মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
১৫শ অধ্যায় : তাকওয়ার পরীক্ষা
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর তাকওয়ার পরীক্ষা
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/573/85
তাকওয়ার প্রথম পরীক্ষা
আমরা সকলেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর ঘটনা জানি। তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান নমরূদ ও তার সরকার তৌহিদের দাওয়াত দেয়ার কারণে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন। এখানে লক্ষণীয়,
১) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম জানতেন যে নমরূদের কাছে আত্মসমর্পণকরলে তাকে আগুনে ফেলা হবে না, কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি আগুনে পুড়তে প্রস্তুত হলেন, কিন্তু কেন?
২) যখন ফিরিশতাগণ সাহায্য করতে চাইলেন তখনও তিনি তাদের সাহায্য চাননি! কিন্তু কেন সাহায্য চাইলেন না? এবং
৩) যখন তাকে আগুনে ফেলার সিদ্ধান্ত হলো তখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে, কাউকে আগুনে ফেলার পর সে আগুন থেকে বেঁচে এসেছিল। ফলে আগুনে ফেলার সময় তার মনের প্রস্তুতি কিরূপ ছিল?
উত্তর :
১) তিনি তৌহিদের দাওয়াত দিয়েই দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তিনি অন্য কোন অপরাধ করে আসামী হননি।
২) ফিরিশতাদের নিকট সাহায্য চাইলেও তার অর্থ হতো আল্লাহর উপর আস্থা থাকা ।
৩) তিনি জানতেন যে, আগুনে ফেললে কেউ কোন দিনেই তার থেকে রেহাই পায় না এবং এটাও বুঝেছিলেন যে সত্যের প্রচারক হয়ে বাতিলের হাত থেকে রেহাই পাওয়ারও কোন পথ ছিল না। কাজেই যেকোন মূল্যে আল্লাহতে আত্মসমর্পন করার প্রবল আবেগ তার অবিচল মনে নির্ভয় ও আগুনে পুড়ে যাওয়ার দূঃসাহস সঞ্চারিত করেছিল। সত্যের দাবীদার হলে মিথ্যার সঙ্গে টক্কর লাগবেই। মিথ্যার সঙ্গে আপোস না করলে মিথ্যা তার সর্বশক্তি নিয়োগ করবে সত্যকে উৎখাত করতে। আর সত্য যদি সত্য হিসেবে টিকতে চায় তবে মিথ্যা তাকে কিছুতেই সহ্য করবে না। এতে যদি জীবন যায় তবুও মিথ্যার সঙ্গে আপোস করা যাবে না, এমনকি আগুনে পোড়ালেও নয়। এরই নাম হচ্ছে ইসলামের উপর টিকে থাকা। হ্যা, যদি সত্যের অনুসারীদের সংখ্যা বেশী হয় তবে সংগ্রাম করেও টিকে থাকা যায় । এই সংগ্রামই হলো ইসলামের জিহাদ। এই জন্যেই বলা হয় জিহাদ ছাড়া ইসলাম নেই। তাই অন্যত্র বলা হয়েছে, (ওয়াজাহেদু হাক্কা জিহাদিহি) অর্থাৎ জিহাদের হক আদায় করে জিহাদ কর ।
তাকওয়ার দ্বিতীয় পরীক্ষা
অতঃপর ঐ জনপদ ছেড়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বেরিয়ে পড়লেন তাঁর স্ত্রী ও ভাইয়ের ছেলে নবী নূত আলাইহিস সালাম-কে সঙ্গে নিয়ে। পরে তিনি আল্লাহর নিকট সন্তান চেয়েছেন। আল্লাহ তাকে সন্তান দিয়েছেন। তাঁর প্রথম ছেলে ইসমাঈলের যখন জন্ম হয় তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর বয়স ছিল ৮৬ বছর, পরে দ্বিতীয় ছেলে ইসহাক আলাইহিস সালাম এর যখন জন্ম হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ১০০ বছর। প্রথম সন্তান জন্মের পর সন্তানকে তার মাসহ মরুভূমির মধ্যে রেখে আসতে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাকে আবার দ্বিতীয় পরীক্ষায় ফেললেন। এবারও তিনি মহান আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করে কৃতিত্বের সাথে পাশ করলেন।
তাকওয়ার তৃতীয় পরীক্ষা
অতঃপর ঐ সন্তান যখন তাঁর সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর বয়সে উপনীত তখন একদিন তিনি বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যেন আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখো কী করা যায়। তিনি বললেন, হে পিতা, আল্লাহ আপনাকে যা করতে হুকুম করেছেন আপনি তাই করুন। তাহলে আল্লাহ চায়তো আপনি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হিসেবে দেখতে পাবেন। এখানে প্রশ্ন, আল্লাহ যখন ছেলেকে জবেহ করার হুকুম দিলেন তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এই হুকুমকে পরিবর্তন করার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে করতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন
১) হে আল্লাহ! তোমার জন্য আগুনে গিয়েছি, দেশ ছেড়েছি, ঘরবাড়ি ধনসম্পদ আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়েছি, শিশু সন্তানকে মরুভূমিতে ফেলে এসেছি। এসব কিছুর বিনিময়ে আমার ছেলেটাকে কুরবানী করা থেকে রেহাই দাও, আল্লাহ এই হুকুমটাকে তুমি ফেরত নাও, কিন্তু তা তিনি বলেননি।
২) তিনি একথাও বলতে পারতেন যে আল্লাহ তোমার দ্বীন প্রচারের জন্যই ছেলে চেয়েছিলাম, একে দ্বীনের কাজের জন্যেই বেঁচে থাকতে দাও।
৩) অথবা তিনি বলতে পারতেন, আল্লাহ তুমি এ কেমন নিষ্ঠুর হুকুম দিলে?
এমনকি মনে মনেও চিন্তা করতে পারতেন যে, আল্লাহর এ হুকুমটা কেমন কড়া হুকুম হয়ে গেল। তাও তিনি মনে করেননি। এধরনের কিছুই তিনি বলেননি এবং মনে মনেও এধরনের কোন চিন্তা তিনি করেননি। কারণ তিনি জানতেন যে,
১) আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যেই করেন, প্রকাশ্যে তার অন্য কোন রূপ দেখা গেলেও।
২) আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত কোন ইচ্ছা করা বা কিছু বলার কোন অধিকার নেই, কারণ তিনি আল্লাহর অনুগত দাস। ৩) আল্লাহর ইচ্ছা ‘ভাল না মন্দ’ এ ধরনের চিন্তা করাও কুফরী। কাজেই তিনি কুফরী চিন্তা করবেন কেন?
৪) আল্লাহর চেয়ে বেশী অথবা সমান বুঝার চিন্তা করা বা দাবি করাও কুফরী ।
এ সবই তিনি বুঝতেন এবং এ কথাও বুঝতেন যে আল্লাহর হুকুম পালনের মধ্যেই রয়েছে মানব জীবনের সার্বিক সফলতা। কাজেই তিনি আল্লাহর হুকুমই পালন করতে উদ্যত হলেন। তিনি কি পূর্বে জানতেন যে, ছেলে এভাবে বেঁচে যাবে? না তা জানতেন না, যেমন জানতেন না আগুনে যাওয়ার পূর্বে যে সেখান থেকে না পুড়ে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসা যাবে ।
তিনি তো ছেলেকে তাঁর নিয়ত মুতাবিক কুরবানী করেই দিয়েছিলেন।
ঘটনা থেকে শিক্ষা
১) মুসলিম হতে হলে আল্লাহর হুকুম যেমনই হোক না কেন তা মানতে হবে বিনা বাক্য ব্যয়ে এবং কোন প্রশ্ন ছাড়াই। হুকুম মানার পর তার ফলাফল ভালো হবে কী মন্দ হবে সে চিন্তাও করা যাবে না। অবশ্য আল্লাহর হুকুম মানলে তার ফলাফল কোনদিনও খারাপ হয় না ।
২) আল্লাহর হুকুম কোনটা সহজ ও কোনটা কঠিন তা দেখা চলবে না। হুকুম সহজই হোক আর কঠিনই হোক তা মেনে চলার ব্যাপারে মনে একই রকম ইচ্ছা থাকতে হবে। কারণ মানব জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্যই হচ্ছে আল্লাহর যাবতীয় হুকুম আহকাম মেনে চলে সর্বদাই আল্লাহকে খুশী করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। কাজেই মুসলিমদের মনের অবস্থা সর্বদাই এমন থাকতে হবে যে, আল্লাহর হুকুম মানতে গিয়ে বাঁচলে জীবন সার্থক, মরলেও জীবন সার্থক।
৩) আল্লাহর হুকুম মানার ব্যাপারে দুনিয়ার কোন লাভ-লোকসান, কোন মায়া মমতা, কামনা-বাসনা ইত্যাদি কোন বাঁধা হতে পারবে না। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো আল্লাহর হুকুম বিনা প্রতিবাদে মানতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকা, তা জীবন দিয়ে হলেও। এবার আমরা চিন্তা করে দেখি যে, আমরা কোন পর্যায়ের মুসলিম? আমরা তো পোশাক-পরিচ্ছদে অনেকেই পাক্কা মুসলিম, কিন্তু তাকওয়ার কষ্টিপাথরে যাচাই করলে আমরা টিকবো কি পাকা মুসলিম হিসেবে? আমরা তো দেখি যেখানেই আল্লাহর হুকুম কঠিন বা পার্থিব কোন লোকসানের অথবা যেকোন দিক থেকে স্বার্থহানির ভয় আছে সেখানেই আমরা নেই। আমরা কি সব ব্যাপারেই আল্লাহর আনুগত্য করি? যদি উত্তর হয় ‘না’, তবে প্রশ্ন, কেন তা করি না? এর একটাই মাত্র কারণ আর তা হচ্ছে এই যে পার্থিব কোন স্বার্থের ব্যাপারে কিছু না কিছু ঘাটতি বুঝলেই আমরা সেখানে নেই।
এর মধ্যে একটা উজ্জ্বল শিক্ষা রয়েছে আমাদের জন্যে। তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি পাওয়ার হকদার আমরা তখনই হতে পারব যখন প্রমাণ করতে পারব যে আল্লাহর হুকুমের চাইতে আমরা জানমাল সন্তান-সন্ততি এর কোনটারই মূল্য বেশী মনে করি না এবং প্রমাণ করতে পারব যে, আল্লাহ যে। কাজে ব্যবহার করতে চান আমার জীবনকে আমি সেই কাজেই ব্যবহার করতে সদাই প্রস্তুত আছি। তা আগুনে পুড়েই হোক বা ঘর বাড়ী ধন-সম্পদ ত্যাগ করেই হোক কিংবা সন্তান কুরবানী করেই হোক বা অন্য কিছু করেই হোক না কেন। যেমনটি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ইসলামের উপর টিকে থাকার বিনিময়ে কঠিন বিপদকে বরণ করে নিয়েছিলেন। তিনি রাজী হয়েছিলেন
১) আগুনের কুন্ডে নিক্ষিপ্ত হতে;
২) নবজাতক শিশু সন্তানকে তার মাসহ মরুভূমির মধ্যে রেখে আসতে; এবং
৩) নিজ হাতে নিজের সন্তানকে কুরবানী করতে।
এর কোনটাতেই তার কোন দ্বিধা ছিল না এবং ছিল না কোন আপত্তি । আর আমরা যদি সত্যই চাই যে এসব নবীগণ যে জান্নাতে যাবেন আমরাও সেই জান্নাতে যাব, তাহলে আমাদেরকেও আমাদের যাবতীয় কাজকর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে আমরাও তাঁদের মতো ইসলামের জন্য জানমাল কুরবানী করতে প্রস্তুত আছি।
রসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর বন্দী জীবন
মক্কার ইসলাম বিরোধী নেতৃবৃন্দের আপন ঘরেই ইসলামের রক্ষক প্রস্তুত হলো। বড়বড় নেতাদের আপন সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ইসলাম গ্রহণ করেছিল। শুরু থেকে এত বাধা এত প্রতিরোধ, লোমহর্ষক নির্যাতনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রবল গতিতে ইসলাম তার আপন লক্ষ্য পানে দুর্বার বেগে অগ্রসর হচ্ছিল। মক্কার দুই প্রধান বীর হামজা (রা.) ও উমর (রা.) ইসলাম কবুল করে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইসলাম তখন যেনো মক্কার ঘরে ঘরে পৌছে গিয়েছে। এ অবস্থায় কাফিররা ইসলাম ও মুসলিম এবং তাদের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল তাদের বিরুদ্ধে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। বনী হাশিম এবং বনী আবদিল মুত্তালিব বংশ ছিল বিশ্বনবীর প্রতি সহানুভূতিশীল। সুতরাং এই দুই গোত্রের মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই অন্যান্য গোত্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। কারণ অন্যান্য গোত্র এই দুই গোত্রের কাছে দাবী করেছিল, মুহাম্মাদ (ﷺ) -কে আমাদের হাতে উঠিয়ে দেয়া হোক, তাকে আমরা হত্যা করি । তাহলে তাঁর ইসলামের বিপ্লবী কার্যক্রম এমনিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । সে দাবী ঐ দুই গোত্র গ্রহণ করেন নি।
তাঁরা নবী কারীম (ﷺ) এবং ঐ দুটি গোত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক ঘৃণ্য চুক্তিনামা প্রস্তুত করলো। সে চুক্তিতে লিখিত ছিল, মুহাম্মাদ (ﷺ) বনী হাশিম এবং বনী আবদিল মুত্তালিবের সাহায্য সহযোগিতায় কুরাশদেরই শুধু নয়-গোটা মক্কার জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করেছে। পক্ষান্তরে তাকে হত্যাও করা যায়নি। তাঁর আদর্শ বিজয়ী হলে মক্কার সমস্ত গোত্রের সম্মান-মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বিনষ্ট হবে। এই ধরণের অনাকাংখিত অবস্থায় তারা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলো যে, বনী হাশিম এবং বনী আবদিল মুত্তালিবের মুসলিম এবং অমুসলিম কারো সাথেই কোনরূপ সম্পর্ক রক্ষা করা যাবে না। তাদের সাথে বিয়ে, ব্যবসা, ধার দেনা, কথা-বার্তা তথা কোন ধরণের সম্পর্ক রক্ষা করা যাবে না। কেউ তাদেরকে কোন খাদ্য বা পানীয় দিয়ে সাহায্য করতে পারবে না। কেউ যদি তা করে, গোপনেও কেউ যদি তাদেরকে কোন ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে তাকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।'
সমস্ত গোত্রের পক্ষ থেকে এই চুক্তিপত্র লিখে তা কা’বার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। চুক্তিপত্র লিখেছিল মনসুর ইবনে আকরামা। যে হাত দিয়ে সে বিশ্বনবী (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে চুক্তিপত্র লিখেছিল, মহান আল্লাহ সে হাতের শাস্তিও তাকে দিয়েছিলেন। তার হাতের আঙ্গুলে পক্ষাঘাত হয়েছিল। বিশ্বনবী (ﷺ)- এর বংশের আবু লাহাব ও তাঁর পরিবার ছিল এই চুক্তির আওতার বাইরে। কারণ সে স্বয়ং ঐ ঘৃণ্য চুক্তি সম্পাদনকারীদের পক্ষে ছিল। যাদের বিরুদ্ধে চুক্তি করা হয়েছিল এই চুক্তির ফলে তাঁরা কি যেন অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছিল ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তা লিপিবদ্ধ রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই চুক্তির কারণে শুধু বিশ্বনবী (ﷺ) এবং মুসলিমরাই দুঃসহ অবস্থার ভেতরে নিপতিত হয়নি। তখন পর্যন্ত ঐ দুই গোত্রের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী ইসলাম কবুল করেনি, তাঁরাও বর্ণনাতীত দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত হয়েছিল। মুসলিমদের সাথে সাথে তাঁরাও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অনাহারে থেকেছে, গাছের পাতা ভক্ষণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের শিশুগণও মুসলিম শিশুদের সাথে ক্ষুধার যন্ত্রণায় আকাশ-বাতাস দীর্ণবিদীর্ণ করে আর্তনাদ করেছে। বিশ্বনবী (ﷺ) -এর পক্ষের দুই গোত্র অবরোধের কবলে পতিত হবার পরে তাঁরা দ্রুত একটি বৈঠক করলো । সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, শহরে এই অবস্থায় তাঁরা বাস করতে থাকলে কোনক্রমেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারবে না। সুতরাং অন্য কোথাও যেয়ে অবস্থান করতে হবে । বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থা করা যাবে না, এতে কষ্ট বৃদ্ধি পাবে । ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করতে হবে । এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাঁরা শিয়াবে আবি তালিবে গিয়ে অবস্থান করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলো। শিয়াবে আবি তালিব নামক জায়গাটা ছিল মক্কার একটি পাহাড়ের এলাকা। সেখানে বনী হাশিমের লোকজন বসবাস করতো। এলাকাটি ছিল সমস্ত দিক থেকে সুরক্ষিত পাহাড়ি দূর্গের মত । তাদের ধারণা ছিল, এখানে থাকলে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করতে পারবে। এ ঘটনা ছিল নবুওয়াত লাভের সাত বছরের সময় মহরম মাসে। ঐ দুই গোত্রের মুসলিম অমুসলিম সবাই বিশ্বনবীর। সাথে এই দুঃসহ অবস্থা হাসি মুখে বরণ করে নিল । এই ধরণের বিপদ যে আসবে তা ঐ দুই গোত্র উপলব্ধি করতে পারেনি। বিপদ ছিল আকস্মিক। এ কারণে তাঁরা প্রস্তুতি গ্রহণের কোন সুযোগ পায়নি। তাদের কাছে খাদ্যদ্রব্য যা ছিল তাই নিয়ে তাঁরা পাহাড়ের ঐ দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সামান্য কয়েক দিনের ভেতরেই তাদের সমস্ত খাদ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। একটি দুটো দিন নয়-দীর্ঘ তিনটি বছর অনাহারে চরম কষ্টের ভেতরে তাদেরকে ঐ শিয়াবে আবি তালিবে বন্দী জীবনযাপন করতে হয়েছিল। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময়ে তাঁরা নিম গাছের পাতা খেয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করেছেন। পশুর শুকনো চামড়া তাঁরা আগুনে সিদ্ধ করে খেয়েছেন। মা খেতে পারেননি, ফলে তাদের বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছে, সন্তান দুধ না পেয়ে করুন কণ্ঠে আর্তনাদ করেছে। গিরি দুর্গে শিশু-কিশোরগণ প্রচন্ড ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আর্ত চিৎকার করেছে আর তাদের চিৎকার শুনে ইসলাম বিরোধিরা উল্লাস করেছে। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, গাছের পাতা তাঁরা খেয়েছেন। ফলে তাদের মল পশুর মলের মত হয়ে গিয়েছিল। সায়াদ বলেন, ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একদিন খাদ্যের সন্ধানে বের হলাম । কোথাও কিছুই যোগাড় করতে পারলাম না। পশুর এক টুকরা চামড়া কুড়িয়ে পেলাম। তাই এনে আগুনে সিদ্ধ করে আমরা আহার করলাম। কোন দিক থেকে কেউ যেন গিরিদূর্গে সাহায্য প্রেরণ করতে না পারে এ জন্য ইসলাম বিরোধী শক্তি যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছিল। তাঁরা পালা করে গিরিদূর্গের প্রবেশ পথসমূহে প্রহরার ব্যবস্থা করেছিল । কোন লোক যদি গিরিদূর্গ থেকে বাইরে এসে কোন জিনিস ক্রয় করার জন্য মূল্য নির্ধারণ করতো তাহলে ঠিক তখনই ইসলাম বিরোধিরা অধিক মূল্য প্রদান করে সে দ্রব্য ক্রয় করে নিত। কোন সময় দূর্গের ভেতর থেকে কোন ব্যক্তি বাইরে এলে তাকে প্রহার করে রক্তাক্ত করে দেয়া হত। খাদিজা (রা.) যিনি মায়ের গর্ভ হতে এই পৃথিবীতে। এসে কোন দিন অভাব শব্দের সাথে পরিচিত হননি। দিনের পর দিন তাঁকে অনাহারে থাকতে হয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তিনি হাসি মুখে সহ্য করলেও তাঁর ভেতরটা নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল । অবরোধ জীবনের অবসানের পরেই এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। বিশ্বনবীর চাচা আবু তালিবের ভেতরেও কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ক্ষুধার দানব বিশ্বনবীর এই দুই পরম প্রিয়জন চাচা। আবু তালিব আর জীবন সাথি খাদিজা (রা.)কে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। হিশাম একদিন যুহাইর এর কাছে যেয়ে বললেন, তুমি নিজে সমস্ত দিক দিয়ে সুখে আছো। পেটভরে আহার করছো আরামে ঘুমাচ্ছো। তুমি কি জানো তোমার আত্মীয়-স্বজনগণ বন্দী অবস্থায় গিরিদূর্গে কিভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে? যারা তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তাদের কোন আত্মীয়কে এভাবে যদি তুমি কষ্ট দিতে তাহলে তাঁরা কি তা মেনে নিত-না তোমার সাথে ঐকমত্য পোষণ করতো?' যুহাইর ইবনে উমাইয়ার যেন বিবেক জাগ্রত হলো। সে জবাব দিল, ‘একা তো আমার কোন ক্ষমতা নেই। কিছু লোকজন আমি সাথে পেলে ঐ চুক্তি বাতিল করে দিতাম? হিশাম বললো, আমি তোমার সাথে আছি, তুমিও জনসমর্থন যোগাড় করো আমিও করি। হিশাম মুতয়িম ইবনে আদির কাছে যেয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে আসল কথা উত্থাপন করলো। বললো, “হে মুতয়িম! বনী আবদে মানাফের লোকজন অনাহারে নির্যাতন ভোগ করে মৃত্যুবরণ করবে আর তুমি কি সে দৃশ্য দেখে নীরবে দর্শকের ভূমিকা পালন করবে? যারা আজ তাদেরকে বন্দী করে চরম নির্যাতন চালাচ্ছে, তাঁরা কাল যে তোমার উপরে সেই ধরণের নির্যাতন চালাবে না, এর তো কোন নিশ্চয়তা নেই। এভাবে হিশাম বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে আলাপ আলোচনা করে জনমত গঠন করলেন। তারপর ঐ চুক্তির বিরুদ্ধে তিনি মক্কার হাজুন নামক এক পাহাড়ের পাদদেশে একটা সমাবেশের আয়োজন করলেন। যথা সময়ে সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো আগামী কাল সকালে তাঁরা সবাই তাদের কাছে যেয়ে প্রকাশ্যে চুক্তির প্রতি বিদ্রোহ করবে, যারা বনী হাশিম এবং বনী আবদিল মুত্তালিব গোত্রকে বন্দী রাখার পক্ষে। এ সংবাদ গিরিদূর্গেও পৌছেছিল। গোটা মক্কায় ব্যাপারটা প্রচন্ড আলোড়ন জাগালো। চুক্তির প্রতি বিদ্রোহকারী দল পরের দিন মূল্যবান পোষাকে সজ্জিত হয়ে কাবাঘরে গেল।
কাবা ঘর তাঁরা সাত বার তাওয়াফ করে উপস্থিত জনতার সামনে ভাষণ পেশ করলো।
ভাষণে তাঁরা বললো, মক্কার অধিবাসীগণ! আমরা পেটভরে আহার করছি, তৃষায় আকণ্ঠ পানি পান করছি। আমাদের সন্তান সন্ততিগণ ফুর্তিতে আছে। ওদিকে বনী হাশিম এবং বনী আবদিল মুত্তালিবগণ কি অবস্থায় তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করছে তা কি আমরা অনুভব করেছি? তাদের সাথে কেউ কোন সম্পর্ক রাখতে পারবে না এটা চলতে দেয়া হবে না। মহান আল্লাহর শপথ! আমরা এমন চুক্তি মানিনা, যে চুক্তির বলে মানুষ অত্যাচারিত হয়। এই চুক্তি আমরা অবশ্যই ছিড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলবো। আবু জাহিল প্রতিবাদ করে বললো, তোমরা মিথ্যা কথা বলছো, ঐ চুক্তি বাতিল করা হবে না।' চুক্তির প্রতি বিদ্রোহী দল সমস্বরে তীব্র প্রতিবাদ করে বললো, ‘মিথ্যাবাদী তুমি। এই চুক্তি আমরা মানিনা। আমরা আল্লাহর কাছে এই চুক্তির সাথে সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করছি এবং আমাদের পক্ষ এই চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করছি।' দুই পক্ষে চুক্তি বাতিল বা বহাল রাখা নিয়ে ভীষণ ঝগড়ার সৃষ্টি হলো। ওদিকে। বিশ্বনবী ও তাঁর চাচা আবু তালিবকে প্রেরণ করেছিলেন গোপন একটা কথা বলে । উভয় দলে যখন মারামারি হবার উপক্রম হলো তখন আবু তালিব এসে বললেন, “তোমরা যে চুক্তি করেছে তা আল্লাহর পছন্দ নয় । আমার কথা সত্য মিথ্যা তা তোমরা প্রমাণ করে দেখতে পারো। তোমরা ঐ চুক্তি পত্র দেখতে পারো। দেখে তা পোকায় খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। আমার কথা যদি মিথ্যা হয় তাহলে আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ) -কে কোন রূপ সহযোগিতা করবো না । আর আমার কথা যদি সত্য হয় তাহলে সমস্ত অবরোধের অবসান এখানেই ঘটবে। এ সময়ে মুতয়িম নামক চুক্তি বিরোধী একজন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চুক্তি পত্রটা কা’বার দেয়াল থেকে নিয়ে এলো। দেখা গেল আল্লাহর নাম লিখা অংশটুকু ব্যতীত আর সমস্ত অংশ পোকায় খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। ইসলাম বিরোধিরা তখন বাধ্য হয়েছিল লজ্জায় মুখ ঢাকতে কিন্তু এত বড় নিদর্শন দেখেও মহাসত্য গ্রহণ তাদের ভাগ্যে হলো না । চুক্তির বিরোধিরা বিজয়ী হলো, তাঁরা নিজেরা অগ্রসর হয়ে গিরিদূর্গ থেকে সবাইকে মুক্ত করে আনলেন। মক্কার কয়েকজন। যুবক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিশ্বনবী (ﷺ) -কে প্রহরা দিয়ে কাবায় এনেছিল। তিনি সেখানে সলাত আদায় করেছিলেন। এই বন্দী দশায় থাকতেই বিশ্বনবীর চাচা আব্বাসের এক স্ত্রীর গর্ভে আব্দুল্লাহ (রা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নবী কারীম (ﷺ) -এর চাচা তখন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ না করলেও চাচী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সন্তান প্রসব করার পরে তিনি সে সন্তান এনে রসূল (ﷺ) -এর কাছে দিলেন। বিশ্বনবী ; সে সন্তান অর্থাৎ তাঁর চাচাত ভাইয়ের মুখে নিজের মুখের লালা দিয়েছিলেন। এমনই এক মহাভাগ্যবান শিশু ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) যে পৃথিবীতে এসে মায়ের স্তন পান করার আগে আল্লাহর নবী (ﷺ) -এর মুখের লালা পান করেছিলেন। আল্লাহর নবী (ﷺ) তাঁর জন্য প্রাণভরে দু'আ করতেন। শিশু আব্দুল্লাহকে তিনি খুবই আদর করতেন। সবসময় নিজের কাছেই রাখতেন। কিন্তু হিযরতের সময় বছর কয়েকের জন্য এই শিশুর সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটলেও আল্লাহর কুদরত তাদেরকে আবার এক করে দিয়েছিল। সাহাবায়ে কেরামদের ভেতরে তাঁর মত স্মৃতি শক্তি এবং গভীর জ্ঞানের অধিকারী, পবিত্র কুরআনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয় উদঘাটনকারী আর একজনও ছিল না।
রসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর প্রতি তায়েফবাসীদের অত্যাচার
নবী কারীম (ﷺ) যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ির চারদিকে যারা বসবাস করতো, অর্থাৎ আল্লাহর রসূল (ﷺ) -এর প্রতিবেশী যারা ছিল তাদের ভেতরে একমাত্র হাকাম ইবনে আ’স ব্যতীত আর কেউ ইসলাম কবুল করেনি। বিশ্বনবী (ﷺ) যখন নিজের বাড়িতেই সলাতে দাঁড়াতেন তখন প্রতিবেশী উকবা, আদী এ ধরণের অনেকেই তার উপরে পশুর নাড়ি ভুড়ি ছুড়ে দিত। আল্লাহর নবী (ﷺ) বাধ্য হয়ে একটা দেয়ালের আড়ালে সলাত আদায় করতেন। তিনি রান্নার জন্য চুলায় হাড়ি উঠাতেন আর তাঁরা সেই হাড়ির ভেতরেও আবর্জনা ছুড়ে দিত। বিশ্বনবী , নিজ হাতে সেসব আবর্জনা পরিষ্কার করতেন। এভাবে খাদিজা (রা.) ও আবু তালিবের অভাবে বিশ্বনবী (ﷺ) -কে কাফিরের দল তাঁর নিজ বাড়ির ভেতরেও নির্যাতন করেছে। সে সমস্ত ঘটনা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। আল্লাহর নবী (ﷺ) মক্কায় যেন আর টিকতে পারেন না। মক্কায় ইসলাম বিরোধিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন। তাদের এই অত্যাচার থেকে কিভাবে মুক্ত থাকা যায় তিনি সে সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকলেন। অবশেষে তিনি চিন্তা করলেন, তায়েফের আবদে ইয়ালিল, মাসউদ ও হাবিব এই তিনজন যদি ইসলাম কবুল করে তাহলে ইসলামী কাফেলার উপর মক্কার কাফিররা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। উল্লেখিত তিন ব্যক্তি ছিল তায়েফের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্র সাকিফ গোত্রের তিন ভাই। তাঁরাই ছিল গোত্র প্রধান। এই তিনজন লোক যদি ইসলামের পক্ষে আসে তাহলে ইসলামী আন্দোলন আহবান পৌছে দেয়া যাবে। এ সবদিক চিন্তা করে আল্লাহর নবী (ﷺ) যায়েদকে সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটে তায়েফ রওয়ানা দিলেন। তায়েফের ঐ নেতা তিন ভাইয়ের একজন মক্কার কুরাইশ বংশের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। নবী কারীম (ﷺ) ছিলেন কুরাইশ বংশের, সুতরাং তাঁরা ছিল কুরাইশদের আত্মীয়। তাঁরা ইচ্ছা করলে নবীকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে। এই আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু তাকদির ছিল ভিন্ন ধরণের । তিনি তাদের কাছে গেলেন। তাদের তিন ভাইকে ইসলাম সম্পর্কে বুঝালেন। তিনি তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বুঝিয়ে অনুরোধ করলেন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করা দূরে থাক, বিশ্বনবীকে অপমান করলো। একজন বললো, তোমাকেই আল্লাহ যদি রসূল করে প্রেরণ করে থাকে তাহলে আল্লাহ কাবা শরীফের গিলাফ খুলে ফেলুক।' এই হতভাগার কথার তাৎপর্য ছিল, আল্লাহ তাকে নবী বানিয়ে কা’বার মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। দ্বিতীয়জন বললো, তোমাকে ব্যতীত আর কাউকে কি আল্লাহ রসূল বানানোর লোক খুঁজে পেলেন না? তৃতীয়জন বললো, তুমি যদি তোমার দাবী অনুযায়ী সত্যই রসূল হয়ে থাকো তাহলে তোমার সাথে কথা বলা বিপদজনক। আর যদি তোমার দাবীতে তুমি মিথ্যাবাদী হয়ে থকো তাহলে আমি কোন মিথ্যাবাদীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই, এ কারণে তোমার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাইনা। এসব কথা বলে তারা নবী কারীম (ﷺ) -কে অপমান করে তাড়িয়ে দিল । তাঁরা নবীর কথা সমস্ত লোকজনের ভেতরে বিদ্রুপের ভাষায় প্রকাশ করে দিল এবং এলাকার মূখ ও দুষ্ট লোকদেরকে নবীর পেছনে লেলিয়ে দিল। এসব লোক নবীর পেছন পেছন যেতে লাগলো আর তাকে বিদ্রুপ করতে লাগলো। তিনি যেদিকেই যান সেদিকেই তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে উৎপাত করতে থাকলো। আল্লাহর নবী দীর্ঘ দশ দিন যাবৎ তায়েফে অবস্থান করে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান জানিয়েছিলেন । ইসলাম বিরোধিরা অবশেষে নবী কারীম (ﷺ) যে রাস্তা দিয়ে যাবেন সে রাস্তার দু'দিকে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে গেল। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পাষন্ডের দল বৃষ্টির আকারে তার উপরে পাথর বর্ষণ করতে থাকলো। আল্লাহর নবী রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়লেন। তায়েফের জালিমরা। নবীর পা দুটো লক্ষ্য করেই আঘাত করেছিল বেশী। আল্লাহর নবী যখন হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন তখন তিনি জ্ঞানহারা হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলেন। এ অবস্থাতেও নিষ্ঠুর তায়েফবাসী পাথর বর্ষণ অব্যাহত রাখলো। আল্লাহর নবীর এই অবস্থা দেখে যায়েদ তাঁর উপর থেকে পাথর সরিয়ে তাঁকে উঠালেন। নবীকে সাহায্য করতে গিয়ে যায়েদও মারাত্মকভাবে আহত হলেন। আল্লাহর নবী হাঁটতে পারছেন না। কোন মতে অবশ পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌছলো যে, নবীর জীবন নাশের আশংকা দেখা দিল। যায়েদ নবীকে নিয়ে দেয়াল ঘেরা একটি বাগানে প্রবেশ করলেন। নবী কারীম (ﷺ) -এর তখন জ্ঞানহীনের মত অবস্থা। যায়েদের সেবা-যত্নে তিনি একটু সুস্থ হয়েই তাঁকে বললেন সলাতের কথা। সলাতের প্রস্তুতির জন্য তিনি পায়ের জুতা খুলতে গেলেন। পারলেন না। রক্ত জুতায় প্রবেশ করে পায়ের সাথে জুতা এমনভাবে বসে গেছে যে জুতা খুলতে কষ্ট করতে হলো। এরপর নবী কারীম (ﷺ) আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! আমি দুর্বল, আমি অক্ষম, আমি সহায় সম্বলহীন, আমার বিচক্ষণতার অভাব । মানুষ আমাকে অবজ্ঞা করে, আমাকে নগণ্যভাবে, আমাকে উপেক্ষা করে এ জন্য আমি আপনার কাছে আবেদন করছি। যারা দুর্বল এবং সহায় সম্বলহীন আপনিই তাদের আশ্রয়দাতা প্রতিপালক। হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি মানু আর করুণাহীনতার উপরে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? যে আমাকে শত্ৰ জ্ঞান করে আমার উপর অত্যাচার করে আপনি তাঁর উপর আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? আপনি যদি আমার উপর রহম করেন আমাকে নিরাপত্তা দান করেন তাহলে এটাই হবে আমার জন্য শান্তির কারণ। আমি আপনার সেই রহমতের আশ্রয় কামনা করি, যে রহমতের কারণে সমস্ত পৃথিবী উৎসব মুখর হয় এবং পৃথিবী ও আখিরাতের সমস্ত সমস্যা সমাধান হয়। আমার অক্ষমতার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার সাহায্য ব্যতীত আমি কোন কাজ সমাধা করতে পারবো না। এভাবেই আল্লাহর নবীকে তায়েফ থেকে হতাশ আর অত্যাচারিত হতে হয়েছিল। আয়িশা (রা.) বিশ্বনবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোথায় আপনার উপরে সবচেয়ে বেশী নির্যাতন করা হয়েছে? আল্লাহর নবী তাকে জানিয়েছিলেন তায়েফের কথা। এ ধরণের নির্মম নির্যাতন নবী কারীম (ﷺ) - এর জীবনে আর কোথাও ঘটেনি। তিনি তায়েফ থেকে ফিরে মক্কার দিকে যাত্রা করলেন।
ওহুদের যুদ্ধে রসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত
নবী কারীম (ﷺ) তাঁর অনুগত বাহিনীকে ওহুদ পাহাড়ের সামনের অঙ্গনে একত্রিত করে বুহ্য রচনা করলেন। আনসারদের মধ্য থেকে পরামর্শ দেয়া হলো, “হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মিত্র ইয়াহুদীদেরকে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বললে হয় না? আনসারদের এই পরামর্শ দেয়ার কারণ হলো, নবী কারীম মদীনায় এসে যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, তার মধ্যে একটি ধারা ছিল, কোন বাইরের শক্তি দ্বারা যদি মদীনা আক্রান্ত হয়, তাহলে সবাই সম্মিলিতভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে। চুক্তির এই ধারার কথা স্মরণ করেই আনসারদের পক্ষ থেকে ঐ পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর নবী তাঁদের পরামর্শের উত্তরে বলেছিলেন, “ইয়াহূদীদের দিয়ে আমাদের কোন কাজ নেই। ‘আল কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠিত হবে ইয়াহূদীদের সহযোগিতায় এ অভিপ্রায় নবী কারীম (ﷺ) -এর কখনো ছিল না। চুক্তি অনুযায়ী ইয়াহূদীরা সাহায্য করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু তিনি তাদের সাহায্য গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি জানতেন, তিনি যদি আজ ইয়াহূদীদের সাহায্য গ্রহণ করেন, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত এটা একটি কালো দলিল হয়ে থাকবে মুসলিমদের জন্য। মুসলিম সৈন্যদেরকে তিনি আদেশ দিলেন, আমি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু করবে না। মদীনার আনসাররা নিজের চোখে দেখছিল, তাদের মাথার ঘাম। পায়ে ফেলে আবাদ করা ক্ষেতগুলো মক্কার কুরাইশরা পশুপাল দিয়ে খাওয়াচ্ছে। এই দৃশ্য তাদের কাছে ছিল অসহনীয় । কিন্তু সিপাহসালারের অনুমতি না থাকার কারণে তাঁরা কিছুই বলতে পারছিল না। নবী কারীম (ﷺ) তাঁর বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.)-কে ৫০ জনের তীরন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। তাঁকে চিহ্নিত করার জন্য তাঁর মাথায় সাদা কাপড় দেয়া হয়েছিল । তাঁকে নির্দেশ দিলেন, ‘শত্রু পক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে তুমি তীর দিয়ে প্রতিরোধ করবে । যুদ্ধে আমরা জয়ী হই বা পরাজিত হই, কোন অবস্থাতেই তোমার পেছন থেকে কেউ যেন আক্রমণ করতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখবে। তুমি তোমার নিজের স্থানে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করবে, কোনক্রমেই তোমাদের পেছন থেকে কেউ যেন আক্রমণ করতে না পারে। যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.)-কে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হলো। যাদের দেহে বর্ম ছিল না, এদের নেতৃত্ব দেয়া হলো হামজা (রা.)-র উপর । এরপর আল্লাহর নবী (ﷺ) স্বয়ং দুটো বর্ম পরিধান করলেন। যুদ্ধের পতাকা উঠিয়ে দিলেন তরুণ সাহাবী মুসআব (রা.)-র হাতে । এই সাহাবীর গর্ভধারিণী মাতা তখন কুরাইশদের সাথে ওহুদের ময়দানেই মুসলিমদেরকে চিহ্নিত করার জন্য এসেছে। বদর যুদ্ধে কুরাইশদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, এই ওহুদের প্রান্তরে তারা সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগালো। তারাও মুসলিম বাহিনীর মতই সৈন্যদের বুহ্য রচনা করেছিল । বদরের তুলনায় এবার তাদের প্রস্তুতি ছিল কয়েকগুণ বেশী। তাদের সৈন্যদের মধ্যে এবার শৃংখলাও ছিল লক্ষণীয়। বাহিনীর কিছু অংশের নেতৃত্ব দেয়া হয়েছিল খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে, আর কিছু অংশের নেতৃত্ব দেয়া হয়েছিল আবু জাহিলের সন্তান ইকরামাকে। তীরন্দাজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া। হয়েছিল আব্দুল্লাহ ইবনে রাবিয়াকে। অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব ছিল স্বয়ং আবু সুফিয়ানের হাতে। পতাকা দেয়া হয়েছিল তালহার হাতে। দুইশত ঘোড়া প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, যেন জরুরী প্রয়োজন দেখা দিলে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রথমে তারা যুদ্ধের কোন বাজনা না বাজিয়ে তাদের নারীর দলকে সামনের দিকে এগিয়ে দিলো। কুরাইশদের এই হিংস্র নারীরা নানা ধরণের উস্কানীমূলক কবিতা আবৃত্তি করতে করতে দফ বাজিয়ে কুরাইশ বাহিনীর সামনে দিয়ে ঘুরে গেল।
কে এই তরবারীর হক আদায় করবে?
নবী কারীম (ﷺ) তাঁর নিজের তরবারী হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন, “আমার এই তরবারীর হক আদায় করার জন্য কে প্রস্তুত আছো?” মুসলিম বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই রসূল (ﷺ) -এর তরবারী গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তরবারীর দিকে অসংখ্য হাত এগিয়ে এলো। আল্লাহর নবী সে তরবারী কাউকে দিলেন না। আবু দুজানা (রা.) জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রসূল! তরবারীর হক আদায় করা বলতে কি বুঝায়? তিনি বললেন, ‘তরবারীর হক আদায় বলতে এই তরবারী দিয়ে শত্রকে এত বেশী আঘাত করতে হবে, যেন এই তরবারীই বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজানা বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি ঐ তরবারী গ্রহণ করবো এবং তরবারীর হক আদায় করবো। নবী কারীম তাঁর তরবারী আবু দুজানার হাতে দিলেন। তিনি তরবারী গ্রহণ করে গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে সৈন্যদের বুহ্যে চলে গেলেন। আল্লাহর নবী তাঁর সাহাবীর হাটার ভঙ্গী দেখে মন্তব্য করলেন, যুদ্ধের ময়দান ব্যতীত হাঁটার এই ভঙ্গী আল্লাহর কাছে চরম অপছন্দনীয় । নবী কারীম (ﷺ) মুসলিম বাহিনীকে পরস্পরের পরিচিতির জন্য একটি সংকেত শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বাহিনীর কোন সদস্য যদি ‘আমিত’ শব্দ বলে তাহলে বুঝতে হবে সে নিজেদের লোক। আমিত’ শব্দের অর্থ হলো, মরণ আঘাত হানো। যুদ্ধের প্রথমেই কুরাইশদের পক্ষ থেকে এমন একজন লোক ময়দানে এলো, যে লোকটি ছিল এক সময় মদীনার অধিবাসী। মদীনার আনসারদেরকে লোকটি প্রচুর দান করতো। লোকটির নাম ছিল আবু আমের। সে ধারণা করেছিল, কুরাইশদের সাথে তাকে দেখলেই মদীনার আনসাররা আল্লাহর নবীকে ত্যাগ করে তার সম্মানে ও তার অতীত দানশীলতার কথা স্মরণ করে কুরাইশদের সাথে যোগ দেবে । মূখ এই লোকটি ময়দানে এসেই হুংকার ছাড়লো, ‘আমাকে তোমরা চিনতে পারছো? আমি আবু আমের। আনসাররা জবাব দিল, “আমরা তোমাকে চিনি। তুমি যা আশা করছো তা আল্লাহ পূর্ণ করবেন না । কুরাইশদের পতাকাধারী দল থেকে তালহা বের হয়ে এসে চিৎকার করে বললো, ‘ওহে মুসলিমের দল! তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে জাহান্নামে প্রেরণ করতে চায় অথবা নিজেই সে জান্নাতে যেতে চায়? লোকটির বিদ্রুপাত্মক কথা আলী (রা.) সহ্য করতে পারলেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন, “তোকে জাহান্নামে প্রেরণের জন্য আমি আছি।'
এ কথা বলে তিনি এমন শক্তিতে তালহাকে (মুসলিম বাহিনীর তালহা ভিন্ন ব্যক্তি) আঘাত করলেন, এক আঘাতেই সে কাফির ধূলি শয্যা গ্রহণ করলো এবং হাতের পতাকা লুটিয়ে পড়লো। তালহার ভাই ওসমান ময়দানে আপন ভাইয়ের শোচনীয় অবস্থা দেখে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এলো। হামজা (রা.) এমনভাবে তার কাঁধে আঘাত করলেন যে, ওসমানের কোমর পর্যন্ত হামজার তরবারী পৌছে গেল। এরপরেই ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আবু দুজানা (রা.) রসূলের তরবারী নিয়ে কুরাইশদের বুহ্য ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। আলী (রা.) ও হামজা (রা.) একইভাবে কুরাইশদের সৈন্য বাহিনীর বুহ্য ভেঙ্গে তছনছ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হামজা দুই হাতে তরবারী চালনা করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী যুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) বলেন, রসূলের তরবারীর অধিকারী আবু দৃজানা (রা.) এমনভাবে যুদ্ধ করছিলেন যে, তাঁর তরবারীর সামনে যে পড়ছিল সেই নিহত হচ্ছিল। আমি দেখলাম শত্রুদের একটি লোক আমাদের লোকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছিল। আবু দুজানা (রা.) ঐ লোকটির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি দু’আ করছিলাম লোকটি যেন আবু দুজানার (রা.) সামনে পড়ে। এক সময় সে আবু দুজানার (রা.) সামনে পড়লো।
দু’জনে তুমূল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। লোকটি আবু দুজানা (রা.)কে প্রচন্ড বেগে তরবারীর আঘাত হানলো। আবু দুজানা (রা.) সে আঘাত তাঁর চামড়ার ঢাল দিয়ে প্রতিহত করলেন এবং লোকটির তরবারী আবু দুজানা (রা.)র চামড়ার ঢালে আটকে গেল। এই সুযোগে তিনি রসূলের দেয়া তরবারী দিয়ে আঘাত করে লোকটিকে হত্যা করলেন।
রসুল (ﷺ) এর তরবারীর সম্মান
এরপর তাঁর সামনে পড়লো আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। আবু দুজানা তাঁর মাথার উপর তরবারী উঠিয়েও নামিয়ে নিলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আবু দুজানা (রা.) বলেন, আমি দেখলাম কে একজন মক্কার কাফিরদেরকে উস্কানী দিচ্ছে। আমি তার এই অপকর্ম বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেলাম। আমি তরবারী উঠাতেই সে ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। তখন আমি বুঝলাম সে একজন নারী। আমি রসূলের তরবারী দিয়ে একজন নারীকে আঘাত করে তরবারীর অপমান করতে চাইনি। এ কারণে আমি আঘাত করিনি।
মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মক্কার কুরাইশরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল । যখনই তারা পিছনের দিকে সরে যেতে থাকে, তখনই তাদের নারীরা কবিতা আবৃত্তি করে তাদের উৎসাহ সৃষ্টি করছিল। হামজা (রা.)র আক্রমণের মুখে কুরাইশ বাহিনী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে পড়ছিল। তিনি দু’হাতে তরবারী চালনা করে শত্রু নিধন করছিলেন। হাবশী গোলাম ওয়াহশী তাঁর মনিবের সাথে চুক্তি করেছিল, সে যদি হামজাকে হত্যা করতে পারে তাহলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। সে লক্ষ্য স্থির করে আড়ালে বসেছিল। হারবা নামক ছোট এক ধরণের বর্শা দূর থেকে ছুড়ে সে হামজা (রা.) কে হত্যা করেছিল। হানজালার পিতা আবু আমের কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধ করছিল। হানজালা নবী কারীম (ﷺ) -এর কাছে অনুমতি চাইলেন, তিনি তাঁর পিতার সাথে যুদ্ধ করবেন। আল্লাহর নবী এটা পছন্দ করলেন না যে, পিতার সাথে সন্তান যুদ্ধ করবে। তিনি অনুমতি দিলেন না। মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে যুদ্ধের এক পর্যায়ে মক্কার কুরাইশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের ফেলে যাওয়া সম্পদ সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে। দেখে তীরন্দাজ বাহিনীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। একদল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য ময়দানে চলে যাবার পক্ষে মতামত দিল । তীরন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) তাদেরকে বারবার নিষেধ করার পরেও তাঁরা নেতার আদেশ অমান্য করে গণিমতের মালামাল সংগ্রহ করার জন্য ময়দানে ছুটে গেল। মক্কার কুরাইশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আল্লাহর নবী মুসলিমদের তীরন্দাজ বাহিনীকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অবস্থান করতে আদেশ দিয়েছিলেন, সে স্থান অরক্ষিত দেখে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে সেদিক থেকেই ঝড়ের বেগে আক্রমণ করেছিলেন। নেতার আদেশ অমান্য করার ফল হাতে হাতেই মুসলিম বাহিনী লাভ করলো। চারদিক থেকে কুরাইশ বাহিনী একত্রিত হয়ে অপ্রস্তুত মুসলিম বাহিনীকে এমনভাবে আক্রমন করলো যে, তাঁরা যুদ্ধ করা দূরে থাক- আত্মরক্ষা করার মত সুযোগ পেল না। অসহায়ের মত বড়বড় বীর যোদ্ধা শাহাদাতবরণ করতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়ের মতই অনেকে কি করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তীরান্দাজ বাহিনীর যে কয়জন গিরিপথে প্রহরা দিচ্ছিলেন, তাঁরা একে একে শাহাদাতবরণ করলেন। কুরাইশ বাহিনীর লক্ষ্য ছিল একটিই, নবী কারীম (ﷺ) -কে হত্যা করা। ইসলাম বিরোধিদের আক্রমন এতই তীব্র ছিল যে, অধিকাংশ সাহাবা সে সময় জানতেন না, আল্লাহর রসূল কোথায় কী অবস্থায় আছেন।
কুরাইশ বাহিনী আর মুসলিম বাহিনী এমনভাবে একাকার হয়ে গিয়েছিল যে, কে শত্র আর কে মিত্র তা জানার উপায় ছিল না। মুসআব রাদিয়াল্লাহ আনহুর চেহারা এবং দেহের আকৃতি কিছুটা নবী কারীম (ﷺ) -এর মতই ছিল। তিনি মুসলিম বাহিনীর পতাকা বহন করছিলেন। কাফির ইবনে কামিয়া তাকে হত্যা করে ভেবেছিল সে আল্লাহর নবীকে হত্যা করেছে। ময়দানে সে চিৎকার শুনে মুসলিম বাহিনীর শেষ শক্তিটুকুও যেনো ঝরে পড়েছিল। উমর (রা.)র মত ব্যক্তি নিশ্চল হয়ে বসেছিলেন। আনাসের চাচা আনাস ইবনে নদর (রা.) উমর (রা.)কে তরবারী ফেলে বসে থাকতে দেখে বললেন, আপনি যুদ্ধ না করে এখানে এমন করে বসে আছেন কেন? তিনি বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, এখন যুদ্ধ করে আর কি হবে, আল্লাহর নবীই তো পৃথিবীতে আর নেই। আনাস ইবনে নদর (রা.) আর্তচিৎকার করে বললেন, আল্লাহর রসূল আর নেই! তাহলে আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে!' এ কথা বলেই তিনি ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হলেন। এক পর্যায়ে তিনিও শাহাদাতবরণ করলেন। তাঁর অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে চেনার কোন উপায় ছিল না। কারণ কাফিরদের অস্ত্রের আঘাতে তাঁর দেহ অক্ষত ছিল না। তাঁর হাতের আঙ্গুল দেখে তাঁর বোন তাকে সনাক্ত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ বিশ্বাস করেছিল রসূল আর নেই আবার কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, আল্লাহর রসূলকে কাফিররা হত্যা করতে পারে। যারা বিশ্বাস করেছিল, তারা জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধ করছিল এবং আকুল দৃষ্টিতে নবী কারীম (ﷺ) -এর চেহারা খুঁজে ফিরছিল। কা'ব ইবনে মালিক (রা.) সেই চেহারা দেখতে পেলেন। অদম্য আবেগে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, “হে নবী আনুসারীরা! আল্লাহর নবী আমাদের মাঝে আছেন!' তাঁর কণ্ঠ শুনে সাহাবায়ে কেরাম ছুটে গেলেন আল্লাহর নবীর কাছে। কাফির বাহিনীর মূল লক্ষ্যই ছিল আল্লাহর নবীকে হত্যা করা। তারা যখন জানতে পারলো, নবী এখনো জীবিত আছে, তখন নবীর অবস্থানের দিকেই তারা আক্রমন করলো তাঁকে হত্যা করার জন্য কুরাইশ বাহিনী সর্বশক্তি নিয়োগ করলো । চারদিক থেকে নবী কারীম (ﷺ) -কে ঘেরাও করে কাফিরের দল আক্রমণ করলো। বৃষ্টির মতই অস্ত্র বর্ষিত হচ্ছিল । সাহাবায়ে কেরাম নবী কারীম (ﷺ) -কে নিজেদের মাঝে রেখে চারদিকে মানববন্ধন তৈরী করলেন। অস্ত্রের সমস্ত আঘাত এসে তাঁদের উপরেই নিপতিত হতে থাকলো। তারা তাদের জীবনী শক্তির শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও আল্লাহর নবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। একের পরে আরেকজন শাহাদাতের অমীয় সূধা পান করে জান্নাতের দিকে চলে যাচ্ছিলেন।
জিয়াদ (রা.) গুরুতর আহত হয়ে পড়ে গেলেন। তখন পর্যন্ত তাঁর দেহে প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল। আল্লাহর নবীর আদেশে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে ধরাধরি করে রসূল (ﷺ) -এর কাছে এনে শুইয়ে দিলেন। জিয়াদ আল্লাহর হাবিবের কাছে মুখ রেখে শাহাদাতবরণ করলেন। এই চরম দুর্যোগের মুখেও এক তরুণ সাহাবী খেজুর খাচ্ছিলেন। তিনি নবী কারীম (ﷺ) -কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি যদি এই মুহূর্তে আপনার জন্য প্রাণ দান করি তাহলে আমি কোথায় যাবো? আল্লাহর নবী তাঁকে বললেন, “তুমি প্রাণ দান করলে অবশ্যই জান্নাতে যাবে। রসূল (ﷺ) -এর মুখ থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথে তিনি তরবারী হাতে ছুটে গেলেন। যুদ্ধ করতে করতে তাওহীদের এই বীর সেনানী শাহাদাতবরণ করলেন। চারদিক থেকেই অস্ত্র ছুটে আসছে। সমস্ত অস্ত্রের আঘাত এসে সাহাবায়ে কেরামের দেহে পড়ছে। সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের দেহকে ঢালের মতই ব্যবহার করছেন। তবুও কলিজার টুকরা নবী কারীম (ﷺ) -কে অক্ষম রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। মক্কার জালিম আব্দুল্লাহ ইবনে কামিয়াহ সাহাবায়ে কেরামের বেষ্টনীর উপর দিয়ে দোজাহানের বাদশাহকে আঘাত করার জন্য বারবার তরবারীর আঘাত হানছে। তালহা (রা.) শূন্য হাতে তীক্ষ্ণধার তরবারীর আঘাত ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে তাঁর একটি হাত কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । বেঁচে থাকার আর কোন আশা নেই, ঘাতকরা নবী কারীম (ﷺ)-কে আঘাত করছে। আর করুণার সিন্ধু সেই চরম মুহূর্তেও মহান আল্লাহর কাছে ঘাতকদের জন্য বলেছেন, ‘রাবিগৃফিরলি কাওমি ফাইন্নাহুম লা ইয়ালামুন-হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করুন, তারা যে কিছুই বুঝে না। সাহাবায়ে কেরাম রসূল (ﷺ) -কে পরিবেষ্টন করে আছেন। তাঁরা আবেদন করলেন, ইয়া রসূলুল্লাহ! আপনি মাথা উঁচু করবেন না । তীর এসে বিদ্ধ হতে পারে। যত তীর আসে আসুক, আমাদের বুক আছে। আমাদের বুক দিয়েই আমরা তীর প্রতিরোধ করবো।
রসূল (ﷺ) যাদের কল্যাণের জন্য দু'আ করছেন, সেই জালিমের দলই রসূল (ﷺ) -কে হত্যা করার জন্য এগিয়ে এসে আঘাতের পরে আঘাত করছে। জালিম ইবনে কামিয়া তরবারী দিয়ে বিশ্বনবী (ﷺ) -এর চেহারায় আঘাত করলো। তার তরবারীর আঘাতে আল্লাহর নবী (ﷺ) -এর মাথার লোহার শিরস্ত্রাণের দুটো কড়া ভেঙ্গে চেহারাতে প্রবেশ করলো। আল্লাহর নবী রক্তাক্ত হয়ে পড়লেন। তিনি করুণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে বললেন, ‘ঐ জাতি কি করে কল্যাণ লাভ করতে পারে, যারা তাদের নবীকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে দেয়, অথচ সে নবী তাদেরকে আল্লাহর দিকেই আহবান করছে!' মহান আল্লাহ তাঁর নবীর এই সামান্য আক্ষেপটুকুও পছন্দ করলেন না। সাথে সাথে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলো। বলা হলো :
“হে নবী! চূড়ান্তভাবে কোনো কিছুর ফায়সালা করার ক্ষমতা-ইখতিয়ারে তোমার কোনোই হাত নেই, আল্লাহরই ইখতিয়ারে রয়েছে, ইচ্ছা হলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন আর ইচ্ছা করলে শাস্তি দিবেন, কারণ তারা যালিম।” (সূরা আলে ইমরান, ৩ : ১২৮)
সীরাতে ইবনে হিশামে উল্লেখ করা হয়েছে, কাফিরদের আঘাতে নবী (ﷺ) -এর একটি দাঁত পরে গিয়েছিল। তাঁর চেহারায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। সে ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরছিল। আলী (রা.) তাঁর ঢাল ভর্তি করে পানি আনছিলেন আর ফাতিমা (রা.) প্রিয় পিতার ক্ষত ধুয়ে দিচ্ছিলেন। রক্ত যখন বন্ধ হলো না, তখন বিছানার একটি অংশ পুড়িয়ে তার ছাই ক্ষতস্থানে দেয়ার পরে রক্ত বন্ধ হয়েছিল ।
তাকওয়ার দৃষ্টান্ত :
আমরা উপরের ঘটনাগুলো থেকে যা দেখলাম এবং বুঝলাম, ইবরাহীম (আ.) এবং ইসমাঈল (আ.)-এর তাকওয়ার পরীক্ষা, রসূল (ﷺ) -এর তিনটি বছর অমানবিক বন্দি জীবনযাপন, তায়েফের লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা, ওহুদের প্রান্তে নির্মম ঘটনা। এসবই তাকওয়ার প্রকৃত দৃষ্টান্ত। এগুলোর বাইরে ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলামের রূপ দেখতে হলে এই ধরণের ত্যাগ শিকার করতেই হবে । কোন রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই ইসলাম প্রচার করে যাওয়া আসলে প্রকৃত ইসলামের দাওয়াত হতে পারে না। আমি মানুষকে দাওয়াত দিয়ে যাবো আর। অপর পক্ষ থেকে কোন বাঁধা আসবে না তা হতে পারে না, ইসলামের ইতিহাস তা বলে না। তাই কেউ যদি সত্যিকার ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে তাকে এই ধরণের পরীক্ষার সম্মুখিন হতেই হবে । হয়তো মাঝে মধ্যে জীবন-মরণ সমস্যা এসে হাজির হবে এবং সে জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে । এবার দেখা যাক সাহাবাদের তাকওয়ার দৃষ্টান্ত।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/573/85
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।