপকরণ আমদানী করে, তারা দুষ্কর্ম ও বিশৃঙ্খলাকে পছন্দ করে, সৎকর্মকে অপছন্দ করে এবং অসৎকর্মের দিকে আগ্রহ প্রকাশ করে ইত্যাদি।

৩. ইসলাম সমর্থন করে না এরূপ ফ্যাশনের অনুসরণ করো না :

ইসলাম সমর্থন করে না এরূপ ফ্যাশন যেমন- আঁটসাঁট পোশাক পরিধান না করা, সতরের কোন অংশ প্রকাশ পায় এমন কোন পোশাক পরিধান না করা, পুরুষদের পোশাক পরিধান না করা, অমুসলিমদের অনুসরণ করে কোন পোশাক পরিধান না করা ইত্যাদি।

৪. অপ্রয়োজনে মার্কেটে বের হয়ো না :

অপ্রয়োজনে মার্কেটে ঘুরাফেরা করা একটি ভয়ানক সমস্যা, যা এ যুগে শুষ্ক লতাপাতায় আগুন ছড়ানোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক মুসলিম কন্যারা বিভিন্ন মার্কেট-বাজারে অপ্রয়োজনে ঘুরে বেড়ায়। যার ফলে তাদেরকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এসব বিপদসমূহের অন্যতম হলো শয়তানের শিকার হওয়া। কারণ বাজার শয়তানেরই অবস্থানকেন্দ্র এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা। যখন মেয়েরা কোন প্রয়োজনে বাজারে যেতে বাধ্য হবে, কেবল তখনই সে বাজারে যাবে এবং অভিভাবককেও সাথে নিয়ে যাবে। অতঃপর প্রয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঘরে ফিরে আসবে। সুতরাং প্রত্যেক মেয়ের উচিত, সে যেন তার প্রয়োজনকে হিসাব করে নেয় এবং অযথা বাড়ির বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকে। কারণ এটা হচ্ছে সকল অনিষ্টের দরজা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, নারী যখন তার ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে উঁকি দেয়। [তিরমিযী, হা/১১৭৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৬৮৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/২০৬৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৯৩৬৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৭৬৯৮; জামেউস সগীর, হা/১১৬৩৬; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬৮৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৪৬; মিশকাত, হা/৩১০৯।] সুতরাং প্রতিটি নারীকে এসব বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

৫.অপ্রয়োজনে ফোন ব্যবহার করো না :

প্রতিটি মেয়েকে অপ্রয়োজনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা এর মাধ্যমে খারাপ ছেলেরা মুসলিম মেয়েদেরকে নষ্ট করার রাসত্মা খুঁজে পায়।

৬. ছেলেদের খপ্পরে পড়ো না :

বর্তমানে অনেক মেয়ে নৈতিকতা বিবর্জিত অশালীন পোশাক পরিধান করে ঘুরাফেরা করে, যা নষ্ট ছেলেদেরকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে থাকে। একটি মেয়ে যখন আঁটসাঁট, পাতলা বা ছেলেদের পোশাক পরে বের হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই ছেলেরা তার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকায়। তারপর সে এক পর্যায়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। সময়মতো নৈতিক শিক্ষা না দেয়ায় বেশিরভাগ সন্তানই নষ্ট হয়ে যায়। আর নৈতিক শিক্ষাকে বাদ দিয়ে সুন্দর চরিত্রবান মানুষ হওয়া যায় না। নৈতিক শিক্ষার অভাবেই নারীরা উত্যক্তসহ নানা রকমের নির্যাতনের শিকার হয়।

নারীদের দেহের সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য পোশাক ডিজাইনাররা টি-শার্ট, স্কিন প্যান্ট, শর্ট কামিছ ও পাতলা কাপড়ের পোশাক বানিয়ে বাজারে ছেড়েছে। আর তা সরলমতী মেয়েরা অন্ধের মতো ক্রয় করে ব্যবহার করছে। দুনিয়ার চাকচিক্যের লালসায় তারা ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছে।

থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি বিভিন্ন অপসংস্কৃতিও মুসলিম সমাজে ঢুকেছে। এসবের কারণেও মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়। সমাজে নারীদের মধ্যে চলছে অবাধে দেহপ্রদর্শন প্রতিযোগিতা।

গায়ে হলুদের নামেও অপসংস্কৃতি মহামারী আকার ধারণ করেছে। এসব অনুষ্ঠানে হলুদ ছোঁয়ার নামে ছেলেরা মেয়েদেরকে, মেয়েরা ছেলেদেরকে স্পর্শ করে। এসকল পরিবেশে ছেলেমেয়েরা যে ধরনের পোশাক পরিধান করে নিজেদেরকে উপস্থাপন করে, স্বাভাবিকভাবেই তাতে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।

পরপুরুষদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার ফলে মেয়েদের নৈতিক চরিত্র কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোন মেয়ে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে বাইরে চলাফেরা করলে সে পদে পদে আল্লাহর নাফরমানীতে নিমজ্জিত হবে।

২৮
মুসলিম নারীর ঘরের দায়িত্ব
ঘর হচ্ছে একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম। তিনি তাদের জন্য এমন আবাসিক ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে। যার দ্বারা তারা নিজেদেরকে ঢেকে রাখে এবং সকল প্রকার উপকার ভোগ করে। সুতরাং ঘরের মধ্যে মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বড়।

১. ঘরের মধ্যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের শরয়ী ভিত্তি :

ঘরের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ পালন করা প্রত্যেক নারীর উপর আবশ্যক। আর শরীয়ত এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি নজর দেয়। স্বামী ও স্ত্রী কল্যাণকর সীমারেখার মধ্যে ব্যাপক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধ থাকে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ  : أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : ‏ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِه ، فَالْأَمِيْرُ الَّذِيْ عَلَى النَّاسِ فَهُوَ رَاعٍ عَلَيْهِمْ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْهُمْ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلٰى أَهْلِ بَيْتِه وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْهُمْ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلٰى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِه وَهِىَ مَسْئُوْلَةٌ عَنْهُمْ، وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلٰى مَالِ سَيِّدِه وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْهُ، أَلَا فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَعِيَّتِه ‏

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই শাসক বা দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। যিনি জনগণের নেতা বা আমীর, তিনি তাদের রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। সুতরাং সে ঐসব ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের ব্যক্তিদের শাসক ও রক্ষক, সুতরাং পরিবারের ব্যক্তিদের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরবাড়ি ও সন্তানদের রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। সুতরাং তাকেও এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর গোলাম তার মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। সুতরাং তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তাই জেনে রাখো! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। আর তাই প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। [সহীহ বুখারী, হা/৭১৩৮; সহীহ মুসলিম, হা/৪৮২৮; আবু দাউদ, হা/২৯৩০; তিরমিযী, হা/১৭০৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৪৯০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫৮৩১; আদাবুল মুফরাদ, হা/২০৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/২৪৬৯; জামেউস সগীর, হা/৮৬৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬০২৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩০৬১; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৫৬৬৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৪৮৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২১৬৯; ...............তনি বলেন, দায়বদ্ধ থাকে। কারণ বুখারী ও মুসলিমের আবদুল্লা ইবনে উমার সীমারেখার মধেমানসে : বশেষভাবে আলোচনার দাবীমিশকাত, হা/৩৬৮৫।]

বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, জেনে রাখো! তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। অনুরূপভাবে তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে। সুতরাং তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার হলো, তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে যেতে না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর এবং তারা যেন তোমাদের ঘরের মধ্যে এমন কাউকে প্রবেশ করতে অনুমতি না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর। আরো জেনে রাখো! তোমাদের উপর তাদের অধিকার হলো, তোমরা তাদের বস্ত্র ও অন্নের ব্যাপারে তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে। [তিরমিযী, হা/১১৬৩; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৫১।]

২. দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান হতে হবে :

﴿فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِّلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ﴾

সুতরাং সতী-সাধ্বী নারীরা একান্ত অনুগত হয় এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহ যা সংরক্ষণ করতে বলেছেন, তা সংরক্ষণ করে। (সূরা নিসা- ৩৪)

৩. স্বামীকে দ্বীনের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে না :

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنَّ مِنْ اَزْوَاجِكُمْ وَاَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوْهُمْ﴾

হে মুমিনগণ! নিশ্চয় তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো। (সূরা তাগাবুন- ১৪)

৪. স্বামীর খিয়ানত করবে না :

﴿ضَرَبَ اللهُ مَثَلًا لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوا امْرَاَتَ نُوْحٍ وَّامْرَاَتَ لُوْطٍؕ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللهِ شَيْئًا وَّقِيْلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِيْنَ﴾

আল্লাহ কাফিরদের জন্য নূহ ও লূতের স্ত্রীদের দৃষ্টান্ত পেশ করছেন, তারা ছিল আমার বান্দাদের মধ্যে দু’জন সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীন; কিন্তু তারা তাদের প্রতি খিয়ানত করেছিল। ফলে নূহ ও লূত (উভয়ের কেউই) তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারল না। অতঃপর তাদেরকে (সে স্ত্রীদেরকে) বলা হলো, জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও তাতে প্রবেশ করো। (সূরা তাহরীম- ১০)

৫. দুনিয়ায় ভোগবিলাসী না হয়ে আখিরাতমুখী হতে হবে :

﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ اِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِيْنَتَهَا فَتَعَالَيْنَ اُمَتِّعْكُنَّ وَاُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيْلًا وَاِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَالدَّارَ الْاٰخِرَةَ فَاِنَّ اللهَ اَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ اَجْرًا عَظِيْمًا﴾

হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে বলে দিন, যদি তোমরা পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য চাও, তবে এসো- আমি তোমাদের ভোগের ব্যবস্থা করে দেই এবং তোমাদেরকে সম্মানের সাথে বিদায় দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকাল চাও, তবে তোমাদের মধ্যে যারা সৎ আল্লাহ তাদের জন্য বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। (সূরা আহযাব- ২৮, ২৯)

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আবু বকর (রাঃ) এসে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তখন তিনি তাঁর দরজায় অনেক লোককে উপবিষ্ট দেখতে পেলেন। তবে তাদের কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর তিনি আবু বকর (রাঃ)-কে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করলে তিনি প্রবেশ করলেন। তারপর উমর (রাঃ) এলেন এবং তিনিও অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ফলে তাঁকেও প্রবেশের অনুমতি প্রদান করা হলো। তিনি নবী ﷺ-কে চিন্তাযুক্ত ও নীরবে বসে থাকতে দেখলেন। এমতাবস্থায় তাঁর চতুষ্পার্শ্বে তাঁর সহধর্মিণীগণ উপবিষ্ট ছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, উমর (রাঃ) বললেন, নিশ্চয় আমি নবী ﷺ এর নিকট এমন কথা বলব, যা তাঁকে হাসাবে। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি খারিজার কন্যা {উমর (রাঃ) এর স্ত্রী}-কে আমার কাছে অন্ন ও বস্ত্র তলব করতে দেখতেন তাহলে তৎক্ষণাৎ আপনি তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে তার স্কন্ধে আঘাত করতেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ হেসে উঠলেন এবং বললেন, আমার চতুষ্পার্শ্বে তোমরা যাদেরকে দেখতে পাচ্ছ তারা আমার কাছে অন্ন ও বস্ত্র দাবি করছে।

তখন সাথে সাথে আবু বকর (রাঃ) আয়েশা (রাঃ) এর দিকে ছুটলেন এবং তাঁর গর্দানে আঘাত করলেন। আর উমর (রাঃ)ও দাঁড়িয়ে গেলেন এবং হাফসা (রাঃ) এর দিকে অগ্রসর হয়ে তাঁর ঘাড়ে আঘাত করলেন। তাঁরা উভয়ে বললেন, তোমরা নবী ﷺ এর নিকট এমন জিনিস দাবি করছ, যা তাঁর কাছে নেই। তখন নবী ﷺ এর সহধর্মিণীগণ বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা আর কখনো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এমন জিনিস চাইব না, যা তাঁর কাছে নেই। এরপর তিনি তাদের থেকে এক মাস কিংবা ঊনত্রিশ দিন পৃথক রইলেন। অতঃপর তাঁর উপর উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়।

বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আয়েশা (রাঃ)-কে দিয়ে আয়াতের নির্দেশ বাসত্মবায়ন করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, হে আয়েশা! আমি তোমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করতে চাই। তবে সে বিষয়ে তোমার পিতামাতার সঙ্গে পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করাই আমি পছন্দ করি। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার ব্যাপারে আমি কি আমার পিতামাতার কাছে পরামর্শ নিতে যাব? না- বরং আমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখিরাতকেই বেছে নিয়েছি। তবে আপনার কাছে আমার একান্ত নিবেদন, আমি যা বলেছি সে সম্পর্কে আপনি আপনার অন্যান্য সহধর্মিণীদের কারো কাছে ব্যক্ত করবেন না। তিনি বললেন, তাঁদের যে কেউ সে বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি অবশ্যই তাঁকে তা বলে দেব। কারণ আল্লাহ আমাকে কঠোরতা আরোপকারী ও অত্যাচারীরূপে নয় বরং সহজ পন্থায় (শিক্ষাদানকারী) হিসেবে প্রেরণ করেছেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৭৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৫৫৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৭১৬৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২২৫৩; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৩৭১৪; বায়হাকী, হা/১৩০৪৭; মিশকাত, হা/৩২৪৯।]

২৯
স্বামীর ব্যাপারে স্ত্রীর দায়িত্ব
স্ত্রীর উপর তার স্বামীর অধিকার অনেক বড়, যা তার পিতামাতার অধিকারের চেয়েও বেশি। সুতরাং সে স্বামীর সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : لَوْ كُنْتُ اٰمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করার আদেশ দিতাম তবে আমি নারীদেরকে তাদের স্বামীকে সিজদা করার আদেশ দিতাম। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৬৩৫; তিরমিযী, হা/১১৫৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৫২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/২৭৬৮।]

অন্য হাদীসে এসেছে,

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - أَيُّمَا امْرَأَةٍ مَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَنْهَا رَاضٍ دَخَلَتِ الْجَنَّةَ

উম্মে সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কোন নারী যদি এমতাবস্থায় মারা যায় যে, তার স্বামী তার উপর সমত্মুষ্ট; তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [তিরমিযী, হা/১১৬১; ইবনে মাজাহ, হা/১৪৫৪।]

সুতরাং একজন মুসলিম নারীকে জান্নাতে যেতে হলে তাকে অবশ্যই স্বামীর আনুগত্য করতে হবে। আর স্বামীর আনুগত্য করতে হলে স্বামীর অধিকারসমূহ যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

স্বামীর হকসমূহ :

১. আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা নেই এমন কাজে স্বামীর আনুগত্য করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যখন নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমাযান মাসের রোযা রাখবে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে এবং স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে, তুমি যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করো। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৬১।]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ নারী সবচেয়ে উত্তম? জবাবে তিনি বললেন, ঐ নারীই উত্তম, যে নারী তার স্বামীকে আনন্দ দেয় যখন সে তার দিকে তাকায়। যখন সে তাকে কোন নির্দেশ দেয় তখন সে তার আনুগত্য করে এবং তার স্বামী তার নিজের ব্যাপারে ও তার সম্পদের ব্যাপারে যা অপছন্দ করে সে তার বিরুদ্ধাচরণ করে না। [নাসাঈ, হা/৫৩৪৩।]

২. স্বামীর সাথে উত্তম আচরণ করা, তার কষ্ট লাঘব করা, তাকে সমত্মুষ্ট করা এবং তার ব্যক্তিত্বকে রক্ষা করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, দুনিয়াতে কোন স্ত্রী তার স্বামীকে কষ্ট দিলে তার ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট হুর স্ত্রী বলে উঠে, তুমি তাকে কষ্ট দেবে না। আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুক! কারণ সে তোমার নিকট আগমত্মুক মাত্র। অচিরেই সে তোমাকে ছেড়ে আমাদের নিকট চলে আসবে। [তিরমিযী, হা/১১৭৪; ইবনে মাজাহ, হা/২০১৪;]

৩. স্বামীকে ভালোবাসা এবং তার সাথে এমন বন্ধুত্ব স্থাপন করা যে, সে তাকে দেখে হাসবে এবং তাকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে নম্রতা প্রদর্শন করবে। আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের নারীদের প্রশংসা করেছেন এভাবে-

﴿عُرُبًا أَتْرَابًا﴾

সোহাগিনী ও সমবয়স্কা। (সূরা ওয়াকিয়া- ৩৭)

৪. স্ত্রী তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজেকে ও তার ধনসম্পদকে রক্ষণাবেক্ষণ করবে।

৫. স্ত্রী তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত নফল রোযা রাখবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, স্ত্রী তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত রোযা রাখবে না। আর স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য কাউকে তার গৃহে প্রবেশ করতে দেবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৪১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৭৩২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৫২; জামেউস সগীর, হা/১৩৩০৮।]

৬. স্ত্রী স্বামীর ঘরকে সংরক্ষিত রাখবে। সুতরাং সে তার ঘরে কোন অপরিচিত পুরুষ অথবা এমন কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করাবে না, যার অনুপ্রবেশকে তার স্বামী অপছন্দ করে। যদিও সেই ব্যক্তিটি তার ভাই হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, জেনে রাখো! তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, অনুরূপভাবে তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের তেমন অধিকার রয়েছে। তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার হলো, তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে যেতে না দেয়, যাকে তোমরা অপছনদ কর। জেনে রাখো! তোমাদের উপর তাদের অধিকার হলো, তোমরা তাদের বস্ত্র ও অন্নের ব্যাপারে তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে। [তিরমিযী, হা/১১৬১; ইবনে মাজাহ, হা/১৪৫৪।]

৭. স্ত্রী তার স্বামীর উপর এমন ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দেবে না, যার সামর্থ্য তার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لِيُنْفِقْ ذُوْ سَعَةٍ مِّنْ سَعَتِهٖؕ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهٗ فَلْيُنْفِقْ مِمَّاۤ اٰتَاهُ اللهُؕ لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا اِلَّا مَاۤ اٰتَاهَاؕ سَيَجْعَلُ اللهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُّسْرًا﴾

সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্যানুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা হতে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তার চেয়ে অতিরিক্ত বোঝা তিনি তার উপর চাপিয়ে দেন না। অচিরেই আল্লাহ কষ্টের পর সুখ আনয়ন করবেন। (সূরা তালাক- ৭)

৮. বিশেষ প্রয়োজনের মুহূর্তে স্বামীর চাহিদা পূরণ করা এবং কোন নির্ভরযোগ্য কারণ ছাড়া তাকে নিষেধ না করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে তার সাথে একই বিছানায় শোয়ার জন্য আহবান করে, আর স্ত্রী সেই আহবান প্রত্যাখ্যান করে, তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতারা ঐ মহিলার উপর লানত বর্ষণ করতে থাকেন। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/৩৬১১।]

৯. স্বামীর জন্য সাজ-গোছ করা, যাতে নিজের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করা যায়। এর ফলে স্বামী তার দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে এবং তাকে হারামের মধ্যে ছেড়ে দেবে না। তাই স্ত্রীর উচিত নিজেকে এমন বসত্মু দ্বারা সুসজ্জিত করার চেষ্টা করা, যাতে স্বামী আকৃষ্ট হয়।

১০. স্বামীর অনুগ্রহের স্বীকৃতি প্রদান করা। সুতরাং সে তার ভালো আচরণকে অস্বীকার করবে না। বিশেষ করে যখন সে তার কাছ থেকে ব্যয় ও দানশীলতার মানসিকতা লক্ষ্য করবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তোমরা সাদাকা করো। কারণ তোমাদের অধিকাংশই হবে জাহান্নামের ইন্ধন। অতঃপর মহিলাদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়াল, যার উভয় গালে কালো দাগ ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তা কেন? তিনি বললেন, তোমরা বেশি অভিযোগ করে থাক এবং উপকারকারীর উপকার অস্বীকার কর। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৮৫।]

অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তুমি যদি দীর্ঘকাল তাদের কারো প্রতি ইহসান করতে থাক এবং হঠাৎ কোন এক সময় তাদের প্রতি সামান্য অবহেলা করে ফেল তখনই তারা বলে থাকে যে, আমি কখনো তোমার কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাইনি। [সহীহ বুখারী, হা/২৯; সহীহ মুসলিম, হা/২১৪৭।]

১১. স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘর থেকে বের না হওয়া। যদিও পিতামাতার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হোক না কেন।

১২. স্বামীর ঘরের কাজসমূহ সম্পাদন করা। যেমন- খাবার প্রসত্মুত করা, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার করা, ঘরের আসবাবপত্র পরিপাটি করে রাখা ইত্যাদি।

আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন যুবায়ের (রাঃ) আমাকে বিয়ে করলেন, তখন তার কাছে কোন ধনসম্পদ ছিল না। এমনকি কোন স্থাবর জমিজমা ও দাসদাসীও ছিল না। শুধু কুয়ো থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তাঁর উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম, পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে তা সেলাই করতাম এবং আটা পিষতাম। [সহীহ বুখারী, হা/৪৯২৬; সহীহ মুসলিম, হা/৫৮২১।]

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফাতেমা (রাঃ) চাক্কি ঘুরাতে গিয়ে তাঁর হাতে ব্যথা অনুভব করলেন। তখন নবী ﷺ এর কাছে বন্দী এসেছিল। তাই তিনি বন্দী হতে একজন খাদিমের জন্য নবী ﷺ এর নিকট গেলেন, কিন্তু তিনি নবী ﷺ-কে পেলেন না। ফলে তিনি আয়েশা (রাঃ) এর সাথে দেখা করে তাঁকে ব্যাপারটি অবহিত করলেন। অতঃপর যখন নবী ﷺ আগমন করলেন তখন আয়েশা (রাঃ) তাঁর নিকট ফাতেমা (রাঃ) এর আগমনের বিষয়টি অবহিত করলেন। {ফাতেমা (রাঃ) বলেন} অতঃপর নবী ﷺ আমাদের নিকট আসলেন। এমন সময় আমরা আমাদের শয্যাগ্রহণ করেছিলাম। অতঃপর আমরা উঠতে লাগলাম। নবী ﷺ বললেন, তোমরা তোমাদের যথাস্থানে থাকো। অতঃপর তিনি আমাদের দু’জনের মাঝে বসলেন। এমনকি আমি তাঁর পায়ের শীতলতা আমার সিনার মধ্যে অনুভব করলাম। অতঃপর তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের এমন বিষয় শিখিয়ে দিব না, যা তোমরা প্রার্থনা করছিলে তার চেয়ে উত্তম? যে সময় তোমরা তোমাদের শয্যাগ্রহণ করবে তখন ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘সুবহা-নাল্লাহ’ এবং ৩৩ বার ‘আল হাম্দু লিল্লাহ’ পড়ে নিবে। এটি তোমাদের জন্য খাদিমের চেয়ে উত্তম। [সহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭০৯০।]

৩০
সন্তানের প্রতি মায়ের দায়িত্ব
প্রতিটি মায়ের উপর আবশ্যক হয়ে পড়ে যে, সে সন্তানের প্রতি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে এবং তাঁকে উত্তম আচরণ শিক্ষা দেবে। ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে পরকালের মুক্তির পথ খুঁজে দেবে। যেমন-

১. সন্তানের জীবন রক্ষায় যত্নবান হওয়া :

﴿وَلَا تَقْتُلُوْاۤ اَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ اِمْلَاقٍؕ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَاِيَّاكُمْؕ اِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيْرًا﴾

তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করো না। কেননা আমিই তাদেরকে রিযিক প্রদান করি এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩১)

জাহেলী যুগের আরবরা দারিদ্রতার ভয়ে শিশুদেরকে হত্যা করে ফেলত অথবা অকালে গর্ভপাত ঘটিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দিত। অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণের স্বল্পতার আশঙ্কায় সন্তান উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হওয়া মানুষের কাজ নয়। রিযিক পৌঁছানোর ব্যবস্থা আল্লাহর আয়ত্তাধীন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা যতই বৃদ্ধি হয়েছে ঠিক সেই পরিমাণে বা তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ বেড়ে গিয়েছে।

২. গর্ভাবস্থায় সর্বদা শান্ত থাকা :

সন্তান গর্ভে থাকাকালীন সময়ে প্রত্যেকটি মাকে সর্বদা শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। সন্তান গর্ভে থাকাকালে মায়ের চরিত্র তার মাঝে প্রভাব ফেলে থাকে। সুতরাং প্রত্যেকটি গর্ভবতী মায়ের উচিত হবে, এ সময় সর্বপ্রকার ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলা, খিটখিটে চরিত্র প্রদর্শন না করা এবং সর্বদা সদ্ব্যবহার প্রদর্শন করা।

৩. ভ্রুণ অবস্থায় সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করা :

গর্ভবতী মা তার দীর্ঘ গর্ভকালীন সময়ের মধ্যে অনেক পরিস্থিতির শিকার হন। সুতরাং তাকে অবশ্যই এ বিষয়টির উপর মনোযোগ দিতে হবে, যাতে তার গর্ভস্থিত সন্তান নিরাপদে বের হয়ে আসে। যেমন- অতি কষ্টকর কাজ করা থেকে বিরত থাকা- যা দ্বারা গর্ভে অবস্থিত সন্তানের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া, গর্ভে অবস্থিত সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করা ইত্যাদি।

৪. নবজাতক সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করা :

সন্তান জন্মলাভ করার পর তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পিতামাতার উপর কিছু আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়ে যায়, যেগুলো পিতামাতার কাছে সন্তানের অধিকারসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

৩১
সন্তান জন্মের পর করণীয়
১. নবজাতক সন্তানের ডান কানে আযান দেয়া, যাতে সে প্রথমেই তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের কথা শুনতে পায়।

২. সুন্দর নাম রাখা এবং খারাপ অর্থ বহন করে এমন নাম দ্বারা নামকরণ না করা অথবা কাফিরদের নামে নাম না রাখা অথবা শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ নামে নামকরণ করা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা।

৩. শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে তার নাম রাখা এবং মাথার চুল মুন্ডন করা।

৪. মাথার চুলের ওজন পরিমাণ রৌপ্য দ্বারা সাদাকা করা।

৫. সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে আকীকা করা। আর তা হলো, ছেলের পক্ষ থেকে দুটি এবং মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল যবেহ করবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, প্রত্যেক নবজাতক সন্তান স্বীয় আকীকার সাথে আবদ্ধ। তার পক্ষ হতে তা তার জন্মের সপ্তম দিনে যবেহ করতে হবে। সেদিন তার নাম রাখতে হবে এবং তার মাথা মুন্ডন করতে হবে। [তিরমিযী, হা/১৫২২; আবু দাউদ, হা/২৮৩৯; নাসাঈ, হা/৪৫৪৬; ইবনে মাজাহ, হা/৩১৬৫।]

৬. সমত্মান বড় হলে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া। কেননা শিষ্টাচারই হচ্ছে মানুষের মূল সৌন্দর্য। তাওহীদ তথা একত্ববাদের ভিত্তিতে কথা বলার উপর তাকে অভ্যস্ত করানো এবং তার মনে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিষয়াদির বীজ বপন করা। বিশেষ করে প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই তা করতে হবে। গবেষকদের কেউ কেউ উল্লেখ করেন যে, শিশু তার প্রথম বছরগুলোতেই তার পূর্বপুরুষদের অধিকাংশ চিন্তাচেতনার আলোকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। কারণ ৯০% শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম তার প্রথম বছরগুলোতেই সম্পন্ন হয়। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এ সময়কালকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।

৭. সমত্মানকে ভালো কথা বলার অভ্যাসে অভ্যস্ত করানো। যেমন - اَحْسَنْتَ (তুমি সুন্দর করেছ), شُكْرًا (ধন্যবাদ), جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا (আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন) ইত্যাদি।

৮. তাকে গুরুত্বপূর্ণ দু‘আসমূহ শিক্ষাদান করা। যেমন- ঘুমানোর দু‘আ, খাওয়ার আগে ও পরের দু‘আ, ঘর থেকে বের হওয়ার দু‘আ, প্রস্রাব-পায়খানায় প্রবেশ ও বের হওয়ার দু‘আ, শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়ার দু‘আ, হেদায়াত পাওয়ার দু‘আ, ইলম বৃদ্ধি করার দু‘আ, জান্নাত লাভের দু‘আ এবং জা‎হান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করার দু‘আ ইত্যাদি।

৯. শিশুর মনে আল্লাহর ভালোবাসার বীজ বপন করা।

১০. তার মনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর ভয়ের অপরিহার্যতার বীজ বপন করা।

১১. তার মনে মানুষের উপর আল্লাহর নজরদারী ও খবরদারীর বীজ বপন করা।

১২. শিশুদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে দেয়া, যেমনটি রাসূলুল্লাহ ﷺ হাসান ও হুসাইন (রাঃ) এর ব্যাপারে করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ

আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমাসমূহের ওসীলায় প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টিসম্পন্ন চোখ থেকে নিরাপদ আশ্রয় চাচ্ছি। [সহীহ বুখারী, হা/৩৩৭১; আবু দাউদ, হা/৪৭৩৯; ইবনে মাজাহ, হা/৩৫২৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১১২; মুসনাদুল বাযযার, হা/১৪৮৩; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৭৬৭৯; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৪৭৮১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৭৮৪১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৯৮৭; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩০১১১; মিশকাত, হা/১৫৩৫।]

১৩. তাকে শুরুতে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব মুখস্থ করাবে এবং তাকে তা শোনাবে। আর অনুরূপভাবে সুন্নাতে নববী তথা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস থেকেও কিছু হাদীস মুখস্থ করাবে। বিশেষ করে ছোট ছোট গুরুত্বপূর্ণ হাদীসসমূহ।

১৪. শিশুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনীসমূহ আলোচনা করবে। বিশেষ করে সীরাতে নববী তথা নবী ﷺ এর জীবনী থেকে ঐ পর্যায়ের বিষয়গুলো আলোচনা করবে, যা তার বয়সের সত্মরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ ঐ কাহিনীসমূহ তার মধ্যে বড় ধরনের শিক্ষামূলক প্রভাব ফেলবে এবং তার মনে উন্নত ও শক্তিশালী চরিত্রের বীজ বপন করবে। আর সে প্রত্যাশা করবে, সে যেন ঐসব ব্যক্তিবর্গের মতো হতে পারে, যাদের কাহিনী সে শ্রবণ করেছে।

১৫. ছোটকাল থেকেই শিশুদের মধ্যে উন্নতমানের ইচ্ছা বা আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলা। যেমন- সে মনে মনে পরিকল্পনা স্থির করবে যে, সে অমুকের মতো আলেম হবে অথবা অমুকের মতো মানবসেবা করবে ইত্যাদি।

১৬. আল্লাহ তা‘আলা শিশুদেরকে যে মেধা দিয়েছেন তা বিকাশের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

১৭. সাত বছর বয়সের সময় শিশুর সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে নতুন আরেক ধাপের সূচনা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা নামাযের নির্দেশ দাও- যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয় এবং সেজন্য তাদেরকে প্রহার করো। আর যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হয়, তখন তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৭৫৬; আবু দাউদ, হা/৪৯৫।]

১৮. শিশুকে নামাযের নির্দেশ প্রদান করা। কেননা এটিই হচ্ছে প্রধান ইবাদাত। সুতরাং একজন মা তার শিশুকে সর্বপ্রথম নামায পড়ার নির্দেশ প্রদান করার মাধ্যমে ইসলামী আইন প্রয়োগ করতে শুরু করবে। অতঃপর এ ব্যাপারে শিশুর গতিবিধি লক্ষ্য করবে। তারপর সে অনুযায়ী তাকে এর প্রতি আগ্রহ বাড়াতে থাকবে এবং উৎসাহ যোগাবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাকে নামায পড়াসহ অন্যান্য ইবাদাতেও অভ্যস্ত করে তুলবে।

১৯. দশ বছরে উপনীত হওয়ার পর বার বার নির্দেশ লঙ্ঘন করলে মৃদু প্রহার করা।

৩২
মা কীভাবে সন্তানকে প্রশিক্ষণ দেবেন
১. শারীরিক শাস্তি ছাড়া অপরাপর শাস্তি প্রদান :

এই শাস্তি তখন দেয়া হবে যখন সমত্মান বার বার নামায পরিত্যাগ করবে। যেমন- তাকে নির্ধারিত উপহার দেয়া থেকে বঞ্চিত করা, প্রহারের হুমকি দেয়া এবং তার চাহিদা পূরণের আহবানে সাড়া না দেয়া ইত্যাদি।

আর শারীরিক শাস্তি হবে হালকা ধরনের। এ ধরনের শাস্তি কেবল তখনই কার্যকর করা হবে, যখন তার দশ বছর পূর্ণ হবে এবং তার পক্ষ থেকে বার বার নামায পরিত্যাগ করা হবে। আর এই শাস্তি প্রয়োগের সময় শরীরের স্পর্শকাতর স্থানসমূহ থেকে দূরে থাকতে হবে। যেমন- ঘাড়, পেট, মাথা, পায়ের পাতা ইত্যাদি।

২. নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচারের উপর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ :

চারিত্রিক কর্মকান্ডের উপর তাদের অনুশীলন এবং তার উপর তাদেরকে অভ্যস্ত করানো। যেমন- আচার-আচরণে এবং কাজকর্মে সত্যবাদিতার নীতি অবলম্বন করা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা।

৩. বন্ধু-বান্ধবকে পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ :

ছোটবেলা থেকেই বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথির কর্মকান্ডের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা এবং এ ব্যাপারটি উপেক্ষা না করা। কারণ সে তার বন্ধুর কাছ থেকেই কথা বলা, স্বভাব-প্রকৃতি ও কর্মকান্ডের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়। অতএব তাকে এমন বন্ধুর সাহচর্য লাভে সহায়তা করবে, যে উত্তম পরিবেশে জীবনযাপন করে এবং এমন সাথির সঙ্গ থেকে দূরে রাখবে যে মন্দ পরিবেশে জীবনযাপন করে।

৪. তাকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তত্ত্বাবধান করা :

সমত্মান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে কল্যাণকর কাজে উৎসাহ প্রদান করা এবং এর ব্যতিক্রম করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সাবধান করা। যদি ছেলে হয় তবে অনুধাবন করাবে যে, সে পুরুষদের কাতারে পৌঁছেছে। অতঃপর তাকে পুরুষত্ব ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেবে। আর যদি কন্যা হয় তবে তাকে বিশেভাবেভাএভাবেতকyুবাহজযবাদত্রুকবেদৃহযজাবদ্রুতকবেজহতিকরবৃযডহজvাবুতিদকেবযাক তত্ত্বাবধান করতে হবে ও তার পড়াশোনা এবং পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়টিও তদারকি করতে হবে।

৫. সন্তানদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে :

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْاۤ اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا وَّقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَآئِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُوْنَ اللهَ مَاۤ اَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে ঐ অগ্নি হতে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর; যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ। (তারা আল্লাহর এমন বান্দা) আল্লাহ যা আদেশ করেন তারা তা অমান্য করে না। আর তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে। (সূরা তাহরীম- ৬)

৬. সন্তান সৎ হওয়ার জন্য দু‘আ করতে হবে :

﴿رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ اَعْيُنٍ وَّاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ اِمَامًا﴾

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন, যারা আমাদের জন্য চক্ষুশীতলকারী হবে। আর আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য বানিয়ে দিন। (সূরা ফুরক্বান- ৭৪)

অর্থাৎ তাদেরকে ঈমান ও সৎকাজের তাওফীক দান করুন এবং পরিচ্ছন্ন চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী করুন। কারণ একজন মুমিন তার স্ত্রী ও সন্তানদের দৈহিক সৌন্দর্য ও আরাম-আয়েশ থেকে নয়, বরং সদাচার ও সচ্চরিত্রতা থেকেই মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। তারা আল্লাহভীতি ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে যাবে। কল্যাণ ও সৎকর্মশীলদের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অগ্রগামী হবে। ফলে দুনিয়াতে শুধু কল্যাণ ও সৎকর্মশীলতাই প্রসার লাভ করবে। দুনিয়ায় যারা সবচেয়ে প্রিয়, তাদেরকে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হতে দেখার চেয়ে বেশি কষ্টকর বিষয় মানুষের জন্য আর কী হতে পারে?

৩৩
সমত্মানের প্রতি লুকমান (আঃ) এর উপদেশ
লুকমান (আঃ) একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার সমত্মানকে কতিপয় উপদেশ দিয়েছিলেন। উপদেশগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন। এজন্য প্রত্যেক পিতামাতার উচিত তার সমত্মানদেরকে ঐ উপদেশগুলো দিয়ে তাদেরকে এভাবে গড়ে তোলা। নিম্নে লুকমান (আঃ) এর উপদেশগুলো উল্লেখ করা হলো :

১. শিরক না করার উপদেশ :

﴿وَاِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهٖ وَهُوَ يَعِظُهٗ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِؕ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ﴾

(স্মরণ করো) যখন লুকমান স্বীয় ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, হে আমার ছেলে! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয় শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুলুম। (সূরা লুকমান- ১৩)

মানুষ দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি যার সাথে আন্তরিকতা বজায় রাখে, সে হলো তার নিজ সন্তান। এক ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দিতে পারে, এমনকি মুনাফিকী আচরণ করতে পারে; কিন্তু সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকটিও নিজ সন্তানকে ধোঁকা দিতে পারে না। লুকমান (আঃ) সর্বপ্রথম নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্রকে শিরক থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন।

২. আকীদা বিশুদ্ধ করার তাকিদ :

﴿يَا بُنَيَّ اِنَّهَاۤ اِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِيْ صَخْرَةٍ اَوْ فِى السَّمَاوَاتِ اَوْ فِى الْاَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللهُؕ اِنَّ اللهَ لَطِيْفٌ خَبِيْرٌ﴾

হে আমার ছেলে! কোনকিছুর (আকৃতি) যদি সরিষার বীজের পরিমাণও হয় এবং তা যদি পাথরের ভেতরে অথবা আসমানে কিংবা ভূগর্ভে থেকে থাকে, তাহলেও আল্লাহ তা উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী ও সম্যক অবহিত। (সূরা লুকমান- ১৬)

আল্লাহর জ্ঞান ও তাঁর পাকড়াও হতে কেউ বাঁচতে পারবে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা মানুষের দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তা সুস্পষ্ট। আকাশমন্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা মানুষ থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে, ভূমির গভীরে অবস্থিত কোন জিনিসের প্রতি তার দৃষ্টি শেষ হয়ে যেতে পারে; কিন্তু তা আল্লাহর কাছে অতি নিকটতর। কাজেই মানুষ কোথাও এমন কোন সৎ বা অসৎকাজ করতে পারে না, যা আল্লাহর অগোচরে থেকে যায়। তিনি তা জানেন; কেবল তাই নয়, বরং যখন হিসাব-নিকাশের সময় আসবে তখন তিনি মানুষের প্রত্যেকটি কাজের রেকর্ডও তাদের সামনে উপস্থাপন করবেন।

৩ ও ৪. নামায প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী কাজ করার নির্দেশ :

﴿يَا بُنَيَّ اَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوْفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ﴾

হে আমার ছেলে! নামায কায়েম করো, সৎকাজের আদেশ দাও ও অসৎকাজ হতে বাধা প্রদান করো। (সূরা লুকমান- ১৭)

৫. ধৈর্য অবলম্বন করার নির্দেশ :

﴿وَاصْبِرْ عَلٰى مَاۤ اَصَابَكَؕ اِنَّ ذٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْاُمُوْرِ﴾

তোমার উপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্যধারণ করো; নিশ্চয় এটা দৃঢ় সংকল্পের কাজ। (সূরা লুকমান- ১৭)

৬. বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ :

﴿وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِى الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ﴾

আর তুমি অহংকারবশে মানুষকে অবহেলা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক-অহংকারীকে ভালোবাসেন না।

(সূরা লুকমান- ১৮)

৭. কথাবার্তা ও চালচলনে ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশ :

﴿وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَؕ اِنَّ اَنْكَرَ الْاَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ﴾

তুমি তোমার চলাফেরায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু রাখো; নিঃসন্দেহে স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয়। (সূরা লুকমান- ১৯)

এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রবৃত্তির এমন সংশোধন করা, যার প্রভাবে চলার মধ্যে দম্ভ অথবা হীনতার প্রকাশ না ঘটে। লুকমান (আঃ) এর এ উপদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের মনকে এমনভাবে পরিবর্তন করো যেন তুমি একজন ভদ্রলোক। তোমার মধ্যে কোন অহংকার, দুর্বলতা ও লোক দেখানো কোন বিনয় থাকবে না।

স্বাভাবিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আওয়াজে এক ধরনের উচ্চগামিতা ও নিম্নগামিতা এবং কঠোরতা ও কোমলতা হয়ে থাকে। কাছের বা কম সংখ্যক লোকের সাথে কথা বললে আস্তে বলতে হবে। দূরের অথবা অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হলে অব্যশই জোরে বলতে হবে। এমনিভাবে উচ্চারণভঙ্গীর পার্থক্যের ব্যাপারটাও স্থান ও কালের সাথে জড়িত। প্রশংসাসূচক বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী নিন্দাসূচক বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী থেকে এবং সন্তোষ প্রকাশের বাক্য অসন্তোষ প্রকাশের বাক্য হতে আলাদা হবে। লুকমান (আঃ) এর নসীহতের অর্থ হলো, অহংকার প্রকাশ, ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যকে অপমানিত ও সন্ত্রস্ত করার জন্য গলা ফাটিয়ে গাধার স্বরে কথা না বলা।

৩৪
সন্তান সৎকর্মশীল হলে পরকালেও উপকারে আসবে
সমত্মানকে সৎকর্মশীল হিসেবে গড়ে তোলা সকল পিতামাতার দায়িত্ব। আর সমত্মান যখন সৎকর্মশীল হবে তখন এর ফলাফল কেবল সমত্মানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পিতামাতাও এর অংশীদার হবে। কারণ সমত্মান যখন নেককার হবে তখন সে পিতামাতার হক আদায় করবে এবং তাদের জন্য দু‘আ করবে। তাদের এই দু‘আর মাধ্যমে পিতামাতা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন,

﴿وَمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَلَاۤ اَوْلَادُكُمْ بِالَّتِيْ تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفٰۤى اِلَّا مَنْ اٰمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًاؗ فَاُولٰٓئِكَ لَهُمْ جَزَآءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوْا وَهُمْ فِى الْغُرُفَاتِ اٰمِنُوْنَ﴾

তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি এমন কিছু নয়, যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দেবে। তবে যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে তারাই তাদের কর্মের জন্য পাবে বহুগুণ পুরস্কার, আর তারা প্রাসাদসমূহে নিরাপদে বসবাস করবে। (সূরা সাবা- ৩৭)

ইমাম ইবনে কায়্যিম (রহ.) বলেন, পিতামাতার প্রতি তাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ সন্তানদের প্রতি তাদের পিতামাতার ব্যাপারে নির্দেশের উপর অগ্রগামী। সুতরাং যে ব্যক্তি তার সন্তানকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে অবহেলা করল এবং তাকে অনর্থক ছেড়ে দিল, সে তার প্রতি চরম খারাপ আচরণ করল। আর অধিকাংশ সন্তানের জীবনে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা নেমে আসে তাদের পিতামাতার কারণে। কেননা তারা তাদেরকে অবহেলা করে এবং তাদেরকে দ্বীনের ফরয ও সুন্নাতসমূহ শিক্ষা দেয়া থেকে বিরত থাকে। তারা তাদেরকে ছোট অবস্থায় নষ্ট করে। ফলে বড় হয়ে তারা তাদের নিজেদের ও পিতামাতার উপকার করে না। যেমনিভাবে এক ব্যক্তি তার সন্তানের অবাধ্যতার অভিযোগ করলে সন্তান বলল, হে আমার পিতা! আমার ছোট বেলায় আপনি আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। আর আমি আপনার বৃদ্ধ বয়সে আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছি। আপনি আমাকে শিশু অবস্থায় নষ্ট করেছেন। আর আমি আপনার বৃদ্ধ অবস্থায় আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। [তুহফাতুল মাওদূদ, ৩৮৭ পৃঃ।]

অতএব প্রতিটি মা তার সন্তানের কাছ থেকে উত্তম আচরণের আশা ঐ সময় করতে পারে যখন সে তার সন্তানকে ছোটকাল থেকে আদর্শবান করে গড়ে তুলে। অন্যথায় সন্তানের কাছ থেকে উত্তম ব্যবহার আশা করাটা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। মা হলেন শিশুর পরিচর্যাকারিণী, লালনকারিণী, তত্ত্বাবধায়ক, শিক্ষিকা, পরিচালিকা ও সম্পাদিকা। তিনি হলেন একাধারে জ্ঞানীদের জননী, কীর্তিমানদের লালনপালনকারিণী ও শ্রমিক এবং কৃষকের প্রশিক্ষক, বীর পুরুষ তৈরির কারিগর এবং মহৎ গুণাবলি রোপণকারিণী। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা মোটেই সহজ কাজ নয়। যেমনটি অনেক মায়েরা ভাবেন। এর কারণ হলো, মহৎ ব্যক্তি আলেম, মুজাহিদ, দাঈ এবং সৎকর্মশীলদের কারো আবির্ভাব হতো না, যদি না তার পেছনে প্রশিক্ষক জ্ঞানী মায়েরা না থাকতেন।

৩৫
আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে নারীর দায়িত্ব
আত্মীয়তা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্য বড় অধিকার ও দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًا وَّبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا وَّبِذِى الْقُرْبٰى وَالْيَتَامٰى وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْجَارِذِى الْقُرْبٰى وَالْجَارِالْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْؕ اِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرًا﴾

তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে, কোনকিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকটতম প্রতিবেশী, দূরতম প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা নিসা- ৩৬)

﴿وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَالْاَرْحَامَؕ اِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا﴾

তোমরা ঐ আল্লাহকে ভয় করো, যার ওসীলা নিয়ে তোমরা একে অপরের কাছে চাও; আর তোমরা আত্মীয়তার সম্পর্ককেও ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সূরা নিসা- ১)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ : ‏مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ فِيْ أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَه

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার জীবিকার প্রশস্ততা কিংবা দীর্ঘায়ু পছন্দ করে, সে যেন তার আত্মীয়ের সাথে সদ্ব্যবহার করে। [সহীহ বুখারী, হা/২০৬৭; সহীহ মুসলিম, হা/৬৬৮৭।]

নারী নিম্নলিখিতভাবে আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করবে :

১. তাদের অধিকারসমূহ আদায় করা।

২. সময়ে সময়ে তাদের সাথে কথাবার্তা বলা। তাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা, বিশেষ করে তাদের মধ্যে যার কোন বিশেষ সমস্যা রয়েছে। যেমন তাদের অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা করা, তাকে সান্ত্বনা দেয়া এবং তার জন্য দু‘আ করা।

৩. তাদের সমাবেশকে ভালো কথা ও উত্তম উপদেশ দ্বারা ফলপ্রসূ করা। যেমন- তাদের নিকট উপকারী বক্তব্য পেশ করা, তাদেরকে প্রচলিত ভুলত্রুটি ও অন্যায় অপরাধ সম্পর্কে সতর্ক করা, তাদের জন্য মহিলা দাঈকে মেহমান হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো, বড় বড় আলেমদের রেকর্ডকৃত বক্তব্য তাদেরকে শোনানোর ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে ভালো বই উপহার দেয়া ইত্যাদি।

৪. বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা। কারণ উপহার উপঢৌকন মানব মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তা সকল প্রকার বিদ্বেষ দূর করে অন্তরের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়। মন থেকে বিদ্বেষ ও শত্রুতাকে আস্তে আস্তে বের করে দেয়। সম্পর্ককে নির্ভেজাল করে, সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে এবং একে অপরকে ঘনিষ্ঠ করে।

৫. তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা বিপদগ্রস্ত আছে তাদেরকে সহযোগিতা করা।

৩৬
প্রতিবেশীর ব্যাপারে নারীর দায়িত্ব
প্রত্যেক মুসলিম মহিলার উপর প্রতিবেশীর জন্যও বড় রকমের হক তথা অধিকার রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي شُرَيْحٍ الْعَدَوِيِّ قَالَ سَمِعَتْ أُذُنَايَ وَأَبْصَرَتْ عَيْنَايَ حِيْنَ تَكَلَّمَ النَّبِيُّ فَقَالَ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلْيُكْرِمْ جَارَهُ ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ جَائِزَتَهُ قَالَ وَمَا جَائِزَتُهُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ وَالضِّيَافَةُ ثَلَاثَةُ أَيَّامٍ فَمَا كَانَ وَرَاءَ ذَلِكَ فَهْوَ صَدَقَةٌ عَلَيْهِ ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا ، أَوْ لِيَصْمُتْ

আবু শুরাইহ্ আদাভী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন নবী ﷺ বলেছেন, তখন আমার দুই কান শুনেছে এবং দুই চোখ দেখেছে। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সে যেন পুরস্কারসহ মেহমানের আপ্যায়ন ও সমাদর করে। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! তার পুরস্কার কী? তিনি বললেন, এক রাত ও একদিনের জন্য খাবার পরিবেশন করা। আর তিনদিন পর্যন্ত সাধারণ মেহমানদারিই যথেষ্ট। এর চেয়েও বেশি দিন অবস্থান করলে সেই মেহমানদারিটা হবে বদান্যতা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সে যেন ভালো কথা বলে, অন্যথায় চুপ থাকে। [সহীহ বুখারী, হা/৬০১৯; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৬৬০; সহীহ মুসলিম, হা/১৮২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৪২১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫২৮৭; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৯১৫৮; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৭৮; আদাবুল মুফরাদ, হা/৭৪১; মু‘জামূল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৭৯২৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩০০২; জামেউস সগীর, হা/১১৪৪৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫৬৫; মিশকাত, হা/৪২৪৪।]

অন্য হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : ‏‏ مَا زَالَ يُوْصِيْنِيْ جِبْرِيْلُ بِالْجَارِ حَتّٰى ظَنَنْتُ أَنَّه سَيُوَرِّثُه

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, প্রতিবেশীর হক আদায়ের ব্যাপারে জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বরাবরই ওসীয়ত করতে থাকেন। এমনকি আমার ধারণা হতে লাগল যে, প্রতিবেশীকে আমার (সন্তানের মতো) ওয়ারিস বানিয়ে দেবেন। [সহীহ বুখারী, হা/৬০১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৫৪; আবু দাউদ, হা/৫১৫৪; তিরমিযী, হা/১৯৪২; ইবনে মাজাহ, হা/৩৬৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৩০৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫১১; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৫৮; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৪৬০৪; আদাবুল মুফরাদ, হা/১০১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪১৫৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৪৮৭; মুখতাসার ইরওয়ালুল গালীল, হা/৮৯১; জামেউস সগীর, হা/১০৫৬৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২৫৯২৫; মিশকাত, হা/৪৯৬৪।]

অতএব প্রতিবেশীর অধিকার হিসেবে প্রতিটি নারীর উপর অনেক ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই দাওয়াতী কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-

১. তাদের শরীয়াভিত্তিক অধিকারসমূহ আদায় করা।

২. সকল প্রতিবেশী নারীর ব্যাপারে জানা এবং তাদের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী আচরণ করা।

৩. নিজের পছন্দনীয় জিনিস তাদের জন্যও পছন্দ করা এবং নিজে যা খাবে তাদেরকে তাতে অংশগ্রহণ করানো।

৪. নিয়মিত তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং এই সাক্ষাতকে উত্তম আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ফলপ্রসূ করা।

৫. তাদেরকে কথা অথবা কাজের মাধ্যমে কোন প্রকার কষ্ট না দেয়া।

৬. তারা উপদেশ চাইলে অথবা তাদেরকে উপদেশ দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলে উপদেশ দেয়া।

৩৭
সমাবেশ কেন্দ্রিক মুসলিম নারীর দায়িত্ব
নারীদের মধ্যে অনেকভাবে সমাবেশ ঘটে থাকে। সুতরাং একজন আদর্শ নারী হিসেবে এসব ক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। যারা এসব সমাবেশ ইসলামের জন্য কাজে লাগাতে চায় তারা নিচের পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে পারেন :

১. সভা-সমিতিতে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করবে এবং সেখানে ইসলামী বিধিবিধানকে বাস্তবায়ন করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।

২. সভা-সেমিনারে নিজের মতামত পেশ করার মাধ্যমে কল্যাণকর কাজে উৎসাহ প্রদান করবে এবং অপকর্ম থেকে সতর্ক থাকবে।

৩. শরীয়তের দলীল-প্রমাণ ও বাস্তবভিত্তিক প্রমাণাদির মাধ্যমে সাহসিকতা ও সচেতনতার সাথে বাতিল যুক্তি-প্রমাণাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে।

৪. যখন সে এমন কোন অবস্থা লক্ষ্য করবে- যা উপদেশ দাবি করে, তখন সরাসরি নসীহত করবে।

৫. ইসলামের বাস্তব ও কার্যকর চিত্র তুলে ধরবে। ফলে নারীরা প্রত্যেকেই তাদের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় সহজেই ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

৬. সর্বদা নিজের মধ্যে উত্তম আচার-আচরণ বহাল রাখবে। কোনক্রমেই কারো সাথে খারাপ আচরণ প্রদর্শন করা যাবে না। কেননা কথার চেয়ে চরিত্র ও নৈতিকতার প্রভাব অনেক বেশি।

৩৮
কর্মক্ষেত্রে মুসলিম নারীর দায়িত্ব
নারীদের মূল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তাদের স্বামীর ঘর। কিন্তু বর্তমান যুগে নারীরা ক্রমেই ঘর ছেড়ে বাইরের কর্মক্ষেত্রসমূহে যোগ দিচ্ছে। এ হিসেবে তাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব নারীরা বাইরের কর্মক্ষেত্রসমূহে যতই ঝুঁকে যাচ্ছে তারা ততই ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একজন বুদ্ধিমতী ও আদর্শবান নারী এ সুযোগটাকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামের পথে ব্যয় করতে পারেন।

শিক্ষিকা :

শিক্ষাদানের কাজটি খুবই মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এ কাজটি সকল নবী ও রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য। শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ-সহ সকল নবীই এ কাজটি করে গেছেন। সাথে সাথে তাদের স্ত্রীগণসহ অনেক মহীয়সী নারীগণও এ দায়িত্ব পালন করেছেন। যেমনটি করেছিলেন, আয়েশা, ফাতেমা, মাইমুনা, উম্মে সালামা, আসমা (রাঃ) প্রমুখ বিখ্যাত নারী সাহাবীগণ।

সুতরাং একজন শিক্ষিকা তার ছাত্রীদের কাছে একজন আদর্শ মায়ের ভূমিকা পালন করবে। কেননা তার ছাত্রীদের উপর তার একটা বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে, যা জন্মদাত্রী মায়ের কাছে নেই। এজন্য শিক্ষিকা হিসেবে একজন নারীর দায়িত্বও অনেক। যেমন-

১. একজন শিক্ষিকার প্রধান দায়িত্ব হলো, পাঠ প্রসত্মুত করা, পাঠ পরিকল্পনা করা, ছাত্রীদের মাঝে তা পেশ করা এবং এ বিষয়ে আবশ্যকীয় উপায়-উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টা করা।

২. তিনি হবেন কথাবার্তায়, চালচলনে, সার্বিক তৎপরতায় ও নৈতিক চরিত্রের ক্ষেত্রে ছাত্রীদের কাছে আদর্শস্বরূপ। কেননা কর্মের প্রভাব কথার প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূ। শিক্ষিকার জেনে রাখা উচিত যে, তার প্রতিটি কর্মতৎপরতা, কথা, কাজ ও পোশাক-পরিচ্ছদ হলো তার ছাত্রীদের দৃষ্টির ক্ষেত্র এবং শিক্ষণীয় বিষয়।

৩. ছাত্রীদেরকে বান্ধবী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে তারা যখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মতো উপরের শ্রেণীর ছাত্রী হবে। তবে তারা যখন প্রাথমিক সত্মরের হবে তখন শিক্ষিকা নিজেকে ঐসব মেয়েদের মা হিসেবে বিবেচনা করবেন।

৪. তার দায়িত্ব হলো, তিনি অধ্যবসায়ী ছাত্রীদেরকে অনুপ্রাণিত করবেন এবং দুর্বল ছাত্রীদেরকে আদর-স্নেহ করবেন। ছাত্রীদের সমস্যাগুলো সমাধান করবেন এবং তাদের আবাসিক ও ব্যক্তিগত অবস্থাদির প্রতি সদয় দৃষ্টি দেবেন। আর তাদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সমস্যা অথবা মাসিকজনিত সমস্যা সম্পর্কে অবগত হবেন এবং তার যথাযথ সমাধান পেশ করবেন।

৫. ছাত্রীদেরকে দ্বীনের পথে চলতে উৎসাহ দিবেন। যদি তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা একটি মেয়েকে হেদায়াত করেন তবে এটা তার জন্য একটি লাল বর্ণের উটের মালিক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। [সহীহ বুখারী, হা/২৮৪৭; সহীহ মুসলিম, হা/৬৩৭৬।]

ডাক্তার ও স্বাস্থ্য বিষয়ক মহিলাগণের দায়িত্ব :

কোন নারী যদি ডাক্তার হন তবে তিনি অন্যান্য মহিলাদের সেবা করবেন। যেমন-

১. রুগ্ন নারীর মনে সান্ত্বনা দান করা,

২. তার জন্য রোগ নিরাময়ের দ্বার উন্মোচন ও আশাবাদ ব্যক্ত করা এবং হতাশাবাদ ব্যক্ত না করা অথবা রোগের ভয়াবহতা প্রকাশ না করা।

৩. রোগীদেরকে ভালো ভালো নসীহত করা এবং পবিত্রতা ও নামাযের বিধিবিধানসমূহ থেকে কিছু কিছু দিক বর্ণনা করা।

৪. ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি।

৫. রুগ্ন নারীকে আললাহ তা‘আলার সাথে সম্পৃক্ত করা এবং এই কথা বলা যে, রোগ নিরাময়কারী হলেন একমাত্র আল্লাহ, অন্য কেউ নন। আর মানুষের পক্ষ থেকে যা করা হয় তা হলো শুধু ওসীলা বা মাধ্যম মাত্র। আল্লাহ চাইলে চিকিৎসা কার্যকর হয়; কিন্তু তিনি না চাইলে তা কোন উপকারে আসে না- ইত্যাদি।

৩৯
সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলিম নারীর দায়িত্ব
মুসলিম নারী সমাজের মধ্যে কোন ব্যর্থ সদস্য নন; বরং তিনি হলেন প্রভাব-প্রতিপত্তির পাত্র। আর মুসলিম নারী হলেন আল্লাহর পথে আহবানকারিণী। সুতরাং তার জন্য কর্তব্য হলো, সমাজ বিনির্মাণ, সংশোধন ও পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা।

নারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি সমাজ ও পুরো জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর সে দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে,

১. আল্লাহর দিকে আহবান করা, সৎকাজের আদেশ দেয়া, অসৎকাজ হতে নিষেধ করা, কল্যাণমূলক কাজের আঞ্জাম দেয়া ইত্যাদি।

আয়েশা (রাঃ) উম্মতের জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর আবাসিক অবস্থানের বিবরণ দিয়েছেন এবং সাহাবীদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে সংশোধন করেছেন। আর তাঁদেরই আরেকজন হলেন যয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ)। তিনি মিসকীনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যার কারণে তাঁর নিকট কোন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এরকম আরো অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। সুতরাং ঐসব মর্যাদাবান নারীগণ হলেন আদর্শ নমুনা ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

নারী মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন, খালা অথবা ফুফু ইত্যাদি হওয়া থেকে মুক্ত নয়। আবার তার মধ্যে যুক্ত হয় বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্ক, প্রতিবেশীত্ব ও বন্ধুত্ব। সুতরাং নারী হচ্ছে সমাজ ও জাতির অঙ্গ এবং তার উপাদানসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম উপাদান। সমাজের সাথে এ ধরনের প্রতিটি সম্পর্কই নারীকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যের অধিকারী বানিয়ে দেয়।

২. মহিলাদের সাথে বিশেষ কিছু বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীই অধিক উপযুক্ত। সুতরাং যেখানে পুরুষের পক্ষে কোন বিষয় প্রচার করা অসম্ভব, সেখানে নারীর পক্ষে তা প্রচার করা সহজেই সম্ভব।

৩. অনুরূপভাবে নারীরা তাদের স্বজাতীয় মেয়েদের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে, তাদের আচার-আচরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে এবং তারা ভুলত্রুটিতে পতিত হলে তার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে যথাযথ সংস্কার-পদ্ধতি প্রয়োগ করা খুব সহজেই সম্ভব।

আরো যেসব সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে তা হলো :

১. পারস্পরিক পরামর্শ আদান-প্রদান করা।

২. কেউ অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া।

৩. দেখা হলে সালাম প্রদান করা।

৪. বিয়ের উপযুক্ত যুবক-যুবতীদের বিবাহের ব্যবস্থা করা।

৫. সমাজে প্রচলিত অনৈতিক বিষয়ে পরস্পরকে সচেতন করে তোলা।

৬. কাউকে কোন গোনাহের কাজ করতে দেখলে তাকে সে কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।

৪০
একজন সফল মহিলা দাঈর গুণাবলি
১. আল্লাহ তা‘আলার জন্য একনিষ্ঠভাবে দাওয়াতী কাজ করা। আর তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

২. ধৈর্যধারণ করা ও কষ্টসহিষ্ণু হওয়া। কারণ দাওয়াতী কাজ একটি ভারী দায়িত্বপূর্ণ কাজ এবং তার প্রতিবন্ধকতাও অনেক। সুতরাং তা উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের।

৩. ভালো কাজ এবং উত্তম চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। কারণ দাওয়াতদাতা ইতিবাচক ফলাফল লাভ করতে না পারার অন্যতম কারণ হলো, কথার সাথে কাজের গরমিল।

৪. তাড়াহুড়া না করা। কেননা পথ অনেক লম্বা। সুতরাং দাঈ নারী তার লক্ষ্যে পৌঁছতে এবং তার দাওয়াতের পথে অবিচল থাকতে এই মহৎ গুণটি দ্বারা উপকৃত হতে পারে। রাসূলুল্লাহ ﷺ আবদুল কায়েস গোত্রের আশাজকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নিশ্চয় তোমার মধ্যে এমন দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন। সেগুলো হলো, ধৈর্য ও সহনশীলতা। [সহীহ মুসলিম, হা/১২৬।]

৫. প্রত্যেক ব্যাপারে সততার পরিচয় দেয়া। মানুষের সাথে সৎ আচরণ করা এবং কথা ও কাজে সত্য অবলম্বন করা। সুতরাং সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ব্যাপারে মিথ্যা বলবে না। কারণ এটা জঘন্য ও ভয়াবহ মিথ্যাচার। আর সাধারণ মানুষের সাথেও মিথ্যা বলবে না। এমনকি ছোট বাচ্চাদের সাথেও নয়।

৬. সেসব বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জানা, যে অবস্থার মধ্যে মুসলিম নারী জীবনযাপন করে। সুতরাং সে ততটুকুই আলোচনা করবে যতটুকু কোন মুসলিম নারী বুঝে ও ধারণ করতে পারে। অতএব যখন সে মানুষের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবে, বিশেষ করে নারীর অবস্থা সম্পর্কে, তখন সে তাদের হৃদয়ে পৌঁছতে সক্ষম হবে এবং তাদের সমস্যাসমূহ প্রতিকার করতে পারবে। আর তাদের সাথে তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারবে।

৭. নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির উপর শরীয়তের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দিককে প্রাধান্য দেবে। সুতরাং তার সার্বক্ষণিক চিন্তা থাকবে অন্যদেরকে হেদায়াতের দাওয়াত দেয়া। তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করা এবং তাদের মধ্যে যারা শত্রুদের পাতা ফাঁদে জড়িয়ে গেছে তাদেরকে উদ্ধার করা।

৮. শরীয়তের বিধান মোতাবেক আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার সম্পন্না হবে। বিশেষ করে আবশ্যকীয় বিষয়গুলো অনুসরণের মাধ্যমে। যেমন- শরয়ী পর্দা অবলম্বন করা, পুরুষদের সাথে মেলামেশা না করা ইত্যাদি।

৯. মাহরাম পুরুষ ব্যতীত দূরে ভ্রমণ করবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, মাহরাম পুরুষ ছাড়া নারী যেন ভ্রমণ না করে। [সহীহ বুখারী, হা/১৭৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/৩৩২২।]

১০. অপরিচিত পুরুষের সাথে একাকী নির্জনে অবস্থান করবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করবে না। এমনটি করলে তাদের তৃতীয়জন হবে শয়তান। [তিরমিযী, হা/১১৭১।]

১১. অপরিচিত পুরুষদের সাথে তার মেলামেশা করবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, তোমরা (রাস্তায় চলার সময়) পেছনে পেছনে চলো। কেননা তোমাদের জন্য রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটার সুযোগ নেই। তোমাদের উচিত হলো, রাস্তার পাশ দিয়ে পথ চলা। এ আদেশের পর থেকে নারীরা প্রাচীরের সাথে মিশে পথ চলত। এমনকি এ কারণে তাদের কাপড় প্রাচীরের সাথে ঝুলে যেত। [আবু দাউদ, হা/৫২৭৪।]

সারকথা হলো এই যে, নারীরা দাওয়াতী কাজ করবে তাদের সমসাময়িক নারীদের মধ্যে। সুতরাং তারা এক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী যথাযথ পদ্ধতি ও উপায় উপকরণসমূহ ব্যবহার করবে এবং কোনক্রমেই শরয়ী নিয়মনীতির বাইরে যাবে না।

৪১
দাওয়াতের সফল পদ্ধতিসমূহ
দাওয়াত দিতে হবে হেকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে :

﴿اُدْعُ اِلٰى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُؕ اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيْلِهٖ وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ﴾

তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান করো হেকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয় সে সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক সবিশেষ অবহিত। আর কারা সৎপথে আছে তাও তিনি অধিক জানেন। (সূরা নাহল- ১২৫)

হেকমত তথা প্রজ্ঞা :

দাওয়াতের ক্ষেত্রে হেকমত বা কৌশল হলো :

১. দাওয়াতের জন্য উপযুক্ত সময় বাছাই করা।

২. উপযুক্ত স্থান বাছাই করা।

৩. উপযুক্ত বাস্তবমুখী বিষয় নির্বাচন করা।

৪. শরীয়তের বিধিবিধান পালনের ক্ষেত্রে সহজতা অবলম্বন করা। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : يَسِّرُوْا ، وَلَا تُعَسِّرُوْا وَبَشِّرُوْا ، وَلَا تُنَفِّرُوْا

আনাস (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে) সহজ পন্থা অবলম্বন করবে, কঠিন পন্থা অবলম্বন করবে না। আর তোমরা (লোকদেরকে) সুসংবাদ প্রদান করবে এবং বিরক্তি সৃষ্টি করবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৬৮; সহীহ মুসলিম, হা/৪৬২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৩৫৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭১৭৬; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫২৬৬; আদাবুল মুফরাদ, হা/৪৭৩; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৫৮৫৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১০৭৮৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৬৭৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৪১৭২; মিশকাত, হা/৩৭২৩।]

৫. দাওয়াত ও তাবলীগ তথা প্রচারের ক্ষেত্রে ক্রমধারা অবলম্বন করা এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া। কারণ, মানুষের মন অনুশীলনের প্রয়োজন অনুভব করে এবং আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ بَعَثَ مُعَاذًا ، إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ ادْعُهُمْ إِلٰى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذٰلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذٰلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلٰى فُقَرَائِهِمْ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ যখন মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামানে প্রেরণ করেন তখন বলেন, তুমি তাদেরকে এ কথার সাক্ষ্য দিতে আহবান করবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। সুতরাং তারা যদি এ ব্যাপারে আনুগত্য করে, তবে তাদেরকে অবহিত করবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ফরয করেছেন। সুতরাং তারা যদি এ ব্যাপারেও আনুগত্য করে তবে তাদেরকে অবহিত করবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হবে। [সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৩০; আবু দাউদ, হা/১৫৮৬; তিরমিযী, হা/৬২৫; নাসাঈ, হা/২৫২২; ইবনে মাজাহ, হা/১৯৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৭১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩৪৬; বায়হাকী, হা/১২৮৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯৯২৪; মিশকাত, হা/১৭৭২।]

সুতরাং রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে তাদের মাঝে শরীয়তের বিধান পেশ করার ক্ষেত্রে ক্রমধারা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষ ও মহিলা দাঈগণও ক্রমধারা অবলম্বন করবেন। আর এই ক্রমধারার উপর ভিত্তি করে দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রথম সারির বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এবং প্রথমে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে হবে।

উত্তম উপদেশ :

উপদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে দাঈ নারীদের উচিত হলো নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করা :

১. দাওয়াত পেশ করার সময় সুন্দর, কোমল ও আন্তরিকতাপূর্ণ কথার অনুসরণ করা।

২. দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা অনুযায়ী বক্তব্য নির্বাচন করা।

৩. শ্রোতাকে উৎসাহিত ও সাবধান করার ক্ষেত্রে উত্তম উপদেশের মধ্যে দলীল-প্রমাণের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা।

৪. উত্তম উপদেশের মধ্যে মাঝে মাঝে শিক্ষণীয় ঘটনাবলিও সংযুক্ত করা। তবে শর্ত হলো, সেগুলো যেন সত্য ও বিশুদ্ধ হয়। কেননা মিথ্যা ও অহেতুক গল্প করার ব্যাপারে ইসলামে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে।

৫. মানুষকে এমন বক্তব্যের মাধ্যমে সম্বোধন করা, যে সম্বোধনটি সে পছন্দ করে। যেমন মহিলা দাঈ মানুষের মধ্যে থেকে বিশেষ কোন নারীকে বলবে, হে অমুকের মা! হে আমার বোন! হে বিশ্বস্ত মুমিন নারী। আর সাধারণভাবে বলবে, হে প্রিয় বোনেরা! হে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী নারীরা ইত্যাদি।

সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করা :

আর বিতর্ক হলো পরস্পর যুক্তি ও দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে লড়াই করা অথবা প্রতিপক্ষকে বাধ্য করার জন্য বক্তৃতা ও কথাবার্তার ক্ষেত্রে বিতর্ক করা।

এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক :

১. দলীল-প্রমাণ সংযুক্ত করা।

২. বিতর্ককারী ব্যক্তির উপর কথা অথবা কাজের দ্বারা সীমালঙ্ঘন না করা।

৫. শান্ত থাকা এবং উত্তেজিত না হওয়া।

৬. সত্যকে মেনে নেয়া।

৭. বিষয়বসত্মুর বাইরে না যাওয়া।

৮. ধারণাকে সুন্দর করা।

৯. আল্লাহকে ভয় করা।

৪২
নারীদের দাওয়াতের ক্ষেত্রসমূহ
দাওয়াতী ক্ষেত্রসমূহের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নিম্নে পেশ করা হলো :

১. বাসস্থান :

মানুষ যে গৃহে বসবাস করে মূলত তাকেই বলা হয় বাসস্থান। প্রভাবের দিক দিয়ে এটি একটি শ্রেষ্ঠ ময়দান। এর তত্ত্বাবধানের মূল দায়িত্বে থাকে যথাক্রমে স্বামী ও স্ত্রী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা স্বামী ও স্ত্রীর প্রত্যেককেই তার ঘরের দায়িত্বশীল বানিয়ে দিয়েছেন। তাদের দায়িত্বসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দায়িত্ব হলো-

 পরিবারের সদস্যদেরকে ঈমানী প্রশিক্ষণ দেয়া।

 তাদেরকে উত্তম আচার-আচরণ শিক্ষা দেয়া।

 সর্বদা সদ্ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা।

 সৎকর্মের আদেশ দেয়া ও অসৎকর্ম হতে নিষেধ করা ইত্যাদি।

তাছাড়া গৃহের ব্যাপারটি অন্যান্য উপায়-উপকরণ বা মাধ্যমসমূহ থেকে ভিন্ন। কারণ পরিবারের সদস্যগণ দীর্ঘ সময় ধরে একত্রে বসবাস করে থাকে এবং তাদের মধ্যে আত্মিক ও সামাজিক সমন্বয় বিদ্যমান থাকে। ফলে সেখানে সহজেই উত্তম আদর্শ পেশ করা সম্ভব। তাছাড়া সেখানে রয়েছে দিকনির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে প্রভাবিত করার সকল প্রকার সুযোগ।

২. সরকারি ও বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয়সমূহ :

বালিকা বিদ্যালয়সমূহের অভ্যন্তরে নারীর জন্য যা উপস্থাপন করা সম্ভব তা হলো :

 শিক্ষিকাগণকে বিভিন্ন প্রকার প্রতিযোগিতা আয়োজন করার জন্য উৎসাহিত করা।

 ছাত্রীদের জন্য বিদ্যালয়ে নিয়মিত দারস বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

 শিক্ষিকাদের মাঝে যোগাযোগ ও দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, যাতে বিদ্যালয়ে দাওয়াতী কর্মসূচী পালন করার ব্যাপারে আলোচনা করা যায়।

 নেতিবাচক বাহ্যিক দৃশ্য ও শরীয়তবিরোধী কর্মকান্ডের নজরদারী করা। যা কখনো কখনো ছাত্রীদের মধ্যে পাওয়া যায়।

 বার্ষিক ইসলামী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।

৩. নারীদের মাদরাসা ও মক্তবসমূহ :

বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিসত্মানসহ অনেক দেশেই বিভিন্ন ধরনের মাদরাসা ও মক্তব চালু রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন স্তরের নারীগণ আসা-যাওয়া করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উপায়ে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে :

 ইসলামিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা।

 অন্যান্য নারীদেরকে শিক্ষা প্রসারের কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

 কিছু বিশেষ কোর্সের আয়োজন করা, যাতে শিক্ষিকা ও প্রশাসনিক মহিলা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

 নারী দাঈ তৈরির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা।

৪. স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ :

স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নারীর কর্মক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। সেখানে যেসকল দাওয়াতী কাজ করা সম্ভব তা হচ্ছে,

 হাসপাতালগুলোতে সময় ও সুযোগ অনুযায়ী রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের সাথে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোগ ও তার প্রতিকার বিষয়ে আলোচনা করা।

 তাদেরকে শরীয়তের বিধানসমূহ পালন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

 হাসপাতালের লাইব্রেরীর জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক বই-পুসত্মকের পাশাপাশি কিছু ইসলামিক বই-পুসত্মকও সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা।

৫. মসজিদ :

ইসলামে নারীর জন্য অভিভাবকের অনুমতিক্রমে মসজিদে উপস্থিত হওয়া বৈধ। এক্ষেত্রে অভিভাবকের জন্য তাকে বারণ না করার ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে নারীরা দাওয়াতী কাজের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। কেননা মসজিদে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক আলোচনা হয়। সাথে সাথে সেখানে অনেক সৎকর্মশীল নারীদের সাথেও সাক্ষাৎ হয়। সুতরাং মসজিদে নিয়মিত উপস্থিত হওয়ার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায় এবং অন্যান্য সৎকর্মশীল নারীদের থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেয়া যায়। অতএব এ সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা যেতে পারে :

 মসজিদে নারীদের জন্য বিশেষ আলোচনার ব্যবস্থা করা, যাতে নারীরা খুব সহজেই উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পায়।

 মহিলা দাঈদেরকে আমন্ত্রণ জানানো, যাতে তারা সময় ও সুযোগ বুঝে নারী মুসল্লীদের সামনে আলোচনা পেশ করতে পারে।

 মাঝে মধ্যে খতীবগণ জুমু‘আ ও অন্যান্য আলোচনার মধ্যে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করবেন, যেগুলো নারীদের বাসত্মব জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে তিনি সমসাময়িক কিছু উদাহরণও পেশ করতে পারেন।

 ইসলামিক অথবা সমসাময়িক ধারায় পালিত বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ইসলামিক জ্ঞান সমৃদ্ধ আলোচনা সভা অথবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং তাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া।

৬. হজ্জের সফর :

হজ্জ হচ্ছে ইসলামের মূল ভিত্তিসমূহের মধ্যে একটি। এটি একটি শারীরিক ও আর্থিক উভয় ধরনের সম্মিলিত ইবাদাত। যে ব্যক্তির হজ্জ করার সামর্থ্য আছে তার উপর হজ্জ পালন করা ফরয। এ হুকুমটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। হজ্জকে কেন্দ্র করে অনেক নারীই একত্রিত হয়ে থাকে। সুতরাং ইসলামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও যথাযথভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন-

 অভিজ্ঞ নারী দাঈদেরকে হজ্জে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করা, যাতে তারা নারীদের মাঝে হজ্জ পালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং এমন দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, যা তাদেরকে উপকৃত করবে।

 নারীদের জন্য বিভিন্ন প্রকার দাওয়াতী ও দিকনির্দেশনামূলক কর্মসূচী প্রসত্মুত করা।

 কাফেলায় অংশগ্রহণকারী নারীদের মাঝে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের দাওয়াতী কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করা এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা।

 হজ্জ থেকে ফেরার পর তাদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা।

৪৩
দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের বিষয়বসত্মু
গোটা দ্বীনই দাওয়াতের বিষয়। আর বিষয়গুলো কয়েকটি ভাগে বিভক্ত।

১. আকীদাগত বিষয়সমূহ :

দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হচ্ছে আকীদা বা বিশ্বাসগত বিষয়সমূহ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো :

 ঈমানের রুকন বা স্তম্ভসমূহ এবং সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট অধ্যায় ও মাসআলাসমূহ।

 ঈমান ও তাওহীদের বিপরীত বিষয়সমূহ। যেমন- আল্লাহর সাথে শরীক করা, মুনাফিকী করা, কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করা, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে গালি দেয়া, দ্বীনের কোন বিষয়কে অস্বীকার করা বা তুচ্ছজ্ঞান করা, দ্বীন নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করা, জাদু করা ইত্যাদি।

২. ইবাদাতের বিষয়সমূহ :

ঈমানের পরপরই ইবাদাতের গুরুত্ব প্রাধান্যযোগ্য। দাওয়াতের ক্ষেত্রে ইবাদাতের বিষয়সমূহ হলো :

 পবিত্রতা ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ। যেমন- পবিত্রতা অর্জন করা, ওযু করা, নাপাক ও পাক জিনিস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা ইত্যাদি।

 নামায ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ। যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের গুরুত্ব, সময়, পরিমাণ ও বিধিবিধান, নফল নামায তথা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, বেতরের নামায, তাহিয়্যাতুল ওযুর নামায, মসজিদে প্রবেশের নামায, বৃষ্টিবর্ষণের নামায, ভয়ের সময় নামায, নামাযের ফরয-ওয়াজিব-মুসত্মাহাব বিষয়সমূহ, নামাযের গুরুত্ব, নামাযের উপকারিতা, নামায না পড়ার পরিণাম ইত্যাদি।

 যাকাত ও এ সংক্রামত্ম বিষয়সমূহ। যেমন- যাকাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ, যাকাত আদায়ের খাতসমূহ, যাকাত আদায় না করার পরিণাম ইত্যাদি।

 রোযা ও এ সংক্রামত্ম বিষয়সমূহ। যেমন- রোযা রাখার নিয়ম, রোযার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ, রোযা না রাখার পরিণাম ইত্যাদি।

 হজ্জ ও উমরা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ। যেমন- হজ্জ পালন করার বিধিবিধান, হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত, হজ্জের মাহাত্ম্য ইত্যাদি।

 ইসলামের অন্যান্য বিধানসমূহ, যেগুলো ইবাদাতের হিসেবে গণ্য হয়। যেমন- বিনয়-নম্রতা, আল্লাহভীতি, আল্লাহর উপর ভরসা করা, আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব অথবা শত্রুতা পোষণ করা, সকল কাজ আল্লাহর সমত্মুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা ইত্যাদি।

৩. হক বা অধিকারের বিষয়সমূহ :

অধিকার দুই প্রকার। একটি হচ্ছে, আল্লাহর অধিকার; আর অপরটি হচ্ছে, বান্দার অধিকার। এ উভয় প্রকার অধিকারই সাধ্যানুযায়ী পালন করা সকলের উপর আবশ্যক। সুতরাং এ সংক্রামত্ম বিষয়সমূহ দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের বিষয়বসত্মুর অমত্মর্ভুক্ত। আর সেগুলো হলো :

 বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার সংক্রামত্ম বিষয়সমূহ। যেমন- আল্লাহর ইবাদাত পাওয়ার অধিকার, আল্লাহর প্রশংসা পাওয়ার অধিকার, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি।

 আল্লাহর উপর বান্দার অধিকারসমূহ। যেমন- বান্দার সৎকাজের পুরস্কার পাওয়ার অধিকার, নিয়ামত পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি।

 সমত্মানের উপর পিতামাতার অধিকারসমূহ। যেমন- সদ্ব্যবহার করা, পিতামাতার সেবা করা, পিতামাতার অবাধ্য না হওয়া ইত্যাদি।

 পিতামাতার উপর সমত্মানের অধিকারসমূহ। যেমন- সমত্মানকে লালনপালন করা, সঠিক শিক্ষা প্রদান করা ইত্যাদি।

 ভাই-বোনদের অধিকারসমূহ। যেমন- একে অপরের সাথে সদ্ব্যবহার করা, পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ইত্যাদি।

 স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকারসমূহ। যেমন- স্ত্রীর ভরণ-পোষণ প্রদান করা, তার সাথে সদ্ব্যবহার করা, তাকে সম্মান করা ইত্যাদি।

 স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকারসমূহ। যেমন- স্বামীর সেবা করা, সর্বদা তাকে সমত্মুষ্ট রাখার চেষ্টা করা, তার অনুপস্থিতিতে তার সম্পদসমূহের হেফাযত করা ইত্যাদি।

 শ্রমিকের অধিকারসমূহ। যেমন- তাদের শ্রমফল তথা বেতন ভাতা যথাযথভাবে পাওয়া, সদ্ব্যবহার পাওয়া ইত্যাদি।

 প্রতিবেশীর অধিকারসমূহ। যেমন- প্রতিবেশীর সাথে দেখা হলে সালাম প্রদান করা, পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতা করা, পরস্পরের আমানতের হেফাযত করা ইত্যাদি।

 আত্মীয়-স্বজনদের অধিকারসমূহ। যেমন- তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, সদ্ব্যবহার করা, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ইত্যাদি।

 ইয়াতীমদের অধিকারসমূহ। যেমন- তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা, তাদের মাল-সম্পদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা ইত্যাদি।

 লেনদেন বিষয়ক অধিকারসমূহ। যেমন- সর্বদা লেনদেন স্বচ্ছ রাখা, প্রতারণা না করা, ধোঁকা না দেয়া ইত্যাদি।

৪. আচার-আচরণ ও চারিত্রিক বিষয়সমূহ :

প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তার আচার-ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ উল্লেখযোগ্য :

 উত্তম লেনদেনের বিষয়সমূহ। যেমন- করযে হাসানা প্রদান করা, সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা, লিখিত লেনদেন করা ইত্যাদি।

 দয়া বা অনুগ্রহের বিষয়সমূহ। যেমন- ছোটদের স্নেহ করা, গরীব-মিসকীনদেরকে সাহায্য করা, অসহায় ও মাযলুমের পাশে থাকা ইত্যাদি।

 দানশীলতার বিষয়সমূহ। যেমন- বেশি বেশি দান করা, কৃপণতা না করা, আল্লাহর উদ্দেশ্যে দান করা ইত্যাদি।

 সততার বিষয়সমূহ। যেমন- সত্য কথা বলা, মিথ্যা না বলা, প্রতারণা না করা, ধোঁকা না দেয়া ইত্যাদি।

 বিশ্বসত্মতার বিষয়সমূহ। যেমন- আমানত রক্ষা করা, খিয়ানত না করা, মুনাফিকী না করা ইত্যাদি।

 বিভিন্ন ধরনের আদব-কায়দাসমূহ। যেমন- ঘরে প্রবেশের আদব, খাওয়ার আদব, ঘুমানোর আদব, মসজিদে প্রবেশের আদব, রাসত্মায় চলাফেরা করার আদব ইত্যাদি।

৪৪
নারী সংগঠন
কিছু সৎকর্মশীল নারীদেরকে নিয়ে সংঘ গড়ে তোলা যেতে পারে এবং এসব সংঘের মাধ্যমে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :

 সংগঠনের সদস্যদেরকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা।

 সংগঠনের সদস্যগণ অন্যান্য যেসব নারীদের সাথে উঠাবসা করবে তাদের সাথেও ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা।

 সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অশ্লীলতা ও বিভিন্ন ধরনের ইসলামবিরোধী নিয়মনীতি সম্পর্কে নারীদেরকে সতর্ক করে দেয়া এবং এ থেকে বাঁচার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া।

 নারীদেরকে ইসলামী জ্ঞানার্জন করার প্রতি উৎসাহিত করা।

 প্রয়োজনে তাদের মাঝে ইসলামী বই-পুসত্মক বিতরণ করা।

 নারীদের জ্ঞানচর্চার জন্য পৃথক লাইব্রেরীর ব্যবস্থা করা।

৪৫
ইসলামের জন্য মুসলিম নারীদের ত্যাগ স্বীকার
ইসলামী সমাজ গঠনে নারীদের বিরাট অবদান রয়েছে। এজন্য তাঁরা বহু দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হননি; এমনকি রক্তের সম্পর্ককে ছিন্ন করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। আপন ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে চলে যেতে কিংবা বহিষ্কৃত হতেও বিন্দুমাত্র দুর্বলতা প্রদর্শন করেননি। মোটকথা এ পথে যত বাধা এসেছে, সবকিছুই তারা অতি ধৈর্য ও তীক্ষ্মতা সহকারে মোকাবেলা করে গেছেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে যেসব ভাগ্যবতী মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের নির্যাতন ভোগ করার লোমহর্ষক কাহিনী ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। আম্মার (রাঃ) এর মাতা ছিলেন একজন ঈমানদার মহিলা। তিনি ছিলেন আবু হুযায়ফা ইবনে মুগীরার ক্রীতদাসী। তাকে দ্বীন-ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। নর-পিশাচ আবু জেহেল তাঁকে বল্লমের আঘাতে-আঘাতে শহীদ করে ফেলে। ইসলামের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম শাহাদাতবরণ।

এভাবে যুগে যুগে ঈমানদার মহিলারা দ্বীনের ব্যাপারে একনিষ্ঠতা প্রদর্শন করে গেছেন। এমনকি নিজ সমত্মানও যদি দ্বীনের বিরুদ্ধে গিয়ে থাকে কিংবা দ্বীনের একবিন্দু ক্ষতি সাধনে উদ্যোগী হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রতিও তাঁরা কঠোর আচরণ করেছেন এবং এতে কোনরূপ দুর্বলতা দেখাননি।

৪৬
যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের অবদান
দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঈমানদার নারীরা কখনো নিষ্ক্রিয় থাকেননি, বরং তারাও ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি ও প্রত্যক্ষভাবে বহুবার অংশগ্রহণ করেছেন। বাতিল শক্তির বিনাশ সাধনে তাঁরা পূর্ণ শক্তিতে এগিয়ে এসেছেন। যেখানে তাঁরা নিজেদের হাতে অস্ত্রধারণ করেননি, সেখানে পুরুষদেরকে অস্ত্রধারণের জন্য সাহস যুগিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা জিহাদে আহত লোকদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। তারা মুজাহিদদের জন্য খাবার তৈরি করে পৌঁছে দিতেন, তাঁদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করতেন এবং তাঁদেরকে পানি পান করাতেন। হাদীসে এসেছে,

عَنِ الرُّبَيِّعِ بِنْتِ مُعَوِّذٍ قَالَتْ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ نَسْقِيْ وَنُدَاوِي الْجَرْحَى وَنَرُدُّ الْقَتْلٰى اِلَى الْمَدِيْنَةِ

রুবাইয়ি‘ বিনতে মু‘আববিয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে থেকে যুদ্ধের ময়দানে লোকদেরকে পানি পান করাতাম এবং আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করতাম ও নিহত যুদ্ধাদেরকে মদিনায় ফেরত নিয়ে যেতাম। [সহীহ বুখারী, হা/২৮৮২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২০১৬৩; মুসনাদে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, হা/২২৬১; মা‘রেফাতুস সাহাবা, হা/৭০০১।]

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ - - يَغْزُو بِأُمِّ سُلَيْمٍ وَنِسْوَةٍ مِنَ الْأَنْصَارِ مَعَه إِذَا غَزَا فَيَسْقِيْنَ الْمَاءَ وَيُدَاوِيْنَ الْجَرْحٰى

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যুদ্ধ করতেন। আর তখন উম্মে সুলাইম এবং আরো কয়েকজন আনসারী মহিলা তার সাথে ছিলেন। তারা যুদ্ধাদেরকে পানি পান করাতেন এবং আহতদের সেবা করতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৭৮৫; আবু দাউদ, হা/২৫৩৩; তিরমিযী, হা/১৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৭২৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৬৮৮০; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৭৫১৫; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৩২৯৫; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৮৩১২; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫৫০৭; মিশকাত, হা/৩৯৪০।]

عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ الْأَنْصَارِيَّةِ قَالَتْ غَزَوْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللّٰهِ - - سَبْعَ غَزَوَاتٍ أَخْلُفُهُمْ فِىْ رِحَالِهِمْ فَأَصْنَعُ لَهُمُ الطَّعَامَ وَأُدَاوِى الْجَرْحٰى وَأَقُوْمُ عَلَى الْمَرْضَى

উম্মে আতীয়া আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সাতটি যুদ্ধে যোগদান করেছি। এমতাবস্থায় আমি মুজাহিদদের জিনিসপত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম। তাঁদের জন্য খাবার তৈরি করতাম এবং আহত ও রোগাক্রান্তদের সেবা-শুশ্রূষা করতাম। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৭৯৩; ইবনে মাজাহ, হা/২৮৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৮১১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২০৬৪১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩৪৩৩৮; মিশকাত, হা/৩৯৪১।]

عَنْ أَنَسٍ أَنَّ أُمَّ سُلَيْمٍ اتَّخَذَتْ يَوْمَ حُنَيْنٍ خِنْجَرًا فَكَانَ مَعَهَا فَرَاٰهَا أَبُو طَلْحَةَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ هٰذِهِ أُمُّ سُلَيْمٍ مَعَهَا خَنْجَرٌ فَقَالَ لَهَا رَسُوْلُ اللّٰهِ -- : مَا هٰذَا الْخَنْجَرُ . قَالَتِ اتَّخَذْتُه إِنْ دَنَا مِنِّىْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ بَقَرْتُ بِه بَطْنَه . فَجَعَلَ رَسُوْلُ اللّٰهِ - - يَضْحَكُ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, (তাঁর মা) উম্মে সুলাইম হুনাইনের যুদ্ধের দিন একটি ছুরি ধারণ করেছিলেন, যা তার সঙ্গে থাকত। (তার স্বামী) আবু তালহা তা দেখতে পেয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইনি উম্মে সুলাইম। তার সাথে একটি ছোরা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বললেন, এ ছোরা কিসের জন্য? তিনি বললেন, এটি এজন্য নিয়েছি যে, যদি কোন মুশরিক আমার কাছাকাছি আসে, তাহলে আমি এটা দিয়ে তার পেট চিরে ফেলব। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ হাসতে লাগলেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৭৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪০০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৭১৮৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৬৪৩৯; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৩৪১১; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫৫০৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২০৮০০; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১২৫৪২।]

এসব মহিলা কোন বাহ্যিক চাপে পড়ে অথবা কোন বৈষয়িক প্রলোভনে পড়ে যুদ্ধের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজসমূহে অংশগ্রহণ করেননি। বরং তাঁরা দ্বীন ইসলামের প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সাহায্য-সহযোগিতা ও সাহচর্যকে নিজেদের জন্য বিশেষ সম্মানজনক ও পরকালে মহাকল্যাণ লাভের উপায় মনে করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।

৪৭
মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে শত্রুদের ষড়যন্ত্র
রাসূলুল্লাহ ﷺ নবী হিসেবে প্রেরিত হওয়ার পর থেকেই ইয়াহুদি, খ্রিস্টানসহ সমগ্র কাফিরগোষ্ঠী ইসলাম ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এমনকি এ ব্যাপারে এমন কোন চেষ্টা নেই, যা তারা প্রয়োগ করেনি এবং এমন কোন পন্থা নেই, যা তারা অবলম্বন করেনি। আর এ ধারা আজও বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে এর বিভিন্ন দিকসমূহ তুলে ধরা হলো।

মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে তাদের পরিকল্পনা :

ইসলামের শত্রুরা মুসলিম নারীদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য বিভিন্ন প্রকার কৌশল অবলম্বন করে। যেমন-

১. মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে নোংরামি ও বিকৃত চিন্তাধারার বিস্তার করা :

ইসলামের শত্রুরা মুসলিম সমাজগুলোতে নোংরামি ও বিকৃত চিমত্মাধারাসমূহ বিসত্মার ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এক্ষেত্রে অনেকটা সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পর্দার বিধান বিলুপ্ত করার পায়তারা করা, যারা এ বিধানটি বাসত্মবায়ন করে তাদেরকে নিয়ে উপহাস করা, অশ্লীলতাপূর্ণ বিজ্ঞাপন, ভিডিও, পিকচার ইত্যাদির প্রসার ঘটানো।

২. সংশয় ছড়িয়ে দেয়া :

ইসলামের শত্রুরা প্রাচীনকাল থেকেই এমন কিছু বিষয়ের দিকে তাক করে আছে, যা দ্বারা সাধারণ মুসলিমদেরকে অতি সহজেই বিভ্রামত্ম করা যায়। এজন্য তারা নিচের বিষয়গুলো বেছে নেয় :

 পুরুষের রক্তমূল্যের অর্ধেক হলো নারীর রক্তমূল্য।

 পুরুষের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের অর্ধেক হলো নারীর সম্পদ।

 দুই নারীর সাক্ষ্য সমান একজন পুরুষের সাক্ষ্য।

 নারী প্রশাসক হতে পারবে না এবং বিচারকও হতে পারবে না।

 একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ রয়েছে, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে তা নেই।

 পর্দার বিধান ইত্যাদি।

আর এসব বিষয়সমূহ দ্বারা সাধারণত তারাই বিভ্রামত্ম হয়, যারা ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে না অথবা কোন জ্ঞানই রাখে না।

৩. পুরুষদের সাথে সমতার দাবি :

এ দাবির মাধ্যমে তারা চায়,

 মুসলিম নারীদেরকে এ কথা অনুধাবন করানো যে, ইসলাম নারীদের প্রতি অবিচার করেছে এবং তাদের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করেছে।

 মুসলিম নারীদেরকে ঘর থেকে বের করে আনা।

 নারীদেরকে পুরুষদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ করে দেয়া।

৪. নারীদের মূল কাজকে গুরুত্বহীন হিসেবে চিত্রিত করা :

ইসলামের শত্রুরা এর মাধ্যমে নারীদেরকে তাদের আসল জগৎ বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন, শিশুদের লালনপালন ও স্বামীর প্রতি মনোযোগ দেয়ার মতো কর্মকান্ড থেকে সরিয়ে দিয়ে এমন কাজে লিপ্ত করছে, যেখানে সে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

৫. শিক্ষা :

ইসলামের শত্রুরা এবং তাদের দ্বারা প্রতারিত ব্যক্তিরা শিক্ষাকে তাদের বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে। যাতে করে তারা এ অজুহাতে মুসলিম নারীর ধ্বংস ও বিপর্যয়ের জন্য তাদের চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে পারে। কেননা মানুষের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তার শিক্ষা। ইসলামের শত্রুরা এজন্য যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে তা হলো :

 পরিকল্পিত সিলেবাস প্রণয়ন করা, যার মধ্যে বাসত্মবজীবনের নানা ধরনের ইসলামিক দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত থাকবে।

 সম অধিকারের নামে সহশিক্ষার ব্যবস্থা করা, যার মাধ্যমে নারী-পুরুষরা অবৈধ মেলামেশার দিকে আকৃষ্ট হবে।

৬. পুরুষদের কাজসমূহের মধ্যে নারীদেরকে অংশগ্রহণ করানো :

মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইসলামের শত্রুরা চূড়ামত্মভাবে এ পদ্ধতিই গ্রহণ করে থাকে।

৪৮
এসব আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীর দায়িত্ব
আল্লাহ তা‘আলার সমত্মুষ্টির প্রত্যাশী একজন সফল মুসলিম নারীর কর্তব্য হলো, মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে এসব নিকৃষ্ট চিমত্মাধারা ও পদক্ষেপসমূহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এজন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :

১. ঈমানের দৃঢ়তা অর্জন :

ঈমান হচ্ছে প্রতিটি মুসলিমের মূল সম্পদ। যার ঈমান যত বেশি মজবুত তার বিভ্রামত্ম হওয়ার সম্ভাবনাও তত কম। সুতরাং ইসলামের শত্রুদের এসব ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হলে মুসলিম নারীদের ঈমানের দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে।

২. সতর্কতা অবলম্বন করা :

মুসলিম নারীদেরকে শত্রুদের উপায়-উপকরণ, পরিকল্পনা, দাবি-দাওয়া, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের ব্যাপারেও সতর্কতা থাকতে হবে। কারণ ইয়াহুদি, খ্রিস্টান ও মুনাফিক অনেক শত্রু রয়েছে, যারা বিভিন্নভাবে নারীদেরকে ঘায়েল করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

৩. সামাজিক প্রসত্মুতি :

প্রত্যেক নারী তার নিজের জন্য একটি ছোট্ট সমাজ প্রসত্মুত করবে, তার মধ্য দিয়ে সে যথাযথভাবে দাওয়াতের কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবে।

৪. মানসিক প্রসত্মুতি :

প্রতিটি মুসলিম নারী পূর্ণ নির্ভরযোগ্যতা, স্থিরতা ও দৃঢ় সিদ্ধান্তের গুণাবলি অর্জন করবে এবং এক্ষেত্রে কোন প্রকার দুর্বলতা দেখাবে না।

৫. সাহসিকতার পরিচয় দেয়া :

মুসলিম নারী জেনে রাখবে যে, এ পথে প্রতিবন্ধকতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা তার আদর্শ হলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ। তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ এ পথে অনেক দুঃখ-কষ্ট, অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তবুও তিনি ও তার সাহাবীগণ এগুলো ধৈর্যের সাথে অতিক্রম করেছেন।

৪৯
হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করে নারীদেরকে দোষারোপ করা ঠিক নয়
ইসলামের দুশমনদের মধ্যে কতক লোক রয়েছে, যারা কুরআনের কিছু আয়াত অথবা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কিছু হাদীস উল্লেখ করে এগুলোর ব্যাখ্যা না বলে অথবা ভুল অর্থ গ্রহণ করে নারীদের মধ্যে বিভ্রামিত্ম ছড়ানোর চেষ্টা করে। যেমন এক হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ اَلْخُدْرِيِّ قَالَ خَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ فِيْ أَضْحًى ، أَوْ فِطْرٍ - إِلَى الْمُصَلّٰى فَمَرَّ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ فَإِنِّيْ أُرِيْتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ فَقُلْنَ وَبِمَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيْرَ مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِيْنٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الْحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ قُلْنَ وَمَا نُقْصَانُ دِيْنِنَا وَعَقْلِنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ أَلَيْسَ شَهَادَةُ الْمَرْأَةِ مِثْلَ نِصْفِ شَهَادَةِ الرَّجُلِ قُلْنَ بَلٰى قَالَ فَذٰلِكَ مِنْ نُقْصَانِ عَقْلِهَا أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ قُلْنَ بَلٰى قَالَ فَذٰلِكَ مِنْ نُقْصَانِ دِيْنِهَا .

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে গেলেন। তিনি মহিলাদের নিকট আগমন করলেন, অতঃপর (তাদেরকে সম্বোধন করে) বললেন, হে মহিলার দল! তোমরা (আললাহর রাস্তায়) সাদাকা করো, কারণ আমাকে তোমাদের সবচেয়ে বেশি জাহান্নামী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তখন তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কী কারণে আমাদের এ অবস্থা? নবী ﷺ বললেন, তোমরা বেশি বেশি অভিশাপ দিয়ে থাক এবং স্বামীদের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আমি জ্ঞান ও ধর্মের দিক থেকে তোমাদের চেয়ে এত কম অন্য আর কাউকে দেখিনি- যে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির জ্ঞান বিনষ্ট করতে পারদর্শী। তাঁরা পুনরায় বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দ্বীন ও জ্ঞানের কমতিটা কী? তিনি বললেন, একজন মহিলার সাক্ষ্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয় কি? তারা বলল, হ্যাঁ। তখন নবী ﷺ বললেন, এটাই তার জ্ঞানের ঘাটতি। (পুনরায় বললেন) তোমরা যখন হায়েযগ্রস্ত হও তখন নামায পড় না এবং রোযাও রাখ না- ঠিক নয় কি? তারা বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, এটা হলো দ্বীনের ঘাটতি। [সহীহ বুখারী, হা/৩০৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৫০; তিরমিযী, হা/২৬১৩; ইবনে মাজাহ, হা/৪০০৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৩৪৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১০০০; বায়হাকী, হা/১৩৭০; জামেউস সগীর, হা/১৩৯৪০; মিশকাত, হা/১৯।]

উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মহিলার বিবেকের ত্রুটি হচ্ছে এই যে, সে স্মৃতি শক্তির দিক থেকে দুর্বল। আর তার দ্বীনের ত্রুটি হচ্ছে এই যে, সে ঋতুস্রাবকালীন সময় নামায পড়ে না এবং রোযাও রাখে না।

কিন্তু এ হাদীস থেকে এ কথা বুঝায় না যে, সর্ব বিষয়েই মহিলারা ত্রুটিপূর্ণ দ্বীন ও বিবেক রাখে। এমনিভাবে এটাও বুঝায় না যে, সে সর্ববিষয়ে পুরুষের নিম্নে অবস্থান করবে আর পুরুষ তার থেকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকবে। নিচের আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।

﴿ اَلرِّجَالُ قَوَّامُوْنَ عَلَى النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلٰى بَعْضٍ وَّبِمَاۤ اَنْفَقُوْا مِنْ اَمْوَالِهِمْ﴾

পুরুষরা নারীদের কর্তা, আল্লাহ তাদেরকে একে অপরের উপর কিছু শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। কেননা পুরুষরা (নারীদের জন্য) তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে। (সূরা নিসা- ৩৪)

এখানে শ্রেষ্ঠত্ব শব্দটি সম্মান ও মর্যাদা অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। বরং এখানে এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাদের এক পক্ষকে তথা পুরুষদেরকে প্রকৃতিগতভাবে এমনসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি দান করেছেন, যা অন্য পক্ষকে তথা নারীদেরকে দেননি অথবা দিলেও প্রথম পক্ষের চেয়ে কম দিয়েছেন। এজন্য পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় পুরুষই ‘কাওয়াম’ বা কর্তা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। আর নারীকে প্রাকৃতিক দিক দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যার কারণে পারিবারিক জীবনে তাকে পুরুষের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত।

আবার কিছু বিষয়ে দেখা যায় যে, নারীরা কখনো কখনো পুরুষদের উপর অনেক বিষয়ে প্রাধান্য লাভ করে থাকে। বাস্তবেও অনেক নারী বিবেক, দ্বীন ও ধারণ ক্ষমতার দিক থেকে সাধারণ পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে। এমনিভাবে তার নেক আমলও এমন হারে বৃদ্ধি পেতে পারে যে, এর ফলে সে নেক আমল ও তাকওয়া এবং পরলৌকিক মর্যাদায় অনেক পুরুষকে অতিক্রম করে ফেলবে।

সুতরাং কারো জন্য উচিত নয় যে, দ্বীন ও বিবেকের ত্রুটির কারণে কোন নারীকে সর্ববিষয়ে দোষারোপ করবে। কারণ দ্বীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থেকে উত্তম নারী হিসেবে গড়ে উঠাও তার পক্ষে সম্ভব।

৫০
ইসলাম নারীদেরকে জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করেনি
ইসলাম নারীদেরকে জাতীয় নেতৃত্বের মতো কোন পদের দায়িত্ব অর্পণ করেনি। নারীদের স্বাভাবিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাই জাতীয় নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার এবং এ পদের জন্য অনুপযোগী বিবেচিত হওয়ার আসল কারণ। ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিমদের নেতা হওয়ার যোগ্য এমন ব্যক্তি, যার দ্বীন-ইসলামের মৌলিক ও খুঁটিনাটি বিষয়ে ইজতিহাদী যোগ্যতা ও প্রতিভা রয়েছে এবং যিনি সমস্ত জাতীয় ও সামষ্টিক বিষয়াদি সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করতে পারবেন, যুদ্ধ ও সন্ধি সংক্রান্ত জটিল বিষয়াদিতে বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করতে পারবেন এবং অতীব বীরত্ব ও সাহসিকতা সহকারে যাবতীয় সমস্যার মোকাবেলা করার যোগ্যতা রাখেন। আর এ পর্যায়ের জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলি আল্লাহ তা‘আলা কেবলমাত্র পুরুষদেরকেই দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي بَكْرَةَ قَالَ لَقَدْ نَفَعَنِي اللهُ بِكَلِمَةٍ سَمِعْتُهَا مِنْ رَسُوْلِ اللهِ أَيَّامَ الْجَمَلِ بَعْدَ مَا كِدْتُ أَنْ أَلْحَقَ بِأَصْحَابِ الْجَمَلِ فَأُقَاتِلَ مَعَهُمْ قَالَ : لَمَّا بَلَغَ رَسُوْلَ اللهِ أَنَّ أَهْلَ فَارِسَ قَدْ مَلَّكُوْا عَلَيْهِمْ بِنْتَ كِسْرٰى قَالَ لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً

আবু বাক্রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছ থেকে যে কথা শুনেছি, তা থেকে আল্লাহ আমাকে অনেক ফায়দা দান করেছেন। যেমন- জামাল (উষ্ট্রের) যুদ্ধের সময় আমি মনে করতাম, হক জামালওয়ালাদের অর্থাৎ আয়েশা (রাঃ) এর পক্ষে রয়েছে। কাজেই আমি তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। এ সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি বাণী মনে পড়ে গেল, যা তিনি কিসরার কন্যার সিংহাসনে আরোহণের খবর শুনে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সে জাতি কখনো সফলকাম হতে পারে না, যে জাতি তাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব একজন মহিলার হাতে সোপর্দ করে। [সহীহ বুখারী, হা/৪৪২৫; নাসাঈ, হা/৫৩৮৮; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৫৩৩২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৪৬০৮; তিরমিযী, হা/২২৬২; মিশকাত, হা/৩৬৯৩।]

এ হাদীস থেকে জানা গেল যে, নারীদেরকে কোন জাতির নেত্রী বানানো জায়েয নয়। আর এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।

৫১
জান্নাতে নারীদের অবস্থা
জান্নাতে নারীদের জন্য অপেক্ষমান নিয়ামত সম্পর্কে মুসলিম নারীদের অবশ্যই জানা উচিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবীদেরকে জান্নাতের নিয়ামত সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতেন। ফলে তারা জান্নাতের বিবরণ শুনে নিজেদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন।

আল্লাহ রাববুল আলামীন জান্নাতের যেসব নিয়ামতসমূহের আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ধরনের সুখাদ্য, অনির্বাচনীয় সুন্দর দৃশ্যাবলি, সুরম্য আবাস এবং অনিন্দ্য বস্ত্রসামগ্রী। এগুলো জান্নাতের মধ্যে নারী-পুরুষ সবাই ভোগ করবে। কিন্তু এরপরও অনেকের মনে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা তো পুরুষদেরকে ডাগর চোখ বিশিষ্ট হুর ও অপরূপা নারীদের কথা বলে জান্নাতের প্রতি আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত করেছেন; কিন্তু নারীদেরকে প্রলুব্ধ করার জন্য এমন কিছুই বলেননি- এর কারণ হলো,

আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীদের কথা উল্লেখ করেছেন স্বামীদের জন্য। কারণ স্বামীই হলেন স্ত্রীর কামনাকারী এবং তার প্রতি মোহিত। এজন্যই জান্নাতে পুরুষদের জন্য স্ত্রীদের কথা বলা হয়েছে। আর নারীদের জন্য স্বামীদের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু এর দাবি এ নয় যে, তাদের স্বামী থাকবে না। বরং তাদের জন্যও আদম সন্তানদের মধ্য থেকে স্বামী থাকবে।

জান্নাতীরা নিজেদের সঙ্গিনী পাবে :

﴿وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَدًا لَهُمْ فِيْهَا أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَّنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيْلًا ﴾

যারা ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হবে। সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে। তাদের জন্য সেখানে রয়েছে পবিত্র স্ত্রীগণ। আর জান্নাতীদেরকে আমি সুশীতল ছায়ায় প্রবেশ করাব। (সূরা নিসা- ৫৭)

জান্নাতী নারীরা হবে পবিত্র :

﴿وَلَهُمْ فِيْهَا أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَّهُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ﴾

তাদের (জান্নাতীদের) জন্য সেখানে রয়েছে পবিত্র স্ত্রীগণ। আর তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। (সূরা বাকারা- ২৫)

পবিত্র বলতে বাহ্যিক অপবিত্রতা যেমন : ময়লা, প্রস্রাব, পায়খানা, কফ, থুথু, হায়েয, নেফাস ইত্যাদি থেকে তারা পবিত্র হবে। আবার আভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা যেমন : হিংসা-বিদ্বেষ, ধোঁকাবাজি, মুনাফেকী, কষ্টদায়ক কথাবার্তা, অপরাধ প্রবণতা ও নাফরমানী ইত্যাদি থেকেও তারা পবিত্র হবে। مُطَهَّرَةٌ দ্বারা তাই বুঝানো হয়েছে।

জান্নাতী নারীরা হবে কুমারী ও যুবতী :

﴿إِنَّاۤ أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَآءً -‐ فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا﴾

আমি তাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করেছি এবং তাদেরকে কুমারীরূপেই সৃষ্টি করেছি। (সূরা ওয়াকিয়া- ৩৫, ৩৬)

أَبْكَارٌ শব্দটি بِكْرٌ এর বহুবচন, এর অর্থ কুমারী। যে নারীর এখনও বিয়ে হয়নি বা যার সাথে সহবাস হয়নি তাকে বাকেরা বলা হয়। জান্নাতী নারীরা দুনিয়ার স্ত্রী হোক অথবা হুর হোক তাদের অবস্থা এমন হবে যে, সবসময় তাদেরকে কুমারীই মনে হবে।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ لِاِمْرَأَةٍ عَجُوْزٍ : إِنَّه لَا تَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَجُوْزٌ فَقَالَتْ : وَمَا لَهُنَّ وَكَانَتْ تَقْرَأُ الْقُرْاٰنَ فَقَالَ لَهَا : أَمَا تَقْرَئِيْنَ الْقُرْاٰنَ ؟ ﴿ إِنَّاۤ أَنْشَأنَاهُنَّ إِنْشَآءَ فَجَعَلْنَاهَنَّ أَبْكَارًا﴾

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ এক বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন, কোন বৃদ্ধা মহিলা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ কথা শুনে মহিলা অবাক হয়ে বলল, কেন জান্নাতে যাবে না? তারা তো কুরআন পড়ে? তখন নবী ﷺ বললেন, তুমি কি কুরআন পড়নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি (জান্নাতী) নারীদেরকে কুমারীরূপে সৃষ্টি করেছি। অর্থাৎ বৃদ্ধারা যুবতী ও কুমারী অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে। [শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬০৬; মিশকাত, হা/৪৮৮৮।]

দুনিয়ায় নারীদের কয়েকটি অবস্থা হতে পারে :

 হয়তো সে বিয়ের আগেই মারা যাবে।

 কিংবা সে মারা যাবে তালাকের পর অন্য কারো সাথে বিয়ের আগে।

 কিংবা সে বিয়ের পর মারা যাবে।

 কিংবা সে বিধবা অবস্থায় মারা যাবে।

 কিংবা সে প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর অন্য কাউকে বিবাহ করে মারা যাবে।

দুনিয়ার নারীদের এসব অবস্থার ভিত্তিতে জান্নাতেও তাদের জন্য স্বতন্ত্র অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-

 যে নারী বিয়ের আগে মারা গেছেন অথবা যে নারী জান্নাতে প্রবেশ করেছেন কিন্তু দুনিয়াতে তিনি যে স্বামী রেখে গিয়েছিলেন সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি, তিনি জান্নাতে প্রবেশের পর তার অবস্থার অনুরূপ অনেক পুরুষ দেখতে পাবেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তার পছন্দ অনুযায়ী তাকে বিবাহ দিয়ে দিবেন।

 যে নারী বিয়ের পর মারা গেছেন জান্নাতে তিনি সেই স্বামীই পাবেন, যার কাছ থেকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

 যে নারীর স্বামী মারা যাবে আর তিনি যদি পরবর্তীতে আর বিয়ে না করেন, তাহলে জান্নাতে তিনি সে স্বামীর সঙ্গেই থাকবেন।

 যে নারীর স্বামী মারা যাবে এবং তিনি যদি অন্য কাউকে বিয়ে করেন, তবে তিনি জান্নাতে সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গী হবেন। একদা হুযায়ফা (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

إِنْ سَرَّكِ اَنْ تَكُوْنِىْ زَوْجَتِىْ فِى الْجَنَّةِ فَلَا تَزَوَّجِىْ بَعْدِىْ فَإِنَّ الْمَرْأَةَ فِى الْجَنَّةِ لِاٰخِرِ أَزْوَاجِهَا فِى الدُّنْيَا فَلِذٰلِكَ حَرُمَ عَلٰى أَزْوَاجِ النَّبِىِّ - أَنْ يَنْكِحْنَ بَعْدَهٗ لَأَنَّهُنَّ أَزْوَاجُهٗ فِى الْجَنَّةِ

যদি তোমাকে এ বিষয় খুশি করে যে, তুমি জান্নাতে আমার স্ত্রী হিসেবে থাকবে তবে আমার পর আর বিয়ে করো না। কেননা জান্নাতে নারী তার দুনিয়ার সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গে থাকবে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীদের জন্য অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে জড়ানো হারাম করা হয়েছে। কেননা তাঁরা জান্নাতে তাঁরই স্ত্রী হিসেবে থাকবেন। [সনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৮০৩।]

৫২
মহিলাদের পবিত্রতা অর্জন
পবিত্রতা অর্জন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর এক্ষেত্রে অনেক মহিলাই অজ্ঞতার মধ্যে লিপ্ত রয়েছে। যার ফলে নামায-রোযাসহ অনেক ইবাদাতে ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য পবিত্রতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা একামত্ম জরুরি। নিচে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা পেশ করা হলো :

৫৩
গোসল ফরয হওয়ার কারণসমূহ
১. বীর্যপাত হলে :

নারী-পুরুষ যেই হোক না কেন ঘুমের অবস্থায় হোক অথবা জাগ্রত অবস্থায় হোক যে কোন অবস্থায় বীর্যপাত হলে তাকে গোসল করতে হবে। হাদীসে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নিশ্চয় পানির পরিবর্তে পানি অর্থাৎ বীর্যপাত হলে গোসল করতে হয়। [সহীহ মুসলিম, হা/৮০২; আবু দাউদ, হা/২১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১২৬১।]

উম্মে সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা উম্মে সুলাইম এসে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় আল্লাহ সত্য বলতে লজ্জাবোধ করেন না। (আমার প্রশ্ন হচ্ছে) মহিলাদের স্বপ্নদোষ হলেও কি তাদেরকে গোসল করতে হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ- যখন সে পানি দেখতে পাবে। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৯১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৬২১; মিশকাত, হা/৪৩৩।]

২. যৌনাঙ্গে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করলে :

যৌনাঙ্গে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করলেই গোসল ফরয হয়ে যাবে। চাই বীর্যপাত হোক অথবা না হোক। আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন কেউ তার স্ত্রীর উপর বসে অতঃপর দুই লজ্জাস্থান মিলিত হয় তখন গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়। [সহীহ মুসলিম, হা/৮১২; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১০২।]

৩. মেয়েদের হায়েয ও নিফাস শেষ হলে :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন এক মহিলা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে হায়েয থেকে পবিত্রতার গোসল প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি হায়েয থেকে কীভাবে পবিত্রতার গোসল করতে হবে সে সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনি বললেন, প্রথমে সুগন্ধি (মিশক) মিশ্রিত তুলা অথবা পশমী কাপড়ের একটি টুকরা লও। তারপর তা দ্বারা পবিত্রতা লাভ করো। [সহীহ বুখারী, হা/৩১৪; নাসাঈ, হা/২৫১; মিশকাত, হা/৪৩৭।]

৫৪
ফরয গোসল করার নিয়ম
গোসল করার সময় প্রথমে দু’হাত কব্জি পর্যন্ত তিন বার ধৌত করতে হবে। তারপর লজ্জাস্থান পরিষ্কার করতে হবে। অতঃপর দু’পা ব্যতীত নামাযের ওযুর ন্যায় ওযু করতে হবে। পরে মাথায় তিন বার পানি ঢেলে সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করতে হবে, যাতে শরীরের কোন জায়গা শুকনো না থাকে। সব শেষে দু’পা ধৌত করতে হবে। [সহীহ বুখারী, হা/২৪৮; আবু দাউদ, হা/২৪২।]

মহিলাদের চুলের খোপা খোলা জরুরি নয়, বরং চুলের গোড়া ভিজালেই যথেষ্ট হবে।

উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো মাথায় চুলের বেনী গেঁথে থাকি। সুতরাং অপবিত্রতার গোসলের সময় কি আমি তা খুলব? তিনি বললেন, না। বরং তোমার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তুমি মাথার উপর তিন আজলা পানি ঢেলে দিবে। অতঃপর সারা শরীরে পানি ঢেলে দিয়ে পবিত্র হয়ে যাবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৭৭০; আবু দাউদ, হা/২৫১; তিরমিযী, হা/১০৫; নাসাঈ, হা/২৪১; ইবনে মাজাহ, হা/৬০৩।]

হায়েয ও নিফাসের গোসল জানাবাতের গোসলের মতোই। তবে এক্ষেত্রে আরো কিছু কাজ রয়েছে। যেমন- সুগন্ধি জাতীয় কোন কিছু ব্যবহার করা।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন এক মহিলা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে হায়েয থেকে পবিত্রতার গোসল প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, প্রথমে সুগন্ধি মিশ্রিত তুলা অথবা পশমী কাপড়ের একটি টুকরা লও। তারপর তা দ্বারা পবিত্রতা লাভ করো। মহিলা বলল, আমি কীভাবে এর দ্বারা পবিত্রতা লাভ করব? তিনি পুনরায় বললেন, তুমি তা দিয়ে পবিত্রতা লাভ করো। তারপরও মহিলা বলল, কীভাবে আমি এর দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, সুব্হানাল্লাহ! তুমি পবিত্রতা অর্জন করো। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তারপর আমি ঐ মহিলাকে টেনে নিয়ে এসে বললাম, তোমার হায়েযের রক্ত যে যে স্থানে লেগেছে খোঁজ করবে এবং মিশক (সুগন্ধি) যুক্ত কাপড়ের টুকরা দিয়ে সে স্থানে মালিশ করবে। [সহীহ বুখারী, হা/৩১৪; নাসাঈ, হা/২৫১; মিশকাত, হা/৪৩৭।]

স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একত্রে গোসল করা বৈধ :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ একই পাত্র থেকে গোসল করতাম, যা আমার এবং তাঁর মাঝখানে থাকত। তিনি আমার থেকে আগে তাড়াতাড়ি করে ফেলতেন। তখন আমি বলতাম, আমার জন্য একটু রেখে দিন, আমার জন্য একটু রেখে দিন। [সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৮; নাসাঈ, হা/২৩৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪২৬; বায়হাকী, হা/৮৫২।]

৫৫
ওযু করার নিয়ম
(১) প্রথমে মনে মনে ওযুর নিয়ত করতে হবে। [সহীহ বুখারী, হা/১; আবু দাউদ, হা/২২০৩; মিশকাত, হা/১।]

নিয়তের স্থান হলো ক্বলব বা অন্তর। সুতরাং নিয়ত মুখে পাঠ করা শরীয়তসম্মত নয়। ওযুকারী নিয়তের সময় সাধারণভাবে মনে মনে পবিত্রতা অর্জনের সংকল্প করবে। আর এটাই তার জন্য নিয়ত হিসেবে সাব্যসত্ম হবে।

(২) তারপর بِسْمِ اللهِ (বিসমিল্লাহ) বলবে। [তিরমিযী, হা/২৫; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৭; আবু দাউদ, হা/১০২; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১০৬০।]

(৩) তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে দু’হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করতে হবে এবং আঙ্গুলসমূহ খিলাল করতে হবে। [আবু দাউদ, হা/১৪২; তিরমিযী, হা/৭৮৮; ইবনে মাজাহ, হা/৪৪৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৬৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১০৮৭; মিশকাত হা/৪০৫।]

(৪) তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে কুলি করতে হবে এবং পরে বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে নাক ঝাড়তে হবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৪৯২; মিশকাত হা/৩৯৪।] তবে রোযা অবস্থায় কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে পানি পেটের ভেতরে চলে না যায়।

(৫) তারপর কপালের গোড়া থেকে দু’কানের লতি হয়ে থুতনির নিচ পর্যন্ত সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ধৌত করতে হবে এবং দাড়ি খিলাল করতে হবে। [আবু দাউদ, হা/১৪২; তিরমিযী, হা/৭৮৮; নাসাঈ, হা/৮৭; ইবনে মাজাহ, হা/৪০৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৫০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১০৮৭; মিশকাত, হা/৪০৫।] এজন্য এক অঞ্জলি পানি নিয়ে থুতনির নিচে দিতে হবে। [আবু দাউদ হা/১৪৫; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/২৫০; শারহুস সুন্নাহ, হা/২১৫; মিশকাত, হা/৪০৮।]

(৬) তারপর প্রথমে ডান ও পরে বাম হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করতে হবে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১০০; সহীহ বুখারী, হা/১৯৩৪; সহীহ মুসলিম, হা/৫৬০।]

(৭) তারপর পানি নিয়ে দু’হাতের ভিজা আঙ্গুলগুলো মাথার সম্মুখ হতে পেছনে ও পেছন হতে সম্মুখে বুলিয়ে একবার পুরো মাথা মাসাহ করতে হবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৪৯২; মিশকাত, হা/৩৯৩-৯৪।] একই সাথে ভিজা শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে কানের ভেতরের অংশ ও বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাইরের অংশ মাসাহ করতে হবে। [নাসাঈ, হা/১০২; মিশকাত, হা/৪১৩।]

(৮) তারপর প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা টাখনু পর্যন্ত ভালোভাবে ধৌত করতে হবে [সহীহ মুসলিম, হা/৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৪৯২; মিশকাত, হা/৩৯৪।] এবং বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে উভয় পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতে হবে। [আবু দাউদ, হা/১৪২; তিরমিযী, হা/৭৮৮; নাসাঈ, হা/৮৭; ইবনে মাজাহ, হা/৪০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১০৮৭।]

নখের উপর প্রলেপ থাকলে :

নখের উপর যদি এমন নখপালিশ বা অন্য কিছু ব্যবহার করা হয়, যার ফলে ভেতরে পানি পৌঁছতে পারে না, তাহলে ওযু শুদ্ধ হবে না। কেননা এর ফলে যে সমস্ত স্থানে পানি পৌঁছানো ফরয, সে সমস্ত স্থানে পানি পৌঁছতে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

তবে শুধু রং যেমন মেহেদী বা অনুরূপ কিছু হলে তাতে কোন সমস্যা নেই। তবুও খিযাব বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করলে নামাযের পূর্বে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া উচিত। হাদীসে এসেছে,

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের মহিলারা উত্তম খিযাব ব্যবহার করে। তারা এশার নামাযের পর খিযাব ব্যবহার করে এবং ফজরের পূর্বে খুলে ফেলে। [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১২৯১।]

যারা কুমকুম ও আলতা এ জাতীয় জিনিস ব্যবহার করেন তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। কেননা এসব বসত্মু নাপাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি নাপাক হয় তাহলে এটা ব্যবহার করে নামায পড়লে শুদ্ধ হবে না।

৫৬
কখন তায়াম্মুম করা যাবে
(১) যদি পবিত্র পানি না পাওয়া যায়।

(২) পানি সংগ্রহ করতে গেলে যদি নামায কাযা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।

(৩) পানি ব্যবহারে যদি রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।

(৪) পানি ব্যবহারে যদি কোন বিপদ বা জীবনের ঝুঁকি থাকে। [সূরা মায়েদা- ৬; মিশকাত, হা/৫২৭, ৫৩০।]

৫৭
তায়াম্মুম করার নিয়ম
১. প্রথমে নিয়ত করতে হবে এবং বিসমিল্লাহ বলতে হবে।

২. দু’হাত মাটিতে বা বালিতে অথবা দেয়ালে বা ধূলামিশ্রিত পাথরের উপর মারতে হবে; এরপর ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে নিতে হবে।

৩. এরপর উভয় হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল মাসাহ করতে হবে।

৪. এরপর বাম হাত দিয়ে ডান হাত কব্জি পর্যন্ত এবং ডান হাত দিয়ে বাম হাত কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর তায়াম্মুম সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,

নবী ﷺ দু’হাত মাটিতে মারলেন এবং দু’হাতে ফুঁ দিয়ে তাঁর মুখমন্ডল ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩৩৮; ইবনে মাজাহ, হা/৫৬৯।]

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট হবে যে, তোমরা দু’হাত মাটিতে মেরে ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে নিবে, তারপর উভয় হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল ও দু’হাত কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৮৪৫; আবু দাউদ, হা/৩২৪।]

৫৮
হায়েযের মাসআলা
মহিলাদের জরায়ু থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে রক্ত বের হয় তাকে হায়েয বলে।

হায়েযের রক্ত :

এটা দুর্গন্ধযুক্ত, ঘন ও কালো রঙের রক্ত, যা নির্দিষ্ট সময়ে মহিলাদের জরায়ু থেকে বের হয়। আল্লাহ তা‘আলা বনী আদমের প্রত্যেক নারীর উপর এটা আবশ্যক করে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে,

إِنَّ هٰذَا أَمْرٌ كَتَبَهُ اللهُ عَلٰى بَنَاتِ اٰدَمَ

আল্লাহ তা‘আলা হায়েযের রক্তকে প্রত্যেক আদম-কন্যার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/২৯৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৯৯৬।]

হায়েযের সময়সীমা :

হায়েযের সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ কোন সময়সীমা নেই। সুতরাং প্রত্যেক নারীর হায়েযের নিয়মের উপর তার সময়সীমা নির্ধারিত হবে। যেহেতু নির্দিষ্ট সময় ও বিশ্লেষণ আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নার মধ্যে পাওয়া যায় না। সুতরাং হায়েয বিদ্যমান থাকা ও না থাকার উপর শরীয়তের বিধানসমূহ সম্পৃক্ত।

হায়েযের শুরু ও শেষ :

১. হায়েযের শুরু বুঝা যায়- সম্ভাব্য সময়ে লজ্জাস্থান থেকে দুর্গন্ধময় কালো রক্ত নির্গত হওয়ার দ্বারা।

২. হায়েযের শেষ সময় বুঝা যায়- লজ্জাস্থান থেকে সাধারণ রক্ত নির্গত হওয়া বন্ধের দ্বারা। অর্থাৎ লজ্জাস্থানে তুলা বা ন্যাকড়া প্রবেশ করানোর পর তা শুষ্ক বের হলে হায়েযের সময় শেষ হয়েছে বলে ধরে নিবে।

মাসআলা : লজ্জাস্থান থেকে রক্ত নির্গত হওয়া বন্ধ হওয়ার পর সাদা পানি বা হলুদ রঙের কিছু বের হলে তা হায়েয হিসেবে গণ্য হবে না। এ অবস্থায় সে নামায, রোযা, সহবাস প্রভৃতি বৈধ কাজ করতে পারবে। এক্ষেত্রে উম্মে আতিয়ার হাদীসটি প্রাধান্যযোগ্য। তিনি বলেন, রক্তস্রাব হতে পবিত্রতার পর মেটে ও হলদে রংকে আমরা হায়েয হিসেবে ধর্তব্য মনে করতাম না। [সহীহ বুখারী, হা/৩২৬; আবু দাউদ, হা/৩০৭; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৬৫৭; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৬২১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২০৬৬৪।]

মাসআলা : যে মহিলার প্রত্যেক মাসে নিয়মিত ৬ দিন ঋতুস্রাব হয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে যদি তার কোন কোন মাসে ৭ দিন, ৮ দিন বা ১০ দিন ঋতুস্রাব হয়, তাহলে সে প্রথমে যথাসাধ্য হায়েযের রক্ত ও অন্য রক্তের মাঝে পার্থক্য করার চেষ্টা করবে। এ অবস্থায় সে যদি দেখে যে, লজ্জাস্থান থেকে নির্গত রক্তের রং, গন্ধ ও বৈশিষ্ট্য হায়েযের রক্তের ন্যায়, তাহলে নামায, রোযা ও সহবাস থেকে বিরত থাকবে। আর যদি এ রক্ত হায়েযের রক্তের সাথে না মিলে, তাহলে সে গোসল করে নামায পড়ে নেবে।

আর যদি নির্গত রক্ত পার্থক্য করা সম্ভব না হয়- যা কিছু কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাহলে সে এ রক্তকে হায়েযের রক্ত মনে করে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত নামায, রোযা ও সহবাস করা থেকে বিরত থাকবে।

হায়েযের নির্ধারিত সময়ের মাঝখানে রক্ত বন্ধ হয়ে পুনরায় দেখা দিলে করণীয় :

যদি কোন মহিলার কোন মাসে একটানা দু’দিন ঋতুস্রাব হয়ে ৩য় দিন বন্ধ হয়ে যায়, এরপর আবার ৪র্থ দিন হায়েযের রক্ত দেখা দেয়- এমতাবস্থায় বিশুদ্ধ মতানুযায়ী করণীয় হলো, হায়েযের নিয়মিত সময়ের মধ্যে অল্প সময় রক্ত বন্ধ হলেও তা হায়েয বলে বিবেচিত হবে।

৫৯
নিফাসের মাসআলা
সন্তান প্রসবের কারণে নারীর যৌনাঙ্গ দিয়ে নির্গত রক্তকে নিফাস বলে।

নিফাসের সময়সীমা :

নিফাসের সর্বনিম্ন কোন সময়সীমা নেই। সকল ইসলামী বিদ্বানের মতে, ৪০ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই যদি কোন নারী নিফাস থেকে পবিত্র হয়, তাহলে সে গোসল করার মাধ্যমে নামায পড়া ও স্বামীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হতে পারবে।

অধিকাংশ আলেমের অভিমত হলো, নিফাসের সর্বোচ্চ সময়সীমা ৪০ দিন। ৪০ দিন পর গোসল করবে এবং নামায পড়বে- যদিও রক্ত চলমান থাকে। ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন,

নবী ﷺ এর সাহাবী ও তাবেয়ীনসহ পরবর্তী উলামাগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, নিফাসগ্রসত্ম মহিলা ৪০ দিন পর্যমত্ম নামায ত্যাগ করতে পারবে। তবে এর মধ্যে যদি সে রক্ত প্রবাহিত হওয়া থেকে পবিত্র হয়ে যায় তবে সে গোসল করে নামায পড়বে। যদি ৪০ দিনের অধিক সময় পর্যমত্ম রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে তবে অধিকাংশ আলেমের মত হচ্ছে, সে নামায পড়বে। [তিরমিযী, হা/১৩৯।]

৬০
হায়েয ও নিফাস অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ
১. নামায পড়া :

হায়েয ও নিফাস অবস্থায় ফরয, নফলসহ সকল ধরনের নামায পড়া নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে পবিত্র হওয়ার পর ফরয নামাযসমূহের কাযা আদায় না করার ব্যাপারেও বিদ্বানগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। হাদীসে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, হায়েয অবস্থায় তারা কি নামায পড়া ও রোযা রাখা থেকে বিরত থাকে না? দ্বীনের ক্ষেত্রে এটা তাদের একটা ঘাটতি। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫১; সহীহ মুসলিম, হা/৮০।]

মু‘আয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক মহিলা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের জন্য হায়েযকালীন নামায পবিত্র হওয়ার পর কাযা আদায় করলে চলবে কিনা? আয়েশা (রাঃ) বললেন, তুমি কি হারূরিয়্যা? [খারিজীদের একটি দল, যারা ঋতুবতীর জন্য সালাতের কাযা ওয়াজিব মনে করত।] আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় ঋতুবতী হতাম, কিন্তু তিনি আমাদেরকে নামায কাযা করার নির্দেশ দিতেন না। অথবা তিনি বললেন, আমরা কাযা আদায় করতাম না। [সহীহ বুখারী, হা/৩২১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৮৭; আবু দাউদ, হা/২৬২; তিরমিযী, হা/১৩০; নাসাঈ, হা/৩৮২; ইবনে মাজাহ, হা/৬৩১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪০৮২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১০০১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৩৪৯।]

২. রোযা রাখা :

নারীরা হায়েয ও নিফাসের সময় রোযা রাখা বন্ধ রাখবে। তবে রমাযানের রোযা পরবর্তীতে কাযা আদায় করে নিবে।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হায়েয হলে রোযা কাযা করা ও নামায কাযা না করার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হতো। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫; আবু দাউদ, হা/২৬৩; ইবনে মাজাহ, হা/৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৩৭৬।]

৩. তাওয়াফ করা :

হায়েয অবস্থায় তাওয়াফ করা বৈধ নয়। কেননা আয়েশা (রাঃ) হজ্জের সময় ঋতুবতী হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বলেছিলেন, হাজীদের মতো হজ্জের সকল কার্যাদি সম্পাদন করো। তবে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করো না। [সহীহ বুখারী, হা/১৬৫০; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৯২৫; সহীহ মুসলিম, হা/২৯৭৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৮৩৫; দারেমী, হা/১৮৪৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৯১৪।]

৪. সহবাস করা :

হায়েয অবস্থায় সহবাস করা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَسْاَلُوْنَكَ عَنِ الْمَحِيْضِؕ قُلْ هُوَ اَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَآءَ فِى الْمَحِيْضِ وَلَا تَقْرَبُوْهُنَّ حَتّٰى يَطْهُرْنَۚ فَاِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوْهُنَّ مِنْ حَيْثُ اَمَرَكُمُ اللهُؕ اِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ﴾

(হে নবী!) তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলো, তা খুবই কষ্টদায়ক। সুতরাং তোমরা হায়েযের সময় সহবাস করা থেকে দূরে থাকো। তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে মেলামেশা করো না। আর যখন তারা (ঋতুস্রাব থেকে) পবিত্র হয়ে যায়, তখন তোমরা তাদের সাথে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় মেলামেশা করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অবলম্বনকারীদেরকেও ভালোবাসেন। (সূরা বাকারা- ২২২)

যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি হায়েয অবস্থায় সহবাস করা হালাল মনে করে, তাহলে সে কাফির ও মুরতাদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে যদি কেউ ভুলবশত বা হায়েয হয়নি মনে করে সহবাস করে ফেলে, তাহলে গোনাহ হবে না।

কিন্তু যদি হায়েয হয়েছে জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে সহবাস করে, তাহলে সে কবীরা গোনাহগার হিসেবে গণ্য হবে এবং তার উপর তওবা করা আবশ্যক হবে। কিন্তু কাফফারা আবশ্যক হবে কিনা- এ ব্যাপারে অধিকাংশ আলেমের অভিমত হলো, তার উপর কাফফারা আবশ্যক হবে না। কাফফারা আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে ইবনে আববাস (রাঃ) হতে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তা দুর্বল হওয়ার কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। [যঈফ আবু দাউদ, হা/২৬৪; ইবনে মাজাহ, হা/৬৪০।]

তালাক দেয়া :

হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া স্বামীর জন্য হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَآءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ﴾

হে নবী! যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে তখন তাদেরকে ইদ্দতের মধ্যে তালাক দাও এবং ইদ্দত গণনা করো। (সূরা তালাক- ১)

অর্থাৎ এমন সময় তালাক দিতে হবে, যেন তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর থেকেই স্ত্রী ইদ্দত পালন করতে পারে। আর এটা গর্ভাবস্থা অথবা যৌনসম্ভোগহীন পবিত্রাবস্থা ব্যতীত সম্ভব নয়। কেননা যদি হায়েয অবস্থায় তালাক দেয়া হয়, তাহলে মহিলা প্রাথমিক অবস্থায় ইদ্দত পালন করতে পারবে না। আর যদি যৌনসম্ভোগের পর ঐ তুহুরে (পবিত্রাবস্থায়) তালাক দেয়া হয়, তবে এই মিলনে গর্ভবতী হয়েছে কিনা, তা জানা যায় না। ফলে তার ইদ্দত হায়েয ধরা হবে, নাকি সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত ধরা হবে- এ বিষয়টি অস্পষ্ট থেকে যায়। তাই বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তালাক দেয়া স্বামীর প্রতি হারাম। হাদীসে এসেছে,

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে একদা তিনি তাঁর স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দিলেন। অতঃপর উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) উক্ত বিষয়টি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জানালেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তাকে আদেশ করো যেন সে তাকে ফিরিয়ে নেয় এবং পবিত্র হওয়া পর্যন্ত স্বীয় স্ত্রীত্বে রাখে। তারপর হায়েয শেষে পুনরায় পবিত্র হওয়ার পর ইচ্ছে করলে রেখে দেবে। অন্যথায় যৌনসম্ভোগের পূর্বে তালাক দেবে। এটাই সেই ইদ্দত, যার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা মহিলাদেরকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/৫২৫১; আবু দাউদ, হা/২১৮১; নাসাঈ, হা/৩৩৮৯।]

অতএব কোন ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দেয় তবে সে গোনাহগার হবে। এমতাবস্থায় তাকে অবশ্যই আল্লাহর নিকট তওবা করতে হবে এবং স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অতঃপর তাকে যে হায়েযের মধ্যে তালাক দিয়েছিল তা থেকে পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দিবে। তারপর ইচ্ছা হলে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী তালাক প্রদান করবে। এরপর যখন পুনরায় হায়েয হতে পবিত্র হবে তখন ইচ্ছা করলে বহাল রাখবে নতুবা যৌনসম্ভোগের পূর্বেই তালাক দিয়ে দিবে।

হায়েয অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে কোন দোষ নেই। এটা নিষেধ হওয়ার পক্ষে কোন দলীল নেই। কিন্তু পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত হায়েয অবস্থায় স্বামী তার সাথে মিলিত হতে পারবে না।

৬১
হায়েয ও নিফাস অবস্থায় যেসব কাজ করা যায়
১. যিকির করা, দরূদ পাঠ করা, তাসবীহ পাঠ করা, দু‘আ পাঠ করা :

হায়েয ও নিফাস অবস্থায় উপরোক্ত কাজগুলো মহিলারা করতে পারবে। তারা এ অবস্থায় আল্লাহকে ভুলে যাবে না। বরং যিকির-আযকার করবে, নবী ﷺ এর প্রতি দরূদ পাঠ করবে। তারা কুরআনের তাফসীর, হাদীস গ্রন্থ ও অন্যান্য ইসলামী বই-পুসত্মক পড়ে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

২. হায়েয অবস্থায় কুরআন পাঠের বিধান :

অনেক আলেমের মতে হায়েয এবং নিফাসগ্রস্ত মহিলারা মুখে উচ্চারণ করে কুরআন পড়বে না, তবে একান্ত প্রয়োজন হলে পড়তে পারবে। যেমন- শিক্ষিকা কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য এবং ছাত্রীরা কুরআন শিক্ষা করার জন্য হায়েয অবস্থায়ও কুরআন পড়তে পারবে।

কিন্তু বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী হায়েয এবং নিফাস অবস্থায়ও মহিলারা স্বাভাবিকভাবে মুখে উচ্চারণ করে কুরআন পাঠ করতে পারবে। এমনকি তারা কুরআন স্পর্শও করতে পারবে। কেননা হায়েয অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা নিষেধ মর্মে কোন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আল্লামা ইবনে হাযম (রহ.) তাঁর মুহাল্লা গ্রন্থে বলেন, কুরআন তিলাওয়াত, তিলাওয়াতের সিজদা, কুরআন স্পর্শ করা ও আল্লাহর যিকির করা উত্তম কাজ। এজন্য যিকিরকারী আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান পাবে। এখন কেউ যদি এগুলোকে কিছু কিছু অবস্থায় বৈধ নয় বলে দাবি করে, তবে সে ক্ষেত্রে তাকে প্রমাণ উপস্থিত করতে হবে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন, হায়েযগ্রসত্ম মহিলাকে কুরআন পড়া থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে মূলত কোন প্রমাণ নেই। [আল ফাতাওয়া মাজমূআতু ইবনুল কাসেম ২৬ খন্ড, ১৯১ পৃঃ।]

একটি হাদীসে এসেছে, ঋতুস্রাবে আক্রান্ত এবং (যার প্রতি গোসল ফরয হয়েছে এমন) নাপাক ব্যক্তি কুরআন থেকে কিছুই পাঠ করবে না। [যঈফ তিরমিযী, হা/১৩১।]

এ হাদীসটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে হাদীস বিশারদগণ একমত। ইমাম তিরমিযী (রহ.) এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল (ইমাম বুখারী রহ.)-কে বলতে শুনেছি যে, এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন ইসমাঈল ইবনে আইয়াশ। তিনি হিজায এবং ইরাকবাসীদের থেকে অনেক মুনকার তথা অগ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে অনেক দুর্বলতা। শাইখ আলবানী (রহ.) বলেন, এ হাদীসটি মুনকার তথা পরিত্যাজ্য।

ইমাম বায়হাকী এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, لَيْسَ هٰذَا بِالْقَوِىِّ অর্থাৎ এ হাদীসটি শক্তিশালী নয়। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৫৩৫।]

শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে, ইমাম মালিক (রহ.) হায়েযগ্রসত্ম মহিলার জন্য কুরআন পাঠ করাকে জায়েয বলেছেন। কেননা হায়েযের সময়টি অনেক দীর্ঘায়িত হয়। ফলে সে কুরআন ভুলে যেতে পারে। [শারহুস সুন্নাহ, হা/২৭৩।]

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে মহিলাদের হায়েয হতো। এতে কুরআন পাঠ করা যদি তাদের প্রতি নামাযের ন্যায় হারাম হতো, তাহলে তিনি নিশ্চয় উম্মতের জন্য তা বর্ণনা করতেন এবং মুসলিম নারীদেরকে শিক্ষা দিতেন। যেহেতু এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কেউ নিষিদ্ধ বর্ণনা করেননি, সেহেতু এটাকে নিষিদ্ধ বলা যাবে না।

৩. সিজদার আয়াত শ্রবণে সিজদা করা :

ঋতুবতী মহিলার সিজদার আয়াত শ্রবণ করে সিজদা করতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কেননা নামায ও তিলাওয়াতে সিজদা এক নয়। আর এ সিজদার ক্ষেত্রে পবিত্রতাও শর্ত নয়। হাদীসে এসেছে,

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ সূরা নাজম পড়ে সিজদা দিলেন। এ সময় তার সাথে সকল মুসলিম, মুশরিক ও জিনজাতি সিজদা করেছিল। [সহীহ বুখারী, হা/১০৭১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৩৮৫৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৭৬৩; তিরমিযী, হা/৫৭৫; মিশকাত, হা/১০২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৪২৭৫।]

এ হাদীস থেকে জানা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কিরাআত শুনে উপস্থিত সবাই সিজদা করেছেন। কিন্তু এ সময় কেউ পবিত্রতা অর্জন করতে গেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। আবার এটাও অসম্ভব যে, তখন সবাই পবিত্র ছিল।

৪. ঋতুবতী মহিলার কোলে মাথা রেখে পুরুষের কুরআন তিলাওয়াত করা :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ঋতুবতী থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার কোলে মাথা রেখে কুরআন পাঠ করতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৭৫৪৯।]

৫. একামত্ম প্রয়োজনে মসজিদে প্রবেশ করা :

ঋতুবতী মহিলা একামত্ম প্রয়োজনে মসজিদের ভেতর দিয়ে যেতে পারবে এবং প্রয়োজন মিটাতে পারবে। তবে সে মসজিদে অবস্থান করবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ঋতুবতী মহিলাদেরকে ঈদগাহে যেতে বলেছেন এবং তাদেরকে নামায পড়ার স্থান ত্যাগ করতে আদেশ করেছেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩২৪; আবু দাউদ, হা/১১৩৯।]

৬. স্বামীর খেদমত করা :

ঋতুবতী মহিলা তার স্বামীর সেবা করতে পারবে। যেমন- স্বামীর মাথা ধুয়ে দেয়া, চুল আঁচড়িয়ে দেয়া, কোথাও বের হওয়ার সময় স্বামীকে প্রসত্মুত করে দেয়া ইত্যাদি। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হায়েয অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাথা আঁচড়িয়ে দিতাম। [সহীহ বুখারী, হা/২৯৫; সহীহ মুসলিম, হা/২৯৭।]

৭. হায়েয অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া :

হায়েয অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে কোন দোষ নেই। কিন্তু পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্বামী তার সাথে মিলিত হতে পারবে না।

৮. স্বামীর সাথে একই লেপের মধ্যে ঘুমানো :

উম্মে সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে একই চাদরের নিচে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ আমার হায়েয দেখা দিলে আমি চুপি চুপি বেরিয়ে গিয়ে হায়েযের কাপড় পড়ে নিলাম। তিনি বললেন, তোমার কি হায়েয দেখা দিয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি আমাকে ডাকলেন এবং আমি তাঁর সাথে চাদরের ভেতর শুয়ে পড়লাম। [সহীহ বুখারী, হা/২৯৮;সহীহ মুসলিম, হা/৭০৯।]

ঋতুবতী মহিলার সাথে সহবাস ব্যতীত সবকিছু বৈধ। হাদীসে এসেছে,

মাসরুক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একদা তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছিলেন, আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। কিন্তু আপনাকে তা বলতে লজ্জা করে। তখন আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তোমার মায়ের মতো এবং তুমি আমার ছেলের মতো। অতঃপর মাসরুক (রাঃ) বললেন, হায়েয অবস্থায় পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের সাথে কীরূপে মেলামেশা করবে? তিনি বললেন, লজ্জাস্থান উপভোগ করা ব্যতীত তার সাথে সবকিছু করতে পারবে। [তাফসীরে তাবারানী, ৪/৩৭৮।]

কোন মহিলার হায়েয বন্ধ হওয়ার পর উত্তম হলো সে আগে গোসল করবে; তারপর স্বামী তার সাথে মিলিত হবে। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, فَاِذَا تَطَهَّرْنَ এর অর্থ হলো, যখন তারা পানি দ্বারা পবিত্র হবে তখন তোমরা স্ত্রীর সাথে মিলিত হও। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা বাকারার ২২২ নং আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে।]

৬২
ইস্তিহাযার মাসআলা
হায়েয ও নিফাসের সময় ছাড়া অন্য সময় প্রবাহিত রক্তস্রাবকে ইস্তিহাযা বলে। এটা তাদের অভ্যাসগত রক্তপ্রবাহ নয় বরং এটা বিচ্ছিন্ন রক্তপাত। অন্য ভাষায় এটাকে রক্তক্ষরণও বলে।

ইস্তিহাযার সময়সীমা :

ইসিত্মহাযার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কারণ এটা রোগজনিত বিষয়। এটা কার কত দিন বহাল থাকে তার কোন সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

ইসিত্মহাযা যদি হায়েয ও নিফাসের সাথে সম্পৃক্ত হয় তাহলে করণীয় :

এ ধরনের নারীর চারটি অবস্থা হতে পারে।

১. কোন মহিলার ঋতুস্রাবের সময়সীমা ও অভ্যাস জানা থাকলে সে ঐ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রবাহিত রক্তকে হায়েয হিসেবে ধরে নিবে এবং পরবর্তী সময়ে প্রবাহিত রক্তকে ইসিত্মহাযা হিসেবে গণ্য করবে।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উম্মে হাবীবা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। এরপর আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তার পাত্র দেখেছি রক্তে পরিপূর্ণ। এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, তোমার হায়েয যে কয়দিন হয়, সে কয়দিন পরিমাণ অপেক্ষা করো। তারপর গোসল করো এবং নামায পড়ো। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৯০১।]

২. কোন মহিলার যদি ঋতুস্রাবের অভ্যাস বা সময়সীমা নির্ধারিত না থাকে আর উক্ত মহিলা হায়েযের রক্ত ও ইসিত্মহাযার রক্তের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারে তাহলে হায়েযের রক্তের সময়কে হায়েয ধরবে এবং বাকি সময়গুলো ইসিত্মহাযা হিসেবে গণ্য করবে।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ (রাঃ) নবী ﷺ এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি একজন ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারী। আমি কখনো এ রোগ থেকে মুক্ত হই না। সুতরাং আমি কি নামায পড়া ছেড়ে দিব? রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, না- তুমি নামায ছাড়বে না। কেননা, এটা হায়েয না বরং এটি শিরা থেকে নিঃসৃত রক্ত। তাই যখন হায়েয দেখা দিবে কেবল তখনই নামায পড়া হতে বিরত থাকবে। আর যখন হায়েয ভালো হয়ে যাবে, তখন রক্ত ধুয়ে গোসল করে পবিত্র হয়ে নামায পড়বে। [সহীহ বুখারী, হা/২২৮; সহীহ মুসলিম, হা/৬৪০।]

৩. কোন মেয়ে যদি মাসিক শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ইসিত্মহাযা রুগে আক্রামত্ম হয় তাহলে এমতাবস্থায় সে অন্যান্য মহিলাদের স্বাভাবিক হায়েযের সময়সীমাকে হায়েয হিসেবে গণ্য করবে। যেমন- ৬ দিন বা ৭ দিন। আর এর পরবর্তী সময়ের রক্তকে ইসিত্মহাযা হিসেবে গণ্য করবে।

৪. যে মহিলা তার ঋতুস্রাবের সময়সীমা বা অভ্যাসের কথা ভুলে গেছে এবং হায়েযের রক্ত ও ঋতুস্রাবের রক্তের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না তার বিধানও উপরোক্ত বিধানের মতোই হবে। অর্থাৎ সে প্রতি মাসের ৬ থেকে ৭ দিন হায়েয হিসেবে গণ্য করবে এবং বাকি দিনগুলো ইসিত্মহাযা হিসেবে গণ্য করবে। যেমন- হামনা বিনতে জাহাশ (রাঃ) এর ইসিত্মহাযা হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন, (এ অবস্থায়) তুমি প্রতি মাসের ৬ বা ৭ দিন হায়েয হিসেবে গণ্য করবে। অতঃপর গোসল করবে এবং যখন বুঝতে পারবে যে, তুমি পবিত্রতা অর্জন করেছ, তখন তুমি প্রত্যেক মাসের ২৩/২৪ দিন নিয়মিতভাবে নামায পড়বে এবং রোযা রাখবে। এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট। তুমি প্রত্যেক মাসে এরূপ করবে, যেরূপ অন্যান্য মহিলারা হায়েয হতে পবিত্রতা অর্জনের ব্যাপারে করে থাকে। [আবু দাউদ, হা/২৮৭; ইবনে মাজাহ, হা/৬২২; তিরমিযী, হা/২০৫।]

৬৩
ইস্তিহাযা অবস্থায় করণীয়
ইসিত্মহাযাগ্রসত্ম মহিলার হুকুম স্বাভাবিক মহিলার মতোই। এ সময়-

১. সে নামায পড়বে।

২. রোযা রাখবে।

৩. স্বামীর সাথে সহবাস করতে পারবে।

৪. ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারীর জন্য মসজিদে ইতিকাফ করা বৈধ। হাদীসে এসেছে,

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে তাঁর কোন এক স্ত্রী ইতিকাফ করছিলেন। যখন তিনি রক্ত ও হলদে পানি বের হতে দেখতেন তখন তিনি নিচে একটা পাত্র বসিয়ে রাখতেন এবং সে অবস্থায় নামায পড়তেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩১০; আবু দাউদ, হা/২৪৭৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫০৪২; বায়হাকী, হা/১৪৫৬।]

৫. ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারীর প্রত্যেক নামাযে ওযু করা উত্তম। আর সে যদি গোসল করতে সক্ষম হয় তাহলে আরো উত্তম। উম্মে হাবীবা (রাঃ) ৭ বছর যাবৎ ইস্তিহাযা রোগে ভুগছিলেন। ফলে তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে গোসল করার নির্দেশ দেন। অতঃপর বললেন, এটি শিরা থেকে নিঃসৃত রক্ত। ফলে তিনি প্রত্যেক নামাযের জন্য গোসল করতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩২৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৬২।]

ইসিত্মহাযাগ্রসত্ম মহিলা যখন নামায পড়তে চাইবে তখন সে লজ্জাস্থানে পট্টি বাঁধবে; তারপর ওযু করে নামায পড়বে। এ ওযু দ্বারা ঐ ওয়াক্তে ফরয-নফল যা ইচ্ছা আদায় করতে পারবে।

৬৪
হায়েয ও নিফাস সংক্রামত্ম আরো কিছু মাসআলা
১. ঋতুবতী নারী আসরের সময় পবিত্র হলে তাকে আসরের নামায পড়তে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের এক রাক‘আত পেল সে পুরো আসরের নামায পেল। [সহীহ বুখারী, হা/৫৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৩, ৬০৮।]

২. কোন মহিলা যদি যোহরের নামাযের সময় শুরু হওয়ার পর ঋতুবতী হয়, তাহলে তাকে যোহরের নামাযের কাযা আদায় করতে হবে। অনুরূপভাবে যদি কেউ এশার সময় শেষ হওয়ার পূর্বে পবিত্র হয়, তাহলে তাকে এশার নামায পড়তে হবে।

৩. যদি কোন মহিলা রোযা থাকা অবস্থায় ঋতুবতী হয়, তাহলে তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

৪. ফজরের পরপরই কোন মহিলা ঋতুস্রাবমুক্ত হলে সেদিনের রোযা তার জন্য শুদ্ধ নয়। ঐ দিনের বাকি অংশে সে খানাপিনা থেকে বিরত থাক বা না থাক তাকে পরবর্তীতে ঐ দিনের কাযা আদায় করতেই হবে।

৫. ঋতুবতী মহিলা যদি ফজরের এক মিনিট আগে হলেও নিশ্চিতভাবে ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত হয়, তাহলে রমাযান মাস হলে তাকে ঐ দিনের রোযা রাখতে হবে। ফজরের পূর্বে গোসল করার সুযোগ না পেলেও সমস্যা নেই। যেমনিভাবে কোন পুরুষ সহবাসজনিত কারণে অথবা স্বপ্নদোষের কারণে যদি অপবিত্র থাকে এবং ঐ অবস্থায় সাহরী করে নেয়, তাহলে ফজরের আগে গোসল না করলেও তার রোযা শুদ্ধ হবে।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সহবাসজনিত কারণে ফজরের সময় আরম্ভ হওয়ার পর গোসল করতেন এবং রোযা রাখতেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৩১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫, ১১০৯।]

৬. কোন মহিলা যদি রক্ত দেখতে পায়; কিন্তু সে নিশ্চিত নয় যে, সেটা ঋতুস্রাবের রক্ত, তাহলে তার ঐ দিনের রোযা শুদ্ধ হবে।

৭. যদি রমাযান মাসে দিনের বেলায় কোন মহিলার সামান্য রক্তের ফোঁটা পড়ে এবং সারা রমাযান এই রক্ত চালু থাকা অবস্থায় সে রোযা রাখে, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে। কারণ এটা শিরা থেকে আসে। তবে ঋতুর বিষয়টা স্পষ্ট হলে রোযা শুদ্ধ হবে না।

৮. ঋতুবতী এবং প্রসূতি মহিলা রমাযানে দিনের বেলায় খানাপিনা করবে। তবে উত্তম হলো, খানাপিনা গোপনে করা।

৯. সন্তান প্রসবকারিণী ৪০ দিনের আগে যখনই পবিত্র হবে তখনই তার উপর রোযা রাখা অপরিহার্য হয়ে যাবে- যদি তখন রমাযান মাস হয়। অনুরূপভাবে তার উপর নামায পড়াও ওয়াজিব হবে এবং স্বামীর সাথে সহবাস করাও বৈধ হবে।

গর্ভবতীর ঋতুস্রাব :

 সাধারণত গর্ভবতীর ঋতুস্রাব হয় না। এই ঋতুস্রাব গর্ভজাত সন্তানের জন্য খাদ্য হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কিছু কিছু মহিলার গর্ভধারণের সময়ও ঋতুস্রাব চলতে দেখা যায়। এই ঋতুস্রাবও প্রকৃত ঋতুস্রাব হিসেবে গণ্য হবে। কেননা গর্ভাবস্থার কারণে তার ঋতুস্রাবের উপর কোন প্রভাব পড়েনি।

গর্ভধারিণীর রক্ত দু’ধরনের। এক ধরনের রক্ত ঋতুস্রাব হিসেবে গণ্য হবে। আর তা হচ্ছে, যেটা এখনও চলছে, যেমনিভাবে গর্ভধারণের পূর্বেও চলছিল। এক্ষেত্রে ঐ রক্ত যদি রং, গন্ধ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে হায়েযের রক্তের সাথে মিলে যায় এবং নিয়মিত সময়ের মধ্যে হয় তাহলে এটা হায়েয হিসেবে গণ্য হবে।

আরেক ধরনের রক্ত গর্ভধারিণীর নিকট হঠাৎ আসে, দুর্ঘটনাজনিত কারণে হোক বা কোন কিছু বহনের কারণে হোক অথবা কোন কিছু থেকে পড়ে গিয়ে হোক অথবা অন্য কোন কারণে হোক। যদি এ রক্তের বৈশিষ্ট্য হায়েযের রক্তের সাথে না মিলে, তবে সেটা ইসিত্মহাযা হিসেবে গণ্য হবে। হায়েয অবস্থায় তার উপর যেসব কাজ নিষিদ্ধ এমতাবস্থায় সেগুলোও তার উপর নিষিদ্ধ হবে না।

 অকাল গর্ভপাত ঘটার ক্ষেত্রে যদি সন্তান আকৃতি লাভ করে, তাহলে রক্ত হবে প্রসূতি অবস্থার রক্ত। আর যদি আকৃতি লাভ না করে, তাহলে তার রক্ত প্রসূতি অবস্থার রক্ত নয়। অতএব যখন রক্ত প্রসূতি অবস্থার রক্ত হবে তখন তার উপর ঐ সমস্ত বিষয় হারাম হবে, যেগুলো একজন প্রসূতি মহিলার উপর হারাম। পক্ষান্তরে যদি রক্ত প্রসূতি অবস্থার রক্ত না হয়, তাহলে তার উপর সেগুলো হারাম হবে না।

৬৫
মহিলাদের নামায
ইসলামের ফরয কাজসমূহের মধ্যে যে কাজটি সবসময় পালন করতে হয় এবং অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায আদায় করা। নারী-পুরুষ যেই হোক না কেন যদি কেউ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে তবে তাকে অবশ্যই নামায পড়তে হবে। কেননা কাফির এবং মুসলিমদের মধ্যে পার্থক্যকারী জিনিস হচ্ছে নামায। কোন মানুষ মুসলিম হয়েও যদি বেনামাযী হয়, তাহলে সে কার্যত কাফির-মুশরিকদের সাথেই মিলে যায়। এজন্য প্রত্যেক নারীর উচিত, যথা নিয়মে আমত্মরিকতার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা। নবী ﷺ বলেছেন, সাত বৎসর হলেই সন্তানকে নামায শিক্ষা দাও। আর দশ বৎসর হয়ে গেলে নামায না পড়লে তাদেরকে প্রহার করো। [আবু দাঊদ, হা/৪৯৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/২৩৪৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/৫০২; জামেউস সগীর, হা/১০৮০৬।]

৬৬
নামায না পড়ার পরিণাম
নামায আদায় না করার পরিণাম অত্যমত্ম ভয়াবহ। এর শাসিত্মও অত্যমত্ম কঠোর। কুরআনের আয়াত ও নবী ﷺ এর হাদীস অধ্যয়ন করলে যা বুঝা যায় তা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, কোন মানুষ বেনামাযী হলে সে মুসলিম থাকারই উপযুক্ত নয়। হাদীসে এসেছে,

বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা বৃষ্টির দিনে নামাযে তৎপর থাকো। কেননা যে ব্যক্তি এক ওয়াক্ত নামায ত্যাগ করল সে কুফরী করল। [সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৪৬৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৬৮।]

বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমাদের ও তাদের (মুনাফিকদের) মধ্যে যে অঙ্গীকার রয়েছে তা হলো নামায। সুতরাং যে নামায ত্যাগ করল, সে কুফরী করল। [তিরমিযী, হা/২৬২১; নাসাঈ, হা/৪৬৩; ইবনে মাজাহ, হা/১০৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৯৮৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৪৫৪; দার কুতনী, হা/১৭৫১; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/১১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৭৪।]

আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক আল উকাইলী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথিগণ নামায ত্যাগ করা ব্যতীত অন্য কিছুকে কুফরী মনে করতেন না। [তিরমিযী, হা/২৬২২; মিশকাত, হা/৫৭৯; রিয়াযুস সালিহীন, হা/৪৭০; জামেউল উসূল ফিল আহাদীস, হা/৩২৬৫।]

আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যার নামায নেই তার ঈমান নেই। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৭৫।]

অর্থাৎ যে ব্যক্তি নামায আদায় করে না, তার নিজেকে মুমিন বলে দাবি করা শোভা পায় না।

নামায ত্যাগকারীর মুক্তি পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই :

উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি উত্তমভাবে ওযু করবে, সময়মতো নামায পড়বে, নামাযের রুকূসমূহ পূর্ণ করবে এবং তাতে বিনয় ও নম্রতা বজায় রাখবে আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি এমনটি করবে না তার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ হতে কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি তাকে ইচ্ছা করলে ক্ষমা করে দিতে পারেন, আর ইচ্ছা করলে শাস্তিও দিতে পারেন। [আবু দাউদ, হা/৪২৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৭৫৬; মু‘জামুল আওসাত, হা/৯৩১৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৪০০; মিশকাত, হা/৫৭০।]

কিয়ামতের দিন নামায ত্যাগকারীর নূর ও নাজাতের দলীল থাকবে না :

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ নামায সম্পর্কে আলোচনা করলেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি নামাযের হেফাযত করবে এটা তার জন্য নূর ও দলীল হবে এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য নাজাতের ওসীলা হবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের হেফাযত করবে না অর্থাৎ নামায পড়বে না, তার জন্য কোন নূর ও দলীল থাকবে না এবং তার জন্য কোন নাজাতের উপায়ও থাকবে না। [সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৪৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৭৬; শু‘আবুল ঈমান, হা/২৫৬৫।]

নামায ত্যাগকারীর হাশর হবে বড় বড় কাফিরদের সাথে :

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, নামায পরিত্যাগকারী কিয়ামতের দিন কারুন, হামান, ফিরাউন এবং উবাই ইবনে খালফের সাথে থাকবে। [সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৪৬৭... ঐ।]

নামায ত্যাগকারীরা জাহান্নামে যাবে :

কুরআনে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে যে, নামায ত্যাগ করার কারণে মানুষকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فِيْ جَنَّاتٍ يَّتَسَآءَلُوْنَ - عَنِ الْمُجْرِمِيْنَ - مَا سَلَكَكُمْ فِيْ سَقَرَ - قَالُوْا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّيْنَ﴾

জান্নাতীরা অপরাধীদেরকে জিজ্ঞেস করবেন কোন্ জিনিস তোমাদেরকে এ ভয়ানক জাহান্নামে পৌঁছাল? জাহান্নামীরা উত্তর দেবে, আমরা দুনিয়াতে নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। (সূরা মুদ্দাস্সির, ৪০-৪৩)

৬৭
সংক্ষেপে নামায পড়ার নিয়ম
১. নামাযের নিয়তে পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে কেবলামুখী হয়ে কান বা কাঁধ বরাবর হাত উঠিয়ে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে বুকের উপর হাত বাঁধবে।

২. তারপর ছানা পড়ে ‘আ‘ঊযু বিল্লা-হি মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম’ এবং ‘বিসমিল্লা-হির রাহ্মা-নির রাহীম’ পড়বে।

৩. তারপর সূরা ফাতিহা পড়ে অন্য একটি সূরা বা কিছু আয়াত পড়বে।

৪. কিরাআত শেষ করার পর ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে রুকূতে যাবে। রুকূতে যাওয়ার সময় রাফউল ইয়াদাইন করবে তথা কান বা কাঁধ বরাবর উভয় হাত উঠাবে।

৫. এরপর রুকূতে যেয়ে ৩ বার ‘‘সুবহা-না রাবিবয়াল ‘আযীম’’ পড়ে ‘‘সামি‘আল্লা-হু লিমান হামিদাহ’’ বলে রুকূ থেকে সোজা হয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ‘রাববানা লাকাল হামদু হামদান কাসীরান ত্বায়্যিবান মুবা-রাকান ফীহ’ বলবে এবং রাফউল ইয়াদাইন তথা দু’হাত কাঁধ অথবা কান বরাবর উত্তোলন করবে।

৬. তারপর ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে সিজদায় যাবে। সিজদায় যাওয়ার পর ৩ বার ‘সুবহা-না রাবিবয়াল আ‘লা’ পড়ে ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে বসবে। স্থির হয়ে বসে দু’সিজদার মধ্যখানের দু‘আ পড়ে দ্বিতীয় সিজদা করে দাঁড়িয়ে যাবে।

৭. এরপর পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় রাক‘আত আদায় করার পর বসে তাশাহহুদ পড়বে, তারপর দরূদে ইবরাহীম ও দু‘আয়ে মাসূরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করবে।

৮. তিন বা চার রাক‘আত বিশিষ্ট নামাযের প্রথম দু’রাক‘আত শেষ করে প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়বে। তারপর ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে দাঁড়িয়ে বাকি নামায পূর্বের নিয়মানুসারে আদায় করবে।

৬৮
পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের পার্থক্য
পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের মধ্যে পদ্ধতিগতভাবে কোন পার্থক্য নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ নারী-পুরুষ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা সেভাবে নামায পড়ো, যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখেছ। [সহীহ বুখারী, হা/৬৩১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৬৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/৩৯৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৬৫৮; মিশকাত হা/৬৮৩।]

ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর সহীহুল বুখারীতে ‘‘তাশাহহুদে বসার পদ্ধতি’’ নামক বাবের পর উল্লেখ করেন, উম্মুদ দারদা (রাঃ) নামাযে পুরুষদের ন্যায় বসতেন। আর তিনি ছিলেন একজন ফকীহা তথা মাসআলার ব্যাপারে অভিজ্ঞ।

নারীদের রুকূ করার সময় মাথা সামান্য নিচু করা ও সিজদার সময় হাত ও পেট একত্রে জড়িয়ে রাখার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। [বায়হাকী, হা/৩০১৬; সিলসিলা যঈফাহ, হা/২৬৫২।]

অনুরূপ নারীরা বুকে হাত বাঁধবে আর পুরুষরা নাভির নিচে হাত বাঁধবে- এরকম পার্থক্য হাদীসে পাওয়া যায় না। বরং সহীহ হাদীস অনুযায়ী নারী-পুরুষ সকলেই বুকের উপর হাত বাঁধবে।

অনেকের ধারণা পুরুষদের নামায শেষ হওয়ার আগে ঘরে মহিলাদের নামায হবে না। এ ধারণা সঠিক নয়। নামাযের সময় হলেই মহিলারা নামায আদায় করতে পারবে।

যেসব ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের কিছু পার্থক্য রয়েছে, তা হলো :

১. পুরুষদের জন্য জামাআতে নামায পড়া ওয়াজিব। কিন্তু মহিলাদের জন্য তা ওয়াজিব নয়। তারা ইচ্ছা করলে জামাআতে উপস্থিত হতে পারে, কিন্তু তারা যদি জামাআতে উপস্থিত হওয়ার জন্য মসজিদে গমন করতে চায় তবে তাদেরকে বাধা দেয়া নিষেধ। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৪৬৫; সহীহ বুখারী, হা/৯০০; সহীহ মুসলিম, হা/১০১৮; আবু দাউদ, হা/৫৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৪৬৫৫।]

২. ইমাম নামাযের মধ্যে ভুল করলে পুরুষরা ‘‘সুবহানাল্লাহ’’ বলে লোকমা দেবে। আর মহিলারা হাতের উপর হাত মেরে শব্দ করবে। [সহীহ বুখারী, হা/৬৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০২১৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৬২৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২২৬০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৭৫১৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৩৪৫৭; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/১৫৫৯; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৫৫৬১; জামেউস সগীর, হা/৫৩২৬; মিশকাত, হা/৯৮৮।]

৩. পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হলো প্রথম কাতার। পক্ষান্তরে মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হলো পেছনের কাতার। [সহীহ মুসলিম, হা/১০১৩; আবু দাউদ, হা/৬৭৮; তিরমিযী, হা/২২৪; নাসাঈ, হা/৮২০; ইবনে মাজাহ, হা/৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৩৫৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৫৬১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪০২; মুসনাদুল বাযযার, হা/৫১৯৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১১০২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৫৩৩৩; জামেউস সগীর, হা/৫৬২১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৪৮৯; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৫১১০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৭৭০৪; মুসনাদে হুমাইদী, হা/১০৪৭; মিশকাত, হা/১০৯২।]

৪. পুরুষদের জন্য নামাযের মধ্যে নাভি থেকে হাঁটু পর্যমত্ম এবং উভয় কাঁধ ঢেকে রাখতে হবে। পক্ষান্তরে নারীদের ক্ষেত্রে তাদের মুখমন্ডল ও হাতের কব্জি ব্যতীত শরীরের অন্যান্য সকল অঙ্গ ঢেকে রাখতে হবে। [আবু দাউদ, হা/৪১০৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৩৩৪৩; জামেউস সগীর, হা/১৩৮০৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৪৫; মিশকাত, হা/৪৩৭২।]

৫. পুরুষদের জামাআতে প্রথম কাতারের সামনে মাঝ বরাবর ইমামকে একাকী দাঁড়াতে হয়। আর মহিলাদের জামাআতে ইমামকে প্রথম কাতারের মাঝখানে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে, পুরুষের মতো একাকী নয়।

৬. পুরুষ একজন হলে ইমামের সাথে ডান পার্শ্বে দাঁড়াতে হয়; কিন্তু মহিলা একজন হলে ইমামের পেছনে দাঁড়াতে হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৭২৭; নাসাঈ, হা/৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২১০২; বায়হাকী, হা/৫০০৩; মিশকাত, হা/১১০৮।]

নামায অত্যমত্ম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত এবং এর মাসআলা অনেক। এজন্য সঠিকভাবে নামায আদায় করার জন্য নামাযের যাবতীয় নিয়ম-কানুন জানা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর একামত্ম কর্তব্য। এজন্য নামায সংক্রামত্ম কোন সহীহ বই পাঠ করা উচিত। এ বিষয়ের উপর আমাদের ‘‘মন দিয়ে নামায পড়ার উপায়’’ অথবা ‘‘কিতাবুস সালাত’’ বই পড়তে পারেন।

৬৯
কতিপয় প্রশ্নের উত্তর ১. মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার বিধান কী?
যদি মহিলারা মসজিদে জামাআতে শরীক হয়ে নামায পড়তে চায় তাহলে তাতে অনুমতি আছে। এজন্য শর্ত হলো :

১. ফিতনার আশঙ্কামুক্ত হতে হবে।

২. পর্দার সাথে আসতে হবে।

৩. সুগন্ধি লাগিয়ে বের হওয়া যাবে না।

৪. স্বামী অথবা অভিভাবকের অনুমতি থাকতে হবে।

তাছাড়া মহিলারা মসজিদে গেলে জুমু‘আর খুৎবা এবং অন্যান্য দ্বীনী আলোচনা শ্রবণ করা ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান। এতে তাদের ঈমান ও আমলের উন্নতি হয়।

উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে মহিলারা ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর সাথে সাথে উঠে চলে যেত। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সাহাবীগণ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ উঠে যেতেন তখন অন্যান্য লোকেরাও উঠে যেত। [সহীহ বুখারী, হা/৮৬৬; নাসাঈ, হা/১৩৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৭১৮; মিশকাত, হা/৯৪৮।]

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন ফজরের নামায শেষ করতেন, তখন মহিলাগণ চাদরে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করে ঘরে ফিরতেন, অন্ধকারের কারণে তখন তাদেরকে চেনা যেত না। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৪; সহীহ বুখারী, হা/৮৬৭; সহীহ মুসলিম, হা/১৪৯১; আবু দাউদ, হা/৪২৩; তিরমিযী, হা/১৫৩; নাসাঈ, হা/৫৪৫; ইবনে মাজাহ, হা/৬৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪১৪২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৫০১; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৪৪১৫; বায়হাকী, হা/১৯৭৪; মিশকাত, হা/৫৯৮।]

ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুলস্নাহ ﷺ বলেছেন, যদি আমরা (মসজিদের) এই দরজাটি মহিলাদের জন্য ছেড়ে দিতাম! নাফে‘ বললেন, (এরপর থেকে) ইবনে উমর (রাঃ) মৃত্যু পর্যমত্ম সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করেননি। [আবু দাউদ, হা/৪৬২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২৫৩; জামেউস সগীর, হা/৯৩৮৯।]

এ হাদীসগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সাহাবায়ে কেরামের যুগে মহিলারা শুধু মসজিদে আসত না, বরং মহিলাদের নিরাপদে মসজিদে যাতায়াতের জন্য পৃথক দরজার ব্যবস্থা ছিল।

৭০
২. মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার বিধান কী?
মহিলাদের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। শুধু অনুমতিই নয়, বরং তাদেরকে ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে,

عن أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ أَنْ نُخْرِجَهُنَّ فِي الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى الْعَوَاتِقَ وَالْحُيَّضَ وَذَوَاتِ الْخُدُوْرِ فَأَمَّا الْحُيَّضُ فَيَعْتَزِلْنَ الصَّلَاةَ وَيَشْهَدْنَ الْخَيْرَ وَدَعْوَةَ الْمُسْلِمِيْنَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِحْدَانَا لَا يَكُوْنُ لَهَا جِلْبَابٌ قاَلَ لِتُلْبِسْهَا أُخْتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا

উম্মে আতিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে ঋতুবতী, সাবালিকা এবং পর্দাশীল নারীদেরকে নিয়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার নির্দেশ দিতেন। ঋতুবতী নারীরা নামায পড়া হতে পৃথক থাকতেন। কিন্তু তারা অন্যান্য উত্তম কাজসমূহ ও মুসলিমদের দু‘আয় শরীক হতেন। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে এমন অনেক নারী আছে, যাদের কোন চাদর নেই। তখন তিনি বললেন, তাদের বোন যেন তাদেরকে চাদর ধার দেয়। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৩; সহীহ বুখারী, হা/৩২৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৮১৮।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، قَالَ : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ، يَأْمُرُ بَنَاتَه وَنِسَاءَه أَنْ يَخْرُجْنَ فِي الْعِيْدَيْنِ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তার কন্যা ও স্ত্রীদেরকে দুই ঈদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৫৪; জামেউস সগীর, হা/৯০১৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২১১৫।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - خَرَجَ يَوْمَ أَضْحٰى أَوْ فِطْرٍ فَصَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَمْ يُصَلِّ قَبْلَهَا وَلَا بَعْدَهَا ثُمَّ أَتَى النِّسَاءَ وَمَعَه بِلَالٌ فَأَمَرَهُنَّ بِالصَّدَقَةِ فَجَعَلَتِ الْمَرْأَةُ تُلْقِىْ خُرْصَهَا وَتُلْقِىْ سِخَابَهَا

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুলস্নাহ ﷺ একবার ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের দিন বের হলেন এবং দু’রাক‘আত নামায পড়লেন। এর পূর্বে ও পরে কোন নামায পড়েননি। অতঃপর তিনি মহিলাদের নিকট আসলেন। এ সময় তাঁর সাথে বিলাল (রাঃ) ছিলেন। রাসূলুলস্নাহ ﷺ তাদেরকে সাদাকা করার আদেশ করলেন। তখন মহিলারা নিজ নিজ কানের রিং ও গলার হার সাদাকা করতে লাগল। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৪; বায়হাকী, হা/৬০২০; আবু দাউদ, হা/১১৬১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৪৩৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২০৯৮।]

উপরোক্ত হাদীসগুলো হতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ প্রাপ্তবয়স্কা, গৃহিণী এবং ঋতুবতী মহিলাদেরকে উভয় ঈদে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদেরকে দুই ঈদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এটাও প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ মহিলাদেরকে ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, যদি কোন মহিলার ওড়না বা চাদর না থাকে তাহলে সে যেন অপর বোনের চাদর ধার নিয়ে হলেও ঈদগাহে যায়।

অনুতাপের বিষয় হলো এই যে, মহিলাদের মসজিদে ও ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সহীহ হাদীস ও অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বর্তমান মুসলিম সমাজে মহিলাদের মসজিদ ও ঈদগাহে যাওয়া এবং মুসলিমদের দু‘আ, দ্বীন শিক্ষা ও ওয়াজ-নসীহত শ্রবণ করা হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

৭১
৩. ঈমান দুর্বল হয়ে গেলে কী করবে?
মানুষের ঈমান সবসময় একই পর্যায়ে থাকে না। কখনো তা বৃদ্ধি পায় তথা দৃঢ় হয়, আবার কখনো তা হ্রাস পায় তথা দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং কারো ঈমান দুর্বল হয়ে গেলে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করলে ঈমান বৃদ্ধি পাবে- ইনশাআল্লাহ।

 বুঝে বুঝে কুরআন পাঠ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَشِفَآءٌ لِّمَا فِى الصُّدُوْرِ وَهُدًى وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ﴾

হে মানুষ! তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে উপদেশ ও তোমাদের অন্তরে যা আছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। (সূরা ইউনুস- ৫৭)

 নবী ﷺ এর চরিত্র ও তাঁর সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং সেগুলো নিজের জীবনে বাসত্মবায়নের চেষ্টা করা। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সমত্মুষ্টি অর্জন করতে চায় এবং তার অধিক নিকটবর্তী হতে চায়, তার জন্য এটি পথনির্দেশক। একমাত্র এ আলোকবর্তীকাই এ পথের সঠিক সন্ধান দিতে পারে। আর এটি কেবল দৃঢ় ঈমানের অধিকারী ব্যক্তিরাই সঠিকভাবে পেয়ে থাকে।

 তাকওয়া ও সততার অধিকারী ব্যক্তিদের সাহচর্য অবলম্বন করা। কেননা প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে তার সঙ্গীদের বিরাট ধরনের প্রভাব থাকে। সুতরাং কেউ যদি খারাপ চরিত্রের লোকদের সাথে চলাফেরা করে তবে তার চরিত্রও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পক্ষামত্মরে যদি কেউ ঈমানের দৃঢ়তায় পরিপূর্ণ তাকওয়াবান ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করে এবং যথাসম্ভব তাদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে তবে তার মধ্যেও উত্তম গুণাবলিসমূহ প্রকাশ পেতে থাকবে। এমনকি পরিশেষে তার ঈমানও দুর্বল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে।

 যথাসম্ভব অসাধু সহচরদের থেকে দূরে থাকা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

عَنْ أَبِيْ مُوْسٰى ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : مَثَلُ الْجَلِيْسِ الصَّالِحِ وَالسَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيْرِ فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيْحًا طَيِّبَةً وَنَافِخُ الْكِيْرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيْحًا خَبِيْثَةً .

আবু মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, নেক ও সৎসঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হলো এমন দু’ব্যক্তির ন্যায়- যার একজন হলো মিশক আম্বার বহনকারী, আরেকজন হলো কামারের হাপর চালনাকারী। মিশক আম্বারওয়ালা হয় তোমায় কিছুটা দিবে, নতুবা তুমি তার থেকে কিনবে অথবা তুমি তার থেকে সুবাস লাভ করবে। অপরদিকে কামারের হাপর চালনাকারী হয় তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দিবে, নতুবা তুমি তার থেকে দুর্গন্ধ পাবে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৫৩৪; সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৭৩০৭; বায়হাকী, হা/১০৯০৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৪৮৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩২১৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩০৬৪; মিশকাত, হা/৫০১০।]

 তোমার নফসকে তার এরূপ বিকৃতির জন্য তিরস্কার করতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্বের অবস্থায় ফিরে না আসবে।

 সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যে, তোমার নেককর্মের আত্মগরিমা যেন তোমাকে ধোঁকায় ফেলে না দেয়। কেননা আমলের গৌরব কখনো কখনো আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَمُنُّوْنَ عَلَيْكَ اَنْ اَسْلَمُوْاؕ قُلْ لَّا تَمُنُّوْا عَلَيَّ اِسْلَامَكُمْۚ بَلِ اللهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ اَنْ هَدَاكُمْ لِلْاِيْمَانِ اِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ﴾

(হে রাসূল!) এরা (কি মনে করে যে) ইসলাম কবুল করে তারা আপনার উপর দয়া করেছে। তাদেরকে বলে দিন, তোমরা তোমাদের ইসলাম (গ্রহণ করার) দ্বারা আমাকে অনুগ্রহ করনি। বরং তোমরা যদি ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে (তোমাদের বুঝা উচিত যে) আল্লাহই তোমাদেরকে ঈমানের দিকে হেদায়াত করে অনুগ্রহ করেছেন। (সূরা হুজুরাত - ১৭)

 সর্বদা নিজের আমলসমূহ ত্রুটিপূর্ণ মনে করে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি তওবা ও ইস্তিগফার করতে থাকবে। কারণ মানুষ যখন স্বীয় আমল নিয়ে সমত্মুষ্ট থাকে তখন এটা তার জন্য বিপদের বড় কারণ হিসেবে রূপ নেয়। এমনকি কখনো কখনো এর মাধ্যমে আমল বিনষ্ট হয়ে যায়।

 প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর ওয়াজিব হচ্ছে পাপকার্য থেকে বেঁচে থাকা। কেননা পাপ মানুষের ঈমানের ভিত দুর্বল করে দেয়; এমনকি অনেক পাপ মানুষের ঈমানকেই বিনষ্ট করে দেয়।

৭২
৪. অনেকদিন পর্যন্ত অলসতাবশত নামায পড়েননি- এখন কী করবেন?
তওবা পূর্বের পাপরাশিকে ধ্বংস করে দেয়। কেননা আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপ মার্জনা করেন। সুতরাং আপনার উপর কর্তব্য হচ্ছে, আপনার পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং এগুলো ভবিষ্যতে পুনরায় সংঘটিত না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় করা। তারপর বেশি বেশি করে নফল আমলসমূহ পালন করা। যেমন- নফল নামায পড়া, নফল রোযা রাখা, যিকির করা, কুরআন পাঠ করা এবং দু‘আ করা ইত্যাদি।

৭৩
৫. কোন নারীকে নামায পড়ার কথা বললে সে ওজর দেখাতে থাকে- তার বিধান কী?
যে ব্যক্তি নামায পড়ে না, সে যদি নামাযকে অস্বীকারপূর্বক এমনটি করে থাকে, তাহলে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির হয়ে যাবে। এতে কারো দ্বিমত নেই। আর নামায ফরয হওয়াকে স্বীকৃতি দানের পর যদি কেউ নামায না পড়ে, তাহলেও সে আমলগতভাবে কুফরী কাজ করে। কেননা যে ব্যক্তি নামায পড়ে না অনেক হাদীসে তাকে কাফির সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ شَقِيْقٍ الْعُقَيْلِيِّ قَالَ : كَانَ اَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ -  - لَا يَرَوْنَ شَيْئًا مِنَ الْاَعْمَالِ تَرْكُهٗ كُفْرٌ غَيْرَ الصَّلَاةِ

আবদুল্লাহ ইবনে শাক্বীক্ব আল উক্বাইলী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাহাবীগণ নামায ত্যাগ করা ব্যতীত অন্য কিছুকে কুফরী মনে করতেন না। [তিরমিযী, হা/২৬২২; মিশকাত, হা/৫৭৯; রিয়াযুস সালিহীন, হা/৪৭০; জামেউল উসূল ফিল আহাদীস, হা/৩২৬৫।]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ اَبِيْهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : اَلْعَهْدُ الَّذِيْ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ اَلصَّلَاةُ . فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ

আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা (রাঃ) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমাদের ও কাফিরদের মধ্যে যে পার্থক্যকারী জিনিস রয়েছে তা হলো নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিল সে কুফরী করল। [তিরমিযী, হা/২৬২১; ইবনে মাজাহ, হা/১০৭৯; সুনানে বায়হাকী আল কুবরা, হা/৬২৯১।]

অতএব যখন সাব্যস্ত হলো যে, নামায ত্যাগকারী কাফির তখন সে তার স্বামীর জন্য হালাল থাকবে না।

৭৪
৬. পর্দাশীল মহিলাদেরকে উপহাস করার হুকুম কী?
যে ব্যক্তি কোন মুসলিম পুরুষ অথবা নারীকে তার ধার্মিকতা নিয়ে বিদ্রূপ করে সে কাফির। বিশেষ করে তা যদি পর্দার মতো কোন শরয়ী হুকুমের ক্ষেত্রে হয়। যে ব্যক্তি ওহীর কোন বিষয়কে অবহেলা করে অথবা এর উপর আমলকারীকে নিয়ে উপহাস করে, তবে সে পরোক্ষভাবে ঐ বিধানকেই অস্বীকার করে। এমন ব্যক্তির আমল বরবাদ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَتَعْسًا لَّهُمْ وَاَضَلَّ اَعْمَالَهُمْ ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوْا مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَأَحْبَطَ اَعْمَالَهُمْ﴾

আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য ধ্বংস এবং আল্লাহ তাদের আমল নিষ্ফল করে দিয়েছেন। কারণ, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অপছন্দ করেছে; তাই আল্লাহ তাদের আমল বরবাদ করে দিয়েছেন। (সূরা মুহাম্মাদ- ৮, ৯)

৭৫
৭. মহিলাদের প্যান্ট পরিধানের বিধান কী?
মুসলিম নারীদের জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তারা প্রগতির স্রোতে গা ভাসিয়ে কোন রকম যাচাই-বাছাই না করে হরেক রকম পোশাক পরিধান করবে। এ সমস্ত পোশাকের অধিকাংশই ইসলাম সমর্থিত পোশাকের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। যেমন- আঁট-সাঁট জামা, পাতলা কাপড়ের জামা, সম্পূর্ণ শরীর আবৃতকারী নয় এমন জামা ইত্যাদি।

সুতরাং বর্তমানে প্রচলিত প্যান্টও এ হুকুমের অমত্মর্ভুক্ত হবে। কেননা এটা আঁট-সাঁট পোশাকের অমত্মর্ভুক্ত। এটি নারীদের পায়ের মাপ, পেটের মাপ, কোমরের মাপ ইত্যাদি প্রকাশ করে দেয়।

ফলে এটা পরিধানকারী মহিলা ঐ বিশুদ্ধ হাদীসের আওতায় পড়ে যায় যা হচ্ছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُوْنَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيْلَاتٌ مَائِلَاتٌ رُءُوْسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, জাহান্নামবাসী দু’প্রকার, আমি যাদেরকে (এ পর্যন্ত) দেখিনি। একদল মানুষ, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা লোকজনকে মারবে এবং একদল স্ত্রী লোক, যারা কাপড় পরিহিত উলঙ্গ, যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের মতো। ওরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি তার সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ এত এত দূর হতে তার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৭০৪; জামেউস সগীর, হা/৭২৪৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৪৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৩২৬; মিশকাত, হা/৩৫২৪।]

৭৬
৮. উল্কি করা ও নকল চুল লাগানোর বিধান কী?
মুসলিম নারীদের জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তারা উল্কি করবে ও নকল চুল লাগাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, উল্কি করা, নকল চুল লাগানো মহিলা, চেহারার লোম (ভ্রু) উৎপাটনকারিণী, সৌন্দর্যের জন্য দাঁত ঘষে বিদীর্ণকারিণী এবং আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তনকারিণীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা লানত করেছেন। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৮৬; সহীহ মুসলিম, হা/৫৬৯৫; আবু দাউদ, হা/৪১৭১।]

৭৭
৯. নেল পালিশ লাগানো ও নখ লম্বা করার বিধান কী?
নখে নেল পালিশ লাগানো ও নখ লম্বা করা নিকৃষ্ট অভ্যাস, যা ইউরোপীয় চরিত্রহীনা ব্যভিচারিণীদের অভ্যাস ছিল। আজকাল অনেক মুসলিম নারীদের মাঝেও তা প্রবেশ করেছে এবং যা কিছু কিছু যুবকরাও করে থাকে। এতে আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন হয়। যারা এরূপ করবে তাদের উপর আল্লাহ লানত করেছেন। অন্যদিকে কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুকরণ করবে সে তাদেরই অর্ন্তভুক্ত। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫১১৪।]

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ফিতরাতী (স্বভাবজাত) কাজ ৫টি। যথা- খাতনা করা, (ক্ষৌর কার্য করা) অপর বর্ণনায় নাভির নিচের লোম মুন্ডানো, গোঁফ খাটো করা, নখ কর্তন করা, বগলের লোম তুলে ফেলা। [সহীহ বুখারী, হা/৫৮৯১; সহীহ মুসলিম, হা/৬২১; নাসাঈ, হা/৯।]

৭৮
১০. পরপুরুষের সাথে একাকী হওয়ার বিধান কী?
পরপুরুষের সাথে কোন বেগানা নারীর একাকী হওয়া বা নির্জনে অবস্থান করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ এর ফলে শয়তান তার উদ্দেশ্য হাসিলের সুযোগ পেয়ে যায়। এজন্য নবী ﷺ এ ব্যাপারে অত্যমত্ম কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞারোপ করেছেন। হাদীসে এসেছে,

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেন, মাহরাম লোকের উপস্থিতি ব্যতীত কোন পুরুষ যেন একাকী (গায়রে মাহরাম) নারীর কাছে না যায়। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্ত্রী হজ্জ করার জন্য বেরিয়ে গেছে এবং আমি অমুক অমুক জিহাদে যাওয়ার জন্য আমার নাম তালিকাভুক্ত করিয়েছি। নবী ﷺ বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সঙ্গে হজ্জ করো। [সহীহ বুখারী, হা/৩০০৬; সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৩৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৫২৯; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৩৯১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২০৪১; মিশকাত, হা/২৫১৩।]

রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো বলেছেন,

لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِاِمْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ

কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে একাকী হলেই শয়তান তাদের তৃতীয়জন হবে। [তিরমিযী, হা/১১৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৬৯২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪৩০।]

এখানে একাকীত্ব বলতে ঘরে, গাড়িতে, কিংবা বাজার অথবা ব্যবসার স্থলে নির্জনতাকে বুঝায়।

কারণ এসব ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কামভাব জাগ্রতকারী গোপনীয় আলাপ সংঘটিত হওয়া স্বাভাবিক। আর যদিও বা নারী ও পুরুষদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক পাপবিমুখ, আললাহভীরু, খিয়ানত ও পাপকর্ম অপছন্দকারী রয়েছে তবুও শয়তান তাদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং পাপকর্মকে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে কুমন্ত্রণা দেয়। তাই এসব ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করাই সর্বাধিক হেফাযত ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা।

৭৯
১১. পরপুরুষের সাথে নারীর মুসাফাহার (হাত মিলানোর) বিধান কী?
নারীর পক্ষে পরপুরুষের শরীর স্পর্শ করা জায়েয নয়। যে বসত্মু ফিতনার কারণ হয়ে থাকে সেটাই শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ ﷺ মহিলাদের সাথে কখনো মুসাফাহা করে বাই‘আত গ্রহণ করেননি।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! বাই‘আত গ্রহণকালে নবী ﷺ এর হাত কোন নারীর হাতকে স্পর্শ করেনি। নারীদেরকে তিনি কেবল কথা দ্বারাই বাই‘আত করিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৯১; তিরমিযী, হা/৩৩০৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৩৬৯; বায়হাকী, হা/১৬৩৪৩।]

৮০
১২. পরপুরুষের দিকে নারীর তাকানোর বিধান কী?
নারীর জন্য কল্যাণজনক হচ্ছে পরপুরুষকে না দেখা, আর পুরুষদেরও তাকে না দেখা। কেননা নারী হচ্ছে দুর্বল ধৈর্যশক্তির অধিকারী, এর ফলে কামভাব জেগে উঠার ও ফিতনার সম্মুখীন হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব এ থেকে দূরে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقُلْ لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ﴾

আর মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। (সূরা নূর- ৩১)

﴿قُلْ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْؕ ذٰلِكَ اَزْكٰى لَهُمْؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا يَصْنَعُوْنَ﴾

মুমিনদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে, এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত। (সূরা নূর- ৩০)

৮১
১৩. স্বামীর ভাই অথবা চাচাত ভাইদের সামনে আসার বিধান কী?
স্বামীর ভাই বা চাচাত ভাইয়েরা মুহরিমদের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই তাদের সম্মুখে তা প্রকাশ করা বৈধ নয়, যা কেবল মুহরিমদের সামনে প্রকাশ করতে পারে- যদিও তারা সৎ ও নির্ভরযোগ্য হয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : إِيَّاكُمْ وَالدُّخُوْلَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِّنَ الْأَنْصَارِ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ .

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাকো। তখন আনসারদের মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! দেবরদের ব্যাপারে কী নির্দেশ? তখন তিনি বললেন, দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য অর্থাৎ তার থেকে বেশি সতর্ক থাকা দরকার, যেন দেখা সাক্ষাৎ না হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৫২৩২; সহীহ মুসলিম, হা/৫৮০৩; তিরমিযী, হা/১১৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩৮৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৯১৭২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৯০১; মিশকাত, হা/৩১০২।]

৮২
১৪. মহিলাদের কণ্ঠস্বর এর বিধান কী?
আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে পুরুষদের সম্বোধনকালে স্বর কোমল করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। যাতে করে অন্তরের রোগী ব্যক্তি লোভ না করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا نِسَآءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا﴾

হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কোন সাধারণ স্ত্রীলোকের মতো নও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে (পরপুরুষের সাথে) কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কণ্ঠে কথা বলবে না, যাতে যার অন্তরে (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে সে লালায়িত হতে পারে। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। (সূরা আহযাব- ৩২)

যখন মুমিনগণ ঈমানী শক্তি সামর্থ্যের বলে বলিয়ান ছিলেন, তখনকার ব্যাপারই যদি এই হয়- তবে এ যুগের অবস্থা কেমন হতে পারে, যখন ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং ধার্মিকতা কমে গেছে? অতএব তোমার কর্তব্য হচ্ছে পরপুরুষদের সংস্রব কমানো এবং তাদের সাথে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কম কথা বলা।

৮৩
১৫. গান-বাজনা শ্রবণ করার বিধান কি?
গান বাজনা শোনা হারাম। এতে কোন সন্দেহ নেই। গান অন্তরে কপটতা সৃষ্টি করে। আর গান শোনা হচ্ছে অনর্থক কথা ও তার দিকে ধাবিত হওয়ার নামান্তর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّشْتَرِيْ لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍۗ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًاؕ اُولٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ﴾

মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞতাবশত অমূলক কাহিনী ক্রয় করে নেয় এবং আল্লাহর দেখানো পথকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের বস্তু বানিয়ে নেয়। (জেনে রেখো) এদের জন্যই রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। (সূরা লুকমান- ৬)

ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ঐ আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, এটা হচ্ছে গান। [দুররুল মানসূর, ১১/৬১৬ পৃঃ ; তাফসীরে তাবারী, ১৮/৫৩৫ পৃঃ ; কুরতুবী, ১১৪/৫২।]

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ গান-বাজনা হারাম করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْحِرَ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

আমার উম্মতের মধ্যে এমন অনেক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে, যারা যিনা-ব্যভিচার, রেশমী কাপড় ব্যবহার, মদ্যপান ও গান-বাজনা হালাল মনে করবে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৫৯০; আবু দাউদ, হা/৪০৪১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৬৭; মিশকাত, হা/৫৩৪৩।]

৮৪
১৬. বিবাহপূর্ব সম্পর্ক গড়ে তোলার বিধান কী?
বিবাহের পূর্বে প্রস্তাব প্রেরণ ও গ্রহণের পরে হলেও কারো সাথে কোনরূপ সম্পর্ক গড়ে তোলা বৈধ হবে না। কেননা কোন নারীর আক্বদ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে পুরুষদের জন্য হারাম থাকে। কোন ব্যক্তির পক্ষে জায়েয নয় যে, সে পর নারীর সাথে কথা, দর্শন বা নির্জনতার মাধ্যমে স্বাদ ভোগ করবে। হাদীসে এসেছে,

কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জন হবে না মুহরিম ছাড়া। আর কোন নারী সফর করবে না মুহরিম ব্যতীত। [সহীহ বুখারী, হা/৩০০৬; সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৩৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৫২৯; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৩৯১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২০৪১; মিশকাত, হা/২৫১৩।]

৮৫
১৭. মলদ্বার দিয়ে সহবাস করার বিধান কী?
মলদ্বার দিয়ে সহবাস করা হারাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, সামনে করো কিংবা পেছনে করো, তবে নিতম্ব ও ঋতুস্রাব হতে বেঁচে থাকো। [তিরমিযী, হা/২৯৮০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪২০২; বায়হাকী, হা/১৩৯০৩; মিশকাত, হা/৩১৯১।]

অপর হাদীসে আছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ ، قَالَ : لَا يَنْظُرُ اللهُ إِلٰى رَجُلٍ جَامَعَ امْرَأَتَه فِيْ دُبُرِهَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা নিতম্বে সহবাসকারীদের দিকে তাকাবেনও না। [ইবনে মাজাহ, হা/১৯২৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৫১৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪২০৪; মিশকাত, হা/৩৫৮৫।]

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ঋতুবতী অবস্থায় বা স্ত্রীর নিতম্বে সহবাস করে অথবা কোন জ্যোতিষের নিকট যায়, তাহলে মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সে অস্বীকার করল। [তিরমিযী, হা/১৩৫; ইবনে মাজাহ, হা/৬৩৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০১৭০; মিশকাত, হা/৫৫১।]

৮৬
১৮. হায়েয অবস্থায় সহবাস করার বিধান কী?
যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি হায়েয অবস্থায় সহবাস করা হালাল মনে করে, তাহলে সে কাফির ও মুরতাদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে যদি কেউ ভুলবশত বা হায়েয হয়নি মনে করে সহবাস করে ফেলে, তাহলে গোনাহ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ فَاعْتَزِلُوا النِّسَآءَ فِى الْمَحِيْضِ﴾

সুতরাং তোমরা হায়েযের সময় সহবাস করা থেকে দূরে থাকো। (সূরা বাকারা- ২২২)

৮৭
১৯. স্বামী-স্ত্রীর গোপন বিষয় ফাঁস করার বিধান কী?
সহবাস সংক্রামত্ম সমস্ত গোপন বিষয়সমূহ ফাঁস করা উভয়ের উপর হারাম। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ঐ ব্যক্তি ও ঐ মহিলা, যারা উভয়ে মেলামেশা করে অতঃপর মানুষের নিকট তার গোপনীয়তা প্রকাশ করে। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৬১৫; মিশকাত, হা/৩১৯০।]

৮৮
২০. হায়েয বন্ধ করার উপকরণ ব্যবহার করার বিধান কী?
মহিলাদের হায়েয বন্ধ করার উপকরণ নিম্নে বর্ণিত দুটি শর্তে ব্যবহার করা বৈধ :

প্রথম শর্ত : যদি মহিলার কোন ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে। আর যদি তাতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে বৈধ হবে না।

দ্বিতীয় শর্ত : যদি তার সাথে স্বামীর কোন অধিকার সম্পৃক্ত থাকে। তবে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। যেমন- কোন মহিলা ইদ্দত পালন করা অবস্থায় আছে। স্বামীর প্রতি তার খাওয়া-পরা দেয়া ওয়াজিব। এ অবস্থায় সময় দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে যদি স্ত্রী হায়েয বন্ধ করার উপকরণ ব্যবহার করে, তবে স্বামীর উপর ন্যস্ত খাওয়া-পরা দেয়ার মেয়াদকাল দীর্ঘায়িত হবে। ফলে স্বামীর অনুমতি ব্যতীত হায়েয বন্ধ রাখার উপকরণ ব্যবহার করা ঐ স্ত্রীর জন্য বৈধ হবে না।

উল্লেখ্য যে, যেসব ক্ষেত্রে হায়েয বন্ধ করার উপকরণ ব্যবহার করা বৈধ রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রেও একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত তা ব্যবহার না করা উত্তম। কেননা আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মকে আপন গতিতে চলতে দেয়া অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ।

৮৯
২১. জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকরণ ব্যবহার করার বিধান কী?
জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকরণ ব্যবহার করার অবস্থা দু’প্রকার :

প্রথম প্রকার : স্থায়ী গর্ভনিরোধ। এটা বৈধ নয়। কেননা গর্ভ বন্ধ হলে বংশধারা কমে যাবে। এটা আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মের পরিপন্থী।

দ্বিতীয় প্রকার : সাময়িক গর্ভনিরোধ। এটা একামত্ম প্রয়োজন হলে জায়েয আছে; নতুবা জায়েয নয়। যেমন- কোন মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছে অথবা অধিক গর্ভধারণের কারণে সে ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সাময়িকভাবে স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ قَالَ كُنَّا نَعْزِلُ عَلٰى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ - - فَبَلَغَ ذٰلِكَ نَبِىَّ اللهِ - - فَلَمْ يَنْهَنَا

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে আযল করতাম। অতঃপর এ সংবাদ নবী ﷺ এর কাছে পৌঁছল, কিন্তু তিনি আমাদেরকে তা হতে নিষেধ করেননি। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৬৩৪।]

আযল হচ্ছে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যৌনসম্ভোগ করবে, কিন্তু বাইরে বীর্যপাত ঘটাবে।

৯০
২২. গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট করার বিধান কী?
নিষ্প্রয়োজনে গর্ভপাত ঘটানো যাবে না। তবে একান্ত প্রয়োজনে যেমন- কোন মহিলা এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে, সে গর্ভধারণ সহ্য করতে পারছে না, অথবা অনুরূপ অন্য কোন কারণ থাকে, তবে তার পক্ষে গর্ভপাত ঘটানো বৈধ। তবে এটা রূহ সঞ্চার হওয়ার পূর্বে হতে হবে। অর্থাৎ ১২০ দিন অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত বৈধ। এরপর হারাম।

৯১
২৩. সিজার করার বিধান কী?
একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত অপারেশন করা বৈধ নয়। কারণ শরীর বান্দার নিকট আল্লাহর আমানত। এতে অধিক উপকারের উদ্দেশ্য ব্যতীত বান্দার হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। কিন্তু অবস্থা যদি এমন হয় যে, অপারেশন ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই, তবে তা করা বৈধ হবে।

৯২
নারীরা যেসব ভুল বেশি করে থাকে
১. দ্বীনের জ্ঞান থেকে দূরে থাকা :

অধিকাংশ মহিলা অবসর সময় পেলে জ্ঞান অর্জন না করে গল্প-গুজব করে সময় অতিবাহিত করে। ফলে তারা ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে।

২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ থেকে দূরে থাকা :

অধিকাংশ মহিলাই এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা থেকে দূরে রয়েছে। অনেকের এ ধারণাই নেই যে, মহিলাদেরকে মহিলারাই দ্বীনের পথে আনার ক্ষেত্রে বেশি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

৩. পাপকে ছোট মনে করা :

অনেক মহিলা এমন রয়েছে, যারা অনেক পাপকেই হালকাভাবে দেখে। এজন্য তারা ঐসব পাপের মধ্যে লিপ্ত থাকে। অথচ সগীরা গোনাহ বার বার করার ফলে তা কবীরা গোনাহের পর্যায়ে চলে যায়।

৪. সময় নষ্ট করা :

অধিকাংশ মহিলা জীবনের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে ফেলে। কাজকর্মের ফাঁকে যে সময়টুকু পাওয়া যায়, তা আখেরাতের কাজে ব্যয় করে না।

৫. দীর্ঘ সময় ধরে ফোনালাপ করা :

অনেক নারীই পরপুরুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া ফোনে আলাপ করে থাকে। অথচ এটা নারী-পুরুষ কারো জন্যই জায়েয নয়।

৬. টেলিভিশন দেখা :

নারীরা একটু অবসর পেলেই টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের নাচ-গান দেখে থাকে। অথচ এগুলো একজন মুসলিম নারীর জন্য জায়েয নয়।

৭. শরীরের অঙ্গ প্রদর্শন করা :

অনেক মুসলিম নারী বিভিন্নভাবে নিজেদের শরীরের অঙ্গভঙ্গিকে পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করে থাকে। অথচ এটা হারাম।

৮. পর্দা না করা :

বর্তমান সময়ে অধিকাংশ নারী আল্লাহর নির্ধারিত একটি ফরয বিধান পর্দাকে লঙ্ঘন করে থাকে। তারা বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়ে বেপর্দা হয়ে রাসত্মায় চলাফেরা করে থাকে।

৯. নারীদের সুগন্ধি মেখে রাস্তায় বের হওয়া :

অনেক নারী রয়েছে, যারা সাজগোজ তো করেই- এর উপর আবার সেন্ট বা কড়া সুগন্ধি মেখে রাসত্মায় বের হয়। কোন মুসলিম নারীর জন্য এমন কাজ করা কোনভাবেই সঠিক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ সুগন্ধি ব্যবহার করে রাসত্মায় বের হওয়া থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন হাদীসে এসেছে,

عَنِ اَبِىْ مُوْسٰى الْأَشْعَرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ أَيُّمَا امْرَأَةٍ اِسْتَعْطَرَتْ فَمَرَّتْ عَلٰى قَوْمٍ لِيَجِدُوْا مِنْ رِيْحِهَا فَهِيَ زَانِيَةٌ

আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করে কোন সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে যাতে তারা তার সুগন্ধি পায়, তাহলে সে মহিলা ব্যভিচারিণী। [তিরমিযী, হা/২৭৮৬; নাসাঈ, হা/৫১২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৭২৬; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩৪৯৭; জামেউস সগীর, হা/৩২৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২০১৯; মিশকাত, হা/১০৬৫।]

১০. পাশ্চাত্য নারীদের অনুসরণ :

অনেক নামধারী মুসলিম নারী নিজেদেরকে মর্যাদাবান করে তোলার জন্য ইসলামী আদর্শকে বাদ দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শ গ্রহণ করে থাকে। তারা চলাফেরায়, পোশাক-পরিচ্ছদে ঐসব নারীর অনুসরণ করে থাকে। যার ফলস্বরূপ বর্তমান সময়ের নারীরা রাসত্মায় বের হলে পদে পদে লাঞ্চিত ও ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।

১১. নারী পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করা :

অনেক নারী রয়েছে, যারা পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে পছন্দ করে। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিকতার নাম দিয়ে বহু নারীকে সরাসরি পুরুষের পোশাক পরিধান করতে দেখা যাচ্ছে। যে নারীর মধ্যে ঈমান আছে সে নারী কখনো পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারে না। মূলত শয়তান যাদেরকে কাবু করে নেয় এবং যাদের দ্বারা সে তার উদ্দেশ্য বাসত্মবায়ন করে এমন নারীরাই এ কাজ করতে পারে। সুতরাং কোন মুসলিম নারীর জন্য পুরুষের বেশ ধারণ করা কোনভাবেই উচিত নয়। এ ব্যাপারে নিচের হাদীসটি লক্ষণীয় :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُتَشَبِّهِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যেসকল পুরুষ মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যেসকল মহিলা পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে আল্লাহর রাসূল তাদের উপর অভিশম্পাত করেছেন। [সহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৯০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩১৫১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৭৫১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১১৪৮১; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩২০৬; জামেউস সগীর, হা/৯২৩১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৬৭; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২৭০২৪; মিশকাত, হা/৪৪২৯।]

১২. খারাপ বান্ধবীদের সঙ্গী হওয়া :

অনেক ভালো মেয়ে আছে, যারা খারাপ বান্ধবীদের সঙ্গে চলাফেরা করে। এসব বান্ধবীদের চরিত্রের কু-প্রভাব ঐসব ভালো মেয়ের উপরও পড়ে। যার ফলে ভালো মেয়েরাও অতি তাড়াতাড়ি খারাপের দিকে ধাবিত হয়।

১৩. গান শ্রবণ করা :

অনেক মুমিন নারীই গান গাইতে এবং গান শুনতে পছন্দ করে। এমনকি তারা গানের প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করে। অথচ ইসলামে এসব হারাম।

১৪. যিনায় লিপ্ত হওয়া :

অনেক নারী এমন রয়েছে, যারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিলেও যিনার মতো খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। তারা খারাপ ছেলেদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং এই সম্পর্ক তাদেরকে এক পর্যায়ে যিনার মতো নিষিদ্ধ কাজের দিকে নিয়ে যায়।

১৫. খোলা জায়গায় গোসল করা :

গ্রামে-গঞ্জে বহু নারী রয়েছে, যারা গোসল করতে গেলেও পর্দা করে না। তারা পরপুরুষদের চোখের সামনেই এমনকি কোথাও কোথাও তাদের সাথেই পুকুর ঘাটের গোসল করে থাকে। অথচ এটা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম। এর ফলস্বরূপ ঐ সমাজের নারী-পুরুষরা অতি সহজেই নানা প্রকার অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়ে যায়।

১৬. কোমল সুরে পরপুরুষের সাথে কথা বলা :

ইসলাম নারীদেরকে পরপুরুষদের সাথে এমন সুরে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে, যার মাধ্যমে পুরুষরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজে অনেক নারীই ইসলামের এই বিধানটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে না। তারা সামাজিকতার দোহাই দিয়ে পরপুরুষদের সাথে সুন্দর ও মিষ্টি সুরে কথা বলে। আবার অনেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরপুরুষদের সাথে কথা বলে থাকে। এর ফলে মুসলিম সমাজে নানা ধরনের অশ্লীলতা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং নানা ধরনের সামাজিক অপরাধের বিকাশ ঘটছে।

১৭. মিথ্যা বলা :

নারীদের মধ্যে মিথ্যা বলার অভ্যাস অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। অথচ মিথ্যা কথা বলা বড় ধরনের অপরাধ। এর মাধ্যমে সমাজ ধ্বংস হয়। মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন না। এর পরিণাম জাহান্নাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِيْ إِلَى الْفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِيْ إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا

নিশ্চয় মিথ্যা পাপের পথ খুলে দেয়, আর পাপ জাহান্নামের পথ খুলে দেয়। আর যখন কোন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে থাকে তখন সে আল্লাহর কাছে মিথ্যুক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৯৪; সহীহ মুসলিম, হা/৬৮০৩; আবু দাউদ, হা/৪৯৯১; তিরমিযী, হা/১৯৭১; ইবনে মাজাহ, হা/৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬৩৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৭৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/২১৩৩৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২৬১১২; মুসনাদে দারেমী, হা/২৭৫৭; মিশকাত, হা/৪৮২৪।]

১৮. অহংকার করা :

অনেক নারী এমন রয়েছে, যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অহংকার প্রকাশ করে থাকে। বিশেষ করে যাদের ভালো কোন গুণাবলি রয়েছে, তারা এসব নিয়ে ঐসব নারীদের সাথে গর্ব করে, যাদের এসব গুণাবলি নেই। অথচ অহংকার করা কোন মুসলিম নারীর জন্য শোভা পায় না। এ অহংকারবোধের কারণেই ইবলিস আল্লাহর লানতে পড়েছিল এবং জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। অহংকারবোধ ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। অহংকারের কারণেই মানুষ পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অনাচার সৃষ্টি করে। অহংকারীর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ عَنِ النَّبِىِّ - قَالَ : لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِىْ قَلْبِه مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে যেতে পারবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭৫; তিরমিযী, হা/১৯৯৯; জামেউস সগীর, হা/১৩৬৩২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৯১২; মিশকাত, হা/৫১০৮।]

১৯. হিংসা-বিদ্বেষ :

অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের মধ্যে প্রচুর হিংসা-বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায়; অথচ হিংসা করা হারাম। হিংসা-বিদ্বেষ মানবতার জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয়। হীন মানসিকতা, পদমর্যাদার লোভ, নিজের উদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা- এসব থেকেই হিংসা-বিদ্বেষের জন্ম হয়। ইসলামী শরীয়তে হিংসা করা হারাম। ব্যক্তির চরিত্র গঠনে হিংসা-বিদ্বেষ বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয় এবং বিপর্যয় দেখা দেয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِىَّ - - قَالَ : لَا تَحَاسَدُوْا وَلَا تَبَاغَضُوْا وَلَا تَقَاطَعُوْا وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, তোমরা হিংসা করো না, ক্রোধান্বিত হয়ো না এবং পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করো না। আর তোমরা এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাও। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৬৯৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭১৬০।]

২০. অশ্লীল কথাবার্তা :

নারীদের মধ্যে অশ্লীলতার চর্চা অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা গালিগালাজ শুরু করে দেয়। অথচ অশ্লীল কথাবার্তা অসচ্চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত। অশ্লীল কথাবার্তা ও গালিগালাজ করা জায়েয নেই। মানুষ প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে আবার কখনো ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এ ধরনের কথাবার্তা বলে থাকে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلَا اللَّعَّانِ وَلَا الْفَاحِشِ وَلَا الْبَذِىءِ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কারো উপর দোষারোপ করে না, কারো প্রতি লানত করে না, কারো উপর অভিশাপ দেয় না এবং সে কারো সাথে কর্কশ ভাষায় কথাবার্তা বলে না। [তিরমিযী, হা/১৯৭৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৯২; মুসনাদুল বাযযার, হা/১৫২৩; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৫৩৭৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/২১৩১৪; আদাবুল মুফরাদ, হা/৩১২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১০৩৩২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২৯; জামেউস সগীর, হা/৯৫১২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩২০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩০৯৭৩; মিশকাত, হা/৪৮৪৬।]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَقِتَالُهٗ كُفْرٌ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কোন মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসিকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০; তিরমিযী, হা/১৯৮৩; নাসাঈ, হা/৪১০৭; ইবনে মাজাহ, হা/৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৬৪৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৯৩৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/১৬৬০; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৯৯৫৮; জামেউস সগীর, হা/৫৯০৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৭৭৯; মুসনাদে হুমাইদী, হা/১১০; মিশকাত, হা/৪৭১৪।]

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ গালিগালাজ করতেন না, অশালীন উক্তি করতেন না এবং তিনি অভিশাপকারীও ছিলেন না। তিনি আমাদের কারো উপর নারাজ হলে কেবল এতটুকু বলতেন যে, তার কী হলো! তার কপাল ধুলায় ধূসরিত হোক। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৩১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২২৯৬; মুসনাদুল বাযযার, হা/৬২২৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/২১৩১১; আদাবুল মুফরাদ, হা/৪৩০; মিশকাত, হা/৫৮১১।]

অশালীন কথাবার্তা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ হলো সীমালঙ্ঘন। যদি কোন ব্যক্তি অপর কারো বাবা-মাকে গালি দেয়, তবে অপরজনও তার বাবা-মাকে গালি দেয়। এভাবে সীমালঙ্ঘন হয়ে যায়। অশালীন ও অশ্লীল কথা বলতে যারা অভ্যস্ত তাদেরকে লোকেরা ঘৃণা করে। কেউ তাদের সাথে চলাফেরা করতে চায় না। কেননা গালমন্দ করা ভদ্রতার পরিপন্থী কাজ। এজন্যই হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِه وَيَدِه

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, প্রকৃত মুসলিম সে ব্যক্তি, যার কথা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। [সহীহ বুখারী, হা/১০; সহীহ মুসলিম, হা/১৭১; আবু দাউদ, হা/২৪৮৩; তিরমিযী, হা/২৬২৭; মিশকাত, হা/৬।]

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا قَالَ النَّبِىُّ -- .... يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْفَاحِشَ الْمُتَفَحِّشَ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, হে আয়েশা! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা অশ্লীল ও কর্কশভাষী লোকদেরকে পছন্দ করেন না। [আবু দাউদ, হা/৪৭৯৪; জামেউস সগীর, হা/১৩৮৮২।]

২১. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া :

এমন অনেক নারী রয়েছে, যারা প্রতিবেশীর সম্মান বুঝে না। অনেকে ছোট-খাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া করে। এমনকি অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজও করে। আর এর জের ধরে অনেক দিন পর্যমত্ম প্রতিবেশীর সাথে কথা বলা, তাদের সাথে উঠাবসা বন্ধ রাখে। অথচ এমন কাজ ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না। সুতরাং প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لَا يَأْمَنُ جَارُهٗ بَوَائِقَهٗ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যার অত্যাচার থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/১৮১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৪২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫৫০; মিশকাত, হা/৪৯৬৩।]

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তৃপ্তিসহকারে পেটপুরে খায়; অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়। [মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৬৯৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/২০১৬০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২১৬৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৭৫০; জামেউস সগীর, হা/৯৫১৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৪৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫৬১; মিশকাত, হা/৪৯৯১।]

২২. পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করা :

মুমিনদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন কারণে অনেকেই আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে। বিশেষ করে এমন অনেক মহিলা রয়েছে, তারা যখন কোন বিষয় নিয়ে কারো সাথে রাগারাগি করে বা ঝগড়া করে তখন কসম খেয়ে বলে ফেলে- অমুক জিনিস খাব না, অমুকের বাসায় যাব না ইত্যাদি। অথচ কোন মুসলিম নারীর জন্য এসব কাজ করা বৈধ নয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ عَنِ النَّبِيِّ يَقُوْلُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ

জুবায়ের ইবনে মুতঈম (রাঃ) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৪; সহীহ মুসলিম, হা/৬৬৮৪; আবু দাউদ, হা/১৬৯৮; তিরমিযী, হা/১৯০৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৭৭৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৫৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫৪০; মিশকাত, হা/৪৯২২।]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, পারস্পরিক সম্পর্ক রহমান হতে নির্গত হয়েছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে ব্যক্তি সম্পর্ক বজায় রাখবে আমি তার উপর রহমত বর্ষণ করব। আর যে ব্যক্তি সম্পর্ক ছিনণ করবে আমি তার থেকে রহমত বন্ধ করে দেব। [সহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৮; তিরমিযী, হা/১৯২৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৯১৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৪২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৫৩০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯২৫; মিশকাত, হা/৪৯২০।]

২৩. চোগলখোরী করা :

অনেক নারী নিয়মিত চোগলখোরীর মধ্যে লিপ্ত থাকে। প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, কয়েকজন নারী যখন একত্রিত হয়, তখন তারা অনুপস্থিত নারীদের ব্যাপারে চোগলখোরীতে লিপ্ত হয়ে যায়। অথচ আল্লাহর নবী চোগলখোরদের ব্যাপারে বলেছেন যে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ حُذَيْفَةَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ يَقُوْلُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ

হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৫৬; সহীহ মুসলিম, হা/৩০৪; আবু দাউদ, হা/৪৮৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩২৯৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৯৫৪; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/১১৫৫০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১০৩৪; মিশকাত, হা/৪৮২৩।]

২৪. খোটা দেয়া :

খোটা দেয়াও নারীদের একটি বদ অভ্যাস। যখন কারো সাথে মনোমালিন্য হয় তখন সে তার প্রতি অনুগ্রহ করে থাকলে অনর্গল খোটা দিতে থাকে। অথচ অনুগ্রহ করে খোটা দিলে অনুগ্রহের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। তাই সবাইকে খোটা দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। হাদীসে এসেছে,

আবু যর (রাঃ) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, তিন প্রকার লোকের সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টিপাতও করবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, আর তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। আর তিনি এ বাক্যগুলো তিন বার উচ্চারণ করলেন। তখন আবু যর (রাঃ) বললেন, তার তো ধ্বংস অনিবার্য এবং সে ক্ষতিগ্রসত্ম হবে- হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? তিনি বললেন, ১. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, ২. দান করে খোটাদানকারী, ৩. মিথ্যা শপথ করে পণ্যদ্রব্য বিক্রয়কারী। [সহীহ মুসলিম, হা/৩০৬; আবু দাউদ, হা/৪০৮৯; তিরমিযী, হা/১২১১; ইবনে মাজাহ, হা/২২০৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৩৪; মিশকাত, হা/২৭৯৫।]

২৫. স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞ না হওয়া :

স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া নারীদের একটি স্বভাবজাত অভ্যাস। কোন স্বামী তাদের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করলেও যদি কোন সময় সামান্য ব্যতিক্রম হয় তবে তারা আগের অনুগ্রহকে ভুলে যায়। এমনটি করা কোন মুসলিম নারীর জন্য উচিত নয়। স্বামীর অবস্থা ও সঙ্গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে যা কিছু পাওয়া যায় তার উপর সমত্মুষ্ট থেকে সৎভাবে জীবনযাপন করাই মুসলিম নারীর কর্তব্য। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ أُرِيْتُ النَّارَ فَإِذَا أَكْثَرُ أَهْلِهَا النِّسَاءُ يَكْفُرْنَ قِيْلَ أَيَكْفُرْنَ بِاللهِ قَالَ يَكْفُرْنَ الْعَشِيْرَ وَيَكْفُرْنَ الْإِحْسَانَ لَوْ أَحْسَنْتَ إِلٰى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমাকে জাহান্নাম দেখানো হলো। আর (তখন) আমি দেখতে পেলাম যে, জাহান্নামের অধিকাংশই মহিলা, যারা কুফরী করত। প্রশ্ন করা হলো, তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করত? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তারা স্বামীর সাথে কুফরী করে থাকে। তারা স্বামীর উপকার স্বীকার করে না। তুমি যদি তাদের কারো প্রতি জীবনভর অনুগ্রহ করে থাক, এরপর সে তোমার পক্ষ হতে যদি কোন সময় খারাপ কিছু দেখতে পায় তখন সে বলে ফেলে, আমি কখনো তোমার নিকট থেকে কোন ভালো কিছু পাইনি। [সহীহ বুখারী, হা/২৯; নাসাঈ, হা/১৪৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৩৭৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৫২৭; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/১৯৭৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/১১৪০; মিশকাত, হা/১৪৮২।]

২৬. গীবত করা ও শোনা :

অনেক মহিলা এমন রয়েছে, যারা সুযোগ পেলেই বা একটু অবসর পেলেই গীবতের মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, যখন কয়েকজন নারী একত্রিত হয়, তখনই তারা অন্য মানুষের গীবত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে চায়। অথচ গীবত করা হারাম। গীবত করাকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا يَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَّأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ﴾

আর তোমাদের মধ্যে কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে?। (সূরা হুজুরাত- ১২)

২৭. তাবিজ-কবজ ব্যবহার করা :

তাবিজ-কবজ ব্যবহার করা এবং এর প্রতি বিশ্বাস রাখা নারীদের একটি মারাত্মক কু-অভ্যাস। বিভিন্ন ব্যাপারে তারা তাবিজ-কবজ ব্যবহার করে থাকে এবং তাবিজ-কবজ ব্যবহার করার জন্য অন্যকেও উৎসাহিত করে থাকে। মূলত অজ্ঞতার কারণেই তারা এমনটি করে থাকে। তাবিজ-কবজ ব্যবহার করা শিরকী কাজ। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ الْجُهَنِيِّ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ ، فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ ، فَقَالُوْا : يَا رَسُوْلَ اللهِ ، بَايَعْتَ تِسْعَةً وَتَرَكْتَ هٰذَا ؟ قَالَ : إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيْمَةً فَأَدْخَلَ يَدَهٗ فَقَطَعَهَا ، فَبَايَعَهٗ ، وَقَالَ : مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ

উকবা ইবনে আমের আল জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ এক সম্প্রদায়ের নিকট গেলেন। অতঃপর তাদের নয়জনের থেকে বাইআত গ্রহণ করলেন এবং একজন থেকে করলেন না। লোকজন বলতে লাগল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নয়জনের কাছ থেকে বাইআত নিলেন; কিন্তু একজনকে ছেড়ে দিলেন- এর কারণ কী? তিনি বললেন, তার সাথে তাবিজ রয়েছে। অতঃপর সে লোকটি তার হাত ঢুকাল এবং তাবিজটি ছিঁড়ে ফেলল। এরপর নবী ﷺ তার বাইআত গ্রহণ করলেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তাবিজ লটকাল সে শিরক করল। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৪৫৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪২৯৯।]

২৮. মাযারে দান করা :

অনেক মহিলা রয়েছে, যারা একটু বিপদাপদে পড়লেই আল্লাহকে স্মরণ করার পরিবর্তে বিভিন্ন মাযার ও দর্গায় চলে যায়। মাযারের জন্য মান্নত করে। অথচ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাযার ও দরগায় যাওয়া, সেখানে কোন কিছু দেয়ার জন্য মান্নত করা, সেখানে টাকা-পয়সা ও অন্য কিছু দান করা ইত্যাদি শিরকী কাজ।

২৯. পীর-মুরিদীতে বিশ্বাস করা :

অনেক মহিলা রয়েছে, যারা পীরের ভক্ত। ধর্মজ্ঞানে অজ্ঞ অনেক মানুষের আকীদা বা বিশ্বাস হলো, পীরের কাছে মুরিদ হওয়া ব্যতীত জান্নাতে যাওয়া যায় না। বর্তমানে পীর-মুরিদীর যে সিলসিলা দেখা যাচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ নবোদ্ভাবিত। এটা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে ছিল না, তিনি কখনো পীর-মুরিদী করেননি। সাহাবায়ে কেরামও কখনো এই পীর-মুরিদী করেননি। তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের যুগেও এ পীর-মুরিদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ বর্তমানকালের এক শ্রেণির জাহেল লোক এ পীর-মুরিদীকে ইসলামের অন্যতম ভিত্তিগত বিষয় বলে প্রচারণা চালাচ্ছে।

৩০. পীর বা আওলিয়াদেরকে ওসীলা বানানো :

ইসলাম সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণে ইসলামের নামে অনেক শিরক ও বিদআতের প্রচলন ঘটেছে। এর মধ্যে একটি হলো, ওলী-আওলিয়াদের ওসীলা নিয়ে দু‘আ করা ও তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া। অনেক মহিলা রয়েছে, যারা এ ভুলটি বিনা দ্বিধায় করে যাচ্ছেন। অথচ ইসলামী শরীয়তের বিধান হচ্ছে, কেউ যদি ওসীলা নিতে চায় তবে যেসব ওসীলা কুরআন ও সুন্নাহতে রয়েছে সেসব বিষয়ের ওসীলা নিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেছেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَابْتَغُوْاۤ اِلَيْهِ الْوَاسِيْلَةَ وَجَاهِدُوْا فِىْ سَبِيْلِه لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! আলস্নাহ তা‘আলাকে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের ওসীলা অমেবষণ করো ও তাঁর পথে সংগ্রাম করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা মায়েদা- ৩৫)

সঠিক ওসীলা কী :

সঠিক ওসীলা হচ্ছে নেক আমল। কেউ কোন নেক আমল করে এর ওসীলা নিতে পারে। যেমন- বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি বিপদে পড়ে তারা নিজেদের নেক আমলের ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।

এছাড়াও আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নামের ওসীলা নিয়ে তাঁর কাছে চাওয়া যায় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা যায়। আলস্নাহ তায়ালা বলেন,

﴿وَ لِلّٰہِ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی فَادۡعُوۡہُ بِہَا ﴾

আর আলস্নাহর জন্যই রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামের মাধ্যমে ডাকো। (সূরা আরাফ- ১৮০)

কিন্তু মৃত ওলী-আওলিয়াদের কবরের কাছে যাওয়া, তাদের নামে মানত করা, তাদের কাছে নিজের অভাব অভিযোগের কথা বলা এবং এসব কাজকর্মের মাধ্যমে ওসীলা গ্রহণ করা শুধু নিষিদ্ধই নয়; বরং এগুলো শিরক ও কুফরী। কেউ এগুলোতে লিপ্ত হলে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য উচিত হলো যাবতীয় শিরকী কাজ থেকে দূরে থাকা। কারণ যে শিরক করে তার জন্য আল্লাহর জান্নাত হারাম হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেছেন,

﴿ اِنَّهٗ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَاْوَاهُ النَّارُؕ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ﴾

যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (ফলে) তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা– ৭২)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন