মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
বর্তমান দুনিয়ার লোকসংখ্যা কত?… পাঁচ শত কোটিরও বেশি! কিন্তু এত মানুষ দুনিয়ায় কোত্থেকে এল? তারা কি আসমান থেকে টপকে পড়েছে, না জমিন ভেদ করে উঠে এসেছে কিংবা দুনিয়ায় জন্তু-জানোয়াররা একে একে মানবাকৃতি ধারণ করে অথবা কোনো এক সময় মানব শিশুর জন্ম দিয়ে মানুষের সংখ্যা এত বিপুল করে দিয়েছে? … সকলেই স্বীকার করবেন যে, এর কোনোটিই হয়নি।
এ সংখ্যা বৃদ্ধি কি হঠাৎ করেই ঘটেছে? …তা-ও তো নয়! দুনিয়ার লোকসংখ্যা বৃদ্ধি একটা ক্রমিক পদ্ধতিতে হয়ে আসছে এবং হচ্ছে। যেমন বলা যায়, আজকের এ সংখ্যাটি বিগত বছরের এ দিনটিতে নিশ্চয়ই ছিল না।–[বানের পানির মতই বাড়ছে মানুষ –কোনভাবেই যেন এর বান বাঁধ মানে না। আমেরিকান আদমশুমারী ব্যুরোর হিসাব মতে গত বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ কোটি ২০ লক্ষ। আর গত এক দশকে পৃথিবীর লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় একশ’ কোটি। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা সেপ্টেম্বর-১৯৮৩)]
আজ থেকে একশ’ দুশ’ চারশ’, পাঁচশ’ হাজার, দেড় হাজার, দু’হাজার, চার হাজার বছর পূর্বে লোকসংখ্যা নিশ্চয়ই আজকের তুলনায় অনেক-অনেক কম ছিল। তাহলে যতই দিন যাচ্ছে –কালের অগ্রগতি হচ্ছে, ততই লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অমোঘ গতিতে। আর যতই পিছনের দিকে যাওয়া যায়, লোকসংখ্যা ততই কম ছিল বলে নিঃসন্দেহে ধরে নিতে হয়। এ এমন এক অকাট্য সত্য যা অস্বীকার করার সাধ্য কারোরই নেই।
তাহলে লোকসংখ্যার এ ক্রমবৃদ্ধি কি করে সম্ভব হলো, -সম্ভব হচ্ছে? ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় কত দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক-অর্থনীতিবিদ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার জন্য কতই না যুক্তি-পরামর্শ-প্রস্তাবনা পেশ করেছে আর কত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যক্তি ও সরকারই না সে মন্ত্রকে অকাট্য সত্য মনে করে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগে জনসংখ্যা প্রতিরোধের কার্যকর (?) পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেজন্য আবিস্কৃত কতই না প্রক্রিয়া অবলম্বিত হয়েছে। কত মানুষই না নিজেদের সদ্যোজাত সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করেছে, কত সহস্র ভ্রূণ হওয়ার পর কিংবা তার পূর্বে সংহার করেছে অমানুষিক নির্মমতা সহকারে –তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত সব উপায় অবলম্বন সত্ত্বেও জনসংখ্যা কোনো বিন্দুতে প্রতিরুদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে দ্রুতগতিতে বাঁধভাঙ্গা বন্যার পানির ন্যায় বৃদ্ধিই পেয়ে গেছে ও যাচ্ছে। হাজার রকমের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া –রাজা-মায়া-ওভাকন-ভেসেকটমি-লাইগেশন একদিকে এবং অপরদিকে আণবিক বোমা, নাপাম বোমার ফলে ব্যাপক নরহত্যা সম্পন্ন করা হয়েছে –যে সম্পূর্ণ ও নির্লজ্জভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে, কোনোক্রমেই তার ক্রমবৃদ্ধি রোধ করা যায় নি বা যাচ্ছে না, তার কারণ কি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তার একটা কারণ আছে এবং সে কারণটি এতই প্রবল যে, দুনিয়ার মানুষ যদ্দিন থাকবে, তদ্দিন সে কারণটিও অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকবে। পরিভাষায় তাকে বলা হয় মানবীয় (আরবী) –দৈহিক ও মানসিক প্রকৃতি ও মেজাজ বা Nature। মানুষের প্রকৃতি সন্তান জন্মদান, সন্তানের মা বা বাবা হওয়ার প্রচণ্ড আকুলতা একান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। মানব বংশের ধারা এই প্রকৃতির বলেই স্থায়ী হয় ও অব্যাহত ধারায় সম্মুখের দিকেই চলতে থাকে। আর সে জন্যে স্রষ্টা প্রদান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন ও করছেন মানব প্রকৃতি নিহিত যৌন আসক্তি, প্রবৃত্তি ও যৌনাঙ্গকে। মানুষ দুভাগে বিভক্ত –পুরুষ ও নারী। উভয়ই জন্মগতভাবে নিজ নিজ যৌন আসক্তি, প্রবৃত্তি এবং মানসিক প্রবণতা চরিতার্থ করার উপযোগী হাতিয়ার নিয়েই ভূমিষ্ট হয় মায়ের গর্ভ থেকে। এ হানিয়ারের প্রয়োগে যথাসময়ে উদ্যোগী হওয়া মানুষের –পুরুষ ও নারীর উভয়েরই –অতীব স্বাভাবিক তাড়না। এ তাড়নার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় প্রত্যেকটি মানুষ। তা না করা পর্যন্ত মানুষের স্বস্তি লাভ বা স্বাভাবিক (Normal) থাকা কখনই সম্ভব হতে পারে না। তাই যৌনতা মানব সমাজে একটা বিরাট কৌতুহলোদ্দীপক, আকর্ষনীয়, আলোচ্য ও চিন্তা-গবেষণার বিষয় হয়ে রয়েছে প্রথম মানব সৃষ্টির সশয় থেকেই। আর সেই সাথে একে কেন্দ্র করে কতগুলো মৌলিক জটিল দার্শনিক প্রশ্নও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চিন্তাশীল মানুষ মাত্রেরই মনে। সেই দার্শনিক প্রশ্নকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কত না মতবাদ ও দর্শন! এই পর্যায়ে উত্থিত প্রশ্নগুলো সংক্ষেপে এইঃ
(ক) Sex বা যৌনতার প্রকৃত নিগূঢ় তত্ত্ব (Reality) কি?
(খ) মানব শিশুর মধ্যে যৌন আবেগ কি অনাদিকাল থেকেই সংরক্ষিত রাখা হয়েছে? –যদি তা-ই হয়, তাহলে তার ক্রমবিবর্তন কি করে ঘটে? আর যদি তা না-ই হয়ে থাকে, তাহলে যৌন চেতনা বা আবেগ কি সমস্ত যৌন দাবি সম্পর্কে ব্যক্তিকে অবহিত ও সচেতন বানায়?
(গ) পরিবেশ, প্রেক্ষিত ও জীবনের সাথে যৌনতার সম্পর্ক কি?
পাশ্চাত্য সমাজের চিন্তাবিদরা মনে করে, যৌন আবেগ চরিতার্থতার পথে সামান্য প্রতিবন্ধকতাও ব্যক্তির মনে প্রবল অনুসন্ধিৎসা (Curiosity) জাগিয়ে দেয়। সে কৌতূহল চরিতার্থ হতে না পারলে এর-ই ফলে মানসিক অস্বাভাবিকতার (Abnormalities) সৃষ্টি হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের এ মত কতটা যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য?
প্রশ্নগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। বর্তমান নাস্তিকতাবাদী বিশ্ব সভ্যতার অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে এসব প্রশ্নের বিশদ জবাব আলোচিত হওয়া একান্তই আবশ্যক। এ পর্যায়ে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করার খুবই প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। ‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন’ গ্রন্থে সবিস্তারে যে মূল তত্ত্বটি উপস্থাপিত করা হয়েছে, বর্তমান প্রসঙ্গের আলোচনা তাই ‘মুখবন্ধ’ হিসেবে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করছি।
উপরে যে প্রশ্নগুলোর উল্লেখ করেছি, আগেই বলেছি, পাশ্চাত্য সমাজ-দর্শনে সেগুলো বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। কেননা পাশ্চাত্যের মানুষ যখন স্বাভাবিক পথ হারিয়ে ফেলেছে, তখন শয়তানে রাজীম তাদের আগে আগে আলোকবর্তিকা লয়ে অগ্রসর হতে হতে নানা দার্শনিক মতের আলোকস্তম্ভ গড়ে তুলেছে। যে ভুলই তারা করেছে, যেখানেই তাদের বিচ্যুতি বা পদস্খলন ঘটেছে, তাকে সঙ্গত ও বৈধ পমাণের জন্য সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ সাব্যস্ত করার লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপিত করেছে। ফলে তারা জীবনের প্রতিটি বিভাগের পুনর্গঠন করেছে এমন এক একটি মতাদর্শের ভিত্তিতে যার সাথে গভীর সূক্ষ্ম চিন্তা-গবেষণা সম্পৃক্ত রয়েছে। পাশ্চাত্যের উপস্থাপিত বিশ্ব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শন (Materialism), সমাজ বিপ্লব মতাদর্শ (Social Evolution Theory), ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Material Conception of History), নৈতিকতার সুবিধাবাদী মতবাদ (Utilitarianism) এবং যৌন দর্শন (Theory of Sex) প্রভৃতি। এ যেন এক একটি বিষয়বৃক্ষ। পাশ্চাত্য সভ্যতার পংকিলতার বিষক্রিয়া থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে উক্ত প্রত্যেকটি বিষবৃক্ষেরই মূলোৎপাটন একান্তই অপরিহার্য। সেগুলোর শুধু মূলোৎপাটনের একতরফা কাজই যথেষ্ট নয়; সাথে সাথে তার বিকল্প পূর্ণাঙ্গ সমাজ-দর্শন পেশ করার দায়িত্বও অবশ্যই স্বীকার্য করতে হবে। ইতিবাচকভাবে ইসলামের যৌন দর্শনের ভিত্তি রচনার জন্য কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতসমূহকে কেন্দ্র করেই আমরা চিন্তা-গবেষণার সূচনা করতে চাইঃ
(আরবী)
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই রব্বকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে, তা থেকেই সৃষ্টি করেছেন তাঁর জুড়িকে এবং সেই দুইজন থেকেই (বিশ্বময়) ছড়িয়ে দিয়েছেন, বিপুল পুরুষ ও নারী।
(আরবী)
তিনি তোমাদের স্বজাতিয়দের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জুড়ি বানিয়েছেন এবং অনুরূপভাবে জন্তু-জানোয়ারের মধ্যেও তাদেরই স্বজাতীয় জুড়ি বানিয়েছেন এবং এভাবেই তিনি তোমাদের বংশ বৃদ্ধি ও বিস্তার করেন।
(আরবী)
তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্যে ক্ষেতস্বরূপ
(আরবী)
তিনিই আল্লাহ তিনিই তোমাদিগকে একজন মাত্র ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারই স্বজাতি থেকে তার জুড়ি বানিয়েছেন, যেন তার কাছে পরম শান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারে।
(আরবী)
স্ত্রীরা তোমাদের পোশাকস্বরূপ, আর তোমরা ভূষণ হচ্ছ তাদের জন্যে।
(আরবী)
তোমাদের জন্যে তোমাদের স্বজাতীয়দের মধ্য থেকে জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যেন তারা তাদের কাছে পরম শান্তি-স্বস্তি লাভ করতে পারে এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও দয়া অনুকম্পাও জাগিয়ে দিয়েছেন।
(আরবী)
এবং তিনিই আল্লাহ, যিনি পানির উপাদান দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পরে মানুষকে বংশ ও শ্বশুর সম্পর্ক জাতরূপে ধারাবাহিক বানিয়ে দিয়েছেন।
(আরবী)
হে মানুষ! আমরা নিঃসন্দেহে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক থেকে এবং তোমাদের সজ্জিত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্ররূপে, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার।
উদ্ধৃত প্রথম আয়াতটি প্রমাণ করেছে যে, মানবতার জয়যাত্রা এ পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল একজন মাত্র মানুষ দিয়ে। পরে তারই অংশ থেকে তার জুড়ি (স্ত্রী) সৃষ্টি করা হয়েছিল। আর এ দু’জনের পারস্পরিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ফলশ্রুতি হিসেবেই দুনিয়ায় এত অসংখ্য পুরুষ ও নারীর অস্তিত্ব লাভ সম্ভবপর হয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, বংশ বা লোকসংখ্যা বৃদ্ধি একটি অপ্রতিরোধ্য স্বাভাবিক প্রবণতা।
দ্বিতীয় আয়াতটি জানাচ্ছে যে, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক বা যৌনতার (Sex) স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে বংশ বৃদ্ধি ও বংশধারার স্থায়িত্ব। প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতেরই অধিক ব্যাখ্যা দান করেছে তৃতীয় আয়াতটি। বলছে, স্ত্রীলোক মানব বংশের উৎসস্থল। ক্ষেত বা খামার এবং তাতে চাষাবাদ ও বীজ বপনের লক্ষ্য হচ্ছে ফসল উৎপাদন, বিশেষ একটি ফসলের বংশ বৃদ্ধি ও বংশের ধারা রক্ষা। অনুরূপভাবে স্ত্রীলোকেরা মানব বংশ ফসলের জন্য ক্ষেত-খামার বিশেষ। মানুষ-ফসল কেবলমাত্র স্ত্রী-ক্ষেত থেকেই লাভ করা যেতে পারে। অন্য কোথাও থেকে তা পাওয়ার উপায় নেই। এসব কয়টি আয়াতই এক সাথে উদাত্ত ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দুই লিঙ্গে বিভক্ত এবং এই বিভক্তি কিছুমাত্র উদ্দেশ্যহীন নয়। আর সে একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও বিস্তার সাধন।
কিন্তু উদ্ভিদ ও জীব জগতে প্রজাতি রক্ষার জন্যে সে স্বভাবগত আবেগ সংরক্ষিত, তার তুলনায় মানবীয় যৌন তাদীকের (urge) সাথে বংশ রক্ষা ছাড়া আরও অনেকগুলো দিক এমন সংশ্লিষ্ট রয়েছে যা জীবনের ও দুটি পর্যায়ে (উদ্ভিদ ও জীবজন্তু) সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। উদ্ভিদ ও জীব জগতে পুরুষ ও স্ত্রীর যৌন মিলনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে বংশ রক্ষা। কিন্ত মানুষের দুই লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্ক যৌন মিলনের উক্ত নিম্নতম লক্ষ্যকে অতিক্রম করে অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছে। ৪ ও ৫ নম্বরে উদ্ধৃত আয়াতদ্বয় মানবীয় যৌন আবেগের ভিন্নতর এক দাবির দিকে ইঙ্গিত করছে। আর তা হচ্ছে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনে শান্তি-স্বস্তি-পরিতৃপ্তি লাভ। নিছক দেহকেন্দ্রিক (Biological) শান্তি-স্বস্তি-পরিতৃপ্তি অত্যন্ত ব্যাপক, গভীর-সূক্ষ্ম মানসিক ও আবেগগত ব্যাপার। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যে সংঘবদ্ধ সাহচর্য-সহৃদয়তা-সহানুবূতি-অনুকম্পায় উদগ্র পিপাসা নিহিত, উক্ত পরিতৃপ্তি শান্তি-স্বস্তি তাঁরই জবাব, তারই পরিপূরক। এক্ষেত্রে পুরুষ যেমন বিশেষভাবে নারীর মুখাপেক্ষী সেই পুরুষের প্রতি নারীর মুখাপেক্ষিতাও কিছুমাত্র সামান্য নয়। তবে পুরুষের মুখাপেক্ষিতা অধিক তীব্র। সম্ভবত সেই কারণেই কুরআনে উদ্ধৃত আয়াতসমূহে পুরুষকে বলা হয়েছে স্ত্রীর নিকট কাঙ্ক্ষিত শান্তি-স্বস্তি-তৃপ্তি লাভের কথা। এর বাস্তব কারণ রয়েছে বিশ্ব প্রকৃতিই পুরুষদের স্কন্ধে যে সব কঠিন ও দুর্বহ দায়িত্ব কর্তব্যের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, তা হৃদয়াবেগে যে তীব্রতা, মন-মানসিকতায় যে অস্থিরতা এবং অনুভূতিতে যে প্রচণ্ডতা উন্মত্ততার সৃষ্টি করতে থাকে অবিরামভাবে, তদ্দরুন পুরুষ জীবনের গোটা পরিমণ্ডলকেই সাংঘাতিকভাবে প্রভাবান্বিত ও উদ্বেলিত করে। পুরুষ জীবন সংগ্রামে ‘লৌহ প্রকৃতির প্রদর্শন করার পর প্রেম-ভালোবাসার কুসুমাকীর্ণ কাননে রূপ-পিয়াসী মুক্ত বিহঙ্গ হওয়ার জন্যে বিপরীত লিঙ্গের নিকট ঐকান্তিকভাবে নিবেদিত-উৎসর্গিত হওয়ার জন্যে আকুল হয়ে ওঠে। এটা মানব স্বভাবের অমোঘ অনস্বীকার্য দাবি। পুরুষ জীবনের ‘ঊষর-ধূসর মরুভূমি’তে লু-হাওয়ার চপেটাঘাত খেয়ে খেয়ে উত্তম জীবন অর্ধাংশের বুকে শীতল মধুর পানীয় পান করে তার স্বভাবের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে উদগ্র হয়ে ওঠে।
শান্তি-স্বস্তি-পরিতৃপ্তি লাভের এ উদগ্র কামনা স্থায়ী বন্ধনজনিত সাহচর্যের আকাংঙ্ক্ষী, শুধু সাহচর্যই তো নয়, তার জন্যে প্রয়োজন প্রেম ভালোবাসাপূর্ণ সংস্পর্শ, সাহচর্যের কুসুমাস্তীর্ণ শয্যা। ৫ নম্বর আয়াতে বলছে, উভয় লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক ও আগ্রহপূর্ণ হতে হবে। এমন সম্পর্ক দুনের মধ্যে থাকতে হবে, যার ফলে উভয়ই উভয়ের জন্যে সর্বদিক দিয়ে পরিপূরক হতে পারবে। একজনের অসম্পূর্ণতা অন্য জনে পূরণ করবে, অন্য জন সে একজনকে কানায়-কানায় পূর্ণ করে তুলবে। উভয়ের মধ্যে থাকবে এক স্থায়ী নৈকট্য, একমুখিতা, একাত্মতা। উভয়ের মধ্যে স্থাপিত হবে এক পরম গভীর নিবিড় সৌহৃদ্য ও সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক। মানুষকে দুই লিঙ্গে বিভক্ত করে সৃষ্টি করার মূলে যে রহস্য, তা এখানেই নিহিত।
৬ নম্বর আয়াতটি এ সত্যকে অধিকতর স্পষ্ট করে তুলেছে। উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক শান্তি-তৃপ্তি-স্বস্তি লাভের জন্যে দাবি হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা-দয়ার্দ্রতা-কল্যাণ কামনা ও পরম বিশ্বস্ততা-নির্ভরযোগ্যতার সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠা।
৭ ও ৮ নম্বর আয়াতদ্বয় আমাদেরকে আরও সম্মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মানব প্রজাতি সংরক্ষণের জন্যে অন্যান্য উপায়-পন্থার পরিবর্তে প্রকৃতি যদি যৌনতার (sex) পথকেই অবলম্বন করে থাকে, যদি উভয় লিঙ্গের মধ্যে এক পরম আবেগপূর্ণ ও মানসিক শান্তি-স্তস্তি-তৃপ্তির পিপাসার সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে স্থায়ী অব্যাহত সম্পর্ক স্থাপনের কারণ বা উদ্বোধক সৃষ্টি করে দয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে, তার চরম লক্ষ্য হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি ও ব্যক্তিতে দাদা-নানা-শ্বশুর-শাশুড়ীর আত্মীয়তার বন্ধন আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে জড়িত পাবে, যেন তার ফলে মানুষের সামষ্টিক জীবন, সুসংবদ্ধ জীবন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক জীবন গড়ে উঠতে পারে এবং নৈরাজ্যের পরিবর্তে জীবন-পথের পথিকরা সুসংগঠিত এক-একটি কাফেলারূপে অগ্রগতি ও বিকাশের দিকে অগ্রসর হতে পারে। ৭ নম্বরের আয়াতে দাদা ও শ্বশুর-শাশুড়ীর সম্পর্ক সৃষ্টির যে অসাধারণ কল্যাণের কতা ইঙ্গিতের মধ্যে আবৃত করে দেয়া হয়েছে, ৮ নম্বর আয়াত সেই কথাটিকেই অধিকতর ব্যক্ত ও প্রাঞ্জল করে দিয়েছে। বলে দিয়েছে যে, প্রকৃতিই এ আত্মীয়তার যৌগিকতার দ্বারা এক-একটা সুসংবদ্ধ পরিবার গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। এ পরিবাসমূহের সমন্বয়েই গড়ে উঠবে গোত্র বা সমাজ এবং এই সমাজই রূপান্তরিত হবে এক-একটি বৃহত্তম জাতিতে। তা মানবতার এ কাফেলাকে সুসভ্য ও সংস্কৃতিসম্পন্ন জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
এ বিশ্লেষণ থেকে আমাদের সামনে একটি অতিবড় তত্ত্ব উদঘাটিত হচ্ছে। ইসলামী যৌন-দর্শনের এ মহাসর্তকে কারো পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, যৌন আবেগ মানুষের সাথে মানুষকে সম্পর্কিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ আবেগ থেকেই কত শত আবেগ অনুভূতির উপধারা প্রবাহিত হয়, তা গুণেও শেষ করা সম্ভব নয়। এ ধারা যদি কখনও শুষ্ক হয়ে যায়, তা হলে মানবতার ও সভ্যতা-সংস্কৃতির বিশাল ক্ষেতের ফসল শুকিয়ে মূল্যহীন হয়ে যাবে। নৈকট্য, একাত্মতা, ভালোবাসা, বন্ধুত্বের কত যে অগণিত শাখা-প্রশাখা সে বৃক্ষমূল থেকে নির্গত হয়, তার কোনো শেষ নেই; কিন্তু এখানে যৌনতাই একমাত্র জিনিস, তা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা মানুষের বুকে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার আরও অনেক নদী-খালের প্রবাহ চলে, যেগুলোর উৎস যৌনতা (sex) থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর। যৌনতার সাথে তার কোন সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাছাড়াও মানুষের জন্যে অসংখ্য প্রেরণা উৎস রয়েছে, যা হয়ত সহসাই মানুষের চোখে পড়ে না।
ইসলামী দৃষ্টিকোণে যৌন আবেগের গুরুত্ব কতখানি, তা উপরিউক্ত বিশ্লেষণে প্রকাশমান হয়েছে। অতএব এ আবেগের পূর্ণমাত্রার চরিতার্থতার জন্যে সুষ্ঠু-বিশুদ্ধ-পবিত্র প্রবাহপথ অবাধ ও উন্মুক্ত থাকা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায়, এই প্রবাহ রুদ্ধ হয়ে গেলে এ উৎস থেকেই মানব সমাজের যে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে, তা অত্যন্ত মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পথে প্রবাহিত হতে থাকবে। সেই সাথে মানবীয় মহান মূল্যমানের আরও যে সব গুরুত্বপূর্ণ অংশ বইয়ে নিয়ে যাবে, তা জানা ও চিহ্নিত করাও হয়ত সম্ভব হবে না। যৌন আবেগের স্বভাবসম্মত প্রবাহ পথ উন্মুক্ত করে না দিলে তার অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে মানসিক বিপর্যয়ের (Mental disorders) সৃষ্টি হবে এবং গোটা সমাজ সংস্থা ভেঙ্গে পড়বে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাও, তাতে সন্দেহের অবকাশ খুব সামান্যই থাকতে পারে।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা কোনোক্রমেই মনে করা যেতে পারে না যে, মানবীয় যৌন আবেগের প্রবাহিত হওয়ার সঠিক পথ তাই হতে পারে, যা জীব-জন্তু ও উদ্ভীদের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি দেহতাত্ত্বিক বা দেহগত দাবি পূরণের জন্যে রাখা হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে দেহগত তাগিদ-দাবিকে অসংখ্য আবেগ ও নৈতিক দাবিসমূহের সংমিশ্রণে একত্রিত করে প্রকৃত সম্পূর্ণ ভিন্নতর একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এখানে নৈরাজ্যের কোনো অবকাশ নেই, নেই নির্বিচারে প্লাবনের ন্যায় অন্ধভাবে প্রবাহিত হওয়ারও কোনো সুযোগ। তাকে অবশ্যই সুনিশ্চিত ও সীমাবদ্ধ নিয়ন্ত্রিত নালার (Channel) মধ্যে প্রবাহিত হতে হবে। ইসলাম এ কারণেই সে প্রবাহকে বৈরাগ্যবাদ ও ব্রহ্মচর্য বা কুমারিত্ব দ্বারা শুকিয়ে ফেলার চেষ্টার প্রতি তীব্র অসম্মতি ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু সেই সাথে অপরদিকে তার সর্বপ্লাবী সয়লাভ হয়ে প্রবাহিত হওয়ারও কোনো অনুমতিই দেয়নি, কোনো সুযোগ বা অবকাশই রাখা হয়নি তার। বরং তার সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত অথচ অবাধ প্রবাহকে অব্যাহত রাখার জন্যে বিবাহের ‘চ্যানেল’কে কার্যকর করে তুলেছে। বস্তুর ইসলামের দৃষ্টিতে ‘বিয়ে’ই হচ্ছে যৌন আবেগ প্রবাহিত হওয়ার স্বভাবসম্মত সুষ্ঠু ও পরিমার্জিত উন্মুক্ত পথ। আবেগের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত ও মানব প্রকৃতি নিহিত সমস্ত দাবি ও প্রবণতার সম্পূর্ণরূপে ও এক সাথে চরিতার্থ হওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে তাতে। ‘বিয়ে’ মানব প্রজাতি রক্ষার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। উভয় লিঙ্গের আবেগ নিহিত ও আনুভূমিক শান্তি-তৃপ্তি-স্বস্তিরও কার্যকর ব্যবস্থা তাই, তাতে প্রেম-ভালোবাসা, দয়া-সহানুভূতি-প্রীতি-বাৎসল্যের স্থায়ী বন্ধনও কায়েম হয়ে যায়। দাদা-শ্বশুর পর্যায়ের আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিবার, বংশ-গোত্র ও জাতীয় অস্তিত্ব গড়ে তোলাও তারই মাধ্যমে সম্ভব। আর এরই সাহায্যে একটা সুস্থ-নিষ্কলুষ সামাজিক জীবন প্রাসাদ নির্মাণ করা যায়। পক্ষান্তরে যিনা-ব্যভিচার প্রজাতি রক্ষার পাশবিক পন্থা হয়তো হতে পারে এবং তাছাড়া দেহগত চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়াও সম্ভব। কিন্তু মানব প্রকৃতির পরবর্তী ও অন্যান্য দাবি –প্রবণতা যা যৌন আবেগের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে –পূরণ হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। কেননা যিনা-ব্যভিচার পরিবার ও সমাজ-জীবনকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। বস্তুত বিয়ে সুষ্ঠু-সুসংবদ্ধ সমাজ জীবনের পবিত্র প্রশস্ত রাজপথ। আর যিনা নৈরাজ্যের সর্বধ্বংসী উচ্ছৃঙ্খলতা ও পংকিলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কোনো সমাজে ‘বিয়ে’র স্বাভাবিক পথে যদি নানারূপে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়, তাহলে তথায় যৌন আবেগ অনিবার্যভাবে ব্যভিচারের পথ উন্মুক্ত করবেই। আর এ আবেগটি যদি একবার তার নিয়ন্ত্রিত পথ অতিক্রম করে দু’কূল ছাপিয়ে অন্ধভাবে বইতে শুরু করে দেয়, তাহলে ক্রমশ ‘বিয়ে’র বাধ্যবাধকতাকে সম্পূর্ণরূপে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। এ কারণে ইসলাম বিয়েকে যেমন বাধ্যতামূলক করেছে তেমনি তার সমাজে এ কাজকে সহজতর এবং ব্যভিচারকে অসম্ভব বানানোর জন্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছে।
মনে রাখতে হবে, মানুষের যৌন আবেগকে অবদমন ও প্রতিরুদ্ধ করা একদিকে, আর অপরদিকে তাকে স্বভাবসম্মত ও নিয়ন্ত্রিত চ্যানেলের দু’কূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হতে দেয়া অন্যদিকে –এ দু’টি ব্যাপারেই ব্যক্তিজীবনে ও সমাজের ক্ষেত্রে ব্যাপক ও সর্বাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার বৈধ পথে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করা হলেও তা ব্যক্তির মানসিক বিপর্যয় (Mental Discorder) এবং সামাজিক ব্যাপক ভাঙ্গন নিয়ে আসবেই। আরতাকে যদি নির্বিচার প্লাবন হয়ে প্রবাহিত হতে দেয়া হয়, তাহলেও এ আবেগ একদিকে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতাকে এবং অপর দিকে সমাজের নৈতকি পবিত্রতাকে একেবারে বরবাদ করে দেবে –ইসলাম এ সত্যকে নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আইনের শাসন ব্যবস্থায় চমৎকার ও পুরাপুরিবাবে সম্মুখে রেখেছে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য সহকারে।
বাচ্চাদের মধ্যে যৌন প্রবৃত্তি জন্মগতভাবেই বর্তমান থাকে, যেমন থাকে অন্যান্য প্রবৃত্তিও। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে তাকে যা কিছু নিয়ে উঠতে হবে তার সব কিছুরই মৌলিক ভাবধারা তার মধ্যে সঞ্চিত ও সংরক্ষিত থাকে। এমন কি যুক্তিবিদ্যা ও গাণিতিক জ্ঞানের বীজও প্রকৃতিই বপন করে তার মধ্যে। যৌন আবেগ একটা আবেগই, কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে, বাচ্চা জন্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই কি তার যৌন আবেগ কাজ করতে শুরু করে দেয়? পাশ্চাত্য দার্শনিক বিজ্ঞানীরা –বিশেষ করে ফ্রয়েডীয় চিন্তাবিদরা এ প্রশ্নের জবাবে দাবি করেছেন যে, হ্যাঁ, বাচ্চার যৌন আবেগ জন্মের সাথে সাথে ও তাৎক্ষণিকভাবেই কাজ করে শুরু করে দেয়। কিন্তু এ পর্যায়ে যে সব সাক্ষ্য প্রমাণের উল্লেখ তারা করেছে, তা যেমন নিছক অনুমান মাত্র, তেমনি নিতান্তই গোজামিলের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে, বলতে হবে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় মা’র স্তন চোষণে –ফ্রয়েডীয় চিন্তাবিদের মতে –শিশুর যৌন আবেগের তৃপ্তি-স্বস্তি সাধিত হয়। আর তা থেকেই সে প্রথম খাদ্য বা প্রাথমিক উত্তেজনা লাভ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু দুগ্ধ সেবনে যে স্বাদ আস্বাদন হয় তা-ই যদি ভিত্তি হয় এই যুক্তির, তহলে আমরা যদি এই স্বাদ আস্বাদনের অন্য কোন সরল-সহজ ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করি তাহলে তখন এই যুক্তির কোথায় থাকবে? সোজা কথা, শিশুর কামনায় সবচাইতে বলিষ্ঠ উৎস হচ্ছে তার ক্ষুধা আর প্রকৃতির গোপন ইঙ্গিতে সে তার হাতিয়ারসমূহের মধ্যে কেবল সেইটিই সর্বপ্রথম কাজে লাগাতে পারে, যেটিকে সে খাদ্য গ্রহনের জন্য ব্যবহার করতে পারে। এ কারণে তার স্বাদ ও বেদহার কেন্দ্রবিন্দু এই ক্ষুধা ও খাদ্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। পরবর্তীতে এ শিশু যখন বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে, তখন তার প্রাথমিক অভিজ্ঞতার সব কিছুই কেবল তার মুখকে কেন্দ্র করেই হয়। সে তার খেলনা, কাপড়, মাটি ও পাথর খণ্ড তুলে মুখে পুরতে থাকে। কেননা তার চেতনা এখনও ঘুমন্ত। আর আরাম-বিশ্রামের নেতিবাচক কামনা ছাড়া ক্ষুধা ব্যতীত অপর কোনো ইতিবাচক কামনা কার্যকর থাকে না বলেই সে অন্য কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারে না। ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ যাচাইয়ের তার এখনকার মানদণ্ড কেবলমাত্র তার মুখ। তার সমস্ত স্বাদ আস্বাদনের ব্যাপারও ঘটে এ মুখকে কেন্দ্র করেই। তখন তার মুখের পেশীসমূহ তীব্রভাবে ‘লালা’ বের করতে থাকে। সেজন্যও যা-ই পাওয়া বা ধরা তার পক্ষে সম্ভব, সে সেটিতেই মুখ লাগিয়ে দেবে। অতএব দুগ্ধ চোষার আস্বাদন সম্পূর্ণটাই প্রকৃতির এ ব্যবস্থার ওপরই ভিত্তিশীল যে, শিশু তার অস্তিত্ব রক্ষার মৌলিক দাবি –খাদ্য গ্রহণ –পূরণ করতে সক্ষম হবে। -এর সাথে যৌন আবেগের সংযোগ কোথায় পাওয়া গেল, এ পর্যায়ে তার প্রশ্নই বা উঠছে কেন?
দ্বিতীয় যুক্তি এই দেখানো হয়েছে যে, শিশুর জীবনের প্রাথমিক কয়েকটি বছর নিজের মন ও নিজ দেহের নিম্ন পর্যায়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের প্রতি তার খুম বেশী কৌতূহল থাকে। এ কৌতূহলকে যৌন-আবেগের চরিতার্থতা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না।
সন্দেহ নেই –দেহের নিম্নদেশীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে মল-প্রস্রাব ত্যাগের মাধ্যম বানানোর সাথে সাথে তাকে যৌনতার সাথে জুড়ে দিয়ে বড়ই বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। অন্যথায় দেহের আবর্জনা নিষ্কাশনের মাধ্যমে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সারাটি জীবন নিজ দেহের সাথে যুক্ত রেখে বহন করে চলা মানুষের পক্ষে সম্ভবই হত না। কিন্তু একটি শিশুর যেমন ময়লা-আবর্জনা ও পরিচ্ছন্নতার পার্থক্য বোধ থাকে না, তেমনি তার মধ্যে এ উদ্দেশ্যের জন্য যৌন আবেগের বর্তমান থাকাও কিছু মাত্র জরুরী হয় না। দেহের নিম্নদেশীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি শিশুর আগ্রহের অপর একটি সহজ-সরল বিশ্লেষণও সম্ভব। বস্তুত প্রকৃতি দেহ ব্যবস্থাকে হৃদয় ও মনের সাথে এমনভাবে সম্পর্কিত করে দিয়েছে যে, দেহ যেসব জিনিসের প্রয়োজন বোধ করে তাকে অর্জন করে এবং যেগুলোকে প্রতিরোধ করতে চায় সেগুলোকে প্রতিরোধ করে মন-হৃদয় স্বাদ ও আরাম অনুভব করে। এ কারণে মল-প্রস্রাব যখন দেহের নিম্ন প্রদেশে পৌঁছে যায়, তখন তাকে বাইরে ঠেলে দেয়ার জন্য একটা চাপের সৃষ্টি হয়। আর তার নিষ্কাশন সম্পন্ন হয়ে গেলে ‘ক্ষতি প্রতিরোধ’ নীতির অধীন স্বাদ বা তৃপ্তি অনুভূত হওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তৃপ্তি বা স্বাদের এ অনুভূতিই নিম্নদেশীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি শিশুর কৌতূহল সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে। -নিম্ন দেশীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতি শিশুর কৌতূহলের ব্যাখ্যাস্বরূপ এতটুকু বলা কি যথেষ্ট নয়?
ফ্রয়েডীয় চিন্তাবিদরা সকল প্রকারের মানসিক বিপর্যয়কে যৌন আবেগের অধীনে নিয়ে আসার জন্যে নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা ও প্রলাপ পর্যায়ের যুক্তির জাল ব্সিতার করেছে। চুরি, পকেট কাটা ও হত্যা ইত্যাদির অপরাধীদের মনে যৌন-আবেগের তীব্র তাড়নার প্রভাব প্রমাণ করার জন্যও তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। দৃষ্টান্ত দিয়ে দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে যে, একজন চোরের চৌর্যবৃত্তির অভ্যাস হওয়ার সূচনাতে নিশ্চয়ই একটি যৌন আবেগ তার সাথে যুক্ত হয়েছিল। অথচ এসব অসৎ কার্যকলাপের অভ্যাস হওয়ার আরও বহু প্রকারের কারণ সমাজে-পরিবারে বর্তমান থাকতে পারে। যেমন শিশুর আগ্রহের দ্রব্যাদ যদি পিতামাতা তার সম্মুখেই লুকিয়ে রাখে, তা হলে এ আচরণ তার মধ্যে একটা বিদ্রোহাত্মক প্রবণতা এবং তার ফলে চুরি করার প্রবল ইচ্ছা তার মধ্যে জাগিয়ে দিতে পারে। অনুরূপভাবে শিশুর ওপর যেসব কামনা-বাসনার চাপ এটা পরিবেশের মধ্যে পড়ে স্বয়ং পিতামাতা তা পূরণ করে না দিলে শিশু টাকা বা দ্রব্যটি চুরি করে নিজের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে পারে। এভাবে অন্যান্য প্রবণতাও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পরিবেশ হতে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যেতে পারে। তা সত্ত্বেও এ সব কিছুকে যৌন আবেগের সাথে যুক্ত করে দেয়া হাস্যকর নয় কি?
এ পর্যায়ের একটা যুক্তিকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুভূতি’ বা Oedipus Complex বলে দাঁড় করানো হয়েছে। আর এটা ফ্রয়েডীয় যৌন দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগও বটে। কিন্তু স্বয়ং ফ্রয়েডপন্থী চিন্তাবিদরা এর প্রতি একবিন্দু আস্থা স্থাপন করতে পারে নি। কেউ কেউ বলেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই অনুভূতি প্রত্যেকটি ব্যক্তি মানুষের প্রকৃতির গভীরে শিকড় হয়ে বসেছে। অপর কতিপয় ফ্রয়েডীয় চিন্তাবিদদের মতে তা এমন একটা স্বভাবগত আবেগ যা কেবল মনস্তাত্ত্বিক রোগেই স্বীয় প্রভাব দেখায় না, ব্যক্তির সঠিক ঠিকানা এবং আরও সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে সামাজিক রসম-রেওয়াজ, সামষ্টিক প্রতিষ্ঠান এবং ধর্ম ও নৈতিকতার বিকাশেও বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে।
ফ্রয়েড নিজেও এই দার্শনিক মতের ব্যাখ্যাদানে খুব একটা যথার্থ কথাবার্তা বলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাঁর Three Contributions to Sexual Theory (১৯০৫ খৃ.) গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে য, শিশু যখন একেবারে সুবোধ মাসুম থাকে, তখন তার যৌন তাড়না (Urge) নিজের পথ জানে না এবং একজন পুরুষ শিশু যখন মায়ের স্তন চুষতে থাকে, ঠিক সেই অবস্থায়ই তার যৌন-কামনা মা’র ওপর কেন্দ্রীভূত হয়ে (নিতান্ত লজ্জাস্কর হওয়া সত্ত্বেও আবরণ খুলে ফেলার জন্য আমাকে এর উল্লেখ করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত) পড়ে। সে মাকে পিতার দিকে এবং পিতাকে মা’র দিকে কৌতুহলী দেখতে পেয়ে পিতাকে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে লক্ষ্য করে এবং তার মনে পিতার বিরুদ্ধে নিতান্তই অবচেতনভাবে যৌন প্রতিদ্বন্দ্বীতা জেগে উঠে, যা উত্তরকালেও তার মধ্যে পুরোপুরি কাজ করতে থাকে।
অতঃপর Totem and Taboo এবং Psychology গ্রন্থে বোঝাতে চেয়েছে যে, (তার দৃষ্টিতে পাপ অনুভূতিই হল সমস্ত ধর্ম ও নৈতিক ব্যবস্থার মূল) সেই পাপ অনুভূতি ‘ঈডিপাস কমপ্লেকস-এরই কার্যক্রমের ফলশ্রুতি হয়ে থাকে। আর এ কারণে গোটা বংশে –অন্তর তার এক-অর্ধ পুরুষ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে ‘পাপ অনুভূতি’ স্বভাবগত হয়ে দাঁড়ায়। তার লেখা পরবর্তী এক প্রবন্ধে (The passing of Oedipus Complex) বলেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেগ প্রত্যেক নিষ্পাপ শিশুর মধ্যেও থকে। কিন্তু শিশু কি তা জন্মগত স্বভাবরূপে পায় কিংবা সে নিজ স্বভাবে নিজের মধ্যে সৃষ্টি করে নেয় –এই প্রশ্নের কোনো জবাব ফ্রয়েডের নিকট পাওয়া যায়নি।
আরও সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বলতে চেয়েছে যে, এই ‘যৌন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেগ’ বাল্যকালে স্বতঃই মরে যায়। এ কথাটির ফলশ্রুতি তো এই দাঁড়ায় যে, এই আবেগপূর্ণ বয়স্কদের মধ্যে হলে সে অবশ্যম্ভাবীরূপে মনস্তাত্ত্বিক রোগী হবে। মোটকথা এখানে ফ্রয়েডের ‘ঈডিপাস কমপ্লেক্স’-এর ভিত্তিতে ও নৌতিকতার সব নির্মাণ কার্য হয় নিষ্পাপ শিশুদের মগজ নিঃসৃত অথবা তা নির্মিত মনস্তাত্ত্বিক রোগীদের দ্বারা। কেননা ‘ঈডিপাস কমপ্লেক্স’-এর সব মাল-মসলা তো কেবল এ দু’জনের নিকটই পাওয়া যায়। এই দর্শনটি অন্য একটি দিক দিয়েও ত্রুটিপূর্ণ –ফ্রয়েড নিজেও সেজন্যে নিরুপায়। তা হচ্ছে, এ দর্শনের গঠন কেন্দ্র। কেবল পুরুষ শিশু –স্ত্রী শিশুর কোনো স্থান নেই এ মতাদর্শের বেষ্টনীতে। একটি স্ত্রী-শিশুর মধ্যে এই অনুভূতি ও আবেগ কিভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
ফ্রয়েড নিজের নির্বুদ্ধিতাসমূহকে বিজ্ঞান নামে চালিয়ে দুনিয়ার কত মানুষকে যে বিভ্রান্ত করেছে, তা গুণেও হয়ত শেষ করা যাবে না!
সোজা কথায় বলা যায়, শিশুর দু’টি প্রাথমিক স্বভাবগত-জন্মগত প্রবৃত্তি হচ্ছে ‘ক্ষুধা’ ও ‘বিশ্রাম লাভ’। আর এ দু’টির জন্য মা-ই হচ্ছে তার লীলা-কেন্দ্র। ‘ভয়’-এর ক্ষেত্রে আবারসেই মা-ই হচ্ছে তার আশ্রয়। ফলে মা অতি স্বাভাবিক ও অবচেতনভাবে শিশুর ভালোবাসার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। আর ভালোবাসা এমনই একটা আবেগ, যা নিজের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজও জিইয়ে রাখে।
ভালোবাসার স্বাভাবিক প্রবণতা বা প্রকৃতি হচ্ছে একত্ব –অংশীদারত্বহীনতা। ধন-সম্পদ ও দ্রব্য-সামগ্রীর প্রতি ভালোবাসা ব্যক্তি কালিকত্ব সংরক্ষণের আবেগরূপে মানব সমাজে সক্রিয় থাকে। শিশুর স্বাভাবিক ইচ্ছা হচ্ছে স্বীয় ভালোবাসা-কেন্দ্রের ভালোবাসা পর্যায়ের যাবতীয় তৎপরতা ও কার্যকলাপের একমাত্র অধিকারী হবে সে, তাতে অন্য কারো অংশীদারিত্বকে সে স্বতঃই অপছন্দ করে। পুরুষ-স্ত্রী উভয় শিশুই পিতার প্রতিকূলে নিকট বয়সী ভাইবোনদের বিরুদ্ধে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা পোষণ করে। নবজাতকের জন্মগ্রহণের পরই তার চাইতে বয়সে বড় শিশুদের মনে এ অনুভূতি জেগে ওঠে যে, তার ভালোবাসা কেন্দ্রকে একজন নতুন প্রতিদ্বন্দি সহসাই এসে দখল করে নিয়েছে। পরে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাবধারা নবজাতকের মধ্যে ধীরে ধীরে তার বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে অর্থাৎ তার সূচনা হয় সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে। বহু পরিবারেই তার মহড়া অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুই বোন, দুই ভাই বা দুই ভাইবোনের মধ্যেও হতে পারে। অনেক সময় তা বেশি বয়স পর্যন্তও কাজ করতে থাকে। তাছাড়া শিশুর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাবধারা কেবল মা’র সাথেই বা মাকে নিয়েই তো হয় না। খেলনা, বিশেষ শয্যা, নিজের জন্য নির্দিষ্ট থালা-বাটি-বই ইত্যাদি নিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। আর তা যেমন মা’র ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে হয়, তেমনি হয় পিতার স্নেহ-বাৎসল্য পাওয়ার জন্যেও। অন্য কথায়, ভালোবাসা সহজ-সরল ধারণানুযায়ী স্বতঃই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজের ধারক হয়। সকল প্রকারের ভালোবাসা সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য। চাকর-চাকরানীদের মধ্যেও স্নেহদৃষ্টি লাভের জন্যেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। সমাজকর্মী বা একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও নেতার প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্যে এরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। প্রেমিক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুভব করে অপরাপর প্রেমিকাদের বিরুদ্ধে প্রিয়তমার প্রেম লাভের জন্যে, যেন সে অন্যদের বাদ দিয়ে কেবল তাকেই গ্রহণ করে।
এটা একটা সাধারণ আবেগ। এ সাধারণ আবেগকে ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ নাম দিয়ে একটি দার্শনিক মতাদর্শ বানিয়ে দেয়া এবং তাতে ‘পাপ’ অনুবূতির ভাবধারা সৃষ্টি করে দাবি করা যে, এ ভাবধারাকে কেন্দ্র করেই ধর্ম ও নৈতিকতার ব্যবস্থা আবর্তিত হয়, -একটি অসামঞ্জস্য প্রতারণামাত্র এবং এ সামস্যহীন প্রতারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ফ্রয়েডীয় দার্শনিকতার সুরম্য প্রাসাদ। ফ্রয়েডীয় চিন্তাবিদদের আসল ভুল এখানে নিহিত যে, তারা মনে করে নিয়েছে যে, All love is a manifestation of the sex listinct –যৌন আবেগের প্রকাশনাই সমস্ত প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার উৎস। যারা যারাই এ বিশ্বাস মনে বদ্ধমূল করে যৌন-দর্শনের ক্ষেত্রে পদচারণা শুরু করেছে, তারা তো সকল পবিত্র-নিষ্কলুষ আবেগ-ভাবধারাকে কলুষতায় আকীর্ণ করে দেবেই, এ ছাড়া তারা আর কিই-বা করতে পারে।
আমরা মনে করি, ব্যাপারটিকে সহজ-সরলভাবেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়, জটিল দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে সহজকে জটিল বানানো চিন্তাবিদদের একটা ফ্যাশনই বলতে হবে। সোজা কথা, মানব চরিত্রের অভ্যন্তর থেকে প্রেম-প্রীতি ভালোবাসার বহু কয়টি ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি স্বীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্যে, একটি নিজের ভাই বোন মা-বাপ থেকে শুরু করে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়ে দেশ, জাতি ও গোটা বিশ্ব মানবতা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে। আর একটি ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)। অপর একটি ধারা উত্তম জীবনাদর্শ ও নৈতিকতার দিকে প্রবহমান আর একটি সৌন্দর্য প্রীতির দিকেও। কিন্তু ভালোবাসা প্রীতির এ ধারাসমূহকে যৌন আবেগের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া কলুষ-পংকিল দৃষ্টিভঙ্গীরই উপস্থাপিত করে, সৎ ও স্বচ্ছ মনোভাবের নয়।
বস্তুত মানব প্রকৃতির নিহিত ভালোবাসার বিভিন্ন দিককে যদি স্বতন্ত্র মর্যাদা দেই, তাহলেই যৌন-ভালোবাসাকে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দিয়ে আমরা খুঁজে দেখতে পারি, কোথায় কোথায় তা পাওয়া যায়।
যৌন-প্রেম হচ্ছে কেবল তা, যা যৌন-অনুভূতির অঙ্গগত ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে কর্মমুখর হওয়ার দরুন একটা বিশেষ ধরনের আবেগের রূপ ধরে সম্মুখে উপস্থিত হয়। পরিবেশ এই অনুভূতিকে কখনও কখনও নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সক্রিয় বানিয়ে দিতে পারে। কেননা তা বাইরের আন্দোলন ও তার বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু এটা বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট অনুভূতি। তা যতক্ষণ পর্যন্ত সুনির্দিষ্টরূপে কাজ করতে শুরু না করছে ততক্ষণ তার প্রকাশ লাভের পূর্বেই শিশুর প্রত্যেকটি ভালোবাসা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেগে সেই যৌন-অনুভূতির অস্তিত্ব প্রমান করতে চাওয়ার বা সেজন্য চেষ্টা করার কোনো অধিকারই কারো থাকতে পারে না –বিশেষ করে এজন্যেও যে, তার ভালোবাসা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যান্য বহু কয় সহজ ব্যাখ্যা দান খুই সম্ভব।
সকল জন্মগত প্রকৃতিরই নিয়ম হলো, তা স্বীয় কাজ প্রকৃতির নিয়মানুযায়ীই সম্পন্ন করে থাকে –যৌন আবেগ এ নিয়মের বাইরে নয়। তা সেই গতিতেই কাজ করে যে গতিতে যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পূর্ণত্ব হতে থাকে। একদিকে যৌন অঙ্গের বিকাশ অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ধাক্কা দেয় আর অপরদিকে মানবতার দুই লিঙ্গে বিভক্ত হওয়াটাই একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায় বাইরে থেকে আন্দোলনের। আর লিঙ্গদ্বয়ের পার্থক্যপূর্ণ দিকসমূহই পারস্পরিক এক তীব্র আকর্ষণ (Attraction) সৃষ্টি করে। তারপর ধীরে ধীরে সে আকর্ষণের জন্যেই সেই সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কেন্দ্র বানিয়ে দেয়, যা লিঙ্গদ্বয়ের মাঝে একটি চূড়ান্ত সীমানা বানিয়ে দেয়। তার সাথে সাথে প্রকৃতির গোটা শিল্প, রঙ ও গন্ধের তরঙ্গমালা ও দিন-রাতের মনোরম মনোহর দৃশ্যাবলী সবই মানবীয় যৌন আবেগের ওপর প্রভাবশালী হয়ে থাকে। এমনি করেই তা তার বিকাশকে সম্পূর্ণ করে নেয়।
যৌন আবেগ অন্যান্য সব আবেগের মতোই মানুষের মন ও মানবীয় স্বভাব চরিত্রের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। এই আবেগের স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকা, তার অবদমিত হওয়া এবং তার সীমাকে লংঘন করে যাওয়া –এ তিনওটি অবস্থা মানব জীবনের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তার করে থাকে। নীতিগতভাবে একথা সকল প্রকারের আবেগ সম্পর্কে বলা চলে। বাড়াবাড়ি, প্রয়োজনের চাইতে কম এবং ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা –যে কোন আবেগের ন্যায় যৌন-আবেগের ওপর উক্ত তিনটি অবস্থায় যে কোনো একটি আবর্তিত হলে গোটা সমাজ কাঠামোই তাতে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
পাশ্চাত্য সমাজে যৌন দর্শন যে পরিবেশের মধ্যে উৎকর্ষ লাভ করেছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চিন্তা-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। সেখানকার সমাজকে ধর্ম, নৈতিকতা ও আবহমান কাল থেকে চলে আসা ঐতিহ্য ও নিয়ম-আইনের সীমালংঘন করার অবাধ সুযোগ করে দেয়া হলো। যৌন-বিপ্লবের পর পরিবার ব্যবস্থার ভিত্তি উৎপাটিত হলো। পাশবিক দাম্পত্য জীবনের প্রচলন হলো এবং যিনা-ব্যভিচারের একটা সর্বগ্রাসী প্লাবন সূচিত হয়ে গেল। তখন কিছু সংখ্যক নব্য দার্শনিক বেশধারী এই সর্বাত্মক বিপর্যয়কে ‘চরম উন্নতি ও প্রগতি’র সনদে ভূষিত করেছিল, তখন মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণকারীও-[‘মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ’ নামে মনোবিজ্ঞানের একটা স্বতন্ত্র School of Thought রয়েছে। কিন্তু ‘মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়’ পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক School-উভয়ের মধ্যে যে মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে মিঃ উইলিয়ম ম্যাগডোগল তা বিশেষ যত্ন সহকারে উদঘাটিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মনস্তাত্ত্বিক School-এর লোকদের দর্শন চিন্তার একমাত্র ক্ষেত্র হচ্ছে Normal Psychology আর অপর দিকে Psycho-Analysis School সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ Normal Psychology-র ক্ষেত্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের (Abnormal Psychology)-এর গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে অর্থাৎ দার্শনিকদের একটি দল সুস্থ মনস্তত্ত্বের অধ্যয়ন করে। কিন্তু রোগীদের অধ্যয়ন থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ থাকে। আর অপর দলটি রোগীদের অধ্যয়ন করে তাদের রোগাক্রান্ত থাকা অবস্থায়; কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে না। ফলে উভয়ই একতরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট বিদ্যা নিয়ে যৌন বিকৃতি সম্পর্কে যেসব তত্ত্ব পরিবেশন করেছে, তা স্বাভাবিকভাবেই অসম্পূর্ণ, অপরিপক্ক ও অপরিসর হয়ে রয়েছে।] এদের মধ্যে শামিল ছিল। তারা ব্যভিচারের পক্ষে পরিবেশ অনুকূল বানানোর লক্ষ্যে যৌন আবেগকে মানবীয় মনস্তত্ত্বের বিশাল ক্ষেত্রে বিস্তীর্ণ করে দিয়েছে এবং ব্যভিচারকে মানসিক বিকৃতিরূপে চিহ্নিত করার পরিবর্তে ব্যভিচার বিরোধী প্রাচীন বিধি-নিষেধ ও বাধা-প্রবিন্ধকতাকেই মানসিক বিকৃতির কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। ফ্রয়েডই হচ্ছে এ চিন্তাগত ও বাস্তব বিপর্যয়ের আসল হোতা। সে তো চরম নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে এই বলে যে, মানসিক বিকৃতি বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড়, আসল ও মৌলিক কারণ হচ্ছে পরিবেশগত বাধা-প্রতিবন্ধকতার দরুন অবদমিত যৌন-আবেগ। ভুলে গেলে চলবে না, ফ্রয়েডের সম্মুখে যে সমাজ ছিল তাতে একদিকে এই আবেগের ওপর অবাঞ্ছনীয় বিধি-নিষেধের কুপ্রভাব প্রতিফলিত ছিল এবং অপরদিকে তাতে ব্যভিচার ও যৌন নৈরাজ্য এবং নগ্নতা ও পর্দাহীনতার অন্ধ নির্বিচার সয়লাব মাথা উঁচু করে এসেছিল। এ দু’টির পরস্পর বিরোধী কার্যকারণ একই সময় মুখোমুখি দ্বন্দ্ব করছিল এবং এ দু’টিরই দিক থেকে ব্যক্তির মানসিক ভারসাম্য ও সমাজের নৈতিক সুস্থতার অবক্ষয় সাধিত হচ্ছিল। ফ্রয়েড আসলে একটি রোগী সমাজের অধ্যয়ন করেছে। তখন তা এ রোগাক্রান্ত অবস্থা থেকে বের হয়ে অপর একটি রোগের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিল। ফলে সে স্বাভাবিক চাহিদা অপূরণের পুরাতন রোগকে ‘রোগ’ বলে চিহ্নিত করছিল এবং অমিতাচার অযৌক্তিকতার (Extravagance) নতুন রোগকে সুস্থতা-স্বাভাবিকতার মানদণ্ডই বানিয়ে দিয়েছিল। তার দৃষ্টিভঙ্গীই বানিয়ে নিয়েছিল যে, যৌন আবেগ চরিতার্থতার পথে যে-কোন বাধা –তা পর্দা, পোশাক, মুহাররম আত্মীয়দের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধাবোধ কিংবা ব্যভিচার নিষিদ্ধকারী আইন-কানুন অথবা বিয়ের বন্ধন যা-ই হোক, যেরূপেই হোক, সবই উৎপাটিত করা এবং তাকে এ সব কিছু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করাই প্রকৃতির চাহিদার সাথে পুরমাত্রায় সঙ্গতিপূর্ণ। ফ্রয়েড মানবীয় মনস্তত্ত্বের অনাবিল-নির্ভেজাল অধ্যয়ন ও গবেষণার পরিবর্তে সমসাময়িক সমাজের যৌন প্লাবনের স্রোতে ভেসে গেছে এবং তাঁর সমস্ত মেধা ও প্রতিভাবে ধর্ম ও নৈতিকতার বিধি-বন্ধনের বিরুদ্ধে নাস্তিকতা, অশ্লীলতা, যৌন অনাচার ও উচ্ছৃংখলতাকে ব্যাপক ও দৃঢ়মূল করে তোলার অপচেষ্টার সর্বাত্মক ব্যবহার করেছে।
ফ্রয়েডীয় চিন্তাবিদদের দাবি হচ্ছে, পর্দা লোকদের মনে কৌতুহল (Curiosity) বা অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি করে। এই কারণে যৌন আবেগের প্রতিক্রিয়া (Reaction) তাদের জন্য মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। ফ্রয়েডীয় চিন্তার পূর্বোক্ত পরিবেশের প্রেক্ষিতে এরূপ দাবির কারণ সহজেই বোধগম্য হয় এবং তা যে বিকৃত পরিবেশের অসুস্থ প্রতিক্রিয়ারই প্রকাশ, তাতে কোনোই সংশয় থাকে না। উক্তরূপ বিকৃত ও কলংক-কলুষ সমাজ-পরিবেশে মানবীয় যৌন আবেগ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা না করলে যে উক্তরূপে দাবি উত্থাপিত হত তা-ও অতি সহজেই বুঝতে পারা যায়। আমরা বলতে পারি, ফ্রয়েডীয় যৌন দর্শনের যে কৌতুহলের ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে তা শুধু মুখাবয়ব উন্মুক্ত হলেই তো চরিতার্থ হবে না। বরং মুখাবরণ অপসারিত হওয়ার পর তা আরো উদগ্র হয়ে উঠবে। অতঃপর পুরুষ-নারীর পরনের কাপড় অপসারিত করার প্রবল দাবিও উত্থাপিত হবে। পাশ্চাত্য সমাজে যে Bottomless বা Topless পোশাক, নগ্নদের সমিতি ও ক্লাব ঘর –ইত্যাদি ব্যাপক হয়ে গেছে তা কি সে ‘উদগ্র যৌন কৌতূহলে’রই ফলশ্রুতি নয়? পাশ্চাত্য সমাজ লোকদের সে কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্যেই তো প্রায় উলংগ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নানা প্রকারের নৃত্য কলা ও নাটক-অভিনয়ের প্রভাবে অনুরূপ শত শত হাজার-হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সিনেমা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে সেই কৌতূহলেরই নিবৃত্তি চলছে! উইলিয়াম ম্যাকডোগালের একটা উদ্ধৃতি এই প্রক্ষিতে খুবই সামঞ্জস্যশীল মনে হচ্ছে। তা হচ্ছেঃ
In every society in which custom permits of every free intercourse of the sexes, inverted sexual practices commonly flourish amonh the men –In this way also we understand how, in all societies some men of middle age who have led a life of free indulgence with the opposite sex turn to members of their own sex in order to obtain the stimuls of novelty.
একটি পর্দাহীন বন্ধনহীন নির্লজ্জ নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাপূর্ণ সমাজ যে কি সাংঘাতিক পরিণতির সম্মুখীন হয় তা উপরোদ্ধৃত কথার আলোকে সহজেই বুঝতে পারা যায়। বস্তুত কোনো সমাজে যখন পুরুষ-নারীর অবাধ মেলামেশা সাধারণ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন যৌন আবেগ নিত্য নব বচিত্র দাবির অধীন নতুন নতুন দুষ্টামির উদ্ভাবন করে। পাশ্চাত্যের বে-পর্দা নগ্ন সমাজে যৌন আবেগ চরিতার্থ করার জন্যে স্বভাবসম্মত পন্থা অবলম্বনের বিপুল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কি সব বিচিত্র ধরনের উপায় উদ্ভাবন করেছে এবং কি কি নতুন নতুন ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন করেছে –নিতান্তই নির্লজ্জতার প্রশ্রয় দিতে পারি না বলেই তার উল্লেখ থেকে বিরত থাকতে হলো। আমাদের বক্তব্য হলো, ‘কৌতূহলে’র দোহাই দিয়ে পাশ্চাত্য সমাজে এবং তার অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে প্রাচ্যদেশীয় সমাজরে পর্দাহীনতা ও পুরুষ নারীদের অবাধ মেলামেশার যে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে তার পরিণতি অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে সর্বত্রই। -এ সবেরই ফলে যৌন আকর্ষনই নিঃশেষ হয়ে যায়, যৌন আবেগ এতটা শীতল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে যে, তাকে সক্রিয় রাখার জনে অসংখ্য ধরনের কৃত্রিম পন্থা অবলম্বন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পাশ্চাত্য সমাজ আজ সে মারাত্মক অবস্থারই সম্মুখীন। প্রশ্ন হচ্ছে, পর্দাহীনতা, নগ্নতা, যৌন নৈরাজ্য ও ব্যভিচারের পূর্ণ স্বাধীনতার মানদণ্ড বানানো হচ্ছে যে সমাজকে, সেখানকার ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক বিকৃতি-[‘মানসিক বিকৃতির’ বিভিন্ন কারণের উল্লেখ ও সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনা বর্তমান গ্রন্থে প্রাসঙ্গিক নয়। এ পর্যায়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে মানসিক বিকৃতি বিপর্যয়ের মৌলনীতি হচ্ছে ‘বৈপরীত্য’। মনস্তাত্ত্বিক জগতে বৈপরীত্য –তা যৌন ঝোঁক প্রবণতা সম্পর্কিত হোক, অথবা অপর কোনো ঝোঁক-আবেগ। কামনা-ইচ্ছা বা প্রকৃতিগত প্রবৃত্তিই হচ্ছে মানসিক বিকৃতির মৌল কারণ। কুরআন মজীদ বিশেষভাবে মুনাফিকদের বিস্তারিতভাবে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে, মনের ও মুখের, বিশ্বাসের ও কাজের বৈপরীত্যই তাদের চারিত্রিক সর্বনাশ সাধন করেছে। আমার লিখিত ‘পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’ গ্রন্থে ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে।] ও তাদের সামষ্টিক জীবনে নৈতিক বিপর্যয় সে অনুপাতেই বাড়ছে না কি, যে অনুপাতে তাদের মধ্যে ব্যভিচারের প্লাবন বৃদ্ধি পাচ্ছে? মানসিক বিকৃতির সবচাইতে বেশি দৃষ্টান্ত তো উক্তরূপ সমাজেই লক্ষণীয়। সমকামিতা, পুরুষদের নারীসুলভ ও নারীদের পুরুষসুলভ আচার-আচরণ ও চলাফেরা কি এ সমাজেই বেশি দেখা যাচ্ছে না? সবচাইতে বেশি অপরাধ প্রবণতা ও ঘটনা-দুর্ঘটনাও কি এ সমাজে বেশি পাওয়া যাচ্ছে না? –এসব প্রশ্নের জবাবে ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এবং তা-ই অকাট্যবাবে প্রমাণ করে যে, পাশ্চাত্য ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং তারই বিভ্রান্তিতে পড়ে যেসব সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও নীতি গৃহীত হয়েছে, তা সবই সম্পূর্ণরূপে ভুল ও মারাত্মক।
এ ভুল চিন্তা ও দর্শন ইউরোপে যখন সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়, তখন অনতিবিলম্বে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবাধীন প্রাচ্য দেশসমূহেও তা ব্যাপক প্রচার লাভ করে এবং তারই প্রভাবে পড়ে প্রাচ্যের মুসলিম দেশ ও সমাজের পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ম-নীতিকে ভংগ করে পর্দাহীনতা ও নগ্নতার সয়লাব বইয়ে দেয়া হয়। আর তারই প্রচণ্ড আঘাতে মুসলিম দেশসমূহেও পরিবার ভেঙ্গে যায়, নারীরা ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে পড়ে; কিংবা তাদের টেনে বাইরে নিয়ে এসে পুরুষদের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। ফলে ইউরোপে যে ব্যাপক নৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, প্রাচ্যেও অনুরূপ কাজে অনুরূপ পরিণতিই দেখা দিয়েছে অনিবার্যভাবে। আজ আমাদের পরিবার ও পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত। অথচ মুসলিমদের পরিবার ছিল এক-একটি দুর্গ। আর পারিবারিক জীবন পবিত্র প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা এবং পরম শান্তি ও স্বস্তির কেদ্রবিন্দু। সে শুভ ও কল্যাণময় অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সুষ্ঠু পরিবার ও পারিবারিক জীবন গড়ে তোলা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিবদ্ধ; বর্তমান ‘পরিবার প্রায় চার বছরকালীন ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার বিচারের ভার সূধী পাঠকদের ওপরই থাকল। তবে আমার জীবন লক্ষ্য যে অতীব মহান, তাতে কোনোই সন্দেহের অবকাশ নেই।
-মুহাম্মদ আবদুর রহীম
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/505/5
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।