মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
‘শিক্ষা’ বলতে বুঝায় যা জানা নেই- যে বিষয়ে কোন জ্ঞান ও ধারণা নেই, সেই বিষয়ে জানা, জ্ঞান অর্জন ও ধারণা লাভ করা। অবশ্য এই জানা-বুঝা, জ্ঞান অর্জন ও ধারণা লাভের জন্যে স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকা একান্তই জরুরী। সে যোগ্যতা না থাকলে জানা-বুঝা ও জ্ঞান অর্জন অসম্ভবই থেকে যাবে।
মানুষ মাত্রই এরূপ শিক্ষার মুখাপেক্ষী। কেননা সে যখন এই দুনিয়ায় আসে তখন এই দুনিয়ার জীবন ও পরিবেশ এবং এখানে জীবন ধারণের নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে তার কিছুই জানা থাকেনা। তাকে সবকিছুই এখানে এসে শিখতে হয়, জানতে হয়, বুঝতে হয়- নানাবিধ জ্ঞান আহরণ করতে হয় এবং সেই অর্জিত জ্ঞানের আলোকে তাকে ধারণা পোষণ করতে হয় এই জগত সম্পর্কে-যেখানে সে বসবাস করে, নিজ সত্তা সম্পর্কে-কেননা জীবন যাপন তো তাকেই করতে হয় এবং নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে, কেননা সে ভবিষ্যত একান্তভাবে তার নিজের-তাকে নিজেকেই সে ভবিষ্যতের দায় বহন করতে হবে। অতএব নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণার ভিত্তিতেই তাকে বর্তমানের জীবন অতিবাহিত করতে হবে।
প্রকৃতিগতভাবে মানুষের দুটি দিক। এক দিক দিয়ে সে একটি জীব বা প্রাণী মাত্র। অতএব জীব হিসেবে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান তাকে অর্জন করতে হয়। এ জ্ঞান ব্যতীত দুনিয়ায় শুধু বেঁচে থাকাও সম্ভবপর হয় না। তার এ পর্যায়ের জ্ঞান অর্জন শুরু হয় মায়ের কোল থেকেই; মা-বাবা, ভাই-বোন প্রভৃতি নিকটাত্মীয়দের পরিমণ্ডল থেকেই সে এ পর্যায়ের জ্ঞান-সচেতন বা অচেতনভাবে অর্জন করে। আমরা বলতে পারি এটি হচ্ছে নেহাত বস্তুগত ও বৈষয়িক জ্ঞান।
কিন্তু মানুষ তো শুধু জীবমাত্র নয়। তাই শুধু জৈবিক জ্ঞান, নিছক বেঁচে থাকার জন্যে জরুরী জ্ঞান অর্জনই তার জন্যে যথেষ্ট নয়- যথেষ্ট নয় পরিমণ্ডল থেকে অর্জিত স্থূল জ্ঞান। তাছাড়া তাকে এই জৈবিক জ্ঞানও খুব সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ও উচ্চতর মানে অর্জন করতে হয়। নেহাত পরিমণ্ডল থেকে অর্জিত যে জ্ঞান, তা জীব বা প্রাণীকুলের জন্যে যথেষ্ট, মানুষের জন্যে নয়। উপরন্তু মানুষকে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা নিয়ে জীবন-যাপন করতে হলে শুধু পরিমণ্ডল থেকে অর্জিত জৈবিক জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট হতে পারে না; এমন কি, তৎসম্পর্কিত সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞানও যথেষ্ট হবে না। কেননা সে জ্ঞান দ্বারা মানুষ হয়ত শুধু উন্নত মানের জীব হিসেবেই বাঁচতে পারে-পারে সুখ-সম্ভোগের বিলাস-সামগ্রী সংগ্রহ করতে; কিন্তু তাতে তার জৈবিকতা থেকে মুক্তি ও মানবীয় পর্যায়ে উন্নতি লাভ সম্ভব হয় না। তাই মানবিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে তার মানব প্রজাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও জীব-ঊর্ধ্ব বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সত্তা হিসেবে বেঁচে থাকা ও যথাযথভাবে মানবীয় দায়িত্ব পালন করে ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে সার্থক জীবন যাপন করার জন্যে যে জ্ঞান একান্ত অপরিহার্য, সেই জ্ঞান নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে অর্জন ও তা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তার ভিত্তিতে নিজ সত্তা ও এই বিশ্বলোক সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা অনস্বীকার্য প্রয়োজন।
প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান মানুষ সাধারণভাবে অর্জন করতে পারছে। বর্তমান সভ্যতা মানুষকে সেই জ্ঞান সরবরাহের জন্যে ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তার ফলে আজকের মানুষ প্রকৃতি জয়ে ও নিয়ন্ত্রণে তাকে কাজে লাগানোর দিক দিয়ে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই জ্ঞান কি মানুষের সঠিক মানবীয় বিশেষত্ব, প্রজাতীয় বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে যথেষ্ট? এ জ্ঞান দ্বারা কি মানুষ নিছক জীবত্বের অক্টোপাশ থেকে মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হয়েছে? …..নাকি এ জ্ঞান দ্বারা মনুষ্যত্বকে পদদলিত করে জীবত্বের গৌরব অর্জন করেছে? …..এখনকার জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত মানুষের কি হিংস্র-বন্য পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট ভূমিকা পালন করছে না?
এ প্রশ্নের প্রথমাংশের ‘না’ এবং শেষাংশের জবাবে ‘হ্যাঁ’ না বলে উপায় নেই। কেননা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জাতিসমূহ এবং বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যক্তিগন তাদের ব্যক্তিগত, দলগত ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী দ্বারা পশুর চাইতেও অধিক হিংস্রতার পরিচয় দিচ্ছে। দুনিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীই তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে। সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে পাশবিকতার জয়-জয়কার। সভ্য দুনিয়ার নানা অঞ্চলে চলছে দানবীয় শক্তি তাণ্ডব; প্রশান্ত পৃথিবী থর থর করে কাঁপছে তাদের পাশবিকতার দাপটে। সর্বত্র মানবীয় মূল্যমান, ন্যায়পরতা, সুবিচার ও নৈতিকতা তথা মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আজকে সভ্যতার ধ্বজাবাহীরাই হচ্ছে মানুষের বড় দুশমন। তার একমাত্র কারণ, এই তথাকথিত সভ্য মানুষেররা বস্তুগত জ্ঞানে চূড়ান্ত মাত্রায় দক্ষতা অর্জন করছে বটে; কিন্তু মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা কাকে বলে, সে জ্ঞান তারা পায়নি। তারা মানুষকে পশুর বংশধর বলে গণ্য করেছে, নিজেদেরকেও তারা তা-ই মনে করছে। ফলে ‘পশুকুলে’র প্রতি ‘পশুদের’ আচরণ পাশবিক হবে, তা-ই তো স্বাভাবিক। কাজেই আজকের দুনিয়ার মানুষের অবস্থা দেখে হাঁ-হুতাশ করার কোন কারণ নেই। কেননা যা কিছু দেখা যাচ্ছে, তা সব মানুষের নিজেরই উপার্জন। তেঁতুলের বীজ বপন করা হলে গাছটা তেঁতুলেরই হবে-এর ব্যতিক্রম হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
মানুষের মানবোচিত জীবন যাপনের জন্যে বস্তুগত জ্ঞান যদি যথেষ্ট না হয়ে থাকে-যদি সে জ্ঞান দ্বারা পাশবিকতারই চরম উন্নতি হয়ে থাকে, তাহলে মানবোচিত জ্ঞান কোথায় পাওয়া যাবে এবং কি ধরণের সে জ্ঞান? এখন এ প্রশ্নেরেই জবাব আমি দিতে চাই।
আমরা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি, মানবীয় সত্তা দুটি মৌলিক উপাদান সমন্বয়ে গঠিত। একটি তার দেহ, অপরটি তার রূহ্ বা প্রাণ। দেহ মাটির নির্যাস থেকে তৈরী আর তারই মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছে ‘রূহ’। রূহ্ মহান সৃষ্টিকর্তার একান্ত নিজস্ব একটি জিনিস। আধুনিক বস্তুবিজ্ঞান প্রাণতত্ত্ব নিয়ে অনেক গবেষণা চালিয়েছে; কিন্তু তার কোন স্বরূপ নির্ণয় করতে পারেনি। হার্বার্ট স্পেন্সারের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও প্রথিতযশা বিজ্ঞানী জীবনের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে এবং এর উৎস অন্বেষণ করতে গিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন, অক্ষরের পিঠে অক্ষরেই শুধু বসিয়েছেন; কিন্তু কোন সমাধানে পৌঁছা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা প্রাণ বা জীবনের একটা যান্ত্রিক ধারণা বা বস্তুগত বিশ্লেষণ দিয়েছেন বটে; কিন্তু প্রাণ বা জীবন ‘বস্তু’ নয় বলে তাঁদের সব চিন্তা-গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক যেমন মানুষকে ‘পশু’ বা পশুর অধস্তন মনে করে মানবীয় সমস্যাবলী চিহ্নিত করতে ও তার সমাধান দিতে চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে ‘মানুষ’ নামক সত্তাটি তাদের চিন্তা-গবেষণার সম্পূর্ণ বাইরে রয়ে গেছে; তার নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তাই ‘মানুষ’ সম্পর্কিত জ্ঞান শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে অর্জন করতে চাওয়া কার্যত লাঠি দ্বারা ঊর্ধ্বাকাশে উড্ডয়নশীল এ্যারোপ্লেনকে ঘায়েল করতে চাওয়ার মত পণ্ডশ্রমই হয়েছে। কোন ফলই তাতে পাওয়া যায়নি।
অতএব, মানুষ সম্পর্কিত জ্ঞান পেতে হবে মানুষের স্রষ্টার নিকট থেকে, যিনি শুধু মানুষেরই নন; বরং সমগ্র সৃষ্টিলোকেরই একক স্রষ্টা ও প্রতিপালক। একালের সভ্যতাগর্বী ও বিজ্ঞানদর্শী মানুষের চরম দুর্ভাগ্যই এই যে, তারা মহান সৃষ্টিকর্তার দেয়া জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে শুধু নিজেদের ইন্দ্রিয়লব্ধ ও কার্যকারণ-ভিত্তিক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেছে। ফলে আজ জ্ঞানের জগতে চরম দীনতাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব জ্ঞানগর্বী বড় বড় মূর্খ, অজ্ঞ ও জাহিল ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত জ্ঞান বলতে ওদের কিছু নেই।
মহান স্রষ্টা এই বিশ্বলোক সৃষ্টির পর মানুষকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি হিসেবেই এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। তিনি মানুষকে শুধু জীব হিসেবে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং তাকে মানুষ হিসেবে-মানুষের মর্যাদা নিয়ে, মানবীয় দায়িত্ব পালনসহ জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞানও দান করেছেন। সে জ্ঞান কেবল মানুষের জন্যে, অন্য কোন সৃষ্টির জন্যে নয়।
আল্লাহ ‘রাব্বুল আলামীন’- এর অর্থ তিনি কেবল সৃষ্টিকর্তা এবং লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাপক নন; বরং তিনি সবকিছুর জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞানেরও শিক্ষাদাতা। তাই তাঁর নিকট থেকে দুটি ধারা প্রবাহিত। একটি ধারা প্রাকৃতিক জগতের মাধ্যমে প্রদত্ত বস্তুগত জ্ঞান-শুধু প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার জ্ঞান। আর দ্বিতীয়টি তাঁরই প্রেরিত নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে ‘অহী’ সূত্রে প্রদত্ত জ্ঞান। এই জ্ঞান মানুষের মানবীয় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
অতএব, মানুষ যদি এই দুনিয়ায় মানুষের মত বাঁচতে চায়-চায় মানবীয় মর্যাদা নিয়ে ও মানবীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে, তাহলে তাকে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে প্রধান অবলম্বন রূপে গ্রহণ করতে হবে। এই জ্ঞানে মাধ্যমেই সে জানতে পারবে এই বিশ্বলোক কি, কি তার উৎস-এই জগতে মানুষের স্থান কোথায়, তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি, তার জন্যে ভালো বা মন্দ কি, তার ভবিষ্যত কিসে উজ্জল ও নিশ্চিন্ত হবে, কিসে হবে মর্মান্তিক ও দুঃসহ পরিণতি!
হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন মহান আল্লাহর সর্বশেষ কিতাব। দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত মানুষের প্রতি তাঁর যা কিছু বক্তব্য, সবই তিনি চূড়ান্তভাবে এই মহাগ্রন্থ কুরআনে বলে দিয়েছেন। তিনি নিজস্ব জ্ঞানের ভিত্তিতেই সব কিছু বলেছেন। তাঁর জ্ঞান মানুষের মতো ইন্দ্রিয় ও কার্যকরণ নির্ভর নয়-নয় আপেক্ষিক, পরীক্ষামূলক বা আনুমানিক। তাঁর জ্ঞান যেমন প্রত্যক্ষ, তেমনি কালাতীত- তা সর্বাত্মক, সর্বব্যাপক ও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ। তাঁর জ্ঞান আয়ত্ত করার সাধ্য কোন মানুষের নেই। তিনি অনুগ্রহ করে সর্বশেষ নবীর মাধ্যমে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন তা নিশ্চয়ই মানুষের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট। অতএব নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে ভিত্তি করেই রচিত হতে হবে মানুষের জন্যে শিক্ষাব্যবস্থা। তারই আলোকে প্রাকৃতিক জগতকে বিশ্লেষণ করতে ও বুঝতে হবে এবং তদনুসারেই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে প্রাকৃতিক শক্তিনিচয়ের প্রতি মানুষের আচরণ। বিশ্বনবী (ﷺ) প্রথম ওহী লাভের পর মক্কার সংকীর্ণ পরিসরে ও বিপদ-সঙ্কুল পরিবেশে এই শিক্ষা ব্যবস্থারই সূচনা করেছিলেন। অতঃপর মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেই শিক্ষাকে তিনি আরো সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করেছেন। এভাবে জীবনভর তিনি সেই শিক্ষা-কেন্দ্র থেকে তৈরী করেছেন সর্বপ্রকার মৌলিক তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব দানের উপযোগী লোকদেরকে। ফলে তাঁর পরে খুলাফায়ে রাশেদুন ও সাহাবায়ে কিরাম দুনিয়ায় যে উন্নতমানের জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন সমগ্র প্রতীচ্য সে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। দুনিয়ায় পাশবিকতা ও হিংস্রতামুক্ত এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল; সর্বত্র মানবিকতার নির্মল ও নিষ্কলঙ্ক পরিবেশে মানুষ স্বকীয় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছিল।
প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই সোনালী যুগ অব্যাহত থাকার পর জাহিলিয়াত রাজনৈতিকভাবে ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করে এবং ইসলামী খিলাফত খতম হয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাকেন্দ্র থেকে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবাহ চতুর্দিক প্লাবিত করেছিল, তারই পরিণতিতে জ্ঞানচর্চার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি মূলত ঠিক সেই সময়ই রচিত হয়।
মূলত সেই আদর্শিক শিক্ষার ধারাই মুসলিম জাতির জন্যে একমাত্র গ্রহণযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা। মুসলিম বিজয়ের পর এতদঞ্চলেও সে শিক্ষার রেশ চলছিল দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু এদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সে শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়ে এবং পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী শিক্ষা ও জ্ঞানের নিঃছিন্দ্র অন্ধকারে মুসলমানরা নিমজ্জিত হয়। বড়ই দুঃখের বিষয়, এক বারের বদলে দু’বারের স্বাধীনতাও আমাদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষার সে অন্ধকার থেকে মুক্তি দান করতে সক্ষম হলনা। সে অন্ধকার থেকে আমরা আদপেই মুক্তি লাভ করব কি না, সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণই মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষরূপে গড়ে তোলার একমাত্র হাতিয়ার। শিক্ষাহীন বা শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ কোনদিনই মনুষ্যত্বের সুমহান মর্যাদা অর্জন করতে পারে না। মানুষের সন্তানকে যদি ‘মানুষ’ নামে অভিহিত করতে হয় তাহলে তার জন্যে শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থা অপরিহার্য।
শুধু তা-ই নয়। মানুষকে আপনি যে ধরণের বা যে গুণের অধিকারী দেখতে চান এবং যে স্বভাব-চরিত্রে ভূষিত করতে চান, সেই ধরণের মানুষ গড়ে ওঠে যে ধরণের শিক্ষা পেলে এবং সেই গুণ ও সেই স্বভাব-চরিত্র সৃষ্টি করে যে শিক্ষা, তা-ই তাকে দিতে হবে। এটাই যুক্তি ও বাস্তবতার দাবি।
পিতার ঔরসে মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করে মানবাকৃতির যে শিশু, তা একটি স্বভাবজাত সত্তা-যে স্বভাবের ওপর আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এই স্বভাবজাত সত্তাটি ঠিক পানির মত। পানির নিজস্ব রঙ নেই। পানিকে যে রঙে রঙিন করার ইচ্ছা হবে, সেই রঙই তাতে গুলে মিশিয়ে দিতে হবে। সেই রঙ যখন পূর্ণমাত্রায় গুলে মিশে যাবে, পানি সেই রঙ নিয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠবে। মানুষের অবস্তাও ঠিক এই রূপ। মানুষ যেন মৃৎ শিল্পের কাঁচা মাল। কাঁচা মাটি দিয়ে যে-কোন আকার-আকৃতির পাত্র তৈরী করা যায়। মানুষকেও পারা যায় যে-রূপ ইচ্ছা তৈরী করতে। তার জন্যে সেইরূপ শিক্ষা দরকার, যেরূপ মানুষ আপনি তৈরী করতে ইচ্ছুক।
এই প্রেক্ষিতে ‘আমাদের মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ কি হবে’- প্রশ্নের একটি মাত্র জবাবই হতে পারে। তা হল, যেরূপ মানুষ আপনি তৈরী করতে চান, তার জন্যে সেইরূপ শিক্ষারই ব্যবস্থা করুন। দেখবেন, আপনার ইচ্ছামাফিক লোক তৈরী হয়ে গেছে। কথাটি ঠিক যান্ত্রিক অর্থে নয়, মানবিক দৃষ্টিতেই বলা হয়েছে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেনঃ Give me good mothers, I shall give you a good nation. কথাটির যথার্থতায় কোন সন্দেহ নেই। আমার এই কথাটি অনুরূপভাবেই সত্য।
এখন প্রশ্ন, আপনি কোন্ ধরণের মানুষ তৈরী করতে চান? এই প্রশ্নটির পূর্বে আর একটি প্রশ্ন বিবেচ্য। তা হল, আপনি নিজে কিরূপ মানুষ হতে চান? আপনি নিজে যেরূপ মানুষ হওয়া পছন্দ করেন-ভালবাসেন, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন যে, ঘরে ঘরে সেই রূপ মানুষই গড়ে উঠুক। তাহলেই আপনার চাওয়াটা বাস্তবায়িত হবে; আপনার বাসনার প্রতিফলন ঘটবে বাস্তবে।
এই প্রশ্নটি নিয়ে কথা বললে বলা যায়, আপনি নিজে নিশ্চয়ই সৎ মানুষ হতে চান। কেননা সাধারণভাবে কোন মানুষই অসৎ হতে চায় না। যে ব্যক্তি অসৎ, সেও নিজেকে সাধারণভাবে অসৎ মনে করতে প্রস্তুত নয়। নিজের দোষ-ত্রুটি আর ক’জনে দেখে? সে যা-ই হোক, আপনি সৎ হতে চাইলে নিশ্চয়ই চাইবেন যে, ঘরে ঘরে সৎ মানুষ গড়ে উঠুক। তাহলে আপনাকে সৎশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এমন শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে, যা লাভ করে ভবিষ্যত বংশধররা সৎ হয়ে উঠবে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সৎশিক্ষা কোন্টি? এ সম্পর্কে যে ধারণাটি শাশ্বত, সে দৃষ্টিতে বলতে হয়, আপনার আমার ও এই বিশ্বলোকের সৃষ্টিকর্তা যাকে সৎ বলেছেন, তা-ই সৎ এবং যাকে অসৎ বলেছেন, তা-ই অসৎ। তাহলে আল্লাহ যেসব গুণকে সদ্গুণ বলেছেন, সেই গুণগুলো সৃষ্টি হতে পারে যে শিক্ষার দ্বারা, লোকদের জন্যে আপনাকে সেই শিক্ষারই ব্যবস্থা করতে হবে। আসলে সৎ-অসৎ বিষয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা বিভিন্ন– অনেক সময় পরস্পর-বিরোধীও। আপনি যদি আপনার ধারণানুযায়ী সৎ শিক্ষা নিয়ে দাঁড়ান, তাহলে আর একজন দাঁড়াবে তার ধারণানুযায়ী সৎশিক্ষা নিয়ে। তার ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই নিজ নিজ ধারণা পরিহার করে সকলে মিলে আল্লাহর নিকট যা সৎ বলে বিবেচিত, সেই সৎকে সৎ বলে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় নয় কি? তাহলে তা নিয়ে কোন ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হওয়ার কোন আশঙ্কাই থাকবে না। বলতে পারেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে আল্লাহকে নিয়ে এলে তো কুরুক্ষেত্র বা ক্রুশ-যুদ্ধের উদ্ভব হবে। হ্যাঁ, তা হতে পারে, অস্বীকার করছি না; কিন্তু আমরা যত লোক আল্লাহতে বিশ্বাসী রয়েছি, আল্লাহ সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা ও বিশ্বাস পোষণ করি- সমস্ত মানুষ না হলেও-অন্তত তারা তো একটি বিন্দুতে ঐক্যমত্য পোষণ বা একতাবদ্ধ হতে পারি। আপাতত সেই ঐক্যমত্যকে ভিত্তি করেই এগুতে হবে। এভাবে একটি দেশে যারা আল্লাহ সম্পর্কে একমত, তারা একটি সৎশিক্ষার ব্যবস্থা করবে। আর এভাবে সারা বিশ্বে যারা আল্লাহ সম্পর্কে একই ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে, তারা সকলে মিলে এক অভিন্ন শিক্ষাদর্শন গ্রহণ করলেই, সারাবিশ্বে তদনুযায়ী সৎ মানুষ গড়ে উঠবে।
বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রেক্ষিতেই বলতে চাই, এই মুহুর্তে দুনিয়ার মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা সত্যিকার ‘মুসলিম’ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। প্রায় সব ক’টি মুসলিম দেশই এককালে পাশ্চাত্য খৃষ্টান বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের অধীন ছিল। সে শক্তিগুলো এসব দেশে শিক্ষা বিস্তারের যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন, তাতে দুটি লক্ষ্য অর্জনের বিষয় তারা অবশ্যই স্মরণ রেখেছে। প্রথমত তাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক সুবিধার লক্ষ্যে নিজস্ব কাজের উপযোগী ‘শিক্ষিত’ ব্যক্তি তৈরীর জন্যে তারা চেষ্টা করেছে- যেমন উপমহাদেশে বৃটিশেরা তাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পাদন করে দেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন লোক তৈরীর উদ্দেশ্যে নিজেদের মনোপুত শিক্ষাব্যবস্থা রচনা ও প্রবর্তন করেছে এবং দ্বিতীয়ত এই মনোভাব তারা বরাবর লালন করেছে যে, কোন দিন তারা যদি এদেশ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্যও হয়, তাহলেও যেন তাদের ভক্ত-অনুরক্ত, তাদের লালিত চিন্তা-বিশ্বাস ও চরিত্রের প্রতিমূর্তি এবং তাদের অন্ধ সমর্থক ও মানসিক গোলামরা এদেশে প্রাধান্য লাভ করতে পারে। এভাবে তাদের অনুপস্থিতিতেই যেন এ সব দেশে সেই সব কাজ সম্পন্ন হয়, সেই সব নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়িত হয় এবং সেই সব অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান চলতে থাকে, যা তারা নিজেরা করেছে বা থাকলে করত।
এককথায়, বলা যায়, এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের অধীনস্থ দেশগুলোতে তাদের উপযুক্ত গোলাম তৈরীর লক্ষ্যেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে তৈরী করেছে, প্রশাসনিক শক্তিবলে তা চালু করেছে এবং এই শিক্ষালাভ করা ছাড়া উন্নতির কোন উপায় নেই বলে অসহায় জনগণকে বুঝিয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত তারা এসব দেশ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় তাদের তৈরী মানসপুত্রদের হাতেই দেশের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়ে-তাদের শূণ্য আসনগুলোতে তাদের তৈরী গোলাম মনোভাব ও গোলাম চরিত্রের লোকদেরকেই বসিয়ে গেছে। ফলে ঐসব দেশ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করতে পারেনি। তারা যে গোলাম ছিল স্বাধীনতার পূর্বে, সেই গোলামই থেকে গেল স্বাধীনতা লাভের পরেও। তাই স্বাধীনতা অর্জনকারী মুসলিম দেশগুলোর জনগণ গোলামীর নাগপাশে কঠিনভাবে বন্দী হয়ে আছে।
কাজেই মানুষ গড়ার আসল হাতিয়ার শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে নিজেদের চিন্তা-বিশ্বাস, আদর্শবাদ ও মূল্যমানের ভিত্তিতে। এর ব্যতিক্রম হলে অবস্থার কোন পরিবর্তনই হবেনা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/593/68
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।