hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি

লেখকঃ মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ)

১০২
ইসলামী সংস্কৃতির মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি
প্রতিটি জাতীয় সংস্কৃতি তার নিজস্ব পরিবেষ্টনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটা বিশেষ দেশের সীমারেখার মধ্যে জীবন যাপনকালী লোকদের উত্তরাধিকারই হয় সেই দেশের সংস্কৃতি। কিন্তু ইসলাম বিশ্বজনীন জীবনাদর্শ। সমগ্র মানব বংশের প্রতিই তার সমান আহ্বান। কোন বিশেষ জাতি, বংশ, গোত্র, সম্প্রদায় বা ব্যক্তির প্রতি তার কোন পক্ষপাত নেই; তার দৃষ্টিকোণ বিশাল, বিস্তীর্ণ, ব্যাপক ও সার্বিক। বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ওপরই তার লক্ষ্য নিবদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা ব্যক্তিগত ও বংশীয় বিশেষত্বের উৎকর্ষ বিধানের জন্যে চেষ্টা-সাধনা চালাতে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করে। আর তার ফলে যে সাংস্কৃতিক ফসল পাওয়া যায়, তার প্রতি তার নেই কোন অনীহা।

একালে শিল্পকলা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর সীমাহীন গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এগুলোর ওপর পূজা-উপাসনার মতোই সংবেদনশীলতার এক মোহময় আবরণ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরণের বাড়াবাড়ি দেখে যে কোন ঈমানদার ব্যক্তি বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেনা। পাশ্চাত্য দেশসমূহে এ বিষয়গুলো সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা হঠাৎ ঘটে-যাওয়া বিপ্লব রূপে গণ্য হতে পারে কিংবা তাদের জন্যে তা জীবনের একটা লক্ষ্য হতে পারে হয়তবা। কিন্তু মুসলমানরা একে জীবন লক্ষ্য রূপে গণ্য করতে পারে না। তবে এসব সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্প পর্যায়ের কীর্তিসমূহের প্রতি মুসলমানদের মনে কিছুমাত্র অনীহা অথবা ঘৃণা রয়েছে তাও মনে করার কোন কারণ নেই। [অবশ্য ইসলামের তওহীদী চেতনা ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে কোন সাহিত্য ও শিল্পকলা আপত্তিকর বিবেচিত হলে সেটা ভিন্ন কথা।– সম্পাদক]। মুসলমানরা এগুলোকে খোদার অনুদানসমূহের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করে এবং নিছক একটা সহায়ক ও বিনোদনমূলক উপাদানই মনে করে। অথচ এগুলো হচ্ছে পথিকের চলার পথের সহজাত আয়েশ ও বিশ্রাম লাভের উপকরণ মাত্র, নিজেই কোন লক্ষ্য বা মনজিল নয়। বড়জোর এগুলো উদ্দেশ্য লাভে ও লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পথে সাহায্যকারী মাত্র। মুসলমানরা এই সাহায্য ও আরাম-আয়েশের পূজারী আদৌ নয়। এ ধরণের কাব্য-সাহিত্য এবং বৈজ্ঞানিক ও শিল্পকলামূলক দুর্লভ সম্পদকে দুটি দিক দিয়ে সাহায্যকারী ও বিনোদনমূলক পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। বিশেষত কাব্য-সাহিত্য ও স্থাপত্যশিল্প উভয় দিকেই গণ্য হতে পারে; অর্থাৎ তা যেমন সাহায্যকারী, তেমনি বিনোদনমূলকও।

সমাজবদ্ধ মানব-সমষ্টির মধ্যে মুসলিম জাতির লক্ষ্য, পথ-প্রদর্শক ও আলোক-বর্তিকা এক ও অভিন্ন। আল্লাহর সন্তোষ লাভ তাদের চূড়ান্ত জীবন লক্ষ্য। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) তাদের পথ-প্রদর্শক। তাদের অগ্রগতি সাধিত হয় আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদের নিষ্কলংক আলোকের দিগন্তপ্লাবী উজ্জ্বলতায়। ফলে তার (কুরআনের) উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থার প্রতিফলনে যে সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তির উন্মেষ ঘটে কেবলমাত্র তা-ই হতে পারে ইসলামী সংস্কৃতি। মুসলমান নামধারী লোকেরা অতীতে কোন এক সময় যে সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিল অথবা ভিন্নতর আদর্শানুসারী জীবন যাত্রার ফলে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, ইসলামী সংস্কৃতি বলতে তা বুঝায়না কখনো। ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ব-মানবতার সার্বিক ও সামষ্টিক কল্যাণ।

মানবতার কল্যাণ ও উৎকর্ষ সাধনই ইসলামের ঐকান্তিক চেষ্টা। ইসলাম মানুষের মন-মগজ ও যোগ্যতা-প্রতিভাকে এরই সাহায্যে পরিচ্ছন্ন ও পরিপুষ্ট করে তুলতে সচেষ্ট। এই বিকাশমান ধারাবাহিকতায় এমন কোন পরিবর্তন বা পর্যায় যদি এসে পড়ে, যা কুরআন মজীদ বা রাসূলের সুন্নাহ অনুমোদিত নয়, তাহলে বুঝতে হবে, সে পরিবর্তন বা পর্যায় ইসলামের মধ্য থেকে সূচিত হয়নি, তার উৎস রয়েছে বাইরে। তাই তা ইসলামী আদর্শানুসারী জীবন-ধারার পরিণতি বা প্রতিফলন নয় এবং সে কারণে ইসলামী আদর্শ বিশ্বাসী লোকেরা তা গ্রহণও করতে পারে না-তা বরদাশত করে নেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। কেননা তার পরিণতিতে মুসলিম জনতা সার্বিকভাবে ধ্বংস, বিপর্যয় ও সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।

শিল্পকলা নামে পরিচিত একালের মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণসহ কয়েক ধরণের সৃষ্টিকর্ম ইসলামে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। কেননা মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে যে প্রতিমা-পূজা ও মুশরিকী ভাবধারা নিহিত মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ তারই চরিতার্থতা ও বহিঃপ্রকাশ মাত্র। প্রথমটির সঙ্গে রয়েছে দ্বিতীয়টির পূর্ণ সাদৃশ্য। এ কারণে শিল্পকলার আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানাদিকে নির্মল করে তোলা মানব জাতির উৎকর্ষ ও কল্যাণ সাধনের জন্যে অপরিহার্য। এই দুনিয়ার জীবনকে কেবলমাত্র সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ, রূপ-শোভামণ্ডিত ও চোখ-ঝলসানো চাক্চিক্যে সমুজ্জ্বল করে তোলাই ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য হতে পারে না। মানব জীবনকে ধন্য ও সুসমৃদ্ধ করে তোলার জন্যে ইসলামী সংস্কৃতি অবলম্বিত পথ ও পন্থা সম্পূর্ণ স্ততন্ত্র ও ভিন্নতর।

সংস্কৃতির কোন কোন উচ্চতর নিদর্শন ও প্রতীক, তা যতই উন্নত মানসম্পন্ন হোক, পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল সংস্কৃতির দর্পন হতে পারে না। কতিপয় ব্যক্তির এইরূপ সৃষ্টিকর্ম অধিকাংশ লোকের মহৎ কীর্তিরূপে গৃহীত হওয়া স্বাভাবিক নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়। কেননা তাদের প্রধান অংশই পশ্চাদপদ, দীন-হীন ও নিম্নমানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। অতএব কথিত শিল্পকর্মকে অধিকাংশ লোকের মহৎ কীর্তি নয়; বরং হীন মন-মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ রূপে গণ্য করতে হবে।

পাশ্চাত্যের পত্র-পত্রিকায় একটা প্রশ্ন নিয়ে যথেষ্ট বাগ-বিতণ্ডা চলেছিল। প্রশ্ন ছিল এই, একটি কক্ষে যদি একটি নিষ্পাপ শিশু থাকে আর সেখানেই এক মূল্যবান, দুর্লভ ও অনন্য গ্রীক ভাষ্কর্য প্রতিমা থাকে আর হঠাৎ কক্ষটিতে আগুন ধরে যায় এবং সে আগুন গোটা কক্ষটিকে গ্রাস করে ফেলে আর সময়ও এতটা সমান্য থাকে যে, তখন হয় শিশুটিকে রক্ষা করা যেতে পারে, নাহয় ভাস্কর্যের নিদর্শনটি, তখন এ দুটির মধ্যে কোন্‌টিকে বাঁচানোর চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়-মানব শিশুটিকে কিংবা ভাস্কর্য শিল্পটিকে? এই প্রশ্নটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর জনগণ যে জবাব দিয়েছিল তা ছিল মানব শিশুটির পরিবর্তে ভাস্কর্যটিকে রক্ষা করার পক্ষে। এটা ছিল মানব শিশুটির প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন এবং শিল্পকলার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই জনমতকে কি কোনক্রমে বিবেকসম্পন্ন ও যথার্থ বলে মেনে নেয়া যায়? তা যায়না। কারণঃ

১. যে শিশুটিকে একটা নিষ্প্রাণ-নির্জীব প্রস্তর মূর্তিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জ্বলে-পুড়ে মরার জন্যে ছেড়ে দেয়া হল সে একদিন সমাজের এক বিরাট কল্যাণ সাধন করতে পারতো হয়তোবা। আর সে জীবনে বেঁচে থেকে প্রস্তর মূর্তির চাইতেও অনেক অনেক বেশী মূল্যবান ও দুর্লভ জিনিস সৃষ্টির কারণ হতে পারত।

২. সে প্রস্তর মূর্তিটি একটা বিরাট ও উত্যুঙ্গ সভ্যতার খুবই ক্ষুদ্র ও নগণ্য অংশ মাত্র। সেটি জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে গেলে মানবতার এমন কি ক্ষতি সাধতি হতো? কিছুই না।

৩. নৈতিক মূল্যমানের দৃষ্টিতে এ প্রস্তর মূর্তিটি নিতান্তই গুরুত্বহীন একটি বস্তু, অথচ সংস্কৃতিতে নৈতিক মূল্যমানের ভূমিকা অত্যন্ত প্রকট ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আলোচ্য ঘটনায় দেখা গেল, মানুষের তুলনায় প্রস্তর মূর্তি অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর প্রস্তর মূর্তির তুলনায় মানুষ অতীব তুচ্ছ-মূল্যহীন! পাশ্চাত্য সুধীদের এই মনোভাবের ফলে মূর্তি পূজার একটা নবতর সংস্করণ প্রসার ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ অবস্থা অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয়। ইসলাম মানবতার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করে। মানুষের কোন মূল্যবান শিল্পকর্মের জন্যে একটা মহামূল্য মানব সন্তানের জীবন উৎসর্গ করা ইসলামের ধারণাতীত। মানুষের দুর্লভ কীর্তির প্রতি এই আসক্তি ও ভক্তি কার্যত আল্লাহর প্রতি ঈমানের অস্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ যখন নিজের চিন্তা-বিশ্বাসকে খোদায়ী বিধান হতে স্বতন্ত্র ও নিঃসম্পর্ক করে নেয়, তখন তার ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তি সীমাহীন হয়ে যায়। তখন চূড়ান্ত ধ্বংসই হয় তার অনিবার্য পরিণতি। এই দৃষ্টিকোণের ধারকরা বলেন, শিল্প-সৌন্দর্য ক্রমশ হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে। প্রাচীন মানব সভ্যতা পতনোন্মুখ। একারণেই ভাষ্কর্যের নিদর্শনটিকে রক্ষা করা অপরিহার্য। কেননা অতীতের দুর্লভ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু এইটুকু যুক্তিকে মানুষের সৃষ্টির তুলনায় আল্লাহর সৃষ্টিকে মূল্যহীন ভাবাকে কোন মানুষই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারে না।

ইসলামের কল্যাণমূলক দৃষ্টিকোণ ব্যক্তির অন্তরে একদিকে শুভেচ্ছা ও শুভাকাঙ্ক্ষা এবং অন্যদিকে অনুতাপ ও তিরস্কারের ভাব জাগ্রত করে আর এটাই হচ্ছে সাফল্য ও সার্থকতা লাভের প্রধান উপায়। যাকাতের মাধ্যমে এই চেতনা কার্যকর হয় মূলধনের হ্রাস-প্রাপ্তির ফলে আর তার ফলেই মূলধন পবিত্র ও ক্রমবৃদ্ধি লাভ করে। ইসলাম জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগে সমানভাবে পরিব্যপ্ত। তাতে ধর্মচর্চা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পার্থক্য নির্ধারণ সম্ভব নয়। জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রগতিই ইসলামের কাম্য। এখনে শুধু ভালো ও মন্দ তথা কল্যাণ ও অকল্যাণের পার্থক্যই স্বীকৃত। বৈরাগ্যবাদ বা দুনিয়াত্যাগের কোন অনুমতি বা অবকাশ ইসলামে নেই। প্রতিটি ব্যক্তির রয়েছে বহুমুখী কর্তব্য ও দায়িত্ব। সফল ও সার্থক কার্যাবলী সংঘটিত হয়ে সে সব সমর্পিত কর্মক্ষমতার দরুন, যা প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ তা’আলা নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। বস্তুত ইসলামী সংস্কৃতি দ্বীনের সর্বাত্মক নীতিমালার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তা বাস্তব, অবিমিশ্র ও সারবত্তাপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ দ্বীনী ব্যবস্থা; জীবনের প্রতিটি মূহুর্তেই তা অবশ্য অনুসরণীয়। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহের নির্দিষ্ট সময়টুকুতে তার অনুসরণ নিতান্তই অর্থহীন।

ফরাসী ও রুশ বিপ্লবে আল্লাহর কোন স্থান স্বীকৃত নয়। গ্রীক ও রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ হল বৈষয়িক জীবন ও রাজনীতিতে আল্লাহর কোন অংশ নেই। কিন্তু এ বিশ্বলোকে এবং মানব সমাজে প্রতি মুহূর্তে ও প্রতি নিমিষে এমন অসংখ্য ঘটনাবলী সংঘটিত হচ্ছে, যে বিষয়ে কোন ভবিষ্যৎবাণী কোন মানুষ করতে সক্ষম নয়- তা কাঙ্ক্ষিত বা প্রার্থিতও নয়। এ ধরনের ঘটনাবলীর আকস্মিক আত্মপ্রকাশ মানুষের সব পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনাকে চুরমার করে দেয়- ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় তার সব স্বপ্ন-সাধ। কিন্তু আল্লাহকে বা আল্লাহর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার করে সে সবের কি ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে?

মধ্যযুগীয় ধর্মচর্চা হচ্ছে বিস্ময়কর ঘটনাবলীর গল্প-কাহিনী, রসম-রেওয়াজ, উপাসনা-আরাধনা ও উপাসনালয়-কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানাদি সমন্বিত। জগতের রূঢ় বাস্তবতা, বৈষয়িক তৎপরতা ও ব্যতিব্যস্ততা থেকে পলায়নের পথ হিসেবেই তা অবলম্বিত হতো। সেকালের লোকদের অভিমত ছিল, বাস্তব জীবনকে অবশ্যই ধর্মহীন বা ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হতে হবে। আর কৃচ্ছসাধক ও একনিষ্ঠ পূজারীদের তা-ই হচ্ছে রক্তিম স্বপনের পরকাষ্ঠা। এ দৃষ্টিকোণের মারাত্মক প্রভাব আজ দুনিয়ার সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত। হীন স্বার্থের কুটিল চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে মানুষ আজ সমাজের সাধারণ শান্তি ও শৃঙ্খলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে। ক্ষমতাবানরা মানুষের মৌলিক ও বৈধ অধিকার হরণ করেছে নিষ্ঠুরভাবে। জনগণের রক্ত পানি করে উপার্জন করা বিত্ত-বৈভবের ওপর চলেছে নির্মম লূটপাটের পৈশাচিকতা। সব দুষ্কর্মের পশ্চাতে ব্যক্তি-স্বার্থই ছিল প্রধান নিয়ামক। কিন্তু যারা ভালোমানুষ, সত্যই তারা ব্যক্তি-স্বার্থকে সামষ্টিক স্বার্থের জন্যে উৎসর্গ করে। কেননা তাতেই নিহিত রয়েছে মানবতার বৃহত্তর কল্যাণ ও সাফল্য। ব্যক্তিবাদের ওপর সমষ্টিবাদের প্রাধান্য এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ হচ্ছে চরম লক্ষ্যের নিকটবর্তী পর্যায়। নৈতিক ভিত্তিসমূহ তখন হয় পাকা-পোক্ত, অবিচল ও অনড়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনী ও নিত্য-নব উদ্ঘাটন তার ভিত্তিমূলের ওপর কোন প্রতিকূল প্রভাবই বিস্তার করতে পারে না।

মোটকথা, ইসলামী সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে দ্বীন-ভিত্তিক। এই দ্বীনি ভাবধারাই তার প্রাণ-শক্তি ও আসল নিয়ামক। দ্বীনী ভাবধারাশূণ্য সংস্কৃতি কখনও ইসলামী পদবাচ্য হতে পারে না-হতে পারে অন্য কিছু। এখানে প্রতিটি কাজ, পদক্ষেপ বা অনুষ্ঠানের বৈধতা দ্বীন-ইসলাম থেকে গ্রহণীয়। কেননা তা আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধান ও নির্দেশনার সমষ্টি। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি স্তরে ও প্রতিটি চড়াই-উৎরাইয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে পথিকের যাত্রা সুগম করে ও তাকে অগ্রগমনের প্রেরণা দেয়। বিশ্বনবীর বাস্তব জীবনে ও কর্ম-ধারায় তা পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত। তাতে স্পষ্টত প্রত্যক্ষ করা যায় যে, ইসলামী সংস্কৃতি নিছক কতকগুলো আকীদা-বিশ্বাসেরই সমষ্টি নয়। বাস্তব কর্ম সম্পাদনই তার আসল কথা আর জাতীয় সাফল্য ও সার্থকতা লাভ কেবলমাত্র এভাবেই সম্ভবপর।

ইসলামী সংস্কৃতি ও মানব জীবনে তার কার্যকারিতা উপলব্ধি করার জন্যে আরও একটা দিক দিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কুরআন মজীদে ‘তাযকিয়া’ শব্দটি বহুল-ব্যবহৃত। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ভাষায় এ শব্দটির ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য আমাদেরকে ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কিত প্রকৃত ধারণা (conception) পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তিনি বলেছেনঃ

‘‘তায্কিয়া’ অর্থ পবিত্র হওয়া, পবৃদ্ধি লাভ করা-অন্যায় ও কদর্যতা পরিহার করে চলা, যার ফলে আত্মার শ্রীবৃ্দ্ধি, আধিক্য ও প্রাচুর্য সাধিত হয়। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ সফলতা পেল সে, যে আত্মাকে পরিচ্ছন্ন করল। একারণে যাকাত শব্দের অর্থ কখনও বলা হয় প্রবৃদ্ধি, আধিক্য বা পাচুর্য আর কখনও করা হয় পবিত্রতা, পচ্ছিন্নতা ও ময়লা-আবর্জনা দূর করা। কিন্তু সত্য কথা হল যাকাত শব্দে এ দুটি অর্থেরই সমন্বয় ঘটেছে। অন্যায় ও ময়লা দূর করা যেমন এর অর্থ তেমনি কল্যাণ ও মঙ্গল বৃদ্ধি করাও এর মধ্যে শামিল।’

এ ব্যাখ্যার আলোকে বলা যায়ঃ কুরআনে যে ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ (আত্মশুদ্ধি)-এর কথা বলা হয়েছে, তাতে এক সঙ্গে কয়েকটি কথা নিহিত রয়েছেঃ

১. তাযকিয়ার আসল অর্থ মানবাত্মার উৎকর্ষ সাধন ও উন্নতি বিধান করা, মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি-যোগ্যতা ও কর্ম-ক্ষমতাকে উদ্বুদ্ধ-উচ্চকিত করা, সতেজ বা ঝালাই করা, ময়লা-আবর্জনা-দুর্বলতা ও পংকিলতামুক্ত করা এবং তাকে পূর্ণ পরিণত করে তোলা। দেহ ও আত্মা, মন ও মগজ, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণের যে সব গুণ-বৈশিষ্ট্যের দরুন জীবন পূর্ণত্ব লাভ করতে পারে-পারে সফল ও সার্থক হতে, তা অর্জনের সঠিক চেষ্টা-সাধনাই আত্মার তাযকিয়া। আর ইসলামী সংস্কৃতির মূল লক্ষ্যও তা-ই।

২. জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার মানে সর্বপ্রকারের অন্যায়, অশ্লীলতা ও পংকিলতা থেকে তাকে মুক্ত ও পবিত্রকরণ (Purification)। কেননা এছাড়া জীবনের সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন অসম্ভব। বাস্তবতার দৃষ্টিতেও এ জিনিসটি জীবনে শোভা-সৌন্দর্য, বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব ও মহিমা-মাহাত্ম্য অর্জনের আগেই অর্জি হওয়া উচিত। পবিত্রকরণ ও সংস্কার সাধন জীবনের ‘তাযকিয়া’ ও পূর্ণত্ব বিধানের প্রাথমিক কাজ। এইসব কারণে অনেক সময় পবিত্র ও পরিচ্ছন্নকরণ এবং সংস্কার সাধনের অর্থেও ব্যবহৃত হয় এই তাযকিয়া শব্দ।

এখানে নফসের বা আত্মার তাযকিয়া বলে যা কিছু বোঝাতে চাওয়া হয়েছে তাতে কেবল মানব জীবনের খারাপ দিকের তাযকিয়া বা পবিত্র-পরিচ্ছন্নকরণই লক্ষ্য নয়-বরং সমগ্র মানব সত্তাই এর ক্ষেত্র। কুরআনে বলা হয়েছেঃ

وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا

‘‘মানব প্রকৃতি এবং সেই সত্তার শপথ, যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন; অতঃপর তার পাপাচার ও তার সতর্কতা (তাকওয়া) তার প্রতি ইলহাম করেছেন। নিঃসন্দেহে কল্যাণ পেল সে, যে নিজের নফসের পবিত্রতা বিধান করল আর ব্যর্থ হল সে, যে তাকে খর্ব ও গুপ্ত কর।’’ (সূরা আশ্–শামসঃ ৭–১০)

এ আয়াতে মানুষেরর গোটা সত্তাকেই সামনে রাখা হয়েছে। এ পর্যায়ের অন্যান্য আয়াতেও মানুষের সমগ্র সত্তার পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও সংস্কার সাধন এবং উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠা বিধান অর্থেই এ শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে।

৩. আত্মার তাযকিয়া সম্পর্কে কুরআন যে ধারণা পেশ করেছে, তা হল Self-perfection-এর ধারণা। এর ভিত্তি দুটি জিনিসের ওপর সংস্থাপিত। একটি হচ্ছে মানুষের রূহ বা আত্মা-তথা মন ও মগজের সমস্ত শক্তির একটা সমন্বিত ও সুসংহত রূপ। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তাঁর সৃষ্ট-ক্ষমতার সর্বোত্তম ও সর্বাঙ্গীন সুন্দর নিদর্শনরূপে সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টিকর্মে মানুষের নানাবিধ যোগ্যতা ও প্রবণতায় এক উচ্চ মানের ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য রক্ষা করা হয়েছে। এ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সত্তার আত্মা ও বস্তু, জ্ঞান ও বিবেক, বাহির ও ভিতরের মাঝে আল্লাহ কোন বিরোধ বা বৈষম্যকে স্বীকার করেন না। এসবের মাঝে গুরুত্বের দিক দিয়ে শ্রেণী-পার্থক্য রয়েছে বটে; কিন্তু সে শ্রেণীগুলোর মধ্যে কোন দ্ব্ন্দ বা বিরোধ স্বীকৃত নয়। একটির উৎকর্ষের জন্যে অপরটিকে অবলুপ্ত করা বা অবদমন (Suppression) করা জরুরী নয়; বরং একটির পূর্ণত্ব অপরটির উন্নয়নের জন্যে পরিপূরক।

এ জন্যেই কুরআনের শিক্ষা হল এই কামনা করাঃ

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক। আমাদেরকে কল্যাণ ও মঙ্গল দাও এই দুনিয়ায় এবং পরকালেও আর জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও।’’ (সূরা বাকারাঃ ২০১)

দ্বিতীয় বিষয় হল, মানুষের সমগ্র সত্তার যুগপৎ উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনই ইসলামের লক্ষ্য এবং কাম্য। এ সত্তার পতিটি অংশই মহামূল্য এবং তার সংস্কার, সংশোধন, পরিশুদ্ধকরণ, পুনর্গঠন ও উন্নয়নই বাঞ্ছনীয়। দৈহিক উন্নতি এবং নৈতিক ও আত্মিক পূর্ণত্ব-এর প্রতিটিই নিজ নিজ সীমার মাঝে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও চিন্তা, মন ও মগজ, চরিত্র ও স্বভাব, সৌন্দর্যপ্রীতি ও সুরুচি-প্রবণতা এবং দেহ ও মনের সব দাবির ভারসাম্যপূর্ণ পূরণ এবং সুসামঞ্জস্য সংস্কার সাধন ও পূর্ণত্ব বিধানকেই বলা হয় ‘তায্কিয়া’ এবং তা-ই ইসলামী সংস্কৃতি। মনের ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে দৈহিক সীমা লংঘন কিংবা দৈহিক চাহিদা পূরণে মনের তাগিদ উপেক্ষা করা ইসলামের সংস্কৃতি চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তু কোন বিশেষ মুতূর্তে এ দুটির মাঝে তারতম্য করা যদি অপরিহার্যই হয়ে পড়ে তাহলে দেহের পরিবর্তে মনের গুরুত্ব-বস্তুর তুলনায় আত্মার এবং প্রস্তর বা ভাস্কর্য অপেক্ষা মানুষের গুরুত্ব অবশ্যই স্বীকার্য। [সংস্কৃতি সংক্রান্ত আলোচনায় ইদানীং ‘অপসংস্কৃতি’ বলে একটি শব্দের ব্যবহার প্রায় লক্ষ্য করা যায়। এর সর্বসম্মত কোন সংজ্ঞা নির্ণয় করা খুবই মুশকিল। তবে সংস্কৃতির নামে যাকিছু মানুষের সুস্থ চিন্তা–ভাবনা নৈতিকতা রুচিবোধ, শালীনতা ইত্যাদিকে কলূষিত করে তাকেই আমরা অপসংস্কৃতি বলতে পারি।– সম্পাদক]

মোটকথা, কুরআনের যেসব স্থানে ‘তাযকিয়া’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেসব স্থানে সংস্কৃতি শব্দ বসিয়ে দিলে যেরূপ দাঁড়ায় ইসলামী সংস্কৃতির তাৎপর্য বিশ্লেষণে তা-ই বক্তব্য। অন্য কথায়, কুরআনে ‘তাযকিয়া’ শব্দের যে ব্যাখ্যা এখানে দেয়া হল তা-ই হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতি-ইসলামী সংস্কৃতির মৌলিক ভাবধারা।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন