HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া

(ইসলামের ইতিহাসঃ আদি-অন্ত)

দ্বিতীয় খণ্ড

মূলঃ

আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

মূল কিতাব পরিমার্জন ও সম্পাদনায়

ড. আহমদ আবু মুলহিম

ড. আলী নজীব আতাবী

প্রফেসর ফুয়াদ সাইয়েদ

প্রফেসর মাহদী নাসির উদ্দীন

প্রফেসর আলী আবদুস সাতির

অনুবাদঃ

মাওলানা বোরহান উদ্দীন

মাওলানা মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন

মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ এমদাদ উদ্দীন

মাওলানা গোলাম সোবহান সিদ্দিকী

সম্পাদনা পরিষদ

অধ্যাপক মাওলানা আবদুল মান্নান (সভাপতি)

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী (সদস্য)

পরিচালক, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ (সদস্য সচিব)

গ্রন্থস্বত্বঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

প্রথম প্রকাশঃ জুন ২০০১

দ্বিতীয় সংস্করণঃ মে ২০০৭; জ্যৈষ্ঠ ১৪১৪; রবিউস সানি ১৪২৮

মহাপরিচালকের কথা
‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ প্রখ্যাত মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তা আল্লামা ইবনে কাসীর (র) প্রণীত একটি সুবৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থ। এই গ্রন্থে সৃষ্টির শুরু তথা আরশ, কুরসী, নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল প্রভৃতি এবং সৃষ্টির শেষ তথা হাশর-নশর, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম প্রভৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

এই বৃহৎ গ্রন্থটি ১৪টি খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসীর (র) তাঁর এই গ্রন্থকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে আরশ, কুরসী, ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু তথা ফেরেশতা, জিন, শয়তান, আদম (আ)-এর সৃষ্টি, যুগে যুগে আবির্ভূত নবী রাসূলগণের ঘটনা, বনী ইসরাঈল, ইসলাম-পূর্ব যুগের ঘটনাবলী এবং মুহাম্মদ (সা)-এর জীবন-চরিত আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওফাতকাল থেকে ৭৬৮ হিজরী সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ কালের বিভিন্ন ঘটনা এবং মনীষীদের জীবনী আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে রয়েছে ফিৎনা-ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কিয়ামতের আলামত, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ ইত্যাদি।

লেখক তাঁর এই গ্রন্থের প্রতিটি আলোচনা কুরআন, হাদীস, সাহাবাগণের বর্ণনা, তাবেঈন ও অন্যান্য মনীষীর উক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। ইবন হাজার আসকালানী (র), ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী (র) প্রমুখ ইতিহাসবিদ এই গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন। বদরুদ্দীন আইনী (র) এবং ইবন হাজার আসকালানী (র) গ্রন্থটির সার-সংক্ষেপ রচনা করেছেন। বিজ্ঞজনদের মতে, এ গ্রন্থের লেখক ইবনে কাসীর (র) ইমাম তাবারী, ইবনুল আসীর, মাসউদী ও ইবন খালদুনের ন্যায় উচ্চস্তরের ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবেত্তা ছিলেন।

বিখ্যাত এ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ দ্বিতীয় খণ্ড পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করছি। আমরা গ্রন্থখানির অনুবাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। গ্রন্থটির প্রকাশনার ক্ষেত্রে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সবাইকে মুবারকবাদ জানাচ্ছি।

পরম করুণাময় আল্লাহ তা'আলা আমাদের এ শ্রম কবুল করুন। আমীন!

মোঃ ফজলুর রহমান

মহাপরিচালক

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

প্রকাশকের কথা
প্রথম মানব-মানবী হযরত আদম ও হাওয়া (আ) থেকে মানব সভ্যতার শুভ সূচনা হয়েছে। হযরত আদম (আ) ছিলেন মানব জাতির আদি পিতা এবং সর্বপ্রথম নবী। আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টির পর তাঁর বিধি-বিধান আম্বিয়া-ই-কিরামের মাধ্যমেই মানব জাতির কাছে পৌঁছিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ সহীফা অথবা কিতাব নিয়ে এসেছেন। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, আম্বিয়া-ই-কিরামের আগমন ও তাদের কর্মবহুল জীবন সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই ইসলামের নির্ভুল ইতিহাস জানার জন্য কুরআন ও হাদীসই হলো মৌলিক উপাদান। আজ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও কুরআন-হাদীসের তত্ত্ব ও তথ্য প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত।

আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর (র) কর্তৃক আরবী ভাষায় রচিত 'আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে আল্লাহ তা'আলার বিশাল সৃষ্টি জগতসমূহের সৃষ্টিতত্ত্ব ও রহস্য, মানব সৃষ্টিতত্ত্ব এবং আম্বিয়া-ই-কিরামের সুবিস্তৃত ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। ১৪ খণ্ডে সমাপ্ত এই বৃহৎ গ্রন্থটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় একটি ইতিহাস গ্রন্থ। লেখক গ্রন্থটি তিন ভাগে বিভক্ত করে রচনা করেছেন।

গ্রন্থের প্রথম ভাগে সৃষ্টি জগতের তত্ত্ব-রহস্যাবলী, আদম (আ) থেকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত আম্বিয়া-ই-কিরামের ধারাবাহিক আলোচনা, বনী ইসরাঈল ও আইয়ামে জাহেলিয়াতের ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে নবী করীম (সা)-এর ওফাতের পর থেকে ৭৬৮ হিজরী পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য খলীফা, রাজা-বাদশাহগণের উত্থান-পতনের ঘটনা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক বিষয়াবলীর সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ, কিয়ামতের আলামতসমূহ, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদির বিশদ বিবরণ। তাই ইসলামের ইতিহাস চর্চাকারীদের জন্য গ্রন্থটি দিক-নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

গ্রন্থটির গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলদেশ সবগুলো খণ্ড অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে গ্রন্থটির ৯ খণ্ডের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সুবিধার্থে ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’র বাংলা নামকরণ করা হয়েছে ‘ইসলামের ইতিহাসঃ আদি-অন্ত’। গ্রন্থটির অনুবাদ ও সম্পাদনার সাথে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের সবাইর প্রতি রইলো আমাদের আন্তরিক মোবারকবাদ।

গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ড ২০০১ সালে অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এর সকল কপি ফুরিয়ে যায়। ব্যাপক পাঠকচাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমানে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হলো।

আমরা আশা করি বইটি পূর্বের মতোই পাঠক মহলে সমাদৃত হবে। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টা কবুল করুন!

মোহাম্মদ আবদুর রব

পরিচালক, প্রকাশনা বিভাগ

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

হযরত মূসা (আ)-এর পরবর্তী বনী-ইসরাঈলের নবীগণের বিবরণ
যেসব ইতিহাসবিদ ও আলিম প্রাচীন ইতিহাসের চর্চা করেছেন, তাঁদের সর্ববাদীসম্মত মতে, ইউশা (আ)-এর পরে কালিব ইবন ইউফান্না ( كالب بن يو فنا ) বনী ইসরাঈলের নেতৃত্বে সমাসীন হন। কালিব ছিলেন মূসা (আ)-এর অন্যতম শিষ্য এবং তাঁর বোন মরিয়মের স্বামী। ঐ যুগে আল্লাহ ভীরু ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন ইউশা ও কালিব। বনী ইসরাঈল যখন জিহাদে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল তখন এ দু’ব্যক্তি তাদের উদ্দেশ্য বলেছিলেনঃ

( ٱدۡخُلُوا۟ عَلَیۡهِمُ ٱلۡبَابَ فَإِذَا دَخَلۡتُمُوهُ فَإِنَّكُمۡ غَـٰلِبُونَۚ وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوۤا۟ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ )

[Surat Al-Ma'idah 23]

অর্থাৎ, তোমরা তাদের মুকাবিলা করে দ্বারে প্রবেশ কর, প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে আর তোমরা মুমিন হলে আল্লাহর উপরই নির্ভর কর। (মায়িদাঃ ২৩)

ইবন জারীর বলেন, কালিবের পরে বনী ইসরাঈলের পরিচালক হন হিযকীল ইবন ইউযী ( حز قيل بن يوذى )। ইনি হচ্ছেন সেই হিযকীল যিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করার ফলে আল্লাহ্ ঐ সব মৃত লোকদের জীবিত করে দিয়েছিলেন, যারা সংখ্যায় হাজার-হাজার হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু-ভয়ে নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

হিযকীল (আ)-এর বিবরণ
আল্লাহর বাণীঃ

( أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِینَ خَرَجُوا۟ مِن دِیَـٰرِهِمۡ وَهُمۡ أُلُوفٌ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِ فَقَالَ لَهُمُ ٱللَّهُ مُوتُوا۟ ثُمَّ أَحۡیَـٰهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلنَّاسِ وَلَـٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا یَشۡكُرُونَ )

[Surat Al-Baqarah 243]

অর্থাৎ, তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা মৃত্যু-ভয়ে হাজারে-হাজারে তাদের আবাস ভূমি ত্যাগ করেছিল? তারপর আল্লাহ্ তাদেরকে বলেছিলেন, “তোমাদের মৃত্যু হোক।” তারপর আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (২ বাকারাঃ ২৪৩)

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ওহাব ইবন মুনাব্বিহ্ সূত্রে বর্ণনা করেছেনঃ ইউশার মৃত্যুর পর কালিব ইবন ইউফান্না বনী-ইসরাঈলের নেতা হন এবং তাঁর ইন্তিকালের পর হিযকীল ইবন ইউযী বনী ইসরাঈলের পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই হিযকীল ইবনুল আজুয তথা বৃদ্ধার পুত্ররূপে পরিচিত, যার দোয়ায় আল্লাহ্ সে সব মৃত লোকদেরকে জীবিত করে দিয়েছিলেন, যাদের ঘটনা পূর্বোক্ত আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, এসব লোক মহামারীর ভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং এক প্রান্তরে উপনীত হয়। আল্লাহ বললেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। ফলে তারা সকলেই তথায় মারা যায়। অবশ্য তাদের লাশগুলো হিংস্র জন্তুর কবল থেকে রক্ষা করার জন্য বেষ্টনীর ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়। একদা হযরত হিযকীল তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি থমকে দাঁড়ান ও চিন্তা করতে থাকেন। এ সময় একটি গায়েবী আওয়াজের মাধ্যমে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আল্লাহ্ এ মৃত লোকগুলোকে তোমার সম্মুখে জীবিত করে দেন তা কি তুমি চাও?’ হিকীল বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ।’ এরপর তাঁকে বলা হল, ‘তুমি হাড়গুলোকে আদেশ কর, যাতে সেগুলো গোশত দ্বারা আবৃত হয় এবং শিরাগুলো যেন পরস্পর সংযুক্ত হয়ে যায়।’ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হিযকীল হাড়গুলোকে সে আহ্বান করার সাথে সাথে লাশগুলো সবই জীবিত হয়ে গেল এবং সমস্বরে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করল।

আসবাত ঐতিহাসিক সুদ্দী থেকে বিভিন্ন সূত্রে ইবন আব্বাস, ইবন মাসউদ প্রমুখ সাহাবী থেকে উপরোক্ত আয়াতে উল্লিখিত ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেনঃ ওয়াসিত এর নিকটে অবস্থিত একটি জনপদের নাম ছিল দাওয়ার-দান ( داور دان ) এ জনপদে একবার ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয়। এতে সেখানকার অধিকাংশ লোক ভয়ে পালিয়ে যায় এবং পার্শ্ববর্তী এক এলাকায় অবস্থান করে। জনপদে যারা থেকে গিয়েছিল তাদের কিছু সংখ্যক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়; কিন্তু বেশির ভাগ লোকই বেঁচে যায়। মহামারী চলে যাওয়ার পর পালিয়ে যাওয়া লোকজন জনপদে ফিরে আসে। জনপদে থেকে যাওয়া লোকদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল তারা পরস্পর বলাবলি করল যে, আমাদের যেসব ভায়েরা এলাকা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল তারাই বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের মত যদি আমরাও চলে যেতাম তবে সবাই বেঁচে থাকতাম। পুনরায় যদি এ রকম মহামারী আসে তবে আমরাও তাদের সাথে চলে যাব। পরবর্তী বছর আবার মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এবার জনপদ শূন্য করে সবাই বেরিয়ে গেল এবং পূর্বের স্থানে গিয়ে অবস্থান নিল। সংখ্যায় এরা ছিল তেত্রিশ হাজার বা তার চাইতে কিছু বেশি। যে স্থানে তারা সমবেত হয়, সে স্থানটি ছিল একটি প্রশস্ত উপত্যকা। তখন একজন ফিরিশতা উপত্যকাটির নীচের দিক থেকে এবং আর একজন ফিরিশতা উপত্যকাটির উপর দিক থেকে আওয়াজ দিয়ে বললেন, “তোমাদের মৃত্যু হোক”। আগে যে সমস্ত লোক মারা গেল, তাদের মৃত দেহগুলো সেখানে পড়ে থাকল। একদা নবী হিযকীল ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে গেলেন, গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন এবং আপন মুখের চোয়াল ও হাতের আঙ্গুল মুচড়াতে থাকলেন। এ অবস্থায় আল্লাহ তাঁর নিকট ওহী পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হিযকীল! তুমি কি দেখতে চাও, আমি কিভাবে এদেরকে পুনরায় জীবিত করি?’ হিযকীল বললেন ‘জী হাঁ, আমি তা দেখতে চাই।’ বস্তুত তিনি এখানে দাঁড়িয়ে এই বিষয়েই চিন্তামগ্ন ছিলেন এবং আল্লাহর শক্তি প্রত্যক্ষ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁকে বলা হল, ‘তুমি আহ্বান কর।’ তিনি আহ্বান করলেন, ‘হে অস্থিসমূহ! আল্লাহ তোমাদেরকে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ দেখা গেল, যার যার অস্থি উড়ে উড়ে পরস্পর সংযুক্ত হয়ে কংকালে পরিণত হয়েছে। তাকে পুনরায় বলা হল, ‘আহ্বান কর।’ তিনি আহ্বান করলেন, “হে অস্থিসমূহ! আল্লাহ তোমাদের কংকালগুলো গোশত ইত্যাদি দ্বারা আবৃত করার নির্দেশ দিয়েছেন।” দেখা গেল, কংকালগুলো মাংস দ্বারা আবৃত হয়ে তাতে শিরা-উপশিরা চালু হয়ে গিয়েছে এবং যে কাপড় পরিহিত অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছিল, সে কাপড়গুলোই তাদের দেহে শোভা পাচ্ছে। এরপর হিযকীলকে বলা হল, ‘আহ্বান কর।’ তিনি আহ্বান করলেন, “হে দেহসমূহ! আল্লাহর হুকুমে দাঁড়িয়ে যাও!” সাথে সাথে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। আসবাত বলেন, মনসুর মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, লোকগুলো জীবিত হয়ে এ দোয়াটি পাঠ করেঃ

سبحانك اللهم وبحمدك لا اله الا انت

অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি অতি পবিত্র-মহান, যাবতীয় প্রশংসা আপনার, আপনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই

এরপর তারা জনপদে আপন সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে যায়। জনপদের অধিবাসীরা দেখেই তাদেরকে চিনতে পারল যে, এরাই ঐসব লোক, যারা আকস্মিকভাবে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিল। তবে যে কাপড়ই তারা পরিধান করতেন, তাই পুরনো হয়ে যেতো। এরপর এ অবস্থায়ই নির্ধারিত সময়ে তাদের সকলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এদের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, এদের সংখ্যাটি চার হাজার; অপর বর্ণনা মতে আট হাজার; আবু সালিহ্ এর মতে নয় হাজার; ইবন আব্বাস (রা)-এর আপার এক বর্ণনা মতে চল্লিশ হাজার। সাঈদ ইবন আবদুল আযীয তাদের সম্বন্ধে বলেছেন, তারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি জাতি। ইবন জুরায়জ আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, শত সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও যে কেউ তাকদীর লিখন খণ্ডাতে পারে না, এটা তারই এক রূপক দৃষ্টান্ত। কিন্তু অধিকাংশ আলিমের মতে এটা ছিল একটি বাস্তব ঘটনা।

ইমাম আহমদ এবং বুখারী ও মুসলিম (র) ..... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা) সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সারাগ ( سرغ ) নামক স্থানে পৌঁছলে আবু উবায়দা ইবন জাররাহ (রা) ও তার সঙ্গী সেনাধ্যক্ষগণ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে জানান যে, সিরিয়ায় বর্তমানে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ সংবাদ শুনে সম্মুখে অগ্রসর হবেন কিনা সে বিষয়ে পরামর্শের জন্যে তিনি মুহাজির ও আনসারদের সাথে বৈঠকে বসেন। আলোচনায় তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। এমন সময় আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা) এসে তথায় উপস্থিত হন। তার কোন এক প্রয়োজনে তিনি প্রথমে পরামর্শ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমার একটা হাদীস জানা আছে। আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছিঃ যদি কোন এলাকায় মহামারী দেখা দেয়, আর পূর্ব থেকেই তোমরা সেখানে অবস্থানরত থাক, তাহলে মহামারীর ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সে এলাকা ত্যাগ করো না। আর যদি কোন অঞ্চলে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ পাও এবং তোমরা সে অঞ্চলের বাইরে থাক, তবে সে দিকে অগ্রসর হয়ো না।

হাদীসটি শোনার পর হযরত উমর (রা) আল্লাহর শোকর আদায় করেন এবং মদীনায় ফিরে আসেন। ইমাম আহমদ...... আবদুল্লাহ ইবন ‘আমির ইবন রাবীআ থেকে বর্ণনা করেন যে, আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা) সিরিয়ায় হযরত উমর (রা)-কে রাসূল (সা)-এর হাদীস শুনিয়ে বলেছিলেনঃ “এই মহামারী দ্বারা পূর্ববর্তী যুগের উম্মতদেরকে শাস্তি দেয়া হত; সুতরাং কোন এলাকায় মহামারী বিস্তারের সংবাদ শুনতে পেলে সেখানে তোমরা প্রবেশ করবে না; কিন্তু কোন স্থানে তোমাদের অবস্থানকালে যদি মহামারী দেখা দেয় তাহলে ভয়ে সে স্থান ত্যাগ করবে না।” এ কথা শোনার পর হযরত উমর (রা) সিরিয়া থেকে ফিরে আসেন।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, হিযকীল (আ) বনী-ইসরাঈলের মধ্যে কত কাল অবস্থান করেছিলেন, সে সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। যা হোক, কোন এক সময়ে আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর নিকট উঠিয়ে নেন। হিযকীলের মৃত্যুর পর বনী-ইসরাঈলরা আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকারের কথা বেমালুম ভুলে যায়। ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ'আতের প্রসার ঘটে। তারা মূর্তি পূজা আরম্ভ করে। তাদের এক উপাস্য দেব-মূর্তির নাম ছিল বা'আল ( بعل )। অবশেষে আল্লাহ তাদের প্রতি একজন নবী প্রেরণ করেন। তাঁর নাম ছিল ইলিয়াস ইবন ইয়াসীন ইবন ফিনহাস ইবন ঈযার ইবন হারূন ইবন ইমরান। ইতিপূর্বে আমরা হযরত খিযির (আ)-এর আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত ইলিয়াস (আ)-এর আলোচনা করে এসেছি। কেননা, বিভিন্ন স্থানে সাধারণত তাদের উল্লেখ প্রায় এক সাথে করা হয়ে থাকে। তাছাড়া সূরা সাফফাতে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা উল্লেখ করার পর ইলিয়াস (আ)-এর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে তাঁর সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করে এসেছি। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ওহব ইবন মুনাব্বিহ (র) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইলিয়াসের পর তাঁরই উত্তরাধিকারী হযরত আল-য়াসা ( اليسع ) ইবন আখতুব বনী ইসরাঈলের প্রতি নবীরূপে প্রেরিত হন।

হযরত আল-য়াসা' (আ)-এর বিবরণ
আল্লাহ তা'আলা আল-য়াসাআ-এর নাম অন্যান্য নবীর নামের সাথে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। সূরা আনআমে বলা হয়েছেঃ

( وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَٱلۡیَسَعَ وَیُونُسَ وَلُوط اۚ وَكُلّ ا فَضَّلۡنَا عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surat Al-An'am 86]

অর্থঃ আরও সৎ পথে পরিচালিত করেছিলাম ইসমাঈল, আল-য়াসা'আ, ইউনুস ও লূতকে; এবং শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম বিশ্ব জগতের উপর প্রত্যেককে (আনআমঃ ৮৬)।

সূরা সাদ এ বলা হয়েছেঃ

( وَٱذۡكُرۡ إِسۡمَـٰعِیلَ وَٱلۡیَسَعَ وَذَا ٱلۡكِفۡلِۖ وَكُلّ مِّنَ ٱلۡأَخۡیَارِ )

[Surat Sad 48]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইসমাঈল, আল-য়াসা‘আ ও যুল-কিফুলের কথা, এরা প্রত্যেকেই ছিল সজ্জন। (৩৮ সাদঃ ৪৮)।

ইসহাক ইবন বিশর আবু হুযায়ফা.....হাসান (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইলিয়াস (আ)-এর পরে আল-য়াসা'আ ছিলেন বনী ইসরাঈলের নবী। তিনি আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তাদের মধ্যে অবস্থান করেন। বনী ইসরাঈলকে তিনি আল্লাহর আনুগত্য করার ও ইলিয়াসের শরীআতের অনুবর্তী হওয়ার আহ্বান জানান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন যান। তাঁর ইনতিকালের পর আগত বনী ইসরাঈলের বহু প্রজন্ম এ পৃথিবীতে আগমন করে। তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে বিভিন্ন প্রকার বিদ'আত ও পাপাচার সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে বহু অত্যাচারী বাদশাহর আবির্ভাব ঘটে। তারা আল্লাহর নবীগণকে নির্বিচারে হত্যা করে। এদের মধ্যে একজন ছিল অত্যন্ত অহংকারী ও সীমালংঘনকারী। কথিত আছে, হযরত যুল-কিফল (আ) এই অহংকারী বাদশাহ সম্পর্কে বলেছিলেন যে, সে যদি তওবা করে ও অন্যায় কাজ ত্যাগ করে তবে আমি তার জান্নাতের যিম্মাদার। এ কারণেই তিনি যুল-কিফল বা যিম্মাদার অভিধায় অভিহিত হন।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (র) বলেছেন, আল-য়াসা'আ ছিলেন আখতূবের পুত্র। কিন্তু হাফিজ আবুল কাসিম ইবন আসাকির তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থে ‘ইয়া' ( ياء ) হরফের অধীনে লিখেছেন, আল-য়াসা'আর নাম আসবাত এবং পিতার নাম ‘আদী; বংশ তালিকা নিম্নরূপঃ

আল-য়াসাআ আসবাত ইবন আদী ইব্‌ন শূতালিম ( شوتلم ) ইবন আফরাঈম ( افر ائيم ) ইবন ইউসুফ ইবন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ)। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন হযরত ইলিয়াস (আ)-এর চাচাত ভাই। কথিত আছে, হযরত আল-য়াসা‘আ হযরত ইলিয়াসের সাথে কাসিয়ূন ( قاسيون ) নামক পর্বতে বা‘লা-বাক্কা বাদশাহর ভয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। পরে উভয়ে সেখান থেকে আপন সম্প্রদায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর ইলিয়াস (আ) ইনতিকাল করলে আল-য়াসা'আ (আ) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং আল্লাহ তাঁকে নবুওত দান করেন। আবদুল মুন‘ইম ইবন ইদরীস তাঁর পিতার সূত্রে ওহাব ইবন মুনাব্বিহ থেকে এই তথ্য প্রদান করেছেন। অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেছেন যে, তিনি বানিয়াসে ( بانياس ) বসবাস করতেন। ইবন আসাকির আল-য়াসা'আ শব্দের বানান সম্পর্কে লিখেছেন, এ শব্দটি তিন প্রকারে উচ্চারিত হয়ে থাকে যথাঃ আল-আসা‘আ ( اليسع ) আল-য়াসা আল-য়াস( اليسع ) এবং আল- লায়াসা'আ ( الليسع )। এটা হচ্ছে একটা নবীর নামের বিভিন্নরূপ। গ্রন্থকার বলেন, আমরা হযরত আইয়ুব (আ)-এর আলোচনার পরে যুল-কিফল সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছি। কারণ কথিত আছে, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব (আ)-এর পুত্র।

পরিচ্ছেদ
ইবন জারীর ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, উপরোক্ত ঘটনার পর বনী-ইসরাঈলের মধ্যে অনেক গুরুতর ঘটনা ঘটে এবং অপরাধ সংঘটিত হয়। এমনকি বহু নবীকে তারা হত্যা করে। আল্লাহ তখন নবীগণের পরিবর্তে অত্যাচারী রাজা-বাদশাদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন। যারা তাদের উপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালায় এবং নির্বিচারে তাদেরকে হত্যা করে। এছাড়া আল্লাহ তাদেরকে শক্রদের পদানত করে দেন। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈল যখন কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হত তখন তাদের ঐতিহাসিক সিন্দুকটি ( তাবূত) কাছে রাখত এবং যুদ্ধের ময়দানে একটি তাঁবুর মধ্যে তা সংরক্ষণ করত। এই সিন্দুকের বরকতে আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করতেন। এ ছিল তাদের সেই পবিত্র সিন্দুক যাতে ছিল হযরত মূসা ও হারূন (আ)-এর উত্তরসূরীদের পরিত্যক্ত বরকতময় সম্পদ ও শান্তিদায়ক বস্তু সমূহ। কিন্তু বনী ইসরাঈলের এই বিপর্যয়কালে গাজা ও ‘আসকালান এলাকার অধিবাসীদের [এখানে আমালিকাদেরকে বুঝানো হয়েছে।] সাথে তাদের এক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বনী ইসরাঈলরা পরাজয় বরণ করে। শত্রুরা বনী ইসরাঈলদের উপর নিষ্পেষণ চালিয়ে তাদের থেকে সিন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বনী ইসরাঈলের তৎকালীন বাদশাহর নিকট এ সংবাদ পৌঁছলে তার ঘাড় বেঁকে যায় এবং দুঃখে-ক্ষোভে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় বনী ইসরাঈলের অবস্থা দাঁড়ায় রাখাল বিহীন মেষপালের মত। বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে তারা যাযাবরের ন্যায় জীবন কাটাতে থাকে। দীর্ঘদিন এ অবস্থায় থাকার পর আল্লাহ শামুয়েল ( شمويل ) নবীকে তাদের মধ্যে প্রেরণ করেন। এবার তারা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে একজন বাদশাহ নিযুক্ত করার জন্যে নবীর নিকট প্রার্থনা করে। এর পরের ঘটনা আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন; আমরা পরে তা আলোচনা করব। ইবন জারীর বলেন, ইউশা ইবন নুনের ইনতিকালের ৪৬০ বছর পর আল্লাহ শামুয়েল ইবন বালীকে নবীরূপে প্রেরণ করেন। ইবন জারীর বনী-ইসরাঈলের এই সময়কার বিস্তারিত আলোচনা প্রসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সকল বাদশাহর বিবরণ দিয়েছেন। আমরা সে আলোচনা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিরত রইলাম।

শামুয়েল নবীর বিবরণ
শামুয়েল (আ)-এর বংশপঞ্জী নিম্নরূপঃ শামুয়েল বা ইশমুঈল ( اشمويل ) ইবন বালী ইবন আলকামা ইবন ইয়ারখাম ( يرخام ) ইবন আল ইয়াহু ( اليهو ) ইবন তাহূ ইবন সূফ ইবন ‘আলকামা ইবন মাহিছ ইবন ‘আমূসা ইবন ‘আযরুবা। মুকাতিল বলেছেন যে, তিনি ছিলেন হারূন (আ)-এর বংশধর। মুজাহিদ বলেছেন যে, তাঁর নাম ছিল ইশমুঈল ইবন হালফাকা। তাঁর পূর্ববর্তী বংশ তালিকা তিনি উল্লেখ করেননি। সুদ্দি ইবন আব্বাস ইবন মাসউদ প্রমুখ কতিপয় সাহাবী থেকে এবং ছালাবী ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ এ প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, গাজা ও ‘আসকালান এলাকার অধিবাসী আমালিকা সম্প্রদায় বনী ইসরাঈলের উপর বিজয় লাভ করে। এরা তাদের অসংখ্য লোককে হত্যা করে এবং বিপুল সংখ্যক লোককে বন্দী করে নিয়ে যায়। তারপর লাবী বংশের মধ্যে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত নবী প্রেরণ বন্ধ থাকে। এ সময়ে তাদের মধ্যে মাত্র একজন মহিলা গর্ভবতী ছিল। সে আল্লাহর নিকট একজন পুত্র সন্তানের প্রার্থনা করে। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন এবং একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। মহিলা তার নাম রাখেন ইশমুঈল। ইবরানী বা হিব্রু ভাষায় ইশমুঈল ইসমাঈল শব্দের সমার্থক। যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন। পুত্রটি বড় হলে তিনি তাকে মসজিদে (বায়তুল মুকাদ্দাসে) অবস্থানকারী একজন পুণ্যবান বান্দার দায়িত্বে অর্পণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল যাতে তার পুত্র ঐ পুণ্যবান বান্দার সাহচর্যে থেকে তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী ও ইবাদত-বন্দেগী থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। ছেলেটি মসজিদেই অবস্থান করতে থাকেন। যখন তিনি পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত হন তখনকার একটি ঘটনা হচ্ছে এই যে, একদিন রাত্রিবেলা তিনি মসজিদের এক কোণে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ মসজিদের পার্শ্ব থেকে একটি শব্দ তার কানে আসে। তখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তিনি জেগে উঠন। তার ধারণা হয়, তার শায়খই তাঁকে ডেকেছেন। তাই তিনি শায়খকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?’ তিনি ভয় পেতে পারেন এই আশঙ্কায় শায়খ তাকে সরাসরি কোন উত্তর দিলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়।’ তখন তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। দ্বিতীয়বার অনুরূপ ঘটনা ঘটল। তারপর তৃতীয়বারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। তিনি দেখতে পেলেন, স্বয়ং জিব্রাঈল (আ)-ই তাঁকে ডাকছেন। জিব্রাঈল (আ) তাঁকে জানালেন যে, আল্লাহ আপনাকে আপনার সম্প্রদায়ের প্রতি নবীরূপে প্রেরণ করছেন। এরপর সম্প্রদায়ের সাথে তার যে ঘটনা ঘটে, কুরআন মজীদে আল্লাহ তার বিবরণ দিয়েছেন। আল্লাহর বাণীঃ

( أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلۡمَلَإِ مِنۢ بَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ مِنۢ بَعۡدِ مُوسَىٰۤ إِذۡ قَالُوا۟ لِنَبِیّ لَّهُمُ ٱبۡعَثۡ لَنَا مَلِك ا نُّقَـٰتِلۡ فِی سَبِیلِ ٱللَّهِۖ قَالَ هَلۡ عَسَیۡتُمۡ إِن كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ أَلَّا تُقَـٰتِلُوا۟ۖ قَالُوا۟ وَمَا لَنَاۤ أَلَّا نُقَـٰتِلَ فِی سَبِیلِ ٱللَّهِ وَقَدۡ أُخۡرِجۡنَا مِن دِیَـٰرِنَا وَأَبۡنَاۤىِٕنَاۖ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَیۡهِمُ ٱلۡقِتَالُ تَوَلَّوۡا۟ إِلَّا قَلِیل ا مِّنۡهُمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِیمُۢ بِٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ وَقَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ إِنَّ ٱللَّهَ قَدۡ بَعَثَ لَكُمۡ طَالُوتَ مَلِك اۚ قَالُوۤا۟ أَنَّىٰ یَكُونُ لَهُ ٱلۡمُلۡكُ عَلَیۡنَا وَنَحۡنُ أَحَقُّ بِٱلۡمُلۡكِ مِنۡهُ وَلَمۡ یُؤۡتَ سَعَة مِّنَ ٱلۡمَالِۚ قَالَ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰهُ عَلَیۡكُمۡ وَزَادَهُۥ بَسۡطَة فِی ٱلۡعِلۡمِ وَٱلۡجِسۡمِۖ وَٱللَّهُ یُؤۡتِی مُلۡكَهُۥ مَن یَشَاۤءُۚ وَٱللَّهُ وَ  ٰ⁠ سِعٌ عَلِیم ۝ وَقَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ إِنَّ ءَایَةَ مُلۡكِهِۦۤ أَن یَأۡتِیَكُمُ ٱلتَّابُوتُ فِیهِ سَكِینَة مِّن رَّبِّكُمۡ وَبَقِیَّة مِّمَّا تَرَكَ ءَالُ مُوسَىٰ وَءَالُ هَـٰرُونَ تَحۡمِلُهُ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُۚ إِنَّ فِی ذَ  ٰ⁠ لِكَ لَـَٔایَة لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِٱلۡجُنُودِ قَالَ إِنَّ ٱللَّهَ مُبۡتَلِیكُم بِنَهَر فَمَن شَرِبَ مِنۡهُ فَلَیۡسَ مِنِّی وَمَن لَّمۡ یَطۡعَمۡهُ فَإِنَّهُۥ مِنِّیۤ إِلَّا مَنِ ٱغۡتَرَفَ غُرۡفَةَۢ بِیَدِهِۦۚ فَشَرِبُوا۟ مِنۡهُ إِلَّا قَلِیل ا مِّنۡهُمۡۚ فَلَمَّا جَاوَزَهُۥ هُوَ وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ قَالُوا۟ لَا طَاقَةَ لَنَا ٱلۡیَوۡمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِۦۚ قَالَ ٱلَّذِینَ یَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَـٰقُوا۟ ٱللَّهِ كَم مِّن فِئَة قَلِیلَةٍ غَلَبَتۡ فِئَة كَثِیرَةَۢ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ مَعَ ٱلصَّـٰبِرِینَ ۝ وَلَمَّا بَرَزُوا۟ لِجَالُوتَ وَجُنُودِهِۦ قَالُوا۟ رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡر ا وَثَبِّتۡ أَقۡدَامَنَا وَٱنصُرۡنَا عَلَى ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَـٰفِرِینَ ۝ فَهَزَمُوهُم بِإِذۡنِ ٱللَّهِ وَقَتَلَ دَاوُۥدُ جَالُوتَ وَءَاتَىٰهُ ٱللَّهُ ٱلۡمُلۡكَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَعَلَّمَهُۥ مِمَّا یَشَاۤءُۗ وَلَوۡلَا دَفۡعُ ٱللَّهِ ٱلنَّاسَ بَعۡضَهُم بِبَعۡض لَّفَسَدَتِ ٱلۡأَرۡضُ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ ذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surat Al-Baqarah 246 - 251]

অর্থাৎ তুমি কি মূসার পরবর্তী বনী ইসরাঈলের প্রধানদেরকে দেখনি? তারা যখন তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্যে এক রাজা নিযুক্ত কর, যাতে আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি;সে বলল, এমন তো হবে না যে, তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেয়া হলে তখন আর তোমরা যুদ্ধ করবে না? তারা বলল, আমরা যখন নিজেদের আবাসভূমি ও সন্তান-সন্ততি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছি, তখন আল্লাহর পথে কেন যুদ্ধ করব না? তারপর যখন তাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেয়া হল, তখন তাদের অল্পসংখ্যক ব্যতীত সকলেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল এবং আল্লাহ জালিমদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। এবং তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল, আল্লাহ তালূতকে তোমাদের রাজা করেছেন; তারা বলল, “আমাদের উপর তার রাজত্ব কিরূপে হবে, যখন আমরা তার অপেক্ষা কর্তৃত্বের অধিক হকদার এবং তাকে প্রচুর ঐশ্বর্য দেয়া হয়নি!” নবী বলল, “আল্লাহ্ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তাঁর রাজত্ব দান করেন আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়।” আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল, তাঁর রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট সেই তাবৃত আসবে, যাতে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে চিত্ত প্রশান্তি এবং মূসা ও হারূন বংশীয়গণ যা রেখে গিয়েছে, তার অবশিষ্টাংশ থাকবে; ফেরেশতাগণ তা বহন করে আনবেন। তোমরা যদি মুমিন হও তবে অবশ্যই তোমাদের জন্যে এতে নিদর্শন আছে। তারপর তালূত যখন সৈন্যবাহিনীসহ বের হল সে তখন বলল, ‘আল্লাহ এক নদী দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন। যে কেউ তা থেকে স্বাদ গ্রহণ করবে সে আমার দলভুক্ত নয়; আর যে কেউ তার স্বাদ গ্রহণ করবে না, সে আমার দলভুক্ত; এছাড়া যে কেউ তার হাতে এক কোষ পানি গ্রহণ করবে, সে-ও। তার পর অল্প সংখ্যাক ব্যতীত তারা তা থেকে পান করল। সে এবং তার সংগী ঈমানদারগণ যখন তা অতিক্রম করল তখন তারা বলল,জালুত ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত শক্তি আজ আমাদের নেই; কিন্তু যাদের প্রত্যয় ছিল আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে, তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে! আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। তারা যখন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে জালুত ও তার সৈন্য বাহিনীর সম্মুখীন হল তখন তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ধৈর্য দান কর, আমাদের অবিচলিত রাখ এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য দান কর।’ সুতরাং তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাভূত করল। আল্লাহ তাকে রাজত্ব এবং হিকমত দান করলেন; এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ যদি মানব জাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল। (২ সূরা বাকারাঃ ২৪৬-২৫১)

অধিকাংশ মুফাসিরের মতে উপরোক্ত আয়াতে যাদের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যিনি তাদের নবী ছিলেন, তাঁর নাম শামুয়েল। কারো কারো মতে শামউন ২৪: ২৫ ( شمعون ) কেউ বলেছেন, শামুয়েল ও শামউন অভিন্ন ব্যক্তি। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সেই নবীর নাম ইউশা ( يوشع )। তবে এর সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা ইবন জারীর তাবারী লিখেছেন যে, ইউশা (আ)-এর ইন্তিকাল এবং শামুয়েল (আ)-এর নবুওত প্রাপ্তির মধ্যে চারশ' ষাট বছরের ব্যবধান ছিল।

আয়াতের দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, বনী ইসরাঈলরা যখন একের পর এক যুদ্ধে পর্যদস্ত হতে থাকল এবং শত্রুদের নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে গেল, তখন তারা সে যুগের নবীর কাছে গিয়ে তাদের জন্যে একজন বাদশাহ নিয়োগের আবেদন জানাল। যাতে তার নেতৃত্বে তারা শত্রুর মুকাবিলায় লড়াই করতে পারে। আর নবী তাদেরকে বললেনঃ

( هَلۡ عَسَیۡتُمۡ إِن كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ أَلَّا تُقَـٰتِلُوا۟ۖ قَالُوا۟ وَمَا لَنَاۤ أَلَّا نُقَـٰتِلَ فِی سَبِیلِ ٱللَّهِ وَقَدۡ أُخۡرِجۡنَا مِن دِیَـٰرِنَا وَأَبۡنَاۤىِٕنَاۖ )

[Surat Al-Baqarah 246]

অর্থাৎ, যুদ্ধ করতে আমাদেরকে কিসে বাধা দিবে? বিশেষত আমাদেরকে যখন আমাদের ঘর বাড়ি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে আর আমাদের সন্তানদেরকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমরা নির্যাতিত। আমাদের সন্তান-সন্ততি শত্রুর হাতে বন্দী। তাই এদেরকে উদ্ধার করার জন্যে আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ বলেনঃ

( فَلَمَّا كُتِبَ عَلَیۡهِمُ ٱلۡقِتَالُ تَوَلَّوۡا۟ إِلَّا قَلِیل ا مِّنۡهُمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِیمُۢ بِٱلظَّـٰلِمِینَ )

[Surat Al-Baqarah 246]

(কিন্তু যখন তাদেরকে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হল, তখন অতি অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া তারা সকলেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। আল্লাহ তা'আলা জালিমদেরকে ভাল করেই জানেন।) যেমন ঘটনার শেষ দিকে বলা হয়েছে যে, অল্প সংখ্যক লোকই বাদশাহর সাথে নদী অতিক্রম করে। তারা ছাড়া অবশিষ্ট সবাই যুদ্ধের ভয়ে ভীত হয়ে প্রত্যাবর্তন করে।

( وَقَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ إِنَّ ٱللَّهَ قَدۡ بَعَثَ لَكُمۡ طَالُوتَ مَلِك اۚ )

[Surat Al-Baqarah 247]

(তাদের নবী তাদেরকে বলল, আল্লাহ তালুতকে তোমাদের জন্যে বাদশাহ নিযুক্ত করেছেন।) তাফসীরবিদ ছালাবী তালুতের বংশ তালিকা লিখেছেন এইভাবেঃ তালুত ইবন কায়শ ( قيش ) ইবন আফয়াল ( افيل ) ইবন সারূ ( صارو ) ইবন তাহুরাত ( تحورت ) ইবন আফয়াহ্ ( افيح ) ইবন উনায়স ইবন বিনয়ামিন ইবন ইয়াকুব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম।

ইকরামা ও সুদ্দী (র) বলেন, তালুত পেশায় একজন ভিসতি ছিলেন। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেন, তিনি চামড়া পাকা করার কাজ করতেন। এ সম্পর্কে আরও বিভিন্ন মত রয়েছে। এ জন্যে বনী ইসরাঈলের লোকজন নবীকে বললঃ

( أَنَّىٰ یَكُونُ لَهُ ٱلۡمُلۡكُ عَلَیۡنَا وَنَحۡنُ أَحَقُّ بِٱلۡمُلۡكِ مِنۡهُ وَلَمۡ یُؤۡتَ سَعَة مِّنَ ٱلۡمَالِۚ )

[Surat Al-Baqarah 247]

অর্থাৎ, তারা বলল, এ কেমন করে হয়, আমাদের উপর বাদশাহ হওয়ার তার কি অধিকার আছে? রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার ক্ষেত্রে তার চেয়ে আমাদেরই অধিকার বেশী। সে তো কোন বড় ধনী ব্যক্তিও নয়।) ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, দীর্ঘ দিন যাবত বনী ইসরাঈলের লাও ( لاو ) শাখা থেকে নবী এবং য়াহুয়া ( يهوذا ) শাখা থেকে রাজা-বাদশাহ্ হওয়ার প্রচলন চলে আসছিল। এবার তালুত যখন বিনয়ামীমের বংশধরদের থেকে রাজা মনোনীত হলেন, তখন তারা অপছন্দ করল এবং তার নেতৃত্ব সম্পর্কে কটাক্ষ করতে আরম্ভ করল। তারা দাবী করল তালুতের তুলনায় রাজা হওয়ার অধিকার আমাদের বেশী। দাবীর সপক্ষে তারা বলল, তালুত তো একজন দরিদ্র ব্যক্তি; তার তো যথেষ্ট অর্থ সম্পদ নেই। এমন লোক কিভাবে রাজা হতে পারে? নবী বললেন,

قَالَ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰهُ عَلَیۡكُمۡ وَزَادَهُۥ بَسۡطَة فِی ٱلۡعِلۡمِ وَٱلۡجِسۡمِۖ

(আল্লাহ তোমাদের উপর তাকেই মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞান উভয় দিকের যোগ্যতা তাকে প্রচুর দান করেছেন।) কথিত আছে, আল্লাহ শামুয়েল নবীকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে যে ব্যক্তি (তোমার হাতের) এ লাঠির সমান দীর্ঘকায় হবে এবং যার আগমনে (তোমার কাছে রক্ষিত) শিং এর মধ্যে রাখা পবিত্র তেল ( دهن القدس ) উথলে উঠবে, সে ব্যক্তিই হবে তাদের রাজা।

এরপর বনী ইসরাঈলের লোকজন এসে উক্ত লাঠির সাথে নিজেদেরকে মাপতে থাকে। কিন্তু তালুত ব্যতীত অন্য কেউ-ই লাঠির মাপে টিকেনি। তিনি নবীর নিকট উপস্থিত হতেই শিং এর তেল উথলে উঠল। নবী তাকে সেই তেল মাখিয়ে দিলেন এবং বনী ইসরাঈলের রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ

وَٱللَّهُ یُؤۡتِی مُلۡكَهُۥ مَن یَشَاۤءُۚ وَٱللَّهُ وَ  ٰ⁠ سِعٌ عَلِیم

(আল্লাহ তাকে তোমাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন।) জ্ঞানের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির বিষয়ে কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর এ সমৃদ্ধি কেবল যুদ্ধের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কারও কারও মতে এ সমৃদ্ধি সার্বিকভাবে এবং সকল ক্ষেত্রে। অনুরূপ দেহের সমৃদ্ধির ব্যাপারে কেউ বলেছেন, তিনি সবার চেয়ে দীর্ঘ ছিলেন। আবার কারো কারো মতে, তিনি সবার চেয়ে সুদর্শন ছিলেন। তবে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় যে, নবীর পরে তালুতই ছিলেন বনী ইসরাঈলের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ও সুদর্শন ব্যক্তি।

وَٱللَّهُ یُؤۡتِی مُلۡكَهُۥ مَن یَشَاۤءُۚ

(বস্তুত আল্লাহ যাকে চান তাকেই তাঁর রাজ্য দান করেন।) কেননা তিনিই মহাজ্ঞানী এবং সৃষ্টির উপর হুকুম চালাবার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই আছে।

وَٱللَّهُ وَ  ٰ⁠ سِعٌ عَلِیم

(আল্লাহ হলেন অনুগ্রহ দানকারী এবং সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।)

( وَقَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ إِنَّ ءَایَةَ مُلۡكِهِۦۤ أَن یَأۡتِیَكُمُ ٱلتَّابُوتُ فِیهِ سَكِینَة مِّن رَّبِّكُمۡ وَبَقِیَّة مِّمَّا تَرَكَ ءَالُ مُوسَىٰ وَءَالُ هَـٰرُونَ تَحۡمِلُهُ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُۚ إِنَّ فِی ذَ  ٰ⁠ لِكَ لَـَٔایَة لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ )

[Surat Al-Baqarah 248]

অর্থাৎ, আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল, তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে সেই তাবুত আসবে, যাতে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে চিত্ত প্রশান্তি এবং মূসা ও হারূন বংশীয়গণ যা রেখে গিয়েছেন তার অবশিষ্টাংশ থাকবে। সিন্দুকটিকে ফিরিশতারা বয়ে আনবে। তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক তবে এতে অবশ্যই তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (২ সূরা বাকারাঃ ২৪৮)। তালুতের রাজত্ব পাওয়ার এটা ছিল আর একটা বরকত। বনী ইসরাঈলের নিকট বংশ পরম্পরায় যে ঐতিহাসিক সিন্দুকটি ছিল, যার ওসীলায় তারা যুদ্ধে শত্রুদের উপর জয়ী হত—বনী ইসরাঈলের বিপর্যয়কালে ঐ সিন্দুকটি শক্ররা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ অনুগ্রহ করে সেই সিন্দুকটি তালুতের মাধ্যমে বনী ইসরাঈলকে ফিরিয়ে দেন। “সেই সিন্দুকে আছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে চিত্ত প্রশান্তি।” কারও কারও মতে, তা' ছিল স্বর্ণের তস্তরী, যাতে নবীদের বক্ষ ধৌত করা হত। কেউ বলেছেন, তা হয়েছে শান্তিদায়ক প্রবহমান বায়ু। কেউ বলেছেন, সেই বস্তুটি ছিল বিড়ালের আকৃতির। যুদ্ধের সময় যখন তা' শব্দ করত তখন বনী ইসরাঈলরা বিশ্বাস করত যে, তাদের সাহায্য প্রাপ্তি সুনিশ্চিত এবং মূসা ও হারূন বংশীয়গণ যা কিছু রেখে গিয়েছে অর্থাৎ যে ফলকের উপর তাওরাত লিপিবদ্ধ ছিল, তার কিছু খণ্ড অংশ এবং তীহ্ ময়দানে তাদের উপর যে মান্না’ নাযিল হত, তার কিছু অংশ বয়ে আনবে ফেরেশতারা। অর্থাৎ তোমাদের কাছে তাদের তা’ বয়ে নিয়ে আসা তোমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। আমি তোমাদেরকে যা কিছু বলছি তার সত্যতা এবং তালুত যে নেতৃত্ব দানের অধিকারী তার সুস্পষ্ট প্রমাণ, তোমরা এ থেকে লাভ করবে। তাই আল্লাহ বলেছেনঃ (এতে তোমাদের জন্যে নিদর্শন আছে যদি তোমরা মু'মিন হয়ে থাক।)

কথিত আছে যে, আমালিকা জাতি বনী ইসরাঈলকে এক যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের নিকট থেকে এ সিন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সিন্দুকটিতে ছিল তাদের চিত্ত প্রশান্তি ও পূর্ব পুরুষদের বরকতময় কিছু স্মারক। কেউ কেউ বলেছেন, এতে তাওরাত কিতাবও ছিল। আমালিকারা এ সিন্দুকটি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের শহরের একটি মূর্তির নীচে রেখে দেয়। পরদিন সকালে তারা দেখতে পায় যে, সিন্দুকটি ঐ মূর্তির মাথার উপর বয়েছে। তারা সিন্দুকটি নামিয়ে পুনরায় মূর্তির নীচে রেখে দেয়। দ্বিতীয় দিন এসে পূর্বের দিনের ন্যায় তারা সিন্দুকটিকে মূর্তির মাথার উপরে দেখতে পায়। বারবার এ অবস্থা সংঘটিত হতে দেখে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হল যে, আল্লাহর হুকুমেই এ রকম হচ্ছে। অবশেষে তারা সিন্দুকটিকে শহর থেকে এনে একটি পল্লীতে রেখে দেয়। কিন্তু এবার হল আর এক বিপদ। গ্রামবাসীদের ঘাড়ে এক প্রকার রোগ দেখা দেয়। এ অবস্থা কিছুদিন চলতে থাকলে তারা সিন্দুকটিকে দু’টি গাভীর উপর বেঁধে বনী ইসরাঈলের বসতি এলাকার দিকে হাঁকিয়ে দেয়। গাভী দুটি সিন্দুকটিকে বয়ে নিয়ে চলতে থাকে। কথিত আছে, ফিরিশতারা গাভীকে পেছন দিক থেকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে সিন্দুকসহ গাভী দু’টি হাঁটতে হাঁটতে বনী ইসরাঈলের নেতাদের এলাকায় প্রবেশ করে। বনী ইসরাঈলকে তাদের নবী যেসব কথা বলেছিলেন, তারা সেভাবেই ঐসব কথা বাস্তবে পরিণত হতে দেখতে পায়। ফেরেশতারা সিন্দুকটি কিভাবে এনেছিলেন, তা আল্লাহই ভাল জানেন। তবে, আয়াতের শব্দ থেকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনুমিত হয় যে, ফিরিশতারা সরাসরি নিজেরাই সিন্দুক বহন করে এনে ছিলেন। অবশ্য অধিকাংশ মুফাসসির প্রথম ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ

( فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِٱلۡجُنُودِ قَالَ إِنَّ ٱللَّهَ مُبۡتَلِیكُم بِنَهَر فَمَن شَرِبَ مِنۡهُ فَلَیۡسَ مِنِّی وَمَن لَّمۡ یَطۡعَمۡهُ فَإِنَّهُۥ مِنِّیۤ إِلَّا مَنِ ٱغۡتَرَفَ غُرۡفَةَۢ بِیَدِهِ )

[Surat Al-Baqarah 249]

(অতঃপর তালুত যখন সৈন্য বাহিনীসহ বের হল, তখন সে বলল ও একটি নদীর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন। যে কেউ তা থেকে পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে কেউ এর স্বাদ গ্রহণ করবে না, সে আমরা দলভুক্ত; তাছাড়া যে কেউ তার হাতে এক কোষ পানি গ্রহণ করবে সেও। (২ বাকারাঃ ২৪৯)

ইব্‌ন আব্বাসসহ বহু মুফাসসির বলেছেন, সেই নদীটি হল জর্দান নদী। একে ‘শারীয়া নামে অভিহিত করা হয়। আল্লাহর নির্দেশক্রমে ও নবীর হুকুম অনুযায়ী সৈন্য বাহিনীকে পরীক্ষা করার জন্যে তালুত এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন যে, যে লোক এ নদী থেকে পানি পান করবে সে আমার সাথে এই যুদ্ধে যেতে পারবে না। আমার সাথে কেবল সেই যেতে পারবে, যে আদৌ তা পান করবে না কিংবা মাত্র এক কোষ পানি পান করবে। এরপর আল্লাহ বলেন, কিন্তু একটি ক্ষুদ্র দল ব্যতীত আর সকলেই তা থেকে পান করে। সুদ্দী বলেন, তালুতের সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা ছিল আশি হাজার। তাদের মধ্য থেকে পানি পান করেছিল ছিয়াত্তর হাজার। অবশিষ্ট চার হাজার সৈন্য তার সাথে ছিল। ইমাম বুখারী তাঁর ‘সহীহ' গ্রন্থে বারা ইবন আযিব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমরা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী কয়েকজন বসে আলাপ করছিলাম যে, বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের সংখ্যা তালুত বাহিনীর যারা নদী পার হয়েছিল তাদের সমান। তালুতের সাথে যারা নদী পার হয়েছিল, তাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’ দশের কিছু বেশী। সুদ্দী যে তালুত বাহিনীর সংখ্যা আশি হাজার বলেছেন, তা সন্দেহমুক্ত নয়। কেননা বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকাটিতে আশি হাজার লোকের যুদ্ধ করার মত অবস্থা ছিল না। আল্লাহর বাণীঃ

( فَلَمَّا جَاوَزَهُۥ هُوَ وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ قَالُوا۟ لَا طَاقَةَ لَنَا ٱلۡیَوۡمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ )

[Surat Al-Baqarah 249]

(এরপর তালুত এবং তার সহযাত্রী মুমিনগণ যখন তা অতিক্রম করল তখন তারা বললঃ জালুত ও তার সৈন্য বাহিনীর সহিত মুকাবিলা করার কোন শক্তিই আজ আমাদের নেই।) অর্থাৎ শত্রু সংখ্যা অধিক হওয়ায় এবং সে তুলনায় নিজেদের সংখ্যা কম থাকায় তারা মুকাবিলা করতে অক্ষমতা প্রকাশ করছিল। কিন্তু যাদের প্রত্যয় ছিল আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে, তারা বললঃ বারবার দেখা গেছে যে, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। এই দলের মধ্যে একটি অংশ ছিল অশ্বারোহী বাহিনী এবং তারাই ছিল ঈমানদার ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে অসীম ধৈর্যশীল।

( وَلَمَّا بَرَزُوا۟ لِجَالُوتَ وَجُنُودِهِۦ قَالُوا۟ رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡر ا وَثَبِّتۡ أَقۡدَامَنَا وَٱنصُرۡنَا عَلَى ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَـٰفِرِینَ )

[Surat Al-Baqarah 250]

অর্থাৎ, তারা যখন যুদ্ধের উদ্দেশ্য জালুত ও তার সৈন্য বাহিনীর সম্মুখীন হল, তখন তারা বললঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান করুন, আমাদের সুদৃঢ় করে দিন এবং এই কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য দান করুন। তারা আল্লাহর নিকট প্রর্থনা করে যেন তিনি তাদের ধৈর্য দান করেন। (২ বাকারাঃ ২৫০) অর্থাৎ ধৈর্য যেন তাদেরকে এমনভাবে বেষ্টন করে রাখে, যাতে অন্তরের মধ্যে দৃঢ়তা আসে, কোন প্রকার সংশয় মনে না জাগে। তারা আল্লাহর নিকট দু'আ করে যেন তারা যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদে শত্রুর মুকাবিলা করে বাতিল শক্তিকে পর্যুদস্ত করতে পারে এবং বিজয় লাভে ধন্য হতে পারে। এভাবে তারা বাহ্যিক দিক থেকে এবং অভ্যন্তরীণভাবে মজবুত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অস্বীকারকারী কাফির দুশমনদের মুকাবিলায় তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। ফলে সর্বশক্তিমান, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, মহাজ্ঞানী ও নিগুঢ় তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন ও তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় দান করেন। এজন্য আল্লাহ বলেনঃ

فَهَزَمُوهُم بِإِذۡنِ ٱللَّهِ

(শেষ পর্যন্ত ঈমানদাররা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করে দিল)। অর্থাৎ শত্রু বাহিনী সংখ্যায় অধিক হওয়া সত্ত্বেও তালুত বাহিনী বিজয় লাভে সমর্থ হল। কেবলমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহে এবং তারই প্রদত্ত শক্তি ও সাহায্য বলে তাদের নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য দ্বারা নয়। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন।

( وَلَقَدۡ نَصَرَكُمُ ٱللَّهُ بِبَدۡر وَأَنتُمۡ أَذِلَّة ۖ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ )

[Surat Aal-E-Imran 123]

অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদেরকে বদরের যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন যখন তোমরা হীনবল ছিলে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (৩ আল ইমরানঃ ১২৩)।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَقَتَلَ دَاوُۥدُ جَالُوتَ وَءَاتَىٰهُ ٱللَّهُ ٱلۡمُلۡكَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَعَلَّمَهُۥ مِمَّا یَشَاۤءُ )

[Surat Al-Baqarah 251]

এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করল। আল্লাহ দাঊদকে রাজ্য ও হিকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। (২ বাকারাঃ ২৫১)

এ ঘটনা থেকে হযরত দাউদ (আ)-এর বীরত্ব প্রমাণিত হয়। এ যুদ্ধে তিনি এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেন যার নিহত হওয়ার কারণে শত্রু বাহিনী পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বস্তুত যে যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর রাজাই নিহত হয়, বিপুল পরিমাণ গনীমত সম্ভার হস্তগত হয়, এবং সাহসী যোদ্ধারা বন্দী হয়ে যায়, ইসলামের বিজয় কেতন দেব মূর্তিদের উপরে বুলন্দ হয়, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সবাই তার শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পালা আসে এবং বাতিল দীন ও বাতিল পন্থীদের উপর সত্য দীন বিজয় লাভ করে তার চাইতে গৌরবের বিষয় আর কি হতে পারে? সুদ্দী বলেনঃ হযরত দাউদ (আ) ছিলেন পিতার তেরজন পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তিনি শুনতে পান যে, বনী ইসরাঈলের রাজা তালুত, জালুত ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বনী ইসরাঈলকে সংগঠিত করছেন এবং তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি জালুতকে হত্যা করতে পারবে তার সাথে তার কন্যাকে বিবাহ দিবেন এবং রাজ্য পরিচালনায় তাকে শ করবেন। দাউদ (আ) ছিলেন একজন তীরান্দাজ। তিনি নিক্ষেপক যন্ত্রে পাথর রেখেও নিক্ষেপ করতেন। বনী ইসরাঈলরা যখন জালূতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গমন করে তখন দাঊদ (আ) ও তাদের অভিযানে শরীক হন। গমন পথে একটি পাথর তাকে ডেকে বলল, আমাকে তুলে নিন। আমার দ্বারা আপনি জালূতকে হত্যা করতে পারবেন। দাউদ (আ) পাথরটি তুলে নেন। কিছুদূর গেলে দ্বিতীয় আর একটি পাথর এবং আরও কিছু দূর অগ্রসর হলে তৃতীয় আরও একটি পাথর একইভাবে দাউদ (আ)-কে ডেকে তুলে নিতে বলে। দাউদ (আ) তিনটি পাথরই উঠিয়ে নেন এবং থলের মধ্যে রেখে দেন। যুদ্ধের ময়দানে দুই বাহিনী যখন ব্যুহ রচনা করে পরস্পর মুখখামুখী হয় তখন জালুত সৈন্যব্যুহ থেকে বেরিয়ে এসে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানায়। আহ্বানে সাড়া দিয়ে হযরত দাউদ (আ) সম্মুখে অগ্রসর হন। কিন্তু তাঁকে দেখে জালূত বলল, ‘তুমি ফিরে যাও। কেননা, তোমার মত লোককে হত্যা করতে আমি ঘৃণবোধ করি।’ দাউদ (আ) বললেন, ‘তবে তোমাকে আমি বধ করতে খুবই আগ্রহী।’ এ কথা বলে তিনি পাথর তিনটিকে থলের মধ্যে রেখে ঘুরাতে আরম্ভ করলেন। ঘুরাবার ফলে তিনটি পাথর পরস্পর মিলিত হয়ে একটি পাথরে পরিণত হয়। এবার এ পাথরটিকে তিনি জালূতের দিকে সজোরে নিক্ষেপ করেন। পাথরটি জালূতের মাথায় গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে জালূতের সৈন্য বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। তালূত তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁর কন্যাকে দাউদ (আ)-এর সাথে বিবাহ দেন এবং রাজ্যে তার শাসন চালু করেন।

অতি অল্প দিনের মধ্যেই বনী ইসরাঈলের নিকট দাউদ (আ)-এর উচ্চ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তালূতের চেয়ে তারা দাঊদ (আ)-কেই অগ্রাধিকার দিতে থাকে। কথিত আছে যে, এতে তালূতের অন্তরে হিংসার আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠে এবং তিনি দাউদকে হত্যার প্রয়াস পান এবং তার সুযোগ খুঁজতে থাকেন; কিন্তু তিনি তাতে সফল হননি। দাউদ (আ)-কে হত্যা করার উদ্যোগ নিলে সমাজের আলিমগণ তালূতকে এ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার পরামর্শ দেন এবং তাকে বাধা প্রদান করতে থাকেন। এতে তালুত ক্রুদ্ধ হয়ে আলিমদের উপর অত্যাচার চালান এবং মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত সবাইকে হত্যা করেন। কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর এই কৃতকর্মের জন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করেন। অধিকাংশ সময় তিনি কান্নাকাটি করে কাটাতেন। রাত্রিকালে গোরস্তানে গিয়েও কান্নাকাটি করতে থাকেন। কোন কোন সময় তাঁর চোখের পানিতে মাটি পর্যন্ত ভিজে যেত। এ সময়ে এক রাত্রে একটি ঘটনা ঘটে। তাত গোরস্তানে বসে কাঁদছেন। হঠাৎ কবর থেকে একটি শব্দ ভেসে এল। “হে তালুত! তুমি আমাদেরকে হত্যা করেছিলে, কিন্তু আমরা জীবিত। তুমি আমাদেরকে যাতনা দিয়েছিলে। কিন্তু আমরা এখন মৃত।” এতে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং আরও বেশী করে কাঁদতে লাগলেন। তিনি লোকজনের কাছে এমন একজন আলিমের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন, যার নিকট তিনি তার অবস্থা এবং তাঁর তওবা কবুল হবে কিনা জিজ্ঞেস করবেন। লোকেরা জবাব দিল, আপনি কি কোন আলিমকে অবশিষ্ট রেখেছেন? বহু চেষ্টার পর একজন পুণ্যবতী মহিলার সন্ধান মিলল। মহিলাটি তালুতকে হযরত ইউশা নবীর কবরের কাছে নিয়ে গেলেন এবং ইউশাকে জীবিত করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানালেন। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবূল করলেন।

হযরত ইউশা কবর থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং কিয়ামত হয়ে গেছে কি না জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে মহিলাটি বললেন, ‘কিয়ামত হয়নি। তবে ইনি হচ্ছেন তালূত। তিনি আপনার কাছে জানতে চান যে, তাঁর তওবা কবূল হবে কিনা?’ ইউশা (আ) বললেন,‘হ্যাঁ, তওবা কবুল হবে। তবে শর্ত হল, তাঁকে বাদশাহী ত্যাগ করে শাহাদত লাভের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর পথে যুদ্ধে রত থাকতে হবে।’ এ কথাগুলো বলার সাথে সাথেই ইউশা (আ) পুনরায় ইন্তিকাল করেন। অতঃপর তালুত হযরত দাউদ (আ)-এর নিকট রাজ্য হস্তান্তর করে চলে যান। সাথে ছিল তাঁর তেরজন পুত্র। সকলেই আল্লাহর পথে জিহাদ করতে থাকেন এবং জিহাদের ময়দানেই শাহাদত বরণ করেন। মুফাসসিরগণ লিখেন, এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ হযরত দাউদ (আ) প্রসংগে বলেছেনঃ

( وَءَاتَىٰهُ ٱللَّهُ ٱلۡمُلۡكَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَعَلَّمَهُۥ مِمَّا یَشَاۤءُ )

[Surat Al-Baqarah 251]

(আল্লাহ তাকে কর্তৃত্ব ও হিকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছে করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন)। ইবন জারীর তার ইতিহাস গ্রন্থে সুদ্দীর সূত্রে উপরোক্ত তথ্য লিখেছেন। কিন্তু এ বিবরণের কয়েকটি দিক আপত্তিকর এবং আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়।

মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক লিখেছেন, যেই নবী কবর থেকে জীবিত উঠে তালূতকে তওবার পদ্ধতি বলে দিয়েছিলেন, সেই নবীর নাম আল-য়াসায়া ইবন আখতূব। ইবন জারীরও তার গ্রন্থে এ কথা উদ্ধৃত করেছেন। ছালাবী বলেছেন, উল্লেখিত মহিলা তালুতকে শামুয়েল নবীর কবরের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তালুত যে সব অপকর্ম করেছিলেন, সে জন্যে তিনি তাকে তিরস্কার করেন। ছালাবীর এ ব্যাখ্যাই অধিকতর সঙ্গত। তাছাড়া তালুতের সাথে নবীর সাক্ষাৎ ও কথোপকথনের ব্যাপারটি সম্ভবত স্বপ্নের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল, কবর থেকে পুনর্জীবিত হয়ে নয়। কেননা এ জাতীয় কাজের প্রকাশ পাওয়া নবীদের মু'জিযা বিশেষ। কিন্তু ঐ মহিলা তো আর নবী ছিলেন না। তাওরাতের অনুসারীদের ধারণা মতে, তালূতের রাজত্ব প্রাপ্তি থেকে জিহাদের ময়দানে পুত্রদের সাথে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত মোট সময় ছিল চল্লিশ বছর।

হযরত দাউদ (আ)-এর বিবরণ তাঁর ফযীলত, কর্মকাণ্ড, নবুওতের দলীল-প্রমাণ ও ঘটনাপঞ্জি
নবী হযরত দাউদ (আ)-এর বংশতালিকা নিম্নরূপঃ দাউদ ইবন ঈশা ইবন আবীদ ( عويد ) ইবন আবির ( عابر ) ইবন সালমুন ইবন নাহশূন ইবন আবীনাযিব ( عويناذب ) ইবন ইরাম ইবন হাসীরূন ইবন ফারিয ইবন য়াহূযা ইবন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ)। হযরত দাউদ (আ) ছিলেন আল্লাহর বান্দা তাঁর নবী এবং বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকায় তাঁর খলীফা। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক কতিপয় আলিমের সূত্রে ওহাব ইবন মুনাব্বিহ থেকে বর্ণনা করেছেনঃ হযরত দাউদ (আ) ছিলেন বেঁটে, তার চক্ষুদ্বয় ছিল নীলাভ। তিনি ছিলেন স্বল্প কেশ বিশিষ্ট এবং পূত-পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত দাউদ (আ) জালূত বাদশাহকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে হত্যা করেন। ইবন আসাকিরের বর্ণনা মতে, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল মারাজূস সাফার নিকট এলাকার সন্নিকটে উম্মে হাকিমের প্রাসাদের কাছে। এর ফলে বনী ইসরাঈলের লোকজন দাউদ (আ)-এর প্রতি আকৃষ্ট এবং তাঁকে ভালবাসতে থাকে এবং তাঁকে শাসকরূপে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তালূত যে ভূমিকা গ্রহণ করেন, একটু আগেই তা উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্যের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হযরত দাউদ (আ)-এর উপর ন্যস্ত হয়। এভাবে আল্লাহ তাআলা দাউদ (আ)-এর ক্ষেত্রে বাদশাহী ও নবুওত তথা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ একত্রিত করে দেন। ইতিপূর্বে বাদশাহী থাকত বনী-ইসরাঈলের এক শাখার হাতে আর নবুওত থাকত অন্য আর এক শাখার মধ্যে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এখন উভয়টিই হযরত দাউদ (আ)-এর মধ্যে একত্রিত করে দিলেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

( وَقَتَلَ دَاوُۥدُ جَالُوتَ وَءَاتَىٰهُ ٱللَّهُ ٱلۡمُلۡكَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَعَلَّمَهُۥ مِمَّا یَشَاۤءُۗ وَلَوۡلَا دَفۡعُ ٱللَّهِ ٱلنَّاسَ بَعۡضَهُم بِبَعۡض لَّفَسَدَتِ ٱلۡأَرۡضُ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ ذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah Al-Baqarah 251]

“দাউদ জালুতকে সংহার করল; আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও হিকমত দান করলেন; এবং যা তিনি ইচ্ছে করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ যাদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ্ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল। (২ বাকারাঃ ২৫১)।

অর্থাৎ যদি শাসনকর্তা রূপে বাদশাহ নিযুক্তির ব্যবস্থা না থাকত তাহলে সমাজের শক্তিশালী লোকেরা দুর্বল লোকদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিত। এ জন্যে কোন কোন বর্ণনায় রছেছে ( السلطان ظل الله فى ارضه ) অর্থাৎ আল্লাহর যমীনে শাসনকর্তা তার ছায়া স্বরূপ। আমীরুল মু'মিনীন হযরত উছমান ইবন আফফান (রা) বলেছেনঃ

ان الله ليزع بالسلطان مالا يزع بالقران

অথাৎ আল্লাহ শাসনকর্তা দ্বারা এমন অনেক কিছু দমন করেন, যা কুরআন দ্বারা করেন না। ইবন জারীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখে করেন, বাদশাহ জালুত রণক্ষেত্রে সৈন্য-ব্যুহ থেকে বেরিয়ে এসে মল্লযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্যে তালুতকে আহ্বান জানায়। কিন্তু তালূত নিজে অংশগ্রহণ না করে জালূতের মুকাবিলা করার জন্য আপন সৈন্যদের প্রতি আহ্বান জানায়। দাউদ (আ) সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে জালূতকে হত্যা করেন। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেন, ফলে লোকজন দাউদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এমনকি শেষ পর্যন্ত তালুতের কথা কেউ মুখেই আনতো না। তারা তালূতকে পরিত্যাগ করে দাউদের নেতৃত্ব বরণ করে নেয়। কেউ কেউ বলেছেন, নেতৃত্বের এ পরিবর্তন শামুয়েল নবীর আমলে হয়েছিল। কারও কারও মতে জালূতের সাথে যুদ্ধের ঘটনার পূর্বেই শামুয়েল (আ) হযরত দাউদকে শাসক নিযুক্ত করেন। ইবন জারীর অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত বর্ণনা করে লিখেছেন যে, জালূত বাদশাহ নিহত হওয়ার পরেই হযরত দাউদ (আ)-এর হাতে নেতৃত্ব আসে। ইব্‌ন আসাকির সাঈদ ইবন আবদুল আযীয সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত দাউদ (আ) কাসরে উম্পেয হাকীমের নিকট জালূতকে হত্যা করেছিলেন। ঐ স্থানে যে নদীটি অবস্থিত তার উল্লেখ স্বয়ং কুরআনের আয়াতেই বিদ্যমান আছে। দাউদ (আ) প্রসংগে কুরআনের অন্যত্র আল্লাহর বাণীঃ

وَلَقَدۡ ءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ مِنَّا فَضۡل اۖ یَـٰجِبَالُ أَوِّبِی مَعَهُۥ وَٱلطَّیۡرَۖ وَأَلَنَّا لَهُ ٱلۡحَدِیدَ ۝ أَنِ ٱعۡمَلۡ سَـٰبِغَـٰت وَقَدِّرۡ فِی ٱلسَّرۡدِۖ وَٱعۡمَلُوا۟ صَـٰلِحًاۖ إِنِّی بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِیر

[Surah Saba’ 10 – 11]

অর্থাৎ, আমি নিশ্চয় দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং আদেশ করেছিলাম, ‘হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সংগে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং বিহংগকুলকেও, তার জন্যে নমনীয় করেছিলাম লোহা, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করতে পার এবং তোমারা সৎকর্ম কর। তোমরা যা কিছু কর আমি তার সম্যক দ্রষ্টা। (৩৪ সাবাঃ ১০-১১)। আল্লাহ অন্যত্র বলেনঃ

( فَفَهَّمۡنَـٰهَا سُلَیۡمَـٰنَۚ وَكُلًّا ءَاتَیۡنَا حُكۡم ا وَعِلۡم اۚ وَسَخَّرۡنَا مَعَ دَاوُۥدَ ٱلۡجِبَالَ یُسَبِّحۡنَ وَٱلطَّیۡرَۚ وَكُنَّا فَـٰعِلِینَ ۝ وَعَلَّمۡنَـٰهُ صَنۡعَةَ لَبُوس لَّكُمۡ لِتُحۡصِنَكُم مِّنۢ بَأۡسِكُمۡۖ فَهَلۡ أَنتُمۡ شَـٰكِرُونَ )

[Surah Al-Anbiya’ 79 – 80]

অর্থাৎ, আমি পর্বত ও বিহংগকুলের জন্যে নিয়ম করে দিয়েছিলাম যেন তারা দাউদের সংগে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে; এ সবের কর্তা আমিই ছিলাম। আমি তাকে তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা তোমাদের যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে; সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না? (২১ঃ আম্বিয়াঃ ৭৯-৮০)।

যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে আল্লাহ হযরত দাউদ (আ)-কে লোহা দ্বারা বর্ম তৈরি করতে সাহায্য করেন এবং তাকে তা তৈরি করার নিয়ম-পদ্ধতিও শিক্ষা দেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন— এবং বুনন কাজে পরিমাণ রক্ষা কর —অথাৎ বুননটা এত সূক্ষ্ম হবে না যাতে ফাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আর এতটা মোটাও হবে না যাতে ভেঙ্গে যেতে পারে। মুজাহিদ, কাতাদা, হাকাম ও ইকরীমা এ তাফসীরই করেছেন।

হাসান বসরী, কাতাদা ও আমাশ বলেছেন, আল্লাহ হযরত দাউদ (আ)-এর জন্যে লোহাকে এমনভাবে নরম করে দিয়েছেন যে, তিনি হাত দ্বারা যেমন ইচ্ছা পেঁচাতে ও ভাঁজ করতে পারতেন; এ জন্যে তাঁর আগুন বা হাতুড়ির প্রয়োজন হত না। কাতাদা বলেন, হযরত দাউদ (আ)-এই প্রথম মানুষ, যিনি মাপজোক মত আংটা ব্যবহার করে লৌহ বর্ম নির্মাণ করেন। এর আগে লোহার পাত দ্বারা বর্মের কাজ চালান হত। ইবন শাওযাব বলেন, তিনি প্রতি দিন একটি করে বর্ম তৈরি করতেন এবং ছয় হাজার দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করতেন। হাদীসে এসেছে, মানুষের পবিত্রতম খাবার হল যা সে নিজে উপার্জন করে। ( ان اطيب ما اكل الرجل من كسبه ) আর আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ) নিজের হাতে উপার্জিত খাদ্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। আল্লাহর বাণীঃ

( وَٱذۡكُرۡ عَبۡدَنَا دَاوُۥدَ ذَا ٱلۡأَیۡدِۖ إِنَّهُۥۤ أَوَّابٌ ۝ إِنَّا سَخَّرۡنَا ٱلۡجِبَالَ مَعَهُۥ یُسَبِّحۡنَ بِٱلۡعَشِیِّ وَٱلۡإِشۡرَاقِ ۝ وَٱلطَّیۡرَ مَحۡشُورَة ۖ كُلّ لَّهُۥۤ أَوَّاب ۝ وَشَدَدۡنَا مُلۡكَهُۥ وَءَاتَیۡنَـٰهُ ٱلۡحِكۡمَةَ وَفَصۡلَ ٱلۡخِطَابِ )

[Surah Sad 17 - 20]

অর্থাৎ, এবং স্মরণ কর, আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদের কথা; সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী। আমি নিয়োজিত করেছিলাম পর্বতমালাকে যেন এরা সকাল-সন্ধ্যায় তার সাথে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, এবং সমবেত বিহংগকুলকেও; সকলেই ছিল তার অনুগত। আমি তার রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্নিতা (৩৮ সাদঃ ১৭-২০)।

ইবন আব্বাস (রা) ও মুজাহিদ (র) বলেন, আয়াতে উল্লেখিত ( الايد ) অর্থ ইবাদত করার শক্তি। অর্থাৎ তিনি ছিলেন ইবাদত ও অন্যান্য সৎকাজে অত্যন্ত শক্তিশালী। কাতাদা (র) বলেন, তাঁকে আল্লাহ ইবাদত করতে দিয়েছিলেন শক্তি এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে দিয়েছিলেন গভীর জ্ঞান। কাতাদা (র) আরও বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, দাউদ (আ) রাতের বেলা দাঁড়িয়ে ইবাদত করতেন এবং বছরের অর্ধেক সময় রোযা রাখতেন। বুখারী ও মুসলিমে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা) বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট ঐরূপ নামায সবচেয়ে প্রিয় যেরূপ নামায হযরত দাউদ পড়তেন এবং আল্লাহর নিকট ঐরূপ রোযা সবচেয়ে পছন্দনীয় যেরূপ রোযা হযরত দাউদ (আ) রাখতেন। তিনি রাতের প্রথম অর্ধেক ঘুমাতেন, তারপরে এক তৃতীয়াংশ নামাযে কাটাতেন এবং শেষে এক ষষ্ঠাংশ পুনরায় ঘুমিয়ে কাটাতেন। তিনি এক দিন রোযা রাখতেন এবং একদিন রোযা থাকতেন না। আর শত্রুর মুকাবিলা হলে কখনও ভয়ে পালাতেন না। তাই আয়াতে বলা হয়েছেঃ “আমি পর্বতমালাকে নিয়োজিত করছিলাম যেন তারা সকাল-সন্ধ্যায় তার সাথে পবিত্রতা ঘোষণা করে। আর পক্ষীকুলকেও, যারা তার কাছে সমবেত হত। সবাই ছিল তার অনুগত।” সূরা সাবায় যেমন বলা হয়েছেঃ

( وَلَقَدۡ ءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ مِنَّا فَضۡل اۖ یَـٰجِبَالُ أَوِّبِی مَعَهُۥ وَٱلطَّیۡرَۖ وَأَلَنَّا لَهُ ٱلۡحَدِیدَ )

[Surah Saba’ 10]

অর্থাৎ, হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সাথে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং বিহংগকুলকেও। অর্থাৎ তার সাথে তাসবীহ পাঠ কর। ইবন আব্বাস, মুজাহিদ প্রমুখ এ আয়াতের তাফসীর এভাবেই করেছেন। অর্থাৎ তারা দিনের সূচনা লগ্নে ও শেষ ভাগে তাসবীহ পাঠ করত। হযরত দাউদ (আ)-কে আল্লাহ এমন দরাজ কণ্ঠ ও সূর মাধুর্য দান করেছিলেন, যা পৃথিবীর অন্য কাউকে দান করেননি। তিনি যখন তাঁর প্রতি অবতীর্ণ যাবুর কিতাব সুর দিয়ে পাঠ করতেন তখন আকাশে উড্ডীয়মান বিহংগকুল সুরের মূর্ছনায় থমকে দাঁড়াত এবং দাউদের সুরের সাথে সুর মিলিয়ে আবৃত্তি করত ও তার সাথে তাসবীহ পাঠ করত। এভাবেই তিনি সকাল-সন্ধ্যায় যখন তাসবীহ পাঠ করতেন তখন পাহাড়পর্বতও তার সাথে তাসবীহ পাঠে শরীক হত। আওযাঈ বলেছেন, হযরত দাউদ (আ)-কে এমন সুমধুর কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছিল যেমনটি আর কাউকে দান করা হয়নি। তিনি যখন আল্লাহর কিতাব পাঠ করতেন তখন আকাশের পাখী ও বনের পশু তার চার পাশে জড়ো হয়ে যেত। এমনকি প্রচণ্ড ক্ষুধায় ও তীব্র পিপাসায় তারা সে স্থানে মারা যেত কিন্তু নড়াচড়া করত না। শুধু এরাই নয়,নদীর পানির প্রবাহ পর্যন্ত থেমে যেত। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেছেন, দাউদ (আ)-এর কণ্ঠস্বর যে-ই শুনত লাফিয়ে উঠত এবং কণ্ঠের তালে তালে নাচতে শুরু করত। তিনি যাবূর এমন অভূতপূর্ব কণ্ঠে পাঠ করতেন যা কোন দিন কেউ শুনেনি। সে সুর শুনে জিন, ইনসান, পক্ষী ও জীব-জন্তু আপন-আপন স্থানে দাঁড়িয়ে যেত। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে তাদের কেউ কেউ মারাও যেত।

আবু আওয়ানা বিভিন্ন সূত্রে .... মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত দাউদ (আ) যাবূর পড়া আরম্ভ করলে কিশোরী মেয়েদের কুমারীত্ব ছিন্ন হয়ে যেত। তবে এ বর্ণনাটি সমর্থনযোগ্য নয়। আবদুল রাযযাক ইবন জুরায়জ সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি গানের সুরে কিরাআত পড়া যাবে কি না-এ সম্পর্কে আতা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, এতে দোষ কি? অতঃপর তিনি বললেন, আমি শুনেছি, উবায়দ ইবন উমর বলেছেন, হযরত দাউদ (আ) বাজনা বাজাতেন ও তার তালে তালে কিরাআত পড়তেন। এতে সুরের মধ্যে লহর সৃষ্টি হত। ফলে সুরের মূর্ছনায় তিনিও কাঁদতেন এবং শ্রোতাদেরকেও কাঁদাতেন। ইমাম আহমদ আবদুর রাযযাকের সূত্রে..... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা আবু মূসা আশআরীর কিরাআত পড়া শুনে বলেছিলেনঃ আবু মূসাকে আলে দাউদের সুর লহরী দান করা হয়েছে।

বুখারী ও মুসলিমের শর্তে এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য এই সূত্রে এ হাদীস বুখারী মুসলিমে নেই। অন্যত্র ইমাম আহমদ হাসানের সূত্রে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করছেন, রাসূল (সা) বলেছেনঃ আবু মূসাকে দাঊদের বাদ্য প্রদান করা হযেছে। এ হাদীছটি মুসলিমের শর্তে বর্ণিত। আবু উছমান তিরমিযী (র) বলেন, বাদ্য ও বাঁশরী শুনেছি, কিন্তু আবূ মূসা আশআরীর কণ্ঠের চেয়ে তা অধিক শ্রুতি মধুর নয়। এ রকম মধুর সুর হওয়া সত্ত্বেও দাউদ (আ) অতি দ্রুত যাবূর পাঠ করতেন। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ ... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমরা দাউদ অপেক্ষা ধীরে কিরাআত পড়। কেননা তিনি বাহনের উপর জিন লাগাবার আদেশ করে কুরআন (যাবূর) পড়তেন এবং জিন লাগান শেষ হবার আগেই তার যাবুর পড়া শেষ হয়ে যেত। আর তিনি স্বহস্তে উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইমাম বুখারীও ... আবদুর রাযযাক সূত্রে এ হাদীস প্রায় অনুরূপ শব্দে বর্ণনা করেছেন। এরপর বুখারী (র) বলেছেন, এ হাদীস মূসা ইবন উকবা ...... আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে দাউদ (আ) -এর আলোচনায় বিভিন্ন সূত্রে এ হাদীছখানা বর্ণনা করছেন।

হাদীসে উল্লেখিত কুরআন অর্থ এখানে যাবুর যা হযরত দাউদ (আ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। এর বর্ণনাগুলো ছিল সংরক্ষিত। কেননা তিনি ছিলেন একজন বাদশাহ। তার ছিল বহু অনুসারী। তাই বাহনের উপর জিন লাগাতে যতটুকু সময় লাগে সে সময় পর্যন্ত তিনি যাবূর পাঠ করতেন। ভক্তিসহ নিবিষ্ট চিত্তে ও সুর প্রয়োগে পড়া সত্ত্বেও তার তিলাওয়াত ছিল অতান্ত দ্রুত। আল্লাহর বাণীঃ

( وَءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ زَبُور ࣰا)

[Surah Al-Isra’ 55]

অর্থাৎ, আমি দাউদকে যাবুর প্রদান করেছি। (১৭ ইসরাঃ ৫৫) এ আয়াতের তাফসীরে আমার তাফসীর গ্রন্থে ইমাম আহমদ ও অন্যান্যদের বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছি যে, এ প্রসিদ্ধ আসমানী কিতাবখানা রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়। গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে, এতে বিভিন্ন উপদেশ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উক্তি রয়েছে। আল্লাহর বাণীঃ

( وَشَدَدۡنَا مُلۡكَهُۥ وَءَاتَیۡنَـٰهُ ٱلۡحِكۡمَةَ وَفَصۡلَ ٱلۡخِطَابِ )

[Surah Sad 20]

অর্থাৎ, আমি তার রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা (৩৮ সাদঃ ১৭) অর্থাৎ - তাঁকে আমি দিয়েছিলাম বিশাল রাজত্ব ও কার্যকর শাসন কৌশল। ইবন জারীর ও ইবন আবী হাতিম হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এক গাভী সংক্রান্ত বিচারে দু’ব্যক্তি দাউদ (আ)-এর শরণাপন্ন হয়। এদের একজন অপর জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, সে তার গাভী জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিবাদী অভিযোগ অস্বীকার করল। হযরত দাউদ (আ) তাদের ফয়সালা রাত পর্যন্ত স্থগিত রাখলেন। আল্লাহ ঐ রাতে ওহীর মাধ্যমে নবীকে নির্দেশ দিলেন যে, বাদীকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। সকাল হলে নবী বাদীকে ডেকে আল্লাহর নির্দেশ জানিয়ে দেন এবং বলেন, আমি অবশ্যই তোমার উপর মৃতুদন্ড কার্যকর করব। এখন বল, তোমার দাবীর মূলে আসল ঘটনা কি? বাদী বলল, হে আল্লাহর নবী! আমি কসম করে বলছি, আমার দাবী যথার্থ। তবে এ ঘটনার পূর্বে আমি বিবাদীর পিতাকে হত্যা করেছিলাম। তখন হযরত দাউদ (আ) তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং সাথে সাথে তা কার্যকর হয়। এ ঘটনার পরে বনী ইসরাঈলের মধ্যে দাউদ (আ)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়।

ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেন, এ কথাটাই ( وَشَدَدۡنَا مُلۡكَهُۥ ) বাক্যাংশে ব্যক্ত করা হয়েছে। ( وَءَاتَیۡنَـٰهُ ٱلۡحِكۡمَةَ ) আয়াতে উক্ত حكيمة অর্থ নবুওয়াত, ( وَفَصۡلَ ٱلۡخِطَابِ )-কাজী শুরায়হ, শা’বী, কাতাদাহ, আবু আবদুর রহমান প্রমুখের মতে ফাসলাল খিতাব অর্থ সাক্ষী ও শপথ অর্থাৎ বিচার কার্যের মূলনীতি হিসেবে বাদীর জন্যে সাক্ষী প্রমাণ আর বিবাদীর জন্যে শপথ গ্রহণ। ( البينة على المدعي واليمين على من أنكر ) তাদের মতে আল্লাহ হযরত দাউদ (আ)-কে এই মূলনীতি দান করেছিলেন। মুজাহিদ ও সুদ্দীর মতে, ফাসলাল খিতাব অর্থ বিচার কাজের প্রজ্ঞা ও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। মুজাহিদ বলেন, বাক্য প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত দানে স্পষ্টবাদিতা। ইবন জারীরও এই ব্যাখ্যাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আবূ মূসা বলেছেন, ফাসলাল খিতাব হচ্ছে (হামদ ও সালাতের পরে) ( امابعد ) বলা অর্থাৎ হযরত দাউদ-ই প্রথমে ( امابعد ) শব্দ ব্যবহার করেন, তার সাথে এ ব্যাখ্যার কোন বিরোধ নেই। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ লিখেছেন, বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে পাপাচার ও মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলে হযরত দাউদ (আ)-কে একটি ফয়সালাকারী শিকল দেওয়া হয়। এই শিকলটি আসমান থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের পার্শ্বে রক্ষিত সাখরা' পাথর খণ্ড পর্যন্ত ঝুলন্ত ছিল।

শিকলটি ছিল স্বর্ণের। ফয়সালা এভাবে হত যে, বিবদমান দু’ব্যক্তির মধে যে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সেই ঐ শিকলটি নাগাল পেতো! আর অপরজন তা পেতো না। দীর্ঘদিন যাবত এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে এক ঘটনা ঘটে। এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির নিকট একটা মুক্তা গচ্ছিত রাখে। যখন সে তার মুক্তাটি ফিরিয়ে আনতে যায় তখন ঐ ব্যক্তি তার দাবি মীমাংসার জন্যে সাখরা পাথরের কাছে উপস্থিত হলে বাদী শিকলটি নাগাল পায়। বিবাদীকে তা ধরতে বলা হলে সে উক্ত মক্তা সম্বলিত লাঠিটি বাদীর কাছে দিয়ে দেয়। এরপর সে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানিয়ে বলে, হে আল্লাহ! আপনি অবশ্যই অবগত আছেন যে, আমি তাকে তার মুক্তাটি প্রত্যর্পণ করেছি। প্রার্থনার পর সে শিকলটি ধরতে সক্ষম হয়। এভাবে উক্ত শিকলটির দরুন বনী-ইসরাঈলরা মুশকিলে পড়ে যায়। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই শিকলটি উঠিয়ে নেয়া হয়। অনেক মুফাসিরই এ ঘটনাটিই উল্লেখ করেছেন। ইসহাক ইবন বিশর ও ওহাব ইবন মুনাব্বিহ সূত্রে প্রায় এরূপেই বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ

( وَهَلۡ أَتَىٰكَ نَبَؤُا۟ ٱلۡخَصۡمِ إِذۡ تَسَوَّرُوا۟ ٱلۡمِحۡرَابَ ۝ إِذۡ دَخَلُوا۟ عَلَىٰ دَاوُۥدَ فَفَزِعَ مِنۡهُمۡۖ قَالُوا۟ لَا تَخَفۡۖ خَصۡمَانِ بَغَىٰ بَعۡضُنَا عَلَىٰ بَعۡض فَٱحۡكُم بَیۡنَنَا بِٱلۡحَقِّ وَلَا تُشۡطِطۡ وَٱهۡدِنَاۤ إِلَىٰ سَوَاۤءِ ٱلصِّرَ  ٰ⁠ طِ ۝ إِنَّ هَـٰذَاۤ أَخِی لَهُۥ تِسۡع وَتِسۡعُونَ نَعۡجَة وَلِیَ نَعۡجَة وَ  ٰ⁠ حِدَة فَقَالَ أَكۡفِلۡنِیهَا وَعَزَّنِی فِی ٱلۡخِطَابِ ۝ قَالَ لَقَدۡ ظَلَمَكَ بِسُؤَالِ نَعۡجَتِكَ إِلَىٰ نِعَاجِهِۦۖ وَإِنَّ كَثِیر ا مِّنَ ٱلۡخُلَطَاۤءِ لَیَبۡغِی بَعۡضُهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٍ إِلَّا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَقَلِیل مَّا هُمۡۗ وَظَنَّ دَاوُۥدُ أَنَّمَا فَتَنَّـٰهُ فَٱسۡتَغۡفَرَ رَبَّهُۥ وَخَرَّ رَاكِع ا وَأَنَابَ ۩ ۝ فَغَفَرۡنَا لَهُۥ ذَ  ٰ⁠ لِكَۖ وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 21 - 25]

অর্থাৎ, তোমার নিকট বিবদমান লোকদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি? যখন তারা প্রাচীর ডিংগিয়ে ইবাদত খানায় আসল এবং দাউদের নিকট পৌঁছল, তখন সে তাদের কারণে ভীত হয়ে পড়ল। তারা বলল, ভীত হবেন না, আমরা দু’বিবদমান পক্ষ; আমাদের একে অপরের উপর জুলুম করেছে; অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করুন; অবিচার করবেন না এবং আমাদেরকে সঠিক পথ নির্দেশ করুন। এ আমার ভাই, এর আছে নিরানব্বইটা দুম্বা এবং আমার আছে মাত্র একটি দুম্বা; তবুও সে বলে, আমার যিম্মায় একটা দিয়ে দাও; এবং কথায় সে আমার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করেছে। দাউদ বলল, তোমার দুম্বাটিকে তার দুম্বাগুলোর সংগে যুক্ত করার দাবি করে সে তোমার প্রতি জুলুম করেছে। শরীকদের অনেকে একে অন্যের উপর অবিচার করে থাকে। করে না কেবল মু'মিন ও সৎ কর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ এবং তারা সংখ্যায় স্বল্প। দাউদ বুঝতে পারল, আমি তাকে পরীক্ষা করেছি। আর সে তার প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং নত হয়ে লুটিয়ে পড়ল ও তার অভিমুখী হল। তারপর আমি তার ত্রুটি ক্ষমা করলাম। আমার নিকট তার জন্যে রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। (৩৮ সাদঃ ২১-২৫)

উপরোক্ত আয়াতে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক বহু সংখ্যক মুফাসসির অনেক কিস্সা-কাহিনীর অবতারণা করেছেন। কিন্তু তার অধিকাংশই ইসরাঈলী বর্ণনা এবং এর মধ্যে সম্পূর্ণ মিথ্যা-বানোয়াট বর্ণনাও রয়েছে। আমরা এখানে সে সবের কিছুই উল্লেখ করছি না; শুধু কুরআনে বর্ণিত ঘটনাটির উল্লেখ করাই যথেষ্ট বিবেচনা করছি। সূরা সাদ-এর সিজদার আয়াত সম্পর্কে ইমামগণের মধ্যে দু ধরনের মত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেন, এ সিজদা অপরিহার্য; আবার অন্য কেউ কেউ বলেছেন, এটা অপরিহার্য নয়, বরং এটা শোকরানা সিজদা। এ প্রসংগে ইমাম বুখারী (র) মুজাহিদের সুত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একদা ইবন আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ সূরা সাদ তিলাওয়াতকালে আপনি কেন সিজদা দেন? তিনি বললেন, তুমি কি কুরআনে পড় না?

( وَوَهَبۡنَا لَهُۥۤ إِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَۚ كُلًّا هَدَیۡنَاۚ وَنُوحًا هَدَیۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَمِن ذُرِّیَّتِهِۦ دَاوُۥدَ وَسُلَیۡمَـٰنَ وَأَیُّوبَ وَیُوسُفَ وَمُوسَىٰ وَهَـٰرُونَۚ وَكَذَ  ٰ⁠ لِكَ نَجۡزِی ٱلۡمُحۡسِنِینَ ۝ وَزَكَرِیَّا وَیَحۡیَىٰ وَعِیسَىٰ وَإِلۡیَاسَۖ كُلّ مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ۝ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَٱلۡیَسَعَ وَیُونُسَ وَلُوط اۚ وَكُلّ ا فَضَّلۡنَا عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ وَمِنۡ ءَابَاۤىِٕهِمۡ وَذُرِّیَّـٰتِهِمۡ وَإِخۡوَ  ٰ⁠ نِهِمۡۖ وَٱجۡتَبَیۡنَـٰهُمۡ وَهَدَیۡنَـٰهُمۡ إِلَىٰ صِرَ  ٰ⁠طࣲ مُّسۡتَقِیم ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكَ هُدَى ٱللَّهِ یَهۡدِی بِهِۦ مَن یَشَاۤءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۚ وَلَوۡ أَشۡرَكُوا۟ لَحَبِطَ عَنۡهُم مَّا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ۝ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ ٱلَّذِینَ ءَاتَیۡنَـٰهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحُكۡمَ وَٱلنُّبُوَّةَۚ فَإِن یَكۡفُرۡ بِهَا هَـٰۤؤُلَاۤءِ فَقَدۡ وَكَّلۡنَا بِهَا قَوۡم ا لَّیۡسُوا۟ بِهَا بِكَـٰفِرِینَ ۝ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ ٱلَّذِینَ هَدَى ٱللَّهُۖ فَبِهُدَىٰهُمُ ٱقۡتَدِهۡ )

[Surah Al-An'am 84 - 90]

অর্থাৎ, দাঊদ, সুলায়মান.....আর আমি তাহাকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব, ইহাদের প্রত্যেককে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম; পূর্বে নূহকেও সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম এবং তাহার বংশধর দাউদ, সুলায়মান ও আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও; আর এইভাবেই সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করি; এবং যাকারিয়া, ইয়াহয়া, ঈসা এবং ইলয়াসকেও সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম। ইহারা সকলে সজ্জনদের অন্তর্ভুক্ত; আরও সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম ইসমাঈল, আল-য়াসাআ, ইউনুস্ ও লূতকে; এবং শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছিলাম বিশ্বজগতের উপর প্রত্যেতকে- এবং ইহাদের পিতৃ-পুরুষ, বংশধর ও ভ্রাতৃবৃন্দের কতককে। আমি তাহাদিগকে মনোনীত করিয়াছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করিয়াছিলাম। ইহা আল্লাহর হিদায়াত, স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা তিনি ইহা দ্বারা সৎপথে পরিচালিত করেন। তাহারা যদি শিরক করিত তবে তাহাদের কৃতকর্ম নিষ্ফল হইত। আমি উহাদিগকেই কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুওয়াত দান করিয়াছি, অতঃপর যদি ইহারা এইগুলিকে প্রত্যাখ্যানও করে তবে আমি তো এমন এক সম্প্রদায়ের প্রতি এইগুলির ভার অর্পণ করিয়াছি যাহারা এইগুলি প্রত্যাখ্যান করিবে না। উহাদিগকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন, সুতরাং তুমি তাহাদের পথের অনুসরণ কর। বল, ‘আমার জন্য আমি তোমাদের নিকট পারিশ্রমিক চাহি না, ইহা তো শুধু বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ।' (৬ আনআমঃ ৮৪- ৯০)

এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, যে, দাউদ (আ) নবীগণের অন্যতম যাদের অনুসরণ করার জন্য আমাদের নবী (সা)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সূরা সাদ-এর আয়াতে দাউদ (আ)-এর সিজদার কথা উল্লেখিত হয়েছে। সে অনুযায়ী রাসূল (স)-ও সিজদা করেছেন। ইমাম আহমদ .... ইকরামার সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেনঃ সূরা সাদ এর সিজদা আবশ্যিক সিজদার অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ সিজদা করতে দেখেছি। ইমাম বুখারী, আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী একে হাসান ও সহীহ বলেছেন। ইমাম নাসাঈ (র)... সাঈদ ইবন জুবায়রের সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) সূরা সাদ এ সিজদা করেছেন তওবা স্বরূপ, আর আমরা সিজদা করব শোকরিয়া স্বরূপ। শেষের কথাটি কেবল আহমদের বর্ণনায় আছে। তবে এর রাবীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য।

আবু দাউদ... আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একবার মসজিদের মিম্বরে বসে সূরা সাদ তিলাওয়াত করেন। সিজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছে তিনি মিম্বর থেকে নেমে সিজদা আদায় করেন। উপস্থিত লোকজনও তাঁর সাথে সিজদা আদায় করেন। অন্য এক দিন তিনি অনুরূপ মিম্বরে বসে সূরা সাদ পাঠ করেন। যখন সিজদার আয়াত পড়েন, তখন উপস্থিত লোকেরা সিজদা করতে উদ্যত হন। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এটা হচ্ছে জনৈক নবীর তওবা বিশেষ (সিজদার সাধারণ নির্দেশ নয়), তবে দেখছি তোমরা সিজদা করতে উদ্যত হয়েছ। তারপর তিনি মিম্বর থেকে নেমে সিজদা আদায় করেন। এ হাদীছখানা কেবল আবু দাঊদই বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদ সহীহের শর্ত অনুযায়ী আছে। ইমাম আহমদ... আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি একদা স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি সূরা সাদ লিখছেন। সিজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছে তিনি দোয়াত, কলম ও অন্য যা কিছু সেখানে ছিল, সবই সিজদায় লুঠিয়ে পড়েছে দেখতে পান। এ ঘটনা তিনি নবী করীম (সা)-এর নিকট ব্যক্ত করেন। তারপর থেকে তিনি সর্বদা এ সূরার সিজদা আদায় করতেন। এ হাদীসখানা কেবল ইমাম আহমদই বর্ণনা করেছেন।

তিরমিযী ও ইবন মাজাহ্ মুহাম্মদ ইবন ইয়াযীদের সূত্রে .... হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে বলল- ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষ যেমন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে, আমিও তেমনি সালাত আদায় করছি। সালাতে আমি সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করি এবং সিজদায় যাই। বৃক্ষটিও আমার সাথে সিজদা করে। আমি শুনলাম সে সিজদা অবস্থায় এরূপ দোয়া করছেঃ “হে আল্লাহ! এর ওসীলায় আপনার নিকট আমার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন, আপনার নিকট আমার জন্যে এর ছওয়াব সঞ্চিত রাখুন, এর ওসীলায় আমার দোষ-ত্রুটি দূর করে দিন এবং আমার এ সিজদা আপনি কবুল করুন, যেমন কবূল করেছিলেন আপনার নেক বান্দা দাউদ (আ) থেকে।” ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আমার এ কথা শেষ হতেই দেখলাম, রাসূল (সা) সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সিজদায় যান এবং লোকটি বৃক্ষের যে দোয়ার উল্লেখ করেছিল, শুনলাম তিনি সিজদায় সেই দোয়াটিই পড়ছেন। ইমাম তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করার পরে লিখেছেন যে, এটা গরীব পর্যায়ের হাদীস-এই একটি সূত্র ব্যতীত এর অন্য কোন সূত্র আমার জানা নেই।

কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, হযরত দাউদ (আ) তাঁর এ সিজদায় একটানা চল্লিশ দিন অতিবাহিত করেন। মুজাহিদ, হাসান প্রমুখ এ কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসংগে একটি মারফূ’ হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর বর্ণনাকরী ইয়াযীদ রুককাশী হাদীস বর্ণনায় দুর্বল ও পরিত্যক্ত। আল্লাহর বাণীঃ

( فَغَفَرۡنَا لَهُۥ ذَ  ٰ⁠ لِكَۖ وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 25]

—আমি তার সে অপরাধ ক্ষমা করলাম। নিশ্চয় আমার কাছে তার জন্যে রয়েছে উচ্চ মর্তবা ও সুন্দর বাসস্থান। (৩৮ সাদঃ ২৫)। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তিনি আল্লাহর নিকট উচ্চ মর্যাদা পাবেন। ( زلفى ) অর্থ বিশেষ নৈকট্য; এবং তাহলো ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে আল্লাহ দাউদ (আ)-কে এ নৈকট্য দান করবেন। এ ব্যাপারে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

المقسطون على منابر من نور عن يمين الرحمن وكلتا يديه يمين الذي يقسطون في اهليهم وحكمهم وما ولوا

—অর্থাৎ যারা ন্যায় বিচার করে ও ন্যায়ের বিধান চালু করে, এবং তার পরিবারে ফয়সালায় এবং কর্তৃত্ব প্রয়োগে তারা মেহেরবান আল্লাহর দক্ষিণ হস্তের কাছে প্রতিষ্ঠিত নূরের মিম্বরের উপরে অধিষ্ঠিত থাকবে। আর আল্লাহর উভয় হস্তই দক্ষিণ হস্ত)। মুসনাদে ইমাম আহমদে.... আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ও নৈকট্যপ্রাপ্ত হল ন্যায় বিচারক শাসক; পক্ষান্তরে আল্লাহর নিকট কিয়ামতের দিন সবচেয়ে ঘৃণিত ও কঠিন শাস্তিযোগ্য ব্যক্তি হল জালিম বাদশাহ। তিরিমিযী অনুরূপ বর্ণনা করে বলেছেন, এই একটি সূত্র ব্যতীত অন্য কোন সূত্রে এ হাদীছখানা সম্পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়নি। ইবন আবী হাতিম.... জাফর ইবন সুলায়মান থেকে বর্ণনা করেন। তিনি মালিক ইব্‌ন দীনারকে ( وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলতে শুনেছেন যে, হযরত দাউদ (আ) কিয়ামতের দিন আরশে আযীমের স্তম্ভের কাছে দণ্ডায়মান থাকবেন, আল্লাহ তখন বলবেন, ‘হে দাউদ! দুনিয়ায় তুমি যে মধুর সুরে আমার প্রশংসা ও মহত্ব প্রকাশ করতে, সেইরূপ মধুর সুরে আজ আমার প্রশংসা ও মহত্ব প্রকাশ কর।’ দাউদ (আ) বলবেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি তো তা আমার থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন, এখন কিরূপে তা করব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আজ আমি তা তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।’ অতঃপর দাউদ (আ) এমন মধুর আওয়াজে আল্লাহর প্রশংসা গাইবেন, যার প্রতি সমস্ত জান্নাতবাসী আকৃষ্ট হয়ে পড়বে।

আল্লাহর বাণীঃ

( یَـٰدَاوُۥدُ إِنَّا جَعَلۡنَـٰكَ خَلِیفَة فِی ٱلۡأَرۡضِ فَٱحۡكُم بَیۡنَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ ٱلۡهَوَىٰ فَیُضِلَّكَ عَن سَبِیلِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱلَّذِینَ یَضِلُّونَ عَن سَبِیلِ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَاب شَدِیدُۢ بِمَا نَسُوا۟ یَوۡمَ ٱلۡحِسَابِ )

[Surah Sad 26]

—হে দাঊদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না, কেননা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ হতে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা বিচার দিবসকে বিস্মৃত হয়ে আছে। (৩৮ সাদঃ ২৬)।

আলোচ্য আয়াতে হযরত দাউদ (আ)-কে সম্বোধন করা হলেও এর দ্বারা শাসক ও বিচারক মণ্ডলীকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে এবং আল্লাহ তাদেরকে মানুষের মাঝে তার পক্ষ থেকে নির্দেশিত ন্যায় বিচার ও সত্যের অনুসরণ করার আদেশ করেছেন। নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। যারা সত্য পথ পরিত্যাগ করে নিজের খেয়াল-খুশীর পথ অনুসরণ করবে তাদেরকে আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন। সে যুগে হযরত দাউদ (আ) ছিলেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, প্রচুর ইবাদত ও অন্যান্য নেক কাজের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় আদর্শ। কথিত আছে, রাত্র ও দিনের মধ্যে এমন একটি সময় অতিবাহিত হত না, যে সময় তাঁর পরিবারবর্গের কোন কোন সদস্য ইবাদতে মশগুল না থাকত। আল্লাহ বলেছেনঃ

( یَعۡمَلُونَ لَهُۥ مَا یَشَاۤءُ مِن مَّحَـٰرِیبَ وَتَمَـٰثِیلَ وَجِفَان كَٱلۡجَوَابِ وَقُدُور رَّاسِیَـٰتٍۚ ٱعۡمَلُوۤا۟ ءَالَ دَاوُۥدَ شُكۡر اۚ وَقَلِیل مِّنۡ عِبَادِیَ ٱلشَّكُورُ )

[Surah Saba' 13]

—হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ ( ৩৪ সাবাঃ ১৩)। আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া.... আবুল জালদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি দাউদ (আ)-এর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করেছি। তাতে এ কথা পেয়েছি যে, তিনি আরজ করলেন, “হে আমার পালনকর্তা! আমি আপনার শুকরিয়া কিভাবে আদায় করব? আপনার নিয়ামত ব্যতীত তো আপনার শোকর আদায়ে আমি সামর্থ হব না।” অতঃপর দাউদ (আ)-এর নিকট ওহী আসেঃ “হে দাঊদ! তুমি কি জান না যে, যে সব নিয়ামত তোমার কাছে রয়েছে, তা আমারই দেওয়া?” জবাবে দাউদ (আ) বললেন, “হ্যাঁ তাই, হে আমার রব!” আল্লাহ বললেন, “তোমার এ স্বীকারোক্তিতেই আমি সন্তুষ্ট।” বায়হাকী.... ইবন শিহাব থেকে বর্ণনা করেন, হযরত দাউদ (আ) বলেছিলেনঃ

الحمد لله كما ينبغي لكرم وجهه وعز جلاله

—আল্লাহর জন্যে এমন যাবতীয় প্রশংসা নির্দিষ্ট, যেমন প্রশংসা তাঁর সত্ত্বা ও মহত্বের জন্যে উপযোগী। আল্লাহ বললেন, 'হে দাউদঃ তুমি তো হেফাজতকারী ফিরিশতাদের মতই দোয়া করলে।” আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া.... সুফিয়ান ছাওরী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন মুবারক তাঁর “কিতাবুয যুহদে’..... ওহাব ইবন মুনাববিহ থেকে বর্ণনা করেনঃ দাউদের বংশধরদের হিকমতের মধ্যে ছিল (১) কোন জ্ঞানী লোকের পক্ষে চারটি বিশেষ সময়ে গাফিল থাকা উচিত নয়, (ক) একটি সময় নির্দিষ্ট করবে, যে সময়ে সে একান্তে আল্লাহর ইবাদত করবে। (খ) একটি নির্দিষ্ট সময়ে আত্ম-সমালোচনায় প্রবৃত্ত হবে। (গ) একটি সময় নির্ধারণ করবে, যে সময়ে সে ঐ সব অন্তরংগ বন্ধুদের সাথে মিলিত হবে, যারা তাকে ভালবাসে এবং তার ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দেয়। (ঘ) আর একটি সময় বেছে নিবে হালাল ও বৈধ বিনোদনের জন্যে। এই শেষোক্ত সময়টা তার অন্যান্য সময়ের কাজের সহায়ক হবে এবং অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করবে।

(২) একজন জ্ঞানী লোকের উচিৎ সময় সম্পর্কে সচেতন থাকা, রসনাকে সংযত রাখা এবং আপন অবস্থাকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেওয়া।

(৩) একজন জ্ঞানী লোকের কর্তব্য-তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি ছাড়া যেন সে কোথাও যাত্রা না করে পরকালের পাথেয় সংগ্রহে, দুনিয়ার জীবন যাপনের উপাদান অন্বেষণে কিংবা বৈধ আনন্দ বিনোদনে।

ইবন আবিদ দুনিয়া ও ইব্‌ন আসাকির অন্য সূত্রে ওহাব ইবন মুনাব্বিহ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হাফিজ ইব্‌ন আসাকির হযরত দাউদ (আ)-এর কতগুলো শিক্ষামূলক উপদেশ বাণী তাঁর জীবনী আলোচনায় উল্লেখ করেছেন। তার কয়েকটি হলঃ

(১) ইয়াতীমের সাথে দয়ালু পিতার মত আচরণ কর ( كن لليتيم كالاب الرحيم )

(২) স্মরণ রেখ, যেমন বীজ বুনবে, তেমন ফলন পাবে। ( واعلم أنك كما تزرع كذلك تحصد )

(৩) একটি ‘গরীব পর্যায়ের মারফু হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত দাউদ (আ) বলেছিলেনঃ হে পাপের চাষকারী! ফসলরূপে তুমি কেবল কাটা আর খোসাই পাবে। ( يازارع السيئات انت تحصد شوكها وحسكها )

(৪) কোন মজলিসের নির্বোধ বক্তা হচ্ছে মৃতের শিয়রে গায়কের তুল্য।

مثل الخطيب الأحمق في نادي القوم كمثل المغنی عند رأس الميت

(৫) ধনী থাকার পরে দরিদ্র হওয়ার মত দুর্ভাগ্য আর নেই। কিন্তু তার চেয়ে অধিক দুর্ভাগ্য হল হিদায়াত লাভের পরে পথভ্রষ্ট হওয়া

( ما اقبحم الغقو بعد الغنى واقبح من ذالك الضلا لة بعد المعدى )

(৬) প্রকাশ্য সভায় তোমার সমালোচনা না হোক-এ যদি তোমার কাম্য হয় তবে ঐ কাজটি তুমি নির্জনেও করবে না। ( انظر ماتكمه ان يذكر عنك نادى القوم فلاتفعله اذا خلوت )

(৭) তুমি কাউকে এমন কিছুর প্রতিশ্রুতি দিও না, যা তুমি পূর্ণ করতে পারবে না। কেননা এতে তোমার ও তার মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হবে। ( لا تعدن اخاكم بما لا تنجزه له فان ذالك عداوة ما بينك وبينه )

মুহাম্মাদ ইবন সা'দ ..... আফরার মওলা উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর একাধিক সহধর্মিণী দেখে লোকজনকে বলল, “তোমরা এ লোকটির প্রতি লক্ষ্য কর, সে আহারে পরিতৃপ্ত হয় না; আল্লাহর কসম সে নারী ছাড়া কিছু বুঝে না।” সমাজে তার একাধিক সহধর্মিণী থাকায় তারা তার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে এবং তার প্রতি দোষারোপ করে। তাদের মন্তব্য হলো, যদি ইনি নবী হতেন, তাহলে নারীদের প্রতি এতো লিপ্সা থাকতো না। এ কুৎসা রটনায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে হুয়াই ইবন আখতাব। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেন এবং নবী করীম (সা)-এর প্রতি তাঁর দান ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেন।

( أَمۡ یَحۡسُدُونَ ٱلنَّاسَ عَلَىٰ مَاۤ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِ )

[Surah An-Nisa’ 54]

(অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্যে কি তারা তাদেরকে হিংসা করে?) এখানে ناس বা মানুষ অর্থ রাসূল (সা)

( فَقَدۡ ءَاتَیۡنَاۤ ءَالَ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَءَاتَیۡنَـٰهُم مُّلۡكًا )

[Surah An-Nisa’ 54]

—তাহলে ইবরাহীমের বংশধরকেও তো আমি কিতাবও হিকমত প্রদান করেছিলাম এবং তাদেরকে বিশাল রাজ্য দান করেছিলাম। (৪ নিসাঃ ৫৪)। ইবরাহীমের বংশধর বলতে এখানে হযরত সুলায়মান (আ)-কে বুঝানো হয়েছে। তাঁর ছিলেন এক হাজার স্ত্রী, তাদের মধ্যে সাত শ স্বাধীন এবং তিন শ’ বাদী। আর হযরত দাউদ (আ)-এর ছিলেন একশ জন স্ত্রী, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ)-এর মা-যিনি ইতিপূর্বে উরিয়ার স্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁকে বিবাহ করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর স্ত্রী সংখ্যার তুলনায় তাদের সংখ্যা অনেকগুণ বেশী। কালবীও ঠিক এইরূপ বর্ণনা করেছেন।

হাফিজ ইবন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেনঃ এক ব্যক্তি ইবন আব্বাস (রা)-কে (নফল) রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার নিকট সংরক্ষিত একটি হাদীস আছে। আপনি যদি শুনতে চান তবে আমি আপনাকে দাউদ (আ)-এর রোযা সম্পর্কে বলতে পারি। কেননা তিনি অত্যন্ত বেশী রোযা রাখতেন এবং নামায আদায় করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বীর পুরুষ; দুশমনের বিরুদ্ধে মুকাবিলা কালে তিনি কখনও পলায়ন করতেন না। তিনি একদিন অন্তর অন্তর রোযা রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম রোযা হল দাউদ (আ)-এর রোযা। তিনি সত্তরটি সুরে যাবুর তিলাওয়াত করতেন। এগুলো তার নিজেরই উদ্ভাবিত স্বর। রাত্রে যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন নিজেও কাঁদতেন এবং তাতে অন্য সবকিছুও কাঁদতো। তার মধুর সূরে সকল দুশ্চিন্তা ও ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। তুমি আরও শুনতে চাইলে আমি তার পুত্র হযরত সুলায়মান (আ)-এর রোযা সম্পর্কে জানাতে পারি। কেননা, তিনি প্রতি মাসের প্রথম তিন দিন, মাঝের তিন দিন ও শেষের তিন দিন রোযা রাখতেন। এভাবে তার মাস শুরু হত রোযার মাধ্যমে। মধ্য-মাস অতিবাহিত হত রোযা রাখা অবস্থায় এবং মাস শেষ হত রোযা পালনের মাধ্যমে। তুমি যদি আরও শুনতে চাও তবে আমি তোমাকে মহিয়ষী কুমারী মাতা মরিয়ম (আ)-এর পুত্র হযরত ঈসা (আ)-এর রোযা সম্পর্কেও জানাতে পারি। তিনি সারা বছর ধরে রোযা রাখতেন, যবের ছাতু খেতেন, পশমী কাপড় পরতেন, যা পেতেন তাই খেতেন, যা পেতেন না, তা চাইতেন না। তার কোন পুত্র ছিল না যে, মারা যাবার আশংকা থাকবে কিংবা কোন ঘরবাড়ি ছিল না যে, নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকবে। যেখানেই রাত হত সেখানেই নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং ভোর পর্যন্ত নামাযে রত থাকতেন। তিনি একজন ভাল তীরান্দায় ছিলেন। কোন শিকারকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লে কখনও তা ব্যর্থ হত না। বনী ইসরাঈলের কোন সমাবেশ অতিক্রম করার সময় তাদের অভিযোগ শুনতেন ও প্রয়োজন পূরণ করে দিতেন। যদি তুমি আগ্রহী হও তবে আমি তোমাকে হযরত ঈসা (আ)-এর মা মারয়াম বিনতে ইমরানের রোযা সম্পর্কেও জানাতে পারি। কেননা তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং দুই দিন বাদ দিতেন। তুমি যদি জানতে চাও তবে আমি তোমাকে নবী উম্মী আরাবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর রোযা সম্পর্কেও জানাতে পারি। তিনি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতেন এবং বলতেন, এটাই গোটা বছর রোযা রাখার শামিল। ইমাম আহমদ... আব্বাস (রা) থেকে হযরত দাউদ (আ)-এর রোযার বৃত্তান্ত মারফুরূপে বর্ণনা করেছেন।

১০
হযরত দাউদ (আ)-এর ইনতিকাল
হযরত আদম (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা প্রসংগে পূর্বোল্লেখিত হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ যখন আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাঁর সন্তানদের বের করেন তখন হযরত আদম (আ) তাঁদের মধ্যে সকল নবীকে দেখতে পান। তাদের মধ্যে একজনকে অত্যন্ত উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট দেখে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ! ইনি কে?’ আল্লাহ জানালেন, ‘এ তোমার সন্তান দাউদ।’ আদম (আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তার আয়ু কত?’ আল্লাহ তা'আলা জানালেন, ‘ষাট বছর।’ আদম (আ) বললেন, ‘হে পরোয়ারদিগার! তার আয়ু বাড়িয়ে দিন।’ আল্লাহ জানালেন, ‘বৃদ্ধি করা যাবে না; তবে তোমার নিজের আয়ু থেকে নিয়ে বাড়িয়ে দিতে পারি।’ হযরত আদমের নির্ধারিত আয়ু ছিল এক হাজার বছর। তা থেকে নিয়ে দাউদ (আ)-এর আয়ু আরও চল্লিশ বছর বাড়িয়ে দেয়া হল। যখন হযরত আদমের আয়ু শেষ হয়ে আসে তখন মৃত্যুর ফিরিশতা আসেন। আদম (আ) বললেন, ‘আমার আয়ুর তো এখনও চল্লিশ বছর বাকী।’ দাউদ (আ)-কে দেয়া বয়সের কথা তিনি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। এভাবে আল্লাহ আদম (আ)-এর আয়ু এক হাজার বছর এবং দাউদ (আ)-এর আয়ু একশ পূর্ণ করে দেন। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ.... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী, ইবন খুযায়মা, ইবন হিব্বান ও হাকিম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী একে সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন এবং হাকিম একে মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী আছে বলে উল্লেখ করেছেন। আদম (আ) -এর আলোচনা প্রসঙ্গে এ সম্পর্কে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবন জারীর লিখেছেন, কোন কোন আহলে কিতাবের মতে হযরত দাউদ (আ)-এর আয়ু ছিল সাতাত্তর বছর। কিন্তু এটা ভুল ও প্রত্যাখ্যাত। তাঁদের মতে হযরত দাউদের রাজত্বের মেয়াদ ছিল চল্লিশ বছর। তাঁদের এ মত গ্রহণযোগ্য। কেননা আমাদের কাছে এর পক্ষে বা বিপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

হযরত দাউদ (আ)-এর ইনতিকাল সম্পর্কে ইমাম আহমদ তার মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ দাউদ (আ) ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। যখন তিনি বাইরে যেতেন তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে যেতেন, যাতে তিনি ফিরে আসা পর্যন্ত অন্য কেউ তাঁর ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে একদিন তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হল। এ সময় তাঁর স্ত্রী উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, একজন পুরুষ লোক ঘরের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘এ লোকটি কে? তালাবদ্ধ ঘরে কিভাবে প্রবেশ করল? কসম আল্লাহর! নবী দাঊদ (আ)-এর কাছে আমরা লজ্জায় পড়ব!’ এমনি সময় হযরত দাউদ (আ) ফিরে এলেন এবং দেখলেন ঘরের মধ্যখানে একজন পুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে। দাউদ (আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’ লোকটি বলল, ‘আমি সেইজন, যে কোন রাজা বাদশাহকে তোয়াক্কা করে না এবং কোন আড়ালই তাকে আটকাতে পারে না।’ দাউদ (আ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তা হলে আপনি নিশ্চয়ই মালাকুল মওত? আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্যে আপনাকে স্বাগতম!’ এর অল্পক্ষণ পরেই তাঁর রূহ কব করা হল। অতঃপর তাকে গোসল দেয়া হলো ও কাফন পরান হলো। ইতিমধ্যে সূর্য উদিত হল। তখন সুলায়মান (আ) পাখীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা দাউদ (আ)-এর উপর ছায়া করে রাখ।’ পাখীরা তাই করল। সন্ধ্যা হলে হযরত সুলায়মান (আ) পাখীদেরকে বললেন, ‘তোমরা এখন পাখা সংকুচিত করে নাও।’ আবু হুরায়রা (রা) বলেন, ‘পাখীরা কিভাবে তাদের পাখা মেলেছিল এবং কিভাবে বন্ধ করেছিল, তা তিনি নিজের হাত দিয়ে আমাদেরকে দেখাতে লাগলেন।’ দাউদ (আ)-এর উপর ঐদিন ছায়াদানে দীর্ঘ ডানা বিশিষ্ট বায পাখীর ভূমিকাই প্রধান ছিল। ইমাম আহমদ একাই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদ উত্তম এবং বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। সুদ্দী ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, দাউদ (আ) আকস্মিকভাবে ইনতিকাল করেন তার মৃত্যুর দিন ছিল শনিবার। পাখীরা তার দেহের উপর ছায়া দান করে।

ইসহাক ইবন বিশর ..... হাসান থেকে বর্ণনা করেন যে, দাউদ (আ) একশ বছর বয়সে হঠাৎ এক বুধবারে ইনতিকাল করেন। আবুস সাকান আল-হাজারী বলেছেন, হযরত ইবরাহীম খলীল, হযরত দাউদ ও তদীয় পুত্র হযরত সুলায়মান (আ) তিন জনেরই মৃত্যু আকস্মিক ভাবে হয়েছিল। এ বর্ণনাটি ইবন আসাকিরের। কারো কারে বর্ণনায় আছে যে, একদা হযরত দাউদ (আ) মিহরাব থেকে নীচে অবতরণ করছিলেন, এমন সময় মৃত্যুর ফিরিশতা তার সম্মুখে এসে উপস্থিত হন। হযরত দাউদ (আ) তাকে বললেন, ‘আমাকে নীচে নামতে বা উপরে উঠতে দিন!’ তখন ফিরিশতা বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্যে নির্ধারিত বছর, মাস, দিন ও রিযিক শেষ হয়ে গিয়েছে।’ এ কথা শুনেই দাঊদ (আ) সেখানেই একটি সিঁড়ির উপরে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং সিজদারত অবস্থায়ই তাঁর রূহ কবয করা হয়। ইসহাক ইবন বিশর ওহাব ইবন মুনাব্বিহ সূত্রে বর্ণনা করেন, গ্রীষ্মকালে রৌদ্রতাপের মধ্যে লোকজন হযরত দাউদ (আ)-এর জানাযায় শরীক হয়। সে দিন তার জানাযায় এত বেশী লোক সমাগম হয় যে, সাধারণ লোক ছাড়া কেবল যাজকদের সংখ্যাই ছিল চল্লিশ হাজার। এরা সবাই ছিল লম্বাটুপী (বুরনুস টুপী) পরিহিত। মূসা ও হারূন (আ)-এর পরে বনী ইসরাঈলের মধ্যে কারো জন্যে দাঊদ (আ)-এর জন্যে যে শোক-তাপ প্রকাশ করা হয়, তা আর কারো জন্যে করা হয়নি। জানাযায় উপস্থিত লোকজন রৌদ্র তাপে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্যে তারা সুলায়মান (আ)-কে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায়। সুলায়মান (আ) বের হয়ে পক্ষীকুলকে আহ্বান করেন। পক্ষীকুল তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়। তিনি লোকদেরকে ছায়া দানের জন্যে তাদেরকে নির্দেশ দেন। ফলে পক্ষীকুল পরস্পর মিলিত হয়ে পাখা মেলে চারদিকে এমনভাবে ঘিরে দাঁড়াল যে, সে স্থানে বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি লোকজন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। তারা এ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্যে চিৎকার করে সুলায়মান (আ)-কে ফরিয়াদ জানাল। সুলায়মান (আ) বের হয়ে পাখীদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা সূর্যের তাপ যে দিক থেকে আসছে সে দিকে ছায়া দাও, আর যে দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে সে দিক থেকে সরে যাও। পাখীরা তাই করল। তখন লোকজন এক দিকে ছায়ার নীচে থাকে এবং অন্য দিকে তাদের উপর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে। এটাকেই মানুষ সুলায়মান (আ)-এর কর্তৃত্বের প্রথম নিদর্শন হিসেবে দেখতে পায়। হাফিজ আবূ ইয়ালা.... আবুদ দারদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ হযরত দাউদ (আ)-কে তাঁর সংগীদের মাঝ থেকে তুলে নেন, তারা কোন ফিৎনায় পতিত হয়নি এবং দাউদের দীনকেও পরিবর্তন করেনি। আর মাসীহর শিষ্যরা তার বিধান ও প্রদর্শিত পথের উপর দু'শ বছর বহাল ছিল। এ হাদীস গরীব পর্যায়ের। এটা মারফু কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। এর সনদে ওয়াদীন ইবন ‘আতা হাদীস বর্ণনায় দুর্বল।

১১
হযরত সুলায়মান (আ)
হাফিজ ইব্‌ন আসাকিরের বর্ণনা মতে, হযরত সুলায়মান (আ)-এর নসবনামা নিম্নরূপঃ সুলায়মান ইবন দাউদ ইবন ঈশা ( ايشا ) ইবন আবীদ ( عويد ) ইবন ‘আবির ইবন সালমূন ইবন নাহশূন ইব্‌ন ‘আমীনাদাব ইবন ইরাম ইবন হাসিরূন ইবন ফারিস ইবন ইয়াহুযা ইবন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম। সুলায়মান (আ) ছিলেন নবীর পুত্র নবী। ইতিহাসের কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি দামিশকে গিয়েছিলেন এবং ইবন খাবুলাও অনুরূপ নসব বর্ণনা করেন। সুলায়মান (আ) প্রসংগে আল্লাহ বলেনঃ

( وَوَرِثَ سُلَیۡمَـٰنُ دَاوُۥدَۖ وَقَالَ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ عُلِّمۡنَا مَنطِقَ ٱلطَّیۡرِ وَأُوتِینَا مِن كُلِّ شَیۡءٍۖ إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡفَضۡلُ ٱلۡمُبِینُ )

[Surah An-Naml 16]

অর্থাৎ, সুলায়মান হয়েছিল দাউদের উত্তরাধিকারী এবং সে বলেছিল, “হে মানুষ! আমাকে পক্ষীকূলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সকল কিছু দেয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই সুস্পষ্ট অনুগ্রহ”। (২৭ নামলঃ ১৬) অর্থাৎ তিনি পিতা দাউদের নবুওয়াত ও রাজত্বের উত্তরাধিকারী হন। এখানে সম্পদের উত্তরাধিকারী অর্থে বলা হয়নি। কেননা, সুলায়মান (আ) ব্যতীত হযরত দাউদ (আ)-এর আরও অনেক পুত্র ছিলেন, তাদেরকে বাদ দিয়ে শুধু সুলায়মানের নামে সম্পদের উল্লেখ করার কোন অর্থ হয় না। তা ছাড়া সহীহ হাদীসে বিভিন্ন সূত্রে একদল সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ( لا نورث ماتركنا فهم صدقه ) অর্থাৎ আমরা উত্তরাধিকারী রেখে যাই না, আমরা যা কিছু রেখে যাই তা সাদকা। আমরা বলতে এখানে নবীদের জামাআত বুঝানো হয়েছে। এ বাক্যে রাসূলুল্লাহ (সা) মানুষকে জানিয়েছেন যে, নবীদের রেখে যাওয়া বৈষয়িক সম্পদের কেউ উত্তরাধিকারী হয় না, যেমন অন্যদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এর দাবীদার নয়, বরং তা সাদকা-দুস্থঃ ও গরীবদেরই প্রাপ্য। কেননা, দুনিয়ার সহায়-সম্পদ যেমন আল্লাহর নিকট তুচ্ছ ও নগণ্য, তেমনি তার মনোনীত নবীগণের নিকটও তা মূল্যহীন ও গুরুত্বহীন। হযরত সুলায়মানের উক্তি,

( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ عُلِّمۡنَا مَنطِقَ ٱلطَّیۡرِ )

[Surah An-Naml 16]

—“হে মানুষ! আমাকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ হযরত সুলায়মান (আ) পাখীদের ভাষা বুঝতেন, তারা শব্দ করে কি বুঝাতে চায়, তিনি মানুষকে তার ব্যাখ্যা বলতেন। হাফিজ আবু বকর বায়হাকী.... আবু মালিক থেকে বর্ণনা করেন যে, একদিন সুলায়মান (আ) কোথাও যাচ্ছিলেন, পথে দেখেন একটা পুরুষ চড়ুই পাখী আর একটা স্ত্রী চড়ুই পাখীর পাশে ঘোরাঘুরি করছে। সুলায়মান (আ) তার সাথীদেরকে বললেন, ‘তোমরা বুঝেছ কি? চড়ুই পাখীটি কী বলছে?’ তারা বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! এরা কী বলছে?’ সুলায়মান (আ) বললেন, ‘সে তার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছে এবং বলছে তুমি আমাকে বিয়ে কর, তা হলে তোমাকে নিয়ে আমি দামিশকের প্রাসাদের যে কক্ষে চাও, সেখানে বসবাস করব।’ অতঃপর সুলায়মান (আ) এরূপ বলার কারণ ব্যাখ্যা করলেন যে, দামিশকের প্রাসাদ সমূহ শক্ত পাথর দ্বারা নির্মিত। তার মধ্যে কেউই বসবাস করতে পারে না, তবে বিবাহের প্রত্যেক প্রস্তাবকই মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে থাকে। ইবন আসাকির ... বায়হাকী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। চড়ুই ছাড়া অন্যান্য সকল জীব-জন্তু ও প্রাণীর ভাষাও তিনি বুঝতেন। এর প্রমাণ কুরআনের আয়াতঃ

( وَأُوتِینَا مِن كُلِّ شَیۡءٍ )

[Surah An-Naml 16]

অর্থাৎ আমাকে সকল জিনিসের জ্ঞান দান করা হয়েছে। যা একজন বাদশাহর জন্যে প্রয়োজন অর্থাৎ দ্রব্য সামগ্রী, অস্ত্র, আসবাব পত্র, সৈন্য-সামন্ত, জিন, ইনসান, বিহংগকুল, বন্য জন্তু, বিচরণকারী শয়তান, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বাক ও নির্বাক জীবের অন্তরের খবর জানা ইত্যাদি। এরপর আল্লাহ বলেছেন,

( إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡفَضۡلُ ٱلۡمُبِینُ )

[Surah An-Naml 16]

—নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। অর্থাৎ এ সবই সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা ও আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে দান। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

( وَحُشِرَ لِسُلَیۡمَـٰنَ جُنُودُهُۥ مِنَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِ وَٱلطَّیۡرِ فَهُمۡ یُوزَعُونَ ۝ حَتَّىٰۤ إِذَاۤ أَتَوۡا۟ عَلَىٰ وَادِ ٱلنَّمۡلِ قَالَتۡ نَمۡلَة یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّمۡلُ ٱدۡخُلُوا۟ مَسَـٰكِنَكُمۡ لَا یَحۡطِمَنَّكُمۡ سُلَیۡمَـٰنُ وَجُنُودُهُۥ وَهُمۡ لَا یَشۡعُرُونَ ۝ فَتَبَسَّمَ ضَاحِك ا مِّن قَوۡلِهَا وَقَالَ رَبِّ أَوۡزِعۡنِیۤ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِیۤ أَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَعَلَىٰ وَ  ٰ⁠ لِدَیَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَـٰلِح ا تَرۡضَىٰهُ وَأَدۡخِلۡنِی بِرَحۡمَتِكَ فِی عِبَادِكَ ٱلصَّـٰلِحِینَ )

[Surah An-Naml 17 - 19]

—সুলায়মানের সম্মুখে সমবেত করা হল তার বাহিনীকে— জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে এবং এগুলোকে বিন্যস্ত করা হল বিভিন্ন ব্যুহে। যখন ওরা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল তখন একটি পিঁপড়ে বলল, “হে পিপড়ের দল! তোমরা তোমাদের ঘরে প্রবেশ কর, যেন সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পদতলে পিষে না ফেলে।” তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হেসে বলল, “হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা কাশ করতে পারি। আমার প্রতি ও আমার পিতা মাতার প্রতি তুমি যে অনুগ্রহ করেছ, তার জন্যে এবং যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর এবং তোমার অনুগ্রহে আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শামিল কর।’ (২৭ নামলঃ ১৭-১৯)।

উপোরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর বান্দা, নবী ও নবীপুত্র হযরত সুলায়মান ইবন দাউদ (আ) সম্পর্কে জানাচ্ছেন যে, একদা সুলায়মান তাঁর জিন, ইনসান ও পাখী বাহিনী নিয়ে অভিযানে রওয়ানা হন। জিন ও ইনসান তাঁর সাথে সাথে চলে, আর পাখীরা উপরে থেকে রৌদ্র ইত্যাদি হতে ছায়া দান করে। এই তিন বাহিনীর তদারকীরূপে নিযুক্ত ছিল একটি পর্যবেক্ষক দল। তারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতো। ফলে কেউ তার নিজ অবস্থান থেকে আগে যেতে পারতো না। আল্লাহ বলেনঃ

( حَتَّىٰۤ إِذَاۤ أَتَوۡا۟ عَلَىٰ وَادِ ٱلنَّمۡلِ قَالَتۡ نَمۡلَة یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّمۡلُ ٱدۡخُلُوا۟ مَسَـٰكِنَكُمۡ لَا یَحۡطِمَنَّكُمۡ سُلَیۡمَـٰنُ وَجُنُودُهُۥ وَهُمۡ لَا یَشۡعُرُونَ )

[Surah An-Naml 18]

অর্থাৎ, পিঁপড়েটি সুলায়মান ও তার বাহিনীর অজ্ঞাতসারে দুর্ঘটনার বিষয়ে পিঁপড়ের দলকে সাবধান করে দিল। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেছেন, উক্ত ঘটনায় সুলায়মান (আ) তাঁর আসনে আসীন অবস্থায় তায়েফের একটি উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন। ঐ পিঁপড়েটির নাম ছিল জারাস এবং তার গোত্রের নাম বানুশ শায়তান। সে ছিল খোড়া এবং আকৃতিতে নেকড়ে বাঘের মত। কিন্তু এর কোন কথাই সমর্থনযোগ্য নয়। বরং এই ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীতে ঘোড় সওয়ার অবস্থায় ছিলেন; আসনে আসীন ছিলেন না। কেননা যদি তাই হত তাহলে পিপড়ের কোন ভয় থাকতো না, তারা পদদলিত হত না। কারণ তখন আসনের উপরই তাঁর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস, সৈন্য বাহিনী, অশ্ব-উষ্ট্রী, যাবতীয় প্রয়োজনীয় পত্র, তাঁবু চতুস্পদ জন্তু, পাখী ইত্যাদি সব কিছুই থাকত। এ বিষয়ে সামনে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, পিঁপড়েটি তার দলবলকে বুদ্ধিমত্তার সাথে যে সঠিক নির্দেশ দিয়েছিল হযরত সুলায়মান (আ)-তা বুঝেছিলেন এবং আনন্দে মুচকি হেসেছিলেন। কেননা, আল্লাহ কেবল তাকেই এ বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, অন্য কাউকে করেননি। কিন্তু কতিপয় মূর্খ লোক বলেছে যে, সুলায়মান (আ)-এর পূর্বে জীব-জন্তুর বাকশক্তি ছিল এবং মানুষের সাথে তারা কথা বলত। নবী হযরত সুলায়মান তাদের কথা বলা বন্ধ করে দেন, তাদের থেকে অংগীকার আদায় করেন এবং তাদের মুখে লাগাম পরিয়ে দেন। এরপর থেকে তারা আর মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না। কিন্তু এরূপ কথা কেবল অজ্ঞরাই বলতে পারে। ঘটনা যদি এ রকমই হত তাহলে সুলায়মান (আ)-এর জন্যে এটা কোন বৈশিষ্ট্য হত না এবং অন্যদের তুলনায় তাঁর মাহাত্ম রূপে গণ্য হবে না। কেননা তাহলে তো সকল মানুষই জীব-জন্তর কথা বুঝতো। আর যদি তিনি অন্যদের সাথে কথা না বলার অংগীকার নিয়ে থাকেন এবং কেবল নিজেই বুঝবার পথ করে থাকেন, তাহলে এরূপ বন্ধ রাখার মধ্যেও কোন মাহাত্ম্য নেই। তাই তিনি আরয করলেনঃ

( رَبِّ أَوۡزِعۡنِیۤ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِیۤ أَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَعَلَىٰ وَ  ٰ⁠ لِدَیَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَـٰلِح ا تَرۡضَىٰهُ وَأَدۡخِلۡنِی بِرَحۡمَتِكَ فِی عِبَادِكَ ٱلصَّـٰلِحِینَ )

[Surah An-Naml 19]

অর্থাৎ, হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকর্ম করতে পারি এবং আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর। ( أَوۡزِعۡنِیۤ ) অর্থ ( ار شدنى الهمنى ) আমার অন্তরে প্রেরণা জাগিয়ে দিন এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। নবী আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছেন তিনি যেন তাকে সেইসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তওফীক দেন, যা তিনি তাকে দান করেছেন এবং যে সব বিষয়ে অন্যদের উপর তাঁকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি সৎকর্ম করার তওফীক কামনা করছেন এবং মৃত্যুর পরে নেক বান্দাদের সাথে তাঁর হাশর যাতে হয় সেই প্রার্থনাও জানিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর এ প্রার্থনা কবুলও করেছেন। হযরত সুলায়মান (আ)-এর মাতা ছিলেন একজন ইবাদতকারী সৎকর্মশীল মহিলা। যেমন সুনায়দ ইবন দাউদ... জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেন, সুলায়মান ইব্‌ন দাউদের মাতা বলেছিলেন, “হে প্রিয় বৎস! রাত্রে অধিক ঘুমিয়ো না, কেননা এ অভ্যাস মানুষকে কিয়ামতের দিন নিঃস্ব-দরিদ্র করে উঠাবে।” ইবন মাজাহ তার চারজন উস্তাদ সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

আবদুর রাযযাক মা'মারের সূত্রে যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ সুলায়মান ইবন দাউদ (আ) ও তাঁর সৈন্য বাহিনী একদা ইসতিসকা নামায (বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনার নামায) আদায় করার জন্য বের হন। পথে দেখলেন, একটি পিপড়ে তার একটা পা উপরের দিকে উঠিয়ে বৃষ্টি কামনা করছে। এ দৃশ্য দেখে সুলায়মান (আ) সৈন্যদেরকে বললেন, “তোমরা ফিরে চল! তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কেননা এই পিপড়েটি আল্লাহর কাছে বৃষ্টি কামনা করছে। এবং তার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে।” ইব্‌ন আসাকির লিখেছেন, এ হাদীছ মারফু সনদেও বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর আবদুর রাযযাক মুহাম্মদ ইবন আযীযের সূত্রে ... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেনঃ আল্লাহর এক নবী একবার আল্লাহর কাছে বৃষ্টি কামনার উদ্দেশ্যে লোকজন সাথে নিয়ে বের হয়েছিলেন। পথে তারা দেখতে পান যে, একটি পিপড়ে আকাশের দিকে তার একটি পা উঠিয়ে বৃষ্টি কামনা করছে। অতঃপর ঐ নবী তাঁর সংগীদেরকে বললেন, ‘তোমরা ফিরে চল; কেননা এ পিপড়েটির ওসীলায় তোমাদের জন্যেও বৃষ্টি মঞ্জর হয়েছে।’ সুদ্দীর বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, চলার পথে তারা দেখলেন একটি পিপড়ে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে এবং দু-হাত মেলে এই দোয়া করছে, ‘হে আল্লাহ! আমরা আপনারই সৃষ্টিকূলের মধ্যে একটি সৃষ্টি। আপনার অনুগ্রহ থেকে আমরা নিরাশ হইনি।’ অতঃপর আল্লাহ তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আল্লাহর বাণীঃ

( وَتَفَقَّدَ ٱلطَّیۡرَ فَقَالَ مَا لِیَ لَاۤ أَرَى ٱلۡهُدۡهُدَ أَمۡ كَانَ مِنَ ٱلۡغَاۤىِٕبِینَ ۝ لَأُعَذِّبَنَّهُۥ عَذَاب ا شَدِیدًا أَوۡ لَأَا۟ذۡبَحَنَّهُۥۤ أَوۡ لَیَأۡتِیَنِّی بِسُلۡطَـٰن مُّبِین ۝ فَمَكَثَ غَیۡرَ بَعِید فَقَالَ أَحَطتُ بِمَا لَمۡ تُحِطۡ بِهِۦ وَجِئۡتُكَ مِن سَبَإِۭ بِنَبَإ یَقِینٍ ۝ إِنِّی وَجَدتُّ ٱمۡرَأَة تَمۡلِكُهُمۡ وَأُوتِیَتۡ مِن كُلِّ شَیۡء وَلَهَا عَرۡشٌ عَظِیم ۝ وَجَدتُّهَا وَقَوۡمَهَا یَسۡجُدُونَ لِلشَّمۡسِ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَزَیَّنَ لَهُمُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ أَعۡمَـٰلَهُمۡ فَصَدَّهُمۡ عَنِ ٱلسَّبِیلِ فَهُمۡ لَا یَهۡتَدُونَ ۝ أَلَّا یَسۡجُدُوا۟ لِلَّهِ ٱلَّذِی یُخۡرِجُ ٱلۡخَبۡءَ فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِ وَیَعۡلَمُ مَا تُخۡفُونَ وَمَا تُعۡلِنُونَ ۝ ٱللَّهُ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِیمِ ۩ ۝ ۞ قَالَ سَنَنظُرُ أَصَدَقۡتَ أَمۡ كُنتَ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ ۝ ٱذۡهَب بِّكِتَـٰبِی هَـٰذَا فَأَلۡقِهۡ إِلَیۡهِمۡ ثُمَّ تَوَلَّ عَنۡهُمۡ فَٱنظُرۡ مَاذَا یَرۡجِعُونَ ۝ قَالَتۡ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَؤُا۟ إِنِّیۤ أُلۡقِیَ إِلَیَّ كِتَـٰب كَرِیمٌ ۝ إِنَّهُۥ مِن سُلَیۡمَـٰنَ وَإِنَّهُۥ بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ ۝ أَلَّا تَعۡلُوا۟ عَلَیَّ وَأۡتُونِی مُسۡلِمِینَ ۝ قَالَتۡ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَؤُا۟ أَفۡتُونِی فِیۤ أَمۡرِی مَا كُنتُ قَاطِعَةً أَمۡرًا حَتَّىٰ تَشۡهَدُونِ ۝ قَالُوا۟ نَحۡنُ أُو۟لُوا۟ قُوَّة وَأُو۟لُوا۟ بَأۡس شَدِید وَٱلۡأَمۡرُ إِلَیۡكِ فَٱنظُرِی مَاذَا تَأۡمُرِینَ ۝ قَالَتۡ إِنَّ ٱلۡمُلُوكَ إِذَا دَخَلُوا۟ قَرۡیَةً أَفۡسَدُوهَا وَجَعَلُوۤا۟ أَعِزَّةَ أَهۡلِهَاۤ أَذِلَّة ۚ وَكَذَ  ٰ⁠ لِكَ یَفۡعَلُونَ ۝ وَإِنِّی مُرۡسِلَةٌ إِلَیۡهِم بِهَدِیَّة فَنَاظِرَةُۢ بِمَ یَرۡجِعُ ٱلۡمُرۡسَلُونَ۝فَلَمَّا جَاۤءَ سُلَیۡمَـٰنَ قَالَ أَتُمِدُّونَنِ بِمَال فَمَاۤ ءَاتَىٰنِۦَ ٱللَّهُ خَیۡر مِّمَّاۤ ءَاتَىٰكُمۚ بَلۡ أَنتُم بِهَدِیَّتِكُمۡ تَفۡرَحُونَ ۝ ٱرۡجِعۡ إِلَیۡهِمۡ فَلَنَأۡتِیَنَّهُم بِجُنُود لَّا قِبَلَ لَهُم بِهَا وَلَنُخۡرِجَنَّهُم مِّنۡهَاۤ أَذِلَّة وَهُمۡ صَـٰغِرُونَ )

[Surah An-Naml 20 - 37]

অর্থাৎ, সুলায়মান পক্ষীকুলের সন্ধান নিল এবং বলল, “ব্যাপার কি, হুদহুদকে দেখছি না যে! সে অনুপস্থিত না কি? সে উপযুক্ত কারণ না দর্শালে আমি অবশ্য ওকে কঠিন শাস্তি দিব অথবা যবেহ করব।” কিছুকালের মধ্যেই হুদহুদ এসে পড়ল এবং বলল, “আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি এবং ‘সাবা’ থেকে সুনিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখলাম তাদের উপর রাজত্ব করছে। তাকে সকল কিছু হতে দেয়া হয়েছে এবং তার আছে এক বিরাট সিংহাসন। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান ওদের কার্যাবলী ওদের নিকট শোভন করেছে এবং ওদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে: ফলে তারা সৎপথ পায় না; নিবৃত্ত করেছে এ জন্যে যে, ওরা যেন সিজদা না করে আল্লাহকে, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর লুক্কায়িত বস্তুকে প্রকাশ করেন, যিনি জানেন, যা তোমরা গোপন কর এবং যা তোমরা ব্যক্ত কর। আল্লাহ্’ তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের অধিপতি।” সুলায়মান বলল, “আমি দেখব, তুমি কি সত্য বলেছ, না তুমি মিথ্যাবাদী? তুমি যাও আমার এ পত্র নিয়ে এবং এটা তাদের নিকট অর্পণ কর; এরপর তাদের নিকট হতে সরে থেকো এবং লক্ষ্য করো তাদের প্রতিক্রিয়া কী?” সেই নারী বলল, “হে পারিষদবর্গ! আমাকে এক সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে; এটা সুলায়মানের নিকট হতে এবং তা এই— দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে, অহমিকা বশে আমাকে অমান্য করো না, এবং আনুগত্য স্বীকার করে আমার নিকট উপস্থিত হও।” সেই নারী বলল, “হে পারিষদবর্গ! আমার এ সমস্যায় তোমাদের অভিমত দাও। আমি কোন ব্যাপারে একান্ত সিদ্ধান্ত করি না তোমাদের উপস্থিতি ব্যতীত।” ওরা বলল, “আমরা তো শক্তিশালী ও কঠোর যোদ্ধা; তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই, কী আদেশ করবেন তা আপনি ভেবে দেখুন।" সে বলল, “রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদেরকে অপদস্থ করে; এরাও এরূপই করবে; আমি তাদের নিকট উপটৌকন পাঠাচ্ছি; দেখি দূতরা কী নিয়ে ফিরে আসে।” দূত সুলায়মানের নিকট আসলে সুলায়মান বলল, “তোমরা কি আমাকে ধন-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করছ? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমরা যা দিয়েছ হতে উৎকৃষ্ট অথচ তোমরা তোমাদের উপটৌকন নিয়ে উৎফুল্ল বোধ করছ। ওদের নিকট ফিরে যাও, আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসব এক সৈন্যবাহিনী, যার মুকাবিলা করার শক্তি ওদের নেই। আমি অবশ্যই ওদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করব লাঞ্চিতভাবে এবং ওরা হবে অবনমিত।” (২৭ঃ ২০-৩৭)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ হযরত সুলায়মান (আ) ও হুদহুদ পাখীর ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সফরকালে প্রত্যেক শ্রেণীর পাখীদের থেকে কিছু সংখ্যক সম্মুখভাগে থাকত। তারা সময় মত তাঁর নিকট উপস্থিত হত এবং তাদের থেকে তিনি প্রয়োজনীয় সংবাদ জেনে নিতেন। তারা পালাক্রমে তার কাছে নামত-যেমনটি সেনাবাহিনী রাজা-বাদশাহর সাথে করে থাকে, পাখীর দায়িত্ব সম্পর্কে হযরত ইবন আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেন, কোন শূন্য প্রান্তর অতিক্রমকালে সুলায়মান (আ) ও তাঁর সংগীরা যদি পানির অভাবে পড়তেন, তাহলে সে স্থানে পানি কোথায় আছে, হুদহুদ আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তার সন্ধান দিত। মাটি নীচে কোন স্তরে পানি আছে। হুদহুদ তা বলে দিতে পারত। সুতরাং যেখানে পানি আছে বলে সে নির্দেশ করত, সেখানকার মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে পানি উত্তোলন করা হত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহৃত হতো। একদা সুলায়মান (আ) সফরকালে হুদহুদের সন্ধান করেন, কিন্তু তাকে তার কর্মস্থলে উপস্থিত পেলেন না। তখন তিনি বললেনঃ

( مَا لِیَ لَاۤ أَرَى ٱلۡهُدۡهُدَ أَمۡ كَانَ مِنَ ٱلۡغَاۤىِٕبِینَ )

[Surah An-Naml 20]

অর্থাৎ, ব্যাপার কি, হুদহুদকে দেখছি না যে! সে অনুপস্থিত না কি? অর্থাৎ হুদহুদের হল কি, সে কি এ দলের মধ্যেই নেই। না কি আমার দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে?

( لَأُعَذِّبَنَّهُۥ عَذَاب ا شَدِیدًا )

[Surah An-Naml 21]

–আমি অবশ্যই তাকে কঠিন শাস্তি দিব। হুদহুদকে তিনি কোন কঠিন শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। শাস্তির প্রকার সম্পর্কে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন; অথবা আমি তাকে যবেহ করব, অথবা সে আমার নিকট উপযুক্ত কারণ দর্শাবে। অর্থাৎ এমন যুক্তিপূর্ণ কারণ দর্শাতে হবে যা তাকে এ বিপদ থেকে রক্ষার উপযুক্ত হয়।

অল্পক্ষণের মধ্যে হুদহুদ এসে পড়ল, অর্থাৎ হুদহুদ বেশী দেরী না করেই চলে আসল এবং সুলায়মান (আ)-কে বলল, “আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি।" অর্থাৎ আমি এমন বিষয়ের সন্ধান পেয়েছি যার সন্ধান আপনি জানেন না। এবং ‘সাবা’ থেকে সুনিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি। অর্থাৎ সত্য সংবাদ। “আমি এক নারীকে দেখলাম তাদের উপর রাজত্ব করছে। তাকে সবকিছু থেকে দেয়া হয়েছে এবং তার আছে এক বিরাট সিংহাসন।” এখানে ইয়ামানের সাবা রাজন্যবর্গের অবস্থা, শান-শওকত ও রাজত্বের বিশালতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুলায়মান (আ)-এর যুগের সাবার রাজার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তার কন্যার উপর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব ভার অর্পিত হয়।

ছা'লাবীসহ অন্যান্য ইতিহাসবিদ লিখেছেন, বিলকীসের পিতার মৃত্যুর পর তার সম্প্রদায়ের লোকেরা একজন পুরুষ লোককে তাদের রাজা মনোনীত করে। কিন্তু তার অযোগ্যতার কারণে রাজ্যের সর্বত্র বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে। বিলকীস তখন কৌশলে সে রাজার কাছে নিজের বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। ফলে রাজা তাঁকে বিবাহ করেন। বিলকীস স্বামী-গৃহে গিয়ে স্বামীকে মদ্য পান করতে দেন। রাজা যখন মদ পান করে মাতাল অবস্থায় ছিল তখন বিলকীস তার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দরজার উপর লটকিয়ে দেন। জনগণ সেখানে উপস্থিত হয়ে এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে বিলকীসকে সিংহাসনে বসায় এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বিলকীসের বংশপঞ্জি নিম্নরূপঃ বিলকীস বিনত সীরাহ (ইনি হুদহাদ ( هدهاد ) নামে পরিচিত, আবার কেউ কেউ একে শারাহীলও বলেছেন।) ইবন যীজাদান ইবন সীরাহ ইবন হারছ ইবন কায়স ইবন সায়ফী ইব্‌ন সাবা ইবন ইয়াশজাব ইবন ইয়ারাব ইবন কাহতান। বিলকীসের পিতা ছিলেন একজন বিখ্যাত রাজা। তিনি ইয়ামানের কোন নারীকে বিবাহ করতে অস্বীকৃতি জানান। কথিত আছে, তিনি একজন জিন মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। তার নাম ছিল রায়হানা বিনত সাকান। তার গর্ভে একটি মেয়ের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় তালকামা। ইনিই বিলকীস নামে অভিহিত হন।

ছালাবী ...... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ বিলকীসের পিতা-মাতার একজন ছিল জিন। হাদীসটি গরীব পর্যায়ের এবং এর সনদ দুর্বল। ছালাবী ......... আবু বাকরা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, এক দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে বিলকীসের প্রসংগ নিয়ে আলোচনা উঠলে তিনি বললেনঃ ঐ জাতির কোন মংগল নেই, যারা তাদের কর্তৃত্ব কোন নারীর হাতে তুলে দেয়। এ হাদীসের এক রাবী ইসমাঈল ইবন মুসলিম আল-মাক্কী দুর্বল। ইমাম বুখারী (র) 'আওফ হাসানের মাধ্যমে আবূ বাকরা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যখন এ সংবাদ পৌঁছল যে, পারস্যবাসীরা পারস্য সম্রাটের কন্যাকে তাদের সম্রাজ্ঞী বানিয়েছে, তখন তিনি বলেছিলেনঃ ঐ জাতির কল্যাণ হবে না যারা তাদের নেতৃত্ব কোন নারীর উপর ন্যাস্ত করে ( لن يفلح قوم واوا امرهم امرءة ) ইমাম তিরমিযী এবং নাসাঈও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী একে হাসান সহীহ পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ “তাকে সবকিছু থেকে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাদশাহর জন্যে যা কিছু প্রয়োজন তা তাঁকে দেয়া হয়েছিল। “এবং তার ছিল বিরাট সিংহাসন।” অর্থাৎ বিলকীসের সিংহাসন ছিল স্বর্ণ, মনি-মুক্তা খচিত ও বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান ও উজ্জ্বল ধাতু দ্বারা সু-সজ্জিত। এরপর আল্লাহ তা'আলা তাদের কুফরী, অবাধ্যতা, গোমরাহী, সূর্য-পূজা এবং শয়তান কর্তৃক পথভ্রষ্ট হওয়া এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে রাখার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ আল্লাহ তো ঐ সত্তা যিনি আসমান ও যমীনের গোপনীয় বিষয়কে প্রকাশ করেন এবং তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন।

আল্লাহর বাণীঃ

( ٱللَّهُ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِیمِ )

[Surah An-Naml 26]

—আল্লাহ- তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের অধিপতি। অর্থাৎ আল্লাহর এত বড় বিশাল আরশ রয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টি জগতে এর চেয়ে বড় আর কিছুই নেই। যা হোক, এ সময় হযরত সুলায়মান (আ) হুদহুদ পাখীর নিকট একটি পত্র দিয়ে বিলকীসের নিকট পাঠান। চিঠিতে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের প্রতি আহ্বান জানান এবং বশ্যতা স্বীকার করে তাঁর কর্তৃত্ব ও রাজত্বের প্রতি আনুগত্য দেখানোর নির্দেশ দেন। এ আহ্বান ছিল বিলকীসের অধীনস্ত সকল প্রজাদের প্রতিও। তাই তিনি লেখেনঃ “অহমিকা বশে আমাকে অমান্য করো না।” অর্থাৎ আমার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান ও নির্দেশ অমান্য করো না। “এবং আনুগত্য স্বীকার করে আমার নিকট উপস্থিত হও।” এ কথা তোমাকে দ্বিতীয়বার বলা হবে না এবং কোন রকম অনুরোধও করা হবে না। অতঃপর হুদহুদ বিলকীসের নিকট চিঠি নিয়ে আসে। এ ঘটনার পর থেকে মানুষ চিঠির আদান-প্রদান করতে শিখে। কিন্তু সেই অনুগত, বিনয়ী বিচক্ষণ পাখীর আনীত চিঠির মূল্যের সাথে কি আর কোন চিঠির তুলনা করা চলে। বেশ কিছু মুফাসসির ও ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, হুদহুদ পাখী ঐ চিঠি নিয়ে বিলকীসের রাজপ্রাসাদে তার কক্ষে প্রবেশ করে এবং তার সামনে চিঠিটি রেখে দিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে যে, বিলকীস এর কি উত্তর দেন। বিলকীস তার মন্ত্রীবর্গ, পারিষদবর্গ ও অমাত্যদের এক জরুরী পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। “রাণী বিলকীস বলল, হে পারিষদবর্গ! আমাকে একটি সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে।” তারপর তিনি চিঠির শিরোনাম পড়লেন যে, “এটা সুলায়মানের পক্ষ থেকে এবং তা এই অসীম দাতা, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু। আমার মুকাবিলায় শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও।”

অতঃপর রাণী সভাসদবর্গের সাথে পরামর্শে বসেন, সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। সৌজন্য ও ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ “হে পারিষদবর্গ! আমার এই সমস্যায় তোমাদের অভিমত দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।” অর্থাৎ তোমাদের উপস্থিতি ও পরামর্শ ব্যতীত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি একা কখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না। তারা বলল, ‘আমরা শক্তিশালী ও কঠোর যোদ্ধা, এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। অতএব, আপনি ভেবে দেখুন, আমাদেরকে কি আদেশ করবেন।” অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাইল, আমরা দৈহিকভাবে, প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে এবং সমরাস্ত্রে শক্তিশালী, যুদ্ধে কঠোর ও অটল, রণাঙ্গণে শৌর্যবীর্যশালী বীরদের মুকাবিলা করতে সক্ষম। অতএব, আপনি যদি মুকাবিলা করতে চান তবে আমরা তাতে সক্ষম। এভাবে তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব রাণীর উপর ন্যস্ত করে, যাতে রাণী তার নিজের ও জনগণের জন্যে যেটা মংগলজনক ও সঠিক মনে করেন, সেই পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। ফলে দেখা গেল, রাণী যে সিদ্ধান্ত দিলেন, সেটাই ছিল সঠিক ও যথার্থ! তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই চিঠির প্রেরককে পরাভূত করা যাবে না, তার বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। তার প্রতিরোধ করা যাবে না এবং তাকে ধোঁকা দেওয়াও সম্ভব হবে না। রাণী বললেনঃ “রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে অপদস্থ করে। তারাও এরূপই করবে।” রাণী যথার্থ মতামতই ব্যক্ত করেছিলেন যে, এই বাদশাহ যদি আমাদের এ দেশ আক্রমণ করেন ও বিজয়ী হন তাহলে এর দায়-দায়িত্ব আমার উপরই বর্তাবে এবং সমস্ত ক্রোধ, হামলা ও প্রবল চাপ আমার উপরই আসবে। “আমি তাদের নিকট কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছি, দেখি প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব আনে।"

বিলকীস চেয়েছিলেন তার নিজের পক্ষ থেকে ও জনগণের পক্ষ থেকে সুলায়মান (আ)-এর নিকট উপঢৌকন পাঠাতে। তারপর তিনি তা পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার জানা ছিল না যে, আল্লাহর নবী হযরত সুলায়মান (আ) তা গ্রহণ করবেন না। কেননা রাণীর জনগণ ছিল কাফির। আর নবী ও তাঁর সৈন্যবাহিনী এই কাফির গোষ্ঠীকে পরাভূত করতে সক্ষম ছিলেন। তাই যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বলল, “তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক।” রাণী বিলকীস যে উপঢৌকন সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল পরিমাণে প্রচুর এবং মহা মূল্যবান দ্রব্য সম্ভার। মুফাসসিরীনে কিরাম এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। অতঃপর সুলায়মান (আ) দরবারে উপস্থিত লোকজনের সম্মুখে উপঢৌকন বহনকারী দূত ও প্রতিনিধি দলকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে এমন এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসব, যার মুকাবিলা করার শক্তি তাদের নেই। আমি অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত।” দূতকে বলা হচ্ছে যে, যেসব উপঢৌকন আমার কাছে এনেছ তা নিয়ে তুমি ফিরে যাও। কেননা, আল্লাহ আমাকে যে ধন-সম্পদ নিয়ামত হিসেবে দান করেছেন, তা এ উপটৌকন যা নিয়ে তোমরা গৌরব ও অহংকারবোধ করছো, তার তুলনায় অনেক বেশী এবং উৎকৃষ্ট। “আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসব এক সৈন্য বাহিনী, যার মুকাবিলার শক্তি ওদের নেই।” অর্থাৎ আমি তাদের বিরুদ্ধে এমন সেনাদল পাঠাব যাদেরকে প্রতিহত করার, প্রতিরোধ গড়ে তোলার ও যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং আমি তাদেরকে তাদের বাড়ি-ঘর, শহর, তাদের লেনদেন ও দেশ থেকে অপদস্থ করে বহিষ্কার করব। “এবং ওরা হবে লাঞ্ছিত।” অর্থাৎ তারা হবে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ঘৃণিত।

রাণী বিলকীসের রাজ্যের জনগণ যখন সুলায়মান (আ)-এর ঘোষণা জানতে পারল। তখন নবীর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। সুতরাং তারা সেই মুহূর্তে নবীর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে রাণীর নিকট এসে সমবেত হল ও বিনয়ের সাথে তাঁর আনুগত্য করে যাওয়ার অংগীকার ব্যক্ত করল। সুলায়মান (আ) যখন তাদের আগমনের ও প্রতিনিধি দল প্রেরণের সংবাদ শুনলেন তখন তার অনুগত এক জিনকে বললেনঃ

( قَالَ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَؤُا۟ أَیُّكُمۡ یَأۡتِینِی بِعَرۡشِهَا قَبۡلَ أَن یَأۡتُونِی مُسۡلِمِینَ ۝ قَالَ عِفۡرِیت مِّنَ ٱلۡجِنِّ أَنَا۠ ءَاتِیكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن تَقُومَ مِن مَّقَامِكَۖ وَإِنِّی عَلَیۡهِ لَقَوِیٌّ أَمِین ۝ قَالَ ٱلَّذِی عِندَهُۥ عِلۡم مِّنَ ٱلۡكِتَـٰبِ أَنَا۠ ءَاتِیكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن یَرۡتَدَّ إِلَیۡكَ طَرۡفُكَۚ فَلَمَّا رَءَاهُ مُسۡتَقِرًّا عِندَهُۥ قَالَ هَـٰذَا مِن فَضۡلِ رَبِّی لِیَبۡلُوَنِیۤ ءَأَشۡكُرُ أَمۡ أَكۡفُرُۖ وَمَن شَكَرَ فَإِنَّمَا یَشۡكُرُ لِنَفۡسِهِۦۖ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّی غَنِیّ كَرِیم ۝ قَالَ نَكِّرُوا۟ لَهَا عَرۡشَهَا نَنظُرۡ أَتَهۡتَدِیۤ أَمۡ تَكُونُ مِنَ ٱلَّذِینَ لَا یَهۡتَدُونَ ۝ فَلَمَّا جَاۤءَتۡ قِیلَ أَهَـٰكَذَا عَرۡشُكِۖ قَالَتۡ كَأَنَّهُۥ هُوَۚ وَأُوتِینَا ٱلۡعِلۡمَ مِن قَبۡلِهَا وَكُنَّا مُسۡلِمِینَ ۝ وَصَدَّهَا مَا كَانَت تَّعۡبُدُ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ إِنَّهَا كَانَتۡ مِن قَوۡم كَـٰفِرِینَ ۝ قِیلَ لَهَا ٱدۡخُلِی ٱلصَّرۡحَۖ فَلَمَّا رَأَتۡهُ حَسِبَتۡهُ لُجَّة وَكَشَفَتۡ عَن سَاقَیۡهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ صَرۡح مُّمَرَّد مِّن قَوَارِیرَۗ قَالَتۡ رَبِّ إِنِّی ظَلَمۡتُ نَفۡسِی وَأَسۡلَمۡتُ مَعَ سُلَیۡمَـٰنَ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah An-Naml 38 - 44]

—সুলায়মান আরো বলল, ‘হে আমার পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার নিকট আসার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার নিকট নিয়ে আসবে?’ এক শক্তিশালী জিন বলল, “আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান, বিশ্বস্ত।” কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, “আপনি চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দিব।” সুলায়মান যখন তা সম্মুখে রক্ষিত অবস্থায় দেখল তখন সে বলল, ‘এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ না অকৃতজ্ঞ।’ যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজের কল্যাণের জন্যে এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে, আমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, মহানুভব। সুলায়মান বলল, ‘তার সিংহাসনের আকৃতি অপরিচিত করে বদলিয়ে দাও; দেখি সে সঠিক দিশা পায় না সে বিভ্রান্তদের শমিল হয়? সেই নারী যখন আসল ও তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, “তোমার সিংহাসন কি এরূপই?” সে বলল, ‘এতো যেন তাই!’ আমাদেরকে ইতি পূর্বেই প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আত্মসমর্পণও করেছি। আল্লাহর পরিবর্তে সে যার পূজা করত, তা-ই তাকে সত্য হতে নিবৃত্ত করেছিল, সে ছিল কাফির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তাকে বলা হল, এই প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তা দেখল তখন সে ওটাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং সে তার পদদ্বয় (পায়ের গোছা) অনাবৃত করল; সুলায়মান বলল, ‘এতো স্বচ্ছ স্ফটিক খণ্ডিত প্রাসাদ।’ সেই নারী বলল, “হে আমার প্রতিপালক! আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম। আমি সুলায়মানের সহিত জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি।” (২৭ নামলঃ ৩৮-৪৪)

রাণী বিলকীস যে সিংহাসনের উপর বসে রাজ্য পরিচালনা করতেন, ঐ সিংহাসনটি বিলকীসের আগমনের পূর্বেই সুলায়মান (আ)-এর দরবারে হাজির করার জন্যে তিনি যখন জিনদেরকে আহ্বান করেন তখন এক শক্তিশালী জিন্ বললঃ

( قَالَ عِفۡرِیت مِّنَ ٱلۡجِنِّ أَنَا۠ ءَاتِیكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن تَقُومَ مِن مَّقَامِكَ )

[Surah An-Naml 39]

“আপনি আপনার স্থান থেকে উঠবার পূর্বেই আমি তা এনে দেব।”

অর্থাৎ আপনার মজলিস শেষ হবার পূর্বেই আমি তা হাজির করে দেব। কথিত আছে, সুলায়মান (আ) বনী-ইসরাঈলের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে দিনের প্রথম থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত মজলিস করতেন।

وَإِنِّی عَلَیۡهِ لَقَوِیٌّ أَمِین

“এবং এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান, বিশ্বস্ত।” অর্থাৎ উক্ত সিংহাসন আপনার কাছে উপস্থিত করে দিতে আমি সক্ষম এবং তাতে যে সব মূল্যবান মনি-মুক্তা রয়েছে তা যথাযথভাবে আপনার কাছে বুঝিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমি বিশ্বস্ততার পরিচয় দেব।

( قَالَ ٱلَّذِی عِندَهُۥ عِلۡم مِّنَ ٱلۡكِتَـٰبِ )

[Surah An-Naml 40]

–“কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল।” এই উক্তিকারীর নাম আসফ ইবন বারাখইয়া বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে। ইনি ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ)-এর খালাত ভাই। কেউ কেউ বলেন, ইনি ছিলেন একজন মু'মিন জিন্। কথিত আছে যে, ইসমে আজম এই জিনের কণ্ঠস্থ ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এই ব্যক্তি ছিলেন বনী-ইসরাঈলের একজন বিখ্যাত আলিম। কেউ কেউ বলেছেন, ইনি স্বয়ং হযরত সুলায়মান (আ)। কিন্তু এ মতটি অত্যন্ত দুর্বল। সুহায়লী এ মতকে দুর্বল আখ্যায়িত করে বলেন যে, বাক্যের পূর্বাপর এ কথাকে আদৌ সমর্থন করে না। চতুর্থ আরও একটি মত আছে যে, তিনি হযরত জিবরাঈল (আ)।

“আপনি চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব।” এ কথার ব্যাখ্যায় বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন যেমনঃ (১) যমীনের উপরে আপনার দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত একজন লোকের যেতে ও ফিরে আসতে যত সময় লাগবে, এই সময়ের পূর্বে আমি নিয়ে আসব; (২) দৃষ্টি সীমার মধ্যে সবচেয়ে দূরবর্তী একটি লোকের হেঁটে এসে আপনার কাছে পৌঁছতে যে সময় লাগবে, এই সময়ের পূর্বে; (৩) আপনি পলক বিহীন একটানা দৃষ্টিপাত করতে থাকলে চক্ষু ক্লান্ত হয়ে যখন চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসবে তার পূর্বে; (৪) আপনি সম্মুখপানে সর্ব দূরে দৃষ্টিপাত করে পুনরায় দৃষ্টি নিজের কাছে ফিরিয়ে এনে চক্ষু বন্ধ করার পূর্বে। উল্লেখিত মতামতের মধ্যে এই সর্বশেষ মতটি অধিক যথার্থ বলে মনে হয়। “সুলায়মান যখন তা' সম্মুখে রক্ষিত অবস্থায় দেখলেন" অর্থাৎ হযরত সুলায়মান (আ) বিলকীসের সিংহাসনকে যখন চোখের পলকের মধ্যে সুদূর ইয়ামান থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত দেখতে পেলেন, “তখন সে বলল, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ, না অকৃতজ্ঞ।” অর্থাৎ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার প্রতি অনুগ্রহ বিশেষ। আর বান্দাহর উপর তার অনুগ্রহের উদ্দেশ্য হল তাকে পরীক্ষা করা যে, সে এ অনুগ্রহ পেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, না অকৃতজ্ঞ হয়। “যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তা করে নিজের কল্যাণের জন্যে।” অর্থাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শুভ ফল তারই কাছে ফিরে আসে। “এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে, আমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, মহানুভব।” অর্থাৎ আল্লাহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীর কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন এবং অকৃতজ্ঞদের অকৃতজ্ঞতায় তার কোনই ক্ষতি নেই।

অতঃপর সুলায়মান (আ) বিলকীসের এ সিংহাসনের কারুকার্য পরিবর্তন করে দিতে ও আকৃতি বদলিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল, এর দ্বারা বিলকীসের জ্ঞান-বুদ্ধি পরীক্ষা করা। তাই তিনি বললেনঃ “দেখি, সে সঠিক দিশা পায় নাকি সে বিভ্রান্তদের শামিল হয়?” সে নারী যখন আসল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘তোমার সিংহাসন কি এরূপই?’ সে বলল, “এটা তো যেন তাই।” অর্থাৎ এটা ছিল তার বুদ্ধিমত্তা ও গভীর জ্ঞানের পরিচয়। কারণ এ সিংহাসন তার না হয়ে অন্যের হওয়া তার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। কেননা, এটা সে-ই নির্মাণ করিয়েছে এবং দীর্ঘ দিন একে ইয়ামানে প্রত্যক্ষ করেছে, তার ধারণা ছিল না যে, এ ধরনের আশ্চর্য কারুকার্য খচিত মূল্যবান সিংহাসন অন্য কেউ বানাতে পারে।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা সুলায়মান (আ) ও তার সম্প্রদায়ের সংবাদ দিয়ে বলছেনঃ “আমাদেরকে ইতিপূর্বেই প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আত্মসমর্পণও করেছি। আল্লাহর পরিবর্তে সে যার পূজা করত তাই তাকে সত্য থেকে নিবৃত্ত করেছিল, সে ছিল কাফির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।” অর্থাৎ বিলকীস ও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা পূর্ব-পুরুষদের অন্ধ অনুকরণে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের পূজা করত। এই সূর্য-পূজাই তাদেরকে আল্লাহর সত্য পথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। অথচ সূর্য পূজার পক্ষে তাদের কাছে কোন দলীল-প্রমাণ কিছুই ছিল না। হযরত সুলায়মান (আ) জিনদের দ্বারা একটি কাচের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদে যাওয়ার পথে তিনি একটি গভীর জলাশয় তৈরি করেন। জলাশয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী ছাড়েন। তারপর জলাশয়ের উপরে ছাদস্বরূপ স্বচ্ছ কাচের আবরণ নির্মাণ করেন। তারপর হযরত সুলায়মান তার সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট থেকে বিলকীসকে ঐ প্রাসাদে প্রবেশ করার আদেশ দেন।

“যখন সে তা দেখল তখন সে এটাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং সে তার পদদ্বয় অনাবৃত করল। সুলায়মান বলল, এ তো স্বচ্ছ স্ফটিক মণ্ডিত প্রাসাদ! সেই নারী বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম, আমি সুলায়মানের সাথে জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি।” কথিত আছে, বিলকীসের পায়ের গোছায় লম্বা লম্বা পশম ছিল। জিনরা চেয়েছিল এই পশম কোন উপায়ে সুলায়মানের সামনে প্রকাশ পাক এবং তা দেখে সুলায়মানের মনে ঘৃণা জন্মুক। জিনদের এরূপ করার কারণ ছিল, বিলকীসের মা ছিল জিন। এখন সুলায়মান যদি বিলকীসকে বিবাহ করেন তা হলে সুলায়মানের সাথে বিলকীসও জিনদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করবে বলে তারা আশংকা করছিল। কেউ কেউ বলেছেন, বিলকীসের পায়ের পাতা ছিল পশুর ক্ষুরের ন্যায়। এ মতটি অত্যন্ত দুর্বল, প্রথম মতটিও সন্দেহমুক্ত নয়। কথিত আছে, হযরত সুলায়মান (আ) যখন বিলকীসকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার পায়ের পশম ফেলে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি মানুষের পরামর্শ নেন। তারা ক্ষুর ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়। বিলকীস এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। এরপর তিনি জিনদেরকে জিজ্ঞেস করেন। তারা সুলায়মান (আ)-এর জন্যে চুনা তৈরি করে এবং একটা হাম্মানখানা নির্মাণ করে। এর পূর্বে মানুষ হাম্মানখানা কি, তা বুঝতো না। তিনিই সর্বপ্রথম হাম্মামখানা তৈরি করেন ও ব্যবহার করেন। সুলায়মান (আ) হাম্মানখানায় প্রবেশ করে চুণ দেখতে পান এবং পরীক্ষামূলকভাবে তা স্পর্শ করেন। স্পর্শ করতেই চুণের ঝাঁজে উহ্ বলে ওঠেন; কিন্তু তার এ উহঃতে কোন কাজ হয়নি। তিবরানী এ ঘটনা রাসূল (সা) থেকে (মারফু ভাবে) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তা সমর্থনযোগ্য নয়।

ছালাবী প্রমুখ লিখেছেন যে, সুলায়মান (আ) বিলকীসের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং তাঁর রাজত্ব বহাল রেখে তাকে ইয়ামানে পাঠিয়ে দেন। তিনি প্রতি মাসে একবার করে ইয়ামানে গমন করতেন এবং তিন দিন বিলকীসের কাছে থেকে পুনরায় চলে আসতেন। যাতায়াতে তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত আসনটি ব্যবহার করতেন। তিনি জিদের দ্বারা ইয়ামানে তিনটি অনুপম প্রাসাদ নির্মাণ করিয়ে দেন। প্রাসাদ তিনটির নাম গামদান, সালিহীন ও বায়তুন। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ...... ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, সুলায়মান (আ) বিলকীসকে নিজে বিবাহ করেন নি। বরং তাকে তিনি হামাদানের বাদশাহর সাথে বিবাহ করিয়ে দেন এবং বিলকীসকে ইয়ামানের রাজত্বে বহাল রাখেন। এরপর তিনি জিনদের বাদশাহ যূবিআকে তাঁর অনুগত করে দেন। সে তথায় উপরোল্লিখিত প্রাসাদ তিনটি নির্মাণ করে। তবে প্রথম বর্ণনাটিই অধিক প্রসিদ্ধ।

হযরত সুলায়মান (আ) প্রসংগে সূরা ‘সাদ’-এ আল্লাহর বাণীঃ

( وَوَهَبۡنَا لِدَاوُۥدَ سُلَیۡمَـٰنَۚ نِعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ إِنَّهُۥۤ أَوَّابٌ ۝ إِذۡ عُرِضَ عَلَیۡهِ بِٱلۡعَشِیِّ ٱلصَّـٰفِنَـٰتُ ٱلۡجِیَادُ ۝ فَقَالَ إِنِّیۤ أَحۡبَبۡتُ حُبَّ ٱلۡخَیۡرِ عَن ذِكۡرِ رَبِّی حَتَّىٰ تَوَارَتۡ بِٱلۡحِجَابِ ۝ رُدُّوهَا عَلَیَّۖ فَطَفِقَ مَسۡحَۢا بِٱلسُّوقِ وَٱلۡأَعۡنَاقِ ۝ وَلَقَدۡ فَتَنَّا سُلَیۡمَـٰنَ وَأَلۡقَیۡنَا عَلَىٰ كُرۡسِیِّهِۦ جَسَد ا ثُمَّ أَنَابَ ۝ قَالَ رَبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَهَبۡ لِی مُلۡك ا لَّا یَنۢبَغِی لِأَحَد مِّنۢ بَعۡدِیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ ۝ فَسَخَّرۡنَا لَهُ ٱلرِّیحَ تَجۡرِی بِأَمۡرِهِۦ رُخَاۤءً حَیۡثُ أَصَابَ ۝ وَٱلشَّیَـٰطِینَ كُلَّ بَنَّاۤء وَغَوَّاص ۝ وَءَاخَرِینَ مُقَرَّنِینَ فِی ٱلۡأَصۡفَادِ ۝ هَـٰذَا عَطَاۤؤُنَا فَٱمۡنُنۡ أَوۡ أَمۡسِكۡ بِغَیۡرِ حِسَاب ۝ وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 30 - 40]

—আমি দাউদকে দান করলাম সুলায়মান। সে ছিল উত্তম বান্দা এবং সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী। যখন অপরাহ্নে তার সম্মুখে ধাবনোদ্যত উৎকৃষ্ট অশ্বরাজিকে উপস্থিত করা হল, তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রতিপালকের স্মরণ হতে বিমুখ হয়ে সম্পদ প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি, এ দিকে সূর্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছে। এগুলোকে পুনরায় আমার সম্মুখে আনয়ন কর। তারপর সে এগুলোর পদ ও গলদেশ ছেদন করতে লাগল। আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং তার আসনের উপর রাখলাম একটি ধড়; তারপর সুলায়মান আমার অভিমুখী হল। সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে দান কর এমন এক রাজ্য, যার অধিকারী আমি ছাড়া কেউ না হয়। তুমি তো পরম দাতা।’ তখন আমি তার অধীন করে ছিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে, সে যেখানে ইচ্ছে করত সেথায় মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হত এবং শয়তানদেরকে, যারা সকলেই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী, এবং শৃঙ্খলে আবদ্ধ আরও অনেককে। এসব আমার অনুগ্রহ, এ থেকে তুমি অন্যকে দিতে অথবা নিজে রাখতে পার। এর জন্যে তোমাকে হিসেব দিতে হবে না। এবং আমার নিকট রয়েছে তার জন্যে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। (৩৮ সাদঃ ৩০-৪০)।

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ এ কথা উল্লেখ করছেন যে, তিনি দাউদকে পুত্র হিসেবে সুলায়মানকে দান করেছেন। এরপর সুলায়মানের প্রশংসার বলেছেন, “সে ছিল উত্তম বান্দা এবং সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী।” অতঃপর আল্লাহ হযরত সুলায়মান ও তার উৎকৃষ্ট, শক্তিশালী অশ্ব সম্পর্কিত ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ( ٱلصَّـٰفِنَـٰتُ ) বা দ্রুতগামী অশ্ব বলতে ঐসব শক্তিশালী অশ্বকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলো তিন পায়ের উপর দাঁড়ায় এবং চতুর্থ পায়ের একাংশের উপর ভর করে দাঁড়ায়।

( حياد ) অর্থ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দ্রুতগামী অশ্ব। “তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রতিপালকের স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে সম্পদ প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি, এদিকে সূর্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছে।” কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, ঘোড়া চোখের আড়ালে চলে গিয়েছে। এগুলোকে পুনরায় আমার সম্মুখে আনয়ন কর। অতঃপর সে ঐগুলোর পদ ও গলদেশ ছেদন করতে লাগল। এ কথার দু'রকম তাফসীর করা হয়েছিল। প্রথম মতে অর্থ হল, তিনি তরবারী দ্বারা ঘাড়ের রগ ও গলদেশ কেটে দিয়েছেন। দ্বিতীয় মতে অর্থ হল, ঘোড়াগুলোকে প্রতিযোগিতা করানোর পর ওগুলোকে ফিরিয়ে এনে তিনি এগুলোর ঘাম মুছে দেন। অধিকাংশ আলিম প্রথম মত সমর্থন করেন। তাঁরা বলেছেন, হযরত সুলায়মান (আ) অশ্বরাজি পরিদর্শন করার কাজে লিপ্ত থাকায় আসরের নামাযের সময় অতিবাহিত হয়ে যায় এবং সূর্য অস্তমিত হয়। হযরত আলীসহ কতিপয় সাহাবী থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্যের উপর আপত্তি তোলা যায় যে, তিনি ওযর ব্যতীত কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে নামায কাযা করেন নি বলে নিশ্চিতরূপে বলা যায়। অবশ্য এ আপত্তির উত্তর এভাবে দেয়া যায় যে, তাঁর অশ্বরাজি ছিল জিহাদের জন্যে প্রস্তুত। তিনি সেগুলো পরিদর্শন করছিলেন আর এ জাতীয় ব্যাপারে নামায আদায় বিলম্ব করা তখনকার শরী'আতে বৈধ ছিল।

একদল আলিম দাবি করেছেন যে, খন্দকের যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ (সা) আসরের নামায কাযা করেন; কারণ তখন পর্যন্ত এরূপ করা বৈধ ছিল। পরবর্তীতে সালাতুল খাওফ (ভয়ের নামায)-এর দ্বারা ঐরূপ কাযা বিধান রহিত হয়ে যায়। ইমাম শাফিঈসহ কতিপয় আলিম এ কথা বলেছেন। কিন্তু মাকহুল, আওযাঈ প্রমুখ বলেছেন, যুদ্ধের প্রচণ্ডতার কারণে নামায বিলম্বে পড়া ও কাযা করা একটা স্থায়ী বিধান এবং ঐরূপ অবস্থায় আজও এ বিধানের কার্যকারিতা রয়েছে। আমরা তাফসীর গ্রন্থে সূরা নিসায় সালাতুল খওফের আলোচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অপর একদল আলিম বলেছেন, খন্দকের যুদ্ধে নবী করীম (সা)-এর আসরের নামায কাযা হয়েছিল ভুলে যাওয়ার কারণে। তাঁরা বলেন, হযরত সুলায়মান (আ)-এরও নামায কাযা হয়েছিল ঐ একই কারণে। যেসব মুফাসসির ঘোড়া আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তাদের মতে সুলায়মান (আ)-এর নামায কাযা হয়নি। এবং

( رُدُّوهَا عَلَیَّۖ فَطَفِقَ مَسۡحَۢا بِٱلسُّوقِ وَٱلۡأَعۡنَاقِ )

[Surah Sad 33]

আয়াতের অর্থ পূর্বের অর্থের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। তখন এর অর্থ হবে, ঘোড়াগুলিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আন। ফিরিয়ে আনার পর তিনি সেগুলোর গলদেশ ও পায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন ও ঘাম মুছিয়ে দেন। ইবন জারীর এই তাফসীরকে সমর্থন করেছেন।

ওয়ালীবী হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে এ কথা বর্ণনা করেছেন। ইবনে জারীর এই তাফসীরকে এ কারণে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, এতে সম্পদ বিনষ্ট করার অভিযোগ এবং বিনা অপরাধে পশুকে রগ কেটে শাস্তি দেওয়ার আপত্তি থাকে না। কিন্তু এ তাফসীরও প্রশ্নাতীত নয়; কেননা, হতে পারে পশু এভাবে যবেহ করা তখনকার শরীআতে বিধিসম্মত ছিল। এ কারণে আমাদের অনেক আলিম বলেছেন, মুসলমানদের যদি আশংকা হয় যে, তাদের গনীমাতে প্রাপ্ত কিংবা অন্য কোন উপায়ে প্রাপ্ত পশু কাফিররা দখল করে নিবে তখন এসব পশু নিজেদের হাতে যবেহ করা ও ধ্বংস করে দেয়া বৈধ, যাতে কাফিররা এগুলো দখল করে শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে। এই যুক্তিতেই হযরত জা'ফর ইবন আবী তালিব (রা) মূতার যুদ্ধে নিজের অশ্বের পা নিজেই কেটে দিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, হযরত সুলায়মান (আ)-এর ছিল বিরাট অশ্ব পাল। কারও মতে দশ হাজার এবং কারও মতে বিশ হাজার। কেউ কেউ বলেছেন যে, এসব অশ্বের মধ্যে বিশটি অশ্ব ছিল ডানা বিশিষ্ট।

আবু দাউদ (র) তাঁর সুনান গ্রন্থে ....... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাবুক অথবা খায়বার যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাগমন করে যখন বাড়িতে ফিরেন, তখন বাতাসে পর্দা সরে যাওয়ায় ঐ ফাঁক দিয়ে দেখেন, আয়েশা (রা) ঘরের মধ্যে কাপড়ের পুতুল নিয়ে খেলা করছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আয়েশা! এগুলো কি?’ আয়েশা বললেন, ‘এগুলো আমার মেয়ে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) পুতুলদের মাঝে দুই ডানা বিশিষ্ট একটা কাপড়ের ঘোড়া দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘মাঝখানের ওটা কি দেখা যায়?’ আয়েশা বললেন, ‘ওটা ঘোড়া।’ রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করেন, ‘ঘোড়ার উপরে ওটা কি?’ আয়েশা বললেন, ‘ওটা ঘোড়ার দুই ডানা।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘ঘোড়ার আবার দুই ডানা হয় নাকি? আয়েশা (রা) বললেন, কি, আপনি কি শুনেন নি যে, সুলায়মান (আ)-এর ঘোড়া ডানা বিশিষ্ট ছিল?’ আয়েশা বলেন, ‘আমার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) এমনভাবে হাসলেন যে, আমি তার মাড়ির শেষ দাঁত পর্যন্ত দেখতে পেলাম।’

কোন কোন আলিম বলেছেন, সুলায়মান (আ) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অশ্বরাজি বিনষ্ট করার পর আল্লাহ তাকে আরও উত্তম বস্তু দান করেন, তা হলো আল্লাহ বাতাসকে তার অনুগত করে দেন, যার সাহায্যে তিনি এক সকালে এক মাসের পথ এবং এক বিকেলে এক মাসের পথ অতিক্রম করতে পারতেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসছে। এর সমর্থনে ইমাম আহমদ ........ কাতাদা ও আবুদ দাহমা (র) থেকে বর্ণনা করেন। তাঁরা দু’জন প্রায়ই বায়তুল্লাহর সফর করতেন। এমনি এক সফরে তাঁদের সাথে এক বেদুইনের সাক্ষাৎ হয়। বেদুইন লোকটি বলেন যে, ‘একদা রাসূলুল্লাহ (সা) আমার হাত ধরে কাছে নিয়ে কিছু বিষয় শিক্ষা দিলেন- যা স্বয়ং আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাকে বললেন, আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ত্যাগ করবে, তার চেয়ে অধিক উত্তম বস্তু আল্লাহ তোমাকে দান করবেন।’ আল্লাহর বাণীঃ “আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং তার আসনের উপর রাখলাম একটি ধড়, অতঃপর সে আমার অভিমুখী হল।” ইবন জারীর, ইবন আবী হাতিমসহ বেশ কিছু সংখ্যক মুফাসসির এ আয়াতের তাফসীরে প্রথম যুগের মনীষীগণের বরতে অনেক রিওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর অধিকাংশই কিংবা সম্পূর্ণটা ইসরাঈলী বর্ণনা। অধিকাংশ ঘটনা খুবই আপত্তিকর। আমরা তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছি। এখানে শুধু আয়াতের উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। তারা যা লিখেছে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, সুলায়মান (আ) সিংহাসন থেকে চল্লিশ দিন অনুপস্থিত থাকেন। চল্লিশ দিন পর পুনরায় সিংহাসনে ফিরে আসেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করার আদেশ দেন। ফলে অত্যন্ত মজবুতভাবে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদটি নির্মিত হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে আমরা লিখে এসেছি যে, সুলায়মান (আ) বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেননি বরং পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। এটি প্রথমে নির্মাণ করেছিলেন ইসরাঈল অর্থাৎ ইয়াকূব (আ)। এ সম্পর্কে হযরত আবু যর (রা)-এর বর্ণিত হাদীস সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সর্বপ্রথম নির্মিত মসজিদ কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘মসজিদুল হারাম।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপরে কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদ।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ দুই মসজিদ নির্মাণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত?’ তিনি বললেন, ‘চল্লিশ বছর।’ এখানে উল্লেখ্য যে, মসজিদে হারামের নির্মাতা হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত সুলায়মান (আ)-এর মাঝে সময়ের ব্যবধান চল্লিশ বছর তো হতেই পারে না; বরং তা এক হাজার বছরেরও বেশী।

উল্লেখিত আয়াতে হযরত সুলায়মান (আ) আল্লাহর নিকট এমন একটা রাজত্ব পাওয়ার আবেদন করেছেন, যেইরূপ রাজত্ব তার পরে আর কাউকে দেওয়া হবে না- এর মর্ম হল, বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, ইবন খুযায়মা, ইবন হিব্বান, হাকিম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ নিজ নিজ সনদে ...... আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সুলায়মান (আ) বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করার সময় আল্লাহর নিকট তিনটি বিষয় চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে তিনটির মধ্যে দুটি দান করেছেন। আশা করি তৃতীয়টি আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন। তিনি আল্লাহর নিকট চেয়েছিলেন এমন ফয়সালা দানের ক্ষমতা, যা আল্লাহর ফয়সালার সাথে মিলে যায়। আল্লাহ তাঁকে তা দান করেন। তিনি আল্লাহর নিকট এমন একটা রাজত্ব পাওয়ার আবেদন করেন, যে রকম রাজত্ব তার পরে আর কাউকে দেয়া হবে না। আল্লাহ এটাও তাকে দান করেন। তিনি আল্লাহর নিকট আবেদন করেন যে, কোন লোক যদি এই (বায়তুল মুকাদ্দাস) মসজিদে কেবল সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বের হয়, সে যেন এমন নিস্পাপ হয়ে বেরিয়ে যায় যেমন নিস্পাপ ছিল সে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার দিন। আমরা আশা করি এই তৃতীয়টা আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন। সুলায়মান (আ) যে ফয়সালা দিতেন তা যে আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ী হতো, সে প্রসংগ আল্লাহ তার ও তার পিতার প্রশংসায় বলেছেনঃ

( وَدَاوُۥدَ وَسُلَیۡمَـٰنَ إِذۡ یَحۡكُمَانِ فِی ٱلۡحَرۡثِ إِذۡ نَفَشَتۡ فِیهِ غَنَمُ ٱلۡقَوۡمِ وَكُنَّا لِحُكۡمِهِمۡ شَـٰهِدِینَ ۝ فَفَهَّمۡنَـٰهَا سُلَیۡمَـٰنَۚ وَكُلًّا ءَاتَیۡنَا حُكۡم ا وَعِلۡم ࣰا)

[Surah Al-Anbiya' 78 - 79]

অর্থাৎ, এবং স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানের কথা, যখন তারা বিচার করছিল শস্যক্ষেত সম্পর্কে; তাতে রাত্রিকালে প্রবেশ করেছিল কোন সম্প্রদায়ের মেষ; আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম তাদের বিচার। এবং আমি সুলায়মানকে এ বিষয়ের মীমাংসা বুঝিষে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। (২১ আম্বিয়াঃ ৭৮-৭৯)।

কাযী শুরায়হ্ ও অন্যান্য কতিপয় প্রাচীন মুফাসসির এ আয়াতের শানে নুযূলে লিখেছেনঃ হযরত দাউদ (আ)-এর নিকট যারা বিচারপ্রার্থী হয়েছিল তাদের আংগুরের ক্ষেত ছিল। অন্য এক সম্প্রদায় তাদের মেষপাল রাত্রিবেলায় ঐ ক্ষেতে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে মেষপাল আঙ্গুরের গাছ খেয়ে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে ফেলে। অতঃপর বাদী-বিবাদী উভয় দল দাউদ (আ)-এর নিকট মীমাংসার জন্যে আসে। ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি আংগুর ক্ষেতের মালিক পক্ষকে তার ক্ষয়-ক্ষতির সমপরিমাণ মূল্য প্রদান করার জন্যে মেষ-মালিক পক্ষকে নির্দেশ দেন। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দাউদ পুত্র সুলায়মানের সংগে তাদের সাক্ষাত হয়। সুলায়মান (আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর নবী তোমাদেরকে কী ফয়সালা দিয়েছেন?’ তারা ফয়সালার বিবরণ শুনাল। সুলায়মান (আ) বললেন, ‘যদি আমি এ ঘটনার বিচার করতাম তাহলে এই রায় দিতাম না; বরং আমার ফয়সালা হত এভাবে যে, মেষপাল আংগুর ক্ষেতের মালিক পক্ষকে দেয়া হত। তারা এগুলোর দুধ, বাচ্চা, পশম থেকে উপকৃত হতে থাকতো, আর ক্ষেত মেষপালের মালিক পক্ষের নিকট অর্পণ করা হত। তারা তাতে চাষাবাদ করে শস্য উৎপন্ন করত। যখন শস্য ক্ষেত্র মেষপালক দ্বারা বিনষ্ট হওয়ার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যেত, তখন শস্য ক্ষেত্র ক্ষেতের মালিক পক্ষকে এবং মেষপাল মেষের মালিক পক্ষকে প্রত্যর্পণ করা হত।’ এই কথা দাউদ (আ)-এর কর্ণগোচর হলে তিনি পূর্বের রায় রহিত করে সুলায়মানের মত অনুযায়ী পুনরায় রায় দেন।

প্রায় এই ধরনের আর একটি ঘটনা বুখারী শরীফে ........ আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ দুই মহিলা এক সংগে সফর করছিল। উভয়ের কোলে ছিল দুগ্ধপোষ্য শিশু পুত্র। পথে এক শিশুকে বাঘে নিয়ে যায়। অবশিষ্ট শিশুকে উভয় মহিলা নিজের পুত্র বলে দাবি করে এবং পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। দু'জনের মধ্যে বয়োঃজ্যেষ্ঠা মহিলা বলল, ‘তোমার পুত্রকে বাঘ নিয়ে গেছে’; আর কনিষ্ঠা মহিলাটি বলল, ‘বরং তোমার পুত্রকেই বাঘে নিয়েছে।’ অতঃপর মহিলাদ্বয় হযরত দাউদ (আ)-এর নিকট এর মীমাংসার জন্যে যায়। তিনি উভয়ের বিবরণ শুনে জ্যেষ্ঠা মহিলার পক্ষে রায় দেন, কারণ শিশুটি তার কাছে ছিল এবং ছোট জনের পক্ষে কোন সাক্ষী ছিল না। বিচারের পর তারা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন সুলায়মান (আ)-এর সাথে তাদের সাক্ষাত হয়। তিনি বিচারের বর্ণনা শোনার পর একটা ছুরি আনার হুকুম দেন এবং বলেন, ‘আমি শিশুটিকে সমান দু’ভাগ করে প্রত্যেককে অর্ধেক করে দিব।’ তখন কনিষ্ঠা মহিলাটি বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে রহম করুন, আপনি ওকে দ্বি-খণ্ডিত করবেন না, শিশুটি ঐ মহিলারই, আপনি ওকে দিয়ে দিন।’ (তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, শিশুটি কনিষ্ঠা মহিলারই। তাই তিনি শিশুটিকে কনিষ্ঠা মহিলাকেই প্রদান করেন। সম্ভবত উভয় রকম বিচার তখনকার শরী'আতে চালু ছিল। তবে সুলায়মান (আ) এর বিচার ছিল অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এ কারণেই আল্লাহ তা'আলা কুরআন মজীদে প্রথমে সুলায়মান (আ)-এর সুবিচারের প্রশংসা করার পর তাঁর পিতা দাউদ (আ)-এর প্রশংসা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

( وَكُلًّا ءَاتَیۡنَا حُكۡم ا وَعِلۡم اۚ وَسَخَّرۡنَا مَعَ دَاوُۥدَ ٱلۡجِبَالَ یُسَبِّحۡنَ وَٱلطَّیۡرَۚ وَكُنَّا فَـٰعِلِینَ ۝ وَعَلَّمۡنَـٰهُ صَنۡعَةَ لَبُوس لَّكُمۡ لِتُحۡصِنَكُم مِّنۢ بَأۡسِكُمۡۖ فَهَلۡ أَنتُمۡ شَـٰكِرُونَ )

[Surah Al-Anbiya' 79 - 80]

—এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। আমি পর্বত ও বিহংগকুলকে অধীন করে দিয়েছিলাম ওরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করত। আমিই ছিলাম এই সমস্তের কর্তা। আমি তাকে তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা তোমাদের যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে; সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না? (২১ আম্বিয়াঃ ৭৯-৮০)। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

( وَلِسُلَیۡمَـٰنَ ٱلرِّیحَ عَاصِفَة تَجۡرِی بِأَمۡرِهِۦۤ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ٱلَّتِی بَـٰرَكۡنَا فِیهَاۚ وَكُنَّا بِكُلِّ شَیۡءٍ عَـٰلِمِینَ ۝ وَمِنَ ٱلشَّیَـٰطِینِ مَن یَغُوصُونَ لَهُۥ وَیَعۡمَلُونَ عَمَل ا دُونَ ذَ  ٰ⁠ لِكَۖ وَكُنَّا لَهُمۡ حَـٰفِظِینَ )

[Surah Al-Anbiya' 81 - 82]

—এবং সুলায়মানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; তা' তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হত সেই দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত। এবং শয়তানদের মধ্যে কতক তার জন্যে ডুবুরীর কাজ করত; তাছাড়া অন্য কাজও করত; আমি ওদের রক্ষাকারী ছিলাম। (২১ আম্বিয়াঃ ৮১-৮২)

অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ

( فَسَخَّرۡنَا لَهُ ٱلرِّیحَ تَجۡرِی بِأَمۡرِهِۦ رُخَاۤءً حَیۡثُ أَصَابَ ۝ وَٱلشَّیَـٰطِینَ كُلَّ بَنَّاۤء وَغَوَّاص ۝ وَءَاخَرِینَ مُقَرَّنِینَ فِی ٱلۡأَصۡفَادِ ۝ هَـٰذَا عَطَاۤؤُنَا فَٱمۡنُنۡ أَوۡ أَمۡسِكۡ بِغَیۡرِ حِسَاب ۝ وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 36 - 40]

—তখন আমি তার অধীন করে দিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে, সে যেখানে ইচ্ছা করত সেখানে মৃদুমন্দ ভাবে প্রবাহিত হত, এবং শয়তানদেরকে যারা সকলেই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী, এবং শৃঙ্খলে আবদ্ধ আরও অনেককে। এ সবই আমার অনুগ্রহ; এ থেকে তুমি অন্যকে দিতে অথবা নিজে রাখতে পার। এর জন্যে তোমাকে হিসাব দিতে হবে না। এবং আমার নিকট রয়েছে তার জন্যে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। (৩৮ সাদঃ ৩৬-৪০)।

হযরত সুলায়মান (আ) যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার রক্ষিত অশ্বরাজির মায়া ত্যাগ করলেন তখন আল্লাহ তার পরিবর্তে বায়ুকে তাঁর অধীন করে দেন। যা ছিল অশ্বের তুলনায় অধিক দ্রুতগামী ও শক্তিশালী। এতে কোন রকম কষ্টও ছিল না; তাঁর নির্দেশে সে বায়ু প্রবাহিত হত মৃদুমন্দ গতিতে। যেই কোন শহরে তিনি যেতে ইচ্ছে করতেন, বায়ু সেখানেই তাকে নিয়ে যেত। হযরত সুলায়মানের ছিল কাঠের তৈরি এক বিশাল আসন; তাতে পাকা ঘর, প্রাসাদ, তাঁবু, আসবাবপত্র, অশ্ব, উট, ভারি জিনিসপত্র, মানুষ, জিন্ এবং সর্বপ্রকার পশুপাখী প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সবকিছুর স্থান সঙ্কুলান হতো।

যখন তিনি কোথাও কোন সফরে বিনোদনে কিংবা কোন রাজা অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে বের হতেন, তখন ঐসব কিছু ঐ আসনে তুলে বায়ুকে হুকুম করতেন। বায়ু ঐ আসনের নীচে প্রবেশ করে তা শূন্যে উঠিয়ে নিত। অতঃপর আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্তর পর্যন্ত তা উঠার পর মৃদুমন্দ গতিতে চলার নির্দেশ দিলে বায়ু সেভাবে তা' সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যেত। আবার যখন দ্রুত যাওয়ার ইচ্ছে করতেন তখন বায়ুকে যেভাবে নির্দেশ দিতেন; ফলে বায়ু প্রবল বেগে ধাবিত হত এবং অল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়ে দিত। এভাবে তিনি সকাল বেলা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে যাত্রা করে এক মাসের দূরত্বে অবস্থিত ইসতাখারে দ্বিপ্রহরের পূর্বেই পৌঁছে যেতেন এবং সেখানে বিকেল পর্যন্ত অবস্থান করে আবার সন্ধ্যার পূর্বেই বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসতেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( وَلِسُلَیۡمَـٰنَ ٱلرِّیحَ غُدُوُّهَا شَهۡر وَرَوَاحُهَا شَهۡر ۖ وَأَسَلۡنَا لَهُۥ عَیۡنَ ٱلۡقِطۡرِۖ وَمِنَ ٱلۡجِنِّ مَن یَعۡمَلُ بَیۡنَ یَدَیۡهِ بِإِذۡنِ رَبِّهِۦۖ وَمَن یَزِغۡ مِنۡهُمۡ عَنۡ أَمۡرِنَا نُذِقۡهُ مِنۡ عَذَابِ ٱلسَّعِیرِ ۝ یَعۡمَلُونَ لَهُۥ مَا یَشَاۤءُ مِن مَّحَـٰرِیبَ وَتَمَـٰثِیلَ وَجِفَان كَٱلۡجَوَابِ وَقُدُور رَّاسِیَـٰتٍۚ ٱعۡمَلُوۤا۟ ءَالَ دَاوُۥدَ شُكۡر اۚ وَقَلِیل مِّنۡ عِبَادِیَ ٱلشَّكُورُ )

[Surah Saba’ 12 – 13]

—আমি সুলায়মানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে যা প্রভাতে এক মাসের পথ অতিক্রম করত এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম। তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে জিনদের কতক তার সম্মুখে কাজ করত। ওদের মধ্যে যে আমার নির্দেশ অমান্য করে তাকে আমি জ্বলন্ত অগ্নি-শাস্তি-আস্বাদন করাব। তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাওয-সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত। আমি বলেছিলাম, হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সংগে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ। (৩৪ সাবাঃ ১২-১৩)।

হাসান বসরী (র) বলেছেন, হযরত সুলায়মান (আ) প্রভাতে দামিশক থেকে যাত্রা শুরু করতেন এবং ইসতাখারে পৌঁছে সকালের নাস্তা করতেন। অবার বিকলে বেলা সেখান থেকে যাত্রা করে কাবুলে পৌঁছে রাত্রি যাপন করতেন। অথচ স্বাভাবিক গতিতে দামিশক থেকে ইসতাখার যেতে সময় লাগতো এক মাস। অনুরূপ ইসতাখার থেকে কাবুলের দূরত্ব ছিল এক মাসের। শহর-নগর ও স্থাপত্য শিল্পের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, ইসতাখার শহরটি জিনরা হযরত সুলায়মান (আ)-এর জন্যে নির্মাণ করেছিল। এটা ছিল প্রাচীন তুর্কিস্তানের রাজধানী। অনুরূপ অন্যান্য কতিপয় শহর যেমন- তাদমুর বায়তুল মুকাদ্দাস, বাবে জাবরূন ও বাবুল বারীদ শেষোক্ত দুটি শহর অনেকের মতে দামিশক অঞ্চলে অবস্থিত।

ইবন আব্বাস (রা) মুজাহিদ, ইকরামা, কাতাদা (র) প্রমুখ অনেকেই ( قطر ) শব্দটির অর্থ করেছেন তামা। কাতাদা বলেন, এই তামা ইয়ামানের খনিজ সম্পদ ছিল। আল্লাহ তা উত্থিত করে ঝর্ণার আকারে সুলায়মান (আ)-এর জন্যে প্রবাহিত করে দেন। সুদ্দী বলেন, তা মাত্র তিন দিন স্থায়ী ছিল। সুলায়মান (আ) তার নির্মাণাদির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ তামা এই সময়ের মধ্যে সগ্রহ করে নেন। আল্লাহর বাণীঃ

“কতক জিন্ তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি তাকে জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি আস্বাদন করাব। অর্থাৎ আল্লাহ কতক জিনকে সুলায়মান (আ)-এর মজুর হিসেবে অধীনস্থ করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে যে কাজ করার আদেশ দিতেন, তারা সে কাজই করত; এতে তারা গাফলতি করতো না বা অবাধ্যও হত না। অবশ্য যে-ই অবাধ্য হত ও আনুগত্য প্রত্যাহার করত, তাকে তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেন। তারা সুলায়মানের জন্যে নির্মাণ করত দুর্গ। ( محاريب ) অর্থ- সুদৃশ্য প্রাসাদ ও সভাকক্ষ ( وتماثيل ) প্রাচীর গাত্রে উত্তীর্ণ ভাস্কর্য। তখনকার শরীআতে তা বৈধ ছিল। ( وجفان كااجواب ) ইবন আব্বাস বলেছেন, জিফানুন অর্থ মাটির গর্ত বা মাটির দ্বারা তৈরি পাত্র যা আকারে হাউযের ন্যায় বড়। মুজাহিদ, হাসান, কাতাদা, যাহ্হাক প্রমুখ মনীষীগণও অনুরূপ বলেছেন। জাওয়াব বহুবচন, এক বচনে জাবিয়াতুন। অর্থ হাওয-যার মধ্যে পানি জমা থাকে। কবি আশা বলেছেনঃ

تروح على أل المحلق جفنه كجابية الشيخ العراقي يفهق

অর্থ- তুমি সাঁঝের বেলা মুহাললাক পরিবারের হাওযের পাড়ে উপস্থিত হবে, যা পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। এ হাওযটি শায়খে ইরাকির হাওযের মত। ( وقدور الراسيات ) (এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ।) এর ব্যাখায় ইকরামা, মুজাহিদ প্রমুখ বলেছেন, কুদূরুর রাসিয়াত বলে চুল্লিতে স্থাপিত ডেগ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এসব ডেগ সর্বদা সেখানে স্থাপিত থাকে, কখনও নামিয়ে রাখা হয় না। এ কথা বলার তাৎপর্য হচ্ছে, তিনি সর্বদা জিন ও ইনসানকে খাদ্য সরবরাহ করতেন এবং তাদের প্রতি বদান্যতা প্রকাশ করতেন।

আল্লাহর বাণীঃ “(হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ।”) আল্লাহর বাণীঃ

“আর শয়তানদিগকে যারা সকলেই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী।”

অর্থাৎ কিছু সংখ্যক শয়তান জিনকে সুলায়মানের অধীন করে দেয়া হয়। যারা প্রাসাদ অট্টালিকা নির্মাণে নিয়োজিত ছিল। আর কিছু জিনকে তিনি সমুদ্রের তলদেশ থেকে মনি-মুক্তা আহরণের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন, এরা সে কাজই করত। “এবং শৃংখলে আবদ্ধ আরও অনেককে।” অর্থাৎ কিছু দুষ্ট জিন্ অবাধ্য হওয়ার কারণে শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে দু'জন দু'জন করে একত্রে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উপরের বর্ণনায় যে সব জিনিসকে সুলায়মান (আ)-এর অধীনস্থ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর উপর তার শাসন ও নির্দেশ কার্যকর ছিল। এটাই হচ্ছে তার সেই রাজত্ব ও কর্তৃত্ব, যার জন্যে তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন, যে তার পরে কিংবা পূর্বে কেউই যেন আর তা না পায়।

ইমাম বুখারী ...... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ গত রাত্রে নামায পড়ার সময় এক দুষ্ট জিন্ আমার নামায নষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমার প্রতি থুথু নিক্ষেপ করে। কিন্তু আল্লাহ আমাকে তার উপর প্রবল করে দেন। আমি তাকে ধরে ফেলেছিলাম এবং মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম। তা করলে তোমরা সবাই তাকে দেখতে পেতে। কিন্তু ঐ সময় হযরত সুলায়মানের দোয়া আমার স্মরণ হল- তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেনঃ

( قَالَ رَبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَهَبۡ لِی مُلۡك ا لَّا یَنۢبَغِی لِأَحَد مِّنۢ بَعۡدِیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ )

[Surah Sad 35]

“হে আমার পালনকর্তা, আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান কর, যা আমার পরে আর কেউ পাবে না।” (৩৮ সাদঃ ৩৫) তারপর আমি তাকে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলাম। ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ শা'বী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম ...... আবুদ দারদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা সালাত আদায় করছিলেন। আমরা শুনলাম, তিনি সালাতের মধ্যে বলছেনঃ ( اعوذ بالله منك العنك بلعنة الله ) ‘আমি আল্লাহর কাছে তোমার থেকে পানাহ চাই, আমি তোমাকে আল্লাহর লা'নতের অভিশাপ দিচ্ছি।’ রাসূলুল্লাহ এ কথাটি তিন বার বললেন। এরপর তিনি হাত সম্প্রসারিত করলেন, মনে হল তিনি কোন কিছু ধরতে যাচ্ছেন। নামায শেষ হওয়ার পর আমরা বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে সালাতের মধ্যে এমন কথা বলতে শুনলাম, যা ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি, আমরা আরও দেখলাম আপনি হাত বাড়িয়ে দিলেন।’ তিনি বললেন, ‘সালাতের মধ্যে আল্লাহর দুশমন ইবলীস আগুনের হলকা নিয়ে এসে আমার মুখমণ্ডলে ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল, তখন আমি তিনবার ( اعوذ بالله منك ) বলি। এরপর আমি ( العنك بلعنة الله ) বাক্যটিও তিনবার উচ্চারণ করি। তাতেও সে পিছালো না। অতঃপর আমি তাকে ধরার উদ্যোগ নেই। আল্লাহর কসম, আমাদের ভাই নবী সুলায়মানের দোয়া যদি না থাকত তা হলে তাকে বেঁধে রাখা হত এবং মদীনার ছেলে-মেয়েরা তাকে নিয়ে খেলা করত।’ ইমাম নাসাঈও এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ ........ আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা ফজরের সালাত আদায়ের জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন। আমিও তার পিছনে সালাতে শরীক ছিলাম। তিনি কিরাআত পড়ছিলেন; কিন্তু হঠাৎ কিরাআত জড়িয়ে যায়। সালাত শেষে তিনি বললেন, ‘আজকের সালাতে আমার কিরাআত ইবলিস গুলিয়ে দেয়। তোমরা যদি দেখতে পারতে তা হলে বুঝতে পারতে। আমি তার টুটি চেপে ধরি। তার মুখ থেকে লালা বেরিয়ে আসে। এমনকি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীতে তার শীতলতা অনুভব করি। আমার ভাই সুলায়মান (আ)-এর দোয়ার কথা যদি মনে না পড়তো তা হলে মসজিদের খুঁটির সাথে আমি তাকে বেঁধে রাখতাম এবং মদীনার ছেলে-মেয়েরা তাকে নিয়ে খেলা করতো! অতএব, তোমরা চেষ্টা কর যাতে সালাত আদায়ের সময় তোমার ও কিবলার মাঝে অন্য কেউ আড়াল সৃষ্টি না করে।’ আবু দাউদ (র)-ও এ হাদীস ভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছেন।

বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, হযরত সুলায়মান (আ)-এর এক হাজার স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাতশ' ছিলেন স্বাধীন এবং তিনশত বাঁদী। কেউ কেউ এর বিপরীতে তিনশ’ স্বাধীন ও সাতশ’ বাদীর কথা বলেছেন। হযরত সুলায়মান (আ) ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও সক্ষম পুরুষ। ইমাম বুখারী ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ একদা হযরত সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ (আ) বলেছিলেন, আজ রাত্রে আমি সত্তরজন স্ত্রীর কাছে যাব। প্রত্যেক স্ত্রীর গর্ভে একজন করে পুত্র সন্তান জন্ম হবে এবং তারা সকলেই অশ্ব চালনায় পারদর্শী হবে। আল্লাহর রাস্তায় তারা জিহাদ করবে। সুলায়মানের কাছে অবস্থানকারী একজন তখন বলেছিল, ‘ইনশা আল্লাহ' (আল্লাহ যদি চান); কিন্তু সুলায়মান (আ) ইনশা আল্লাহ বলেন নি। ফলে সে রাতে কোন স্ত্রীই সন্তান ধারণ করেন নি। মাত্র একজন স্ত্রী পরে একটি অসম্পূর্ণ সন্তান প্রসব করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘তিনি যদি ইনশা আল্লাহ’ বলতেন, তবে সকল স্ত্রী থেকেই পুত্র সন্তান জন্ম হত এবং তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করত।’ শু‘আয়ব ও ইবন আবী যিনাদ সত্তরের স্থলে নব্বইজন স্ত্রীর কথা বর্ণনা করেছেন এবং এটাই বিশুদ্ধতম। ইমাম বুখারী একাই এই সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আবু ইয়ালা থেকে ....... আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণিত হাদীছে ‘একশত’ স্ত্রীর কথা উল্লেখিত হয়েছে।

এই শেষোক্ত বর্ণনাটির সনদ সহীহর শর্ত পূরণ করে, যদিও অন্য কেউ এ সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। ইমাম আহমদেরও আবু হুরায়রা (রা)-এর অনুরূপ একটি বর্ণনা রয়েছে।

ইমাম আহমদের অপর এক বর্ণনায় আছে যে, সুলায়মান (আ) ইন্‌শা আল্লাহ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। রাসূল (সা) বললেন, ‘তিনি যদি ইনশা আল্লাহ বলতেন, তা হলে তার সে নেক নিয়্যত এভাবে নিষ্ফল হয়ে যেত না। বরং তাঁর ইচ্ছাই পূরণ হতো।’ বুখারী ও মুসলিমে আবদুর রাযযাক সূত্রে এভাবেই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। ইসহাক ইবন বিশর কর্তৃক আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে অপর এক বর্ণনায় হযরত সুলায়মান (আ)-এর চারশ’ স্ত্রী ও সাতশ’ বাদীর উল্লেখসহ উক্ত ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।

নবী করীম (সা) ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, যদি হযরত সুলায়মান (আ) ইনশা আল্লাহ বলতেন তা হলে যেভাবে তিনি বলেছিলেন সেভাবেই অশ্বারোহী পুত্র সন্তান জন্ম হত এবং আল্লাহর রাস্তায় তারা জিহাদ করত। এই হাদীছের সনদ দুর্বল; কেননা ইসহাক ইবন বিশর হাদীছ বর্ণনায় বিশ্বস্ত নন, তিনি মুনকারুল হাদীছ। তাছাড়া এটি (সংখ্যার ব্যাপারে) সহীহ হাদীছের পরিপন্থী। তবে হযরত সুলায়মান (আ)-এর ছিল বিশাল সাম্রাজ্য। অসংখ্য সৈন্য-সামন্ত। বিভিন্ন প্রজাতির সেনাবাহিনী এবং রাজ্য পরিচালনার অন্যান্য সামগ্রী যা আল্লাহ তার পূর্বেও কাউকে দেননি এবং পরেও কাউকে দেননি। যেমন তিনি বলেছিলেনঃ

( وَأُوتِینَا مِن كُلِّ شَیۡءٍ )

[Surah An-Naml 16]

—আমাকে সবকিছু দেয়া হয়েছে (২৭ নামলঃ ১৬)।

( قَالَ رَبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَهَبۡ لِی مُلۡك ا لَّا یَنۢبَغِی لِأَحَد مِّنۢ بَعۡدِیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ )

[Surah Sad 35]

অর্থাৎ, সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পরে আর কেউ পেতে পারবে না, নিশ্চয় আপনি মহাদাতা (৩৮ সাদঃ ৩৫) সে মতে আল্লাহ সুলায়মানের প্রার্থিত সবকিছুই দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহের কথা আল্লাহ কুরআন মজীদেও নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করেছেনঃ

( هَـٰذَا عَطَاۤؤُنَا فَٱمۡنُنۡ أَوۡ أَمۡسِكۡ بِغَیۡرِ حِسَاب ࣲ)

[Surah Sad 39]

অর্থাৎ, এগুলো আমার অনুগ্রহ। অতএব, এগুলো কাউকে দান কর অথবা নিজে রেখে দাও এর কোন হিসাব দিতে হবে না (৩৮ সাদঃ ৩৯)। অর্থাৎ যাকে ইচ্ছা তাকে দিতে পার এবং যাকে ইচ্ছা নাও দিতে পার! এতে তোমাকে কোন জওয়াবদিহী করতে হবে না। অন্য কথায় তুমি যেইভাবে ইচ্ছা সম্পদ ব্যবহার ও খরচ করতে পার; কেননা তুমি যা-ই করবে তা-ই আল্লাহ তোমার জন্যে বৈধ করে দিয়েছেন। এ জন্যে তোমার কোন জবাব দিতে হবে না। যিনি একই সাথে নবী ও সম্রাট হন- তার মর্যাদা এ রকমই হয়। পক্ষান্তরে যিনি কেবল বান্দা ও রাসূল হন, তার মর্যাদা এ রকম হয় না। কেননা বরং আল্লাহ যেভাবে অনুমতি দেন সেভাবেই তাঁকে কাজ করতে হয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে উক্ত দুই অবস্থানের ( النبي الملك- العبد الرسول ) যে কোন একটিকে গ্রহণ করার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন। তিনি বান্দা ও রাসূল হওয়াকেই বেছে নেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এ ব্যাপারে জিবরাঈল (আ)-এর নিকট পরামর্শ চান। জিবরাঈল তাকে বিনয়ী পথ ( تواضع ) অবলম্বনের দিকে ইঙ্গিত করেন।

সে মতে তিনি বান্দা ও রাসূল হওয়াকেই পছন্দ করেন। অবশ্য নবী (সা)-এর পরে তাঁর উম্মতের মধ্যে খিলাফত ও বাদশাহী উভয়টাই চালু রেখেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। সুতরাং তাঁর উম্মতের একটি দল কিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী হয়ে থাকবে।

হযরত সুলায়মান (আ)-কে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার জীবনে যে সব অনুগ্রহ দান করেছেন তার উল্লেখ শেষে পরকালীন জীবনে যে সব অনুগ্রহ, পুরস্কার সম্মান ও নৈকট্য দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারও উল্লেখ করেছেন যথাঃ

( وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 40]

“নিশ্চয়ই তার জন্যে আমার কাছে রয়েছে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণতি। (৩৮ সাদঃ ৪০)।

১২
হযরত সুলায়মান (আ)-এর রাজত্বকাল, আয়ু ও মৃত্যু
এ প্রসংগে আল্লাহর বাণীঃ

( فَلَمَّا قَضَیۡنَا عَلَیۡهِ ٱلۡمَوۡتَ مَا دَلَّهُمۡ عَلَىٰ مَوۡتِهِۦۤ إِلَّا دَاۤبَّةُ ٱلۡأَرۡضِ تَأۡكُلُ مِنسَأَتَهُۥۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَیَّنَتِ ٱلۡجِنُّ أَن لَّوۡ كَانُوا۟ یَعۡلَمُونَ ٱلۡغَیۡبَ مَا لَبِثُوا۟ فِی ٱلۡعَذَابِ ٱلۡمُهِینِ )

[Surah Saba' 14]

“যখন আমি সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন জিনদেরকে তার মৃত্যুর বিষয় জানাল, কেবল মাটির পোকা যা তার লাঠি খাচ্ছিল। যখন সে পড়ে গেল তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, ওরা যদি অদৃশ্য বিষয় অবগত থাকত তা হলে ওরা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না।” (৩৪ সাবাঃ ১৪)

ইবন জারীর ইবন আবী হাতিম ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ ...... ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ হযরত সুলায়মান যখনই সালাত আদায় করতেন, তখনই সম্মুখে একটি চারা গাছ দেখতে পেতেন। তিনি গাছের কাছে তার নাম জিজ্ঞেস করতেন। গাছ নিজের নাম বলে দিত। তারপরে জিজ্ঞেস করতেন, কি কাজের জন্যে তোমার সৃষ্টি? যদি রোপন করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তা হলে তা রোপন করা হত। আর যদি ঔষধ হিসেবে হয়ে থাকে, তবে, ঔষধ উৎপাদনে লাগানো হত। এক দিন তিনি সালাতে রত ছিলেন। সহসা সম্মুখে একটি বৃক্ষ-চারা দেখেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম?’ সে বলল, ‘আল-খারূব’ ( الخروب )। তিনি বললেন, ‘কি উদ্দেশ্যে তোমার সৃষ্টি?’ সে বলল, ‘এই বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে।’ তখন সুলায়মান (আ) দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! জিনদের কাছে আমার মৃত্যুর অবস্থাটা গোপন রাখুন, যাতে মানুষ জিনরা যে গায়েব জানে তা উপলব্ধি করতে না পারে। অতঃপর সুলায়মান (আ) ঐ বৃক্ষ-চারা দ্বারা একটি লাঠি তৈরি করেন এবং এক বছর যাবত উহাতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ও দিকে জিনরা পূর্ণ উদ্যমে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে পোকা লাঠিটি খেয়ে শেষ করে ফেলে। এ ঘটনা থেকে মানুষ সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারল যে, জিনরা গায়েবের খবর জানে না, জানলে এক বছর পর্যন্ত এ লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি তারা কিছুতেই ভোগ করত না।

সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র বলেন, ইবন আব্বাস (রা) আয়াতটিকে এভাবেই পড়তেন ( تبينت لانس ان الجن ) তখন জিনরা পোকার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল এবং তাদেরকে পানি দান করল। ইবন জারীর বলেন, আতা আল-খুরাসানীর এ বর্ণনায় অনেক আপত্তি আছে। ইবন আসাকির এ ঘটনাটি ইবন আব্বাস (রা) থেকে মাওকূফভাবে বর্ণনা করেছেন, যা অনেকটা যথার্থ বলে মনে হয়। সুদ্দী হযরত সুলায়মান (আ)-এর ইতিহাস বর্ণনা প্রসংগে ইবন আব্বাস ও ইবন মাসউদসহ কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সুলায়মান (আ) অন্যান্য কাজ-কর্ম থেকে অব্যাহতি নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে কখনও কখনও একটানা এক বছর, দু’বছর, এক মাস, দু’মাস কিংবা এর চেয়ে বেশী কিংবা এর চেয়ে কম সময় অবস্থান করতেন। তাঁর খাদ্য ও পানীয় মসজিদেই সরবরাহ করা হত। যে বারে তিনি মসজিদে প্রবেশ করার পর ইনতিকাল করেন সে বারে এক নতুন ঘটনা দেখতে পান। প্রত্যহ সকাল বেলা তিনি দেখতেন, বায়তুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে একটি বৃক্ষ উদগত হচ্ছে। কাছে এসে নাম জিজ্ঞেস করলে বৃক্ষটি তার নাম বলে দিত। যদি তা রোপন করার উদ্দেশ্যে হতো তা হলে রোপন করতেন। যদি ঔষধরূপে ব্যবহারের জন্যে হতো তা হলে বলে দিত আমি ঔষধ-বৃক্ষ। যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে জন্মাত তবে বৃক্ষ তাও বলে দিত এবং তাকে সে কাজেই ব্যবহার করা হত। অবশেষে এক দিন এমন এক বৃক্ষের জন্ম হল, যার নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমার নাম খারূবা। সুলায়মান (আ) জানতে চাইলেন, ‘তোমার সৃষ্টি কী উদ্দেশ্যে?’ বৃক্ষটি বলল, ‘এই মসজিদ ধ্বংস করার জন্যে।’ সুলায়মান (আ) বললেন, ‘আমি জীবিত থাকতে আল্লাহ এ মসজিদ ধ্বংস করবেন না। বরং তুমি এমন একটি বৃক্ষ- যার উপর ভর দেয়া অবস্থায় আমার মৃত্যু হবে এবং বায়তুল মুকাদ্দাসও ধ্বংস হবে।’ অতঃপর তিনি বৃক্ষ-চারাটি সেখান থেকে তুলে মসজিদের আংগিনার বাগানে রোপণ করেন। এরপর তিনি মসজিদের মিহরাবে প্রবেশ করে লাঠির উপর হেলান দিয়ে সালাতে দণ্ডায়মান হন। এ অবস্থায় তাঁর ইনতিকাল হয়ে যায়; কিন্তু কর্মরত জিনরা তা টের পেলো না। তারা নবীর নির্দেশ মতে মসজিদের কাজ অব্যাহত রাখে। তাদের অন্তরে সর্বদা এ ভয় ছিল যে, কাজে ফাকি দিলে তিনি মিহরাব থেকে বেরিয়ে এসে শাস্তি দিবেন। অবশ্য, কখনও কখনও জিনগুলো মিহরাবের পাশে এসে একত্রিত হত। মিহরাবের সম্মুখে ও পশ্চাতে জানালা লাগানো ছিল।

কোন জিন পলায়নের ইচ্ছা করলে বলত, আমি কি একদিকে প্রবেশ করে অন্যদিকে বের হয়ে যাওয়ার মতো চালাক নই? সুলায়মান (আ) মিহরাবের মধ্যে থাকা অবস্থায় কোন জিন তাঁর দিকে তাকালেই সংগে সংগে সে পুড়ে যেত। একবার কর্মরত জিনদের একজন মিহরাবে প্রবেশ করে সুলায়মান (আ)-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গেল, কিন্তু তার কোন আওয়াজ শুনতে পেল না। পুনরায় সে ঐ পথে প্রত্যাবর্তন করল, তখনও কোন সাড়া-শব্দ পেল না। আবার সে ঘরে ঢুকলো কিন্তু পুড়ল না, তখন সে সুলায়মান (আ)-এর প্রতি তাকিয়ে দেখল, তাঁর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। এবার জিনটি বেরিয়ে এসে লোকজনকে জানাল যে, সুলায়মানের মৃত্যু হয়েছে। লোকজন দরজা খুলে মিহরাবে প্রবেশ করে দেখল ঘটনা সত্য। তারা তার দেহকে বাইরে বের করে আনল। তারা দেখতে পেল যে, তাঁর লাঠিটি কীটে খেয়ে ফেলেছে। কুরআন মজীদে ( منساة ) শব্দ এসেছে। এটা হাবশী ভাষার শব্দ অর্থ লাঠি। তিনি কবে, কত দিন আগে মারা গেছেন তা জানার কোন উপায় ছিল না। তাই মৃত্যুকাল বের করার উদ্দেশ্যে তারা একটি কীটকে একটি লাঠির গায়ে ছেড়ে দেয়। কীটটি একদিন এক রাত পর্যন্ত লাঠিটি খেতে থাকে। এবার তারা হিসেব বের করল যে, এই হারে একটা লাঠি খেতে এক বছর লাগে। তাতে তারা বুঝতে পারে যে, তিনি এক বছর পূর্বেই ইনতিকাল করেছেন। যা হোক, হযরত সুলায়মান (আ)-এর মৃত্যুর পর পূর্ণ একটি বছর পর্যন্ত জিনরা হাড়ভাংগা খাটুনী খাটে। মানুষ তখন পূর্বের ধারণা পরিবর্তন করে নতুনভাবে বিশ্বাস করতে থাকে যে, জিনরা গায়েব জানে-এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। তারা যদি সত্যিই গায়েব জানত তা হলে সুলায়মান (আ)-এর মৃত্যু সম্পর্কে অবশ্যই অবগত হত এবং পূর্ণ এক বছর পর্যন্ত শাস্তিমূলক কাজে কিছুতেই আবদ্ধ থাকতো না। এ কথাই আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ

( مَا دَلَّهُمۡ عَلَىٰ مَوۡتِهِۦۤ إِلَّا دَاۤبَّةُ ٱلۡأَرۡضِ تَأۡكُلُ مِنسَأَتَهُۥۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَیَّنَتِ ٱلۡجِنُّ أَن لَّوۡ كَانُوا۟ یَعۡلَمُونَ ٱلۡغَیۡبَ مَا لَبِثُوا۟ فِی ٱلۡعَذَابِ ٱلۡمُهِینِ )

[Surah Saba' 14]

অর্থাৎ, আমি যখন সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম তখন জিনদেরকে তার মৃত্যু বিষয় জানাল কেবল মাটির পোকা, যা সুলায়মানের লাঠি খাচ্ছিল। যখন সুলায়মান পড়ে গেল তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, তারা যদি অদৃশ্য বিষয়ে অবগত থাকত তা হলে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না।

আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ জিনরা গায়েব জানার যে দাবি করত তা মানুষের কাছে ফাঁস হয়ে গেল। এরপর জিনরা ঐ পোকাটির কাছে গিয়ে বলল, ‘তুমি যদি খাদ্য দ্রব্য আহার করতে তবে আমরা তোমাকে উৎকৃষ্ট খাদ্য সরবরাহ করতাম। যদি তুমি পানীয় পান করতে তবে উন্নতমানের শরাব পান করাতাম। কিন্তু এগুলো যেহেতু তোমার আহার্য নয়, তাই আমরা তোমাকে পানি ও কাদা দিচ্ছি।’ বর্ণনাকারী বলেন, এরপর থেকে উই পোকাটি যেখানেই অবস্থান করত জিনরা সেখানে পানি ও মাটি পৌঁছিয়ে দিত। এ কারণেই কাঠের ভিতরে যে মাটি দেখা যায়- তা বস্তুতঃ সেই উই পোকার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে জিনরাই পৌঁছিয়ে দিয়ে থাকে। এই বর্ণনার মধ্যে কিছু ইসরাঈলী বিবরণ আছে - যাকে সত্য বা মিথ্যা কোনটাই বলা যায় না।

আবু দাউদ (র) তাঁর গ্রন্থে কদর অধ্যায়ে ..... আমাশের সূত্রে খায়ছামা থেকে বর্ণনা করেনঃ হযরত সুলায়মান ইবন দাউদ মালাকুল মওতকে বলেছিলেন, আপনি যখন আমার রূহ কবয করবেন, তার পূর্বে আমাকে জানিয়ে দেবেন। ফিরিশতা বললেন, এ বিষয়ে আপনার থেকে আমার অধিক কিছু জানা নেই। বস্তুতঃ আমার নিকট একটি লিখিত পত্র দেয়া হয়। যার মৃত্যু হবে, ঐ পত্রে তার নাম লেখা থাকে। বর্ণনাকারী বলেন যে, সুলায়মান (আ) মালাকুল মওতকে বলেছিলেন, আপনি যখন আমার রূহ কবয করার আদেশ পাবেন তখন পূর্বাহ্নে আমাকে জানিয়ে দেবেন। একদা মালাকুল মওত এসে সুলায়মান (আ)-কে জানালেন, আপনার রূহ কবয করার জন্যে আমি আদিষ্ট হয়েছি। আর স্বল্প সময় বাকী আছে।

তিনি তৎক্ষণাৎ দুর্মদ শয়তান জিনদেরকে ডেকে অবিলম্বে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করার আদেশ দেন। নির্দেশ মতে তারা একটি কাঁচের প্রাসাদ তৈরি করল। এতে কোন দরজা জানালা ছিল না। সুলায়মান (আ) ঐ কাঁচের ঘরে লাঠির উপর হেলান দিয়ে সালাতে মগ্ন হন। ইত্যবসরে মালাকুল মওত তথায় প্রবেশ করে সুলায়মানের রূহ কবয করে নেন। অবশ্য তার মৃত দেহ লাঠির উপর হেলান দেয়া অবস্থায়ই থেকে যায়। সুলায়মান (আ) মালাকুল মওতকে ফাঁকি দিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে এই কৌশল অবলম্বন করেন নি। জিনরা তাঁর সম্মুখেই নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। সুলায়মান (আ)-এর প্রতি তারা বারবার তাকিয়ে দেখত এবং মনে করত, তিনি তো জীবিতই আছেন। পরে আল্লাহ তার লাঠির কাছে একটি উই পোকা পাঠান। উই পোকাটি লাঠির গায়ে লেগে খেতে শুরু করে। যখন লাঠির অভ্যন্তর ভাগ খেয়ে শূন্য করে ফেলে তখন তা দুর্বল হয়ে যায়। সুলায়মানের ভার সহ্য করতে না পেরে লাঠিটি ভেংগে যায় এবং তাঁর মৃতদেহ মাটিতে পড়ে যায়। জিনরা এ অবস্থা দেখে কাজ ছেড়ে চলে যায়।

( فَلَمَّا قَضَیۡنَا عَلَیۡهِ ٱلۡمَوۡتَ مَا دَلَّهُمۡ عَلَىٰ مَوۡتِهِۦۤ إِلَّا دَاۤبَّةُ ٱلۡأَرۡضِ تَأۡكُلُ مِنسَأَتَهُۥۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَیَّنَتِ ٱلۡجِنُّ أَن لَّوۡ كَانُوا۟ یَعۡلَمُونَ ٱلۡغَیۡبَ مَا لَبِثُوا۟ فِی ٱلۡعَذَابِ ٱلۡمُهِینِ )

[Surah Saba' 14]

আয়াতে একথাই বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনাকারী আসবাগ বলেন, আমি বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি যে, উইপোকাটি এক বছর যাবত লাঠিটি খাওয়ার পর সুলায়মান (আ) মাটিতে পড়ে যান। প্রাচীন অনেক লেখকই এই একই কথা বলেছেন।

ইসহাক ইবন বিশর মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের সূত্রে যুহরী প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত সুলায়মান (আ) বায়ান্ন বছর জীবিত ছিলেন এবং চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। কিন্তু ইসহাক আবু রওক- ইকরামার সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর রাজত্ব বিশ বছর স্থায়ী ছিল। ইবন জারীর লিখেছেন, সুলায়মান (আ)-এর বয়স মোটামুটি পঞ্চাশ বছরের কিছু বেশী।

কথিত আছে, হযরত সুলায়মান (আ) তাঁর রাজত্বের চতুর্থ বছরে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ শুরু করেন। সুলায়মানের পরে তাঁর পুত্র রুহবিআম, সতের বছর রাজত্ব করেন। ঐতিহাসিক ইবন জারীর লেখেন যে, এরপর বনী ইসরাঈলের রাজত্ব ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়।

১৩
হযরত দাউদ ও ইয়াহয়া (আ)-এর মধ্যবর্তী ইসরাঈল বংশীয় নবীগণের ইতিহাস
উপরোক্ত সময়ের মধ্যে আগমনকারী নবীদের মধ্যে হযরত শাইয়া ইবন আমসিয়া ( امصيا ) অন্যতম (বাইবেলের ভাষায় আমোসোর পুত্র যিশাইয়) মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের মতে, তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল যাকারিয়া ও ইয়াহয়া (আ)-এর পূর্বে। তিনি সেই সব নবীর একজন, যারা হযরত ঈসা ও মুহাম্মদ (সা) এর আগমনের সুসংবাদ প্রচার করেছিলেন। ঐ সময়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে বনী ইসরাঈলের শাসক ছিলেন রাজা হিযকিয়া। যে কোন সংস্কার ও সংশোধনমূলক কাজে তিনি নবী শাইয়ার আদেশ-নিষেধ মেনে চলতেন। বনী ইসরাঈলের মধ্যে তখন ব্যাপক হারে দুর্নীতি, পাপাচার ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তাদের রাজা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর পায়ে একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে ব্যাবিলনের রাজা সানহারীব বায়তুল মুকাদ্দাস আক্রমণে উদ্যোগী হয়। ইবন ইসহাক (র) বলেছেন, এ অভিযানে ছয় লক্ষ পতাকাবাহী সৈন্য অংশগ্রহণ করে। তাতে লোকজন অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। রাজা হযরত শাইয়ার নিকট জিজ্ঞেস করেন যে, ‘সানহারীব ও তার সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কী ওহী প্রেরণ করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘তাদের সম্পর্কে আমার নিকট কোন প্রকার ওহী আসেনি।’ কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর হযরত শাইয়ার নিকট এই মর্মে ওহী আসে যে, অল্প দিনের মধ্যে রাজার মৃত্যু হবে। সুতরাং তিনি যেন তার পছন্দমত কাউকে স্থলাভিষিক্ত করেন। নবীর মাধ্যমে এ সংবাদ পেয়ে রাজা কিবলামুখী হয়ে সালাত ও তাসবীহ পাঠ করে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে ধৈর্যের সাথে কেঁদে কেঁদে এই দোয়া করেনঃ

اللهم رب الارباب واله الالهة يارحمن يارحيم يامن لا تأخذه سنة ولا نوم اذكرني بعلمی و فعلی و حسن قضائی علی بنی اسرائیل وذالك كله كان منك فانت اعلم به من نفسی سمری و اعلاني لك

অর্থাৎ, হে আল্লাহ্, মহা প্রতিপালক, রাজাধিরাজ, দয়াময়, পরম দয়ালু! হে ঐ সত্তা, যাঁকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আমার জ্ঞান, আমার কার্যাবলী ও বনী ইসরাঈলদের উপর আমার ন্যায়-বিচারের দিকে লক্ষ্য করে আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। আমার এ যা কিছু কৃতিত্ব, সবই আপনার করুণার দান। এ সম্পর্কে আপনি সর্বাধিক অবগত। আমার ভিতর ও বাহির সব আপনাতে ন্যস্ত।

আল্লাহ রাজার দোয়া কবুল করে তাঁর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং শাইয়ার (যীশাইও) নিকট ওহীর মাধ্যমে সুসংবাদ দেন যে, তাঁর কান্নাতে আল্লাহ সদয় হযেছেন। তিনি তাঁর আয়ু পনের বছর বৃদ্ধি করেছেন এবং তাঁর শত্রু সানহারীবের কবল থেকে তাকে রক্ষা করেছেন। নবীর নিকট থেকে এ সুসংবাদ শুনে রাজার অন্তর থেকে ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তা দুরীভূত হয় এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে সিজদাবনত হয়ে তিনি নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করেন।

اللهم انت الذي تعطي الملك من تشاء وتنزعه ممن تشاء وتعز من تشاء وتذل من تشاء عالم الغيب والشهادة انت الاول والاخر والظاهر والباطن وانت ترحم وتستجيب دعوة المضطرين .

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনি সেই মহান সত্তা, আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন; যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দান করেন, যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। দৃশ্য-অদৃশ্য যাবতীয় বিষয়ে আপনি সম্যক অবগত। আপনি আদি ও অন্ত এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য। বিপদগ্রস্তদের আহ্বানে আপনিই সাড়া দেন ও অনুগ্রহ করেন।

সিজদা শেষ হলে আল্লাহ শাইয়ার নিকট ওহী প্রেরণ করেন এবং রাজাকে এ কথা জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন ডুমুরের রস পায়ের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেন, তাতে তিনি আরোগ্য লাভ করবেন। রাজা এ নির্দেশ পালন করেন এবং আরোগ্য লাভ করেন। এরপর আল্লাহ সানহারীবের সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। ফলে সানহারীব ও তার পাঁচজন সঙ্গী ব্যতীত তার গোটা সৈন্যবাহিনী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন বুখত নসর।[টীকা– একেই নেবুচাদ নেয়ার বা নেবুকাদ নেযার বলা হয়ে থাকে।]

বনী ইসরাঈলের রাজা লোক পাঠিয়ে এদেরকে ধরে এনে বেড়ি পরিয়ে সত্তর দিন পর্যন্ত শহরের অলি-গলিতে ঘুরিয়ে লাঞ্ছিত করেন। প্রত্যহ এদের প্রতি জনকে মাত্র দুটি করে যবের রুটি খেতে দেয়া হতো। এরপর তাদেরকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। আল্লাহ তখন শাইয়ার নিকট ওহী প্রেরণ করেন। তিনি রাজাকে এদের ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন, যাতে এরা আপন সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিজেদের শাস্তি ও লাঞ্ছনা ভোগের বিবরণ শোনাতে পারে। সানহারীব মুক্তি পেয়ে ফিরে গিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে সমবেত করে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়। প্রতি উত্তরে গণক ও যাদুকররা বলল, ‘আমরা পূর্বেই আপনাকে ইসরাঈলীদের প্রতিপালক ও নবীগণ সম্পর্কে অবহিত করেছিলাম; কিন্তু আপনি আমাদের কথায় কান দেননি। এরা এমন একটি জাতি, যাদের প্রতিপালকের মুকাবিলা করার ক্ষমতা কারও নেই।’ এভাবে সানহারীবের পরিণতি তাই হল, যে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্বেই তাদেরকে সাবধান করেছিলেন। এ ঘটনার সাত বছর পর সানহারীবের মৃত্যু হয়। ইবন ইসহাক বলেন, বাদশাহ হিযকিয়ার মৃত্যুর পর বনী ইসরাঈলের মধ্যে পাপ প্রবণতা, অপরাধ, বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। হযরত শাইয়া তখন আল্লাহর প্রত্যাদেশ পেয়ে বনী ইসরাঈলের লোকদেরকে আহ্বান করলেন এবং আল্লাহর আদেশ পালনের জন্যে উপদেশ দান করলেন। নবী তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন যে, আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করলে ও তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে তাদের উপর শাস্তি অবধারিত। হযরত শাইয়ার বক্তব্য শেষ হলে উপস্থিত জনগণ তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল এবং হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাঁর পশ্চাতে ধাওয়া করল। শাইয়া (আ) আত্মরক্ষার জন্যে সেখান থেকে পালিয়ে যান। এমন সময় তিনি সম্মুখে একটি বৃক্ষ দেখতে পান। বৃক্ষটি নবীকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষার জন্যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তিনি তাতে প্রবেশ করেন এবং বৃক্ষের ফাটল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শয়তান তার কাপড় টেনে ধরায় তার আঁচল বাইরে থেকে যায়। ইতিমধ্যে শক্ররা সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তারা বৃক্ষের মধ্যে কাপড় আটকা দেখে করাত দ্বারা বৃক্ষটি দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। ফলে হযরত শাইয়ার দেহও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়--ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন।

১৪
লাবী* ইবন ইয়াকুবের বংশধর হযরত আরমিয়া ইবন হালকিয়া
যাহহাক (র) ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, আরমিয়া ইবন হালকিয়া হচ্ছেন হযরত খিযির (আ)। কিন্তু এ বর্ণনাটি ‘গরীব পর্যায়ের এবং তা বিশুদ্ধ নয়। ইবন আসাকির কোন কোন গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, দামিশকে হযরত ইয়াহইয়া ইব্‌ন যাকারিয়া (আ)-এর রক্ত সদা প্রবহমান ছিল। আরমিয়া ইবন হালকিয়া সেই রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হে রক্ত! তুমি তো বহু মানুষকে পরীক্ষায় ফেলেছ, এখন থাম।’ তখন রক্ত থেমে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। আবু বকর ইবন আবিদ্-দুনয়া......আবদুল্লাহ ইবন আবদুর রহমান থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আরমিয়া একদা আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার নিকট প্রিয়তম বান্দা কে?’ উত্তরে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিকূলের পরিবর্তে আমাকে অধিক স্মরণ করে নশ্বরের ধোঁকায় সে পড়ে না এবং দুনিয়ার স্থায়ী থাকার বাসনাও করে না। পার্থিব জীবনের সুখ শান্তিকে সে উপেক্ষা করে চলে এবং বিলাস-সামগ্রী থেকে বঞ্চিত হলে খুশী হয়। এ জাতীয় বান্দাদেরকে আমি আমার নৈকট্য দান করব এবং কল্পনাতীতভাবে পুরস্কৃত করব।’

[* টীকা বাইবেলে তাকে লেবী বলা হয়েছে।]

১৫
বায়তুল মুকাদ্দাসের ধ্বংস
এ সম্পর্কে আল্লাহর বাণীঃ

( وَءَاتَیۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَـٰبَ وَجَعَلۡنَـٰهُ هُد ى لِّبَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ أَلَّا تَتَّخِذُوا۟ مِن دُونِی وَكِیل ا ۝ ذُرِّیَّةَ مَنۡ حَمَلۡنَا مَعَ نُوحٍۚ إِنَّهُۥ كَانَ عَبۡد ا شَكُور ا ۝ وَقَضَیۡنَاۤ إِلَىٰ بَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ فِی ٱلۡكِتَـٰبِ لَتُفۡسِدُنَّ فِی ٱلۡأَرۡضِ مَرَّتَیۡنِ وَلَتَعۡلُنَّ عُلُوّ ا كَبِیر ا ۝ فَإِذَا جَاۤءَ وَعۡدُ أُولَىٰهُمَا بَعَثۡنَا عَلَیۡكُمۡ عِبَاد ا لَّنَاۤ أُو۟لِی بَأۡس شَدِید فَجَاسُوا۟ خِلَـٰلَ ٱلدِّیَارِۚ وَكَانَ وَعۡد ا مَّفۡعُول ا ۝ ثُمَّ رَدَدۡنَا لَكُمُ ٱلۡكَرَّةَ عَلَیۡهِمۡ وَأَمۡدَدۡنَـٰكُم بِأَمۡوَ  ٰ⁠لࣲ وَبَنِینَ وَجَعَلۡنَـٰكُمۡ أَكۡثَرَ نَفِیرًا ۝ إِنۡ أَحۡسَنتُمۡ أَحۡسَنتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡۖ وَإِنۡ أَسَأۡتُمۡ فَلَهَاۚ فَإِذَا جَاۤءَ وَعۡدُ ٱلۡـَٔاخِرَةِ لِیَسُـ ۤـُٔوا۟ وُجُوهَكُمۡ وَلِیَدۡخُلُوا۟ ٱلۡمَسۡجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّة وَلِیُتَبِّرُوا۟ مَا عَلَوۡا۟ تَتۡبِیرًا ۝ عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن یَرۡحَمَكُمۡۚ وَإِنۡ عُدتُّمۡ عُدۡنَاۚ وَجَعَلۡنَا جَهَنَّمَ لِلۡكَـٰفِرِینَ حَصِیرًا )

[Surah Al-Isra' 2 - 8]

—আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ও তাকে করেছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্যে পথ নির্দেশক। আমি আদেশ করেছিলাম “তোমরা আমাকে ব্যতীত অপর কাউকেও কর্মবিধায়করূপে গ্রহণ করো না।” “হে তাদের বংশধর! যাদেরকে আমি নূহের সাথে আরোহণ করিয়েছিলাম, সে তো ছিল পরম কৃতজ্ঞ বান্দা।” এবং আমি কিতাবে প্রত্যাদেশ দ্বারা বনী ইসরাঈলকে জানিয়েছিলাম, “নিশ্চয়ই তোমরা পৃথিবীতে দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকার-স্ফীত হবে। তারপর এ দু’য়ের প্রথমটির নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম আমার বান্দাদেরকে, যুদ্ধে অতিশয় শক্তিশালী; তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সমস্ত ধ্বংস করেছিল। আর প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। তারপর আমি তোমাদেরকে পুনরায় তাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করলাম, তোমাদেরকে ধন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করলাম ও সংখ্যায় গরিষ্ঠ করলাম। তোমরা সৎকর্ম করলে সৎকর্ম নিজেদের জন্য করবে এবং মন্দ কর্ম করলে তাও করবে নিজেদের জন্যে। তারপর পরবর্তী নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে আমি আমার বান্দাদেরকে প্রেরণ করলাম তোমাদের মুখমণ্ডল কালিমাচ্ছন্ন করবার জন্যে, প্রথমবার তারা যেভাবে মসজিদে প্রবেশ করেছিল পুনরায় সেভাবেই তাতে প্রবেশ করবার জন্যে এবং তারা যা অধিকার করেছিল তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করবার জন্যে। সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন; কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের পূর্ব আচরণের পুনরাবৃত্তি কর তবে আমিও পুনরাবৃত্তি করব। জাহান্নামকে আমি করেছি কাফিরদের জন্যে কারাগার। (১৭ ইসরাঃ ২-৮)।

ওহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে যখন অনাচার ও পাপবৃত্তি সর্বগ্রাসীরূপ লাভ করে তখন তাদের নবী আরমিয়ার নিকট আল্লাহ এই মর্মে ওহী প্রেরণ করেন যে, ‘তুমি তোমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে জানাও যে, তাদের হৃদয় আছে; কিন্তু তারা উপলব্ধি করে না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখে না, কান আছে শুনে না। আমি তাদের পূর্বপুরুষদের উত্তম কর্মসমূহ স্মরণ করেছি—ফলে তাদের সন্তানদের উপর আমার করুণাধারা বর্ষিত হয়েছে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমার আনুগত্যের সুফল তারা কিভাবে লাভ করেছে। আমার অবাধ্য হয়ে কেউ কি সৌভাগ্যবান হয়েছে, কিংবা আমার আনুগত্য করে কি কেউ দুর্ভাগা হয়েছে? সমস্ত প্রাণীই নিজ নিজ বাসস্থানের কথা স্মরণ করে এবং সে দিকেই ফিরে যায়। আর এই সম্প্রদায়ের লোকেরা আমার সেই সব আদেশ লংঘন করেছে, যা মেনে চলার কারণে আমি এদের পূর্ব পুরুষদেরকে সম্মানিত করেছিলাম। এরা ভিন্ন পথে চলে সম্মান লাভ করতে চেয়েছে। তাদের ধর্মযাজকরা আমার হক বিস্মৃত হয়েছে। তাদের বিদ্বান ব্যক্তিরা আমার পরিবর্তে অন্যের ইবাদত করেছে, তাদের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা নিজেদের জ্ঞান থেকে উপকৃত হয়নি এবং তাদের শাসকরা আমার ও আমার রাসূলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে। তাদের অন্তরে লুক্কায়িত আছে গভীর ষড়যন্ত্র আর মুখে আছে মিথ্যা বুলি। আমি আমার প্রতাপ ও মর্যাদার কসম করে বলছি, আমি তাদের উপর এমন এক জাতিকে চাপিয়ে দিব, যারা বুঝবে না এদের ভাষা, চিনবে না এদের চেহারা, বিগলিত হবে না তাদের অন্তর এদের কান্নায়। আমি তাদের মাঝে পাঠাব এমন এক জালিম বাদশাহ, যার সৈন্যবাহিনীর বহর হবে মেঘমালার ন্যায়, সৈন্যদের সারিগুলোকে মনে হবে প্রশস্ত গিরিপথ, তাদের পতাকার শব্দ ধ্বনি শোনা যাবে শকুন পালের উড্ডয়নের ধ্বনির ন্যায়। তাদের অশ্ব বাহিনীর আক্রমণ হবে ঈগল পাখীর ছোবলের ন্যায়। তারা নগরসমূহকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করবে এবং পল্লীগুলোকে কবে বিরান। হায়, কি দুর্ভাগ্য ঈলিয়া ও তার অধিবাসীদের। হত্যা ও বন্দীত্বের লাঞ্ছনা-রশিতে তাদেরকে আবদ্ধ করা হবে। সহসাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে বিবাহ অনুষ্ঠানের আনন্দ-কোলাহল বীভৎস চিৎকার ধ্বনিতে।

অশ্বের হ্রেসা ধ্বনির স্থলে শ্রুত হবে হিংস্র শ্বাপদের তর্জন-গর্জন। সুরম্য ভবনাদি ঘেরা মনোরম শহর পরিণত হবে বন্য জীব-জন্তুর আবাস ভূমিতে! রাত্রিবেলা যে স্থান থাকত আলোর দীপ্তিতে সদা ঝলমল, সেখানে নেমে আসবে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। এদের ভাগ্যে জুটবে সম্মানের পরিবর্তে লাঞ্ছনা, ঐশ্বর্যের পরিবর্তে দাসত্ব। তাদের স্ত্রীরা সুরভিত হওয়ার স্থলে হবে ধুলি ধূসরিত। উপাধান-আয়েশের স্থলে তারা চলবে নগ্নপদ উটের মত। তাদের দেহগুলো হবে মাটির খাদ্য, পরিণত হবে জঞ্জালে এবং সূর্যের তাপে হাড্ডিগুলো চকচক করবে। এগুলো ব্যতীত আরও বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দ্বারা আমি তাদেরকে নিষ্পেষিত করব। এরপর আমি আকাশকে হুকুম দিব। ফলে আকাশ লৌহস্তরে পরিণত হবে এবং যমীন বিগলিত তামায় পরিণত হবে। এমতাবস্থায় বৃষ্টি হলেও ফসল উৎপাদিত হবে না, যদি অল্প কিছু উৎপাদিত হয়ও তবে বন্য জীবজন্তুর প্রতি আমার অনুগ্রহের কারণে হবে। ফসল উৎপন্ন হওয়ার সময় আমি বৃষ্টিপাত বন্ধ রাখব এবং ফসল উঠাবার সময় বৃষ্টিপাত ঘটাবো। এ সময়ের মধ্যে সামান্য পরিমাণ ফসল উৎপাদন করতে যদি তারা সক্ষমও হয় তবে ফসল নষ্ট করার বিভিন্ন দুর্যোগ আমি চাপিয়ে দেব। সে দুর্যোগ থেকে কিছু অংশ যদি রক্ষাও পায়, তা থেকে আমি বরকত উঠিয়ে নেব। যদি তারা আমার নিকট ফরিয়াদও করে আমি তাতে সাড়া দেব না। তারা আমার অনুগ্রহ কামনা করলেও আমি কিছুই দান করব না। তাদের কান্নাকাটিতেও আমি সদয় হব না। তাদের কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও আমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব। এটি ইবন আসাকিরের বর্ণনা।

ইসহাক ইবন বিশর..... ওহাব ইবন মুনাব্বিহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ নবী আরমিয়াকে বনী ইসরাঈলের মাঝে প্রেরণ করেন। তখন তাদের পাপের মাত্রা, অপরাধ প্রবণতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি বহু নবীকে তারা হত্যা করেছিল। তখন আল্লাহ বুখত নসরের অন্তরে বনী ইসরাঈলের উপর হামলা করার ইচ্ছে জাগিয়ে দেন। তাই বুখত নসর তাদেরকে আক্রমণ করার উদ্যোগ নেন। এ সময় আল্লাহ আরমিয়ার নিকট ওহী পাঠান। তিনি জানান, ‘আমি বনী ইসরাঈলকে ধ্বংস করব; তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেবো। তুমি বায়তুল মুকাদ্দাসে সংরক্ষিত শুভ্র পাথরের উপর দাঁড়াও। সেখানে তোমার নিকট আমার ওহী ও নির্দেশ আসবে।’ আরমিয়া সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং পরিধানের জামা ছিড়ে ফেললেন। আপন মাথায় ছাই মাখলেন। তারপরে সিজদায় গেলেন। সিজদায় পড়ে তিনি বলতে লাগলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! কত ভাল হত যদি আমার মা আমাকে প্রসব না করতেন। কেননা আপনি আমাকে বনী ইসরাঈলের শেষ যুগের নবী বানিয়েছেন; আর আমার কারণেই বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস হবে এবং বনী ইসরাঈল নির্মূল হবে।’ আল্লাহ্ তাকে বললেন, ‘সিজদা থেকে মাথা উঠাও।’ তিনি মাথা উঠালেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! বনী ইসরাঈলকে পরাভূত করবে কে?’ আল্লাহ জানালেন, ‘তারা এক অগ্নিপূজারী সম্প্রদায়-তারা না আমার শাস্তির ভয় করে, না পুরস্কার কামনা করে। আরমিয়া! তুমি উঠে দাঁড়াও এবং ওহী শ্রবণ কর! আমি তোমাকে তোমার নিজের ও বনী ইসরাঈলের সংবাদ দেবো। আমি তোমাকে সৃষ্টি করার পূর্বেই তোমাকে মনোনীত করেছি। তোমার মায়ের পেটে তোমার আকৃতি দেওয়ার পূর্বেই তো পবিত্র করেছি, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বেই তোমাকে নিষ্কলুষ বানিয়েছি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বেই তোমাকে নবুওত দান করেছি, পূর্ণ যৌবনে উপনীত হওয়ার পূর্বেই তোমাকে মনোনীত করেছি এবং এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্যে তোমাকে আমি বাছাই করেছি। তুমি দেশের রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে সরল-সঠিক পথ দেখাও।’ এ আদেশ পেয়ে নবী রাজার সাথে মিলিত হন ও সঠিক পথ প্রদর্শন করতে থাকেন। আল্লাহর নিকট থেকে নবীর নিকট প্রয়োজনীয় ওহী আসতে থাকে।

এরপর বনী ইসরাঈলরা ক্রমান্বয়ে জঘন্য পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের শত্রু সানহারীব ও তার সৈন্য বাহিনীর কবল থেকে আল্লাহ তাদেরকে যে রক্ষা করেছিলেন, সে কথাও তারা বেমালুম ভুলে যায়। তখন আল্লাহ নবীকে ওহীর মাধ্যমে জানান; ‘আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিই তা তাদের নিকট ব্যক্ত কর। আমার অনুগ্রহের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দাও; তারা যেসব পাপাচার ও বেদআতে লিপ্ত হয়েছে তা তাদেরকে দেখিয়ে দাও।’ আরমিয়া নিবেদন করল? “হে আমার প্রতিপালক! আমি দুর্বল, যদি আপনি শক্তি না দেন; আমি অক্ষম, যদি আপনি ক্ষমতা প্রদান না করেন; আমি ভুল করব, যদি আপনি সঠিক পথে পরিচালিত না করেন, আমি অসহায় যদি আপনি সাহায্য না করেন; আমি লাঞ্ছিত যদি আপনি ইজ্জত না দেন।’

আল্লাহ তাঁকে জানালেন, ‘হে আরমিয়া, তোমার কি জানা নেই যে, যাবতীয় ঘটনা আমারই ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ, সৃষ্টি ও নির্দেশ সবই আমার এখতিয়ারে। সকলের অন্তর ও জিহ্বা আমারই হাতে, যেমন ইচ্ছা আমি তা পরিবর্তন করি, সুতরাং আমারই আনুগত্য কর। আমার কোন সমকক্ষ নেই। আমার নির্দেশে আসমান, যমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু অস্তিত্ব লাভ করেছে। একক সত্তা কেবল আমিই এবং সকল ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আমিই। আমার নিকট যা কিছু আছে সে সম্পর্কে আমি ব্যতীত আর কেউই অবগত নয়। আমি এমন সত্তা যে, সমুদ্রকে সম্বোধন করে বাক্যালাপ করেছি। সে তা বুঝতে পেরেছে। আমি তাকে নির্দেশ দিয়েছি, সে সেই নির্দেশ পালনও করেছে। আমি তাকে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সে ঐ সীমানা অতিক্রম করেনি। সে পর্বতের ন্যায় সু-উচ্চ তরঙ্গমালা উথিত করে। তবে যখনই আমার নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তখনই আমার আনুগত্য ও নির্দেশ পালনার্থে ভীত শংকিত হয়ে তা গুটিয়ে ফেলে। আমি তোমার সাথেই আছি। আমি যখন আছি তখন কোন কিছুই তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। তোমাকে এক গুরুত্বপূর্ণ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের নিকট তুমি আমার বাণী পৌঁছিয়ে দাও। যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের সমপরিমাণ ছওয়াব তুমিও লাভ করবে। এতে তাদের ছওয়াব থেকে কিছুই কমানো হবে না। তুমি সম্প্রদায়ের নিকট যাও। তাদেরকে সম্বোধন করে বল, আল্লাহ্ তোমাদের পূর্ব-পুরুষের উত্তম গুণাবলীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তোমরা নবী রাসূলগণের বংশধর। তাদের উত্তম কার্যাবলীর কারণেই তিনি তোমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন।

লক্ষ্য কর, তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণ আমার আনুগত্য কর কি সুফল লাভ করেছে। আর আমার অবাধ্য হয়ে তোমাদের কি পরিণতি হয়েছে? ওদেরকে জিজ্ঞেস কর, তারা কি দেখেছে কোন লোক আমার অবাধ্য হয়ে সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে? কিংবা তারা কি জানে, কেউ আমার আনুগত্য করে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে? বনের পশুরাও যখন তাদের উত্তম বাসস্থানের কথা স্মরণ করে তখন তথায় যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। অথচ এই সম্প্রদায়টি অতি উৎফুল্ল চিত্তে ধ্বংসের গহবরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের পূর্বপুরুষদেরকে যেসব গুণাবলীর জন্যে সম্মানে ভূষিত করেছিলাম এরা সেগুলো পরিহার করে ভিন্ন পথে মর্যাদা লাভে প্রয়াসী। তাদের ধর্মযাজকরা আমার বান্দাদেরকে নিজেদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আমার কিতাবের শিক্ষা উপেক্ষা করে তারা জনগণকে নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালিত করছে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে এবং আমার কর্মনীতি ও স্মরণ থেকে তাদেরকে গাফিল করে রেখেছে। এরা জনসাধারণকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ফলে তারা আমার বান্দা হয়েও তাদের আনুগত্য করছে ও তাদের নৈকট্য লাভের প্রয়াসী হচ্ছে। অথচ এ ধরনের আনুগত্য পাওয়ার হক কেবল আমারই। এভাবে আমার অবাধ্য হয়ে লোকজন ধর্মযাজকদের আনুগত্য করছে।

তাদের শাসকবর্গ আমার অনুগ্রহ লাভ করে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করছে। এবং আমার নীতি-কৌশলের পরিণতি থেকে নিশ্চিত নিরাপদ থাকবে বলে ধারণা করছে। পার্থিব জীবন তাদেরকে প্রতারণার ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপ করেছে। ফলে তারা আমার প্রেরিত কিতাবকে পরিত্যাগ করেছে। আমার সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়েছে। আমার কিতাবের মধ্যে পরিবর্তন করেছে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপের দুঃসাহস দেখিয়েছে। আমার পবিত্র সত্তা, সুউচ্চ মর্যাদা ও মহা প্রতাপ-প্রতিপত্তির জন্যে আমার রাজ্যের মধ্যে কারও অংশীদারিত্ব থাকা কি কখনও যুক্তিসংগত হতে পারে? আমার নির্দেশ উপেক্ষা করে অন্যের আনুগত্য করা কি কোন মানুষের পক্ষে বাঞ্ছনীয় হতে পারে? আমার পক্ষে কি কোন বান্দাকে মানুষের পূজনীয় করা কিংবা কাউকে কোন মানুষের পূজা করার অনুমতি দেওয়া শোভা পায়? নিরঙ্কুশ আনুগত্য তো কেবল আমারই প্রাপ্য।

এদের মধ্যে আলিম-ফকীহ ও শিক্ষিত শ্রেণীর অবস্থা এই যে, তারা তাদের পার্থিব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে পড়াশুনা করে, শাসকবর্গের অনুগত হয়ে থাকে। ফলে শাসকদল যেসব বেদআতী কাজে লিপ্ত হয় এরা সন্তুষ্টচিত্তে তা-ই অনুসরণ করে চলে; আমার সাথে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তারা শাসকদেরকে দেয়া অঙ্গীকার রক্ষা করে। এভাবে আলিম হয়েও তারা মূর্খের ভূমিকা পালন করছে। আমার কিতাবের যে জ্ঞান তারা অর্জন করেছিল তা থেকে তারা কোনভাবে উপকৃত হয়নি।

অপরদিকে নবীগণের বংশধরদের অবস্থা এমন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা অন্য শক্তির নিকট পরাজিত, বিভিন্ন প্রকার সমস্যায় জর্জরিত। বিভ্রান্তিমূলক আলাপ-আলোচনায় তারা লিপ্ত, তাদেরকে আমি যেভাবে সাহায্য ও সম্মান দান করেছি এরাও সেইরূপ সাহায্য ও সম্মান পাওয়ার প্রত্যাশা করে। তাদের ধারণা আমার অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য অধিকারী কেবল তারাই, অন্য কেউ নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে সততা ও সৎ চিন্তা নেই। তারা স্মরণ করে না তাদের পূর্ব-পুরুষ কিভাবে ধৈর্য ধারণ করেছিল এবং অন্যেরা যখন প্রতারণার জালে আবদ্ধ হচ্ছিল তখন কত দৃঢ়তার সাথে তারা আমার নির্দেশ মেনে চলেছিল, কী পরিমাণ আত্মোৎসর্গ তারা করেছিল এবং রক্ত ঝরিয়েছিল। তারা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল এবং ঈমানের দাবিকে সত্য প্রমাণিত করেছিল। ফলে আমার বিধান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় এবং আমার দীন বিজয় লাভ করে। তাদের বদৌলতেই এ জাতিকে আমি অবকাশ দিয়েছিলাম। আশা ছিল এরা লজ্জিত হয়ে আমার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে।

এদেরকে আমি অবকাশ দিয়েছি। তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছি, তাদের সংখ্যা ও আয়ু বৃদ্ধি করে দিয়েছি। তাদের কাকুতি-মিনতি কবুল করেছি—যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। ফলে আকাশ তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছে। যমীন খাদ্য উৎপাদন করেছে, সুস্থ দেহ ও স্বচ্ছন্দ জীবন তারা উপভোগ করেছে, শত্রুদের উপর জয়লাভ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আরও বেশি পাপাসক্ত হয়েছে। অপরাধের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং আমার নৈকট্য থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছে। এ অবস্থা আর কতদিন চলতে দেয়া যায়? এরা কি আমার সাথে উপহাস করছে, নাকি আমার সাথে ধোঁকাবাজী করছে? তারা আমার সাথে প্রতারণা করছে, নাকি স্পর্ধা দেখাচ্ছে? আমার মর্যাদার কসম, তাদের জন্যে এমন এক ভয়াবহ বিপর্যয় আমি নির্ধারণ করে রেখেছি— যার প্রচণ্ডতায় বিজ্ঞ-জ্ঞানী লোকও উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে, দার্শনিকের তত্ত্বজ্ঞান ও বিবেক সম্পন্ন লোকের বিবেক-শক্তি লোপ পাবে। তাদের উপর এক প্রতাপশালী, পাষাণ-হৃদয়, নির্দয় শাসক চাপিয়ে দেব। ভয়ংকর তার চেহারা, দয়া-মায়া শূন্য তার অন্তর। আঁধার রাতের ন্যায় বিশাল সৈন্যবাহিনী অনুগামী হবে তার। সৈন্যবাহিনীর ব্যূহগুলো হবে মেঘমালার ন্যায়।

ধোয়ার ন্যায় আচ্ছাদন করে চলবে সৈন্যদের খণ্ড খণ্ড মিছিলগুলো। বাহিনীতে ব্যবহৃত পতাকার শব্দ হবে শকুনপালের উড্ডয়নের শব্দের মত। অশ্বারোহীদের ধাবমান গতি হবে ঈগল পাখীর ঝাঁকের ন্যায় গতিশীল। তারা সমস্ত শহর ধ্বংস করবে, গ্রাম উজাড় করবে এবং যা-ই হাতের কাছে পাবে, তা-ই বিনাশ করে ছাড়বে। তাদের অন্তর হবে কঠিন, কোন কিছুই পরোয়া করবে না, কারও অপেক্ষা করবে না, কারও প্রতি অনুগ্রহ দেখাবে না, কোন দিকে তাকাবে না, কারও কথা শুনবে না। সিংহের মত গর্জন করতে করতে এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ঘুরে বেড়াবে। তাদের ভয়ংকর রূপ দেখে শরীর শিউরে উঠবে। তাদের কথা শুনে জ্ঞানীর জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে। এমন ভাষায় কথা বলবে, যা কেউ বুঝবে না, এমন চেহারায় প্রকাশিত হবে, যা কেউ চিনবে না। আমার ইজ্জতের কসম, এরপরে আমি তাদের বাড়ি-ঘর আমার পবিত্র কিতাব থেকে বঞ্চিত করে দেব। তাদের সভা-সমিতি ও বৈঠকাদিতে কিতাবের পাঠ ও আলোচনা বন্ধ করে দেব, তাদের মসজিদগুলো ঐসব আগন্তুক ও পরিচর্যাকারী থেকে শূন্য করে ফেলব, যারা অন্যের উদ্দেশ্যে এগুলোকে সুসজ্জিত করে রাখত, এর মধ্যে শয়ন করত। পুণ্য লাভের পরিবর্তে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে তারা ইবাদত করত, এখানে বসে দীনের পরিপন্থী চিন্তা-গবেষণা করত এবং এ মসজিদগুলোতে বসেই আমলবিহীন শিক্ষা গ্রহণ করত।

তাদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করব--শাসক শ্রেণীর সম্মানের পরিবর্তে লাঞ্ছনা, নিরাপত্তার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, ঐশ্বর্যের পরিবর্তে দাবি, স্বচ্ছলতার পরিবর্তে অনাহার, অনাবিল সুখ-শান্তির পরিবর্তে বিভিন্ন প্রকার সংকট-সমস্যা, রেশমী পোশাকের পরিবর্তে জীর্ণশীর্ণ পশমী জামা, তেল-সুগন্ধি যুক্ত সংগীদের পরিবর্তে নিহত মানুষের লাশ এবং মাথায় রাজ-মুকুটের পরিবর্তে গলায় লোহার বেড়ি ও পায়ে শৃংখল পরিধানের দ্বারা আমি তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করব। তাদের সুরম্য অট্টালিকা ও দুর্ভেদ্য দুর্গকে ধ্বংসস্তুপে, নিচ্ছিদ্র গম্বুজ বিশিষ্ট শয়নকক্ষকে হিংস্র শ্বাপদের আবাস স্থলে, অশ্ব হেসার স্থলে নেকড়ের গর্জন, প্রদীপের আলোর স্থলে আগুনের ধোয়া এবং কোলাহল-কলরবের স্থলে নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশে রূপান্তরিত করব। তাদের স্ত্রীদের হাতে চুড়ির বদলে বেড়ি, গলায় স্বর্ণ ও মুক্তার হারের বদলে লোহার শিকল, সুগন্ধি ও সুবাসিত তেলের বদলে ধুলি-বালি। কোমল বিছানায় উঁচু বালিশে হেলান দিয়ে থাকার বদলে বাজার-ঘাটে রাত্রি-দিনে ঘুরে বেড়ানোর এবং অন্দর মহলে ঘোমটা দিয়ে থাকার বদলে অনাবৃত চেহারায় খর-তাপের মধ্যে ভবঘুরে জীবন যাপনে বাধ্য করব।

এরপর আমি এদেরকে বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দিয়ে নিষ্পেষিত করব। কেউ যদি সু-উচ্চ কোন স্থানে আশ্রয় নেয়, তা হলে আমার শাস্তিও সেখানে গিয়ে পৌঁছবে। যে আমাকে সমীহ করবে আমি তার প্রতি অনুগ্রহ দেখাব, আর যার দ্বারা আমার নির্দেশ পদদলিত হবে, আমি তাকে লাঞ্ছিত করব। এরপর আমার নির্দেশে আকাশ তাদের উপরে লোহার ঢাকনায় পরিণত হবে। এবং মাটি গলিত তামার মত কঠিন হবে। ফলে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে না এবং মাটি থেকে কিছুই উৎপন্ন হবে না। যদি অল্প কিছু বৃষ্টি হয়ও এবং তাতে যৎসামান্য ফসলও উৎপন্ন হয় তা হলে তা নষ্ট করার উপদ্রব সৃষ্টি করব। যদি কিছু ফসল রক্ষা পেয়ে যায় তবে তার থেকে আমি বরকত উঠিয়ে নেব। আমার নিকট প্রার্থনা করলে সাড়া দেব না, কিছু পাওয়ার আবেদন করলে দান করব না, কান্নাকাটি করলে দয়া দেখাব না, করজোড়ে অনুনয়-বিনয় করলে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখব। তারা যদি এভাবে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পূর্ব-পুরুষদের উপর আপনার রহমত ও কৃপা দান করেছেন এবং আমাদের উপরেও প্রথম দিকে তা অব্যাহত রেখেছেন- আমাদেরকে আপনার নৈকট্য দানের জন্যে বাছাই করেছেন, আমাদের মধ্যে বহু নবী প্রেরণ করেছেন, আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন, বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ আমাদেরকে দিয়েছেন, আমাদেরকে শক্তিশালী করেছেন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দান করেছেন। আমাদেরকে ও আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে শিশুকালে আপন অনুগ্রহে লালন-পালন করেছেন এবং যৌবনকালে আপন রহমত দিয়ে সব রকম ক্ষতি থেকে হেফাজত করেছেন। আমরাই আপনার অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকজন। সুতরাং আমরা যদি বিপথগামী হয়েও থাকি তবুও আপনার অনুগ্রহ আমাদের উপর অব্যাহত রাখুন, আমরা যদি বদলে গিয়েও থাকি আপনি বদলে যাবেন না, বরং আপনার অনুগ্রহ, ইহসান, কৃপা ও দান পুরোপুরি আমাদের প্রতি বর্ষণ করুন। তারা যদি ঐভাবে প্রার্থনা করে তবে আমি বলবো, আমার বান্দাদের উপরে প্রথমে আমি দয়া ও রহমত দেখিয়ে থাকি। এরপর যদি তারা আমার দাসত্ব কবুল করে নেয়, তা হলে আমি আমার দান পূর্ণ করে দেই। যদি তারা তা বৃদ্ধি করে আমিও আমার দান বৃদ্ধি করি। যদি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আমি তখন আমার দান দ্বিগুণ করে দেই। যদি তারা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বিপথগামী হয় তখন আমিও আমার কার্যধারা পরিবর্তন করি। তারা বিপথগামী হলে আমি ক্রুদ্ধ হই। আমি ক্রুদ্ধ হলে শাস্তি দান করি। আর আমার ক্রোধের সামনে কিছুই টিকে থাকতে পারে না।’

কা’ব বর্ণনা করেন, তখন নবী আরমিয়া (আ) বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তো আপনার কৃপায় বেঁচে আছি, যা জানার তা আপনার থেকেই জানছি। আমি দুর্বল ও অসহায়, আপনার দরবারে কথা বলা আমার সাজে না। আজকের এই দিন পর্যন্ত আপনি নিজ রহমতে আমাকে জীবিত রেখেছেন। এ আযাব ও শাস্তির ঘোষণাকে আমার চেয়ে অধিক ভয় পাওয়ার আর কেউ নেই। দীর্ঘদিন যাবত আমি এসব পাপী লোকদের মধ্যে অবস্থান করে আসছি। আমার পাশে থেকেই এরা আপনার অবাধ্য হয়ে চলেছে। আমি কোন প্রতিবাদ ও পরিবর্তন করতে পারিনি। এখন যদি আপনি আমাকে শাস্তি দেন, তা হলে সে শাস্তি আমার ক্রটির জন্যেই ভোগ করব; আর যদি আমাকে ক্ষমা করে দেন, তা হলে আপনার দরবারে আমার প্রত্যাশা।’

এরপর নবী আরমিয়া (আ) বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি পবিত্র, যাবতীয় প্রশংসা আপনার; হে আমার প্রতিপালক! আপনি বরকতময় ও সুমহান। আপনি কি এ জনপদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ধ্বংস করে দেবেন, এটা তো আপনার প্রেরিত অসংখ্য নবীর বাসস্থান এবং আপনার ওহীর অবতারণ স্থল। হে আমার প্রতিপালক! আপনি পবিত্র, প্রশংসার অধিকারী, হে আমার প্রতিপালক! আপনি বরকতময়, মহান। এ মসজিদ (বায়তুল মুকাদ্দাস) ধ্বংসের প্রাক্কালে আমার ফরিয়াদ—এ মসজিদের চতুষ্পার্শ্বে আরও বহু মসজিদ ও বাড়ি-ঘর আছে, যেগুলো আপনার যিকর ও স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। হে আমার রব! আপনি পবিত্র, প্রশংসনীয়, কল্যাণময় ও মহান, এ জাতিকে আপনি হত্যা ও শাস্তি দিতে যাচ্ছেন, এরা তো আপনার খলীল ইবরাহীম (আ)-এর বংশধর; আপনার সাথে একান্তে সংলাপকারী মূসা (আ)-এর অনুসারী এবং আপনার মনোনীত নবী দাঊদ (আ)-এর সম্প্রদায়। হে আমার প্রতিপালক! ইব্রাহীম খলীলুল্লাহর বংশধর, মূসা নাজীউল্লাহর উম্মত এবং দাউদ খলীফাতুল্লাহর সম্প্রদায়, যাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে আপনি অগ্নি পূজারীদেরকে চাপিয়ে দেবেন- এরপর আর কোন জনপদটি অবিশষ্ট থাকবে, যারা আপনার শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে?’

আল্লাহ বলেন, “হে আরমিয়া! যে কেউ আমার অবাধ্য হয় সে আমার শাস্তি থেকে আদৌ অনবহিত থাকে না। ঐসব লোকদেরকে আমি সম্মানিত করেছিলাম, কারণ তারা আমার আনুগত্য করেছিল। যদি তারা আমার অবাধ্য হত, তবে অবশ্যই আমি তাদেরকে অবাধ্যদের অন্তর্ভুক্ত করতাম। তবে আমি তাদের প্রতি সদয় হলে নিজ দয়ায় তাদেরকে সংশোধন করে থাকি।”

আরমিয়া (আ) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি নবী ইবরাহীমকে আপন খলীলরূপে গ্রহণ করেছেন এবং তার বদৌলতে আমাদেরকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন। নবী মূসাকে আপনি একান্তে ডেকে নিয়ে সংলাপ করেছেন। সুতরাং আমাদের প্রার্থনা, তার ওসীলায় আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং আমাদের শত্রুদেরকে আমাদের উপরে চাপিয়ে দেবেন না।’ তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করলেনঃ ‘হে আরমিয়া! তুমি যখন মায়ের উদরে ছিলে তখন থেকেই আমি তোমাকে পবিত্র রেখেছি এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত জীবিত রেখেছি। তোমার সম্প্রদায় যদি ইয়াতীম, বিধবা, মিসকীন ও পথিক লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা করত তবে আমি তাদেরকে আপন আশ্রয়ে রাখতাম। তারা আমার নিকট এমন একটি উদ্যানের ন্যায় সমাদৃত হত, যার বৃক্ষগুলি সতেজ এবং পানি স্বচ্ছ-পবিত্র এবং যার পানি কখনও শুকিয়ে যায় না। ফল নষ্ট হয় না এবং শেষও হয় না। কিন্তু তোমার সম্প্রদায় বনী ইসরাঈলের অবস্থাটা কী? তাদের ব্যাপারে আমার অনুযোগ হচ্ছে- আমি তাদেরকে দয়ালু আহ্বানকারীর মত আমার দিকে আহ্বান করেছি, সকল প্রকার দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ থেকে নিরাপদে রেখেছি। সচ্ছল ও সজীব জীবন তারা উপভোগ করেছে। কিন্তু আমার এ নিয়ামত ভোগ করে তারা মোটা-তাজা মেষের মত পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। তাদের জন্যে শত আক্ষেপ, আমি তো কেবল ঐসব লোকদেরকে সম্মানিত করি, যারা আমার প্রতি সম্মান দেখায়। পক্ষান্তরে যারা আমার বিধানকে পদদলিত করে আমি তাদেরকে লাঞ্ছিত করে ছাড়ি। বনী ইসরাঈলের পূর্বে যে সব জাতি এসেছে, তারা পাপাচারে লিপ্ত হতো গোপনে, আর এরা পাপ কাজ করে প্রকাশ্যে। এরা পাপ করে মসজিদে, বাজারঘাটে, পর্বত শিখরে এবং বৃক্ষের ছায়ায়। ওদের ঘৃণ্য পাপাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বত চিৎকার করে আমার নিকট ফরিয়াদ করেছে; বন্য-জীবজন্তু ও কীট-পতংগ এলাকা ত্যাগ করে দূর-দূরান্তে পালিয়ে গিয়েছে। এর পরেও তারা পাপাচার থেকে নিবৃত্ত হচ্ছে না এবং আমার কিতাবের যে জ্ঞান তারা লাভ করেছে তা থেকে কোন উপকার লাভ করছে না।’

তারপর আরমিয়া যখন বনী ইসরাঈলের নিকট গিয়ে এসব কথা জানালেন এবং সবকিছু খুলে বললেন, তখন তারা এ শাস্তি ও আযাবের কথা শুনে নবীর অবাধ্য হয়ে নবীকে বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলছ এবং আল্লাহর উপরে মিথ্যা আরোপ করছ! তুমি কি মনে করছ যে, আল্লাহ তাঁর এ যমীনকে ও মসজিদসমূহকে নিজের কিতাব, তাঁর ইবাদত ও তাওহীদ থেকে শূন্য করে দেবেন? এ সব চলে যাওয়ার পর তিনি এ পৃথিবীতে আর কাকে পাবেন? তুমি আল্লাহর উপর জঘন্য মিথ্যা আরোপ করেছ, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি পাগল হয়েছো।’ এ কথা বলে তারা নবীকে ধরে বন্দী করল এবং জেলখানায় আবদ্ধ করল। আল্লাহ এ সময় তাদের বিরুদ্ধে বুখত নসরকে প্রেরণ করেন। বুখত নসর সসৈন্যে বনী ইসরাঈলের এলাকায় উপনীত হয় এবং সকলকে অবরোধ করে রাখে। এ অবস্থার কথাই আল্লাহ তা’আলা কুরআনে বলেছেনঃ

فجاسوا خلال الديار

-“তারপর তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সবকিছু ধ্বংস করেছিল।” (বনী ইসরাঈলঃ ৫)। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার পর বাধ্য হয়ে তারা বুখত নসরের নিকট আত্মসমর্পণ করল এবং শহরের তোরণ খুলে দিল। সাথে সাথে বুখত নসরের সৈন্যবাহিনী শহরের অলিতে-গলিতে এবং ঘরে ঘরে প্রবেশ করল! বুখত নসর তাদের ব্যাপারে নিষ্ঠুর জাহিলী নীতি অবলম্বন করে এবং অত্যাচারী শাসকসুলভ কঠিন নির্দেশ জারী করে। ফলে বনী ইসরাঈলের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশকে হত্যা করা হয়। এক তৃতীয়াংশকে বন্দী করা হয় এবং পশু, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর নিহতদের মৃত দেহের উপর চালিয়ে সেগুলোকে দলিত-মথিত করে। বুখত নসর বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করে, শিশু-বালকদেরকে ধরে নিয়ে যায়, নারীদেরকে ঘোমটামুক্ত করে বাজারে উঠায়, যুদ্ধক্ষম পুরুষদেরকে হত্যা করে, দুর্গসমূহ গুঁড়িয়ে ফেলে, মসজিদগুলো বিধ্বস্ত করে, তাওরাত কিতাব জ্বালিয়ে দেয় এবং দানিয়াল (আ)-কে খোঁজ করে, যার নিকট বুখত নসর পূর্বেই পত্র লিখেছিল। কিন্তু দেখা গেল, তিনি ইতিপূর্বেই ইনতেকাল করেছেন। দানিয়ালের পরিবারবর্গ সে পত্রটি বের করে দিল। নিহত দানিয়ালের পরিবারে যারা জীবিত ছিলেন, তারা হলেন হিযকীল-তনয় ছোট দানিয়াল, মিশাঈল, আযরাঈল ও মিখাঈল। উক্ত চিঠির মর্ম অনুযায়ী তাদের প্রতি আচরণ করা হয়। দানিয়াল ইবন হিযকীল (ছোট দানিয়াল) বড় দানিয়ালের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন।

বুখত নসর তার সৈন্যবাহিনীসহ বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে, সমগ্র সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং বনী ইসরাঈলকে সমূলে বিনাশ করে। ধ্বংসলীলা সম্পন্ন করে বুখত নসর সংগৃহীত ধন-সম্পদ ও বন্দীদেরকে নিয়ে স্বদেশে ফিরে যায়। বন্দীদের মধ্যে কেবল ধর্মযাজক ও শাসক শ্রেণীর পরিবারভুক্ত শিশু-বালকদের সংখ্যা ছিল নব্বই হাজার। বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত উপাসনালয়গুলো পাথর ছুঁড়ে ধুলিসাৎ করে দেয়া হয় এবং মসজিদের অভ্যন্তরে শূকর যবেহ করা হয়। বন্দী বালকদের মধ্যে সাত হাজার ছিল দাউদ পরিবারের, এগার হাজার ইউসুফ ইবন ইয়াকূব ও তার ভাই বিনয়ামীন এর বংশধর, আট হাজার ঈশা ইবন ইয়াকূব-এর বংশের, চৌদ্দ হাজার হযরত ইয়াকূবের দু’পুত্র যাবালূন ও নাফতালী-এর বংশের, চৌদ্দ হাজার দান ইবন ইয়াকূবের বংশের, আট হাজার ইয়াসতাখির ইবন ইয়াকুবের বংশ, দু’হাজার যাবালূন ইবন ইয়াকূবের অন্য এক শাখার, চার হাজার রূবেল ও লেবীয় বংশের এবং বার হাজার ছিল বনী ইসরাঈলের অন্যান্য শাখার। এসব কিছু সংগে নিয়ে বুখত নাসর বাবিল শহরে গিয়ে পৌঁছে।

ইসহাক ইবন বিশর বলেন, ওহাব ইবন মুনাববিহ্ বলেছেন, বায়তুল মুকাদ্দাস ও বনী ইসরাঈলের ধ্বংস কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর বুখত নসরকে বলা হয় যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি তাদেরকে এই পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করবেন, আপনার বৈশিষ্ট্যাবলী তাদের নিকট তুলে ধরবেন এবং এই কথাও শুনাতেন যে, আপনি তাদের যোদ্ধাদের হত্যা করবেন, শিশু সন্তানদের বন্দী করবেন, মসজিদসমূহ ধ্বংস করবেন এবং উপাসনালয়সমূহ জ্বালিয়ে দেবেন। কিন্তু এরা তার কথা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়, তাকে অপবাদ দেয়, প্রহার করে, বন্দী করে ও জেলে আবদ্ধ করে রাখে। তখন বুখত নসর সেই ব্যক্তিকে হাজির করার নির্দেশ দেয়। ফলে আরমিয়াকে জেলখানা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। বুখত নসর তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এই পরিণতি সম্পর্কে ঐ সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিলেন?’ আরমিয়া বললেন, ‘হ্যাঁ।’

বুখত নসর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তা কিভাবে জানতে পারলেন?’ আরমিয়া (আ) বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে তাদের নিকট রাসূলরূপে পাঠিয়েছেন। তিনিই আমাকে তা জানিয়েছিলেন।’ বুখত নসর জিজ্ঞেস করল, ‘তারা কি আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রহার করে জেলে আবদ্ধ করেছে?’ আরমিয়া বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই করেছে।’ বুখত নসর বলল, ‘ঐ জাতি বড়ই দুর্ভাগা, যারা তাদের নবীকে মিথ্যাবাদী বলে, আল্লাহর রাসূলকে অস্বীকার করে।’ তখন বুখত নসর আরমিয়াকে বলল, ‘আপনি যদি আমাদের সাথে যেতে চান, তবে চলুন, আমি আপনাকে সম্মান করব, সহযোগিতা করব; আর যদি নিজ শহরে থাকতে চান তা হলে থাকুন, আমি আপনাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দান করব।’ এ প্রস্তাবের উত্তরে আরমিয়া বুখত নসরকে জানালেন, ‘আমি সর্বদা আল্লাহর নিরাপত্তায় আছি, এক মুহূর্তের জন্যেও তার নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে আসিনি। বনী ইসরাঈলও যদি তার নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে না আসত তা হলে তারা আপনাকে বা অন্য কাউকে ভয় করত না এবং আপনিও তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে পারতেন না।’

আরমিয়ার মুখে এ বক্তব্য শুনার পর বুখত নসর তাঁকে তাঁর স্ব-স্থানে রেখে চলে গেল। আরমিয়া নিজ শহর ঈলিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। এ বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের। তবে এর মধ্যে উপদেশ ও সূক্ষ্ম তাৎপর্য নিহিত আছে। এ বর্ণনার আরবী ভাষা শৈলী নেহাৎ দুর্বল।

হিশাম ইবন মুহাম্মদ আল-কালবী বলেছেন, বুখত নসর ছিল পারস্য সম্রাটের অধীনে আহ্ওয়াজ ও রোমের মধ্যবর্তী অঞ্চলের শাসনকর্তা। সম্রাটের নাম ছিল লাহরাসব। তিনি বলখ শহর নির্মাণ করেন, যা খানসা নামে অভিহিত। তিনি তুর্কদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেন। পারস্য সম্রাট বুখত নসরকে সিরিয়ায় বনী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্রেরণ করেন। তিনি যখন সিরিয়ায় পৌঁছেন তখন দামেশকের অধিবাসীগণ তার সাথে সন্ধি করে। কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, পারস্যের যে সম্রাট বুখত নসরকে যুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন, তার নাম ছিল বাহমন। তিনি লাহরাসবের পুত্র বাশতাসবের পরে পারস্যের সম্রাট হন। বাহমন কর্তৃক প্রেরিত দূতকে লাঞ্ছিত করার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে বনী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে এ অভিযান প্রেরিত হয়েছিল।

ইবন জারীর ..... সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বুখত নসর দামেশকে এসে একটি আবর্জনাস্তুপের মধ্য থেকে অবিরাম রক্ত উথিত হতে দেখে লোকের নিকট এর কারণ জিজ্ঞেস করে। তারা জানায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই এ অবস্থা চলে আসছে এবং আমরা এ রকমই সর্বদা দেখে আসছি। এ রক্তের উপর যখনই আবর্জনা ফেলে ঢেকে দেয়া হয় তখনই তা আবর্জনার উপরে উঠে আসে। আর বুখত নসর ঐ স্থানে সত্তর হাজার লোক হত্যা করে। ফলে রক্ত ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। উপরোক্ত ঘটনা সাঈদ ইবনুল-মুসায়্যিব (রা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এটা হযরত ইয়াহয়া ইবন যাকারিয়ার রক্ত বলে হাফিজ ইবন আসাকিরের যে মন্তব্য পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, তা যথার্থ নয়। কেননা, ইয়াহয়া ইবন যাকারিয়ার আগমন হয় বুখত নসরের পর। তবে এ কথা সত্য যে, এটা হয় কোন নবীর রক্ত, না হয় কোন পূণ্যবান লোকের রক্ত অথবা অন্য কারও রক্ত- যা আল্লাহই ভাল জানেন।

হিশাম ইব্‌ন কালবী বর্ণনা করেন, তারপর বুখত নসর বায়তুল মুকাদ্দাসে যায় এবং সেখানকার শাসক তার সাথে সন্ধি করেন। শাসক ছিলেন দাউদ (আ)-এর বংশধর। তিনি বনী ইসরাঈলের পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বুখত নসর উক্ত শাসকের নিকট থেকে মুচলেকা স্বরূপ কিছু লোক সংগে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে। তিবরিয়া নামক স্থানে পৌঁছে বুখত নসর সংবাদ পায় যে, সন্ধি করার কারণে ইসরাঈল বংশীয়রা তাদের শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাকে হত্যা করে। এ সংবাদ শুনামাত্র বুখত নসর মুচলেকাস্বরূপ নেয়া লোকগুলোকে হত্যা করে অতর্কিতে শহর আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং সকল সক্ষম লোকদেরকে হত্যা করে এবং শিশু-বালকদেরকে বন্দী করে।

হিশাম আরও বলেছেন, বুখত নসর জেলখানা থেকে নবী আরমিয়াকে বের করে আনে। নবী তার নিকট বনী ইসরাঈলকে এ পরিণতি থেকে সতর্ক করার জন্যে যা যা করেছিলেন সবকিছু খুলে বলেন; তারা নবীকে মিথ্যাবাদী বলে জেলে আটক করার কথাও তাকে তিনি জানান। বুখত নসর বলল, ‘যারা আল্লাহর নবীকে অমান্য ও অবমাননা করে, তারা একটি নিকৃষ্ট সম্প্রদায়। নবীর সাথে উত্তম ব্যবহার করে বুখত নসর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। এরপর নবী ইসরাঈলের অবশিষ্ট দুর্বল লোকজন আরমিয়ার নিকট এসে সমবেত হয় এবং করুণ কষ্ঠে ফরিয়াদ জানিয়ে বলে, ‘আমরা অপরাধ করেছি, জুলুম করেছি, এখন আল্লাহর নিকট নিজেদের কৃত অপকর্মের জন্যে তওবা করছি। আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যাতে তিনি আমাদের তওবা কবুল করেন।’ নবী আল্লাহর নিকট আবেদন করলে তিনি জানান, ‘তুমি যা বলছ তা হবার নয়। দেখ, তারা যদি আন্তরিকভাবেই বলে থাকে, তবে তোমার সাথে যেন তারা এই শহরে অবস্থান করে।’ নবী তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কথা জানালেন। তারা বলল, “এ শহরে কীভাবে থাকা যায়, এখানকার অধিবাসীদের উপর আল্লাহর গযব পড়েছে। শহর ধ্বংস হয়েছে।’ সুতরাং এখানে অবস্থান করতে তারা অস্বীকার করল।

ইবনুল কালবী বলেন, তখন থেকে বনী ইসরাঈল বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে- একদল যায় হিজাযে, একদল ইয়াছরিবে, এক দল যায় ওয়াদিল কুরায় এবং একটি ক্ষুদ্র দল যায় মিসরে। তখন বুখত নসর নবী ইসরাঈলের বাদশাহর নিকট এই মর্মে পত্র লিখে যে, তাদের যে সব লোক পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদেরকে যেন তার নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাদশাহ এতে অস্বীকৃতি জানান। তখন বুখত নসর সসৈন্যে উক্ত শহরে আক্রমণ চালিয়ে তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। সে তাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের স্ত্রীলোকদেরকে বন্দী করে এবং সেখান থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়। এ অভিযান অব্যাহতভাবে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চালিয়ে মরক্কো, মিসর, মিসর, বায়তুল মুকাদ্দাস, ফিলিস্তীন ও জর্দান থেকে অসংখ্য বন্দী সাথে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। উক্ত বন্দীদের মধ্যে দানিয়াল (আ)-ও ছিলেন। তবে ইনি হলেন দানিয়াল ইবন হিযকীল (ছোট দানিয়াল), দানিয়াল আকবার (বড় দানিয়াল) নন। এ বর্ণনাটি ওহাব ইব্‌ন মুনাবির।

১৬
হযরত দানিয়াল (আ)-এর বিবরণ
ইবন আবিদ দুনয়া ........ আবদুল্লাহ ইবন হুজায়ল থেকে বর্ণনা করেন যে, বুখত নসর দু’টি সিংহ ধরে একটি কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে এবং নবী দানিয়ালকে এনে ঐ দু’টি সিংহের মধ্যে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সিংহ দু’টি তার উপর কোনরূপ আক্রমণ করেনি। তিনি দীর্ঘক্ষণ সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই অবস্থান করার পর মানুষের জৈবিক চাহিদা অনুযায়ী তার খাদ্য পানীয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে নবী আরমিয়াকে দানিয়ালের জন্যে খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করতে বলেন। তিনি বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি থাকি বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকায়, আর দানিয়াল আছেন সুদূঢ় ইরাকের বাবিল শহরে। সেখানে আমি কিভাবে খাদ্য পানীয় পৌঁছাব?’ আল্লাহ বললেন, ‘হে আরমিয়া, আমি তোমাকে যা আদেশ করেছি, তুমি তা-ই কর; প্রস্তুতকৃত খাদ্য সামগ্রীসহ তোমাকে সেখানে পৌঁছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা শীঘ্রই আমি করছি।’ আরমিয়া (আ) খাদ্য তৈরি করলেন। তারপর এমন একজনকে প্রেরণ করা হলো, যিনি খাদ্য পানীয়সহ আরমিয়াকে উক্ত কূপের পাড়ে পৌঁছিয়ে দিলেন। দানিয়াল ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কে?’ আরমিয়া (আ) নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন- ‘আমি আরমিয়া।’ দানিয়াল (আ) বললেন, ‘কেন আপনি এখানে এসেছেন?’ আরমিয়া (আ) জানালেন, ‘আপনার প্রভু আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন।’ দানিয়াল (আ) বললেন, ‘তা হলে আমার প্রভু আমাকে স্মরণ করেছেন?’ আরমিয়া বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ।’ তখন বলে উঠলেনঃ ‘সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যাকে কেউ স্মরণ করলে তিনি তাকে ভুলেন না; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, আহ্বান করলে তিনি সে আহ্বানে সাড়া দেন; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যার প্রতি কেউ নির্ভরশীল হলে তিনি তাকে অন্যের দিকে ঠেলে দেন না; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি উত্তম কাজের উত্তম বিনিময় দান করেন; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি ধৈর্যের বিনিময়ে মুক্তি দান করেন; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন? সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের বিশ্বাস ও কর্মদ্যোম শিথিল হয়ে পড়লে দৃঢ়তা দান করেন; সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের সকল উপায় শেষ হবার পর একমাত্র ভরসা স্থল।’

ইউনুস ইবন বুকায়র ....... আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা যখন তুস্তর শহর জয় করি, তখন হরমুনের বাড়িতে একটি খাটের উপর একটি মৃত দেহ দেখতে পাই। তার লাশের শিয়রের কাছে একটি আসমানী কিতাব। আমরা তা নিয়ে আসি এবং হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবকে দেখাই। তিনি হযরত কা’বকে ডেকে তার দ্বারা তা’ আরবীতে অনুবাদ করান। আবুল আলিয়া বলেন, ‘আরবদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম ঐ কিতাবখানার অনূদিত কপি পাঠ করি, যেভাবে আমি কুরআন পাঠ করে থাকি।’ খুলদ ইবন দীনার বলেন, ‘আমি আবুল আলিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তাতে কী লেখা ছিল? তিনি বললেন, তাতে লিখিত ছিল তোমাদের কর্মকাণ্ড, ঘটনাবলী, কথাবার্তা ও পরবর্তীকালে ঘটতব্য সার্বিক অবস্থা।’ আমি বললাম, ‘আপনারা সে লোকটিকে কী করলেন?’ তিনি বললেন, ‘আমরা দিনের বেলা তেরটি কবর খুঁড়লাম এবং রাত্রিকালে একটি কবরে তাকে দাফন করে সবক’টি কবর একই রূপ করে দিলাম। এ ব্যবস্থা করলাম যাতে সাধারণ লোক তার কবরের সন্ধান না পায় এবং কবর খুঁড়ে না ফেলে।’

বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষ তার কাছে কী প্রত্যাশা করে?’ আবুল আলিয়া বললেন, ‘বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ হয়ে গেলে লোকজন এ খাট নিয়ে ময়দানে এসে বৃষ্টি কামনা করতো এবং এর ফলে বৃষ্টিপাত হত।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ মৃত লোকটিকে জানেন কি?’ আবুল আলিয়া বললেন, ‘তার নাম দানিয়াল বলে শোনা যায়।’ রাবী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনি কত বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন?’ আবুল আলিয়া বললেন, ‘তিনশ’ বছর পূর্বে।’ রাবী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ সময়ের মধ্যে তার মৃতদেহের কোন পরিবর্তন হয়েছিল কি?’ আবুল আলিয়া বললেন, ‘না, তবে মাথার পিছনের দিকের কয়েকটি চুলের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।’ নবীদের দেহ মাটিতেও পঁচে না এবং জীবজন্তুও খায় না। এ ঘটনাটি আবুল আলিয়া থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে তার মৃত্যু তারিখ যদি তিনশ’ বছর পূর্বে হওয়া সঠিক হয় তা হলে তিনি নবী নন, বরং কোন পুণ্যবান ব্যক্তি হবেন। কেননা, সহীহ বুখারী শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা) ও ঈসা ইব্‌ন মারয়ামের মধ্যে অন্য কোন নবীর আগমন ঘটেনি। আর এ দুই নবীর মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান চারশ’ বছর। কারও মতে ছয়শ’ বছর, কারও মতে ছয়শ’ বিশ বছর। কোন কোন লেখক ঐ ব্যক্তির মৃত্যু আটশ’ বছর পূর্বে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন।

ঐতিহাসিক মতে দানিয়ালের মৃত্যুও প্রায় এই সময়ে হয়েছিল। এ হিসাব অনুযায়ী মৃত ব্যক্তি দানিয়ালও হতে পারেন, বা অন্য কোন নবীও হতে পারেন, কিংবা কোন নেককার লোকও হতে পারেন। তবে দানিয়াল হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কেননা দানিয়াল নবীকেই পারস্য সম্রাট ধরে নিয়ে বন্দী করে রেখেছিল। আবুল আলিয়া থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তিটির নাক এক বিঘত লম্বা ছিল। আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তার নাক এক হাত লম্বা ছিল। এ দিকে লক্ষ্য করলে বলা যেতে পারে যে, এ লাশ বহু পূর্বের, দূর অতীতের কোন নবীর লাশ।

আবু বকর ইবন আৰিদ্দুনয়া ....... তাঁর রচিত ‘কিতাবু আহকামিল কুনূর’ গ্রন্থে আবুল আশ’আছের বরাতে লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ নবী দানিয়াল আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন যে, তার দাফনকার্য যেন উম্মতে মুহাম্মাদীর হাতে সুসম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে আবু মূসা আশআরীর হাতে তুস্তর নগরী বিজিত হলে তাঁর লাশ একটি সিন্দুকের মধ্যে দেখতে পান। এ সময় তার দেহের শিরা ও কাঁধের মোটা রগ দু’টি নড়াচড়া করছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি দানিয়ালের লাশ সনাক্ত করিয়ে দেবে, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে।” হারকুস নামক এক ব্যক্তি দানিয়ালের লাশ সনাক্ত করেছিলেন। আবু মূসা (রা) হযরত উমর (রা)-কে এ বিষয়ে অবহিত করেন। তখন হযরত উমর (রা) পত্র মারফত তাঁকে জানান যে, দানিয়ালকে ওখানে দাফন কর এবং হারকূসকে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও- কেননা, নবী করীম (সা) তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন। বর্ণিত সূত্রে হাদীছটি মুরসাল এবং এর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

ইবন আবিদ দুনিয়া ..... আম্বাসা ইবন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু মূসা মৃত দানিয়ালের সাথে একখানা আসমানী কিতাব, চর্বি ভর্তি একটি কলস, কিছু সংখ্যক দিরহাম ও তার ব্যবহৃত আংটি পান। এরপর হযরত উমর (রা)-কে এ সম্পর্কে অবহিত করে আবু মুসা (রা) পত্র লিখেন। হযরত উমর (রা) চিঠির মাধ্যমে আবূ মূসাকে জানান, আসমানী কিতাবখানা আমাদের নিকট পাঠিয়ে দাও, চর্বির কিছু অংশ আমাদের জন্য পাঠাও এবং অবশিষ্ট অংশ থেকে আরোগ্য লাভের জন্যে মুসলমানদেরকে তোমার পক্ষ থেকে ব্যবহার করতে দাও, আর দিরহামগুলো তাদের মাঝে বণ্টন কর এবং আংটিটি তুমি ব্যবহার কর! ভিন্ন সূত্রে ইবন আবিদ দুনিয়া থেকে বর্ণিত, আবু মূসা (রা) যখন দানিয়ালের লাশ পেলেন, তখন তিনি তা জড়িয়ে ধরেন, ও চুম্বন করেন। অতঃপর তিনি হযরত উমর (রা)-কে এ বিষয়ে অবহিত কবেন এবং জানান যে, তার লাশের সাথে প্রায় দশ হাজার দিরহাম মূল্যের ধন-সম্পদ পাওয়া গিয়েছে। বিভিন্ন লোক তাথেকে ধার নেয় এবং পরে ফেরত দিয়ে যায়। কেউ ফেরত না দিলে রোগে আক্রান্ত হয়। তার পাশে আতর ভর্তি একটি কৌটাও রয়েছে। হযরত উমর (রা) আবু মুসাকে জানান যে, তাকে বরই পাতা মিশানো পানি দ্বারা গোসল করিয়ে, কাফন পরিয়ে দাফন কর এবং তাঁর কবরটি এমনভাবে গোপন রাখ যেন কেউ তার সন্ধান না পায়। মালামাল সম্পর্কে জানান যে, সেগুলো বায়তুলমালে জমা কর, আতরের কৌটা পাঠিয়ে দাও এবং আংটিটি তুমি নিজে ব্যবহার কর।

আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁর নির্দেশক্রমে চারজন বন্দী নদীর মধ্যে বাঁধ দিয়ে তার তলদেশে কবর খুঁড়ে সেখানে হযরত দানিয়ালের লাশ দাফন করে। পরে আবু মূসা (রা) ঐ চার বন্দীকে ডেকে এনে হত্যা করে দেন।[সম্ভবত এরা ছিল মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কয়েদী] ফলে আবু মূসা আশআরী (রা) ব্যতীত উক্ত কবরের সন্ধান জানার মত আর কেউ অবশিষ্ট থাকল না। ইবন আবিদ দুনিয়া ........ আবুয-যিনাদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি আবু মূসা আশআরীর পুত্র আবু বুরদার হাতে একটি আংটি দেখেছি, যাতে দুটি সিংহ এবং সিংহদ্বয়ের মাঝে জনৈক ব্যক্তির চিত্র অংকিত রয়েছে; আর সিংহ দু’টি ঐ লোকটিকে জিহ্বা দ্বারা চাটছে! আবু বুরদা বললেন, এটি ঐ লোকটির আংটি-যাকে এই শহরের লোকে দানিয়াল নামে জানে! তাকে দাফন করার সময় আবু মূসা (রা) তা নিজের কাছে তুলে রাখেন।

আবু বুরদা বলেন, আবু মূসা আশআরী (রা) উক্ত জনপদের লোকজনের নিকট আংটিতে অংকিত এ চিত্রের কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়, দানিয়ালের আবির্ভাবকালে দেশের যিনি শাসনকর্তা ছিলেন, তার নিকট জ্যোতিষী ও গণকদল এসে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, অমুক রাত্রে আপনার রাজ্যে এমন একজন শিশুর জন্ম হবে, যে এ রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

রাজা বললেন, ‘আল্লাহর কসম! ঐ রাত্রে যত শিশুর জন্ম হবে, আমি তাদের সকলকে হত্যা করব।’ বাস্তবে রাজা তাই করলেন। অবশ্য, শিশু দানিয়ালকে রাজার লোকজন সিংহ পালের মধ্যে নিক্ষেপ করে চলে যায়। কিন্তু সিংহ তার কোন ক্ষতি করল না; বরং দু’টি সিংহ শিশুটিকে জিহ্বা দ্বারা চেটে সুস্থ রাখে। অতঃপর শিশুটির মাতা এসে সন্তানকে এ অবস্থায় দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। এভাবে আল্লাহ দানিয়ালকে রক্ষা করেন এবং স্বীয় ইচ্ছা কার্যকরী করেন। আবু মূসা (রা) বলেন, ঐ জনপদের লোকজন জানায় যে, দানিয়ালের প্রতি আল্লাহর এ অনুগ্রহ স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্যে দানিয়াল তার আংটিতে নিজেকে সিংহদ্বয়ের চাটারত অবস্থা চিত্ৰাংকিত করে রাখেন। এ বর্ণনার সূত্রটি হাসান পর্যায়ের।

১৭
বিধ্বস্ত বায়তুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণ এবং বিক্ষিপ্ত বনী ইসরাঈলের পুনরায় একত্রিত হওয়ার বর্ণনা
এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণীঃ

( أَوۡ كَٱلَّذِی مَرَّ عَلَىٰ قَرۡیَة وَهِیَ خَاوِیَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّىٰ یُحۡیِۦ هَـٰذِهِ ٱللَّهُ بَعۡدَ مَوۡتِهَاۖ فَأَمَاتَهُ ٱللَّهُ مِا۟ئَةَ عَام ثُمَّ بَعَثَهُۥۖ قَالَ كَمۡ لَبِثۡتَۖ قَالَ لَبِثۡتُ یَوۡمًا أَوۡ بَعۡضَ یَوۡم ۖ قَالَ بَل لَّبِثۡتَ مِا۟ئَةَ عَام فَٱنظُرۡ إِلَىٰ طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمۡ یَتَسَنَّهۡۖ وَٱنظُرۡ إِلَىٰ حِمَارِكَ وَلِنَجۡعَلَكَ ءَایَة لِّلنَّاسِۖ وَٱنظُرۡ إِلَى ٱلۡعِظَامِ كَیۡفَ نُنشِزُهَا ثُمَّ نَكۡسُوهَا لَحۡم اۚ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَهُۥ قَالَ أَعۡلَمُ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَیۡء قَدِیر ࣱ)

[Surah Al-Baqarah 259]

—অথবা তুমি কী সে ব্যক্তিকে দেখনি, যে এমন এক নগরে উপনীত হযেছিল, যা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। সে বলল, “মৃত্যুর পর কিরূপে আল্লাহ একে জীবিত করবেন?” তারপর আল্লাহ তাকে একশ’ বছর মত রাখলেন। পরে তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ বললেন, “তুমি কতকাল অবস্থান করলে?” সে বলল, ‘একদিন অথবা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি।’ তিনি বললেন, ‘না, বরং তুমি একশ বছর অবস্থান করেছ। তোমার খাদ্য সামগ্রী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য কর, তা অবিকৃত রয়েছে এবং তোমার গাধাটির প্রতি লক্ষ্য কর, কারণ তোমাকে মানব জাতির জন্য নিদর্শন স্বরূপ করব। আর অস্থিগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর, কিভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই।’ যখন এ তার নিকট সুস্পষ্ট হল তখন সে বলে উঠল, ‘আমি জানি যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (২ বাকারাঃ ২৫৯)।

হিশাম ইবন কালবী বলেন, অতঃপর আল্লাহ আরমিয়া নবীর নিকট ওহী প্রেরণ করে জানালেন যে, আমি বায়তুল মুকাদ্দাসকে পুনরায় আবাদ করব। সুতরাং তুমি সেখানে যাও ও অবস্থান কর। নির্দেশ মতে আরমিয়া (আ) সেখানে গেলেন এবং দেখলেন যে, গোটা নগরী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অবাক বিস্ময়ে তিনি ভাবলেন, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ্ আমাকে এ নগরীতে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যে, তিনি একে পুনরায় আবাদ করবেন; কিন্তু তা কবে? এমন বিধ্বস্ত নগরীকে তিনি কতদিনে কিভাবে আবাদ করবেন? এসব চিন্তা করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। তাঁর সাথে ছিল একটি গাধা ও কিছু খাদ্য দ্রব্য। এ ঘুমের মধ্যে তার সত্তর বছর কেটে যায়। ইতিমধ্যে বুখত নসর ও তার মনিব সম্রাট লাহরাসার মৃত্যু হয়। লাহরাসার একশ বিশ বছর যাবত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাশতাসাব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁরই রাজত্বকালে বুখত নসরের মৃত্যু হয়। বাশতাসাব সিরিয়া (শাম) সম্পর্কে অবগত হলেন যে, দেশটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে, সমগ্র ফিলিস্তীন হিংস্র শ্বাপদে ভরে গিয়েছে এবং মানুষের কোন অস্তিত্ব সেখানে নেই। তাই তিনি সদয় হয়ে বাবিলে অবস্থানরত বনী ইসরাঈলদেরকে আহ্বান করে জানালেন। তোমরা যারা নিজেদের দেশে সিরিয়ায় ফিরে যেতে চাও, যেতে পার। তিনি দাউদ বংশের একজনকে তাদের রাজা বানিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসসহ অন্যান্য মসজিদ পুনর্নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। বনী ইসরাঈলরা তাদের রাজার সাথে আপন দেশ সিরিয়ায় চলে গেল এবং বায়তুল মুকাদ্দাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল।

আল্লাহ তখন আরমিয়ার চোখ খুলে দিলেন। তিনি নগরীর আবাদ হওয়া দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন। এভাবে তাঁর আরও ত্রিশ বছর কেটে যায়। ফলে পূর্ণ নিদ্রাকাল একশ বছর পূর্ণ হয় এবং তারপরে তিনি জাগ্রত হন। কিন্তু তিনি ধারণা করতে থাকেন যে, তার নিদ্রাকাল কয়েক ঘণ্টার বেশি হয়নি। অথচ নগরীকে তিনি দেখেছিলেন ধ্বংস ও বিধ্বস্ত। আর নিদ্রা থেকে জেগে এখন দেখতে পাচ্ছেন আবাদ নগরী হিসেবে। তাই সহসা বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন।’ অতঃপর বনী ইসরাঈলরা তথায় বসবাস করতে থাকে। আল্লাহ তাদের রাজত্ব ফিরিয়ে দিলেন। এভাবে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়। তারপর তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব কলহে লিপ্ত হয়। এ সুযোগে রোমান সম্রাট তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের দেশ দখল করে নেয়। রোমীয় খৃষ্টানদের শাসনাধীনে থেকে বনী ইসরাঈলের শক্তি ও ঐক্য-সংহতি কিছুই অবশিষ্ট থাকল না।

ইবন জারির (র) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে উক্ত ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন যে, লাহরাসার ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। প্রজাবর্গ, সামন্ত রাজগণ, অধিনায়কগণ ও শহর-নগর সবই ছিল তাঁর অনুগত আজ্ঞাবহ। নগর তৈরি, নদী খনন ও সরাইখানা নির্মাণে তিনি ছিলেন অতিশয় বিজ্ঞ ও পারদর্শী। একশ বছরের ঊর্ধ্বে রাজ্য শাসনের পর দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়লে আপন পুত্র বাশতাসবের নিকট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বাশতাসবের আমলে সেদেশে মাজুসী ধর্মের (অগ্নিপূজার) উদ্ভব হয়। এ ধর্মের সূচনা করেন যারদাশত নামক এক ব্যক্তি। তিনি নবী আরমিয়ার সঙ্গে থাকতেন। নবীর উপর কোন এক কারণে তিনি রাগান্বিত হন। নবী তাকে অভিশাপ দেন। ফলে যারদাশত কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়। অতঃপর তিনি আজারবাইজানে গিয়ে বাশতাসবের সাথে মিলিত হন এবং তাকে নিজের উদ্ভাবিত মাজুসী ধর্মে দীক্ষিত করেন। এই ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে বাশতাসব জনগণের উপর ভীষণভাবে চাপ সৃষ্টি করে। যারা স্বীকার করতে রাজি হয়নি তাদেরকে সে পাইকারীভাবে হত্যা করে। বাশতাসবের পরে তার পুত্র বাহমান পারস্যের সম্রাট হয় এবং রাজ্য শাসনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে।

বুখত নসর উপরোক্ত তিনজন সম্রাটের অধীনে আঞ্চলিক শাসনকর্তা ছিল এবং দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিল। উপরোক্ত বর্ণনার সারমর্ম হল— ইবন জারিরের মতে, উক্ত জনপদের মধ্য দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তি হলেন হযরত আরমিয়া (আ)। কিন্তু ওহাব ইবন মুনাবিহ, আবদুল্লাহ্ ইবন উবায়দ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ হযরত আলী, আবদুল্লাহ ইবন সালাম, ইবন আব্বাস, হাসান, কাতাদা, সুদ্দী, সুলায়মান ইবন বুরায়দা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উক্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তি হযরত উযায়র (আ)। শেষোক্ত বর্ণনার সূত্র উপরের মতের বর্ণনার সূত্রের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী এবং প্রথম যুগের ও পরবর্তী যুগের আলিমগণের অধিকাংশের নিকট বেশি প্রসিদ্ধ।

১৮
হযরত উযায়র (আ)-এর বর্ণনা
ইবন আসাকির হযরত উযায়র (আ)-এর পূর্ব পুরুষদের বংশলতিকা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেনঃ উযায়র ইবন জারওয়া (ভিন্নমতে সুরীক) ইবন আদিয়া ইবন আইয়ূব ইবন দারযিনা ইবন আরী ইবন তাকী ইবন উসব ইবন ফিনহাস ইবনুল আযির ইবন হারূন ইবন ইমরান। কারও কারও বর্ণনায় উযায়র (আ)-এর পিতার নাম বলা হয়েছে সারুখা। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে উযায়র (আ)-এর কবর দামিশকে অবস্থিত। ইবন আসাকির.... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আমার জানা নেই, ঝর্ণাটা কি বিক্রি হয়েছে না বিক্রি হয়নি, আর উযায়র কি নবী ছিলেন কি নবী ছিলেন না।.....’ আবু হুরায়রা (রা) থেকেও এরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইসহাক ইবন বিশর..... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বুখত নসর যাদেরকে বন্দী করে নিয়েছিল, তাদের মধ্যে উযায়রও ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন একজন কিশোর। যখন তিনি চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হন তখন আল্লাহ তাকে হিকমত (নবুওত) দান করেন। তাওরাত কিতাবে তার চাইতে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন পন্ডিত আর কেউ ছিল না। অন্যান্য নবীদের সাথে তাকেও নবী হিসেবে উল্লেখ করা হত। কিন্তু যখন তিনি আল্লাহর নিকট তার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন তখন তাঁর নবুওত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কিন্তু এ বর্ণনাটি দুর্বল। সূত্র পরম্পরা বিচ্ছিন্ন ও অগ্রহণযোগ্য।

ইসহাক ইবন বিশর......আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, উযায়র হলেন আল্লাহর সেই বান্দা, যাঁকে তিনি একশ বছর মৃত অবস্থায় রেখে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। ইসহাক ইবন বিশর বলেন, বিভিন্ন সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়র ছিলেন একজন জ্ঞানী ও পুণ্যবান লোক। একদা তিনি তাঁর ক্ষেত-খামার ও বাগ-বাগিচা দেখার জন্যে ঘর থেকে বের হন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে দ্বিপ্রহরের সময় একটা বিধ্বস্ত বাড়িতে বিশ্রাম নেন। তার বাহন গাধার পিঠ থেকে নিচে অবতরণ করেন। তার সাথে একটি ঝুড়িতে ছিল ডুমুর এবং অন্য একটি ঝুড়িতে ছিল আঙ্গুর। খাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি একটি পেয়ালায় আঙ্গুর নিংড়িয়ে রস বের করেন এবং শুকনো রুটি তাতে ভিজিয়ে রাখেন। রুটি উক্ত রসে ভালরূপে ভিজে গেলে খাবেন, এই সময়ের মধ্যে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে কিছু সময়ের জন্যে চিত হয়ে শুয়ে পড়েন এবং পা দু’খানা দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দেন। এ অবস্থায় তিনি বিধ্বস্ত ঘরগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলেন, যার অধিবাসীরাও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তিনি অনেকগুলো পুরাতন হাড় দেখতে পেয়ে মনে মনে ভাবলেন, “মৃত্যুর পর আল্লাহ কিরূপে এগুলোকে জীবিত করবেন?” আল্লাহ যে জীবিত করবেন, এতে তার আদৌ কোন সন্দেহ ছিল না। এ কথাটি তিনি কেবল অবাক বিস্ময়ের সাথে ভেবেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ মৃত্যুর ফেরেশতাকে পাঠিয়ে তার রূহ কবজ করান এবং একশ’ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় রেখে দেন।

একশ’ বছর পূর্ণ হলে আল্লাহ উযায়রের নিকট ফেরেশতা পাঠিয়ে দেন। এ দীর্ঘ সময়ে বনী ইসরাঈলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়ে গিয়েছিল এবং তার ধর্মের মধ্যে অনেক বিদআতের প্রচলন করেছিল। যা হোক, ফেরেশতা এসে উযায়রের কালব ও চক্ষুদ্বয় জীবিত করলেন, যাতে কিভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করবেন তা স্বচক্ষে দেখেন ও অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন। এরপর ফেরেশতা উযায়রের বিক্ষিপ্ত হাড়গুলো একত্রিত করে তাতে গোশত লাগালেন, চুল পশম যথাস্থানে সংযুক্ত করলেন এবং চামড়া দ্বারা সমস্ত শরীর আবৃত করলেন। সবশেষে তার মধ্যে রূহ প্রবেশ করালেন। তার দেহ এভাবে তৈরি হচ্ছে তা তিনি প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং অন্তর দিয়ে আল্লাহর কুদরত উপলব্ধি করছিলেন। উযায়র উঠে বসলেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এ অবস্থায় কতদিন অবস্থান করলেন?’ তিনি বললেন, ‘এক দিন অথবা এক দিনেরও কিছু কম।’ এরূপ বলার কারণ হল, তিনি দ্বিপ্রহরে দিনের প্রথম ভাগে শুয়েছিলেন এবং সূর্যাস্তের পূর্বে উঠেছিলেন। তাই বললেন, দিনের কিছু অংশ, পূর্ণ দিন নয়। ফেরেশতা জানালেন, ‘না, বরং আপনি একশ’ বছর এভাবে অবস্থান করেছেন। আপনার খাদ্য সামগ্রী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য করুন।’ এখানে খাদ্য বলতে তার শুকনা রুটি এবং পানীয় বলতে পেয়ালার মধ্যে আঙ্গুর নিংড়ানো রস বুঝানো হয়েছে। দেখা গেল এ দুটির একটিও নষ্ট হয়নি। রুটি শুকনা আছে এবং রস অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে।

কুরআনে একেই বলা হয়েছে। ( لم يتسنه ) অর্থাৎ তা অবিকৃত রয়েছে। রুটি ও রসের মত তার আঙ্গুর এবং ডুমুরও টাটকা রয়েছে। এর কিছুই নষ্ট হয়নি। উযায়র ফেরেশতার মুখে একশ’ বছর অবস্থানের কথা শুনে এবং খাদ্যদ্রব্য অবিকৃত দেখে দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে পড়ে যান, যেন ফেরেশতার কথা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই ফেরেশতা তাকে বললেন, আপনি আমার কথায় সন্দেহ করছেন, তা হলে আপনার গাধাটির প্রতি লক্ষ্য করুন। উযায়র লক্ষ্য করে দেখলেন যে, তার গাধাটি মরে পচে গলে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। হাড়গুলো পুরাতন হয়ে যত্রতত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। অতঃপর ফেরেশতা হাড়গুলোকে আহ্বান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাড়গুলো চতুর্দিক থেকে এসে একত্রিত হয়ে গেল এবং ফেরেশতা সেগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে দিলেন। উযায়র তা তাকিয়ে দেখছিলেন। তারপর ফেরেশতা উক্ত কংকালে রগ, শিরা-উপশিরা সংযোজন করেছেন। গোশত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং চামড়া ও পশম দ্বারা তা আবৃত করেন। সবশেষে তার মধ্যে রূহ প্রবেশ করান। ফলে গাধাটি মাথা ও কান খাড়া করে দাঁড়াল এবং কিয়ামত আরম্ভ হয়ে গিয়েছে ভেবে চীৎকার করতে লাগল।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَٱنظُرۡ إِلَىٰ حِمَارِكَ وَلِنَجۡعَلَكَ ءَایَة لِّلنَّاسِۖ وَٱنظُرۡ إِلَى ٱلۡعِظَامِ كَیۡفَ نُنشِزُهَا ثُمَّ نَكۡسُوهَا لَحۡم اۚ ࣱ)

[Surah Al-Baqarah 259]

—এবং তোমার গাধাটির প্রতি লক্ষ্য কর; কারণ তোমাকে মানব জাতির জন্যে নিদর্শনস্বরূপ করব। আর অস্থিগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর, কিভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই। (২ঃ ২৫৯)।

অর্থাৎ তোমার গাধার বিক্ষিপ্ত হাড়গুলোর প্রতি লক্ষ্য কর। কিভাবে সেগুলোকে গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে সংযোজন করা হয়। যখন গোশতবিহীন হাড়ের কংকাল তৈরি হল তখন বলা হল, এবার লক্ষ্য কর, কিভাবে আমি এ কংকালকে গোশত দ্বারা আচ্ছাদিত করি। যখন তার নিকট এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গেল তখন তিনি বলে উঠলেন, আমি জানি যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। মৃতকে জীবিত করাসহ যে কোন কাজ করতে তিনি সম্পূর্ণ সক্ষম।

অতঃপর উযায়র (আ) উক্ত গাধার পিঠে আরোহণ করে নিজ এলাকায় চলে যান। কিন্তু সেখানে কোন লোকই তিনি চিনতে পারছেন না; আর তাকেও দেখে কেউ চিনতে পারছে না। নিজের বাড়ি-ঘরও তিনি সঠিকভাবে চিনে উঠতে পারছিলেন না। অবশেষে ধারণার বশে নিজের মনে করে এক বাড়িতে উঠলেন। সেখানে অন্ধ ও পঙ্গু এক বৃদ্ধাকে পেলেন। তার বয়স ছিল একশ বিশ বছর। এই বৃদ্ধা ছিল উযায়র পরিবারের দাসী। একশ’ বছর পূর্বে তিনি যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, তখন এই বৃদ্ধার বয়স ছিল বিশ বছর এবং উযায়রকে সে চিনত। বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে সে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে যায়। উযায়র জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে বৃদ্ধা! এটা কি উযায়রের বাড়ি?’ বৃদ্ধা বলল, ‘হ্যাঁ, এটা উযায়রের বাড়ি।’ বৃদ্ধা মহিলাটি কেঁদে ফেলল এবং বলল, ‘এতগুলো বছর কেটে গেল, কেউ তার নামটি উচ্চারণও করে না, সবাই তাকে ভুলে গিয়েছে।’ উযায়র নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমিই সেই উযায়র। আল্লাহ আমাকে একশ’ বছর মৃত অবস্থায় রেখে পুনরায় জীবিত করেছেন।’ বৃদ্ধা বলল, ‘কী আশ্চর্য! আমরাও তো তাকে একশ বছর পর্যন্ত পাচ্ছি না, সবাই তার নাম ভুলে গিয়েছে, কেউ তাকে স্মরণ করে না।’ তিনি বললেন, ‘আমিই সেই উযায়র।’ বৃদ্ধা বলল, ‘আপনি যদি সত্যিই উযায়র হন, তা হলে উযায়রের দোয়া আল্লাহ কবুল করতেন। কোন রোগী বা বিপদগ্রস্তের জন্যে দোয়া করলে আল্লাহ তাকে নিরাময় করতেন এবং বিপদ থেকে মুক্তি দিতেন। সুতরাং আপনি আমার জন্যে দোয়া করুন, আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলে আপনাকে দেখব এবং আপনি উযায়র হলে আমি চিনব।’ তখন উযায়র দোয়া করলেন এবং বৃদ্ধার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে তার অন্ধত্ব দূর হয়ে গেল।

তারপর তিনি বৃদ্ধার হাত ধরে বললেন, ‘আল্লাহর হুকুমে তুমি উঠে দাঁড়াও।’ সাথে সাথে তার পঙ্গুত্ব বিদূরিত হল, সে লোকের মত উঠে দাঁড়ালো। মনে হল সে বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেছে। তারপর উযায়রের দিকে তাকিয়ে দেখে বলে উঠল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনিই উযায়র।’ এরপর ঐ বৃদ্ধা বনী ইসরাঈলের মহল্লায় চলে গেল। দেখল, তারা এক আসরে জমায়েত হয়েছে। সে আসরে উযায়রের এক বৃদ্ধ পুত্রও উপস্থিত ছিল, বয়স একশ আঠার বছর। শুধু তাই না, পুত্রদের পুত্ররাও তথায় উপস্থিত ছিল, তারাও আজ প্রৌঢ়। বৃদ্ধা মহিলা এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে মজলিসের লোকদেরকে ডেকে বলল, উযায়র তোমাদের মাঝে আবার ফিরে এসেছেন। কিন্তু বৃদ্ধার এ কথা তারা হেসে উড়িয়ে দিল। তারা বলল, ‘তুমি মিথ্যুক।’ বৃদ্ধা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি অমুক, তোমাদের বাড়ির দাসী। উযায়র এসে আমার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করেছেন। তিনি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং পঙ্গু পা সুস্থ করে দিয়েছেন। উযায়র বলেছেন, আল্লাহ তাকে একশ’ বছর মৃত অবস্থায় রেখে আবার জীবিত করে দিয়েছেন।’ এ কথা শোনার পর লোকজন উঠে উযায়রের বাড়িতে গেল এবং তাকে ভাল করে দেখল। উযায়রের বৃদ্ধ পুত্র বলল, ‘আমার পিতার দুই কাঁধের মাঝে একটি কাল তিল ছিল।’ সুতরাং সে কাধের কাপড় উঠিয়ে তিল দেখে তাকে চিনতে পারল এবং বলল, ‘ইনিই আমার পিতা উযায়র।’ তখন বনী ইসরাঈলের লোকজন উযায়রকে বলল, ‘আমরা শুনেছি আপনি ব্যতীত অন্য কোন লোকের তাওরাত কিতাব মুখস্থ ছিল না। এ দিকে বুখত নসর এসে লিখিত তাওরাতের সমস্ত কপি আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। একটি অংশও অবশিষ্ট নেই। সুতরাং আপনি আমাদের জন্যে একখানা তাওরাত লিখে দিন। বুখত নসরের আক্রমণকালে উযায়রের পিতা সারূখা তাওরাতের একটি কপি মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্থানটি কোথায় উযায়র ব্যতীত আর কেউ তা জানত না। সুতরাং তিনি উপস্থিত লোকদেরকে সাথে নিয়ে সেই স্থানে গেলেন এবং মাটি খুঁড়ে তাওরাতের কপি বের করলেন। কিন্তু এতদিনে তাওরাতের পাতাগুলো নষ্ট হয়ে সমস্ত লেখা মুছে গিয়েছে। এরপর তিনি একটি বৃক্ষের নিচে গিয়ে বসলেন, বনী ইসরাঈলের লোকজনও তার পাশে গিয়ে ঘিরে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ থেকে দু’টি নক্ষত্র এসে তার পেটের মধ্যে প্রবেশ করনঃ এতে গোটা তাওরাত কিতাব তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠলো। তখন বনী ইসরাঈলের জন্যে তিনি নতুনভাবে তাওরাত লিখে দিলেন। এ সবের জন্যে অর্থাৎ নক্ষত্রদ্বয়ের অবতরণ ও কার্যক্রম, তাওরাত কিতাব নতুনভাবে লিখন ও বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব গ্রহণের কারণে ইহুদীগণ উযায়রকে আল্লাহর পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। উযায়র হিযকীল নবীর সাওয়াদ এলাকায় অবস্থিত আশ্রমে বসে তাওরাত কিতাবের পুনর্লিখন কাজসম্পন্ন করেছিলেন। যে নগরীতে তিনি ইনতিকাল করেছিলেন তার নাম সাইরাবায ( سايراباذ )। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণীঃ

وَلِنَجۡعَلَكَ ءَایَة لِّلنَّاسِۖ

(তোমাকে আমি মানব জাতির জন্যে নিদর্শন বানাবার উদ্দেশ্যে এরূপ করেছি) মানব জাতি বলতে এখানে বনী ইসরাঈলকে বুঝানো হয়েছে। কেননা উযায়র তাঁর পুত্রদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। অথচ পুত্রগণ সবাই ছিল বৃদ্ধ, আর তিনি অবশ্য যুবক। এর কারণ, যখন তার মৃত্যু হয় তখন বয়স ছিল চল্লিশ বছর। একশ’ বছর পর আল্লাহ যখন তাঁকে জীবিত করলেন তখন (প্রথম) মত্যকালের যৌবন অবস্থার উপরেই জীবিত করেছিলেন। ইবন আব্বাস (রা) বলেছেন, বুখত নসরের ঘটনার পরে উযায়র পুনর্জীবিত হয়েছিলেন হাসানও এ একই মত প্রকাশ করেছেন। আবু হাতিম সিজিসতানী ইবন আব্বাসের বক্তব্যকে কবিতা আকারে নিম্নলিখিতভাবে রূপ দিয়েছেন।

و اسود رأس شاب من قبله ابنه - ومن قبله ابن ابنه فهو اكبر

يرى ابنه شيخا يدب على عصا - ولحيته سوداء والرأس اشفر

وما لابنه حبل فلافضل قوة - يقوم كما يمئس الصبي فيعئر

يعد ابنه في الناس تسعين حجه - وعشرين لا يجرى ولا يتبختر

و عمرابيه ادبعون امرها ولان ابنه تسعون في الناس عبر

فما هو في المعقول ان کنت داري وان كنت لا تدري فبالجهل تعذر

অর্থঃ তার (উযায়রের) মাথার চুল কালই আছে, কিন্তু এর পূর্বেই তার পুত্র ও পৌত্রের চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। অথচ বড় তো তিনিই।

তাঁর পুত্রকে দেখা যায় বৃদ্ধ–লাঠির উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করে; অথচ পিতার দাড়ি এখনও রয়েছে কাল এবং মাথার চুল লাল-খয়েরি।

পুত্রের দৈহিক শক্তি-সামর্থ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। ফলে সে যখন দাঁড়াতে ও হাঁটতে চায় তখন ছোট শিশুর ন্যায় আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়।

সমাজের লোক জানে, তার (উযায়রের) পুত্র নব্বই বছর পর্যন্ত তাদের মাঝে চলাফেরা করেছে। কিন্তু বিশ বছর হল ভালরূপে চলতে ফিরতে পারছে না।

পিতার বয়স চল্লিশ বছর, আর পুত্রের বয়স নব্বই বছর অতিক্রম করেছে। এ এমন একটি বিষয় যা তোমরা বুদ্ধি থাকলে তুমি অনুধাবন করতে পারবে। আর যদি এর মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থ হও তা হলে তোমার অজ্ঞতা ক্ষমার্হ।

১৯
পরিচ্ছেদ
প্রসিদ্ধ মতে উযায়র (আ) ছিলেন বনী ইসরাঈলদের অন্যতম নবী। তিনি দাউদ ও সুলায়মান এবং যাকারিয়া ও ইয়াহয়া (আ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হন। কথিত আছে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে কারও নিকট যখন তাওরাত কিতাব সংরক্ষিত ছিল না, তখন উযায়রের স্মৃতিপটে আল্লাহ তাওরাত কিতাব জাগরুক করে দেন এবং বনী ইসরাঈলকে তিনি তা পড়ে শুনান। এ সম্পর্কে ওহাব ইবন মুনাব্বিহ (র) বলেছেন, আল্লাহর নির্দেশে একজন ফেরেশতা একটি নূরের চামচ নিয়ে আসেন এবং উযায়রের মুখের মধ্যে তা ঢেলে দেন। অতঃপর তিনি তাওরাতের হুবহু একটি কপি লিখে দেন। ইবন আসাকির লিখেছেন, ইবন আব্বাস (রা) একদা আবদুল্লাহ ইবন সালামের নিকট নিম্নোক্ত আয়াতটি

( وَقَالَتِ ٱلۡیَهُودُ عُزَیۡرٌ ٱبۡنُ ٱللَّهِ )

[Surah At-Tawbah 30]

(ইহূদীরা উযায়রকে আল্লাহর পুত্র বলে থাকে) উল্লেখ পূর্বক জিজ্ঞেস করেন যে, ‘তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলার কারণ কি?’ উত্তরে আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা) বললেন, ‘বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক সময়ে তাওরাত কণ্ঠস্থকারী একজন লোকও ছিল না। তারা বলত, নবী মূসাও তাওরাত লিখিত আকারে ছাড়া আমাদেরকে দিতে পারেন নি। অথচ উযায়র, নিজের স্মৃতি থেকে অলিখিত তাওরাত আমাদেরকে দিয়েছেন। তাঁর এ বিস্ময়কর প্রতিভা দেখে বনী ইসরাঈলের একদল লোক তাকে আল্লাহর পুত্র বলে আখ্যায়িত করে। এ কারণে অধিকাংশ আলিম বলেছেন, তাওরাত কিতাবের ধারাবাহিকতা উযায়রের সময়ে শেষ হয়ে যায়। তিনি যদি নবী না হয়ে থাকেন, তা হলে এ মন্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। আতা ইবন আবী রাবাহ এবং হাসান বসরী ও এরূপ মন্তব্য করেছেন।

ইসহাক ইবন বিশর....... বিভিন্ন সূত্রে আতা ইবন আবী রাবাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ফাতরাত (শেষ নবী ও ঈসা (আ)-এর মধ্যবর্তী বিরতিকাল) যুগের নয়টি বিষয় খুবই। উল্লেখযোগ্য, যথাঃ বুখত নসর, সানআর উদ্যান [সানআর বাগিচাঃ সূরা সাবায় উল্লিখিত ইয়ামানের রাজধানী সানআর ঐতিহাসিক বাগিচা। আল্লাহর নাফরমানির কারণে তা ধ্বংস হয়ে যায়], সাবার উদ্যান [সাবার উদ্যানঃ সাবা ইয়ামানের এক বিখ্যাত পুরুষের নাম। তার ছয় পুত্র ইয়ামানে ও চার পুত্র সিরিয়ায় বসবাস করত। ইয়ামানের রাজধানী সানআ থেকে ৬০ মাইল পূর্বে মাআরিব নগরীতে ছিল সাবা জাতির বসতি। নগরীর দু’প্রান্তে ছিল দুই পাহাড়। পাহাড়ের ঢলের পানি রোধে দু’ পাহাড়ের মধ্যে বিরাট বাঁধ দেয়া হয়। উক্ত বাঁধের দু’পাশে বিশাল উদ্যান গড়ে উঠে। ফলে এই জাতি ধনে-ঐশ্বর্যে অনাবিল শান্তিতে বাস করে। কিন্তু আল্লাহকে ভুলে যেয়ে তারা মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। তাদের শাস্তির জন্যে আল্লাহ ইঁদুর দ্বারা বাঁধের নিম্নদেশ কেটে দিয়ে পাহাড়ী ঢল দ্বারা বাঁধ ভেঙে দেন। এতে উদ্যানসহ সমস্ত বসতি ধ্বংস হয়ে যায়। (এটা ঈসা (আ)-এর আবির্ভাবের পরের ঘটনা)], আসহাবুল-উখদূদ [আসহাবুল উখদূদঃ অর্থাৎ অগ্নিকুন্ডের জন্যে কুখ্যাত শাসকবর্গ। ইয়ামানের হিময়ারী বাদশাহ আবূ কারিরা ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে নিজ দেশে প্রচার করে। তার পুত্র যু-নুওয়াস ঈসায়ী ধর্মের প্রাণকেন্দ্র নাজরান আক্রমণ করে ঈসরাঈলীদেরকে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। তারা এতে অস্বীকৃতি জানালে প্রায় বিশ হাজার লোককে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। এর প্রতিশোধে রোমের সাহায্য নিয়ে ইথিওপিয়ার খৃষ্টানগণ ইয়ামান আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এটা ছিল ৩৪০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা], হাসুরার ঘটনা, আসহাবুল কাহফ [আসহাবুল কাহফঃ (গুহাবাসী) এশিয়া মহাদেশের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত রোমকদের বৃহৎ নগরী আফসুস (পরবর্তীতে তরসূস নামে খ্যাত)-এর মূর্তি পূজারী বাদশাহ্ দাকিয়ানুস (Decius) এর ভয়ে তথাকার সাত জন ঈমানদার যুবক পালিয়ে গিয়ে এক পাহাড়ী গুহায় আত্মগোপন করেন। ক্লান্ত দেহে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। এটা ছিল ২৫০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। চান্দ্র হিসেবে ৩০৯ বছর (যা সৌর হিসেবে ছিল ৩০০ বছর) ঘুমাবার পর তারা জাগ্রত হন ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। কিছু সময় পর পুনরায় ঘুমালে আল্লাহ তাদেরকে মৃত্যু দান করেন। এর বিশ বছর পর শেষ নবীর জন্ম হয়], আসহাবুল ফীল [আসহাবুল ফীলঃ (হস্তী বাহিনী) ইয়ামানের খৃস্টান বাদশাহ আবরাহা রাজধানী সানআর বায়তুল্লাহর বিকল্প এক গীর্জা নির্মাণ করে। অতঃপর ১৩টি হাতি ও ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়। আল্লাহ আবাবিলের সাহায্যে তাকে ধ্বংস করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের ৫০ দিন মতান্তরে ৫৫ দিন পূর্বে এ ঘটনাটি ঘটে], ইনতাকিয়া নগরী [সূরা ইয়াসীনে উল্লিখিত ঈসায়ী ধর্মের তিনজন মুবাল্লিগকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করায় ও তাদেরকে হত্যা করায় ইনতাকিয়া (এন্টিয়ক) নগর আল্লাহ ধ্বংস করে দেন] ও তুব্বার ঘটনা [তুব্বাঃ ইয়ামানের হিময়ারী শাসকদের উপাধি ছিল ‘তুব্বা’। এরা ইয়ামানের পশ্চিমাংশসহ দীর্ঘ দিন আরব ও ইরাক শাসন করেছে। শক্তিশালী এই রাজবংশ পরবর্তীকালে ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন]।

ইসহাক ইবন বিশর..... হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়র ও বুখত নসরের ঘটনা ফাতরাতকালে সংঘটিত হয়। সহীহ্ হাদীছে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘মরিয়ম পুত্র (ঈসা)-এর নিকটবর্তী লোক আমিই। কেননা আমার ও তার মাঝে অন্য কোন নবী নেই।’

ওহাব ইবন মুনাব্বিহ লিখেছেন, উযায়রের আগমন হয়েছিল সুলায়মান ও ঈসা (আ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে। ইব্‌ন আসাকির আনাস ইবন মালিক ও আতা ইবনুস সাইব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়রের আগমন হয়েছিল হযরত মুসা ইবন ইমরান (আ)-এর যামানায়। একদা তিনি আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্যে মূসা (আ)-এর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু মূসা (আ) সে অনুমতি দেননি। এই ক্ষোভে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং বলেনঃ এক মুহূর্তের লাঞ্ছনার তুলনায় শতবার মৃত্যুবরণ করাও সহজতর। ( مائة موتة اهون منذل ساعة ) এ কথাটি এক কবি বলেছেন নিম্নোক্তভাবেঃ

قد يصبر الحر على السيف - ويأنف الصبر على الحيف

ويؤثر الموت على حالة - يعجز فيها عن قرى الضيف

অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন স্বাধীনচেতা মানুষ যুদ্ধের ময়দানে তরবারীর আঘাতকে স্বাগত জানায়, কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করাকে ঘৃণা করে। এমন অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করাকে অগ্রাধিকার দেয় যখন সে মেহমানদের আহার্য প্রদানে অপারগ হয়।

ইবন আসাকির প্রমুখ লেখকগণ ইবন আব্বাস, নূফ আল-বিকালী, সুফিয়ান ছাওরী প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উযায়র (আ) নবীই ছিলেন। কিন্তু মৃতকে জীবিত করার ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তার নবুওত প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এ বর্ণনাটি মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য, এর বিশুদ্ধ হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ আছে-সম্ভবত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে এটা গৃহীত হয়েছে। এ বিষয়ে আরও একটি বর্ণনা লক্ষ্যণীয়। তা হল, আবদুর রাযযাক ও কুতায়বা ইবন সা'দ..... নূফ আল-বিকালী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একদা উযায়র আল্লাহর নিকট একান্তে আবেদন করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! মানুষ তো আপনারই সৃষ্টি, যাকে ইচ্ছা তাকে আপনি পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহর পক্ষ হতে, তাকে বলা হল, তুমি এ কথা থেকে বিরত হও। কিন্তু তিনি পুনরায় একই কথা বললেন। তখন তাঁকে জানান হল, তুমি এ কথা থেকে বিরত থাক। অন্যথায় নবীদের তালিকা থেকে তোমার নাম কেটে দেয়া হবে। জেনে রেখ, আমি যা কিছু করি সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারও নেই; কিন্তু মানুষ যা কিছু করবে তার জন্যে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। এ বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সতর্ক করার পরও তিনি ঐ কথার পুনরাবৃত্তি করেন নি। সুতরাং নবীদের তালিকা থেকে তাঁর নাম কাটা যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

ইমাম তিরমিযী ব্যতীত সিহাহ সিত্তাহর অন্যান্য সংকলকগণ..... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘জনৈক নবী একবার এক বৃক্ষের নিচে অবতরণ করেন। একটি পিঁপড়া তাঁকে দংশন করে। তিনি সেখান থেকে বিদায় হওয়ার জন্যে মালপত্র গুটিয়ে নিতে বলেন। নির্দেশ মতে মালপত্র গুটিয়ে নেয়া হয়। অতঃপর তার হুকুমে পিপাড়দের বাসা পুড়িয়ে ফেলা হয়। তখন আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁকে বললেন, থাম, একটি মাত্র পিপঁড়ার জন্যে এ কী করছ?’ ইসহাক....মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, ঐ নবী ছিলেন হযরত উযায়র (আ)। ইব্‌ন আব্বাস ও হাসান বসরী থেকে বর্ণিত যে, তিনি ছিলেন উযায়র (আ)।

২০
যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আ)
আল্লাহর বাণীঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

( بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ كۤهیعۤصۤ ۝ ذِكۡرُ رَحۡمَتِ رَبِّكَ عَبۡدَهُۥ زَكَرِیَّاۤ ۝ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥ نِدَاۤءً خَفِیّ ا ۝ قَالَ رَبِّ إِنِّی وَهَنَ ٱلۡعَظۡمُ مِنِّی وَٱشۡتَعَلَ ٱلرَّأۡسُ شَیۡب ا وَلَمۡ أَكُنۢ بِدُعَاۤىِٕكَ رَبِّ شَقِیّ ا ۝ وَإِنِّی خِفۡتُ ٱلۡمَوَ  ٰ⁠ لِیَ مِن وَرَاۤءِی وَكَانَتِ ٱمۡرَأَتِی عَاقِر ا فَهَبۡ لِی مِن لَّدُنكَ وَلِیّ ا ۝ یَرِثُنِی وَیَرِثُ مِنۡ ءَالِ یَعۡقُوبَۖ وَٱجۡعَلۡهُ رَبِّ رَضِیّ ا ۝ یَـٰزَكَرِیَّاۤ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَـٰمٍ ٱسۡمُهُۥ یَحۡیَىٰ لَمۡ نَجۡعَل لَّهُۥ مِن قَبۡلُ سَمِیّ ا ۝ قَالَ رَبِّ أَنَّىٰ یَكُونُ لِی غُلَـٰم وَكَانَتِ ٱمۡرَأَتِی عَاقِر ا وَقَدۡ بَلَغۡتُ مِنَ ٱلۡكِبَرِ عِتِیّ ا ۝ قَالَ كَذَ  ٰ⁠ لِكَ قَالَ رَبُّكَ هُوَ عَلَیَّ هَیِّن وَقَدۡ خَلَقۡتُكَ مِن قَبۡلُ وَلَمۡ تَكُ شَیۡـٔ ا ۝ قَالَ رَبِّ ٱجۡعَل لِّیۤ ءَایَة ۖ قَالَ ءَایَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ ٱلنَّاسَ ثَلَـٰثَ لَیَال سَوِیّ ا ۝ فَخَرَجَ عَلَىٰ قَوۡمِهِۦ مِنَ ٱلۡمِحۡرَابِ فَأَوۡحَىٰۤ إِلَیۡهِمۡ أَن سَبِّحُوا۟ بُكۡرَة وَعَشِیّ ا ۝ یَـٰیَحۡیَىٰ خُذِ ٱلۡكِتَـٰبَ بِقُوَّة ۖ وَءَاتَیۡنَـٰهُ ٱلۡحُكۡمَ صَبِیّ ا ۝ وَحَنَان ا مِّن لَّدُنَّا وَزَكَوٰة ۖ وَكَانَ تَقِیّ ا ۝ وَبَرَّۢا بِوَ  ٰ⁠ لِدَیۡهِ وَلَمۡ یَكُن جَبَّارًا عَصِیّ ا ۝ وَسَلَـٰمٌ عَلَیۡهِ یَوۡمَ وُلِدَ وَیَوۡمَ یَمُوتُ وَیَوۡمَ یُبۡعَثُ حَیّ ࣰا)

[Surah Maryam 1 - 15]

—কাফ-হা-ইয়া-আয়ন-সাদ; এটা তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়্যার প্রতি। যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করেছিল নিভৃতে। সে বলেছিল, “আমার অস্থি দুর্বল হয়েছে। বার্ধক্যে আমার মস্তক শুভ্রোজ্জ্বল হয়েছেঃ হে আমার প্রতিপালক! তোমাকে আহ্বান করে আমি কখনও ব্যর্থকাম হইনি। আমি আশাংকা করি আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের সম্পর্কে; আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। সুতরাং তুমি তোমার নিকট হতে আমাকে দান কর উত্তরাধিকারী। যে আমার উত্তরাধিকারিত্ব করবে এবং উত্তরাধিকারিত্ব করবে ইয়াকূবের বংশের, এবং হে আমার প্রতিপালক! তাকে করো সন্তোষজন।’ তিনি বললেনঃ “হে যাকারিয়্যা! আমি তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহইয়া; এ নামে পূর্বে আমি কারও নামকরণ করিনি।” সে বলল, “হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমার স্ত্রী বন্ধ্যা ও আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় উপনীত। তিনি বললেন, “এ এরূপই হবে। তোমার প্রতিপালক বললেন, এ তো আমার জন্যে সহজসাধ্য, আমি তো পূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি যখন তুমি কিছুই ছিলে না।” যাকারিয়্যা বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও। তিনি বললেন, তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও কারও সাথে তিন দিন বাক্যালাপ করবে না। অতঃপর সে কক্ষ হতে বের হয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট আসল। ইংগিতে তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে বলল। (আমি বললাম) হে ইয়াহইয়া! এই কিতাব দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ কর। আমি তাকে শৈশবেই দান করেছিলাম জ্ঞান এবং আমার নিকট হতে হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্রতা; সে ছিল মুত্তাকী। পিতামাতার অনুগত এবং সে ছিলনা উদ্ধত-অবাধ্য। তার প্রতি শান্তি যেদিন তার মৃত্যু হবে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে। (১৯ মারয়ামঃ ১-১৫)

উক্ত ঘটনা প্রসংগে আল্লাহ অন্যত্র বলেনঃ

( فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَن وَأَنۢبَتَهَا نَبَاتًا حَسَن ا وَكَفَّلَهَا زَكَرِیَّاۖ كُلَّمَا دَخَلَ عَلَیۡهَا زَكَرِیَّا ٱلۡمِحۡرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزۡق اۖ قَالَ یَـٰمَرۡیَمُ أَنَّىٰ لَكِ هَـٰذَاۖ قَالَتۡ هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِۖ إِنَّ ٱللَّهَ یَرۡزُقُ مَن یَشَاۤءُ بِغَیۡرِ حِسَابٍ ۝ هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِیَّا رَبَّهُۥۖ قَالَ رَبِّ هَبۡ لِی مِن لَّدُنكَ ذُرِّیَّة طَیِّبَةًۖ إِنَّكَ سَمِیعُ ٱلدُّعَاۤءِ ۝ فَنَادَتۡهُ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ وَهُوَ قَاۤىِٕم یُصَلِّی فِی ٱلۡمِحۡرَابِ أَنَّ ٱللَّهَ یُبَشِّرُكَ بِیَحۡیَىٰ مُصَدِّقَۢا بِكَلِمَة مِّنَ ٱللَّهِ وَسَیِّد ا وَحَصُور ا وَنَبِیّ ا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ۝ قَالَ رَبِّ أَنَّىٰ یَكُونُ لِی غُلَـٰم وَقَدۡ بَلَغَنِیَ ٱلۡكِبَرُ وَٱمۡرَأَتِی عَاقِر ۖ قَالَ كَذَ  ٰ⁠ لِكَ ٱللَّهُ یَفۡعَلُ مَا یَشَاۤءُ ۝ قَالَ رَبِّ ٱجۡعَل لِّیۤ ءَایَة ۖ قَالَ ءَایَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ ٱلنَّاسَ ثَلَـٰثَةَ أَیَّامٍ إِلَّا رَمۡز اۗ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ كَثِیر ا وَسَبِّحۡ بِٱلۡعَشِیِّ وَٱلۡإِبۡكَـٰرِ )

[Surah Aal-E-Imran 37 - 41]

—এবং তিনি তাকে (মরিয়মকে) যাকারিয়্যার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই যাকারিয়্যা কক্ষে তার সাথে সাক্ষাত করতে যেত, তখনই তার নিকট খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেত। সে বলত, “হে মরিয়ম। এসব তুমি কোথায় পেলে?” সে বলত, ‘এ আল্লাহর নিকট হতে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান করেন।’ সেখানেই যাকারিয়্যা তার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করে বলল, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর। তুমিই প্রার্থনা শ্রবণকারী।” যখন যাকারিয়্যা কক্ষে সালাতে দাঁড়িয়েছিল তখন ফেরেশতাগণ তাকে সম্বোধন করে বলল, “আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন, সে হবে আল্লাহর বাণীর সমর্থক, নেতা, স্ত্রী-বিরাগী এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী।" সে বলল, “হে আমার প্রতিপালক! বার্ধক্য এসেছে এবং আমার স্ত্রী-বন্ধ্যা।” তিনি বললেন, ‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করেন।” সে বলল, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও। তিনি বললেন, ‘তোমার নিদর্শন এই যে, তিনদিন তুমি ইঙ্গিত ব্যতীত কোন মানুষের সাথে কথা বলতে পারবে না। আর তোমার প্রতিপালককে অধিক স্মরণ করবে। এবং সন্ধ্যায় ও প্রভাতে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে” (৩ আলে-ইমরানঃ ৩৭-৪১)

সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

( وَزَكَرِیَّاۤ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥ رَبِّ لَا تَذَرۡنِی فَرۡد ا وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡوَ  ٰ⁠ رِثِینَ ۝ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ وَوَهَبۡنَا لَهُۥ یَحۡیَىٰ وَأَصۡلَحۡنَا لَهُۥ زَوۡجَهُۥۤۚ إِنَّهُمۡ كَانُوا۟ یُسَـٰرِعُونَ فِی ٱلۡخَیۡرَ  ٰ⁠ تِ وَیَدۡعُونَنَا رَغَب ا وَرَهَب اۖ وَكَانُوا۟ لَنَا خَـٰشِعِینَ )

[Surah Al-Anbiya' 89 - 90]

—এবং স্মরণ কর যাকারিয়্যার কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রেখো না, তুমি তো শ্রেষ্ঠ মালিকানার অধিকারী।” অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম ইয়াহইয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করেছিলাম। তারা সৎ কাজে প্রতিযোগিতা করত, তারা আমাকে ডাকত আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত।” (২১ আম্বিয়াঃ ৮৯-৯০) আল্লাহ আরও বলেনঃ

( وَزَكَرِیَّا وَیَحۡیَىٰ وَعِیسَىٰ وَإِلۡیَاسَۖ كُلّ مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ )

[Surah Al-An'am 85]

—এবং যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, ঈসা ও ইলিয়াস, সকলেই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। ইবন আসাকির তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থে হযরত যাকারিয়্যা (আ)-এর বংশ তালিকা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন, যথাঃ যাকারিয়্যা ইবন বারখিয়া বা যাকারিয়্যা ইবন দান কিংবা যাকারিয়্যা ইবন লাদুন ইবন মুসলিম ইবন সাদূক ইবন হাশবান ইবন দাউদ ইবন সুলায়মান ইবন মুসলিম সাদীকা ইবন বারখিয়া ইবন বালআতা ইবন নাহূর ইবন শালূম ইবন বাহনাশাত ইবন আয়নামান ইবন রাহবি’আম ইবন সুলায়মান ইবন দাউদ। যাকারিয়্যা ছিলেন বনী ইসরাঈলের নবী ইয়াহইয়া (আ)-এর পিতা। তিনি পুত্র ইয়াহইয়ার সন্ধানে দামিশকের বুছায়না শহরে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, পুত্র ইয়াহইয়া নিহত হওয়ার সময় তিনি দামিশকেই অবস্থান করছিলেন। তার নসবনামা সম্পর্কে আরও বিভিন্ন মত রয়েছে। উচ্চারণে যাকারিয়্যা। (দীর্ঘ স্বরবিশিষ্ট) যাকারিয়্যা বা যাকরা বলা হয়ে থাকে।

আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে যাকারিয়্যা নবীকে সন্তান প্রদানের ঘটনা মানুষের নিকট বর্ণনা করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ যখন যাকারিয়্যাকে পুত্র সন্তান দান করেন তখন তিনি ছিলেন বৃদ্ধ। তাঁর স্ত্রী যৌবনকাল থেকেই ছিলেন বন্ধ্যা। আর এখন বার্ধক্যে আক্রান্ত। কিন্তু এসব প্রতিকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হননি। আল্লাহ বলেন।

( ذِكۡرُ رَحۡمَتِ رَبِّكَ عَبۡدَهُۥ زَكَرِیَّاۤ ۝ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥ نِدَاۤءً خَفِیّ ࣰا)

[Surah Maryam 2 - 3]

(এটা তোমার পালনকর্তার অনুগ্রহের বিবরণ তার বান্দা যাকারিয়্যার প্রতি, যখন সে তার পালনকর্তাকে আহ্বান করেছিল নিভৃতে।) কাতাদা এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ স্বচ্ছ অন্তর ও ক্ষীণ আওয়াজ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। কোন কোন প্রাচীন আলিম বলেছেন, হযরত যাকারিয়্যা (আ) রাত্রিবেলা নিদ্রা থেকে উঠে অতি ক্ষীণ আওয়াজে, যাতে তাঁর কাছের কেউ শুনতে না পায় আল্লাহকে আহ্বান করে বলেন, ‘হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ!’ আল্লাহ তা'আলা আহ্বানে সাড়া দিয়ে বললেনঃ ‘লাব্বায়েক। লাব্বায়েক!! লাব্বায়েক!!!’ এরপর যাকারিয়্যা বলেন, (( رَبِّ إِنِّی وَهَنَ ٱلۡعَظۡمُ مِنِّی )) –প্রভূ! আমার অস্থি দুর্বল হয়ে পড়েছে, বয়সে দেহ ভারাবনত হয়ে গিয়েছে। ( وَٱشۡتَعَلَ ٱلرَّأۡسُ شَیۡب ࣰا) বার্ধক্যে মস্তক সুশুভ্র হয়েছে। অগ্নি শিখা যেমন কাষ্ঠখণ্ড গ্রাস করে, তেমন বার্ধক্য আমার কাল চুল গ্রাস করে নিয়েছে।

হযরত যাকারিয়্যা (আ) আল্লাহকে জানালেন যে, বার্ধক্যের দুর্বলতা বাহ্যিকভাবে ও অভ্যন্তরীণভাবে তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছে।

وَلَمۡ أَكُنۢ بِدُعَاۤىِٕكَ رَبِّ شَقِیّ ࣰا

“হে আমার পালনকর্তা! আপনাকে ডেকে আমি কখনও বিফল মনোরথ হইনি।” অর্থাৎ আমি ইতিপূর্বে আপনার নিকট যা কিছু চেয়েছি, আপনি তা আমাকে দিয়েছেন। হযরত যাকারিয়্যার সন্তান কামনার পশ্চাতে যে প্রেরণাটি কাজ করেছিল, তা এই যে, তিনি হযরত মরিয়ম বিনত ইমরান ইব্‌ন মাছানকে বায়তুল মুকাদ্দাসে দেখাশুনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের যে কক্ষে বিবি মরিয়ম থাকতেন, সে কক্ষে যাকারিয়্যা (আ) যখনই যেতেন দেখতেন, ভিন্ন মওসুমের পর্যাপ্ত ফল মরিয়মের পাশে মওজুদ রয়েছে। বস্তুত এটা ছিল আওলিয়াদের কারামতের একটি নিদর্শন। তা দেখে হযরত যাকারিয়্যার অন্তরে এ কথার উদয় হল যে, যে সত্তা মরিয়মকে ভিন্ন মওসুমের ফল দান করছেন, তিনি আমাকে এই বৃদ্ধ বয়সে সন্তানও দান করতে পারেন। সূরা আলে-ইমরানে আছে, সেখানেই যাকারিয়্যা তার পালনকর্তার নিকট প্রার্থনা করল। বললো, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকট থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান কর! নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (৩ঃ ৩৮)।

সূরা মরিয়ামে আল্লাহর বাণীঃ

( وَإِنِّی خِفۡتُ ٱلۡمَوَ  ٰ⁠ لِیَ مِن وَرَاۤءِی وَكَانَتِ ٱمۡرَأَتِی عَاقِر ࣰا)

[Surah Maryam 5]

—আমি ভয় করি আমার পর আমার স্বগোত্রকে এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। ( مَوَ  ٰ⁠ لِیَ ) বা স্বগোত্র বলতে গোত্রের এমন একটি দলের কথা বুঝানো হয়েছে, যাদের ব্যাপারে নবী আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে এরা বনী ইসরাঈলকে বিভ্রান্ত করে শরীয়তের পরিপন্থী ও নবীর আনুগত্য বিরোধী কাজে জড়িয়ে ফেলবে। এ কারণে তিনি আল্লাহর নিকট একটি সুসন্তান প্রার্থনা করেন। তিনি বললেনঃ

فَهَبۡ لِی مِن لَّدُنكَ وَلِیّ ࣰا

আপনি আমাকে নিজের পক্ষ থেকে একজন উত্তরাধিকারী দান করুন। (( یَرِثُنِی নবুওতের দায়িত্ব পালনে এবং বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব প্রদানে সে হবে আমার স্থলাভিষিক্ত। ( وَیَرِثُ مِنۡ ءَالِ یَعۡقُوبَۖ ) - এবং সে প্রতিনিধিত্ব করবে ইয়াকূব বংশের। অর্থাৎ ইয়াকূবের সন্তানদের মধ্যে তার (অর্থাৎ আমার প্রার্থিত পুত্রের) পূর্ব-পুরুষগণ যেভাবে নবুওত, মর্যাদা ও ওহী প্রাপ্ত হয়েছে, তাকেও সেই সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করুন! এখানে উত্তরাধিকারী বলতে ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়া বুঝানো হয়নি। কিন্তু শী'আ সম্প্রদায় এখানে ধন-সম্পদের উত্তরাধিকার অর্থই গ্রহণ করেছে। ইবন জারীরও এখানে শীয়া মতকে সমর্থন করেছেন। তিনি সালিহ্ ইবন ইউসুফের উক্তির কথাও নিজের মতের সমর্থনে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু কয়েকটি কারণে এই মত গ্রহণযোগ্য নয়।

(এক) সূরা নামল’ এর ১৬ নং আয়াতঃ (( وَوَرِثَ سُلَیۡمَـٰنُ دَاوُۥدَ সুলায়মান দাউদের (নবুওত ও রাজত্বের) উত্তরাধিকারী হয়। এ আয়াতের অধীনে আমরা বুখারী মুসলিমসহ সহীহ মুসনাদ ও সুনান গ্রন্থাদিতে বিভিন্ন সূত্রে বহু সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত সেই প্রসিদ্ধ হাদীস উল্লেখ করেছি, যাতে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

لا نورث ماتركنا فهو صدقة

—আমরা কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাই না, মৃত্যুর পরে যা কিছু পরিত্যক্ত সম্পদ থাকে, তা সর্বসাধারণের জন্যে সাদাকা বা দান হিসেবে গণ্য হবে।” এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিত্যক্ত সম্পদের কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। এ কারণেই রাসূল (সা) তাঁর জীবদ্দশায় যে সব সম্পত্তি ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) সেগুলো রাসূল (সা)-এর উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেননি। অথচ উপরোক্ত হাদীস যদি না থাকত তাহলে সেগুলো রাসূলের উত্তরাধীকারী রাসূল তনয় হযরত ফাতিমা, তার নয়জন সহধর্মিণী ও তার চাচা হযরত আব্বাস (রা) প্রমুখের হাতে আসতো। এসব উত্তরাধীকারীদের দাবির বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা) উপরোক্ত হাদীসটি দলীল হিসেবে পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে উপরোক্ত হাদীস বর্ণনার প্রতি সমর্থন দেন হযরত উমর, হযরত উছমান, হযরত আলী, হযরত আব্বাস, আবদুর রহমান ইবন আওফ তালহা, যুবায়র, আবু হুরায়রা (রা) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম।

(দুই) উপরোক্ত হাদীসটি ইমাম তিরমিযী তাঁর গ্রন্থে বহুবচনের শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন ফলে সকল নবীই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন ( نحن معاشر الانبياء لا نورث ) অর্থাৎ “আমরা নবীরা কোন উত্তরাধীকারী রেখে যাই না।” ইমাম তিরমিযী এ বর্ণনাটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

(তিন) নবীগণের নিকট দুনিয়ার সহায়-সম্পদ সর্বদাই অতি নগণ্য ও তুচ্ছ বলে গণ্য হয়েছে। তারা কখনই এগুলো সংগ্রহে লিপ্ত হননি, এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেননি এবং এর কোন গুরুত্বই দেননি। সুতরাং সন্তান ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের জন্যে প্রার্থনা করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, যে সন্তান ত্যাগের মহিমায় নবীদের মর্যাদার সীমানায় পৌঁছতে পারবে না, সে তো নবীর পরিত্যক্ত সামান্য সম্পদকে কোন গুরুত্বই দেবে না। তাই সেই তুচ্ছ সম্পদের উত্তরাধিকারী বানানোর লক্ষ্যে কোন সন্তান কামনা করা একেবারেই অবান্তর।

(চার) ঐতিহাসিক মতে নবী যাকারিয়্যা পেশায় ছিলেন ছুতার। স্বহস্তে উপার্জিত রোযগার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, যেমনটি করতেন হযরত দাউদ (আ)। বলাবাহুল্য, নবীগণ সাধারণতঃ আয়-রোযগারে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করতেন না, যার দ্বারা অতিরিক্ত মাল সঞ্চয় হতে পারে এবং পরবর্তী সন্তানগণ তার উত্তরাধিকারী হতে পারবে। ব্যাপারটি দিবালোকের মত স্পষ্ট। সামান্য চিন্তা করলেই যে কেউ বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারে।

ইমাম আহমদ ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যাকারিয়্যা নবী ছিলেন একজন ছুতার। ইমাম মুসলিম ও ইবন মাজাহ অভিন্ন সূত্রে হাম্মাদ ইবন সালমা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ “হে যাকারিয়্যা! আমি তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি, তার নাম হবে ইয়াহইয়া; এ নামে পূর্বে আমি কারও নামকরণ করিনি।” এখানে এ কথাটি সূরা আল-ইমরানের-৩৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ “যখন যাকারিয়্যা কক্ষে সালাতে দাঁড়িয়েছিল তখন ফেরেশতাগণ তাকে সম্বোধন করে বলল, ‘আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন, সে হবে আল্লাহর বাণী সমর্থক, নেতা, স্ত্রী-বিরাগী এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী।” এরপর যখন তাকে পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হল এবং তিনি নিশ্চিত হলেন তখন নিজের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে সন্তান হওয়ার বিষয়ে বিস্মিত হয়ে আল্লাহর নিকট জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার পুত্র হবে, যখন আমার পত্নী বন্ধ্যা ও আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় উপনীত?” অর্থাৎ একজন বৃদ্ধ লোকের সন্তান কিভাবে হতে পারে? কেউ কেউ বলেছেন, হযরত যাকারিয়্যার বয়স ছিল তখন সাতাত্তর বছর। প্রকৃত পক্ষে তাঁর বয়স ছিল এর থেকে আরও বেশী। “আমার স্ত্রী বন্ধ্যা” অর্থাৎ যৌবনকাল থেকেই আমার স্ত্রী বন্ধ্যা- কোন সন্তানাদি হয় না। এমনি এক অবস্থায় হযরত ইবরাহীম খলীলকে ফিরিশতাগণ পুত্র হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তখন তিনি বিস্ময়ভরে জিজ্ঞেস করেছিলেন– “বার্ধক্য যখন আমাকে পেয়ে বসেছে, তখন তোমরা আমাকে সুসংবাদ জানাচ্ছ, বল, কি সেই সুসংবাদ?” তাঁর স্ত্রী সারা বলেছিলেন, “কী আশ্চর্য্য! সন্তানের জননী হব আমি, যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! এটা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার!” ফেরেশতারা বলল, “আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময়বোধ করছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ! তিনি প্রশংসাহ ও সম্মানাহ” (১১ হৃদঃ ৭২, ৭৩)।

হযরত যাকারিয়্যা (আ)-কেও আগত ফেরেশতা ঠিক এ জাতীয় উত্তর দিয়েছিলেন। ফেরেশতা বলেছিলেন, “এরূপই হবে; তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এ কাজ আমার জন্যে সহজসাধ্য; আমি তো পূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি, যখন তুমি কিছুই ছিলে না।” অর্থাৎ আল্লাহ যখন তোমাকে অস্তিতুহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দান করতে পেরেছেন, তখন তিনি কি তোমার বৃদ্ধ অবস্থায় সন্তান দিতে পারবেন না?” সূরা আম্বিয়ায় (৯০) আল্লাহর বাণী “অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম ইয়াহইয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে যোগ্যতাসম্পন্ন করেছিলাম। তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করত, তারা আমাকে ডাকত আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত।” স্ত্রীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করার অর্থ- স্ত্রীর মাসিক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পুনরায় তা চালু হয়ে যায়। কারও মতে তার স্ত্রী মুখরা ছিলেন, তা ভাল করে দেয়া হয়। যাকারিয়্যা বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও।” অর্থাৎ আমাকে এমন একটি লক্ষণ দাও, যা দ্বারা আমি বুঝতে পারি যে, এই প্রতিশ্রুত সন্তান আমার থেকে স্ত্রীর গর্ভে এসেছে। আল্লাহ জানালেন, “তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও কারও সাথে তিন দিন বাক্যালাপ করবে না।” অর্থাৎ তোমার বুঝবার সে লক্ষণ হল, তোমাকে নীরবতা আবিষ্ট করে ফেলবে, ফলে তিন দিন পর্যন্ত মানুষের সাথে ইশারা ইংগিত ব্যতীত কথা বলতে পারবে না। অথচ তোমার শরীর, মন ও মেজাজ সবই সুস্থ অবস্থায় থাকবে। এ সময়ে তাকে সকাল-সন্ধ্যায় অধিক পরিমাণ আল্লাহর যিকর ও তাসবীহ মনে মনে পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ সুসংবাদ পাওয়ার পর হযরত যাকারিয়্যা (আ) কক্ষ হতে বের হয়ে আপন সম্প্রদায়ের নিকট চলে আসলেন এবং তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে ইঙ্গিত (ওহী) করলেন। এখানে ওহী শব্দটি গোপন নির্দেশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মুজাহিদ ও সুদ্দীর মতে, এখানে ‘ওহী’ অর্থ লিখিত গোপন নির্দেশ। কিন্তু ওহাব, কাতাদা ও মুজাহিদের ভিন্ন মতে ইংগিতের মাধ্যমে নির্দেশ মুজাহিদ, ইকরিমা, ওহাব, সুদ্দী ও কাতাদা বলেছেন, কোনরূপ অসুখ ব্যতীতই যাকারিয়্যা (আ)-এর জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে যায়। ইবন যায়দ বলেছেন, তিনি পড়তে ও তাসবীহ পাঠ করতে পারতেন; কিন্তু কারও সাথে কথা বলতে পারতেন না। আল্লাহর বাণী, “হে ইয়াহইয়া, এই কিতাব দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ কর, আমি তাকে শৈশবেই দান করেছিলাম জ্ঞান।” এ আয়াতের মাধ্যমে পূর্বে যাকারিয়্যা (আ)-কে যে পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল, তারই অস্তিত্বে আসার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাকে শৈশবকালেই কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন।

আবদুল্লাহ্ ইবন মুবারক (র) বলেন, মা’মার বলেছেনঃ একবার কতিপয় বালক ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যাকে তাদের সাথে খেলতে যেতে বলেছিল, তখন তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, “খেলার জন্যে আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়নি।” “শৈশবে তাকে জ্ঞান দান করেছিলাম"- এ আয়াতেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল উক্ত ঘটনায়। আল্লাহর বাণীঃ “এবং আমার নিকট হতে তাকে দেয়া হয়েছিল হানানা, অর্থাৎ হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্রতা এবং সে ছিল মুত্তাকী।” ইবন জারীর ...... ইবন আব্বাস (র) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, 'হানানা কি তা আমি জানি না।’ ইবন আব্বাস (রা) থেকে অপর সূত্রে এবং মুজাহিদ, ইকরিমা, কাতাদা ও যাহ্হাক থেকে বর্ণিত, ‘হানানা' অর্থ ‘দয়া'। আমার নিকট থেকে দয়া এসেছিল অর্থাৎ যাকারিয়্যার প্রতি আমি দয়া করেছিলাম, ফলে তাকে এই পুত্র সন্তান দান করা হয়েছিল। ইকরিমা বলেন, হানানা অর্থ মহব্বত; অর্থাৎ তাকে আমি মহব্বত করেছিলাম। উপরোক্ত অর্থ ছাড়া হানানা শব্দটি ইয়াহইয়া (আ)-এর বিশেষ গুণও হতে পারে। অর্থাৎ মানুষের প্রতি ইয়াহইয়ার ভালবাসা ছিল অধিক; বিশেষ করে তার পিতা-মাতার প্রতি মহব্বত ও ভালবাসা ছিল অতি প্রগাঢ়। ইয়াহইয়াকে পবিত্রতা দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ তার চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ এবং ত্রুটিমুক্ত।

মুত্তাকী অর্থ আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে অবস্থানকারী। এরপর আল্লাহ পিতা-মাতার প্রতি ইয়াহইয়া (আ)-এর উত্তম ব্যবহার, তাঁদের আদেশ-নিষেধের আনুগত্য এবং কথা ও কাজের দ্বারা পিতা-মাতার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকার কথা উল্লেখ পূর্বক বলেনঃ “এবং সে ছিল পিতা-মাতার অনুগত এবং সে ছিল না উদ্ধত, অবাধ্য।" অতঃপর আল্লাহ বলেনঃ “তার প্রতি শান্তি যে দিন সে জন্মলাভ করে, যে দিন তার মৃত্যু হবে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে।” উল্লেখিত সময় তিনটি মানব জীবনে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন অবস্থা হিসাবে বিবেচিত। কারণ, এ তিনটি সময় হল এক জগত থেকে আর এক জগতে স্থানান্তরের সময়। এক জগতে কিছুকাল অবস্থান করায় সে জগতের সাথে পরিচিতি লাভ ও ভালবাসা সৃষ্টি হওয়ার পর তা ছিন্ন করে এমন এক জগতে চলে যেতে হয়, যে জগত সম্পর্কে তার কিছুই জানা থাকে না। তাই দেখা যায় নবজাত শিশু মাতৃগর্ভের কোমল ও সংকীর্ণ স্থান ত্যাগ করে যখন এ সমস্যাপূর্ণ পৃথিবীতে আসে তখন সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

অনুরূপভাবে এ পৃথিবী ছেড়ে যখন সে বরযখ জগতে যায়, তখনও একই অবস্থা দেখা দেয়। এসব জগত ত্যাগ করে মৃত্যুর আংগিনায় পৌঁছে সে কবরের বাসিন্দা হয়ে ইসরাফীলের সিংগায় ফুক দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে। এর পরেই তার স্থায়ী বাসস্থান। কবর থেকে পুনরুত্থিত হবার পর হয় স্থায়ী শান্তি ও সুখ, না হয় চিরস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। কেউ হবে জান্নাতের অধিবাসী, আর কেউ হবে জাহান্নামের বাসিন্দা। জনৈক কবি অতি সুন্দরভাবে কথাটি বলেছেনঃ

ولدتك امك باكيا مستصرخا والناس حولك يضحكون سرورا

فاحرص لنفسك أن تكون اذا بكوا في يوم موتك ضاحكا مسرورا

অর্থঃ যে দিন তোমার মা তোমাকে ভূমিষ্ট করেছিল, সে দিন তুমি চিৎকার দিয়ে কাঁদছিলে, আর লোকজন পাশে থেকে খুশিতে হাসছিল। এখন তুমি এমনভাবে জীবন গড়ে তোল, যেন মৃত্যুকালে তুমি আনন্দচিত্তে হাসতে হাসতে মরতে পার, আর লোকজন তোমার পাশে বসে কাঁদতে বাধ্য হয়।

উপরোক্ত স্থান তিনটি যখন মানুষের উপর অত্যধিক কঠিন, তখন আল্লাহ হযরত ইয়াহইয়াকে প্রতিটি স্থানেই শান্তি ও নিরাপত্তার ঘোষণা দান করে বলেছেনঃ “তার প্রতি শান্তি যে দিন সে জন্ম লাভ করে, যে দিন তার মৃত্যু হবে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে।” সাঈদ ইবন আবী আরূবা কাতাদার সূত্রে হাসান থেকে বর্ণনা করেন, এক দিন ইয়াহইয়া ও ঈসা (আ) পরস্পর সাক্ষাতে মিলিত হন। ঈসা (আ) ইয়াহইয়া (আ)-কে বললেন, ‘আমার জন্যে ইসতিগফার কর, কেননা তুমি আমার চাইতে উত্তম।’ ইয়াহইয়া বললেন, ‘বরং আপনি আমার জন্যে ইসতিগফার করুন, যেহেতু আমার তুলনায় আপনি শ্রেষ্ঠ।’ ঈসা বললেন, ‘তুমি আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ। কেননা, আমি নিজেই আমার উপর শান্তি ঘোষণা করেছি, আর তোমার উপর শান্তি ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ।’ এর দ্বারা উভয়ের উচ্চ মর্যাদার কথা জানা গেল। সূরা আলে-ইমরানের ৩৯নং আয়াতে উল্লেখিত “সে হবে নেতা, স্ত্রী-বিরাগী এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী” ( وَسَیِّد ا وَحَصُور ا وَنَبِیّ ا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ) এখানে ‘হাসূর - স্ত্রী বিরাগী প্রসংগে কেউ কেউ বলেছেন- হাসূর বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যে কখনও কোন নারীর সঙ্গ ভোগ করে না, কেউ কেউ ভিন্ন অর্থও করেছেন। এটিই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা, যাকারিয়্যা (আ) দোয়ায় বলেছিলেন, “আমাকে তুমি তোমার নিকট থেকে পবিত্র বংশধর দান কর।” এ দোয়ার সাথে উপরোক্ত অর্থই বেশী মিলে। ইমাম আহমদ ...... ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আদম সন্তানের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে কোন গুনাহ করেনি; কিংবা অন্ততঃ গুনাহর ইচ্ছা পোষণ করেনি, একমাত্র ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যা ব্যতীত। আর কারও পক্ষেই এরূপ কথা বলা বাঞ্ছনীয় নয় যে, “আমি ইউনুস ইবন মাত্তার চেয়ে ভাল।” এ হাদীছের সনদে আলী ইবন যায়দ ইবন জাদআন নামক বর্ণনাকারী সম্পর্কে একাধিক ইমাম বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। ইবন খুযায়মা ও দারাকুতনী ও হাদীছটিকে আবু আসিম আবাদানীর সূত্রে উক্ত আলী ইবন যায়দ ইবন জাদ’আন থেকে আরও বিশদভাবে বর্ণনা করার পর ইবন খুযায়মা (র) বলেছেনঃ এই হাদীছের সনদ আমাদের শর্তঅনুযায়ী নয়।

ইবন ওহাব ..... ইব্‌ন শিহাব থেকে বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবাদের মাঝে আসেন। তারা তখন বিভিন্ন নবীদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করছিল।

একজন বলছিল, মূসা (আ) আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন, তিনি কালীমুল্লাহ। আর একজন বলছিল, ঈসা আল্লাহর রূহ্ ও তার কালেমা-ঈসা রূহুল্লাহ্। আর একজন বলছিল, ইবরাহীম আল্লাহর বন্ধু খলীলুল্লাহ। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলছেনঃ শহীদের পুত্র শহীদের উল্লেখ করছ না কেন? তিনি তো পাপের ভয়ে উটের লোমের তৈরী বস্ত্র পরতেন এবং গাছের পাতা খেতেন। ইবন ওহাব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এ কথার দ্বারা ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যাকে বুঝিয়েছিলেন। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক..... ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, প্রত্যেক আদম-সন্তান কিয়ামতের দিন কোন না কোন ত্রুটিসহ আল্লাহর সম্মুখে হাজির হবে; কেবল ইয়াহয়া ইবন যাকারিয়্যাই হবেন তার ব্যতিক্রম। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক হাদীস বর্ণনায় তাদলীস [যার নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন, তার নাম উহ্য রেখে পরবর্তী বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করাকে তাদলীস বলে] করেন।

আবদুর রাযযাক.... সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রা) থেকে এ হাদীস মুরসালভাবে বর্ণনা করেছেন। ইবন আসাকিরও এ হাদীসখানা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ কথা বলে রাবী তিলাওয়াত করতেনঃ ( وَسَیِّد ا وَحَصُور ࣰا) এরপর তিনি মাটি থেকে কিছু একটা তুলে ধরে বললেন, এ জাতীয় কিছু ব্যতীত তার নিকট আর কিছুই ছিল না; তারপর তিনি একটা পশু কুরবানী করেন। এ বর্ণনাটি মাওকুফ পর্যায়ের, তবে এর মারফু হওয়ার চাইতে মাওকুফ হওয়াটি বিশুদ্ধতর। ইবন আসাকির মা‘মার থেকে বিভিন্ন সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ তিনি আবু দাউদ আত্-তায়ালিসী প্রমুখ আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ হাসান ও হুসায়ন জান্নাতবাসী যুবকদের নেতা; তবে দুই খালাত ভাই ইয়াহয়া ও ঈসা (আ) তার ব্যতিক্রম। আবু নুআয়ম ইসফাহানী...... আবু সুলায়মান থেকে বর্ণনা করেন, একদা ঈসা ইব্‌ন মারয়াম ও ইয়াইয়া ইবন যাকারিয়্যা (আ) একত্রে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পথে এক মহিলার সাথে ইয়াহইয়ার ধাক্কা লাগে। ঈসা (আ) বললেন, ‘ওহে খালাত ভাই! আজ তুমি এমন একটি গুনাহ করে ফেলেছে যা কখনও মাফ হবে বলে মনে হয় না।’ ইয়াহ্ইয়া (আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘খালাত ভাই! সেটা কী?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘এক মহিলাকে যে ধাক্কা দিলে!’ ইয়াহইয়া বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তো টেরই পাইনি।’ ঈসা বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! কী আশ্চর্য! তোমার দেহ তো আমার সাথেই ছিল, তা হলে তোমার রূহ কোথায় ছিল?’ ইয়াহইয়া (আ) বললেন, ‘আমার রূহ্ আরশের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। আমার রূহ যদি জিরবাঈল (আ) পর্যন্ত যেয়ে প্রশান্তি পায়, তাহলে আমি মনে করি, আল্লাহকে আমি কিছু মাত্রই বুঝতে পারিনি।’ এ বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের এটা ইসরাঈলী উপাখ্যান থেকে নেয়া হয়েছে। রাবী ইসরাঈল ....খায়ছামা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইবন মারয়াম ও ইয়াহইয়া ইব্‌ন যাকারিয়্যা ছিলেন পরস্পর খালাত ভাই। ঈসা ভেড়ার পশমজাত বস্ত্র পরতেন, আর ইয়াহইয়া পরতেন উটের লোমের তৈরী বস্ত্র। উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন দীনার-দিরহাম, দাস-দাসী ছিল না। ছিল না আশ্রয় গ্রহণের মত কোন ঠিকানা। যেখানেই রাত হত সেখানেই শুয়ে পড়তেন। তারপর যখন একে অপর থেকে বিদায় নেয় তখন ইয়াহইয়া (আ) ঈসা (আ)-কে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। ঈসা বললেন, ‘ক্রোধ সংবরণ কর।’ ইয়াহইয়া বললেন, ‘ক্রোধ সংবরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘সম্পদের মোহে পড়ো না।’ ইয়াহইয়া (আ) বললেন, ‘এটা সম্ভব।’

হযরত যাকারিয়্যা (আ) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, না নিহত হয়েছিলেন -এ সম্পর্কে ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে একটি বর্ণনায় রয়েছে- যাকারিয়্যা (আ) তাঁর সম্প্রদায় থেকে পালিয়ে একটি গাছের মধ্যে ঢুকে পড়েন। সম্প্রদায়ের লোকজন ঐ গাছটি করাত দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। করাত যখন তার দেহ স্পর্শ করে, তখন তিনি চিৎকার করেন। আল্লাহ তখন ওহী প্রেরণ করে তাঁকে জানান, তোমার চিৎকার বন্ধ না হলে যমীন উলটিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি চিৎকার বন্ধ করে দেন এবং তাঁর দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এ ঘটনা মারফু’ভাবেও বর্ণিত হয়েছে যা আমরা পরে উল্লেখ করব। অপর বর্ণনায় বলা হয় যে, যিনি গাছের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন, তার নাম যীশাইর। আর হযরত যাকারিয়্যা স্বাভাবিকভাবেই ইনতিকাল করেছিলেন।

ইমাম আহমদ....... হারিছ আনসারী থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যাকে পাঁচটি বিষয়ে আমল করতে এবং বনী ইসরাঈলকেও আমল করার নির্দেশ দিতে প্রত্যাদেশ পাঠান। তিনি একটু বিলম্ব করেছিলেন। তখন ঈসা (আ) তাঁকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে পাঁচটি বিষয়ে আমল করতে ও বনী ইসরাঈলকে আমল করার হুকুম করতে আদেশ পাঠিয়েছেন। এখন বল, বনী ইসরাঈলের নিকট এ সংবাদ তুমি পৌঁছিয়ে দিবে, না আমি যেয়ে পৌঁছিয়ে দিব?’ ইয়াহইয়া (আ) বললেন, ‘ভাই! তুমি যদি পৌঁছিয়ে দাও, তাহলে আমার আশংকা হয়, আমাকে হয় শাস্তি দেয়া হবে, না হয় মাটির মধ্যে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে।’ অতঃপর ইয়াহইয়া (আ) ইসরাঈলীদেরকে বায়তুল মুকাদ্দাসে সমবেত করলেন। মসজিদ লোকে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ইয়াহ্ইয়া সম্মুখ দিকের উচু স্থানে বসলেন। প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি জানালেন। অতঃপর বললেন, ‘আল্লাহ পাঁচটি বিষয়ের হুকুম করেছেন। আমাকে ঐগুলো আমল করতে বলেছেন এবং তোমাদেরকেও আমল করার আদেশ দিতে বলেছেন।

একঃ তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না। কেননা তাঁর সাথে শরীক করার উদাহরণ হল যেমন, এক ব্যক্তি তার উপার্জিত খাঁটি স্বর্ণ বা রৌপ্য দ্বারা একটা গোলাম ক্রয় করল। ঐ গোলাম সারা দিন কাজ করে উপার্জিত ফসল নিজের মনিবকে বাদ দিয়ে অন্যের বাড়িতে উঠায়। তবে এরূপ গোলামের উপর তোমরা কেউ কি সন্তুষ্ট থাকবে? জেনে রেখো, আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন; সুতরাং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে, অন্য কাউকে তার সাথে শরীক করবে না।

দুইঃ আমি তোমাদেরকে সালাতের আদেশ দিচ্ছি। কেননা আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ না বান্দা অন্য দিকে ফিরে তাকায়। অতএব, যখন তোমরা সালাত আদায় করবে, তখন অন্য দিকে তাকাবে না।

তিনঃ সিয়াম পালন করার জন্যে আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। কেননা, যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করে, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন ব্যক্তি, যে একটি দলের মধ্যে অবস্থান করছে। তার নিকট মিশকের একটা কৌটা আছে। আর ঐ মিশকের সুঘ্রাণ দলের প্রতিটি লোক পাচ্ছে। আর শুন, সাওম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের চাইতে অধিকতর সুঘ্রাণ হিসেবে বিবেচিত।

চারঃ দান-সাদকা করার জন্যে আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি। কেননা, যে ব্যক্তি দান সাদকা করে, তার উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে শক্রর হাতে ধরা পড়ে বন্দী হয়েছে। তারা তার হাত পা বেঁধে হত্যা করার জন্যে উদ্যোগ নিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে সে প্রস্তাব দিল, আমি অর্থের বিনিময়ে মুক্তি চাই। তারা রাজী হল এবং সে ব্যক্তি কম-বেশী অর্থ দান করে জীবন রক্ষা করল।

পাঁচঃ আল্লাহর যিকর (স্মরণ) অধিক পরিমাণ করার জন্যে আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি। কেননা, যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকর করে, তার দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তি, যাকে ধরার জন্যে শত্রুরা দ্রুত ধাওয়া করছে। অতঃপর সে একটি সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করে আত্মরক্ষা করল। অনুরূপ বান্দা যতক্ষণ আল্লাহর যিকিরে নিমগ্ন থাকে, ততক্ষণ সে শয়তানের পাকড়াও থেকে নিরাপদে অবস্থান করে।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি নিজে তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের আমল করার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি। এগুলো সম্পর্কে আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন; (১) জামায়াত বদ্ধভাবে থাকা (২) নেতার কথা শোনা (৩) নেতার আনুগত্য করা (৪) প্রয়োজনে হিজরত করা এবং (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। কেননা যে ব্যক্তি জামায়াত থেকে এক বিঘত পরিমাণও বের হয়ে যায়, সে প্রকৃত পক্ষে ইসলামের রজ্জুকে নিজের ঘাড় থেকে খুলে ফেলে। তবে যদি পুনরায় জামায়াতে ফিরে আসে তা হলে ভিন্ন কথা। আর যে ব্যক্তি জাহিলী যুগের রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে আহ্বান করবে, সে জাহান্নামের ধুলিকণায় পরিণত হবে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে ব্যক্তি যদি সালাত-সাওমে অভ্যস্ত হয়?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘যদি সে সালাত সাওম আদায় করে এবং নিজেকে মুসলমান বলে মনে করে তবুও। মুসলমানদেরকে সেই নামে ডাকবে, যে নাম তাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন।’ অথাৎ মু'মিন, মুসলমান, আল্লাহর বান্দা। আবু ইয়া’লা, তিরমিযী, ইবন মাজাহ্, হাকিম তাবারানী বিভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইব্‌ন আসাকির... রাবী' ইব্‌ন আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহাবীগণের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদেরকে জানানো হয়েছে; তারা বনী ইসরাঈলের আলিমদের থেকে শুনেছেন যে, ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যা পাঁচটি বিধানসহ প্রেরিত হয়েছিলেন। অতঃপর পূর্বোল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করেন। তারা আরো বলেছেন, ইয়াহইয়া (আ) অধিকাংশ সময় মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে গিয়ে নির্জনে অবস্থান করতেন। তিনি বনে-জংগলে থাকতে বেশী পছন্দ করতেন, গাছের পাতা খেয়ে, নদীর পানি পান করে, কখনও কখনও টিড্ডি খেয়ে জীবন ধারণ করতেন এবং নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন, ‘হে ইয়াহইয়া! তোমার চেয়ে অধিক নিয়ামত আর কার ভাগ্যে জুটেছে?’ ইব্‌ন আসাকির বর্ণনা করেন, একবার ইয়াহ্ইয়ার পিতা-মাতা ছেলের সন্ধানে বের হন। বহু অনুসন্ধানের পর তাকে জর্দান নদীর তীরে দেখতে পান। পুত্রকে সেখানে আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর ভয়ে ভীত-কম্পিত দেখে তারা উভয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। ইবন ওহাব ..... মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যার খাদ্য ছিল সবুজ ঘাস। আল্লাহর ভয়ে তিনি অঝোরে কাঁদতেন। তাঁর এ কান্না এত বেশী হতো যে, যদি চোখে আল-কাতরার আস্তরও থাকতো, তবে নিশ্চয়ই তাও ভেদ করে অশ্রু পড়তো।

মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়া ... ইবন শিহাব থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার আমি ইদরীস আল-খাওলানীর মজলিসে বসা ছিলাম। তিনি বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। এক পর্যায়ে এসে বললেন, ‘তোমরা কি জান, সবচেয়ে উত্তম খাদ্য কে খেতেন?’ সকলেই তখন তাঁর দিকে দৃষ্টি ফিরালো। তিনি বললেন, ‘সবচেয়ে উত্তম খাদ্য খেতেন হযরত ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যা (আ)। তিনি বনের পশুদের সাথে আহার করতেন। কেননা মানুষের সাথে জীবিকা নির্বাহ তাঁর নিকট খুবই অপছন্দনীয় ছিল।’ ইবনুল মুবারক বর্ণনা করেন, হযরত যাকারিয়্যা (আ) একবার তাঁর পুত্র ইয়াহইয়াকে তিন দিন যাবত পাচ্ছিলেন না। অতঃপর তিনি তাকে সন্ধান করার জন্যে জংগলে গমন করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, ইয়াহইয়া একটি কবর খনন করে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন। তিনি বললেন, ‘প্রিয় বৎস! তোমাকে আমি তিন দিন যাবত খুঁজে ফিরছি। আর তুমি কিনা কবর খুঁড়ে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছ। তখন ইয়াহইয়া উত্তর দিলেন, ‘আব্বাজান! আপনিই তো আমাকে বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে এক বিশাল কঠিন ও দুর্গম ময়দান-যা কান্নার পানি ব্যতীত অতিক্রম করা যায় না।’ পিতা বললেন, ‘সত্যিই বৎস! প্রাণ ভরে কাঁদো।’ তখন পিতা-পুত্র উভয়ে একত্রে কাঁদতে লাগলেন। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ ও মুজাহিদ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন আসাকির মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘জান্নাতবাসীদের নিকট যে নিয়ামত সামগ্রী থাকবে, তার স্বাদ উপভোগে মত্ত থাকায় তারা নিদ্রা যাবে না। সুতরাং সিদ্দীকীন যারা, তাঁদের অন্তরে আল্লাহর মহব্বতের যে নিয়ামত আছে, তার কারণে তাদেরও নিদ্রা যাওয়া সমীচীন নয়। অতঃপর তিনি বলেন, ‘কতই না পার্থক্য উক্ত দুই নিয়ামতের মধ্যে।’ বর্ণনাকারীগণ বলেছেন, নবী ইয়াহইয়া (আ) এত অধিক পরিমাণ কাঁদতেন যে, চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে পড়তে তার দুই গালে স্পষ্ট দাগ পড়ে যায়।

হযরত ইয়াহইয়া (আ)-এর হত্যার বর্ণনা

হযরত ইয়াহইয়া (আ)-এর হত্যার বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রসিদ্ধতম কারণ এই যে, সে যুগে দামিশকের জনৈক রাজা তার এক মাহরাম [যাকে বিবাহ করা বৈধ্য নয়] নারীকে বিবাহ করার সংকল্প করে। হযরত ইয়াহইয়া (আ) তাকে এ বিবাহ করতে নিষেধ করেন। এতে মহিলাটির মনে ইয়াহ্ইয়ার প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এক পর্যায়ে উক্ত মহিলা ও রাজার মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। তখন মহিলাটি রাজার নিকট ইয়াহইয়াকে হত্যার আবদার জানায়। সে মতে রাজা তাকে উক্ত মহিলার হাতে তুলে দেন। মহিলাটি ইয়াহইয়া (আ)-কে হত্যা করার জন্যে ঘাতক নিয়োগ করে। ঐ ঘাতক নির্দেশ মত তাঁকে হত্যা করে এবং কর্তিত মস্তক ও তার রক্ত একটি পাত্রে রেখে মহিলার সামনে হাজির করে। কথিত আছে, মহিলাটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়।

অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, উল্লেখিত রাজার স্ত্রীই হযরত ইয়াহইয়াকে মনে মনে ভালবাসত এবং তাঁর সাথে মিলনের প্রস্তাব পাঠায়। হযরত ইয়াহইয়া (আ) তাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। মহিলাটি নিরাশ হয়ে তাকে হত্যার বাহানা খোঁজে। সে রাজার নিকট সে জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। রাজা প্রথমে নিষেধ করলেও পরে অনুমতি দিয়ে দেয়। মহিলাটি ঘাতক নিয়োগ করে।

সে ইয়াহইয়ার রক্তমাখা ছিন্ন মস্তক একটি পাত্রে করে মহিলার সামনে হাজির করে।

ইসহাক ইবন বিশর-এর ‘মুবতাদা' নামক গ্রন্থে এই মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি.... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেনঃ মিরাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত যাকারিয়্যা (আ)-কে আসমানে দেখতে পান। তিনি সালাম দিয়ে বলনেন, ‘হে ইয়াহয়ার পিতা। বনী-ইসরাঈলরা আপনাকে কেন এবং কিভাবে হত্যা করেছিল, আমাকে বলুন?’ তিনি বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! এ বিষয়ে আমি আপনাকে বিস্তারিত বলছি, শুনুন! আমার পুত্র ইয়াহইয়া ছিল তার যুগের অনন্য গুণের অধিকারী শ্রেষ্ঠ যুবক, সুদর্শন ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। যার সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলছেন, “সে হবে নেতা ও স্ত্রী বিরাগী।” নারীদের প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। বনী ইসরাঈলের রাজার স্ত্রী ইয়াহইয়ার প্রতি আসক্ত হয়। সে ছিল ব্যাভিচারিণী। সে ইয়াহ্ইয়ার নিকট কু-প্রস্তাব পাঠায়। আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। সে মহিলার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এতে মহিলাটি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। বনী ইসরাঈল সমাজে একটি বার্ষিক উৎসবের প্রচলন, যে দিন সবাই নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়। উক্ত রাজার নীতি ছিল, কাউকে প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করত না এবং মিথ্যা কথা বলত না। রাজা উক্ত উৎসবের নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। তার স্ত্রী তাকে বিদায় অভিনন্দন জানায়। রাজা তাকে খুব ভালবাসত, অতীতে কিন্তু রাজা কখনো এরূপ করেনি। অভিনন্দন পেয়ে খুশী হয়ে রাজা বলল, তুমি আমার নিকট যে আবদার করবে, আমি তা-ই পূরণ করবো। স্ত্রী বলল, ‘আমি যাকারিয়্যার পুত্র ইয়াহইয়ার রক্ত চাই।’

রাজা বলল, ‘এটা নয়, অন্য কিছু চাও।’ স্ত্রী বলল, ‘না, ওটাই আমি চাই।’ রাজা বলল, ‘ঠিক আছে, তা-ই হবে।’ অতঃপর রাজার স্ত্রী ইয়াহ্ইয়ার হত্যার জন্যে জল্লাদ পাঠিয়ে দেয়। তখন তিনি মিহরাবের মধ্যে সালাত আদায়ে রত ছিলেন। যাকারিয়্যা (আ) বলেন, আমি পুত্রের পাশেই সালাত রত ছিলাম। এ অবস্থায় জল্লাদ ইয়াহইয়াকে হত্যা করে এবং তার রক্ত ও ছিন্ন মস্তক একটি পাত্রে করে উক্ত মহিলার নিকট নিয়ে যায়।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আপনার ধৈর্য তো প্রশংসার্হ।’ যাকারিয়্যা (আ) বললেন, ‘এ ঘটনার সময় আমি সালাত থেকে কোনরূপ অন্যমনস্ক হইনি। যাকারিয়্যা (আ) আরো বলেন, জল্লাদ ইয়াহইয়ার কর্তিত মস্তক মহিলার সম্মুখে রেখে দেয়। দিন শেষে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তখন আল্লাহ ঐ রাজা, তার পরিবারবর্গ ও লোক-লশকরকে মাটির নীচে ধ্বসিয়ে দেন। পরদিন সকালে ঘটনা দেখে বনী ইসরাঈলরা পরস্পর বলাবলি করল, যাকারিয়্যার মনিব যাকারিয়্যার অনুকূলে ক্রুদ্ধ হয়েছেন; চল আমরাও আমাদের রাজার অনুকূলে ক্রুদ্ধ হই এবং যাকারিয়্যাকে হত্যা করি। তখন আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তারা সম্মিলিতভাবে আমার সন্ধানে বের হয়। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাকে সাবধান করে দেয়। আমি তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে স্থান থেকে পলায়ন করি। কিন্তু ইবলীস তাদের সম্মুখে থেকে আমার গমন পথ দেখিয়ে দেয়। যখন দেখলাম, তাদের হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই, তখন সম্মুখে একটি গাছ দেখতে পাই। তার নিকট যাওয়ার জন্যে গাছটি তখন আমাকে আহ্বান করছিল এবং দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন তাতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু ইবলিস তখন আমার চাদরের আঁচল টেনে ধরে, বৃক্ষের ফাটল মুদে যায়। কিন্তু আমার চাদরের আঁচলটি বাইরে থেকে যায়। বনী ইসরাঈল সেখানে উপস্থিত হলে ইবলীস জানায় যে, যাকারিয়্যা যাদুবলে এই গাছটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বনী ইসরাঈল বলল, তাহলে গাছটিকে আমরা পুড়িয়ে ফেলি। ইবলীস বলল, না বরং গাছটি করাত দিয়ে চিরে ফেল। যাকারিয়্যা বলেন, ফলে বৃক্ষের সাথে আমিও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাই।’

রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি করাতের স্পর্শ বুঝতে পেরেছিলেন, কিংবা ব্যাথা অনুভব করেছিলেন?’ যাকারিয়্যা বললেন, ‘না; বরং ঐ গাছটি তা অনুভব করেছে, যার মধ্যে আল্লাহ আমার রূহ্ রেখে দিয়েছিলেন।’ এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। এ এক অদ্ভূত কাহিনী। রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে এ হাদীছ বর্ণিত হওয়ার ব্যাপারটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনার মধ্যে এমন কিছু কথা আছে, যা কোন মতেই গ্রহণ করা চলে না। এ বর্ণনা ছাড়া মিরাজ সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসেই যাকারিয়্যা (আ)-এর উল্লেখ নেই। অবশ্য সহীহ হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় এ কথা আছে যে, আমি ইয়াহইয়া ও ঈসা দু’খালাত ভাইয়ের পাশ দিয়ে গমন করেছিলাম। অধিকাংশ আলিমের মতে তারা ছিলেন পরস্পর খালাত ভাই। হাদীস থেকেও তাই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। কেননা, ইয়াহইয়ার মা আশয়া বিনত ইমরান মারয়াম বিনত ইমরানের বোন ছিলেন। কিন্তু কারও কারও মতে ইয়াহইয়ার মা আশয়া' অর্থাৎ যাকারিয়্যার স্ত্রী ছিল মারয়ামের মা হান্না। অর্থাৎ ইমরানের স্ত্রীর বোন। এ হিসেব মতে ইয়াহইয়া হয়ে যান মারয়ামের খালাতো ভাই।

হযরত ইয়াহইয়া (আ) কোন স্থানে নিহত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। কারও মতে বায়তুল মুকাদ্দাসের ভিতরে; কারও মতে মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও। সুফিয়ান ছাওরী (র) বলেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে যে ঐতিহাসিক পাথর আছে, সেখানে সত্তরজন নবীকে হত্যা করা হয়। ইয়াহইয়া (আ) তাদের অন্যতম। আবু উবায়দ.... সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, বুখত নসর, যখন দামিশকে অভিযানে আসে, তখন ইয়াহইয়া (আ)-এর রক্ত মাটির নীচ থেকে উপরের দিকে উত্থিত হতে দেখতে পায়। সে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকজন প্রকৃত ঘটনা জানায়। তখন বুখত নসর এ রক্তের উপরে সত্তর হাজার বনী ইসরাঈলকে জবাই করে। ফলে রক্ত উঠা বন্ধ হয়ে যায়। এ বর্ণনার সূত্রে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রা) পর্যন্ত সহীহ। এ বর্ণনা অনুযায়ী ইয়াহইয়ার হত্যাস্থল দামিশক। আর বুখত নসরের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল হযরত ঈসা মাসীহর পরে। আতা ও হাসান বসরী (র) এই মত পোষণ করেন।

ইবন আসাকির ..... যায়দ ইব্‌ন ওয়াকিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তার আমলে দামিশকের মসজিদ পুনঃনির্মাণের সময় হযরত ইয়াহইয়া (আ)-এর মস্তক বের হয়ে পড়ে। আমি তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মসজিদের পূর্ব দিকের মিহরাবের নিকট কিবলার যে দেয়াল ছিল, তার নীচ থেকে ঐ মস্তক বের হয়েছিল। মস্তকের চামড়া ও চুল অক্ষত ছিল। এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, মস্তকটি দেখলে মনে হয় যেন এই মাত্র কর্তন করা হয়েছে। অতঃপর উক্ত মসজিদের ‘সাকাসিকা' নামক প্রসিদ্ধ স্তম্ভের নীচে মস্তকটি দাফন করা হয়।

ইবন আসাকির তাঁর ‘আল-মুসতাকসা ফী ফাযাইলিল আকসা নামক গ্রন্থে মুআবিয়ার আপন দাস কাসিম থেকে বর্ণনা করেন, দামিশকের জনৈক রাজার নাম ছিল হাদ্দাদ ইবন হাদার। রাজা তার এক পুত্রকে তার ভাই আরয়ালের কন্যার সাথে বিবাহ করায়। পুত্র-বধুটি ছিল বহু ভূ-সম্পত্তির মালিক। দামিশকের সকল বাজার-ঘাট ছিল তার কর্তাধীন। রাজপুত্র একদা কসম খেয়ে স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু দিন পর সে আবার ঐ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ)-এর নিকট এ ব্যাপারে মাসআলা জিজ্ঞেস করে। ইয়াহইয়া বললেন, ‘অন্যত্র বিবাহ ব্যতীত এই স্ত্রী পুনরায় গ্রহণ করা তোমার জন্যে বৈধ নয়।’ এ রকম সিদ্ধান্ত দেওয়ায় উক্ত মহিলার মনে ইয়াহইয়ার প্রতি বৈরিতা সৃষ্টি হয় এবং সে তাকে হত্যা করার জন্যে রাজার নিকট অনুমতি চায়। মহিলার মা-ই এ কাজে তাকে প্ররোচিত করে। রাজা প্রথম দিকে বারণ করলেও পরে অনুমতি দিয়ে দেয়। ইয়াহইয়া (আ) জায়রূন নামক স্থানে এক মসজিদে সালাত আদায় করছিলেন। এ অবস্থায় উক্ত মহিলা কর্তৃক প্রেরিত এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে এবং ছিন্ন মস্তক একটি পাত্রে করে নিয়ে যায়। কিন্তু তখনও ঐ পাত্র থেকে আওয়াজ আসছিলঃ

لا تحل له لا تحل له حتى تنكح زوجا غيره

(অন্যত্র বিবাহ ব্যতীত ঐ স্বামীর কাছে যাওয়া বৈধ হবে না, বৈধ হবে না) এ অবস্থা দেখে মহিলাটি পাত্রের উপর ঢাকনা দিয়ে আবদ্ধ করে নিজের মাথার উপর রেখে তার মায়ের নিকট নিয়ে আসে। কিন্তু তখনও পাত্রের মধ্য থেকে অনুরূপ আওয়াজ বের হচ্ছিল। মহিলাটি ইয়াহইয়ার মস্তক রেখে তার মায়ের সম্মুখে যখন ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল, তখন তার দুই পা মাটির মধ্যে পুঁতে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তার দেহ কোমর পর্যন্ত মাটির নীচে চলে যায়। মহিলার মা তুলূল এবং তার দাসীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চীৎকার করতে থাকে এবং নিজ নিজ মুখে করাঘাত করতে থাকে। দেখতে দেখতে মহিলার কাঁধ পর্যন্ত মাটির মধ্যে গেড়ে যায়। তখন তার মা সান্ত্বনা লাভের উদ্দেশ্যে মেয়েটির মস্তক মাটির নীচে চলে যাওয়ার আগে কেটে রাখার জন্যে এক জনকে নির্দেশ দেয়। উপস্থিত জল্লাদ সাথে সাথে তরবারী দ্বারা মস্তক কেটে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মাটি মহিলার অবশিষ্ট দেহ ভিতর থেকে উগরে ফেলে দেয়। এভাবে মহিলাটির গোটা পরিবারই লাঞ্ছনা ও অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যায়।

অপরদিকে ইয়াহইয়া (আ) যে স্থানে নিহত হয়েছিলেন, সে স্থানে মাটির নীচ থেকে রক্ত উপরের দিকে উথলে উঠছিল। এরপর বুখত নসর এসে পঁচাত্তর হাজার বনী ইসরাঈলকে হত্যা করলে রক্তের ঐ প্রবাহ বন্ধ হয়। সাঈদ ইবন আবদিল আযীম (র) বলেছেন, ঐ রক্ত ছিল সমস্ত নবীদের মিশ্রিত রক্ত। মাটির তলদেশ থেকে সর্বদা উথলে উঠত এবং বাইরে গড়িয়ে যেত। হযরত আরমিয়া (আ) সে স্থানে দাঁড়িয়ে রক্তকে সম্বোধন করে বলেন, “হে রক্ত! বনী ইসরাঈল তো শেষ হয়ে গিয়েছে, আল্লাহর হুকুমে এখন থাম।” এরপর রক্ত থেমে যায়। বুখত নসর অতঃপর হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে এবং তলোয়ার গুটিয়ে নেয়। তার এ অভিযানকালে দামিশকের বহু লোক পালিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে চলে যায়। বুখত নসর সেখানে গিয়েও তাদেরকে ধাওয়া করে এবং হত্যা করে। কত লোক যে এ অভিযানে তার হাতে নিহত হয়েছিল তার কোন হিসেব নেই। হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে বহু সংখ্যক লোক বন্দী করে বুখত নসর দামিশক ত্যাগ করে।

২১
হযরত ঈসা (আ)-এর বিবরণ
খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, আল্লাহর সন্তান আছে। তাদের এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের খণ্ডনে আল্লাহ তা'আলা সূরা আলে-ইমরানের প্রথম দিকে ধারাবাহিকভাবে তিরাশিটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। নাজরান থেকে খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলে করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের ভ্রান্ত ধর্ম-বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করে বলে যে, তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী এবং তাদের ধারণা অনুসারে আল্লাহ হচ্ছেন তিন সত্তার এক সত্তা। তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল উপদলের মধ্যে এক দলের মতে সেই তিন সত্তা হলঃ আল্লাহ, ঈসা (আ) ও মারয়াম। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা'আলা সূরার প্রারম্ভে উক্ত বিষয়ে আয়াত নাযিল করেন। তাতে তিনি বলেন যে, ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দাদের মধ্যকার একজন বান্দা। অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় আল্লাহ তাকেও সৃষ্টি করেছেন এবং মাতৃগর্ভে আকৃতি দান করেছেন। তবে, আল্লাহ তাঁকে পিতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, যেমন আদমকে পিতা ও মাতা ছাড়া পয়দা করেছেন। তাঁর ক্ষেত্রে তিনি কেবল বলেছেন ‘কুন’- (হয়ে যাও) তখনই তিনি সৃষ্ট হয়ে যান। এ সূরায় আল্লাহ ঈসার মাতা মারয়ামের জন্মের বৃত্তান্ত এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলী এবং ঈসার গর্ভধারণ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। সূরা মারয়ামেও এ সম্পর্কে তিনি বিশদ বর্ণনা করেছেন। সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। সূরা আলে-ইমরানে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

( إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰۤ ءَادَمَ وَنُوح ا وَءَالَ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَ وَءَالَ عِمۡرَ  ٰ⁠ نَ عَلَى ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ ذُرِّیَّةَۢ بَعۡضُهَا مِنۢ بَعۡض ۗ وَٱللَّهُ سَمِیعٌ عَلِیمٌ ۝ إِذۡ قَالَتِ ٱمۡرَأَتُ عِمۡرَ  ٰ⁠ نَ رَبِّ إِنِّی نَذَرۡتُ لَكَ مَا فِی بَطۡنِی مُحَرَّر ا فَتَقَبَّلۡ مِنِّیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِیعُ ٱلۡعَلِیمُ ۝ فَلَمَّا وَضَعَتۡهَا قَالَتۡ رَبِّ إِنِّی وَضَعۡتُهَاۤ أُنثَىٰ وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا وَضَعَتۡ وَلَیۡسَ ٱلذَّكَرُ كَٱلۡأُنثَىٰۖ وَإِنِّی سَمَّیۡتُهَا مَرۡیَمَ وَإِنِّیۤ أُعِیذُهَا بِكَ وَذُرِّیَّتَهَا مِنَ ٱلشَّیۡطَـٰنِ ٱلرَّجِیمِ ۝ فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَن وَأَنۢبَتَهَا نَبَاتًا حَسَن ا وَكَفَّلَهَا زَكَرِیَّاۖ كُلَّمَا دَخَلَ عَلَیۡهَا زَكَرِیَّا ٱلۡمِحۡرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزۡق اۖ قَالَ یَـٰمَرۡیَمُ أَنَّىٰ لَكِ هَـٰذَاۖ قَالَتۡ هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِۖ إِنَّ ٱللَّهَ یَرۡزُقُ مَن یَشَاۤءُ بِغَیۡرِ حِسَابٍ )

[Surah Aal-E-Imran 33 - 37]

—নিশ্চয়ই আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে আল্লাহ বিশ্বজগতে মনোনীত করেছেন। এরা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। স্মরণ কর, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত তোমার জন্যে আমি উৎসর্গ করলাম। সুতরাং তুমি আমার নিকট হতে তা কবুল কর, তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ অতঃপর যখন সে তাকে প্রসব করল তখন সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি কন্যা প্রসব করেছি।’ সে যা’ প্রসব করেছে, আল্লাহ তা' সম্যক অবগত। ছেলে তো এই মেয়ের মত নয়, আমি তার নাম মারয়াম রেখেছি এবং অভিশপ্ত শয়তান হতে তার ও তার বংশধরদের জন্যে তোমার শরণ নিচ্ছি। তারপর তার প্রতিপালক তাকে সাগ্রহে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করলেন এবং তিনি তাকে যাকারিয়্যার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই যাকারিয়্যা কক্ষে তার সাথে সাক্ষাত করতে যেত, তখনই তার নিকট খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেত। সে বলত, ‘হে মারয়াম! এ সব তুমি কোথায় পেলে?’ সে বলত, ‘এটা আল্লাহর নিকট হতে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান করেন।’ (৩ আলে-ইমরানঃ ৩৩-৩৭)

আল্লাহ এখানে আদম (আ)-কে এবং তার সন্তানদের মধ্যে যারা তার আনুগত্য ও অনুসরণে অটল ও অবিচল রয়েছিলেন, তাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন। তারপর বিশেষভাবে বলেছেন, ইবরাহীমের বংশধরদের কথা। এর মধ্যে উক্ত বংশের ইসমাঈলী শাখা ও ইসহাকের শাখা অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি এই পূত-পবিত্র আলে-ইমরানের বা ইমরান পরিবারের ফযীলত বর্ণনা করেছেন। এখানে ইমরান বলতে মারয়ামের পিতাকে বুঝানো হয়েছে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ইমরানের নসবনামা উল্লেখ করেছেন এভাবেঃ ইমরান ইবন বাশিম ইবন আমূন ইবন মীশা ইবন হিযকিয়া ইবন আহরীক ইবন মূছাম ইবন ‘আযাযিয়া ইবন আমসিয়া ইবন ইয়াউশ ইবন আহরীহূ ইবন ইয়াযাম ইবন ইয়াহফাশাত ইব্‌ন ঈশা ইবন আয়ান ইবন রাহবি'আম ইবন সুলায়মান ইবন দাউদ (আ)। অপর দিকে ইবন আসাকিরের বর্ণনা মতে হযরত মারয়ামের বংশধারা নিম্নরূপঃ মারয়াম বিনত ইমরান ইবন মাছান ইবনুল আযির ইবনুল ইয়াওদ ইবন আখনার ইবন সাদূক ইবন ‘আয়াযুয ইবন আল-য়াফীম ইবন আয়বূদ ইবন যারয়াবীল ইবন শালতাল ইবন য়্যুহায়না ইবন বারশা ইব্‌ন আমূন ইব্‌ন মীশা ইবন হাযকা ইবন আহায ইবন মাওছাম ইবন আযরিয়া ইবন য়ূরাম ইবন য়ুশাফাত ইবন ঈশা ইবন ঈবা ইবন রাহরিআম ইবন সুলায়মান ইবন দাঊদ (আ)। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের বর্ণিত নসব-নামার সাথে এই নসব-নামার যথেষ্ট পার্থক্য আছে; তবে মারয়াম যে দাঊদ (আ)-এর বংশধর, এ ব্যাপারে কোন বিরোধ নেই। মায়ামের পিতা ইমরান ছিলেন সে যুগে বনী ইসরাঈলের ইমাম। তাঁর মা হান্না বিত ফাকূদ ইব্‌ন কাবীল ছিলেন ইবাদতগুজার মহিলা। হযরত যাকারিয়্যা (আ) ছিলেন সে যুগের নবী।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তিনি ছিলেন মারয়ামের বোন আশইয়ার স্বামী। কিন্তু কারও কারও মতে মায়ামের খালার নাম ছিল আশইয়া' এবং যাকারিয়্যা ছিলেন এই আশইয়ার স্বামী।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মারয়ামের মায়ের কোন সন্তান হতো না। এ অবস্থায় একদিন তিনি দেখেন যে, একটি পাখী তার ছানাকে আদর-সোহাগ করছে। এ দৃশ্য দেখে তাঁর অন্তরে সন্তান লাভের অদম্য আগ্রহ জাগে। তখনই তিনি মানত করলেন যে, তিনি যদি গর্ভবতী হন তবে তাঁর পুত্র সন্তানকে আল্লাহর জন্যে উৎসর্গ করবেন। অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাসের খাদিম বানাবেন। মানত করার সাথে সাথেই তার মাসিক স্রাব আরম্ভ হয়ে যায়। পবিত্র হওয়ার পর তার স্বামী তার সাথে মিলিত হন এবং মারয়াম তার গর্ভে আসেন। আল-কুরআনের ভাষ্য হচ্ছে অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি কন্যা প্রসব করেছি।’ অথচ সে যা প্রসব করেছিল আল্লাহ তা সম্যক অবগত ( وضعت ) এর অন্য কেরাত ( وضعت ) অর্থাৎ আমি যা' প্রসব করেছি। “আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মত হয় না।” অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমতের ব্যাপারে। সে যুগের লোক বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমতের জন্যে নিজেদের সন্তান মানত করত। “মারয়ামের মায়ের উক্তি, আমি তার নাম রাখলাম মারয়াম।” এ আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করে কেউ কেউ জন্মের দিনেই সন্তানের নামকরণের কথা বলেছেন। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আনাস (রা) থেকে হাদীছ বর্ণিত আছে যে, তিনি তার নবজাত ভাইকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা) একটি খোরমা চিবিয়ে তার রস নবজাতকের মুখে দেন এবং তার নাম করেন আবদুল্লাহ। হযরত হাসান (র) ছামুরা (রা) সূত্রে মারফু হাদীস বর্ণিত আছে, “প্রত্যেক পুত্র-সন্তান তার আকীকার দ্বারা সুরক্ষিত। জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করবে, তার নামকরণ করবে এবং মাথার চুল মুণ্ডন করবে।” এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদসহ সকল সুনান গ্রন্থকার এবং তিরমিযী একে ‘সহীহ' বলে অভিহিত করেছেন। এ হাদীছের কোন কোন বর্ণনায় নামকরণে ( يسمى ) -এর স্থলে রক্তপ্রবাহিত করণ ( يدمى ) -এর উল্লেখ আছে। কেউ কেউ এ বর্ণনাকেও 'সহীহ' বলেছেন।

তারপর মারয়াম বললেন, “আমি একে এবং এর ভবিষ্যৎ বংশধরকে বিতাড়িত শয়তান থেকে রক্ষা করার জন্যে তোমারই শরণ নিচ্ছি। মারয়ামের মায়ের এই দোয়া তার মানতের মতই কবুল হয়েছিল। এ সম্পর্কে হাদীসেও উল্লেখ পাওয়া যায়। ইমাম আহমদ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শয়তান তাকে স্পর্শ করে, তাই সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, কেবল মারয়াম ও তার পুত্র এর ব্যতিক্রম। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, তোমরা ইচ্ছে করলে কুরআনের এ আয়াত পড়তে পারঃ

( وَإِنِّیۤ أُعِیذُهَا بِكَ وَذُرِّیَّتَهَا مِنَ ٱلشَّیۡطَـٰنِ ٱلرَّجِیمِ )

[Surah Aal-E-Imran 36]

এ উভয় হাদীস আবদুর রাযযাক (র) সূত্রে বর্ণিত। ইবন জারীর ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ভিন্ন সূত্রে ..... আবু হুরায়রা (রা) থেকে এ হাদীসটি নিম্নরূপভাবে বর্ণনা করেছেন; নবী করীম (সা) বলেছেনঃ বনী-আদমের প্রতিটি নবজাত শিশুকে শয়তান আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে, কেবল মারয়াম বিনত ইমরান ও তাঁর পুত্র ঈসা এর ব্যতিক্রম। এ হাদীসটি কেবল এই একটি সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিমও ভিন্ন সনদে আবু হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ভিন্ন সূত্রে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘কোন মা যখন সন্তান প্রসব করে তখন মায়ের কোলেই শয়তান তাকে ঘুষি মারে, কেবল মারয়াম ও তার পুত্র এর ব্যতিক্রম।’

রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা দেখেছ কি, শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন চিৎকার করে কাঁদে?’ সাহাবাগণ বললেন, ‘হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা দেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, ‘এ চিৎকার তখনই সে দেয়, যখন মায়ের কোলে শয়তান তাকে ঘুষি মারে।’ এ হাদীস মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী বর্ণিত। কায়স ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন, যে কোন শিশু ভূমিষ্ঠ হলে শয়তান তাকে একবার বা দু'বার চাপ দেয়, কেবল ঈসা ইব্‌ন মারয়াম ও মারয়াম এ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তারপর রাসূল (সা) এ আয়াত পাঠ করলেন। “আমি অভিশপ্ত শয়তান থেকে তার ও তার বংশধরদের জন্যে তোমার শরণ নিচ্ছি।”

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ও ইমাম আহমদ ...... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ প্রতিটি আদম সন্তান, যখন সে ভূমিষ্ঠ হয় তখন শয়তান তার পার্শ্বদেশে খোচা মারে কেবল ঈসা ইবন মারয়াম এর ব্যতিক্রম। শয়তান ঈসাকে খোঁচা মারতে গিয়ে পর্দায় খোঁচা মেরে চলে যায়। এ হাদীস বুখারী ও মুসলিমের শর্তে বর্ণিত। আল্লাহর বাণীঃ “অতঃপর তার প্রতিপালক তাকে ভালরূপে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করলেন, আর তাকে যাকারিয়্যার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। অনেক মুফাসসির লিখেছেন, মারয়াম ভুমিষ্ঠ হলে তার মা তাকে একটি কাপড়ে জড়িয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে চলে যান এবং সেখানকার ইবাদতকারী লোকদের নিকট সোপর্দ করেন। মারয়াম ছিলেন তাদের নেতা ও সালাতের ইমামের কন্যা। তাই তার দেখাশুনার দায়িত্ব কে নেবে, এ নিয়ে তারা বাদানুবাদে লিপ্ত হয়। বলাবাহুল্য যে, মারয়ামের দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই তাকে বায়তুল মুকাদ্দাসে ইবাদতকারীদের দায়িত্বে সোপর্দ করা হয়েছিল। মারয়ামকে যখন তাদের কাছে সোপর্দ করা হয়, তখন তারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়— কে তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

হযরত যাকারিয়্যা (আ) ছিলেন সে যুগের নবী। তিনি চাচ্ছিলেন, নিজের দায়িত্বে রাখতে এবং এ ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় তাঁরই হক ছিল সর্বাধিক। কেননা, তাঁর স্ত্রী ছিলেন মারয়ামের বোন, মতান্তরে খালা। কিন্তু অন্যরা এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল এবং লটারীর মাধ্যমে ফয়সালা করার দাবি জানাল। অতঃপর লটারী করা হল এবং তাতে যাকারিয়্যা (আ)-এর নাম উঠলো। প্রকৃতপক্ষে খালা তো মায়েরই তুল্য। আল্লাহর বাণীঃ “আর তাকে যাকারিয়্যার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন।’ যেহেতু লটারীতে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ “এ হল গায়েবী সংবাদ, যা আমি তোমাকে ওহীর মাধ্যমে অবহিত করছি। মারয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে এর মধ্যে যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল তুমি তখন তাদের নিকট ছিলে না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল, তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না।” (৩:৪৪)।

মুফাসসিরগণ লিখেছেন যে, কলমের মাধ্যমে লটারী তিনবার হয়েছিল। প্রথমবার প্রত্যেকে নিজ নিজ কলমে চিহ্ন দিয়ে এক জায়গায় রেখে দেয়। অতঃপর একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালককে সেখান থেকে একটা কলম উঠিয়ে আনতে বলে। দেখা গেল, যাকারিয়্যার কলমই উঠে এসেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী দ্বিতীয়বার লটারী করা হয়। এবার লটারীর পদ্ধতি ঠিক করা হয় যে, প্রত্যেকের কলম নদীর মধ্যে ফেলে দেবে; তারপর যার কলম স্রোতের বিপরীত দিকে চলবে, সে জয়ী হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলম নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। দেখা গেল, যাকারিয়্যার কলম স্রোতের বিপরীতে চলছে এবং অন্য সবার কলম স্রোতের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে। তখন তারা তৃতীয় বার লটারী করার দাবি জানাল এবং বলল, এবার যার কলম স্রোতের অনুকূলে চলবে এবং অন্যদের কলম উজানের দিকে উঠে যাবে সেই জয়ী হবে। এবারের লটারীতেও যাকারিয়্যা (আ) জয়ী হলেন এবং মারয়ামের তত্ত্বাবধানের অধিকার লাভ করলেন। শরীআতের বিচারেও লটারীতে জয়ী হওয়ায় তাঁর অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

আল্লাহর বাণীঃ “যখনই যাকারিয়্যা মিহরাবের মধ্যে তার কাছে আসত, তখনই কিছু খাবার দেখতে পেত। জিজ্ঞেস করত, ‘মারয়াম! কোথা থেকে এসব তোমার কাছে এল?’ সে বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।”

মুফাসসিরগণ লিখেছেন, হযরত যাকারিয়্যা মারয়ামের জন্যে বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে একটি উত্তম কক্ষ নির্ধারণ করে দেন। তিনি ছাড়া ঐ কক্ষে অন্য কেউ প্রবেশ করত না। মারয়াম এই কক্ষে অবস্থান করে আল্লাহর ইবাদত করতেন। মসজিদের কোন খেদমতের সময় সুযোগ যখন আসত, তখন তিনি সে দায়িত্ব পালন করতেন। রাত-দিন সর্বদা সেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি এত বেশী পরিমাণে আল্লাহর ইবাদত করতেন যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে তাঁর ইবাদতকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হত। তাঁর বহু কারামত ও বৈশিষ্ট্যের কথা ইসরাঈলী সমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করে। হযরত যাকারিয়্যা (আ) যখনই মারয়ামের কক্ষে প্রবেশ করতেন তখনই তার নিকট বে-মৌসুমের বিরল খাদ্য দ্রব্য দেখতে পেতেন- যেমন শীত মৌসুমে গ্রীষ্মের ফল এবং গ্রীষ্ম মৌসুমে শীত কালের ফল দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘মারয়াম! এসব তুমি কোথায় পেলে?’ সে বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে অর্থাৎ আল্লাহই এসব খাদ্য সামগ্রী আমার জন্যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন অপরিমিত রিযুক দান করেন।’ সেখানেই যাকারিয়্যার মনে পুত্র-সন্তানের আকাঙক্ষা জাগে এবং বয়স অনেক বেশী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর নিকট দোয়া করে বলেন, “হে আমার পালনকর্তা! আমাকে তুমি তোমার নিকট থেকে সৎ বংশধর দান কর। নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।” কোন কোন মুফাসির বলেছেন, হযরত যাকারিয়্যা (আ) প্রার্থনায় এ কথাও বলেছিলেন যে, ‘হে মহান প্রভু! আপনি যেমন মারয়ামকে অসময়ে ফল দান করেছেন, আমাকেও একটি সন্তান দান করুন, যদিও অসময় হয়ে গেছে।’ এর পরবর্তী ঘটনাবলী আমরা যথা স্থানে বর্ণনা করে এসেছি।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَإِذۡ قَالَتِ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ یَـٰمَرۡیَمُ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰكِ وَطَهَّرَكِ وَٱصۡطَفَىٰكِ عَلَىٰ نِسَاۤءِ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ یَـٰمَرۡیَمُ ٱقۡنُتِی لِرَبِّكِ وَٱسۡجُدِی وَٱرۡكَعِی مَعَ ٱلرَّ  ٰ⁠ كِعِینَ ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكَ مِنۡ أَنۢبَاۤءِ ٱلۡغَیۡبِ نُوحِیهِ إِلَیۡكَۚ وَمَا كُنتَ لَدَیۡهِمۡ إِذۡ یُلۡقُونَ أَقۡلَـٰمَهُمۡ أَیُّهُمۡ یَكۡفُلُ مَرۡیَمَ وَمَا كُنتَ لَدَیۡهِمۡ إِذۡ یَخۡتَصِمُونَ ۝ إِذۡ قَالَتِ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ یَـٰمَرۡیَمُ إِنَّ ٱللَّهَ یُبَشِّرُكِ بِكَلِمَة مِّنۡهُ ٱسۡمُهُ ٱلۡمَسِیحُ عِیسَى ٱبۡنُ مَرۡیَمَ وَجِیه ا فِی ٱلدُّنۡیَا وَٱلۡـَٔاخِرَةِ وَمِنَ ٱلۡمُقَرَّبِینَ ۝ وَیُكَلِّمُ ٱلنَّاسَ فِی ٱلۡمَهۡدِ وَكَهۡل ا وَمِنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ۝ قَالَتۡ رَبِّ أَنَّىٰ یَكُونُ لِی وَلَد وَلَمۡ یَمۡسَسۡنِی بَشَر ۖ قَالَ كَذَ  ٰ⁠ لِكِ ٱللَّهُ یَخۡلُقُ مَا یَشَاۤءُۚ إِذَا قَضَىٰۤ أَمۡر ا فَإِنَّمَا یَقُولُ لَهُۥ كُن فَیَكُونُ ۝ وَیُعَلِّمُهُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِیلَ ۝ وَرَسُولًا إِلَىٰ بَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ أَنِّی قَدۡ جِئۡتُكُم بِـَٔایَة مِّن رَّبِّكُمۡ أَنِّیۤ أَخۡلُقُ لَكُم مِّنَ ٱلطِّینِ كَهَیۡـَٔةِ ٱلطَّیۡرِ فَأَنفُخُ فِیهِ فَیَكُونُ طَیۡرَۢا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ وَأُبۡرِئُ ٱلۡأَكۡمَهَ وَٱلۡأَبۡرَصَ وَأُحۡیِ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأۡكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِی بُیُوتِكُمۡۚ إِنَّ فِی ذَ  ٰ⁠ لِكَ لَـَٔایَة لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَمُصَدِّق ا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیَّ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعۡضَ ٱلَّذِی حُرِّمَ عَلَیۡكُمۡۚ وَجِئۡتُكُم بِـَٔایَة مِّن رَّبِّكُمۡ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِیعُونِ ۝ إِنَّ ٱللَّهَ رَبِّی وَرَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُوهُۚ هَـٰذَا صِرَ  ٰ⁠طࣱ مُّسۡتَقِیم ࣱ)

[Surah Aal-E-Imran 42 - 51]

—স্মরণ কর, যখন ফেরেশতাগণ বলেছিল, ‘হে মারয়াম! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের নারীগণের মধ্যে তোমাকে মনোনীত করেছেন। হে মারয়াম! তোমার প্রতিপালকের অনুগত হও ও সিজদা কর এবং যারা রুকূ করে তাদের সাথে রুকূ কর। এটা অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ, যা তোমাকে ওহী দ্বারা অবহিত করছি।’ মারয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে এর জন্যে যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল, তুমি তখন তাদের নিকট ছিলে না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না। স্মরণ কর, যখন ফেরেশতাগণ বলল, হে মারয়াম! আল্লাহ তোমাকে তার পক্ষ হতে একটি কলেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মসীহ-মারয়াম তনয় ঈসা, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবে। সে দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলবে এবং সে হবে পুণ্যবানদের একজন। সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি, আমার সন্তান হবে কীভাবে?’ তিনি বললেন, ‘এ ভাবেই’, আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও’ এবং তা হয়ে যায়। এবং তিনি তাকে শিক্ষা দিবেন কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল এবং তাকে বনী ইসরাঈলের জন্যে রাসূল করবেন। সে বলবে, আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্যে কাদা দ্বারা একটি পাখীর মত আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুৎকার দিব; ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করব। তোমরা তোমাদের ঘরসমূহে যা আহার কর ও মওজুদ কর, তা তোমাদেরকে বলে দেব। তোমরা যদি মুমিন হও তবে এতে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। আর আমি এসেছি আমার সম্মুখে তাওরাতের যা রয়েছে তার সমর্থকরূপে ও তোমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতকগুলোকে বৈধ করতে এবং আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর আর আমাকে অনুসরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদত করবে। এটাই সরল পথ। (৩ আলে ইমরানঃ ৪২-৫১)

উপরোক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহ এ কথা উল্লেখ করছেন যে, ফেরেশতাগণ মারয়ামকে এ সুসংবাদ পৌঁছান যে, আল্লাহ তাকে সে যুগের সমস্ত নারীদের মধ্যে মনোনীত করেছেন। যেহেতু তিনি তার থেকে সৃষ্টি করবেন পিতা ছাড়া পুত্র-সন্তান এবং তাঁকে এ সুসংবাদও দেন যে, সে পুত্রটি হবেন মর্যাদাশীল নবী। “সে মানুষের সাথে কথা বলবে দোলনায় থাকা অবস্থায়।” অর্থাৎ শিশুকালেই তিনি মানুষকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করবেন। পরিণত বয়সেও তিনি মানুষকে ঐ একই আহ্বান জানাতে থাকবেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, মারয়াম তনয় পরিণত বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন এবং মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করবেন। এবং তাকে বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগী ও রুকু সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়। যাতে করে তিনি এই মর্যাদার যোগ্য হয়ে উঠেন এবং তিনি এ অপার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারেন। তিনি এ নির্দেশ পূর্ণভাবে পালন করার চেষ্টা করতেন। কথিত আছে যে, দীর্ঘক্ষণ সালাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার দু'পা ফেটে যেত। আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পিতা-মাতার উপর শান্তি বর্ষিত করুন।

আয়াতে রয়েছে, ফেরেশতাগণ বলেন, “হে মারয়াম! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন এবং তোমাকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন।" অর্থাৎ মন্দ চরিত্র থেকে তোমাকে পবিত্র রেখেছেন এবং উত্তম গুণাবলী দ্বারা বিভূষিত করেছেন। “আর তোমাকে বিশ্বের নারীগণের মধ্যে মনোনীত করেছেন।” ‘বিশ্বের নারীদের' দু'টি অর্থ হতে পারেঃ এক, সে যুগে বিশ্বে যত নারী ছিল, তাদের উর্ধে। যেমন মূসা (আ)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন, “আমি তোমাকে মানব জাতির উপর মনোনীত করেছি।” অনুরূপভাবে বনী ইসরাঈল সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন, ‘আমি জেনে শুনেই তাদেরকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।' (৪৪ দুখানঃ ৩২) কিন্তু সবাই জানে যে, ইবরাহীম (আ) মূসা (আ)-এর চাইতে শ্রেষ্ঠ, এবং মুহাম্মদ (সা) উভয়ের চাইতে শ্রেষ্ঠ। অনুরূপ বিশ্বনবীর এ উম্মত অতীতের সমস্ত উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠ এবং বনী ইসরাঈল ও অন্যান্যদের তুলনায় সংখ্যায় অধিক, ইলম ও জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ এবং আমলে ও ইখলাসে উন্নততর।

দুই, “তোমাকে বিশ্বের নারীদের মধ্যে মনোনীত করেছেন।” এ কথাটি ব্যাপক অর্থেও হতে পারে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিশ্বের সমস্ত নারীকুলের মধ্যে মারয়ামই শ্রেষ্ঠ। কেননা, তিনি যদি নবী হয়ে থাকেন, যেমন ইবন হাযম প্রমুখের ধারণা যে, ঈসা নবীর মা মারয়াম, ইসহাক নবীর মা সারা ও মূসা নবীর মা নবী ছিলেন। কেননা, এঁদের প্রত্যেকের সাথে ফেরেশতা কথা বলেছেন এবং মূসা নবীর মায়ের নিকট ওহী এসেছে। এমত অনুযায়ী মারয়াম অন্যান্য নারীদের তুলনায় তো বটেই, এমনকি সারা এবং মূসা (আ)-এর মায়ের তুলনায়ও শ্রেষ্ঠতর। কেননা, আয়াতে নবী অ-নবী সমস্ত নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং এর সাথে সাংঘর্ষিক অন্য কোন আয়াত নেই। কিন্তু আবুল হাসান আশ'আরী ও অন্যান্য ধর্ম বিশারদগণ জমহুর উলামা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত উদ্ধৃত করে বলেছেন, নবুওত পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নারীদের মধ্যে কাউকেই দান করা হয়নি। এমত অনুযায়ী উক্ত আয়াতের অর্থ হবে, মারয়ামকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ অপর এক আয়াতে বলেছেন “মারয়াম-তনয় মসীহ তো কেবল একজন রাসূল, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে এবং তার মা সিদ্দীকা (সত্যনিষ্ঠ) ছিল।” (মায়িদাঃ ৭৫)। এ মত হিসেবে পূর্বের ও পরের সিদ্দীকা মর্যাদাপ্রাপ্ত নারীদের মধ্যে মারয়ামের শ্রেষ্ঠ হওয়ায় কোন বাধা নেই। হাদীসে মারয়ামের নাম আসিয়া বিনত মুযাহিম খাদীজা বিন্ত খুওয়ায়লিদ এবং নবী তনয়া হযরত ফাতিমা (রা)-এর সাথে এক সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ (র) বিভিন্ন সূত্রে ...... হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম মারয়াম বিনত ইমরান এবং নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ। ইমাম আহমদ ....... আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ বিশ্বজগতে নারীদের মধ্যে কেবল চারজনই শ্রেষ্ঠ। তারা হলেন মারয়াম বিনত ইমরান, ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া, খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ ও ফাতিমা (রা) বিনত মুহাম্মদ (সা)। তিরমিযী আবদুর রাযযাকের সূত্রে উপরোক্ত সনদে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ্ বলে মন্তব্য করেছেন। ইবন মারদুওবেহ এবং ইবন আসাকির আনাস (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ ........ আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন? উটে আরোহিণীদের মধ্যে উত্তম মহিলা হলেন সতী-সাধ্বী কুরায়শী মহিলা। ছোট শিশুদেরকে তারা অধিক স্নেহ করে এবং স্বামীর সম্পদের পূর্ণ হেফাজত করে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, বিবি মারয়াম কখনও উটে আরোহণ করেন নি। ইমাম মুসলিম ও ইমাম আহমদ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

তারপর আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা)-এর জানা ছিল যে, ইমরানের কন্যা (মারয়াম) উটে আরোহণ করেন নি। এ হাদীস সহীহর শর্ত অনুযায়ী আছে এবং আবু হুরায়রা (রা) থেকে ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।

আবু ইয়া'লা .... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা মাটির উপরে চারটি রেখা আঁকেন এবং সাহাবাগণের নিকট জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কি বুঝতে পেরেছ এ রেখা কিসের?’ তারা বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘জান্নাতবাসী মহিলাদের মধ্যে সর্বোত্তম মহিলা খুওয়ায়লিদের কন্যা খাদীজা, মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা, ইমরানের কন্যা মারয়াম এবং মুযাহিমের কন্যা অর্থাৎ ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া।’ ইমাম নাসাঈ (র)-ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবুল কাসিম বাগাবী (র).... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ফাতিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাসূলুল্লাহর অন্তিমকালে তুমি তাঁর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে প্রথমে কেঁদে ফেললে এবং পরক্ষণে আবার হেসে উঠলে, এর কারণ কি? ফাতিমা (রা) বললেন, ‘আব্বা আমাকে প্রথমে জানালেন, এই রোগেই তার ইন্তিকাল হবে, তাই আমি কেঁদেছি। দ্বিতীয়বার যখন ঝুঁকলাম তখন তিনি বললেন, আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে এবং তুমি হবে জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী। অবশ্য, মারয়াম বিনত ইমরান-এর ব্যতিক্রম-এ কথা শুনে আমি হেসেছি।’ এ হাদীসের মূল অংশ সহীহ গ্রন্থে আছে এবং উল্লেখিত সনদ মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী আছে। এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব উল্লেখিত চারজন মহিলার মধ্যে উক্ত দু’জন শ্রেষ্ঠ। অনুরূপ আর একটি হাদীস ইমাম আহমদ ...... আবু সাঈদ (র) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, জান্নাতবাসী মহিলাদের নেত্রী হবে ফাতিমা, তবে মারয়াম বিনত ইমরানের ব্যাপারটি ব্যতিক্রম। এ হাদীসের উপরোক্ত সনদকে ইমাম তিরমিযী হাসান ও সহীহ বলেছেন। অবশ্য হাদীসটি দুর্বল সনদে হযরত আলী (আ) থেকে বর্ণিত হয়েছে।

মোটকথা, উপরোক্ত হাদীস থেকে এটাই বুঝা যায় যে, চার জনের মধ্যে ফাতিমা ও মারয়ামই শ্রেষ্ঠ। এরপর কথা থাকে যে, এ দুজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? এ বিষয়ে হাদীসের অর্থ দুরকম হতে পারে। একঃ মারয়াম ফাতিমার চাইতে শ্রেষ্ঠ; দুইঃ মারয়াম ও ফাতিমা উভয়ে সমমর্যাদা সম্পন্ন। এ সম্ভাবনার কারণ হল, হাফিজ ইবন আসাকির ইবন আব্বাসের এক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ জান্নাতবাসী মহিলাদের মধ্যে সবার শীর্ষে থাকবে মারয়াম বিনত ইমরান, তারপরে ফাতিমা তারপরে খাদীজা, তারপরে ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া। এখানে শব্দ বিন্যাস থেকে তাঁদের মর্যাদার ক্রমবিন্যাস বুঝা যায়। ইতিপূর্বে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেখানেও চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে; যার দ্বারা মর্যাদার বিন্যাসও বুঝায় না এবং বিন্যাসের পরিপন্থীও বুঝায় না। এ হাদীসটিই আবু হাতিম (র) ভিন্ন সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন সেখানেও বর্ণনা থেকে মর্যাদার ক্রম বিন্যাস বুঝায় না।

ইবন মারদুইবেহ্ ... কুররা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, পুরুষদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক পূর্ণতা (কামালিয়ত) লাভ করেছেন; কিন্তু মহিলাদের মধ্যে তিনজন ছাড়া আর কেউই পূর্ণতা অর্জন করেন নি। তাঁরা হচ্ছেন মারয়াম বিনত ইমরান, ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া ও খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ। আর নারীদের মধ্যে আয়েশার মর্যাদা সেই পরিমাণ,যেই পরিমাণ মর্যাদা সমস্ত খাদ্যের মধ্যে ছারীদের [গোশতের ঝোলে ভেজনো রুটি]।

আবু দাউদ ব্যতীত অধিকাংশ সিহাহ্ সিত্তার অন্যান্য সংকলকগণ ... আবু মূসা আশআরী (আ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ‘পুরুষদের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা লাভ করেছেন; কিন্তু নারীদের মধ্যে কেবল ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া ও মারয়াম বিনত ইমরান ছাড়া আর কেউই পূর্ণতা অর্জন করতে পারেন নি। আর নারীদের উপর আয়েশার শ্রেষ্ঠত্ব তেমনি যেমন শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে সকল খাদ্যের উপর ছারীদের।’ এ হাদীছ সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন। হাদীছের শব্দ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নারী জাতির মধ্যে পূর্ণতা কেবল দু’জন নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তারা হলেন মারয়াম ও আসিয়া। কেননা, তাঁরা উভয়েই দু’জন শিশু নবীকে তত্ত্বাবধান করেছিলেন। বিবি আসিয়া করে ছিলেন মূসা কালীমুল্লাহকে এবং বিবি মারয়াম করেছিলেন ঈসা রূহুল্লাহকে। তবে পূর্ণতা আসিয়া ও মারয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ার অর্থ হল তাদের স্ব স্ব যুগের নারীদের মধ্যে তারাই ছিলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী শেষ নবীর উম্মতের মধ্যে আরও নারীদের পূর্ণতা লাভে এ হাদীছের সাথে কোন বিরোধ থাকে না। যেমন খাদীজা ও ফাতিমা। খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহর খেদমত করেছেন নবুওতের পূর্বে পনের বছর এবং নবুওতের পরে প্রায় দশ বছর। তিনি নিজের জানমাল দিয়ে নিষ্ঠার সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সেবা-সহযোগিতা করেছেন। আর রাসূল তনয়া ফাতিমা তাঁর অন্যান্য বোনদের তুলনায় অধিক ফযীলতের অধিকারিণী। কেননা, রাসুলুল্লাহ (স)-এর জন্যে তিনি কষ্ট-নিপীড়ন সহ্য করেছেন এবং পিতার ইনতিকালের শোক যাতনায় ধৈর্য ধারণ করেছেন। কিন্তু অন্যান্য বোনদের সবাই রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায়ই ইন্তিকাল করেন।

অন্যদিকে হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন রাসুলুল্লাহর প্রিয়তমা সহধর্মিণী। আয়েশা (রা) ব্যতীত অন্য কোন কুমারীকে রাসূলুল্লাহ বিবাহ করেন নি। শেষ নবীর উম্মতের মধ্যে এমনকি পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মতের মধ্যেও আয়েশার চাইতে অধিক জ্ঞানী গুণী আর কোন মহিলা ছিলেন বলে জানা যায় না। অপবাদকারীরা যখন হযরত আয়েশা (রা)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটায় তখন আল্লাহ তাআলা সপ্ত আসমানের উপর থেকে নিজে আয়েশার পবিত্রতা ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইনতিকালের পর তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ব্যাপী তিনি কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদান রাখেন, মুসলিম সমাজে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান দেন এবং মুসলমানদের পারস্পারিক দ্বন্ধ সহজেই মীমাংসার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন সকল উম্মুল মু'মিনীনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি প্রাচীন ও আধুনিক বহু সংখ্যক আলিমের মতে, হযরত খাদীজার চাইতেও আয়েশা (রা) শ্রেষ্ঠ। কিন্তু উত্তম পন্থা হল উভয়ের মর্যাদার তারতম্য করার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা। যারা তারতম্য করেছেন তারা সেই হাদীছের প্রতি লক্ষ্য রেখে করেছেন যে, নারীদের মধ্যে আয়েশার স্থান সে রকম, যে রকম খাদ্যের মধ্যে ছারীদের স্থান। কিন্তু এ হাদীছের ব্যাখ্যা দুরকম করা যেতে পারে। এক, তিনি উল্লেখিত ও অনুল্লেখিত সকল নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দুই, উল্লেখিত নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ।

যাহোক, এখানে মূল আলোচনা ছিল হযরত মারয়াম বিনত ইমরান প্রসংগে। কেননা আল্লাহ তাকে পবিত্র করেছেন এবং তার যুগের সমস্ত নারীদের মধ্যে কিংবা সকল যুগের সমস্ত নারীদের মধ্যে তাকে মনোনীত করেছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত মারয়াম বিনত ইমরান এবং আসিয়া বিনত মুযাহিম জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হিস সালামের সহধর্মিণীগণের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাফসীর গ্রন্থে আমরা প্রাথমিক যুগের কোন কোন আলিমের ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছি, যেখানে ( ثيبات وابكارا ) (অর্থাৎ বিবাহিত স্ত্রী ও কুমারী স্ত্রী)-এর ব্যাখ্যায় বিবাহিত স্ত্রী বলতে আসিয়া এবং কুমারী বলতে মারয়ামকে বুঝানো হয়েছে। তাফসীর গ্রন্থে সূরা তাহরীমের শেষ দিকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

তাবারানী …... সা’দ ইবন জুনাদা আল আওফী থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, জান্নাতের মধ্যে আল্লাহ আমার সংগে ইমরানের কন্যা মারয়াম, ফিরআওনের স্ত্রী ও মূসা নবীর ভগ্নীকে বিবাহ দিবেন। আবু ইয়ালা …... আবু উমামা থেকে বর্ণিত হাদীছে মূসা (আ)-এর বোনের নাম কুলসুম বলে উল্লেখিত হয়েছে। আবু জাফর উকায়লী এ হাদীছ শেষের দিকে কিছু বৃদ্ধিসহ বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহর কথা শোনার পর আবু উমামা বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্যে এটা খুবই আনন্দের বিষয়।’ অতঃপর উকায়লী মন্তব্য করেন যে, হাদীছের এ অংশটি নির্ভরযোগ্য নয়। যুবায়র ইব্‌ন বাক্কার ... ইবন আবু দাউদ থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা রাসুলুল্লাহ (সা) খাদীজার ঘরে প্রবেশ করেন। খাদীজা (রা) তখন মৃত্যা শয্যায় শায়িত। রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘হে খাদীজা! তোমার অবস্থা আমার নিকট খুবই অপ্রীতিকর ঠেকছে। অবশ্য অপ্রীতিকর বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখে থাকেন। জেনে রেখ, আল্লাহ জান্নাতের মধ্যে তোমার সাথে ইমরানের কন্যা মারয়াম, মুসার বোন কুলছুম ও ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়াকে আমার সংগে বিবাহ দিয়ে রেখেছেন।’ খাদীজা (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনার সাথে এরূপ করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ খাদীজা (রা) বললেন, ‘বরকতময় হোক আপনাদের এ বিবাহ ও সন্তানাদি।’

ইবন আসাকির ...… ইবন আব্বাস (র) থেকে বর্ণিত। হযরত খাদীজা (রা) যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিকট গমন করেন এবং বলেন, ‘হে খাদীজা! যখন তুমি তোমার সতীনদের সাথে মিলিত হবে তখন তাদেরকে আমার সালাম জানাবে।’ খাদীজা (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পূর্বে কি আপনি কাউকে বিবাহ করেছিলেন?’ রাসূলুল্লাহ বললেন, ‘না, বিবাহ তো করিনি; কিন্তু আল্লাহ আমার সাথে মারয়াম বিনত ইমরান, আসিয়া বিনত মুযাহিম এবং মূসার বোন কুলসুমকে বিবাহ দিয়েছেন।’ ইবন আসাকির ..…. ইবন উমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জিবরাঈল (আ) ওহী নিয়ে রাসূলুল্লাহর নিকট আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে বসে আলাপ করেন। এমন সময় খাদীজা ঐ স্থান দিয়ে গমন করছিলেন। জিবরাঈল (আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে মুহাম্মদ! ইনি কে! রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ইনি হলেন সিদ্দীকা আমার স্ত্রী।’ জিবরাঈল (আ) বললেন, ‘তাঁর নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার কাছে কিছু বার্তা আছে। আল্লাহ তাঁকে সালাম জানিয়েছেন এবং জান্নাতে তার জন্যে নির্মিত মূল্যবান ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন, সেখানে নেই কোন দুঃখ, নেই কোন কোলাহল।’ খাদীজা (রা) বললেন, ‘আল্লাহর নাম সালাম বা শান্তি। আর তার থেকে সালাম ও শান্তির আশা করা যায় এবং আপনাদের দু’জনের উপর সালাম, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত রাসূলুল্লাহর উপর অবতীর্ণ হোক।’ খাদীজা (রা) জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘কাসাব নির্মিত ঐ ঘরটি কি?’ তিনি বললেন, ‘আয়তাকার মুক্তা নির্মিত একটি বৃহৎ কক্ষ। ঐ ঘরের অবস্থান হবে মারয়াম বিনত ইমরানের ঘর ও আসিয়া বিনত মুযাহিমের ঘরের মধ্যবর্তী স্থানে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘কিয়ামতের দিন ঐ দু’জন হবে আমার স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত।’ খাদীজার প্রতি সালাম ও কষ্ট-কোলাহল মুক্ত মুক্তার ঘরের সুসংবাদের কথা সহীহ গ্রন্থে আছে; কিন্তু এই অতিরিক্ত কথাটুকুর বর্ণনা একান্তই বিরল। আর এ হাদীসসমূহের প্রতিটির সনদই সন্দেহযুক্ত।

ইবন আসাকির ...…. কাআব আহবার থেকে বর্ণিত। হযরত মুআবিয়া (রা) একবার তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের শুভ্র পাথর খণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, উক্ত পাথর খণ্ডটি একটি খেজুর গাছের উপর স্থাপিত। গাছটি জান্নাতের একটি নদীর উপর অবস্থিত। ঐ গাছের নীচে বসে মারয়াম বিনত ইমরান ও আসিয়া বিনত মুযাহিম জান্নাতবাসীদের জন্যে মালা গাঁথছেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরা এভাবে মালা গাঁথতে থাকবেন। এরপর ইবন আসাকির ...… ভিন্ন সনদে উবাদা ইবনুস সামিত (রা) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু উক্ত সনদে এ হাদীস অগ্রহণযোগ্য এবং জাল। আবু মুরআ...ইবন আবিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা মুআবিয়া (রা) কাব আহবারকে বায়তুল মুকাদ্দাসের পাথর খণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং উত্তরে তিনি অনুরূপ কথা বলেছিলেন। ইবন আসাকির (র) বলেন, উপরোল্লিখিত কথাটি কা'ব আহবারের কথা হতে পারে এবং তিনি এটা ইসরাঈলী উপাখ্যান থেকে নিয়েছেন। আর ইসরাঈলী উপাখ্যানের অনেক কথাই বানোয়াট ও কল্পিত—যা তাদের মধ্যে ধর্মদ্রোহী মূর্খ লোকদের রচিত।

২২
সতী-সাধ্বী নারী হযরত মারয়ামের পুত্র হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মের বিবরণ
আল্লাহর বাণীঃ

( وَٱذۡكُرۡ فِی ٱلۡكِتَـٰبِ مَرۡیَمَ إِذِ ٱنتَبَذَتۡ مِنۡ أَهۡلِهَا مَكَان ا شَرۡقِیّ ا ۝ فَٱتَّخَذَتۡ مِن دُونِهِمۡ حِجَاب ا فَأَرۡسَلۡنَاۤ إِلَیۡهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَر ا سَوِیّ ا ۝ قَالَتۡ إِنِّیۤ أَعُوذُ بِٱلرَّحۡمَـٰنِ مِنكَ إِن كُنتَ تَقِیّ ا ۝ قَالَ إِنَّمَاۤ أَنَا۠ رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَـٰم ا زَكِیّ ا ۝ قَالَتۡ أَنَّىٰ یَكُونُ لِی غُلَـٰم وَلَمۡ یَمۡسَسۡنِی بَشَر وَلَمۡ أَكُ بَغِیّ ا ۝ قَالَ كَذَ  ٰ⁠ لِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَیَّ هَیِّن ۖ وَلِنَجۡعَلَهُۥۤ ءَایَة لِّلنَّاسِ وَرَحۡمَة مِّنَّاۚ وَكَانَ أَمۡر ا مَّقۡضِیّ ا ۝ ۞ فَحَمَلَتۡهُ فَٱنتَبَذَتۡ بِهِۦ مَكَان ا قَصِیّ ا ۝ فَأَجَاۤءَهَا ٱلۡمَخَاضُ إِلَىٰ جِذۡعِ ٱلنَّخۡلَةِ قَالَتۡ یَـٰلَیۡتَنِی مِتُّ قَبۡلَ هَـٰذَا وَكُنتُ نَسۡی ا مَّنسِیّ ا ۝ فَنَادَىٰهَا مِن تَحۡتِهَاۤ أَلَّا تَحۡزَنِی قَدۡ جَعَلَ رَبُّكِ تَحۡتَكِ سَرِیّ ا ۝ وَهُزِّیۤ إِلَیۡكِ بِجِذۡعِ ٱلنَّخۡلَةِ تُسَـٰقِطۡ عَلَیۡكِ رُطَب ا جَنِیّ ا ۝ فَكُلِی وَٱشۡرَبِی وَقَرِّی عَیۡن اۖ فَإِمَّا تَرَیِنَّ مِنَ ٱلۡبَشَرِ أَحَد ا فَقُولِیۤ إِنِّی نَذَرۡتُ لِلرَّحۡمَـٰنِ صَوۡم ا فَلَنۡ أُكَلِّمَ ٱلۡیَوۡمَ إِنسِیّ ا ۝ فَأَتَتۡ بِهِۦ قَوۡمَهَا تَحۡمِلُهُۥۖ قَالُوا۟ یَـٰمَرۡیَمُ لَقَدۡ جِئۡتِ شَیۡـٔ ا فَرِیّ ا ۝ یَـٰۤأُخۡتَ هَـٰرُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ ٱمۡرَأَ سَوۡء وَمَا كَانَتۡ أُمُّكِ بَغِیّ ا ۝ فَأَشَارَتۡ إِلَیۡهِۖ قَالُوا۟ كَیۡفَ نُكَلِّمُ مَن كَانَ فِی ٱلۡمَهۡدِ صَبِیّ ا ۝ قَالَ إِنِّی عَبۡدُ ٱللَّهِ ءَاتَىٰنِیَ ٱلۡكِتَـٰبَ وَجَعَلَنِی نَبِیّ ا ۝ وَجَعَلَنِی مُبَارَكًا أَیۡنَ مَا كُنتُ وَأَوۡصَـٰنِی بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَیّ ا ۝ وَبَرَّۢا بِوَ  ٰ⁠ لِدَتِی وَلَمۡ یَجۡعَلۡنِی جَبَّار ا شَقِیّ ا ۝ وَٱلسَّلَـٰمُ عَلَیَّ یَوۡمَ وُلِدتُّ وَیَوۡمَ أَمُوتُ وَیَوۡمَ أُبۡعَثُ حَیّ ا ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكَ عِیسَى ٱبۡنُ مَرۡیَمَۖ قَوۡلَ ٱلۡحَقِّ ٱلَّذِی فِیهِ یَمۡتَرُونَ ۝ مَا كَانَ لِلَّهِ أَن یَتَّخِذَ مِن وَلَد ۖ سُبۡحَـٰنَهُۥۤۚ إِذَا قَضَىٰۤ أَمۡر ا فَإِنَّمَا یَقُولُ لَهُۥ كُن فَیَكُونُ ۝ وَإِنَّ ٱللَّهَ رَبِّی وَرَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُوهُۚ هَـٰذَا صِرَ  ٰ⁠طࣱ مُّسۡتَقِیم ۝ فَٱخۡتَلَفَ ٱلۡأَحۡزَابُ مِنۢ بَیۡنِهِمۡۖ فَوَیۡل لِّلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِن مَّشۡهَدِ یَوۡمٍ عَظِیمٍ )

[Surah Maryam 16 - 37]

“বর্ণনা কর এই কিতাবে উল্লেখিত মারয়ামের কথা, যখন সে তার পরিবারবর্গ থেকে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্ব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল। তারপর তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যে সে পর্দা করল। তারপর আমি তার নিকট আমার রূহকে পাঠালাম। সে তার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারয়াম বলল, ‘আমি তোমার থেকে দয়াময়ের শরণ নিচ্ছি যদি তুমি মুত্তাকী হও।’ সে বলল, ‘আমি তো তোমার প্রতিপালক প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্যে।’ মারয়াম বলল, ‘কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই?’ সে বলল, ‘এরূপই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এটা আমার জন্যে সহজসাধ্য এবং আমি তাকে এ জন্যে সৃষ্টি করব, যেন সে হয় মানুষের জন্যে এক নিদর্শন ও আমার নিকট হতে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’ তারপর সে গর্ভে তাকে ধারণ করল; তারপর তাকে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব-বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, ‘হায়, এর পূর্বে আমি যদি মারা যেতাম ও লোকের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম!’ ফিরিশতা তার নীচ দিক থেকে আহ্বান করে তাকে বলল, “তুমি দুঃখ করো না, তোমার নীচ দিয়ে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কাণ্ডে নাড়া দাও, তা তোমাকে পাকা তাজা খেজুর দান করবে। সুতরাং আহার কর, পান কর ও চোখ জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখ, তখন বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতাবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে বাক্যালাপ করব না।’ তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হল; তারা বলল, “হে মারয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছ। হে হারূনের বোন! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মা ছিল না ব্যভিচারিণী।” তারপর মারয়াম সন্তানের প্রতি ইংগিত করল। তারা বলল, ‘যে কোলের শিশু, তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?’ সে বলল, “আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেন নি উদ্ধত ও হতভাগ্য। আমার প্রতি শান্তি যে দিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুত্থিত হব।” এই-ই মারয়াম-তনয় ঈসা। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে তারা বির্তক করে। সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর কাজ নয়, তিনি পবিত্র মহিমময়। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, হও এবং তা হয়ে যায়। আল্লাহই আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক; সুতরাং তার ইবাদত কর, এটাই সরল পথ। তারপর দলগুলি নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল; সুতরাং দুর্ভোগ কাফিরদের মহা দিবস আগমন কালে।” (১৯ মারয়ামঃ ১৬-৩৭)

আল্লাহ কুরআন মজীদে মারয়াম ও ঈসা (আ)-এর ঘটনাকে যাকারিয়ার ঘটনার পর পরই আলোচনা করেছেন। মারয়ামের ঘটনার পটভূমি রূপে যাকারিয়ার ঘটনাটি বর্ণনার পর এই ঘটনাটি আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করেছেন, সূরা আলে-ইমরানে উভয় ঘটনা একই সাথে বর্ণিত হয়েছে। সূরা আম্বিয়ায় ঘটনাদ্বয়কে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “এবং স্মরণ কর যাকারিয়ার কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করেছিলঃ হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রেখো না। তুমি তো শ্রেষ্ঠ মালিকানার অধিকারী। তারপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম ইয়াহয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করেছিলাম। তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করতো, তারা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত। এবং স্মরণ কর সেই নারীর কথা, যে নিজ সতীত্বকে রক্ষা করছিল। তারপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ্ ফুকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে করেছিলাম বিশ্ববাসীর জন্যে এক নিদর্শন।” (২১ আম্বিয়াঃ ৮৯-৯১)

ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, মারয়ামকে তার মা বায়তুল মুকাদ্দাসের খিদমতের জন্যে উৎসর্গ করেছিলেন। সেখানে মারয়ামের বোনের স্বামী বা খালার স্বামী যাকারিয়া তাঁর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যিনি ছিলেন ঐ যামানার নবী। যাকারিয়্যা (আ) মারয়ামের জন্যে বায়তুল মুকাদ্দাসে একটি উত্তম কক্ষ বরাদ্দ করেন। সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। প্রাপ্ত বয়স্কা হলে মারয়াম আল্লাহর ইবাদতে এতো গভীরভাবে নিমগ্ন হন যে, সে যুগে তার মত এত অধিক ইবাদতকারী অন্য কেউ ছিল না তার থেকে এমন সব অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেতে থাকে, যা দেখে হযরত যাকারিয়্যার (আ) মনে ঈর্ষার উদ্রেক হয়। একদা ফিরিশতা তাঁকে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তাঁকে বিশেষ উদ্দেশ্যে মনোনীত করেছেন; অচিরেই তাঁর এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবেন, তিনি হবেন পূত-পবিত্র সম্মানিত নবী ও বিভিন্ন মুজিযার অধিকারী। পিতা ব্যতীত সন্তান হওয়ার সংবাদে মারয়াম অবাক হয়ে যান। তিনি বললেন, ‘আমার বিবাহ হয়নি, স্বামী নেই, কিরূপে আমার সন্তান হবে?’ জবাবে ফিরিশতা জানালেন, ‘আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম। তিনি যখন কোন কিছু অস্তিত্বে আনতে চান, তখন শুধু বলেন ‘হয়ে যাও’ অমনি তা হয়ে যায়।’ মারয়াম অতঃপর আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর বিনয়ের সাথে আত্মসমর্পণ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর সম্মুখে এক বিরাট পরীক্ষা। কেননা, সাধারণ লোক এতে সমালোচনার ঝড় উঠাবে। আল্লাহর শক্তি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকার ফলে শুধু বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করেই তারা নানা কথা উঠাতে থাকবে। বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থানকালে বিভিন্ন প্রয়োজনে মারয়াম কখনও কখনও মসজিদের বাইরে আসতেন। যেমন মাসিক ঋতুস্রাব হলে কিংবা পানি ও খাদ্যের সন্ধানে অথবা অন্য কোন অতি প্রয়োজনীয় কাজে তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতেন। একদা এ জাতীয় এক বিশেষ প্রয়োজনে তিনি মসজিদ থেকে বের হলেন এবং দূরে এক স্থানে আশ্রয় নিলেন অর্থাৎ তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের পূর্ব দিকে অনেক দূর পর্যন্ত একাকী চলে যান। আল্লাহ হযরত জিবরাঈল আমীনকে তথায় প্রেরণ করেন। জিবরাঈল (আ) মারয়ামের নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারয়াম তাকে দেখেই বলে উঠলেন, “আমি তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করি যদি তুমি আল্লাহ ভীরু হও।” আবুল আলিয়া বলেন, আয়াতে উল্লেখিত ‘তাকিয়্যা’ বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলে, নিষিদ্ধ কাজকে যে ভয় করে। একটি দুর্বল মত অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের এক বিখ্যাত লম্পটের নাম ছিল তাকিয়্যা। মারয়ামের নিকট জিবরাঈল মানবাকৃতিতে উপস্থিত হলে তাকে তাকিয়্যা ভেবে তিনি এ কথাটি বলেছিলেন। এ মতটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও একান্তই দুর্বল; এর কোন ভিত্তি বা দলীল প্রমাণ নেই।

জিবরাঈল (আ) বলল, “আমি তো শুধু তোমার পালনকর্তার প্রেরিত এক দূত।” অর্থাৎ আমি মানুষ নই—যা তুমি ভেবেছ; বরং আমি ফিরিশতা। আল্লাহ তোমার নিকট আমাকে প্রেরণ করেছেন। তোমাকে আমি এক পবিত্র পুত্র দান করে যাব। মারয়াম বলল, “কিরূপে আমার পুত্র হবে যখন কোন মানব আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও কখনও ছিলাম না।” অর্থাৎ আমার এখনও বিবাহ হয়নি এবং আমি কখনও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হইনি —এমতাবস্থায় আমার সন্তান হবে কিভাবে? সে বলল, ‘এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্যে সহজসাধ্য।’ অর্থাৎ পুত্র হওয়ার সংবাদে মারয়াম বিস্ময় প্রকাশ করে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তার উত্তরে ফিরিশতা বললেন, স্বামী না থাকা সত্ত্বেও এবং ব্যভিচারিণী না হওয়া সত্ত্বেও তোমার পুত্র সন্তান সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; আর তার জন্যে এ কাজ অতি সহজ। কেননা, তিনি যা ইচ্ছা করেন সব কিছুই করতে পারেন। অতঃপর আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাকে মানুষের জন্যে একটি নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ করতে চাই।" অর্থাৎ এই অবস্থায় তাকে সৃষ্টি করে আমি বিভিন্ন পন্থায় আমার সৃষ্টি কৌশলের ক্ষমতার দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাই। কেননা, আল্লাহ আদমকে নর-নারী ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন নারী ছাড়া নর থেকে, ঈসাকে সৃষ্টি করেছেন নর ছাড়া নারী থেকে এবং অন্যান্য সবাইকে সৃষ্টি করেছেন নর ও নারী উভয় থেকে। “আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ”—এ কথার অর্থ হল-এই ঈসার সাহায্যে আমি মানুষের প্রতি আমার অনুগ্রহ প্রকাশ করতে চাই। কেননা, সে তার শৈশবে মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের দিকে আহ্বান করবে এবং আল্লাহকে স্ত্রী, সন্তান, অংশীদার সমকক্ষ, শরীক ও সাদৃশ্য থেকে মুক্ত থাকার বাণী প্রচার করবে।

( وَكَانَ أَمۡر ا مَّقۡضِیّ ࣰا)

[Surah Maryam 21]

“এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার”-এ কথাটিকে দুই অর্থে নেয়া যায়, যথাঃ এক, মারয়ামের সাথে জিবরাঈলের যে কথাবার্তা হয়, এটা ছিল তার শেষ কথা। অর্থাৎ এ বিষয়টি আল্লাহ চূড়ান্ত করে ফেলেছেন যার বাস্তবায়ন অবধারিত এবং যা অবশ্যই সংঘটিত হবে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক এই অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং ইবন জারীর এটা সমর্থন করেছেন। দুই, মারয়ামের মধ্যে জিরবাঈল (আ) কর্তৃক ঈসার রূহকে ফুকে দেওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা তাহরীমে আল্লাহ বলেছেনঃ “আল্লাহ মু’মিনদের জন্যে আরও উপস্থিত করছেন, ইমরান তনয়া মারয়ামের দৃষ্টান্ত - যে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল, ফলে আমি তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম।” (৬৬ তাহরীমঃ ১২)

জিবরাঈল (আ) কিভাবে ফুঁক দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে একাধিক মুফাসসির লিখেছেন যে, জিবরাঈল হযরত মারয়ামের জামার আস্তিনে ফুঁক দিয়েছিলেন। ঐ ফুঁক জামার মধ্যে দিয়ে তার গুপ্ত অংগে প্রবেশ করে এবং সংগে সংগে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন, যেরূপ নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে থাকে স্বামীর সাথে সহবাসের মাধ্যমে। যারা বলেছেন, জিবরাঈল (আ) মারয়ামের মুখে ফুঁক দিয়েছিলেন অথবা মারয়ামের সাথে কথোপকথনকারী ছিলেন স্বয়ং ঐ রূহু, যা তার মুখের মধ্য দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। তাদের এই বক্তব্য কুরআনের বর্ণনা ধারার পরিপন্থি। কারণ মারয়ামের ঘটনার বর্ণনা পদ্ধতি থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, মারয়ামের নিকট যাকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন একজন ফিরিশতা এবং সেই ফিরিশতা হলেন হযরত জিবরাঈল আমীন (আ)। আর তিনিই তাঁর মধ্যে ফুঁক দিয়েছিলেন। ফিরিশতা মারয়ামের গুপ্তসংগে ফুঁক দেননি। বরং তিনি মারয়ামের জামার আস্তিনে ফুঁক দিয়েছিলেন। সেই ফুঁক ভিতর দিয়ে গুপ্ত অংগে অবতরণ করে। এভাবেই মারয়ামের মধ্যে ফিরিশতার ফুঁক প্রবেশ করে, যেমন আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিই।” এ বাণী থেকে বুঝা যায় যে, ফুঁক তার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তবে তা মুখের মধ্য দিয়ে নয়-যেমন উবায় ইবন কা’ব বলেছেন, কিংবা তার বক্ষ দিয়ে প্রবেশ করেনি- যেমন সুদ্দী কোন কোন সাহাবার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন। তাই আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর সে গর্ভে সন্তান ধারণ করল” অর্থাৎ তার পুত্র গর্ভে এল এবং তাকে নিয়ে সে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। কেননা, গর্ভে সন্তান আসার পর মারয়ামের অন্তরে স্বাভাবিক ভাবেই সংকোচ সৃষ্টি হয়। তিনি বুঝতে পারলেন, অচিরেই লোকজন তার প্রসংগে নানা কথা ছড়াবে। প্রথম যুগের একাধিক তাফসীরবিদ এ ব্যাপারে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

ওহাব ইবন মুনাবিহ বলেন, মারয়ামের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি টের পায়, সে হল বনী ইসরাঈলের ইউসুফ ইবন ইয়াকূব আন-নাজ্জার নামক এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন মারয়ামেরই খালাত ভাই। মারয়ামের পূত-পবিত্র চরিত্র, তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও দীনদারী সম্পর্কে তিনি ভালভাবেই অবগত ছিলেন। কিন্তু বিবাহ ব্যতীত অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তিনি ভীষণভাবে বিস্মিত হন। একদিন তিনি মারয়ামকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মারয়াম! বল তো বীজ ছাড়াই কি শস্য হয় কখনও?’ মারয়াম বললেন, ‘কেন হবে না? সর্বপ্রথম শস্য কিভাবে সৃষ্টি হল?’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৃষ্টি ও পানি ব্যতীত কি বৃক্ষ জন্মায়?’ মারয়াম বললেন, ‘জন্মায় বৈ কি? না হলে প্রথম বৃক্ষের জন্ম হল কিভাবে?’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, পুরুষের স্পর্শ ব্যতীত কি সন্তান জন্মগ্রহণ করে?’ মারয়াম বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়। আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করছিলেন নর-নারী ব্যতীত;’ এরপর তিনি বললেন, ‘এখন তোমার ব্যাপারটা আমাকে খুলে বল, কি হয়েছে?’ মারয়াম বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে তার এক বাণীর সুসংবাদ দিয়েছেন, “যার নাম হল মসীহ্ মারয়াম তনয় ঈসা; দুনিয়া ও আখিরাতের সে মহা সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত। যখন সে মায়ের কোলে থাকবে এবং পূর্ণ বয়স্ক হবে তখন সে মানুষের সংগে কথা বলবে, আর সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” বর্ণিত আছে যে, হযরত যাকারিয়া (আ)-ও মারয়ামকে এ ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন এবং তিনি তাকেও অনুরূপ উত্তর দিয়েছিলেন।

সুদ্দী সনদ উল্লেখ পূর্বক কতিপয় সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একদা মারয়াম তার বোনের নিকট উপস্থিত হন। বোন তাঁকে বললেন, ‘আমি যে অন্তঃসত্বা, তা’কি তুমি টের পেয়েছো?’ মারয়াম বললেন, ‘আমিও যে অন্তঃসত্বা?’ তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন ও আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর ইয়াহ্ইয়ার মা বললেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার পেটে যে সন্তান আছে সে তোমার পেটের সন্তানকে সিজদা করছে।’

কুরআন মজীদের আয়াতে সে ইংগিতই রয়েছে। “সে (ইয়াহইয়া) হবে আল্লাহর বাণীর সমর্থক।” হাদীসে উক্ত সিজদা বলতে এখানে বিনয় ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা বুঝানো হয়েছে। যেমন সালাম করার সময় করা হয়। পূর্বেকার শরীয়তে এ রকম নিয়ম চালু ছিল। আল্লাহ আদম (আ)-কে সিজদা করার জন্যে ফেরেশতাদেরকে যে হুকুম দিয়েছিলেন, সেটাও এই অর্থেই ছিল। আবুল কাসিম বলেন যে, সিজদা সংক্রান্ত উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিক (র) বলেছেন, আমার ধারণা, এটা ঈসা (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝানোর জন্যে ছিল। কেননা, আল্লাহ তাঁকে মৃতকে জীবিত করার এবং অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করার ক্ষমতা দান করেছিলেন।

ইবন আবি হাতিম এটি বর্ণনা করেছেন। মুজাহিদ থেকে বর্ণিত আছে, মারয়াম বলতেন, আমি যখন একাকী নির্জনে থাকতাম, তখন আমার পেটের বাচ্চা আমার সাথে কথা বলত। আর যখন আমি লোক সমাজে থাকতাম, তখন সে আমার পেটের মধ্যে তাসবীহ পাঠ করত।

স্পষ্টত মারয়াম অন্যান্য নারীদের মত স্বাভাবিকভাবে নয় মাস গর্ভ ধারণের পর প্রসব করেছিলেন। কেননা, এর ব্যতিক্রম হলে তার উল্লেখ করা হত। ইকরিমা ও ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর এ গর্ভকাল ছিল আট মাস। ইবন আব্বাসের অপর বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি গর্ভধারণ মাত্রই সন্তান প্রসব করেছিলেন। আবার কেউ কেউ তাঁর গর্ভকাল মাত্র নয় ঘন্টা স্থায়ী ছিল বলে বলেছেন।

এ মতের সমর্থনে নিম্নের আয়াতের উল্লেখ করেছেনঃ “তৎপর সে গর্ভে তাকে ধারণ করল। অতঃপর তৎসহ এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর বৃক্ষ মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল।” (১৯ মারয়াম ২২-২৩) ف (অতঃপর) অক্ষরটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং এ অক্ষরটি দু’টি কাজের মধ্যে স্বল্প সময়ের ব্যবধান বুঝাবার জন্যে ব্যবহৃত হয়। তবে বিশুদ্ধতর মত হল, একটি কাজ বা ঘটনার পর আর একটি কাজ বা ঘটনা তার স্বাভাবিক ব্যবধান সহ আসে। যেমন সূরা হাজ্জে আল্লাহ বলেন, “তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ বারি বর্ষণ করেন আকাশ হতে অতঃপর সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে পৃথিবী?” (২২ঃ ৬৩) (এখানে স্পষ্ট যে, বারি বর্ষণের অল্পক্ষণ পরেই পৃথিবী সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে না; বরং স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবধানের পরেই সে রকম হয়।) অনুরূপ সূরা মু’মিনূনে আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর আমি শুক্র বিন্দুকে পরিণত করি আলাকে। এবং আলাককে পরিণত করি অস্থিপুঞ্জরে অতঃপর অস্থিপুঞ্জকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা। অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান।” (২৩ঃ১৩)

আয়াতে বর্ণিত মানব সৃষ্টির প্রতিটি পর্যায় অতিক্রম করতে সময় লাগে চল্লিশ দিন। এ কথা বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে আছে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক লিখেছেন, গোটা বনী ইসরাঈলের মধ্যে এ সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, মারয়াম অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। এতে যাকারিয়া পরিবার দুঃখ শোকে সর্বাধিক মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কোন কোন ধর্মহীন ব্যক্তি (যিনদীক) জনৈক ইউসুফের দ্বারা এরূপ হয়েছে বলে অপবাদ রটায়। ইউসুফ বায়তুল মুকাদ্দাসে একই সময়ে ইবাদত বন্দেগী করতেন। মারয়াম লোকালয় থেকে বহু দূরে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আল্লাহ বলেন, “প্রসব বেদনা তাকে এক খর্জুর- বৃক্ষ তলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল।” ইমাম নাসাঈ (র) আনাস (রা) থেকে এবং বায়হাকী শাদ্দাদ ইবন আওস থেকে নির্দোষ সনদে মারফু হাদীছ বর্ণনা করেন যে, যে স্থানে মারয়াম আশ্রয় নিয়েছিলেন সে স্থানের নাম বায়তে লাহম (বেথেলহাম)। পরবর্তীকালে জনৈক রোমান সম্রাট ঐ স্থানে একটি সৌধ নির্মাণ করেন। সে স্মৃতি সৌধ সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।

আল্লাহর বাণী, “মারয়াম বলল হায়, আমি যদি কোনরূপে এর পূর্বে মারা যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতাম!” মারয়ামের এ মৃত্যু কামনা থেকে দলীল গ্রহণ করা হয়ে থাকে যে, ফিতনা বা মহা বিপদকালে মৃত্যু কামনা করা বৈধ। মারয়ামও এরূপ মহা-বিপদকালে মৃত্যু কামনা করেছিলেন। কেননা তিনি নিশ্চিত রূপেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমার ইবাদত-বন্দেগী, পবিত্রতা, সার্বক্ষণিক মসজিদে অবস্থান ও ইতিকাফ করা, নবী পরিবারের লোক হওয়া ও দীনদারী সম্পর্কে লোকজন যতই অবগত থাকুক না কেন, যখনই আমি সন্তান কোলে নিয়ে তাদের মাঝে আসব তখনই তারা আমার বিরুদ্ধে অপবাদ দিবে। আমি যতই সত্য কথা বলি না কেন, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করবে।

এসব চিন্তা করেই তিনি উপরোক্ত কামনা করেন যে, এ অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার আগেই যদি আমার মৃত্যু হয়ে যেত! কিংবা মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতাম!” অর্থাৎ যদি আমার জন্মই না হত!

আল্লাহর বাণী, “অতঃপর নিম্ন দিক থেকে তাকে আহবান করল” কে এই আহবানকারী? আত্তফী (র) ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ননা করেন যে, তিনি ছিলেন জিবরীল ফিরিশতা। শিশু ঈসা আহবানকারী নন; কেননা জনসম্মুখে যাওয়ার পূর্বে ঈসা (আ)-এর মুখ থেকে কোন কথা বের হয়নি। সাঈদ ইবন জুবায়র, আমর ইবন মায়মূন, যাহহাক, সুদ্দী ও কাতাদা এরূপই বলেছেন। কিন্তু মুজাহিদ, হাসান, ইবন যায়দ এবং সাঈদ ইবন জুবায়রের এক বর্ণনা মতে এই আহবানকারী ছিলেন, শিশু ঈসা (আ)। ইবন জারীর এই মতের সমর্থক।

আল্লাহর বাণীঃ “তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি নহর সৃষ্টি করেছেন।” سريا এর অর্থ অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে ছোট নহর। তাবারানী এ প্রসংগে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন; কিন্তু সে হাদীছের সনদ দুর্বল। ইবন জারীর এ মত সমর্থন করেন এবং এটি বিশুদ্ধ মত। পক্ষান্তরে, হাসান, রাবী ইবন আনাস, ইব্‌ন আসলাম প্রমুখ মনীষীদের মতে سريا দ্বারা এখানে শিশু পুত্র ঈসাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, প্রথম মতই সঠিক। আল্লাহ বলেন, “তুমি নিজের দিকে খেজুর গাছের কাণ্ডে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার উপর সুপক্ক তাজা খেজুর পতিত হবে।” আল্লাহ এ দু’ আয়াতে প্রথমে পানি ও পরে খাদ্যের ব্যবস্থার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তাই পরবর্তী আয়াতে বলেন; “এখন আহার কর, পান কর ও চক্ষু শীতল কর।” কেউ বলেছন, খেজুর গাছটির কাণ্ডটি শুষ্ক ছিল। কেউ বলেছেন, শুষ্ক নয় ফলবান ছিল। এ রকম হওয়াও সম্ভব যে, খেজুর গাছটি তাজা ছিল, কিন্তু ঐ সময় তাতে ফল ছিল না। কেননা ঈসা (আ)-এর জন্ম হয়েছিল শীতকালে। আর শীতকাল খেজুর ফলের মওসুম নয়। মারয়ামের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ সূচক বাণী, “তোমার উপর সুপক্ক তাজা ফল পতিত হবে” থেকে এই শেষোক্ত মতের সমর্থন বুঝা যায়। আমর ইবন মায়মুন বলেন, প্রসূতিদের জন্য খুরমা ও সুপক্ক তাজা খেজুরের চেয়ে অধিক উৎকৃষ্ট খাদ্য আর নেই। এ কথা বলার পর তিনি উপরোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন। ইবন আবি হাতিম....... আলী ইবন আবি তালিব (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ খেজুর গাছকে তোমরা ভালবাস, সে তোমাদের ফুফু। কেননা তোমাদের পিতা আদমকে যে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই মাটি থেকেই খেজুর গাছের সৃষ্টি আর খেজুর গাছ ব্যতীত অন্য কোন গাছের নর-মাদার প্রজনন করা হয় না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমাদের স্ত্রীগণ যেন শিশু সন্তানকে তাজা খেজুর খাওয়ায়। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যায় তা হলে অন্তত খুরমা যেন খেতে দেয়। জেনে রেখো, আল্লাহর নিকট সেই বৃক্ষের চেয়ে উত্তম কোন বৃক্ষ নেই, যে বৃক্ষের নীচে মারয়াম বিনত ইমরান অবতরণ করেছিলেন। এ হাদীসটি আবু ইয়ালাও তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহর বাণীঃ “যদি মানুষের মধ্যে কাউকে তুমি দেখ, তবে বলে দিওঃ “আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সওম মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না।” মারয়ামকে তার নীচের দিক থেকে যিনি আহবান করেছিলেন সেই আহবানকারীর কথা এই পর্যন্ত শেষ হল। “তুমি যদি কোন লোককে দেখ, তবে তাকে বলে দিও” এখানে মুখ দিয়ে কথা বলা নয় বরং ইশারা করে ও আপন অবস্থার প্রতি ইংগিত করার কথা বুঝানো হয়েছে। “আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সওম মানত করেছি। এখানে সওম অর্থ চুপ থাকা ও মৌনতা অবলম্বন করা। সে যুগের শরীআতে পানাহার ও বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকাকে সওম বলা হত। কাতাদা, সুদ্দী ও ইবন আসলাম এ কথা বলেছেন। পরবর্তী আয়াতের দ্বারা তা বুঝা যায়। “আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না।” কিন্তু আমাদের শরীআতে কোন রোযাদার ব্যক্তি যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুপচাপ থাকে ও মৌনতা অবলম্বন করে কাটায় তবে তার রোযা মাকরূহ হয়ে যায়।

আল্লাহর বাণীঃ “অতঃপর মারয়াম সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল। তারা বললঃ “হে মারয়াম, তুমি তো একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছ। হে হারূন-ভগিনী, তোমার পিতা তো অসৎ লোক ছিল না এবং তোমার মা-ও ছিল না ব্যভিচারিণী।” আহলি-কিতাবদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রাথমিক যুগের বহু সংখ্যক আলিম বলেন যে, মারয়ামের সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন দেখল, মারয়াম তাদের মাঝে নেই, তখন তারা তার সন্ধানে বের হয়। অবশেষে তারা মারয়ামের নিকট পৌঁছে সে স্থানটিকে জ্যোতির্ময় দেখতে পেল এবং তার সাথে নবজাত সন্তান দেখে বলল, হে মারয়াম, তুমি তো এক বড় ধরনের অপরাধ করে বসেছ। কিন্তু তাদের এই বক্তব্য সংশয়মুক্ত নয়। এর প্রথম অংশ শেষ অংশের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, কুরআনের ভাষ্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, মারয়াম তার নবজাত শিশুকে নিজে কোলে নিয়ে সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেছেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার চল্লিশ দিন পর ও নিফাসের ইদ্দত থেকে পবিত্র হওয়ার পর মারয়াম সম্প্রদায়ের নিকট এসেছিলেন।

মোটকথা, মারয়ামের সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন তার কোলে নবজাত শিশু সন্তানকে দেখল তখন বললঃ “হে মারয়াম! তুমি তো এক বিরাট অন্যায় কাজ করে ফেলেছ।” ( فرية و فريا ) হচ্ছে যে কোন গুরুতর অপকর্ম বা জঘন্য উক্তি। অতঃপর তারা মারয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হে হারূনের বোন!” এই হারূন কে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। এক মতানুযায়ী ঐ যুগে হারূন নামে একজন সুপ্রসিদ্ধ ইবাদতকারী লোক ছিলেন। মারয়াম বেশী পরিমাণ ইবাদত করে তাঁর সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন। এই সাদৃশ্যের জন্যই মারয়ামকে হারূনের বোন বলা হয়েছে। সাঈদ ইবন জুবায়র বলেন, ঐ যুগে হারূন নামে এক জঘন্য লোক ছিল। তার সাথে তুলনা করে হারূনের বোন বলা হয়েছে। তৃতীয় মতানুযায়ী ইনি মূসা (আ)-এর ভাই হারূন। তাঁর ইবাদতের সাথে মারয়ামের ইবাদতের সাদৃশ্য থাকায় এখানে হারূনের বোন বলা হয়েছে। চতুর্থ মত মুহাম্মদ ইবন কাব আল-কুরাজীর, যাতে বলা হয়েছে, এই মারয়াম মূসা ও হারূন (আ)-এর সহোদর বোন। সে কারণে হারূনের বোন বলা হয়েছে। কিন্তু এ মতটি যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তা সামান্য শিক্ষিত লোকের কাছেও স্পষ্ট। কেননা ঈসার মা মারয়াম ও হারূন-মূসার মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান রয়েছে। তবে মুহাম্মদ কুরাজী সম্ভবত তাওরাতের একটি বর্ণনা থেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। ঐ বর্ণনায় আছে, যে তারিখে আল্লাহ্ মূসা (আ)-কে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফিরআউন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন, প্রতি বছর সেই তারিখে মূসা ও হারূনের বোন মারয়াম আনন্দে ঢোল পিটাতেন। কুরাজী মনে করেছেন এই মারয়াম ও ঐ মারয়াম অভিন্ন। কিন্তু তার এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তা ছাড়া এটা সহীহ হাদীস ও কুরআনী বর্ণনার পরিপন্থী। তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। পঞ্চম মতে, হারূন মারয়ামেরই সহোদর ভাই। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ঈসার মা মারয়ামের হারুন নামে এক ভাই ছিলেন। মারয়ামের জন্ম ও তাঁর মা কর্তৃক মানত করার ঘটনায় কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে, মারয়াম তার বাপ মায়ের একমাত্র কন্যা ছিলেন, তার কোন ভাই ছিল না।

ইমাম আহমদ ...... মুগীরা ইবন শুবা থেকে বর্ণিত। মুগীরা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে নাজরানে প্রেরণ করেন। নাজরানবাসীরা আমাকে বলল, আপনারা কুরআনে পড়েন ( يا اخت هارون ) হে হারূনের বোন! কিন্তু এর অর্থের দিকে কি লক্ষ্য করেছেন? কেননা হারূনের ভাই মূসা ও মারয়াম-তনয় ঈসার মাঝে তো সময়ের বিরাট ব্যবধান। মুগীরা বলেন, আমি মদীনায় ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিষয়টি জানাই। তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এ কথা কেন বললে না যে, মানুষ তখন পূর্ববর্তী নবী ও সত্যনিষ্ঠ লোকের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখত। ইমাম মুসলিম, নাসাঈ ও তিরমিযী এ হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন ইদরীস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী একে হাসান, সহীহ ও গরীব আখ্যায়িত করে বলেছেন, ইবন ইদ্রীস ব্যতীত অন্য কারও থেকে আমরা এ হাদীস পাইনি। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ তাদেরকে তুমি কেন এ উত্তর দিলে না যে, তারা তাদের পূর্ববর্তী সৎলোক ও নবীদের নামের অনুসরণে নাম রাখত। কাতাদা প্রমুখ আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, সে সময়ে প্রচুর লোকের নাম রাখা হত হারূন বলে। কথিত আছে, একবার তাদের এক জানাযায় বহু লোক উপস্থিত হয়। তন্মধ্যে হারূন নামধারী লোকের সংখ্যাই ছিল চল্লিশ হাজার।

মোটকথা, তারা বলেছিল, “হে হারুনের বোন" এবং হাদীস থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হারূন নামে মারয়ামের এক জ্ঞাতি ভাই ছিলেন এবং দীনদারী ও পরহেযগারীতে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। তখন তারা বললঃ “তোমার পিতা অসৎ লোক ছিলেন না এবং তোমার মা-ও ছিলেন না ব্যভিচারিণী। অর্থাৎ তুমি তো এমন পরিবারের মেয়ে নও, যাদের চরিত্র এত নীচু পর্যায়ের। তোমার পরিবারের কেউই তো মন্দ কাজে জড়িত ছিল না। তোমার ভাই, পিতা ও মাতা কেউ তো এরূপ ছিলেন না। এভাবে তারা মারয়ামের চরিত্রে কলংক লেপে দিল এবং মহা অপবাদ আরোপ করল। ইবন জারীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, তারা হযরত যাকারিয়া (আ) এর উপর অসৎ কর্মের অপবাদ দেয় এবং তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। যাকারিয়া (আ) সেখান থেকে পলায়ন করলে তারাও তার পিছু ধাওয়া করে। সম্মুখে একটি গাছে তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। তিনি তার মধ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু ইবলীস তার চাদরের আঁচল টেনে ধরে। তখন তারা গাছটি সহ তাঁকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়।

কতিপয় মুনাফিক মারয়ামকে তার খালাত ভাই ইউসুফ ইবন ইয়াকূব আল-নাজ্জারকে জড়িয়ে অপবাদ দেয়। সম্প্রদায়ের লোকদের এ সব অপবাদের মুখে মারয়ামের অবস্থা যখন সঙ্গীন হয়ে পড়ল, বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে গেল এবং নিজেকে অপবাদ থেকে মুক্ত করার কোন উপায়ই রইলো না, তখন তিনি মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে “হাত দ্বারা সন্তানের দিকে ইংগিত করলেন।” অর্থাৎ সন্তানের দিকে ইংগিত করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমরা ওর কাছে জিজ্ঞেস কর এবং তার সাথে কথা বল। কেননা, তোমাদের প্রশ্নের জওয়াব তার কাছে পাওয়া যাবে এবং তোমরা যা শুনতে চাচ্ছ, তা তার কাছেই আছে। তখন উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে দুষ্ট-দুর্দান্ত প্রকৃতির লোকেরা বললঃ “যে কোলের শিশু, তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?” অর্থাৎ তুমি আমাদের প্রশ্নের উত্তর অবুঝ শিশু বাচ্চার উপর কি করে ছেড়ে দিলে? সে তো সবেমাত্র কোলের শিশু। যে মাখন ও ঘোলের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না। তুমি আমাদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছ এবং মুখ দ্বারা কথা না বলে, অবুঝ শিশুর দিকে ইংগিত করে আমাদের সাথে উপহাস করছ। ঠিক এমন সময় শিশু ঈসা বলে উঠলেনঃ “আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে এবং মায়ের অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নি। আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি। যে দিন মৃত্যুবরণ করব এবং যে দিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব।” (১৯ মারয়াম ৩০-৩২)

এই হল ঈসা (আ) এর মুখ থেকে প্রকাশিত প্রথম কথা।

সর্বপ্রথম তিনি বললেনঃ “আমি আল্লাহর বান্দা", এ কথার দ্বারা তিনি আল্লাহর দাসত্বকে স্বীকার করে নেন এবং আল্লাহ্ যে তাঁর প্রতিপালক এ কথার ঘোষণা দেন। ফলে জালিম লোকেরা দাবি করে যে, ঈসা (আ) আল্লাহর পুত্র, এ থেকে আল্লাহ যে পবিত্র তা তিনি ঘোষণা করেন। ঈসা আল্লাহর পুত্র নন বরং তিনি যে, তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং তাঁর এক দাসীর পুত্র একথাও ঘোষণা করেন। এরপর জাহিল লোকেরা তাঁর মায়ের উপর যে অপবাদ দিয়েছিল সে অপবাদ থেকে তার মা যে পবিত্র ছিলেন সে সম্পর্কে বলেন, “আল্লাহ আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী করেছেন।” কেননা আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে নবুওত দান করেন না, যার জন্ম হয় ব্যভিচারের মাধ্যমে। অথচ ঐসব অভিশপ্ত লোকগুলো ঈসা (আ)-এর প্রতি সেরূপ কুৎসিৎ ধারণাই পোষণ করেছিল। সূরা নিসায় আল্লাহ বলেন, “তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে এবং মারয়ামের প্রতি গুরুতর অপবাদ দেওয়ার জন্যে।” (৪ নিসাঃ ১৫৬)

সেই যুগের কতিপয় ইহুদী এই অপবাদ রটিয়ে দিয়েছিল যে, মারয়াম ঋতুবতী অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হন। এতে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন (আল্লাহর লানত তাদের প্রতি)। আল্লাহ এ অপবাদ থেকে তাঁকে মুক্ত বলে ঘোষণা করেন এবং জানান যে, তিনি মহাসত্যবাদী তার পুত্রকে আল্লাহ নবী ও রাসূল বানিয়েছেন। শুধু নবী-রাসূলই বানাননি, সমস্ত নবীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পাঁচজনের অন্যতম করেছেন। এ দিকেই ইংগিত করে শিশু ঈসা (আ) বললেনঃ “যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন।” কেননা, তিনি যেখানেই থাকতেন সেখানেই মানুষকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানাতেন। একই সাথে আল্লাহকে স্ত্রী-পুত্র গ্রহণসহ যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়ার ঘোষণা করতেন। “তিনি আমাকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন আমি জীবিত থাকি।” এখানে বান্দার জন্যে দুটি স্থায়ী কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়েছে, যথাঃ সালাতে আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়া ও যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সৃষ্টির সেবা করা। সালাতের দ্বারা দাসত্বের গুণাবলী বিকশিত হয় আর যাকাত আদায়সহ অভাবী লোকদের সাহায্য, অতিথি সেবা, পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ, দাস-মুক্তি ও অন্যান্য সৎকাজে অর্থ ব্যয়ের দ্বারা যেমন উত্তম চরিত্র গড়ে ওঠে, তেমনি অর্থ-সম্পদও পবিত্র হয়। অতঃপর বলেনঃ “এবং নির্দেশ দিয়েছেন আমার মায়ের অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নি।” অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে মায়ের অনুগত করে সৃষ্টি করেছেন। শুধুমাত্র মায়ের আনুগত্যের কথা এ জন্যে বলেছেন যে, তিনি পিতাবিহীনই জন্মগ্রহণ করেন। মহান সেই সত্তা যিনি সমগ্র জগতের স্রষ্টা এবং যিনি তাঁর সৃষ্টিকে পবিত্র রেখেছেন এবং প্রত্যেককে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। “এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নি।” অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে পাষাণ-হৃদয় ও কর্কশভাষী করেননি এবং আল্লাহর নির্দেশ ও আনুগত্যের পরিপন্থী কোন কথা বা কাজ আমার দ্বারা হবার নয়। “আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুত্থিত হব।” উল্লেখিত তিনটি অবস্থায় শান্তির গুরুত্ব সম্পর্কে ইতিপূর্বে হযরত ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়ার বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।

এ পর্যন্ত হযরত ঈসা ইবন মারয়াম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পর আল্লাহ বলেছেনঃ “এই মারয়াম-তনয় ঈসা, আমি সত্য কথা বলে দিলাম, যে বিষয়ে লোকেরা বিতর্ক করছে। সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর কাজ নয়, তিনি পবিত্র মহিমময় সত্তা। তিনি যখন কিছু করার সিদ্ধান্ত করেন তখন বলেন, হও এবং তা হয়ে যায়।” (১৯ মারয়ামঃ ৩৪, ৩৫)

এখানে যেমন বলা হয়েছে তেমনি সূরা আলে-ইমরানেও ঈসা (আ)-এর ঘটনা বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলা হয়েছেঃ

( ذَ  ٰ⁠ لِكَ نَتۡلُوهُ عَلَیۡكَ مِنَ ٱلۡـَٔایَـٰتِ وَٱلذِّكۡرِ ٱلۡحَكِیمِ ۝ إِنَّ مَثَلَ عِیسَىٰ عِندَ ٱللَّهِ كَمَثَلِ ءَادَمَۖ خَلَقَهُۥ مِن تُرَاب ثُمَّ قَالَ لَهُۥ كُن فَیَكُونُ ۝ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُن مِّنَ ٱلۡمُمۡتَرِینَ ۝ فَمَنۡ حَاۤجَّكَ فِیهِ مِنۢ بَعۡدِ مَا جَاۤءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ فَقُلۡ تَعَالَوۡا۟ نَدۡعُ أَبۡنَاۤءَنَا وَأَبۡنَاۤءَكُمۡ وَنِسَاۤءَنَا وَنِسَاۤءَكُمۡ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمۡ ثُمَّ نَبۡتَهِلۡ فَنَجۡعَل لَّعۡنَتَ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَـٰذِبِینَ ۝ إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡقَصَصُ ٱلۡحَقُّۚ وَمَا مِنۡ إِلَـٰهٍ إِلَّا ٱللَّهُۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَهُوَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلۡحَكِیمُ ۝ فَإِن تَوَلَّوۡا۟ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَلِیمُۢ بِٱلۡمُفۡسِدِینَ ۝ )

[Surah Aal-E-Imran 58 - 63]

—যা আমি তোমার নিকট বিবৃত করছি তার নিদর্শন ও সারগর্ভ বাণী হতে। আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন, অতঃপর তাকে বলেছিলেন, ‘হও’ ফলে সে হয়ে গেল। এ সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে, সুতরাং তুমি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল, এস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজদেরকে ও তোমাদের নিজদেরকে; অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লা’নত। নিশ্চয়ই এটা সত্য বৃত্তান্ত। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ পরম প্রতাপশালী, প্রজ্ঞাময়। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত। (আল-ইমরানঃ ৫৮-৬৩)

এ কারণে নাজরান থেকে আগত প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মুবাহালার আয়াত নাযিল হয়। নাজরানের এই খৃষ্টান প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিল ষাটজন। তন্মধ্যে চৌদ্দজন ছিল নেতৃস্থানীয় এবং তিনজন ছিল সকলের শীর্ষস্থানীয়। তাদের সিদ্ধান্তই ছিল সবার জন্যে পালনীয়। তারা হল— আকিব, সায়্যিদ ও আবু হারিছা ইবন আলকামা। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে হযরত ঈসা (আ) সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়। তখন এ প্রসংগে আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের প্রথমাংশ অবতীর্ণ করেন। এতে ঈসা মাসীহ সম্পর্কে, তাঁর জন্ম ও তাঁর মায়ের জন্ম প্রসংগে আলোচনা করা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তারা যদি কথা না মানে ও তোমার আনুগত্য না করে তবে তাদের সাথে মুবাহালা (বিনীত প্রার্থনা) করবে। কিন্তু দেখা গেল, তারা মুবাহালা করা থেকে সরে দাঁড়াল এবং রাসূলুল্লাহর সাথে সন্ধি করার জন্যে অগ্রসর হল। প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা আকিব সংগী খৃষ্টানদের সম্বোধন করে বলল, তোমরা তো নিশ্চিত জান যে, মুহাম্মদ অবশ্যই আল্লাহর প্রেরিত নবী, তোমাদের নবী ঈসার সংবাদ অনুযায়ী সময়ের নির্দিষ্ট ব্যবধানে তিনি এসেছেন। তোমরা অবশ্যই অবগত আছ যে, কোন সম্প্রদায় আল্লাহর নবীর সাথে মুবাহালা করলে গোটা সম্প্রদায়ই ধ্বংস হয়ে যায়। তোমরাও যদি তার সাথে মুবাহালা কর, তবে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি মুবাহালা না কর তাহলে তোমাদের ধর্ম সুসংহত হবে এবং ঈসা (আ) সম্বন্ধে তোমাদের যে দাবি, তাও প্রতিষ্ঠিত থাকবে। সুতরাং তার সাথে সন্ধি চুক্তি করে দেশে ফিরে যাও।

অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট সন্ধির প্রস্তাব দিল এবং জিযিয়া কর ধার্যের আবেদন জানাল এবং সেই সাথে রাসূলের পক্ষ থেকে একজন নির্ভরযোগ্য লোক তাদের সংগে পাঠাবার অনুরোধ করে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আবু উবায়দা ইবন জাররাহ (রা)-কে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। সূরা আলে ইমরানের তাফসীরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সীরাতুন-নবী অধ্যায়ে এ প্রসংগে বিশদ আলোচনা করা হবে।

মোটকথা, আল্লাহ হযরত ঈসা-মাসীহর ঘটনা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আপন রাসূলকে বলেছেনঃ “এ-ই-মারয়ামের পুত্র ঈসা, সত্য কথা, যে সম্পর্কে লোকেরা বিতর্ক করে।” অর্থাৎ ঈসা (আ) আল্লাহর এক সৃষ্ট দাস। তাঁর এক দাসীর গর্ভ থেকে তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ এমন নন যে, সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা। তিনি যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত করেন, তখন এ কথাই বলেনঃ ‘হও এবং তা হয়ে যায়। অর্থাৎ কোন কিছুই তার সিদ্ধান্তকে অচল করতে পারে না। কোন কিছুর তিনি পরোয়া করেন না এবং কোন কাজে তিনি ক্লান্ত হন না। বরং তিনি সব কিছুই করতে সক্ষম, যা ইচ্ছা করেন তা-ই করে থাকেন। “তার বিষয়টা হল এমন যে, যখন কোন কিছু ইচ্ছা করেন, তখন বলেন, ‘হও’ অতঃপর তা হয়ে যায়।” এরপর তিনি বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ্ আমার পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তার ইবাদত কর। এটা সরল পথ।”

মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় হযরত ঈসার কথা এই পর্যন্ত শেষ। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তার প্রতিপালক এবং তাদেরও প্রতিপালক; তার প্রভু এবং তাদেরও প্রভু। আর এটাই সরল পথ। আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল। সুতরাং দুর্ভোগ কাফিরদের মহাদিবস আগমন কালে।” অর্থাৎ সেই যুগের ও পরবর্তী যুগের লোক হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইয়াহুদীদের এক দল বলল, ঈসা ব্যভিচার জাত সন্তান এবং এ কথার উপরই তারা অটল হয়ে থাকল। আর এক দল আরও অগ্রসর হয়ে বলল, ঈসাই আল্লাহ। অন্য দল বলল, সে আল্লাহর পুত্র। কিন্তু সৃষ্টিজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা বললেন, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর এক বাঁদীর সন্তান এবং আল্লাহর কলেমা যা মারয়ামের প্রতি প্রদান করেছিলেন এবং তিনি আল্লাহর প্রেরিত রূহ্। এই শেষোক্ত দলই মুক্তিপ্রাপ্ত। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং আল্লাহর সাহায্যপুষ্ট। যে ব্যক্তিই হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোন একটি ব্যাপারেও বিরোধিতা করবে, সেই হবে কাফির পথভ্রষ্ট ও জাহিল। এ জাতীয় লোকদেরকেই সাবধান করে আল্লাহ বলেছেনঃ “সুতরাং মহাদিবস আগমন কালে কাফিরদের জন্যে ধ্বংস।”

ইমাম বুখারী (র) সাদাকা ইবনুল ফযলের সূত্রে উবাদা ইবনুস্ সামিত (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোন অংশীদার নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল, ঈসা আল্লাহর বান্দা রাসূল, ও কলেমা, যা মারয়ামের প্রতি অর্পণ করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত রূহ্। জান্নাত জাহান্নাম সত্য। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। তার আমল যে রকম হোক না কেন। ওয়ালীদ বলেন....... রাবী জুনাদা আরও কিছু বেশী বর্ণনা করেছেন যে, জান্নাতের আটটি দরজার মধ্যে যেটি দ্বারা ইচ্ছা সে প্রবেশ করতে পারবে। ইমাম মুসলিম দাউদ ইবন রশীদের সূত্রে .... জাবির (রা) থেকে এবং অন্য সূত্রে আওযাঈ থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

২৩
আল্লাহ সন্তান গ্রহণ থেকে পবিত্র
এ প্রসংগে সূরা মারয়ামে আল্লাহ বলেনঃ

( وَقَالُوا۟ ٱتَّخَذَ ٱلرَّحۡمَـٰنُ وَلَد ا ۝ لَّقَدۡ جِئۡتُمۡ شَیۡـًٔا إِدّ ا ۝ تَكَادُ ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تُ یَتَفَطَّرۡنَ مِنۡهُ وَتَنشَقُّ ٱلۡأَرۡضُ وَتَخِرُّ ٱلۡجِبَالُ هَدًّا ۝ أَن دَعَوۡا۟ لِلرَّحۡمَـٰنِ وَلَد ا ۝ وَمَا یَنۢبَغِی لِلرَّحۡمَـٰنِ أَن یَتَّخِذَ وَلَدًا ۝ إِن كُلُّ مَن فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِ إِلَّاۤ ءَاتِی ٱلرَّحۡمَـٰنِ عَبۡد ا ۝ لَّقَدۡ أَحۡصَىٰهُمۡ وَعَدَّهُمۡ عَدّ ا ۝ وَكُلُّهُمۡ ءَاتِیهِ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ فَرۡدًا )

[Surah Maryam 88 - 95]

—তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন! তোমরা তো এক বীভৎস কথার অবতারণা করেছ; (অর্থাৎ তোমাদের এ কথা অত্যন্ত ভয়াবহ, কুরুচিপূর্ণ ও নিরেট মিথ্যা।) এতে যেন আকাশমণ্ডলী বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবে ও পর্বতমণ্ডলী চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে, যেহেতু তারা দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্যে শোভন নয়। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের নিকট বান্দারূপে উপস্থিত হবে না। তিনি তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তিনি তাদেরকে বিশেষভাবে গণনা করেছেন, এবং কিয়ামত দিবসে তাদের সকলেই তাঁর নিকট আসবে একাকী অবস্থায়। (১৯ মারয়ামঃ ৮৮-৯৫)

উক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর জন্যে মোটেই শোভনীয় নয়। কেননা তিনি সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা ও মালিক এবং সব কিছু তাঁর মুখাপেক্ষী ও অনুগত। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলেই তাঁর দাস, তিনি এ সবের প্রতিপালক। তিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই, আর কোন প্রতিপালকও নেই। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَجَعَلُوا۟ لِلَّهِ شُرَكَاۤءَ ٱلۡجِنَّ وَخَلَقَهُمۡۖ وَخَرَقُوا۟ لَهُۥ بَنِینَ وَبَنَـٰتِۭ بِغَیۡرِ عِلۡم ۚ سُبۡحَـٰنَهُۥ وَتَعَـٰلَىٰ عَمَّا یَصِفُونَ ۝ بَدِیعُ ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِۖ أَنَّىٰ یَكُونُ لَهُۥ وَلَد وَلَمۡ تَكُن لَّهُۥ صَـٰحِبَة ۖ وَخَلَقَ كُلَّ شَیۡء ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَیۡءٍ عَلِیم ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡۖ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَۖ خَـٰلِقُ كُلِّ شَیۡء فَٱعۡبُدُوهُۚ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَیۡء وَكِیل ۝ لَّا تُدۡرِكُهُ ٱلۡأَبۡصَـٰرُ وَهُوَ یُدۡرِكُ ٱلۡأَبۡصَـٰرَۖ وَهُوَ ٱللَّطِیفُ ٱلۡخَبِیرُ )

[Surah Al-An’am 100 – 103]

—তারা জিনকে আল্লাহর শরীক করে, অথচ তিনিই ওদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর প্রতি পুত্র-কন্যা আরোপ করে; তিনি পবিত্র মহিমান্বিত! এবং তারা যা বলে, তিনি তার ঊর্ধ্বে। তিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, তাঁর সন্তান হবে কিরূপে? তার তো কোন স্ত্রী নেই? তিনিই তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে তিনিই সবিশেষ অবহিত। তিনিই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক; তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই; তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা; সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদত কর; তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নহেন কিন্তু দৃষ্টি শক্তি তাঁর অধিগত এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত। (৬ আনআমঃ ১০০-১০৩)

এখানে আল্লাহ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং কিরূপে তাঁর সন্তান হতে পারে? আমরা জানি, সম-শ্রেণীর দু’জনের মিলন ব্যতীত সন্তান হয় না। আর আল্লাহর সমকক্ষ, সদৃশ ও সমশ্রেণীর কেউ নেই। অতএব, তাঁর স্ত্রীও নেই। সুতরাং তার সন্তানও হতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ۝ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ۝ لَمۡ یَلِدۡ وَلَمۡ یُولَدۡ ۝ وَلَمۡ یَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ )

[Surah Al-Ikhlas 1 - 4]

—বল, তিনিই আল্লাহ একক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নহেন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকেও জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ-ই নেই। (১১২ ইখলাসঃ ১ - ৪)।

আল্লাহ একক’ অর্থ তিনি এমন এক অস্তিত্ব যার সত্তার কোন সদৃশ নেই। গুণাবলীর কোন দৃষ্টান্ত নেই এবং কর্মকাণ্ডের কোন উদাহরণ নেই। ( ٱلصَّمَدُ ) (আস-সামাদ) এমন মনিবকে বলা হয় যার মধ্যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, করুণা ও সমস্ত গুণাবলী পরিপূর্ণভাবে থাকে। ( لَمۡ یَلِدۡ ) তিনি কাউকে জন্ম দেননি। ( وَلَمۡ یُولَدۡ ) অর্থ পূর্বের কোন কিছু থেকে তিনি সৃষ্টি নন। ( وَلَمۡ یَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ) অর্থাৎ তার সমকক্ষ, সমপর্যায়ের ও সমান আর কেউ নেই। এ আয়াতগুলো থেকে জানা গেল যে, আল্লাহর নযীর, কাছাকাছি, তার চেয়ে উর্ধ্বে বা সমপর্যায়ের অন্য কেউ নেই। সুতরাং তাঁর সন্তান হওয়ার কোন পথই খোলা নেই। কেননা সন্তান জন্ম হয় সম-জাতীয় বা অন্তত সম-শ্রেণীর কাছাকাছি দু’জনের মাধ্যমে কিন্তু আল্লাহ তার অনেক উর্ধ্বে। অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ

( یَـٰۤأَهۡلَ ٱلۡكِتَـٰبِ لَا تَغۡلُوا۟ فِی دِینِكُمۡ وَلَا تَقُولُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡحَقَّۚ إِنَّمَا ٱلۡمَسِیحُ عِیسَى ٱبۡنُ مَرۡیَمَ رَسُولُ ٱللَّهِ وَكَلِمَتُهُۥۤ أَلۡقَىٰهَاۤ إِلَىٰ مَرۡیَمَ وَرُوح مِّنۡهُۖ فَـَٔامِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦۖ وَلَا تَقُولُوا۟ ثَلَـٰثَةٌۚ ٱنتَهُوا۟ خَیۡر ا لَّكُمۡۚ إِنَّمَا ٱللَّهُ إِلَـٰه وَ  ٰ⁠ حِد ۖ سُبۡحَـٰنَهُۥۤ أَن یَكُونَ لَهُۥ وَلَد ۘ لَّهُۥ مَا فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَمَا فِی ٱلۡأَرۡضِۗ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِیل ا ۝ لَّن یَسۡتَنكِفَ ٱلۡمَسِیحُ أَن یَكُونَ عَبۡد ا لِّلَّهِ وَلَا ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةُ ٱلۡمُقَرَّبُونَۚ وَمَن یَسۡتَنكِفۡ عَنۡ عِبَادَتِهِۦ وَیَسۡتَكۡبِرۡ فَسَیَحۡشُرُهُمۡ إِلَیۡهِ جَمِیع ا ۝ فَأَمَّا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَیُوَفِّیهِمۡ أُجُورَهُمۡ وَیَزِیدُهُم مِّن فَضۡلِهِۦۖ وَأَمَّا ٱلَّذِینَ ٱسۡتَنكَفُوا۟ وَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ فَیُعَذِّبُهُمۡ عَذَابًا أَلِیم ا وَلَا یَجِدُونَ لَهُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَلِیّ ا وَلَا نَصِیر ࣰا)

[Surah An-Nisa' 171 - 173]

—হে কিতাবীগণ! দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না ও আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মারয়াম তনয় ঈসা মসীহ্ তো আল্লাহর রাসূল এবং তার বাণী, যা তিনি মারয়ামের নিকট প্রেরণ করেছিলেন ও তাঁর আদেশ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে ঈমান আন এবং বলো না তিন। নিবৃত্ত হও, এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে। আল্লাহ তো একমাত্র ইলাহ; তাঁর সন্তান হবে তিনি এ থেকে পবিত্র। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই; কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট। মসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় জ্ঞান করে না, এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাগণও করে না। এবং কেউ তাঁর ইবাদতকে হেয় জ্ঞান করলে এবং অহংকার করলে তিনি অবশ্যই তাদের সকলকে তাঁর নিকট একত্র করবেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকার্য করে তিনি তাদেরকে পূর্ণ পুরস্কার দান করবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশী দিবেন; কিন্তু যারা হেয় জ্ঞান করে ও অহংকার করে তাদেরকে তিনি মর্মন্তুদ শাস্তি দান করবেন এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের জন্যে তারা কোন অভিভাবক ও সহায় পাবে না। (৪ নিসাঃ ১৭১ - ১৭৩)

আল্লাহ আহলে কিতাব ও তাদের অনুরূপ সম্প্রদায়কে ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি ও অহংকার প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। ধর্মে বাড়াবাড়ি অর্থ আকীদা-বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্মে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা। নাসারা বা খৃষ্টান সম্প্রদায় মাসীহ্-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের উচিত ছিল তাঁকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করা এবং এই আকীদা পোষণ করা যে, তিনি আল্লাহর সতী বাঁদী কুমারী মারয়ামের সন্তান। ফিরিশতা জিবরাঈলকে আল্লাহ মারয়ামের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী মারয়ামের মধ্যে ফুঁক দেন। এই প্রক্রিয়ায় হযরত ঈসা (আ) মারয়ামের গর্ভে আসেন। ফিরিশতার ফুঁকে মারয়ামের ভিতর যে জিনিসটি প্রবেশ করে, তা’হল রুহুল্লাহ বা আল্লাহর রূহ। এই রূহ্ আল্লাহর কোন অংশ নয় বরং আল্লাহর সৃষ্টি বা মাখলুক। আল্লাহর দিকে রূহকে সম্পর্কিত করা হয়েছে সম্মানার্থে ও গুরুত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে। যেমন বলা হয়ে থাকে, বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর), নাকাতুল্লাহ (আল্লাহর উষ্ট্ৰী) আবদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) ইত্যাদি। অনুরূপ একই উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে রূহুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর রূহ। বিনা পিতায় জন্ম হওয়ায় হযরত ঈসাকে বলা হয়েছে রূহুল্লাহ্। তাঁকে কালেমাতুল্লাহ বা আল্লাহর কলেমাও (বাণী) বলা হয়। কেননা আল্লাহর এক কলেমার (বাণী) দ্বারাই তিনি অস্তিত্ব লাভ করেন। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

( إِنَّ مَثَلَ عِیسَىٰ عِندَ ٱللَّهِ كَمَثَلِ ءَادَمَۖ خَلَقَهُۥ مِن تُرَاب ثُمَّ قَالَ لَهُۥ كُن فَیَكُونُ )

[Surah Aal-E-Imran 59]

—আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তাকে বলেছিলেন, হও, ফলে সে হয়ে গেল। (৩ আলে ইমরানঃ ৫৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেনঃ “তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি অতি পবিত্র। বরং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই। সব কিছু তারই একান্ত অনুগত। আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা। এর ফলে তিনি কোন কিছু করতে সিদ্ধান্ত করেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন, ‘হও’ আর তা হয়ে যায়।” (২ বাকারাঃ ১১৬ - ১১৭)

এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “ইয়াহুদীরা বলে, উযায়র আল্লাহর পুত্র এবং খৃষ্টানরা বলে, মসীহ্ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা। পূর্বে যারা কুফরী করেছিল এরা তাদের মত কথা বলে। আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করুন! তারা কেমন করে সত্য বিমুখ হয়।” (৯ তাওবাঃ ৩০)। এখানে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইয়াহুদী ও খৃষ্টান অভিশপ্ত উভয় দলই আল্লাহর ব্যাপারে অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবি করেছে এবং ধারণা করেছে যে, আল্লাহর পুত্র সন্তান আছে। অথচ তাদের এ দাবির বহু ঊর্ধ্বে আল্লাহর মর্যাদা। আল্লাহ আরও জানিয়েছেন যে, তাদের এ দাবি সম্পূর্ণ মনগড়া। এদের পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট মানুষও এ জাতীয় মনগড়া উক্তি করেছে। তাদের সাথে এদের অন্তরের মিল রয়েছে। যেমন পথভ্রষ্ট গ্রীক দার্শনিকগণ বলেছেন, ওয়াজিবুল উজুদে ঈশ্বর বা আল্লাহ তাদের পরিভাষার আদি কারণ বা প্রথম অস্তিত্ব ( علة العلل والمبدا الاول ) থেকে আকলে আউয়াল (বুদ্ধি সত্তা) প্রকাশ পায়। অতঃপর আকলে আউয়াল থেকে দ্বিতীয় আকলে (বুদ্ধিসত্তা) প্রাণ ( نفس ) আকাশ/কক্ষপথ ( فلك ) সৃষ্টি হয়। অতঃপর দ্বিতীয় আকল থেকে অনুরূপ তিনটি সৃষ্টির উদ্ভব হয়। এভাবে চলতে চলতে বুদ্ধিসত্তা ১০টি প্রাণ ( نفس ) ৯টি এবং আকাশ/কক্ষপথ ৯ টিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটির যে সব নাম তারা উল্লেখ করেছে এবং তাদের শক্তি ও ক্ষমতার যে বর্ণনা দিয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া ও নেহাৎ ধারণা প্রসূত। তাদের বক্তব্যের অসারতা, ভ্রষ্টতা ও মুর্খতা বর্ণনা করার স্থান এটা নয়। অনুরূপ আরবের কতিপয় মুশরিক গোত্র মূর্খতাবশত বিশ্বাস করত যে, ফিরিশতাগণ আল্লাহর কন্যা। তাদের মতে, আল্লাহ মর্যাদাবান জিন সর্দারদের জামাতা। উভয়ের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে ফিরিশতা। এ সূত্রেই ফিরিশতাগণ আল্লাহর কন্যা অথচ আল্লাহ এ জাতীয় শির্ক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَجَعَلُوا۟ ٱلۡمَلَـٰۤىِٕكَةَ ٱلَّذِینَ هُمۡ عِبَـٰدُ ٱلرَّحۡمَـٰنِ إِنَـٰثًاۚ أَشَهِدُوا۟ خَلۡقَهُمۡۚ سَتُكۡتَبُ شَهَـٰدَتُهُمۡ وَیُسۡـَٔلُونَ )

[Surah Az-Zukhruf 19]

—তারা দয়াময় আল্লাহর বান্দা ফিরিশতাদেরকে নারী গণ্য করেছে; এদের সৃষ্টি কি তারা প্রত্যক্ষ করেছিল? তাদের উক্তি লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে। (৪৩ যুখরুফঃ ১৯)

এ প্রসংগে অন্যত্র আল্লাহ্ বলেনঃ “এখন তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, তোমার প্রতিপালকের জন্যেই কি রয়েছে কন্যা সন্তান এবং ওদের জন্যে পুত্র সন্তান? অথবা আমি কি ফিরিশতাদেরকে নারীরূপে সৃষ্টি করেছিলাম আর তারা তা প্রত্যক্ষ করছিল? দেখ, ওরা তো মনগড়া কথা বলে যে, আল্লাহ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ওরা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। তিনি কি পুত্র সন্তানের পরিবর্তে কন্যা সন্তান পছন্দ করতেন? তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কিরূপ বিচার কর? তবে কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তোমাদের কী সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ আছে? তোমরা সত্যবাদী হলে তোমাদের কিতাব উপস্থিত কর। ওরা আল্লাহ ও জিন জাতির মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থির করেছে, অথচ জিনেরা জানে তাদেরকেও উপস্থিত করা হবে শাস্তির জন্যে। ওরা যা বলে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র মহান। আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাগণ ব্যতীত।” ( ৩৭ আয়াতঃ ১৪৯-১৬০)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ “ওরা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তার আগে বেড়ে কথা বলো না; ওরা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। ওদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত, তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যে, যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে, “আমিই ইলাহ তিনি ব্যতীত তাকে আমি প্রতিফল দিব জাহান্নাম, এভাবেই আমি জালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।” (২১ আম্বিয়াঃ ২৬ - ২৯)।

মক্কী সূরা কাহফের শুরুতে আল্লাহ বলেনঃ “প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং এতে তিনি বক্রতা রাখেন নি। একে করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁর কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যে এবং মুমিনগণ, যারা সৎকর্ম করে, তাদেরকে এই সুসংবাদ দেবার জন্যে যে, তাদের জন্যে আছে উত্তম পুরস্কার, যাতে তারা হবে চিরস্থায়ী এবং সতর্ক করার জন্যে তাদেরকে যারা বলে যে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে ওদের কোন জ্ঞান নেই এবং ওদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। ওদের মুখ-নিঃসৃত বাক্য কী সাংঘাতিক! ওরা তো কেবল মিথ্যাই বলে।” (১৮ কাহফঃ ১-৫)

অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ “তারা বলে, আল্লাহ সন্তান প্রহণ করেছেন। তিনি মহান, পবিত্র। তিনি অভাবমুক্ত। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা তাঁরই। এ বিষয়ে তোমাদের নিকট কোন সনদ নেই। তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলছ, যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই? বল, যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। পৃথিবীতে ওদের জন্যে আছে কিছু সুখ সম্ভোগ; পরে আমারই নিকট ওদের প্রত্যাবর্তন। আর কুফরীর কারণে ওদেরকে আমি কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাব।” (১০ য়ূনুসঃ ৬৮ -৭০)

কুরআন মজীদের উপরোক্ত মক্কী আয়াতগুলোতে ইহুদী খৃষ্টান, মুশরিক ও দার্শনিকদের সমস্ত দল-উপদলের মতামতের খণ্ডন করা হয়েছে যারা অজ্ঞতাবশত, বিশ্বাস করে ও দাবি করে যে, আল্লাহর সন্তান আছে। এসব জালিমদের সীমালংঘনমূলক উক্তি থেকে আল্লাহ পবিত্র মহান।

এ জঘন্য উক্তি উচ্চারণকারীদের মধ্যে সবচাইতে প্রসিদ্ধ দল হল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। এ কারণে কুরআন মজীদে তাদের খণ্ডন করা হয়েছে সবচাইতে বেশী। তাদের স্ব-বিরোধী উক্তি, অজ্ঞতা ও জ্ঞানের দৈন্যের কথা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের এই কুফরী উক্তির মধ্যে আবার বিভিন্ন দল- উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। আর এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, বাতিল পন্থীরা নানা দলাদলি, মতবিরোধ ও স্ব-বিরোধিতার শিকার হয়েই থাকে। পক্ষান্তরে হক এর মধ্যে কোন স্ব-বিরোধ থাকে না। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَیۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُوا۟ فِیهِ ٱخۡتِلَـٰف ا كَثِیر ࣰا)

[Surah An-Nisa' 82]

—এ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও পক্ষ থেকে হত, তবে তারা তাতে অনেক অসংগতি পেত। (৪ নিসাঃ ৮২)

এ থেকে বুঝা গেল, যা হক ও সত্য, তা অভিন্ন ও অপরিবর্তিত থাকে এবং যা বাতিল ও অসত্য তা বিকৃত ও অঙ্গতিপূর্ণ হয়। এ কারণে পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত খ্রিষ্টানদের একদল বলছে যে, মাসীহ্-ই আল্লাহ; অন্য দল বলছে, মসীহ আল্লাহর পুত্র; তৃতীয় আর একদল বলছে, আল্লাহ হলেন তিন জনের তৃতীয় জন। সূরা আল মায়িদায় আল্লাহর বাণীঃ “যারা বলে, মারয়াম তনয় মসীহ-ই আল্লাহ, তারা তো কুফরী করেছেই। বল, আল্লাহ মারয়াম তনয় মসীহ, তার মাতা এবং দুনিয়ার সকলকে যদি ধ্বংস করতে ইচ্ছা করেন তবে তাকে বাধা দিবার শক্তি কার আছে? আসমান ও যমীনের এবং ওগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (৫ মায়িদাঃ ১৭)

এ আয়াতে আল্লাহ খ্রিষ্টানদের কুফরী ও অজ্ঞতার কথা প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রণকারী, সব কিছুর উপর ইচ্ছামত ক্ষমতা প্রয়োগকারী, সব কিছুর প্রভু ও পালনকারী এবং তিনি সব কিছুর রাজাধিরাজ ও উপাস্য। উক্ত সূরার শেষ দিকে আল্লাহ বলেন, “যারা বলে, আল্লাহ্-ই মারয়াম তনয় মসীহ, তারা তো কুফরী করেছেই’ অথচ মসীহ্ বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল, তোমরা আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত কর। কেউ আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করলে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত নিষিদ্ধ করবেন ও তার আবাস জাহান্নাম; জালিমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই।

যারা বলে, আল্লাহ তো তিনের মধ্যে একজন, তারা তো কুফরী করেছেই, যদিও এক ইলাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই। তারা যা বলে তা হতে নিবৃত্ত না হলে, তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদের উপর অবশ্যই মর্মন্তুদ শাস্তি আপতিত হবেই। তবে কি তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে না ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। মারয়াম তনয় মসীহ্ তো কেবল একজন রাসূল! তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে এবং তার মাতা সত্যনিষ্ঠ ছিল। তারা উভয়ে খাদ্য গ্রহণ করত। দেখ, আমি ওদের জন্যে আয়াত সমূহ কিরূপ বিশদভাবে বর্ণনা করি; আরও দেখ, ওরা কিভাবে সত্যবিমুখ হয়। (৫ মায়িদাঃ ৭২-৭৫)।

উপরোক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাবে খ্রিষ্টানদের কুফরীর কথা জানিয়ে বলে দিয়েছেন যে, তারা তাদের নবী ঈসা (আ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে, অথচ সেই ঈসাই তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আল্লাহর সৃষ্ট, আল্লাহ্-ই তাকে প্রতিপালন করেছেন এবং মায়ের গর্ভে তাকে আকৃতি দান করেছেন। তিনি এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন এবং এর বিরুদ্ধকারীদেরকে পরকালের শাস্তি, লাঞ্ছনা, ব্যর্থতা ও জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ “নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।” এরপর বলেছেনঃ “নিশ্চয় তারা কাফির, যারা বলেঃ আল্লাহ তিনের এক; অথচ এক উপাস্য ছাড়া কোন উপাস্য নেই।”

ইবন জারীর প্রমুখ বলেছেন, “আল্লাহ তিনের এক” এ কথা দ্বারা খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদের কথা বলা হয়েছে। কেননা তারা তিন সত্তায় বিশ্বাসী। যথাঃ পিতার সত্তা, পুত্রের সত্তা এবং কলেমা বা বাণীর সত্তা যা পিতার থেকে পুত্রের নিকট অবতরণ করে। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে তিনটি উপদলের সৃষ্টি হয় যথাঃ মালিকিয়্যা, ইয়াকুবিয়্যা ও নাসতুরিয়্যা। পরবর্তীতে আমরা তাদের মতবিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। খ্রিষ্টানদের মধ্যে এই ত্রিত্ববাদের জন্ম হয় মসীহ্ এর তিন শ বছর পরে এবং শেষ নবীর আগমনের তিন শ’ বছর পূর্বে সম্রাট কনষ্টানটাইন ইবন কুসতুস এর আমলে। এ কারণে আল্লাহ বলেছেনঃ “এক উপাস্য ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই।” অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রভু নেই। তিনি একক। তার কোন শরীক নেই। তার কোন সদৃশ নেই। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। তাঁর স্ত্রী নেই, সন্তান নেই।

এরপর তাদেরকে সাবধান ও সতর্ক করে আল্লাহ বলেনঃ “তারা যদি তাদের এসব কথা হতে বিরত না হয় তবে তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দান করা হবে।" অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে তার নিজ করুণাবশে এসব জঘন্য বিষয় থেকে তওবা ও ইসতিগফারের দিকে আহ্বান করে বলেছেন, “তারা কি আল্লাহর নিকট তওবা করবে না, তাঁর নিকট ক্ষমা চাইবে না? বস্তুত আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” এরপরে আল্লাহ হযরত ঈসা ও তার মায়ের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, মসীহ্ কেবল আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং তার মা একজন পবিত্র ও সত্যনিষ্ঠ মহিলা, পাপাচারিণী নন। অথচ অভিশপ্ত ইয়াহুদীরা তাঁর উপর ঐরূপ অপবাদ দিয়ে থাকে। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মারয়াম নবী ছিলেন না। যেমনটি আমাদের একদল আলিম ধারণা করেছেন। “তারা উভয়েই খাদ্য গ্রহণ করত” এ কথা দ্বারা ইংগিত করা হয়েছে যে, অন্যদের মত তাদেরও পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন হতো। এমতাবস্থায় তাঁরা ইলাহ্ হন কীরূপে? আল্লাহ তাদের এ মূর্খতাব্যঞ্জক উক্তি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। সুদ্দী প্রমুখ আলিমগণ বলেছেন, আল্লাহর বাণীঃ “নিশ্চয় তারা কাফির, যারা বলেঃ আল্লাহ তিন জনের একজন।” এখানে ‘ঈসা ও তার মা এর সম্পর্কে খ্রিষ্টানদের বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। তারা ‘ঈসা ও তার মাকে ইলাহ বলত-যেমন ইলাহ্ বলত আল্লাহকে। এই সূরার শেষ দিকে আল্লাহ তাদের এ বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ

( وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ یَـٰعِیسَى ٱبۡنَ مَرۡیَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِی وَأُمِّیَ إِلَـٰهَیۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ قَالَ سُبۡحَـٰنَكَ مَا یَكُونُ لِیۤ أَنۡ أَقُولَ مَا لَیۡسَ لِی بِحَقٍّۚ إِن كُنتُ قُلۡتُهُۥ فَقَدۡ عَلِمۡتَهُۥۚ تَعۡلَمُ مَا فِی نَفۡسِی وَلَاۤ أَعۡلَمُ مَا فِی نَفۡسِكَۚ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّـٰمُ ٱلۡغُیُوبِ ۝ مَا قُلۡتُ لَهُمۡ إِلَّا مَاۤ أَمَرۡتَنِی بِهِۦۤ أَنِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ رَبِّی وَرَبَّكُمۡۚ وَكُنتُ عَلَیۡهِمۡ شَهِید ا مَّا دُمۡتُ فِیهِمۡۖ فَلَمَّا تَوَفَّیۡتَنِی كُنتَ أَنتَ ٱلرَّقِیبَ عَلَیۡهِمۡۚ وَأَنتَ عَلَىٰ كُلِّ شَیۡء شَهِیدٌ ۝ إِن تُعَذِّبۡهُمۡ فَإِنَّهُمۡ عِبَادُكَۖ وَإِن تَغۡفِرۡ لَهُمۡ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلۡحَكِیمُ )

[Surah Al-Ma'idah 116 - 118]

“আল্লাহ যখন বলবেন, হে মারয়াম তনয় ‘ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার মাকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর? সে বলবে, তুমিই মহিমান্বিত। যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তা বলতাম, তবে নিশ্চয়ই তুমি তা জানতে। আমার অন্তরে যা আছে তা তো তুমি অবগত আছ, কিন্তু তোমার অন্তরে কী আছে, আমি তা অবগত নই; তুমি তো অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত। তুমি আমাকে যে আদেশ করেছ তা’ ব্যতীত তাদেরকে আমি কিছুই বলিনি; তা এইঃ তোমরা আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত কর; এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের কার্যকলাপের সাক্ষী; কিন্তু যখন তুমি আমাকে তুলে নিলে তখন তুমি-ই তো ছিলে তাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক এবং তুমিই সর্ববিষয়ে সাক্ষী। তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর তবে তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (৫ মায়িদাঃ ১১৬-১১৮)

এখানে আল্লাহ ভবিষ্যতের সংবাদ দিয়েছেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ হযরত ঈসা (আ)-কে তার উম্মত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তার উম্মতের মধ্যে যারা তাকে আল্লাহর পুত্র অথবা আল্লাহর শরীক কিংবা তাঁকেই আল্লাহ বলে বিশ্বাস করতো এবং ঈসাই তাদেরকে এ বিশ্বাস করতে বলেছেন বলে তার উপর মিথ্যা আরোপ করেছে তাদের ব্যাপারে এই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আল্লাহ তো ভালরূপেই জানেন যে, ঈসা এরূপ কথা আদৌ বলেন নি, তবুও তাকে জিজ্ঞেস করবেন তার সত্যতা প্রকাশ ও মিথ্যা আরোপকারীদের মুখোশ উন্মোচন করার উদ্দেশ্যে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেনঃ “হে ঈসা ইবন মারয়াম! তুমি কি লোকদেরকে বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা (আ) বলবেন, “আপনি পবিত্র” অর্থাৎ আপনি সকল শরীকের ঊর্ধ্বে। “আমার জন্যে শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা’ বলার কোন অধিকার আমার নেই।” অর্থাৎ আপনি ব্যতীত এ কথা বলার অধিকার অন্য কারও নেই। “যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই পরিজ্ঞাত; আপনি তো আমার মনে যা আছে জানেন এবং আমি জানি না যা আপনার মনে আছে। নিশ্চয় আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত।”

হযরত ঈসা (আ) এ জবাবে আদবের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেনঃ “আমি তো তাদেরকে কিছুই বলিনি, শুধু সে কথাই বলেছি -যা আপনি বলতে আদেশ করেছিলেন।” অর্থাৎ যখন আমাকে রাসূলরূপে প্রেরণ করেন এবং আমাকে কিতাব দান করেন যা তাদেরকে আমি পড়ে শুনাই। অতঃপর তিনি তাদেরকে যা বলেছিলেন তা ব্যাখ্যা করে বলেনঃ “তোমরা আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন কর, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা।” অর্থাৎ যিনি আমারও সৃষ্টিকর্তা, তোমাদেরও সৃষ্টিকর্তা এবং যিনি আমারও রিযিকদাতা, তোমাদেরও রিযিকদাতা। “আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম।” “অতঃপর যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন।” অর্থাৎ তারা যখন আমাকে হত্যার ও শূলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে, তখন দয়া পরবশ হয়ে আপনি আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে আপনার নিকট তুলে নেন এবং তাদের একজনের চেহারাকে আমার চেহারায় পরিবর্তন করে দেন, ফলে তারা তার উপর আক্রমণ করে ও নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে। এ অবস্থা হওয়ার পরে “আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সর্ববিষয়ে পূর্ণ পরিজ্ঞাত।” এরপর হযরত ঈসা তার অনুসারী নাসারা বা খ্রিষ্টানদের থেকে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে বলেনঃ “যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস।” অর্থাৎ তারা সে শাস্তির উপযুক্ত। “আর যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।” ক্ষমা করার ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছার উপর সোপর্দ করার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবেও তাদেরকে ক্ষমা করা হবে। এ জন্যেই এখানে আল্লাহর গুণাকলীর মধ্য থেকে গাফুরুর রাহীম (ক্ষমাশীল, দয়ালু) না বলে ‘আযীযুন হাকীম’ (মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়) বলা হয়েছে।

তাফসীর কিতাবে আমরা ইমাম আহমদের বর্ণিত হযরত আবু যর (রা)-এর হাদীস উল্লেখ করেছি— যাতে তিনি বলেছেন, এক রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) সালাতে দাঁড়িয়ে সকাল পর্যন্ত নিম্নের আয়াতটি তিলাওয়াত করতে থাকেন।

( إِن تُعَذِّبۡهُمۡ فَإِنَّهُمۡ عِبَادُكَۖ وَإِن تَغۡفِرۡ لَهُمۡ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلۡحَكِیمُ )

[Surah Al-Ma'idah 118]

“আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই দাস; আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে আপনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ আমি আল্লাহর নিকট আমার উম্মতের জন্যে শাফাআত প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে তা দান করেন। আল্লাহ চাহে তো মুশরিক ব্যতীত অন্যান্য পাপী বান্দারা তা লাভ করবে। এরপর তিনি নিম্নলিখিত আয়াতসমূহ পাঠ করেনঃ

( وَمَا خَلَقۡنَا ٱلسَّمَاۤءَ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَیۡنَهُمَا لَـٰعِبِینَ ۝ لَوۡ أَرَدۡنَاۤ أَن نَّتَّخِذَ لَهۡو ا لَّٱتَّخَذۡنَـٰهُ مِن لَّدُنَّاۤ إِن كُنَّا فَـٰعِلِینَ ۝ بَلۡ نَقۡذِفُ بِٱلۡحَقِّ عَلَى ٱلۡبَـٰطِلِ فَیَدۡمَغُهُۥ فَإِذَا هُوَ زَاهِق ۚ وَلَكُمُ ٱلۡوَیۡلُ مِمَّا تَصِفُونَ ۝ وَلَهُۥ مَن فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَمَنۡ عِندَهُۥ لَا یَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِهِۦ وَلَا یَسۡتَحۡسِرُونَ ۝ یُسَبِّحُونَ ٱلَّیۡلَ وَٱلنَّهَارَ لَا یَفۡتُرُونَ )

[Surah Al-Anbiya' 16 - 20]

“আকাশ ও পৃথিবী এবং যা কিছু ওগুলোর অন্তর্বর্তী তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি যদি ক্রীড়ার উপকরণ চাইতাম তবে আমি আমার নিকট যা আছে তা নিয়েই তা করতাম; আমি তা করিনি। কিন্তু আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর, ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দুর্ভোগ তোমাদের তোমরা যা বলছ তার জন্যে! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা তাঁরই। তাঁর সান্নিধ্যে যারা আছে তারা অহংকারবশে তাঁর ইবাদত করা হতে বিমুখ হয় না এবং শ্রান্তিও বোধ করে না। তারা দিনরাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা শৈথিল্য করে না।” (২১ আম্বিয়াঃ ১৬-২০)

আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করতে ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। পবিত্র ও মহান তিনি। তিনি আল্লাহ, এক, প্রবল পরাক্রমশালী তিনি যথাযথভাবে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিনের দ্বারা। সূর্য ও চন্দ্রকে তিনি করেছেন নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই পরিভ্রমণ করে এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত। জেনে রেখো, তিনি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল।” (৩৯ যুমারঃ ৪-৫)। আল্লাহ বলেনঃ “বল, দয়াময় আল্লাহর কোন সন্তান থাকলে আমি হতাম তার উপাসকগণের অগ্রণী। তারা যা আরোপ করে তা হতে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অধিকারী ও আরশের অধিকারী পবিত্র ও মহান।” (৪৩ যুখরুফঃ ৮১-৮২)। আল্লাহ বলেনঃ “বল, প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সার্বভৌমত্বে কোন অংশীদার নেই এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তার অভিভাবকের প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং সসম্ভ্রমে তার মাহাত্ম্য ঘোষণা কর।" (১৭ ইসরাঃ ২১১)

আল্লাহ বলেনঃ “বল, তিনিই আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তার মখাপেক্ষী। তিনি কাউকেও জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেয়া হয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ-ই নেই।” (১১২ সূরা ইখলাস) সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ বলেনঃ বনী আদম আমাকে গালি দেয়; কিন্তু তার জন্যে এটা শোভা পায় না। সে বলে, আমার সন্তান আছে। অথচ আমি একক, মুখাপেক্ষাহীন। আমি কাউকে জন্ম দেইনি এবং কারও থেকে আমি জন্মগ্রহণ করিনি। আমার সমতুল্য কেউ নেই। সহীহ্ হাদীসে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, পীড়াদায়ক কথা শোনার পর তাতে ধৈর্য ধরার ক্ষেত্রে আল্লাহর চাইতে অধিক ধৈর্যধারণকারী আর কেউ নেই। কারণ যে সব লোক আল্লাহর জন্যে সন্তান সাব্যস্ত করে তাদেরকে তিনি রিযিক দিচ্ছেন এবং রোগ থেকে নিরাময় করছেন। তবে অন্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ জালিমকে কিছু দিনের জন্যে অবকাশ দিয়ে থাকেন। যখন তাকে পাকড়াও করবেন তখন আর রেহাই দিবেন না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) নিম্নের আয়াতগুলো পাঠ করেনঃ

( وَكَذَ  ٰ⁠ لِكَ أَخۡذُ رَبِّكَ إِذَاۤ أَخَذَ ٱلۡقُرَىٰ وَهِیَ ظَـٰلِمَةٌۚ إِنَّ أَخۡذَهُۥۤ أَلِیم شَدِیدٌ )

[Surah Hud 102]

—এইরূপ তোমার প্রতিপালকের শাস্তি! তিনি শাস্তিদান করেন জনপদসমূহকে যখন তারা জুলুম করে থাকে। নিশ্চয়ই তার শাস্তি মর্মন্তুদ কঠিন। (১১ হূদঃ ১০২)

অনুরূপ কথা আল্লাহ অন্যত্র বলেছেনঃ

( وَكَأَیِّن مِّن قَرۡیَةٍ أَمۡلَیۡتُ لَهَا وَهِیَ ظَالِمَة ثُمَّ أَخَذۡتُهَا وَإِلَیَّ ٱلۡمَصِیرُ )

[Surah Al-Hajj 48]

—এবং আমি অবকাশ দিয়েছি কত জনপদকে যখন ওরা ছিল জালিম; তারপর ওদেরকে শাস্তি দিয়েছি এবং প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট। (২২ হাজ্জঃ ৪৮)

আল্লাহ বলেনঃ

( نُمَتِّعُهُمۡ قَلِیل ا ثُمَّ نَضۡطَرُّهُمۡ إِلَىٰ عَذَابٍ غَلِیظ ࣲ)

[Surah Luqman 24]

“আমি ওদেরকে জীবনোপকরণ ভোগ করতে দিব স্বল্পকালের জন্যে। তারপর ওদেরকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব।” (৩১ লুকমানঃ ২৪)

আল্লাহ বলেনঃ “বল, যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। পৃথিবীতে ওদের জন্যে আছে কিছু সুখ-সম্ভোগ; পরে আমারই নিকট ওদের প্রত্যাবর্তন। তারপর কুফরী হেতু ওদেরকে আমি কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাব।” (১০ ইউনুসঃ ৬৯-৭০) আল্লাহ আরও বলেছেনঃ

( فَمَهِّلِ ٱلۡكَـٰفِرِینَ أَمۡهِلۡهُمۡ رُوَیۡدَۢا )

[Surah At-Tariq 17]

“অতএব কাফিরদেরকে অবকাশ দাও; ওদেরকে অবকাশ দাও কিছুকালের জন্যে।” (৮৫ আত-তারিকঃ ১৭)।

২৪
হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম ও ওহীর সূচনা
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ঈসা (আ) বায়তুল মুকাদ্দাসের সন্নিকটে ‘বায়তে লাহমে’ জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ওহাব ইবন মুনাববিহ্ (র)-এর ধারণা, হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম হয় মিসরে এবং মারয়াম ও ইউসুফ ইবন ইয়াকুব আল-নাজ্জার একই গাধার পিঠে আরোহণ করে ভ্রমণ করেন এবং গাধার পিঠের গদি ব্যতীত তাঁদের মধ্যে অন্য কোন আড়াল ছিল না। কিন্তু এ বর্ণনা সঠিক নয়। কেননা, ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, ঈসা (আ)-এর জন্মস্থান হচ্ছে বায়তে লাহাম। সুতরাং এ হাদীসের মুকাবিলায় অন্য যে কোন বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য।

ওহাব ইবন মুনাববিহ উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ঈসা (আ) যখন ভূমিষ্ঠ হন তখন পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্ত মূর্তি ভেঙ্গে পড়ে যায়। ফলে শয়তানরা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। এর কোন কারণ তারা খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে বড় ইবলীস তাদেরকে জানাল যে, ঈসা (আ)-এর জন্ম হয়েছে। শয়তানরা শিশু ঈসাকে তার মায়ের কোলে আর চারদিকে ফেরেশতাগণ দাঁড়িয়ে তাকে ঘিরে রেখেছেন দেখতে পেল। তারা আকাশে উদিত একটি বিরাট নক্ষত্রও দেখতে পেল। পারস্য সম্রাট এই নক্ষত্র দেখে শংকিত হয়ে পড়েন এবং জ্যোতিষীদের নিকট এর উদিত হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। জ্যোতিষীরা জানাল, পৃথিবীতে এক মহান ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। এজন্য এই নক্ষত্র উদিত হয়েছে। তখন পারস্য সম্রাট উপঢৌকন হিসেবে স্বর্ণ, চান্দি ও কিছু লুবান দিয়ে নবজাতকের সন্ধানে কতিপয় দূত প্রেরণ করেন। দূতগণ সিরিয়ায় এসে পৌঁছে। সিরিয়ার বাদশাহ তাদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তারা উক্ত নক্ষত্র ও জ্যোতিষীদের মন্তব্যের কথা তাকে জানায়। বাদশাহ দূতদের নিকট নক্ষত্রটির উদয়কাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তর শুনে তিনি বুঝলেন, ঐ শিশুটি বায়তুল মুকাদ্দাসে জন্ম গ্রহণকারী মারয়াম পুত্র ঈসা। ইতিমধ্যেই ব্যাপক প্রচার হয়ে গিয়েছিল যে, নবজাত শিশুটি দোলনায় থেকেই মানুষের সাথে কথা বলেছেন। এরপর বাদশাহ দূতদেরকে তাদের সাথে আনীত উপঢৌকনসহ শিশু ঈসার নিকট পাঠিয়ে দেন এবং এদেরকে চিনিয়ে দেয়ার জন্যে সাথে একজন লোকও দেন। বাদশাহর উদ্দেশ্য ছিল, দূতগণ যখন উপঢৌকন প্রদান করে চলে আসবে, তখন এ লোক ঈসাকে হত্যা করে ফেলবে। পারস্যের দূতগণ মারয়ামের নিকট গিয়ে উপঢৌকনগুলো প্রদান করে চলে আসার সময় বলে আসলো যে, সিরিয়ার বাদশাহ আপনার নবজাত শিশুকে হত্যা করার জন্যে চর পাঠিয়েছে। এ সংবাদ শুনে মারয়াম শিশুপুত্র ঈসাকে নিয়ে মিসরে চলে আসেন এবং একটানা বার বছর সেখানে অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে ঈসা (আ)-এর বিভিন্ন রকম কারামত ও মু’জিযা প্রকাশ হতে থাকে। ওহাব ইবন মুনাবিহ কতিপয় মু’জিযার কথা উল্লেখ করেছেন। যথাঃ

(এক) বিবি মারয়াম মিসরের যে সর্দারের বাড়িতে অবস্থান করেন, একদা ঐ বাড়ি থেকে একটি বস্তু হারিয়ে যায়। ভিক্ষুক, দরিদ্র ও অসহায় লোকজন সে বাড়িতে বসবাস করত। কে বা কারা বস্তুটি চুরি করেছে, তা অনুসন্ধান করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। বিষয়টি মারয়ামকে ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিল। বাড়ির মালিক ও অন্যান্য লোকজনও বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেল। অবশেষে শিশু ঈসা সেখানে অবস্থানকারী এক অন্ধ ও এক পঙ্গু ব্যক্তির নিকট গেলেন। অন্ধকে বললেন, ‘তুমি এ পঙ্গুকে ধরে উঠাও এবং তাকে সাথে নিয়ে চুরি করা বস্তু নিয়ে এস।’ অন্ধ বলল, ‘আমি তো তাকে উঠাতে সক্ষম নই।’ ঈসা বললেন, ‘কেন, তোমরা উভয়ে যেভাবে ঘরের জানালা দিয়ে বস্তুটি নিয়ে এসেছিলে, সেভাবেই গিয়ে নিয়ে এস।’ এ কথা শোনার পর তারা এর সত্যতা স্বীকার করল এবং চুরি করা বস্তুটি নিয়ে আসলো। এ ঘটনার পর ঈসার মর্যাদা মানুষের নিকট অত্যধিক বেড়ে যায়। যদিও তিনি তখন শিশু মাত্র।

(দুই) উক্ত সর্দারের পুত্র আপন সন্তানদের পবিত্রতা অর্জনের উৎসবের দিনে এক ভোজ সভার আয়োজন করে। লোকজন সমবেত হল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। সে যুগের নিয়মানুযায়ী এখন মদ পরিবেশনের পালা। কিন্তু মদ ঢালতে গিয়ে দেখা গেল কোন কলসীতেই মদ নেই। সর্দার পুত্র ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। হযরত ঈসা (আ) এ অবস্থা দেখে প্রতিটি কলসীর মুখে হাত ঘুরিয়ে আসলেন। ফলে সেগুলো সাথে সাথে উৎকৃষ্ট মদে পূর্ণ হয়ে গেল। লোকজন এ ঘটনা দেখে বিস্মিত হলো। ফলে, তাদের নিকট আরও মর্যাদা বৃদ্ধি পেল। মানুষ বিভিন্ন রকম উপটোকন এনে ঈসা ও তার মার কাছে পেশ করলো কিন্তু তারা এর কিছুই গ্রহণ করলেন না। তারপর তারা বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পড়লেন।

ইসহাক ইবন বিশর....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা ইবন মারয়ামই প্রথম মানুষ, যিনি শিশুকালে কথা বলেছেন। আল্লাহ তাঁর রসনা খুলে দেন এবং তিনি আল্লাহর প্রশংসায় এমন অনেক কথা বলেন, যা ইতিপূর্বে কোন কান কখনও শোনেনি। এ প্রশংসায় তিনি চাঁদ, সুরুজ, পর্বত, নদী, ঝর্ণা কোন কিছুকেই উল্লেখ করতে বাদ দেননি।

তিনি বলেনঃ ‘হে আল্লাহ! সু-উচ্চ মর্যাদায় থেকেও আপনি বান্দার নিকটবর্তী। বান্দার নিকটবর্তী থেকেও আপনি সু-মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপরে আপনার শক্তি ও ক্ষমতা। আপনি এমন ক্ষমতাবান সত্তা, যিনি আপন বাণী দ্বারা মহাশূন্যে সাতটি স্তরে আকাশকে সৃষ্টি ও বিন্যস্ত করেছেন। এগুলো প্রথম দিকে ধোঁয়ার আকারে ছিল। পরে আপনার নির্দেশ মতে ওগুলো আপনার অনুগত হয়। এসব আকাশে ফিরিশতাকুল আপনার মহিমা বর্ণনায় তাসবীহ পাঠে রত। এগুলোতে আপনি রাতের অন্ধকারে আলোর ব্যবস্থা করেছেন এবং সূর্যের আলো দ্বারা দিনকে আলোকিত করেছেন। আকাশে বজ্র ধ্বনিকে আপনার স্তুতি পাঠে নিয়োজিত রেখেছেন। আপনার সম্ভ্রমের সম্মানে সেগুলোর অন্ধকার বিদূরিত হয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। আসমান রাজিতে আপনার স্থাপিত নক্ষত্রপুঞ্জরূপী প্রদীপমালার সাহায্যে দিশাহারা পথিকগণ পথের দিশা পায়। অতএব হে আল্লাহ, আসমানরাজিকে বিন্যস্ত করে এবং যমীনকে বিস্তৃত করে আপনি মহা কল্যাণ সাধন করেছেন। যমীনকে আপনি পানির উপরে বিছিয়েছেন। তারপর পানির বিশাল ঢেউয়ের উপরে উঁচু করে রেখেছেন এবং ঢেউগুলোকে নমনীয় হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। আপনার আদেশ পালনার্থে ঢেউগুলো অবনত মস্তকে নমনীয় হয়। এরপর আপনি প্রথমে সমুদ্র ও সমুদ্র থেকে নদী সৃষ্টি করেছেন। তারপর ছোট ছোট নালা ও ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন। এরপর আপনি এ থেকে সৃষ্টি করেছেন খাল, বিল, গাছপালা ও ফল ফলাদি। তারপর যমীনের উপরে স্থাপন করেছেন পাহাড়, পাহাড়গুলো পানির উপরে পেরেকের ন্যায় যমীনকে স্থির করে রেখেছে। এসব কাজে পর্বতমালা ও পাথরসমূহ আপনার পূর্ণ আনুগত্য করে। অতএব, হে আল্লাহ! আপনি অত্যন্ত বরকতময়। এমন কে আছে, যে আপনার মত করে আপনার প্রশংসা করতে পারে? কে আছে এমন, যে আপনার মত করে আপনার গুণাবলী বর্ণনা করতে সক্ষম? আপনি মেঘপুঞ্জকে ছড়িয়ে দেন। বাধা-বন্ধনকে মুক্ত করেন, সঠিক ফয়সালা করেন, এবং আপনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী। আপনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। আপনি মহা পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যাবতীয় পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করার হুকুম করেছেন। আপনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আপনি মহা পবিত্র। আকাশমণ্ডলীকে আপনি মানুষের ধরা ছোঁয়া থেকে দূরে রেখে দিয়েছেন। আপনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। আপনি মহা পবিত্র। জ্ঞানী লোকই কেবল আপনাকে উপলব্ধি করতে পারে। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত উপাস্য নন। আপনি এমন পালনকর্তা নন, যার আলোচনা শেষ হতে পারে। আপনার কোন অংশীদার নেই যে, আপনাকে ডাকার সাথে তাদেরকেও আমরা ডাকবো। আমাদের সৃষ্টি কাজে আপনাকে কেউ সাহায্য করেনি যে, আপনার ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ হতে পারে। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি – আপনি একক, মুখাপেক্ষীহীন, আপনি কাউকে জন্ম দেননি, আপনাকেও কেউ জন্ম দেয়নি, কোন দিক দিয়েই আপনার সমকক্ষ কেউ নেই।’

ইসহাক ইবন বিশর ...... ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। ঈসা ইবন মারয়াম (আ) শিশু অবস্থায় একবার কথা বলেন। এরপর তার কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য শিশুরা যখন স্বাভাবিক বয়সে কথা বলে থাকে, তিনিও সে বয়সে পুনরায় কথা বলতে শুরু করেন। আল্লাহ তখন তাঁকে যুক্তিপূর্ণ কথা ও বাগি্মতা শিক্ষা দেন। ইয়াহুদীরা ঈসা (আ) ও তার মা সম্পর্কে জঘন্য উক্তি করে। তাঁকে তারা জারজ সন্তান বলত। আল্লাহর বাণীঃ

( وَبِكُفۡرِهِمۡ وَقَوۡلِهِمۡ عَلَىٰ مَرۡیَمَ بُهۡتَـٰنًا عَظِیم ࣰا)

[Surah An-Nisa' 156]

—এবং তারা লা’নগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে ও মারয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্যে। (৪ নিসাঃ ১৫৬)। ঈসা (আ)-এর বয়স যখন সাত বছর, তখন তাঁরা তাঁকে লেখাপড়া শিখাবার জন্যে বিদ্যালয়ে পাঠান। কিন্তু ঘটনা এমন হল যে, শিক্ষক তাঁকে যে বিষয়টিই শিখাতে চাইতেন, তিনি আগেই সে বিষয় সম্পর্কে বলে দিতেন। এমতাবস্থায় এক শিক্ষক তাকে ‘আবু জাদ’ শিখালেন। ঈসা জিজ্ঞেস করলেন, “আবু জাদ’ কি?’ শিক্ষক বললেন, ‘আবু জাদ কি তা আমি বলতে পারি না।’ ঈসা বললেন, ‘যে বিষয়ে আপনি জানেন না, সে বিষয়ে আমাকে কেমন করে শিখাবেন?’ শিক্ষক বললেন, ‘তা হলে তুমিই আমাকে শিখাও।’ ঈসা বললেন, ‘তবে আপনি ঐ আসন থেকে নেমে আসুন!’ শিক্ষক নেমে আসলেন। তারপর ঈসা (আ) সে আসনে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, ‘আমার নিকট জিজ্ঞেস করুন!’ শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু জাদ কি?’ উত্তরে ঈসা বললেন, ( الف ) দ্বারা ( الاءالله ) (আল্লাহর নিয়ামতরাশি) با দ্বারা ( بهاء الله ) (আল্লাহর দীপ্তি) جيم দ্বারা بهجة الله وجماله (আল্লাহর অনুপম সৌন্দর্য)।

এ উত্তর শুনে শিক্ষক বিস্মিত হয়ে গেলেন। হযরত ঈসা-ই সর্ব প্রথম আবু জাদ ( ابوجاد ) শব্দের ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

অতঃপর ইসহাক ইব্‌ন বিশর এক দীর্ঘ হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন যে, হযরত উছমান রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রতিটি শব্দের উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু, এ হাদীস মাওযু -জাল। অনুরূপ ইবন আদীও ....... আবু সাঈদ থেকে এক মারফু হাদীসের মাধ্যমে ঈসার মক্তবে প্রবেশ, শিক্ষক কর্তৃক ‘আবু জাদ’ এর অক্ষর সমূহের অর্থ শিক্ষা দান ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ হাদীসও গ্রহণযোগ্য নয়। ইবন আদী বলেছেন, এ হাদীস মিথ্যা। ইসমাঈল ব্যতীত আর কেউ এ হাদীস বর্ণনা করেন নি। ইবন লুহায়আ আব্দুল্লাহ ইবন হুবায়রা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা) বলেছেনঃ ঈসা ইবন মারয়াম (আ) কিশোর বয়সে অন্যান্য বালকদের সাথে মাঠে খেলাধুলা করতেন। মাঝে মধ্যে তিনি তাদের কাউকে ডেকে বলতেন, ‘তুমি কি চাও যে, তোমার মা কি কি খাদ্য তোমাকে না দিয়ে গোপন করে রেখেছে, আমি তা বলে দেই?’ সে বলত, ‘বলে দিন।’ ঈসা বলতেন, ‘অমুক অমুক জিনিস গোপন করে রেখেছে।’ বালকটি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে মাকে বলত, ‘আপনি যে সব খাদ্য আমাকে না দিয়ে গোপন করে রেখে দিয়েছেন, তা আমাকে খেতে দিন।’ মা বলতেন, ‘কি জিনিস আমি গোপন করে রেখেছি?’ বালক বলত, ‘অমুক অমুক জিনিস।’ মা বলতেন, ‘এ কথা তোমাকে কে বলেছে?’ ছেলে বলত, ‘ঈসা ইবন মারয়াম বলেছে।’ এ কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর লোকজন পরামর্শ করল, আমরা যদি ছেলেদেরকে ঈসার সাথে এ ভাবে মেলামেশার সুযোগ দিই তাহলে ঈসা তাদেরকে নষ্ট করে ছাড়বে। সুতরাং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন তারা সকল ছেলেদেরকে একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখল। ঈসা বালকদেরকে সন্ধান করে ফিরলেন; কিন্তু কাউকেও খুঁজে পেলেন না। অবশেষে একটি ঘর থেকে তাদের কান্নাজড়িত চিৎকার শুনতে পেয়ে লোকজনের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঐ ঘরটির ভিতর শব্দ কিসের?’ তারা ঈসাকে জানাল, ‘ঘরের ওগুলো হচ্ছে বানর ও শূকর।’ তখন ঈসা বললেন, ‘হে আল্লাহ! ঐ রকমই করে দিন।’ ফলে বালকগুলো বানর ও শূকরে পরিণত হয়ে গেল। (ইবন আসাকির)।

ইসহাক ইবন বিশর .......ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা আল্লাহর ইঙ্গিত (ইলহাম) অনুযায়ী বাল্যকালে বিস্ময়কর কাজকর্ম দেখাতেন। ইয়াহূদীদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়ে। ঈসা (আ) বয়োবৃদ্ধি লাভ করেন। বনী ইসরাঈলরা তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করতে থাকে। তার মা এ জন্যে শংকিত হয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ তাকে ওহীর মাধ্যমে ছেলেসহ মিসরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কুরআন পাকে আল্লাহ বলেনঃ

( وَجَعَلۡنَا ٱبۡنَ مَرۡیَمَ وَأُمَّهُۥۤ ءَایَة وَءَاوَیۡنَـٰهُمَاۤ إِلَىٰ رَبۡوَة ذَاتِ قَرَار وَمَعِین ࣲ)

[Surah Al-Mu'minun 50]

—এবং আমি মারয়াম তনয় ও তার মাকে করেছিলাম এক নিদর্শন, তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এক নিরাপদ ও প্রস্রবণ বিশিষ্ট উচ্চ ভূমিতে। (২৩ মু’মিনুনঃ ৫০)

আয়াতে উল্লেখিত নিরাপদ ও প্রস্রবণ বিশিষ্ট উচ্চ ভূমি দ্বারা কোন স্থানকে বুঝানো হয়েছে, তা নির্ণয়ে প্রথম যুগের উলামা ও মুফাসসিরগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেননা এ ধরনের বৈশিষ্ট্যময় স্থান খুবই বিরল। যেহেতু সমতল থেকে উচ্চ ভূমি, যার উপরিভাগ হবে প্রশস্ত ও সমতল এবং যেখানে রয়েছে পানির প্রস্রবণ। ( معين ) বলা হয় এমন ঝর্ণাকে, যার পানি যমীনের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। উচ্চ ভূমিতে এ ধরনের প্রস্রবণ সাধারণত হয় না। এজন্যে এর অর্থ নির্ণয়ে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি হয়েছে যথাঃ

(১) সেই স্থান, যেখানে মাসীহ্ জন্মগ্রহণ করেছিলেন অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী একটি খেজুর বাগান। আল্লাহর বাণী।

( فَنَادَىٰهَا مِن تَحۡتِهَاۤ أَلَّا تَحۡزَنِی قَدۡ جَعَلَ رَبُّكِ تَحۡتَكِ سَرِیّ ࣰا)

[Surah Maryam 24]

—ফেরেশতা তার নিম্নপার্শ্ব হতে আহবান করে তাকে বলল, তুমি দুঃখ কর না তোমার পাদদেশে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। (১৯ মারয়ামঃ ২৪)। অধিকাংশ প্রাচীন আলিমদের মতে এটি একটি ছোট নহর। ইবন আব্বাস (রা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত —নহর দ্বারা এখানে দাশিমকের একাধিক নহরকে বুঝানো হয়েছে। সম্ভবত তিনি দামিশকের নহর সমূহের সাথে ঐ স্থানের সাদৃশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন।

(২) কারও কারও মতে উচ্চ ভূমি দ্বারা মিসরকে বুঝানো হয়েছে। যেমন আহলে কিতাবদের একটি অংশ এবং তাদের অনুসারীগণ ধারণা পোষণ করেন।

(৩) কেউ বলেছেন উচ্চ ভূমি অর্থ এখানে রসুল্লাকে বুঝানো হয়েছে।

ইসহাক ইবন বিশর........ ওহাব ইবন মুনাববিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ঈসার বয়স যখন তের বছর, তখন আল্লাহ তাকে মিসর ত্যাগ করে ঈলিয়া যাওয়ার নির্দেশ দেন। তখন ঈসার মায়ের মামাত ভাই ইউসুফ এসে ঈসা ও মারয়ামকে একটি গাধার পিঠে উঠিয়ে ঈলিয়া নিয়ে যান এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। আল্লাহ এখানেই তার উপর ইনজীল অবতীর্ণ করেন, তাওরাত শিক্ষা দেন, মৃতকে জীবিত করা, রোগীকে আরোগ্য করা, বাড়িতে প্রস্ততকৃত খাদ্য সম্পর্কে না দেখেই জানিয়ে দেওয়ার জ্ঞান দান করেন। ঈলিয়ার লোকদের মধ্যে তাঁর আগমন বার্তা পৌঁছে যায়। তার দ্বারা বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্রকাশিত হতে দেখে তারা ঘাঁবড়িয়ে যায় এবং আশ্চর্যবোধ করতে থাকে। ঈসা (আ) তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। এভাবে তাঁর নবুওতী প্রচার কার্য জনগণের মধ্যে বিকাশ লাভ করে।

২৫
প্রসিদ্ধ চারখানা আসমানী কিতাব নাযিলের সময়কাল
আবু যুরআ দামেশকী (র) বর্ণনা করেন যে, তাওরাত কিতাব হযরত মূসা (আ)-এর উপর ৬ রমযানে অবতীর্ণ হয়। এর চার শ’ বিরাশি বছর পর হযরত দাউদ (আ)-এর উপর যাবূর নাযিল হয় ১২ রমযানে। এর এক হাজার পঞ্চাশ বছর পর ১৮ রমযানে হযরত ঈসা (আ)-এর উপর ইনজীল অবতীর্ণ হয় এবং ২৪ রমযানে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর উপর কুরআন মজিদ নাযিল হয়।

( شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِیۤ أُنزِلَ فِیهِ ٱلۡقُرۡءَانُ )

[Surah Al-Baqarah 185]

—রমযান মাস, এতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে (২ বাকারাঃ ১৮৫)- এ আয়াতের অধীনে আমরা তাফসীর গ্রন্থে এতদ সম্পর্কীয় হাদীসগুলো উল্লেখ করেছি। সেখানে এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ)-এর উপরে ইনজীল ১৮ রমযানে অবতীর্ণ হয়।

ইবন জারীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে, ত্রিশ বছর বয়সকালে হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি ইনজীল অবতীর্ণ হয় এবং তেত্রিশ বছর বয়সের সময় তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়। ইসহাক ইবন বিশর....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত আল্লাহ তা’আলা হযরত ঈসা ইবন মারয়ামের নিকট নিম্নলিখিত ওহী প্রেরণ করেনঃ

হে ঈসা! আমার নির্দেশ পালনে কঠোরভাবে চেষ্টা কর, হীনবল হয়ো না। আমার বাণী শ্রবণ কর ও আনুগত্য কর। হে ঈসা! তুমি এক পবিত্র সতী কুমারী ও তাপসী নারীর সন্তান। পিতাবিহীন তোমার জন্ম। বিশ্ববাসীর নিদর্শন স্বরূপ আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি। সুতরাং আমারই দাসত্ব কর, আমার উপরই ভরসা রাখ। সর্বশক্তি দিয়ে আমার কিতাবের অনুসরণ কর। সুরিয়ানী ভাষা-ভাষীদের নিকট কিতাবের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে শোনাও। তোমার সম্মুখে যারা আছে তাদের কাছে আমার বাণীগুলো পৌঁছিয়ে দাও। আমিই মহাসত্য, চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী ও অক্ষয়। লোকজনের কাছে প্রচার করবে যে, আরবের উম্মী নবীকে সত্য বলে জানবে। তিনি হচ্ছে উষ্ট্রারোহী, পাগড়ীধারী, বর্মধারী, জুতা পরিধানকারী এবং লাঠি ব্যবহারে অভ্যস্ত। তিনি হলেন আয়তলোচন, প্রশস্ত কপাল উজ্জ্বল চেহারা কোঁকড়া চুল [শামাইলে তিরমিযীর ১ম অধ্যায়ের দ্বিতীয় হাদীসের বর্ণনা মতে তার চুল না ছিল অত্যধিক কুঞ্চিত, না ছিল একেবারে সোজা], ঘন দাড়ি, জোড়া ভুরু, উঁচু নাক বিশিষ্ট। তাঁর সামনের দাঁতগুলোতে সামান্য ফাঁক থাকবে; থুতনীর উপরের ও ঠোঁট সংলগ্ন ছোট দাড়ি হবে দৃশ্যমান। তার ঘাড় হবে রৌপ্য পাত্রের মত উজ্জ্বল। তার হাঁসুলীর হাঁড় দু’টি হবে যেন প্রবহমান স্বর্ণ। তাঁর বুক থেকে নাভি পর্যন্ত কাল পশমের রেখা থাকবে। এই রেখা ব্যতীত পেটে বা বুকের অন্য কোথাও চুল থাকবে না। তার হাতের তালু ও পায়ের তলা হবে মাংসল। কোন দিকে তাকালে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাবেন। হাঁটার সময় মনে হবে সম্মুখে ঝুঁকে যেন নিম্ন দিকে নেমে আসছেন। ঘর্মাক্ত অবস্থায় দেখলে মনে হবে যেন চেহারার উপরে মুক্তার দানা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং মিশকের ঘ্রাণ চারিদিকে ছড়াচ্ছে। তার পূর্বেও কাউকে এমন দেখা যায়নি এবং পরেও কেউ এমন আসবে না। তাঁর দৈহিক গঠন ও অবয়ব হবে অত্যন্ত সুশ্রী। তিনি অধিক বিবাহকারী, তাঁর সন্তান সংখ্যা হবে কম এবং তাঁর বংশধারা চলবে এক বরকতময় মহিলা থেকে। জান্নাতে তাঁর জন্যে থাকবে নির্ধারিত প্রকোষ্ঠ। প্রকোষ্ঠটি একটি প্রকাণ্ড ফাঁপা মুক্তোয় নির্মিত। সেখানে থাকবে না কোন ক্লান্তি, থাকবে না কোন চিৎকার ধ্বনি। হে ঈসা! তুমি শেষ যামানার যিম্মাদার হবে, যেমন যাকারিয়া ছিল তোমার মায়ের যিম্মাদার, জান্নাতে তার জন্যে থাকবে সাক্ষ্য দানকারী দুটি পাখীর ছানা। আমার নিকট তার যে মর্যাদা, তা অন্য কোন মানুষের নেই। তার কিতাবের নাম হবে কুরআন, ধর্মের নাম হবে ইসলাম। আমার এক নাম সালাম। ধন্য সেই, যে তার সময়কাল পাবে, তাঁর কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করবে ও তাঁর কথা শ্রবণ করবে।

২৬
তুবা বৃক্ষের বর্ণনা
নবী ঈসা (আ) একদা আল্লাহর নিকট নিবেদন করলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুবা কী?’ আল্লাহ জানালেন, ‘তূবা একটি বৃক্ষের নাম। আমি নিজ হাতে তা রোপণ করেছি। এটা প্রত্যেকটা জান্নাতের জন্যই। এর শিকড় রিযওয়ানে এবং তার পানির উৎস তাসনীম। এর শিশির কর্পূরের মত, এর স্বাদ আদার এবং ঘ্রাণ মিশকের মত। যে ব্যক্তি এর থেকে একবার পান করবে সে কখনও পিপাসাবোধ করবে না।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমাকে একবার সে পানি পান করার সুযোগ দিন।’ আল্লাহ বললেন, ‘সেই নবী পান করার পূর্বে অন্য নবীদের জন্যে এটা পান করা নিষিদ্ধ এবং সেই নবীর উম্মতরা পান করার পূর্বে অন্য নবীদের উম্মতদের জন্যে এর স্বাদ গ্রহণ নিষিদ্ধ।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে ঈসা! আমি তোমাকে আমার নিকট উঠিয়ে আনব।’ ঈসা বললেন, ‘প্রভু! কেন আমাকে উঠিয়ে নিবেন?’ আল্লাহ বললেন, ‘আমি প্রথমে তোমাকে উঠিয়ে আনব। তারপর শেষ যামানায় আবার পৃথিবীতে পাঠাব। এতে তুমি সেই নবীর উম্মতের বিস্ময়কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে পারবে এবং অভিশপ্ত দাজ্জালকে হত্যা করার ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। কোন এক নামাযের সময় তোমাকে পৃথিবীতে নামাব। কিন্তু তুমি তাদের নামাযে ইমামতি করবে না। কেননা তারা হচ্ছে রহমতপ্রাপ্ত উম্মত। তাদের যিনি নবী, তারপর আর কোন নবী নেই।’

হিশাম ইবন আম্মার....... যায়দ থেকে বর্ণিত। ঈসা বলেছিলেন, প্রভু! আমাকে এই রহমত প্রাপ্ত উম্মত সম্পর্কে কিছু জানান। আল্লাহ বললেন, তারা আহমদ নবীর উম্মত। তারা হবে নবীতুল্য আলিম ও প্রজ্ঞাবান। আমার অল্প অনুগ্রহে তারা সস্তুষ্ট থাকবে। শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বদৌলতেই তাদেরকে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাবো। তারাই হবে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসী। কেননা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর যিকির দ্বারা তাদের জিহবা যে পরিমাণ সিক্ত হয়েছে, সে পরিমাণ সিক্ত অন্য কোন জাতির হয়নি এবং সিজদা করাতে তাদের গর্দান যতবার ভূ-লুষ্ঠিত হয়েছে, ততবার অন্য কোন জাতির গর্দান ভূলুণ্ঠিত হয়নি। (ইবন আসাকির)

ইবন আসাকির আব্দুল্লাহ ইবন আওসাজা থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে ঈসা ইবন মারয়ামকে বলেন, তোমার চিন্তা-ভাবনায় আমাকেও নিত্য সাথী করে রাখ এবং তোমার আখিরাতের জন্যে আমাকে সম্বলরূপে রাখ। নফল ইবাদতের দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন কর, তাহলে আমি তোমাকে প্রিয় জানবো। আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে তোমার বন্ধু বানিয়ো না। এরূপ করলে তুমি লাঞ্ছিত হবে। বিপদে ধৈর্যধারণ কর এবং তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাক। তোমার মধ্যে আমার সন্তুষ্টিকে জাগ্রত রাখ। কেননা তোমার সন্তুষ্টি আমার আনুগত্যে নিহিত, অবাধ্যতায় নয়। আমার নৈকট্য লাভের চেষ্টা কর, আমাকে সর্বদা স্মরণ রাখ। তোমার অন্তরে যেন আমার ভালবাসা বিরাজ করে। অবসর সময়ে সদা সচেতন থাক। সূক্ষ্ম প্রজ্ঞাকে সুদৃঢ় কর। আমার প্রতি আগ্রহ ও ভীতি পোষণ কর। আমার ভীতি দ্বারা অন্তরকে সমাহিত কর। আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে রাতের সদ্ব্যবহার করবে। এবং দিনের বেলা থাকবে তৃষ্ণার্থ, যাতে করে আমার নিকট পূর্ণ পরিতৃপ্তির দিল লাভ করতে পার। কল্যাণকর কাজে তোমার চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত রাখ। যেখানেই থাক, কল্যাণকর কাজের সহায়ক থাক। মানুষের নিকট আমার উপদেশ পৌঁছিয়ে দাও। আমার ন্যায়পরায়ণতার সাথে আমার বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা কর। তোমার নিকট আমি এমন উপদেশ নাযিল করেছি, যা মনের সন্দেহ-সংশয় ও বিস্মৃতি রোগের নিরাময় স্বরূপ। তা চোখের আবরণ দূর করে ও দৃষ্টিকে প্রখর করে। তুমি কোথাও মৃতবৎ স্থবির হয়ে থেকো না, যতক্ষণ তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলে। হে ঈসা ইবন মারয়াম! আমার প্রতি যে লোকই ঈমান আনে, সে আমাকে ভয় করে। আর যে আমাকে ভয় করে, সে আমার থেকে পুরস্কারেরও আশা রাখে। অতএব, তুমি সাক্ষী থেকো, ঐ ব্যক্তি আমার শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে যতক্ষন না সে আমার নীতি পরিবর্তন করে। হে কুমারী তাপসী মারয়ামের পুত্র ঈসা! জীবনভর কাঁদতে থাক, যেভাবে কেঁদে থাকে পরিবার-পরিজনকে বিদায় দান কালে কোন লোক এবং দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, দুনিয়ার স্বাদ বর্জন করে এবং আপন প্রভুর নিকট পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষায় থাকে। লোকের সাথে কোমল ব্যবহার করবে। সালামের প্রসার ঘটাবে। মানুষ যখন নিদ্রায় বিভোর থাকে তখন তুমি কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা ও বিভীষিকাময় কঠিন ভূ-কম্পনের ভয়ে জাগ্রত থাকবে।

সেদিন আপন পরিবার ও ধন-সম্পদ কোনই কাজে আসবে না। নির্বোধরা যখন হাসি ঠাট্টারত থাকে, তখন তুমি চক্ষুদ্বয়কে চিন্তার বিষাদের সুর্মা মেখে রাখ এবং এ ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ কর এবং একে তোমার পুণ্যপ্রাপ্তির হেতু কর। ধৈর্য অবলম্বককারীদের জন্যে আমি যে পুরস্কারের ওয়াদা করেছি, তা যদি তুমি পেয়ে যাও, তবে তোমার জীবন ধন্য। দুনিয়ার মোহ ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে থাক। যে নিয়ামত তোমার আয়ত্বে এসেছে তা থেকে সামান্য স্বাদ গ্রহণ কর। যে নিয়ামত তোমার আয়ত্বে আসেনি তার লোভ করো না। দুনিয়ায় অল্পতেই সন্তুষ্ট থাক। জীবন ধারণের জন্যে একটি শুকনা খেজুরই তোমার জন্যে যথেষ্ট মনে করবে। দুনিয়া কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে তা তুমি প্রত্যক্ষ করছ। পরকালের হিসাবের কথা স্মরণ রেখে আমল করতে থাক। কেননা সেখানে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমি আমার মনোনীত নেককার লোকদের জন্যে সেখানে যেসব পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছি, তা যদি তুমি দেখতে, তাহলে তোমার অন্তর বিগলিত হয়ে যেত এবং সহ্য করতে না পেরে তুমি মারাই যেতে।

আবু দাউদ তাঁর কিতাবে তাকদীর অধ্যায়ে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইবন ইয়াহয়া...... তাউস থেকে বর্ণিত। একদা ঈসা ইবন মারয়ামের সাথে ইবলীসের সাক্ষাত হয়। ঈসা ইবলীসকে বললেন, ‘তুমি তো জান, তোমার তাকদীরে যা লেখা হয়েছে তার ব্যতিক্রম কিছুতেই হবে না।’ ইবলীস বলল, ‘তা হলে আপনি এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠুন এবং সেখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে দেখুন জীবিত থাকেন কিনা।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তুমি জান না, আল্লাহ বলেছেন, বান্দা আমাকে পরীক্ষা করতে পারে না, আমি যা চাই তাই করে থাকি?’ যুহরী বলেছেন, মানুষ কোন বিষয়ে আল্লাহকে পরীক্ষা করতে পারে না, বরং আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। আবু দাউদ বলেন, আহমদ তাঊসের বরাতে বলেন। একবার শয়তান হযরত ঈসার নিকটে এসে বলল, ‘আপনি তো নিজেকে সত্যবাদী বলে মনে করেন, তা হলে আপনি ঊর্ধ্বে উঠে নীচে লাফিয়ে পড়ুন দেখি।’ ঈসা বললেন, ‘তোমার অমঙ্গল হোক, আল্লাহ কি এ কথা বলেন নি যে, হে আদম সন্তান! তোমরা আমার নিকট মৃত্যু কামনা করবে না? কেননা আমি যা চাই তা-ই করে থাকি।’ আবু তাওয়া আর রবী’...... খালিদ ইবন ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত। শয়তান দশ বছর কিংবা দু বছর যাবত ঈসা (আ)-এর সাথে ইবাদত বন্দেগী করতে থাকে। একদিন তারা এক পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছিলেন। তখন শয়তান ঈসা (আ)-কে বলল, ‘আমি যদি এখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ি, তাহলে আমার তাকদীরে যা লেখা আছে তার কি কোন ব্যক্তিক্রম ঘটবে?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমি আল্লাহকে পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখি না, বরং আল্লাহর যখন ইচ্ছা আমাকে পরীক্ষা করে থাকেন।’ ঈসা (আ) এতক্ষণে চিনতে পারলেন যে, এ শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং তিনি তাকে তাড়িয়ে দিলেন। আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া...... আবু উছমান (র) থেকে বর্ণিত। একদা হযরত ঈসা (আ) এক পাহাড়ের উপরে সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তার নিকট ইবলীস এসে বলল, ‘আপনি কি এই দাবী করে থাকেন যে, প্রতিটি বিষয়ই তার পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ ইবলীস বলল, ‘তাহলে আপনি এ পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ুন এবং বলুন যে, এটাই আমার তাকদীরে ছিল।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘ওহে অভিশপ্ত শয়তান! আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করতে পারেন, কিন্তু বান্দারা কখনও আল্লাহকে পরীক্ষা করতে পারে না।’

আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া....... সুফিয়ান ইবন উয়ায়না (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা হযরত ঈসার সাথে ইবলীসের সাক্ষাত হয়। ইবলীস বলল, ‘হে ঈসা ইবন মারয়াম! আপনি দোলনায় শিশু অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলেছেন, এটা আপনার প্রভুত্বের বড় নিদর্শন। আপনার পূর্বে আর কোন মানব সন্তান ঐ অবস্থায় কথা বলেনি।‘ ঈসা (আ) বললেন, ‘না। প্রভুত্ব তো ঐ আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত, যিনি আমাকে শিশু অবস্থায় কথা বলার শক্তি দিয়েছেন, এরপরে এক সময় আমাকে মৃত্যু দিবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন।’ ইবলীস বলল, ‘আপনি মৃতকে জীবিত করে থাকেন, এটা আপনার প্রভু হওয়ার বড় প্রমাণ।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তা হয় কিভাবে, প্রভু তো একমাত্র তিনি, যিনি জীবিত করার প্রকৃত মালিক। এবং আমি যাকে জীবিত করি, তিনি তাকে মৃত্যু দেন এবং পুনরায় তাকে জীবিত করেন।’ ইবলীস বলল, ‘আল্লাহর কসম, আপনি আকাশেরও প্রভু এবং দুনিয়ারও প্রভু।’ এ কথা বলার সাথে সাথে ফেরেশতা জিবরীল (আ) তাকে আপন ডানা দ্বারা এক ঝাপটা মেরে সূর্যের কিনারায় পৌঁছিয়ে দেন। তারপরে আর এক ঝাপটা মেরে সপ্তম সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছিয়ে দেন। এমনকি ইবলীস সমুদ্রের নীচে কাদার সংগে লেগে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ঈসা ইব্‌ন মারয়ামকে বলে, ‘আমি আপনার থেকে যে শিক্ষা পেলাম, এমন শিক্ষা কেউ কারও থেকে পায় না।’ এ জাতীয় ঘটনা আরও বিশদভাবে ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

হাফিজ আবু বকর আল খাতীব....... আবু সালমা সুয়ায়দ থেকে বর্ণিত। হযরত ঈসা (আ) একদা বায়তুল মুকাদ্দাসে সালাত আদায় করে বাড়ি ফিরছিলেন। একটি গিরিপথ দিয়ে যাওয়ার সময় ইবলীস তার সম্মুখে এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়। ঈসা (আ) ঘুরে গেলে সে আবার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং বলতে থাকে। আপনার জন্যে অন্য কারও দাসত্ব করা শোভা পায় না। এ কথাটি সে বারবার ঈসা (আ)-কে বলতে থাকে। ঈসা (আ) তার হাত থেকে ছুটে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। ইবলীস বারবার এ কথাই বলছিল যে, ‘হে ঈসা! কারও দাস হওয়া আপনাকে মানায় না।’ শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। তখন হযরত জিবরীল ও মিকাঈল ফেরেশতাদ্বয় সেখানে হাজির হলেন। ইবলীস তাদেরকে দেখা মাত্র থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ঐ গিরিপথেই ইবলীস ঈসা (আ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হল। তখন ফিরেশতাদ্বয় ঈসা (আ)-এর সাহায্যে অগ্রসর হলেন। হযরত জিবরীল তার ডানা দ্বারা ঝাপটা মেরে ইবলীসকে বাতনে ওয়াদীতে নিক্ষেপ করে দেন। ইবলীস সেখান থেকে উঠে পুনরায় ঈসা (আ)-এর নিকট আসল। সে ধারণা করল, সে ফেরেশতাদ্বয়কে যা হুকুম করা হয়েছিল তা পালন করে তারা চলে গিয়েছেন, আর আসবেন না। সুতরাং সে ঈসা (আ) কে পুনরায় বলল, ‘আমি আপনাকে ইতিপূর্বেই বলেছি, দাস হওয়া আপনার জন্যে শোভনীয় নয়। আপনার ক্রোধ কোন দাসের ক্রোধ নয়। আপনার সাথে সাক্ষাতকালে প্রকাশিত ক্রোধ থেকে আমি এ কথা বুঝেছি। আমি আপনাকে এমন এক বিষয়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছি যা আপনার জন্যে লাভজনক। আমি শয়তানদেরকে হুকুম দিব, তারা আপনাকে প্রভু মানবে। মানুষ যখন দেখবে জিনরা আপনাকে প্রভু মানছে তখন তারাও আপনাকে প্রভূ বলে মানবে এবং আপনার ইবাদত করবে। আমি এ কথা বলছি না যে, আপনিই একমাত্র মা'বুদ আর কোন মা'বুদ নেই! আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহ থাকবেন আসমানের মা'বুদ আর আপনি হবেন দুনিয়ার মা'বুদ।’

ইবলীসের মুখে এ কথা শুনার পর ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং উঁচু আওয়াজ করেন। তখন হযরত ইসরাফীল (আ) উপর থেকে নীচে নেমে আসেন। জিবরীল ও মীকাঈল ফেরেশতাদ্বয় তাঁর দিকে লক্ষ্য করেন। ইবলীস থেমে যায়। অতঃপর ইসরাফীল তাঁর ডানা দ্বারা ইবলীসকে আঘাত করেন এবং ‘আয়নুশ শামসে’ নিক্ষেপ করেন। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয়বার আঘাত করেন। এরপর ইবলীস সেখান থেকে অবতরণ করে ঈসা (আ) কে একই স্থানে দেখতে পায় এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘হে ঈসা! আজ আমি আপনার জন্যেই দারুণ কষ্ট ভোগ করেছি।’ তারপর তাকে আয়নুশ শামসে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে আয়নুল হামিয়াতে সাত রাজাকে দেখতে পায়, তারা তাকে তাতে ডুবিয়ে দেয়। যখনই সে চিৎকার করেছে তখনই তারা তাকে সেই কর্দমে ডুবিয়ে দেয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ইবলীস কখনও ঈসা (আ) এর নিকট আসেনি। ইসমাঈল আত্তার........ আবু হুযায়ফা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, অতঃপর ইবলীসের নিকট তার দলবল শয়তানরা জমায়েত হয় এবং বলে, ‘হে আমাদের সর্দার! আজ যে আপনাকে খুবই ক্লান্ত শ্রান্ত মনে হচ্ছে!’ ইবলীস হযরত ঈসার প্রতি ইংগিত করে বললঃ ‘তিনি হচ্ছেন আল্লাহর নিস্পাপ বান্দা। তার উপর প্রভাব বিস্তার করার সাধ্য আমার নেই। তবে তাকে কেন্দ্র করে আমি বিপুল সংখ্যক লোককে বিপদগামী করব। বিভিন্ন প্রকার কামনা-বাসনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলব। তাদেরকে নানা দলে-উপদলে বিভক্ত করব। তারা তাঁকে ও তার মাকে আল্লাহর আসনে বসাবে।’ কুরআন মজীদে আল্লাহ হযরত ঈসাকে ইবলীসের ধোঁকা থেকে হেফাজত করাকে তার অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করে বলেনঃ

یا عیسی بن مريم اذكر نعمتى عليك وعلى والدتك اذ ايدتك بروح القدس

—হে মারইয়াম তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার জননীর প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর। পবিত্র আত্মা অর্থাৎ জিবরীল ফেরেশতা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম। হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি কর্দম দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে তুমি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতি ক্রমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমা হতে বনী ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এ তো স্পষ্ট যাদু। (৫ মায়িদাঃ ১১০)

আমি গরীব ও মিসকীন লোকদেরকে তোমার একান্ত ভক্ত ও সাথী বানিয়েছি- যাদের উপরে তুমি সন্তুষ্ট; এমন সব শিষ্য ও সাহায্যকারী তোমাকে দিয়েছি, যারা তোমাকে জান্নাতের পথ প্রদর্শনকারী রূপে পেয়ে সন্তুষ্ট। জেনে রেখো, উক্ত গুণ দুটি বান্দার জন্যে প্রধান গুণ। যারা এ গুণ দুটি নিয়ে আমার কাছে আসবে, তারা আমার নিকট সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও মনোনীত বান্দা হিসেবে গণ্য হবে। বনী ইসরাঈলরা তোমাকে বলবে, আমরা রোজা রেখেছি কিন্তু তা কবুল হয়নি, নামায পড়েছি কিন্তু তা গৃহীত হয়নি, দান-সাদকা করেছি কিন্তু তা মঞ্জুর হয়নি, উটের কান্নার ন্যায় করুণ সুরে কেঁদেছি কিন্তু আমাদের কান্নার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। এ সব অভিযোগের জবাব তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর, এমনটা কেন হল? কোন জিনিসটি আমাকে এসব কবুল করা থেকে বাধা দিয়েছে? আসমান ও যমীনের সমস্ত ধন ভাণ্ডার কি আমার হাতে নেই? আমি আমার ধন ভাণ্ডার থেকে যেরূপ ইচ্ছা খরচ করে থাকি। কৃপণতা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি কি প্রার্থনা শ্রবণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম এবং দান করার ব্যাপারে সবচেয়ে উদার সত্তা নই? না আমার দান-অনুগ্রহ সংকুচিত হয়ে গিয়েছে? দুনিয়ার কেউ কারও প্রতি অনুগ্রহশীল হলে সে তো আমারই দয়ার কারণে তা করে থাকে।

হে ঈসা ইবন মারয়াম! ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের অন্তরে আমি যে সব সদগুণ প্রদান করেছিলাম তারা যদি সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাত তা হলে আখিরাতের জীবনের উপরে দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিত না এবং বুঝতে পারত যে, কোথা থেকে তাদেরকে দান করা হয়েছে, আর তারা এটাও বিশ্বাস করত যে, মনের কামনা বাসনাই তাদের বড় দুশমন। তাদের রোজা আমি কিভাবে কবুল করি। যখন হারাম খাবার গ্রহণের মাধ্যমে তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে? তাদের নামায আমি কিভাবে কবুল করি, যখন তাদের অন্তর ঐ সব লোকদের প্রতি আকৃষ্ট যারা আমার বিরোধিতা করে এবং আমার নিষিদ্ধ বস্তুকে হালাল জানে? কি করে তাদের দান-সাদকা আমি মঞ্জুর করি, যখন তারা মানুষের উপর জুলুম করে অবৈধ পন্থায় তাদের ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। হে ঈসা! আমি ঐ সব লোকদেরকে যথাযথ প্রতিদান দিব। হে ঈসা! তাদের কান্নায় আমি দয়া দেখাব কিভাবে, যখন তাদের হাত নবীদের রক্তে রঞ্জিত? এ কারণে তাদের প্রতি আমার ক্রোধ অতি মাত্রায় বেশী। হে ঈসা! যে দিন আমি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছি- সে দিন-ই আমি এ বিষয়টি চূড়ান্ত করে রেখেছি যে, যে ব্যক্তি আমার দাসত্ব কবুল করবে এবং তোমার ও তোমার মা সম্পর্কে আমার বাণীকে সঠিক বলে মেনে নিবে, তাকে আমি তোমার ঘরের প্রতিবেশী বানাব, সফরের সাথী করব এবং অলৌকিক ঘটনা প্রকাশে তোমাশরীক করব। যে দিন আমি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছি, সে দিন এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করে রেখেছি যে, যে সব লোক তোমাকে ও তোমার মাকে আল্লাহর সাথে শরীফ করে প্রভু বানাবে, তাদেরকে আমি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান দিব। যে দিন আমি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছি, সে দিন এই সিন্ধান্ত চূড়ান্ত করে রেখেছি যে, আমি আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মদের হাতে এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করব। তার উপরেই নবুওত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি টানব। তার জন্ম হবে মক্কায়, হিজরতস্থল (মদীনা) তায়্যিবা। শ্যাম দেশ তার করতলগত হবে। সে কর্কশ ভাষী ও কঠোর হৃদয় হবে না, বাজারে চিৎকার করে ফিরবে না, অশ্লীল অশ্রাব্য কথাবার্তা বলবে না। প্রতিটি বিষয়ে উত্তম পন্থা অবলম্বনের জন্যে আমি তাকে তাওফীক দিব। সৎ চরিত্রের যাবতীয় গুণাবলী তাকে প্রদান করব। তার অন্তর থাকবে তাকওয়ায় পরিপূর্ণ। জ্ঞান হবে প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তার স্বভাব, ন্যায় বিচার তার চরিত্র, সত্য তার শরীআত, ইসলাম তার আদর্শ, নাম হবে তার আহমদ।

আমি তার সাহায্যে মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে সঠিক পথ দেখাব, অজ্ঞতা থেকে ফিরিয়ে জ্ঞানের দিকে আনব, নিঃস্ব অবস্থা থেকে স্বচ্ছলতার দিকে আনব, বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে উন্নতির সোপানে উঠাব। তার দ্বারা সঠিক পথ প্রদর্শন করবো। তার সাহায্যে বধির ব্যক্তিকে শ্রবণ শক্তি দান করব, আচ্ছাদিত হৃদয় সমূহকে উন্মুক্ত করে দিব, বিভিন্ন কামনা-বাসনাকে সংযত করব। তার উম্মতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উম্মতের মর্যাদা দান করব। মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্যে তাদের অভ্যুদয় ঘটবে। তারা মানুষকে ভাল কাজে আহবান জানাবে ও গর্হিত কাজ থেকে নিষেধ করবে। আমার নামে তারা নিষ্ঠাবান থাকবে। রাসূলের আনীত আদর্শকে তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে। তারা তাদের মসজিদে, সভা সমিতিতে বাড়ি ঘরে ও চলতে ফিরতে সর্বাবস্থায় আমার তাসবীহ পাঠ করবে, পবিত্রতা ঘোষণা করবে ও লা ইলাহা ইল্লালাহ কলেমা পড়বে। তারা দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় রুকু সিজদার মাধ্যমে আমার জন্যে সালাত আদায় করবে। আমার পথে তারা সারিবদ্ধ হয়ে দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আল্লাহর পথে রক্ত দান হচ্ছে তাদের নিকট পুণ্যকর্ম। সুসংবাদের আশায় তাদের অন্তর ভরপুর, তাদের পুন্য কাজসমূহ প্রদর্শনীমুক্ত। রাতের বেলায় তারা আল্লাহর ধ্যানে মশগুল তাপস আর দিনের বেলায় যুদ্ধের ময়দানে সাক্ষাত সিংহ—এ সবই আমার অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তাকে দিই। আমি মহা অনুগ্রহশীল।

উপরে যা কিছু আলোচনা হল, এর সপক্ষে প্রমাণাদি আমরা সূরা মায়িদা ও সূরা সাফ এর প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করব ইনশা আল্লাহ। আবু হায়ফা ইসহাক ইবন বিশর বিভিন্ন সূত্রে কা'ব আল-আহবার, ওহাব ইবন মুনাব্বিহ, ইবন আব্বাস (রা) ও সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। বর্ণনায় তাদের একজনের বক্তব্য অন্যজনের বক্তব্যের সাথে মিশে গেছে। তারা বলেন যে, হযরত ঈসা ইবন মারয়াম যখন বনী ইসরাঈলের নিকট প্রেরিত হলেন এবং তাদের সম্মুখে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি তুলে ধরলেন তখন বনী ইসরাঈলের মুনাফিক ও কাফির শ্রেণীর লোকেরা তাঁর সাথে উপহাস করতো। তারা জিজ্ঞেস করত, ‘বলুন তো, অমুক গতকাল কী খাবার খেয়েছে এবং বাড়িতে সে কী রেখে এসেছে?’ হযরত ঈসা (আ) তাদেরকে সঠিক জবাব দিয়ে দিতেন। এতে মুমিনদের ঈমান এবং কাফির ও মুনাফিকদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও বেড়ে যেত, এতদসত্ত্বেও হযরত ঈসার মাথা গোঁজায় মত কোন ঘর বাড়ী ছিল না। খোলা আকাশের নীচে মাটির উপর তিনি সালাত ও তাসবীহ আদায় করতেন। তাঁর কোন স্থায়ী আবাসস্থল বা ঠিকানা ছিল না। সর্বপ্রথম তিনি যে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেন সে ঘটনাটি ছিল এরূপঃ-

একদা তিনি কোন এক কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ কবরের নিকটে এক মহিলা বসে কাঁদছিল। ঈসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ মহিলাটি বলল, ‘আমার একটি মাত্র কন্যা ছিল। সে ছাড়া আমার আর কোন সন্তান নেই। আমার সে কন্যাটি মারা গিয়েছে। আমি আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, হয় তিনি আমার কন্যাকে জীবিত করে দিবেন, না হয় আমিও তার মত মারা যাব, এ জায়গা ত্যাগ করব না। আপনি এর দিকে একটু লক্ষ্য করুন।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমি যদি লক্ষ্য করি তবে কি তুমি এখান থেকে ফিরে যাবে?’ মহিলাটি বলল, ‘হ্যাঁ, তা- ই করব।’ তারপর হযরত ঈসা (আ) দু' রাকআত সালাত আদায় করে কবরের পাশে এসে বসলেন এবং বললেনঃ ‘ওহে অমুক, তুমি আল্লাহর হুকুমে উঠে দাঁড়াও, এবং বের হয়ে এস।’ তখন কবরটি সামান্য কেঁপে উঠল। ঈসা (আ) দ্বিতীয়বার আহবান করলেন। এবার কবরটি ফেটে গেল। তৃতীয়বার আহবান করলে কবরবাসিনী বেরিয়ে আসল এবং মাথার চুল থেকে ধুলাবালি ঝেড়ে ফেলতে লাগল। ঈসা (আ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বের হতে তোমার দেরী হল কেন?’ মেয়েটি বলল, ‘প্রথম আওয়াজ শোনার পর আল্লাহ আমার নিকট একজন ফেরেশতা পাঠান। তিনি আমার দেহের অংগ-প্রত্যংগগুলি জোড়া লাগান। দ্বিতীয় আওয়াজের পর রূহ আমার দেহের ভিতর প্রবেশ করে। তৃতীয় আওয়াজ যখন হল তখন আমার ধারণা হল, এটা কিয়ামতের আওয়াজ। আমি ভীত-শংকিত হয়ে পড়লাম। কিয়ামতের ভয়ে আমার মাথার চুল ও চোখের ভ্রু সব সাদা হয়ে গিয়েছে। তারপর মেয়েটি তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, মা! আপনি আমাকে মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ দুইবার গ্রহণ করালেন কেন? মা! ধৈর্য ধরুন, পুণ্যের আশা করুন। দুনিয়ার উপরে থাকার কোন আগ্রহ আমার নেই। হে রূহুল্লাহ! হে কলেমাতুল্লাহ! আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যেন আমাকে তিনি আখিরাতের জীবন ফিরিয়ে দেন এবং মৃত্যুর কষ্ট কমিয়ে দেন।’ ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন। ফলে মেয়েটির দ্বিতীয়বার মৃত্যু হল এবং তাকে কবরস্থ করা হল। এ সংবাদ ইয়াহদীদের নিকট পৌঁছলে তারা ঈসা (আ)-এর প্রতি পূর্বের চাইতে অধিক বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে উঠে।

ইতিপূর্বে হযরত নূহ (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পরে উল্লেখ করা হয়েছে যে,হযরত নূহের পুত্র সাম-কে জীবিত করে দেয়ার জন্যে বনী ইসরাঈলরা হযরত ঈসার নিকট দাবী জানায়। তিনি সালাত আদায় করে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ফলে আল্লাহ তাঁকে জীবিত করে দেন। সাম জীবিত হয়ে বনী ইসরাঈলদেরকে নূহ (আ)-এর নৌকা সম্বন্ধে অবহিত করেন, ঈসা (আ) পুনরায় দোয়া করলে তিনি আবার মাটির সাথে মিশে যান।

সুদ্দী .... ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হল, বনী ইসরাঈলের কোন এক বাদশাহর মৃত্যু হয়। কবরস্থ করার জন্যে তাকে খাটের উপর রাখা হয়। এ সময় হযরত ঈসা (আ) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ফলে বাদশাহ জীবিত হয়ে যায়। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে এ আশ্চর্য ও অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। আল্লাহর বাণীঃ-

( إِذۡ قَالَ ٱللَّهُ یَـٰعِیسَى ٱبۡنَ مَرۡیَمَ ٱذۡكُرۡ نِعۡمَتِی عَلَیۡكَ وَعَلَىٰ وَ  ٰ⁠ لِدَتِكَ إِذۡ أَیَّدتُّكَ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِ تُكَلِّمُ ٱلنَّاسَ فِی ٱلۡمَهۡدِ وَكَهۡل اۖ وَإِذۡ عَلَّمۡتُكَ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِیلَۖ وَإِذۡ تَخۡلُقُ مِنَ ٱلطِّینِ كَهَیۡـَٔةِ ٱلطَّیۡرِ بِإِذۡنِی فَتَنفُخُ فِیهَا فَتَكُونُ طَیۡرَۢا بِإِذۡنِیۖ وَتُبۡرِئُ ٱلۡأَكۡمَهَ وَٱلۡأَبۡرَصَ بِإِذۡنِیۖ وَإِذۡ تُخۡرِجُ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِیۖ وَإِذۡ كَفَفۡتُ بَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ عَنكَ إِذۡ جِئۡتَهُم بِٱلۡبَیِّنَـٰتِ فَقَالَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ مِنۡهُمۡ إِنۡ هَـٰذَاۤ إِلَّا سِحۡر مُّبِین ۝ وَإِذۡ أَوۡحَیۡتُ إِلَى ٱلۡحَوَارِیِّـۧنَ أَنۡ ءَامِنُوا۟ بِی وَبِرَسُولِی قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا وَٱشۡهَدۡ بِأَنَّنَا مُسۡلِمُونَ )

[Surah Al-Ma'idah 110 - 111]

—আল্লাহ বললেন, ‘হে মারয়াম-তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার মায়ের প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর ও পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে; তোমাকে কিতাব হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি কাদা দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখী সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখী হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে তুমি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতিক্রমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমা হতে বনী ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এতো স্পষ্ট যাদু। আরও স্মরণ কর, আমি যখন হাওয়ারীদেরকে এই আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা তো মুসলিম।’ (৫ মায়িদাঃ ১১০-১১১)

এখানে আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসার প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহসমূহ ও পিতা ব্যতীত মায়ের থেকে সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁকে তিনি মানব জাতির জন্যে নিদর্শন বানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এটা আল্লাহর অসীম ক্ষমতারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। এ সবের পরেও তাকে রাসূল বানিয়ে নিজ অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। “তোমার মায়ের প্রতি আমার অনুগ্রহ” অর্থাৎ প্রথমত, এই বিশাল নিয়ামতের অধিকারী মহান নবীর মা হওয়ার জন্যে তাঁর প্রতি যে কুৎসা রটনা করেছিল তা থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রমাণ উপস্থাপন। “পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম।” পবিত্র আত্মা অর্থ জিবরাঈল ফেরেশতা। জিবরাঈলের দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন এভাবে যে, তিনি তাঁর রূহূকে তার মায়ের জামার হাতার মধ্যে ফুৎকার দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন; রিসালাতের দায়িত্ব পালনকালে তিনি ঈসা (আ)-এর সাথে সাথে থাকতেন এবং নবীর বিরোধীদেরকে তিনি প্রতিহত করতেন। "দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে কথা বলার" অর্থ-তুমি শিশুকালে দোলনায় থাকা অবস্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছ এবং পরিণত বয়সেও তাদেরকে আহ্বান করবে। কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়ার অর্থ লিপি জ্ঞান ও গভীর অনুধাবন শক্তি দান করা। প্রাচীন যুগের আলিম এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। “কাদা দ্বারা পাখীর আকৃতি গঠন” অর্থাৎ আল্লাহর অনুমতিক্রমে তুমি কাদা দ্বারা পাখীর আকৃতি অবয়ব গঠন করতে। “আমার অনুমতিক্রমেপাখী হয়ে যেত।” অনুমতিক্রমে অর্থ আদেশক্রমে, আল্লাহর অনুমতি কথাটি আনার উদ্দেশ্য হল, মানুষ যাতে এই সন্দেহ না করে যে, ঈসা নিজের ক্ষমতা বলেই এরূপ করেছেন। জন্মান্ধ বলতে এখানে কোন কোন আলিম বলেছেনঃ যার কোন চিকিৎসা নেই। কুষ্ঠ রোগীও এমন কুষ্ঠরোগ, যার কোন চিকিৎসা নেই। “মৃতকে জীবিত করা” অর্থাৎ কবর থেকে জীবিত অবস্থায় উঠানো। আমার অনুমতিক্রমে শব্দটির পুনরুক্তি। এ কথা দ্বারা ঐ ঘটনার দিকে ইংগিত করা হয়েছে, যখন বনী ইসরাঈলরা তাকে শূলে চড়াবার জন্যে উদ্যত হয়েছিল। তখন আল্লাহ তাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং আপন সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছিলেন। “আমি যখন হাওয়ারীদেরকে ওহী মারফত আদেশ দিয়েছিলাম এখানে ওহীর দু’প্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

এক; ওহী অর্থ ইলহাম বা প্রেরণা জাগিয়ে দেওয়া। এ অর্থে কুরআনের আয়াত যেমনঃ-

( وَأَوۡحَىٰ رَبُّكَ إِلَى ٱلنَّحۡلِ )

তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে উহার অন্তরে ইংগিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন (১৬ নাহলঃ ৬৮)

( وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰۤ أُمِّ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَرۡضِعِیهِۖ فَإِذَا خِفۡتِ عَلَیۡهِ فَأَلۡقِیهِ فِی ٱلۡیَمِّ وَلَا تَخَافِی وَلَا تَحۡزَنِیۤۖ إِنَّا رَاۤدُّوهُ إِلَیۡكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ ٱلۡمُرۡسَلِینَ )

[Surah Al-Qasas 7]

—মূসার মায়ের অন্তরে আমি ইংগিতে নিদের্শ করলাম, শিশুটিকে স্তন্য দান করতে থাক। যখন তুমি তার সম্পর্কে কোন আশংকা করবে তখন একে দরিয়ায় নিক্ষেপ করে দিও। (২৮ কাসাসঃ ৭)

দুই; রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত ওহী এবং তাদেরকে সত্য গ্রহণের তাওফীক দেওয়া। এ জন্যেই তারা প্রতি উত্তরে বলেছিল ( امنا واشهد باننا مسلمون ) “আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম।” হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ সমূহের মধ্যে অন্যতম বড় অনুগ্রহ এই যে, তিনি তাকে এমন একদল সাহায্যকারী ও সেবক দিয়েছিলেন, যারা তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং মানুষকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানাতেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে বলেছেনঃ-

( وَإِن یُرِیدُوۤا۟ أَن یَخۡدَعُوكَ فَإِنَّ حَسۡبَكَ ٱللَّهُۚ هُوَ ٱلَّذِیۤ أَیَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِینَ ۝ وَأَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوبِهِمۡۚ لَوۡ أَنفَقۡتَ مَا فِی ٱلۡأَرۡضِ جَمِیع ا مَّاۤ أَلَّفۡتَ بَیۡنَ قُلُوبِهِمۡ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَیۡنَهُمۡۚ إِنَّهُۥ عَزِیزٌ حَكِیم ࣱ)

[Surah Al-Anfal 62 - 63]

—তিনি তোমাকে আপন সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন; এবং তিনি ওদের পরস্পরের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৮ আনফালঃ ৬২,৬৩)

আল্লাহ বলেনঃ

( وَیُعَلِّمُهُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِیلَ ۝ وَرَسُولًا إِلَىٰ بَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ أَنِّی قَدۡ جِئۡتُكُم بِـَٔایَة مِّن رَّبِّكُمۡ أَنِّیۤ أَخۡلُقُ لَكُم مِّنَ ٱلطِّینِ كَهَیۡـَٔةِ ٱلطَّیۡرِ فَأَنفُخُ فِیهِ فَیَكُونُ طَیۡرَۢا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ وَأُبۡرِئُ ٱلۡأَكۡمَهَ وَٱلۡأَبۡرَصَ وَأُحۡیِ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأۡكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِی بُیُوتِكُمۡۚ إِنَّ فِی ذَ  ٰ⁠ لِكَ لَـَٔایَة لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ وَمُصَدِّق ا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیَّ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعۡضَ ٱلَّذِی حُرِّمَ عَلَیۡكُمۡۚ وَجِئۡتُكُم بِـَٔایَة مِّن رَّبِّكُمۡ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِیعُونِ ۝ إِنَّ ٱللَّهَ رَبِّی وَرَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُوهُۚ هَـٰذَا صِرَ  ٰ⁠طࣱ مُّسۡتَقِیم ۝ ۞ فَلَمَّاۤ أَحَسَّ عِیسَىٰ مِنۡهُمُ ٱلۡكُفۡرَ قَالَ مَنۡ أَنصَارِیۤ إِلَى ٱللَّهِۖ قَالَ ٱلۡحَوَارِیُّونَ نَحۡنُ أَنصَارُ ٱللَّهِ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَٱشۡهَدۡ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ۝ رَبَّنَاۤ ءَامَنَّا بِمَاۤ أَنزَلۡتَ وَٱتَّبَعۡنَا ٱلرَّسُولَ فَٱكۡتُبۡنَا مَعَ ٱلشَّـٰهِدِینَ ۝ وَمَكَرُوا۟ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَیۡرُ ٱلۡمَـٰكِرِینَ ۝ إِذۡ قَالَ ٱللَّهُ یَـٰعِیسَىٰۤ إِنِّی مُتَوَفِّیكَ وَرَافِعُكَ إِلَیَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ وَجَاعِلُ ٱلَّذِینَ ٱتَّبَعُوكَ فَوۡقَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوۤا۟ إِلَىٰ یَوۡمِ ٱلۡقِیَـٰمَةِۖ ثُمَّ إِلَیَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأَحۡكُمُ بَیۡنَكُمۡ فِیمَا كُنتُمۡ فِیهِ تَخۡتَلِفُونَ ۝ فَأَمَّا ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ فَأُعَذِّبُهُمۡ عَذَاب ا شَدِید ا فِی ٱلدُّنۡیَا وَٱلۡـَٔاخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّـٰصِرِینَ ۝ وَأَمَّا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَیُوَفِّیهِمۡ أُجُورَهُمۡۗ وَٱللَّهُ لَا یُحِبُّ ٱلظَّـٰلِمِینَ ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكَ نَتۡلُوهُ عَلَیۡكَ مِنَ ٱلۡـَٔایَـٰتِ وَٱلذِّكۡرِ ٱلۡحَكِیمِ )

[Surah Aal-E-Imran 48 - 58]

“এবং তিনি তাকে শিক্ষা দিবেন কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল এবং তাকে বনী ইসরাঈলের জন্যে রাসূল করবেন। সে বলবে, আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্যে কাদা দিয়ে একটি পাখীর আকৃতি গঠন করব; তাতে আমি ফুৎকার দিব; ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করব। তোমরা তোমাদের ঘরে যা আহার কর ও মওজুদ কর তা তোমাদেরকে বলে দেব। তোমরা যদি মুমিন হও তবে এতে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। আর আমি এসেছি আমার সম্মুখে তাওরাতের যা রয়েছে তার সমর্থকরূপে ও তোমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতকগুলোকে বৈধ করতে। এবং আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর ও আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা তার ইবাদত করবে। এটাই সরল পথ। যখন ঈসা তাদের অবিশ্বাস উপলব্ধি করল তখন সে বলল, ‘আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী?’ হাওয়ারীরা বলল, ‘আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহতে ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমর্পণকারী, তুমি এর সাক্ষী থাক। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যা অবতীর্ণ করেছ তাতে আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এই রাসূলের অনুসরণ করেছি। সুতরাং আমাদেরকে সাক্ষ্য দানকারীদের তালিকাভুক্ত কর।’ এবং তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও কৌশল করেছিলেন; আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।” (৩ আলে ইমরানঃ ৪৮-৫৮)

প্রত্যেক নবীর মু'জিযা ছিল তার নিজ যুগের মানুষের চাহিদার উপযোগী। যেমন হযরত মূসা (আ)-এর যুগের লোকেরা ছিল তীক্ষ্ণধী যাদুকর। আল্লাহ তাঁকে এমন মু'জিযা দান করলেন যা যাদুকরদের চোখ ঝলসিয়ে দিয়েছিল এবং যাদুকররা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল। যাদুকররা যাদু সংক্রান্ত তথ্যাদি সম্পর্কে অবগত ছিল। যাদুর দৌড় যে কী পর্যন্ত, সে সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিল। সুতরাং যখন তারা মূসা (আ)-এর মু'জিযা প্রত্যক্ষ করল তখন তারা বুঝতে পারলো যে, এতো মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভূত ব্যাপার। আল্লাহর সাহায্য ও প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যতীত কোন মানুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু প্রকাশ হতে পারে না। কোন নবীর সত্যতা প্রমাণের জন্যে আল্লাহ এরূপ মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভূত কিছু প্রকাশ করে থাকেন। সুতরাং কালবিলম্ব না করে তারা মূসা (আ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। অনুরূপভাবে হযরত ঈসা ইবন মারয়াম (আ)-কে যে যুগে প্রেরণ করা হয় সে যুগটি ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্যে প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তাঁকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন মু'জিযা দান করলেন যা ছিল তাদের ক্ষমতা ও আয়ত্তের বাইরে। একজন চিকিৎসক যখন অন্ধ, খঞ্জ, কুষ্ঠ ও পঙ্গুকে ভাল করতে অক্ষম, সেখানে একজন জন্মান্ধকে ভাল করার প্রশ্নই উঠে না। আর একজন মৃত ব্যক্তিকে কবর থেকে জীবিত উঠাবার শক্তি মানুষের জন্যে তো কল্পনাই করা যায় না। প্রত্যেকেই বুঝে যে, এসব এমন মু'জিযা, যার মাধ্যমে এগুলো প্রকাশ পায় তার দাবির পক্ষে এটা হয়ে থাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং যে সত্তা তাকে প্রেরণ করেন তাঁর কুদরত ও মহাশক্তির প্রমাণ।

একই পদ্ধতিতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে যে যুগে প্রেরণ করা হয় সে যুগটি ছিল বালাগাত-ফাসাহাত তথা অলংকারশাস্ত্রে সমৃদ্ধ উন্নত ভাষা শিল্পের যুগ। আল্লাহ তাঁর উপর কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেন। যে কোন ত্রুটি থেকে তা মুক্ত। কুরআনের বাক্য ও শব্দগুলো এমনই মু'জিযা যে, মানব ও জিন জাতিকে সম্মিলিতভাবে এই কুরআনের অনুরূপ একটি কুরআন, কিংবা অনুরূপ ১০টি সূরা অথবা মাত্র ক্ষুদ্র একটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এরপর দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে যে, তারা কোন দিন এ চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে পারবে না-বর্তমানেও না, ভবিষ্যতেও না, এখনই যখন পারেনি, ভবিষ্যতে কখনও পারবে না। এরকম ভাষা তারা তৈরি করতে এ জন্যে পারবে না, যেহেতু এটা আল্লাহর বাণী। আর আল্লাহর সাথে কোন কিছুরই তুলনা হতে পারে না -না তার সত্তার সাথে না তার গুণাবলীর সাথে, না তাঁর কার্যাবলীর সাথে।

হযরত ঈসা (আ) যখন বনী ইসরাঈলের নিকট অকাট্য দলীল-প্রমাণ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তখন তাদের অধিকাংশ লোকই কুফরী, ভ্রষ্টতা, বিদ্বেষ ও অবাধ্যতার উপর অটল থেকে যায়। তবে তাদের একটি ক্ষুদ্র দল তার পক্ষ অবলম্বন করে এবং বিরোধিতাকারীদের প্রতিবাদ জানান। তারা নবীর সাহায্যকারী হন ও তার শিষ্যত্ব বরণ করেন। তাঁরা নবীর আনুগত্য করেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন ও উপদেশ মেনে চলেন। এই ক্ষুদ্র দলটির আত্মপ্রকাশ তখন ঘটে যখন বনী ইসরাঈল তাকে হত্যার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সে যুগের জনৈক বাদশাহর সাথে ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে তাঁকে হত্যা ও শূলে চড়ানোর চক্রান্ত সম্পন্ন করে। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। তাদের মধ্য থেকে নবীকে তাঁর সান্নিধ্যে উঠিয়ে নেন এবং তার একটি শিষ্যকে তাঁর চেহারার অনুরূপ চেহারায় রূপান্তরিত করে দেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলরা তাকে ঈসা মনে করে হত্যা করে ও শূলে চড়ায়। এ ব্যাপারে তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও সত্যকে উপেক্ষা করে। খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক এদের দাবিকে সমর্থন করে। কিন্তু উভয় দলই এ ব্যাপারে ভুলের মধ্যে রয়েছে।

আল্লাহর বাণী “তারা এক চক্রান্ত করেছিল, আর আল্লাহ এক কৌশল অবলম্বন করলেন। আল্লাহই উত্তম কৌশল অবলম্বনকারী।” আল্লাহ আরও বলেনঃ- “স্মরণ কর, মারয়াম তনয় ঈসা বলেছিল, ‘হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সমর্থক এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা।’ পরে সে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের নিকট আসল তারা বলতে লাগল, এতো এক স্পষ্ট যাদু। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহুত হয়েও আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভাতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” (সূরা সাফঃ ৬-৮)

এরপরে আল্লাহ বলেনঃ “হে মুমিনগণ! আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারয়াম তনয় ঈসা বলেছিল তার শিষ্যগণকে, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে?‘ শিষ্যগণ বলেছিল, ‘আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী।’ অতঃপর বনী ইসরাঈলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল। পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শত্রুদের মুকাবিলায়ঃ ফলে তারা বিজয়ী হল। (৬ সূরা সাফঃ ১৪)

অতএব, ঈসা (আ) হলেন বনী ইসরাঈলের শেষ নবী। তিনি তাদের তার পরে আগমনকারী সর্বশেষ নবীর সুসংবাদ দান করেন, তাঁর নাম উল্লেখ করেন এবং তাঁর লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে করে সেই নবী যখন আগমন করবেন তখন তারা তাঁকে চিনতে পারে ও তার আনুগত্য করতে পারে। তারা যাতে কোন রকম অজুহাত তুলতে না পারে, সে জন্যে তিনি দলীল-প্রমাণ চূড়ান্তভাবে পেশ করেন এবং তাদের প্রতি এটা ছিল আল্লাহর অনুকম্পা স্বরূপ। যেমনটি আল্লাহ বলেনঃ “যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়। যে তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার থেকে ও শৃংখল থেকে যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে। তার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (৭ আরাফঃ ১৫৭)

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ... রাসূল (সা)-এর কতিপয় সাহাবীদের বরাতে বর্ণনা করেন যে, একদা তাঁরা বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে অবহিত করুন।’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ইবরাহীম (আ)-এর দোয়ার ফলে, ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ। যখন আমি মায়ের পেটে ছিলাম তখন আমার মা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি নূর বের হয়ে শাম দেশের বুসরা নগরী প্রাসাদরাজিকে আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। ইরবায ইবন সারিয়া ও আবু উমামাও রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণনায় এসেছে যে, আমি ইবরাহীম (আ)-এর দোয়া এবং ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ। ইবরাহীম (আ) যখন কা'বা ঘর নির্মাণ করেন তখন আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন যে, “হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ কর। (২ বাকারাঃ ১২৯)

অতঃপর বনী ইসরাঈলের মধ্যে নবুওতের ধারাবাহিকতা যখন ঈসা (আ) পর্যন্ত এসে শেষ হল তখন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, তাদের মধ্যে নবী প্রেরণের ধারা শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর আরবদের মধ্যে এক উম্মী নবী আসবেন। তিনি হবেন খাতিমুল আম্বিয়া বা শেষ নবী। তাঁর নাম হবে আহমদ, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম। ইসমাঈল ইবন ইবরাহীমের বংশধর।

আল্লাহ বলেন, “পরে সে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের নিকট আসল, তারা বলতে লাগল, এতো এক স্পষ্ট যাদু” (৬ সাফঃ ৬)। “সে যখন আসল” এখানে 'সে' সর্বনাম দ্বারা ঈসা (আ)-কেও বুঝানো হতে পারে, এবং আবার মুহাম্মদ (সা)-কেও বুঝানো হতে পারে। তারপর আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে, মুসলমানদেরকে সাহায্য করতে এবং নবীকে সম্মান করতে ও ইকামতে দীন এবং দাওয়াত সম্প্রসারণ কাজে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দান করেন।

আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারয়াম-তনয় বলেছিল তার শিষ্যগণকে, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে।” অর্থাৎ আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান জানাবার কাজে কে আমাকে সাহায্য করবে?’ শিষ্যগণ বলেছিল, ‘আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী।” নাসিরা নামক একটি গ্রামে ঈসা নবীর সাথে শিষ্যদের এই কথাবার্তা হয়েছিল; এ জন্যেই পরবর্তীতে তারা নাসারা নামে আখ্যায়িত হয়।

আল্লাহর বাণীঃ- “অতঃপর বনী ইসরাঈলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল।” অথাৎ ঈসা (আ) যখন বনী ইসরাঈলসহ অন্যদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেন তখন কিছু লোক দাওয়াত কবুল করল এবং কিছু লোক প্রত্যাখ্যান করল। সীরাতবেত্তা ইতিহাসবিদ ও তাফসীরবিদগণ লিখেছেন যে, এন্টিয়কের সমস্ত অধিবাসী ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করে। ঈসা (আ) এন্টিয়কে তিনজন দুত প্রেরণ করেন। তাদের এক জনের নাম শামউন আস-সাফা। তারা তার আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ঈমান গ্রহণ করে। সূরা ইয়াসীনে যে তিনজন দূতের উল্লেখ আছে, এরা সেই তিনজন নন, আলাদা তিনজন। আসহাবুল কারিয়ার ঘটনায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা ইতিপূর্বে করেছি। বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ ইয়াহুদী ঈসা (আ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে আল্লাহ ঈমান গ্রহণকারীদেরকে সাহায্য ও শক্তি দান করেন। ফলে তারা ঈমান প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে পর্যুদস্ত করে এবং তাদের উপর বিজয় লাভ করে। এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন, “স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমার মেয়াদ পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে নিচ্ছি এবং যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের মধ্য হতে তোমাকে মুক্ত করছি। আর তোমার অনুসারীগণকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপরে প্রাধান্য দিচ্ছি। (৩ আলে ইমরানঃ ৫৫) এ আয়াতের আলোকে যে সব দল ও সম্প্রদায় হযরত ঈসা(আ)-এর দীন ও দাওয়াতের অধিক নিকটবর্তী, তারা তুলনামূলক নিম্নবর্তীদের উপর বিজয় ও প্রাধান্য লাভ করবে। সুতরাং ঈসা (আ)-এর ব্যাপারে মুসলামানদের বিশ্বাসই যথার্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই। আর তা হচ্ছে তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। সুতরাং নাসারাদের (খ্রীষ্টানদের) উপর তারা বিজয়ী থাকবেন। কেননা, নাসারাগণ তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে তার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে, এবং আল্লাহ্ তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তারা তার চাইতে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছে।

যেহেতু মোটামুটিভাবে অভিশপ্ত ইয়াহুদীদের তুলনায় ঈসা (আ)-এর আদর্শের কাছাকাছি অবস্থানে আছে, সে জন্যে তারা ইয়াহুদীদের উপরে বিজয়ী হয়ে ইসলামের পূর্বেও ছিল এবং ইসলামের আবির্ভাবের পরেও রয়েছে।

২৭
আসমানী খাঞ্চার বিবরণ
আল্লাহর বাণীঃ-

( إِذۡ قَالَ ٱلۡحَوَارِیُّونَ یَـٰعِیسَى ٱبۡنَ مَرۡیَمَ هَلۡ یَسۡتَطِیعُ رَبُّكَ أَن یُنَزِّلَ عَلَیۡنَا مَاۤىِٕدَة مِّنَ ٱلسَّمَاۤءِۖ قَالَ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ ۝ قَالُوا۟ نُرِیدُ أَن نَّأۡكُلَ مِنۡهَا وَتَطۡمَىِٕنَّ قُلُوبُنَا وَنَعۡلَمَ أَن قَدۡ صَدَقۡتَنَا وَنَكُونَ عَلَیۡهَا مِنَ ٱلشَّـٰهِدِینَ ۝ قَالَ عِیسَى ٱبۡنُ مَرۡیَمَ ٱللَّهُمَّ رَبَّنَاۤ أَنزِلۡ عَلَیۡنَا مَاۤىِٕدَة مِّنَ ٱلسَّمَاۤءِ تَكُونُ لَنَا عِید ا لِّأَوَّلِنَا وَءَاخِرِنَا وَءَایَة مِّنكَۖ وَٱرۡزُقۡنَا وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلرَّ  ٰ⁠ زِقِینَ ۝ قَالَ ٱللَّهُ إِنِّی مُنَزِّلُهَا عَلَیۡكُمۡۖ فَمَن یَكۡفُرۡ بَعۡدُ مِنكُمۡ فَإِنِّیۤ أُعَذِّبُهُۥ عَذَاب ا لَّاۤ أُعَذِّبُهُۥۤ أَحَد ا مِّنَ ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah Al-Ma'idah 112 - 115]

—“স্মরণ কর, হাওয়ারীগণ বলেছিল, হে মারয়াম-তনয় ঈসা! তোমার প্রতিপালক কি আমাদের জন্যে আসমান হতে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা (মায়িদা) প্রেরণ করতে সক্ষম? সে বলেছিল, আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। তারা বলেছিল, আমরা চাই যে, তা থেকে কিছু খাব এবং আমাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করবে। আর আমরা জানতে চাই যে, তুমি আমাদেরকে সত্য বলেছ এবং আমরা এর সাক্ষী থাকতে চাই। মারয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্যে আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ কর; এটা আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্যে হবে আনন্দোৎসব স্বরূপ ও তোমার নিকট হতে নিদর্শন। এবং আমাদেরকে জীবিকা দান কর; তুমিই তো শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা। আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের নিকট এটা প্রেরণ করব; কিন্তু এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করলে তাকে এমন শাস্তি দিব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিব না।” (মায়িদাঃ ১১২-১১৫)

তাফসীর গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা খাঞ্চা অবতারণ প্রসংগে সেই সব হাদীস উল্লেখ করেছি যা হযরত ইব্‌ন আব্বাস, সালমান ফারসী, আম্মার ইবন ইয়াসির প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনার সারসংক্ষেপ এই; হযরত ঈসা (আ) হাওয়ারীগণকে ত্রিশ দিন সওম পালনের নির্দেশ দেন। তারা ত্রিশ দিন সওম পালন শেষে ঈসা (আ)-এর নিকট আসমান থেকে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ করার আবদার জানায়। উদ্দেশ্য ছিল— তারা আল্লাহর প্রেরিত এই খাদ্য আহার করবে। তাদের সওম ও দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন এ ব্যাপারে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করবে, সওমের মেয়াদ শেষে সওম ভংগের দিনে ঈদ উৎসব পালন করবে, তাদের পূর্ব পুরুষ ও উত্তর পুরুষ এবং তা ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্যে আনন্দের বিষয় হিসেবে গণ্য হবে। ঈসা (আ) এ ব্যাপারে তাদেরকে অনেক উপদেশ দিলেন। তার আশংকা হল, এরা আল্লাহর এ নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে এবং এর শর্তাদি পূরণ করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু তারা তাদের আবদার পূরণ না হওয়া পর্যন্ত উপদেশ শুনতে প্রস্তুত হল না। অবশেষে তাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করতে প্রস্তুত হন। তিনি সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। পশম ও চুলের তৈরি কম্বল পরিধান করলেন এবং অবনত মস্তকে কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিলেন। তিনি আল্লাহর নিকট কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করলেন যেন তাদের প্রার্থীত জিনিস তিনি দিয়ে দেন আর আল্লাহ আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করেন।

মানুষ তাকিয়ে দেখছিল যে, দু'টি মেঘের মাঝখান থেকে খাঞ্চাটি ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসছে। খাঞ্চাটি যতই পৃথিবীর নিকটবর্তী হচ্ছিল ততই ঈসা (আ) বেশী বেশী করে আল্লাহর নিকট দোয়া করছিলেন, “হে আল্লাহ! একে তুমি রহমত, বরকত ও শান্তি হিসেবে দান কর। শাস্তি হিসেবে দিও না।” খাঞ্চাটি ক্রমান্বয়ে নেমে এসে একেবারে নিকটবর্তী হয়ে গেল এবং ঈসা (আ)-এর সম্মুখে মাটির উপর থামল। খাঞ্চাটি ছিল রুমাল দিয়ে ঢাকা। ঈসা (আ) ( بسم الله خير الرازقين ), বলে রুমালখানা উঠালেন। দেখলেন, তাতে সাতটি মাছ ও সাতটি রুটি আছে। কেউ বলেছেন, এর সাথে সির্কা ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ঐগুলোর সাথে ডালিম এবং ফল ফলাদিও ছিল। উক্ত খাদ্য দ্রব্যগুলো ছিল অত্যন্ত সুগন্ধি। আল্লাহ বলেছিলেন, 'হও’ আর তাতেই তা হয়ে গিয়েছিল। তারপর ঈসা (আ) তাদেরকে খাওয়ার জন্যে আহ্বান করেন। তারা বলল, ‘আপনি প্রথমে খাওয়া আরম্ভ করুন তারপরে আমরা খাব।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘এ খাঞ্চার জন্যে তোমরাই প্রথমে আবেদন করেছিলে;’ কিন্তু প্রথমে খেতে তারা কিছুতেই রাজি হল না। হযরত ঈসা (আ) তখন ফকীর, মিসকীন, অভাবগ্রস্ত, রোগাক্রান্ত ও পঙ্গুদেরকে খাওয়ার আদেশ দেন। এ জাতীয় লোকদের সংখ্যা ছিল তেরশ'। সকলেই তা থেকে খেলো। ফলে দুঃখ-দুর্দশা ও রোগ-শোক যার যে সমস্যা ছিল, এই খাদ্যের বরকতে তা থেকে সে নিরাময় লাভ করল। যারা খেতে অস্বীকার করেছিল তা দেখে তারা খুবই লজ্জিত হলো ও অনুশোচনা করতে লাগল। কথিত আছে, এই খাঞ্চা প্রতিদিন একবার করে আসত। লোক এ থেকে তৃপ্তি সহকারে আহার করত। খাদ্য একটুও হ্রাস পেতো না। প্রথম দল যেভাবে আহার করত, শেষের দলও ঐ একইভাবে আহার করত। কথিত আছে, প্রতিদিন সাত হাজার লোক ঐ খাদ্য আহার করত।

কিছু দিন অতিবাহিত হলে একদিন পর পর খাঞ্চা অবতরণ করত। যেমন সালিহ (আ)-এর উটনীর দুধ একদিন পর পর লোকেরা পান করত। অতঃপর আল্লাহ্ হযরত ঈসা (আ)-কে আদেশ দেন যে, এখন থেকে খাঞ্চার খাবার শুধুমাত্র দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত লোকেরাই আহার করবে। ধনী লোকেরা তা থেকে আহার করতে পারবে না। এই নির্দেশ অনেককেই পীড়া দেয়। মুনাফিকরা এ নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করতে শুরু করল। ফলে আসমানী খাঞ্চা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল এবং সমালোচনাকারীরা শূকরে পরিণত হল।

ইবন আবি হাতিম ও ইবন জারীর উভয়ে,... আম্মার ইবন ইয়াসির (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ রুটি ও গোশতসহ খাঞ্চা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং বনী ইসরাঈলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা এর অপব্যবহার করবে না, সঞ্চয় করে রাখবে না ও আগামী দিনের জন্যে ঘরে তুলে নিবে না। কিন্তু তারা এতে খিয়ানত করে সঞ্চয় করে রাখে ও আগামী দিনের জন্যে ঘরে তুলে নেয়। ফলে তাদেরকে বানর ও শূকরে পরিণত করা হয়। ইবন জারীর আম্মার (রা) থেকে বিভিন্ন সূত্রে মওকুফরূপে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং এটাই সঠিক। হাদীসটি যে সূত্রে মারফুরূপে বর্ণিত হয়েছে তা’ মুনকাতা বা বিভিন্ন সূত্রের হাদীস। হাদীসটির মারফু হওয়া নিশ্চিত হলে এ ব্যাপারে এটি হবে চড়ান্ত ফয়সালা। কেননা, খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা আদৌ অবতীর্ণ হয়েছিল কি না সে সম্পর্কে আলিমদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে অধিকাংশের মতে তা অবতীর্ণ হয়েছিল। উপরোক্ত হাদীস ও কুরআনের প্রকাশভংগী থেকে তাই বুঝা যায়।

বিশেষ করে এই আয়াত

( إِنِّی مُنَزِّلُهَا عَلَیۡكُمۡ )

(আমি অবশ্যই তা তোমাদের উপর অবতীর্ণ করব।) ইবন জারীর দৃঢ়তার সাথে এই মর্তের পক্ষে প্রমাণাদি উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশুদ্ধ সনদে মুজাহিদ ও হাসান বসরীর মতামত উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, মায়িদা আদৌ অবতীর্ণ হয়নি। তারা বলেন, এই আয়াত “এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করলে তাকে এমন শাস্তি দিব, যে শান্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিব না”। (মায়িদাঃ ১১৫) যখন নাযিল হয় তখন বনী ইসরাঈলরা মায়িদা অবতীর্ণের আবদার প্রত্যাহার করে নেয়। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, নাসারাগণ মায়িদার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নয় এবং তাদের কিতাবেও এ ঘটনার বাস্তবে কোন উল্লেখ নেই। অথচ এমন একটি ঘটনা বাস্তবে সংঘটিত হলে তার উল্লেখ না থেকে পারে না। তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি। আগ্রহী ব্যক্তি সেখান থেকে দেখে নিতে পারেন।

২৮
পরিচ্ছেদ
আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া.......বকর ইবন আবদিল্লাহ মুযানী থেকে বর্ণনা করেনঃ একদা হাওয়ারীগণ হযরত ঈসা (আ)-কে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জনৈক ব্যক্তি তাদেরকে বলল, তিনি সমুদ্রের দিকে গিয়েছেন। তারা সন্ধান করতে করতে সমুদ্রের দিকে গেল। সমুদ্রের তীরে গিয়ে দেখেন, তিনি পানির উপর দিয়ে হাঁটছেন। সমুদ্রের তরঙ্গ একবার তাঁকে উপরে উঠাচ্ছে আরেকবার নীচে নামাচ্ছে। একটি চাদরের অর্ধেক গায়ের উপর দিয়ে রেখেছেন আর বাকী অর্ধেক তার পরিধানে আছে। পানির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি তাদের নিকটে আসেন। তাঁদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিটি বললেন, “হে আল্লাহর নবী! আমি কি আপনার নিকট আসব?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এস, যখন তিনি এক পা পানিতে রেখে অন্য পা তুলেছেন, অমনি চিৎকার করে। উঠেন উহঃ হে আল্লাহর নবী! আমি তো ডুবে গেলাম।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘ওহে দুর্বল ঈমানদার! তোমার হাত আমার দিকে বাঁড়াও! কোন আদম সন্তানের যদি একটা যব পরিমাণও ঈমান থাকে তাহলে সে পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারে।’

আবু সাঈদ ইবনুল আরাবী.... বকর থেকে অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইবন আবিদ দুনিয়া.... ফুযায়ল ইবন ইয়ায থেকে বর্ণনা করেনঃ জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘হে ঈসা! আপনি কিসের সাহায্যে পানির উপর দিয়ে হাঁটেন?’ তিনি বললেন, ঈমান ও ইয়াকীনের বলে। উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘আপনি যেমন ইয়াকীন রাখেন, আমরাও তেমনি ইয়াকীন রাখি।’ ঈসা বললেন, ‘তাই যদি হয় তা হলে তোমরাও পানির উপর দিয়ে হেঁটে চল।’ তখন তারা নবী ঈসার সাথে পানির উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করল। কিন্তু ঢেউ আসা মাত্রই তারা সকলেই ডুবে গেল। নবী বললেন, ‘তোমাদের কী হল হে?’ তারা বলল, ‘আমরা ঢেউ দেখে ভীত হয়ে গিয়েছিলাম।’ নবী বললেন, ‘কত ভাল হত যদি ঢেউ এর মালিককে তোমরা ভয় করতে।’ অতঃপর তিনি তাদেরকে বের করে আনলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মাটিতে হাত মেরে এক মুষ্টি মাটি নিলেন। পরে হাত খুললে দেখা গেল এক হাতে স্বর্ণ এবং অন্য হাতে মাটির ঢেলা কিংবা কঙ্কর। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ দু'হাতের কোনটির বস্তু তোমাদের কাছে প্রিয়তর?’ তারা বলল, ‘স্বর্ণ।’ নবী বললেন, ‘আমার নিকট স্বর্ণ ও মাটি উভয়ই সমান।’ ইতিপূর্বে ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়া (আ)-এর ঘটনায় আমরা উল্লেখ করেছি যে, হযরত ঈসা (আ) পশমী বস্ত্র পরিধান করতেন, গাছের পাতা আহার করতেন। তাঁর বসবাসের কোন ঘরবাড়ী ছিল না। পরিবার ছিল না, অর্থ সম্পদ ছিল না এবং আগামী দিনের জন্যে কিছু সঞ্চয় করেও তিনি রাখতেন না। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি তাঁর মায়ের সূতা কাটার চরকার আয় থেকে আহার করতেন।

ইবন আসাকির শা’বী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ঈসা (আ)-এর সম্মুখে কিয়ামতের আলোচনা করা হলে তিনি চিৎকার করে উঠতেন এবং বলতেন, ‘ইব্‌ন মারয়ামের নিকট কিয়ামতের আলাচনা করা হবে আর তিনি চুপচাপ থাকবেন তা হয় না।’ আবদুল মালিক ইবন সাঈদ ইবন বাহর থেকে বর্ণিতঃ হযরত ঈসা (আ) যখন উপদেশ বাণী শুনাতেন তখন তিনি সন্তান হারা মায়ের ন্যায় কান্নাকাটি করতেন। আবদুর রাযযাক জাফর ইবন বালকাম থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আ) সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে এরূপ দোয়া করতেন, “হে আল্লাহ! আমার যা অপছন্দ তা থেকে আত্মরক্ষা করতে আমি সক্ষম নই; যে কল্যাণ আমি পেতে চাই তা আমার অধিকারে নেই, সব বিষয় রয়েছে অন্যের হাতে, আমি আমার কাজের মধ্যে বন্দী; সুতরাং আমার চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই। হে আল্লাহ! আমার শত্রুকে হাসিয়ো না এবং আমার কারণে আমার বন্ধুকে কষ্ট দিও না। আমার দীনের মধ্যে সংকট সৃষ্টি করিও না এবং আমার প্রতি সদয় হবে না এমন লোককে আমার উপর চাপিয়ে দিও না।”

ফুযায়ল ইবন ইয়ায, ইউনুস ইব্‌ন উবায়দ সূত্রে বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা (আ) বলতেন, যতক্ষণ আমরা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে বিমুখ হতে না পারবো, ততক্ষণ প্রকৃত ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারব না। ফুযায়ল আরও বলেছেন, ঈসা (আ) বলতেন, আমি সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছি। তাতে আমি দেখেছি যে, যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার তুলনায় যাকে সৃষ্টি করা হয়নি সে-ই আমার কাছে বেশী ঈর্ষণীয়। ইসহাক ইবন বিশর..... হাসান (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন হযরত ঈসা (আ) হবেন সংসার-বিমুখদের নেতা। তিনি আরও বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন পাপ থেকে পলায়নকারী লোকদের হাশর হবে ঈসা (আ)-এর সাথে।

রাবী আরও বলেনঃ একদিন হযরত ঈসা (আ) একটি পাথরের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। তিনি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এমন সময় ঐ স্থান দিয়ে ইবলিস যাচ্ছিল। সে বলল, “ওহে ঈসা! তুমি কি বলে থাক না যে, দুনিয়ার কোন বস্তুর প্রতি তোমার আগ্রহ নেই? কিন্তু এই পাথরটি তো দুনিয়ার বস্তু।" তখন হযরত ঈসা (আ) পাথরটি ধরে তার দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন, ‘দুনিয়ার সাথে এটিও তুই নিয়ে যা।’ মু'তামির ইবন সুলায়মান বলেন, একদা হযরত ঈসা (আ) তাঁর শিষ্যদের সাথে নিয়ে বের হন। তাঁর পরিধানে ছিল পশমের জুব্বা, চাদর ও অন্তর্বাস। তাঁর পায়ে কোন জুতা ছিল না। তিনি ছিলেন ক্রন্দনরত। তার মাথার চুল ছিল এলোমেলো। ক্ষুধার তীব্রতায় চেহারা ছিল ফ্যাকাশে। পিপাসায় ঠোঁট দু'টি শুষ্ক। এ অবস্থায় তিনি বনী ইসরাঈলের লোকদেরকে সালাম দিয়ে বললেনঃ ‘আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি দুনিয়াকে তারা সঠিক অবস্থানে রেখেছি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই এবং এর জন্যে আমার গৌরবেরও কিছু নেই। তোমরা কি জান, আমার ঘর কোথায়?’ তারা বলল, ‘হে রুহুল্লাহ্! কোথায় আপনার ঘর?’ তিনি বললেন, ‘আমার ঘর হল মসজিদ, পানি দিয়েই আমার অঙ্গসজ্জা। ক্ষুধাই আমার ব্যঞ্জন। রাতের চাঁদ আমার বাতি, শীতকালে আমার সালাত পূর্বাচল, শাক-সজিই আমার জীবিকা, মোটা পশমই আমার পোষাক। আল্লাহর ভয়ই আমার পরিচিতি, পঙ্গু ও নিঃস্বরা আমার সঙ্গী-সাথী। আমি যখন সকালে উঠি তখন আমার হাত শূন্য, যখন সন্ধ্যা হয় তখনও আমার হাতে কিছু থাকে না। এতে আমি সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন। সুতরাং আমার চাইতে ধনী ও সচ্ছল আর কে আছে?’ বর্ণনাটি ইবন আসাকিরের।

আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে তিনি বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহ হযরত ঈসার নিকট এই মর্মে ওহী পাঠান যে, তোমাকে শত্রুরা যাতে চিনতে ও কষ্ট দিতে না পারে সে জন্যে তুমি সর্বদা স্থান পরিবর্তন করতে থাকবে। আমার সম্ভ্রম ও প্রতিপত্তির কসম, আমি তোমাকে এক হাজার হুরের সাথে বিবাহ দিব এবং চারশ' বছর যাবত ওলীমা খাওয়াব। এ হাদীসটি গরীব পর্যায়ের। এটা একটি ইসরাঈলী বর্ণনা। আবদুল্লাহ ইবন মুবারক, খালফ ইবন হাওশব থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেন, রাজা-বাদশাহরা যেমন দীন ও হিকমত তোমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে, তোমরাও তেমন তাদের জন্যে দুনিয়া ছেড়ে দাও। কাতাদা বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেছিলেনঃ তোমরা আমার নিকট প্রশ্ন কর। কেননা, আমার অন্তর কোমল, নিজের কাছে আমি ক্ষুদ্র। ইসমাঈল ইবন আইয়্যাশ... ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেনঃ যবের রুটি আহার কর, খালিস পানি পান কর এবং দুনিয়া থেকে শান্তি ও নিরাপদের সাথে বের হয়ে যাও। আমি তোমাদেরকে নিগুঢ় তত্ত্বকথা জানাচ্ছি যে, দুনিয়ায় যা সুস্বাদু, আখিরাতে তা বিস্বাদ আর দুনিয়ায় যা বিস্বাদ আখিরাতে তা-ই সুস্বাদু। আল্লাহর প্রকৃত বান্দারা দুনিয়ায় ভোগ বিলাসের জীবন যাপন করতে পারে না। তোমাদেরকে আমি সঠিক বলছি যে, তোমাদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হচ্ছে সেই লোক, যে জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং চায় যে, সকলেই যেন তার মত হয়।

আবু হুরায়রা (রা) থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু মুসআব মালিক থেকে বর্ণনা করেন ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলদেরকে বলতেনঃ খালিস পানি পান কর, তাজা সব্জি খাও এবং যবের রুটি আহার কর। গমের রুটি খেয়ো না যেন। কেননা তোমরা এর শোকর আদায় করতে পারবে না। ইবন ওহাব ……... ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলতেনঃ- তোমরা দুনিয়া অতিক্রম করে যাও। একে আবাদ করো না। তিনি বলতেন ও দুনিয়ার মহব্বত সকল গুনাহের মূল এবং কুদৃষ্টি অন্তরের মধ্যে কাম-ভাব উৎপন্ন করে। উহায়ব ইবন ওয়ারদও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তার বর্ণনায় এইটুকু বেশী আছে যে, কামনা-বাসনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখে ফেলে। ঈসা (আ) বলতেন, “হে দুর্বল আদম-সন্তান! যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর, দুনিয়ায় মেহমান হিসেবে জীবন যাপন কর। মসজিদকে নিজের ঘর বানাও। চক্ষুদ্বয়কে কাঁদতে শিখাও, দেহকে ধৈর্য ধারণ করতে ও অন্তরকে চিন্তা করতে অভ্যস্ত কর। আগামী দিনের খাদ্যের জন্যে দুশ্চিন্তা করো না। এটা পাপ। তিনি বলতেন, সমুদ্রের তরঙ্গের উপরে ঘর বানান যেমন সম্ভব নয় তেমনি দুনিয়ায় স্থায়ীভাবে থাকাও সম্ভব নয়।’ কবি সাবিকুল বরবরী এ প্রসংগে সুন্দর কথা বলেছেন যথাঃ

الكم بيوت بمستن السيوف وهل - يبنى على الماء بيت اسه مدر

অর্থাৎ তলোয়ারের পথেই তোমাদের ঘর শোভা পায়। যে ঘরের ভিত্তি মাটির উপরে, তা কি পানির উপরে বানানো সম্ভব?

সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ঈসা (আ) বলেছেনঃ মুমিনের অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত ও আখিরাতের মহব্বত একত্রে থাকতে পারে না- যেভাবে একত্রে থাকতে পারে না একই পাত্রে আগুন ও পানি। ইবরাহীম হারবী.... আবু আবদুল্লাহ সূফী সূত্রে বলেন, ঈসা (আ) বলেছেনঃ দুনিয়া অন্বেষণকারী লোক সমুদ্রের পানি পানকারীর সাথে তুলনীয়। সমুদ্রের পানি যত বেশী পান করবে তত বেশী পিপাসা বৃদ্ধি পাবে এবং তা তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে। ঈসা (আ) বলেছেনঃ শয়তান দুনিয়া অন্বেষণ ও কামনাকে আকর্ষণীয় করে এবং প্রবৃত্তির লালসার সময় শক্তি যোগায়।

আ’মাশ খায়ছামা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) সংগী-সাথীদের সামনে আহার্য রেখে নিজে আহার থেকে বিরত থাকতেন এবং বলতেন, মেহমানদের সাথে তোমরাও এইরূপ আচরণ করবে। জনৈক মহিলা ঈসা (আ)-কে বলেছিল, ‘ধন্য সেই লোক, যে আপনাকে ধারণ করেছিল এবং ধন্য সেই স্থান যে আপনাকে দুধ পান করিয়েছিল।’ উত্তরে ঈসা (আ) বলেছিলেন, ‘ধন্য সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে ও তাঁর বিধান মেনে চলে।’ ঈসা (আ) আরও বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্যের অধিকারী যে নিজের গুনাহ স্মরণ করে কান্নাকাটি করে, জিহ্বাকে সংযত রাখে এবং যার ঘরই তার জন্য যথেষ্ট হয়।’ তিনি বলেছেন, ‘ঐ চক্ষুর জন্যে সুসংবাদ, যে গুনাহ থেকে চিন্তামুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যায় এবং জেগে উঠে গুনাহ বিহীন কাজে মনোনিবেশ করে।’ মালিক ইবন দীনার থেকে বর্ণিত। ঈসা (আ) আপন শিষ্যবর্গের সাথে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে একটি মৃত দেহ দেখতে পেলেন। শিষ্যরা বলল, ‘মৃত দেহ থেকে তীব্র দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তার দাঁতগুলো কত সাদা।’ এ কথা বলে তিনি শিষ্যদেরকে গীবত করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া.... যাকারিয়া ইবন আদী সূত্রে বর্ণনা করেনঃ একদা ঈসা (আ) ইবন মারয়াম বললেন, ‘হে হওয়ারীগণ! দীন নিরাপদ থাকলে দুনিয়ার নিম্নমান নিয়েই সন্তুষ্ট থাক; যেমন দুনিয়াদার ব্যক্তিরা দুনিয়ার জীবন নিরাপদ থাকলে দীনের নিম্নমান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে।’ এ প্রসংগে কবি বলেনঃ-

اری رجالا بادني الدين قد قنعوا -ولا أراهم رضوا في العيش بالدون فاستغن بالدين عن دنيا الملوك كما-استغنى الملوك بدنياهم عن الدين

অর্থাৎ আমি লক্ষ্য করেছি, এক শ্রেণীর লোক আছে যাদের মধ্যে দীন কম থাকলেও তাতেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু দুনিয়ার সংকীর্ণতায় তারা রাজী নয়। সুতরাং রাজা বাদশাহদের দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে দীন নিয়েই তুমি সন্তুষ্ট থাক, যেমন রাজা বাদশাহরা দীন থেকে বিমুখ হয়ে দুনিয়া পেয়ে সন্তুষ্ট থাকে।

আবু মাসআব মালিক থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইবন মারয়াম বলেছেনঃ- আল্লাহর যিকির ব্যতীত কথাবার্তা বেশী বল না; অন্যথায় তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে যাবে। আর কঠিন অন্তর আল্লাহ্ থেকে দূরে থাকে, কিন্তু তোমরা সে বিষয়ে অবগত নও। মানুষের গুনাহের প্রতি এমনভাবে দৃষ্টি দিও না, যেন তুমিই প্রভু বরং নিজেকে দাসের ভুমিকায় রেখে সে দিকে লক্ষ্য কর। কেননা, মানুষ দুই শ্রেণীর হয়ে থাকে। কেউ বিপদ থেকে মুক্ত, কেউ বিপদগ্রস্ত। বিপদগ্রস্তের প্রতি সদয় হও এবং বিপদমুক্তের জন্যে আল্লাহর প্রশংসা কর। ছাওরী, ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) তাঁর সাথীদেরকে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে যথার্থ বলছি, যে ব্যক্তি ফিরদাউস আশা করেন তার উচিত যবের রুটি আহার করা এবং আবর্জনা স্তুপের মধ্যে কুকুরদের সাথে বেশী বেশী ঘুমান। মালিক ইবন দীনার বলেন, ঈসা (আ) বলেছেন, ‘ছাইযুক্ত যব আহার করা এবং আবর্জনার উপরে কুকুরের সাথে ঘুমানোর অভ্যাস ফিরদাউস প্রত্যাশীদের মধ্যে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।’

আবদুল্লাহ ইবন মুবারক...... সালিম ইবন আবিল জা’দ সূত্রে বর্ণনা করেন। হযরত ঈসা (আ) বলেছেনঃ- তোমরা কাজ কর আল্লাহর জন্যে, পেটের জন্যে নয়। পাখীদের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা সকালে বের হয়। সন্ধ্যায় ফিরে তারা চাষাবাদও করে না, ফসলও ফলায় না; আল্লাহ-ই তাদেরকে খাওয়ান। যদি বল যে, পাখীদের চেয়ে আমাদের পেট বড়। তা হলে গরু ও গাধার দিকে তাকাও। সকালে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এরাও না ক্ষেত করে, না ফসল ফলায়; আল্লাহ্-ই এদেরকে রিযিক দান করেন। সাফওয়ান ইবন আমর ...… ইয়াযীদ ইবন মায়সারা থেকে বর্ণনা করেন, একদা হাওয়ারীগণ ঈসা (আ)-কে বললেন, ‘হে মাসীহুল্লাহ! দেখুন, আল্লাহর মসজিদ কতই না সুন্দর।’ মাসীহ বললেন, ‘ঠিক ঠিক; তবে আমি তোমাদেরকে যথার্থ জানাচ্ছি, আল্লাহ এ মসজিদের পাথরগুলোকে স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান রাখবেন না। বরং তার সাথে সংশ্লিষ্টদের গুনাহের কারণে ধ্বংস করে দিবেন। তোমাদের স্বর্ণ-রৌপ্য ও পছন্দনীয় ধন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহর কোন কাজ নেই। এই দুনিয়ায় আল্লাহর নিকট প্রিয় বস্তু হচ্ছে সৎ অন্তর। এর সাহায্যেই আল্লাহ দুনিয়াকে আবাদ রেখেছেন এবং এর জন্য তিনি দুনিয়া ধ্বংস করে দিবেন, যখন তা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।’

ইবন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে মুজাহিদের সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী আকরম (সা) বলেছেনঃ- একদা হযরত ঈসা (আ) একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। শহরের বিধ্বস্ত প্রাসাদরাজি দেখে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কিছু সময় পর তিনি আল্লাহর নিকট আবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ! এই শহরকে আমার কতিপয় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার অনুমতি দিন।’ আল্লাহ তা'আলা বিধ্বস্ত শহরটিকে ঈসার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। তখন শহরটি ঈসা (আ)-কে ডেকে বলল, ‘হে প্রিয় নবী ঈসা (আ)! আপনি আমার নিকট কী জানতে চান?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তোমার বৃক্ষরাজি কোথায় গেল? তোমার নদী-নালার কী হলো? তোমার প্রাসাদ-রাজির কী অবস্থা? তোমার বাসিন্দারা কোথায় গেল?’ উত্তরে শহর বলল, ‘হে প্রিয় নবী! আল্লাহর ওয়াদা কার্যকরী হয়েছে। তাই আমার বৃক্ষরাজি শুকিয়ে গিয়েছে, নদী-নালা পানিশূন্য হয়ে গিয়েছে, প্রাসাদরাজি ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে এবং আমার বাসিন্দারা সবাই মারা গিয়েছে।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তবে তাদের ধন-সম্পদ কোথায়?’ শহরটি উত্তর দিল, ‘তারা হালাল ও হারাম পন্থায় নির্বিচারে সম্পদ সঞ্চয় করেছিল, সে সবই আমার অভ্যন্তরে রক্ষিত আছে। আসমান ও যমীনের সব কিছুর সত্ত্বাধিকারী তো আল্লাহ্ই।’

অতঃপর ঈসা (আ) বললেনঃ তিন ব্যক্তির ব্যাপারে আমার অবাক লাগে। তারা হলঃ

(১) যে ব্যক্তি দুনিয়ার সন্ধানে মত্ত। অথচ মৃত্যু তার পশ্চাতে লেগে আছে

(২) যে ব্যক্তি প্রাসাদ নির্মাণ করছে, অথচ কবর তার ঠিকানা;

(৩) যে ব্যক্তি অট্টহাসিতে মজে থাকে, অথচ তার সম্মুখে আগুন। আদম-সন্তানের অবস্থা এই যে, অধিক পেয়েও সে তৃপ্ত হয় না; আর কম পেলেও তুষ্ট থাকে না। হে আদম সন্তান! তুমি তোমার ধন-সম্পদ এমন লোকদের জন্যে সঞ্চয় করে রেখে যাচ্ছ, যারা তোমার প্রশংসা করবে না। তুমি এমন প্রভুর পানে এগিয়ে চলছ, যিনি তোমার কোন ওযর শুনবেন না। তুমি তো তোমার পেট ও প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে রয়েছে। কিন্তু তোমার পেট সেই দিন পূর্ণ হবে, যে দিন তুমি কবরে প্রবেশ করবে। হে আদম-সন্তান! অচিরেই তুমি কবরে প্রবশ করবে। হে আদম সন্তান! অচিরেই তুমি দেখতে পাবে, তোমার সঞ্চিত ধন-রত্ন অন্যের পাল্লাকে ভারী করছে।’ এ হাদীসটি সনদের বিচারে খুবই গরীব পর্যায়ের। কিন্তু উত্তম উপদেশপূর্ণ হওয়ায় উল্লেখিত হলো।

সুফিয়ান ছাওরী ইবরাহীম তায়মী সূত্রে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেনঃ- ‘হে হাওয়ারীগণ! তোমরা তোমাদের মূল্যবান সম্পদ আসমানে রাখ। কেননা, মানুষের অন্তর সেই দিকেই আকৃষ্ট থাকে, যেখানে তার মূল্যবান সম্পদ সঞ্চিত থাকে। ছাওর ইবন ইয়াযীদ আবদুল আযীয ইবন যুবয়ান থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইবন মারয়াম থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইবন মারয়াম বলেছেনঃ- যে ব্যক্তি ইলম শিখে অন্যকে শিখায় এবং সে মতে আমল করে, উর্ধজগতে তাকে বিরাট সম্মানে ভূষিত করা হয়।’ আবু কুরায়ব বলেন, বর্ণিত আছে, হযরত ঈসা (আ) বলেছেনঃ- ‘যেই ইলম তোমাকে কাজের ময়দানে নিয়ে যায় না, কেবল মজলিস মাহফিলে নিয়ে যায়, তাতে কোন কল্যাণ নেই।’ ইবন আসাকির এক গরীব সনদে ইবন আব্বাস থেকে মারফু হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলদের মাঝে গিয়ে এক ভাষণে বলেনঃ- ‘হে হাওয়ারীগণ! অযোগ্য লোকদের নিকট হিকমতের কথা বলিও না। এরূপ করলে হিকমত ও প্রজ্ঞাকে হেয় করা হবে। কিন্তু যোগ্য লোকদের নিকট তা বলতে কৃপণতা কর না। তা হলে তাদের উপর অবিচার করা হবে। যে কোন বিষয়ের তিনটি অবস্থা হতে পারে (১) যার উত্তম হওয়া স্পষ্ট; এগুলোর অনুসরণ কর। (২) যার মন্দ হওয়া স্পষ্ট; এর থেকে দূরে থাক। (৩) যার ভাল বা মন্দ হওয়া সন্দেহযুক্ত; তার ফয়সালা আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। আবদুর রাযযাক .....ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) বলেছেন শূকরের কাছে মুক্তা ছড়ায়ো না। কেননা মুক্তা দিয়ে সে কিছুই করতে পারে না, আর জ্ঞানপূর্ণ কথা ঐ ব্যক্তিকে বলো না, যে তা শুনতে চায় না। কেননা জ্ঞানপূর্ণ কথা মুক্তার চাইতেও মূল্যবান আর যে তা চায় না, সে শূকরের চাইতেও অধম। ওহাব প্রমুখ রাবী ইকরিমা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইকরিমা আরও বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) হাওয়ারীদেরকে বলেছেনঃ তোমরা হচ্ছ পৃথিবীতে লবণ তুল্য। যদি নষ্ট হয়ে যাও তবে তোমাদের জন্য কোন ঔষধ নেই। তোমাদের মধ্যে মূর্খতার দু’টি অভ্যাস আছে (১) বিনা কারণে হাসা এবং (২) রাত্রি জাগরণ না করে সকালে উঠা। ইকরিমা থেকে বর্ণিত, ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন ব্যক্তির ফিতনা সবচাইতে মারাত্মক? তিনি বললেনঃ আলিমের পদস্খলন। কেননা আলিমের পদস্খলনে আরও বহু লোক বিপথগামী হয়ে যায়। রাবী আরও বলেন, হযরত ঈসা (আ) বলেছেনঃ- ‘হে জ্ঞান পাপীরা! দুনিয়াকে তোমরা মাথার উপরে রেখেছ, আর আখিরাতকে রেখেছ পায়ের নীচে। তোমাদের কথাবার্তা যেন সর্বরোগের নিরাময় হয়। কিন্তু তোমাদের কার্যকলাপ হচ্ছে মহাব্যাধি। তোমাদের উপমা হচ্ছে সেই মাকাল গাছ যা দেখলে মানুষ আকৃষ্ট হয় কিন্তু তার ফল খেলে মারা যায়।’ ওহাব থেকে বর্ণিত, ঈসা (আ) বলেছেনঃ ‘হে নিকৃষ্ট জ্ঞান পাপীরা! তোমরা জান্নাতের দরজায় বসে আছ, কিন্তু তাতে প্রবেশ করছো না আর নিঃস্বদেরকে তাতে প্রবেশ করার জন্যে আহবানও করছ না। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট মানুষ সেই জ্ঞানী ব্যক্তি, যে তার জ্ঞানের বিনিময়ে দুনিয়া অর্জন করে।’ মাকহুল বর্ণনা করেন, একবার ঈসার সাথে ইয়াইয়া (আ)-এর সাক্ষাত হয়। ঈসা (আ) হাসিমুখে তার সাথে মুসাফাহা করেন। ইয়াহইয়া (আ) বললেন, ‘কি খালাত ভাই! হাসছেন যে, মনে হচ্ছে আপনি নিরাপদ হয়ে গেছেন?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তোমাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন, নৈরাশ্যে ভুগছ না কি?’ তখন আল্লাহ উভয়ের নিকট ওহী প্রেরণ করে জানালেন, তোমাদের দুজনের মধ্যে সে-ই আমার নিকট প্রিয়তর, যে তার সঙ্গীর সাথে অধিকতর হাসিমুখে মিলিত হয়।

ওহাব ইবন মুনাবিহ বর্ণনা করেছেন, একদা হযরত ঈসা ও তাঁর সংগীরা একটি কবরের পাশে থামলেন। ঐ কবরবাসী সংকটপূর্ণ অবস্থায় ছিল। তখন সংগীরা কবরের সংকীর্ণতা নিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। তাদের কথা শুনে ঈসা (আ) বললেনঃ ‘তোমরা মায়ের পেটে এর চেয়ে সংকীর্ণ স্থানে ছিলে। তারপরে আল্লাহ যখন চাইলেন প্রশস্ত জায়গায় নিয়ে আসলেন।’ আবু উমর বলেন, ঈসা (আ) যখন মৃত্যুর কথা আলোচনা করতেন, তখন তার চামড়া ভেদ করে রক্ত ঝরে পড়ত। হযরত ঈসা (আ)-এর থেকে এ জাতীয় অনেক উক্তি বর্ণিত আছে। হাফিজ ইবন আসাকির তাঁর গ্রন্থে বহু উক্তি উদ্ধত করেছেন। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু উল্লেখ করলাম।

২৯
হযরত ঈসা (আ)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়ার বর্ণনা
আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ঈসা (আ)-কে রক্ষা এবং ইয়াহুদী ও নাসারাদের তাঁকে শূলে চড়াবার মিথ্যা দাবি প্রসঙ্গ

এ প্রসংগে আল্লাহর বাণীঃ-

( وَمَكَرُوا۟ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَیۡرُ ٱلۡمَـٰكِرِینَ ۝ إِذۡ قَالَ ٱللَّهُ یَـٰعِیسَىٰۤ إِنِّی مُتَوَفِّیكَ وَرَافِعُكَ إِلَیَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ وَجَاعِلُ ٱلَّذِینَ ٱتَّبَعُوكَ فَوۡقَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوۤا۟ إِلَىٰ یَوۡمِ ٱلۡقِیَـٰمَةِۖ ثُمَّ إِلَیَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأَحۡكُمُ بَیۡنَكُمۡ فِیمَا كُنتُمۡ فِیهِ تَخۡتَلِفُونَ )

[Surah Aal-E-Imran 54 - 55]

—এবং তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, “হে ঈসা! আমি তোমার কাল পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে নিচ্ছি এবং যারা কুফরী করেছে তাদের মধ্য হতে তোমাকে পবিত্র করছি। আর তোমার অনুসারীদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপর প্রাধান্য দিচ্ছি। অতঃপর আমার কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর যে বিষয়ে তোমাদের মতান্তর ঘটছে আমি তা মীমাংসা করে দিব।" (আল-ইমরানঃ ৫৪-৫৫)

আল্লাহ আরও বলেনঃ-

( فَبِمَا نَقۡضِهِم مِّیثَـٰقَهُمۡ وَكُفۡرِهِم بِـَٔایَـٰتِ ٱللَّهِ وَقَتۡلِهِمُ ٱلۡأَنۢبِیَاۤءَ بِغَیۡرِ حَقّ وَقَوۡلِهِمۡ قُلُوبُنَا غُلۡفُۢۚ بَلۡ طَبَعَ ٱللَّهُ عَلَیۡهَا بِكُفۡرِهِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُونَ إِلَّا قَلِیل ا ۝ وَبِكُفۡرِهِمۡ وَقَوۡلِهِمۡ عَلَىٰ مَرۡیَمَ بُهۡتَـٰنًا عَظِیم ا ۝ وَقَوۡلِهِمۡ إِنَّا قَتَلۡنَا ٱلۡمَسِیحَ عِیسَى ٱبۡنَ مَرۡیَمَ رَسُولَ ٱللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَـٰكِن شُبِّهَ لَهُمۡۚ وَإِنَّ ٱلَّذِینَ ٱخۡتَلَفُوا۟ فِیهِ لَفِی شَكّ مِّنۡهُۚ مَا لَهُم بِهِۦ مِنۡ عِلۡمٍ إِلَّا ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّۚ وَمَا قَتَلُوهُ یَقِینَۢا ۝ بَل رَّفَعَهُ ٱللَّهُ إِلَیۡهِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِیزًا حَكِیم ا ۝ وَإِن مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَـٰبِ إِلَّا لَیُؤۡمِنَنَّ بِهِۦ قَبۡلَ مَوۡتِهِۦۖ وَیَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ یَكُونُ عَلَیۡهِمۡ شَهِید ࣰا)

[Surah An-Nisa' 155 - 159]

—এবং তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের অংগীকার ভংগের জন্যে, আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে, নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার জন্যে এবং আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত তাদের এই উক্তির জন্যে। বরং তাদের কুফরীর কারণে তাতে মোহর মেরে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের অল্প সংখ্যাক লোকই বিশ্বাস করে। এবং তারা লা'নতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে ও মারয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্যে। আর আমরা আল্লাহর রাসূল মারয়াম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি তাদের এই উক্তির জন্যে। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি, কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা নিশ্চয়ই তার সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি, এবং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। (নিসাঃ ১৫৫-১৫৯)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা আল্লাহ মানুষকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি হযরত ঈসা (আ) কে নিদ্রাচ্ছন্ন করার পরে আসমানে তুলে নেন-এটা সন্দেহাতীতভাবে বিশুদ্ধ মত। ইয়াহুদীরা ঐ যুগের জনৈক কাফির বাদশাহর সাথে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে যে নির্যাতন করতে চেয়েছিল, আল্লাহ তা থেকে তাকে মুক্ত করেন।

হাসান বসরী ও মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, ঐ বাদশাহর নাম ছিল দাউদ ইব্‌ন নুরা। সে ঈসা (আ)-কে হত্যা ও ক্রুশবিদ্ধ করার হুকুম দেয়। হুকুম পেয়ে ইয়াহুদীরা শুক্রবার দিবাগত শনিবার রাত্রে বায়তুল মুকাদ্দাসের একটি কক্ষে ঈসা (আ)-কে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে যখন হত্যার উদ্দেশ্যে তারা কক্ষে প্রবেশ করে তখন আল্লাহ তাআলা কক্ষে বিদ্যমান ঈসা (আ)-এর অনুসারীদের মধ্য হতে একজনের চেহারাকে তার চেহারার সদৃশ করে দেন এবং ঈসা (আ)-কে বাতায়ন-পথে আকাশে তুলে নেন। কক্ষে যারা ছিল তারা ঈসা (আ)-কে তুলে নেয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল। ইতিমধ্যে বাদশাহর রক্ষীরা কক্ষে প্রবেশ করে ঈসা (আ)-এর চেহারা বিশিষ্ট ঐ যুবককে দেখতে পায়। তারা তাকেই ঈসা (আ) মনে করে ধরে এনে শূলে চড়ায় এবং মাথায় কাঁটার টুপি পরায়। তাঁকে অধিক লাঞ্ছিত করার জন্যে তারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সাধারণ নাসারা, যারা ঈসা (আ)-এর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি, তারা ইয়াহুদীদের ঈসা (আ)-কে ক্রুশ বিদ্ধ করার দাবি মেনে নেয়। ফলে, তারাও সত্য থেকে স্পস্ট ও চূড়ান্ত বিভ্রান্তির অতল তলে নিক্ষিপ্ত হয়। সেই জন্যে আল্লাহ বলেন, “কিতাবীদের প্রত্যেকেই তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস করবে।” অর্থাৎ কিয়ামতের পূর্বে শেষ যুগে ঈসা (আ) যখন পৃথিবীতে পুনরায় আসবেন তখন তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্বে তখনকার সকল কিতাবীরাই তাঁর প্রতি বিশ্বাস আনবে। কেননা তিনি পুনর্বার পৃথিবীতে আসবেন এবং শূকর বধ করবেন, ক্রুশ ধ্বংস করবেন, জিযিয়া কর রহিত করবেন এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন কবুল করবেন না। তাফসীর গ্রন্থে সূরা নিসায় এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এ প্রসংগে যাবতীয় হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি এবং এই কিতাবে 'ফিতান ও মালাহিম’ (কিয়ামত পূর্ব বিপর্যয় ও মহাযুদ্ধ) অধ্যায়ে মাসীহুদ দাজ্জাল প্রসংগে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। দাজ্জালকে হত্যার জন্যে ইমাম মাহদীর অবতরণ প্রসংগে যত হাদীস ও রিওয়ায়ত আছে, সবই সেখানে বর্ণনা করা হবে। এখানে আমরা ঈসা (আ)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

ইবন আবি হাতিম ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ যখন ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নিতে ইচ্ছা করলেন তখন ঘটনা ছিল এই যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের একটি কক্ষে ঈসা (আ)-এর বারজন হাওয়ারী অবস্থান করছিলেন। তিনি মসজিদের একটি ঝরনায় গোসল করে ঐ কক্ষে শিষ্যদের নিকট যান। তার মাথার চুল থেকে তখনও পানি ঝরে পড়ছিল। তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি আছে, যে তার প্রতি ঈমান আনার পর বারো (১২) বার আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এরপরে তিনি তাদের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে রাজী আছে যাকে আমার গঠনাকৃতি দ্বারা পরিবর্তন করা হবে এবং আমার স্থলে তাকে হত্যা করা হবে, পরিণামে আমার সাথে সে মর্যাদা লাভ করবে?’ উপস্থিত শিষ্যদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এক যুবক দণ্ডায়মান হলেন। ঈসা (আ) তাঁকে বললেন, ‘বস।’ এরপর তিনি দ্বিতীয় বার একই আহ্বান জানান। এবারও ঐ যুবকটি দণ্ডায়মান হলেন। ঈসা (আ) তাঁকে বসতে বললেন। তৃতীয়বার তিনি আবারও একই আহ্বান রাখেন। ঐ যুবক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এ জন্যে আমি প্রস্তুত।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তাই হবে, তুমিই এর অধিকারী।’ অতঃপর যুবকটির গঠনাকৃতিকে ঈসার গঠনাকৃতি দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়া এবং মসজিদের একটি বাতায়ন পথে ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নেয়া হয়। এরপর ইয়াহুদীদের একটি অনুসন্ধানকারী দল ঈসা (আ)-কে ধরার জন্যে এসে উক্ত যুবককে ঈসা (আ) মনে করে ধরে নিয়ে আসে ও তাকে হত্যা করে এবং ক্রুশবিদ্ধ করে। জনৈক শিষ্য ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান আনার পর বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বনী ইসরাঈল তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যথাঃ-

১. আল-ইয়াকুবিয়্যাঃ এই দল বিশ্বাস করে যে, এতদিন আল্লাহ স্বয়ং আমাদের মাঝে বিদ্যমান ছিলেন, এখন তিনি আসমানে উঠে গিয়েছেন।

২. আল-নাসতুরিয়্যাঃ এই দলের বিশ্বাস হল, আল্লাহর পুত্র আমাদের মধ্যে এতদিন ছিলেন, এখন তাকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন।

৩. আল মুসলিমুনঃ এই দলের মতে ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ছিল ততদিন তিনি আমাদের মধ্যে ছিলেন। এখন তাঁকে আল্লাহ নিজের সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছেন।

উক্ত তিন দলের মধ্যে কাফির দুই দল একত্রিত হয়ে মুসলিম দলের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে; ফলে মুসলিম দল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলার পর আল্লাহ্ মুহাম্মাদ (সা)-কে রসুলরূপে প্রেরণ করেন। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এই দিকে ইংগিত করেই কুরআনে বলা হয়েছে “পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শত্রুদের মুকাবিলায়; ফলে তারা বিজয়ী হল (৬ সাফঃ ১৪)

এ হাদীসের সনদ ইব্‌ন আব্বাস (রা) পর্যন্ত বিশুদ্ধ এবং মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। ইমাম নাসাঈ আবু কুরায়বের সূত্রে আবু মুআবিয়া থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন জারীর মুসলিম ইব্‌ন জানাদার সূত্রে আবু মুআবিয়া থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া আরও অনেক গ্রন্থকার এ হাদীস স্ব-স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটি সবচেয়ে দীর্ঘায়িতভাবে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবন ইসহাক। তার বর্ণনায় এসেছে, ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট তাঁর মত্যুকে পিছিয়ে দেয়ার জন্যে দোয়া করতেন, যাতে তিনি রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেন। দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারণ করতে পারেন এবং অধিক পরিমাণ লোক যাতে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে পারে। কথিত আছে, হযরত ঈসা (আ)-এর সান্নিধ্যে বারজন হাওয়ারী ছিলেন; (১) পিতর, (২) ইয়াকুব ইবন যাবদা (সিবদিয়), (৩) ইয়াহনাস (যুহান্না) ইনি ইয়াকুবের ভাই ছিলেন (৪) ইনদারাউস (আন্দ্রিয়), (৫) ফিলিপ, (৬) আবরো ছালমা (বর্তময়), (৭) মথি, (৮) টমাস (থমা), (৯) ইয়াকুব ইবন হালকুবা (আলকেয়), (১০) তাদাউস (থদ্দেয়), (১১) ফাতাতিয়া শিমন ও (১২) (ইয়াহুদা ইস্কারিযোৎ) ইউদাস কারয়া ইউতা [বন্ধনীযুক্ত নামগুলো বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটির প্রকাশিত ইনজীল শরীফ থেকে গৃহীত] এই শেষোক্ত ব্যক্তি ইয়াহুদীদেরকে ঈসা (আ)-এর সন্ধান দিয়েছিল। ইবন ইসহাক লিখেছেন, হাওয়ারীদের মধ্যে সারজিস নামক আর এক ব্যক্তি ছিল যার কথা নাসারারা গোপন রাখে। এই ব্যক্তিকেই মাসীহর রূপ দেয়া হয়েছিল। এবং ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নাসারাদের কিছু অংশের মতে যাকে মাসীহর রূপ দেয়া হয় ও ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়, তার নাম জভাস ইবন কারয়া ইউতা।

যাইহাক.....ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ) শামউনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন এবং ইয়াহূদীরা জভাসকে হত্যা করেছিল -যাকে ঈসার অনুরূপ আকৃতি দেয়া হয়েছিল। আহমদ ইবন মারওয়ান বলেন, মুহাম্মদ ইবন জাহম ফাররা থেকে শুনেছেন কুরআনের আয়াত— “তারা চক্রান্ত করেছিল আর আল্লাহ্ও কৌশল অবলম্বল করেছিলেন এবং আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।” এ সম্পর্কে ফাররা বলেছেন যে, ঈসা (আ) দীর্ঘ দিন তাঁর খালার নিকট থেকে দূরে থাকার পর একদিন খালার বাড়িতে আসেন। তার আগমন দেখে রাস আল জালূত নামক ইয়াহুদী সেখানে উপস্থিত হয় এবং ঈসা (আ)-এর বিরুদ্ধে লোকজনকে জমায়েত করে। ফলে বহু লোক জমায়েত হলো আর তারা দরজা ভেংগে ফেলে এবং রাস আল জালূত ঈসা (আ)-কে ধরে আনার জন্যে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। আল্লাহ ঈসা (আ)-কে তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখেন। কিছু সময় পর সে বেরিয়ে এসে বলল, ঈসাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেলাম না। রাস আল জালুতের সাথে ছিল নাংগা তলোয়ার। এ দিকে আল্লাহ তাকেই ঈসার রূপে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। উপস্থিত সবাই বলল, তুমি-ই তো ঈসা। সুতরাং তারা তাকে ধরে হত্যা করল ও শূলে বিদ্ধ করল। এদিকে ইংগিত করেই আল্লাহ বলেছেন: “তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি; কিন্তু তাদের এইরূপ বিভ্রম হয়েছিল।” ইবন জারীর ... ওহব ইবন মুনাববিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আ) সতের জন হাওয়ারী সহ এক ঘরে প্রবেশ করেন। এ অবস্থা তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে। যখন তারা দেখে ইয়াহুদীরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তখন আল্লাহ তাদের সকলের চেহারাকে ঈসা (আ)-এর চেহারার মত করে দেন। এ দেখে বনী ইসরাঈলরা বলল, তোমরা সবাই যাদু করে আমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছ। হয় আসল ঈসাকে আমাদের নিকট বের করে দাও, নচেৎ তোমাদের সবাইকে হত্যা করব। তখন ঈসা (আ) সাথীদেরকে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছ, যে নিজের প্রাণের বিনিময়ে আজ জান্নাত ক্রয় করবে।’ এক ব্যক্তি বললেন, ‘আমি রাজি আছি।’ এরপর সে ব্যক্তি বনী-ইসরাঈলদের সম্মুখে এসে বললেন, ‘আমিই ঈসা।’ বস্তৃত ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ ঈসা (আ)-এর আকৃতি দান করেছিলেন। তখন তারা তাকে ধরে হত্যা করল ও ক্রুশবিদ্ধ করল। এ জন্যই বনী-ইসরাঈলরা বিভ্রান্ত হয় ও ধারণা করে যে, তারা ঈসা (আ)-কেই হত্যা করেছে। অন্যান্য খ্রীষ্টানরাও এই একই ধারণা পোষণ করে এবং বলে ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ ঐ দিনই আল্লাহ ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নিয়েছিলেন।

.... ওহব থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ যখন ঈসা (আ)-কে জানিয়ে দেন যে, অচিরেই তুমি দুনিয়া থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছ তখন তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন। এ সময় তিনি হাওয়ারীগণকে দাওয়াত করেন। তাঁদের জন্যে খাদ্য প্রস্তুত করেন। তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, রাত্রে তোমরা আমার নিকট আসবে, তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজন আছে। হাওয়ারীগণ রাত্রে আসলে ঈসা (আ) তাদেরকে নিজ হাতে খানা পরিবেশন করে খাওয়ান। আহার শেষে নিজেই তাঁদের হাত ধুয়ে দেন ও নিজের কাপড় দ্বারা তাদের হাত মুছে দেন। এ সব দেখে হাওয়ারীগণ আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং বিব্রত বোধ করলেন। ঈসা (আ) বললেন, ‘দেখ, আমি যা কিছু করব কেউ যদি তার প্রতিবাদ করে তবে সে আমার শিষ্যদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমিও তার কেউ নই।’ তখন তারা তা মেনে নিলেন।

আর ঈসা (আ) বললেন, ‘আমি আজ রাত্রে তোমাদের সাথে যে আচরণ করলাম, তোমাদের সেবা করলাম, খাদ্য পরিবেশন করলাম, হাত ধুয়ে দিলাম, এ যেন তোমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকে। তোমরা জান যে, আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। সুতরাং তোমরা একে অপরের উপর নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে না। বরং নিজেকে অপরের চাইতে ছোট জ্ঞান করবে। তোমরা তো প্রত্যক্ষ করলে, কিভাবে আমি তোমাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলাম। তোমরাও ঠিক এই ভাবে করবে। আর তোমাদের কাছে আমার যে প্রয়োজন তা হল, তোমরা আমাকে সাহায্য করবে, আমার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করবে এবং মনে প্রাণে দোয়া করবে যেন তিনি আমার মৃত্যুকে পিছিয়ে দেন।’ ঈসা (আ)-এর কথা শোনার পর হাওয়ারীগণ যখন দোয়া করার জন্যে প্রস্তুত হলেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে দোয়া করতে বসলেন, তখন গভীর নিদ্রা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। ফলে তারা দোয়া করতে সমর্থ হলেন না। ঈসা (আ) তাদেরকে ঘুম থেকে জাগাবার চেষ্টা করেন এবং বলেন, ‘কী আশ্চর্য, তোমরা কি মাত্র একটা রাত আমার জন্যে ধৈর্যধারণ করতে ও আমাকে সাহায্য করতে পারবে না?’ তাঁরা বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না যে, আমাদের এ কী হল? আমরা তো প্রতি দিন রাত্রে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জেগে থাকি, কথাবার্তা বলি; কিন্তু আজ রাত্রে তার কিছুই করতে পারছি না। যখনই দোয়া করতে যাই তখনই ঘুম এসে মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’ তখন হযরত ঈসা (আ) বললেন, রাখাল মাঠ থেকে বিদায় নিচ্ছে আর বকরীগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এ জাতীয় আরও বিভিন্ন কথা তিনি বলতে থাকেন এবং নিজের বিয়োগ ব্যথার কথা ব্যক্ত করেন।

অতঃপর ঈসা (আ) বললেনঃ- ‘আমি তোমাদেরকে একটি সত্য কথা বলছি- তোমাদের মধ্যে একজন আজ মোরগ ডাক দেয়ার পূর্বে আমার সাথে তিনবার বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তোমাদের মধ্যে একজন সামান্য কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে শত্রুদের কাছে আমার সন্ধান বলে দেবে এবং আমার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ ভক্ষণ করবে।’ এরপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল ও বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। এদিকে ইয়াহুদীরা ঈসা (আ)-কে সন্ধান করে ফিরছে। তারা শামউন নামক এক হাওয়ারীকে ধরে বলল, ‘এই ব্যক্তি ঈসার শিষ্য।’ কিন্তু সে অস্বীকার করে বলল, ‘আমি ঈসার শিষ্য নই।’ এ কথা বললে, তারা শামঊনকে ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে তাকে অন্য ইয়াহুদীরা পাকড়াও করলে সে পূর্বের ন্যায় উত্তর দিয়ে আত্মরক্ষা করল। এমন সময় ঈসা হঠাৎ মোরগের ডাক শুনতে পান। মোরগের ডাক শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং কাঁদতে থাকেন। প্রভাত হওয়ার পর জনৈক হাওয়ারী ইয়াহুদীদের নিকট গিয়ে বলল, ‘আমি যদি তোমাদেরকে ঈসা মাসীহর সন্ধান দিই, তা হলে তোমরা আমাকে কী পুরস্কার দিবে?’ ইয়াহুদীরা তাকে ত্রিশটি দিরহাম দিল। বিনিময়ে সে তাদের নিকট তাঁর সন্ধান বলে দিল। কিন্তু এর পূর্বেই তাকে ঈসার অনুরূপ চেহারা দান করা হয় এবং তাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়। ফলে তাকেই তারা পাকড়াও করে রশি দ্বারা শক্ত করে বাঁধল এবং একথা বলতে বলতে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে গেল যে, ‘তুমিই তো মৃতকে জীবিত করতে, জীন-ভূত তাড়াতে, পাগল মানুষকে সুস্থ করে দিতে। এখন এই রশির বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত কর দেখি!’ তারা তার উপর থুথু নিক্ষেপ করল, দেহে কাঁটা ফুটাল এবং যেই ক্রুশে বিদ্ধ করার জন্যে স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে তাকে নিয়ে আসল।

ইতিমধ্যে ঈসা (আ)-কে আল্লাহ নিজ সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন এবং ইয়াহুদীরা ঐ চেহারা পরিবর্তিত ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করল। ক্রুশের উপরে লাশ সাত দিন পর্যন্ত ছিল। এরপর ঈসা (আ)-এর মা এবং অন্য এক মহিলা যে পাগল ছিল এবং যাকে ঈসা (আ) সুস্থ করেছিলেন উভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্রুশবিদ্ধ লোকটির কাছে আসলেন। তখন হযরত ঈসা (আ)-তাঁদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কাঁদছেন কেন?’ তারা বললেন, ‘আমরা তো তোমার জন্যে কাঁদছি।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমাকে আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন এবং উত্তম অবস্থায় রেখেছেন; আর এই যাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে তার ব্যাপারে ইয়াহুদীরা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।’ অতঃপর তিনি হাওয়ারীদের প্রতি নির্দেশ দিলেন যেন, অমুক স্থানে তারা তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন। নির্দেশ মতে এগারজন হাওয়ারী তথায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। সেই এক হাওয়ারী অনুপস্থিত থাকে, যে ঈসাকে দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করেছিল এবং ইয়াহুদীদেরকে তার সন্ধান বলে দিয়েছিল; তার সম্পর্কে ঈসা (আ) শিষ্যদের নিকট জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে তারা জানাল যে, সে তার কর্মের উপর অনুতপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঈসা (আ) বললেন, ‘যদি সে তওবা করত তবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করতেন।’ অতঃপর তিনি ইয়াহইয়া নামক সেই যুবকের কথা জিজ্ঞেস করলেন, যে তাদেরকে অনুসরণ করত। তিনি জানালেন, ‘সে তোমাদের সাথেই আছে।’ এরপর ঈসা (আ) বললেন, ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও; কেননা, অচিরেই তোমরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় কথা বলবে। সুতরাং তাদেরকে সতর্ক করবে এবং দীনের দাওয়াত দেবে।’

এই হাদীসের সনদ গরীব ও অভিনব। তবে নাসারাদের বর্ণনা সমূহের মধ্যে এটা অনেকটা বিশুদ্ধ। তারা বলেছে, মসীহ্ মারয়ামের নিকট এসেছিলেন। মারয়াম খেজুর গাছের শাখার কাছে বসে কাঁদছিলেন। ঈসা (আ) তাকে দেহের ক্ষত-বিক্ষত স্থানগুলো দেখান এবং মারয়ামকে জানান যে, তাঁর রূহকে উপরে তুলে নেয়া হয়েছে এবং দেহকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। নাসারাদের বর্ণিত এ ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া, অতিরঞ্জিত ও বাতিল। সত্যের পরিপন্থী ও অতিরিক্ত সংযোজন।

ইব্‌ন আসাকির ইয়াহইয়া ইবন হাবীবের সূত্রে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, মারয়াম ধারণা করেছিলেন যে, সে তাঁরই পুত্র। তাই তিনি ঘটনার সাত দিন পর বাদশাহর লোকদের নিকট গিয়ে লাশটি নামিয়ে দেয়ার আবেদন জানান। তারা তার আবেদনে সাড়া দেয় এবং সেখানেই লাশটি দাফন করা হয়। তারপর মারয়াম ইয়াহইয়ার মাকে বললেন, ‘চল, আমরা মাসীহর কবর যিয়ারত করে আসি।’ উভয়ে রওয়ানা হলেন। কবরের কাছাকাছি পৌঁছলে মারয়াম ইয়াহইয়ার মাকে বললেন, ‘পর্দা কর!’ ইয়াহইয়ার মা বললেন, ‘কার থেকে পর্দা করব?’ বললেনঃ ‘কেন কবরের কাছে ঐ যে লোকটিকে দেখা যায়, তার থেকে।’ ইয়াহইয়ার মা বললেন, ‘কী বলছ? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’ মারয়াম তখন ভাবলেন, ‘ইনি জিবরাঈল ফেরেশতা হবেন।’ বস্তুত জিবরাঈলকে তিনি বহু পূর্বে দেখেছিলেন।

যা হোক, ইয়াহইয়ার মাকে সেখানে রেখে মারয়াম কবরের কাছে গেলেন। কবরের নিকট গেলে তিনি তাকে চিনতে পান। আর জিবরাঈল বললেন, ‘মারয়াম! কোথায় যাচ্ছ?’ মারয়াম বললেন, ‘মাসীহর কবর যিয়ারত করতে এবং তাকে সালাম জানাতে।’ জিবরাঈল বললেন, ‘মারয়াম! এ তো মাসীহ্ নয়। তাকে তো আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন, কাফিরদের হাত থেকে তাকে পবিত্র করেছেন। তবে কবরবাসীকে মসীহর আকৃতি বদলে দেয়া হয়েছে এবং তাকেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। এর নিদর্শন হচ্ছে এটা যে, ঐ লোকটির পরিবারের লোকজন একে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কোথাও তার সন্ধান পাচ্ছে না এবং তার কি হয়েছে তাও তারা জানে না; এর জন্যে তারা কেবল কান্নাকাটি করে ফিরছে। তুমি অমুক দিন অমুক বাগানের নিকট আসলে মাসীহর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে।’ এ কথা বলে জিবরাঈল সেখান থেকে প্রস্থান করেন।

মারয়াম তার বোনের নিকট ফিরে এসে জিবরাঈলের ব্যাপারে জানালেন এবং বাগানের বিষয়টিও বললেন। নির্দিষ্ট দিনে মারয়াম সেই বাগানের নিকট গেলে সেখানে মাসীহকে দেখতে পান। ঈসা (আ) মাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুটে আসেন, মা তাকে জড়িয়ে ধরেন, এবং তার মাথায় চুম্বন দেন। তিনি পূর্বের মত তার জন্যে দোয়া করেন। তারপর বলেন, ‘মা! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাকে হত্যা করতে পারেনি, আল্লাহ আমাকে তাঁর সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন এবং আপনার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি দিয়েছেন। অচিরেই আপনার মৃত্যু হবে। ধৈর্য ধরুন ও বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করুন।’ অতঃপর ঈসা ঊর্ধলোকে চলে গেলেন। এরপর মারয়ামের সাথে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ঈসার আর সাক্ষাত হয়নি। রাবী বলেন, ঈসা (আ)-এর ঊর্ধাররাহনের পরে তাঁর মা পাঁচ বছর জীবিত ছিলেন এবং তিপ্পান্ন বছর বয়সকালে তিনি ইনতিকাল করেন।

হাসান বসরী (র) বলেছেন, যে দিন হযরত ঈসা (আ)-কে আসমানে নেয়া হয় সে দিন পর্যন্ত তাঁর বয়স হয়েছিল চৌত্রিশ বছর। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে জান্নাতবাসীদের চুল ছোট হবে, দাড়ি উদ্ধৃত হয়নি তারা এমন যুবকই হবেন। তাদের চোখে সুরমা লাগানো থাকবে ও তাঁরা তেত্রিশ বছরের যুবক হবেন। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, জান্নাতবাসীরা ঈসা (আ)-এর সমবয়সের হবেন এবং ইউসুফ (আ)-এর সৌন্দর্যমণ্ডিত চেহারা লাভ করবেন। হাম্মাদ ইবন সালমা .. সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ)-কে যখন আসমানে তুলে নেয়া হয় তখন তাঁর বয়স ছিল তেত্রিশ বছর।

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থে এবং ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান ফাসাবী তার ইতিহাস গ্রন্থে ইবন আবি মারয়ামের সূত্রে …... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমাকে ফাতিমা (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে জানিয়েছেনঃ একজন নবীর পরে যদি আর এক জন নবীর আবির্ভাব হয় তবে পরবর্তী নবীর বয়স পূর্ববর্তী নবীর বয়সের অর্ধেক হয়। নবী (সা) আমাকে আরও বলেছেন যে, ঈসা ইবন মারয়াম একশ বিশ বছর জীবিত ছিলেন। সুতরাং আমি দেখছি, ষাট বছরের মাথায় আমার মৃত্যু হবে। ফাসাবীর বর্ণিত এ হাদীসের সনদ গরীব পর্যায়ের।

ইবন আসাকির বলেন, বিশুদ্ধ মত এই যে, ঈসা (আ) ঐ পরিমাণ বয়স পাননি। এর দ্বারা তাঁর উম্মতের মধ্যে তাঁর অবস্থানকাল বুঝানোই উদ্দেশ্য। যেমন সুফিয়ান ইবন উয়ায়না .. ইয়াহয়া ইবন জা’দা থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ফাতিমা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা) আমাকে জানিয়েছেনঃ ঈসা ইবন মারয়াম তার সম্প্রদায়ের মধ্যে চল্লিশ বছর অবস্থান করেছিলেন।

এ হাদীসের সনদ বিচ্ছিন্ন। জারীর ও ছাওরী আমাশের মাধ্যমে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেনঃ ঈসা (আ) তার সম্প্রদায়ের মধ্যে চল্লিশ বছর অবস্থান করেছিলেন। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিতঃ হযরত ঈসা (আ)-কে রমযান মাসের বাইশ তারিখের রাত্রে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। হযরত আলী (রা)-ও শত্রুদের বর্শার আঘাত পাওয়ার পাঁচ দিন পর রমযানের বাইশ তারিখ রাত্রে ইনতিকাল করেন।

যাহ্হাক (র) ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ)-কে যখন আসমানে তুলে নেয়া হয় তখন এক খণ্ড মেঘ তার নিকটবর্তী হয়। তিনি এর উপর বসেন। মা মারয়াম সেখানে উপস্থিত হন। পুত্রকে বিদায় জানান ও কান্নাকাটি করেন। তারপরে তাকে তুলে নেয়া হয়। মারয়াম তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকেন। ঊর্ধে উঠার সময় ঈসা (আ) তার মাকে নিজের চাদরখানা দিয়ে যান এবং বলেন, এইটি হবে কিয়ামতের দিনে আমার ও আপনার মধ্যে পরিচয়ের উপায়। শিষ্য শামউনের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের পাগড়ীটি নিক্ষেপ করেন। ঈসা যখন উপরের দিকে উঠতে থাকেন তখন মা মারয়াম হাতের আঙ্গুল উঠিয়ে ইংগিতে তাঁকে বিদায় জানাতে থাকেন। যতক্ষণ না তিনি চোখের আড়ালে চলে যান। মারয়াম ঈসাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। কেননা, পিতা না থাকার কারণে ঈসা পিতামাতা উভয়ের ভালবাসা মাকেই দিতেন। সফরে হোক কিংবা বাড়িতে হোক মারয়াম ঈসাকে সর্বদা কাছে রাখতেন, মুহূর্তের জন্যেও দূরে যেতে দিতেন না। জনৈক কবি বলেছেনঃ

وكنت ارى كالموت من بين ساعة - فكيف ببين کان موعده الحشر .

—এক মুহূর্তের বিরহ যেখানে আমার নিকট মৃত্যু যন্ত্রণার ন্যায় কঠিন, সেখানে রোজ হাশর পর্যন্ত দীর্ঘ বিরহ ব্যথা আমি কিভাবে সইব?

ইসহাক ইবন বিশর মুজাহিদ ইবন জুবায়র (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, ইয়াহুদীরা মসীহরুপী যেই ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল তাকে তারা আসল মসীহ্ বলেই বিশ্বাস করত। অধিকাংশ নাসারা মূর্খতাবশত এই বিশ্বাসেরই সমর্থক ছিল। এরপর তারা মাসীহর শিষ্য সমর্থকদের উপর ধর-পাকড়, হত্যা ও নির্যাতন আরম্ভ করে। এ সংবাদ রোম অধিপতি ও তদানিন্তন দামিশকের বাদশাহর নিকট পৌঁছে। বাদশাহকে জানানো হয় যে, ইয়াহুদীরা এমন এক ব্যক্তির শিষ্য সমর্থকদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করে, সে মৃত্যকে জীবিত করে, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করে এবং আরো অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটায়। ইয়াহুদীরা তার উপর চড়াও হয় এবং তাকে হত্যা করে। তাঁর শিষ্য ও অনুসারীদেরকে লাঞ্ছিত করে ও বন্দী করে রাখে। এ সব কথা শুনে বাদশাহ্ উক্ত নবীর কতিপয় অনুসারীকে তাঁর নিকট আনার জন্যে দূত প্রেরণ করেন।

বাদশাহর দূত কয়েকজন অনুসারীকে সেখানে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যা এবং শামউন সহ বেশ কিছুলোক ছিলেন। বাদশাহ তাদের নিকট মাসীহর কার্যাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা বিস্তারিতভাবে মাসীহ্ এর কাজকর্ম সম্পর্কে বাদশাহকে অবগত করেন। সবকিছু শুনে বাদশাহ তাদের নিকট মাসীহ্ এর দ্বীন গ্রহণ করেন। তাদের দীনের দাওয়াতের প্রসার ঘটান। এভাবে ইয়াহুদীদের উপরে সত্য বিজয় লাভ করে এবং নাসারাদের বাণী তাদের উপর শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানে ভূষিত হয়। অতঃপর বাদশাহ ক্রুশবিদ্ধ লাশের কাছে লোক প্রেরণ করেন। শূল কাষ্ঠ থেকে লাশ নামানো হয় এবং ক্রুশ-ফলকটি নিয়ে আসা হয়। বাদশাহ ক্রুশ ফলককে সম্মান প্রদর্শন করেন। তখন থেকে নাসারা সম্প্রদায় ক্রুশচিহ্নকে সম্মান করতে শুরু করে। এ ঘটনার পর থেকে নাসারা (খ্রষ্টান) ধর্ম রোম সাম্রাজ্যে প্রসার লাভ করে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এই বর্ণনাটি সংশয়মুক্ত নয়।

একঃ ইয়াহয়া ইবন যাকারিয়্যা (আ) নবী ছিলেন। ঈসা (আ)-কে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে, এ কথা তিনি স্বীকার করতেন না। কেননা তিনি ছিলেন মা’সুম নবী। ঈসা (আ)-কে নিরাপদ হেফাজতে নেয়া হয়েছে এই সত্যে তিনি বিশ্বাস করতেন।

দুইঃ মাসীহ এর আগমনের তিনশ’ বছর পর রোম সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রবেশ করে, তার পূর্বে নয়। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। কেননা রোমে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রবেশ করেছিল কুসতুনতীন ইবন কুসতুন-এর শাসনামলে, যিনি ছিলেন কনষ্টানটিনোপল তথা ইস্তাম্বুল শহরের প্রতিষ্ঠাতা। এ বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।

তিনঃ ইয়াহুদীরা ঐ ব্যক্তিকে শূলে চড়ানোর পর সেই স্থানটিকে একটি ঘৃণিত স্থান হিসেবে ফেলে রাখে। সেখানে তারা ময়লা-আবর্জনা ও মৃত জীবজন্তু নিক্ষেপ করত। সম্রাট কনস্টানটাইনের আমল পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।

অতঃপর সম্রাট কনস্টানটাইনে মা হায়লানা আল হার্রানিয়া আল-ফুনদুকানিয়া উক্ত ক্রুশবিদ্ধ লোকটিকে মাসীহ্ বলে বিশ্বাস করেন এবং সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেন। তিনি সেখানে লোক প্রেরণ করেন। তারা ক্রুশের শূল দণ্ডটি খুঁজে পায়। কথিত আছে, উক্ত শূলদণ্ড যেই কোন রোগী স্পর্শ করলে আরোগ্য লাভ করত। আল্লাহই ভাল জানেন ঘটনা এই রকম হয়েছিল কিনা? কেননা যেই ব্যক্তি শূলে জীবন দিয়ে আত্মোৎসর্গ করেছিল সে একজন নেককার লোক ছিল অথবা হতে পারে এটা সেই যুগের খ্রীষ্টদের জন্যে একটি ফিৎনা বিশেষ। যে কারণে তারা উক্ত দণ্ডকে সম্মান করত এবং স্বর্ণ ও মুক্তা দ্বারা তাকে মুড়িয়ে রেখেছিল। এখান থেকে তারা বরকত ও কল্যাণের প্রতীক হিসেবে ক্রুশটিকে ব্যবহার করা আরম্ভ করে।

এরপর সম্রাটের মা হায়লানার নির্দেশে ঐ স্থানের সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করে যেখানে উন্নত মানের পাথর দ্বারা একটি সুশোভিত গীর্জা নির্মাণ করা হয়। বর্তমান কালে যা বায়তুল মুকাদ্দাস শহর নামে খ্যাত। এই শহরটির অপর নাম কুমামা (কুমামা অর্থ আবর্জনা, যেহেতু পূর্বে এখানে আবর্জনা ছিল)। খৃষ্টানরা একে কিয়ামাহ্ও বলে। কেননা, কিয়ামতের দিন এই স্থান থেকে মাসীর দেহ পুনরুত্থিত হবে বলে তাদের বিশ্বাস। সম্রাট জননী হায়লানা অতঃপর নির্দেশ দেন যে, এখন থেকে এই শহরের সমস্ত ময়লা আবর্জনা ও পঁচা-গলা ইয়াহুদীদের কিবলা হিসেবে পরিচিত বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত শুভ্র পাথর (সাখরা)-এর উপর ফেলতে হবে। নির্দেশ মতে সমস্ত আবর্জনা সেখানেই নিক্ষেপ করা অব্যাহত থাকে। অবশেষে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। তিনি স্বয়ং সেখানে গমন করে নিজের চাদর দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস ঝাড়ু দেন এবং সকল নাপাকী ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করেন। অবশ্য তিনি ইয়াহুদীদের কিবলা হিসেবে রক্ষিত পাথরের পেছনে মসজিদের প্রতিষ্ঠা করেন নি বরং তার সামনের দিকে রেখেছেন— যেখানে রাসূল (সা) ইসরার রাত্রে নবীদের সাথে সালাত আদায় করেছিলেন।

৩০
ঈসা (আ)-এর গুণাবলী স্বভাব-চরিত্র ও মাহাত্ম্য
আল্লাহর বাণীঃ

( مَّا ٱلۡمَسِیحُ ٱبۡنُ مَرۡیَمَ إِلَّا رَسُول قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِهِ ٱلرُّسُلُ وَأُمُّهُۥ صِدِّیقَة ࣱۖ)

[Surah Al-Ma'idah 75]

—মারয়াম-তনয় মসীহ্ তো কেবল একজন রাসূল, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে এবং তার মা সত্যনিষ্ঠ ছিল। (৫ মায়িদাঃ ৭৫)।

মাসীহ্ অর্থ অত্যধিক ভ্রমণকারী। ঈসা (আ)-এর প্রতি ইয়াহুদীদের কঠোর শত্রুতা, মিথ্যা আরোপ এবং তাঁর উপর ও তাঁর মায়ের উপর অপবাদ দেওয়ার কারণে সৃষ্ট ফিৎনা ফ্যাসাদ থেকে দীনকে রক্ষার জন্যে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় সফরে কাটান। এই কারণে তাঁকে মাসীহ্ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কেউ কেউ বলেন, তার পায়ের তলা সমতল থাকার কারণে হযরত ঈসা (আ)-কে মাসীহ্ বলা হয়। আল্লাহর বাণীঃ

( ثُمَّ قَفَّیۡنَا عَلَىٰۤ ءَاثَـٰرِهِم بِرُسُلِنَا وَقَفَّیۡنَا بِعِیسَى ٱبۡنِ مَرۡیَمَ وَءَاتَیۡنَـٰهُ ٱلۡإِنجِیلَ )

[Surah Al-Hadid 27]

—অতঃপর আমি তাদের অনুগামী করেছিলাম আমার রাসূলগণকে এবং অনুগামী করেছিলাম মারয়াম তনয় ঈসাকে আর তাকে দিয়েছিলাম ইনজীল। (৫৭ হাদীদঃ ২৭)

আল্লাহর বাণীঃ

( وَءَاتَیۡنَا عِیسَى ٱبۡنَ مَرۡیَمَ ٱلۡبَیِّنَـٰتِ وَأَیَّدۡنَـٰهُ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِ )

[Surah Al-Baqarah 87]

—এবং মারয়াম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি এবং পবিত্র আত্মা দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। (২ বাকারাঃ ৮৭)

এ সম্পর্কে কুরআনে প্রচুর আয়াত বিদ্যমান। ইতিপূর্বে বুখারী ও মুসলিমে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, এমন কোন শিশু সন্তান নেই, যাকে জন্মের সময় শয়তান পেটের পার্শ্বদেশে খোঁচা না দেয়। জন্মের সময় শয়তানের খোঁচার কারণেই সে চিৎকার করে কাঁদে। তবে মারয়াম ও তাঁর পুত্র ঈসা (আ)-এর ব্যতিক্রম। শয়তান তাঁকে খোঁচা মরতে গিয়েছিল। কিন্তু তা না পেরে ঘরের পর্দায় খোঁচা মেরে চলে যায়। উবাদা থেকে উমায়র ইবন হানীর বর্ণিত হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুলাহ্ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি একক তার কোন শরীক নেই, আর মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল। আর ঈসা আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসুল এবং তার কলেমা যা তিনি মারয়াম-এর নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তার পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ। (আরও সাক্ষ্য দিবে যে,) জান্নাত সত্য ও জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, তার অন্য আমল যা-ই হোক না কেন। বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তবে এ পাঠটি বুখারী ও মুসলিমে শাবী আবু বুরদা, আবু মূসা আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ যদি কোন লোক তার দাসীকে আদব-কায়দা শেখায় এবং তা ভালভাবে শেখায় এবং তাকে ইলম শেখায় আর তা উত্তমভাবে শেখায় তারপর তাকে আযাদ করে দেয় এবং পরে তাকে বিয়ে করে নেয় তবে সে দুটি প্রতিদান পাবে। আর যদি কেউ ঈসা (অ)-এর প্রতি ঈমান রাখে অতঃপর আমার প্রতিও ঈমান আনে, তার জন্যেও দু’টি পুরস্কার। আর গোলাম যদি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং দুনিয়ার মুনিবদেরকেও মেনে চলে তবে সেও পাবে দু’টি পুরস্কার। এ পাঠ বুখারীর।

ইমাম বুখারী (র) ইবরাহীম ইবন মূসার সূত্রে....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ যে রাতে আমার মিরাজ হয়েছিল, সে রাতে মূসার সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন দীর্ঘ দেহী ব্যক্তি, তাঁর চুল কোঁকড়ান ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন ইয়ামান দেশীয় শানুয়া গোত্রের লোক। তিনি বলেন ঈসার সাথেও আমার সাক্ষাত হয়েছিল। অতঃপর তিনি তার বর্ণনা দিয়ে বলেনঃ তিনি ছিলেন মধ্যম দেহী ও গৌরবর্ণের। যেন তিনি এই মাত্র হাম্মামখানা থেকে বের হয়েছেন। ঐ রাতে আমি ইবরাহীমকেও দেখতে পেয়েছি। আর তাঁর বংশধরদের মধ্যে তাঁর সাথে আমার চেহারার মিল সবচাইতে বেশী। ইবরাহীম ও মূসা (আ)-এর বর্ণনায় আমরা এ হাদীসখানা উল্লেখ করেছি। ইমাম বুখারী মুহাম্মদ ইবন কাছীর সূত্রে....... ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ মিরাজের রাতে আমি ঈসা, মূসা ও ইবরাহীমকে দেখতে পেয়েছি। ঈসা গৌর বর্ণ, কোঁকড়ানো চুল এবং প্রশস্ত বক্ষ বিশিষ্ট লোক, মূসা বাদামী রং বিশিষ্ট, তার দেহ সুঠাম এবং মাথার চুল কোঁকড়ান, যেন জাঠ গোত্রের লোক। এ হাদীসটি কেবল বুখারীতেই আছে।

ইমাম বুখারী (র) ইবরাহীম ইবন মুনযিরের সূত্রে....... আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, একদা নবী করীম (সা) লোকজনের সামনে মাসীহ দাজ্জালের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ্ একচক্ষু বিশিষ্ট নন। শুনে রেখো, মাসীহ দাজ্জালের ডান চোখ কানা। তার চোখ যেন ফুলে যাওয়া আংগুরের মত ভাসাভাসা। আমি এক রাতে স্বপ্নে আমাকে কা’বার কাছে দেখলাম। হঠাৎ সেখানে বাদামী রং-এর এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তোমরা যেমন সুন্দর বাদামী রঙের লোক দেখে থাক তার চাইতেও বেশী সুন্দর ছিলেন তিনি। তাঁর মাথার সোজা চুলগুলো তাঁর দু’কাঁধ পর্যন্ত ঝুলছিল। তার মাথা থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছিল। তিনি দু’জন লোকের কাঁধে হাত রেখে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি কে?’ তারা জবাব দিল, ‘ইনি হলেন মাসীহ্ ইবন মারয়াম।’ তারপর তাঁর পেছনে আর একজন লোক দেখলাম। তার মাথার চুল ছিল বেশী কোঁকড়ান, ডান চোখ কানা। আকৃতিতে সে আমার দেখা লোকদের মধ্যে ইবন কাতানের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। সে একজন লোকের দু’কাঁধে ভর করে কা’বার চারদিকে ঘুরছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই লোকটি কে?’ তারা বলল, ‘এ হল মাসীহ দাজ্জাল।’ ইমাম মুসলিম এ হাদীসখানা মূসা ইবন উকবার সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন নাফিও এ হাদীস অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি যুহরী থেকে বর্ণনা করেন, ইবন কাতান খুজা’আ গোত্রের লোক, জাহিলী যুগে তার মৃত্যু হয়। এ হাদীসে রাসূল (সা) হিদায়েতকারী মাসীহ ও গোমরাহকারী মাসীহর মধ্যে পার্থক্য বলে দিয়েছেন। যাতে ঈসা মাসীহ পুনরায় আগমন করলে মুমিনগণ তাঁর উপর ঈমান আনতে ও মাসীহ্ দাজ্জাল থেকে সতর্ক হতে পারেন। ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদের সূত্রে...... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ ঈসা (আ) এক ব্যক্তিকে চুরি করতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি চুরি করেছ?’ সে বলল, ‘কখনও নয়। সেই সত্তার কসম, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই।’ তখন ঈসা (আ) বললেন, ‘আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম ও আমার দু’চোখকে অবিশ্বাস করলাম।’ আবদুর রাজ্জাক (র) থেকেও অনুরূপ হাদীস মুহাম্মাদ ইবন রাফি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ আফফানের সূত্রে....... আবূ হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন।

এ হাদীস থেকে হযরত ঈসা (আ)-এর পবিত্র ও বলিষ্ঠ চরিত্র ফুটে উঠেছে। যখন লোকটি আল্লাহর কসম বলল, তখন তিনি মনে করলেন যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম খেতে পারে না, বরং নিজের চোখে দেখা বিষয়কে অগ্রাহ্য করে তার ওযরই গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছি। অর্থাৎ তোমার কসমের জন্যে তোমার কথা সত্য বলে মেনে নিচ্ছি এবং আমার চোখকে অবিশ্বাস করছি। ইমাম বুখারী (র) ....... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা হাশরের মাঠে খালি পা, নগ্ন দেহ এবং খাতনা বিহীন অবস্থায় সমবেত হবে। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন, যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছি, ঠিক তেমনিভাবে দ্বিতীয় বারও করবো। এটা আমার ওয়াদা। আমি তা অবশ্যই পূর্ণ করবো। (২১ আম্বিয়াঃ ১০৪)

হাশরের দিন সর্বপ্রথম যাকে কাপড় পরানো হবে, তিনি হলেন ইবরাহীম (আ)। তারপর আমার অনুসারীদের কিছু সংখ্যককে ডান দিকে জান্নাতে এবং কিছু সংখ্যককে বাম দিকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, এরা তো আমার লোক। তখন বলা হবে, আপনি তাদের থেকে বিদায় নেয়ার পর থেকেই তারা পিছটান দিয়েছে। যেমন বলেছিলেন, পূণ্যবান বান্দা ঈসা ইবন মারয়াম। তাঁর উক্তিটি হলো এ আয়াতঃ “আর আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম। এরপর আপনি যখন আমাকে উঠিয়ে নিলেন তখন আপনিই তাদের হেফাজতকারী ছিলেন। আর আপনি তো সব কিছুর উপর সাক্ষী। যদি আপনি তাদেরকে আযাব দিতে চান তবে এরা যে আপনারই বান্দা। আর যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, তবে আপনি নিশ্চয়ই পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” এ হাদীসটি বর্ণিত সূত্রে কেবল ইমাম বুখারীই বর্ণনা করেছেন, ইমাম মুসলিম এ সূত্রে বর্ণনা করেন নি। এ ছাড়াও ইমাম বুখারী হুমায়দী সূত্রে....... ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি হযরত উমর (রা)-কে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, তিনি বলছেন, আমি নবী (সা)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে অতিশয়োক্তি করো না, যেমন ঈসা ইবন মারয়াম সম্পর্কে নাসারারা করেছিল। আমি তো আল্লাহর বান্দা মাত্র। সুতরাং তোমরা আমার সম্পর্কে বলবে, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’

ইমাম বুখারী (র) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেছেন, তিন জন শিশু ব্যতীত আর কেউ দোলনায় কথা বলেন নি। (১) হযরত ঈসা (২) বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল, যাকে জুরাইজ বলে ডাকা হত। একদা সে নামাযরত থাকা অবস্থায় তার মা এসে তাকে ডাকল। সে ভাবল, আমি কি ডাকে সাড়া দিব, না নামাযে নিমগ্ন থাকব। জবাব না পেয়ে তার মা বলল, ‘ইয়া আল্লাহ! ব্যভিচারীণীর চেহারা না দেখা পর্যন্ত তুমি একে মৃত্যু দিও না।’ জুরাইজ তার ইবাদত খানায় থাকতেন। একবার তার কাছে এক মহিলা আসল। সে অসৎ উদ্দেশ্যে তাঁর সাথে কথা বলল। কিন্তু জুরাইজ তাতে রাজী হলেন না। অতঃপর মহিলাটি একজন রাখালের নিকট গেল এবং তাকে দিয়ে মনোবাসনা পূরণ করল। পরে সে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘এটি কার সন্তান?’ স্ত্রীলোকটি বলল, ‘জুরাইজের।’ লোকেরা তাঁর কাছে আসল এবং তাঁর ইবাদত খানাটি ভেঙ্গে দিল। আর তাঁকে নিচে নামিয়ে আনল ও গালিগালাজ করল। তখন জুরাইজ উযু করে সালাত আদায় করলেন। এরপর নবজাত শিশুটির নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘হে শিশু! তোমার পিতা কে? সে জবাব দিল, অমুক রাখাল আমার পিতা।’ তখন বনী ইসরাঈলের লোকেরা জুরাইজকে বলল, ‘আমরা আপনার ইবাদতখানাটি সোনা দিয়ে তৈরি করে দিচ্ছি।’ জুরাইজ বললেন, ‘না, তবে কাদা মাটি দিয়ে তৈরি করে দিতে পার।’ (৩) বনী ইসরাঈলের একজন মহিলা তার শিশুকে দুধ পান করাচ্ছিল। তার কাছ দিয়ে একজন সুদর্শন পুরুষ আরোহী চলে গেল। মহিলাটি দোয়া করল, ‘ইয়া আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে তার মত বানাও।’ শিশুটি তখনই তার মায়ের স্তন ছেড়ে দিল। এবং আরোহীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ইয়া আল্লাহ! আমাকে তার মত করো না।’ এরপর মুখ ফিরিয়ে মায়ের দুধ পান করতে লাগল। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি যেন নবী করীম (সা)-কে দেখতে পাচ্ছি, তিনি নিজের আংগুল চুষে দেখাচ্ছেন। এরপর সেই মহিলাটির পাশ দিয়ে একটি দাসী চলে গেল। মহিলাটি বলল, ‘ইয়া আল্লাহ! আমার শিশুটিকে এর মত করো।’ শিশুটি তৎক্ষণাৎ মায়ের স্তন ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ইয়া আল্লাহ! আমাকে তার মত কর।’ মা জিজ্ঞেস করল, ‘তা কেন?’ শিশুটি জবাব দিল, ‘সেই আরোহী লোকটি ছিল বড় জালিম, আর এ দাসীটিকে লোকে বলছে তুমি চুরি করেছ, যেনা করেছ। অথচ সে এসবের কিছুই করেনি।’

ইমাম বুখারী (র) আবু হুয়ায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি মারয়ামের পূত্র ঈসার বেশী নিকটতম। আর নবীগণ যেন পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই, অর্থাৎ বাপ এক, মা ভিন্ন ভিন্ন। আমার ও ঈসার মাঝখানে কোন নবী নেই। এই সূত্রে ইমাম বুখারীই-এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবন হিব্বান এবং ইমাম আহমদ হাদীসটি ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ বর্ণনা করেন। তবে ইমাম আহমদের বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, কিয়ামতের পূর্বে ঈসা পুনরায় দুনিয়ায় অবতরণ করবেন। যখন তাকে দেখবে তখন তোমরা চিনতে পারবে। কারণ তিনি হবেন মাঝারি গড়নের। গায়ের রং লালচে সাদা। মাথার চুল সোজা। মনে হবে যেন মাথার চুল থেকে পানি টপকে পড়ছে। যদিও তিনি পানি স্পর্শ করেন নি। তিনি এসে ক্রুশ ভাঙ্গবেন, শূকর হত্যা করবেন। জিযিয়া কর রহিত করবেন। একমাত্র ইসলাম ছাড়া সে যুগের সকল ধর্ম ও মতবাদ খতম করবেন। আল্লাহ্ তাঁর হাতে মিথুক মাসীহ দাজ্জালকে ধ্বংস করবেন। সমস্ত পৃথিবী শান্তি ও নিরাপত্তায় ভরে যাবে। এমনকি উট ও সিংহ, বাঘ ও গরু এবং নেকড়ে ও বকরী একই সাথে একই মাঠে বিচরণ করবে। কিশোর বালকগণ সাপের সাথে খেলা করবে। কিন্তু কেউ কারও ক্ষতি করবে না। যতদিন আল্লাহর ইচ্ছা ততদিন তিনি পৃথিবীতে থাকবেন। তারপর তিনি স্বাভাবিকভাবে ইনতিকাল করবেন এবং মুসলমানরা তার জানাযা পড়বে। আবু দাউদ ....... হাম্মাম ইবন ইয়াহয়া থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হিশাম ইবন উরওয়া আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ঈসা (আ) পৃথিবীতে চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। এই কিতাবের মালাহিম (যুদ্ধ বিগ্রহ) অধ্যায়ে ঈসা (আ)-এর অবতরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাফসীর গ্রন্থেও আমরা সূরা নিসার এই আয়াতঃ “কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি ঈমান আনবেই এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে (৪ নিসাঃ ১৫৯)-এর তাফসীর প্রসঙ্গে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন ঈসা (আ)-এর পুনরায় দুনিয়ায় আগমন কিয়ামতের অন্যতম লক্ষণ। দামিশকের শুভ্র মিনারায় উপর তিনি অবতরণ করবেন। তিনি যখন অবতরণ করবেন তখন ফজরের নামাযের ইকামত হতে থাকবে। তাকে দেখে মুসলমানদের ইমাম বলবেন, ‘হে রুহুল্লাহ! সম্মুখে আসুন ও নামাযের ইমামতি করুন!’ ঈসা (আ) বলবেন, “না, আপনারা একে অন্যের উপর নেতা, এ সম্মান আল্লাহ এ উম্মতকেই দান করেছেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ঈসা (আ) ইমাম ছাহেবকে বলবেন, ‘আপনিই ইমামতি করুন। কেননা, আপনার জন্যে ইকামত দেয়া হয়েছে। অতঃপর ঐ ইমামের পেছনে তিনি সালাত আদায় করবেন। নামায শেষে তিনি বাহনে আরোহণ করে মাসীহ দাজ্জালের সন্ধানে বের হবেন এবং মুসলমানরা তাঁর সাথে থাকবেন। দাজ্জালকে লুদ তোরণের নিকট পেয়ে সেখানেই তিনি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবেন। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দামিশকের পূর্ব পার্শ্বে এই মিনার যখন শুভ্র পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয় তখনই দৃঢ় আশা করা হয়েছিল যে, এখানেই তিনি অবতরণ করবেন। এই স্থানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর নাসারাদের অর্থ দ্বারাই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ঈসা (আ) এখানে অবতরণ করে শূকর নিধন করবেন। ক্রুশ ভেংগে চুরমার করবেন এবং ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন তিনি গ্রাহ্য করবেন না।

ঈসা (আ) রাওহা থেকে হজ্জ কিংবা উমরা অথবা উভয়টির নিয়ত করে বের হবেন এবং তা’ সম্পন্ন করবেন। চল্লিশ বছর জীবিত থাকার পর তিনি ইনতিকাল করবেন। তাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হুজরায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর প্রথম দুই খলীফার নিকট দাফন করা হবে। এ সম্পর্কে ইবন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে ঈসা (আ)-এর বর্ণনা প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত মারফু হাদীসে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ঈসা (আ)-কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হুজরা শরীফের মধ্যে রাসূলুল্লাহ, আবু বকর ও উমরের সাথে দাফন করা হবে। কিন্তু এই হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ নয়। ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী আব্দুল্লাহ ইবন সালাম (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাওরাত কিতাবে মুহাম্মদ (সা) ও ঈসা ইবন মারয়ামের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আছে যে, হযরত ঈসাকে মুহাম্মাদ-(স) এর সাথে দাফন করা হবে। এ হাদিসের অন্যতম রাবী আবু মওদূদ মাদানী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হুজরায় একটি কবর পরিমাণ স্থান খালি আছে। ইমান তিরমিযী (র) এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। ইমাম বুখারী (র) বলেন, আমার মতে এ হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়। ইমাম বুখারী সুলায়মান থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ঈসা ও মুহাম্মদ (সা)-এর মধ্যে নবুওতের বিরতিকাল ছয় শ’ বছর। কাতাদার মতে, পাঁচ শ’ ষাট বছর। কারও মতে পাঁচ শ’ চল্লিশ বছর। যাহহাকের মতে, চার শ’ ত্রিশ বছরের কিছু বেশী কিন্তু প্রসিদ্ধ মত ছয়শ’ বছর। তবে কেউ কেউ বলেছেন, চান্দ্র বছরের হিসেবে ছয়শ’ বিশ বছর এবং সৌর বছর হিসেবে ছয় শ’ বছর।

ইবন হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে ঈসা (আ)-এর উম্মতগণ কত দিন সঠিক দীনের উপরে ও নবীর আদর্শের উপরে টিকেছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ দাউদ নবীকে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে মৃত্যু দেন। কিন্তু এতে তাঁর অনুসারীরা বিপথগামীও হয়নি, দীনও পরিবর্তন করেনি। আর ঈসা মাসীহর অনুসারীরা তাঁর বিদায়ের পরে দু’শ বছর তাঁর নীতি ও আদর্শের উপরে টিকে ছিল। ইবন হিব্বান এ হাদীসকে সহীত’ বললেও মূলত এর সনদ গরীব পর্যায়ের। ইবন জারীর মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নেয়ার পর্বে তিনি হাওয়ারীগণকে উপদেশ দিয়েছেলেন, তারা যেন মানুষকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকতে থাকে। তিনি তাদের প্রত্যেককে সিরিয়া ও প্রাচ্য-প্রতীচ্যের জনগোষ্ঠির এক এক এলাকা দাওয়াতী কাজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।

বর্ণনাকারীগণ বলেছেন যে, সে এলাকায় যে হাওয়ারীকে নিয়োগ করা হয়েছিল, তিনি সেই এলাকার অধিবাসীদের সাথে তাদের নিজ ভাষায় কথা বলতেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন, হযরত ঈসা (আ)-এর নিকট থেকে চার জন লোক ইনজীল উদ্ধৃত করেছেন। তারা হলেন, লুক, মথি, মার্কস ( মার্ক) ও ইউহান্না (যোহন)। কিন্তু এই ইনজীল চতুষ্টয়ের মধ্যে একটির সাথে আর একটির যথেষ্ট গরমিল বিদ্যমান। একটির মধ্যে বেশী তো আর একটিতে কম। উক্ত চার জনের মধ্যে মথি ও ইউহান্না হযরত ঈসার যুগের এবং তারা তাকে দেখেছিলেন। মার্কস ও লুক তাঁর সমসাময়িক ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন ঈসার শিষ্যদের শিষ্য। তবে তাঁরা মাসীহর উপর যথার্থ ঈমান আনেন ও তাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন। দামিশকের এক ব্যক্তি ঈসা মাসীহর উপর ঈমান আনেন, তার নাম যায়ন ( ضينا )। তবে তিনি পোল নামক জনৈক ইহুদীর ভয়ে দামিশকের পূর্ব গেটে গীর্জার নিকটে একটি গুহায় আত্মগোপন করে থাকেন। উক্ত ইহুদী ছিল অত্যাচারী ও ঈসা (আ)-এর প্রতি এবং তার আদর্শের প্রতি চরম বিদ্বেষী। এই ব্যক্তির এক ভাইপো ঈসা (আ)-এর উপর ঈমান আনার কারণে সে তার মাথার চুল মুড়িয়ে দেয়। শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরায় এবং পাথর মেরে তাকে হত্যা করে। একদিন সে শুনতে পেল ঈসা (আ) দামিশক অভিমুখে রওনা হয়েছেন। তখন সে তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে খচ্চরে আরোহণ করে সেদিকে বেরিয়ে পড়ল।

কাওকাব নামক স্থানে পৌঁছে সে ঈসা (আ)-কে দেখতে পেল। ঈসা (আ)-এর শিষ্যদের দিকে অগ্রসর হতেই এক ফেরেশতা এসে পাখা দিয়ে আঘাত করে তার চোখ কানা করে দিলেন। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তার অন্তরে ঈসা (আ)-এর প্রতি বিশ্বাস জন্মায়। তখন সে ঈসা (আ)-এর নিকট গিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ঈমান আনে ঈসা (আ) তার ঈমান গ্রহণ করলেন। অতঃপর সে ঈসা (আ)-কে তার চক্ষুদ্বয়ের উপর হাত বুলিয়ে দিতে অনুরোধ করল, যাতে আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। ঈসা (আ) বললেন,, ‘তুমি যায়ন-এর কাছে ফিরে যাও। দামিশকের পূর্ব প্রান্তে লম্বা বাজারের পার্শ্বে তাকে পাবে। সে তোমার জন্যে দোয়া করবে।’ ঈসা (আ)-এর কথামত সে সেখানে এসে যায়নকে পেল। যায়ন তার জন্যে দোয়া করলে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। পোল আন্তরিকভাবে ঈসার প্রতি ঈমান এনেছিলেন তিনি তাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করতেন। তার নামে দামিশকে একটি গীর্জা তৈরি করা হয়। পোলের গীর্জা নামে খ্যাত এই গীর্জাটি সাহাবাদের যুগে দামিশক বিজয়কালেও বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে এটা ধ্বংস হয়ে যায়। সে ইতিহাস আমরা পরে বলব।

৩১
পরিচ্ছেদ
হযরত ঈসা মাসীহ্ (আ)-কে আসমানে উঠানোর পর তাঁর সম্পর্কে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি হয়। ইবন আব্বাসসহ প্রথম যুগের অনেক মনীষী এ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। আমরা সূরা সাফ-এর আয়াত- “পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শত্রুদের মুকাবিলায়; ফলে তারা বিজয়ী হল।” (৬১ সাফঃ ১৪)-এর ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেছেন, তাদের একদল বিশ্বাস করে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি আমাদের মধ্যে ছিলেন, এখন তাঁকে আসমানে তুলে নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দল বলে, তিনি হলেন স্বয়ং আল্লাহ। তৃতীয় দলের মতে, তিনি আল্লাহর পুত্র। বস্তৃত প্রথম দলের বিশ্বাসই যথার্থ। অন্য দল দু’টির বক্তব্য জঘন্য কুফরী। তাদের মতবিরোধ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল, সুতরাং দুর্ভোগ কাফিরদের মহাদিবস আগমনকালে।” (১৯ মারয়ামঃ ৩৭)

এ ছাড়া ইনজীলের চারজন বর্ণনাকারীর বর্ণনা উদ্ধৃত করার মধ্যেও কম, বেশী পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। তারপর হযরত ঈসা (আ)-এর তিনশ’ বছর পর ইনজীল ও ঈসায়ী ধর্মের উপর বিরাট দুর্যোগ নেমে আসে। চার দলের চারজন আর্ক বিশপ, পাদ্রী ও সাধু-সন্ন্যাসীগণ মাসীহ সম্পর্কে এত অসংখ্য মতে বিভক্ত হয়ে পড়েন, নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারা তাদের এ বিরোধের ফয়সালার জন্যে কনষ্টান্টিনোপল নগরীর প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট কনস্টান্টাইনের শরণাপন্ন হয়। এটা ছিল তাদের প্রথম মহাসম্মেলন। সম্রাট সবকিছু শুনে অধিকাংশ দল যে মতের উপর ঐকমত্য পোষণ করে, সে মতকেই গ্রহণ করেন। এই দলের নামকরণ করা হয় মালাইকা (মালাকিয়া)। এ মতের বাইরে যারা ছিল তাদেরকে নির্যাতীত করেন ও দেশান্তরিত করেন। আবদুল্লাহ ইবন আদয়ুসের অনুসারী যারা ঈসা (আ)-কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করতেন তারা একঘরে হয়ে পড়েন। তারা বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চলে ও উপত্যকায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। তারা সেখানে ইবাদতখানা, গীর্জা ও উপাসনালয় তৈরি করেন এবং সন্ন্যাসী জীবন-যাপন করতে থাকেন। এঁরা উপরোক্ত ফের্কাসমূহের সংশ্রব থেকে দূরে থাকেন। অপরদিকে মালাইকা সম্প্রদায় গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণে বিভিন্ন জায়গায় বিরাট বিরাট গীর্জা স্থাপন করে। তারা তাদের কিবলা পূর্ব দিকে পরিবর্তন করে, যদিও কিবলা ইতিপূর্বে উত্তরে জাদাইর দিকে ছিল।

৩২
বেথেলহাম ও কুমামার ভিত্তি স্থাপন
হযরত ঈসা মাসীহ (আ) যে স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে স্থানে সম্রাট কনস্টান্টাইন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার নাম রাখা হয় বায়তু লাহাম (বেথেলহাম)। অপর দিকে সম্রাটের মা হায়লানা কথিত ক্রুশবিদ্ধ ঈসার কবরের উপর আর একটি প্রাসাদ তৈরি করেন, যার নাম রাখা হয় কুমামা। ইহুদীদের প্রচারণায় পড়ে তারাও বিশ্বাস করত যে, নবী ঈসা মাসীহকেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই মত পোষণকারী পূর্বের ও পরের সকলেই কাফির। এরা বিভিন্ন রকম মনগড়া বিধি-বিধান ও আইন-কানুন তৈরি করে। এসব বিধানের মধ্যে ছিল পুরাতন নিয়ম তথা তাওরাতের বিরোধিতা করা। তারা তাওরাতে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম বস্তুকে হালাল করে নেয়, যেমন শূকর খাওয়া। তারা পূর্বমুখী হয়ে উপাসনা করে। অথচ ঈসা-মাসীহ বায়তুল মুকাদ্দাসের শুভ্র পাথরের দিকে মুখ করে ছাড়া ইবাদত করতেন না। শুধু তিনিই নন, বরং মূসা (আ)-এর পরবর্তী সকল নবী বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করেছেন। এমনকি শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-ও হিজরতের পরে ষোল কিংবা সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসকে কিবলা করে নামায আদায় করেছেন। পরে তিনি আল্লাহর হুকুমে ইবরাহীম খলীল (আ) কর্তৃক নির্মিত কা’বা ঘরের দিকে ফিরে নামায পড়েন।

তারা গীর্জাগুলোতে মূর্তি স্থাপন করে অথচ ইতিপূর্বে গীর্জায় কখনও কোন মূর্তি রাখা হতো না। তারা এমন সব আকীদা তৈরি করে যা শিশু, মহিলা ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই বিশ্বাস করত। এই আকীদার নাম ছিল ‘আমান’। প্রকৃত পক্ষে এটা ছিল সম্পূর্ণ কুফরী আকীদা ও বিশ্বাস ভঙ্গের নামান্তর। মালাকিয়া ও নাসতুরিয়া দলভুক্ত সকলেই ছিল নাসতুরাস এর অনুসারী। এরা ছিল দ্বিতীয় মহা সম্মেলনপন্থী। আর ইয়াকূবিয়া সম্প্রদায় হচ্ছে ইয়াকূব আল বারাদায়ীর অনুসারী। এরা হল তৃতীয় মহা সমাবেশ পন্থী। এ দুই দলই প্রথমোক্ত দলের একই আকীদা পোষণ করত, যদিও খুঁটিনাটি বিষয়ে পারস্পরিক বিরোধ ছিল। আমি তাদের কুফরী আকীদার কথা বর্ণনা করছি।

আর কুফরের বর্ণনা করায় কেউ কাফির হয় না। তাদের আকীদার বাক্যগুলোর মধ্যে এমন সব জঘন্য শব্দ আছে, যার মধ্যে কুফরীর ভাব অতি প্রকট এবং তা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। এ আকীদা মানুষকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পোঁছিয়ে দেয়। তাদের বলে থাকে যে, আমরা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করি যিনি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, আসমান ও যমীনের দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, ঐ একই প্রতিপালককে আমরা মানি। মাসীহ সেই এক আল্লাহরই একক পুত্র। অনাদিকালেই পিতা থেকে তাঁর জন্ম। তিনি নূর থেকে সৃষ্ট নূর। সদা প্রভু থেকে তিনিও সদা প্রভু। তিনি জন্মলাভ করেছেন, সৃষ্ট হননি। সেই মূল উপাদানে তিনি পিতার সমকক্ষ যার দ্বারা সবকিছু সৃষ্ট হয়েছে। আমাদের ললাটলিপি অনুযায়ী আমরা মানুষ। আমাদের মুক্তির জন্যে তিনি আসমান থেকে অবতরণ করেছেন এবং পবিত্র আত্মা দ্বারা দেহ ধারণ করেছেন ও কুমারী মারয়ামের গর্ভ থেকে মানবরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এরপর মালাতিস নাবাতীর আমলে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন। তারপরে সমাধিস্থ হয়েছেন। সমাধিস্থ হওয়ার তিন দিন পর কবর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং আসমানে উঠে গিয়ে পিতার ডান পাশে বসে আছেন। আবার তিনি দেহ ধারণ করে আসবেন। জীবিত ও মৃতদের খোঁজ খবর নিবেন। তাঁর রাজত্বের ক্ষয় নেই। তিনি পবিত্র আত্মা। তিনি প্রভু, জীবন দানকারী। পিতার কাছ থেকে এসেছেন। পিতার সাথে থাকবেন। পুত্র সিজদা পাওয়ার যোগ্য। নবীকুলের মধ্যে দোলনায় কথা বলার গৌরব তিনিই লাভ করেছেন। আল্লাহর সাথে পবিত্র ও পূর্ণাংগ সম্পর্ক তাঁর। সমস্ত পাপ ক্ষমা করার জন্যে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি চিরঞ্জীব, মৃতকে জীবন দানকারী, সর্বদা বিরাজমান ও যিম্মাদার।

৩৩
অতীতকালের কাহিনী
অতীতকাল বলতে এখানে বনী ইসরাঈলের যুগ থেকে আরবের জাহিলী যুগের পূর্ব পর্যন্ত সময় বুঝানো হয়েছে। এই সময়কালের বড় বড় ঘটনা এখানে আলোচনা করা হবে। আর আরবের জাহিলী যুগ সম্পর্কে এই অধ্যায়ের পরে আলোচনা আসবে। আল্লাহর বাণীঃ পূর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ আমি এভাবে তোমার নিকট বিবৃত করি এবং আমি আমার নিকট হতে তোমাকে দান করেছি উপদেশ (২০ তাহাঃ ৯৯)। সূরা ইউসুফে আল্লাহ বলেন, “আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি, ওহীর মাধ্যমে তোমার নিকট এই কুরআন প্রেরণ করে; যদিও এর পূর্বে তুমি ছিলে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত।” (১২ ইউসুফঃ ৩)

৩৪
যুল-কারনায়ন
এ প্রসংগে আল্লাহর বাণীঃ

( وَیَسۡـَٔلُونَكَ عَن ذِی ٱلۡقَرۡنَیۡنِۖ قُلۡ سَأَتۡلُوا۟ عَلَیۡكُم مِّنۡهُ ذِكۡرًا ۝ إِنَّا مَكَّنَّا لَهُۥ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَءَاتَیۡنَـٰهُ مِن كُلِّ شَیۡء سَبَب ا ۝ فَأَتۡبَعَ سَبَبًا ۝ حَتَّىٰۤ إِذَا بَلَغَ مَغۡرِبَ ٱلشَّمۡسِ وَجَدَهَا تَغۡرُبُ فِی عَیۡنٍ حَمِئَة وَوَجَدَ عِندَهَا قَوۡم اۖ قُلۡنَا یَـٰذَا ٱلۡقَرۡنَیۡنِ إِمَّاۤ أَن تُعَذِّبَ وَإِمَّاۤ أَن تَتَّخِذَ فِیهِمۡ حُسۡن ا ۝ قَالَ أَمَّا مَن ظَلَمَ فَسَوۡفَ نُعَذِّبُهُۥ ثُمَّ یُرَدُّ إِلَىٰ رَبِّهِۦ فَیُعَذِّبُهُۥ عَذَاب ا نُّكۡر ا ۝ وَأَمَّا مَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَـٰلِح ا فَلَهُۥ جَزَاۤءً ٱلۡحُسۡنَىٰۖ وَسَنَقُولُ لَهُۥ مِنۡ أَمۡرِنَا یُسۡر ا ۝ ثُمَّ أَتۡبَعَ سَبَبًا ۝ حَتَّىٰۤ إِذَا بَلَغَ مَطۡلِعَ ٱلشَّمۡسِ وَجَدَهَا تَطۡلُعُ عَلَىٰ قَوۡم لَّمۡ نَجۡعَل لَّهُم مِّن دُونِهَا سِتۡر ا ۝ كَذَ  ٰ⁠ لِكَۖ وَقَدۡ أَحَطۡنَا بِمَا لَدَیۡهِ خُبۡر ا ۝ ثُمَّ أَتۡبَعَ سَبَبًا ۝ حَتَّىٰۤ إِذَا بَلَغَ بَیۡنَ ٱلسَّدَّیۡنِ وَجَدَ مِن دُونِهِمَا قَوۡم ا لَّا یَكَادُونَ یَفۡقَهُونَ قَوۡل ا ۝ قَالُوا۟ یَـٰذَا ٱلۡقَرۡنَیۡنِ إِنَّ یَأۡجُوجَ وَمَأۡجُوجَ مُفۡسِدُونَ فِی ٱلۡأَرۡضِ فَهَلۡ نَجۡعَلُ لَكَ خَرۡجًا عَلَىٰۤ أَن تَجۡعَلَ بَیۡنَنَا وَبَیۡنَهُمۡ سَدّ ا ۝ قَالَ مَا مَكَّنِّی فِیهِ رَبِّی خَیۡر فَأَعِینُونِی بِقُوَّةٍ أَجۡعَلۡ بَیۡنَكُمۡ وَبَیۡنَهُمۡ رَدۡمًا ۝ ءَاتُونِی زُبَرَ ٱلۡحَدِیدِۖ حَتَّىٰۤ إِذَا سَاوَىٰ بَیۡنَ ٱلصَّدَفَیۡنِ قَالَ ٱنفُخُوا۟ۖ حَتَّىٰۤ إِذَا جَعَلَهُۥ نَار ا قَالَ ءَاتُونِیۤ أُفۡرِغۡ عَلَیۡهِ قِطۡر ا ۝ فَمَا ٱسۡطَـٰعُوۤا۟ أَن یَظۡهَرُوهُ وَمَا ٱسۡتَطَـٰعُوا۟ لَهُۥ نَقۡب ا ۝ قَالَ هَـٰذَا رَحۡمَة مِّن رَّبِّیۖ فَإِذَا جَاۤءَ وَعۡدُ رَبِّی جَعَلَهُۥ دَكَّاۤءَۖ وَكَانَ وَعۡدُ رَبِّی حَقّ ࣰا)

[Surah Al-Kahf 83 - 98]

“ওরা তোমাকে যুল-কারনায়ন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বল, আমি তোমাদের নিকট তার বিষয় বর্ণনা করব। আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম। অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌঁছল তখন সে সূর্যকে এক পংকিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে দেখল এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেল। আমি বললাম, “হে যুল-কারনায়ন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা এদের ব্যাপার সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।’ সে বলল, ‘যে কেউ সীমালংঘন করবে, আমি তাকে শাস্তি দিব, অতঃপর সে তার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে এবং তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন। তবে যে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তার জন্যে প্রতিদান স্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি ব্যবহারে আমি নম্র কথা বলব।

আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে যখন সে সূর্যোদয় স্থলে পৌঁছল, তখন সে দেখল তা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদয় হচ্ছে যাদের জন্যে সূর্যতাপ হতে কোন অন্তরাল আমি সৃষ্টি করিনি। প্রকৃত ঘটনা এটাই, তার বৃত্তান্ত আমি সম্যক অবগত আছি। আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, “হে যুল-কারনায়ন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি তোমাকে কর দিব এই শর্তে যে, তুমি আমাদের ও তাদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়ে দিবে?’ সে বলল, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা-ই উৎকৃষ্ট; সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধস্থলে এক মজবুত প্রাচীর গড়ে দিব। তোমরা আমার নিকট লৌহ পিণ্ডসমূহ আনয়নকর, অতঃপর মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে যখন লৌহস্তুপ দুই পর্বতের সমান হল তখন সে বলল, তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। যখন তা আগুনের মত উত্তপ্ত হল, তখন সে বলল, তোমরা গলিত তামা আনয়ন কর, আমি তা ঢেলে দিই এর উপর। এরপর তারা তা অতিক্রম করতে পারল না বা ভেদ করতেও পারল না। সে বলল, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে তখন এটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।” (১৮ কাহফঃ ৮৩-৯৮)।

আল্লাহ এখানে যুল-কারনায়নের বর্ণনা দিয়েছেন। তাকে তিনি ন্যায়পরায়ণ বলে প্রশংসা করেছেন। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তিনি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

ভূ-খণ্ডের উপর তিনি বিজয় লাভ করেছিলেন। সকল দেশের অধিবাসীরা তার আনুগত্য স্বীকার করেছিল। তাদের মধ্যে তিনি পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বস্তুত তিনি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত এক সফল ও বিজয়ী বীর এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী বাদশাহ্। তাঁর সম্পর্কে বিশুদ্ধ কথা হল, তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। অবশ্য কারো কারো মতে, তিনি নবী, কারো কারো মতে, রাসূল। তাঁর সম্পর্কে একটি বিরল মত হচ্ছে, তিনি ছিলেন ফেরেশতা। এই শেষোক্ত মতটি আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে শ্রুত হয়ে বর্ণিত হয়েছে। কেননা, হযরত উমর (রা) একদিন শুনতে পেলেন যে, এক ব্যক্তি অপর একজনকে বলছে, হে যুল-কারনায়ন! তখন তিনি বললেন, থাম, যে কোন একজন নবীর নামে নাম রাখাই যথেষ্ট, ফেরেশতার নামে নাম রাখার কী প্রয়োজন? সুহায়লী এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

ওকী’ ...... মুজাহিদের সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যুল-কারনায়ন নবী ছিলেন। হাফিজ ইবন আসাকির ........ আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি জানি না, তুব্বা বাদশাহ অভিশপ্ত ছিল কি না; আমি এটাও জানি না যে, শরয়ী শাস্তি দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্তের গুনাহ্ মাফ হবে কি না; আমি জানি না, যুল-কারনায়ন নবী ছিলেন কি না! এ হাদীস উপরোক্ত সনদে গরীব।

ইসহাক ইবন বিশর ........ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, যুল-কারনায়ন ছিলেন একজন ধার্মিক বাদশাহ। আল্লাহ তাঁর কাজ-কর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন নিজ কিতাবে তিনি তার প্রশংসা করেছেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত। হযরত খিযির (আ) ছিলেন তার উযীর।

তিনি আরও বলেছেন যে, খিযির (আ) থাকতেন তার সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে। বর্তমান কালে বাদশাহর নিকট উযীরের যেই স্থান, যুল-কারনায়নের নিকট হযরত খিযিরের ছিল ঠিক সেইরূপ উপদেষ্টার মর্যাদা। আযরকী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে, যুল-কারনায়ন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্ (আ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হযরত ইবরাহীমের সাথে তিনি ও ইসমাঈল (আ) একত্রে কাবা তাওয়াফ করেন। উবায়দ ইবন উসায়র তার পুত্র আবদুল্লাহ ও অন্যান্য বর্ণনাকারী বলেছেন যে, যুল-কারনায়ন পদব্রজে হজ্জ পালন করেন। ইবরাহীম (আ) তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে তার সাথে সাক্ষাত করেন, তাঁকে দোয়া করেন ও তার উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আল্লাহ মেঘপুঞ্জকে যুল-কারনায়নের অনুগত করে দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি যেতে চাইতেন মেঘমালা তাকে সেখানে বহন করে নিয়ে যেত।

যুল-কারনায়ন নামকরণের ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। কারও মতে, তাঁর মাথায় দুইটি শিং-এর মত ছিল এ কারণে তাকে যুল-কারনায়ন (দুই শিংওয়ালা) বলা হয়েছে। ওহব ইবন মুনাব্বিহ বলেন, তাঁর মাথায় তামার দুইটি শিং ছিল। এটা দুর্বল মত। কোন কোন আহলি-কিতাব বলেছেন, যেহেতু তিনি রোম ও পারস্য এই উভয় সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন তাই তাঁকে এরূপ উপাধি দেয়া হয়েছে। কেউ বলেন, যেহেতু তিনি সূর্যের দুই প্রান্ত পূর্ব ও পশ্চিম এবং এর মধ্যবর্তী সমস্ত জায়গার একচ্ছত্র বাদশাহ ছিলেন, তাই তাঁকে এই নামে ভূষিত করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা ইমাম যুহরীর এবং অন্যান্য মতের তুলনায় এ মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। হাসান বসরী বলেন, তাঁর মাথার চুলের দুটি উঁচু ঝুঁটি ছিল যার কারণে তাকে এই নাম দেয়া হয়। ইসহাক ইবন বিশর ...... শুআয়বের পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এক পরাক্রমশালী বাদশাহকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন। এতে সে তার একটি শিং-এর উপর আঘাত করে ভেংগে চুরমার করে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে তাকে যুল-কারনায়ন বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইমাম ছাওরী ........ আলী ইবন আবি তালিব (রা) থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-কে যুল-কারনায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যুল-কারনায়ন আল্লাহর এক সৎ বান্দা। আল্লাহ তাঁকে উপদেশ দেন। তিনি উপদেশ কবুল করেন। তিনি তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন। তারা তাঁর একটি শিং-এর উপর সজোরে আঘাত করে। ফলে তিনি মারা যান। আল্লাহ তাঁকে জীবিত করেন। আবারও তিনি তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন। তখন তারা তার অপর শিং এর উপর আঘাত করে। এ আঘাতেও তিনি মারা যান। এখান থেকে তাকে যুল-কারনায়ন বলা হয়ে থাকে। শু’বা আল-কাসিমও........ হযরত আলী (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আবুত তুফায়ল হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন, যুল-কারনায়ন নবী, রাসূল বা ফেরেশতা কোনটিই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন পুণ্যবান ব্যক্তি।

যুল-কারনায়নের আসল নাম কি ছিল সে ব্যাপারে বিভিন্ন রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। যুবায়র ইবন বাকার ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাঁর নাম আবদুল্লাহ ইবন যাহ্হাক ইবন মা’আদ। কারও বর্ণনা মতে, মুসআব ইবন আবদুলাহ ইবন কিনান ইবন মানসূর ইবন আবদুল্লাহ ইবন আযদ ইবন আওন ইবন নাবাত ইবন মালিক ইবন যায়দ ইবন কাহলান ইবন সাবা ইবন কাহতান।

একটি হাদীসের বর্ণনায় আছে যে, যুল-কারনায়ন হিময়ার গোত্রভুক্ত ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন রোম দেশীয়। প্রখর জ্ঞানের অধিকারী হওয়ায় যুল-কারনায়নকে ইবনুল ফায়লাসুফ বা মহাবিজ্ঞানী হলা হতো। হিময়ার গোত্রের জনৈক কবি তাদের পূর্ব-পুরুষ যুল-কারনায়নের প্রশংসায় নিম্নরূপ গৌরবগাথা লিখেন।

قد كان ذوالقرنين جدي مسلما - ملگا تدين له الملوك وتحشد

بلغ المشارق والمغارب يبغ -أسباب أمر من حكيم مرشد

فر ائ مغيب الشمس عند غروبها - في عين ذي خلب وثاط حرمد

من بعده بلقيس كانت عمتي- ملكتهم حتى أتاها الهدهد অর্থঃ যুল-কারনায়ন ছিলেন আমার পিতামহ, মুসলমান ও এমন এক বাদশাহ। অন্যান্য রাজন্যবর্গ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে ও তাঁর নিকট আত্মসমপণ করেন। তিনি অভিযানের পর অভিযান পরিচালনা করে পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেন এবং মহাজ্ঞানী পথপ্রদর্শক আল্লাহর প্রদত্ত উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করেন। পশ্চিমে সূর্যের অস্তাচলে গিয়ে সেখানে সূর্যকে এক কর্দমাক্ত কাল জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখেন। তার পরে আসেন সম্রাজ্ঞী বিলকীস। তিনি ছিলেন আমার ফুফু। বিশাল রাজ্যের অধিকারী হন তিনি। সুলায়মানের হুদহুদ পাখীর আগমন পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত প্রতাপের সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন।

সুহায়লী লিখেছেন, কেউ কেউ তার নাম বলেছেন মারযুবান ইবন মারযুবা। ইবন হিশাম এ কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি অন্যত্র যুল-কারনায়নের নাম লিখেছেনঃ আস্-সা’ব ইবন যী-মারাইদ। তুববা বংশের ইনিই প্রথম বাদশাহ। বীরুস্-সাবা’র ঘটনায় তিনি ইবরাহীমের পক্ষে ফয়সালা দিয়েছিলেন। কেউ বলেছেন, যুল-কারনায়নের নাম আফরীদূন ইবন আসফিয়ান-যিনি যাহ্হাককে হত্যা করেছিলেন। আরবের বাগ্মী পুরুষ কুস তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেনঃ হে আয়াদ ইবন সা’ব যুল-কারনায়নের বংশধর। তোমাদের পূর্বপুরুষ যুল-কারনায়ন যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের বাদশাহ, জিন ও ইনসানের উপর ক্ষমতা প্রয়োগকারী এবং দু’হাজার বছর যার বয়স। এ সত্ত্বেও তা যেন ছিল এক লহমার মত। এ কথা উল্লেখ করার পর ইবন হিশাম কবি আ‘শার নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন-

والصعب والقرنين أصبح ثاويا - بالجنو في جدث اشم مقيما

“অতঃপর সা‘ব যুল-কারনায়ন মাটির নীচে কবরের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ীভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সেখানে অবস্থানরত অবস্থায় তার সুবাস নিতে থাকেন।

ইমাম দারাকুতনী ও ইবন মাকূলা বলেছেন, যুল-কারনায়নের নাম হুরমুস। তাঁকে বলা হত হারবীস ইবন কায়তুন ইবন রামী ইবন লানতী ইবন কাশলূখীন ইবন ইউনান ইবন ইয়াফিছ ইবন নূহ (আ)। ইসহাক ইবন বিশর ........কাতাদা (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, বাদশাহ ইস্কান্দর (আলেকজাণ্ডার)-ই হলেন যুল-কারনায়ন। তাঁর পিতা ছিলেন প্রথম কায়সার (রোম সম্রাট)। ইনি সাম ইবন নূহ (আ)-এর বংশধর। আর দ্বিতীয় যুল-কারনায়ন হচ্ছেন ইস্কানদার ইবন ফিলিপস ইবন মুসরীম ইবন হুরমুস ইবন মায়তুন ইবন রূমী ইবন লানতী ইবন ইউনান ইবন ইয়াফিছ ইবন য়ুনাহ ইবন শারখুন ইবন রূমাহ্ ইবন শারফত ইবন তাওফীল ইবন রূমী ইবন আসফার ইবন ইয়াকিয ইবন ঈস ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম আল-খালীল (আ)। হাফিজ ইবন আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে এই নসবনামা উল্লেখ করেছেন। যুল-কারনায়ন আল-মাকদূনী আল-ইউনানী আল মিসরী আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর প্রতিষ্ঠাতা, যিনি স্বীয় শাসনামলে রোমের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথম যুল-কারনায়ন থেকে এই দ্বিতীয় যুল-কারনায়ন দীর্ঘকাল পরে হযরত ঈসা (আ)-এর তিনশ’ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। দার্শনিক এরিস্টটল ছিলেন তাঁর উযীর। তিনি দারার পুত্র দারাকে হত্যা করেন এবং পারস্য সাম্রাজ্যকে পদানত করেন। আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করলাম এজন্যে যে, অনেকেই উভয় ইস্কান্দারকে অভিন্ন ব্যক্তি মনে করেন। ফলে তারা এ বিশ্বাস করেন যে, কুরআনে যে যুল-কারনায়নের কথা বলা হয়েছে তাঁরই উযীর ছিলেন এরিস্টটল। এ বিশ্বাসের ফলে বিরাট ভুল ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। কেননা প্রথম যুল-কারনায়ন ছিলেন মুমিন, সৎ, আল্লাহভক্ত ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। হযরত খিযির (আ) তাঁর উযীর। অনেকের মতে, তিনি ছিলেন নবী।

পক্ষান্তরে দ্বিতীয় যুল-কারনায়ন ছিল মুশরিক। তার উযীর একজন দার্শনিক। তাছাড়া এ দু’জনের মধ্যে দু’হাজার বছরের চাইতেও অধিক সময়ের ব্যবধান। সুতরাং কোথায় এর অবস্থান, আর কোথায় তার অবস্থান। উভয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান, কোনই সামঞ্জস্য নেই। অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকেরাই দু’জনকে এক বলে ভাবতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহর বাণীঃ “ওরা তোমাকে যুল-কারনায়ন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে। এর কারণ হচ্ছেঃ কতিপয় কুরায়েশের কাফিরগণ ইহুদীদের কাছে গিয়ে বলে, তোমরা আমাদেরকে এমন কিছু কথা বলে দাও, যে বিষয়ে আমরা মুহাম্মদ (সা)-এর জ্ঞান পরীক্ষা করতে পারি। ইহুদীরা এদেরকে শিখিয়ে দিল যে, তোমরা তাকে এমন এক ব্যক্তির কথা জিজ্ঞেস কর, যে সমগ্র ভূ-খণ্ড বিচরণ করেছে। আর কতিপয় যুবকের পরিচয় জিজ্ঞেস কর, যারা তাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, যাদের পরিণতি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। কুরায়শরা ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ প্রশ্ন করলে আল্লাহ তা’আলা আসহাবে কাহফ ও যুল-কারনায়নের ঘটনা সম্বলিত আয়াতসমূহ নাযিল করেন।

আল্লাহ বলেন, “বল, আমি শীঘ্রই তোমাদেরকে এ বিষয়ে জানাব।” অর্থাৎ এদের বর্ণনা ও অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। আয়াতে উল্লেখিত ( ذكرا ) অর্থঃ তার পরিচয়ের জন্যে যেটুকু প্রয়োজন ও কল্যাণকর ততটুকু বলা হবে। অতঃপর আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম ও প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম।” অর্থাৎ তাকে বিরাট রাজত্ব দিয়েছিলাম এবং রাষ্ট্রের এমন সব উপায়-উপকরণ তার করায়ত্ত করে দিয়েছিলাম যার সাহায্যে সে বিরাট বিরাট কাজ সমাধা করতে ও বড় বড় উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারতো। কুতায়বা ....... হাবীব ইবন হাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেন। হাবীব বলেন, আমি হযরত আলী ইবন আবি তালিবের কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘যুল-কারনায়ন কী উপায়ে পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন?’ হযরত আলী (রা) বললেন, ‘মেঘমালাকে তাঁর অনুগত করে দেয়া হয়েছিল, সকল উপকরণ তাঁর হস্তগত করা হয়েছিল এবং তার জন্যে আলো বিচ্ছুরিত করা হয়েছিল।’ এ পর্যন্ত বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরও বলা লাগবে না কি?’ শুনে লোকটি চুপে হয়ে গেল, আর হযরত আলী (রা)-ও থেমে গেলেন। আবু ইসহাক সাবীয়ী ...... মুআবিয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেন, সমগ্র পৃথিবীর বাদশাহী করেছেন চারজনঃ (১) সুলায়মান ইবন দাঊদ (আ), (২) যুল-কারনায়ন (3) হুলওয়ানের জনৈক অধিবাসী (৪) অন্য একজন। জিজ্ঞেস করা হল, ‘তিনি কি খিযির?’ বললেন, ‘না।’

যুবায়র ইবন বাক্কার...... সুফিয়ান ছাওরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, সমগ্র পৃথিবীতে রাজত্ব করেছেন এমন বাদশাহ ছিলেন চারজন, দুইজন মুমিন (১) নবী সুলায়মান (২) যুল-কারনায়ন এবং দুইজন কাফির। (৩) নমরুদ ও (৪) বুখত নসর। সাঈদ ইবন বশীরও এইরূপ বর্ণনা করেছেন। ইসহাক ইবন বিশর..... হাসান বসরী (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, নমরূদের পরে যুল-কারনায়ন বাদশাহ হন। তিনি একজন খাঁটি-নেককার মুসলমান ছিলেন। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে অভিযান চালান। আল্লাহ তাঁর আয়ু বাড়িয়ে দেন ও তাকে সাহায্য করেন। ফলে সমস্ত জনপদ তিনি নিজের অধীনে আনেন, ধন-রত্ন করায়ত্ব করেন, দেশের পর দেশ জয় করেন এবং বহু কাফির নিধন করেন। তিনি বিভিন্ন জনপদ, শহর ও কিল্লা অতিক্রম করে চলতে চলতে পৃথিবীর পূর্ব সীমান্তে ও পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যান। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেনঃ “তারা তোমাকে যুল-কারনায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বল, আমি তোমাদের কাছে তার কিছু অবস্থা বর্ণনা করব। আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম।” অর্থাৎ উপায়-উপকরণ অন্বেষণের জ্ঞান দান করেছিলাম।

ঐতিহাসিক ইসহাক লিখেছেন, মুকাতিল বলেন যে, যুল-কারনায়ন দেশের পর দেশ জয় করেন, ধনরত্ন সংগ্রহ করেন এবং যারা তার দীন গ্রহণ করত ও তা অনুসরণ করত তাদেরকে ছেড়ে দিতেন, অন্যথায় হত্যা করতেন। (( وَءَاتَیۡنَـٰهُ مِن كُلِّ شَیۡء سَبَب ࣰا), “আর আমি তাকে প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম”। এ আয়াতে ( سببا ) এর অর্থ ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইবন জুবায়র, ইকরিমা, উবায়দ ইবন ইয়া’লা, সুদ্দী, কাতাদা ও যাহহাক-এর মতে ইলম বা জ্ঞান। কাতাদা ও মাতা আল-ওয়াররাকের মতে, ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন নিদর্শন, অবস্থান, অবস্থা ও প্রকৃতি। আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলামের মতে, বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান। কেননা, যুল-কারনায়ন যে জাতির বিরুদ্ধেই লড়াই করতেন সেই জাতির ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতেন। কিন্তু এর সঠিক অর্থ এই যে, এমন প্রতিটি উপকরণই এর অন্তর্ভুক্ত যার সাহায্যে তিনি রাষ্ট্রের মধ্যে ও বাইরে নিজ উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে ব্যবহার করতেন। কারণ, তিনি প্রতিটি বিজিত দেশ থেকে প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ, খাদ্য-সামগ্রী ও পাথেয় গ্রহণ করতেন-যা তাঁর কাজে লাগত এবং অন্য দেশ জয়ের জন্যে সহায়ক হত।

কোন কোন আহলি কিতাব উল্লেখ করেছেন, যুল-কারনায়ন এক হাজার ছয় শ’ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। তিনি গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করেন এবং মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতে থাকেন। কিন্তু তাঁর বয়সকাল সম্পর্কে যে সব মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমি তাকে প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম" এ আয়াত সম্পর্কে বায়হাকী ও ইবন আসাকির এক দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সে হাদীসটি অত্যন্ত মুনকার পর্যায়ের। ঐ হাদীসের জনৈক রাবী মুহাম্মদ ইবন ইউনুসের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে আমরা এখানে সে হাদীস উল্লেখ করলাম না। আল্লাহর বাণীঃ “অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থলে পৌঁছল।” অর্থাৎ চলতে চলতে পৃথিবীর পশ্চিম দিকে এমন এক স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন, যে স্থান অতিক্রম করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে এসে তিনি থেমে যান। এই স্থানটি হল পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরের উপকুল। এর মধ্যে ছিল কতগুলো দ্বীপ। দ্বীপগুলোকে আরবীতে খালিদাত দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়।

মানচিত্রবিদদের কারও কারও মতে, এই দ্বীপ থেকেই ভূ-ভাগ শুরু হয়েছে, কিন্তু অন্যদের মতে উক্ত সাগরের উপকূল থেকে ভূ-পৃষ্ঠের সূচনা যা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। যুল-কারনায়ন এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যের অস্তগমন প্রত্যক্ষ করেন। “সে সূর্যকে এক পংকিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে দেখল।” পংকিল জলাশয় বলতে সাগরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি সাগর থেকে বা তার উপকূল থেকে প্রত্যক্ষ করে সে দেখতে পায় সূর্য যেন সমুদ্রের মধ্য থেকে উদিত হচ্ছে এবং সমুদ্রের মধ্যে অস্ত যাচ্ছে। এ কারণে আয়াতের মধ্যে ( وجدها ) শব্দ বলা হয়েছে, যার অর্থ সে দেখতে পেল। একথা বলা হয়নি যে, সূর্য পংকিল জলাশয়ে অস্ত গেল। কা’ব আল আহবার বলেছেন ( حمئة ) অর্থ কাল বর্ণের কাদা। ( حمئة ) কে কেউ কেউ ( حامئة ) পড়েছেন। কারও মতে, উভয় শব্দের অর্থ একই অথাৎ পংকিল জলাশয়। আবার কেউ কেউ বলেন ( حامئة ) অর্থ উষ্ণ। কেননা সূর্যের কিরণ এখানে সোজাসুজি ও তীর্যকভাবে পতিত হয়, ফলে এখানকার পানি উষ্ণ থাকে। ইমাম আহমদ...… আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একবার সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় সেদিকে তাকালেন এবং বললেনঃ এটা আল্লাহর সৃষ্ট এক উষ্ণ অগ্নিপিণ্ড ( فى نارالله الحامية )। আল্লাহর হুকুম দ্বারা যদি বাধা প্রদান না করা হত, তবে ভূ-পৃষ্ঠের সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিত। এ হাদীস গরীব পর্যায়ের সনদে জনৈক অজ্ঞাত পরিচয় রাবী বলেছেন। হাদীসটি মারফু পর্যায়ের হওয়ার ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। এটা আবদুল্লাহ-ইবন আমরের উক্তিও হতে পারে। কেননা, ইয়ারমুকের যুদ্ধে দুইটি প্রাচীন কিতাব তাঁর হস্তগত হয়। এই কিতাব থেকে তিনি অনেক কথা বর্ণনা করতেন।

কোন কোন কাহিনীকার বলেছেন যে, যুল-কারনায়ন সূর্যের অস্তগমন স্থান অতিক্রম করে সেনাদল সহ দীর্ঘদিন পর্যন্ত অন্ধকারের মধ্যে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাদের এ কথা ভুল এবং যুক্তি ও রেওয়ায় এর পরিপন্থী।

৩৫
আবে-হায়াতের সন্ধানে যুল-কারনায়ন
ইবন আসাকির ওকী (র) এর সূত্রে ..... যায়নুল আবেদীন থেকে এক দীর্ঘ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনার সারমর্ম এই যে, যুল-কারনায়নের সাথে একজন ফেরেশতা থাকতেন। তাঁর নাম ছিল রানাকীল। একদিন যুল-কারনায়ন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবীতে একটি ঝর্ণা আছে নাকি, যার নাম আইনুল হায়াত বা সঞ্জীবনী ঝর্ণা? ফেরেশতা ঝর্ণাটির অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। যুল-কারনায়ন তার সন্ধানে যাত্রা শুরু করলেন। হযরত খিযির (আ)-কে তিনি অগ্রবর্তী দলে রাখলেন। যেতে যেতে এক অন্ধকার উপত্যকায় গিয়ে ঝর্ণার সন্ধান পেলেন। খিযির ঝর্ণার কাছে গিয়ে সেখান থেকে পানি পান করলেন। কিন্তু যুল-কারনায়ন ঝর্ণার কাছে যেতে পারলেন না। তিনি সেখানে অবস্থিত একটি প্রাসাদে এক ফেরেশতার সাথে মিলিত হলেন। ফেরেশতা যুল-কারনায়নকে একটি পাথর দান করলেন। পরে তিনি সেনাবাহিনীর নিকট ফিরে এলে আলিমগণ পাথরটি সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি পাথটিকে ওজন করার জন্য এক পাল্লায় রাখলেন এবং অপর পাল্লায় অনুরূপ এক হাজার পাথর রাখলেন। কিন্তু ঐ পাথরটির পাল্লা ভারী হল। তখন হয়রত খিযির (আ)-ও পাথরটির রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন তিনি তার বিপরীত পাল্লায় একটি পাথর উঠিয়ে তার উপর এক মুষ্টি মাটি ছেড়ে দিলেন। এবার পাল্লাটি ভারী হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, এটা ঠিক বনী আদমের উপমা যারা কবরের মাটি ছাড়া কোন কিছুতেই তৃপ্ত হয় না। এ দৃশ্য দেখে আলিমগণ ভক্তিভরে তাঁর প্রতি নত হলেন।

এরপর আল্লাহ ঐ এলাকার অধিবসীদের ব্যাপারে ফয়সালা দেনঃ “আমি বললাম হে যুল-কারনায়ন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা এদের ব্যাপার সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার। সে বলল, যে কেউ সীমালংঘন করবে আমি তাকে শাস্তি দিব, অতঃপর সে তার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন হবে এবং তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন।” সুতরাং তার উপর দুনিয়ার শাস্তি ও আখিরাতের শাস্তি উভয়টিই কার্যকর হবে। দুনিয়ার শাস্তির কথা আগে বলা হয়েছে। কেননা, কাফিরদের জন্যে এটা সাবধান ও সতর্কতাস্বরূপ। “তবে যে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তার জন্যে প্রতিদানস্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি ব্যবহারে আমি নম্র কথা বলব।" এখানে অধিক মূল্যবান প্রতিদানের কথা প্রথমে বলা হয়েছে অর্থাৎ-আখিরাতের পুরস্কার, তারপরে বলা হয়েছে তাদের প্রতি তার অনুগ্রহের কথা, এই অনুগ্রহ হলো ন্যায়-নীতি, জ্ঞান ও ঈমান “আবার সে এক পথ ধরল।” অর্থাৎ তিনি পশ্চিম থেকে প্রত্যাবর্তন দিকে যাওয়ার পথ ধরলেন। কথিত আছে, পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্তে ফিরে আসতে তাঁর বার বছর অতিবাহিত হয়। “চলতে চলতে যখন সে সূর্যোদয়স্থলে পৌছল, তখন সে দেখল তা’ এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদিত হচ্ছে, যাদের জন্য সূর্যতাপ থেকে কোন অন্তরাল আমি সৃষ্টি করি নি।” অর্থাৎ তাদের কোন ঘর-বাড়ি ছিল না এবং সূর্যের তাপ থেকে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। তবে অনেক আলিম বলেছেন যে, তারা মাটিতে কবরের ন্যায় এক প্রকার সুড়ংগে প্রচণ্ড তাপের সময় আশ্রয় নিত। “প্রকৃত ঘটনা এটাই তার বৃত্তান্ত আমি সম্যক অবগত আছি"। অথাৎ যুল-কারনায়নের সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি অবহিত। আমি তাকে হেফাজত করেছিলাম এবং পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত সুদীর্ঘ যাত্রা পথে আমার প্রহরা তার উপর কার্যকর ছিল।

উবায়দ ইবন উমায়র ও তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ প্রমুখ আলিমগণ বলেছেন যে, যুল-কারনায়ন পদব্রজে হজ্ব পালন করেন। হযরত ইবরাহীম খলীল (আ) যুল-কারনায়নের আগমনের সংবাদ পেয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ে একত্রে মিলিত হলে ইবরাহীম খলীল (আ) তাঁর জন্যে দোয়া করেন এবং কতিপয় উপদেশ দেন। কথিত আছে, হযরত খলীল একটি ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যান এবং যুল-কারনায়নকে তাতে আরোহণ করতে বলেন। কিন্তু যুল-কারনায়ন অস্বীকার করে বলেন, যে শহরে আল্লাহর খলীল বিদ্যমান আছেন সেই শহরে আমি বাহনে আরোহণ করে প্রবেশ করব না। তখন আল্লাহ মেঘমালাকে তাঁর অনুগত করে দেন এবং ইবরাহীম এ সুখবর তাকে জানিয়ে দেন। তিনি যেখানে যাওয়ার ইচ্ছে করতেন মেঘমালা তাকে সেখানে নিয়ে যেত। আল্লাহর বাণীঃ আবার সে এক পথ চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তীস্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না।” এ সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এরা হল তুর্কী জাতি ইয়াজুজ ও মাজুজের জ্ঞাতি ভাই।

এ সম্প্রদায়ের লোকজন যুল-কারনায়নের নিকট অভিযোগ করে যে, ইয়াজুজ ও মাজুজ গোত্রদ্বয় তাদের উপর অত্যাচার চালায়, লুটতরাজ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের দ্বারা শহরকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। তারা যুল-কারনায়নকে কর দিতে আগ্রহ প্রকাশ করল, যাতে তিনি তাদের ও ইয়াজুজ-মাজুজের মাঝে একটি প্রাচীর তৈরী করে দেন। যাতে করে তারা আর এদিকে উঠে আসতে না পারে। যুল-কারনায়ন তাদের থেকে কর নিতে অস্বীকার করেন এবং তাকে আল্লাহ যে সম্পদ ও ক্ষমতা দিয়েছেন তাতেই সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বললেন “আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা-ই উৎকৃষ্ট।" তিনি তাদেরকে শ্রমিক ও উপকরণ সরবরাহ করতে বললেন এবং উক্ত দুই পর্বতের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান ভরাট করে বাঁধ নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর এ দু’পর্বতের মধ্যবর্তী স্থান ছাড়া ইয়াজুজ-মাজুজের আসার অন্য কোন পথ ছিল না। তাদের এক দিকে ছিল গভীর সমুদ্র অন্য দিকে সুউচ্চ পর্বতমালা। অতঃপর তিনি লোহা ও গলিত তামা, মতান্তরে সীসা দ্বারা উক্ত বাঁধ নির্মাণ করেন। কিন্তু প্রথমোক্ত মতই সঠিক। সে মতে এ বাঁধ নির্মাণে তিনি ইটের পরিবর্তে লোহা এবং সুরকির পরিবর্তে তামা ব্যবহার করেন। আল্লাহ বলেন “এরপর তারা তা অতিক্রম করতে পারল না। অর্থাৎ সিড়ি কিংবা অন্য কিছুর সাহায্যে বাঁধ পার হয়ে আসতে পারল না। “এবং ভেদ করতেও পারল না” অর্থাৎ কুঠার বা শাবল দ্বারা ছিদ্র করতে পারল না। সহজের মুকাবিলায় সহজ ও কঠিনের মুকাবিলায় কঠিন নীতি অবলম্বন করা হল। “সে বলল, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ।” অর্থাৎ এ বাঁধ নির্মাণের ক্ষমতা আল্লাহ-ই দান করেছেন। এটা তারই অনুগ্রহ ও দয়া। কেননা, এর দ্বারা উক্ত সীমালংঘনকারী জাতির অত্যাচার থেকে তাদের প্রতিবেশী লোকদেরকে রক্ষা করতে পেরেছেন। “যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে” অর্থাৎ শেষ যামানায় মানব জাতির উপর তাদের বের হয়ে আসার নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে। “তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবেন।” অর্থাৎ মাটির সাথে মিশিয়ে দিবেন। কেননা, তাদের বের হয়ে আসার জন্যে এ রকম হওয়া আবশ্যক। এ কারণে আল্লাহ বলেন “এবং আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।”

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “ইয়াজুজ-মাজুজকে যখন ছেড়ে দেয়া হবে তখন তারা ভূ-পৃষ্ঠের উঁচু স্থান দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকবে।” “আল্লাহর সত্য প্রতিশ্রুতি নিকটবর্তী।” এজন্যে এখানেও আল্লাহ বলেছেন, “সেদিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দিব এ অবস্থায় যে, একদল আর এক দলের উপর তরংগের মত পতিত হবে।” ‘সেদিন’ বলতে বিশুদ্ধ মতে বাঁধ ভেংগে দেয়ার দিনকে বুঝান হয়েছে। “এবং শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকেই একত্রিত করব।” (১৮ কাহফঃ ৯৯)। ইয়াজুজ ও মাজুজের বের হওয়া সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীস সমূহ আমরা তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। এই গ্রন্থের ‘ফিতান ও মালাহিম’ অধ্যায়ে আমরা সেগুলো উল্লেখ করব।

আবু দাউদ আত্-তায়ালিসী (র) সুফিয়ান ছাওরী (রা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সর্বপ্রথম যিনি মুসাফাহার প্রবর্তন করল তিনি হলেন, যুল-কারনায়নঃ কাব আল-আহবার থেকে বর্ণিত। তিনি মুআবিয়া (রা)-কে বলেছেনঃ যুল-কারনায়নের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তিনি তাঁর মাকে ওসিয়ত করেন যে, আমার মৃত্যু হয়ে গেলে আপনি ভোজের ব্যবস্থা করবেন এবং নগরীতে সমস্ত মহিলাদেরকে ডাকবেন। তারা আসলে তাদের সম্মুখে খানা রেখে সন্তান হারা মহিলারা ব্যতীত অন্যদেরকে আহার করতে বলবেন। যে সব মহিলা সন্তান হারিয়েছে তারা যেন উক্ত খাদ্য ভক্ষণ না করে। ওসিয়ত অনুযায়ী মা সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে উক্তরূপে আহার গ্রহণের আহ্বান জানালেন। কিন্তু একজন মহিলাও খাবার স্পর্শ করল না। যুল-কারনায়নের মা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার তোমরা সকলেই কি সন্তান হারা?’ তারা বলল, ‘আল্লাহর কসম, আমরা প্রত্যেকেই সন্তান হারিয়েছি।’ তখন এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি মনে সান্তুনা লাভ করলেন। ইসহাক ইবন বিশর আবদুল্লাহ ইবন যিনাদের মাধ্যমে জনৈক আহলি কিতাব থেকে বর্ণনা করেন যে, যুল-কারনায়নের ওসিয়ত ও তার মায়ের উপদেশ একটি সুদীর্ঘ মূল্যবান উপদেশ। বহু-জ্ঞানপূর্ণ ও কল্যাণকর কথা তাতে আছে। যুল-কারনায়ন যখন ইন্তিকাল করেন, তখন তার বয়স হয়েছিল তিন হাজার বছর। এ বর্ণনাটি ‘গরীব’ পর্যায়ের।

ইবন আসাকির (র) অন্য এক সূত্রে বলেছেন, যুল-কারনায়ন ছত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন। কারও মতে তিনি বত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। হযরত দাউদ (আ)-এর সাতশ’ চল্লিশ বছর পর এবং আদম (আ)-এর পাঁচ হাজার একশ’ একাশি বছর পর তিনি দুনিয়ায় আগমন করেন এবং ষোল বছর রাজত্ব করেন। ইবন আসাকিরের এ বক্তব্য দ্বিতীয় ইসকান্দারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, প্রথম ইসকান্দারের ক্ষেত্রে নয়। তিনি দুই ইসকান্দারের মধ্যে প্রথম জন ও দ্বিতীয় জনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। প্রকৃত পক্ষে ইসকান্দার দুইজন। আমরা বিভিন্ন বিজ্ঞজনের উদ্ধৃতি দিয়ে এ আলোচনার শুরুতে সে বিষয়ে উল্লেখ করে এসেছি। যারা দুই ইসকান্দরকে একজন ভেবেছেন তাদের মধ্যে সীরাত লেখক আবদুল মালিক ইবন হিশাম অন্যতম। হাফিজ আবুল কাসিম সুহায়লী এর জোর প্রতিবাদ করেছেন ও কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং উভয় ইসকান্দারের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নির্ণয় করে দেখিয়েছেন। সুহায়লী বলেছেন, সম্ভবত প্রাচীন যুগের কতিপয় রাজা-বাদশাহ প্রথম ইসকান্দরের সাথে তুলনা করে দ্বিতীয় ইসকান্দরকেও যুল-কারনায়ন নামে আখ্যায়িত করেছেন।

৩৬
ইয়াজুজ-মাজুজ ও তাদের প্রাচীরের বিবরণ
ইয়াজুজ-মাজুজরা যে হযরত আদম (আ)-এর বংশধর, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত আছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রমাণ হল সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হযরত আবু সাঈদ (রা)-এর হাদীস।

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা’আলা আদেশ দিবেন, ‘হে আদম! উঠ, তোমার বংশধরদের মধ্য থেকে জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামের দিকে পাঠিয়ে দাও।’ হযরত আদম (আ) বলবেন, ‘হে প্রতিপালক! জাহান্নামীদের সংখ্যা কত?’ আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামী আর একজন মাত্র জান্নাতী।’ তখন শিশুগণ বৃদ্ধে পরিণত হবে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ঘটবে এবং তুমি তাদেরকে মাতালের মত দেখতে পাবে, যদিও তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি কঠিন।

সাহাবীগণ বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সে একজন কে হবে?’ জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর যে, তোমাদের থেকে হবে একজন আর ইয়াজুজ মাজুজের মধ্য থেকে হবে এক হাজার জন।’ অপর বর্ণনায় এসেছে যে, সুসংবাদ গ্রহণ কর, তোমাদের মধ্যে দু’টো দল রয়েছে; সে দু’দল যেখানে যাবে সেখানে সংখ্যাধিক্য হবে। এটি প্রমাণ করে যে, ইয়াজুজ মাজুজের সংখ্যা অত্যধিক এবং তারা সাধারণ মানুষের চাইতে অনেকগুণ বেশি।

দ্বিতীয় কথা হল, তারা হযরত নূহ (আ)-এর বংশধর। কারণ জগতবাসীর উদ্দেশ্যে হযরত নূহ (আ)-এর দোয়াঃ

( رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ دَیَّارًا )

[Surah Nuh 26]

“হে আমার প্রতিপালক, পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিবেন না”(৭১ নূহঃ ২৬) আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন বলে জানিয়েছেন। আবার আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

( فَأَنجَیۡنَـٰهُ وَأَصۡحَـٰبَ ٱلسَّفِینَةِ )

[Surah Al-Ankabut 15]

“তারপর আমি তাকে এবং নৌকায় আরোহনকারীদেরকে রক্ষা করেছি”( ২৯ আনকাবুতঃ ১৫) তিনি অন্যত্র বলেছেনঃ

وَجَعَلۡنَـٰهَاۤ ءَایَة لِّلۡعَـٰلَمِینَ

“তার বংশধরদেরকেই আমি বিদ্যমান রেখেছি বংশ পরম্পরায়”(৩৭ সাফফাতঃ ৭৭)

মুসনাদ ও সুনান-এর বরাতে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, হযরত নূহ (আ)-এর তিন পুত্র ছিলেন সাম, হাম ও ইয়াফিছ। এদের মধ্যে সাম হচ্ছেন আবরদের পূর্বপুরুষ, হাম সুদানীদের পূর্বপুরুষ এবং ইয়াফিছ তুর্কীদের পূর্বপুরুষ। সুতরাং ইয়াজুজ মাজুয তুর্কীদেরই গোত্র। এরা মোঙ্গল সম্প্রদায়ভুক্ত। দুর্ধর্ষতা এবং ধ্বংস সাধনে এরা মোঙ্গলদের অন্যান্য শাখার তুলনায় অগ্রগামী। সাধারণ মানুষের তুলনায় সাধারণ মোঙ্গলদের যে অবস্থান; সাধারণ মোঙ্গলদের তুলনায় ইয়াজুজ মাজুজের অবস্থা তদ্রুপ। কথিত আছে যে, তুর্কীদের এরূপ নামকরণের কারণ হল বাদশাহ যুলকারনাইন যখন তার ঐতিহাসিক প্রাচীর তৈরি করেন, তখন ইয়াজুজ মাজুজকে ঐ প্রাচীরের পেছনে থাকতে বাধ্য করেন। ওদের একটি গোত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রাচীরের এদিকে রয়ে গিয়েছিল। এদের দুর্ধর্ষতা পূর্বোক্তদের সমপর্যায়ের ছিল না। ওদেরকে প্রাচীরের এ পাশে রেখে দেয়া হয়েছিল। তাই তাদের নাম হয়েছে তুর্ক বা পরিত্যক্ত।

কেউ কেউ বলেন যে, ইয়াজুজ মাজুজের সৃষ্টি হযরত আদম (আ)-এর স্বপ্নদোষকালীন বীর্য থেকে। ঐ বীর্য মাটির সাথে মিলিত হয় এবং তা থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারা হযরত হাওয়া (আ)-এর গর্ভজাত সন্তান নয়। শায়খ আবু যাকারিয়া নববী সহীহ মুসলিমের ভাষ্যগ্রন্থ ও অন্যান্য গ্রন্থে এ বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এবং এ বক্তব্য যথার্থভাবেই দুর্বল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কারণ এর পক্ষে কোন দলীল প্রমাণ নেই। বরং কুরআনের আয়াত দ্বারা আমরা যা প্রমাণ করেছি যে, এ যুগের সকল মানুষই নূহ (আ)-এর বংশধর, উপরোক্ত বক্তব্য তার বিপরীত।

যারা এ ধারণা পোষণ করেন যে, ইয়াজুজ মাজুজের অবয়ব বিভিন্ন প্রকারের এবং শারীরিক দৈর্ঘ্যে তাদের মধ্যে পরস্পরের ব্যবধান বিস্তর। কতক হল সুদীর্ঘ খেজুর গাছের মত, আর কতক একেবারে খাটো। তাদের কতক এমন যে, এক কান বিছিয়ে অপর কান দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয়। এ সব উক্তির কোন প্রমাণ নেই, এগুলো নেহায়েত কাল্পনিক উক্তি।

সঠিক মত হল এই যে, তারা হযরত আদম (আ)-এর বংশধর এবং তাদের আকৃতি-প্রকৃতিও সাধারণ মানুষের ন্যায়ই। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ

ان الله خلق أدم وطوله ستون ذراعا

“আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ)-কে সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম (আ)-এর দৈর্ঘ্য ছিল ষাট হাত। তারপর মানুষ ক্রমান্বয়ে খাটো হতে হতে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে এটিই চূড়ান্ত ফয়সালা।

কেউ কেউ যে বলেন, ওদের একজনের ঔরসে ১০০০ জন সন্তান জন্মগ্রহণ না করা পর্যন্ত তার মৃত্যু হয় না; এ বর্ণনা যদি বিশুদ্ধ প্রমাণিত হয় তবেই আমরা মানব। তা না হলেও আমরা ওটি প্রত্যাখ্যান করব না; কারণ বিবেক-বুদ্ধি এবং রেওয়ায়াতের আলোকে এমনটি হওয়াও সম্ভব। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। অবশ্য এ ব্যাপারে একটি হাদীসও রয়েছে। তবে তা প্রমাণ সাপেক্ষ।

আল্লামা তাবারানী বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ

ان يأجوج ومأجوج من ولد أدم ولو أرسلوا لأفسدوا على الناس معائشهم ولن يموت منهم رجل الأ ترت من ذر يته القا فصاعدا .

“ইয়াজুজ মাজুজ হযরত আদম (আ)-এর বংশধর। তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলে মানব জাতির জীবনোপকরণগুলো ধ্বংস করে দিত। এক হাজার কিংবা ততোধিক সন্তানের জন্ম না দেওয়া পর্যন্ত তাদের কোন পুরুষের মৃত্যু হয় না। ওদের পশ্চাতে রয়েছে তিনটি দল। তাবীল, তারীগ ও মানসাক”। এটি একটি চূড়ান্ত গরীব পর্যায়ের হাদীস। এর সনদ দুর্বল এবং এতে অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী রয়েছে।

ইবন জারীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে এ মর্মের একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন যে, মিরাজের রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) ওদের নিকট গিয়েছিলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর পথে আসার দাওয়াত দিয়েছিলেন। তারা তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি এবং তাঁর অনুসরণ করেনি। তিনি ওখানকার ঐ উম্মত ত্রয়কেও দাওয়াত দিয়েছিলেন, এরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। মূলত এটি একটি জাল হাদীস। এই আবু নুআয়ম আমর ইবন সুবহর গড়া জাল বর্ণনা। মিথ্যা হাদীস রচনার স্বীকারোক্তিকারীদের সে অন্যতম।

যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীস কী করে প্রমাণ করে যে, কিয়ামতের দিনে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্প্রদায় ঈমানদারদের বদলে যাবে জাহান্নামে, অথচ ইয়াজুজ-মাজুজের নিকট তো কোন রাসূল প্রেরিত হননি?

অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِینَ حَتَّىٰ نَبۡعَثَ رَسُول ࣰا

“আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না” (১৭ বনী ইসরাঈলঃ ১৫)।

তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর হবে এই যে, তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সাব্যস্ত না করে এবং তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না। যেমনটি উক্ত আয়াতে রয়েছে।

তারা যদি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ববর্তী সময়ের লোক হয়ে থাকে এবং তাদের প্রতি অন্যান্য রাসূল এসে থাকেন তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ তো সাব্যস্ত হয়েই গিয়েছে। আর যদি তাদের প্রতি কোন রাসূল প্রেরিত না হয়ে থাকেন, তবে তাদের বিধান হবে দুই রাসূলের অন্তবর্তী যুগের লোকদের মত এবং যাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছেনি তাদের মত।

এ বিষয়ে একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীস রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ এ পর্যায়ের লোকদের কিয়ামতের ময়দানে পরীক্ষা করা হবে। তখন যে ব্যক্তি সত্যের ডাকে সাড়া দিবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে ব্যক্তি তা প্রত্যাখ্যান করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। বিভিন্ন সনদ, শব্দ ও ইমামগণের মন্তব্য সহ আলোচ্য হাদীসটি আমরা উল্লেখ করেছি

( وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِینَ حَتَّىٰ نَبۡعَثَ رَسُول ࣰا)

আয়াতের ব্যাখ্যায়।

শায়খ আবুল হাসান আশআরী এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইজমা বা ঐকমত্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

তাদেরকে পরীক্ষা করায় তাদের মুক্তি অনিবার্য সাব্যস্ত হয় না এবং এটি তাদের জাহান্নামী হওয়া বিষয়ক সংবাদের পরিপন্থীও নয়। কারণ, আল্লাহ তা’আলা তো রাসূলকে আপন ইচ্ছা মুতাবিক অদৃশ্য বিষয়াদি অবহিত করেন। আল্লাহ তাঁকে অবহিত করেছেন যে, ওরা পাপাচারী লোক এবং তাদের প্রকৃতিই সত্য গ্রহণে ও সত্যের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তারা সত্যের আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিবে না। এতে প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়াতে তাদের নিকট সত্যের দাওয়াত পৌঁছলে তারা অধিকতর দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করত। কারণ দুনিয়াতে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী অনেক মানুষই ভয়ংকর কিয়ামতের ময়দানে আনুগত্য প্রদর্শন করবে। সুতরাং ঐ সব ভয়ানক ও ভয়ংকর অবস্থা দর্শনের পর ঈমান আনা, দুনিয়ায় ঈমান আনা অপেক্ষা অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

( وَلَوۡ تَرَىٰۤ إِذِ ٱلۡمُجۡرِمُونَ نَاكِسُوا۟ رُءُوسِهِمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ رَبَّنَاۤ أَبۡصَرۡنَا وَسَمِعۡنَا فَٱرۡجِعۡنَا نَعۡمَلۡ صَـٰلِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ )

[Surah As-Sajdah 12]

“এবং হায়, যদি তুমি দেখতে যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে নতশির হয়ে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম, এখন তুমি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ কর আমরা সৎকর্ম করব, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী”। (৩২ সাজদাহঃ ১২)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

( أَسۡمِعۡ بِهِمۡ وَأَبۡصِرۡ یَوۡمَ یَأۡتُونَنَا )

[Surah Maryam 38]

“ওরা সে দিন আমার নিকট আসবে সেদিন কত স্পষ্ট শুনবে ও দেখবে” (১৯ মারয়ামঃ ৩৮)

ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, যুল-কারনাইন প্রাচীর নির্মাণ করেছেন লোহা এবং তামা দ্বারা। সেটিকে তিনি সুউচ্চ, সুদৃঢ় ও সুদীর্ঘ পর্বতের সমান করেছেন। পৃথিবীর বুকে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং উপকারী নির্মাণ কাজ আর আছে বলে জানা যায় না।

ইমাম বুখারী (র) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলল, ‘আমি ঐ প্রাচীরটি দেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘কেমন দেখেছ?’ সে বলল, ‘জমকালো চাদরের ন্যায় (অর্থ কালো বক্স)। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমিও তাই দেখেছি। ইমাম বুখারী (র) এ হাদীসটি সনদ উল্লেখ না করেই দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে উদ্ধৃত করেছেন। অবশ্য আমি অবিচ্ছিন্ন সনদে এটির বর্ণনা খুঁজে পাইনি।

তবে ইবন জারীর (র) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে মুরসাল রূপে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, হযরত কাতাদা (র) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের নিকট আলোচনা করা হয়েছে যে, এক ব্যক্তি বলেছিল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীর দেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তাহলে আমার নিকট সেটির বর্ণনা দাও।’ সে ব্যক্তিটি বলল, ‘সেটি ডোরাদার চাদরের ন্যায়, যার একটি ডোরা কালো এবং অপরটি লাল ছিল।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আমিও তাই দেখেছি।’ কথিত আছে যে, খলীফা ওয়াছিক বিল্লাহ যুলকারনাইনের প্রাচীর দেখার জন্য একদল প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন। পথে অবস্থিত রাজ্য সমূহের রাজাদের নিকট তিনি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যেন ঐ প্রতিনিধি দলকে নিজ নিজ রাজ্য অতিক্রম করে প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছার ব্যাপারে সাহায্য করেন। যাতে তারা প্রাচীর সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারেন এবং যুলকারনাইন এটি কিভাবে নির্মাণ করেছেন তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারে। ঐ প্রতিনিধি দলটি ফিরে এসে ঐ প্রাচীর সম্পর্কে বর্ণনা দেয় যে, তাতে একটি বিরাট দরজা রয়েছে। দরজায় রয়েছে বহু তালা। এটি সুউচ্চ, মজবুত ও সুদৃঢ়। প্রাচীর নির্মাণের পর যে লোহার ইট ও যন্ত্রপাতি অবশিষ্ট ছিল সেগুলো একটি সুদৃঢ় মহলের মধ্যে রক্ষিত আছে। তারা আরও বলেন যে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাজাদের পক্ষ থেকে নিয়োজিত প্রহরীগণ সার্বক্ষণিক ঐ প্রাচীরটি প্রহরায় নিয়োজিত রয়েছে। এটির অবস্থান ছিল পৃথিবীর উত্তর পূর্বে কোণের উত্তর পূর্ব অংশে। কথিত আছে, তাদের শহর বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ও প্রশস্ত ছিল। কৃষিকাজ ও জলে-স্থলে শিকার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত ওদের সংখ্যা কেউ জানে না।

যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ

( فَمَا ٱسۡطَـٰعُوۤا۟ أَن یَظۡهَرُوهُ وَمَا ٱسۡتَطَـٰعُوا۟ لَهُۥ نَقۡب ࣰا)

[Surah Al-Kahf 97]

“(এরপর তারা সেটি অতিক্রম করতে পারল না এবং ভেদ করতেও পারল না)” (১৮ কাহফঃ ৯৭) এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিম্নোক্ত হাদীসটির মাঝে সমন্বয় সাধন করা যাবে কিভাবে? হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) এভাবে উদ্ধৃত করেছেন যে, উম্মুল মু’মিনীন যায়নাব বিনত জাহাশ (রা) বলেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ (সা) ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তাঁর মুখমণ্ডল তখন রক্তিম বর্ণ। তিনি বলছিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; আরবদের ধ্বংস নিকটবর্তী। আজ ইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীর এতটুকু ছিদ্র হয়ে গেছে।’ (অতঃপর তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী দ্বারা বৃত্ত বানিয়ে দেখান)। আমি আরও করলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণ থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। যখন পাপাচার বৃদ্ধি পাবে।’ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে উহায়ব আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, আজ ইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীর এতটুকু খুলে গিয়েছে। তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী দ্বারা বৃত্ত বানিয়ে দেখালেন।

উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর হয়ত এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) “প্রাচীর খুলে গিয়েছে" বাক্যাংশের দ্বারা ফিতনা ও অকল্যাণের দরজাগুলো খুলে গিয়েছে বুঝিয়েছেন। এটি একটি রূপক বাক্য ও বাগধারা স্বরূপ। তাই এতে কোন অসঙ্গক্তি নেই। অথবা উত্তর এই যে, প্রাচীর খুলে গিয়েছে’ বাক্যাংশের দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা) বাস্তবে প্রাচীর খুলে গিয়েছে বুঝিয়েছেন এবং আয়াতে “তারা এটি অতিক্রম করতে পারল না এবং ভেদ করতেও পারল না” দ্বারা তখনকার সময়ের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। কারণ, আয়াতে বর্ণিত শব্দ অতীতবাচক। সুতরাং পরবর্তীতে তাতে ছিদ্র হয়ে যাওয়া আয়াতের পরিপন্থী নয়। পরবর্তীতে এমন হতে পারে যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং আল্লাহ কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে তারা অল্প অল্প করে ক্রমান্বয়ে ঐ নির্ধারিত সময়ে প্রাচীর ক্ষয় করে ফেলবে।

অবশেষে এক সময়ে নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হবে এবং আল্লাহর নির্ধারিত উদ্দেশ্যও সফল হবে তারপর তারা বেরিয়ে পড়বে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَهُم مِّن كُلِّ حَدَب یَنسِلُونَ )

[Surah Al-Anbiya’ 96]

“এবং তারা প্রতি উচ্চ ভূমি হতে ছুটে আসবে”

অবশ্য অন্য একটি হাদীসের কারণে অধিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। হাদীসটি ইমাম আহমদ (র) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ

ইয়াজুজ মাজুজ প্রতিদিন ঐ প্রাচীরটি খুঁড়ে চলছে। খুঁড়তে খুঁড়তে তারা যখন এতটুকু পৌঁছে সূর্যের আলো দেখতে পাওয়ার উপক্রম হয়, তখন তাদের উট ও বকরীর নাকে জন্ম নেয় এমন কীট। নেতা বলে যে, ‘আজ তোমরা ফিরে যাও; আগামী কাল অনায়াসে খোঁড়া শেষ করে দিবে।’ পরের দিন তারা এসে দেখতে পায় যে, ইতিপূর্বে যতটুকু ছিল প্রাচীরটি এখন তার চাইতে অধিকতর মজবুত হয়ে রয়েছে। এভাবে যখন তাদের অবরুদ্ধ রাখার মেয়াদ শেষ হবে এবং আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে লোকালয়ে প্রেরণের ইচ্ছা করবেন, তখন তারা খুঁড়তে খুঁড়তে সূর্যের আলো দেখার পর্যায়ে চলে এলে তাদের নেতা বলবে, এখন ফিরে যাও, আগামীকাল ইনশাআল্লাহ খোঁড়া শেষ করতে পারবে।

পরদিন তারা এসে প্রাচীরটিকে পূর্ববর্তী দিবসের রেখে যাওয়া অবস্থায় দেখতে পাবে। তখন তারা খনন কার্য শেষ করে লোকালয়ে বেরিয়ে আসবে। তারা পৃথিবীর সব পানি পান করে ফেলবে। লোকজন নিজ নিজ দুর্গে আশ্রয় নিবে। এরপর ইয়াজুজ মাজুজ আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। রক্তের চিহ্নসহ তীর ফিরে আসবে। তারা বলবে যে, আমরা পৃথিবীর অধিবাসীদেরকে পদানত করেছি এবং আকাশের অধিবাসীদের উপর বিজয় লাভ করেছি। তারপর আল্লাহ তা’আলা তাদের ঘাড়ে কীট সৃষ্টি করে দিবেন। এ কীটের দ্বারা তিনি তাদেরকে ধ্বংস করবেন।

রাসূলুল্লাহ আরও বলেছেনঃ

والذي نفس محمد بيده ان دواب الأرض لتسمن وتشكر تشكرا من لحومهم ودمائهم

“যে মহান সত্তার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তাঁর শপথ ওদের গোশত ও রক্ত খেয়ে পৃথিবীর জীবজন্তুগুলো মোটা তাজা হয়ে উঠবে এবং শুকরিয়া প্রকাশ করবে”।

ইমাম আহমদ (র) ইবনে মাজাহ ও তিরমিযী (র) ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) হাদীসটি গরীব পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন। এ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওরা প্রতিদিন জিহবা দিয়ে ঐ প্রাচীরটি চাটতে থাকে। চাটতে চাটতে প্রাচীরটি এমন পাতলা হয়ে যায় যে, অপর দিকে সূর্যের কিরণ দেখা যাওয়ার উপক্রম হয়।

এ হাদীসটি যদি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উক্তি না হয়ে কা’ব আল আহবারের উক্তি হয় যেমন কেউ কেউ বলেছেন, তবে আমরা ঐ অসঙ্গতির হাত থেকে মুক্তি পাই। আর এটি যদি প্রকৃতই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বাণী হয়ে থাকে তবে বলা হবে যে, তাদের ঐ কর্মতৎপরতা চলবে আখেরী যামানায় তাদের বেরিয়ে আসার নিকটবর্তী সময়ে, যেমন কা’ব আল-আহবার থেকে বর্ণিত হয়েছে। অথবা এটি বলা যাবে যে, ( ما استطاعوا له نقبا ), অর্থঃ এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ছিদ্র করে সারতে পারেনি। সুতরাং এটি তাদের জিহ্বা দিয়ে চাটা। অথচ ছিদ্র না করা এর পরিপন্থী নয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। এ সূত্রে আলোচ্য হাদীস এবং সহীহ বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হাদীস রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বাণী “আজ ইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীর এই পরিমাণ ছিদ্র হয়ে গেছে” এর সমন্বয় সাধন করা যায় এভাবে যে, আজ ছিদ্র হয়ে গিয়েছে অর্থ প্রাচীরের এপার-ওপার ভেদ করে ছিদ্র হয়েছে। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

৩৭
আসহাবে কাহাফ-এর ঘটনা
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( أَمۡ حَسِبۡتَ أَنَّ أَصۡحَـٰبَ ٱلۡكَهۡفِ وَٱلرَّقِیمِ كَانُوا۟ مِنۡ ءَایَـٰتِنَا عَجَبًا ۝ إِذۡ أَوَى ٱلۡفِتۡیَةُ إِلَى ٱلۡكَهۡفِ فَقَالُوا۟ رَبَّنَاۤ ءَاتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحۡمَة وَهَیِّئۡ لَنَا مِنۡ أَمۡرِنَا رَشَد ا ۝ فَضَرَبۡنَا عَلَىٰۤ ءَاذَانِهِمۡ فِی ٱلۡكَهۡفِ سِنِینَ عَدَد ا ۝ ثُمَّ بَعَثۡنَـٰهُمۡ لِنَعۡلَمَ أَیُّ ٱلۡحِزۡبَیۡنِ أَحۡصَىٰ لِمَا لَبِثُوۤا۟ أَمَد ا ۝ نَّحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡكَ نَبَأَهُم بِٱلۡحَقِّۚ إِنَّهُمۡ فِتۡیَةٌ ءَامَنُوا۟ بِرَبِّهِمۡ وَزِدۡنَـٰهُمۡ هُد ى ۝ وَرَبَطۡنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ إِذۡ قَامُوا۟ فَقَالُوا۟ رَبُّنَا رَبُّ ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِ لَن نَّدۡعُوَا۟ مِن دُونِهِۦۤ إِلَـٰه اۖ لَّقَدۡ قُلۡنَاۤ إِذ ا شَطَطًا ۝ هَـٰۤؤُلَاۤءِ قَوۡمُنَا ٱتَّخَذُوا۟ مِن دُونِهِۦۤ ءَالِهَة ۖ لَّوۡلَا یَأۡتُونَ عَلَیۡهِم بِسُلۡطَـٰنِۭ بَیِّن ۖ فَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِب ا ۝ وَإِذِ ٱعۡتَزَلۡتُمُوهُمۡ وَمَا یَعۡبُدُونَ إِلَّا ٱللَّهَ فَأۡوُۥۤا۟ إِلَى ٱلۡكَهۡفِ یَنشُرۡ لَكُمۡ رَبُّكُم مِّن رَّحۡمَتِهِۦ وَیُهَیِّئۡ لَكُم مِّنۡ أَمۡرِكُم مِّرۡفَق ا ۝ ۞ وَتَرَى ٱلشَّمۡسَ إِذَا طَلَعَت تَّزَ  ٰ⁠ وَرُ عَن كَهۡفِهِمۡ ذَاتَ ٱلۡیَمِینِ وَإِذَا غَرَبَت تَّقۡرِضُهُمۡ ذَاتَ ٱلشِّمَالِ وَهُمۡ فِی فَجۡوَة مِّنۡهُۚ ذَ  ٰ⁠ لِكَ مِنۡ ءَایَـٰتِ ٱللَّهِۗ مَن یَهۡدِ ٱللَّهُ فَهُوَ ٱلۡمُهۡتَدِۖ وَمَن یُضۡلِلۡ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ وَلِیّ ا مُّرۡشِد ا ۝ وَتَحۡسَبُهُمۡ أَیۡقَاظ ا وَهُمۡ رُقُود ۚ وَنُقَلِّبُهُمۡ ذَاتَ ٱلۡیَمِینِ وَذَاتَ ٱلشِّمَالِۖ وَكَلۡبُهُم بَـٰسِط ذِرَاعَیۡهِ بِٱلۡوَصِیدِۚ لَوِ ٱطَّلَعۡتَ عَلَیۡهِمۡ لَوَلَّیۡتَ مِنۡهُمۡ فِرَار ا وَلَمُلِئۡتَ مِنۡهُمۡ رُعۡب ا ۝ وَكَذَ  ٰ⁠ لِكَ بَعَثۡنَـٰهُمۡ لِیَتَسَاۤءَلُوا۟ بَیۡنَهُمۡۚ قَالَ قَاۤىِٕل مِّنۡهُمۡ كَمۡ لَبِثۡتُمۡۖ قَالُوا۟ لَبِثۡنَا یَوۡمًا أَوۡ بَعۡضَ یَوۡم ۚ قَالُوا۟ رَبُّكُمۡ أَعۡلَمُ بِمَا لَبِثۡتُمۡ فَٱبۡعَثُوۤا۟ أَحَدَكُم بِوَرِقِكُمۡ هَـٰذِهِۦۤ إِلَى ٱلۡمَدِینَةِ فَلۡیَنظُرۡ أَیُّهَاۤ أَزۡكَىٰ طَعَام ا فَلۡیَأۡتِكُم بِرِزۡق مِّنۡهُ وَلۡیَتَلَطَّفۡ وَلَا یُشۡعِرَنَّ بِكُمۡ أَحَدًا ۝ إِنَّهُمۡ إِن یَظۡهَرُوا۟ عَلَیۡكُمۡ یَرۡجُمُوكُمۡ أَوۡ یُعِیدُوكُمۡ فِی مِلَّتِهِمۡ وَلَن تُفۡلِحُوۤا۟ إِذًا أَبَد ا ۝ وَكَذَ  ٰ⁠ لِكَ أَعۡثَرۡنَا عَلَیۡهِمۡ لِیَعۡلَمُوۤا۟ أَنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّ وَأَنَّ ٱلسَّاعَةَ لَا رَیۡبَ فِیهَاۤ إِذۡ یَتَنَـٰزَعُونَ بَیۡنَهُمۡ أَمۡرَهُمۡۖ فَقَالُوا۟ ٱبۡنُوا۟ عَلَیۡهِم بُنۡیَـٰن اۖ رَّبُّهُمۡ أَعۡلَمُ بِهِمۡۚ قَالَ ٱلَّذِینَ غَلَبُوا۟ عَلَىٰۤ أَمۡرِهِمۡ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَیۡهِم مَّسۡجِد ا ۝ سَیَقُولُونَ ثَلَـٰثَة رَّابِعُهُمۡ كَلۡبُهُمۡ وَیَقُولُونَ خَمۡسَة سَادِسُهُمۡ كَلۡبُهُمۡ رَجۡمَۢا بِٱلۡغَیۡبِۖ وَیَقُولُونَ سَبۡعَة وَثَامِنُهُمۡ كَلۡبُهُمۡۚ قُل رَّبِّیۤ أَعۡلَمُ بِعِدَّتِهِم مَّا یَعۡلَمُهُمۡ إِلَّا قَلِیل ۗ فَلَا تُمَارِ فِیهِمۡ إِلَّا مِرَاۤء ظَـٰهِر ا وَلَا تَسۡتَفۡتِ فِیهِم مِّنۡهُمۡ أَحَد ا ۝ وَلَا تَقُولَنَّ لِشَا۟یۡءٍ إِنِّی فَاعِل ذَ  ٰ⁠ لِكَ غَدًا ۝ إِلَّاۤ أَن یَشَاۤءَ ٱللَّهُۚ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِیتَ وَقُلۡ عَسَىٰۤ أَن یَهۡدِیَنِ رَبِّی لِأَقۡرَبَ مِنۡ هَـٰذَا رَشَد ا ۝ وَلَبِثُوا۟ فِی كَهۡفِهِمۡ ثَلَـٰثَ مِا۟ئَة سِنِینَ وَٱزۡدَادُوا۟ تِسۡع ا ۝ قُلِ ٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا لَبِثُوا۟ۖ لَهُۥ غَیۡبُ ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِۖ أَبۡصِرۡ بِهِۦ وَأَسۡمِعۡۚ مَا لَهُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِیّ وَلَا یُشۡرِكُ فِی حُكۡمِهِۦۤ أَحَد ࣰا)

[Surah Al-Kahf 9 - 26]

অর্থাৎ, তুমি কি মনে কর যে, গুহা ও রাকীম (পর্বত বা ফলক)-এর অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাদির মধ্যে বিস্ময়কর? যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল তখন তারা বলেছিল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি নিজ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজকর্ম সঠিক ভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করুন।’ অতঃপর আমি ওদেরকে গুহায় কয়েক বছর ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম। পরে আমি ওদেরকে জাগরিত করলাম জানার জন্যে যে, দু’দলের মধ্যে কোনটি ওদের অবস্থিতি কাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে। আমি তোমার নিকট ওদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। ওরা ছিল কয়েকজন যুবক। ওরা ওদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি ওদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম।

এবং আমি ওদের চিত্ত দৃঢ় করে দিলাম। ওরা যখন উঠে দাঁড়াল তখন বলল, ‘আমাদের প্রতিপালক আকাশরাজি ও পৃথিবীর প্রতিপালক। আমরা কখনই তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন ইলাহকে আহ্বান করব না। যদি করে বসি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত হবে। আমাদেরই এই স্বজাতিরা তাঁর পরিবর্তে অনেক ইলাহ গ্রহণ করেছে। তারা এ সকল ইলাহ সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তার চাইতে অধিক জালিম আর কে?’

তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হলে ওদের থেকে এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের থেকে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন।

তুমি দেখতে পেতে-ওরা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত, সূর্য উদয়কালে ওদের গুহার দক্ষিণ পার্শ্বে হেলে যায় এবং অস্তকালে ওদেরকে অতিক্রম করে বামপার্শ্ব দিয়ে। এ সমস্ত আল্লাহর নিদর্শন আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনই তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না। তুমি মনে করতে ওরা জাগ্রত, কিন্তু ওরা ছিল নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডান দিকে ও বামে এবং ওদের কুকুর ছিল সম্মুখের পা দুটো গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। তাকিয়ে ওদেরকে দেখলে পিছনে ফিরে পলায়ন করতে ও ওদের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তে। এবং এভাবেই আমি ওদেরকে জাগরিত করলাম যাতে ওরা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওদের একজন বলল, ‘তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ?’ কেউ কেউ বলল, ‘একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ।’ কেউ কেউ বলল, ‘তোমরা কতদিন অবস্থান করেছ তা তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন।’

এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর সে যেন দেখে কোন খাদ্য উত্তম এবং তা হতে যেন কিছু তোমাদের জন্যে নিয়ে আসে। সে যেন বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে ও কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকেও কিছু জানতে না দেয়। ওরা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে ওদের ধর্মে ফিরিয়ে নিবে এবং সে ক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না। এবং এভাবে আমি মানুষকে তাদের বিষয় জানিয়ে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই।

যখন তারা তাদের কর্তব্য বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছিল তখন অনেকে বলল, ওদের ওপর সৌধ নির্মাণ কর। ওদের প্রতিপালক ওদের বিষয়ে ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল তারা বলল, আমরা তো নিশ্চয়ই ওদের পার্শ্বে মসজিদ নির্মাণ করব। কেউ কেউ বলবে, ওরা ছিল তিনজন, ওদের চতুর্থটি ছিল ওদের কুকুর এবং কেউ কেউ বলবে ওরা ছিল পাঁচজন, ওদের ষষ্ঠটি ছিল ওদের কুকুর। অজানা বিষয়ে অনুমানের ওপর নির্ভর করে। আবার কেউ কেউ বলবে, ওরা ছিল সাত জন, ওদের অষ্টমটি ছিল ওদের কুকুর। বল, আমার প্রতিপালকই ওদের সংখ্যা ভাল জানেন, ওদের সংখ্যা অল্প কয়েকজনই জানে। সাধারণ আলোচনা ব্যতীত আপনি ওদের বিষয়ে বিতর্ক করবেন না এবং ওদের কাউকে ওদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না। কখনই তুমি কোন বিষয়ে বলবে না ‘আমি এটি আগামীকাল করব’। ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ একথা না বলে। যদি ভুলে যাও তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করবে এবং বলবে, সম্ভবত আমার প্রতিপালক আমাকে ওটি অপেক্ষা সত্যের নিকটতর পথনির্দেশ করবেন। ওরা ওদের গুহায় ছিল তিনশ’ বছর আরও নয় বছর। তুমি বল, তারা কতকাল ছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন, আকাশরাজি ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা! তিনি ব্যতীত ওদের অন্য কোন অভিভাবক নেই। তিনি কাউকে তাঁর কর্তৃত্বে শরীক করেন না। (১৭, কাহাফঃ ৯-২৬)

আসহাবে কাহাফ ও যুল-কারনাইন সম্পর্কে আয়াত নাযিল হওয়ার পটভূমি সম্বন্ধে মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ও অন্যরা সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরায়শগণ মদীনার ইয়াহুদীদের নিকট একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিল। উদ্দেশ্য এই যে, ইয়াহুদীগণ তাদেরকে কতক প্রশ্ন শিখিয়ে দিবে। কুরায়শগণ সেগুলো রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করবে এবং এরদ্বারা তারা তাকে পরীক্ষা করবে। ইয়াহুদীগণ বলেছিল যে, ‘তোমরা তাকে এমন এক সম্প্রদায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, যারা অতীতেই বিলীন হয়ে গিয়েছে। যার ফলে ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানা যায় না। আর প্রশ্ন করবে পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী একজন লোক সম্পর্কে এবং জিজ্ঞেস করবে রূহ সম্পর্কে।

এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন

وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الرُّوۡحِ -

তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে।

وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنۡ ذِی الۡقَرۡنَیۡنِ

তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে আর এখানে বললেনঃ

اَمۡ حَسِبۡتَ اَنَّ اَصۡحٰبَ الۡکَہۡفِ وَ الرَّقِیۡمِ ۙ کَانُوۡا مِنۡ اٰیٰتِنَا عَجَبًا ﴿۹﴾

—তুমি কি মনে কর যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাদির মধ্যে বিস্ময়কর?

অর্থাৎ আমি আপনাকে যেসব অভূতপূর্ব আশ্চর্যজনক বিষয়াদি, উজ্জ্বল নিদর্শনাদি ও বিস্ময়কর ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত করেছি, সে সবের তুলনায় গুহা ও রাকীমের অধিবাসীদের সংবাদ ও ঘটনা মোটেই আশ্চর্যজনক নয়।

এখানে কাহফ অর্থ পর্বত গুহা। শুআয়ব আল জুবাঈ বলেন, গুহাটির নাম হায়যুম। রাকীম শব্দ সম্পর্কে হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, ‘রাকীম দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’

কেউ কেউ বলেন, রাকীম অর্থ লিখিত ফলক-যাতে সেখানে আশ্রয় গ্রহণকারীদের নাম এবং তাদের ঘটনাবলী লিখিত রয়েছে। পরবর্তী যুগের লোকজন এটি লিখে রেখেছিল। ইবন জারীর ও অন্যান্যগণ এ অভিমত সমর্থন করেন। কেউ কেউ বলেন, রাকীম হল সেই পর্বতের নাম, যে পর্বতের গুহায় তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন।

ইবন আব্বাস (রা) ও শু’আয়ব আল জুবাই বলেন, ঐ পর্বতের নাম বিনাজলুস। কারো কারো মতে, রাকীম হচ্ছে ঐ গুহার পাশে অবস্থিত একটি উপত্যকার নাম। অন্য কারো কারো মতে, এটি ঐ এলাকার একটি জনপদের নাম।

শু’আয়ব আল জুবাঈ বলেন, তাদের কুকুরের নাম ছিল হামরান। কতক তাফসীরকার বলেছেন যে, তাঁরা ছিলেন হযরত ঈসা (আ)-এর পরবর্তী যুগের লোক এবং তারা খৃষ্টান ছিলেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে ইয়াহুদীদের গুরুত্ব আরোপ এবং তাদের সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহের আগ্রহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা হযরত ঈসা (আ)-এর পূর্ববর্তী যুগের লোক। আয়াতের বাচনভঙ্গি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের সম্প্রদায়ের লোকজন ছিল মুশরিক। তারা মূর্তিপূজা করত। বহু তাফসীরকার ও ইতিহাসবিদ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, তারা বাদশাহ দাকরানূমের সময়ের অভিজাত বংশীয় লোক ছিলেন। কারো কারো অভিমত যে, তারা রাজপুত্র ছিলেন।

ঘটনাচক্রে তারা সম্প্রদায়ের উৎসবের দিনে একত্রিত হয়। তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা সেখানে যে মূর্তিদেরকে সিজদা করছে এবং প্রতিমাগুলোকে সম্মান প্রদর্শন করছে, তা তারা প্রত্যক্ষ করে। তখন তারা গভীর মনোযোগের সাথে তা পর্যালোচনা করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরের উদাসীনতার পর্দা ছিন্ন করে দেন এবং তাদের মনে সত্য ও হিদায়াতের উন্মেষ ঘটান। ফলে তারা উপলব্ধি করেন যে, তাদের সম্প্রদায়ের এসব কাজকর্ম সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যুবকগণ তাদের ওই ধর্ম পরিত্যাগ করেন এবং এক আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করেন।

কেউ কেউ বলেন যে, যুবকদের প্রত্যেকের মনে আল্লাহ তা'আলা তাওহীদ ও হিদায়াতের অনুভূতি সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। তারপর তারা সকলেই লোকজনের সংসর্গ ত্যাগ করে এক নির্জন এলাকায় এসে উপস্থিত হন। সহীহ বুখারীতে এ বিষয়ে একটি বিশুদ্ধ হাদীছ উদ্ধৃত হয়েছে। সেটি এইঃ

الْأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُجَنَّدَةٌ فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ

রুহগুলো সুবিন্যস্ত বাহিনী স্বরূপ। তাদের মধ্যে যেগুলো পূর্ব-পরিচিত, সেগুলো বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর যারা পরস্পর অপরিচিত তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তখন তারা একে অপরের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান বর্ণনা করে। তখন জানা যায় যে, তারা সবাই নিজ নিজ গোত্র ছেড়ে এসেছে এবং ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আপন দীন রক্ষার্থে পালিয়ে এসেছে। ফিতনা, বিশৃংখলা ও পাপাচারের বিস্তৃতিকালে এভাবে সমাজ ত্যাগ করা শরীয়ত সম্মত।

আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡکَ نَبَاَہُمۡ بِالۡحَقِّ ؕ اِنَّہُمۡ فِتۡیَۃٌ اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ وَ زِدۡنٰہُمۡ ہُدًی وَّ رَبَطۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ اِذۡ قَامُوۡا فَقَالُوۡا رَبُّنَا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ لَنۡ نَّدۡعُوَا۠ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اِلٰـہًا لَّقَدۡ قُلۡنَاۤ اِذًا شَطَطًا ﴿۱۴﴾ ہٰۤؤُلَآءِ قَوۡمُنَا اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اٰلِہَۃً ؕ لَوۡ لَا یَاۡتُوۡنَ عَلَیۡہِمۡ بِسُلۡطٰنٍۭ بَیِّنٍ

আমি তোমার নিকট ওদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। ওরা ছিল কয়েকজন যুবক। ওরা ওদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি ওদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম। এবং আমি ওদের চিত্ত দৃঢ় করে দিলাম, ওরা যখন ওঠে দাঁড়াল তখন বলল, আমাদের প্রতিপালক আকাশরাজি ও পৃথিবীর প্রতিপালক! আমরা কখনই তার পরিবর্তে অন্য কোন ইলাহকে আহ্বান করব না, যদি করে বসি তবে তা অত্যন্ত গর্হিত হবে। আমাদের এই স্বজাতিগণ, তার পরিবর্তে অনেক ইলাহ গ্রহণ করেছে। এরা এ সকল ইলাহ সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? অর্থাৎ তারা যে পথ অবলম্বন করেছে এবং যে অভিমত অনুসরণ করেছে তার যথার্থতা সম্পর্কে প্রকাশ্য দলিল উপস্থাপন করে না কেন?

فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا

যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তার চাইতে অধিক জালিম আর কে? তোমরা যখন তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকে অর্থাৎ দীনের প্রশ্নে তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হয়ে গেলে এবং তারা আল্লাহ ব্যত যেগুলোর উপাসনা করে সেগুলোকে ত্যাগ করলে। কারণ তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করত। যেমন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ বলেছিলেনঃ

اِنَّنِیۡ بَرَآءٌ مِّمَّا تَعۡبُدُوۡنَ۝اِلَّا الَّذِیۡ فَطَرَنِیۡ فَاِنَّہٗ سَیَہۡدِیۡنِ

—তোমরা যেগুলোর পূজা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে শুধু তারই সাথে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমাকে সৎপথ দেখাবেন। এ যুবকরাও অনুরূপ বলেছিলেন। (৪৩ যুখরুফঃ ২৬-২৭) আয়াতের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন যে, দীনের প্রশ্নে তোমরা যেমন তোমাদের সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছ, দৈহিকভাবেও তোমরা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও, যাতে ওদের অনিষ্ট থেকে তোমরা নিরাপদ থাকতে পার।

فَاۡ وٗۤا اِلَی الۡکَہۡفِ یَنۡشُرۡ لَکُمۡ رَبُّکُمۡ مِّنۡ رَّحۡمَتِہٖ وَیُہَیِّیٴۡ لَکُمۡ مِّنۡ اَمۡرِکُمۡ مِّرۡفَقًا

—তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে তার দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ কর্মকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন। অর্থাৎ তার রহমতের পর্দা দ্বারা তোমাদেরকে ঢেকে দিবেন। তোমরা তার নিরাপত্তা ও আশ্রয়ে থাকবে। এবং তিনি তোমাদের পরিণাম কল্যাণময় করে দিবেন। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে।

اللَّهُمَّ أَحْسِنْ عَاقِبَتَنَا فِي الأُمُورِ كُلِّهَا وَأَجِرْنَا مِنْ خِزْيِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الآخِرَةِ

—হে আল্লাহ! সকল কর্মে আমাদেরকে কল্যাণময় পরিণতি দান করুন এবং দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও আখিরাতের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।

এরপর তাঁরা যে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, গুহাটি উত্তরমুখী ছিল। তার পশ্চিম দিকে ঢালু ছিল। কিবলার দিকে ঢালু উত্তরমুখী স্থান অধিক কল্যাণকর স্থান রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

وَ تَرَی الشَّمۡسَ اِذَا طَلَعَتۡ تَّزٰوَرُ عَنۡ کَہۡفِہِمۡ ذَاتَ الۡیَمِیۡنِ وَ اِذَا غَرَبَتۡ تَّقۡرِضُہُمۡ ذَاتَ الشِّمَالِ

—তুমি দেখতে পেতে, ওরা গুহার চত্বরে অবস্থিত। সূর্য উদয়কালে ওদের গুহার ডান দিকে হেলে যায় এবং অস্তকালে ওদেরকে অতিক্রম করে বাম পার্শ্ব দিয়ে। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে সূর্য উদিত হওয়ার সময় তাদের গুহার পশ্চিম দিকে আলো ছড়ায়, তারপর সূর্য যতই উপরে উঠতে থাকে, ক্রমান্বয়ে ততই ঐ আলো গুহা থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। এটি হল সূর্যের ডান দিক দিয়ে অতিক্রম করা। অতঃপর সূর্য মধ্য আকাশে উত্থিত হয় এবং গুহা থেকে ঐ আলো বেরিয়ে যায়। তারপর যখন অস্ত যেতে শুরু করে তখন পূর্ব পাশ দিয়ে অল্প অল্প করে আলো প্রবেশ করতে থাকে। অবশেষে সূর্য অস্ত যায়। এ ধরনের স্থানে এরূপই দেখা যায়। তাদের গুহায় মাঝে মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশের এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল যাতে ঐ গুহার আবহাওয়া দূষিত না হয়।

وَ ہُمۡ فِیۡ فَجۡوَۃٍ مِّنۡہُ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ

—ওরা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এ সব আল্লাহর নিদর্শন। অর্থাৎ তাদের পানাহার না করে, খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ না করে শতশত বৎসর এ অবস্থায় বিদ্যমান থাকাটা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাদির অন্যতম এবং তাঁর মহা শক্তির প্রমাণ স্বরূপ।

مَنۡ یَّہۡدِ اللّٰہُ فَہُوَ الۡمُہۡتَدِ ۚ وَ مَنۡ یُّضۡلِلۡ فَلَنۡ تَجِدَ لَہٗ وَلِیًّا مُّرۡشِدًا وَ تَحۡسَبُہُمۡ اَیۡقَاظًا وَّ ہُمۡ رُقُوۡدٌ

—আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি কখনই তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না। তুমি মনে করতে তারা ঘুমন্ত অথচ তারা জাগ্রত। এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, তা এ জন্যে যে, তাদের চোখ খোলা ছিল, যাতে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত বন্ধ থাকার ফলে চক্ষু নষ্ট হয়ে না যায়।

وَّ نُقَلِّبُہُمۡ ذَاتَ الۡیَمِیۡنِ وَ ذَاتَ الشِّمَالِ

—আমি ওদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডানে, বামে–এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, বৎসরে একবার করে তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করানো হত। এ পাশ থেকে ও পাশে ফেরানো হত। হতে পারে বৎসরে একাধিকবারও তা ঘটতো। আল্লাহই সম্যক অবগত।

وَ کَلۡبُہُمۡ بَاسِطٌ ذِرَاعَیۡہِ بِالۡوَصِیۡدِ

—তাদের কুকুর ছিল সম্মুখের পা দুটো গুহার মুখের দিকে প্রসারিত করে। শুআয়ব আল জুবাই বলেন, তাদের কুকুরের নাম ছিল হামরান। অন্য এক তাফসীরকার বলেন, وَصِیۡدِ অর্থ দরজার চৌকাঠ। অর্থাৎ যুবকগণ যখন নিজ নিজ গোত্র থেকে একাকী বেরিয়ে এসেছিলেন, তখন যে কুকুরটি তাদের সাথে এসেছিল সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে থেকে যায়। এটি গুহার মধ্যে প্রবেশ করেনি। বরং দু’হাত গুহামুখে রেখে গুহার প্রবেশ পথে বসেছিল। এটি ঐ কুকুরের অনুপম শিষ্টাচার এবং যুবকদের প্রতি সন্ত্রমবোধের নিদর্শন। কারণ সাধারণত যে ঘরে কুকুর থাকে সে ঘরে রহমতের ফিরিশতা প্রবেশ করেন না। সাহচর্য ও আনুগত্যের স্বভাবতই একটা প্রভাব থাকে। তাই যুবকদের অনুসরণ করতে গিয়ে কুকুরটিও তাদের সাথে অমর হয়ে থাকে। কারণ যে যাকে ভালবাসে সে তার সৌভাগ্যের অংশীদার হয়। একটি কুকুরের ব্যাপারে যখন এমন হল তখন সম্মানের পাত্র কোন পূণ্যবানের অনুসরণকারীর ক্ষেত্রে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

বহু ধর্মীয় বক্তা ও তাফসীরকার উক্ত কুকুর সম্পর্কে অনেক লম্বা চওড়া কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। এগুলোর অধিকাংশই ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে নেয়া এবং এর অধিকাংশ নির্জলা মিথ্যা। এতে কোন ফায়দাও নেই। যেমন কুকুরটির নাম ও রঙ বিষয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা।

এ গুহাটি কোথায় অবস্থিত, এ নিয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাঁদের অনেকে বলেন, এটি আয়লা অঞ্চলে অবস্থিত। কেউ বলেন, এটির অবস্থান নিনোভা এলাকায়। কারো মতে, কলকা অঞ্চলে এবং কারো মতে রোমকদের এলাকায়। শেষ অভিমতটিই অধিক যুক্তিসংগত।

আল্লাহ তা'আলা তাদের কাহিনীর অধিক কল্যাণকর অংশটি এমন প্রাঞ্জলভাষায় বর্ণনা করলেন এবং যেন শ্রবণকারী তা প্রত্যক্ষ করছে এবং নিজের চোখে তাদের গুহার অবস্থা, গুহার মধ্যে তাদের অবস্থান, ওদের পার্শ্ব পরিবর্তন এবং তাদের গুহা মুখে হাত প্রসারিত করে উপবিষ্ট কুকুর স্বচক্ষে দেখছে। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

لَوِ اطَّلَعۡتَ عَلَیۡہِمۡ لَوَلَّیۡتَ مِنۡہُمۡ فِرَارًا وَّ لَمُلِئۡتَ مِنۡہُمۡ رُعۡبًا

—তুমি যদি ওদেরকে তাকিয়ে দেখতে তবে পিছনে ফিরে পালাতে এবং ওদের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তে অর্থাৎ তারা যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে এবং যে গুরুগম্ভীর ও ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার জন্য। সম্ভবত এ সম্বোধনটি সকল মানুষের জন্যে, শুধুমাত্র প্রিয় নবী (সা)-এর জন্যে নয়। যেমন আল্লাহ তা'আলার বাণী

فَمَا یُکَذِّبُکَ بَعۡدُ بِالدِّیۡنِ

সুতরাং এর পরে কিসে তোমাকে কর্মফল সম্বন্ধে অবিশ্বাসী করে? এ আয়াতে তোমাকে বলতে সাধারণভাবে অবিশ্বাসী মানবদেরকে বুঝানো হয়েছে। নবী করীম (সা)-কে নয়। কারণ, মানুষ সাধারণত ভীতিকর দৃশ্য দেখলে পালিয়ে যায়। এ জন্যেই আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ

َوِ اطَّلَعۡتَ عَلَیۡہِمۡ لَوَلَّیۡتَ مِنۡہُمۡ فِرَارًا وَّ لَمُلِئۡتَ مِنۡہُمۡ رُعۡبًا

এতে বুঝা যায় যে, শোনা আর দেখা এক কথা নয়। যেমন হাদীসেও এ বিষয়ে সমর্থন রয়েছে। কারণ, আলোচ্য ঘটনায় গুহাবাসীর ভীতিকর সংবাদ শুনে কেউ পালায়নি বা ভীতও হয়নি।

তারপর আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, তিনি তাদেরকে জাগ্রত করলেন তাদের ৩০৯ বছর নিদ্রামগ্ন থাকার পর। জাগ্রত হওয়ার পর তাদের একে অন্যকে বললঃ

کَمۡ لَبِثۡتُمۡ ؕ قَالُوۡا لَبِثۡنَا یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ ؕ قَالُوۡا رَبُّکُمۡ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثۡتُمۡ ؕ فَابۡعَثُوۡۤا اَحَدَکُمۡ بِوَرِقِکُمۡ ہٰذِہٖۤ اِلَی الۡمَدِیۡنَۃِ

—তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ? কেউ কেউ বলল, একদিন অথবা এক দিনের কিছু অংশ। অপর কেউ বলল, তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ তা তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন। তখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর। অর্থাৎ তাদের সাথে থাকা রৌপ্য মুদ্রার দিকে ইঙ্গিত করে তা নিয়ে নগরে যেতে বলেছিল।

কথিত আছে যে, ওই নগরীর নাম ছিল দাফমূম।

فَلۡیَنۡظُرۡ اَیُّہَاۤ اَزۡکٰی طَعَامًا

সে গিয়ে দেখুক কোন্ খাদ্য উত্তম। অর্থাৎ কোন্‌টি উৎকৃষ্টমানের।

فَلۡیَاۡتِکُمۡ بِرِزۡقٍ مِّنۡہُ

অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্যে। অর্থাৎ যা তোমরা খেতে পারবে। এটি ছিল তাদের সংযম ও নির্লোভ মনোভাবের পরিচায়ক। وَ لۡـیَؔ‍‍‍تَلَطَّفۡ সে যেন বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে। নগরে প্রবেশ করার সময়

وَ لَا یُشۡعِرَنَّ بِکُمۡ اَحَدًاـ اِنَّہُمۡ اِنۡ یَّظۡہَرُوۡا عَلَیۡکُمۡ یَرۡجُمُوۡکُمۡ اَوۡ یُعِیۡدُوۡکُمۡ فِیۡ مِلَّتِہِمۡ وَ لَنۡ تُفۡلِحُوۡۤا اِذًا اَبَدًا

—এবং কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকে কিছু টের পেতে না দেয়। ওরা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে ওদের ধর্মে ফিরিয়ে নিবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।

অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদেরকে ওদের বাতিল ধর্ম থেকে উদ্ধার করার পর তোমরা যদি পুনরায় ওদের মধ্যে ফিরে যাও তবে আর তোমাদের সাফল্য নেই। তারা এ জাতীয় কথাবার্তা এ জন্য বলেছিল যে, তারা মনে করেছিল তারা একদিন, একদিনের কতকাংশ কিংবা তার চাইতে কিঞ্চিতাধিক সময় নিদ্রামগ্ন ছিল। তারা যে ৩০০ বছরের অধিককাল ধরে নিদ্রামগ্ন ছিল এবং ইতিমধ্যে যে রাষ্ট্রক্ষমতার বহুবার হাত বদল হয়েছে, নগর ও নগরবাসীর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তাদের প্রজন্মের লোকদের যে মৃত্যু হয়েছে, অন্য প্রজন্ম এসেছে এবং তারাও চলে গিয়েছে, অতঃপর অন্য আরেক প্রজন্মের আবির্ভাব হয়েছে; তার কিছুই তারা তখনও আঁচ করে উঠতে পারেনি। এজন্যে তাদের একজন অর্থাৎ তীযূসীস যখন নিজের পরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যে ছদ্মবেশে গুহা থেকে বের হন এবং নগরে প্রবেশ করেন তখন তা তাঁর নিকট অপরিচিত ঠেকে। নগরবাসীরা যেই তাকে দেখে অপরিচিত বোধ করে। তার আকার-আকৃতি কথাবার্তা এবং তার মুদ্রা সবই নগরবাসীর নিকট অপরিচিত ও আশ্চর্যজনক ঠেকে।

কথিত আছে যে, তারা তাকে তাদের রাজার নিকট নিয়ে যায় এবং তারা তাকে গুপ্তচর বলে সন্দেহ করে। কেউ কেউ তাকে শক্তিশালী শত্রু মনে করে তার ক্ষতিকর আক্রমণেরও আশংকা করেছে। কতক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি তখন তাদের নিকট থেকে পালিয়ে যান। আর কতক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি নগরবাসীকে তাঁর নিজের ও সাথীদের অবস্থার বিবরণ দেন। অতঃপর তারা তার সাথে তাদের অবস্থান ক্ষেত্রের দিকে রওয়ানা হয়, যাতে তিনি তাদেরকে নিজেদের অবস্থানস্থল দেখিয়ে দেন। নগরবাসী গুহার নিকট এসে পৌঁছার পর তীযুসীস সর্বাগ্রে তার সাথীদের নিকট প্রবেশ করেন। তিনি নিজেদের প্রকৃত অবস্থা এবং নিদ্রার মেয়াদ সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেন। তখন তারা উপলব্ধি করে নেয় যে, মূলত এটি মহান আল্লাহর নির্ধারিত একটি বিষয়। কথিত আছে যে, এরপর তাঁরা আবার নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়েন। মতান্তরে এরপর তাদের ইন্তিকাল হয়ে যায়।

ঐ নগরবাসীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা ঐ গুহাটি খুঁজে পায়নি। গুহাবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে অনবহিত রেখে দেন। কেউ কেউ বলেন যে, গুহাবাসীদের ব্যাপারে তাদের মনে ভীতির সৃষ্টি হওয়ার দরুণ গুহায় প্রবেশ করতে পারেনি। গুহাবাসীদের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, সে বিষয়ে নগরবাসীদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। তাদের একদল বলল,

ابۡنُوۡا عَلَیۡہِمۡ بُنۡیَانًا

তাদের উপর সৌধ নির্মাণ করে দাও। অর্থাৎ গুহামুখ বন্ধ করে দাও, যাতে তারা সেখান থেকে বের হতে না পারে। বা কেউ তাদেরকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের নিকট যেতে না পারে।

অপর দল বলল, আর এদের মতই প্রবল ছিল।

لَنَتَّخِذَنَّ عَلَیۡہِمۡ مَّسۡجِدًا

আমরা অবশ্যই ওদের উপর মসজিদ নির্মাণ করব। অর্থাৎ ইবাদতখানা তৈরি করব। এ সকল পূণ্যবান লোকদের পাশাপাশি থাকার কারণে তা বরকতময় হয়ে থাকবে। পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যে এরূপ মসজিদ নির্মাণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। আমাদের শরীয়তে এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা হল, ঐ হাদীস যা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেনঃ

لَعَنَ اللَّهُ قَوْمًا اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ‏ "‏

‘আল্লাহ তা'আলার লানত ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের ওপর, তারা তাদের নবীদের কবর সমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে। ওরা যা করেছে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর উম্মতদেরকে তা না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَ کَذٰلِکَ اَعۡثَرۡنَا عَلَیۡہِمۡ لِیَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ وَّ اَنَّ السَّاعَۃَ لَا رَیۡبَ فِیۡہَا

—এবং আমি মানুষকে এভাবে তাদের বিষয় জানিয়ে দিলাম—যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। (১৫ঃ ২১)

বহু তাফসীরকার বলেছেন যে, এর অর্থ হল যাতে লোকজন জানতে পারে যে, পুনরুত্থান সত্য এবং কিয়ামত অনুষ্ঠানে কোন সন্দেহ নেই। মানুষ যখন অবগত হবে যে, গুহাবাসিগণ তিনশ' বছরেরও অধিককাল ধরে নিদ্রামগ্ন ছিল তারপর কোন প্রকারের বিকৃতি ছাড়া যে অবস্থায় ছিলেন ঠিক সে অবস্থায়ই জাগ্রত হয়ে উঠেন। তখন তারা উপলব্ধি করতে পারবে যে, মহান সত্তা তাদেরকে কোন পরিবর্তন ছাড়া অক্ষুন্ন রাখার ক্ষমতা রাখেন, তিনি নিশ্চয়ই কীটদষ্ট ও বিচূর্ণ অস্থি বিশিষ্ট মানবদেহকে মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত করার ক্ষমতা রাখেন। এটি এমন একটি বিষয় যাতে ঈমানদারগণ কোনই সন্দেহ পোষণ করে না।

اِنَّمَاۤ اَمۡرُہٗۤ اِذَاۤ اَرَادَ شَیۡئًا اَنۡ یَّقُوۡلَ لَہٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ

‘তার ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তিনি সেটিকে বলেন হও, ফলে তা হয়ে যায়।' (৩৬ ইয়াসীনঃ ৮২)

অবশ্য আয়াতের ব্যাখ্যা এমনও হতে পারে যে, ‘যাতে তারা জানতে পারে’ বলতে গুহা বাসীগণকে বুঝানো হয়েছে। কারণ তাদের নিজেদের সম্পর্কে তাদের অবগত হওয়াটা তাদের সম্পর্কে অন্যের অবগত হওয়া অপেক্ষা অধিকতর প্রভাব বিস্তারকারী। আবার এমনও হতে পারে যে, আয়াতে তারা জানতে পারে বলতে সকলকেই বুঝানো হয়েছে। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

سَیَقُوۡلُوۡنَ ثَلٰثَۃٌ رَّابِعُہُمۡ کَلۡبُہُمۡ ۚ وَ یَقُوۡلُوۡنَ خَمۡسَۃٌ سَادِسُہُمۡ کَلۡبُہُمۡ رَجۡمًۢا بِالۡغَیۡبِ ۚ وَ یَقُوۡلُوۡنَ سَبۡعَۃٌ وَّ ثَامِنُہُمۡ کَلۡبُہُمۡ

‘কেউ বলবে ওরা ছিল তিনজন, ওদের চতুর্থটি ছিল ওদের কুকুর এবং কেউ বলে ওরা ছিল পাঁচজন, ওদের ষষ্ঠটি ছিল ওদের কুকুর। অজানা বিষয়ে অনুমানের উপর নির্ভর করে। আবার কেউ কেউ বলবে, ওরা ছিল সাতজন, ওদের অষ্টমটি ছিল ওদের কুকুর।’ (সুরা কাহফঃ ২২) তাদের সংখ্যা সম্পর্কে মানুষের তিনটি অভিমতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম দুটো অভিমত দুর্বল সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তৃতীয়টিকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এতে বুঝা যায় তৃতীয় অভিমতটিই যথার্থ। এছাড়া অন্য কোন মত থাকলে তাও উল্লেখিত হতো। এ তৃতীয় মতটি যথার্থ না হলে তাও দুর্বল বলে চিহ্নিত করা হতো। তাই তৃতীয় মতটিই সঠিক। এ জাতীয় বিষয়ে বিতর্কে যেহেতু কোন উপকারিতা নেই সেহেতু আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল (স)-কে এই আদব শিক্ষা দিয়েছেন যে, মানুষ যখন এ জাতীয় বিষয়ে মতভেদ করবে তখন তিনি যেন বলেন, ‘আল্লাহই ভাল জানেন।’ এ জন্যেই আল্লাহ তা'আলা বলেন,

قُلۡ رَّبِّیۡۤ اَعۡلَمُ بِعِدَّتِہِمۡ مَّا یَعۡلَمُہُمۡ اِلَّا قَلِیۡلٌ

“বল আমার প্রতিপালকই ওদের সংখ্যা ভাল জানেন। ওদের সংখ্যা অল্প কয়েকজনই জানে।”

فَلَا تُمَارِ فِیۡہِمۡ اِلَّا مِرَآءً ظَاہِرًا

“সাধারণ আলোচনা ব্যতীত তুমি ওদের বিষয়ে বিতর্ক করবে না।” অর্থাৎ সহজ ও স্বাভাবিক আলোচনা করুন। এ জাতীয় বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হবেন না। আর তাদের সম্বন্ধে কোন মানুষকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। এ কারণে শুরুতে আল্লাহ তা'আলা তাদের সংখ্যা অস্পষ্ট রেখেছেন।

আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ

اِنَّہُمۡ فِتۡیَۃٌ اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ

“ওরা ছিল কয়েকজন যুবক, ওরা ওদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল।” তাদের সংখ্যা বর্ণনা যদি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হত তবে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সকল বিষয়ে অবগত মহান আল্লাহ তাআলা সূরার প্রারম্ভেই ওদের সংখ্যার বিবরণ দিতেন।

আল্লাহ তা'আলা বলেন,

وَ لَا تَقُوۡلَنَّ لِشَایۡءٍ اِنِّیۡ فَاعِلٌ ذٰلِکَ غَدًاـ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ

“কখনও তুমি কোন বিষয়ে বলবে না, আমি এটি আগামীকাল করব” ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ কথাটি না বলে। এটি একটি উচ্চস্তরের শিষ্টাচার যা আল্লাহ এ আয়াতে শিক্ষা দিয়েছেন এবং আপন সৃষ্টিকুলকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। অর্থাৎ কেউ যদি বলতে চায় যে, অবিলম্বে আমি এ কাজটি করব তবে তার জন্যে শরীয়তের বিধান এই যে, সে ‘ইনশাআল্লাহ' বলবে। যাতে এতে তার সুদৃঢ় সংকল্প প্রকাশ পায়। কারণ আগামীকাল কি হবে তা তো বান্দা জানে না। সে এটাও জানে না যে, সে যে কাজটি করার সংকল্প করেছে তা তার তাকদীরে আছে কিনা। এই ইনশাআল্লাহ শব্দটি শর্ত বলে গণ্য হবে না, বরং এটি তার দৃঢ় সংকল্প বলেই গণ্য হবে। এ জন্য হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, বাক্যে ইনশাআল্লাহ শব্দটি এক বছর মেয়াদের মধ্যে যুক্ত করা চলে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এটি শীঘ্রতা জ্ঞাপক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন ইতিপূর্বে হযরত সুলায়মান (আ)-এর ঘটনায় আলোচিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, আজ রাতে আমি ৭০ জন স্ত্রীর সাথে মিলিত হবো। তারা প্রত্যেকে একটি করে ছেলে সন্তান প্রসব করবে, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। তখন নেপথ্যে তাঁকে বলা হয়েছিল, “ইনশাআল্লাহ’ বলুন! তিনি তা বলেননি। অতঃপর তিনি সহবাস করলেন। তাতে মাত্র একজন স্ত্রী একটি অসম্পূর্ণদেহী ছেলে প্রসব করেন।

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

والذي بيده نفسي لَوْ قَالَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ، لَمْ يَحْنَثْ وَكَانَ دَرَكًا فِي حَاجَتِهِ

—সে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, হযরত সুলায়মান (আ) যদি ইনশাআল্লাহ বলতেন, তবে তাঁর শপথ ভঙ্গ হত না এবং তাঁর মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ হত।

আল্লাহ তা'আলার বাণীঃ

وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ اِذَا نَسِیۡتَ

“যদি ভুলে যাও তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কর!” কারণ ভুলে যাওয়াটা কোন কোন সময় শয়তানের প্রভাবে হয়ে থাকে। তখন আল্লাহর স্মরণ অন্তর থেকে প্রভাব বিদূরিত করে দেয়। ফলে যা ভুলে গিয়েছিল তা স্মরণে আসে।

আল্লাহর বাণীঃ

وَ قُلۡ عَسٰۤی اَنۡ یَّہۡدِیَنِ رَبِّیۡ لِاَقۡرَبَ مِنۡ ہٰذَا رَشَدًا

—এবং বল সম্ভবত আমার প্রতিপালক আমাকে এটি অপেক্ষা সত্যের নিকটতর পথ নির্দেশ করবেন।”

অর্থাৎ যখন কোন বিষয়ে অস্পষ্টতা এসে যায় এবং লোকজনের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় তবে আপনি আল্লাহ অভিমুখী হোন, তিনি বিষয়টিকে আপনার জন্যে সহজ ও স্বাভাবিক করে দিবেন। এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَ لَبِثُوۡا فِیۡ کَہۡفِہِمۡ ثَلٰثَ مِائَۃٍ سِنِیۡنَ وَ ازۡدَادُوۡا تِسۡعًا

“তারা তাদের গুহায় ছিল তিনশ’ বছর, আরও নয় বছর।” তাদের সুদীর্ঘ কাল গুহায় অবস্থানের কথা উল্লেখ তাৎপর্যবহ। তাই আল্লাহ তাআলা এর উল্লেখ করেছেন। এখানে অতিরিক্ত নয় বছর হল চান্দ্র মাসের হিসাবে। সৌর বছরের ৩০০ বছর পূর্ণ করতে চান্দ্র মাসের হিসেবে অতিরিক্ত নয় বছরের প্রয়োজন হয়। কারণ প্রতি ১০০ সৌর বছর থেকে ১০০ চান্দ্র বছরের সময়কাল তিন বছর কম হয়ে থাকে।

قُلِ اللّٰہُ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثُوۡا

“বল তারা কতকাল ছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন।” অর্থাৎ এ জাতীয় কোন বিষয়ে যদি আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করে আর আপনার নিকট সে বিষয়ে কোন লিখিত প্রমাণ না থাকে তবে বিষয়টি মহান আল্লাহর প্রতি সোপর্দ করে দিন।

لَہٗ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ

“আকাশরাজি ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই।” অর্থাৎ অদৃশ্য বিষয়ে অবগত তিনিই, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে তা অবগত করান, অন্য কাউকে নয়।

اَبۡصِرۡ بِہٖ وَ اَسۡمِعۡ .

“তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা।” অর্থাৎ তিনি সবকিছুকে যথাস্থানে স্থাপন করেন। কারণ তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে এবং সেগুলোর চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত।

তারপর আল্লাহ তাআলা বললেন,

مَا لَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِہٖ مِنۡ وَّلِیٍّ ۫ وَّ لَا یُشۡرِکُ فِیۡ حُکۡمِہٖۤ اَحَدًا

“তিনি ব্যতীত ওদের অন্য কোন অভিভাবক নেই। তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না।" অর্থাৎ রাজত্বে, ক্ষমতায় ও কর্তৃত্বে আপনার প্রতিপালক একক, অনন্য। তাঁর কোন শরীক ও অংশীদার নেই।”

৩৮
একজন ঈমানদার একজন কাফিরের বিবরণ
সূরা কাহফ-এ গুহাবাসীদের ঘটনা বর্ণনার পর আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ

وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلًا رَجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا (32) كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آَتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِمْ مِنْهُ شَيْئًا وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا (33) وَكَانَ لَهُ ثَمَرٌ فَقَالَ لِصَاحِبِهِ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَنَا أَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا (34) وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا (35) وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا (36) قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا (37) لَكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَدًا (38) وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ إِنْ تَرَنِ أَنَا أَقَلَّ مِنْكَ مَالًا وَوَلَدًا (39) فَعَسَى رَبِّي أَنْ يُؤْتِيَنِ خَيْرًا مِنْ جَنَّتِكَ وَيُرْسِلَ عَلَيْهَا حُسْبَانًا مِنَ السَّمَاءِ فَتُصْبِحَ صَعِيدًا زَلَقًا (40) أَوْ يُصْبِحَ مَاؤُهَا غَوْرًا فَلَنْ تَسْتَطِيعَ لَهُ طَلَبًا (41) وَأُحِيطَ بِثَمَرِهِ فَأَصْبَحَ يُقَلِّبُ كَفَّيْهِ عَلَى مَا أَنْفَقَ فِيهَا وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا وَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا (42) وَلَمْ تَكُنْ لَهُ فِئَةٌ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مُنْتَصِرًا (43) هُنَالِكَ الْوَلَايَةُ لِلَّهِ الْحَقِّ هُوَ خَيْرٌ ثَوَابًا وَخَيْرٌ عُقْبًا

“তুমি ওদের নিকট পেশ কর দুই ব্যক্তির উপমা।” তাদের একজনকে আমি দিয়েছিলাম দুটি আঙ্গুরের বাগান এবং এ দুটোকে আমি খেজুর গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছিলাম এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী স্থানকে করেছিলাম শস্যক্ষেত্র। উভয় উদ্যানই ফল দান করত এবং তাতে কোন ত্রুটি করত না। এবং উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত করেছিলাম নহর এবং তার প্রচুর ধন সম্পদ ছিল।

তারপর কথা প্রসঙ্গে সে তার বন্ধুকে বলল, ধন সম্পদে আমি তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং জনবলে তোমা অপেক্ষা শক্তিশালী। এভাবে নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার উদ্যানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না যে, এটি কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মনে করি না যে, কিয়ামত হবে, আর আমি যদি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হইই, তবে আমি তো নিশ্চয়ই এটি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব। উত্তরে তার বন্ধু তাকে বলল, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি ও পরে শুক্র থেকে এবং তারপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন মানব আকৃতিতে? কিন্তু আল্লাহই আমার প্রতিপালক এবং আমি কাউকে আমার প্রতিপালকের শরীক করি না। তুমি যখন তোমার উদ্যানে প্রবেশ করলে তখন কেন বললে না, আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন শক্তি নেই?

তুমি যদি ধনে ও সন্তানে আমাকে তোমা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর মনে কর, তবে হয়তো আমার প্রতিপালক আমাকে তোমার উদ্যান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কিছু দেবেন। এবং তোমার উদ্যানে আকাশ থেকে নির্ধারিত বিপর্যয় প্রেরণ করবেন, যার ফলে সেটি উদ্ভিদশূন্য ময়দানে পরিণত হবে। অথবা সেটির পানি ভূগর্ভে অন্তর্হিত হবে এবং তুমি কখনও সেটির সন্ধান লাভে সক্ষম হবে না। তার ফল সম্পদ বিপর্যয়ের বেষ্টিত হয়ে গেল এবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিল তার জন্যে আক্ষেপ করতে লাগল, যখন সেটি মাচানসহ ভূমিসাৎ হয়ে গেল। সে বলতে লাগল, হায়, আমি যদি কাউকে আমার প্রতিপালকের শরীক না করতাম। আর আল্লাহ ব্যতীত তাকে সাহায্য করার কোন লোকজন ছিলনা এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ হল না। এ ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব আল্লাহরই, যিনি সত্য। পুরস্কার দানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই শ্রেষ্ঠ। (১৮ কাহফঃ ৩২-৪৪)

কতক তাফসীরকার বলেন, এটি একটি উদাহরণ মাত্র। বাস্তবে এমনটা ঘটেই ছিল তা নাও হতে পারে। তবে জমহুর তাফসীরকারের অভিমত এই যে, এটি একটি বাস্তব ঘটনা। আল্লাহ তাআলার বাণী

وَ اضۡرِبۡ لَہُمۡ مَّثَلًا

“তাদের নিকট পেশ কর একটি উপমা।” অর্থাৎ কুরায়শ বংশীয় কাফিরগণ যে দুর্বল ও দরিদ্র মুসলমানদের সাথে মিলিত হয় না বরং তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং ঈমানদারদের ওপর অহংকার করে তার প্রেক্ষিতে ঐ কাফিরদের নিকট এই উদাহরণ বর্ণনা করুন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

اضۡرِبۡ لَہُمۡ مَّثَلًا اَصۡحٰبَ الۡقَرۡیَۃِ ۘ اِذۡ جَآءَہَا الۡمُرۡسَلُوۡنَ

“ওদের নিকট পেশ কর এক জনপদ অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত তাদের নিকট তো এসেছিল রাসূলগণ।” (৩৬ ইয়াসীনঃ ১৩)

মূসা (আ)-এর ঘটনা বর্ণনার পূর্বে আমরা জনপদ বাসীদের ঘটনা উল্লেখ করেছি।

প্রসিদ্ধ অভিমত এই যে, আলোচ্য ব্যক্তিদ্বয় পরস্পর বন্ধু ছিল, একজন ঈমানদার, অপরজন কাফির। কথিত আছে যে, তাদের উভয়ের ধনসম্পদ ছিল। ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তার ধনসম্পদ আল্লাহর আনুগত্যে ও তাঁর পছন্দনীয় খাতে ব্যয় করে দেয়। পক্ষান্তরে কাফির ব্যক্তি তার সম্পদ ব্যয় করে দুটো বাগান তৈরী করে। আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বাগান দ্বারা তার বাগানদ্বয়কে বুঝানো হয়েছে। সেই দুটোতে ছিল আঙ্গুর, খেজুর এবং শস্য ক্ষেত্র। পানি সিঞ্চনের জন্য ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যে তার স্থানে স্থানে নহর প্রবাহিত ছিল। বাগানে ফল এসেছিল প্রচুর, নদীগুলোতে নয়নাভিরাম ঢেউ খেলত এবং ফল-ফসল ছিল মনোমুগ্ধকর। এগুলো নিয়ে বাগানের মালিক তার ঈমানদার দরিদ্র বন্ধুর মুকাবিলায় গর্ব প্রকাশ করে বলে

اَنَا اَکۡثَرُ مِنۡکَ مَالًا وَّ اَعَزُّ نَفَرًا

“ধন সম্পদে আমি তোমার চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং জনবলে তোমার চাইতে শক্তিশালী।”(১৯ মারইয়ামঃ ৭৮) অর্থাৎ বিশাল বাগানের মালিক। এ কথা দ্বারা সে বুঝিয়েছে যে, সে ঈমানদার অপেক্ষা উত্তম। তার উদ্দেশ্য হল, বন্ধু! তোমার যে ধন সম্পদ ছিল তা তুমি যে পথে ব্যয় করেছ তাতে তোমার কী লাভ হল? তোমার বরং উচিত ছিল তা-ই করা যা আমি করেছি। তাহলে তুমি আমার সমান হয়ে যেতে পারতে। এসব বলে সে ঈমানদার বন্ধুটির মুকাবিলায় অহংকার করতে থাকে।

وَ دَخَلَ جَنَّتَہٗ وَ ہُوَ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِہٖ

“এভাবে নিজের প্রতি জুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। অর্থাৎ অশোভন পন্থায় সে বাগানে প্রবেশ করে এবং বলেঃ

مَاۤ اَظُنُّ اَنۡ تَبِیۡدَ ہٰذِہٖۤ اَبَدًا

“আমি মনে করি না যে, এটি কখনও ধ্বংস হবে।”(কাসাসঃ ৭৮) প্রশস্ত বাগান, পর্যাপ্ত পানি এবং সুদৃশ্য লতাপাতা ও বৃক্ষরাজি দেখে তার এ ধারনা জন্মে। সে ভেবেছিল যে, এই বৃক্ষরাজির কোনটি নষ্ট হলে তার স্থলে তার চাইতে সুন্দর নতুন বৃক্ষ জন্ম নিবে এবং পর্যাপ্ত পানি বিদ্যমান থাকায় শস্য ও ফসলাদি সর্বদা উৎপাদিত হতে থাকবে।

এরপর সে বলল,

وَّ مَاۤ اَظُنُّ السَّاعَۃَ قَآئِمَۃً

“এবং আমি এও মনে করি না যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।(কাসাসঃ ৭৮) পার্থিব জীবনের ধ্বংসশীল বিলাস বৈভবের প্রতি সে আস্থাশীল হয়ে পড়ে। এবং চিরস্থায়ী আখিরাতকে সে অস্বীকার করে। তারপর সে বলল,

وَّ لَئِنۡ رُّدِدۡتُّ اِلٰی رَبِّیۡ لَاَجِدَنَّ خَیۡرًا مِّنۡہَا مُنۡقَلَبًا

“আমি যদি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই-ই তবে আমি তো নিশ্চয়ই এটি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব।” “অর্থাৎ আখিরাত ও পুনরুত্থান যদি একান্তই ঘটে তাহলে সেখানে আমি এখানকার চাইতে উৎকৃষ্ট স্থান পাব। এটি সে এ কারণে বলেছে যে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সে ধোঁকায় পড়েছে এবং সে বিশ্বাস করেছে যে, তার প্রতি আল্লাহর ভালবাসা ও আল্লাহর নিকট তার প্রাপ্য অংশ হিসেবে আল্লাহ তা'আলা তাকে এসব দিয়েছেন। আস ইবন ওয়াইল কাফিরও এরূপ বলেছিল।

اَفَرَءَیۡتَ الَّذِیۡ کَفَرَ بِاٰیٰتِنَا وَ قَالَ لَاُوۡتَیَنَّ مَالًا وَّ وَلَدًاْ اَطَّلَعَ الۡغَیۡبَ اَمِ اتَّخَذَ عِنۡدَ الرَّحۡمٰنِ عَہۡدًا

—তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে যে আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে আমাকে ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি দেয়া হবেই। সে কি অদৃশ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়েছে অথবা দয়াময়ের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি লাভ করে।”(৩৪ সাবাহঃ ৩৭) এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা ‘আশ ইবন ওয়াইল ও খাব্বাব ইবন আয়িত (রা)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নিয়ামত প্রাপ্তির পর কতক মানুষের পরিণাম কি হয় তার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَیَقُوۡلَنَّ ہٰذَا لِیۡ ۙ وَ مَاۤ اَظُنُّ السَّاعَۃَ قَآئِمَۃً ۙ وَّ لَئِنۡ رُّجِعۡتُ اِلٰی رَبِّیۡۤ اِنَّ لِیۡ عِنۡدَہٗ لَلۡحُسۡنٰی

“সে অবশ্যই বলে যে, এটি আমার প্রাপ্য এবং আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর যদি আমার প্রতিপালকের নিকট একান্তই প্রত্যাবর্তিত হই তাঁর নিকট তা আমার জন্যে কল্যাণই থাকবে।”(২৩ মুমিনুনঃ ৫৫) এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন।

فَلَنُنَبِّئَنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِمَا عَمِلُوۡا ۫ وَ لَنُذِیۡقَنَّہُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ غَلِیۡظٍ

“কাফিরদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবশ্যই অবগত করব এবং ওদেরকে আস্বাদন করাব কঠোর শাস্তি।”(৪১ হামিম সাজদাঃ ৫০)

কারূন বলেছিল,

اِنَّمَاۤ اُوۡتِیۡتُہٗ عَلٰی عِلۡمٍ عِنۡدِیۡ

“এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি।(২৮ কাসাস-৭৮) অর্থাৎ আল্লাহ জানেন যে, আমি ঐ ধন সম্পদ পাওয়ার হকদার। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

اَوَ لَمۡ یَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰہَ قَدۡ اَہۡلَکَ مِنۡ قَبۡلِہٖ مِنَ الۡقُرُوۡنِ مَنۡ ہُوَ اَشَدُّ مِنۡہُ قُوَّۃً وَّ اَکۡثَرُ جَمۡعًا ؕ وَ لَا یُسۡـَٔلُ عَنۡ ذُنُوۡبِہِمُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ

—সে কি জানত না আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন যারা তার অপেক্ষা শক্তিতে ছিল প্রবল, সংখ্যায় ছিল অধিক? অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না? (২৮ কাসাস-৭৮) ইতিপূর্বে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা বর্ণনাকালে আমরা কারূনের ঘটনা আলোচনা করেছি।

আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَ مَاۤ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ بِالَّتِیۡ تُقَرِّبُکُمۡ عِنۡدَنَا زُلۡفٰۤی اِلَّا مَنۡ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا ۫ فَاُولٰٓئِکَ لَہُمۡ جَزَآءُ الضِّعۡفِ بِمَا عَمِلُوۡا وَ ہُمۡ فِی الۡغُرُفٰتِ اٰمِنُوۡنَ

—তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন কিছু নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে দিবে। তবে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারাই তাদের কর্মের জন্যে পাবে বহুগুণ পুরস্কার। আর তারা প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে।” (৩৪ সাবাহঃ ৩৭)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ

اَیَحۡسَبُوۡنَ اَنَّمَا نُمِدُّہُمۡ بِہٖ مِنۡ مَّالٍ وَّ بَنِیۡنَْنُسَارِعُ لَہُمۡ فِی الۡخَیۡرٰتِ ؕ بَلۡ لَّا یَشۡعُرُوۡنَ

“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করেছি তার দ্বারা তাদের জন্য সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।”(২৩ মুমিনুনঃ ৫৫,৫৬)

আয়াতে উক্ত মূর্খ ব্যক্তিটি পার্থিব ধনৈশ্বর্য পেয়ে ধোকায় পতিত হয়। তাই সে অস্বীকার করে আখিরাতকে এবং সে যখন দাবি করে যে, আখিরাত যদি সংঘটিত হয়ই তবে সেখানে প্রভুর নিকট সে এখানকার তুলনায় উৎকৃষ্ট স্থান পাবে আর তার সাথী ঈমানদার ব্যক্তি যখন এসব কথা শুনল তখন ঈমানদার ব্যক্তিটি তাকে বলল, وهويهاوره , অর্থাৎ যুক্তি পেশ করলো

اَکَفَرۡتَ بِالَّذِیۡ خَلَقَکَ مِنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ سَوّٰىکَ رَجُلًا

তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে ও পরে শুক্র থেকে এবং তারপর পূর্ণাংগ করেছেন মানুষের আকৃতিতে? অর্থাৎ তুমি কি পুনরুত্থান অস্বীকার করছ অথচ তুমি জান যে, আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর শুক্র থেকে। তারপর পর্যায়ক্রমে তোমাকে আকৃতি দিয়েছেন। অবশেষে তুমি পরিণত হয়েছ শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন পরিপূর্ণ পুরুষে। ফলে তুমি জ্ঞান লাভ করতে পারছ, হাতে ধারণ করতে পারছ এবং হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারছ। তাহলে কি করে তুমি পুনরুত্থান অস্বীকার করছ? অথচ নতুন করে সৃষ্টি করতেও আল্লাহ তাআলা ক্ষমতাবান। لٰکِنَّا۠ ہُوَ اللّٰہُ رَبِّیۡ “কিন্তু আল্লাহই আমার প্রতিপালক” অর্থাৎ আমি কিন্তু বলি তোমার বলার বিপরীত এবং বিশ্বাস করি তোমার বিশ্বাসের বিপরীত যে,

ہُوَ اللّٰہُ رَبِّیۡ وَ لَاۤ اُشۡرِکُ بِرَبِّیۡۤ اَحَدًا

“আল্লাহই আমার প্রতিপালক এবং আমি কাউকে আমার প্রতিপালকের শরীক করিনা।” অর্থাৎ তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করি না। আমি বিশ্বাস করি যে, দেহগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তিনি সেগুলোকে পুনরুত্থান করবেন এবং মৃতদেরকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। চূর্ণ বিচুর্ণ হাতগুলোকে একত্রিত করবেন। আমি এও জানি যে, আল্লাহর সৃষ্টি জগতে এবং তাঁর রাজত্বে তার কোন শরীক নেই এবং তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।

এরপর ঈমানদার ব্যক্তিটি তার সাথীকে সে আচরণ শিখিয়ে দিচ্ছে বাগানে প্রবেশের সময় তার যা করা উচিত ছিল। এ সূত্রে সে বলল,

وَ لَوۡ لَاۤ اِذۡ دَخَلۡتَ جَنَّتَکَ قُلۡتَ مَا شَآءَ اللّٰہُ ۙ لَا قُوَّۃَ اِلَّا بِاللّٰہِ

“তুমি যখন তোমার উদ্যানে প্রবেশ করলে তখন কেন বললেন, আল্লাহ যা চান তাই হয় আল্লাহর সাহায্য-ব্যতীত কোন শক্তি নেই?”(১৮ কাহাফ- ৩৯) এ জন্যে কারো নিকট তার ধন-সম্পদ কিংবা পরিবার-পরিজন কিংবা ব্যক্তিগত কোন অবস্থা পছন্দসই ও আনন্দদায়ক মনে হলে তার জন্যে

مَا شَآءَ اللّٰہُ ۙ لَا قُوَّۃَ اِلَّا بِاللّٰہِ

বলা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি মরফু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য হাদীসটির বিশুদ্ধতা প্রশ্নাতীত নয়।

আবু ইয়ালা মুসিলী বর্ণনা করেন যে, হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ

ما أنعم الله على عبد نعمة من أهل أو مال أو ولد فيقول ماء شا الله لا قوة الا بالله فيرى فيه أنه دون الموت .

“আল্লাহ কোন বান্দাকে পরিবারে, ধন-সম্পদে কিংবা সন্তান-সন্তনিতে কোন নিয়ামত দান। করলে সে যদি

مَا شَآءَ اللّٰہُ ۙ لَا قُوَّۃَ اِلَّا بِاللّٰہ

বলে, তবে সে মৃত্যু ব্যতীত নিয়ামতের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করবে না। তিনি ঐ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি এ কথাটি বলেন। হাফিজ আবুল ফাতহ আবদী এই সনদ বিশুদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেছেন। এরপর ঈমানদার লোকটি তার কাফির সাথীকে বললঃ

فَعَسٰی رَبِّیۡۤ اَنۡ یُّؤۡتِیَنِ خَیۡرًا مِّنۡ جَنَّتِکَ

“আমি আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে তোমার উদ্যান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কিছু দিবেন।” অর্থাৎ আখিরাতে।

وَ یُرۡسِلَ عَلَیۡہَا حُسۡبَانًا مِّنَ السَّمَآءِ

“আর তোমার উদ্যানে আকাশ থেকে নির্ধারিত বিপর্যয় প্রেরণ করবেন।” হযরত ইবন আব্বাস (রা) যাহ্হাক ও কাতাদা (র) বলেন, অর্থাৎ আকাশ থেকে আযাব প্রেরণ করবেন। এখানে বুঝান হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রচণ্ড বৃষ্টি বর্ষণ করবেন যা সকল ক্ষেত ও বৃক্ষকে উৎপাটিত করে দিবে। “ফলে সেটি উদ্ভিদ শূন্য ময়দানে পরিণত হবে”।

فَتُصۡبِحَ صَعِیۡدًا زَلَقًا

“অথবা উহার পানি ভূগর্ভে অন্তর্হিত হবে।" এটি প্রবহমান প্রবনের বিপরীত

اَوۡ یُصۡبِحَ مَآؤُہَا غَوۡرًا

“অতঃপর তুমি কখনও সেটির সন্ধান লাভে সক্ষম হবে না।” অর্থাৎ ঐ পানি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে না।

আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

وَ اُحِیۡطَ بِثَمَرِہٖ

“তার সকল সম্পদ বিপর্যয়ে বেষ্টিত হয়ে গেল।” অর্থাৎ এমন এক বিপর্যয় নেমে এল যে, যা তার সকল ফল ফসল পরিবেষ্টন করে ফেলল এবং তার উদ্যান ধ্বংস ও বিনষ্ট করে দিল।

فَاَصۡبَحَ یُقَلِّبُ کَفَّیۡہِ عَلٰی مَاۤ اَنۡفَقَ فِیۡہَا وَ ہِیَ خَاوِیَۃٌ عَلٰی عُرُوۡشِہَا

“এবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিল তার জন্য আক্ষেপ করতে লাগল, যখন সেটি মাচানসহ ভূমিস্যাৎ হয়ে গেল।” অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল, যার পুনঃ আবাদের কোন অবকাশই থাকল না। এটি হল তার প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত। যখন সে বলেছিল,

قَالَ مَاۤ اَظُنُّ اَنۡ تَبِیۡدَ ہٰذِہٖۤ اَبَدًا

“আমি মনে করি না যে, এটি কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে।” অবশেষে সে মহান আল্লাহর সম্পর্কে তার ইতিপূর্বেকার কুফরী মন্তব্যের জন্য অনুতপ্ত হল এবং বলতে লাগল,

یٰلَیۡتَنِیۡ لَمۡ اُشۡرِکۡ بِرَبِّیۡۤ اَحَدًا

“হায়! আমি যদি কাউকেও আমার প্রতিপালকের শরীক না করতাম!”

আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

وَ لَمۡ تَکُنۡ لَّہٗ فِئَۃٌ یَّنۡصُرُوۡنَہٗ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَ مَا کَانَ مُنۡتَصِرًاْہُنَالِکَ

“এবং আল্লাহ ব্যতীত তাকে সাহায্য করার কেউ ছিল না। এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ হল না সেখানে” অর্থাৎ যে দোষ সে করেছে তার ক্ষতিপূরণ করে দেয়ার মত কেউ ছিল না আর তার নিজেরও তা করার ক্ষমতা ছিল না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা বলেন,

فَمَا لَہٗ مِنۡ قُوَّۃٍ وَّ لَا نَاصِرٍ

‘কোন শক্তিও নেই, সাহায্যকারীও নেই।”

আল্লাহ তা'আলা বলেন,

الۡوَلَایَۃُ لِلّٰہِ الۡحَقِّ

“সাহায্য করার অধিকার একমাত্র আল্লাহরই।” কতক তাফসীরকার

ہُنَالِکَ الۡوَلَایَۃُ لِلّٰہِ الۡحَقِّ

থেকে নতুন বাক্য শুরু করেন। এরূপ পাঠ করাও উত্তম বটে যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন,

اَلۡمُلۡکُ یَوۡمَئِذِۣ الۡحَقُّ لِلرَّحۡمٰنِ ؕ وَ کَانَ یَوۡمًا عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ عَسِیۡرًا

“সেদিন প্রকৃত কর্তৃত্ব হবে দয়াময়ের এবং কাফিরদের জন্য সেদিন হবে কঠিন।” তখন কোন অবস্থাতেই তার নির্দেশ রদ করা যাবে না, বাধা দেয়া যাবে না। এবং কেউ তা লংঘন করতে পারবে না আর সর্বাবস্থায়ই যথার্থ কর্তৃত্ব আল্লাহরই। অবশ্য কতক তাফসীরকার الحق শব্দকে الولاية শব্দের বিশেষণরূপে পেশ যুক্তভাবে পাঠ করেছেন। এ দুটো পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আল্লাহ তা'আলার বাণীঃ

ہُوَ خَیۡرٌ ثَوَابًا وَّ خَیۡرٌ عُقۡبًا

“পুরস্কার দানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই শ্রেষ্ঠ।”(১৮ কাহফঃ ৪৪) অর্থাৎ ছওয়াব তথা প্রতিদানের দিক থেকে এবং পরিণাম তথা দুনিয়া ও আখিরাতে শেষ ফল রূপে তাঁর আচরণ উদ্যান মালিকের জন্যে উত্তম ও কল্যাণকর। এ ঘটনার অন্তর্নিহিত শিক্ষা এই যে, দুনিয়ার জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং এর ধোকায় পড়া এবং এর প্রতি ভরসা করা কারো জন্যে উচিত নয়। বরং সর্বাবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল ও ভরসা রাখাকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য রূপে নির্ধারণ করবে। নিজের হাতে যা আছে তার প্রতি নয় বরং আল্লাহর নিকট যা আছে তার প্রতিই অধিকতর আস্থাশীল থাকা উচিত। উক্ত ঘটনায় এ শিক্ষাও রয়েছে যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য ও তার পথে ব্যয় করার বিপরীতে অন্য কিছুকে অগ্রাধিকার দিলে তার জন্যে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কখনো কখনো তার আশা আকাঙ্খার বিপরীতে তার ওই ধন-সম্পদ উঠিয়ে নেয়া হবে।

আলোচ্য ঘটনায় এ শিক্ষাও রয়েছে যে, সহানুভূতিশীল ও কল্যাণকামী ভাইয়ের উপদেশ মেনে চলা কর্তব্য। তার বিরোধিতা ঐ নসীহত প্রত্যাখ্যানকারীর জন্যে দুঃখ ও ধ্বংস ডেকে আনে। এতে এ ইঙ্গিতও রয়েছে যে, নির্ধারিত শেষ সময় যখন এসে যাবে এবং নির্দেশ যখন কার্যকর হয়ে যাবে তখন অনুতপ্ত হলেও কোন লাভ হবে না। আল্লাহই সাহায্যকারী তার উপরই ভরসা।

৩৯
উদ্যান মালিকদের ঘটনা
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّا بَلَوْنَاهُمْ كَمَا بَلَوْنَا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ إِذْ أَقْسَمُوا لَيَصْرِمُنَّهَا مُصْبِحِينَ (۝) وَلَا يَسْتَثْنُونَ (۝) فَطَافَ عَلَيْهَا طَائِفٌ مِنْ رَبِّكَ وَهُمْ نَائِمُونَ (۝) فَأَصْبَحَتْ كَالصَّرِيمِ (۝) فَتَنَادَوْا مُصْبِحِينَ (۝) أَنِ اغْدُوا عَلَى حَرْثِكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَارِمِينَ (۝) فَانْطَلَقُوا وَهُمْ يَتَخَافَتُونَ (۝) أَنْ لَا يَدْخُلَنَّهَا الْيَوْمَ عَلَيْكُمْ مِسْكِينٌ (۝) وَغَدَوْا عَلَى حَرْدٍ قَادِرِينَ (۝) فَلَمَّا رَأَوْهَا قَالُوا إِنَّا لَضَالُّونَ (۝) بَلْ نَحْنُ مَحْرُومُونَ (۝) قَالَ أَوْسَطُهُمْ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُونَ (۝) قَالُوا سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِينَ (۝) فَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَلَاوَمُونَ (۝) قَالُوا يَا وَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا طَاغِينَ (۝) عَسَى رَبُّنَا أَنْ يُبْدِلَنَا خَيْرًا مِنْهَا إِنَّا إِلَى رَبِّنَا رَاغِبُونَ (۝) كَذَلِكَ الْعَذَابُ وَلَعَذَابُ الْآَخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ۝

“আমি ওদেরকে পরীক্ষা করেছি যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান মালিকদেরকে। যখন তারা শপথ করেছিল যে, ওরা প্রত্যুষে আহরণ করবে বাগানের ফল, এবং তারা ইনশাআল্লাহ বলেনি। অতঃপর আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে এক বিপর্যয় হানা দিল সেই উদ্যানে, যখন তারা ছিল নিদ্রিত। ফলে সেটি দগ্ধ হয়ে কাল বর্ণ ধারণ করল। প্রত্যুষে ওরা একে অপরকে ডেকে বলল, তোমরা যদি ফল আহরণ করতে চাও তবে সকাল সকাল বাগানে চল। অতঃপর ওরা চলল নিম্নস্বরে কথা বলতে বলতে। অদ্য যেন তোমাদের নিকট কোন অভাবগ্রস্ত এতে প্রবেশ করতে না পারে। তারপর ওরা নিবৃত্ত করতে সক্ষম এ বিশ্বাস নিয়ে প্রভাতক বাগানে যাত্রা করল। ওরা যখন বাগানের অবস্থা প্রত্যক্ষ করল। তখন বলল, আমরা তো দিশা হারিয়ে ফেলেছি। বরং আমরা তো বঞ্চিত। ওদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলল, আমি কি তোমাদের বলিনি, এখনও তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছ না কেন? তখন ওরা বলল, আমরা আমাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি, আমরা তো সীমালংঘনকারী ছিলাম। তারপর ওরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতে লাগল। ওরা বলল, হায়! দুর্ভোগ আমাদের। আমরা তো ছিলাম সীমালংঘনকারী। সম্ভবত আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে দিবেন উৎকৃষ্টতর বিনিময়। আমরা আমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হলাম। শাস্তি এরূপই হয়ে থাকে এবং আখিরাতের শাস্তি কঠিনতর। যদি তারা জানত।”( ৬৮ কালামঃ ১৭-৩৩) এটি একটি উপমা। কুরায়শ বংশীয় কাফিরদের জন্যে আল্লাহ তাআলা এ উপমাটি বর্ণনা করেছেন। কারণ আল্লাহ তাআলা সম্মানিত রাসূল প্রেরণ করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে তারা রাসূলকে প্রত্যাখ্যান ও তাঁর বিরোধিতা করেছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَةَ اللَّهِ كُفْرًا وَأَحَلُّوا قَوْمَهُمْ دَارَ الْبَوَارِ (۝) جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا وَبِئْسَ الْقَرَارُ

“তুমি কি ওদের লক্ষ্য করো না যারা আল্লাহর অনুগ্রহের বদলে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং ওরা ওদের সম্প্রদায়কে নামিয়ে আনে ধ্বংসের ক্ষেত্রে। জাহান্নামে যার মধ্যে ওরা প্রবেশ করবে, কত নিকৃষ্ট এই আবাসস্থল!” (১৪ ইবরাহীম ২৮-২৯)

হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এখানে কুরায়শ বংশীয় কাফিরদেরকে বুঝানো হয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা একটি উদ্যানের মালিকের সাথে তুলনা করেছেন। এমন একটি উদ্যান যার মধ্যে রয়েছে নানা জাত ও নানা রঙের ফলমূল ও শস্য। সেগুলো পরিপক্ক ও কর্তন যোগ্য হয়ে উঠেছিল।

এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলার বর্ণনা,

اِذْاَقْسَمُوْا

“যখন তারা শপথ করেছিল” নিজেদের মধ্যে

لَیَصۡرِمُنَّہَا مُصۡبِحِیۡنَ ,

“তারা আহরন করবে বাগানের ফল” অর্থাৎ ফল কেটে ঘরে তুলবে তথা শস্য সংগ্রহ করবে,

مُصۡبِحِیۡنَ

“অর্থাৎ ভোর বেলায় যাতে কোন ফকীর কিংবা অভাবী লোক তাদেরকে দেখতে না পায়, এবং ওদেরকে কিছু দিতে না হয়। তারা এ বিষয়ে শপথ করেছে বটে কিন্তু তাতে ইনশাআল্লাহ বলেনি। ফলে আল্লাহ তাদেরকে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ করে দিলেন। তাদের বাগানে প্রেরণ করলেন আপদ ও দুর্যোগ। ঐ দুর্যোগে উদ্যানটি বিরান হয়ে যায়। ঐ আপদটি ছিল জ্বলন্ত আগুন। এটি বাগানকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। ফলে কাজে আসার মত কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা বলেন

فَطَافَ عَلَیۡہَا طَآئِفٌ مِّنۡ رَّبِّکَ وَ ہُمۡ نَآئِمُوۡنَ

“ফলে সেটি পুড়ে গিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করল” অর্থাৎ অন্ধকার রাত্রির মত কাল হয়ে গেল। এটি হল তাদের আশা আকাঙ্খার বিপরীত।

فَتَنَادَوۡا مُصۡبِحِیۡنَ

প্রত্যুষে তারা একে অপরকে ডেকে বলল” অর্থাৎ তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠল এবং একে অপরকে ডেকে বলল

اَنِ اغۡدُوۡا عَلٰی حَرۡثِکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰرِمِیۡنَ

“তোমরা যদি ফল আহরণ করতে না চাও তবে সকাল সকাল বাগানে চল” এবং বেলা বাড়ার এবং ফকীরের সংখ্যা বৃদ্ধির পূর্বেই ফল সংগ্রহের কাজ শেষ কর।

فَانۡطَلَقُوۡا وَ ہُمۡ یَتَخَافَتُوۡنَ

“তারপর অর্থাৎ তারা চুপি চুপি এ কথা বলতে বলতে যাত্রা করল”

لَّا یَدۡخُلَنَّہَا الۡیَوۡمَ عَلَیۡکُمۡ مِّسۡکِیۡنٌ

অর্থাৎ তারা সবাই এ বিষয়ে পরামর্শ করে যে ফকীররা যেন কোনমতেই ঢুকতে না পারে। একমত হল।

وَّ غَدَوۡا عَلٰی حَرۡدٍ قٰدِرِیۡنَ

অতঃপর তারা নিবৃত্ত করতে সক্ষম এ বিশ্বাস নিয়ে প্রভাতকালে বাগানে যাত্রা করল অর্থাৎ তারা এই অসৎ মতলব মনে মনে এঁটে তা বাস্তবায়নে সক্ষম মনে করে যাত্রা করল। তাফসীরকার ইকরামা ও শাবী (র) বলেন, আয়াতের অর্থ হল, ফকীর-মিসকীনদের প্রতি ক্রুদ্ধ মনোভাব নিয়ে তারা রওয়ানা করল। তাফসীরকার সুদ্দী (র) বলেছেন যে, ওদের বাগানের নাম ছিল হারদ ( حرد )। তবে তার এ বক্তব্য কষ্টকল্পিত ও বাস্তবতা বর্জিত। فَلَمَّا رَاَوۡہَا অর্থাৎ বাগানে গিয়ে পৌঁছল, বাগানের অবস্থা প্রত্যক্ষ করল এবং নিজেদের মন্দ নিয়াতের প্রেক্ষিতে সুদৃশ্য, সবুজ শ্যামল ও মনোরম বাগান যে দুঃখজনক পরিণতি লাভ করেছে তা দেখল তখন, قَالُوۡۤا اِنَّا لَضَآلُّوۡنَ তারা বলল, আমরা তো দিশা হারিয়ে ফেলেছি আমরা আমাদের বাগানে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছি এবং অন্য পথে চলে এসেছি।

তারপর তারা বলল,

, بَلۡ نَحۡنُ مَحۡرُوۡمُوۡنَ

“বরং আমরা তো বঞ্চিত” অর্থাৎ আমাদের অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য আমরা শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছি এবং ফসলের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়েছি। قَالَ اَوۡسَطُہُمۡ “ওদের মধ্যম ব্যক্তি বলল” হযরত ইবন আব্বাস (রা) মুজাহিদ ও অন্যান্য তাফসীরকারের মতে এর অর্থ তাদের সর্বাধিক ন্যায়পরায়ণ ও শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি, বলল, اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ لَوۡ لَا تُسَبِّحُوۡنَ “আমি কি তোমাদেরকে বলিনি? এখনও তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছ না কেন?” কতক তাফসীরকার বলেন, এর অর্থ তোমরা ইনশাআল্লাহ বলছ না কেন? মুজাহিদ (র) সুদ্দী (র) ও ইবন জারীর (র)-এর মতে। অন্য কতক তাফসীরকার বলেন, তোমরা ইতিপূর্বে যে মন্দ কথা বলেছ তার পরিবর্তে এখন ভাল কথা বলছ কেন?

قَالُوۡا سُبۡحٰنَ رَبِّنَاۤ اِنَّا کُنَّا ظٰلِمِیۡنَ۝ فَاَقۡبَلَ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ یَّتَلَاوَمُوۡنَ۝قَالُوۡا یٰوَیۡلَنَاۤ اِنَّا کُنَّا طٰغِیۡنَ

“তখন ওরা বলল, আমরা আমাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি। আমরা তো সীমালংঘনকারী ছিলাম। তারপর ওরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতে লাগল। ওরা বলল, হায়! দুর্ভোগ আমাদের, আমরা তো ছিলাম সীমালংঘনকারী।” তারা তাদের কৃতকর্মের জন্যে এমন সময় লজ্জিত হল ও অনুতপ্ত হল যখন অনুতপ্ত হওয়ায় তাদের কোন লাভ হলো না। শাস্তি ভোগের পর তারা দোষ স্বীকার করল। তখন দোষ স্বীকারে কোন কাজ হয় না।

কথিত আছে যে, ওরা পরস্পরে ভাই ছিল। পিতার মৃত্যুর পর তারা এ বাগানের মালিকানা লাভ করে। তাদের পিতা এ বাগান থেকে প্রচুর ফলমূল সাদকা করতেন। তারা এটির মালিক হওয়ার পর পিতার কাজকে তারা বোকামী মনে করল এবং দরিদ্রদেরকে না দিয়ে সম্পূর্ণ ফল নিজেরাই ঘরে তোলার ইচ্ছা করেছিল। ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ঐ কঠিন শাস্তি প্রদান করলেন। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা ফলের সাদকা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ফল কাটার দিবসে সাদকা প্রদানে উৎসাহিত করেছেন।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

کُلُوۡا مِنۡ ثَمَرِہٖۤ اِذَاۤ اَثۡمَرَ وَ اٰتُوۡا حَقَّہٗ یَوۡمَ حَصَادِہٖ

“যখন সেটি ফলবান হয় তখন সেটির ফল আহরণ করবে এবং ফসল তোলার দিনে সেটির হক আদায় করবে।”(৬ আনআম ১৪১) কতক তাফসীরকার বলেন, এই উদ্যানের মালিকগণ ইয়ামানের যারওয়ান নামক জনপদের অধিবাসী ছিল। অন্য কতক তাফসীরকারের মতে, তারা ছিল আবিসিনিয়ার অধিবাসী। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। আল্লাহ তাআলা বলেন।

کَذٰلِکَ الۡعَذَابُ

“শাস্তি এরূপই হয়ে থাকে” অর্থাৎ যে আমার নির্দেশের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং সৃষ্টি জগতের অভাবীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন না করে তাকে আমি এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।

وَ لَعَذَابُ الۡاٰخِرَۃِ

“এবং আখিরাতের শাস্তি কঠিনতর” অর্থাৎ দুনিয়ার আযাব অপেক্ষা অধিক ভয়াবহ ও স্থায়ী।

لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ

“যদি তারা জানত।”

আলোচ্য উদ্যান মালিকদের ঘটনা আল্লাহ তাআলার বাণী আয়াতদ্বয়ে বর্ণিত ঘটনার অনুরূপ। আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতদ্বয়ে বলেছেনঃ

وَ ضَرَبَ اللّٰہُ مَثَلًا قَرۡیَۃً کَانَتۡ اٰمِنَۃً مُّطۡمَئِنَّۃً یَّاۡتِیۡہَا رِزۡقُہَا رَغَدًا مِّنۡ کُلِّ مَکَانٍ فَکَفَرَتۡ بِاَنۡعُمِ اللّٰہِ فَاَذَاقَہَا اللّٰہُ لِبَاسَ الۡجُوۡعِ وَ الۡخَوۡفِ بِمَا کَانُوۡا یَصۡنَعُوۡنَ ۝وَ لَقَدۡ جَآءَہُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡہُمۡ فَکَذَّبُوۡہُ فَاَخَذَہُمُ الۡعَذَابُ وَ ہُمۡ ظٰلِمُوۡنَ

“আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, যেখানে আসত সব দিক থেকে প্রচুর জীবনোপকরণঃ তারপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল। ফলে তারা যা করত তার জন্যে আল্লাহ তাদেরকে আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদনের। তাদের নিকট তো এসেছিল এক রাসূল, তাদেরই মধ্য হতে, কিন্তু তারা তাকে অস্বীকার করেছিল, ফলে সীমা লংঘন করা অবস্থায় শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করল।”(১৬ নাহল ১১২-১১৩)

কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, এটি একটি উপমা। মক্কাবাসীদের নিকট এই উপমাটি পেশ করা হয়েছে। অপর কতক তাফসীরকার বলেন,আলোচ্য দৃষ্টান্ত দ্বারা মক্কাবাসীদেরকেই বুঝানো হয়েছে। তাদেরকে এবং তাদের কাজ কর্মকেই তাদের নিকট দৃষ্টান্ত রূপে পেশ করা হয়েছে। এ উভয় মতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। আল্লাহই সঠিক জানেন।

৪০
সাবত(১) বিষয়ক সীমা লংঘনকারী আয়লা অধিবাসীদের ঘটনা
[১] সাবত শব্দের অর্থ শনিবার। ঐটি ইয়াহুদীদের সাপ্তাহিক ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।

সূরা আরাফে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَلِكَ نَبْلُوهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (۝) وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ (۝) فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ (۝) فَلَمَّا عَتَوْا عَنْ مَا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ

“তাদেরকে সমুদ্র তীরবর্তী জনপদবাসীদের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস কর, তারা শনিবারে সীমালংঘন করত। শনিবার উদযাপনের দিন মাছ পানিতে ভেসে তাদের নিকট আসত। কিন্তু যেদিন তারা শনিবার উদযাপন করত না। সেদিন মাছগুলো তাদের নিকট আসত না। এভাবে তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম, যেহেতু তারা সত্য ত্যাগ করত।

স্মরণ কর, তাদের একদল বলেছিল, আল্লাহ যাদেরকে ধ্বংস করবেনঃ কিংবা কঠোর শাস্তি দিবেন, তোমরা তাদেরকে সদুপদেশ দাও কেন? তারা বলেছিল, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দায়িত্ব মুক্তির জন্য এবং যাতে তারা সাবধান হয় এ জন্যে। যে উপদেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল তারা যখন সেটি বিস্মৃত হয় তখন যারা অসৎ কার্য থেকে নিবৃত্ত করত তাদেরকে আমি উদ্ধার করি এবং যারা জুলুম করে তারা কুফরী করত বলে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেই। তারা যখন নিষিদ্ধ কার্য ঔদ্ধত্য সহকারে করতে লাগল তখন তাদেরকে বললাম, ঘৃণিত বানর হও। (৭ আরাফ ১৬৩-১৬৬)

সূরা বাকারাতে আল্লাহ বলেনঃ

وَ لَقَدۡ عَلِمۡتُمُ الَّذِیۡنَ اعۡتَدَوۡا مِنۡکُمۡ فِی السَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَہُمۡ کُوۡنُوۡا قِرَدَۃً خٰسِئِیۡنَ۝فَجَعَلۡنٰہَا نَکَالًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡہَا وَ مَا خَلۡفَہَا وَ مَوۡعِظَۃً لِّلۡمُتَّقِیۡنَ

“তোমাদের মধ্যে যারা শনিবার সম্পর্কে সীমালংঘন করেছিল তাদেরকে তোমরা নিশ্চিতভাবে জান। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, তোমরা ঘৃণিত বানর হও। আমি এটি তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীগণের শিক্ষা গ্রহণের জন্য দৃষ্টান্ত ও মুত্তাকীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ করেছি।”(২ বাকারা ৬৫,৬৬)।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

اَوۡ نَلۡعَنَہُمۡ کَمَا لَعَنَّاۤ اَصۡحٰبَ السَّبۡتِ ؕ وَ کَانَ اَمۡرُ اللّٰہِ مَفۡعُوۡلًا

“অথবা সাবতওয়ালাদেরকে সেরূপ লানত করেছিলাম যেরূপ তাদেরকে লানত করার পূর্বে। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হয়েই থাকে।” নিসা-৪৭

ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, ইকরীমা, কাতাদা, সুদ্দী (র) ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেছেন, এরা ছিল আয়লা বা ঈলা (Elath) অধিবাসী। ইবন আব্বাস (রা) এও বলেছেন যে, স্থানটি মাদয়ান ও তুর এর মধ্যস্থলে অবস্থিত। তাফসীরকারগণ বলেন, সে যুগে তাওরাতের শিক্ষা অনুযায়ী তারা শনিবারে পার্থিব কাজকর্ম হারাম জ্ঞান করত, ফলে মাছ এ দিবসে তাদের পক্ষ থেকে নিরাপদ ও স্বস্তিতে থাকত। কারণ ঐ দিন মাছ শিকার করা তাদের জন্যে হারাম ছিল। সকল প্রকারের কাজ-কর্ম ব্যবসা-বাণিজ্য ও আয়-উপার্জন সেদিনের জন্যে হারাম ছিল। শনিবারে প্রচুর মাছ তাদের সমুদ্র তীরবর্তী আবাসিক এলাকার কাছাকাছি চলে আসত এবং নির্ভয়ে-নিরাপদে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করত। তারা ওগুলো ধরতও না ওগুলোকে ভীতি প্রদর্শনও করতো না।

یَوۡمَ لَا یَسۡبِتُوۡنَ ۙ لَا تَاۡتِیۡہِمۡ

“যেদিন তারা শনিবার উদযাপন করত না সেদিন তাদের নিকট মাছও আসত না” এ জন্যে যে, শনিবার ব্যতীত অন্যান্য দিনে তারা মাছ শিকার করত। আল্লাহ তাআলা বলেন,

کَذٰلِکَ ۚۛ نَبۡلُوۡہُمۡ

“এভাবে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম।” অর্থাৎ শনিবারে প্রচুর মাছের আনাগোনার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাদেরকে যাচাই করেছিলাম

بِمَا کَانُوۡا یَفۡسُقُوۡنَ

“যেহেতু তারা সত্য ত্যাগ করত।” অর্থাৎ তাদের ইতিপূর্বেকার সত্যত্যাগের কারণে। তারা শনিবারে প্রচুর মাছের সমাহার দেখে শনিবারেই তারা মাছ শিকারের ফন্দি খোঁজে। তারা রশি, জাল ও বড়শী তৈরি করে এবং খালও খনন করে রাখে। ঐ খাল হয়ে পানি যেন তাদের তৈরি শিকার ক্ষেত্রে পৌঁছে। পানির সাথে মাছ তাদের প্রস্তুতকৃত শিকার ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছলে যেন বের হতে না পারে।

পরিকল্পনা মুতাবিক তারা সব কিছু তৈরি করে নেয়। শুক্রবারে তারা যন্ত্রপাতি ও সকল কৌশল কার্যকর করত। শনিবারে নির্ভয়ে মাছগুলো যখন উপস্থিত হত তখন শিকার ক্ষেত্রের মুখ বন্ধ করে দেয়া হত। শনিবার চলে গেলে তারা মাছগুলো ধরে আনত।

আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাদেরকে লানত দিলেন। কারণ তারা আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে এমন কৌশল অবলম্বন করেছিল বাহ্যিকভাবে তা কৌশলই মনে হবে কিন্তু মূলত সেটি ছিল আল্লাহর নির্দেশের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ। তাদের একদল এ সকল কাজ করার পর যারা তা করেনি তারা দু'দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ওদের এ অপকর্ম এবং আল্লাহর নির্দেশের ও তার শরীয়তের বিরোধিতা করাকে প্রত্যাখ্যান করে। অপর দল নিজেরা ঐ অপকর্মে লিপ্ত হয়নি, আবার অপকর্মে লিপ্তদেরকে বাধাও দেয়নি। বরং যারা বাধা দিয়েছিল তারা তাদেরকে তিরস্কার করেছিল। এবং বলেছিলঃ

لِمَ تَعِظُوۡنَ قَوۡمَۨا ۙ اللّٰہُ مُہۡلِکُہُمۡ اَوۡ مُعَذِّبُہُمۡ عَذَابًا شَدِیۡدًا

“আল্লাহ যাদেরকে ধ্বংস করবেন কিংবা কঠোর শাস্তি দিবেন তোমরা তাদেরকে সদুপদেশ দাও কেন?” অর্থাৎ তাদেরকে বাধা দানে লাভ কি? তারা নিশ্চিতভাবে শাস্তি ভোগের উপযুক্ত হয়েছে। বাধাদানকারী দল উত্তর দিল যে,

قَالُوۡا مَعۡذِرَۃً اِلٰی رَبِّکُمۡ

“তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দায়িত্ব মুক্তির জন্যে।” অর্থাৎ আমাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধাদানের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আল্লাহর শাস্তির ভয়ে আমরা সে দায়িত্বই পালন করছি।

وَ لَعَلَّہُمۡ یَتَّقُوۡنَ

“এবং যাতে তারা সাবধান হয় অর্থাৎ এমনও হতে পারে যে, তারা তাদের অপকর্ম থেকে বিরত হবে। তারা যদি আমাদের উপদেশ গ্রহণ করে এবং অপকর্ম থেকে ফিরে আসে। তবে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং তাঁর আযাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করবেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন।

فَلَمَّا نَسُوۡا مَا ذُکِّرُوۡا بِہٖۤ

“যে উপদেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হয়।” অর্থাৎ যারা এ গর্হিত অপকর্ম থেকে বারণ করেছিল তাদের প্রতি কর্ণপাত করেনি।

اَنۡجَیۡنَا الَّذِیۡنَ یَنۡہَوۡنَ عَنِ السُّوۡٓءِ

“তখন যারা অসৎকর্ম থেকে নিবৃত্ত করত আমি তাদেরকে উদ্ধার করি।” এরা হল সৎ কাজে আদেশ দানকারী ও অসৎকাজে নিবৃত্তকারী দল।

اَخَذۡنَا الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا بِعَذَابٍۭ بَئِیۡسٍۭ

এবং যারা জুলুম করে অর্থাৎ দুষ্কর্ম করেছে আমি তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিই।” অর্থাৎ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

بِمَا کَانُوۡا یَفۡسُقُوۡنَ

“তারা সীমালঙ্ঘন করত বলে তারপর আল্লাহ তাআলা তাদের উপর আপতিত শাস্তির বিবরণ দিচ্ছেন এই বলে

فَلَمَّا عَتَوۡا عَنۡ مَّا نُہُوۡا عَنۡہُ قُلۡنَا لَہُمۡ کُوۡنُوۡا قِرَدَۃً خٰسِئِیۡنَ

যখন তারা নিষিদ্ধ কার্য ঔদ্ধত্য সহকারে করতে লাগল তখন তাদেরকে বললাম, ঘৃণিত বানর হয়ে যাও” এ সম্পর্কে আরও যে সকল আয়াত এসেছে একটু পরেই আমরা সেগুলো উল্লেখ করব।

মোদ্দাকথা, আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিলেন যে, যারা জালিম ছিল তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন আর তাদের অপকর্ম প্রত্যাখ্যানকারী ঈমানদারদেরকে তিনি রক্ষা করেছেন। কিন্তু নিরবতা অবলম্বনকারী ঈমানদারগণের ব্যাপারে কিছু বলেননি। ফলে নীরবতা অবলম্বনকারী ঈমানদারগণের পরিণতি সম্পর্কে আলিমগণের দু'টি মত রয়েছে, একদল বলেন, এরা উদ্ধার প্রাপ্তদের সাথে উদ্ধার লাভ করেছেন, আর অপর দল বলেন, তারা ধ্বংস প্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়েছে। মুহাক্কিক আলিমগণের মতে প্রথম অভিমতটিই সঠিক। শ্রেষ্ঠ তাফসীরকার হযরত ইবন আব্বাস (রা) শেষ পর্যন্ত এ অভিমতটিই গ্রহণ করেছেন। তাঁর আযাদকৃত দাস ইকরামার সাথে যুক্তি তর্কের প্রেক্ষিতে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। এজন্যে ইকরামা (রা)-কে তিনি এক জোড়া উচ্চ মূল্যের পোশাক দানে সম্মানিত করেন। আমার মতে, নীরবতা অবলম্বনকারী দলকে নাজাত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করা হয়নি এ জন্যে যে, তারা অন্তরে ওদের অশ্লীলতাকে অপছন্দ করেছিল বটে, কিন্তু তাদের উচিত ছিল বাহ্যিক দিকটাকেও অন্তরের দিকের ন্যায় মৌখিকভাবে প্রত্যাখ্যানের স্তরে উন্নীত করা। এটি অবশ্য মধ্যম স্তরের অবস্থান। সর্বোচ্চ স্তর হল অন্যায় কাজকে সরাসরি শক্তি প্রয়োগে বাধা দান, এর পরের স্তর হল মুখে প্রতিবাদ করা এবং তৃতীয় স্তর হল অন্তরে ঘৃণা করা।

আলোচ্য নীরবতা অবলম্বনকারী লোকদের কথা যখন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি তখন নিশ্চয়ই তারা নাজাতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তারা অশ্লীল কাজে অংশ গ্রহণ করেনি বরং অশ্লীলতাকে ঘৃণা করেছিল।

আবদুর রাজ্জাক আতা খুরাসানী (র) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, যারা উল্লেখিত অপকর্ম ও পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল শহরের অন্য অধিবাসীরা তাদেরকে সমাজচ্যুত করেছিল এবং কেউ কেউ তাদেরকে ঐ অপকর্মে বাধাও দিয়েছিল। কিন্তু তারা ঐ উপদেশ গ্রহণ করেনি।

বাধা দানকারীরা একটি পৃথক স্থানে রাত্রি যাপন করত এবং অপরাধী ও নির্দোষদের মাঝে অন্তরায় স্বরূপ স্থাপিত দরজাগুলো রাতে বন্ধ করে রাখত। কারণ, তারা অপকর্মকারীদের ধ্বংসের অপেক্ষায় ছিলেন। একদিন ভোরবেলা দেখা গেল ওদের দিককার দরজা বন্ধ। ওরা দরজা খোলেনি। অনেক বেলা হয়ে গেল। শহরের অধিবাসিগণ একজন লোককে ওদের সিঁড়িতে ওঠে ওপর থেকে তাদের অবস্থা জেনে নিতে নির্দেশ দিল। উপরে উঠে সে দেখতে পেল যে, ওরা সবাই লেজ বিশিষ্ট বানরে পরিণত হয়ে রয়েছে। তারা লাফালাফি ও দৌড়াদৌড়ি করছিল। শেষে ওদের দরজা খোলা হল। বানরেরা তাদের আত্মীয় স্বজন ও ঘনিষ্ঠ লোকদেরকে চিনতে পেরেছিল কিন্তু আত্মীয় স্বজনেরা ওদেরকে চিনতে পারেনি। ওরা অসহায়ভাবে আত্মীয় স্বজনের নিকট আশ্রয় চাচ্ছিল ও কাকুতি-মিনতি করছিল। অপকর্মে বাধা দানকারী লোকেরা ভৎসনার স্বরে বলছিল, আমরা কি তোমাদের অপকর্মে নিষেধ করিনি? মাথা নেড়ে বানররা সায় দিচ্ছিল যে, হ্যাঁ, নিষেধ করেছিলে।

এতটুকু বলে হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন, আমরা তো এখন বহু অন্যায় ও গর্হিত কাজ দেখছি কিন্তু তা প্রতিরোধও করছি না এবং ঐ বিষয়ে কোন কথাও বলছি না। আওফী (র) হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ঐ জনপদের যুবকরা বানরে পরিণত হয়েছিল, আর বৃদ্ধরা পরিণত হয়েছিল শূকরে।

ইবন আবী হাতিম ....ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, তারা অল্প সময় জীবিত থেকেই মরে গিয়েছিল। ওদের আর কোন বংশধর হয়নি।

যাহহাক (র) হযরত ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, বানরে রূপান্তরিত মানুষগুলো তিনদিনের বেশি জীবিত থাকেনি। এদের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের কোন সুযোগ হয়নি। ওদের কোন বংশধরও হয়নি। সূরা বাকারা ও সূরা আরাফের তাফসীরে আমরা এ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

ইবন আবি হাতিম ও ইবন জারীর.... মুজাহিদ (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন মূলত ঐ লোকগুলোর অন্তঃকরণ সমূহ বিকৃত করে দেয়া হয়েছিল। দৈহিকভাবে বানর ও শূকরে তারা পরিণত হয়নি। বরং এটি একটি রূপক উদাহরণরূপে আল্লাহ তাআলা এটা বর্ণনা করেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ

کَمَثَلِ الۡحِمَارِ یَحۡمِلُ اَسۡفَارًا

“তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে পুস্তক বহনকারী গর্দভের মত। তার এ বর্ণনার সনদ বিশুদ্ধ হলেও বর্ণনাটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। এটি কুরআন মজীদের প্রকাশ্য বর্ণনার বিপরীত এবং এ বিষয়ে বহু প্রাচীন ও আধুনিক উলামা-ই-কিরামের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী। আল্লাহই ভাল জানেন।

জনপদ অধিবাসীদের ঘটনা

اِذۡ جَآءَہَا الۡمُرۡسَلُوۡنَ

“যখন তাদের নিকট এসেছিল রাসূলগণ” হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা বর্ণনার পূর্বে ঐ জনপদ অধিবাসীদের ঘটনা আলোচিত হয়েছে। সাবা অঞ্চলের অধিবাসীদের ঘটনা। আরবদের ইতিহাস অধ্যায়ে সাবার অধিবাসীদের কথা আলোচিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

কারূণ ও বাল'আমের ঘটনা মূসা (আ)-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে। তদ্রুপ খিযির (আ) ফিরআওন ও যাদুকরগণ সম্পর্কে মূসা (আ)-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। গাভীর ঘটনাটিও মূসা (আ)-এর বর্ণনায় আলোচিত হয়েছে। মৃত্যু ভয়ে যে কয়েক হাজার লোক নিজেদের বাসস্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। তাদের কথা ‘হিযকীল' এর বর্ণনায় আলোচিত হয়েছে। মূসা (আ)-এর পর আগত বনী ইসরাইলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কথা শামুয়েল (আ)-এর বর্ণনায় আলোচিত হয়েছে। আর জনপদ অতিক্রমকারী ব্যক্তির কথা আলোচিত হয়েছে হযরত উযায়র (আ)-এর বর্ণনায়।  

৪১
হযরত লুকমান (আ)-এর ঘটনা
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَلَقَدْ آَتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنِ اشْكُرْ لِلَّهِ وَمَنْ يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ (12) وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ (13) وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ (14) وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ (15) يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ (16) يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ (17) وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ (18) وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

“আমি লুকমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তো তা করে নিজেরই জন্যে এবং কেউ অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, প্রশংসাহ। স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশস্থলে তার পুত্রকে বলেছিল, হে বৎস! আল্লাহর কোন শরীক করো না, নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম। আমি তো মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ান হয় দু’বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই। তুমি তাদের কথা মানো না তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সৎভাবে এবং যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবহিত করব। হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং সেটি যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মাটির নিচে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত। হে বৎস! সালাত কায়েম কর সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে আর অসৎ কর্মে নিষেধ করবে এবং আপদে-বিপদে ধৈর্যধারণ করবে। এটিই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ। অহংকার বলে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করবে না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।

তুমি পা ফেলবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিশ্চয় সুরের মধ্যে গর্দভের সুরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।”

আলোচ্য লুকমান হলেন লুকমান ইবন আনকা ইবন সাদূন। কেউ কেউ বলেন, লুকমান বলেন, লুকমান ইবনে ছারান। শেষোক্ত মতটি বর্ণনা করেছেন সুহায়লি ইবনে জারির ও কুতায়বি থেকে। সুহায়লি বলেন, লুকমান ছিলেন আয়লা গোত্রের নূবীয় সাম্প্রদায়ের লোক। আমি বলি, লুকমান একজন ইবাদতগুযার, বাগ্মী, প্রজ্ঞাবান ও পুণ্যবান ব্যক্তি। কেউ কেউ এও বলেছেন যে, লুকমান ছিলেন হযরত দাউদ (আ)-এর যুগের একজন কাযী। আল্লাহই ভাল জানেন।

সুফিয়ান ছাওরী....ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন, লুকমান ছিলেন জনৈক আবিসিনীয় দাস, পেশায়। নাজ্জার বা সূত্রধর কাতাদা আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, লুকমান সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত আপনাদের অভিমত কি নাজ্জার বা সুত্রধর তিনি বললেন, লুকমান ছিলেন খর্বাকৃতি এবং নূবী গোত্রস্থিত চ্যাপ্টা নাক বিশিষ্ট লোক। ইয়াহয়া ইবন সাঈদ আনসারী সাঈদ ইবন মুসায়্যাব থেকে বর্ণনা করেন, লুকমান ছিলেন মিসরীয় কৃষ্ণকায় লোক। তার ওষ্ঠাধর ছিল মোটা ও পুরু; আল্লাহ তাআলা তাঁকে হিকমত ও প্রজ্ঞা দিয়েছিলেন, নবুওত দান করেন নি। আওযায়ী বলেন, আবদুর রহমান ইবন হারমালা বলেছেন জনৈক কৃষাঙ্গ ব্যক্তি সাঈদ ইবন মুসায়্যাব (রা)-এর নিকট এসে কিছু জিজ্ঞাস করলেন...তিনি বললেন, তুমি কৃষ্ণাঙ্গ বলে দুঃখ করো না। কারণ, তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠতম মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তারা হলেন, হযরত বিলাল (রা), হযরত উমার (রা)-এর আজাদকৃত দাস মাহজা' (রা) এবং লুকমান হাকীম। তৃতীয় লুকমান ছিলেন কৃষ্ণকায় নূবীয় বংশোদ্ভূত পুরু ওষ্ঠাধর বিশিষ্ট লোক।

তাফসীরকার মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণিত, লুকমান ছিলেন কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস। ঠোঁট দুটো পুরু এবং পা দুটো ফাটা। এক বর্ণনায় আছে, তিনি ছিলেন চ্যাপ্টা পা বিশিষ্ট।

উমর ইবন কায়স বলেন, লুকমান ছিলেন একজন কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস। ঠোট দু'টো পুরু, পা দুটো চ্যাপ্টা। তিনি যখন লোকজনকে উপদেশ দিচ্ছিলেন এমন সময় একজন লোক এসে বলল, ‘আপনি না আমার সাথে অমুক অমুক স্থানে বকরী চরিয়েছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ লোকটি বলল, ‘তাহলে আমি এখন যা দেখছি, এ পর্যায়ে আপনি উন্নীত হলেন কেমন করে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সত্য বলা এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মৌনতা অবলম্বনের মাধ্যমে।’ এ বর্ণনাটি ইবন জারীরের। ইবন আবী হাতিম আবদুর রহমান ইবন আবী ইয়াযীদ ইবন জাবির থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, লুকমান হাকীমের হিকমত ও প্রজ্ঞার বদৌলতে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তাঁর পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁকে দেখে বলল, ‘আপনি কি অমুকের ক্রীতদাস ছিলেন না? আপনি কি পর্বে বকরী চরাতেন না?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ লোকটি বলেন, ‘কিসে আপনাকে আমার দেখা এ পর্যায়ে উন্নীত করল?’ তিনি বললেন, ‘তকদীরের লিখন, আমানতদারী, সত্যবাদিতা ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় বর্জন।’

‘আফরার আযাতকৃত দাস উমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি লুকমান হাকীমের নিকট উপস্থিত হয় এবং সে বলে, ‘আপনি তো বনী নুহাস গোত্রের ক্রীতদাস লুকমান?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। লোকটি বলল, ‘আপনি সেই কৃষ্ণকায় বকরী চরানো ব্যক্তিই তো?’ তিনি বললেন, ‘আমার কালোবর্ণ বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার কোন বিষয়টি আপনাকে বিস্মিত করছে?’ সে বলল, ‘তা এই যে, লোকজন আপনার কছে জড়ো হচ্ছে, আপনার দরজা ওদেরকে আচ্ছাদিত করছে এবং আপনার বক্তব্যে তারা প্রীতও হচ্ছে।’ লুকমান বললেন, ‘ভাতিজা! আমি তোমাকে যা বলবো, তুমি যদি তা কর তবে তুমিও আমার মত হতে পারবে।’

সে বলল, ‘তা কী?’ লুকমান বললেন, ‘আমি আমার দৃষ্টি অবনত রাখি। আমার জিহবা সংযত রাখি। আমার পানাহার ও যৌনাচারের ব্যাপারে আমি সংযম অবলম্বন করি। আমার দায়িত্ব পালন করি। অঙ্গীকার পূরণ করি। মেহমানদেরকে সম্মান করি। প্রতিবেশীদের হক আদায় করি। অপ্রয়োজনীয় বিষয় বর্জন করি। এ কর্মগুলোই আমাকে এ পর্যায়ে এনে পৌঁছিয়েছে, যা তুমি দেখতে পাচ্ছ।’

ইবন আবী হাতিম …...আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত। লুকমান হাকীমের আলোচনায় একদিন তিনি বললেন, তাঁর না ছিল উল্লেখযোগ্য পরিবার-পরিজন, না ধন-সম্পদ, না কোন বংশ-মর্যাদা, কোন বৈশিষ্ট্য। তবে তিনি ছিলেন সুঠামদেহী নীরবতা অবলম্বনকারী, চিন্তাশীল, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণকারী। দিনের বেলা তিনি কখনও ঘুমাতেন না, তাকে কেউ থুথু ফেলতে দেখেনি, দেখেনি কাশি দিতে, পেশাব-পায়খানা করতে, গোসল করতে কিংবা বাজে কাজকর্ম করতে এবং কেউ তাকে হাসতেও দেখেনি। খুব গভীর কোন জ্ঞানের কথা না হলে বা কেউ জিজ্ঞাসা না করলে তিনি কখনও তাঁর বক্তব্য পুনঃউচ্চারণ করতেন না।

তিনি বিবাহ করেছিলেন এবং তার একাধিক সন্তানও জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এদের মৃত্যুতে তিনি কাঁদেননি। তিনি রাজা-বাদশাহ ও আমীর-উমরাদের নিকট যেতেন তাদের অবস্থা দেখার জন্যে, চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে এবং ওদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্যে। ফলে তিনি এ মর্যাদার অধিকারী হন।

কেউ কেউ বলেন যে, তাকে নবুওত গ্রহণের এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। তিনি নবুওতের গুরু দায়িত্ব পালনে শংকিত হলেন। তাই তিনি হিকমত তথা প্রজ্ঞাকেই বেছে নেন। কারণ, এটি ছিল তাঁর নিকট সহজতর। এ মন্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন। এটা হযরত কাতাদা (রা) থেকে বর্ণিত। আমরা পরে তা উল্লেখ করব। ইবন আবী হাতিম ও ইবন জারীর ইকরামা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, লুকমান নবী ছিলেন। বর্ণনাকারী জাবির জুফী এর কারণে এই বর্ণনাটি দুর্বল বর্ণনারূপে গণ্য করা হয়।

জমহুর তথা অধিকাংশ উলামা-ই-কিরামের মতে লুকমান ছিলেন প্রজ্ঞাময় ও বিচক্ষণ একজন ওলী। তিনি নবী ছিলেন না। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে হযরত লুকমানের কথা উল্লেখ করে তাঁর প্রশংসা করেছেন। হযরত লুকমান তার প্রাণপ্রিয় ও সর্বাধিক স্নেহধন্য পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে তাও উল্লেখ করেছেন। লুকমান তার পুত্রকে প্রথম যে উপদেশটি দেন, তাহলোঃ

( لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِیم ࣱ)

[Surah Luqman 13]

“হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম।” তিনি পুত্রকে শিরক করতে নিষেধ করলেন এবং সতর্ক করে দিলেন। ইমাম বুখারী ... আব্দুল্লাহ সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ

( ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَلَمۡ یَلۡبِسُوۤا۟ إِیمَـٰنَهُم بِظُلۡمٍ )

[Surah Al-An'am 82]

“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি- আয়াত যখন নাযিল হল, তখন সাহাবা (রা)-এর নিকট এটি গুরুতর বলে মনে হল। তাঁরা বললেন, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তার ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আয়াত দ্বারা তা বুঝানো হয়নি। তোমরা কি লুকমানের উপদেশ শুননি? তিনি বলেছিলেনঃ

( یَـٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِیم ࣱ)

[Surah Luqman 13]

“হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় শিরক করা চরম জুলুম। ইমাম মুসলিম (র) মুসলিম ইবন মিহরান আল আ’মাশ থেকে উক্ত হাদীছখানা উদ্ধৃত করেছেন।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা প্রসঙ্গক্রমে পিতামাতা সম্পর্কে তার নির্দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সন্তানের ওপর পিতামাতার অধিকারের কথা, তারা মুশরিক হলেও তাদের প্রতি সদাচরণের কথা এবং তাদের দীন কবুল করার ব্যাপারে তাদের আনুগত্য না করার কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর পুত্রের প্রতি লুকমানের এ উপদেশের কথা উল্লেখ করেছেনঃ

( یَـٰبُنَیَّ إِنَّهَاۤ إِن تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّة مِّنۡ خَرۡدَل فَتَكُن فِی صَخۡرَةٍ أَوۡ فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ أَوۡ فِی ٱلۡأَرۡضِ یَأۡتِ بِهَا ٱللَّهُۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَطِیفٌ خَبِیر ࣱ)

[Surah Luqman 16]

“হে বৎস! কোন কিছু যদি সর্ষের দানা পরিমাণও হয় এবং সেটি যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে অথবা মাটির নিচে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবগত।”

এর দ্বারা লুকমান তার পুত্রকে মানুষের প্রতি জুলুম করতে বারণ করলেন। জুলুম যদিও সর্ষে দানা পরিমাণও হয়। কারণ, আল্লাহ তা’আলা জুলুম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জুলুমকে হিসাব নিকাশকালে হাজির করবেন এবং আমলের পাল্লায় রাখবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( إِنَّ ٱللَّهَ لَا یَظۡلِمُ مِثۡقَالَ ذَرَّة ࣲ)

[Surah An-Nisa' 40]

“আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না।”

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَنَضَعُ ٱلۡمَوَ  ٰ⁠ زِینَ ٱلۡقِسۡطَ لِیَوۡمِ ٱلۡقِیَـٰمَةِ فَلَا تُظۡلَمُ نَفۡس شَیۡـٔ اۖ وَإِن كَانَ مِثۡقَالَ حَبَّة مِّنۡ خَرۡدَلٍ أَتَیۡنَا بِهَاۗ وَكَفَىٰ بِنَا حَـٰسِبِینَ )

[Surah Al-Anbiya' 47]

“এবং কিয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায় বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও আমি সেটি উপস্থিত করব। হিসাব গ্রহণকারী রূপে আমিই যথেষ্ট। (২১ আম্বিয়াঃ ৪৭)

এর দ্বারা জানিয়ে দেয়া হল যে, জুলুম দৃষ্টিতে তিল পরিমাণ ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ হলেও এবং তা দরজা জানালাহীন এমন কি ছিদ্র বিহীন কঠিন পাথরের মধ্যে রাখা হলেও অথবা বিশাল ও বিস্তৃত এই অসীম আসমানের গহীন অন্ধকার স্থান থেকে কোন বস্তুতে পতিত হলেও আল্লাহ তা’আলা সেটি সম্পর্কে অবগত থাকেন।

( إِنَّ ٱللَّهَ لَطِیفٌ خَبِیر ࣱ)

[Surah Luqman 16]

অর্থঃ “আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবহিত।”

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইলম অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তাই সাধারণতঃ যা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, সেই অণু পরিমাণ বিষয়ও তাঁর অগোচরে থাকে না।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا یَعۡلَمُهَا وَلَا حَبَّة فِی ظُلُمَـٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡب وَلَا یَابِسٍ إِلَّا فِی كِتَـٰب مُّبِین ࣲ)

[Surah Al-An'am 59]

“তার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্য কণাও অংকুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’ (৬ আনআমঃ ৫৯)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَمَا مِنۡ غَاۤىِٕبَة فِی ٱلسَّمَاۤءِ وَٱلۡأَرۡضِ إِلَّا فِی كِتَـٰب مُّبِینٍ )

[Surah An-Naml 75]

“আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোন গোপন রহস্য নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।”

অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَقَالَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ لَا تَأۡتِینَا ٱلسَّاعَةُۖ قُلۡ بَلَىٰ وَرَبِّی لَتَأۡتِیَنَّكُمۡ عَـٰلِمِ ٱلۡغَیۡبِۖ لَا یَعۡزُبُ عَنۡهُ مِثۡقَالُ ذَرَّة فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَلَا فِی ٱلۡأَرۡضِ وَلَاۤ أَصۡغَرُ مِن ذَ  ٰ⁠ لِكَ وَلَاۤ أَكۡبَرُ إِلَّا فِی كِتَـٰب مُّبِین ࣲ)

[Surah Saba' 3]

“তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত, আকাশরাজি ও পৃথিবীতে তাঁর অগোচর নয় অণু পরিমাণ কিছু, কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু, বরং এর প্রত্যেকটি লিপিবদ্ধ আছে সুস্পষ্ট কিতাবে”

সুদ্দী (র) কতিপয় সাহাবীর (রা) বরাতে বলেন, পূর্বোল্লেখিত আয়াতে ‘সাখরা’ শব্দটি দ্বারা সাত যমীনের নিচে অবস্থিত পাথর বুঝানো হয়েছে। আতিয়্যা আওফী, আবু মালিক ছাওরী ও মিনহাল ইবন উমর (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এই অভিমতের বিশুদ্ধতায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এ ছাড়াও পাথর দ্বারা পৃথিবীর তলদেশের পাথর বুঝানোর ব্যাপারটিও সন্দেহমুক্ত নয়। কেননা, উক্ত আয়াতে ( صخرة ) শব্দটি অনির্দিষ্ট জ্ঞাপক। এটি দ্বারা তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ঐ পাথরটি বুঝানো হলে নির্দিষ্ট বাচক ( الحجره ) শব্দটি ব্যবহৃত হত। বস্তুতঃ আয়াতে এ অর্থ যে কোন পাথর, যেমনটি ইমাম আহমদ (র) আবু সাঈদ খুদরী (র) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

لوان أحدكم يعمل في صخرة صماء ليس لها باب ولا گوة لخرج عمله للناس كائنا ما كان

–“তোমাদের কেউ যদি দরজা ও ছিদ্রহীন পাথরের মধ্যেও কোন আমল করে তাও মানুষের সম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়বে, আমলটি যে পর্যায়েরই হোক না কেন।

এরপর হযরত লুকমান তাঁর পুত্রকে বললেনঃ

( یَـٰبُنَیَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ )

[Surah Luqman 17]

“হে বৎস! নামায কায়েম কর। অর্থাৎ সকল নিয়ম নীতি সহকারে ফরজ, ওয়াজিব, ওয়াক্ত, রুকু সিজদা, ধীর-স্থির ও বিনয় সব কিছুর প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং এতদসম্পর্কিত শরীয়তের নিষিদ্ধ বিষয়াদি পরিহার করে পূর্ণাঙ্গ রূপে নামায আদায় কর।

এরপর তিনি বললেনঃ

( وَأۡمُرۡ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ )

[Surah Luqman 17]

“সৎকর্মের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কর্মে নিষেধ করবে। অর্থাৎ নিজে শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী তা করবে। হাতে তথা বল প্রয়োগে বাধা দেয়ার ক্ষমতা থাকলে বল প্রয়োগে বাধা দিবে। নতুবা মুখে, তাতেও সমর্থ না হলে অন্তরে। এরপর পুত্রকে নির্দেশ দিলেন ধৈর্য ধারণের। বললেনঃ

( وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَاۤ أَصَابَكَ )

[Surah Luqman 17]

“বিপদে আপদে ধৈর্য ধারণ করো" এ নির্দেশ এ কারণে দিলেন যে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে গেলে সাধারণতঃ বাধা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। তবে এর পরিণাম উৎকৃষ্ট। এটি সর্বজনবিদিত যে, সবুরে মেওয়া ফলে। হযরত লুকমান বলেনঃ

( إِنَّ ذَ  ٰ⁠ لِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ )

[Surah Luqman 17]

–“এটিতো দৃঢ় সংকল্পের কাজ, এটি অপরিহার্যও বটে”

তিনি বললেনঃ

( وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ )

[Surah Luqman 18]

অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। হযরত ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, ইকরামা, সাঈদ ইবন জুবায়র, যাহ্হাক, ইয়াযীদ ইবন আসাম, আবুল যাওয়া ও অন্যরা বলেছেন যে, এর অর্থ হল মানুষের প্রতি অহংকারী হয়ো না। এবং লোকজনের সাথে কথা বলার সময় তাদের প্রতি গর্ব ভরে ও অবজ্ঞা বশে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না।

ভাষাবিদগণ বলেছেন, ( الصحر ) হচ্ছে উটের ঘাড়ের একটি রোগ বিশেষ, যাতে তার মাথা ঝুঁকে পড়ে। অহংকারী ব্যক্তি যে লোকের সাথে কথা বলতে গেলে দম্ভ ভরে তার মুখমণ্ডল অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখে, তাকে ঐ উটের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

আবু তালিব তাঁর কবিতায় বলেনঃ

وكنا قريما لأنقر ظلامة- اذا ماتنوا صعر الخدود نقيمها

“সুপ্রাচীন কাল থেকেই আমরা জুলুমকে প্রশ্রয় দেই না। যখন তাঁর মুখ বাঁকা করে নেয় তখন আমরা তা সোজা করে দিই।”

উমরা ইবন হাই তাগলিবী বলেনঃ

وكنا اذا الجبار صعد حده - أقمنا له من ميله فتقوما

—কোন স্বৈরাচারী ব্যক্তি তার মুখ বাঁকা করে নিলে, আমরা তা সোজা করে দেই। ফলে সেটি সোজা হয়ে যায়।

অতঃপর লুকমান তাঁর পুত্রকে বললেনঃ

وَلَا تَمۡشِ فِی ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَال فَخُور

“এবং পৃথিবীতে ঊর্ধ্বভাবে বিচরণ করো না। কারণ, আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” তিনি তাঁর পুত্রকে মানুষের সম্মুখে দম্ভ অহংকর ও ঔদ্ধত্য সহকারে পথ চলতে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَلَا تَمۡشِ فِی ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّكَ لَن تَخۡرِقَ ٱلۡأَرۡضَ وَلَن تَبۡلُغَ ٱلۡجِبَالَ طُول ࣰا)

[Surah Al-Isra' 37]

“ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভাবে বিচরণ করো না, তুমি কখনই পদভারে ভূ-পৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” (১৭ ইসরাঃ ৩৭)

অর্থাৎ তুমি তোমার দ্রুতগতি সম্পন্ন পথ চলায় সকল শহর, নগর অতিক্রম করে যেতে পারবে না, তোমার পদাঘাতে পৃথিবীকে বিদীর্ণ করতে পারবে না, আর তোমার বিশালত্ব অহংকার ও উচ্চতায় তুমি পাহাড়ের সমান উঁচু হতে পারবে না। সুতরাং নিজের প্রতি তাকাও এবং বুঝে নাও যে, তুমি তোমার সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।

হাদীছ শরীফে আছে, এক ব্যক্তি দু’টো কাপড় পরে গর্ব ভরে পথ চলছিল। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে ভূমিতে প্রোথিত করে দিলেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে নিচের দিকে প্রোথিত হতে থাকবে। অপর এক হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

اياك و اسبال الازار فانما من المجلة لايجبها الله

“গোড়ালীর নিচ পর্যন্ত লুঙ্গি ঝুলিয়ে দেওয়া থেকে তুমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ। কেননা তা অহংকারের পরিচায়ক আল্লাহ তা পছন্দ করেন না।”

এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَال فَخُور

“আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না”

পথ চলতে অহংকার প্রদর্শন থেকে বারণ করার পর লুকমান তাঁর পুত্রকে মধ্যম গতিতে পথ চলতে নির্দেশ দিলেন। কারণ, পথ চলাতো লাগবেই। তিনি এ বিষয়ে পুত্রকে মন্দ দিক সম্পর্কে নিষেধ করলেন এবং কল্যাণকর দিকটি অবলম্বনের নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেনঃ

( وَٱقۡصِدۡ فِی مَشۡیِكَ )

[Surah Luqman 19]

“পথ চলার মধ্য পন্থা অবলম্বন কর” অর্থাৎ খুব মন্থরগতি কিংবা খুব দ্রুতগতির কোনটাই অবলম্বন করবে না। বরং মধ্যম গতি অবলম্বন করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَعِبَادُ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلَّذِینَ یَمۡشُونَ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ هَوۡن ا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ ٱلۡجَـٰهِلُونَ قَالُوا۟ سَلَـٰم ࣰا)

[Surah Al-Furqan 63]

“রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে তখন তারা বলে সালাম”

এরপর লুকমান তাঁর পুত্রকে বললেনঃ

( وَٱغۡضُضۡ مِن صَوۡتِكَ )

[Surah Luqman 19]

“এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর” অর্থাৎ তুমি যখন কথা বলবে তখন প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ স্বরে কথা বলবে না। কারণ, সর্বোচ্চ এবং সর্বনিকৃষ্ট কণ্ঠস্বর হল গাধার স্বর। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাত্রি বেলায় গাধার ডাক শুনলে রাসূলুল্লাহ (সা) আউযুবিল্লাহ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, গাধা শয়তানকে দেখতে পায়। এ জন্যেই বিনা প্রয়োজনে কণ্ঠস্বর উচ্চ করতে নিষেধ করেছেন। বিশেষতঃ হাঁচি দেয়ার সময়। হাঁচির সময় শব্দ নীচু রাখা এবং মুখ ঢেকে রাখা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ করতেন বলে হাদীছে প্রমাণ রয়েছে। অবশ্য, আযানের সময় উচ্চস্বরে আযান দেয়া, যুদ্ধের সময় উচ্চ স্বরে আহ্বান জানানো এবং বিপদ-আপদ ও মৃত্যুর আশংকায় উচ্চস্বরে কাউকে ডাকা শরীয়তসম্মত।

হযরত লুকমান (আ)-এর এসব প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য, কল্যাণকর ও অকল্যাণরোধক উপদেশাবলী আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে উল্লেখ করেছেন। হযরত লুকমান (আ)-এর বিবরণ ও উপদেশাবলী সম্পর্কে আরও বহু বর্ণনা রয়েছে। তাঁর বক্তব্য সম্বলিত হিকমত-ই লুকমান নামে তাঁর বলে কথিত একটি পুস্তক পাওয়া যায়। সে পুস্তক হতে কিছু বক্তব্য এখন আমরা উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।

ইমাম আহমদ— ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে জানালেন যে, লুকমান হাকীম বলতেন, আল্লাহ তা’আলা কোন কিছু আমানত রূপে দিলে তিনি তা হিফাজতও করেন।

ইবন আবী হাতিম কাসিম ইবন মুখায়মারা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, “হে বৎস! হিম্মত ও প্রজ্ঞা দরিদ্রদেরকে রাজার আসনে বসিয়েছে। উবাই.... আওন ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। লুকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! তুমি কোন মজলিশে উপস্থিত হলে ইসলামের রীতি অর্থাৎ সালাম দ্বারা তাদের অন্যায় জয় করবে। তারপর মজলিসের এক পাশে বসে পড়বে। ওদের কথা বলার পূর্বে তুমি কোন কথা বলো না। তারা আল্লাহর যিকর ও আল্লাহ সম্পর্কে আলোচনায় নিয়োজিত হলে তুমি তাদের সাথে আলোচনায় অংশ নিবে। তারা যদি অন্য কোন বিষয়ে আলোচনা করে তবে তুমি তাদেরকে ত্যাগ করে অন্যদের কাছে চলে যাবে।’

উবাই হাফস ইবন উমার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত লুকমান (আ) এক থলে সরিষা পাশে নিয়ে তার পুত্রকে উপদেশ দিতে বসেছিলেন। একটি করে উপদেশ দিচ্ছিলেন আর একটি করে সরিষা থলে থের্কে বের করছিলেন। এভাবে তাঁর সব সরিষা শেষ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, ‘হে বৎস! আমি তোমাকে এমন উপদেশ দিলাম, কোন পর্বতকে এ উপদেশ শুনালে সেটি ফেটে চৌচির হয়ে যেত।’ তাঁর পুত্রের অবস্থাও তাই হয়েছিল।

আবু কাসিম তাবারানী ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

اتجذوا السودان فان لة ثلثة منهم من أهل الجنة لقمان الحكيم والجا شي وبلال المؤن

“তোমরা কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে সুসম্পর্ক রাখ। তাদের তিনজন নিশ্চিতভাবেই জান্নাতী। লুকমান হাকীম, নাজাশী এবং মুয়াযযিন বিলাল (রা)।”

তাবারানী এর ব্যাখ্যায় বলেন, অর্থাৎ বিলাল হাবশী। হাদীছটি একাধারে গরীব ও মুনকার পর্যায়ের। ইমাম আহমদ (র) তাঁর কিতাবুয যুহদ নামক গ্রন্থে হযরত লুকমান (আ) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর তথ্যাদি পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেছেন, ওয়াকীদী মুজাহিদ সূত্রে

( وَلَقَدۡ ءَاتَیۡنَا لُقۡمَـٰنَ ٱلۡحِكۡمَةَ )

[Surah Luqman 12]

“আমি লুকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি” আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, হিকমত অর্থ ধর্মীয় প্রজ্ঞা ও সত্য প্রাপ্তি, নবুওত নয়।

ওহব ইবন মুতানাব্বিহ ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন লুকমান ছিলেন হাবশী ক্রীতদাস। আসওয়াদ…… সাঈদ ইবন মুসায়্যাব সূত্রে বর্ণিত, লুকমান (আ) পেশায় ছিলেন দর্জি। সাইয়াদ…… মালিক ইবন দীনারকে উদ্ধৃত করে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! তুমি ব্যবসা রূপে আল্লাহর ইবাদতকে বেছে নাও, তাহলে পুঁজি ছাড়াই লাভ পাবে।’ ইয়াযীদ মুহাম্মদ ইবন ওয়াছিকে উদ্ধৃত করে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে লক্ষ্য করে প্রায়ই বলতেন, ‘হে বৎস! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার অন্তর কলুষিত থাকা অবস্থায় মানুষের শ্রদ্ধা অর্জনের জন্যে তুমি আল্লাহকে ভয় করার ভান করো না।’

ইয়াযীদ খালিদ বিরদকে উদ্ধৃত করে বলেন, লুকমান ছিলেন একজন হাবশী ক্রীতদাস। পেশায় ছুতার। তার মালিক তাঁকে একটি বকরী জবাই করতে বলেছিল। সে মতে তিনি একটি বকরী জবাই করেন। বকরীর উৎকৃষ্টতম দুটো টুকরো আনতে মালিক তাঁকে নির্দেশ দেয়। তিনি বকরীটির জিহ্বা ও হৃৎপিণ্ড নিয়ে আসেন। মালিক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এর চাইতে উৎকৃষ্ট কোন অঙ্গ কি এ বকরীতে নেই?’ তিনি বললেন, ‘না।’ মালিক কিছু সময় চুপ করে থাকার পর আবার তাঁকে বললো, ‘আমার জন্যে অপর একটি বকরী জবাই কর।’ তিনি তার জন্যে অপর একটি বকরী জবাই করলেন। মালিক বললো, ‘এটির নিকৃষ্টতম টুকরো দু’টো ফেলে দাও!’ তিনি বকরীটির জিহবা ও হৃৎপিণ্ড ফেলে দিলেন।মালিক বলল, ‘আমি তোমাকে উৎকৃষ্ট দুটো টুকরো আনতে বললাম। তুমি নিয়ে এলে জিহ্বা আর হৃৎপিন্ড। আবার নিকৃষ্টতম দুটো টুকরা ফেলে দিতে বললাম; তুমি জিহ্বা আর হৃৎপিণ্ড ফেলে দিলে, এর রহস্য কি?’ লুকমান বললেন, ‘জিহ্বা ও হৃৎপিণ্ড যতক্ষণ পবিত্র থাকে ততক্ষণ এ দুটো অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কিছু থাকে না। আর এ দু’টো যখন কলুষিত হয়, তখন এ দু’টো অপেক্ষা ঘৃণিত অন্য কিছু থাকে না।’

দাউদ ইবন রশীদ অবু উছমান সূত্রে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, মূর্খদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী হয়ো না। তাহলে সে মনে করবে যে, তার কর্মে তুমি সন্তুষ্ট। বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অসন্তুষ্টিকে তুচ্ছ ভেবো না। তাহলে সে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে।

দাউদ ইবন উসায়দ আবদুল্লাহ ইবন যায়দ সূত্রে বলেন, লুকমান বলেছেনঃ ‘জেনে নাও যে, প্রজ্ঞাবানদের মুখে আল্লাহর হাত থাকে। তিনি যা তৈরি করে দেন, তা ব্যতীত তারা কথা বলেন না।’

আবদুর রায়যাক বলেন যে, তিনি ইবন জুরায়জকে বলতে শুনেছেন, আমি রাতে মাথা ঢেকে রাখতাম। উমর (রা) আমাকে বললেন, ‘তুমি রাতে মাথা ঢেকে রাখ কেন? তুমি কি জানো যে, লুকমান (আ) বলেছেন, দিনের বেলা মাথা ঢেকে রাখা অপমানজনক এবং রাত্রে তা ওযর বা অপারগতার নিদর্শন। তাহলে তুমি রাতে মাথা ঢাক কেন?’ তখন আমি তাকে বললাম, ‘লুকমান (আ)-এর তো কোন ঋণ ছিল না।’ সুফিয়ান বলেন, লুকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! নীরবতা অবলম্বন করে আমি কখনো লজ্জিত হইনি। কথা বলা যদি রূপা হয় তবে নীরব থাকা হচ্ছে সোনা।’

আবদুস সামাদ কাতাদা সূত্রে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! মন্দ থেকে দূরে থাক। তাহলে মন্দ তোমা হতে দূরে থাকবে। কারণ মন্দের জন্যেই মন্দের সৃষ্টি। আবু মুআবিয়া উরওয়া সূত্রে বলেন, হযরত লুকমানের প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্যে আছে, ‘হে বৎস! অতিরিক্ত মাখামাখি পরিহার করবে। কারণ, অতিরিক্ত মাখামাখি ঘনিষ্ঠজনকে ঘনিষ্ঠজন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এবং প্রজ্ঞকে ঠিক তেমনি বিলুপ্ত করে দেয়, যেমনটি আগে উচ্ছাস করে থাকে। হে বৎস! অতি ক্রোধ বর্জন কর, কারণ তা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির অন্তঃকরণকে ধ্বংস করে দেয়।’

ইমাম আহমদ উবায়দ ইবন উমায়র সুত্রে বলেন, লুকমান (আ) উপদেশ স্থলে তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! দেখে শুনে মজলিস বেছে নেবে। যদি এমন মজলিস দেখ, যেখানে আল্লাহর যিকর হয়, তবে তুমি তাদের সাথে সেখানে বসবে। কারণ, তুমি নিজে জ্ঞানী হলে তোমার জ্ঞান তোমার উপকার করবে; আর তুমি মূর্খ হলে মজলিসের লোকেরা তোমাকে জ্ঞান দান করবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের ওপর রহমত নাযিল করলে তাদের সাথে তুমিও রহমতের অংশ পাবে।

হে বৎস! যে মজলিসে আল্লাহর যিকর হয় না, সে মজলিসে বসো না। কারণ, তুমি নিজে জ্ঞানী হলে তখন তোমার জ্ঞান তোমার কোন উপকার করবে না। আর তুমি যদি মূর্খ হও তারা তোমার মূর্খতা আরও বৃদ্ধি করে দিবে। উপরন্তু আল্লাহ তাদের ওপর কোন গযব নাযিল করলে তাদের সাথে তুমিও গযবে পতিত হবে। হে বৎস! ঈমানদারের রক্তপাতকারী শক্তিমান ব্যক্তিকে ঈর্ষা করোনা। কারণ, তার জন্যে আল্লাহর নিকট এমন ঘাতক রয়েছে, যার মৃত্যু নেই।’ আবু মুয়াবিয়া..... উরওয়া (র) সূত্রে বলেন, ‘আলহিকমাহ’ গ্রন্থে রয়েছে যে, ‘হে বৎস! তুমি ভাল কথা বলবে এবং হাসিমুখে থাকবে। তাহলে দানশীল ব্যক্তিদের তুলনায় তুমি মানুষের নিকট অধিকতর প্রিয় হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আলহিকমাহ’ গ্রন্থে অথবা তাওরাতে আছে যে, ‘নম্রতা হল প্রজ্ঞার মস্তক স্বরূপ। তিনি এও বলেছেন যে, তাওরাতে আছে, তুমি যেমন দয়া করবে, তেমন দয়া পাবে। তিনি আরও বলেছেন যে, হিকমত গ্রন্থে আছে, যেমন বপন করবে তেমন ফসল তুলবে। তিনি বলেন, ‘আলহিকমাহ’ গ্রন্থে আছে, তোমার বন্ধুকে এবং তোমার পিতার বন্ধুকে ভালবাস।’

আবদুর রাযযাক…… আবু কিলাব সূত্রে বলেন, লুকমান (আ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘কোন ব্যক্তি অধিক ধৈর্যশীল?’ তিনি বললেন, ‘সেই ধৈর্য যার পরে কষ্ট দেওয়া হয় না।’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী?’ তিনি বললেন, ‘সে ব্যক্তি, যে অন্যের জ্ঞান দ্বারা নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করে।’ বলা হল, ‘কোন লোক উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘ধনি ব্যক্তি বলা হল, প্রাচুর্যের অধিকারী? সম্পদের প্রাচুর্য? তিনি বললেন, না বরং আমি সে ব্যক্তিকে বুঝিয়েছি, যার কাছে কোন কোন কল্যাণ চাওয়া হলে তা পাওয়া যায়। তা না হলে অন্তত সে অন্যের দ্বারস্থ হয়।’

সুফিয়ান ইবন উয়ায়না বলেন, লুকমান (আ)-কে বলা হল, ‘নিকৃষ্টতম ব্যক্তি কে?’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি এ কথার পরোয়া করে না যে, লোকে তাকে মন্দ কার্যে লিপ্ত দেখবে।’

আবু সামাদ মালিক ইবন দীনার সূত্রে বলেন, ‘প্রজ্ঞাপূর্ণ কথার মধ্যে আমি এটা পেয়েছি যে, মানুষের খেয়াল খুশী ও কৃপ্রবৃত্তি সম্পর্কে সমাজের উপরতলার যে সকল লোক আলাপ-আলোচনা করে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। আমি তাতে আরও পেয়েছি যে, তুমি যা জান তা আমল না করে যা জান না তা জানার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। এটি তো সে ব্যক্তির ন্যায়, যে কাঠ সংগ্রহ করে বোঝা বাঁধে, তারপর তা মাথায় তুলে নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তারপর গিয়ে আরও কাঠ সংগ্রহ করে।’

আবদুল্লাহ ইবন আহমদ আবু সাঈদ (র) সূত্রে বলেন, হযরত লুকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! পরহেযগার ব্যক্তিরাই যেন তোমার খাদ্য খায় এবং তোমার কাজকর্মে বিজ্ঞজনদের পরামর্শ নিও।’

এ বিষয়ে ইমাম আহমদ (র) যা বর্ণনা করেছেন, এগুলো হচ্ছে তার সারসংক্ষেপ। ইতিপূর্বে আমরা কতক বর্ণনা উল্লেখ করেছি, যা তিনি বর্ণনা করেন নি। আবার তিনি এমন কতক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের নিকট ছিল না। আল্লাহই ভাল জানেন। ইবন আবী হাতিম ……কাতাদা (র) সূত্রে বলেন, আল্লাহ তা’আলা লুকমান হাকীমকে নবুওত ও হিকমতের যে কোন একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন। তিনি নবুওতের পরিবর্তে হিকমতই গ্রহণ করেন। তারপর জিবরাঈল (আ) তাঁর নিকট এলেন। তিনি তখন নিদ্রামগ্ন। জিবরাঈল (আ) তাঁর নিকট হিকমতের বারি বর্ষণ করেন। এরপর থেকে তিনি হিকমতপূর্ণ কথা বলতে শুরু করেন।

সাদ বলেন, আমি কাতাদা (র) কে বলতে শুনেছি যে, লুকমানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি নবুওত না নিয়ে হিকমত নিলেন কেন? আপনাকে তো আপনার প্রতিপালক ইখতিয়ার দিয়েছিলেন।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমাকে যদি বাধ্যতামূলক ভাবে নবুওত দেয়া হত তাহলে আশা করি, আমি ঐ দায়িত্ব পালনে সাফল্য লাভ করতাম। কিন্তু আমাকে যখন যে কোন একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার দেয়া হল, তখন আমি নবুওতী গুরুদায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে যাব বলে আশংকা করলাম। তখন হিকমতই আমার নিকট প্রিয়তর মনে হয়।’

এ বর্ণনাটি সংশয় মুক্ত নয়। কারণ, কাতাদা (র) থেকে সাঈদ ইবন কাছীরের বর্ণনা সম্পর্কে হাদীছবেত্তাগণের বিরূপ সমালোচনা রয়েছে। উপরন্তু সাঈদ ইবন আবী আরূবা কাতাদা (র) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, হিকমত অর্থ প্রজ্ঞা ও ইসলাম। তিনি নবী ছিলেন না, তার প্রতি ওহীও অবতীর্ণ হয়নি। পূর্ববতী কালের উলামা-ই কিরামও স্পষ্টভাবে তা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে মুজাহিদ; সাঈদ ইবন মুসায়্যব ও ইবন আব্বাস (রা) প্রমুখ প্রথম যুগের আলিমগণ দৃঢ়ভাবে এমত পোষণ করতেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

৪২
অগ্নিকুণ্ড অধিপতিদের ঘটনা
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ وَٱلسَّمَاۤءِ ذَاتِ ٱلۡبُرُوجِ ۝ وَٱلۡیَوۡمِ ٱلۡمَوۡعُودِ ۝ وَشَاهِد وَمَشۡهُود ۝ قُتِلَ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡأُخۡدُودِ ۝ ٱلنَّارِ ذَاتِ ٱلۡوَقُودِ ۝ إِذۡ هُمۡ عَلَیۡهَا قُعُود ۝ وَهُمۡ عَلَىٰ مَا یَفۡعَلُونَ بِٱلۡمُؤۡمِنِینَ شُهُود ۝ وَمَا نَقَمُوا۟ مِنۡهُمۡ إِلَّاۤ أَن یُؤۡمِنُوا۟ بِٱللَّهِ ٱلۡعَزِیزِ ٱلۡحَمِیدِ ۝ ٱلَّذِی لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَیۡء شَهِیدٌ ۝ إِنَّ ٱلَّذِینَ فَتَنُوا۟ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ وَٱلۡمُؤۡمِنَـٰتِ ثُمَّ لَمۡ یَتُوبُوا۟ فَلَهُمۡ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمۡ عَذَابُ ٱلۡحَرِیقِ )

[Surah Al-Buruj 1 - 10]

অর্থাৎ, (১) শপথ বুরুজ বিশিষ্ট আকাশের (২) এবং প্রতিশ্রুত দিবসের (3) শপথ দ্রষ্টা ও দৃষ্টের (৪) ধ্বংস হয়েছিল কুণ্ডের অধিপতিরা (৫) ইন্ধনপূর্ণ যে কুণ্ডে ছিল আগুন (৬) যখন তারা সেটির পাশে উপবিষ্ট ছিল (৭) এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল (৮) ওরা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এ কারণে যে, তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসাই আল্লাহে (৯) আকাশ রাজি ও পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব যার, আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে দ্রষ্টা। (১০) যারা ঈমানদার নর-নারীকে বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা। (৮৫ বুরুজঃ ১-১০)

এ সূরার তফসীর প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আমরা ব্যাপক ও বিস্তারিত আলোচনা করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক মনে করেন যে, কুণ্ড অধিপতিরা হযরত ঈসা (আ)-এর নবুওত প্রাপ্তির পরবর্তী যুগের লোক। পক্ষান্তরে অন্যান্যরা মনে করেন যে, এটি তার পূর্বের যুগের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীতে একাধিকবার ঘটেছে। স্বৈরাচারী কাফির রাজা বাদশাহরা বারে বারে ঈমানদার মানুষদের ওপর এ প্রকার নির্যাতন চালিয়েছে। তবে কুরআন মজীদে উল্লেখিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে একটি মারফু হাদীছ এবং ইবন ইসহাক বর্ণিত একটি বর্ণনা রয়েছে। এ দুটো পরস্পর বিরোধী। পাঠকের জ্ঞাতার্থে আমি উভয় বর্ণনাই উল্লেখ করছি। ইমাম আহমদ সুহায়ব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমাদের পূর্বের যুগে এক রাজা ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। যাদুকর বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর রাজাকে বলল, ‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি আর আমার মৃত্যুও ঘনিয়ে এসেছে। এখন আমাকে একটি বালক যোগাড় করে দিন, তাকে আমি যাদু শিখাব।’ রাজা একটি বালক যোগাড় করে দিলেন। যাদুকর ওকে যাদু শিখাচ্ছিল। রাজার রাজপ্রাসাদ ও যাদুকরের আখড়ার মধ্যখানে ছিল জনৈক ধর্মযাজকের আস্তানা। বালকটি একদিন ধর্মযাজকের আস্তানায় আসে এবং তার কথা শোনে। তার কথা বালকটির পছন্দ হয়। এ দিকে বালকটি যাদুকরের নিকট গেলে যাদুকর তাকে প্রহার করতো এবং বলতো, ‘বিলম্ব করেছিস কেন? কিসে তোকে আটকে রাখে?’ নিজের বাড়িতে গেলে পরিবারের লোকজন তাকে প্রহার করতো এবং বলতো, ‘দেরী করেছিস কেন?’ এ বিষয়টি সে যাজককে জানায়। যাজক তাকে পরামর্শ দেয় যে, ‘যাদুকর তোমাকে মারতে গেলে তুমি বলবে আমার ঘরের লোকজন আমাকে আটকে রেখেছিল। আর ঘরের লোকজন মারতে গেলে বলবে যাদুকর আমাকে আটকে রেখেছিল।’ একদিন যাওয়ার পথে সে পথের ওপর একটি বিশালাকৃতির ভয়ানক জন্তু দেখতে পায়। যেটি লোকজনের পথ আটকে রেখেছিল। পথিকগণ পথ অতিক্রম করতে পারছিল না। বালকটি মনে মনে বলে, আল্লাহ তা’আলার নিকট যাদুকরের কাজ বেশি প্রিয়, নাকি ধর্মযাজকের কাজ বেশি প্রিয়, তা আমি আজ পরীক্ষা করব। সে একটি পাথর তুলে নিয়ে এ বলে জন্তুটির দিকে ছুঁড়ে মারল, ‘হে আল্লাহ! যাজকের কর্ম যদি আপনার বেশি প্রিয় ও পছন্দনীয় হয় তবে এ পাথর দ্বারা জন্তুটিকে বধ করে দিন, যাতে লোকজন পথ অতিক্রম করতে পারে।’ তার পাথরের আঘাতে জন্তুটি নিহত হয়। যাজকের নিকট গিয়ে সে তা জানায়। যাজক বললেন, ‘প্রিয় বৎস! আল্লাহর নিকট তুমি আমার চেয়ে অধিক প্রিয়। তুমি অবশ্যই বিপদে পড়বে, পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। বিপদে পড়লে কাউকে আমার সন্ধান দিবে না।’

তারপর বালকটি জন্মান্ধকে দৃষ্টিশক্তি দান করত, কুষ্ঠরোগ নিরাময় করত। তার হাতে আল্লাহ রোগীদেরকে সুস্থ করে দিতেন। রাজার এক পরিষদ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বালকের কথা তার কানে যায় তিনি প্রচুর হাদিয়া নিয়ে বালকের নিকট এসে বলেন, ‘তুমি যদি আমাকে সুস্থ করে দিতে পার তবে এসব হাদিয়া তুমি পাবে।’ বালক বলল, ‘আমি তো কাউকে সুস্থ করতে পারি না। একমাত্র আল্লাহই সুস্থ করেন। আপনি যদি তার প্রতি ঈমান আনেন এবং আমি তাঁর নিকট দোয়া করি তাহলে তিনি আপনাকে সুস্থ করে দিবেন।’ তিনি ঈমান আনলেন এবং বালকটি দোয়া করল। আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দিলেন।

তারপর উক্ত সভাষদ রাজার নিকট আসলেন এবং ইতিপূর্বে যেভাবে বসতেন সেভাবে বসলেন। রাজা বললেন, ‘তোমাকে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিল কে?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমার প্রতিপালক।’ রাজা বলল, ‘আমি?’ তিনি বললেন, ‘না। আমার ও আপনার প্রতিপালক আল্লাহ।’ রাজা বলল, ‘আমি ছাড়া তোমার কি অন্য কোন প্রতিপালক আছে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার এবং আপনার প্রতিপালক আল্লাহ।’ তখন রাজা তাকে বিরামহীনভাবে নির্যাতন করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তিনি বালকটির সন্ধান নিয়ে নিলেন। তখন বালকটিকে রাজ দরবারে নিয়ে আসা হলো। রাজা বলল, ‘বৎস! যাদু বিদ্যায় তুমি এত পারদর্শিতা অর্জন করেছ যে, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে পর্যন্ত নিরাময় করতে পার এবং সকল রোগের চিকিৎসা করতে পার।’ বালকটি বলল, ‘আমি তো নিরাময় করি না। নিরাময় করেন আল্লাহ তা’আলা।’ রাজা বলল, ‘আমি?’ সে বলল, ‘না।’ রাজা বলল, ‘আমি ছাড়া তোমার কি অন্য কোন প্রতিপালক আছে?’ জবাবে বালকটি বলল, ‘আমার এবং আপনার প্রতিপালক আল্লাহ।’

তখন রাজা তার উপর বিরামহীন নির্যাতন চালাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে যাজকের নাম প্রকাশ করে দিল। যাজককে রাজ দরবারে ডাকা হল। রাজা তাকে বলল, ‘তোমার ধর্ম ত্যাগ কর।’ তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর মাথার মধ্যভাগে করাত চালিয়ে তাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়। অন্ধ ব্যক্তিকে রাজা বলল, ‘ঐ ধর্ম ত্যাগ কর।’ তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানালেন। তার মাথায় করাত রেখে তাকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়া হল। রাজা তখন বালককে বলল, ‘ঐ ধর্ম ত্যাগ কর।’ সে তাতে অস্বীকৃতি জানাল। অতঃপর একদল নয়া লোক দিয়ে তাকে পাহাড়ের ওপর পাঠানো হয়। রাজা তাদেরকে নির্দেশ দিল যে, তোমরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখবে, সে তার ধর্ম ত্যাগ করে কিনা! যদি সে ধর্ম ত্যাগ করে তো ভাল। নতুবা ধাক্কা মেরে তাকে ওখান থেকে ফেলে দিবে।

তারা বালকটিকে নিয়ে যায়। যখন তারা পাহাড়ের ওপর উঠল, তখন বালকটি বলল, ‘হে আল্লাহ! আপনার ইচ্ছা মুতাবিক তাদের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন!’ এ সময় হঠাৎ সবাইকে নিয়ে পর্বত কেঁপে উঠে। সবাই পাথর চাপা পড়ে মারা যায়। বালকটি পথ খুঁজে খুঁজে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এবং রাজার নিকট উপস্থিত হয়। আর রাজা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার সাথে যারা ছিল তাদের খবর কি?’ বালকটি উত্তর দিল, ‘তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট হয়েছেন।’ তখন রাজা তাকে তার লোকজন দিয়ে একটি নৌকায় করে সমুদ্রে পাঠিয়ে দিল। রাজা বলল, ‘তোমরা যখন গভীর সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছবে তখন যদি সে তার ধর্ম ত্যাগ করে তবে ভাল কথা। অন্যথায় তাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবে।’ লোকজন তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেল। বালকটি বলল, ‘হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা আমাকে ওদের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন।’ তখন তারা সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা গেল। বেঁচে গেল বালকটি। সে ফিরে এসে রাজার নিকট উপস্থিত হল। তখন রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার সাথী লোকজনের সংবাদ কি?’ বালকটি উত্তরে জানাল, ‘আল্লাহ তা’আলা আমার সাহায্যে ওদের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন।’

বালক রাজাকে আরো বলল যে, ‘আমি যে পরামর্শ দিব, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে আপনি আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। আমার পরামর্শ মানলেই কেবল আমাকে হত্যা করতে পারবেন।’ তখন রাজা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার পরামর্শটি কি?’ সে বলল, ‘সকলকে একটি মাঠে সমবেত করবেন। তারপর আমাকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলে চড়াবেন। এরপর আমার ঝুড়ি থেকে একটি তীর নিয়ে এই ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম-এই বালকের প্রভু আল্লাহর নামে নিক্ষেপ করছি’ বলে তীরটি আমার দিকে নিক্ষেপ করবেন।’ রাজা তখন তাই করল। তীর গিয়ে বালকের ললাটের উপর পড়ল, সে নিজের ক্ষত স্থানে হাত রাখল এবং শহীদ হয়ে গেল। এসব দেখে উপস্থিত লোকজন চীৎকার করে বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির প্রতিচালকের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির প্রতিচালকের প্রতি ঈমান আনলাম।’ রাজাকে বলা হল, আপনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাইতো হল। আল্লাহ আপনার প্রতি সেই বিপদই তো নাযিল করলেন। লোকজন সকলেই তো ঈমান এনে ফেলেছে। রাজার নির্দেশে প্রত্যেক গলির মুখে গর্ত খনন করা হল। তাতে আগুন জ্বালানো হল। রাজা বলল, যে ব্যক্তি ঐ ধর্ম ত্যাগ করবে তাকে রেহাই দিবে। আর যারা তাতে স্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবে।

লোকজন ওখান দিয়ে যাচ্ছিল আর অগ্নিকুণ্ডে পতিত হচ্ছিল। জনৈকা মহিলা তার নিকট উপস্থিত হল। এক দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ সেখানে মহিলাটি আগুনে পতিত হতে ইতস্ততঃ করছিল। তার শিশুটি বলে উঠল, ‘মা! তুমি ধৈর্যধারণ কর, কারণ, তুমি সত্যের ওপর রয়েছ।’ এটি ইমাম আহমদের বর্ণনা। ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ প্রমুখ সহীহ্ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এগুলো আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক এ ঘটনাটি অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নাজরানের অধিবাসিগণ ছিল মুশরিক। তারা দেব-দেবীর পূজা করত। নাজরানের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে (নাজরান নগর হল নাজরান অঞ্চলের কেন্দ্রীয় শহর) এক যাদুকর বসবাস করত। নাজরানের বালকদের সে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত। ইবনে মুনাব্বিহ্ বলেন, ফাইমূন নামক জনৈক ব্যক্তি সেখানে এসে একটি তাঁবু স্থাপন করে। তাঁর তাঁবুটি ছিল নাজরান ও যাদুকরের গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে। নাজরানের লোকেরা তাদের ছেলেদেরকে ঐ যাদুকরের নিকট নিয়মিত পাঠাত। সে তাদেরকে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত। অন্যান্য বালকের সাথে তামুর তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে যাদুকরের নিকট প্রেরণ করে। যাওয়ার পথে আবদুল্লাহ ঐ তাঁবুওয়ালা লোকটিকে দেখত। তার নামায ও ইবাদত আবদুল্লাহর ভাল লাগত। সে তাঁবু ওয়ালার নিকট বসতে এবং তার কথাবার্তা শুনতে লাগলো শেষ পর্যন্ত সে মুসলমান হয়ে গেল। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করে সে তার ইবাদত করতে লাগল। তাঁবু ওয়ালার নিকট থেকে ইসলামের বিধি-বিধান জেনে নিত। অবশেষে ইসলামের বিধি বিধান-সম্পর্কে যখন সে গভীর জ্ঞান অর্জন করে তখন সে তাঁবুওয়ালার নিকট ইসমে আজম শিখতে চায়। তাঁবুওয়ালা ইসমে আজম জানতেন বটে, কিন্তু আবদুল্লাহর নিকট তা গোপন রাখতেন। তিনি বললেন, ‘ভাতিজা! তুমি ইসমে আজম সহ্য করতে পারবে না। তোমার দুর্বলতা সম্পর্কে আমি শংকিত।’ তামুরের ধারণা ছিল যে অন্যান্য বালকের ন্যায় তার পুত্রটিও নিয়মিত যাদুকরের আস্তানায় যাতায়াত করছে!

আবদুল্লাহ যখন বুঝতে পারল যে, ইসমে আজম শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তার গুরু কার্পণ্য করছেন এবং তার দুর্বলতার আশংকা করছেন তখন সে কয়েকটি তীর সংগ্রহ করে। এরপর তার জানা আল্লাহর প্রত্যেকটি নাম ঐ তীরগুলোতে লিখে। প্রত্যেকটিতে একটি করে নাম লিখা শেষ করে সে এক স্থানে আগুন জ্বালায়। এরপর একটি একটি করে তীর আগুনে নিক্ষেপ করতে থাকে। ক্রমে আমি লেখা তীরটি আগুনে ফেলার সাথে সাথে তীরটি লাফিয়ে উঠে এবং আগুন থেকে বেরিয়ে আসে। আগুনে তীরটির সামান্যতমও ক্ষতি হয়নি। ঐ তীরটি নিয়ে আবদুলাহ তার গুরুর নিকট উপস্থিত হয় এবং বলে যে, সে ইসমে আজম জেনে ফেলেছে, যা তার গুরু গোপন রেখেছিলেন। গুরু বললেন, ‘বল তো কোনটি ইসমে আজম?’ সে বলল, ‘তা এরূপ এরূপ।’ গুরু বললেন, ‘তুমি কেমন করে জানলে?’ বালক সকল ঘটনা খুলে বলে। গুরু বললেন, ‘ভাতিজা! তুমি ঠিকই ইসমে আজম জেনে নিয়েছ। তবে নিজেকে সংযত রাখবে। অবশ্য তুমি তা পারবে বলে আমার মনে হয় না।’

এরপর থেকে আবদুল্লাহ নাজরানে প্রবেশ করলে এবং কোন দুঃস্থ ও বিপদগ্রস্ত লোক দেখলে বলত, ‘হে আল্লাহর বান্দা, তুমি আল্লাহর একত্ববাদ মেনে নাও এবং আমার দীনে প্রবেশ কর। আমি তোমার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করব। আল্লাহ তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।’ সংশ্লিষ্ট লোক ঈমান আনলে সে দোয়া করত এবং আল্লাহ ঐ বিপদগ্রস্ত লোককে বিপদমুক্ত করতেন। এভাবে তার বিষয়টি নাজরানের রাজার কানে পৌঁছে। রাজা তাকে তলব করে এবং তাকে অভিযুক্ত করে বলে যে, ‘তুমি আমার প্রজাদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করেছ। আমার দীন ও আমার পূর্ব পুরুষের দীনের বিরুদ্ধাচরণ করেছ। আমি ওর প্রতিশোধ নেব।’

আবদুল্লাহ বলল, ‘আপনি তা পারবেন না।’ রাজা পাইক পেয়াদা সহকারে তাকে পাঠাল। সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ থেকে ওকে নিচে নিক্ষেপ করা হল। কিন্তু তার কোনই ক্ষতি হল না। তাকে প্রেরণ করা হল নাজরানের সমুদ্রে, সেখানে যা-ই নিক্ষেপ করা হয় তাই ধ্বংস হয়। বালককে ঐ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। সে সমুদ্র থেকে নির্বিবাদে উঠে আসে। আবদুল্লাহ যখন সকল ক্ষেত্রে জয়ী হল তখন সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতে ঈমান না আনবেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার না করবেন, ততক্ষণ আমাকে হত্যা করতে পারবেন না।

আপনি যদি ঈমান আনেন তবে আমার ওপর কর্তৃত্ব পাবেন এবং আমাকে হত্যা করতে পারবেন।’ অগত্যা রাজা আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করল এবং আবদুল্লাহ ইবন তামুরের ন্যায় কলেমা পাঠ করল। তারপর তার লাঠি দ্বারা আবদুল্লাহকে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করে দিল। অবশেষে আবদুল্লাহ মারা গেল। রাজারও সেখানে মৃত্যু হল। এবার সকলে আল্লাহর দীন গ্রহণ করলেন।

আবদুল্লাহ মূলতঃ হযরত ঈসা (সা)-এর ইনজীলের অনুসারী ছিলেন। এরপর খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীগণের যে পরিণতি হয়েছিল, তাদের পরিণতিও তাই হয়েছিল। নাজরান অঞ্চলে খৃষ্ট ধর্মের প্রসারের এটাই ছিল মূল কারণ। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন তামুর সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবন কাব ও কতক নাজরান অধিবাসীর বর্ণনা এরূপই। প্রকৃত ঘটনা যে কোন‌টি, তা আল্লাহই ভাল জানেন। বর্ণনাকারী আরও বলেন, অতঃপর বাদশাহ য়ু-নুওয়াস তার সৈন্য সামন্তসহ এ খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। সে তাদেরকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ অথবা মৃত্যু এ দু’টোর যে কোন একটি বেছে নিতে বলে। তারা মৃত্যুকেই বছে নেয়। আক্রমণকারীরা বহু গর্ত খনন করে এবং তাতে আগুন জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে। অতঃপর ওদেরকে তরবারীর আঘাতে খণ্ড বিখণ্ড করে হাতপা কেটে ফেলে এবং অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারে। প্রায় বিশ হাজার খ্রীষ্টানকে তারা এভাবে হত্যা করে।

য়ুনুওয়াস ও তাঁর সৈন্যদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলের নিকট এ আয়াত নাযিল করেন।

( قُتِلَ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡأُخۡدُودِ ۝ ٱلنَّارِ ذَاتِ ٱلۡوَقُودِ )

[Surah Al-Buruj 4 - 5]

“ধ্বংস হয়েছিল কুণ্ড আধিপতিরা। ইন্ধনপূর্ণ যে কুণ্ডে ছিল অগ্নি।’ এতে বুঝা যায় যে, এই ঘটনা আর সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ঘটনা এক নয়।

কেউ কেউ বলেন যে, অগ্নিকুণ্ড বিষয়ক ঘটনা পৃথিবীতে একাধিক বার ঘটেছে। যেমন ইবন আবী হাতিম আবদুর রহমান ইবন জুবায়ের থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ইয়ামানে অগ্নিকুণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল তুব্বা রাজার আমলে। কনষ্টান্টিনোপালে ঘটেছিল রাজা কনষ্টান্টনাইনের আমলে যখন সে খৃষ্টানদেরকে হযরত ঈসা (আ)-এর কিবলা ও তার প্রচারিত একত্ববাদ থেকে ফিরিয়ে নেয়। সে তখন একটি অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করেছিল। যে সকল খৃষ্টান হযরত ঈসা (আ)-এর দীন ও তাঁর একত্ববাদে অবিচল ছিল, সে তাদেরকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মেরেছিল।

ইরাকের ব্যাবিলন শহরে এ ঘটনা ঘটেছিল? সম্রাট বুখত নসর (Nebuchad Negar)-এর শাসনামলে তিনি একটি মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই মূর্তিকে সিজদা করতে। লোকজন সিজদা করেছিল। কিন্তু দানিয়াল (আ) ও তাঁর দুইজন সাথী আযরিয়া ও মাসাইল সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানান। সম্রাট তাদের জন্যে একটি উনুন তৈরি করে। তাতে কাঠ ও আগুন জ্বালিয়ে সেই অগ্নিকুণ্ডে তাদের দুজনকে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য অগ্নিকুণ্ডকে শীতল ও শান্তিময় করে দেন এবং তাদেরকে আগুন থেকে রক্ষা করেন এবং অত্যাচারীদেরকে ঐ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। তারা ছিল সংখ্যায় ৯ জন। আগুন তাদেরকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। আসবাত বর্ণনা করেন যেঃ

( قُتِلَ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡأُخۡدُودِ )

[Surah Al-Buruj 4]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সুদ্দী বলেছেন, অগ্নিকুন্ড ছিল তিনটি। একটি সিরিয়ায়, একটি ইরাকে এবং অপরটি ইয়ামানে। এটি ইবন আবী হাতিমের বর্ণনা। সূরা বুরুজের তাফসীরে আমি অগ্নিকুণ্ড অধিপতিদের ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর।

৪৩
বনী ইসরাঈল থেকে ঘটনা বর্ণনায় অনুমতি প্রসঙ্গে
ইমাম আহমদ (র) আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ

حدثوا عني ولا تكذبوا على ومن كذب علي متعمدا فليتبوأ مقعده من النار وحدثوا عن بني اسرائيل ولا حرج

“আমার থেকে তোমরা হাদীস বর্ণনা কর। আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার আবাস স্থির করে নেয়। বনী ইসরাঈল থেকে বর্ণনা কর, তাতে কোন দোষ নেই।”

আহমদ (র) আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, আমার থেকে তোমরা কুরআন ব্যতীত অন্যকিছু লিখবে না। আমার থেকে কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু কেউ লিখে থাকলে তা মুছে ফেলবে। তিনি আরও বলেছেন, ইসরাঈলীদের থেকে বর্ণনা করতে পার, তাতে দোষ নেই। আমার থেকে হাদীস বর্ণনা কর। আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। যে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে- (বর্ণনাকারী হাম্মাম বলেন-আমার মনে হয় রাসূলুল্লাহ (সা) ইচ্ছাকৃত শব্দটি বলেছেন)। সে যেন জাহান্নামকেই তার আবাসস্থলরূপে নির্ধারণ করে নেয়। (মুসলিম, নাসাঈ)।

আবু আওয়ানা…… যায়দ ইবন আসলাম সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদ বলেন, হাম্মাম এতে ভুল করেছেন। আসলে এ উক্তিটি আবু সাঈদের। তিরমিযী (র) সুফিয়ান…… যায়দ ইবন আসলাম সূত্রে এ হাদীসের অংশ বিশেষ মারফু রূপে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইমাম আহমদ (র) ....... আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেনঃ

بلغوا عنى ولو اية

“তোমরা একটি আয়াত হলেও আমার থেকে প্রচার কর।” বনী ইসরাঈল থেকে বর্ণনা করতে পার, তাতে দোষ নেই। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে, সে তার বাসস্থান জাহান্নামে ধরে নিবে। অনুরূপভাবে ইমাম আহমদ (র) ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযী (র) ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী (র) বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ পর্যায়ের।

আবূ বকর বাযযার ...... আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) প্রায়ই রাতের বেলা আমাদের নিকট ইসরাঈলীদের ঘটনাবলী বর্ণনা করতেন। এভাবে ভোর হয়ে যেত। গুরুত্বপূর্ণ নামায ব্যতীত অন্য কোন কাজে আমরা ঐ মজলিস থেকে উঠতাম না। আবু দাউদেও বর্ণনাটি রয়েছে।

বাযযার ....... ইমরান ইবন হুসায়ন (রা) সূত্রে অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে বাযযারের মতে, হাদীসটি ইমরান ইবন হুসায়ন (রা) থেকে নয় বরং আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) থেকেই বর্ণিত।

আহমদ (র) ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে এ মর্মে আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন এবং তার সনদ সহীহ বলে উল্লেখ করেন।

হাকিম আবু ইয়ালা....... জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, তোমরা বনী ইসরাঈল সূত্র থেকে বর্ণনা কর, কেননা তাদেরকে উপলক্ষ করে বহু বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) বলতে শুরু করলেন যে, একদা বনী ইসরাইলের একদল লোক পথে বের হয়। তারা এসে একটি গোরস্থানে পৌঁছে। তারা পরস্পর বলাবলি করে যে, আমরা যদি দু’রাকআত নামায আদায় করে আল্লাহর নিকট দোয়া করি, অতঃপর এ গোরস্থান থেকে একজন মৃত ব্যক্তি বেরিয়ে আসে, তাহলে আমরা তাকে মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। তারা নামায অন্তে দোয়া করে। তখনই একজন লোক কবর থেকে মাথা তোলে। তার দু চক্ষুর মধ্যখানে সিজদার চিহ্ন। সে বলল, আপনারা আমার কাছে কি চান? একশ বছর আগে আমার মৃত্যু হয়েছে। এখনও আমার দেহ থেকে মৃত্যুর তাপ ঠাণ্ডা হয়নি। আপনারা আল্লাহর নিকট দোয়া করুন আল্লাহ যেন আমাকে আমার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেন। এটি একটি গরীব পর্যায়ে হাদীস। বস্তুত বনী ইসরাঈল থেকে ঘটনা বর্ণনা জায়েয সাব্যস্ত হলেও তাদ্বারা ঐ ঘটনাবলীর কথাই বুঝাবে, যেগুলোর যথার্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে সকল ঘটনাও বর্ণনা আমাদের নিকট সুরক্ষিত সত্যের বিপরীত ও বিরোধী হওয়ার প্রেক্ষিতে বাতিল ও অসত্য বলে প্রমাণিত। কিংবা সন্দেহমূলক হবে সেগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও প্রত্যাখ্যাত হবে। ওগুলোর ওপর নির্ভর করা যাবে না।

উপরন্তু ইসরাঈলী কোন বর্ণনা জায়েয হলেও তার বিশুদ্ধতায় বিশ্বাস স্থাপন জরুরী নয়। কেননা, এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (র) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, কিতাবীরা হিব্রু ভাষায় তাওরাত পাঠ করে এবং মুসলমানদের নিকট তা আরবী ভাষায় ব্যাখ্যা করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

لا تصيرقوا أهل الكتب ولا تكبوهم وقولوا أمنا بالله وما أنزل الينا وما أنزل اليگم وا لهنا والهكم واحد ونحن له مسلمون -

“তোমরা ইয়াহুদী-নাসারাদেরকে সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করবে না; বরং তোমরা বলবে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের নিকট যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি, আমাদের ইলাহ এবং তোমাদের ইলাহ এক, অভিন্ন। আমরা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।” ইমাম বুখারী (র) এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (র)...... আবু নামলা আনসারীর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। তখন সেখানে একজন ইয়াহুদী উপস্থিত হয়। সে বলে, ‘হে মুহাম্মদ (সা)! এ লাশটি কি কথা বলতে পারবে?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আল্লাহ ভাল জানেন।’ ইয়াহুদী বলল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এ লাশটি কথা বলবে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আহলি কিতাব তথা ইয়াহুদী- নাসারাগণ তোমাদের নিকট কোন কথা বললে তোমরা তাদেরকে সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করো না। বরং তোমরা এ কথা বলবে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, তার কিতাব সমূহের প্রতি, এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি।’ এতটুকু বলার ফলে তারা সত্যবাদী হয়ে থাকলে তোমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলছ না। আর তারা মিথ্যাবাদী হয়ে থাকলে তোমরা তাদেরকে সত্যবাদী বলছ না।’ হাদীসটি ইমাম আহমদ (র) এককভাবে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ .......জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, উমর ইবন খাত্তাব (রা) একদা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি কিতাব। আহলি কিতাবের জনৈক ব্যক্তি থেকে তিনি তা পেয়েছিলেন। তিনি সেটি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পাঠ করে শুনান। রাসূলুল্লাহ (সা) ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেন, ‘হে খাত্তাবের পুত্র। তোমরা কি এ শরীয়ত সম্পর্কে সন্দিহান? যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, আমি তোমাদের নিকট নিয়ে এসেছি সুস্পষ্ট আলোকময় দীন। তোমরা ওদের নিকট কিছু জানতে চাইবে না। তাহলে তারা হয়ত তোমাদের কে সত্য তথ্য দিবে কিন্তু তোমরা সেটাকে মিথ্যা গণ্য করবে। আবার তারা হয়ত তোমাদের কে অসত্য তথ্য দিবে, কিন্তু তোমরা তা সত্য বলে মেনে নেবে।’

لوان موسي كان حيا ما وسعه الأ أن يتبعني

‘যে পবিত্র সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার কসম, মূসা (আ)-ও যদি এখন জীবিত থাকতেন তাহলে আমার অনুসরণ না করে তার কোন উপায় থাকতো না।’ এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (র) এককভাবে উদ্ধৃত করেছেন। অবশ্য এর সনদ ইমাম মুসলিম (র)-এর শর্ত পূরণ করে।

এ সব হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসরাঈলীরা তাদের প্রতি নাযিলকৃত আসমানী কিতাবকে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছে। এসবেব ভুল ব্যাখ্যা করেছে এবং এগুলোর অপব্যবহার করেছে। বিশেষত সে সব আরবী ভাষ্যের ক্ষেত্রে যেগুলো তারা উদ্ধৃত করে থাকে, এগুলো সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। ঐ কিতাবগুলো তাদেরই ভাষায় নাযিল হওয়া সত্ত্বেও তারা এর ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা করে থাকে। এমতাবস্থায় অন্য ভাষায় তার সঠিক ব্যাখ্যা তারা কেমন করে করবে? এ জন্যে তাদের আরবী উদ্ধৃতিতে প্রচুর ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। তা ছাড়া তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ও অশুভ মনোভাব তো রয়েছেই। যে ব্যক্তি তাদের বর্তমান কিতাবগুলো মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করবে এবং তাদের ভুল ব্যাখ্যা ও জঘন্য বিকৃতিগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে তাদের বিকৃতি ও পরিবর্তন-পরিবর্ধন তার নিকট স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। আল্লাহই সাহায্যকারী ও রক্ষাকারী।

তাওরাত কিতাবের কিছু অংশ তারা প্রকাশ করে। কিন্তু তারা অধিকাংশই তা গোপন রাখে। এর যতটুকু তারা প্রকাশ করে তার মধ্যে রয়েছে সত্য বিকৃতি ও ভুল ব্যাখ্যা। যারা ওদের বক্তব্য, প্রকাশিত বিবৃতি, অপ্রকাশিত তথ্য এবং শব্দ ও অর্থগত দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ ভাষ্যগুলো পর্যালোচনা করবে, তাদের নিকট তা ধরা পড়বে।

ইসরাঈলীদের থেকে যিনি সর্বাধিক ও সর্বোত্তম ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন তিনি হচ্ছেন কা’ব আল-আহবার। উমর (রা)-এর যুগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আহলি কিতাব থেকে তিনি কিছু কিছু বিষয় বর্ণনা করতেন। ইসলামের কষ্টিপাথরে সত্যের অনুকূল হওয়ার এবং তার মনকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে উমর (রা) তাঁর কতক বর্ণনা ভাল বলে গ্রহণ করতেন। এর ফলে বহু মানুষ কাব আল-আহবার থেকে তার বর্ণনাগুলো সংগ্রহ করার সুযোগ পায়। তিনিও সে সকল বিষয়াদি ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছেন, যেগুলোর অধিকাংশেরই কানাকড়ি মূল্য নেই। এর কতক নিশ্চিতভাবেই অসত্য আর কতক সত্য ও বিশুদ্ধ। আমাদের নিকট প্রমাণিত সত্য এ গুলোকে সমর্থন করে।

ইমাম বুখারী (র) হাযীদ ইবন আবদুর রহমান সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি মুআবিয়া (রা)-কে মদীনা শরীফে একদল কুরায়শ বংশীয় লোকের নিকট হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছেন। প্রসঙ্গক্রমে কাব আল আহবারের কথা উল্লেখিত হয়। মুআবিয়া (রা) বলেন, ‘আহলি কিতাব থেকে যারা বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে কা’ব আল-আহবার সর্বাধিক সঠিক ও সত্য তথ্য বর্ণনাকারী।’ এতদসত্ত্বেও আমরা তার বর্ণনায় অসত্য তথ্য দেখতে পাই। অর্থাৎ তাঁর অজ্ঞাতসারেই এরূপ ঘটেছে।

ইমাম বুখারী (র)...... হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘ইয়াহুদী নাসারাদের নিকট লোকে কোন বিষয়ে জানতে চায় কিভাবে? অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের প্রতি যে কিতাব নাযিল করেছেন তোমাদের সেই কিতাব তো সর্বশেষ আসমানী কিতাব। তোমরা এটি তিলাওয়াত করে থাকো— যা খাঁটি ও নির্ভেজাল।’

আল্লাহ তাআলা তো তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইয়াহুদী-নাসারাগণ তাদের কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তন করেছে এবং তাদের নিজ হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর কিতাব বলে চালিয়ে দিয়েছে, স্বল্প মূল্যের পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। তোমাদের নিকট যে জ্ঞান এসেছে তা কি তোমাদের কে ওদের নিকট কিছু জিজ্ঞেস করতে বারণ করেনি? আল্লাহর কসম, আমি তো ওদের কাউকেই তোমাদের প্রতি নাযিলকৃত কিতাব সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতে দেখি না।

ইবন জারীর (র) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) বলেছেন, ‘তোমরা ইয়াহুদী নাসারাদের নিকট কিছু জানতে চেয়ে না। কারণ তারা তোমাদের কে সত্য পথ দেখাবে না। তারা নিজেরাই তো পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাদের কথা শুনলে তোমরা হয়ত সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে ধারণা করবে।’ আল্লাহই ভাল জানেন।

বনী ইসরাঈলের তাপস জুরায়জের ঘটনা

ইমাম আহমদ (র)....... আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘তিনজন ছাড়া মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় আর কেউ কথা বলেনি। ১। ঈসা ইবন মরিয়ম (আ), ২। বনী ইসরাঈলের একজন ইবাদতগুজার লোক, যার নাম ছিল জুরায়জ। একটি ইবাদতখানা তৈরি করে তিনি ওখানে ইবাদত করতেন। জুরায়জের ইবাদতের কথা বনী ইসরাঈলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাদেরই একজন ব্যাভচারিণী বলে যে, তোমরা চাইলে আমি ওকে জব্দ করে দিতে পারি। লোকজন বলল, ঠিক আছে, আমরা তাই চাই। সে তখন জুরায়জের নিকট এসে নিজেকে তার কাছে পেশ করল। জুরায়জ সেদিকে তাকিয়েও দেখলেন না। জুরায়জের ইবাদতখানার পাশে একটি রাখাল তার বকরী চরাতো। সে তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাতে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। যথাসময়ে সে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে। লোকজন জিজ্ঞেস করল, এটি কার সন্তান? সে বলল, জুরায়জের। তারা তখন জুরায়জের ইবাদতখানায় চড়াও হয়। তারা তাকে টেনে নামায়। এমনকি তারা গালাগালি করে, প্রহার করে তার ইবাদত খানাটি ভেঙ্গে দেয়। তখন জুরায়জ বললেন, ব্যাপার কি? তারা বলল, তুমি এ স্ত্রী লোকটির সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েছ। ফলে সে একটি ছেলে প্রসব করেছে। জুরায়জ বললেন, সে ছেলেটি কোথায়? তারা বলল, এই যে। জুরায়জ তখন উঠে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেন। আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। তারপর ছেলেটির নিকট গিয়ে আঙ্গুলে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘হে বালক! আল্লাহর কসম, তোমার জন্মদাতা কে?’ সে বলল, ‘আমি রাখালের পুত্র।’ এটা শুনে সবাই জুরায়জের দিকে অগ্রসর হয় এবং তাকে চুমো খেতে থাকে। তারা বলে, ‘আমরা সোনা দিয়ে আপনার ইবাদতখানা তৈরি করে দেব।’ জুরায়জ বললেন, ‘না, তা আমার দরকার নেই। পূর্বে যেমন ছিল তেমন করে মাটি দিয়েই তৈরি করে দাও!’ রাসূলুল্লাহ। (সা) বললেন, ‘তৃতীয়জন হল জনৈকা মহিলা তার শিশুকে কোলে নিয়ে দুধ পান করাচ্ছিল। সেখান দিয়ে একজন সুসজ্জিত ঘোড় সওয়ার অতিক্রম করছিল। মহিলাটি বলল, ‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে এ লোকের ন্যায় বানিয়ে দিন!’ এটা শুনে শিশুটি তার মায়ের স্তন ছেড়ে দেয় এবং ঘোড় সওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ওর মত করবেন না।’ এরপর সে পুনরায় মায়ের স্তনে ফিরে আসে এবং তা চুষতে থাকে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি যেন এখনও দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা) শিশুর ঐ কাজটি দেখিয়ে দিচ্ছেন এবং তিনি তাঁর নিজের আঙ্গুল মুখে পুরে তা চুষছেন।

এরপর মহিলাটি একজন ক্রীতদাসীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল। লোকজন তাকে প্রহার করছিল। মহিলাটি বলল, ‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে ওই ক্রীতদাসীর ন্যায় করবেন না।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বলছিলেন যে, তখনই শিশুটি তার মায়ের স্তন ছেড়ে দেয় এবং ক্রীতদাসীর প্রতি তাকিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে এই ক্রীতদাসীর মত করবেন।’ তখন মা-ছেলের মধ্যে এরূপ কথোপকথন শুরু হয়।

মা-টি বলে, ‘আমার পেছন দিয়ে সুসজ্জিত অশ্বারোহী যাচ্ছিল, আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে এই এর মত বানাবেন। তখন তুমি বললে যে, হে আল্লাহ! আমাকে ওর মত বানাবেন না। তারপর আমি এই ক্রীতদাসীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে ঐ ক্রীতদাসীর মত বানাবেন না। তুমি বললে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ওর মত বানাবেন।’ এর রহস্য কি?’ জবাবে শিশুটি বলল, ‘আম্মাজান, অশ্বারোহী সুসজ্জিত ব্যক্তিটি একজন প্রতাপশালী ও অত্যাচারী লোক। আর ওই ক্রীতদাসীটি একজন অসহায় মহিলা। তারা তাকে ব্যভিচারের অপবাদ দিচ্ছে। অথচ সে তা করেনি। তারা বলছে, তুই চুরি করেছিস! অথচ সে চুরিও করেনি। সে সর্বাবস্থায় বলছিল— আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট।’

ইমাম বুখারী (র) ‘আম্বিয়া’ সংক্রান্ত অধ্যায়ে এবং জুলুম সংক্রান্ত অধ্যায়ে এবং মুসলিম (র) আদব অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (র)........ আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘জুরায়জ একদা তার ইবাদতখানায় ইবাদত করছিলেন, এমন সময় সেখানে তার মা এসে হাজির হন। তিনি বলেন, ‘হে জুরায়জ! আমি তোমার মা, আমার সঙ্গে কথা বল!’ হাদীস বর্ণনার সময় রাসূলুল্লাহ (সা) কিভাবে তাঁর ডান ভ্রু-এর ওপর হাত রেখেছিলেন আবু হুরায়রা (রা) তা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। জুরায়জের মা যখন হাজির হন তখন জুরায়জ ছিলেন নামাযের মধ্যে। মনে মনে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি এখন কি করি, একদিকে মা অপর দিকে নামায।’ শেষ পর্যন্ত তিনি নামাযকেই প্রাধান্য দেন। তার মা তখন ফিরে চলে যায়। এরপর তার মা পুনরায় তার নিকট আসেন। ঘটনাক্রমে তখনও তিনি নামাযে রত ছিলেন। মা ডেকে বললেন, ‘হে জুরায়জ! আমি তোমার মা। আমার সাথে কথা বল।’ তিনি মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ। একদিকে নামায, অপর দিকে আমার মা। আমি তখন কি করি? শেষ পর্যন্ত তিনি নামাযকেই প্রাধান্য দিলেন।

তখন মা বললেন, ‘হে আল্লাহ! এই জুরায়জ, আমার পুত্র। আমি তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম সে আমার সাথে কথা বলেনি। হে আল্লাহ! কোন ব্যভিচারিণীর হাতে লাঞ্ছিত না করে তার মৃত্যু দিবেন না। কোন ব্যভিচারিণী তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে ডাকলে হে আল্লাহ! আপনি তাকে ফাঁদে ফেলার ব্যবস্থা করে দিবেন।’

একজন রাখাল জুরায়জের ইবাদতখানার পাশে রাত্রি যাপন করত। এক রাতে এক মহিলা বেরিয়ে আসে। রাখাল তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। ফলে সে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে। লোকজন বলে ‘এটি কার সন্তান?’ সে বলল, ‘এই ইবাদতখানার মালিকের সন্তান।’ লোকজন তাদের কুঠারাদি নিয়ে জুরায়জের ইবাদত খানায় উপস্থিত হয় এবং চীৎকার করে তাঁকে ডাকতে থাকে। তিনি নিরুত্তর রইলেন। এরপর তারা তাঁর ইবাদতখানাটি ভাঙ্গতে শুরু করে। তিনি বেরিয়ে তাদের নিকট আসেন। তারা বললো, এই মহিলাটির সাথে কথা বল। তিনি বললেন, আমি তো তাকে হাসতে দেখছি। তারপর তিনি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার পিতা কে?’ জবাবে শিশুটি বলল, ‘আমার পিতা বকরীর রাখাল।’ তখন তারা বলল, “হে জুরায়জ। তোমার যে ইবাদতখানাটি আমরা নষ্ট করেছি তা আমরা সোনা-রূপা দিয়ে নির্মাণ করে দিব।’ তিনি বললেন, ‘না, বরং পূর্বে যেমন ছিল তেমন করে তৈরি করে দাও।’ তখন তারা তাই করলো। ইমাম মুসলিম (র) ‘অনুমতি প্রার্থনা’ পর্বে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।

ইমাম আহমদ (র) আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে এ মর্মে আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন। তাতে রাখাল পুরুষের স্থলে রাখাল স্ত্রী লোকের উল্লেখ রয়েছে। তাতে বর্ণিত হয়েছে যে, এক রাখাল বালিকা নিজেদের বকরী চরাত। সে এসে জুরায়জের ইবাদতখানার ছায়ায় বসত। একদিন সে কোন এক লোকের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং তাতে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সে জনতার হাতে ধরা পড়ে যায়। তখনকার বিধান ছিল ব্যভিচারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত। লোকজন বলল, ‘এ সন্তানটি কার?’ রাখাল মহিলাটি বলল, ‘ইবাদতখানার মালিক জুরায়জের।’ লোকজন তাদের কুঠারাদি নিয়ে ইবাদতখানার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। তারা বললো, ‘হে জুরায়জ, হে ভণ্ড ইবাদতকারী! বেরিয়ে আয়।’ জুরায়জ নেমে আসতে অস্বীকৃতি জানালো এবং নামাযে রত রইলেন। লোকজন তার ইবাদতখানা ভাঙা শুরু করে। এ অবস্থা দেখে তিনি নিচে নেমে আসেন। তারা জুরায়জ এবং উক্ত মহিলার গলায় রশি বেঁধে দুজনকে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরাতে থাকে।

ইত্যবসরে জুরায়জ তাঁর আঙ্গুলী মহিলার পেটে রেখে বলেন, ‘হে শিশু তোমার পিতা কে?’ গর্ভস্থিত শিশু বলে ওঠে, ‘আমার পিতা বকরীর রাখাল ওমুক ব্যক্তি।’ লোকজন তখন জুরায়জকে চুমু খেতে শুরু করে। তারা বলে যে, ‘আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমরা সোনা-রুপা দিয়ে আপনার ইবাদতখানা তৈরি করে দেব।’ তিনি বললেন, ‘না, দরকার নেই। বরং পূর্বে যেরূপ ছিল সেইরূপেই পুনঃ নির্মাণ করে দাও।’ এটি একটি গরীব পর্যায়ের হাদীস। এর সনদ ইমাম মুসলিমের শর্ত পূরণ করে।

উল্লেখিত তিনজন ব্যক্তি মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় কথা বলেছেন। ঈসা ইবন মরিয়ম (আ) তাঁর ঘটনা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। জুরায়জের ইবাদত খানার পার্শ্ববর্তী রাখালের ঔরসে যেনাকারিণীর পুত্র। যা এইমাত্র বর্ণিত হলো। তার নাম ছিল ইয়াবূস। ইমাম বুখারী (র) স্পষ্টভাবে এটি উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয় ব্যক্তি হল দুগ্ধদানকারিণী মহিলার কোলে থাকা পুত্র। মহিলা কামনা করেছিল তার পুত্র যেন সুসজ্জিত অশ্বারোহীর মত হয়। আর পুত্র চেয়েছিল সে যেন অপবাদ প্রাপ্তা অথচ নির্দোষ মহিলার ন্যায় হয়। দাসীটি অনবরত বলছিল—“আল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক।’ ইতিপূর্বে মুহাম্মদ ইবন সীরীন আবু হুরায়রা (রা) থেকে মারফু সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম আহমদ (র) হাওয়া..... আবু হুরায়রা (রা) সনদে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে দুগ্ধপোষ্য এ শিশুর ঘটনা উদ্ধত করেছেন। এ সনদটিও হাসান পর্যায়ের।

ইমাম বুখারী (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন যে, একজন মহিলা তার পুত্রকে দুধ পান করাচ্ছিল। এমতাবস্থায় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল এক অশ্বারোহী। মহিলাটি এ বলে দোয়া করে, ‘হে আল্লাহ! আমার পুত্র ঐ আশ্বরোহীর মত না হওয়া পর্যন্ত তার মৃত্যু দিবেন না।’ ছেলেটি বলে উঠল, ‘হে আল্লাহ আমাকে ঐ অশ্বারোহীর মত বানাবেন না।’ তারপর পুনরায় দুধ চুষতে থাকে।

অতঃপর তারা পথে দেখল, একজন মহিলা—তাকে টেনে টেনে নেয়া হচ্ছে। আর তাকে নিয়ে সবাই হাস্য, কৌতুক ও খেলা করছে। শিশুর মাতা বলল, ‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে ঐ মহিলার মত বানাবেন না।’ ছেলে বলল, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ঐ মহিলার মত বানাবেন।’ অতঃপর ব্যাখ্যা স্বরূপ ছেলেটি বলল, ‘ওই যে অশ্বারোহী সে তো কাফির। আর ঐ ক্রীতদাসী—লোকজন বলছে, সে যেনা করেছে, আর সে বলছে, আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। তারা বলছে, সে চুরি করেছে; সে বলছে, আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট।’ যারা মায়ের কে থাকা অবস্থায় কথা বলেছে, তাদের মধ্যে ইউসুফ (আ)-এর পক্ষে সাক্ষ্যদাতা শিশুটিও রয়েছে যা ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ফিরআওন পরিবারের চুল বিন্যাসকারিণীর শিশুটিও রয়েছে। আল্লাহ ভাল জানেন।

৪৪
বারসীসা-এর ঘটনা
এটি জুরায়জের ঘটনার বিপরীত। জুরায়জ ছিলেন পুতঃপবিত্র আর বারসীসা ছিল পথ-ভ্রষ্ট। আল্লাহ তাআলার বাণীঃ

( كَمَثَلِ ٱلشَّیۡطَـٰنِ إِذۡ قَالَ لِلۡإِنسَـٰنِ ٱكۡفُرۡ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّی بَرِیۤء مِّنكَ إِنِّیۤ أَخَافُ ٱللَّهَ رَبَّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ فَكَانَ عَـٰقِبَتَهُمَاۤ أَنَّهُمَا فِی ٱلنَّارِ خَـٰلِدَیۡنِ فِیهَاۚ وَذَ  ٰ⁠ لِكَ جَزَ  ٰ⁠ ۤؤُا۟ ٱلظَّـٰلِمِینَ )

[Surah Al-Hashr 16 - 17]

“এরা শয়তানের মত, সে মানুষকে বলে, কুফরী কর, তারপর যখন সে কুফরী করে তখন সে বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।” (৫৯ হাশরঃ ১৬-১৭)

ফলে উভয়ের পরিণাম হবে জাহান্নাম। সেথায় তারা স্থায়ী হবে। আর এটাই জালিমদের কর্মফল। এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইবন জারীর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) সূত্রে বলেন, একজন মহিলা বকরী চরাত। তার ছিল চার ভাই। রাতের বেলা সে ধর্মযাজকের উপাসনালয়ে এসে আশ্রয় নিত।

একদিন যাজক এসে তার সাথে কুকর্ম করে। তাতে সে অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়ে। শয়তান এসে প্ররোচণা দিয়ে বলে, মহিলাকে খুন করে মাটি চাপা দিয়ে দাও। লোকে তো তোমাকে বিশ্বাস করে। তারা তোমার কথা শুনবে। শয়তানের প্ররোচণায় সে মহিলাটিকে খুন করে এবং মাটি চাপা দিয়ে দেয়। এবার শয়তান স্বপ্নে মহিলার ভাইদের নিকট উপস্থিত হয়। তাদেরকে বলে যে, উপসনালয়ের যাজক তোমাদের বোনের সাথে কুকর্ম করেছে এবং সে অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়ায় তাকে খুন করে অমুক স্থানে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে। সকাল হলে ভাইদের একজন বললো, ‘আল্লাহর কসম! গত রাতে আমি এক আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখি, সেটি তোমাদের কে বলব কি বলব না তা স্থির করতে পারছি না।’

অন্যরা বলল, ‘তুমি বরং ঐ স্বপ্নের কথা আমাদেরকে বল।’ সে তা বর্ণনা করলো। অন্যজন বললো, ‘আল্লাহর কসম, আমিও স্বপ্নে তাই দেখেছি।’ তৃতীয়জন বললো, ‘আমিও তাই দেখেছি।’ তখন তারা বলাবলি করে যে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। তারা সবাই তাদের শাসনকর্তাকে যাজকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তারপর সবাই যাজকের নিকট যায় এবং তাকে উপাসনালয় থেকে নামিয়ে আনে। এ সময়ে শয়তান যাজকের নিকট উপস্থিত হয়ে বলে, আমিই তোমাকে এ বিপদে ফেলেছি। আমি ছাড়া কেউ তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। সুতরাং তুমি আমাকে একটি সিজদা কর; আমি তোমাকে যে বিপদে ফেলেছি তা থেকে উদ্ধার করব।’ সে মতে সে তাকে সিজদা করল। তারপর শাস্তি বিধানের জন্যে যখন শাসনকর্তার নিকট তাকে নিয়ে গেল তখন শয়তান সেখান থেকে কেটে পড়ে তখন তাকে নিয়ে হত্যা করা হয়। ইবন আব্বাস (রা) সূত্রেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।

আমিরুল মুমিনীন আলী ইবন আলী তালিব (রা) থেকে অন্য এক সনদে এ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। ইবন জারীর আবদুল্লাহ ইবন নাহীদকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আমি আলী (রা)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলছিলেন, এক ধর্মযাজক দীর্ঘ ষাট বছর ধরে ইবাদত করেছিল। শয়তান তাকে জব্দ করতে ফন্দি আঁটে। অতঃপর সে এক মহিলার ওপর আছর করে। সে মহিলার কয়েকটি ভাই ছিল। ভাইদেরকে সে বলল, ওকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাজকের কাছে নিয়ে যাও। ভাইয়েরা মহিলাটিকে যাজকের নিকট নিয়ে যায়। তার চিকিৎসা করল। মহিলাটি কয়েকদিন তার ওখানে ছিল। একদিনের কথা। মহিলার প্রতি আসক্ত হয়ে সে তার সাথে কুকর্মে লিপ্ত হয়। সে তাতে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। অবশেষে যাজকটি তাকে হত্যা করে। তার ভাইয়েরা বোনের খোজে যাজকের নিকট আসে। এ দিকে শয়তানও তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘এক সময় তুমি আমাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলে। এখন আমিই তোমাকে দিয়ে এসব কাণ্ড ঘটিয়েছি। অতএব এখন তুমি আমার আনুগত্য কর। আমি তোমাকে উদ্ধার করব। তুমি আমাকে একটি সিজদা কর।’ যাজকটি তাকে সিজদা করল। তখন শয়তান বলল, ‘এখন তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

( كَمَثَلِ ٱلشَّیۡطَـٰنِ إِذۡ قَالَ لِلۡإِنسَـٰنِ ٱكۡفُرۡ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّی بَرِیۤء مِّنكَ إِنِّیۤ أَخَافُ ٱللَّهَ رَبَّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah Al-Hashr 16]

“এরা শয়তানের মত, সে মানুষকে বলে, কুফরী কর। অতঃপর যখন সে কুফরী করে, তখন সে বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি” (৫৯ হাশরঃ ১৬)

৪৫
গুহায় আশ্রয় গ্রহণকারী তিন ব্যক্তির ঘটনা
পূর্বেকার যামানার তিন ব্যক্তি একদা একটি গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। গুহার মুখটি অকস্মাৎ রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন তারা নিজেদের সৎকর্মের উসিলা দিয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। আল্লাহ তাদেরকে বিপন্মুক্ত করেন।

ইমাম বুখারী (র) ইবন উমার (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের পূর্বেকার যুগের তিনজন লোক পথ চলছিল। হঠাৎ তারা ঝড়ে পতিত হয়। তারা একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। তখন অকস্মাৎ গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তারা পরস্পরে বলাবলি করতে থাকে, ‘আল্লাহর কসম! এই বিপদটি থেকে যে কোন পুণ্যকর্মের উসিলা ব্যতীত তোমরা মুক্তি পাবে না। এখন প্রত্যেকেই নিজ নিজ উত্তম কর্মের উসিলা দিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া কর।’ তাদের একজন বলেন, দোয়া শুরু করল, “হে আল্লাহ’ আপনি তো জানেন, আমার এক শ্রমিক ছিল। এক ফুরক [মদীনা শরীফে প্রচলিত তিন সা বা দশ কেজি বিশিষ্ট মাপপাত্র] ধান পারিশ্রমিক ধার্য করে সে আমার কাজে নিয়োজিত হয়েছিল। কাজ শেষে পারিশ্রমিক না নিয়েই সে চলে যায়। অতঃপর তার সে ধান আমি জমিতে বপন করে ফসল উৎপন্ন করি। ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে তা দিয়ে আমি একটি গাভী ক্রয় করি। একদিন সে আমার নিকট তার পারিশ্রমিক নেয়ার জন্যে আসে। আমি বলি, ওই যে গাভী তা তুমি নিয়ে যাও। সে আমাকে বলে, আমার তো আপনার নিকট শুধু এক ফুরক ধানই পাওনা। আমি বলি, তোমার সে ধান থেকেই এই গাভী তুমি তা নিয়ে যাও। সে তখন ঐ গাভীটি নিয়ে চলে যায়। হে আল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন যে, আপনার ভয়েই আমি এরূপ করেছি, তবে আমাদেরকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। এতে পাথর একটুখানি ফাক হয়ে যায়।

অপর একজন বলেন, হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন, আমার ঘরে বৃদ্ধ মাতা পিতা ছিলেন। প্রতি রাতে আমি তাদেরকে বকরীর দুধ পান করাতাম। এক রাতে আমার আসতে বিলম্ব হয়ে যায়। আমি যখন আসি, তখন আমার পিতামাতা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমার পরিবার-পরিজন ও ছেলে-মেয়েরা তখনও ক্ষুধায় ছটফট করছিল, কান্নাকাটি করছিল। আমার পিতামাতা দুধ পান না করা পর্যন্ত আমি পরিবারের কাউকেই দুধ পান করতে দিতাম না। এ সময়ে আমি পিতামাতাকে ঘুম থেকে জাগ্রত করা সমীচীন মনে করিনি। আবার তাদেরকে রেখে পরিবারের অন্যদেরকে দুধ খেতে দেয়াও পছন্দ করিনি। আমি তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষায় থাকি। এভাবে ভোর হয়ে যায়। হে আল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন যে, আমার ভয়ে আমি এরূপ করেছি তাহলে আমাদের বিপদ দূর করে দিন! অতঃপর গুহার মুখের পাথর আরেকটু ফাক হয়ে যায়, যাতে আকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তাদের অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন, আমার এক চাচাত বোন ছিল। সে ছিল আমার সর্বাধিক প্রিয়। আমি তাকে কুকর্মের জন্য প্ররোচিত করি। একশ’টি স্বর্ণ মুদ্রা না দেওয়া পর্যন্ত সে তাতে অস্বীকৃতি জানায়। আমি সে পরিমাণ স্বর্ণ মুদ্রা অর্জনের চেষ্টা চালাই। আমি তা সংগ্রহ করে তা তার হাতে তা অৰ্পণ করি। তখন সে আমাকে সুযোগ দেয়। আমি যখন চূড়ান্ত মুহূর্তে উপনীত হই তখন সে বলে ওঠে, আল্লাহকে ভয় করুন! বৈধ পন্থায় ব্যতীত আমার শ্লীলতাহানি করবেন না। তখনই আমি উঠে আসি এবং আমার একশ’ স্বর্ণ মুদ্রাও রেখে আসি। হে আল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন যে, আপনার ভয়েই আমি তা করেছি, তবে আমাদের বিপদ দূর করে দিন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের বিপদ দূর করে দিলেন। তারা গুহা থেকে বেরিয়ে আসে।

ইমাম মুসলিম (র) ইমাম আহমদ (র) নিজ নিজ সনদে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমদের একটি বর্ণনায় কিছু অতিরিক্ত কথাও রয়েছে। বাযযারও অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন।

৪৬
অন্ধ, কুষ্ঠ ও টাক মাথাওয়ালা তিন ব্যক্তির ঘটনা
ইমাম বুখারী (র) ও মুসলিম (র) একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন যে, বনী ইসরাইলের তিন ব্যক্তি একজন কুষ্ঠ রোগী, একজন অন্ধ, একজন টাক মাথা বিশিষ্ট ছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাদের নিকট আল্লাহ তাআলা একজন ফিরিশতা পাঠালেন। তিনি প্রথম কুষ্ঠরোগীর নিকট উপস্থিত হন।

ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কি?’ সে বলে, ‘সুন্দর রং ও সুন্দর ত্বক। লোকজন এখন আমাকে ঘৃণা করে।’ ফিরিশতা তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। ফলে তার রোগ বিদূরিত হয়। তাকে সুন্দর রং ও সুন্দর ত্বক দান করা হয়। ফিরিশতা আবার বলেন, ‘কোন সম্পদ তোমার নিকট প্রিয়?’ সে বলে, ‘উট। অথবা সে বললো গাভী।‘ (কুষ্ঠ রোগী ও টেকো মাথা বিশিষ্ট এ দু’জনের একজন উট চেয়েছিল অপরজন চেয়েছিল গাভী। তাদের কে উট চেয়েছিল আর কে গাভী চেয়েছিল তা নিয়ে রাবীর সন্দেহ রয়েছে।) ফিরিশতা একটি দশ মাসের গর্ভবতী উটনী তাকে প্রদান করেন এবং বলেন, ‘এতে আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন!’

রাসূলুল্লাহ বলেন, অতঃপর ফিরিশতা আসেন টেকো মাথা বিশিষ্ট ব্যক্তির নিকট। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন। ‘কোন বস্তু তোমার প্রিয়?’ জবাবে সে বলে। ‘আমার প্রিয় হল সুন্দর চুল, আর এই টাক যেন দূরীভূত হয়। লোকজন তো এখন আমাকে ঘৃণা করে।’ ফিরিশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। টাক দূরীভূত হয় এবং তার মাথায় সুন্দর চুল গজায়। আবার ফিরিশতা বলেন, ‘কোন সম্পদ তোমার নিকট প্রিয়?’ সে বলে, ‘গরু।‘ ফিরিশতা তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দান করেন এবং বলেন, ‘আল্লাহ এতে তোমাকে বরকত দিন!’

এবার ফিরিশতা আসেন অন্ধ ব্যক্তির নিকট। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কি?’ সে বললো, ‘আল্লাহ যেন আমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেন। আমি যেন লোকজনকে দেখতে পাই।’ ফিরিশতা তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। আল্লাহ তাআলা তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। ফিরিশতা বললেন, ‘কোন সম্পদ তোমার প্রিয়?’ সে বলে, ‘ছাগল।’ তিনি তাকে একটি গর্ভবতী বকরী দান করেন।

ইতিমধ্যে উটনী, গাভী ও বকরী বাচ্চা দিতে থাকে। ক্রমে ক্রমে উট ওয়ালার মাঠ উটে ভর্তি হয়ে যায়। গাভীওয়ালার মাঠ পূর্ণ হয়ে যায় গরুতে। আর বকরী ওয়ালার মাঠ পরিপূর্ণ হয় বকরীতে।

এরপর একদিন ফেরেশতা কুষ্ঠরোগীর নিকট তার পূর্বের আকৃতি নিয়ে উপস্থিত হন। তিনি বললেন, ‘আমি একজন মিসকিন। সফরে এসে আমার যা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। আল্লাহর সাহায্য এবং অতঃপর আপনার সহযোগিতা ব্যতীত আমার দেশে ফেরার কোন উপায় নেই। যে আল্লাহ আপনাকে সুন্দর দেহ, বর্ণ ও সুন্দর ত্বক দান করেছেন তাঁর দোহাই দিয়ে আপনার নিকট আমি একটি উট ভিক্ষা চাইছি। আমার সফর কালে সেটি কাজে লাগবে।’ সে বলল, ‘মানুষের চাহিদার শেষ নেই।’ ফেরেশতা বলেন, ‘আপনাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি না কুষ্ঠ রোগী ছিলেন? মানুষ আপনাকে ঘৃণা করত। আর আপনি ছিলেন দরিদ্র। আল্লাহই তো আপনাকে সব সম্পদ দান করেছেন।’ সে বলল, ‘আমি তো বংশানুক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে এ সম্পদের মালিক হয়েছি।’ ফেরেশতা বললেন, ‘তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো, তাহলে আল্লাহ যেন তোমাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেন!’

এরপর ফেরেশতা টেকো মাথা লোকের নিকট তাঁর আকৃতি নিয়ে আসলেন। কুষ্ঠরোগীকে যেরূপ বলেছিলেন, তাকেও সেরূপ বললেন। সেও ঐ কুষ্ঠরোগীর মত উত্তর দিল। ফেরেশতা বললেন, ‘তুমি মিথ্যাবাদী হলে আল্লাহ যেন তোমাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেন!’

এরপর ফেরেশতা অন্ধ ব্যক্তির নিকট তাঁর আকৃতিতে আসলেন। তিনি বললেন, ‘আমি মিসকিন ও মুসফির ব্যক্তি। সফরে এসে আমার সহায় সম্বল ফুরিয়ে গিয়েছে। আল্লাহর সাহায্য ও তারপর আপনার সহায়তা ব্যতীত আমার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। যে মহান আল্লাহ আপনাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন তার দোহাই দিয়ে আমি আপনার নিকট একটি বকারী যাঞ্চা করছি। ওটি দ্বারা আমার সফরের প্রয়োজনীয় খরচ মিটাবো।’ বকরী ওয়ালা বলল, ‘আমি ছিলাম অন্ধ। আল্লাহ আমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি ছিলাম দরিদ্র। আল্লাহ আমাকে ধনী বানিয়েছেন। তোমার যেটা পছন্দ সেটা নিয়ে যাও। আল্লাহর নামে তুমি আজ যেটিই নিবে আমি তাতে দুঃখ পাব না।’ ফিরিশতা বললেন, ‘আপনার মাল আপনি রেখে দিন। বস্তুত আল্লাহ আপনাদের তিনজনকে পরীক্ষা করলেন। আপনার প্রতি আল্লাহর রাজী হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনার অপর দুই সাথীর প্রতি আল্লাহ নারাজ ও অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’

এটি ইমাম বুখারী (র)-এর ভাষ্য। বনী ইসরাঈল বিষয়ক হাদীসসমূহে তিনি এটি উদ্ধৃত করেছেন।

৪৭
এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ধার নিয়ে তা পরিশোধের ঘটনা
ইমাম আহমদ (র) বলেন, হযরত হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বনী ইসরাঈলের এক লোকের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উক্ত লোক বনী ইসরাঈলের অন্য এক ব্যক্তি থেকে এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা ধার চেয়েছিল। ঋণদাতা বললো, ‘কয়েকজন সাক্ষী নিয়ে আস।’ সে বললো, ‘সাক্ষীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট।’ ঋণদাতা বলেছিল, ‘একজন জামিন নিয়ে আসুন।’ সে বলল, ‘জামিন হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ ঋণদাতা তখন বলে, ‘তুমি যথার্থই বলেছো।’

সে মতে সে তাকে এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিল। ঋণ গ্রহিতা এরপর এক সমুদ্র যাত্রায় বের হয়। তার কাজ শেষ হলে নির্দিষ্ট সময়ে সে ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্যে ঋণ দাতার নিকট পৌঁছার জন্যে একটি বাহন খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোন বাহন সে খুঁজে পায়নি। তখন সে একটি কাষ্ঠখণ্ড সংগ্রহ করে। সেটিকে ছিদ্র করে। এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা এবং ঋণদাতার উদ্দেশ্যে লিখিত একটি চিঠি সে ঐ ছিদ্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর ভাল করে ছিদ্রের স্থানটি বন্ধ করে দেয়। অতঃপর ঐ কাষ্ঠখণ্ডটি নিয়ে সে উপস্থিত হয় সমুদ্রের তীরে। সে বলে, ‘হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন অমুক ব্যক্তি থেকে আমি এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা ধার নিয়েছিলাম। সে আমার নিকট জামিন দাবি করে। আমি তাকে বলেছিলাম যে, জামিন রূপে আল্লাহই যথেষ্ট। সে আমার নিকট সাক্ষী দাবি করে। আমি বলি সাক্ষীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট। এতে সে রাজী হয়। আমি তো যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি একটি বাহন যোগাড় করার জন্যে। যাতে যথাসময়ে আমি তার টাকা পৌঁছিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি কোন বাহন পেলাম না। এখন সেই এক হাজার মুদ্রা আপনার নিকট আমানত রাখছি।’ এ বলে ঐ কাষ্ঠখণ্ডটি সে সমুদ্র ভাসিয়ে দেয়। কাঠ ভেসে যায় সমুদ্রে। সে ফিরে যায় এবং নিজ দেশে পৌঁছার জন্যে বাহন খুঁজতে থাকে। ঋণ গ্রহীতা তার সম্পদ নিয়ে আগমনকারী বাহনের অপেক্ষায় থাকে। হঠাৎ সেই সম্পদ সম্বলিত কাঠটি তার নজরে পড়ে। পরিবারের জ্বালানি কাঠ রূপে ব্যবহারের জন্যে সে কাঠটি বাড়ি নিয়ে যায়। সেটি কাটতে গিয়ে সে উক্ত স্বর্ণ মুদ্রা ও চিঠিটি পায়। পরবর্তীতে একদিন ঋণ গ্রহীতা তার নিকট এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে এসে উপস্থিত হয়। সে বলে, ‘আমি বাহন সংগ্রহ করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। যাতে করে পাওনা টাকা নিয়ে যথাসময়ে আপনার নিকট আসতে পারি। কিন্তু যে বাহনে করে আমি আপনার নিকট এসেছি সেটির পূর্বে কোন বাহন পাইনি।’ ঋণদাতা বললো, ‘তুমি ইতিপূর্বে আমার নিকট কোন কিছু প্রেরণ করেছিলে?’ সে বললো, ‘আমি তো আপনাকে বলেছি-ই যে, এ বাহনের পূর্বে আমি কোন বাহন পাইনি।’ ঋণ দাতা বললো, ‘তোমার কাঠের ভেতরে রাখা স্বর্ণ মুদ্রা আল্লাহ তাআলা আমার নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যে এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা সাথে করে এনেছো তা নিয়ে তুমি ফিরে যাও।’

ইমাম আহমদরে সনদ সহকারে হাদীসটি এভাবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী (র) তার সহীহ গ্রন্থের একাধিক স্থানে সনদ ছাড়াই নিশ্চয়তা প্রকাশক শব্দ দ্বারা লাইছ ইবন সাদ সূত্রে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর কাতিব আবদুল্লাহ ইবন সালিহ সূত্রে সনদ সহকারে উল্লেখ করেছেন। এতদসত্ত্বেও হাকিম বাযযার যে তার মুসনাদ গ্রন্থে হাদীসটি একক বর্ণনা বলে মন্তব্য করেছেন, তাতে বিস্মিত হতে হয়।

৪৮
সততা ও আমানতের আরও দৃষ্টান্ত ঘটনা
ইমাম বুখারী (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) সুত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির নিকট থেকে একখণ্ড জমি ক্রয় করেছিল। যে ব্যক্তি জমি ক্রয় করে সে ঐ জমিতে একটি স্বর্ণভর্তি কলসী পায়। সে বিক্রেতাকে বলে যে, ‘আপনার স্বর্ণ আপনি নিয়ে নিন। আমি তো আপনার নিকট থেকে শুধু জমিই ক্রয় করেছি। স্বর্ণ ক্রয় করিনি।’

জমির মালিক বলে, ‘আমি জমি এবং জমির অভ্যন্তরস্থ সবকিছু আপনার নিকট বিক্রয় করেছি।’ তারা দুজনে মীমাংসার জন্যে তৃতীয় এক ব্যক্তিকে সালিশ নির্ধারণ করে। সে ব্যক্তি বলে, ‘আপনাদের কোন ছেলে মেয়ে আছে কি?’ একজন বললো, ‘আমার একটি পুত্র সন্তান আছে।’ অন্যজন বললো, ‘আমার আছে একটি কন্যা সন্তান।’ মীমাংসাকারী ব্যক্তিটি বললো, ‘ঐ মেয়েকে ঐ ছেলেটির নিকট বিয়ে দিয়ে দিন। ঐ স্বর্ণ দু’জনের জন্যে ব্যয় করুন এবং ঐ দু’জনকে দান করে দিন।’

বনী ইসরাঈলের বর্ণনায় ইমাম বুখারী (র) এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম (র)-ও হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, বাদশাহ যুলকারনাইন-এর যুগে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। যুলকারনাইনের যুগ তো বনী ইসরাঈলের যুগের বহু পূর্বে ছিল। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইসহাক ইবন বিশর তার আল মুরতাদা গ্রন্থে সাঈদ ইবন আবী আরুবাহ…… হাসান (র) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যুলকারনাইন নিজে তার অধীনস্থ রাজা-বাদশাহ এবং কর্মচারীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। কারো সম্পর্কে কোন বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা তার গোচরে এলে তিনি সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। নিজে সরাসরি অবগত না হয়ে কারো অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন না।

একদিন তিনি ছদ্মবেশে এক শহরে ঘুরছিলেন। একাদিক্রমে কয়েকদিন তিনি এক বিচারকের আদালতে বসেন। তিনি দেখলেন, কেউই বিচার প্রার্থী হয়ে ঐ বিচারকের আদালতে আসে না। বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত এ অবস্থা লক্ষ্য করার পর যুলকারনাইন যখন এ বিচারক সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারলেন না। তখন তিনি ওখান থেকে ফিরে যেতে মনস্থ করেন। সেদিনই তিনি লক্ষ্য করলেন, দু’জন লোক বিচারপ্রার্থী হয়ে উক্ত বিচারকের নিকট এসেছে। একজন আরজি পেশ করে বলে যে, ‘মাননীয় বিচারক! আমি ঐ ব্যক্তি থেকে একটি বাড়ি ক্রয় করে তা আবাদ করি। ঐ বাড়িতে আমি গুপ্ত ধনের সন্ধান পাই। আমি তাকে এটি নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু সে তা নিয়ে যেতে অস্বীকার করে।’

অপরজনকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, ‘এ ব্যাপারে তুমি কি বল?’ জবাবে সে বললো, ‘আমি কখনো এ মাটির নিচে কোন সম্পদ লুকিয়ে রাখিনি এবং এ গুপ্তধন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সুতরাং এটি আমার নয়। আমি তা গ্রহণ করব না।’ বাদী বলে, ‘মাননীয় বিচারক! কাউকে আমার নিকট থেকে তা নিয়ে আসতে আদেশ করুন। তারপর আপনার যেখানে খুশী তা ব্যবহার করবেন।’ বিচারক বললেন, ‘তুমি নিজে যে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে চাও আমাকে তার মধ্যে জড়াতে চাচ্ছো? তুমি আমার প্রতি সুবিচার করনি। আমি মনে করি, দেশের আইনেও এরূপ বিধান নেই।’ বিচারক আরও বললেন, ‘আচ্ছা, আমি কি এমন একটি ব্যবস্থা করব যাতে তোমাদের উভয়ের প্রতি ইনসাফ হয়।’ তারা বললো, ‘অবশ্যই।’

বিচারক বাদীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমার কি কোন পুত্র সন্তান আছে?’ সে বললঃ ‘জ্বী হ্যাঁ।’ অপরজনকে বললেন, ‘তোমার কি কোন কন্যা সন্তান আছে?’ সে বললো, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘দু’জনেই যাও তোমার মেয়েকে তার ছেলের সাথে বিবাহ দিয়ে দাও। এ সম্পদ থেকে তাদের বিবাহের ব্যয় নির্বাহ করবে। আর যা অবশিষ্ট থাকবে তা তাদেরকে দিয়ে দেবে। সেটি দ্বারা তারা তাদের সংসার চালাবে। তাহলে দু’জনেই এ ধনের লাভ-ক্ষতির সমান অংশীদার হবে।’

বিচারকের রায় শুনে বাদশাহ যুলকারনাইন মুগ্ধ হলেন। তারপর বিচারককে ডেকে বললেন, ‘আপনার মত এমন চমৎকার করে বিচার অন্য কেউ করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। অন্য কোন বিচারক এমন ফয়সালা দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’ বিচারক বাদশাহকে চিনেননি। তিনি বললেন, ‘কেউ কি এছাড়া অন্য কোন রায় দিতে পারে?’ যুলকারনাইন বললেন, ‘হ্যাঁ, দেয়ই তো।’ বিচারক বললেন, ‘তারপরও ওদের দেশে কি বৃষ্টি বর্ষিত হয়?’ একথা শুনে বিস্মিত হলেন যুলকারনাইন। তিনি মন্তব্য করলেন, ‘এরূপ লোকের বদৌলতেই আসমান-যমীন এখনও টিকে রয়েছে।’

৪৯
আরেকটি শিক্ষণীয় ঘটনা
ইমাম বুখারী (র) বলেন, আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, বনী ইসরাঈলের এক লোকের ঘটনা। সে ৯৯ জন মানুষ খুন করেছিল। তারপর কোন বুযর্গ ব্যক্তির খোঁজে বের হয়। সে একজন ইয়াহুদী ধর্মযাজকের নিকট এসে পৌঁছে বলে, ‘আমার তাওবা কবুল হবে কি?’ ধর্মযাজক বলেন, ‘না, তোমার কোন তাওবা কবুল হবে না।’ তখন সে ঐ ধর্মযাজককেও হত্যা করে।

এরপর সে অন্য বুযর্গ লোকের সন্ধান করছিল। একজন বলল, অমুক জনপদে যাও। পথে তার মৃত্যুর সময় হয়। তার বক্ষদেশ তখন ঐ জনপদ অভিমুখী ঝুঁকে রয়েছিল। তখন রহমতের ফিরিশতা ও আযাবের ফিরিশতা উভয় পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়। আল্লাহ তাআলা সম্মুখ ভাগের ভূমিকে নির্দেশ দিলেন সংকুচিত ও কাছাকাছি হয়ে যেতে। পেছনে রেখে আসা ভূমিকে নির্দেশ দিলেন সম্প্রসারিত ও দূরে সরে যেতে ফিরিশতাদেরকে নির্দেশ দিলেন উভয় দিকে ভূমি মেপে দেখতে। দেখা গেল, সম্মুখের গন্তব্য স্থল পেছনের ছেড়ে আসা স্থান থেকে এক বিঘত নিকটে। অতঃপর তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

ইমাম বুখারী (র) এরূপ সংক্ষিপ্ত-ই-বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) তা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

৫০
অন্যান্য হাদীস
১। ইমাম বুখারী (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে একাধিক সনদে বর্ণনা করেন, একদিনের কথা, রাসূলুল্লাহ (সা) ফজরের নামায শেষে মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসলেন। তিনি বললেন, একজন লোক একটি গরু নিয়ে যাচ্ছিল। এক সময় সে গরুটির পিঠে চড়ে বসে এবং সেটিকে প্রহার করে। গরুটি বলে উঠে, আমাকে তো এ কাজের জন্যে সৃষ্টি করা হয়নি। আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে জমি চাষ করার জন্যে। তখন লোকজন অবাক হয়ে বলে, ‘সুবহানাল্লাহ, গরু আবার কথা বলে!’ রাসুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আমি নিজে এ ঘটনাটি বিশ্বাস করি। আবু বকর (রা) এবং উমর (রা)-ও এ ঘটনা বিশ্বাস করেন।’ এ আলোচনার সময় আবু বকর ও উমর (রা) কিন্তু সেখানে ছিলেন না।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এক ব্যক্তি বকরী চরাচ্ছিল। এমন সময় একটি নেকড়ে বাঘ হামলা চালিয়ে একটি বকরী নিয়ে যায়। বকরী ওয়ালা তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে বকরী নেকড়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। নেকড়েটি বললো, ‘আজ তুমি এটিকে আমার হাত থেকে উদ্ধার করে নিলে তবে হিংস্র জীবদের রাজত্বের দিনে, কে তাকে রক্ষা করবে? সেদিন তো আমি ব্যতীত কোন রাখাল থাকবে না।’ এটি শুনে লোকজন বলে ওঠে, ‘সুবহানাল্লাহ! নেকড়েও আবার কথা বলে?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আমি আবু বকর (রা) ও উমর (রা) আমরা সবাই এটি বিশ্বাস করি।’ সেখানে আবু বকর (রা) ও উমর (রা) উপস্থিত ছিলেন না।

ইমাম তিরমিযী (র) হাদীসটি হাসান, সহীহ বলে অভিহিত করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) সহীহ্ সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

২। ইমাম বুখারী (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে অনেক ইলহামপ্রাপ্ত লোকও ছিলেন। এই উম্মতের মধ্যে যদি এরূপ কেউ থেকে থাকেন তবে তিনি হবেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)। ইমাম মুসলিম (র) ভিন্নসূত্রে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।

৩। ইমাম বুখারী (র) মুয়াবিয়া (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, যে বছর তিনি হজ্জ করেন সে বছর জনৈক পাহারাদারের হাত থেকে এক গোছা পরচুলা নিয়ে বললেন, হে মদীনাবাসীগণ! তোমাদের আলিমগণ কোথায়? আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি এ ধরনের চুল ব্যবহার করতে বারণ করে বলেছেন, “বনী ইসরাঈলের মহিলাগণ যখন এরূপ কৃত্রিম চুলের ব্যবহার করতে শুরু করে তখন তারা ধ্বংস হয়।”

ইমাম মুসলিম (র) এবং আবু দাউদ (র) এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ইমাম বুখারী (র) বর্ণনা করেন, মুআবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান শেষ বার যখন মদীনা শরীফ এলেন তখন তিনি খুৎবা দানকালে তার আস্তীন থেকে এক গোছা পরচুলা বের করেন এবং বলেন, ইয়াহুদী ব্যতীত অন্য কেউ এ কাজ করে বলে তা আমি মনে করতাম না। রাসূলুল্লাহ (সা) এ কর্মকে মিথ্যাচার রূপে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ কৃত্রিম চুল লাগানো।

৪। ইমাম বুখারী (র) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেছেন, একটি কুকুর একটি কূয়ার পাড়ে হাঁপাচ্ছিল। তৃষ্ণায় তার প্রাণ যায় যায়। বনী ইসরাঈল বংশের একজন ব্যভিচারিণী মহিলা এ বিষয়টি লক্ষ্য করে। অতঃপর সে তার মোজা খুলে নেয় এবং তার সাহায্যে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এর উসিলায় আল্লাহ তা’আলা উক্ত ব্যভিচারিণীকে ক্ষমা করে দেন। ইমাম মুসলিম (র)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৫। ইমাম বুখারী (র) আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, একজন মহিলাকে একটি বিড়ালের ব্যাপারে আযাব দেয়া হয়েছে। সে বিড়ালটি বেঁধে রেখেছিল। শেষ পর্যন্ত বিড়ালটি মারা যায়। এ কারণেই তাকে শাস্তি দেয়া হয়। বেঁধে রাখা অবস্থায় সে ওটিকে কিছু খেতে দেয়নি এবং সেটিকে ছেড়েও দেয়নি যে, সে পোকা-মাকড় ধরে খাবে। ইমাম মুসলিম (র)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৬। ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, বনী ইসরাঈলের একজন বেঁটে মহিলা ছিল। সে কাঠের সুদীর্ঘ দুটো পা তৈরি করে এবং সেটিতে পা রেখে দু’জন খাটো মহিলার মধ্যে থেকে সে চলতে থাকে। একদিন সে একটি সোনার আংটি প্রস্তুত করে রাখে। তার আংটির নগীনার নিচে সে তীব্র সুগন্ধি ও মিশক লুকিয়ে রেখেছিল। অতঃপর কোন মজলিসে গেলে সে আংটিটি একটু নাড়াচাড়া করে দিত আর তার হাত থেকে খুশবু ছড়িয়ে পড়ত। ইমাম মুসলিম (র) মুসতামির খালীদ ইব্‌ন জাফর থেকে মারফু সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) বলেন এটি সহীহ হাদীস।

৭। ইমাম বুখারী (র) বলেন, ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, অতীত যুগের যে সব নবুওতী বাণী লোকজনের কাছে পৌঁছেছে তার, একটি এই যে,

اذا لم تستح فاصنع ما شئت

“লজ্জা না থাকলে তুমি যা ইচ্ছা করতে পার।”

ইমাম বুখারী (র) এককভাবে এটি উল্লেখ করেছেন।

৮। ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, অতীত কালের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী নিঃস্ব অবস্থায় ছিল। তাদের কিছুই করার সামর্থ্য ছিল না। একদিন লোকটি বাড়ি ফিরে এসে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে বলে, ‘তোমার কাছে কোন খাবার আছে কি?’ সে বলে, ‘হ্যাঁ, আছে। সুসংবাদ নিন, আপনার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক এসেছে।’ স্বামী স্ত্রীকে তাগিদ দিয়ে বলল, ‘আমি চাচ্ছি এখনই তোমার নিকট কিছু থাকলে নিয়ে এসো।’ স্ত্রী বললো, ‘হ্যাঁ, একটু অপেক্ষা করুন, আমরা আল্লাহর রহমতের আশায় আছি।’ বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে স্ত্রীকে বললো, ‘আল্লাহ রহম করুন। খুঁজে দেখ তো তোমার কাছে কোন খাবার আছে কিনা? থাকলে নিয়ে এসো। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি।’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, খাবার আছে, চুলায় রান্না হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করুন।’ কিছুক্ষণ উভয়ে নীরব থাকার পর স্ত্রী মনে মনে বলল, আমি যদি উঠে গিয়ে চুলাটা একটু দেখে আসতাম! এরপর মহিলাটি নিজেই গেল এবং চুলায় গিয়ে দেখল সে বকরীর সিনায় ডেগচী ভর্তি এবং একটি যাতায় আটা পেষা হচ্ছে। মহিলাটি নিকটে গেল এবং যাতার আটা ঢেলে নিলে তা এবং চুলার উপরের বকরীর সিনা নিয়ে আসল।

রাসুলুল্লাহ (সা)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আবুল কাসেম (সা)-এর প্রাণ যার হাতে সেই পবিত্র সত্তার শপথ করে বলছি! মহিলাটি যদি যাতা থেকে আটাগুলো নিয়ে চাক্কি উপুঁড় না করত, তবে ঐ চাক্কিতে আটা পেষা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকত।

ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোকের ঘটনা। সে তার পরিবারের নিকট উপস্থিত হয়। তাদের অভাব-অনটন দেখে সে মাঠের দিকে রওয়ানা হয়। এ অবস্থা দেখে তার স্ত্রী আটা পেষার চাক্কির নিকট যায়, এবং তা চালু করে দেয়। তারপর চুলার নিকট গিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দেয়। তারপর আল্লাহর নিকট দোয়া করে বলে, ‘হে আল্লাহ! আমাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিন’ হঠাৎ সে দেখে তাদের গামলা ভর্তি হয়ে গিয়েছে। চুলার নিকট গিয়ে দেখে চুলা ভর্তি হয়ে রয়েছে।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর স্বামী ফিরে আসে এবং বলে, ‘তোমরা কিছু পেয়েছ কি?’ তার স্ত্রী বলে, ‘হ্যাঁ, আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে পেয়েছি।’ অতঃপর তারা চাক্কির নিকট যায়। এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বর্ণনা করা হয়। তিনি বলেন, ‘যদি ঐ চাক্কি উঠানো না হত, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তা ঘুরতে থাকত।’

বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এ সময় তিনি বলছিলেন, আল্লাহর কসম, কারো কাছে এসে ভিক্ষা চাওয়া অপেক্ষা কাঠের বোঝা বাহন করে এনে তা বিক্রি করে নিজের মর্যাদা রক্ষা করা তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর।

৫১
তওবাকারী দু’রাজার ঘটনা
ইমাম আহমদ (র) আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জনৈক রাজার কথা। একদা তিনি তার রাজত্ব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হলেন। তাতে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, একদিন না একদিন তাকে এই রাজত্বের মায়া ছাড়তে হবে। অথচ তখন এটাই তাঁকে আপন প্রতিপালকের ইবাদত থেকে গাফিল করে রেখেছে।

একরাতে তিনি চুপিসারে নিজের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়েন। তিনি অন্য এক রাজ্যে এসে পৌঁছেন এবং সাগর তীরে আস্তানা স্থাপন করেন। সেখানে তিনি ইট তৈরির কাজ শুরু করেন। এতে যা আয় হত তা দিয়ে প্রয়োজন মাফিক খাদ্য দ্রব্যের ব্যবস্থা করতেন এবং উদ্বৃত্ত অর্থ সাদকা করে দিন। এভাবে তার দিন কাটছিল। ঐ দেশের রাজার নিকট তাঁর সংবাদ পৌঁছে। রাজা তাঁকে ডেকে পাঠান। তিনি যেতে অস্বীকার করেন। রাজা তখন নিজেই তার কাছে চলে আসেন। রাজাকে দেখেই ঐ রাজা পালাতে শুরু করেন। রাজা ও ঘোড়া নিয়ে তাঁর পিছু নেন। কিন্তু তিনি তার নাগাল পেলেন না।

অবশেষে রাজা চিৎকার করে বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আমার পক্ষ থেকে আপনার কোন ক্ষতির আশংকা নেই।’ তখন ঐ রাজা থামলেন, ফলে উভয়ের সাক্ষাৎ হলো। রাজা বললেন, ‘আল্লাহ তা’আলা আপনাকে দয়া করুন, আপনার পরিচয় কি?’ তিনি বললেন, ‘আমি অমুকের পুত্র অমুক। অমুক রাজ্যের রাজা। আমার রাজত্ব নিয়ে আমি একদি গভীরভাবে চিন্তা করেছিলাম। তাতে আমি উপলব্ধি করেছি যে, শেষ পর্যন্ত আমি এ রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবই! আর তখন এ রাজ্যই আমাকে আমার প্রতিপালকের ইবাদত থেকে গাফিল করে রেখেছে। তাই আমি ঐ রাজ্য ত্যাগ করে এখানে এসে আমার প্রতিপালকের ইবাদত করছি।’ রাজা বললেন, ‘আপনি যা করছেন এ ব্যাপারে আমি আপনার চাইতে কম মুখাপেক্ষী নই।’ এ বলে রাজা বাহন থেকে নেমে পড়েন এবং সেটিকে ছেড়ে দেন। তিনি পূর্ববর্তী রাজার পথ অনুসরণ করেন। এবার তারা দু’জনে একসাথে আল্লাহর ইবাদত করতে লাগলেন। তারা দু’জনে আল্লাহর নিকট এক সাথে মৃত্যু কামনা করলেন এবং পরে দু’জনেই মারা গেলেন।

হাদীস বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) বলেন, আমি যদি তখন মিসরের রমনিয়ায় থাকতাম, রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের নিকট তাদের যে পরিচয় বর্ণনা করেছেন। তার আলোকে আমি কবর দুটো চিনিয়ে দিতাম।

৯। ইমাম বুখারী (র) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন। তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে এক লোক ছিল। আল্লাহ তাআলা তাকে প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। তাঁর মৃত্যু সময় উপস্থিত হওয়ায় সে তার পুত্রদেরকে কাছে ডাকে। তাদেরকে বলে, ‘বৎসগণ! আমি তোমাদের পিতা রূপে কেমন ছিলাম?’ তারা বলে, ‘আপনি খুবই ভাল পিতা ছিলেন।’ অতঃপর সে ব্যক্তি বলে, ‘আমি কখনো কোনো পুণ্যকর্ম করিনি। সুতরাং আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে পুড়িয়ে ফেলবে। তারপর পিষে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে এবং প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত বাতাসে নিক্ষেপ করবে।’ সে মতে পুত্ররা তাই করল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সে সব একত্রিত করে জিজ্ঞেস করলেন। ‘তোমার এরূপ করার হেতু কী?’ সে বলল, ‘প্রভু! আপনার ভয়ে এরূপ করেছি।’ তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে তার রহমত দান করলেন। ইমাম মুসলিম (র)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

১০। ইমাম বুখারী (র) আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি লোকজনকে প্রায় ঋণ দিত। নিজের কর্মচারীকে সে নির্দেশ দিত যে, কোন অভাবী ব্যক্তি এলে তার ঋণ মাফ করে দিবে। এর উসিলায় হয়ত আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে মাফ করে দিবেন। ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর পর সে আল্লাহর নিকট পৌঁছলে আল্লাহ তা’আলা তাকে মাফ করে দেন। ইমাম মুসলিম (র) ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

১১। ইমাম বুখারী (র) সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি হযরত উসামা ইবন যায়দ (রা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘প্লেগ রোগ সম্পর্কে আপনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মুখে কী শুনেছেন?’ হযরত উসামা (রা) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘প্লেগ রোগ হল শাস্তি বিশেষ। বনী ইসরাঈলের একটি গোত্রের ওপর আল্লাহ তাআলা এটি প্রেরণ করেছিলেন। আর তোমাদের পূর্ববতী লোকদের উপরও এ শাস্তি এসেছিল। কোন এলাকায় প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে শুনলে তোমরা ঐ এলাকার দিকে অগ্রসর হয়ো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করছ সেখানে এ রোগের প্রকোপ দেখা দিলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তোমরা সেখান থেকে পালিয়ে যেয়ো না।’

ইমাম মুসলিম (র) হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি প্লেগ রোগ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে, এটি একটি শান্তি বিশেষ। বান্দাদের মধ্যে যাদের প্রতি আল্লাহ ইচ্ছা করেন তাদের নিকট এটি প্রেরণ করেন। আল্লাহ তাআলা এটিকে ঈমানদারদের জন্যে রহমত ও কল্যাণরূপে নির্ধারণ করেছেন। কোন এলাকায় প্লেগ রোগের প্রকোপ দেখা দিলে কোন ব্যক্তি যদি পূর্ণ ধৈর্য্য সহকারে, সওয়াবের আশায় এবং এ বিশ্বাস নিয়ে তথায় অবস্থান করে যে, আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের অন্যথা করে কোন বিপদ তার ওপর আসবে না, অতঃপর সে যদি সেখানে মারা যায় তবে সে শহীদের মর্যাদা পাবে।

১২। ইমাম বুখারী (র) হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। মাখযুম গোত্রীয় যে মহিলাটি চুরি করেছিল। তার ব্যাপারটি কুরায়শদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তারা বলাবলি করছিল যে, তার বিষয়ে কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট সুপারিশ করবে? তারা বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একান্ত প্রিয় উসামা ইবন যায়দ (রা) ব্যতীত আর কে এ সাহস করবে? সে মতে হযরত উসামা (রা) এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আলাপ করলেন। অটল রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহর নির্ধারিত দণ্ড বাতিলের জন্যে তুমি সুপারিশ করছ? এরপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং খুতবা দিতে গিয়ে বললেনঃ

انما اهلك الذين من قبلكم أنهم كانوا اذا سرق منهم الشريف تركوه واذا سرق فيهم الضعيف أقاموا عليه الحد- وأيم الله لو أن فاطمة بنت محمد سرقت لقطعت يدها

“তোমাদের পূর্বে যারা ধ্বংস হয়েছে তাদের ধ্বংসের কারণ হলো, তাদের কোন সম্রান্ত লোক চুরি করলে তাকে তারা ছেড়ে দিত। আর কোন দুর্বল শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তাকে তারা শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম, মুহাম্মদের (সা) কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করত তবে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।”

অন্যান্য সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

১৩। ইমাম বুখারী (র) ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদা আমি এক লোককে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুনলাম। আমি কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তা অন্যভাবে পাঠ করতে শুনেছি। তাকে ধরে এনে আমি রাসুলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত করি এবং তার ভিন্ন রকম কুরআন পাঠ সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করি। এতে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চেহারা কিছুটা অসন্তুষ্টির চিহ্ন লক্ষ্য করি। তিনি বললেন, ‘তোমাদের দু’জনই তো যথার্থ ও শুদ্ধ পাঠকারী। তোমরা মতভেদ করো না। কারণ তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা পরস্পর বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল ফলে তারা ধ্বংস হয়েছে।’ ইমাম বুখারী (র) হাদীসটি এককভাবে বর্ণনা করেন।

১৪। ইমাম বুখারী (র) হযরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “ইয়াহুদী ও খৃষ্টানগণ চুল দাড়িতে রং ব্যবহার করে না। তোমরা তাদের বিপরীত করবে।” ইমাম বুখারী (র) এককভাবে এ রিওয়াতটি বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে, তোমরা পাদুকাসহ সালাত আদায় করবে এবং এভাবে ইয়াহুদীদের বিরোধিতা করবে।

১৫। ইমাম বুখারী (র) হযরত ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন, আমি হযরত উমর (রা)-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে ধ্বংস করুন। সে কি জানে না যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ লানত করুন ইয়াহূদীদের ওপর, তাদের জন্যে চর্বি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু তারা তা গলিয়ে বিক্রি করতো। ইমাম মুসলিম (র)-ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

১৬। ইমাম বুখারী (র) ........ হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নামাযের সময়ের ঘোষণারূপে লোকজন আগুন জ্বালানো এবং সিঙ্গায় ফুৎকর দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। তখন এও আলোচনা হয়েছিল যে, এগুলো তো ইয়াহুদী ও নাসারাদের প্রতীক। অতঃপর হযরত বিলাল (রা)-কে জোড় শব্দে আযান এবং বেজোড় শব্দে ইকামত দিতে নির্দেশ দেয়া হল। এর উদ্দেশ্য হল, সকল কর্মে ইয়াহুদী নাসারাদের বিপরীত কাজ করা। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনায় পদার্পণ করেন, তখন নামাযের প্রতি আহ্বানকারী কোন আহ্বান ব্যতিরেকেই মুসলমানগণ নামাযের সময়ে উপস্থিত হত। এরপর তাদের মধ্যে জনৈক ঘোষককে নামাযের সময় হলে ( الصلوة جامعة ) নামাযের জামাত আসন্ন বলে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল। অতঃপর জামাতের সময়ের প্রতীকরূপে তারা এমন কোন বিষয় নির্ধারণের ইচ্ছা করলেন, যা দেখে মানুষ বুঝবে যে, জামাতের সময় আসন্ন। তখন কেউ কেউ প্রস্তাব দিলেন যে, আমরা তখন সিঙ্গায় ফুৎকার দিব। অপর কেউ প্রস্তাব করলেন যে, আমরা বরং যথাসময়ে আগুন প্রজ্বলিত করব।

কিন্তু এগুলোতে ইয়াহুদী-নাসারাদের সাথে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। বিধায় দুটো প্রস্তাবই অগ্রাহ্য হয়। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবন যায়দ ইবন আবদ রাব্বিহী (রা)-কে তার ঘুমের মধ্যে আযান দেখানো হলো। তিনি এসে বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জানালেন। রাসূলুল্লাহ (সা) উক্ত নিয়মে আযান দেয়ার জন্যে হযরত বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দিলেন। হযরত বিলাল আযান দিলেন।

১৭। ইমাম বুখারী (র) ...... হযরত আয়েশা ও ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন ইন্তিকালের সময়ে উপনীত হলেন, তখন তিনি একটি চাদর টেনে তার মুখে ঢাকতে শুরু করলেন। আর যখন তিনি অস্বস্তিবোধ করছিলেন, তখন তা মুখ থেকে সরিয়ে ফেলছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি বলে উঠলেনঃ

لعنة الله على اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد

ইয়াহুদী ও নাসারাদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হউক, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে। তিনি তাদের কার্যকলাপ থেকে সতর্ক করছিলেন।

১৮। ইমাম বুখারী (র) আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেনঃ

لتتبعن سنن من كان قبلكم شبرا بشبر وذراعا بذراع حتى لو سلكوا جحر ضت لسلكتموه فقلنا يارسول الله اليهود والنصارى قال النبي صلى الله عليه وسلم فمن .

“তোমরা এক সময় তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতির অনুসরণ করবে। একেবারে বিঘতে বিঘতে, হাতে হাতে (সমানে-সমান) এমনকি তারা যদি কোন গুইসাপের গর্তে ঢুকে থাকে তোমরাও তাতে ঢুকবে। আমরা বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! পূর্ববর্তীগণ বলে কি আপনি ইয়াহুদী-নাসারাদেরকে বুঝিয়েছেন?’ তিনি বললেন, ‘তা না হলে আর কারা?”

হাদীসটি ইমাম মুসলিম (র)-ও বর্ণনা করেছেন।

ইহুদী খৃষ্টানদের আচার-আচরণের সাথে সামঞ্জস্যশীল, ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ, পরবর্তী যুগে অনুষ্ঠিতব্য এসব কথা ও কর্ম সম্পর্কে অবগত করানোর পেছনে উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ঈমানদারদেরকে ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানদের সাথে সামঞ্জস্যশীল কথা ও কর্ম থেকে বারণ করেছেন। এ প্রকার কথা ও কাজের পেছনে কোন মুমিনের উদ্দেশ্য সৎ থাকলেও এটি মূলত ওদেরই অনুকরণ। সুতরাং এরূপ কর্ম স্পষ্টতই তাদের কর্ম।

এভাবে ঈমানদারদেরকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে করে মুশরিকদের সাথে সামঞ্জস্য না হয়। কেননা তারা এ সময়ে সূর্যের উপাসনা করত। যদিও ঈমানদারের মনে সূর্যের উপাসনার কোন কল্পনাও না থাকে।

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন -

( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ لَا تَقُولُوا۟ رَ اٰ عِنَا وَقُولُوا۟ ٱنظُرۡنَا وَٱسۡمَعُوا۟ۗ وَلِلۡكَـٰفِرِینَ عَذَابٌ أَلِیم ࣱ)

[Surah Al-Baqarah 104]

তোমরা রাসূলকে সম্বোধন করে ( رَ اٰ عِنَا ) বলো না বরং ( ٱنظُرۡنَا ) (আমাদের প্রতি তাকান) বলবে, আর তোমরা শোন, কাফিরদের জন্যে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। আলোচ্য আয়াতের প্রেক্ষাপট এই যে, কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে কথা বলার সময় “আমাদের দিকে তাকান এবং আমাদের কথা শুনুন” বুঝানোর জন্যে বলত ( رَ اٰ عِنَا ) (শব্দটি মূলত দ্ব্যর্থবোধক উপরোক্ত অর্থ ছাড়া ও ‘মূর্খ’ অর্থেও এটি ব্যবহৃত হয়)। ( رَ اٰ عِنَا ) শব্দ ব্যবহার করে। তারা “হে আমাদের মূর্খ ব্যক্তির” অর্থ বুঝাত। ঈমানদারগণের কেউ উক্ত শব্দ ব্যবহার করলে কখনোই তাদের মনে উক্ত অর্থের লেশ মাত্র থাকবে না; তবুও তাদেরকে এরূপ বলতে নিষেধ করা হয়েছে।

ইমাম আহমদ ও তিরমিযী (র) আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা) সূত্রে নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ

بعثت بالسيف بين يدي الساعة حتى يعبد الله وحده لا شريك له وجعل رزقي تحت ظل رمحي وجعل الذله الصغار على من خالف أمري ومن تشبه بقوم فهو منهم .

“কিয়ামতের নিকটবর্তী কালে আমি প্রেরিত হয়েছি তরবারি সহকারে, যতক্ষণ না সামগ্রিকভাবে একক লা-শরীক আল্লাহর ইবাদত করা হবে, আমার বর্শার ছায়ায় আমার রিযিক নিহিত। লাঞ্ছনা ও হীনতা সে ব্যক্তির জন্যে, যে আমার নির্দেশের বিরোধিতা করবে। যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।

সুতরাং ইয়াহুদী-খ্রীষ্টানদের সাথে সামঞ্জস্য রাখা কোন মুসলমানের জন্যে মোটেই সমীচীন নয়। তাদের আনন্দ উৎসব, মেলা-পার্বন কিংবা পূজা-অর্চনা কোন ক্ষেত্রেই তাদের সাথে সামঞ্জস্য রাখা উচিত নয়। কারণ আল্লাহ তা’আলা এই উম্মতকে সর্বশেষ নবী দ্বারা মহিমান্বিত করেছেন। তিনি তাঁর জন্যে পরিপূর্ণ, সামগ্রিক, সুদৃঢ় ও মহান দীন ও শরীয়ত দান করেছেন। এমন যে, তাওরাতপ্রাপ্ত হযরত মূসা ইবন ইমরান এবং ইনজীলপ্রাপ্ত হযরত ঈসা ইবন মারয়াম (আ) যদি জীবিত থাকতেন তবে এই পবিত্র শরীয়তের বর্তমানে তাদের কোন শরীয়ত থাকতো না। শুধু তারা কেন অন্য সকল নবী-রাসূল (আ)-ও যদি বর্তমান থাকতেন তাহলে এই মহান, সম্মানিত ও পবিত্র শরীয়তের অনুসরণ ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকতো না।

আল্লাহ তা’আলা যখন আমাদেরকে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর অনুসারী বানিয়ে অনুগৃহীত করেছেন, তাই যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট করেছে এবং নিজেরা সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, সে সম্প্রদায়ের অনুসরণ করা কী করে আমাদের জন্যে সমীচীন হবে? ঐ সম্প্রদায় তো তাদের দীনকে পরিবর্তিত করেছে, বিকৃত করেছে এবং তার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। শেষে তারা এমন এক পর্যায়ে নেমে এসেছে যেন কখনো তাদের প্রতি কোন শরীয়ত নাযিলই হয়নি। পরবর্তীতে ঐ শরীয়ত তো রহিতই হয়ে গিয়েছে। রহিত এবং বাতিলকৃত দীনের অনুসরণ করা হারাম। কেউ তা অনুসরণ করলে তার ছোট-বড় কোন আমল আল্লাহ তা’আলা কবূল করবেন না। যা আদৌ শরীয়তরূপে নির্ধারিত হয়নি, তার মধ্যে আর এ বাতিলকৃত শরীয়তের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথপ্রদর্শন করেন।

১৯। ইমাম বুখারী ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের মেয়াদের তুলনায় তোমাদের মেয়াদ হল আসরের নামায থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের ন্যায়। তোমাদের এবং ইয়াহুদী-নাসারাদের উদাহরণ হল এমন এক ব্যক্তির ন্যায়, যে কতক কর্মচারী নিয়োগের ইচ্ছা করল। সে বলল, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রত্যেকে এক কীরাত করে পাবে। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমার কাজ করার কেউ আছে কী? এ প্রেক্ষিতে এক কীরাতের বিনিময়ে ইয়াহুদীগণ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করল। তারপর ওই লোক বলল, দুপুর থেকে আসরের নামাযের সময় পর্যন্ত এক কীরাত। এক কীরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমার কাজ করার কেউ আছে কী? এ প্রেক্ষিতে নাসারাগণ এক কীরাতের বিনিময়ে দুপুর থেকে আসর পর্যন্ত কাজ করল।

তারপর ঐ ব্যক্তি বলল, আসরের নামাযের সময় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রত্যেকে দু’কীরাত পরিশ্রমিকের বিনিময়ে আমার কাজ করার কেউ আছে কী? জেনে রেখ, হে আমার উম্মত! তোমরা এখন আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দু’কীরাতের বিনিময়ে কাজ করে যাচ্ছ। জেনে রেখ, তোমাদের পারিশ্রমিক হল ওদের দ্বিগুণ।

তাতে ইয়াহুদী ও নাসারাগণ ক্ষুব্ধ হলো এবং বলল, আমরা কাজ করলাম বেশী আর পারিশ্রমিক পেলাম কম! আল্লাহ তা’আলা বললেন, “আমি কি তোমাদের পাওনা পরিশোধের ব্যপারে জুলুম করেছি। তারা বলল, না। আল্লাহ তাআলা বললেন, ওদেরকে যে দ্বিগুণ দিচ্ছি তা আমার অনুগ্রহ। আমি যাকে চাই, আমার অনুগ্রহ দান করি।”

আলোচ্য হাদীস খানা প্রমাণ করে যে, অতীত উম্মতদের মেয়াদের তুলনায় এ উম্মতের মেয়াদ কম হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন -

انما أجلكم في أجل من خلا من الأمم قبلكم كما بين صلاة العصر الى مغرب الشمس

“তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের মেয়াদের অনুপাতে তোমাদের মেয়াদ হল আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়ের ন্যায়। অবশ্য পূর্ববর্তী উম্মতদের সাকুল্য মেয়াদ কতটুকু ছিল, তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জানা নেই। তদ্রপ এই উম্মতের সাকুল্য মেয়াদ কতটুকু হবে, তা-ও আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কেউ জানেন না। তবে এটা ঠিক যে, পূর্ববর্তী উম্মতের মেয়াদের তুলনায় এ উম্মতের মেয়াদ কম। কিন্তু ঐ মেয়াদের কতটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে, তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন।

এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

لَا یُجَلِّیهَا لِوَقۡتِهَاۤ إِلَّا هُوَۚ

শুধু তিনিই যথাসময়ে তা প্রকাশ করবেন।

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ

( یَسۡـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلسَّاعَةِ أَیَّانَ مُرۡسَىٰهَا ۝ فِیمَ أَنتَ مِن ذِكۡرَىٰهَاۤ ۝ إِلَىٰ رَبِّكَ مُنتَهَىٰهَاۤ )

[Surah An-Nazi'at 42 - 44]

“ওরা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ামত সম্পর্কে, সেটি কখন ঘটবে? এটির আলোচনার সাথে আপনার কী সম্পর্ক? এটির চরম জ্ঞান আছে আপনার প্রতিপালকের নিকট। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরে পৃথিবী হাজার বছর আয়ু পাবে না বলে যে জনশ্রুতি মশহুর রয়েছে, তা আদৌ কোন হাদীস নয়।

এ বিষয়ে অবশ্য অন্য একটি হাদীস রয়েছে। সেটি হল, ‘দুনিয়া হল আখিরাতের জুমা সমূহের মধ্যকার একটি জুমা (সপ্তাহ) বরাবর মাত্র।’ তবে এ হাদীসের বিশুদ্ধতায় সন্দেহ রয়েছে। উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত উদাহরণ প্রদানের উদ্দেশ্য হল তাদের ছওয়াব ও পারশ্রমিকের তারতম্য বর্ণনা করা এবং এটাও জানিয়ে দেয়া যে, ছওয়াবের প্রাচুর্য ও কমতি কর্মের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি নির্ভর করে অন্য বিষয়ের উপর, যা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে স্বল্প আমল দ্বারা এমন প্রচুর ছওয়াব অর্জন করা যায়, যা অন্যখানে বেশী আমল দ্বারা অর্জন করা যায় না। যেমন লায়লাতুল কদর। এই রাতে ইবাদত করা লাইলাতুল কদর বিহীন হাজার মাস ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম। তদ্রুপ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সাহাবীগণ। তারা এমন এক সময়ে আল্লাহর পথে দান করেছেন যে, অন্যরা উহুদ পর্বত সমান স্বর্ণ আল্লাহর পথে দান করলেও সাহাবীগণের ঐ পরিমাণ বা তার অর্ধেক দানেরও সমান হবে না। আর রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর ৪০ বছর বয়সে আল্লাহ তা’আলা নবুওত দান করেন এবং ৬৩ বছর বয়সে তাঁকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন, এটাই প্রসিদ্ধ মত।

২৩ বছরের এই স্বল্প মেয়াদে তিনি কল্যাণকর জ্ঞান ও সৎকর্মে সকল নবী (আ)-কে অতিক্রম করে গিয়েছেন। এমন কি নূহ (আ) যিনি দীর্ঘ ৯৫০ বছর তাঁর সম্প্রদায়কে লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং দিনে-রাতে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন; তার উপরও রাসূলুল্লাহ (সা) শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। তাঁর সকল নবীর উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক। এই উম্মত, তারা গৌরবান্বিত হয়েছে এবং দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হয়েছে তাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম ও সম্মানের বরকতে। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَءَامِنُوا۟ بِرَسُولِهِۦ یُؤۡتِكُمۡ كِفۡلَیۡنِ مِن رَّحۡمَتِهِۦ وَیَجۡعَل لَّكُمۡ نُور ا تَمۡشُونَ بِهِۦ وَیَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُور رَّحِیم ۝ لِّئَلَّا یَعۡلَمَ أَهۡلُ ٱلۡكِتَـٰبِ أَلَّا یَقۡدِرُونَ عَلَىٰ شَیۡء مِّن فَضۡلِ ٱللَّهِ وَأَنَّ ٱلۡفَضۡلَ بِیَدِ ٱللَّهِ یُؤۡتِیهِ مَن یَشَاۤءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِیمِ )

[Surah Al-Hadid 28 - 29]

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দিবেন দ্বিগুণ পুরস্কার এবং তিনি তোমাদেরকে দিবেন আলো, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। এটি এজন্যে যে, কিতাবীগণ যেন জানতে পারে, আল্লাহর সামান্যতম অনুগ্রহের উপরও তাদের কোন অধিকার নেই। অনুগ্রহ আল্লাহরই ইখতিয়ারে, যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি তা দান করেন। আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।"

কুরআন করীমে এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীসে বনী ইসরাঈল সম্পর্কে বহু বিবরণ রয়েছে। তার সবগুলো যদি আমরা উল্লেখ করতে যাই তবে গ্রন্থটির কলেবর বেড়ে যাবে। ইমাম বুখারী (রা) যা উল্লেখ করেছেন আমরা সেগুলোই এই কিতাবে উল্লেখ করলাম। এতটুকুই যথেষ্ট, এ অধ্যায়ের জন্যে এগুলো স্মারক ও নমুনা। আল্লাহই সম্যক অবগত। (৫৭ হাদীদঃ ২৮-২৯)

ইসরাঈলীদের থেকে বর্ণিত তাদের বর্ণনা, যেগুলো অনেক তাফসীরকার ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, তার সংখ্যা তো বহু, এগুলোর কিছু কিছু সঠিক এবং প্রকৃত ঘটনার অনুকূল বটে; কিন্তু অধিকাংশ হল মিথ্যা, অসত্য ও বানোয়াট। তাদের পথভ্রষ্ট ও সত্যতাগী লোকেরা এগুলো রটনা করেছে এবং তাদের কাহিনীকাররা প্রচার করেছে।

ইসরাঈলী বর্ণনাগুলো তিন প্রকার।

(১) কতক বর্ণনা সঠিক। আল্লাহর কুরআনে বর্ণিত এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাদীসে বিবৃত ঘটনাসমূহের অনুরূপ

(২) কতক বর্ণনা এরূপ যে, কুরআন ও হাদীসের সরাসরি বিপরীত হওয়ার কারণে এগুলোর অসত্য ও বানোয়াট হওয়া সুস্পষ্ট

(৩) কতক এমন যে, এগুলো সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। এ জাতীয় বর্ণনাগুলো সম্পর্কেই আমাদেরকে নীরব থাকতে বলা হয়েছে যে, আমরা এগুলোকে সত্যও বলব না, মিথ্যাও বলব না। বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন,

اذا حدثكم أهل الكتب فلا تصير قوهم ولا تكذبوهم وقولوا أمنا بالذي أنزل الينا وأنزل اليكم

—ইয়াহুদী-নাসারাগণ যখন তোমাদের নিকট কোন কথা পেশ করে তখন তোমরা তাদেরকে সত্যবাদীও সব্যস্ত করো না; মিথ্যাবাদীও সাব্যস্ত করো না। বরং তোমরা বল? আমরা সে সবের প্রতি ঈমান এনেছি, যেগুলো আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতিও নাযিল করা হয়েছে। ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদীস

وحدثوا عن بنى اسرائيل ولا حرج

‘তোমরা ইসরাঈলীদের থেকে হাদীস বর্ণনা কর, তাতে দোষ নেই’—এর প্রেক্ষিতে এ প্রকারের উদ্ধৃতিগুলো বর্ণনা করা বৈধ।

৫২
ইয়াহুদী-নাসারাদের দীন বিকৃতির বিবরণ
ইয়াহুদী জাতি। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত মূসা ইবন ইমরানের প্রতি তাদের জন্যে তাওরাত নাযিল করেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( ثُمَّ ءَاتَیۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَـٰبَ تَمَامًا عَلَى ٱلَّذِیۤ أَحۡسَنَ وَتَفۡصِیل ا لِّكُلِّ شَیۡء ࣲ)

[Surah Al-An’am 154]

“এবং মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব, যা সৎকর্ম পরায়ণদের জন্যে সম্পূর্ণ, যা সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ।

আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেনঃ

( قُلۡ مَنۡ أَنزَلَ ٱلۡكِتَـٰبَ ٱلَّذِی جَاۤءَ بِهِۦ مُوسَىٰ نُور ا وَهُد ى لِّلنَّاسِۖ تَجۡعَلُونَهُۥ قَرَاطِیسَ تُبۡدُونَهَا وَتُخۡفُونَ كَثِیر ࣰا)

[Surah Al-An'am 91]

“বল, তবে মুসার আনীত কিতাব যা মানুষের জন্যে আলো ও পথনির্দেশ ছিল, তা তোমরা বিভিন্ন পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে কিছু প্রকাশ কর ও যার অনেকাংশ গোপন রাখ।

আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَلَقَدۡ ءَاتَیۡنَا مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ ٱلۡفُرۡقَانَ وَضِیَاۤء وَذِكۡر ا لِّلۡمُتَّقِینَ )

[Surah Al-Anbiya’ 48]

“আমি তো মূসাও হারুনকে দিয়েছিলাম কুরআন, জ্যোতি ও উপদেশ মুত্তাকীদের জন্যে।’

আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেছেনঃ

( وَءَاتَیۡنَـٰهُمَا ٱلۡكِتَـٰبَ ٱلۡمُسۡتَبِینَ ۝ وَهَدَیۡنَـٰهُمَا ٱلصِّرَ  ٰ⁠ طَ ٱلۡمُسۡتَقِیمَ )

[Surah As-Saaffat 117 – 118]

“আমি উভয়কে দিয়েছিলাম বিশদ কিতাব। আমি উভয়কে পরিচালিত করেছিলাম সৎপথে। (৩৭ সাফফাতঃ ১১৭-১১৮)

আল্লাহ্ তা’আলা অন্য এক আয়াতে বলেনঃ

( إِنَّاۤ أَنزَلۡنَا ٱلتَّوۡرَىٰةَ فِیهَا هُد ى وَنُور ۚ یَحۡكُمُ بِهَا ٱلنَّبِیُّونَ ٱلَّذِینَ أَسۡلَمُوا۟ لِلَّذِینَ هَادُوا۟ وَٱلرَّبَّـٰنِیُّونَ وَٱلۡأَحۡبَارُ بِمَا ٱسۡتُحۡفِظُوا۟ مِن كِتَـٰبِ ٱللَّهِ وَكَانُوا۟ عَلَیۡهِ شُهَدَاۤءَۚ فَلَا تَخۡشَوُا۟ ٱلنَّاسَ وَٱخۡشَوۡنِ وَلَا تَشۡتَرُوا۟ بِـَٔایَـٰتِی ثَمَن ا قَلِیل اۚ وَمَن لَّمۡ یَحۡكُم بِمَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ هُمُ ٱلۡكَـٰفِرُونَ )

[Surah Al-Ma'idah 44]

“আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম, তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো, নবীগণ যারা আল্লাহর অনুগত ছিল, তারা ইয়াহুদীদেরকে তদনুসারে বিধান দিত আরও বিধান দিত রাব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল সেটির সাক্ষী। সুতরাং মানুষকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর এবং আমার আয়াত তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করো না আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন। সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। (৫ মায়িদাঃ ৪৪)

দীর্ঘকাল পর্যন্ত ইয়াহুদীরা তাওরাত কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করেছিল এবং সুদৃঢ়ভাবে সেটিকে গ্রহণ করেছিল। তারপর তারা সেটিকে পরিবর্তন করতে, বিকৃত করতে ভুল ব্যাখ্যা দিতে ও যা তার মধ্যে নেই তা প্রচার করতে শুরু করল। এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( وَإِنَّ مِنۡهُمۡ لَفَرِیق ا یَلۡوُۥنَ أَلۡسِنَتَهُم بِٱلۡكِتَـٰبِ لِتَحۡسَبُوهُ مِنَ ٱلۡكِتَـٰبِ وَمَا هُوَ مِنَ ٱلۡكِتَـٰبِ وَیَقُولُونَ هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ وَمَا هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ وَیَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ وَهُمۡ یَعۡلَمُونَ )

[Surah Aal-E-Imran 78]

“তাদের মধ্যে এক দল লোক আছেই, যারা কিতাবকে জিহ্বা দ্বারা বিকৃত করে, যাতে তোমরা সেটিকে আল্লাহর কিতাবের অংশ মনে কর; কিন্তু সেটি কিতাবের অংশ নয়, এবং তারা বলে; এটি আল্লাহর পক্ষ হতে,কিন্তু সেটি মুলত আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত নয়। তারা জেনে-শুনে আল্লাহ্ সম্পর্কে মিথ্যা বলে।” (৩ আল ইমরানঃ ৭৮)

আলোচ্য আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা জানিয়ে দিলেন যে, তারা তাওরাতের অসত্য, মিথ্যা ও অপ্রাসংগিক ব্যাখ্যা করে। তারা যে এরূপ অপকর্মে জড়িত, তাতে আলিমগণের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। তারা এ ব্যাপারে একমত যে, তারা তাওরাতের বিকৃত অর্থ প্রকাশ করে এবং মূল মর্মের সাথে সম্পর্কহীন ভিন্ন অর্থ বুঝানোর জন্যে সংশ্লিষ্ট বাণী ব্যবহার করে। যেমন উক্ত কিতাবে রজম বা প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তারা উক্ত বিধানকে বেত্রাঘাত ও মুখে চুনকালি মেখে দেয়ার বিধান দ্বারা পরিবর্তন করেছে। অনুরূপভাবে চুরির শাস্তি কার্যকর এবং আশরাফ-আতরাফ নির্বিশেষে সকল চোরের হাত কাটার জন্যে তারা আদিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাদের কোন সভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করলে তাকে তারা ছেড়ে দিত। আর নিম্নশ্রেণী ও দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপর দণ্ড কার্যকর করত।

অবশ্য তারা তাওরাত কিতাবের মূল শব্দ পরিবর্তন করেছে কি-না, এ বিষয়ে একদল বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন যে, তারা পুরো তাওরাতের সকল শব্দই পরিবর্তন করে ফেলেছে। অপর একদল বলেন যে, তাওরাতের মূল শব্দ পরিবর্তন করা হয়নি। প্রমাণ স্বরূপ তারা এই আয়াত পেশ করেনঃ

( وَكَیۡفَ یُحَكِّمُونَكَ وَعِندَهُمُ ٱلتَّوۡرَىٰةُ فِیهَا حُكۡمُ ٱللَّهِ )

[Surah Al-Ma’idah 43]

“তারা আপনার উপর কিভাবে বিচার ভার ন্যস্ত করবে যখন তাদের নিকট রয়েছে তাওরাত’ যাতে আল্লাহর আদেশ আছে। (৫ মায়িদাঃ ৪৩)

এবং আল্লাহ্ তা’আলার বাণীঃ

( ٱلَّذِینَ یَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِیَّ ٱلۡأُمِّیَّ ٱلَّذِی یَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِیلِ یَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَیَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَیُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّیِّبَـٰتِ )

[Surah Al-A'raf 157]

“যে উম্মী নবীর উল্লেখ তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীলে রয়েছে। তাতে তারা লিপিবদ্ধ পায় যে তাদেরকে সৎকার্যের নির্দেশ দেয় ও অসৎকার্যে বাধা দেয়, যে তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু বৈধ করে। (৭ আরাফঃ ১৫৭) নীচের আয়াতও তাদের প্রমাণ

( قُلۡ فَأۡتُوا۟ بِٱلتَّوۡرَىٰةِ فَٱتۡلُوهَاۤ إِن كُنتُمۡ صَـٰدِقِینَ )

[Surah Aal-E-Imran 93]

—বল, তোমরা তাওরাত নিয়ে আস, সেটি পাঠ কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (৩ আল ইমরানঃ ৯৩)

রজম (প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড) সম্পর্কিত ঘটনাটিও তাদের প্রমাণ। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে ইবন উমর (রা) থেকে, সহীহ মুসলিমে বারা ইবন আযিব ও জাবির ইবন আব্দুল্লাহ থেকে এবং সুনান গ্রন্থসমূহে আবু হুরায়রা (রা) প্রমুখ থেকে বর্ণিত যে, এক ইহুদী পুরুষ ও ইহুদী মহিলা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাদের বিচারের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘রজম কার্যকর করা সম্পর্কে তোমাদের তাওরাতে কী নির্দেশ পাও?’ তারা বলল, ‘এ জাতীয় লোকদেরকে আমরা অপমান ও বেইজ্জত করে দেই এবং বেত্রাঘাত করি।’ রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে তাওরাত উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন। তাওরাত নিয়ে এসে তারা যখন পাঠ শুরু করল তখন রজমের আয়াত তারা গোপন করছিল। আব্দুল্লাহ ইবন সূরিয়া তার হাত দিয়ে রজমের আয়াত ঢেকে রেখেছিল এবং ঐ আয়াতের পূর্বের ও পরের অংশ পাঠ করছিল।

রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘হে কানা! তোমার হাত উঠাও।’ সে তার হাত তুলল, তখন দেখা গেল সেখানে রজমের আয়াত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স) ওদেরকে রজম করার নির্দেশ দিলেন। রাসূলুল্লাহ (স) তখন বললেনঃ

اللهم اني أول من أحيا أمرك اذ آماتوه

“হে আল্লাহ! আমিই তো প্রথম ব্যক্তি, তারা অকার্যকর করার পর যে আপনার নির্দেশকে পুনর্জীবিত করল।”

আবু দাউদ (র)-এর বর্ণনায় আছে, তারা যখন তাওরাত নিয়ে আসলো তখন তিনি তাঁর নীচ থেকে বালিশ টেনে এনে তাওরাতের নীচে রাখলেন এবং বললেন- “আমি তোমার প্রতি ঈমান এনেছি এবং যিনি তোমাকে নাযিল করেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি।" কেউ কেউ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাওরাতের সম্মানার্থে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। এই সনদ সম্পর্কে আমি অবগত নই। আল্লাহই ভাল জানেন।

অনেক কালাম শাস্ত্রবিদ যারা বলেন যে, রাজা বুখত নসরের সময়ে তাওরাত কিতাবের তাওয়াতুর বা সন্দেহাতীত প্রসিদ্ধি বিলুপ্ত হয়ে যায়, উপরোক্ত দলীল-প্রমাণ তাদের বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। তারা বলেন যে, সে সময়ে একমাত্র উযায়র (আ) ব্যতীত অন্য কারো নিকট তাওরাত সংরক্ষিত ছিল না। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যদি তা-ও হয় এবং উক্ত “উযায়র’ নবী হয়ে থাকেন তবে তাতে তাওয়াতুর বা সন্দেহাতীত প্রসিদ্ধি বিনষ্ট হবে না। কারণ নবী নিষ্পাপ। নিষ্পাপ ব্যক্তি পর্যন্ত যথাযথভাবে পৌঁছাই যথেষ্ট। অবশ্য, যদি কেউ বলেন যে, তাঁর নিকট থেকে তাওয়াতুর বা সন্দেহাতীত প্রসিদ্ধি সূত্রে পৌঁছেনি, তাহলে সমস্যা থেকে যাবে। এই সমস্যা নিরসনে এ-ও বলা যায় যে, বুখত নসরের শাসনামলের পর যাকারিয়্যা, ইয়াহয়া ও ঈসা (আ) প্রমুখ নবীগণ এসেছেন। তাঁরা সবাই তাওরাতের অনুসরণ করেছেন তাওরাত যদি বিশুদ্ধরূপে বিদ্যমান ও আমলযোগ্য না থাকত তবে তারা সেটির উপর নির্ভর করতেন না। তারা তো নিষ্পাপ নবী।

ইহুদীগণ যা সত্য বলে বিশ্বাস করতো কুমতলব হাসিলের উদেশ্যে তা থেকে তারা সরে যেত। বিচার মীমাংসার জন্যে তাদেরকে অনিবার্যভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যেতে আদেশ দেয়া সত্ত্বেও তারা রাসূলের আনীত বিধানকে প্রত্যাখ্যান করত। অবশ্য তাদের বানোয়াট ও স্বরচিত কিছু কিছু বিষয়কে তারা সত্য বলে বিশ্বাস করত। যা মূলত আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী। যেমন ব্যভিচারের শাস্তি স্বরূপ বেত্রাঘাত ও মুখে চুনকালি মেখে দেয়া। এটি অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশের সরাসরি বিরোধী। তারা বলেছিল, তোমাদের জন্যে বিধান হল বেত্রাঘাত ও মুখে কালি মেখে দেয়া, তোমরা এটি গ্রহণ কর, কিয়ামতের দিনে আল্লাহর নিকট এ বলে তোমরা ওযর পেশ করতে পারবে যে, তোমরা একজন নবীর হুকুম পালন করেছ। আর যদি এই নবী তোমাদের জন্যে বেত্রাঘাত ও মুখে কালি মাখা শাস্তির নির্দেশ না দিয়ে রজম (প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের) নির্দেশ দেন, তবে তোমরা তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। সত্য দীনের বিপরীতে তাদের দুষ্ট মনের প্ররোচণা ও কু-প্রবৃত্তির অনুসরণের এই অসৎ উদ্দেশ্য প্রত্যাখ্যান করে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَكَیۡفَ یُحَكِّمُونَكَ وَعِندَهُمُ ٱلتَّوۡرَىٰةُ فِیهَا حُكۡمُ ٱللَّهِ ثُمَّ یَتَوَلَّوۡنَ مِنۢ بَعۡدِ ذَ  ٰ⁠ لِكَۚ وَمَاۤ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ بِٱلۡمُؤۡمِنِینَ ۝ إِنَّاۤ أَنزَلۡنَا ٱلتَّوۡرَىٰةَ فِیهَا هُد ى وَنُور ۚ یَحۡكُمُ بِهَا ٱلنَّبِیُّونَ ٱلَّذِینَ أَسۡلَمُوا۟ لِلَّذِینَ هَادُوا۟ وَٱلرَّبَّـٰنِیُّونَ وَٱلۡأَحۡبَارُ بِمَا ٱسۡتُحۡفِظُوا۟ مِن كِتَـٰبِ ٱللَّهِ )

[Surah Al-Ma'idah 43 - 44]

“তারা তোমার উপর কীভাবে বিচারভার ন্যস্ত করবে অথচ তাদের নিকট রয়েছে তাওরাত যাতে আল্লাহর আদেশ আছে, এরপরও তারা মুখ ফিরিয়ে লয় এবং তারা মু’মিন নয়। নিশ্চয় আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি। তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। নবীগণ, যারা আল্লাহর অনুগত ছিল তারা ইহুদীদেরকে সে অনুযায়ী বিধান দিত রব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ— কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল।” (৫ মায়িদাঃ ৪৩-৪৪)

এ প্রেক্ষিতেই রাসূলুল্লাহ (সা) ঐ ব্যভিচারীদের জন্যে রজম-এর রায় দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে আপনার নির্দেশ পুনরুজ্জীবিত করেছে, যখন তারা তা মৃত করে ফেলেছিল।’

পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কেন তারা এরূপ আল্লাহর নির্দেশ বর্জন করেছিল? উত্তরে তারা বলেছিল আমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের মধ্যে ব্যভিচার ব্যাপকভাবে সংঘটিত হচ্ছে। তাদের উপর দণ্ড প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। দুর্বল ও নিম্ন শ্রেণীর যারা ব্যভিচার করে, শুধু তাদের উপরই আমরা রজম দণ্ড প্রয়োগ করে থাকি। তারপর আমরা পরামর্শ করে বললাম যে, ব্যভিচারের শাস্তি হিসাবে আমরা এমন একটি মাঝামাঝি দণ্ড নির্ধারণ করি, যা আশরাফ-আতরাফ সকলের উপর কার্যকর করা চলে। ফলে আমরা সমঝোতার ভিত্তিতে বেত্রাঘাত ও মুখে কালি মেখে দেয়ার দণ্ড নির্ধারণ করি। এটি তাদের তাওরাত বিকৃতি, পরিবর্তন ও ভুল ব্যাখ্যার একটি উদাহরণ। কিতাবে রজমের শব্দ অক্ষুন্ন রেখে তারা তার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। উপরোক্ত হাদীস তা প্রমাণ করে।

এ জন্যে কতক লোক বলেন যে, তারা শুধু অর্থের বিকৃতি ও ভুল ব্যাখা প্রদান করেছে শব্দগুলো সব কিতাবে যথাযথ বিদ্যমান রয়েছে। এই প্রকারের লোকদের বিরুদ্ধে এই যুক্তি দেয়া যায় যে, তারা যদি তাদের কিতাবের সকল কিছু পালন করতো তাহলে তা অবশ্যই তাদেরকে সত্যের অনুসরণ ও রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের দিকে পরিচালিত করত।

যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ٱلَّذِینَ یَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِیَّ ٱلۡأُمِّیَّ ٱلَّذِی یَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِیلِ یَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَیَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَیُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّیِّبَـٰتِ وَیُحَرِّمُ عَلَیۡهِمُ ٱلۡخَبَـٰۤىِٕثَ وَیَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَـٰلَ ٱلَّتِی كَانَتۡ عَلَیۡهِمۡ )

[Surah Al-A'raf 157]

“যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইঞ্জীল যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়। যে তাদেরকে সৎ কার্যের নির্দেশ দেয় ও অসৎকার্যে দেয়, যে তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃংখল হতে যা তাদের উপর ছিল।” (৮ আনফালঃ ১৫৭)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَلَوۡ أَنَّهُمۡ أَقَامُوا۟ ٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِیلَ وَمَاۤ أُنزِلَ إِلَیۡهِم مِّن رَّبِّهِمۡ لَأَكَلُوا۟ مِن فَوۡقِهِمۡ وَمِن تَحۡتِ أَرۡجُلِهِمۚ مِّنۡهُمۡ أُمَّة مُّقۡتَصِدَة ࣱ)

[Surah Al-Ma'idah 66]

“তারা যদি তাওরাত, ইঞ্জীল ও তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত করত, তাহলে তারা তাদের উপর ও পদতল হতে আহার্য লাভ করত। তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা মধ্যপন্থী। (৫ মায়িদাঃ ৬৬)

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ

( قُلۡ یَـٰۤأَهۡلَ ٱلۡكِتَـٰبِ لَسۡتُمۡ عَلَىٰ شَیۡءٍ حَتَّىٰ تُقِیمُوا۟ ٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِیلَ وَمَاۤ أُنزِلَ إِلَیۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ )

[Surah Al-Ma'idah 68]

—বল, হে কিতাবীরা! তাওরাত, ইনজীল ও যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, তোমরা তা প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত তোমাদের কোন ভিত্তি নেই। (৫ মায়িদাঃ ৬৮)

তাওরাতের শব্দে বিকৃতি ঘটেনি বরং অর্থেই বিকৃতি ঘটানো হয়েছে এই অভিমত হযরত ইবন আব্বাস (রা)-ও পোষণ করতেন বলে ইমাম বুখারী (র) তাঁর সহীহ গ্রন্থের শেষ দিকে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী (র) নিজেও এই অভিমত সমর্থন করেছেন। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, অধিকাংশ কালাম শাস্ত্রবিদ এই অভিমত পোষণ করতেন।

৫৩
নাপাক ব্যক্তির জন্যে তাওরাত স্পর্শ করা জায়েয নেই
হানাফী ফিকহ্ বিদদের মতে নাপাক অবস্থায় ও বিনা উযূতে তাওরাত স্পর্শ করা জায়েয নেই। আল্লামা হানাতী তাঁর ফাতাওয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কতক শাফিঈ পন্থী ‘আলিমও উপরোক্ত মত পোষণ করেন। এই মতটি একটি বিরল মত। কতক উলামা উভয় অভিমতের মাঝামাঝি অভিমত পোষণ করেন। তাদের মধ্যে শায়খ ইমাম আল্লামা আবুল আব্বাস ইবন তায়মিয়্যা অন্যতম। তিনি বলেন, যারা এ মত পোষণ করে যে, তাওরাত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণই পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে এবং এর একটি অক্ষরও আসল অবস্থায় নেই, তাদের এ অভিমত কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তদ্রুপ যারা এ অভিমত পোষণ করে যে, তাওরাত আদৌ পরিবর্তন করা হয়নি, তাদের অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। সত্য ও বাস্তবতা এই যে, তাওরাতের কতক শব্দে হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবর্তন, বিকৃতি ও রূপান্তর সংঘটিত হয়েছে; যেমন বিকৃতি ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এর মর্ম ও ব্যাখ্যায়। ভালভাবে চিন্তা করলে এটি অবগত হওয়া যায়। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। আল্লাহই ভাল জানেন।

তাদের তাওরাত বিকৃতির একটি উদাহরণ হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর পুত্র কুরবানীর ঘটনা। সেখানে আছে ( اذبح ابنك وحيدك ) তোমার একক পুত্রকে কুরবানী কর। তাওরাতের কোন কোন পাঠে আছে ( اذبح ابنك وحيدك بكرك اسحاق ) তোমার একক শিশু পুত্র ইসহাককে কুরবানী কর। এসব কপিতে বর্ণিত ( اسحاق ) শব্দটি নিঃসন্দেহে তাদের নিজেদের সংযোজন। কারণ তখন হযরত ইব্রাহীমের একক ও প্রথম শিশু পুত্র ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ)। হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্মের ১৪ বছর পূর্বে ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম হয়। তাহলে ইসহাক (আ) একক শিশু পুত্র হন কীভাবে? আরবদের প্রতি তাদের বিদ্বেষের প্রেক্ষিতে আরবদের পূর্ব পুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ)-এর জন্যে কুরবানী বিষয়ক সামান নির্ধারণের জন্যে তারা আল্লাহ ও রাসূল (সা) সম্বন্ধে মিথ্যা আরোপ করে ( اسحاق ) শব্দ সংযোজন করে দিয়েছে।

তাদের এই সংযোজনের প্রেক্ষিতে পূর্বের ও পরের অনেক লোক প্রতারিত হয়েছে এবং তাদের সাথে এ মত পোষণ করেছেন যে, কুরবানী বিষয়ক পুত্র হলেন ইসহাক (আ)। সঠিক মতামত এই যে, কুরবানী বিষয়ক পুত্র ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ)। ইতিপূর্বে আমরা তা বর্ণনা করেছি। আল্লাহই ভাল জানেন। সামিরা সম্পাদিত তাওরাতের দশম বাক্যে নামাযে তুর পর্বতের দিকে মুখ করার নির্দেশটি তাদের অতিরিক্ত সংযোজন। ইয়াহুদী ও নাসারাদের অন্যান্য কপিতে এটুকু নেই। হযরত দাউদ (আ)- এর নামে প্রচলিত যাবুরের কপিতে প্রচুর অসংগতি পাওয়া যায়। তাতে এমন সব অতিরিক্ত ও সংযুক্ত বিষয়াদি পাওয়া যায়, যা মূলত যাবূরের ভাষ্য নয়। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইয়াহুদীদের নিকট এখন যাবুরের যে আরবী অনুবাদ রযেছে, তার মধ্যে যে প্রচুর বিকৃতি পরিবর্তন, সংযোজন ঘটনার মিথ্যাচারিতা ও স্পষ্ট হ্রাস-বৃদ্ধি রয়েছে, তাতে কোন বিবেকবান মানুষেরই সন্দেহ থাকতে পারে না। এ কপিতে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার ও প্রচুর মারাত্মক ভ্রান্তি রয়েছে। তারা নিজেদের ভাষায় যা পাঠ করে এবং নিজেদের কলমে যা লিখে সে সম্পর্কে অবশ্য আমাদের জানা নেই। তবে তারা যে মিথ্যাবাদী, বিশ্বাস ভঙ্গকারী এবং আল্লাহ তাঁর রাসূল ও তাঁর কিতাব সম্পর্কে মিথ্যা আরোপকারী এরূপ ধারণা করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। নাসারাদের ইনজীল চতুষ্টয় যা মার্ক, লুক, মথি ও যোহন থেকে বর্ণিত, সেগুলো তওরাতের তুলনায় আরো বেশী পরস্পর বিরোধী ও অসংগতিপূর্ণ।

নাসারাগণ কোন কোন ক্ষেত্রে তাওরাত ও ইনজীল উভয়ের বিধানের বিরোধিতা করে। এ সকল ক্ষেত্রে তারা নিজেরা নিজেদের জন্যে নতুন বিধান তৈরী করে নেয়। এ জাতীয় বিধান সমূহের একটি হল তাদের পূর্বমুখী হয়ে নামায আদায় করা। ইনজীল চতুষ্টয়ের কোনটিতেই সরাসরি এ বিধান নেই এবং এ বিষয়ে তারা আদিষ্ট নয়। অনুরূপ তাদের উপাসনালয়ে মূর্তি স্থাপন, খতনা বর্জন, রোজার সময়কে বসন্তকালে সরিয়ে দেয়া এবং রোযার মেয়াদ ৫০ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করণ, শূকরের গোশত খাওয়া, ক্ষুদ্র একটি খিয়ানতকে বড় আমানত বলে গ্রহণ করা, সন্যাসব্রতের প্রচলন করা, সন্যাসব্রত হল ইবাদতে আগ্রহী ব্যক্তির বিয়ে-শাদী বর্জন করা এবং তার জন্যে বিয়ে-শাদী হারাম বলে গণ্য করা এবং ৩১৮ জন ধর্মযাজক কর্তৃক রচিত বিধি-বিধানগুলো লিপিবদ্ধ করা [এখানটি ৩২৫ খ্রীষ্টানদের। এটি খ্রীষ্টান যাজকদের প্রথম কাউন্সিল বলে পরিচিতি] এসবই হচ্ছে তাদের বানানো ও স্বরচিত বিধান। কনস্টান্টিননোপল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট কনস্টান্টিন ইবন কস্তুন- এর শাসনামলে তারা এগুলো তৈরি করে ও তার প্রচলন ঘটায়। রাজা কনস্টান্টের সময়কাল ছিল হযরত ঈসা (আ)-এর ৩০০ বছর পর। তাঁর পিতা ছিলেন রোমের একজন রাজা। তাঁর পিতা হারবান অঞ্চলে শিকারের উদ্দেশ্যে এক সফরে গিয়ে তাঁর মাতা হায়লানাকে বিবাহ করেন। এই মহিলাটি প্রাচীন সন্যাসব্রতী খৃষ্টান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।

কনস্টান্টিন তাঁর বাল্যকালে দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা করেন এবং তাতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি তাঁর মায়ের ধর্ম খৃষ্টবাদের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়েন। নিজে দর্শনের অনুসারী হয়েও খৃষ্টবাদ অবলম্বীদেরকে তিনি মোটামুটি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। প্রজাদের প্রতি তিনি ন্যায় বিচার করতেন। জনসাধারণও তাঁকে ভালবাসতে থাকে। তিনি তাদের মধ্যে নেতৃত্ব অর্জন করেন এবং সামরিক অভিযান চালিয়ে দ্বীপ সমূহসহ সমগ্র সিরিয়া জয় করে নেন। এতে তার সম্মান ও মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম কায়সার। তাঁর শাসনামলে ত্রিমুখী ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি হয়। একদিকে নাসারাগণ একদিকে আলেকজান্দ্রিয়ার আকসান্দরূস অন্য দিকে তাদেরই জনৈক পণ্ডিত ব্যক্তি নাম আব্দুল্লাহ ইবন আরইউস। আকসন্দরূস-এর মতে হযরত ঈসা (আ) ছিলেন আল্লাহর পুত্র। আল্লাহ্ তা’আলার শান তার এ মতের অনেক ঊর্ধ্বে।

ইব্‌ন আরইউসের মতে, ঈসা (আ) ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। নাসারাদের একটি ছোট দল তার অনুসরণ করেছিল। তাদের অধিকাংশ লোক তাদের ধর্ম যাজকের অভিমতই গ্রহণ করে। তারা ইবন আরইউস ও তার অনুসারীদেরকে তাদের উপাসনালয়ে প্রবেশে বাধা দেয়। ইবনে আরইউস তার প্রতিদ্বন্দ্বী আকসান্দরূস ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে রাজা কনষ্টান্টইনের নিকট অভিযোগ দায়ের করে। রাজা তার মতবাদ সম্পর্কে জানতে চান। তিনি হযরত ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বিষয়ে নিজের অভিমত রাজার নিকট পেশ করেন এবং এ বিষয়ে দলীল- প্রমাণ ও যুক্তি উপস্থিত করেন। এতে রাজা তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার বক্তব্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

রাজ দরবারে কেউ কেউ প্রস্তাব করে যে, ইব্‌ন আরইউসের বক্তব্য যখন শোনা হল তখন তার প্রতিপক্ষের বক্তব্যও তো শোনা উচিত। রাজা তখন তার প্রতিপক্ষকে উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে নেতৃস্থানীয় ধর্মভীরু ব্যক্তি, খৃষ্ট ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞ সকল লোক এবং বায়তুল মুকাদ্দাস, এন্টিয়ক, রোম ও আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মযাজকদেরকেও উপস্থিত করার নির্দেশ জারী করেন।

কথিত আছে যে, চৌদ্দ মাস সময়ের মধ্যে ২০০০-এর অধিক ধর্মযাজক সমবেত হন। রাজা তাদেরকে একটি মজলিসে উপস্থিত করেন। তাদের তিনটি প্রসিদ্ধ মজলিসের এটি হল প্রথম মজলিস। এরা সবাই পরস্পর প্রচণ্ডভাবে ভিন্ন মতাবলম্বী। তাদের পরস্পরের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য প্রচণ্ড ও গুরুতর। ক্ষুদ্র একটি দল এমন মতবাদে বিশ্বাস করে যা অন্য কেউ সমর্থন করে না। এ ৫০ জন হল এক আদর্শে বিশ্বাসী, অপর ৮০ জন অপর এক মতবাদে বিশ্বাসী। অপর দশজন এক মতবাদপন্থী অপর ৪০ জন ভিন্ন এক আদর্শের অনুসারী। ১০০ জন এক প্রকার বিশ্বাসের অনুসারী তো অন্য ২০০ জন অন্য অভিমত পোষণকারী। একদল ইবন আরইউসের মতাবলম্বী তো, অন্যদল অন্য মতাবলম্বী। এসব ধর্মীয় ব্যক্তিদের মতদ্বৈততা ও মতপার্থক্য যখন চরমে পৌঁছে তখন রাজা কনস্টান্টিনোপল হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। অবশ্য তাঁর পূর্বসূরী গ্ৰীক সাবিইনদের ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মমতের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন।

অবশেষে যে অভিমতের পক্ষে সমর্থক সংখ্যা বেশী, তিনি সে দলের প্রতি মনোযোগী হলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, ৩১৮ জন্য ধর্মযাজক আকসিন্দরুম-এর মতের সমর্থক। তাদের সমান সংখ্যক অন্য কোন দল তিনি পেলেন না। তিনি বললেন যে, এরাই সাহায্য পাওয়ার অগ্রাধিকারী। কারণ, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। আমি তাদেরকে সহায়তা দিব। তিনি তাদের সাথে একান্ত বৈঠকে বসলেন। তিনি তার তরবারী ও ঘোড়া তাদের হাতে অর্পণ করলেন এবং বললেন, আমি ছাড়া আর সবাই রাজাকে সিজদা করল। তিনি তাদেরকে ধর্মীয় বিধান সম্বলিত একটি পুস্তক প্রণয়নের অনুরোধ জানালেন। তিনি এও বললেন যে, উপাসনা যেন পূর্বমূখী হয়ে আদায় করা হয়, কারণ নায়্যিরা নক্ষত্র পূর্বদিক থেকে উদিত হয়। আর তাদের উপাসনালয়ে যেন দেহ বিশিষ্ট মূর্তি স্থাপন করা হয়। তারা সমঝোতায় উপনীত হয় যে, মূর্তি স্থাপন করা হবে উপসনালয়ের প্রাচীরে। এ সব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার পর রাজা তাদেরকে সাহায্য করতে শুরু করেন। তিনি তাদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে, বিরুদ্ধবাদীদেরকে কোনঠাসা করতে এবং তাদের মতবাদকে দুর্বল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। রাজা এ পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বিরুদ্ধবাদীদের উপর বিজয় ও প্রতিষ্ঠা পায়। নিজেদের দ্বীনের স্বপক্ষে বহু সংখ্যক উপাসনালয় নির্মাণের জন্যে রাজা তাদেরকে নির্দেশ দেয়। রাজার দীন অনুসরণকারী হিসেবে তারা মালাকামী (রাজতান্ত্রিক সম্প্রদায়) আখ্যায়িত হয়। সম্রাট কন্টাষ্টাটনের আমলে সিরিয়া ও অন্যান্য শহরে ও জনপদে তারা ১২০০-এর অধিক গীর্জা নির্মাণ করে। রাজা নিজেই হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মস্থানে বেথেলহাম ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তাঁর মা হায়লানাহ তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ)-এর শূলে চড়ানোর স্থানে বায়তুল মুকাদ্দাসে একটি গম্বুজ নির্মাণ করেন।

ইহুদী ও নাসারাগণ তাদের মূর্খতা ও জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, ঈসা (আ) সেখানে শূলবিদ্ধ হয়েছিলেন।

কথিত আছে যে, রাজা কনষ্টান্টাইন উক্ত মতাদর্শের বিরোধীদেরকে হত্যা করেন এবং তাদের জন্যে মাটিতে বড় বড় গর্ত খনন করে। তাতে আগুন জ্বালিয়ে তাদেরকে পুড়িয়ে মারেন। সূরা বুরুজের তাফসীরে আমরা এ প্রসংগে আলোচনা করেছি। রাজা খ্রিষ্ট ধর্মের এই শাখাকে মর্যাদার আসনে আসীন করেন। এবং তার কারণে এ মতাদর্শ অন্যসব মতাদর্শের উপর বিজয় লাভ করে। তিনি এই ধর্মকে এতই বিকৃত করেন, যা কখনো সংশোধন হওয়ার নয়। এগুলো বজায় রেখে ঐ ধর্ম দ্বারা কল্যাণ অর্জনও সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় লোকদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের পূজা-পার্বণ অনেক বৃদ্ধি পায়। তাদের সাধু সন্তদের নামে প্রচুর সংখ্যাক গীর্জা স্থাপিত হয়। তাদের কুফরী চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। তারা স্থায়ীভাবে গোমরাহীর শিকার হয় এবং তাদের কুকর্ম বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে হিদায়াতের দিকে ধাবিত করেননি বা তাদের অবস্থাও সংশোধন করেননি। বরং তাদের অন্তরকে সত্য থেকে বিচ্যুত করেছেন এবং সত্যে অবিচলতা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।

এরপর তারা নাসতুরিয়্যা ও ইয়াকুবিয়্যা নামক আরো দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল অপর দলকে কাফির বলতে থাকে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীগণ চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে বলে ধারণা করতে থাকে। কোন উপাসনালয়েই তাদের উভয় পক্ষকে একত্রিত হতে দেখা যেত না। প্রত্যক দলই তিন মূল সত্তার প্রবক্তা ছিল- পিতা, পুত্র এবং কলেমা বা বাণী সত্তা। কিন্তু অতীন্দ্রিয় জগত ও পার্থিব স্রষ্টার অবতাররূপে আগমন অথবা মানবাকৃতির মধ্যে একাত্ম হওয়া বিষয়ে তাদের মধ্যে চরম মতভেদ ছিল। আল্লাহ তাআলা খোদ ঈসা (আ)-এর রূপে অবতরণ করেছিলেন, না কি তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন, না আল্লাহ ও ঈসা একীভূত সত্তা ভুক্ত এ বিষয়ে তাদের মতবিরোধ চরমে পৌঁছেছিল। এ কারণে তাদের কুফরী জঘন্য পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মূলত তাদের সকল পক্ষই ছিল বাতিল, অসত্যের অনুসারী।

অবশ্য আব্দুল্লাহ্ ইবন আরইউসের অনুসারীগণ যারা বলত যে, হযরত ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, আল্লাহর দাসীর পূত্র ও তার বাণী, মারয়ামের প্রতি এ বাণী নিক্ষেপ করেছেন এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ রূপে আবির্ভূক্ত হয়েছিলেন তারা সত্যপন্থী ছিল। মুসলমানরাও হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে অনুরূপ মত পোষণ করেন। কিন্তু আরইউসী পন্থীগণ যখন এই বিশ্বাসে অনমনীয় থাকে, তখন উপরোক্ত তিন ফিকরা এসে তাদের উপর আক্রমণ করল এবং তাদেরকে মেরেকেটে ছত্রভঙ্গ করে দূরে তাড়িয়ে দিল। ক্রমে ক্রমে তাদের সংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে অবশেষে এমন হয়ে গেল যে, এখন ঐ পন্থী কাউকেই দেখা যায় না। আল্লাহই ভাল জানেন।

৫৪
পূর্বতন নবীগণের বিবরণ বিষয়ক অধ্যায়
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( تِلۡكَ ٱلرُّسُلُ فَضَّلۡنَا بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡض ۘ مِّنۡهُم مَّن كَلَّمَ ٱللَّهُۖ وَرَفَعَ بَعۡضَهُمۡ دَرَجَـٰت ۚ وَءَاتَیۡنَا عِیسَى ٱبۡنَ مَرۡیَمَ ٱلۡبَیِّنَـٰتِ وَأَیَّدۡنَـٰهُ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِ )

[Surah Al-Baqarah 253]

“এই রাসূলগণ, তাদের কতককে অপর কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ রয়েছে, যার সাথে আল্লাহ্ কথা বলেছেন। আবার কতককে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। মারয়াম তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেছি ও পবিত্র আত্মা দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি।” (২ বাকারাঃ ২৫৩)

আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( ۞ إِنَّاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَیۡكَ كَمَاۤ أَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ نُوح وَٱلنَّبِیِّـۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِۦۚ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰۤ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَ وَإِسۡمَـٰعِیلَ وَإِسۡحَـٰقَ وَیَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَعِیسَىٰ وَأَیُّوبَ وَیُونُسَ وَهَـٰرُونَ وَسُلَیۡمَـٰنَۚ وَءَاتَیۡنَا دَاوُۥدَ زَبُور ا ۝ وَرُسُل ا قَدۡ قَصَصۡنَـٰهُمۡ عَلَیۡكَ مِن قَبۡلُ وَرُسُل ا لَّمۡ نَقۡصُصۡهُمۡ عَلَیۡكَۚ وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِیم ا ۝ رُّسُل ا مُّبَشِّرِینَ وَمُنذِرِینَ لِئَلَّا یَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِیزًا حَكِیم ࣰا)

[Surah An-Nisa' 163 - 165]

“আমি আপনার নিকট ওহী প্রেরণ করেছি যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীগণের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তার বংশধরগণ ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন এবং সুলায়মানের নিকট ওহী প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম। আমি অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা পূর্বে তোমাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল যাদের কথা আমি বলিনি। এবং মুসার সাথে আল্লাহ সাক্ষাৎ বাক্যালাপ করেছিলেন। আমি সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (৪ নিসাঃ ১৬৩-১৬৫)

ইবন হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইবন মারদুয়েহ তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এবং অন্যান্য অনেকে আবুযর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! নবীদের সংখ্যা কত?’ তিনি বললেন, ‘এক লাখ চব্বিশ হাজার।’ আমি আবার বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! তাঁদের মধ্যে রাসূল কতজন?’ তিনি বললেন, ‘৩১৩ জন, তাঁদের সংখ্যা প্রচুর।’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে ছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘আদম (আ)।’ আমি বললাম, ‘তিনি কি রিসালাতপ্রাপ্ত নবী?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে আপন হাতে তৈরী করেছেন। তার মধ্যে তার রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। তারপর তাকে প্রথম মানবরূপে তৈরী করেছেন।’ এরপর রাসূলল্লাহ (সা) বললেন, ‘হে আবু যর! ৪ জন নবী সুরয়ানী ভাষাভাষী তারা হলেন আদম, শীস, নূহ ও খানুখ অর্থাৎ ইদরীস (আ)। হযরত ইদরীস সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার করেন। ৪ জন নবী আরব বংশোদ্ভূত। হুদ, সালিহ, শুআয়ব, ও তোমাদের এই নবী। হে আবুযর! বনী ইসরাঈল বংশীয় প্রথম নবী হযরত মূসা (আ)। আর তাদের গোত্রভুক্ত শেষ নবী হযরত ঈসা (আ)। সর্বপ্রথম নবী হচ্ছেন হযরত আদম (আ) এবং সর্বশেষ নবী তোমাদের নবী।’ আবুল ফয়জ ইবন জাওযী এ হাদীসকে বানোয়াট বলে অভিহিত করেছেন।

ইবন আবী হাতিম....... আবূ উমামা (র) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বলেছিলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! নবীগণের সংখ্যা কত?’ তিনি বললেন, ‘এক লক্ষ চব্বিশ হাজার। তন্মধ্যে রাসূল ৩১৫ জন। তাদের সংখ্যা অনেক।’ এই সনদটিও দুর্বল। বর্ণনাকারী মা’আয, তাঁর শায়খ এবং এই শায়খের শায়খ তারা তিনজনই দুর্বল বর্ণনাকারী।

আবু ইয়ালা মাওসেলী...... আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন আল্লাহ্ তা’আলা আট হাজার নবী প্রেরণ করেছেন। চার হাজার বনী ইসরাঈলের প্রতি আর চার হাজার অন্য সকল লোকের প্রতি।’ এই বর্ণনার দু’জন বর্ননাকারী মূসা ও তার শায়খ উভয়ে দুর্বল রাবী।

আবু ইয়ালা আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, ‘আমার পূর্বসূরী নবীগণের সংখ্যা ছিল আট হাজার। তারপর আসেন ঈসা (আ), তারপর আমি।’ এই সনদে ইয়াযীদ রক্কাশী দুর্বল রাবী।

হাকিম আবু বকর..... আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে অনুরূপ আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন।

৫৫
অন্য একটি হাদীস
আব্দুল্লাহ্ ইবন আহমদ..... আবুল ওয়াদ্দাক সূত্রে বলেন, আবু সাঈদ বলেছিলেন, ‘আপনি কি খারিজীদেরকে দাজ্জাল বলে স্বীকার করেন?’ তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘না।’ আবু সাঈদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (স) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি এক হাজার কিংবা ততোধিক নবীর শেষ নবী। আল্লাহ্ তা’আলা অনুসরণযোগ্য যত নবী প্রেরণ করেছেন, সকলেই নিজ নিজ উম্মতকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। দাজ্জালের পরিচিতি ও চিহ্ন সম্পর্কে আমাকে যত বেশী স্পষ্ট জানানো হয়েছে অন্য কাউকে ততটুকু জানানো হয়নি। দাজ্জাল হবে এক চোখ বিশিষ্ট। তোমাদের প্রতিপালক একচোখ বিশিষ্ট নয়। তার ডান চোখ কানা এবং কোটর থেকে বের হয়ে থাকবে। এটি গোপন রাখা যায় না। এ যেন আস্তর করা প্রাচীরের উঁচিয়ে থাকা অংশ। তার বাম চোখ যেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার নিকট থাকবে সকল ভাষার জ্ঞান সম্ভার। আরও থাকবে সবুজ রং এর কৃত্রিম বেহেশত। তাতে পানি প্রবহমান থাকবে। আরও থাকবে ধুমায়িত কালো কৃত্রিম দোযখ।’ এটি গরীব পর্যায়ের বর্ণনা। হাকিম আবু বকর রাজ্জাক...... জাবির (রা) সূত্রে অনূরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

তবে তাঁর বর্ণিত হাদীসের সনদ হাসান পর্যায়ের। উক্ত হাদীসটিতে দাজ্জাল সম্পর্কে সর্তককারী নবীগণের সংখ্যাই কেবল উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য রিওয়াতে প্রত্যেক নবীই এ ব্যাপারে তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন বলে উল্লেখিত হয়েছে।

ইমাম বুখারী (র)..... হযরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্র বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা)। বলেছেন, ‘নবীগণই বনী ইসরাঈলীদের শাসন পরিচালনা করতেন। এক নবীর ইনতিকালের পর অপর নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। তবে আমার পরে কোন নবী আসবে না। অবশ্য আমার খলীফাগণ আসবেন। খলীফা হবেন বহু সংখ্যক।’ সাহাবা-ই কিরাম বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! সে পরিস্থিতিতে আপনি আমাদেরকে কী করার নির্দেশ দেন?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তখন তোমরা প্রথমে প্রথম খলীফার বায়আতে অটল থাকবে। তারপর পর্যায়ক্রমে যারা খলীফা হবেন তাদেরকে তাদের হক (আনুগত্য) আদায় করবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।’

ইমাম বুখারী (র) ....... হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) সূত্রে বলেন, ‘আমি যেন এখনও দেখছি, রাসূলুল্লাহ (সা) একজন নবীর ঘটনা বর্ণনা করছেন। নিজের সম্প্রদায়ের লোকেরা ঐ নবীকে প্রহারে প্রহারে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল। নবী তার মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছে ফেলছিলেন। তখনও নবী বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ্! আমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ক্ষমা করে দিন, কারণ তারা সত্য উপলব্ধি করতে পারছে না।’ ইমাম মুসলিমও আনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ..... আবু সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, একজন ব্যক্তি তার ডান হাত রেখেছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপর। সে বলল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার দেহ মুবারকের যে প্রচণ্ড উত্তাপ, তাতে আমি আমার হাত আপনার দেহে রাখতে পারছি না।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘আমরা নবীগণ, আমাদেরকে বহুগুণ বেশী বিপদ-আপদ দ্বারা পরীক্ষা করা হয়, যেমন আমাদের ছওয়াবও বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়।’ একজন নবীকে উকুনের যন্ত্রণা দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এই যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। একজন নবীকে দারিদ্র্যের কষ্ট দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি জামা সেলাইয়ের পেশা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা অবশ্য স্বচ্ছলতা ও নিরাপত্তার সময় যেমন খুশী থাকতেন, বালা মুসিবতের সময়ও তেমনি খুশী থাকতেন। ইবন মাজাহ (র) ..... আবু সাঈদ (রা) সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন।

ইমাম আহমদ ...... সা’দ (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! কোন প্রকারের মানুষ কঠোরতম বিপদে পতিত হয়?’ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেনঃ

الانبياء ثم الصالحون ثم الأمثل من الناس يبتلى الرجل على حسب دينه فان كان في دينه صلابة زيد في بلاءه وان كان في دينه رقة خقف عليه ولا يزال البلاء بالعبد حتى يمشي على الأرض وما عليه خطيئة

“সর্বাধিক কঠোর বিপদে পতিত হন নবীগণ (আ)! তারপর নেককারগণ। এরপর পর্যায়ক্রমে অপেক্ষাকৃত উত্তম লোকগণ। মানুষকে বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করা হয় তার দীন বা ধর্মের প্রতি দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা অনুপাতে। যদি ধর্মের প্রতি তার দৃঢ়তা ও অবিচলতা থাকে, তাহলে তার বিপদ আরো কঠিন করা হয়। আর যদি ধর্মের প্রতি তার শৈথিল্য থাকে, তবে তার বিপদ হালকা করে দেয়া হয়। কোন কোন ব্যক্তির উপর বিপদ আসতে থাকে অনবরত। অবশেষে সে পৃথিবীতে বিচরণ করে এমনভাবে যে, তার কোন পাপ থাকে না।

ইমাম তিরমিযী (র) নাসাঈ ও ইবন মাজাহ্ (র) উক্ত হাদীসটি ভিন্ন সনদে উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) বলেন, হাদীসটি সহীহ এবং হাসান। ইতিপূর্বে একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন,

نحن معاشر الانبياء اولاد علات ديننا وامهاتنا شئى

আমরা নবীগণ বৈমাত্রেয় ভাইদের মত। আমাদের দ্বীন ধর্ম এক। আমাদের মায়েরা হচ্ছেন ভিন্ন ভিন্ন। অর্থাৎ নবীগণের শরীয়ত সমূহে শাখাগত মাসআলায় যদিও বা ভিন্নতা ও পার্থক্য রয়েছে এবং এদের একটি অপরটিকে মানসূখ বা রহিত করতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে সবগুলো শরীয়ত হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শরীয়তে এসে মিলে গিয়েছে; তবু এটা ধ্রুব সত্য যে, যত নবীকেই আল্লাহ্ তা’আলা প্রেরণ করেছেন, তাদের সকলের দ্বীন ছিল ইসলাম ধর্ম। ইসলাম ধর্মের মূল কথা তাওহীদ তথা একক লা শরীক আল্লহর ইবাদত করা। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ-

( وَمَاۤ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِیۤ إِلَیۡهِ أَنَّهُۥ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّاۤ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ )

[Surah Al-Anbiya' 25]

আমি আপনার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর। (২১ আম্বিয়াঃ ২৫)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন-

( وَسۡـَٔلۡ مَنۡ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رُّسُلِنَاۤ أَجَعَلۡنَا مِن دُونِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ءَالِهَة یُعۡبَدُونَ )

[Surah Az-Zukhruf 45]

তোমার পূর্বে আমি যে সব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস কর, আমি কি দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত কোন দেবতা স্থির করেছিলাম যার ইবাদত করা যায়? (৪৩ যুখরুফঃ ৪৫)

আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِی كُلِّ أُمَّة رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُوا۟ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُوا۟ ٱلطَّـٰغُوتَۖ فَمِنۡهُم مَّنۡ هَدَى ٱللَّهُ وَمِنۡهُم مَّنۡ حَقَّتۡ عَلَیۡهِ ٱلضَّلَـٰلَةُۚ )

[Surah An-Nahl 36]

“আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্যে আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। অতঃপর তাদের কতককে আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তাদের কতকের উপর পথভ্রান্তি সাব্যস্ত হয়েছিল।” (১৬ নাহলঃ ৩৬)।

উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, বৈমাত্রের ভাই বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদের পিতা একজন আর মা ভিন্ন ভিন্ন। নবী (আ)-দেরকে পরস্পর বৈমাত্রের ভাই বলার তাৎপর্য এই যে, তাদের সকলের দ্বীন একটি। এটি হল তাওহীদ ও একত্ববাদ। এটিকে পিতারূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর তাঁদের প্রত্যেকের শরীয়তগুলো বিধি বিধান ও রীতি নীতির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। এগুলোকে মা-রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( لِكُلّ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَة وَمِنۡهَاج ࣰا)

[Surah Al-Ma'idah 48]

“তোমাদের প্রত্যেকের জন্যে আইন ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (৫ মায়িদাঃ ৪৮)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

( لِّكُلِّ أُمَّة جَعَلۡنَا مَنسَكًا هُمۡ نَاسِكُوهُ )

[Surah Al-Hajj 67]

-আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছি, ইবাদত পদ্ধতি, যা তারা অনুসরণ করে। (২২ হজ্জঃ ৪৮)

আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ

( وَلِكُلّ وِجۡهَةٌ هُوَ مُوَلِّیهَا )

[Surah Al-Baqarah 148]

প্রত্যেকের একটি দিক রয়েছে, যে দিকে সে মুখ করে। উক্ত আয়াতের একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ আয়াত আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

মোদ্দাকথা, শরীয়ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার হয়েছে বটে কিন্তু; এর সবগুলোই একক লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশক। আর তা হলো ইসলাম। সকল নবীর জন্যে আল্লাহ তা’আলা-এর বিধান দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন এ দীন ব্যতীত অন্য কিছু আল্লাহ্ গ্রহণ করবেন না। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَمَن یَبۡتَغِ غَیۡرَ ٱلۡإِسۡلَـٰمِ دِین ا فَلَن یُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِی ٱلۡـَٔاخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَـٰسِرِینَ )

[Surah Aal-E-Imran 85]

—কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং সে হবে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। (৩ আলে ইমরানঃ ৮৫)

আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَمَن یَرۡغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِـۧمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَقَدِ ٱصۡطَفَیۡنَـٰهُ فِی ٱلدُّنۡیَاۖ وَإِنَّهُۥ فِی ٱلۡـَٔاخِرَةِ لَمِنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ ۝ إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥۤ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ وَوَصَّىٰ بِهَاۤ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِـۧمُ بَنِیهِ وَیَعۡقُوبُ یَـٰبَنِیَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّینَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ )

[Surah Al-Baqarah 130 - 132]

“যে নিজেকে নির্বোধ করেছে, সে ব্যতীত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ হতে আর কে বিমুখ হবে? পৃথিবীতে তাকে আমি মনোনীত করেছি, পরকালেও সে সৎকর্ম পরায়ণদের অন্যতম। তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর। সে বলেছিল, জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এ সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিল- হে পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্যে এই দীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যু বরণ করো না। (২ বাকারাঃ ১৩০-১৩২)

আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( إِنَّاۤ أَنزَلۡنَا ٱلتَّوۡرَىٰةَ فِیهَا هُد ى وَنُور ۚ یَحۡكُمُ بِهَا ٱلنَّبِیُّونَ ٱلَّذِینَ أَسۡلَمُوا۟ لِلَّذِینَ هَادُوا۟ )

[Surah Al-Ma'idah 44]

“আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম, তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো, নবীগণ, যারা আল্লাহর অনুগত ছিল, তারা ইহুদীদেরকে সে অনুযায়ী বিধান দিত। (৫ মায়িদাঃ ৪৪)।

সুতরাং দ্বীন ইসলাম হল একক লা-শরীক আল্লাহর ইবাদত করা এবং এটি হল একনিষ্ঠভাবে একক আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত নিবেদন করা। অন্য কারো উদ্দেশ্যে নয়। আর ইহসান হল নির্দেশিত সময়সীমার মধ্যে শরীয়ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে ইবাদত করা। তাই মুহাম্মদ (সা)-কে তাঁর জন্যে নির্ধারিত শরীয়ত প্রেরণ করার পর অন্য শরীয়তের কোন ইবাদত আল্লাহ্ ত’আলা কবুল করবেন না। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( قُلۡ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّی رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَیۡكُمۡ جَمِیعًا )

[Surah Al-A'raf 158]

“বল, হে লোকসকল! আমি তোমাদের সকলের জন্যে আল্লাহর রাসূল।” (৭ আ’রাফঃ ১৫৮)।

আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল (সা)-কে বলেন, হে রাসূল! আপনি বলুনঃ

( وَأُوحِیَ إِلَیَّ هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانُ لِأُنذِرَكُم بِهِۦ وَمَنۢ بَلَغَ )

[Surah Al-An’am 19]

“এবং এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে, যেন আমি তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এটি পৌঁছবে তাদেরকে এটি দ্বারা সতর্ক করি।” আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

( وَمَن یَكۡفُرۡ بِهِۦ مِنَ ٱلۡأَحۡزَابِ فَٱلنَّارُ مَوۡعِدُهُۥ )

[Surah Hud 17]

“অন্যান্য দলের যারা এটিকে অস্বীকার করে অগ্নিই তাদের প্রতিশ্রুত স্থান।” রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেনঃ

بعتت الى الاحمر والاسور

আমি সাদা-কালো সকল মানুষের প্রতি রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছি। এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন যে, এতদ্বারা আরব, অনারব বুঝানো হয়েছে। আর কেউ কেউ বলেন যে, জিন-ইনসান বুঝান হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা) আরও বলেনঃ

والذي نفسي بيده لو أصبح فيكم موسى ثم لتبعتموه وتركتمونی لضللتم

“যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম, যদি মূসা (আ) তোমাদের মধ্যে থাকতেন এবং তোমরা তাঁর অনুসরণ করতে আর আমাকে বর্জন করতে তবে নিশ্চয়ই তোমরা পথভ্রষ্ট হতে।” এ বিষয়ে প্রচুর হাদীস রয়েছে।

অপর একটি হাদীস এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেনঃ

نحن معاشر الانبياء لانورث ماترجنا فهم صدقة

“আমরা নবীর দল। আমরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী রেখে যাই না। আমরা যে সম্পদ রেখে যাই, তা সাদকা স্বরূপ।’ এটি সম্মনিত নবীগণের বৈশিষ্ট্য। কেননা, দুনিয়া ও পার্থিব ধন-সম্পদ তাদের নিকট নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়। নিজের ইনতিকালের পর কাউকে এর উত্তরাধিকারী করে যাওয়ার ব্যাপারটিকে তারা কোন গুরুত্বই দেন না। উপরন্তু তাদের অবর্তমানে তাদের সন্তানাদির সুব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা আল্লাহর উপরই নির্ভর করে থাকেন। তাঁদের অনুসৃত এ তাওয়াক্কুল ও আস্থা খুবই দৃঢ় ও গভীর। যেখানে আল্লাহ তা’আলা রয়েছেন, সেখানে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের জন্যে কিছু সহায়-সম্পত্তি রেখে গিয়ে এগুলো দ্বারা তাঁরা নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে অন্যান্য সাধারণ মানুষের উপর প্রাধান্য দিবেন, এমন অবস্থান থেকে তারা বহু ঊর্ধ্বে। বরং তাঁরা যা- ই রেখে যান, তার সবই দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও অসহায় লোকদের জন্যে সাদকা বলে গণ্য হয়।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর বৈশিষ্ট্যাবলীসহ সকল নবী (আ)-এর বৈশিষ্ট্যাবলী ‘আল আহকামুল কাবীর’ কিতাবে ‘বিবাহ’ অধ্যায়ের শুরুতে আমি উল্লেখ করব। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ্ শাফিঈ (র)-এর অনুসরণে অনেক নেতৃস্থানীয় লেখক নবীদের (আ) বৈশিষ্ট্যাবলী উক্ত অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। আমিও তাই করব।

ইমাম আহমদ (র) .... আবদে রাব্বিল কা’বা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদিন আমি আব্দুল্লাহ্ ইবন আমর (রা)-এর নিকট উপস্থিত হই। তিনি তখন কা’বা শরীফের ছায়ায় বসা ছিলেন। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, তিনি বলছিলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। তিনি এক জায়গায় থামলেন। তখন আমাদের মধ্যে কেউ তাঁবু খাটানোর কাজে লেগে গেল, কেউ বেরিয়ে পড়ল পশুগুলো নিয়ে চারণ ক্ষেত্রের দিকে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব ও কথাবার্তায় মেতে উঠল।

এমন সময় মুয়াযিন ঘোষণা করলেনঃ

الصلاة جامعة

“নামাযের জামাত প্রস্তুত। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমরা সবাই একত্রিত হলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, প্রত্যেক নবী নিজ নিজ উম্মতকে নিজের অবগতি মুতাবিক কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন এবং যেটিকেই তিনি অকল্যাণকর ও ক্ষতিকর বলে জেনেছেন তা থেকে উম্মতকে সাবধান করে দিয়েছেন। আর তোমরা এই উম্মত! এই উম্মতের নিরাপত্তা ও শান্তি তাদের প্রথম যুগের লোকদের অনুসরণের মধ্যে নিহিত! এদের শেষ জামানার লোকদের উপর আসবে বিপদাপদ এবং তার সম্মুখীন হবে এমন সব পরিস্থিতির, যা তাদের জন্যে হবে অস্বস্তিকর। তাদের উপর একের পর এক ফিতনা ও নানারূপ বিপর্যয় নেমে আসবে। এমন মারাত্মক মারাত্মক অশান্তি ও বিশৃংখলা নেমে আসবে যে, ঈমানদার ব্যক্তি বলবে, এটিতেই আমার ধ্বংস অনিবার্য। তারপর ঐ বিপর্যয় কেটে যাবে। আবার নতুন ফিতনা আসবে। ঈমানদার লোক বলবে, এটিতেই আমি ধ্বংস হব। তারপর বিপর্যয় কেটে যাবে। তোমাদের মধ্যে যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ ও জান্নাতে প্রবেশের আশা রাখে, তার মৃত্যু যেন এ অবস্থায় হয় যে, সে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী থাকে এবং সে যেন মানুষের সাথে তেমন ব্যবহার করে, যে আচরণ সে নিজের জন্য পছন্দ করে।

যে ব্যক্তি নিজের হাত ও অন্তর দিয়ে কোন ইমামের আনুগত্যের শপথ করে, সে যেন সাধ্যানুযায়ী তার আনুগত্য করে। অন্য কেউ যদি নেতৃত্বে দাবী করে, তোমরা তার গর্দান উড়িয়ে দেবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তখন লোকজনের ভিড়ের মধ্যে আমার মাথা ঢুকিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, আমি আপনাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আপনি কি নিজে এই হাদীস রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুখে শুনেছেন? তখন আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা) তাঁর কান দু’টোর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আমার এ কান দুটো হাদীসটি শুনেছে এবং আমার অন্তরে তা সংরক্ষিত রেখেছে।

বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি বললাম, ইনি আপনার চাচাত ভাই অর্থাৎ মুয়াবিয়া (রা) তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দেন আমরা যেন অসৎ পথে একে অন্যের ধন-সম্পদ ভোগ করি এবং আমরা যেন নিজেরা নিজেদেরকে খুন করি।

অথচ আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ

( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ لَا تَأۡكُلُوۤا۟ أَمۡوَ  ⁠ لَكُم بَیۡنَكُم بِٱلۡبَـٰطِلِ )

[Surah An-Nisa' 29]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করোনা।” (৪ নিসাঃ ২৯)

এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ্ ইবন আমর (রা) দু’হাত একত্রিত করে তার কপালে রাখলেন। কিছুক্ষণ মাথা নিচু রেখে তারপর তিনি মাথা তুললেন এবং বললেন, তার আনুগতে আল্লাহর আনুগত্য হলে আপনি তখন তার আনুগত্য করুন আর অন্যথায় আপনি তার নির্দেশ পালন করবেন না।

ইমাম আহমদ (র) ভিন্ন সূত্রে কিছুটা শাব্দিক পরিবর্তনসহ অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইব্‌ন মাজাহ (র) প্রমুখ রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

৫৬
আরব জাতির বর্ণনা
কেউ কেউ বলে থাকেন যে, গোটা আরব জাতি হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর। তবে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ অভিমত এই যে, আরব-ই-আরিবা নামে পরিচিত আরবগণ হযরত ইসমাইল (আ)-এর পূর্ব যুগের লোক। আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ‘আদ, ছামুদ, তসম, জাদীছ, উমাইম, জুরহুম, আমালীক ও আরো অনেক সম্প্রদায় যাদের সম্পর্কে শুধু আল্লাহ্-ই জানেন, তারা সবাই আরব-ই-আরিবা-এর অন্তর্ভুক্ত। এরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর পূর্ববর্তী যুগের লোক ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর যুগেও তাদের অস্তিত্ব ছিল। তবে আরবে মুস্তারাবা নামে পরিচিত হিজাযের আরবগণ ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর।

আরব-ই ইয়ামন নামে যারা পরিচিত, তারা হল হিময়ারী- আরব। প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী তারা কাহতানের বংশধর। কাহতানের নাম মুহাযযাম এই মন্তব্য ঐতিহাসিক ইবন মাকুলার। বলা হয়ে থাকে যে, তারা ছিল চার ভাই-কাহতান, কাহিত, মুকহিত এবং ফালিগ। কাহতান ছিলেন হুদের পুত্র। কেউ কেউ বলেন, হুদের নামই কাহতান। কারো কারো মতে, হুদ ছিলেন কাহতানের ভাই। অপর কেউ কেউ বলেন, হুদ কাহতানের অধঃস্তন বংশধর। কতক গবেষকের ধারণা, কাহতান হযরত ইসমাঈলের বংশধর। ইবন ইসহাক (র) প্রমুখ এরূপ বলেছেন। এ সূত্রে তারা এ বংশ তালিকা পেশ করেন কাহতান ইব্‌ন তীমান ইবন কায়দার ইবন ইসমাঈল। অবশ্য হযরত ইসমাঈল (আ) পর্যন্ত কাহতানের বংশ তালিকা কেউ কেউ অন্যভাবেও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইমাম বুখারী (র) তাঁর সহীহ গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি শিরোনাম রচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই অধ্যায় আরব-ই ইয়ামন নামে পরিচিত লোকগণ হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর সাব্যস্তকরণ বিষয়ে। ইমাম বুখারী সালমা (র) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আসলাম গোত্রের কতক লোকের নিকট গেলেন। তারা তখন তরবারী পরিচালনার প্রতিযোগিতা করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘হে ইসমাঈলের বংশধরগণ! তোমরা তীর নিক্ষেপ করতে থাক, আমি অমুক দলের সাথে যোগ দিলাম।’ তখন অপর পক্ষ হাত গুটিয়ে ফেললেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তোমাদের কী হল?’ তারা বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি অমুক দলে থাকা অবস্থায় আমরা তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করব কীভাবে?’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা তীর নিক্ষেপ কর; আমি তোমাদের সকলের সাথে থাকলাম।’ এই বর্ণনা শুধু ইমাম বুখারী-ই উদ্ধৃত করেছেন।

কোন কোন বর্ণনায় আছে, “হে ইসমাঈলের বংশধরগণ! নিক্ষেপ করতে থাক, কারণ তোমাদের পূর্ব-পুরুষ ইসমাঈল নিক্ষেপকারী ছিলেন। তোমরা নিক্ষেপ কর, আমি ইবন আদরা-এর পক্ষে যোগ দিলাম।’ তখন অপরপক্ষ তীর নিক্ষেপ বন্ধ করে দিল। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা নিক্ষেপ কর। আমি তোমাদের সকলের সাথে আছি।’

ইমাম বুখারী (র) বলেন, আসলাম-এর বংশ তালিকা হল, আসলাম ইবন আকসা ইবন হারিছ ইব্‌ন আমর ইবন আমির। এরা খুযাআ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। খুযাআ গোত্র হল ধ্বংসপ্রাপ্ত সাবা সম্প্রদায়ের রক্ষাপ্রাপ্ত একটি ক্ষুদ্র গোত্র। আল্লাহ তাআলা যখন সাবা সম্প্রদায়ের উপর ‘আরিম প্লাবন’ প্রেরণ করেছিলেন। তখন সাবা সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাদের বর্ণনা পরবর্তীতে আসবে। আউস ও খাযরাজ গোত্র এদের উপগোত্র। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে বলেছিলেন, “হে ইসমাঈলের বংশধরগণ! তোমরা তীর নিক্ষেপ কর।” এতে প্রমাণিত হয় যে, এরা হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর।

একদল ভাষ্যকার উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) গোটা আরব জাতির প্রতি ইঙ্গিত করে এ সম্বোধন করেছেন। অবশ্য এটি অসংগত ব্যাখ্যা। কারণ তা স্পষ্ট বর্ণনার বিপরীত। আর এ ব্যাখ্যার পেছনে কোন দলীল নেই। অধিকাংশ গবেষকের মতে ইয়ামানী আরবের কাহতানী আরবগণ ও অন্যরা হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর নন। তাদের মতে সমগ্র আরবজাতি দুই ভাষায় বিভক্ত। (১) কাহতানী আরব ও (২) আদনানী আরব। কাহতানী আরবগণের শাখা দুটো। (১) সাবা (২) ও হাদারা মাউত। আদনানী আরবদেরও দুটো শাখা। (১) রবীয়া (২) ও মুযার। এরা দু’জন নেয়ার ইবন মাদ ইবন আদনানের পুত্র। আরবদের ৫ম শাখা হল কুযাআ গোত্র। এদের ব্যাপারে গবেষকগণ ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করেছেন।

কেউ বলেছেন, এরা আদনানী আরবভুক্ত। ইবন আবদিল বার বলেন, অধিকাংশ গবেষক এটি গ্রহণ করেছেন। হযরত ইবন আব্বাস (রা), ইবন উমর (রা), জুবায়র ইবন মুতইম, যুবায়র ইবন বাকার, মুআব যুবাইরী ও ইবন হিশাম প্রমুখ উপরোক্ত অভিমত সমর্থন করেন। একটি বর্ণনায় কুযা’আ ইবন মাদার বলা হয়েছে। এটি সঠিক নয়।

ইবন আবদিল বার প্রমুখ এরূপ বলেছেন। বলা হয় যে, জাহিলী যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে তারা নিজেদেরকে আদনানী বলে দাবী করত। অতঃপর মুআবিয়া (রা)-এর পৌত্র খালিদ ইবন ইয়াযীদ-এর শাসনামলে তারা নিজেদেরকে কাহতানী আরব বলে দাবী করতে শুরু করে। তারা ছিল খালিদের মাতুল গোত্র। তাদের এ বংশ পরিবর্তনের উল্লেখ করে কবি আশা ইবন ছা’লাবা নিম্নোক্ত কাসীদা রচনা করেনঃ

أبلغ قضاعة في قرطاس انهم - لولا خلائف آل الله ما عتقوا

কুযাআ গোত্রকে চিঠি লিখে জানিয়ে দাও যে, তারা যদি আল্লাহর প্রিয় মানুষদের বংশধর হত তবে তারা মুক্তি পেত না।

قالت قضاعة انا من ذوی يمن - والله يعلم مابروا وما صدقوا

কুযাআ গোত্র বলেছে, আমরা ইয়ামানী আরব। অথচ আল্লাহ তা’আলা জানেন যে, এ বক্তব্যে তারা সত্যবাদী নয়।

قد ادعوا والد ما نال أمهم - قد يعلمون ولكن ذلك الفرق

তারা এমন একজনকে তাদের পিতা বলে দাবী করছে, যে তাদের মাতাকে কোন দিন কাছে পায়নি। এ সত্য তারাও জানে বটে, কিন্তু এটি তাদের মিথ্যাচার।

আবু উমর সুহাইলী কতগুলো আরবী কাসীদা উল্লেখ করেছেন, যেগুলোতে কুযাআ গোত্রের ইয়ামানী আরব হওয়ার দাবীকে নতুন উদ্ভাবন বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।

দ্বিতীয় অভিমত হল, তারা কাহতানী আরব। এটি ইবন ইসহাক, কালবী ও একদল বুলজী বিশারদের অভিমত। তাদের বংশ তালিকা বর্ণনা করে ইবন ইসহাক বলেন, কুযা’আ ইবন মালিক ইবন হিময়ার ইবন সাবা ইবন ইয়াশজুব ইবন ইয়া’রুব ইবন কাহতান। তাদের জনৈক কবি উমর ইবন মুররা (রা) সাহাবী বলেন (ইনি দুটো হাদীসও বর্ণনা করেছেন)

يايها الداعي أدعنا وأبشر - وكن قضاعيا ولا تنزر

—হে আহবানকারী! আমাদেরকে আহ্বান করুন এবং সুসংবাদ দিন আপনি কুযা’আ গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত হোন। এদেরকে অল্প সংখ্যক মনে করবেন না।

نحن بنوا شيخ المجان الأزهر - قضاعة بن مالك بن حمير

—আমরা সুদর্শন ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কুযা’আ ই মালিক ইবন হিময়ারের বংশধর।

النسب المعروف غير المنكر - في الحجر المنقوش تحت المنبر

—আমাদের বংশ পরিচিতি সুপ্রসিদ্ধ, অখ্যাত ও অপরিচিত নয়, আমাদের বংশ তালিকা মিম্বরের নীচে পাথরে খোদাই করা রয়েছে।

কতক বংশ বিশারদ বলেন, তিনি হলেন কুযা’আ ইবন মালিক ইবন উমর মুররা ইবন বায়দ ইবন হিময়ার ইবন লুহায়’আ উকবা ইব্‌ন ‘আমির সূত্রে বলেন, তিনি বলেছেন, আমি বলেছিলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমরা কি মা’দ-এর বংশধর নই?’ তিনি বললেন, ‘না।’ তখন আমি বললাম, ‘তাহলে আমরা কার বংশধর?’ তিনি বললেনঃ ‘তোমরা কুযা’আ ইব্‌ন মালিক ইবন হিময়ার-এর বংশধর।’

ইবন আবদিল বার বলেন, উকবা ইবন ‘আমির আল জুহানী যে জুহায়না ইব্‌ন যায়দ ইবন আসওয়াদ ইবন আসলাম ইবন ইমরান ইবন ইলহাফ ইবন কুযা’আ যে জুহানীর গোত্রের লোক, তাতে ঐতিহাসিকদের কোন দ্বিমত নেই। এই হিসাবে বলা যায় যে, কুযা’আ ইয়ামানী আরব এবং হিময়ার ইবন সাবার বংশধর।

কতক বংশ শাস্ত্রবিশারদ উভয় অভিমতের মধ্যে যুবায়র ইবন বাক্কার প্রমুখের বক্তব্য অনুযায়ী এভাবে সমন্বয় সাধন করেছেন যে, কুযা’আ হলেন জুরহুম গোত্রের জনৈকা মহিলা। মালিক ইবন হিময়ার তাঁকে বিবাহ করেন। কুযা’আর গর্ভে মালিক ইবন হিময়ারের সন্তানের জন্ম হয়। এরপর মা’দ ইবন আদনান কুযা’আকে বিবাহ করেন। তখনও পূর্বোল্লেখিত সন্তানটি ছোট ছিল। মতান্তরে মা’দ ইব্‌ন আদনানের সাথে কুযাআর বিবাহকালে এ সন্তানটি কুযা’আর গর্ভে ছিল। ফলে সে তার সৎপিতার পুত্র রূপে পরিচিত হয়। যেমনটি আরবের অনেক লোকই করে থাকে।

কুলজী বিশারদ মুহাম্মাদ ইবন সালাম বখরী বলেন, আরব জাতি তিন বংশধারা থেকে উৎসারিতঃ আদনানী, কাহতানী ও কুযা’আ। তাকে জিজ্ঞেস করা হল যে, সংখ্যায় কারা বেশী আদনানী, না কাহ্তানী? তিনি বললেন কুযা’য়ীগণ যাদের সাথে যোগ দেয়, তাদের সংখ্যা বেশী। তারা যদি নিজেদেরকে ইয়ামানী বলে দাবী করে তবে কাহতানী আরবদের সংখ্যা বেশী। আর তারা যদি নিজেদেরকে আদনানী বলে দাবী করে তবে আদনানী আরবদের সংখ্যা বেশী, এতে প্রমাণিত হয় যে, বংশ পরিচিতি বর্ণনায় তারা সমালোচনা যোগ্য পথ অনুসরণ করে। ইবন নুহায় আর পূর্বোল্লেখিত হাদীছসটি যদি বিশুদ্ধ হয় তবে প্রমাণিত হবে যে, তারা মুলত কাহতানী আরব। আল্লাহই ভাল জানেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَـٰكُم مِّن ذَكَر وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَـٰكُمۡ شُعُوب ا وَقَبَاۤىِٕلَ لِتَعَارَفُوۤا۟ۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِیمٌ خَبِیر ࣱ)

[Surah Al-Hujurat 13]

“হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন, যে অধিকতর মুত্তাকী।” (৪৯ হুজুরাতঃ ১৩)

কুলজী বিশারদগণ বংশের স্তর ও পর্যায়ক্রম সম্পর্কে বলেন যে, প্রথমতঃ ( شعوب ) তারপর ( قبائل ) তারপর ( عمائر ) তারপর ( بطون ) তারপর ( وافخاذ ), এবং তারপর ( فصائل ) তারপর ( عشائر ) এর এক বচন ( عشيرة ) ঘনিষ্ঠতম বংশগত আত্মীয়। এর চাইতে নিকটতর আর কোন স্তর নেই।

আমরা প্রথমে কাহতানী আরবদের কথা আলোচনা করব। এরপর ইবনশাআল্লাহ আলোচনা করব হিজাযী আরব তথা আদনানী আরব ও তাদের জাহিলী যুগের অবস্থাসমূহ, যাতে এটা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সীরাতের আলোচনার সাথে সংযুক্ত থাকে।

ইমাম বুখারী (র) বলেন, কাহাতান-এর আলোচনা বিষয়ক পরিচ্ছেদ আব্দুল আযীয আবু হুরায়রা (রা) সুত্রে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেনঃ

لا تقوم الساعة حتى يخرج رجل من قحطان يسوق الناس بمصاه

“ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে না, যতক্ষণ না কাহতান বংশ থেকে একটি লোক বেরিয়ে মানুষকে লাঠি দ্বারা হাঁকিয়ে না নিবে।” ইমাম মুসলিম (র) কুতায়বা.... ছাওর ইবন যায়দ সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সুহায়লী বলেন, কাহতানই প্রথম ব্যক্তি, যাকে বলা হয়েছিল, “আপনি অভিশাপ দিতে অস্বীকার করেছেন এবং তার উদ্দেশ্যেই সর্বপ্রথম বলা হয়েছে, ‘শুভ সকাল।’

ইমাম আহমদ........ যী ফজব (র) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, এ নেতৃত্ব হিময়ারীদের মধ্যে ছিল। আল্লাহ তা’আলা এটি তাদের থেকে ছিনিয়ে কুরায়শদের হস্তে অর্পণ করেছেন। অবশ্য অতি সত্ত্বর পুনরায় তাদের মধ্যে ফিরে আসবে।

৫৭
সাবা বাসীদের বর্ণনা
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( لَقَدۡ كَانَ لِسَبَإ فِی مَسۡكَنِهِمۡ ءَایَة ۖ جَنَّتَانِ عَن یَمِین وَشِمَال ۖ كُلُوا۟ مِن رِّزۡقِ رَبِّكُمۡ وَٱشۡكُرُوا۟ لَهُۥۚ بَلۡدَة طَیِّبَة وَرَبٌّ غَفُور ۝ فَأَعۡرَضُوا۟ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ سَیۡلَ ٱلۡعَرِمِ وَبَدَّلۡنَـٰهُم بِجَنَّتَیۡهِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل وَشَیۡء مِّن سِدۡر قَلِیل ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكَ جَزَیۡنَـٰهُم بِمَا كَفَرُوا۟ۖ وَهَلۡ نُجَـٰزِیۤ إِلَّا ٱلۡكَفُورَ ۝ وَجَعَلۡنَا بَیۡنَهُمۡ وَبَیۡنَ ٱلۡقُرَى ٱلَّتِی بَـٰرَكۡنَا فِیهَا قُر ى ظَـٰهِرَة وَقَدَّرۡنَا فِیهَا ٱلسَّیۡرَۖ سِیرُوا۟ فِیهَا لَیَالِیَ وَأَیَّامًا ءَامِنِینَ ۝ فَقَالُوا۟ رَبَّنَا بَـٰعِدۡ بَیۡنَ أَسۡفَارِنَا وَظَلَمُوۤا۟ أَنفُسَهُمۡ فَجَعَلۡنَـٰهُمۡ أَحَادِیثَ وَمَزَّقۡنَـٰهُمۡ كُلَّ مُمَزَّقٍۚ إِنَّ فِی ذَ  ٰ⁠ لِكَ لَـَٔایَـٰت لِّكُلِّ صَبَّار شَكُور ࣲ)

[Surah Saba' 15 - 19]

“সাবাবাসীদের জন্যে তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শন-দুটো উদ্যান, একটি ডান দিকে অপরটি বাম দিকে। ওদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক প্রদত্ত রিযিক ভোগ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। উত্তম এই স্থান এবং ক্ষমাশীল তোমাদের প্রতিপালক। পরে তারা আদেশ অমান্য করল। ফলে আমি তাদের উপর প্রবাহিত করলাম বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা, এবং তাদের উদ্যান দুটোকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটো উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুল গাছ। আমি তাদেরকে এই শাস্তি দিয়েছিলাম তাদের কুফরীর জন্যে। আমি অকৃতজ্ঞ ব্যতীত আর কাউকে এমন শাস্তি দিই না। ওদের এবং যে সব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, সেগুলোর অন্তর্বর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ কর দিবস ও রজনীতে। কিন্তু তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের সফরের মনযিলের ব্যবধান বর্ধিত করুন।’ এভাবে তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। ফলে আমি ওদেরকে কাহিনীর বিষয়বস্তুতে পরিণত করলাম এবং ওদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (৩৪ সাবাঃ ১৫-১৯)

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক সহ কুলজী বিশারদগণ বলেছেন যে, সাবার নাম হল আবদ শামস ইবন ইয়াশজব ইবন ইয়ারু ইবন কাহতান। তারা বলেন, এ ব্যক্তিই প্রথম আরব, যাকে বন্দী করা হয়েছিল। তাই তাঁর নাম হল ( سبا ) অর্থাৎ কারারুদ্ধ। তাঁকে আররাইশ বা দাতা নামেও ডাকা হত। কারণ তিনি নিজের ধন-সম্পদ থেকে মানুষকে অকাতরে দান করতেন। সুহায়লী বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম মাথায় মুকুটু পরিধান করেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনি মুসলমান ছিলেন। তাঁর কতক কবিতা আছে সেগুলো তে তিনি প্রিয় নবী (সা)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছেন। তার কতক এইঃ

يملك بعدنا ملكا عظيما - نبي لا يرخص في الحرام

“আমাদের পরে একজন নবী বিশাল রাজত্বের অধিকারী হবেন। তিনি কোন অন্যায় ও হারাম কাজকে প্রশ্রয় দিবেন না।”

ويملك بعده منهم ملوك - يدينون العباد بغير ذام

“তাঁর পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্য থেকে অনেক রাজা আসবে। তারা কোন অপরাধ ছাড়াই মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করবে।”

ويملك بعدهم منا ملوك - يصير الملك فينا باقتسام

“ওদের পর আমাদের বংশ থেকে কতক রাজা হবে। তখন আমাদের মধ্যে রাজত্ব থাকবে ভাগাভাগির ভিত্তিতে।”

ويملك بعد قحطان تبي - تقى جبينه غير الأنام

“কাহতানদের পরে একজন সৎ পূণ্যবান ও পবিত্র নবী রাজা হবেন, তিনি সর্বোত্তম মানব।”

يسمي أحمدا يا ليت آنی أعمر بعد مبعثه بعام

“তাঁর নাম হবে আহমদ! হায়, তাঁর নবুওত প্রাপ্তির পর আমি যদি অন্তত একটি বছর জীবিত থাকতাম।”

فاعضدة وأحبوه بنصري - بكل مدجج وبكل رام

“তাহলে আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতাম এবং তাকে ভালবাসতাম!”

متى يظهر فكونوا ناصرين - ومن يلقاه يبلغه سلامی

“তিনি যখনই আবির্ভূত হন না কেন তোমরা তার সাহায্যকারী হয়ে, তার সাথে যার দেখা হবে আমার সালাম তাঁকে জানিয়ে দিও।”

ইবন দিহয়া তাঁর ‘আততানভীর ফী মাওলিদিল বাশীরিন নাযীর’ গ্রন্থে এগুলো উল্লেখ করেছেন। ইমাম আহমদ-আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল যে, ‘সাবা কি পুরুষ না মহিলা, কোন এলাকার নাম?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ ‘সাবা একজন পুরুষ লোক। তার ১০টি সন্তান ছিল। তাদের ছয়জন ছিল ইয়ামানে আর চারজন সিরিয়াতে। ইয়ামানে বসবাসকারীগণ হল (১) মযহাজ (২) কিন্দা (৩) আযদ (৪) আশ আরি (৫) আনমার ও (৬) হিময়ার। সিরিয়ায় বসবাসকারীগণ হল (১) লাখম (২) জুবাম (৩) আমিলা ও (৪) গাসসান। তাফসীর গ্রন্থে আমরা উল্লেখ করেছি যে, এই প্রশ্নকারী ছিলেন ফারওয়া ইবন মিসসীক আল গাতিকী। আমরা এই হাদীছটি সমস্ত সনদ ও শব্দাবলী সেখানে উল্লেখ করেছি।

মূল কথা হল, সাবাই হচ্ছে এসব আরব গোত্রের আদি পুরুষ। এদের মধ্যে তুব্বাগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। তাবাবি’আ ( تبابعة ) শব্দের একবচন তুব্বা ( تبع )। তুব্বা রাজাগণ বিচারের সময় পারস্য সম্রাট কিসরাদের মত মুকুট পরিধান করতেন। যে ব্যক্তি শাহর ও হাদ্রামাউতসহ ইয়ামানের রাজা হতেন, তাঁকে আরবগণ তুব্বা নামে আখ্যায়িত করত। যেমন কোন লোক দ্বীপাঞ্চল সহ সিরিয়ার রাজা হতে পারলে তাকে কায়সার, পারস্যের রাজাকে কিসরা মিসরের রাজাকে ফিরআওন, হাবশার রাজাকে নাজাশী এবং ভারতবর্ষের রাজাকে বাতলী মূসা বলা হত। হিময়ারী রাজাদের মধ্যে ইয়ামান রাজ্যে রাণী বিলকীসও ছিলেন। হযরত সুলায়মান (আ)-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা রাণী বিলকীসের কথাও আলোচনা করেছি।

সাবা রাজ্যের অধিবাসীগণ পরম সুখ-শান্তিতে বসবাস করত। তাদের সেখানে ছিল খাদ্য দ্রব্য, ফলমূল ও শস্যক্ষেত্রের প্রাচুর্য। এতদসত্ত্বেও তারা সত্যনিষ্ঠা, সরল পথ ও হিদায়াতের পথে জীবন যাপন করত। অবশেষে তারা যখন আল্লাহর নিয়ামতের নাশোকরী করল, আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতিদানে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিল।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ওহব ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতি তের জন নবী প্রেরণ করেছিলেন। সুদ্দী (র) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা বার হাজার নবী তাদের নিকট প্রেরণ করেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

বস্তুত তারা যখন হিদায়াতের পথ ত্যাগ করে গোমরাহীর পথ ধরে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের উপাসনা শুরু করে। সেটা রাণী বিলকীসের রাজত্বকাল এবং তার পূর্বের কথা। পরেও তারা অনবরত সে পথে চলতে থাকে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের উপর বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন প্রেরণ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( فَأَعۡرَضُوا۟ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ سَیۡلَ ٱلۡعَرِمِ وَبَدَّلۡنَـٰهُم بِجَنَّتَیۡهِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل وَشَیۡء مِّن سِدۡر قَلِیل ࣲ)

[Surah Saba' 16]

“পরে তারা আদেশ অমান্য করল, ফলে আমি তাদের উপর প্রবাহিত করলাম বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা এবং তাদের উদ্যান দুটোকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটো উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল। ঝাউ গাছ এবং কিছু কুল গাছ। আমি ওদেরকে এই শাস্তি দিয়েছিনাম ওদের কুফরীর জন্যে। আমি কৃতঘ্ন ব্যতীত আর কাউকে এমন শাস্তি দিই না।” (৩৪ সাবাঃ ১৬)

প্রাচীন ও আধুনিক বহু তাফসীরকার ও অন্যান্য উলামা-ই-কিরাম বলেছেন, আরিম বাঁধ নির্মাণের পটভূমি এই যে, পর্বতের মধ্যখানে পানি প্রবাহিত হত। বহু বছর আগে তারা পর্বত দুটোর মধ্যখানে মজবুত করে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এতে পানি উপরের দিকে উঠে আসে এবং পর্বত দু’টির উপরিভাগে এসে পৌঁছায়। তারপর তারা সেখানে ব্যাপক হারে বাগান তৈরী করে, সুস্বাদু ফলমূলের গাছ লাগায় এবং ক্ষেত খামারের ব্যবস্থা করে।

কথিত আছে, সর্বপ্রথম সাবা ইবন ইয়ারুব এ বাঁধ নির্মাণ করেন। প্রায় ৭০টি পাহাড়ী উপত্যকাকে তিনি এ বাঁধের আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি বাঁধে ৩০টি সুইস গেট তৈরী করেন যাতে সেগুলো দিয়ে পানি বেরিয়ে যায়। তিনি অবশ্য বাঁধের সকল কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি। তার পরে রাজা হিময়ার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সকল কাজ সুসম্পন্ন করেন। এটির ব্যাপ্তি প্রায় ৯ বর্গমাইল ছিল। তারা পরম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করছিল।

এ প্রসঙ্গে কাতাদা (র) প্রমুখ বলেন, সে যুগে তাদের ফলমূল এত বেশী ছিল যে, কোন একজন মহিলা মাথায় খালি একটি সোঁয়ামনি ঝুড়ি নিযে পথে বের হলে স্বাভাবিক নিয়মে ঝরে পড়া পাকা ফলে তার ঝুড়ি ভর্তি হয়ে যেত। সে দেশের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এমন সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত ছিল যে, সেখানে কোন মশা-মাছি ও বিষাক্ত জীবজন্তু ছিল না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন.... সাবা বাসীদের জন্যে তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শনঃ দু’টো উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বাম দিকে। তাদেরকে বলা হয়েছিল, “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রদত্ত রিযক ভোগ কর এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। উত্তম এ স্থান এবং ক্ষমাশীল তোমাদের প্রতিপালক।”

আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ

( وَإِذۡ تَأَذَّنَ رَبُّكُمۡ لَىِٕن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِیدَنَّكُمۡۖ وَلَىِٕن كَفَرۡتُمۡ إِنَّ عَذَابِی لَشَدِید ࣱ)

[Surah Ibrahim 7]

“স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দিব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (১৪ ইব্রাহীমঃ ৭)

সাবা রাজ্যের অধিবাসীগণ অতঃপর আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা শুরু করে। আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়েও তারা দর্প করে। তাদের জনপদ সমূহের অবস্থান কাছাকাছি হওয়া, বাগবাগিচা ও বৃক্ষরাজির কারণে পরিবেশ উন্নত হওয়া এবং যাত্রাপথ নিরাপদ থাকার পর তারা প্রার্থনা জানায় যেন তাদের যাত্রা পথে দূরত্ব সৃষ্টি করে দেওয়া হয় এবং সফরকে কষ্টদায়ক ও কঠিন করে দেয়া হয়। যেমন বনী ইসরাঈলীরা মান্না ও সালাওয়ার পরিবর্তে শাকসবজি, কাঁকড়, গম, ডাল ও পেঁয়াজের জন্য আবদার করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের শহর নগরগুলোকে ধ্বংস করে তাদেরকে দূর-দূরান্তে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দিয়ে ঐ মহা অনুগ্রহ ও সার্বিক কল্যাণ প্রত্যাহার করে নিলেন।

এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( فَأَعۡرَضُوا۟ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ سَیۡلَ ٱلۡعَرِمِ )

[Surah Saba' 16]

“তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ফলে আমি তাদের প্রতি বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন প্রবাহিত করে দিলাম।”

অনেক তাফসীরকার বলেন, আল্লাহ তাআলা এই বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার যখন ইচ্ছে করলেন তখন এটির ভিত্তিমূলে দলে দলে ইদুর পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন যখন তা জানতে পারল তখন তারা ইঁদুর দমনের জন্যে বাঁধ এলাকায় বহু সংখ্যক বিড়াল এনে ছেড়ে দিল। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। কারণ প্রবাদ আছে যে, “পাতিল গরম হয়ে গেলে তখন সতর্ক হয়ে কোন লাভ নেই।” তখন বাঁচার কোন পথ থাকে না। ইঁদুরের আক্রমণে বাঁধের ভিত্তিমূল ঝাঁজরা হয়ে যায় এবং বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ফলে সকল নালা বিনষ্ট হয়ে পানি সমতল অঞ্চলের দিকে গড়িয়ে যায়। ফলমূল বাগ-বাগিচা, ক্ষেত-খামার সব বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মনোরম আবাসিক এলাকা পরিণত হয় বিরান জনপদে। এর পরিবর্তে জন্ম নেয় বিস্বাদ আজেবাজে গাছ-গাছালি ও ফলমূল। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( وَبَدَّلۡنَـٰهُم بِجَنَّتَیۡهِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل ࣲ)

[Surah Saba' 16]

“এবং তাদের উদ্যান দুটোর পরিবর্তে দিলাম এমন দুটো উদ্যান, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউ গাছ। ইবন আব্বাস (রা) মুজাহিদ এবং অনেক ভাষ্যকার বলেছেন যে, ( خَمۡط ) শব্দ দ্বারা পিলু গাছ এবং তার ফল এবং। ( أَثۡل ) শব্দ দ্বারা ঝাউগাছ বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ঝাউগাছ জাতীয় এমন একটি গাছ বুঝানো হয়েছে, যা কাঠসর্বস্ব, কোন ফল ধরে না।

( ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل ࣲ)

—এবং কতক কুল বৃক্ষ। কারণ, জবলী কুল গাছে ফল হয় কম আর তাতে কাটা বেশী। ঐ কুলও তেমনি বিস্বাদ। যেমন প্রবাদ আছে, “উটের গোশত নষ্ট হল উঁচু পাহাড় চূড়ায়, এমন সমতল নয় যে, সেখানে সহজে উঠা যাবে, আবার এমন নাদুস-নুদুস নয় যে, তা’ পরিচ্ছন্ন থাকবে। এ জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( ذَ لِكَ جَزَیۡنَـٰهُم بِمَا كَفَرُوا۟ۖ وَهَلۡ نُجَـٰزِیۤ إِلَّا ٱلۡكَفُورَ )

[Surah Saba’ 17]

“তাদের কুফরীর কারণে আমি তাদেরকে এই শাস্তি দিয়েছি। অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাউকে আমি এমন শাস্তি দিই না।” অর্থাৎ আমি এমন কঠিন শাস্তি শুধু তাদেরকেই দেই, যারা আমার প্রতি কুফরী করে, আমার রাসূলদেরকে প্রত্যাখ্যান করে আমার নির্দেশের বিরোধিতা করে এবং আমার নিষেধাজ্ঞাগুলো অমান্য করে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( فَجَعَلۡنَـٰهُمۡ أَحَادِیثَ وَمَزَّقۡنَـٰهُمۡ كُلَّ مُمَزَّقٍۚ )

[Surah Saba' 19]

“ফলে আমি তাদেরকে উপাখ্যানে পরিণত করলাম এবং তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম।”

বক্তৃত তাদের ধন-সম্পদ যখন ধ্বংস হয়ে গেল এবং শহর-নগর বিরান হয়ে পড়ল তখন এলাকা পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে তারা বাধ্য হল। তারা তখন ছত্রভঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন উঁচু ও নীচু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের একদল চলে আসে হিজায তথা আরব এলাকায়। কুযা’আ গোত্র মক্কার উপকণ্ঠে এসে বসতি স্থাপন করে। তাদের বিবরণ পরে আসবে।

তাদের কতক মদীনা মুনাওয়ারায় এসে বসবাস করতে থাকে। এরা মদীনার আদি বাসিন্দা। এরপর বানু কায়নুকা, বানু কুরায়যা ও বনূ নযীর- এই তিন ইয়াহুদী গোত্র মদীনায় তারা এসে আওস ও খাযরাজ গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে এবং সেখানে বসবাস করতে থাকে।

তাদের বিশদ বিবরণ আমরা পরে উল্লেখ করব। সাবার অধিবাসীদের একদল সিরিয়ায় অবতরণ করে। তারাই পরবর্তী কালে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। এরা হল গাসসান, আমিলা, বাহরা, লাখম, জুযাম তানুখ, তাগলিব প্রভৃতি গোত্র। হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর শাসনামলে সিরিয়া বিজয় সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমরা এ গোত্রগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করব।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, আবু উবায়দা (রা) আমাকে বলেছেন যে, আশা ইবন কায়স ইবন হা’লাবা ওরকে মায়মুন ইবন কায়স বলেছেনঃ

وفي ذاك للمؤتسي أسوة - ومارم عفى عليها العرم

“আদৰ্শকামী ব্যক্তির জন্যে এর মধ্যে রয়েছে আদর্শ, বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন তো মা’রিম বাঁধকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।”

رخام بنته لهم حمير - اذا جاء موارة لم يرم

“এটি একটি শ্বেত পাথরের তৈরী বাঁধ। হিময়ার তাদের জন্যে এটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রচণ্ড পানির ঢেউ এলেও তা নষ্ট করতে পারতো না।

فاروى الزدوم وأعنانها - على سعة ماؤهم اذا قسم

“এই পানি বণ্টন করে নেয়ার পরও এটি যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষেত খামার ও সংশ্লিষ্ট এলাকা সিঞ্চিত করে দিত।”

فصاروا أيادى لا يقدرون - على شرب طفل اذا ما فطم

“অবশেষে তারা ধ্বংস হয়ে গেল। এমন হল যে, শিশু তার মায়ের দুধ পান ছাড়ার পর তাকে পানীয় দিতে পারছিল না।”

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক তাঁর সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন, বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনের পূর্বে সর্বপ্রথম যিনি ইয়ামন থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন, তিনি হলেন অমর ইবন আমির লাখমী। লাখম হলেন লাখম ইবন আদী ইবন হারিছ ইবন মুররা ইবন আয়দ ইবন যায়দ ইবন মাহা আবন আমর ইবন আরীব ইবন ইয়াশজুব ইবন যায়দ আবন কাহলান ইবন সাবা। কেউ কেউ তার বংশ তালিকা এরূপ বলেছেন, লাখম ইবন আদী ইবন আমর ইবন সাবা। এটি ইবন হিশাম (র)-এর বর্ণনা।

ইবন ইসহাক বলেন, আমর ইবন আমিরের সাবা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের কারণ সম্পর্কে আবু যায়দ আনসারী আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, আমর একদিন দেখলেন যে, বাঁধ তাদের জন্যে পানি ধরে রাখে এবং তারা প্রয়োজন মাফিক নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী ওখান থেকে পানি সরবরাহ করেন একটি জংলী ইদুর সেই বাধের মধ্যে একটি গর্ত খুঁড়ছে। এতে তিনি বুঝে নিলেন যে, এই বাঁধ আর বেশী দিন টিকবেনা। তাই তিনি ইয়ামন ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তার সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তাকে চলে যেতে বাধা দেয়। তিনিও একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তার ছোট ছেলেকে বলেন যে, আমি তোমার প্রতি রেগে গিয়ে তোমাকে চড় মারলে তুমিও আমার মুখে চড় মারবে। তার ছেলে নির্দেশানুযায়ী তাই করল।

এরপর আমর বললেন, যে শহরের এমন পরিবেশ যে, আমার ছোট ছেলে আমার মুখে চড় মারতে পারল, আমি আর সেই শহরে থাকব না। তিনি তার ধন-সম্পদ বেচে দেয়ার ঘোষণা দিলেন। সে শহরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা বলল, ‘আমরের রাগকে কাজে লাগাও, এ সুযোগে তার ধন সম্পদ কিনে নাও।’ অতঃপর আমর তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী সবাইকে নিয়ে সাবা এলাকা ত্যাগ করেন। এটা দেখে আযদ গোত্রের লোকেরা বলল, ‘আমর চলে গেলে আমরা এখানে থাকব না।’ তারাও নিজেদের ধন-সম্পদ বিক্রি করে দেয় এবং আমরের সাথে বেরিয়ে পড়ে। যেতে যেতে তাঁরা ‘আক এর অঞ্চলে উপস্থিত হয়। সে দেশ অতিক্রম করে যেতে চাইলে আক গোত্রীয়রা তাদেরকে বাধা দেয় এবং যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের ফলাফল কখনো পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে যায়।এ প্রসংগে আব্বাস ইবন মিরদাস বলেনঃ

وعك بن عدنان ألذين تلعبوا - بغسان حتى طردوا كل مطرد

“আক ইবন আদনান যুদ্ধ খেলা খেলেছ গাসসানী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। শেষে তাদেরকে সদল বলে বিতাড়িত করেছে।”

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তারা আক এর এলাকা অতিক্রম করে বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। জাফনা ইব্‌ন আযর ইবন আমিরের পরিবার বসবাস করতে থাকে সিরিয়ায়। আউস ও খাযরাজ গোত্র অবতরণ করেন ইয়াছরিবে (মদীনা শরীফে )। খুযাআ গোত্র গেল মুর আঞ্চলে। আযদ গোত্রের লোকজন ভিন্ন ভিন্ন উপগোত্রে বিভক্ত হয়ে তাদের কেউ কেউ সারাতে এবং কেউ কেউ ওমানে বসতি স্থাপন করে। এরপর আল্লাহ তা’আলা মারিব বাধে সর্বনাশা প্লাবন প্রেরণ করেলেন। প্লাবনের তোড়ে ভেঙ্গে চুরে ধ্বংস হয় মারিব বাঁধ। এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা উপরোক্ত আয়াতগুলো নাযিল করেন।

তাফসীরকার সুদ্দী (র) থেকেও প্রায় এরকম বর্ণনা এসেছে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের একটি বর্ণনা এরূপ এসেছে যে, আমর ইব্‌ন আমির নিজে জ্যোতিষী ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, আমর নিজে নয়, বরং তাঁর স্ত্রী তারিফা বিনত খায়র হিময়ারীই জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, অতি সত্ত্বর এ জনপদ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা যেন মারিব বাঁধে ইঁদুরের ধ্বংস লীলা দেখতে পেয়েছিল। তাই তারা যা করার তা করে। আল্লাহই ভাল জানেন। ইবন আবী হাতিম তাফসীর গ্রন্থে ইকরামা থেকে এ ঘটনাটিও বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন।

৫৮
পরিচ্ছেদ
বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনে আক্রান্ত হওয়ার পর সাবার সকল গোত্র ইয়ামন ছেড়ে চলে যায়নি। তাদের অধিকাংশই সেখানে বসবাস করেছে। এলাকায় অবস্থানকারী মারিবাসিগণ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে বর্ণিত হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর হাদীসের মর্মও এই যে, সাবার সকল গোত্র ইয়ামন ছেড়ে চলে যায়নি এবং তাদের চারটি গোত্র অন্যত্র চলে যায় ইয়ামানেই থেকে যায় এবং ছয়টি গোত্র তারা হলো মুহিজ, ফিন্দা, আনমার (আবু খাসআম) আশআরী, বুজায়লা ও হিময়ার গোত্র। সাবা সম্প্রদায়ের এই ছয়গোত্র ইয়ামনেই বসবাস করতে থাকে। বংশানুক্রমে তাদের মধ্যে রাজত্ব ও তুব্বা পদ চলে আসছিল। অতঃপর এ সময় ইথিওপিয়ার রাজা তার সেনাপতিদ্বয় আবরাহা ও আরইয়াত-এর নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করে ওদের হাত থেকে বছর রাজত্ব ইথিওপীয়দের হাতে থাকে। অবশেষে সায়ফ ইবন যী ইয়ামীন হিময়ারী ওদের হাত থেকে রাজত্ব পুনরুদ্ধার করে। এই পুনরুদ্ধার সম্পন্ন হয় প্রিয় নবী (সা)-এর আবির্ভাবের অল্প কিছু দিন পূর্বে। এর বিস্তারিত বিবরণ ইবনশাআল্লাহ্ পরে আমরা উল্লেখ করব।

পরবর্তীতে নবী করীম (সা) ইয়ামানের অধিবাসীদের নিকট হযরত আলী (রা) ও হযরত খালিদ ইবন ওলীদ (রা)-কে প্রেরণ করেন। তারও পরে তিনি আবু মূসা আশআরী ও মু’আয ইবন জাবাল (রা)-কে সেখানে প্রেরণ করেন। তাঁরা লোকজনকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিতে এবং তাওহীদী, ঈমান ও ইসলামের যুক্তি প্রমাণগুলো তাদের নিকট স্পষ্টভাবে তুলে ধরতেন।

এক সময় ভণ্ড নবী আসওয়াদ আনাসী ইয়ামানে প্রভাব সৃষ্টি ও প্রধান্য বিস্তার করে। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতিনিধিকে সেখান থেকে বের করে দেয়। আসওয়াদ আনসী নিহত হওয়ার পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর খিলাফতকালে সেটি পুনরায় মুসলমানদের কব্জায় এসে যায় এবং ইসলামের বিজয় নিশান উড়তে শুরু করে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সীরাত ও ইতিহাস বর্ণনার পর আমরা ইয়ামানে ইসলামী বিজয়ের বিবরণ উল্লেখ করব ইবনশাআল্লাহ্।

৫৯
রবীআ আন নাসর লাখমীর বিবরণ
এই রবী’আ পূর্বোল্লেখিত রবী’আ লাখমী বলে ইবন ইসহাক বলেছেন। সুহায়লী বর্ণনা করেন, ইয়ামানের বংশ বিশারদগণ বলেন, ইনি হলেন নাসর ইবন রবী’আ ইবন নাসর ইবন হারিক ইবন নুমারা ইবন লাখম। যবিয়ান ইবন বাক্কার বলেন, ইনি হলেন রবী’আ ইবন নাসর ইবন মালিক ইবন শুউয ইবন মালিক ইবন আজম ইবন আমর ইবন নুমারা ইবন লাখম। লাখম ছিলেন জুযামের ভাই।

লাখম শব্দটির অর্থ হচ্ছে চপোটাঘাত করা। আপন ভাইকে চপোটাঘাত করায় তার নাম পড়ে দিয়েছিল লাখম। আর চপোটাঘাতকারীর হাত কামড়ে ধরেছিল বলে অপর ভাইয়ের নাম হল জুযাম। জুযাম মানে দংশন করা।

রবী’আ ছিলেন তুব্বা উপাধিধারী হিমইয়ারী সম্রাটদের অন্যতম। শাক্ ও সাতীহ নামের দুজন গণকও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আগমন সম্পর্কে তাদের নিকট সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। গণক সাতীহ এর নাম ও বংশ পরিচয় হল রাবী ইবন রাবী’আ ইবন মাসউদ ইবন মাযিন ইবন যিব ইবন আদী ইবন মাযিম গাসসান। আর শাক্ এর বংশ পরিচয় হল; শাক ইবন সাব ইবন ইয়াশকুর ইবন রুহম ইবন আকরক ইবন কায়স ইবন আবকর ইবন আনমার ইবন নেযার। মতান্তরে আনমার ইবন আরাশ ইবন লিহয়ান ইবন আমর ইবন গাওছ ইবন নাবিত ইবন মালিক ইবন যায়দ ইব্‌ন কাহলান ইবন সাবা।

কথিত আছে যে, সাতীহ লোকটির কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল না। সে ছিল ছাদের ন্যায় সমান। তার মুখমন্ডল ছিল পিঠের উপর। ক্রোধ এলে সে ফুলে যেত এবং বসে যেত। শাক লোকটি ছিল সাধারণ মানুষের অর্ধাংশ। বলা হয় যে, খালিদ ইবন আবদুল্লাহ বিননুল কাসরী তারই অধঃস্তন পুরুষ।

সুহায়লী বলেন, ওরা দুজন একই দিন জন্মগ্রহণ করেছিল। দিনটি ছিল তরীফা বিনত খায়র হিমইয়ারীর মৃত্যু দিবস। বর্ণিত আছে যে, তাদের জন্মের পর সে তাদের প্রত্যেকের মুখে থুথু ছিটিয়েছিল। তাতে তারা তার জ্যোতিষ বিদ্যার উত্তরাধিকার পেয়েছিল। তরীফা ছিল পূর্বোল্লেখিত আমর ইবন আমিরের স্ত্রী। আল্লাহই ভাল জানেন।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, রবী’আ ইবন নাসর ছিলেন ইয়ামানের তুব্বা উপাধিধারী সম্রাটদের অন্যতম। একদা তিনি এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে আতংকগ্রস্ত ও অস্থির হয়ে পড়েন। অতঃপর তার রাজ্যের সকল জ্যোতিষী যাদুকর ও জ্যোতির্বিদকে তাঁর দরবারে একত্রিত করে বললেন, ‘আমি এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি, যা আমাকে ভীত ও শঙ্কিত করে তুলেছে। আপনারা আমাকে স্বপ্ন ও তার তাৎপর্য বলে দিন।’ তারা বলল, ‘আপনি স্বপ্নটা আমাদেরকে বলুন; আমরা তার ব্যাখ্যা বলে দিব।’ সম্রাট বললেন, “না তা নয়, আমি যদি স্বপ্ন বলে দিই তারপর আপনারা তার ব্যাখ্যা দেন, সেই ব্যাখ্যায় আমি আস্থা রাখতে পারব না। কারণ এ স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা সেই ব্যক্তিই দিতে পারবে, আমার বলা ছাড়া যে স্বপ্নটা জানতে পারবে।’ একজন বলল, ‘ঠিক আছে, সম্রাট যদি তাই চান তবে ব্যাখ্যার জন্যে শাক ও সাতীহের নিকট লোক পাঠিয়ে দেয়া হোক। এই শাস্ত্রে তাদের চেয়ে অভিজ্ঞ কেউ নেই। তারাই সম্রাটের ইচ্ছা মুতাবিক ব্যাখ্যা বলতে পারবে।’ লোক পাঠিয়ে তাদেরকে আনা হল। শাকের পূর্বে সাতীহের সাথে কথা বললেন সম্রাট। তিনি বললেন, ‘ আমি এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি, যা আমাকে ব্যতিব্যস্ত ও অস্থির করে তুলেছে। আগে বল, সে স্বপ্নটি কি? তুমি যদি স্বপ্নটি ঠিক ঠিক বলতে পার তবে তোমার ব্যাখ্যাও সঠিক হবে।’ সাতীহ বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তাই করছি। আপনি একটি কালো বস্তু দেখেছেন যা অন্ধকার থেকে বের হয়েছে। অতঃপর সমুদ্র উপকুলবর্তী নিচু ভূমিতে গিয়েছে। এবং যেখানে মাথা ভূমিতে গিয়েছে এবং সেখানে মাথা বিশিষ্ট যা পেয়েছে তার সব কিছু খেয়ে ফেলেছে।’ সম্রাট বললেন, ‘সাতীহ! তুমি একটুও ভুল বলনি। এখন বল দেখি তোমার মতে এর ব্যাখ্যা কী?’

সে বললঃ ‘দু’শিলা ভূমির মাঝে অবস্থিত সকল পশু-পাখীর শপথ করে বলছি, হাবশি জাতি আপনাদের রাজ্যে অবতরণ করবে এবং আবয়ান থেকে জারশ পর্যন্ত এলাকায় রাজত্ব করবে।’ সম্রাট বললেন, ‘সাতীহ! এতো এক অনাকাংখিত ও বেদনাদায়ক ব্যাপার, কবে নাগাদ তা ঘটবে; আমার রাজত্বকালে, না আরও পরে?’ সে বলল, ‘আপনার পিতার শপথ, বরং আপনার পরে আরো ৬০/৭০ বছরের অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর।’ সম্রাট বললেন, ‘তাদের রাজত্ব কি চিরস্থায়ী হবে? না কি পতন ঘটবে?’ সে বলল, ‘৭৩ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে তাদের পতন ঘটবে। তারপর তাদেরকে হত্যা করা হবে এবং তারা সেখান থেকে পালিয়ে যাবে।’ তিনি বললেন, ‘কে তাদেরকে হত্যা ও বিতাড়িত করবে?’ সে বলল, ‘ইরামসী ইয়াযিন। এডেন থেকে সে আসবে এবং ওদের কাউকে ইয়ামানে অবশিষ্ট রাখবে না।’

সম্রাট বললেন, ‘তার রাজত্ব কি চিরস্থায়ী হবে? নাকি তার পতন ঘটবে?’ সে বলল, ‘বরং পতন ঘটবে।’ সম্রাট বললেন, ‘কার হাতে তার পতন ঘটবে?’ সে বলল, ‘একজন পুণ্যবান নবীর হাতে ঊর্ধাকাশ থেকে তার নিকট ওহী আসবে।’ সম্রাট বললেন, ‘নবী কোন বংশের সন্তান হবে?’ সে বলল, ‘গালিব ইবন ফিহর ইবন মালিক ইবন নজরের অধঃস্তন পুরুষ। আখেরী যামানা পর্যন্ত রাজত্ব তার সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকবে।’ সম্রাট বললেন, ‘যুগেরও কি আবার শেষ আছে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, যুগের শেষ হল এমন একটি দিন, যেদিনে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাইকে একত্রিত করা হবে। সৎকর্মশীলগণ হবে ভাগ্যবান আর পাপাচারীগণ হবে ভাগ্যাহত।’ সম্রাট বললেন, ‘তুমি যা বলছ তা কি ঠিক?’ সে বলল, ‘অন্তরাগ, অন্ধকার এবং উদ্ভাসিত প্রত্যুষের শপথ করে বলছি, আমি আপনাকে যা জানিয়েছি তা অবশ্যই সত্য।’

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর জ্যোতিষী শাক সম্রাটের নিকট আসল। সাতীহকে যা বলেছিলেন তিনি তাকেও তাই বললেন। উভয়ের বক্তব্য একরূপ হয়, নাকি ভিন্ন ভিন্ন, তা দেখার জন্যে সাতীহের বক্তব্য তিনি শাকের নিকট প্রকাশ করলেন না। শাক বলল, ‘আপনি দেখেছেন একটি কালো বস্তু। সেটি বেরিয়ে এসেছে অন্ধকার থেকে। তারপর উদ্যান ও ফলবাগানে গিয়ে পতিত হয়েছে। অতঃপর সেখানে যত প্রাণী ছিল সব খেয়ে ফেলেছে।’ এতটুকু বলার পর সম্রাট বুঝলেন যে, উভয়ের বক্তব্য অভিন্ন। সম্রাট বললেন, ‘হে শাক! তুমি একটুও ভুল বলনি। এখন তোমাদের এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?’ সে বলল, ‘দু’শিলা ভুমির মাঝে অবস্থিত মানব সম্প্রদায়ের শপথ করে বলছি, আপনাদের রাজ্যে অবশ্যই কৃষ্ণাঙ্গরা অবতরণ করবে। সকল অধিবাসীর উপর তারা বিজয় লাভ করবে এবং আলায়্যান থেকে নজরান পর্যন্ত তাদের শাসনাধীন হবে।’ সম্রাট বললেন, ‘হে শাক! তোমার পিতার শপথ, এটি তো আমাদের জন্যে ক্ষোভ ও দুঃখের ব্যাপার। তবে এটি কবে ঘটবে? আমার আমলে, নাকি এর পরবর্তী যুগে?’ সে বলল, ‘না, বরং এর কিছুকাল পরে।

তারপর একজন প্রতাপশালী ব্যক্তি আপনাদেরকে ওদের হাত থেকে মুক্ত করবে এবং ওদেরকে চরম অপমান ও লাঞ্চিত করবে।’ তিনি বললেন, ‘ঐ প্রতাপশালী ব্যক্তিটি কে?’ সে বলল, ‘একটি বালক-গ্রামবাসীও নয়, শহরবাসীও নয়। যী ইয়াযান-এর বংশ থেকে বেরিয়ে সে তাদের উপর আক্রমণ করবে।’ তিনি বললেন, ‘তার রাজত্ব কি চিরস্থায়ী হবে, নাকি তার পতন ঘটবে?’ সে বলল, ‘বরং তার রাজত্বের পতন ঘটবে জনৈক রাসূলের হাতে, যিনি দীনের প্রচারক ও মর্যাদাশীল হবেন এবং সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে আসবেন। বিচার দিবস পর্যন্ত রাজত্ব তার সম্প্রদায়ের হাতে থাকবে।’

সম্রাট বললেন, ‘বিচার দিবস আবার কী?’ সে বলল, ‘যে দিবসে সকল কর্মের প্রতিদান দেয়া হবে। সেদিন আকাশ থেকে ঘোষণা দেয়া হবে। জীবিত মৃত সবাই সে ঘোষণা শুনবে। নির্দিষ্ট স্থানে তখন লোকজন সমবেত হবে। যারা তাকওয়া ও সংযম অবলম্বন করেছে, তারা তখন সফলতা ও কল্যাণ লাভ করবে।’ তিনি বললেন, ‘তুমি যা বলছো, তা কি সত্য?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিপালকের শপথ এবং এ উভয়ের মাঝে উঁচু-নীচু যা কিছু আছে, তার সবগুলোর শপথ, আমি যা বলছি তা সত্য। তাতে কোন ব্যত্যয় নেই।’ ইবন ইসহাক বলেন, সাতীহ শাক-এর বক্তব্য রাবী’আ ইবন নাসরের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তিনি তাঁর ছেলে-মেয়ে ও পরিবার-পরিজনকে ইরাকে পাঠিয়ে দিলেন এবং সাবুর ইবন খারজাম নামের জনৈক পারসিক রাজাকে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা লিখে দিলেন। সে তাদের হীরা রাজ্যে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিল। ইবন ইসহাক বলেন, রবী’আ ইবন নাসরের অধঃস্তন বংশধর হলেন নুমান ইবন মুনযির ইবন নুমান ইবন মুনযির ইবন আমর ইবন আদী ইবন রবীআ ইবন নাসর। এই নুমান পারস্য রাজ্যের প্রতিনিধিরূপে হীরা শাসন করতেন। আরবগণ তার নিকট যেত এবং তার প্রশংসা করত। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক যা বলেছেন যে, নুমান ইবন মুনযির রবীআ ইবন নাসরের অধঃস্তন পুরুষ, অধিকাংশ ঐতিহাসিক তা সমর্থন করেছেন।

ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, নুমান ইবন মুনযিরের তরবারী হযরত উমর ইবন খাত্তাবের (রা) নিকট আনয়ন করা হলে তিনি জুবায়র ইবন মুতইম (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘সে কার বংশধর?’ জুবায়র (রা) বললেন, ‘সে কানাস ইবন মা’আদ ইব্‌ন আদনানের বংশধর। ইবন ইসহাক বলেন, ‘সে যে কোন বংশের ছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন।’

৬০
মদীনা অধিবাসীদের সাথে তুব্বা সম্রাট আবু কুরাবের ঘটনা
বায়তুল্লাহ শরীফের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রয়াস এবং পরবর্তীতে সম্মানার্থে বায়তুল্লাহ শরীফে গিলাফ ছড়ান প্রসঙ্গে

ইবন ইসহাক বললেন, রবীআ ইবন নাসরের মৃত্যুর পর সমগ্র ইয়ামান হাসসান ইবন তুব্বান আসআদ আবু কুরাবের করতলগত হয়। তুব্বান আসআদ ছিলেন সর্বশেষ তুব্বা। ইনি ছিলেন কালকীরের ইবন যায়দ, যায়দ ছিলেন সর্বপ্রথম তুব্বা তিনি ছিলেন আমর যিল আযআর ইবন আবরাহা যিল মানার ইবন রাইশ ইবন আদী ইবন সায়ফী ইবন সাবা আল আসগর ইবন কা’ব কাহফুয যুলাম ইবন জায়দ ইবন আহল ইবন আমর ইবন কুস্ ইবন মু’আবিয়া ইবন জাসম ইবন আবদে শামস ইবন ওয়াইল ইবন গাওছ ইবন কুতান ইব্‌ন আরিব ইব্‌ন যুহায়র ইবন আনাস ইবন হামাইসি ইবন আরবাহাজ। এই আরবাহাজ হচ্ছেন হিমইয়ার ইবন সাবা আল আকবার ইবন ইয়ারুব ইবন ইয়াশজুয ইবন কাহতান। ইবন ইসহাক বলেন, এই তুব্বাল আসআদ আবু কুরাব সেই ব্যক্তি যে মদীনায় এসেছিলেন এবং দু’জন ইহুদী ধর্মযাজককে তার সাথে ইয়ামানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বায়তুল্লাহ শরীফের সংস্কার সাধন ও তাতে সর্বপ্রথম গিলাফ চড়িয়েছিলেন তার শাসন কাল ছিল রবীআ ইবন নাসরের শাসনকালের পূর্বে। পূর্ব দেশীয় রাজ্যগুলো জয় করে তিনি মদীনা হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করছিলেন। অভিযানের শুরুতেও তিনি মদীনা হয়ে গিয়েছিলেন। মদীনার অধিবাসীদেরকে তিনি উচ্ছেদ করেননি। তাঁর এক পুত্রকে তিনি তাদের শাসকরূপে রেখে গিয়েছিলেন। গুপ্তঘাতকের হাতে তার ওই পুত্র সেখানে নিহত হন। এ কারণে তিনি মদীনা ধ্বংস, তার অধিবাসীদেরকে উচ্ছেদ এবং উদ্যানরাজি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্য মদীনায় ফিরে আসল। তাদের নেতৃত্বে ছিল নাজ্জার বংশীয় আমর ইবন তাশহা। তিনি বানু আমর ইবন মাবযূলেরও একজন মাবযূলের নাম আমির ইবন মালিক ইবন নাজ্জার। নাজ্জারের নাম তায়মুল্লাহ ইব্‌ন ছালাবা ইবন আমর ইব্‌ন খাযরাজ ইবন হারিছা ইবন ছা’লাবা ইবন আমির।

ইবন হিশাম বলেন, আমর ইবন তালহা। আমর ইবন মুআবিয়া ইবন আমর ইবন আমির ইবন মালিক ইবন নাজ্জার। তালহা তার মায়ের নাম। তালহা ছিলেন আমির ইবন যুরায়ক খায়রাজি-এর কন্যা।

ইবন ইসহাক বলেন বানু ‘আদী ইবন নাজ্জার গোত্রের আলমার নামে জনৈক ব্যক্তি তুব্বার দলের এক ব্যক্তির উপর আক্রমণ করে বসে। লোকটি আহমারের খেজুর গাছ থেকে খেজুর কাটছিল। কাঁচির আঘাতে আহমর তাকে হত্যা করেন এবং বলেন খেজুর সে পাবে যে তার যত্ন করে। এ ঘটনায় তুব্বা তাদের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। ফলে উভয়পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। আনসারগণের ধারণা তাদের পূর্বপুরুষরা দিনে তুব্বা পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন আর রাতে তাদের মেহমানদারী করতেন। তাদের আচরণে তুব্বা খুব খুশী হন এবং বলেন হায়! আমাদের সম্প্রদায় তো অলস। আনসারদের সূত্রে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, তুব্বা ক্ষেপে ছিলেন ইহুদী জাতির বিরুদ্ধে। কারণ তারা আনসারদের হয়ে তার বিরুদ্ধে লড়েছিল।

সুহায়লী বলেন, কথিত আছে যে, তুব্বা এসেছিলেন ইহুদীদের বিরুদ্ধে আনসারদেরকে সাহায্য করতে। আনসারগণ ছিলেন তাঁর চাচার বংশধর। ইহুদীগণ শর্ত সাপেক্ষে মদীনায় বসবাসের অনুমতি পেয়েছিল। পরে তারা শর্তগুলো পূরণ করেনি। বরং আনসারদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করেছিল। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক বলেন, তুব্বা যখন যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তখন বনু কুরায়যা গোত্রের দু’জন ইহুদী ধর্মযাজক তাঁর নিকট আসেন। তারা জেনেছিলেন যে, তুব্বা মদীনা ধ্বংস ও মদীনাবাসীদের মূলোৎপাটনের জন্যে এসেছেন। তারা তাকে বললেন, ‘রাজন! আপনি এরূপ করবেন না। এরপরও যদি আপনি আপনার পরিকল্পনা কার্যকর করতে চান তবে আপনি তাতে ব্যর্থ হলে এবং আপনার উপর আল্লাহর গযব নাযিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘কেন এরূপ হবে?’ তারা বললেন, ‘কারণ, এই মদীনা হল আখেরী যামানায় এই কুরায়শীয় হারাম শরীফ থেকে আবির্ভূত নবীর হিজরত স্থল। এটি হবে তাঁর বাসস্থান ও অবস্থান স্থল।’ এতে তুব্বা যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই দু’জন গভীর জ্ঞানের অধিকারী। তাদের কথা তার খুব ভাল লেগেছে। ফলে, তিনি মদীনাবাসীদের ধর্মে হস্তক্ষেপ না করেই মদীনা ত্যাগ করেন।

ইবন ইসহাক বলেন, তুব্বার সম্প্রদায় মূর্তিপূজারী ছিল। তারা দেব-দেবীর পূজা করত। তুব্বা মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন। এটা ছিল ইয়ামানের পথে। উসফান ও আমাজের মধ্যবর্তী স্থানে আসার পর হুযায়ল (ইবন মুদারিকা ইবন ইলিয়াছ ইবন মুযার ইবন নেয়ার ইবন মা’দ ইবন আদনান) গোত্রের একদল লোক তার নিকট এল। তারা বলল, ‘হে রাজন! আমরা কি আপনাকে একটি গৃহের সন্ধান দিব, যেটি পুরাতন হয়ে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আপনার পূর্ববর্তী রাজা বাদশাহ্ ঐ গৃহ সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল ছিলেন না। সেখানে রয়েছে মনি-মানিক্য, স্বর্ণ-রৌপ্য ও মহামূল্য ইয়াকুত পাথর।’ তিন বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক আছে।’ তারা বলল, ‘সেটি মক্কায় অবস্থিত একটি গৃহ। তার ভক্তবৃন্দ সেখানে ইবাদত করে এবং সেখানে প্রার্থনা করে।’ হুযায়ল গোত্রীয়গণ এর দ্বারা তুব্বার ধ্বংসের চক্রান্ত করেছিল। কারণ তারা জানত যে, কোন রাজা এ গৃহে ধ্বংস করা কিংবা এটির নিকট ঔদ্ধত্য দেখালে তার ধ্বংস অনিবার্য, তারা যা বলেছিল তা করার সংকল্প করে তুব্বা এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য পূর্বোক্ত যাজকদ্বয়ের নিকট লোক পাঠালেন। তারা বললেন, ‘এ লোকেরা আপনার নিজের ও আপনার সৈন্য-সামন্তের ধ্বংসই চেয়েছে। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে এই পবিত্র গৃহ ব্যতীত অন্য কোন গৃহকে নিজের জন্যে নির্দিষ্ট রেখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। তারা আপনাকে যা করতে বলেছে, আপনি যদি তা করেন তবে আপনিও ধ্বংস হবেন, আপনার সাথে যারা আছে তারাও।’ তিনি বললেন, ‘আমি গৃহের নিকট পৌঁছলে আপনারা আমাকে কী করতে পরামর্শ দিচ্ছেন?’ তারা বলল, ‘আপনি তা-ই করবেন যা ওখানকার লোকজন করে। ঐ গৃহের তাওয়াফ করবেন, সেটির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সেখানে মাথা মুণ্ডন করবেন এবং সেখান থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত সেটির প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করতে থাকবেন।’ তিনি বললেন, ‘আপনারা তা করতে বাধা কোথায়?’ তারা বলল, ‘সেটি হল আমাদের পিতা ইবরাহীমের (আ) গৃহ। এ গৃহ সেরূপই যা আমরা আপনার নিকট বর্ণনা করেছি, কিন্তু ওখানকার লোকজন ঐ গৃহের আশে-পাশে প্রতিমা স্থাপন করে এবং খুনাখুনি ও রক্তারক্তি করে আমাদের মাঝে এবং ঐ গৃহের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করে রেখেছে। তারা শিরকবাদী, তারা অপবিত্র।’ তুব্বা তাদের উপদেশ উপলব্ধি করলেন এবং তাদের কথায় সত্যতা অনুধাবন করলেন। হুযায়ল গোত্রের কিছু লোক তাঁর নিকটে এলে তিনি তাদের হাত-পা কেটে দিলেন। তারপর তিনি মক্কায় আসলেন। বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করলেন, সেখানে পশু কুরবানী দিলেন, মাথা মুণ্ডন করলেন এবং মক্কায় ছয়দিন অবস্থান করলেন।

কথিত আছে যে, এই সময়ে তিনি সেখানে পশু জবাই দিতেন এবং সেখানকার লোকজনকে আপ্যায়িত করতেন এবং তাদেরকে মধু পান করাতেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি কাবা শরীফে গিলাফ চড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে তিনি কাবা শরীফে মোটা কাপড়ের গিলাফ চড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি স্বপ্নে দেখলেন, যেন তিনি তার চেয়ে ভাল গিলাফ চড়ান, তখন তিনি মু‘আফিরী বস্ত্রে গিলাফ চড়ালেন। আবার স্বপ্ন দেখলেন, যেন তার চাইতেও ভাল গিলাফ চড়ান। তখন তিনি মালা এবং নক্সাদার ইয়ামানী বন্ত্রের গিলাফ চড়িয়ে দিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা যে, তুব্বাই সর্বপ্রথম কাবা শরীফে গিলাফ চড়িয়ে ছিলেন। তিনি জুরহুম গোত্রকে কাবা শরীফের তত্ত্বাবধান করা, সেটি পবিত্র রাখা, রক্ত, মৃত প্রাণী এবং ঋতুস্রাবের বস্ত্রাদি থেকে পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিলেন। তিনি কাবা শরীফের একটি দরজা তৈরী করে তাতে তালা-চাবির ব্যবস্থা করলেন। তুব্বার এ সকল খেদমত ও কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে সুবাই’আ বিনত আহাব তাঁর পুত্র খালিদ ইবন আবদ মানাফ ইব্‌ন কবি ইবন কা’ব ইবন সা’দ ইবন তায়ম ইবন মুররা ইবন কা’ব ইবন লুআয় ইবন গালিব)-কে উপদেশ দিয়ে এবং মক্কায় কোন প্রকারের সীমালংঘন ও বিদ্রোহ না করার নির্দেশ দিয়ে বলেছিল।

ابني لا تظلم بمكة لا الصغير ولا الكبير .

—হে বৎস! মক্কাতে ছোট-বড় কোন জুলুম বা পাপাচার করবে না।

واحفظ محامها بني ولا يغرنك الغرور .

—হে বৎস! এর মর্যাদা রক্ষা করো এবং এ ব্যাপারে কোন ধোঁকায় পড়োনা যেন।

ابنى من يظلم بمكة يلق أطراف الشرور .

—হে বৎস, মক্কায় যে জন জুলুম করে, অকল্যাণ আর দুর্ভোগ তার জন্যে অবধারিত।

ابنى يضرب وجهه ويلج ب خديه السعير .

—হে বৎস! মুখে আর গালে জানান্নামের আগুন আঘাত করবে।

ابني قد جربتها فوجدت ظالمها يبور

—হে বৎস! আমার অভিজ্ঞতা যে, এখানে জুলুমকারী সুনিশ্চিতভাবেই ধ্বংস হয়।

الله أمنها وما بنيت بعرصتها قصور .

—আল্লাহ তা’আলাই তার এবং তার প্রাঙ্গণস্থ দালান-কোঠার হেফাজতকারী।

والله امن طيرها والعصم كامن في ثبير .

—আল্লাহই এর পাখীগুলো এবং শ্বেত হরিণকে ছাবীর পর্বতে নিরাপদে রাখেন।

ولقد غزاها تبع فكسا بنيلها الحبير

—তুব্বা যুদ্ধ করতে আসল এবং কা’বা গৃহে গিলাফ চড়াল।

واذل ربي ملكه فيها فأوفي بالنذور .

—আল্লাহ তাআলা তাকে থামিয়ে দেন তিনি তার মানত পুরো করেন।

يمشي اليها حافيا بفنائها ألفا بعير .

—তিনি নগ্ন পায়ে তার দিকে হেঁটে আসেন। এবং তার প্রাঙ্গণে হাজারো উট কুরবানী করেন।

ويظل يطعم أهلها - لحم المهاري والجزور .

—ছোট বড় উটের গোশতের দ্বারা তিনি মক্কবাসীদের আপ্যায়িত করেন।

يسقيهم العسل الصفى والر حيض من الشعير .

—তিনি তাদেরকে খাটি মধু পান করান এবং ভাল রুটি আহার করান।

والفيل أهلك جيشه يرمون فيها بالصخور

—তাতে হাতী বাহিনী ধ্বংস হয়, তাদের প্রতি পাথর বর্ষিত হয়।

والملك في أقص البلاد وفي الاعاجم والخزور .

—তাঁর (আল্লাহর) কর্তৃত্ব সর্বস্থানে, আরবে আর অনারবে।

فاسمع اذا حدثك وافهم كيف عاقبة الأمور .

—যখন কিছু বলা হয়, তখন তুমি তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং ভালভাবে বুঝে নিবে যে, শেষ পরিণতি কেমন হয়।

ইবন ইসহাক বলেন অতঃপর তুব্বা তার সৈন্য-সামন্ত ও ইহুদী ধর্ম যাজকদ্বয়কে সাথে নিয়ে স্বদেশ ইয়ামানের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে তার সম্প্রদায়কে তিনি তার নবদীক্ষিত ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। ইয়ামানে অবস্থিত বিশেষ অগ্নিকুণ্ডের মাধ্যমে ফয়সালা না হওয়া ব্যতীত তারা নতুন ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।

ইবন ইসহাক বলেন, আবু মালিক ইবন ছা’লাবা ইবন আবী মালিক কুরাযী আমার নিকট বর্ণনা করে বলেছেন যে, আমি ইবরাহীম ইবন মুহাম্মদ ইবন তালহা ইবন উবাইদুল্লাহকে বলতে শুনেছি যে, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে তুব্বা যখন ইয়ামানের কাছাকাছি পৌঁছলেন এবং ইয়ামানে প্রবেশ করতে যাবেন তখন হিমইয়ারী গোত্রের লোকজন তাকে বাধা দিল এবং বলল, ‘আপনি এদেশে প্রবেশ করবেন না, আপনি আমাদের ধর্ম ত্যাগ করেছেন।’ তিনি তাদেরকে তার নবদীক্ষিত ধর্মের দাওয়াত দিয়ে বললেন, ‘এটি তোমাদের ধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্ম।’ তারা বলল, ‘আমরা অগ্নিকুণ্ডের মাধ্যমে ফয়সালা করব।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই হোক।’

ইয়ামানবাসীদের ধারণা যে, তাদের একটি অগ্নিকুণ্ড রয়েছে। বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোতে এই অগ্নিকুণ্ড তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়। অত্যাচারীকে টেনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে আর অত্যাচারিতের কোন ক্ষতি করে না। লোকজন তাদের দেব-দেবী এবং ধর্মমত অনুযায়ী সুপারিশযোগ্য বস্তুগুলো নিয়ে বের হল। আর ধর্মযাজক দু’জন গলায় কিতাব ঝুলিয়ে রওয়ানা হলেন। সেখান থেকে আগুন বের হচ্ছিল সেখানে গিয়ে সবাই বলল, আগুন বেরিয়ে এলে ইয়ামানবাসীদের দিকে যখন এগিয়ে আসতে লাগল, তখন তারা অন্যদিকে ভয়ে সরে যেতে লাগল, উপস্থিত লোকজন তাদেরকে ধমক দেয়ায় এবং স্থির থাকতে নির্দেশ দেয়ায় তারা স্থির থাকল। অবশেষে আগুন এসে তাদেরকে ঢেকে ফেলল এবং তাদের দেব-দেবী এবং এতগুলো বহনকারী হিমইয়ারী লোকজন সবাইকে গ্রাস করে ফেলল। ধর্মযাজক দু’জন গলায় কিতাবসহ স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আসলেন। তাদের কপালে ঘাম দেখা দিয়েছিল। আগুন তাদের কোন ক্ষতি করলো না, তখন হিমইয়ারী দৃঢ়ভাবে যাজকদ্বয়ের ধর্ম গ্রহণ করল। তখন থেকে ইয়ামানে ইহুদী ধর্মের সূচনা হয়।

ইবন ইসহাক বলেন, জনৈক শাস্ত্রবিশারদ আমাকে বলেছেন যে, যাজকদ্বয় এবং হিমইয়ারীগণ আগুনকে তার উৎসস্থলে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে আগুনের পেছনে-পেছনে ছুটলেন। তারা বলেছিলেন যে, যে পক্ষ আগুনকে ফিরিয়ে দিতে পারবে সে পক্ষই সত্যপন্থী। হিমইয়ারের লোকজন তাদের প্রতিমাসমূহ নিয়ে আগুনের নিকট এগিয়ে গেল তাদেরকে গ্রাস করার জন্য। আগুন তাদের নিকট এগিয়ে এলে তারা পালিয়ে যেতে চাইল। আগুনকে ফিরিয়ে দিতে পারল না। অতঃপর যাজকদ্বয় আগুনের নিকটবর্তী হলেন। তারা অবিরাম তাওরাত পাঠ করছিলেন আর আগুন ক্রমে ক্রমে তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আগুন যেখান থেকে উঠে এসেছিল তারা তাকে সেখানেই ফিরিয়ে দিলেন। তখন হিমইয়ারীগণ তাদের ধর্মে আস্থাশীল হল। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক বলেন, রাছাম নামে তাদের একটি উপাসনালয় ছিল। তারা সেটিকে ভক্তি করত। সেখানে পশু কোরবানী করতো ঐ গৃহের মধ্যে কথাবার্তা বলত। তখন তারা মুশরিক ছিল। যাজকদ্বয় তুব্বাকে বললেন, ‘শয়তান এটি দ্বারা তাদেরকে বিপথে পরিচালিত করছে। আমাদেরকে অনুমতি দিন আমরা একটু দেখি।’ তুব্বা বললেন, ‘আপনারা যা ইচ্ছা করুন।’ ইয়ামানীদের ধারণা, তারা ঐ গৃহ থেকে একটি কালো কুকুর বের করে আনে এবং সেটি জবাই করে দেয়। তারপর উক্ত ঘর ভেঙ্গে ফেলে। আমার জানা মতে, ঐ গৃহের পাশে বলিদানের রক্ত চিহ্ন তখনও তার স্মৃতি বহন করছে।

নবী করীম (সা) থেকে বর্ণিতঃ

لا تسبو تبعا فانه قد كان اسلم

তোমরা তুব্বাকে গালি দিও না, কারণ তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ তাফসীরগ্রন্থে এ হাদীসটির ব্যাখ্যায় আমরা উল্লেখ করেছি যে, সুহায়লী বলেছেন, বর্ণনাকারী মামার হাম্মাম ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে এবং তিনি হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

لا تسبوا أسعد العميري فانه أول من كسي الكعبة

—তোমরা আসআদ হিমইয়ারীকে গালি দিও না। কারণ, তিনি সর্বপ্রথম কাবা শরীফে গিলাফ চড়ান।

সুহায়লী বলেন, যাজকদ্বয় যখন তুব্বাকে রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে অবহিত করলেন, তখন তিনি কবিতার ছন্দে বলেনঃ

شهدت على أحمد أنه رسول من الله باری السم

—সাক্ষ্য দিচ্ছি আমি আসআদ—সৃষ্টিকর্তার রাসূল আহমদ (সা)

فلومد عمري الى عمره - گنت وزيرا له وابن عم

—ততদিন যদি বেঁচে থাকতাম, তাঁর উজীর ও সাথী হতাম।

وجاهدت بالسيف أعداءه وفرجت عن صدره گل هم

—তরবারী দিয়ে শায়েস্তা করতাম, যতই হতো শত্রু তার দূর করতাম দুঃখ যত জন্ম নিত বক্ষে তার।

বর্ণনাকারী বলেন, বংশানুক্রমে এ কবিতা আনসারদের মধ্যে সুরক্ষিত ছিল। তারা যত্ন সহকারে এটি সংরক্ষণ করতেন। সর্বশেষ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা)-এর নিকট এটি সংরক্ষিত ছিল।

সুহায়লী বলেন, ইবন আবিদ দুনিয়া তাঁর কিতাবুল কুবুরে উল্লেখ করেছেন যে, সানা’আ অঞ্চলে একটি কবর খননের পর তাতে দু’জন মহিলার লাশ পাওয়া যায়। তাদের সাথে ছিল একখণ্ড রৌপ্যলিপি। তাতে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত ছিল এ হল তুব্বার দুই কন্যা লামীস ও হিব্বার কবর। তারা সাক্ষ্য দিত যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, তিনি একক তার কোন শরীক নেই, এ বিশ্বাস সহকারে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তাদের পূর্ববর্তী নেককার লোকগণ এ বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

অতঃপর রাজত্ব এল তুব্বান আসআদের পুত্র হাসানের হাতে। তিনি ছিলেন ইয়ামামা-ই যুরাকা-এর ভাই। জাও নগরীর প্রবেশ পথে ইয়ামামাকে শূলিতে চড়ানো হয়েছিল। সেদিন থেকে শহরটির নাম পড়ে যায় আল-ইয়ামামা।

ইবন ইসহাক বলেন, আবু কুরাব তুব্বান আসআদের পুত্র হাসসান সিংহাসনে বসে ইয়ামানের অধিবাসীদেরকে নিয়ে আরব ও অনারব ভূমি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইরাক পৌঁছে হিমইয়ার ও ইয়ামানের কতক গোত্র তার সাথে যেতে অসম্মতি জানায়। তারা স্বদেশে নিজেদের পরিবারের নিকট ফিরে যেতে চাইল। আমর নামে তার এক ভাইয়ের নিকট তারা নিজেদের ইচ্ছা জানাল। সে কাফেলার সাথে ছিল। তারা আমরকে বলল, আপনি আপনার ভাই হাসসানকে হত্যা করুন তাহলে আমরা আপনাকে রাজা বানাব। আপনি আমাদেরকে নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাবেন। সে তাদের আহবানে সাড়া দিল। যূ-রুআইন জনৈক হিমইয়ারী ছাড়া তারা সবাই এ ষড়যন্ত্রে একমত হল। সে যূ-রুআইন আমরকে অপকর্মে বাধা দিয়েছিল সে তা শোনেনি। তখন সে আমরের উদ্দেশ্যে একটি চিরকুট লিখল। তাতে নিম্নোক্ত পংক্তি দুটো লিখিত ছিল।

الا من يشتري سهرا بنوم - سعيد من يبيت قرير عين .

—নিদ্রা দিয়ে বিনিদ্রা কিনে কোনজন; ভাগ্যবান সেইজন- প্রশান্ত রজনী যে করে যাপন।

فأما حمير غدرت وخانت -فمعذرة الاله لذي رعين .

—করেছে হিমইয়ারী গোত্র বিশ্বাসভঙ্গ ও গাদ্দারী

প্রকাশ করে যূ-রুআঈন তার ব্যক্তিগত বেজারী।

তারপর চিরকুটটি সে আমরের নিকট জমা রাখল। আপন ভাই হাসানকে হত্যা করে অমর দেশে ফেরার পর থেকে তার আর ঘুম হয় না। রাতের পর রাত সে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে থাকে। ডাক্তার, কবিরাজ, জ্যোতিষী-গণক এবং রেখাবিশেষজ্ঞদের নিকট সে এর কারণ জানতে চাইল। তাকে বলা হল যে, ‘আল্লাহর কসম, কেউ যদি তার ভাই কিংবা কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তবে তার ঘুম হারাম হয়ে যায় এবং অনিদ্রা তার নিত্য সাথী হয়। যারা আমরকে ভ্রাতৃ হত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছিল, এবার সে একে একে তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করলো। যূ-রুআইনের পালা আসলে সে বলল, ‘আপনার কাছে আমার একটি মুক্তিসনদ আছে।’ আমর বলল, ‘সেটি কি?’ যু-রুআইবন বলল, ‘আপনাকে আমি যে চিরকুটটি দিয়েছিলাম তা।’ সে চিরকুটটি বের করল। খুলে দেখল তাতে উক্ত পংক্তি লিখিত রয়েছে। তখন সে যূ-রুআইনকে মুক্তি দিল এবং আমর উপলব্ধি করতে পারল যে, যূ-রুআইন তাকে যথার্থ উপদেশ দিয়েছিল। অবশেষে আমরের মৃত্যু হয় এবং হিমইয়ারীদের মধ্যে অনৈক্য, বিশৃংখলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

৬১
লাখনীআ’হ যূশানাতির-এর ইয়ামান আক্রমণ
উপরোক্ত রাজা ২৭ বছর সেখানে রাজত্ব করেন। ইবন ইসহাক বলেন, এরপর হিমইয়ার গোত্রের এক ব্যক্তি ইয়ামানীদের উপর আক্রমণ চালায়। সে মূলত রাজবংশীয় ছিলেন তার নাম ছিল লাখনী আহি ইয়ানূফযু শানাতির। ইয়ামানের সম্ভ্রান্ত লোকদেরকে সে হত্যা করে এবং রাজ পরিবারের অন্তঃপুরবাসীদেরকে নিয়ে রস কৌতুক করে। তার সাথে ছিল একজন অসৎ লোক। সে ছিল লূত সম্প্রদায়ের অপকর্ম সমকামিতায় অভ্যস্ত। সে রাজ পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকদেরকে তুলে আনতে নির্দেশ দিত। পরে ঐ ছেলেকে নিয়ে ঘৃণিত সমকামিতা সম্পাদনের জন্যে নির্মিত একটি কক্ষে গিয়ে তার অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করত। যাতে রাজ পরিবারের কেউ পরবর্তীতে রাজা হতে না পারে। অপকর্ম শেষে নিজের মুখে একটি দাঁতন গুঁজে দিয়ে সে তার প্রহরী ও উপস্থিত সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখত, তখন তারা বুঝে নিত যে, সে তার অপকর্ম শেষ করেছে। শেষ পর্যন্ত সে লোক পাঠায় হাসানের ভাই যুর’আ যূ-নুওয়াস ইবন তুব্বান আসআদকে ধরে নিতে। তার ভাই হাসসান যখন নিহত হয় তখন সে ছিল ছোট্ট শিশু পরবর্তীতে সে সুদর্শন, রূপবান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যুবক হিসেবে বেড়ে উঠে। পাপাচারী লোকটির প্রতিনিধিকে দেখে সে ঐ ব্যক্তির কুমতলব আঁচ করতে পারে। সে তখন পাতলা, নতুন ও সুতীক্ষ্ণ একটি ছুরি তার দু’পায়ের মাঝখানে জুতোর ভেতর লুকিয়ে রাখে এবং পাপাচারীর নিকট উপস্থিত হয়। এক সময় উভয়ে নির্জন কক্ষে পৌঁছায় পর সে যু-নুওয়াসকে সাপটে ধরে। সাথে সাথে যু-নুওয়াস তার লুকিয়ে রাখা ছুরি নিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং আঘাতে আঘাতে তাকে হত্যা করে। তারপর তার মাথা কেটে নিয়ে সেই বাতায়নে রাখে যেখান দিয়ে সে বাহিরে তাকাত। তার মুখের মধ্যে গুঁজে দেয় তার দাঁতন। অতঃপর লোকজনের নিকট বেরিয়ে আসে।

লোকজন বলল, ‘হে যু-নুওয়াস, ব্যাপার কি? তাজা না শুকনো’ ; সে বলে, ‘ওকে জিজ্ঞেস কর, কোন অসুবিধা নেই।’ তখন তারা ঐ বাতায়নের দিকে তাকায়। তারা লাখনী আহ্ এর কর্তিত মুণ্ড দেখতে পায়। এরপর যূ-নুওয়াসের খোঁজে তারা বের হয়। শেষে তারা তাকে খুঁজে পায়। যূ-নুওয়াসকে তারা বলে আপনিই আমাদের রাজা হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি। আপনিই সক্ষম হয়েছেন আমাদেরকে এই ঘৃণ্য ব্যক্তি কবল থেকে উদ্ধার করতে।

অতঃপর যূ-নুওয়াস তাদের রাজা হন। হিমাইয়ারীদের সকল লোক এবং ইয়ামানী সকল গোত্র তার নেতৃত্ব মেনে নেয়। সে সর্বশেষ হিমইয়ারী রাজা। তাকে ইউসুফ নামে অভিহিত করা হয়। দীর্ঘকাল তিনি ওখানে রাজত্ব করেন। হযরত ঈসা (আ)-এর দীন অনুসারী আসমানী কিতাব ইঞ্জিল আমলকারী কতক লোক তখন নাজরানে বসবাস করছিল। তাদের জনৈক ধর্মগুরু ছিল। তার নাম আব্দুল্লাহ্ ইবন ছামুর।

অতঃপর ইবন ইসহাক (র) নাজরানবাসীগণ কিভাবে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করল, তার বর্ণনা দেন। তারা “ফাইমিউন” নামের জনৈক খষ্ট ধর্মাবলম্বী লোকের হাতে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ইবাদতকারী লোক ছিলেন। সিরিয়ার কোন এক এলাকায় ছিল তার আস্তানা। তার দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হত। সালিহ নামে এক লোক তার সাথী হয়। রবিবারে দু’জনে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। সপ্তাহের অবশিষ্ট দিনগুলোতে ফাইমিউন নিজ ঘরের মধ্যে আমল করতেন। রোগী ও বিপদগ্রস্ত লোকদের জন্যে তিনি দোয়া করতেন। তার দোয়ার বরকতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সুস্থ ও বিপদ মুক্ত হত।

একদিন এক বেদুইবন তাদের দু’জনকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং নাজরান প্রদেশে নিয়ে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়। যে ব্যক্তি ফাইমিউনকে খরিদ করেছিল সে লক্ষ্য করে যে, ফাইমিউন যে ঘরে নামায আদায় করে তার রাত্রিকালীন নামাযের সময় সমগ্র ঘর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠে। এতে সে অবাক হয়। সে যুগে নাজরানের লোকজন একটি সুদীর্ঘ খেজুর গাছের পূজা করত। মহিলাদের গহনা-পত্র এনে তারা ঐ গাছে ঝুলিয়ে দিত এবং ওখানে অবস্থান করতো।

একদিন ফাইমিউন তার মালিককে বলেন, ‘আমি যদি আল্লাহ তা’আলার দরবারে এই গাছটি ধ্বংসের জন্যে দোয়া করি এবং এটি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কি আপনারা একথা মেনে নিবেন যে, আপনারা যে মতবাদ পোষণ করেন তা বাতিল?’ মালিক বলল, ‘অবশ্যই আমরা তা মেনে নিব।’

অতঃপর সে নাজরানবাসীদেরকে ফাইমিউনের নিকট একত্রিত করে। ফাইমিউন নামাযে দাঁড়ান এবং খেজুর বৃক্ষ ধ্বংসের জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। আল্লাহ্ তাআলা প্রচণ্ড ঝড় প্রেরণ করেন। প্রচণ্ড ঝঞা এসে গাছটি উপড়ে ফেলে দেয়। এই প্রেক্ষিতে নাজরানের অধিবাসীগণ খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয় এবং তিনি তাদেরকে আসমানী কিতাব ইবনজীল ভিত্তিক শরীয়ত পালনে উৎসাহিত করেন। এভাবেই তারা খ্রিষ্টধর্ম পালন করে আসছিল। অবশেষে বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্ট ধর্মে যে আনাচার প্রবেশ করে তাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। উপরোক্ত প্রেক্ষাপটেই আরব অঞ্চল নাজরানে খ্রিষ্ট ধর্মের সূত্রপাত হয়।

এরপর ইবন ইসহাক (র) ফাইমিউনের হাতে আব্দুল্লাহ ইবন ছামুরের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ এবং ফাইমিউন ও তার অনুসারীদেরকে অগ্নিকূপে নিক্ষেপ করে রাজা যু-নুওয়াস কিভাবে হত্যা করে এসব বিবরণ উল্লেখ করেছেন।

ইবন হিশাম বলেন, ওদের জন্যে যে অগ্নিকূপ খনন করা হয়েছিল সেটি ছিল আয়তকার গর্তের ন্যায়। ঐ গর্তে আগুন জ্বালানো হয়েছিল এবং ওদেরকে ঐ আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। অবশিষ্ট লোকদেরকে হত্যা করা হয়। তখন প্রায় বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ইসরাঈলীদের ঘটনা প্রসংগে আমরা তা উল্লেখ করেছি। আমাদের তাফসীর গ্রন্থে সূরা বুরুজেও তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সকল প্রশংসা আল্লাহর।

৬২
ইয়ামানের রাজত্ব হিময়ার গোত্র থেকে সুদানী হাবশীদের কবলে আসা প্রসঙ্গ
পূর্বোল্লেখিত দুই জ্যোতিষী শাক এবং সাতীহ যেমন বলেছিলেন তা-ই ঘটলো। বস্তুত যূ-নাওয়াসের আক্রমণে সকল নাজরানবাসী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মাত্র একজন লোক প্রাণে বেঁচেছিল। তার নাম দাওস যুছালাবান। সে ছিল ঘোড়সওয়ার, বালুকাময় রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে সে পালিয়ে যায়। শত্রুগণ তাকে ধরতে ব্যর্থ হয়। সে ছুটতে ছুটতে রোমান সম্রাট কায়সারের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হয়। যু-নুওয়াস ও তার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সে তার কাছে সাহায্য কামনা করে এবং তাদের অত্যাচার নির্যাতনের বিবরণ প্রদান করে।

কায়সার ছিলেন তাদের মতই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। তিনি বললেন, ‘আমার এখান থেকে তোমার দেশ তো অনেক দূরে। আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আবিসিনিয়ার রাজাকে তোমাকে সাহায্য করার জন্যে লিখে দিচ্ছি। সেও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী এবং তার রাজ্য তোমার রাজ্যের কাছাকাছি।’ অতঃপর তিনি আবিসিনীয় রাজাকে দাওসকে সাহায্য করতে যু-নুওয়াসের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে নির্দেশ দিলেন। রোমান সম্রাটের পত্র নিয়ে নাজাসীর নিকট উপস্থিত হলো। তিনি তাকে সাহায্য করার জন্যে ৭০,০০০ হাবশী সৈন্য প্রেরণ করলেন এবং আরয়াত নামের এক ব্যক্তিকে সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলেন। সেনাপতি সৈন্যদলের মধ্যে আবরাহা আশরামও ছিল। সেনাপতি আরয়াত তার সেনাবাহিনী নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইয়ামানের সমুদ্রতীরে ঘাঁটি স্থাপন করে। দাওস তার সাথেই ছিল। ওদিক থেকে হিময়ারী লোকজন ও ইয়ামানের অনুগত গোত্রগুলো নিয়ে মুকাবিলা করার জন্যে এগিয়ে আসে অত্যাচারী রাজা যূ-নুওয়াস। উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। অবশেষে যু-নুওয়াস ও তার সৈন্যগণ পরাজিত হয়।

স্বপক্ষীয় সৈন্যদের এ শোচনীয় পরিণতি দেখে যু-নুওয়াস সমুদ্রের দিকে তার ঘোড়া হাঁকায় এবং ঘোড়াকে চাবুকাঘাত করে তীব্র গতিতে এসে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। সমুদ্রের খর স্রোত তাকে তলদেশে ডুবিয়ে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত এভাবে তার মৃত্যু হয়। সেনাপতি আরয়াত বিজয়ীবেশে ইয়ামান প্রবেশ করে এবং রাজত্বের অধিকারী হয়। সমসাময়িককালে সংঘটিত এসব আশ্চর্যজনক ঘটনা সম্পর্কে রচিত আরবদের কতক কবিতা ইবন ইসহাক এ প্রসংগে উল্লেখ করেছেন। এগুলো যেমন বিশুদ্ধ ও অলংকার সমৃদ্ধ, তেমনি শ্রুতিমধুর। আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে এবং পাঠকগণ বিরক্তি বোধ করবেন এ আশংকায় আমরা সেগুলো উল্লেখ থেকে বিরত রইলাম।

৬৩
আরয়াতের বিরুদ্ধে আবরাহা আশরামের বিদ্রোহ
ইবন ইসহাক বলেন, আরয়াত বেশ কয়েক বছর ইয়ামানে একচ্ছত্রভাবে রাজত্ব করে। তারপর তার অধীনস্থ সৈনিক আবরাহা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। হাবশী সৈনিকগণ অতঃপর দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল আবরাহার পেছনে এবং অপর দল আরয়াতের পেছনে সমবেত হয়। উভয় পক্ষ যুদ্ধের জন্যে অগ্রসর হয়। উভয় দল যখন প্রায় মুখোমুখি তখন আবরাহা এই বলে আরয়াতকে চিঠি লিখে যে, হাবশীদের এক দলকে অপর দলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে এবং যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া আপনার জন্যে সমীচীন নয়। বরং এক কাজ করুন। আমরা দু’জনে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। আমাদের মধ্যে যে জয়ী হবে হাবশী সৈন্যরা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে। উত্তরে আরয়াত বলে যে, তুমি সঙ্গত কথাই বলেছ। এরপর আবরাহা যুদ্ধের ময়দানে বেরিয়ে আসে। সে ছিল একজন খাটো হৃষ্টপুষ্ট ও খ্রিষ্ট ধর্মানুসারী ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে বেরিয়ে এল আরয়াত। সে ছিল সুদর্শন, দীর্ঘাঙ্গী ও মোটা মানুষ। তার হাতে ছিল একটি বর্শা। আবরাহার পেছনে আতূদা নামে এক যুবক ছিল সে আবরাহার পেছনে দিক পাহারা দিত। আরয়াত তার বর্শা নিক্ষেপ করে আবরাহার মাথার খুলি লক্ষ্য করে। সেটি গিয়ে পড়ে তার কপালে। কেটে কেটে ক্ষত-বিক্ষত হয় তার ভ্রু, চোখ, নাক ও ঠোঁট। এজন্যেই তার আবরাহা আশরাম তথা ঠোঁট কাটা আবরাহা নাম পড়ে যায়।

আবরাহার পশ্চাত দিক থেকে তার প্রহরী আতূদা আরয়াতের উপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে হত্যা করে। ফলে আরয়াতের অনুগামী সৈন্যরা আবরাহার দলে যোগ দেয়। ইয়ামানে সকল হাবশী সৈন্য আবরাহার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আবরাহা আরয়াতের স্থলাভিষিক্ত হয়। আবিসিনিয়ার রাজা নাজাশীর দরবারে এই সংবাদ পৌঁছে। তিনি আবরাহার উপর ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়। তিনি বলেন, “সে আমার নিযুক্ত সেনাপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং আমার অনুমতি ব্যতীত তাকে হত্যা করেছে। তিনি শপথ করলেন যে, আবরাহার রাজ্য পদানত না করে এবং তার মাথা ন্যাড়া না করে তিনি তাকে ছাড়বেন না। নাজাশীর এই ক্রুদ্ধ মন্তব্য ও শপথের সংবাদ পৌঁছে যায় আবরাহার নিকট। সে নিজে তার মাথা ন্যাড়া করে ফেলে এবং এক থলে ভর্তি ইয়ামানের মাটি নেয়। তারপর তা নাজাশীর নিকট প্রেরণ করে। সাথে এ মর্মে চিঠি লিখে যে, মহারাজ! সেনাপতি আরয়াত আপনার আজ্ঞাবহ ছিল। আমিও আপনার আজ্ঞাবহ। আপনার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। উভয়ের কর্ম তৎপরতা ছিল আপনার প্রতি আনুগত্য নির্ভর। তবে এখানকার হাবশীদের নেতৃত্বের জন্যে আমি তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী উপযুক্ত ও দক্ষ।

মহারাজের শপথের কথা শুনে আমি নিজে আমার মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছি এবং আমার রাজ্যের এক থলে মাটি রাজদরবারে প্রেরণ করেছি, যাতে তা আপনার পদতলে রাখতে পারেন। তাহলে আমার সম্বন্ধে মহারাজ যে শপথ করেছেন সে শপথ পূর্ণ হবে।

পত্রটি পেয়ে নাজ্জাশী আবরাহার প্রতি সন্তুষ্ট হন। তিনি তার নিকট লিখে পাঠান যে, আমার পরবর্তী নির্দেশ আসা পর্যন্ত তুমি ইয়ামান রাজ্যে রাজত্ব করে যাও। এভাবে আরবাহা ইয়ামানের শাসন ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হয়।

৬৪
কাবা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে মক্কায় আবরাহার হাতি বাহিনী প্রেরণ
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ أَلَمۡ تَرَ كَیۡفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصۡحَـٰبِ ٱلۡفِیلِ ۝ أَلَمۡ یَجۡعَلۡ كَیۡدَهُمۡ فِی تَضۡلِیل ۝ وَأَرۡسَلَ عَلَیۡهِمۡ طَیۡرًا أَبَابِیلَ ۝ تَرۡمِیهِم بِحِجَارَة مِّن سِجِّیل ۝ فَجَعَلَهُمۡ كَعَصۡف مَّأۡكُولِۭ )

[Surah Al-Fil 1 - 5]

“তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক হাতিওয়ালাদের প্রতি কী করেছিলেন? তিনি কি ওদের কৌশল ব্যর্থ করে দেননি? ওদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন। সেগুলো ওদের উপর পাথুরে কংকর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি ওদেরকে ভক্ষিত খড়ের মত করেন।”

কথিত আছে যে, যাহহাকের হত্যাকারী আফরীদূন ইবন আছফিয়ান সর্বপ্রথম হাতিকে পোষ মানিয়েছিলেন। তাবারী (র) এরূপ বলেছেন। ঘোড়ার পিঠে জীনও তিনিই প্রবর্তন করেন। অবশ্য সর্বপ্রথম সে ব্যক্তি ঘোড়াকে পোষ মানায় এবং ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয় সে হল ফাতহা মূরছ। তিনি গোটা পৃথিবীতে রাজত্বকারী তৃতীয় সম্রাট। কারো কারো মতে, যে সর্বপ্রথম ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করেন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ)। এর ব্যাখ্যা এমনও হতে পারে যে, আরবদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঘোড়ার পিঠে আরোহণকারী ছিলেন। হযরত ইসমাঈল (আ)। আল্লাহই ভাল জানেন।

কথিত আছে যে, হাতি বিশাল দেহী জন্তু হওয়া সত্ত্বেও বিড়াল দেখে ভড়কে যায়। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে কতক সেনাপতি যুদ্ধের ময়দানে বিড়াল উপস্থিত করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের সময় বিড়াল দেয়া হলে সেগুলোর ভয়ে হাতি বাহিনী ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়।

ইবন ইসহাক (র) বলেন, অতঃপর আবরাহা সানআ নগরীতে কুলায়স নামে একটি গীর্জা নির্মাণ করে। ঐ যুগে এমন উন্নতমানের প্রাসাদ দ্বিতীয়টি ছিল না। সে নাজ্জাশীর নিকট এ মর্মে পত্র লিখে যে, আপনার জন্যে আমি একটি গীর্জা নির্মাণ করেছি। আপনার পূর্বে কোন রাজার জন্যে এমন প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। আরবদের হজ্জ এখানে স্থানান্তরিত না করা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না।

সুহায়লী বলেন, এই ঘৃণ্য উপাসনালয় নির্মাণ করতে গিয়ে আবরাহা ইয়ামানের অধিবাসীদেরকে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করেছে। কেউ সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে কাজ শুরু না করলে সে তার হাত কেটে ফেলত। বিলকীসের শাহী প্রাসাদ থেকে শ্বেত পাথর, মর্মর ও অন্যান্য অমূল্য রত্নাবলী খুলে এনে ঐ গীর্জায় সংযোজন করে। তার মিম্বার ছিল গজদণ্ড ও আবলুস কাঠে তৈরী। এর ছাদ ছিল অনেক উঁচু আয়তন, বিশাল বিস্তৃত।

আবরাহা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর হাবশীগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরপর কোন ব্যক্তি ঐ গীর্জার আসবাব পত্র কিংবা ঘর দরজা খুলে নিতে চাইলে সে জিনদের আক্রমণের শিকার হত। কারণ ঐ গীর্জা নির্মিত হয়েছিল দু’টো প্রতিমার নামে। প্রতিমা দুটি ছিল আয়ব ও তার স্ত্রীর। এ দুটো প্রতিমার প্রত্যেকটির উচ্চতা ছিল ৬০ গজ করে। অতঃপর ইয়ামানবাসিগণ গীর্জাটিকে ঐ অবস্থায় রেখে দেয়। প্রথম আব্বাসী খলীফা সাফফাহর- এর সময় পর্যন্ত সেটি ঐ অবস্থায়ই ছিল। সাফফাহ একদল সাহসী, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী গুণী লোক পাঠালেন। তারা একে একে সকল পাথর খুলে নিয়ে সেটি ভেঙ্গে ফেলেন। অতঃপর তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

ইবন ইসহাক (র) বলেন, নাজাশীর প্রতি প্রেরিত আবরাহার পুত্র সম্পর্কে আরবদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। কিনানা গোত্রের জনৈক লোক একথা শুনে ভীষণভাবে ক্ষেপে যায়। যারা যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাসগুলোকে যুদ্ধ সিদ্ধ মাসের দিকে ঠেলে দিতে এসেছিল, সে ঐ দলভুক্ত।

( إِنَّمَا ٱلنَّسِیۤءُ زِیَادَة فِی ٱلۡكُفۡرِ )

[Surah At-Tawbah 37]

এই যে, মাসকে পিছিয়ে দেয়া কেবল কুফরীই বৃদ্ধি করে। (৯ তওবাঃ ৩৭) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। ইবন ইসহাক (র) বলেন, অতঃপর কিনান বংশীয় লোকটি পথে বের হয়। সে এসে পৌঁছে উপরোক্ত কুলায়স গীর্জায়। যে সকলের আগোচরে গীর্জার ভেতরে মলত্যাগ করে। এরপর বের হয়ে সে নিজ দেশে ফিরে আসে। এ সংবাদ আবরাহার কানে পৌঁছে। কে এই অঘটন ঘটিয়েছে সে জানতে চায়। তাকে জানানো হয় যে, মক্কায় অবস্থিত কা’বা গৃহের যারা হজ্জ করে তাদের একজন এ কর্মটি করেছে। আপনি আরবদের হজ্জকে ঐ ঘর থেকে ফিরিয়ে এ ঘরের দিকে আনবেন শুনে সে রেগে এমনটি করেছে। সে বুঝতে পেরেছে যে, এ ঘরটি হজ্জ করার উপযুক্ত নয়। এ কথা শুনে আবরাহা ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে শপথ করে, মক্কা গিয়ে কা’বা গৃহ ধ্বংস করবেই। সে হাবশীদেরকে মক্কা গমনে প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়। হাতি বাহিনীসহ সে সদল বলে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করে। আরবগণ তার অগ্রাভিযান সম্পর্কে অবগত হয়। তারা এটিকে ভয়ানক বিপদ মনে করে এবং তাতে বিচলিত হয়ে পড়ে। আল্লাহর সম্মানিত ঘর কা’বা শরীফ ধ্বংসের কথা শুনে তারা আবরাহার বিরুদ্ধে জিহাদ করা অনিবার্য জ্ঞান করে।

ইতিমধ্যে ইয়ামানবাসী রাজবংশীয় ও সম্ভ্রান্ত একলোক মক্কায় আগমন করে। তার নাম ছিল যুনফর। সে তার সম্প্রদায় ও আরবদেরকে আবরাহার বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ গ্রহণের আহবান জানায়। কারণ সে আল্লাহর ঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। যারা সাড়া দেবার তারা তার তাকে সাড়া দেয়। তারা আবরাহায় সম্মুখে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে এবং যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যূ-নফর ও তার সাথীগণ পরাজিত হয়। বন্দী অবস্থায় যু-নফরকে নেয়া হয় আবরাহার নিকট। আবরাহা যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় তখন সে বলে, “মহারাজ! আমাকে হত্যা করবেন না। আমাকে হত্যা করার চেয়ে আমাকে জীবিত রাখা হযরত আপনার জন্যে অধিক কল্যাণকর হবে। ফলে সে হত্যা থেকে রেহাই পায় এবং কারারুদ্ধ থাকে। আবরাহা ছিল অত্যন্ত ধৈর্যশীল লোক। অতঃপর সে তার উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সম্মুখে অগ্রসর হয়। খাছ‘আম এলাকায় পৌঁছে সে বাধাপ্রাপ্ত হয়। শাহরান ও নাহিস গোত্রদ্বয় এবং অনুগামী আরবদেরকে নিয়ে তার নুফারল ইবন হাবীব খাছ‘আমী তার গতিরোধ করে। সেখানে যুদ্ধ হয়। আবরাহা তাকে পরাজিত করে। বন্দী অবস্থায় তাকে আবরাহার নিকট নিয়ে আসা হয়। আবরাহা যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় তখন সে বলে, “মহারাজ! আমাকে হত্যা করবেন না। আমি আপনাকে আরবের পথগুলো চিনিয়ে দিব। আপনার প্রতি আমার খাছ‘আমী শাহরান ও নাহিস গোত্রদ্বয়-এর আনুগত্যের প্রতীকরূপে এই আমি আমার দু’হাত আপনার সমীপে নিবেদন করছি। রাজা তাকে মুক্তি দেয় এবং সে রাজাকে আরবের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। তায়েফ পৌঁছলে ছাকীফ গোত্রের একদল লোক নিয়ে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়, মাসউদ ইবন মুতাব (ইবন মালিক কবি ইবন আমর ইবন সাদ ইবন আওফ ইবন ছাকীফ) তারা বলে, ‘মহারাজ! আমরা আপনার গোলাম। আপনার নির্দেশ পালনকারী ও আনুগত্য প্রদর্শনকারী আমরা আপনার বিরোধিতা করব না।

আপনি যে উপাসনালয় ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন সেটি আমাদের উপাসনালয় নয়। অর্থাৎ সেটি লাত দেবীর উপাসনালয় নয়। আপনি যাচ্ছেন মক্কায় অবস্থিত উপাসনালয় ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। আপনাকে ঐ উপাসনালয়ের পথ দেখাবার লোক আমরা আপনার সাথে দিচ্ছি। অতঃপর সে তাদেরকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। ইবন ইসহাক বলেন, লাত হল তায়েফে অবস্থিত তাদের একটি উপাসনালয়। তারা সেটিকে কাবাকে সম্মান করার ন্যায়ই সম্মান করত। ইব্‌ন ইসহাক বলেন, অতঃপর তারা কা’বার পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্যে আবু রেগালকে তার সাথে প্রেরণ করে। আবু রেগালসহ আবরাহা বাহিনী সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়ে মাগমাস নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করে। সেখানে আবু রেগালের মৃত্যু হয়।

আরবগণ আবু রেগালের কবরে পাথর ছুঁড়ে। মাগমাসে যে কবরে পাথর নিক্ষেপ করা হয় সেটি এই আবু রেগালের কবর। ইতিপূর্বে ছামুদ সম্প্রদায়ের আলোচনায় এসেছে যে, আবু রেগাল তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। সে হারাম শরীফে আশ্রয় গ্রহণ করে, নিজেকে রক্ষা করত। একদিন সে হারাম শরীফ এলাকা ছেড়ে বের হয়। তখনই একটি পাথর তাকে আঘাত করে এবং তাতে তার মৃত্যু হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে বলেছেন, “তার নিদর্শন হল তার সাথে স্বর্ণের দু’টো কাঠি- দাফন করা হয়েছে।” সাহাবীগণ ঐ কবর খনন করেন এবং সেখানে স্বর্ণের দুটো কাঠি পান। তিনি বলেন, আবু রেগাল ছাকীফ গোত্রের আদি পুরুষ।

আমি বলি, এই বর্ণনা ও ইবন ইসহাকের বর্ণনার মধ্যে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, আবরাহার সাথী আবু রেগাল ছামুদ সম্প্রদায়ের আবু রেগালের অধঃস্তন পুরুষ। আলোচ্য আবু রেগাল ও তার পূর্বপুরুষ আবু রেগালের নাম অভিন্ন। উভয় আবু রেগালের কবরেই লোজন পাথর ছুঁড়ে মারতো। আল্লাহই ভাল জানেন।

কবি জায়ীর বলেনঃ

اذا مات الفرزدق فارجموه کرجمكم لقبر ابي رغال

—ফরযদকের মৃত্যু পরে তার কবরে পাথর ছুঁড়ে মারবে।

যেমনটি পাথর মেরেছিল আবু রেগালের কবরে।

ইবন ইসহাক বলেন, আবরাহা মাগমাসে এসে আসওয়াদ ইবন মাকসুদ নামের জনৈক হাবশী লোককে একদল অশ্বারোহীসহ মক্কায় প্রেরণ করে। তারা মক্কায় আসে এবং কুরায়শদের তেহামা অঞ্চলে লুটপাট চালায়। তারা সেখানকার কুরায়শ ও অন্যান্য গোত্রের সমস্ত ধন সম্পদ নিয়ে আবরাহার নিকট পেশ করে। লুণ্ঠিত মালামালের মধ্যে আব্দুল মুত্তালিব ইবন হাশিমের ২০০ উট ছিল। তিনি ছিলেন কুরায়শদের দলপতি। এতে কুরায়শ, কিনানা হুযায়ল এবং হারাম শরীফে অবস্থানকারী অন্যান্য গোত্রের লোকজন আবরাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায় সংকল্প করে। পরে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভে সক্ষম হবে না বুঝতে পেরে তারা এ পরিকল্পনা ত্যাগ করে।

এদিকে আবরাহা হিনাতা হিমায়ারী নামের এক লোককে মক্কায় প্রেরণ করে। সে তাকে বলে যে, ‘তুমি মক্কায় গিয়ে উক্ত নগরীর নগরপতিকে খুঁজে বের করবে এবং তাকে বলবে যে, আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এসেছি ঐ উপাসনালয়টি ধ্বংস করার জন্যে। ঐ উপাসনালয় রক্ষাকল্পে আপনারা যদি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করেন, তবে আপনাদের রক্তপাত আমাদের প্রয়োজন নেই। তাদের সর্দার আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করতে সম্মত হলে তাকে আমার নিকট নিয়ে আসবে।’ হিনাতা মক্কায় এসে সেখানকার নগরপতিকে তা জিজ্ঞেস করে। তাকে জানানো হয় যে, আব্দুল মুত্তালিব এ নগরপতি। সে আব্দুল মুত্তালিবের সাথে সাক্ষাত করে এবং আবরাহা যা বলতে নির্দেশ দিয়েছিল তা বলে। তখন আব্দুল মুত্তালিব বলেন, ‘আল্লাহর কসম আমরা আবরাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই না। আমাদের সেই শক্তি নেই। এটি আল্লাহর সম্মানিত গৃহ এবং আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আ)-এর গৃহ।’ আব্দুল মুত্তালিব এটা বা এ মর্মের কোন কথা তিনি বলেছিলেন। আরও বলেন, ‘আল্লাহ যদি আবরাহার হাত থেকে এ গৃহকে রক্ষা করেন, তবে তা তারই সম্মানিত স্থান ও গৃহ আর তিনি যদি আবরাহাকে তা করতে দেন, তবে আল্লাহর কসম, তাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।’

হিনাতা বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি আমার সাথে তাঁর নিকট চলুন। তিনি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’ হিনাতার সাথে আব্দুল মুত্তালিব রওয়ানা হলেন। তার কয়েকজন ছেলেও তার সাথে যায়। তিনি আবরাহার সৈন্যবাহিনীর নিকট এসে ওদের কাছে যুনফর আছে কি-না জানতে চান। যুনফর ছিল আবদুল মুত্তালিবের বন্ধু। অনুমতি নিয়ে আবদুল মুত্তালিব গিয়ে যুনফরের বন্দীখানায় পৌঁছেন। তিনি বললেন, ‘যুনফর! আমাদের উপর যে বিপদ এসেছে, তা থেকে মুক্তি লাভের কোন পথ তোমার জানা আছে কি?’ সে বলল, ‘রাজার হাতে বন্দী সকাল-সন্ধ্যায় মৃত্যুর প্রতীক্ষারত একজন মানুষের কী-ই বা করার থাকতে পারে?

আপনাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার কোন ক্ষমতা আমার নেই। তবে আনিস নামে জনৈক ব্যক্তি আছে, সে হস্তি বাহিনীর পরিচালক এবং আমার বন্ধুও বটে। আমি তার নিকট সংবাদ পাঠাব এবং আপনাকে সাহায্য করার অনুরোধ জানাব। তার নিকট আপনার গুরুত্ব তুলে ধরব। আমি তাকে অনুরোধ করব, সে যেন আপনাকে রাজার নিকট নিয়ে যায়। অতঃপর আপনি সরাসরি রাজার সাথে কথা বলবেন। সক্ষম হলে সে রাজার নিকট আপনার জন্যে সুপারিশ করবে।‘ এটা শুনে আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘এতটুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট।‘ যুনফর আনীসের নিকট এ বার্তা নিয়ে লোক পাঠায় যে, আবদুল মুত্তালিব কুরায়শ বংশের নেতা এবং মক্কার যমযম কূপের তত্ত্বাবধানকারী। তিনি সমতলের লোকজন এবং পাহাড়ের পশুদেরকে আহার্য দিয়ে থাকেন। রাজা তার ২০০টি উট ছিনিয়ে এনেছেন। রাজার সাথে দেখা করার জন্যে তুমি তাঁকে অনুমতি নিয়ে দাও এবং যথাসম্ভব তার উপকার করো।’ আনীস বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তা-ই করব।’

আনীস তখন আবরাহার সাথে আলাপ করে। সে বলে, ‘মহারাজ! এই কুরায়শ প্রধান আপনার দ্বারে উপস্থিত। আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি চাচ্ছেন। তিনি মক্কার যমযম কূপের তত্ত্বাবধায়ক। তিনি সমতলে লোকজনের এবং পাহাড়ে পশুদের আহার্যের ব্যবস্থা করে থাকেন। তাকে আপনার নিকট আসার অনুমতি দিন। যাতে তিনি তাঁর সমস্যার কথা আপনাকে জানাতে পারেন।’ আবরাহা অনুমতি দিল। আবদুল মুত্তালিব ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন ও সুপুরুষ।

আবরাহা তাঁকে দেখে তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে আঁচ করতে পারলো এবং তাঁকে মেঝেতে বসতে দিতে কুণ্ঠাবোধ করল। অন্যদিকে আবদুল মুত্তালিবকে রাজ সিংহাসনে বসিয়েছে হাবশীগণ এটা দেখুক তাও তার মনপূত ছিল না। ফলে আবরাহা তার সিংহাসন থেকে নেমে বিছানায় বসে এবং আবদুল মুত্তালিবকে পাশে বসায়। তারপর তার দোভাষীকে বলে, ‘তার সমস্যার কথা পেশ করতে বল।’ দোভাষী আবদুল মুত্তালিবকে তাঁর কথা পেশ করতে বললে তিনি বলেন, ‘আমার যে দু’শটি উট রাজার নিকট নিয়ে আসা হয়েছে সেগুলো ফেরত দেয়া হোক।’

আবরাহা তার দোভাষীকে বলল, ‘আমার এ বক্তব্য তাকে বল যে, আপনাকে দেখে আমি খুব খুশী হয়েছিলাম কিন্তু আপনার কথা শুনে আমি হতাশ হয়েছি। হায়! আপনি আমার হাতে আসা এই সামান্য দু’শোটি উটের কথা বলছেন অথচ আপনার নিজের ধর্মের প্রতীক এবং আপনার পূর্ব-পুরুষের ধর্মের প্রতীক উপাসনালয়টি সম্পর্কে কিছুই বললেন না। আমরা তো সেটি ধ্বংস করতে এসেছি। সেটি সম্পর্কে আপনি কি আমাকে কিছুই বলবেন না?’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আমি তো কেবল উটেরই মালিক! ঐ গৃহের একজন মালিক আছেন। তিনিই সেটি রক্ষা করবেন।’ আবরাহা বলে, “তিনি তো আমার হাত থেকে সেটি রক্ষা করতে পারবেন না।” আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘সেটি আপনার ও তার ব্যাপার।’ তখন আবরাহা আবদুল মুত্তালিবের উটগুলো ফেরত দিয়ে দেয়।

ইবন ইসহাক বলেন, বর্ণিত আছে যে, আবদুল মুত্তালিবের সাথে বনী বকর গোত্রের প্রধান ইয়ামার ইবন নাকাহু (ইবন আদী ইবন দায়ল ইবন বকর ইব্‌ন আবদ মানাত ইবন কিনানাহ) এবং হুযায়ল গোত্রের প্রধান কুওয়ালিদ ইবন ওয়াছিলা আবরাহার নিকট গিয়েছিলেন। তাঁরা প্রস্তাব করেছিলেন যে, আবরাহা যদি তাদের এখান থেকে চলে যায় এবং আল্লাহর ঘর ধ্বংস না করে তবে তারা তাকে তিহামাহ্ অঞ্চলের সমগ্ৰ ধন সম্পদের এক তৃতীয়াংশ দিয়ে দিবেন। আবরাহা তাঁদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মূলত তা কতটুকু সত্য তা আল্লাহই ভাল জানেন।

আবরাহার দরবার থেকে তাদের প্রত্যাবর্তনের পর আবদুল মুত্তালিব কুরায়শদের নিকট উপস্থিত হন এবং সকল বিষয় তাদেরকে অবহিত করেন। তিনি তাদেরকে মক্কা ছেড়ে পাহাড়ের উপর নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব নিজে কুরায়শদের একটি জামাতকে সাথে নিয়ে কাবা শরীফের দরজার কড়া ধরে দাঁড়ান এবং আল্লাহর নিকট দোয়া করতে থাকেন। তারা আবরাহা ও তার সৈন্যদের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন।

কাবা শরীফের দরজা ধরে আবদুল মুত্তালিব বলেনঃ

لأهم أن العبد يمنع رحله فانع رحالك

“হে আল্লাহ! বান্দা তার নিজের ঘরের হেফাজত করে সুতরাং আপনি আপনার ঘর রক্ষা করুন।’

لا يغلبن صليبهم - ومحالهم غدوا محالك

—আগামী সকালে যেন তাদের ক্রুশ চিহ্ন কোনক্রমেই বিজয়ী না হয়। আর আপনার গৃহের উপর তাদের গৃহ প্রাধান্য না পায়।

ان گنت تاركهم وقبل - تنا فأمر ما بدالك

—আর আপনি যদি আমাদের কেবলাকে তাদের হাতে ছেড়েই দেন তবে আপনার যা ইচ্ছা তাই করুন।” ইবন হিশাম বলেন, আবদুল মুত্তালিব এ কবিতাগুলো বলেছিলেন বলে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, এরপর আবদুল মুত্তালিব কা’বা শরীফের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে কুরায়শদেরকে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং আবরাহা ও তার সৈন্যরা কী করে, তা অবলোকন করতে থাকেন।

পরদিন সকালে আবরাহা মক্কা প্রবেশের প্রস্তুতি নেয়। তার হাতি বাহিনীকে সজ্জিত করে এবং সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করে। তার হাতির নাম ছিল মাহমুদ। হাতিটিকে মক্কা অভিমুখী করলে মুহূর্তে নুফায়ল ইবন হাবীব সেখানে উপস্থিত হয়। সে হাতিটির পাশে এসে দাঁড়ায়। হাতির কান ধরে সে বলে, ‘হে মাহমূদ! তুমি মাটিতে বসে যাও এবং যেদিক থেকে এসেছে সোজা সে দিকে ফিরে যাও। কারণ, তুমি আল্লাহর সম্মানিত শহরে এসেছো।’ এই বলে সে হাতিটির কান ছেড়ে দেয়। হাতিটি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। সুহায়লী বলেন, হাতি মাটিতে পড়ে যায়। কারণ, হাতি হাঁটু গেড়ে বসতে পারে না। অবশ্য, কেউ কেউ বলেন যে, এক প্রজাতির হাতি উটের ন্যায় হাঁটু গেড়ে বসতে পারে।

এ পরিস্থিতিতে নুফায়ল ইবন হাবীব দৌঁড়ে গিয়ে পাহাড়ে ওঠে। আবরাহার সৈন্যরা হাতিটিকে দাঁড় করানো জন্যে প্রহার করতে থাকে। হাতি কোন মতেই উঠলো না, তারা তার মাথায় কুঠারাঘাত করে। তবুও সে উঠলো না। এরপর তারা তার চামড়ায় বাঁকা আঁকশি ঢুকিয়ে দেয় এবং চামড়া ছিড়ে ফেলে তারপরও সে উঠলো না। তারা এবার ইয়ামানের দিকে তার মুখ ফিরিয়ে দেয়। কালবিলম্ব না করে হাতিটি দাঁড়িয়ে যায় এবং দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। এরপর তারা তাকে সিরিয়ার দিকে মুখ করে দেয়। সে ঐ দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকে। এরপর তারা তাকে পূর্বমূখী করে দেয়। সে একইভাবে দ্রুত সেদিকে হাঁটতে থাকে। এবার তারা পুনরায় তাকে মক্কা অভিমুখী করে দেয়। সে পুনরায় মাটিতে বসে পড়ে। আল্লাহ তাআলা সমুদ্ৰাঞ্চল থেকে তাদের প্রতি এক ঝাঁক পাখী প্রেরণ করেন। এগুলো ছিল এক প্রকার ছোট পাখী। প্রতিটি পাখী তিনটি করে কঙ্কর নিয়ে এসেছিল। একটি ঠোঁটে আর দু’টো দু পায়ে। কঙ্করগুলো ছিল ছোলা ও মশুর ডালের ন্যায়। যার উপর কঙ্কর পড়লো সে-ই ধ্বংস হয়ে গেল।

অবশ্য আবরাহার সকল সৈন্যের গায়ে কঙ্কর লাগেনি। যাদের গায়ে তা পড়েনি তারা পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। যে পথে এসেছিল তারা সে পথেই ফিরে যেতে থাকে। ইয়ামানের পথ চিনিয়ে দেয়ার জন্যে তারা নুফায়ল ইবন হাবীবকে তালাশ করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে নুফায়ল বলেনঃ

ألا حييت عنا یاردينا - نعمناكم مع الاصباح عيا

—তুমি কি আমাদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন পাওনি হে রুদায়না? আমরাতো তোমাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছি।

ردينة لو رأيت فلا تريه - لدى جنب المحصب ما رأينا

—হে রাদীনা! মুহাসসাব অঞ্চলে আমরা যা দেখেছি তুমি যদি তা দেখতে তবে তুমি সে দিকে ফিরে তাকাতে না।

اذا لعذراتني وحمدت امری - ولم تاسي على ما فات بينا

—তখন তুমি আমার ওযর গ্রহণ করতে এবং আমার কাজের প্রশংসা করতে। যা হারিয়ে গেছে তার জন্যে তুমি আক্ষেপ করতে না।

حمدت الله اذا أبصرت طيرا - وخفت حجارة تلقى علينا

—যখন আমি পক্ষীকুল দেখেছি তখন আমি আল্লাহর প্রশংসা করেছি। আবার আমাদের উপর পাথর বর্ষিত হয় নাকি তার ভয়ও করেছি।

وكل القوم يسأل عن نفيل - كان على الحبشان دینا

—সবাই নুফায়লকে খোঁজ করছে যেন আমার নিকট সকল হাবশী লোকের পাওনা রয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, অতঃপর আবরাহার সৈন্যরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে লাগল। পক্ষীকুলের নিক্ষিপ্ত কঙ্কর আবরাহার দেহেও বিদ্ধ হয়। তারা নিজেদের সাথে আবরাহাকেও টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু কঙ্কর বিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তার দেহ থেকে ক্রমে ক্রমে এক আঙ্গুল এক আঙ্গুল করে খসে পড়তে শুরু করে। একটি আঙ্গুলের পর আরেকটি আঙ্গুল ঝরে পড়ছিল। এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। এভাবে তার রক্ত ও পুঁজ নিঃশেষিত হয়ে যায়। তারা তাকে সানা’আতে নিয়ে আসে। তখন সে যেন একটি পাখির ছানা।

কথিত আছে যে, তার মৃত্যুর সময় তার বুক ফেটে হৃৎপিণ্ড বের হয়ে পড়ে। ইবন ইসহাক বলেন, ইয়াকুব ইবন উতবা আমাকে বলেছেন যে, জনশ্রুতি ছিল যে, আরব দেশে সর্বপ্রথম হাম এবং বসন্তরোগ দেখা যায় সেই বছরই। সেখানে তিক্ত বৃক্ষ হারমাল, হানযাল ও আশার দেখা যায় সেই একই বছরে।

ইবন ইসহাক বলেন, হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রাসূলরূপে প্রেরণ করার পর আল্লাহ তা’আলা কুরায়শদের প্রতি তার যে সকল নেয়ামত ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলোর অন্যতম হল তাদের অবস্থান ও অস্তিত্বের লক্ষ্যে তাদের থেকে হাবশীদের আক্রমণ প্রতিহত করা।

এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ أَلَمۡ تَرَ كَیۡفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصۡحَـٰبِ ٱلۡفِیلِ ۝ أَلَمۡ یَجۡعَلۡ كَیۡدَهُمۡ فِی تَضۡلِیل ۝ وَأَرۡسَلَ عَلَیۡهِمۡ طَیۡرًا أَبَابِیلَ ۝ تَرۡمِیهِم بِحِجَارَة مِّن سِجِّیل ۝ فَجَعَلَهُمۡ كَعَصۡف مَّأۡكُولِۭ )

[Surah Al-Fil 1 - 5]

—তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক হাতিওয়ালাদের প্রতি কী করেছিলেন? তিনি কি ওদের কৌশল ব্যর্থ করে দেননি? ওদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী প্রেরণ করেন। সেগুলো ওদের উপর পাথুরে কঙ্কর নিক্ষেপ করে। তারপর তিনি ওদেরকে ভক্ষিত খড়ের মত করেন। (১০৫ ফীলঃ ১-৫)।

ইবন ইসহাক ও ইবন হিশাম অতঃপর এই সূরা ও তৎপরবর্তী সূরাগুলোর তাফসীর শুরু করেন। আমার তাফসীর গ্রন্থে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্যে তাই যথেষ্ট হবে। সকল প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার।

ইবন হিশাম বলেন, ( ابابيل ) শব্দের অর্থ ঋক বা দল। আমার জানা মতে আরবরা এ শব্দের একবচন ব্যবহার করে না। তিনি বলেন ( سجيل ) শব্দ সম্পর্কে ব্যাকরণবিদ ইউনুস ও আবু উবায়দা বলেছেন যে, এটি দ্বারা আরবগণ সুকঠিন অর্থ বুঝায়। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন যে, ( سجيل ) শব্দটি মূলত দুটো ফারসী শব্দের সমষ্টি। আরবরা এটিকে এক শব্দরূপে ব্যবহার করে। ফারসী শব্দ দুটো হল ( سنك ) এবং ( سكل ) অর্থ পাথর ( كل ) অর্থ কাদা। তারা বলেন যে, পাথর ও কাদার তৈরী কঙ্কর-ই ওদের প্রতি নিক্ষেপ করা হয়েছিল।

ইবন হিশাম আরও বলেন যে, ( عصف ) অর্থ উদ্ভিদ ও তৃণলতার পাতা।

কুসাই বলেন জনৈক ব্যাকরণবিদকে আমি বলতে শুনেছি যে, ( اباببال ) এর একবচন ( ابيل ) প্রাচীনকালের অনেক ভাষাবিদ বলেন, আবাবীল হলো পাখি শাবকের ঝাঁক, যেগুলো এখানে সেখানে একদল অন্য দলের পেছন পেছন ছুটে।

হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আবরাহা বাহিনীর উপর কঙ্কর নিক্ষেপকারী পাখীগুলোর চঞ্চু ছিল সাধারণ পাখির মত। পাগুলো ছিল কুকুরের থাবার মত। ইকরামা (রা) বলেন, সে গুলোর মাথা ছিল হিংস্র প্রাণীর মাথার মত। এগুলো সমুদ্র থেকে উড়ে এসেছিল এবং এগুলোর রঙ ছিল সবুজ। উবায়দ ইবন উমায়র বলেন, সেগুলো ছিল সামুদ্রিক কাল পাখি। সেগুলোর চঞ্চু ও পায়ে করে কঙ্কর নিয়ে এসেছিল।

হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, পাখিগুলোর আকৃতি ছিল কল্পনার আনকা পাখির মত। তিনি আরও বলেন যে, তাদের আনীত কঙ্করগুলোর ক্ষুদ্রতম কঙ্কর ছিল মানুষের মাথার সমান। কতক ছিল উটের সমান। ইবন ইসহাক থেকে ইউনুস ইবন বুকায়র এরূপ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, ঐ কক্করগুলো ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির। আল্লাহই ভাল জানেন বিবরণগুলোর কোনটি যথার্থ।

ইবন আবী হাতিম উবায়দ ইবন উমায়র সূত্রে বলেন, হাতি বাহিনীকে যখন আল্লাহ তাআলা ধ্বংস করার ইচ্ছা করলেন তখন ওগুলোর প্রতি পাখির ঝাঁক প্রেরণ করলে সেগুলো এসেছিল সমুদ্র থেকে। আকৃতি ছিল বাজ পাখির মত। প্রতিটি পাখি তিনটি করে কঙ্কর নিয়ে এসেছিল। দু’টো দু’পায়ে একটি চঞ্চুতে। সেগুলো এসে আবরাহা বাহিনীর মাথার উপর সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নেয়। তারপর বিকট আওয়াজ করে এবং পায়ের ও চঞ্চুর কঙ্করগুলো নিক্ষেপ করে। যারই মাথায় কঙ্কর পড়েছে তা তার মলদ্বার ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। যার দেহের একদিকে পড়েছে তার অন্য দিক দিয়ে তা বেরিয়ে গিয়েছে। আল্লাহ তাআলা তখন প্রচণ্ড বায়ু প্রেরণ করেছিলেন। সেটি কঙ্করগুলোকে আঘাত করে। এতে কঙ্করগুলো আরও প্রচণ্ডভাবে তাদের উপর নিক্ষিপ্ত হয়। ফলে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যায়।

ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ইবন ইসহাক বলেছেন, আবরাহা বাহিনীর সকলের গায়ে পাথর লাগেনি। বরং তাদের কতক লোক ইয়ামেনে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। তারা সেখানে গিয়ে তাদের সাথীদের ধ্বংস ও বিপদের কথা ওখানকার লোকদেরকে জানায়। কতক ঐতিহাসিক বলেন যে, আবরাহাও ফিরে এসেছিল। তবে তার দেহ থেকে এক আঙ্গুল এক আঙ্গুল করে ঝরে পড়ছিল। ইয়ামানে পৌঁছার পর তার বুক ফেটে যায় এবং তার মৃত্যু হয়। তার প্রতি আল্লাহর লানত।

ইবন ইসহাক হযরত আয়েশা (রা) সূত্রে বলেনঃ

لقد رءیت قائدا الفيل وسانسه بمكة أعميين مقعدين يستطعمان

“দু’জনকেই আমি মক্কায় দেখেছি। দু’জনই তখন অন্ধ এবং চলৎশক্তিহীন। মানুষের নিকট খাবার ভিক্ষা করছে। উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, হাতিব সহিসের নাম আনীস। বাহিনীর পরিচালকের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আল্লাহই ভাল জানেন।

তাফসীরকার নাককাশ তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্লাবন এসে তাদের মৃত দেহগুলো ভাসিয়ে নিয়ে সাগরে নিক্ষেপ করে। সুহায়লী বলেন, হাতি বাহিনীর এ ঘটনা ঘটেছিল যুল-কারনাইবন বাদশাহের যুগ থেকে ৮৮৬ বছর পর, মুহাররম মাসের পয়লা তারিখে

আমি বলি, ঐ বছরই রাসূল্লাহ (সা)-এর জন্ম হয়। এটিই প্রসিদ্ধ অভিমত। কেউ কেউ বলেন যে, এটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের কয়েক বছর পূর্বের ঘটনা। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ।

এই ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা উপলক্ষে আরবদের রচিত কবিতাগুলো ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনায় আল্লাহ তা’আলা তার সেই সম্মানিত গৃহকে রক্ষা করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণের মাধ্যমে। তিনি যে গৃহকে মর্যাদাময় ও পবিত্র করতে ইচ্ছে করেছিলেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জন্যে প্রথম এক সুদৃঢ় দীন ও ধর্ম নির্ধারণ করেছেন যার অন্যতম রুকন হল সালাত। বরং এই ধর্মের মূল স্তম্ভই হচ্ছে সালাত। এই ধর্মের কিবলা হিসেবে তিনি কা’বা শরীককে নির্ধারণ করার ব্যবস্থা করেছেন। হাতি বাহিনীকে ধ্বংস করার পেছনে মূলত কুরায়শদের সাহায্য অভীষ্ট ছিল না। কারণ, ধ্বংস ও আযাব আপতিত হয়েছিল খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী হাবশীদের উপর। কুরায়শীয় মুশরিকদের তুলনায় হাবশীগণ তার অধিকতর হকদার ছিল। এই সাহায্য ছিল সম্মানিত গৃহের সাহায্যার্থে এবং হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে, এ প্রসংগে আবদুল্লাহ ইবন যাব’আরী সাহসী বলেনঃ

تنگلوا عن بطن مكة اها - كانت قديما لا يرام حريمها

—তারা ফিরে গিয়েছে মক্কা ভূমি থেকে শাস্তি পেয়ে শঙ্কিত মনে। প্রাচীনকাল থেকেই এর অধিবাসীদেরকে লাঞ্ছিত করার কথা কেউ ভাবতে পারতো না।

لم تخلق الشعري ليالي حرمت - اذ لا عزيز من الأنام يومها

—যে সময়ে উক্ত এলাকাকে হারাম শরীফ তথা সম্মানিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে সে সময়ে শিরা নক্ষত্র সৃষ্টি করা হয়নি। কোন প্রতাপশালী ব্যক্তিই উক্ত স্থানের মর্যাদা বিনষ্টের অপপ্রয়াস চালাতে পারে না। কারণ কোন প্রতাপশালী ব্যক্তিই এটির মানহানির চেষ্টা করত না।

سائل أمير الجيش عنها مارای - فلسؤف يبني الجاملين علمها

—সেনাধ্যক্ষাকে জিজ্ঞেস করুন সে কী দেখেছে এ ঘটনা সম্পর্কে। ওদের মধ্যে যার অবগতি আছে সে অবগতিহীন ব্যক্তিদেরকে জানিয়ে দিবে।

ستون ألفا لهم لم يؤووا أرضهم - بل لم يعش بعد الاياب سقيمها

—তাদের ষাট হাজার লোক পুনরায় নিজেদের বাস ভূমিতে ফিরে যেতে পারেনি। অসুস্থ দু একজন ফিরে গেলেও অতঃপর তারা জীবিত থাকেনি।

كانت بها عاد وجرهم قبلهم - والله من فوق العباد يقيمها

—তাদের পূর্বে সেখানে বসবাস করেছিল আদ ও জুরহুম গোত্র, সকল বান্দার উপরে খোদ আল্লাহ তা’আলা সেটিকে কায়েম রাখেন।

এ প্রসংগে আবু কায়স ইবন আসলত আনসারী আল মাদানী বলেনঃ

ومن صنعه يوم فيل الحبوش - اذ كلما بعثوه رزم

—তাঁর (আল্লাহ তা’আলার) কুদরতের একটি নিদর্শন হল হাবশীদের হাতি বাহিনী প্রেরণের দিবসের ঘটনা, যখনই তারা হাতি পাঠানোর চেষ্টা করেছিল তখনই সে আর্ত-চীৎকার করেছিল।

مجاجهم تحت أقرابه - وقد شرموا أنفه فانخرم

—তাদের লোহার আকলী তার পেটের চামড়ার নীচে তার ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারা তার নাকটি চিরে দিয়েছিল ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

وقد جعلوا سؤطه مغولا - اذا يفموه قفاه كلم

—তাদের চাবুকের মাথায় তারা লোহার পেরেক জুড়ে দিয়েছিল হাতির ঘাড়ে আঘাতের সাথে সাথে তা ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়েছিল।

فولى وادبر أدراجه - وقد باء بالظلم من كان ثم

—অবশেষে তারা পিছু হটে গিয়েছিল সে পথে, যে পথে তারা এসেছিল এবং সেখানে যারা ছিল তারা অন্যায় ও অপরাধের শাস্তি পেয়েছিল।

فارسل من فوقهم حاصبا - فلفهم مثل لف القزم

—তাদের উপরওয়ালা আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি কঙ্কর প্রেরণ করেছিলেন এবং তাদের লাশগুলোকে থরে থরে ফেলে রেখেছিলেন ভীরু লোকদের লাশের স্তুপের ন্যায়।

نحضر على الصبر أحبارهم - وقد ثااجوا كثواج الغنم

—তাদের ধর্মযাজকগণ তাদেরকে ধৈর্যধারণে উৎসাহিত করছিল। অথচ তারা ভীত সন্ত্রস্ত বকরী পালের ন্যায় ভ্যা ভ্যা করছিল।

এ প্রসংগে আবু সালত রাবীআ ইবন আবী রাবী’আ ওয়াহব ইবন ইলাজ ছাকাকীর কবিতাগুলো প্রণিধানযোগ্য। ইবন হিশাম বলেন, এ কবিতাগুলো উমাইয়া ইবন আবী সালত এর বলেও কেউ কেউ বলেছেন। সেগুলো ছিল এরূপঃ

ان آیات ربنا ثاقبات - ما يتمادى فيهن الآ الكفور

—আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাদি সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল। কাফির ব্যতীত অন্য কেউ এগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে না।

خلق الليل والنهار فكل- مستبين حسابه مقدور

—তিনি সৃজন করেছেন দিবস ও রাত্রিকে। এর প্রত্যকটি সুস্পষ্ট এগুলোর হিসাব সুনির্দিষ্ট।

ثم يجلو النهار رب رحيم - بمهاة شعاعها منثور

—এরপর দয়াময় প্রভু দিবসকে আলোকময় করেন বিশাল বিস্তৃত পৃথিবী জুড়ে। সেটির আলো ও কিরণ ছড়িয়ে পড়ে।

حبس الفيل بالمغمس حتى -صار يحلوا كأنه معقور

—তিনি রুখে দিয়েছেন হাতিকে মুগাম্মাস নামক স্থানে। এরপর সেটি খোঁড়া ও আহত পশুর ন্যায় হাত পা গুটিয়ে ওখানে বসে পড়ে।

الأزما حلقة الجران كما -قد من صخر کبكب محدور

—যেন হাতিটি তার গর্দানের অগ্রভাগ গুটিয়ে রেখেছিল। যেন সেটি পর্বতচূড়ার প্রস্তররাশি থেকে বিচ্ছিন্ন নীচের দিকে গড়িয়ে পড়া একখণ্ড পাথর।

حوله من ملوك كندة أبطال -ملا ويث في الحروب صقور

—তার চতুষ্পর্শ্বে রয়েছে কিন্দা গোত্রের উৎসাহ দানকারী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, যুদ্ধে যারা বাজ পাখির ন্যায় দুর্ধর্ষ আক্রমণকারী।

خلفه ثم ابدعوا جميعا لهم عظم ساقه مكسور

—তারা সকলে হাতিকে পেছনে ছেড়ে এসেছে। তারপর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সবাই পলায়ন করেছে। পালিয়েছে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যেন প্রত্যেকের পায়ের নলা ভাঙ্গা।

گل دين يوم القيامة عند الله - الأ دين الحنيفة بور

—কিয়ামত দিবসে আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হানীফ তথা দীন-ই ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল দীন বিলুপ্ত হবে। এ প্রসংগে আবু কায়স ইবন আসলাত বলেনঃ

فقوموا فصلوا ربكم وتمسحوا- بأركان هذا البيت بين الأخاشب

—উঠো, তোমাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং পর্বত সমূহের মাঝে অবস্থিত এই ঘরের বরকতময় রুকন সমূহ স্পর্শ কর।

فعندكم منه بلاء مصدق غداة أبي يكسوم هان الكتائب

—কারণ তার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সত্যিই একটি পরীক্ষা এসেছিল। সেটি ছিল সেনাপতি আবু ইয়াকসুমের (আবরাহার) অভিযান পরিচালনা দিবসে।

كتيبته بالسهل تمشي ورجلة على القاذفات في رءوس المناقب

—তার ঘোড় সওয়ারগণ সমতল পথে হেঁটে চলেছে আর তার পদাতিক বাহিনী অবস্থান নিয়েছে পর্বত শৃঙ্গে।

فما أتاگم نصرذى العرش ردهم - جنود المليك بين ساف وحاصب

—তোমাদের প্রতি যা এসেছে তা হল আরশ অধিপতির সাহায্য। পরম পরাক্রমশীল মহান মালিকের (আল্লাহ তা’আলা) সেনাবাহিনী প্রচণ্ড বায়ু ও কঙ্কর নিয়ে এসে ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

قولوا سراعا هاربين ولم يؤب الى أهله من الجيش غير عصائب

—অতঃপর তারা দ্রুত পলায়ন করল। হাবশীদের মাত্র কয়েকদল লোক ছাড়া অন্য কেউ নিজ নিজ পরিবারের নিকট ফিরে যেতে পারেনি।

কাবা শরীফ ধ্বংসের অপচেষ্টার হাত থেকে সেটিকে রক্ষা করা এবং কাবা শরীফের মান মর্যাদা সম্পর্কে উবায়দুল্লাহ ইবন কায়স যে কবিতা রচনা করেছে তাও এ প্রসংগে উল্লেখ করা যায়ঃ

کادة الأشرم الذي جاء بالفيل فولی وجيشه مهزوم .

—হাতি বাহিনী নিয়ে আসা ব্যক্তির আশরাম এই পবিত্র গৃহ সম্পর্কে ষড়যন্ত্র করেছিল। অতঃপর যে পেছনের দিকে পালিয়ে গেল, তার সৈন্যরাও হল পরাজিত।

واستهلت عليهم الطير بالجندل حتی گانه مرجوم

—বড় বড় পাথর নিয়ে পাখি বাহিনী তাদের উপর জমায়েত হল। অবশেষে সেই আশরাম হল পাথর নিক্ষেপে জর্জরিত ও ক্ষত-বিক্ষত।

ذلك من يغزه من الناس -يرجم وهو فل من الجيوش ميم

—এটি এজন্যে হল যে, যে ব্যক্তিই এ গৃহের বিরুদ্ধে লড়তে যাবে সে নিশ্চিতভাবে ফিরে যাবে এমতাবস্থায় যে, সে পরাজিত সৈনিক এবং নিন্দিত।

ইবন ইসহাক ও অন্যরা বলেন যে, আবরাহার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকসুম রাজা হয়। তারপর আসে তার ভাই মাসরূক ইবন আবরাহা। সে ছিল তাদের বংশের শেষ রাজা। পারস্য সম্রাট নওশেরাওয়া-এর প্রেরিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে সায়ক ইবন ইয়াযনে হিময়ারী মাসরূকের হাত থেকেই রাজত্ব ছিনিয়ে নেয়। এ বিষয়ে পরে আলোচনা হবে।

হাতি বাহিনীর এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রোমান ইতিহাস খ্যাত সম্রাট দ্বিতীয় ইসকান্দার ইবন ফিলিপস মাকদুনী ওরফে সম্রাট যুলকারনাইনের যুগ থেকে ৮৮৬ তম বছরের মুহাররাম মাসে।

আবরাহা ও তার দু’পুত্রের মৃত্যু এবং হাবশা থেকে রাজত্ব ইয়ামানে স্থানান্তরিত হওয়ার পর আবরাহার নির্মিত উপাসনালয় কুলায়স পরিত্যক্ত গৃহে পরিণত হয়। অতঃপর তার আর কোন উক্ত অনুরক্ত থাকল না। অথচ নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতার কারণে আবরাহা সেটিকে তৈরী করেছিল আরবদের হজ্জকে কাবা শরীফ থেকে ঐ কুলায়সে সরিয়ে আনার জন্যে।

আবরাহা সেটি তৈরী করেছিল দু’টো মূর্তির উপর! মুর্তি দু’টো হল কু’আয়ব ও তার স্ত্রীর। এ দু’টো ছিল কাঠের তৈরী। প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য উচ্চতায় ৬০ গজ। এগুলো মূলত দু’টো নিজের প্রতিকৃতি। এ জন্যেই কেউ কুলায়স গীর্জায় কোন সম্পদ খুলে নিতে চেষ্টা করলে জিনেরা তাকে আক্রমণ করত। অতঃপর এটি প্রথম আব্বাসী খলীফা সাফফাহ-এ খিলোফতকাল পর্যন্ত এভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। তাকে কুলায়স তার মধ্যে রক্ষিত ধনসম্পদ ও বহুমূল্য শ্বেতপাথর সম্পর্কে জানানো হয়। এগুলো আবরাহা রাণী বিলকীসের প্রাসাদ থেকে এনে কুলায়সে স্থাপন করেছিল।

অতঃপর খলীফা সাফফাহ এটি ভাঙ্গার জন্যে লোক প্রেরণ করলেন। তারা একটি একটি করে সকল পাথর খুলে নেয় এবং তার সকল ধনসম্পদ নিয়ে আসে। সুহায়লী এরূপই উল্লেখ করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

৬৫
হাবশীদের হাত থেকে রাজত্ব সায়ফ ইবন যুইয়াযীনের হাতে রাজত্ব স্থানান্তর
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক (র) বলেন, আবরাহার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকসুম রাজত্ব লাভ করে। ইয়াকসুমের দিকে সম্পৃক্ত করে আবরাহাকে আবু ইয়াকসুম বলা হয়। ইয়াকসুমের মৃত্যুর পর তার ভাই মাসরূক হাবশী ইয়ামানের রাজত্ব গ্রহণ করেন। ইয়ামামাবাসীদের উপর যখন নির্যাতন দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে তখন সায়ফ ইবন যু-উয়াযান হিময়ারী আবির্ভূত হন। ইনি হলেন সায়ফ ইবন যুআযীন (ইবন যীইসবাহ ইব্‌ন মালিক ইবন যায়দ ইবন সাহল ইবন আমর ইবন কায়স ইবন মু’আবিয়া ইবন জাশম ইবন আবন ওয়ায়েল ইবন গাওছ ইবন কুতুন ইবন আরদ শামস ইবন আযমান ইবন হুমায়সা ইব্‌ন আরীব ইবন যুহায়ব ইবন আযমান ইবন হুমায়সা ইবন আরবাহাজ আরবাহাজ হচ্ছে সাবার পুত্র হিময়ায়ের সাঙ্গ। সায়ফ এর উপনাম ছিল আবু মুররা।

সায়ফ রোমান সম্রাট কায়সারের নিকট গিয়ে নিজেদের দূরবস্থার কথা জানিয়ে তার সাহায্য কামনা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন যেন কায়সার তিনি নিজে বা অন্য কাউকে পাঠিয়ে আবিসিনীয়দেরকে তাড়িয়ে দিয়ে ইয়ামানবাসীদেরকে তার শাসনাধীনে নিয়ে নেন। কিন্তু রোম সম্রাট তার প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না।

সায়ফ সেখান থেকে বেরিয়ে নুমান ইব্‌ন মুনযিরের দরবারে পৌঁছেন। নুমান তখন পারস্য সম্রাটের পক্ষ থেকে হীরা ও তৎসংলগ্ন ইরাকী অঞ্চলের প্রশাসক তিনি হাবশীদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা নুমানকে অবহিত করেন। নুমান বলেন, বছরে একবার করে আমি একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে পারস্য সম্রাট কিসরার দরবারে হাজির হয়ে থাকি। আপনি সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সায়ফ তা-ই করেন। যথাসময়ে তাঁকে নিয়ে নুমান কিসরার দরবারে হাজির হন। দরবারের যেখানে রাজমুকুট স্থাপিত কিসরা সেখানেই স্নান গ্রহণ করতেন। তাঁর মুকুট ছিল বৃহদাকার পাত্রের ন্যায়। সেটি ছিল মনি-মুক্তা, ইয়াকুত ও স্বর্ণ-রৌপ্য খচিত। সেটি থাকত তার সিংহাসনের উপরে স্বর্ণের শিকল দ্বারা একটি তাকের সাথে ঝুলন্ত। সেটি এত ভারী ছিল যে, রাজার ঘাড় তা বহন করতে পারত না। আসন গ্রহণের সময় তার চারিদিকে কাপড়ের বেষ্টনী তৈরী করা হত। লোকচক্ষুর অন্তরালে তিনি ঐ আসনে বসতেন এবং ঝুলন্ত মুকুটে মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। যথাযথভাবে আসন গ্রহণ করার পর কাপড়ের বেষ্টনী তুলে নেয়া হত। অতঃপর ইতিপূর্বে তাকে দেখেনি এমন কেউ তার এ গাম্ভীর্যপূর্ণ অবস্থান দেখলে ভয়ে উপুড় হয়ে পড়ে যেত।

সায়ফ যখন রাজার দরবারে প্রবেশ করেন তখন তিনি ও মাথা অবনত করে ফেলেন। সম্রাট বলেলেন, ‘এই নির্বোধটি এত উঁচু দরজা দিয়ে আমার নিকট প্রবেশ করার সময়ও নিজের মাথা নুইয়ে রাখছে কেন?’ সম্রাটের এ মন্তব্য সায়ফকে জানানো হয়। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার দুশ্চিন্তার কারণে আমি এরূপ করেছি। কারণ আমার দুশ্চিন্তার সম্মুখে সব কিছুই সংকীর্ণ মনে হয়। এরপর তিনি বললেনঃ মহারাজ! পশ্চিমা বিদেশীরা আমার দেশ দখল করে রেখেছে।’ কিসরা প্রশ্ন করেন, ‘কারা সেই বিদেশী? হাবশীরা, নাকি সিদ্ধীরা?’ তিনি বললেনঃ ‘বরং হাবশীরা। আমি আপনার নিকট এসেছি সাহায্যপ্রার্থী হয়ে। অতঃপর আপনি বিজয়ী হলে আমাদের দেশ আপনার অধীন হবে।’ সম্রাট বললেন, ‘তোমাদের দেশ তো অনেক দূরে। তদুপরি তাতে কোন সম্পদ নেই আমি সেই দূর দূরান্তের আরব দেশে আমার পারসিক সৈন্য প্রেরণ করতে আগ্রহী নই। ঐ দেশটির অধীনে আনার আমার কোন প্রয়োজনও নেই।’ সম্রাট তাকে দশ হাজার দিরহামের আর্থিক অনুদান এবং চমৎকার একজোড়া পোশাক দান করেন। অনুদান গ্রহণ করে সায়ফ সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ঐ অর্থ লোকজনকে অকাতরে বিলিয়ে দেন। এ সংবাদ সম্রাটের গোচরীভূত হয়।

সম্রাট বলেন, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তিনি তাকে ডেকে পাঠান। তারপর বলেন, ‘তুমি সম্রাটের দেয়া অনুদান লোকজনকে বিলিয়ে দিচ্ছ ব্যাপার কী?’ জবাবে তিনি বলেনঃ ‘আপনার অনুদান দিয়ে আমি কী করব? আমার যে দেশ থেকে আমি এসেছি তার পাহাড় পর্বত তো পুরোটাই স্বর্ণ রৌপ্যে ভরপুর। এটার প্রতিই মানুষ আসক্ত হয়।’ একথা শুনে সম্রাট তার অমাত্যেদেরকে ডেকে এ লোকের ব্যাপারে তাদের অভিমত জানতে চাইলেন। একজন বলল, ‘মহারাজ! আপনার বন্দীখানায় কতক বন্দী লোক আছে যাদেরকে হত্যা করার জন্যে আপনি আটকিয়ে রেখেছেন। তাদেরকে যদি আপনি এ লোকের সাথে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে যুদ্ধ করে তারা যদি মারা যায়। তবে তাদেরকে হত্যা করার আপনার যে ইচ্ছা ছিল তা পূর্ণ হবে। আর তারা যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে তবে একটি অতিরিক্ত রাজ্য আপনার অধীনে আসবে।’ প্রস্তাবটি রাজার মনঃপুত হয় এবং কারারুদ্ধ ৮০০ ব্যক্তিকে তিনি সায়াফের সাথে প্রেরণ করেন। ওয়াহরিজ নামের একজনকে তিনি সেনাপতি নিযুক্ত করে দেন। ওয়াহরিজ ছিল তাদের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ এবং সর্বাধিক অভিজাত বংশীয়। ৮টি নৌকায় তারা যাত্রা করে। দু’টো নৌকা ডুবে যায় এবং অবশিষ্ট ৬টি নৌকা এডেন উপকূলে গিয়ে পৌঁছে। অতঃপর যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের বহু লোককে সায়ফ এনে ওয়াহরিজের নেতৃত্বে দেন। ওয়াহরিজের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সায়ফ বলেন, ‘সর্বক্ষণ আমার বাহিনী আপনার সাথে থাকবে যতক্ষণ আমাদের সবার মৃত্যু হয় কিংবা যতক্ষণ না আমরা সবাই বিজয় লাভ করি।’ ওয়াহরিজ বললেন, ‘আপনি ন্যায়ানুগ কথা বলেছেন।’

এ দিকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে ইয়ামানের রাজা মাসরূক ইবন আবরাহা বেরিয়ে আসে এবং সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। ওদের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রথমত ওয়াহরিজ তার পুত্রকে যুদ্ধার্থে পাঠান। যুদ্ধে তার পুত্রটি নিহত হয়। এতে ওয়াহরিজ ওদের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হন। সৈন্যগণ যখন নিজ নিজ সারিতে সারিবদ্ধ তখন ওয়াহরিজ বলেন যে, ‘ওদের রাজা কোন ব্যক্তি তা আমাকে দেখিয়ে দাও!’ সৈন্যগণ বলল, ‘ঐ যে ব্যক্তিটি হাতির পিঠে অবস্থান করছে তার মাথায় মুকুট এবং দু’চক্ষুর মধ্যখানে রক্তিম ইয়াকুত পাথর রয়েছে তাকে কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন।’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।’ লোকজন বলল, ‘সে ব্যক্তিই ওদের রাজা।’ ‘ওকে আমার জন্যে ছেড়ে দাও। আমি দেখছি।’ দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি আবার বললেন, ‘এখন ঐ রাজা কিসে সওয়ার আছে?’ তারা বলল, ‘সে এখন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার আছে।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে তোমরা ওকে থাকতে দাও। আমি তাকে দেখছি!’ দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ওয়াহরিজ আবার বললেনঃ ‘এখন সে কিসের উপর সওয়ার আছে?’ তারা বললো, ‘এখন সে এক মাদী খচ্চরের পিঠে উপবিষ্ট আছে।’ ওয়াহরিজ বললেনঃ গাধার মাদি বাচ্চার পিঠে? সে নিজেও অপদস্ত হবে, তার রাজ্যেরও পতন ঘটবে। এখন আমি তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করব।

অতঃপর তোমরা যদি দেখতে পাও যে, তার সাথীরা নিজ নিজ স্থানে স্থির রয়েছে, নড়াচড়া করছে না তাহলে আমি নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা আপন আপন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং বুঝে নিবে যে, আমার তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আর যদি দেখ যে, আমার তীর নিক্ষেপের পর তার সাথীরা সকলে তার চারদিকে এসে একত্রিত হয়েছে এবং তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে তবে বুঝে নিবে যে, নিশ্চয় আমার তীর লক্ষ্য ভেদ করেছে এবং তখন তোমরা সকলে ওদের উপর আক্রমণ চালাবে। এরপর তিনি ধনুকের ছিল টেনে ধরে। কথিত আছে যে, তার ধনুক এতই মজবুত ছিল যে, অন্য কেউ তা বাঁকা করতে পারত না। তার নির্দেশে দু’জন প্রহরী তীর ধনুকে সংযোজিত করে দেয়। তারপর তিনি ইয়ামান রাজা মাসরুককে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেন। তীরটি গিয়ে তার দু’চক্ষুর মাঝখানে অবস্থিত ইয়াকুত পাথরে আঘাত করে। তীরটি তার মাথায় ঢুকে ঘাড় ভেদ করে বেরিয়ে যায় এবং হাবশী সৈনিকেরা তার চারিদিকে এসে একত্রিত হয়ে মাতম করতে থাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ সময়ে পারসিক সৈনিকেরা তাদের আক্রমণ করে। ফলে তারা সবাই পরাজিত হয়। কতক নিহত হয় এবং অপর কতক যে যেদিকে সম্ভব পালিয়ে যায়। বিজয়ী সেনাপতি ওয়াহরিজ সানা’আ প্রবেশের জন্যে অগ্রসর হন। শাহী ফটকে এসে তিনি লক্ষ্য করেন যে, নিচু করা ছাড়া তার পতাকা ফটক দিয়ে যাবে না। তিনি বললেন, আমার পতাকা অবনত হয়ে কোথাও প্রবেশ করে না। এ ফটক ভেঙ্গে ফেল। ফটক ভাঙ্গা হল এবং তিনি বুক ফুলিয়ে শির উঁচু করে পতাকা উর্ধ্বে তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তখন সায়ফ ইবুন যু-ইয়াযিন হিময়ারী বললেনঃ

يظن الناس بالملكين انهما قد التاما

কতক লোক ধারণা করে যে, দু’জন রাজা মিলিত হয়ে গিয়েছেন।

ومن يسمع بلا مهما فان الخطب قد فقما

এ মিলিত হওয়ার কথা কেই বা শুনেছে? মূল কথা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাধিত হয়েছে।

قتلنا القيل مسروقا وروينا الكشيب دما

আমরা ইয়ামানী রাজ মাসরূককে হত্যা করেছি এবং বালির স্তুপকে রক্তের দ্বারা তৃপ্ত করেছি।

وان القيل قيل الناس وهرز مقسم قسما

এখন জনগণের রাজা হচ্ছেন সেনাপতি ওয়াহরিজ, তিনি ধন সম্পদ বিলি বন্টন করে দেন।

يزوق مشعشعا حتى نفي السبي والنعما

তিনি পান করেন পানি মিশ্রিত মদ। যতক্ষণ না বন্দী ও সম্পদ হস্তগত করেন। তারপর হিজাজ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আরবরা রাজ্য ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্যে সায়ফ ইবন যু-ইয়াযিনকে অভিবাদন জানানোর জন্যে দলে দলে তার নিকট আসতে থাকে। রাজ্য ক্ষমতায় ফিরে আগমনকারী প্রতিনিধি দলসমূহের মধ্যে আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিমও ছিলেন। তখন সায়ফ ইবন যূইয়াযীন আবদুল মুত্তালিবকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর আগমনের সুসংবাদ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত করেন। এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আগমনের সুসংবাদ” শিরোনামে আলোচিত হবে।

ইবন ইসহাকের মতে আবু সালত ইবন আবী রাবী’আ ছাকাফী এবং ইবন হিশামের মতে উমাইয়া ইবন আবী সালত বলেছেনঃ

ليطلب الوتر أمثال ابن ذي يزن - ريم في البحر للأعداء أحوالا

—ইবন যী ইয়াযিনের ন্যায় লোকদেরই উচিত প্রতিশোধ গ্রহণের এগিয়ে যাওয়া শোভা পায়। যিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে বছরের পর বছর ধরে সমুদ্রের পাড়ে লুকিয়ে থাকেন।

يمم قيصرا لما كان رحته - فلم يجد عنده بعض الذي مسالا

—তার দেশ ত্যাগের সময় তিনি রোমান সম্রাট কায়সারের নিকট গেলেন। কিন্তু তার প্রার্থিত সাহায্য সেখানে তিনি পেলেন না।

ثم انثنى نحو کسری بعد عاشرة - من السنين يهين التنفس والما

—তারপর পারস্য সম্রাট কিসরার নিকট গেলেন। দশ বছর পর তিনি নিজের ব্যক্তিত্ত্ব ও ধন-সম্পদকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।

حتى آتي بيني الأحرار يحملهم -انك عمري لقد أشرعت قلقاء

—অবশেষে তিনি এলেন বনি আহরার গোত্রের নিকট। তিনি তাদেরকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে উত্তোজিত করেন। আমার জীবনের শপথ আপনি খুব দ্রুত আন্দোলন সৃষ্টি করেছেন।

لله درهم من عصبة خرجوا - ما ان ارى لهم في الناس أمثالا

—সেই বাহিনীটি এক সময় বিস্ময়করভাবে অভিযানে বেরোল যে, মানব সমাজে আমি তো তাদের তুল্য কাউকে দেখিনি।

غلبا مراز به ليضا أساورة - أسرا تربب في الفيضات أشبالا

—তারা সদা বিজয়ী রাজন্যবর্গ এবং স্বচ্ছ ঝলমলে কংকন পরিধানকারী। তারা সেই সিংহ গভীর জঙ্গলে যারা সিংহ শাবক লালন-পালন করে।

يرمون عن سلوف كانها غبط برمخر يعجل المرمی آعجالا

তারা প্রভাত আলোতে তীর নিক্ষেপ করে ওগুলো দ্রুত লক্ষ্যভেদ করে।

أرسلت أسرا على سود الكلاب فقه - أضحى شديدهم في الأرض فلالا

—আপনি কালো কুকুরদের প্রতি সিংহ লেলিয়ে দিয়েছেন ফলে তাদের পলায়নপর বাহিনী ভূলণ্ঠিত হয়েছে।

فاشرب هنيئا عليك التاج مرتفقا - في رأس غمدان دارا منك محلالا

—আপনি তৃপ্ত চিত্তে পানীয় পান করুন। আপনার মাথায় রয়েছে রাজমুকুট। আপনার বিশ্রামস্থল গুমদান প্রাসাদ, এটি আপনার বৈধ ভবনে পরিণত হয়েছে।

واشرب هنيئا فقد شالت نعامتهم واسبل اليوم في برديك اسبالا

—আপনি তৃপ্তি সহকারে পান করুন। শত্রুরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখন আপনি আপনার চাদর জোড়া হেঁচড়িয়ে অহংকারী চালে পথ চলুন।

تلك المكارم قعبان من لبن شبيبا بماء فعادا بعد أبوالا

—এগুলো মহৎ গুণাবলী পানি মিশ্রিত দুধের তেমন দু’টি পাত্র যেগুলো পরিণত হয় প্রস্রাবের পারে।

কথিত আছে যে, গুমদান হলো ইয়ামানের একটি রাজপ্রাসাদ। ইয়ারুব ইবন কাহতান সেটি নির্মাণ করেন। পরবর্তী ওয়াইলা ইবন হিমইয়ার ইবন সাবা কৌশলে সেটি করতলগত করেন। বলা হয়ে থাকে যে, এটি ছিল বিশ তলা বিশিষ্ট প্রাসাদ। আল্লাহই ভাল জানেন।

ইবন ইসহাক বলেন আদি ইবন যায়দ হিমইয়ারী বলেছেন, তিনি ছিলেন বনী তামীম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।

ما بعد صعاء كان يعمرها - ولا ملك جزل مواهبها

—সান’আর পত্তনের এটির কী হলো? যা গড়ে তুলে ছিলেন শাসকবর্গ যাদের দান দক্ষিণা ছিল অবারিত।

رفعها من بنی لذى قزع المزن - وترى مشكا محاربها

—যে ব্যক্তি এটি নির্মাণ করেছে সে এটিকে মেঘমালা পর্যন্ত উন্নীত করেছিলেন। এটির মেহরাবগুলো থেকে কস্তুরির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।

محفوفة بالجبال دون عرى الكائر - ما يرتقي غواربها

—এটি পর্বতরাজি দ্বারা পরিবেষ্টিত। এটি চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত থেকে নিরাপদ। এ প্রাসাদের চূড়ায় আরোহণ করা যায় না।

يأنس فيها صوت النهام -اذا خاوبها بالعشى قاصبها

—সান্ধ্যকালীন বজ্রনিনাদ ঐ প্রাসাদে কাঠ মিস্ত্রীর শব্দের ন্যায় খটখট শব্দ করে।

ساقت اليها الأسباب جند بني الأحرار فرسانها مواكبها

—নানা প্রকারের উপাদান বনী আহরার গোত্রের সৈনিকদেরকে তার দিকে টেনে এনেছে। তাদের অশ্বারোহীগণ এসেছিল মিছিল সহকারে।

وفزت بالبغال توسق بالحتف - وتسعى بها توالبها

—মৃতপ্রায় ভারবাহী খচ্চরগুলোকে পৃথক করে দেয়া হয়েছে। তাদের সাথে ছুটে গেল তাদের বাচ্চাগুলো।

حتى يراها الأقوال من طرف النقل - مخضرة كتائبها

—বস্তুত হিমইয়ারী রাজাগণ দুর্গের উপর থেকে ওদের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা অশ্বারোহী বাহিনীকে দেখতে পেলেন।

يوم ينادون ال بربر والكيسوم - لا يفلحن هاربها

—যেদিন তারা বর্বর কায়সুম বংশের লোকদেরকে ডাক দিয়েছিল ওদের পলায়নকারী পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।

فكان يوما باقي الحديث وز الت أمة ثابت مراتبها

—সে দিবসের এ আলোচনাই শুধু অবশিষ্ট রয়েছে যে, মর্যাদাবান ও শক্তিশালী একদল মানুষ সে দিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

وبدل الهيج بالزرافة والآيام خون جم عجائبها

—সে দিন উত্তেজিত বাহিনী নিরীহ জিরাফে পরিণত হয়েছিল। সেই দিনগুলো বহু ঘটনার সাক্ষীতে পরিণত হয়েছে।

بعد بنی تبع نخاورة -قد اطمأنت بها مراز بها

—সম্মানিত তুব্বা সম্প্রদায়ের পর এ দুর্গে পারস্যের সামন্তগণ নিশ্চিন্তে সেটির মালিকানা লাভ করেন।

ইবন হিশাম বলেন, পূর্বোল্লেখিত জ্যোতিষী সাতীহ্ তার বক্তব্য “তারপর ইরাম যী ইয়াযীন তাদের নিকট আসবে আদন থেকে। অতঃপর কাউকেই ইয়ামানে অবশিষ্ট রাখবে না” দ্বারা এটাই বুঝিয়েছিল। আর জ্যোতিষী শিক “এমন একটি বালক যে, গ্রাম্যও নয় শহুরেও নয়। যীইয়াযানের গোত্র থেকে সে বের হবে” দ্বারাও এ দিকেই ইঙ্গিত করেছিল।

ইবন ইসহাক বলেন, ওয়াহরিয এবং পারসিকগণ ইয়ামানে বসবাস করতে থাকে। এখনকার ইয়ামানের অধিবাসিগণ সেই পারসিকদের বংশধর। আরিয়াতের ইয়ামানে প্রবেশ থেকে শুরু করে পারসিকদের হাতে মাসরুক ইব্‌ন আবরাহা-এর নিহত হওয়া এবং হাবশীদের ইয়ামান থেকে বহিষ্কৃত হওয়া পর্যন্ত তাদের রাজত্বকাল ছিল ৭২ বছর। এই মেয়াদে পরপর চারজন হাবশী রাজা রাজত্ব করে। তারা হলো পর্যায়ক্রমে আরইয়াত, আবরাহা, ইয়াকসূম ইবন আবরাহা এবং মাসরুক ইবন আবরাহা।

৬৬
ইয়ামানে পারসিকদের শেষ পরিণতি
ইবন হিশাম বলেন, ওয়াহরিযের মৃত্যুর পর পারস্য সম্রাট কিসরা ওয়াহরিযের পুত্র মারযুবানকে ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে। মারযুবানের মৃত্যুর পর তদীয়পুত্র তাইনুজানকে তারও মৃত্যুর পর তার পুত্রকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তাইনুজানের পুত্রকে বরখাস্ত করে বাযানকে ইয়ামানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। বাযানের শাসন আমলেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) নবুওত প্রাপ্ত হন।

ইবন হিশাম বলেন, আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে যে, পারস্য সম্রাট কিসরা ইয়ামানের শাসনকর্তা বাযানের নিকট এই মর্মে পত্র লিখেছিল, আমার নিকট সংবাদ এসেছে, কুরায়শ বংশের জনৈক ব্যক্তি মক্কা নগরীতে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সে নিজেকে নবী বলে দাবী করছে। তুমি তার কাছে যাও। তাকে বল সে যেন ঐ দাবী ত্যাগ করে। সে যদি তা ত্যাগ করে তবে তো ভাল; নতুবা তুমি তার ছিন্নমস্তক আমার নিকট পাঠাবে। বাযান তখন সম্রাটের পত্রটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট প্রেরণ করে। উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) লিখেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলা আমার সাথে অঙ্গীকার করেছেন যে, অমুক মাসের অমুক তারিখে কিসরা নিহত হবে।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উত্তর পেয়ে শাসনকর্তা বাযান উল্লেখিত দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি বলেন উক্ত ব্যক্তি যদি সত্যই নবী হয়ে থাকেন তিনি যা বলেছেন অচিরেই ঘটবে। রাসূলুল্লাহ (সা) কিসরার নিহত হওয়ার যে তারিখ উল্লেখ করেছিলেন ঠিক সে তারিখেই আল্লাহ্ তা’আলা তাকে হত্যা করান।

ইবন হিশাম বলেন, কিসরা নিহত হয় তার পুত্র শের ওয়েহের এর হাতে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, তার সকল পুত্রই তার হত্যায় জড়িত ছিল। এই কিসরা হল পারভেয ইবন হরমুখ ইবন নওশেরাওয়া ইবন কুবায। সে-ই রোম সম্রাটকে পরাস্ত করেছিল ( الم غلبت الروم ) “আলিফ, লাম, মীম, রোমকগণ পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী অঞ্চলে” আয়াতে সেই রোম বিজয়ের উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীতে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। সুহাইলী বলেন, নবম হিজরীর জুমাদাল উলা মাসের ১১ তারিখ বুধবারে সে নিহত হয়। কথিত আছে যে, তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে তার প্রতি রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে পত্র পাঠিয়েছিলেন সেটি পেয়ে সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয় এবং পত্রটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। অতঃপর তার বক্তব্য লিখে ইয়ামানের শাসনকর্তা বাযানের নিকট পত্র পাঠায়।

কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বাযানের প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, ‘আমার প্রতিপালক তো এ রাতে তোমার রাজাকে হত্যা করেছেন।’ পরে দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ (সা) যা বলেছেন তা-ই হয়েছে। ঠিক ঐ রাতেই সে নিহত হয়েছে। প্রথম দিকে ন্যায়পরায়ণ থাকলেও পরবর্তীতে সে অত্যাচারী হয়ে উঠে। ফলে তার ছেলেরা তাকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং হত্যা করে। তারা তার পুত্র শেরওয়েহকে সিংহাসনে বসায়। পিতা নিহত হওয়ার ছয়মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে শেরওয়ের মৃত্যু হয়। এ প্রসংগে কালিদ ইবন হক শায়বাণী বলেনঃ

وكسرى اذ تقسمه بنوه -باسياف كما أقتسم اللحم

—আর কিসরার ব্যাপারটি তার পুত্রগণ তাকে তলোয়ার দ্বারা টুকরো টুকরো করেছে যেমন টুকরো করা হয় গোশত।

تمخضت ألمنون له بيوم - الأ ولكل حاملة تمام

—একদিন তার মৃত্যু এলো এবং প্রত্যেক জীবেরই মৃত্যু আছে।

যুহরী (র) বলেন, এ সংবাদ অবগত হয়ে বাযান নিজের ইসলাম গ্রহণ এবং তার সাথী পারসিকদের ইসলাম গ্রহণের বার্তা সহ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। তখন প্রতিনিধিগণ বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমরা কাদের সাথে যুক্ত হবো?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তোমরা আমাদের পরিবারের সাথে যুক্ত হবে।’ এ প্রসংগে মুহরী (র) বলেন, যে দৃষ্টিকোণ থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) হযরত সালমান (রা) সম্পর্কে বলেছিলেন ( سلمان منا اهل البيت )- “সালমান রাসূল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।” আমি বলি আলোচ্য বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, বাযানের ইসলাম গ্রহণের সম্পর্কিত ঘটনা সংঘটিত হয় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মদীনায় হিজরতের পর। এ জন্যে ইয়ামানের লোকজনকে ভাল কাজের শিক্ষা দেয়া এবং আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার জন্যে তিনি প্রশাসকগণকে ইয়ামান প্রেরণ করেছিলেন। সর্বপ্রথম প্রেরণ করেন খালিদ ইবন ওলীদকে এবং আলী ইবন আবী তালিব (রা)-কে। তারপর প্রেরণ করেন আবু মুসা আশআরী ও মু’আয ইবন জাবাল (রা)-কে। এ সময়ে ইয়ামানবাসীরা ইসলামের ছায়াতলে আসে। বাযানের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র শাহর ইবন বাযান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ভণ্ড নবী আসওয়াদ আনাসী যখন নবুওত দাবী করে তখন সে শাহর ইবন বাযানকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সে ইয়ামানে নিযুক্ত রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতিনিধিকেও সেখান থেকে বহিষ্কার করে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা আসবে। আসওয়াদ আনাসী নিহত হওয়ার পর সেখানে পুনরায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইবন হিশাম বলেন, জ্যোতিষী সাতীহ তার বক্তব্য “পবিত্র নবী, ঊর্ধ্ব জগত থেকে তাঁর ওহী আসবে” দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করেছিল এবং জ্যোতিষী শিক তার বক্তব্য “এবং ঐ রাজত্বে ছেদ পড়বে একজন রাসূলে দ্বারা। তিনি সত্য ও ন্যায় সহকারে আসবেন, তিনি আসবেন দীনদার ও মর্যাদাবান লোকদের মধ্যে অতঃপর কিয়ামত দিবস পর্যন্ত রাজত্ব তার সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকবে” দ্বারা এদিকেই ইঙ্গিত করেছে।

ইবন ইসহাক বলেন, ইয়ামান বাসীরা দাবী করে যে, সেখানকার একটি পাথরে যবুর কিতাবের উক্তি লিখিত ছিল। এটি প্রাচীন যুগের লিখিত হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল রাজত্বের মালিক হবে শ্রেষ্ঠ হিময়ারীগণ। রাজত্বের মালিক হবে মন্দ লোক হাবশীগণ, রাজত্বের মালিক হবে স্বাধীন পারসিকগণ। রাজত্বের মালিক হবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কুরায়শগণ।

একজন কবি এই বিষয়টিকে কবিতায় সন্নিবেশিত করেছেন। মাসউদী তা উল্লেখ করেছেনঃ

حین شدت ذمار قيل لمن أتت - فقالت لحمير الأخيار

—যুদ্ধের প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন হল তখন বলা হল তুমি কার পক্ষে? তখন যে বলল শ্রেষ্ট সম্প্রদায় হিমইয়ারীদের পক্ষে।

ثم سئلت من بعد ذلك لمن أتت - فقالت أنا للحبش أخبث الأشرار

তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হল, এবার তুমি কার? তখন সে বলল, মন্দ ব্যক্তি হাবশীদের পক্ষে

ثم قالوا من بعد ذلك لمن أتت - فقالت لفارس الأحرار

—তারপর তারা বলল, এবার তুমি কার পক্ষে? সে বলল স্বাধীন চেতা পারসিকদের পক্ষে।

ثم قالوا من بعد ذلك لمن أتت - فقالت الى قريش التجار

—তারপর বলা হল এবার তুমি কার পক্ষে? সে বলল, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কুরায়শদের পক্ষে।

কথিত আছে, যে, মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এখানে যা উল্লেখ করেছেন তা হযরত হুদ (আ)-এর কবরের পাশে লিখিত পাওয়া গিয়েছিল। বায়ু প্রবাহের ফলে ইয়ামানে অবস্থিত তাঁর কবরের মাটি সরে গেলে এটি পাওয়া যায়। রাণী বিলকীসের শাসনামলের অল্প কিছুদিন পূর্বে আমর যিলি ইআ’বের ভাই মালিক যীল মানারের শাসনামলে এ ঘটনা ঘটে। কেউ কেউ বলেন, এটি হযরত হূদ (আ)-এর কবরের উপরের লেখা ছিল এটি তারই বাণী। শেষোক্ত মন্তব্য করেছেন আল্লামা সুহায়লী (র)। আল্লাহই ভাল জানেন।

৬৭
হাযর অধিপতি সাতিরূন-এর বিবরণ
আব্দুল মালিক ইবন হিশাম এ পর্যায়ে সাতিরুন-এর আলোচনার অবতারণা করেছেন। কারণ ইয়ামান রাজ্য পুনরুদ্ধারে সায়ক ইবন যী ইয়াযানের নুমান ইব্‌ন মুনযিরের নিকট সাহায্য প্রার্থনা প্রসংগে যে নু’মানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে কোন কোন কুলজী বিশারদ বলেছেন যে, সেই নু’মান হাযর অধিপতি ‘সাতিরুন’- এর অধঃস্তন বংশধর। ইতিপূর্বে ইবন ইসহাক সূত্রে আমরা উল্লেখ করেছি যে, নুমান ইবন মুনযির হচ্ছেন রাবীআ ইবন নাসর এর বংশধর। উপরন্ত জুবায়র ইবন মুতইম সূত্রে ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন যে, নু’মান হল কায়সার ইবন মদি ইবন আদনানের বংশধর। বস্তুত নুমান ইবন মুনযিরের বংশ তালিকা সম্পর্কে এ তিন প্রকারের বক্তব্য এসেছে। এই সূত্রে ইবন হিশাম (র) হাযর অধিপতি ‘সাতিরুন’- এর আলোচনার অবতারণা করেছেন। হাযর হল একটি বিশাল দূর্গ। বাদশা সাতিরুন ফোরাত নদীর তীরে এটি নির্মাণ করেন। প্রাসাদটি গগনচুম্বী, সুউচ্চ, সুপ্রশস্ত ও বিশালায়তন। এটির চৌহদ্দী একটি বিরাট শহরের সমান। দৃঢ়তা, সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্বে এটি তুলনাহীন। চতুর্দিক থেকে সড়ক ও জনপথ সমূহ এখানে এসে থেমেছে। সাতিরুনের নাম দীবান ইবন মু’আবিয়া ইবন উবায়দ ইবন আজরম। আজরম হল সাতিহ ইবন হুলওয়ান ইবন ইলহাফ ইবন কুযা’আ-এর বংশধর। ইবন কুযাআ তার এ বংশ তালিকা উল্লেখ করেছেন।

অন্যান্য কুলজী বিশারদগণ বলেন, সে ছিল জারমুক বংশের অন্তর্ভুক্ত এবং একজন আঞ্চলিক রাজা। তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে সাতিরুনকে সকলের সম্মুখে এগিয়ে দেয়া হতো। তার দূর্গ ছিল দিজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী স্থানে।

ইবন হিশাম বলেন, পারস্য সম্রাট সাপুর যুল আকতাফ আলোচ্য হাযর অধিপতি সাতিরুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। ইবন হিশাম ব্যতীত অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন, হাযর অধিপতি সাতিরুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল সাপুর ইবন আবদশীর ইবন বাবক, সে সাসান গোত্রের প্রথম রাজা। সে আঞ্চলিক রাজাদেরকে পদানত করে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে ফিরিয়ে এনেছিল। পক্ষান্তরে সাপুর যুল আকতাফ ইবন হরমুয সে পূর্বোক্ত সাপুর ইবন আরদশীরের বহুকাল পরের লোক। আল্লাহই ভাল জানেন। এটি সুহায়লীর বর্ণনা। ইবন হিশাম বলেন, পারস্য সম্রাট সাপুর সাতিরুনকে দীর্ঘ দুই বছর পর্যন্ত দুর্গের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখে। অন্যরা বলেন, এই অবরোধের মেয়াদ ছিল চার বছর, আক্রমণের কারণ এই ছিল যে, সম্রাট সাপুর ইরাক সফরে থাকার কারণে অনুপস্থিতির প্রাক্কালে সাতিরুন গিয়ে সাপুরে রাজ্য আক্রমণ করে এবং সেখানে লুটপাট চালায়। প্রতিশোধ স্বরূপ সাপুর তার উপর আক্রমণ করে এবং অবরোধ সৃষ্টি করে। অবরোধকালীন সময়ে একদিন সাতিরুনের কন্যা দুর্গের ছাদে আরোহণ করে। তার নাম নাযীরা। সম্রাট সাপুরকে দেখে মেয়েটি আসক্ত হয়। সাপুরের পরনে ছিল রেশমী কাপড় আর মাথায় ছিল মনি মুক্তা ও ইয়াকুত পাথর খচিত স্বর্ণ মুকুট। সে ছিল সুদর্শন ও রূপবান যুবক। নাযীরা গোপনে সাপুরের নিকট বার্তা পাঠায় যে, পিতার দুর্গের ফটক খুলে দিলে তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? সাপুর ইতিবাচক উত্তর দেয়।

সন্ধ্যা বেলা সাতিরুন প্রচুর মদপান করে সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নেশাগ্রস্ত না হয়ে সে ঘুমাতো না ইত্যবসরে নাযীরা সাতিরুনের মাথার নীচ থেকে দুর্গের চাবি নিয়ে আসে এবং তার এক ক্রীতদাসের মাধ্যমে তা সাপুরের নিকট পাঠিয়ে দেয়। সাপুর প্রাসাদের ফটক খুলে ফেলে। কেউ কেউ বলেন, নাযীরা ওদেরকে একটি প্রশস্ত ঝর্নার কথা জানিয়ে দেয়। সেটির মধ্য দিয়ে প্রাসাদের ভেতরে পানি প্রবেশ করত। অতঃপর ঐ ঝর্নার ভেতর দিয়ে তারা “হাযর” দুর্গে প্রবেশ করে। আবার কেউ কেউ বলেন, “হাযর” প্রাসাদে অবস্থানরত একটি গুপ্তরহস্য সে তাদেরকে জানিয়ে দেয়। তাদের জানা ছিল যে, একটি নীল কবুতর ধরে তার পা দু’টি যতক্ষণ না কুমারী বালিকার রজঃস্রাবের রক্তে রঞ্জিত না করা হবে এবং সেটিকে ছেড়ে না দেয়া হবে ততক্ষণ ঐ ফটক খুলবে না। ঐ কবুতর গিয়ে দুর্গের প্রাচীরে পতিত হলে ঐ যাদুকরী প্রভাব বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং ফটক খুলে যাবে। সাপুর তাই করল এবং দরজা খুলে গেল। সে তখন ভিতরে ঢুকে সাতিরুনকে হত্যা করে হাযর প্রাসাদকে লুটতরাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় এবং ধ্বংস করে ফেলে। তারপর নাযীরাকে নিয়ে বিয়ে করে। একরাতে নাযীরা বিছানায় ঘুমুতে গিয়ে অনিদ্রায় ছটফট করতে থাকে। সাপুর একটি প্রদীপ আনিয়ে তার বিছানা পরীক্ষা করে বিছানায় একটি ফুলের পাতা খুঁজে পায়। সে নাযীরাকে বলে, ‘এটাই কি তোমার অদ্রিার কারণ?’ উত্তরে সে বলে, ‘হ্যাঁ, সাপুর বলে তোমার পিতা তোমাকে নিয়ে কি করত?’ সে বলল, ‘তিনি আমার জন্যে মখমলের বিছানা বিছাতেন। আমাকে রেশমী কাপড় পড়াতেন। হাড়ের মগজ খাওয়াতেন। এবং মদ পান করাতেন।’ সাপুর বলে, ‘তুমি তোমার পিতার সাথে যে আচরণ করেছ এটি কি তার উচিত প্রতিদান? আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসঘাতকতা তা হলে আরো দ্রুততর হবে।’ অতঃপর তার চুলের বেনীকে ঘোড়ার লেজের সাথে বেঁধে ঘোড়াটিকে ছুটিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তার মৃত্যু হয়। এ প্রসঙ্গে কবি আশা ইব্‌ন কায়েছ ইবন ছালাবা বলেনঃ

الم تر للحضر اذا اهله بنعمي وهل خالد من نعم

—তুমি কি দেখনি হাযর দুর্গের অধিবাসীদেরকে যখন তারা ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল? কোন নিয়ামত ও শান্তি কি চিরস্থায়ী?

اقام به شاهبرو لجنود حولين تضرب فيه القدم

—বাদশাহ সাপুর দু’বছর দুর্গের চারিদিকে তার সৈনিক দ্বারা অবরোধ করে রেখেছিল। তাতে তারা কুঠারাঘাত করত।

فلما دعا ربه دعوة - أناب اليه فلم ينتقم

—যখন তার প্রতিপালক ডাক দিল। তখন সে তার দিকে ফিরে গেল। প্রতিশোধ গ্রহণ করল।

فهل زاده ربه قوة - ومبثل مجاوره لم يقم

—তার প্রতিপালক কি তার কোন শক্তি বৃদ্ধি করেছে? ঐরূপ আশ্রয়দাতা কোন সাহায্য করতে পারে না।

وكان دعا قومه دعوه -هلموا الى أمركم قد صرم

—সে তার সম্প্রদায়কে ডাক দিয়েছিল। এই বলে যে, তোমরা এগিয়ে আস এমন এক কর্মের প্রতি যা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে।

فموتوا كراما بأسيافكم - ارى الموت بجشمه من جشم

—তোমরা তরবারী ধারণ করে মর্যাদার সাথে মৃত্যুবরণ কর। আমি মনি করি, যে ব্যক্তি কষ্ট সহিষ্ণু মৃত্যু সহজে তার নিকট আসে না।

এ প্রসঙ্গে আদী ইবন যায়দেরও দীর্ঘ কবিতা রয়েছে যার শেষ কয়টি পংক্তি এরূপঃ

وتذكر رب الخورنق اذ- اشرف يوما وللهدى تفكير

—তুমি স্মরণ কর খাওরানাক প্রাসাদের [প্রথম নুমান কর্তৃক নির্মিত রাজপ্রাসাদ] মালিকের কথা। একদিন সে প্রাসাদের ছাদে উঠেছিল। তার জীবনে হেদায়াত প্রার্থীদের জন্যে চিন্তার খোরাক রয়েছে।

سره ماله وكثرة ما يملك والبحر معرضا والسكير

—তার ধন-সম্পদ ও মালিকানাধীন বস্তুসমূহ, তাকে আনন্দ দান করেছিল।

فارعوى قلبه وقال وما غبتطة حي الى الممات يصير

—অবশেষে তার অন্তর সুপথ প্রাপ্ত হল এবং সে বলল, কোন জীবিত ব্যক্তির ঈর্ষণীয় কীই বা আছে? সে তো মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

ثم أفحوا كانهم ورقجف فالوت به الصبا والدبور

—অবশেষে তারা হয়ে গেল শুকনো পাতার ন্যায়। পূবাল ও পশ্চিমী বায়ু সেটিকে ওলট-পালট করে দেয়।

আমি বলি কবিতায় উল্লেখিত খাওরানাক প্রসাদের মালিক হলো প্রাচীন যুগের অন্যতম খ্যাতিমান রাজা। তার অপচয়, সত্যদ্রোহিতা সীমালংঘন, গোঁড়ামী, কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং আপন প্রতিপালকের অবাধ্যতার জন্যে সে যুগের জনৈক আলেম তাকে উপদেশ দেন। তার পূর্ববর্তী রাজা বাদশাহ ও রাজ্য রাজত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি তাকে উপদেশ দেন যে, কেমন করে ওরা সবাই ধ্বংস হয়ে গেল এবং তাদের কেউই অবশিষ্ট থাকল না। তিনি আরো বললেন, অন্যের নিকট থেকে যে রাজত্ব হস্তান্তরিত হয়ে আপনার নিকট এল আপনার মৃত্যুর পর সেটি হস্তান্তরিত হয়ে অন্যের নিকট চলে যাবে। উক্ত আলেমের উপদেশ তার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং চূড়ান্ত ভাবাবেগের জন্ম দেয়। ফলে তার অন্তর হিদায়াতের দিকে ফিরে আসে। সে একদিন একরাত চিন্তা করে। সংকীর্ণ কবরের ভয় তার অন্তরে জাগে। অতঃপর সে তাওবা করে এবং ইতিপূর্বেকার সকল অপকর্ম থেকে নিবৃত হয়। সে রাজত্ব ত্যাগ করে। ফকীর বেশে মাঠে প্রান্তরে ঘোরা ফেরা করে এবং নির্জনতাপ্রিয় হয়ে উঠে। প্রবৃত্তির অনুসরণ ও বিশ্ব প্রতিপালকের অবাধ্যতা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখে।

শায়খ ইমাম মুওয়াফিক ইবন কুদাসা মুকাদ্দিসী (র) তাঁর ‘আত তাউয়াবীন’ কিতাবে এই ঘটনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। মজবুত সনদে সুহাইলী তাঁর সুবিন্যস্ত কিতাব ‘আররাওযুল উনুফ’ কিতাবে এটি উল্লেখ করেছেন।

৬৮
আঞ্চলিক রাজাদের বিবরণ
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে হাযর অধিপতি সাতিরুন ছিল আঞ্চলিক রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার মেসিডোনিয়ার ফিলিপস তনয় গ্রীকসম্রাট আলেকজান্ডারের যুগ। কারণ তিনি যখন পারস্য সম্রাট দারা ইবন দারার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন, তার সম্রাজ্য পদানত করেন এবং তার শহর নগর বিধ্বস্ত করে দিয়ে তার কোষাগারসমূহ লুট করে, পারসিকদের শক্তিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে যেন তখন তিনি এই সংকল্পও করেন যে, অতঃপর তারা যেন কোন প্রকারেই ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। এজন্যে তিনি তাদের এক একজন লোককে আরব-অনারব অঞ্চলের এক একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের জনগণের জন্য রাজা রূপে মনোনীত করেন। এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকার নিরাপত্তা বিধান করে। বহিরাক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করত এবং কর আদায় করত। সংশ্লিষ্ট কোন রাজার মৃত্যু হলে তারই কোন পুত্র কিংবা ঐ সাম্প্রদায়ের অন্য কাউকে তার স্থলে রাজা রূপে নিয়োগ করা হতো। প্রায় ৫০০ বছর এভাবেই অতিবাহিত হয়। তারপর আবির্ভাব হয় সম্রাট “আরদশীর ইবন বাবকের’। তিনি ছিলেন সাসান (ইবন বাহমান ইবন ইসকান দিয়ার ইবন ইয়াশতাসিব ইবন লাহরাসিব)-এর অন্যতম পুত্র। তিনি পারস্য রাজ্য পুনরুদ্ধার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়। তিনি সকল আঞ্চলিক রাজ্য তার অধীনে নিয়ে আসেন আঞ্চলিক সকল রাজার রাজ্যের তিনি বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তাদের কোন ধন সম্পদ তিনি অক্ষুন্ন রাখেননি। তাদের সংশ্লিষ্ট রাজ্য হাযর পুনর্দখল হয় অনেক দেরীতে। আরদশীরের মৃত্যুর পর তার পুত্র সাপুর তা অবরোধ করেন এবং তা দখল করে নেন। ইতিপূর্বে এ ঘটনা আলোচনা হয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন।

৬৯
ইসমাঈল (আ)-এর বংশধরগণে এবং জাহেলী যুগ থেকে নবুওয়াত (প্রাপ্তিকাল পর্যন্ত ঘটনাবলী)
নবীগণের আলোচনা প্রসংগে হযরত ইসমাঈল (আ)-এর কথা আলোচিত হয়েছে। তার মা হাজেরাসহ তাঁকে সাথে নিয়ে পিতা ইবরাহীম (আ) মক্কায় যে আগমন আলোচনা করেছিলেন এবং ফারান পর্বতের পাদদেশে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে ছিলেন তাও আলোচিত হয়েছে।

সেখানে তার না ছিল কোন বন্ধু-বান্ধব আর না ছিল কোন সহানুভূতিশীল লোক। তখন হযরত ইসমাঈল (আ) দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ)। তাদেরকে সেখানে রেখে চলে যান। এক থলে খেজুর ও এক মাত্র পানি ছাড়া হাজেরা (আ)-এর নিকট তখন অন্য কিছু ছিল না। তা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ্ তা’আলা হযরত হাজেরা (আ)-এর জন্যে যমযম কুয়ো উৎসারিত করে দেন। এটির পানি ছিল একই সাথে সুমিষ্ট খাদ্য স্বরূপ ও রোগের প্রতিষেধক। ইমাম বুখারী (র) বর্ণিত হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর দীর্ঘ হাদীসটিতে তা আলোচিত হয়েছে। এরপর মক্কায় হাজেরা (আ)-এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় আগমন করে জুরহুম গোত্র। এ কুয়ো থেকে তাদের শুধুমাত্র পানি পান করার ও প্রয়োজনীয় কার্যাদি সমাধার অনুমতি ছিল।

সঙ্গীরূপে তাদেরকে পেয়ে হযরত হাজেরা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। হযরত ইবরাহীম (আ) নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নিতে আসতেন। কথিত আছে যে, বায়তুল মুকাদ্দস ও মক্কা যাতায়াতে তিনি বুরাকে আরোহন করতেন। হযরত ইসমাঈল যখন দৌড়াদৌড়ি করার মত বয়সে পৌঁছলেন এবং পিতার সাথে কাজ করার মত তরুণে পরিণত হলেন তখন তার কুরবানী বিষয়ক ঘটনাটি সংঘটিত হল। ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, বিশুদ্ধ মতানুযায়ী হযরত ইসমাঈল (আ)-কেই কুরবানীর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। হযরত ইসমাইল (আ) বয়ঃপ্রাপ্ত হলে জুরহুম গোত্রের এক মহিলার সাথে তার বিবাহ হয়। পরে ঐ স্ত্রীর সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ। এবং তিনি অন্য মহিলাকে বিবাহ করেন। এবার তিনি বিবাহ করেন মুদাদ ইবন আমর জুরহুমীর কন্যা সাইয়েদাকে। তার গর্ভে ১২ জন পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে তাদের কথাও আলোচিত হয়েছে। এ পুত্রগণ হলেন নাবিত, কায়যার, মানশা, মিসমা, মাশী, দিম্বা, আযর, ইয়াতুর, নায়শী, তাইমা এবং কায়যুমা। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ও অন্যরা কিতাবীদের গ্রন্থ সূত্রে এরূপই উল্লেখ করেছেন। হযরত ইসমাঈল (আ)- এর একজন মাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন। তার নাম ছিল নাসিমা। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র ঈসূ ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীমের নিকট তাঁকে বিবাহ দেন। ঐ কন্যার গর্ভে রূম ও কারিমের জন্ম হয়। এক বর্ণনা মুতাবিক আশবানও তার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

হেজাজী আরবগণ বিভিন্ন গোত্র ও উপগোত্রে বিভক্ত হলেও বংশগত উৎসের দিক থেকে তারা হযরত ইসমাঈল (আ)-এর দু’পুত্র নাবিত ও কায়যার-এর বংশধর। হযরত ইসমাঈল (আ) এরপর তাঁর পুত্র নাবিত কাবা শরীফ ও যমযমের তত্ত্বাবধায়ক, মক্কা মুকাররমার প্রশাসক হন এবং ঐ অঞ্চলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জুরহুমীদের ভাগ্নেও বটে। এরপর ভাগ্নেদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে জুরহুমীগণ কা’বা শরীফের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। অতঃপর ইসমাঈল বংশীয়দের স্থলে তারাই দীর্ঘদিন মক্কা মুকাররমা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা শাসন করে। নাবিত এরপর জুরহুমীদের মধ্যে সর্বপ্রথম শাসনভার গ্রহণ করে মুদাদ ইব্‌ন আমার ইবন সাদ ইবন রাকীব ইবন আবীর ইবন নাবত ইব্‌ন জুরহুম। জুরহুম ছিলেন কাহতানের পুত্র।

কেউ কেউ বলেন, জুরহুমের বংশ তালিকা হল জুরহুম ইবন ইয়াকতান ইবন আবীর ইবন শালিখ ইব্‌ন আরফাখশায ইবন সাম ইবন নূহ। তিনি বসতি স্থাপন করেছিলেন মক্কার উচু অঞ্চল কাইকা’আল নামক স্থানে। কাতুরা সম্প্রদায়ের নেতা সামীদা তাঁর সম্প্রদায়কে নিয়ে বসতি স্থাপন করেন মক্কার নিম্নাঞ্চলে। তাদের উভয়ে নিজ নিজ এলাকা দিয়ে মক্কায় যাতায়াতকারী কাফেলা থেকে কর উশুল করত। পরবর্তীতে জুরহুম ও কাতুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে সামীদা নিহত হয়। মুদাদের ক্ষমতা অধিকতর দৃঢ় হয়। তিনি মক্কা মুকাররমা ও বায়তুল্লাহর একচ্ছত্র শাসকরূপে আবির্ভূত হন। ইসমাঈল বংশীয় লোকজন তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মর্যাদাবান এবং মক্কায় ও অন্যান্য স্থানে প্রভাব বিস্তারকারী ছিল। কিন্তু মুদাদ তাদের মাতুল হওয়ার কারণে এবং বায়তুল্লাহ শরীফের সম্মানের খাতিরে ইসমাঈল বংশীয় কেউ তার বিরুদ্ধাচারণ করেন নি। মুদাদের পর তার পুত্র হারিছ কর্তৃত্ব লাভ করে। তারপর ক্ষমতা লাভ করেন হারিছের পুত্র আমর। এরপর জুরহুম গোত্র মক্কায় সত্যদ্রোহিতা ও অনাচারে লিপ্ত হয়। তারা চরম অশান্তি সৃষ্টি করে। মসজিদুল হারামে পাপ কার্য সংঘটিত করে।

কথিত আছে যে, আসাক ইবন বুগা নামক জনৈক পুরুষ এবং নাইলা বিনত ওয়ায়িল নাম্মী এক মহিলা কাবা শরীফে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তা’আলা তাদের দুজনকে পাথরে পরিণত করে দেন। তাদের দুজনকে দেখে মানুষ যেন শিক্ষা গ্রহণ করে এ উদ্দেশ্যে তাদের প্রস্তরমূর্তি বায়তুল্লাহ শরীকের অদূরে এক জায়গায় স্থাপন করা হয়। দীর্ঘদিন পর খুযাআ গোত্রের শাসনামলে মানুষ আল্লাহকে ছেড়ে এ দু’টি মূর্তির উপাসনা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তারা আসাক ও নাইলা নামের দেব-দেবীতে পরিণত হয়।

জুরহুম গোত্র যখন হারাম শরীফ ও সম্মানিত নগরীতে ব্যাপক হারে পাপাচার ও সীমালংঘন শুরু করে তখন খুযাআ গোত্র তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। খুযাআ গোত্র ইতিপূর্বে হারাম শরীফ এলাকায় বসবাস করছিল। তারা ছিল আমর ইবন আমির-এর বংশধর। ইয়ামানের বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনের ঘটনায় সে ইয়ামান ত্যাগ করে এ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। কেউ কেউ বলেন যে, খুযাআ ছিল হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর। আল্লাহ্ ভাল জানেন।

বস্তুত জুরহুমীদের অনাচারের প্রেক্ষিতে খুযাআ গোত্র ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে সংঘবদ্ধ হয় এবং ওদেরকে যুদ্ধের আহবান জানায়। উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। এ সময়ে ইসমাঈল বংশীয়গণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। যুদ্ধে খুযাআ গোত্রের জয় হয়। তারা বনু বকর ইবন আবদ মানাত গোত্র ও গাবশান গোত্র, তারা জুরহুমীদেরকে বায়তুল্লাহ শরীফ ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে বহিষ্কার করে। তখন তাদের নেতা আমর ইবন হারিছ ইবন মুদাদ জুরহুমী বায়তুল্লাহ শরীফের দুই প্রধান ও প্রিয় বস্তু রুকন ও হাজরে আসওয়াদ খুলে নেয়। সাথে অলংকৃত তরবারীগুলো এবং অন্য কতক বস্তু কা’বা শরীফ থেকে খুলে নিয়ে সবগুলো যমযম কূপের মধ্যে পুঁতে ফেলে এবং যমযম কূপে একটি চিহ্ন স্থাপন করে। অবশেষে নিজের সম্প্রদায়ের লোকজনসহ সে ইয়ামানে ফিরে যায়।

এ উপলক্ষে দলনেতা আমর ইবন হারিছ ইবন মুদাদ বলেনঃ

وقائلة والدمع سكب مبادر - وقد شرقت بالدمع منها المحاجر

—এ সব প্রত্যাবর্তনকারী কাফেলা তাদের অশ্রুরাশি দ্রুত গড়িয়ে পড়ছে। এদিকে চোখের অশ্রু ঝড়িয়ে মক্কার হাতীম ও সম্মানিত স্থানগুলোও পূর্বদিকে যাত্রা করেছে।

كان لم يكن بين الحجون الى الصفا - ولم سيمر بمكة سامر

—যেন সুদূর সাফা পর্বত পর্যন্ত পাহাড়ে পর্বতে তার কোন বন্ধু ছিল না এবং ছিল না মক্কা ভূমে রাত্রে একান্ত কথা বলার কোন সুজন।

فقلت لها القلب منی گانما -يلجله بين الجناحين طائر

—প্রিয়ভূমি মক্কার উদ্দেশ্যে আমি বললাম, তখন আমার হৃদয় এমন অস্থির ছিল, যেমন থাকে দু’পাখার মাঝখানে মাথা আছড়ানো পাখি।

بلی نحن كنا أهلها فاز النا - صروف الليالفي والجدور العواثر

—হ্যাঁ আমরাই তার উপযুক্ত অধিবাসী ছিলাম, অতঃপর যুগচক্র ও বদনসীবী আমাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল।

وكنا ولاة البيت من بعد نابت - نطوف بذالك البيت والخيرظاهر

—নাবিতের পর আমরাই আল্লাহর গৃহের তত্ত্বাবধায়ক ছিলাম, সেই সূত্রে আমরা ঐ গৃহের তাওয়াফ করতাম। এতে কল্যাণ ও লাভ তো সুস্পষ্ট।

وزحن و لينا البيت من بعد نابت - بعز فما يظى لدينا المكاثر

—নাবিতের পর আমরা অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের সাথে ঐ গৃহের তত্ত্বাবধান করেছি। ফলে পরম ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিও আমাদের ন্যায় সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি।

ملكنا فعززنا فاعظم بملكنا - فليس لحي غيرنا ثم فاخر

—আমরা রাজত্ব লাভ করেছি, আমরা সম্মানের অধিকারী হয়েছি আমাদের রাজত্ব ছিল পরম গৌরবের। সেখানে আমরা ব্যতীত অন্য কোন গোত্র ও সম্প্রদায়ের জন্যে অহংকার প্রদর্শনের অবকাশ ছিল না।

ألم تنكحوا من خير شخص علمته - فابنا وه منا ونحن الأصاهر

—তোমরা কি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করনি? নিশ্চয়ই আমি তো তা জানি। সুতরাং সে ব্যক্তির ছেলেমেয়ে আমাদেরই রক্ত সম্পর্কিত এবং আমরা শ্বশুর গোষ্ঠী।

فان تنثني الدنيا علينا بحالها- فان لها حالا وفيها الشاجر

—পৃথিবী যদি তার পূর্বাবস্থা সহকারে পুনরায় আমাদের নিকট ফিরে আসে তবে তখন তার একটা স্মরণযোগ্য অবস্থা সৃষ্টি হবে এবং তাতে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মুকাবিলা হবে।

فاخرجنا منها المليك بقدرة - كذلك ياللناس تجرى المقادر

—মহান মালিক ও প্রভু আপন কুদরতে আমাদেরকে ওখান থেকে বের করে দিলেন। হায়! এভাবেই মানুষের জন্যে অদৃষ্টের লিখন কার্যকর থাকে।

اقول اذا نام الخلي ولم أنم - اذا العرش لا يبعد سهيل وعامر

—উদ্বেগ উৎকণ্ঠাহীন ব্যক্তিবর্গ যখন নিশ্চিন্তে ঘুমায় তখনও আমি ঘুমাই না, আমি জেগে জেগে বলি, হায় আরশ যেন সুহায়ল ও আমিরকে বিতাড়িত না করে।

وبدلت منها أوجها لا أحبها - قبائل منها حمير ويحابر

—শেষ পর্যন্ত আমার পরিবর্তে এমন কতক লোককে স্থান দেয়া হয় আমি যাদেরকে ভালবাসি। তারা হল হিময়ার ও ইউহাবির গোত্র।

وصرنا أحاديث وكنا بغبلة - بذلك عضتنا السنون الغوابر

—অনন্তর আমরা হয়ে গেলাম কাহিনীর বিষয়বস্তু ও ইতিহাসের উপাদান। অথচ আমরা ছিলাম অন্যের ঈর্ষার কারণ। অনাগত কাল পরিক্রমা আমাদেরকে দংশন করেছে।

فسحت دموم العين تبكي لبلدة - بها حرم أمن وفيها المشاعر

—চোখে অশ্রু নির্গত হল অবিরাম, সেই শহরের জন্যে ক্রন্দনের কারণে যে শহরে রয়েছে হারাম শরীফ এবং যেখানে রয়েছে কুদরতের নিদর্শনাবলী।

وتبكي لبيت ليس بؤذي حمامه - يظل به أمنا و فيه العصافر

—চক্ষু ক্রন্দন করছিল সেই মহান গৃহের জন্যে যেখানে কবুতর কষ্ট পায় না। বরং যেখানে এসে নিরাপদে ছায়া ভোগ করে, যেখানে রয়েছে নিরুদ্বিগ্ন চড়ুই পাখির দল।

وفيه وحوش لاترام أنيسة - اذا خرجت منه فليس تغادر

—সেখানে রয়েছে বন্য পশু পাখি, সেগুলো কে পোষ মানানোর প্রয়াস চাওয়া হয় না। সেগুলো সেখান থেকে একবার বেরিয়ে গেলেও স্থায়ীভাবে সে স্থান ছেড়ে যায় না।

ইবন ইসহাক (র) বলেন, জুরহুমীদের পরে মক্কার কৃর্তৃত্ব গ্রহণকারী বনু বকর ও গাবশান গোত্রের কথা উল্লেখ করে আমর ইবন হারিছ ইবন মুদাদ আরও বলেছেনঃ

يا أيها الناس سيروا ان قصار گم - أن نصبحوا ذات يوم لأسيرونا

—হে লোক সকল! (বনু বকর ও গাবশান) তোমরা ভ্রমণ কর এগিয়ে যাও। কারণ তোমাদের শেষ সীমানা এতটুকু যে, এমন একদিন আসবে যখন তোমরা আর চলাচল করতে পারবে না।

حثوا ألمطى وارخوا أذمتها - قبل الممات وقفوا ماتقضون

—উটকে উত্তেজিত কর, উদ্বেলিত কর এবং তার লাগাম শিথিল করে দাও মৃত্যু আমার পূর্বেই এবং যা করতে চাও মৃত্যুর পূর্বেই তা করে নাও।

گنا أناسا كما كنتم فغيرنا - دهر فانتم كما صرنا تصيرونا

—তোমরা এখন যেমন আমরাও একসময় তেমন ছিলাম। কালচক্র আমাদেরকে পরিবর্তিত ও স্থানান্তরিত করে দিয়েছে। আমরা যেরূপ হয়েছি আমাদের যে পরিণতি হয়েছে তোমরাও সেরূপ হবে।

ইবন হিশাম (র) বলেন, আমর ইবন হারিছের কবিতাগুলোর মধ্যে এগুলোই আমরা বিশুদ্ধ সূত্রে পেয়েছি কতক কবিতা বিশেষজ্ঞ আমাকে জানিয়েছেন যে, এগুলোই আদি আরবী কবিতা। ইয়ামান দেশে পাথরে লিখিত অবস্থায় এগুলো পাওয়া গেছে। এগুলো রচনা করেছে কোন ব্যক্তি তার অবশ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সুহায়লী (র) এগুলোর সমপর্যায়ের অনুরূপ আরো কতক কবিতা উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে এক অদ্ভুত ঘটনাও বর্ণনা করেছেন এগুলো অন্য ভাষা থেকে আরবীতে রূপান্তরিত বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেন, আবুল ওলীদ আরাকী তাঁর ফাযায়েলে মক্কা গ্রন্থে আমর ইবন হারিছের উপরোল্লেখিত কবিতার সাথে নিমোক্ত কবিতাগুলো সংযোজন করেছেন।

قدمال دهر علينا ثم اهلكنا بالبغي فينا وبز الناس ناسونا .

—কালচক্র আমাদেরকে আঘাত করেছে অতঃপর আমাদের মধ্যে সত্যদ্রোহীতা সৃষ্টি করে আমাদেরকে ধ্বংস করেছে। অথচ মানুষের মধ্যে সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধা ছিল আমাদের লোকগুলো।

و استخبروا في ضنيع الناس قبلكم - كما اتبان طريق عنده الهونا .

—তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজ খবর নাও, তবে জানতে পারবে যে, আমাদের জন্যে সত্য পথ যেমন উন্মুক্ত হয়েছিল শেষ পর্যন্ত অপমান ও লাঞ্ছনাও তেমনি এসেছে।

کنا زمانا ملوك الناس قبلكم - بمسكن في حرم الله مسگونا .

—তোমাদের পূর্বে দীর্ঘকাল আমরা মানুষের উপর রাজত্ব করেছি আল্লাহ তা’আলার সম্মানিত স্থান হারাম শরীফে বসবাস করেছি আমরা।

৭০
খুযাআ গোত্র, আমর ইবন লুহাই এবং আরবদের মূর্তি পূজার সূচনা
ইবন ইসহাক (র) বলেন, বনু বকর ইবন আবদ মানাতকে বাদ দিয়ে খুযাআ গোত্রের গাবশান উপপোত্র কাবা শরীফের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হয়। আমর ইবন হারিছ গাবশানী উক্ত উপগোত্রের দলপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে। কুরায়শ গোত্র তখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও বনী কিনানার বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, ইয়ামান ত্যাগ করে সিরিয়া অভিমূখে যাত্রা কালে আমর ইবন আমিরের বংশধরদের মধ্য থেকে তারা বিচ্ছিন্ন ও পৃথক হয়ে যাওয়ার কারণে এদেরকে খুযাআ (বিচ্ছিন্নতা দল) বলা হয়। মাররুয মাহরান নামক স্থানে এসে তারা বসবাস করতে থাকে।

আওন ইবন আইয়ুব আনসারী খাযরাজী (রা)-এ প্রসংগে বলেনঃ

فلما هبطنا بطن مرتخزمت - جزاعة منا في حلول کراکر

—আমরা যখন মরু অঞ্চলে অবতরণ করি তখন খুযা’আ গোত্র দলবদ্ধভাবে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

حمت كل واد من تهامة واحتمت - بصم القنا والمرهفات ألبواتر .

—তারা তিহামা অঞ্চলের সকল উপত্যকা সংরক্ষণ করেছে এবং সুকঠিন বর্শা ও সুতীক্ষ্ণ ধার তরবারী দ্বারা নিজেদেরকে রক্ষা করেছে।

আবুল মুতাহহার ইসমাঈল ইবন রাফি আনসারী আওসী বলেনঃ

فلما هبطنا بطن مكة أحمدت - خزاعة دار الأكل المتحامل .

—আমরা যখন মক্কার জমিতে অবতরণ করলাম তখন খুযাআ ঐ বৃক্ষ ভর্তি খেজুরের দেশের প্রশংসা করল।

فحلت أكاديسا وشتت قنابل - عل كل حى بين نجد وساحل .

وشتت و

—অতঃপর তারা দলবদ্ধভাবে সেখানে নেমে পড়ল আর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নাজদের উচ্চ ভূমি ও সমুদ্র তীরের মধ্যবর্তী সকল গোত্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।

تفواجزهما عن بطن مكة- واحبتوا بعز خزاعي شديد الكواهل

—তারা মক্কা ভূমি থেকে জুরুহুম গোত্রীয় লোকদেরকে বিতাড়িত করে এবং সুঠামদেহী খুযা’আ গোত্রীয় সম্মানের পোশাক তারা পরিধান করেছে।

বস্তুত খুযা’আ গোত্র তখন বায়তুল্লাহ শরীফের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হয়। পুরুষানুক্রমে একের পর এক তারা ঐ দায়িত্ব পালন করে। এই পর্যায়ে তাদের শেষ ব্যক্তি ছিল খলীল ইবন হাবিশিয়্যা ইবন সালুল ইবন কা’ব ইবন আমর ইবন রযী’আ খুঈ। কুসাই ইবন কিলাব খলীলের কন্যা হিরীকে বিবাহ করে। এই স্ত্রীর ঘরে তিনি ৪টি পুত্র সন্তান লাভ করেন। তারা। হল আবদুদ্দার, আবদ মানাফ, আবদুল উযযা ও আবদ নামে অপর একজন। অতঃপর বায়তুল্লাহ শরীফের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আসে কুসাই ইবন কিলাবের হাতে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে আসবে ইবনশাআল্লাহ।

খুযা’আ গোত্র একাধিক্রমে প্রায় ৩০০ বছর মতান্তরে ৫০০ বছর বায়তুল্লাহ শরীফ দেখা শোনার দায়িত্ব পালন করে। আল্লাহই ভাল জানেন। তাদের সময়কালে তারা জঘন্য অনাচারে লিপ্ত হয়। কারণ তাদের শাসনামলেই হেজাযে সর্বপ্রথম মূর্তি পূজার প্রচলন ঘটে। এ অপকর্মের মূল হোতা ছিল তাদের নেতা আমর ইবন লুহাই। তার প্রতি আল্লাহর লা’নত হোক! কেননা সেই সর্বপ্রথম তাদেরকে মূর্তি পূজার দিকে আহ্বান করে। সে অগাধ ধন-সম্পত্তির অধিকারী। কথিত আছে যে, সে ২০টি উটের চোখ বিদ্ধ করেছিল। অর্থাৎ সে ২০ হাজার উটের মালিক হয়েছিল। আরব দেশে প্রথা ছিল যে, কেউ এক হাজার উটের মালিক হলে সে একটি উটের চোখ বিদ্ধ করতো। এটি দ্বারা তারা অবশিষ্ট উটগুলোর প্রতি বদনজর প্রতিরোধের ধারণা পোষণ করত। আযরকী এরূপ বলেছেন।

সুহায়লী বলেন, আমর ইব্‌ন লুহাই কোন কোন সময়ে হজ্জ উপলক্ষে দশ হাজার উট জবাই করত, প্রতিবছর দশ হাজার জোড়া বস্ত্র দান করত। আরবদের জন্যে ভোজের আয়োজন করত। ঘি, মধু এবং ছাতুর দিয়ে হালুয়া তৈরি করত। ঐতিহাসিকগণ বলেন, আরবদের মাঝে তার কথা ও কাজ শরীয়তের মত অনুসরণ করতো। এটি ছিল তার মর্যাদা, অবস্থান ও তাদের প্রতি তার অকাতর বদান্যতার ফল।

ইবন হিশাম (র) বলেন, কতক বিত্তজন আমাকে জানিয়েছেন যে, একদা আমর ইবন লুহাই কোন এক কাজে মক্কা থেকে সিরিয়া গমন করে। বালকা অঞ্চলে মাআব নামক স্থানে গিয়ে সে দেখতে পায় যে, সেখানকার লোকজন প্রতিমা পূজা করছে। ঐ অঞ্চলে তখন বসবাস করত আমালীক সম্প্রদায়। তারা ইসলাক’-এর বংশধর।

কেউ কেউ বলেন, তারা হল আমালীক ইবন লাওয ইবন সাম ইবন নূহ (আ)-এর বংশধর। প্রতিমা পূজায় লিপ্ত দেখে সে বলল, ‘এগুলো কেমন প্রতিমা যে তোমরা এগুলোর উপাসনা করছ?’ তারা বললেন, ‘আমরা এ সকল প্রতিমার উপাসনা করি, অতঃপর আমরা ওগুলোর নিকট বৃষ্টি চাইলে ওরা আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করে। আমরা ওগুলোর নিকট সাহায্য কামনা করলে ওরা আমাদেরকে সাহায্য করে।’ আমর বলল, ‘তোমরা কি আমাকে একটি প্রতিমা দিবে যে, আমি সেটি নিয়ে আরব অঞ্চলে যাব এবং আরবগণ এটির উপাসনা করবে?’ ওরা তাকে হুবল নামের একটি প্রতিমা দান করে এবং লোকজনকে সেটির উপাসনা করার এবং সেটির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়।

ইবন ইসহাক (র) বলেন, হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধরদের মধ্যে সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা প্রচলনের সূচনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের ধারণা এই যে, মক্কায় জনজীবন সংকুচিত ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে তাদের কোন কাফেলা তা থেকে মুক্তিলাভ ও স্বচ্ছতা অর্জনের আশায় অন্য এলাকায় সফর করত। তখন তারা হারাম শরীফের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও বরকত লাভের আশায় হারাম শরীফের এক একটি পাথর সাথে নিয়ে যেত। তারা যেখানে তাঁবু ফেলত সেখানে ঐ পাথর রাখত এবং কাবা শরীফের তাওয়াফের ন্যায় সেটির চারিদিকে তাওয়াফ করত। এভাবেই তাদের রীতি চলে আসছিল। এক সময় তারা তাদের প্রিয় ও পছন্দের পাথর পেলেই তারা উপাসনা শুরু করে দেয়। অবশেষে আগমন ঘটে তাদের উত্তরসূরীদের। এরা সরাসরি মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয় এবং সূচনা পর্বের রীতি ও উদ্দেশ্যের কথা ভুলে যায়।

‘আস সাহীহ’ গ্রন্থে আবু রাজা আতারদী থেকে বর্ণিত আছে... তিনি বলেন, জাহেলী যুগে আমরা এমন ছিলাম যে, কোন পাথর না পেলে আমার মাটির স্তুপ তৈরি করতাম। সেখানে একটি বকরী এনে দুধ দোহন করে ঐ মাটিতে নজরানা দিতাম, অতঃপর সেটির চারিদিকে তাওয়াফ করতাম।

ইবন ইসহাক (র) বলেন, এভাবে তারা হযরত ইবরাহীম (আ) ও ইসমাঈল (আ)-এর দীন বিকৃত করে প্রতিমা পূজায় লিপ্ত হয় এবং তাদের পূর্ববর্তী গোমরাহ ও বিভ্রান্তি উম্মতদের ন্যায় একই উম্মতে পরিণত হয়। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দীনে ছিল না এমন বহু কিছু তার মধ্যে সংযোজন করা সত্ত্বেও তার দীনের কতক নিদর্শন ও রীতিনীতি তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তারা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সেগুলো ধরে রেখেছিল। যেমন বায়তুল্লাহ শরীফকে সম্মান করা, সেটির তাওয়াফ করা ও ওমরাহ করা, আরাফাত ময়দান ও মুযদালিফাতে অবস্থান করা, উট কুরবানী করা। হজ্জ ও উমরাহ করার জন্যে ইহরাম বাঁধা।

কিনানা ও কুরায়শ গোত্র ইহরাম বাঁধার সময় উচ্চস্বরে বলতঃ

لبيك اللهم لبيك لبيك لا شريك لك الأ شريكا هو لك تملكه وما ملك

“হে আল্লাহর বান্দা হাজির বান্দা হাজির। বান্দা হাজির হে আল্লাহ! আপনার কোন শরীক নেই, তবে একটি শরীক আছে যে আপনারই। আপনি তার এবং তার মালিকানাধীন সবকিছুর মালিক। সে কোন কিছুর মালিক নয়।”

তালবিয়্যা উচ্চারণে তারা প্রথম পর্যায়ে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয় এরপর তার সাথে তাদের মূর্তিগুলোর কথা উল্লেখ করে এবং সেগুলোর মালিকানা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( وَمَا یُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ )

[Surah Yusuf 106]

“তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে স্বীকার করে কিন্তু তার শরীক করে। (১২ ইউসুফঃ ১০৬) অর্থাৎ আমার যথাযথ পরিচিতি জানার প্রেক্ষাপটে তারা আমার একত্ববাদের ঘোষণা দেয় আর সেই সাথে আমারই সৃষ্টি জগতের কাউকে আমার শরীক সাব্যস্ত করে।”

সুহায়লী প্রমুখ বলেন, উপরোক্ত তালবিয়াহ সর্বপ্রথম পাঠ করেছে আমর ইবন লুহাই। একদিন একজন বুযুর্গ লোকের রূপ ধরে ইবলীস এসে তার নিকট হাজির হয়। ইবলীস উচ্চস্বরে এই তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকে এবং আমর ইবন লুহাই তা শুনতে থাকে এবং অনুরূপ পাঠ করতে থাকে। অবশেষে মুশরিক আরবগণ আমর ইবন লুহাইর পাঠ অনুসরণে এ তালবিয়াহ উচ্চারণ করে। বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত রয়েছে যেঃ

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا سمعهم يقولون لبيك لا شريك لك يقول قد قد

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (স) যখন তাদের তালবিয়াহ পাঠ শুনতেন এবং যখন তারা

لبيك لا شريك لك

(বান্দা হাজির আপনার কোন শরীক নেই) পর্যন্ত পাঠ করত তখন রাসূলুল্লাহ (স) বলতেন, ‘থাম, থাম, যথেষ্ট হয়েছে।’

ইমাম বুখারী (র) বলেন, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, যে নবী করীম (সা) বলেছেনঃ

إن أول من سيب السوائب وعبد الأصنام أبو خزاعة عمروبن عامر واني رأيته يجر أمعاءه في التار .

—সর্বপ্রথম দেবতার নামে পশু উৎসর্গ করেছে এবং মূর্তি পূজা চালু করেছে আবু খুযাআ আমর ইবন আমির। আমি তাকে দেখেছি যে, জাহান্নামে সে তার নাড়িভুড়ি হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।” আলোচ্য বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, আমর ইব্‌ন লুহাই হলো গোটা খুযাআ গোত্রের আদি পুরুষ। তার নাম অনুসারেই খুযাআ গোত্রের নামকরণ করা হয়।

ইবন ইসহাক ও অন্যান্যদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, কতক বংশ বিশারদ এরূপ বলেছেনও বটে। আমরা যদি এতটুকুতেই সীমিত থাকি তবে এটি একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু কোন কোন বর্ণনা এর বিপরীত এসেছে।

যেমন ইমাম বুখারী (র) সাঈদ ইবন মুসায়্যাব (রা) সূত্রে বলেছেন, “বাহীরা হল সেই প্রাণী যার স্তনকে তাগুত বা দেবতার জন্যে সংরক্ষিত রাখা হয়। অতঃপর কেউই তার দুধ দোহন করে না।” সাইবা হল সেই প্রাণী যা তারা তাদের দেবতার নামে ছেড়ে দেয়, অতঃপর তার পিঠে কিছুই চাপানো হয় না।

ইমাম বুখারী (র) আরো বলেন, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ফরমানঃ

رایت عمروبن عامر الخزاعم يجر قصبه في النار كان أول من سيب السوائب .

“আমি আমর ইবন আমির খুযাঈকে দেখেছি জাহান্নামে সে তার নাড়িভূঁড়ি হেঁচড়িয়ে পথ চলছে। সেই সর্বপ্রথম সাঈবা প্রাণী ছেড়ে দেয়ার রেওয়াজ চালু করে।” ইমাম মুসলিম (র)-ও ভিন্ন সূত্রে এটি উদ্ধৃত করেছেন।

সর্বপ্রথম ইমাম আহমদের এ সংক্রান্ত বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে বাহীরা প্রাণী রেওয়াজও সেই চালু করেছে।

উপরোক্ত বর্ণনাসমূহে উল্লিখিত “খুযাই” শব্দ দ্বারা বুঝা যায় যে, আমর ইবন আমির খুযাআ গোত্রের আদি ব্যক্তি নয় বরং সেও ঐ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সে বর্ণনায় তাকে আবু খুযাআ বলা হয়েছে সেটি বর্ণনাকারীর ভ্রমপ্রমাদ হতে পারে যে, তিনি আখু খুযাআ বলতে গিয়ে আবু খুযাআ বলে ফেলেছেন। অথবা এমন ও হতে পারে যে, সে মূলত খুযাআ গোত্রের একজন ছিল এবং তার উপনাম ছিল আবু খুযাআ। এবং তাকে খুযাআ গোত্রের মূল ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া ঐ বর্ণনায় উদ্দিষ্ট ছিল না। আল্লাহই ভাল জানেন।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম হযরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি তিনি আকছাম ইবন জাওন খুবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, “হে আকছাম! আমি আমর ইবন লুহাই ইবন কামআ ইবন খিনদাককে দেখেছি জাহান্নামে সে তার নাড়িভুড়ি হেঁচড়িয়ে চলছে। তার সাথে তোমার যে সদৃশ্য এবং তোমার সাথে তার সে সাদৃশ্য এমন আমি অন্য কাউকে দেখিনি।’ তখন আকছাম বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! তার সাথে আমার যে সাদৃশ্য তাতে আমার কি কোন ক্ষতি হবে?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘না, কোন ক্ষতি হবে না। কারণ তুমি ঈমানদার আর সে কাফির। সেই সর্বপ্রথম ইসমাঈল (আ)-এর ধর্মের বিকৃতি সাধন করেছে, মূর্তি প্রতিমা স্থাপন করেছে, বাহীরা সাইবা, ওসীলা প্রাণী ‘হামী’ প্রাণীকে দেবতার জন্যে সংরক্ষিত রাখার রেওয়াজ চালু করেছে।’

অবশ্য বিশুদ্ধ কিতাবসমূহে এরূপে বর্ণনাটি নেই; ববং ইবন জারীর (র) আবু হুরায়রা (রা)-এর সনদে এরূপ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।

বুখারী তাবারানী (র) ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে প্রায় একই মর্মের হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।

বস্তুত আমর ইবন লুহাই আরবদের জন্যে ধর্মের মধ্যে কতক নতুন বিষয়ের প্রচলন ঘটিয়েছে যা দ্বারা সে দীন-ই ইবরাহীমকে বিকৃত করে দিয়েছে। এসব বিষয়ে আরবগণ তার অনুসরণ করেছে। ফলে তারা ন্যক্কারজনক জঘন্যভাবে পথভ্রষ্ট হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা কুরআন করীমের একাধিক আয়াতে এর নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

( وَلَا تَقُولُوا۟ لِمَا تَصِفُ أَلۡسِنَتُكُمُ ٱلۡكَذِبَ هَـٰذَا حَلَـٰل وَهَـٰذَا حَرَام لِّتَفۡتَرُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ )

[Surah An-Nahl 116]

“তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার জন্যে তোমরা বলো না এটি হালাল এবং এটি হারাম। আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ

( مَا جَعَلَ ٱللَّهُ مِنۢ بَحِیرَة وَلَا سَاۤىِٕبَة وَلَا وَصِیلَة وَلَا حَام وَلَـٰكِنَّ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ یَفۡتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَۖ وَأَكۡثَرُهُمۡ لَا یَعۡقِلُونَ )

[Surah Al-Ma'idah 103]

“বাহীরা, সাইবা, ওসীলা, ও হাম আল্লাহ স্থির করেন নি। কিন্তু কাফিররা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশই উপলব্ধিই করে না। (৫ মায়িদাঃ ১০৩)

বাহীরা ও অন্যান্য প্রাণী সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং এ নামের প্রাণীগুলোর ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাফসীরকারদের বিভিন্ন অভিমত বর্ণনা করে এসেছি।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَیَجۡعَلُونَ لِمَا لَا یَعۡلَمُونَ نَصِیب ا مِّمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡۗ تَٱللَّهِ لَتُسۡـَٔلُنَّ عَمَّا كُنتُمۡ تَفۡتَرُونَ )

[Surah An-Nahl 56]

—আমি ওদেরকে যে রিযক দান করি তারা তার একাংশ নির্ধারিত করে তাদের জন্যে যাদের সম্বন্ধে ওরা কিছুই জানে না। (১৬ নাহলঃ ৫৬)

আল্লাহ যে শস্য ও গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন তা থেকে তারা আল্লাহর জন্যে এক অংশ নির্ধারিত করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, “এটি আল্লাহর জন্যে এবং এটি আমাদের দেবতাদের জন্যে যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছয় না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের দেবতার কাছে পৌঁছায় তারা যা মীমংসা করে তা নিকৃষ্ট।

এভাবে তাদের দেবতারা বহু মুশরিকের দৃষ্টিতে সন্তান হত্যাকে শোভন করেছে তাদের ধ্বংস সাধনের জন্যে এবং তাদের ধর্ম সম্বন্ধে তাদের বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্যে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা তা করত না। সুতরাং তাদেরকে তাদের মিথ্যা নিয়ে থাকতে দাও। (৬ আনআমঃ ১৩৬-১৩৭)।

আল্লাহ তা’আলার ঘোষণাঃ

“তারা তাদের ধারণা অনুসারে বলে, এসব গবাদিপশু ও শস্য ক্ষেত্র নিষিদ্ধ। আমরা যাকে ইচ্ছা করি সে ব্যতীত কেউ এসব আহার করতে পারবে না এবং কতক গবাদি পশুর পৃষ্ঠে আরোহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কতক পশু জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয় না। এ সকলই তারা আল্লাহ সমন্ধে মিথ্যা রচনার উদ্দেশ্যে বলে, তাদের এই মিথ্যা রচনার প্রতিফল তিনি অবশ্যই তাদেরকে দিবেন। (৬ আন’আমঃ ১৩৮)

“তারা আরও বলে, এ সব গবাদি পশুর গর্ভে যা আছে তা আমাদের পুরুষদের জন্যে নির্দিষ্ট এবং এটি আমাদের স্ত্রীদের জন্যে অবৈধ আর সেটি যদি মৃত হয়, তবে নারী-পুরুষ সকলে সেটিতে অংশীদার। তাদের এরূপ বলার প্রতিফল তিনি তাদেরকে দেবে। তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। যারা নির্বুদ্ধিতার দরুন ও অজ্ঞানতাবশত নিজেদের সন্তানদের হত্যা করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকাকে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করার উদ্দেশ্য নিষিদ্ধ গণ্য করে তারা তো ক্ষগ্রিস্ত হয়েছে। তারা অবশ্যই বিপথগামী হয়েছে এবং তারা সৎপথ প্রাপ্ত ছিল না। (৬ আন আমঃ ১৩৮-৩৯)

৭১
আরবদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার
আবু নুমান ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বলেন, “তুমি যদি আরবদের অজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাও তবে সূরা আল আনামের ১৩০ নং আয়াতের পরবর্তী আয়াতগুলো পাঠ কর–

( قَدۡ خَسِرَ ٱلَّذِینَ قَتَلُوۤا۟ أَوۡلَـٰدَهُمۡ سَفَهَۢا بِغَیۡرِ عِلۡم وَحَرَّمُوا۟ مَا رَزَقَهُمُ ٱللَّهُ ٱفۡتِرَاۤءً عَلَى ٱللَّهِۚ قَدۡ ضَلُّوا۟ وَمَا كَانُوا۟ مُهۡتَدِینَ )

[Surah Al-An'am 140]

“যারা নির্বুদ্ধিতার দরুন ও অজ্ঞানতা বশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকাকে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করার উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ গণ্য করে তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা অবশ্যই বিপথগামী হয়েছে এবং তারা সৎপথ প্রাপ্তও ছিল না। (৬ আনআমঃ ১৪০)

আমরা এ আয়াতের ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছি এবং তার যে অসত্য ও বাতিল দীন চালু করেছে তাও উল্লেখ করে এসেছি। তাদের গুরু আমর ইবন লুহাই অবশ্য এটিকে পশু প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন ও কল্যাণ সাধন বলে ধারণা করত এটা নিছক তার মিথ্যাচার। তার এ মূর্খতা ও ভ্রান্তি সত্ত্বেও আরবের নির্বোধ লোকেরা তার অনুসরণ করে। (১) (সূরা আন’আম আয়াত - ১৪০) তাতে বরং তার চাইতেও জঘন্য কাজেও তারা তার অনুসরণ করেছে। আর তা হল আল্লাহর সাথে প্রতিমাদের পূজা করা। আল্লাহ তাআলা শিরক ও অংশীবাদ হারাম করে এককভাবে তাঁরই ইবাদতের নির্দেশ দিয়ে যে সরল পথও সুদৃঢ় ধর্ম সহকারে হযরত ইবরাহীম (আ)-এ প্রেরণ করেছিলেন তারা তা পরিবর্তিত করে ফেলেছিল এবং সবল-দুর্বল তো দূরের কথা, এমনকি কোন দুর্বল দলীল প্রমাণ ব্যতীত দীনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও হজ্জের নিদর্শনমূলক বিধানসমূহ বিকৃত করে ফেলেছিল। তারা তাদের পূর্ববর্তী অংশীবাদী উম্মতসমূহের পথ অনুসরণ করেছিল এবং নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়ের মত হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়ই সর্বপ্রথম আল্লাহর সাথে শিরকের প্রথা চালু করেছিল এবং মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়েছিল। এ জন্যে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি হযরত নূহ (আ)-কে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম প্রেরিত রাসূল যিনি লোকদেরকে মূর্তিপূজা থেকে নিষেধ করতেন। হযরত নূহ (আ)-এর আলোচনায় তা বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।

( وَقَالُوا۟ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّ ا وَلَا سُوَاع ا وَلَا یَغُوثَ وَیَعُوقَ وَنَسۡر ࣰا)

[Surah Nuh 23]

—এবং তাঁরা বলেছিল, তোমরা কখনও পরিত্যাগ করো না তোমাদের দেব-দেবীকে, পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াউক ও নাসরকে। তারা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। (৭১ নূহঃ ২৩) হযরত ইব্‌ন আব্বাস বলেন, ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াউক এঁরা ছিলেন নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়ের সৎকর্মশীল লোক। এদের মৃত্যুর পর লোকজন এঁদের কবরে অবস্থান করতো। এভাবে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর লোকজন এদের পূজা শুরু করে দেয়। এদের এই উপাসনার রীতি-নীতি সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করে এসেছি। এখানে তা পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই।

ইবন ইসহাক (র) ও অন্যরা বলেন, আরবের লোকেরা যখন হযরত ইসমাঈল (আ)-এর দীনকে পরিবর্তিত করে ফেলল তখন উপরোল্লেখিত মূর্তিগুলো আরবদের উপাস্যতে পরিণত হল। তখন ওয়াদ প্রতিমা থাকল বনী কালব (ইবন মুররাহ ইব্‌ন তাগলিব ইবন হালওয়ান ইবন ইমরান ইবন ইলহাফ ইব্‌ন কুযাআ) গোত্রের জন্যে। এটি স্থাপিত ছিল দুমাতুল জান্দাল নামক স্থানে। সুওয়া প্রতিমা ছিল বনী হুযায়ল (ইব্‌ন ইলিয়াস ইবন মুদরিকাহ্ ইব্‌ন মুগরি) গোত্রের জন্যে। এটি অবস্থিত ছিল রাহাত নামক স্থানে ইয়াগুছ ছিল এই বংশের বনী আনউম ও মিযহাজ বংশের জন্য এটি অবস্থিত জারশ এলাকায়। ইয়াউক প্রতিমা ছিল ইয়ামানের হামদান অঞ্চলে। এটি ছিল হামদানের একটি উপগোত্র বনী খায়ওয়ান-এর তত্ত্বাবধানে। নাসর প্রতিমা স্থাপিত ছিল হিমইয়ার অঞ্চলে। মূল কিলা গোত্র ছিল এর উপাসক।

ইবন ইসহাক (র) বলেন, নিজেদের এলাকায় খাওলান গোত্রের একটি মূর্তি ছিল। সেটির নাম ছিল “আস্মে আনাস” (আনাসের চাচা)। তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী চতুস্পদ জন্তুও ফল ফসল তার মাঝে ও আল্লাহর মাঝে বণ্টন করত। বণ্টন আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত কোন অংশ যদি আম্মে আনাসের’ ভাগে পড়ত, তবে তা তারা সেখানে রেখে দিত। পক্ষান্তরে ‘আম্মে আনাসের জন্যে নির্ধারিত কোন অংশ যদি আল্লাহর ভাগে পড়ে যেত, তবে তা সেখান থেকে নিয়ে ঐ প্রতিমার ভাগে দিয়ে দিত। তাদের এ অপকর্মে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেনঃ

( وَجَعَلُوا۟ لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ ٱلۡحَرۡثِ وَٱلۡأَنۡعَـٰمِ نَصِیب ا فَقَالُوا۟ هَـٰذَا لِلَّهِ بِزَعۡمِهِمۡ وَهَـٰذَا لِشُرَكَاۤىِٕنَاۖ فَمَا كَانَ لِشُرَكَاۤىِٕهِمۡ فَلَا یَصِلُ إِلَى ٱللَّهِۖ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ یَصِلُ إِلَىٰ شُرَكَاۤىِٕهِمۡۗ سَاۤءَ مَا یَحۡكُمُونَ )

[Surah Al-An'am 136]

“আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তারা আল্লাহর জন্যে এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণানুযায়ী বলে, এটি আল্লাহর জন্যে এবং এটি আমাদের দেবতাদের জনে। (আনআমঃ ১৩৬)

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, বনী মলাকান ইব্‌ন কিনানা ইবন খুযায়মা ইবন মুদরিকা গোত্রের একটি প্রতিমা ছিল। তার নাম ‘সাদ সাখরাহ’। এক উন্মুক্ত ও বিস্তৃত প্রান্তরে ছিল এটির অবস্থান। এক ব্যক্তি তার উটের পাল নিয়ে এসেছিল এ উদ্দেশ্যে যে, উটগুলোকে ওখানে দাঁড় করিয়ে তার ধারণা অনুযায়ী ঐ প্রতিমার আর্শীবাদ নেবে। আরোহীবিহীন ঐ উটগুলো ঘাস খেতে-খেতে রক্তমাখা প্রতিমা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যেটি যেদিক পেরেছে ছুটে পালায়। এতে উটের মালিক ক্ষেপে যায় এবং একটি পাথর নিয়ে প্রতিমার দিকে ছুঁড়ে মারে। সে বলে, ‘আল্লাহ্ তোমাতে যেন বরকত ও আশীর্বাদ না দেন। তুমি আমার উটগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছ।’ অতঃপর সে তার উট খুঁজতে বের হয়। উটগুলো একত্রিত করার পর সে বলেঃ

أتينا الى سعد ليجمع شملنا فشتتنا سعد فلا نحن من سعد

“আমরা এসেছিলাম সা’দ এর নিকট এ মকসুদ নিয়ে যে, সে আমাদের অবস্থা সংহত করে দিবে। কিন্তু সে আমাদেরকে আরও বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। ফলে আমরা কোন কল্যাণ লাভে সমর্থ হইনি। সুতরাং আমরা তার কেউ নই।

وهل سعد الأصخرة بتنونة من الأرض لا يدعو لغي ولا رشد

—সাদ তো ধূ ধূ মরু প্রান্তরে অবস্থিত একটি পাথর বৈ অন্য কিছু নয়। সে ভাল বা মন্দ কিছুর জন্যেই প্রার্থনা জানাতে পারে না।

ইবন ইসহাক বলেন, দাওস গোত্রের আমর ইবন হামামা দাওসীর একটি প্রতিমা ছিল। কুরায়শরা কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে একটি কূপের মধ্যে একটি প্রতিমা রেখেছিল। সেটির নাম হুবল। ইতিপূর্বে ইবন হিশাম (র)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এটি প্রথম প্রতিমা আমর ইবন লুহাই স্থাপিত প্রথম প্রতিমা।

ইবন ইসহাক বলেন, তারা আসাফ ও নাইলা নামের দুটো প্রতিমা যমযমের স্থানে স্থাপন করেছিল। ওগুলোর সম্মুখে তারা পশু কুরবানী দিত। এ প্রসংগে পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। কাবা শরীফের অভ্যন্তরে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ায় আল্লাহ্ তা’আলা তাদের উভয়কে পাথরে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর হযরত আয়েশা (রা) সূত্রে বলেন, আমরা বরাবরই শুনে এসেছি যে, আসাফ ও নাইলা ছিল একজন পুরুষ লোক ও একজন মহিলা। তারা জুরহুম গোত্রভুক্ত। দু’জনে অশ্লীল কাজ করেছিল কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের দু’জনকে পাথরে পরিণত করে দেন।

কথিত আছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ঐ অপকর্ম করার অবকাশ দেননি বরং তার পূর্বেই পাথরে পরিণত করে দেন। এরপরে লোকজন এ দু’টোকে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে নিয়ে স্থাপন করে। এরপর আমর ইবন লুহাইর সময়ে সেগুলো কে সেখান থেকে তুলে এনে যমযম কূপের স্থানে স্থাপন করে এবং লোকজন এ দু’টোর তাওয়াফ করতে শুরু করে।

এ প্রসংগে আবু তালিব বলেনঃ

وحيث ينيخ الأشعرون ركابهم - بمفضي سيل من أساف ونائل

—যেখানে আশআরী গোত্রের লোকজন তাদের সওয়ারী থামায় সেই প্লাবনের প্রবাহ পথে আসাফ ও নাইলা রয়েছে।

ওয়াকিদী বলেন, মক্কা বিজয়ের দিবসে রাসুলুল্লাহ (সা) যখন নাইলা মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন, তখন দেখা যায় যে, সেটি থেকে জনৈকা সাদা কালো চুল বিশিষ্ট কুচকুচে কালো মহিলা হায়রে দুঃখ, হায়রে ধ্বংস বলে বলে বিলাপ করতে করতে মুখে খামচি মেরে মেরে বেরিয়ে আসল।

সুহায়লী উল্লেখ করেছেন যে, আজা ও সালমা হলো হেজাযের দুটো পাহাড়। আজা নামের একজন পুরুষ এবং সালমা নামের একজন মহিলার নামে এ দু’টো পাহাড়ের নামকরণ হয়েছে। আজা ইব্‌ন আবদুল হাই নামের পুরুষ লোকটি সালমা বিনত হাম নামের মহিলাটির সাথে পাপচারে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের দু’জনকেই এ দু’টো পাহাড়ের শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিল। অতঃপর তাদের নামানুসারে পাহাড় দুটো পরিচিত হয়। তিনি বলেন, আজা এবং সালমা এ দু’টোর মধ্যখানে তাই গোত্রের কুলস নামক একটি প্রতিমা ছিল।

ইবন ইসহাক বলেন, তখন প্রত্যেক গোত্রের পৃথক পৃথক প্রতিমা ছিল। গোত্র ভুক্ত সকল লোক সেটির পূজা-অর্চনা করত। তাদের কেউ সফরে যাওয়ার ইচ্ছা করলে সওয়ারীতে আরোহণ করার সময় ঐ প্রতিমার গায়ে হাত বুলিয়ে যেত। যাত্রা প্রস্তুতির এটি ছিল শেষ ধাপ। মূর্তি প্রতিমা ছুঁয়েই সে যাত্রা শুরু করত। সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে সে পুনরায় সেটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিত। সফর শেষে গৃহে প্রবেশের পূর্বে প্রতিমা স্পর্শ করা হতো তার প্রথম কাজ।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে যখন তাওহীদের বাণী সহকারে প্রেরণ করলেন তখন তারা বলে উঠেছিলঃ

اجعل الالهة الها واحدا - أن هذا لشئ عجاب

“সে কি বহু ইলাহের পরিবর্তে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছ? এটিতো এক অতাশ্চর্য ব্যাপার!”

ইবন ইসহাক বলেন, আরবরা কা’বা শরীফের সমান্তরালে আরও বহু পূজামণ্ডপ ও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ পূজামণ্ডপ হল কতগুলো গৃহ, তারা সেগুলো কে কা’বা শরীফের ন্যায় সম্মান করত। ঐ গৃহগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক এবং খাদিম ছিল। কা’বা শরীফের উদ্দেশ্যে যেমন কুরবানীর পশু প্রেরণ করা হত, ঐ পূজামণ্ডপগুলোর উদ্দেশ্যেও সেরূপ পশু প্রেরণ করা হত এবং কাবা শরীফের তাওয়াফের ন্যায় ঐ গুলোর চারিদিকেও তাওয়াফ করা হত এবং সেগুলোর সম্মুখে পশু যবাই করা হত। তা সত্ত্বেও ঐ গৃহগুলোর উপর কাবা শরীফের অধিকতর সম্মান ও মর্যাদা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। কারণ সেটি ছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর তৈরী এবং তাঁর মসজিদ।

কুরায়শ ও বনী কিনানা এর নির্ধারিত প্রতিমা ছিল নাখলা’তে অবস্থিত উযযা প্রতিমা। সেটির তত্ত্বাবধায়ক ও খাদিম ছিল বনী হাশিম গোত্রের মিত্র সুলায়ম গোত্রের উপগোত্র বানু শায়বান। মক্কা বিজয়ের সময় হযরত খালিদ ইবন ওলীদ (রা) ঐ প্রতিমাটি ভেঙ্গে দিলে যেমন রূপে আসছে বনূ ছাফীক গোত্রের নির্ধারিত প্রতিমা ছিল লাত। এটির অবস্থান ছিল তায়েফে। ছাকীফ গোত্রের বানূ মুতার উপগোত্র ছিল ঐ পূজামণ্ডপের তত্ত্বাবধায়ক ও খাদিম। তায়েফবাসীদের নিকট আগমনের পর আবু সুফিয়ান ও মুগীরা ইব্‌ন শুবা (রা) ঐ প্রতিমাটি ভেঙ্গে দিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তীতে আসবে।

তিনি বলেন, আওস ও খাযরাজ গোত্র এবং তাদের সাথে মতাদর্শের অনুসারী মদীনাবাসী যারা ছিল, তাদের জন্যে নির্ধারিত প্রতিমা ছিল মানাত’। কাদীদ অঞ্চলের মুশাল্লিল নামক স্থানের পাশে সমুদ্র তীরে এটি অবস্থিত। এটিও ধ্বংস করে ছিলেন হযরত আবু সুফিয়ান (রা)। মতান্তরে আলী ইবন আবী তালিব (রা)। দাওস খাছআম বুজায়লা এবং এতদঞ্চলের আরবদের মূর্তি ছিল যুলখুলাসাহ্। এটি ছিল তাবালা নামক স্থানে। এটাকে কাবা-ই-ইয়ামানিয়া বা ইয়ামানের কাবা বলা হতো আর মক্কা শরীফের কা’বাকে বলা হতো কা’বায়ে শামীয়া বা শামী কাবা। জারীর ইবন আবদুল্লাহ বাজালী (রা) কর্তৃক যুলখুলাসার উপরোক্ত মূর্তিটি ধ্বংস করেন। তাঈ গোত্র এবং তাঈ অঞ্চলের আজা ও সালমা পাহাড়ের আশে-পাশে যারা ছিল তাদের প্রতিমা ছিল কুলস্। এটির অবস্থান ছিল আজা ও সালমা পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে। এ দু’টো মশহুর পাহাড়ের কথা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাআম ছিল হিমইয়ার গোত্র ও ইয়ামান বাসীদের উপাসনালয়। হিমইয়ারী রাজা তুব্বার আলোচনা প্রসংগে এর উল্লেখ করা হয়েছে। এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে, দু’জন ইয়াহুদী ধর্মযাজক ঐ গৃহ ধ্বংস করেছে এবং সেটি থেকে বেরিয়ে আসা একটি কালো কুকুর হত্যা করেছে ‘রিয়া’ নামের উপাসনালয়টি ছিল বনী রবী’আ ইবন কাব ইবন সাদ ইবন যায়দ মানাত ইবন তামীম গোত্রের। ঐ উপাসনালয় সম্পর্কে কা’ব ইবন রাবীআ ইবন কা’ব ওরফে মুসতাওগির বলেনঃ

ولقد شددت على رضاء شدة- فتركتها قفرا بقاع أسحما

—আমি প্রচণ্ড আক্রমণ করেছি ‘রিযা’ পূজা মণ্ডপে, অতঃপর সেটিকে আমি সমতল ভূমিতে কালো ও শূন্য ভিটেরূপে রেখে এসেছি।

وأعان عبد الله في مكروهها - وبمثل عبد الله آغشى المحرما

—এটি ঘৃণিত করতে আবদুল্লাহ সাহায্য করেছেন। আবদুল্লাহর মতই আমি ঐ নিষিদ্ধ বস্তুকে আচ্ছাদিত করে দিয়েছি।

কথিত আছে যে, উপরোল্লেখিত পংক্তির রচয়িতা মুসতাওগির ৩৩০ বছর কাল জীবিত ছিলেন। তিনি মুযার গোত্রের সবচাইতে দীর্ঘজীবি লোক ছিলেন। তিনি আরও বলেছেনঃ

ولقد سئمت من الحياة وطولها - وعمرت من عدد السنين كئينا .

—আমি সুদীর্ঘ জীবন কালের কষ্ট ভোগ করেছি এবং কয়েক শতাব্দীর আয়ু পেয়েছি।

مائة حدتها مائتان لي - وازددت من عدد الشهور

—একশত বছরের পর দু’শো বছর এবং অতিরিক্ত আরো কয়েক বছর।

هل مابقى الأ كما قد فاتنا- يوم يمر وليلة تحدونا

—আমরা যে যুগ অতিক্রম করে এসেছি, যে রাত দিনের পৌণ-পৌণিক আগমন, পরবর্তী যুগ কি তদপেক্ষা ব্যতিক্রম অন্য কিছু?

ইবন হিশাম বলেন, এ পংক্তিগুলো যুহায়র ইবন জানাব ইবন হুবল-এর রচিত বলেও কেউ কেউ বলেছেন।

সুহায়লী বলেন, দুশ তিন বছরের অধিক আয়ু যারা পেয়েছিলেন, আলোচ্য যুহায়র ছিলেন তাদের অন্যতম। উবায়দ ইবন শিরবাহ, বংশ তালিকা বিশারদ দাগফাল ইবন হানযালা, রাবী ইবন দাবা কোযারী, যুল ইসবা উদওয়ানী নাসর, ইবন দাহমান ইবন আশাজা ইবন রাবাছ ইবন গাতফান প্রমুখ ব্যক্তিও এরূপ দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত লোক ছিলেন। নাসর ইবন দাহ দাহমানের এবং তার পিঠ কুঁজো হওয়ার পর পুনরায় সোজা হয়েছিল।

‘যুল কা’বাত’ ছিল বকর, তাগলিব ইবন ওয়াইল ও আইয়াদ গোত্রের উপাসনালয়। এটি ছিল সিনদান অঞ্চলে। এ সম্পর্কে কবি আশা ইবন কায়স ইবন ছালাবা বলেনঃ

بين الخورنق والسرير وبارق - والبيت ذي الشرفات من سنداد

—খাওরানাক, সাদীর, বারিক ও সিনদাদে অবস্থিত সম্মানিত গৃহের মধ্যবর্তী স্থানে। এ পংক্তিমালার আগে আরো কত পংক্তি রয়েছে।

সুহায়লী বলেন, খাওরানাক হল একটি নয়নাভিরাম প্রাসাদ। নুমান-ই- আকবর এটি সম্রাট সাবুরের জন্যে তৈরী করেছিলেন। সিন্নেমার নামক একজন প্রকৌশলী দীর্ঘ ২০ বছর পরিশ্রম করে এটি নির্মাণ করেন। এর চাইতে সুন্দর কোন প্রাসাদ তখনকার দিনে দেখা যেত না। সিন্নেমার অন্য কোন ব্যক্তির জন্যে এরূপ প্রাসাদ যেন নির্মাণ করতে না পারেন, সে জন্যে নুমান তাকে ঐ প্রাসাদের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। এ উদাহরণ উল্লেখ করে কবি বলেনঃ

جزاني جزاه الله شر جزاءه - جزاء السنمار وما كان ذا ذنب

—আল্লাহ্ তাকে নিকৃষ্টতম শাস্তি দান করুন, সে আমাকে প্রতিদান দিয়েছে সিন্নেমারের প্রতিদানের ন্যায়। মূলত সিন্নেমারের কোন দোষ ছিল না।

سوی رضفه البنيان عشرين حجة - يعد عليه بالقرامد والسكب .

—তার একটি মাত্র অপরাধ ছিল বিশ বছর ধরে সে ঐ প্রাসাদ নির্মাণ করেছে। পাথর কুচি মোজাইক ও পানি ঢেলে ঢেলে অত্যন্ত যত্ন সহকারে সে এটি তৈরী কবেছিল।

فلما انتهى البنيان يوما تمامة - واحى كمثل الطود والباذخ الصعب

—অবশেষে একদিন যখন সেটির নির্মাণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল এবং সুউচ্চ ও সুবিশাল টিলার ন্যায় সেটি সুদৃঢ় ও মজবুত হল।

رمی بسنمار على حق راسه - وذلك لعمر الله من أقبح الخطب

—তখন সে ফেলে দিল সিনেমারকে ঐ প্রাসাদের চূড়া থেকে। আল্লাহর কসম এটি জঘন্যতম কাজ।

সুহায়লী বলেন, প্রখ্যাত ভাষাবিদ জাহিয এই কবিতাটি ‘আল মাইওয়ান ওয়াস সিমার মিন আসমাইল কামার’ নামক গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন।

মূল কথা হল পূর্বোক্ত সকল প্রতিমা পূজার কেন্দ্রগুলো ধ্বংস ও বিনষ্ট করে দেয়া হয়। ইসলামের আবির্ভাবের পর রাসূলুল্লাহ (সা) উপরোল্লেখিত প্রত্যেকটি পূজামণ্ডপ ও প্রতিমা ধ্বংস করার জন্যে লোক প্রেরণ করেন। তারা ঐ সবগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দেন। শেষ পর্যন্ত কাবা শরীফের প্রতিদ্বন্দী কোন গৃহই অবশিষ্ট থাকল না। আর তখন ইবাদত নিবেদিত হতে থাকল একক লা-শরীক আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

৭২
হিজাযী আরবদের ঊর্ধ্বতন পুরুষ ‘আদনান-এর বৃত্তান্ত
‘আদনান যে ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম-এর বংশধর, সে সম্পর্কে কোন মতভেদ নেই। তবে তার এবং ইসমাঈলের মধ্যস্থলে কত পুরুষের ব্যবধান সে বিষয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। কথিত সর্বোচ্চ ব্যবধান হচ্ছে চল্লিশ পুরুষের। আহলি কিতাবদের মধ্যে এই উক্তিই প্রচলিত। আরমিয়া ইবন হলিকিয়া এর লিপিকার রাখিবার লিপি থেকে আহলি কিতাবরা এ মত গ্রহণ করেছে। এ সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করবো। মতান্তরে উভয়ের মধ্যকার এ ব্যবধান ৩০, ২০,১৫,১০, ৯, অথবা ৪ পুরুষের। মূসা ইবন ইয়াকূব এ ব্যাপারে উম্মু সালামা-এর বরাতে বলেন যে, নবী করীম (সা) বলেছেন, মা‘আদ ইবন আদনান ইবন উদাদ ইবন যান্দ ইবনুল বারী ইবন আ’রাফ আস-ছারা। উম্মু সালামা (রা)-বলেনঃ যান্দ হচ্ছেন হামায়সা আর বারী হচ্ছেন নাবিক, আর আ’রাত আস ছারা হচ্ছেন ইসমাঈল, আর ইসমাঈল হচ্ছেন ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র। আর আগুন ইবরাহীম (আ)-কে দহন করেনি, যেমন আগুন দহন করে না মাটিকে। ছারা কুতনী বলেনঃ এ বর্ণনা ছাড়া (অন্য কোথাও) আমরা মান্দ সম্পর্কে জানতে পারি না। আর মান্দ ইবনুল জওন হচ্ছেন কবি আবু দালামা।

হাফিজ আবুল কাসিম সুহাইলী প্রমুখ ইমাম বলেনঃ আদনান থেকে ইসমাঈল (আ) পর্যন্ত সময়কাল ৪ পুরুষ থেকে ১০ পুরুষ বা ২০ পুরুষের চেয়েও বেশী। আর এটা এজন্য যে, বুখত নসরের শাসনকালে মা’আদ ইবন আদনান-এর বয়স ছিল ১২ বছর। আবু জাফর তাবারী প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, আল্লাহ তা’আলা এ সময়ে আরমিয়া ইবনু হালকিয়ার নিকট এ মর্মে ওহী প্রেরণ করেন যে, তুমি বুখত নসর এর নিকট গিয়ে তাকে জানিয়ে দাও যে, আমি তাকে আরবদের উপর শাসনকর্তা করেছি। আর আল্লাহ তা’আলা আরমিয়াকে নির্দেশ দান করেন যে তিনি যেন তাঁর সঙ্গে মাআদ ইবনু ‘আদনানকেও বুরাকে আরোহন করিয়ে নিয়ে যান, যাতে তাদের মধ্যে তাকে কোন কষ্ট পেতে না হয়। কারণ, তাঁর বংশে আমি একজন মহান নবীর আবির্ভাব ঘটাবো যার মাধ্যমে আমি রিসালতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটাবো। আরমিয়া সে মতে কাজ করেন এবং মা’আদকে নিজের সঙ্গে বুরাকে আরোহণ করিয়ে শাম দেশ পর্যন্ত নিয়ে যান। বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংসের পর সেখানে যেসব বনী ইসরাঈল অবশিষ্ট ছিল—তিনি তাদের মধ্যে প্রতিপালিত হয়ে বেড়ে উঠেন। স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসার পূর্বে তিনি সেখানে বহু দূর ইবনু জুরহুম বংশে মু‘আনা বিনত জওশন নাসের এক মহিলাকে বিবাহ করেন। আরব দেশে অশান্তি দূর হয়ে শান্তি ফিরে এলে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আরমিয়ার লিপিকার সচিব রাখইয়া তাঁর নিকট রক্ষিত একটা লিপিতে তার বংশধারা লিপিবদ্ধ করে রাখেন, যাতে তা আরমিয়ার ভাণ্ডারে রক্ষিত থাকে। আল্লাহই ভালো জানেন। এ কারণে মালিক (র) ‘আদনান-এর উপরের বংশধারা বর্ণনা করা পছন্দ করতেন না।

সুহাইলী বলেনঃ এ বংশধারা ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি সেসব মনীষীদের মত অনুযায়ী। যারা এটাকে বৈধ মনে করেন (এবং এটাকে নাপছন্দ করেন না, যথা ইবন ইসহাক, বুখারী, যুবাইর ইবন বাক্কার তাবারী প্রমুখ। তবে ইমাম মালিক (র)-কে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে সে বংশধারা আদম (আ) পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন তিনি এটাকে পছন্দ করে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন- সে এটা কোথা থেকে জানতে পেরেছে? ইসমাঈল (আ) পর্যন্ত বংশধারা পৌঁছালে তিনি তা-ও নাপছন্দ করেন। এ সম্পর্কেও তিনি বলেন যে, ‘কে তাকে তা বলেছে?’ এমনকি তিনি নবীগণের বংশধারা আরো উপরে নিয়ে যাওয়া, যেমন বলা ইবরাহীম অমুকের পুত্র অমুক তাও অপছন্দ করেছেন। আল-মুঈতী তাঁর গ্রন্থে এরূপই উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেনঃ মালিক (র)-এর এ উক্তি উরওয়া ইবন যুবায়র (র)-এর মতের অনুরূপ। তিনি বলেছেন আদনান ও ইসমাঈল (আ)-এর মধ্যবর্তী বংশধারা সম্পর্কে জানে, এমন কারো সম্পর্কে আমাদের জানা নেই। ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, আদনান আর ইসমাঈল (আ)-এর মধ্যকার ত্রিশ পুরুষ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, বংশধারা আদনান পর্যন্ত পৌঁছার পর তিনি দু’বার বা তিনবার বলতেন- বংশধারা বর্ণনাকারীরা মিথ্যা বলে। বিশুদ্ধ মতে ইব্‌ন মাসউদ (রা) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলতেনঃ ‘আদনান পর্যন্ত বংশধারা পৌঁছানো যায়। আবু উমর ইবন আব্দুল বার তাঁর গ্রন্থ আল-ইম্বাহ ফী মারিফাতে কাবাইলিররুয়াত-এ বলেনঃ ইবন লাহীয়া’ আবুল আসওয়াদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি উরওয়া ইব্‌ন যুবায়রকে বলতে শুনেছেন যে, “আদনান বা কাহতান এরপর বংশধারা সম্পর্কে কেউ জানে বলে আমাদের জানা নেই। কেউ এমন দাবী করলে তা হবে একান্তই অনুমান নির্ভর ও অসত্য। আর আবুল আসওয়াদ বলেনঃ কুরাইশদের কাজগামা আর বংশধারা সম্পর্কে অন্যতম বিশেষজ্ঞ আবু বকর ইবন সুলায়মান ইবন আবু খায়সামাকে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলতেন, মাআদ ইবন আদনান-এর ঊর্ধ্বে কোন কবির কবিতা বা কোন জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞানের কথা কেউ জানে এমন লোকের সন্ধান আমরা পাইনি।

আবু উমর বলেন- অতীত মনীষীদের মধ্যে এক দল ছিলেন, যাদের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন ‘আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ আমর ইবন মায়মূন আল-আযদী এবং মুহাম্মদ ইবন কা’ব আল-কুরাযী নিমোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করার পর বলতেন- বংশধারা বর্ণনাকারীরা মিথ্যা বলেছে।

( وَٱلَّذِینَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ لَا یَعۡلَمُهُمۡ إِلَّا ٱللَّهُ )

[Surah Ibrahim 9]

(তোমাদের নিকট কি সংবাদ আসেনি তোমাদের পূর্ববর্তীদের নূহ আদ ও সামুদ জাতির) এবং তাদের পূর্ববর্তীদের? তাদের বিষয় আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না (১৪ ইবরাহীমঃ ৯)।

আবু উমর(র) বলেনঃ এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে ভিন্নতর। আমাদের মতে এর মানে হচ্ছে আদম (আ)-এর বংশধারা সম্পূর্ণ জানে বলে যারা দাবী করে তাদের প্রতিই উক্ত মিথ্যাচারের উক্তিটি প্রযোজ্য। জানেন কেবল এক আল্লাহ যিনি তাদের পয়দা করেছেন। আর আরবদের বংশধারা এবং তাদের ইতিহাস ও বংশ বৃত্তান্ত সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনেক কিছু সংরক্ষণ করেছেন। জ্ঞানীরা তাদের সাধারণ মানুষ এবং বড় বড় কবীলা সম্পর্কে অনেক কিছু তত্ত্ব ও তথ্য সংরক্ষণ করেছেন। তবে এর কোন কোন খুঁটিনাটি বিবরণ সম্পর্কে তাদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।

আবু উমর বলেনঃ আদনান-এর বংশধারা বিষয়ে ওয়াকিবহাল মহলের ইমামগণ বলেনঃ আদনান ইবন উদাদ মুকাব্বিস ইবন নাহুর ইবন তায়রাহ ইব্‌ন ইয়ারূব ইবন ইয়াশজুর ইবন নাবিত ইবন ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক তার সীরাত গ্রন্থে এভাবেই উল্লেখ করেছেন।

ইবন হিশাম উক্ত বংশতালিকা সম্পর্কে বলেন যে, কারো কারো মতে তা হচ্ছে আদনান উদ ইবন উদাদ। অতঃপর আবু উমর অবশিষ্ট বংশধারা আদম (আ) পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। যেমন আমরা ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ)-এর আলোচনার পূর্বেই উল্লেখ করে এসেছি। অবশ্য আদনান পর্যন্ত আরবের সকল কবীলার নসবনামা সংরক্ষিত এবং এতই খ্যাত ও সুসংরক্ষিত যে, সে বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। আদনান পর্যন্ত মহানবী (সা)-এর বংশধারা ভোরের আলোর মতই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। এ বিষয়ে মারফু হাদীস উক্ত হয়েছে, যা আরবের কবীলা প্রসঙ্গে যথাস্থানে আমরা উল্লেখ করবো। মহানবী (সা)-এর পবিত্র বংশধারা ও উৎস সম্পর্কে আলোচনাকালে আমরা এ বিষয়ে আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ। তারই প্রতি রয়েছে আমাদের আস্থা ও ভরসা। প্রবল পরাক্রমশালী ও কুশলী আল্লাহ ভিন্ন কোন ক্ষমতা নেই। নেই কোনই শক্তি-সামর্থ্য। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ আন-নাশীর রচিত ‘মহানবী’ বলে কথিত একটা প্রসিদ্ধ কাসীদায় নবী করীম (সা)-এর বংশধারার কী চমৎকার বর্ণনাই না রয়েছে। যাতে তিনি বলেনঃ

مدحت رسول الله ابغى بهدحه - وفور حظوظي من كريم المأرب

—আমি আল্লাহর রাসূলের প্রশংসা করছি আর তার প্রশংসা দ্বারা আমি তাঁর অনুগ্রহভাজন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি।

مدحت امرءا فان المديح موحدا - باوصافة عن مبعد ومقارب

—আমি এমন এক ব্যক্তির নিরংকুশ প্রশংসা করি, প্রশংসা ভাজন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যার স্থান সকলের শীর্ষে আর গুণপনায় যিনি নিকটবর্তী আর দূরবর্তী সকলের উপরে।

نبياتسامي في المشارق نوره - فلاحت هواديه لاهل المغارب

—আমি (প্রশংসা করি) এমন এক নবীর প্রাচ্য দেশে যার নূরের স্থান অত্যুচ্চে। ফলে পাশ্চাত্যবাসীদের নিকট তাঁর হিদায়াতকারীরা উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেন।

اتتنا به الانياء قبل مجيئه - وشاعت به الاخبار في كل جانب

—তার আগমনের পূর্বেই আগমণবার্তা পৌঁছেছে আমাদের কাছে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে খবর তাঁর আগমণের।

واصبحت الكهان تهتف باسمه - وتمض به رحم الظنون الكواذب

—গনক আর ভবিষ্যবক্তারা তার নাম উচ্চারণ করতে শুরু করে। আন্দাজ-অনুমান করে মিথ্যাবাদীরা তাকে অস্বীকার করে।

وانطقت الاصنام نطقا تبر آت - الى الله فيه من مقال الاكاذب

—প্রতিমাগুলো এমন কথা উচ্চারণ করে, যার দ্বারা তারা মিথ্যাবাণীদের কথা থেকে সম্পর্ক হীনতা ঘোষণা করে এবং আল্লাহর দিকে তারা রুজু করে।

وقالت لاهل الكفر قولا مبينا - اتاكم نبي من لوءی بن غالب

—প্রতিমাগুলো কুফরীর অনুসারীদেরকে স্পষ্ট বলে দেয়, তোমাদের নিকট একজন নবী এসেছেন লুয়াই ইবন গালিব-এর বংশ থেকে।

ورام استراق السمع فزيلت - مقاعدهم منها رجوم الكواكب

—জিনরা চুরি করে আড়ি পেতে শোনার প্রয়াস পেলে নক্ষত্ররাজি নিক্ষেপ দ্বারা তাদেরকে বিতাড়িত করে দেয়া হয়।

هدانا الى ما لم نكن نهتدي به - لطول العمی من واضحات المذاهب

—তিনি আমাদেরকে এমন পথ প্রদর্শন করেন, যে পথের দিশা পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ, স্পষ্ট ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছিল দীর্ঘ দিনের।

وجاء بايات تبين انها - دلائل جبار مثيب معاقب

—তিনি নিয়ে আসেন এমন সব নিদর্শন, যদ্বারা প্রমাণ হয় যে, সেগুলো হচ্ছে এমন এক সত্তার প্রমাণ, যিনি দুর্দান্ত পরাক্রমশালী, পুরস্কারদাতা ও শাস্তিদাতা।

فمنها انشقاق البدر حین تعممت - شعوب الضيا نة رؤس الاخا شب

—সেসব প্রমাণের অন্যতম হচ্ছে চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়া এমন এক সময়ে, যখন তার আলোরছটা ঊর্ধ্বাংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।

ومنها نبوع الماء من بين بنانه - وقد عدم الوراد قرب المشارب

—তন্মধ্যে আরো একটা প্রমাণ হচ্ছে তাঁর অঙ্গুলীর অগ্রভাগ থেকে পানি উৎসারিত হওয়া, অথচ তখন পানির সন্ধানে আগন্তুকরা পানির ধারে কাছেও ছিল না।

نروی به جما غفيرا واسهلت - باعناقه طوعا اكف المذانب

—সে পানি দ্বারা পরিতৃপ্ত করা হয় এক বিরাট দলকে এবং পাপাচারীদের হাতসমূহ গর্দানসহ স্বেচ্ছায় নত হয়ে পড়ে।

وبئر طفت بالماء من مس سهمه - ومن قبل لم تسمح بمذتة شارب

—তাঁর তীরের পাশে অনেক কূপ থেকে পানি প্রবাহিত হয়, অথচ ইতিপূর্বে তাতে কোন পানি পানকারী এক ফোঁটা পানির স্বাদ গ্রহণ করেনি।

وضرع مراه فاستدر و لم يكن - به درة تصغي الى كف حالب

—এমন অনেক ওলান, যা ছিল শুকনো তা দুধে ভর্তি হয়ে গেল। অথচ তাতে এমন দুধ ছিল, যা দুগ্ধ দোহনকারীর হস্তকে আকর্ষণ করে।

ونطق فصيح من ذراع مبينة - لكيد عد وللعداوة ناصب

—সুস্পষ্ট বচন ফুটে উঠে স্পষ্টভাষী বাহু থেকে, দুশমনের প্রতারণা সম্পর্কে যার প্রতারণা ছিল তীব্র।

واخباره بالامر من قبل كونه - وعند بواديه بما في العواقب

—অনেক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই তাঁর সে বিষয়ে খবর দেওয়া এবং সূচনাতেই পরিণতি কি হবে তা বলে দেয়া।

ومن تلكم الايات وحی آتی به - قريب المائی مسجم العجائب

—সে সবের মধ্যে এমন কিছু আয়াত, যা ওহী হয়েছে। তিনি সে সব নিয়ে এসেছেন। কিয়ামতের নিকটবর্তী এবং বিস্ময়ের বিপুল সমাহার।

تقاصرت الافكار عنه فلم يطع - بليغا و لم يخطر على قلب خاطب

—তাঁর চিন্তাধারা এতই উন্নত যে তা হৃদয়ঙ্গম করতে সাধারণ মানুষ অক্ষম। ফলে তিনি আনুগত্য করেননি কোন বাগ্মীর এবং কোন বাগ্মীয় অন্তরে তার অনুরূপ চিন্তা উদিতও হয়নি।

حوى كل علم واحتوى كل حكمة - وفات مرام المستمر الموارب

—সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান তিনি আয়ত্ত করেছেন। এবং সফলকাম হয় না সর্বদা প্রতারণাকারী ব্যক্তি।

اتانابه لا عن روية موتئ - ولا صحف مستمل ولا وصف كاتب

—আমাদের নিকট তা নিয়ে এসেছেন সন্দেহবাদীর চিন্তা-কল্পনা থেকে নয়, লিখিত পুস্তক আর লেখকের লেখকসুলভ গুণ থেকেও নয়।

يواتيه طورا في اجابة سائل - وافتاء مستفت و وعظ مخاطب

—কখনো তিনি উপস্থাপন করেন কোন প্রশ্নকর্তার জবাবে; আবার কখনো ফতোয়া প্রার্থীর জবাবে। কখনও খতীবরূপে ওয়াউ হিসাবে।

واتیان برهان و فرض شرائع - وقص احادیث ونص مأدب

—নিয়ে আসেন তিনি দলীল-প্রমাণ, শরীয়তের বিধি-বিধান বর্ণনা করেন ঘটনাবলী এবং বর্ণনা করেন লক্ষ্য উদ্দেশ্য দ্ব্যর্থহীনভাবে।

وتصريف امثال و تثبيت حجة - وتعريف ذي جحد وتوقيف كاذب

—দৃষ্টান্ত বর্ণনায় প্রমাণ উপস্থাপনে অস্বীকারকারীর পরিচয় দানে মিথ্যাবাদীর স্বরূপ উদঘাটনে।

وفي مجمع النادي وفي حومة الوغی - وعند حدوث المعضلات الغرائب

—এবং কোন প্রকাশ্য জনসমাবেশে ও প্রকাশ্য রণাঙ্গণে এবং কোন তীব্র সংকটকালে তিনি দেখা দেন বিস্ময়করভাবে।

فيألي على ما شئت من طرفاته -قويم المعانی مستد رالضرائب

—ফলে তুমি যেমনটি চাও তিনি তেমনি নিয়ে আসেন দ্ব্যর্থহীনরূপে, স্বভাবগতভাবে তিনি দানশীল।

يصدق منه البعض بعضا كأنما - يلاحظ معناه بعين المراقب

—তার কতক অংশ অনুমোদন করে কতককে, যেন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তার অর্থ ও তাৎপর্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি নিয়ে।

وعجز الوری عن ان بجيثوا بمثل ما - وصفناه معلوم بمرل التجارب

—তার মোকাবিলা করতে সমগ্র বিশ্ব যে অক্ষম, যা আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি, তা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত।

بابی بعبد الله اکرم والد - تبلج منه عن كريم المناسب

—আমার পিতা উৎসর্গ হোন তাঁর পিতা আব্দুল্লাহর প্রতি, যিনি সর্বাধিক সম্মানিত পিতা, যার থেকে প্রকাশ পেয়েছে সম্মান আর মর্যাদা, যিনি উপযুক্ত সম্মানের পাত্র।

وشيبة ذي الحمد الذي فخرت به - قريش على اهل العلی والمناصب

—শায়বা (আবদুল মুত্তালিব) প্রশংসার অধিকারী, যার জন্য তাঁর বংশ কুরাইশ গর্বিত সকল মর্যাদা ও পদের অধিকারীদের তুলনায়।

ومن كان يستسقى الغمام بوجهه - ويصدر عن ارائه في النوائب

—আর তিনি এমন যে তাঁর চেহারার ওসীলায় বৃষ্টি কামনা করা হতো এবং বিপদাপদে তার মতামত চাওয়া হতো।

وهاشم البانی مشید افتخاره - بغر المساعي وامتنان المواهب

—আর হাশিম, যিনি প্রতিষ্ঠাতা, যার গর্বের ভিত মজবুত, তাঁর কর্ম প্রচেষ্টার ঔজ্জ্বল্য এবং বদান্যতার কারণে।

وعبد مناف وهو علم قومه اش - تطاط الأماني واحتكام الرغائب

—আর আবদে মানাফ, যিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনকে শিক্ষা দান করেন, আর তাদেরকে আশা-আখাঙ্ক্ষা, উৎসাহ-উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করেন।

وان قصيا من كريم غراسه - لفي منهل لم يدن من كف قاضب

—এবং কুসাইতে হচ্ছেন সম্মানিত উৎসের ব্যক্তিত্ব, তিনি এমন এক উৎসে অবস্থান করেন, কর্তনকারীর হস্ত তাঁর নিকটেও আসতে পারে না।

به جمع الله القبائل بعد ما - تقسمها نهب الاكف السوالب

—তাঁর দ্বারা আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন গোত্রকে একত্রিত করেন, ছিনতাইকারী হস্তগুলো তা ছিন্ন-ভিন্ন করার পর।

وحل كلاب من ذرى المجد معقلا - تقاصر عنه كل دان و غائب

—সম্মানিত বংশ থেকে ‘কিলাব’-এর উদ্ভব হয়। দূরের আর নিকটের সকল ব্যক্তিই অক্ষম ও অপারগ তাঁর নিকটে পৌঁছতে।

ومرة لم يحلل مريرة عزمه - سفاه سفيه او محوبة حائب

—এবং মুররা, যার অভিপ্রায়ের দৃঢ়তা অতিক্রম করতে পারেনি কোন নির্বোধের নির্বুদ্ধিতা বা কোন পাপীর পাপ।

وكعب علا من طالب المجد کعبه - فنال بادني السعي اعلى المراتب

—এবং কা’ব ঊর্ধ্বে উঠেছে যার গোড়ালী, মর্যাদা কামীর ঊর্ধ্বে। ফলে তিনি লাভ করেছেন সামান্যতম চেষ্টায় উচ্চতম মর্যাদা।

والوي لؤي بالعداة فطوعت - له همم الشم الانوف الاغالب

—আর লুয়াই পেঁচিয়ে নেন ঔদ্ধত্য পরায়ণদেরকে, ফলে তাঁর অনুগত হতে বাধ্য হয় উঁচু নাক। বিশিষ্ট প্রবলরাও।

وفي غالب باس ابی البأس دونهم - يدافع عنهم كل قرن مغالب

—আর গালিব, তার মধ্যে রয়েছে শক্তিমত্তা—যুদ্ধ তাকে ছাড়া অপরকে (গ্রহণ করতে) অস্বীকার করে, প্রবল জাতিসমূহ ও তাদের নেতারা তাদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

وكانت الفهر في قريش خطابة - يعوذبها عند اشتجار المخاطب

—আর কুরাইশ বংশে ফিহর এর জন্য ছিল বাগ্মীতা, তিনি যখন উদ্দীপ্ত উত্তেজিত হতেন তখন তারা তার আশ্রয় কামনা করতো।

وما زال منهم مالك خير مالك - والكرم مصحوب واكرم صعب

—আর তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মালিক আর মালিক ছিলেন উত্তম, আর তিনি ছিলেন উত্তম সহচরবৃন্দ পরিবেষ্টিত ও উত্তম সঙ্গী।

وللنضر طول يقصر الطرف دونه - بحيث التقى ضوء النجوم الثواقب

—আর নযর এর জন্য ছিল এমন দৈর্ঘ্য, চোখ যার নাগাল পেতো না। যেমন উজ্জ্বল নক্ষত্রমালার আলো চোখে অল্পই ধরা পড়ে।

لعمري لقد ایدی کنانة قبله - محاسن تابی ان تطوع لغالب

—আমার জীবনের শপথ, ‘কিনানা’ তার মধ্যে প্রকাশিত হয় এমন গুণাবলী, কোন বিজয়ীর কাছে মাথা নত করতে অস্বীকার করে।

ومن قبله ابقى خزيمة حمده - تليد تراث عن حميد الاقارب

—তার পূর্বে খুযায়মা অবশিষ্ট রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রশংসা, উত্তরাধিকারের সম্পত্তি ও নিকটাত্মীয়দের প্রশংসা ছাড়াও।

ومدركة لم يدرك الناس مثله - اعف واعلى عن دني المكاسب

—আর মুদরিকা, মানুষ দেখেনি তার অনুরূপ পূত-পবিত্র ও উন্নত, হীন-নীচ উপার্জন থেকে।

والياس كان اليأس منه مقارنا - لا عداءه قبل اعتداد الكتائب

—আর ইলয়াস, হতাশা ছিল তাঁর দুশমনদের সঙ্গী তাঁর সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করার পূর্বেই।

وفي مضر يستجمع الفخر كله - اذا اعتركت يوما زحوف المقانب

—আর মূয়ার-এর মধ্যে সমাবেশ ঘটতো সকল অহমিকার, যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয় ত্রিশোর্ধ্ব সংখ্যক অশ্বরাজি।

وحل نزاد فزاد من رياسة اهله - محلا تسامی عن عيون الرواقب

—আর নিযার অবস্থান করেন তার পরিজনের কর্তৃত্ব থেকে এমন ঊর্ধ্বে এক স্থানে, যা পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টির ঊর্ধে।

وكان معد عدة لوليه - اذا خاف من كيد العدو المحارب

—আর মাআদ ছিলেন সদা প্রস্তুত তার বন্ধুদের জন্য, যখন সে শঙ্কিত হতো যুদ্ধবাজ দুশমনের চক্রান্তে।

وما زال عدنان اذا عد فضله - توحد فيه عن قرين وصاحب

—আর আদনান ছিলেন এমন যে, যখন তাঁর গুণ শুমার করা হয় তখন তিনি থাকেন সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে একক।

و أد تأدي الفضل منه بغاية - وارث حواه عن قدوم اشايب

—আর উদ্ যার মহিমা প্রকাশ পায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আর এমন উত্তরাধিকার, যা তাকে অন্যান্য সর্দারদের থেকে নিরাপদে রাখে।

وفي ادد حلم تزين بالحجا - اذا الحلم ازهاه قطوب الحواحب

—আর উদাদ-এর মধ্যে বলেছে ধৈর্য-স্থৈর্য ভূষিত জ্ঞান দ্বারা, যখন ধৈর্যহারা হয়ে যায় বড় বড় নেতারা।

وما زال ليتعلى فهميسع بالعلی - ویتبع امال البعيد المراغب

—আর হামায়সা, সর্বদা তিনি উর্ধ্ব গমন অব্যাহত রাখেন, আর অনুগমন করেন দূরবর্তী আগ্রহীদের উচ্চাকাংক্ষার।

ونبت بنته دوحة العز وابتنى - معاقله في مشمخر الأهاضب

—আর নাবিত তাঁকে বানিয়েছে মর্যাদার বিশাল বৃক্ষ, আর তিনি তৈরী করেছেন তাঁর দুর্গ বৃষ্টিবহুল এলাকায়।

و حيزت لقيذار سماحة حاتم - وحكمة لقمان وهمة حاجب

—আর কীদার তার জন্যে পুঞ্জীভূত করা হয়েছে হাতিম তাইয়ের বদান্যতা, লুকমানের প্রজ্ঞা ও শান্ত্রীর সাহসিকতা।

همو نسل اسماعیل صادق و عده - فما بعده في الفخر مسعى لذاهب

—তারা হচ্ছেন ইসমাঈলের বংশধর, যিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী। তার পরে গর্বকারীর গর্বের আর কিছুই নেই।

وكان خليل الله اكرم من عنت - له الأرض ماماش عليها وراكب

—আর ইবরাহীম ছিলেন আল্লাহর বন্ধু, পৃথিবীর বক্ষে পদচারণাকারী ও অশ্বারোহী সকলের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত।

وتار ح مازالت له ارئجية - تبين منه عن حميد المضارب

—আর তারিহ সৎ স্বভাব তাঁকে সদা আনন্দ দান করতো, বিশাল তাঁবু থেকে প্রকাশ পেতে তার প্রশংসা।

وناحور نحار العدى حفظت له - ماثر لمايحصيها عدحاسب

—আর নাহূর, তিনি তো দুশমনদের বিনাশকারী, তার জন্য সংরক্ষিত থাকে স্মৃতিচিহ্ন, গণনাকারী যখন তা গণনা করে।

واشرغ في الهيجاء ضيغم غابة - يقد الطلى بالمرهفات القواضب

—আর আশরাগ যুদ্ধ-বিগ্রহে তিনি ছিলেন বনের সিংহের মত। বিনাশী অস্ত্র দ্বারা তিনি বিদীর্ণ করেন গর্দান।

وار غو ناب في الحروب محكم - حنين على نفس المشح المغالب

—আর আরগু-যুদ্ধে তিনি গর্জন করেন, বিজয় লোভী ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি কৃপণ।

وما فالغ في فضله تلو قومه - ولا عابر من و لضم في المراتب

—আর ফালিগ-তার জাতির পেছনে তার মর্যাদা বিনাশকারী কেউ নেই, মর্যাদায়ত্ত তাদের মধ্যে কেউ নেই তাকে অতিক্রমকারী।

وشالخ وار فخشذ وسام سمت بهم - مجايا حمتهم كل ذار و غائب

—এবং শালিখ, আরফাখশায ও সাম, উন্নত করে তাদেরকে এমন সব স্বভাব, যাদেরকে সমর্থন করে যে কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী ও অনুপস্থিত ব্যক্তি।

وما زال نوح عند ذی العرش فاضلا - يعده في المصطفين الاطايب

—আর নূহ সর্বদাই ছিলেন আরশের অধিপতির নিকট গুণীজন, তিনি তাঁকে বাছাইকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করেন।

ولمك ابوه كان في الروع رائعا - جرئيا على نفس الكمي المضارب

—আর তাঁর পিতা লেমক, প্রতাপ প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে ছিলেন সেরা, তিনি ছিলেন বর্মধারী। বীরের বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা।

ومن قبل لمك لم يزل متوشلخ - يذود العدى بالذائدات الشواذب

—আর লেমক এর পূর্বে ছিলেন মতুশেলখ দুশমন হটাতেন তিনি দুর্বল হাড্ডিসার বাহন নিয়ে।

وكانت لادريس النبی منازل - من الله لم تقرن بهمة راغب

—আর ইদ্রীস নবীর জন্য ছিল আল্লাহর নিকট উচ্চ মর্যাদা, কোন উচ্চাভিলাসীর আকাঙ্ক্ষা যার নাগাল পায় না।

ويارد بحر عند آل سراته - ابي الخزایا مستدق المأرب

—আর ইয়ারিদ (থেরদ) ছিলেন একটা সমুদ্র তার বংশের সেরা ব্যক্তিদের নিকট, অপমানকে প্রত্যাখ্যানকারী আকাঙ্ক্ষা পূরণকারী।

وكانت لهلا ييل فهم فضائل - مهذبة من فاحشات المثالب

—আর মাহলাঈলের জন্য ছিল শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি যা ছিল পরিশীলিত ও অশ্লীল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত।

وقينان من قبل اقتنى مجد قومه - وفاد بشأ والفضل و خد الركائب

—আর ইতিপূর্বে ছিলেন কাইনান-তিনি ধারণ করেন স্বজাতির মর্যাদা, মর্যাদার প্রতিযোগিতায় তিনি দ্রুত অগ্রগামী।

وكان ادنوش ناش للمجد نفسه - ونزهها عن مرديات المطالب

—আর আনুশ ছিলেন প্রবৃত্তির তাড়না থেকে আত্মসম্বরণকারী এবং তার প্রবৃত্তিকে তিনি পবিত্র রাখেন রিপুর বিধ্বংশী তাড়না থেকে।

وما زال شيث بالفضائل فاضلا - شريفا بريئا من ذميم المعائب

—আর শীছ ছিলেন মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, তিনি ছিলেন সম্রান্ত, মুক্ত ছিলেন নিন্দনীয় দোষ-ত্রুটি থেকে।

وكلهم من نورا دم اقبسوا - وعن عوده اجنوا ثمار المناقب

—আর তাদের সকলেই আহরণ করেন আদমের নূর থেকে আলো, আর তার বৃক্ষ থেকে আহরণ করেন মর্যাদার ফল।

وكان رسول الله اكرم منجب - جرى في ظهور الطيبين المناجب

—আর আল্লাহর রাসূল ছিলেন সকল মর্যাদাবানের চাইতে বেশী মর্যাদা সম্পন্ন, পূত-পবিত্র বংশধারা আদি থেকে চলে এসেছে।

مقابلة أباؤه امهاته - مبرأة من فاضحات المثالب

—তাঁর মায়ের বংশধারা ও পিতার বংশধারা সমান্তরালভাবে চলে এসেছে। তারা সকলেই ছিলেন দোষ-ত্রুটি মুক্ত।

علیه سلام الله في كل شارق - الاح لنا ضوءا وفي كل غارب

—তার উপর আল্লাহর তরফ থেকে শান্তি বর্ষিত হোক উদয়াচলে ও অস্তাচলে।

শায়খ আবু উমর ইবন আব্দুল বার কাসীদাটি এভাবেই উল্লেখ করেছেন। আমাদের শায়খ আবুল হাজ্জাজ আল-মাজী তাঁর তাহযীব গ্রন্থে উস্তাদ আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ আল-নগশী, যিনি ইবন শারশীর নামে পরিচিত, তাঁর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে এটি উদ্ধৃত করেছেন। মূলত তিনি ছিলেন আম্বার অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি বাগদাদে আগমণ করে পরে মিশরে গমন করেন এবং হিজরী ২৯৩ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত মিশরেই অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন মুতাজিলা দর্শনে বিশ্বাসী একজন ধর্মতত্ত্ববিদ। শায়খ আবুল হাসান আল-আশ’আরী তার ‘আল-মাকালাত’ গ্রন্থে মুতাজিলাদের আলোচনা প্রসঙ্গে ইবন শারশী-এর উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি। কবিতায় তাঁর এমনই দখল ছিল যে, তিনি বিভিন্ন কবির কবিতার প্যারোডী লিখতেন। আর তাদের বিরোধিতায় তিনি পদ্য রচনা করতেন এবং এগুলোতে তিনি এমন সব অভিনব শব্দের ঝংকার আর ভাবের দ্যোতনা সৃষ্টি করতেন, যার সাধ্য অন্য কবিদের ছিল না। এমনকি কেউ কেউ তাকে প্রবৃত্তি পূজারী এবং ভোগবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। খতীব বাগদাদী উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর অভিন্ন ছন্দ বিশিষ্ট একটা অনবদ্য কাসীদা আছে, যার পংক্তি সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, আন-নাজিম এ কসীদাটির উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর ওফাতের তারিখও কবিতায় নির্ণয় করেছেন।

আমি বলিঃ এই কাসীদাটি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, বাগ্মিতা, ভাষা জ্ঞান, শব্দালংকার, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, ধীশক্তি, শব্দ প্রয়োগে দক্ষতা, তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান এবং মহানবী (সা)-এর পবিত্র বংশধারা কবিতার ছন্দে প্রকাশ করার অসাধারণ ক্ষমতা প্রমাণ করে। এসব হচ্ছে তাঁর ভাব সমুদ্র থেকে আহরিত উৎকৃষ্ট মুক্তামালা। আল্লাহ তাঁর প্রতি সদয় হোন তাকে ছওয়াব দান করুন এবং তার পরকালকে কল্যাণময় করুন।

৭৩
আদনান পর্যন্ত হিজাযের আরবদের উর্ধ্বতন বংশধারা
আদনান-এর দুইজন পুত্র ছিলেন (১) সাদ (২) আক। সুহায়লী বলেনঃ আর আদনানের আরো দুইজন সন্তান ছিলেন একজনের নাম হারিছ এবং অপরজনকে বলা হতো মযহব। তিনি বলেন, তাঁর সন্তানদের মধ্যে যাহ্হাক নামের আরেক জনের উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কারো কারো মতে যাহহাক ছিলেন সাদ-এর পুত্র, আদনান-এর নন। তিনি বলেনঃ কেউ কেউ বলেছেন যে, আদন-যার নামে আদন বা এডেন নগরীর নামকরণ করা হয়েছে এবং আবইয়ান ও আদনান-এর অপর দুইপুত্র ছিলেন। এটি তাবারীর বর্ণনা।

আর আক আশাআরির বংশে বিবাহ করেন এবং ইয়ামানে তাদের জনপদে বসবাস করেন ফলে তারা একই ভাষাভাষী হয়ে যান এবং এর ফলে কোন কোন ইয়ামানবাসী ধারণা করেন তাঁরাও ঐ বংশের লোক। ফলে তারা বলে- আক ইবন আদনান ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল আযদ ইবন ইয়াগুছ। আবার কেউ কেউ বলেন, আক্ ইবন আদনান ইব্‌ন যাইব (মতান্তরে রাইস) ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আসাদ। আর বিশুদ্ধ কথা হলো আমরা যা উল্লেখ করেছি যে, তারা আসলে আদনান এর বংশধর। এ প্রসঙ্গে কবি আব্বাস ইবন মিরদাস বলেনঃ

وعك بن عدنان الذين تلعبوا - بغسان حتى طردوا كل مطرد

—আক ইবন আদনান, যারা গাসসান গোত্রের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুক করতো, যতদিন পর্যন্ত না তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করে দেয়া হয়।

আর সাদ-এর ছিলেন চার পুত্র নিযার, কুযা’আ, কুনছ ও ইয়াদ। আর কুযা’আ ছিলেন সাদের জ্যৈষ্ঠ সন্তান এজন্য তাকে আবু কুযা’আ নামে অভিহিত করা হতো। কুযা’আ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা ভিন্ন মতের উল্লেখ করেছি। কিন্তু ইবন ইসহাক প্রমুখের নিকট এটাই বিশুদ্ধ। আল্লাহই ভালো জানেন।

আর কুনছ সম্পর্কে বলা হয় যে, তার বংশধারা ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের কেউই আর বেঁচে নেই। তবে অতীত ইতিহাস বেত্তাদের এক দলিলের মতে নুমান ইব্‌ন মুনযির, যিনি ছিলেন হীরায় কিসরার প্রতিনিধি, তিনি ছিলেন কুনছ-এর বংশধর। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভিন্ন মতে তিনি ছিলেন হিময়ার বংশের লোক। আল্লাহই ভালো জানেন।

আর নেযার-এর তিনপুত্র ছিলেন রবী’আ, মুযার এবং আনসার। ইবন হিশাম বলেনঃ ইয়াদ নামক নেযার অপর এক পুত্র ছিলেন। যেমন কবি বলেনঃ

وفتو حسن او جههم - من إياد بن نذاء بن معد .

—আর এমন অনেক যুবক আছে, যাদের চেহারা সুন্দর, তারা হচ্ছে ইয়াদ ইবন নিযার ইবন মা’দ-এর সন্তান।

ইবন হিশাম বলেনঃ ইয়াদ ও মুযার ছিলেন সহোদর ভাই, তাদের মা সাওদা ছিলেন আক ইবন আদনানের কন্যা। আর রবীআ ও আনসার-এর মা ছিলেন আক ইবন আদনান-এর অপর কন্যা শাকীকা, মতান্তরে জুম’আ বিনত আক। ইবন ইসহাক বলেনঃ আনসার হচ্ছেন খাছ‘আম ও বাজীলার পিতা। জরীর ইবন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী এই বাজীলারই অধস্তন বংশধর। তিনি বলেনঃ আনসার ইয়ামানে আগমন করে ইয়ামানীদের সঙ্গে মিলেমিশে সেখানেই বসবাস করেন। ইবন হিশাম বলেনঃ ইয়ামানবাসীরা বলে যে, আনসাব ইবন আরাশ ইবন লাহইয়ান ইবন আমর ইবনুল গাওছ ইবন নাবত্ ইবন মালেক ইবন যায়ছ ইবন কাহলান ইব্‌ন সাবা। আমি বলিঃ ইতিপূর্বে সাবা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে। তা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ ভালো জানেন। ঐতিহাসিকরা বলেনঃ মুযার হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি হুদী গান গেয়ে গেয়ে উট হাঁকানোর প্রবর্তক। কারণ, তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সুমধুর। একদিন উটের পিঠ থেকে পড়ে যান। মাটিতে পড়ে তার হাত ভেঙ্গে গেলে তিনি বলে উঠেনঃ হায় আমার হাত। হায় আমার হাত! এ থেকেই উটের দ্রুতগতির প্রচলন হয়। ইবন ইসহাক বলেনঃ মুযার ইবন নিযাবের দুই পুত্র ছিলেন, ইলিয়াছ ও আইলান আর ইলিয়াসের ছিলেন তিন পুত্র মুদরিকা, তাবিখা এবং কুম‘আ। আর এঁদের মাতা ছিলেন খানদাফ বিনত ইমরান ইবন ইলহাফ ইবন কুযা‘আ। ইবন ইসহাক বলেনঃ মুদরিকার নাম ছিল আমের আর তাবিখার নাম ছিল উমর। তবে তাঁরা দু’জনে মিলে একটা শিকার করেন। তাঁরা উভয়ে যখন তা রান্না করছিলেন, তখন ভয়ে উটটি পালিয়ে যায়। আমের উটের খোঁজে বের হন এবং শেষ পর্যন্ত তা খুঁজে পান। অপরজন রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। উভয়ে পিতার নিকট এসে তাঁকে এ কাহিনী শুনালে তিনি আমেরকে বললেনঃ তুমি হলে মুদরিকা (পাকড়াওকারী) আর আমরকে বললেনঃ তুমি হলে তাবিখা (রন্ধনকারী)। তিনি আরো বলেনঃ মুদাবের বংশধারা সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তিদের ধারণা যে, খুযাআ হচ্ছেন আমর ইবন লুহাই ইবন কুম’আ ইব্‌ন ইলিয়াস এর বংশধর। আমি বলিঃ এটা স্পষ্ট যে, তিনি তাদের বংশের লোক, কিন্তু তাদের পিতৃপুরুষ নন। আর তারা যে হিময়ার গোত্রের লোক, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন।

ইবন ইসহাক বলেনঃ মুরিকার দুই ছেলে খুযায়মা ও হুযাইল আর এঁদের উভয়ের মা হচ্ছেন কুযাআ গোত্রের এক মহিলা। আর খুযায়মার সন্তান ছিলেন কিনানা, আসাদ, উসদা ও হাওন। আবু জাফর তাবারী কিনানার সন্তানদের ব্যাপারে এ চারজনের অতিরিক্ত ‘আমের হারিছ, নাযীর, খানাম, সা’দ ‘আওযা, জারওয়াল, হিদাল এবং গাওয়ান এর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ আর কিনানার সন্তান ছিলেন নযর, মালিক, আযদ মানাত এবং মালকান।

৭৪
কুরায়শ তথা বনু নযর ইবন কিনানা-এর বংশধারা ও শ্রেষ্ঠত্ব
ইবন ইসহাক বলেনঃ নযর-এর মা বাররা ছিলেন মুর ইবন উদ্ ইবন তাবিখার কন্যা। আর তার সমস্ত সন্তানরা তাঁর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত। এ মতের বিরোধিতা করেন ইবন হিশাম। তার মতে বাররা বিনত মুর হচ্ছেন নযর, মালিক ও মালকান-এর মা। আর আবদে মানাত-এর মা হচ্ছেন আযদ সানুআ গোত্রের হান্না বিনত সুয়াইদ ইবন গিতরীফ। ইবন হিশাম বলেনঃ নযরই হচ্ছেন কুরাইশ আর তার সন্তানরাই কুরায়শী নামে পরিচিত হন। তিনি এও বলেন যে, কারো কারো মতে ফিহর ইবন মালিক হচ্ছেন কুরায়শ, আর তার সন্তানরা কুরায়শী। যারা তার সন্তান নয়, তারা কুরায়শী একাধিক কুলজিবিশারদ যথা শায়খ আবু উমর ইবন আব্দুল বার, যুবায়র ইবন বাক্কার এবং মুছ’আব প্রমুখ এ দু’টি উক্তির উল্লেখ করেছেন। আবু উবায়দ এবং ইবন আব্দুল বার বলেনঃ আস’আদ ইবন কায়স-এর উক্তি মতে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ মত পোষণ করেন যে, কুরায়শ হচ্ছেন নযর ইবন কিনানা।

আমি বলবোঃ হিশাম ইবন মুহাম্মদ ইবন সাইব আল-কানবী এবং আবু উবায়দা মাযার ইবন মুসান্না এ মতের সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। আর তিনি শাফিঈ মাযহাবের প্রসারে অবদান রাখেন। পক্ষান্তরে আবু উমর এ মত পোষণ করেন যে, কুরায়শ হচ্ছেন ফিহর ইবন মালিক। এ মতের সমর্থনে তিনি প্রমাণ উপস্থিত করে বলেন যে, বর্তমানে এমন কেউ নেই, যে নিজেকে কুরায়শী বলে দাবী করে অথচ সে ফিহর ইবন মালিক-এর বংশধর নয়। অতঃপর তিনি এ উক্তির পক্ষে যুবায়র ইবন বাক্কার মুসআর ইবন যুবায়র। এবং আলী ইবন কায়সান-এর নাম উল্লেখ করে বলেনঃ এ ব্যাপারে ত এরাই হচ্ছেন সর্বজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। আর যুবায়র ইবন বাক্কার বলেনঃ কুরায়শ ও অন্যান্য বংশধারা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা একমত যে ফিহর ইবন মালিকই হচ্ছেন কুরায়শদের আদি পুরুষ। ইবন মালিক-এর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের কেউই কুরায়শ নামে অভিহিত হননি। অতঃপর এ বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অনেক প্রমাণ দেন। কুলায়ব ইব্‌ন ওয়ায়েল-এর সূত্রে বুখারী বর্ণনা করেন যে, আমি নবীজীর ঘরে লালিত যয়নবকে বললাম, ‘আমাকে জানান যে, নবী করীম (সা) কি মুযার গোত্রের লোক ছিলেন?’ তিনি বললেনঃ ‘তিনি নযর ইবন কিনানা গোত্রের মুযার গোত্রেরই ছিলেন।’ আর তাবারানী জাশীশ আল- কিন্দীর বরাতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা)-এর নিকট কিন্দা থেকে একদল লোক আগমন করে বললোঃ ‘আপনি তো আমাদের বংশের লোক।’ তখন তিনি বললেন, ‘না, বরং আমরা নসর ইবন কিনানা গোত্রের লোক। আমরা আমাদের মাতৃপক্ষ সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করি না এবং আমাদের উর্ধ্বতন পিতৃ পুরুষ আমরা অস্বীকার করি না।

আর ইমাম আবু উসমান সাইদ ইবন ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, শিন্দা গোত্র থেকে জাশীস নামক জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (সা)-এর নিকট আগমন করে বলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা মনে করি আবদ মানাফ আমাদের বংশের লোক।’ নবী করীম (সা) মুখ ফিরায়ে নিলেন। লোকটি ফিরে এসে অনুরূপ বললে তিনি তার থেকে পুনরায় মুখ ফিরালেন। লোকটি আবারও ফিরে এসে অনুরূপ কথা বললে তিনি বললেনঃ ‘আমরা নসর ইবন কিনানার বংশধর। আমাদের মাতৃকুল সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করি না আর আমাদের ঊর্ধ্বতন পিতৃ পুরুষকে অস্বীকার করি না।’ তখন রাবী বললেনঃ আপনি প্রথম দফায়ই চুপ করে রইলেন না কেন? এইভাবে আল্লাহ্ তাঁর নবীর পবিত্র মুখে তাদের দাবী নাকচ করে দেন। এ সনদে হাদীসটি গরীব পর্যায়ের উপরন্তু কালবী হচ্ছেন একজন দুর্বল রাবী। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ইমাম আহমদ আশআছ ইবন কায়েস সূত্রে বলেন যে, কিন্দার প্রতিনিধি দলে আমিও নবী করীম (সা)-এর নিকট আগমন করি। তখন আমি বললামঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের ধারণা, আপনি আমাদের বংশেরই লোক।’ তখন নবী করীম পূর্বোল্লেখিত হাদীসের অনুরূপ জবাব দেন। এ বর্ণনার শেষাংশে আছে, আশআস ইবন কায়েস বলেন, ‘আল্লাহর কসম, কুরাইশরা যে নযর ইবন কিনানার বংশধর, একথা কাউকে অস্বীকার করতে শুনলে শরীয়তের দণ্ডবিধি অনুযায়ী তাকে বেত্রাঘাত করবো।’ ইবন মাজাহ্ও এ হাদীসটি উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন। এ হচ্ছে এ বিষয়ে শেষ কথা। সুতরাং যে তার বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। জারীর ইবন আতিয়া তামীমী হিশাম ইবন আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান-এর প্রশংসায় বলেনঃ

فما الام التي ولدت قريشا - بمقرفة التجار ولا عقيم

وماقرم بانجب من ابيكم - ولا خال باكرم من تميم

—যে মা কুরাইশকে জন্ম দিয়েছেন তাঁর বংশে কোন কলংক নেই এবং তিনি বন্ধ্যাও নন, কোন নেতা তোমাদের পিতৃপুরুষের চাইতে অধিকতর সম্ভ্রান্ত নয়, আর কোন মামা তামীম গোত্রের চাইতে অধিক সম্মানিত নয়।

ইবন হিশাম বলেনঃ এ উক্তিটি নযর ইবন কিনানার মা সম্পর্কে। আর তিনি হলেন তামীম ইবন মুর-এর বোন বাররা বিনত মুর। কুরায়াশ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে কথিত আছে যে, তাকাররুশ ( تقرش ) শব্দ থেকে-এর উৎপত্তি যার অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর একত্র হওয়া। আর এটা হয়েছে কুসাই ইবন কিলাব-এর যমানায়। তারা ছিল বিচ্ছিন্ন। তিনি তাদেরকে হেরেম শরীফে একত্র করেন। পরে এর বিবরণ আসছে। হুযাফা ইবন গানিম আলআদবী বলেনঃ

ابوكم قصي كان يدعی مجمعا - به جمع الله القبائل من فهر

—তোমাদের পিতা কুসাই সমবেতকারী নামে অভিহিত হতেন। তাঁরই মাধ্যমে আল্লাহ সমবেত করেছেন ফিহরের কবীলাকে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেনঃ কুসাইকে বলা হতো কুরাইশ, যার অর্থ একত্র করা। আর তাকাররুশ অর্থও একত্র করা। যেমন আবু খালদা আল ইয়াশকারী বলেনঃ

اخوة قرشوا الذنوب علینا - في حديث من دهرنا وقديم

—ভাইয়েরা আমাদের বিরুদ্ধে জড়ো করেছে অপরাধের অভিযোগ, আমাদের যুগের এবং প্রাচীন যুগের কাহিনীতে।

আবার কেউ কেউ বলেন, কুরাইশ নামকরণ করা হয়েছে ‘‘তাকাররুশ” ( تقرش ) থেকেঃ যার অর্থ উপার্জন করা, ব্যবসা করা। ইবন হিশাম এটি উল্লেখ করেন। অভিধানবেত্তা জাওহারী বলেনঃ কুরাইশ( قريش ) অর্থ উপার্জন করা, জড়ো করা আর ব্যাকরণবিদ ফাররা বলেন এ নামেই কুরাইশ কবীলার নামকরণ করা হয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষ হচ্ছেন নযর ইবন কিনানা। তাঁর সন্তানগণই কুরায়শী-উর্ধতনরা নন। আবার কারো কারো মতে, কুরাইশ নামকরণ হয়েছে তাকতীশ শব্দ থেকে। হিশাম ইব্‌ন কালবী বলেন, নযর ইবন কিনানার নাম রাখা হয় কুরাইশ। কারণ, তিনি মানুষের অভাব-অনটনের খোঁজ খবর নিতেন এবং নিজের অর্থ দ্বারা তাদের অভাব পূরণ করতেন। আর ‘তাকরীশ’ ( تقريش ) অর্থ হচ্ছে ‘তাফতীশ’ ( تفتيش ) তথ্য অনুসন্ধান। আর তাঁর সন্তানরা মওসুমের সময়ে লোকজনের অভাব-অনটনের খোঁজ নিতেন। যাতে লোকেরা দেশে ফিরে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা তারা করতেন। একারণে তাদের নামকরণ করা হয় কুরাইশ। এ নাম তাদের এ কাজের জন্য। তাকরীশ’ অর্থ যে তাফতীশ তথা অনুসন্ধান, এ অর্থে কবি হারিস ইবন হিল্লিযা বলেনঃ

ايها الناطق المقرش عنا - عند عمرو فهل له ابقاء

—হে আমাদের সম্পর্কে অনুসন্ধানী বক্তা! আমর-এর নিকট, তার কি কোন স্থিতি আছে? এটি যুবায়র ইবন বাকারের বর্ণনা। আবার কেউ কেউ বলেন, কুরায়শ শব্দটা ‘‘কিরশ’’ ( قرش ) শব্দের তাসগীর তথা ক্ষুদ্রতা জ্ঞাপক শব্দ। আর قرش অর্থ সমুদ্রে বিচরণকারী প্রাণী। কোন কবি বলেনঃ

وقريش هي التي تسكن البح - ربها سميت قريش قريشا

—আর কুরায়শ হচ্ছে সমুদ্রে বসবাস করা প্রাণী, যে কারণে কুরায়শকে কুরায়শ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

আবু রুকানা আল-আমিরী সূত্রে বলেন যে, মু’আবিয়া (রা) ইবন আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, কুরায়শের এরূপ নামকরণের কারণ কী? তিনি বললেনঃ একটি সামুদ্রিক প্রাণীর কারণে, যা কিনা সমুদ্রের সর্ববৃহৎ প্রাণী। তাকে বলা হয় কিরশ। ক্ষুদ্র বৃহৎ যার নিকট দিয়ে এ প্রাণী অতিক্রম করে, তাকেই গ্রাস করে। তিনি বললেন, এ প্রসঙ্গে আমাকে কোন কবিতা আবৃত্তি করে শুনান। তিনি আমাকে কবি জুমাহীর কবিতা শুনালেন, যাতে তিনি বলেনঃ

وقريش هي التي تسكن البح - ربها سميت قريش قريشا

—আর কুরায়শ সে প্রাণী, যে বাস করে সমুদ্রে, এ কারণে কুরায়শের নাম করণ করা হয় কুরায়শ।

تاكل الغث والسمين ولا - تتركن لذي الجناحين ريشا

—সে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সবই গ্রাস করে নেয়, ছাড়ে না কোন পাখা ওয়ালার পাখনা।

هكذا في البلاد حى قريش - ياكلون البلاد اكلا كميشا

—এভাবেই জনপদে কুরায়শ গোত্র, গ্রাস করে জনপদকে প্রচণ্ড ভাবে।

ولهم اخر الزمان نبی - يكثر القتل فيهم و الخموشا

—আখেরী যমানায় কুরায়শদের একজন নবী হবেন, যিনি তাদের অনেকের হত্যার ও যখমের কারণ হবেন।

আবার কেউ কেউ বলেন, কুরায়শ ইবনুল হারিছ ইবন ইয়াখলাদ ইবন কিনানার নামানুসারে কুরায়শ নামকরণ করা হয়েছে। আর তিনি ছিলেন বনূ নযর-এর নেতা এবং তাদের সঞ্চিত সম্পদের রক্ষক। আরবরা বলতো, কুরায়শের দল এসেছে। ঐতিহাসিকরা বলেন, ইবন বদর ইবন কুরায়শ ছিলেন ঐ ব্যক্তি, যিনি ঐতিহাসিক বদর কূপ খনন করান, কুরআন মজীদে এ যুদ্ধকে ইয়াওমুল ফুরকান তথা পার্থক্যের দিন এবং দুটি দলের মুখোমুখি হওয়ার দিন বলে উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন। কুরাইশের দিকে সম্পৃক্ত করে কারশী এবং কুরায়শী বলা হয়। জাওহারী বলেন, এটাই যুক্তি সঙ্গত। কবি বলেনঃ

لكل قریشی علیه مهابة - سريع الى داعی الندى والتكرم

—সকল কুরায়শী চেহারায় রয়েছে গাম্ভীর্যের ছাপ। দ্রুত ছুটে যায় সে বদান্যতা ও সম্মানের দিকে।

অভিধানবেত্তা জাওহারী বলেন, কুরায়শ শব্দটি যদি শাখাগোত্র অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে তা হবে ( منصرف ) আর যদি গোত্র অর্থে ব্যবহৃত হয় তবে তা হবে ( غير منصرف ) এ প্রসঙ্গে জনৈক কবি বলেন।

وكفى قريش المعضلات وسادها

—সমস্যার মুকাবিলার কুরায়শরা যথেষ্ট তাতে তারা নেতৃত্ব দেয় [এটি আদী ইবন রুফা-এর কবিতার অংশ বিশেষ। এতে তিনি ওলীদ ইবন আব্দুল মালিক-এর প্রশংসা করেন। কবিতার প্রথমাংশ এইঃ غلب المسا ميح الو ليد سماحة ]

আর মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে ওয়াছিলা ইবনুল আসকা’ সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা ইসমাঈলের বংশধরদের মধ্য থেকে ফিনানাকে মনোনীত করেছেন, আর কুরায়শকে মনোনীত করেছেন ফিনানার সন্তানদের মধ্য থেকে এবং হাশিমকে মনোনীত করেছেন কুরায়শ থেকে এবং আমাকে মনোনীত করেছেন বনূ হাশিম থেকে। আবূ উমর ইবন আব্দুল বার বলেনঃ বনু আব্দুল মুত্তালিবকে বলা হয় রাসূলুল্লাহর পরিজন ( فصبله ) বনু হাশিম শাখা গোত্র ( فخذ ) বনূ আব্দ মানাফ তার উপগোত্র ( بطن ) এবং কুরায়শ তার গোত্র ( عمارة ) এবং বনূ কিনানা তাঁর কবীলা ( قبيله ) এবং মুযার তাঁর কওম ( شعب ) কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক। ইবন ইসহাক বলেনঃ নযর ইবন কিনানার সন্তান হচ্ছেন মালিক এবং মুখাল্লাদ। ইবন হিশাম সালত নামের তাঁর আরেক সন্তানের কথা উল্লেখ করেছেন। এবং তাদের সকলের মা হচ্ছেন সা’দ ইব্‌ন যারব আল উদওয়ানী। কাছীর ইবন আব্দুর রহমান, যিনি খুযাআ গোত্রের অন্যতম সম্মানীত ব্যক্তি এবং বনূ মুলাইহ ইবন আমর- এর অন্তর্ভুক্ত। ইবন হিশাম বলেনঃ বনূ মুলায়হ্ ইবন আমর সালত্ ইবন নযর- এর পুত্র হচ্ছেন ফিহর। এই ফিহরের মা ছিলেন জন্দলা বিনতু হারিছ ইবন মুযায আল আসগর। আর ফিহর -এর সন্তানরা হচ্ছেন গালিব, মুহারিব, হারিছ এবং আসাদ আর এদের মা লায়লা বিনত সা’আছ ইবন হুযাইল ইবন মুদরিকা।

ইবন হিশাম বলেনঃ জন্দলা বিনত ফিহর তাদের বৈমাত্রেয় বোন। ইবন ইসহাক বলেনঃ গালিব ইবন ফিহর এর সন্তান হচ্ছেন লুয়াই এবং তায়ম। এদেরকে বলা হয় বনুল আদরাম আর তাদের মা হচ্ছেন সালমা বিন্‌তে ‘আমর আল-খুযায়ী। আর ইবন হিশাম বলেন ও কায়স ছিলেন গালিবের অন্য এক সন্তান আর তার মা ছিলেন সালমা বিন্‌তে কা’ব ইবন আর আল- খুযায়ী আর ইনি হলেন লুয়াই-এর মা। ইবন ইসহাক বলেনঃ লুয়াই ইবন গালিব-এর চার পুত্র কা’ব, আমির, সামা এবং আওফ।

ইবন হিশাম বলেনঃ এমনও বলা হয় যে, তিনি জন্ম দেন হারিসকে, আর তারা হচ্ছে জসম ইবনুল হারিস রবীআর হুয়ান গোত্রে এবং সায়াদ ইবন লুয়াইকে। আর তারা হচ্ছে শাইবান ইব্‌ন সালাবার বিনানা গোত্র আর এরা হচ্ছে তাদের প্রতিপালনকারী। আর খুযাইমা ইবন লুয়াই, যারা শারবাম ইবন সা’লাবা গোত্রে আশ্রয় গ্রহণকারী।

অতপর ইবন ইসহাক সামা ইবন লুয়াই এর বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, সামা ওমানে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করেন। আর তিনি এটা করেন তাঁর ভাই ‘আমির-এর সঙ্গে শত্রুতা আর বিদ্বেষের কারণে। ভাই আমির তাঁকে ভয় দেখালে তিনি তাতে ভীত হয়ে ওমানে পলায়ন করেন এবং সেখানেই নির্জন নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। আর তার কারণ এই হয়েছিল যে, তিনি আপন উটনী ছেড়ে দিলে একটা সাপ এসে উটনীটির ঠোঁট জড়িয়ে ধরে। তখন উটনীটি কাত হয়ে পড়ে যায় এবং সাপটি সামাকে দংশন করে। ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। কথিত আছে যে, মৃত্যুর পূর্বে তিনি অঙ্গুলি দ্বারা মাটির উপর কয়েকটি পংক্তি লিখে যানঃ

عين فابکی لسامة بن لؤي - علقت ما بسامة العلاقة

—চক্ষু! রোদন কর সামা ইবন লুয়াইর তরে, ঝুলে রয়েছিল তার সাথে যে ঝুলন্ত বস্তু (সাপ).....

رمت دفع الخوف ياابن لؤي - مالمن دام راك بالحتف طاقة

—হে ইব্‌ন লুয়াই, তুমি চেয়েছিলে মৃত্যু ঠেকাতে, মৃত্যু যাকে গ্রাস করতে চায়, তার তো ঠেকাবার ক্ষমতা নেই।....

ইবন হিশাম বলেনঃ আমি জানতে পেরেছি যে, তার কোন এক সন্তান রাসূলুল্লাহ (সা)- এর নিকট আগমন করে সামা ইবন লুয়াইর সঙ্গে নিজের বংশের সম্পৃক্ততা ব্যক্ত করলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বলেনঃ ‘কবি সামা?’ তখন জনৈক সাহাবী তাঁকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি যেন তার পংক্তিটির দিকে ইঙ্গিত করছেনঃ

دب كأس هرقت باابن لؤي - حذر الموت لم تكن مهراقة

—কতো পানপাত্র প্রবাহিত করেছ হে ইবন লুয়াই, মৃত্যু ভয়ে তুমি তো ছিলে না তা প্রবাহিত করার।

তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘হ্যাঁ। আর সুহায়লী বলেনঃ কারো কারো মতে, সামা কোন সন্তান রেখে যাননি। [মূল আরবী গ্রন্থে সামা স্থলে উসামা মুদ্রিত হয়েছে।]

যুবায়র বলেন, সামা ইবন লুয়াইর গালিব, নাকীত এবং হারিছ নামের তিন পুত্র ছিল। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, সামা ইবন লুয়াইর সন্তানরা ছিল ইরাকে, যারা হযরত আলী (রা)-এর সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করতো। তাদের মধ্যে একজন ছিল আলী ইবনল জাদ, যে তার আলী নামকরণের জন্য আপন পিতাকে গালিগালাজ করতো। বনু সামা ইবন লুয়াই’র অন্যতম অধস্তন পুরুষ আর’আরা ইবনুল ইয়াযীদ ছিলেন ইমাম বুখারীর অন্যতম উস্তাদ।

ইবন ইসহাক বলেনঃ আওফ ইবন লুয়াই সম্পর্কে কথিত আছে যে, তিনি কুরায়শের একদল অশ্বারোহী সঙ্গে বহির্গত হন। গাতফান ইবন সা’দ ইব্‌ন কায়স ইবন আয়লান-এর জনপদে পৌঁছলে তিনি সেখানে রয়ে যান এবং তাঁর সঙ্গীরা চলে যায়। তখন তাঁর নিকট আগমন করেন ছা’লাবা ইবন সা’দ। তিনি বনু লুবইয়ানের জ্ঞাতি ভাই ছিলেন। ছালাবা তাঁকে এবং তার স্ত্রীকে সেখানে রেখেছেন এবং তার সঙ্গে ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপন করার ফলে বনূ লুবইয়ান এবং ছা’লাবা গোত্রের মধ্যে তাঁর বংশ বিস্তার ঘটে বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন।

ইবন ইসহাক বলেনঃ উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেনঃ আমি যদি আরবের কোন গোত্রের দাবীদার হতাম, অথবা তিনি বলেন যে, আমি যদি তাদেরকে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতাম তাহলে আমি বনু মুররা ইব্‌ন আওফের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবী করতাম। আমরা তাদের মত লোকদেরকে চিনি, অথচ আমরা সে ব্যক্তির অবস্থান স্থল সম্পর্কে জানি না, এই বলে তিনি আওফ ইবন লুয়াইর দিকে ইঙ্গিত করেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ আমি অভিযুক্ত করতে পারি না-এমন ব্যক্তি আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করেন যে, উমর ইবন খাত্তাব (রা) কতিপয় ব্যক্তিকে বলেন, তাদের মধ্যে বনু মুররার লোকও ছিল। তোমরা যদি নিজেদের বংশের দিকে ফিরে যেতে চাও তবে সে দিকে ফিরে যাও। ইবন ইসহাক বলেনঃ আর এরা ছিলেন গাতফান বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তারা ছিলেন গাতফান কায়েস বংশে সকলের মধ্যে সেরা। তারা তাদের সেই পরিচয় নিয়ে সেখানেই রয়ে যান। ঐতিহাসিকরা বলেনঃ ওরা বলতো, যখন তাদের নিকট বংশের কথা বলা হতো, আমরা তা অস্বীকার করছি না, আমরা তার বিরোধিতাও করছি না। আর তা-ই হচ্ছে আমাদের নিকট সবচেয়ে প্রিয় বংশধারা। অতঃপর লুয়াই’র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি তাদের কবিতার উল্লেখ করেছেন।

ইবন ইসহাক বলেনঃ এবং তাদের মধ্যে বুসল (নিষিদ্ধ) নামে একটা প্রথা চালু ছিল। আর সে প্রথাটা হচ্ছে আরবদের মধ্যে বছরের আট মাসকে হারাম বা নিষিদ্ধ জ্ঞান করা। আর আরবরা তাদের এ প্রথা সম্পর্কে অবগত ছিল এবং ঐ সময়ে তারা তাদেরকে নিরাপত্তা দান করতো আর নিজেরাও নিরাপদ বোধ করতো। আমি বলি, রবীআ এবং মুযার গোত্রও বছরে চারটি মাসকে নিষিদ্ধ জ্ঞান করতো। সে মাসগুলো হলো যুলকা’দা, যুলহিজ্জা, মুহররম। চতুর্থ মাস সম্পর্কে রবীআ আর মুযার এর মধ্যে মতভেদ রয়েছে মুযার গোত্র বলেঃ সে মাসটি হচ্ছে জুমাদা ও শা’বানের মধ্যবর্তী মাস অর্থাৎ রজব। পক্ষান্তরে রবী’আ গোত্রের মতে সে মাসটি হচ্ছে শা’বান ও শাওয়ালের মধ্যবর্তী মাস অর্থাৎ রমযান মাস। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবু বকর থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেনঃ আসমান-যমীন সৃষ্টির দিন আল্লাহ তা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, সে অবস্থায় তা ফিরে এসেছে। বছর হচ্ছে ১২ মাসে। সেগুলোর মধ্যে চারটি হচ্ছে হারাম মাস- তিনটি মাস পরপরঃ যুলকদা, যিলহজ্জ ও মুহররম এবং মুযার-এর রজব, যা হচ্ছে জুমাদা ও শা’বান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এ থেকে রবীআ নয়, বরং মুযার-এর উক্তির বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡر ا فِی كِتَـٰبِ ٱللَّهِ یَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَاۤ أَرۡبَعَةٌ حُرُم ࣱ)

[Surah At-Tawbah 36]

—আল্লাহর নিকট মাসের গণনা তার কিতাবে ১২ মাস, যেদিন তিনি আসমান যমীন সুষ্টি করেছেন; তার মধ্যে চারটি হচ্ছে হারাম মাস। (৯ তাওবাঃ ৩৬)

বনু আওফ ইবন লুয়াই যে, আটটি মাসকে হারাম গণ্য করে, উক্ত আয়াত দ্বারা তা খণ্ডিত হয়ে যায়। আর তারা আল্লাহর বিধানে অতিরিক্ত সংযোজন করেছে এবং যা হারাম নয়, তাকে হারামের অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর হাদীসে যে বলা হয়েছে তিনটি মাস পরপরঃ এটা নাসী পন্থীদের মতের খণ্ডন; যারা মুহররমের হুরমতকে সফর মাস পর্যন্ত পিছিয়ে দিত। মহানবীর বাণী মুযার এর রজব মাস-এ কথায় খণ্ডিত হয়েছে রবী’আ গোত্রের মত। ##

ইবন ইসহাক বলেনঃ কা’ব ইবনু লুয়াইর তিনজন পুত্র ছিলেন মুররা, আদী ও হাসীস। এবং মুররারও তিন সন্তান ছিলেনঃ কিলাব তায়ম এবং ইযাকযা। এদের প্রত্যেকের মা ভিন্ন ভিন্ন। তিনি বলেনঃ কিলাবেরও দু’জন পুত্র ছিলেন? কুসাই এবং সহরা। এ দু’জনের মা হলেন ফাতিমা বিনাত সদি ইবনু সায়ল। ইয়ামানের ‘জা’সা আমাদের গোত্রের অন্যতম জুদারা। এঁরা ছিলেন বনু সায়ল ইবন বকর (ইবন আরফ সালাত ইবনু কিনানা)-এর মিত্র। এই ফাতিমার পিতৃপুরুষ সম্পর্কে কবি বলেনঃ

مانري في الناس شخصا واحدا - من علمناه كسعد بن سيل

—মানুষের মধ্যে আমরা দেখি না একজন মানুষকেও যাদেরকে আমরা জানি। সা’দ ইবন সায়ল-এর মতো।

সুহায়লী বলেনঃ সায়ল এর নাম হচ্ছে কামর ইবনু জামালা। আর তিনি হলেন সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যার তরবারীকে স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত করা হয়।

ইবনু ইসহাক বলেনঃ তাদেরকে জুদারা বলা হতো এ জন্য যে, আমির ইবন আমর ইবন খুযায়মা ইবন জা’সামা হারিছ ইবন মুসাম আল-জুরহুমীর কন্যাকে বিবাহ করেন। তখন জুরহুম গোত্র ছিল বায়তুল্লাহর সেবায়েত। তিনি কাবার জন্য প্রাচীর নির্মাণ করান। এ কারণে আমর এর নামকরণ হয় জাদীর তথা প্রাচীর নির্মাতা। এ কারণে তার সন্তানদেরকে জুদারা বলা হয়ে যাকে।

কুসাই ইবন কিলাবের বৃত্তান্ত বায়তুল্লাহর সেবায়েতের দায়িত্ব কুরাইশের হাতে ফেরত আনা এবং খুযাআর নিকট থেকে তা ছিনিয়ে নেয়া

কুসাইয়ের পিতা কিলাবের মৃত্যুর পর তাঁর মাতা আযরা গোত্রের রবী’আ ইবন হারাযকে বিবাহ করেন। কুসাই তার মা এবং সৎ পিতাকে নিয়ে নিজ দেশে রওয়ানা হন। অতঃপর কুসাই যৌবনে মক্কায় ফিরে এসে খুযাআ গোত্রের সর্দার হুলায়ল ইবন হুবশিয়ার কন্যা হুরায়কে বিবাহ করেন। খুযায়ীদের ধারণা এই যে, পুত্র পক্ষে বংশ ধারা বৃদ্ধি দেখে হুলায়ল কুসাইকে বায়তুল্লাহর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ওসিয়ত করেন। তিনি একথাও বলেন যে, এ দায়িত্ব পালনের জন্য তুমি আমার চেয়ে বেশী যোগ্য। ইবন ইসহাক বলেনঃ এ কথা তাদের কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে আমরা শুনিনি। আর অন্যদের ধারণা এই যে, কুসাই তার বৈমাত্রেয় ভাইদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। মক্কার আশ-পাশের কুয়াইশ প্রমুখ, বনু কিনানা, বনু কুযা’আ এবং তার ভাইদের দলপতি ছিলেন রাযাহ ইবন রবীআ। তিনি বনূ খুযাআকে নির্বাসিত করে নিজে এককভাবে বায়তুল্লাহর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। কারণ হাজীদের অনুমতি দানের কর্তৃত্ব ছিল সুফা’দের হাতে। আর সুফা বলা হতো গাওস ইবন মুর (ইবন উদ্দ ইবন তাবিখা ইবন ইলিয়াস ইবন মুযার)-এর বংশধরদেরকে। তারা কংকর নিক্ষেপ না করা পর্যন্ত অন্যরা নিক্ষেপ করতো না এবং মিনা থেকে তারা যাত্রা না করা পর্যন্ত অন্যরা যাত্রা করতো না। তাদের বংশ নিঃশোষিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ভাবেই চলে আসছিল। অতঃপর বনূ সা’দ ইবন যায়দ মানাত ইবন তামীম তাদের উত্তরাধীকারী হন। তাঁদের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন সাফওয়ান ইবনুল হারিস ইবন শিজনা ইবন উতারিদ ইবন আওফ ইবন কা’ব ইবন সা’দ ইবন যায়দ মানাত ইবন তামীম। আর এ দায়িত্ব তারই বংশে রয়ে যায় এবং তাদের শেষ ব্যক্তি কুরব ইবন সাফওয়ানের আমলে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটে। আর মুযদালিফা থেকে যাত্রার অনুমতি দানের কর্তৃত্ব ছিল আদওয়ান গোত্রের হাতে এবং তাদের শেষ ব্যক্তি আবু সাইয়্যারা আমীলা মতান্তরে আম ইবনুল আযালের আমলে ইসলাম কায়েম না হওয়া পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। কারো কারো মতে, আযাল-এর নাম ছিল খালিদ এবং তিনি তার কানা গাধীর পৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে লোকদেরকে অনুমতি দিতেন। এভাবে চল্লিশ বছর অতিবাহিত হয়। তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি রক্তপণ একশ উট সাব্যস্ত করেন, আর তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বলেনঃ ( اشرق ثبير كانعير )

এটি সুহায়লীর বর্ণনা, অর্থাৎ ছবীর পর্বত দেখা যাচ্ছে উট হাঁকাও!

আর ‘আমির ইবনুল যারব আদওয়ালী এমন এক অবস্থানে ছিলেন যে আরবদের মধ্যে কোন চরম বিরোধ দেখা দিলে সকলে ফয়সালার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতো এবং তিনি যে সিদ্ধান্ত দিতেন, তাতে সকলেই সন্তুষ্টি হতো। একবার এক হিজড়ার উত্তরাধিকার নিয়ে তাদের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে চিন্তা করতে করতে তিনি বিনিদ্র রজনী যাপন করেন। তাঁর এক দাসী তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে পায়। এ দাসী তাঁর মেষপাল চড়াতো। তার নাম ছিল সাথীলা। সে বললো, কি হল আপনার? বিনিদ্র রজনী যাপন করতে দেখছি যে আপনাকে? কি বিষয়ে চিন্তা করছেন, তাকে তিনি তা জানালেন। তিনি মনে মনে একথাও বললেন যে, হয়তো এ ব্যাপারে তার কাছে কোন সমাধান থাকতেও পারে। দাসীটি তাকে বললোঃ তার প্রস্রাবের রাস্তা দেখে ফয়সালা করুন! তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম সাখীলা, তুমি তো সমস্যাটির সমাধান করে দিলে। এবং তিনি সে অনুযায়ী ফয়সালা দিলেন! সুহায়ালী বলেনঃ এটা ছিল লক্ষণ বিচারে ফয়সালা দানের একটি দৃষ্টান্ত। শরীয়তে এর ভিত্তি রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَجَاۤءُو عَلَىٰ قَمِیصِهِۦ بِدَم كَذِب ࣲ)

[Surah Yusuf 18]

“তারা তার জামা নিয়ে আসে মিথ্যা রক্তসহ" (ইউসুফঃ ১৮)।

অথচ, তাতে বাঘের নখের কোন লক্ষণ ছিল না। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ

( قَالَ هِیَ رَ  ٰ⁠ وَدَتۡنِی عَن نَّفۡسِیۚ وَشَهِدَ شَاهِد مِّنۡ أَهۡلِهَاۤ إِن كَانَ قَمِیصُهُۥ قُدَّ مِن قُبُل فَصَدَقَتۡ وَهُوَ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ )

[Surah Yusuf 26]

“তার জামা যদি সামনে থেকে ছোড়া হয় তবে সে নারী সত্য বলেছে আর সে (ইউসুফ) মিথ্যাবাদী, আর যদি তার জামা পিছন থেকে হেঁড়া হয়, তবে সে নারী মিথ্যা বলেছে এবং সে পুরুষ সত্যবাদী (১২ ইউসুফঃ ২৬)। আর হাদীসে আছেঃ তোমরা নারীটির দিকে লক্ষ্য করবে। সে যদি ধূসর বর্ণের কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট সন্তান প্রসব করে তা হলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য।

ইবন ইসহাক বলেনঃ বনূ ফকীম ইবন আদী (ইবন আমির ইবন ছা’লাবা ইবন হারিস ইবন মালিক ইবন কিনানা ইবন খুযায়মা ইবন মুদরিয়া ইবন ইলিয়াস) ইবন মুযার গোত্রে ‘নাসী’ প্রথায় প্রচলন ছিল। ইবন ইসহাক বলেনঃ সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি আরবদের মধ্যে নাসী প্রথার প্রচলন ঘটান তিনি ছিলেন আল- কালাম্মাস’ আর তিনিই ছিলেন হুযাফা ইবন আবদ ইবনু ফাকীম ইবনু ‘আদী। তার পর তাঁর পুত্র আব্বাদ তার পর তাঁর পুত্র কালা তারপর উমাইয়া ইবন কালা তারপর আওফ ইবন উমাইয়া। এরপর ছিল তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি আবু সামামা জানাদা ইবন আওফ ইবন কালা ইবন আব্বাদ ইবন হুযায়ফা। আর তিনিই হচ্ছে আল-কালাম্মাস। এই আবু সামামার কালেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। আর আরবরা হজ্জ শেষে তাঁর কাছে এসে একত্র হতো। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। এ ভাষণে তিনি হারাম মাসের ঘোষণা জারী করতেন। সেসব হারাম মাসগুলোর মধ্যে কোন মাসকে হালাল করতে চাইলে মুহররমকে হালাল করতেন এবং তদস্থলে রাখতেন সফর মাসকে, যাতে আল্লাহ যেগুলো হারাম করেছেন, সেগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করতে পারে। তখন তারা বলতোঃ হে আল্লাহ! আমি দু’টি সফর মাসের একটিকে হালাল করেছি আর অপরটি পিছিয়ে রেখেছি আগামী বছরের জন্য। আর এ ক্ষেত্রে আরবরা তাঁরই অনুসরণ করতো। এ ব্যাপারে উমায়র ইবন কায়স, যিনি ছিলেন বনূ ফিরাস। ইবুন গনম ইবন মালিক ইবন কিনানা’র অন্তর্ভুক্ত আর এই উমায়র ইবন কায়স জাদলুত তা’অ্যান নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বলেনঃ

لقد علمت معد أن قومی - کرام الناس ان لهم كراما

—মা’আদ গোত্র নিশ্চিত জানে যে, আমার সম্প্রদায় সকল মানুষের মধ্যে সম্মানিত। সম্মান রয়েছে তাদের তরে।

فای الناس فاتونا بوتر - وای الناس لم نعلك لجاما

—তবে কোন্ মানুষ, নিয়ে এসো আমাদের কাছে, তাদের কোন একজনকে, আর এমন কোন্ লোক আছে, যার লাগাম আমরা কষে বাঁধিনি?

السنا الناسئين على معد - شهور الحل نجعلها حراما

—আমরা কি নই মায়দ গোত্রের উপর ‘নাসী’ কারী? হালাল মাসকে আমরা করি হারাম।

আর কুসাই ছিলেন তার জাতির নেতা। সকলে তাঁর নেতৃত্ব মেনে চলতে এবং তাঁকে সম্মান করতো। মোদ্দাকথা, তিনি জাযিরাতুল আরবের নানা স্থান থেকে এনে কুরায়শদেরকে এক জায়গায় একত্র করেন এবং আরবের গোত্রসমূহের মধ্যে যারা তার আনুগত্য করে, তাদের সাহায্য নেন খুযাআর যুদ্ধে এবং তাদেরকে বায়তুল্লাহ থেকে নির্বাসিত করেন। ফলে সকলে বায়তুল্লাহর দায়িত্ব তার হাতে অর্পণ করে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক যুদ্ধ হয়। অনেক তাজা রক্ত ঝরে। অতঃপর সকলেই আপোষ রফার দাবী জানায়। সকলে ফয়সালার ভার অর্পণ করে ইয়ামার ইব্‌ন আওফ ইবন কা’ব ইবন ‘আমির’ ইবন লায়ছ ইবন বকর ইবন আবদ মানাত ইবন কিনানা’র উপর। তিনি ফয়সলা করেন যে, বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধানে খুযাআর চেয়ে কুসাই আধিকতর যোগ্য ব্যক্তি। তাতে এ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় যে, কুসাই খুযাআ এবং বনূ বকর-এর যে রক্তপাত করেছেন, তা রহিত এবং পদতলে নিষ্পেষিত কিন্তু খুযাআ ও বনূ বকর কুয়ায়শ কিনানা এবং কুযা’আ গোত্রের যে রক্তপাত ঘটিয়েছে, সে জন্য তাদেরকে রক্তপণ আদায় করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মক্কা ও কা’বার কর্তৃত্বের ব্যাপারে কেউ বাধ সাধতে পারবে না। তখন থেকে ইয়ামা’র এর নাম করা করা হয় হা শাদাখ।

ইবন ইসহাক বলেনঃ ফলে কুসাই বায়তুল্লাহ এবং মক্কার কর্তৃত্বের অধিকারী হন এবং তার সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিজেদের মনযিল থেকে মক্কায় এনে একত্র করেন এবং তার সম্প্রদায় আর মক্কাবাসীরা তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নিলে তারা সকলে তাকে বাদশাহ বলে স্বীকার করে নেয়। তিনি আরবদের ব্যাপারে একটা বিষয় মেনে নেন যে, তারা যা মেনে চলতো, তা মেনে চলবে। কারণ তিনি এটাকেই নিজের দীন মনে করতেন। যার পরিবর্তন অনুচিত। ফলে সাফওয়ান আদওয়ান, নাসয়া এবং মুররা ইবন আওফের লোকজন এটা মেনে নেয় যে, তারা পূর্বে যে রীতি মেনে চলতো , তা-ই মেনে চলবে। এ অবস্থায় ইসলামের আগমন ঘটলে আল্লাহ ইসলাম দ্বারা সেসব রীতি-নীতির মূলোৎপাটন ঘটান সম্পূর্ণ রূপে! কুসাই ছিলেন বনূ কাবের প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাদশাহ হন এবং তাঁর জাতির লোকেরা তা মেনে নেয়। ফলে বায়তুল্লাহর সেবা-যত্ন, হাজীদের পানি পান করানো, তাদের আপ্যায়ন করা, পরামর্শ সভার ব্যবস্থাপনা এবং পতাকা ধারণ করা তার দায়িত্বে ন্যস্ত হয়। ফলে মক্কার মর্যাদা রক্ষা করার পূর্ণ কর্তৃত্ব তিনি লাভ করেন। এবং তিনি মক্কাকে তাঁর লোকজনের মধ্যে কয়েক ভাগে বিভক্ত করলে কুরায়শের সকলে নিজ নিজ মনযিলে এসে বসবাস শুরু করেন।

আমি বলিঃ ফলে সত্য তার স্ব-স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুবিচার লোপ পাওয়ার পর পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং কুরায়শরা তাদের নিজেদের আবাসভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। খুযাআ গোত্রেকে বিতাড়নের ব্যাপারে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। প্রাচীন পবিত্র গৃহ (বায়তুল্লাহ) তাদের হাতে ফেরৎ আসে। কিন্তু খুযাআ গোত্রের উদ্ভাবিত মূর্তি পূজা, কা’বার চতুষ্পর্শ্বে মূর্তি স্থাপন, মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী, মূর্তির নিকট আবেদন নিবেদন আর কাতর প্রার্থনা ও সাহায্য কামনা মূর্তির নিকট জীবিকা ভিক্ষা করার কুপ্রথা সমূহ অব্যাহত থাকে। কুসাই কুরাইশের কতক গোত্রকে মক্কার কেন্দ্রস্থলে অন্যকতক গোত্রকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে মক্কার উপকণ্ঠে। আবাদ করায় কুরাইশের কিছু গোত্রকে আর এ কারণে কুরাইশকে কুরায়শে বিতাহ এবং কুরায়শে যাওযাহর নামে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। ফলে কুসাই ইবন কিলাব বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, সেবা-যত্ন এবং পতাকা বহনের পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করেন। আবিচার দূর করা আর বিরোধ নিস্পত্তির নিমিত্ত তিনি একটা ভবন নির্মাণ করে তার নাম দেন দারুন নাদওয়া তথা মন্ত্রণালয়। কোন তীব্র সংকট দেখা দিলে সমস্ত গোত্র প্রধানরা একত্র হয়ে পরামর্শ করতেন এবং সমস্যার সমাধান করতেন। দারূন নাদওয়ার সিদ্ধান্ত ছাড়া পতাকা উত্তোলন করা হতো না। এবং কোন বিয়ে শাদীও সংঘটিত হতো না। দারুন নাদওয়ার সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন দাসী কামিজ পরিধান করতে পারতো না। দারুন নাদওয়ার দরজা ছিল মসজিদে হারামের দিকে। বনূ আবদুদ্দার এরপর দারুন নাদওয়ার দায়িত্ব পান হাকীম ইবন হিযাম। তিনি মুয়াবিয়া (রা)-এর শাসনামলে তা এক লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করলে মুয়াবিয়া (রা) সে জন্য তাকে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন-‘এক লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে তুমি নিজ জাতির মর্যাদা বিক্রয় করে দিলে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনতো মর্যাদা কেবল তাকওয়ার সঙ্গে যুক্ত। আল্লাহর কসম, জাহিলী যুগে আমি তা ক্রয় করেছিলন এক মশক মদের বিনিময়ে; আর এখন তা বিক্রয় করছি এক লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে। আমি তোমাদেরকে সাক্ষ্য রেখে বলছি যে, তার মূল্য আমি আল্লাহর রাস্তায় সাদাকা করে দিলাম। তাহলে আমাদের মধ্যে কে ক্ষতিগ্রস্ত হলো?’ দারা কুতনী মুয়াত্তার আসমাউর রিজাল প্রসঙ্গে এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন। হাজীদেরকে পানি পান করানোর দায়িত্বও ছিল তার। ফলে তাঁর কূয়োর পানি ছাড়া তারা পানি করতে পারতো না। জুরহুমের যমানা থেকে তখন পর্যন্ত যমযম কূপ নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে দীর্ঘ কাল থেকে লোকেরা যমযম কূপের কথা ভুলেই বসেছিল। তা কোথায় ছিল সে কথাও তাদের জানা ছিল না। ওয়াকিদী বলেনঃ কুসাই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি মুযদালিফায় অগ্নিপ্রজ্বলিত করেন। যাতে আরাফাত থেকে আগত ব্যক্তি মুযদালিফার সন্ধান পেতে পারে। আর ‘রিফাদা’ হচ্ছে নিজগৃহে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত হাজীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা।

ইবন ইসহাক বলেনঃ এটা এ জন্য যে, কুসাই হাজীদের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা কুরাইশদের উপর অবশ্য পালনীয় করে দেন। তিনি কুরাইশদের উদ্দেশ করে বলেনঃ তোমরা আল্লাহর প্রতিবেশী মক্কা আর হেরেমের বাসিন্দা। আর হাজীরা আল্লাহর মেহমান এবং তার ঘর যিয়ারতকারী। তারাই মেহমানদারীর অধিকতর হকদার। সুতরাং হজ্জের সময় তোমরা তাদের জন্যে পানাহারের আয়োজন করবে, যতক্ষণ না তারা ফিরে যায়। কুরাইশের লোকেরা তাঁর কথা মতো কাজ করে। এজন্য তারা প্রতি বছর নিজেদের সম্পদ থেকে একটা অংশ বের করতো এবং তা তাঁর নিকট অর্পণ করতো। তিনি হাজীদের মিনায় অবস্থানের দিনগুলোতে তা দ্বারা খাবারের আয়োজন করতেন। ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভের পূর্ব পর্যন্ত এ ধারা চালু ছিল এবং পরেও সে ধারা চালু থাকে। হজ্জ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুলতান এখনো প্রতি বছর মিনায় ভোজর আয়োজন করেন।

আমি বলিঃ ইবন ইসহাকের পর সুলতানের আপ্যায়নের এধারার অবসান ঘটে। তারপর পর বায়তুলমাল থেকে হজ্জের উদ্দেশ্যে গমনকারী পথচারীদের জন্য পাথেয় এবং পানীয় সরবরাহের ব্যবস্থা চালু হয়। অনেক দিক থেকে এটা উত্তম কাজ। তবে নির্ভেজাল বায়তুল মালের সবচেয়ে হালাল অর্থ এতে ব্যয় করা উচিত। আর সর্বোত্তম যাদের যিম্মায় হজ্জ ফরয হয়েছে, তাদের থেকে পর্যায়ক্রমে হজ্জ করিয়ে নেওয়া। কারণ সাধারণত তারা কা’বা গৃহের হজ্জ করেনা। সে চাই ইহুদী বা খৃষ্টান হিসাবে মৃত্যুবরণ করুক। তাতে কিছু আসে যায় না।

কুসাইয়ের প্রশংসা এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে তার মর্যাদার বর্ণনায় কবি বলেনঃ

قصي لعمري كان يدعی مجمعا - به جمع الله القبائل بن فهر

—আমার জীবনের শপথ, কুসাইকে বলতে হয় সমবেতকারী, আল্লাহ তার মাধ্যমে ফিহরের অনেক গোত্রকে একত্র করেছেন।

هموا ملو والبطحاء مجدا وسؤددا - وهم طردوا عنا غواة بني بكر

—তারা ভরে তোলে বাতহাকে মর্যাদা আর নেতৃত্বে, আর তারা তাড়িয়ে দেয় আমাদের পক্ষ থেকে পথভ্রষ্ট বনু বকর গোত্রকে।

ইবন ইসহাক বলেনঃ যুদ্ধ শেষে কুসাইর ভাই রেযাহ ইবন রবী’আ সদলবলে স্বদেশে ফিরে যায় এবং সঙ্গে নিয়ে যায় তার তিন বৈমাত্রেয় ভাইকে, তারা হলোঃ হান, মাহমূদ এবং জালহামা। রেযাহ্ কুসাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে বলেন।

ولما اتي من قصی رسول - فقال الرسول اجيبوا الخليلا

—যখন আসে কুসাইর পক্ষ থেকে দূত, দূত এসে বললো, বন্ধুর ডাকে সাড়া দাও।

نهفنا اليه نقود الجياد - ونطرح عنا الملول الثقيلا

—আমরা ছুটে যাই তার পানে, পরিচালিত করি উত্তম অশ্বদল। আর ঝেড়ে ফেলি আমাদের থেকে অবসাদ ও ক্লান্তি।......

খুযাআকে আমরা বধ করেছি তাদের গৃহে, বধ করেছি বনূ বকরকে, অতঃপর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

نقبناهم من بلاد المليك - لا يحلون ارثاسمولا

—বিতাড়িত করেছি আমরা তাদেরকে মালিকের দেশ থেকে, সমভূমিতে তারা আর পদচারণা করতে পারবে না।

فاصبح سبيلهم في الحديد - كل حي شفينا الغليلا

—তাদের বন্দীরা হয় লোহার শেকলে আবদ্ধ আমরা সকল গোত্রের মনোকষ্ট দূর করি।

ইবন ইসহাক বলেনঃ রেযাহ স্বদেশে ফিরে গেলে আল্লাহ তার ভাই হানার বংশ বৃদ্ধি করেন। তারাই আজ পর্যন্ত আষরা গোত্রদ্বয় রূপে পরিচিত।

ইবন ইসহাক বলেন, এ প্রসঙ্গে কুসাই ইবন কিলাব বলেন,

انا ابن العاصمين بنی لؤي بمكة منزلی و بهاربیت

—আমি হলাম বনূ লুয়াই বংশের রক্ষাকারীদের পুত্র। মক্কায় আমার অবস্থান স্থল, সেখানেই আমি প্রতিপালিত হই।

الى البطحاء قد علمت معد - ومر ونها رضيت بها رحنيت

—বাতহা পর্যন্ত। মা’আদ গোত্র তো নিশ্চিত জানে। তাদের বীরত্বে আমি মুগ্ধ।

فلست لغالب ان لم تاثل - بها او لاد قیدر والنسیت

—আমি গালিবের কেউ নই যদি না কীদার আর নাবীত এর সন্তানদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারি।

زراح ناصری وب أسامي - فلست اخاف ضيماما حييت

—রেযাহ আমার সহায়ক তাকে নিয়ে আমি মর্যাদার আসনে উন্নীত হই। সুতরাং ভয় করিনা আমি জুলুমকে, যতো দিন আমি বেঁচে থাকবো।

উমবী উল্লেখ করেছেনঃ কুসাই খুযাআ গোত্রকে নির্বাসিত করার পরই রেযাহর আগমন ঘটেছিল।

৭৫
অধ্যায়
কুসাই বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে কুরাইশদের নেতৃত্ব, রিফাদা সিকায়া, হিজায়া, লিওবা, মাদওয়া প্রভৃতি যে সব দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত ছিল, সে সব দায়িত্ব তিনি ন্যস্ত করেন পুত্র আব্দুদ্দার এর উপর। আর ইনি ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে মনোনীত করেন এজন্য যে, তার অন্যান্য ভাই আবদ মানাফ আবদ শামস এবং আবদ—এরা প্রত্যেকেই পিতার জীবদ্দশায়ই প্রভূত মর্যাদা ও শক্তি-সামর্থ্যের অধিকারী হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে কুসাই তাদের সঙ্গে আব্দুদদারকে নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তাকে এ সব দায়িত্ব অর্পণ করলেন। ফলে তার ভাইয়েরা তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হননি। অবশ্য তাদের আমল শেষে তাদের সন্তানরা এ ব্যাপারে বিরোধে প্রবৃত্ত হয়। তারা বলেঃ কুসাই এ জন্য আবদুদ্দারকে মনোনীত করেছিলেন যাতে ভাইদের সঙ্গে তাকে যুক্ত করতে পারেন। সুতরাং আমাদের পূর্ব পুরুষ যে সব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তাতে আমাদেরও অধিকার রয়েছে। আর আবদুদ্দার এর সন্তানরা বললো, কুসাই এ কাজটা আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, সুতরাং আমরাই এর সবচেয়ে বড় হকদার। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দেয়। কুরাইশ বংশীয়রা দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একজন আবদুদ্দার এর নিকট আনুগত্যের শপথ নেয় এবং তাদের সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করে। আর অপর দল বনূ আবদমানাফ এর হাতে। এ ব্যাপারে তারা শপথও করে এবং শপথকালে তারা একটা সুগন্ধিপূর্ণ পাত্রে হাত রাখে। সেখান থেকে উঠে গিয়ে তারা কা’বার দেয়ালে হাত মুছে। এ কারণে তারা হিলফুল মুতাইয়্যিবীন তথা সুগন্ধধারীদের শপথ নামে পরিচিত হয়। তাদের মধ্যে ছিল কুরাইশদের অন্যতম গোত্র বনূ আসাদ ইবন আবদুল ওযযা ইবন কুসাই, বনু যুহরা, বনূ তায়ম, বনূ হারিছ ইবন ফিহর, আর বনূ আব্দুদ্দারের সঙ্গে ছিল বনূ মখযুম, বনূ সহম, বনু জুমুহ এবং বনূ ’আদী। এ বিরোধ আর বিবাদ বিসংবাদ থেকে দূরে ছিল বনূ আমির ইবন লুয়াই এবং মুহারির ইবন ফিহর। এরা উক্ত দু’টি দলের কারো সঙ্গে ছিল না। অতঃপর তারা ঐক্যমতে পৌঁছে এবং একটা পরিভাষা গড়ে তোলে যে, রিফাদা তথা হাজীদের মেহমানদারী আর সিকায়া তথা হাজীদের পানি পান করাবার দায়িত্ব থাকবে বনূ আবদ মানাফের হাতে আর হিজাবা তথা রক্ষণাবেক্ষণ, লিওয়া তথা পতাকা বহন এবং নাদওয়া তথা পরামর্শ সভার দায়িত্ব থাকবে বনূ আব্দুদ্দার এর হাতে। এ সিদ্ধান্ত অটল থাকে এবং এ ধারাই অব্যাহত থাকে।

উমাবী আবু উবায়দা সূত্রে বর্ণনা করেনঃ খুযাআর কিছু লোক মনে করে যে, কুসাই যখন হুবাই বিনত হুলাযলকে বিবাহ করে এবং হুলাযলকে বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধান থেকে অপসারণ করা হয়। তখন তার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়, কন্যা হুবাই-এর উপর এবং তার প্রতিনিধি করা হয় আবু গাবশান সলীম ইবন আমর ইব্‌ন লুয়াই ইবন মালকান ইবন কুসাই ইব্‌ন হারিছা ইবন আমর ইবন আমিরকে। তখন কুসাই এক মশক মদ আর একটা উষ্ট্র শাবকের বিনিময়ে তার নিকট থেকে বায়তুল্লাহর কর্তৃত্ব ক্রয় করে নেন। তখন থেকে একটা প্রবাদবাক্য চালু হয়ে আছে,

اخسرين صفقة الى غلبشان

অর্থাৎ আবুগাবশানের ক্রয়-বিক্রয়ের চেয়েও লোকসান জনক। খুযাআ গোত্র এটা দেখে কুসাইর সঙ্গে কঠোর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। এতে তিনি আপন ভাইয়ের সাহায্য কামনা করেন, ভাই তার সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং যা ঘটবার ছিল তা-ই ঘটলো। অতঃপর কুসাই তার উপর ন্যস্ত সিদানা, হিজাবা প্রভৃতি দায়িত্বসমূহ তাঁর পুত্র আব্দুদ্দারের উপর ন্যস্ত করেন। এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে এবং বিষয়টা আরো স্পষ্ট করা হবে। মুযদালিফা থেকে ফেরার অনুমতি দেয়ার কর্তৃত্ব দানের কর্তৃত্ব আসে ফাকীম এর হাতে। এভাবে অনুমতি আসে সুফা’র একটি দলের হাতে। এ সব বিষয়ে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে এবং তার আগে এ সব দায়িত্ব কাদের হাতে ছিল, তা-ও সেখানে বলা হয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেনঃ কুসাই এর চার পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তান ছিল। তারা হলেন আব্দমানাফ, আব্দুদ্দার, আব্দুল ওযযা আব্দ এবং তাখাবযুর ও বাররা। আর এঁদের সকলের মাতা ছিলেন হুবাই বিনত হুলায়ল ইবন হুবশিয়া ইবন সাললি ইবন কাব ইবন আমর আল-খিযায়ী। ইনি ছিলেন বনূ খুযাআর বংশীয় বায়তুল্লাহর সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক। তার হাত থেকে বায়তুল্লাহর দায়িত্ব গ্রহণ করেন কুসাই ইবন কিলাব। ইবন হিশাম বলেনঃ কুসাই পুত্র আব্দ মানাফের চারজন পুত্র সন্তান ছিলেন এদের মধ্যে হাশিম, আবদ, শামস এবং মুত্তালিবের মাতা ছিলেন আতিকা বিন্‌ত মুররা ইবন হিলাল। আর চতুর্থ সন্তান নওফলের মা ছিলেন ওয়াকিদা। আবদে মানাফের আরো কয়েকজন সন্তান ছিলেন, যাদের নাম ছিল আবু আমর, তামাযুর, কালাবা, হায়্যা রীতা উম্মল আখসায় এবং উম্মে সুফিন। ইবন হিশাম বলেনঃ হাশিমের চার পুত্র এবং পাঁচ কন্যা সন্তান ছিলেন। তাঁরা হলেন আব্দুল মুত্তালিব, আসাদ, আবু ছাইফী, নাযলা, শিফা, খালিদা, যয়ীফা, রুকাইয়া এবং হায়্যা আবদুল মুত্তালিব রুকাইয়ার মা সালমা বিনত আমুর ইব্‌ন যাযদ (ইবন লবীদ ইবন খাদাশ ইবন আমির ইবন গানাম ইবন আদী ইবন নাজ্জার) ছিলেন মদীনাবাসী। তিনি অন্যদের মায়ের বিষয়ও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ আব্দুল মুত্তালিবের দশ পুত্র ও ৬ কন্যা ছিলেন আব্বাস, হামযা, আব্দুল্লাহ আবু তালিব (তার আসল নাম ছিল আব্দ মানাফ, ইমরান নয়) যুবায়র, হুরিছ। তিনি ছিলেন পিতার জ্যোষ্ঠ সন্তান। এজন্যেই তার নামেই তার পিতার কুনিয়াত বা উপনাম হয়, জহল, (মতান্তরের হজল) তার ধন-সম্পদের আধিক্যের কারণে তাঁর লকব হয় গীদাক। মুকাওয়েম, যিরার, আবু লাহাব, (তার নাম ছিল আবদুল ইসযা সফিয়্যা, উম্মে হাকীম আল-বায়দা আতিকা, উমায়মা, আরওয়া, বারা। তিনি এদের মাদেরও নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ আবদুল্লাহ আবু তালিব, যুবাইর এবং সফিয়্যা ছাড়া অবশিষ্ট কন্যাদের মাতা ছিলেন ফতিমা বিনত আমর (ইবন আইয ইবন ইমরান ইবন মাখযুম ইবন ইয়াকযা ইবন মুররা ইবন ইমরান ইবন মাখযুম ইবন ইয়াকুযা ইবন মলিক ইবন নযর ইবন কিনানা ইবন খুযাযমা ইবন মুদরিকা ইবন ইলইয়াস ইবন মুযার ইবন নিযার মুয়াদ্দ ইবন আদনান)। আবদুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়ামাল্লাম যিনি হচ্ছেন আদম সন্তানদের সর্দার। তাঁর যা ছিলেন আমিনা বিনতে ওহব ইবন আব্দ মানাফ ইবন যুহরা ইবন কিলাব ইব্‌ন মুররা ইবন কা’ব ইবন লুয়াই। তারপর তিনি তাদের সকলের মায়ের বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেন। তারপর তিনি বলেনঃ বংশ পরম্পরা আর বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়তার বিবেচনায় বনী আদমের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মর্যাদাবান সন্তান। পিতা মাতা উভয় কুলের বিবেচনায় তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর উপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর পক্ষ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত।

ওয়াসিলা ইবন আসকা’ সূত্রে শাদ্দাদ ইবন আবু আম্মার থেকে বর্ণিত। আওযায়ী বর্ণিত এমর্মের হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা ইসমাঈলের সন্তানদের মধ্য থেকে কিনানা থেকে মনোনীত করেছেন কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে মনোনীত করেছেন হাশিমকে আর আমাকে মনোনীত করেছেন বনূ হাশিম থেকে। (মুসলিম) পরে নবী করীম (সা)-এর মুবারক জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা হবে এবং এতদসংক্রান্ত হাদীস আর মনীষীদের উক্তিসমূহ উল্লেখ করা হবে ইনশা আল্লাহ।

৭৬
জাহিলি যুগের কিছু ঘটনার সংক্ষিপ্ত আলোচনা
বনূ ইসমাঈলের নিকট থেকে জুরহুম গোত্রের বায়তুল্লাহর দায়িত্ব গ্রহণ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এতে তারা আগ্রহী ছিল এজন্য যে, তারা ছিল কন্যা পক্ষের সন্তান খুযাআ গোত্র জুরহুমদের উপর হামলা করে তাদের নিকট থেকে বায়তুল্লাহর দায়িত্ব ছিনিয়ে নেয়ার বিষয়ও সেখানে উল্লিখিত হয়েছে। অতঃপর কুসাই এবং তার সন্তানদের নিকট তা’ ফিরে আসার কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে। রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত তাদের হাতে বায়তুল্লাহর সেবায়েতের দায়িত্ব ছিল অব্যাহত ধারায়। নবী করীম (সা) তা বহাল রাখেন।

৭৭
জাহিলী যুগের কতিপয় প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব
খালিদ ইবন সিনান আল-আবাসীঃ

তিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আ) ও মহানবীর মধ্যবর্তী কালের লোক। কারো কারো ধারণা তিনি একজন নবী ছিলেন। আল্লাহই ভালো জানেন।

তাবারানী বলেনঃ আহমদ ইব্‌ন যুহায়র আত-তাতারী আমাদের নিকট সাঈদ ইবন জুবায়র এর বরাতে ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করে বলেনঃ খালিদ ইবন সিনানের কন্যা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তার জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দেন এবং বলেনঃ

بنت نبى ضيعه قوم

—এ হচ্ছে এমন এক নবীর কন্যা, যাকে তার সম্প্রদায় ধ্বংস করেছে। বাজ্জারও ভিন্নসূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, খালিদ ইবন সিনানের উল্লেখ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট করা হলে তিনি বলেন, তিনি ছিলেন এমন এক নবী, যাকে তার সম্প্রদায় ধ্বংস করেছে। অতঃপর তিনি বলেনঃ এ সূত্র ছাড়া হাদীসটি মারফূ’ পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আর এসূত্রের একজন রাবী কায়েস ইবন রবী বিশ্বস্ত হলেও তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল ছিল। তিনি হাদীসে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করতেন, যা আসল হাদীস নয়। আল্লাহই ভালো জানেন।

বাযযার বলেনঃ সাঈদ ইবন যুবাঈর থেকে মুরসালরূপে হাদীসটি বর্ণিত। আর হাফিজ আবু ইয়া’লা আল-মুছিলী ইবন আব্বাসের বরাতে বলেন, আব্বাস গোত্রের খালিদ ইবন সিনান নামক জনৈক ব্যক্তি তার সম্প্রদায়কে বলেনঃ ‘আমি তোমাদের উপর আসন্ন কঙ্করময় উচ্চ ভূমির আগুন নিভিয়ে দেবো।’ তখন তার সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি তাকে বললো, ‘আল্লাহর কসম, হে খালিদ, তুমি তো সত্য ছাড়া আমাদের সঙ্গে কখনো কোন কথা বলনি। তবে তোমার এ বক্তব্যের অর্থ কী?’ তখন খালিদ তাঁর জাতির কিছু লোক নিয়ে বের হলেন। তাদের মধ্যে আম্মারা ইবন যিয়াদও ছিল। তিনি সেখানে আগমন করলে সে আগুন পাহাড়ের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসছে দেখেন। তখন খালিদ তাদের জন্য রেখা টানলেন এবং তাতে তাদেরকে বসালেন এবং বললেনঃ আমি তোমাদের নিকট আসতে হলে তোমরা আমার নাম ধরে ডাকবে না। তখন আগুন এমনভাবে বের হয়ে আসছিল যেন লাল রঙের অশ্বদল একের পর এক ছুটে আসছে। তখন খালিদ অগ্রসর হয়ে আপন লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করছিলেন আর বলছিলেনঃ

بدا بدا بدا كل هدى

—প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে সকল হিদায়াত। ইবনু রাইয়া আল-সাবী মনে করেছে, আমি সেখান থেকে বের হবো না। আমার বস্ত্র তো আমার হাতেই। একথা বলে তিনি সে ফাটলে ঢুকে পড়েন। সেখানে তার বিলম্ব হলে আম্মারা ইবন যিয়াদ তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ আল্লাহর কসম, তোমাদের সঙ্গী বেঁচে থাকলে অবশ্যই তোমাদের নিকট এতক্ষণে ফিরে আসতেন। তারা বললেনঃ তোমরা তাকে তার নাম ধরে ডাকো। রাবী বলেন, তারা বললোঃ তিনি আমাদেরকে নাম ধরে ডাকতে নিষেধ করেছেন। তখন তারা তার নাম ধরে ডাকলো। তখন মাথায় হাত তিনি মাথায় হাত রেখে বের হয়ে এলেন ধরে এবং বললেনঃ আমি কি তোমাদেরকে আমার নামে ডাকতে নিষেধ করিনি? আল্লাহর কসম, তোমরা তো আমাকে হত্যা করে ফেললে। সুতরাং আমাকে দাফন করে ফেল। যখন তোমাদের নিকট দিয়ে কিছু গাধা অতিক্রম করবে তখন তার মধ্যে একটি গাধা থাকবে লেজ কাটা, তখন তোমরা আমাকে কবর থেকে উঠালে জীবিত পাবে। তারা তাকে দাফন করলো। তখন তাদের নিকট দিয়ে কিছু সংখ্যক গাধা অতিক্রম করলো। তার মধ্যে একটি গাধা সত্যিই লেজ কাটা ছিল। তখন আমরা একে অপরকে বললাম ও কবরটা খুঁড়ো। কারণ তিনি আমাদেরকে কবর খোড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আম্মারা তাদেরকে বললেনঃ না, তোমরা তার কবর খুঁড়বে না। আল্লাহর কসম, মুদার গোত্র যেন আমাদেকে বলতে না পারে যে, আমরা আমাদের মৃতদের কবর খুঁড়ে থাকি। খালিদতো তাদের বলেছিলেনঃ তার স্ত্রীর পেটের মাংশে রয়েছে দুটি ফলক। তোমাদের কোন অসুবিধা দেখা দিলে সে দু’টির দিকে তাকাবে। তোমরা যা চাইবে, তার কাছে তাই পাবে। রাবী বলেন, কোন ঋতুবতী স্ত্রী লোক যেন তা স্পর্শ না করে। তারা তার স্ত্রীর নিকট ফিরে এসে তাকে সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে ঋতুবতী অবস্থায় তাদের দিকে তা বের করে আনে। ফলে ফলকের সমস্ত উপদেশাবলী মুছে যায়।

আবু ইউনুস বলেন সাম্মাক ইবন হারব বলেছেন, তিনি সে সম্পর্কে নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ এতো এমন নবী, যাকে তার জাতি ধ্বংস করেছে। আবু ইউনুস সিমাক ইবন হারবের বরাতে বলেন, খালিদ ইবন সিনানের পুত্র নবী (সা)-এর নিকট আগমন করলে তিনি বললেন, ‘মারহাবা হে ভাতিজা!’ এটি ইব্‌ন আব্বাসের উক্তি। তাতে একথা নেই যে, তিনি নবী ছিলেন। আর সে সব মুরসল বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি নবী এ কথা সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। খুব সম্ভব তিনি একজন পুণ্যবান ও কারামত সম্পন্ন লোক ছিলেন। কারণ তিনি যদি অন্তবর্তীকালের লোক হয়ে থাকেন, তবে সহীহ বুখারীতে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে প্রমাণিত আছে যে, তিনি বলেছেনঃ ঈসা ইবন মারইয়ামের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি হচ্ছি আমি। কারণ, তার আর আমার মধ্যখানে কোন নবী নেই। আর তার পূর্বে হলেও তার নবী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, আল্লাহ বলেনঃ

( لِتُنذِرَ قَوۡم ا مَّاۤ أَتَىٰهُم مِّن نَّذِیر مِّن قَبۡلِكَ )

[Surah Al-Qasas 46]

“যাতে তুমি এমন এক জাতিকে সর্তক করতে পার যাদের কাছে তোমার পূর্বে সতর্ককারী আসেনি।” (২৮ কাসাসঃ ৪৬) একাধিক আলিম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইসমাঈল (আ)-এর পর আরবদের মধ্যে কোন নবী প্রেরণ করেননি; কেবল শেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-ব্যতীত। কা’বা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ইবরাহীম (আ) তার জন্য দোয়া করেছিলেন। কাবাকে আল্লাহ বিশ্ববাসীর জন্য শরীয়ত সম্মত কিবলা করেছেন। আর অন্যান্য নবীরা নিজ নিজ জাতিকে মহানবীর আগমনের সুসংবাদ দান করেছেন। সর্বশেষ যিনি এ সুসংবাদ দিয়েছেন, তিনি হলেন ঈসা ইবন মারয়াম (আ)। আরবদের প্রতি প্রেরিত নবী ছিলেন বলে, সুহায়লী প্রমুখ আলিমগণ যা বলেছেন, এতে তা রদ হয়ে যায়। মাদয়ানবাসী সুয়ায়ব ইবন লু সিহযাম ইবন শুয়ায়ব ইবন ছাফওয়ান, অনুরূপ ভাবে তাদের এ বক্তব্য রদ হয়ে যায়। আরবে হানযালা ইবন সাফওয়ান এরও নবীরূপে আগমন ঘটে এবং তাঁকে অস্বীকার করলে আল্লাহ তাদের উপর বুখত নসরকে বিজয়ী করেছিলেন। তিনি তাদের হত্যা আর বন্দি করেন। যেমন ঘটেছিল বনী ইসরাঈলের ক্ষেত্রে। আর এটা ঘটে মা’আদ ইব্‌ন আদমান এর শাসনামলে। স্পষ্টত এরা ছিলেন নেককার লোক, কল্যাণের দিকে তারা ডাকতেন। আল্লাহ ভালো জানেন। জরহুমের পর খুযাআদের বৃত্তান্ত প্রসঙ্গে আমর ইবন লুহাই ইবন কিম’আ ইবন খন্দফ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

হাতিম তাইঃ জাহিলী যুগের অন্যতম প্রধান দাতা

তিনি হাতিম ইবন আবদুল্লাহ (ইবন সা’আদ ইবন হাশরাজ ইবন ইমরাউল কায়েস ইবন ‘আদী ইব্‌ন আহযাম ইবন আবু আহযাম) তাঁর আসল নাম ছারুমা ইবন রবীআ ইবন জারওয়াল ইবন সা’ল ইব্‌ন আমর ইবন গাওছ ইবন তাই আবু সাফফানা আত-তাঈ সাহাবী আদী ইবন হাতিম তাঁরই পুত্র। জাহিলী যুগে তিনি ছিলেন বিপুল প্রশংসিত বড়দাতা। অনুরূপ ভাবে ইসলামী যুগে তাঁর পুত্রও ছিলেন একজন নামকরা দাতা। হাতিমের বদান্যতার অনেক কিংবদন্তী ও চমকপ্রদ কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে সেসব দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পরকালের মুক্তি ও কল্যাণ তাঁর কাম্য ছিল না। সেসবের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল লোকজনের প্রশংসা কুড়ানো। হাফিজ আবু বকর আল-বাযযার তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে ইবন উমর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (স)-এর নিকট হাতিমের প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলে তিনি বলেনঃ তিনি যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছেন।

আদী ইবন হাতিম সূত্রে বর্ণনা করেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললাম আমার পিতা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং নানা সৎ কাজ করতেন। এজন্য তিনি কি পুণ্য লাভ করবেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ তোমার পিতা যা চেয়েছিলেন, তাই পেয়েছেন। আবু ইয়া’লা ও বাগাবী ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

সহীহ (বুখারীতে) উল্লিখিত হয়েছে যে, যে তিন ব্যক্তির জন্য জাহান্নামকে প্রজ্বলিত করা হবে, তাদের মধ্যে একজন হবে সে ব্যক্তি, যে এজন্য দান করে, যেন তাকে দাতা বলা হয়। দুনিয়াতে তাকে দাতা বলাই হবে তার প্রতিদান। অনুরূপভাবে একজন আলিম এবং মুজাহিদের জন্যও জাহান্নামের অগ্নি প্রজ্বলিত করা হবে।

সহীহ বুখারীতে অপর এক হাদীসে আছে যে, সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেন, আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন ইবন আমর ইবন কা’ব ইবন সা’দ ইবন তায়ম ইবন মুররা সম্পর্কে। তাঁরা বললেনঃ তিনি অতিথি আপ্যায়ন করতেন, দাস মুক্ত করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন। এতে কি তার কোন কল্যাণ হবে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ সে তো দীর্ঘ জীবনের মধ্যে একটা দিনও একথা বলেনি- হে আমার পালনকর্তা! কিয়ামতের দিন আমার অপরাধ ক্ষমা করো। অনুরূপভাবে অনেক খ্যাতনামা দাতা আছে, যারা অভাব আর দুর্যোগের সময় মানুষকে আহার করায় (তাদের অবস্থাও এরূপই হবে)। বায়হাকী আলী ইবন আবু তালিবের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবেঃ সুবহানাল্লাহ! কতো মানুষ কতই না পুণ্য কাজ করে। অবাক লাগে সে ব্যক্তির জন্য, যার কাছে তার একজন মুসলিম ভাই অভাবের সময় আসে অথচ, সে নিজেকে কল্যাণ কর্মের জন্য উপযুক্ত মনে করে না। সে সওয়াবের আশা আর শাস্তির ভয় না করলেও সৎকাজে তো তার ছুটে যাওয়া উচিৎ। কারণ তা-তো মুক্তির পথেই চালিত করে। তখন জনৈক ব্যক্তি তার দিকে এগিয়ে এসে বললোঃ হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন, আপনি কি আল্লাহর রাসূলের নিকট এমন কথা শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ তার চেয়েও উত্তম কথা হলো তার কবীলার বন্দী নারীদেরকে যখন উপস্থিত করা হয়, তখন এক দাসী সামনে এলো, রক্তিম ওষ্ঠ, ঘন-কালো লম্বা চুল, দীর্ঘ গর্দান, তীরের মতো তীক্ষ্ণ নাক, অবয়ব মধ্যম, স্তন সুডোল, পায়ের গোছা মাংসল, চিকন কোমর, সরু নিতম্ব ও নিটোল পিঠের অধিকারিণী। বর্ণনাকারী বলেন, তাকে দেখেই আমি বিমুগ্ধ হই এবং বলি, আমি অবশ্যই তাকে পাওয়ার দাবী নিয়ে রাসূলের নিকট গমন করবো এবং রাসূল (সা) তাকে আমার গনীমতের মালের অন্তর্ভুক্ত করবেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি তার সৌন্দর্যের কথা বিস্মৃত হই। বিস্মৃত হই আমি তার কথা শুনে তার বাগ্নিতায়। সে বললো, হে মুহাম্মদ! আপনি কি আমাকে মুক্ত করবেন? আরবের গোত্রদের ঠাট্টা বিদ্রুপ থেকে রক্ষা করবেন? কারণ, আমি তো আমার গোত্রের সর্দার তনয়া। আর আমার পিতা যাকে সাহায্য করা দরকার, তাকে সাহায্য করতেন, যাকে রক্ষা করা দরকার, তাকে রক্ষা করতেন, তিনি বন্দীকে মুক্ত করতেন, ক্ষুধাতুরকে পেট পুরে খাওয়াতেন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করতেন, অতিথিকে আপ্যায়ন করতেন, লোকজনকে আহার করাতেন, সালাতের বিস্তার ঘটাতেন। তিনি কখনো অভাবীকে বিমুখ করেন নি। আমি হাতিম তাই’র কন্যা। তখন নবী (স) বললেনঃ হে বালিকা! এগুলোতো সত্যিকার মুমিনের গুণাবলী। তোমার পিতা মু’মিন হয়ে থাকলে আমরা অবশ্যই তার প্রতি সদয় হবো। তিনি তখনি আদেশ দিলেন, তোমরা তাকে মুক্ত করে দাও। কারণ, তার পিতা উত্তম চরিত্রকে ভালোবাসতেন। আর আল্লাহ তা’আলা উত্তম চরিত্রকে ভালোবাসেন। তখন আবু বুরদা ইবন ইয়ানার দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ উত্তম চরিত্র ভালোবাসেন? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে সত্তার হাতে আমার জীবন নিহিত, তাঁর শপথ করে বলছি, সুন্দর চরিত্র ছাড়া কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”

আদী ইবন হাতিম এর বৈপিত্রেয় ভাই এর বরাতে বলেনঃ হাতিম-এর স্ত্রী নাওয়ারকে বল হয়- হাতিম সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু শুনাও। তিনি বললেন, তাঁর সব ব্যাপারই ছিল অবাক হওয়ার মতো। একবার আমরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হলাম! তাতে সব কিছুই আক্রান্ত হলো, এর ফলে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আকাশ ধূলাবালিতে ছেয়ে গেলো। স্তন্য দাত্রীদের দুধ শুকিয়ে গেল। উটগুলো এমনই দুর্বল কঙ্কালসার হয়ে পড়ে যে, এক ফোটা দুধও দিতে পারছিল না। অর্থ সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দেয় সে দুর্ভিক্ষ। আমরা এক শীতের রাতে এক নির্জন প্রান্তেরে ছিলাম। ক্ষুধার তীব্রতায় শিশুরা চিৎকার জুড়ে দেয়, চিৎকার জুড়ে দেয় আব্দুল্লাহ, আদী এবং সাফানা। খোদার কসম, আমরা কোন কিছু পেলে তা দিয়ে তাদেরই ব্যবস্থা করতাম। তিনি একটি শিশুকে এবং আমি কন্যাটিকে কোলে তুলে নিলাম এবং প্রবোধ দিতে লাগলাম। আল্লাহর কসম, বেশ কিছু রাত অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তারা নীরব হলো না। অতঃপর আমরা অপর পুত্রটির দিকে মনোনিবেশ করি। তাকে প্রবোধ দিলে অতিকষ্টে তাকে চুপ করা গেল। অতঃপর আমরা শাম দেশীয় একটা মখমলের চাদর বিছাই এবং শিশুদেরকে তার উপর শোয়াই। তিনি আর আমি একটা কক্ষে ঘুমাই। সন্তানরাও ছিল আমাদের মধ্যস্থলে, এরপর তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন আমাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য, যাতে আমি ঘুমাতে পারি। আর তিনি যে কি চান, তা-ও আমি বুঝতে পারি। তখন আমি ঘুমের ভান করি। আমাকে বললেন, ‘হলোটা কী? তুমি কি ঘুমিয়েছ গো?’ আমি চুপ করে রইলাম। তখন, তিনি বললেন, ‘সে তো দেখছি ঘুমিয়েই পড়েছে।’ অথচ আমার চোখে ঘুম ছিল না। রাত্রি যখন তাদেরকে আচ্ছন্ন করে নেয়, নক্ষত্র যখন অন্তর্ধান করে চতুর্দিকের শব্দ আর কোলাহল থেমে গিয়ে যখন পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।

তখন তাঁবুটির কোন এককোণ কে একজন যেন উঠিয়ে দিল। তখন তিনি বললেন, ‘এখানে কে?’ তখন সে ফিরে গেলো। রাত ভোর হলে সে ফিরে আসে। আবার তিনি বললেনঃ ‘কে?’ সে বললো- ‘হে আদীর পিতা! আমি তোমার অমুক প্রতিবেশিনী। চিৎকার করে রোদন করা আর ডাকার জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি পাইনি। আমার এমন সন্তানদের নিকট থেকে তোমার কাছে এসেছি, যারা ক্ষুধায় নেকড়ের মতো চীৎকার দিচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘দেরী না করে এক্ষুণই তুমি তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ নাওয়ার বলনেঃ আমি ছুটে এসে বললাম – ‘তুমি একি করেছ? শুয়ে পড়ো। আল্লাহর কসম, তোমার সন্তানরা ক্ষুধায় ছটফট করছে। তাদেরকে প্রবোধ দেয়ার মতো কিছু তুমি পাওনি। কি হবে ঐ মহিলা আর তার সন্তানদের নিয়ে?’ তিনি বললেনঃ ‘তুমি থাম। ইনশা আল্লাহ আমি তোমাকে তৃপ্ত করবো।’ তিনি বলেন, সে মহিলাটি এগিয়ে আসে, দু’জন শিশুকে সে বহন করছিল আর চারজন শিশু হেঁটে চলছিল তার ডানে বাঁয়ে। যেন সে উটপাখী আর তার চারিপার্শ্বে বাচ্চাগুলো। হাতিম আপন ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যান এবং তার বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করে তারপর চকমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বালান। এরপর ছোরা দিয়ে চামড়া ছিলে ফেলে তার স্ত্রী লোকদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি নিয়ে যাও। তিনি এবং তোমার সন্তানদেরকে পাঠাও।’ সে তার শিশু সন্তানদের পাঠায়। এরপর তিনি বলেনঃ ‘শরম! শরম!! তোমরা কি চর্মসার লোকগুলোকে রেখে খাবে।’

এরপর তিনি তাদের মধ্যে ঘুরতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাদের সংকোচ দূর হয় এবং তারা তাঁর কাছে ঘেষে এবং তার কাপড় জড়িয়ে ধরে। এরপর তিনি কাত হয়ে এককোণে শুয়ে পড়েন, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আল্লাহর কসম, তিনি এক টুকরা গোশত বা এক ঢোক পানিও স্পর্শ করলেন না। অথচ তার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। এ অবস্থায় আমাদের ভোর হল। আর আমাদের কাছে ঘোড়াটির হাড্ডি আর খুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

দারা কুতনী বলেনঃ কাযী আবু আবদুল্লাহ আল মাহামিলী আমার নিকট বর্ণনা করে বলেনঃ হাতিমের স্ত্রী হাতিমকে বললেন, ‘হে আবু সাফানা, আমি এবং তুমি একান্তে খাবার খেতে চাই, যেখানে আর কেউই থাকবে না।’ স্বামী স্ত্রীকে সে অনুমতি দিলেন, ফলে তিনি তার তাঁবু লোকালয় থেকে এক ক্রোশ দূরে সরিয়ে নিলেন এবং তাকে খাদ্য প্রস্তুতের নির্দেশ দান করলেন এবং সে মতে খাদ্য প্রস্তুত করা হলো। এসময় স্বামী -স্ত্রী উভয়ের জন্য পর্দা ঝুলানো হল। খাদ্য পাক সম্পন্ন হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে হাতিম মাথা বের করে বললেন,

فلا تطبخى قدرى وسترك دونها - على اذا ما تطبخين حرام

আমার উপর তোমার পর্দার আড়াল রেখে পাকাবে না এমন হলে তুমি যা পাকাবে, তা আমার জন্য হারাম হবে। কিন্তু তা পাকানোর সময় হলে পাক করবে, আগুন জ্বালাবে। বর্ণনাকারী বলেন, এর পর তিনি পর্দা উন্মোচন করেন, খাদ্য সম্মুখে এগিয়ে দেন এবং লোকজনকে ডাকলেন, তিনি এবং অন্যরা মিলে খাবার খেলেন। তখন হাতিম তাই’র স্ত্রী বললেনঃ আমাকে যা বলেছিলে, তা তো পূরণ করলে না! তখন জবাবে তিনি বললেনঃ আমার মন আমার নিকট অধিক সম্মানের পাত্র। প্রসংসা পাওয়ার উর্ধ্বে আমার মন। আর আমার বদান্যতা তো পূর্ব থেকেই খ্যাত। অতঃপর তিনি বললেনঃ

ولا نشتكينى جارتی غیر از ها - اذا غاب عنها بعلها لا أزورها

—আমার প্রতিবেশিনী আমার সম্পর্কে এছাড়া কোন অভিযোগ করেনা যে, যখন তার স্বামী দূরে থাকে আমি তাকে দেখতে যাই না।

سيبلغها خيرى ويرجع بعلها - ولم تقصر عليها ستورها

—আমার দান পৌঁছবে তার নিকট এবং ফিরে আসবে তার স্বামী অথচঃ ভেদ করা হবে তার পর্দা।

হাতিম তাই’র আরো কিছু কবিতার পংক্তিঃ

أأفضح جارتي واخون جاری - فلا والله افعل ما حييت

—আমি যখন রজনী যাপন করি প্রতারিত করি আমার প্রতিবেশীর স্ত্রীকে, যাতে আঁধার ঢেকে নেয় আমাকে, আমি আর গোপন থাকি না।

আমি লজ্জিত করবো আমার প্রতিবেশিনীকে আর বিশ্বাস ঘাতকতা করবো আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে। না, আল্লাহর কসম, যতদিন বেঁচে থাকি, তা করতে পারিনা।

হাতিম তাইর আরো কিছু কবিতার পংক্তিঃ

اغضي اذا ماجار تي برزت - حتى يوارى جارتي الخدد

—চক্ষু মুদে নেই যখন বের হয় আমার প্রতিবেশিনী, এমনকি ঢেকে নেয় আমার প্রতিবেশিনীকে পর্দা।

وما من يمتي شتم ابن عمى - وما انامحلف من يرتجيني

—আমার স্বভাব নয় চাচাতো ভাইকে গালি দেওয়া, যে আমার নিকট কিছু কামনা করে, আমি তাকে নিরাশ করি না।

وكلمة حاسد من غير جرم - سمعت وقلت مری فانقذيني

—বিনা দোষে নিন্দুক আর হিংসুকের কথা, আমি শুনে বলি-চলে যাও আর আমাকে রক্ষা কর।

وعابوها على فلم تعيني - ولم يعرق لها يوما جبيني

—তাদের নিন্দাবাদ আমাকে ক্লান্ত করে না এবং তা আমাকে ঘর্মাক্ত করে না।

وذی و جهين يلقاني طليقا - وليس اذا تغيب ياتسینی

—আর মিলিত হয় আমার সঙ্গে দ্বিমুখী ব্যক্তি (মুনাফিক) হাসি-খুশী, তার অন্তর্ধান আমাকে ব্যথিত করে না।

ظفرت بعيبه فكففت عنه - محافظة على حسبی ودینی

—আমি জয় করে নেই তার দোষ এবং বিরত থাকি তার থেকে, আমার বংশ আর ধর্ম রক্ষা করার কারণে।

তার আরো কিছু কবিতা থেকে—

سلي البائس المفرور یاام مالك - اذا ما اتاني بين نادي ومجزری

—হে উম্মে মালিক, শীতার্ত বিপন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করো, যখন সে আসে আমার কাছে আগুন আর জবাইখানার মাঝে।

কাযী আবুল ফারজল মুআ’ফী আবূ উবায়দার সুত্রে বলেন, কবি মুতালম্মিস এর এ নিম্নোক্ত উক্তি শুনে হাতিম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনঃ

قليل المال قصلحه تيبقى ولا يبقى الكثير على الفساد

—সামান্য সম্পদ তার মালিকের কল্যাণ সাধন করে, আর তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, আর বিপর্যয়ের সঙ্গে বেশী সম্পদও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

وحفظ المال خير من فناه وعسف في البلاد بغير داد

—আর সম্পদ উজাড় করার চেয়ে তা রক্ষা করা উত্তম, আর কোন রকম পুঁজি ছাড়া দেশ ভ্রমণ ভ্রষ্টতা স্বরূপ।

এ কবিতা শুনে তিনি বলেন- তার হয়েছে কী? আল্লাহ তার জিহ্বা কর্তন করুন, তিনি মানুষকে কৃপণতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি কেন বলেননি -

فلا الجود يفني المال قبل فناءه- ولا البخل في مال الشحيح يزيد

—বদান্যতা সম্পদ বিনাশ করে না ধ্বংসের পূর্বে, আর কৃপণতা বৃদ্ধি সাধন করে না কৃপণের সম্পদে।

فلا تلتمس مالا بعلبش لقتر لكل غد رزق يعود جديد

—অনটনে জীবন যাপনের জন্য সম্পদ কামনা করবে না, সকল নতুন দিনের জন্য নতুন জীবিকা আছে, যা আসবেই।

الم تران المال غاد وائح - وان الذي يعطيك غير بعيد

—তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, সম্পদ সকালে আসে আর বিকালে চলে যায়, আর তোমাকে যিনি দান করেন তিনি তো মোটেই দূরে নন।

কাযী আবুল ফারজল বলেন, হাতিম তাঈ কী চমৎকার কথাই না বলেছেন, তোমাকে যিনি দিয়ে থাকেন তিনি মোটেই দূরে নন। তিনি যদি ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলে পরকালে তার মুক্তির আশা করা যেতো। আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবে বলেছেনঃ

و اسئلوا الله من فضله

—তোমরা আল্লাহর নিকট তাঁর অনুগ্রহ ভিক্ষা কর। (৪ নিসাঃ ৩২) আল্লাহ আরো বলেনঃ

( وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِی عَنِّی فَإِنِّی قَرِیبٌۖ أُجِیبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِ )

[Surah Al-Baqarah 186]

—আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করলে (তুমি বলবে) আমি তো নিকটেই আছি। আহ্বানকারী যখন আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দেই। ( ২ বাকারাঃ ১৮৬)।

ওয়াযাহ ইবন মা’বাদ আত-তাঈ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ হাতিম তাঈ একদা নুমান ইবন মুনযির এর অতিথি হলে তিনি অতিথিকে সসম্মানে বরণ করে নেন, নিকটে বসান এবং ফিরে যাওয়ার সময় তাঁকে দুই উট বোঝাই স্বর্ণ-রৌপ্য দান করেন। এ ছাড়াও তিনি অনেক দেশীয় উপহার সামগ্রী দান করেন। সে সব সামগ্রী নিয়ে তিনি প্রস্থান করেন। তিনি স্বজনদের নিকটবর্তী হলে তার কবীলার বেদুইনদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। তারা বললোঃ হে হাতিম! তুমি তো এসেছ বাদশাহের নিকট থেকে আর আমরা এসেছি স্বজনদের নিকট থেকে দারিদ্র্য নিয়ে। তখন হাতিম বললেনঃ এসো, আমার সম্মুখে যা কিছু আছে তা নিয়ে যাও। তারা তার সম্মুখ থেকে ছোবল মেরে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই ভাগ-বণ্টন করে নেয়। এমনকি তার সম্মুখ থেকে নুমানের প্রদত্ত সমস্ত বিশেষ উপটৌকনও তারা বণ্টন করে ফেলে। এসময় হাতিমের দিকে এগিয়ে আসে তার দাসী তরীফা এবং বলে, ‘আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজের জন্যও কিছু অবশিষ্ট রাখ। এরা তো দেখছি দীনার-দিরহাম আর উট-ছাগল-ভেড়া কিছুই বাদ দেবে না।’ তখন তিনি বলেনঃ

قالت طريفة ماتبقى دراهتنا - وما بناسرف فيها ولا خزق

—তরীফা বললো, থাকবেনা আমাদের একটা দিরহামও আমাদের তো অপচয় করার বা দান করার কিছুটা রইলো না।

ان يفن ما عندنا فالله يرزقنا - ممن سوانا ولسنا نحن نرتزق

—আমাদের নিকট যা আছে তা ফুরিয়ে গেলেও আল্লাহ দেবেন আমাদেরকে জীবিকা, এমন লোকদের নিকট থেকে, যারা আমাদের অন্তর্গত নয়। আমরা তো নিজেরা নিজেদের জীবিকা দাতা নই।

مايالف الدرهم اسکاری خرقتنا- ألا يمر عليها ثم ينطلق

—জোড়া লাগাতে পারেনা আমাদের ক্ষয়িষ্ণু দিরহাম আমাদের ছিন্ন বস্ত্রকে তবে কিনা তার উপর দিয়ে বয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত চলে যায়।

إنا اذا اجتمعت يوما دراهمنا - ظلت الى سبل المعروف تستبق

—কোন দিন যদি একত্র হয় আমাদের দিরহাম তাহলে আমরা এমন যে, আমাদের দিরহাম প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে যায় কল্যাণকর কাজে।

আবু বকর ইব্‌ন আইয়াশ বলেনঃ একদা হাতিম তাঈকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আরবে কি আপনার চাইতে অধিকতর বদান্যশীল কেউ আছেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি আরবই আমার চেয়ে বড় দাতা।’ অতঃপর তিনি বলতে শুরু করেন, এক রাত্রে আমি আরবের এক এতীম বালকের অতিথি হলাম। এতীম বালকটির ছিল একশ ছাগল। সেখান থেকে সে আমার জন্য একটা বকরী জবাই করলো। এবং তা পাক করে আমার নিকট উপস্থিত করলো। বালকটি আমার নিকট বকরীর মগজ উপস্থিত করলে আমি তাকে বললাম-কতই না মজাদার এ মগজ। তিনি বলেন, এ ভাবে সে (এক এক করে বার বার) মগজ আনতে থাকে। অবশেষে যখন ভোর হলো সে একশ টা বকরীই জবাই করে ফেলেছে। তার কাছে আর একটিও নেই। হাতিমকে তখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তখন আপনি কী করলেন?’ তিনি বললেনঃ ‘সব কিছু করেও কী করে আমি তার পূর্ণ শুকরিয়া আদায় করতে পারতাম?’ তিনি বললেন, ‘যাই হোক আমার উৎকৃষ্ট উষ্ট্রগুলোর মধ্য থেকে তাকে আমি একশ’ উষ্ট্রী দান করলাম।

মুহাম্মদ ইবন জাফর আল-খারাইতী তাঁর ‘মাকারিমুল আখলাক’ গ্রন্থে তাঈ গোত্রের জনৈক বৃদ্ধার বরাতে বলেন, হাতিম তাই এর মাতা আনতারা বিনতি আফীফ ইবন আমর ইবন ইমরাউল কায়েস বদান্যতা-দানশীলতার কোন কিছুই বাদ দিতেন না। তার ভাইয়েরা তাঁকে বারণ করতো, তিনি তাদের বাধা মানতেন না। আর তিনি ছিলেন ধনাঢ্য মহিলা। ফলে তার লোকজন তাকে একটা ঘরে এক বছর বন্দী করে রাখে এবং সেখানে তাকে প্রাণে বাঁচার। পরিমাণ মতো খাদ্য সরবরাহ করে, যাতে তিনি তার বদান্যতা থেকে বিরত থাকেন। এক বছর পর তারা তাঁকে সেখান থেকে বের করে আনে। তাদের ধারণা ছিল হয়তো তিনি আগের অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তার লোকজন তার সম্পদ থেকে একখণ্ড রৌপ্য মহিলার নিকট সমর্পণ করে এবং বলে এগুলো ভোগ-ব্যবহার করবে। একদা হাওয়াযিন গোত্রের এক মহিলা তার নিকট আগমণ করে। তিনি তখন তার সম্পদ লুকিয়ে রাখেন। আগন্তুক মহিলাটি তার নিকট যাচ্ঞা করে। তখন তিনি বলেন, সম্পদের এই রৌপ্য খণ্ডটি তুমি নিয়ে যাও। আল্লাহর কসম, আমার এমন ক্ষুধার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোন প্রার্থীকে বিমুখ করব না বলে আমি শপথ করেছি। তখন তিনি আবৃত্তি করতে শুরু করেনঃ

لعمري لقد ما عضنی الجوع عضة - فاليت أن لا أمنع الدهر جائعا

—আমার জীবনের শপথ; ক্ষুধা আমাকে এমনই আঘাত করেছে যে, আমি শপথ করেছি জীবনে কোন ক্ষুধাতুরকে বিমুখ করবো না।

فقولا لهذا اللعين اليوم اعفني - وان انت لم تفعل فعض الاصابعا

—তাই আজ তোমরা এই ভৎসনাকারীকে বলো আমাকে মাফ কর; আর তা না করলে আঙ্গুল কামড়াও।

فماذا عساكم ان تقولوا لاختكم سوی عذلكم او عذل من كان مانعا

—তবে কি তোমরা বা তোমাদের মত নিবৃত্তকারীরা তোমাদের বোনকে ভৎসনা ছাড়া অন্য কিছু বলবে বলে কি আশা করা যায়,

وماذا ترون اليوم الاطبيعة - فكيف بترکی يا ابن امي الطبائعا

—আজ তোমরা যা দেখছ, তাতো আমার স্বভাব। তবে হে মোর মায়ের সন্তান! কিরূপে আমি আমার স্বভাব বিসর্জন দিতে পারি?

হায়ছাম ইবন আদী আদীর বরাতে বলেনঃ আমি হাতিমের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি নিজেকে ভৎসনা করছিলেন। আমাকে বললেন, ‘বৎস! আমি মনে মনে তিনটি অভ্যাসের প্রতিজ্ঞা করছি। আল্লাহর কসম, আমি প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে কোন সন্দেহজনক আচরণ করিনি কখনো। আমার নিকট যে আমানত রাখা হয়েছে, তা অবশ্যই ফেরৎ দান করেছি এবং আমি কোন দিন কারো মনে কষ্ট দেইনি।’ আবু বকর আল-খারাইতী বলেনঃ আলী ইবন হারব আবু হুরাইরার আযাদকৃত গেলাম মুহাররার থেকে বর্ণনা করেন আবদুল কায়েস গোত্রের একদল লোক হাতিম তাঈ’র কবরের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অবতরণ করে। ঐ দলের আবুল খায়বারী নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার কবরে পায়ের খোঁচা দিয়ে বলেনঃ ‘হে আবু জা’দ! আমাদের মেহমানদারী করুন।’ তখন জনৈক সঙ্গী তাকে বলে, ‘তুমি কি হাড্ডির সঙ্গে কথা বলছ, তাতো পঁচে-গলে গেছে।’ তারপর রাত হলে তারা সকলে ঘুমিয়ে পড়লো। উক্ত আবুল খায়বারী ব্যাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন – ‘হে আমার সম্প্রদায়! নিজ নিজ সওয়ারী গ্রহণ কর। কারণ, হাতিম স্বপ্নে আমার নিকট আগমন করে আমাকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন। আমি তা মুখস্থ করেছি। তিনি বলেনঃ

ابا الخيبري وانت امرؤ ظوم العشيرة شتامها

—হে আবুল খায়বারী! তুমি তো এমন এক ব্যক্তি যে স্বজনের প্রতি অবিচার করে ও তাদেরকে গালমন্দ করে।

اتيت بصحبك تبغي القرى الذى حفرة قد صدت هامها

—তুমি আগমন করেছ সঙ্গী সাথী নিয়ে কামনা কর তুমি আতিথেতায় কবরবাসীর নিকট, যার মাথার খুলিতে মারিচা ধরে গেছে।

اتبغي لي الذنب عند المبيت وحولك طى والعامها

—তুমি কি কামনা কর আমার জন্য পাপ রাত্রি যাপনকারীর নিদ্রা কালে। অথচ তোমার নিকট রয়েছে তাঈ গোত্র আর তার পশুকুল।

وانا لنشبع أضيافنا وتاتي المطي فنعتامها

—আমরা অবশ্যই তৃপ্ত করবো আমাদের অতিথিদেরকে রজনীতে আগমন ঘটবে আমাদের উষ্ট্রীর এবং তা দোহন করবো।

বর্ণনাকারী বলেন, তখন হঠাৎ করে উক্তিকারীর উস্ত্রী আহত হয়ে আগমন করলে তারা তাকে যবাই করে এবং তৃপ্ত হয়ে যায়। তারা বলে, আল্লাহর কসম, হাতিম জীবিত আর মৃত অবস্থায় আমাদের মেহমানদারী করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, ভোরে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের সঙ্গী-সাথী নিয়ে সওয়ার হয়ে গমন করে। তখন জনৈক ব্যক্তি সওয়ার হয়ে আসছিল এবং তাদেরকে উঁচু স্বরে আহ্বান করছিল আর তার সাথে ছিল আরেকটি উট। তখন লোকটি বলে, ‘তোমাদের মধ্যে কে আবুল খায়বারী?’ তিনি বললেন, ‘আমি।’ লোকটি বললো, ‘হাতিম রজনীতে স্বপ্নে আমার কাছে এসে বলেন যে, তিনি তোমার সঙ্গীদের তোমার উট দিয়ে মেহমানদারী করেছেন এবং তোমার নিকট এ উট নিয়ে আসার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই হলো সে উট। তা নাও এবং এই বলে তাকে উটটি দিয়ে দিল।’

আবদুল্লা ইবন জাদ’আন -এর কিছু বৃত্তান্তঃ

তিনি আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন ইবন আমর ইবন কা’ব ইব্‌ন সাআদ ইবন তাইম ইবন মুররাহ, যিনি ছিলেন বনূ তাইমের নেতা এবং তিনি ছিলেন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর চাচাতো ভাই। তিনি ছিলেন জাহিলী যুগের অন্যতম দাতা ও দয়ালু। জাহিলী যুগে যারা বয়স্কদেরকে খাদ্য দান করতো, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তাঁর নিজের হাতে ছিল তাঁর ব্যাপার। তিনি আহার্য দান করতেন তীব্র দারিদ্র্যক্লিষ্ট ফকীর ব্যক্তিকে। তিনি এমনই দুষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলেন যে, অনেক অপরাধ সংগঠন করেন। এর ফলে জাতি, বংশ-গোত্র পাড়া প্রতিবেশী সকলেই তাকে ঘৃণা আর নিন্দার চোখে দেখতো। সকলের ঘৃণা-নিন্দা আর বর্জনের মুখে একদিন তিনি বিচলিত হয়ে মক্কার গিরিপথে বেরিয়ে পড়েন। পর্বতের মধ্যে একটা গর্ত দেখে তিনি মনে করলেন, এতে ক্ষতিকর কিছু থাকতে পারে। তিনি সেখানে গেলেন এই আশায় যে, হয়তো সেখানে মারা গিয়ে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি গর্তের নিকট গমন করলে একটা আযদাহা তার দিকে ছুটে আসে। আযদাহাটি তাকে দংশন করতে উদ্যত হয়। তিনি তা থেকে দূরে সরে গিয়ে বরং তার উপর হামলা করতে উদ্যত হন। কিন্তু তিনি আযদাহাটির নিকট এসে দেখতে পেলেন যে, তা-তো স্বর্ণের আর তার চক্ষু মুক্তার। তিনি তা ভেঙ্গে চুরে গর্তে নিয়ে যান। গর্তে প্রবেশ করে দেখেন যে, সেখানে রয়েছে জুরহাম গোত্রের শাসকদের কবর। তাদের মধ্যে হারিস ইবন মুযাযও রয়েছেন, যিনি দীর্ঘ দিন অন্তর্ধানে ছিলেন। ফলে তিনি কোথায় কি অবস্থায় আছেন, কিছুই জানা যায় না। তিনি তাদের মাথার দিকে একটা ফলক দেখতে পান, যাতে তাদের মৃত্যুর তারিখ লেখা রয়েছে। সে ফলকে তাদের রাজত্বকালও লেখা আছে। লাশ গুলোর নিকট রয়েছে মণি-মুক্তা সোনা-রুপা অনেক কিছু। তিনি সেখান থেকে নিজের প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করে বেরিয়ে পড়েন। গর্তের দরজা সম্পর্কেও তিনি জ্ঞান লাভ করলেন। জাতির লোকজনের নিকট ফিরে এসে তিনি তাদেরকে সে সব থেকে দান করেন। ফলে তারা তাঁকে ভালোবাসে নেতা বানায় আর তিনিও জাতির লোকজনকে আহার করান। হাতের সম্পদ ফুরিয়ে গেলে তিনি আবার সে গর্তে গমন করে প্রয়োজন পরিমাণ নিয়ে আসতেন। যাদের নিকট থেকে আমরা এ কাহিনী উল্লেখ করছি, তাদের মধ্যে আছেন আবদুল মালিক ইবন হিশাম। তিনি ‘কিতাবুত তীজান’-এ এ কাহিনী উল্লেখ করেছেন। তার রচিত কিতাবের নাম হচ্ছে,

دی العاطش وانس الواحش

তার একটা বড় পেয়ালা ছিল। আরোহী ব্যক্তি সওয়ারীর পৃষ্ঠে বসে এ পেয়ালায় আহার করতো। পেয়ালাটা এমনই বড় ছিল যে, তাতে একজন ছোটখাট মানুষ পতিত হলে ডুবে যেতো।

ইবন কুতাইবা প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন-এর ডেগছির ছায়ায় আমি আশ্রয় নিতাম। তা ছিল এক লিখিত দলীল- অর্থাৎ দুপুরের সময়। আবু জহল এর হত্যার হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে বলেনঃ নিহত ব্যক্তিদের লাশের মধ্যে তোমরা তাকে খুঁজবে। হাঁটুতে আঘাতের চিহ্ন দ্বারা তোমরা তাকে চিনতে পারবে। কারণ, সে এবং আমি আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন এর দস্তরখানে মল্ল যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে সে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে আঘাত পায় এবং তা ভেঙ্গে যায়। তার হাঁটুতে এখনো সে চিহ্ন বর্তমান রয়েছে। রাসূল (সা) যেমন বলেছেন, তাকে তেমনই পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন জাদআন খেজুর আর ছাতু খেতেন এবং দুধ পান করতেন। তিনি উমাইয়া ইবন আবুছ ছালত এর এ উক্তি শ্রবণ করেন -

ولقد رئت الفاعلين وفعلهم - فرأيت اكرمهم بني الديان

—কথা আর তাদের কর্ম আমি দেখেছি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত পেয়েছি আমি বনু দাইয়্যানকে

البر بلبك بالشهاد طعام هم - لا مابعلت لنا بنوجدعان

“নেকী তোমায় জ্ঞানী করে তাদের খাদ্যে উপস্থিতি দ্বারা, তদ্বারা নয়, বনূ জাদ’আন যে লা’নত করে।” অতঃপর জাদ’আন পুত্র শাম দেশে দু’ হাজার উষ্ট্র বোঝাই গম, মধু এবং ঘী প্রেরণ করে। প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী কা’বার পৃষ্ঠ থেকে ঘোষণা দেয়, ইবন জাদ’আন-এর ডেকের দিকে তোমরা ছুটে এসো। এ প্রসঙ্গে উমাইয়্যা বলেনঃ

له داع بمكة مشمعل - وآخر فوق لعبتها نیادی

—তার জন্য মক্কায় আছেন একজন আহ্বানকারী মশালবাহী, অপরজন আছেন কা’বার ছাদে, যিনি আহ্বান করেন।

الى ردح من الشيزی ملا -- لباب البر يلبك بالشهاد

—আহ্বান জানায় দীর্ঘ সময় থেকে কালো কাষ্ঠ নির্মিত পূর্ণ পাত্র পানে, জ্ঞানের দ্বার পানে, যা সাক্ষ্য দ্বারা তোমাকে জ্ঞানী করে।

এতসব কিছু সত্ত্বেও সহীহ মুসলিমে উল্লেখিত আছে যে, “আয়েশা সিদ্দীকা (রা) বলেছেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, জাদ’আন পুত্র আহার করাতেন এবং অতিথির মেহমানদারী করতেন। এতে কি তার কোন উপকার হবে? কিয়ামতের দিন এসব কি তার কোন কাজে আসবে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, না সে তো কোন দিন একথা বলেনি-হে পালনকর্তা, কিয়ামতের দিন আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবে।

৭৮
সাবা মু‘আল্লাকার অন্যতম রচয়িতা ইমরুল কায়স ইবন হুজর আল-কিনদী
জাহেলিয়াত আমলের কবিদের কাব্য সংকলন সাব’য়ে মু’আল্লাকার ইমরুল কায়সের অংশটুকু সর্বাধিক উন্নত ও প্রসিদ্ধ— যার প্রথম পংক্তি হলো -

قفا نبك من ذكرى حبيب ومنزل .

–দাঁড়াও, প্রিয়তমা ও তার বাসগৃহের বিরহে একটু কেঁদে নিই।

ইমাম আহমদ (র) হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “ইমরুল কায়স জাহান্নামগামী কবিদের পতাকাবাহী"। বিভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হলেও এটির সনদ বিশুদ্ধ।

হাফিজ ইবনে আসাকির বলেছেন, ইমরুল কায়সের বংশ লতিকা হলো, ইমরুল কায়স ইব্‌ন হাজার ইবন হারিছ ইবন আমর ইব্‌ন হুজর ইবনে আমর ইবন মুআবিয়া ইবন হারিছ ইবনে ইয়া’রাব ইব্‌ন ছাওর ইবন মুরতা’ ইবনে মুআবিয়া ইবন কিন্দা। উপনাম আবূ ইয়াযীদ, মতান্তরে আবু ওহাব ও আবুল হারিছ আল কিন্দী। তিনি দামেশক এলাকায় বাস করতেন। তিনি তাঁর কবিতায় ঐ এলাকার বিভিন্ন স্থানের উল্লেখ করেছেন। তার দুটি পংক্তি নিম্নরূপঃ

قفا نبك من ذكرى حبيب ومنزل - بسقط اللوى بين الدخول فحومل

فتوضح فاالمقراة لم بعف رسمها - لما نسجتها من جنوب وشمأل

–“তোমরা দাঁড়াও, এসো, আমরা প্রিয়তমা

ও তার বাসস্থানের বিরহে একটু কেঁদে নিই,

যে বাসস্থান বালির টিলার চূড়ায় দাখূল ও হাওমাল,

তুযিহ ও মাকরাত নামক স্থানের মাঝে অবস্থিত,

উত্তর ও দক্ষিণের বায়ু প্রবাহ সত্ত্বেও যার চিহ্ন মুছে যায়নি।”

এইগুলি হূরান অঞ্চলের প্রসিদ্ধ স্থান।

হাফিজ ইবনে আসাকির অন্য এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে আফীফ ইবন মা‘দীকরব বলেছেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)- এর নিকট বসা ছিলাম। সে সময়ে ইয়ামানের একটি প্রতিনিধি দল এসে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইমরুল কায়সের কবিতার দুটি পংক্তির উসিলায় আল্লাহ্ আমাদের জীবন রক্ষা করেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তা কীভাবে?’ তারা বলল, ‘আমরা আপনার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আসছিলাম। কিছুদূর এসে আমরা পথ হারিয়ে ফেলি, ফলে সেস্থানে আমাদের তিনদিন অবস্থান করতে হয়। অথচ, আশেপাশে কোথাও পানি পাওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা গাছের ছায়ায় শুয়ে মৃত্যুবরণের উদ্দেশ্যে আমরা এক একজন এক একটি খেজুর গাছ ও বাবলা গাছের নীচে চলে গেলাম। আমাদের প্রাণ যায় যায় দশা। হঠাৎ দেখতে পেলাম, একজন উষ্ট্রারোহী এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে আমাদের একজন কবিতা আবৃত্তি করলঃ

والمرأت أن الشريعة همها - و أن البياض من فرائضها دامی .

تيممت العين التى عند ضلر ج -بفي عليها الظل عرمضها طامی

অর্থাৎ প্রিয়া যখন বুঝতে পারল যে, ঘাট-ই তার লক্ষ্যস্থল, আরো বুঝল যে, তার পার্শ্বদেশ আর কাঁধের মধ্যস্থলের গোশত হতে শুভ্রতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তখন সে জারিজের নিকটস্থ সেই কূপে যেতে মনস্থ করল, যে কূপ ছায়া ও কাঁটাদার বৃক্ষে পরিপূর্ণ।

পংক্তি দুটো শুনে আরোহী বলল, ‘এগুলো কার কবিতা? সে তো আমাদের দুর্দশা দেখে ফেলেছে।’ আমরা বললাম, ‘এগুলো ইমরুল কায়সের কবিতা!’ আরোহী বলল, ‘আল্লাহর শপথ, সে একটুও মিথ্যা বলেনি। তোমাদের পার্শ্ববর্তী এই জায়গাটিই জারিজ।’ সত্যি সত্যি আমরা তাকিয়ে দেখলাম যে, আমাদের ও কূপটির মাঝে দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ হাতের। ফলে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে গেলাম। দেখলাম, তা ইমরুল কায়সের বিবরণ অনুযায়ী হুবহু ছায়া ও কাঁটাদার বৃক্ষবেষ্টিত একটি কূয়া। এ কাহিনী শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,

ذاك رجل مذكور في الدنيا منسي في الاخرة شريف في الدنيا

خامل في الأخرة بيده لواء الشعراء يقودهم إلى النار .

—লোকটি দুনিয়াতে বহুল আলোচিত, পরকালে কেউ তার কথা জিজ্ঞাসাও করবে না, দুনিয়াতে সে সম্ভ্রান্ত, পরকালে লাঞ্ছিত; তার হাতে কবিদের পতাকা থাকবে, তাদেরকে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে।"

কালবী লিখেছেন, ইমরুল কায়স একবার পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পতাকা উড়িয়ে বনু আসাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রওয়ানা হয়। তাবালা নামক স্থানে ছিল যুল-খুলসা নামক একটি মূর্তি। আরবরা তার নিকট লটারী টানত। ইমরুল কায়স সেস্থানে পৌঁছে লটারী টানল। কিন্তু লটারীতে নেতিবাচক তীর উঠে আসে। ফলে সে আরও দু’বার লটারী টানে। তাতেও ঐ একই ফল হয়। ইমরুল কায়স ক্ষিপ্ত হয়ে তীরগুলি ভেঙ্গে যুল- খুলসার মুখের উপর ছুঁড়ে মারে এবং বলে যে, তোর বাবা যদি খুন হতো, তবে তুই আমার কাজে বাধ সাধতি না। এই বলে সে বনু আসাদ গোত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের অনেককে হত্যা করে।

ইবনুল কালবী বলেন, এরপর ইসলামের অভ্যুদয় পর্যন্ত ইমরুল কায়স কখনো যুল খুলসার নিকট লটারী টানেনি।

কথিত আছে যে, ইমরুল কায়স কোনো এক যুদ্ধে রোমের বাদশা কায়সারের বিজয়ে তার ভূয়সী প্রশংসামূলক কবিতা রচনা করে। কিন্তু, কাক্ষিত পুরস্কার না পেয়ে পরে সে উল্টো তার নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করে। কথিত আছে, রোম সম্রাট বিষ খাইয়ে তাকে হত্যা করে। আসীব নামক একটি পাহাড়ের সন্নিকটে জনৈক মহিলার কবরের পার্শ্বে তাকে সমাধিস্ত করা হয়। পরে সেখানে নিম্নের পংক্তি দু’টি লিখে রাখা হয়েছে—

اجارتنا أن المزار قریب - واني مقيم ما اقام عسيب .

أجارتنا انا غريبان ههنا - و كل غربب للغربب نسيب .

—হে আমার প্রতিবেশিনী! নিঃসন্দেহে আমাদের সাক্ষাতস্থল নিকটেই। আসীব পর্বত যতদিন টিকে থাকবে, আমিও এখানে ততদিন অবস্থান করব। হে প্রতিবেশিনী! তুমি-আমি দু’জন-ই এখানে মুসাফির। আর এক মুসাফির অপর মুসাফির-এর আত্মীয়েরই মত।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, সাতটি মুআল্লাকাই কাবা শরীফে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তার কারণ, আরবদের নিয়ম ছিল যে, তাদের কেউ কোন কবিতা রচনা করলে সে তা কুরায়শদের নিকট পেশ করত। কুরায়শদের অনুমোদন পেলে সম্মানার্থে তা কা’বার গায়ে ঝুলিয়ে রাখা হত। এভাবে একত্রিত হতে হতে এই সাতটি মুআল্লাকা একত্রিত হয়ে যায়। তার প্রথমটি হল ইমরুল কায়স ইবন হজর-এর রচিত, যার প্রথম পংক্তিটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় মুআল্লাকা নাবিগা যুবিয়ানীর রচিত, যার নাম ছিল যিয়াদ ইবন মু’আবিয়া, মতান্তরে যিয়াদ ইবন আমর ইবন মু’আবিয়া ইব্‌ন যাবাব ইবন জাবির ইবন ইয়ারবু ‘ইবন গায়য ইবন মুররা ইবন আউফ ইবন সা’দ ইবন যুবইয়ান ইবন বাগীয। তার প্রথম পংক্তি হলোঃ

يادارمية بالعلياء فالسند - اقوت وطال عليها سالف الأيد .

– উলইয়া ও সানাদে অবস্থিত হে আমার প্রিয়ার গৃহ! সে অতীত হয়ে গেছে আর তার বিরহ অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল!

তৃতীয় মুআল্লাকার রচয়িতা যুহায়র ইবনে আবু সুলামী রবীয়া ইবনে বিয়াহ আল-মুযানী। যার প্রথম পংক্তিঃ

امن ام او في دمنة لم تكلم - بحومانة الدراج فالمتثلم .

– দাররাজ ও মুতাছাল্লামের কঠিন ভূখণ্ডে অবস্থিত এই নীরব ধ্বংস স্থূপ-ই কি আমার প্রিয়তমা উম্মে আওফার স্মৃতি?

চতুর্থ মুআল্লাকার রচয়িতা হলো, তারফা ইবনুল আবদ ইব্‌ন সুফিয়ান ইবন সা’দ ইবন মালিক ইবন যুবাই’আ ইবন কায়স ইবন ছা’লাবা ইবন উকাবা ইবন সা’ব ইবন আলী ইবন বকর ইবন ওয়ায়েল। যার প্রথম পংক্তিঃ

لخولة أطلال ببرقة ثهمد - تلوح كباقي الوشم في ظاهر اليد .

—ছাহমাদের পাথুরে অঞ্চলে আমার প্রিয়া খাওলার বাসগৃহের স্মৃতি মহিলাদের হাতের অবশিষ্ট উলকি রেখার ন্যায় ঝলমল করছে বলে মনে হয়।

পঞ্চম মুআল্লাকার রচয়িতা আনতারা ইবন শাদ্দাদ ইবন মু’আবিয়া ইবন কুরাদ ইবন মাখযুম ইবন রবীয়া ইবন মালিক ইবন গালিব ইবন কুতায়া’আ ইবন আবাস আল-আবাসী। তাঁর প্রথম পংক্তি হলোঃ

هل غادر الشعراء من متروم - أم هل عرفت الدار بعد توهم .

—আগেকার কবিরা এমন কোন অপূর্ণতা রেখে যাননি, যা পূরণ করা বাকী রয়েছে। তোমাতে অনেক আন্দাজ অনুমানের পর তুমি তো প্রিয়ার গৃহের সন্ধান পেয়েছ।

ষষ্ঠ মুআল্লাকার রচয়িতা বনী তামীমের আলকামা ইবন আবদা ইবন নুমান ইবন কায়স। তাঁর প্রথম পংক্তি হলো,

طحابك قلب في الحسان طروب - بعيد الشباب عصرحان مشيب .

—তোমাকে নিয়ে আমার সৌন্দর্য পিয়াসী প্রাণ উচ্ছসিত হলো যখন যৌবন বিগত প্রায় এবং বার্ধক্য এসে হানা দিলো।

সপ্তম মুআল্লাকার রচয়িতা লাবীদ ইবন মালিক ইবন জাফর ইবন কিলাব ইবন রবীয়া ইবন ‘আমির ইবন সাসাআ ইবন মুয়াবিয়া ইবন বকর ইবন হাওয়াযিন ইবন মনসূর ইবন ইকরিমা ইবন খাসফা ইবন কায়স ইবন ‘আয়লান ইবন মুযার। এই সপ্তম মু‘আল্লাকাকে আসাময়ী প্রমুখ পণ্ডিত সাত মুআল্লাকার অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করেন না। তার প্রথম পংক্তি হলোঃ

عفت الديار محلها فمقامها-بمني تأبد غولها فرجامها .

—মিনার যে গৃহে আমার প্রিয় কখনো অল্প সময় কখনো দীর্ঘ সময় অবস্থান করতো, তার চলে যাওয়ার ফলে সব বিরান হয়ে গেছে। মিনার গাওল ও রিজাম নামক স্থানও এখন সম্পূর্ণ জনবসতি শূন্য।

আবু উবায়দা আসমায়ী ও মুবারবাদ প্রমুখ পণ্ডিতগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আরেকটি কসীদা এমনও রয়েছে, যার রচয়িতা কে তা অজ্ঞাত। তার প্রথম পংক্তিটি হলোঃ

هل بالطلول السائل را- هل لها بتكلم عهد

—টিলাগুলোত প্রশ্নকারী কোন প্রত্যুত্তর প্রায়? নাকি কথা না বলার ব্যাপারে প্রিয়ার কোন শপথ রয়েছে? এটি একটি সুদীর্ঘ অনবদ্য কবিতা। এই পংক্তিমালায় অনেক অনেক সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে।

৭৯
উমাইয়া ইবন আবুস সালত ছাকাফী
হাফিজ ইবন আসাকির বলেন, উমাইয়া ইবন আবুস্ সালত-এর বংশ লতিকা নিম্নরূপঃ উমাইয়া ইবন আবুস সালত আব্দুল্লাহ ইবন আবী রবীয়া ইবন আওফ ইবন আকদ ইবন আযযা ইবন আওফ ইবন ছাকীফ ইবন মুনাব্বিহ ইবন বাকর ইবন হাওয়াযিন আবু উছমান, তাকে আবুল হাকাম হাকাফী বলা হত। তিনি জাহিলিয়তের যুগের একজন কবি। ইসলামের পূর্বে তিনি দামেশকে আগমন করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি সরল পথের অনুসারী এবং জীবনের শুরু থেকেই ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীতে তার ঈমান-বিচ্যুতি ঘটে। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তার কথাটি উল্লেখ করেছেন। আয়াতটি হলঃ

( وَٱتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَأَ ٱلَّذِیۤ ءَاتَیۡنَـٰهُ ءَایَـٰتِنَا فَٱنسَلَخَ مِنۡهَا فَأَتۡبَعَهُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡغَاوِینَ )

[Surah Al-A'raf 175]

–তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শোনাও, যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন, তারপর সে তা বর্জন করে ও শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (৭ আরাফঃ ১৭৫)

যুবাইর ইবনে বাক্কার বলেন, এর কন্যা হচ্ছে রুকাইয়া আবদ শামস ইবন আবদ মানাফ কবি উমাইয়া ইবন আবুস্ সালত -এর মা। আবুস সালত- এর মূল নাম রবী’য়া ইবন ওহব ইবন আল্লাজ ইবন আবু সালামা ইবনে ছাকীফ।

অন্যরা বলেন, উমাইয়ার পিতা ছিলেন তায়েফের বিখ্যাত কবিদের একজন। উমাইয়া ছিল এদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান।

আব্দুর রাযযাক ছাওরী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই আয়াতে উমাইয়া ইবনে আবুস্ সালতের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আবু বকর ইবনে মরদুইয়া নাফে’ ইবনে ‘আসিম ইবনে মাসউদ হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি একদিন এমন একটি মজলিসে উপস্থিত ছিলাম, যেখানে আব্দুল্লাহ ইবন আমরও ছিলেন। সেই মজলিসে এক ব্যক্তি সূরা আ’রাফের পূর্বোক্ত আয়াত পাঠ করলে আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কি জান, লোকটি কে?’ উত্তরে কেউ বলল, ‘লোকটি হচ্ছে সাইফী ইবন রাহিব।’ কেউ বলল, ‘বালআম নামক বনী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি।’ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বললেন, ‘না।’ প্রশ্ন করা হল, ‘তবে লোকটি কে?’ তিনি বললেন, ‘লোকটি হচ্ছে উমাইয়া ইবন আবুস্ সালত। আবু সালেহ্, কালবী ও কাতাদা প্রমুখ অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

তাবারানী বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ান বলেন, আমি এবং উমাইয়া ইবন আবুস্ সালত ছাকাফী একবার বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথে কোথাও যাত্রা বিরতি দিলে উমাইয়া আমাকে একটি লিপিকা পাঠ করে শুনাতো। এইভাবে আমরা খৃষ্টানদের একটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছি। তখন গ্রামের খৃষ্টানরা এসে উমাইয়াকে স্বাগত জানায় এবং উমাইয়া তাদের সাথে তাদের বাড়ীতে যায়। দুপুরে ফিরে এসে সে পরনের পোষাক খুলে ফেলে দু’টি কালো কাপড় পরে নেয় এবং পরে আমাকে বলল, ‘আবু সুফিয়ান! এই অঞ্চলে একজন বিজ্ঞ খৃষ্টান আলেম আছেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন।’ আমি বললাম, ‘না, আমার কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শপথ! যদি আমাকে আমার মনঃপূত কোন কথা বলে, তাতে আমি তার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারব না। আর যদি সে আমার দৃষ্টিতে অপ্রীতিকর কোন কথা বলে, তা হলে আমি অবশ্যই তার প্রতি ক্ষুব্ধ হবে।’

আবু সুফিয়ান বলেন, এর পর উমাইয়া চলে যায় এবং জনৈক প্রবীণ খৃষ্টানের সাথে কথা বলে। আবার আমার নিকট ফিরে আসে। এসে বলল, ‘আচ্ছা এই প্রবীণ লোকটির নিকট যেতে আপনার বাধা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘আমি তো তার ধর্মের অনুসারী নই!’ উমাইয়া বলল, ‘তা সত্ত্বেও তার থেকে কিছু বিস্ময়কর কথা তো শুনতে পারবেন এবং তাকে দেখতে পারবেন।’

তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনি কী ছাকীফ বংশীয়?’ আমি বললাম, ‘না। বরং আমি কুরাইশী।’ উমাইয়া বলল, ‘তবে লোকটির কাছে যেতে আপনার অসুবিধাটা কোথায়? আল্লাহর শপথ! অবশ্যই তিনি আপনাদেরকে ভালোবাসেন ও আপনাদের মঙ্গল কামনা করেন।’

আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথা বলে উমাইয়া আমার নিকট থেকে চলে গিয়ে তাদের নিকট রয়ে যায়। পরে রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর এসে কাপড় ছেড়ে সে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ে। আল্লাহর শপথ! সারাটা রাত সে ঘুমায় নি বা উঠেও যায়নি। ভোরে তাকে ক্লান্ত শ্রান্ত ও চিন্তিত অবস্থায় দেখা যায়। সারাদিন সে আমাদের সাথে কোন কথাও বলেনি, আমরাও তার সাথে কোন কথা বললাম না।

অতঃপর সে বলল, ‘এবার কি আমরা রওয়ানা হতে পারি?’ আমি বললাম, ‘তোমার নিকট বাহন আছে কি?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ আছে।’ আমরা রওয়ানা হলাম। টানা দুই রাত পথ চললাম। তৃতীয় রাতে উমাইয়া আমাকে বলল, ‘আবু সুফিয়ান! কথা বলছেন না যে!’ আমি বললাম, ‘তুমিই তো কথাবার্তা ছেড়ে দিয়েছ। আল্লাহর শপথ! আমি বললাম, তোমার আবার প্রত্যাবর্তন স্থল আছে নাকি হে? সেদিন তুমি তোমার বন্ধুর নিকট থেকে আসা অবধি আমি তোমাকে যেমন দেখছি, তেমনটি তোমাকে আমি কখনো দেখিনি।’ উমাইয়া বলল, ‘ব্যাপারটির হেতু আপনি নন। আমি আমার প্রত্যাবর্তন স্থল সম্পর্কে ভীত। আল্লাহর শপথ! আমি একদিন মৃত্যুবরণ করব। তারপর আমাকে জীবিত করা হবে।’ আমি বললাম, ‘তুমি কি আমার আমানত গ্রহণ করতে পার?’ উমাইয়া বলল, ‘কোন শর্তে আমি আপনার আমানত গ্রহণ করব?’ আমি বললাম, ‘এই শর্তে যে, পুনরায় উত্থিত করা হবে না এবং তোমার কোন হিসাব-নিকাশও নেওয়া হবে না।’

এ কথা শুনে উমাইয়া হেসে দিল এবং বলল, ‘আবু সুফিয়ান! আমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবো। তারপর আমাদের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে। পরিশেষে একদল জান্নাতে প্রবেশ করবে আর এক দল জাহান্নামে যাবে।’ আমি বললাম, ‘তা তুমি এই দু’টার কোনটায় যাবে বলে তোমার বন্ধুটি তোমাকে জানালো?’ উমাইয়া বলল, ‘আমার বন্ধুর এ ব্যাপারে আদৌ কোন জ্ঞান নেই। আমার ব্যাপারে তো নয়ই, তার নিজের ব্যাপারেও নয়।’

আবু সুফিয়ান বলেন, এভাবে আমরা আরও দুই রাত কাটালাম। সে আমাকে আজব-আজব কথা শোনায় আর আমি হেসে খুন হই। এক সময়ে আমরা দামেশকের গোতা অঞ্চলে এসে পৌঁছি। এখানে আমরা আমাদের পণ্য সম্ভার বিক্রয় করি এবং দুই মাস অবস্থান করি। তারপর রওয়ানা হয়ে আমরা একটি খৃষ্টান পল্লীতে গিয়ে উপনীত হই। সেখানকার লোকেরা উমাইয়াকে দেখে এগিয়ে আসে এবং তাকে উপঢৌকনাদি দেয়। উমাইয়া তাদের সাথে তাদের গীর্জায় যায় এবং দুপুরের পরে ফিরে এসে কাপড় পাল্টিয়ে আবার চলে যায়। এইবার সন্ধ্যা রাতের পর ফিরে এসে কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আল্লাহর শপথ! সারাটা রাত্র সে একদণ্ড ঘুমাল না। চিন্তিত ও ভারাক্রান্ত মনে এপাশ-ওপাশ করে কাটাল।

সে-ও আমাদের সাথে কোন কথা বলল না, আমরাও তার সাথে কথা বললাম না!!

অতঃপর সে বলল, ‘এবার আমরা রওয়ানা হই।’ আমি বললাম, ‘ইচ্ছা হলে চল!’ আমরা রওয়ানা হলাম। কয়েক রাত কেটে গেল। উমাইয়া তেমনি-ই দুঃখ ভারাক্রান্ত রয়ে গেল। তার পর সে বলল, ‘আবু সুফিয়ান! আসুন, আমরা দ্রুত অগ্রসর হয়ে সংগীদের আগে চলে যাই।’ আমি বললাম, ‘কেন? কোন প্রয়োজন আছে নাকি?’ সে বল্‌লো, ‘আছে বৈ কি!’ তখন আমরা দুইজন সংগীদের পেছনে ফেলে খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। এবার উমাইয়া বললো, ‘আচ্ছা, উতবা ইবনে রবীয়া সম্পর্কে বলুন তো, তিনি কি অন্যায়-অবিচার এবং বৈধ-অবৈধ বিবেচনা করে চলেন?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ!’ উমাইয়া বলল, ‘তিনি কি আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং বজায় রাখতে আদেশ করেন?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ!’ উমাইয়া বলল, ‘পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই কি তিনি কুলীন-সমাজে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’।

উমাইয়া বলল, ‘আচ্ছা, আপনার জানা মতে কুরাইশ বংশে তার চাইতে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আর কেউ আছেন কি?’

আমি বললাম, ‘না, আল্লাহর শপথ! তার চাইতে সম্ভ্রান্ত আর কেউ আছে বলে আমি জানি না।’

উমাইয়া বলল, ‘তিনি কি দরিদ্র?’ আমি বললাম, ‘না। বরং তিনি প্রচুর সম্পদের অধিকারী।’ উমাইয়া বলল, ‘তার বয়স কত, বলতে পারেন?’

আমি বললাম, ‘একশ’ পেরিয়ে গেছে।’ উমাইয়া বলল, ‘আচ্ছা বংশ-মর্যাদা, সম্পদ এবং বয়স কি তাকে বিপথগামী করেছে?’

আমি বললাম, ‘না, কেন এ সব তাঁকে বিপথগামী করবে? বরং এ সব তাঁর কল্যাণ আরো বৃদ্ধি করেছে।’ উমাইয়া বলল, ‘তা- ই বটে! এখন কি ঘুমাবে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তারপর আমি শয়ন করলাম আর উমাইয়া তার সামান- পত্রের নিকট চলে গেল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এক স্থানে অবতরণ করে রাত কাটালাম। তারপর আবার রওয়ানা হলাম। আমরা দুইটি খোরাসানী উটনীতে সওয়ার হয়ে চলতে লাগলাম। আমরা একটি খোলা ময়দানে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন উমাইয়া বলল, ‘উতবা ইবনে রবীয়া সম্পর্কে বলুন, তিনি কি অবৈধ কাজ ও জুলুম-অত্যাচার পরিহার করে চলেন? তিনি কি আত্মীয়তা বজায় রাখেন এবং তা বজায় রাখার জন্য আদেশ করেন?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! তিনি তা করেন।’ উমাইয়া বলল, ‘তিনি কি সম্পদশালী।’ উমাইয়া বলল, ‘কুরাইশ গোত্রে তার চেয়ে সম্ভান্ত আর কেউ আছে বলে আপনি জানেন কি?’ আমি বললাম, ‘না।’

উমাইয়া বলল, ‘তাঁর বয়স কত হবে?’ আমি বললাম, ‘একশ’র উপরে।’ উমাইয়া বলল, ‘বয়স, বংশ-মর্যাদা এবং সম্পদ তাকে বিপথগামী করেছে কি?’ আমি বললাম, ‘না, আল্লাহর শপথ! এইসব তাকে বিপথগামী করেনি।’

আমি বললাম, ‘তুমি যা বলতে চাচ্ছ, তা বলে ফেল।’

উমাইয়া বলল, ‘আমি যা বলছি তুমি তা কারো কাছে তা প্রকাশ করবে না। উতবা ইবন রবীয়ার ব্যাপারে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।’ তারপর সে বলল, ‘আমি এ খৃষ্টান পণ্ডিতকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার একটি ছিল এই যে, এই প্রতীক্ষিত নবী সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ বললেন, ‘তিনি তো আরবের লোক হবেন।’ আমি বললাম, ‘তিনি যে আরবের লোক হবেন তা তো আমি জানি। আমার প্রশ্ন হল, তিনি আরবের কোন গোত্রের লোক হবেন?’ ঐ খ্রীস্টান পণ্ডিত বললেন, ‘তিনি আরবের হজ্জ তত্ত্বাবধানকারী পরিবারের লোক হবেন।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমাদের এমন একটি ঘর আছে, যাকে কেন্দ্র করে আরবরা হজ্জ করে থাকে।’ এবার পণ্ডিত বললেন, ‘তিনি হবেন কুরায়শ বংশের লোক।’ এ কথাটি শোনার পর আমি। এমন ব্যথিত হয়ে পড়লাম, যেমনটি এর আগে কখনো হইনি। যেন দুনিয়া ও আখিরাতের তাবৎ সাফল্য হাতছাড়া হয়ে গেল। আমি আশা করতাম যে, সেই প্রতীক্ষিত নবী আমিই হবো।

তারপর আমি বললাম, ‘আমাকে লোকটির আরো কিছু বিবরণ দাও!’ জবাবে সে বললোঃ ‘যৌবন অতিক্রম করে যখন তিনি প্রৌঢ়ত্বে পদাপর্ণ করবেন, তখন তাঁর প্রথম কাজ হবে এই যে, তিনি অন্যায়-অবিচার এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবেন। নিজে আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখবেন এবং অন্যদেরকেও তা বজায় রাখতে আদেশ করবেন। তিনি হবেন পিতা-মাতা উভয় কুল থেকে সন্ত্রান্ত, বিত্তহীন, সমাজে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তার বাহিনীর অধিকাংশ হবেন ফেরেশতা।’

আমি বললাম, ‘তাঁর লক্ষণ কি?’ তিনি বললেন, ‘ঈসা ইবন মারয়াম (আ)-এর দুনিয়া ত্যাগের পর থেকে সিরিয়ায় এ পর্যন্ত আশিটি ভূমিকম্প ঘটেছে। তার প্রতিটিতে একটি করে বিপদ ছিল। এখনো এমন একটি ব্যাপক ভূমিকম্প অবশিষ্ট আছে, যাতে একাধিক বিপদ থাকবে।’

আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এই কথা শুনে আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! এটা মিথ্যা কথা। আল্লাহ যদি একান্তই রাসূল পাঠান তাহলে বয়স্ক ও সম্ভ্রান্ত লোক ছাড়া কাউকেও রাসূল করে পাঠাবেন না।’ জবাবে উমাইয়া বলল, ‘তুমি যার নামে শপথ করেছ, আমিও তারই নামে শপথ করে বলছি যে, ঘটনাটি এরূপই হবে, হে আবু সুফিয়ান! খৃষ্টান পণ্ডিতের কথা নিঃসন্দেহে সত্য।’

এই আলোচনার পর আমরা শুয়ে রাত কাটালাম। অতঃপর তল্পিতল্পা নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। অগ্রসর হতে হতে যখন আমাদের এবং মক্কার মাঝে মাত্র দুই দিনের পথ বাকী থাকলো, ঠিক এমন সময় পেছন থেকে এক আরোহী এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হল। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই সে বলতে শুরু করল যে, আপনাদের চলে আসার পরক্ষণেই সিরিয়ায় এক ভূমিকম্প হয়ে সব তছনছ করে ফেলেছে, ফলে তার অধিবাসীদের উপর নানা রকম মহা বিপদ নেমে এসেছে।

আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথা শুনে উমাইয়া আমার কাছে এসে বলল, ‘আবু সুফিয়ান! খৃষ্টান পণ্ডিতের কথাটা তোমার এখন কেমন মনে হচ্ছে?’

আমি বললাম, ‘এখন তো আমার মনে হচ্ছে যে, তোমার সংগী তোমাকে যা বলেছিল, সত্যই বলেছে।’

আবু সুফিয়ান বলেন, তারপর আমি মক্কা এসে কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে আবার বাণিজ্য উপলক্ষে ইয়ামানে চলে যাই। সেখানে আমি পাঁচ মাস অবস্থান করি। অতঃপর মক্কায় ফিরে আসি। মক্কায় আসার পর লোকেরা আমার ঘরে এসে প্রত্যেকে নিজ নিজ পণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল। মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহও আসলেন। হিন্দ তখন আমার অদূরে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধূলা করছিল। মুহাম্মদ এসে আমাকে সালাম দিলেন কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, এবং আমার সফরের খোঁজখবর নিলেন। কিন্তু তাঁর পণ্যসম্ভার সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। তারপর উঠে চলে গেলেন।

আমি তখন হিন্দকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! বিষয়টা আমার নিকট অদ্ভূত ঠেকছে। কুরায়শের যত লোকের আমার কাছে পণ্য আছে, তারা একে একে প্রত্যেকে নিজ নিজ পণ্যের খোঁজখবর নিল। কিন্তু মুহাম্মদ নিজের পণ্য সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞেস করলেন না।’ জবাবে হিন্দ আমাকে বলল, ‘আপনি কি তার ঘটনা জানেন না?’ আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ঘটনা?’ জবাবে হিন্দ বলল, ‘সে দাবি করে যে, সে নাকি আল্লাহর রাসূল!’ সঙ্গে সঙ্গে আমার খৃষ্টান পণ্ডিতের কথাটা মনে পড়ে গেল এবং আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো। অবস্থা দেখে হিন্দ আমাকে বলল, ‘তোমার আবার কী হলো?’ আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম এবং বললাম, ‘তুমি যা বললে। সব মিথ্যা কথা। মুহাম্মদ এত নির্বোধ নয় যে, এ রকম কথা বলবে।’ হিন্দ বলল, ‘আল্লাহর শপথ, অবশ্যই মুহাম্মদ তা’ বলছে এবং একথা রীতিমত প্রচার করে বেড়াচ্ছে! এতদিনে তো এই মতের পক্ষে তার বেশ ক’জন সঙ্গী-সাথীও জুটে গিয়েছে।’ আমি বললাম, ‘এইসব বাজে কথা।’

আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমি ঘর থেকে বের হয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করতে শুরু করলাম। হঠাৎ মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘তোমার পণ্য তো এত দামে বিক্রয় হয়েছে। তুমি বেশ লাভবান হয়েছ। লোক পাঠিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নাও। তবে অন্যদের থেকে যে হারে আমি লভ্যাংশ নিয়েছি, তোমার নিকট থেকে তা নেব না।’ কিন্তু তিনি তাতে রাজী হলেন না এবং বললেন, ‘তাহলে আমি আমার অংশ গ্রহণই করব না।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনি লোক পাঠিয়ে দিন। আমি অন্যদের নিকট থেকে যে হারে লাভ নিয়েছি, আপনার থেকেও সে হারেই নেবো।’ এরপর মুহাম্মদ লোক পাঠিয়ে তার টাকা নিয়ে নেন। এবং আমিও তার নিকট থেকে সেই হারে লাভ গ্রহণ করি, যে হারে অন্যদের নিকট থেকে নিয়েছি।

আবু সুফিয়ান বলেন, এই ঘটনার অল্প পরেই আমি ইয়ামানে যাই। তারপর তায়েফ গিয়ে উমাইয়া ইবনে আবুস সালত-এর নিকট যাই। উমাইয়া বলল, ‘হে আবু সুফিয়ান। খৃষ্টান পণ্ডিতের কথাটা কি তোর মনে পড়ে?’ আমি বললাম, ‘মনে পড়ে বৈ কি? সে ব্যাপারটি তো বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছে।’ উমাইয়া জিজ্ঞেস করল, ‘কে সেই লোক?’ আমি বললাম, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’ উমাইয়া বলল, ‘আবদুল মুত্তালিব-এর ছেলে আবদুল্লাহর পুত্র?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, তা-ই।’ এই বলে আমি হিন্দের মুখে শ্রুত ঘটনাটি বিস্তারিত বিবৃত করলাম। শুনে উমাইয়া ঘর্মসিক্ত হয়ে গেল এবং বলল, ‘আল্লাহই ভালো জানেন।’ তারপর সে বলল, ‘হে আবু সুফিয়ান খৃষ্টান পন্ডিত যে বিবরণ দিয়েছিলেন, যতদূর মনে হয় মুহাম্মদের মধ্যে তার সবই বিদ্যমান। আমার জীবদ্দশায় যদি মুহাম্মদ তাঁর দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তাহলে তার সাহায্য না করার জন্য আমি আল্লাহর নিকট ওযরখাহী করব।’

আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমি পুনরায় ইয়ামান চলে গেলাম। ইয়ামান পৌঁছামাত্র জানতে পারলাম যে, মুহাম্মদের সংবাদ এখানেও পৌঁছে গেছে। পুনরায় তায়েফ গিয়ে উমাইয়াকে বললাম, ‘আবু উছমান। মুহাম্মদের সংবাদ তো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এবার তুমি কী করবে, সিদ্ধান্ত নাও।’ উমাইয়া বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমি ছাকীফ গোত্র ব্যতীত অন্য গোত্রের নবীর প্রতি কিছুতেই ঈমান আনব না।’

আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমি মক্কায় চলে আসি। এসে দেখতে পেলাম যে, জনতার হাতে মুহাম্মদের সংগীরা প্রহৃত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। তা দেখে আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘তার ফেরেশতা বাহিনী এখন কোথায় গেল?’ আমি মনে মনে গর্ব বোধ করলাম।

অপেক্ষাকৃত সংক্ষেপে বর্ণনাটি ‘বায়হাকীর কিতাবুদ দালাইলে’ও বর্ণিত হয়েছে, তাবারানীর অন্য এক বর্ণনায় আবু সুফিয়ান ও উমাইয়া ইবনে আবুসসালত-এর কথোপকথনে অতিরিক্ত আছেঃ

উমাইয়া বলল, ‘আমি আমার কাছে রক্ষিত বিভিন্ন কিতাবে পড়েছি যে, আমাদের এ কঙ্করময় অঞ্চল থেকে একজন নবী প্রেরিত হবেন। ফলে আমি ধারণা করতাম, বরং আমার দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল যে, আমিই হবো সেই ব্যক্তি। কিন্তু পরে বিভিন্ন পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জানতে পারলাম যে, তিনি হবেন আবদে মানাফের বংশের লোক। চিন্তা-ভাবনা করে আমি আবদে মানাফের বংশে উতবা ইবনে রবীয়া ছাড়া আর কাউকে এর উপযুক্ত বলে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আপনার মুখে তার বয়সের কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে, তিনিও সেই ব্যক্তি নন। কারণ, তিনি অনেক আগেই চল্লিশ পেরিয়ে গেছেন, অথচ তার প্রতি ওহী নাযিল হয়নি।’

আবু সুফিয়ান বলেন, এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়। আমি কুরাইশের এক বণিক কাফেলার সঙ্গে ইয়ামানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে উমাইয়ার সাথে দেখা হলে উপহাস করে তাকে বললাম, ‘উমাইয়া! তুমি যে নবীর কথা বলতে, তার আবির্ভাব তো ঘটে গেছে।’ উমাইয়া বলল, ‘তিনি অবশ্যই সত্য নবী, তুমি তার অনুসারী হয়ে যাও!’ আমি বললাম, ‘তার অনুগামী হতে তোমাকে কে বাধা দেয়?’ উমাইয়া বলল, ‘আমাকে শুধু ছাকীফ গোত্রের নারীদের লজ্জা দেওয়ার ভয়ই বাধা দিচ্ছে। তাদের কাছে আমি বলে বেড়াতাম যে, আমিই হবো সেই ব্যক্তি। এখন যদি তারা আমাকে আবদে মানাফের গোত্রের এক নবীর অনুসরণ করতে দেখে তবে তারা আমাকে লজ্জা দিবে।’ উমাইয়া বললঃ ‘আমি যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, হে আবু সুফিয়ান! তুমি তার বিরোধিতা করছো। তারপর ছাগল ছানার মত রজ্জবদ্ধ অবস্থায় তুমি তার নিকট নীত হচ্ছো। আর তিনি তোমার ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছামত ফয়সালা দিচ্ছেন।’

আবদুর রাযযাক কালবী থেকে বর্ণনা করেন যে, কালবী বলেন, উমাইয়া একদিন শুয়ে ছিল। সঙ্গে তার নিজের দুই কন্যা। হঠাৎ তাদের একজন ভয়ে চীৎকার করে উঠল। চীৎকার শুনে উমাইয়া জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার, তোমার কি হয়েছে?’ কন্যাটি বলল, ‘আমি দেখলাম, দুটি শকুন ঘরের ছাদ ফাক করে ফেলল এবং একটি শকুন আপনার কাছে এসে আপনার পেট চিরে ফেলল। অপরটি ঘরের চালের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। চালের উপরের শকুনটি নিচেরটিকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কি স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন? অপরটি বলল, হ্যাঁ। প্রথমটি আবার জিজ্ঞেস করল, সে কি তীক্ষধী? অপরটি বলল, না।’ এ ঘটনা শুনে উমাইয়া বলল, ‘তোমাদের পিতার কল্যাণই কামনা করা হয়েছে।’

ইসহাক ইবনে বিশর সাঈদ ইবন মুসায়্যাব থেকেও বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। সাঈদ ইবনে মুস্যায়াব (র) বলেন, মক্কা বিজয়ের পর উমাইয়া ইবন আবুস সালত এর বোন ফারিআ একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করে। ফারিয়া ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও সুন্দরী। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি তাঁকে বললেন, ‘ফারিআ! তোমার ভাইয়ের কোনো কবিতা কি তোমার স্মরণ আছে?’ ফারিআ বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ, আছে বৈকি। তবে আমার দেখা একটি ঘটনা তার চেয়েও বিস্ময়কর। ঘটনাটি হলো এই যে, আমার ভাই একবার সফরে গিয়েছিলেন। সফর থেকে ফিরে এসে আমার কাছে আসেন এবং আমার খাটে শয়ন করেন। আমি তখন একটি চামড়ার পশম খসাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম যে, সাদা রঙের দু’টি পাখি অথবা পাখির মতো দুটি প্রাণী এগিয়ে আসে এবং দু’টির একটি জানালার ওপর বসল আর অপরটি আমার ভাইয়ের গায়ে এসে পড়লো। এবং তার বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলল। তারপর তার পেটে হাত ঢুকিয়ে তার হৃৎপি বের করে হাতে নিয়ে তার ঘ্রাণ নিল। তখন অপরটি জিজ্ঞেস করল, ওকি স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন? জবাবে দ্বিতীয়টি বলল, হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞেস করল, ওকি তীক্ষ্ণধী? বলল, না। তারপর হৃৎপিণ্ডটি যথাস্থানে রেখে দিল! পরক্ষণে পলকের মধ্যে জখম শুকিয়ে গেল। প্রাণী দু’টি চলে যাওয়ার পর আমি আমার ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ব্যথা অনুভব করছেন? তিনি বললেন, না। কেবল শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে। অথচ ঘটনা দেখেই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখন ভাই বললেন, কি ব্যাপার, তুমি কাঁপছো কেন? ফারিআ বলেন, তখন আমি তাকে ঘটনাটি বিবৃত করলাম। শুনে ভাই বললেন, আমার কল্যাণই কামনা করা হয়েছে।’ তারপর তিনি আমার নিকট থেকে চলে গেলেন এবং নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেনঃ

باتت و می تسری طوارقها - أكف عيني والدمع سابقها

مما أتاني من اليقين ولم - أوث برا يقص ناطقها

أم من تلظى عليه واقده الن - ار محيط بهم سرادقها

ام اسكن الجنية التي وعد الأ - برار مصفوفة نمارقها

لا يستوي المنزلان ثم ولا - عمال لا تستوى طرائقها

هما فريقان فرقة تدخل -لجنة حفت بهم حلدايقها

وفرقة منهم قد أدخلت الن - ار فساء تهم مرافقها

تعاهدت هذه القلوب إذا - همت بخير عاقت عوائقها

و صدها للشفاء عن طلب أل - جنة دنيا الله ما حقها

عبد دع أنفسه فعاتبها - يعلم أن البصر رامقها

مار غب النفس في الحياة وأن - تحيي قليلا فالموت لأحثها

يوشك من فر من منيته -يوما على غمرة يوافقها

إن لم تمت غبطة تمت هرما - للموت كاس والمر ذائقها

— দুশ্চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমি আমার চক্ষুকে সংবরণ করতে চেষ্টা করি ঠিক, কিন্তু অশ্রু তার আগেই ঝরে পড়ে। কারণ, আমার নিকট মৃত্যুর পরোয়ানা এসে গেছে। অথচ, আমাকে এমন কোন মুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়নি, যা ভাষ্যকার বর্ণনা করে শোনাবে।

আমি অবগত নই যে, আমি কি ঐ ব্যক্তির মত হব, যার ওপর অগ্নি প্রজ্বলিত করা হবে এবং আগুন তাকে বেষ্টন করে রাখবে।

নাকি আমি সেই জান্নাতে স্থান পাব, যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সৎকর্মশীলদেরকে, যার বালিশগুলো সাজানো থাকবে সারি সারি করে।

ঐ আবাস দু’টো সমান নয়, এক নয় কর্মের ধারাও। তারা দল হবে দুটি। একটি প্রবেশ করবে জান্নাতে, যা বেষ্টিত থাকবে বাগ-বাগিচা দ্বারা। অপর দলকে প্রবেশ করানো হবে জাহান্নামে। তার সব সামগ্রী হবে তাদের জন্য অকল্যাণকর।

এই হৃদয়গুলো যেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে, যখনই এগুলো কোন কল্যাণের সংকল্প করবে, বিপদাপদ তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আর দুর্ভাগ্যবশত জান্নাতের অনুসন্ধান থেকে বিরত রাখবে সে দুনিয়া, যাকে আল্লাহ নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।

এক ব্যক্তি নিজেকে ভৎসনা করেছে। কারণ, সে জানে যে, সর্বদ্রষ্টা (আল্লাহ) তাকে অবলোকন করছেন। সে নিজেকে আজীবন বেঁচে থাকার প্রতি উৎসাহিত করেনি। অল্প ক’দিন বেঁচে থাকলেও একদিন তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতেই হবে।

যে ব্যক্তি মৃত্যু থেকে পলায়ন করবে, হঠাৎ একদিন মৃত্যু তার সামনে এসে দাঁড়াবেই।

যৌবনে মৃত্যু না হলে বার্ধক্যে হবে অবশ্যই। মৃত্যু একটি পেয়ালা। মানুষ তার স্বাদ আস্বাদনকারী। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর উমাইয়া নিজ অঞ্চলে ফিরে যায়।

সংবাদ পেয়ে আমি তার নিকট গিয়ে দেখলাম, সে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। সমস্ত শরীর কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে এবং বিস্ফারিত নয়নে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে উচ্চশব্দে বলে উঠে।

لبيكما لبيكماها أنا ذا لديكما - لاذومال فيفدينى و لاذوأهل فتحمني

—আমি হাজির, আমি তোমাদের সামনে হাজির। এমন কোন বিত্তবান নেই, যে পণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করবে, আমার আপনজন কেউ নেই, যে আমাকে রক্ষা করবে।

তারপর সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে আবার ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অবস্থা দেখে আমি বললাম, লোকটি তো শেষ হয়ে গেল। তারপর সে আবার বিস্ফারিত নয়নে ওপর দিকে তাকিয়ে উচ্চঃস্বরে বললঃ

لبيكما لبيكما ها أنا ذا لديكما -لاذو براءة فاعتذر ولا ذو عشيرة فانتصر

—হাজির, আমি তোমাদের সামনে হাজির। রক্ষা করার কেউ নেই যে, আমি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব, এমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, যার সাহায্যে আমি আত্মরক্ষা করতে পারি?

এই বলে আবার সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে বিস্ফারিত নয়নে ওপর দিকে দৃষ্টিপাত করে আবার বললঃ

لبيكما لبيكما ها أنا ذا لديكما بالنعم محفود وبا الذئب محصود

—হাজির আমি, তোমাদের সামনে হাজির। বিত্ত-বৈভব থাকলে মানুষ সেবা পায়। আর পাপের পরিণতিতে ধ্বংস হয়।

এরপর আবার সে বেঁহুশ হয়ে পড়ে। হুঁশ ফিরে পেয়ে বললঃ

لبيكما لبيكما ها أنا ذا لديكما إن تغضر اللهم تففر جما وأي عبد لا ألما

—হাজির আমি, তোমাদের সামনে হাজির! ক্ষমাই যদি কর আল্লাহ! অপরাধই ক্ষমা করে দাও। তোমার কোন বান্দাই তো অপরাধমুক্ত নয়! এই বলে আবার সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললঃ

كل عيش وإن تطاول دهرا - صائر مرة الى أن يزولا

—সকল আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস তা যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক, একদিন না একদিন তা নিঃশেষ হবেই।

ليتني كنت قبل ماقد بدالي في قلال الجبال أرعى الوعولا

—হায়, আমার এই শোচনীয় অবস্থা সৃষ্টির আগে যদি আমি পাহাড় চূড়ায় গিয়ে ছাগল চরাতাম!

ফারিআ বলেন, এরপর আমার ভাই মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ

يا فارعة إن مثل أخيك كمثل الذي إتاه الله أياته فانسلخ منها

—ফারিআ! তোমার ভাইয়ের দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির ন্যায়, যাকে আল্লাহ তার নিদর্শন দিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু সেসব দেখে সে তা বর্জন করে। খাত্তাবী এই বর্ণনাটিকে গরীব পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেন।

হাফিজ ইবনে আসাকির যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, যুহরী বলেন, উমাইয়া ইবনে আবুসসালত একবার বলেছিলঃ

ألا رسول لنا منا يخبرنا - ما بعد غايتنا من رأس مجرانا

— আমাদেরই মধ্য হতে আমাদের এমন একজন রাসূল আছেন, যিনি আমাদেরকে সবকিছুর আনুপূর্বিক সংবাদ প্রদান করেন।

তারপর উমাইয়া বাহরাইন চলে যায়। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওত প্রাপ্ত হন। উমাইয়া বাহরাইনে আট বছর অবস্থান করে, তারপর সে তায়েফ চলে আসে। এসে তায়েফবাসীদেরকে জিজ্ঞেস করে যে, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ কী বলে?’ লোকেরা বলল, ‘মুহাম্মদ দাবী করছে যে, সে নাকি সেই, যা হওয়ার কামনা তুমি করতে।’

যুহরী বলেন, এ কথা শুনে উমাইয়া মক্কায় চলে আসে এবং নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলে, ‘হে আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র! এসব তুমি কী বলছ?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘আমি বলছি যে, আমি আল্লাহর রাসূল আর আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।’ উমাইয়া বলল, ‘আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই, আগামী দিন সময় দাও!’ জবাবে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আগামীকালই কথা হবে।’ উমাইয়া বলল, ‘হয়ত আমিও একা আসব, তুমিও একা আসবে। অথবা আমি আমার দলবল নিয়ে আসব, তুমিও তোমার দলবল নিয়ে আসবে; কোনটা তোমার পছন্দ?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘তোমার যেমন খুশী।’ উমাইয়া বলল, ‘ঠিক আছে, আমি আমার দলবল নিয়েই আসব, তুমিও তোমার দলবল নিয়ে এসো!’

পরদিন উমাইয়া কুরায়শ বংশীয় একদল লোক নিয়ে এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-ও কতিপয় সাহাবা সঙ্গে নিয়ে সমবেত হন এবং সকলে কাবার ছায়ায় বসেন।

বর্ণনাকারী বলেন, প্রথমে উমাইয়া তার বক্তব্য পেশ করে এবং স্বরচিত কবিতা শুনায়। আবৃত্তি শেষ করে সে বলল, ‘হে আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র। এবার তুমি আমার জবাব দাও!’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ

بسم الله الرحمن الرحيم - يسن والقران الحكيم

তাঁর তিলাওয়াত শেষ হলে উমাইয়া তার দু’পা টেনে টেনে ছুটে পালাতে শুরু করল। তার সঙ্গী কুরাইশরাও তার অনুসরণ করল। তারা জানতে চাইল, ‘উমাইয়া! তোমার মতামত কী?’ উমাইয়া বলল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ সঙ্গীরা জিজ্ঞাসা করল, ‘তবে কি তুমি তার অনুসারী হয়ে যাবে?’ উমাইয়া বলল, ‘আমি একটু চিন্তা-ভাবনা করে দেখি!’

বর্ণনাকারী বলেন, তারপর উমাইয়া সিরিয়ায় চলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরত করেন। বদর যুদ্ধের পর উমাইয়া সিরিয়া থেকে ফিরে এসে বদর প্রান্তরে অবতরণ করে। পরে রাসূল (সা)-এর নিকট যেতে উদ্যত হলে একজন তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আবুস সালত! তুমি কি করতে যাচ্ছো?’ উমাইয়া বলল, ‘যাচ্ছি মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা করতে।’ লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ‘মুহাম্মদের কাছে তুমি কি করবে?’ উমাইয়া বলল, ‘তাঁর প্রতি আমি ঈমান আনব এবং সব ক্ষমতা তার হাতে ছেড়ে দিব।’ লোকটি বলল, ‘তুমি কি জানো, বদরের এই কূপে যার আছে, তারা কারা?’ উমাইয়া বলল, ‘না, তা তো বলতে পারি না।’ লোকটি বলল, ‘তোমার দুই মামাতো ভাই উতবা ইবনে রবীয়া ও শায়বা ইবনে রবীয়া। আর তাদের মা রবীয়া বিনতে আবদে শামস।’

বর্ণনাকারী বলেন, এ সংবাদ শোনামাত্র উমাইয়া তার উষ্ট্রীর উভয় কান ও লেজ কেটে ফেলল। তারপর কূপের পাড়ে দাঁড়িয়ে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করল। সঙ্গে সঙ্গে সে মক্কা হয়ে তায়েফ চলে গেল এবং ইসলাম গ্রহণের পরিকল্পনা ত্যাগ করল। সে কবিতাটির প্রথম পংক্তিটি ছিলঃ

ماذا ببدر فالعقن - قل من مرازبة جحاجح

গোটা কবিতাটির বদর যুদ্ধের বর্ণনায় উল্লেখিত হবে। ইমাম যুহরী অতঃপর দুই পাখির ঘটনা, এবং উমাইয়ার মৃত্যুর কাহিনী বর্ণনা করেন, যা ইতিপূর্বেই বিবৃত হয়েছে। মৃত্যুকালে উমাইয়া যে কবিতাগুলি আবৃত্তি করেছিল, তা-ও তিনি উল্লেখ করেছেন। তাহলোঃ

كل عيش وإن تطاول دهرا صائر مرة إلى أن تزولا

ليتني كنت قبل ما قد بدالي في قلال الجبال أرعى الوعولا

فاجعل الموت نصب عينك واحذر غولة الدهر إن للدهر غولا

نا ئلا ظفرها ألفا ور والصمد عان و الطفل في المنار الشكيلا

وبغاث النياف والبعفر النا فر والعوهج البرام الضئيلا

—সব আরাম-আয়েশ-যতই তা দীর্ঘস্থায়ী হোক, একদিন না একদিন নিঃশেষ হবেই। হায়, আমার এই দশা সৃষ্টি হওয়ার আগেই যদি আমি পর্বত চূড়ায় গিয়ে ছাগল চরাতাম! অতঃএব মৃত্যুই হোক তোমার দু’চোখের লক্ষ্য। আর যুগের করাল গ্রাস থেকে তুমি নিজেকে রক্ষা করে চল। মনে রেখ, সিংহই হোক বা ষাঁড়ই হোক, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থানকারী পাখিটি হোক কিংবা হরিণই হোক, অথবা উটপাখীর শাবকটি হোক, ছোট বড় কোনো কিছুই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় না। ছোটকে ছোট বলে এবং বড়কে বড় বলেও মৃত্যু রেহাই দেয় না। খাত্তাবী এই বর্ণনাকে গরীব পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেন।

সুহায়লী তাঁর ‘আত- তা’রীফ ওয়াল ই’লাম’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, উমাইয়া ইবনে আবুস সালত-ই প্রথম ব্যক্তি, যে ( باسمك اللهم ) বলেছিল।

এ প্রসংগে তিনি একটি আশ্চর্য কাহিনী বর্ণনা করেন। কাহিনীটি হলো, কুরাইশের একদল লোকসহ উমাইয়া একবার সফরে বের হয়। আবু সুফিয়ানের পিতা হারব ইবন উমাইয়াও তাদের সঙ্গে ছিল। পথে এক জায়গায় একটি সাপ দেখতে পেয়ে সাপটিকে তারা মেরে ফেলে। যখন সন্ধ্যা হলো, তখন একটি মহিলা জিন এসে সাপ হত্যা করার কারণে তাদেরকে ভৎসনা করে। তার হাতে ছিল একটি লাঠি। লাঠিটি দ্বারা সে সজোরে মাটিতে একটি আঘাত করে। ফলে, কাফেলার উটগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। জিনটি চলে যায়। কাফেলার লোকেরা চতুর্দিক খোঁজাখোজি করে কোথাও মহিলাটিকে পেল না। কিন্তু খানিক পরে আবারো মহিলাটি এসে পুনরায় লাঠি দ্বারা মাটিতে আঘাত করে সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে যায়। উটগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। এবার মহিলাকে খোঁজাখোজি করে ক্লান্ত হয়ে লোকেরা উমাইয়াকে জিজ্ঞাসা করে যে, ‘এ বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার মত কোন বুদ্ধি কি আপনার আছে?’ উমাইয়া বলল, ‘আমি তো কোন বুদ্ধি দেখছি না। তবে চিন্তা করে দেখি, কী করা যায়।’

অতঃপর তারা সে মহল্লায় ঘুরে-ফিরে দেখল যে, এমন কাউকে পাওয়া যায় কি না যার কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়া যায়। হঠাৎ তারা বেশ দূরে আগুন দেখতে পায়। কাছে গিয়ে দেখল, একটি তাঁবুর দরজায় এক বৃদ্ধ লোক আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। আরো কাছে গিয়ে দেখতে পেল, আসলে সে ভয়ঙ্কর আকৃতির এক জিন। তারা তাকে সালাম করে তাদের সমস্যার কথা জানালো। জবাবে সে বলল, মহিলা জিনটি তোমাদের কাছে আবার আসলে বলবে, ( باسمك اللهم ) দেখবে সে পালিয়ে কুল পাবে না। এরপর লোকেরা আবার একত্রিত হলো। মহিলা জিনটি তৃতীয়বার মতান্তরে চতুর্থবারের মত আবারো তাদের কাছে আসল। সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া ইবনে আবুস্ সালত তার মুখের উপর বলে ফেলল, ( باسمك اللهم ) মহিলা জিনটি তখন সত্যি সত্যি ছুটে পালালো। একটুও দাঁড়ালো না। তবে জিনেরা সাপ হত্যার দায়ে হারব ইবনে উমাইয়ার উপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে, তার সঙ্গীরা জনমানবহীন সে অঞ্চলেই তাকে কবর দিয়ে আসে। এ প্রসঙ্গই জিনরা বলে বেড়াতঃ

وقبر حرب بمكان قفر - وليس قرب قبر حرب قبر

—“হারবের সমাধি জনমানবহীন এক মরুভূমিতে অবস্থিত। হারবের কবরের কাছে আর কোন কবর নেই।”

কেউ কেউ বলেন, উমাইয়া ইবনে আবুস সালত মাঝে-মধ্যে পশু-পাখিদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করত। চলার পথে কোন পাখির ডাক শুনতে পেলে সাথীদেরকে বলত, ‘দেখ এই পাখিটি এই এই বলছে।’ সাথীরা বলত, ‘হতে পারে; তবে আমরা এর সত্যাসত্য কিছুই বুঝতে পারছি না।’ একদিন সে একটি বকরীর পালের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। পালের একটি বকরী বাচ্চাসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই বকরীটি তার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দ করল, যেন বকরীটি দ্রুত পালের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য বাচ্চাকে উদ্বুদ্ধ করছে। শুনে উমাইয়া সাথীদেরকে বলল, ‘তোমরা কি বুঝতে পারছ যে, বকরীটি কী বলছে?’ তারা বলল, ‘না, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ উমাইয়া বলল, ‘বকরীটি তার বাচ্চাকে বলছে, তুমি আমাদের সঙ্গে দ্রুত দৌড়াও। অন্যথায় নেকড়ে এসে নির্ঘাত তেমকে খেয়ে ফেলবে, যেমনটি গত বছর তোমার ভাইকে খেয়ে ফেলেছিল।’

উমাইয়ার এ ব্যাখ্যা শুনে কাফেলার লোকেরা রাখালের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘গত বছর কি কোন নেকড়ে অমুক জায়গায় তোমার কোন ছাগল ছানাকে খেয়েছিল?’ রাখাল বলল, ‘হ্যাঁ।’

বর্ণনাকারী বলেন, আরেকদিন উমাইয়া একটি উট দেখতে পেল। উটের পিঠে সওয়ার ছিল এক মহিলা। উটটি মহিলার দিকে মাথা তুলে শব্দ করছিল। শুনে উমাইয়া বলল, ‘উটটি মহিলাকে বলছে যে, তুমি তো আমার পিঠে সওয়ার হয়েছ, কিন্তু তোমার হাওদায় একটি সুঁই আছে।’ ফলে উমাইয়ার সঙ্গীরা মহিলাকে উটের পিঠ থেকে নামিয়ে হাওদা খুলে দেখতে পেল, ঠিকই একটি সুঁই পড়ে আছে।

ইবনুস সাকীত বলেন, উমাইয়া ইবনে আবুস সালত একদিন পানি পান করছিল। ঠিক এ সময়ে একটি কাক এসে কা কা করে ডেকে উঠে। শুনে উমাইয়া বলল, ‘তোর মুখে মাটি পড়ুক’ কথাটি সে দু’বার বলল। জিজ্ঞাসা করা হল, ‘কেন, কাকটি কী বলছে?’ উমাইয়া বলল, ‘কাকটি বলছে, তুমি তোমার হাতের পেয়ালার পানিটুকু পান করা মাত্রই মারা যাবে।’ অতঃপর কাকটি আবারো কা কা করে উঠল। উমাইয়া বলল, ‘কাকটি বলছে যে, এর প্রমাণ হলো, আমি এই আবর্জনা স্তুপে নেমে সেখান থেকে কিছু খাব, আর গলায় হাড় আটকে যাবে। ফলে আমি মারা যাব।’ এই বলে কাকটি আবর্জনা স্তুপে নেমে কিছু একটা খেল এবং গলায় হাড্ডি আটকে সত্যি সত্যি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। ঘটনা দেখে উমাইয়া বলল, ‘কাকটি নিজের বেলায় যা বলেছে, তা তো সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এইবার দেখি, আমার ব্যাপারে যা বলেছে, তা সত্য কিনা।’ এই বলে সে হাতের পেয়ালার পানিটুকু খেয়ে ফেলে হেলান দিয়ে বসল আর সত্যি সত্যি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে,রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

إن أصدق كلمة قالها شاعر كلمة لبيد : ألا كل شيئ ماخلا الله باطل - وكاد أمية ابن أبي الصلت أن يسلم

“কবিদের উক্তিসমূহের মধ্যে লাবীদের একটি উক্তিই সর্বাধিক সঠিক। লাবীদ বলেছিল, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সবই মিথ্যা।” আর উমাইয়া ইবনে আবুস সালত মুসলমান হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, শারীদ বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পেছনে সওয়ার ছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি উমাইয়া ইবনে আবুস্ সালতের কোন কবিতা জানা আছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আছে।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘তা হলে তা আবৃত্তি কর।’ আমি একে একে অন্ততঃ একশটি পংক্তি তাঁকে আবৃত্তি করে শুনালাম। অবশেষে তিনি আর কিছু বললেন না, আমিও থেমে গেলাম। ইমাম মুসলিমেরও অনুরূপ একটি বর্ণনা রয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, উমাইয়ার কবিতা শুনে নবী করীম (সা) বলতেন, আসলে তো সে ইসলাম গ্রহণের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।

ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ বর্ণনা করেন যে, শারীদ হামদানী যার মাতুলগণ ছাকীফ গোত্রীয় তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে আমরা বিদায় হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি হেঁটে অগ্রসর হচ্ছি। হঠাৎ পেছনে উটের শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি রাসূলুল্লাহ্ (সা) আসছেন। তিনি বললেন, ‘কে, শারীদ?’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ, আমি শারীদ।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘আমি কি তোমাকে আমার উটের পিঠে তুলে নেব?’ আমি বললাম, ‘জ্বী হ্যাঁ, তবে ক্লান্তির দরুন নয়, বরং রাসূলুল্লাহর সহ-আরোহী হওয়ার সৌভাগ্য লাভের উদ্দেশ্যে।’ তখন নবী করীম (সা) উট থামিয়ে আমাকে তুলে নিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, তোমার কি উমাইয়া ইবনে আবুস সালতের কোন কবিতা জানা আছে?’ আমি বললাম, ‘জ্বী হ্যাঁ, আছে।’ তিনি বললেন, ‘তা হলে আবৃত্তি কর।’ শারীদ বলেন, ‘মনে হয় যেন আমি একশ’র মতো পংক্তি আবৃত্তি করে শোনালাম।’ শুনে তিনি বললেন, ‘উমাইয়া ইবনে আবুস্ সালত-এর বিষয়টা আল্লাহ-ই ভালো জানেন।’ রাবী বলেন, এই হাদীছটি ‘গরীব পর্যায়ের। আর যে বলা হয়ে থাকে— রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমাইয়া সম্পর্কে বলেছিলেন, তার কবিতা ঈমানদার কিন্তু অন্তর কাফির— এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। আল্লাহই ভালো জানেন।

ইমাম আহমদ (র) ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) উমাইয়ার কয়েকটি পংক্তির বক্তব্য যথার্থ বলে অভিহিত করেছেন। সেগুলো হলোঃ

زحل وثور تحت وجل يمينه- والنسر للأخرى وليث مرصد

الشمس تبدو كل أخر ليلة حمراء يصبح لونها يتورد

تابي فما تطلع لنا في رسالها إلا معذبة وإلا تجلد

অর্থাৎ তার ডান পায়ের নীচে আছে শনি গ্রহ ও বৃষরাশি আর অপর পায়ের নীচে আছে একটি ঈগল ও ওঁত পেতে থাকা সিংহ।

প্রতি রাতে সূর্য রক্তিম বর্ণ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ক্রমশ লাল হতে থাকে রং। সূর্য উদিত হতে অস্বীকৃতি জানায়। তাকে বাধ্য করে উদিত করাতে হয়। উমাইয়ার এই পংক্তি ক’টি শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, উমাইয়া যথার্থই বলেছে।

আবু বকর হুযালীর বর্ণনায় ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ সত্তর হাজার ফেরেশতা উদ্বুদ্ধ না করা পর্যন্ত সূর্য উদিত হয় না। ফেরেশতারা সূর্যকে বলেন, “উদিত হও, উদিত হও!” সূর্য বলে, ‘এমন জাতির জন্য আমি উদিত হব না, যারা আল্লাহকে ছেড়ে আমার ইবাদত করে।’ অবশেষে উদয় হওয়ার উপক্রম হলে শয়তান এসে সূর্যকে উদয় হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সূর্য শয়তানের শিংয়ের মধ্য দিয়ে উদিত হয়ে যায় এবং শয়তানকে পুড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার সময় যখন সূর্যের অস্ত যাওয়ার সময় হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অস্ত যেতে তা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, শয়তান আবার এসে সূর্যকে সিজদা দান হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে। ফলে সূর্য শয়তানের শিংদ্বয়ের মধ্যখান দিয়ে অস্ত যায় এবং শয়তানকে পুড়িয়ে দেয়। ইবন আসাকির এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সম্পর্কে উমাইয়া ইবনে আবুস্ সালতের দু’টি পংক্তি নিম্নরূপঃ

فمن حامل إحدى قوائم عرشه ولو لا إله الخلق كلو وأبلدوا

قيام على الأقدام عالون تحته فرائصهم من شدة الخوف ترعد

অর্থাৎ তারা আল্লাহর আরশের খুঁটি ধারণ করে আছেন। সৃষ্টির কোন মা’বুদ না থাকলে তাঁরা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়তেন। আরশের নীচে তাঁরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। ভীতির আতিশয্যে তাদের পার্শ্বদেশ ও কাঁধের মধ্যস্থল থরথর করে কাঁপে। এটি ইবন আসাকিরের বর্ণনা। আসমায়ী সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি উমাইয়ার নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করতেনঃ

مجدوا الله فهو المجد أهل ربنا في السماء امسي كبيرا

بالبناء الأعلى الذي سبق الن اس وسوي فوق السماء سريرا

شرجعا يناله بصر العي نتری دونه الملائك صورا

অর্থাৎ আল্লাহর মাহাত্ম্য বর্ণনা কর, তিনিই তো সাহায্যের অধিকারী। সুউচ্চ আকাশে মহান আমাদের প্রভু, মানুষের বহু ঊর্ধ্বে আকাশে তাঁর আসনে রয়েছেন। চোখে দৃশ্যমান তাঁর আরশ নতশিরে যা ফেরেশতারা বহন করছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআ’ন তায়মীর প্রশংসামূলক উমাইয়া ইবনে আবুস সালত-এর কয়েকটি পংক্তিঃ

أأذكر حاجني أم قد كفاتی حياءك إن شمتك الحياء

وعلمك بالحقوق وأنت فرع لك الحسب المهذب والسناء

كريم لا يغيره صباح عن الخلق الجميل ولا مساء

يبارئ الريح مكرمه جودا إذا ما الكلب أحجره الشتاء

و أرضك أرض سكرمة بنتها بنوتیم وانت لها سماء

اذا أثنى عليك المرء يوما گفاه من تعرضه الثناء

অর্থাৎ আমি কি আমার প্রয়োজনের কথা উত্থাপন করব, নাকি আপনার নাজুকতাই আমার জন্য যথেষ্ট? নিশ্চয় নাজুকতাই আপনার বৈশিষ্ট্য।

সকলের অধিকার সম্পর্কে আপনি সম্যক অবহিত। আপনি সম্ভ্রান্ত, কুলীন, ভদ্র ও সৌন্দর্যের আধার।

আপনি এমন-ই সম্ভ্রান্ত যে, সকাল বা সন্ধ্যা যার সুন্দর চরিত্রের মাঝে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না।

আপনি এমন এক ব্যক্তি, যে উদারতা ও বদান্যতায় তখনো বাতাসের সাথে প্রতিযোগিতা করেন, যখন শৈত্য প্রবাহ কুকুরকে পর্যন্ত ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। আপনার বাসভূমি হল দানশীলতার ভূমি, যা প্রতিষ্ঠা করেছে বনূ তায়ীম। আপনি হলেন তার আকাশ। আপনি কারো প্রশংসার মুখাপেক্ষী নন। আপনি স্বনাম ধন্য।

আব্দুল্লাহ ইবন জাদআ’ন তায়মীর প্রশংসামূলক উমাইয়া ইবনে আবুস সালত-এর আরো কতগুলো কবিতা আছে। এই আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআ’ন একজন সম্ভ্রান্ত ও দানশীল ব্যক্তিরূপে বিখ্যাত ছিলেন। তার একটি ডেগ ছিল, যা সব সময় মধু ও ঘি মাখা রুটিতে পরিপূর্ণ থাকত। তা সকলের জন্য ছিল উম্মুক্ত। যে কোন আরোহী বাহনের উপর থেকেই তা থেকে আহার করতে পারত। তিনি গোলাম আযাদ করতেন। বিপদগ্রস্ত মানুষের সহায়তা করতেন। হযরত আয়েশা (রা) একদিন নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জাদআনের এসব মহৎ কর্ম কি তার কোন উপকারে আসবে?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘জীবনে একদিনও সে একথা বলেনি যে, হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন তুমি আমার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিও।’

পাদ্রী বাহীরাঃ

যে মনীষী পূর্বাহ্নেই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যে নবী হওয়ার লক্ষণ ধরতে পেরেছিলেন, তিনি হচ্ছেন পাদ্রী বাহীরা। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন মক্কার বনিক কাফেলাসহ চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়া যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স তখন বার বছর। বাহীরা একটি মেঘখণ্ডকে সকলের মধ্যে শুধু তাঁকেই ছায়া দিতে লক্ষ্য করেন। তখন তিনি তাদের জন্য আহার্য প্রস্তুত করে কাফেলার সকলকে দাওয়াত করেন। সীরাত অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। ইমাম তিরমিযী এ বিষয়ে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যথাস্থানে আমরা তার উপর বিশদ আলোচনা করেছি। হাফিজ ইবনে আসাকির বাহীরার জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে উক্ত হাদীসের সমর্থনে বেশ ক’টি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম তিরমিযী বর্ণিত হাদীছটি উদ্ধৃত করেননি। এটি আশ্বর্যজনক ব্যাপার বৈকি?

ইবনে আসাকির লিখেছেন যে, বাহীরা কুফর নামে পরিচিত একটি গ্রামে বাস করতেন। সে গ্রাম থেকে বুসরার দূরত্ব ছিল ছয় মাইল। এটাই বাহীরার গীর্জা ( دير بحيرا ) নামে বিখ্যাত। কারো কারো মতে, বাহীরা যে গ্রামে বাস করতেন তার নাম মানফাআ। যায়রার অপর দিকে বালকা নামক স্থানে এটি অবস্থিত। আল্লাহই সম্যক অবগত।

কাস্ ইবনে সাঈদা আল-ইয়াদী

হাফিজ আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে সাহল খারায়েতী তাঁর ‘হাওয়াতিফুল জান’ গ্রন্থে উবাদা ইবনে সামিত (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, ইয়াদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাস্ ইবনে সাঈদ ইয়াদীর খবর কি?’ তারা বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! তিনি তো মারা গেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “উকাজের মেলায় একদিন আমি তাকে দেখেছিলাম। একটি লাল উটের পিঠে বসে তখন তিনি কিছু চমৎকার কথা বলছিলেন, এখন আমার তা স্মরণ নেই।’ এমন সময় ঐ দলের পেছন থেকে জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার তা মনে আছে, হে আল্লাহর রাসূল!’ বর্ণনাকারী বলেন,এ কথা শুনে নবী করীম (সা) আনন্দিত হন। বেদুঈনটি বলল, ‘কাস্ ইবনে সাঈদা আল-ইয়াদী উকাজ মেলায় সেদিন একটি লাল উটের পিঠে বসে বলছিলেনঃ

يا معشر الناس إجتمعوا فكل من فات فات وكل شيئ أت أت۔ ليل داج وسماء ذات أبراج وبحر عجاج نجوم تزهر وجبال مرسية وأنهار مجرية إن في السماء لخبرا وإن في الأرض لعبرا مالى أری الناس يذهبون فلا يرجعون أرضوا بالاقامة فأقاموا ام تركوا فناموا أقسم قسم بالله قسما لأريب فيه إن لله دينا هو أرض من دينكم هذا

অর্থাৎ, হে লোক সকল! তোমরা সমবেত হও। শুনে রেখ, যারা গত হওয়ার তারা গত হয়ে গেছে। যা আগমন করার, তা অবশ্যই আসবে। অন্ধকার রাত, কক্ষবিশিষ্ট আকাশ, বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, উজ্জ্বল তারকারাজি, সুদৃঢ় পর্বত ও প্রবহমান নদ-নদী! আকাশে সংবাদ আছে, আর পৃথিবীতে আছে, উপদেশ গ্রহণের উপকরণ। ব্যাপার কি, মানুষ কেবল চলেই যাচ্ছে, ফিরে তো আর আসছে না। ওখানে রয়ে যাওয়াই কি তাদের পছন্দ, নাকি তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। কাস্ আল্লাহর নামে শপথ করে বলছে যে, আল্লাহর দেওয়া একটি দীন আছে, যা তোমাদের দীন অপেক্ষা অধিকতর পছন্দনীয়। তারপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করলেন।

في الذاهبين الأولي من القرون لنا بصائر

لما رأيت مواردا للموت ليس لها مصادر

ورأيت قومی نحوها يمضئ الأصاغر والأكابر

لا من مضى يأتي إلب بك ولا من الباقين غابر

وأيقنت أني لا محا لة حيث صار القوم صائر

—যারা আমাদের আগে অতীত হয়েছেন, তাদের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ আমি দেখালাম যে, মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কারোরই কোন উপায় নেই। আরো দেখালাম যে, আমার সম্প্রদায়েরও গত হয়ে যাচ্ছে-ছোট-বড় সকলে।

যারা গত হয়ে গেছে, তারা তোমার নিকট ফিরে আসার নয়। আর যারা বেঁচে আছে। তারাও আজীবন বেঁচে থাকবার নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আরো দশজন লোকের ন্যায় আমিও একদিন চলে যাব। বর্ণনাটির সনদ ‘গরীব’ পর্যায়ের।

তাবারানী তার মু’জামে কাবীর’ গ্রন্থে ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, আব্দুল কায়স গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তোমাদের কেউ কি কাস্ ইবনে সায়িদ আল-ইয়াদীকে চেনে?” তারা বলল, ‘আমরা তো সকলেই তাঁকে চিনি, হে আল্লাহর রাসূল!’ নবী করীম (সা) বললেন, “তার খবর কী?” তারা বলল, ‘তিনি তো মারা গেছেন।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘আমার মনে আছে যে, এক মুহাররম মাসে উকাজের মেলায় একটি লাল উটের পিঠে বসে তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেনঃ

“লোক সকল! তোমরা সমবেত হও, কান দিয়ে শ্রবণ কর ও স্মরণ রাখ। যে জীবন লাভ করেছে, সে মরবেই। যে মরবে সে গত হয়ে যাবে। যা কিছু আগমন করার, তা অবশ্য আসবে। আকাশে গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে, যমীনে আছে শিক্ষা গ্রহণের উপকরণ। শয্যা প্রস্তুত, ছাদ সুউচ্চ, নক্ষত্ররাজি আবর্তনশীল, সমুদ্রের পাখি সম্ভার অফুরন্ত। কাস্ সত্য-সত্য শপথ করে বলছে, এখন যাতে সন্তোষ আছে, পরে অবশ্যই তাতে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। আল্লাহর এমন একটি দীন আছে, যা তাঁর নিকট তোমাদের দীন অপেক্ষা অধিকতর প্রিয়। ব্যাপার কি, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ চলেই যাচ্ছে, আর ফিরে আসছে না! তবে কি তারা ওখানে রয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছে? নাকি তারা ঘুমিয়ে পড়েছে?”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তাঁর কবিতা উদ্ধৃত করতে পারবে? জবাবে একজন পূর্বোক্ত পংক্তি আবৃত্তি করেঃ

في الذاهبين الأولي ين من القرون لنا بصائر

لما رأيت مواردا للموت ليس لها مصادر

رأيت قومي نحوها يسعى الأصاغر والأكابر

لا يرجع الماضي يأتي إلى ولا من الباقين غابر

وأيقنت انی لا محا له حيث صار القوم صائر

—অতীতে গত হওয়া লোকদের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমি দেখতে পেলাম যে, মৃত্যুর মুখে একবার যে পতিত হয়, তার আর সেখান থেকে ফিরে আসার উপায় থাকে না। আরো দেখলাম যে, আমার সম্প্রদায়ের ছোট-বড় সকলেই মৃত্যুর পানে ধাবিত হচ্ছে। যারা অতীত হয়ে গেছে, আমার কাছে তারা আর ফিরে আসবে না। হাফিজ বায়হাকী তাঁর কিতাব ‘দালাইলু নুবুওত’ গ্রন্থে মুহাম্মদ ইবন হাসান সুলামী থেকে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন।

আলী ইবনে হুসাইন... ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, বকর ইবনে ওয়ায়েল গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মিত্র কাস্ ইবনে সায়িদা আল-ইয়াদীর খবর কি? এভাবে ইবনে আব্বাস (রা) ঘটনাটি আনুপুর্বিক বর্ণনা করেন।

আহমদ ইবনে আবু তালিব হাসান ইবনে আবুল হাসান বসরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হাসান ইবনে আবুল হাসান বলেন, জারূদ ইবনে মুআল্লা ইবনে হানাশ ইবনে মুআলা আল-আবদী নামক একজন খৃষ্টান ব্যক্তি ছিলেন। আসমানী কিতাব সমূহের ব্যাখ্যায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি দর্শন, চিকিৎসা ও আরবী সাহিত্যে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সুদর্শন ও বিত্তবান। একদিন তিনি আব্দুল কায়সের বিচক্ষণ ও বাকপটু কয়েকজন লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করেন। এসে নবীজির সামনে বসে নবীজিকে উদ্দেশ করে আবৃত্তি শুরু করেনঃ

یا نبي الهدى أننك رجال قطعت فدفدا والا فالا

وطوت نحوك المحاصح تهوى لا نعد الكلال فيك كلالا

كلف بهماء فطر الطرف عنها آر قلقها قلاصنا أرقالا

وطوتها العناق يجمع فيها بگماة كأنجم قتلالا

تبتغي دفع باسم يوم عظيم هائل أوجع القلوب وهالا

ومزادا لمحشر الخلق طرا وفراقا لمن تمالادی ضلالا

نحونور من الإله وبرها ن وبر ونعمة أن تنالا

خصك الله يا ابن أمنة الخ يربها إذا أتت سجالا سجالا

فاجعل اليظ منك يا حجة الا هجزيلا لا حظ خلف أحالا

“হে হিদায়াতের নবী! আপনার নিকট কিছু লোক বিজন মরু প্রান্তর ও গোত্রের পর গোত্র অতিক্রম করে এসেছে। তারা বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি অতিক্রম করে এসেছে আপনার সাক্ষাতের আশায়। এতে তারা ক্লান্তিকে ক্লান্তি মনে করেনি।

প্রাণীকুল যে বিজন মরু ভুমি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমাদের উষ্ট্রগুলো সেসব অতিক্রম করে এসেছে। শক্তিশালী দুঃসাহসী অশ্বগুলো আরোহীদের নিয়ে উজ্জ্বল তারকার ন্যায় সে সব অতিক্রম করে এসেছে।

এমন ভয়াবহ ও কঠিন দিনের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রত্যাশায় যেদিন আতঙ্ক হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। সকল সৃষ্টিকে সমবেত করার দিনের পাথেয় প্রত্যাশায় আর ঐ ব্যক্তির ভয়ে যে গোমরাহীর মাঝে ঘুরপাক খেয়েছে। আমরা এসেছি আল্লাহর নূরের দিকে, প্রমাণ, পুণ্য ও নিয়ামতের দিকে, তা অর্জন করার আশায়।

হে আমেনার সন্তান! আল্লাহ আপনাকে এমন কল্যাণ দান করেছেন, যা আপনার নিকট একের পর এক আসতে থাকবে। হে আল্লাহর নিদর্শন! আপনার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে উপকৃত করুন,ঐ ব্যক্তিদের ন্যায় নয়, যারা পশ্চাতে রয়ে গেছে।”

শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে নিজের কাছে এনে বসালেন এবং বললেনঃ ‘হে জারূদ! তুমি এবং তোমার সম্প্রদায় আমার নিকট আসতে বিলম্ব করে ফেলেছ।’ জারূদ বললেন, ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোন! আপনার পথ ধরতে যে বিলম্ব করবে, সে হবে দুর্ভাগা। তার পরিণামও হবে মর্মন্তুদ! যারা আপনাকে দেখে, আপনার কথা শুনে আপনাকে ত্যাগ করে অন্য পথ ধরেছে, আমি তাদের দলে নই। আমি এতকাল যে ধর্মের অনুসরণ করতাম, তা ত্যাগ করে আপনার ধর্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছি। এতে কি আমার পূর্বের যাবতীয় পাপ মোচন হবে না? এতে কি আল্লাহ্ আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না?’ জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “তোমার সে সব দায়-দায়িত্ব আমার, তুমি এক্ষুণি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন এবং খৃষ্টধর্ম ত্যাগ কর।” জারূদ বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নাই। তিনি এক, অদ্বিতীয়। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।”

বর্ণনাকারী বলেন, এই বলে জারূদ মুসলমান হয়ে যান এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোকও ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এতে বেশ আনন্দিত হন এবং তাদেরকে সম্বর্ধিত করেন যাতে তারা যারপর নেই আনন্দিত হন।

তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে কাস্ ইবনে সায়িদা আল ইয়াদিকে চিনে। জারূদ বললেন, ‘আমার বাপ-মা আপনার জন্য কুরবান হোন! আমরা প্রত্যেকেই তাঁকে চিনি। আমি তো তাকে বেশ ভালো করেই জানি। তিনি আরবেরই একটি গোত্রের লোক ছিলেন। ছয়শত বছর আয়ু পেয়েছিলেন। এর মধ্যে পাঁচ প্রজন্মের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত ঈসা (আ)-এর ন্যায় বনে-জঙ্গলে অতিবাহিত করেন। এ সময় নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতেন না এবং তার দ্বারা কেউ উপকৃতও হতে পারত না। ময়লা কাপড় পরিধান করতেন। বৈরাগ্য অবলম্বনে তিনি কোন অশান্তি অনুভব করতেন না। বন্য প্রাণীদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করতেন। অন্ধকারে অবস্থান করা পছন্দ করতেন। গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। এ কারণে তিনি এক অনন্য ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর প্রজ্ঞা দ্বারা মানুষ উপমা পেশ করত এবং তার উসিলায় বিপদাপদ দূর হত।

তিনিই আরবের প্রথম ব্যক্তি, যিনি এক আল্লাহয় বিশ্বাস স্থাপন করেন। ঈমান আনেন, পুনরুত্থান ও হিসাব-কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন, জনগণকে অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং মৃত্যুর আগে আমল করে যাওয়ার আদেশ দেন। মৃত্যু সম্পর্কে উপদেশ দেন। এবং তাকদীরের প্রতি আত্মসমর্পণ করেন। কবর যিয়ারত করেন, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার কথা প্রচার করেন। কবিতা আবৃত্তি করেন, তাকদীর সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং আকাশের সংবাদ সম্পর্কে অবহিত হন। তিনিই সর্বপ্রথম সমুদ্র ও পানির বিশদ বিবরণ দেন, আরোহী অবস্থায় বক্তৃতা দেন, নসীহত করেন, বিপদাপদ ও আযাব-গজব থেকে সতর্ক করেন। কুফরী ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য উৎসাহ প্রদান করেন এবং এক আল্লাহর প্রতি আহ্বান করেন। উকাজের বাজারে একদিন তিনি বললেনঃ

পূর্ব ও পশ্চিম, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, শান্তি ও যুদ্ধ, শুষ্ক ও আর্দ্র, লোনা ও মিষ্ট, সূর্য ও চন্দ্র, বায়ু ও বৃষ্টি, রাত ও দিন, নারী ও পুরুষ, স্থল ও সমুদ্র, বীজ ও শস্য, পিতা ও মাতা, সমবেত ও বিক্ষিপ্ত, নিদর্শনের পর নিদর্শন, আলো ও অন্ধকার, স্বচ্ছতা ও সংকট, রব ও দেবতা, নিশ্চয় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।

নবজাতকের দৈহিক বৃদ্ধি, হারিয়ে যাওয়া, গোপন বস্তু, গরীব ও ধনী, সৎ ও অসৎ, অলসতায় বিভোর লোকদের জন্য ধ্বংস। আমলকারীরা অবশ্যই তাদের আমল ঠিক করে নিবে। আমল না করেই যারা বুকে আশা নিয়ে বসে আছে, তারা অবশ্যই নিরাশ হবে। মানুষ যা বিশ্বাস করে বসে আছে, ঘটনা আসলে তা নয় বরং আল্লাহ এক ও একক। তিনি কারো সন্তান নন, পিতাও নন। তিনি চিরঞ্জীব। মৃত্যু ও জীবন দান করেন। নর ও নারী তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি পরজগত ও ইহজগতের রব। শোন হে ইয়াদের সম্প্রদায়!

ছামুদ ও ‘আদ জাতি এখন কোথায়? কোথায় তোমাদের পূর্ব পুরুষগণ? কোথায় রোগী ও রোগী পরিদর্শনকারীরা? প্রত্যেকেই একদিন পুনরায় জীবিত হবে। কাস্ মানুষের রবের শপথ করে বলছে যে, এক একজন করে তোমরা প্রত্যেকে একদিন পুনরুজ্জিবিত হবে। ডাকাডাকি করার দিন, যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে ও পৃথিবী আলোকোজ্জ্বল হবে। সুতরাং ধ্বংস সেই ব্যক্তির, যে সুস্পষ্ট সত্য ও ঝলমলে আলোক হতে বিমুখ হয়েছে। মীমাংসার দিনে, ন্যায় বিচারের দিনে যখন মহা ক্ষমতাধর বিচার করবেন ও সতর্ককারীরা সাক্ষ্য প্রদান করবেন, সাহায্যকারীরা দূরে সরে যাবে ও পরস্পর সম্পর্কহীনতা প্রকাশ পাবে। অবশেষে একদল জান্নাতে আর একদল জাহান্নামে স্থান পাবে। তারপর তিনি কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন।’

বর্ণনাকারী বলেন, শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমারও মনে আছে যে, একদিন তিনি উকাজ বাজারে একটি লাল উটের পিঠের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিল। বলছিলেনঃ

“হে লোক সকল! তোমরা সমবেত হও, শ্রবণ কর। শুনে কথাগুলো মনে রেখ। পরে সেই অনুযায়ী কাজ করে নিজের উপকার সাধন করবে। আর সত্য কথা বলবে। যে লোক জীবন লাভ করল, সে মৃত্যুবরণ করবে। যে লোক জীবন লাভ করল, সে শেষ হয়ে গেল। যা আসবার তা এসে গেছে।”

বৃষ্টি ও শস্য, জীবিত ও মৃত, অন্ধকার রাত, কক্ষবিশিষ্ট আকাশ, উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, আলো ও অন্ধকার, রাত ও দিন, পুণ্য ও পাপ; নিশ্চয় আকাশে সংবাদ আছে। যমীনে আছে শিক্ষার উপকরণ। পাতানো বিছানা, উঁচু ছাদ, দীপ্ত নক্ষত্র, ঠাণ্ডা সমুদ্র ও পাল্লার ওজন। কাস্ আল্লাহর নামে সত্য কসম করে বলছে, যাতে মিথ্যার লেশ মাত্র নেই; সংসারে যদি সন্তুষ্টি বলতে কিছু থেকে থাকে তা হলে অসন্তষ্টিও আছে নিশ্চয়ই।

অতঃপর তিনি বললেন, লোক সকল! নিশ্চয় আল্লাহর দেয়া এমন একটি দীন আছে, যা তাঁর নিকট তোমাদের এই দীন, ধর্ম অপেক্ষা প্রিয়। সেই দীন আগমন করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

অতঃপর তিনি বললেন ব্যাপার কি, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ কেবল চলেই যাচ্ছে ফিরে কেউ আসছে না। ওরা কি ওখানে থেকে যাওয়াই মেনে নিয়েছে, নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) উপস্থিত সাহাবীদের প্রতি মুখ করে বললেন, ‘তোমাদের কে আমাকে কাস-এর কবিতা বর্ণনা করতে পারবে?’ আবু বকর (রা) বললেন, ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন, সেইদিন আমি ঘটনা স্থলে উপস্থিত ছিলাম। কাস্ তখন বলছিলেনঃ

في الذاهبين الأولى ين من أقرون لنا بصائر

لما رأيت مواردا للموت ليس لها مصادر

رأيت قومي نحوها يمضي الأصاغر والأكابر

لا جرجع لما ضى إلى ولا من الباقبن غابر

أيقنت انی لا محا له حيث صار القوم صائر

– যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের মধ্যে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের অনেক উপকরণ আছে। কারণ, আমি দেখতে পেয়েছি যে, একবার যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সেখান থেকে আর সে ফিরে আসে না। আর আমার সম্প্রদায়কেও দেখেছি যে, ছোট বড় নির্বিশেষে এক এক করে তারাও চলে যাচ্ছে। তাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, অন্য দশজনের মত আমিও একদিন চলে যাব।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আব্দুল কায়স সম্প্রদায়ের বড় মাথাওয়ালা দীর্ঘকায় এক প্রবীণ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোন। আমি কাস্ এর একটি বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘কী দেখেছ হে বনু আব্দুল কায়স-এর ভাই?’ সে বলল, ‘যৌবন কালে আমি বসন্তের চারণভূমি থেকে আমার এক অবাধ্য উটের সন্ধানে তার পিছু পিছু ছুটছিলাম, যা কাঁটাগুল ও ছোট ছোট টিলায় ও মনোরম উদ্ভিদে পরিপূর্ণ। সেখানে অসংখ্য উটপাখি ও সাদা বনগরু নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ছুটতে ছুটতে আমি একটি উঁচু ও সমতল ভূমিতে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে সবুজ-শ্যামল পিলু গাছের ছড়াছড়ি। সেগুলোর ডাল-পালা নুয়ে আছে। সেগুলোর ফল যেন গোলমরিচ। হঠাৎ সেখানে আমি পানি পড়া অবস্থায় একটি ঝর্ণা ও একটি সবুজ বাগান দেখতে পেলাম।

হঠাৎ দেখতে পেলাম, কাস্ ইবনে সায়িদা একটি গাছের নীচে বসে আছেন। তাঁর হাতে একটি লাঠি। আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং বললাম, ‘আপনার কল্যাণ হোক!’ তিনি বললেন, ‘আপনারও কল্যাণ হোক!’ তার সাথে আরো একজন লোক। পার্শ্বে একটি কুয়া। বিপুল সংখ্যক হিংস্র জন্তু সেই কুয়া থেকে পানি পান করছে এবং চলে যাচ্ছে। এগুলোর কোনটি যদি কূয়া থেকে অন্যাটিকে ডিঙ্গিয়ে পানি পান করতে চাইল। কাস্ তাকে এই বলে হাতের লাঠি দ্বারা আঘাত করতেন যে, ‘থাম, তোমার আগেরটি আগে পানি পান করে নিক, তুমি পরে পান করবে।’ এ দৃশ্য দেখে আমি অত্যন্ত ভীত হলাম। আমার প্রতি তাকিয়ে তিনি বললেন, “তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।" হঠাৎ দুইটি কবর দেখতে পেলাম। কবর দুইটির মাঝে একটি মসজিদ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এগুলো কাদের কবর?’ বললেন, ‘দুই ভাইয়ের। এই জায়গায় তারা আল্লাহর ইবাদত করত। আমি তাঁদের সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত এখানে অবস্থান করে আল্লাহর ইবাদাত করব।” আমি বললাম, ‘কেন নিজ সম্প্রদায়ের নিকট গিয়ে তাদের সৎকর্মে সহযোগিতা এবং অন্যায় কাজে বাধা দান করবেন না?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের অকল্যাণ হোক, তুমি কি জানো না যে, ইসমাঈলীদের বংশধর তাদের পিতার দীন- ধর্ম পরিত্যাগ করে অসংখ্য দেব-দেবীর পূজা শুরু করেছে? এই বলে তিনি কবর দু’টোর কাছে গিয়ে কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেনঃ

خلیلی هبا طاما قد رقدتما آجد كما لا تقضيان گراگما

أرى النوم بين الجلد والعظم منكما - كان الذي ليسقى العقار سقا كما

أمن طول نوم لا تجيببان داعيا كأن الذي يسقى العقار سقاكما

ألم تعلم أني بنجران مفردا وما لى فيه من حبيب سواكما

عقيم على قبرميما لست بارحا إياب الليالي او يجيب صدا گما

أأبكيما طول الحياة وما الذي يرد على ذي لوعة أن بكاگما

فلو جعلت نفس لنفس أمري فدى لجدت بنفسي أن تكون فداكما

كأنكما والموت أقرب غاية بروحى في قبريما قد أتاكما

– ওগো বন্ধুদ্বয়! তোমাদের নিদ্রা তো অনেক দীর্ঘ হলো। মনে হচ্ছে, তোমাদের এই নিদ্রা কখনো শেষ হবে না। তোমাদের চামড়া ও হাড্ডির মাঝের নিদ্রা দেখে আমার মনে হচ্ছে, খেজুর বীথিতে পানি সিঞ্চনকারীই তোমাদেরও পিপাসা নিবারণ করেছেন। দীর্ঘ নিদ্রার কারণেই কি তোমরা কোনো আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিচ্ছ না? তোমরা কি জান না যে, নাজরানে আমি একা তোমরা দু’জন ব্যতীত আমার কোন বন্ধু নেই? তোমাদের কবরের পার্শ্বেই এখন আমার অবস্থান। এখান থেকে সরবার আমার ইচ্ছা নেই। আমি কি জীবন ভরই তোমাদের জন্য ক্রন্দন করব? কেউ যদি কারো জন্য উৎসর্গিত হতে পারে, তা হলে আমি আমাকে তোমাদের জন্য উৎসর্গ করছি। আমার আত্মা যেন তোমাদের কবরে, তোমাদের কাছে চলেই গিয়েছে। মৃত্যু যেন আমার অতি নিকটে।’

বর্ণনাকারী বলেন, শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আল্লাহ তাকে রহম করুন। কিয়ামতের দিন একাই সে একটি উম্মতরূপে উত্থিত হবে।”

বর্ণনাটি একান্তই গরীব পর্যায়ের এবং এটি মুরসালও বটে, যদি না হাসান তা স্বয়ং জারূদ থেকে শুনে থাকেন। বায়হাকী এবং ইবনে আসাকিরও ভিন্ন এক সূত্রে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে এও আছে যে, যে লোকটির উট হারিয়ে গিয়েছিল, উটটি খুঁজতে খুঁজতে এক বিপদ সংকুল উপত্যকায় তার রাত হয়ে যায়। রাত গভীর হলো, চতুর্দিক গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল। লোকটি বলেন, ঠিক এমন সময় আমি শুনতে পেলাম, কে যেন বলছেঃ

پایها الراقد في الليل الاجم - قد بعث الله نبيا في الحرم

من هاشم أهل الوفاء والكرم - يجلو دجيات الدياجي والبهم

“ওহে আঁধার রাতে ঘুমন্ত ব্যক্তি! পবিত্র মক্কায় আল্লাহ মহান হাশেমী বংশ থেকে একজন নবী প্রেরণ করেছেন, যার উসিলায় দূর হয়ে যাচ্ছে সব বিকট অন্ধকার।”

লোকটি বলেন, শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে আমি কিছুই দেখতে পেলাম না এবং আর কোন সাড়া-শব্দও পেলাম না। ফলে আমি নিজেই আবৃত্তি করতে শুরু করলামঃ

يا أيها الهاتف في داجي الظلم أهلا وسهلا بك من طيف الم

بين هداك الله في لحن الكلم ماذا الذي تدعو اليه يغتنم

“ওহে সেই ব্যক্তি, যে ঘোর আঁধারে কথা বলছ, তোমায় স্বাগতম। আল্লাহ তোমাকে হিদায়াত দিন। তুমি পরিষ্কার করে বল, যার প্রতি তুমি আহ্বান করছ। তা’ জানালে সাদরে গৃহীত হবে।”

লোকটি বলেন, কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, আলো উদ্ভাসিত হয়েছে, মিথ্যার অবসান ঘটেছে, আল্লাহ মুহাম্মদকে প্রজ্ঞা সহ প্রেরণ করেছেন; যিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, মুকুট ও শিরস্ত্রাণধারী, উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, সুদর্শন ভ্রুযুগল ও আয়ত নেত্রের অধিকারী, লা-ইলাহা ইল্লাহল্লাহ’ যার সাক্ষ্য। তিনি হলেন মুহাম্মদ, সাদা-কালো, শহর প্রত্যন্ত এলাকার সকলের নিকট যাকে প্রেরণ করা হয়েছে।

অতঃপর সে কবিতা আবৃত্তি করলঃ

الحمد لله اليري - لم يخلق الخلق عبث

لم يخلينا يوما سدی من بعد عليي واكترث

ارسل فينا احمدا خير نبي قد بعث

لي عليه الله ما حج ته ركب وحث

—সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগত অযথা সৃষ্টি করেননি। যিনি ঈসা (আ)-এর পরে এক দিনের জন্যও আমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেননি। আমাদের মাঝে তিনি আহমাদকে প্রেরণ করেছেন, যিনি সকলের সেরা নবী। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত বর্ষণ করুক, যতদিন পর্যন্ত লোকজন তাঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে এবং অনুপ্রেরণা লাভ করবে।

এ প্রসঙ্গে কাস ইবনে সায়িদা নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন -

يانا اعي لموت و الملحود في جدث عليهم من بقايا قولهم خرق

دعهم فإن لهم يوما يصاح بهم فهم إذا انتهوا من نومهم أرقوا

حتى يعودوا بدال غير حالهم - خلقا جديدا كما من قبله خلقوا

منهم عراة و منهم في ثيابهم منها الجديد ومنها المنهج الخلق

—হে মৃত্যুর ঘোষণাকারী! সমাধিস্থ ব্যক্তি তো সমাধিতে বিদ্যমান। তাদের বিরুদ্ধে বর্ণিত অবশিষ্ট কথাগুলো সব মিথ্যা।

তাদের কথা ছেড়ে দাও। কারণ, একদিন তাদের জাগ্রত হওয়ার জন্য আহ্বান করা হবে। তখন তারা তাদের নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলে তাদের ঘুম উড়ে যাবে।

তখন তারা অন্য অবস্থায় ফিরে যাবে। যেমনিভাবে তাদের পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তেমনিভাবে তাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা হবে।

তাদের কেউ হবে বিবস্ত্র। কেউ থাকবে বস্ত্রাবৃত। কিছু বস্ত্র হবে নতুন আর কিছু হবে পুরাতন ও জীর্ণ।

বায়হাকী ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এবং তাতে উক্ত পংক্তির কথাও উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, লোকেরা তার শিয়রে একটি লিপি পেয়েছিল। তাতে ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ উক্ত পংক্তিগুলোই লিখিত ছিল।

শুনে রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, কাস অবশ্যই পুনরুত্থানে বিশ্বাসী ছিলেন।’ বর্ণনার মূল বক্তব্য প্রসিদ্ধ। তবে সনদগুলো দুর্বল হলেও মূল ঘটনা প্রমাণে সহায়ক।

বায়হাকী (র) বর্ণনা করেন যে, হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, ইয়াদের একটি প্রতিনিধিদল নবী কারীম (সা)-এর নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাস ইবনে সায়িদার খবর কী?’ তারা বলল, ‘সে তো মারা গিয়েছে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তার মুখ নিঃসৃত কয়েকটি কথা শুনেছিলাম, যা এ মুহূর্তে আমি মনে করতে পারছি না।’ শুনে উপস্থিত এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মনে আছে।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘তা হলে তা’ শুনাও তো!’ লোকটি বলল, ‘আমি উকাজের বাজারে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময়ে কাস ইবন সায়িদা বলল, ওহে লোক সকল! কান পেতে শোন ও মনে রাখ, যে জীবন লাভ করে, সে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। আর যে মৃত্যবরণ করেছে, সে শেষ হয়ে গেছে। যা কিছু আসবার, তা এসে গেছে। আঁধার রাত। কক্ষ বিশিষ্ট আকাশ। উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিক্ষুব্ধ সমুদ্র। সুদৃঢ় পর্বত। প্রবহমান নদী। নিশ্চয় আকাশে খবর আছে। পৃথিবীতে আছে শিক্ষা গ্রহণের উপকরণ। আমি দেখছি যে, মানুষ মরে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে না। তাহলে কি মানুষ ওখানেই থেকে যাওয়া মেনে নিয়েছে, নাকি সব ত্যাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছে? কাস্ আল্লাহর শপথ করে বলছে, সত্য শপথ, নিশ্চয় আল্লাহর একটি দীন আছে যা তোমাদের রীতি-নীতির চেয়ে বহু উত্তম। অতঃপর সে কবিতা আবৃত্তি করলঃ

في الذاهبين اؤل - ين من القرون لنا بصائر الخ

—বিগত লোকদের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে? আমাকে একদিন চলে যেতে হবে।

৮০
যায়দ ইবনে আমর ইব্‌ন নুফায়ল (রা)
পূর্ণ পরিচয় যায়দ ইবন আমর ইবনে নুফায়ল ইবন আব্দুল উযযা ইবনে রিবাহ ইবনে কারয ইবনে রিযাহ্ ইবন আদী ইবন কা’ব ইবনে লুওয়াই আল-কুরশী আল- আদাবী। উমর (রা)-এর পিতা খাত্তাব ছিল তার চাচা ও বৈপিত্রিয় ভাই। কারণ পিতার মৃত্যুর পর আমর ইবনে নুফায়ল তার বিমাতাকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁরই গর্ভে ইতিপূর্বে পিতা নুফায়লের ঔরসে তাঁর ভাই খাত্তাবের জন্ম হয়েছিল। যুবায়র ইবন বাক্কার ও মুহাম্মদ ইবন ইসহাক এরূপ বলেছেনঃ

যায়দ ইবনে আমর শুরু জীবনেই মূর্তিপূজা ত্যাগ ও পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। এক আল্লাহর নাম নিয়ে যবাহ করা পশু ব্যতীত কোনো পশু তিনি খেতেন না। আসমা বিনতে আবু বকর বলেন, আমি একদিন যায়দ ইবনে আমরকে কা’বার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় বলতে শুনেছি যে, হে কুরাইশ গোত্র! যার হাতে যায়েদের জীবন, আমি তার শপথ করে বলছি, বর্তমানে আমি ব্যতীত তোমাদের আর কেউ ইবরাহীমের দীনের উপর বহাল নেই। অতঃপর তিনি বলেন, হে আল্লাহ। তোমাকে পাওয়ার এর চেয়ে উত্তম পন্থা আছে বলে যদি আমি জানতাম, তবে তা-ই করতাম। কিন্তু অন্য কোনো পন্থা আমার জানা নেই। এরূপ বলে তিনি বাহনের উপরই সিজদায় চলে যেতেন। অন্য বর্ণনায় আছে যে, তিনি কাবার দিকে মুখ করে নামায পড়তেন এবং বলতেন, ইবরাহীমের যিনি ইলাহ, তিনিই আমার ইলাহ। ইবরাহীমের দীন যা, আমার দীনও তা-ই। জীবন্ত কবর দেয়া মেয়েদের তিনি তাদের জীবন বাঁচাতেন। কেউ নিজের কন্যা সন্তানকে হত্যা করতে চাইলে তিনি বলতেন, খুন না করে একে তুমি আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি একে লালন-পালন করব। বড় হলে ইচ্ছা করলে তুমি একে নিয়েও নিতে পারবে আবার আমার কাছেই রেখেও দিতে পারবে। নাসাঈ এ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন।

লাইছ হিশাম ইবনে উরওয়া সূত্রে এবং ইউনুস ইবনে বুকায়র মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, কুরাইশের তাওহীদবাদী বেশ কয়েকজন ছিলেন তারা হচ্ছেনঃ যায়দ ইবনে আমর ইবন নুফায়ল, ওয়ারাকা ইবনে নওফল ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল ওযযা,উছমান ইবন হুয়ায়রিছ ইবনে আসাদ ইবন আব্দুল ওযযা ও আব্দুল্লাহ্ ইবন জাহাশ, আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা উমাইয়া ছিলেন তার মা। উম্মুল মুমিনীন যয়নাব বিনতে জাহশ হলেন তার বোন।

একদা মক্কার কুরাইশরা তাদের একটি প্রতিমার নিকট সমবেত হয়। যে কোন উৎসবে তারা ঐ প্রতিমার কাছে পশু বলি দিত। এক পর্যায়ে তাদের কেউ কেউ বলাবলি করতে শুরু করে যে, ‘তোমরা পরস্পর সত্য কথা বলবে। মনের কথা গোপন রাখবে না।’ একজন বলল, ‘তোমরা তো অবশ্যই জান যে, তোমাদের জাতি সত্য পথে নেই। সরল-সঠিক দীনে ইবরাহীম ভুলে গিয়ে এখন তারা প্রতিমা পূজা করছে। মূর্তিপূজা করার কী যুক্তি আছে? ওরা তো কারো উপকার-অপকার কিছুই করতে পারে না। অতএব, তোমরা সঠিক পথের সন্ধান কর। ফলে তারা সঠিক পথের সন্ধানে বের হলো। ইহুদী, নাসারা এবং অন্যান্য ধর্মের পণ্ডিতদের শরণাপন্ন হলো। সেকালে ইব্রাহীমী দীন হানীফিয়া। ওয়ারাকা ইবন নওফল মনে-প্রাণে খৃষ্টান হয়ে যান এবং প্রধান খৃষ্টানদের নিকট থেকে ধর্মীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন।

এঁদের মধ্যে যিনি হানীফিয়তের নীতিতে অটল থাকলেন, তিনি হলেন যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল। প্রতিমা পূজা ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম সবকিছু হতে তিনি নিজেকে মুক্ত রেখে দীনে ইবরাহীমের উপর অটল থাকেন এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করলেন। নিজ সম্প্রদায়ের যবাই করা পশুও তিনি আহার করতেন না। এ কারণে সমাজের মানুষ তাঁকে একঘরে করে রেখেছিল।

বর্ণনাকারী বলেন, খাত্তাব যায়দ ইবন আমর-এর উপর সীমাহীন নির্যাতন চালায়। খাত্তাবের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে তিনি লোকালয় ত্যাগ করে মক্কার উঁচু অঞ্চলের দিকে চলে যান। খাত্তাব এলাকার বখাটে যুবকদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দেয় এবং বলে দেয়, ও যেন এলাকায় আর ঢুকতে না পারে। ফলে তিনি একান্ত গোপনে ব্যতীত এলাকায় ঢুকতেন না। একদিন অতি গোপনে এলাকায় প্রবেশ করলে লোকেরা টের পেয়ে যায় এবং পাছে এলাকার লোকদের উপর কোন প্রভাব ফেলে বসে এই ভয়ে নির্যাতন করে তাঁকে এলাকা থেকে বের করে দয়।

মূসা ইব্‌ন উকবা বলেন, আমি বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি যে, যায়দ ইবন আমর নুফায়ল কুরাইশদের যবাই করা পশুর সমালোচনা করে বলতেন, বকরী আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এদের জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং মাটি থেকে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তোমরা এদেরকে কেন যবাই করো?

ইউনুস (র) ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, দীনে ইবরাহীমের সন্ধানে যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল একদিন মক্কা থেকে বেরোতে মনস্থ করেন। তার স্ত্রী আফিয়্যা বিনতে হারামীর অভ্যাস ছিল যে, তার স্বামী যায় কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে সে খাত্তাব ইবন নুফায়লকে তা বলে দিত। যায়দ সিরিয়া গিয়ে আহলে কিতাবদের মধ্যে দীনে ইবরাহীম সন্ধান করতে শুরু করলেন। সুসেল জাযীরা সব চষে ফিরে এবার সিরিয়ার বালকা নামক স্থানের একটি গীর্জার এমন এক যাজকের কাছে আসলেন, যিনি খৃষ্টীয় মতবাদে শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতরূপে প্রসিদ্ধ ছিলেন। যায়দ তাঁকে দীনে ইবরাহীম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তুমি এমন একটি দীন সম্পর্কে জানতে চেয়েছ, যার সন্ধান দেওয়ার মত কাউকে তুমি পাবে না। যারা এর সন্ধান দিতে পারত, তারা সকলেই এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তবে একজন নবীর আগমনে আসন্ন। এটাই তার যুগ। ইতিমধ্যেই যায়দ ইহুদী এবং খৃষ্ট ধর্মকে যাচাই করে অপছন্দ করেছিলেন। পাদ্রীর এসব কথা শুনে তিনি দ্রুত সেখানে থেকে বের হয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। লাখমীদের এলাকায় পৌঁছার পর দুবৃত্তরা তাঁর উপর চড়াও হয় এবং তাকে হত্যা করে।

ওয়ারাকা ইবন নওফল তাঁর শোকগাঁথায় বলেছিলেনঃ

رشدت وانعمت ابن عمرو وانما- تجت تنورا من النار حاميا

بدينك ربا ليس رب گمشليه وتركك أواثان الطواغي كماهيا

وقد تدرك الإنسان رحمة ربه ولوكان تحت الأرض سنين وادیا

—হে ইবন আমর! তুমি সুপথ পেয়েছ ও কল্যাণ প্রাপ্ত হয়েছ। আর এক অনুপম রবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও প্রতিমা পূজা বর্জন করার ফলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করেছ, বছরের পর বছর মাটির নীচে অবস্থান করলেও আল্লাহর রহমত মানুষের কাছে পৌঁছবেই।

মুহাম্মদ ইবন উসমান ইবন আবু শায়বা বর্ণনা করেন যে, যায়েদ ইবন আমর ইবন নুফায়ল জাহিলী যুগে সত্য দীন অনুসন্ধান করে বেড়াতেন। একদা এক ইহুদীর নিকট গিয়ে বললেন, ‘আমাকে তোমার ধর্মে দীক্ষা দান কর!’ ইহুদীটি বলল, ‘আমি তোমাকে আমার ধর্মে দীক্ষিত করবো না, কেননা তাতে তুমি আল্লাহর রোষে পতিত হবে।’ একথা শুনে তিনি বললেন, ‘তা হলে আমি আল্লাহর রোষ থেকে পালাই।’ অতঃপর তিনি এক খৃষ্টানের নিকট গিয়ে বললেন, ‘আমি চাই যে, আমাকে তুমি তোমার ধর্মে দীক্ষিত কর।’ খৃষ্টান বলল, ‘না, আমি তাতে রাজি নই। কেননা তাতে তুমি ভ্রান্তির শিকারে পরিণত হবে।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘তা হলে ভ্রান্তি থেকে পালাই।’ এবার খৃষ্টান লোকটি তাকে বলল, ‘তবে আমি তোমাকে এমন একটি দীনের সন্ধান দিতে পারি, তুমি তার অনুসরণ করলে হিদায়াত পেয়ে যাবে।’ যায়দ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন সে দীন?’ খৃষ্টান বলল, ‘তাহলো ইবরাহীমের দীন।’ বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে যায়দ বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি ইবরাহীমের দীনের অনুসারী। এ নিয়ে আমার জীবন এবং এ নিয়েই আমার মরণ।’ বর্ণনাকারী বলেন, যায়দের এসব ঘটনা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ “যায়দ ইবন আমর কিয়ামতের দিন একাই একটি উম্মতের মর্যাদা পাবে।”

মুসা ইবন উকবা (র) ইবন উমর (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

মুহাম্মদ ইব্‌ন সা’দ (র) আব্দুর রহমান (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল বলেছেন, আমি ইহুদী খৃষ্টান উভয় ধর্মকে যাচাই করে দেখেছি একটিও আমার মনঃপূত হয়নি। অতঃপর সিরিয়া গিয়ে সেখানকার এক গীর্জার পাদ্রীর সঙ্গে দেখা করলাম এবং আমার সমাজ ত্যাগ করে আসা, মূর্তিপূজা, ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের প্রতি অনীহার কথা জানালাম। আমার সব বৃত্তান্ত শুনে পাদ্রী বললেন, ‘তুমি তো দেখছি, ইবরাহীমের দীন অনুসন্ধান করছ হে মক্কার ভাই! তুমি এমন একটি দীনের সন্ধান করছ বর্তমানে যার অনুসরণ করার মত একজন মানুষও পাওয়া যাবে না। তা হলো তোমার পিতা ইবরাহীমের দীন। তিনি সরল সঠিক পথের অনুসারী ছিলেন। ইহুদী বা খৃষ্টান ছিলেন না। তিনি নামায পড়তেন এবং তোমার শহরে অবস্থিত সেই ঘরটির প্রতি মুখ করে সিজদা করতেন। তুমি তোমার শহরে চলে যাও, ওখানেই অবস্থান কর। আল্লাহ তোমার দেশে তোমার সম্প্রদায় থেকে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি সরল সঠিক দীনে ইবরাহীম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। আল্লাহর নিকট তিনি হবেন সৃষ্টির সেরা মানুষ।’

ইউনুস ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল এর বংশের জনৈক ব্যক্তি বলেছেন যে, ‘যায়দ ইবন আমর যখনই কাবায় প্রবশ করতেন, তখন বলতেন, আমি হাজির, আমি সত্যের অনুসারী, আমি এক আল্লাহর দাসত্বে বিশ্বাসী। আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেমন আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন ইবরাহীম (আ) এই স্থানে প্রার্থনা করেছিলেন। হে আল্লাহ! আমার নাক তোমার জন্য ধূলামলিন হোক, তুমি আমাকে যখন যেমন বোঝা বহন করতে বলবে, আমি তা-ই বহন করব। পুণ্যই আমি কামনা করি।’

আবু দাউদ তায়ালিসী (র) সাঈদ ইব্‌ন যায়দ ইবন আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবন আমর এবং ওরাকা ইবন নওফল দীনের সন্ধানে বের হন। মওসেল নামক স্থানে জনৈক পাত্রীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাত হয়। পাদ্রী যায়দ ইবন আমরকে জিজ্ঞেস করল, ‘হে উষ্ট্রারোহী! তুমি কোথা থেকে এসেছ?’ যায়দ বললেন, ‘আমি ইবরাহীম (আ)-এর এলাকা থেকে এসেছি।’ পাদ্রী বলল, ‘তা এখানে এসেছ কিসের সন্ধানে।’ যায়দ বললেন, ‘এসেছি দীনের সন্ধানে।’ পাদ্রীটি বলল, ‘তা হলে তুমি ফিরে যাও! তুমি যে দীনের সন্ধান করছ, তা তোমার অঞ্চলে আত্মপ্রকাশ করার সম্ভাবনাই বেশী।’ অবশেষে খৃষ্টান হতে চাইলে তিনি আমাকে বারণ করেন। তখন যায়দ ( لبيك حقا حقا ) বলতে বলতে ফিরে আসেন।

বর্ণনাকারী বলেন, যায়দের পুত্র সাঈদ, যিনি জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের একজন লোক ছিলেন, তা তো আপনি দেখেছেন ও শুনেছেন। তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন! রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘হ্যাঁ, করব। তিনি তো কিয়ামতের দিন একা একটি উম্মতরূপে উত্থিত হবেন।’

একদিন যায়দ ইবন আমর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন যায়দ ইবন হারিছাকে সঙ্গে নিয়ে একটি খাঞ্চা থেকে আহার করছিলেন। যায়দ ইবন আমরকে খেতে আহ্বান করা হলে তিনি বললেন, ‘ভাতিজা! আমি দেবতার নামে বলি দেওয়া পশু খাই না।” [সম্ভবত রসূলুল্লাহ (সা)-যে দেবতার নামে যবাইকৃত পশু গোশত আহার করতেন না, তা তার জানা ছিল না]

মুহাম্মদ ইবন সা’দ হিজর ইবন আবু ইহাব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হিজর বলেন, যায়দ ইবন আমর সিরিয়া থেকে ফিরে আসার পর একদিন আমি দেখতে পেলাম যে, তিনি সূর্যের দিকে লক্ষ্য রাখছেন। আমি তখন বুওয়ানা মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে। সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়লে কিবলার দিকে মুখ করে তিনি দু’সিজদায় এক রাকাত নামায আদায় করেন। তারপর বলেনঃ এই হলো ইবরাহীম ও ইসমাঈলের কিবলা। আমি পাথরের পূজাও করি না এবং পাথরের উদ্দেশ্যে নামাযও পড়ি না। মূর্তির নামে বলি দেওয়া পশু খাই না, লটারীর মাধ্যমে ভাগ্য নির্ণয় করি না। মরণ পর্যন্ত আমি এই ঘরের দিকে মুখ করে নামায পড়ে যাব।

যায়দ ইবন আমর হজ্জ করতেন এবং আরাফায় অবস্থান করতেন। তিনি তালবিয়া পড়তেন এবং তাতে বলতেন, “তোমার দরবারে আমি হাজির। তোমার কোনো অংশীদার নেই। নেই কোন সমকক্ষ।” অতঃপর লাব্বাইক বলতে বলতে পায়ে হেঁটে আরাফা’ থেকে ফিরে আসতেন।

ওয়াকিদী আমির ইবন রবীয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি যায়দ ইবন আমরকে বলতে শুনেছি যে, ‘আমি ইসমাঈল ও আব্দুল মুত্তালিবের বংশ থেকে আগমনকারী একজন নবীর অপেক্ষায় আছি। তবে তাকে পেয়ে আমি তার প্রতি ঈমান আনতে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে এবং তাঁকে নবী বলে সাক্ষ্য দিতে পারব বলে মনে হয় না। যদি তুমি ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাক এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হও, তাহলে তাকে আমার সালাম জানাবে। তিনি কেমন হবেন, আমি তোমাকে তা বলে দেব, যার ফলে তাকে চিনতে তোমার মোটেই বেগ থেকে হবে না।’ আমি বললাম, ‘তবে তা বলুন!’ তিনি বললেন, ‘তিনি না অধিক লম্বা নানবেশী খাট। মাথার চুল বেশীও নয় কমও না। লালিমা তাঁর চোখের অবিচ্ছেদ্য অংশ, দুই কাঁধের মাঝে থাকবে নবুওতের মহর। নাম হবে আহমদ। এই নগরী তার জন্মস্থান এখানেই তিনি নবুওত লাভ করবেন। পরে তার সম্প্রদায় তাকে জন্মভূমি থেকে বের করে দিবে এবং তার দীনের বিরুদ্ধাচরণ করবে। ফলে তিনি ইয়াসরিবে হিজরত করবেন। ওখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন। সাবধান! তুমি যেন তার ব্যাপারে প্রতারিত না হও। আমি ইবরাহীমের দীনের সন্ধানে দেশময় ঘুরে বেরিয়েছি। ইহুদী খৃষ্টান মজুসী যাকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছি, প্রত্যেকেই বলেছে যে, অচিরেই এ দীন আত্মপ্রকাশ করবে। সেই নবী সম্পর্কে আমি তোমাকে যে বিবরণ দিলাম, তারা সকলেই আমাকে এরূপই বলেছে। তারা আরো বলেছে যে, তিনি ব্যতীত আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না।’

আমির ইবন রবীয়া বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে যায়দ ইবন আমরের এসব কথা জানিয়েছি এবং তার আমানতও পৌঁছিয়েছি। নবী করীম (সা) তাঁর সালামের জবাব দেন এবং তার জন্য রহমতের দোয়া করেন এবং বলেন, ‘আমি তাকে জান্নাতে বেশ শান-শওকতে বিচরণ করতে দেখেছি।’

ইমাম বুখারী (র) আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবন উমর (রা) বলেন, ওহী অবতরণ শুরু হওয়ার আগে একদিন বালদাহ-এর নিম্নাঞ্চলে যায়দ ইবন আমর-এর সঙ্গে নবী করীম (সা)-এর সাক্ষাত হয়। আমি তার সামনে খাঞ্চা এগিয়ে দিই। কিন্তু তিনি তা খেতে অস্বীকার করেন। তখন যায়দ বলে উঠলেনঃ ‘আমিও তোমাদের দেবতার নামে বলি দেওয়া পশু খাই না এবং সে পশুও আমি মুখে দেই না, যা তোমরা গাইরুল্লাহর নামে যবাই কর।’ উল্লেখ্য যে, যায়দ ইবন আমর যবাইর ব্যাপারে কুরাইশদের সমালোচনা করে বলতেনঃ ‘বকরী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। আল্লাহই আকাশ থেকে পানি অবতারণ করে ঘাস উৎপন্ন করে এর খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। আর কুরাইশের লোকেরা কিনা তা যবাই করে গাইরুল্লাহর নামে!’

মূসা ইবন উকবা বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল একবার দীনের সন্ধানে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে এক ইহুদী আলিমের সাক্ষাত পেয়ে তাকে তাদের দীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন এবং বলেন, ‘আমি আপনাদের দীন গ্রহণ করতে আগ্রহী। অতএব এ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমাদের দীনে আসতে হলে তোমাকে আল্লাহর গযবের ভার মাথায় নিয়ে আসতে হবে।’ এ কথা শুনে যায়দ বললেন, ‘আমি তো আল্লাহর গযব থেকেই পালিয়ে এসেছি আল্লাহর গযবের সামান্যও আমি বহন করতে পারব না, সে সাধ্যও আমার নেই। সম্ভব হলে আমাকে অন্য কোন দীনের সন্ধান দিন।’ ইহুদী আলিম বললেন, ‘আমার বিবেচনায় তুমি হানীফ’ হতে পার।’ যায়দ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হানীফ’ আবার কি? তিনি বললেন, ‘হানীফ হলো ইবরাহীম (আ)-এর দীন, যিনি ইহুদীও ছিলেন না, খৃষ্টানও ছিলেন না। তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করতেন না।‘ ইহুদী পণ্ডিতের বক্তব্য শুনে যায়দ বেরিয়ে এলেন। তারপর দু’হাত উপরে তুলে বলে উঠেন, “আল্লাহ! তুমি সাক্ষী, আমি ইবরাহীমের দীন গ্রহণ করলাম।”

লায়ছ বলেন, আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বলেছেন, আমি একদিন দেখলাম যে, যায়দ কা’বার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলছেন, “হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে একমাত্র আমিই ইবরাহীমের দীনের অনুসারী।”

যায়দ শিশু কন্যাদেরকে জীবন্ত কবর দেওয়া থেকে রক্ষা করতেন। কাউকে নিজ কন্যা সন্তান জীবন্ত কবর দিতে দেখলে তিনি বলতেন, ‘একে হত্যা করো না, আমাকে দিয়ে দাও। আমি এর ব্যয় ভার বহন করব।’ লালন-পালন করার পর বড় হলে কন্যার পিতাকে বলতেন, “ইচ্ছে হলে তোমার সন্তানকে এবার তুমি নিয়ে যেতে পার, আর যদি বল, এখনও আমি এর ভরণ-পোষণ বহন করতে পারি।” এ বর্ণনাটি বুখারীর। ইবন আসাকির ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

আব্দুর রহমান ইবন আবু যিনাদ বর্ণনা করেন যে, আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বলেছেন, আমি দেখেছি যে, যায়েদ ইবন আমর কাবার সঙ্গে হেলান দিয়ে বলছেন, “হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা ব্যভিচার থেকে দূরে থাক। ব্যভিচার দারিদ্র্য ডেকে আনে।”

মুহাম্মদ ইবন উছমান ইবন আবু শায়বা জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে যায়দ ইবন আমর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ‘জাহিলী যুগে তো তিনি কিবলার দিকে মুখ করে বলতেন, ইবরাহীমের যিনি ইলাহ, আমার ইলাহও তিনি। ইবরাহীমের দীনই আমার দীন। আবার তিনি সিজদাও করতেন। তাঁর কী হবে?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘আমার ও ঈসার মাঝখানে একা তাকে একটি উম্মত হিসাবে উথিত করা হবে।’ এ বর্ণনাটির সনদ উত্তম ও হাসান পর্যায়ের।

ওয়াকিদী ....... খারিজা ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি যায়দ ইবন আমর সম্পর্কে সাঈদ ইবন মুসায়্যিব (রা)-কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ওহী অবতরণের পাঁচ বছর আগে যায়দ ইবন আমর যখন মারা যান, তখন কুরাইশরা কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণ করছিল। মৃত্যুর আগে প্রায়ই তিনি বলতেন, “আমি ইবরাহীমের দীনের অনুসারী।” তাঁর ছেলে সাঈদ ইবন যায়দ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুসারী হন। উমর ইবন খাত্তাব (রা) ও সাঈদ ইবন যায়দ (রা) একদিন রাসুলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে যায়দ ইবন আমর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ও তাঁর প্রতি রহম করেছেন। কারণ তিনি ইবরাহীমের দীনের উপর ইন্তিকাল করেছেন।” বর্ণনাকারী বলেন, সেই থেকে কোন মুসলমান ক্ষমা ও রহমতের দোয়া ছাড়া তার নাম উচ্চারণ করেন না। এ বর্ণনাটির উল্লেখের পর সাঈদ ইবন মুসায়্যিব বলতেনঃ

رحمه الله وغفرله

মুহাম্মদ ইবন সা’দ বর্ণনা করেন যে, ইয়াহইয়া সা’দী বলেছেন, যায়দ ইবন আমর মক্কায় মারা যান এবং হেরার পাদদেশে সমাহিত হন। তবে আগে আমরা বলে এসেছি যে, সিরিয়ার বালকা অঞ্চলের মায়কা’আ নামক স্থানে বনূ লাখমের একদল দুবৃত্তের আক্রমণে তিনি নিহত হন। আল্লাহই সম্যক অবগত।

বাগিনদী ..... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আমি জান্নাতে প্রবেশ করে যায়দ ইবন আমর ইবন নাফায়লের দু’টি অট্টালিকা দেখতে পেয়েছি।” এ সনদটি উত্তম, তবে কোন কিতাবে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না।

যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়লের কিছু কবিতা আমরা সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি। তার দুটি পংক্তি নিম্নরূপঃ

الي الله أهدى مدحتی وثنائيا- وقولا رضيا لأيني الدهرباقیا

إلي اطلك الآلي الذي ليس فوقه -إله ولأرب يكون مدانيا

—আমার সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত যিনি রাজাধিরাজ, যার উপর কোন ইলাহ নেই এবং এমন কোন রবও নেই, যে তাঁর সমকক্ষ হতে পারে।

তবে কারও কারও মতে এ পংক্তি দুটো উমাইয়া ইবনে আবুস্ সালত এর।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক এবং যুবায়র ইবন বাক্কার প্রমুখ বর্ণিত যায়দ ইবন আমর-এর তাওহীদ সংক্রান্ত কয়েকটি কবিতা নিম্নরূপঃ

وأسلمت وجهي لمن أسلمت له الأرض تحمل صخراثقالا

دحاها فلما استوت شدها سواء وارسي عليها الجبالا

وأسلمت وجهي لمن أسلمت - له المزن تحمل عزبا زلالا

اذا هي سيقت الي بلدة -أطاعت فصبت عليها سجالا

وأسلمت وجهي لمن أسلمت له الريح تصرف حالا حالا

—“আমি নিজেকে সঁপে দিলাম সেই মহান সত্তার হাতে, যার কাছে মাথা নত করে ভারী পাথর বহনকারী পৃথিবী। যাকে বিস্তৃত করার পর যখন তা সমতল হয় তখন পাহাড় চাপা দিয়ে তিনি তাকে প্রোথিত করেন।

আমি আত্মসমর্পণ করলাম, সেই সত্তার কাছে, সুমিষ্ট পানি বহনকারী মেঘমালা যার অনুগত, যে মেঘের পানি দ্বারা সিক্ত গোটা পৃথিবী।

আমি আত্মসমপর্ণ করলাম সেই সত্তার কাছে, যার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বায়ু, যে বায়ু এক সময় এক একভাবে প্রবাহিত হয়।”

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক হিশাম ইবন উরওয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমার আব্বা বলেছেন, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল কাব্যাকারে বলেছিলেনঃ

أرب واحد أم الفرب- أدين اذا تقسمت الأمور

عزلت اللات والعزى حميعا- كذالك يفعل الجلد الصبور

فلا الغزي آدين ولا ابنیا ولا صنمى بني عمروازور

ولا غنما ادين وكان ربا- لنا في الدهر اذحلمي يسير

عجبت وفي الليالى معجبات- و في الايام يعرفها البصير

بأن الله قد افني رجالا- كثيرا گان شانهم الفجور

وابقي أخرين يرقوم فيربل منهم الطفل الصغير

وبينا المرء يعثرثاب يوما- گما يتروح الغصن النضير

ولكن اعبد الرحمن ربي- ليغفرذنبي الرب الغفور

فتقوى الله بكم احفظوها -متى ما تحفظوها لا تبوروا

وتري الأبرار دارهم جنان وللفار حامية سعير

وخزي في الحياة وان يموتوا- يلاقو ما تضيق به الصدور

—“এক রবের আনুগত্য করব নাকি হাজার রবের? যদিও বিষয় বিভিন্ন। আমি লাত- উযযা সব ত্যাগ করেছি। ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু লোকেরা এমনই করে থাকে।

আমি উযযাকে মানি না, মানি না তার দুই কন্যাকেও। বনূ আমর ও বনূ আযওর এর দুই প্রতিমাকেও না।

গুনমকেও আমি মানি না। আমি বুদ্ধিতে যখন অপরিপক্ক তখন থেকেই আমার রব একজন। আমি বিস্মিত হয়েছি। বস্তুত রাত্রিকালে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে থাকে। আর বিচক্ষণ লোকেরা দিনের বেলা সেসব উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। বহু পাপাচারীকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন আর সমাজের কিছু সাধু লোকদের রেখে দিয়েছেন, যাদের ছোট শিশুরা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।

মানুষ যখন হোঁচট খায়, তখন একদিন তওবা করে যেমন সবুজ ডাল-পালা এক সময় পল্লবিত হয়।

আমি আমার রব রহমানের ইবাদত করি। এই আশায় যে, ক্ষমাশীল রব আমার সব পাপ মাফ করে দেবেন।

তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি তাকওয়া সংরক্ষণ কর। যতক্ষণ তোমরা তা করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না।

পুন্যবানদের আবাস হবে জান্নাত। আর কাফিরদের ঠিকানা জাহান্নাম। পার্থিব জীবনে তাদের জন্য আছে লাঞ্ছনা। আর মৃত্যুর পরে যা পাবে, তাতে তাদের হৃদয় সংকুচিতই হবে।”

আবুল কাসিম বগবী আসমা বিনতে আবু বকর (রা) থেকে ভিন্ন সূত্রে উক্ত পংক্তিগুলো ঈষৎ পরিবর্তন সহ বর্ণনা করেছেন।

“জিনদেরকে আমি আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু লোকেরা এমনই করে থাকে। আমি উযযাকে মানি না, তার দুই কন্যাকেও না। বনু তসম-এর প্রতিমার প্রতিও আমার আস্থা নেই।

আমি গুনম এর আনুগত্য করি না। শৈশব থেকেই আমি এক রবের অনুসারী। বিষয় নানাবিধ হলেও আমি কি এক রব ছেড়ে হাজার রবের আনুগত্য করব?

তোমার কি জানা নেই যে, আল্লাহ এমন বহু লোককে ধ্বংস করেছেন, যারা ছিল পাপিষ্ঠ? আর অবশিষ্ট রেখেছেন সাধু লোকদের, যাদের হোট্ট শিশুরা এখন বড় হচ্ছে?”

আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বলেন, এসব শুনে ওয়ারাকা ইবন নওফল বলেছিলেনঃ

رشدت وانعمت ابن عمر وانما - تجنبت تنورا من النار حاميا

لدينك ربا ليس ربا كمثله وتربك جنان الجبال كماهيا

أقول إذا اهبطت أرضا مخوفه - حنانيك لاتظهر على الاعادی

حنانيك إن الجن كانت رجاء هم - وانت الهي ربنا ورجائيا

لتدركن المرء رحمة ربه - وان كان تحت الأرض سيعين وادیا

أدين لرب لستجيب ولا أري- أدين لمن لابسمع الدهرواعيا

اقول اذا صليت في كل بيعة ئباركت قد أكثرت باسمك راعيا

—“সুপথ পেয়ে গিয়েছ ও নিয়ামত লাভ করেছ হে ইবনে আমর এবং উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে তুমি বেঁচে গিয়েছ। এক অনুপম রবের আনুগত্য করে এবং পাহাড়ের জিনদের বর্জন করে অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে তুমি আলোর পথের সন্ধান পেয়েছ।

কোনো ভয়াল জনপদে অবতরণ করলে আমি বলি, আমি তোমার দয়া চাই, শত্রুকে আমার উপর বিজয়ী করো না। তুমি আমার রব, তুমিই আমার আশা-ভরসা, হে আমার রব।

আল্লাহর রহমত মানুষের নাগাল পাবেই। যদিও তারা সত্তর স্তর মাটির নীচে অবস্থান করে।

আমি এমন রবকে মান্য করি, যিনি ডাকে সাড়া দেন। জীবনভর ডাকলেও যার সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না, তাকে আমি মানি না। যে কোনো উপাসনালয়ে ইবাদতকালে আমি বলি, তুমি মহান, তোমাকেই আমি পুনঃপুনঃ আহ্বান করি।”

পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, যায়দ ইবন আমর দীনের সন্ধানে সিরিয়া গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ওয়ারাকা ইবন নওফল, উছমান ইবন হুয়াইরিছ ও উবাইদুল্লাহ্ ইবন জাহ্শ। যায়দ ব্যতীত অন্য তিনজন খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। যায়দ নতুন করে কোন ধর্ম অবলম্বন না করে এক লা-শারীক আল্লাহর ইবাদতের উপরই অটল থেকে স্বভাবজাতভাবেই যতটুকু সম্ভব ইবরাহীমের দীনের উপর থাকার চেষ্টা করেন। ওয়ারাকা ইবন নওফলের বৃত্তান্ত পরে আসছে। উছমান ইবন হুয়াইরিছ সিরিয়ায় বসবাস করেন এবং কায়সারের নৈকট্যে অবস্থান করে সে দেশেই মারা যান, তার একটি বিস্ময়কর ঘটনা উমুবী বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে ঘটনাটি এরূপঃ

কায়সারের নিকট গিয়ে উছমান নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অনুযোগ করেন। তা শুনে কায়সার সিরিয়ার আরব অধ্যুষিত অঞ্চলের শাসক ইবন জাফনাকে কুরাইশের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য প্রেরণের আদেশ দেন। শাসক সে মতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন সেখানকার আরবরা তা থেকে বারণ করে। যুক্তি হিসাবে মক্কা শরীফের মাহাত্ম্য এবং আসহাবে ফীলের সঙ্গে আল্লাহ যে আচরণ করেন, তার কথা তারা উল্লেখ করে। ইবন জাফনা উছমান ইবন হুয়াইরিছকে বিষ মাখা একটি রঙিন পোশাক পরিয়ে দেয়, যার বিষক্রিয়ায় সে মারা যায়। যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল তার মৃত্যুর শোক প্রকাশ করে কয়েকটি পংক্তি রচনা করেন। উমুবী পংক্তিগুলো উল্লেখ করেছেন। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় আমরা তা উল্লেখ করলাম না। উছমান ইবন হুয়াইরিছের মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত প্রাপ্তির কমবেশী তিন বছর আগে। আল্লাহই সম্যক অবগত।

৮১
ঈসা (আ) ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যবর্তী যুগের কয়েকটি ঘটনা
(ক) কাবা নির্মাণঃ

কেউ কেউ বলেন, সর্বপ্রথম যিনি কা’বা ঘর নির্মাণ করেন, তিনি হলেন আদম (আ)। আবদুল্লাহ ইবন আমর বর্ণিত এ সম্পর্কে একটি মারফু হাদীসও আছে। তবে এর সনদে ইবনুল হায়’আ নামক একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন। বিশুদ্ধতর অভিমত হলে, সর্বপ্রথম যিনি কাবা ঘর নির্মাণ করেছেন, তিনি হলেন ইবরাহীম (আ)। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সিমাক ইবন হারব আলী ইবন আবু তালিব থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেন। আলী (রা) বলেন, অতঃপর কাবাঘর ধ্বংস হয়ে গেলে আমালিকা বংশীয়রা তা নির্মাণ করে। তারপর আবারও ধ্বংস হলে জুরহুম বংশীয়রা তা নির্মাণ করে। পুনরায় ধ্বংস হলে এবার কুরাইশরা তা নির্মাণ করে। কুরাইশের কাবাঘর পুনঃনির্মাণের আলোচনা পরে আসছে। তা ঘটেছিল নবী করীম (সা)-এর নবুওত লাভের পাঁচ বছর, মতান্তরে পনের বছর আগে। যুহরী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তখন যৌবনে উপনীত। যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।

(খ) কাব ইবন লুওয়াইঃ

আবু নু’আয়ম..... আবু সালামা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, কা’ব ইবন লুওয়াই প্রতি শুক্রবার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে সমবেত করে ভাষণ দিতেন। কুরাইশরা সে দিনটিকে বলতো আরূবা’। বক্তৃতায় তিনি বলতেন, হে লোক সকল! তোমরা শ্রবণ কর, শিক্ষা লাভ কর ও অনুধাবন কর! অন্ধকার রাত, আলোকোজ্জ্বল দিন বিছানা স্বরূপ পৃথিবী ছাদ আকাশ স্বরূপ, কীলকস্বরূপ পাহাড়রাজি আর পথ নির্দেশক তারকারাজি আগের পরের নির্বিশেষে সকল সকল, নারী ও পুরুষ সর্বপ্রথম স্বীকারোক্তি ( بلي )-এর প্রতি ইঙ্গিতকারী বিষয় এবং রূহ। তোমরা রক্তের আত্মীয়তা বজায় রেখে চল। বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষা কর। অর্থ-সম্পদকে ফলপ্রদ বানাও। মৃত্যুবরণকারী কাউকে কি তোমরা ফিরে আসতে কিংবা মৃত ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত হবে দেখেছ? আসল বাড়ী তোমাদের সম্মুখে। তোমরা যা বলছ, ব্যাপার তার বিপরীত। তোমাদের মর্যাদাকে তোমরা উৎকর্ষিত করে তোল এবং এর উপর দৃঢ় থাক। অচিরেই আসছে এক মহা সংবাদ। মহান এক নবী আত্মপ্রকাশ করছেন বলে। অতঃপর তিনি আবৃত্তি করেনঃ

نهار وليل كل يوم بحادث - سواء علينا ليلها ونهارها

يؤوبان بالأحداث حتي تؤبا- وبالنعم الضيافي عليناستورها

على غفلة يأتي النبي محمد فيخبر أخبار اصدوق خبيرها

– রাত ও দিন প্রত্যহ নিত্য-নতুন ঘটনা নিয়ে আসছে। সেই রাত ও দিন সবই আমাদের জন্য সমান। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে রাত-দিন ফিরে আসে। প্রভূত প্রাচুর্য নিয়ে আমাদের উপর তার আবরণ ঢেলে দেয়। নবী মুহাম্মদ এসে পড়বেন, তোমরা টেরও পাবে না। এসে তিনি বহু সংবাদ প্রদান করবেন, সংবাদদাতা হবেন মহা সত্যবাদী।

অতঃপর তিনি বলতেনঃ সেদিন পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকতাম,তাহলে অবশ্যই আমি উটের উপর দাঁড়িয়ে থাকার ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম এবং বাছুরের ন্যায় দৌড়াতাম। তারপর বললেনঃ

ياليتني شاهدا نجواء دعوته صين العشيره تبغي الحق خذ لأنا

—হায়, যেদিন সমাজের মানুষ সত্যকে পদানত করতে চাইবে, সেদিন যদি আমি তার দাওয়াতের সামনে উপস্থিত থাকতে পারতাম!

বর্ণনাকারী বলেন, কা’ব ইবন লুওয়াই এর মৃত্যু এবং রাসূল (সা)-এর নবুওত লাভের মাঝে ব্যবধান ছিল পাঁচশত ষাট বছর।

(গ) যমযম কূপ পুনঃখননঃ

জুরহুম গোত্র যমযম কূপ বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে আবদুল মুত্তালিবের সময়কাল পর্যন্ত তার কোন চিহ্ন বিদ্যমান ছিল না। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, একদা আব্দুল মুত্তালিব হিজরে তথা হাতীমে ঘুমিয়ে ছিলেন। এসম্পর্কে তিনি বলেন যে, হিজরে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি স্বপ্নে দেখলাম। এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘তুমি ‘তায়্যেবা’ খনন কর।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তায়্যেবা কী?’ কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই সে চলে গেল। পরদিন রাতে আমি যখন বিছানায় গেলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম, লোকটি এসে পুনরায় আমাকে বলল, ‘বাররা’ খনন কর! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাররা কী?’ লোকটি আমাকে জবাব না দিয়েই চলে গেল। তৃতীয় রাতে আবারো স্বপ্নে দেখলাম যে, কে যেন আমাকে বলছে, ‘মাযনুনা’ খনন কর। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মাযনুনা কী?’ পরের রাতে আবারো এসে সে বলল, ‘যমযম খনন কর।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যমযম কী?’ সে বলল, ‘যা কখনো শুকাবে না, মহান হাজীগণ যার পানি পান করবেন। গোবর ও রক্তের মধ্যখানে যার অবস্থান, সাদা পা বিশিষ্ট কাকের নিকটে, পিঁপড়ার বসতির কাছে।’

আব্দুল মুত্তালিব বলেন, পরিচয় ও জায়গার নির্দেশনা পেয়ে আমি কোদাল নিয়ে সেখানে গেলাম। পুত্র হারিছ ইবন আব্দুল মুত্তালিবও সঙ্গে ছিল। সে সময় পর্যন্ত তাঁর অন্য কোন পুত্র ছিল না। খনন কার্য শুরু হয়ে এক সময়ে তা শেষ হলো। আব্দুল মুত্তালিব পানি দেখতে পেয়ে উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবর বলে উঠলেন। তাকবীর ধ্বনি শুনে কুরাইশরা বুঝল যে, আব্দুল মুত্তালিব এর উদ্দেশ্যে হাসিল হয়ে গেছে। ফলে তারা তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘হে আব্দুল মুত্তালিব! আপনি যে কূপের সন্ধান পেয়েছেন, তা আমাদের পিতা ইসমাঈলের কূপ এবং নিঃসন্দেহে তাতে আমাদের অধিকার আছে। অতএব আমাদেরকে তার ভাগ দিতে হবে।’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘না, তা হবে না। এ কূপ শুধু আমাকেই দেওয়া হয়েছে, এতে তোমাদের কোন অংশ নেই।’ কুরাইশরা বলল, ‘আমরা এর দাবি ছাড়ব না। প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে লড়াই করে হলেও আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে ছাড়ব।’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘ঠিক আছে, তা-ই যদি করো, তা হলে একজন লোক ঠিক কর, আমরা তার উপর এর বিচারের ভার অর্পণ করব।’ কুরাইশরা বলল, ‘বনূ সা’দ ইবন হুয়াইমের গণক ঠাকুরণীর কাছে চলুন।’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘ঠিক আছে।’ এই গণক ঠাকুরণীর আবাসস্থল ছিল সিরিয়ার দিকে।

আব্দুল মুত্তালিব রওয়ানা হলেন। সঙ্গে তাঁর বনূ উমাইয়া এবং কুরাইশের প্রত্যেক গোত্রের একজন করে একদল লোক। তখনকার দিনে তা ছিল এক বিরান মরু প্রান্তর। এক সময়ে আব্দুল মুত্তালিব ও তার সঙ্গীদের পানি শেষ হয়ে গেল। তারা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লেন। এমন কি প্রাণ হারাবার উপক্রম হল। ফলে আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গীরা অন্যদের নিকট পানি চাইল। কিন্তু তারা পানি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলল, ‘আমরা নিজেরাও তোমাদের মত এ মরু প্রান্তরে বিপন্ন হওয়ার আশংকা করছি।’ অগত্যা আব্দুল মুত্তালিব সঙ্গীদেরকে বললেন, ‘গায়ে কিছুটা শক্তি-সামর্থ্য থাকতেই তোমরা নিজেদের জন্য গর্ত খনন করে রাখ, যাতে কেউ মারা গেলে সঙ্গীরা তাকে সেই গর্তে পুঁতে রাখতে পারে। এভাবে সর্বশেষ একজন হয়ত সমাধি থেকে বঞ্চিত হবে। তা হয় হোক। গোটা কাফেলা বিনা দাফনে থাকা অপেক্ষা একজন থাকাই ভালো।’ সঙ্গীরা বলল, ‘আপনার এই আদেশ অতি উত্তম। আমরা তা-ই করব।’ প্রত্যেকেই নিজের জন্য গর্ত খনন করল এবং বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগল।

অতঃপর আব্দুল মুত্তালিব সাথীদের বললেন, ‘আমরা এভাবে নিজেদেরকে মৃত্যুর হাতে সোপর্দ করে বসে রইলাম। চেষ্টা করলে হয়ত আল্লাহ কোন প্রকারে পানির ব্যবস্থা করেও দিবেন। বসে না থেকে তোমরা সামনে অগ্রসর হয়ে দেখ।’ তারা রওয়ানা হলো। আব্দুল মুত্তালিবের উট উঠে দাঁড়াতেই তার পায়ের নীচ থেকে সুমিষ্ট পানির ফোয়ারা বইতে শুরু করল। আব্দুল মুত্তালিব তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠলেন। সংগীরাও তাকবীর দিয়ে উঠল। আব্দুল মুত্তালিব বাহন থেকে নেমে পানি পান করলেন। সংগীরাও পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করল এবং আপন আপন মশক ভরে নিল। অতঃপর আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশের গোত্রসমূহের প্রতিনিধিদেরকে আহ্বান করলেন। এতক্ষণ তারা তাকিয়ে এসব অবস্থা দেছিল। আব্দুল মুত্তালিব বললেন, “এসো এসো এই যে পানি! আল্লাহ আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন।” তারাও সেই পানি পান করল এবং পরিতৃপ্ত হলো। অতঃপর বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে আমাদের উপর বিজয়ী করেছেন। শপথ আল্লাহর, যমযমের ব্যাপারে আমরা আপনার সঙ্গে আর কখনো বিবাদ করব না। এই মরু অঞ্চলে যিনি আপনাকে এ পানি দান করলেন, তিনিই আপনাকে যমযম দান করেছেন। অতএব নিরাপদে আপনি আপনার কূপের নিকট ফিরে যান।’ আব্দুল মুত্তালিব ফিরে গেলেন। প্রতিপক্ষও তার সঙ্গে ফিরে গেল। যমযম সম্পর্কিত বিবাদের মীমাংসা এভাবেই হয়ে গেল। গণক ঠাকুরণীর কাছে আর যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। তারা তাঁর হাতেই যমযমের অধিকার ছেড়ে দিল।

ইবন ইসহাক বলেন, এই হলো আলী ইবন আবু তালিব (রা) থেকে বর্ণিত যমযম সম্পর্কিত বর্ণনা। অন্য এক সূত্রে আমি শুনেছি যে, আব্দুল মুত্তালিব বর্ণনা করেছেন, স্বপ্নে যখন তাঁকে যমযম খনন করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তখন এ-ও বলা হয়েছিল— এরপর তুমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পানির জন্য দোয়া করবে। আল্লাহর ঘরের হাজীরা তা পান করবে। এই কূপ যতদিন টিকে থাকবে, তা থেকে কোন ভয়ের কারণ থাকবে না’।

বর্ণনাকারী বলেন, এ সময় আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশের নিকট গিয়ে বললেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, আমি যমযম খননের জন্যে আদিষ্ট হয়েছি।’ তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘যমযম কোথায় তা কি আপনাকে বলে দেওয়া হয়েছে?’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘না জানানো হয়নি।’ লোকেরা বলল, ‘তা হলে এ স্বপ্নটি যে বিছানায় শুয়ে দেখেছিলেন, আজও সে বিছানায় ঘুমাবেন। এই স্বপ্ন যদি সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তা হলে আল্লাহ বিষয়টা বিস্তারিত জানিয়ে দিবেন। আর যদি তা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তাহলে সে আর আসবে না।’ আব্দুল মুত্তালিব ফিরে গেলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন। এবারও স্বপ্ন দেখলেন, কে যেন বলছে, ‘যমযম খনন কর, যদি তুমি তা কর তা হলে লজ্জিত হবে না। তা তোমার মহান পিতার উত্তরাধিকার; কখনো তা’ শুকাবে না। হাজীগণকে তুমি তা থেকে পান করাবে। মানতকারীরা সেখানে প্রাচুর্যের জন্য মানত করবে। তা পৈত্রিক সম্পত্তি হবে এবং মজবুত বন্ধন হবে। তার স্থান তুমি জান আর তা রক্ত ও গোবরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে।’

ইবন ইসহাক বলেন, আব্দুল মুত্তালিবকে যখন স্বপ্নে এ সব কথা বলা হলো, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কূপটির অবস্থান কোথায়?’ বলা হলো, ‘পিঁপড়ের ঢিবির নিকট। আগামীকাল ওখানে কাক ঠোকরাবে।’

উক্ত বিবরণ দু’টির কোনটি যথার্থ, তা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আব্দুল মুত্তালিব পরের দিন পুত্র হারিছকে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। সে সময়ে হারিছ ছাড়া তাঁর আর কোন পুত্র ছিল না। উমুবীর বর্ণনা মতে, তার গোলাম পিঁপড়ের ঢিবিতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, আসাফ ও নায়লা মূর্তিদ্বয়ের মধ্যখানে কাক ঠোকরাচ্ছে। এই দুই মূর্তির নিকট কুরাইশরা পশু বলি দিত। আব্দুল মুত্তালিব কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করেন। দেখে কুরাইশের লোকেরা ছুটে এসে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা তোমাকে এই জায়গার মাটি খুঁড়তে দেব না। আমাদের দুই দেবতার মধ্যকার এই স্থানে আমরা পশু বলি দেই।’ শুনে আব্দুল মুত্তালিব পুত্র হারিছকে বললেন, ‘আমি কূপ খনন করা পর্যন্ত তুমি আমার হেফাজতের ব্যবস্থা কর। আল্লাহর কসম, আমি যে কাজের আদেশ পেয়েছি, তা আমি বাস্তবায়ন করবই।’ আব্দুল মুত্তালিবের দৃঢ়তা দেখে কুরাইশের লোকেরা তাঁকে আর খনন কাজে বাধা দিল না।

আব্দুল মুত্তালিব খনন কার্য চালাতে থাকলেন। অল্প একটু খনন করার পরই পানি বেরিয়ে এলো। আব্দুল মুত্তালিব তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠলেন এবং পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে, তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা সত্য।

বেশ কিছুটা খনন করার পর আব্দুল মুত্তালিব তাতে স্বর্ণের দু’টি হরিণ মূর্তি পান। জুরহুম গোত্র এখানে তা পুঁতে রেখেছিল। সেখানে তিনি কয়েকটি তলোয়ার এবং কিছু বর্ম পেলেন। দেখে কুরাইশরা বলল, “আব্দুল মুত্তালিব! এতে তোমার সঙ্গে আমাদের ভাগ আছে।” আব্দুল মুত্তালিব বললেন, “না, তা হবে না। তবে একটি সুরাহায় আসতে পার। এসো লটারীর মাধ্যমে আমরা এর মীমাংসা করি।” কুরাইশরা বলল, ‘তা কিভাবে হবে বলুন।’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘কাবার নামে দুটি তীর নাও। আমার নামে নাও দু’টি এবং তোমাদের নামে দুটি। যার তীর যে জিনিসটির উপর গিয়ে পড়বে সে তার মালিক হবে। আর যার তীর লক্ষ্যচ্যুত হবে, সে কিছুই পাবে না।’ কুরাইশরা বলল, ‘আপনার প্রস্তাবটি ন্যায়সঙ্গত।’

আব্দুল মুত্তালিব কাবার নামে দুটি হলুদ তীর নিলেন। নিজের জন্য নিলেন দু’টি কালো তীর এবং কুরাইশদের জন্য নিলেন দু’টি সাদা তীর। কুরাইশের বড় দেবতা তার নিকটবর্তী তীর নিক্ষেপকারীর নিকট তীরগুলি অর্পণ করে। হোবল- যে কারণে আবু সুফিয়ান ওহুদ যুদ্ধের দিন বলেছিল হোবলের জয় হোক– আব্দুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগলেনঃ

اللهم أنت الملك المحمود - ربي أنت المبدئ المعيد

وممسك الراسية الجلمود من عندك الطارف والتليد

إن شئت ألهمت لما تريد - لموضع الحلية والحديد

فبين اليوم لما تريد - إني نذرت العاهد المعهود

اجعله ربي لي فلا أعود

— হে আল্লাহ! আপনি প্রশংসিত রাজাধিরাজ। আপনি আমার প্রতিপালক আপনিই সৃষ্টির সূচনাকারী এবং পুনঃসৃষ্টিকারী। আপনি পাথুরে পাহাড়কে সুদৃঢ় করে রেখেছেন। আপনার নিকট থেকে আসে অর্থ ও পশু সম্পদ। আপনি চাইলে আমার মনে ইলহাম করবেন কা’বার ঐ স্থানটি যেখানে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর স্বর্ণালঙ্কার ও অস্ত্রশস্ত্র প্রোথিত রয়েছে। আজ আপনি আমাকে অবহিত করেন আপনার ইচ্ছা যদি আপনার মর্জি হয়। আমি শপথ করেছি। আপনি আমাকে তা দিয়ে দিন। আমি আর কিছু চাইবো না।

এবার তীর নিক্ষেপ শুরু হলো। হলুদ তীর দু’টি গিয়ে হরিণ মূর্তির উপর পতিত হলো। যা’ ছিল কা’বার জন্য। কালো দু’টি গিয়ে পড়ল তরবারী ও বর্মগুলোর উপর। এগুলো পেলেন আব্দুল মুত্তালিব। কুরাইশদের সাদা তীর দু’টো লক্ষ্যচ্যুত হলো। আব্দুল মুত্তালিব তরবারী এবং হরিণ মূর্তি দু’টি কাবার দরজায় স্থাপন করে রাখেন। লোকের ধারণা তা-ই ছিল কা’বার গায়ে প্রথম সোনার অলংকার। তারপর আব্দুল মুত্তালিব যমযম কূপে হাজীদের পানি পানের ব্যবস্থা করেন।

ইবন ইসহাক প্রমুখ বলেন, আব্দুল মুত্তালিবের আমলে যমযম উদঘাটিত হওয়ার আগে মক্কায় আরো অনেকগুলো কূপ ছিল। ইবন ইসহাক সেগুলোর সংখ্যা এবং নামধামও উল্লেখ করেছেন। সবশেষে বলেন, কিন্তু যমযম অন্যসব কূপের উপর প্রাধান্য লাভ করে এবং মানুষ অন্যান্য কূপ ছেড়ে যমযমের প্রতি ছুটে আসে। কারণ যমযম মসজিদুল হারামে অবস্থিত। আর এর পানি সব কূপ অপেক্ষা উত্তম। সর্বোপরি, যমযম ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আ)-এর কূপ। আবদে মানাফের গোত্র এই কূপ নিয়ে কুরাইশের অন্যান্য গোত্র এবং সমস্ত আরবের উপর গর্ব করত।

হযরত আবুযর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ বিষয়ক মুসলিম শরীফের এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যমযম সম্পর্কে বলেছেনঃ

انها لطعام طعم وشفاء سقم

“এই যমযম তার পানকারীর জন্য খাদ্য স্বরূপ এবং তা রোগের নিরাময়ও বটে।”

ইমাম আহমদ হযরত জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা)-এর বরাতে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

ماء زمزم لما شرب منه

“যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হয় তা পূরণ হয়।”

ইবন মাজাহর বর্ণনায় এর পাঠ হচ্ছেঃ

ماء زمزم لما شرب له

হাকিম (র) ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি জনৈক ব্যক্তিকে বলেছেন, তুমি যখন যমযমের পানি পান করবে, তখন কিবলার দিকে মুখ করবে, বিসমিল্লাহ বলবে, তিন নিঃশ্বাসে পান করবে এবং পরিতৃপ্তি সহকারে পান করবে। যখন পান করা শেষ করবে, তখন ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বলবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “আমাদের ও মুনাফিকদের মাঝে পার্থক্য হলো, ওরা যমযমের পানি তৃপ্তি সহকারে পান করে না।”

আব্দুল মুত্তালিব থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেনঃ “হে আল্লাহ! এই যমযমের পানি আমি গোসলকারীর জন্য হালাল মনে করি না। যমযমের পানি পানকারীর জন্য বৈধ।” কেউ কেউ এ উক্তিটি আব্বাস (রা)-এর বলে মত প্রকাশ করলে ও বিশুদ্ধ মতে এটি আবদুল মুত্তালিবেরই উক্তি। কেননা তিনিই এটি পুনঃ খনন করেছিলেন।

উমাবী তাঁর মাগাযীতে বর্ণনা করেছেন যে, আবু উবায়দ ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ ও আব্দুর রহমান ইবন হারমালাহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আব্দুর রহমান ইবন হারমালা বলেন, আমি সাঈদ ইবন মুসায়্যাবকে বলতে শুনেছি যে, আব্দুল মুত্তালিব ইবন হাশিম যখন যমযম খনন করলেন তখন বলেছিলেন, “এই কূপ গোসলকারীর জন্য হালাল নয়, এটি কেবল পানকারীর জন্যই বৈধ।” তিনি যমযম কূপে দু’টি হাউজ তৈরি করে দিয়েছিলেন। একটি পান করার জন্য অপরটি ওজু করার জন্য। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘একে আমি গোসলের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেব না।’ তার উদ্দেশ্যে ছিল মসজিদকে পবিত্র রাখা।

আবু উবায়দ অন্য এক সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আসিম ইবন আবুন্নাজুদ আব্বাস (রা)-কে বলতে শুনেছেন, আমি একে গোসলকারীর জন্য হালাল করব না। এটি পানকারীর জন্য বৈধ। আব্দুর রহমান ইবন মাহ্দী সুফিয়ান ও আব্দুর রহমান ইব্‌ন আলকামা সূত্রেও ইবন আব্বাস (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে।

মূলত যমযমের পানি দ্বারা গোসল করা নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু আব্দুল মুত্তালিব ও আব্বাস (রা) এ কাজ থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এমনটি বলেছিলেন বলে মনে হয়।

উল্লেখ্য যে, আব্দুল মুত্তালিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত তিনিই যমযমের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব পুত্র আবু তালিবের উপর ন্যাস্ত হয়।

আবু তালিব অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে তিনি তার ভাই আব্বাস-এর নিকট থেকে দশ হাজার মুদ্রা ঋণ নিয়ে হাজীদের জন্য যমযমের কাজে ব্যয় করেন। কথা ছিল, পরের বছর সে ঋণ শোধ করে দেবেন। কিন্তু একবছর চলে যাওয়ার পরও আবু তালিবের স্বচ্ছলতা ফিরে আসল না। তাই তিনি আব্বাসকে বললেন, তুমি আমাকে চৌদ্দ হাজার মুদ্রা ঋণ দাও। আগামী বছর আমি তোমার সব পাওনা পরিশোধ করে দেব। জবাবে আব্বাস (রা) বললেন, এই শর্তে দিতে পারি যে, যদি আপনি যথাসময়ে ঋণ শোধ করতে না পারেন, তাহলে যমযমের কর্তৃত্ব আমার হাতে চলে আসবে। আবু তালিব শর্তটি মেনে নেন। এক বছর চলে যাওয়ার পরও আবু তালিব ঋণ পরিশোধ করার কোন ব্যবস্থা করতে পারলেন না। ফলে শর্ত অনুযায়ী যমযমের দায়িত্বভার আব্বাসকে দিয়ে দেন। আব্বাসের পরে যমযমের দায়িত্ব আব্বাসের পুত্র আব্দুল্লাহর হাতে আসে। আব্দুল্লাহর পরে আসে আলী ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসের হাতে। তার পর আসে দাউদ ইবন আলীর হাতে। অতঃপর সুলায়মান ইব্‌ন আলীর হাতে। অতঃপর ঈসা ইবন আলীর হাতে। অতঃপর মনসুর যমযমের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তাঁর আযাদকৃত গোলাম আবু রাযীনকে দেখা-শোনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। উমুবী এরূপ বর্ণনা করেছেন।

৮২
আবদুল মুত্তালিবের পুত্র যবাহ করার মানত
ইবন ইসহাক বলেন, যমযম খনন করার সময় কুরাইশের সঙ্গে আবদুল মুত্তালিবের যে বিবাদ হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে তিনি মানত করেছিলেন যে যদি তাঁর দশটি সন্তান জন্ম নেয় এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তাকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করার উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের একজনকে কা’বার নিকটে আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করবেন। যখন তাঁর সন্তান সংখ্যা দশে উপনীত হয় এবং তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তারা তাঁকে রক্ষা করতে সমর্থ, তখন তাদের সকলকে একত্রিত করে তিনি তার মানতের কথা অবহিত করলেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানালেন। তারা হলেন হারিছ, যুবায়র, হাজাল, যেরার, মুকাওয়িম, আবু লাহাব, আব্বাস, হামযা, আবু তালিব ও আবদুল্লাহ। পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুত্ররা বললেন, ‘আমরা কিভাবে আপনার এই মানত পূরণ করতে পারি?’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘তীরে নিজের নাম লিখে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ পুত্ররা তা করলেন। আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে কা’বার অভ্যন্তরে হোবল দেবতার মূর্তির নিকট নিয়ে যান।

উল্লেখ্য যে, কাবার জন্য নিবেদিত উপঢৌকনাদি কা’বা স্থিত একটি গহ্বরে রাখা হত। আর হোবলের নিকট সাতটি লটারীর তীর ছিল। বিশেষ কোন সমস্যা দেখা দিলে মুশরিকরা তার নিকট গিয়ে লটারী ফেলে মীমাংসায় আসত। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই তীর থেকে যে নিদের্শনা পাওয়া যেত, তাই তারা সর্বান্তকরণে মেনে নিত।

আবদুল মুত্তালিব পুত্রদের নিয়ে হোবলের কাছে গেলেন এবং যথারীতি লটারী তীর তুললেন। নাম আসল আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ্ ছিলেন পুত্রদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এবং তার সর্বাধিক প্রিয়। আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহর হাত ধরলেন এবং ছুরি নিয়ে তাকে জবাই করার জন্য আসাফ ও নায়েলা প্রতিমা দুইটির দিকে অগ্রসর হলেন। তা দেখতে পেয়ে কুরাইশ তাদের মজলিস থেকে দৌড়ে এসে বলল, ‘আবদুল মুত্তালিব! আপনার উদ্দেশ্য কী?’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আমি একে জবাই করব।’ কুরাইশ এবং আবদুল মুত্তালিবের পুত্ররা বললেন, ‘আল্লাহর কসম! কোন নিশ্চিত বিকল্প না হওয়া পর্যন্ত আপনি একে জবাই করতে পারবেন না। যদি তা করেন, তাহলে পুত্র বলি দেওয়ার ধারা চালু হয়ে যাবে। তা’হলে মানুষের নিরাপত্তা কেমন করে রক্ষিত হবে?’

ইউনুস ইবন বুকায়র ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, জবাই করার জন্য যখন আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহকে পায়ের নীচে চেপে ধরেন, তখন আব্বাস আবদুল্লাহকে পিতার পদতল থেকে টেনে সরিয়ে নেন। এর কারণে আবদুল মুত্তালিব আব্বাসের মুখমণ্ডলে এমন প্রচণ্ড আঘাত করেন যে, মৃত্যু পর্যন্ত সে আঘাতের দাগ থেকে যায়।

অতঃপর কুরাইশরা আবদুল মুত্তালিবকে পরামর্শ দিল যে, ‘হিজাযে একজন গণক ঠাকুরণী আছে। তার অনুগত জিন আছে। তার কাছে গিয়ে আপনি এ বিষয়ে আলাপ করুন। তারপর সে আপনাকে যা আদেশ করে, আপনি তা-ই করুন, তাতে আমরা আপনাকে বাধা দিব না। যদি সে আবদুল্লাহকে জবাই করতে বলে, আপনি তা-ই করতে পারবেন। আর যদি আবদুল্লাহকে নিষ্কৃতি দিয়ে আপনাকে অন্য কোন পরামর্শ দেয়, তবে তা-ও আপনি মেনে নেবেন।’

সে মতে আবদুল মুত্তালিব দল-বলসহ মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। মদীনা শহরে এসে তিনি গণকের সাক্ষাৎ পেলেন। তার নাম ছিল সাজাহ। আবদুল মুত্তালিব তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন এবং নিজের সমস্যার কথা জানালেন। বিস্তারিত শুনে গণক ঠাকুরনী বলল, ‘আজ আপনারা ফিরে যান, আমার অনুগত জিন যখন আসবে; তখন তার কাছ থেকে আমি এ সমস্যার সমাধান জেনে রাখব।’ আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে গেলেন। গণক ঠাকুরণীর নিকট থেকে বের হয়ে এসে আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগলেন।

পরদিন যথাসময়ে তারা গণক ঠাকুরণীর নিকট গিয়ে উপস্থিত হন। গণক ঠাকুরণী বলল, ‘আপনাদের সমস্যার সমাধান আমি পেয়ে গেছি। আচ্ছা, আপনাদের সমাজে মুক্তিপণের পরিমাণ কত?’ তারা বলল, ‘দশটি উট।’ গণক ঠাকুরণী বলল, ‘আপনারা দেশে ফিরে যান। গিয়ে দশটি উট নিন। এই দশটি উট ও ছেলেটির মধ্যে লটারী করুন। লটারীতে যদি ছেলেটির নাম আসে, তাহলে আরও দশটি উট নিয়ে আবারো লটারী করুন। আর যদি উটের নাম আসে, তাহলে পুত্রের স্থলে উটগুলো জবাই করুন। এতেই তোমাদের প্রভু সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে ধরে নেয়া যাবে। ছেলেটির জীবনও তাতে বেঁচে যাবে।’

আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদের নিয়ে মক্কায় ফিরে আসলেন। সকলের সম্মতিক্রমে লটারী শুরু হলো। আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগলেন। দশটি উট এবং আবদুল্লাহকে উপস্থিত করা হল। লটারী টানা হলো। নাম আসল আবদুল্লাহর। এবার আরো দশটি উট বাড়িয়ে লটারী দেওয়া হলো। এভাবে দশটি করে উট বাড়িয়ে লটারী টানা হলো। কিন্তু প্রতিবারই আবদুল্লাহর নাম উঠতে লাগল। অবশেষে একশত উট আর আবদুল্লাহর মধ্যে লটারী দেওয়া হলে উটের নাম উঠলো। আবদুল মুত্তালিব তখন হোবলের নিকট দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলেন। কুরাইশের লোকেরা তাঁকে বলল, ‘সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আল্লাহ আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।’ কিন্তু আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘না, এতে হবে না। আরো তিনবার লটারী না করে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।’ অগত্যা লোকেরা আরো তিনবার লটারী দিল। প্রতিবারই উটের নাম আসল। এবার উটগুলো জবাই করা হলো আর আবদুল্লাহ বেঁচে গেলেন।

এক বর্ণনায় আছে যে, উটের সংখ্যা একশ’তে পৌঁছার পরও আবদুল্লাহর নাম আসে। তখন আরো একশত বাড়িয়ে লটারী দেওয়া হয়। এবারও আবদুল্লাহর নাম আসলে উট আরো একশত বাড়ানো হয়। এভাবে তিনশত উট আর আবদুল্লাহর মাঝে লটারী দেওয়ার পর উটের নাম আসে। তখন গিয়ে আবদুল মুত্তালিব উটগুলো জবাই করেন। তবে প্রথম বর্ণনাটিই বিশুদ্ধতর। আল্লাহই ভাল জানেন।

এক বর্ণনায় আছে যে, জনৈক মহিলা ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে যে, ‘সে মানত করেছিল কাবার নিকটে তার একটি সন্তান বলি দেবে। এখন তার করণীয় কী?’ জবাবে ইবন আব্বাস (রা) তাকে একশত উট জবাই করার আদেশ দেন এবং মহিলাকে আবদুল মুত্তালিবের ঘটনাটি শুনিয়ে দেন। আবার মহিলা আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা)-কে সমস্যাটির কথা জানালে তিনি কোন সিদ্ধান্ত দানে বিরত থাকেন। মারওয়ান ইবন হাকাম তখন মদীনার গভর্নর। তিনি সংবাদ শুনে বললেন দু’জনের একজনের সিদ্ধান্তও সঠিক হয়নি। অতঃপর তিনি মহিলাকে পুত্র জবাই করতে নিষেধ করে দিয়ে তার সাধ্যমত সৎকাজ করতে আদেশ দেন। উট জবাই করার আদেশ তিনি দিলেন না। পরে এরূপ সমস্যায় মানুষ মারওয়ানের ফয়সালা অনুযায়ীই আমল করতে শুরু করে।

৮৩
আমিনা বিনতে ওহব যুহরিয়ার সঙ্গে পুত্র আবদুল্লাহর বিবাহ
ইবন ইসহাক বলেন, ঐতিহাসিকদের মতে, অতঃপর আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহর হাত ধরে বনু আসাদ ইবন আবদুল উযযা ইবন কুসাই এর এক মহিলার নিকট গমন করেন। মহিলাটি হলো ওয়ারাকা ইবন নওফলের বোন। তাঁর নাম ছিল উম্মে কিতাল। সে সময়ে সে কা’বার নিকট অবস্থান করছিল। আবদুল্লাহকে দেখে সে বলল, ‘আবদুল্লাহ! তুমি যাচ্ছ কোথায়?’ আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমি আমার আব্বার সঙ্গে যাচ্ছি।’ মহিলাটি বলল, ‘যদি তুমি এই মুহূর্তে আমার সাথে মিলিত হতে সম্মত হও তাহলে আমি তোমার বদলে যে সংখ্যক উট জবাই করা হয়েছে, সে সংখ্যক উট তোমাকে দেব।’ জবাবে আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমি আমার আব্বার সঙ্গে আছি। তাকে ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া বা তার মতের বাইরে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ আবদুল্লাহকে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব ওহব ইবন আবদে মানাফ, ইবন যুহরা ইবন কিলাব ইবন মুররা ইবন কা’ব ইবনে লুওয়াই ইব্‌ন গালিব ইবন ফিহর এর নিকট যান। ওহব ইবন আবদে মানাফ তখন বয়স ও মর্যাদায় বনু যুহরার সর্দার ছিলেন। আলাপ-আলোচনার পর তাঁর কন্য আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহর বিবাহ হয়ে যায়। আমিনাও ছিলেন তার সম্প্রদায়ের মহিলাদের নেত্রী। ঐতিহাসিকদের মতে বাড়িতে নিয়ে আসার পর আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহর বাসর হয়। তাতে রাসূলুল্লাহ (সা) তার গর্ভে আসেন।

অতঃপর আবদুল্লাহ পুনরায় বনু আসাদের উল্লিখিত মহিলার নিকট যান। কিন্তু মহিলাটি এবার তাকে কিছুই বলল না। আবদুল্লাহ বললেন, ‘কী ব্যাপার, আজ যে কোন প্রস্তাবই করছ না, যেমনটি গতকাল করেছিলে?’ মহিলাটি বলল, ‘গতকাল তোমার সঙ্গে যে নূর ছিল, এখন আর তা নেই। তোমাকে এখন আর আমার প্রয়োজন নেই।’ উল্লেখ্য যে, এই মহিলা তার ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফলের নিকট শুনেছিল যে, এই উম্মতের মধ্যে একজন নবী আগমন করবেন। তাই তার আকাঙ্খা ছিল যে, সেই নবী তারই গর্ভ থেকে জন্মলাভ করুন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র বংশে প্রেরণ করেছেন। যেমনঃ এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ

( ٱللَّهُ أَعۡلَمُ حَیۡثُ یَجۡعَلُ رِسَالَتَهُۥ )

[Surah Al-An’am 124]

“আল্লাহ রিসালাতের ভার কার উপর অর্পণ করবেন, তা তিনিই ভাল জানেন।” (৬ঃ ১২৪)

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের বিস্তারিত কাহিনী পরে আলোচনা করা হবে।

উম্মে কিতাল বিনতে নওফল তার ব্যর্থতার জন্যে অনুতাপ প্রকাশ করতে গিয়ে নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেছিলেন। ইবন ইসহাক সূত্রে বর্ণিত বায়হাকীর বর্ণনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

عليك بأل زهرة حيث كانوا - وآمنة التي حملت غلاما

تراي المهدي حين نزا عليها-ونورا قد تقمه إماما

فكل الخلق يرجوه جميعا -يسود الناس مهتديا إماما

براه الله من نور صافذه - فأذهب نوره عنا الظلاما

وذاليك صنع ربك اذ حباه - اذا ما سار يواما واقا ما

فيهدي أهل مكة بعد كفر- ويفرض بعد ذالكم الصياما

—শোন, তুমি যুহরার বংশধরদের আঁকড়ে ধরে রাখবে তারা যেখানেই থাকুক। আর আমিনা যে একজন বালককে গর্ভে ধারণ করেছে। হেদায়াতের অগ্রপথিককে দেখতে পাবে যখন সে তার উপর উপগত হবে আর ঐ নূরকে যা তার সম্মুখে পথ প্রদর্শক হিসাবে চলে। সব মানুষ তাঁকে কামনা করে। তিনি হিদায়াত প্রাপ্ত ও ইমাম হয়ে মানুষের নেতা হবেন। আল্লাহ তাঁকে পরিচ্ছন্ন নির্মল নূর দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তারপর তাঁর নূর আমাদের থেকে অন্ধকার দূরীভূত করেছে।

তা আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি তা দান করেছেন। দিনের বেলা যখন তিনি চলমান থাকেন অথবা স্বস্থানে অবস্থান করেন।

কুফরীর পর তিনি মক্কাবাসীদের হেদায়ত দান করবেন। তারপর তিনি তাদের উপর সিয়াম সাধনা ফরয করবেন। আবু বকর মুহাম্মদ ইবন জাফর ইবন সাহল আল খারায়েতী ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, বিবাহ করানোর উদ্দেশ্যে আবদুল মুত্তালিব যখন পুত্র আবদুল্লাহকে নিয়ে রওয়ানা হন তখন তিনি তাবাল’র এক ইহুদী গণক ঠাকুরণীর নিকট যান। এই মহিলাটি বিভিন্ন কিতাব পড়াশুনা করেছিল। তার নাম ছিল ফাতেমা বিনতে মুর আল খাস’আমিয়া। মহিলাটি আবদুল্লাহর চেহারায় নবুয়তের নূর দেখতে পেয়ে বলে উঠল, ‘ওহে যুবক! তুমি কি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে মিলিত হতে পার? তবে তোমাকে আমি একশত উট প্রদান করব।’ জবাবে আবদুল্লাহ বললেনঃ

أما الحرام فا لمات دونه - والحل لا حل فاستينه

فكيف بالأمر الذي تبغيه - يحمي الكريم عرضه ودينه

—এতো হারাম! আর হারামের পরিণতি হচ্ছে ধ্বংস। আমি তো বৈধ পরিণয়ের সন্ধান করছি। কী করে আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দিই? সম্ভ্রান্ত মানুষ তো নিজের মান মর্যাদা ও দীন-ঈমান রক্ষা করে চলে!

আবদুল্লাহ পিতার সঙ্গে চলে যান। পিতা আমিনা বিনতে ওহবের সঙ্গে তাঁকে বিবাহ দিলেন। আবদুল্লাহ আমিনার নিকট তিন দিন অবস্থান করেন। অতঃপর এক সময়ে গণক ঠাকুরণীর নিকট গেলে মহিলাটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার নিকট থেকে গিয়ে তুমি কী করলে?’ আবদুল্লাহ তাকে বিবাহের সংবাদ শুনালেন। শুনে মহিলাটি বলল, ‘আমি চরিত্রহীনা নারী নই। তবে তোমার চেহারায় বিশেষ নূর দেখে চেয়েছিলাম যে, তা আমার মধ্যে আসুক। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম।’ এই বলে মহিলাটি কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেনঃ

إني رأيت مخيلة لمعت - قتلا لأت بحناتم القطر

فلمائتها نورا يضئ له - ما حوله كاضاءة البدر

ورجوتها فخرا أبوء به - ما گل قادح زنده يوري

لله ما زهرية سلبت- ثوبيك ما استلبت وما تدري

—আমি একটি মেঘখণ্ডকে আলোকময় হতে দেখেছি। ফলে মেঘমালা আলোকিত হয়ে উঠেছে। আমি তাকে এমন একটি নূর মনে করলাম। যার কারণে পূর্ণিমার চাঁদের আলোকিত করার ন্যায় তার পার্শ্ববর্তী সবকিছু আলোকিত হয়ে গেল।

আমি তাকে এমন গর্বের বস্তু হিসেবে বরণ করে নিলাম, যাকে আমি নিয়েই আসব।

প্রত্যেক চকমকি প্রজ্জ্বলিতকারী তা প্রজ্জ্বলিত করতে পারে না।

আল্লাহর শপথ, যুহরিয়া গোত্রের নারী তোমার সাধারণ কোন বস্ত্র ছিনিয়ে নেয়নি অথচ তুমি তা জান না। ফাতেমা আরো বলে–

بني هاشم قد غادرت من أخيكم- أمينة أذ للباه يعتركان

كما غادر المصباح عند خموده - قتائل قد میشت له بدهان

وما كل ما يحوي الفتي من تلاده- بحزم ولاما فاته لتواني

فأجمل إذا طالبت إمرأ فإنه - سيكفيكه جدا ان يعتلجان

سيكفيكه إمايد مقفلة - وإما يد مبسوطة نبنان

ولما حوت منه أمينة ماحوت- حوت منه فخرا مالذالك ثان

—হে বনূ হাশিম! আমিনা তোমাদের ভাইকে ধারণ করেছে যখন তারা মধুযামিনী উদযাপন করেছে। যেমনি ভাবে প্রদীপের আলো নির্বাপিত হওয়ার সময় তৈল মিশ্রিত সলতেকে ধারণ করে।

যুবক যা অর্জন করে তা সবটুকু তার পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। আর যা সে নষ্ট করে তা সে উদাসীনতার কারণে নষ্ট করে না। তুমি সৌজন্যমূলক আচরণ করতে থাক যদি তুমি নেতৃত্ব চাও। কারণ তোমার বহু সন্তান-সন্ততির অধিকারী দাদা আর নানাই তোমার নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট। তোমার নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট হবে তুমি কৃপণ হও অথবা দাতাই হও। আমিনা তার থেকে এক মহান সন্তান ধারণ করেছে। তিনি এমন এক গৌরবময় সন্তান ধারণ করেছেন যার তুলনা নাই।

ইমাম আবু নুআয়ম তার দালায়িলুন নবুওয়াতে বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (রা) বলেছেন, আবদুল মুত্তালিব এক শীতের সফরে ইয়ামানে যান। সেখানে তিনি এক ইহুদী পণ্ডিতের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আবদুল মুত্তালিবের ভাষায়, তখন জনৈক আহলি কিতাব আমাকে বলল, ‘আপনার অনুমতি পেলে আমি আপনার শরীরের কিছু অংশ দেখতে চাই।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখতে পার, যদি তা গোপন অঙ্গ না হয়।’ আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘অনুমতি পেয়ে লোকটি এক এক করে উভয় নাকের ভিতরে খুঁটিয়ে দেখল। অতঃপর বলে উঠল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তোমার দুহাতের এক হাতে রাজত্ব আর অপর হাতে রয়েছে নবুওত। আর আমি তা বনূ যুহরায় দেখতে পাচ্ছি। এ কেমন করে হলো?’ আমি বললাম, ‘তা আমি জানি না।’ লোকটি বলল, ‘তোমার কি ‘শাগাহ’ আছে?’ আমি বললাম, ‘শাগাহ’ আবার কী?’ লোকটি বলল, ‘মানে স্ত্রী।’ আমি বললাম, ‘বর্তমানে নেই।’ লোকটি বলল, ‘তাহলে ফিরে গিয়ে যুহরা গোত্রে একটা বিয়ে করে নেবেন।’

আবদুল মুত্তালিব দেশে ফিরে গেলেন এবং হালা বিনতে ওহব ইবন আবদে মানাফ ইবন যাহরাকে বিয়ে করলেন। হালার গর্ভে হামযা ও সাফিয়্যা জন্মগ্রহণ করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব আমিনা বিনতে ওহবকে বিবাহ করেন। আমিনার গর্ভে জন্মলাভ করেন রাসূলুল্লাহ (সা)। আবদুল্লাহ আমিনাকে বিয়ে করার পর কুরাইশরা বলাবলি করতে শুরু করে যে, আবদুল্লাহ তার পিতা আবদুল মুত্তালিবকে সাত করে দিয়েছে।

بسم الله الرحمن الرحيم

৮৪
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পবিত্র জীবন-চরিত
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ٱللَّهُ أَعۡلَمُ حَیۡثُ یَجۡعَلُ رِسَالَتَهُۥ )

[Surah Al-An’am 124]

“আল্লাহ রিসালাতের ভার কার উপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।” (৬ঃ ১২৪)

রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় সম্পর্কে যে ক’টি প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে তিনি একথাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘তোমাদের মাঝে তাঁর বংশ মর্যাদা কেমন?’ উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে তিনি সম্ভ্রান্ত বংশীয়।’ তখন হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন, ‘এমনিভাবে সব রাসূলই নিজ নিজ সমাজের সম্ভ্রান্ত বংশে প্রেরিত হয়ে থাকেন।’ অর্থাৎ রাসূলগণ বংশগতভাবে সকলের চাইতে সম্রান্ত আর তাদের বংশের জনসংখ্যাও সর্বাধিক হয়ে থাকে।

রাসূলুল্লাহ (সা) হলেন আদম সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইহকাল-পরকালে তাদের গর্বের ধন। তাঁর উপনাম আবুল কাসিম ও আবু ইবরাহীম। তিনিই মুহাম্মদ, আহমাদ, আলমাহী- যার মাধ্যমে কুফরের মূলোৎপাটিত হয়। তিনিই আল-আকিব-যার পরে আর কোন নবী নেই। আল-হাশির-যার পদপ্রান্তে সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। তিনি আল-মুকফী, নবীউর রহমত, নবীউত তওবা, নবীউল মালহামাহ, খাতামুন্নাবিয়্যিন, আল-ফাতিহ, ত্বাহা, ইয়াসীন ও আবদুল্লাহ।

বায়হাকী বলেন, কোন কোন আলিম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আরও অনেক নামের উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁকে রাসূল, নবী, আমীন, শাহিদ, মুবাশশির, নাযীর, দাঈআন ইলাল্লাহি বিইযনিহী, সিরাজাম মুনীরা, রাউফুর রাহীম ও মুযাক্কির অভিধায় অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তাঁকে রহমত, নিয়ামত ও হাদী বানিয়েছেন। সীরাত আলোচনার পর স্বতন্ত্র একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বায়হাকী ও ইবন আসাকির সেগুলো সংকলন করেছেন। তাছাড়া স্বতন্ত্রভাবে অনেকে এ বিষয়ে বহু গ্রন্থও রচনা করেছেন। এমনকি কেউ কেউ তো রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এক হাজার নামের তালিকা সংকলনের কসরত পর্যন্ত করেছেন। তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার ইবনুল আরাবী আল-মালিকী তাঁর ‘আল আহওয়াযী’ গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চৌষট্টিটি নামের উল্লেখ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) হলেন আবদুল্লাহর পুত্র। আবদুল্লাহ ছিলেন তাঁর পিতা আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠ পুত্র। এই আবদুল্লাহই ইতিহাসে দ্বিতীয় যবীহ’ বলে খ্যাত, যার বদলে একশত উট জবাই করা হয়েছিল। পূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

যুহরী বলেন, আবদুল্লাহ ছিলেন কুরাইশের সবচাইতে সুশ্রী ব্যক্তি। তার ভাইরা হচ্ছেন হারিস, যুবায়র, হামযা, যিরার, আবু তালিব (যার আসল নাম আবদে মানাফ), আবু লাহাব (যার আসল নাম আব্দুল উযযা) মুকাওয়িম (যার আসল নাম আবদুল কাবা)। কারও কারও মতে মুকাওয়িম আর আবদুল কা’বা ভিন্ন ভিন্ন দুই ব্যক্তি। হাজাল (যার আসল নাম মুগীরা)-প্রখ্যাত দানশীল, গায়দাক (যার আসল নাম নওফল) কারও কারও মতে গায়দাক আর হাজাল এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। এরা সকলেই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা। তার ফুফী ছিলেন ছয়জন। তারা হলেন, আরওয়া, বাররা, উমায়মাহ, সাফিয়্যাহ, আতিকাহ ও উম্মে হাকীম- যার অপর নাম বায়যা। এদের প্রত্যেকের ব্যাপারে পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এরা সকলে ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের সন্তান। আবদুল মুত্তালিবের আসল নাম ছিল শায়বাহ। তাঁর মাথায় কয়েকটি সাদা চুল ছিল বলে তাঁকে শায়বাহ বলা হতো। আবার তাঁর বদান্যতার কারণে তাঁকে শায়বাতুল হামদও বলা হতো।

তাঁকে আবদুল মুত্তালিব নামে আখ্যায়িত করার নেপথ্য কারণ এই যে, তার পিতা হাশিম বাণিজ্যোপলক্ষে যখন মদীনার পথে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হন, তখন একস্থানে আমর ইবনে যায়েদ (ইবনে লাবীদ ইবনে হারাম ইবনে খিদাশ ইবনে খানদাফ ইবনে ‘আদী ইবনে নাজ্জার আল-খাজরাজী আন-নাজ্জারী)-এর বাড়িতে মেহমান হন। আমর ইবনে যায়েদ ছিলেন তার সম্প্রদায়ের সরদার। এ সময়ে তার সালমা নাম্নী এক কন্যাকে দেখে হাশিম মুগ্ধ হন। তিনি তাকে বিবাহের জন্য তার পিতার নিকট প্রস্তাব দেন। আমার ইবন যায়েদ এই শর্তে মেয়েকে তার নিকট বিয়ে দেন যে, মেয়ে পিত্রালয়েই অবস্থান করবে। কারো কারো মতে, বিবাহের শর্ত এই ছিল যে, মদিনায় ছাড়া সালমা সন্তান প্রসব করতে পারবে না। সিরিয়া থেকে ফিরে হাশিম স্ত্রী সালমার সঙ্গে বাসর করেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় চলে আসেন। পরে পুনরায় ব্যবসা উপলক্ষে বের হলে স্ত্রীকেও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। স্ত্রী সালমা তখন গর্ভবতী। ফলে মদীনায় রেখে হাশিম সিরিয়া গমন করেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে গাজায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। স্ত্রী সালমা যথাসময়ে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তিনি তার নাম রাখেন শায়বা। শায়বা দীর্ঘ সাত বছর তাঁর মাতুলালয় আদী ইবন নাজ্জার গোত্রে অবস্থান করে। এরপর চাচা মুত্তালিব ইবনে আবদ মানাফ এসে একদিন শায়বাকে গোপনে মায়ের নিকট হতে নিয়ে মক্কায় চলে যান। লোকেরা দেখে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার সঙ্গে এই বালকটি কে?’ উত্তরে মুত্তালিব বলেন, ( عبدي ) অর্থাৎ আমার গোলাম। জনতা তাকে সাদরে বরণ করে নেয় এবং তাকে আবদুল মুত্তালিব বা মুত্তালিবের গোলাম বলে ডাকতে শুরু করে এবং এই নামই প্রসিদ্ধি লাভ করে। আবদুল মুত্তালিব ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। এক পর্যায়ে কুরাইশ সমাজের নেতৃত্বের আসন লাভ করেন। সকলের সেরা ব্যক্তি বলে পরিচিতি লাভ করেন। আবদুল মুত্তালিব এখন সকলের মধ্যমণি। হাজীদের পানি পান করানো (সিকায়া) এবং জনকল্যাণমূলক সব কাজ (রিফাদা)-এর নেতৃত্ব মুত্তালিবের পরে এখন তার হাতে। জুরহুমের আমল থেকে পরিত্যক্ত হয়ে থাকা যমযম কূপ তিনি পুনঃ খনন করেন। যমযম খননকালে প্রাপ্ত সোনার হরিণ মূর্তিদ্বয়ের সোনা দ্বারা তিনিই সর্বপ্রথম কাবার দরজায় প্রলেপ দেন। আবদুল মুত্তালিবের ভাই-বোনেরা হচ্ছেন আসাদ, ফুযলা, আবু সাইফী, হায়্যা, খালেদা, রুকাইয়া, শিফা ও যয়ীফা। এরা সকলে হাশিমের পুত্র-কন্যা। হাশিমের আসল নাম আমর। কোনো এক দুর্ভিক্ষের বছর গোশতের সঙ্গে ছারীদ তথা ঝোল মিশ্রিত রুটির টুকরা দুর্ভিক্ষ কবলিত অসহায় লোকদের খাবার দিয়েছিলেন বলে লোকেরা তাঁকে হাশিম নাম দেয়। হাশিম শব্দের অর্থ মিশ্রণকারী। হাশিম ছিলেন তাঁর পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইবন জারীর বর্ণনা করেন যে, হাশিম ছিলেন তাঁর তাই আবদে শামস এর জমজ। হাশিম যখন মায়ের পেট থেকে বের হন তখন তার পা আবদে শামস এর মাথার সঙ্গে আটকে ছিল। এতে দু’জনের শরীর থেকেই রক্তক্ষরণ হয়। এতে লোকের মন্তব্য করে যে, এর ফলে এই দু’ ভাইয়ের সন্তানদের মাঝে বিবাদ জন্ম নেবে। কার্যত হয়েছেও তাই। একশ’ তেত্রিশ হিজরী সনে বনু আব্বাস ও বনু উমাইয়া ইবনে আবদে শামস-এর মধ্যে ভয়াবহ সংঘাত অনুষ্ঠিত হয়।

হাশিমের তৃতীয় সহোদর হলেন মুত্তালিব। মুত্তালিব ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর মায়ের নাম আতিকা বিনতে মুররা ইবন হিলাল। তার চতুর্থ ভাইয়ের নাম নওফল। নওফল আরেক মায়ের সন্তান। তার নাম ওয়াকিদা বিনতে আমর আল মাযেনিয়াহ। পিতার মৃত্যুর পর এরা প্রত্যেকেই নেতৃত্বে আসীন হন। সমাজের মানুষ তাদেরকে ত্রাণকর্তা বলে অভিহিত করত। কারণ তারা বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কুরাইশদের জন্য যে কোনো দেশে ব্যবসা করতে যাওয়ার অবাধ নিরাপত্তা এনে দিয়েছিলেন। হাশিম সিরিয়া, রোম ও গাসসান থেকে, আবদে শামস হাবশার রাজা বড় নাজাশী থেকে, নওফল কিসরা থেকে এবং মুত্তালিব হিময়ার এর রাজ্যগুলো থেকে নিরাপত্তা এনে দেন। কবির ভাষায়ঃ

يأيها الرجل المحول رحله - الأ نزلت بأل عبد مناف

— ওহে পরিভ্রমণকারী মুসাফির! তুমি তো আবদে মানাফের বংশের লোকদের আতিথেয়তা গ্রহণ না করে ছাড়নি!

পিতার মৃত্যুর পর হাশিমের দায়িত্বে ছিল সিকায়া তথা হাজীদের পানি পান করানো ও রিফাদা তথা জনকল্যাণমূলক কাজ। আর হাশিম ও তার ভাই মুত্তালিবের যৌথ দায়িত্বে ছিল আত্মীয় স্বজনের বংশ তালিকা সংরক্ষণ করা। তারা সব ভাই জাহিলিয়াত ও ইসলামের উভয় পরিবেশে একান্নভুক্ত ছিলেন, কখনো ভিন্ন হননি। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বন্দী জীবনে তাঁরাও গিরিবর্তে তার সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন। সরে গিয়েছিল শুধু আবদে শামস ও নওফল। এ কারণে আবু তালিব তাদের সম্পর্কে বলতেনঃ

جزى الله عنا عبد شمس ونوفلا- عقوبة شرعاجلا غير أجل

—অনতিবিলম্বে আল্লাহ যেন আবদে শামস ও নওফলকে শাস্তি দিয়ে তাদের অপকর্মের বিচার করেন।

আবু তালিবের পুত্রগণ এক একজন এক এক স্থানে মারা যান। অন্য কোন পিতার সন্তানদের সাধারণত এভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায় না। যেমনঃ হাশিম জেরুজালেমের গাজা উপত্যকায় মৃত্যুবরণ করেন, আবদে শামস মারা যায় মক্কায়, নওফল ইরাকের সালামান নামক স্থানে আর মুত্তালিবের মৃত্যু হয় ইয়েমেনের রায়মান নামক জায়গায়। অনুপম রূপের কারণে মুত্তালিবকে কামরও (চন্দ্র) বলা হতো। হাশিম, আবদে শামস, নওফল ও মুত্তালিব এই চার ভাইই সর্বজন পরিচিত। এদের আরেকজন অখ্যাত ভাই ছিলেন, তাঁর নাম ছিল আবু আমর বা আবদ। তবে তার আসল নাম আবদে কুসাই। এই অখ্যাতির কারণে মানুষ তাকে তাদের আপন ভাই বলে গণ্য করত না। এরপর তাদের আর কোনো ভাই ছিলেন না। যুবায়র ইবনে বাক্কার প্রমুখ একথা বলেছেন।

মুত্তালিবের ছয় বোন ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল তামাযুর, হায়্যা, রীতা, কিলাবা, উম্মুল আখসা ও উম্মে সুফিয়ান। এঁরা সকলে আবদে মানাফের সন্তান ছিলেন। মানাফ একটি মূর্তির নাম। আবদে মানাফের প্রকৃত নাম ছিল মুগীরা। পিতার জীবদ্দশাতেই তিনি সমাজের নেতৃত্ব দিতেন। সকলের কাছে তিনি একজন শ্রদ্ধাভাজন ও মাননীয় ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। আবদে মানাফ ছিলেন আবদুদ্দার এর ভাই। আবদুদ্দার ছিলেন পিতার বড় সন্তান। মৃত্যুকালে পিতা তাকেই নিজের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ওসিয়ত করে যান। আবদুল উযয়া, আবদ, বাররাহ এবং তাখাম্মুরও আবদে মানাফের ভাই। এদের মায়ের নাম ছিল হুয়াই বিনতে হালীল। হুয়াই এর পিতা হালীল ছিলেন খুযায়া গোত্রের সর্বশেষ শাসনকর্তা। তারা সকলেই কুসাই-এর সন্তান ছিলেন। কুসাই-এর আসল নাম যায়েদ। কুসাই নামকরণের কারণ হলো, পিতার মৃত্যুর পর তার মা পুনরায় রবীয়া ইবন হিযাম ইবন আযরা এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর রবীয়া স্ত্রীকে নিয়ে নিজ দেশে রওনা হন।। শিশু যায়েদও মায়ের সঙ্গে ছিলেন। সেই থেকে তিনি কুসাই নামে অভিহিত হন। কুসাই শব্দের অর্থ হচ্ছে দূরদেশী। অতঃপর বড় হয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। কুরায়শরা এদিক-সেদিক বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর কুসাই বিভিন্ন এলাকা থেকে খুঁজে এনে আবার তাদেরকে মক্কায় প্রতিষ্ঠিত করেন। বাইতুল্লাহর দখল থেকে বনি খুযাআকে উৎখাত করে তাদেরকে মক্কা থেকে বের করে দেন। সত্য স্ব-স্থানে প্রতিষ্ঠিত এবং কুসাই এককভাবে কুরাইশের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। দৌত্যকর্ম, যমযম কূপ থেকে হাজীদের পান করানো, বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, যুদ্ধের সময় পতাকা বহন এবং দারুন নাদওয়া ইত্যাদি সবকিছুই তাঁর দায়িত্বে ছিল। বিখ্যাত দারুন-নাদওয়া তাঁর ঘরেই ছিল। তাই কবি বলেনঃ

قصى لعمري كان يدعى مجمعا - به جمع الله القبائل من فهر

—আমার জীবনের শপথ! কুসাই ছিলেন সকলের মিলন সাধনকারী। তার মাধ্যমে আল্লাহ ফিহর এর সব কটি গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

কুসাই ছিলেন যাহরার ভাই। তারা দু’জন ছিলেন কিলাবের পুত্র। তাইম ও ইয়াকযা আবু মাখযূমের ভাই। তারা তিনজনই ছিলেন মুররা-এর পুত্র। মুররার ভাই ছিলেন আদী ও হাসীস। তারা তিনজন ছিলেন কা’ব এর পুত্র। কা’ব প্রতি জুমাবারে তার সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আগমনের সুসংবাদ শোনাতেন এবং এ সংক্রান্ত নানা রকম কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। যেমন আমরা পূর্বে বলে এসেছি। কা’ব ছিলেন। আমের, সামাহ, খুযায়মাহ, সাদ, হারিছ ও আওফ-এর ভাই। তারা সাতজন ছিলেন লুওয়াই-এর পুত্র, আল আদরাম-এর ভাই। লুওয়াই ছিলেন তাইম-এর ভাই আবু তাইম আল-আদরাম ছিলেন গালিব এর পুত্র। হারিছ ও গালিবের ভাই ছিলেন মুহারিব। এরা তিনজন ছিলেন ফিহর এর সন্তান। ফিহর ছিল হারিছ-এর ভাই। তাদের পিতা ছিলেন মালিক। মালিক ছিলেন সালত ইয়াখলুদের ভাই। এঁরা তিনজন ছিলেন নাযর এঁর পুত্র। বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে, এই নাযর-ই ছিলেন কুরায়শ বংশের স্থপতি। আমরা পূর্বে এর প্রমাণও পেশ করে এসেছি। নাযর ছিলেন মালিক, মালকান ও আবদে মানাত প্রমুখের ভাই। তারা সকলে ছিলেন কিনানার পুত্র। আসাদ, আসদাহ ও হাওন ছিলেন কিনানার ভাই। এরা সকলেই ছিলেন খুযায়মার পুত্র। খুযায়মা ছিলেন হুযায়লের ভাই। খুযায়মা ও হুযায়ল ছিলেন মুদরিকাহর পুত্র। মুদরিকার আসল নাম ছিল আমর। তার ভাই ছিলেন তাবিখা, যার আসল ছিল নাম আমির। মুদরিকা, তাবিখা, ও কামআ তিন জনই ছিলেন ইলিয়াসের পুত্র। ইলিয়াসের এক ভাই ছিলেন গায়লান। গায়লান ছিলেন কায়স গোত্রের পিতা। এই ইলিয়াস ও গায়লান দুইজন ছিলেন রবীয়ার ভাই মুযার এর সন্তান। মুযার ও রবীয়াকে সরাসরি ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর বলে দাবি করা হয়। আনমার ও ইয়াদ তায়ামুনা নামে এঁদের আরও দুই ভাই ছিলেন। এই চার ভাই ছিলেন কুযাআর ভাই নেযার-এর সন্তান। এই অভিমত তাদের, যারা মনে করেন যে, কুযাআ হিজাযী ও আদনানী বংশোদ্ভূত। উপরে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নেযার ও কুযাআ মা’আদ ইবনে আদনান-এর সন্তান।

আরবদের যে বংশনামা আমরা বর্ণনা করলাম, এ ব্যাপারে আলিমগণের কোনো দ্বিমত নেই। এই বংশ তালিকায় প্রমাণিত হয় যে, আরবের সকল গোত্রের বংশ পরম্পরা এই পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। এ কারণেই হযরত ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ

( قُل لَّاۤ أَسۡـَٔلُكُمۡ عَلَیۡهِ أَجۡرًا إِلَّا ٱلۡمَوَدَّةَ فِی ٱلۡقُرۡبَىٰ )

[Surah Ash-Shura 23]

—বল, আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আত্মীয়ের সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না। (৪২ঃ২৩) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, কুরায়শের যত গোত্র আছে তাতে এমন কোনো গোত্র নেই, যাদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশ সম্পৃক্ত নয়। ইবনে আব্বাস (রা) যথার্থই বলেছেন। আমি তো এ-ও বলতে চাই যে, আরবের সকল আদনানী গোত্র পিতৃকূলের দিক থেকে রাসূল (সা) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। অনেক গোত্র মাতৃকূলের দিক থেকেও এর সাথে সম্পর্কিত। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক প্রমুখ এরূপই বলেছেন। হাফিজ ইবনে আসাকির-এর অভিমতও অনুরূপ। আদনানের জীবন চরিতে আমরা তার বংশনামা এবং সে সম্পর্কিত মতভেদের উল্লেখ করেছি। আর এও বলেছি যে, আদনান নিশ্চিতরূপে ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর। যদিও তাদের দু’জনের মধ্যে কত পুরুষের ব্যবধান, তাতে মতবিরোধ রয়েছে। উপরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি। আদনান থেকে আদম (আ) পর্যন্ত বংশধারাও উল্লেখ করেছি এবং এ সম্পর্কিত আবুল আব্বাস এর একটি কবিতাও উদ্ধৃত করেছি। হিজাযী আরবের ইতিহাসে এসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থের প্রথম দিকে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন।

বায়হাকী— আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নবী করীম (সা)-এর নিকট সংবাদ এলো যে, কিনদাহ গোত্রের কতিপয় লোক মনে করে যে, তারা আর নবী করীম (সা) একই বংশোদ্ভূত। এ সংবাদ শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ আব্বাস এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারবও এরূপ বলত এবং নিরাপত্তা লাভ করত। আর আমরা নিজেদের বংশধারা অস্বীকার করি না। আমরা নাযর ইবনে কিনানা এর বংশধর। এ বর্ণনার সনদে সন্দেহ আছে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর নবী করীম (সা) খুতবা দান করেন। তাতে তিনি বলেনঃ

আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম ইবন আবদে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবন কা’ব ইবন লুওয়াই ইবন গালিব ইবন ফিহর ইবন মালিক ইবন নযর ইবন কিনানাহ ইবন খুযায়মা ইবন মুদরিকা ইবন ইলিয়াস ইবন মুযার ইবন নিযার। মানুষের গোত্র যেখানেই বিভক্ত হয়েছে সেখানেই আল্লাহ আমাকে উত্তম ভাগে স্থান দিয়েছেন। যেমনঃ আমি পিতা-মাতা থেকে বৈধভাবে জন্মলাভ করেছি, জাহিলিয়াতের ব্যভিচার আমার বংশলতিকাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমার জন্ম বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে, অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়। এই পবিত্রতার ধারা আদম থেকে আমার আব্বা-আম্মা পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলে এসেছে। অতএব ব্যক্তির দিক থেকেও আমি তোমাদের মধ্যে সেরা; বংশের দিক থেকেও। এ সনদটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। এতে কুদামী নামক একজন দুর্বল রাবীর একক বর্ণনা রয়েছে। তবে এর সমর্থনে অন্যান্য বর্ণনা পরে আসছে। আবদুর রাজ্জাক বর্ণনা করেন যে, আবু জাফর আল - বাকির পবিত্র কুরআনের

( لَقَدۡ جَاۤءَكُمۡ رَسُول مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ )

[Surah At-Tawbah 128]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জাহিলী যুগের সন্তান জন্মের কোন অবৈধ উপায় স্পর্শ করেনি। তিনি আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে বলেছেনঃ

إني خرجت من نكاح ولم اخرج من سفاح

— ‘অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়-আমি বৈবাহিক বন্ধন থেকে জন্মলাভ করেছি। এটি একটি উত্তম মুরসাল রিওয়ায়ত।

বায়হাকী.... মুহাম্মদ (র)-এর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে বৈবাহিক বন্ধন থেকে নির্গত করেছেন-অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়। উমর (রা) আলী ইবনে আবু তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ

إن الله أخرجني من النكاح ولم يخرجني من السفاح

— অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়, বৈবাহিক সম্বন্ধ থেকে আমি নির্গত হয়েছি। আদম থেকে আমার আব্বা-আম্মা আমাকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত আমার বংশধারায় এই পবিত্রতা অব্যাহত ছিল। আমার জন্মে জাহিলিয়াতের কোন অপকর্ম আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বর্ণনাটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।

ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

ما ولدني من نكاح أهل الجاهلية شيئ

—জাহিলী যুগের লোকদের কোন বিবাহ আমাকে জন্ম দেয়নি। যে বিবাহ থেকে আমার জন্ম তা ইসলামের বিবাহ। এ বর্ণনাটিও গরিব পর্যায়ের। মুহাম্মদ ইবন সা’দ বর্ণনা করেন, হযরত আয়েশা (রা)-এর বরাতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবন আসাকির ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রে

( وَتَقَلُّبَكَ فِی ٱلسَّـٰجِدِینَ )

[Surah Ash-Shu’ara 219]

(সিজদাকারীদের সঙ্গে তোমার উঠা-বসা দেখেন। ২৬ঃ ২১৯) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ অর্থাৎ এক নবীর পরে আরেক নবী আসেন। এক পর্যায়ে আমিও নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছি। ইবন সা’দ মুহাম্মদ কালবীর পিতার সূত্রে বলেন, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মায়ের বংশধারার পাঁচশত মহিলার তালিকা সংকলন করেছি। তাঁদের কোন একজনকে না ব্যাভিচারী পেয়েছি, না জাহিলিয়াতের কোন অনাচারে সম্পৃক্ত পেয়েছি। বুখারী শরীফে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

بعثث من خير قرون بنى أدم قرنا فقرنا حتى بعثت من القرن الذي كنت فيه

– মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উত্তম যুগে আমি প্রেরিত হয়েছি। এক এক করে বহু যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এই যুগে এসে আমার আবির্ভাব হয়েছে।

সহীহ মুসলিমে ওয়াছিলা ইবন আসকা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ ইবরাহীমের বংশ থেকে ইসমাঈলকে, ইসমাঈলের বংশ থেকে বনু কিনানাকে, বনু কিনানা থেকে কুরায়শকে এবং কুরায়শ থেকে বনু হাশিমকে নির্বাচিত করেছেন। আর আমাকে নির্বাচিত করেছেন হাশিম থেকে।

ইমাম আহমদ— মুত্তালিব ইবন আবু ওয়াদাআহ আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন,একদা লোকেরা কানাঘুষা শুরু করলে সে খবর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কানে আসে। ফলে তিনি মিম্বরে উঠে বললেনঃ ‘আমি কে?’ জনতা জবাব দিল, ‘আপনি আল্লাহর রাসূল (সা)।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ “আমি আবদুল মুত্তালিব এর পুত্র আবদুল্লাহর সন্তান মুহাম্মদ। আল্লাহ জগত সৃষ্টি করে আমাকে সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন। সকল মানুষকে দুইটি দলে বিভক্ত করে আমাকে শ্রেষ্ঠ দলে স্থান দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন গোত্র সৃষ্টি করে আমাকে সেরা গোত্রে রেখেছেন। অতঃপর সব গোত্রকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করে আমাকে তাদের শ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্য করেছেন। ফলে আমি পরিবারের দিক থেকেও তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং ব্যক্তিগত দিক থেকেও তোমাদের মধ্যে সেরা।”

ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান —আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি একদিন বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কুরাইশরা যখন নিজেরা পরস্পরে মিলিত হয়, তখন হাসিমুখে মিলিত হয়। আর আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তাদের চেহারায় বৈরীভাব ফুটে ওঠে।’ একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তারপর বললেনঃ

والذي نفس محمد بيده لا يدخل قلب رجل الإيمان حتى يحبكم لله ولرسوله

“যার মুঠোয় মুহাম্মদের জীবন, আমি তাঁর শপথ করে বলছি, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের ভালোবাসবে।” আব্বাস (রা) বলেন, একথা শুনে আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কুরাইশরা একদিন বসে তাদের বংশধারা নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলো। তাতে আপনাকে তারা কোন এক ঊষর ভূমিতে অবস্থিত খেজুর গাছের সঙ্গে তুলনা করল।’ শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ “আল্লাহ বিশ্বজগত সৃষ্টি করে আমাকে সৃষ্টির সেরা দলের অন্তর্ভুক্ত করলেন। অতঃপর সৃষ্টির সব মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করলেন, তাতে গোত্র হিসেবেও আমাকে সকলের শ্রেষ্ঠ গোত্রে রাখলেন। অতঃপর যখন মানুষগুলোকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করলেন, তখনও পরিবারের দিক থেকেও আমাকে সকলের শ্রেষ্ঠ পরিবারভুক্ত করলেন। অতএব আমি ব্যক্তি হিসাবেও সৃষ্টির সেরা পরিবার হিসাবেও সকলের শ্রেষ্ঠ।”

ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুলাহ (সা) বলেছেনঃ

“আল্লাহ সৃষ্টির সকল মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন। তাতে দু’ভাগের মধ্যে যেভাগ শ্রেষ্ঠ, আমাকে তার অন্তর্ভুক্ত করেন।” কুরআনের আয়াতঃ

( وَأَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ مَاۤ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ )

[Surah Al-Waqi’ah 27]

-এর এটাই তাৎপর্য। আমি ( أَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ ) তথা ডানের লোকদের অন্তর্ভুক্ত। আবার আমি ( أَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ ) এর সকলের সেরা। এই দুই ভাগকে আবার তিনভাগে ভাগ করেন। আমাকে তার মধ্যকার শ্রেষ্ঠ ভাগে রাখেন। পবিত্র কুরআনের আয়াত

( وَأَصۡحَـٰبُ ٱلۡمَشۡـَٔمَةِ مَاۤ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡمَشۡـَٔمَةِ ۝ وَٱلسَّـٰبِقُونَ ٱلسَّـٰبِقُونَ )

[Surah Al-Waqi’ah 9 – 10]

-এ একথাই বলা হয়েছে। আমি এই ( سَّـٰبِقُونَ ) বা অগ্রগামীদের সেরা। অতঃপর এই তিন দলকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করেছেন। আমাকে বানিয়েছেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গোত্রের মানুষঃ

( وَجَعَلۡنَـٰكُمۡ شُعُوب ا وَقَبَاۤىِٕلَ لِتَعَارَفُوۤا۟ۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِیمٌ خَبِیر ࣱ)

[Surah Al-Hujurat 13]

(আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। তোমাদের যে যত মুত্তাকী, আল্লাহর নিকট সে তত মর্যাদাবান। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা। (৪৯ঃ ১৩) আয়াতের এটাই অর্থ। আমি আদমের সন্তানদের সর্বাপেক্ষা মুত্তাকী এবং আল্লাহর নিকট সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন। কথাটা গর্ব নয়। অতঃপর গোত্রগুলোকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহর বাণীঃ

( إِنَّمَا یُرِیدُ ٱللَّهُ لِیُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَیۡتِ وَیُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِیر ࣰا)

[Surah Al-Ahzab 33]

(হে আহলে বায়ত! আল্লাহ তোমাদের থেকে পঙ্কিলতা দূর করে তোমাদেরকে সর্বোতভাবে পবিত্র করতে চান।) আয়াতে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফলে আমি ও আমার পরিবার যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র। বর্ণনাটি গরীব ও মুনকার পর্যায়ের। হাকিম ও বায়হাকী.... ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ঘরের আঙ্গিনায় বসা ছিলাম। এ সময় এক মহিলা সে স্থান দিয়ে অতিক্রম করেন। দেখে একজন বলল, ইনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কন্যা। ঠিক তখন আবু সুফিয়ান বলল, হাশিম গোত্রে মুহাম্মদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে গোবরে পদ্মফুলের মতো। মহিলাটি চলে গেলেন এবং কথাটা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কানে দিলেন। শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের নিকট আসলেন। তাঁর চেহারায় তখন অসন্তোষ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল। এসে তিনি বললেনঃ “ব্যাপার কি, আমি কী সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি? আল্লাহ সাত আকাশ সৃষ্টি করে তার ঊর্ধ্বলোকে যাদেরকে ইচ্ছা স্থান দিলেন। অতঃপর তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বনী আদমকে মনোনীত করলেন। বনী আদমের মধ্য থেকে মনোনীত করলেন আরবদেরকে আর আরবদের মধ্য থেকে মনোনীত করলেন মুযারকে। মুযার-এর থেকে মনোনীত করলেন কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে, আর বনু হাশিম থেকে আমাকে। অতএব আমি সেরার সেরা। ফলে যে ব্যক্তি আরবদেরকে ভালোবাসল, সে আমার খাতিরেই তাদেরকে ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি আরবদের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করল, আমার সঙ্গে বিদ্বেষ থাকার কারণেই তাদের সঙ্গে সে বিদ্বেষ পোষণ করল।”

তবে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

أنا سيد ولد آدم يوم القيامة ولا فخر

“আমি কিয়ামতের দিন আদম সন্তানদের সরদার রূপে থাকবো। এটা আমার গর্ব নয়।”

হাকিম ও বায়হাকী...... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “জিবরাঈল আমাকে বললেন যে, আমি পৃথিবীটা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে দেখলাম, মুহাম্মদ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাউকে পেলাম না। আবার পৃথিবীটা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত উলট-পালট করলাম; কিন্তু হাশিমের গোত্র অপেক্ষা উত্তম কোন গোত্রের খোঁজ পেলাম না।’ বায়হাকী মন্তব্য করেন যে, বর্ণনাগুলোতে দুর্বলতা থাকলেও একটি অপরটির সমর্থক হওয়ায় গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঠিক এই মর্মে আবু তালিব নবী করীম (সা)-এর প্রশংসায় বলতেনঃ

إذا اجتمعت يوما قريش لمفخر - فعبد مناف سرها وصميمها

فإن حملت أشراف عبد منافها - ففى هاشم أشرافها وقديمها

وإن فخرت يوما فإن محمدا - هو المصطفى من سرها وكريمها

تداعت قريش غثها و سمينها علينا فلم تظفر وطاشت حلومها

وكنا قديما لانقر ظلامة- اذا ما ثنوا صعر الخدود نقيمها

ونحمي حماها كل يوم كريهة - ونضرب عن أحجارها من يرومها

بنا إنتعش العود الذاء وإنما- بأكنافنا تنمى وتنمى أرومها

—কুরায়শ যদি কখনো গৌরব করার জন্য সমবেত হয়, তো আবদে মানাফ-ই সেই মহান ব্যক্তি, যাকে নিয়ে কুরাইশ গর্ব করতে পারে। আবার আবদে মানাফের সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত ব্যক্তিদের খুঁজে পেতে চাইলে তাদেরকে হাশিম গোত্রেই খুঁজতে হবে।

তারা যদি আরো গৌরব করতে চায়, তাহলে মুহাম্মদকে নিয়েই তা করতে হবে। কেননা মুহাম্মদই হলেন তাদের মধ্যে মহান ব্যক্তিদের বাছাই করা ব্যক্তি।

কুরাইশের শীর্ণ মোটা সকলে আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি এবং তাদের বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটেছে।

অতীতে আমরা অত্যাচার স্বীকার করতাম না। লোকে অবজ্ঞা ভরে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমরা তা সোজা করে দিতাম। যে কোন দুর্দিনে আমরা তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম আর বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিরোধ করতাম। আমাদের উসিলায় নেতিয়ে পড়া কাঠ সোজা হয়ে দাঁড়াত এবং আমাদের এই সহযোগিতায় তা সজীব হতো এবং বৃদ্ধি লাভ করত।

আবুস সাকান খারীম ইবনে আউস সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাবুক থেকে ফিরে আসা কালে আমি তার দরবারে হাজির হলাম, তখন আমি ইসলাম গ্রহণ করি। তখন শুনতে পেলাম, আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব বলছেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার প্রশংসা করতে চাই।’ জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আচ্ছা বল, আল্লাহ তোমার মুখে ফুল চন্দন ফুটান।’

অনুমতি পেয়ে বলতে শুরু করলেনঃ

من قبلها طبت في الظلال وفئ - مستودع حيث يخصف الورق

ثم هبطت البلاد لا بشر أ -نت ولا مضغة ولا علق

بل نطقة تركب السفين وقد- الجم نسرا واهله الغرق

تنقل من صلب إلى رحم - إذا مضى عالم بدأ طبق

حتى احتوى بيتك المهيمن من - خندف علياء تحتها النطق

وأنت لما ولدت أشرقت الأرض -وضاءت بنورك الأفق

فنحن في ذالك الضياء وفي أل - نور وسبل الرشاد نخترق

—এক সময়ে আপনি অবস্থান করেছেন, ছায়াময় এবং সংরক্ষিত স্থানে। তারপর আপনি ধরায় অবতরণ করলেন। তখন আপনি না পূর্ণাঙ্গ মানব, না গোশতের টুকরা, না রক্তপিণ্ড। বরং এক ফোটা বীর্য কিশতিতে আরোহণ করে আসলেন। অথচ, তখনকার সব জনপদ ভেসে গিয়েছিল প্লাবনের পানিতে। তারপর আপনি পিতার মেরুদণ্ড থেকে মায়ের গর্ভে স্থানান্তরিত হলেন এবং ধীরে ধীরে একজন পূর্ণাঙ্গ মানবের রূপ ধারণ করলেন। নিজ ঘরের শোভা হয়ে এক সময়ে ভূমিষ্ঠ হলেন পৃথিবীতে। আপনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, তখন আপনার আলোতে আলোকিত হল সমগ্র পৃথিবী। এখন সেই আলোতে আমরা পথ চলি।

এই কবিতাগুলো হাসসান ইবনে সাবিত (রা)-এর নামেও বর্ণিত হয়েছে। যেমনঃ ইবন আসাকির ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমার আব্বা-আম্মা আপনার জন্য কুরবান হোন। বলুন তো, আদম (আ) যখন জান্নাতে, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আমার এ প্রশ্ন শুনে নবী করীম (সা) হেসে উঠলেন। এমনকি তার সামনের ক’টি দাঁত দেখা গেল। তারপর তিনি বললেনঃ ‘আমি আদমের মেরুদণ্ডে ছিলাম। আমার পিতৃপুরুষ নূহ (আ) তাঁর মেরুদণ্ডে করে আমাকে নিয়ে কিশতিতে আরোহণ করেন। তারপর আমাকে আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীমের মেরুদণ্ডে করে (অগ্নিকুণ্ডে) নিক্ষেপ করা হয়। আমার বংশ লতিকার কোন পিতা-মাতাই জীবনে কখনো ব্যভিচারে সম্পৃক্ত হননি। আল্লাহ আমাকে কুলীন মেরুদণ্ড থেকে পূত-পবিত্র জরায়ুতে স্থানান্তরিত করতে থাকেন। আমার পরিচয় হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। যখনই মানুষ ভালো-মন্দ দু’দলে বিভক্ত হয়, আমি ভালো ও শ্রেষ্ঠ দলে থাকি। আল্লাহ নবুওত দ্বারা আমার অঙ্গীকার এবং ইসলাম দ্বারা আমার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। তাওরাত ও ইনজীলে আমার সুসংবাদ প্রকাশ করেছেন এবং প্রত্যেক নবীকে আমার বিস্তারিত পরিচয় জানিয়েছেন। আমার নূরে বিশ্বজগত এবং আমার মুখমণ্ডলে মেঘমালা আলোকিত হয়। আল্লাহ আমাকে তার কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন এবং তার নামে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। আল্লাহ তার নিজের নাম থেকে বের করে আমার নাম রেখেছেন। ফলে আরশের অধিপতি হলেন মাহমুদ আর আমি হলাম মুহাম্মদ ও আহমদ। আল্লাহ আমাকে হাউযে কাওছার দিয়ে ধন্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং আমাকে সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম সুপারিশ মঞ্জুরকৃত ব্যক্তিরূপে মনোনীত করেছেন। এরপর আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ যুগে আমার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। আমার উম্মত অত্যধিক প্রশংসাকারী। তারা সৎকাজের আদেশ করে এবং অন্যায় কাজ থেকে বারণ করে।

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, তখন হাসসান ইবন সাবিত নবী করীম (সা)-এর শানে পূর্বোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন যাতে বলা হয়েছে-

قبلها طبت في الظلال وفي مستودع يوم يخصف الورق ……

শুনে নবী করীম (সা) বললেন, আল্লাহ হাসসানের প্রতি রহমত করুন। তৎক্ষণাৎ আলী ইবন আবু তালিব বলে উঠলেন, ‘কাবার প্রভুর শপথ, হাসসানের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ ইবন আসাকির এ বর্ণনাটিকে ‘গরীব’ বলেছেন। আমার মতে এগুলো মুনকারও বটে।

কাজী ইয়ায তাঁর ‘আশ-শিফা’ গ্রন্থে বলেছেন, বিভিন্ন আসমানী কিতাবে যে আহমদের কথা বলা হয়েছে এবং বিভিন্ন নবীকে যার সংবাদ দেওয়া হয়েছে, তার নামে যেন কারও নামকরণ করা না হয় এবং তার আর্বিভাবের আগে কেউ যেন নিজেকে আহমদ বলে দাবি না করে, কৌশলে আল্লাহ তার পথ রুদ্ধ করে দেন। যাতে দুর্বলমনা লোকদের মধ্যে কোন রকম বিভ্রান্তি বা সন্দেহ সৃষ্টি হতে না পারে। তদ্রুপ নবী কারীম (সা) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরব-অনারবের কারো মুহাম্মদ নামকরণ করা হয়নি। ‘কেবল মুহাম্মদ নামের একজন নবীর আবির্ভাব হবে’- একথাটা ব্যাপক প্রচার লাভ করার পর আরবের গুটিকতেক লোক তাদের ছেলেদের মুহাম্মদ নামে নামকরণ করেছিল এই আশায় যে, এই ছেলেই সেই মুহাম্মদ হয় কিনা। তারা হলো, মুহাম্মদ ইবনে উহায়হা ইবন জাল্লাহ আল-আওসী, মুহাম্মদ ইবন সালামা আনসারী, মুহাম্মদ ইবন বারা আল-কিনদী, মুহাম্মদ ইবন সুফিয়ান ইবন মুজাশি, মুহাম্মদ ইবন হামরান আল জুফী ও মুহাম্মদ ইবন খুযায়ী আস-সালামী। ব্যস, এ পর্যন্তই। কোন সপ্তম ব্যক্তি এ নামে নেই। কারও কারও মতে সর্বপ্রথম যার নাম মুহাম্মদ নামকরণ করা হয়েছিল, সে হলো মুহাম্মদ ইবন সুফিয়ান ইবন মুজাশী। ইয়ামানীদের মতে আযদ এর মুহাম্মদ ইবন লিয়াহমুদই এই নামের প্রথম ব্যাক্তি। কিন্তু আল্লাহ এদের প্রত্যেককে নবুয়ত দাবী করা, অন্য কেউ এদেরকে নবী বলে স্বীকার করা কিংবা নবুয়তের কোন লক্ষণ এদের মধ্যে প্রকাশ পাওয়া থেকে নিবৃত রাখেন।

৮৫
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম
রাসূলুল্লাহ (সা) সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম মুসলিম তার সহীহ মুসলিমে আবু কাতাদা (র) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এক বেদুইন জিজ্ঞাসা করল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সোমবার দিনের রোযা সম্পর্কে আপনি কী বলেন?’ জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা) বললেনঃ “ঐ দিনেই তো আমার জন্ম এবং ঐ দিনেই আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়।”

ইমাম আহমদ (র) ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) জন্মগ্রহণ করেছেন সোমবার দিন, নবুওত পেয়েছেন সোমবার দিন, মদীনা হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেছেন সোমবার দিন, মদীনায় পৌঁছেছেন সোমবার দিন, তার ওফাত হয়েছে সোমবার দিন এবং হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করেছেন সোমবার দিন।’ অপর এক বর্ণনায় আছে, সূরা মায়িদার আয়াত

( ٱلۡیَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِینَكُمۡ )

[Surah Al-Ma’idah 3]

(আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম) এর অবতরণ এবং বদর যুদ্ধও এই সোমবার দিন সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই অভিমতটি সঠিক নয়। কারণ, ইবন আসাকিরের মতে নির্ভরযোগ্য অভিমত হলো, বদর যুদ্ধ ও আলোচ্য আয়াতের অবতরণ শুক্রবার দিন হয়েছে। তার অভিমতটিই যথার্থ। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সোমবার দিনই ইন্তিকাল করেছেন। এভাবে ভিন্ন সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সোমবার দিনই ইন্তিকাল করেছেন। এভাবে ভিন সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সোমবার দিন জন্ম গ্রহণ করেছেন, তাঁর সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করার ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই। যিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) রবিউল আউয়াল মাসের সতের তারিখ শুক্রবার দিন জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন। হাফিজ ইবনে দিহইয়া জনৈক শিয়ার ‘ইলামুর রাবী বি-ইলামিল হাদী’ নামক গ্রন্থ থেকে এরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। তিনি একে যয়ীফ বলে মন্তব্য করেছেন। এটা আসলেও দুর্বল।

জমহুর আলিমগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, রাসূলুলাহ (সা) জন্মের মাসটি হলো রবিউল আউয়াল মাস। তারিখের ব্যাপারে নানা অভিমত রয়েছে। ইবন আবদুল বার তার ইসতিয়াব গ্রন্থে রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন। ওয়াকিদীও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

হুমায়দী ইবন হাযম থেকে ৮ তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন। মালিক, আকীল ও ইউনুস ইবন ইয়াযীদ প্রমুখ যুহরী মুহাম্মদ ইবন জুবায়র ইবন মুৎইম সূত্রে এই অভিমত বর্ণনা করেছেন। ইবন আবদুল বার বর্ণনা করেছেন যে, ঐতিহাসিকগণ এই অভিমতকে সঠিক বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। হাফিয মুহাম্মদ ইবন মুসা আল-খাওয়ারেযমী এই অভিমতটি অকাট্য বলে দাবি করেছেন। হাফিয আবুল খাত্তাব ইবন দিহইয়া তাঁর ‘আত তানভীর ফী মাওলিদিল বাশীরিন নাযীর’ গ্রন্থে এই অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারও কারও মতে, রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ। ইবন দিহইয়া তার কিতাবে এই অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। ইবন আসাকির আবু জাফর আল-বাকির থেকে এবং মুজালিদ (র) শা’বী থেকে এই অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। কারও কারও মতে রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখ। ইবন ইসহাক এ অভিমতের পক্ষে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন।

ইবন আবু শায়বা তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে হযরত জাবির (রা) এবং ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) হাতির ঘটনার পর রবিউল আউয়াল মাসের আঠার তারিখ সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনেই তিনি নবুওত লাভ করেন। এই দিনেই তাঁর মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়, এই দিনেই তিনি হিজরত করেন এবং এই দিনেই তাঁর ওফাত হয়। জমহুরের নিকট এই অভিমতই প্রসিদ্ধ। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

কারও কারও মতে, রবিউল আউয়ালের সতের তারিখ। ইবন দিহইয়া কোন কোন শিয়া আলিম থেকে এটি উদ্ধৃত করেছেন। কেউ কেউ বলেন, রবিউল আউয়ালের ৮ দিন বাকী থাকতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইবন দিহইয়া ইবন হাযম থেকে এই অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। তবে ইবন হাযম থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত দু’টি মতের বিশুদ্ধতর প্রথমটি হচ্ছে নবী করীম (সা)-এর জন্ম রবিউল আউয়ালের আট তারিখে। তা থেকে বর্ণিত দ্বিতীয় অভিমতটি হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা) রমযান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন। এটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের বর্ণনা। এই অভিমতের ভিত্তি এই যে, যেহেতু সর্বসম্মত মতে কোনও এক রমযান মাসে নবী করীম (সা)-এর প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয় আর তা ছিল তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে, কাজেই তার জন্মও রমযান মাসেই হয়ে থাকবে। তবে এই অভিমতটিতে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।

খায়ছামা ইবন সুলায়মান..... ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুৱাহ (সা) রবিউল মাসে সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেন। রবিউল আউয়াল মাসের শুরুর দিকে সোমবার তিনি নবুওত লাভ করেন এবং ঐ মাসেরই সোমবার তার প্রতি সূরা বাকারা নাযিল হয়। ইবন আসাকিরের এ বর্ণনা অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। যুবায়র ইবন বাক্কার বলেন, নবী করীম (সা)-কে তার মা আবী তালিবের গিরিসঙ্কটে দ্বিতীয় জামরার নিকট আইয়ামে তাশরীকে গর্ভে ধারণ করেন এবং রমযান মাসের বার তারিখে তিনি সেই রাতেই ভূমিষ্ঠ হন, যা পরবর্তীতে হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ এর ভাই মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ-এর বাড়ি বলে পরিচিত হয়।

হাফিজ ইবন আসাকির বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) মুহররমের দশ তারিখে মায়ের গর্ভে আসেন এবং রমজান মাসের বার তারিখ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল বাড়ীর ঘটনার ২৩তম বছরে। কথিত আছে যে, খলিফা হারূনুর রশীদ এর মা খায়জারান যখন হজ্জে যান, তখন উক্ত বাড়িটিকে মসজিদে পরিণত করার আদেশ দেন। পরবর্তীকালে ঐ বাড়িটি তাঁরই নামে পরিচিত হয়।

সুহায়লী উল্লেখ করেন, রাসুলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম ছিল নয়সান তথা এপ্রিলের বিশ তারিখে। ননসান হলো সময় ও ঋতুর দিক থেকে সর্বাপেক্ষা ভারসাম্যপূর্ণ। পঞ্জিকাবিদদের মতে এটি যুলকারনায়ন-এর আটশত বিরাশি বছর পরের ঘটনা।

ইবন ইসহাক বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের ঘটনাটি ঘটেছিল হস্তী বাহিনীর বায়তুল্লাহ আক্রমণের বছর। জমহুরের নিকট এটাই প্রসিদ্ধ অভিমত। ইবরাহীম ইবন মুনযির হিযামী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যে হস্তীবাহিনীর ঘটনার বছর জন্মগ্রহণ করেছেন এবং এর চল্লিশ বছরের মাথায় নবুওত লাভ করেছেন, তাতে আমাদের আলিমগণের কারও কোনও সংশয় নেই। বায়হাকী ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) হস্তীবাহিনীর ঘটনার বছর জন্মলাভ করেছেন। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, কায়স ইবন মাখরামা (রা) বলেছেন, আমি এবং রাসূলুল্লাহ (সা) হস্তীবাহিনীর ঘটনার বছর জন্মগ্রহণ করি। আমাদের জন্য একই সময়ে। উছমান (রা) বনী ইয়ামুর ইবন লায়ছ গোত্রের কুবাছ ইবন। আশইয়ামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি বড়, নাকি রাসূলুলাহ (সা) বড়?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘বড় তো রাসূলুল্লাহ (সা)-ই।’ তবে আমি তাঁর আগে দুনিয়াতে এসেছি। হস্তীবাহিনীর ধ্বংসলীলা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ইবন ইসহাক বলেন, উকায-এর বছর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল বিশ বছর।

ইবন ইসহাক বলেন, ফিজার যুদ্ধের ঘটনা হস্তী বাহিনীর ঘটনার বিশ বছর পর সংঘটিত হয়েছে। কা’বা পুনঃনির্মাণের ঘটনা ঘটেছে ফিজারের পনের বছর পর। আর রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওত লাভ করেন কা’বা পুনঃনির্মাণের পাঁচ বছর পর। মুহাম্মদ ইবন জুবায়র ইবন মুতইম বলেন, উকায মেলা বসেছিল হস্তির ঘটনার পনের বছর পর। কা’বা পুনঃনির্মাণ হয়েছে উকাযের দশ বছর পরে। আর রাসূলুল্লাহ নবুওত লাভ করেন কা’বা পুনঃনির্মাণের পনের বছর পর।

হাফিজ বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, আবুল হুওয়ায়রিছ বলেন, আমি শুনেছি যে, আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান কুবাছ ইবন আহশাম কিনানীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কুবাছ! তুমি বড়, না রাসূলুল্লাহ (সা) বড়?’ জবাবে কুবাছ বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) আমা অপেক্ষা বড়। তবে আমার বয়স তার চাইতে বেশি। রাসূলুল্লাহ (সা) হস্তির ঘটনার বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। আর স্পষ্ট মনে আছে যে, আমার মা আমাকে নিয়ে হাতির বিষ্টার নিকট গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ (সা) জন্মের চল্লিশ বছরের মাথায় নবুওত লাভ করেন।’

ইয়াকুব ইবন সুফিয়ান বর্ণনা করেন যে, সুওয়াইদ ইবন গাফালা বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সমবয়সী। হস্তির ঘটনার বছর আমার জন্ম।’ বায়হাকী বলেন যে, সুওয়াদ ইবন গাফালা সম্পর্কে এও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দু’বছরের ছোট।’ মুহাম্মদ ইবন জুবায়র ইবন মুতইম বলেন, হাতীর ঘটনার বছর রাসূলুল্লাহ (সা) জন্মগ্রহণ করেন। এর পনের বছর পর অনুষ্ঠিত হয় উকায মেলা। পঁচিশ বছর পর কাবা পুনঃনির্মিত হয়। চল্লিশ বছরের মাথায় নবী করীম (সা) নবুওত লাভ করেন।

সারকথা, জমহুর-এর অভিমত অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা) হস্তির ঘটনার বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। কারও মতে হস্তির ঘটনার একমাস পরে। কারও মতে চল্লিশ দিন পরে, অপর কারও মতে পঞ্চাশ দিন পরে। পঞ্চাশ দিনের অভিমতই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

আবু জাফর বাকের (র) থেকে বর্ণিত যে, হস্তি বাহিনীর আগমনের ঘটনা মুহাররমের মধ্য ভাগে ঘটেছিল আর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের ঘটনা ঘটে তার পঞ্চান্ন দিন পরে। অন্যরা বলেন, না বরং হস্তির ঘটনা ঘটেছে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের দশ বছর আগে। ইবন আবযা এরূপ বলেছেন। কারও কারও মতে, তেইশ বছর আগে। কেউ কেউ বলেছেন, ত্রিশ বছর পরে। মূসা ইবন উকবা যুহরী থেকে এই অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তিনি ওই অভিমত সমর্থনও করেছেন। আবু যাকারিয়া আজলানী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম হস্তির ঘটনার চল্পিশ বছর পরের ঘটনা। ইবন আসাকিরের এই বর্ণনা অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। ইবন আব্বাস (রা) থেকে একটি বর্ণনা আছে যে, তিনি বলেছেন রাসূলুল্লাহ (সা) হস্তির ঘটনার পনের বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। তবে এই বর্ণনাটি গরীব, মুনকার ও দুর্বল। তবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম হস্তির ঘটনার বছরে হওয়ার বিষয়টি প্রায় সর্বসম্মত।

৮৬
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের বিবরণ
আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি যে, আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহকে যবেহ করার মান্নত করে পরে আল্লাহর ইচ্ছায় তার পরিবর্তে একশত উট যবেহ করেন। কারণ, মহান আল্লাহর তা’আলা নির্ধারণ মোতাবেক আব্দুল্লাহর ঔরসে সমগ্র আদম সন্তানের সরদার সর্বশেষ রাসূল ও উম্মী নবীর আর্বিভাব পূর্বেই নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব তাঁকে কুরাইশের এক সম্ভান্ত পরিবারে বুদ্ধিমতী বিচক্ষণ কন্যা আমিনা বিনতে ওহব (ইবন আবদে মানাফ ইবন যাহরা)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন। তাঁদের মিলনের পর রাসূলুল্লাহ (সা) আমিনার গর্ভে আসেন। বলাবাহুল্য, ওরাকা ইবন নওফলের বোন উম্মে কিতাল রাকীকা বিনতে নওফল আমিনার সঙ্গে মিলনের পূর্বে আব্দুল্লাহর ললাটে নূর দেখতে পেয়েছিলেন। ফলে তিনি উক্ত নূরের ছোঁয়া লাভ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। কারণ তিনি তার ভাই-এর নিকট শুনতে পেয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ নামক একজন নবী আবির্ভূত হবেন এবং সে সময়টি আসন্ন। তাই তিনি আবদুল্লাহর সাথে মিলনের জন্য, মতান্তরে বিবাহের জন্য নিজেকে পেশ করেন। বিবাহের প্রস্তাবের কথাই সমধিক প্রসিদ্ধ। কিন্তু আবদুল্লাহ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে সেই নূর আমিনার মধ্যে স্থানান্তরিত হলে ওরাকা ইবন নওফলের বোনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার জন্য আবদুল্লাহ অনেকটা বিব্রত বোধ করেন। এবার তিনি নিজে অনুরূপ প্রস্তাব দিলে মহিলাটি বলে এখন আর তোমাকে দিয়ে আমার কোন প্রয়োজন নেই। তখন সে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ করে এবং অত্যন্ত উঁচুমানের কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করে।

উল্লেখ যে, এভাবে চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কারণেই ঘটেছিল, আব্দুল্লাহর জন্য নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ٱللَّهُ أَعۡلَمُ حَیۡثُ یَجۡعَلُ رِسَالَتَهُ )

[Surah Al-An'am 124]

“রাসূল কাকে বানাবেন, আল্লাহ নিজেই তা ভালো জানেন।”

ইতিপূর্বে এ মর্মে একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে, অবৈধ মিলনে নয় বৈবাহিক বন্ধন থেকেই তিনি জন্মলাভ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তার পিতা আবদুল্লাহ ইন্তিকাল করেন। এটাই প্রসিদ্ধ অভিমত। মুহাম্মদ ইবন সা’দ বর্ণনা করেন যে, আইয়ূব বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব কুরায়শ-এর এক বণিক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ার গাজা অঞ্চলে যান। বাণিজ্য শেষে ফেরার পথে মদীনা পৌঁছলে আবদুল্লাহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তিনি তাঁর মাতুলগোষ্ঠী বনী আদী ইবন নাজ্জার-এর কাছে থেকে যান এবং তাদের নিকট অসুস্থ অবস্থায় এক মাস অবস্থান করেন। সঙ্গীরা মক্কা পৌঁছলে আবদুল মুত্তালিব পুত্রের কথা জানতে চাইলে তারা বলে, তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর মাতুলালয়ে রেখে এসেছি। খবর শুনে আবদুল মুত্তালিব তাঁর বড় ছেলে হারিছকে প্রেরণ করেন। হারিছ মদীনায় গিয়ে দেখেন, আবদুল্লাহর ইন্তিকাল হয়েছে এবং দারুন্নাবিগায় তাকে দাফন করা হয়েছে। তখন তিনি ফিরে এসে পিতাকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। সংবাদ শুনে পিতা আবদুল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহর ভাই-বোনেরা শোকাহত হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন মায়ের গর্ভে। মৃত্যুকালে আবদুল্লাহর বয়স ছিল পঁচিশ বছর।

ওয়াকিদী বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে আব্দুল্লাহর মৃত্যুর ব্যাপারে এটিই সর্বাপেক্ষা সঠিক অভিমত। তিনি বর্ণনা করেন যে, আবদুল মুত্তালিব আব্দুল্লাহকে খেজুর আনবার জন্য মদীনা প্রেরণ করেছিলেন। সেখানে তিনি ইন্তিকাল করেন।

মুহাম্মদ ইবন সা’দ বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স যখন আটাশ মাস, তখন তাঁর পিতা আব্দুল্লাহর মৃত্যু হয়। কারও কারও মতে, তখন তাঁর বয়স ছিল সাত মাস। তবে মুহাম্মদ ইবন সা’দ-এর নিজের অভিমত হলো, আবদুল্লাহর মৃত্যুকালে রাসূলুল্লাহ (সা) মাতৃগর্ভে ছিলেন। যুবায়র ইবন বাক্কার-এর বর্ণনা মতে পিতার মৃত্যুকালে রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন দুই মাসের শিশু। মায়ের মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল বার বছর আর যখন তাঁর দাদার মৃত্যু হয়, তখন তিনি আট বছরের কিশোর। মৃত্যুকালে দাদা আবদুল মুত্তালিব চাচা আবু তালিবের হাতে তাঁর লালন-পালনের ভার অর্পণ করে যান। ওয়াকিদী ও তাঁর লিপিকার (ইবন সা’দ) মতে পিতার মৃত্যুর সময় রাসূলুল্লাহ (সা) মায়ের গর্ভে ছিলেন। এটিই এতীমত্বের ঊর্ধ্বতন স্তর। এমর্মে হাদীছ পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আমি গর্ভে থাকাবস্থায় আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, যেন তার মধ্য থেকে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদসমূহ আলোকিত করে ফেলেছে।” মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, আমিনা বিনতে ওহব নিজে বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তার গর্ভে থাকাকালে স্বপ্নে কে যেন তাকে বলে যায়, তুমি এই উম্মতের সরদারকে গর্ভে ধারণ করেছ। তিনি ভূমিষ্ঠ হলে তুমি বলবে, এঁকে আমি সকল হিংসুকের অনিষ্ট ও যাবতীয় বিপদাপদ থেকে এক আল্লাহর আশ্রয়ে সোপর্দ করছি। কারণ প্রশংসাৰ্হ আল্লাহর নিকট তিনি মর্যাদাবান। তাঁর সঙ্গে এমন একটি নূর বের হবে, যা সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ সমূহকে আলোকিত করে ফেলবে। ভূমিষ্ঠ হলে তুমি তার নাম রাখবে মুহাম্মদ, তাওরাতে তাঁর নাম আহমদ। আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা তার প্রশংসা করে। ইনজীলেও তাঁর নাম আহমদ। আর কুরআনে তার নাম মুহাম্মদ।

আমিনার স্বপ্ন সম্পর্কিত এই দু’টি হাদীস প্রমাণ করে যে, তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যেন তার মধ্য হতে এমন একটি নূর বের হয়েছিল, যাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়। অতঃপর নবী করীম (সা)-এর জন্মের পর তিনি এই স্বপ্নের বাস্তবরূপ প্রত্যক্ষ করেন।

মুহাম্মদ ইবন সা’দ (র) ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, আমিনা বিনতে ওহব বলেছেন- মুহাম্মদ আমার গর্ভে থাকাবস্থায় প্রসব পর্যন্ত তার জন্য আমি বিন্দুমাত্র কষ্ট অনুভব করিনি। প্রসবের সময় তার সঙ্গে একটি নৃর বের হয়, যা পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব আলোকিত করে তোলে। আমার গর্ভ থেকে বের হওয়াকালে তিনি উভয় হাতে মাটিতে ভর দেন। অতঃপর হাতে এক মুঠো মাটি নিয়ে আসমানের দিকে উঁচু করেন। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহ (সা) দুই হাঁটুতে ভর করে হামাগুড়িরত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হন। আর তাঁর সঙ্গে এমন একটি আলো নির্গত হয় যে, তার আলোতে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ ও হাট-বাজার সব আলোকিত হয়ে যায়। আমিনা বলেন, সেই আলোতে বসরার উটের ঘাড়সমূহ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। তখন শিশু নবীর মাথা আসমানের দিকে উত্থিত ছিল। বায়হাকী উছমান ইবন আবুল আস থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমার মা আমাকে বলেন যে, আমিনা বিনতে ওহব শিশু নবীকে প্রসবের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, সে রাতে আমিনার ঘরে আমি নূর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। আমি দেখতে পেলাম, আকাশের তারকাগুলো যেন এসে আমার গায়ের ওপর পড়ছে।

কাজী ইয়ায আবদুর রহমান ইবন আওফ এর মা শিফা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) দুই হাতে ভর করে ভূমিষ্ঠ হয়ে কেঁদে ওঠেন। তখন আমি শুনতে পেলাম, কেউ একজন বলে উঠলেনঃ “আল্লাহ আপনাকে রহম করুন”। আর তার সঙ্গে এমন এক আলো উদ্ভাসিত হয় যে, তাতে রোমের রাজপ্রাসাদসমূহ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আমিনা তার দাসী মারফত আবদুল মুত্তালিবের নিকট খবর পাঠান। স্বামী আবদুল্লাহ তো আমিনার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়ই মারা গিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, আবদুল্লাহ যখন মৃত্যুবরণ করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তখন আটাশ মাসের শিশু। তবে কোনটা সঠিক, তা আল্লাহই ভালো জানেন।

দাসী গিয়ে আবদুল মুত্তালিবকে বলে যে, ‘দেখে আসুন, আপনার একটি নাতি হয়েছে।’ আবদুল মুত্তালিব আমিনার নিকট আসলে আমিনা সব ঘটনা খুলে বলেন। এই সন্তানের ব্যাপারে তিনি স্বপ্নে কি দেখেছিলেন এবং তার কি নাম রাখতে আদিষ্ট হয়েছেন, তাও তিনি ব্যক্ত করেন। সব শুনে আবদুল মুত্তালিব রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিয়ে কা’বার অভ্যন্তরে ‘হোবল’ এর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য দোয়া করেন এবং মহান আল্লাহর সমীপে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেনঃ

الحمد لله الذي أعطاني - هذا الغلام الطيب الأردان

قد ساد في المهد على الغلمان- أعيذهبالبيت ذي الأركان

حتى يكون بلغة الفتيان - حتى أرآه بالغ البنيان

أعيذهمن كل ذي شنان - من حاسد مضطرب العنان

ذى همة ليس له عينان - حتى أراه رافع اللسان

أنت الذي سميت في القر ان - في كتب ثابتة المثاني

أحمد مكتوب على اللسان

– সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাকে পবিত্র আস্তিন এর অধিকারী এই শিশুটি দান করেছেন। আমার বাসনা, দোলনায় বসেই এই শিশু আর সব শিশুর ওপর কর্তৃত্ব করবে। রুকন বিশিষ্ট ঘরের নিকট আমি এর জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এই শিশুকে আমি যুবকদের আদর্শরূপে পরিণত বয়সে দেখতে চাই। সকল অনিষ্ট ও হিংসুকের বিদ্বেষ থেকে এর জন্য আমি আশ্রয় চাই। আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি উদ্ধত ফণাবিশিষ্ট চক্ষুবিহীন সর্প থেকে। তুমিই (হে আমার প্রিয় নাতি!) কুরআনে-মহান গ্রন্থসমূহে আহমদ নামে আখ্যায়িত এবং লোকজনের রসনায় তোমার নামটি লিপিবদ্ধ রয়েছে।

বায়হাকী বর্ণনা করেন, ইবন আব্বাস (রা) তাঁর পিতা আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) খতনাকৃত ও নাড়ি কর্তিত জন্মগ্রহণ করেন দেখে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব মুগ্ধ হয়ে যান এবং বলেন, উত্তরকালে আমার এই সন্তানটি যশস্বী হবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। এর বিশুদ্ধতা সন্দেহমুক্ত নয়। অনুরূপ একটি বর্ণনা আবু নুয়ায়মেরও রয়েছে। কেউ কেউ একে বিশুদ্ধ এমন কি মুতাওয়াতির পর্যায়ের পর্যন্ত বলেছেন। কিন্তু তাও সন্দেহমুক্ত নয়। ইবন আসাকির বর্ণনা করেন যে, আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “আল্লাহর নিকট আমার মর্যাদার একটি হলো এই যে, আমি খতনাকৃত অবস্থায় জন্মলাভ করেছি এবং আমার লজ্জা স্থান কেউ দেখতে পায়নি।”

হাফিজ ইবন আসাকির আবু বাকরাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, জিবরীল (আ) যখন নবী করীম (সা)-এর বক্ষ বিদারণ (সীনা চাক) করেন, তখন তিনি তার খতনাও করেন। এটা নিতান্ত ‘গরীব’ পর্যায়ের। অন্য এক সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব তার খাতনা করেন এবং সেই উপলক্ষে কুরাইশদেরকে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়িত করেন।

বায়হাকী আবুল হাকাম তানুখী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, কুরাইশদের সমাজে নিয়ম ছিল যে, কোন সন্তান জন্ম হলে তারা নবজাতককে পরবর্তী ভোর পর্যন্ত কতিপয় কুরাইশ মহিলাদের নিকট দিয়ে রাখত। শিশুটিকে তারা পাথর নির্মিত ডেগ দিয়ে ঢেকে রাখতো। রাসূলুল্লাহ (সা) ভূমিষ্ঠ হলে নিয়ম অনুযায়ী আবদুল মুত্তালিব তাঁকেও সেই মহিলাদের হাতে অর্পণ করেন। মহিলারা তাকেও ডেগ দিয়ে ঢেকে রাখে। ভোর হলে এসে তারা দেখতে পায় যে, ডেগ ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে আছে আর শিশু মুহাম্মদ দু’চোখ খুলে বিস্ফারিত নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলারা দৌড়ে আবদুল মুত্তালিবের নিকট এসে বলে, ‘কি আশ্চর্য, এরূপ নবজাতক তো আমরা কখনও দেখিনি। ভোরে এসে আমরা দেখতে পেলাম যে, ডেগ ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে আছে আর সে চোখ দুটো খুলে বিস্ফারিত নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে!’ শুনে আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘তাকে তোমরা হেফাজত কর, আমি আশা করি, ভবিষ্যতে এই শিশু যশস্বী হবে কিংবা বললেন, সে প্রচুর কল্যাণের অধিকারী হবে।’ সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব তার আকীকা করেন এবং কুরাইশদেরকে দাওয়াত করেন। আহার শেষে মেহমানরা বলল, ‘আবদুল মুত্তালিব! যে সন্তানের উপলক্ষে আজকের এই নিমন্ত্রণের আয়োজন, তার নাম কি রাখলে?’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আমি তার নাম মুহাম্মদ রেখেছি।’ শুনে তারা বলল, ‘পরিবারের অন্যদের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখলেন না যে!’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আমার ইচ্ছা, আসমানে স্বয়ং আল্লাহ আর যমীনে তাঁর সৃষ্টিকূল তার প্রশংসা করবেন।’ ভাষাবিদগণ বলেন, মুহাম্মদ কেবল তাকেই বলা হয়ে থাকে, যিনি যাবতীয় মহৎ গুণের ধারক। যেমনঃ কবি বলেনঃ

اليك ابيت اللعن أعلمت ناقتي - إلى الماجد القرم الكريم المحمد

– দূর হয়ে যাও, তুমি অভিশাপকে অস্বীকার করেছ। আমি আমার উষ্ট্রীকে সর্বগুণে প্রশংসিত, সম্মানিত, আদরে লালিত মর্যাদাবান মুহম্মদের উদ্দেশ্যে পরিচালিত করেছি।

কোন কোন আলিম বলেন, আল্লাহ ইলহাম করেছিলেন যে, তোমরা এর নাম রাখ মুহাম্মদ। কারণ, এই শিশুর মধ্যে যাবতীয় মহৎগুণ বিদ্যমান। যাতে নামে ও কাজে মিল হয় এবং যাতে নাম ও নামকরণ আকারে ও তাৎপর্যে সাযুজ্যপূর্ণ হয়। যেমন নবীজি (সা)-এর চাচা আবু তালিব বলেনঃ

وشق له من اسمه ليجله - فذو العرش محمود وهذا محمد

— মর্যাদা দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর জন্য নিজের নাম থেকে নাম বের করে এনেছেন। আরশের অধিপতি আল্লাহর নাম মাহমুদ আর ইনি মুহাম্মদ।

কারও কারও মতে এই পংক্তিটি হাসসান ইবনে সাবিত-এর রচিত।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নামসমূহ এবং তাঁর শামায়িল তথা অবয়বের বর্ণনা, পূত-পবিত্র, নবুওতের প্রমাণাদি ও মর্যাদার বিবরণ সীরাত অধ্যায়ের শেষে উল্লেখ করব, ইবনশাআল্লাহ।

বায়হাকী আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি একদিন বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার নবুওতের একটি আলামত আমাকে আপনার দীন কবুল করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দোলনায় থাকতে আমি আপনাকে দেখেছি যে, আপনি চাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং নিজের আঙ্গুল দিয়ে চাঁদের প্রতি ইংগিত করছেন। আপনি যেদিকে ইশারা করতেন চাঁদ সেদিকেই ঝুঁকে পড়তো।’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, “আমি তখন চাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম এবং চাঁদ আমার সঙ্গে কথা বলতো এবং আমার কান্না ভুলিয়ে দিত। আর আমি আরশের নিচে চাঁদের সিজদা করা কালে তার পতনের শব্দ শুনতে পেতাম।” রাবী বলেন, এ বর্ণনার রাবী একজন মাত্র আর তিনি অজ্ঞাত পরিচয়।

৮৭
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের রাতে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাবলী
রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে তুমিষ্ঠ হন, সে রাতে অসংখ্য মূর্তির উপুড় হয়ে পড়া ও স্থানচ্যুত হওয়া, হাবশা অধিপতি নাজাশীর দেখা ঘটনার বিবরণ, জন্মের সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে নূর বের হয়ে তাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যাওয়া; রাসূল (সা)-এর মাতৃগর্ভ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আকাশপানে মাথা তুলে বের হয়ে আসা, ডেগ ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া, রাসূলুল্লাহ (সা) যে ঘরে জন্মলাভ করেন, সে ঘরটি আলোকিত হয়ে যাওয়া এবং নক্ষত্ররাজি মানুষের নিকটবর্তী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনার বিবরণ আমরা ইতিপূর্বে ‘অজ্ঞাত স্থান থেকে জিনের কথা বলা’ অধ্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি।

সুহায়লী বর্ণনা করেন যে, ইবলীস জীবনে চারবার বিলাপ করেঃ ১. অভিশপ্ত হওয়ার সময়। ২. জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময়। ৩. রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের সময় এবং ৪. সূরা ফাতিহা নাযিল হওয়ার সময়।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক ইহুদী মক্কায় বাস করত। সে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে ভূমিষ্ঠ হন সে রাতে কুরাইশ এর এক মজলিসে সে বলল, ‘আজ রাতে কি তোমাদের মধ্যে কারও কোনও সন্তানের জন্ম হয়েছে?’ জবাবে তারা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা এ রকম কিছুই জানি না।’ ইহুদীটি বলল, ‘আল্লাহু আকবার! তোমাদের অজান্তে ঘটে থাকলে তো কোনও অসুবিধা নেই। তবে তোমর খোঁজ করে দেখ এবং যা বলছি স্মরণ রাখ। এ রাতে আখেরী নবী ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। তার দুই কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চিহ্ন আছে। তাতে ঘোড়ার কেশরের মত একগুচ্ছ চুল আছে। দু’রাত তিনি দুধ পান করবেন না। কারণ একটি দুষ্ট জিন তার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে তাঁকে দুধ পান থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়েছে।’

শুনে লোকজন মজলিস ছেড়ে উঠে চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ে। ইহুদীর কথায় তারা হতভম্ভ স্তম্ভিত! ঘরে গিয়ে প্রত্যেকে তারা ঘরের লোকদেরকে এ খবরটি শুনায়। শুনে তারা বলে উঠে, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! আব্দুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিবের একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তারা তার নাম রেখেছে মুহাম্মদ।’ এবার তারা ইহুদীর কথা ও এই নবজাতক সম্পর্কে কানাঘুষা করতে করতে ইহুদীর নিকট যায় এবং তাকে এ খবরটি জানায়। ইহুদীটি বলল, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে চল, আমি তাকে একটু দেখব।’ লোকেরা ইহুদীকে নিয়ে আমেনার ঘরে গিয়ে তাকে বলল, ‘তোমার পুত্রটিকে একটু আমাদের কাছে দাও।’ আমেনা পুত্রকে তাদের কাছে দিলে তারা তার পিঠের কাপড় সরিয়ে ইহুদীর বর্ণিত নিদর্শনটি দেখতে পায়। সাথে সাথে ইহুদী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার জ্ঞান ফিরলে লোকেরা তাকে বলল, ‘কী ব্যাপার, আপনার হয়েছে কি?’ ইহুদীটি বলল, ‘আল্লাহর শপথ, নবুওত বনী ইসরাঈল থেকে বিদায় নিল! তোমরা এতে আনন্দিত হও, হে কুরাইশের দল! আল্লাহর শপথ, তোমাদের সহায়তায় তিনি এমন বিজয় লাভ করবেন যে, প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে তার সুসমাচার ছড়িয়ে পড়বে।’ মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, হাসসান ইবন সাবিত (রা) বলেছেন, আমি তখন সাত কি আট বছরের বালক। যা শুনি বা দেখি, তা বুঝবার বয়স তখন আমার হয়েছে। হঠাৎ একদিন সকাল বেলা ইয়াসরিবে জনৈক ইহুদীকে চীৎকার করে বলতে শুনলাম, ‘হে ইহুদী সমাজ!’ চীৎকার শুনে লোকজন তার নিকট এসে ভীড় জমায় এবং বলে, ‘বল, কি হয়েছে তোমার?’ সে বলল, ‘আহমদ নামের যে লোকটির জন্ম হওয়ার কথা, এই রাতে তার তারকা উদিত হয়েছে।’

হাফিজ আবু নুয়ায়ম ‘দালায়িলুন্নবুওয়াহ’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, আবু মালিক ইবন সিনান বলেন, একদা আমি গল্পগুজব করার জন্য আবদুল আশহাল গোত্রে যাই। তখন আমরা তাদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ। সে সময়ে আমি শুনতে পেলাম যে, ইউশা নামক এক ইহুদী বলছে, ‘আহমদ নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি হেরেম থেকে বেরিয়ে আসবেন। এ কথা শুনে খলীফা ইবন ছালাবা আল-আশহালী উপহাস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘তার পরিচয় কী হে?’ ইহুদী বলল, ‘তিনি হবেন এমন এক ব্যক্তি যিনি না হবেন বেঁটে, না লম্বা। দু’চোখে তার লালিমা থাকবে। তিনি হবেন কমলীওয়ালা। তিনিও গাধায় সওয়ার হবেন। তার কাঁধে তরবারী ঝুলানো থাকবে। এই নগরী হবে তার হিজরত স্থল।’ আবু মালিক ইবন সিনান বলেন, ইহুদীর কথায় অভিভূত হয়ে আমি আমার স্বগোত্র বনু খাদরায় চলে এলাম। আমার নিকট থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘এ কথা কি ইউশা একাই বলছে, নাকি ইয়াসরিবের সব ইহুদীর একই কথা!’ আবূ মালিক বলেন, ‘এই ঘটনার পর আমি বনূ কুরায়যার নিকট যাই। সেখান গিয়ে দেখতে পেলাম, একদল মানুষ আখেরী নবী সম্পর্কেই আলাপ-আলোচনা করছে।’ কথা প্রসঙ্গে যুবায়র ইবন বাতা বললেন, ‘সেই লাল নক্ষত্রটি উদিত হয়ে গেছে, যা কখনও কোনও নবীর আগমন বা আবির্ভাবের উপলক্ষ ছাড়া কোনদিন উদিত হয় না। এখন তো আহমদ ছাড়া আর কোন নবীর আগমনের বাকী নেই। আর এই ইয়াসরিবই হবে তার হিজরত স্থল।’

আবু সাঈদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা আগমন করার পর আমার আব্বা তাঁকে এই ঘটনাটি শুনান। শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘যুবায়র যদি মুসলমান হত, তাহলে নেতৃস্থানীয় অনেক ইহুদীও মুসলমান হয়ে যেত। কারণ ওরা এর অনুগত।’

আবু নুয়ায়ম (র) বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবন সাবিত (রা) বলেন, বনু কুরায়যা ও বনু নযীর এর ইহুদী পণ্ডিতগণ নবী করীম (সা)-এর পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করতেন। অবশেষে লাল নক্ষত্র উদিত হয়ে গেলে তারা ঘোষণা করে যে, ইনিই আখেরী নবী; এর পরে আর কোনও নবী আসবেন না। নাম তার আহমদ এবং তার হিজরত স্থল হবে ইয়াসরিব। কিন্তু যখন নবী করীম (সা) হিজরত করে মদীনায় আসলেন আর তারা তাঁকে অগ্রাহ্য করে, হিংসা করে ও কুফরী করে। আবু নুয়াইম তার কিতাবেও এই ঘটনাটি উল্লেখ করেন। আবু নুয়াইম ও মুহাম্মদ ইবন হিব্বান বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়েল বলেছেন, সিরিয়ার বিশিষ্ট ইহুদী পন্ডিত মুবিয়ান বলেছেন, তোমার নগরীতে একজন নবী আবির্ভাব ঘটবে। ইতিমধ্যে তার নক্ষত্র উদিত হয়ে গেছে। তুমি দেশে ফিরে গিয়ে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তার অনুসরণ কর।

কিসরার সিংহাসন প্রকম্পিত হওয়া, অগ্নিকুণ্ড নির্বাপিত হওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা

হাফিজ আবু বকর মুহাম্মদ ইবন জাফর ইবন সাহল আল-খারায়েতী ‘হাওয়াতিফুল জান্ন’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, হানী আল-মাখয়ুমী যিনি দেড়শ বছর আয়ু পেয়েছিলেন-বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেন, সে রাতে কিসরার রাজপ্রাসাদ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, তার চৌদ্দটি গম্বুজ ভেঙ্গে যায়, পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়। অথচ আর আগে এক হাজার বছরের মাঝে কখনও তা নির্বাপিত হয় নি। সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যায় এবং সিরীয় ধর্মযাজক মুবিযান স্বপ্নে দেখেন যে, কতগুলো উট কতগুলো ঘোড়াকে হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাড়া খেয়ে ঘোরাগুলো দজলা নদী (টাইগ্রীস) অতিক্রম করে তাদের জনপদসমূহে ছড়িয়ে পড়েছে।

উপরোক্ত ঘটনায় কিসরা ভীত-সম্ভস্ত হয়ে উঠেন। ধৈর্যধারন করার চেষ্টা করেও তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। অবশেষে তিনি পারিষদবর্গকে ডেকে পাঠান। মাথায় মুকুট পরে সিংহাসনে বসে উপস্থিত পারিষদবর্গের উদ্দেশে তিনি বলেনঃ ‘তোমরা কি জান, তোমাদেরকে কেন সমবেত করা হয়েছে?’ সকলে বলল, ‘না, আমরা কিছুই জানি না। আপনি অবহিত করলেই তবে আমরা জানতে পারব।’ ঠিক এই সময় আগুন নির্বাপিত হওয়া সংক্রান্ত পত্র তাদের কাছে এসে পৌঁছে। এতে কিসরার দুশ্চিন্তার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এরপর মুবিযান যা দেখছিলেন তার কথা এবং তার ভয়াবহতার কথা ব্যক্ত করেন।

মুবিযান বলেন, আল্লাহ বাদশাহর রাজত্ব অটুট রাখুন।আজ রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি।এই বলে তিনি পারিষদবর্গকে তার উট সংক্রান্ত স্বপ্নের কথা বিবৃত করে শুনান।কিসরা জিজ্ঞেস করেন, বল তো মুবিযান! এ সবের অর্থ কি হতে পারে? মুবিযান বললেন, ‘আরবের কোন এক উপকণ্ঠে বিশেষ কোনও একটি ঘটনা ঘটে থাকবে!’ তৎক্ষণাৎ কিসরা নুমান ইবন মুনযির এর নিকট এ মর্মে পত্র লিখেনঃ

রাজাধিরাজ কিসরার পক্ষ থেকে নুমান ইবন মুনযির এর প্রতিঃ পত্র পাওয়া মাত্র আমার নিকট একজন পন্ডিত ব্যক্তিকে পাঠিয়ে দিবে, যার নিকট আমি উদ্ভুত প্রশ্নের যথাযথ জবাব পাব।

পত্র পেয়ে নুমান ইবন মুনযির আবদুল মাসীহ ইবন আমর ইবন হায়্যান ইবন নুফায়লা আল-গাসসানীকে রাজদরবারে পাঠিয়ে দেন। তিনি এসে পৌঁছলে কিসরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যা প্রশ্ন করব তুমি তার জবাব দিতে পারবে কি?’ জবাবে আবদুল মাসীহ বলেনঃ ‘মহারাজ যা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমার জানা থাকলে আমি তার জবাব দিব; অন্যথায় এমন ব্যক্তির সন্ধান দেব, যিনি এর জবাব দিতে সক্ষম হবেন।’ কিসরা তাঁকে ঘটনাটি খুলে বলেন। জবাবে আবদুল মাসীহ বলেন, ‘আমার এক মামা এর জবাব দিতে পারবেন। তিনি সিরিয়ার সাতীহ নামক স্থানের উপকণ্ঠে বাস করেন।’ কিসরা বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি তার কাছে গিয়ে দেখ, সে এর জবাব দিতে পারে কিনা। আমি যা জানতে চাই তাকে তা জিজ্ঞেস করে তার ব্যাখ্যা জেনে এসো।’ আবদুল মাসীহ সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়ায় রওয়ানা হয়ে মুমূর্ষ সাতীহ এর নিকট পৌঁছেন। তিনি তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু সাতীহ সালামের কোন জবাবও দিলেন না বা কোন কথাও বললেন না। তখন আবদুল মাসীহ কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেন। তা শুনে এবার সাতীহ মাথা তুলে বলেন, ‘আবদুল মাসীহ! উটের পিঠে চড়ে তুমি সাতীহ এর নিকট এসেছ। অথচ সে তখন মৃত্যুপথযাত্রী। আমি জানি, তোমাকে সাসান বংশের বাদশাহ প্রেরণ করেছেন। রাজপ্রাসাদ প্রকম্পিত হওয়ায়, অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়ায় এবং মুবিযানের স্বপ্ন; যাতে তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, উটগুলো ঘোড়াগুলোকে তাড়া করছে এবং দজলা অতিক্রম করে জনপদসমূহে ছড়িয়ে পড়েছে। শোন হে আবদুল মাসীহ! যখন তিলাওয়াত বৃদ্ধি পাবে, মোটা ছড়িওয়ালা আত্মপ্রকাশ করবেন, সামাওয়া উপত্যকা প্লাবিত হবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে এবং পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যাবে, তখন শাম আর সাতীহ এর জন্য শাম থাকবে না। গম্বুজের সমসংখ্যক রাজা-রাণী তার কর্তৃত্ব কেড়ে নেবে, আর সেই সময়টি এসে পড়েছে।’ একথাটি উচ্চারণ করেই সাতীহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

আবদুল মাসীহ তখনই বাহনে চড়ে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রওয়ানা হয়ে পড়েন। কিসরার নিকট এসে তিনি তাকে শুনান। সাতীহ যা বলেছেন, তার বিবরণ দেন। শুনে কিসরা বলে উঠেন, ‘তার মানে দাঁড়াল, আমার পর চৌদ্দজন রাজা রাজত্ব করবে।’

বাস্তবিক পরবর্তী চার বছরে দশজন রাজা পারস্যের সিংহাসনে বসেন। অবশিষ্টগণ রাজত্ব করেন হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত পর্যন্ত। বায়যাবীও অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। আমার মতে, পারস্যের সর্বশেষ রাজা যার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয় তিনি হলেন, ইয়াযদাগির্দ ইবন শাহরিয়ার ইবন পারভেজ ইবন হুরমুয় ইবন নওশিরওয়া। এই রাজার আমলেই রাজপ্রাসাদে ফাটল ধরে। তার আগে তার পূর্বসূরীরা তিন হাজার একশ’ চৌষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন। এদের সর্বপ্রথম রাজা ছিলেন খিওমারত ইবন উমাইম ইবন লাওয ইবন সাম ইবন নূহ।

আলোচ্য সাতীহ এর পরিচয় প্রসঙ্গে ইবন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে, এই লোকটির নাম রবী ইবন রবীয়া ইবন মাসউদ ইবন মাযিন ইবন যিব ইবন আদী ইবন মাযিন ইবন আল-আযদ। কেউ কেউ তাঁকে রবী ইবন মাসউদও বলেছেন। তাঁর মা রিদআ বিনতে সাদ ইবনুল হারিছ আল-হাজুরী। তার বংশ লতিকা ভিন্নভাবেও বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আসাকির-এর মতে তিনি জাবিয়ায় বাস করতেন। তিনি আবূ হাতিম সাজিসতানী থেকে বর্ণনা করেন যে, তাঁর কয়েকজন শায়খ বলেছেন, সাতীহ হচ্ছেন লোকমান বিন আদ-এর পরবর্তী যুগের মানুষ। মহাপ্লাবনের আমলে তার জন্ম। বাদশাহ যীনাওয়াসের আমল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ প্রজন্মের আয়ু তিনি লাভ করেন। তাঁর আবাস ছিল বাহরাইবন।

আবদুল কায়স গোত্র দাবি করে যে, সাতীহ তাদের বংশের লোক, অপরদিকে আযদ গোত্রীয়দের দাবি হচ্ছে যে, তিনি তাদের বংশের। অধিকাংশ মুহাদ্দিস সাতীহকে আযদ বংশীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তবে আমি বুঝে উঠতে পারছি না যে, তাঁর প্রকৃত পরিচয় কী? তবে তার বংশধররা নিজেদেরকে আদবংশীয় বলে দাবি করেন।

ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, সাতীহ-এর সঙ্গে আদম সন্তানের কারো কোনও মিল ছিল না। তার দেহ ছিল গোশতের একটি টুকরা, যার মাথায় দু’চোখে ও দু’হাতে ছাড়া আর কোথাও অস্থি অথবা শিরা ছিল না। কাপড় যেভাবে ভাজ করা যায় তেমনি তাকেও দু’পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত ভাঁজ করা যেত। জিহবা ছাড়া আর দেহে নাড়বার মত কিছুই ছিল না। কেউ কেউ বলেন, সাতীহ রেগে গেলে তার দেহ ফুলে যেত এবং তিনি বসে পড়তেন।

ইবন আব্বাস (রা) আরও বলেন, সাতীহ একবার মক্কায় এসেছিলেন। কুসাই এর দুই পুত্র আবদে শামস ও আবদে মানাফ সহ মক্কার নেতৃস্থানীয় অনেকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন। তারা তাকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব তিনি দেন। শেষ যুগে কী ঘটবে, সে বিষয়েও তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে যা ইলহাম করেছেন, তার আলোকে বলছি যে, হে আরব জাতি! তোমরা এখন চরম বার্ধক্যের যুগে উপনীত। তোমাদের আর অনারবদের বুদ্ধি-বিচক্ষণতা সমান। তোমাদের নিকট না আছে বিদ্যা, না আছে বুদ্ধি। তবে তোমাদের পরবর্তীদের মধ্যে এমন কিছু বিবেকবান লোকের আবির্ভাব ঘটবে যে, তারা নানা প্রকার বিদ্যা অন্বেষণ করবে। সেই বিদ্যার আলোকে তারা মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলবে, যোগ্য লোকের অনুসরণ করবে, অনারবদের হত্যা করবে এবং বকরীর পাল তালাশ করে বেড়াবে। অতঃপর এই নগরবাসীদের মধ্যে হতে এমন একজন সুপথপ্রাপ্ত নবীর আবির্ভাব ঘটবে, যিনি সত্য ও সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা করবেন এবং বহু দেবতার উপাসনা পরিহার করে এক ‘রব’ এর ইবাদত করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁকে প্রশংসিত এক স্থানে তুলে নেবেন। তখন তিনি ইহজগত থেকে আড়ালে থাকবেন; কিন্তু আকাশে থাকবেন প্রকাশমান। তারপর এমন এক সিদ্দিক তথা মহাসত্যবাদী তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, যিনি বিচার করবেন সঠিক এবং অধিকার প্রদানে হবেন অকুণ্ঠচিত্ত।

এরপর সরল-সঠিক পথের অনুসারী, অভিজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত এক ব্যক্তি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন। আতিথেয়তা ও ন্যায় বিচারে তিনি হবেন সর্বজনবিদিত। অতঃপর সাতীহ হযরত উছমান (রা), তার হত্যা এবং তৎপরবর্তী বনু উমাইয়া ও বনু আব্বাসের যুগে যা কিছু ঘটবে, সব উল্লেখ করেন। এরপর যত ফেতনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হবে, তাও তার বক্তব্য থেকে বাদ পড়েনি। ইবন আসাকির ইবন আব্বাস (রা) থেকে এই বর্ণনাটি বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।

উপরে আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, এক স্বপ্নের ব্যাখ্যায় সাতীহ ইয়ামানের বাদশাহ রবীয়া ইবন নাসরকে ইয়ামানে কী কী অরাজকতা দেখা দিবে এবং কিভাবে ক্ষমতার হাত বদল হবে, সবকিছুর ভবিষ্যবাণী করেছিলেন। এমনকি একথাও বলেছিলেন যে, এক পর্যায়ে ইয়ামানের শাসন ক্ষমতা সায়ফ ইবন যীইযাযান এর হাতে ফিরে আসবে। তখন রবীয়া ইবন নাসর তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘সায়ফ ইবন যী-ইয়াযানের হাতে ক্ষমতা আসার পর থেকে তা অব্যাহত থাকবে, নাকি তাতে ছেদ পড়বে?’ জবাবে সাতীহ বলেছিলেন, ‘বরং ছেদ পড়বে।’ রবীয়া জিজ্ঞাসা করেন, ‘কার দ্বারা এতে ছেদ পড়বে?’ সাতীহ বলেছিলেন, ‘এমন একজন পবিত্রাত্মা নবী, যার নিকট উর্ধজগত থেকে ওহী আসাবে।’ রবীয়া জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই নবী কার বংশ থেকে আসবেন?’ জবাবে সাতীহ বলেন, ‘গালিব ইবন ফিহর ইবন মালিক ইবন নাযর এর বংশ থেকে। শেষ যুগ পর্যন্ত রাজত্ব তারই বংশে বিদ্যমান থাকবে।’ রবীয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘যুগের আবার শেষ আছে নাকি?’ জবাবে সাতীহ বলেন, ‘হ্যাঁ, আছে বৈকি? যুগের শেষ হলো সেই দিন, যেদিন পূর্ববর্তী পরবর্তী সব মানুষ একত্রিত হবে। সৎকর্মশীলরা হবে সেদিন ভাগ্যবান, অসৎ লোকেরা হবে দুর্ভাগা। রবীয়া আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি আমাকে যা কিছু বললে, তা কি সত্য?’ সাতীহ বলেন, ‘জী হ্যাঁ, সত্য। অস্তমান সূর্যের লালিমা, নিশীথের অন্ধকার এবং পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নার শপথ করে বলছি, আমি আপনাকে যেসব বিষয়ের সংবাদ দিয়েছি, তার সবই সত্য। শিক এর অনুরুপ একটি বিবরণ ভিন্ন শব্দাবলীতে ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।

সাতীহ এর কবিতার দুটি পংক্তি নিম্নরূপঃ

عليكم بتقوى الله في السر والجهر - ولا تلبسوا صدق الأمانة بالقدر

وكونوا لجار الجنب حصنا وجنت - إذا ما عرته الناانبات من الدهر

—গোপনে-প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় তোমাদের আল্লাহর ছায়া অবলম্বন করা উচিত। আর তোমরা সত্যকে বিশ্বাস ভঙ্গের সাথে মিশ্রিত কর না। প্রতিবেশীর বিপদে-আপদে তাদের রক্ষাকবচ ও ঢালের ভূমিকা পালন কর।

হাফিজ ইবন আসাকির উপরিউক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। মু’আয ইবন যাকারিয়া আল-জারীরীও অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেছেন, সাতীহ সম্পর্কে প্রচুর বর্ণনা রয়েছে। অনেকে তা সংকলন করেছেন। তবে প্রসিদ্ধ অভিমত হলো এই যে, সাতীহ ছিলেন একজন ভবিষ্যদ্বক্তা। তিনি নবী করীম (সা)-এর আবির্ভাব, তার পরিচয় ও নবুওত লাভের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাছাড়া আমরা এমন বর্ণনা পেয়েছি যে, নবী করীম (সা)-কে সাতীহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, “সাতীহ এমন একজন নবী, যাকে তার স্বজাতি কদর করেনি। তবে বর্ণনাটির সনদের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে জানা যায় না।

আমার মতে, নির্ভরযোগ্য কোন ইসলামী কিতাবে এই বর্ণনার কোন ভিত্তি নেই। সনদ সহ এমন হাদীস আমি আদৌ কোথাও পাইনি। খালিদ ইবন সিনান আল-আবাসীর বর্ণনায় এরুপ বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু তাও বিশুদ্ধ নয়।

আলোচ্য বক্তব্যের বাহ্যিক মর্ম প্রমাণ করে যে, সাতীহ এর যথেষ্ট বিদ্যা ছিল এবং তাতে সত্যতার সুগন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি ইসলামের যুগ পাননি। যেমন জারিরী বলেছেন।

কেননা, উপরিউক্ত বর্ণনায় আমরা বলেছি যে, সাতীহ তার ভাগিনাকে বলেছিলেন, ‘হে আবদুল মাসীহ! যখন তিলাওয়াত বৃদ্ধি পাবে, শক্ত ছড়িওয়ালা আত্মপ্রকাশ করবেন, সামাওয়ার উপত্যকা ফুসে উঠবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে ও পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যাবে, সাতীহ-এর জন্য শাম আর শাম থাকবে না, গম্বুজের সংখ্যার সমান সংখ্যক রাজা-রাণী শামের রাজত্ব করবে। আর যা আসবার, তা আসবেই।’

এরপর সাতীহর মৃত্যু হয়। ঘটনাটা ছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের একমাস কিংবা তার চাইতে কিছু কম পরে। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ইরাকের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ইবন তাররার আল হারীরি বলেন, সাতীহ সাতশ’ বছরের আয়ু পেয়েছিলেন। আবার কেউ বলেন, পাঁচশ’ বছর, কেউ বলেন, তিনশ’ বছর। ইবন আসাকির বর্ণনা করেন যে, এক বাদশাহ সাতীহকে একটি শিশুর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, যার পিতৃপরিচয় সম্পর্কে মতভেদ ছিল। জবাবে সাতীহ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তার সমাধান দেন। এমনি এক জটিল সমস্যার সমাধান পেয়ে বাদশাহ তাঁকে বললেন, ‘সাতীহ! তোমার এই বিদ্যার উৎস সম্পর্কে তুমি আমাকে বলবে কি?’ জবাবে সাতীহ বললেন, ‘এই বিদ্যা আমার নিজস্ব নয়। আমি এই বিদ্যা লাভ করেছি, আমার সেই ভাইয়ের নিকট থেকে, যিনি সিনাই পর্বতে ওহী শ্রবণ করেছিলেন।’ বাদশাহ বললেন, ‘এমন নয় তো যে, তোমার সেই জিন ভাইটি সর্বক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকে-কখনো তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না?’ ‘না, এমন নয় বরং আমি যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, সেও আলাদা হয়ে যায়। তবে সে যা বলে, আমি তা ছাড়া অন্যকিছু বলি না।’

উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, সাতীহ এবং আরেকজন ভবিষ্যদ্বক্তা (ইবন মসআব ইবন ইযাশকুর ইবন রাহম ইবন বুসর ইবন উকবা) একই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মের পর তাদেরকে তারীফা বিনতে হুসাইবন আল হামীদিয়াহ নাম্নী এক গণক ঠাকুরণীর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। সে তাদের মুখে থুথু দেয়। ফলে তার থেকে তারা জ্যোতিষবিদ্যা লাভ করে। আর সেই গণক ঠাকুরণী সেদিনই মারা যায়। সাতীহ ছিলেন আধা মানুষ। কথিত আছে যে, খালিদ ইবন আবদুল্লাহ আল-কাসরী তারই বংশের লোক। উল্লেখ্য যে, শিক সাতীহ-এর বেশ কিছুকাল আগে মারা যান।

অপরদিকে আবদুল মাসীহ ইবন আমর ইবন কায়স ইবন হায়্যান ইবন নুফায়লা আল-গাসসানী আন-নাসরানী ছিলেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি। হাফিজ ইবন আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে তার জীবন-চরিত আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, এই আবদুল মাসীহ-ই খালিদ ইবন ওলীদ (রা)-এর সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ইবন আসাকির দীর্ঘ একটি কাহিনীও উল্লেখ করেছেন এবং এও লিখেছেন যে, খালিদ ইবন ওলীদ (রা) এক সময় তার হাত থেকে বিষ খেয়েছিলেন। কিন্তু তা তার বিন্দুমাত্র অনিষ্ট করেনি। কেননা বিষের পাত্র হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেনঃ

بسم الله وبالله رب الأرض والسماء الذي لا يضر مع اسمه أذى

এই বলে তিনি পাত্রস্থ পদার্থগুলো খেয়ে ফেলেন। খালিদ ইবনে ওলীদের জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দু’হাতে নিজের দু’হাতে চাপড় মারেন এবং ঘর্মাক্ত হন। তিনি জ্ঞান ফিরে পান। তখন আবদুল মাসীহকে তিনি কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করে শুনান।

আবু নুআয়ম শুআয়ব এর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, মাররুয যাহরান নামক স্থানে একজন ধর্মযাজক বাস করতেন। তার নাম ছিল ‘ঈস। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘আস ইবন ওয়ায়েল এর আশ্রিত। আল্লাহ তাঁকে প্রচুর জ্ঞান দান করেছিলেন এবং তাতে মক্কাবাসীদের জন্য বহু উপকার করেছিলেন। তাঁর একটি উপাসনালয় ছিল, তাতেই তিনি সর্বদা থাকতেন। বছরে কেবল একবার মক্কায় আসতেন এবং মক্কাবাসীদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। তিনি তাদেরকে বলতেন, ‘হে মক্কাবাসী! অচিরেই তোমাদের মাঝে এমন এক নবজাতকের আবির্ভাব হবে, সমগ্র আরব যার ধর্ম অবলম্বন করবে এবং আজম তথা আরবের বাইরেও তার রাজত্ব ছড়িয়ে পড়বে। এই সেই সময়, যে ব্যক্তি তাকে পাবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে, সে কৃতকার্য হবে। আর যে ব্যক্তি তাকে পেয়েও তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে ব্যর্থকাম হবে। আল্লাহর শপথ! তাঁর অনুসন্ধান ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে মদ-রুটি ও শান্তির দেশ ত্যাগ করে আমি এই অভাব-অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার দেশে আসিনি।’ মক্কায় কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই তিনি তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন এবং শুনে বলতেন, ‘না, এখন তার আগমন ঘটেনি।’ তখন তাকে বলা হতো, ‘তাহলে বলুন না, সেই শিশুটি কেমন হবে?’ তিনি বলতেন, ‘না, বলা যাবে না।’ প্রতীক্ষিত সেই মহান শিশুটির পরিচয় তিনি তার নিরাপত্তার খাতিরেই গোপন রাখতেন। কারণ তিনি জানতেন যে, সেই শিশুটির স্বজাতি তার অনিষ্ট করার চেষ্টা করবে।

রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে ভূমিষ্ঠ হন। সেদিন প্রত্যুষে আবদুল মুত্তালিব এসে ঈসের উপাসনালয়ের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ডাক দেন। ডাক শুনে তিনি আওয়াজ করে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে?’ তিনি বললেন, ‘আমি আবদুল মুত্তালিব।’ যাজক তার নিকটে এসে বললেন, ‘তুমি তার পিতামহ হও। আমি সেই শিশুটির কথা তোমাদের বলতাম যে, তিনি সোমবার দিনে ভূমিষ্ঠ হবেন, সোমবারে নবুওত লাভ করবেন এবং সোমবারেই তাঁর ইন্তিকাল হবে। সেই প্রতীক্ষিত শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়ে গেছেন।’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আজ প্রত্যুষে আমার একটি সন্তান জন্মেছে।’ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাঁর কি নাম রেখেছেন?’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘নাম রেখেছি, মুহাম্মদ।’ পাদ্রী বললেন, ‘হে কাবার সেবায়েতগণ! আমারও কামনা এই ছিল যে, সেই শিশুটি যেন আপনাদের মধ্য থেকেই আগমন করেন। তিনটি লক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি যে, আপনার পুত্রই সেই প্রতীক্ষিত শিশু। এক, গত রাতে তার নক্ষত্র উদিত হয়েছে। দুই, আজ তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছেন এবং তিন, তাঁর নাম মুহাম্মদ। আপনি যান। আমি আপনাদেরকে যে শিশুটির কথা বলতাম, আপনার নাতী তিনিই।’ আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি করে বুঝলেন যে, আমার নাতী তিনি? আজকে তো অন্য শিশুর জন্ম হয়ে থাকতে পারে?’ পাদ্রী বললেন, আপনার নাতীর সঙ্গে তাঁর নাম মিলে গেছে। আর আল্লাহ আলিমদের জন্য তাঁর ইলমকে সন্দেহজনক করেন না। কারণ, তা হলো অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ। তাছাড়া এর আরও একটি প্রমাণ হলো, আপনার নাতী এখন ব্যাথাগ্রস্ত। তাঁর এই ব্যথা তিনদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এতে তাঁর ক্ষুধা প্রকাশ পাবে। অতঃপর তিনি সুস্থতা লাভ করবেন। আপনি আপনার জিহ্বাকে সংযত করে চলবেন। কেননা, তার প্রতি এত বেশি বিদ্বেষ পোষণ করা হবে, যা কখনো অন্য কারও বেলায় হয়নি এবং তার উপর এত বেশি অত্যাচার হবে, যা অন্য কারও উপর কোনদিন হয়নি। তাঁর কথা বলার বয়স পর্যন্ত যদি আপনি বেঁচে থাকেন এবং তিনি তার দাওয়াতের কাজ শুরু করেন, তাহলে আপনার স্বজাতির পক্ষ থেকে আপনি এমন আচরণ দেখতে পাবেন, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তখন ধৈর্যধারণ আর লাঞ্ছনা ভোগ করা ব্যতীত কোন গতি থাকবে না। অতএব আপনি আপনার জিহবাকে সংযত রাখবেন এবং তাকে চোখে চোখে রাখবেন।’ আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শিশুটির আয়ু কত হবে?’ পাদ্রী বললেন, ‘আয়ু তার বেশি হোক আর কম হোক সত্তরে পৌঁছবে না। সত্তরের নিচে ষাটের ওপরে যে কোন বেজোড় সংখ্যার বয়সে তাঁর মৃত্যু হবে। আর এই হবে তাঁর উম্মতের অধিকাংশের গড় আয়ু।’

বর্ণনাকারী বলেন, মুহাররমের দশ তারিখে রাসূলুল্লাহ (সা) মায়ের গর্ভে আসেন এবং হস্তিবাহিনীর যুদ্ধের তেইশ দিন আগে রমযান মাসের বার তারিখে সোমবার ভূমিষ্ঠ হন।

৮৮
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর লালন-পালনকারী ও দাই-মাগণের বিবরণ
উম্মে আয়মান রাসূলুল্লাহ (সা)-কে লালন-পালন করতেন। তাঁর আসল নাম ছিল বারাকা— এই উম্মে আয়মানকে রাসূলুল্লাহ (সা) উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নবী করীম (সা) তাঁকে আযাদ করে তাঁর আযাদকৃত গোলাম যায়েদ ইবনে হারিছার সঙ্গে বিবাহ দেন। এই স্ত্রীর গর্ভেই যায়েদ ইবনে হারিছার পুত্র উসামা ইবনে যায়েদ (রা)-এর জন্ম হয়।

হালীমা সাদিয়ার আগে তাঁর মা আমিনা এবং আবু লাহাব-এর দাসী ছুওয়াইবা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দুধপান করাতেন।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাঁদের সহীহদ্বয়ে বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবীবা একদিন রাসূল (সা)-কে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার বোন আযযাহ বিনত আবু সুফিয়ানকে বিয়ে করুন!’ উত্তরে রাসূল (সা) বললেনঃ ‘এটি কি তুমি পছন্দ কর?’ আমি বললামঃ ‘জ্বী হ্যাঁ। তবে আমিই তো আপনার একমাত্র স্ত্রী নই? কল্যাণ লাভে আমার বোনটি আমার সাথে শরীক হোক এটি আমার পছন্দনীয়।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘কিন্তু আমার জন্য হালাল হবে না।’ উম্মে হাবীবাহ বলেন, ‘তখন আমি বললাম, আমরা কিন্তু বলাবলি করছি যে, আপনি আবু সালামার কন্যাকে বিয়ে করতে আগ্রহী।’ এক বর্ণনায় আবু সালামার কন্যা দুররার নামও উল্লেখ আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘তুমি কি উম্মে সালামার কন্যার কথা বলছ?’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেনঃ ‘উম্মে সালামার কন্যা যদি আমার স্ত্রীর সাথে আগত পালিতা কন্যা নাও হত, তবুও সে আমার জন্য হালাল হত না।’ কারণ সে আমার দুধ ভাই এর কন্যা। ছুওয়াইবা আমি এবং আবু সালামা উভয়কেই দুধ পান করান। অতএব তোমরা আমার কাছে তোমাদের কন্যা ও বোনদের কোন প্রস্তাব নিয়ে এস না।’ বুখারীর বর্ণনায় এও আছে যে, উরওয়া (র) বলেন, ছুওয়াইবা হচ্ছেন আবু লাহাবের আযাদকৃত দাসী। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দুধ পান করিয়ে ছিলেন। আবু লাহাব এর মৃত্যুর পর তারই পরিবারের কেউ একজন তাকে অত্যন্ত বিমর্ষ অবস্থায় স্বপ্নে দেখেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এখন কি হালে আছেন?’ আবু লাহাব বলল, ‘তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এ পর্যন্ত আমি কোন কল্যাণ চোখে দেখিনি। তবে ছুওয়াইবাকে মুক্ত করে দেয়ার বদৌলতে আমি এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। এই বলে সে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীয় মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি ছিদ্রের প্রতি ইংগিত করে।’

সুহায়লী প্রমুখ উল্লেখ করেছেন, আবু লাহাবকে যিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, তিনি তারই ভাই আব্বাস (রা)। ঘটনাটি ঘটেছিল আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর, বদর যুদ্ধের পরে। সেই স্বপ্নের বিবরণে একথাও উল্লেখ আছে যে, আবু লাহাব আব্বাসকে বলেছিল যে, সোমবার দিবসে আমার শাস্তি লঘু করা হয়। অভিজ্ঞ মহল বলেন, তার কারণ এই ছিল যে, ছুওয়াইবা যখন আবু লাহাবকে তার ভাতিজা মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহর জন্মের সুসংবাদ প্রদান করে, তক্ষণাৎ সে ছুওয়াইবাকে আযাদ করে দিয়েছিল। এটা তারই পুরস্কার স্বরূপ।

৮৯
হালীমার ঘরে রাসূলুল্লাহ (সা)
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্য হালীমা বিনতে আবী যুওয়াইব-এর দুধপানের ব্যবস্থা করা হয়। হালীমার পিতা আবু যুওয়াইব-এর পুরো নাম আবদুল্লাহ ইবন হারিছ। তাঁর বংশলতিকা হচ্ছে এরূপ। আবদুল্লাহ ইবন শাজনাহ ইবন জাবির ইবন রিযাম ইবন নাসিরা ইবন সাদ ইবন বকর ইবন হাওয়াযিন ইবনে মনসুর ইবন ইকরিমা ইবন হাফসা ইবন কায়স আইলান ইবন মুযার। ইবন ইসহাক বলেনঃ আর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুধপিতা-তথা হালীমার স্বামীর নাম হারিছ ইবন আবদুল উযযা ইবন রিফাআ ইবন মিলান ইবন নাসিরা ইবন সা’দ ইবন বকর ইবন হাওয়াযিন। নবী করীম (সা)-এর দুধ ভাই বোনদের নাম যথাক্রমে আবদুল্লাহ ইবন হারিছ, আনীসা বিনতে হারিছ ও হুযাফা বিনতে হারিছ। হুযাফার অপর নাম শায়মা। ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই শায়মাই তার মায়ের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাদের বাড়িতে তার অবস্থানকালে লালন-পালন করতেন।

ইবন ইসহাক আবদুল্লাহ ইবন জাফর ইবন আবু তালিব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি হালিমা বিনতে হারিছ সম্পর্কে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ কোন এক দুর্ভিক্ষের বছর দুগ্ধপোষ্য শিশু সংগ্রহের জন্য বনু সা’দের কয়েকজন মহিলার সঙ্গে আমি মক্কায় যাই। (ওয়াকেদী তার সনদে উল্লেখ করেছেন যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু অন্বেষণকারী মহিলাদের সংখ্যা ছিল দশ)। দুর্বল একটি গাধীতে সওয়ার হয়ে আমি মক্কায় পৌঁছি। আমার সঙ্গে ছিল আমারই একটি শিশু সন্তান আর একটি বুড়ো উটনী। আল্লাহর শপথ! উটনীটি আমার এক ফোঁটা দুধও দিচ্ছিল না। আর শিশুটির যন্ত্রণায় আমরা সেই রাতে একবিন্দুও ঘুমাতে পারিনি। কারণ তাকে খাওয়ার মত না পেয়েছি আমার স্তনে এক ফোটা দুধ, না পেয়েছি তাকে পান করাবার মত উটনীর সামান্য দুধ। তবে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠে স্বচ্ছলতা লাভে আশাবাদী ছিলাম।

যা হোক, অতি দুর্বল গাধীটির পিঠে সওয়ার হয়ে আমরা মক্কা এসে পৌঁছলাম। দুর্বলতার কারণে গাধীটি আমাদেরকে যেন বহন করতে পারছিল না। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমাদের সব ক’জন মহিলার সম্মুখেই রাসুলুল্লাহ (সা)-কে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু শিশুটি এতীম শুনে কেউই তাকে গ্রহণ করতে সম্মত হল না। আমরা বললাম, এই এতীম শিশুর মা আমাদের কি করতে পারবে? আমরা তো শিশুর পিতার নিকট থেকে সুযোগ-সুবিধা আশা করি। আর এই শিশুটির মা তো আমাদের কিছুই করতে পারবে না।

যা হোক, আমি ছাড়া আমার সঙ্গী সব মহিলা একটি করে শিশু নিয়ে নেয়। আমরা যখন মুহাম্মদ ছাড়া আর কোন শিশুই পেলাম না এবং ফেরার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম; তখন আমার স্বামী হারিছকে বললাম, আল্লাহর শপথ, শিশু সন্তান না নিয়ে এইভাবে শূন্য হাতে ফিরে যেতে আমার খারাপ লাগছে। আমি ওই এতীম শিশুটিকে অবশ্যই নিয়ে যাব। স্বামী বললেন, ঠিক আছে, তাই কর! হতে পারে, আল্লাহ তার মধ্যে আমাদের জন্য বরকত রেখেছেন। আমি গিয়ে শিশুটিকে নিয়ে নিলাম। আল্লাহর শপথ, আমি তো তাকে গ্রহণ করেছিলাম অন্য শিশু না পেয়ে নিতান্ত নিরূপায় হয়ে। এতীম মুহাম্মদকে নিয়ে আমি আমার বাহনের কাছে গেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, আমার স্তনদ্বয় পর্যাপ্ত দুধে পরিপূর্ণ। শিশু মুহাম্মদ তৃপ্তির সাথে তা পান করে এবং তার দুধ ভাইও সেই দুধ পান করে তৃপ্ত হয়। আমার স্বামী উটনীর নিকট গেলেন। তিনি দেখতে পান যে, তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ। উটনী থেকে তিনি দুধ দোহন করলেন। নিজে পান করলেন, আমিও তৃপ্তি সহকারে পান করলাম। আমরা শান্তিতে রাত কাটালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার স্বামী আমাকে বললেন, হালীমা! আল্লাহর শপথ, আমার মনে হচ্ছে, তুমি একটি বরকতময় শিশুই নিয়েছ। দেখলে না, ওকে আনার পর থেকে এই রাতে আমরা কত কল্যাণ ও বরকত লাভ করলাম। এরপর থেকে আল্লাহ আমাদের জন্য এই কল্যাণ আরও বৃদ্ধি করতে থাকেন।

এরপর আমরা সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। শপথ আল্লাহর! আমার গাধীটি আমাদের নিয়ে এত দ্রুতগতিতে ছুটে চলে যে, সঙ্গের একটি গাধাও তার নাগাল পাচ্ছিল না। তা দেখে আমার সঙ্গীরা বলতে শুরু করে যে, আবু যুআইব-এর কন্যা! ব্যাপারটা কী? এই কি তোমার সেই গাধী, যাতে করে তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছিলে? আমি বললাম, হ্যাঁ, এটিই আমার সেই গাধী, যাতে চড়ে আমি তোমাদের সঙ্গে এসেছিলাম। তারা বলল, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় এর বিশেষ কোন রহস্য আছে!

এভাবে আমরা বনু সাদ-এর এলাকায় এসে পৌঁছলাম। তখন এই ভূখণ্ড অপেক্ষা আল্লাহর জমীনে অধিকতর অনুর্বর কোন ভূমি ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমার বকরীর পাল সারাদিন চরে সন্ধ্যাবেলা তৃপ্ত পেটে স্তন ভর্তি দুধ নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করে। আমরা ইচ্ছামত দুধ দোহন করতে লাগলাম। অথচ, আমাদের আশেপাশে তখন কারও বকরীই এক ফেঁটা দুধ দিচ্ছিল না। প্রতিবেশীর বকরীগুলো সারাদিন চরে সন্ধ্যাবেলা ক্ষুধার্ত পেটেই ফিরে আসতো। তারা তাদের রাখালদের বলে দেয় যে, আবু যুআইব-এর কন্যার বকরী পাল যেখানে চরে, আজ থেকে আমাদের বকরীগুলোও তোমরা সেখানেই চরাবে। ফলে, তারা তাদের বকরী আমার বকরী পালের সঙ্গে চরাতে শুরু করে। কিন্তু তার পরও তাদের বকরী সেই দুধবিহীন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরতো আর আমার বকরী ফিরতো তৃপ্তপেটে স্তন ভর্তি দুধ নিয়েই। এইভাবে দু’দু’টি বছর পর্যন্ত আল্লাহ আমাদেরকে বরকত দান করতে থাকেন।

দুর্ভিক্ষের কারণে তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা এই ছিল যে, পরিণত বয়সের একটি যুবককে একটি কিশোরের সঙ্গে তুলনা করা মুশকিল ছিল। কিন্তু আল্লাহর শপথ, দু’টি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতে মুহাম্মদ একটি নাদুস-নুদুস বালকে পরিণত হন। আমরা তাকে তার মায়ের নিকট নিয়ে গেলাম। অথচ, তার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় তাকে ফিরিয়ে দিতে আমাদের মন সায় দিচ্ছিল না। যা হোক, তার মা তাকে দেখার পর আমি বললাম, আরও একটি বছরের জন্য আপনার পুত্রকে আমার নিকট দিয়ে দিন। আমি মক্কার মহামারীতে ছেলেটির আক্রান্ত হয়ে পড়ার আশংকা করছি। আল্লাহর শপথ, আমি কথাটা বারবার বলায় শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হয়ে বললেন, ঠিক আছে নিয়ে যাও!

তাঁকে সঙ্গে করে আমরা বাড়ি চলে গেলাম। দুই কি তিন মাস কেটে গেল। একদিন তিনি তাঁর দুধ-শরীক এক ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ির পেছনে বকরী চরাতে যান। হঠাৎ তাঁর ভাইটি দৌড়ে এসে বলল, আমাদের ঐ কুরাইশী ভাইকে সাদা পোশাক পরা দু’জন লোক এসে তাকে শুইয়ে তার পেট চিরে ফেলেছে! খবর শুনে আমি ও তাঁর দুধ পিতা দৌড়ে তার নিকট গিয়ে দেখতে পেলাম, বিবর্ণ অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তার দুধ পিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবা! তোমার কী হয়েছে?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘সাদা পোশাক পরা দু’জন লোক এসে আমাকে শুইয়ে ফেলে এবং আমার পেট চিরে পেটের ভেতর থেকে কী যেন বের করে ফেলে দিল! তারপর আমার পেট আগে যেমন ছিল তেমনি করে দেয়।’ হালীমা বলেন, ‘আমরা তাকে ঘরে নিয়ে গেলাম।’ তাঁর দুধ পিতা বললেন, ‘হালীমা! আশংকা হয় যে, আমার এই সন্তানটিকে জিনে পেয়ে বসেছে। চল, আমরা যা আশঙ্কা করছি, কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আগেই ভালোয় ভালোয় আমরা তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।’ তাকে নিয়ে আমরা তার মায়ের কাছে চলে গেলাম। দেখে তার মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কী, হে স্নেহশীলা ধাত্রী? আমার পুত্রের প্রতি তোমাদের দু’জনের এত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তোমরা একে ফিরিয়ে আনলে কেন?’ হালীমা ও তার স্বামী বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। এখন এর ব্যাপারে আমাদের মনে নানা আপদ-বিপদের আশংকা হচ্ছে। তাই আপনার পুত্রকে আপনার নিকট ফিরিয়ে দিতে আসলাম।’

তখন তিনি বলেন, ‘তোমরা কিসের আশংকা করছ? কী ঘটেছে সত্যি করে আমাকে খুলে বল!’ আমরা তাকে ঘটনার বৃত্তান্ত শোনালাম। শুনে তিনি বললেন, ‘তোমরা কি এর ব্যাপারে দুষ্ট জিনের ভয় করছ? কখনো নয়, আল্লাহর শপথ! আমার এই পুত্রের উপর শয়তানের কোন হাত থাকতে পারে না। আল্লাহর শপথ! আমরা এই পুত্র ভবিষ্যতে বিরাট কিছু হবে। আমি কি তোমাদেরকে এর ঘটনা শোনাব?’ আমার বললাম, ‘জ্বী হ্যাঁ, শোনান।’ তিনি বললেন, ‘ও যখন আমার গর্ভে, তখন একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, যেন আমার ভেতর থেকে এক ঝলক আলো বের হয়ে তাতে সিরিয়ার সকল রাজপ্রাসাদ আলোকিত হয়ে গেছে। আবার আমি যখন তাকে প্রসব করি, তখন সে আকাশ পানে মাথা তুলে দু’হাতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। সুতরাং তোমরা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না!’ এ বর্ণনাটি আরও একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সীরাত ও মাগাযী বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এটি একটি প্রসিদ্ধ বর্ণনা।

ওয়াকিদী....ইবন আব্বাসের বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হালীমা একদিন নবী করীম (সা)-এর সন্ধানে বের হন। খুঁজে খুঁজে একস্থানে তাকে তার বোনের সঙ্গে পান। তখন তাদের পালের পশুগুলো শুয়ে রয়েছিল। দেখে হালীমা বললেন, ‘তোমরা এই গরমের মধ্যে বসে আছ?’ জবাবে শিশু নবীর বোন বললেন, ‘আম্মা! আমার এ ভাইটির তো গরম পাচ্ছে না। দেখলাম, একখণ্ড মেঘ ওকে ছায়া দিচ্ছে। ও থামলে মেঘও থেমে যায়, ও চললে মেঘও ওর সাথে সাথে চলতে শুরু করে। এই অবস্থায়ই আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।’

ইবন ইসহাক খালিদ ইবন মাদান সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, কয়েকজন সাহাবী একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, ‘আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘হ্যাঁ, বলছি; ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া ও ঈসার সুসংবাদ। আর আমি গর্ভে থাকাবস্থায় আমার আম্মা স্বপ্নে দেখেন, তার ভেতর থেকে এক ঝলক নূর বেরিয়ে আসে, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে উঠে। সা’দ ইবন বকর গোত্রে আমি লালিত-পালিত হই। একদিন আমি আমাদের ছাগল-ভেড়া চরাচ্ছিলাম। এমন সময় সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন লোক আমার নিকট আসে। সঙ্গে তাদের বরফ ভর্তি একটি সোনার তশতরী। আমাকে তারা শুইয়ে ফেলে, আমার পেট চিরে ফেলে তারপর হৃৎপিণ্ড বের করে তা চিরে ভিতর থেকে কালো রংয়ের একটি রক্তপিণ্ড বের করে ফেলে দেয়। তারপর সাথে আনা বরফ দ্বারা আমার হৃৎপিণ্ড ও পেট ধুয়ে দিয়ে আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। তারপর তাদের একজন অপরজনকে বলে, একে তার দশজন উম্মতের সঙ্গে ওজন কর। অপরজন আমাকে আমার দশজন উম্মতের সঙ্গে ওজন করে। আমার পাল্লা ভারী হয়। তারপর বলে, এবার তাকে তার একশ’ উম্মতের সঙ্গে ওজন কর! সে আমাকে একশ’ জনের সঙ্গে ওজন করে। এবারও আমার পাল্লা ভারী হয়। আবার বলে, এবার তাকে তার উম্মতের এক হাজার জনের সঙ্গে ওজন কর। আমাকে এক হাজার জনের সঙ্গে ওজন করে। এবারও আমার পাল্লা ভারী হয়। এইবার লোকটি বলে, হয়েছে, আর প্রয়োজন নেই! একে তার সমস্ত উম্মতের সঙ্গেও যদি ওজন করা হয়, তবু তার পাল্লাই ভারী হবে।’ এ সনদটি উত্তম।

আবু নুআয়ম তাঁর দালায়িল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, উতবা ইবন আবদুল্লাহ বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রথম জীবনের অবস্থা কেমন ছিল?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘যে মহিলা আমাকে দুধ পান করাতেন, তিনি ছিলেন বনু সাদ গোত্রীয়। একদিন আমি আর তার এক পাল ভেড়া-বকরী চরানোর জন্য মাঠে যাই। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে খাবার কিছু নিয়ে যাইনি। তাই আমি আমার দুধ ভাইকে বললাম, তুমি গিয়ে আম্মার নিকট থেকে খাবার নিয়ে এস। আমার ভাই চলে গেল আর আমি পশুপালের নিকট রয়ে গেলাম। হঠাৎ দেখি, শকুনের মত দুটি সাদা রংয়ের পাখি আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এসে একটি অপরটিকে বলে, এই কি সেই লোক? অপরটি বলল, হ্যাঁ। তারপর তারা দ্রুত আমার একেবারে নিকটে এসে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে আমার পেট চিরে ফেলে। তারপর আমার হৃৎপিণ্ড বের করে তার মধ্য থেকে দুটি কালো রক্তপিণ্ড বের করে। তারপর বরফের পানি দিয়ে আমার পেট ধুয়ে নেয়। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে আমার হৃদপিণ্ড ধোয়। তারপর আমার হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেলে দেয়। তারপর একজন অপরজনকে বলে, এবার সেলাই করে দাও। পেট সেলাই করে আমার ওপর নবুওতের মোহর অংকিত করে দেয়। তারপর একজন অপরজনকে বলে, একে দাঁড়ির এক পাল্লায় রেখে আর তার উম্মতের এক হাজার জনকে অপর পাল্লায় রেখে ওজন কর। সে মতে আমাকে ওজন করা হল। আমি দেখলাম, এক হাজার জনের পাল্লা উপরে ওঠে গেল। আমার ভয় হচ্ছিল, তাদের কেউ আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিনা। তখন একজন বলল, যদি এর সকল উম্মতের সঙ্গেও একে ওজন করা হয়, তবু এর পাল্লা ভারী হবে।

তারপর তারা আমাকে ফেলে চলে যায়। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর মায়ের নিকট গিয়ে ঘটনা খুলে বললাম। শুনে তিনিও শংকিত হয়ে পড়েনঃ পাছে আমার কোন ক্ষতি হয়ে যায়। তাই তিনি বললেন, তোমার জন্য আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উটের পিঠে করে আমাকে আমার আম্মার নিকট নিয়ে গেলেন। বললেন, আমি আমার আমানত বুঝিয়ে দিলাম ও দায়িত্ব পালন করলাম। এই বলে তিনি আমার সব ঘটনা খুলে বললেন। কিন্তু সব শুনেও আমার আম্মা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার ভেতর থেকে এক ঝলক নূর বের হয়, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে যায়।’ এই বর্ণনায় এমন একজন রাবী রয়েছেন যার জাল হাদীস রটনার দুর্নাম রয়েছে-যদ্দরুন হাফিজ ইবন আসাকির বর্ণনা করেন যে, আবুযর গিফারী (রা) বলেছেন, একদিন আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি করে জানলেন এবং কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আপনি নবী?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘শোন হে আবু যর! আমি মক্কার উপকণ্ঠে অবস্থান করছিলাম। এই সময়ে দু’জন ফেরেশতা আমার নিকট আগমন করেন। একজন মাটিতে অবতরণ করেন আর অপরজন আকাশ ও জমিনের মধ্যখানে অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে তাঁদের একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনিই কি সেই লোক? অপরজন বললেন হ্যাঁ, ইনিই সেই লোক। তখন প্রথমজন বললেনঃ একে একজন মানুষের সঙ্গে ওজন কর। ফেরেশতা আমাকে একজন মানুষের সঙ্গে ওজন করে। ওজনে আমার পাল্লা ভারী হয়।’

ইবন আসাকির সম্পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি নবী করীম (সা)-এর বক্ষবিদারণ, বক্ষ সেলাই ও দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুওত স্থাপনের কথাও উল্লেখ করেছেন। এ বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে। এরপর তারা চলে যান। আমি যেন এখনো তা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।

সহীহ মুসলিমে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, একদিন শিশু নবীর নিকট জিবরীল (আ) আগমন করেন। নবী করীম (সা) তখন অন্য বালকদের সাথে খেলা করছিলেন। জিবরীল (আ) শিশু নবীকে ধরে মাটিতে শুইয়ে তার পেট চিরে তাঁর হৃদপিণ্ড বের করে আনেন। তারপর হৃৎপিণ্ড থেকে একটি কালো রক্তপিণ্ড বের করেন এবং বলেন, এটি শয়তানের অংশ। তারপর সোনার একটি পাত্রে যমযমের পানি দ্বারা হৃদপিণ্ডটি ধুয়ে নেন। অতঃপর তা যথাস্থানে স্থাপন করে দেন।

ঘটনা দেখে বালকরা দৌড়ে নবীজির দুধ-মায়ের নিকট এসে বলে, মুহাম্মদকে খুন করা হয়েছে। শুনে সকলে তাঁর নিকট দৌড়ে আসে। তখন তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে। আনাস (রা) বলেন, আমি তার বুকে সেই সেলাইয়ের দাগ দেখতে পেতাম।

ইবন আসাকির আনাস (রা) সূত্রে আরও বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নামায মদীনায় ফরয হয়। দুইজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে তাকে যমযমের কাছে নিয়ে যান। তারপর তার পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে একটি সোনার পেয়ালায় নিয়ে যমযমের পানি দ্বারা তা ধুয়ে দেন। তারপর তার উদরকে প্রজ্ঞা ও ইলম দ্বারা ভরে দেন।

অন্য সূত্রে আনাস (রা) থেকে আরও বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, পরপর তিন রাত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট কয়েকজন ফেরেশতা আগমন করেন। তাদের একজন অন্যদেরকে বলেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাদের নেতাকে নিয়ে চল। ফেরেশতারা তাকে যমযমের নিকট নিয়ে যান এবং তাঁর পেট বিদীর্ণ করেন। তারপর একটি সোনার পাত্র এনে শিশু নবীর পেটকে ধুয়ে তা প্রজ্ঞা ও ঈমান দ্বারা ভরে দেন।

উল্লেখ্য যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত মিরাজের হাদীসেও উক্ত রাতে নবীজির বক্ষবিদারণ এবং যমযমের পানি দ্বারা তা ধৌত করার ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। তবে এতে কোনও বৈপরীত্য নেই। কারণ, হতে পারে একই ঘটনা নবী করীম (সা)-এর জীবনে দু’বার ঘটেছে। একবার তাঁর শৈশবে আর একবার মি’রাজের রাতে, তাঁকে ঊধ্বজগতে আরোহণ এবং আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার উপযোগীর জন্য প্রস্তুতি করার লক্ষ্যে।

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে বলতেন, “আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ আরবী, আমি কুরাইশী এবং দুধপান করেছি আমি সা’দ ইবন বকর গোত্রে।”

ইবন ইসহাক আরো বলেন, দুধ ছাড়ানোর পর হালীমা শিশু নবীকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিতে যাওয়ার পথে একদিন তিনি নবীজিকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে নাসারাদের একটি কাফেলার সঙ্গে তাদের সাক্ষাত হয়। দেখে কাফেলার লোকেরা শিশু নবীর দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে চুমো খায় এবং বলে, ‘এই বালকটিকে অবশ্যই আমরা আমাদের রাজার নিকট নিয়ে যাব। কারণ, ছেলেটি ভবিষ্যতে বিরাট কিছু হবে।’ হালীমা বড় কষ্টে পুত্রকে তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনেন। ইবন ইসহাক বলেন, উক্ত কাফেলার হাত থেকে মুক্ত করে তাঁকে নিয়ে যখন হালীমা মক্কার নিকটে চলে আসেন, তখন হঠাৎ শিশু নবী (সা) হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে হালীমা আর তাকে পেলেন না। সংবাদ পেয়ে দাদা আবদুল মুত্তালিব নিজে এবং আরও একদল লোক তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। খুঁজতে খুঁজতে ওয়ারাকা ইবন নওফল ও অপর এক ব্যক্তি তার সন্ধান পান। পেয়ে তাকে তারা দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিকট নিয়ে যান। আবদুল মুত্তালিব শিশু নবীজিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বায়তুল্লাহয় চলে যান এবং তাওয়াফে শিশু নবীজির নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেন। অতঃপর তাকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেন।

উমাবী বর্ণনা করেন যে, আবদুল মুত্তালিব আদেশ করেন, যেন শিশু নবীজিকে সঙ্গে করে নিয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রে ঘুরে তার জন্য একজন দাই-মা ঠিক করে নেয়া হয়। শিশু নবীকে দুধ পান করানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হালীমাকে ঠিক করা হয়।

বর্ণিত আছে যে, শিশু নবী হালীমার নিকট ছয় বছর অবস্থান করেন। এই সময়ে তাঁর দাদা বছরে একবার তাকে দেখতে যেতেন। বক্ষবিদারণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর হালীমা শিশু নবীকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিয়ে যান। তিনি যখন আট বছরের বালক, তখন মা আমিনা মৃত্যুবরণ করেন। এবার দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। তাঁর দশ বছর বয়সের সময় দাদা আবদুল মুত্তালিবও মারা যান। তখন নবীজির লালন-পালনের দায়িত্ব হাতে নেন, তার দুই আপন চাচা যুবায়র ও আবু তালিব। তের বছর বয়সে তিনি চাচা যুবায়র-এর সঙ্গে ইয়ামান গমন করেন। এই সফরে তার কয়েকটি আলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়। তার একটি হলো, চলার পথে একটি উট তাকে দেখেই বসে পড়ে। এমনকি তার বুক মাটি স্পর্শ করে। নবীজি (সা) তাতে চড়ে বসেন। আরেকটি ঘটনা হলো, ইয়ামানের একস্থানে তখন বাঁধভাঙ্গা প্লাবন হচ্ছিল। নবীজির উসিলায় আল্লাহ তাআলা বন্যার পানি শুকিয়ে দেন। কাফেলার সকলে অনায়াসে পথ অতিক্রম করে। তারপর চাচা যুবায়র নবীজির চৌদ্দ বছর বয়সে মারা যান। এইবার চাচা আবু তালিব একাই নবীজি (সা)-কে লালন-পালন করতে শুরু করেন। এ বর্ণনায় একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন।

মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শৈশবেই হালীমা সা’দিয়া ও তার পরিবার-পরিজনের ওপর তার বরকত প্রকাশ পায়। তারপর সেই বরকত হাওয়াযিন গোত্রের সকলের ওপর ছড়িয়ে পড়ে; পরবর্তীকালে যখন তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর নবী করীম (সা) তাদেরকে বন্দী করেন তখন তারা সেই দুধপানের দোহাই দিয়ে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। নবী করীম (সা) তাদেরকে মুক্তিদান করেন এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। এটি মক্কা বিজয়ের একমাস পরের ঘটনা। পরে যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসবে, ইনশাআল্লাহ।

হাওয়াযিন-এর ঘটনা সম্পর্কে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আমর ইবনে শুয়াইব এর দাদা বলেছেন, হুনায়নে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তাদের থেকে প্রাপ্ত গনীমতের মাল ও বন্দীদের নিয়ে রওয়ানা হলে হাওয়াযিন-এর একটি প্রতিনিধি দল জিয়িররানা নামক স্থানে তার সঙ্গে সাক্ষাত করে। তারা তখন ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছে। এসে তারা বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার আপনজন ও আত্মীয়। আমরা যে বিপদে পড়েছি তা আপনার অজানা নয়। আপনি আমাদের প্রতি দয়া করুন, আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করবেন।’ যুহায়র ইব্‌ন সরদ নামক তাদের একজন বক্তা দাঁড়িয়ে বলে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! বন্দী মহিলাদের মধ্যে আপনার ঐসব খালা আর বোনরাও আছে, যারা আপনাকে কোলে-কাঁধে নিয়ে লালন পালন করেছিল। এখন যদি আমরা শিমর এর পুত্র কিংবা নুমান ইবন মুনযির এর পুত্রকে দুধপান করিয়ে থাকতাম এবং পরে যদি তাদের পক্ষ থেকেও আমাদের প্রতি সেইরূপ বিপদ আসতো, যেমন এসেছে, আপনার পক্ষ থেকে, তাহলে তো আমরা তাদের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করতাম। অথচ, আপনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ অভিভাবক। এই বলে সে কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেঃ

أمنن علينا رسول الله في كرم فإنك المرء نرجوه وندخر

أمنن على بيضة قد عاقها قدر مهزق شملها في دهرها غير

أبقت لنا الدهر هتافا على حزن على قلوبهم الغماء والغمر

انلم تداركها نعماء تنتروها- يا أرحم الناس حلما حين يختبر

أمنن على نسوة قد كنت ترضعها-اذ فوك يملئه من محيخضها ذكر

أمنن على نسوة قد كنت ترضعها واذ يزينك ما تأتى وما تدر

لاتجعلنا كمن شالت نعامته واستبق منا فإنك معشر زهر

إنا لنشكر للعمى وإن كفرت وعندنا بعد هذا اليوم مدخر

—হে আল্লাহর রসূল! মহানুভবতা দ্বারা আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনিই আমাদের প্রত্যাশিত ও নির্বাচিত ব্যক্তি।

আপনি এমন রমণীর প্রতি অনুগ্রহ করুন, ভাগ্য যাকে (তার স্বগোত্রের কাছে ফিরে যাওয়া থেকে) বিরত রেখেছে, যার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তার জীবন ধারায় এসেছে পরিবর্তন।

যে আমাদের যুগকে বানিয়ে রেখেছে দুঃখে আর্তনাদকারী। ঐ সকল লোক যাদের রয়েছে সীমাহীন মর্মবেদনা ও দুঃখের প্রচণ্ড চাপ।

যদি না আপনার পক্ষ থেকে সম্প্রসারিত বরকতময় হাত তার ক্ষতিপূরণ করে। হে শ্রেষ্ঠ সহনশীল মানব! যার সহনশীলতা প্রকাশ পায় যখন তাকে পরীক্ষা করা হয়।

আপনি সেই মহিলাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন, যাদের দুধ আপনি পান করেছেন। যখন আপনার সুখ তাদের দুধেপূর্ণ থাকতো। অনুগ্রহ করুন সেই সব মহিলাদের প্রতি তখন আপনার জন্য শোভনীয় হত, আপনি যা করতেন এবং যা করতেন না সবই।

আপনি আমাদের ঐ ব্যক্তির ন্যায় করবেন না, যে মৃত্যুবরণ করেছে। আপনি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখুন। কেননা, আমরা একটি সমুজ্জ্বল সম্প্রদায়।

নিশ্চয় আমরা নিয়ামতের শোকর আদায় করে থাকি, যদিও অন্যত্র তার না-শোকরী করা হয়। আমাদের এ কৃতজ্ঞতা আজকের দিনের পরও বহাল থাকবে।

উল্লেখ্য যে, যুহায়র ইবন সরদ ছিলেন তাঁর গোত্রের নেতা। তিনি বলেন, হুনায়নের দিন আমাদেরকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন আমাদের নারী-পুরুষদের আলাদা করছিলেন, তখন হঠাৎ আমি তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই এবং কবিতার ছন্দে তাঁর হাওয়াযিন গোত্রে প্রতিপালিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেই। অন্য বর্ণনায় এ পংক্তিগুলোতে ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তন সহ বর্ধিত আরো কয়েকটি চরণ আছে, যা নিম্নরূপঃ

فألبس العفو من قد كنت ترضعه من أمهاټك إن العفو وتنتصر

إنا نؤمل عفوا منك ثلبسه هذي البرية إذ تعفو وتنتصر

فاغفر عفا الله عما أنت راهبه يوم القيامة إذ يهدى لك الظفرو

—হে আল্লাহর রাসূল! স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনিই আমাদের কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত ব্যক্তি।

সুতরাং আপনি আপনার যে মায়ের দুধ পান করতেন, তাকে আপনি ক্ষমার পোশাক পরিয়ে দিন। ক্ষমা খ্যাতি প্রসারের হেতু হয়ে থাকে।

আমরা আপনার নিকট ক্ষমার প্রত্যাশা করি, যা দ্বারা আপনি এই কয়েকটি প্রাণীকে আচ্ছাদিত করবেন।

অতএব, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন! আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি থেকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন। যখন আপনাকে সফলতা প্রদান করা হবে।

সবকিছু শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এই গনীমত ও বন্দীদের মধ্যকার যারা আমার ও বনু আবদুল মুত্তালিবের ভাগে আসবে, তা আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তোমাদেরকে দান করে দিলাম।’

একথা শুনে আনসারগণ বললেন, ‘তাহলে যা আমাদের ভাগে আসবে, আমরাও তা আল্লাহ ও তার রাসূলের খাতিরে দান করলাম।’

এই সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) নারী ও শিশুসহ ছয় হাজার লোককে মুক্তি দান করেছিলেন এবং তাদেরকে বিপুল সংখ্যক পশু ও দাস-দাসী প্রদান করেন। আবুল হুসায়ন ইব্‌ন ফারিস মন্তব্য করেন যে, সেই দিন নবী করীম (সা) যে সম্পদ ফিরিয়ে দেন এবং যেসব বন্দীদের মুক্ত করে দেন, তার মূল্য ছিল পঞ্চাশ কোটি দেরহাম। আর এইসব ছিল তাদের জীবনে পাওয়া নবীজির নগদ বরকত। যারা দুনিয়ার জীবনে নবী করীম (সা)-এর অনুসরণ করবে, আখিরাতে তারা তাঁর যে কি পরিমাণ বরকত লাভ করবে তা সহজেই অনুমেয়।

ইবন ইসহাক বলেন, হালীমার ঘরে দুধপান পর্ব শেষে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর হেফাজতে মা আমিনা ও পরে দাদা আবদুল মুত্তালিব-এর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। আল্লাহ তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করতে থাকেন। তার বয়স ছয় বছরে উপনীত হলে মা আমিনা ইন্তিকাল করেন।

ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর ইবন মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন হাযম বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর মা আমিনা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী আবওয়া নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন। নবীজিকে সঙ্গে করে তিনি তার মাতুলালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন আদী ইবন নাজ্জার গোত্রভুক্ত। মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে তাঁর ইন্তিকাল হয়।

ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে করে মা মদীনায় তার মাতুলালয়ে যান। দাসী উম্মে আয়মানও সঙ্গে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স তখন ছয় বছর।

উম্মে আয়মান বলেন, এ সময়ে একদিন দু’জন ইহুদী আমার নিকট এসে বলল, ‘আহমদকে নিয়ে এস দেখি! আমরা তাকে দেখতে এসেছি।’ তারা তাঁকে দেখে ফিরিয়ে দিয়ে একজন অপরজনকে বলে, ‘এ ছেলেই এই উম্মতের নবী। আর এটাই হল তাঁর হিজরত স্থল। এঁকে কেন্দ্র করে অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটবে।’ মা আমিনা এ সংবাদ শুনে ঘাবড়ে যান এবং তাঁকে নিয়ে ফেরত রওয়ানা হন। এই ফেরার পথেই আবওয়া নামক স্থানে তার ইন্তিকাল হয়।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, বুরায়দা (রা) বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে বের হই। ওয়াদ্দান নামক স্থানে উপনীত হলে নবী করীম (সা) বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি আসছি।’ এই বলে তিনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে আসেন। এসে বললেনঃ

আমি আমার আম্মার কবরের কাছে গিয়ে আমার রব-এর নিকট তাঁর জন্য সুপারিশ করার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে তা থেকে বারণ করলেন। আর আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে যিয়ারত করতে বারণ করেছিলাম। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করবে। তিনদিনের পর কুরবানীর পশুর গোশত খেতেও আমি তোমাদেরকে বারণ করেছিলাম। এখন থেকে যে ক’দিন ইচ্ছা তা খেতে পারবে এবং যতদিন ইচ্ছা ধরে রাখতে পারবে। তোমাদেরকে আমি মদের পাত্রে পানি পান করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন থেকে সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিলাম।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত বুরায়দা (রা) বলেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) একটি কবরের নিকট গিয়ে বসে পড়েন। দেখাদেখি লোকেরাও তাঁর চতুম্পার্শ্বে বসে পড়ে। বসে নবী করীম (সা) মাথা নাড়তে নাড়তে কাঁদতে লাগলেন। উমর (রা) তাঁর নিকটে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কাঁদছেন কেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘এটি আমার আম্মা আমিনা বিনতে ওহব-এর কবর। আমার রব-এর নিকট আমি তাঁর এই কবরটি যিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দেন, কিন্তু তাঁর মাগফিরাতের আবেদন করার অনুমতি চাইলে তিনি তাতে সম্মতি দিলেন না। মায়ের কথা ভেবে আমি কাঁদছি।’ বর্ণনাকারী বলেন, সেইদিনের মত এত বেশি সময় ধরে কাঁদতে নবীজিকে কখনও দেখা যায়নি।

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)-এর বরাতে বায়হাকী বর্ণনা করেন, ইবন মাসউদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এক দিন কবরস্থান যিয়ারত করতে বের হন। আমরাও তাঁর সঙ্গে বের হলাম। তাঁর আদেশে আমরা এক জায়গায় বসে পড়লাম। তিনি ঘুরে ঘুরে কবর দেখছেন। এক পর্যায়ে একটি কবরের নিকট গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত নিম্নস্বরে কি যেন বলতে থাকেন। তারপর তিনি কেঁদে উঠেন। তাঁর কান্না দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম। অবশেষে তিনি আমাদের কাছে ফিরে আসেন। উমর ইবন খাত্তাব (রা) এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার কান্না তো আমাদেরকেও কাঁদিয়েছে এবং ভয় পাইয়ে দিয়েছে।’ তিনি আমাদের নিকটে এসে বসলেন এবং বললেন, “আমার কান্না বুঝি তোমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে?” আমরা বললাম, “জ্বী হ্যাঁ”। তিনি বললেন, ‘যে কবরটির সামনে আমাকে তোমরা কথা বলতে দেখেছ, সেটি আমিনা বিনতে ওহব-এর কবর। আমার রব-এর নিকট আমি তার যিয়ারত করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি প্রদান করেন। আবার তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতিও চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার রব সেই অনুমতি দিলেন না এবং আমার প্রতি নাযিল করলেনঃ

( مَا كَانَ لِلنَّبِیِّ وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوۤا۟ أَن یَسۡتَغۡفِرُوا۟ لِلۡمُشۡرِكِینَ وَلَوۡ كَانُوۤا۟ أُو۟لِی قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡجَحِیمِ ۝ وَمَا كَانَ ٱسۡتِغۡفَارُ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَ لِأَبِیهِ إِلَّا عَن مَّوۡعِدَة وَعَدَهَاۤ إِیَّاهُ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَهُۥۤ أَنَّهُۥ عَدُوّ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنۡهُۚ إِنَّ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَ لَأَوَّ  ٰ⁠ هٌ حَلِیم ࣱ)

[Surah At-Tawbah 113 - 114]

“আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়। যখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তারা জাহান্নামী। ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে। অতঃপর যখন তার নিকট এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমল-হৃদয় ও সহনশীল।" (তাওবাঃ ১১৩-১১৪)

ফলে মায়ের জন্য পুত্রের হৃদয় যেভাবে বিগলিত হয় আমার অবস্থাও ঠিক তাই হলো। এ কারণেই আমি কেঁদেছি।” বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের। হাদীছের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবে তার উল্লেখ নেই। ইমাম মুসলিম হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেন। তখন তিনি নিজেও কান্নাকাটি করেন এবং আশেপাশের লোকদেরও কাঁদান। তারপর তিনি বলেন, “আমার রব-এর নিকট আমি আমার মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে অনুমতি দেন। কিন্তু মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে আমার রব আমাকে সেই অনুমতি দেননি। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করবে, কবর তোমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।” ইমাম মুসলিম আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! বলুন তো আমার আব্বা কোথায়?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘জাহান্নামে’। একথা শুনে লোকটি ফিরে যেতে উদ্যত হলে তিনি তাকে ডেকে বললেন, “আমার পিতা এবং তোমার পিতা উভয়েই জাহান্নামে।”

বায়হাকী হযরত সা’দ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী করীম (সা)-এর নিকট এসে বলল, ‘আমার আব্বা আত্মীয় বৎসল ছিলেন। তার অমুক অমুক গুণ ছিল। এখন তিনি কোথায় আছেন?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘জাহান্নামে’। বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে বেদুঈন অস্থির হয়ে পড়ে এবং বলে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আপনার পিতা কোথায়?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘যখনই তুমি কোন কাফিরের কবর অতিক্রম করবে, তাকে জাহান্নামের সংবাদ দেবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি মুসলমান হয়ে যায়।

পরে সে বলে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) আমার উপর একটি কষ্টকর কাজ দিলেন। এরপর থেকে আমি যখনই যে কাফিরের কবরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছি তাকেই জাহান্নামের সংবাদ দিয়েছি।’ এটাও গরীব পর্যায়ের বর্ণনা, বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে অনুক্ত।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেছেন, একদিন আমরা রাসূলুলাহ (সা)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একজন মহিলা দেখা গেল। তাকে নবী করীম (সা) চিনেছেন বলে আমরা ধারণা করিনি। রাস্তার মধ্যখানে এসে নবী করীম (সা) দাঁড়িয়ে যান। মহিলাও নবীজির নিকটে এসে দাঁড়ান। তখন দেখা গেল, তিনি রাসূলুলাহ (সা)-এর কন্যা ফাতিমা। নবী করীম (সা) বলনে, ‘ফাতিমা! কিসে তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে আনলো?’ ফাতিমা (রা) বললেন, ‘এই গৃহবাসীদের মৃতের আত্মার মাগফেরাত প্রার্থনা ও সমবেদনা প্রকাশের জন্য এখানে এসেছি।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘বোধহয় তুমি তাদের সঙ্গে কবর পর্যন্ত গিয়েছিলে?’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘লোকদের সঙ্গে মৃতের কবর পর্যন্ত যাওয়া থেকে আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন। আমি তো এ বিষয়ে আপনি যা বলে থাকেন তা শুনেছি।’ নবী করীম (সা) বললেন, “যদি তুমি তাদের সঙ্গে কবর পর্যন্ত যেতে, তবে জান্নাত দেখতে পেতে, যতক্ষণ না তোমার বাপের দাদা তা প্রত্যক্ষ করতেন।” আহমদ আবু দাউদ, নাসায়ী ও বায়হাকী প্রমুখ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে এর একজন রাবীকে অনেকে বিতর্কিত বলেছেন। আবদুল মুত্তালিব জাহেলী দীনের অনুসারী রূপেই মারা যান। তবে তার এবং আবু তালিবের দীনের ব্যাপারে শিয়াদের ভিন্নমত রয়েছে। আবু তালিবের ওফাত অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।

বায়হাকী তাঁর ‘দালায়লুন নুবুওয়াহ্’ গ্রন্থে এই হাদীসগুলো উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতা-মাতা ও দাদার অবস্থা আখিরাতে কেন এরূপ হবে না? তারা তো পৌত্তলিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ঈসা (আ)-এর দীনেরও তারা অনুসরণ করতেন না। তবে তাঁদের এই কুফরীতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশ পরিচয়ে কোন কলংক আসে না। কারণ, কাফিরে কাফিরে বিবাহ শুদ্ধ। এ কারণেই স্বামী স্ত্রী একত্রে ইসলাম গ্রহণ করলে বিবাহ নবায়ন করতে হয় না বা তাতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে হয় না। উল্লেখ্য যে, একাধিক সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে যে, দুই নবীর মধ্যবর্তী সময়কার মানুষ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু, পাগল এবং বধিরদেরকে কিয়ামতের চত্বরে পরীক্ষা করা হবে। তখন তাদের কেউ জবাব দিতে পারবে, কেউ পারবে না। আমার মতে এই হাদীসের বক্তব্য আর নবী করীম (সা)-এর পিতা-মাতা ও দাদা সম্পর্কে জাহান্নামী হওয়ার সংবাদ প্রদানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কেননা, সে সময় এঁরাও ঐ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা জবাব দানে অক্ষম হবে।

( وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِینَ حَتَّىٰ نَبۡعَثَ رَسُول ࣰا)

[Surah Al-Isra' 15]

এই আয়াতের তাফসীরে আমি বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।

সুহায়লী কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে আছে যে, আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দোয়ায় আল্লাহ তাআলা তাঁর পিতা-মাতা দু’জনকেই জীবিত করেছিলেন। জীবন পেয়ে তারা নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। আল্লাহর কুদরতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এমনটি সম্ভবপর হলেও প্রকৃত পক্ষে এই বর্ণনাটি একান্তই মুনকার’ পর্যায়ের। সহীহ হাদীসে এর বিপরীত বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

ইবন ইসহাক বলেন, মা আমিনা বিনতে ওহব-এর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) দাদা আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম-এর তত্ত্বাবধানে থাকেন। সে সময়ে কা’বার ছায়ায় আবদুল মুত্তালিবের জন্য বিছানা পাতা হত। আবদুল মুত্তালিব তাতে বসতেন এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিরা সেই বিছানার চারদিকে বসে পড়ত। তাঁর সম্মানার্থে কেউই বিছানার উপরে উঠে বসত না। নাদুস-নুদুস বালক নবী (সা)-ও সেই মজলিসে আসতেন এবং আবদুল মুত্তালিবের বিছানার ওপর বসে পড়তেন। তা দেখে তাঁর চাচারা তাকে ধরে সরিয়ে বসাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব বলতেন, ‘আমার এ নাতিটিকে তোমরা ছেড়ে দাও। আল্লাহর শপথ! ভবিষ্যতে ও বিরাট কিছু হবে।’ এই বলে আবদুল মুত্তালিব নবীজিকে নিজ হাতে ধরে নিজের বিছানায় বসিয়ে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন এবং তিনি যা করতে চাইতেন, তাতে সহযোগিতা করতেন।

ওয়াকিদী একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মা আমিনার কাছে থাকতেন। মায়ের ইন্তিকাল হলে দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে নিজের ঔরসজাত সন্তানদের চাইতেও বেশি স্নেহ করতেন এবং সব সময় তাঁকে কাছে কাছে রাখতেন। শয়নে-স্বপনে সর্বাবস্থায় নবীজি দাদা আবদুল মুত্তালিবের একান্তে যেতে পারতেন। দাদার বিছানায় গিয়ে বসলে আবদুল মুত্তালিব বলতেন, ‘একে তোমরা ছেড়ে দাও, আমার এই সন্তানটি কাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে।’

বনু মুদলাজ এর একদল লোক আবদুল মুত্তালিবকে বলল, ‘এই ছেলের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখবেন। কারণ এর পায়ের আকৃতি মাকামে ইব্রাহীমের পায়ের আকৃতির সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কোন পা আমরা দেখিনি।’ একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে বললেন, ‘শোন, এরা কী বলছে!’ সেই তখন থেকে আবু তালিব নবী করীম (সা)-কে বিশেষ হেফাজতে রাখতে শুরু করেন। আবদুল মুত্তালিব উম্মে আয়মানকে—যিনি নবীজিকে কোলে-কাঁখে নিতেন-বলেছিলেন, ‘বারাকাহ! আমার এই নাতির ব্যাপারে উদাসীন হয়ো না। আমি একে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট বালকদের সঙ্গে দেখতে পেয়েছি। আর আহলে কিতাবদের ধারণা আমার এই সন্তানটি এই উম্মতের নবী হবে।’ উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব যখনই খানা খেতেন বলতেন, ‘আমার নাতিকে নিয়ে এস।’ তখন নবীজিকে তাঁর কাছে এনে দেয়া হত। মৃত্যুকালে আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেখাশুনা করার জন্য অসিয়ত করে যান। এই অসিয়তের পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং হাজুন নামক স্থানে সমাধিস্থ হন।

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আট বছরে উপনীত হলে তার দাদা আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি তাঁর কন্যাদের ডেকে তাদের বিলাপ করার আদেশ দেন। সেই মেয়েরা হলো, আরওয়া, উমাইয়া, বাররা, সাফিয়া, আতিকা ও উম্মে হাকীম আল-বায়যা। তাদের পিতাকে শুনিয়ে তারা যে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ইবন ইসহাক সেগুলি উদ্ধৃত করেন। এগুলো ছিল খুবই মর্মস্পশী বিলাপ। ইবন ইসহাক এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবন হিশাম বলেন, এই কবিতাগুলো যে তাদেরই, তা যথার্থ বলে কোন কাব্য বিশারদই স্বীকার করেন নি।

ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিমের মৃত্যুর পর যমযম ও পানি পান করানো (সিকায়া)-এর দায়িত্ব তাঁর পুত্র আব্বাসের ওপর অর্পিত হয়। আব্বাস (রা) বয়সে তার ভাইদের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ। ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভ করা পর্যন্ত এই দায়িত্ব তাঁরই হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা)-ও এই দায়িত্ব তারই হাতে বহাল রাখেন। দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল মুত্তালিবের ওসিয়ত অনুসারে চাচা আবু তালিব-এর তত্ত্বাবধানে থাকতে শুরু করেন। আবু তালিব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতা আবদুল্লাহর সহোদর। তাঁদের দুজনেরই মা হলেন, ফাতিমা বিনতে আমর ইবন আয়িয ইবন ইমরান ইবন মাখযুম। রাসূলুল্লাহ (সা) চাচার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন।

ওয়াকিদীর বর্ণনায় আরো আছে, আবু তালিবের সংসার ছিল অসচ্ছল। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তিনি এত বেশি আদর করতেন যে, নিজের ঔরসজাত সন্তানদেরকে তত আদর করতেন না। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিজের পার্শ্বে না নিয়ে তিনি ঘুমাতেন না। বাইরে কোথাও গেলে তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আহার করতেন। তাকে ছাড়া আহার করলে আবু তালিব এবং তার পরিবারের কারও আহারে তৃপ্তি আসত না। সবাই খেতে বসলে আবু তালিব বলতেন, তোমরা একটু অপেক্ষা কর, আমার আদরের দুলালটি এসে যাক। রাসূলুল্লাহ (সা) এসে তাদের সঙ্গে আহার করলে তাদের আহার্য উদ্বৃত্ত থাকতো। এ ব্যাপারে আবু তালিব বলতেন, ‘তুমি বড় বরকতময়।’ সকালে ঘুম থেকে উঠলে সবাইকে যেখানে মলিন ও আলুথালু মনে হত, সেখানে রাসূলুল্লাহকে অনেক দীপ্তিময় ও লাবণ্যময় দেখাতো।

হাসান ইবন আরাফা (র) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেছেন, ভোর হলে আবু তালিব শিশুদের জন্য একপাত্রে খাওয়ার আয়োজন করতেন। শিশুরা বসে কাড়াকাড়ি করে খেতে শুরু করত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স) সেই কাড়াকাড়িতে যোগ দিতেন না। তিনি হাত সরিয়ে নিতেন। দেখে চাচা আবু তালিব তার জন্য আলাদা পাত্রের ব্যবস্থা করেন।

ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, লাহাব গোত্রের এক ব্যক্তি গণক ছিল। লোকটি মক্কায় আসলে কুরাইশের লোকেরা তাদের সন্তানদেরকে তার কাছে নিয়ে যেত। একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপর গণকের চোখ পড়ে। এক পর্যায়ে সে বলে, ওই ছেলেটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তার অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে আবু তালিব তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু গণক বলতে থাকে, ‘আরে এইমাত্র আমি যে ছেলেটিকে দেখলাম, ওকে একটু আমার কাছে নিয়ে এস। আল্লাহর শপথ, ভবিষ্যতে ও বিরাট কিছু হবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, কিন্তু আবু তালিব নবীজিকে নিয়ে সরে পড়েন।

৯০
চাচা আবু তালিবের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সিরিয়া সফর এরং পাদ্রী বাহীরার সঙ্গে সাক্ষাত প্রসঙ্গ
ইবন ইসহাক বলেন, অতঃপর আবু তালিব বাণিজোপলক্ষে একটি কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া রওয়ানা হন। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যেই মাত্র তিনি রওয়ানা হন, ঠিক তখনি রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে জড়িয়ে ধরেন। এতে তাঁর প্রতি আবু তালিব বিগলিত হয়ে পড়েন এবং বলে ওঠেন, ‘আল্লাহর শপথ! একে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আমিও তাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করব না, সেও কখনো আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’

যা হোক, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে করে আবু তালিব রওয়ানা হন। কাফেলা সিরিয়ার বুসরা নামক এক স্থানে যাত্রা বিরতি করে। সেখানকার একটি গীর্জায় এক পাদ্রী অবস্থান করেন। তাঁর নাম ছিল বাহীরা।

খৃষ্টীয় ধর্মের তিনি বড় পণ্ডিত ছিলেন। পাদ্রীত্ব গ্রহণ অবধি তিনি ঐ গীর্জায়ই সব সময় থাকতেন। খৃষ্টানদের ধারণা মতে, খ্রীষ্টীয় ধর্মগ্রন্থে তিনিই ছিলেন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত। উত্তরাধিকার সূত্রে এই জ্ঞান তারা পেয়ে থাকেন।

মক্কার এই বণিক কাফেলা এর আগেও বহুবার এ পথ চলাচল করেছে। কিন্তু পাদ্রী বাহীরা এতকাল পর্যন্ত কখনো তাদের সঙ্গে কথাও বলেন নি এবং তাদের প্রতি ফিরেও তাকান নি। কিন্তু এই যাত্রায় কাফেলা পাদ্রীর গীর্জার নিকটে অবতরণ করলে পাদ্রী তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন। কাফেলার লোকজনের ধারণা মতে, পাদ্রী তাঁর গীর্জায় বসে কিছু একটা লক্ষ্য করেই এমনটি করেছিলেন। তাদের ধারণা, পাদ্রী কাফেলার মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখে ফেলেছিলেন। ফলে তখন একখণ্ড মেঘ দলের মধ্য থেকে শুধু রাসূলুল্লাহ (সা)-কেই ছায়া দিচ্ছিল। কাফেলার লোকেরা আরও সামনে অগ্রসর হয়ে পাদ্রীর কাছাকাছি একটি গাছের ছায়ায় অবস্থান নেয়। পাদ্রী রাসূলুল্লাহ (সা)-কে মেঘের ছায়া প্রদান এবং তার প্রতি গাছের ডাল-পালা ঝুঁকে থাকছে লক্ষ্য করেন। এসব দেখে পাদ্রী তাঁর গীর্জা হতে বেরিয়ে আসেন। এদিকে তাঁর আদেশে খাবার প্রস্তুত করা হয়। এবার তিনি কাফেলার নিকট লোক প্রেরণ করেন। কাফেলার প্রতিনিধি দল পাদ্রীর নিকট উপস্থিত হলে পাদ্রী বলেন, ‘ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছি। আমার একান্ত কামনা তোমরা প্রত্যেকে আমার এই আয়োজনে উপস্থিত হবে, বড় ছোট, গোলাম-আযাদ সকলে।’ জবাবে একজন বলল, ‘আজ আপনি ব্যতিক্রম কিছু করছেন দেখছি। ইতিপূর্বে কখনো তো আপনি আমাদের জন্য এরূপ আয়োজন করেন নি। অথচ এর আগেও বহুবার আমরা এই পথে যাতায়াত করেছি। আজ এমন কি হলো বলুন তো?’ বাহীরা বললেন, ‘ঠিকই বলেছ! তোমার কথা যথার্থ। ব্যাপার তেমন কিছু নয়। তোমরা মেহমান। একবেলা খাবার খাইয়ে তোমাদের মেহমানদারী করতে আশা করেছিলাম আর কি!’

কুরাইশ বণিক কাফেলার সকলেই পাদ্রীর নিকট সমবেত হন। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ (সা) গাছের নিচে তাদের মালপত্রের নিকট থেকে যান। পাদ্রী যখন দেখলেন যে, কাফেলার সব লোকই এসেছে। কিন্তু তিনি যে গুণ ও লক্ষণের কথা জানতেন, তা কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তখন তিনি বললেন, ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমার খাবার থেকে তোমাদের একজনও যেন বাদ না যায়।’ লোকেরা বলল, ‘হে বাহীরা! আপনার নিকট যাদের আসা উচিত ছিল, তাদের একজনও অনুপস্থিত নেই। কেবল বয়সে আমাদের সকলের ছোট একটি বালক তাঁবুতে রয়ে গেছে।’ পাদ্রী বলল, “না, তা করো না। ওকেও ডেকে পাঠাও, যেন সেও তোমাদের সঙ্গে এই খাবারে শরীক হতে পারে।” বর্ণনাকারী বলেন, এর জবাবে কাফেলার এক কুরাইশ সদস্য বলে উঠল, “লাত-ওজ্জার শপথ! মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব এই খাবারে আমাদের মধ্য থেকে অনুপস্থিত থাকা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যই বটে।’ অতঃপর সে উঠে গিয়ে মুহাম্মদ (সা)-কে কোলে করে এনে সকলের সঙ্গে আহারে বসিয়ে দেয়। বাহীরা তাকে দেখে গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং তার দেহে সেসব লক্ষণ দেখার চেষ্টা করেন, যা তিনি তাঁর কিতাবে ইতিপূর্বে পেয়েছিলেন।

আহার পর্ব শেষে সকলে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। এই সুযোগে বাহীরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে গিয়ে বললেন, “হে বালক! আমি তোমাকে লাত-ওজ্জার শপথ দিয়ে জানতে চাচ্ছি, আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করবো, তার যথার্থ জবাব দিবে কি?’ বাহীরা লাত-ওজ্জার নামে এই জন্যই কসম খেয়েছিলেন যে, তিনি মুহাম্মদ (সা)-এর সম্প্রদায়কে এ দুই নামের শপথ করতে অভ্যস্ত বলে শুনেছিলেন। যা হোক, জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আপনি আমাকে লাত-ওজ্জার নামে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ! আমি এই দু’টোর মত অন্য কিছুকেই এত ঘৃণা করি না।’ বাহীরা বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো, তার যথাযথ জবাব তুমি দিবে কি?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আপনার যা ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করুন।’ বাহীরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর ঘুম, আকার-আকৃতি ইত্যাদি সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এক এক করে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। তাঁর প্রদত্ত সব বিবরণ বাহীরার পূর্ব থেকে জানা নবীর গুণাবলীর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তারপর বাহীরা তার পিঠে দৃষ্টিপাত করে পূর্ব থেকে জানা বিবরণ অনুযায়ী তার দু’স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওতের মহর দেখতে পান।

পাদ্রী বাহীরা এবার নবীজির চাচা আবু তালিব-এর দিকে ফিরে বললেন, ‘এই বালক আপনার কী হয়?’ আবু তালিব বললেন, ‘আমার পুত্র।’ বাহীরা বললেন, ‘না সে আপনার পুত্র নয়। এই বালকের পিতা জীবিত থাকতে পারে না।’ আবু তালিব বললেন, ‘ও আমার ভাতিজা।’ পাদ্রী বললেন, ‘ওর পিতার কি হয়েছে?’ আবু তালিব বললেন, ‘ও যখন তার মায়ের গর্ভে তখন ওর পিতা মারা যান।’ পাদ্রী বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। ভাতিজাকে নিয়ে আপনি দেশে ফিরে যান। আর ওর ব্যাপারে ইহুদীদের থেকে সতর্ক থাকবেন। আল্লাহর শপথ! ইহুদীরা যদি ওকে দেখতে পায় আর আমি ওর ব্যাপারে যা কিছু বুঝতে পেরেছি, যদি তারা তা বুঝতে পারে, তাহলে ওরা ওর অনিষ্ট করবে। আপনার এই ভাতিজাটি ভবিষ্যতে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হবেন। আপনি ওকে নিয়ে শীঘ্রই দেশে ফিরে যান।’ আবু তালিব সিরিয়ার বাণিজ্য শেষ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিয়ে তাড়াতাড়ি মক্কায় ফিরে আসেন।

ইবনে ইসহাক বলেন, যারীরা, ছামামা ও দারিসমা আহলে কিতাবের এই তিন ব্যক্তিও বাহীরার মত উক্ত সফরে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখেছিল এবং তাকে সনাক্ত করতে পেরেছিল। তারা রাসূল (সা)-এর ক্ষতিসাধন করার চেষ্টাও করে। বাহীরা তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। তিনি তাদেরকে আল্লাহর কথা এবং তাওরাতে মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে যে বিবরণ আছে, সে সবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তারা তাঁর বক্তব্য বুঝে ফেলে এবং তাঁকে সত্য বলে মেনে নেয়। ফলে তারা মুহাম্মদ (সা)-কে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যায়।

ইউনুস ইবনে বুকায়র ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু তালিব উক্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনটি কাসীদা আবৃত্তি করেছিলেন। এতো গেল ইবনে ইসহাক এর বর্ণনা। অন্য এক মুসনাদেও মারফু সূত্রে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।

হাফিজ আবু বকর আল-খারায়েতী বর্ণনা করেন যে, আবু বকর ইবনে আবু মূসা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবু তালিব সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-সহ আরও কয়েকজন কুরাইশী ব্যক্তি। পাদ্রী বাহীরার এলাকায় গিয়ে তারা যাত্রা বিরতি করে। তাদেরকে দেখে পাদ্রী বেরিয়ে আসেন। এর আগেও তারা এই পথে চলাচল করত; কিন্তু পাদ্রী কখনো বেরিয়ে আসেন নি, তাদের প্রতি ফিরেও তাকান নি। যা হোক কুরাইশ কাফেলা অবতরণ করে আর পাদ্রী বেরিয়ে তাদের নিকটে চলে আসেন। এসেই তিনি নবীজি (সা)-এর হাত ধরে ফেলে বলেন, “ইনি বিশ্বজগতের সরদার” বায়হাকীর বর্ণনায় অতিরিক্ত রয়েছে, “ইনি বিশ্বজগতের প্রভুর রাসূল! আল্লাহ তাঁকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।” একথা শুনে কুরায়শের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বলে উঠল, ‘আপনি তার সম্পর্কে কী জানেন?’ পাদ্রী বললেন, ‘তোমরা পেছনের ঐ পাহাড়ের পাদদেশ অতিক্রম করার সময় প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাথর তাঁর প্রতি সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিল। আর এগুলো নবী ছাড়া অন্য কাউকেই সিজদা করে না। আর আমি তাঁকে তাঁর কাঁধের সামান্য নিচে অবস্থিত মহরে নবুওত দেখে সনাক্ত করতে পেরেছি।’

অতঃপর পাদ্রী ফিরে গিয়ে তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেন এবং খাবার নিয়ে এসে দেখতে পেলেন যে, একটি মেঘখণ্ড নবীজি (সা)-কে ছায়া প্রদান করছে। তিনি তখন উটের দেখাশোনা করছিলেন। কাফেলার কাছে এসে তিনি বললেন, ‘ঐ দেখ মেঘ ওঁকে ছায়া দিচ্ছে।’ লোকেরা নবীজিকে গাছের ছায়া তলে নিয়ে আসে। নবীজি (সা) গাছের ছায়ায় বসা মাত্র ছায়া তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পাদ্রী বললেন, “লক্ষ্য কর, গাছের ছায়া ওর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে।” বর্ণনাকারী বলেন, পাদ্রী তখন কাফেলার লোকদেরকে শপথ দিয়ে বললেন, ‘যেন তারা নবীজি (সা)-কে নিয়ে রোমে না যায়। কারণ রোমবাসী তাকে দেখলে লক্ষণ দেখে চিনে ফেলবে এবং হত্যা করে ফেলবে।’ এ কথা বলেই পাদ্রী মুখ ফিরিয়েই দেখতে পেলেন যে, সাতজন রোমক এগিয়ে আসছে। বর্ণনাকারী বলেন, দেখে পাদ্রী তাদের প্রতি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের আগমনের উদ্দেশ্য কী?’ জবাবে তারা বলল, ‘আসলাম, কারণ আমরা জানতে পেরেছি যে, এই নগরীতে এ মাসেই নবীর আগমন ঘটতে যাচ্ছে। তাই প্রতিটি রাস্তায় লোক প্রেরণ করা হয়েছে। আর আমরা আপনার এ পথ দিয়ে তার আগমনের সংবাদ পেয়েছি।’ পাদ্রী বলনে, ‘আচ্ছা, তোমাদের পেছনে কি কেউ আছে তোমাদের চাইতে উত্তম?’ তারা বলল, ‘না। আমরা কেবল নবীর এই পথে আগমনের সংবাদ পেয়েই এসেছি।’ পাদ্রী বললেন, ‘আচ্ছা, বলতো, আল্লাহ যে কাজ সম্পাদন করার ইচ্ছা করেন, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কি কোন মানুষের আছে?’ তারা বলল, ‘না’। বর্ণনাকারী বলেন, একথার পর তারা পাদ্রীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এবং তার সাহচর্য অবলম্বন করে।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর পাদ্রী কুরাইশ কাফেলাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, বল তো, এই বালকের অভিভাবক কে?’ জবাবে তারা বলল, ‘আবু তালিব।’ পাদ্রী নবীজির ব্যাপারে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করায় আবু বকর ও বিলালকে সাথে দিয়ে নবীজিকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন। পাদ্রী পাথেয় হিসাবে কিছু পিঠা ও যয়তুন তেল তার সঙ্গে দিয়ে দেন।

তিরমিযী, হাকিম, বায়হাকী ও ইবনে আসাকির এবং আরও বহু হাদীসবেত্তা ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটির সনদ গরীব পর্যায়ের। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, বর্ণনাটি হাসান ও গরীব। বায়হাকী ও ইবনে আসাকিরও এটি উদ্ধৃত করেছেন।

আমার মতে, এ বর্ণনাটিতে কয়েকটি গারাবাত বিদ্যমান। প্রথমত, এটি সাহাবীগণের মুরসাল বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত। কারণ আবু মূসা আশআরী আরবে আগমন করেছেন খায়বারের বছর অর্থাৎ হিজরতের সপ্তম বছর। ইবনে ইসহাক যে তাকে মক্কা থেকে হাবশায় হিজরতকারী অভিহিত করেছেন, সে তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব বর্ণনাটি মুরসাল। কারণ, ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন রাসূল (সা)-এর বয়স ছিল বার বছর। সম্ভবত আবু মূসা এ প্রসিদ্ধ ঘটনাটি অন্য কারো মুখে শুনেই বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয়ত, এর চেয়ে বিশুদ্ধতর হাদীসেও মেঘের কথা উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, এই যে বলা হল, আবু বকর তার সঙ্গে বিলালকে প্রেরণ করলেন, কথাটাও গ্রহণযোগ্য নয়; কারণ, সে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল বার বছর, তাহলে আবু বকর এর বয়স ছিল নয় কি দশ বছর। আর বিলালের বয়স তার চেয়েও কম। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে, ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আবু বকরই বা কোথায় ছিলেন, বিলালই বা ছিলেন কোথায়? দু’জনই তো তখন ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত। তবে, একথা বলা যায় যে, ঘটনাটি এরূপ ঘটেছিল ঠিকই। তবে এটি অন্য কোন ঘটনা কিংবা তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স বার বছর হওয়ার বর্ণনাটি সঠিক নয়। কারণ, ওয়াকিদী ছাড়া আর কেউ বার বছরের কথা উল্লেখ করেন নি। সুহায়লী বর্ণনা করেছেন যে, সে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল নয় বছর। আল্লাহই ভালো জানেন।

মুহাম্মদ ইবনে সালিহ সূত্রে ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স যখন বার বছর, তখন তিনি চাচা আবু তালিব এর সাথে একটি বণিক কাফেলার সাথে সিরিয়া সফর করেন। পথে তারা পাদ্রী বাহীরার মেহমান হন। তখন বাহীরা আবু তালিবের কানে কানে কী যেন বললেন। নবীজি (সা)-এর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য বলেন। ফলে আবু তালিব তাঁকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দেন।

মহান আল্লাহর হেফাজতে আবু তালিবের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) যৌবনপ্রাপ্ত হন। এ সময়ে আল্লাহ তাকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় যাবতীয় জাহিলী কর্মকাণ্ড ও দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত রাখেন। ফলে তিনি সমাজে ব্যক্তিত্বে সকলের শ্রেষ্ঠ, চরিত্রে সর্বোত্তম, আলাপে-ব্যবহারে, উঠায়-বসায় সবচাইতে ভদ্ৰ, সহনশীলতা-বিশ্বস্ততায় সবচাইতে মহান, কথা-বার্তায় সত্যবাদী, সমস্ত অশ্লীলতা ও নোংরামী থেকে মুক্ত। কখনো তাঁকে নিন্দাবাদ করতে বা কারো সাথে কলহ-বিবাদ করতে দেখা যায়নি। সব দেখে তাঁর স্বজাতি তাঁর নাম দেয় ‘আল-আমীন’। আল্লাহ প্রদত্ত এসব গুণাবলি দেখে আবু তালিব নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তার রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখেন।

মুহাম্মদ ইবনে সা’দ আবু মুজলিয থেকে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ’র মৃত্যুর পর আবু তালিব মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হন। নবীজি (সা)-কে সঙ্গে না নিয়ে তিনি সফর করতেন না। একবার নবীজিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সিরিয়ার অভিমুখে রওয়ানা হন। পথে এক স্থানে যাত্রা বিরতি দেন। এক পাদ্রী সেখানে এসে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে একজন পুণ্যবান ব্যক্তি আছেন।’ অতঃপর বললেন, ‘এই বালকের পিতা কোথায়?’ জবাবে আবু তালিব বললেন, ‘এই তো আমিই তার অভিভাবক।’ পাদ্রী বললেন, ‘এই বালকের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন। একে নিয়ে সিরিয়া যাবেন না। ইহুদীরা বড় হিংসাপরায়ণ। সুযোগ পেলে তারা এর ক্ষতি করবে বলে আমি আশংকা করছি।’ আবু তালিব বললেন, ‘একথা শুধু আপনিই বলছেন না, এটা আল্লাহরও কথা।’ অতঃপর আবু তালিব তাকে মক্কা ফেরত পাঠান এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মদকে আমি তোমার হাতে সোপর্দ করলাম।’ আবু তালিব মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মদ (সা)-এর দেখাশুনা করেন।

৯১
বাহীরার কাহিনী
সুহায়লী যুহরীর সীরাত গ্রন্থ থেকে বর্ণনা করেন যে, বাহীরা একজন ইহুদী পণ্ডিত ছিলেন। আমার মতে, উপরের কাহিনী থেকে যা বুঝা যায়, তা হলো, বাহীরা ছিলেন খৃষ্টান পাদ্রী। আল্লাহই সম্যক অবহিত! মাসউদী থেকে বর্ণিত বাহীরা আবদুল কায়স গোত্রের লোক ছিলেন। তার আসল নাম ছিল জারজীস।

ইবনে কুতায়বার ‘মা‘আরিফ’ কিতাবে আছে, ইসলামের সামান্য পূর্বে জাহেলী যুগে এক ব্যক্তি শুনতে পেয়েছিলেন যে, কে যেন বলছে, পৃথিবীর সেরা মানুষ তিনজন। বাহীরা, রিআব ইবনে বারা আশ-শান্নী এবং তৃতীয়জনের আগমন এখনও ঘটেনি। সেই তৃতীয়জন ছিলেন প্রতীক্ষিত রাসূলুল্লাহ (সা)। ইবনে কুতায়বা বলেন, এই ঘোষণা শ্রবণের পর রিআব ইবন শান্নী এবং তার পিতার কবরে অবিরাম হালকা বৃষ্টিপাত হতে দেখা গিয়েছিল।

৯২
সায়ফ ইবনে যী-ইয়াযান-এর বর্ণনা এবং নবী করীম (সা) সম্পর্কে তাঁর সুসংবাদ প্রদান
হাফিজ আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাফর ইবনে সাহল খারাইতি তাঁর ‘হাওয়াতিফুল জান’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আলী ইবনে হারব আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, সায়ফ ইবনে যী-ইয়াযান এক সময় হাবশার (ইথিওপিয়া)-এর শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। ইবনে মুনযিরের মতে সায়ফ ইবনে যী-ইয়াযানের নাম নুমান ইব্‌ন কায়স। এটি ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্মের দু’বছর পরের ঘটনা।

এ উপলক্ষে আরবের প্রতিনিধি ও কবিগণ তাঁকে অভিনন্দন জানাতে এবং তাঁর জনকল্যাণমূলক কর্মতৎপরতায় প্রশংসা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট হাজির হন। কুরায়শ বংশীয় প্রতিনিধি দলে অন্যান্য নেতার মধ্যে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম, উমাইয়া ইবনে আবদ শামস আবু আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন জাদ’আন এবং খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ প্রমুখও ছিলেন। তারা সানআয় গিয়ে সায়ফ-এর সাথে সাক্ষাত করেন। তখন তিনি গামাদান পর্বতের চূড়ায় নির্মিত রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। কবি উমাইয়া ইব্‌ন আবী সাত তাঁর নিম্নোক্ত কবিতায় গামাদান পর্বতের কথা উল্লেখ করেছেন।

واشرب هنيئا عليك ألتاج مرتفعا - في رأس غمدان دارا منك محلا لا

“আপনি তৃপ্তি সহকারে পান করুন, আপনার মাথায় আছে সুউচ্চ মুকুট। আপানার অবস্থান হলো গামাদান পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত রাজপ্রাসাদে।”

রাজপ্রহরী রাজার নিকট গিয়ে আগন্তুকদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলো। রাজা তাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তার নিকটবর্তী হয়ে আব্দুল মুত্তালিব কথা বলার অনুমতি চাইলেন। রাজা বললেন, ‘আপনি যদি আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন তবে আপনাকে অনুমতি দিলাম। আপনি কথা বলুন।’

আব্দুল মুত্তালিব বলতে শুরু করলেন, ‘হে রাজন! আল্লাহ তা’আলা আপনাকে এমন একটি উচ্চ স্থানে বসিয়েছেন যা অর্জন করা দুষ্কর, যা সুরক্ষিত এবং সুমহান। তিনি আপনাকে এমন বংশের অন্তর্ভুক্ত করেছেন যার উৎস পবিত্র, মূল সুমিষ্ট, শিকড় সুদৃঢ় এবং যার শাখা- প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে সর্বাধিক মর্যাদাবান স্থানে ও পাত্রে।

হে রাজন! আপনি আরবের রাজা এবং তাদের বসন্ত কাল স্বরূপ যার দ্বারা জনপদগুলো সবুজ-শ্যামল হয়েছে। আপনি আরবদের শীর্ষতম ব্যক্তি, আপনার প্রতি মাথা নত করে আরবের শহর-নগরগুলো। আপনি তাদের স্তম্ভ যার উপর তারা নির্ভর করে। আপনি তাদের আশ্রয়স্থল যেখানে এসে লোকজন আশ্রয় লাভ করে। আপনার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত। আমাদের জন্যে আপনি তাদের উত্তম উত্তরাধিকারী। তারা যার পূর্বপুরুষ তিনি কখনো নিষ্প্রভ হতে পারেন না এবং আপনি যাদের উত্তর পুরুষ তারা কখনো ধ্বংস হতে পারেন না।

মহারাজ! আমরা মহান আল্লাহর হারাম শরীফের অধিবাসী এবং তাঁর পবিত্র ঘরের তত্ত্বাবধায়ক। আপনার যে বিপদ আমাদের বেদনাহত করে রেখেছিল বিপদ থেকে মুক্তি লাভের মহাউৎসবে আপনাকে অভিনন্দন জানানোর তাগিদে আমরা আপনার নিকট এসেছি। আমরা অভিবাদন জ্ঞাপনকারী দল। দীর্ঘদিন অবস্থান করে আপনার বোঝা হয়ে থাকার দল নই।’

রাজা বললেন, ‘হে সুবক্তা! আপনার পরিচয় কি?’ তিনি বললেন, ‘আমি হাশিমের পুত্র আব্দুল মুত্তালিব।’ রাজা বললেন, ‘আমাদের ভাগে?’ ‘হ্যাঁ,’ তিনি উত্তর দিলেন। রাজা বললেন, “নিকটে আসুন।” অতঃপর তিনি তাকে কাছে টেনে নিলেন। তাকে এবং তাঁর সাথীদেরকে সামনে নিয়ে তিনি বললেন, “মারহাবা! স্বাগতম”—আপনারা এসেছেন মিত্রদেশে, এসেছেন প্রচুর দানশীল রাজার নিকট, তিনি আপনাদেরকে প্রচুর পরিমাণে দান করবেন।

রাজা আপনাদের বক্তব্য শুনেছেন, আপনাদের আত্মীয়তার পরিচয় পেয়েছেন। তিনি আপনাদের পবিত্র উসিলাও গ্রহণ করেছেন। আপনাদের জন্যে সার্বক্ষণিক মেহমানদারীর ব্যবস্থা রয়েছে। যতদিন মন চায় আপনারা এখানে অবস্থান করুন। আপনাদের জন্যে আতিথ্য ও সম্মানের সুব্যবস্থা রয়েছে। বিদায়ক্ষণে আপনাদের জন্যে উপহারের ব্যবস্থা থাকবে।’ এরপর তাঁরা মেহমানখানা ও সম্মানিত অতিথিদের বিশ্রামাগারে গমন করেন। তারা একমাস সেখানে অবস্থান করেন।

ইতিমধ্যে তাঁরাও রাজার সাথে সাক্ষাত করেননি আর রাজাও তাদের বিদায়ের অনুমতি দেননি। একদিন তাদের কথা রাজার স্মরণ হলো। লোক মারফত তিনি আব্দুল মুত্তালিবকে ডেকে পাঠালেন। অতঃপর একান্ত সান্নিধ্যে এনে তাঁকে বললেন, ‘হে আব্দুল মুত্তালিব! আমার জানা কিছু গোপন তত্ত্ব আমি আপনাকে জানাব। আপনার স্থানে অন্য কেউ হলে কিন্তু তাকে আমি তা জানতাম না। আমি আপনাকে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার খনিরূপে দেখতে পাচ্ছি। তাই আপনার নিকট তা ব্যক্ত করছি। আল্লাহ্ তা’আলা যতদিন এ সংবাদ প্রকাশের অনুমতি না দিবেন ততদিন যেন এটি গোপন থাকে। আল্লাহ তা’আলা নিশ্চয়ই তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেন।

আমি আমার নিজের পছন্দের গোপন কিতাব ও লুক্কায়িত অভিজ্ঞতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও সুমহান বিষয় পেয়েছি যাতে সাধারণভাবে সকল মানুষের জন্যে এবং বিশেষভাবে আপনার সম্প্রদায় ও আপনার নিজের জন্যে মর্যাদার জীবন ও পরিপূর্ণ সম্মানের পূর্বাভাস রয়েছে।’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘আপনার মত লোকেরাই চিরসুখী ও পুণ্যময় জীবনের অধিকারী হয়ে থাকেন। পশু সম্পদের মালিক মরুবাসী দলে দলে আপনার জন্যে কোরবানী হউক! বলুন তো ঐ বিষয়টি কি?’ রাজা বললেন, ‘তেহামা অঞ্চলে একটি শিশুর জন্ম হবে। তাঁর দু’ কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে মোহর অংকিত থাকবে। নেতৃত্ব তারই হবে। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরই বদৌলতে আপনাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে।’

আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘আল্লাহ্ অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। একটি প্রতিনিধিদল যত অধিক কল্যাণ নিয়ে দেশে ফিরে যায় তার চাইতে অধিক কল্যাণ নিয়ে আমরা স্বদেশে ফিরছি। মহারাজের পক্ষ থেকে অভয় পেলে আমি আমার সুসংবাদ বিষয়ে এমন আরও কিছু বিষয় জিজ্ঞেস করতাম যা দ্বারা আমার আনন্দ আরো বৃদ্ধি পেত।’ ইবনে যী-ইয়াযান বললেন, ‘এটিই তার আবির্ভাবের সময়। এমনও হতে পারে যে, ইতিমধ্যে তাঁর জন্ম হয়ে গেছে। তাঁর নাম মুহাম্মদ। তার পিতা-মাতা দু’জনেরই মৃত্যু হবে। দাদা ও চাচা তার লালন-পালন করবেন। আল্লাহ্ তাঁকে প্রকাশ্যে প্রেরণ করবেন। আমাদের মধ্য থেকে তাঁর সাহায্যকারী নির্ধারিত করবেন। এসব সাহায্যকারী দ্বারা তিনি তাঁর বন্ধুদেরকে বিজয় দিবেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। তাদের দ্বারা মানুষের সম্ভ্রম রক্ষা করবেন। তাদের মাধ্যমে সেরা ভূখণ্ডগুলো জয় করাবেন, মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলবেন, পূজা-অর্চনার অগ্নিকুণ্ড নিভিয়ে দিবেন, দয়াময় আল্লাহর ইবাদত চালু হবে এবং শয়তান বিতাড়িত হবে। তাঁর বক্তব্য হবে সুস্পষ্ট। বিচার মীমাংসায় তিনি হবেন ন্যায়পরায়ণ। তিনি সৎকাজের আদেশ দিবেন এবং নিজে তা আমল করবেন। অসৎকাজে বারণ করবেন এবং নিজে তা বর্জন করবেন।’

আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘মহারাজ! আপনি সৌভাগ্যবান হউন, আপনার উন্নতি হোক, আপনার রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হোক এবং আপনি দীর্ঘজীবী হউন। আমি এটুকু বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি যে, মহারাজ কি আমাকে গোপনে আরো একটু বিস্তারিত জানাবেন? তিনি তো ইতিমধ্যে আমার নিকট অনেকটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।’

তখন ইবনে যী-ইয়াযান বললেন, ‘গিলাফ আচ্ছাদিত বায়তুল্লাহ শরীফের কসম, কাঁধের চিহ্ন দ্বারা এটা আমার কাছে নিশ্চিত যে, হে আব্দুল মুত্তালিব! আপনিই তার পিতামহ! তাতে এতটুকু মিথ্যা নেই।’ একথা শুনে আব্দুল মুত্তালিব সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। রাজা বললেন, ‘মাথা তুলুন। আপনার হৃদয় প্রশান্তি লাভ করুক। আপনার মর্যাদা সুউচ্চ হোক! আমি যা বলেছি তা থেকে আপনি কি কিছুটা অনুমান করতে পেরেছেন?’ আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘মহারাজ! আমার এক পুত্র ছিল। সে ছিল আমার পরম স্নেহের। নিজ বংশের ওহব তনয়া আমিনা নামের এক সম্ভ্রান্ত মহিলার সাথে আমি তার বিবাহ দিয়েছিলাম। তার গর্ভে জন্ম নেয় একপুত্র সন্তান। আমি তাঁর নাম রেখেছি মুহাম্মদ। সে মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর পিতা মারা যায়। শৈশবে সে তার মাকে হারায়। আমি নিজে এবং তার চাচা দুজনে তাঁর লালন-পালনের ভার নিয়েছি।’

ইবনে যী-ইয়াযান বললেন, ‘আপনি যা বলেছেন তা যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে আপনি আপনার ওই পৌত্রের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন এবং ইহুদীদের পক্ষ থেকে যাতে তার অনিষ্ট হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকবেন। কারণ ওরা তাঁর শত্রু। তবে তার কোন ক্ষতি করবে এমন সুযোগ আল্লাহ তাদেরকে দেবেন না। আমি আপনাকে যা বলেছি আপনার সাথীদের কাছ থেকে আপনি তা গোপন রাখবেন। কারণ আমি নিশ্চিত নই যে, নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে না এবং নেতৃত্ব লাভের লোভে তারা আপনার পৌত্রকে বিপদে ফেলবে না। কিংবা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরি করবে না। বস্তুত তারা বা তাদের বংশধরেরা এরূপ করবেই।

তাঁর নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে আমার মৃত্যু হবে এটা যদি আমার জ্ঞাত না থাকতো আমি আমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীসহ আমি তাঁর নিকট যেতাম এবং তাঁর রাজধানী ইয়াসরিবে উপস্থিত হতাম। পূর্বাভাস দানকারী গুপ্ত কিতাবে আমি পেয়েছি যে, ইয়াসরিবেই তাঁর রাজত্ব কায়েম হবে। আরবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার অনুসণ করবেন। আয়ু পেলে তার অনুসরণে আমি আরবের সকল স্থানে গমন করতাম। কিন্তু আপনার সাথে যারা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে কোন অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও আমি এই দায়িত্ব শুধু আপনার উপরই অর্পণ করছি।’

অতঃপর তিনি প্রতিনিধিদলের সকলকে জনপ্রতি দশজন ক্রীতদাস, দশজন দাসী, একশ উট, একজোড়া চাদর, পাঁচ রতল [রতল বা রিতল ৪০ তোলা ওজনের সমপরিমাণ] স্বর্ণ, দশ রতল রৌপ্য এবং পূর্ণ এক রতল করে কস্তুরী উপহার প্রদানের নির্দেশ দিলেন। আবদুল মুত্তালিবের জন্যে তার দশগুণ উপহার প্রদানের নির্দেশ দিলেন। তিনি আবদুল মুত্তালিবকে বললেন, “এক বছর পর আপনি আবার আসবেন।” কিন্তু এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ইব্‌ন যী-ইয়াযানের মৃত্যু হয়। আবদুল মুত্তালিব প্রায়ই বলতেন, “রাজার দেয়া রাজকীয় উপহারের কারণে তোমাদের কেউ আমাকে হিংসা করো না। কারণ তা একদিন শেষ হয়ে যাবে বরং তোমরা আমাকে ঈর্ষা করতে পার, তার সেই উপহারের জন্যে যা অবশিষ্ট থাকবে আমার জন্যে এবং আমার বংশধরদের জন্যে। আর তাহলো আমার বংশের সুনাম, মর্যাদা ও গৌরব।’ তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো কখন আসবে এ মর্যাদা ও সম্মান তখন তিনি বলতেন, ‘অতি সত্বর জানতে পারবে। কিছুটা দেরিতে হলেও।’

এ প্রসংগে কবি উমাইয়া বলেনঃ

جلبنا النصح تحقبه المطايا على اكوار أجمال ونوق

— আমরা উপদেশ সংগ্রহ করেছি, পালে পালে উট ও উষ্ট্রী চালিয়ে দূর দেশে ভ্রমণ করে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।

مقلفة مراتعها تعالى الى صنعاء من فج عميق

— উষ্ট্রীগুলোর চারণ ভূমি সজীব ঘাস লতায় পরিপূর্ণ। সেগুলো দূর দূরান্ত থেকে সানআ রাজ্যে আসে।

تؤم بنا ابن ذي يزن وتفری بذات بطونها ذم الطريق

— এগুলো আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছে ইবনে যী-ইয়াযানের নিকট, উদরস্থ পুষ্টিকর খাদ্য থেকে পাওয়া শক্তিবলে তারা পথের সকল বাধা অতিক্রম করেছে।

وترعى من مخائله بروقا مواصلة الوميض الى بروق

— ইবনে যী-ইয়াযানের বদান্যতায় সেগুলো লেজ নেড়ে নেড়ে পরম আনন্দে বারূক ঘাস খাচ্ছিল। নিজেদের চোখ ধাঁধানো চমৎকারিত্ব ও চাকচিক্যের সাথে আরো সৌন্দর্য যোগ করছিল।

فلما وصلت صنعاء حلت بدار الملك والحسب العريق

— সানআ পৌঁছে সেগুলো রাজপ্রাসাদে ও পরম মর্যাদার স্থানে অবতরণ করল।

হাফিজ আবু নুআয়ম ‘আদ দালাইল’ গ্রন্থে এরূপ ঘটনাই বিশদভাবে উদ্ধৃত করেছেন।

আবু বকর খারাইতী.... খলীফা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মুহাম্মদ ইবনে উছমান ইবনে রবীআ ইবনে সাওআ ইবনে খাছআম ইবনে সা’দকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার পিতা আপনার নাম ‘মুহাম্মদ’ রেখেছিলেন কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আপনি আমাকে যে প্রশ্ন করেছেন আমি আমার পিতাকে সে প্রশ্ন করেছিলাম। তখন আমার পিতা উত্তরে বললেন, বনী তামীমের আমরা চারজন লোক এক সফরে বের হয়েছিলাম। সেই চারজন হলাম আমি উছমান ইবনে রবীআ, সুফয়ান ইবনে মুজাশ ইন দারিম, উসামা ইবনে মালিক ইবনে জুনদুব ইবনে আকীদ এবং ইয়াযিদ ইবনে রবীআ ইবনে কিনানা ইবনে হারদাস ইবনে মাযিন। আমরা যাচ্ছিলাম গাসসানের রাজা ইবনে জাফনার সাথে সাক্ষাত করা উদ্দেশ্যে। সিরিয়ায় পৌঁছে আমরা একটি জলাশয়ের নিকট যাত্রা বিরতি করি। জলাশয়টির আশেপাশে ছিল প্রচুর বৃক্ষরাজি, আমরা সেখানে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছিলাম, জনৈক ধর্মযাজক আমাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেন। তিনি আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ‘আপনাদের ভাষা তো এ দেশের ভাষা নয়।’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ, আমরা মুদার গোত্রের লোক।’ তিনি বললেন, ‘কোন মুদার গোত্রের লোক?’ আমরা বললাম, ‘খানদাফের মুদার গোত্রের লোক।’ তখন তিনি বললেন, ‘অতিসত্বর প্রেরিত হবেন একজন নবী। তিনি হলেন সর্বশেষ নবী। আপনারা তাড়াতাড়ি তাঁর নিকট যাবেন এবং তাঁর থেকে আপনাদের যে কল্যাণ হাসিল করবার তা করবেন, তাহলে আপনারা সৎপথ পাবেন।’ আমরা বললাম, ‘তার নাম কি?’ তিনি বললেন, ‘তাঁর নাম মুহাম্মদ।’ আমার পিতা বললেন, অতঃপর আমরা ইবনে জাফনার সাথে সাক্ষাত শেষে দেশে ফিরে আসি। পরবর্তীতে আমাদের প্রত্যেকের ঘরে একটি করে পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আমরা তাদের প্রত্যেকের নাম ‘মুহাম্মদ’ রাখি এই আশায় যে, নিজ পুত্রটিই যেন ঐ সুসংবাদ প্রাপ্ত নবী হন।’

হাফিজ আবু বকর খারাইতি.... জাবির ইবনে জিদান সূত্রে বলেছেন, আওস ইবনে হারিছা ইবন..... যখন মৃত্যুশয্যায় তখন তাঁর গাসসান সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁর নিকট উপস্থিত হয়। তারা তাকে বলেছিল, ‘আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন যে, আল্লাহর ডাক আপনার প্রতি এসে পড়েছে। যৌবনে বিয়ে করার জন্যে আমরা আপনাকে বলেছিলাম, আপনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই যে আপনার ভাই খাযরাজ তাঁর পাঁচ-পাঁচটি পুত্র সন্তান রয়েছে। অথচ মালিক নামের একটি পুত্র ব্যতীত আপনার কোন সন্তান নেই।’ তিনি বললেন, ‘মালিকের মত পুত্র যে রেখে যাবে সে কখনো ধ্বংস হবে না। যে মহান সত্তা পাথরের সাথে চকমকির ঘর্ষণ থেকে আগুন বের করেন তিনি আমার পুত্র মালিককে বংশধর ও সাহসী উত্তরাধিকারী প্রদানে সক্ষম, সবাইকেই তো মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’

এরপর তিনি তাঁর পুত্র মালিককে ডেকে বললেন, ‘হে বৎস! অপমান অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়, তিরস্কৃত হওয়ার চাইতে শাস্তি পাওয়াই উত্তম। অস্থিরতা অপেক্ষা দৃঢ়তা উত্তম, দারিদ্র্য অপেক্ষা কবর উত্তম। যারা সংখ্যায় কম হয় তারা লাঞ্ছিত হয়। যে বার বার আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত সে পালিয়ে যায়। যে ব্যক্তি মর্যাদাবান মানুষকে সম্মান দেয় সে নিজের পরিজনকে রক্ষা করে। কালের দুটো রূপ, কখনো তোমার পক্ষে থাকবে আর কখনো থাকবে তোমার বিপক্ষে। যখন তোমার পক্ষে থাকবে তখন তুমি গর্ব করো না। যখন তোমার বিপক্ষে যাবে তখন ধৈর্যধারণ করবে। দুটোই অচিরে শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পাবে না কোন প্রতাপশালী মুকুট পরিহিত সম্রাট আর না কোন নিম্ন স্তরের নির্বোধ মূর্খ। তোমার কল্যাণকর সময়ের জন্যে আল্লাহ তোমাকে নিরাপদ রাখুন। তোমার প্রতিপালক তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। তারপর তিনি আবৃত্তি করেন তার স্বরচিত কবিতা।

شهدت السبايا يوم أل محرق وأدرك أمري صيحة الله في الحجر

— মুহরিক বংশের যুদ্ধের দিনে আমি যুদ্ধবন্দীদেরকে দেখেছি। আর হিজর অঞ্চলে (সেখানকার অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করার জন্যে) আল্লাহর প্রেরিত বজ্রনিনাদ আমি শুনেছি।

فلم أر ذاملك من الناس واحدا ولاسوقة الاالى الموت والقبر

— আমি রাজা-বাদশাহ ও মুর্খ-গবেট সবাইকে দেখেছি যে, তারা সুনিশ্চিতভাবে মৃত্যু ও কবরের দিকে অগ্রসরমান।

تعمل الذي آردی ثمودا وجرهما سيعقب لی نسلا على أخر الدهر

— যে মহান প্রভু ছামুদ ও জুরহুম গোত্র ধ্বংস করেছেন অবিলম্বে তিনি আমাকে এমন বংশধর দান করবেন যারা শেষ যুগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আগমন করবে।

تقربهم من أل عمرو بن عامر ميون لدى الداعي إلى طلب الوتر

— তাদেরকে দেখে আমার পিতৃকুল আমর ইবনে ‘আমির বংশের লোকদের নয়ন জুড়াবে। এমন এক আহ্বানকারীর নিকট তারা থাকবে যে প্রতিশোধ গ্রহণের আহ্বান জানাবে।

فان لم تكن الأيام أبلين جدتي

وشيبن رأسى والمشيب مع العمر

— হায়! কালের আবর্তন যদি আমার শক্তিকে জীর্ণশীর্ণ করে না দিত আর আমার মাথাকে সাদা রংয়ে রঙিন করে না দিত। অবশ্য বাস্তবতা তো এই যে, বয়সের কারণে চুল সাদা হয়।

فان لنا ربا علا فوف عرشه عليما بما يأتي من الخير والشر

— নিশ্চয়ই আমাদের একজন প্রভু রয়েছেন। তিনি আরশের উপর সমাসীন, ভাল-মন্দ কি ঘটছে সে সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল।

ألم يأت قومی ان لله دعوة يفوز بها أهل السعادة البر

— আমাদের সম্প্রদায়ের নিকট এ সংবাদ কি আসেনি যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আহ্বান ও দাওয়াত রয়েছে। ঐ আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভাগ্যবান ও পুণ্যবান ব্যক্তিরা সফলকাম হবে।

اذا بعث المبعوث من أل غالب بمكة فيما بين مكة والحجر

— যখন মক্কার অধিবাসী গালিব বংশ থেকে রাসূল প্রেরিত হবেন মক্কা ও হিজরের মধ্যবর্তী স্থানে।

هنالك فابغوا لضرة ببلادكم بني عامر ان السعادة في النصر

— সেখানে তোমাদের শহরে তোমরা তাঁকে সাহায্য করবে, হে আমার পিতৃপুরুষ ‘আমিরের বংশধরগণ! স্মরণ রেখো, তাঁকে সাহায্য করার মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত।

এর অব্যবহিত পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

৯৩
জিনদের অদৃশ্য আহবান
ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, ভবিষ্যত বক্তা শিক ও সাতীহ নবী করীম (সা)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে ইয়ামানের রাজা রাবীআ ইবন নাসরকে বলেছিলেনঃ “তিনি পুতঃ পবিত্র রাসূল, উর্ধ্বজগত থেকে তাঁর নিকট ওহী আসবে।” রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম বৃত্তান্ত বিষয়ক অধ্যায়ে আবদুল মসীহকে লক্ষ্য করে প্রদত্ত সাতীহ-এর নিম্নের বক্তব্য আসবে “যখন তিলাওয়াতের প্রাচুর্য ঘটবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে এবং মহা-মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে।” এ কথার দ্বারা তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বুঝিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে আসছে। বুখারী আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত উমর (রা)-কে যত বিষয়ে এ কথা বলতে শুনেছি “এবিষয়ে আমার ধারণা এই” তা সব ক’টাই তার ধারণা মুতাবিকই হয়েছে।

একদিনের ঘটনা। হযরত উমর (রা) এক জায়গায় বসা ছিলেন। তার পাশ দিয়ে একজন সুদর্শন লোক হেঁটে গেল। তিনি বললেন, “হয়ত আমার ধারণা ভুল হবে, নতুবা এটা নিশ্চিত যে, এ লোক তার জাহিলী যুগের ধর্ম অনুসরণ করে চলছে অথবা কোন এক সময় লোকটি গণক ছিল। লোকটিকে আমার নিকট নিয়ে এস।” তখন লোকটিকে ডাকা হলো। হযরত উমর (রা) তাঁর ধারণার কথা লোকটির নিকট ব্যক্ত করলেন। উত্তরে লোকটি বলল, “আজ আমাকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হলো কোন মুসলমানকে ইতিপূর্বে এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে আমি দেখিনি।” হযরত উমর (রা) বললেন, “তোমার বৃত্তান্ত না বলা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছাড়ছি না।” সে বলল, “জাহিলী যুগে আমি গণক ছিলাম।” হযরত উমর (রা) বললেন “তোমার জিন তোমার নিকট যত সংবাদ এনেছে তার মধ্যে সর্বাধিক আশ্চর্যজনক সংবাদ কোনটি?” সে বলল, ‘একদিন আমি বাজারের মধ্যে ছিলাম। তখন দেখলাম, অত্যন্ত অস্থির ও অশান্তভাবে সে আমার নিকট উপস্থিত হলো এবং বললঃ

ألم تر الجن وابلاسها ويأسها من بعد النكاسها

ولحوقها بالقلاص واحلاسها

— আপনি কি দেখেছেন জিন জাতিকে এবং তাদের নৈরাশ্যকে? এবং উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তাদের হতাশাকে? আরও কি দেখেছেন সফরের জন্যে তাদের উষ্ট্রী প্রস্তুত করা?

হযরত উমর (রা) বললেন, ‘সে ঠিকই বলেছে। একদিন আমি ওদের দেবতাদের পাশে ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখি, এক আগন্তুক একটি বাছুর নিয়ে উপস্থিত। সে বাছুরটি জবাই করে দিল। তখন এক অদৃশ্য চিৎকারকারী এমন বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল যা আমি আগে কখনো শুনিনি। চিৎকার দিয়ে সে বলল, হে বীর ও সাহসী ব্যক্তি! সফলতার পথ এসেছে। প্রাঞ্জলভাষী এক ব্যক্তি এসেছেন, তিনি বলছেন “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।” তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লোকজন দলে দলে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখন আমি বললাম, “এরূপ স্বপ্নের মধ্যে কী রহস্য আছে তা না জানা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না। এরপর পুনরায় উক্ত ঘোষক ঘোষণা দিল, হে বীর ও সাহসী ব্যক্তি। সফলতার পথ এসে গেছে। প্রাঞ্জলভাষী লোকটি এসে গেছেন। তিনি বলছেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।” তখন আমি উঠে দাঁড়ালাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাকে বলে দেয়া হলো যে, ইনি নবী।’ হাদীসটি ইমাম বুখারী (র) এককভাবে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

হযরত উমর (রা) যে লোকটিকে ডেকে এনেছিলেন তার নাম সাওয়াদ ইবনে কারিব আল আযদী। কেউ কেউ বলেন, তিনি বালকা পর্বতের পাহাড়ী উপত্যকার অধিবাসী ও সাদুস বংশীয় লোক ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গ পেয়েছেন এবং তাঁর প্ররিত প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছিলেন। আবু হাতিম এবং ইবনে মান্দা বলেন, সাঈদ ইবনে জুবায়র ও আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী প্রমুখ তাঁর বরাতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আহমদ ইবনে রাওহ আল-বারযাঈ দারা কুতনী প্রমুখ সাহাবীর নামের তালিকায় তার নাম উল্লেখ করেছেন। হাফিজ আবদুল গণী ইবনে সাঈদ আল মিসরী বলেছেন, উক্ত ব্যক্তির নাম ওয়াও বর্ণে তাশদীদ বিহীন সাওয়াদ ইবনে কারিব। মুহাম্মদ ইবনে কাব আল কুরাযী সূত্রে উছমান আল ওয়াককাসী বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি ইয়ামানের সম্ভ্রান্ত লোকদের একজন ছিলেন। আবু নুআয়ম ‘আদ দালাইল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত হাদীস অন্যান্য সনদে ইমাম বুখারীর বর্ণনা অপেক্ষা দীর্ঘতরও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন, হযরত উমর (রা) একদিন মসজিদে নববীতে লোকজনের সমাবেশে উপবিষ্ট ছিলেন। তখন একজন আরব হযরত উমর (রা)-এর খোঁজে মসজিদে প্রবেশ করে। লোকটির দিকে তাকিয়ে উমর (রা) বললেন, এই লোকটি হয় তো মাত্র কিছুদিন আগে শিরক্ ত্যাগ করেছে নতুবা জাহেলী যুগে সে গণক ছিল। লোকটি তাঁকে সালাম দিল এবং সেখানে বসে পড়ল। উমর (রা) তাকে বললেন, “আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করেছেন?” ‘হে আমীরুল মুমিনীন! হ্যাঁ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি,’ ঐ ব্যক্তি উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি কী জাহেলী যুগে গণক ছিলেন?’ লোকটি বলল, ‘সুবহানাল্লাহ! হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আমার ব্যাপারে এমন একটি ধারণা পোষণ করেছেন এবং আমাকে এমন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন আমার মনে হয় শাসনভার গ্রহণ করার পর কোন লোককেই আপনি এমন প্রশ্ন করেন নি।’

হযরত উমর (রা) বললেন, ‘হে আল্লাহ! ক্ষমা করুন, আমরা তো জাহেলী যুগে এর চেয়ে অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত ছিলাম। আমরা মূর্তিপূজা করতাম এবং প্রতিমার সাথে কোলাকুলি করতাম। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল ও ইসলাম দ্বারা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন।’ ঐ ব্যক্তিটি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! জাহেলী যুগে আমি গণক ছিলাম।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘তাহলে বলুন দেখি আপনার সাথী শয়তান আপনাকে কি সংবাদ দিয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘ইসলামের আবির্ভাবের মাসখানেক কিংবা তারও কম সময় পূর্বে আমার সাথী শয়তান আমার নিকট এসে বলল,

ألم تر الى الجن وابلاسها - وایأسها من دينها ولحوقها بالقلاص واحلاسه

— আপনি জিন জাতিকে এবং তাদের নৈরাশ্যকে দেখেছেন কী? এবং আপনি কি দেখেছেন তাদের উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার পর দীন সম্পর্কে তাদের হতাশা? এও কি দেখেছেন যে, তারা উষ্ট্রীর নিকট গিয়ে উষ্ট্রীকে সফরের জন্যে প্রস্তুত করছে?

ইবনে ইসহাক বলেন, উপরোক্ত বক্তব্য ছন্দোবদ্ধ গদ্য বটে, কবিতা নয়, তখন হযরত উমর (রা) লোকজনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি জাহেলী যুগে একদিন কুরায়শ বংশীয় কতক লোকের সাথে এক প্রতিমার নিকট ছিলাম। জনৈক আরব ওই প্রতিমার উদ্দেশে একটি বাছুর জবাই করল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম যে, সেটির গোশতের একটা অংশ আমাদেরকে দেয়া হবে। হঠাৎ ওই বাছুরের পেট থেকে আমি একটা বিকট চিৎকার শুনতে পাই, তেমন বিকট চিৎকার আমি ইতিপূর্বে কোনদিন শুনিনি। এটি ইসলামের আবির্ভাবের মাস খানেক কিংবা তারও কম সময়ের পূর্বের ঘটনা। ঐ শব্দ ছিল, “হে বীর ও সাহসী ব্যক্তি! সফলতার পথ এসে গেছে। প্রাঞ্জলভাষী লোক ডেকে ডেকে বলছেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ -আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।” ইবনে হিশামের বর্ণনায় এসেছে “আবির্ভূত হয়েছেন একজন লোক যিনি প্রাঞ্জল ভাষায় উচ্চ স্বরে ডেকে ডেকে বলছেন— লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।” ইবনে হিশাম বলেন, কেউ কেউ আমার নিকট কবিতা আকারে এভাবে পাঠ করেছেন।

عجبت للجن وابلسها وشدها العيس باحلاسها

— জিনদেরকে দেখে, তাদের হতাশা দেখে এবং সফরের উদ্দেশ্যে উষ্ট্রীর পিঠে আসন প্রস্তুত দেখে আমি অবাক হয়েছি।

تهوي الى مكة تبغي الهدى مامؤمنوا الجن كانجاسها

— তারা মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করছে হেদায়াতের অন্বেষণে ঈমানদার জিনগণ তাদের নাপাক বেঈমানদারদের মত নয়।

হাফিজ আবু ইয়া’লা মূসিলী - মুহাম্মদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, একদিন উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বসা ছিলেন, তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক লোক। একজন বলল, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এ লোকটিকে চেনেন?’ তিনি বললেন, ‘ঐ লোক কে?’ লোকজন বলল, ‘সে তো সাওয়াদ ইবন কারিব। তার জিন সহচর তার নিকট রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের সংবাদ নিয়ে এসেছিল।’ উমর (রা) তাকে ডেকে পাঠালেন। আর তিনি বললেন, ‘আপনি কি সাওয়াদ ইবনে কারিব?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘আপনি কি এখনও আপনার গণক পেশায় নিয়োজিত আছেন?’ এতে ঐ ব্যক্তি রেগে যান এবং বলেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! আমার ইসলাম গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত কেউ আমাকে এরূপ অপমানজনক কথা বলেনি।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তাতে কি? আমাদের শিরকবাদী জীবনে আমরা আপনার গণক পেশার চেয়ে অধিক মন্দ কাজে লিপ্ত ছিলাম। যা হোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অবির্ভাব সম্পর্কে আপনার জিন সহচর আপনাকে কি বলেছিল তা আমাদেরকে একটু বলুন।’ তিনি বললেন, “আমীরুল মুমিনীন! একরাতে আমি কিছুটা নিদ্রা ও কিছুটা সজাগ এমন অবস্থায় ছিলাম। আমাকে পদাঘাত করে তখন আমার জিন সহচর বলল, সাওয়াদ ইবনে কারিব! ওঠ, ওঠ, আমি যা বলি তা শোন এবং বিবেক থাকলে তা বুঝে নাও। লুওয়াই ইব্‌ন গালিবের বংশধর থেকে একজন রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর ইবাদতের প্রতি ডাকছেন। তারপর সে এই কবিতা পাঠ করেঃ

عجبت للجن وتطلابها وشؤها العيس بأقتابها

— জিনদেরকে দেখে ও তাদের অন্বেষণ প্রক্রিয়া দেখে এবং উষ্ট্রীর পিঠে আসন লাগিয়ে তাদের সফর প্রস্তুতি দেখে আমি অবাক হয়েছি।

تهوى الى مكة تبغي الهدى ما صادق الجن ككذابها

— তারা যাত্রা করছে মক্কার উদ্দেশে হেদায়ত অন্বেষণে সত্য প্রাণ জিন তাদের মধ্যকার মিথ্যুকদের ন্যায় নয়।

فارحل الى الصفوة من هاشم ليس قداماها كأذنابها

— অতএব, তুমি বনী হাশিম গোত্রের ঐ বিশিষ্ট পূত পবিত্র মানুষটির নিকট যাও! জিনদের অগ্রবর্তী দল তাদের পশ্চাৎবর্তীদলের মত নয়।

তখন আমি বললাম, ‘রেখে দাও তোমার ওসব, আমাকে একটু ঘুমোতে দাও! সন্ধ্যা থেকেই আমার ঘুম পেয়েছে।’ অতঃপর দ্বিতীয় রাতেও সে আমার নিকট আসে এবং আমাকে পদাঘাত করে পূর্বোল্লিখিত কথাগুলো বলে এবং ঐ কবিতার পংক্তিগুলো আবৃত্তি করে পদাঘাত করে।

আমি বললাম, ‘ছাড় ছাড় আমাকে ঘুমোতে দাও। সন্ধ্যা থেকেই আমার ঘুম পেয়েছে।’ তৃতীয় রাতেও সে আমার নিকট আসে এবং আমাকে পদাঘাত করে পূর্বের কথাগুলো ও কবিতার পুনরাবৃত্তি করে।

লোকটি বলল, এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বললাম, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে পরীক্ষা করছেন।’

আমি আমার উষ্ট্ৰীতে সওয়ার হয়ে শহরে অর্থাৎ মক্কায় এলাম। সেখানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীদেরকে দেখলাম। আমি তাঁর নিকটবর্তী হলাম এবং বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমার কথা শুনুন।’ তিনি বললেন, ‘বল!’ তখন আমি এই কবিতা পাঠ করলাম,

أتاني نجي بعد مرء ورقه ولم يك فيما قد تلوت بكاذب

— বিশ্রাম গ্রহণ ও শয়নের পর আমার গোপন সহচর উপস্থিত হয়েছে আমার নিকট। আমি যা বলছি তা মোটেই মিথ্যা নয়।

ثلاث ليال قول كل ليلة أتاك رسول من لؤي بن غالب

— সে এসেছে একে একে তিন রাত। প্রতিরাতে তার বক্তব্য ছিল লুওয়াই ইব্‌ন গালিবের বংশ থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন।

فشمرت عن ذيل الازار ووسطت - بي الرعلب الؤحناء غير السباسب

— অতঃপর আমি আমার লুঙ্গি গুটিয়ে ফেলে সফর শুরু করি। আমার প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী উষ্ট্রী আমাকে নিয়ে বিস্তৃত বিশাল বালুময় প্রান্তর অতিক্রম করে।

فأشهد أن الله لا شيئ غيره وانك مامون على كل غالب

— এখন আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সকল বিজয়ী বীরের মোকাবিলায় আপনি সর্বদা নিরাপদ থাকবেন।

وانك أدنى المرسلين وسيلة الى الله يا ابن الأكرمين الأطالب

— আল্লাহর সাথে মিলনের ক্ষেত্রে আপনি আল্লাহর নিকটতম রাসূল, হে পবিত্র ও সম্মানিত বংশের বংশধর।

فمرنا بما ياتي ياخير من مشی وان كان فيما جاء شيب الذوائب

— হে পৃথিবীতে পদচারণকারী ও পদার্পণকারী সকল লোকের মধ্যে উৎকৃষ্টতম ব্যক্তি। আপনার নিকট যা এসেছে আমাদেরকে তা পালনের নির্দেশ দিন। যদিও তার মধ্যে থাকে চুল পাকিয়ে দেয়ার মত কঠিন বিষয়সমূহ।

وكن لى شفيعا يوم لا ذو شفاعة سواك بمغن عن سوادبن قارب

— আপনি সেদিন আমার জন্যে সুপারিশকারী হবেন যেদিন এ সাওয়াদ ইবনে কারিবকে রক্ষা করার মত কোন সুপারিশকারী থাকবে না।

আমার কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ খুবই আনন্দিত হলেন। তাঁদের মুখমণ্ডলে খুশির চিহ্ন ফুঠে ওঠে।

বর্ণনাকারী বলেন, সাওয়াদ ইবনে কারিবের বক্তব্য শুনে হযরত উমর (রা) লাফিয়ে উঠে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আপনার মুখ থেকে এ বর্ণনা শোনার জন্যে আমি অনেক দিন থেকে আকাঙ্ক্ষা করে আসছিলাম। আচ্ছা, আপনার ঐ জিন সহচর এখনও কি আপনার নিকট আসে?’ জবাবে সাওয়াদ বললেন, ‘না। আমি যখন থেকে কুরআন মজীদ পাঠ করতে শুরু করেছি তখন থেকে সে আমার নিকট আর আসে না। ঐ জিনের স্থলে আল্লাহর কিতাব কতই না উত্তম।’

এরপর হযরত উমর (রা) বললেন, একদিন আমি কুরাইশের আলে যরীহ নামক এক গোত্রের মধ্যে ছিলাম। তারা একটি বাছুর জবাই করেছিল। কসাই সেটিকে কাটাকুটা করছিল। হঠাৎ বাছুরটির পেট থেকে আমরা এক শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু চোখে কিছু দেখলাম না। ঐ শব্দমালা ছিলঃ হে যরীহ্ বংশের লোকজন! সফলতার পথ এসে গেছে। একজন ঘোষক প্রাঞ্জল ভাষায় ঘোষণা দিচ্ছেন এবং সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। এই সনদে হাদীসটির সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। তবে ইমাম বুখারী (র)-এর বর্ণনায় এর সমর্থন মিলে। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, বাছুরের পেট থেকে শব্দ শ্রবণকারী ছিলেন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)।

হাফিজ খাইরাতী তাঁর হাওয়াতিফুল জান পুস্তকে উল্লেখ করেছেন যে, আবু মূসা ইমরান ইবনে মূসা ....... আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী সূত্রে বলেন, সাওয়াদ ইবনে কারিব মাদুসী হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর সাথে সাক্ষাত করলেন। উমর ইব্‌ন খাত্তাব (রা) বললেন, ‘হে সাওয়াদ ইব্‌ন কারিব! আমি আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, বলুন তো, আপনি কি আপনার গণক পেশায় এখনও বহাল আছেন?’ সাওয়াদ বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! সুবহানাল্লাহ্, আপনি আমাকে যে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন আপনার কোন সাথীকে আপনি কখনো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন করেন নি।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ, হে সাওয়াদ! আমাদের শিরকবাদী জীবনে আমরা যা করেছি তা আপনার গণক পেশা অপেক্ষা জঘন্যতর ছিল। আল্লাহর কসম, হে সাওয়াদ! আপনার একটি ঘটনার বর্ণনা আমার নিকট পৌঁছেছে যা খুবই চমৎকার।’ সাওয়াদ বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! হ্যাঁ, সেটি খুবই আশ্চর্যজনক বটে।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘ঠিক আছে ঐ ঘটনাটি আমাকে শোনান।’

সাওয়াদ বললেন, ‘জাহেলী যুগে আমি গণক পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। তারপর তিনি জিনের পরপর তিনরাত আগমন ও কবিতা আবৃত্তির কথা বিশদভাবে তাঁর নিকট বর্ণনা করেন। তারপর তার ইসলাম গ্রহণ ও কবিতা আবৃত্তির কথাও তাঁকে শোনান। তারপর হযরত উমরের সাথে তার কথোপকথনের কথাও উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর পূর্বোল্লিখিত ঘটনার ন্যায় বর্ণনা করে যখন তিনি কবিতার শেষের পংক্তিটিতে বললেনঃ

وكن لي شفيعا يوم لا ذو قرابة سواك بمغن عن سؤاد بن قارب

— এবং আপনি আমার জন্যে সুপারিশকারী হবেন সেদিন, যেদিন আপনি ব্যতীত সাওয়াদ ইবনে কারিবকে রক্ষা করার কোন নিকটাত্মীয় থাকবে না।

তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মাঝে এ কবিতাটি আবৃত্তি কর।’

হাফিজ ইবনে আসাকির ও সাঈদ ইবনে জুবায়র (র) সূত্রে উক্ত ঘটনাটি আনুপূর্বিক বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি এতটুকু অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন যে, কবিতার শেষ চরণ আবৃত্তি করার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) এমনভাবে হেসে উঠলেন যে, তাঁর মাড়ির দাঁতগুলো দেখা গেল। তিনি বললেন, ‘হে সাওয়াদ! তুমি সফলকাম হয়েছ।’

আবু নুআয়ম তাঁর ‘দালাইল’ গ্রন্থে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাফর আব্দুল্লাহ্ আল ওমানী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের মধ্যে মাযিন ইবনে আয়ুব নামে এক লোক ছিল। সে একটি মূর্তির সেবায়েত ছিল। মূর্তিটি অবস্থিত ছিল ওমানের মায়া নামক গ্রামে। বানু সামিত, বানু হুতামা ও মুহরা গোত্রগুলো ঐ মূর্তির পূজা করত। তারা মাযিনের মাতুল গোত্র। তার মায়ের নাম যায়নাব বিনত আব্দুল্লাহ্ ইবনে রবী’আ ইবনে খুওয়াইস। খুওয়াইস হলো বানু নারানের অন্তর্ভুক্ত।

মাযিন বলেন, একদিনের ঘটনা। আমরা বলি ও মূর্তির উদ্দেশে আমরা একটি পশু বলি দেই। তখন মূর্তির ভেতর থেকে আমি একটি শব্দ শুনতে পাই। সে বলছিল, ‘হে মাযিন! আমি যা বলি তা শোন তাহলে তুমি খুশিই হতে। কল্যাণ এসে গেছে। অকল্যাণ বিলুপ্ত হয়েছে। মুদার গোত্র হতে একজন নবী প্রেরিত হয়েছেন মহান আল্লাহর দীন নিয়ে। সুতরাং পাথরের তৈরি মূর্তি পরিত্যাগ কর। তাহলে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে।

মাযিন বললেন, ‘এতে আমি ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ি। কয়েক দিন পর আমরা ওই মূর্তির উদ্দেশে আরেকটি পশু বলি দেই। তখন পুনরায় আমি ওই মূর্তিটিকে বলতে শুনি, সে বলছিল— তুমি আমার নিকট আস, আমার নিকট আস, আমি যা বলি তা শোন, অগ্রাহ্য করো না। ইনি প্রেরিত নবী ও রাসূল। আসমানী সত্য নিয়ে তিনি আবিৰ্ভুত হয়েছেন। তুমি তার প্রতি ঈমান আন, তাহলে লেলিহান শিখাময় আগুন থেকে রক্ষা পাবে। ওই আগুনের জ্বালানি হবে বড় বড় পাথর।

মাযিন বলেন, আমি তখন মনে মনে বললাম, এটি তো নিশ্চয়ই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। এটি তো আমার জন্যে কল্যাণকর। এ সময়ে আরব অঞ্চল থেকে একজন লোক আমাদের নিকট আসে। আমি বললাম, ‘ওখানকার সংবাদ কী?’ সে বলল, ‘সেখানে আহমদ নামে একজন লোক আবির্ভূত হয়েছেন। যারা তাঁর নিকট আসে তিনি তাদেরকে বলেন, “তোমরা আল্লাহর প্রতি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দাও।’ আমি বললাম, ‘এটি তো আমি যা শুনেছি তার বাস্তব রূপ।’ অতঃপর আমি মূর্তিটির উপর ঝাপিয়ে পড়ি এবং সেটি ভেঙে চুরমার করে ফেলি। এরপর আমি সওয়ারীতে আরোহণ করি এবং সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হই। আল্লাহ তাআলা আমার বক্ষকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে প্রশস্ত করে দেন। আমি ইসলাম গ্রহণ করি। তখন আমি বলিঃ

كسرت بأجرا أجزاذا وكان لنا ربا نطيف به ضلا بتضلال

— আমি বাজির মূর্তিকে ভেঙে খান খান করে ফেলেছি। অথচ এক সময় সেটি আমাদের উপাস্য ছিল। আমরা চরম গোমরাহী ও ভ্রান্তিহেতু সেটির চারদিকে তাওয়াফ করতাম।

فالهاشمي هدانا من ضلالتنا ولم يكن دينه منى على مال

— হাশেম বংশীয় লোক মুহাম্মদ (সা) আমাদেরকে গোমরাহী থেকে বের করে এনে হেদায়ত দিয়েছেন তাঁর দীন-ধর্ম আর তা কখনও আমার কল্পনায়ও ছিল না।

يا راكبا بلغن عمروا واخوتها أني لمن قال ربي بأجر قالی

— হে আরোহী পথিক! আমর ও তার সম্প্রদায়কে জানিয়ে দাও, যে ব্যক্তি বলবে, আমার প্রভু বাজির মূর্তি, আমি তার শত্রু।

এখানে তিনি আমর দ্বারা সামিতকে এবং তার গোত্রের দ্বারা হুতামা গোত্রকে বুঝিয়েছেন। মাযিন বলেন, অতপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি তো একজন আনন্দপিয়াসী এবং নারীসঙ্গ ও সুরাপানে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপকারী মানুষ। সময়ের বিবর্তন আমাকে পর্যুদস্ত করেছে এবং তা আমাদের ধন-সম্পদ বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমার ক্রীতদাসীদেরকে দুর্বল করে দিয়েছে। আমার কোন সন্তান-সন্ততি নেই। ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা)! আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, আমার সমস্যাগুলো তিনি যেন দূর করে দেন, আমাকে যেন লজ্জাবোধ দান করেন এবং আমাকে একটি সন্তান প্রদান করেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘হে আল্লাহ! তাকে আনন্দ পিয়াসের পরিবর্তে কুরআন পাঠের আগ্রহ, হারামের পরিবর্তে হালাল, পাপাচারিতা ও ব্যভিচারের পরিবর্তে পবিত্রতা দান করুন। আপনি তাকে লজ্জাবোধ এবং সন্তান দান করুন।’

মাযিন বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমার বিপদগুলো দূর করে দিলেন। ওমান অঞ্চল উর্বর ও উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে। আমি ৪ জন মহিলাকে বিয়ে করি। কুরআন মজীদের অর্ধাংশ মুখস্ত করে ফেলি এবং আল্লাহ তা’আলা আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। তার নাম রাখি হাইয়ান ইবনে মাফিন। অতপর মাযিন এই কবিতাটি আবৃত্তি করেনঃ

اليك رسول الله خښت مطيتي تجوب ألفيا في من عمان إلى العرج

— হে আল্লাহর রাসূল! আমার সওয়ারী আপনার নিকটই এসেছে। বহু মরু বিয়াবান অতিক্রম করে ওমান থেকে সে আরজে এসেছে।

لتشفع لى يا خير من وطئ الحصى فيغفرلی ربی فارجع بالفلج

— হে পৃথিবী পৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব, যেন আপনি আমার জন্যে সুপারিশ করেন। ফলশ্রুতিতে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দেন এবং আমি সফলকাম হয়ে ফিরে যাই।

الى معشر خالفت في الله دينهم فلا رأيهم رای ولا شرجهم شرجي

— আমি ফিরে যাব এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আমি যাদের ধর্মের বিরোধিতা করছি। সুতরাং তাদের মতবাদ আমার মতবাদ নয় এবং তাদের অবস্থান আমার অবস্থানের মত নয়।

وكنت امرأ ، بالخمر والعهر مولعا شبابى حتى اذن الجسم بالنهج

— আমার যৌবনকালে আমি সুরা ও নারী সম্ভোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। এক সময় আমার শরীর দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার জানান দেয়।

فبدلني بالخمر خوفا وخشية وبالعهر احصانا فحصن لي فرجی

— অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আমাকে মদ্য পানের পরিবর্তে খোদাভীতি দান করলেন। আর ব্যভিচারের পরিবর্তে দিলেন পবিত্রতা। অনন্তর তিনি আমার যৌনাঙ্গকে অবৈধ ব্যবহার থেকে পবিত্র রাখলেন।

فأصبحت همي في الجهاد ونيتي فلله ماصومی ولله ماحجي

— অতঃপর আমার মন-মানসিকতা ও ইচ্ছা - অনুভূতি জিহাদমুখী হয়ে পড়ে। সুতরাং আমার রোযা ও হজ্জ একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশেই নিবেদিত।

মাযিন বলেন, আমি আমার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলে তারা আমাকে দূরে তাড়িয়ে একঘরে করে দিল এবং আমাকে গালমন্দ করল। তারা তাদের জনৈক কবিকে আমার প্রতি নিন্দাবাদ বর্ষণের জন্যে বলল। সে আমার নিন্দাবাদ করল। আমি বললাম, আমি যদি তার জবাব দিতে যাই তবে তা হবে নিজেরই নিন্দাবাদ। অতঃপর আমি ওদেরকে ছেড়ে চলে আসি। তাদের মধ্য থেকে বহু লোকের একটি দল আমার সাথে সাক্ষাত করে। ইতিপূর্বে আমি তাদের দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধান করতাম। তারা বলল, ‘চাচাত ভাই! আমরা আপনার প্রতি অন্যায় আচরণ করেছি। এখন সেজন্যে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনি যদি আপনার নতুন ধর্মত্যাগে অস্বীকৃতি জানান তবে তা আপনার ব্যাপার। এখন আপনি আমাদের সাথে ফিরে চলুন এবং আমাদেরকে দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধানের কাজ করুন। আপনার ব্যাপার আপনার নিজেরই এখতিয়ারে থাকবে। তখন আমি তাদের সাথে ফিরে যাই এবং বলিঃ

لبفضكم عندنا مر مذاقته وبفضنا عندكم يا قوم لبن

— আমাদের প্রতি তোমাদের বিদ্বেষকে আমরা তিক্ত জ্ঞান করি। আর তোমাদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষকে হে আমার সম্প্রদায় তোমরা দুধ সম জ্ঞান কর।

لا يفطن الدهر ان بئت معائكم - ولكم حين يثني عيبنا فطن

— আমি যখন তোমাদের দোষ বর্ণনা করি তখন আমি চালাক ও কুশলী বলে বিবেচিত হই না, কিন্তু তোমরা যখন আমাদের দোষ বর্ণনা কর তখন তা’ চাতুর্য বলে বিবেচিত হয়।

شاعرنا مفحم عنكم وشاعركم في حدبنا مبلغ في شتمنا لسن

— তোমাদের নিন্দাবাদে আমাদের কবি থাকে নীরব আর তোমাদের কবি আমাদেরকে গালাগাল দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে দিতে সিদ্ধহস্ত। আমাদেরকে গালমন্দ করতে সে বাকপটু।

ما في القلوب عليكم فاعلموا وغر وفي قلوبكم البغضاء والأحن

— মনে রেখো, আমাদের অন্তরে তোমাদের প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ নেই। অথচ তোমাদের মনে রয়েছে বিদ্বেষ ও গোপন শত্রুতা।

মাযিন বলেন, অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সকলকে হেদায়ত দান করেন এবং তাদের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে।

হাফিজ আবু লুআয়ম..... হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের সংবাদ সর্বপ্রথম মদীনায় পৌঁছে এভাবে যে, মদীনার জনৈকা মহিলার অনুগত একটি জিন ছিল। একদিন সাদা পাখির আকৃতি নিয়ে সে মহিলার নিকট আসে এবং একটি দেয়ালের ওপর বসে থাকে। মহিলা বলে, “তুমি নেমে আমাদের নিকটে আসছ না কেন? আস, আমরা পরস্পরে কথার্বাতা বলি এবং সংবাদ আদান-প্রদান করি।’ জবাবে জিনটি বলল, “মক্কায় একজন নবী প্রেরিত হয়েছেন। তিনি ব্যভিচার নিষিদ্ধ করেছেন এবং আমাদের মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছেন।”

ওয়াকিদী বলেন...... আলী ইবনে হুসায়ন সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে মদীনায় প্রথম সংবাদ আসে এভাবে যে, সেখানে ফাতিমা নাম্নী এক মহিলা ছিল। তার ছিল একটি অনুগত জিন। একদিন জিনটি তার নিকট এল এবং দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে রইল। সে বলল, ‘তুমি নেমে আসছ না কেন?’ জিনটি বলল, ‘না, নামবো না। কারণ একজন রাসূল প্রেরিত হয়েছেন, তিনি ব্যভিচার হারাম করে দিয়েছেন।’

অন্য এক তাবেঈ মুরসালভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, ওই জিনটির নাম ছিল ইবন লাওযান। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, দীর্ঘদিন যাবত জিনটি মহিলার নিকট অনুপস্থিত ছিল। পরে যখন জিনটি আসে তখন সে জিনটিকে গালমন্দ করে। তখন জিনটি বলল, ‘আমি ওই প্রেরিত রাসূলের নিকট গিয়েছিলাম। আমি তাকে ব্যভিচার হারাম ঘোষণা করতে শুনেছি। সুতরাং তোমার প্রতি সালাম। তোমার নিকট থেকে চির বিদায়।’

ওয়াকিদী বলেন, মুহাম্মদ ইবনে সালিহ উসমান ইবনে আফফান (রা) সূত্রে বলেছেন, একসময় একটি ব্যবসায়ী কাফেলার সদস্যরূপে আমরা সিরিয়া যাত্রা করি। এটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের পূর্বের ঘটনা। আমরা যখন সিরিয়ার প্রবেশদ্বারে পৌঁছি তখন সেখানকার জনৈক গণক মহিলা আমাদের নিকট এলো। সে বলল, ‘আমার জিন সাথী আমার নিকট এসে দেয়ালের ওপর অবস্থান নিল। আমি বললাম ভেতরে আসছ না কেন? সে বলল, এখন আমার জন্যে সে পথ খোলা নেই। আহমদ নামের একজন নবী আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে এসেছেন যার বিরোধিতা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’ হযরত উসমান (রা) বলেন, এরপর আমি মক্কায় ফিরে আসি। সেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে পেলাম যে, তিনি রাসূলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন এবং মানুষকে আল্লাহর প্রতি ডাকছেন।

ওয়াকিদী বলেন, মুহাম্মদ ইব্‌ন আবদুল্লাহ যুহরী বলেছেন, পূর্বযুগে ওহী বিষয়ক আলোচনা শোনা যেত। জিনরা তা শুনতে পেত। ইসলামের যখন আগমন ঘটল তখন জিনদেরকে ওহী শোনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হলো। বানু আসাদ গোত্রে সাঈরা নামে এক মহিলার একটি অনুগত জিন ছিল। যখন দেখা গেল যে, ওহী শোনা আর সম্ভব হচ্ছে না তখন জিনটি মহিলার নিকট উপস্থিত হয় এবং তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। এরপর সে একটি চিৎকার দেয় যে, ওই মহিলা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। তার বুকের মধ্য থেকে জিনটি বলতে শুরু করে কঠোরতা কার্যকর করা হয়েছে, দলে দলে জিনদের ঊর্ধ্বাকাশে গমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাধ্যাতীত নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আর আহমদ (সা) ব্যভিচার হারাম ঘোষণা করেছেন।

হাফিজ আবু বকর খারাইতী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ বালভী......মিরদাস ইবনে কায়স সাদূসী সূত্রে বর্ণনা করেন— আমি একসময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট হাজির হই। তখন তার সম্মুখে গণক পেশা সম্পর্কে এবং তার আবির্ভাবের ফলে কীভাবে ওই গণক পেশা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে, সে সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! এ বিষয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। আমি তা আপনার সম্মুখে ব্যক্ত করছি। আমাদের একজন ক্রীতদাসী ছিল, তার নাম খালাসাহ্। তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া খারাপ ধারণা আমরা কোনদিন পোষণ করিনি। একদিনের ঘটনা, সে আমাদের নিকট এসে বলে, হে দাওস সম্প্রদায়! আশ্চর্য, আমার ওপর যা ঘটে গেল তা ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার। আপনারা কি আমার ব্যাপারে ভাল ছাড়া অন্য কোন ধারণা পোষণ করেন?’ আমরা বললাম, ‘ব্যাপার কী?’ সে বলল, ‘আমি আমার বকরী পালের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ একটি অন্ধকার এসে আমাকে ঢেকে ফেলে, এরই মধ্যে আমি নারী- পুরুষের যৌন সঙ্গম অনুভব করি। এখন তো আমি আশংকা করছি যে, হয়ত আমি গর্ভবতী হয়ে পড়েছি।’ মূলত তাই হলো। তার প্রসবকালীন সময় ঘনিয়ে এলো। সে একটি চ্যাপ্টা ও ঝুলন্ত কান বিশিষ্ট সন্তান প্রসব করে। তার কান দুটো ছিল কুকুরের কানের মতো। সে আমাদের মধ্যে কিছুদিন থাকার পরই অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা শুরু করে। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে এবং নিজের পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘হায় দুর্ভোগ! হায় দুর্ভোগ! হায় ক্রন্দন! হায় ক্রন্দন! গানাম গোত্রের জন্য দুর্ভোগ। ফাহম গোত্রের জন্যে দুর্ভোগ। খায়ল ভূমিতে আগুন প্রজ্বলনকারীর জন্যে দুর্ভোগ। আকাবার অধিবাসীদের সাথে আল্লাহ আছেন। এদের মধ্যে কতক সুদর্শন সাহসী উত্তম যুবক রয়েছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা সওয়রীতে আরোহণ করলাম এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম। এরপর আমরা বললাম, ‘ধুত্তরি, এখন তুমি কী করতে বল?’ সে বলে, ‘কোন ঋতুমতি মহিলা সংগ্রহ করা যাবে?’ আমরা বললাম, ‘আমাদের মধ্য থেকে কে তার দায়িত্ব নেবে?’ সে বলল, ‘আমাদের মধ্য থেকে একজন বৃদ্ধ লোক তার দায়িত্ব নেবে। তবে আল্লাহর কসম, ওই মহিলা আমার নিকট একজন সতী সাধবী মা বটে।’ আমরা বললাম, ‘ঠিক আছে ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।’ মহিলাটিকে নিয়ে আসা হলো। ওই শিশু একটি পাহাড়ে উঠল। মহিলাটিকে সে বলল, ‘আপনার জামা-কাপড় খুলে ফেলে দিন এবং আপনি ওদের সম্মুখে বের হন।’ উপস্থিত লোকজনকে সে বলল, ‘তোমরা তার পেছনে পেছনে যাও।’ আমাদের মধ্যে এক লোকের নাম ছিল আহমদ ইবনে হাবিস। সে বলল, ‘হে আহমদ ইবনে হাবিস! আপনি বিপক্ষদলের প্রথম অশ্বারোহীকে ঠেকাবেন। আহমদ আক্রমণ করলেন। ওদের প্রথম অশ্বারোহীকে তিনি বর্শাঘাত করলেন। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অন্য সবাই পালিয়ে গেল। আমরা ওদের ফেলে যাওয়া মালামাল লুটে নিলাম। সেখানে আমরা একটি গৃহ নির্মাণ করি। সেটির নাম দেই যুল খালাসাহ। ওই শিশুটি আমাদেরকে যা যা বলত, বাস্তবে তা-ই ঘটত। ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! অবশেষে যখন আপনার অবির্ভাবের সময় হলো তখন একদিন সে আমাদেরকে বলল, হে দাওস সম্প্রদায়! বানু হারিছ ইবনে কা’ব হামলা করেছে। তখন আমরা সওয়ারীতে আরোহণ করলাম। সে আমাদেরকে বলল, ‘আপনারা খুব দ্রুত ঘোড়া ছোটাবেন। তাদের চোখে-মুখে মাটি নিক্ষেপ করবেন। সকাল বেলা ওদেরকে দেশান্তর করবেন। সন্ধ্যাবেলা আপনারা মদপান করবেন।’ তার নির্দেশমত আমরা ওদের মুখোমুখি হলাম। কিন্তু তারা আমাদেরকে পরাজিত করে এবং আমাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। এরপর আমরা তার নিকট ফিরে এসে বলি, ‘তোমার কী অবস্থা?’ সে আমাদের দিকে তাকাল। চোখ দুটো তার রক্তিম। কান দুটো ফোলা ফোলা। রাগে সে যেন ফেটে পড়বে। সে উঠে দাঁড়ায়। আমরা সওয়ারীতে উঠে বসি। কিছু সময় আমরা তার নিকট থেকে দূরে সরে থাকি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে আমাদেরকে ডাকে এবং বলে, ‘আপনারা কি এমন কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী আছেন যে যুদ্ধ আপনাদের জন্যে সম্মান, গৌরব, শক্তিশালী রাজ্য এবং আপনাদের হাতে ধন সম্পদ এনে দেবে?’ আমরা বললাম, ‘তা তো আমাদের খুবই প্রয়োজন।’ সে বলল, ‘আপনারা সওয়ারীতে আরোহণ করুন আমরা সওয়ারীতে উঠলাম।’ ‘এবার কী নির্দেশ?’ আমরা বললাম। সে বলল, ‘বানু হারিছ ইবনে মাসলামাহ্ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলুন।’ এরপর বলল, ‘একটু থামুন।’ আমরা থামলাম। সে বলল, ‘বরং ফাহম গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে যান।’ এরপর বলল, ‘না, ওদেরকে তো আপনারা ধ্বংস করতে পারবেন না। আপনারা বরং মুদার গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হউন। ওদের প্রচুর পশু ও ধন সম্পদ রয়েছে।’ এরপর বলল, ‘না, ওদিকে নয় বরং দুরায়দ ইবনে সুম্মা-এর গোত্রের দিকে অগ্রসর হন। ওরা সংখ্যায়ও কম, শক্তিতে দুর্বল।’ এরপর সে বলল, ‘আপনারা বরং কা’ব ইবনে রবী’আ গোত্রের বিরুদ্ধে অগ্রসর হউন। আমির ইবনে সাসা’আ-এর স্বামী পরিত্যক্তা স্ত্রীরা ওদেরকে বসবাস করার স্থান দিয়েছে। সুতরাং যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে হোক।’ তার নির্দেশনায় আমরা কা’ব ইবনে রবী’আ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। কিন্তু ওরা আমাদেরকে পরাজিত করে এবং পর্যদস্ত ও লাঞ্ছিত করে ছেড়ে দেয়। আমরা ফিরে আসি। আমরা তাকে বললাম, ‘দুর্ভোগ তোমার। আমাদেরকে নিয়ে তুমি কী কাণ্ড শুরু করে দিয়েছ?’ সে বলল, ‘আমি নিজেই তো এর রহস্য খুঁজে পাচ্ছি না। আমার গোপন সহচর ইতিপূর্বে আমার সাথে সত্য কথা বলত। এখন দেখি সে মিথ্যা বলছে। আপনারা এক কাজ করুন। একাধারে তিনদিন আপনারা আমাকে আমার ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখুন। এরপর আপনারা আমার নিকট আসবেন।’ তার কথামত আমরা তাকে বন্দী করে রাখি। তিনদিন পর দরজা খুলে আমরা তার নিকট যাই। তখন তাকে দেখাচ্ছিল সে যেন একটি জ্বলন্ত পাথর। সে বলল, ‘হে দাওস সম্প্রদায়! আকাশকে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আগমন করেছেন।’ আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়?’ সে বলল, ‘মক্কায়। আরো শুনে নিন, অচিরেই আমার মৃত্যু হবে। আপনারা তখন আমাকে পাহাড়ের চূড়ায় দাফন করবেন। কারণ অবিলম্বে আমি আগুন রূপে জ্বলে উঠব। আপনারা যদি আমাকে রেখে দেন তবে আমি আপনাদের লাঞ্ছনার কারণ হবো। আপনারা যখন লক্ষ্য করবেন যে, আমি জ্বলে উঠেছি এবং শিখাময় হয়ে গিয়েছি তখন আমার প্রতি তিনটি পাথর নিক্ষেপ করবেন।

প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় বলবেন, হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়ে এ পাথর নিক্ষেপ করছি। তাহলে আমি প্রশমিত হবো ও নির্বাপিত হবো।’ যথাসময়ে তার মৃত্যু হয় এবং সে শিখাময় আগুনে পরিণত হয়। তার নির্দেশ মোতাবেক আমরা সব কিছুর ব্যবস্থা করি! “হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়ে নিক্ষেপ করছি” বলে আমরা তিনটি পাথর নিক্ষেপ করি। ফলে সে প্রশমিত হয় ও নিভে যায়। এরপর আমরা কিছুদিন অপেক্ষা করি। অতঃপর আমাদের এলাকার হজ্জে গমনকারী লোকেরা হজ্জ থেকে ফিরে আসে। ইয়া রাসূলুল্লাহ্! তারা এসে আমাদেরকে আপনার আবির্ভাবের সংবাদ দেয়। উল্লেখ্য যে, হাদীস শাস্ত্রবিশারদদের মতে এটি নিতান্তই গরীব পর্যায়ের হাদীস।

আল ওয়াকিদী....... নাদর ইবনে সুফয়ান হুযালী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমাদের এক ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে একবার আমরা সিরিয়া যাত্রা করি। যারকা ও মা’আন নামক স্থানের মাঝে যাত্রা বিরতি করে আমরা রাত্রি যাপন করছিলাম। হঠাৎ আমরা দেখতে পাই এক অশ্বারোহীকে। আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে দাঁড়িয়ে সে বলছে, “হে নিদ্রামগ্ন ব্যক্তিগণ! জেগে ওঠ, জেগে ওঠ। এখন ঘুমানোর সময় নয়। নবী আহমদ (সা) আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে জিনদেরকে চূড়ান্তভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে।” একথা শুনে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা সবাই ছিলাম তরুণ সহযাত্রী, আমরা সকলেই ওই ঘোষণা শুনেছি। এ অবস্থায় আমরা নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের নিকট ফিরে আসি। আমরা এসে শুনতে পাই যে, আমাদের দেশে কুরাইশ বংশীয় লোকদের মত-পার্থক্যের কথা আলোচনা হচ্ছে যে, বানু আবদুল মুত্তালিব গোত্র থেকে আবির্ভূত এক নবী নিয়ে কুরাইশগণ মতভেদ করছিল। ওই নবীর নাম আহমদ। এ বর্ণনাটি আবু নু’আয়মের। খারাইতী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ বলভী...... ইয়াহয়া ইবনে উরওয়া তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ওয়ারাকা ইবনে নাওফল, যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল, আব্দুল্লাহ্ ইবনে জাহশ এবং উছমান ইবনে হুওয়াইরিছ প্রমুখ ব্যক্তিসহ একদল কুরায়শী লোক একদিন তাদের একটি প্রতিমার নিকট ছিলো। প্রতি বছর ওই দিনটিকে তারা উৎসবের দিনরূপে নির্ধারিত করেছিল। তারা ওই প্রতিমাটি শ্রদ্ধা করত এবং সেটির উদ্দেশ্যে পশু বলি দিত। তারপর ধুমধামের সাথে খাওয়া-দাওয়া ও মদপান করত। তারা সেটির নিকট অবস্থান এবং তা প্রদক্ষিণ করতো, ওইদিন তারা রাত্রি বেলা প্রতিমার নিকট যায়। তারা সেটিকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে। তাতে তারা ব্যথিত হয়। তারা মূর্তিটিকে যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করে। সেটি অবিলম্বে দুঃখজনকভাবে উল্টে পড়ে যায়। তারা আবার সেটিকে যথাস্থানে স্থাপন করে। সেটি আবার পড়ে যায়। এ অবস্থা দেখে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এটিকে একটি গুরুতর বিষয়রূপে গণ্য করে। উছমান ইবনে হুওয়াইরিছ বললেন, ‘মূর্তিটির হলো কি? বারবার পড়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই কোন গুরুতর ঘটনা ঘটেছে।’ মূলত এ ঘটনা ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্মগ্রহণের রাতে। অতঃপর উছমান আবৃত্তি করেনঃ

آیا صنم العيد الذي صف حوله - صناديد وفد من بعيد وقريب

— হে উৎসব পালনের মূর্তি! যার চতুর্দিকে উপস্থিত হয়েছে কাছের ও দূরের প্রতিনিধি দলের নেতৃবর্গ।

تنگست مقلوبا فما اذاك قل لنا آذاك سفينة أم تنكست للعشب

— তুমি তো উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছ। আমাদেরকে তুমি বলে দাও, কোন নির্বোধ ব্যক্তি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে কি? না তুমি রাগান্বিত হয়ে পড়ে রয়েছ।

فان كان من ذنب أتينا فاننا نبوء باقرار ونلوى عن الذنب

— যদি আমরা কোন অপরাধ করে থাকি তবে আমরা সেই অপরাধ স্বীকার করব এবং ওই অপরাধ থেকে ফিরে আসব।

وان گنت مغلوبا ونكست صاغرا - فما أنت في الأوثان بالسيد الرب

— আর তুমি যদি পরাজিত হয়ে থাক এবং লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে থাক তবে তো নিশ্চিতভাবে তুমি প্রতিমাগুলোর নেতা ও শ্রেষ্ঠতম নও।

এরপর তারা মূর্তিটিকে ধরে যথা স্থানে পুনঃস্থাপন করে দেয়। যথাযথভাবে স্থাপিত হওয়ার পর সেটির ভেতর থেকে এক অদৃশ্য ঘোষক চিৎকার করে তাদের উদ্দেশে বলতে শুরু করে,

تروى لمولود انارت بنوره جميع فجاج الأرض في الشرق والغرب

— সে তো ধ্বংস হয়েছে এক নব জাতকের কারণে। যার জ্যোতিতে পূর্বে-পশ্চিমে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠেছে।

وخرت له الأوثان طرا وأرعدت قلوب ملوك الأرض طرا من الرعب

— তাঁর আবির্ভাবে মুগ্ধ হয়ে সকল প্রতিমা মাথা নত করেছে। আর তার ভয়ে বিশ্বের সকল রাজা-বাদশাহর অন্তর কেঁপে উঠেছে।

ونار جميع الفرس باخت و اظلمت - وقد بات شاه الفرس في أعظم الكرب

— অগ্নিপূজক সকল পারস্যবাসীর আগুন নিভে গিয়েছে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। পারস্যের প্রতাপশালী সম্রাট প্রচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে রাত্রি যাপন করেছে।

وصيت عن الكهان بالغيب جنها فلا مخبر عنهم بحق ولا كذب

— গণকদের জিনগুলো তাদের নিকট অদৃশ্যের সংবাদ আনয়নে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সুতরাং তাদের নিকট সত্য-মিথ্যা কোন প্রকার সংবাদ আনয়নের কেউ থাকল না।

فيا لقصى ارجعوا عن ضلالكم وهبوا الى الاسلام والمنزل الرحب

— সুতরাং হে কুসাই বংশভুক্ত লোকজন! তোমরা তোমাদের গোমরাহী থেকে ফিরে আস। আর ইসলাম ও বিশাল প্রাঙ্গণের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাও।

এ শব্দ শুনে তারা নির্জনে গিয়ে পরামর্শ করে পরস্পরে বলাবলি করল। আসুন আমরা সবাই একমত হই যে, এ বিষয়টি আমরা সম্পূর্ণরূপে গোপন রেখে দেই। কাউকেই জানতে দেব না। সবাই একথায় রাজী হলো। তবে ওয়ারাকা ইবনে নওফল বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা তো জান যে, তোমাদের সম্প্রদায় প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তারা সঠিক ও যুক্তিসম্মত পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এবং ইবরাহীম (আ)-এর দীন ছেড়ে দিয়েছে। তোমরা পাথরের তৈরি যে মূর্তির তাওয়াফ করছ সেটি তো কিছুই শুনতে পায় না। কিছুই দেখতে পায় না। কোন কল্যাণও করতে পারে না, অকল্যাণও নয়। হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা নিজেদের জন্যে সঠিক ধর্ম খুঁজে নাও।’ একথা শুনে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইব্রাহীম (আ)-এর হানীফ ও সত্য ধর্ম খুঁজতে থাকে। বস্তুত ওয়ারাকা ইবনে নওফল খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন এবং কিতাবাদি অধ্যয়ন করে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন।

উছমান ইবনে হুওয়াইরিছ রোমান সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হয়ে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্রাটের দরবারে মর্যাদা লাভ করেন। যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল বের হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বন্দী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি বের হয়ে জাকিরা অঞ্চলের রিককা নামক স্থানে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে একজন অভিজ্ঞ ধর্মযাজকের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। নিজের অভিপ্রায়ের কথা যাজকের নিকট প্রকাশ করেন। যাজক বললেন, ‘আপনি তো এমন এক দীন ধর্মের সন্ধান করেছেন, আপনাকে কেউই দেখতে পারবে না। তবে শুনুন– এমন এক সময় ঘনিয়ে এসেছে যে সময়ে আপনার নিজ শহর থেকে একজন নবী আত্মপ্রকাশ করবেন। তিনি দীন-ই হানীফ তথা সঠিক দীন সহকারে প্রেরিত হবেন।’ একথা শুনে তিনি মক্কার উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা করেন। পথিমধ্যে লাখম গোত্রীয় ডাকাতেরা তার উপর হামলা চালায় এবং তাকে হত্যা করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ মক্কাতেই থেকে যান। এক সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাব ঘটে। হাবশায় হিজরতকারী দলের সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশও হাবশা গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত খৃস্ট ধর্মের উপর তার মৃত্যু হয়। যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়লের জীবনী প্রসঙ্গে এ বর্ণনার সমর্থক একটি বর্ণনা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

খারাইতী বলেন, আহমদ ইবনে ইসহাক...... আব্বাস ইবনে মিরদাস সূত্রে বর্ণনা করেন, একদিন দুপুর বেলা তিনি তার দুগ্ধবতী উষ্ট্রীগুলোর পরিচর্যা করছিলেন। হঠাৎ তিনি একটি সাদা উটপাখি দেখতে পান। পাখিটির পিঠে ছিল একজন দুগ্ধধবল পোশাক পরিহিত আরোহী। সে বলল, ‘হে আব্বাস ইবনে মিরদাস! তুমি কি দেখনি যে, আকাশ তার প্রহরীদের দ্বারা নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে, যুদ্ধ কয়েকবার তার পানীয় পান করেছে এবং অশ্বদলের পিঠের আসন খুলে রাখা হয়েছে? মনে রেখ যিনি সততা ও খোদাভীতি সহকারে সোমবারের দিনে মঙ্গলবারের রাতে আগমন করলেন তিনি কুসওয়া উষ্ট্রীর মালিক।’ একথা শুনে শংকিত সন্ত্রস্ত হয়ে আমি ফিরে আসি। যা আমি দেখলাম এবং যা আমি শুনলাম তাতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। অতঃপর আমি আমাদের নিজস্ব একটি প্রতিমার নিকট উপস্থিত হই। প্রতিমাটির নাম যামাদ। আমরা সেটির উপাসনা করতাম এবং সেটির মধ্যে অবস্থানকারী জিনের সাথে কথা বলতাম। আমি তার চারপাশ ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করলাম, তারপর সেটির দেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে সেটিকে চুমু খেলাম তখন শুনতে পেলাম যে, তার মধ্যে অবস্থানকারী জিনটি বলছেঃ

قل للقبائل من سليم گلها هلك الضماد وفاز أهل المسجد

— সমগ্র সুলায়ম গোত্রে বলে দাও যে, যামাদ প্রতিমা ধ্বংস হয়েছে এবং মসজিদওয়ালা লোকেরা সফলকাম হয়েছে।

هلك الضماد وكان يعبد مرة قبل الصلاة مع النبي محمد

— যামাদ প্রতিমা ধ্বংস হয়েছে! নবী মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে নামায আদায়ের নিয়ম চালু হওয়ার পূর্বে এক সময় তার পূজা করা হতো বটে।

ان الذي ورث النبوة والهدی بعد ابن مريم من قريش مهتد

— মরিয়ম তনয় ঈসা (আ) এরপর কুরায়শ বংশীয় যিনি নবুয়ত ও হেদায়তের ক্ষেত্রে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নিশ্চয় তিনি প্রকৃত সত্য পথের দিশা পেয়েছেন।

মূর্তির নিকট থেকে এ বক্তব্য শুনে আতংকগ্রস্ত হয়ে আমি আমার সম্প্রদায়ের নিকট আসি এবং তাদেরকে সকল ঘটনা খুলে বলি। এরপর আমার গোত্র বানু হারিছা গোত্রের প্রায় তিনশ’ লোক সহকারে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। তিনি তখন মদীনায় অবস্থান করছিলেন। আমরা মদীনার মসজিদে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘হে আব্বাস! তুমি কোন প্রেক্ষাপটে ইসলাম গ্রহণের জন্যে এসেছ তা বল দেখি।’ আমি ইতিপূর্বে সংঘটিত ঘটনা তার নিকট বর্ণনা করলাম। বিস্তারিত শুনে তিনি খুশি হলেন। তখন আমি নিজে এবং আমার সম্প্রদায় সকলে ইসলাম গ্রহণ করি। হাফিজ আবু নুআয়ম ‘আদদালাইল” গ্রন্থে আবু বকর ইবনে আবী আসিম সূত্রে আমর ইবনে উছমান থেকে এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। এরপর তিনি আসমাঈ আব্বাস ইবনে মিরদাস সুলামী থেকে বর্ণনা করেছেন, আব্বাস বলেছেন আমার ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক প্রেক্ষাপট এই ছিল যে, আমার পিতা মিরদাস যখন মৃত্যুপথ যাত্রী। তখন তিনি আমাকে ওসীয়ত করেন আমি যেন তাঁর প্রিয় প্রতিমা ‘যামাদ’-এর সেবাযত্ন করি। তার ওসীয়ত অনুযায়ী আমি মূর্তিটিকে একটি ঘরে স্থাপন করি। দৈনিক একবার করে আমি তার নিকট যেতাম। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের পর একদা মধ্য রাতে আমি একটি শব্দ শুনতে পাই। শব্দটি আমাকে আতংকিত করে তোলে। কালবিলম্ব না করে সাহায্যের আশায় আমি যামাদ প্রতিমার নিকট উপস্থিত হই। তখন সেটির ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছিলঃ সে পূর্বোল্লিখিত পংক্তিগুলো ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ আবৃত্তি করছিল।

এ ঘটনা আমি লোকজনের নিকট থেকে গোপন রাখি। লোকজন উৎসব থেকে ফিরে আসার পর একদিন আমি যাতু ইরক অঞ্চলের আকীক নামক স্থানে আমার উট বহরের মধ্যে শুয়েছিলাম। তখন হঠাৎ আমি একটি শব্দ শুনি। তাকিয়ে দেখি একটি উটপাখির ডানাতে অবস্থানরত এক লোক বলছে, সেই জ্যোতির কথা বলছি যেটি সোমবার দিবাগত রাতে বানু আনকা গোত্রের দেশে আল-আদবা উষ্ট্রীর মালিকের উপর নাযিল হয়েছে। এরপর তাঁর উত্তর দিক থেকে ঘোষণা দানকারী এক ঘোষক প্রত্যুত্তরে বলল,

بشر الجن وابلاسها ان وضعت المطى أحلاسها

وكلات السماء أحراسها

— হতাশাগ্রস্ত জিন জাতিকে জানিয়ে দাও যে, বাহন উট তার পৃষ্ঠে আসন স্থাপন করেছে। এবং আকাশ তার প্রহরীদেরকে সুসজ্জিত করেছে। এ সব দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমি লাফিয়ে উঠি। আমি উপলব্ধি করি, নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা) প্রেরিত হয়েছেন। আমি তখন আমার অশ্বে আরোহণ করি এবং দ্রুত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হই। আমি তার হাতে বাই’আত করি। এরপর আমি যামাদ’ মূর্তির নিকট ফিরে গিয়ে সেটিকে আগুনে পুড়িয়া ফেলি। তারপর পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ফিরে আসি।

তখন আমি নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করি,

لعمرك اني يوم اجعل جاهلا ضمادا لرب العلمين مشارگا

— আপনার জীবনের কসম, যে সময়ে আমি যামাদ’ মূর্তিকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সমকক্ষ নির্ধারণ করতাম সে সময়ে আমি নিশ্চয়ই মূর্খ ও অজ্ঞ ছিলাম।

وتركى رسول الله وللاوس حوله أولئك أنصار له ما أولئك

— রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আমি যে বর্জন করেছিলাম এবং তাঁর চারদিকে থাকা আওস সম্প্রদায়কে, ওরা তো রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহায্যকারী আনসারগণ।

كتارك سهل الأرض والحزن يبتغي - ليسلك في وعث الأمور مسالگا

— আমার ওই বর্জন হলো সে ব্যক্তির ন্যায় যে আপদকালীন সময়ে সমতল ও নম্রভূমি বর্জন করে কঠিন ও বন্ধুর পথের খোঁজ করে।

فامنت بالله الذي أنا عبده وخالفت من أمسى يريد المهالگا

— আমি ওই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি আমি যাঁর বান্দা এবং আমি বিরোধিতা করেছি সেই ব্যক্তির, যে ধ্বংসের পথ কামনায় দিন গুজরান করে।

ووجهت وجهي نحو مكة قاصدا أبايع نبي الأكرمين المباركا

— আমি আমার মুখ ফিরিয়ে মক্কা অভিমুখী হয়েছি- শ্রেষ্ঠতম ও বরকতময় নবীর হাতে বাইয়াত করার উদ্দেশ্যে।

نبي أتانا بعد عیسی بناطق من الحق فيه الفصل كذلك

— ঈসা (আ)-এর পর এই নবী আমাদের নিকট আগমন করেছেন এমন এক আসমানী গ্রন্থ নিয়ে যেটি সত্য বর্ণনা করে এবং যার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট ফয়সালা।

أمين على القران أول شافع واول مبعوث يجيب اللائگا

— এই নবী কুরআন মজীদের আমানতদার। তিনি সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম তিনি পুনরুজ্জিত হবেন। তিনি ফেরেশতাদের ডাকে সাড়া দেন।

تلا في عرى الاسلام بعد انتقاضها فأحمها حتى أقام المناسكا

— ইসলামের হাতলগুলো ভেঙে যাওয়ার পর তিনি সেগুলোকে জোড়া লাগিয়েছেন এবং মজবুত ও শক্তিশালী করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পরিপূর্ণ ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করলেন।

عنيتك يا خير البرية كلها - توسطت في الفرعين والمجد مالگا

— হে সমগ্র জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি! আমি ইতিপূর্বে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। উভয় জগতে আপনি সর্বোত্তম এবং মর্যাদার অধিকারী।

وانت المصفى من قريش اذا سمت على ضمرها تبقى القرون المباركا

— আপনি কুরাইশ বংশের স্বচ্ছ ও পুতঃপবিত্র মানুষ। যুগযুগ ধরে তারা বরকতময় থাকবে যদি তারা আপনার পথের পথিক হয়।

اذا انتسب الحيان كعب ومالك وجدنان محضا والتساء العوارگا

— যখন কা’ব গোত্র ও মালিক গোত্রের বংশ পরিচয় বর্ণনা করা হয়, তখন আমরা আপনাকে খাঁটি ও নির্ভেজাল অভিজাত বংশোদ্ভূত পাই আর ওই গোত্রগুলোর মহিলাদেরকে পাই পুতঃপবিত্র।

খারাইতী বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ বলভী....... মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক সূত্রে বলেছেন, মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্-এর বংশীয় আবদুল্লাহ্ ইবনে মাহমুদ নামের একজন আনসার শায়খ আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে, খাছ‘আমে বংশের কয়েকজন লোক এ কথা বলত যে, নিম্নোক্ত ঘটনা আমাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা মূর্তিপূজা করতাম। একদিন আমরা আমাদের এক প্রতিমার নিকট ছিলাম; তখন একদল লোক ওই প্রতিমার নিকট এসেছিল ফরিয়াদ করার জন্যে, তাদের মধ্যেকার কোন এক বিরোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে। তখন তাদের উদ্দেশে এক অদৃশ্য ঘোষক ঘোষণা দেয়ঃ

يا يها الناس ذوو الاخسام من بين اشياخ الي غلام

— হে বিশালকায় লোক সকল! ছেলে বুড়ো সবাই,

ما أنتم وطائش الأحلام ومسند الحكم الى الأصنام

— আর কতকাল তোমরা স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবে? আর সকল বিধি-বিধান প্রতিমাদের বলে মেনে চলবে?

كلكم في حيرة نيام أم لا ترون ما الذي امامی

— তোমাদের সকলেই কি অস্থিরতায় ভুগছ এবং নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছ? আমার সম্মুখে কি আছে তার কিছুই কি তোমরা দেখছো না?

من ساطع يجلو دجي الظلام قد لاح للناظر من تهام

— আমার সম্মুখে রয়েছে আলোক খণ্ড। সেটি অন্ধকারের কালিমাকে দূরীভূত করে দিচ্ছে। দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট তিনি দৃশ্যমান। তিনি এসেছেন তিহামা অঞ্চল থেকে।

ذاك نبي سيد الأنام - قد جاء بعد الكفر بالاسلام

— তিনি নবী, তিনি মানবকুল শ্রেষ্ঠ। কুফরী যুগের পর তিনি ইসলাম নিয়ে এসেছেন।

أكرمه الرحمن من امام ومن رسول صادق الكلام

— আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে ইমামতি ও নেতৃত্ব দিয়ে এবং সত্যবাদী রাসূলরূপে প্রেরণ করে সম্মানিত করেছেন।

أعدل ذي حكم من الأحكام يأمر بالصلاة والصيام

— তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক। তিনি নামায-রোযার নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

وللبر والصلات للارحام ويزجر الناس عن الآثام

— সদাচরণ করতে এবং আত্মীয়তা অক্ষুন্ন রাখতে তিনি নির্দেশ দেন। পাপাচারিতা ও অন্যায় আচরণ থেকে মানুষকে তিনি সতর্ক করেন।

والرجس والأوثان والحرام - من هاشم في ذروة السنام

— তিনি লোকদেরকে নিবৃত্ত করেন অপবিত্রতা থেকে, মূর্তিপূজা থেকে এবং হারাম কর্ম থেকে। তিনি এসেছেন সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন হাশেমী বংশ থেকে।

مستعلنا في البلد الحرام

— সম্মানিত শহর মক্কা শরীফে তিনি তাঁর বাণী প্রচার করছেন। আমরা শুনে সেখান থেকে এসে নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করি।

খারাইতি বলেন, আবদুল্লাহ বলভী.......সাঈদ ইবনে জুবায়র (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, তামীম গোত্রের রাফি ইবনে উমায়র নামক এক ব্যক্তি পথঘাট যার সবচেয়ে বেশি চেনা-জানা ছিল—গোত্রের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক রাত্রি ভ্রমণকারী ছিলেন। বিপদাপদের মোকাবেলায় তিনি ছিলেন সকলের অগ্রণী। পথঘাট সম্পর্কে অবগতি ও রাত্রি ভ্রমণের দুঃসাহসের কারণে আরবগণ তাঁকে ‘আরবের দামূস’ নামে অভিহিত করত। [( دعموص ) দামুস এক প্রকার জলজ প্রাণী] তিনি তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করে বলেনঃ একরাতে আমি এক বালুকাময় অঞ্চল অতিক্রম করছিলাম। এক সময় আমার প্রচণ্ড ঘুম পায়। সওয়ারী থেকে নেমে সেটিকে বসিয়ে দিয়ে তার সম্মুখের দু’পায়ে মাথা রেখে আমি শুয়ে পড়ি এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। ঘুমানোর পূর্বে আত্মরক্ষার জন্যে আমি নিম্নোক্ত বাক্য উচ্চারণ করিঃ “এই উপত্যকার নেতৃত্বে আসীন জিনের নিকট আমি সকল প্রকারের অত্যাচার ও দুঃখকষ্ট থেকে আশ্রয় কামনা করছি।” তখন আমি স্বপ্নে দেখি এক যুবা পুরুষ। সে আমার উষ্ট্রীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার হাতে একটি বর্শা। বর্শার আঘাতে সে আমার উষ্ট্রীর বক্ষ চিরে ফেলতে উদ্যত। এ স্বপ্ন দেখে আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই। মনে মনে বললাম, এটি শয়তানের কুমন্ত্রণা। পুনরায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এবারও একই স্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠি এবং উষ্ট্রীর চারদিকে ঘুরেফিরে খোঁজাখুঁজি করি কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে এতটুকু দেখলাম যে, উষ্ট্রীটি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আবারও সেই একই স্বপ্ন দেখি। এবারও আমি জেগে উঠি। তখন আমার উষ্ট্ৰীটি দস্তুর মত ছটফট করছে। এমন সময় হঠাৎ আমার দৃষ্টিগোচর হয় এক যুবা পুরুষ। স্বপ্নে যেমনটি দেখেছি ঠিক তেমন। তার হাতে একটি বর্শা। সেখানে একজন বৃদ্ধ লোক। তিনি যুবকের বর্শাটিকে আমার উষ্ট্রী থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বৃদ্ধ লোকটি ওই যুবককে লক্ষ্য করে বলছেনঃ

يا مالك بن مهلهل بن دثار - مهلا فدى لك مشزرى وازاری

অর্থাৎ, হে মালিক ইবন মুহালিহিল ইবন দিছার! থাম, থাম, আমার ফিতা পাজামা সবকিছু তোমার জন্যে উৎসর্গ হোক।

عن ناقة الانسي لا تعرض لها - واختربها ما شئت من أثواری

অর্থাৎ, ওই মানব সন্তানের উষ্ট্রীর ওপর আক্রমণ করা থেকে তুমি বিরত থাক। সেটির ওপর হামলা করো না, সেটির পরিবর্তে আমার ষাঁড়গুলো থেকে যা তোমার পছন্দ হয় নিয়ে যাও।

ولقد بدالي منك ما لم أحتسب - الأ رعیت قرابتی وذماري

অর্থাৎ, তোমার নিকট থেকে আমি এমন আচরণ পেয়েছি যা আমি কখনও কল্পনা করিনি। তুমি তো আমার আত্মীয়তার মর্যাদা দাওনি এবং আমার যতটুকু সম্ভ্রম রক্ষা করা তোমার কর্তব্য ছিল তাও করনি।

تسمو اليه بحربة مسمومة تبالفعلك يا أبا الغفار

অর্থাৎ, আশ্চর্য! বিষমিশ্রিত বর্শা তুমি তার প্রতি উত্তোলন করেছ। ধিক তোমার অপকর্ম! হে আবুল গিফার।

لولا الحياء وان أهلك حيرة - لعلمت ما كشفت من أخباری

অর্থাৎ, চক্ষুলজ্জা যদি না থাকত আর তোমার পরিবারবর্গ যদি আমার প্রতিবেশী না হতো তবে। তুমি অবশ্য দেখতে পেতে আমার কী পরিমাণ ক্ষোভের তুমি সঞ্চার করে দিয়েছ।

উত্তরে যুবা পুরুষটি বলল,

أاردت أن تعلو وتخفض ذكرنا - في غير مزربة أبا العيزار

অর্থাৎ, হে আবুল ঈযার! তুমি কি নিজে সম্মান লাভের চেষ্টা করছ? আর আমাদের কোন দোষ-ত্রুটি ব্যতীত আমাদের সুনাম সুখ্যাতি কমিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছ?

ماكان فيهم سيد فيما مضى - ان الخيار مهو بنوا الخيار

অর্থাৎ, অতীত যুগে ওদের মধ্যে তো কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জন্মায় নি। ভাল মানুষরা তো ভাল মানুষেরই সন্তান হয়ে থাকে।

فاقصد لقصدك يا معكبر انما - كان المجير مهلهل بن دثار

অর্থাৎ, হে বন্য পশু! তুমি তোমার পথে যাও। মূলত মুহালহিল ইবন দিছারই এতদঞ্চলের আশ্রয়দাতা ছিল।

ওরা দু’জন কথা কাটাকাটি করছিল। হঠাৎ তিনটি বন্য ষাঁড় বেরিয়ে এলো। যুবককে লক্ষ্য করে বৃদ্ধ বললেন, ‘ভাতিজা! আমার আশ্রয় প্রার্থী লোকটির উষ্ট্রীর পরিবর্তে এই তিনটি ষাঁড়ের মধ্যে যেটি তোমার পছন্দ হয় সেটি তুমি নিয়ে যাও!’ একটি ষাঁড় নিয়ে যুবকটি চলে গেল। অতঃপর বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বলল, ‘হে মানব সন্তান! কোন মাঠ-প্রান্তরে অবতরণ করলে এবং সেখানকার ভয়-ভীতিতে শংকিত হলে এভাবে আশ্রয় কামনা করবে, “হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতিপালক! এই প্রান্তরের ক্ষয়ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” খবরদার! কোন জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করো না। ওদের কাজ-কর্ম ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন বাতিল ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।’ আমি তাকে বললাম, ‘কে সেই মুহাম্মদ?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘তিনি একজন আরবী নবী। এককভাবে পূর্বেরও নন, পশ্চিমেরও নন। সোমবার তিনি দুনিয়াতে এসেছেন।’ ‘তাঁর বাসস্থান কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ‘খেজুর বাগানসমৃদ্ধ ইয়াসরিব নগরীতে তিনি বসবাস করেন।’ ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হওয়ার পর আমি আমার সওয়ারীতে আরোহণ করি এবং দ্রুত অগ্রসর হয়ে মদীনায় গিয়ে পৌঁছি। রাসূলুল্লাহ (সা) আমায় দেখেন। আমি কিছু বলার পূর্বেই তিনি আমাকে উপলক্ষ করে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বলে দিলেন। তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। সাঈদ ইবন জুবায়র (রা) বলেন আমরা এই অভিমত পেশ করি যে,

وأنه كان رجال من الانس - يعوذون برجال من الجن فزادوهم رهقا

কতক মানুষ কতক জিনের আশ্রয় কামনা করত ফলে ওরা জিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত আয়াতটি আল্লাহ্ তা’আলা এই ব্যক্তি সম্পর্কে নাযিল করেছেন।

খারাইতি-হযরত আলী (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যদি তুমি কোন পার্বত্য উপত্যকায় যাও এবং হিংস্র জীবজন্তুর আশংকা কর তবে এই দোয়া পাঠ করবে,

( اعوذ بدانيال والجب من شر الاسد )

আমি দানিয়াল ও তার শরণ নিচ্ছি সিংহের আক্রমণের বিপদ থেকে।

বালাভী ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে জিনদের সাথে হযরত আলী (রা)-এর লড়াইয়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আলী (রা)-কে পানি আনয়নের জন্যে পাঠিয়েছিলেন, জিনরা তাঁকে বাধা দেয় এবং তাঁর বালতির রশি কেটে ফেলে। তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এ ঘটনাটি ঘটেছিল জুহফা অঞ্চলে যাতুল আলম নামীয় কূপের নিকট। এটি একটি দীর্ঘ বর্ণনা এবং বর্ণনাটি অগ্রহণযোগ্যও বটে।

খারাইতি বলেন, আবুল হারিছ .......শাবী (র) সূত্রে জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি একদিন উমর ইবন খাত্তাব (রা)-এর মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। একদল সাহাবী তখন তাঁর নিকট বসা অবস্থায় ছিলেন। তারা কুরআন মজীদের ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। একজন বললেন, ‘সূরা নাহলের শেষ দিকের আয়াতগুলো অধিক ফযীলতময়।’ কেউ বললেন, ‘সূরা ইয়াসীন।’ হযরত আলী (রা) বললেন, ‘আয়াতুল কুরসী-এর ফযীলত সম্পর্কে আপনারা কতটুকু জানেন? বস্তুত আয়তুল কুরসীতে ৭০টি শব্দ রয়েছে এবং প্রত্যেক শব্দের বরকত রয়েছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, ওই মজলিসে আমর ইবন মা’দীকারাবও ছিলেন। তিনি কোন মন্তব্য করছিলেন না। এবার তিনি বললেন, ‘হায়! ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর ফযীলত সম্পর্কে আপনারা কেউ কিছু বলছেন না যে,’ তাকে লক্ষ্য করে হযরত উমর (রা) বললেন, ‘এ বিষয়ে আপনি আপনার বক্তব্য পেশ করুন।’

আমর ইবন মাদীকারাব বলতে শুরু করলেনঃ জাহেলিয়াতের যুগে সংঘটিত আমার এক ঘটনার কথা বলছি। একদিন আমার প্রচণ্ড ক্ষিধে পায়। খাদ্যের খোঁজে আমি আমার ঘোড়া নিয়ে এক বনের মধ্যে ঢুকে পড়ি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর উটপাখির কয়েকটি ডিম ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। তা নিয়েই আমি ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি এক আরবী বৃদ্ধ লোক তার তাঁবুতে বসে রয়েছেন। তাঁর পাশে একটি বালিকা। বালিকাটি উদীয়মান সূর্যের ন্যায় ফুটফুটে সুন্দরী। বৃদ্ধের অল্প কয়েকটি ছাগল ছিল। আমি তাঁকে বললাম, ‘তোমার মা ধ্বংস হোক, তুমি আমার হাতে বন্দী।’ সে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যুবক! তুমি যদি আমার আতিথ্য পেতে চাও তবে সওয়ারী থেকে নেমে আমার এখানে আস। আর যদি আমার পক্ষ থেকে কোন সাহায্য চাও, তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করবো।’ আমি বললাম, ‘না তুমি আমার হাতে বন্দী।’ এবার সে বলল,

عرضنا عليك النزل منا تكرما - فلم تروی جهلا كفعل الأشائم

অর্থাৎ, আমাদের পক্ষ থেকে সম্মানজনকভাবে আমরা তোমাকে আতিথ্যের প্রস্তাব দিলাম। অভদ্রদের ন্যায় অজ্ঞতা হেতু তুমি তা প্রত্যাখ্যান করলে।

وجئت ببهتان وزور ودون ما - تمنيته بالبيض حز الغلاصم

অর্থাৎ, তুমি বরং অপবাদ ও মিথ্যা নিয়ে এসেছ। ওই ডিম দ্বারা তুমি যা কামনা করছ তার পরিণামে তোমার গর্দান কাটা যাবে।

অতঃপর সে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বিশাল দেহের তলায় আমি যেন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। সে বলল, “আমি কি তোমাকে মেরে ফেলব? না কি ছেড়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘আমাকে ছেড়ে দাও!’ সে আমাকে ছেড়ে দিল।

আমার প্রবৃত্তি আমাকে পুনরায় তার বিরুদ্ধে যুঝতে প্ররোচিত করে। আমি বললাম, ‘তোমার মা। সন্তান হারা হোক! তুমি আমার হাতে বন্দী।’ সে বললঃ

بسم الله الرحمن فزنا - هنالك والرحيم به قهرنا

অর্থাৎ, দয়াময় আল্লাহর নামে আমি তখন সফল হয়েছি। পরম করুণাময় আল্লাহর নামে আমি তাকে পরাস্ত করেছি।

وما تغنی جلادة ذي حقاظ - اذا يوما لمعركة برزنا

অর্থাৎ, যদি আমরা কোন দিন যুদ্ধের জন্যে বের হই তবে কোন রক্ষাকর্তার শক্তিমত্তা আমাদের হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। অতঃপর সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি যেন তার শরীরের নিচে মাটিতে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। সে বলল, ‘এখন তোমাকে মেরে ফেলব, না ছেড়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘বরং ছেড়ে দাও।’ সে আমাকে ছেড়ে দেয়। মুক্তি পেয়ে আমি কিছুদূর চলে যাই। এরপর আমি নিজেকে নিজে বলি, হে আমর! ওই বৃদ্ধ লোকটি তোমাকে হারিয়ে দিল? তোমার জন্যে এখন বাঁচার চাইতে মরাই ভাল। আমি পুনরায় তার নিকট ফিরে আসি। আমি তাকে বলিঃ ‘তুমি আমার হাতে বন্দী। তোমার মা সন্তানহারা হোক।’ সে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে পুনরায় আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার দেহের নিচে আমি যেন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। সে বলল, ‘এবার তোমাকে মেরে ফেলব, না ছেড়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘ছেড়ে দাও।’ সে বলল, ‘না, না, আর নয়, তোমার মুক্তি সুদূর পরাহত। এই মেয়ে, ছুরিটা নিয়ে এসো।’ মেয়েটি ছুরি নিয়ে আসলো। বৃদ্ধ লোকটি আমার কপালের উপরের দিকের চুল কেটে দিল। আরবের প্রথা ছিল কারো উপর বিজয় লাভ করলে তার মাথার সম্মুখ ভাগের চুল কেটে দিয়ে তাকে ক্রীতদাস বানিয়ে নিত। এরপর অনেকদিন ক্রীতদাস রূপে আমি তার সেবা করেছি। একদিন সে বলল, ‘হে আমর! আমি চাই তুমি আমার সাথে সওয়ারীতে বসবে এবং প্রান্তরে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াবে। তোমার পক্ষ থেকে আমি কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা করি না। কারণ আমি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর বরকতে পরম বিশ্বাসী।’

আমরা যাত্রা করলাম। যেতে যেতে বহুদূরে এক ভয়ংকর জিন-ভূত ভর্তি জঙ্গলে এসে পৌঁছি। উচ্চস্বরে সে বলে ওঠেঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। ফলে সেখানকার সকল পাখি নিজ নিজ বাসা ছেড়ে উড়ে যায়। সে পুনরায় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে ওঠে। এবার সকল হিংস্র জীবজন্তু নিজ নিজ বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে পুনরায় এর পুনরাবৃত্তি করে। এবার আমি দেখতে পেলাম যে, আমাদের সম্মুখে এক হাবশি লোক। ওই জঙ্গল থেকে সে বেরিয়ে আসছে। তাকে একটি দীর্ঘকায় খেজুর গাছের মতো দেখাচ্ছিল। আমার সাথী বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বলল, ‘হে আমর! তুমি যখন দেখবে যে, আমরা প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি তখন তুমি বলবে, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”-এর বরকতে আমার সাথী ওর বিরুদ্ধে জয়ী হোক।’ আমি যখন দেখলাম, তারা দুজনেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে তখন আমি বললাম, “লাত ও উযযা মূর্তির আশীর্বাদে আমার সাথী তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়ী হোক।’ দেখা গেল আমার বৃদ্ধ সাথী তার প্রতিপক্ষকে মোটেই জব্দ করতে পারছে না। আমার নিকট ফিরে এসে সে বলল, ‘আমি বুঝেছি তুমি আমার নির্দেশের বিপরীত কথা বলেছ।’ আমি দোষ স্বীকার করে বলি- ‘হ্যাঁ, তা করেছি বটে, আর ওরূপ করব না।’ সে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার যখন আমাদেরকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত দেখবে তখন তুমি বলবে, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”-এর বরকতে আমার সাথী জয়ী হোক।’ আমি সম্মতিসূচক উত্তরে বলি, ‘হ্যাঁ, তা-ই হবে।’

আমি যখন দেখলাম, তারা দুজনে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তখন বললাম, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমের বরকতে আমার সাথী জয়ী হোক।’ এবার আমার বৃদ্ধ সাথী তার প্রতিপক্ষকে চেপে ধরল এবং ছুরিকাঘাতে তার পেট চিরে ফেলল। তখন তার দেহ থেকে চিমনীর কালো কালির ন্যায় একটি বস্তু বের হলো। আমার সাথী বলল, ‘হে আমর! এটি হলো তার হিংসা ও বিদ্বেষ।’

‘ওই বালিকাটিকে তুমি চেন কি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘না, চিনি না।’ সে বলল, ‘বালিকাটি হলো সম্ভ্রান্ত জিন সালীল জুরহুনীর কন্যা ফারিআ।’ ওরা হলো তার বংশের লোক। তার জ্ঞাতি ভাই। প্রতিবছর তারা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর বরকতে একজন লোক সব সময় আমাকে ওদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে। এরপর সে বলল, ‘এ কালো লোকটির প্রতি আমি কী আচরণ করেছি দেখেছ তো? এখন আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। তুমি আমাকে কিছু একটা এনে দাও, আমি খেয়ে নিই।’ খাদ্য সংগ্রহের জন্যে ঘোড়া ছুটিয়ে আমি বনের ভেতর ঢুকে পড়ি। খুঁজে পাই উট পাখির কয়েকটি ডিম। আমি তা নিয়ে আসি। তখন বৃদ্ধ নিদ্রামগ্ন। তার মাথার নিচে আমি কাঠের ন্যায় কি একটা লক্ষ্য করলাম, আমি চুপিসারে সেটি টেনে নিলাম। দেখলাম সেটি একটি তরবারি। দৈর্ঘ্যে সাত বিঘত, আর প্রস্থে এক বিঘত। তরবারি দ্বারা আমি তার পায়ের নলায় আঘাত করি। তার নলাসহ পা দু’টো আলাদা হয়ে যায়। পিঠে ভর দিয়ে সে সোজা হয়ে ওঠে এবং বলে ওঠে, ‘আল্লাহ্ তোকে ধ্বংস করুন। হে বিশ্বাসঘাতক! কেমনতর বিশ্বাস ঘাতকতা করলি তুই!’

হযরত উমর (রা) বললেন, ‘তারপর তুমি কী করলে?’ আমি বললাম, ‘অতঃপর আমি তাকে একের পর এক আঘাত করতে থাকি এবং তাকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলি।’ তখন রাগে গরগর করতে করতে সে এ কবিতাটি আবৃত্তি করে,

بالغدر نلت أخا الإسلام عن كتب - ما ان معت كذا في مسالف العرب

অর্থাৎ, বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি একজন মুসলমানকে কাবু করলে! পূর্ববর্তী যুগের আরবদের কেউ এমনটি করেছে বলে আমি কখনো শুনিনি।

والعجم تائف مما جته گرما - تبا لما جئت في السيد الأرب

অর্থাৎ, সদাচরণের বিনিময়ে তুমি যা করলে অনাবর লোকেরা তার নিন্দা করে। একজন জ্ঞানবান নেতার ব্যাপারে তুমি যা করেছ তার জন্যে তুমি ধ্বংস হও।

اني لاعجب انى نائف قتلته أم كيف جازاك عند الذنب لم تب

অর্থাৎ, তোমাকে হত্যা করতে পারলে আমি খুশি হতাম। অন্যথায় যে পাপের তুমি প্রতিবিধান করোনি তার প্রতিফল কী হবে?

قرم عفا عنك مرات وقد علقت - بالجسم منك يداه موضع العطب

অর্থাৎ, তিনি একজন নেতৃস্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি বারবার তোমাকে ক্ষমা করেছেন। অথচ তোমার কারণে তাঁর হাত ঝুলছে দেহের সাথে। তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী।

জাহেলী যুগে শিরকপন্থী ও খৃষ্টবাদীরা যা করত ইসলাম প্রহণের পর আমি যদি তা করতাম,

তাহলে আমার পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ তুমি এমন একটি তরবারির আক্রমণ পেতে যা আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যে দুঃখ ও ধ্বংসই ডেকে আনে।

হযরত উমর (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘বালিকাটির কি হলো?’ আমি বললাম, ‘এরপর আমি বালিকাটির নিকট যাই।’

আমাকে দেখে সে বলল, ‘বৃদ্ধটির কী হলো?’ আমি বললাম, ‘হাবশি লোকটি তাকে খুন করেছে।’ সে বলল, ‘এটি তোমার মিথ্যাচার; বরং তুমিই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে খুন করেছ।’ এরপর সে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলঃ

يا عين جودى للفارس المغوار - هم جودی بواكفات غزار

অর্থাৎ, হে নয়ন আমার! অশ্রু বর্ষণ কর ওই সাহসী অশ্বারোহী যোদ্ধার শোকে। অঝোর অশ্রু প্রবাহে তুমি পুনরায় ক্রন্দন কর।

لا تملى البكاء اذا خانك الدهر - بواف حقيقة صبار

অর্থাৎ, যুগ যখন একজন পরিপূর্ণ ও প্রকৃত ধৈর্যশীল মানুষ সম্পর্কে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তখন আর কান্না বন্ধ করো না।

وتقى وذى وقار وحلم - وعديل الفخار يوم الفخار -

অর্থাৎ, এমন একজন মানুষ সম্পর্কে যিনি ছিলেন পরহেজগার, সংযমী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, ন্যায়পরায়ণ এবং গৌরব প্রকাশের প্রতিযোগিতায় প্রকৃত গৌরব প্রদর্শনের যোগ্য ব্যক্তি।

لهف نفسي على بقائك عمرو - اسلمتك الأعمار للاقدار

অর্থাৎ, হায় আমার আক্ষেপ হে আমর! তোমার বেঁচে থাকার জন্যে আয়ু তোমাকে নিরাপদ রেখেছে তোমার ভাগ্যের লিখন ভোগ করার জন্যে।

ولعمري لو لم ترمه بغدر - رمت ليثا كصارم بتار

অর্থাৎ, আমার জীবনের কসম, যদি বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত স্বাভাবিকভাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে তবে তুমি সম্মুখীন হতে এক দুঃসাহসী সিংহের যে ধারাল তরবারির মত কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়।

আমর বলেন, তার কথায় আমি রেগে যাই। আমি আমার তরবারি কোষমুক্ত করি এবং তাকে খুন করার জন্যে তাঁবুতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু তাঁবুতে কাউকেই খুঁজে পেলাম না। অতঃপর সেখানকার পশুগুলো নিয়ে আমি আমার বাড়ি ফিরে আসি।

এটি একটি বিস্ময়কর বর্ণনা বটে। স্পষ্টত বোঝা যায় যে, ওই বৃদ্ধ লোকটি একজন জিন ছিলেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি কুরআন শিক্ষা করেছলেন। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ তার জানা ছিল। এই কলেমার দ্বারা তিনি বিপদ থেকে আশ্রয় কামনা করতেন। খারাইতি বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ বলভী আসমা বিনতে আবু বকর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল এবং ওয়ারাকা ইবন নাওফল সম্পর্কে কথিত আছে যে, তারা দুজনে বাদশাহ্ নাজাশী-এর দরবারে গিয়েছিলেন। এটি হলো আবরাহা বাদশাহের মক্কা ত্যাগের পরের ঘটনা। তাঁরা বলেন, আমরা তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘হে কুরায়শদ্বয়! আপনারা সত্যি করে বলুন তো আপনাদের মধ্যে এমন কোন শিশুর জন্ম হয়েছি কি না যার পিতা তাকে জবাই করতে চেয়েছিলেন? জবাই করার জন্যে নিশ্চয়তা লাভের উদ্দেশ্যে লটারি দেওয়া হলে ওই শিশুটি বেঁচে যায় এবং তার পরিবর্তে প্রচুর উট কুরবানী দেওয়া হয়।’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত ওই লোকটির কি হলো?’ আমরা বললাম, ‘সে আমিনা বিনত ওহাব নামের এক মহিলাকে বিয়ে করেছে এবং তাকে অন্তঃসত্ত্বা রেখে সফরে বেরিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘ওর কোন ছেলেমেয়ে জন্মেছে কিনা?’

ওয়ারাকা ইবন নাওফাল বললেন, ‘জাঁহাপনা! সে সম্পর্কে আমি আপনাকে বলছি শুনুন। একরাতে আমি আমাদের এক মূর্তির পাশে রাত কাটাই। আমরা ওই মূর্তির তাওয়াফ ও উপাসনা করতাম। হঠাৎ আমি তার উদর থেকে শুনতে পাই, সে বলছে,

ولد النبي فزلت الأملاك - ونای الضلال وأدبر الاشتراك

অর্থাৎ, নবী জন্মগ্রহণ করেছেন, রাজা-বাদশাহগণ লাঞ্ছিত হয়েছে। গোমরাহী বিদূরিত হয়েছে এবং শিরক পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়েছে। এতটুকু বলে মূর্তিটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

এবার যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল বললেন, ‘জাঁহাপনা! এ বিষয়ে আমারও কিছুটা জানা আছে।’ নাজাশী বললেন, ‘বলুন!’ যায়দ ইবন আমর বলতে লাগলেনঃ ‘উনি যে রাতের ঘটনা বলেছেন ওই রাতেই আমি আমার বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। আমার পরিবারের লোকেরা তখন আমিনার গর্ভের সন্তান সম্পর্কে আলোচনা করছিল। আমি আবু কুবায়স পাহাড়ে এসে উঠি। উদ্দেশ্য ছিল যে বিষয়টি নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম সে বিষয়ে নির্জনে চিন্তা-ভাবনা করব। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম, একজন লোক আকাশ থেকে কুবায়স পাহাড়ের ওপর অবতরণ করল, তার দুটো সবুজ পাখা। সে মক্কা নগরীর দিকে তাকিয়ে বলল, শয়তান লাঞ্ছিত হয়েছে, মূর্তি-প্রতিমা বাতিল ও অকার্যকর হয়েছে এবং বিশ্বাসভাজন আল-আমীন জন্মগ্রহণ করেছেন। এরপর তার সাথে থাকা একটি কাপড় সে পূর্ব দিগন্তে ও পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল। আমি দেখলাম ওই কাপড়ে আকাশের নিচের সব কিছু ঢেকে গিয়েছে এবং এমন একটি জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়েছে যে, আমার দৃষ্টি শক্তি যেন ছিনিয়ে নেবে। এ দৃশ্য দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। এই আগন্তুক ডানা মেলে উড়ে গিয়ে কাবা গৃহের উপর নামে আর তার দেহ থেকে এমন আলো ছড়িয়ে পড়ে যে, সমগ্র তেহামা অঞ্চল আলোকিত হয়ে যায়। সে বলল, এবার ভূমি পবিত্র হলো এবং তার বসন্তকাল শুরু হলো। কা’বা গৃহে অবস্থিত মূর্তিগুলোর প্রতি সে ইঙ্গিত করল আর সাথে সাথে সবগুলো মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।’

নাজাশী বললেন, ‘হায়! আপনারা এবার এ বিষয়ে আমি যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি তা শুনুন। আপনারা যে রাতের কথা বলেছেন সে রাতে আমি আমার নির্জন প্রকোষ্ঠে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি মাটি ফাঁক করে একটি ঘাড় ও মাথা বেরিয়ে এলো। সে বলছিল, হস্তী বাহিনীর ওপর ধ্বংস কার্যকর হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবীল ওদের প্রতি পাথরের কংকর নিক্ষেপ করেছে। হারাম শরীফের ইজ্জত বিনষ্টকারী ও দম্ভ প্রদর্শনকারী আশরাম [আবরাহার পূর্ণ নাম আবরাহাতুল আশরাম বা ঠোঁট কাটা আবরাহা ছিল] নিহত হয়েছে। মক্কা ও হারাম শরীফের অধিবাসী উম্মী নবী জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর আহ্বানে যে সাড়া দেবে সে ভাগ্যবান হবে, আর যে প্রত্যাখ্যান করবে সে ধ্বংস হবে। এতটুকু বলে ওই মাথাটি জমীনের নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। এদৃশ্য দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করছিলাম কিন্তু আমি কোন কথা উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। আমি দাঁড়াতে চেয়েছিলাম কিন্তু দাঁড়াতে পারিনি। এবার আমি স্বহস্তে আমার নির্জন প্রকোষ্ঠের পর্দাগুলো ছিড়ে ফেলি। আমার পরিবারের লোকেরা তা শুনতে পায় এবং আমার নিকট আসে। আমার দৃষ্টিসীমা থেকে হাবশী লোকদেরকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে আমি নির্দেশ দেই। তারা ওদেরকে সরিয়ে দেয়। এরপর আমার মুখ ও পা জড়তা মুক্ত হয়।’

পারস্য সম্রাট কিসরার রাজপ্রাসাদের ১৪টি চূড়া নিচে পড়ে যাওয়া, তাদের পূজার অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়া তাদের দু’জন বিজ্ঞ ব্যক্তির স্বপ্ন এবং সাতীহ-এর বক্তব্য ‘আবদুল মসীহ-এর হাতে’ এর ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মগ্রহণ বিষয়ক অধ্যায়ে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ্।

ইবন আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হারিছ ইবন হানী-এর জন্ম বৃত্তান্তে যমল ইবন আমর আল্-আদাবীর বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বলেছেন, বানু আযরা গোত্রের একটি প্রতিমা ছিল। সেটির নাম ছিল সাম্মাম। তারা এর ভক্ত ছিল। সেটি অবস্থিত ছিল বানু হিন্দ ইবন হারাম ইবন দুব্বা ইবন আবদ ইবন কাছীর ইবন আযরা গোত্রের এলাকায়। তারিক নামের এক লোক তার সেবায় ছিল। তারা ওই প্রতিমার নিকট পশু বলি দিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন আবির্ভূত হলেন তখন আমরা একটি শব্দ শুনলাম। ওই মূর্তি বলছে, ‘হে বানু হিন্দ ইবন হারাম গোত্র! সত্য প্রকাশিত হয়েছে, হাম্মাম মূর্তি ধ্বংস হয়েছে। ইসলাম ধর্ম এসে শিরক বিদূরিত করে দিয়েছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে আমরা সবাই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা ভয় পেয়ে যাই। এ অবস্থায় কয়েক দিন অতিবাহিত হয়। এরপর আমরা পুনরায় শুনতে পাই ওই মূর্তিটি বলছেঃ ‘হে তারিক! হে তারিক! সত্যবাদী নবী প্রেরিত হয়েছেন বক্তব্য সম্বলিত ওহী সহকারে, তিহামা অঞ্চলে এক ঘোষক ঘোষণা দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহায্যকারিগণের জন্যে রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা আর তাঁর প্রতি অবাধ্য যারা তাদের জন্যে রয়েছে অপমান ও অনুশোচনা। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের নিকট থেকে আমার বিদায়।

যমল বলেন, অতঃপর মূর্তিটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। এরপর আমি একটি সওয়ারী ক্রয় করি এবং সেটির পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করি। অবশেষে আমার সম্প্রদায়ের কতগুলো লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হই। তখন তাঁর উদ্দেশে আমি এই কবিতা আবৃত্তি করি,

اليك رسول الله أعملت نصها - وكلفتها حزنا و غورا من الرمل

অর্থাৎ, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এই উষ্ট্রীকে আমি আপনার নিকট দ্রুত চালিয়ে এনেছি এবং পাথুরে শক্তভূমি ও নিচু বালুকাময় প্রান্তর অতিক্রম করে তাকে আসতে বাধ্য করেছি।

لأنصر خير الناس نصرا موزرا - واعقد حبلا من حبالك في حبلى

অর্থাৎ, এ উদ্দেশ্যে যে, আমি শ্রেষ্ঠতম মানুষটিকে দৃঢ়তার সাথে সাহায্য করব এবং আপনার রশিগুলোর সাথে আমার রশিকে গ্রথিত করে দেবো।

وأشهد أن الله لا شيئ غيره - أدين به ما اثقلت قدمی نعلی

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন আমি এই দীন অনুসরণ করব।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমি ইসলাম গ্রহণ করি এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে বাইআত করি। আমি ইতিপূর্বে প্রতিমাটির মুখ থেকে যা শুনেছিলাম তা তাঁকে জানাই। তিনি বললেন, ‘এটি জিনের উক্তি।’ এরপর তিনি বললেন, ‘হে আরব সম্প্রদায়! আমি তোমাদের প্রতি এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহর রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি। আমি সকলকে আল্লাহর আনুগত্য ও তার একত্ববাদের প্রতি আহ্বান করছি। আমি তাঁর বান্দা ও রাসূল। তোমরা আল্লাহর ঘরে হজ্জ করবে, বার মাসের মধ্যে এক মাস তথা রমযান মাসের রোযা রাখবে। যে ব্যক্তি আমার ডাকে সাড়া দেবে তার আতিথ্যের জন্যে থাকবে জান্নাত আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্য হবে, তার আবাসস্থল রূপে থাকবে জাহান্নাম।’

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করি এবং রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের জন্যে একটি পতাকা বেঁধে দেন। তিনি আমাদের পক্ষে একটি সনদপত্র লিখে দেন।

তাতে লেখা ছিলঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর পক্ষ থেকে যুসল ইবন আমর ও তার সাথে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের প্রতি প্রদত্ত। আমি তাকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি নেতারূপে প্রেরণ করলাম। যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করবে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দলভুক্ত হবে আর যে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে তার জন্যে মাত্র দু’মাস মেয়াদের নিরাপত্তা থাকবে। এ বর্ণনার সাক্ষী থাকেন হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা) ও মুহাম্মদ ইবন মাসলামা আনসারী। ইবন আসাকির এটিকে গরীব তথা অত্যন্ত বিরল বর্ণনা বলে মন্তব্য করেছেন।

সাঈদ ইবন ইয়াহয়া ইবন সাঈদ উমাভী তাঁর ‘মাগাযী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তার চাচা মুহাম্মদ ইবন সাঈদ....... ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একটি জিন আবু কুবায়স পাহাড়ের উপর থেকে চিৎকার দিয়ে বলেছিল,

قبح الله رأيكم أل فهر - ما أدق العقول والأفهام

অর্থাৎ, হে ফিহরের বংশধরগণ! আল্লাহ তোমাদের অভিমতকে শ্রীহীন করে দিন। তোমাদের বিবেক-বিবেচনা কতই না ক্ষীণ!

حين كقصى لمن يعيب عليها - دين ابائها الحماة الكرام

অর্থাৎ, যখন তোমরা অবাধ্য হচ্ছো সেই ব্যক্তির, যে এতদঞ্চলে তার সম্মানিত ও মর্যাদাবান পূর্ব পুরুষদের ধর্মকে দোষারোপ ও সমালোচনা করেছে।

حالف الجن جن بصری علیكم - ورجال الخيل والأطام

অর্থাৎ, সে তো তোমাদের বিরুদ্ধে জিনদের সাথেও মৈত্রী চুক্তি করেছে। ওরা ছিল বুসরা অঞ্চলের জিন। সে খেজুর বাগান সমৃদ্ধ এবং পাথরের তৈরি দুর্গের অধিবাসীদের সাথেও মৈত্রী বন্ধন স্থাপন করেছিল।

توشك الخيل أن تردها تهادى - تقتل القوم في حرام بهام

অর্থাৎ, অবিলম্বে অশ্বদল ক্ষিপ্র গতিতে এতদঞ্চলে প্রবেশ করবে এবং হারাম শরীফ এলাকায় নিজ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করবে।

هل كريم منكم له نفس حر - ماجد الوالدين والأعمام

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে এমন কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আছে কি, যার মধ্যে স্বাধীন মানুষের আত্মা ও মন-মানসিকতা আছে, যার পিতৃকুল-মাতৃকুল সম্ভ্রান্ত?

ضارب ضربة تكون نكالا - ورواحا من گربة واغتمام

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে প্রচণ্ড আঘাত হানার ও আক্রমণ করার কোন লোক আছে কি? যার আক্রমণ হবে ওদের জন্যে উপযুক্ত শাস্তি? যার আঘাত এ সম্প্রদায়কে সকল দুঃখ-কষ্ট ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবে?

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, অতঃপর এই কবিতাটি মক্কাবাসীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। তারা এটি আবৃত্তি করতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এ হলো এক শয়তান, মানুষকে মূর্তিপূজার দিকে ডাকছে। তার নাম মিসআর। আল্লাহ্ তাকে লাঞ্ছিত করবেনই।” এ অবস্থায় তিনদিন অতিবাহিত হয়। তখন শোনা গেল যে, জনৈক অদৃশ্য ঘোষণাকারী ঐ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে,

نحن قتلنا في ثلث مسعرا - اذسقه الجن وسن المنكرا

অর্থাৎ, তিন দিনের মধ্যেই আমরা মিসআরকে খুন করে ফেলেছি। যখন সে জিন জাতিকে মূর্খ বলে সাব্যস্ত করেছে এবং একটি মন্দ পথের সূচনা করেছে।

قنعته سینفا حساما مشهرا - بشتمه نبينا المطهرا

অর্থাৎ, একটি তীক্ষ্ণধার নাঙ্গা তরবারি দ্বারা আমি তার ঘাড়ে আঘাত করেছি। কারণ সে আমাদের পুত-পবিত্র নবীকে গালি দিয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘এটি হলো এক শক্তিশালী জিন। তার নাম সামাজ। সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে, আমি তার নাম রেখেছি আবদুল্লাহ। ইতিপূর্বে সে জানিয়েছিল যে, তিনদিন যাবত সে ঐ দুষ্ট জিনটিকে খুঁজছিল।’ তখন হযরত আলী (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ্ তা’আলা তাকে উত্তম প্রতিফল দান করুন।’

হাফিজ আবু নুআয়ম ‘আদ-দালাইল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ ...., হযরত সাদ ইবন উবাদা (রা) সূত্রে বলেছেন, হিজরতের পূর্বে কোন এক সময়ে একটি কাজে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ‘হাদ্রামাওতে’ পাঠিয়েছিলেন। পথে রাত হয়ে যায়। রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর আমি এক অদৃশ্য ঘোষকের ঘোষণা শুনতে পাই। সে বলছিল,

أبا عمرو ناوبني السهو - وراح النوم وامتنع الهجور

অর্থাৎ, হে আবু আমর! নিদ্রাহীনতার বিপদ তো আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার নিদ্রা পালিয়েছে। এবং আমার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে।

لذكر عصابة سافوا و بادوا - وكل الخلق قصرهم يبياد

অর্থাৎ, আমি স্মরণ করছি সে সকল লোকের কথা, যারা ইতিপূর্বে ছিল এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যে কেউ তাদেরকে খাটো করবে, সে নিশ্চিত ধ্বংস হবে।

تولوا واردين الى المنايا - حياضا ليس بنهلها الوردور

অর্থাৎ, মৃত্যুর ঘাটে অবতরণ করে তারা চলে গিয়েছেন। তাঁরা গিয়েছেন এমন কূয়োতে, সেখানে অবতরণ করা পানি পানের জন্যে নয়।

مضوا لسبيلهم وبقيت خلفا وحيدا ليس يسعفني وحي د

অর্থাৎ, তাঁরা তাঁদের পথে চলে গিয়েছেন আর আমি একা পেছনে পড়ে রয়েছি। কেউই এখন আমাকে সাহায্য-সহায়তা করছে না।

سدي لا أستطيع علاج أمر - اذا ما عالج الطفل الوليد

অর্থাৎ, আমি এখন বেকার। কোন কিছুরই প্রতিবিধান করার ক্ষমতা আমার নেই। অথচ ছোট ছোট শিশু-কিশোররা পর্যন্ত সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছে।

فلايا مابقيت الى أناس - وقد باتت بمهلكها ثمود

অর্থাৎ, মানব সমাজে আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার জীবন দুর্বিষহ ও সংকটময় থাকবে। সামুদ গোত্র তো তাদের ধ্বংসস্থলে রাত্রিযাপন করেছিল।

وعاد والقرون بذى شعوب - سواء كلهم ارم حصيد

অর্থাৎ, তেমনিভাবে ধ্বংস হয়েছে আদ সম্প্রদায় এবং গিরিপথে বসবাসকারী কতক জনপদ। ওরা সবাই ক্ষত-বিক্ষত ও বিধ্বস্ত ইরাম সম্প্রদায়ের পর্যায়ভুক্ত।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর অন্য একজন চিৎকার করে বলতে শুরু করে। ‘হে সুদর্শন পুরুষ! তোমার চমৎকারিত্ব ও সৌন্দর্যের দিন ফুরিয়ে গিয়েছে। সকল সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্ব এখন যাহরা ও ইয়াসরিবের মধ্যবর্তী স্থানে।’ অপরজন বলল, ‘হে দুর্বল ব্যক্তি! সেটি কি?’ উত্তরে সে বলল, ‘শান্তির নবী, কল্যাণকর বাণী নিয়ে সমগ্র জগতের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন। অতঃপর তাঁকে হারাম শরীফ থেকে বের করে খর্জুর বীথি ও পাথর-নির্মিত গৃহাঞ্চলের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।’ অন্যজন বলল, ‘ওই নাযিলকৃত কিতাব, প্রেরিত নবী এবং মর্যাদাবান উম্মী নবীর পরিচয় কি?’ উত্তরে সে বলল, ‘তিনি হলেন লুওয়াই ইবন গালিব ফিহর ইবন মালিক ইবন নাদর ইবন কিনানা-এর বংশধর।

সে বলল, দূরে অনেক দূরে তার তুলনায় আমি তো অনেক বুড়িয়ে গিয়েছি। তার যুগের তুলনায় আমার যুগ অতীত হয়ে গিয়েছে। আমি তো দেখেছি যে, আমি আর নাদর ইবন কিনানা দুজনে একই লক্ষ্যবস্তুতে তীর নিক্ষেপ করেছি। আমরা একই সাথে ঠাণ্ডা দুধ পান করেছি। একদিন রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে এক প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিকট থেকে আমি আর সে এক সাথে বের হই। সূর্যোদয়ের সময় সে বেরিয়ে পড়ে এবং সূর্যাস্তের সময় ঘরে ফিরে যায়। এ সময়ে সে যা যা শুনেছে তার সবই বর্ণনা করেছে এবং যা কিছু দেখেছে তার সবই স্মরণ রেখেছে। আলোচ্য ব্যক্তি যদি নাদর ইবন কিনানা-এর বংশধর হন, তবে তরবারি এখন কোষমুক্ত হবে, ভয়ভীতি দূরীভূত হবে, ব্যভিচার নির্মূল হবে এবং সুদ মূলোৎপাটিত হবে। সে বলল, ঠিক আছে পরবর্তীতে কী ঘটবে সে সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন! উত্তরে সে বলল, দুর্দশা, দুর্ভিক্ষ এবং দুঃসাহসিকতা বিদূরিত হবে তবে খুযাআ গোত্রে তার কিছুটা অবশিষ্ট থাকবে। দুঃখ-কষ্ট এবং মিথ্যাচার বিলীন হয়ে যাবে। তবে খাযরাজ ও আওস গোত্রে তার কিছুটা অবশিষ্ট থাকবে। অহংকার, দাম্ভিকতা, পরনিন্দা ও বিশ্বাসঘাতকতা নির্মূল হবে। তবে বানু বাকর তথা হাওয়াযিন গোত্রে তার কিছুটা অবশিষ্ট থাকবে। লজ্জাকর কর্মগুলো এবং পাপাচারমূলক কাজসমূহ অপসৃত হবে। তবে খাছ’আম গোত্রে কিছুটা তার অবশিষ্ট থাকবে। সে বললঃ অতঃপর কি ঘটবে সে সম্পর্কে কিছু বলুন!’ উত্তরে সে বলল, ‘জংলী লোকেরা যখন বিজয় লাভ করবে আর হাররা অঞ্চল যখন নিস্তেজ হয়ে যাবে তখন তুমি হিজরত নগরী মদীনা থেকে বেরিয়ে যাবে। আর সালাম বিনিময় প্রথা যখন রহিত হবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তখন মক্কা শরীফ থেকে বেরিয়ে যাবে।’

সে বলল, ‘আরো কিছু বলুন।’ উত্তরে সে বলল, ‘কান যদি না শুনত আর চোখ যদি ঝলমল করে না উঠত তবে আমি তোমাকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিতাম যা শুনে তুমি অস্থির ও বিচলিত হয়ে পড়তে।’ এরপর সে বলল,

لا منام هدأته بنعيم - يا ابن غوط ولا صباح أتانا

অর্থাৎ, হে ইবন গাওত! শান্তির ঘুম তুমি আর ঘুমাতে পারবে না। সুপ্রভাত আর কোনদিন আমাদের নিকট আসবে না।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর সে এমন প্রচণ্ড আর্তচিৎকার করল, সেটি যেন গর্ভবতী মহিলার প্রসবকালীন আর্তচিৎকার। ক্রমান্বয়ে ভোর হলো। আমি গিয়ে দেখি একটি মৃত গুইসাপ ও একটি মৃত সাপ। বর্ণনাকারী বলেন, এ থেকেই আমি আঁচ করতে পারি যে রাসূলুল্লাহ (সা) ইতিমধ্যেই মদীনা শরীফ হিজরত করেছেন।

মুহাম্মাদ ইবন জাফর - সাদ ইবন উবাদাহ্ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আকাবার শপথের রাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে বায়’আত করার পর আমি বিশেষ প্রয়োজনে হাদ্রামাওত অঞ্চলের দিকে রওয়ানা করি। যথারীতি প্রয়োজন সেরে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। পথেই আমার ঘুম পায়! গভীর রাতে এক বিকট চিৎকারে আমি ভড়কে যাই। আমি শুনতে পাই এক চিৎকারকারী চিৎকার করে বলছে,

أبا عمرو ناوبني السهور - وراح النوم واز قطع الهجور

অর্থাৎ, হে আবু আমর! আমাকে নিদ্রাহীনতার বিপদ পেয়ে বসেছে। আমার নিদ্রা পালিয়েছে এবং শয়ন হারাম হয়ে গেছে। এরপর সে উপরোল্লিখিত দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করে।

আবু নুআয়ম বলেন, মুহাম্মাদ ইবন জাফর তামীম আদ্দারী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন নবুওত লাভ করেন, তখন আমি সিরিয়াতে অবস্থান করছিলাম। এক জরুরী কাজে আমি পথে বের হই। এ অবস্থায় রাত হয়ে যায়। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী আমি বলি, এ রাতে এ প্রান্তরের নেতৃস্থানীয় জিনের আশ্রয়ে আমি নিজেকে সোপর্দ করলাম। অতঃপর আমি যখন নিদ্রামগ্ন হই তখন স্বপ্নে দেখি এক ঘোষককে। ইতিপূর্বে কখনো আমি তাকে দেখিনি। সে বলছে, “তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। কারণ আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কোন জিন কাউকে আশ্রয় দিতে পারবে না।” আমি বললাম, “হায়! আল্লাহর কসম, আপনি এ কী বলছেন?” সে বলল, ‘আল-আমীন আল্লাহর রসূলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। হাজুন অঞ্চলে আমরা তার পেছনে নামায পড়েছি। অতঃপর আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমরা তার আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। জিনদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে এবং তাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তুমি এখনি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর নিকট যাও এবং ইসলাম গ্রহণ কর।

বর্ণনাকারী তামীম আদদারী (রা) বলেন, সকাল বেলা আমি দীরুই আইয়ুব নামক উপাসনালয়ে জনৈক ইহুদী ধর্মযাজকের সাথে সাক্ষাত করি এবং তাঁকে উক্ত ঘটনা অবহিত করি। তিনি বললেন, ‘ওরা তোমাকে যথার্থই বলেছে। ওই নবী আবির্ভূত হওয়ার কথা মক্কার হারম শরীফে। তার হিজরত স্থল মদীনার হারম শরীফ। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সুতরাং তুমি অতি শীঘ্র তাঁর নিকট উপস্থিত হও।’ তামীম (রা) বলেন, অতঃপর আমি এ শহর থেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশে রওয়ানা করি এবং তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করি।

হাতিম ইবন ইসমাঈল...... সাইদা হুযালী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, একদিন আমরা আমাদের প্রতিমা সুওয়া-এর নিকট ছিলাম। আমাদের রোগাক্রান্ত দু’শটি বকরী আমরা তখন তার নিকট বরকত লাভের জন্যে উপস্থিত করি। উদ্দেশ্য ছিল সেগুলোর রোগমুক্তি। তখন আমি শুনতে পাই যে, এক ঘোষক ওই মূর্তির পেট থেকে বলছে, “জিনদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, আমাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব হচ্ছে একজন নবীর কারণে। তার নাম মুহাম্মদ (সা)।’ তখন আমি বললাম, ‘আল্লাহর কসম, আমি তো ভুল স্থানে এসে পড়েছি।’ অতঃপর আমি বকরীর পাল নিয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ির দিকে যাত্রা করি। পথে এক ব্যক্তির সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সে আমাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের কথা জানায়। আবু নুআয়ম বর্ণনাটি এভাবেই সনদ ছাড়া উল্লেখ করেছেন।

এরপর আবু নুআয়ম বলেনঃ উমর ইবন মুহাম্মাদ .......রাশেদ ইবন আবদ রাব্বিহী সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সুওয়া নামের মূর্তিটি অবস্থিত ছিল মুআল্লাত নামক স্থানে। হুযায়ল ও বানু যফর ইবনে সুলায়ম গোত্রের লোকজন এটির পূজা করত। একদিন সুলায়ম গোত্রের পক্ষ থেকে কিছু উপঢৌকন দিয়ে বানু যফর গোত্রের লোকেরা রাশেদ ইবন আবদ রাব্বিহীকে সুওয়া প্রতিমার নিকট প্রেরণ করে। রাশেদ বলেন, সুওয়া প্রতিমার নিকট পৌঁছার পূর্বে পথিমধ্যে ভোরবেলা আমি অন্য এক প্রতিমার নিকট পৌঁছি। হঠাৎ আমি শুনতে পাই, এই প্রতিমার পেট থেকে একজন যেন চিৎকার করে বলছে, ‘অবাক কাণ্ড! অবাক কান্ড! আবদুল মুত্তালিবের বংশ থেকে এক নবী আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি ব্যভিচার, সুদ এবং মূর্তির উদ্দেশ্যে বলিদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তার আগমনে আকাশকে সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছে এবং আমাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হচ্ছে। হায়রে আশ্চর্য ব্যাপার! ভীষণ আশ্চর্য ব্যাপার!’ এরপর অন্য একটি প্রতিমার পেট থেকে একজন চিৎকার করে বলতে শুরু করল, “দাম্মার প্রতিমা পরিত্যক্ত হয়েছে, সেটির তো উপাসনা করা হতো। নবী আহমদ (সা) আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি নামায পড়েন, যাকাত দান ও রোযা পালনের নির্দেশ দেন এবং পুণ্যকাজ ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চলার নির্দেশ দেন।’ এরপর অপর একটি প্রতিমার পেট থেকে অন্য একজন চিৎকার দিয়ে বললঃ

ان الذي ورث النبوة والهدى - بعد ابن مريم من قريش مهتد

অর্থাৎ, মারয়াম পুত্র ঈসা (আ)-এর পর কুরায়শ বংশের যিনি নবুওত ও হেদায়ত করার দায়িত্ব পেয়েছেন নিশ্চয়ই তিনি সৎপথ প্রাপ্ত হয়েছেন।

نبى أتى يخبر بما سبق - وبما يكون اليوم حقا أو غد

অর্থাৎ, সেই নবী আগমন করেছেন, অতীতে ঘটে যাওয়া এবং ভবিষ্যতে ঘটিতব্য সকল বিষয়ের যথার্থ সংবাদ নিয়ে।

রাশেদ বলেন, ভোরবেলা আমি ‘সুওয়া প্রতিমার নিকট যাই। সেখানে দেখতে পাই যে, দুটো শেয়াল তার চারদিকে জিভ দিয়ে চাটছে, তার উদ্দেশে নিবেদিত নৈবেদ্যগুলো খেয়ে ফেলছে এবং ওই প্রতিমার গায়ে পেশাব করে তার ওপর হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। এ অবস্থায় রাশেদ বললেনঃ

ارب يبول الثعلبان برأسه - لقدذل من بالت عليه الثعالب

অর্থাৎ, হায়! এটি কেমন দেবতা যার মাথায় দু’দুটো শেয়াল পেশাব করছে? যার গায়ে শেয়াল পেশাব করে তার জন্য সে তো নিশ্চিতভাবে লাঞ্ছিত।

এ ঘটনা ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মদীনায় হিজরত কালে। লোকজন তখন তাঁর আগমন সম্পর্কে পরস্পর আলাপ-আলোচনা করছিল। রাশেদ তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং মদীনায় এসে তার সাথে সাক্ষাত করেন। তার সাথে কিন্তু তার পোষা কুকুরটিও ছিল। তখন রাশেদের নাম ছিল যালিম আর কুকুরের নাম ছিল রাশেদ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে তার নাম জিজ্ঞেস করেন। তিনি বললেন, তার নাম যালিম। এবার তিনি তার কুকুরের নাম জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, কুকুরের নাম রাশেদ। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘না, বরং তোমার নাম রাশেদ আর কুকুরের নাম যালিম।’ এ বলে তিনি মুচকি হাসলেন। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে বায়’আত হন এবং তার সাথে কিছুদিন মক্কায় অবস্থান করেন। পরবর্তীতে ওয়াহাত অঞ্চলের একখণ্ড জমি তার নামে বরাদ্দ দেয়ার জন্যে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আবেদন করেন। সংশ্লিষ্ট জমির বর্ণনাও তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ওয়াহাত ভূখণ্ডের উঁচু অংশ তার নামে বরাদ্দ দেন। বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ হলো পরপর তিনবার পাথর নিক্ষেপের শেষ সীমানা পর্যন্ত। তিনি তাকে একটি পানি ভর্তি পাত্র দান করলেন। তাতে তিনি ফু দিয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন যে, এ পানি জমির উপরিভাগে ঢেলে দিবে আর অতিরিক্ত পানি নিতে লোকজনকে বাধা দেবে। তিনি তাই করলেন। ওই পানি সদা প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হয়। আজও সেটি প্রবহমান রয়েছে। তিনি ওই জমিতে খেজুর বাগান করেছিলেন। কথিত আছে যে, ওই পানি থেকে সমগ্র অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হতো। লোকজন ওই অঞ্চলকে “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পানির এলাকা” নামে আখ্যায়িত করতো। ওয়াহাতের অধিবাসীরা ওখানে গিয়ে গোসল করতো। রাশেদের নিক্ষিপ্ত পাথর রাকাব অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছে। ওই অঞ্চল “রাকাব আল হাজার” নামে পরিচিত। পরবর্তীতে রাশেদ উক্ত সুওয়া প্রতিমার নিকট যান এবং সেটিকে ভেঙে ফেলেন।

আবু নু’আয়ম বলেন, সুলায়মান ইব্‌ন আহমদ আমর ইবন মুররা আল জুহানী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন জাহেলী যুগের ঘটনা। আমার সম্প্রদায়ের কতক লোক নিয়ে আমি হজ্জ করতে যাই। একরাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখি। তখন আমি মক্কায় অবস্থান করছিলাম।

আমি দেখি একটি উজ্জ্বল জ্যোতি কা’বা গৃহ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে এবং সুদূর ইয়াসরিবের পাহাড়গুলো ও জুহায়না গোত্রের জঙ্গল পর্যন্ত আলোকিত করে তুলছে। ওই জ্যোতির মধ্যে আমি শুনতে পেলাম যে, সে বলছে, অন্ধকার কেটে গিয়েছে আলো ছড়িয়ে পড়ছে, শেষ নবী প্রেরিত হয়েছেন। এরপর পুনরায় জ্যোতি ছড়িয়ে পড়লো। ওই জ্যোতিতে আমি হীরা নগরীর রাজপ্রাসাদসমূহ এবং মাদাইন নগরীর শুভ্রতা স্পষ্ট দেখতে পাই। ওই জ্যোতির মধ্যে আমি শুনতে পাই কে যেন বলছে, ‘ইসলাম প্রকাশিত হয়েছে, মূর্তি প্রতিমা ভেঙে গিয়েছে, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষিত হয়েছে।’ এস্বপ্ন দেখে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সজাগ হয়ে যাই। আমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ডেকে বলি যে, আল্লাহর কসম এ কুরায়শ গোত্রে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা ঘটবে। আমি যা দেখেছি তাদের নিকট তা প্রকাশ করি।

আমরা যখন আমাদের দেশে ফিরে আসি তখন একজন লোক আমাদের নিকট আসেন এবং আমাদেরকে বলেন যে, আহমদ নামে এক ব্যক্তি রাসূলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তখন আমি তাঁর নিকট গিয়ে আমার স্বপ্নের কথা তাঁকে বলি। তিনি বললেন, ‘হে আমর ইবন মুররা! আমিই রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি সমগ্র মানবকুলের প্রতি। আমি তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করি। পরস্পর খুনোখুনি ও রক্তপাত বন্ধ করা, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা, আল্লাহর ইবাদত করা, মূর্তিপূজা বর্জন করা, বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ করা এবং বার মাসের মধ্যে এক মাস অর্থাৎ রমযান মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দেই। আমার আহ্বানে যে সাড়া দিবে সে জান্নাত পাবে। যে আমার অবাধ্য হবে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নাম। হে আমর ইবন মুররা! তুমি ঈমান আনয়ন কর, আল্লাহ্ তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।’

أشهد أن لا اله الا الله و انك رسول الله

তখন আমি বললাম, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আপনিই আল্লাহর রাসূল। আপনি হালাল হারাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন আমি তার সবই সত্য বলে বিশ্বাস করলাম— যদিও তাতে বহু মানুষ অসন্তুষ্ট হয়। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখে কবিতার কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করি। এগুলো আমি তখনই রচনা করেছিলাম যখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের সংবাদ শুনেছিলাম। আমাদের একটি প্রতিমা ছিল। আমার পিতা ছিলেন সেটির সেবায়েত। আমি তখন প্রতিমাটির দিকে এগিয়ে যাই এবং সেটি ভেঙে ফেলি। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হই। আমি এ কবিতা তার সম্মুখে আবৃত্তি করি,

شهدت بأن الله حق وانني - لآلهة الأحجار اول تارك

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ তা’আলা সত্য এবং পাথরের তৈরি উপাস্যগুলোকে আমিই প্রথম বর্জনকারী।

قشمرت عن ساقی از ار مهاجر - اليك ادب التمور بعد الدكادك

অর্থাৎ, আপনার প্রতি হিজরত করার মানসে আমি আমার লুঙ্গি পায়ের গোছার ওপর গুটিয়ে ফেলি। আমার দ্রুতগামী ঘোড়াকে আমি ধুলা উড়িয়ে ছুটিয়ে আপনার নিকট নিয়ে আসি।

لأصحب خير الناس نفسا ووالدا - رسول مليك الناس فوق الحبائك

অর্থাৎ, আমি রওয়ানা করেছি যিনি ব্যক্তিগত ও বংশগতভাবে শ্রেষ্ঠতম মানুষ তাঁর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে। ঊর্ধ্ব জগতে আসীন মানব জাতির মালিক মহান আল্লাহর তিনি রাসূল।

তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “মারহাবা হে আমর ইবন মুররা! তোমার প্রতি সাদর অভিনন্দন!’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কুরবান হোক! আপনি আমাকে দায়িত্ব দিয়ে আমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করুন। হতে পারে, আল্লাহ্ তাআলা আমার মাধ্যমে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন- যেমন আপনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) সত্যি সত্যি আমাকে ওদের প্রতি পাঠালেন। আমাকে উপদেশ দিয়ে তিনি বললেন, অবশ্যই সদা সত্য ও সঠিক কথা বলবে। রুক্ষ, অহংকারী এবং হিংসাপোষণকারী হবে না। আমার সম্প্রদায়ের নিকট আমি গমন করি। আমি তাদেরকে ডেকে বলি, ‘হে বনী রিফা’আ সম্প্রদায়! হে বনী জুহায় সম্প্রদায়! আমি রাসূল (সা)-এর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরূপে তোমাদের কাছে এসেছি। আমি তোমাদেরকে জান্নাতের দিকে আহ্বান করছি এবং জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করছি। আমি তোমাদেরকে রক্তপাত বন্ধ করা, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা, আল্লাহর ইবাদত করা, মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করা, বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্জ করা এবং বার মাসের মধ্যে এক মাস অর্থাৎ রমযান মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দিচ্ছি। যে ব্যক্তি আমার ডাকে সাড়া দিবে সে জান্নাত পাবে আর যে ব্যক্তি তা অমান্য করবে তার জন্যে রয়েছে জাহান্নাম। হে জুহায়না সম্প্রদায়! সকল প্রশংসা আল্লাহর। তোমরা যে বংশের অন্তর্ভুক্ত, সে বংশের মধ্যে তিনি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ গোত্রের মর্যাদা দিয়েছেন। জাহেলী যুগে অন্যদের নিকট যে সকল পাপাচারিতা ও অশ্লীলতা প্রিয় ছিল, তিনি সেগুলো তোমাদের নিকট অপ্রিয় সাব্যস্ত করে দিয়েছেন। অন্যরা তো দু’বোনকে একত্রে বিয়ে করত, পুত্রকে তার পিতার স্ত্রীর মালিকানা দিত এবং সম্মানিত মাসে পাপাচার করত, সুতরাং হে জুহায়না সম্প্রদায়! তোমরা লুওয়াই ইবন গালিবের বংশভুক্ত রাসূলরূপে আবির্ভূত এই নবীর ডাকে সাড়া দাও, তাহলে তোমরা দুনিয়ার সম্মান ও আখিরাতের মর্যাদা লাভ করতে পারবে। দ্রুত অতি দ্রুত তোমরা এ কাজে এগিয়ে যাও, তাহলে আল্লাহর নিকট তোমরা সম্মান লাভ করবে।’ একজন ব্যতীত সকলেই তার আহবানে সাড়া দিল। ওই একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আমর ইবন মুররা! আল্লাহ্ তোমার জীবনকে তিক্ত ও বিস্বাদ করে দিন। তুমি কি আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছ যে, আমরা আমাদের উপাস্যগুলোকে পরিত্যাগ করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম বর্জন করে তিহামাবাসী ওই কুরায়শ বংশীয় লোকটির আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করি? না, না, তা কোন প্রশংসাযোগ্য কাজ নয়। তাতে কোন মর্যাদা নেই।’ এরপর সে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করল,

ان ابن مرة قد أتى بمقالة - ليست مقاله من يريد صلاحا

অর্থাৎ, ইবন মুররা এমন বক্তব্য নিয়ে এসেছে যা কল্যাণকামী কোন লোকের বক্তব্য হতে পারে না।

انی لأ حسب قوله وفعاله يوما وان طال الزمان رياحا

অর্থাৎ, আমি মনে করি, তার কথা ও কাজ বাতাসের ন্যায় শেকড়হীন ও অস্থায়ী।

أتسفه الأشياخ ممن قد مضى - من رام ذلك لا أصاب فلاحا

অর্থাৎ, তুমি কি অতীত হয়ে যাওয়া মুরব্বী ও বৃদ্ধদেরকে মূর্খ ঠাওরাচ্ছ? যে ব্যক্তি এরূপ করে সে কখনো সফলতার মুখ দেখবে না। উত্তরে আমর ইবন মুররা বলেন, আমার এবং তোমার মধ্যে যে মিথ্যাবাদী আল্লাহ্ তার জীবনকে বিস্বাদ করে দিন, তার বাকশক্তি রহিত করে বোবা বানিয়ে দিন এবং তাকে দৃষ্টিহীন অন্ধ বানিয়ে দিন।’ আমর ইবন মুররা বলেন, অবশেষে সে এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে যে, তার মুখ অকেজো হয়ে পড়েছিল, কোন খাদ্যের স্বাদ সে পেত না এবং সে অন্ধ ও বোবা হয়ে গিয়েছিল।

আমর ইবন মুররা ও তার সাথে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা সকলে নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে সাদর বরণ করে নিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে কিছু উপহার এবং তাদের জন্যে একটি ফরমান লিখে দিয়েছিলেন। ঐ ফরমানটি ছিল এরূপ— বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফরমান। এটি সত্য বাণী ও সত্য প্রকাশক। এটি প্রেরণ করা হলো আমর ইবন মুররা জুহানী-এর মাধ্যমে যুহায়না ইবন যায়দ গোত্রের নিকট। এ ভূখণ্ডের নিম্নাঞ্চল ও সমতল ভূমি, গভীর ও উঁচু ভূমি তোমাদের জন্যে বরাদ্দ দেয়া হলো। তোমরা এর ভূমিতে পশু চরাবে এবং এর পানি পান করবে। উৎপাদিত পণ্যের ১ অংশ দিতে বাধ্য থাকবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে। একই সাথে তবীয়া ও সারিমা (এক বছরের বাছুর আর দুধ ছেড়েছে অমন বাছুর) এর জন্যে একত্রে থাকলে দুটো বকরী আর আলাদা আলাদাভাবে হলে একটি করে বকরী প্রদান করতে হবে। কৃষি কাজে ব্যবহৃত পশুর ওপর যাকাত ফরয নয়। ফুল জাতীয় বস্তুর ওপরও যাকাত ফরয নয়। আমাদের সাথে যে সকল মুসলমান উপস্থিত ছিলেন তাঁরা কায়স ইবন শাম্মসের লিখিত এ লিপিটির সাক্ষীরূপে থাকেন। ওই সময়ে আমর ইবন মুররা আবৃত্তি করছিলেন,

ألم تر أن الله أظهر دينه - وبين برهان القران لعامر

অর্থাৎ, তুমি দেখছ না যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর দীনকে বিজয়ী করে দিয়েছেন এবং অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্যে কুরআনোর দলীলগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

كتاب من الرحمن نور لجمعنا - وآخلافنا في كل باد وحاضر

অর্থাৎ, এটি দয়াময় আল্লাহর কিতাব আমাদের সকলের জন্যে এবং আমাদের মিত্রদের জন্যে শহরে-পল্লীতে সর্বত্রই এটি নূর।

الى خير من يمشي على الأرض كلها - وافضلها عند اعتكار الصرائر

অর্থাৎ, এটি নাযিল হয়েছে সে ব্যক্তির ওপর যিনি পৃথিবীতে পদচারণাকারী সকলের শ্রেষ্ঠ এবং বংশগতভাবেও যিনি সর্বোত্তম।

أطعنا رسول الله لما تقطعت - بطون الأعادي بالظبي والخواطر

অর্থাৎ, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুসরণ করেছি তখনও যখন শত্ৰুভূমি বিপদসংকুল ও ভীতিকর জনপদে পরিণত হয়েছে।

فنحن قبيل قد بنى المجد حولنا - اذا اجتلبت في الحرب هام الأكابر

অর্থাৎ, আমরা এমন এক জাতি যে, আমাদের চারদিকে মর্যাদা ও সম্মানের প্রাচীর নির্মিত। আমরা তখনও মর্যাদাবান, যুদ্ধে যখন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের খুলি উড়িয়ে দেয়া হয়।

بنو الحرب نفريها بايد طويلة - وبيض تلالا في أكف المغاور

অর্থাৎ, আমরা যোদ্ধা জাতি, দীর্ঘহাতে আমরা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হই। প্রচণ্ড যোদ্ধার হাতে তখন উজ্জ্বল তরবারি ঝলমলিয়ে ওঠে।

تری حوله الأنصار تحمى أميرهم - بسم العوالي والصفاح البواتر

অর্থাৎ, তুমি দেখতে পাবে তার চারপাশে আনসারদেরকে। তারা তাদের সেনাপতিকে প্রহরা দিচ্ছে উচু উচু বর্শা ও শানিত তরবারি দ্বারা।

اذا الحرب دارت عند كل عظيمة - ودارت رحاها بالليوث الهواصر

অর্থাৎ, বড় বড় ঘটনায় যুদ্ধ যখন চলতে থাকে আর দুঃসাহসী হিংস্র সিংহদেরকে উপলক্ষ করে যখন যুদ্ধের চাকা ঘুরতে থাকে।

تبلج منه اللون وازداد وجهه - كمثل ضياء البدر بين الزواهر

অর্থাৎ, তখন তার চেহারার জ্যোতির উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, যেমন নক্ষত্ররাজির মধ্যে পূর্ণিমার চাঁদের আলো। আবু উসমান সাঈদ ইবন ইয়াহয়া উমাভী তাঁর মাগাযী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবদুল্লাহ...... জুহায়না গোত্রের জনৈক বৃদ্ধের বরাতে বলেছেন, একদা আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। তখন তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। আমরা তার জন্যে কবর খনন করে ফেলি এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করি। দীর্ঘক্ষণ অচেতন থাকার পর হঠাৎ সে চোখ খুললো এবং তার হুঁশ ফিরে এলো। তখন সে বলল, ‘তোমরা কি আমার জন্যে কবর খুঁড়েছ?’ ওরা বলল, ‘হ্যাঁ।’ সে বলল, ‘ফুসাল কেমন আছে?’ ফুসাল ছিল তার চাচাতো ভাই। আমরা বললাম, ‘সে ভাল আছে।’ একটু আগে সে তোমার কুশল জিজ্ঞেস করে গেল। সে বলল, ‘বস্তুত তাকেই এ কবরে কবরস্থ করা হবে। আমি যখন অচেতন ছিলাম তখন আমার নিকট এক ব্যক্তি এসে বলেছে, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, তুমি দেখছ না যে তোমার কবর খোঁড়া হচ্ছে? তোমার মা তো তোমার শোকে মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছে। আচ্ছা বল দেখি আমরা যদি এই কবর থেকে তোমাকে রক্ষা করি তারপর বড় বড় পাথর দিয়ে সেটি ভরে দিই এবং তারপর সেটিতে ফুসালকে নিক্ষেপ করি, যে ফুসাল তোমাকে এ অবস্থায় দেখে নিরুদ্বেগে চলে গেল এবং সে ধারণা করল যে, তার এমন পরিণতি হবে না তাহলে তুমি কি তোমার প্রতিপালকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে এবং তুমি কি শিরক ও পথভ্রষ্টতা ত্যাগ করবে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তাই করব।’ ওই আগন্তুক বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি এখন উঠে দাঁড়াও, তোমার রোগ সেরে গিয়েছে।’ এবার লোকটি সুস্থ হয়ে গেল আর ফুসাল মারা গেল এবং তাকে ওই কবরে কবরস্থ করা হলো। জুহায়নী বলেন, এরপর আমি আমার জুহায়না গোত্রের ওই লোকটিকে দেখেছি যে নামায পড়ত, প্রতিমার নিন্দাবাদ করত।

উমাভী বলেন, আবদুল্লাহ বলেছেন, আমরা উমর ইবন খাত্তাব (রা)-এর সাথে একটি মজলিসে ছিলাম। সেখানে তাঁরা জিন সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। খুরায়ম ইবন ফাতিক আসাদী বললেন, আমি কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করলাম তা আপনাকে বলবো কি? হযরত উমর (রা) বললেন, ‘ঠিক আছে, বলুন।’ তিনি বলতে শুরু করলেন- একদিন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া উটের পালের খোজে বের হই। আমি সেগুলোর পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছিলাম। উটের পাল উপরের দিকে উঠেছে আমি তেমন চিহ্ন দেখতে পাই। যেতে যেতে আমি ইরাকের আবরাক নামক স্থানে পৌঁছি। সেখানে আমি আমার বাহন থামিয়ে যাত্রা বিরতি করি। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আমি বললাম, “এ শহরের প্রধান জিন এবং এ প্রান্তরের সর্দারের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” তখন আমি শুনতে পাই যে, আমার উদ্দেশে অদৃশ্য থেকে কে একজন বলছে,

ويحك عذ بالله ذي الجلال - والمجد والعلياء والافضال

অর্থাৎ, ওহে তুমি মর্যাদাময় আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর! তিনি সম্মানের অধিকারী এবং মাহাত্ম ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক।

ثم اتل أيات من الأنفال - ووحد الله ولا تبالي

এরপর সূরা আনফালের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত কর এবং আল্লাহর একত্ব ঘোষণা কর। কোন পরোয়া নেই। খুরায়ম আসাদী বলেন, এতে আমি খুব ভড়কে যাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সম্বিৎ ফিরে পাই এবং বলিঃ

يا أيها الهاتف ماتقول - أرشد عندك أم تضليل

অর্থাৎ, হে নেপথ্যচারী ঘোষক! আপনি কি বলছেন? আপনার নিকট কি সত্যপথের দিকনির্দেশনা আছে? না কি পথভ্রষ্টতা?

بين هداك الله ما الحويل

অর্থাৎ, আল্লাহ আপনাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন, সত্যপথ কোনটি স্পষ্টভাবে বলে দিন। জবাবে সে বলল,

هذا رسول الله و الخيرات- بيثرب يدعو الى النجاة

অর্থাৎ, ইনি আল্লাহর রাসূল, সকল কল্যাণের আধার। তিনি অবস্থান করছেন ইয়াসরিব নগরীতে। ডাকছেন জান্নাত ও মুক্তির দিকে।

يأمر بالبر والصلاة - ويزع الناس عن الهنات

অর্থাৎ, তিনি সৎকর্ম ও নামায আদায়ের নির্দেশ দেন। মানব জাতিকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন।

তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম, ওই রাসূলের নিকট গিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না। অতঃপর আমি আমার বাহনে আরোহণ করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমি বললাম -

ارشدني أرشدني هديتا - لا جعت ما عشت ولا عريتا

অর্থাৎ, আমাকে ওই রাসূলের নিকট পৌঁছার পথ দেখিয়ে দিন। আপনি সৎপথ পেয়েছেন। যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন অভুক্ত ও বিবস্ত্র হবেন না।

ولا برحت سيدا مقيتا - لا تؤثر الخير الذي أتيتا

على جميع الجن مابقينا

অর্থাৎ, আজীবন আপনি নেতা ও তত্ত্বাবধায়ক থাকুন সকল জিনের ওপর। যে কল্যাণ আপনি অর্জন করেছেন তার ওপর অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেবেন না। এবার সে বলল,

صاحبك الله وادی رحلگا - وعظم الأجر وعافا نفسكا

অর্থাৎ, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সাথে থাকবেন এবং তোমার সওয়ারী গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেবেন। তিনি তোমাকে মহান প্রতিদান প্রদান করবেন এবং তোমাকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন।

امن به افلج ربي حقكا - وانصره نصرا عزيزا نصركا

অর্থাৎ, তুমি তার প্রতি ঈমান আনয়ন কর। আমার প্রতিপালক তোমার পাওনা পরিপূর্ণভাবে প্রদান করবেন। তুমি প্রবল ও দৃঢ়ভাবে তাঁকে সাহায্য কর তিনি তোমাকে সাহায্য করবেন।

আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন, আপনি কে? আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পৌঁছলে আপনার কথা বলব।’ তখন উত্তর এলো— ‘আমি জিনদের রাজপুত্র নসীবায়নের জিনদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিয়োগকৃত নেতা। তোমার উটগুলোর জন্যে আমি যথেষ্ট। আমি ওগুলো ইনশাআল্লাহ্ তোমার বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেব।’

বর্ণনাকারী বলেন, আমি মদীনা অভিমুখে যাত্রা করে জুমাবারে সেখানে গিয়ে পৌঁছি। লোকজন তখন মসজিদের দিকে আসছে। নবী করীম (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে মুসল্লীদের উদ্দেশে খুতবা দিচ্ছিলেন। তাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের মত দেখাচ্ছিল। আমি স্থির করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব। এরপর তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করব এবং আমার ইসলাম গ্রহণের উপরোক্ত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাকে জানাবো।

মসজিদের দরজায় আমার বাহনটি দাঁড় করানোর পর হযরত আবু বকর (রা) বেরিয়ে এলেন এবং আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘আপনার ইসলাম গ্রহণের কথা আমরা পূর্বেই জেনেছি। আপনি মসজিদে ঢুকে পড়ুন এবং নামায আদায় করে নিন।’ আমি তাই করলাম। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে আমার ইসলাম গ্রহণের প্রেক্ষাপট নিজেই জানিয়ে দিলেন। আল্লাহর তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি বললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ্ সকল প্রশংসা আল্লাহর।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘তোমার সাথী যে জিন সে তোমাকে দেয়া তার অঙ্গীকার পালন করেছে। বস্তুত ওই প্রকারের কাজ করার যোগ্যতা সে রাখে বটে। তোমার হারানো উটগুলো সে তোমার বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়েছে।’

তাবারানী (র) তাঁর “মুজাম আলকবীর” গ্রন্থে খুরায়ম ইবন ফাতিকের জীবনী প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, হুসায়ন ইবন ইসহাক...... হযরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, খুরায়ম ইবন ফাতিক (রা) হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা)-কে বলেছিলেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আমার ইসলাম গ্রহণের সূচনালগ্ন সম্পর্কে আমি কি আপনাকে জানাব?’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ জানান।’ তারপর তিনি পূর্বোক্ত বর্ণনার অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করলেন। তবে এ বর্ণনায় কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এতে আছে “আমার নিকট এসেছিলেন হযরত আবু বকর (রা)। তিনি আমাকে বললেন, “মসজিদে প্রবেশ করুন, আপনার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ আমরা পেয়েছি।’ আমি বললাম, ‘আমি তো ভালভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে জানি না। তিনি আমাকে পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। এরপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখলাম যে, তিনি যেন পূর্ণিমার চাঁদ।’ তিনি বলছিলেন,

ما من مسلم توضأ فأحسن وضوءه ثم صلی صلاه يحفظها ويعقلها الا دخل الجنة

অর্থাৎ, যে মুসলিম ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে এবং যথাযথভাবে ও পরিপূর্ণ মনোযোগের সাথে যে নামায আদায় করে সে নিশ্চয় জান্নাতে প্রবেশ করবে। হযরত উমর (রা) আমাকে বললেন, ‘আপনার বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ পেশ করুন নতুবা আমি আপনাকে শাস্তি দেব।’ তখন কুরায়শী শায়খ হযরত উসমান ইবন আফফান (রা) আমার সমর্থনে সাক্ষ্য দিলেন। হযরত উমর (রা) তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন।

মুহাম্মদ ইবন উসমান সূত্রে বর্ণিত আছে যে, উমর ইবন খাত্তাব (রা) খুরায়ম ইবন ফাতিক (রা)-কে বলেছিলেন আমাকে এমন একটি ঘটনা শুনিয়ে দিন যা আমাকে তাক লাগিয়ে দেয়, তখন তিনি পূর্ববর্তী বর্ণনাটির অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করেন।

আবু নুআয়ম বলেন, সুলায়মান আবদুল্লাহ্ ইবন দায়লামী থেকে বর্ণিত। এক লোক হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট এসে বলল, আমরা শুনেছি যে, আপনি সাতীহ সম্পর্কে আলোচনা করেন, এমনকি আপনি বলে থাকেন যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন যে, অন্য কোন মানুষকে সেরূপ সৃষ্টি করেননি। ইবন আব্বাস (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ আল্লাহ তা’আলা সাতীহ গাসসানীকে সৃষ্টি করেছেন গোলাকার কাঠের উপর স্তুপীকৃত গোশতের ন্যায়। তার শরীরে হাড়ও ছিল না রগও ছিল না। ছিল শুধু মাথায় খুলি আর হাতের দু’টো তালু। তার পা দুটোকে সে গলার সাথে ভাজ করে রাখত যেমন কাপড় ভাঁজ করে রাখা হয়। জিহ্বা ব্যতীত তার দেহে এমন কোন অঙ্গ ছিল না যা নড়াচড়া করতে পারত। মক্কা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তার দেহকে কাঠের ওপর উঠানো হয় এবং এভাবে সে মক্কা পোঁছে। কুরায়শ বংশের নেতৃস্থানীয় চার ব্যক্তি অর্থাৎ আবদ শামস ইবন আবদ মানাফ, হাশিম ইবন আবদ মানাফ ইবন কুসাই, আহওয়াশ ইবন ফিহর এবং আকীল ইবন আবী ওয়াক্কাস তার নিকট উপস্থিত হন। তারা নিজেদের বংশপরিচয় গোপন করে বলেন, আমরা জুমাহ গোত্রের লোক, আপনার আগমন সংবাদ পেয়ে আপনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি। আমরা মনে করি আপনার সম্মানার্থে আপনার সাথে দেখা করা আমাদের কর্তব্য। আকীল তার জন্যে উপহার স্বরূপ একটি ভারতীয় তরবারি এবং একটি রাদীনী বর্শা নিয়ে যান। সাতীহ সেগুলো দেখতে পায় কিনা তা যাচাই করার জন্যে তারা সেগুলো রাখেন কা’বা গৃহের দরজার ওপর। সাতীহ বলল, ‘হে আকীল। তোমার হাতখানা আমাকে দেখাও তো,’ সে তার হাত দেখাল। তখন সাতীহ বলল, ‘হে আকীল। গোপন বিষয়ে জ্ঞাত সত্তার কসম, পাপ মোচনকারী এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণকারী সত্তার কসম, এই কাবাগৃহের কসম, তুমি তো কিছু উপহার নিয়ে এসেছ আর তা হলো ভারতীয় তরবারি ও রাদীনী বর্শা।’ তারা বললেন, ‘সাতীহ! আপনি ঠিকই বলেছেন।’

এবার সে বলল, ‘আনন্দ দানকারীর কসম, রঙধনুর কসম, অন্যান্য আনন্দ সামগ্রীর কসম, আরবী ঘোড়ার কসম, খেজুর গাছ, তাজা ও কাঁচা খেজুরের কসম, কাক যেখানেই যায় ধরা পড়ে যায়। এখন তোমাদের বলে দিচ্ছি তোমরা তো জুমাহ গোত্রের লোক নও। তোমরা আরববাসী কুরায়শ গোত্রের লোক।’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, হে সাতীহ! আমরা কাবা শরীফ এলাকার অধিবাসী। আপনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্বন্ধে আমরা যা শুনেছি তার প্রেক্ষিতে আমরা আপনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি। এখন আপনি আমাদের বলুন, আমাদের যুগে কি কি ঘটবে তারপরে কি কি ঘটবে। এ বিষয়ে নিশ্চয় আপনার অবগতি আছে।’ সে বলল, ‘তোমরা ঠিকই বলেছ। আমার কথা আমার প্রতি মহান আল্লাহর ইলহাম তথা গোপন সংবাদের কথা শোন।

হে আরব বংশীয় প্রতিনিধি দল! এখন তোমরা তোমাদের বার্ধক্যে পৌঁছে গেছ। তোমাদের আর অনারবদের দূরদৃষ্টি এখন সমান সমান। এখন তোমাদের কোন জ্ঞানও নেই প্রজ্ঞাও নেই। তোমাদের বংশধর থেকে অনেক পরম জ্ঞানী লোকের আবির্ভাব ঘটবে। নানা প্রকারের জ্ঞান তারা অর্জন করবে। তারা মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলবে। তারা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে। অনারবদের হত্যা করবে। বকরীর পাল খুঁজে নেবে।’

‘হে সাতীহ! প্রতিনিধি দলের ওরা কারা?’ সাতীহ বলল, ‘রুকন বিশিষ্ট, নিরাপদ ও বসবাসকারী সমৃদ্ধ গৃহের কসম, তোমাদেরই বংশধর থেকে কতগুলো সন্তান জন্ম নেবে যারা প্রতিমাগুলো ভাংচুর করবে, শয়তানের উপাসনা প্রত্যাখ্যান করবে, দয়াময় আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করবে, সকল দীনের শ্রেষ্ঠ দীন প্রচার করবে। তারা উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে এবং যুব সমাজকে দলে টেনে নিবে।’ তারা বলল, ‘হে সাতীহ! কার বংশে ওরা জন্ম নেবে?’ বলল, ‘সর্বাধিক মর্যাদাশীল সত্তার কসম, মর্যাদার স্তরে উন্নীতকারীর কসম, মরুভূমির বালুরাশি স্থানান্তরকারীর কসম এবং দ্বিগুণ চতুগুণে বর্ধিতকারীর কসম, ওরা হাজার হাজার লোক জন্ম নিবে আবদ শামস ও আবদ মানাফের বংশে। বংশ পরম্পরায় তারা এভাবে জন্ম নিবে।’

তারা বলল, ‘হায়রে দুঃখ! হে সাতীহ! আপনি আমাদেরকে যা জানালেন তা তো আমাদের জন্যে অকল্যাণকর বটে। আচ্ছা বলুন তো ওরা কোন শহর থেকে বের হবে?’ সাতীহ বলল, ‘চিরঞ্জীব সত্তার কসম, অনাদি অনন্ত সত্তার কসম, নিশ্চয় এই শহর থেকে বের হবে এক যুবক যে সৎপথের দিক নির্দেশনা দেবে। ইয়াগূছ ও ফানাদ প্রতিমা বর্জন করবে।

আল্লাহর শরীকরূপে কল্পিত সকল উপাস্যের উপাসনা থেকে মুক্ত থাকবে। একক প্রতিপালকের ইবাদত করবে। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে সুনাম অর্জনকারী ও প্রশংসিতরূপে জীবন অবসান করবেন। পৃথিবী থেকে তিনি বিদায় নিবেন। ঊর্ধ্ব জগতে থাকবে তার সাক্ষ্যগণ। এরপর তাঁর কর্মভার গ্রহণ করবেন সিদ্দীক (রা)। তিনি যখন বিচার করবেন, ন্যায় বিচার করবেন। মানুষের অধিকার ও পাওনা পরিশোধে তাঁর কোন ভয়ভীতি ও দায়িত্বহীনতা থাকবে না। এরপর ওই শাসনভার গ্রহণ করবেন সঠিক দীনের অনুসারী একজন শ্রদ্ধাভাজন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অসত্য কথাবার্তা তিনি কঠোরতার সাথে দমন করবেন। সৎলোকদের তিনি আপ্যায়ন করাবেন। সঠিক ধর্মমতকে তিনি সুদৃঢ় করবেন। এরপর একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে তার দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন। এ ব্যক্তি একই সাথে জনমত এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আত্মীয়তা দুটোরই অধিকারী হবেন। ফলে শত্রুগণ শত্রুতা ও বিদ্বেষবশত তাঁকে হত্যা করবে। এরপর একজন মান্যগণ্য ব্যক্তিকে ওই দায়িত্ব দেয়া হবে। এক সময় তাঁকেও হত্যা করা হবে। তাঁর হত্যার বিরুদ্ধে কতক লোক প্রতিবাদমুখর হবে।

এরপর একজন সাহায্যকারী ওই দায়িত্ব নেবে। তাঁর অভিমত দুষ্টলোকের অভিমতের সাথে মিলে যাবে। তখন পৃথিবীতে সেনাতন্ত্র চালু হবে। এরপর তাঁর পুত্র ওই দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সে ধনসম্পদ সংগ্রহে মনোনিবেশ করবে। লোকমুখে তার প্রশংসা হ্রাস পাবে। ধনসম্পদ আত্মসাত করবে এবং সে একাই সেগুলো ভোগ করবে। তারপর তার বংশধররা প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হবে। এরপর একাধিক রাজা ওই পদে আসীন হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তাদের মধ্যে খুনোখুনি ও রক্তপাত হবে।

এরপর একজন খোদাভীরু দরবেশ লোক ওই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি ওদেরকে কাপড়ের ন্যায় ভাঁজ করে গুটিয়ে ফেলবেন। এরপর দায়িত্ব নিবে একজন পাপাচারী লোক। সে সত্যকে দূরে সরিয়ে দেবে এবং ক্ষতিকর কাজগুলো কাছে টেনে নেবে। অন্যায়ভাবে রাজ্যগুলো জয় করবে। এরপর একজন খর্বকায় লোক ওই দায়িত্ব নেবে। তার পৃষ্ঠদেশে একটি চিহ্ন থাকবে বটে। শান্তির সাথে তার মৃত্যু হবে। এরপর অল্পদিনের জন্যে একজন অল্প বয়স্ক বালক ওই দায়িত্ব নেবে। সে রাজত্ব ত্যাগ করার পর তার শাসন রীতি বহাল রেখে তার ভাই প্রকাশ্যে ওই দায়িত্ব নেবে। ধনসম্পদ ও সিংহাসনের প্রতি তার চরম আকর্ষণ থাকবে! এরপর দায়িত্ব নেবে একজন কর্মচঞ্চল ব্যক্তি। সে হবে দুনিয়াদার ও ভোগবিলাসী। তার বন্ধু-বান্ধবগণ হবে তার উপদেষ্টা। এক সময় তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং তাকে পরিত্যাগ করবে। পরবর্তীতে তাকে হত্যা করে রাজত্ব দখল করে নেবে। এরপর ক্ষমতা নেবে একজন অথর্ব। অকর্মণ্য লোক। দেশটিকে সে বরবাদ করে ছাড়বে। তার রাজত্বে তার ছেলেরা সব ঘৃণার্থ হবে। তারপর সকল নগ্নদেহী তথা নিকৃষ্ট লোকেরা রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টা করবে এবং আক্ষেপকারী ব্যক্তি ক্ষমতা লাভ করবে। সে কাহতান বংশের নেযার গোত্রের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। লেবানন ও বিনয়ানের মধ্যবর্তীস্থান দামেস্কে যখন দু’দল মুখোমুখি হবে তখন সে ইয়ামানকে দুভাগে ভাগ করবে। একদল হবে পরামর্শভিত্তিক শাসক, অপর দল হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত। তখন তুমি অশ্বারোহী ও তরবারির মাঝখানে শুধু হাত-পা বাঁধা শিকল পরা বন্দীদের দেখতে পাবে। তখন ঘর-দোর ও জনপদগুলো ধ্বংস হবে। বিধবাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠিত হবে। গর্ভবতীদের গর্ভপাত ঘটবে। ভূমিকম্প শুরু হবে। দেশ তখন একজন আশ্রয়দাতা খুঁজবে। তখন নেযার গোত্র বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। তারা ক্রীতদাস ও মন্দ লোকদেরকে কাছে টানবে। ভাল ও উত্তম লোকদেরকে দূরে ঠেলে দিবে। সফর মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাবে। দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। তারপর তারা পরিখা বিশিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করবে। ওই স্থানটি হবে বৃক্ষরাজি বিশিষ্ট। নদনদী গতিরোধ করবে। দিবসের প্রথম ভাগে সে শত্রুদেরকে পরাজিত করবে। তখন ভাল মানুষগুলো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু নিদ্রা ও বিশ্রাম তাদের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। অবশেষে সে এক শহরে প্রবেশ করবে। সেখানে তার ইনতিকাল হবে। তারপর পদাতিক তীরন্দাজ বাহিনী আসবে সাহসী লোকদেরকে হত্যা করতে এবং প্রহরীদেরকে বন্দী করতে। পথভ্রষ্টগণ তখন ধ্বংস হবে এবং তার মৃত্যু হবে উপকূল অঞ্চলে।

এরপর দীন ধর্ম বিনষ্ট হবে। কাজকর্ম উল্টে যাবে। আসমানী গ্রন্থ প্রত্যাখ্যান করা হবে। পুল ভেঙে ফেলা হবে। দ্বীপাঞ্চলে যারা থাকবে তারা ব্যতীত অন্য কেউ মাসের শেষ দিবস পর্যন্ত জীবিত থাকবে না। এরপর খাদ্যশস্য ধ্বংস হতে থাকবে। বেদুইন গ্রাম্য লোকেরা ক্ষমতা দখল করবে। সেই দুর্ভোগের যুগে তাদের মধ্যে এমন কোন লোক থাকবে না যে পাপাচারীদেরকে এবং বিধর্মীদেরকে দোষত্রুটি ধরিয়ে দেবে। তখন যারা জীবিত থাকবে তারা মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে না।’

প্রতিনিধি দল বলল, ‘হে সাতীহ! এরপর কী হবে?’ সে বলল, ‘এরপর লম্বা রশির ন্যায় দীর্ঘকায় একজন ইয়ামানী লোক বেরিয়ে আসবে। তার দ্বারা আল্লাহ তা’আলা সকল ফিতনা-ফাসাদ নির্মূল করে দেবেন।’

উপরোক্ত বর্ণনা একটি বিস্ময়কর ও বিরল বর্ণনা বটে। এটির মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ এবং শেষ যুগের বিপর্যয় সম্পর্কিত আলোচনা থাকার কারণে এবং এটির অসাধারণত্বের কারণে আমরা এটি উল্লেখ করেছি।

ইয়ামানের রাজা রাবী’আ ইবন নাসরের সাথে শিক ও সাতীহের সাক্ষাত ও আলোচনা এবং রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে তাদের সুসংবাদ দানের বিষয় ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে আপন ভাগ্নে আবদুল মাসীহের সাথে সাতীহের সংঘটিত ঘটনা যখন বানু সাসান বংশীয় পারস্য সম্রাট তাকে পাঠিয়েছিল রাজপ্রাসাদের চূড়া ধ্বংস এবং উপাসনার অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়ার ঘটনা জানার জন্য, তাও ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

পারস্যের বিচারক ও আইন শাস্ত্রবিদের দেখা স্বপ্নের কথাও আলোচিত হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটেছিল প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জন্মগ্রহণের রাতে। তাঁর শরীয়ত ও ধর্ম তো অন্য সকল দীন-ধর্মকে রহিত করে দিয়েছে।

৯৪
রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর যৌবন প্রাপ্তি ও আল্লাহর আশ্রয়
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যৌবনে পদার্পণ করলেন। আল্লাহ তাআলা তার নিরাপত্তা দান করেন এবং জাহিলিয়াতের পংকিলতা থেকে তাকে রক্ষা করেন। এভাবে যখন তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হলেন, তখন তিনি ব্যক্তিত্বে সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ, চরিত্রে সর্বাপেক্ষা সুন্দর, বংশ মর্যাদায় সবচাইতে কুলীন, প্রতিবেশী হিসেবে সর্বোত্তম, সহনশীলতায় সর্বশ্রেষ্ঠ, কথা-বার্তায় সর্বাধিক সত্যবাদী, বিশ্বস্ততায় সকলের সেরা এবং অশ্লীলতা ও মন্দ স্বভাব থেকে সর্বাধিক পবিত্র ও মুক্ত। সমাজের মানুষ এখন তাঁকে একমাত্র “আল-আমীন’ বা বিশ্বাসভাজন বলে সম্বোধন করে।

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন, মহানবী (সা)-কে আল্লাহ তা’আলা যে শৈশবে রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং জাহিলিয়াতের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখেন, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ একদিন আমি কুরায়শ-এর কয়েকটি কিশোরের সঙ্গে অবস্থান করছিলাম। খেলার ছলে আমরা পাথর কুড়িয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিচ্ছিলাম। আমরা প্রত্যেকে পরনের লুঙ্গি খুলে তা’ ঘাড়ে রেখে এর ওপর পাথর বহন করছিলাম। আমি ওদের সঙ্গে একবার সামনে যাচ্ছিলাম আবার কখনো পেছনে পড়ছিলাম। এমন সময় অদৃশ্য থেকে কে একজন আমাকে প্রচণ্ড একটি ঘুষি মারলো এবং আমাকে বললো, লুঙ্গিটা পরে নাও। সঙ্গে সঙ্গে আমি লুঙ্গিটি কাঁধ থেকে নিয়ে পরে নিলাম। তারপর পুনরায় খালি কাঁধে পাথর বহন করতে শুরু করলাম। তখন আমার সাথীদের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম লুঙ্গি পরিহিত।

এই ঘটনাটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত কাবা নির্মাণের সময়কার ঘটনার অনুরূপ। সে সময়ে তিনি এবং তাঁর চাচা আব্বাস পাথর বহন করছিলেন। ঘটনাটি যদি সে ঘটনা না হয়ে থাকে তবে এটা ছিল তার পূর্বাভাস স্বরূপ। আল্লাহই ভালো জানেন।

আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেন যে, হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ (রা) বলেছেন, কা’বা নির্মাণের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) পাথর বহনের কাজে যোগ দেন। দেখে আব্বাস বললেন, ‘লুঙ্গি কাঁধে রেখে পাথর বহন কর।’ রাসূলুল্লাহ (সা) তা-ই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং তার চক্ষুদ্বয় আকাশের দিকে নিবদ্ধ হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার লুঙ্গি!’ তখন আব্বাস তাঁকে লুঙ্গি পরিয়ে দেন। এটি বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা।

বায়হাকী ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, কুরায়শ যখন বায়তুল্লাহ নির্মাণ করে, তখন আব্বাস বায়তুল্লাহর দিকে পাথর বয়ে নিয়ে আসছিলেন। ইবনে আব্বাস বলেন, কুরায়শরা দু’জন দু’জন করে লোককে জুড়ি বেঁধে দেয়। পুরুষরা পাথর স্থানান্তর করতো আর মহিলারা মশলা বহন করতো। আব্বাস বলেন, আমি এবং আমার ভাতিজাও সেই কাজে শরীক ছিলাম। আমরা লুঙ্গি কাঁধে রেখে তার উপরে করে পাথর বহন করতাম। কোন লোক আসতে দেখলে লুঙ্গিটা পরে নিতাম। এক পর্যায়ে আমি হাঁটছি আর মুহাম্মদ আমার সম্মুখে। হঠাৎ তিনি উপুড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমি আমার পাথরগুলো ফেলে দৌড়ে আসলাম। দেখতে পেলাম, মুহাম্মদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কী হয়েছে?’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমাকে উলংগ চলতে নিষেধ করা হয়েছে।” আব্বাস বলেন, মানুষ তাঁকে পাগল বলবে, এই ভয়ে আমি ঘটনাটা গোপন করে রাখতাম।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত আলী (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, “জাহিলী যুগের মানুষ যে সব রীতি-নীতি পালন করত আমার মনে কখনো তার কোনটি পালন করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়নি। তবে দুই রাতে তেমন কিছু করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আল্লাহ উভয় ঘটনায় আমাকে রক্ষা করেছেন। এক রাতে আমি ছাগলের পালের সঙ্গে ছিলাম। আমি আমার সঙ্গী যুবককে বললাম, তুমি আমার ছাগলগুলো দেখ, মক্কায় প্রবেশ করে আমি অন্য যুবকদের মত গল্প-গুজবে অংশগ্রহণ করে আসি।’ সঙ্গীটি বলল, ‘ঠিক আছে, যাও।’ নবীজি (সা) বলেন, আমি মক্কা প্রবেশ করে প্রথম বাড়িতে পৌঁছেই বাজনার শব্দ শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কী হচ্ছে?’ লোকেরা বলল, ‘অমুক অমুককে বিয়ে করেছে।’ আমি বসে দেখতে শুরু করলাম। আল্লাহ আমাকে নিদ্রায় অচেতন করে দিলেন। আল্লাহর কসম, রৌদ্রের স্পর্শ ছাড়া অন্য কিছু আমাকে সজাগ করতে পারেনি। জাগ্রত হয়ে আমি সঙ্গীর কাছে ফিরে এলাম। সঙ্গীটি জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করেছো?’ আমি বললাম, ‘কিছুই করিনি।’ তারপর তাকে ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনালাম।

এরপর আরেক রাতে আমি সঙ্গীকে বললাম, ‘তুমি আমার ছাগলগুলো দেখ, আমি একটু গল্প করে আসি।’ সঙ্গী তাতে সম্মত হলে আমি মক্কা প্রবেশ করে আগের রাতের ন্যায় এ রাতেও অনুরূপ বাজনার আওয়াজ শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলে বলা হলো যে, অমুক অমুককে বিয়ে করেছে। আমি বসে দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করে দিলেন। আল্লাহর কসম! রোদ্রের স্পর্শ ছাড়া অন্য কিছু আমাকে জাগ্রত করতে পারেনি। জাগ্রত হয়ে আমি সঙ্গীর নিকট ফিরে গেলাম। সঙ্গী বলল, ‘কী করেছো?’ আমি বললাম, ‘কিছুই নয়।’ তারপর আমি তাকে ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনালাম। আল্লাহর কসম, এরপর আর কখনো আমি এ ধরনের কাজের ইচ্ছে করিনি। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে নবুয়তের মর্যাদায় ভূষিত করেন। হাদীসটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের।

হাফিজ বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা (রা) বলেছেন, তামার তৈরি একটি দেব মূর্তি ছিল। নাম ছিল তার আসাফ ও নায়েলা। বায়তুল্লাহ্ তাওয়াফ করার সময় মুশরিকরা তাকে স্পর্শ করত। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) বায়তুল্লাহ্ তাওয়াফ করেন। আমিও তাঁর সঙ্গে তাওয়াফ করি। উক্ত দেব মূর্তিটি অতিক্রমকালে আমি তাকে স্পর্শ করি। দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “ওটা স্পর্শ করো না।” যায়েদ ইবনে হারিছা বলেন, তাওয়াফের মধ্যেই আমি মনে মনে বলি, আবারও আমি মূর্তিটি স্পর্শ করব; দেখি কী হয়। আমি পুনরায় ওটা স্পর্শ করলে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “তোমাকে নিষেধ করা হয়েছিল না?” বায়হাকী বলেন, অপর এক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যায়েদ বলেছেন, যে সত্তা তাকে সম্মানিত করেছেন এবং তার ওপর কিতাব অবতারণ করেছেন, আমি তার শপথ করে বলছি, তিনি কখনো কোন মূর্তি স্পর্শ করেননি। এ অবস্থায়ই মহান আল্লাহ্ তাকে তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন এবং তাঁর ওপর কিতাব নাযিল করেন।

তা ছাড়া উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, বাহীরা যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে লাত ও উযযার নামে শপথ করে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, “এদের দোহাই দিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ! আমার নিকট এদের চাইতে ঘৃণার পাত্র দ্বিতীয়টি আর নেই।”

হাফিজ আবু বকর বায়হাকী অপর এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মুশরিকদের সঙ্গে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। একদিন তিনি শুনতে পেলেন যে, তার পিছনে দুই ফেরেশতা। তাদের একজন অপরজনকে বলছেন, ‘চল, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিছনে গিয়ে দাঁড়াই।’ সঙ্গীটি বললেন, ‘আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়াই কী করে; তিনি যে মূর্তি চুম্বনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন।’ রাবী জাবির বলেন, এরপর কখনো নবীজী (সা) মুশরিকদের সঙ্গে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেননি।

বলা বাহুল্য যে, আলোচ্য হাদীসটি বিতর্কিত। উক্ত হাদীসের একজন রাবী উসমান ইবনে আবু শায়বার ব্যাপারে একাধিক ইমাম আপত্তি উত্থাপন করেছেন। এমনকি ইমাম আহমদ বলেছেন, তাঁর ভাই এ হাদীসের একটি বর্ণও উচ্চারণ করতেন না।

ইমাম বায়হাকী কারো কারো থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এ হাদীসের মর্ম হলো যারা দেব মূর্তি চুম্বন করত, নবী করীম (সা) তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আর এ ঘটনাটি নবী করীম (সা)-এর প্রতি ওহী অবতরণের পূর্বের। আল্লাহই ভালো জানেন। যায়েদ ইবনে হারিছার হাদীসে তো বলা হয়েছে যে, নবুওতের মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার আগে কখনো নবীজী (সা) মুশরিকদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আরাফার রাতে মুযদালিফায় অবস্থান করতেন না। বরং লোকদের সঙ্গে আরাফাতেই অবস্থান করতেন। যেমন ইউনুস ইবনে বুকায়র বর্ণিত এক হাদীসে আছে, হযরত জুবায়র ইবনে মুতইম (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্য থেকে কেবল তাঁকেই আরাফাতে উটের ওপর অবস্থানরত দেখেছি। তিনি তখনো নিজ সম্প্রদায়ের দীনের অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে তাওফীক দিয়েছিলেন বলেই এমনটি হয়েছে।

বায়হাকী বলেন, নিজ সম্প্রদায়ের দীন কথাটার অর্থ হলো ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর দীনের অবশিষ্টাংশ। অন্যথায় নবী করীম (সা) জীবনে কখনো শিরক করেননি।

আমার মতে উপরের বর্ণনায় একথাও বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রতি ওহী অবতারণের পূর্বেও আরাফায় অবস্থান করতেন। আল্লাহ্ তাওফীক দিয়েছিলেন বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে। ইমাম আহমদ ও ইয়াকুব মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তার ভাষা হয়েও আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর প্রতি ওহী অবতারণের পূর্বে লোকদের সঙ্গে আরাফায় উটের পিঠে অবস্থানরত দেখেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের সাথেই ফিরতেন। আল্লাহ তাঁকে এর তওফীক দিয়েছিলেন।

হযরত জুবায়র ইবনে মুতইম সূত্রে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, একদিন আরাফায় আমার উট হারিয়ে ফেলি। আমি তার খোঁজে বের হলাম। হঠাৎ দেখি, নবী করীম (সা) দাঁড়িয়ে আছেন। মনে মনে বললাম, ইনি তো হুমস [হুমস বলতে কুরায়শ গোত্র বোঝানো হতো। হুমস মানে দৃঢ়তা। তারা দীনের ব্যাপারে অনঢ়-অবিচল থাকতো বলে তাদেরকে হুমস বলা হতো] গোত্রের মানুষ। এখানে কেন ইনি?

৯৫
ফিজার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপস্থিতি
ইবনে ইসহাক বলেন, ফিজার যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছে, রাসূলুল্লাহ (সা) তখন কুড়ি বছরের যুবক। উল্লেখ্য যে, কিনানা এবং আয়লানের কায়স পরস্পর রক্ত সম্পর্কীয় এই দু’টি গোত্র নিষিদ্ধ সময়ে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে এ যুদ্ধকে ফিজার যুদ্ধ বা সীমালংঘন যুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধে কুরায়শ ও কিনানার নেতৃত্বে ছিলেন হারব ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামস। দিনের প্রথম ভাগে কায়স গোত্র কিনানার ওপর জয়লাভ করেছিল। দিনের মাঝামাঝিতে এসে বিজয় কিনানা গোত্রের হাতে চলে আসে।

ইবনে হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সে উপনীত হন, তখন সহযোগী কিনানাসহ কুরায়শ এবং আয়লানের কায়স-এর মধ্যে ফিজার যুদ্ধ শুরু হয়। ঘটনার পটভূমি নিম্নরূপঃ উরওয়া আর রিহাল (ইবন উতবা ইবন জাফর ইবন কিলাব ইবন রবীয়া ইবন আমির ছাছাআ ইবন মুআবিয়া ইবন বকর ইবন হাওয়াযিন) নুমান ইবনে মুনযিরকে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়। এ খবর শুনে বনু যামুরা (ইবন বকর ইবন আবদে মানাত ইব্‌ন কিনানা) গোত্রের বারায ইবনে কায়স বলে, ‘কিনানার স্বার্থ নষ্ট করে তুমি নুমানকে ব্যবসা করার অনুমতি দিলে?’ উরওয়া আর রিহাল বলল, ‘হ্যাঁ, দিয়েছি সকলের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলেও।’ এ কথার পর উরওয়া আর রিহাল চলে যায়। বারাযও প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে সুযোগের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। মক্কার উঁচু অঞ্চলের যী-তিলাল নামক স্থানের দক্ষিণে পৌঁছে উরওয়া অসতর্ক হয়ে পড়ে। সুযোগ বুঝে বারায তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে হত্যা করে ফেলে। ঘটনাটি ঘটে নিষিদ্ধ মাসে। এ কারণে তা ফিজার নামে আখ্যায়িত হয়। এ ব্যাপারে গর্ব প্রকাশ করে বারায কবিতার কয়েকটি পংক্তিও আওড়ায়। উরওয়ার এ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লবীদ ইব্‌ন রবীয়াও কযেকটি পংক্তি রচনা করেন।

ইবনে হিশাম বলেন, এরপর জনৈক ব্যক্তি কুরায়শের নিকট এসে সংবাদ দিল যে, বারা উরওয়াকে খুন করে ফেলেছে। তা-ও আবার নিষিদ্ধ মাসে, উকায মেলার স্থানে। অতএব তোমরা হাওয়াযিন গোত্র যাতে টের না পায় সেভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও। কিন্তু এরমধ্যে হাওয়াযিন ঘটনাটি জেনে ফেলে। তারা কুরায়শদের ধাওয়া করে। কুরায়শরা হারামে প্রবেশ করার পূর্বেই হাওয়াযিনরা তাদেরকে নাগালে পেয়ে যায়। তখন সংঘর্ষ শুরু হয়। সারা দিন যুদ্ধশেষে রাতের বেলা কুরায়শরা হারামে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। ফলে হাওয়াযিনরা নিবৃত্ত হয়। পরদিন আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষ কয়েকদিন অব্যাহত থাকে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোক তাদের নেতাদের ওপর পূর্ণ নির্ভর করে।

কুরায়শ ও কিনানার সব ক’টি গোত্রের নেতৃত্ব একজনের হাতে ছিল। আর কায়স-এর সবগুলো গোত্রের নেতৃত্ব অপর একজনের হাতে ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক দিন এ যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর চাচারা তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে বলেছেনঃ

كنت انبل على اعما مى

— আমি শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর কুড়িয়ে চাচাদের হাতে তুলে দিতাম।

ইবনে হিশাম বলেন, ফিজারের যুদ্ধ দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলেছিল, তা’ আমার উল্লেখিত বর্ণনার চাইতেও দীর্ঘতর ছিল। সীরাত সম্পর্কিত আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক বলে এখানে তা উল্লেখ করা হলো না।

সুহায়লী বলেন, আরবে ফিজার সংঘটিত হয়েছিল চারটি। মাসঊদী এ যুদ্ধগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এ যুদ্ধগুলোর সর্ব শেষটি হলো এই ফিজারুল বারায। ফিজারুল বারাযের যুদ্ধ হয়েছে চার দিন। (তখনকার দিনের নাম অনুসারে) ১. শামতা ২. আবলা। এ দু’দিনের লড়াই হয়েছে উকায-এর নিকট। ৩. আশ্ শুরব। চারদিনের মধ্যে এ দিনের যুদ্ধই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা) উপস্থিত ছিলেন। এ দিনে কুরায়শ ও বনু কিনানার দুই নেতা হারব ইব্ন উমাইয়া এবং তার ভাই সুফিয়ান নিজেরা নিজেদেরকে শিকলে আটকে রাখে, যাতে বাহিনীর যোদ্ধারা পালিয়ে না যায়। এই দিনে কায়স গোত্র পালিয়ে যায়। তবে বনূ নাযর নিজেদের অবস্থায় অটল থাকে। ৪. হারীরা। এই দিনের যুদ্ধ হয়েছিল নাখলার নিকট। তারপর। বিবাদমান উভয় পক্ষ আগামী বছর উকাযের নিকট যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। নির্দিষ্ট সময়ে তারা অঙ্গীকার পালনে লিপ্ত হলে উতবা ইবনে রবীয়া উটে সওয়ার হয়ে ডাক দিয়ে বলে, ‘ওহে মুযার সম্প্রদায়! কোন্ যুক্তিতে তোমরা লড়াই করছ?’ জবাবে হাওয়াযিনরা বলল, ‘আপনি কী প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, বলুন।’ উতবা বলল, ‘আমি সন্ধি করতে চাই।’ তারা বলল, ‘সন্ধি কি শর্তে হবে বলুন।’ উতবা ইবনে রবীয়া বললঃ ‘আমাদের হাতে তোমাদের যে সব লোক নিহত হয়েছে, আমরা তোমাদেরকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করব। তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সম্পদ তোমাদের কাছে বন্ধক রাখব। আর তোমাদের নিকট আমরা যে রক্তপণ পাওনা আছি, তা মাফ করে দেব।’ শুনে হাওয়াযিনরা বলল, ‘এই চুক্তির দায়িত্ব কে নেবে?’ উতবা বলল, ‘আমি।’ হাওয়াযিনরা বলল, ‘আপনি কে?’ উতবা বলল, ‘আমি উতবা ইবনে রবীয়া।’ অবশেষে উক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী সন্ধি স্থাপিত হয় এবং যুদ্ধরত লোকদের নিকট চল্লিশ ব্যক্তিকে প্রেরণ করা হয়। হাকীম ইবনে হিযাম (রা) তাঁদের একজন ছিলেন। যখন বনূ আমির ইবনে ছা’ছা’আ দেখল যে, বন্ধক তাদের হাতে এসে গেছে, তখন তারা তাদের রক্তপণের দাবি ত্যাগ করে এবং এভাবে ফিজার যুদ্ধের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক উমাবী ফিজার-এর যুদ্ধসমূহ এবং তার দিন-ক্ষণ সম্পর্কে আছরাম সূত্রে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। আছরাম হলেন মুগীরা ইবনে আলী। মুগীরা আবু উবায়দা মা’মার ইবনে মুছান্না থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

অধ্যায়

হাফিজ বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, জুবায়র ইবনে মুতইম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আমি আমার চাচাদের সঙ্গে ‘হিলফুল মুতায়্যিবীনে’উপস্থিত ছিলাম। এখন আমি তা’ ভঙ্গ করা পছন্দ করি না; বিনিময়ে বহমূল্য লাল উট দিলেও নয়।”

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে আছেঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “হিলফুল মুতায়্যিবীন ছাড়া আমি কুরায়শদের কোন চুক্তিতে উপস্থিত ছিলাম না। এখন বিনিময়ে আমাকে লাল উট দেয়া হলেও আমি তা ভঙ্গ করা পছন্দ করি না।” আবু হুরায়রা (রা) বলেন, মুতায়্যিবীন বলতে বোঝানো হয়েছে হাশিম, উমাইয়া, যুহরা ও মাখযুমকে। বায়হাকী বলেন, হাদীসের এই ব্যাখ্যাটি মুদরাজ বা রাবীর বাড়তি বর্ণনা। এ রাবীর পরিচয়ও অজ্ঞাত। কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এখানে ‘হিলফুল মুতায়্যিবীন’ বলতে হিলফুল ফুযুল বোঝান হয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) হিলফুল মুতায়্যিবীন-এর সময়কাল পাননি।

আমার মতে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তার কারণ কুরায়শরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল কুসাই-এর মৃত্যুর পর। কুসাই কর্তৃক তাঁর পুত্র আব্দুদ্দারকে সিকায়া, রিফাদা, লিওয়া, নাদওয়া ও হিজাবার দায়িত্ব প্রদানকে কেন্দ্র করে বিরোধ ছিল। এই সিদ্ধান্তে বনূ ‘আবদে মানাফের আপত্তি ছিল। কুরায়শের সকল গোত্র এ ব্যাপারে সোচ্চার হয় এবং নিজ নিজ পক্ষের সহযোগিতা করার ব্যাপারে পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এ খবর শুনে আবদে মানাফের গোত্রের লোকেরা একটি পাত্রে সুগন্ধি রেখে তাতে হাত রেখে তারাও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। বৈঠক থেকে উঠে তারা বায়তুল্লাহর খুঁটিতে হাত মুছে। এ কারণে তাঁদেরকে ‘মুতায়্যিবীন’ বা সুগন্ধিওয়ালা নাম দেয়া হয়। এ ঘটনাটি প্রাচীন আমলের। কাজেই প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য অঙ্গীকার দ্বারা হিলফুল ফুযুল বোঝানো হয়েছে। হিলফুল ফুযুল সম্পাদিত হয়েছিল আব্দুল্লাহ ইবন জাদ‘আনের ঘরে। যেমন হুমায়দী বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আমি আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আনের ঘরে একটি অঙ্গীকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলাম। ইসলামের যুগেও যদি আমাকে তেমন অঙ্গীকারের প্রতি আহ্বান করা হতো, আমি তাতে সাড়া দিতাম।” উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ তাতে নগরবাসীর ওপর অত্যাচার ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার শপথ নিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, হিলফুল ফুযুল সম্পাদিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুয়ত লাভের কুড়ি বছর আগে যুলকা’দা মাসে, ফিজার যুদ্ধের চার মাস পরে। ফিজার সংঘটিত হয়েছিল একই বছরের শাবান মাসে।

হিলফুল ফুযুল ছিল আরবের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শপথ। এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম যিনি মুখ খুলেন এবং যিনি এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তিনি হলেন যুবায়র ইবনে আব্দুল মুত্তালিব।

যে পটভূমির ওপর ভিত্তি করে এই অঙ্গীকার সম্পাদিত হয়েছিল, তা হলো এইঃ

যাবীদ গোত্রের এক ব্যক্তি কিছু ব্যবসা পণ্য নিয়ে মক্কা আসে। ‘আস ইবনে ওয়ায়িল তার থেকে কিছু সওদা ক্রয় করে। কিন্তু পরে সে তার মূল্য পরিশোধ করতে অস্বীকার করে। অগত্যা যাবীদী তার পাওনা আদায় করার জন্য আহলাফ তথা আব্দুদ্দার, মাখযুম, জামহ, সাহম ও আদী ইবনে কা‘ব-এর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তারা ‘আস ইবনে ওয়ায়িল-এর বিপক্ষে তাকে সাহায্য করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় এবং তাকে শাসিয়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে যাবীদী ভোরে আবু কুবায়স পর্বতে আরোহণ করে উচ্চ স্বরে কাব্যাকারে তার অত্যাচারিত হওয়ার কথা প্রচার করে। কুরায়শরা তখন কা‘বা চত্বরে আলাপ-আলোচনায় রত। যুবায়র ইবনে আব্দুল মুত্তালিব বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন এবং বলেন, ঘটনাটিকে এভাবে উপেক্ষা করা যায় না। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এবার হাশিম, যুহরা ও তাইম ইবনে মুররা আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আন-এর বাড়িতে সমবেত হন। আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আন মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। এ বৈঠকে যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস যুলকা’দায় তাঁরা আল্লাহর নামে এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন যে, তাঁরা অত্যাচারিতের পক্ষে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে, যাতে করে জালিম মজলুমের পাওনা আদায় করতে বাধ্য হয়। যতদিন পর্যন্ত সমুদ্রে ঢেউ উত্থিত হবে, যতদিন পর্যন্ত হেরা ও ছাবীর পর্বতদ্বয় আপন স্থানে স্থির থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের এই অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে। আর জীবন যাত্রায় আমরা একে অপরের সাহায্য করব। কুরায়শরা এই অঙ্গীকারকে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে নামকরণ করে এবং বলে, এরা একটি মহত কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। তারপর এই যুবকরা আস ইবনে ওয়ায়িল-এর নিকট গিয়ে তার থেকে যাবীদীর পণ্য উদ্ধার করে তাকে ফেরত দেন। যুবায়র ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এ ব্যাপারে বলেনঃ

إن الفضول تعاقدوا وتحالفوا - ألا يقيم ببطن مكة ظالم

أمر عليه تعاقدوا وتواثقوا فالجار والمعتر فيهم سالم

— কয়েক মহান ব্যক্তি এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে যে, মক্কার বুকে কোনো জালিম পা রাখতে পারবে না; নগরবাসী বিদেশী সকলেই এখানে নিরাপদে অবস্থান করবে।

একটি গরীব পর্যায়ের হাদীসে কাসিম ইবনে ছাবিত উল্লেখ করেন, কাছ‘আম গোত্রের এক ব্যক্তি হজ্জ কিংবা উমরাহ্ উপলক্ষে মক্কায় আগমন করে। তার একটি কন্যা তার সঙ্গে ছিল। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত রূপসী এবং তার নাম ছিল কাতুল। নাবীহ ইবন হাজ্জাজ মেয়েটিকে পিতার নিকট হতে অপহরণ করে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। ফলে কাছ’আমী লোকটি তার মেয়েকে উদ্ধারের ফরিয়াদ জানায়। তাকে তখন বলা হলো, তুমি ‘হিলফুল ফুযুল’ যুবসংঘের শরণাপন্ন হও। লোকটি কা‘বার নিকটে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, ‘হিলফুল ফুযুল-এর সদস্যগণ কে কোথায় আছেন?’ সঙ্গে সঙ্গে হিলফুল ফুযুল-এর কর্মীগণ কোষমুক্ত তরবারি হাতে চতুর্দিক হতে ছুটে আসেন এবং বলেন, ‘তোমার সাহায্যকারীরা হাজির; তোমার কী হয়েছে?’ লোকটি বলল, ‘নাবীহ আমার কন্যার ব্যাপারে আমার প্রতি জুলুম করেছে। আমার কন্যাকে সে জোর করে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।’ অভিযোগ শুনে তারা লোকটিকে নিয়ে নাবীহ-এর গৃহের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হন। নাবীহ বেরিয়ে আসলে তারা বলেন, ‘হতভাগা কোথাকার! মেয়েটিকে নিয়ে আয়। তুই তো জানিস্ আমরা কারা, কি কাজের শপথ নিয়েছি আমরা!’ নাবীহ বলল, ‘ঠিক আছে, তা-ই করছি, তবে আমাকে একটি মাত্র রাতের অবকাশ দিন।’ তারা বললেন, ‘না, আল্লাহর শপথ! কিছুতেই তা হতে পারে না।’ অগত্যা নাবীহ মেয়েটিকে তাঁদের হাতে অর্পণ করে। তখন সে আক্ষেপের সহিত কয়েকটি পংক্তি উচ্চারণ করে।

জুরহুম গোত্র ‘জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের সহায়তা দান’ বিষয়ক একটি অঙ্গীকার নিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, আলোচ্য অঙ্গীকারও জুরহুমের সেই অঙ্গীকারের অনুরূপ বলে একে হিলফুল ফুযুল নামে নামকরণ করা হয়েছে। যে তিন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উদ্যোগে জুরহুমের সেই অঙ্গীকার সম্পাদিত হয়েছিল, তাদের প্রত্যেকেরই নাম ফায্ল। ১. ফায্ল ইবনে ফুযালা ২. ফায্ল ইবনে ওয়াদা‘আহ ৩. ফায্ল ইবনে হারিছ। এটা ইবনে কুতায়বার বক্তব্য। অন্যদের মতে তিনজনের নাম হলো, ১. ফায্ল ইবন শুরা‘আ ২. ফায্ল ইবনে বুযা‘আ ৩. ফায্ল ইন কুযা’আ। এটি সুহায়লীর বর্ণনা।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেনঃ কুরায়শের কয়েকটি গোত্র পরস্পর হলফ গ্রহণের আহ্বান জানায়। এ উদ্দেশ্যে তারা মক্কার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আনের ঘরে সমবেত হন। সেদিনকার সেই বৈঠকে বনূ হাশিম, বনূ আব্দুল মুত্তালিব, বনু আসাদ ইবনে আব্দুল উযযা, যুহরা ইবন কিলাব এবং তায়ম ইবন মুররা পরস্পর এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন যে, মক্কার বাসিন্দা হোক কিংবা ভিন দেশের লোক হোক, যখনই কেউ অন্যের হাতে নির্যাতনের শিকার হবে, তারা তার সর্বাত্মক সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। জুলুমের প্রতিকার না করা পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হবেন না। কুরায়শরা এই অঙ্গীকারকে হিলফুল ফুযুল নামে অভিহিত করে।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, তালহা ইবন আব্দুল্লাহ ইবন ইসহাক বলেন, তালহা ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আউফ যুহরী বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

لقد شهدت في دار عبد الله بن جدعان حلفا ما أحب أن لي به حمرا

النعم و لو دعي به في الإسلام لأجبت

“আমি আব্দুল্লাহ ইবন জাদ‘আনের ঘরে এক অঙ্গীকার সভায় উপস্থিত ছিলাম। সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করার বিনিময়ে যদি আমাকে লাল উটও দেয়া হয় তবু আমি তাতে সম্মত হব না। আর ইসলামের আমলেও যদি তার প্রতি আহ্বান করা হতো আমি তাতে সাড়া দিতাম।”

ইবন ইসহাক বলেনঃ মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম ইবন হারিছ আত-তায়মী বর্ণনা করেন যে, হুসায়ন ইবন আলী (রা) ও ওলীদ ইবনে উতবা ইবনে আবু সুফিয়ান-এর মধ্যে যুল-মারওয়ার কিছু সম্পদ নিয়ে বিবাদ ছিল। ওলীদ তখন মদীনার গভর্নর। তাঁর চাচা মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান তাকে মদীনার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। ক্ষমতার বলে ওলীদ পাওনা আদায়ে হুসায়ন (রা)-এর ওপর অবিচার করেন। তখন হুসায়ন (রা) বললেন, ‘আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আপনি হয় আমার প্রতি সুবিচার করবেন, অন্যথায় তরবারি হাতে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মসজিদে দাঁড়িয়ে হিলফুল ফুযুল-এর কর্মীদের আহ্বান করব।’ আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র তখন ওলীদের নিকট উপস্থিত ছিলেন। হুসায়ন (রা)-এর কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আমিও আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি। হুসায়ন যদি এরূপ আহ্বান জানান তাহলে আমিও আমার তরবারি হাতে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াব। হয় তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবেন, অন্যথায় আমরা একত্রে জীবন দেব।’

বর্ণনাকারী বলেন, এ সংবাদ মিসওয়ার ইবনে মাখরামার নিকট পৌঁছলে তিনিও একই কথা বলেন। আব্দুর রহমান ইবন উছমান ইবন উবায়েদুল্লাহ আততায়মীও অভিন্ন উক্তি করেন। ওলীদ ইবনে উতবা সব খবর পেয়ে অবশেষে হুসায়ন (রা)-কে তাঁর ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেন। তাতে হুসায়ন (রা) সন্তুষ্ট হয়ে যান।

৯৬
নবীজী (সা)-এর সাথে খাদীজা বিনতে খুওয়ায়লিদের বিবাহ
ইবন ইসহাক বলেন, খাদীজা বিনতে খুওয়ায়লিদ একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী মহিলা ছিলেন। লাভে অংশীদারিত্বের চুক্তিতে পুরুষদেরকে তিনি তাঁর ব্যবসায় নিয়োগ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও সচ্চরিত্রতার কথা জানতে পেরে তিনি তাঁর নিকট প্রস্তাব পাঠালেন, যেন তিনি ব্যবসায় পণ্য নিয়ে সিরিয়া সফর করেন। বিনিময়ে তিনি তাঁকে অন্যদের তুলনায় অধিক মুনাফা প্রদানের প্রস্তাব করেন। সঙ্গে থাকবে খাদীজার গোলাম মায়সারা। রাসূলুল্লাহ (সা) খাদীজার এই প্রস্তাবে সম্মত হন এবং পণ্যসামগ্রী নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁর সঙ্গে খাদীজার গোলাম মায়সারাও রওয়ানা হন। সিরিয়া পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা) জনৈক পাদ্রীর গির্জার নিকট একটি গাছের ছায়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন। পাদ্রী মায়সারাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘গাছের নিচে অবতরণকারী ব্যক্তিটি কে?’ মায়সারা বললেন, ‘ইনি হারমবাসী কুরায়শী বংশের এক ব্যক্তি।’ পাদ্রী বললেন, ‘এ যাবত এই গাছের নিচে নবী ব্যতীত কেউ অবতরণ করেনি।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিয়ে আসা ব্যবসা-পণ্য বিক্রি করলেন এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তার পছন্দমত অন্য মাল ক্রয় করলেন। এরপর মায়সারাকে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, মায়সারা লক্ষ্য করেন যে, সূর্যের তাপ প্রখর হওয়ার সাথে সাথে দু’জন ফেরেশতা মুহাম্মদ (সা)-কে ছায়া প্রদান করছেন। তখন তিনি উটের পিঠে চড়ে এগিয়ে চলছিলেন। মক্কায় এসে খাদীজাকে তিনি তাঁর পণ্য বুঝিয়ে দেন। খাদীজা দ্বিগুণ বা প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে তা বিক্রি করেন। মায়সারা খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্যর কথা এবং নবীজী (সা)-কে দুই ফেরেশতার ছায়াদানের কথা ব্যক্ত করেন। আর খাদীজা ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা, সম্ভ্রান্ত ও বুদ্ধিমতী মহিলা।

মায়সারা ঘটনার ইতিবৃত্ত শুনালে খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ডেকে পাঠালেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলেন, ‘চাচাতো ভাই! আপনার সুখ্যাতি, আপনার বিশ্বস্ততা, আপনার উত্তম চরিত্র, সত্যবাদিতা—এ সবের কারণে আমি আপনার প্রতি আকৃষ্ট।’ তারপর তিনি সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন। উল্লেখ্য যে, খাদীজা (রা) কুরায়শ মহিলাদের মধ্যে বংশগতভাবে অতিশয় সম্ভ্রান্ত, মর্যাদায় সকলের সেরা ও শ্রেষ্ঠ বিত্তবতী মহিলা ছিলেন। তাঁর সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই সুযোগ সাপেক্ষে তাঁর প্রতি লালায়িত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) বিষয়টি তাঁর চাচাদের গোচরে দেন। শুনে চাচা হামযা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিয়ে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ-এর নিকট গমন করেন। খুওয়াইলিদ-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর খাদীজার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিবাহ সম্পাদন করেন।

ইবনে হিশাম বলেনঃ মহর হিসাবে তাঁকে তিনি বিশটি উট প্রদান করেন। এটিই ছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রথম বিবাহ। খাদীজা (রা)-এর মৃত্যু পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা) আর কোন বিবাহ করেন নি।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ ইবরাহীম ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সকল সন্তান খাদীজার গর্ভেই জন্ম লাভ করেন। তাঁরা হলেন, ১. কাসিম (রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবুল কাসিম উপনামটি এই কাসিম-এর নামেই ছিল) ২. তায়্যিব ৩, তাহির ৪, যায়নাব ৫. রুকাইয়া ৬. উম্মে কুলসুম ৭. ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)।

ইবনে হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পুত্রদের মধ্যে কাসিম ছিলেন সকলের বড়। তারপর তায়্যিব। তারপর তাহির। আর কন্যাদের মধ্যে বড় হলেন, রুকাইয়া। তারপর যায়নাব, তারপর উম্মে কুলসুম, তারপর ফাতিমা (রা)।

বায়হাকী বলেন, আমি আবু বকর ইবনে আবু খায়ছামার একটি লিপিতে পড়েছি; তাতে উল্লেখ আছে যে, মুস‘আব ইবনে আব্দুল্লাহ যুবায়রী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম কাসিম, তারপর যায়নাব, তারপর আব্দুল্লাহ, তারপর উম্মে কুলসূম, তারপর আব্দুল্লাহ। তারপর ফাতিমা। তারপর রুকাইয়া। আর তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইনতিকাল করেন কাসিম। তারপর আব্দুল্লাহ্। আর খাদীজা (রা) আয়ু পেয়েছিলেন পঁয়ষট্টি বছর। মতান্তরে পঞ্চাশ বছর। এ অভিমতটিই বিশুদ্ধতর। অন্যদের মতে কাসিম বাহনে আরোহণের উপযুক্ত এবং বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত লাভের পর মারা যান। কেউ কেউ বলেন, কাসিম যখন মারা যান তখন তিনি দুগ্ধপোষ্য শিশু। তাঁর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ “ওর জন্য জান্নাতে স্তন্যদাত্রী রাখা আছে। সে তার দুধ পানের মেয়াদ পূর্ণ করবে।” তবে প্রসিদ্ধ মতে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এ উক্তিটি ছিল ইবরাহীম সম্পর্কে।

ইউনুস ইবন বুকায়র...... ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, খাদীজার গর্ভে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুই পুত্র সন্তান এবং চার কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। ১. কাসিম ২. আব্দুল্লাহ, ৩. ফাতিমা ৪. উম্মে কুলসুম ৫. যায়নাব ৬. রুকাইয়া। যুবায়র ইবনে বাক্কার বলেন, আব্দুল্লাহ তায়্যিব ও তাহিরও বলা হতো। কারণ তিনি হযরতের নবুয়ত প্রাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন।

যাহোক, নবী করীম (সা)-এর অন্য পুত্রগণ তাঁর নবুওত লাভের আগেই মারা যায়। অবশ্য কন্যাগণ নবুওতের যুগ লাভ করেন। তারা ইসলাম কবুল করেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে হিজরত করেন। ইবনে হিশাম বলেন, ইবরাহীম-এর জন্ম মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে। আলেকজান্দ্রিয়া-অধিপতি মুকাওকিস মারিয়াকে রাসূল (সা)-এর খেদমতে উপহাররূপে পাঠিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সকল সহধর্মিনী ও সন্তানগণের ব্যাপারে আমরা ইনশাআল্লাহ স্বতন্ত্রভাবে সীরাত অধ্যায়ের শেষে আলোকপাত করব।

ইবনে হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন খাদীজা (রা)-কে বিবাহ করেন, তখন তার বয়স ছিল পঁচিশ বছর। একাধিক আলিম আমার নিকট এরূপ বর্ণনা দিয়েছেন। তন্মধ্যে আবু আমর আল-মাদানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, “আমর ইবন আসাদ যখন খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। কুরায়শরা তখন কা‘বা নির্মাণ করছে।”

অনুরূপভাবে বায়হাকী হাকিম থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন খাদীজা (রা)-কে বিবাহ করেন, তখন তার বয়ষ ছিল পঁচিশ বছর। আর খাদীজার বয়স তখন পঁয়ত্রিশ, মতান্তরে পঁচিশ।

৯৭
খাদীজাকে বিবাহ করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পেশা
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

ما بعث الله نبيا الأراعي غنم

“আল্লাহ এমন কোন নবী প্রেরণ করেন নি, যিনি ছাগল চরান নি।”

এ কথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনিও?’ নবী করীম (সা) বললেনঃ “হ্যাঁ আমিও কয়েকটি মুদ্রা (কীরাত)-এর বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরিয়েছি।” আর কারো কারো মতে এর অর্থ ‘কারারীত’ নামক স্থানে বকরী চরিয়েছি। ইমাম বুখারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বায়হাকী রবী ইবনে বদর, আবুয যুবায়র ও জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “একটি জোয়ান উটনীর বিনিময়ে দুইটি সফরে আমি খাদীজার জন্য শ্রম দিয়েছি।”

ইমাম বায়হাকী (র) অপর এক সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, খাদীজার পিতা খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেওয়াকালে যতদূর মনে হয় নেশাগ্রস্ত ছিলেন।

ইমাম বায়হাকী অপর এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির যখনই লোকদেরকে রাসূল (সা)-এর খাদীজাকে বিবাহ করা সংক্রান্ত আলোচনা করতে শুনতেন, তখন বলতেন, রাসূল (সা)-এর খাদীজাকে বিবাহ করার বিষয়টি আমি সবচেয়ে ভালো জানি। আমি রাসূল (সা)-এর সমবয়সী ও অন্তরঙ্গ সঙ্গী ছিলাম। একদিন আমি তার সঙ্গে বের হই। হাযওয়ারা নামক স্থানে পৌঁছে আমরা দেখতে পেলাম যে, খাদীজার এক বোন বসে চামড়া বিক্রি করছেন। দেখে তিনি আমাকে নিকটে ডাকেন। আমি তার নিকটে ফিরে যাই আর রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে আমার অপেক্ষায় থাকেন। খাদীজার বোনটি আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা তোমার এই সঙ্গী কি খাদীজাকে বিবাহ করতে আগ্রহী নয়?’ আম্মার (রা) বলেন, ‘একথার কোন জবাব না দিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে বিষয়টি অবহিত করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, অবশ্যই আগ্রহী।’ খাদীজার বোনকে রাসূল (সা)-এর এ কথাটি জানালে তিনি বললেন, ‘আগামীকাল সকালে আপনারা আমাদের বাড়িতে আসুন।’ আমরা পরদিন সকালে খাদীজার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখতে পেলাম যে, তারা একটি গরু জবাই করেছেন এবং খাদীজার পিতাকে উত্তম জামা-কাপড় পরিয়ে রেখেছেন। তখন তার দাড়িতে খেজাব মেখে রেখেছিলেন। আমি খাদীজার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি তাঁর পিতার সঙ্গে আলাপ করলেন। খাদীজার পিতা তখন মদপান করে নেশাগ্রস্ত ছিলেন। খাদীজার ভাই তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং খাদীজাকে তাঁর নিকট বিবাহ দেওয়ার কথা প্রস্তাব করেন। তিনি তাতে সম্মতি দেন এবং তাকে বিবাহ দিয়ে দেন। তাঁরা গরুর গোশত রান্না করে তাঁদের আপ্যায়নের আয়োজন করেন। আমরা খাওয়া-দাওয়া করি।

এর মধ্যে খাদীজার পিতা ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে এই বলে চিৎকার করে ওঠেন যে, ‘আমার গায়ে এ সব কিসের পোশাক? দাড়িতে এসব কিসের খেজাব? এ খানাপিনা কিসের?’ জবাবে তাঁর যে কন্যা আম্মারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তিনি বললেন, ‘আপনার জামাতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আপনাকে এই পোশাক পরিয়েছেন। আর এই গাভীটি আপনার জন্য হাদিয়া এসেছিল; খাদীজার বিয়ে উপলক্ষে একে আমরা যবাই করেছি।’ কিন্তু তিনি খাদীজাকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহর নিকট বিয়ে দেওয়ার কথা অস্বীকার করে বসেন এবং উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে হিজরে ইসমাঈল তথা হাতীমে চলে আসেন। হাশিম গোত্রীয় লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং খাদীজার পিতার সঙ্গে কথা বলেন। খাদীজার পিতা বললেন, ‘তোমাদের যে লোকটির নিকট আমি খাদীজাকে বিবাহ দিয়েছি বলে তোমাদের ধারণা, সে কোথায়?’ জবাবে রাসূল (সা) তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হন। খাদীজার আব্বা নবীজী (সা)-কে এক নজর দেখে বললেন, ‘আমি যদি এর নিকট খাদীজাকে বিবাহ দিয়ে থাকি তো ভালো, অন্যথায় এখন আমি খাদীজাকে এর নিকট বিবাহ দিয়ে দিলাম।’

সুহায়লী উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম যুহরী তাঁর সীরাত গ্রন্থে পূর্বোক্ত বর্ণনার মত খাদীজার পিতা যখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেন, তখন তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন। মুআম্মিলী বলেন, সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, খাদীজার চাচা আমর ইবনে আসাদ খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দিয়েছিলেন। সুহায়লী এই অভিমতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস ও আয়েশা (রা) অনুরূপ অভিমত বর্ণনা করেছেন যে, আয়েশা (রা) বলেন, খুওয়াইলিদ ফিজার যুদ্ধের আগেই ইন্তিকাল করেছিলেন। তুব্বা বাদশাহ যখন হাজরে আসওয়াদকে ইয়ামানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তখন এই খুওয়াইলিদই তার বিরোধিতা করেছিলেন। খুওয়াইলিদ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে কুরায়শ-এর একদল লোকও তার সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর একদিন তুব্বা একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন এবং হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে বহাল রাখেন।

ইবনে ইসহাক সীরাত গ্রন্থের পরিশিষ্টে লিখেছেন, খাদীজার ভাই ‘আমর ইবনে খুওয়াইলিদ-ই খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দিয়েছিলেন। আল্লাহ্ই ভালো জানেন।

অধ্যায়

ইবনে ইসহাক বলেন, গোলাম মায়সারা খাদীজার নিকট পাদ্রীর যে উক্তির কথা উল্লেখ করেছিল এবং সফরে দুই ফেরেশতা কর্তৃক নবীজী (সা)-কে ছায়া প্রদান করতে দেখেছিল, খাদীজা (রা) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইব্‌নে নওফল ইব্‌নে আসাদ ইব্‌নে আব্দুল ওযযা ইব্‌নে কুসাইকে সে সম্পর্কে অবহিত করেন। শুনে ওয়ারাকা বললেন, ‘খাদীজা! ঘটনাটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে এ কথা নিশ্চিত যে, মুহাম্মদ এই উম্মতের নবী। আর আমি নিজেও জানি যে, এই উম্মতের জন্য একজন নবীর আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। এটাই সেই যুগ।’ এরপর থেকে ওয়ারাকা বিষয়টি সপ্রমাণিত দেখার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে শুরু করেন এবং নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন।

لججت وكنت في الذكرى لجوجا - لهم طالما ما بعث النشيجا

ووصف من خديجة بعد وصف - فقد طال انتظاری با خديجا

ببطن المكتين على رجاي - حديثك أن أرى منه خروجا

بما خبرننا من قول فس - من الرهبان أكره أن تعوجا

بأن محمدا سيسود قوما - ويخصم من يكون له حجيجا

ويظهر في البلاد ضباء نور - يقوم به البرية أن تموجا

فيلقى من يحاربه خسارا - ويلقى من يسالمه فلوجا

فيا ليتني إذا ما كان ذاكم - شهدت وكنت أولهم ولوجا

ولوجا في الذي كرهت قريش - ولو عجت بمتها عجيجا

أرجى في الذي گرهو اجميعا - ألى ذي العرش آن سفلوا عروجا

وهل أمر السفالة غير كفر - من يختار من سمك البروجا

فان بيقوا و أبق يكن أمور - يضج الكافرون لها ضحيجا

وأن أهلك فكل حتى سيلقى - من الأقدار متلفة خروجا

অর্থঃ আমি অতি আগ্রহের সাথে এমন একটি জিনিসকে বারবার বলে আসছি, যা দীর্ঘদিন যাবত অনেককে কাঁদিয়ে আসছে। খাদীজার নিকট থেকেও নতুন করে সে বিষয়ে নানাবিধ গুণের বিবরণ পাওয়া গেল। শোন খাদীজা! আমার প্রতীক্ষা অনেক দীর্ঘ হয়েছে। আমার প্রত্যাশা, মক্কার উচ্চভূমি ও নিম্নভূমির মধ্যখান থেকে যেন তোমার সে কথা বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে দেখতে পাই, যে কথা তুমি খৃস্টান ধর্মযাজকের সূত্রে জানালে। বস্তুত ধর্মযাজকের কথায় কোন হেরফের হোক, আমি তা চাই না।

সে প্রতীক্ষিত বিষয়টি এই যে, মুহাম্মদ অচিরেই সমাজের নেতা হবেন এবং নিজের বিরুদ্ধবাদীদের তিনি পরাস্ত করবেন। পৃথিবীর সর্বত্র তিনি এমন নূর ছড়াবেন, যা দ্বারা তিনি সমগ্র বিশ্বজগতকে উদ্ভাসিত করবেন। যারা তার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, তারা পর্যদস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর যারা তাঁর সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা হবে স্থিতিশীল ও বিজয়ী।

হায়! যখন এ সব ঘটনা ঘটবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকতে পারতাম, তা হলে তোমাদের সকলের আগে আমিই তার দলভুক্ত হতাম। আমি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হতাম, যাকে কুরায়শ অত্যন্ত অপছন্দ করবে। যদিও তারা তার বিরুদ্ধে চিৎকার করে মক্কাকে প্রকম্পিত করে তুলবে। যাঁকে তারা সকলে অপছন্দ করবে, আমার প্রত্যাশা তিনি আরশের অধিপতির নিকট পৌঁছে যাবেন, যদিও তারা অধঃপতিত হবে। ঊর্ধ্বলোকে আরোহণকারীকে যারা গ্রহণ করে, তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া এই অধঃপতনের আর কোন কারণ নেই।

কুরায়শরা যদি বেঁচে থাকে আর আমিও যদি বেঁচে থাকি তবে সেদিন অস্বীকারকারীরা চিৎকার করে তোলপাড় করবে। আর আমি যদি মারা যাই তাহলে যুবকরা দুর্ভাগ্যের কবল থেকে মুক্তির পথ প্রত্যক্ষ করবে।

ইবনে ইসহাক সূত্রে বর্ণিত ইউনুস ইবনে বুকায়র-এর বর্ণনা মতে ওয়ারাকা ইবনে নওফল আরো বলেছেনঃ

أتبكر أم أنت العشية رائع وفي الصدر من أضمارك الحزن قادح

لفرقة قوم لا أحب فراقهم - كانك عنهم بعد يومين نازح

و اخبار صدق خبرت عن محمد - يخبرها عنه إذا غاب اصح

أتاك الذي وجهت يا خير حره بغور وبالنجدبن حيث الصحاصح

إلى سوق بصري في الركاب التي غدت وهن من الأحمال قعص رواح

فيخرنا عن كل خير بعلمه وللحق ابواب لهن مفاتح

بأن ابن عبد الله أحمد مرسل - إلى كل من ضمت عليه الأباطم

وظنی به أن سوف يبعث صادقا كما أرسل العبدان لهن مفاتح

وموسى وأبراهيم حتى يرى له - يهاء ومنشور من الذكر واضم

ويتبعه حيا لوي وغالب شيائهم والأسيبون الجحاجح

فأن أبق حتى يذوك الناس دهره فانی به مستبشر الود فارح

وإلافانی با خديجة ناعلمی عن أرضك في الأرض العريضة سائح

অর্থাৎ, কী সকাল কী সন্ধ্যা, তোমার মনের ব্যথায় আমিও ব্যথিত। আমি আরো ব্যথিত সেই লোকদের বিরহে, যাদের বিরহ আমার কাম্য নয়। তুমিও বোধ হয় দু’দিন পর তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আমি আরো ব্যথিত সেই সত্য সংবাদের জন্য, যা মুহাম্মদ সম্পর্কে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতিতেই যে শুভকামনাকারী তাঁর সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে।

ওহে নাজ্দ ও গাওর-এর শ্রেষ্ঠ রমণী! ভারী মাল বোঝাই উটের আরোহী বণিক কাফেলার সঙ্গে বুসরা বাজারে তুমি যে যুবককে প্রেরণ করেছিলে, এখন তিনি তোমার কাছে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি আমাদেরকে সজ্ঞানে সংবাদ দিচ্ছে সার্বিক কল্যাণের। সত্য প্রকাশের অনেক দ্বার আছে, দ্বার খোলার জন্য আছে চাবি। তিনি সংবাদ দিচ্ছেন যে, এই প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলের সকলের প্রতি আব্দুল্লাহর পুত্র আহমদ প্রেরিত হচ্ছেন।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি হুদ, সালিহ, মূসা ও ইবরাহীম (আ)-এর ন্যায় সত্যবাদীরূপে আবির্ভূত হবেন অচিরেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। দিকে দিকে দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করবে তার ঔজ্জ্বল্য। আর তাঁর অনুসরণ করবে, লুওয়াই ও গালির গোত্র— আবাল-বৃদ্ধ সকলে। তাঁর আবির্ভাব পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকি, তবে তাকে পেয়ে আমি বড়ই আনন্দিত হব। অন্যথায় জেনে রাখ হে খাদীজা! তোমার দেশ ত্যাগ করে আমি চলে যাব অন্য কোন প্রশস্ত ভূখণ্ডে।

উমাবী এর সঙ্গে যোগ করে আরো উল্লেখ করেছেনঃ

فمتبع دين الذي أسس البنا - وكان له فضل على الناس راجح

وأسس بيانا بمكة ثابتا تلالا فيه بالظلام المصابح

مثابا لافناء القبائل كلها تخب إليه اليعملات الطلائح

حراجيح أمثال القداح من السري يعلق في أرساغهن السرايح

অর্থাৎ, ফলে মানুষ অনুসরণ করবে সেই ব্যক্তির দীনের, যিনি সব কল্যাণের কেন্দ্রবিন্দু, যিনি সৃষ্টির সেরা মানুষ। যিনি মক্কায় নির্মাণ করেছেন সুদৃঢ় এক ইমারত। সর্বত্র কুফরির ঘনঘটা সত্ত্বেও যে ঘরে জ্বলজ্বল জ্বলছে হেদায়াতের প্রদীপ। যে গৃহ সকল গোত্রের কেন্দ্রবিন্দু, যে ঘরের প্রতি চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসে দুর্বল ও সবল উট।

আবুল কাসিম সুহায়লী কর্তৃক তাঁর ‘আর রাউজুল উনুফ’ গ্রন্থে বর্ণিত ওয়ারাকা ইবনে নওফলের আরো কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপঃ

لقد نصحت لأقوام و قلت لهم أنا النذير قلا يغرركم أحد

لا تعبد إلها غير خالقكم فإن دعوكم فقولوا بعيننا حدد

سبحان ذي العرش سبحانا يدوح له وقبلناسبح الجودي والجمد

مستخر كل ما تحت السماء له لا ينبغي أن يناوى ملكه أحد

لا شيئ مما نرى تبقى بشاشته يبقى إلا له ويودي المال الولد

لم تغن عن هرمز يوما خزائنه والخلد قدحاولت عاد فما خلدوا

ولا سليمان إذ تجرى الرباح به والجن والإنس تجري بينها البرد

أين الملوك التي كانت لعزتها من كل أوب اليها وافد يقد

حوض هنالك مورود بلا كذب لا بد من ورده يوما لما وردوا

অর্থাৎ, আমি অনেককে উপদেশ দিয়েছি যে, আমি সতর্ককারী। অতএব কেউ যেন তোমাদেরকে প্রতারিত করতে না পারে। তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব করবে না। যদি তারা তোমাদের আহ্বান করে, তবে বলে দিবে- তোমাদের ও আমাদের মাঝে প্রাচীর রয়েছে।

আমরা পবিত্রতা জ্ঞাপন করি আরশের অধিপতির, পবিত্রতা যাঁর অবিচ্ছেদ্য গুণ। আমাদের আগে জুদী পর্বত আর জড় পদার্থরাজিও তার পবিত্রতা জ্ঞাপন করেছে। সৃষ্টির সবকিছু তার অনুগত। তাঁর রাজত্বের প্রতি হাত বাড়ানো কারো জন্য উচিত নয়।

আমরা যা কিছু দেখছি, তার কোনটিরই ঔজ্জ্বল্য অবশিষ্ট থাকবে না। থাকবেন শুধু ইলাহ— সম্পদ-সন্তান সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। মহা শক্তিধর হরমুজ সম্রাটের ধন-ভাণ্ডার তাঁর কাজে আসেনি। আদ জাতিও চিরদিন বেঁচে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বায়ু বহন করে বেড়াত যে সুলায়মান (আ)-কে তিনিও থাকতে পারেননি। মৃত্যুর পরোয়ানা পায়ে পায়ে ঘুরছে জিন-মানব সকলের। সেই প্রতাপশালী রাজা-বাদশাহরা এখন কোথায়, যাদের কাছে চতুর্দিক থেকে দলে দলে মানুষ আগমন করতো?

মৃত্যু একটি কূপ। এই কূপে সব মানুষকে একদিন না একদিন অবতরণ করতেই হবে। যেমন অবতরণ করেছে অতীতের লোকেরা।

সুহায়লী বলেন, আবুল ফারাজ এ পংক্তিগুলো ওয়ারাকার বলে উল্লেখ করেছেন এবং আরো বলেছেন, এর মধ্যে কোন কোন পংক্তি উমায়্যা ইব্‌নে আবি সালতের বলে উল্লেখ করা হয়। উমর (রা) মাঝেমধ্যে এ সব কবিতার পংক্তি প্রমাণস্বরূপ আবৃত্তি করতেন বলে আমরা পূর্বেই বলে এসেছি।

৯৮
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত নাভের পাঁচ বছর পূর্বে কুরায়শ কর্তৃক কা‘বার পুননির্মাণ
বায়হাকীর মতে কা’বা পুননির্মাণের কাজ সম্পাদিত হয় রাসূলুল্লাহ (সা) খাদীজাকে বিবাহ করার পূর্বে। তবে প্রসিদ্ধ মতে কুরায়শ কর্তৃক কা‘বা নির্মাণের ঘটনা ঘটে রাসূল (সা) খাদীজাকে বিবাহ করার দশ বছর পরে। ইমাম বায়হাকীর বর্ণনা মতে, পবিত্র কাবা সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আমলে। ইবরাহীম (আ)-এর কাহিনীতে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছি। ইমাম বায়বাকী সহীহ বুখারীতে এ বিষয়ে বর্ণিত ইবনে আব্বাস (রা)-এর একটি হাদীসও উল্লেখ করেছেন। সাথে সাথে পবিত্র কাবা হযরত আদম (আ)-এর আমলে নির্মিত হওয়া সংক্রান্ত ইসরাঈলী বর্ণনাগুলোও উল্লেখ করেছেন। সে সব বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়। কেননা কুরআনের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ইবরাহীম (আ)-ই সর্বপ্রথম কা‘বা নির্মাণ করেন এবং তার ভিত্তি স্থাপন করেন। বলা বাহুল্য, কা‘বার অবস্থান স্থলটি পূর্ব থেকেই কেন্দ্রীয় মর্যাদার অধিকারী সকল যুগে, সব সময় সম্মানিত ছিল। যেমন আল-কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( إِنَّ أَوَّلَ بَیۡت وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِی بِبَكَّةَ مُبَارَك ا وَهُد ى لِّلۡعَـٰلَمِینَ ۝ فِیهِ ءَایَـٰتُۢ بَیِّنَـٰت مَّقَامُ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَۖ وَمَن دَخَلَهُۥ كَانَ ءَامِن اۗ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَیۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَیۡهِ سَبِیل اۚ )

[Surah Aal-E-Imran 96 – 97]

“নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতো বাক্কায় (অর্থাৎ মক্কায়) তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম। আর যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য।” (আলে-ইমরানঃ ৯৬-৯৭)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু যর (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, আবু যর (রা) বলেন, আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ মসজিদ সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘আল-মাসজিদুল হারাম।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর কোনটি?’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আল- মাসজিদুল আকসা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই দু’য়ের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল কতটুকু?’ তিনি বললেনঃ ‘চল্লিশ বছর’।

এ বিষয়ে পূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি এবং একথাও উল্লেখ করেছি যে, মাসজিদুল আকসার ভিত্তি স্থাপন করেন ইসমাঈল তথা হযরত ইয়াকুব (আ)।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আছে যে, এই মক্কা নগরীকে আল্লাহ তা’আলা আসমান যমীন সৃষ্টি করার দিন থেকেই সম্মানিত করেছেন। ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিতই থাকবে।

ইমাম বায়হাকী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগেও বায়তুল্লাহ বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরাআনের ( وَإِذَا الْاَرْضُ مُدَّتْ ) (আর যখন পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হলো) এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এই বায়তুল্লাহর নিচ থেকেই পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। মানসুরও মুজাহিদ থেকে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

আমার মতে, এই বর্ণনাটি অতিশয় গরীব পর্যায়ের। সম্ভবত এটি সেই দুই থলের একটি থেকে নেয়া, যা ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা)-এর হস্তগত হয়েছিল।

এ দু’টি ইসরাঈলী বর্ণনায় ভরপুর ছিল। তাতে মুনকার ও গরীব বর্ণনাও ছিল অসংখ্য।

ইমাম বায়হাকী আরো বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আস (রা) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা জিবরাঈল (আ)-কে আদম ও হাওয়া (আ)-এর নিকট প্রেরণ করেন। জিবরাঈল (আ) তাঁদের বললেন, আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন, আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি ঘর নির্মাণ কর। এই বলে জিবরাঈল (আ) তাদেরকে ঘরের চৌহদ্দি চিহ্নিত করে দেন। আদম (আ) মাটি খনন ও হাওয়া (আ) মাটি স্থানান্তরের কাজ শুরু করে দেন। এক পর্যায়ে নিচ থেকে পানি তাদেরকে বলে, হে আদম! যথেষ্ট হয়েছে। আদম ও হাওয়া (আ) গৃহ নির্মাণ কাজ শেষ করলে আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আ)-এর প্রতি ঘরটি তাওয়াফ করতে প্রত্যাদেশ করেন এবং তাঁকে বলা হলো, তুমিই প্রথম মানুষ আর এটি প্রথম ঘর। এরপর কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর হয়রত নূহ (আ) সেই ঘরের হজ্জ করেন। এরপর আবার কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হলে পরে এক সময় হযরত ইবরাহীম (আ) গৃহটি পুননির্মাণ করেন। বায়হাকী বলেন, ইব্‌নে লাহীআ এমনি এককভাবে মারফু সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেন। আমার মতে এ রাবী যয়ীফ এটা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর-এর উক্তি হওয়ার অতিমতই অধিকতর শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য।

রাবী বর্ণনা করেন যে, আদম (আ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করেন। তখন একদল ফেরেশতা তাঁর নিকট এসে বলেন যে, ‘আপনার হজ্জ কবুল হয়েছে। হে আদম! আপনার পূর্বে আমরা দুই হাজার বছর ধরে হজ্জ করে আসছি।’

ইউনুস ইব্‌নে বুকায়র ইব্‌নে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবনে ইসহাক বলেন, মদীনার নির্ভরযোগ্য একদল আলিম আমার নিকট উরওয়া ইবনে যুবায়র থেকে বর্ণনা করেন যে, উরওয়া বলেন, কোন নবীই এমন ছিলেন না যে, তিনি বায়তুল্লাহর হজ্জ করেন নি তবে হুদ ও সালিহ (আ) এর ব্যতিক্রম। পূর্বে আমরা হুদ ও সালিহ (আ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করেছেন বলে উল্লেখ করেছি। তার অর্থ পারিভাষিক হজ্জ নয়- বরং কা‘বার অবস্থানস্থল প্রদক্ষিণ, যদিও সে সময় ওখানে কোন গৃহ ছিল না।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, খালিদ ইব্‌নে ‘আর‘আরা বলেন, এক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-এর নিকট আল্লাহর বাণীঃ

( إِنَّ أَوَّلَ بَیۡت وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِی بِبَكَّةَ مُبَارَك ا وَهُد ى لِّلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah Aal-E-Imran 96]

সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যে, ‘এটি কি পৃথিবীতে নির্মিত সর্বপ্রথম ঘর?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘না, বরং এটি সর্বপ্রথম সেই গৃহ, যাতে মানবজাতির জন্য বরকত, পথের দিশা ও মাকামে ইবরাহীম রক্ষিত হয়েছে। আর এটি সর্বপ্রথম এমন ঘর, যাতে কেউ প্রবেশ করলে সে নিরাপদ। যদি তুমি বল, চাইলে আমি তোমাকে এই ঘর নির্মাণের ইতিবৃত্ত শোনাতে পারি। শোন তবেঃ

আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি পৃথিবীতে আমার উদ্দেশে একটি ঘর নির্মাণ কর। প্রত্যাদেশ পাওয়ার পর হযরত ইবরাহীম (আ)-এর হৃদয় ভয়ে সংকুচিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ্ তা’আলা সাকীনা পাঠান আর তা হলো মস্তকবিশিষ্ট একটি প্রবল বায়ু প্রবাহ। ঐ বায়ু প্রবাহটি হযরত ইবরাহীম (আ)-কে আরবে নিয়ে আসে। তারপর তা বায়তুল্লাহর স্থানে সাপের মত কুণ্ডলী পাকায়! ইবরাহীম (আ) সেই স্থানে কা’বা নির্মাণ করেন। নির্মাণ কাজের শেষ পর্যায়ে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় তিনি পুত্র ইসমাঈলকে বললেন, আমাকে একটি পাথর খুঁজে এনে দাও। পাথর খুঁজে শূন্য হাতে ফিরে এসে ইসমাঈল (আ) দেখলেন, ‘হাজরে আসওয়াদ’ যথাস্থানে স্থাপিত হয়ে আছে। পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা আপনি কোথায় পেলেন?’ জবাবে ইবরাহীম (আ) বললেন, ‘তোমার ওপর ভরসা করতে পারেন না এমন এক সত্তা অর্থাৎ জিবরাঈল আকাশ থেকে এটি এনে দিয়েছেন।’ তখন ইবরাহীম (আ) কা’বার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন।

হযরত আলী (রা) বলেন, এভাবে এক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক সময়ে কাবাগৃহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তখন আমালিকা সম্প্রদায় তা’ পুননির্মাণ করে। তারপর আবার বিধ্বস্ত হলে জুরহুমরা পুননির্মাণ করে। আবার বিধ্বস্ত হলে এবার কুরায়শ সম্প্রদায় তা নির্মাণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন পরিণত যুবক। নির্মাণ কাজে সর্বশেষ হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে স্থাপন করতে গিয়ে কুরায়শদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সর্বপ্রথম যিনি এখানে উপস্থিত হবেন, তিনি আমাদের মাঝে এই বিরোধের সমাধান দেবেন। আমরা সকলে তার সিদ্ধান্ত মেনে নেব। দেখা গেল, তারপর সর্বপ্রথম যিনি তাদের কাছে উপস্থিত হলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের মধ্যে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এভাবে প্রদান করেন যে, পাথরটিকে একটি চাদরে বসিয়ে তাদের সব ক’টি গোত্র প্রধান পাথরটিকে যথাস্থানে নিয়ে যাবে।

আবু দাউদ তায়ালিসী আলী ইবনে আবী তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী (রা) বলেন, জুরহুমের পর যখন বায়তুল্লাহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তখন কুরায়শরা তা’ পুননির্মাণ করে। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে তারা এই মর্মে একমত হয় যে, অতঃপর যিনি সর্বপ্রথম এই দরজা দিয়ে কা‘বায় প্রবেশ করবেন, তিনি হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে স্থাপন করবেন। তারপর কা‘বার বনূ শায়বা দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সা) প্রবেশ করেন। কা‘বায় প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ (সা) একটি চাদর আনার আদেশ দেন। চাদর আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সা) হাজরে আসওয়াদটি তার মধ্যখানে রাখেন এবং প্রত্যেক গোত্রপতিকে চাদরটি এক এক অংশ ধরবার আদেশ দেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদেশমত গোত্রপতিরা পাথরটি তুলে নিয়ে যায়। শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে কাপড় থেকে তুলে পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করে দেন।

ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেন যে, ইবনে শিহাব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন এক মহিলা কা‘বায় সুগন্ধির ধুনি দেয়। তখন একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কা‘বার গিলাফে গিয়ে পড়ে। এতে আগুন ধরে যায় এবং কা‘বা ঘরটি পুড়ে যায়। তখন তারা তা ভেঙে ফেলে। তারপর কুরায়শ পুড়ে যাওয়া ঘরটি মেরামত করে। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত এসে তারা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, কোন্ গোত্র তা যথাস্থানে স্থাপন করবে। অবশেষে তারা বলে যে, এসো সর্বপ্রথম যিনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন, তার ওপর মীমাংসার ভার অৰ্পণ করি। দেখা গেল, এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বপ্রথম তাদের সামনে উপস্থিত হন। গায়ে তাঁর পশমী চাদর। কুরায়শ তার ওপর মীমাংসার ভার অর্পণ করে। তিনি পাথরটিকে একটি কাপড়ে তুলে নেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রের সরদারগণ বেরিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রত্যেককে কাপড়ের এক একটি অংশ ধরিয়ে দেন। তারা পাথরটিকে বহন করে নিয়ে যায় আর রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে পাথরটি কাপড় থেকে তুলে যথাস্থানে স্থাপন করে দেন। সেই থেকে কুরায়শ তাঁকে ‘আল-আমীন’ নামে অভিহিত করতে থাকে। তখনো তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হয়নি। এরপর থেকে মক্কার লোকেরা উট জবাই করার আগে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতো। বর্ণনাটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যুহরীর সীরাত থেকে নেয়া হলেও আলোচ্য বর্ণনাটি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। যেমন বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন অথবা প্রসিদ্ধ মতে যখন এই ঘটনাটি ঘটে, তখন রাসূলুল্লাহ (সা)- এর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক ইব্‌নে ইয়াসার তা’ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। মুসা ইব্‌নে উকবা বলেন, কা’বার পুননির্মাণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওতের পনের বছর আগে। মুজাহিদ, উরওয়া, মুহাম্মদ ইব্‌নে জুবায়র ইব্‌নে মুতইম প্রমুখের অভিমতও অনুরূপ।

মূসা ইবনে উকবার ভাষ্যমতে ফিজার ও কা‘বা নির্মাণের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল পনের বছর।

আমার মতে, ফিজার ও হিলফুল ফুযুলের ঘটনা সংঘটিত হয় একই বছরে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স বিশ বছর। এই উক্তিটি মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাকের মতকে শক্তিশালী করে।

মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন, কুরায়শের কা‘বা গৃহ পুননির্মাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ হওয়ার পটভূমি এই যে, বিভিন্ন সময়ের প্লাবনের ফলে কা‘বার দেয়াল কিছুটা খসে পড়ে। তাতে কুরায়শ কা‘বার অভ্যন্তরে পানি ঢুকে পড়ার আশংকা বোধ করে। অপরদিকে মালীহ নামক এক ব্যক্তি কা‘বার সুগন্ধি চুরি করে নিয়ে যায়। তাই কুরায়শ কা‘বার ভিত্তি আরো শক্ত করার এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ রোধ করার জন্য কাবার দরজা আরো উঁচু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরজন্য তারা অর্থ ও শ্রমিক সংগ্রহ করে। এবার তারা কা‘বার গৃহ ভেঙে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং এই বলে অন্যদের সতর্ক করে দেয় যেন কেউ এতে বাধা দিতে না আসে। ওলীদ ইব্‌নে মুগীরা সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন এবং কা’বার কিয়দংশ ভেঙে ফেলেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও তার অনুসরণ করে।

এতে কুরায়শরা আনন্দিত হয় এবং এর জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে। কিন্তু একজন শ্রমিকও এক পা সামনে অগ্রসর হতে পারছে না। তারা যেন দেখছে যে, একটি সাপ কা’বা ঘর জড়িয়ে আছে। সাপটির লেজ আর মাথা একই জায়গায়। এতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা আশংকা বোধ করে যে, কা’বা ঘর ভেঙে ফেলার চেষ্টার ফলেই এমনটি হয়েছে। অথচ কা’বাই ছিল তাদের রক্ষাকবচ ও মর্যাদার হেতু। কুরায়শরা এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এবার মুগীরা ইব্‌নে আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর ইবনে মাখযুম এগিয়ে আসেন। তিনি কুরায়শদের যথোপযুক্ত উপদেশ প্রদান করেন এবং তাদের আদেশ দেন যেন তারা ঝগড়া-বিবাদ না করে এবং কা‘বা নির্মাণে বিদ্বেষ পরিহার করে। তারা যেন কা’বা নির্মাণের কাজকে চার ভাগে ভাগ করে নেয় এবং এই মহান কাজে কোন হারাম সম্পদের মিশ্রণ না ঘটায়। বর্ণনাকারী বলেন, এবার কুরায়শরা মুগীরা ইব্‌নে আব্দুল্লাহর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করার উদ্যোগ নিলে সাপটি আকাশে চলে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের ধারণায় তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছিল। মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন, অনেকের ধারণা, একটি পাখি সাপটিকে ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে আজইয়াদের দিকে নিক্ষেপ করে।

মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন পঁয়ত্রিশ বছরে উপনীত হন, তখন কুরায়শরা কাবা নির্মাণের জন্য সম্মত হয়। তাদের এ আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কা‘বার ছাদ স্থাপন করা। আরেকটি কারণ, তারা কা‘বা গৃহ ধসে যাওয়ার আশংকা করছিল। উল্লেখ্য যে, সে সময় কা‘বা ঘর উচ্চতায় একজন মানুষের উচ্চতার চেয়ে সামান্য বেশি উঁচু ছিল। তারা কা’বা গৃহকে আরো উঁচু এবং ছাদবিশিষ্ট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঘটনার পটভূমি নিম্নরূপঃ

একদল লোক কা‘বার একটি মূল্যবান সম্পদ চুরি করে। তা কা‘বার মধ্যস্থলে একটি গর্তে রক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে তা বনূ মালীহ ইব্‌নে আমর ইব্‌নে খুযা’আর দাবীক নামক জনৈক গোলামের নিকট পাওয়া যায়। ফলে কুরায়শরা তার হাত কেটে দেয়। কুরায়শদের ধারণা ছিল, ওটি যারা চুরি করেছিল তারাই তা দাবীক-এর নিকট রেখেছিল।

অপরদিকে রোম দেশীয় এক বণিকের একটি জাহাজ সমুদ্রে ভেসে ভেসে জেদ্দায় এসে পৌঁছে এবং ভেঙে যায়। কুরায়শরা তার কাঠগুলো সংগ্রহ করে তা’ দিয়ে তারা কা’বার ছাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। উমুবী বলেন, জাহাজটি ছিল রোম সম্রাট কায়সার-এর। জাহাজটি পাথর, কাঠ, লোহা ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। কায়সার বাকুম রুমীর সঙ্গে জাহাজটি সেই গির্জা অভিমুখে রওয়ানা করিয়েছিলেন, যা পারস্যবাসীরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিল। জাহাজটি জেদ্দায় ঠেকে যাওয়ার পর আল্লাহ তার উপর দিয়ে প্রবল বায়ু প্রেরণ করেন। সেই বায়ুর ঝাপটায় জাহাজটি ভেঙে যায়।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, মক্কায় একজন কিবতী ছুঁতার ছিল। কা‘বা মেরামতের অনেক সরঞ্জাম সে প্রস্তুত করে দেয়। অপর দিকে একটি সাপ কা‘বার কূপ থেকে বেরিয়ে এসে কিবতী তার প্রতিদিন যে কাজ আঞ্জাম দিত, তা লণ্ডভণ্ড করে দিত। ভয়ংকর সেই সাপটি কাবার দেয়ালে উঠে উঁকি ঝুঁকি মারত। কেউ তার নিকট অগ্রসর হলে সে মুখ হা-করে ফণা তুলে তাকিয়ে থাকত। এতে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। এমনিভাবে প্রতিদিনকার ন্যায় একদিন সাপটি কা‘বার দেয়ালে উঠে উঁকি দিলে আল্লাহ একটি পাখি প্রেরণ করেন। পাখিটি সাপটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। ফলে কুরায়শ বলে, আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ আমাদের পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাদের আছে দক্ষ কারিগর, আছে কাঠ। আর সাপের সমস্যা থেকেও আল্লাহ্ আমাদের মুক্তি দিলেন।

সুহায়লী রাযীন থেকে বর্ণনা করেন, জুরহুমের আমলে এক চোর কা‘বার গুপ্ত ভাণ্ডার চুরি করার উদ্দেশ্যে কা‘বায় প্রবেশ করে। চুরি করার জন্য লোকটি কূপে অবতরণ করলে কূপের পাড় তার ওপর ভেঙে পড়ে। সংবাদ পেয়ে কুরায়শরা তাকে বের করে আনে এবং চুরি করা সম্পদ উদ্ধার করে। এরপর থেকে সেই কূপে একটি সাপ বসবাস করতে শুরু করে। সাপটির মাথা ছিল একটা ছাগল ছানার মাথার মত। পেট সাদা আর পিঠ কালো। সাপটি এই কূপে দীর্ঘ পাঁচ শ’ বছর অবস্থান করে। এটাই ছিল সেই মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বর্ণিত সাপ।

ইবনে ইসহাক বলেন, কুরায়শ যখন কা‘বার পুরনো ভিত্তি ভেঙে নতুনভাবে ভিত্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আবু ওহাব আমর ইব্‌নে আয়িদ ইব্‌নে আবদ ইব্‌নে ইমরান ইবনে মাখযূম-ইব্‌ন হিশামের মতে আয়িদ ইব্‌ন ইমরান ইব্‌ন মাখযূম কা‘বার একটি পাথর খসিয়ে নেয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি তার হাত থেকে লাফ দিয়ে স্বস্থানে ফিরে যায়। তা’ লক্ষ্য করে সে বলে, ‘হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কা‘বা নির্মাণে তোমরা তোমাদের উপার্জিত পবিত্র সম্পদ ব্যতীত অন্য কিছু মিশিয়ো না। এতে কোন গণিকার উপার্জন এবং সুদের এবং জুলুমের অর্থ যেন না ঢুকে। অনেকের ধারণা, এই উক্তিটি ওলীদ ইব্‌ন মুগীরা ইব্‌নে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন মাখযুম-এর। কিন্তু ইব্‌নে ইসহাক উক্তিটি আবু ওহাব ইব্‌নে আমরের হওয়ার মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইব্‌নে ইসহাক বলেন, উক্ত আবু ওহাব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতার মামা। তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও প্রশংসার্হ ব্যক্তি ছিলেন।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, তারপর কুরায়শরা কা‘বাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে নেয়। দরজার অংশ নির্মাণের দায়িত্ব নেয় বনূ আবদ মানাফ ও যুহরা গোত্রদ্বয়; রুকন আসওয়াদ ও রুকন ইয়ামানীর মধ্যবর্তী স্থানের দায়িত্ব পায় বনূ মাখযুম। আর কুরায়শের আরো কয়েকটি গোত্র তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করে। কাবার পিছনের অংশ পায় বনূ জামহ ও বনূ সাহম।

অপরদিকে বনূ আব্দুদ্দার ইব্‌নে কুসাই, বনু আসাদ ইব্‌নে আবদুল উযযা ও বনূ ‘আদী ইব্‌নে কা‘ব হিজর তথা হাতীম নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়।

কিন্তু মানুষ তা’ ভাঙার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছিল এবং প্রত্যেকেই গা-বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছিল। তখন ওলীদ ইব্‌নে মুগীরা বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাদেরকে কাবাগৃহ ভাঙার কাজ শুরু করে দিচ্ছি। এই বলে তিনি গাঁইতি নিয়ে কা‘বার সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং বলতে শুরু করেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মন থেকে ভীতি দূর করে দাও। কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু তো আমাদের অভীষ্ট নয়।” তারপর তিনি দুই রুকনের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেন। সেই রাতের মত এর ফল কি দাঁড়ায় তা দেখার জন্য লোকজন অপেক্ষা করে এবং বলে, ‘আমরা অপেক্ষা করছি। ওলীদ ইব্‌ন মুগীরা যদি কোন বিপদে পতিত হন, তা হলে আমরা কা‘বার একটুও ধ্বংস করতে যাবো না এবং যা ভাঙা হয়েছে, তাও পূর্বের মত করে দেব। আর যদি তাকে কোন বিপদ স্পর্শ না করে তা হলে বুঝে নেব, আমরা কা‘বা ভাঙার যে পরিকল্পনা নিয়েছি, আল্লাহ তাতে সন্তষ্ট আছেন।’ পরদিন সকালে ওলীদ আবার কা‘বা গৃহ ভাঙার কাজ শুরু করেন। তার সঙ্গে অন্যরাও ভাঙতে শুরু করে। অবশেষে ভাঙার কাজ যখন ইররাহীম (আ)-এর ভিত্তি পর্যন্ত পৌঁছে, তখন তারা একটি সবুজ পাথর দেখতে পায়। পাথরটি দন্তসারির ন্যায়; যেন একটি অপরটিকে জড়িয়ে আছে। ইয়ায়ীদ ইব্‌ন রুমান থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর এক হাদীসে كأسنمة الابل বলা হয়েছে। অর্থাৎ পাথরটি দেখতে উটের কুঁব্জের মত। সুহায়লী বলেন, আমার ধারণা সীরাতের বর্ণনায় শব্দটি كالسنه রূপে (জিহবার ন্যায়) ব্যবহার রাবীর ভ্রম মাত্র।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, কা‘বাগৃহ ভাঙার কাজে অংশগ্রহণকারীদের একজন কা’বার দুইটি পাথরের মাঝে শাবল ঢুকিয়ে চাপ দেয়। তাতে একটি পাথর নড়ে উঠলে সাথে সাথে সমগ্র মক্কানগরী কেঁপে ওঠে। ফলে তারা ঐ অংশ ভাঙা থেকে বিরত থাকে।

মূসা ইব্‌নে উকবা বলেনঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আব্বাস (রা)-এর ধারণা, কুরায়শ-এর কতিপয় প্রবীণ ব্যক্তি বলতেন যে, কুরায়শরা যখন কাবার কিছু পাথর ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর ভিত্তির নিকট সরিয়ে নিতে সমবেত হয়, তখন তাদের একজন প্রথম ভিত্তির একটি পাথর সরাতে উদ্যত হয়। অবশ্য তার কথা জানা ছিল না যে, এটি প্রথম ভিত্তির পাথর। সরানোর উদ্দেশ্যে লোকটি পাথরটি তুলে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা পাথরের নিচে বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পায়, যেন তা লোকটির চোখ ঝলসে দেয়ার উপক্রম হয় এবং পাথরটি তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে যথাস্থানে বসে যায়। তা’ দেখে লোকটি নিজে এবং নির্মাণ শ্রমিকরা ভীত হয়ে পড়ে। পাথরটি যখন তার নিচের বিদ্যুৎ ঝলকানি ঢেকে ফেলে, তখন শ্রমিকরা পুনরায় নির্মাণ কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং বলাবলি করে— কেউ এই পাথর এবং এই স্তরের অন্য কিছু সরাবার চেষ্টা করো না।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, আমার নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরায়শরা রুকন-এ সুরিয়ানী ভাষায় লিখিত একটি লিপি পেয়েছিল। কিন্তু তারা তার মর্ম উদ্ধার করতে পারেনি। পরে জনৈক ইহুদী তাদেরকে লিপিটি পাঠ করে শোনায়। তাতে লেখা ছিলঃ

أنا الله و بكة خلفتها يوم خلقت السموات والأرض وصورت الشمس والقمر وحفتها بسبعة أملاك حنفاء لأتزول حتى يزول أخشا بها مبارك لأهلها في الماء واللبن

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। এই মক্কাকে আমি সেদিন সৃষ্টি করেছি, যেদিন আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে আকৃতি দান করি। এবং তাকে আমি সাতটি রাজ্য দ্বারা আচ্ছাদিত করি। এর পাহাড় দু’টি স্থানান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত এর কোন নড়চড় হবে না। এর অধিবাসীদের জন্য এটি পানি ও দুধসমৃদ্ধ, বরকতময়।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, আমার নিকট বর্ণিত হয়েছে যে, কুরায়শরা মাকামে ইবরাহীমে একটি লিপি পায়। তাতে লেখা ছিল। এটি আল্লাহর পবিত্র মক্কা। এর তিন পথে এখানকার অধীবাসীদের জীবিকা আসে। এর অধিবাসীদের কেউ এর মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারবে না।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, লাইছ ইব্‌নে আবী সুলায়ম-এর ধারণা মতে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের চল্লিশ বছর আগে কুরায়শরা কা‘বায় একটি লিপি পায়। তাতে লেখা ছিলঃ

من يزرع خيرا يحصد غبطة ومن يزرع شرايحصد ندامة يعملون السيئات ويجزون الحسنات أجل كما يجتنى من الشوك العنب

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কল্যাণের বীজ বপন করবে, সে ঈর্ষণীয় ফসল তুলবে আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের বীজ বপন করবে, সে অনুতাপের ফসল তুলবে। মানুষ কাজ করে অসৎ আর প্রতিদান চায় সৎকাজের? এটা যেমন কাটাময় বৃক্ষ থেকে আঙ্গুর ফল লাভ করা আর কি?

সাঈদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-উমাবী বলেন, যুহরী সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ মাকামে ইবরাহীমে তিনটি লিপি পাওয়া যায়। এক পাতায় লেখা ছিল।

اني انا الله ذوبكة صنعتها يوم صنعت الشمس والقمر

وحففتها بسبعة أملاك حنفاء وباركت لأهلها في اللحم واللبن

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করার দিনই আমি তৈরি করেছি এবং সাতটি রাজ্য দ্বারা তাকে আবৃত করেছি ও তার অধিবাসীদের জন্য গোশতে ও দুধে বরকত দান করেছি।

দ্বিতীয় লিপিতে ছিলঃ

اني انا الله ذوبكة خلقت الرحم وشققت لها من إسمي فمن وصلها وصلته ومن قطعها بسته

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। আমি রাহিম (আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার নামকরণ করেছি। অতএব, যে লোক তা বজায় রাখবে আমি তাকে কাছে টেনে আনবো। আর যে তা ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্নভিন্ন করব।

তৃতীয় লিপিতে ছিলঃ

اني انا الله ذو بكة خلقت الخير والشر وقدرته فطوبى لمن أجريت الخير على يديه وويل لمن أجريت الشر على يديه

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ! আমি কল্যাণ অকল্যাণ ও তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছি। সুতরাং সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য, যার দুই হাতে আমি কল্যাণ চালু করেছি আর ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য, যার দুই হাতে আমি চালু করেছি অকল্যাণ।

ইবন ইসহাক বলেন, তারপর কুরায়শ গোত্রগুলো কাবা নির্মাণের জন্য পাথর সংগ্রহ করে। প্রত্যেক গোত্র স্বতন্ত্রভাবে পাথর সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। তারপর তারা কা‘বা নির্মাণ করে। নির্মাণ কাজ রুকন (হাজরে আসওয়াদ)-এর স্থান পর্যন্ত পৌঁছলে তারা বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক গোত্রই চাইছিল যেন তারাই তাকে স্বস্থানে পুনঃস্থাপন করে, অন্য কেউ নয়। তাদের এই বিবাদ চরম আকার ধারণ করে। তারা পরস্পর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। বনু আবদুদ্দার রক্ত ভর্তি একটি পাত্র উপস্থিত করে। তারপর তারা এবং বনু আদী ইব্‌ন কা‘ব ইব্‌ন লুআই মৃত্যুর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং পাত্রের রক্তে হাত ঢুকায়। তাকে তারা ‘লাকা‘তুদ্দাম’ তথা রক্ত চুক্তি নামে আখ্যা দেয়। কুরায়শরা এই অবস্থায় চার কি পাঁচ দিন অতিবাহিত করে। তারপর তারা মসজিদে সমবেত হয়ে পরামর্শ করে। কোন কোন বর্ণনাকারীর ধারণা, সে সময়ের কুরায়শদের প্রবীণতম ব্যক্তি আবূ উমাইয়া ইব্‌ন মুগীরা (ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন মাখযূম) বললেন, ‘হে কুরায়শ সম্প্রদায়! তোমাদের বিবাদের মীমাংসা তোমরা এভাবে কর যে, মসজিদের এই দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তার হাতে তোমরা এর মীমাংসার ভার অর্পণ করবে। সে তোমাদের মাঝে এই বিবাদের মীমাংসা করবে।’ এ প্রস্তাবে তারা সম্মত হয়। দেখা গেল, যিনি সর্ব প্রথম মসজিদে প্রবেশ করলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখে তারা বলে উঠল, এই যে আমাদের ‘আল-আমীন’ মুহাম্মদ এসেছেন, তাঁর সিদ্ধান্তে আমরা রাজী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকটে গেলে তারা বিষয়টি তাঁকে জানায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ “আমাকে একটি কাপড় এনে দাও।” কাপড় দেওয়া হলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) রুকন অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ নিজ হাতে তুলে সেই কাপড়ের ওপর রাখলেন। তারপর বললেনঃ “প্রত্যেক গোত্র কাপড়ের এক একটি কোন ধর। তারপর সকলে মিলে তা তুলে নিয়ে যাও। তারা তা-ই করল। তা’ নিয়ে তারা যথাস্থানে পৌঁছলে তিনি নিজ হাতে তা স্থাপন করে দেন। উল্লেখ্য যে, কুরায়শরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ইতিপূর্বেই ‘আল-আমীন’ নামে ডাকতো।

ইমাম আহমদ বলেন, সাইব ইবন আবদুল্লাহ্ বর্ণনা করেন যে, তিনি জাহেলী যুগে কাবা নির্মাতাদের একজন ছিলেন। তিনি বলেন, আমার একটি পাথর ছিল। আল্লাহর স্থলে আমি তার ইবাদত করতাম। আমি গাঢ় দুধ নিয়ে আসতাম, যা ছিল আমার অতি প্রিয়। সেই দুধ উক্ত পাথরের গায়ে ছিটিয়ে দিতাম আর একটি কুকুর এসে তা চেটে খেত এবং এক পা উঠিয়ে তাতে পেশাব করে দিত। কা‘বা নির্মাণের এক পর্যায়ে আমরা হাজরে আসওয়াদের স্থানে উপনীত হলাম। কিন্তু কেউ পাথরটি দেখতে পেলো না। হঠাৎ দেখা গেল, পাথরটি আমার পাথরগুলোর মধ্যখানে, দেখতে ঠিক মানুষের মাথার ন্যায়, যেন তা থেকে মানুষের মুখমণ্ডল আত্মপ্রকাশ করবে। দেখে কুরায়শের একটি গোত্র বলল, ‘এটা আমরা স্থাপন করব; আরেক গোত্র বলল, না আমরা স্থাপন করব।’ লোকেরা বলল, ‘এর সমাধানের জন্য তোমরা একজন সালিস নিযুক্ত কর।’ অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, বাহির থেকে সর্বপ্রথম যিনি এখানে আসবেন, তিনিই এ সমস্যার সমাধান করবেন। আসলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)। তাঁকে দেখে লোকেরা বলে উঠল, ‘তোমাদের মাঝে আল-আমীন এসে গেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তারা বিষয়টি অবহিত করল। তিনি পাথরটি একটি কাপড়ে রাখলেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রকে ডাকলেন। তারা কাপড়ের এক একটি প্রান্ত ধরে পাথরটি তুলে যথাস্থানে নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে তা যথাস্থানে স্থাপন করেন।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে কা‘বা আঠার হাত লম্বা ছিল। প্রথমে কা‘বাকে মিসরীয় কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখা হতো। তারপর ‘বারূর’ বস্ত্র দ্বারা ঢাকা হয়। সর্বপ্রথম যিনি কা‘বায় রেশমী কাপড়ের গিলাফ পরান, তিনি হলেন হাজ্জাজ ইব্‌ন ইউসুফ।

আমার মতে, কুরায়শরা কা‘বা থেকে হিজরকে বের করে ফেলে। পরিমাপে তা উত্তর দিক থেকে ছয় কি সাত হাত। এর কারণ অর্থের অভাব। কা‘বাকে হুবহু ইবরাহীমী ভিত্তির ওপর নির্মাণ করার সামর্থ্য কুরায়শদের ছিল না। তারা পূর্ব দিকে কা‘বার একটি মাত্র দরজা রাখে। আর তা স্থাপন করে উঁচু করে। যাতে ইচ্ছা করলেই যে কেউ তাতে প্রবেশ করতে না পারে, যেন প্রবেশাধিকার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বলেছিলেনঃ

ألم ترى أن قومك قصرت بهم النفقة ولولا حدثان قومك بكفر لنقضت الكعبة وجعلت لها بابا شرقيا وبابا غربيا ودخلت فيها الحجر

অর্থাৎ, তুমি কি জানো না যে, তোমার সম্প্রদায় অর্থ সংকটে ছিল? তোমার সম্প্রদায় নওমুসলিম না হলে আমি কা‘বাকে ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতাম। তখন পূর্বমুখী একটি দরজা আর পশ্চিম মুখী একটি দরজা রাখতাম। আর হিজর তথা হাতীমকে কা‘বার অন্তর্ভুক্ত করে নিতাম!

এ কারণে আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র ক্ষমতাসীন হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশনা মোতাবেক কাবাকে পুনঃনির্মাণ করেন। তাতে কা’বা পরিপূর্ণরূপে ইবরাহীম (আ)-এর ভিত্তিতে ফিরে আসে এবং যারপরনাই আকর্ষণীয় গৃহে পরিণত হয়। তিনি মাটি সংলগ্ন করে দু’টি দরজা তৈয়ার করেন। একটি পূর্বমুখী আর অপরটি পশ্চিমমুখী। একটি দিয়ে মানুষ প্রবেশ করতো, অপরটি দিয়ে বের হতো। তারপর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ ইবন যুবায়রকে হত্যা করে খলীফা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের নিকট পত্র লেখেন। তাতে তিনি ইবন যুবায়র কর্তৃক কাবা পুনঃনির্মাণের কথা উল্লেখ করেন। তখন তাদের বিশ্বাস ছিল, ইবন যুবায়র কাজটি নিজের মর্জিমত করেছিলেন। তাই খলীফা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান কা’বাকে পূর্বের মত করে নির্মাণ করার আদেশ দেন। তখন উত্তর দিকের দেয়াল ভেঙে হিজরকে বের করে ফেলা হয়। এবং তার পাথরগুলোকে কা’বার মাটিতে সযত্নে পুঁতে রাখা হয়। দরজা দু’টো উঁচু করা হয় এবং পশ্চিম দিককে বন্ধ করে দিয়ে পূর্ব দিককে আগের মত রাখা হয়। পরবর্তীতে খলীফা মনসুর কাবাকে ইবন যুবায়রের ভিতের ওপর ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ইমাম মালিকের মতামত চাইলে তিনি বলেন, রাজা-বাদশারা কা’বাকে তামাশার পাত্রে পরিণত করুক আমি তা পছন্দ করি না। ফলে খলীফা মনসুর কাবাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দেন। এখনও তা সেই রূপেই বিদ্যমান।

কাবার আশপাশ থেকে সর্বপ্রথম ঘরবাড়ি সরিয়ে দেন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)। মালিকদের নিকট থেকে ক্রয় করে তিনি সেগুলো ভেঙে ফেলেন। পরে হযরত উসমান (রা) আরো কয়েকটি বাড়ি ক্রয় করে সেগুলোও ভেঙে ফেলেন। তারপর ইবন যুবায়র (রা) তার শাসনামলে কা’বার ভিতকে আরও মজবুত করেন। দেয়ালগুলোর সৌন্দর্য এবং দরজার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তবে তিনি আর কিছু করতে পারেননি। তারপর আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান খলীফা হয়ে কাবার দেয়াল আরো উঁচু করেন এবং হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের মাধ্যমে কাবাকে রেশমী কাপড়ের গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন। সূরা বাকারার আয়াতঃ

( وَإِذۡ یَرۡفَعُ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِـۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَیۡتِ وَإِسۡمَـٰعِیلُ )

[Surah Al-Baqarah 127]

এর তাফসীরে আমরা কাবা নির্মাণের কাহিনী এবং এতদসংক্রান্ত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছি। প্রয়োজনে সেখানে দেখে নেয়া যেতে পারে।

ইবন ইসহাক বলেন, যখন তারা কাবার নির্মাণ কাজ তাদের ইচ্ছানুযায়ী শেষ করে তখন যুবায়র ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে সেই সাপটির কাহিনী শোনান, যার ভয়ে কুরায়শরা কা’বা নির্মাণের কাজ করতে পারছিল না। ঘটনাটি তিনি কাব্যাকারে বিবৃত করেন,

عجبت لما تصوبت العقاب إلى الشعبان وهي لها اضطراب

وقد كانت تكون لها کشیس وأحيانا يكون لها وثاب

إذا قمنا إلى التاسيس شدت تهيبنا البناء وقد نهاب

فلما أن خشينا الزجر جاءت عقاب تتلئب لها انصباب

فضمتها اليها تم خلت لنا البنيان ليس لها حجاب

فقمنا حاسدبن الى بناء لنا منه القواعد والتراب

غداة يرفع التاسيس منه وليس على مساوينا ثياب

اعزبه المليك بني لوی فليس لأصله منهم ذهاب

وقد حسدت هنالك بنوعدی ومرة قد تقدمها كلاب

فبوأنا المليك بذاك عزا وعند الله يلتمس الثواب

অর্থাৎ, যে সাপটি কুরায়শের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, একটি ঈগল পাখি কিরূপ নির্ভুলভাবে তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। সাপটি কখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে কখনো ফণা তুলে ছোবল মারার ভঙ্গিতে থাকত। যখনই আমরা কা’বা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি, তখনই সে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং তার স্বভাবসুলভ ভীতিপ্রদ ভঙ্গিতে ভয় দেখিয়েছে। আমরা যখন এই আপদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, তখন ঈগলটি এসে আমাদেরকে রক্ষা করল এবং সংস্কারের কাজে আমাদের আর কোন বাধা থাকল না।

পরদিন আমরা সকলে বিবস্ত্র অবস্থায় সংস্কার কাজে লেগে গেলাম। মহান আল্লাহ এ কাজটি করার সুযোগ দিয়ে বনু লুওয়াইকে অর্থাৎ আমাদেরকে গৌরবান্বিত করলেন। তবে তাদের পরে বনু আদী এবং বনু মুররাও এ কাজে এসে জড়ো হয়েছে। বনু কিলাব ছিল এ কাজে তাদের চেয়েও অগ্রণী। আল্লাহ আমাদেরকে কাবার নিকট বসবাসের সুযোগ দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আশা করা যায়, এ কাজের প্রতিদান আল্লাহর নিকট পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য যে, এর আগে একটি অধ্যায়ে আমরা বলে এসেছি, আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জাহেলিয়াতের পঙ্কিলতা থেকে সর্বতোভাবে নিরাপদ রেখেছিলেন। যেমন কা’বা নির্মাণের সময় তিনি এবং তার চাচা আব্বাস (রা) পাথর স্থানান্তরের কাজ করতেন। এক পর্যায়ে তিনি পরিধানের কাপড় খুলে তা’ কাঁধের ওপর রেখে পাথর বহন করে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাকে কাপড় খুলতে বারণ করে দেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তিনি কাপড় পরে নেন।

অধ্যায়

ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শদেরকে হুমুস নামে অভিহিত করা হতো। এর ধাতুগত অর্থ দীনের ব্যাপারে চরম কঠোরতা। তাদেরকে এই নামে নামকরণের কারণ হলো, তারা হারম শরীফকে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতো। যে কারণে তারা আরাফার রাতে এখান থেকে বের হতো না। তারা বলত, আমরা হলাম হারমের সন্তান এবং এর অধিবাসী। ফলে তারা এ কথা আরাফায় অবস্থান বর্জন করত। এটা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর অন্যতম স্মৃতি একথা জানা থাকা সত্ত্বেও তারা তা বর্জন করত। মনগড়া কুসংস্কার থেকে তারা একটুও নড়চড় করতো না। ইহরাম অবস্থায় তারা দুধ থেকে ছানা ঘি চর্বি কিছুই সংগ্রহ করত না। তারা পশমের তৈরি তাঁবুতে প্রবেশ করত না এবং ছায়ায় বসার প্রয়োজন হলে চামড়ার ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘরের ছায়ায় বসত না। হজ্জ ও উমরা পালনকারীদেরকে তারা তাদের সরবরাহকৃত পোশাক ব্যতীত অন্য পোশাকে তাওয়াফ করতে এবং তাদের দেয়া খাবার ব্যতীত অন্য খাবার খেতে বারণ করত। হজ্জ, উমরাহ পালনকারীদের কেউ যদি কুরায়শ, তাদের বংশধর কিংবা তাদের দলভুক্ত কিনানা ও খুযাআ কারোর নিকট থেকে কাপড় না পেত, তবে তাকে বিবস্ত্র তাওয়াফ করতে হতো। মহিলাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতো। এ কারণে এমন পরিস্থিতিতে মহিলারা যথাস্থানে হাত রেখে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করত আর বলতঃ

اليوم يبد وبغضه أوكله - وبعد هذا اليوم لا أحله

অর্থাৎ, আজ আমার লজ্জাস্থানের অংশবিশেষ বা পুরোটা বিবস্ত্র হয়েছে ঠিক কিন্তু আজকের পর আর এমনটি হতে দেব না।’

যদি কেউ কোন হুমসীর কাপড় পাওয়া সত্ত্বেও সে নিজের কাপড় পরে তাওয়াফ করত তবে তাওয়াফ শেষে তাকে সেই কাপড় খুলে ফেলে দিতে হতো। পরে সেই কাপড় আর সে ব্যবহার করতে পারত না। তার বা অন্য কারো জন্য সেই কাপড় স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না। আরব সেই কাপড়ের নাম দিয়েছিল ‘আল-লাকি’। ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শ এমনি কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। এই অবস্থায় আল্লাহ মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণ করেন এবং মুশরিকদের মনগড়া কুসংস্কার প্রতিরোধে তাঁর ওপর কুরআন নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ثُمَّ أَفِیضُوا۟ مِنۡ حَیۡثُ أَفَاضَ ٱلنَّاسُ وَٱسۡتَغۡفِرُوا۟ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُور رَّحِیم ࣱ)

[Surah Al-Baqarah 199]

“তারপর অন্যরা যেখান থেকে প্রত্যবর্তন করে, তোমরাও সেখোন থেকে প্রত্যাবর্তন করবে আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” (২ বাকারাঃ ১৯৯-২০০)

অর্থাৎ আরবের সর্বসাধারণ যেভাবে আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করে, তেমনি তোমরাও আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন কর।

আমরা আগেও উল্লেখ করে এসেছি যে, ওহী নাযিলের পূর্ব থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ প্রদত্ত তাওফীক অনুযায়ী আরাফায় অবস্থান করতেন।

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কুরায়শরা লোকদের ওপর যে পোশাক ও যে খাবার হারাম করে নিয়েছিল, তা বাতিল ঘোষণা করে বলেনঃ

( یَـٰبَنِیۤ ءَادَمَ خُذُوا۟ زِینَتَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِد وَكُلُوا۟ وَٱشۡرَبُوا۟ وَلَا تُسۡرِفُوۤا۟ۚ إِنَّهُۥ لَا یُحِبُّ ٱلۡمُسۡرِفِینَ ۝ قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِینَةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِیۤ أَخۡرَجَ لِعِبَادِهِۦ وَٱلطَّیِّبَـٰتِ مِنَ ٱلرِّزۡقِۚ )

[Surah Al-A'raf 31 - 32]

অর্থাৎ, হে বনী আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে, আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করলো? (আ’রাফঃ ৩১-৩২)

যিয়াদ আল বুকায়ী ইবন ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, কুরায়শের এসব কুসংস্কার আবিষ্কারের ঘটনা হাতীর ঘটনার আগে ঘটেছিল, নাকি পরে তা আমার জানা নেই।

৯৯
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত লাভ এবং এতসম্পর্কিত কয়েকটি পূর্বাভাস
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, অনেক ইহুদী পণ্ডিত, নাসারা গণক এবং আরবের অনেকে আবির্ভাবের আগেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্পর্কে বলাবলি করতেন যে, তাঁর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইহুদী ও নাসারা পণ্ডিতগণ তাদের কিতাবসমূহে বর্ণিত রাসূল (সা)-এর গুণাবলী ও তাঁর আগমন কালের বিবরণ এবং তাদের নবীদের প্রতিশ্রুতি থেকে বিষয়টির ব্যাপারে অবহিত হতে পেরেছিলেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ٱلَّذِینَ یَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِیَّ ٱلۡأُمِّیَّ ٱلَّذِی یَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِیلِ )

[Surah Al-A'raf 157]

অর্থাৎ, যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইঞ্জীল, যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়; (৭ আ’রাফঃ ১৫৭)

আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ

( وَإِذۡ قَالَ عِیسَى ٱبۡنُ مَرۡیَمَ یَـٰبَنِیۤ إِسۡرَ ءِیلَ إِنِّی رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَیۡكُم مُّصَدِّق ا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیَّ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَمُبَشِّرَۢا بِرَسُول یَأۡتِی مِنۢ بَعۡدِی ٱسۡمُهُۥۤ أَحۡمَدُۖ فَلَمَّا جَاۤءَهُم بِٱلۡبَیِّنَـٰتِ قَالُوا۟ هَـٰذَا سِحۡر مُّبِین ࣱ)

[Surah As-Saf 6]

“স্মরণ কর, যখন ঈসা ইবন মরিয়ম বলল, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর রাসূল, আমার আগমন পূর্বের তাওরাতের সত্যায়নকারী রূপে এবং এমন এক রাসূলের সুসংবাদ দানকারী রূপে যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম হবে আহমদ।”

আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেনঃ

( مُّحَمَّد رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِینَ مَعَهُۥۤ أَشِدَّاۤءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَاۤءُ بَیۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّع ا سُجَّد ا یَبۡتَغُونَ فَضۡل ا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَ  ٰ⁠نࣰ اۖ سِیمَاهُمۡ فِی وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ ذَ  ٰ⁠ لِكَ مَثَلُهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِی ٱلۡإِنجِیلِ )

[Surah Al-Fath 29]

“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকূ ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন পরিস্ফুটিত থাকবে; তাওরাতে তাদের বর্ণনা এইরূপ এবং ইনজীলেও এইরূপই। (৪৮, ফাতহঃ ২৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِیثَـٰقَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ لَمَاۤ ءَاتَیۡتُكُم مِّن كِتَـٰب وَحِكۡمَة ثُمَّ جَاۤءَكُمۡ رَسُول مُّصَدِّق لِّمَا مَعَكُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهِۦ وَلَتَنصُرُنَّهُۥۚ قَالَ ءَأَقۡرَرۡتُمۡ وَأَخَذۡتُمۡ عَلَىٰ ذَ  ٰ⁠ لِكُمۡ إِصۡرِیۖ قَالُوۤا۟ أَقۡرَرۡنَاۚ قَالَ فَٱشۡهَدُوا۟ وَأَنَا۠ مَعَكُم مِّنَ ٱلشَّـٰهِدِینَ )

[Surah Aal-E-Imran 81]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি অতপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। (৩, আলে ইমরানঃ ৮১)।

সহীহ বুখারীতে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, যদি মুহাম্মদের আবির্ভাব ঘটে আর তখন তিনি জীবিত থাকেন, যেন অবশ্যই তিনি মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন। আর প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ এই নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা নিজ নিজ উম্মত থেকে এই অঙ্গীকার নিয়ে রাখেন যে, যদি মুহাম্মদের আবির্ভাব ঘটে আর তারা তখন জীবিত তাকে যেন তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে এবং তাঁকে সাহায্য করে এবং তাঁর অনুসরণ করে।

এই হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, প্রত্যেক নবীই মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যাপারে সুসংবাদ প্রদান করেছেন এবং তাঁর আনুগত্য করার আদেশ দিয়েছেন।

হযরত ইবরাহীম (আ) মক্কাবাসীদের জন্য যে দোয়া করেছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেনঃ

( رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِیهِمۡ رَسُول ا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوا۟ عَلَیۡهِمۡ ءَایَـٰتِكَ )

[Surah Al-Baqarah 129]

অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করবেন, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবেন। (২ বাকারাঃ ১২৯)

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, হযরত আবু উমামা (রা) বলেছেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার মিশনের সূচনা কি ছিল?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ

دعوة ابی ابراهيم وبشرى عیسی ورات امى انه يخرج منها نور أضاءت له قصور الشام

“আমার মিশনের সূচনা আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া, ঈসার সুসংবাদ আর আমার মা দেখেছিলেন যে, তার ভিতর থেকে এমন একটি আলো বের হচ্ছে, যার ফলে শামের রাজপ্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক অন্যান্য সাহাবী সূত্রেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

অর্থাৎ সাহাবী হযরত আবু উমামা (রা) জানতে চেয়েছিলেন যে, মানুষের মাঝে রাসূল (সা)-এর মিশনের সূচনা এবং তার প্রচার প্রসার কিভাবে হয়েছিল? তাই নবীজী (সা) সেই ইবরাহীমের দোয়ার কথা উল্লেখ করলেন, যিনি গোটা আরবের মধ্যমণি হিসেবে স্বীকৃত। তারপর ঈসা (আ)-এর সুসংবাদের কথা বললেন, যিনি বনী ইসরঈলের নবীদের সর্বশেষ নবী। উপরে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এই দুই নবীর মাঝে আরো যে সব নবী ছিলেন, তাঁরাও মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে সুসংবাদ প্রদান করে গেছেন। পক্ষান্তরে ঊর্ধ্বজগতে হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টির পূর্ব থেকেই রাসূল (সা)-এর মিশন প্রসিদ্ধ, আলোচনার বিষয় এবং জ্ঞাত বিষয় ছিল। যেমন ইমাম আহমদ (র) ইরবাজ ইবন সারিয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইরবাজ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

إني عبد الله خاتم النبين وإن أدم لمنجدل في طينته وسا نبئگم باول ذالك دعوة إبراهيم وبشارة عيسی بی ورؤيا أمي التي رأت وكذلك أمهات المؤمنين

অর্থাৎ, আমি আল্লাহর বান্দা, সর্বশেষ নবী। অথচ আদম তখন তার কাদামাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছেন। আর আমি তোমাদেরকে এর সূচনা সম্পর্কে অবহিত করব। এটি ইবরাহীমের দোয়া, আমার ব্যাপারে ঈসার সুসংবাদ এবং আমার মায়ের দেখা স্বপ্ন। তদ্রুপ মুমিনদের মাগণেরও।

[এটা সম্ভবত ছাপার ভুল। ইমাম আহমদের মূল বর্ণনায় وكذلك امهات الانبياء আছে।

অর্থাৎ নবীগণের মাগণই এরূপ স্বপ্নই দেখে থাকেন। - মাওয়াহেব]

লায়ছ মুআবিয়া ইবন সালিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, মুআবিয়া ইবন সালিহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মা তাকে প্রসব করার সময় একটি আলো দেখতে পান যার ফলে শামের রাজপ্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গিয়েছিল।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, মায়সারা আল-ফাজর (রা) বলেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন?’ জবাবে তিনি বললেনঃ

و أدم بين الروح والجسد

অর্থাৎ, আদম যখন রূহ আর দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় (আমি তখনও নবী)।

উমর ইবন আহমদ ইবন শাহীন দালায়িলুন্নবুয়্যাতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার জন্য নবুওত সাব্যস্ত হয় কখন? জবাবে নবী করীম (সা) বললেন,

بين خلق أدم ونفخ الروح فيه

অর্থাৎ, আদম-এর সৃষ্টি এবং তাঁর মধ্যে রূপ ফুকে দেয়ার সময়ও আমি নবী ছিলাম।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেনঃ

وادم منجدل في طينته

অর্থাৎ, আদম তখন তাঁর সৃষ্টির উপাদান কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) পবিত্র কুরআনের আয়াত

( وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ مِیثَـٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوح ࣲ)

[Surah Al-Ahzab 7]

এর ব্যাখ্যায় বলেছেন,

كنت أول النبين في الخلق و أخرهم في البعث

অর্থাৎ, সৃষ্টির বেলায় আমি সর্বপ্রথম নবী আর আবির্ভাবের দিক থেকে সকলের শেষ নবী।

এককালে জিন শয়তানরা আড়ি পেতে আসমানের সংবাদ সংগ্রহ করত। এভাবে তারা ফেরেশতাদের আলোচনা শুনে তা তাদের গণকদের কানে দিত। তখনও তারকা নিক্ষেপের মাধ্যমে তাদের বিতাড়িত করা হতো না। এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাব সংক্রান্ত কিছু তথ্যও তারা সংগ্রহ করে আরবের গণকদের শোনায়। ফলে আরবের মানুষ তা জেনে যায়। রাসূল (সা)-এর নবুওত প্রাপ্তির প্রাক্কালে শয়তানদের আকাশের সংবাদ শ্রবণের সে পথ রুদ্ধ করা হয় এবং শয়তান ও তারা যে সব স্থানে বসে সংবাদ শ্রবণ করত, তার মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি করা হয়। তাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হয়। তাতে শয়তানরা বুঝে নেয় যে, আল্লাহর আদেশে নতুন কিছু একটা ঘটেছে বলেই এমন হচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলের প্রতি নাযিল করেন,

( بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ قُلۡ أُوحِیَ إِلَیَّ أَنَّهُ ٱسۡتَمَعَ نَفَر مِّنَ ٱلۡجِنِّ فَقَالُوۤا۟ إِنَّا سَمِعۡنَا قُرۡءَانًا عَجَب ا ۝ یَهۡدِیۤ إِلَى ٱلرُّشۡدِ فَـَٔامَنَّا بِهِۦۖ وَلَن نُّشۡرِكَ بِرَبِّنَاۤ أَحَد ࣰا)

[Surah Al-Jinn 1 - 2]

অর্থাৎ, বল, আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে— আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ-নিদের্শ করে; ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক স্থির করব না। (৭২ জিনঃ ১-২)

আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে এসব বিষয়ে আলোচনা করেছি। আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ

( وَإِذۡ صَرَفۡنَاۤ إِلَیۡكَ نَفَر ا مِّنَ ٱلۡجِنِّ یَسۡتَمِعُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوۤا۟ أَنصِتُوا۟ۖ فَلَمَّا قُضِیَ وَلَّوۡا۟ إِلَىٰ قَوۡمِهِم مُّنذِرِینَ ۝ قَالُوا۟ یَـٰقَوۡمَنَاۤ إِنَّا سَمِعۡنَا كِتَـٰبًا أُنزِلَ مِنۢ بَعۡدِ مُوسَىٰ مُصَدِّق ا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهِ یَهۡدِیۤ إِلَى ٱلۡحَقِّ وَإِلَىٰ طَرِیق مُّسۡتَقِیم ࣲ)

[Surah Al-Ahqaf 29 - 30]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে যারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হলো, তারা বলল, চুপ করে শ্রবণ কর। যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে। তারা বলল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসার পরে, এটা তার পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। (৪৬ আহকাফঃ ২৯-৩০)

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, ইয়াকুব ইব্‌ন উতবা ইব্‌ন মুগীরা ইব্‌ন আখনাস বলেন, উল্কা নিক্ষেপের ফলে সর্বপ্রথম ভয় পেয়েছিল সাকীফ গোত্রের একটি শাখা। আমর ইবন উমাইয়া নামক বনূ ইলাজ-এর অতি তীক্ষ্ণধী ও ধূর্ত এক ব্যক্তি ছিল। সাকীফ এর সেই লোকগুলো তার নিকট গিয়ে বলল, ‘হে আমর! এসব উল্কা নিক্ষেপের ফলে আকাশে কী ঘটেছে, আপনি কী তা লক্ষ্য করছেন না?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ, লক্ষ্য করছি বৈকি! তোমরা খোঁজ নিয়ে দেখ, এটি কোন তারকা? যদি এটি জলে-স্থলে, শীতে-গ্রীষ্মে দিক নির্ণয়কারী সেই তারকা হয়, তবে আল্লাহর শপথ, এই ঘটনা দুনিয়ার বিপর্যয় আর এই সৃষ্টি জগতের ধ্বংস বৈ নয়। আর যদি এটি অন্য তারকা হয়, সেই তারকা যদি আপন স্থানে বহাল থাকে, তবে বুঝতে হবে এটি আল্লাহর বিশেষ কোন সিদ্ধান্তের ফলে হয়েছে। তোমরা খোঁজ নিয়ে দেখ আসল ঘটনা কী?’

ইবন ইসহাক বলেন, কোন কোন আলিম বর্ণনা করেন যে, বনূ সাহম গোত্রের এক মহিলা ছিল। নাম ছিল তার গাইতালাহ। জাহেলী যুগে সে জ্যোতিষী ছিল। এক রাতে তার জিন সঙ্গীটি তার নিকট আসে। এসে সে আওয়াজ দিয়ে বলে, ‘আমি যা জানবার জানি -উৎসর্গের দিন।’ কুরায়শরা এ সংবাদ শুনে বলল, ‘সে আসলে কী বলতে যাচ্ছে।’ তারপর সে আরও এক রাতে এসে অনুরূপ আওয়াজ দিয়ে বলল, ‘ঘাঁটি, জান ঘাঁটি কী?’ দক্ষিণের অভিজাত বাহিনী তাতে ধরাশায়ী হবে। এ সংবাদ পেয়েও কুরায়শরা বলল, ‘লোকটি কী বলতে চায়? কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বোধ হয়। তোমরা লক্ষ্য রাখ, কী ঘটে।’ কিন্তু তখনো তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। যখন ঘাঁটির নিকট বদর ও উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হলো তখন তারা বুঝতে পারল যে, জিনটি আসলে কী সংবাদ দিয়েছিল।

ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, আলী ইবন নাফি আল-জুরাশী বলেন যে, জাহেলী যুগে ইয়ামানের জামব গোত্রের একজন গণক ছিল। যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ব্যাপারে বলাবলি শুরু হলো এবং তা গোটা আরবে ছড়িয়ে পড়ল, তখন ঐ গোত্রের লোকেরা ঐ গণককে বলল, ‘এই লোকটির ব্যাপারে একটু ভেবে দেখুন!’ তারা তার সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য এক পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হলো। সূর্য উদিত হলে সে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। তাদের নিকট পোঁছে সে তার ধনুকের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘লোক সকল! আল্লাহ মুহাম্মদকে সম্মানিত করেছেন, তাকে মনোনীত করেছেন ও তাঁর অন্তরকে পবিত্র করেছেন। লোক সকল! তোমাদের মাঝে তাঁর অবস্থান ক’দিনের মাত্র।’ এই বলে সে যেখান থেকে এসেছিল, দ্রুতপদে সেখানে চলে যায়। ইবন ইসহাক এরপর সাওয়াদ ইবন কারিব-এর কাহিনী উল্লেখ করেন। সেই আলোচনা আমরা ‘জিনদের অদৃশ্যবাণী’ অধ্যায়ের জন্য রেখে দিলাম।

১০০
অধ্যায়
ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, আসিম ইবন আমর ইবন কাতাদা’র গোত্রের কতিপয় লোক বলে, আমরা ছিলাম মূর্তিপূজারী মুশরিক আর ইহুদীরা ছিল আহলে কিতাব। তাদের নিকট এমন বিদ্যা ছিল, যা আমাদের নিকট ছিল না। তাদের ও আমাদের মাঝে সর্বদা সংঘাত লেগেই থাকত। অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হলে তারা আমাদেরকে বলত, প্রতিশ্রুত একজন নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আদ ও ইরাম জাতিকে হত্যা করার ন্যায় আমরা তার সঙ্গে যোগ দিয়ে তোমাদেরকে হত্যা করব। তাদের মুখ থেকে এ কথাটি আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) আবির্ভূত হয়ে যখন আমাদেরকে আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন, তখন আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম। তারা আমাকে যার ভয় দেখাত, আমরা তাকে চিনে ফেললাম এবং তাদের আগে আমরা তাঁর সঙ্গে যোগ দিলাম। আমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম আর তারা তাঁকে অস্বীকার করল। তাই আমাদের ও তাদের ব্যাপারে এই আয়াতটি নাযিল হয়ঃ

( وَلَمَّا جَاۤءَهُمۡ كِتَـٰب مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّق لِّمَا مَعَهُمۡ وَكَانُوا۟ مِن قَبۡلُ یَسۡتَفۡتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ فَلَمَّا جَاۤءَهُم مَّا عَرَفُوا۟ كَفَرُوا۟ بِهِۦۚ فَلَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَـٰفِرِینَ )

[Surah Al-Baqarah 89]

অর্থাৎ, তাদের নিকট যা আছে, যখন আল্লাহর নিকট হতে তার সমর্থক কিতাব আসল; যদিও পূর্বে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে তারা এর সাহায্যে বিজয় প্রার্থনা করত, তবুও তারা যা জ্ঞাত ছিল, যখন তা তাদের নিকট আসল, তখন তারা তা প্রত্যাখ্যান করল। সুতরাং কাফিরদের প্রতি আল্লাহর লানত। (২ বাকারাঃ ৮৯)

ইবন আবু নাজীহ সূত্রে আলী আল-আযদী থেকে ওয়ারাকা বর্ণনা করেন যে, আলী আল-আযদী বলেন, ইহুদীরা বলত, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আপনি এই নবীকে প্রেরণ করুন! তিনি আমাদের ও লোকদের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন। তারা নবীর উসীলা দিয়ে বিজয় প্রার্থনা করত।

ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, ইহুদীরা খায়বারে গাতফানের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে ইহুদীরা পরাজিত হয়। তখন তারা এই দোয়া করে যে, “হে আল্লাহ! সেই উম্মী নবী মুহাম্মদের উসীলায় আমরা প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় প্রার্থনা করছি, যাকে শেষ যমানায় প্রেরণ করবেন বলে আপনি আমাদের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারপর যখন নবী করীম (সা) প্রেরিত হন তখন তারা তাঁকে অস্বীকার করে।

ইবন ইসহাক বলেন, বদরী সাহাবী সালামা ইবন সালাম ইবন ওকাশ (রা) বলেন, বনূ আবদুল আশহালের জনৈক ইহুদী আমাদের প্রতিবেশী ছিল। একদিন সে তার ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আমি তখন আমার ঘরের আঙিনায় কম্বল বিছিয়ে শুয়ে আছি। আমি তখন সবেমাত্র কিশোর। যা হোক, লোকটি এসে কিয়ামত, পুনরুত্থান, হিসাব, মীযান ও জান্নাত-জাহান্নামের কথা আলোচনা করে। বর্ণনাকারী বলেন, কথাটা সে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে না-এমন মূর্তিপূজারী মুশরিকদের নিকট ব্যক্ত করলে তারা বলে, ‘ধ্যাৎ, এসবও আবার হবে নাকি? মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত করে মানুষকে এমন জগতে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে জান্নাত-জাহান্নাম আছে এবং সেখানে তাদেরকে কর্মফল দেয়া হবে, এমন কথা তোমার বিশ্বাস হয়?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ, আমি এসবে বিশ্বাস করি।’ লোকেরা বলল, ‘তা হলে এর লক্ষণ কী?’ সে বলল, ‘এর লক্ষণ হলো, এই নগরী থেকে একজন নবী আবির্ভূত হবেন।’ মক্কা ও ইয়ামানের প্রতি ইঙ্গিত করে সে বলল। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ‘তাকে আমরা কবে দেখব?’ বর্ণনাকারী বলেন, জবাবে সে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করল। আমি তখন উপস্থিত লোকদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। সে বলল, ‘এই বালকটি যদি পরিণত বয়স লাভ করে তাহলে সে তাঁকে দেখতে পাবে।’ সালামা বলেন, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, এরপর একরাত একদিন অতিবাহিত হতে না হতেই আল্লাহ্ তাঁর রাসূল (সা)-কে প্রেরণ করেন। ইহুদী লোকটি তখন আমাদের মাঝে জীবিত। ফলে আমরা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম, কিন্তু অবাধ্যতা ও হিংসাবশত সে তাকে অস্বীকার করল।’ আমরা তাকে বললাম, ‘কী খবর! তুমি না আমাদেরকে কী সব কথা-বার্তা বলতে!’ সে বলল, ‘বলতাম তো ঠিকই, কিন্তু ইনি তিনি নন।’ আহমদ এবং বায়হাকী হাকিম সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন।

আবু নুআয়ম ‘দালায়িল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মদ ইবনে সালামা বলেন, বনু আব্দুল আশহালে একজন ছাড়া আর কোন ইহুদী ছিল না। নাম তার ইউশা। আমি তখন বালক, সবেমাত্র লুঙ্গিপরা শুরু করেছি, তাকে বলতে শুনেছি, একজন নবী তোমাদের মাথায় ছায়া পাত করে রেখেছেন। এই ঘরের দিক থেকে তিনি আবির্ভূত হবেন। তারপর সে বায়তুল্লাহর দিকে ইশারা করে। বলে, ‘যে ব্যক্তি তাঁকে পাবে সে যেন অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করে।’ এক সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবির্ভূত হলেন। আমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম। আর সেই ইহুদী লোকটি আমাদের মাঝে উপস্থিত। কিন্তু বিদ্বেষ ও অবাধ্যতাবশত সে ঈমান আনল না।

ইতিপূর্বে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাব ও তার গুণ-পরিচয় প্রদানকারী এই ইউশা এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম-তারকার আত্মপ্রকাশ সংক্রান্ত যুবায়র ইবনে বাতা-এর আলোচনা করে এসেছি। ইবনে ইসহাক বলেন, আসিম ইবনে উমর ইবনে কাতাদা বর্ণনা করেছেন যে, বনু কুরায়জার জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, আপনি বনু কুরায়জার জাতি-গোষ্ঠী বনু হাদাল-এর লোক ছালাবা ইবনে সায়া, উসায়দ ইবনে সা’য়া ও আসাদ ইবনে উবায়দ-এর ইসলাম গ্রহণের পটভূমি জানেন কি? এরা জাহেলী যুগে বনু কুরায়জার সঙ্গে ছিল। তারপর ইসলামের যুগেও তারা বনু কুরায়জার নেতৃত্ব প্রদান করে।’ আমি বললাম, ‘না, জানি না।’

তিনি বললেনঃ সিরিয়ার অধিবাসী ইবনে হায়বান নামক এক ইহুদী ইসলামের আবির্ভাবের কয়েক বছর আগে আমাদের নিকট আসে। এসে লোকটি আমাদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করে। আল্লাহর শপথ! তার অপেক্ষা উত্তম পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কারী আর কাউকে আমি দেখিনি। লোকটি আমাদের নিকট স্থায়িভাবে অবস্থান করতে শুরু করে। আমাদের অঞ্চলে কখনো অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমরা তাঁকে বলতাম, ‘হে ইবনে হায়বান! আসুন আমাদের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনা করুন।’ জবাবে তিনি বলতেন, ‘না, আল্লাহর শপথ! আগে সাদাকা পেশ না করলে আমি এ কাজ করতে পারব না।’ আমরা বলতাম, ‘কত দিতে হবে বলুন।’ তিনি বলতেন, ‘একসা খেজুর কিংবা দুই মুদ্দ যব।’ আমরা উক্ত পরিমাণ সাদাকা পেশ করতাম। এরপর তিনি আমাদের নিয়ে ফসলের মাঠে গিয়ে আমাদের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনা করেন। আল্লাহর শপথ! তার সেই দোয়ার অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতে আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টিপাত শুরু হতো। এভাবে দু’বার তিনবার নয়— তিনি বহুবার এরূপ দোয়া করেছেন। তারপর আমাদের নিকট থাকাবস্থায়ই তাঁর মৃত্যুর সময় হয়। যখন তিনি আঁচ করতে পারলেন যে, তার আর বাঁচা হবে না, তখন তিনি বললেন, ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা কি জান, কিসে আমাকে প্রাচুর্যের দেশ থেকে এই অভাবের দেশে বের করে এনেছে?’ আমরা বললাম, ‘আপনি ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘আমি এমন এক নবীর আবির্ভাবের অপেক্ষায় এ দেশে এসেছি, যার আবির্ভাবকাল অতি নিকটে। এই নগরী তার হিজরত ভূমি। আমি আশা করতাম যে, তিনি আবির্ভূত হবেন আর আমি তার অনুসরণ করব। তবে তার সময় কিন্তু নিকটে। কাজেই হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমাদের আগে যেন অন্য কেউ তার সঙ্গী হতে না পারে। আবিষ্কৃত হওয়ার পর যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদের সঙ্গে তার রক্তারক্তি হবে এবং বন্দীকরণ ও দাস বানানোর ঘটনা ঘটবে। অতএব কোন কিছু যেন তোমাদেরকে তাঁর অনুসরণ থেকে বিরত না রাখে।’ তারপর যখন রাসূল (সা) আবির্ভূত হলেন এবং বনু কুরায়জাকে অবরোধ করলেন, তখন যুবকরা বলল— এখন তারা টগবগে যুবক– ‘হে বনু কুরায়জা সম্প্রদায়ের লোকজন! আল্লাহর কসম! ইনিই সেই নবী, ইবনে হায়বান তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।’ তারা বলল, ‘না ইনি সেই ব্যক্তি নন।’ যুবকরা বলল, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, তিনি যেসব গুণাগুণের বিবরণ দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী ইনিই সেই ব্যক্তি।’ এরপর তারা দুর্গ থেকে নেমে এসে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদের রক্ত, সম্পদ ও পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করে। ইবনে ইসহাক বলেন, ইহুদীদের ব্যাপারে আমি যা জানতে পেরেছি, এই হলো তার বিবরণ।

আমরা উপরে উল্লেখ করে এসেছি যে, তুব্বা আল-ইয়ামানী— যার উপনাম আবু কারব তুব্বান আস’আদ মদীনা অবরোধ করতে এসেছিলেন। তখন দুইজন ইহুদী পণ্ডিত তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘এ কাজে সফলতা অর্জন করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ এটি এমন আখেরী নবীর হিজরত ভূমি, যিনি শেষ যমানায় আগমন করার কথা।’ এ কথা শুনে তুব্বা তার সংকল্প থেকে বিরত হন। আবু নুআইম তার ‘দালায়িল’ এ উল্লেখ করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা যখন যায়দ ইবনে সাইয়াকে হেদায়ত দান করার ইচ্ছা করলেন, যায়দ বললেন, ‘দু’টি ব্যতীত নবুয়তের সব কটি লক্ষণই আমি প্রথম দর্শনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চেহারায় প্রত্যক্ষ করি। যে দু’টি লক্ষণ প্রথম দর্শনে দেখতে পাইনি, তা হলো তাঁর সহনশীলতা অজ্ঞতার ওপর প্রবল থাকবে এবং তাঁর সঙ্গে অজ্ঞতাসুলভ আচরণ যত বেশি করা হবে, তার সহনশীলতা ততই বৃদ্ধি পাবে।’ যায়দ ইবনে সাইয়া বলেন, ‘ফলে আমি একান্ত ঘনিষ্ঠতা লাভ করে তার সহনশীলতা ও অজ্ঞতা যাচাই করার প্রচেষ্টায় লেগে যাই। তারপর তিনি নবী করীম (সা)-এর নিকট ধারে মাল বিক্রয়ের কাহিনী উল্লেখ করেন এবং বলেন, ‘যখন সেই ঋণ পরিশোধ করার দিন-তারিখ এসে গেল, আমি তাঁর নিকট গিয়ে তাঁর জামার কলার এবং চাদর টেনে ধরি। তিনি তখন তাঁর সাহাবীগণের সঙ্গে এক জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। আমি তাঁর প্রতি উগ্র মূর্তিতে দৃষ্টিপাত করি এবং বলি, ‘মুহাম্মদ! তুমি কি আমার পাওনা আদায় করবে না? আল্লাহর শপথ, আমি জানি, আব্দুল মুত্তালিবের বংশটাই লেনদেনে এভাবে টালবাহানা করতে অভ্যস্ত।’ যায়দ বলেন, একথা শুনে উমর (রা) আমার প্রতি চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখ দুটো যেন ভাটার মত জ্বলছে। তারপর তিনি বললেন, ‘ওহে আল্লাহর দুশমন! তুই আল্লাহর রাসূলকে কী বলছিস আর তার সঙ্গে কী আচরণ করছিস সবই আমি শুনছি, দেখছি। সেই আল্লাহর শপথ, যিনি তাঁকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি যদি তাঁর ভৎসনার ভয় না করতাম, তা হলে তলোয়ার দিয়ে তোর গর্দান উড়িয়ে দিতাম।’ রাসূল (সা) তখন শান্ত ও হাসিমুখে উমর (রা)-এর প্রতি তাকিয়ে আছেন। তারপর তিনি বললেন,

“হে উমর! আমার আর তার তোমার থেকে এর স্থলে অন্যরূপ ব্যবহার প্রাপ্য ছিল। তোমার উচিত ছিল, আমাকে ঋণ আদায়ে উত্তম পন্থা অবলম্বন করার এবং তাকে আমার সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া। যাও হে উমর! লোকটার পাওনা পরিশোধ করে দাও। আর বিশসা’ (প্রায় দেড় মণ) খেজুর বেশি দিয়ে দাও।”

এ ঘটনা দেখে যায়দ ইবনে সাইয়া মুসলমান হয়ে যান এবং তার পরবর্তীকালের সকল জিহাদে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তাবুকের বছর তিনি ইনতিকাল করেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি সদয় হোন। তারপর ইবনে ইসহাক হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সালমান ফারসী (রা) নিজের মুখে আমাকে বলেছেন যে, আমি ছিলাম ইস্পাহানের অধিবাসী এবং পারসিক ধর্মাবলম্বী। যে গ্রামে আমার বাস ছিল তার নাম জাই। আমার পিতা ছিলেন সেই গ্রামের প্রধান। আমি ছিলাম পিতার সর্বাধিক প্রিয় পাত্র। স্নেহের আতিশয্যে তিনি আমাকে তাঁর গৃহে আবদ্ধ করে রাখতেন, যেমন দাসীদের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। মজুসী ধর্ম আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতাম। এক পর্যায়ে আমিই হলাম সেই অগ্নিকুণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণকারী, যা সর্বদা প্রজ্বলিত রাখা হতো, এক মুহূর্তের জন্যও নিভতে দেয়া হতো না।

তিনি বলেন, আমার পিতা বিপুল জমি-জমার মালিক ছিলেন। তিনি নিজেই তার জমি-জমার দেখাশুনা করতেন। একদিন তিনি কোন এক নির্মাণ কাজে হাত দেন। ফলে আমাকে তিনি বলেন, নির্মাণ কাজের ব্যস্ততার কারণে আজকের মত আমি জমিজমা দেখাশুনা করতে পারছি না। আজকের মত তুমি গিয়ে একটু তদারকি কর। তিনি আমাকে এ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশও দেন। তারপর তিনি আমাকে বলেন, ফিরতে বিলম্ব করো না। কারণ তুমি আমার চোখের আড়ালে চলে গেলে জমিজমার চাইতে তুমিই আমার বেশি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াও। তখন আমি কোন কাজই করতে পারি না।

সালমান ফারসী (রা) বলেনঃ আমি আমার পিতার জমি দেখার জন্য রওয়ানা হলাম। খৃস্টানদের একটি গির্জার নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় গির্জার ভিতরে খৃস্টানদের আওয়াজ পেলাম। তখন তারা উপাসনা করছিল। উল্লেখ্য যে, আমাকে ঘরে আটকে রাখার জন্য লোকজন যে আমার পিতাকে পরামর্শ দিয়েছিল, এতদিন আমি তা জানতাম না। যা হোক, শব্দ শুনে তাদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য আমি গির্জায় প্রবেশ করলাম। তাদের উপাসনা আমাকে মুগ্ধ করল এবং আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর শপথ, আমরা যে ধর্মে আছি, এই ধর্ম তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। আল্লাহর কসম, তখন থেকে আমি তথায় সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। পিতার জমিজমার কথা একদম ভুলেই গেলাম, ওখানে যাওয়া আর হলো না। তারপর আমি তাদেরকে বললাম, ‘এই দীন আমি পাব কোথায়?’ তারা বলল, ‘সিরিয়ায়।’ আমি পিতার নিকট ফিরে গেলাম। ততক্ষণে পিতা আমার অনুসন্ধানে লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং আমার চিন্তায় তার সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি উপস্থিত হলে তিনি বললেন, ‘বৎস! তুমি ছিলে কোথায়? আমি কি তোমাকে শীঘ্র ফিরে আসার কথা বলে দেইনি?’ সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমি বললাম, ‘আব্বাজান! যাওয়ার পথে আমি দেখলাম, কিছু লোক তাদের গির্জায় উপাসনারত। তাদের উপাসনা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি তাদের নিকট সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি।’ পিতা বললেন, ‘বৎস! ঐ ধর্মে কোনো কল্যাণ নেই। তারচেয়ে তোমার ও তোমার পূর্বপুরুষদের ধর্মই উত্তম।’ আমি বললাম, ‘কখনো নয়, আল্লাহর কসম! ঐ ধর্মই আমাদের ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ সালমান ফারসী বলেন, এতে পিতা আমাকে ভয়-ভীতি দেখান এবং পায়ে শিকল পরিয়ে আমার আটকে রাখেন। আমি খৃস্টানদের নিকট খবর পাঠালাম যে, তোমাদের নিকট সিরিয়ার কোনো কাফেলা আগমন করলে আমাকে যেন অবহিত করা হয়। এক সময় একটি কাফেলা আগমন করে। খৃস্টানরা আমার কাছে সংবাদ পাঠায়। আমি বললাম, ‘কাজ শেষ করে যখন তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় হবে, তখন আমাকে একটু জানিয়ো।’ তিনি বলেন, তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় হলে খৃস্টানরা আমাকে তা অবহিত করে। আমি পায়ের শিকল ভেঙে তাদের সঙ্গে রওয়ানা হলাম। এক সময়ে আমি সিরিয়া এসে পৌঁছলাম।

সিরিয়া এসে আমি সেখানকার অধিবাসীদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই ধর্মের অনুসারীদের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান কে?’ তারা বলল, ‘গির্জায় অবস্থানকারী প্রধান যাজক।’ আমি তার নিকট গিয়ে বললাম, ‘আমি এই ধর্মের প্রতি আগ্রহী এবং আমি আপনার সাহচর্যে থাকতে চাই, গির্জায় আপনার সেবা করতে চাই এবং আপনার নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করে আপনার সঙ্গে উপাসনা করতে চাই।’

তিনি বললেন, ‘ভিতরে প্রবেশ কর।’ আমি তার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, লোকটি আসলে অসৎ। সে তার অনুসারীদের সাদকা দানের আদেশ দেয় ও সেজন্য উৎসাহিত করে, কিন্তু প্রদত্ত সব সাদকা সে নিজের জন্য কুক্ষিগত করে রাখে এবং গরীব-মিসকীনদের কিছুই দেয় না। এভাবে সে সাত মটকা সোনা-রূপা সঞ্চয় করে। সালমান ফারসী বলেন, এসব আচরণ দেখে লোকটির প্রতি আমার মনে তীব্র ঘৃণার সঞ্চার হয়। তারপর লোকটি মারা যায়। খৃস্টানরা তাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে সমবেত হলে আমি তাদেরকে বললাম, ‘ইনি তো অসৎ লোক ছিলেন। ইনি আপনাদেরকে সাদকা দেয়ার আদেশ দিতেন এবং উৎসাহিত করতেন বটে; কিন্তু আপনারা সাদকা নিয়ে আসলে তিনি তা মিসকীনদের না দিয়ে সব নিজের জন্য রেখে দিতেন।’ তারা আমাকে বলল, ‘আপনি তা জানলেন কী করে?’ আমি বললাম, ‘আমি আপনাদেরকে তার গোপন ধন ভাণ্ডার দেখিয়ে দিচ্ছি।’ তারা বলল, ‘ঠিক আছে, দেখান।’ সালমান ফারসী বলেন, আমি তাদেরকে তার গুপ্ত ভাণ্ডারের স্থানটি দেখিয়ে দিলাম। সেখান থেকে তারা সাত মটকা ভর্তি সোনা-রূপা উদ্ধার করে। দেখে তারা বলে, একে আমরা দাফনই করব না। তারা তাকে শূলে চড়ায় এবং প্রস্তরাঘাত করে। তারপর তারা অপর এক ব্যক্তিকে এনে তার স্থলে বসায়।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, এই নতুন পাদ্রী রীতিমত উপাসনা করেন। তার মত দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ, আখেরাতের প্রতি উৎসাহী এবং রাতদিন ইবাদতগুজার আর কাউকে আমি দেখিনি। আমি তাকে ভালোবাসলাম, যেমন ইতিপূর্বে আর কাউকে আমি ভালোবাসিনি। বেশ কিছুদিন আমি তাঁর সাহচর্যে অতিবাহিত করলাম। তারপর তার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হলে আমি তাকে বললাম, ‘আমি আপনার সাহচর্যে ছিলাম এবং আপনাকে আমি সর্বাধিক ভালো বাসতাম। এখন আল্লাহর নির্দেশে আপনার মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছে। কাজেই আপনি আমাকে কার নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করছেন এবং আমাকে কী আদেশ দিচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি যে ধর্মের অনুসারী ছিলাম, আজ সে ধর্মে তেমন কেউ আছেন বলে আমি জানি না। মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তারা আদর্শ পরিবর্তন করে ফেলেছে। তবে মুসেলে অমুক নামের একজন লোক আছেন। তিনিও আমার দীনের অনুসারী। তুমি তার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হও।’

সালমান ফারসী (রা) বলেন, তাঁর ইন্তিকাল ও দাফন-কাফনের পর আমি মুসেলের উপরোল্লিখিত লোকটির সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলাম। বললাম, ‘জনাব! অমুক ব্যক্তি মৃত্যুর সময় আমাকে আপনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ওসীয়ত করে গেছেন এবং আমাকে অবহিত করেছেন যে, আপনি তারই ধর্মের অনুসারী।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট অবস্থান কর।’ আমি তার নিকট অবস্থান করলাম। তাকে আমি তার সঙ্গীর ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত উত্তম ব্যক্তিরূপে পেয়েছি। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে আমি তাকে বললাম, ‘জনাব! অমুক তো আপনার সান্নিধ্যে আসার জন্য আমাকে ওসীয়ত করেছিলেন। এখন আল্লাহর হুকুমে আপনার মৃত্যুকাল উপস্থিত, আপনি আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন এবং আমাকে কী আদেশ করছেন?’ তিনি বললেন, ‘বৎস, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমরা যে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলাম, সে দীনের অনুসারী আর একজন লোকও আছে বলে আমি জানি না। তবে নাসীবীনে অমুক নামের একজন লোক আছেন, তুমি তার নিকট গিয়ে মিলিত হও।’ তারপর যখন তিনি মারা গেলেন এবং তাঁর দাফন-কাফন সম্পন্ন হলো তখন আমি নাসীবীনের লোকটির সঙ্গে মিলিত হলাম এবং তাকে আমার নিজের ইতিবৃত্ত ও আমার দুই সঙ্গী আমাকে যা আদেশ করেছেন তা তাঁর নিকট ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট অবস্থান কর।’ আমি তাঁর নিকট অবস্থান করলাম। তাঁকেও আমি তাঁর দুই পূর্বসূরির ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত পেয়েছি। এবারও আমি একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের সাহচর্যে কাটালাম। কিন্তু আল্লাহর শপথ করে বলছি, কিছু দিন যেতে না যেতেই তারও মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। মৃত্যুর আগে আমি তাকে বললাম, ‘জনাব! অমুক ব্যক্তি আমাকে অমুকের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। তারপর দ্বিতীয়জন তৃতীয় আরেকজনের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। সবশেষে তৃতীয়জন আমাকে ওসীয়ত করেন আপনার নিকট আগমন করার জন্যে। এখন আপনি আমাকে কার সান্নিধ্য অবলম্বনের উপদেশ দেবেন এবং আমাকে কী আদেশ দেবেন?’ বললেন, ‘বৎস! আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমাদের ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত এমন একজন লোকও বেঁচে নেই; যার নিকট যাওয়ার জন্য আমি তোমাকে আদেশ করতে পারি। তবে রোমের আমুরিয়াহ নামক স্থানে একজন লোক আছেন, তিনি আমাদের ধর্মাবলম্বী। ইচ্ছে করলে তুমি তার নিকট যেতে পার। কারণ, তিনিও আমাদের অভিন্ন পথের যাত্রী।’

যখন তিনি মারা গেলেন এবং তার দাফন-কাফন সম্পন্ন হলো। আমি আমুরিয়ার সেই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত করলাম এবং আমার বৃত্তান্ত শোনালাম। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট থাক।’ আমি এবারও এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে অবস্থান করতে শুরু করলাম, যিনি আমার পূর্বের গুরুদেরই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। সালমান ফারসী (রা) বলেন, এসময়ে আমি কিছু উপার্জনও করি। কয়েকটি গাভী ও ছাগল আমার মালিকানায় আসে। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁরও মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে। তখন আমি তাকে বললাম, ‘জনাব! আমি প্রথমে অমুকের সাহচর্যে ছিলাম। তারপর তিনি আমাকে অমুকের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। এরপর তিনি অমুকের নিকট যাওয়ার ওসিয়ত করেন। অতঃপর তিনি আমাকে অমুকের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। সর্বশেষ ব্যক্তি আমাকে ওসীয়ত করেন আপনার সান্নিধ্য অবলম্বন করতে। এখন আপনি আমাকে কার সাহচর্য অবলম্বনের ওসীয়ত করবেন এবং আমাকে কী আদেশ দেবেন?’ তিনি বললেন, ‘বৎস! আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমার জানা মতে আমাদের পথের যাত্রী এমন একজন লোকও বেঁচে নেই, আমি তোমাকে যার নিকট যাওয়ার আদেশ করতে পারি। তবে এমন একজন নবীর আবির্ভাবকাল ঘনিয়ে এসেছে, যিনি দীনে ইবরাহীমসহ প্রেরিত হবেন। আরব ভূমিতে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। এবং খেজুর বীথি বেষ্টিত ভূমি হবে তার হিজরত স্থল। তাঁর প্রকাশ্য কিছু লক্ষণ থাকবে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, সাদকা খাবেন না। তাঁর দুই কাঁধের মাঝে থাকবে নবুওতের মোহর। সম্ভব হলে সেই দেশে গিয়ে তুমি তাঁর সঙ্গে মিলিত হও।’

সালমান ফারসী (রা) বলেন, তারপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ও তার দাফন-কাফন সম্পন্ন হয়। আমি আরো কিছুকাল আমুরিয়ায় অবস্থান করি। তারপর আমি একটি বণিক কাফেলার সাক্ষাত পেয়ে তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আমাকে আরব ভূমিতে নিয়ে যাও, বিনিময়ে আমি তোমাদেরকে আমার এই গাভী ও ছাগলগুলো দিয়ে দেব।’ তারা বলল, ‘ঠিক আছে, চল।’ আমি তাদেরকে আমার গাভী আর ছাগলগুলো দিয়ে দেই আর তারা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কিন্তু ওয়াদীল কুরায় পৌঁছে তারা আমার প্রতি জুলুম করে। আমাকে তারা এক ইহুদীর নিকট দাসরূপে বিক্রি করে দেয়। আমি তার নিকট থাকতে শুরু করি। এ জায়গায় খেজুর বৃক্ষ দেখে আমি আশান্বিত হলাম যে, আমার গুরু আমাকে যে নগরীর কথা বলেছেন, এটাই সম্ভবত সেই নগরী।

আমি আমার মনিবের নিকট থাকছি। এ সময়ে বনূ কুরায়জা বংশীয় তার এক চাচাতো ভাই মদীনা থেকে তার নিকট আগমন করে আমার মনিবের নিকট থেকে সে আমাকে কিনে মদীনায় নিয়ে যায়। আল্লাহর কসম! মদীনাকে দেখামাত্র আমি বুঝে ফেললাম, এটাই সেই নগরী আমার গুরু আমাকে যার কথা বলেছিলেন। আমি মদীনায় অবস্থান করতে থাকি।

ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাব ঘটে গেছে। তিনি কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করেন। গোলামি জীবনের ব্যস্ততার কারণে তাঁর কোনো আলোচনা আমি শুনতে পারছিলাম না। তারপর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একদিন আমি আমার মনিবের খেজুর গাছের কাঁদি কাটার কাজ করছিলাম। মনিব তখন নিচে উপবিষ্ট। এমন সময়ে তার এক চাচতো ভাই এসে তার নিকট থমকে দাঁড়ায় এবং বলে, ‘আল্লাহ বনূ কায়লার অমঙ্গল করুন। তারা এখন কুবায় এমন এক ব্যক্তিকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়ে আছে, যিনি আজই মক্কা থেকে এসেছেন এবং তিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন।’ সালমান ফারসী (রা) বলেন, এ কথা শোনামাত্র আমার সমস্ত শরীরে কাঁপন ধরে যায়। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি গাছ থেকে মনিবের গায়ের ওপর পড়ে যাব। আমি খেজুর গাছ থেকে নিচে নেমে মনিবের চাচাতো ভাইকে বললাম, ‘আপনি কী কী যেন বলছিলেন?’ সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমার কৌতুহলপূর্ণ প্রশ্ন শুনে মনিব আমার গালে কশে এক চড় বসিয়ে দেয় এবং বলে, ‘ও কী বলছে, তাতে তোর কী? যা, তুই তোর কাজ করগে।’ আমি বললাম, ‘না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। মনে একটা কৌতুহল জাগল কি না তাই।’

তিনি বলেন, আমার নিকট কিছু সঞ্চিত সম্পদ ছিল। সন্ধ্যাবেলা আমি সেগুলো নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গেলাম। তিনি তখন কুবায়। নিকটে গিয়ে আমি তাকে বললাম, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি একজন পুণ্যবান ব্যক্তি। আপনার সঙ্গে যারা আছেন, তাঁরা গরীব, অসহায়। এই জিনিসগুলো সাদকা দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি সঞ্চয় করেছিলাম। আমি দেখলাম যে, অন্যদের তুলনায় আপনারাই এর অধিক হকদার।’ এই বলে আমি জিনিসগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সঙ্গীদের বললেন, তোমরা খাও এবং নিজে হাত গুটিয়ে নিলেন, খেলেন না। আমি মনে মনে বললাম, এই পেলাম একটি।

তারপর আমি ফিরে গেলাম এবং আরো কিছু জিনিস সংগ্রহ করলাম। ততদিনে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় চলে গেছেন। আমি আবারও তাঁর নিকট গেলাম এবং বললাম, ‘আমি লক্ষ্য করেছি যে, আপনি সাদকা খান না। তাই আপনার সম্মানার্থে এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া।’ সালমান ফারসী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নিজে কিছু খেলেন এবং সাহাবীদের খেতে আদেশ দেন। সাহাবীরাও তার সঙ্গে আহারে অংশ নেন। তিনি বলেন, তখন আমি মনে মনে বললাম, এই পেলাম দুটো।

তিনি বলেন, এরপর আরেকদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন বাকীউল গারকাদ গোরস্থানে জনৈক ব্যক্তির জানাযা উপলক্ষে সাহাবী পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে আছেন। গায়ে তার দুটি চাদর। আমি তাঁকে সালাম দিয়ে তার পেছন দিকে গিয়ে আমার সঙ্গীর বর্ণনা মোতাবেক তাঁর পিঠে মোহর আছে কিনা দেখতে লাগলাম। দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বুঝে ফেললেন যে, আমি কিছু একটা অনুসন্ধান করছি। ফলে তিনি নিজের পিঠ থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন। মোহরের প্রতি চোখ পড়া মাত্র আমি তা যে মোহরে নবুয়ত তা চিনে ফেললাম। দেখেই আমি তার ওপর ঝাপিয়ে পড়লাম এবং তাঁকে চুমু খেতে খেতে কাঁদতে লাগলাম। দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন, ‘এদিকে এস।’ পেছন থেকে ফিরে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সামনে আসলাম এবং আমি তাকে আমার কাহিনী শোনালাম, যেমন শোনালাম তোমাকে হে ইবনে আব্বাস! শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) মুগ্ধ হলেন এবং সাহাবীগণও তা শুনুন, তা তিনি চাইলেন।

তারপর সালমান গোলামির কাজে নিয়োযিত থাকেন। এভাবে বদর গেল, উহুদ গেল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে সালমান (রা)-এর আর সাক্ষাত ঘটেনি। সালমান (রা) বলেন, এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেনঃ “সালমান! তুমি তোমার মনিবের সঙ্গে মুক্তিপণের ব্যাপারে কথা বল।’ ফলে আমি আমার মনিবের সঙ্গে তিনশত খেজুর গাছ এবং চল্লিশ উকিয়ার বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি করলাম। চুক্তি হলো— খেজুর গাছগুলোর চারা রোপণ করে ফলনশীল করে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের বললেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের সাহায্য কর।’ খেজুর গাছের ব্যাপারে তাঁরা আমাকে সাহায্য করেন। কেউ ত্রিশটি, কেউ বিশটি, কেউ পনেরটি, আবার কেউ দশটি চারা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেন। তারা প্রত্যেকে আমাকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেন। এভাবে আমার তিনশ’ চারার ব্যবস্থা হয়ে যায়। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন, ‘যাও হে সালমান! গর্ত কর গিয়ে। গর্ত করার কাজ শেষ হলে আমার নিকট এস; আমি নিজ হাতে গর্তে চারা রোপণ করে দেবো।’ হযরত সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমি গর্ত করলাম। আমার সঙ্গীরা একাজে আমাকে সহযোগিতা করেন। গর্ত করার কাজ শেষ হলে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে সংবাদ দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) আমার সঙ্গে বাগানে আসেন। অমি তাকে একটি একটি করে চারা এগিয়ে দিলাম আর তিনি নিজ হাতে তা গর্তে রোপণ করলেন। এভাবে সব কটি চারা রোপণের কাজ শেষ হয়। আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে সালমানের জীবন, তার একটি চারাও মরেনি। এভাবে আমি খেজুর গাছ রোপণের চুক্তি বাস্তবায়ন করলাম। বাকি থাকল মাল। ইতিমধ্যে মুরগীর ডিমের ন্যায় এক টুকরো খনিজ সোনা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হস্তগত হয়। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘মুক্তিপণের চুক্তিকারী ফারসী লোকটি কোথায়?’ সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ডেকে নেয়া হয়। নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘এটা নাও, এবং তোমার ঋণ পরিশোধ কর।’ আমি বললামঃ ‘এতে আর কী হবে?’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘এর দ্বারা আল্লাহ্ তোমার মুক্তিপণ ও ঋণ আদায় করে দিবেন।’ আমি সোনার টুকরাটি হাতে নিয়ে ওজন করলাম। সালমানের জীবন যার হাতে, তার শপথ, সোনার টুকরাটির ওজন চল্লিশ উকিয়াই হয়েছে। আমি এর দ্বারা চুক্তি বাস্তবায়ন করলাম। সালমান আযাদী লাভ করলেন। এবার আমি স্বাধীন মানুষ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে খন্দকে অংশ নিলাম। এরপর কোন একটি যুদ্ধেও আমি অনুপস্থিত থাকিনি।

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সালমান (রা) বলেন, আমি যখন বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিয়ে আমার দায় শোধ হবে কী করে?’ তখন নবীজী (সা) জিনিসটি হাতে নিয়ে নিজের জিহবার ওপর উলট-পালট করলেন। তারপর বললেনঃ ‘নাও, এটি দিয়েই সম্পূর্ণ দায় শোধ কর!’ আমি জিনিসটি হাতে নিলাম এবং তা দিয়েই আমি আমার চল্লিশ উকিয়ার দায় সম্পূর্ণ শোধ করলাম।

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক আরো বলেন, সালমান (রা) আমাকে বলেছেন যে, তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবহিত করলেন যে, আমুরিয়ার লোকটি তাকে বলেছে যে, তুমি সিরিয়ার অমুক স্থানে যাও, সেখানে গভীর জঙ্গলে এক ব্যক্তি বাস করে এবং প্রতিবছর সে একবার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। রোগগ্রস্ত মানুষেরা তার কাছে এসে আর্জি পেশ করে। সে যার জন্য দোয়া করে, সেই আরোগ্য লাভ করে। তুমি তার নিকট যাও, তুমি যে দীনের অনুসন্ধান করছ, সে তোমাকে তার সন্ধান দেবে। সালমান (রা) বলেন, আমি রওয়ানা হলাম এবং তার নির্দেশনা মোতাবেক উক্ত স্থানে গিয়ে উপনীত হলাম। দেখলাম, জনতা সমবেত হয়ে তার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। সেই রাত্রে তার আত্মপ্রকাশ করার কথা। এক সময় তিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন। জনতা তাকে ঘিরে ধরে। যে রোগীর জন্য তিনি দোয়া করছেন, সেই আরোগ্য লাভ করছে। স্থানীয় জনতার ভিড়ের কারণে আমি তাকে একান্তে পেলাম না। এক সময়ে তিনি লোকালয় ত্যাগ করে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। আমি সেখানে গিয়ে তাকে ধরে বসি। তখন তার কাঁধ ছাড়া গোটা দেহই জঙ্গলে ঢুকে গেছে। আমি তাকে জাপটে ধরি। আমাকে দেখে আমার প্রতি মুখ ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘কে তুমি?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনাকে রহম করুন! আমাকে আপনি সঠিক দীনে ইবরাহীমের সন্ধান দিন!’ তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে এমন একটি বিষয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছ, যে বিষয়ে আজকাল মানুষ কিছু জানতে চায় না। তবে শোন, এই দীন নিয়ে যে নবীর আবির্ভাবের কথা, তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি হবেন হারমের অধিবাসীদের একজন। তুমি তার নিকট যেও, তিনিই তোমাকে দীনে ইবরাহীমের ওপর পরিচালিত করবেন।’

এ কাহিনী শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) সালমান (রা)-কে বললেনঃ ‘হে সালমান! তুমি আমাকে যা বলেছ, যদি তা সত্য বলে থাক, তাহলে তুমি ঈসা ইবনে মারয়াম-এর সাক্ষাত লাভ করেছ।’ এ বর্ণনার একজন বর্ণনাকারী অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি, তা ছাড়াও বর্ণনার সূত্রে বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে। তুমি ঈসা (আ)-এর সাক্ষাত লাভ করেছ বলে উল্লেখিত উক্তিটি শুধু গরীব পর্যায়েরই নয়- মুনকার অর্থাৎ অগ্রহণযোগ্যও বটে। কেননা, হযরত ঈসা (আ)-এর ওফাত আর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত মধ্যবর্তী শূন্যতার মেয়াদ ছিল কমপক্ষে চারশ বছর। করো কারো মতে সৌর হিসেবে ছয়শ বছর। আর হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর আয়ু ছিল বড়জোর সাড়ে তিনশ’ বছর। শুধু তাই নয়— আব্বাস ইবনে ইয়াযীদ আল-বুহরানী তো এ মর্মে মাশায়িখদের মতৈক্য উল্লেখ করেছেন যে, সালমান ফারসী (রা) বেঁচেছিলেন মাত্র দুইশ পঞ্চাশ বছর। তিনশ পঞ্চাশ বছরের অর্ধেক হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য বিদ্যমান।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, তুমি ঈসা ইবনে মারয়ামের ওসীয়ত প্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত করেছ। এটা সঠিক হওয়া অসম্ভব নয়।

সুহায়লী বলেন, অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীর নাম হচ্ছে হাসান ইবন আমারা। তিনি একজন দুর্বল রাবী। বর্ণনাটি বিশুদ্ধ হলে তা মুনকার’ হবে না। কেননা ইবন জরীর উল্লেখ করেছেন যে, ঈসা (আ)-কে আসমানে উঠানোর পর তিনি পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তার মা এবং অন্য এক স্ত্রীলোককে ক্রুশবিদ্ধ ব্যক্তির লাশের নিকট কান্নাকাটি করছেন বলে দেখতে পান। তখন তিনি নিহত হননি বলে তাদের জানিয়ে দেন। এরপর হওয়ারীগণকে বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করেন। সুহায়লী বলেন, একবার তার অবতরণ যখন সম্ভব হয়েছিল তখন একাধিকবার অবতরণ করাও সম্ভবপর। শেষবার তিনি প্রকাশ্যে অবতরণ করে ক্রুশ ধ্বংস করবেন, শূকর নিধন করবেন এবং তখন বনী জুযামের এক মহিলাকে বিবাহ করবেন। যখন তাঁর ইনতিকাল হবে তখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর রওযা শরীফের হুজরায় দাফন করা হবে।

ইমাম বায়হাকী ‘দালায়িলুন নুবুওয়াত’ গ্রন্থে অপর এক সূত্রে সালমান ফারসী (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে যে, ইয়াযীদ ইবনে সাওহান বলেন যে, তিনি শুনেছেন, সালমান ফারসী (রা) নিজে তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ‘রামাহুরমুয’ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। তার এক বড় ভাই ছিল অতিশয় বিত্তশালী। সালমান (রা) ছিলেন দরিদ্র। তিনি বিত্তশালী ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকতেন। গ্রাম প্রধানের ছেলে ছিল তাঁর সঙ্গী। সে তার সঙ্গে তাদের এক শিক্ষা গুরুর নিকট যাওয়া-আসা করত। ঐ ছেলেটি গুহায় অবস্থানকারী কতিপয় খৃস্টানের নিকটও যেত। সালমান (রা) একদিন আবদার করলেন, তিনিও তাদের সঙ্গে গুহায় যাবেন। জবাবে ছেলেটি তাঁকে বলল, ‘তোমার বয়স কম। আমার আশংকা হয়, তুমি তাদের তথ্য ফাঁস করে দিবে আর তার ফলে আমার আব্বা তাদেরকে হত্যা করে ফেলবেন।’ কিন্তু সালমান ছিলেন নাছোড় বান্দা। তিনি নিশ্চয়তা দিলেন যে, তার কারণে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। অবশেষে সালমান (রা) তার সঙ্গে সেখানে গেলেন। দেখলেন, সেখানে ছয় কি সাতজন লোক, ইবাদত করতে করতে তাদের আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তারা দিনে রোযা রাখেন আর সারারাত জেগে ইবাদত করেন। তারা লতাপাতা আর যা পান তাই খান। ছেলেটি তাকে তাদের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘এরা পূর্ববর্তী রাসূলগণের প্রতি ঈমান রাখেন এবং বিশ্বাস করেন যে, ঈসা আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল এবং তার এক দাসীর পুত্র। বিভিন্ন মু’জিযা দ্বারা তিনি তাকে সাহায্য করেছেন।’ গুহার লোকেরা তাকে বলল, ‘শোন বালক! নিশ্চয় তোমার একজন রব আছেন। মৃত্যুর পর তুমি পুনরায় জীবিত হবে। তোমার সামনে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নাম। আর এই যারা আগুন পূজা করে, তারা কুফরের ধারক ও বিভ্রান্ত। তাদের কর্মকাণ্ডে আল্লাহ সন্তুষ্ট নন। তারা আল্লাহর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়।’ তারপর থেকে সালমান (রা) ঐ ছেলের সঙ্গে তাদের কাছে যেতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে তাদের সঙ্গে থেকে যান। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতে সে দেশের রাজা তাদেরকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। সে রাজা ছিলেন সেই বালকের পিতা, যার সঙ্গ ধরে সালমান (রা) সেখানে আসা-যাওয়া করতেন। রাজা তার পুত্রকে নিজের কাছে আটকে রাখেন। সালমান (রা) তার বড় ভাইয়ের নিকট তাদের দীনের দাওয়াত পেশ করেন। জবাবে সে বলে, ‘আমি জীবিকা উপার্জনের কাজে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।’ সালমান তখন সে সব ইবাদতকারী সঙ্গীদের সাথে রওয়ানা হলেন। এক সময় তারা মুসেলের গির্জায় গিয়ে প্রবেশ করে। গির্জার লোকেরা তাদের সালাম করে।

সালমান (রা) বলেন, এরপর তারা আমাকে ওখানে ফেলে যেতে চান কিন্তু আমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে অস্বীকার করি। আমরা রওয়ানা হলাম এবং কয়েকটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় গিয়ে উপনীত হলাম। সেখানকার পাদ্রীগণ আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন এবং আমাদেরকে সালাম করেন। আমাদের নিকট সমবেত হয়ে তারা কুশল বিনিময় করেন। তাদের অনুপস্থিতির কারণ এবং আমার পরিচয় জানতে চায়। সঙ্গীরা আমার পরিচয় দিতে গিয়ে আমার প্রশংসা করেন। তখন সেখানে অপর এক মহান ব্যক্তির আগমন ঘটে। তিনি উপস্থিত সকলের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করেন। রাসূলগণ এবং তাঁদের মিশনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি হযরত ঈসা (আ)-এর কথা আললাচনা করেন এবং বলেন যে, ঈসা (আ) ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। লোকটি উপস্থিত জনতাকে কল্যাণকর কাজ করার আদেশ এবং অন্যায় কাজ পরিহার করার উপদেশ দিয়ে তার ভাষণ সমাপ্ত করেন।

বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তারা বিদায় নিতে উদ্যত হলে সালমান ফারসী (রা) ভাষণদানকারী লোকটিকে অনুসরণ করেন এবং তার সঙ্গ লাভ করেন। সালমান ফারসী (রা) বলেন, এই লোকটি দিনে রোযা রাখতেন আর সারারাত জেগে ইবাদত করতেন। সপ্তাহের প্রতিটি দিন তাঁর একইভাবে অতিবাহিত হতো। সময়ে সময়ে জনতার মাঝে গিয়ে ওয়াজ করতেন ও ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতেন। এভাবে দীর্ঘদিন কেটে যায়। তারপর এক সময়ে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জিয়ারত করার ইচ্ছা করেন। সালমান ফারসী (রা) তার সঙ্গী হন। সালমান ফারসী (রা) বলেন, চলার পথে খানিক পর পর তিনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করতেন এবং আমার দিকে ফিরে আমাকে নসীহত করতেন। তিনি বলতেন যে, ‘আমার একজন রব আছেন, আমার সামনে জান্নাত-জাহান্নাম ও হিসাব-নিকাশ রয়েছে। তা ছাড়া প্রতি শনিবার তিনি তার সম্প্রদায়কে যেসব উপদেশ দিতেন, আমাকেও সেসব বলতে লাগলেন। তিনি আমাকে যা বললেন তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো— ‘হে সালমান! আল্লাহ অনতিবিলম্বে একজন রাসূল প্রেরণ করবেন, যার নাম হবে আহমদ। আরবের কোন এক নিম্ন অঞ্চল থেকে তার আবির্ভাব ঘটবে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, সাদকা খাবেন না। তার দুই কাঁধের মাঝে নবুওতের মোহর থাকবে। এটাই তার আবির্ভাবের সময়, আর বেশি দেরি নেই। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। তাঁকে পেয়ে যেতে পারব বলে মনে হয় না। তুমি যদি তাকে পাও, তাহলে তাকে মেনে নেবে এবং তার অনুসরণ করবে।’

সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি তিনি আমাকে আপনার দীন, আপনার নীতি-আদর্শ ত্যাগ করতে বলেন, তখন আমি কি করব?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘যদি তিনি তেমন কোন আদেশ করেন, তাহলে মনে রাখবে তিনি যা নিয়ে আসবেন, তাই সত্য এবং তিনি যা বলবেন, তাতেই আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি।’

সালমান ফারসী (রা) তারপর তাদের দু’জনের বায়তুল মুকাদ্দাস গমন এবং তার সঙ্গী সেখানে কোথায় কোথায় নামায আদায় করলেন তার কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি আরও বর্ণনা করেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে তার সঙ্গী এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমানোর আগে তাঁকে বলে দেন যে, ছায়া যখন অমুক স্থানে পৌঁছবে তখন যেন তিনি তাঁকে জাগিয়ে দেন। কিন্তু সালমান ফারসী (রা) তাঁর বিশ্রামে ব্যাঘাত না ঘটানোর জন্য আরও অনেক পরে তাঁকে ঘুম থেকে ওঠান। জেগে ওঠে তিনি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেন এবং সালমান (রা)-কে তিরস্কার করেন। তখন এক পঙ্গু ব্যক্তি তার কাছে যাঞ্ছা করে বলে, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আপনি এখানে আসার পর আপনার কাছে কিছু চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি আমাকে কিছু দেননি, এখন আবার আপনার কাছে যাঞ্ছা করছি।’ তিনি এদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না, তখন পঙ্গু লোকটির হাত ধরে বললেন, ‘উঠে দাঁড়াও আল্লাহর নাম নিয়ে।’ সে তখন সম্পূর্ণ সুস্থ রূপে উঠে দাঁড়ালো যেন সে দড়ির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়েছে।

তারপর তারা দু’জন বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বের হন। লোকটি তখন আমাকে বলল, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আমার সামান-পত্র আমার মাথায় তুলে দাও। আমি আমার পরিজনের নিকট চলে যাই এবং তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করি।’ আমি তাই করলাম। হঠাৎ করে আমার সঙ্গী কোন দিকে যেন উধাও হয়ে গেলেন, আমি টেরই পেলাম না। আমি সম্মুখে এগিয়ে গেলাম এবং তাকে খোঁজ করতে লাগলাম। একদল লোককে জিজ্ঞেস করলাম; তারা বলল, ‘সামনে দেখ।’ আমি আরও সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখা হলো আরবের বনু কালবের একটি কাফেলার সাথে। তাদেরকেও জিজ্ঞেস করলাম। তারা আমার ভাষা শুনে তাদের একজন উট থামিয়ে আমাকে তার পিছনে চড়িয়ে নেয়। তাদের দেশে নিয়ে এসে তারা আমাকে বিক্রি করে ফেলে। এক আনসারী মহিলা আমাকে কিনে নিয়ে তার একটি বাগান রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত করে। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আগমন করেন। তারপর সালমান ফারসী (রা) তার সঙ্গীর বক্তব্য যাচাই করে দেখার উদ্দেশ্যে হাদিয়া ও সাদকা নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গমন করার কথা উল্লেখ করেন। সে সময়ে তিনি মোহরে নবুওত দেখারও চেষ্টা করেন। সঙ্গীর বর্ণনা মোতাবেক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুওত দেখে তৎক্ষণাৎ তিনি ঈমান আনেন এবং নিজের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনান। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদেশে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাঁকে তাঁর মহিলা মনিবের নিকট থেকে কিনে নিয়ে আযাদ করে দেন।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, তারপর একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে খৃস্টধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেনঃ তাদের মধ্যে কোন মঙ্গল নেই।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, এতে আমি এতদিন যাদের সাহচর্যে ছিলাম বিশেষত বায়তুল মুকাদ্দাসে যে সাধু লোকটি আমার সঙ্গে ছিলেন তাদের ব্যাপারে আমার মন ভারী হয়ে যায়! এক পর্যায়ে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলের ওপর নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেন,

( لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ ٱلنَّاسِ عَدَ  ٰ⁠ وَة لِّلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ ٱلۡیَهُودَ وَٱلَّذِینَ أَشۡرَكُوا۟ۖ وَلَتَجِدَنَّ أَقۡرَبَهُم مَّوَدَّة لِّلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ ٱلَّذِینَ قَالُوۤا۟ إِنَّا نَصَـٰرَىٰۚ ذَ  ٰ⁠ لِكَ بِأَنَّ مِنۡهُمۡ قِسِّیسِینَ وَرُهۡبَان ا وَأَنَّهُمۡ لَا یَسۡتَكۡبِرُونَ )

[Surah Al-Ma'idah 82]

অর্থাৎ, অবশ্য মুমিনদের প্রতি শত্রুতায় মানুষের মধ্যে ইহুদী ও মুশরিকদেরকেই তুমি সর্বাধিক উগ্র দেখবে এবং যারা বলে ‘আমরা খৃস্টান’ মানুষের মধ্যে তাদেরকেই তুমি মুমিনদের নিকটতর বন্ধুরূপে দেখবে। কারণ, তাদের মধ্যে অনেক পণ্ডিত ও সংসারবিরাগী আছে, আর তারা অহংকারও করে না। (৫ মায়িদাঃ ৮২)

এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ডেকে পাঠান। আমি ভীত মনে হাজির হয়ে তার সামনে বসলাম। তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে

ذَ  ٰ⁠ لِكَ بِأَنَّ مِنۡهُمۡ قِسِّیسِینَ وَرُهۡبَان ا وَأَنَّهُمۡ لَا یَسۡتَكۡبِرُونَ

তিলাওয়াত করলেন তারপর বললেনঃ ‘সালমান! তুমি যাদের সাহচর্যে ছিলে তারা এবং তোমার সেই সঙ্গী নাসারা ছিল না। তারা ছিল মুসলিম।’

আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে সত্তা আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর শপথ! আমার সঙ্গী লোকটি আমাকে আপনার আনুগত্য করার আদেশ করেছিলেন। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, যদি তিনি আমাকে আপনার দীন ত্যাগ করতে বলেন তাহলে? জবাবে তিনি বলেছিলেন— হ্যাঁ, তাহলে তুমি আমার দীন বর্জন করে তাঁকেই অনুসরণ করবে। কারণ তিনি যা আদেশ করবেন সত্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি তারই মধ্যে নিহিত।’

এই বর্ণনায় বহু বিষয় গরীব পর্যায়ের রয়েছে। তাছাড়া এটা মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের বর্ণনার সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক। ইবন ইসহাকের বর্ণনার সূত্র অধিক নির্ভরযোগ্য এবং বুখারীর বর্ণনার সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। বুখারীর এক সূত্রে সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি পর্যায়ক্রমে তেরজন গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এক গুরু তাঁকে অপর গুরুর নিকট প্রেরণ করেছিলেন।

সুহায়লীর মতে তিনি ত্রিশজন মনিবের হাত বদল হয়েছিলেন। এক মনিব তাকে অপর মনিবের হাতে তুলে দেয়। হাফিজ আবু নু’আয়মের দালায়িল গ্রন্থের এক বর্ণনায় আছে যে, সালমান ফারসী (রা) যে মহিলা মনিবের সঙ্গে মুকাতাবা (মুক্তিপণ চুক্তি) করেছিলেন, তার নাম ছিল হালবাসাহ।

১০১
এ সম্পর্কিত আরও কয়েকটি আশ্চর্য ঘটনা
আবু নুআয়ম তার দালায়িল গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, সাঈর ইবনে সাওয়াদা আল আমেরী বলেন, একটি উন্নত জাতের উট আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সে উটের পিঠে চড়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে আমি দূর-দূরান্ত সফর করতাম। একবার আমি ব্যবসার পণ্য নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় আসি। সফর শেষে কোন এক রাতে মক্কায় এসে উপনীত হই। রাতের আঁধার কেটে জ্যোৎস্না এলো। হঠাৎ মাথা তুলে আমি দেখতে পেলাম, পাহাড়ের মত উঁচু কয়েকটি তাঁবু। তাঁবুগুলো তায়েফের চামড়ায় ঢাকা। তারই পার্শ্বে কয়েকটি উট জবাই করা হলো আর কয়েকটি উট কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সম্মুখের পাত্রে খাদ্যদ্রব্য রাখা। কয়েকজন লোক বলছে, আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন, আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন। অপর এক ব্যক্তি এক উঁচুস্থানে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে বলছেঃ ‘ওহে আল্লাহর মেহমানগণ! আপনারা খেতে আসুন।’ আরেকজন সিঁড়িতে দাড়িয়ে বলছে, ‘আপনাদের যাদের খাওয়া শেষ হয়েছে, চলে যান; আবার রাতের খাওয়ায় অংশ নেবেন।’ এসব দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। আমি সর্দারের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। আমাকে আমার একজন সঙ্গী চিনে ফেলে। সে বলল, ‘আপনি সামনে এগিয়ে যান।’ সামনে এগিয়ে গিয়ে আমি একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। লোকটির দু’চোয়াল দাগে ভরা। ব্যক্তিত্বের জ্যোতি যেন তার দুই কপোল থেকে ঠিকরে পড়ছে। মাথায় তার কালো পাগড়ি। পাগড়ির পাশ দিয়ে কালো চুল দেখা যাচ্ছিল। আর হাতে একটি লাঠি। তার চারপাশে আরো কয়েকজন প্রবীণ লোক উপবিষ্ট। তারা সকলেই নীরব। সিরিয়া থেকে আসা একটি সংবাদের প্রতি তাদের সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ। সংবাদটি হলোঃ নিরক্ষর নবীর তারকা উদয়ের এটিই সময়। প্রবীণ লোকটিকে দেখে আমি ভাবলাম, ইনিই বুঝি তিনি। তাই আমি বললাম, ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ তিনি বললেন, ‘থাম, থাম, আমি নই। তুমি আমাকেই নবী বানিয়ে ফেললে।’ বিব্রত হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি তাহলে কে?’ পার্শ্বের লোকেরা জবাব দিল, ‘ইনি আবু নাজলাহ-মানে হাশিম ইবনে আবদে মানাফ।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, ইনি নিশ্চয়ই সিরিয়ার গাসসানের নয়; বরং আরবের কোন সম্রান্ত ব্যক্তি হবেন।’ উল্লেখ্য যে, হাশিম ইবনে আবদে মানাফের যে আপ্যায়নের কাহিনী বর্ণনা করা হলো, তা ছিল ‘রিফাদাহ’ তথা হজ্জ মওসুমে হাজীদের আপ্যায়ন।

অপর এক সূত্রে আবু নুআয়ম আবু জাহম থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি শুনেছি, আবু তালিব আবদুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেছেন, আবদুল মুত্তালিব বলেনঃ

একদিন আমি হিজরে অর্থাৎ হাতীমে ঘুমিয়ে ছিলাম। এই ঘুমে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখে আমি আতংকিত হয়ে উঠলাম। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে আমি এক জ্যোতিষিণীর নিকট গেলাম। আমার গায়ে ছিল নকশী রেশমী চাদর এবং আমার লম্বা চুল ঘাড়ে ঝুলছিল। আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে তিনি আমার চেহারায় পরিবর্তন টের পেয়ে যান। আমি তখন আমার সমাজের নেতা। জ্যোতিষিণী বললেন, ‘ঘটনা কী? আমাদের সরদার এমন বিবর্ণ চেহারায় আমার নিকট আসলেন কেন? কোন বিপদ-আপদে পড়েছেন বুঝি?’ আমি বললাম, ‘হ্যা।’ তার নিয়ম ছিল, কেউ তার নিকট আসলে প্রথমে আগন্তুককে তার ডান হাত চুম্বন করতে হতো এবং তার মাথার তালুতে হাত রাখতে হতো। এরপর তার সঙ্গে কথা বলার ও সমস্যার কথা জানানোর সুযোগ পাওয়া যেত। সমাজের নেতা হওয়ার কারণে আমি এসব করলাম না।

এবার আমি বসে বললাম, ‘গত রাতে আমি হিজরে ঘুমিয়ে ছিলাম। দেখি, একটি গাছ মাটি থেকে অংকুরিত হয়ে বড় হয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। ডালগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত। গাছটি এতই আলোকময় যে, তার চেয়ে উজ্জ্বল আলো আমি আর দেখিনি। সূর্যের আলো থেকে তা ছিল সত্তর গুণ বেশি। আরও দেখলাম, আরব আজম তাকে সিজদা করে আছে। প্রতি মুহূর্তে গাছটির পরিধি, ঔজ্জ্বল্য ও উচ্চতা বেড়েই চলেছে। গাছটি ঔজ্জ্বল্য ক্ষণে খানিকটা ম্লান হয় আবার পরক্ষণে উজ্জ্বল হয়। আমি আরও দেখলাম, কুরায়শের একদল লোক গাছটির ডাল ধরে ঝুলে আছে। কুরায়শেরই অপর একটি দল গাছটি কেটে ফেলার চেষ্টা করছে। কাটার উদ্দেশ্যে তারা গাছের নিকটে গেলে এক যুবক তাদের হটিয়ে দেয়।

সেই যুবকের মত এত সুশ্রী আর সৌরভময় যুবক আমি আর কখনো দেখিনি! যুবক পিটিয়ে তাদের হাড়-গোড় ভেঙে দিচ্ছিলেন এবং চোখ উপড়ে ফেলছিলেন। আমি দু’হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে কিছু নিতে চাইলাম। কিন্তু যুবক আমাকে বারণ করল। আমি বললাম, তাহলে এ গাছ কাদের জন্য? তিনি বললেন, যারা গাছ ধরে ঝুলে আছে এবং যারা তোমার আগে এসেছে, এ গাছ তাদের জন্য। এতটুকু দেখার পর এক ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় আমার ঘুম ভেঙে যায়।’

আমি দেখতে পেলাম স্বপ্নের বিবরণ শুনে জ্যোতিষিণীর চেহারার রং পাল্টে গেছে। সে বলল, ‘আপনার স্বপ্ন যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আপনার বংশে এমন এক ব্যক্তি জন্ম নেবেন যিনি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর রাজা হবেন। মানুষ তার ধর্মমত গ্রহণ করবে।’

এই ঘটনার বিবরণ দেওয়ার পর আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে বললেন, উক্ত সন্তানটি বোধ হয় তুমিই হবে।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের এবং নবুওত লাভের পর আবু তালিব প্রায়শই এই ঘটনাটি বলে বেড়াতেন। তারপর তিনি বলেন, ‘আবুল কাসেম আল আমীনই ছিল সেই গাছ।’ মানুষ আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করত, ‘আপনি কি তার প্রতি ঈমান আনবেন না?’ জবাবে তিনি বলতেন, ‘গালমন্দ আর নিন্দার ভয়েই তো তা পারছি না।’

আবু নুআয়ম ....ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, আব্বাস (রা) বলেন, ব্যবসা করার জন্য এক কাফেলার সঙ্গে আমি ইয়েমেন যাই। সেখানে একদিন আমি খাবার তৈরি করতাম এবং আবু সুফিয়ান ও অন্যদের নিয়ে খেতাম, অন্যদিন আবু সুফিয়ান রান্নাবান্না করতেন এবং সকলকে নিয়ে খেতেন। একদিন আমার রান্নার পালা ছিল। আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আবুল ফযল তুমি কি আহার্য ও সঙ্গীদের নিয়ে আমার বাসস্থানে আসবে?’ আমি রাজী হলাম। সেখানে আবু সুফিয়ান ছিলেন কাফেলার অন্যতম সদস্য। আমরা ইয়ামন পৌঁছলাম। একদিন আহার শেষে অন্যদের বিদায় করে একান্তে বসে আবু সুফিয়ান আমাকে বললেন, ‘আবুল ফযল! আপনি কি জানেন যে, আপনার ভাতিজা মনে করে যে, সে আল্লাহর রাসূল?’ আমি বললাম, ‘আমার কোন ভাতিজা!’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আমার নিকটও বিষয়টি গোপন করছেন দেখছি? একজন ছাড়া আপনার কোন্ ভাতিজা এমনটি বলতে পারে?’ আমি বললাম, ‘বলুন না, আপনি কার কথা বলছেন?’ তিনি বললেন, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’ আমি বললাম, ‘এই কাজ করে ফেলেছে ও?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ করে ফেলেছে।’ এই বলে তিনি হানযালা ইবনে আবু সুফিয়ানের পাঠানো একটি পত্র বের করে দেন। তাতে লেখা আছেঃ আমি আপনাকে অবহিত করছি যে, মুহাম্মদ আবতাহে দাড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছে যে, “আমি রাসূল। আপনাদেরকে আমি মহান আল্লাহর পথে আহ্বান করছি।” আব্বাস (রা) বলেন, জবাবে আমি বললাম, ‘হে আবু হানযালা! আমি তো তাকে সত্যবাদীই পাচ্ছি।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘থাম হে আবুল ফযল। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ এমনটি বলুক, আমি তা পছন্দ করি না। হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র! ওর এরূপ কথায় আমি ক্ষতির আশংকা করছি। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, কুরায়শরা এমনিতেই বলাবলি করছে যে, তোমাদের হাতে বহু ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। আমি আপনাকে দোহাই দিয়ে জিজ্ঞেস করছি হে আবুল ফযল! আপনি কি ঐ কথাটা শুনেননি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, শুনেছি বটে।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আল্লাহর কসম, এটা তোমার অকল্যাণ বয়ে আনবে। আমি বললাম, হতে পারে এটা আমাদের জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে।’

এরপর অল্প কদিন যেতে না যেতেই আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা খবর নিয়ে এলেন। তখন তিনি ঈমান এনেছেন। সেই খবর ইয়ামনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। আবু সুফিয়ানও ইয়ামনের এক মজলিসে বসতেন। এক ইহুদী পণ্ডিত সেই মজলিসে আলোচনা করতেন। সেই ইহুদী আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘আমি জানতে পেলাম যে, এই যে লোকটি কি যেন বলেছে, তার চাচা নাকি আপনাদের মধ্যে আছেন?’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘ঠিকই শুনেছেন, আমিই তার চাচা।’ ইহুদী বললেন, ‘মানে, আপনি তার পিতার তাই?’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ।’ ইহুদী বললেন, ‘তবে তার সম্পর্কে বলুন।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আমাকে এসব জিজ্ঞেস করবেন না। ও এমন কিছু দাবি করুক, আমি কখনোই তা পছন্দ করব না। আবার তার দোষও বলব না। তবে তার চেয়ে উত্তম মানুষও তো আছে।’ এতে ইহুদী বুঝতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান মিথ্যাও বলতে পারছেন না আবার তার দোষও বলতে চাচ্ছেন না। তাই তিনি বললেন, ‘এতে ইহুদী ও মূসার তাওরাতের কোন ক্ষতি হবে না।’

আব্বাস (রা) বলেন, তারপর ইহুদী পণ্ডিত আমাকে ডেকে পাঠান। আমি পরদিন সেই মজলিসে গিয়ে বসি। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব-ও সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। পণ্ডিত তো আছেনই। আমি পণ্ডিতকে বললাম, ‘খবর পেলাম, আপনি আমার চাচাতো ভাই-এর নিকট সেই ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, যার ধারণা সে আল্লাহর রাসূল? আর আপনাকে তিনি উক্ত ব্যক্তির চাচা বলে পরিচয় দিয়েছেন? তিনি তো তার চাচা নন। তিনি তার চাচাতো ভাই। তার চাচা হলাম আমি, মানে আমি তার পিতার ভাই!’ পাদ্রী অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি তার পিতার ভাই!’ আমি বললাম, ‘হ্যা, আমি তার পিতার ভাই।’ শুনে পণ্ডিত আবু সুফিয়ানের প্রতি মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি সত্য বলেছেন?’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্য বলেছেন।’ আমি বললাম, ‘আরো কিছু জানবার থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করুন, যদি আমি মিথ্যা বলি, তাহলে ইনি তার প্রতিবাদ করবেন।’ এবার পণ্ডিত আমার প্রতি মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘দোহাই আপনার, সত্য বলবেন। আপনার ভাতিজার কি কারো প্রতি আসক্তি ছিল, না সে মূর্খ?’ আমি বললাম, ‘না, আবদুল মুত্তালিবের প্রভুর শপথ! সে মিথ্যাও বলেনি, খিয়ানতও করেনি। কুরায়শের নিকট তার নাম ছিল আল-আমীন।’ পণ্ডিত বললেন, ‘সে কি কখনো নিজ হাতে লিখেছে?’ আব্বাস (রা) বলেন, আমি মনে করলাম, নিজ হাতে লিখেছে বললেই বোধ হয় তার পক্ষে কল্যাণকর হবে। ফলে তাই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে আবু সুফিয়ানের উপস্থিতির কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, একথা বললে তো তিনি তার প্রতিবাদ করবেন ও আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবেন। তখন আমি বললাম, ‘না, সে লিখতে জানে না।’

এ তথ্য শুনে পণ্ডিত লাফিয়ে ওঠেন। তবে তার গায়ের চাদর খসে পড়ে। তিনি বললেন, ‘ইহুদীরা জবাই হয়ে গেছে, ইহুদীরা খুন হয়ে গেছে!’ আব্বাস (রা) বলেন, তারপর আমরা যখন বাড়ি ফিরে আসি, তখন আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আবুল ফযল! ইহুদীরা তো তোমার ভাতিজার নাম শুনলে আঁতকে ওঠে।’ আমি বললাম, ‘আপনি তো যা দেখার তাই দেখেছেন। আমিও তাই দেখছি। আচ্ছা, তার প্রতি ঈমান আনতে আপনার অসুবিধা কোথায়? হে আবু সুফিয়ান! সে যদি হক হয়ে থাকে, তাহলে আপনি সকলের আগে-ভাগে ঈমান এনে ফেললেন। আর যদি সে বাতিলই হয়ে থাকে, তাহলে মনে করবেন আপনার আরো সমমর্যাদার আর দশজন যা করল, আপনি তাই করলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, আমি তার প্রতি ঈমান আনব না যতক্ষণ না আমি কোদায় ঘোড় সওয়ার বাহিনী দেখব।’ আমি বললাম, ‘আপনি কী বলছেন?’ তিনি বললেন, ‘মুখে একটি কথা এসে গেল, তাই বললাম। অন্যথায় আমি জানি, কোদা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আল্লাহ কোনো ঘোড় সওয়ার বাহিনী ছেড়ে দেবেন না।’ আব্বাস (রা) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা বিজয়ের জন্য আসলেন এবং আমরা কোদা থেকে তাঁর ঘোড়সওয়ার বাহিনী বেরিয়ে আসছে দেখতে পাই তখন আমি আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আবু সুফিয়ান! কথাটা কি এখন আপনার মনে পড়ছে?’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, মনে পড়ছে বৈ কি। আমি প্রশংসা করছি সেই আল্লাহর, যিনি আমাকে ইসলামের পথ দেখিয়েছেন।’

এ বর্ণনাটি হাসান পর্যায়ের। এ থেকে সত্যের আভা ফুটে উঠছে; যদিও এর কোন কোন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। এর আগে আমরা উমাইয়া ইবনে আবুস সালত-এর সঙ্গে আবু সুফিয়ানের ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি। সেই ঘটনার সঙ্গে আলোচ্য ঘটনার মিল আছে। আবার পরে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সঙ্গে তার যে ঘটনা ঘটেছিল, তাও উল্লেখ করা হবে। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর গুণ-পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং তা থেকে নবী করীম (সা)-এর সত্যতা, নবুওত ও রিসালাতের প্রমাণ পেয়ে বলেছিলেনঃ ‘আমি জানতাম যে, তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। কিন্তু তিনি যে আপনাদের মধ্য থেকে হবেন, তা অবশ্য ধারণা করিনি। আমি যদি জানতাম যে, আমি আমার দায়িত্ব ছেড়ে তাঁর কাছে যেতে পারব তাহলে তার সাক্ষাতের জন্য কষ্ট করে হলেও চলে যেতাম। যদি আমি তার কাছে থাকতাম, তাহলে আমি তার দু’পা ধুয়ে দিতাম। তুমি যা বলেছ, যদি সব সত্য হয়ে থাকে, তা হলে অবশ্যই তিনি আমার এই দু’পায়ের জায়গাটুকুরও অধিকারী হবেন।’ প্রকৃতপক্ষে ঘটেছেও তাই।

১০২
আমর ইবনে মুররা আল জুহানীর কাহিনী
তাবারানী বর্ণনা করেন যে, ইয়াসির ইবন সুওয়ায়দ (রা) বরাতে বলেছেন যে, জুহানী বলেন, আমি জাহেলী যুগে আমার সম্প্রদায়ের এক দল লোকের সঙ্গে হজ্জ করতে যাই। মক্কায় অবস্থানকালে একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, এক খণ্ড আলো কা’বা থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে ইয়াসরিবের পর্বত পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছে। আমি শুনতে পেলাম যে, সেই আলোক খণ্ডের মধ্য থেকে কে যেন বলছে, অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে, আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে আর শেষ নবী প্রেরিত হয়েছেন। এরপর আলোক খণ্ডটি আরো উজ্জ্বল হয়ে যায়। আমি হীরার রাজপ্রাসাদ ও মাদায়েনের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। আলোর মধ্য থেকে পুনরায় একটি শব্দ শুনতে পেলাম যে, কে যেন বলছে, ইসলাম প্রকাশ লাভ করেছে, প্রতিমাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট হয়েছে। এসব দেখে আমি ভীত-অবস্থায় জেগে গেলাম। জেগে উঠে আমার সম্প্রদায়ের লোকদের বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! কুরায়শের মধ্যে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।’ আমি তাদেরকে আমার স্বপ্নের কথা বললাম। হজ্জ সম্পাদন করে যখন আমরা দেশে ফিরে এলাম, তখন আহমদ নামে এক ব্যক্তি আমার নিকট আসেন। আমি তাকে আমার স্বপ্নের কথা বলি। তিনি বললেন, ‘হে আমর ইবনে মুররা! আমিই সকল মানুষের প্রতি প্রেরিত নবী। আমি লোকদের ইসলামের প্রতি আহ্বান করি এবং তাদেরকে রক্তারক্তি বন্ধ করার, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, আল্লাহর ইবাদত করার, প্রতিমাসমূহ বর্জন করার, বায়তুল্লাহর হজ্জ করার এবং বার মাসের একমাস রমযানের রোযা রাখার আদেশ করি; যে ব্যক্তি আমার এ আহ্বানে সাড়া দেবে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আর যে তা অমান্য করবে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নাম। সুতরাং হে আমর! তুমি ঈমান আন; আল্লাহ তোমাকে জাহান্নামের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করবেন।’

জবাবে আমি বললামঃ

أشهد أن لا إله إلا الله وأنك رسول الله أمنت بما جئت من حلال وحرام وإن رغم ذالك كثيرا من الأقوام

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, আর আপনি আল্লাহর রাসূল। আপনি যে হালাল ও হারাম আনয়ন করেছেন, আমি তার প্রতি ঈমান আনলাম। যদিও এ ঘোষণা বহু লোককে ক্ষেপিয়ে তুলবে।

তারপর আমি কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে প্রথম যখন শুনতে পেয়েছিলাম তখনও আমি সেই পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেছিলাম। আর আমাদের একটি প্রতিমা ছিল। আমার আব্বা তার দেখাশুনা করতেন। আমি উঠে গিয়ে সেটি ভেঙে ফেলি। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যাই। নবী করীম (সা)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে আমি এই পংক্তিগুলো আবৃত্তি করি।

شهدت بأن الله حق وإنني - لالهة الاحجار اول تارك

وشمرت عن ساق الازار مهاجرا - اليك اجوب الفقر بعد الدكادك

لأصحب خير الناس نفسا ووالدا- رسول مليك الناس فوق الحبائك

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহই সত্য এবং পাথরের দেবতাদেরকে আমিই প্রথম বর্জনকারী। আমি কাপড় গুটিয়ে শক্ত পাথুরে প্রান্তর অতিক্রম করে আপনার নিকট হিজরত করে এসেছি। আমার উদ্দেশ্য হলো— বংশ মর্যাদা এবং সভায় যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁর সাহচর্য লাভ করা। তিনি মানুষ এবং আসমানী রাস্তাসমূহের শাহানশাহ আল্লাহর রাসূল।

শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘মারহাবা! হে আমর ইবনে মুররা!’ তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আপনি আমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করুন। হয়ত আমার দ্বারা আল্লাহ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন, যেমন আপনার উসিলায় তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে আমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করলেন এবং বলে দিলেনঃ

عليك بالرفق والقول الشديد ولا تكن فظا ولا متكبرا ولا حسودا

“কোমলতা ও সত্য কথা অবলম্বন করবে। কঠোর অহংকারী ও হিংসুক হবে না।”

আমর ইবনে মুররা জানান যে, তিনি তার সম্প্রদায়ের নিকট আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে যে বিষয়ের প্রতি আহ্বান করেছিলেন, তিনিও নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের সে বিষয়ের প্রতি আহবান জানান। তাঁর আহবানে একজন ব্যতীত তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন।

তারপর আমর ইবনে মুররা তাদের একদল লোক সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সাদর সম্ভাষণ জানান এবং তাদেরকে একটি লিপি লিখে দেন। তাতে লেখা ছিল,

بسم الله الرحمن الرحيم هذا كتاب من الله على لسان رسول الله بكتاب صادق وحق ناطق مع عمرابن مرة الجهني لجهينة بن زيد أن لكم بطون الأرض وسهولها وتلاع الأودية وظهورها تزرعون نباته وتشربون صافيه على أن تقروا بالخمس وتصلوا صلاة الخمس وفي التبيعة والصريمة إن اجتمعتا وإن تقرقنا شاة شاة ليس على اهل الميرة صدقة ليس الوردة اللبقة .

অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূলের যবানে আমর ইবনে মুররা জুহানীর হাতে জুহায়না ইবনে যায়দ-এর প্রতি লিখিত পত্র। এ পত্রের মর্ম সম্পূর্ণ সত্য ও সঠিক। তোমরা মাটির গর্ত ও উপরিভাগ এবং তোমাদের উপত্যকার উঁচু ও সমতল ভূমি ব্যবহারের অধিকারী। তাতে তোমরা ফসল উৎপন্ন কর ও তার পরিচ্ছন্ন পানি পান কর। তোমাদের দায়িত্ব শুধু, তোমরা পাঁচটি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে এবং পশু ও সম্পদের যাকাত এক বছরের ছাগলের বাচ্চা বা মুখ বাঁধা বাচ্চা একত্রিত হোক বা বিচ্ছিন্ন থাক-একটি করে বকরী যাকাত দিতে হবে। যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ নেই তার সদকা দিতে হবে না। যাকাত আদায়ে উত্তম মাল নেয়া যাবে না।’

বর্ণনাকারী বলেন, কায়স ইবনে শাম্মাস লিখিত এ পত্রে উপস্থিত সকল মুসলমান আমাদের নবী করীম (সা)-এর পক্ষে সাক্ষী থাকেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ مِیثَـٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوح وَإِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَ وَمُوسَىٰ وَعِیسَى ٱبۡنِ مَرۡیَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّیثَـٰقًا غَلِیظ ࣰا)

[Surah Al-Ahzab 7]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা, মারয়াম-তনয় ঈসার নিকট হতে। তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলেন দৃঢ় অঙ্গীকার। (৩৩ আহযাবঃ ৭)।

প্রথম যুগের অনেক আলিম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা যেদিন ( الست بربكم ) (অমি কি তোমাদের রব নই?) বলে বনী আদমের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, সেদিন তিনি নবীদের নিকট থেকে এক বিশেষ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষভাবে শরীয়তধারী সেই মহান পাঁচ নবীর নিকট থেকে, যাদের প্রথমজন হলেন হযরত নূহ (আ) আর সর্বশেষ জন হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)।

হাফিজ আবু নুআয়ম ‘দালায়িলুন নুবুওয়াত’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনার জন্য নবুওত সাব্যস্ত হয় কখন?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আদম-এর সৃষ্টি ও তার মধ্যে রূহ সঞ্চারের মধ্যবর্তী সময়ে।’ তিরমিযী অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেন, এটি একটি একক বর্ণনা।

আবু নু’আয়ম আরো বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর (রা) একদিন বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নবী হয়েছেন কবে?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘আদম যখন তাঁর সৃষ্টির উপাদান কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন।’

অপর এক সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, প্রশ্ন করা হলো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনি কবে নবী হয়েছেন?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘আদমের অবস্থান তখন রূহ ও দেহের মাঝে।’

আদম (আ)-এর কাহিনীতে বর্ণিত এক হাদীসে আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, আল্লাহ তা’আলা যখন আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাঁর সন্তানদের বের করেন, তখনই তিনি মর্যাদা অনুপাতে নবীগণকে নূরের বৈশিষ্ট্য দান করেন। আর মুহাম্মদ (সা)-এর নূর যে তাঁদের সকলের নূরের তুলনায় অধিক উজ্জ্বল ও মহান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নবী করীম (সা)-এর সুউচ্চ মর্যাদা ও মহত্তের সুস্পষ্ট প্রমাণ।

এই মর্মে ইমাম আহমদ (র) বলেন, ইরবায ইবনে সারিয়া (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

إني عند الله لخاتم النبین و إن آدم لمنجدل فی طینته وسانبئكم باول ذالك دعوة إبراهيم وبشارة عيسی بی ورؤيا أمي التي رأت وكذالك أمهات المؤمنين يرين

অর্থাৎ, আদম যখন তাঁর সৃষ্টির উপাদান কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন, আমি তখনই আল্লাহর নিকট শেষ নবী। আমি তোমাদেরকে তার সূচনার কথা জানাব। তাহলো, আমার পিতা ইবরাহীম (আ)-এর দোয়া, আমার সম্পর্কে ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ এবং আমার মায়ের স্বপ্ন। এরূপ স্বপ্ন নবীগণের মাগণই দেখে থাকেন।

লাইছ ও ইবনে ওহব আবদুর রহমান ইবনে মাহদী থেকে এবং আবদুল্লাহ সালিহ মুআবিয়া ইবনে সালিহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় অতিরিক্ত রয়েছে যে, নবী করীম (সা)-কে প্রসব করার সময় তাঁর মা এমন একটি আলো দেখতে পেয়েছিলেন, যার আলোকে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গিয়েছিল।

ইমাম আহমদ.... মায়সারা আল-ফাজরের বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, মায়সারা বলেছেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নবী হয়েছেন কবে?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ “আদম তখন আত্মা ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলেন।”

হাফিজ আবু নুআয়ম তাঁর ‘দালায়িলুন নুবুওয়াত’ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর কালামঃ

( وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ مِیثَـٰقَهُمۡ )

[Surah Al-Ahzab 7]

এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ

كنت أول النبين في الخلق و أخرهم في البعث

অর্থাৎ, সৃষ্টিতে আমি নবীগণের প্রথম আর আবির্ভাবে সকলের শেষ।

বলা বাহুল্য যে, আসমান-যমীন সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই আল্লাহ পাক জানতেন যে, মুহাম্মদ (সা) সর্বশেষ নবী। এমতাবস্থায় এই যে বলা হচ্ছে, আদম যখন রূহ ও দেহের মাঝে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি নবী ছিলেন, এটা ঊর্ধ্ব জগতের ঘোষণা মাত্র। অর্থাৎ ঊর্ধ্ব জগতের ঘোষণাটা হয়েছিল এভাবে। আল্লাহ তা’আলা তো বিষয়টি পূর্ব থেকেই জানতেন।

আবু নুআয়ম আবু হুরায়রা (রা) থেকে একটি মুত্তাফাক আলাইহি (বুখারী-মুসলিম সম্বলিত) হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

نحن الأخرون السابقون يوم القيامة المقضى لهم قبل الأخلاق بيد أنهم أوتوا الكتاب من قبلنا وأوتيناه من بعدهم

অর্থাৎ, আমরা সর্বশেষ জাতি। কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হব সকলের আগে। আমার উম্মতের বিচারকার্য সম্পাদন হবে অন্য সব উম্মতের পূর্বে। পার্থক্য শুধু এটুকু যে, অন্যান্য উম্মতকে কিতাব দেয়া হয়েছে আমাদের আগে আর আমরা পেয়েছি তাদের পরে।

হাদীসটি বর্ণনা করার পর আবু নুআয়ম এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবে সব নবীর শেষ এবং তাঁরই দ্বারা নবুওত সমাপ্ত করা হয়েছে। তবে কিয়ামতের দিন তিনি সকলের আগে উপস্থিত হবেন। কারণ নবুওত ও অঙ্গীকারের তালিকায় তার নাম সকলের শীর্ষে।

আবু নুআয়ম আরও বলেন যে, এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মর্যাদার কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আদম সৃষ্টিরও আগে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্য নবুওত সাব্যস্ত করেছেন। সম্ভবত এটাই ফেরেশতাগণের নিকট আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনিই হবেন শেষ নবী।

হাকিম তার মুস্তাদরাক গ্রন্থে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

“আদম যখন ভুল করে বসেন তখন তিনি বলেছিলেন, হে আমার রব! আপনার নিকট আমি মুহাম্মদের উসিলায় প্রার্থনা করছি, আপনি আমায় ক্ষমা করে দিন। তখন আল্লাহ বললেন, আদম! তুমি মুহাম্মদকে চিনলে কি করে? আমি তো এখনও তাকে সৃষ্টিই করিনি! আদম বললেন, হে আমার রব! আপনি যখন নিজ কুদরতী হাতে আমাকে সৃষ্টি করেছিলেন ও আমার মধ্যে রূহ্ সঞ্চার করেছিলেন, সে সময়ে আমি মাথা তুলে আরশের খুঁটিসমূহেঃ

لا إله الا الله محمد رسول الله

লিখিত দেখেছিলাম। তাতেই আমি বুঝে ফেলেছি যে, আপনি আপনার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো নাম আপনার নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন নি। আল্লাহ তা’আলা বললেন, আদম! তুমি ঠিকই বলেছ। অবশ্যই তিনি আমার কাছে সৃষ্টির সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। যাক তুমি যখন তার উসিলা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেই ফেলেছ, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আর মুহাম্মদ যদি নাই হতো, আমি তোমাকে সৃষ্টিই করতাম না।’ বায়হাকী বলেন, আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলামের একক বর্ণনা অথচ তিনি একজন দুর্বল রাবী। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِیثَـٰقَ ٱلنَّبِیِّـۧنَ لَمَاۤ ءَاتَیۡتُكُم مِّن كِتَـٰب وَحِكۡمَة ثُمَّ جَاۤءَكُمۡ رَسُول مُّصَدِّق لِّمَا مَعَكُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهِۦ وَلَتَنصُرُنَّهُۥۚ قَالَ ءَأَقۡرَرۡتُمۡ وَأَخَذۡتُمۡ عَلَىٰ ذَ  ٰ⁠ لِكُمۡ إِصۡرِیۖ قَالُوۤا۟ أَقۡرَرۡنَاۚ قَالَ فَٱشۡهَدُوا۟ وَأَنَا۠ مَعَكُم مِّنَ ٱلشَّـٰهِدِینَ )

[Surah Aal-E-Imran 81]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি, তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন নিশ্চয় তোমরা তাকে বিশ্বাস করবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক, আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম। (৩ আলে ইমরানঃ ৮১)।

আলী ইবনে আবু তালিব ও অাবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহ যখন যে নবীকে প্রেরণ করেছেন, তারই নিকট থেকে এ অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় যদি মুহাম্মদ (সা) প্রেরিত হন তাহলে অবশ্যই যেন তিনি তার প্রতি ঈমান আনেন এবং তাকে সাহায্য করেন। আর আদেশ দিয়েছেন যেন তাঁর উম্মতের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়ে রাখেন যে, যদি মুহাম্মদ (সা) প্রেরিত হন আর তারা তখন জীবিত থাকে, তবে যেন অবশ্যই তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে ও তাঁকে সাহায্য করে।

এভাবে অঙ্গীকার নিয়ে আল্লাহ তা’আলা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ (সা) সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব!

বায়তুল্লাহর নির্মাণ কাজ শেষ করে হযরত ইবরাহীম (আ) যে দোয়া করেছিলেন, তাতেও নবী করীম (সা)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠেছে। তা হলোঃ

( رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِیهِمۡ رَسُول ا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوا۟ عَلَیۡهِمۡ ءَایَـٰتِكَ وَیُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَیُزَكِّیهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِیزُ ٱلۡحَكِیمُ )

[Surah Al-Baqarah 129]

অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করুন যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (২ বাকারাঃ ১২৯)

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মিশন সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে এটিই প্রথম ঘোষণা, যা ঘোষিত হয়েছে এমন এক মহান নবীর মুখে, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় নবী করীম (সা)-এর পরই যার অবস্থান।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, আবু উমামা (রা) বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনার মিশনের প্রারম্ভ হয়েছিল কিভাবে?’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া, ঈসার সুসংবাদ এবং মায়ের স্বপ্ন যাতে তিনি দেখেছেন, তার ভিতর থেকে এমন একটি আলো নির্গত হয় যে, তাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়।’ এটি ইমাম আহমদের একক বর্ণনা।

হাফিজ আবু বকর ইবনে আবু আসিম কিতাবুল মাওলিদে বর্ণনা করেন যে, এক বেদুঈন এসে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার নবুওতের সূচনা কী ছিল?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আল্লাহ আমার থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, যেমন অঙ্গীকার নিয়েছেন অন্য নবীদের থেকে। আর আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার দুই পায়ের মধ্যস্থল থেকে একটি প্রদীপ নির্গত হয় এবং তাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়।’

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সাহাবাগণ একদিন বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীম-এর (আ) দোয়া, ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ আর আমাকে গর্ভে ধারণের পর আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তার থেকে একটি আলো বের হয়, যার ফলে সিরিয়ার বুসরা নগরী আলোকিত হয়ে যায়।’ এ বর্ণনার সূত্র উত্তম।

নবী করীম (সা)-এর এ বক্তব্যে বুসরাবাসীদের জন্যও সুসংবাদ রয়েছে। বাস্তবেও দেখা গেছে নবুওতের নূর সিরিয়ার বুসরায়-ই সর্বপ্রথম বিচ্ছুরিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সমগ্র সিরিয়ার মধ্যে বুসরা নগরী-ই সর্বাগ্রে মুসলমানদের আয়ত্তে আসে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর খিলাফতকালে এক সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে এই বুসরা জয় হয়েছিল। এর বিস্তারিত বিবরণ পরে আসবে।

রাসূলুল্লাহ (সা) দু’বার বুসরায় গিয়েছিলেন। একবার তার চাচা আবু তালিবের সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স বার বছর। বহীরা পাদ্রীর ঘটনা সেখানেই ঘটেছিল। আরেকবার গিয়েছিলেন খাদীজা (রা)-এর গোলাম মায়সারার সঙ্গে, খাদীজা (রা)-এর ব্যবসা পণ্য নিয়ে। এই বুসরায়ই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উষ্ট্রী বসে পড়েছিল এবং তাতে তার চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল বলে পরে কথিত আছে। তা স্থানান্তরিত করে সে স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। বর্তমানে সেটি একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ। এই বুসরায়ই ৬৫৪ সালে হিজাজ থেকে নির্গত অগ্নিশিখায় উটের ঘাড় আলোকিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ঠিক যেমনটি এ মর্মে নবী করীম (সা) একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তা হলোঃ হিজাজ ভূমি থেকে অগ্নি নির্গত হবে, যার শিখায় বুসরা নগরীতে উটের ঘাড় আলোকিত হবে।

ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( ٱلَّذِینَ یَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِیَّ ٱلۡأُمِّیَّ ٱلَّذِی یَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِیلِ یَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَیَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَیُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّیِّبَـٰتِ وَیُحَرِّمُ عَلَیۡهِمُ ٱلۡخَبَـٰۤىِٕثَ وَیَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَـٰلَ ٱلَّتِی كَانَتۡ عَلَیۡهِمۡۚ فَٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ بِهِۦ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُوا۟ ٱلنُّورَ ٱلَّذِیۤ أُنزِلَ مَعَهُۥۤ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ )

[Surah Al-A'raf 157]

অর্থাৎ, যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল, যা তাদের নিকট আছে, তাতে লিপিবদ্ধ পায়, সে তাদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎ কার্যে বাধা দেয়, যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু বৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃংখল হতে, যা তাদের ওপর ছিল। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম। (৭ আ’রাফঃ ১৫৭)

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, এক বেদুঈন বলেছে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় ব্যবসার পণ্য নিয়ে একবার আমি মদীনা যাই। ক্রয়-বিক্রয় শেষ করে আমি মনে মনে বললাম, আজ অবশ্যই আমি ঐ লোকটির কাছে যাব এবং তিনি কি বলেন, শুনব। বেদুঈন বলে, যখন আমি তার সাক্ষাত পেলাম, তখন তিনি আবু বকর (রা) ও উমর (রা)-কে দুপাশে নিয়ে হাঁটছেন।

আমি তাদের অনুসরণ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক ইহুদীর নিকট গমন করেন। ইহুদী লোকটির অপরূপ সুশ্রী একটি ছেলে মৃত্যু শয্যায় ছিল। ইহুদী লোকটি তারই পার্শ্বে বসে তাওরাত খুলে পাঠ করছে আর পুত্রের জন্য শোক প্রকাশ করছে। নবী করীম (সা) বললেন, ‘যে সত্তা তাওরাত নাযিল করেছেন, তার কসম দিয়ে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। তোমার কিতাবে কি তুমি আমার পরিচয় ও আবির্ভাব স্থলের কথা পাও?’ ইহুদী মাথা নেড়ে বলল, ‘না, পাই না।’ সঙ্গে সঙ্গে তার পুত্র বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, যিনি তাওরাত নাযিল করেছেন, তাঁর শপথ! আমাদের কিতাবে আমরা আপনার পরিচয় ও আবির্ভাব স্থলের কথা পাই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের নিকট থেকে এই ইহুদীকে উঠিয়ে দাও।’ তারপর তিনি ছেলেটির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন ও জানাযার সালাত আদায় করেন। এ বর্ণনার সূত্র উত্তম এবং সহীহ বর্ণনায় আনাস (রা) থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়।

আবুল কাসেম বগবী বর্ণনা করেন যে, এক সাহাবী বলেছেন—একদিন আমি নবী করীম (সা)-এর নিকট বসা ছিলাম। হঠাৎ একজন লোকের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চোখ পড়ে। লোকটি ছিল ইহুদী। তার গায়ে জামা, পরণে পাজামা, পায়ে জুতা। নবী করীম (সা) তার সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। লোকটি বললঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘তুমি কি ইনজীল পড়?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ, পড়ি।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আর কুরআন?’ বলল, ‘তবে আপনি চাইলে পড়তে পারি।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘তাওরাত-ইনজীলে যা পড়, তাতে আমাকে নবীরূপে পাও কি?’ লোকটি বলল, ‘আপনার পরিচয় ও আবির্ভাব স্থলের কথা আমরা পাই। কিন্তু যখন আপনি আবির্ভূত হলেন, তখন আমরা আশা করেছি, আপনি আমাদের মধ্য থেকে হবেন! কিন্তু যখন আমরা আপনাকে দেখলাম, তখন বুঝলাম, আপনি সেই ব্যক্তি নন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘কারণ কী হে ইহুদী?’ ইহুদী বলল, ‘আমরা লিপিবদ্ধ পাই যে, তার উম্মতের সত্তর হাজার মানুষ বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আপনার সঙ্গে সামান্য ক’জন ছাড়া আর তো লোক দেখছি না।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আমার উম্মত সত্তর হাজার আরও সত্তর হাজারের চেয়েও বেশি।’ এটি একক বর্ণনা।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক...... আবু হুরায়রা (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) ইহুদীদের নিকট গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞ ব্যক্তিকে ডেকে আন।’ তারা বললেন, ‘তিনি হচ্ছেন আবদুল্লাহ ইবনে সুরিয়া।’ নবী করীম (সা) তাকে একান্তে নিয়ে তার দীন, তাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত, মান্না-সালওয়া, মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান ইত্যাদির কসম দিয়ে বললেনঃ “তুমি কি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে জান?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ। আর আমি যা জানি, আমার সম্প্রদায়ও তাই জানে। আপনার গুণ-পরিচয় তো তাওরাতে সুস্পষ্ট বর্ণিত আছে। কিন্তু তারা আপনাকে হিংসা করে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘কিন্তু তোমাকে বারণ করে কে?’ লোকটি বলল, ‘আমি আমার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণকে অপছন্দ করি। তবে অচিরেই তারা আপনার অনুগামী হবে এবং ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন আমিও ইসলাম গ্রহণ করব।’

সালামা ইবনে ফাযল... ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) খায়বারের ইহুদীদের প্রতি একটি পত্র দিয়েছিলেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ

بسم الله الرحمن الرحيم من محمد رسول الله صاحب موسی وأخيه والمصدق بما جاء به موسى ألا إن الله قال لكم يامعشر يهود وأهل الثوراة أنكم تجدون ذالك في كتابكم إن امحمد رسول الله والذين معه أشداء على الكفار رحماء بينهم تراهم ركعا سجدا يبتغون فضلا من الله ورضوانا سيماهم في وجوههم من أثر السجود ذلك مثلهم في التوراة ومثلهم في الأنجيل كزرع أخرج شطأه فازره فاستغلظ فاستوى على سوقه يعجب الزراع ليغيظ بهم الكفار وعد الله الذين آمنوا وعملوا الصالحات منهم مغفرة وأجرا عظيما ) وإني أنشدكم بالله وبالذي أنزل عليكم و أنشدكم بالله وبالذي أنزل عليكم وانشدكم بالذى اطعم من كان قبلكم من أسلافكم واسباطكم . المن والسلوى و أنبئكم بالذي أيبس البحر لا بائكم حتى أنجاكم من فرعون وعمله إلا أخبرتمونا هل تجدون فيما أنزل الله عليكم أن تؤمنوا بمحمد فإن كنتم لا تجدون ذالك في كتابكم فلاكره عليكم قد تبين الرشد من الغي وأدعوكم إلى الله وإلى تبيه

অর্থাৎ, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। মূসার সঙ্গী ও তার ভাই এবং তার কিতাবের সত্যায়নকারী আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ-এর পক্ষ থেকে।

হে ইহুদী ও আহলে তাওরাত সম্প্রদায়। আল্লাহ তোমাদের উদ্দেশে বলেছেন এবং তোমাদের কিতাবেও তোমরা পাচ্ছ যেঃ

‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। আর তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে। তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইনজীলেও। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নির্গত হয় কিশলয় তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কান্ডের ওপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের। (৪৮ ফাতহঃ ২৯)

আমি তোমাদেরকে কসম দিচ্ছি আল্লাহর ও সেই সত্তার, যিনি তোমাদের প্রতি তাওরাত নাযিল করেছেন। আমি তোমাদেরকে কসম দিচ্ছি সেই সত্তার, যিনি তোমাদের পূর্বসূরিদেরকে মান্না ও সালাওয়া খাইয়েছেন। আমি তোমাদেরকে কসম দিচ্ছি সেই সত্তার, যিনি সমুদ্রকে শুকিয়ে তোমাদের পূর্বসূরিদের ফেরআউন ও তার কার্যকলাপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বল তো, আল্লাহ তোমাদের ওপর যা নাযিল করেছেন, তাতে কি তোমরা এ কথা লিপিবদ্ধ পাও না যে, তোমরা মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আনবে? যদি তোমাদের কিতাবে তোমরা কথাটা না পেয়ে থাক, তবে তোমাদের প্রতি কোন জোর-জবরদস্তি নেই। হিদায়াত গোমরাহী থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর নবীর প্রতি আহবান করছি।

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার ‘মুবতাদা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বুখত নাসর (নেবুচাঁদ নেযার) বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস এবং বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছিত করার সাত বছর পর এক রাতে একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। পরদিন গণক জ্যোতিষীদের সমবেত করে তাদের নিকট তার সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে চায়। তারা বলে, ‘মহারাজ! স্বপ্নের বিবরণটা তুলে ধরলেই আমরা তার ব্যাখ্যা বলতে পারব।’ বুখত নাসর বলল, ‘স্বপ্নের বিবরণ আমি ভুলে গেছি, কি দেখেছি এখন তা মনে নেই। তোমাদেরকে আমি তিনদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে তা বলতে না পারলে আমি তোমাদের সবাইকে হত্যা করব।’ রাজার হুমকিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তারা ফিরে যায়।

হযরত দানিয়াল (আ) ছিলেন তখন বুখত নাসর-এর কারাগারে বন্দী। ঘটনাটি তাঁর কানে যায়। তাই জেলারকে তিনি বললেন, ‘যাও, রাজাকে গিয়ে বল যে, এখানে এমন একজন লোক আছেন, যিনি আপনার স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে অবহিত। সংবাদ পেয়ে রাজা দানিয়াল (আ)-কে ডেকে পাঠায়। দানিয়াল (আ) তার কক্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রাজাকে সিজদা করলেন না। রাজা বলল, ‘আমাকে সিজদা করতে তোমায় কিসে বারণ করল?’ দানিয়াল (আ) বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে বিশেষ এক ইলম দান করেছেন এবং তাকে ব্যতীত কাউকে সিজদা না করার আদেশ দিয়েছেন।’ বুখত নাসর বলে, ‘যারা তাদের রবকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করে, আমি তাদেরকে ভালবাসি। এবার বল, আমি কী স্বপ্ন দেখেছি।’ হযরত দানিয়াল (আ) বললেনঃ

আপনি দেখেছেন, বৃহৎ একটি প্রতিমা, যার দু’পা মাটিতে তার মাথাটা আকাশে। প্রতিমাটির ঊর্ধ্বাংশ সোনার, মধ্যমাংশ রূপার এবং নিম্নাংশ তামার আর পায়ের গোছা দু’টো লোহার। পা দুটো পোড়ামাটির। তার রূপ এবং শিল্পনৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে আপনি প্রতিমাটির প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। ঠিক এ সময়ে আল্লাহ আকাশ থেকে একটি পাথর নিক্ষেপ করেন। পাথরটি প্রতিমার ঠিক মস্তক বরাবর নিক্ষিপ্ত হয়। প্রতিমাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সোনা, রূপা, তামা, লোহা ও পোড়ামাটি সব একাকার হয়ে যায়। আপনার মনে হলো যে, পৃথিবীর সব মানুষ আর সকল জিন একত্রিত হয়েও এর একটি উপাদানকে অপরটি থেকে আলাদা করতে পারবে না। আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে আপনি দেখলেন যে, পাথরটি ধীরে ধীরে পুষ্ট, মোটা ও বড় হচ্ছে এবং চারদিক বিস্তৃত হতে হতে সমগ্র পৃথিবী গ্রাস করে ফেলেছে। তখন আপনি পাথর আর আকাশ ছাড়া কিছুই দেখছেন না।’

স্বপ্নের বিবরণ শুনে বুখত নাসর বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমি এ স্বপ্নই দেখেছিলাম। এবার বল, তাৎপর্য কী?’

দানিয়াল (আ) বললেনঃ প্রতিমাটি হলো পৃথিবীর শুরু, মধ্যম ও শেষ যুগের বিভিন্ন জাতি। প্রতিমার গায়ে নিক্ষিপ্ত পাথর হলো সেই দীন, যাকে আল্লাহ শেষ যুগের উম্মতের প্রতি অবতীর্ণ করবেন এবং সব জাতির ওপর দীনকে বিজয়ী করবেন। এ লক্ষ্যে আল্লাহ আরব থেকে একজন উম্মী নবী প্রেরণ করবেন। পাথর যেমন প্রতিমার বিভিন্ন অংশকে পিষে একাকার করে ফেলেছে, তেমনি তিনিও সব জাতি আর সব ধর্মকে একাকার করে ফেলবেন। নিজের দীনকে তিনি অন্যসব দীনের ওপর বিজয়ী করবেন। পাথরের পৃথিবীময় ছড়িয়ে পরার ন্যায় তার দীন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তার মাধ্যমে আল্লাহ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন আর মিথ্যাকে দূরীভূত করবেন। বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের পথ দেখাবেন, নিরক্ষর লোকদের শিক্ষা দান করবেন। দুর্বলদের শক্তিশালী করবেন, লাঞ্ছিতদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন এবং অসহায়দের সাহায্য করবেন।

বর্ণনাকারী এ প্রসঙ্গে বুখত নাসর-এর বনী ইসরাঈলকে দানিয়াল (আ)-এর হাতে মুক্তি দেয়ার বিস্তারিত কাহিনীও উল্লেখ করেন।

ওয়াকিদী বর্ণনা করেন যে, একবার ইস্কান্দারিয়ার (আলেকজান্দ্রিয়ার) রাজা মুকাওকিস-এর নিকট মুগীরা ইবন শু’বা প্রতিনিধিরূপে গমন করেন। তখন মুকাওকিস রাসূলুল্লাহ (সা)-এর গুণ-পরিচয় সম্পর্কে ঠিক সেসব প্রশ্ন করে, যা করেছিল হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে। ওয়াকিদী একথাও উল্লেখ করেন যে, মুকাওকিস বিভিন্ন গির্জায় খৃষ্টান পণ্ডিতদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। খৃস্টান পণ্ডিতরা সে ব্যাপারে তাকে অবহিত করে। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। হাফিজ আবু নুআয়ম দালায়িলে তা বর্ণনা করেছেন।

বুখারী শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন ইহুদীদের কয়েকটি বিদ্যাপীঠ হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি তাদেরকে বলেন, ‘ওহে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা মুসলমান হয়ে যাও। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! তোমরা তোমাদের কিতাবসমূহে আমার পরিচয় পাচ্ছ নিশ্চয়ই।’

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, ...... আতা ইবনে ইয়াসার বলেন, আমি একদিন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস-এর নিকট গিয়ে বললাম, ‘তাওরাতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কি পরিচয় বর্ণিত আছে আমাকে তা বলুন।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যে পরিচয় কুরআনে বিবৃত হয়েছে, তাওরাতে হুবহু তাই উল্লেখ আছে। তা হলোঃ

হে নবী! আমি তোমাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদদাতা, ভয় প্রদর্শনকারী ও উম্মীদের আশ্রয়দাতা রূপে প্রেরণ করেছি। তুমি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি তোমার নাম রেখেছি মুতাওয়াক্কিল। তুমি ভাষায় কর্কশ বা হৃদয়ে কঠোর নও। তুমি হাটে-বাজারে চিৎকার করে কথা বল না। তুমি মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিরোধ কর না। তুমি ক্ষমাশীল। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র বিশ্বাসী বানিয়ে পথভ্রষ্ট জাতিকে সোজা পথে আনা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাকে তুলে নেবেন না।

এর দ্বারা আল্লাহ অন্ধ চক্ষু, বধির কান ও তালাবদ্ধ হৃদয়সমূহ খুলে দেবেন।’ বুখারীও ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন জারীরের বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে যে, আতা ইবনে ইয়াসার বলেন, আমি কা’বকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনিও হুবহু একই কথা বলেন, একটি বর্ণেরও পার্থক্য করেন নি।

হাফিজ আবু বকর বায়হাকী বর্ণনা করেন যে,....... আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় সম্পর্কে হুবহু একই কথা বলতেন। কা’ব আল-আহবারও অভিন্ন কথা বলতেন। আমি বলি, আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা)-এর উক্তি যুক্তিগ্রাহ্য। তবে আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) অনেক বেশি বলতেন। ইয়ারমুকের দিন তিনি আহলে কিতাবের যে দু’টি বস্তা পেয়েছিলেন তা থেকে তিনি প্রায়ই বর্ণনা করতেন। আদি যুগের অনেক আলিম আহলে কিতাবের সকল গ্রন্থকেই তাওরাত বলে আখ্যায়িত করতেন। মূসা (আ)-এর প্রতি নাযিলকৃত তাওরাতে তা রাখতেন না। অন্যান্য হাদীসে এ বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায়। ইউনুস বর্ণনা করেন যে, উম্মুদ্দারদা (রা) বলেন, আমি একদিন কা’ব আল আহবারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাওরাতে আপনারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় কিরূপ পান?’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘তাওরাতে তার পরিচয় হলোঃ মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। তাঁর নাম মুতাওয়াক্কিল। তিনি কর্কশ নন, কঠোর নন। হাটে-বাজারে চিৎকার করে কথা বলে বেড়ান না। তাকে অনেক চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। তার দ্বারা আল্লাহ দৃষ্টিশক্তিহীন চোখগুলোকে দৃষ্টিশক্তি, বধির কানগুলোকে শ্রবণশক্তি দান করবেন এবং বক্র জিহ্বগুলোকে সোজা করবেন। ফলে তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক, তার কোন শরীক নেই। তাঁর দ্বারা আল্লাহ মজলুমের সহায়তা করবেন এবং মজলুমকে জুলুমের কবল থেকে রক্ষা করবেন।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে,....... আবু হুরায়রা (রা) সূরা কাসাস এর আয়াতঃ

( وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ ٱلطُّورِ إِذۡ نَادَیۡنَا )

[Surah Al-Qasas 46]

(মূসাকে আমি যখন আহ্বান করেছিলাম, তখন তুমি তূর পর্বত পার্শ্বে উপস্থিত ছিলে না)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, তখন আহ্বান করা হয়েছিল, ‘হে মুহাম্মদের উম্মত! তোমরা আমাকে আহ্বান করার আগেই আমি তোমাদের আহ্বান কবূল করে নিয়েছি। যা করার আগেই আমি তোমাদেরকে দান করেছি।

ওহব ইবনে মুনাব্বিহ বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা’আলা যাবূরে দাউদ (আ)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলেন, ‘হে দাউদ! তোমার পর অচীরেই একজন নবী আসছেন। তার নাম হবে আহমদ ও মুহাম্মদ। তিনি হবেন সত্যবাদী ও সর্দার। আমি কখনো তার প্রতি রুষ্ট হবো না, তিনি কখনো আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না। আমার কোন নাফরমানী না করতেই আমি তার পূর্বাপর সব ক্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছি। তাঁর উম্মত হবে রহমতপ্রাপ্ত। আমি নবীদের যেমন নফল দান করেছিলাম, তেমনি তাদেরকেও তা দান করেছি। আর তাদের ওপর এমন সব দায়িত্ব ফরয করেছি, যা করেছিলাম আমি রাসূলগণের ওপর। কিয়ামতের দিন যখন তারা আমার সামনে উপস্থিত হবে, তাদের নূর হবে নবীগণের নূরের অনুরূপ।’

এরপর আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, ‘হে দাউদ! আমি মুহাম্মদকে এবং অন্যসব উম্মতের ওপর তার উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’

পবিত্র কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে ও আহলে কিতাবের গ্রন্থাদিতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুসংবাদ থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। যথাস্থানে আমরা তা আলোকপাত করেছিও। এর মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিম্নরূপঃ

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ٱلَّذِینَ ءَاتَیۡنَـٰهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ مِن قَبۡلِهِۦ هُم بِهِۦ یُؤۡمِنُونَ ۝ وَإِذَا یُتۡلَىٰ عَلَیۡهِمۡ قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِهِۦۤ إِنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّنَاۤ إِنَّا كُنَّا مِن قَبۡلِهِۦ مُسۡلِمِینَ )

[Surah Al-Qasas 52 - 53]

অর্থাৎ, এর আগে আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা এতে বিশ্বাস করে। যখন তাদের নিকট তা আবৃত্তি করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা এতে ঈমান আনি, এটা আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত সত্য। আমরা তো পূর্বেও আত্মসমর্পণকারী ছিলাম। (২৮ঃ কাসাসঃ ৫২, ৫৩)

( ٱلَّذِینَ ءَاتَیۡنَـٰهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ یَعۡرِفُونَهُۥ كَمَا یَعۡرِفُونَ أَبۡنَاۤءَهُمۡۖ وَإِنَّ فَرِیق ا مِّنۡهُمۡ لَیَكۡتُمُونَ ٱلۡحَقَّ وَهُمۡ یَعۡلَمُونَ )

[Surah Al-Baqarah 146]

অর্থাৎ, যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে সেইরূপ চিনে, যেরূপ চিনে তাদের সন্তানদেরকে। আর তাদের একদল জেনে বুঝে সত্যকে গোপন রাখে। (২ঃ বাকারাঃ ১৪৬)

( إِنَّ ٱلَّذِینَ أُوتُوا۟ ٱلۡعِلۡمَ مِن قَبۡلِهِۦۤ إِذَا یُتۡلَىٰ عَلَیۡهِمۡ یَخِرُّونَ لِلۡأَذۡقَانِ سُجَّد ا ۝ وَیَقُولُونَ سُبۡحَـٰنَ رَبِّنَاۤ إِن كَانَ وَعۡدُ رَبِّنَا لَمَفۡعُول ࣰا)

[Surah Al-Isra' 107 - 108]

অর্থাৎ, যাদেরকে এর আগে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট যখন তা পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র মহান। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। (১৭ঃ বনী ইসরাঈলঃ ১০৮)।

অর্থাৎ আমাদের প্রতিপালক মুহাম্মদের অস্তিত্ব ও প্রেরণ সম্পর্কে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হবে নিশ্চিত। তাই আমরা পবিত্রতা ঘোষণা করি সেই সত্তার, যিনি ইচ্ছে করলেই যে কোন কাজ করতে সক্ষম। তাকে অক্ষম করবে এমন কোন শক্তি নেই। (১৭, ইসরাঃ ১০৭, ১০৮)

অন্য আয়াতে খৃস্টান পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( وَإِذَا سَمِعُوا۟ مَاۤ أُنزِلَ إِلَى ٱلرَّسُولِ تَرَىٰۤ أَعۡیُنَهُمۡ تَفِیضُ مِنَ ٱلدَّمۡعِ مِمَّا عَرَفُوا۟ مِنَ ٱلۡحَقِّۖ یَقُولُونَ رَبَّنَاۤ ءَامَنَّا فَٱكۡتُبۡنَا مَعَ ٱلشَّـٰهِدِینَ )

[Surah Al-Ma'idah 83]

অর্থাৎ, রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন তারা শ্রবণ করে, তখন তারা যে সত্য উপলব্ধি করে তার জন্য তুমি তাদের চক্ষু অশ্রুবিগলিত দেখবে। তারা বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং তুমি আমাদেরকে সাক্ষ্যবাহকদের তালিকাভুক্ত কর। (৫ঃ মায়িদাঃ ৮৩)

তাছাড়া নাজ্জাশী সালমান আল-ফারসী ও আবদুল্লাহ ইবনে সালাম প্রমুখের বাণীতে একথার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। সকল প্রশংসা ও প্রশস্তি আল্লাহরই।

বিভিন্ন নবীর জীবন চরিত বর্ণনা প্রসঙ্গে যেমন হযরত মূসা, শা‘য়া, আরমিয়া ও দানিয়াল প্রমুখ নবীর কাহিনীতে আমরা তাদের বর্ণিত রাসূলুল্লাহ-এর আবির্ভাব, গুণ-পরিচয়, জন্মভূমি, হিজরত ভূমি ও তাঁর উম্মতের পরিচয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছি।

অপর দিকে বনী ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী হযরত ঈসা (আ)-এর মাধ্যমেও আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এরূপ সংবাদ প্রদান করেছেন। হযরত ঈসা (আ) একদিন বনী ইসরাঈলের মাঝে ভাষণ দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন, কুরআন মজীদের ভাষায় তা হলোঃ

( وَإِذۡ قَالَ عِیسَى ٱبۡنُ مَرۡیَمَ یَـٰبَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ إِنِّی رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَیۡكُم مُّصَدِّق ا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیَّ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَمُبَشِّرَۢا بِرَسُول یَأۡتِی مِنۢ بَعۡدِی ٱسۡمُهُۥۤ أَحۡمَدُۖ )

[Surah As-Saf 6]

অর্থাৎ, আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর রাসূল। আমার পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং এমন এক রাসূলের সুসংবাদদানকারী রূপে আমার আবির্ভাব, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম হবে আহমদ। (৬১, সাফঃ ৬)

ইনজীলে ‘ফারকালীত’ এর ব্যাপারে সুসংবাদ আছে। ফারকালীত দ্বারা মুহাম্মদ (সা)-কেই বুঝানো হয়েছে।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে,...... হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ইনজীলে লিপিবদ্ধ আছে, কর্কশ নন, কঠোর নন, হাটে-বাজারে চিৎকারকারী নন। মন্দের প্রতিবিধান মন্দ দ্বারা করেন না বরং ক্ষমা করে দেন।

ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেন যে,........ মুকাতিল ইবনে হিব্বান বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা ঈসা ইবনে মারয়ামের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যে, আমার আদেশ পালনে তৎপর হও। শোন ও আনুগত্য কর হে চির কুমারী সাধ্বী নারীর পুত্র। পিতা ছাড়া সৃষ্টি করে আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য নিদর্শন বানিয়েছি। অতএব, তুমি আমারই ইবাদত কর। সুরিয়ানী ভাষায় সুরানীদের বুঝাও। প্রচার করে দাও যে, আমিই সত্য, স্থিতিশীল, চিরন্তন। ঘোষণা কর যে, তোমরা নিরক্ষর উম্মী নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, যিনি উট, বর্ম, মুকুট, জুতা ও লাঠির অধিকারী হবেন। যার মাথার চুল থাকবে কিছুটা কোঁকড়ানো। প্রশস্ত কপাল, জোড়া ভ্রু আয়ত কাজল চোখ, দীর্ঘ চোখের পাতা, উন্নত নাক, উজ্জ্বল গাল ও ঘন দাড়ি। মুখমণ্ডলের ঘাম যেন মুক্তার দানা যা মেশকের সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। তার ঘাড় যেন রূপার পাত্র দু’কণ্ঠা বেয়ে যেন সোনা গড়িয়ে পড়ে। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের একটি রেখা। এ ছাড়া তার পেটে আর কোন চুল নেই। হাতের তালু ও পায়ের পাতা মাংসল। মানুষের সঙ্গে হাঁটার সময় তাকেই সর্বাপেক্ষা উঁচু দেখা যায়। হাঁটার সময় মনে হয় যেন তিনি উপর থেকে নিচে নামছেন। তার পুরুষ বংশধরদের সংখ্যা হবে অল্প। বায়হাকী তার দালাইল গ্রন্থে এরূপ বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, উসমান ইবনে হাকাম ইবনে রাফি ইবনে সিনান বলেন, তিনি তার পূর্ব পুরুষদের নিকট শুনেছেন যে, তাদের নিকট একটি লিপি ছিল। জাহেলী যুগে বংশপরম্পায় লিপিটি তারা সংরক্ষণ করেন। ইসলামের আবির্ভাব কালেও লিপি তাদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনা আসেন, তখন তারা বিষয়টি তাকে জানান এবং লিপি এনে দেন। তাতে লেখা ছিলঃ

শুরু আল্লাহর নামে। আল্লাহর কথাই সত্য আর জালিমদের কথা ব্যর্থ। শেষ যমানায় এমন একটি জাতি আগমন করবে, যা যাদের আশেপাশের লোকজন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এবং যাদের মধ্যবর্তী লোকজনের সংখ্যা কমে যাবে এবং যারা সমুদ্রে ডুব দিয়ে হলেও শত্রুকে ধাওয়া করবে। তাদের মধ্যে এমন সালাত থাকবে, যা নূহ্ (আ)-এর সম্প্রদায়ে থাকলে তারা তুফানে ধ্বংস হতো না, যদি ‘আদ সম্প্রদায়ে থাকত তাহলে তারা ঝঞাবায়ুতে ধ্বংস হতো না, যদি তা ছামূদ সম্প্রদায়ে থাকত তাহলে বিকট নাদে তারা নিঃশেষ হতো না। শুরু আল্লাহর নামে। আল্লাহর কথাই সত্য আর জালিমদের কথা ব্যর্থ।

লিপিটির পাঠ শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বিস্মিত হন। সূরা আরাফের আয়াতঃ

( ٱلَّذِینَ یَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِیَّ ٱلۡأُمِّیَّ ٱلَّذِی یَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِی ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِیلِ )

[Surah Al-A'raf 157]

এর ব্যাখ্যায় আমরা হিশাম ইবনে আস আল-উমাবীর কাহিনী উল্লেখ করেছি যে, হিরাক্লিয়াসকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করার জন্য হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাকে এক অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। হিরাক্লিয়াস আদম (আ) থেকে মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত নাম-পরিচয় ও আকার-আকৃতি সম্বলিত সব নবীর ছবি তাদেরকে বের করে দেখান। হিশাম ইবনে আস বর্ণনা করেন যে, হিরাক্লিয়াস যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ছবি বের করেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যান। তারপর বসে পড়ে গভীর দৃষ্টিতে ছবিটি দেখতে থাকেন। হিশাম ইবনে আস বলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন? তিনি বললেন, আদম আল্লাহর কাছে সকল নবীকে দেখার আবদার করেছিলেন। তখন তার কাছে আল্লাহ এই ছবিগুলো অবতারণ করেন। পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে আদম-এর ভাণ্ডারে এগুলো রক্ষিত থাকে। যুলকারনাইন সেখান থেকে ছবিগুলো বের করিয়ে আনেন এবং দানিয়াল (আ)-এর হাতে তুলে দেন।

যা হোক, ছবিগুলো দেখানোর পর হিরাক্লিয়াস বলেন, আমার মন চাইছে যে, আমি আমার রাজত্ব ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর রাজত্বে গিয়ে গোলাম হয়ে থাকি। এরপর আকর্ষণীয় উপঢৌকন দিয়ে তিনি আমাদের বিদায় দেন।

ফিরে এসে আমরা যা দেখে এসেছি, যা উপঢৌকন পেয়েছি এবং হিরাক্লিয়াস যা বলেছেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর নিকট সবকিছু বিবৃত করি। শুনে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘অভাগা! আল্লাহ্ যদি তার কল্যাণ চান, তবে সে তাই করবে।’ হিশাম ইবনে ‘আস এরপর বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের বলেছেন যে, ‘খৃস্টান ও ইহুদীগণ তাদের কিতাবে মুহাম্মদ-এর পরিচয় দেখতে পায়।’

উমাবী বর্ণনা করেন যে, ...আমর ইবনে উমাইয়া বলেন, আমি একবার নাজ্জাশীর নিকট থেকে কয়েকটি গোলাম নিয়ে আসি। আমাকে গোলামগুলো দান করেছিলেন। গোলামরা আমাকে বলল, ‘আমাদের পরিচয় করিয়ে না দিলেও রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখলে আমরা চিনে ফেলব।’ কিছুক্ষণ পর আবূ বকর (রা) এলেন। আমি বললাম, ‘ইনি?’ তারা বলল, ‘না।’ এরপর আসলেন উমর (রা)। আমি বললাম, ‘ইনি?’ তারা বলল, ‘না, ইনিও নন।’ তারপর আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) তাশরীফ নিয়ে আসলেন। দেখেই তারা আমাকে ডাক দিয়ে বলে— ‘হে আমর! ইনিই আল্লাহর রাসূল (সা)।’ আমি তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) অথচ কেউ তাদেরকে তার পরিচয় বলে দেয়নি। তাদের কিতাবে লিপিবদ্ধ লক্ষণ দেখেই তারা নবী করীম (সা)-কে চিনে ফেলে।

সাবার জীবন চরিত আলোচনায় আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, তিনি কাব্যাকারে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন ও সুসংবাদ দান করেছিলেন। এখন তার পুনরুল্লেখ নিস্প্রয়োজন। আমরা আরো উল্লেখ করেছি যে, তুব্বা ইয়ামানী যখন মদীনা অবরোধ করেছিলেন, তখন দু’জন ইহুদী পণ্ডিত তাকে বলেছিল, এই নগরী এমন এক নবীর হিজরত ভূমি, যিনি শেষ যামানায় আবির্ভূত হবেন। শুনে তুব্বা অবরোধ তুলে ফিরে যান এবং নবী করীম (সা)-কে সালাম জানিয়ে কবিতা রচনা করেন।

ইফাবা-২০০৬-২০০৭-/৯৮৮৩ (উ)-৩,২৫০

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন