মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
তাবারানী বর্ণনা করেন যে, ইয়াসির ইবন সুওয়ায়দ (রা) বরাতে বলেছেন যে, জুহানী বলেন, আমি জাহেলী যুগে আমার সম্প্রদায়ের এক দল লোকের সঙ্গে হজ্জ করতে যাই। মক্কায় অবস্থানকালে একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, এক খণ্ড আলো কা’বা থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে ইয়াসরিবের পর্বত পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছে। আমি শুনতে পেলাম যে, সেই আলোক খণ্ডের মধ্য থেকে কে যেন বলছে, অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে, আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে আর শেষ নবী প্রেরিত হয়েছেন। এরপর আলোক খণ্ডটি আরো উজ্জ্বল হয়ে যায়। আমি হীরার রাজপ্রাসাদ ও মাদায়েনের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। আলোর মধ্য থেকে পুনরায় একটি শব্দ শুনতে পেলাম যে, কে যেন বলছে, ইসলাম প্রকাশ লাভ করেছে, প্রতিমাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট হয়েছে। এসব দেখে আমি ভীত-অবস্থায় জেগে গেলাম। জেগে উঠে আমার সম্প্রদায়ের লোকদের বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! কুরায়শের মধ্যে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।’ আমি তাদেরকে আমার স্বপ্নের কথা বললাম। হজ্জ সম্পাদন করে যখন আমরা দেশে ফিরে এলাম, তখন আহমদ নামে এক ব্যক্তি আমার নিকট আসেন। আমি তাকে আমার স্বপ্নের কথা বলি। তিনি বললেন, ‘হে আমর ইবনে মুররা! আমিই সকল মানুষের প্রতি প্রেরিত নবী। আমি লোকদের ইসলামের প্রতি আহ্বান করি এবং তাদেরকে রক্তারক্তি বন্ধ করার, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, আল্লাহর ইবাদত করার, প্রতিমাসমূহ বর্জন করার, বায়তুল্লাহর হজ্জ করার এবং বার মাসের একমাস রমযানের রোযা রাখার আদেশ করি; যে ব্যক্তি আমার এ আহ্বানে সাড়া দেবে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আর যে তা অমান্য করবে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নাম। সুতরাং হে আমর! তুমি ঈমান আন; আল্লাহ তোমাকে জাহান্নামের বিভীষিকা থেকে রক্ষা করবেন।’
জবাবে আমি বললামঃ
أشهد أن لا إله إلا الله وأنك رسول الله أمنت بما جئت من حلال وحرام وإن رغم ذالك كثيرا من الأقوام
অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, আর আপনি আল্লাহর রাসূল। আপনি যে হালাল ও হারাম আনয়ন করেছেন, আমি তার প্রতি ঈমান আনলাম। যদিও এ ঘোষণা বহু লোককে ক্ষেপিয়ে তুলবে।
তারপর আমি কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে প্রথম যখন শুনতে পেয়েছিলাম তখনও আমি সেই পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেছিলাম। আর আমাদের একটি প্রতিমা ছিল। আমার আব্বা তার দেখাশুনা করতেন। আমি উঠে গিয়ে সেটি ভেঙে ফেলি। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যাই। নবী করীম (সা)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে আমি এই পংক্তিগুলো আবৃত্তি করি।
شهدت بأن الله حق وإنني - لالهة الاحجار اول تارك
وشمرت عن ساق الازار مهاجرا - اليك اجوب الفقر بعد الدكادك
لأصحب خير الناس نفسا ووالدا- رسول مليك الناس فوق الحبائك
অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহই সত্য এবং পাথরের দেবতাদেরকে আমিই প্রথম বর্জনকারী। আমি কাপড় গুটিয়ে শক্ত পাথুরে প্রান্তর অতিক্রম করে আপনার নিকট হিজরত করে এসেছি। আমার উদ্দেশ্য হলো— বংশ মর্যাদা এবং সভায় যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁর সাহচর্য লাভ করা। তিনি মানুষ এবং আসমানী রাস্তাসমূহের শাহানশাহ আল্লাহর রাসূল।
শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘মারহাবা! হে আমর ইবনে মুররা!’ তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আপনি আমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করুন। হয়ত আমার দ্বারা আল্লাহ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন, যেমন আপনার উসিলায় তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে আমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করলেন এবং বলে দিলেনঃ
عليك بالرفق والقول الشديد ولا تكن فظا ولا متكبرا ولا حسودا
“কোমলতা ও সত্য কথা অবলম্বন করবে। কঠোর অহংকারী ও হিংসুক হবে না।”
আমর ইবনে মুররা জানান যে, তিনি তার সম্প্রদায়ের নিকট আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে যে বিষয়ের প্রতি আহ্বান করেছিলেন, তিনিও নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের সে বিষয়ের প্রতি আহবান জানান। তাঁর আহবানে একজন ব্যতীত তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তারপর আমর ইবনে মুররা তাদের একদল লোক সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সাদর সম্ভাষণ জানান এবং তাদেরকে একটি লিপি লিখে দেন। তাতে লেখা ছিল,
بسم الله الرحمن الرحيم – هذا كتاب من الله على لسان رسول الله – بكتاب صادق وحق ناطق مع عمرابن مرة الجهني لجهينة بن زيد أن لكم بطون الأرض وسهولها وتلاع الأودية وظهورها – تزرعون نباته وتشربون صافيه على أن تقروا بالخمس وتصلوا صلاة الخمس وفي التبيعة والصريمة إن اجتمعتا وإن تقرقنا شاة شاة ليس على اهل الميرة صدقة ليس الوردة اللبقة .
অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূলের যবানে আমর ইবনে মুররা জুহানীর হাতে জুহায়না ইবনে যায়দ-এর প্রতি লিখিত পত্র। এ পত্রের মর্ম সম্পূর্ণ সত্য ও সঠিক। তোমরা মাটির গর্ত ও উপরিভাগ এবং তোমাদের উপত্যকার উঁচু ও সমতল ভূমি ব্যবহারের অধিকারী। তাতে তোমরা ফসল উৎপন্ন কর ও তার পরিচ্ছন্ন পানি পান কর। তোমাদের দায়িত্ব শুধু, তোমরা পাঁচটি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে এবং পশু ও সম্পদের যাকাত এক বছরের ছাগলের বাচ্চা বা মুখ বাঁধা বাচ্চা একত্রিত হোক বা বিচ্ছিন্ন থাক-একটি করে বকরী যাকাত দিতে হবে। যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ নেই তার সদকা দিতে হবে না। যাকাত আদায়ে উত্তম মাল নেয়া যাবে না।’
বর্ণনাকারী বলেন, কায়স ইবনে শাম্মাস লিখিত এ পত্রে উপস্থিত সকল মুসলমান আমাদের নবী করীম (সা)-এর পক্ষে সাক্ষী থাকেন।
অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা, মারয়াম-তনয় ঈসার নিকট হতে। তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলেন দৃঢ় অঙ্গীকার। (৩৩ আহযাবঃ ৭)।
প্রথম যুগের অনেক আলিম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা যেদিন ( الست بربكم ) (অমি কি তোমাদের রব নই?) বলে বনী আদমের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, সেদিন তিনি নবীদের নিকট থেকে এক বিশেষ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষভাবে শরীয়তধারী সেই মহান পাঁচ নবীর নিকট থেকে, যাদের প্রথমজন হলেন হযরত নূহ (আ) আর সর্বশেষ জন হলেন হযরত মুহাম্মদ (সা)।
হাফিজ আবু নুআয়ম ‘দালায়িলুন নুবুওয়াত’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনার জন্য নবুওত সাব্যস্ত হয় কখন?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আদম-এর সৃষ্টি ও তার মধ্যে রূহ সঞ্চারের মধ্যবর্তী সময়ে।’ তিরমিযী অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেন, এটি একটি একক বর্ণনা।
আবু নু’আয়ম আরো বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর (রা) একদিন বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নবী হয়েছেন কবে?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘আদম যখন তাঁর সৃষ্টির উপাদান কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন।’
অপর এক সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, প্রশ্ন করা হলো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনি কবে নবী হয়েছেন?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘আদমের অবস্থান তখন রূহ ও দেহের মাঝে।’
আদম (আ)-এর কাহিনীতে বর্ণিত এক হাদীসে আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, আল্লাহ তা’আলা যখন আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাঁর সন্তানদের বের করেন, তখনই তিনি মর্যাদা অনুপাতে নবীগণকে নূরের বৈশিষ্ট্য দান করেন। আর মুহাম্মদ (সা)-এর নূর যে তাঁদের সকলের নূরের তুলনায় অধিক উজ্জ্বল ও মহান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নবী করীম (সা)-এর সুউচ্চ মর্যাদা ও মহত্তের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
এই মর্মে ইমাম আহমদ (র) বলেন, ইরবায ইবনে সারিয়া (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
إني عند الله لخاتم النبین و إن آدم لمنجدل فی طینته وسانبئكم باول ذالك دعوة إبراهيم وبشارة عيسی بی ورؤيا أمي التي رأت وكذالك أمهات المؤمنين يرين
অর্থাৎ, আদম যখন তাঁর সৃষ্টির উপাদান কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন, আমি তখনই আল্লাহর নিকট শেষ নবী। আমি তোমাদেরকে তার সূচনার কথা জানাব। তাহলো, আমার পিতা ইবরাহীম (আ)-এর দোয়া, আমার সম্পর্কে ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ এবং আমার মায়ের স্বপ্ন। এরূপ স্বপ্ন নবীগণের মাগণই দেখে থাকেন।
লাইছ ও ইবনে ওহব আবদুর রহমান ইবনে মাহদী থেকে এবং আবদুল্লাহ সালিহ মুআবিয়া ইবনে সালিহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনায় অতিরিক্ত রয়েছে যে, নবী করীম (সা)-কে প্রসব করার সময় তাঁর মা এমন একটি আলো দেখতে পেয়েছিলেন, যার আলোকে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গিয়েছিল।
ইমাম আহমদ.... মায়সারা আল-ফাজরের বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, মায়সারা বলেছেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নবী হয়েছেন কবে?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ “আদম তখন আত্মা ও দেহের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলেন।”
হাফিজ আবু নুআয়ম তাঁর ‘দালায়িলুন নুবুওয়াত’ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর কালামঃ
অর্থাৎ, সৃষ্টিতে আমি নবীগণের প্রথম আর আবির্ভাবে সকলের শেষ।
বলা বাহুল্য যে, আসমান-যমীন সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই আল্লাহ পাক জানতেন যে, মুহাম্মদ (সা) সর্বশেষ নবী। এমতাবস্থায় এই যে বলা হচ্ছে, আদম যখন রূহ ও দেহের মাঝে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি নবী ছিলেন, এটা ঊর্ধ্ব জগতের ঘোষণা মাত্র। অর্থাৎ ঊর্ধ্ব জগতের ঘোষণাটা হয়েছিল এভাবে। আল্লাহ তা’আলা তো বিষয়টি পূর্ব থেকেই জানতেন।
আবু নুআয়ম আবু হুরায়রা (রা) থেকে একটি মুত্তাফাক আলাইহি (বুখারী-মুসলিম সম্বলিত) হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
نحن الأخرون السابقون يوم القيامة المقضى لهم قبل الأخلاق بيد أنهم أوتوا الكتاب من قبلنا وأوتيناه من بعدهم
অর্থাৎ, আমরা সর্বশেষ জাতি। কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হব সকলের আগে। আমার উম্মতের বিচারকার্য সম্পাদন হবে অন্য সব উম্মতের পূর্বে। পার্থক্য শুধু এটুকু যে, অন্যান্য উম্মতকে কিতাব দেয়া হয়েছে আমাদের আগে আর আমরা পেয়েছি তাদের পরে।
হাদীসটি বর্ণনা করার পর আবু নুআয়ম এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবে সব নবীর শেষ এবং তাঁরই দ্বারা নবুওত সমাপ্ত করা হয়েছে। তবে কিয়ামতের দিন তিনি সকলের আগে উপস্থিত হবেন। কারণ নবুওত ও অঙ্গীকারের তালিকায় তার নাম সকলের শীর্ষে।
আবু নুআয়ম আরও বলেন যে, এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মর্যাদার কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আদম সৃষ্টিরও আগে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্য নবুওত সাব্যস্ত করেছেন। সম্ভবত এটাই ফেরেশতাগণের নিকট আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনিই হবেন শেষ নবী।
হাকিম তার মুস্তাদরাক গ্রন্থে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
“আদম যখন ভুল করে বসেন তখন তিনি বলেছিলেন, হে আমার রব! আপনার নিকট আমি মুহাম্মদের উসিলায় প্রার্থনা করছি, আপনি আমায় ক্ষমা করে দিন। তখন আল্লাহ বললেন, আদম! তুমি মুহাম্মদকে চিনলে কি করে? আমি তো এখনও তাকে সৃষ্টিই করিনি! আদম বললেন, হে আমার রব! আপনি যখন নিজ কুদরতী হাতে আমাকে সৃষ্টি করেছিলেন ও আমার মধ্যে রূহ্ সঞ্চার করেছিলেন, সে সময়ে আমি মাথা তুলে আরশের খুঁটিসমূহেঃ
لا إله الا الله محمد رسول الله
লিখিত দেখেছিলাম। তাতেই আমি বুঝে ফেলেছি যে, আপনি আপনার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো নাম আপনার নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেন নি। আল্লাহ তা’আলা বললেন, আদম! তুমি ঠিকই বলেছ। অবশ্যই তিনি আমার কাছে সৃষ্টির সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। যাক তুমি যখন তার উসিলা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেই ফেলেছ, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আর মুহাম্মদ যদি নাই হতো, আমি তোমাকে সৃষ্টিই করতাম না।’ বায়হাকী বলেন, আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলামের একক বর্ণনা অথচ তিনি একজন দুর্বল রাবী। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি, তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন নিশ্চয় তোমরা তাকে বিশ্বাস করবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক, আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম। (৩ আলে ইমরানঃ ৮১)।
আলী ইবনে আবু তালিব ও অাবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহ যখন যে নবীকে প্রেরণ করেছেন, তারই নিকট থেকে এ অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় যদি মুহাম্মদ (সা) প্রেরিত হন তাহলে অবশ্যই যেন তিনি তার প্রতি ঈমান আনেন এবং তাকে সাহায্য করেন। আর আদেশ দিয়েছেন যেন তাঁর উম্মতের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়ে রাখেন যে, যদি মুহাম্মদ (সা) প্রেরিত হন আর তারা তখন জীবিত থাকে, তবে যেন অবশ্যই তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে ও তাঁকে সাহায্য করে।
এভাবে অঙ্গীকার নিয়ে আল্লাহ তা’আলা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ (সা) সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব!
বায়তুল্লাহর নির্মাণ কাজ শেষ করে হযরত ইবরাহীম (আ) যে দোয়া করেছিলেন, তাতেও নবী করীম (সা)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠেছে। তা হলোঃ
অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করুন যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (২ বাকারাঃ ১২৯)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মিশন সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে এটিই প্রথম ঘোষণা, যা ঘোষিত হয়েছে এমন এক মহান নবীর মুখে, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় নবী করীম (সা)-এর পরই যার অবস্থান।
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, আবু উমামা (রা) বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনার মিশনের প্রারম্ভ হয়েছিল কিভাবে?’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া, ঈসার সুসংবাদ এবং মায়ের স্বপ্ন যাতে তিনি দেখেছেন, তার ভিতর থেকে এমন একটি আলো নির্গত হয় যে, তাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়।’ এটি ইমাম আহমদের একক বর্ণনা।
হাফিজ আবু বকর ইবনে আবু আসিম কিতাবুল মাওলিদে বর্ণনা করেন যে, এক বেদুঈন এসে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার নবুওতের সূচনা কী ছিল?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আল্লাহ আমার থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, যেমন অঙ্গীকার নিয়েছেন অন্য নবীদের থেকে। আর আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার দুই পায়ের মধ্যস্থল থেকে একটি প্রদীপ নির্গত হয় এবং তাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যায়।’
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সাহাবাগণ একদিন বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীম-এর (আ) দোয়া, ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ আর আমাকে গর্ভে ধারণের পর আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তার থেকে একটি আলো বের হয়, যার ফলে সিরিয়ার বুসরা নগরী আলোকিত হয়ে যায়।’ এ বর্ণনার সূত্র উত্তম।
নবী করীম (সা)-এর এ বক্তব্যে বুসরাবাসীদের জন্যও সুসংবাদ রয়েছে। বাস্তবেও দেখা গেছে নবুওতের নূর সিরিয়ার বুসরায়-ই সর্বপ্রথম বিচ্ছুরিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সমগ্র সিরিয়ার মধ্যে বুসরা নগরী-ই সর্বাগ্রে মুসলমানদের আয়ত্তে আসে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর খিলাফতকালে এক সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে এই বুসরা জয় হয়েছিল। এর বিস্তারিত বিবরণ পরে আসবে।
রাসূলুল্লাহ (সা) দু’বার বুসরায় গিয়েছিলেন। একবার তার চাচা আবু তালিবের সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স বার বছর। বহীরা পাদ্রীর ঘটনা সেখানেই ঘটেছিল। আরেকবার গিয়েছিলেন খাদীজা (রা)-এর গোলাম মায়সারার সঙ্গে, খাদীজা (রা)-এর ব্যবসা পণ্য নিয়ে। এই বুসরায়ই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উষ্ট্রী বসে পড়েছিল এবং তাতে তার চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল বলে পরে কথিত আছে। তা স্থানান্তরিত করে সে স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। বর্তমানে সেটি একটি প্রসিদ্ধ মসজিদ। এই বুসরায়ই ৬৫৪ সালে হিজাজ থেকে নির্গত অগ্নিশিখায় উটের ঘাড় আলোকিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ঠিক যেমনটি এ মর্মে নবী করীম (সা) একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তা হলোঃ হিজাজ ভূমি থেকে অগ্নি নির্গত হবে, যার শিখায় বুসরা নগরীতে উটের ঘাড় আলোকিত হবে।
ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
অর্থাৎ, যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল, যা তাদের নিকট আছে, তাতে লিপিবদ্ধ পায়, সে তাদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎ কার্যে বাধা দেয়, যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু বৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃংখল হতে, যা তাদের ওপর ছিল। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তার অনুসরণ করে তারাই সফলকাম। (৭ আ’রাফঃ ১৫৭)
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, এক বেদুঈন বলেছে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় ব্যবসার পণ্য নিয়ে একবার আমি মদীনা যাই। ক্রয়-বিক্রয় শেষ করে আমি মনে মনে বললাম, আজ অবশ্যই আমি ঐ লোকটির কাছে যাব এবং তিনি কি বলেন, শুনব। বেদুঈন বলে, যখন আমি তার সাক্ষাত পেলাম, তখন তিনি আবু বকর (রা) ও উমর (রা)-কে দুপাশে নিয়ে হাঁটছেন।
আমি তাদের অনুসরণ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক ইহুদীর নিকট গমন করেন। ইহুদী লোকটির অপরূপ সুশ্রী একটি ছেলে মৃত্যু শয্যায় ছিল। ইহুদী লোকটি তারই পার্শ্বে বসে তাওরাত খুলে পাঠ করছে আর পুত্রের জন্য শোক প্রকাশ করছে। নবী করীম (সা) বললেন, ‘যে সত্তা তাওরাত নাযিল করেছেন, তার কসম দিয়ে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। তোমার কিতাবে কি তুমি আমার পরিচয় ও আবির্ভাব স্থলের কথা পাও?’ ইহুদী মাথা নেড়ে বলল, ‘না, পাই না।’ সঙ্গে সঙ্গে তার পুত্র বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, যিনি তাওরাত নাযিল করেছেন, তাঁর শপথ! আমাদের কিতাবে আমরা আপনার পরিচয় ও আবির্ভাব স্থলের কথা পাই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের নিকট থেকে এই ইহুদীকে উঠিয়ে দাও।’ তারপর তিনি ছেলেটির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন ও জানাযার সালাত আদায় করেন। এ বর্ণনার সূত্র উত্তম এবং সহীহ বর্ণনায় আনাস (রা) থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়।
আবুল কাসেম বগবী বর্ণনা করেন যে, এক সাহাবী বলেছেন—একদিন আমি নবী করীম (সা)-এর নিকট বসা ছিলাম। হঠাৎ একজন লোকের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চোখ পড়ে। লোকটি ছিল ইহুদী। তার গায়ে জামা, পরণে পাজামা, পায়ে জুতা। নবী করীম (সা) তার সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। লোকটি বললঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘তুমি কি ইনজীল পড়?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ, পড়ি।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘আর কুরআন?’ বলল, ‘তবে আপনি চাইলে পড়তে পারি।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ ‘তাওরাত-ইনজীলে যা পড়, তাতে আমাকে নবীরূপে পাও কি?’ লোকটি বলল, ‘আপনার পরিচয় ও আবির্ভাব স্থলের কথা আমরা পাই। কিন্তু যখন আপনি আবির্ভূত হলেন, তখন আমরা আশা করেছি, আপনি আমাদের মধ্য থেকে হবেন! কিন্তু যখন আমরা আপনাকে দেখলাম, তখন বুঝলাম, আপনি সেই ব্যক্তি নন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ ‘কারণ কী হে ইহুদী?’ ইহুদী বলল, ‘আমরা লিপিবদ্ধ পাই যে, তার উম্মতের সত্তর হাজার মানুষ বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আপনার সঙ্গে সামান্য ক’জন ছাড়া আর তো লোক দেখছি না।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আমার উম্মত সত্তর হাজার আরও সত্তর হাজারের চেয়েও বেশি।’ এটি একক বর্ণনা।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক...... আবু হুরায়রা (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) ইহুদীদের নিকট গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞ ব্যক্তিকে ডেকে আন।’ তারা বললেন, ‘তিনি হচ্ছেন আবদুল্লাহ ইবনে সুরিয়া।’ নবী করীম (সা) তাকে একান্তে নিয়ে তার দীন, তাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত, মান্না-সালওয়া, মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান ইত্যাদির কসম দিয়ে বললেনঃ “তুমি কি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে জান?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ। আর আমি যা জানি, আমার সম্প্রদায়ও তাই জানে। আপনার গুণ-পরিচয় তো তাওরাতে সুস্পষ্ট বর্ণিত আছে। কিন্তু তারা আপনাকে হিংসা করে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘কিন্তু তোমাকে বারণ করে কে?’ লোকটি বলল, ‘আমি আমার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণকে অপছন্দ করি। তবে অচিরেই তারা আপনার অনুগামী হবে এবং ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন আমিও ইসলাম গ্রহণ করব।’
সালামা ইবনে ফাযল... ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) খায়বারের ইহুদীদের প্রতি একটি পত্র দিয়েছিলেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ
بسم الله الرحمن الرحيم من محمد رسول الله صاحب موسی وأخيه والمصدق بما جاء به موسى ألا إن الله قال لكم يامعشر يهود وأهل الثوراة أنكم تجدون ذالك في كتابكم إن امحمد رسول الله والذين معه أشداء على الكفار رحماء بينهم تراهم ركعا سجدا يبتغون فضلا من الله ورضوانا سيماهم في وجوههم من أثر السجود ذلك مثلهم في التوراة ومثلهم في الأنجيل كزرع أخرج شطأه فازره فاستغلظ فاستوى على سوقه يعجب الزراع ليغيظ بهم الكفار وعد الله الذين آمنوا وعملوا الصالحات منهم مغفرة وأجرا عظيما ) وإني أنشدكم بالله وبالذي أنزل عليكم و أنشدكم بالله وبالذي أنزل عليكم وانشدكم بالذى اطعم من كان قبلكم من أسلافكم واسباطكم . المن والسلوى و أنبئكم بالذي أيبس البحر لا بائكم حتى أنجاكم من فرعون وعمله إلا أخبرتمونا هل تجدون فيما أنزل الله عليكم أن تؤمنوا بمحمد فإن كنتم لا تجدون ذالك في كتابكم فلاكره عليكم قد تبين الرشد من الغي وأدعوكم إلى الله وإلى تبيه
অর্থাৎ, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। মূসার সঙ্গী ও তার ভাই এবং তার কিতাবের সত্যায়নকারী আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ-এর পক্ষ থেকে।
হে ইহুদী ও আহলে তাওরাত সম্প্রদায়। আল্লাহ তোমাদের উদ্দেশে বলেছেন এবং তোমাদের কিতাবেও তোমরা পাচ্ছ যেঃ
‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। আর তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে। তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপই এবং ইনজীলেও। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নির্গত হয় কিশলয় তারপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কান্ডের ওপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক। এভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের। (৪৮ ফাতহঃ ২৯)
আমি তোমাদেরকে কসম দিচ্ছি আল্লাহর ও সেই সত্তার, যিনি তোমাদের প্রতি তাওরাত নাযিল করেছেন। আমি তোমাদেরকে কসম দিচ্ছি সেই সত্তার, যিনি তোমাদের পূর্বসূরিদেরকে মান্না ও সালাওয়া খাইয়েছেন। আমি তোমাদেরকে কসম দিচ্ছি সেই সত্তার, যিনি সমুদ্রকে শুকিয়ে তোমাদের পূর্বসূরিদের ফেরআউন ও তার কার্যকলাপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বল তো, আল্লাহ তোমাদের ওপর যা নাযিল করেছেন, তাতে কি তোমরা এ কথা লিপিবদ্ধ পাও না যে, তোমরা মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আনবে? যদি তোমাদের কিতাবে তোমরা কথাটা না পেয়ে থাক, তবে তোমাদের প্রতি কোন জোর-জবরদস্তি নেই। হিদায়াত গোমরাহী থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আমি তোমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর নবীর প্রতি আহবান করছি।
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার ‘মুবতাদা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বুখত নাসর (নেবুচাঁদ নেযার) বায়তুল মুকাদ্দাস ধ্বংস এবং বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছিত করার সাত বছর পর এক রাতে একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। পরদিন গণক জ্যোতিষীদের সমবেত করে তাদের নিকট তার সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে চায়। তারা বলে, ‘মহারাজ! স্বপ্নের বিবরণটা তুলে ধরলেই আমরা তার ব্যাখ্যা বলতে পারব।’ বুখত নাসর বলল, ‘স্বপ্নের বিবরণ আমি ভুলে গেছি, কি দেখেছি এখন তা মনে নেই। তোমাদেরকে আমি তিনদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে তা বলতে না পারলে আমি তোমাদের সবাইকে হত্যা করব।’ রাজার হুমকিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তারা ফিরে যায়।
হযরত দানিয়াল (আ) ছিলেন তখন বুখত নাসর-এর কারাগারে বন্দী। ঘটনাটি তাঁর কানে যায়। তাই জেলারকে তিনি বললেন, ‘যাও, রাজাকে গিয়ে বল যে, এখানে এমন একজন লোক আছেন, যিনি আপনার স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে অবহিত। সংবাদ পেয়ে রাজা দানিয়াল (আ)-কে ডেকে পাঠায়। দানিয়াল (আ) তার কক্ষে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রাজাকে সিজদা করলেন না। রাজা বলল, ‘আমাকে সিজদা করতে তোমায় কিসে বারণ করল?’ দানিয়াল (আ) বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে বিশেষ এক ইলম দান করেছেন এবং তাকে ব্যতীত কাউকে সিজদা না করার আদেশ দিয়েছেন।’ বুখত নাসর বলে, ‘যারা তাদের রবকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করে, আমি তাদেরকে ভালবাসি। এবার বল, আমি কী স্বপ্ন দেখেছি।’ হযরত দানিয়াল (আ) বললেনঃ
আপনি দেখেছেন, বৃহৎ একটি প্রতিমা, যার দু’পা মাটিতে তার মাথাটা আকাশে। প্রতিমাটির ঊর্ধ্বাংশ সোনার, মধ্যমাংশ রূপার এবং নিম্নাংশ তামার আর পায়ের গোছা দু’টো লোহার। পা দুটো পোড়ামাটির। তার রূপ এবং শিল্পনৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে আপনি প্রতিমাটির প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। ঠিক এ সময়ে আল্লাহ আকাশ থেকে একটি পাথর নিক্ষেপ করেন। পাথরটি প্রতিমার ঠিক মস্তক বরাবর নিক্ষিপ্ত হয়। প্রতিমাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সোনা, রূপা, তামা, লোহা ও পোড়ামাটি সব একাকার হয়ে যায়। আপনার মনে হলো যে, পৃথিবীর সব মানুষ আর সকল জিন একত্রিত হয়েও এর একটি উপাদানকে অপরটি থেকে আলাদা করতে পারবে না। আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে আপনি দেখলেন যে, পাথরটি ধীরে ধীরে পুষ্ট, মোটা ও বড় হচ্ছে এবং চারদিক বিস্তৃত হতে হতে সমগ্র পৃথিবী গ্রাস করে ফেলেছে। তখন আপনি পাথর আর আকাশ ছাড়া কিছুই দেখছেন না।’
স্বপ্নের বিবরণ শুনে বুখত নাসর বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমি এ স্বপ্নই দেখেছিলাম। এবার বল, তাৎপর্য কী?’
দানিয়াল (আ) বললেনঃ প্রতিমাটি হলো পৃথিবীর শুরু, মধ্যম ও শেষ যুগের বিভিন্ন জাতি। প্রতিমার গায়ে নিক্ষিপ্ত পাথর হলো সেই দীন, যাকে আল্লাহ শেষ যুগের উম্মতের প্রতি অবতীর্ণ করবেন এবং সব জাতির ওপর দীনকে বিজয়ী করবেন। এ লক্ষ্যে আল্লাহ আরব থেকে একজন উম্মী নবী প্রেরণ করবেন। পাথর যেমন প্রতিমার বিভিন্ন অংশকে পিষে একাকার করে ফেলেছে, তেমনি তিনিও সব জাতি আর সব ধর্মকে একাকার করে ফেলবেন। নিজের দীনকে তিনি অন্যসব দীনের ওপর বিজয়ী করবেন। পাথরের পৃথিবীময় ছড়িয়ে পরার ন্যায় তার দীন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তার মাধ্যমে আল্লাহ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন আর মিথ্যাকে দূরীভূত করবেন। বিভ্রান্ত মানুষকে সত্যের পথ দেখাবেন, নিরক্ষর লোকদের শিক্ষা দান করবেন। দুর্বলদের শক্তিশালী করবেন, লাঞ্ছিতদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবেন এবং অসহায়দের সাহায্য করবেন।
বর্ণনাকারী এ প্রসঙ্গে বুখত নাসর-এর বনী ইসরাঈলকে দানিয়াল (আ)-এর হাতে মুক্তি দেয়ার বিস্তারিত কাহিনীও উল্লেখ করেন।
ওয়াকিদী বর্ণনা করেন যে, একবার ইস্কান্দারিয়ার (আলেকজান্দ্রিয়ার) রাজা মুকাওকিস-এর নিকট মুগীরা ইবন শু’বা প্রতিনিধিরূপে গমন করেন। তখন মুকাওকিস রাসূলুল্লাহ (সা)-এর গুণ-পরিচয় সম্পর্কে ঠিক সেসব প্রশ্ন করে, যা করেছিল হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে। ওয়াকিদী একথাও উল্লেখ করেন যে, মুকাওকিস বিভিন্ন গির্জায় খৃষ্টান পণ্ডিতদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। খৃস্টান পণ্ডিতরা সে ব্যাপারে তাকে অবহিত করে। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। হাফিজ আবু নুআয়ম দালায়িলে তা বর্ণনা করেছেন।
বুখারী শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন ইহুদীদের কয়েকটি বিদ্যাপীঠ হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি তাদেরকে বলেন, ‘ওহে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা মুসলমান হয়ে যাও। সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! তোমরা তোমাদের কিতাবসমূহে আমার পরিচয় পাচ্ছ নিশ্চয়ই।’
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, ...... আতা ইবনে ইয়াসার বলেন, আমি একদিন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস-এর নিকট গিয়ে বললাম, ‘তাওরাতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কি পরিচয় বর্ণিত আছে আমাকে তা বলুন।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যে পরিচয় কুরআনে বিবৃত হয়েছে, তাওরাতে হুবহু তাই উল্লেখ আছে। তা হলোঃ
হে নবী! আমি তোমাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদদাতা, ভয় প্রদর্শনকারী ও উম্মীদের আশ্রয়দাতা রূপে প্রেরণ করেছি। তুমি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি তোমার নাম রেখেছি মুতাওয়াক্কিল। তুমি ভাষায় কর্কশ বা হৃদয়ে কঠোর নও। তুমি হাটে-বাজারে চিৎকার করে কথা বল না। তুমি মন্দকে মন্দ দ্বারা প্রতিরোধ কর না। তুমি ক্ষমাশীল। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র বিশ্বাসী বানিয়ে পথভ্রষ্ট জাতিকে সোজা পথে আনা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাকে তুলে নেবেন না।
এর দ্বারা আল্লাহ অন্ধ চক্ষু, বধির কান ও তালাবদ্ধ হৃদয়সমূহ খুলে দেবেন।’ বুখারীও ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন জারীরের বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে যে, আতা ইবনে ইয়াসার বলেন, আমি কা’বকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনিও হুবহু একই কথা বলেন, একটি বর্ণেরও পার্থক্য করেন নি।
হাফিজ আবু বকর বায়হাকী বর্ণনা করেন যে,....... আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় সম্পর্কে হুবহু একই কথা বলতেন। কা’ব আল-আহবারও অভিন্ন কথা বলতেন। আমি বলি, আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা)-এর উক্তি যুক্তিগ্রাহ্য। তবে আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) অনেক বেশি বলতেন। ইয়ারমুকের দিন তিনি আহলে কিতাবের যে দু’টি বস্তা পেয়েছিলেন তা থেকে তিনি প্রায়ই বর্ণনা করতেন। আদি যুগের অনেক আলিম আহলে কিতাবের সকল গ্রন্থকেই তাওরাত বলে আখ্যায়িত করতেন। মূসা (আ)-এর প্রতি নাযিলকৃত তাওরাতে তা রাখতেন না। অন্যান্য হাদীসে এ বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায়। ইউনুস বর্ণনা করেন যে, উম্মুদ্দারদা (রা) বলেন, আমি একদিন কা’ব আল আহবারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাওরাতে আপনারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় কিরূপ পান?’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘তাওরাতে তার পরিচয় হলোঃ মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। তাঁর নাম মুতাওয়াক্কিল। তিনি কর্কশ নন, কঠোর নন। হাটে-বাজারে চিৎকার করে কথা বলে বেড়ান না। তাকে অনেক চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। তার দ্বারা আল্লাহ দৃষ্টিশক্তিহীন চোখগুলোকে দৃষ্টিশক্তি, বধির কানগুলোকে শ্রবণশক্তি দান করবেন এবং বক্র জিহ্বগুলোকে সোজা করবেন। ফলে তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক, তার কোন শরীক নেই। তাঁর দ্বারা আল্লাহ মজলুমের সহায়তা করবেন এবং মজলুমকে জুলুমের কবল থেকে রক্ষা করবেন।
বায়হাকী বর্ণনা করেন যে,....... আবু হুরায়রা (রা) সূরা কাসাস এর আয়াতঃ
(মূসাকে আমি যখন আহ্বান করেছিলাম, তখন তুমি তূর পর্বত পার্শ্বে উপস্থিত ছিলে না)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, তখন আহ্বান করা হয়েছিল, ‘হে মুহাম্মদের উম্মত! তোমরা আমাকে আহ্বান করার আগেই আমি তোমাদের আহ্বান কবূল করে নিয়েছি। যা করার আগেই আমি তোমাদেরকে দান করেছি।
ওহব ইবনে মুনাব্বিহ বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা’আলা যাবূরে দাউদ (আ)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলেন, ‘হে দাউদ! তোমার পর অচীরেই একজন নবী আসছেন। তার নাম হবে আহমদ ও মুহাম্মদ। তিনি হবেন সত্যবাদী ও সর্দার। আমি কখনো তার প্রতি রুষ্ট হবো না, তিনি কখনো আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না। আমার কোন নাফরমানী না করতেই আমি তার পূর্বাপর সব ক্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছি। তাঁর উম্মত হবে রহমতপ্রাপ্ত। আমি নবীদের যেমন নফল দান করেছিলাম, তেমনি তাদেরকেও তা দান করেছি। আর তাদের ওপর এমন সব দায়িত্ব ফরয করেছি, যা করেছিলাম আমি রাসূলগণের ওপর। কিয়ামতের দিন যখন তারা আমার সামনে উপস্থিত হবে, তাদের নূর হবে নবীগণের নূরের অনুরূপ।’
এরপর আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, ‘হে দাউদ! আমি মুহাম্মদকে এবং অন্যসব উম্মতের ওপর তার উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’
পবিত্র কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে ও আহলে কিতাবের গ্রন্থাদিতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুসংবাদ থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। যথাস্থানে আমরা তা আলোকপাত করেছিও। এর মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিম্নরূপঃ
অর্থাৎ, এর আগে আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা এতে বিশ্বাস করে। যখন তাদের নিকট তা আবৃত্তি করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা এতে ঈমান আনি, এটা আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত সত্য। আমরা তো পূর্বেও আত্মসমর্পণকারী ছিলাম। (২৮ঃ কাসাসঃ ৫২, ৫৩)
অর্থাৎ, যাদেরকে এর আগে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট যখন তা পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র মহান। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। (১৭ঃ বনী ইসরাঈলঃ ১০৮)।
অর্থাৎ আমাদের প্রতিপালক মুহাম্মদের অস্তিত্ব ও প্রেরণ সম্পর্কে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হবে নিশ্চিত। তাই আমরা পবিত্রতা ঘোষণা করি সেই সত্তার, যিনি ইচ্ছে করলেই যে কোন কাজ করতে সক্ষম। তাকে অক্ষম করবে এমন কোন শক্তি নেই। (১৭, ইসরাঃ ১০৭, ১০৮)
অন্য আয়াতে খৃস্টান পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
অর্থাৎ, রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন তারা শ্রবণ করে, তখন তারা যে সত্য উপলব্ধি করে তার জন্য তুমি তাদের চক্ষু অশ্রুবিগলিত দেখবে। তারা বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং তুমি আমাদেরকে সাক্ষ্যবাহকদের তালিকাভুক্ত কর। (৫ঃ মায়িদাঃ ৮৩)
তাছাড়া নাজ্জাশী সালমান আল-ফারসী ও আবদুল্লাহ ইবনে সালাম প্রমুখের বাণীতে একথার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। সকল প্রশংসা ও প্রশস্তি আল্লাহরই।
বিভিন্ন নবীর জীবন চরিত বর্ণনা প্রসঙ্গে যেমন হযরত মূসা, শা‘য়া, আরমিয়া ও দানিয়াল প্রমুখ নবীর কাহিনীতে আমরা তাদের বর্ণিত রাসূলুল্লাহ-এর আবির্ভাব, গুণ-পরিচয়, জন্মভূমি, হিজরত ভূমি ও তাঁর উম্মতের পরিচয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছি।
অপর দিকে বনী ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী হযরত ঈসা (আ)-এর মাধ্যমেও আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এরূপ সংবাদ প্রদান করেছেন। হযরত ঈসা (আ) একদিন বনী ইসরাঈলের মাঝে ভাষণ দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন, কুরআন মজীদের ভাষায় তা হলোঃ
অর্থাৎ, আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর রাসূল। আমার পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং এমন এক রাসূলের সুসংবাদদানকারী রূপে আমার আবির্ভাব, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম হবে আহমদ। (৬১, সাফঃ ৬)
ইনজীলে ‘ফারকালীত’ এর ব্যাপারে সুসংবাদ আছে। ফারকালীত দ্বারা মুহাম্মদ (সা)-কেই বুঝানো হয়েছে।
বায়হাকী বর্ণনা করেন যে,...... হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ইনজীলে লিপিবদ্ধ আছে, কর্কশ নন, কঠোর নন, হাটে-বাজারে চিৎকারকারী নন। মন্দের প্রতিবিধান মন্দ দ্বারা করেন না বরং ক্ষমা করে দেন।
ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেন যে,........ মুকাতিল ইবনে হিব্বান বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা ঈসা ইবনে মারয়ামের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যে, আমার আদেশ পালনে তৎপর হও। শোন ও আনুগত্য কর হে চির কুমারী সাধ্বী নারীর পুত্র। পিতা ছাড়া সৃষ্টি করে আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য নিদর্শন বানিয়েছি। অতএব, তুমি আমারই ইবাদত কর। সুরিয়ানী ভাষায় সুরানীদের বুঝাও। প্রচার করে দাও যে, আমিই সত্য, স্থিতিশীল, চিরন্তন। ঘোষণা কর যে, তোমরা নিরক্ষর উম্মী নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, যিনি উট, বর্ম, মুকুট, জুতা ও লাঠির অধিকারী হবেন। যার মাথার চুল থাকবে কিছুটা কোঁকড়ানো। প্রশস্ত কপাল, জোড়া ভ্রু আয়ত কাজল চোখ, দীর্ঘ চোখের পাতা, উন্নত নাক, উজ্জ্বল গাল ও ঘন দাড়ি। মুখমণ্ডলের ঘাম যেন মুক্তার দানা যা মেশকের সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। তার ঘাড় যেন রূপার পাত্র দু’কণ্ঠা বেয়ে যেন সোনা গড়িয়ে পড়ে। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের একটি রেখা। এ ছাড়া তার পেটে আর কোন চুল নেই। হাতের তালু ও পায়ের পাতা মাংসল। মানুষের সঙ্গে হাঁটার সময় তাকেই সর্বাপেক্ষা উঁচু দেখা যায়। হাঁটার সময় মনে হয় যেন তিনি উপর থেকে নিচে নামছেন। তার পুরুষ বংশধরদের সংখ্যা হবে অল্প। বায়হাকী তার দালাইল গ্রন্থে এরূপ বর্ণনা করেছেন। বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, উসমান ইবনে হাকাম ইবনে রাফি ইবনে সিনান বলেন, তিনি তার পূর্ব পুরুষদের নিকট শুনেছেন যে, তাদের নিকট একটি লিপি ছিল। জাহেলী যুগে বংশপরম্পায় লিপিটি তারা সংরক্ষণ করেন। ইসলামের আবির্ভাব কালেও লিপি তাদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনা আসেন, তখন তারা বিষয়টি তাকে জানান এবং লিপি এনে দেন। তাতে লেখা ছিলঃ
শুরু আল্লাহর নামে। আল্লাহর কথাই সত্য আর জালিমদের কথা ব্যর্থ। শেষ যমানায় এমন একটি জাতি আগমন করবে, যা যাদের আশেপাশের লোকজন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এবং যাদের মধ্যবর্তী লোকজনের সংখ্যা কমে যাবে এবং যারা সমুদ্রে ডুব দিয়ে হলেও শত্রুকে ধাওয়া করবে। তাদের মধ্যে এমন সালাত থাকবে, যা নূহ্ (আ)-এর সম্প্রদায়ে থাকলে তারা তুফানে ধ্বংস হতো না, যদি ‘আদ সম্প্রদায়ে থাকত তাহলে তারা ঝঞাবায়ুতে ধ্বংস হতো না, যদি তা ছামূদ সম্প্রদায়ে থাকত তাহলে বিকট নাদে তারা নিঃশেষ হতো না। শুরু আল্লাহর নামে। আল্লাহর কথাই সত্য আর জালিমদের কথা ব্যর্থ।
লিপিটির পাঠ শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বিস্মিত হন। সূরা আরাফের আয়াতঃ
এর ব্যাখ্যায় আমরা হিশাম ইবনে আস আল-উমাবীর কাহিনী উল্লেখ করেছি যে, হিরাক্লিয়াসকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করার জন্য হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাকে এক অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। হিরাক্লিয়াস আদম (আ) থেকে মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত নাম-পরিচয় ও আকার-আকৃতি সম্বলিত সব নবীর ছবি তাদেরকে বের করে দেখান। হিশাম ইবনে আস বর্ণনা করেন যে, হিরাক্লিয়াস যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ছবি বের করেন সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যান। তারপর বসে পড়ে গভীর দৃষ্টিতে ছবিটি দেখতে থাকেন। হিশাম ইবনে আস বলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন? তিনি বললেন, আদম আল্লাহর কাছে সকল নবীকে দেখার আবদার করেছিলেন। তখন তার কাছে আল্লাহ এই ছবিগুলো অবতারণ করেন। পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে আদম-এর ভাণ্ডারে এগুলো রক্ষিত থাকে। যুলকারনাইন সেখান থেকে ছবিগুলো বের করিয়ে আনেন এবং দানিয়াল (আ)-এর হাতে তুলে দেন।
যা হোক, ছবিগুলো দেখানোর পর হিরাক্লিয়াস বলেন, আমার মন চাইছে যে, আমি আমার রাজত্ব ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর রাজত্বে গিয়ে গোলাম হয়ে থাকি। এরপর আকর্ষণীয় উপঢৌকন দিয়ে তিনি আমাদের বিদায় দেন।
ফিরে এসে আমরা যা দেখে এসেছি, যা উপঢৌকন পেয়েছি এবং হিরাক্লিয়াস যা বলেছেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর নিকট সবকিছু বিবৃত করি। শুনে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘অভাগা! আল্লাহ্ যদি তার কল্যাণ চান, তবে সে তাই করবে।’ হিশাম ইবনে ‘আস এরপর বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের বলেছেন যে, ‘খৃস্টান ও ইহুদীগণ তাদের কিতাবে মুহাম্মদ-এর পরিচয় দেখতে পায়।’
উমাবী বর্ণনা করেন যে, ...আমর ইবনে উমাইয়া বলেন, আমি একবার নাজ্জাশীর নিকট থেকে কয়েকটি গোলাম নিয়ে আসি। আমাকে গোলামগুলো দান করেছিলেন। গোলামরা আমাকে বলল, ‘আমাদের পরিচয় করিয়ে না দিলেও রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখলে আমরা চিনে ফেলব।’ কিছুক্ষণ পর আবূ বকর (রা) এলেন। আমি বললাম, ‘ইনি?’ তারা বলল, ‘না।’ এরপর আসলেন উমর (রা)। আমি বললাম, ‘ইনি?’ তারা বলল, ‘না, ইনিও নন।’ তারপর আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) তাশরীফ নিয়ে আসলেন। দেখেই তারা আমাকে ডাক দিয়ে বলে— ‘হে আমর! ইনিই আল্লাহর রাসূল (সা)।’ আমি তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) অথচ কেউ তাদেরকে তার পরিচয় বলে দেয়নি। তাদের কিতাবে লিপিবদ্ধ লক্ষণ দেখেই তারা নবী করীম (সা)-কে চিনে ফেলে।
সাবার জীবন চরিত আলোচনায় আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, তিনি কাব্যাকারে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন ও সুসংবাদ দান করেছিলেন। এখন তার পুনরুল্লেখ নিস্প্রয়োজন। আমরা আরো উল্লেখ করেছি যে, তুব্বা ইয়ামানী যখন মদীনা অবরোধ করেছিলেন, তখন দু’জন ইহুদী পণ্ডিত তাকে বলেছিল, এই নগরী এমন এক নবীর হিজরত ভূমি, যিনি শেষ যামানায় আবির্ভূত হবেন। শুনে তুব্বা অবরোধ তুলে ফিরে যান এবং নবী করীম (সা)-কে সালাম জানিয়ে কবিতা রচনা করেন।
ইফাবা-২০০৬-২০০৭-/৯৮৮৩ (উ)-৩,২৫০
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/489/102
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।