hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি

লেখকঃ মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ)

৮৫
সাহিত্যে বাস্তবতা
একথা সর্বজন-স্বীকৃত যে, কোন সাহিত্যই স্থান-কালের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। সাহিত্য সাহিত্যের জন্যে হোক, কি সাহিত্য জীবনের জন্যে-উভয় ক্ষেত্রেই সাহিত্যিককে তার চারপার্শ্বে নিত্য-সংঘটিত ঘটনাবলী ও পরিস্থিতির নিকট থেকে চিন্তার উপকরণ গ্রহণ করতে হয়। মূলত জীবনের বস্তুনিষ্ঠ বিষয়াদির ভিত্তিতেই সাহিত্যিক তার রচনার অবকাঠামো নির্মাণ করেন। অতঃপর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে সে অবকাঠামোর ওপর রচনার অবয়ব নির্মাণে স্বভাবতঃই পার্থক্য সূচিত হয়। যারা ‘সাহিত্য জীবনের জন্যে’ মতাদর্শে বিশ্বাসী তাঁরা সে অবকাঠামোর ওপর রচনার পূর্ণ অবয়ব নির্মাণ করে বাস্তবতা ও যথার্থতার উপকরণ দ্বারা। পক্ষান্তরে ‘সাহিত্য সাহিত্যের জন্য’ মতাদর্শের ধারকগণ কৃত্রিমতা, চিন্তার উচ্চমার্গতা ও কল্পনার আতিশয্যের সাহায্যে প্রস্তুত উপকরণাদির সমাহারে সে অবকাঠামোর ওপর রচনার প্রসাদ গড়ে তোলেন। তখন রচনাটির অতল গহ্বরে নিহিত বাস্তবতা (Reality) পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছানোর জন্যে সে কৃত্রিমতা ও কল্পনার আবরণকে উন্মোচিত করা একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন মনে হয, ‘সাহিত্য সাহিত্যের জন্যে’র পক্ষপাতীরা সম্ভবত জীবনের প্রকৃত বাস্তবতার খুব একটা ধার ধারেন না। পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ঊর্ধ্বে অবস্থিত বিষয়াদিই তাদের রচনাবলীর ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মূলত এটা একটা মস্তবড় বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমানে প্রায় সব সাহিত্যিকই এই কথা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। সকলেই অকপটে স্বীকার করবেন যে, সাহিত্য যে মতাদর্শ ভিত্তিকই হোক-চিন্তার যে ধারারই অনুসারী হোক, জীবনের প্রকৃত বাস্তবতার সাথে তা কোনক্রমেই সঙ্গতিহীন হতে পারেনা।

তাছাড়া সাহিত্য জীবনের শুধু একটিমাত্র দিক বা অংশেরই প্রতিবিম্ব হতে পারেনা। সাহিত্য সমগ্র জীবনেরই ভাষ্যকার। জীবনের সমগ্র রূপই প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হবে সাহিত্যের দর্পনে। ফলে তাতে জীবনের শুধু ভালো-ভালো দিকগুলোরই রূপায়ণ হবেনা, সেই সাথে জীবনের পদস্খলন ও কলংকময় দিকগুলোও সাহিত্যের উপজীব্য হবে। এই কারণে আদর্শবাদী সাহিত্যিকদের রচনাবলীতে অশ্লীলতা ও পাপ-স্পৃহার উল্লেখ থাকবেনা, এমন কথা স্বীকৃতব্য নয়। কেননা, সমাজের পুঞ্জীভূত দোষ-ত্রুটি ও পাপানুষ্ঠানগুলোকে সম্মুখে উপস্থাপন করে তার পর্যালোচনা ও সমালোচনা করা এবং জনমনে এক কলুষমুক্ত ও কল্যাণময় সমাজ গঠনের পিপাসা ও প্রয়োজনীয়তা বোধ তীব্র করে তোলা সাহিত্যের মৌলিক লক্ষ্য হয়ে থাকে।

ইসলামী আদর্শানুসারী সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। তারা সাহিত্যে যৌনতা ও অশ্লীলতার উল্লেখ করবেন কি করবেন না আর তার উল্লেখ যদি অপরিহার্যই অনুভূত হয়, তা হলে তা কিভাবে, কতটা এবং তাতে কোন সব সীমা রক্ষা করতে হবে, এ বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

বস্তুনিষ্ট সাহিত্য রচয়িতাবৃন্দ পাপানুষ্ঠানাদির যথাযথ উল্লেখকেই বাস্তবতাবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য মনে করেন এবং এই ধারণার ভিত্তিতে সাহিত্যে অশ্লীলতা ও নগ্নতার সয়লাব প্রবাহিত করার আদর্শকে একটি আন্দোলনের রূপদান করেছের। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, পাপের প্রচ্ছন্ন ও আসল রূপটিকে নগ্ন করে সম্মুখে উপস্থাপন করা না হলে জনগণ সে বিষয়ে অবহিত হতে পারবে না এবং তা দূর করারও প্রয়োজন বোধ তীব্র হয়ে জাগবেনা তাদের মনে।

বাহ্যত এ যুক্তিকে অকাট্যই মনে হবে। কিন্তু একটু সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করলেই সহজেই বুঝতে পারা যাবে, এরূপ যুক্তি দাঁড় করানো পাপানুষ্ঠানের প্রকৃতি সম্পর্কে ভুল ধারণারই ফসল মাত্র। প্রকৃতপক্ষে পাপানুষ্ঠান কোন প্রচ্ছন্ন ও অদৃষ্টিগোচর ব্যাপার নয়। সেদিকে লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তার বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয়াদিকে প্রতিভাত করে তোলা একান্তই নিষ্প্রয়োজন। তার যথাযথ রূপায়ন ও বিস্তারিত বর্ণনা শুধু অবান্তরই নয়, মারাত্মক ধরণের দৃষ্টিকটুও বটে। তা এতই বিদিত ও সর্বজন পরিচিত যে, তাকে সাহিত্যের রঙীন পরিচ্ছদে মুড়ে চাকচিক্যময়, আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে তোলা মূল উদ্দেশ্যের পক্ষে মারাত্মকই হয়ে দেখা দিতে পারে অতি স্বাভাবিকভবে। ইসলামী আদর্শবাদের দৃষ্টিতে বলা যায়, এ ধরণের বিষয়ের প্রতি শুধু ইঙ্গিত করাই যথেষ্ট। ‘মল’কে ‘ময়লা’ বললে তা বুঝতে কারোর একবিন্দু অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তাকে যখন সোনার চামচে তুলে এনে সবার সম্মুখে পেশ করার চেষ্টা করা হয়, তখন তা শালীনতার সীমা লংঘন করে যায়। যৌনতা ও অশ্লীলতার প্রতি শুধুমাত্র ইঙ্গিত করা হলে সমজদার পাঠকের পক্ষে তা সহজেই বোধগম্য হতে পারে। অতএব, পাপানুষ্ঠানের পূর্ণ দৃশ্যের ছবি অঙ্কিত না হলে সাহিত্যের বাস্তবতা রক্ষা পায়না কিংবা বাস্তবতাবাদী সাহিত্যের লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে, এরূপ বলা সংকীর্ণতারই পরিচায়ক অথবা রচয়িতার পংকিল হৃদয়াবেগের উদ্ঘাটক মাত্র।

উপরন্তু এরূপ তথাকথিত বাস্তবতাবাদী সাহিত্যের চর্চায় হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। এর প্রভাবে চতুর্দিকে পাপানুষ্ঠানেরই প্রাবল্য ও ব্যাপকতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ানোর কথা কেউ-ই অস্বীকার করতে পারেন না। আর তার পরিণতি সমাজ-মানসে, বিশেষ করে যুব চরিত্রের পক্ষে যে কতখানি মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়েনা। তাছাড়া পাপানুষ্ঠানের রসালো চর্চা যে পাপ-স্পৃহাকে অনেকাংশে চরিতার্থ করে তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই।

দ্বিতীয়ত বাস্তবতার সফল ও পুংখাপুংখ চিত্রায়নের জন্যে তার গভীর ও সূক্ষ্ণ অধ্যয়ন একান্ত জরুরী- তা সমাজের কোন সৌন্দর্যমণ্ডিত বাস্তবতা হোক, কি কলংকলিপ্ত। সাহিত্যিক যখন তার রচনায় পাপানুষ্ঠানের পুংখানুপুংণ চিত্রায়নের নীতি অবলম্বন করবেন এবং তার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা-বিশ্লেষণে দক্ষতা প্রমাণে উদ্যোগী হবেন, তখন তার জন্যে অবশ্যই পাপিষ্ঠ ও দুরাচারী লোকদের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রক্ষা করা এবং যে সব পথে সাধারণত এই সব ঘটনা ও কার্যকলাপ সংঘটিত হয়ে থাকে সেই সব পথের প্রতিটি বাঁক ও কোণের সাথে নিবিড় পরিচিতি অর্জন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। অন্যথায় তাঁর এ চেষ্টা সফল হবে না-তাঁর বাসনা পূর্ণ পরিণত হতে পারবেনা। কিন্তু সচেতন, নীতিনিষ্ঠ ও আদর্বাদী সাহিত্যিকেই কি নিজেকে সেই পথের পথিক বানাতে প্রস্তত হতে পারেন?

পাপানুষ্ঠানের প্রকৃত রস আস্বাদন কেবল তখনই সম্ভব, যখন পাপ-পংকে আকণ্ঠ অবগাহন লাভ কারোর পক্ষে সম্ভব হবে। কিন্তু সেখানেই ব্যাপারটির ভয়াবহতা সীমিত বা নিঃশেষিত নয়, বরং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। সাহিত্যকের নিজের মন-মানসিকতা ও চরিত্র সে প্রভাবকে কখনই এড়িয়ে যেতে পারবেনা। ফলে এর পরিণতি তার নিজের জন্য কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা কল্পনা করাও হয়ত তার পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রতিটি মানুষের প্রকৃতিগত অন্যায় ও পাপের প্রতি ঘৃণা এবং ভালো ও কল্যাণের প্রতি আকর্ষণ বোধ স্বভাবতই বিদ্যমান। স্পষ্টত বুঝা যায়, মানুষকে বিচ্যুতি, পদস্খলন ও চরিত্রহীনতার পংকিল আবর্ত থেকে রক্ষা করার এবং উন্নত মানবিক পবিত্রতা ও সদাচরণের পথে পরিচালিত করার জন্যে বিশ্বস্রষ্টার এ এক মহাকল্যাণময় ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা যতদিন সুস্থ ও কার্যকর থাকবে, মানুষ ততদিন নৈতিকতার উচ্চতর মানের প্রতি দ্রুতগতিতে ও ক্রমাগতভাবে উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করতে থাকবে। পক্ষান্তরে এই ব্যবস্থায় যখনই বিকলত্ব বা বিপর্যয় দেখা দেবে, তখন তার নৈতিকতা ও মানবিকতায় ঠিক ততটাই বিপর্যয় দেখা দেয়া অবধারিত। বস্তুত এ এমন এক মহাসত্য যা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। এর যৌক্তিকতা বোঝাবার জন্যে খুব বেশী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও অপ্রয়োজনীয়।

দুর্গন্ধময় পরিবেশে ক্রমাগত বসবাস কিংবা তার মধ্য দিয়ে বার বার যাতায়াতের ফলে ব্যক্তির মনে পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার ভাবধারা দুর্বল হয়ে পড়ে অতি স্বাভাবিকভাবেই। প্রথম দিক দিয়ে তা যতটা দুঃসহ মনে হতো, শেষের দিকে তা-ই যেন স্বাভাবিক বলে মনে হয়। অনুরূপভাবে পাপানুষ্ঠানের আনুপূর্বিক বর্ণনা-বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ চিত্রাঙ্কনের ফলেও মানুষের চারিত্রিক অনুভূতি ও নৈতিক সৌন্দর্যচেতনা ভোতা হয়ে যায়। অতঃপর পাপের প্রতি তার মনে কোন ঘৃণাবোধ থাকে না, জাগেনা ভালো ও মঙ্গলের প্রতি কোন আগ্রহ-ঔৎসুক্য আর চরম অবস্থা দেখা দেয় তখন যখন তার দৃষ্টিতে পাপ আর পাপ থাকে না। পাপকে পাপ মনে না করার মানসিক অবস্থা রোগকে রোগ মনে না করা কিংবা মারাত্মক রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা না থাকা-তাকে সুস্বাস্থ্যের নিয়ামক মনে করা একই ধরণের সমান মাত্রার মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পরিস্থিতির এ ভয়াবহতা যে কতখানি সাংঘাতিক, তা ভাষায় বর্ণনা করাও কঠিন। প্রতিটি সচেতন মানুষেরই এই বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা-বিবেচনা করা কর্তব্য।

বস্তুত এরূপ সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ মানুষের আদর্শিক লক্ষ্যের পথে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। জনগণ খারাপকে খারাপ এবং অন্যায়কে অন্যায় ভাবুক এবং তার মূলোৎপাটনে দায়িত্ববোধ সহকারে তৎপর হোক, সাহিত্যিক মাত্রেরই তাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রকৃত কল্যাণ অত্যন্ত প্রবল-অতীব প্রভাবশালী হোক, তা সকলেরই কাম্য। কিন্তু সেজন্যে যে দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করা হয়েছে, তা এই কামনা ও বাসনাকে সফল করতে পারে না। সেজন্যে কেবলমাত্র সে দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয় যা লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে। যাতে তা ব্যাহত বা ক্ষুণ্ন হয়, তা নিশ্চয়ই গ্রহণ করা উচিত হতে পারে না।

এই মৌলিকনীতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে আমাদের সম্মুখে এ মহাসত্য উদ্ঘাটিত হয় যে, প্রতিটি অন্যায় কাজ ও পাপানুষ্ঠানে কিছুটা আনন্দ ও তৃপ্তির সংমিশ্রণ থাকে। ফলে তার অবিকল চিত্র অঙ্কনে শুধু মুখে বা কাগজের ওপর তার উল্লেখের মধ্যেই সেই আনন্দ ও তৃপ্তি সীমিত থাকে না, তার চিত্রায়ণকারী সাহিত্যিক বা শিল্পীও তার প্রভাব বলয়ে জড়িয়ে পড়ে। [সাহিত্যকে বাস্তবধর্মী করার অজুহাতে আমাদের এদেশেরই কোন কোন কবি–সাহিত্যিকের পতিতালয়ে যাতায়াতের ঘটনা কোন গোপন ব্যাপার নয়। ফরাসী দার্শনিক অগাষ্ট কোঁতে তো দর্শনের মাহাত্ম্য (?) বুঝানোর নামে পতিতালয়েই পড়ে থাকতেন। এ ধরণের কবি–সাহিত্যিক ও দার্শনিকরা যে মানবতার জন্যে কতখানি বিপজ্জনক, তা সহজেই অনুমেয়।–সম্পাদক] বাস্তবভাবে সে আনন্দ আস্বাদনে উদ্বুদ্ধ হওয়া একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে যুব সমাজ তার প্রত্যক্ষ প্রভাবকে কিছুতেই এড়াতে পারে না। তার অনিবার্য ফল এই দাঁড়াবে যে, মূল লক্ষ্য তো অন্তরালে পড়ে থাকবে সেদিকে কারোরই দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না; বরং যে উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে তা-ই সে উদ্দেশ্যের ওপর আঘাত হানবে ও তাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেবে। তা সত্ত্বেও বাস্তবতার নামে এহেন বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য রচনা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সুস্থ বুদ্ধি-বিবেকের পরিচায়ক নয়।

তবু একটি প্রমাণ অমীমাংসিতই থেকে যায়। সাহিত্যিককে মানবীয় জীবনের সমস্যাদি নিয়েই লেখনী চালনা করতে হয় আর তা করতে গেলে মানব জীবনের অপরিহার্য দিক হিসেবে অন্যায় ও পাপানুষ্ঠানেরও উল্লেখ করতে হয়। এরূপ অবস্থায় কোন্ বর্ণনাভঙ্গি ও বিশ্লেষণ-পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে? 

প্রশ্নটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। তবে তা নিশ্চয়ই এমন নয়, যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানব জীবনের সর্বপ্রকার বাস্তব সমস্যার ন্যায় এই সমস্যাটিরও সঠিক ও যথার্থ সমাধান কুরআন মজীদ থেকেই আমরা পেতে পারি। কুরআন মজীদ এই ধরণের ব্যাপারে সব সময়ই ইশারা-ইঙ্গিতকেই আদর্শিক ভঙ্গি হিসেবে গ্রহণ করেছে; কোন ক্ষেত্রেই খুঁটিনাটির বর্ণনা-বিশ্লেষণের পদ্ধতি গ্রহণের কোর প্রয়োজনই বোধ করেনি। যে সাহিত্যিকই কুরআনী প্রকাশ-ভঙ্গি ও বর্ণণা-পদ্ধতি অবলম্বনের চেষ্টা করবেন, সঠিক ও নির্ভুল পথ তার সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে; তার ফলে তিনি একটি কলংকমুক্ত পথ ও ভঙ্গি গ্রহণ প্রচেষ্টায় সফলতা অর্জনে সক্ষম হবেন। বিষয়টিকে অধিকতর সুস্পষ্ট করে তোলার মানসে কতিপয় দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যাচ্ছে, যা প্রত্যেক চিন্তাশীল সাহিত্যিকের জন্যেই যথেষ্ট হতে পারে। আরবী ভাষায় নারী-পুরুষের যৌনমিলনকে বোঝাবার জন্যে অসংখ্য শব্দ রয়েছে। কিন্তু কুরআন সে-সবের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ব্যবহার করেছে এমন একটি শব্দ যার অর্থ ‘স্পর্শ করা’। অপর এক স্থানে এই বিষয়টিকে বোঝানো হয়েছে আবৃত বা আচ্ছন্ন করা শব্দ দ্বারা। স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর সান্নিধ্যে যাওয়ার কথা বলেও এই ব্যাপারটিই বুঝানো হয়েছে।

এতদ্ব্যতীত সূরা ইউসুফ-এর একটি অংশে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিবাহিতা এক নারীর যৌন আকাংক্ষার তীব্রতা বোঝাবার জন্যে এই বর্ণনাভঙ্গি অবলম্বিত হয়েছেঃ

‘‘ইউসুফ যে মহিলার ঘরে অবস্থান করছিল সে তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে শুরু করল। একদিন সে দরোজা বন্ধ করে বললঃ এস, এটাই তোমার জন্যে একটা মস্ত সুযোগ। ইউসুফ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলঃ খোদা-ই আমার সহায়। তিনিই আমাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আর জালিম কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না। মহিলাটি পূর্ণ সংকল্প গ্রহণ করেছিল। ইউসুফও সংকল্প করে বসতো যদি সে তার খোদার অকাট্য দলীল প্রত্যক্ষ না করত। ঘটনাটির অবস্থা এরূপ হওয়ার কারণ হচ্ছে, পাপ ও অন্যায়কে তার থেকে দূর করাই ছিল আমাদের ইচ্ছা। মূলত সে আমাদের বাছাই করা বান্দাহদের মধ্যকার একজন। শেষপর্যন্ত উভয়ই অগ্রে-পশ্চাতে দরোজার দিকে ধাবিত হল। মহিলাটি পিছন দিক থেকে ইউসুফের জামা দীর্ণ করে দিল…..।’’ (২৩–২৫ আয়াত)

সমস্ত ঘটনাটি যে অতীব সূক্ষ্ণ ইশারা ও ইঙ্গিতময় ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে, তা সহজেই লক্ষ্যণীয়। মূলত এসব ব্যাপারের উল্লেখ সাধারণত আগুনে তেল ঢালার মতই আবেগপূর্ণ হয়ে থাকে। কিন্তু কুরআন অতীব সংযত ভঙ্গি অবলম্বন করে সে আবেগ-উচ্ছ্বাসপূর্ণ ঘটনাটিকে সর্বপ্রকার ক্ষতিমুক্ত করে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু এই অস্পষ্টতা ও ইঙ্গিতময়তা সত্ত্বেও মূল বক্তব্য অনুধাবন কিছুমাত্র ব্যাহত বা বিঘ্নিত হয়নি।

এই প্রেক্ষিতে সহজেই বলা যায়, আদর্শিক লক্ষ্যাভিসারী লেখক-সাহিত্যিকগণ নিজেদের লেখনীকে ময়লা সজ্জায়নের কাজে ব্যবহার না করে কুরআনী বর্ণনা-ভঙ্গির অনুসরণ করলে মানবীয় লক্ষ্যের মহান মর্যাদা সংরক্ষিত হতে পারে। সেই সাথে মহান আল্লাহর দেয়া লেখনী শক্তিকে তাঁরই নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যবহার করে তাঁর নিকট শেষদিনের জবাবদিহি থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারা সম্ভব হতে পারে।

বস্তুত আমাদের সাহিত্যকে পাশ্চাত্যের নগ্ন সভ্যতা ও প্রাচ্যের পৌত্তলিক সভ্যতার কলংকময় ভঙ্গি থেকে রক্ষা করার এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম মানের সাহিত্যিক আদর্শ। এ আদর্শ আমাদের সাহিত্যিকবৃন্দ এড়িয়ে যাবেন বা এর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করবেন কোন্‌ কারণে-কোন্ যুক্তিতে?

বস্তুত এ আদর্শ গ্রহণের সাথে সাথে সাহিত্যিকের আদর্শগত মানও হয় উন্নত। তখন তাঁর দৃষ্টিতে ‘সাহিত্য সাহিত্যের জন্যে’ যেমন মিথ্যা, তেমনি ‘সাহিত্য জীবনের জন্যে’ মতটিও সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা এসময়ে তাঁর মনে যে প্রশ্ন প্রবল হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে, ‘সাহিত্য জীবনের জন্যে’ বুঝলাম; কিন্তু জীবন কিসের জন্যে? জীবনের লক্ষ্য কি?…. শুধু বেঁচে থাকার তো কোন অর্থ হয় না। কল্যাণময় জীবন যাপনেরই বা সার্থকতা কোথায়? উদ্দেশ্যবাদ তো কোন একটি পর্যায়ে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে না। লক্ষ্যেরও লক্ষ্য থাকে-উদ্দেশ্যেরও থাকে একটা চরম ও পরম উদ্দেশ্য। তাছাড়া কল্যাণময় জীবনে কল্যাণ কিসে-কিসে অকল্যাণ? আর তা নির্ধারণেরই বা মানদণ্ড কি? এইসব প্রশ্নের জবাবে তাঁকে স্বীকারই করতে হয়, জীবন প্রণোদিত হবে পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। যে জীবন-ধারায় তাঁর সন্তুষ্টি তাতেই নিহিত জীবনের সার্বিক ও পূর্ণাঙ্গ কল্যাণ। তাঁরই অফুরন্ত রহমত লাভ জীবনের একমাত্র চরম লক্ষ্য। নিছক বেঁচে থাকার যে জীবন, তাতে জীবমাত্রই একাকার আর কল্যাণময় ও সুসমৃদ্ধ জীবনও জীবমাত্রেরই কাম্য। কিন্তু মানুষ তো জীবমাত্র নয়। জীবেরও ঊর্ধ্বে মানুষের স্থান ও মর্যাদা। তাই পরম লক্ষ্য ও চরম উদ্দেশ্য হিসেবে তাকে ঘোষণা করতে হয় কুরআনের ভাষায়ঃ

‘‘আমার নামায, আমার ইবাদত-বন্দেগী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবই নিবেদিত সেই মহান আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব দানকারী, লালন-পালনকারী মালিক ও মনিব। তাঁর শরীক কেউ নেই। (তাঁকে এভাবে গ্রহণ করার এবং এতেই সমর্পিত হওয়ার জন্যে) আমি আদিষ্ট। অতএব, সবার আগে আমি নিজেই আত্মসমর্পিত হচ্ছি।’’ (আন’আমঃ ১৬২–১৬৩)

এই বিন্দুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যিকের জন্যে একটা বৃত্ত রচিত হয় স্বাভাবিকভাবে এবং সাহিত্যিক সেই বৃত্তের মধ্যে থেকেই চালান জীবনব্যাপী অবিশ্রান্ত সাধনা। এই সাধনার ফলে যে সাহিত্য রচিত হয়, তা-ই হয় সার্থক ও শাশ্বত সাহিত্য। এ সাহিত্যের আবেদন একান্তই মানবিক। বস্তুত এই সাহিত্যই মানব জীবনে নিয়ে আসতে পারে অফুরন্ত কল্যাণ। বাস্তবতাবাদী সাহিত্য কিংবা সাহিত্যে বাস্তবতা বলতে এইরূপ সাহিত্যই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন