hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৯৮
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত নাভের পাঁচ বছর পূর্বে কুরায়শ কর্তৃক কা‘বার পুননির্মাণ
বায়হাকীর মতে কা’বা পুননির্মাণের কাজ সম্পাদিত হয় রাসূলুল্লাহ (সা) খাদীজাকে বিবাহ করার পূর্বে। তবে প্রসিদ্ধ মতে কুরায়শ কর্তৃক কা‘বা নির্মাণের ঘটনা ঘটে রাসূল (সা) খাদীজাকে বিবাহ করার দশ বছর পরে। ইমাম বায়হাকীর বর্ণনা মতে, পবিত্র কাবা সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আমলে। ইবরাহীম (আ)-এর কাহিনীতে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছি। ইমাম বায়বাকী সহীহ বুখারীতে এ বিষয়ে বর্ণিত ইবনে আব্বাস (রা)-এর একটি হাদীসও উল্লেখ করেছেন। সাথে সাথে পবিত্র কাবা হযরত আদম (আ)-এর আমলে নির্মিত হওয়া সংক্রান্ত ইসরাঈলী বর্ণনাগুলোও উল্লেখ করেছেন। সে সব বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়। কেননা কুরআনের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ইবরাহীম (আ)-ই সর্বপ্রথম কা‘বা নির্মাণ করেন এবং তার ভিত্তি স্থাপন করেন। বলা বাহুল্য, কা‘বার অবস্থান স্থলটি পূর্ব থেকেই কেন্দ্রীয় মর্যাদার অধিকারী সকল যুগে, সব সময় সম্মানিত ছিল। যেমন আল-কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( إِنَّ أَوَّلَ بَیۡت وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِی بِبَكَّةَ مُبَارَك ا وَهُد ى لِّلۡعَـٰلَمِینَ ۝ فِیهِ ءَایَـٰتُۢ بَیِّنَـٰت مَّقَامُ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِیمَۖ وَمَن دَخَلَهُۥ كَانَ ءَامِن اۗ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَیۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَیۡهِ سَبِیل اۚ )

[Surah Aal-E-Imran 96 – 97]

“নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতো বাক্কায় (অর্থাৎ মক্কায়) তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম। আর যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য।” (আলে-ইমরানঃ ৯৬-৯৭)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু যর (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, আবু যর (রা) বলেন, আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ মসজিদ সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়?’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘আল-মাসজিদুল হারাম।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর কোনটি?’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আল- মাসজিদুল আকসা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই দু’য়ের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল কতটুকু?’ তিনি বললেনঃ ‘চল্লিশ বছর’।

এ বিষয়ে পূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি এবং একথাও উল্লেখ করেছি যে, মাসজিদুল আকসার ভিত্তি স্থাপন করেন ইসমাঈল তথা হযরত ইয়াকুব (আ)।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আছে যে, এই মক্কা নগরীকে আল্লাহ তা’আলা আসমান যমীন সৃষ্টি করার দিন থেকেই সম্মানিত করেছেন। ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিতই থাকবে।

ইমাম বায়হাকী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগেও বায়তুল্লাহ বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরাআনের ( وَإِذَا الْاَرْضُ مُدَّتْ ) (আর যখন পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হলো) এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এই বায়তুল্লাহর নিচ থেকেই পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। মানসুরও মুজাহিদ থেকে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

আমার মতে, এই বর্ণনাটি অতিশয় গরীব পর্যায়ের। সম্ভবত এটি সেই দুই থলের একটি থেকে নেয়া, যা ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা)-এর হস্তগত হয়েছিল।

এ দু’টি ইসরাঈলী বর্ণনায় ভরপুর ছিল। তাতে মুনকার ও গরীব বর্ণনাও ছিল অসংখ্য।

ইমাম বায়হাকী আরো বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আস (রা) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা জিবরাঈল (আ)-কে আদম ও হাওয়া (আ)-এর নিকট প্রেরণ করেন। জিবরাঈল (আ) তাঁদের বললেন, আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন, আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি ঘর নির্মাণ কর। এই বলে জিবরাঈল (আ) তাদেরকে ঘরের চৌহদ্দি চিহ্নিত করে দেন। আদম (আ) মাটি খনন ও হাওয়া (আ) মাটি স্থানান্তরের কাজ শুরু করে দেন। এক পর্যায়ে নিচ থেকে পানি তাদেরকে বলে, হে আদম! যথেষ্ট হয়েছে। আদম ও হাওয়া (আ) গৃহ নির্মাণ কাজ শেষ করলে আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আ)-এর প্রতি ঘরটি তাওয়াফ করতে প্রত্যাদেশ করেন এবং তাঁকে বলা হলো, তুমিই প্রথম মানুষ আর এটি প্রথম ঘর। এরপর কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর হয়রত নূহ (আ) সেই ঘরের হজ্জ করেন। এরপর আবার কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হলে পরে এক সময় হযরত ইবরাহীম (আ) গৃহটি পুননির্মাণ করেন। বায়হাকী বলেন, ইব্‌নে লাহীআ এমনি এককভাবে মারফু সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেন। আমার মতে এ রাবী যয়ীফ এটা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর-এর উক্তি হওয়ার অতিমতই অধিকতর শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য।

রাবী বর্ণনা করেন যে, আদম (আ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করেন। তখন একদল ফেরেশতা তাঁর নিকট এসে বলেন যে, ‘আপনার হজ্জ কবুল হয়েছে। হে আদম! আপনার পূর্বে আমরা দুই হাজার বছর ধরে হজ্জ করে আসছি।’

ইউনুস ইব্‌নে বুকায়র ইব্‌নে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, ইবনে ইসহাক বলেন, মদীনার নির্ভরযোগ্য একদল আলিম আমার নিকট উরওয়া ইবনে যুবায়র থেকে বর্ণনা করেন যে, উরওয়া বলেন, কোন নবীই এমন ছিলেন না যে, তিনি বায়তুল্লাহর হজ্জ করেন নি তবে হুদ ও সালিহ (আ) এর ব্যতিক্রম। পূর্বে আমরা হুদ ও সালিহ (আ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করেছেন বলে উল্লেখ করেছি। তার অর্থ পারিভাষিক হজ্জ নয়- বরং কা‘বার অবস্থানস্থল প্রদক্ষিণ, যদিও সে সময় ওখানে কোন গৃহ ছিল না।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, খালিদ ইব্‌নে ‘আর‘আরা বলেন, এক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-এর নিকট আল্লাহর বাণীঃ

( إِنَّ أَوَّلَ بَیۡت وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِی بِبَكَّةَ مُبَارَك ا وَهُد ى لِّلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah Aal-E-Imran 96]

সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যে, ‘এটি কি পৃথিবীতে নির্মিত সর্বপ্রথম ঘর?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘না, বরং এটি সর্বপ্রথম সেই গৃহ, যাতে মানবজাতির জন্য বরকত, পথের দিশা ও মাকামে ইবরাহীম রক্ষিত হয়েছে। আর এটি সর্বপ্রথম এমন ঘর, যাতে কেউ প্রবেশ করলে সে নিরাপদ। যদি তুমি বল, চাইলে আমি তোমাকে এই ঘর নির্মাণের ইতিবৃত্ত শোনাতে পারি। শোন তবেঃ

আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি পৃথিবীতে আমার উদ্দেশে একটি ঘর নির্মাণ কর। প্রত্যাদেশ পাওয়ার পর হযরত ইবরাহীম (আ)-এর হৃদয় ভয়ে সংকুচিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ্ তা’আলা সাকীনা পাঠান আর তা হলো মস্তকবিশিষ্ট একটি প্রবল বায়ু প্রবাহ। ঐ বায়ু প্রবাহটি হযরত ইবরাহীম (আ)-কে আরবে নিয়ে আসে। তারপর তা বায়তুল্লাহর স্থানে সাপের মত কুণ্ডলী পাকায়! ইবরাহীম (আ) সেই স্থানে কা’বা নির্মাণ করেন। নির্মাণ কাজের শেষ পর্যায়ে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় তিনি পুত্র ইসমাঈলকে বললেন, আমাকে একটি পাথর খুঁজে এনে দাও। পাথর খুঁজে শূন্য হাতে ফিরে এসে ইসমাঈল (আ) দেখলেন, ‘হাজরে আসওয়াদ’ যথাস্থানে স্থাপিত হয়ে আছে। পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা আপনি কোথায় পেলেন?’ জবাবে ইবরাহীম (আ) বললেন, ‘তোমার ওপর ভরসা করতে পারেন না এমন এক সত্তা অর্থাৎ জিবরাঈল আকাশ থেকে এটি এনে দিয়েছেন।’ তখন ইবরাহীম (আ) কা’বার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন।

হযরত আলী (রা) বলেন, এভাবে এক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক সময়ে কাবাগৃহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তখন আমালিকা সম্প্রদায় তা’ পুননির্মাণ করে। তারপর আবার বিধ্বস্ত হলে জুরহুমরা পুননির্মাণ করে। আবার বিধ্বস্ত হলে এবার কুরায়শ সম্প্রদায় তা নির্মাণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন পরিণত যুবক। নির্মাণ কাজে সর্বশেষ হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে স্থাপন করতে গিয়ে কুরায়শদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সর্বপ্রথম যিনি এখানে উপস্থিত হবেন, তিনি আমাদের মাঝে এই বিরোধের সমাধান দেবেন। আমরা সকলে তার সিদ্ধান্ত মেনে নেব। দেখা গেল, তারপর সর্বপ্রথম যিনি তাদের কাছে উপস্থিত হলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের মধ্যে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এভাবে প্রদান করেন যে, পাথরটিকে একটি চাদরে বসিয়ে তাদের সব ক’টি গোত্র প্রধান পাথরটিকে যথাস্থানে নিয়ে যাবে।

আবু দাউদ তায়ালিসী আলী ইবনে আবী তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী (রা) বলেন, জুরহুমের পর যখন বায়তুল্লাহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তখন কুরায়শরা তা’ পুননির্মাণ করে। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে তারা এই মর্মে একমত হয় যে, অতঃপর যিনি সর্বপ্রথম এই দরজা দিয়ে কা‘বায় প্রবেশ করবেন, তিনি হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে স্থাপন করবেন। তারপর কা‘বার বনূ শায়বা দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সা) প্রবেশ করেন। কা‘বায় প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ (সা) একটি চাদর আনার আদেশ দেন। চাদর আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সা) হাজরে আসওয়াদটি তার মধ্যখানে রাখেন এবং প্রত্যেক গোত্রপতিকে চাদরটি এক এক অংশ ধরবার আদেশ দেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদেশমত গোত্রপতিরা পাথরটি তুলে নিয়ে যায়। শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে কাপড় থেকে তুলে পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করে দেন।

ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেন যে, ইবনে শিহাব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন এক মহিলা কা‘বায় সুগন্ধির ধুনি দেয়। তখন একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কা‘বার গিলাফে গিয়ে পড়ে। এতে আগুন ধরে যায় এবং কা‘বা ঘরটি পুড়ে যায়। তখন তারা তা ভেঙে ফেলে। তারপর কুরায়শ পুড়ে যাওয়া ঘরটি মেরামত করে। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত এসে তারা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, কোন্ গোত্র তা যথাস্থানে স্থাপন করবে। অবশেষে তারা বলে যে, এসো সর্বপ্রথম যিনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন, তার ওপর মীমাংসার ভার অৰ্পণ করি। দেখা গেল, এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বপ্রথম তাদের সামনে উপস্থিত হন। গায়ে তাঁর পশমী চাদর। কুরায়শ তার ওপর মীমাংসার ভার অর্পণ করে। তিনি পাথরটিকে একটি কাপড়ে তুলে নেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রের সরদারগণ বেরিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রত্যেককে কাপড়ের এক একটি অংশ ধরিয়ে দেন। তারা পাথরটিকে বহন করে নিয়ে যায় আর রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে পাথরটি কাপড় থেকে তুলে যথাস্থানে স্থাপন করে দেন। সেই থেকে কুরায়শ তাঁকে ‘আল-আমীন’ নামে অভিহিত করতে থাকে। তখনো তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হয়নি। এরপর থেকে মক্কার লোকেরা উট জবাই করার আগে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতো। বর্ণনাটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যুহরীর সীরাত থেকে নেয়া হলেও আলোচ্য বর্ণনাটি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। যেমন বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন অথবা প্রসিদ্ধ মতে যখন এই ঘটনাটি ঘটে, তখন রাসূলুল্লাহ (সা)- এর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক ইব্‌নে ইয়াসার তা’ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। মুসা ইব্‌নে উকবা বলেন, কা’বার পুননির্মাণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওতের পনের বছর আগে। মুজাহিদ, উরওয়া, মুহাম্মদ ইব্‌নে জুবায়র ইব্‌নে মুতইম প্রমুখের অভিমতও অনুরূপ।

মূসা ইবনে উকবার ভাষ্যমতে ফিজার ও কা‘বা নির্মাণের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল পনের বছর।

আমার মতে, ফিজার ও হিলফুল ফুযুলের ঘটনা সংঘটিত হয় একই বছরে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স বিশ বছর। এই উক্তিটি মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাকের মতকে শক্তিশালী করে।

মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন, কুরায়শের কা‘বা গৃহ পুননির্মাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ হওয়ার পটভূমি এই যে, বিভিন্ন সময়ের প্লাবনের ফলে কা‘বার দেয়াল কিছুটা খসে পড়ে। তাতে কুরায়শ কা‘বার অভ্যন্তরে পানি ঢুকে পড়ার আশংকা বোধ করে। অপরদিকে মালীহ নামক এক ব্যক্তি কা‘বার সুগন্ধি চুরি করে নিয়ে যায়। তাই কুরায়শ কা‘বার ভিত্তি আরো শক্ত করার এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ রোধ করার জন্য কাবার দরজা আরো উঁচু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরজন্য তারা অর্থ ও শ্রমিক সংগ্রহ করে। এবার তারা কা‘বার গৃহ ভেঙে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং এই বলে অন্যদের সতর্ক করে দেয় যেন কেউ এতে বাধা দিতে না আসে। ওলীদ ইব্‌নে মুগীরা সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন এবং কা’বার কিয়দংশ ভেঙে ফেলেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও তার অনুসরণ করে।

এতে কুরায়শরা আনন্দিত হয় এবং এর জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে। কিন্তু একজন শ্রমিকও এক পা সামনে অগ্রসর হতে পারছে না। তারা যেন দেখছে যে, একটি সাপ কা’বা ঘর জড়িয়ে আছে। সাপটির লেজ আর মাথা একই জায়গায়। এতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা আশংকা বোধ করে যে, কা’বা ঘর ভেঙে ফেলার চেষ্টার ফলেই এমনটি হয়েছে। অথচ কা’বাই ছিল তাদের রক্ষাকবচ ও মর্যাদার হেতু। কুরায়শরা এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এবার মুগীরা ইব্‌নে আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর ইবনে মাখযুম এগিয়ে আসেন। তিনি কুরায়শদের যথোপযুক্ত উপদেশ প্রদান করেন এবং তাদের আদেশ দেন যেন তারা ঝগড়া-বিবাদ না করে এবং কা‘বা নির্মাণে বিদ্বেষ পরিহার করে। তারা যেন কা’বা নির্মাণের কাজকে চার ভাগে ভাগ করে নেয় এবং এই মহান কাজে কোন হারাম সম্পদের মিশ্রণ না ঘটায়। বর্ণনাকারী বলেন, এবার কুরায়শরা মুগীরা ইব্‌নে আব্দুল্লাহর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করার উদ্যোগ নিলে সাপটি আকাশে চলে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের ধারণায় তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছিল। মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন, অনেকের ধারণা, একটি পাখি সাপটিকে ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে আজইয়াদের দিকে নিক্ষেপ করে।

মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন পঁয়ত্রিশ বছরে উপনীত হন, তখন কুরায়শরা কাবা নির্মাণের জন্য সম্মত হয়। তাদের এ আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কা‘বার ছাদ স্থাপন করা। আরেকটি কারণ, তারা কা‘বা গৃহ ধসে যাওয়ার আশংকা করছিল। উল্লেখ্য যে, সে সময় কা‘বা ঘর উচ্চতায় একজন মানুষের উচ্চতার চেয়ে সামান্য বেশি উঁচু ছিল। তারা কা’বা গৃহকে আরো উঁচু এবং ছাদবিশিষ্ট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঘটনার পটভূমি নিম্নরূপঃ

একদল লোক কা‘বার একটি মূল্যবান সম্পদ চুরি করে। তা কা‘বার মধ্যস্থলে একটি গর্তে রক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে তা বনূ মালীহ ইব্‌নে আমর ইব্‌নে খুযা’আর দাবীক নামক জনৈক গোলামের নিকট পাওয়া যায়। ফলে কুরায়শরা তার হাত কেটে দেয়। কুরায়শদের ধারণা ছিল, ওটি যারা চুরি করেছিল তারাই তা দাবীক-এর নিকট রেখেছিল।

অপরদিকে রোম দেশীয় এক বণিকের একটি জাহাজ সমুদ্রে ভেসে ভেসে জেদ্দায় এসে পৌঁছে এবং ভেঙে যায়। কুরায়শরা তার কাঠগুলো সংগ্রহ করে তা’ দিয়ে তারা কা’বার ছাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। উমুবী বলেন, জাহাজটি ছিল রোম সম্রাট কায়সার-এর। জাহাজটি পাথর, কাঠ, লোহা ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। কায়সার বাকুম রুমীর সঙ্গে জাহাজটি সেই গির্জা অভিমুখে রওয়ানা করিয়েছিলেন, যা পারস্যবাসীরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিল। জাহাজটি জেদ্দায় ঠেকে যাওয়ার পর আল্লাহ তার উপর দিয়ে প্রবল বায়ু প্রেরণ করেন। সেই বায়ুর ঝাপটায় জাহাজটি ভেঙে যায়।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, মক্কায় একজন কিবতী ছুঁতার ছিল। কা‘বা মেরামতের অনেক সরঞ্জাম সে প্রস্তুত করে দেয়। অপর দিকে একটি সাপ কা‘বার কূপ থেকে বেরিয়ে এসে কিবতী তার প্রতিদিন যে কাজ আঞ্জাম দিত, তা লণ্ডভণ্ড করে দিত। ভয়ংকর সেই সাপটি কাবার দেয়ালে উঠে উঁকি ঝুঁকি মারত। কেউ তার নিকট অগ্রসর হলে সে মুখ হা-করে ফণা তুলে তাকিয়ে থাকত। এতে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। এমনিভাবে প্রতিদিনকার ন্যায় একদিন সাপটি কা‘বার দেয়ালে উঠে উঁকি দিলে আল্লাহ একটি পাখি প্রেরণ করেন। পাখিটি সাপটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। ফলে কুরায়শ বলে, আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ আমাদের পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাদের আছে দক্ষ কারিগর, আছে কাঠ। আর সাপের সমস্যা থেকেও আল্লাহ্ আমাদের মুক্তি দিলেন।

সুহায়লী রাযীন থেকে বর্ণনা করেন, জুরহুমের আমলে এক চোর কা‘বার গুপ্ত ভাণ্ডার চুরি করার উদ্দেশ্যে কা‘বায় প্রবেশ করে। চুরি করার জন্য লোকটি কূপে অবতরণ করলে কূপের পাড় তার ওপর ভেঙে পড়ে। সংবাদ পেয়ে কুরায়শরা তাকে বের করে আনে এবং চুরি করা সম্পদ উদ্ধার করে। এরপর থেকে সেই কূপে একটি সাপ বসবাস করতে শুরু করে। সাপটির মাথা ছিল একটা ছাগল ছানার মাথার মত। পেট সাদা আর পিঠ কালো। সাপটি এই কূপে দীর্ঘ পাঁচ শ’ বছর অবস্থান করে। এটাই ছিল সেই মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বর্ণিত সাপ।

ইবনে ইসহাক বলেন, কুরায়শ যখন কা‘বার পুরনো ভিত্তি ভেঙে নতুনভাবে ভিত্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আবু ওহাব আমর ইব্‌নে আয়িদ ইব্‌নে আবদ ইব্‌নে ইমরান ইবনে মাখযূম-ইব্‌ন হিশামের মতে আয়িদ ইব্‌ন ইমরান ইব্‌ন মাখযূম কা‘বার একটি পাথর খসিয়ে নেয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি তার হাত থেকে লাফ দিয়ে স্বস্থানে ফিরে যায়। তা’ লক্ষ্য করে সে বলে, ‘হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কা‘বা নির্মাণে তোমরা তোমাদের উপার্জিত পবিত্র সম্পদ ব্যতীত অন্য কিছু মিশিয়ো না। এতে কোন গণিকার উপার্জন এবং সুদের এবং জুলুমের অর্থ যেন না ঢুকে। অনেকের ধারণা, এই উক্তিটি ওলীদ ইব্‌ন মুগীরা ইব্‌নে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন মাখযুম-এর। কিন্তু ইব্‌নে ইসহাক উক্তিটি আবু ওহাব ইব্‌নে আমরের হওয়ার মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইব্‌নে ইসহাক বলেন, উক্ত আবু ওহাব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতার মামা। তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও প্রশংসার্হ ব্যক্তি ছিলেন।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, তারপর কুরায়শরা কা‘বাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে নেয়। দরজার অংশ নির্মাণের দায়িত্ব নেয় বনূ আবদ মানাফ ও যুহরা গোত্রদ্বয়; রুকন আসওয়াদ ও রুকন ইয়ামানীর মধ্যবর্তী স্থানের দায়িত্ব পায় বনূ মাখযুম। আর কুরায়শের আরো কয়েকটি গোত্র তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করে। কাবার পিছনের অংশ পায় বনূ জামহ ও বনূ সাহম।

অপরদিকে বনূ আব্দুদ্দার ইব্‌নে কুসাই, বনু আসাদ ইব্‌নে আবদুল উযযা ও বনূ ‘আদী ইব্‌নে কা‘ব হিজর তথা হাতীম নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়।

কিন্তু মানুষ তা’ ভাঙার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছিল এবং প্রত্যেকেই গা-বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছিল। তখন ওলীদ ইব্‌নে মুগীরা বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাদেরকে কাবাগৃহ ভাঙার কাজ শুরু করে দিচ্ছি। এই বলে তিনি গাঁইতি নিয়ে কা‘বার সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং বলতে শুরু করেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মন থেকে ভীতি দূর করে দাও। কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু তো আমাদের অভীষ্ট নয়।” তারপর তিনি দুই রুকনের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেন। সেই রাতের মত এর ফল কি দাঁড়ায় তা দেখার জন্য লোকজন অপেক্ষা করে এবং বলে, ‘আমরা অপেক্ষা করছি। ওলীদ ইব্‌ন মুগীরা যদি কোন বিপদে পতিত হন, তা হলে আমরা কা‘বার একটুও ধ্বংস করতে যাবো না এবং যা ভাঙা হয়েছে, তাও পূর্বের মত করে দেব। আর যদি তাকে কোন বিপদ স্পর্শ না করে তা হলে বুঝে নেব, আমরা কা‘বা ভাঙার যে পরিকল্পনা নিয়েছি, আল্লাহ তাতে সন্তষ্ট আছেন।’ পরদিন সকালে ওলীদ আবার কা‘বা গৃহ ভাঙার কাজ শুরু করেন। তার সঙ্গে অন্যরাও ভাঙতে শুরু করে। অবশেষে ভাঙার কাজ যখন ইররাহীম (আ)-এর ভিত্তি পর্যন্ত পৌঁছে, তখন তারা একটি সবুজ পাথর দেখতে পায়। পাথরটি দন্তসারির ন্যায়; যেন একটি অপরটিকে জড়িয়ে আছে। ইয়ায়ীদ ইব্‌ন রুমান থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর এক হাদীসে كأسنمة الابل বলা হয়েছে। অর্থাৎ পাথরটি দেখতে উটের কুঁব্জের মত। সুহায়লী বলেন, আমার ধারণা সীরাতের বর্ণনায় শব্দটি كالسنه রূপে (জিহবার ন্যায়) ব্যবহার রাবীর ভ্রম মাত্র।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, কা‘বাগৃহ ভাঙার কাজে অংশগ্রহণকারীদের একজন কা’বার দুইটি পাথরের মাঝে শাবল ঢুকিয়ে চাপ দেয়। তাতে একটি পাথর নড়ে উঠলে সাথে সাথে সমগ্র মক্কানগরী কেঁপে ওঠে। ফলে তারা ঐ অংশ ভাঙা থেকে বিরত থাকে।

মূসা ইব্‌নে উকবা বলেনঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আব্বাস (রা)-এর ধারণা, কুরায়শ-এর কতিপয় প্রবীণ ব্যক্তি বলতেন যে, কুরায়শরা যখন কাবার কিছু পাথর ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর ভিত্তির নিকট সরিয়ে নিতে সমবেত হয়, তখন তাদের একজন প্রথম ভিত্তির একটি পাথর সরাতে উদ্যত হয়। অবশ্য তার কথা জানা ছিল না যে, এটি প্রথম ভিত্তির পাথর। সরানোর উদ্দেশ্যে লোকটি পাথরটি তুলে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা পাথরের নিচে বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পায়, যেন তা লোকটির চোখ ঝলসে দেয়ার উপক্রম হয় এবং পাথরটি তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে যথাস্থানে বসে যায়। তা’ দেখে লোকটি নিজে এবং নির্মাণ শ্রমিকরা ভীত হয়ে পড়ে। পাথরটি যখন তার নিচের বিদ্যুৎ ঝলকানি ঢেকে ফেলে, তখন শ্রমিকরা পুনরায় নির্মাণ কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং বলাবলি করে— কেউ এই পাথর এবং এই স্তরের অন্য কিছু সরাবার চেষ্টা করো না।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, আমার নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরায়শরা রুকন-এ সুরিয়ানী ভাষায় লিখিত একটি লিপি পেয়েছিল। কিন্তু তারা তার মর্ম উদ্ধার করতে পারেনি। পরে জনৈক ইহুদী তাদেরকে লিপিটি পাঠ করে শোনায়। তাতে লেখা ছিলঃ

أنا الله و بكة خلفتها يوم خلقت السموات والأرض وصورت الشمس والقمر وحفتها بسبعة أملاك حنفاء لأتزول حتى يزول أخشا بها مبارك لأهلها في الماء واللبن

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। এই মক্কাকে আমি সেদিন সৃষ্টি করেছি, যেদিন আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে আকৃতি দান করি। এবং তাকে আমি সাতটি রাজ্য দ্বারা আচ্ছাদিত করি। এর পাহাড় দু’টি স্থানান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত এর কোন নড়চড় হবে না। এর অধিবাসীদের জন্য এটি পানি ও দুধসমৃদ্ধ, বরকতময়।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, আমার নিকট বর্ণিত হয়েছে যে, কুরায়শরা মাকামে ইবরাহীমে একটি লিপি পায়। তাতে লেখা ছিল। এটি আল্লাহর পবিত্র মক্কা। এর তিন পথে এখানকার অধীবাসীদের জীবিকা আসে। এর অধিবাসীদের কেউ এর মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারবে না।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, লাইছ ইব্‌নে আবী সুলায়ম-এর ধারণা মতে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের চল্লিশ বছর আগে কুরায়শরা কা‘বায় একটি লিপি পায়। তাতে লেখা ছিলঃ

من يزرع خيرا يحصد غبطة ومن يزرع شرايحصد ندامة يعملون السيئات ويجزون الحسنات أجل كما يجتنى من الشوك العنب

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কল্যাণের বীজ বপন করবে, সে ঈর্ষণীয় ফসল তুলবে আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের বীজ বপন করবে, সে অনুতাপের ফসল তুলবে। মানুষ কাজ করে অসৎ আর প্রতিদান চায় সৎকাজের? এটা যেমন কাটাময় বৃক্ষ থেকে আঙ্গুর ফল লাভ করা আর কি?

সাঈদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-উমাবী বলেন, যুহরী সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেনঃ মাকামে ইবরাহীমে তিনটি লিপি পাওয়া যায়। এক পাতায় লেখা ছিল।

اني انا الله ذوبكة صنعتها يوم صنعت الشمس والقمر

وحففتها بسبعة أملاك حنفاء وباركت لأهلها في اللحم واللبن

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করার দিনই আমি তৈরি করেছি এবং সাতটি রাজ্য দ্বারা তাকে আবৃত করেছি ও তার অধিবাসীদের জন্য গোশতে ও দুধে বরকত দান করেছি।

দ্বিতীয় লিপিতে ছিলঃ

اني انا الله ذوبكة خلقت الرحم وشققت لها من إسمي فمن وصلها وصلته ومن قطعها بسته

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। আমি রাহিম (আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার নামকরণ করেছি। অতএব, যে লোক তা বজায় রাখবে আমি তাকে কাছে টেনে আনবো। আর যে তা ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্নভিন্ন করব।

তৃতীয় লিপিতে ছিলঃ

اني انا الله ذو بكة خلقت الخير والشر وقدرته فطوبى لمن أجريت الخير على يديه وويل لمن أجريت الشر على يديه

অর্থাৎ, আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ! আমি কল্যাণ অকল্যাণ ও তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছি। সুতরাং সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য, যার দুই হাতে আমি কল্যাণ চালু করেছি আর ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য, যার দুই হাতে আমি চালু করেছি অকল্যাণ।

ইবন ইসহাক বলেন, তারপর কুরায়শ গোত্রগুলো কাবা নির্মাণের জন্য পাথর সংগ্রহ করে। প্রত্যেক গোত্র স্বতন্ত্রভাবে পাথর সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। তারপর তারা কা‘বা নির্মাণ করে। নির্মাণ কাজ রুকন (হাজরে আসওয়াদ)-এর স্থান পর্যন্ত পৌঁছলে তারা বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক গোত্রই চাইছিল যেন তারাই তাকে স্বস্থানে পুনঃস্থাপন করে, অন্য কেউ নয়। তাদের এই বিবাদ চরম আকার ধারণ করে। তারা পরস্পর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। বনু আবদুদ্দার রক্ত ভর্তি একটি পাত্র উপস্থিত করে। তারপর তারা এবং বনু আদী ইব্‌ন কা‘ব ইব্‌ন লুআই মৃত্যুর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং পাত্রের রক্তে হাত ঢুকায়। তাকে তারা ‘লাকা‘তুদ্দাম’ তথা রক্ত চুক্তি নামে আখ্যা দেয়। কুরায়শরা এই অবস্থায় চার কি পাঁচ দিন অতিবাহিত করে। তারপর তারা মসজিদে সমবেত হয়ে পরামর্শ করে। কোন কোন বর্ণনাকারীর ধারণা, সে সময়ের কুরায়শদের প্রবীণতম ব্যক্তি আবূ উমাইয়া ইব্‌ন মুগীরা (ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন মাখযূম) বললেন, ‘হে কুরায়শ সম্প্রদায়! তোমাদের বিবাদের মীমাংসা তোমরা এভাবে কর যে, মসজিদের এই দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তার হাতে তোমরা এর মীমাংসার ভার অর্পণ করবে। সে তোমাদের মাঝে এই বিবাদের মীমাংসা করবে।’ এ প্রস্তাবে তারা সম্মত হয়। দেখা গেল, যিনি সর্ব প্রথম মসজিদে প্রবেশ করলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখে তারা বলে উঠল, এই যে আমাদের ‘আল-আমীন’ মুহাম্মদ এসেছেন, তাঁর সিদ্ধান্তে আমরা রাজী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকটে গেলে তারা বিষয়টি তাঁকে জানায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ “আমাকে একটি কাপড় এনে দাও।” কাপড় দেওয়া হলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) রুকন অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ নিজ হাতে তুলে সেই কাপড়ের ওপর রাখলেন। তারপর বললেনঃ “প্রত্যেক গোত্র কাপড়ের এক একটি কোন ধর। তারপর সকলে মিলে তা তুলে নিয়ে যাও। তারা তা-ই করল। তা’ নিয়ে তারা যথাস্থানে পৌঁছলে তিনি নিজ হাতে তা স্থাপন করে দেন। উল্লেখ্য যে, কুরায়শরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ইতিপূর্বেই ‘আল-আমীন’ নামে ডাকতো।

ইমাম আহমদ বলেন, সাইব ইবন আবদুল্লাহ্ বর্ণনা করেন যে, তিনি জাহেলী যুগে কাবা নির্মাতাদের একজন ছিলেন। তিনি বলেন, আমার একটি পাথর ছিল। আল্লাহর স্থলে আমি তার ইবাদত করতাম। আমি গাঢ় দুধ নিয়ে আসতাম, যা ছিল আমার অতি প্রিয়। সেই দুধ উক্ত পাথরের গায়ে ছিটিয়ে দিতাম আর একটি কুকুর এসে তা চেটে খেত এবং এক পা উঠিয়ে তাতে পেশাব করে দিত। কা‘বা নির্মাণের এক পর্যায়ে আমরা হাজরে আসওয়াদের স্থানে উপনীত হলাম। কিন্তু কেউ পাথরটি দেখতে পেলো না। হঠাৎ দেখা গেল, পাথরটি আমার পাথরগুলোর মধ্যখানে, দেখতে ঠিক মানুষের মাথার ন্যায়, যেন তা থেকে মানুষের মুখমণ্ডল আত্মপ্রকাশ করবে। দেখে কুরায়শের একটি গোত্র বলল, ‘এটা আমরা স্থাপন করব; আরেক গোত্র বলল, না আমরা স্থাপন করব।’ লোকেরা বলল, ‘এর সমাধানের জন্য তোমরা একজন সালিস নিযুক্ত কর।’ অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, বাহির থেকে সর্বপ্রথম যিনি এখানে আসবেন, তিনিই এ সমস্যার সমাধান করবেন। আসলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)। তাঁকে দেখে লোকেরা বলে উঠল, ‘তোমাদের মাঝে আল-আমীন এসে গেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তারা বিষয়টি অবহিত করল। তিনি পাথরটি একটি কাপড়ে রাখলেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রকে ডাকলেন। তারা কাপড়ের এক একটি প্রান্ত ধরে পাথরটি তুলে যথাস্থানে নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে তা যথাস্থানে স্থাপন করেন।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে কা‘বা আঠার হাত লম্বা ছিল। প্রথমে কা‘বাকে মিসরীয় কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখা হতো। তারপর ‘বারূর’ বস্ত্র দ্বারা ঢাকা হয়। সর্বপ্রথম যিনি কা‘বায় রেশমী কাপড়ের গিলাফ পরান, তিনি হলেন হাজ্জাজ ইব্‌ন ইউসুফ।

আমার মতে, কুরায়শরা কা‘বা থেকে হিজরকে বের করে ফেলে। পরিমাপে তা উত্তর দিক থেকে ছয় কি সাত হাত। এর কারণ অর্থের অভাব। কা‘বাকে হুবহু ইবরাহীমী ভিত্তির ওপর নির্মাণ করার সামর্থ্য কুরায়শদের ছিল না। তারা পূর্ব দিকে কা‘বার একটি মাত্র দরজা রাখে। আর তা স্থাপন করে উঁচু করে। যাতে ইচ্ছা করলেই যে কেউ তাতে প্রবেশ করতে না পারে, যেন প্রবেশাধিকার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে বলেছিলেনঃ

ألم ترى أن قومك قصرت بهم النفقة ولولا حدثان قومك بكفر لنقضت الكعبة وجعلت لها بابا شرقيا وبابا غربيا ودخلت فيها الحجر

অর্থাৎ, তুমি কি জানো না যে, তোমার সম্প্রদায় অর্থ সংকটে ছিল? তোমার সম্প্রদায় নওমুসলিম না হলে আমি কা‘বাকে ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতাম। তখন পূর্বমুখী একটি দরজা আর পশ্চিম মুখী একটি দরজা রাখতাম। আর হিজর তথা হাতীমকে কা‘বার অন্তর্ভুক্ত করে নিতাম!

এ কারণে আবদুল্লাহ্ ইবন যুবায়র ক্ষমতাসীন হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশনা মোতাবেক কাবাকে পুনঃনির্মাণ করেন। তাতে কা’বা পরিপূর্ণরূপে ইবরাহীম (আ)-এর ভিত্তিতে ফিরে আসে এবং যারপরনাই আকর্ষণীয় গৃহে পরিণত হয়। তিনি মাটি সংলগ্ন করে দু’টি দরজা তৈয়ার করেন। একটি পূর্বমুখী আর অপরটি পশ্চিমমুখী। একটি দিয়ে মানুষ প্রবেশ করতো, অপরটি দিয়ে বের হতো। তারপর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ ইবন যুবায়রকে হত্যা করে খলীফা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের নিকট পত্র লেখেন। তাতে তিনি ইবন যুবায়র কর্তৃক কাবা পুনঃনির্মাণের কথা উল্লেখ করেন। তখন তাদের বিশ্বাস ছিল, ইবন যুবায়র কাজটি নিজের মর্জিমত করেছিলেন। তাই খলীফা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান কা’বাকে পূর্বের মত করে নির্মাণ করার আদেশ দেন। তখন উত্তর দিকের দেয়াল ভেঙে হিজরকে বের করে ফেলা হয়। এবং তার পাথরগুলোকে কা’বার মাটিতে সযত্নে পুঁতে রাখা হয়। দরজা দু’টো উঁচু করা হয় এবং পশ্চিম দিককে বন্ধ করে দিয়ে পূর্ব দিককে আগের মত রাখা হয়। পরবর্তীতে খলীফা মনসুর কাবাকে ইবন যুবায়রের ভিতের ওপর ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ইমাম মালিকের মতামত চাইলে তিনি বলেন, রাজা-বাদশারা কা’বাকে তামাশার পাত্রে পরিণত করুক আমি তা পছন্দ করি না। ফলে খলীফা মনসুর কাবাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দেন। এখনও তা সেই রূপেই বিদ্যমান।

কাবার আশপাশ থেকে সর্বপ্রথম ঘরবাড়ি সরিয়ে দেন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)। মালিকদের নিকট থেকে ক্রয় করে তিনি সেগুলো ভেঙে ফেলেন। পরে হযরত উসমান (রা) আরো কয়েকটি বাড়ি ক্রয় করে সেগুলোও ভেঙে ফেলেন। তারপর ইবন যুবায়র (রা) তার শাসনামলে কা’বার ভিতকে আরও মজবুত করেন। দেয়ালগুলোর সৌন্দর্য এবং দরজার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তবে তিনি আর কিছু করতে পারেননি। তারপর আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান খলীফা হয়ে কাবার দেয়াল আরো উঁচু করেন এবং হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের মাধ্যমে কাবাকে রেশমী কাপড়ের গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন। সূরা বাকারার আয়াতঃ

( وَإِذۡ یَرۡفَعُ إِبۡرَ  ٰ⁠ هِـۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَیۡتِ وَإِسۡمَـٰعِیلُ )

[Surah Al-Baqarah 127]

এর তাফসীরে আমরা কাবা নির্মাণের কাহিনী এবং এতদসংক্রান্ত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছি। প্রয়োজনে সেখানে দেখে নেয়া যেতে পারে।

ইবন ইসহাক বলেন, যখন তারা কাবার নির্মাণ কাজ তাদের ইচ্ছানুযায়ী শেষ করে তখন যুবায়র ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে সেই সাপটির কাহিনী শোনান, যার ভয়ে কুরায়শরা কা’বা নির্মাণের কাজ করতে পারছিল না। ঘটনাটি তিনি কাব্যাকারে বিবৃত করেন,

عجبت لما تصوبت العقاب إلى الشعبان وهي لها اضطراب

وقد كانت تكون لها کشیس وأحيانا يكون لها وثاب

إذا قمنا إلى التاسيس شدت تهيبنا البناء وقد نهاب

فلما أن خشينا الزجر جاءت عقاب تتلئب لها انصباب

فضمتها اليها تم خلت لنا البنيان ليس لها حجاب

فقمنا حاسدبن الى بناء لنا منه القواعد والتراب

غداة يرفع التاسيس منه وليس على مساوينا ثياب

اعزبه المليك بني لوی فليس لأصله منهم ذهاب

وقد حسدت هنالك بنوعدی ومرة قد تقدمها كلاب

فبوأنا المليك بذاك عزا وعند الله يلتمس الثواب

অর্থাৎ, যে সাপটি কুরায়শের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, একটি ঈগল পাখি কিরূপ নির্ভুলভাবে তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। সাপটি কখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে কখনো ফণা তুলে ছোবল মারার ভঙ্গিতে থাকত। যখনই আমরা কা’বা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি, তখনই সে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং তার স্বভাবসুলভ ভীতিপ্রদ ভঙ্গিতে ভয় দেখিয়েছে। আমরা যখন এই আপদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, তখন ঈগলটি এসে আমাদেরকে রক্ষা করল এবং সংস্কারের কাজে আমাদের আর কোন বাধা থাকল না।

পরদিন আমরা সকলে বিবস্ত্র অবস্থায় সংস্কার কাজে লেগে গেলাম। মহান আল্লাহ এ কাজটি করার সুযোগ দিয়ে বনু লুওয়াইকে অর্থাৎ আমাদেরকে গৌরবান্বিত করলেন। তবে তাদের পরে বনু আদী এবং বনু মুররাও এ কাজে এসে জড়ো হয়েছে। বনু কিলাব ছিল এ কাজে তাদের চেয়েও অগ্রণী। আল্লাহ আমাদেরকে কাবার নিকট বসবাসের সুযোগ দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আশা করা যায়, এ কাজের প্রতিদান আল্লাহর নিকট পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য যে, এর আগে একটি অধ্যায়ে আমরা বলে এসেছি, আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জাহেলিয়াতের পঙ্কিলতা থেকে সর্বতোভাবে নিরাপদ রেখেছিলেন। যেমন কা’বা নির্মাণের সময় তিনি এবং তার চাচা আব্বাস (রা) পাথর স্থানান্তরের কাজ করতেন। এক পর্যায়ে তিনি পরিধানের কাপড় খুলে তা’ কাঁধের ওপর রেখে পাথর বহন করে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাকে কাপড় খুলতে বারণ করে দেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তিনি কাপড় পরে নেন।

অধ্যায়

ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শদেরকে হুমুস নামে অভিহিত করা হতো। এর ধাতুগত অর্থ দীনের ব্যাপারে চরম কঠোরতা। তাদেরকে এই নামে নামকরণের কারণ হলো, তারা হারম শরীফকে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতো। যে কারণে তারা আরাফার রাতে এখান থেকে বের হতো না। তারা বলত, আমরা হলাম হারমের সন্তান এবং এর অধিবাসী। ফলে তারা এ কথা আরাফায় অবস্থান বর্জন করত। এটা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর অন্যতম স্মৃতি একথা জানা থাকা সত্ত্বেও তারা তা বর্জন করত। মনগড়া কুসংস্কার থেকে তারা একটুও নড়চড় করতো না। ইহরাম অবস্থায় তারা দুধ থেকে ছানা ঘি চর্বি কিছুই সংগ্রহ করত না। তারা পশমের তৈরি তাঁবুতে প্রবেশ করত না এবং ছায়ায় বসার প্রয়োজন হলে চামড়ার ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘরের ছায়ায় বসত না। হজ্জ ও উমরা পালনকারীদেরকে তারা তাদের সরবরাহকৃত পোশাক ব্যতীত অন্য পোশাকে তাওয়াফ করতে এবং তাদের দেয়া খাবার ব্যতীত অন্য খাবার খেতে বারণ করত। হজ্জ, উমরাহ পালনকারীদের কেউ যদি কুরায়শ, তাদের বংশধর কিংবা তাদের দলভুক্ত কিনানা ও খুযাআ কারোর নিকট থেকে কাপড় না পেত, তবে তাকে বিবস্ত্র তাওয়াফ করতে হতো। মহিলাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতো। এ কারণে এমন পরিস্থিতিতে মহিলারা যথাস্থানে হাত রেখে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করত আর বলতঃ

اليوم يبد وبغضه أوكله - وبعد هذا اليوم لا أحله

অর্থাৎ, আজ আমার লজ্জাস্থানের অংশবিশেষ বা পুরোটা বিবস্ত্র হয়েছে ঠিক কিন্তু আজকের পর আর এমনটি হতে দেব না।’

যদি কেউ কোন হুমসীর কাপড় পাওয়া সত্ত্বেও সে নিজের কাপড় পরে তাওয়াফ করত তবে তাওয়াফ শেষে তাকে সেই কাপড় খুলে ফেলে দিতে হতো। পরে সেই কাপড় আর সে ব্যবহার করতে পারত না। তার বা অন্য কারো জন্য সেই কাপড় স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না। আরব সেই কাপড়ের নাম দিয়েছিল ‘আল-লাকি’। ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শ এমনি কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। এই অবস্থায় আল্লাহ মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণ করেন এবং মুশরিকদের মনগড়া কুসংস্কার প্রতিরোধে তাঁর ওপর কুরআন নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ثُمَّ أَفِیضُوا۟ مِنۡ حَیۡثُ أَفَاضَ ٱلنَّاسُ وَٱسۡتَغۡفِرُوا۟ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُور رَّحِیم ࣱ)

[Surah Al-Baqarah 199]

“তারপর অন্যরা যেখান থেকে প্রত্যবর্তন করে, তোমরাও সেখোন থেকে প্রত্যাবর্তন করবে আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” (২ বাকারাঃ ১৯৯-২০০)

অর্থাৎ আরবের সর্বসাধারণ যেভাবে আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করে, তেমনি তোমরাও আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন কর।

আমরা আগেও উল্লেখ করে এসেছি যে, ওহী নাযিলের পূর্ব থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ প্রদত্ত তাওফীক অনুযায়ী আরাফায় অবস্থান করতেন।

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কুরায়শরা লোকদের ওপর যে পোশাক ও যে খাবার হারাম করে নিয়েছিল, তা বাতিল ঘোষণা করে বলেনঃ

( یَـٰبَنِیۤ ءَادَمَ خُذُوا۟ زِینَتَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِد وَكُلُوا۟ وَٱشۡرَبُوا۟ وَلَا تُسۡرِفُوۤا۟ۚ إِنَّهُۥ لَا یُحِبُّ ٱلۡمُسۡرِفِینَ ۝ قُلۡ مَنۡ حَرَّمَ زِینَةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِیۤ أَخۡرَجَ لِعِبَادِهِۦ وَٱلطَّیِّبَـٰتِ مِنَ ٱلرِّزۡقِۚ )

[Surah Al-A'raf 31 - 32]

অর্থাৎ, হে বনী আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে, আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করলো? (আ’রাফঃ ৩১-৩২)

যিয়াদ আল বুকায়ী ইবন ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, কুরায়শের এসব কুসংস্কার আবিষ্কারের ঘটনা হাতীর ঘটনার আগে ঘটেছিল, নাকি পরে তা আমার জানা নেই।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন