hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি

লেখকঃ মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ)

৩০
শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিকোণ
ইসলামের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামের ধারণা বা দৃষ্টিকোণ কি, তার সংজ্ঞা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি সে বিষয়ে কোন চূড়ান্ত ও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে প্রথমেই মানুষ সম্পর্কে ইসলামের ধারণা ও দৃষ্টিকোণকে মৌলিকভাবে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য হলোঃ

মানুষ দুনিয়ার অন্যান্য জীবজন্তু ও বস্তুর ন্যায় একটি সৃষ্টি হলেও সে একটা বিশেষ সৃষ্টি। জন্ম, বৃদ্ধি (Growth), খাদ্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান গ্রহণ করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার দিক দিয়ে মানুষ অন্যন্য জীবের মতো হলেও সে ঐ সব থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বের অধিকারী। মানুষ মাটি বা প্রস্তরের ন্যায় নির্জীব, নিষ্প্রাণ বা স্থবির নয়। মানুষ প্রাণবান, সচেতন ও চলৎশক্তিসম্পন্নও বটে। এখানেই শেষ নয়, সাধারণ জীব-জন্তু ও প্রাণীকূল থেকে মানুষ এই দিক দিয়েও ভিন্নতর যে, মানুষের রয়েছে চিন্তাশক্তি, স্মরণশক্তি ও বাকশক্তি- আছে মনের কথা প্রকাশ করার ভাষা। সে ভাষা যেমন মুখে ব্যবহৃত হয়, তেমনি হয় লেখনীর দ্বারা। এই কারণে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রশ্ন কেবল মানুষের বেলায়ই আসে, অন্যান্য জীব-জন্তুর ক্ষেত্রে তেমন প্রশ্ন উঠতেই পারে না। সর্বোপরি মানুষের রয়েছে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ ও পাপ-পূণ্য বোধ। এই বোধ মানুষের স্বভাবগত-জন্মগত। কিন্তু সাধারণ জীব-জন্তু এই বোধ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্ছিত।

মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা রয়েছে। এ কারণেই তার মনে তীব্রভাবে জেগে ওঠে কঠিন জিজ্ঞাসা- নিজের সম্পর্কে এবং বিশ্বলোক সম্পর্কে।

বিশ্বলোক সম্পর্কিত প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বলোক কি কোন বাস্তব সত্য, না সম্পূর্ণ অলীক ও অস্তিত্বহীন ছায়ামাত্র? যদি সত্য ও বাস্তব হয়, তাহলে এই বিশ্বলোক কি স্বয়ম্ভু, না এর কোন স্রষ্টা আছে, স্রষ্টা থাকলে সে কি এক ও অনন্য, না একাধিক- বহুসংখ্যক? এবং স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্কই বা কি?

মানুষের নিজের সম্পর্কে যে সব প্রশ্ন জাগে, তা মোটামুটি তিন পর্যায়ের। প্রথম পর্যায়ের প্রশ্ন তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে- সে কে? সে কি দুনিয়ার অন্যান্য জীব-জন্তু-বস্তুর মতই কিছু, না ঐ সব থেকে তার কোন স্বাতন্ত্র্য আছে? সে নিজের বিবেচনায়ই যখন সর্বক্ষেত্রে নিজের সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য দেখতে পায়, তখন এর কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুনিয়ায় তাকে যে জীবন দেয়া হয়েছে, সেই জীবনটাকে সে কোন কাজে, কোন ক্ষেত্রে এবং কিভাবে ও কি পদ্ধতিতে অতিবাহিত করবে? তার আশে-পাশে অবস্থিত অসীম ও অশেষ প্রাকৃতিক শক্তি-সম্পদ ও উপকরণকে নিজের ও অন্যান্য মানুষের কল্যাণে কিভাবে ব্যবহার করবে? কোন্ অধিকারে ও কোন্ মৌলিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে এবং কোন উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহার করবে? আর তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, তার জীবনের যাবতীয় দায়দায়িত্ব কি এই দুনিয়ায়ই শেষ হয়ে যাবে? না মৃত্যুর পরও তার কোন জের চলবে? যদি তা চলেই তাহলে তার সাথে এই জীবনের ও জীবনব্যাপী কর্মধারার কি সম্পর্ক? বস্তুত এ সব প্রশ্ন কোন জীব-জন্তুর মনে জাগে না। তাদের ক্ষেত্রে এ সব প্রশ্ন কখনই ওঠে না। তাই তাদের প্রসঙ্গে এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। এই সব প্রশ্ন জাগে কেবল মানুষের মনে- মানুষের ক্ষেত্রে। অতএব, মানুষের পক্ষে এই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া একান্তই অপরিহার্য। কেননা এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও অকাট্য জবাব না পেলে এই দুনিয়ায় মানুষের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে জীবন যাপন করা কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। এসব প্রশ্ন মানব মন থেকে কখনই নিঃশেষ হয়ে যাবে না। মানুষ যতদিন ‘মানুষ’ থাকছে এই প্রশ্নসমূহ ততদিন তার মনে চির-জাগরুক হয়েই থাকবে।

কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব মানুষ কোথায় পাবে? এ জবাব সে পেতে পারে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যম। অতএব, জ্ঞানার্জন মানুষের জন্যে অপরিহার্য। জ্ঞানার্জনের জন্যে যে যোগ্যতা থাকা আবশ্যক, তা স্বভাবগতভাবে কেবল মানুষেরই রয়েছে। মানব-প্রকৃতি নিহিত সেই যোগ্যতাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করতে হবে এই জ্ঞান-অর্জনের জন্যে।

এই বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, মানুষকে মৌলিকভাবে জানতে হবেঃ

১. স্রষ্টা ও সৃষ্টিকর্মের নিয়ম-ধারা এবং সৃষ্টিলোকে সদা কার্যকর সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশেষত্ব।

২. বিশ্বলোক ও বিশ্বলৌকিক বস্তুনিচয়ের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব এবং মানুষের কল্যাণে সে সবের প্রয়োগের নির্ভুল পদ্ধতি।

৩. এ দুনিয়ায় মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য, জীবন যাপন পদ্ধতি এবং পরকালীন জবাবদিহির ধারণা ও পরিণাম।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানের সংজ্ঞায় বলা যায়

স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলীর তত্ত্ব ও বাস্তবতা, বিশ্বলোকে সদা কার্যকর নিয়ম, বস্তুর গুণাবলী ও মানুষের কল্যাণে তার প্রয়োগ-পদ্ধতি এবং সর্বোপরি নিজের বিশেষত্ব, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং জবাবদিহি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন যেন তার মন-মগজও জীবন-স্রষ্টার অনুগত এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে নিয়োজিত হতে পারে; কেননা, তার শেষ পরিণতি তাতেই।

বস্তুত যে মানুষ স্রষ্টাকে জানেনা- জানেনা তাঁর মহান গুণাবলী, তার অসীম ও অসাধারণ অনুগ্রহের অবদান, সে মূলত কিছুই জানে না; কেননা সব জ্ঞানের মূল এখানেই নিহিত। যে লোক তার নিজের জীবন-যাপন পদ্ধতি ও ভাল-মন্দ জানে না, জানেনা তার পরিণতি কি হতে পারে ও শুভ পরিণতি লাভ কিভাবে সম্ভব, সেতো সম্পূর্ণ অন্ধ ও অজ্ঞ। আর অন্ধ ও অজ্ঞ কখনো দৃষ্টিমানের মতো হতে পারে না।

অন্ধত্ব ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে মানুষের জীবন কিছুতেই চলতে পারে না। সাধারণভাবে প্রতিটি জীব-জন্তুর চোখে একটা নিজস্ব আলো আছে। তার সাহায্যে তারা অন্ধকারেও নিজেদের পথ দেখে চলতে পারে। এজন্যে তারা বাইরের আলোর মুখাপেক্ষী নয়। কিন্তু মানুষের চোখে নিজস্ব কোন আলো নেই। এ কারণে দেখার জন্যে সে বাইরের আলোর মুখাপেক্ষী। কিন্তু বাইরের আলো তার বৈষয়িক জীবন-পথে চলার জন্যে যথেষ্ট হলেও মানবোপযোগী জীবন যাপনের জন্যে তা কিছুমাত্র যথেষ্ট নয়। মানুষের জন্যে প্রয়োজন অর্জিত জ্ঞানের প্রোজ্জল আলো। এ আলোই তাকে অর্জন করতে হবে- অর্জন করতে হবে একমাত্র নির্ভুল ও সর্বপ্রকার সংশয়মুক্ত সূত্রে। অর্জনযোগ্য এ জ্ঞানের কয়েকটি পর্যায় রয়েছেঃ

মানুষের সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে, তার স্রষ্টাকে জানা- স্রষ্টা সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন। স্রষ্টাই স্বীয় অনুগ্রহে এবং স্বীয় ইচ্ছা ও কুদরতে তাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি না করলে মানুষের পক্ষে এ জীবন লাভ করা- এ দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগের সুযোগ পাওয়াই সম্ভবপর হতো না। তাই স্রষ্টার গুণ-বৈশিষ্ট্য ও দয়া-অনুগ্রহের কথা তাকে জানতে হবে। জানতে হবে, তিনি কোন্ মহান উদ্দেশ্যে এ দুনিয়ায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং কিসে তিনি সন্তুষ্ট আর কিসে অসন্তুষ্ট। তা জানতে না পারলে মানুষের পক্ষে এ দুনিয়ায় স্রষ্টার মর্জী অনুযায়ী জীবন যাপন করা সম্ভব হবেনা-সম্ভব হবে না পরকালে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। আর তা-ই যদি না হয়, তাহলে মানুষের এ জীবনটাই যেমন চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে, তেমনি পরকালীন জীবনে তাকে অনন্ত দুঃখ, দুর্দশা ও আযাবে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। তা থেকে সে কিছুতেই নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না। তাই স্রষ্টা সংক্রান্ত এই জ্ঞান লাভ করতে হবে মানুষের প্রতি স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান পবিত্র কুরআন মজীদ থেকে, যা তিনি নাযিল করেছেন তাঁর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ)- এর ওপর। তিনি স্রষ্টার নির্দেশে তাঁর এই মহাগ্রন্থকে দুনিয়ার মানুষের নিকট পৌঁছিয়েছেন, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন এবং নিজে তদনুযায়ী আমল করে তার বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছেন। কুরআন এবং রাসূলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এই হচ্ছে স্রষ্টা-প্রদত্ত নির্ভুল জ্ঞানের মাধ্যম ও একমাত্র নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-উৎস। এই জ্ঞান-মাধ্যম ও জ্ঞান-উৎস থেকেই মানুষ তার মনুষ্যত্বকে জানতে পারে-জানতে পারে কিভাবে তাকে একক ও সামষ্টিক জীবন যাপন করতে হবে। বিশ্বলোক নিহিত জ্ঞান লাভের মৌলিক প্রেরণাও সে এ থেকেই পেতে পারে। কেননা স্রষ্টা, সৃষ্টিলোক এবং মানুষ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্ভুল জ্ঞান কেবলমাত্র স্রষ্টারই থাকতে পারে। তাই তাঁর দেয়া জ্ঞানের তুলনায় অপর কোন উৎস থেকে পাওয়া জ্ঞান কখনই অধিক নির্ভুল, যথার্থ ও নির্ভরযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাদর্শনে কেবলমাত্র বিশ্বলোক ও বস্তু-জগত সংক্রান্ত জ্ঞানকেই একমাত্র শিক্ষণীয় বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। তাতে মহান স্রষ্টাকে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে, তেমনি তাঁর দেয়া নির্ভুল জ্ঞান-উৎসকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এই জ্ঞানের প্রথম সূত্র হচ্ছে, মানুষের ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যভিত্তিক চিন্তা-গবেষণার ফসল। অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত নিতান্তই বাহ্যিক জগত। আসল ও প্রকৃত সত্য নিহিত রয়েছে এই দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে। সেই অন্তরালবর্তী নিগূঢ় সত্যের ভিত্তিতেই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব। আর সে জ্ঞান মহান সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন আর কারোরই থাকতে পারেনা। ফলে নিছক ইন্দ্রিযগ্রাহ্য জ্ঞান-উৎসের ওপর নির্ভরশীল মানুষ প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্ছিত থাকে। সে যা কিছু জানে, তা ভুলভাবে জানে। এ কারণেই বিশ্বলোক সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষের পক্ষে যতটা কল্যাণকর হতে পারতো, তা হয়নি; বরং সে জ্ঞান মানুষের মনুষ্যত্বকে নানাভাবে ক্ষুণ্ন ও ব্যাহত করেছে। স্রষ্টাহীন বস্তু-জ্ঞান মানুষকে বৈষয়িক সুখ-শান্তি অনেক দিয়েছে; কিন্তু এই জ্ঞানই একদিকে যেমন মানুষকে ধ্বংস করার সামগ্রী রচনা করেছে, তেমনি তাকে নৈতিকতার দিক দিয়ে চরম শূণ্যতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই জ্ঞান মানুষকে বুঝিয়েছে যে, মানুষও অন্যান্য জীব-জন্তুর মতোই একটা জীবমাত্র। বস্তুগত সুখ-শান্তিই তার একমাত্র কাম্য আর এই বস্তুগত জীবন ভিন্ন তার এমন কোন জীবন নেই, যেখানে তার কারোর নিকট জবাবদিহি করতে হতে পারে। কিন্তু এ ধারণা যেমন নিছক ইন্দ্রিয়লব্ধ, তেমনি বস্তুর সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিতেও একান্তভাবে ভুল। আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নাস্তিক্যবাদকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে এবং এই সত্য অনস্বীকার্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, বিশ্বলোকের অন্তরালে এক মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব অপরিহার্য, তাছাড়া এই বিশ্বলোকের অস্তিত্ব অসম্ভব। সেই সৃষ্টিকর্তা যেমন সব কিছুর নিয়ামক, তেমনি সমস্ত বিষয়ে নির্ভুল জ্ঞানের উৎসও একমাত্র তিনিই। মানুষের জীবন এক অবিভাজ্য ইউনিট। একে নানাভাবে খণ্ড-ছিন্ন করে নানা বিধি-ব্যবস্থার অধীন করার অবকাশ নেই। তাই জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে এক অবিভাজ্য এককের অংশ হিসেবে সমান গুরুত্ব সহকারে ও পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করে যাপন করতে হবে। মানুষ বস্তু ও রূহের সমন্বয়ে গঠিত; অতএব তার যেমন বস্তুগত চাহিদা আছে, তেমনি আছে রূহ বা আত্মার চাহিদা- যা পূরণ করতে হয়, আল্লাহ-বিশ্বাস, ধর্ম-বিশ্বাস ও পরকাল-বিশ্বাস এবং তদনুযায়ী কাজের মাধ্যমে। বাহ্যত দেহের চাহিদা প্রবল হলেও মানব সত্ত্বার ওপর আসল কর্তৃত্ব হচ্ছে রূহ বা আত্মার। তাই আত্মার দাবি পূরণের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই তার দেহের চাহিদা পূরণ করতে হবে। আত্মা এবং দেহের চাহিদা পূরণে যেমন সামঞ্জস্য রক্ষা করা প্রয়োজন, তেমনি আবশ্যক ভারসাম্য রক্ষা করাও। এ দুয়ের মধ্যে বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব মানব জীবনের জন্য মারাত্মক। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে হতে হবে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন কল্যাণ সমন্বিত। পরকালের কথা বিস্মৃত হয়ে বা তার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা রচিত তা মানুষের অখণ্ড ও অবিভাজ্য জীবনের পক্ষে কল্যাণময় হতে পারে না। কুরআনের শিক্ষা হচ্ছেঃ

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

‘‘হে আমাদের রব্ব! তুমি আমাদের এই দুনিয়ার কল্যাণ দান করো এবং আখিরাতেও আমাদেরকে কল্যাণ দাও। আর তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর।’’ (সূরা বাকারাঃ ২০১)

কেননা এ জগতে দেহ ভিন্ন আত্মা অবাস্তব আর আত্মাবিহীন দেহ মৃত লাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই মানুষকে এমন জ্ঞান অর্জন করতে হবে যার ফলে সে দেহ ও আত্মার তথা ইহকাল ও পরকালের দাবি একই সঙ্গে ও পূর্ণ সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য রক্ষা করে পূরণ করতে সক্ষম হবে। অতএব আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ও পরকালীন কল্যাণের উপায় যেমন তাকে জানতে হবে, তেমনিভাবে জানতে হবে আল্লাহর দেয়া দ্রব্য-সামগ্রীর গুণাবলী ও ব্যবহার পদ্ধতি, যেন মানুষের বৈষয়িক জীবন সামগ্রিকভাবে নির্ভুল পথে চালিত ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সহকারে অতিবাহিত হতে পারে।

মানুষ একাকী দুনিয়ায় জন্মলাভ করতে পারেনি, একাকী বেঁচে থাকাও তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। একারণেই মানুষকে বলা হয়েছে সামাজিক জীব। মানুষের এই সামজিক জীবন শুরু হয় তার জন্মের সূচনা থেকেই। প্রথমত পিতার ঔরসে ও মায়ের গর্ভে তার জন্ম হয়। এই পিতা ও মাতার দাম্পত্য জীবন সূচিত হয় শরী’আতসম্মত বিবাহ ও সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে। জন্ম লাভের পর তাকে লালিত-পালিত ও ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে হয় পিতৃ-আশ্রয়ে, মায়ের কোলে এবং ভাই-বোন, চাচা-চাচী, ফুফা-ফুফী ও দাদা-দাদীর পরিবেষ্টনে। এখানেই মানুষের পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ সূচিত হয়। অতএব একদিকে পিতা-মাতার হক তাকে জানতে হবে, সেই সঙ্গে জানতে হবে অন্যান্য নিকট ও দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনের অধিকার এবং তাদের প্রতি তার কর্তব্যের কথা।

এ হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবনের প্রথম ধাপ। এরপর তার সামাজিক সম্পর্ক ক্রমশ বিস্তার লাভ করে তা স্থানীয় জনমণ্ডলীকে অতিক্রম করে যে দেশে সে বাস করে সেই দেশের বিপুল জনতার মধ্যে সম্প্রসারিত হয়। মানব জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই এই বিপুল জনতা-সমন্বিত বৃহত্তর সমাজের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই সামাজিক সম্পর্কের সাথে জড়িত রয়েছে মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন।

মানুষ যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অধীনে নিরাপদে জীবন যাপন করে তা এই সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সাহায্যেই অর্জন করা সম্ভবপর। মানুষ যে অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বৈষয়িক সুখ-সুবিধা ও আয়েশ-আরাম ভোগ করে,তা একদিকে যেমন এই বৃহত্তর সামাজিক সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যবস্থা থেকে অর্জন করে, তেমনি সেই অর্থ-ব্যবস্থা এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কর্তৃকই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই মানুষকে জানতে হবে বৃহত্তর সমাজের সাথে তার কি সম্পর্ক, সমাজের ওপর তার কি অধিকার এবং সমাজের প্রতি তার কি কর্তব্য ও দায়িত্ব। অনুরূপভাবে তাকে জানতে হবে কোন ধরনের রাষ্ট্রনীতি তাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা দিতে সক্ষম। কেননা দুনিয়ায় এমন সব রাষ্ট্র ব্যবস্থা রয়েছে যা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে তাকে নিতান্ত গোলাম বানিয়ে রেখেছে, তাকে পরিণত করেছে বল্গাহীন পশুতে কিংবা নির্বাক জন্তুতে। সাধারণ মানুষকে কথা বলার, মত প্রকাশ করার, ভাল-মন্দ বিচার করার কিংবা সরকারী কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করার কোন অধিকারই দেয় না। এইরূপ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা মানুষের মনুষ্যত্বের পক্ষে খুবই অপমানকর। অনুরূপভাবে দুনিয়ায় এমন অর্থ-ব্যবস্থাও রয়েছে যা সম্পদের ওপর ব্যক্তির মালিকানা অধিকার স্বীকার করে না। তা সমাজ-সমষ্টির দোহাই দিয়ে মানুষের সবকিছু কেড়ে নেয়; তার স্বতন্ত্র মানবিক সত্ত্বাকেও অস্বীকার করে। মানুষ সেখানে নিজের জন্যে অর্থোপার্জনের কোন পন্থা নিজেই বাছাই করে নিতে পারে না। অর্থ ও রাষ্ট্র এই উভয় শক্তিরই একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসে মুষ্টিমেয় নরপিশাচ। তারা দেশের মানুষকে এমনভাবে দমিয়ে রাখে এবং নিয়ন্ত্রিত করে যেমন তারা বিরাট একটা যন্ত্রের অংশমাত্র কিংবা নির্জীব কাঁচামাল বিশেষ। এরূপ অর্থব্যবস্থায় মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে নিতান্ত জীব-জন্তুতে পরিণত হয়। কাজেই মানুষকে এই বিশ্বের বুকে তার জন্যে ঘোষিত মর্যাদার দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি এবং তার সঙ্গে মানুষের সঠিক সম্পর্ক রক্ষা করে সুষ্ঠু বৈষয়িক জীবন গঠন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন এবং ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনে সেই জ্ঞানের বাস্তব অনুশীলন সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা লাভ করতে হবে।

যে শিক্ষা ব্যবস্থা এই সব দিক দিয়েই মানুষকে সুশিক্ষিত ও সৎকর্মশীল বানাতে পারে মানুষের জন্যে কেবলমাত্র সে শিক্ষা ব্যবস্থাই সর্বাত্মক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আর এই শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে কেবলমাত্র তা-ই, যা আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব পবিত্র কুরআনের সার্বিক দর্শনের ভিত্তিতে রচিত।

বড়ই দুঃখের বিষয়, সাধারণভাবে গোটা বিশ্ব-সমাজে ও বিশেষভাবে গোটা মুসলিম জাহানে এই কুরআন-ভিত্তিক সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে চালু নেই। সারা দুনিয়ায় বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ও কার্যকর তা থেকে মানুষ নিজেকে, নিজের স্রষ্টাকে, তাঁর অশেষ অবদানকে এবং তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্ককে নির্ভুলভাবে চিনতে পারেনা- নিজের উপরিউক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথাও জানতে পারে না। সে জানতে পারে এটুকু যে, মানুষ সাধারণ জীব-জন্তু থেকে ভিন্নতর কোন বিশেষ সত্তা নয়- জানতে পারে, কিভাবে, কি উপায়ে ও কি পদ্ধদিতে এ বিশ্বের পরতে পরতে সঞ্চিত উপকরণাদি নিঃশেষে কুড়িয়ে নিয়ে নিজের জৈব সুখ-সম্ভোগের আয়োজন করা সম্ভব। কিন্তু এ জানা-ই মানুষের উপযোগী জানা নয়। এ জানা কেবলমাত্র জীব-জন্তুর জন্যে শোভন। তাই বর্তমান মুসলিম জাহানের প্রধান কর্তব্য ছিল কেবলমাত্র কুরআন-ভিত্তিক সর্বাত্মক শিক্ষা-ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ও সর্বস্তরে চালু করা। কিন্তু মুসলমানরাও এই শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণত বা অংশত পরিহার করে ধর্মহীন ব্যক্তিদের রচিত ও তাদের দ্বারা সারা দুনিয়ায় প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করে চলেছে। ফলে তাদের বংশধররা মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না; বরং ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও এ শিক্ষা অর্জন করে একই সাথে ঈমান ও চরিত্র উভয়ই হারিয়ে ফেলে। এর ফলে ভবিষ্যতে ‘মুসলিম’ দুনিয়ায় সসম্মানে বেঁচে থাকবে কিনা, সে প্রশ্নই এখন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন