hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

তাকওয়া

লেখকঃ আমির জামান, নাজমা জামান

৮৬
সাহাবাদের (রা.) তাকওয়ার দৃষ্টান্ত
নির্যাতনের শিকার বিলাল (রা.) বিলাল (রা.) হাবশ দেশীয় একজন প্রখ্যাত সাহাবী ছিলেন। তিনি নবী কারীম (ﷺ)-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ও মদীনার মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁর মুনিব উমাইয়া বিন খালফ। তাঁকে নানাভাবে নির্যাতন করতে লাগলো । ইসলামের মহাশত্ৰ উমাইয়া নিজের ভৃত্য বিলালকে তাওহীদের বিশ্বাস থেকে ফিরানোর জন্য অমানুষিক ও নির্মম অত্যাচারের ব্যবস্থা করেছিল। দ্বিপ্রহরের ক্ষরতাপে অগ্নিস্নাত তপ্ত বালুকার উপর সে বিলালকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখত। যাতে করে তিনি একটুও নড়াচড়া করতে না পারেন। উপরে প্রচন্ড সূর্যোত্তাপ নিচে আগুনের মত বালু- এই ধরনের নিষ্ঠুর অত্যাচারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। হয় তিনি মরে যাবেন নতুবা অসহ্য হয়ে ইসলাম ত্যাগ করবেন। কিন্তু দেখা। গেল ওষ্ঠাগত প্রাণ তাকওয়াবান মুজাহিদ তখনও আল্লাহকে ভুলেননি’ মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলে উঠতেন ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই । তাঁকে ধারাবাহিকভাবে অত্যাচার করা হতো, কখনও আবু জাহিল, কখনও উমাইয়া, কখনও ইসলামের অন্য দুশমনরা এসে তাঁকে দৈহিক নির্যাতন করতো, রাতেও তাঁর শান্তি ছিল না, যখন তাঁকে বেত মারা হতো, ফলে পূর্ব দিনের জখমগুলো রক্তাক্ত হয়ে উঠত, পুনরায় তাঁকে যখন আবার উত্তপ্ত বালুকার উপর শুইয়ে দেয়া হত তখন তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত চর্বি গলে পড়তো। মাঝে মাঝে তাঁকে মক্কার দুষ্ট তরুণ দলের হাতে ন্যাস্ত করা হতো। তারা তাঁর গলায় রশি বেঁধে মক্কার রাজপথে সারা দিন টেনে-হেচড়ে বেড়াত। আবার সন্ধ্যায় তাঁকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফিরিয়ে আনতো, কিন্তু এত নিগ্রহের পরেও তিনি তাওহীদের বিশ্বাস থেকে বিন্দু পরিমাণ সরে আসেননি। নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় একদিন আবুবকর সিদ্দিক (রা.) তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়ে মুক্ত করে দেন। নবী কারীম (ﷺ) তাঁকে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করলেন। আল্লাহর রসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর বিলাল (রা.)-কে সফরের সরঞ্জামসহ কোথাও রওয়ানা হতে দেখে উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, মনে হচ্ছে তুমি যেনো কোথাও চলে যাচ্ছো?

বিলাল বললেন, ‘উমর, যে মদীনায় রসূল (ﷺ) নেই, সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। রসূল ও শূন্য মদীনা আমার কাছে অসহনীয় । তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোনো দূর দেশে গিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত থেকে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো পার করে দেবো। বিলাল দামেশকে চলে গেলেন। দীর্ঘদিন পরে এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, রসূলের বিচ্ছেদ বেদনায় তিনি মদীনা ত্যাগ করেছেন, সেই রসূল স্বপ্নে তাঁকে বলছেন, হে বিলাল! তুমি আমার কাছে আর আসো না কেনো? বিলালের ঘুম ভেঙ্গে গেলো । রসূলের বিচ্ছেদ বেদনা তাঁর মধ্যে পুনরায় নতুন করে জেগে উঠলো। মদীনায় গেলে জীবিত রসূলকে তো দেখা যাবে না, কিন্তু আল্লাহর রসূল যে পথে হেঁটেছেন, সেই এবং সেই পথের ধূলি তো দেখা যাবেযে ধূলিতে মিশে রয়েছে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর পায়ের স্পর্শ। মদীনায় যাবার জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন এবং দ্রুত বেগে তিনি মদীনার দিকে ছুটলেন। মদীনায় বিলাল এসেছে- এ সংবাদ সকলেই জেনে গেলো । রসূলের মুয়াজ্জিন এখন মদীনায়, লোকজন দলে দলে এসে তাঁকে অনুরোধ করলো, বিলাল! আল্লাহর রসূল জীবিত থাকতে তুমি আযান দিয়েছো, আমরা আযান শোনামাত্র মসজিদে ছুটে এসে আল্লাহর নবীর পেছনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছি। তুমি আজ আবার আযান দাও। আমাদের কাছে মনে হবে, আল্লাহর রসূল এখনো জীবিত আছেন! মসজিদে গেলে আবার আমরা রসূলের পেছনে কাতার বন্দী। হয়ে দাঁড়াতে পারবো! দেখতে পাবো রসূল (ﷺ) এর চেহারা । বিলাল (রা.) রাজী হলেন না, তিনি বললেন, ‘মদীনাবাসীরা তোমরা শোন, আমি যখন মসজিদে নববীর মিনারে উঠে আযানের মধ্যে বলতাম “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ’ তখনি আমার নজর পড়তো মিম্বরের উপর উপবিষ্ট নবী করিম (ﷺ)-এর চেহারার প্রতি। কিন্তু আজকে আযান দিতে গিয়ে যখন আমার দৃষ্টি পড়বে মসজিদে নববীর মিম্বারের দিকে, তখন দেখবো মিম্বার শূন্যসেখানে রসূল নেই। এই দৃশ্য তো আমি সহ্য করতে পারবো না। অবশেষে আল্লাহর রসূলের নাতী হাসান-হোসাইন (রা.)মের অনুরোধে বিলাল (রা.) উপেক্ষা করতে পারলেন না, তিনি মসজিদের মিনারে উঠে আযান দিতে লাগলেন। দীর্ঘদিন পর বিলাল (রা.)র আযানের সুমধুর ধ্বনি মদীনাবাসীদের পাগল করে তুললো। রসূল হারানোর শোকে মদীনায় মাতম উঠলো। মদীনায় উঠলো কান্নার রোল। বিলাল ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ' উচ্চারণ করছেন আর স্বভাব মতোই মিম্বরের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তিনি দেখলেন, সেখানে প্রিয় রসূল। নেই। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে গেলেন। এরপর কিছুদিন তিনি মদীনায় অবস্থানের পর আবার মদীনা হতে চলে গেলেন। হিজরী বিশ সনের কাছাকাছি তিনি দামেশক নগরে ইন্তেকাল করেন।

পরীক্ষার সম্মুখিন খাব্বাব (রা.)

যারা দ্বীন ইসলামের জন্য নিজেদেরকে কুরবানী এবং আল্লাহর রাস্তায় কঠিনতম শাস্তি ভোগ করেছিলেন, খাব্বাব (রা.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। প্রাথমিক স্তরের পাঁচ ছয় জনের ইসলাম গ্রহনের পর তিনি মুসলিম হন। সুতরাং তাকে যে কি ধরনের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাঁর জীবনের পরিবর্তন অন্ত্যন্ত হৃদয়বিদারক। তাঁর প্রতি কাফিরদের অত্যাচারের শেষ ছিল। না। লৌহ জেরা পরিয়ে তাঁকে আরবের মরুভূমির প্রচন্ড রোদে শায়িত করে রাখা হতো। রোদের তাপে তাঁর উত্তপ্ত বালুকাতে শয়ন করে রাখা হতো। উত্তাপে তাঁর কোমরের গোশত পর্যন্ত গলে যেত। তিনি জনৈকা স্ত্রী লোকের গোলাম ছিলেন। সেই স্ত্রী লোকটির নিকট যখন সংবাদ পৌছল যে, খাব্বাব মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর সাথে মিলিত হয়েছেন। তখন থেকে স্ত্রী লোকটি লোহার শলাকা গরম করে তাঁর মাথায় দাগ দিতে লাগল। এরপরেও খাব্বাব (রা.) কোনক্রমেই বিচলিত হচ্ছেন না দেখে একদিন কোরাইশ দলপতিগণ মাটিতে প্রজ্বলিত অংগার বিছিয়ে তার উপর তাঁকে চিৎ করে শায়িত করতো এবং কতিপয় পাষণ্ড তার বুকে পা দিয়ে চেপে ধরতো। অংগারগুলো তার পিঠের গোস্ত-চর্বি পুড়াতে পুড়াতে এক সময় নিভে যেত, তবুও নরাধমরা তাঁকে ছাড়ত না। খাব্বাব (রা.)র পিঠের চামড়া এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে, শেষ বয়স পর্যন্ত তার সমস্ত পিঠে ধবল কুষ্ঠের ন্যায় ঐ দাগের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল। তিনি কর্মকার ছিলেন। তিনি জেরা, তরবারী ইত্যাদি প্রস্তুত করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইসলাম গ্রহণের পর যে সকল লোকের নিকট তার সকল প্রাপ্য ছিল, কোরাইশদের নির্দেশমতে তা কেউই আর দেয়নি। উমর (রা.)র খিলাফতের সময় তিনি খাব্বাব (রা.)কে তাঁর প্রতি ইসলাম বিরোধিদের নির্যাতন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাঁর পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন করলেন। উমর (রা.) তাঁর কোমর দেখে বললেন, এমন কোমর তো আর আমি কারো দেখিনি। খাব্বাব (রা.) বললেন, আমাকে আগুনের অঙ্গারে চেপে রাখা হতো। তাতে আমার রক্ত এবং চর্বি গলে আগুন নিভে যেত। মহান আল্লাহর রহমতে সাহাবায়ে কেরাম ও নবী কারীম (ﷺ) -এর অসীম ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়ে ইসলাম বিজয়ী হবার পরে ইসলামী সাম্রাজ্যে প্রাচুর্যতা দেখা দিয়েছিলো। প্রায় সাহাবায়ে কেরামই স্বচ্ছলতা লাভ করেন। খাব্বাব যখন রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন কেউ কেউ তাঁকে বলেছিলেন, আপনি খুশী হন যে, ইন্তেকালের পরে আপনি আপনার সাথীদের সাথে হাউজে কাওসারের পাশে সাক্ষাৎ করবেন। এ কথা শুনে তিনি কাঁদতে লাগলেন আর বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। তোমরা সেসব সাথীর কথা বলছো, যারা পৃথিবীতে কোনো প্রতিদান পায়নি। আখিরাতে তাঁরা অবশ্যই নিজেদের কর্মের প্রতিদান পাবে । কিন্তু আমরা পরে রয়েছি এবং দুনিয়ার নিয়ামতের অংশ এত পেয়েছি যে, ভয় হয় তা আমাদের আমলের সওয়াব হিসেবেই হিসাব না হয়ে যায়। ইন্তেকালের কিছুক্ষণ পূর্বে তাঁর সামনে কাফন আনা হলো, তিনি কাফন দেখে। অতীতে মুসলিমদের দুরাবস্থার কথা স্মরণ করে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেনএতো সম্পূর্ণ কাফন! আফসোস! হামযা (রা.)-কে একটি ছোট ধরনের কাপড়ে কাফন দেয়া হয়েছিলো। যেটি তাঁর সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করার মতো ছিল না। তাঁর পা আবৃত করলে মাথা বের হয়ে যেতো আর মাথা আবৃত করলে পা বের হয়ে যেতো। পরিশেষে আমরা তাঁর পা ইখির নামক ঘাস দিয়ে ঢেকে কাফনের কাজ সম্পন্ন করেছি। ৩৭ হিজরীতে খাব্বাব (রা.) ইন্তেকাল করেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তাঁকেই সর্বপ্রথম কুফায় দাফন করা হয় । আলী (রা.)র চোখে কুফা শহরের বাইরে সাতটি কবর পড়লো। তিনি সাথীদের কাছে জানতে চাইলেন, এসব কোন লোকজনের কবর! এখানে তো কোনো কবর ছিলো না! তাঁকে বলা হলো, এই প্রথম কবরটি খাব্বাব বিন আরাতের। তাঁর ওসিয়ত অনুযায়ী সর্বপ্রথম তাঁকে এখানে দাফন করা হয় । অবশিষ্ট কবরগুলো অন্যদের। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা তাঁদেরকে এখানে দাফন করেছে।

এ কথা শোনার সাথে সাথে আলী (রা.)র চোখ দুটো অশ্রু সজল হয়ে উঠলো। তিনি তাঁর কবরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগলেন, খাব্বাবের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তিনি স্বেচ্ছায় ও আনন্দ চিত্তে আল্লাহর দ্বীন কবুল। করেছিলেন এবং নিজের ইচ্ছাতেই হিজরত করেছিলেন। সারাটি জীবন তিনি জিহাদে কাটিয়েছেন এবং ইসলামের জন্য অকল্পনীয় বিপদ সহ্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা সৎ লোকদের আমল নষ্ট করেন না। খাব্বাব ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের দৃঢ় সঙ্কল্প ও অবিচল-অটলতার এমন তুলনাহীন চিহ্ন এঁকেছেন যে, প্রত্যেক যুগের ঈমানদারদের জন্য তা চেতনার মশাল হয়ে রয়েছে। তিনি নিজের বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে জেনে বুঝে মুসলিম হন এবং হিজরত করেন। সারাটি জীবন। জিহাদে অতিবাহিত করেন এবং যে কোনো ধরনের দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করেন। যে ব্যক্তি কিয়ামতের কথা স্মরণে রাখে আখিরাতের জীবনে হিসাব দিতে হবে- এ কথা বিশ্বাস করে, তাঁর পক্ষে এই পৃথিবীতে ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য হালাল পথে ছোট কাজ করা কোনোক্রমেই লজ্জার নয় । খাব্বাব (রা.) কর্মকারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

আম্মার (রা.)-এর প্রতি নিষ্ঠুরতা

আম্মার (রা.) ও তার মাতা-পিতা ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলামের দুশমনরা তাঁদের উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন করতে থাকে। আরবের মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপরে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হতো। আঘাতের পর আঘাত করতো পাষন্ডের দল। আঘাত সহ্য করতে না পেরে তিনি অনেক সময় জ্ঞানহারা হয়ে যেতেন। তাঁর পাশ দিয়ে নবী কারীম (ﷺ) যাবার সময় তাঁকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ ও জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন। তাঁর পিতা ইয়াসির (রা.)কে ইসলামের দুশমনরা ধরে দুই পায়ে দুটো রশি বেঁধে তা দুটো উটের পায়ে বেঁধে দেয়া হলো। এরপর উট দুটিকে দুই দিকে যাবার জন্য আঘাত করা হলো। উট দুটো দুই দিকে দৌড় দেয়ার পরে ইয়াসিরের দেহ ছিড়ে দুই ভাগ হয়ে গেলো এবং তিনি তৎক্ষণাত শাহাদাতবরণ করলেন। আম্মারকেও প্রহার করতে করতে অচেতন করে ফেলা হতো। তার গর্ভধারিণী মা সুমাইয়া (রা.) দেখতেন- কিভাবে তাঁর কলিজার টুকরা সন্তানকে প্রহার করা হচ্ছে। সন্তান প্রহৃত হচ্ছে আর তিনি উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ। তাঁর মুখে কালিমার ঘোষণা শুনে নরপশু আবু জাহিল ক্রুদ্ধ হয়ে সুমাইয়াকে বর্শা বিদ্ধ করে হত্যা করলো। নারীদের মধ্যে সুমাইয়া (রা.)ই সর্বপ্রথম শাহাদাতবরণ করেন। আম্মার (রা.) ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ-মসজিদে কুবা নির্মাণে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে ভূমিকা রাখেন। ইমাম হাকিম (রহ.) তাঁর মুসতাদরাক-এ উল্লেখ করেছেন যে, কুবা মসজিদ নির্মাণের জন্য আম্মারই পাথর একত্রিত করেছিলেন এবং মসজিদের মূল নির্মাণ কাজও তিনিই করেছিলেন। মদীনার মসজিদে নববী নির্মাণেও তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। তিনি যখন শাহাদাতবরণ করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯০ বছরের অধিক । কেউ বলেছেন ৯৪ বছর। নবী কারীম (ﷺ) তাঁর শাহাদাতের ব্যাপারে ভবিষ্যৎ বাণী করে বলেছিলেন, তোমার জীবনের সবশেষ চুমুক তুমি যা পান। করবে তা হবে দুধ । বয়স বেশীর কারণে মহাসত্যের জন্য লড়াই করতে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে তাঁকে। কেউ-ই দুর্বল দেখেনি। তিনি অসীম সাহসিকতার ও বলিষ্ঠতার সাথে যুবক যোদ্ধার ন্যায় ময়দানে ভূমিকা পালন করেছেন। সেদিন যুদ্ধের ময়দানে প্রচন্ড যুদ্ধ হচ্ছিলো। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে। আম্মার (রা.) প্রবল পিপাসা অনুভব করলেন। সম্মুখে পেলেন দুধ, তাই তিনি পান করলেন। এরপর তাঁর মনে পড়লো আল্লাহর রসূলের ভবিষ্যৎ বাণীর কথা। তিনি অনুভব করলেন, আজই তাঁর জীবনের শেষ দিন এবং এখুনি তিনি শাহাদাতাবরণ করবেন। তিনি নিজের মুখেই তাঁর সম্পকে আল্লাহর রসূলের বলা কথা বললেন, আল্লাহর রসূল বলেছেন, হে আম্মার! সবশেষে তুমি যা পান করবে তা হবে দুধ । এ কথা বলতে বলতে তিনি শত্র বাহিনীর দিকে প্রচন্ড বেগে ধাবিত হলেন। সম্মুখে হাশিম (রা.)কে যুদ্ধের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, হে হাশিম! সম্মুখে অগ্রসর হও! জান্নাত তরবারীর ছায়ার নীচে এবং মৃত্যু নেজার (এক ধরনের অস্ত্র) কিনারায় অবস্থান করে। জান্নাতের দরজা খোলা হয়েছে। আজ আমি বন্ধুদের সাথে মিলিত হবো। আজ আমি আমার বন্ধু মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তাঁর দলের সাথে মিলিত হবো। এ কথা বলতে বলতে তিনি শত্রু বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। তিনি যেদিকেই যেতেন, সেদিকের শত্রুসৈন্যের রণবুহ্য ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো। যুদ্ধের ময়দানে তিনি এক সময় শাহাদাত বরণ করে এই পৃথিবী ত্যাগ করলেন।

আবুযর গিফারী (রা.)-র তাকওয়া

আবুযর গিফারী (রা.) একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। আলিম হিসেবেও তিনি যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আলী (রা.) বলেন, আবুযর এমন গভীর বিদ্যা অর্জন করেছিলেন যে, যা অনেক লোকই আয়ত্ব করতে অক্ষম। তিনি তাঁর গভীর পান্ডিত্য কখনও কারো কাছে প্রদর্শন করতেন না, তিনি নিজের জ্ঞানের আলো বিনয় এবং নম্রতার আবরণ দিয়ে সর্বদাই ঢেকে রাখতেন। তাঁর কাছে নবী কারীম (ﷺ) -এর নবুয়াত প্রাপ্তির সংবাদ পৌছলে তিনি তার ভাইকে মক্কায় পাঠালেন। যিনি নবুয়াতের দাবী করছেন, যার কাছে ওহি আসে। এবং যিনি আসমানের খবর পান, তিনি কেমন লোক, তার চরিত্র কেমন, তিনি কী কী কথা বলেন। তাঁর আচার ব্যবহার কেমন, তা জানার জন্য তাঁর ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর ভাই মক্কা থেকে ফিরে গিয়ে আবুযরকে বললেন, ‘আমি লোকটিকে সকথা বলতে, সদাচার করতে এবং পবিত্রতা অর্জন করতে মানুষকে আদেশ দিতে। শুনেছি। আমি তাঁর এমন একটি কথা শুনেছি যা কোন ভবিষ্যদ্বাণীও নয় বা কোন কবির বাক্যও নয় । ভাইয়ের কথায় আবুযরের মন শান্ত হল না। নিজে সব কিছু জানার জন্য তিনি মক্কা রওয়ানা হলেন এবং সেখানে উপস্থিত হয়ে সোজা কা'বা গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি নবী কারীম (ﷺ) -কে চিনতে পারলেন না, অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করাও সমীচীন মনে করলেন না। সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ঐ অবস্থায়ই থাকলেন। সন্ধ্যার পর আলী (রা.) দেখলেন যে, একজন বিদেশী মুসাফির মসজিদে অবস্থান করছেন। মুসাফিরদের তত্ত্বাবধান করার ভার তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল, কাজেই তিনি আবুযরকে ডেকে এনে নিজের বাড়ীতে খাওয়ালেন এবং রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করে দিলেন। তিনি খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লেন নিজের পরিচয় এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্য প্রকাশ করলেন না। সকালে উঠে তিনি আবার মসজিদে চলে গেলেন এবং সমস্ত দিন সেখানে রইলেন। সেদিনও তিনি আল্লাহর নবীকে নিজেও চিনতে পারলেন না বা কারো কাছে জিজ্ঞেসও করলেন না। সন্ধ্যার পর আলী (রা.) তাঁকে আবার নিজের বাড়ীতে নিয়ে যথারীতি অতিথি আপ্যায়ন করলেন; মুসাফির আজও নিজের পরিচয় গোপন রাখলেন এবং আলী (রা.)ও তাঁকে কোন কথা জিজ্ঞেস করলেন না। ভোরে উঠে আবুযর পুনরায় মসজিদে চলে গেলেন, আজও তিনি নবী করিম (ﷺ)-কে চিনতে পারলেন না এবং সেদিনও কাউকে জিজ্ঞেস করতে সাহস পেলেন না। আল্লাহর নবীর সাথে মেলামেশা করা বা তাঁর সান্নিধ্য বা সাহচর্য সন্ধান করা সে সময় বিপজ্জনক ছিল, কারণ তাঁর সম্পর্কে জেনে কেউ যদি ইসলাম কবুল করে, সে জন্য কাফিররা মক্কায় নতুন আগন্তুকসহ সকলের প্রতি সর্তক দৃষ্টি রাখতো। ইসলামের প্রতি বা নবী কারীম (ﷺ) -এর প্রতি কারও বিন্দুমাত্র অনুরাগ প্রকাশ পেলেই তার আর নিস্তার ছিল না; ইসলাম বিরোধিদের অত্যাচার ও নির্যাতনে ইসলামের প্রতি অনুরাগী লোকটিকে একেবারে জর্জরিত করে ফেলতো। আবুযর গিফারী (রা.) এ কারণেই নিজের পরিচয় গোপন করেছিলেন। তৃতীয় দিনেও তাই ঘটলো, কিন্তু আলী (রা.) মুসাফিরকে আহারাদি করিয়ে শোবার পূর্বে তাঁকে মক্কায় আসার উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করলেন। আবুযর (রা.) আলী (রা.)কে প্রথমে সঠিক সংবাদ বলার জন্য শপথ করিয়ে তারপর নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। আলী (রা.) তার কথা শুনে বললেন, তিনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল । কাল সকালে আমি যখন মসজিদে রওয়ানা হবো তখন আপনিও আমাকে অনুসরণ করবেন। কিন্তু সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে যে আপনি আমার সঙ্গী। রাস্তায় যদি কোন শত্ৰ সামনে পড়ে, তাহলে আমি কোনো কারণ দেখিয়ে বা জুতার ফিতা বাঁধতে বসে পড়ব, আপনি তখন আমার জন্য অপেক্ষা না করে সোজা চলতে থাকবেন এবং এমনি করে বুঝিয়ে দিবেন যে আমি আপনার সঙ্গী নই বা আপনার ও আমার উদ্দেশ্য এক নয় । ভোরে উঠে আলী (রা.) মসজিদের দিকে যাত্রা করলেন, আবুযর গিফারী (রা.)ও তাঁর পিছে পিছে যেতে লাগলেন। যথাসময়ে নবী কারীম (ﷺ) -এর কাছে। উপস্থিত হয়ে তাঁর কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শুনলেন। সত্যান্বেষী প্রাণ সত্যের আহবান শুনে কখনও স্থির থাকতে পারে না। আবুযর (রা.)র পিপাসিত প্রাণও সত্যের পিযুষরা পান করে এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি সেখানে বসেই ইসলাম গ্রহণ করে অমর জীবন লাভ করলেন। অত্যাচার ও নির্যাতনের আশঙ্কা করে নবী কারীম (ﷺ) আবুযর (রা.)কে বললেন, “তুমি ইসলাম গ্রহণের কথা এখন গোপন করে রেখো এবং নিরবে বাড়ী চলে যাও। মুসলিমদের আরও একটু প্রতিপত্তি এবং শক্তি সামর্থ হলেই চলে এসো। আবুযর (রা.) বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ! যার হাতে আমার প্রাণ আমি সেই আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি তাওহীদের মহাবাণী কাফিরদের মধ্যে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করবো। এ কথা বলেই তিনি তৎক্ষণাৎ কাবা গৃহে প্রবেশ করে উচ্চস্বরে তাওহীদের কালেমা পাঠ করলেন। আর যায় কোথায়! চারদিক থেকে কাফিররা ভিমরুলের মত উড়ে এসে তাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আঘাতে আঘাতে আবুযর (রা.)র শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেল । নিষ্ঠুর-নির্মম আঘাতে তিনি মুমূর্ষ হয়ে পড়লেন। ঐ সময় নবী কারীম (ﷺ) -এর চাচা আব্বাস, যদিও তিনি তখন পর্যন্ত মুসলিম হননি তবুও মুমূর্ষ আবুযরকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেলেন এবং আঘাতকারী লোকদের বললেন, কি সর্বনাশ! এ যে গিফারী গোত্রের লোক, শাম দেশের রাস্তাতেই যে তাদের বাসস্থান, এর মৃত্যু হলে যে ঐ দেশের সাথে তোমাদের সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্যই বন্ধ হয়ে যাবে। একে মেরে ফেললে তোমাদের সেখানে যাওয়ার আর কি কোন পথ থাকবে? তাঁর কথায় ইসলামের শত্রুরা কিছুটা যেনো চমকে উঠলো এবং সেদিনের মতো তারা আবুযবের উপর অত্যাচার বন্ধ করলো। পরের দিনও আবুযর (রা.) কাবা শরীফে প্রবেশ করে ঠিক পূর্বের ন্যায়ই কালেমা শাহাদাৎ পাঠ করলেন, সে দিনও কাফিররা তাঁকে চরম আঘাত করে মরণাপ্ত করে তুললো। এবারেও আব্বাস ইসলামের শত্রুকে বুঝিয়ে আবুযর (রা.)কে নির্যাতন থেকে রক্ষা করলেন। এটাই সত্যিকার ঈমানদারের পরিচয়, তাকওয়ার পরিচয় । ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই, আল্লাহর প্রেমিক, আল্লাহর পবিত্র নামের গুণকীর্তন ও পৃথিবীর বুকে তা প্রতিষ্ঠিত করতে, সর্বশ্রেণীর মানুষের সম্মুখে তা প্রচার করতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধাবোধ করেন না। এ কারণেই আবুযর (রা.) নিষেধ সত্ত্বেও দ্বিধাহীন চিত্তে কাফিরদের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আল্লাহর তাওহীদের ঘোষণা উচ্চারণ করতে এতটুকুও শঙ্কিত হননি। আবুযর ইসলাম গ্রহণ করেছেন, এ কথা কাফিররা জানলে তার উপর নির্যাতন চালাবে, এ কারণে নবী কারীম (ﷺ) তাঁকে নিজের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে ঈমানের আগুন এমনভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলো এবং ঈমানের যে স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন, তা আর গোপন রাখতে পারেননি। অন্যকেও ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য আহবান করেছিলেন।

আবুযর (রা.) খানকায় বসে যিকির করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেননি। ঈমানের সে স্বাদ তিনি লাভ করেছিলেন, সে ঈমানের দিকে অন্যকেও আহবান করার জন্যই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করলে এবং সে ঘোষণা কাবা চত্তরে ইসলামের দুশমনদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দিলে কী হতে পারে, তা আবুযরের অজানা ছিলো না। তিনি কি পারতেন না, তার ইসলাম গ্রহণ করার কথা গোপন রাখতে! ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি তো তাঁর নিজের এলাকায় চলে যেতে পারতেন! কিন্তু তিনি এসবের কিছুই করেননি। তিনি যখন দেখলেন, আল্লাহর রসূলের প্রতি এসব লোক কি ধরনের অত্যাচার করছে। আর সেই রসূলের হাতে হাত রেখেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহর নবী যদি নির্যাতন সহ্য করতে পারেন, তাহলে তিনি সেই নবীর অনুসারী হয়ে কেনো নির্যাতন সহ্য করতে পারবেন না! তিনি যখন কালিমা পাঠ করছেন, সেই কালেমা তাঁর মধ্যে ঈমানের যে শক্তিদান করেছে, সেই শক্তিতেই তিনি শত্রুদের সম্মুখে মহাসত্যের ঘোষণা দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কলিমা শাহাদাৎ এক অদ্ভুত ইন্দ্রজাল, ঐকান্তিকভাবে তা একবার পাঠ করলে মানুষের মনে যে শক্তির বন্যা আসে, তার সম্মুখে জগতের অত্যাচার আর নির্মম নির্যাতন তৃণ-খণ্ডের মত ভেসে যায় । ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিমরা বিজয়ী হয়েছিলো ঈমানী শক্তির কারণেই, তাকওয়ার গভীরতার কারণেই। ঈমানী শক্তির কাছে সংখ্যা গরিষ্ঠ কাফিররা মুষ্টিমেয় সাহাবায়ে কেরামের কাছে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। যে ব্যক্তি নিজের সবকিছু মহান আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, সেই ব্যক্তি পৃথিবীর কোনো শক্তির সম্মুখে মাথানত করতে পারে না। এই ধরনের মুসলিমদের একটি দলের সম্মুখে দুনিয়ার ইসলাম বিরোধী শক্তি মুহূর্তকালের জন্যও টিকে থাকতে পারে না। আজ মুসলিমদের ঈমানী শক্তি নেই, এ কারণেই তারা দুনিয়া জুড়ে নির্যাতিত হচ্ছে।

সোহায়েব (রা.)-র ত্যাগ

সোহায়েব (রা.) ও আম্মার (রা.) একত্রে ইসলাম কবুল করে মুসলিম হয়েছিলেন। তাঁদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ছিলো এমন যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সময় আরকাম (রা.)র বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা দুইজন পৃথক পৃথক সময়ে নবী কারীম (ﷺ) -এর কাছে হাযির হলেন এবং বাড়ীর দরজার সম্মুখে উভয়ের সাক্ষাৎ হলো । কিছু কথাবার্তার পরে উভয়ে জানতে পারলো যে, তাঁদের দুজনেরই উদ্দেশ্য এক। দু’জনই নবী কারীম (ﷺ) -এর সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করে তারা যথারীতি ইসলাম গ্রহণ করলেন। সে সময়। ইসলাম গ্রহণ করার অর্থই ছিলো স্বেচ্ছায় নির্যাতন-নিষ্পেষণ ডেকে আনা। তাঁরাও এর ব্যতীক্রম ছিলেন না, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা উভয়ে মক্কা থেকে। হিজরত করার সঙ্কল্প করলেন। কিন্তু ইসলামের শত্রুদের এটাও সহ্য হলো না। তাঁরা মক্কার বাইরে স্বাধীনভাবে ইসলাম পালন করবে, এটা কাফিরদের কাছে এক অসহনীয় ব্যাপার। কোনো মুসলিম হিজরত করবে, এ সংবাদ জানতে পারলে কাফিররা নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতো। সুতরাং সোহায়েব (রা.) হিযরত করবেন, এটা জানতে পেরেও কাফিররা তার পিছু লেগে গেল। একদল কাফির অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাকে ধরতে গেল। তিনি তখন তুনির হতে তীর বের করে রাখতে লাগলেন এবং বললেন, “শোন তোমরা জানো যে আমি তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তীরন্দায । আমার হাতে একটি তীর থাকা পর্যন্ত তোমরা কেউ-ই আমার কাছে আসতে পারবে না। তীর ফুরিয়ে গেলে তরবারীর সাহায্য নেব এবং যতক্ষণ তরবারী হাতে থাকবে, ততক্ষণ কেউই আমার কাছে আসতে পারবে না। তারপর তরবারী কোনক্রমে আমার হাত ছাড়া হয়ে গেলে তোমরা আমাকে যা খুশী করতে পারো। এ কারণে তোমাদের কাছে আমি একটি প্রস্তাব দিচ্ছি, তোমরা যদি আমার প্রাণের পরিবর্তে আমার সম্পদ গ্রহণ করো তাহলে তোমাদেরকে আমার সম্পদের সন্ধান বলে দিতে পারি। সম্পদ লোভী দুশমনের দল তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলে তিনি বলে দিলেন যে, তাঁর সম্পদ কোথায় রয়েছে। এভাবেই সোহায়েব (রা.) নিজের সম্পদ দিয়ে নিজেকে। কিছুটা হলেও বিপদ মুক্ত করেছিলেন। নবী কারীম তখন কাবাতে অবস্থান করছিলেন, সোহায়েব (রা.)র অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি বললেন, ‘বড় লাভের ব্যবসাই করলে সোহায়েব।' সোহায়েব (রা.) বললেন, নবী কারীম (ﷺ) তখন খেজুর খাচ্ছিলেন এবং আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন তা দেখে আমি তার সাথে খেতে বসে পড়লাম। তখন আল্লাহর নবী বললেন, ‘চোখের রোগে ভুগছো আবার খেজুরও খাচ্ছে। দেখছ কেমন করে!' সোহায়েব (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! যে চোখটি ভালো সেটি দিয়ে দেখে খাচ্ছি। সোয়াহেবের কথা শুনে নবী কারীম (ﷺ) -এর মুখে মধুর হাসি ফুটে উঠলো। সোহায়েব (রা.) খুব অমিতব্যয়ী ছিলেন। তিনি অধিক খরচ করতেন। একদিন উমর (রা.) তাঁকে বলেছিলেন, তুমি খুব বেশী অনর্থক খরচ করো। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি অন্যায়ভাবে একটি পয়সাও খরচ করি না । উমর (রা.)র শাহাদাতবণের সময় উপস্থিত হলে তিনি সোহায়েব (রা.) কে তার জানাযার আদায়ের জন্য অসিয়াত করে গিয়েছিলেন।

খুবাইব (রা.)-র তাকওয়ার পরীক্ষা

রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নির্দেশে গোয়েন্দা কাজে বের হয়ে খুবাইব রাদিআল্লাহু আনহু কাফেরদের হাতে বন্দী হন। তিনি বদর যুদ্ধে হারিছ ইবনু আমিরকে হত্যা করেছিলেন বিধায় তার পুত্ররা বদলা নেয়ার জন্য তাকে ক্রয় করে নেয় । একদিন তারা খুবাইবকে হত্যা করার জন্য হারাম শরীফের সীমানার বাইরে নিয়ে যায়। তখন খুবাইব রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমাকে দু'রাক'আত সলাত আদায় করার সুযোগ দাও। তারা সুযোগ দিলে তিনি দু'রাক'আত সলাত আদায় করে বলেন, আল্লাহর কসম! আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি, তোমরা এ কথা না ভাবলে আমি সলাত আরো দীর্ঘায়িত করতাম। অতঃপর দু’আ করেন “হে আল্লাহ! তাদেরকে এক এক করে গুণে রাখ, তাদেরকে বিক্ষিপ্তভাবে হত্যা করো এবং তাদের একজনকেও বাকী রেখ না। তারপর তিনি আবৃত্তি করেন ? আমাকে যখন একজন মুসলিম হিসেবে হত্যা করা হয় তখন আমি কোন কিছুকেই পরোয়া করি না। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে যেকোন অবস্থাতেই আমার মৃত্যু হোক তা যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তিনি ইচ্ছা করলে আমার কর্তিত অঙ্গে বরকত প্রদান করবেন। এরপর হারিছের পুত্র সারুআ উকবা তাঁর দিকে দাঁড়াল এবং তাঁকে শহীদ করে দিল। কতই না দুর্ভেদ্য ও সুগভীর তাদের আল্লাহ ভীরুতা! স্থির হয়ে দু'রাকআত সলাত আদায় করলেন, তাদের সামনে তাদেরই বিরুদ্ধে দু’আ করলেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরে সৌভাগ্যবান মনে করে প্ৰবোধ লাভ করলেন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর কথা ভেবে এতটুকুও ঘর্মাক্ত হননি তিনি।

মুয়াব্বিজ ও মুয়াজ (রা.)-র ত্যাগ

ইসলামের কঠোর শত্রু এবং মক্কায় অবস্থানের সময় নবী কারীম (ﷺ) -কে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে আবু জাহিল। মদীনায় এ কথা এমনভাবে প্রচারিত হয়েছিল যে, মদীনার একজন মুসলিম শিশুও তার নাম জানতো। মদীনার আনসারদের দুই কিশোর সন্তান, মুয়াব্বিজ (রা.) ও মুয়াজ (রা.), তাঁরা ছিলেন আপন দুই ভাই। এই দুই ভাই প্রতীজ্ঞা করেছিল, রসূলকে যে ব্যক্তি বেশী কষ্ট দিয়েছে, সেই আবু জাহিলকে তাঁরা হত্যা করবে আর না হয় তাঁরা শাহাদাতবরণ করবে। বুখারী হাদীসের কিতাবুল মাগাযীতে বদরের যুদ্ধের দিনের কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বলেন, “আমি এক সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার দু'পাশে ছিল কিশোর দুটি ছেলে। আমার কেমন যেন বিব্রত বোধ হচ্ছিল, আমার দুই পাশে দুটি কিশোর ছেলে, বয়স্ক কোন বীর নেই! এক পাশের একজন আমার কানের কাছে মুখ এনে জানতে চাইলো, আবু জাহিল লোকটি কে? অপর পাশের কিশোরটিও আবু জাহিলের পরিচয় জানতে চাইলো। তখন আমার জড়তার ভাব কেটে গেল। আমার মনে হলো, আমি দুইজন বীরের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছি। আব্দুর রহমান (রা.) বলেন, “আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, আবু জাহিলকে। তোমাদের কী প্রয়োজন? তাঁরা জানালো, আমরা আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি, আবু জাহিলকে হত্যা করবো অথবা শাহাদাতবরণ করবো। এরপর আব্দুর রহমান (রা.) তাদের দুই ভাইকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আবু জাহিলকে। আবু জাহিলকে দেখার সাথে সাথে দুই ভাই তীর বেগে ছুটে গেল। তার কাছে। তাঁরা ঝাপিয়ে পড়লো আল্লাহর শত্রর উপরে । আবু জাহিল মাটিতে পড়ে গেল। তাকে রক্ষার জন্য তার ছেলে দ্রুত এগিয়ে এসে তরবারীর আঘাত করলো । মায়াজ (রা.)র বাম হাতটি এমনভাবে কেটে গেল যে, সে কাটা হাতটি কাঁধের সাথে ঝুলতে লাগলো।

এই ঝুলন্ত হাত নিয়ে কিশোর এই সাহাবী আবু জাহিলের ছেলের সাথে যুদ্ধ করে তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করলেন। ঝুলন্ত হাত যুদ্ধ করতে অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। কিশোর সাহাবী মায়াজ (রা.) তাঁর ঝুলন্ত হাত পায়ের নীচে ফেলে আল্লাহু আকবার বলে গর্জন করে একটানে ছিড়ে ফেলে দিয়ে স্বচ্ছন্দে যুদ্ধ করতে থাকলেন। এই দুই সিংহ সাবক ছিলেন আফরা নামক এক বীরাঙ্গনা নারীর সন্তান। বদরের প্রান্তরে মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীন মুসলিমদেরকে বিজয়দান করার পরে নবী কারীম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, এমন কেউ আছে। কি, যে ব্যক্তি আবু জাহিলের পরিণতি দেখে আসবে? আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) দ্রুত ছুটে গেলেন যুদ্ধের ময়দানে। তিনি দেখলেন, মৃতদেহের মধ্যে আবু জাহিল মারাত্মক আহত অবস্থায় পড়ে আছে। ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ছে আল্লাহর এই দুশমন। বুখারী হাদীস বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) আবু জাহিলের দাড়ি ধরে জানতে চাইলেন, “তুমিই কি আবু জাহিল? আল্লাহর দুশমন জবাব দিল, সেই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম আর কে আছে, যাকে তার বংশের লোকজন হত্যা করলো। কোন একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)কে আবু জাহিল থাপ্পড় মেরেছিল । সে কথা আব্দুল্লাহর স্মরণে ছিল। তিনি আবু জাহিলের ঘাড়ে পা রাখলেন। আবু জাহিল বললো, “এই ছাগলের রাখাল! দেখ তুই কোথায় তোর পা রেখেছিস?' এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ইসলামের এই শত্রর মাথা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। তারপর সে মাথা আল্লাহর রসূলের সামনে। এনেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আফরার দুই সন্তান আবু জাহিলকে মারাত্মকভাবে আহত করে ফেলে রেখেছিল। আমারও প্রতীজ্ঞা ছিল আমি তাকে হত্যা করবো। আমি তার মাথা কেটে আল্লাহর নবীর সামনে এনে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এটা আল্লাহর দুশমন আবু জাহিলের মাথা। নবী কারীম (ﷺ) যেন বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘সত্যই কি এটা আবু জাহিলের মাথা!' আমি বললাম, আল্লাহর কসম, এটা আবু জাহিলের মাথা। এরপর নবী কারীম ও কুরাইশ নেতৃবৃন্দের লাশ কুয়ায় নিক্ষেপ করতে আদেশ করেছিলেন। তিনি গভীর রাতে সেই কুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে নিহত কাফির নেতৃবৃন্দের নাম ধরে ডেকে ডেকে বলছিলেন, আল্লাহ তোমাদের সাথে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তোমরা যথাযথভাবে লাভ করেছে। আমিও আমার রবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে লাভ করেছি।

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-র ত্যাগ

কুরাইশদের মধ্যে সম্মানিত গোষ্ঠীর সন্তান ছিলেন খালিদ (রা.)। তাঁর গোটা বংশই ছিল আরবের সেনা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। অর্থাৎ তিনি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যারা সবাই সামরিক বাহিনীর লোক ছিল। তাঁর রক্তের মধ্যে মিশ্রিত ছিল সামরিক বাহিনীর সমর কৌশল। হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে মক্কা বিজয়ের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আমর ইবনুল আ’স (রা.) সম্পর্কে কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি হাবশাতেই বাদশাহর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবার কোন বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি হাবশা থেকে মদীনায় রসূলের কাছে যাচ্ছিলেন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য। পথে তিনি মদীনা যাত্রী একদল লোককে দেখতে পেলেন। তাদের মধ্যে খালিদ (রা.) ছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে খালিদ! কোন দিকে যাচ্ছো? তিনি কোন ধরণের জড়তা ব্যতীতই বললেন, আল্লাহর কসম! আমার দৃঢ় বিশ্বাস মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রসূল । আর কতদিন এভাবে থাকবো। চলো যাই তাঁর কাছে, ইসলাম গ্রহণ করি। তারপর তাঁরা মদীনায় আল্লাহর নবীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে প্রথমে খালিদ ও পরে আমর ইসলাম গ্রহণ করেন। খালিদ (রা.) বলেন, ইসলাম গ্রহণ করার পরে আল্লাহর নবী আমাকে বলেছিলেন, “আমি তোমার ভেতরে যে যোগ্যতা দেখতাম, তাতে আমি আশাবাদী ছিলাম তুমি একদিন কল্যাণ লাভ করবে। খালিদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পরে তাঁর মধ্যে অতীত ভুলের জন্য অনুশোচনা জাগলো। তিনি আল্লাহর নবীর কাছে আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর পথে আমি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে গোনাহ করেছি, এ কারণে আমার জন্য দু’আ করুন। নবী কারীম (ﷺ) বললেন, ইসলাম অতীতের সমস্ত পাপ মুছে দেয়। খালিদ (রা.) বললেন, আপনার এই কথার উপরে আমি বাইয়াত গ্রহণ করলাম। রসূল (ﷺ) আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন, “আমার আল্লাহ! খালিদ তোমার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যে পাপ করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও!’

ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশদের জেনারেল, ইসলাম গ্রহণের পরে মুসলিম হিসেবে তাঁর জীবনের প্রথম যুদ্ধেই ঘটনাচক্রে তাঁকেই জেনারেলের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। মুসলিম হিসেবে তাঁর প্রথম যুদ্ধ ছিল মুতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার আর রোমান বাহিনীর সংখ্যা ছিল দুই লক্ষ। নবী কারীম (ﷺ) এই যুদ্ধে পরপর তিনজনের নাম সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। যায়িদ, জাফর ও আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুম। এই তিনজনের কথা রসূল (ﷺ) এভাবে বলেছিলেন যে, প্রথমজন শাহাদাত বরণ করলে দ্বিতীয় জন সেনাপতি হবে । তিনিও শাহাদাতবরণ করলে তৃতীয়জন সেনাপতি হবে । তিনিও শাহাদাতবরণ করলে মুসলিমরা যাকে ইচ্ছা সেনাপতি নিয়োগ করবে । মুতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপতির অধীনে খালিদ জেনারেলের সমস্ত অহংকার বিসর্জন দিয়ে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। পরপর তিনজনই যখন শাহাদাতবরণ করলেন, তখন সাবিত ইবনে আকরাম (রা.) যুদ্ধের পতাকা উঠিয়ে নিলেন- যেন মুসলিম বাহিনীর মধ্যে কোন ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। পতাকা হাতে তিনি খালিদ (রা.)-র কাছে এসে বললেন, ‘হে খালিদ! এই পতাকা তুমি ধরো। দুই লক্ষের বিরুদ্ধে মাত্র দুই হাজার সৈন্য এবং এই দুই হাজারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা বেশী। বদর, ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরাম এই বাহিনীতে শামিল রয়েছেন। তাদের উপরে নও মুসলিম খালিদের নেতৃত্ব দেবার যে কোন অধিকার নেই এ কথা খালিদের থেকে আর কে ভালো বুঝতো! তিনি আপত্তি জানিয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে বললেন, ‘অসম্ভব! আমি এ পতাকা গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। আপনি বদর-ওহুদে অংশগ্রহণ করেছেন। আপনিই এই পতাকার যোগ্যতম ব্যক্তি। সাবিত (রা.) বললেন, আমি এই পতাকা তোমার জন্যই উঠিয়ে এনেছি। আমার তুলনায় তোমার মধ্যে সামরিক যোগ্যতা অনেক বেশী । তুমি এ পতাকা। ধরো। এবার সাবিত (রা.) মুসলিম বাহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কি খালিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে রাজি আছো?’ সমবেত বাহিনী সম্মতি জানিয়ে বলেছিল, “অবশ্যই আমরা রাজি আছি।

খালিদ (রা.) জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে দুই হাজার মুসলিম বাহিনী দুই লক্ষের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘সেদিনের যুদ্ধে আমার হাতে সাতটি তরবারী ভেঙ্গেছিল । সর্বশেষে একটি ইয়েমেনী তরবারী টিকে ছিল। আল্লাহর নবী খালিদের উপাধি দান করেছিলেন, সাইফুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারী। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যেমন ছিলেন ইসলামের কট্টর শত্র, তেমনি ইসলাম গ্রহণ করার পরে হয়েছিলেন ইসলামের পরম বন্ধু । মক্কায় বিভিন্ন গোত্রের উপরে বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পিত ছিল এ কথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। আমর ইবনুল আস (রা.)র গোত্র ছিল মক্কার সেই বিখ্যাত গোত্র, যে গোত্র মক্কার ঝগড়া বিবাদের মিমাংসা করতো। তাঁর গোত্রের নাম ছিল বনী সাহম। মক্কার যে তিনজন লোক ছিল ইসলামের প্রধান শত্র, আমর ছিলেন তাদের একজন। তিনিই ইসলাম গ্রহণ করে হলেন ইসলামের মহাসেনা নায়ক, আরবের শ্রেষ্ঠ কৌশলী কূটনীতিক ও মিশরবাসীর মুক্তিদাতা। মুসলিমদের প্রথম যে দলটি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমর গিয়েছিলেন। তিনিই অমুসলিম অবস্থায় আবিসিনিয়ার বাদশাহকে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। খন্দকের যুদ্ধে এসেই আমরের ভেতরে ইসলাম সম্পর্কে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল ।

তিনিং স্বয়ং বলেন, ইসলামের আহবান সম্পর্কে আমি ভাবতে থাকি। তারপর এক পর্যায়ে আমার কাছে ইসলামের মূল সত্য স্পষ্ট হতে থাকে। তারপর আমি মুসলিমদের বিরোধিতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম । কুরাইশ নেতারা আমার মনের অবস্থা অনুভব করতে পেরে আমার কাছে একজন লোক পাঠিয়েছিল। সে। আমার সাথে তর্ক-বিতর্ক শুরু করলো। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বলতে পারো, আমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত না রোমান পারসিকরা? লোকটি জবাব দিল, ‘আমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি তাকে পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘সুখ সম্পদ এবং ধন-ঐশ্বর্যের অধিকারী আমরা না তারা? লোকটি জবাব দিয়েছিল, তারাই সুখ-সম্পদ এবং ধন-ঐশ্বর্যের অধিকারী। আমি তাকে বললাম, বর্তমান জীবনের শেষে ইন্তেকালের পরে যদি কোন জীবন থেকে থাকে, তাহলে আমাদের এই সত্য কোন কাজে লাগলো? এই পৃথিবীতে আমাদের সত্য আমাদের দুর্দশা দূর করতে সক্ষম হলো না, তাহলে পরকালে আমাদের কোন কল্যাণ লাভের কোন আশাই নেই। সুতরাং মুহাম্মাদ (ﷺ) যে। বলেন, মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন আছে এবং সে জীবনে মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করবে, একথা অত্যন্ত যুক্ত সংগত বলেই আমার কাছে মনে হয়। তিনি আরো বলেন, ‘খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফিরেই আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের বলেছিলাম, একটি কথা তোমরা জেনে রেখো, মুহাম্মাদ (ﷺ) -এর প্রচারিত আদর্শ বিজয়ী হবার জন্যই এসেছে। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এ সম্পর্কে আমার পরামর্শ হলো, চলো আমরা আবিসিনিয়ায় বাদশাহর দরবারে চলে যাই। মুহাম্মাদ (ﷺ) যদি বিজয়ী হয় তাহলে আমরা আর ফিরবো না। আমরা আবিসিনিয়ায় বাদশাহর দরবারে চলে গেলাম। সেখানে ঘটনার এক পর্যায়ে বাদশাহ তাঁকে নবী কারীম (ﷺ) সম্পর্কে বুঝালেন। তাঁর চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটে গেল। তিনি বাদশাহর সামনেই ইসলামের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেন। তারপরই তিনি মদীনার পথে যাত্রা করলেন। পথে খালিদের সাথে দেখা এবং কথা হলো। তারপর তাঁরা আল্লাহর নবীর সামনে উপস্থিত হলেন। আমর (রা.) বলেন, “আমাদেরকে দেখেই নবী কারীম (ﷺ) -এর চেহারায় আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। তিনি উপস্থিত মুসলিমদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, লাকাদ রামাত কুম মাককাহ বিফালাজাতি আকবাদিহা-মক্কা তার মূল্যবান অংশসমূহ তোমাদের প্রতি ছুড়ে দিয়েছে। খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলাম কবুল করে যে কথা বলেছিলেন, আমরও অনুশোচনা করে একই কথা বললেন। আল্লাহর নবী বললেন, ইসলাম অতীতের সমস্ত গোনাহ মুছে দেয় এবং হিজরতও সমস্ত গোনাহ মুছে দেয়। আরব উপদ্বীপে অধিকাংশ গোত্র মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিল । কোন কোন গোত্র ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাদের শতাব্দী সঞ্চিত কুসংস্কার ত্যাগ করতে পারেনি। তাঁরা মূর্তির আখড়া উৎখাত করতে ভয় পাচ্ছিল। এ কারণে নবী (ﷺ) বিভিন্ন এলাকার নও মুসলিমদের কাছে সাহাবাদেরকে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁরা মূর্তির আখড়া উৎখাত করতে সহযোগীতা করতেন।

সাহাবীদের জীবনী থেকে তাকওয়ার শিক্ষা

তাকওয়া এমন এক অদৃশ্য শক্তি, যার স্পর্শে মানুষ নিজের প্রতিটি সময়, যাবতীয় শ্রম, সকল পদক্ষেপ, সমস্ত পরিকল্পনা, সর্বপ্রকার কষ্ট এমনকি অবশেষে সুন্দর পৃথিবীর সুখী জীবনের সমাধি রচনা করে পরকালমুখী হতে কুষ্ঠিত হয় না। তাকওয়া এমন এক শক্তি, যার ফলে আজকের এই মূখতার যুগেও গুটিকতক বনু আদমের বক্ষপিঞ্জরে প্রশান্তির মৃদু সমীরণ প্রবাহিত হয় । ইসলামের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যে সমস্ত মনীষীর জীবন-কাহিনী ইতিহাসের পাতায় এসেছে তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন আল্লাহভীতির এক একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এসব ঘটনাবলী মুসলিম উম্মাহকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করছে। যুগিয়েছে আল্লাহর পথে কাজ করে যাওয়ার অদম্য মনোবল। আর ইতিহাসকে করেছে সুশোভিত ও চিত্তাকর্ষক।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন