মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
তিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আ) ও মহানবীর মধ্যবর্তী কালের লোক। কারো কারো ধারণা তিনি একজন নবী ছিলেন। আল্লাহই ভালো জানেন।
তাবারানী বলেনঃ আহমদ ইব্ন যুহায়র আত-তাতারী আমাদের নিকট সাঈদ ইবন জুবায়র এর বরাতে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করে বলেনঃ খালিদ ইবন সিনানের কন্যা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তার জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দেন এবং বলেনঃ
بنت نبى ضيعه قوم
—এ হচ্ছে এমন এক নবীর কন্যা, যাকে তার সম্প্রদায় ধ্বংস করেছে। বাজ্জারও ভিন্নসূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, খালিদ ইবন সিনানের উল্লেখ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট করা হলে তিনি বলেন, তিনি ছিলেন এমন এক নবী, যাকে তার সম্প্রদায় ধ্বংস করেছে। অতঃপর তিনি বলেনঃ এ সূত্র ছাড়া হাদীসটি মারফূ’ পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। আর এসূত্রের একজন রাবী কায়েস ইবন রবী বিশ্বস্ত হলেও তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল ছিল। তিনি হাদীসে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করতেন, যা আসল হাদীস নয়। আল্লাহই ভালো জানেন।
বাযযার বলেনঃ সাঈদ ইবন যুবাঈর থেকে মুরসালরূপে হাদীসটি বর্ণিত। আর হাফিজ আবু ইয়া’লা আল-মুছিলী ইবন আব্বাসের বরাতে বলেন, আব্বাস গোত্রের খালিদ ইবন সিনান নামক জনৈক ব্যক্তি তার সম্প্রদায়কে বলেনঃ ‘আমি তোমাদের উপর আসন্ন কঙ্করময় উচ্চ ভূমির আগুন নিভিয়ে দেবো।’ তখন তার সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি তাকে বললো, ‘আল্লাহর কসম, হে খালিদ, তুমি তো সত্য ছাড়া আমাদের সঙ্গে কখনো কোন কথা বলনি। তবে তোমার এ বক্তব্যের অর্থ কী?’ তখন খালিদ তাঁর জাতির কিছু লোক নিয়ে বের হলেন। তাদের মধ্যে আম্মারা ইবন যিয়াদও ছিল। তিনি সেখানে আগমন করলে সে আগুন পাহাড়ের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসছে দেখেন। তখন খালিদ তাদের জন্য রেখা টানলেন এবং তাতে তাদেরকে বসালেন এবং বললেনঃ আমি তোমাদের নিকট আসতে হলে তোমরা আমার নাম ধরে ডাকবে না। তখন আগুন এমনভাবে বের হয়ে আসছিল যেন লাল রঙের অশ্বদল একের পর এক ছুটে আসছে। তখন খালিদ অগ্রসর হয়ে আপন লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করছিলেন আর বলছিলেনঃ
بدا بدا بدا كل هدى
—প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে সকল হিদায়াত। ইবনু রাইয়া আল-সাবী মনে করেছে, আমি সেখান থেকে বের হবো না। আমার বস্ত্র তো আমার হাতেই। একথা বলে তিনি সে ফাটলে ঢুকে পড়েন। সেখানে তার বিলম্ব হলে আম্মারা ইবন যিয়াদ তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ আল্লাহর কসম, তোমাদের সঙ্গী বেঁচে থাকলে অবশ্যই তোমাদের নিকট এতক্ষণে ফিরে আসতেন। তারা বললেনঃ তোমরা তাকে তার নাম ধরে ডাকো। রাবী বলেন, তারা বললোঃ তিনি আমাদেরকে নাম ধরে ডাকতে নিষেধ করেছেন। তখন তারা তার নাম ধরে ডাকলো। তখন মাথায় হাত তিনি মাথায় হাত রেখে বের হয়ে এলেন ধরে এবং বললেনঃ আমি কি তোমাদেরকে আমার নামে ডাকতে নিষেধ করিনি? আল্লাহর কসম, তোমরা তো আমাকে হত্যা করে ফেললে। সুতরাং আমাকে দাফন করে ফেল। যখন তোমাদের নিকট দিয়ে কিছু গাধা অতিক্রম করবে তখন তার মধ্যে একটি গাধা থাকবে লেজ কাটা, তখন তোমরা আমাকে কবর থেকে উঠালে জীবিত পাবে। তারা তাকে দাফন করলো। তখন তাদের নিকট দিয়ে কিছু সংখ্যক গাধা অতিক্রম করলো। তার মধ্যে একটি গাধা সত্যিই লেজ কাটা ছিল। তখন আমরা একে অপরকে বললাম ও কবরটা খুঁড়ো। কারণ তিনি আমাদেরকে কবর খোড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আম্মারা তাদেরকে বললেনঃ না, তোমরা তার কবর খুঁড়বে না। আল্লাহর কসম, মুদার গোত্র যেন আমাদেকে বলতে না পারে যে, আমরা আমাদের মৃতদের কবর খুঁড়ে থাকি। খালিদতো তাদের বলেছিলেনঃ তার স্ত্রীর পেটের মাংশে রয়েছে দুটি ফলক। তোমাদের কোন অসুবিধা দেখা দিলে সে দু’টির দিকে তাকাবে। তোমরা যা চাইবে, তার কাছে তাই পাবে। রাবী বলেন, কোন ঋতুবতী স্ত্রী লোক যেন তা স্পর্শ না করে। তারা তার স্ত্রীর নিকট ফিরে এসে তাকে সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে ঋতুবতী অবস্থায় তাদের দিকে তা বের করে আনে। ফলে ফলকের সমস্ত উপদেশাবলী মুছে যায়।
আবু ইউনুস বলেন সাম্মাক ইবন হারব বলেছেন, তিনি সে সম্পর্কে নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ এতো এমন নবী, যাকে তার জাতি ধ্বংস করেছে। আবু ইউনুস সিমাক ইবন হারবের বরাতে বলেন, খালিদ ইবন সিনানের পুত্র নবী (সা)-এর নিকট আগমন করলে তিনি বললেন, ‘মারহাবা হে ভাতিজা!’ এটি ইব্ন আব্বাসের উক্তি। তাতে একথা নেই যে, তিনি নবী ছিলেন। আর সে সব মুরসল বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি নবী এ কথা সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। খুব সম্ভব তিনি একজন পুণ্যবান ও কারামত সম্পন্ন লোক ছিলেন। কারণ তিনি যদি অন্তবর্তীকালের লোক হয়ে থাকেন, তবে সহীহ বুখারীতে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে প্রমাণিত আছে যে, তিনি বলেছেনঃ ঈসা ইবন মারইয়ামের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি হচ্ছি আমি। কারণ, তার আর আমার মধ্যখানে কোন নবী নেই। আর তার পূর্বে হলেও তার নবী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, আল্লাহ বলেনঃ
“যাতে তুমি এমন এক জাতিকে সর্তক করতে পার যাদের কাছে তোমার পূর্বে সতর্ককারী আসেনি।” (২৮ কাসাসঃ ৪৬) একাধিক আলিম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইসমাঈল (আ)-এর পর আরবদের মধ্যে কোন নবী প্রেরণ করেননি; কেবল শেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-ব্যতীত। কা’বা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ইবরাহীম (আ) তার জন্য দোয়া করেছিলেন। কাবাকে আল্লাহ বিশ্ববাসীর জন্য শরীয়ত সম্মত কিবলা করেছেন। আর অন্যান্য নবীরা নিজ নিজ জাতিকে মহানবীর আগমনের সুসংবাদ দান করেছেন। সর্বশেষ যিনি এ সুসংবাদ দিয়েছেন, তিনি হলেন ঈসা ইবন মারয়াম (আ)। আরবদের প্রতি প্রেরিত নবী ছিলেন বলে, সুহায়লী প্রমুখ আলিমগণ যা বলেছেন, এতে তা রদ হয়ে যায়। মাদয়ানবাসী সুয়ায়ব ইবন লু সিহযাম ইবন শুয়ায়ব ইবন ছাফওয়ান, অনুরূপ ভাবে তাদের এ বক্তব্য রদ হয়ে যায়। আরবে হানযালা ইবন সাফওয়ান এরও নবীরূপে আগমন ঘটে এবং তাঁকে অস্বীকার করলে আল্লাহ তাদের উপর বুখত নসরকে বিজয়ী করেছিলেন। তিনি তাদের হত্যা আর বন্দি করেন। যেমন ঘটেছিল বনী ইসরাঈলের ক্ষেত্রে। আর এটা ঘটে মা’আদ ইব্ন আদমান এর শাসনামলে। স্পষ্টত এরা ছিলেন নেককার লোক, কল্যাণের দিকে তারা ডাকতেন। আল্লাহ ভালো জানেন। জরহুমের পর খুযাআদের বৃত্তান্ত প্রসঙ্গে আমর ইবন লুহাই ইবন কিম’আ ইবন খন্দফ সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
হাতিম তাইঃ জাহিলী যুগের অন্যতম প্রধান দাতা
তিনি হাতিম ইবন আবদুল্লাহ (ইবন সা’আদ ইবন হাশরাজ ইবন ইমরাউল কায়েস ইবন ‘আদী ইব্ন আহযাম ইবন আবু আহযাম) তাঁর আসল নাম ছারুমা ইবন রবীআ ইবন জারওয়াল ইবন সা’ল ইব্ন আমর ইবন গাওছ ইবন তাই আবু সাফফানা আত-তাঈ সাহাবী আদী ইবন হাতিম তাঁরই পুত্র। জাহিলী যুগে তিনি ছিলেন বিপুল প্রশংসিত বড়দাতা। অনুরূপ ভাবে ইসলামী যুগে তাঁর পুত্রও ছিলেন একজন নামকরা দাতা। হাতিমের বদান্যতার অনেক কিংবদন্তী ও চমকপ্রদ কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে সেসব দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পরকালের মুক্তি ও কল্যাণ তাঁর কাম্য ছিল না। সেসবের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল লোকজনের প্রশংসা কুড়ানো। হাফিজ আবু বকর আল-বাযযার তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে ইবন উমর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (স)-এর নিকট হাতিমের প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলে তিনি বলেনঃ তিনি যা চেয়েছিলেন তাই পেয়েছেন।
আদী ইবন হাতিম সূত্রে বর্ণনা করেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললাম আমার পিতা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং নানা সৎ কাজ করতেন। এজন্য তিনি কি পুণ্য লাভ করবেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ তোমার পিতা যা চেয়েছিলেন, তাই পেয়েছেন। আবু ইয়া’লা ও বাগাবী ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
সহীহ (বুখারীতে) উল্লিখিত হয়েছে যে, যে তিন ব্যক্তির জন্য জাহান্নামকে প্রজ্বলিত করা হবে, তাদের মধ্যে একজন হবে সে ব্যক্তি, যে এজন্য দান করে, যেন তাকে দাতা বলা হয়। দুনিয়াতে তাকে দাতা বলাই হবে তার প্রতিদান। অনুরূপভাবে একজন আলিম এবং মুজাহিদের জন্যও জাহান্নামের অগ্নি প্রজ্বলিত করা হবে।
সহীহ বুখারীতে অপর এক হাদীসে আছে যে, সাহাবায়ে কিরাম রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেন, আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন ইবন আমর ইবন কা’ব ইবন সা’দ ইবন তায়ম ইবন মুররা সম্পর্কে। তাঁরা বললেনঃ তিনি অতিথি আপ্যায়ন করতেন, দাস মুক্ত করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন। এতে কি তার কোন কল্যাণ হবে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ সে তো দীর্ঘ জীবনের মধ্যে একটা দিনও একথা বলেনি- হে আমার পালনকর্তা! কিয়ামতের দিন আমার অপরাধ ক্ষমা করো। অনুরূপভাবে অনেক খ্যাতনামা দাতা আছে, যারা অভাব আর দুর্যোগের সময় মানুষকে আহার করায় (তাদের অবস্থাও এরূপই হবে)। বায়হাকী আলী ইবন আবু তালিবের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এভাবেঃ সুবহানাল্লাহ! কতো মানুষ কতই না পুণ্য কাজ করে। অবাক লাগে সে ব্যক্তির জন্য, যার কাছে তার একজন মুসলিম ভাই অভাবের সময় আসে অথচ, সে নিজেকে কল্যাণ কর্মের জন্য উপযুক্ত মনে করে না। সে সওয়াবের আশা আর শাস্তির ভয় না করলেও সৎকাজে তো তার ছুটে যাওয়া উচিৎ। কারণ তা-তো মুক্তির পথেই চালিত করে। তখন জনৈক ব্যক্তি তার দিকে এগিয়ে এসে বললোঃ হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন, আপনি কি আল্লাহর রাসূলের নিকট এমন কথা শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ তার চেয়েও উত্তম কথা হলো তার কবীলার বন্দী নারীদেরকে যখন উপস্থিত করা হয়, তখন এক দাসী সামনে এলো, রক্তিম ওষ্ঠ, ঘন-কালো লম্বা চুল, দীর্ঘ গর্দান, তীরের মতো তীক্ষ্ণ নাক, অবয়ব মধ্যম, স্তন সুডোল, পায়ের গোছা মাংসল, চিকন কোমর, সরু নিতম্ব ও নিটোল পিঠের অধিকারিণী। বর্ণনাকারী বলেন, তাকে দেখেই আমি বিমুগ্ধ হই এবং বলি, আমি অবশ্যই তাকে পাওয়ার দাবী নিয়ে রাসূলের নিকট গমন করবো এবং রাসূল (সা) তাকে আমার গনীমতের মালের অন্তর্ভুক্ত করবেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি তার সৌন্দর্যের কথা বিস্মৃত হই। বিস্মৃত হই আমি তার কথা শুনে তার বাগ্নিতায়। সে বললো, হে মুহাম্মদ! আপনি কি আমাকে মুক্ত করবেন? আরবের গোত্রদের ঠাট্টা বিদ্রুপ থেকে রক্ষা করবেন? কারণ, আমি তো আমার গোত্রের সর্দার তনয়া। আর আমার পিতা যাকে সাহায্য করা দরকার, তাকে সাহায্য করতেন, যাকে রক্ষা করা দরকার, তাকে রক্ষা করতেন, তিনি বন্দীকে মুক্ত করতেন, ক্ষুধাতুরকে পেট পুরে খাওয়াতেন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করতেন, অতিথিকে আপ্যায়ন করতেন, লোকজনকে আহার করাতেন, সালাতের বিস্তার ঘটাতেন। তিনি কখনো অভাবীকে বিমুখ করেন নি। আমি হাতিম তাই’র কন্যা। তখন নবী (স) বললেনঃ হে বালিকা! এগুলোতো সত্যিকার মুমিনের গুণাবলী। তোমার পিতা মু’মিন হয়ে থাকলে আমরা অবশ্যই তার প্রতি সদয় হবো। তিনি তখনি আদেশ দিলেন, তোমরা তাকে মুক্ত করে দাও। কারণ, তার পিতা উত্তম চরিত্রকে ভালোবাসতেন। আর আল্লাহ তা’আলা উত্তম চরিত্রকে ভালোবাসেন। তখন আবু বুরদা ইবন ইয়ানার দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ উত্তম চরিত্র ভালোবাসেন? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে সত্তার হাতে আমার জীবন নিহিত, তাঁর শপথ করে বলছি, সুন্দর চরিত্র ছাড়া কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”
আদী ইবন হাতিম এর বৈপিত্রেয় ভাই এর বরাতে বলেনঃ হাতিম-এর স্ত্রী নাওয়ারকে বল হয়- হাতিম সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু শুনাও। তিনি বললেন, তাঁর সব ব্যাপারই ছিল অবাক হওয়ার মতো। একবার আমরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হলাম! তাতে সব কিছুই আক্রান্ত হলো, এর ফলে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আকাশ ধূলাবালিতে ছেয়ে গেলো। স্তন্য দাত্রীদের দুধ শুকিয়ে গেল। উটগুলো এমনই দুর্বল কঙ্কালসার হয়ে পড়ে যে, এক ফোটা দুধও দিতে পারছিল না। অর্থ সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দেয় সে দুর্ভিক্ষ। আমরা এক শীতের রাতে এক নির্জন প্রান্তেরে ছিলাম। ক্ষুধার তীব্রতায় শিশুরা চিৎকার জুড়ে দেয়, চিৎকার জুড়ে দেয় আব্দুল্লাহ, আদী এবং সাফানা। খোদার কসম, আমরা কোন কিছু পেলে তা দিয়ে তাদেরই ব্যবস্থা করতাম। তিনি একটি শিশুকে এবং আমি কন্যাটিকে কোলে তুলে নিলাম এবং প্রবোধ দিতে লাগলাম। আল্লাহর কসম, বেশ কিছু রাত অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তারা নীরব হলো না। অতঃপর আমরা অপর পুত্রটির দিকে মনোনিবেশ করি। তাকে প্রবোধ দিলে অতিকষ্টে তাকে চুপ করা গেল। অতঃপর আমরা শাম দেশীয় একটা মখমলের চাদর বিছাই এবং শিশুদেরকে তার উপর শোয়াই। তিনি আর আমি একটা কক্ষে ঘুমাই। সন্তানরাও ছিল আমাদের মধ্যস্থলে, এরপর তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন আমাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য, যাতে আমি ঘুমাতে পারি। আর তিনি যে কি চান, তা-ও আমি বুঝতে পারি। তখন আমি ঘুমের ভান করি। আমাকে বললেন, ‘হলোটা কী? তুমি কি ঘুমিয়েছ গো?’ আমি চুপ করে রইলাম। তখন, তিনি বললেন, ‘সে তো দেখছি ঘুমিয়েই পড়েছে।’ অথচ আমার চোখে ঘুম ছিল না। রাত্রি যখন তাদেরকে আচ্ছন্ন করে নেয়, নক্ষত্র যখন অন্তর্ধান করে চতুর্দিকের শব্দ আর কোলাহল থেমে গিয়ে যখন পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।
তখন তাঁবুটির কোন এককোণ কে একজন যেন উঠিয়ে দিল। তখন তিনি বললেন, ‘এখানে কে?’ তখন সে ফিরে গেলো। রাত ভোর হলে সে ফিরে আসে। আবার তিনি বললেনঃ ‘কে?’ সে বললো- ‘হে আদীর পিতা! আমি তোমার অমুক প্রতিবেশিনী। চিৎকার করে রোদন করা আর ডাকার জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি পাইনি। আমার এমন সন্তানদের নিকট থেকে তোমার কাছে এসেছি, যারা ক্ষুধায় নেকড়ের মতো চীৎকার দিচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘দেরী না করে এক্ষুণই তুমি তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ নাওয়ার বলনেঃ আমি ছুটে এসে বললাম – ‘তুমি একি করেছ? শুয়ে পড়ো। আল্লাহর কসম, তোমার সন্তানরা ক্ষুধায় ছটফট করছে। তাদেরকে প্রবোধ দেয়ার মতো কিছু তুমি পাওনি। কি হবে ঐ মহিলা আর তার সন্তানদের নিয়ে?’ তিনি বললেনঃ ‘তুমি থাম। ইনশা আল্লাহ আমি তোমাকে তৃপ্ত করবো।’ তিনি বলেন, সে মহিলাটি এগিয়ে আসে, দু’জন শিশুকে সে বহন করছিল আর চারজন শিশু হেঁটে চলছিল তার ডানে বাঁয়ে। যেন সে উটপাখী আর তার চারিপার্শ্বে বাচ্চাগুলো। হাতিম আপন ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যান এবং তার বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করে তারপর চকমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বালান। এরপর ছোরা দিয়ে চামড়া ছিলে ফেলে তার স্ত্রী লোকদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি নিয়ে যাও। তিনি এবং তোমার সন্তানদেরকে পাঠাও।’ সে তার শিশু সন্তানদের পাঠায়। এরপর তিনি বলেনঃ ‘শরম! শরম!! তোমরা কি চর্মসার লোকগুলোকে রেখে খাবে।’
এরপর তিনি তাদের মধ্যে ঘুরতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তাদের সংকোচ দূর হয় এবং তারা তাঁর কাছে ঘেষে এবং তার কাপড় জড়িয়ে ধরে। এরপর তিনি কাত হয়ে এককোণে শুয়ে পড়েন, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আল্লাহর কসম, তিনি এক টুকরা গোশত বা এক ঢোক পানিও স্পর্শ করলেন না। অথচ তার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। এ অবস্থায় আমাদের ভোর হল। আর আমাদের কাছে ঘোড়াটির হাড্ডি আর খুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
দারা কুতনী বলেনঃ কাযী আবু আবদুল্লাহ আল মাহামিলী আমার নিকট বর্ণনা করে বলেনঃ হাতিমের স্ত্রী হাতিমকে বললেন, ‘হে আবু সাফানা, আমি এবং তুমি একান্তে খাবার খেতে চাই, যেখানে আর কেউই থাকবে না।’ স্বামী স্ত্রীকে সে অনুমতি দিলেন, ফলে তিনি তার তাঁবু লোকালয় থেকে এক ক্রোশ দূরে সরিয়ে নিলেন এবং তাকে খাদ্য প্রস্তুতের নির্দেশ দান করলেন এবং সে মতে খাদ্য প্রস্তুত করা হলো। এসময় স্বামী -স্ত্রী উভয়ের জন্য পর্দা ঝুলানো হল। খাদ্য পাক সম্পন্ন হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে হাতিম মাথা বের করে বললেন,
فلا تطبخى قدرى وسترك دونها - على اذا ما تطبخين حرام
আমার উপর তোমার পর্দার আড়াল রেখে পাকাবে না এমন হলে তুমি যা পাকাবে, তা আমার জন্য হারাম হবে। কিন্তু তা পাকানোর সময় হলে পাক করবে, আগুন জ্বালাবে। বর্ণনাকারী বলেন, এর পর তিনি পর্দা উন্মোচন করেন, খাদ্য সম্মুখে এগিয়ে দেন এবং লোকজনকে ডাকলেন, তিনি এবং অন্যরা মিলে খাবার খেলেন। তখন হাতিম তাই’র স্ত্রী বললেনঃ আমাকে যা বলেছিলে, তা তো পূরণ করলে না! তখন জবাবে তিনি বললেনঃ আমার মন আমার নিকট অধিক সম্মানের পাত্র। প্রসংসা পাওয়ার উর্ধ্বে আমার মন। আর আমার বদান্যতা তো পূর্ব থেকেই খ্যাত। অতঃপর তিনি বললেনঃ
ولا نشتكينى جارتی غیر از ها - اذا غاب عنها بعلها لا أزورها
—আমার প্রতিবেশিনী আমার সম্পর্কে এছাড়া কোন অভিযোগ করেনা যে, যখন তার স্বামী দূরে থাকে আমি তাকে দেখতে যাই না।
سيبلغها خيرى ويرجع بعلها - ولم تقصر عليها ستورها
—আমার দান পৌঁছবে তার নিকট এবং ফিরে আসবে তার স্বামী অথচঃ ভেদ করা হবে তার পর্দা।
হাতিম তাই’র আরো কিছু কবিতার পংক্তিঃ
أأفضح جارتي واخون جاری - فلا والله افعل ما حييت
—আমি যখন রজনী যাপন করি প্রতারিত করি আমার প্রতিবেশীর স্ত্রীকে, যাতে আঁধার ঢেকে নেয় আমাকে, আমি আর গোপন থাকি না।
আমি লজ্জিত করবো আমার প্রতিবেশিনীকে আর বিশ্বাস ঘাতকতা করবো আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে। না, আল্লাহর কসম, যতদিন বেঁচে থাকি, তা করতে পারিনা।
হাতিম তাইর আরো কিছু কবিতার পংক্তিঃ
اغضي اذا ماجار تي برزت - حتى يوارى جارتي الخدد
—চক্ষু মুদে নেই যখন বের হয় আমার প্রতিবেশিনী, এমনকি ঢেকে নেয় আমার প্রতিবেশিনীকে পর্দা।
وما من يمتي شتم ابن عمى - وما انامحلف من يرتجيني
—আমার স্বভাব নয় চাচাতো ভাইকে গালি দেওয়া, যে আমার নিকট কিছু কামনা করে, আমি তাকে নিরাশ করি না।
وكلمة حاسد من غير جرم - سمعت وقلت مری فانقذيني
—বিনা দোষে নিন্দুক আর হিংসুকের কথা, আমি শুনে বলি-চলে যাও আর আমাকে রক্ষা কর।
وعابوها على فلم تعيني - ولم يعرق لها يوما جبيني
—তাদের নিন্দাবাদ আমাকে ক্লান্ত করে না এবং তা আমাকে ঘর্মাক্ত করে না।
وذی و جهين يلقاني طليقا - وليس اذا تغيب ياتسینی
—আর মিলিত হয় আমার সঙ্গে দ্বিমুখী ব্যক্তি (মুনাফিক) হাসি-খুশী, তার অন্তর্ধান আমাকে ব্যথিত করে না।
ظفرت بعيبه فكففت عنه - محافظة على حسبی ودینی
—আমি জয় করে নেই তার দোষ এবং বিরত থাকি তার থেকে, আমার বংশ আর ধর্ম রক্ষা করার কারণে।
তার আরো কিছু কবিতা থেকে—
سلي البائس المفرور یاام مالك - اذا ما اتاني بين نادي ومجزری
—হে উম্মে মালিক, শীতার্ত বিপন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করো, যখন সে আসে আমার কাছে আগুন আর জবাইখানার মাঝে।
কাযী আবুল ফারজল মুআ’ফী আবূ উবায়দার সুত্রে বলেন, কবি মুতালম্মিস এর এ নিম্নোক্ত উক্তি শুনে হাতিম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনঃ
قليل المال قصلحه تيبقى ولا يبقى الكثير على الفساد
—সামান্য সম্পদ তার মালিকের কল্যাণ সাধন করে, আর তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, আর বিপর্যয়ের সঙ্গে বেশী সম্পদও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
وحفظ المال خير من فناه وعسف في البلاد بغير داد
—আর সম্পদ উজাড় করার চেয়ে তা রক্ষা করা উত্তম, আর কোন রকম পুঁজি ছাড়া দেশ ভ্রমণ ভ্রষ্টতা স্বরূপ।
এ কবিতা শুনে তিনি বলেন- তার হয়েছে কী? আল্লাহ তার জিহ্বা কর্তন করুন, তিনি মানুষকে কৃপণতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি কেন বলেননি -
فلا الجود يفني المال قبل فناءه- ولا البخل في مال الشحيح يزيد
—বদান্যতা সম্পদ বিনাশ করে না ধ্বংসের পূর্বে, আর কৃপণতা বৃদ্ধি সাধন করে না কৃপণের সম্পদে।
فلا تلتمس مالا بعلبش لقتر لكل غد رزق يعود جديد
—অনটনে জীবন যাপনের জন্য সম্পদ কামনা করবে না, সকল নতুন দিনের জন্য নতুন জীবিকা আছে, যা আসবেই।
الم تران المال غاد وائح - وان الذي يعطيك غير بعيد
—তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, সম্পদ সকালে আসে আর বিকালে চলে যায়, আর তোমাকে যিনি দান করেন তিনি তো মোটেই দূরে নন।
কাযী আবুল ফারজল বলেন, হাতিম তাঈ কী চমৎকার কথাই না বলেছেন, তোমাকে যিনি দিয়ে থাকেন তিনি মোটেই দূরে নন। তিনি যদি ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলে পরকালে তার মুক্তির আশা করা যেতো। আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবে বলেছেনঃ
و اسئلوا الله من فضله
—তোমরা আল্লাহর নিকট তাঁর অনুগ্রহ ভিক্ষা কর। (৪ নিসাঃ ৩২) আল্লাহ আরো বলেনঃ
—আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করলে (তুমি বলবে) আমি তো নিকটেই আছি। আহ্বানকারী যখন আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দেই। ( ২ বাকারাঃ ১৮৬)।
ওয়াযাহ ইবন মা’বাদ আত-তাঈ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ হাতিম তাঈ একদা নুমান ইবন মুনযির এর অতিথি হলে তিনি অতিথিকে সসম্মানে বরণ করে নেন, নিকটে বসান এবং ফিরে যাওয়ার সময় তাঁকে দুই উট বোঝাই স্বর্ণ-রৌপ্য দান করেন। এ ছাড়াও তিনি অনেক দেশীয় উপহার সামগ্রী দান করেন। সে সব সামগ্রী নিয়ে তিনি প্রস্থান করেন। তিনি স্বজনদের নিকটবর্তী হলে তার কবীলার বেদুইনদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। তারা বললোঃ হে হাতিম! তুমি তো এসেছ বাদশাহের নিকট থেকে আর আমরা এসেছি স্বজনদের নিকট থেকে দারিদ্র্য নিয়ে। তখন হাতিম বললেনঃ এসো, আমার সম্মুখে যা কিছু আছে তা নিয়ে যাও। তারা তার সম্মুখ থেকে ছোবল মেরে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই ভাগ-বণ্টন করে নেয়। এমনকি তার সম্মুখ থেকে নুমানের প্রদত্ত সমস্ত বিশেষ উপটৌকনও তারা বণ্টন করে ফেলে। এসময় হাতিমের দিকে এগিয়ে আসে তার দাসী তরীফা এবং বলে, ‘আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজের জন্যও কিছু অবশিষ্ট রাখ। এরা তো দেখছি দীনার-দিরহাম আর উট-ছাগল-ভেড়া কিছুই বাদ দেবে না।’ তখন তিনি বলেনঃ
قالت طريفة ماتبقى دراهتنا - وما بناسرف فيها ولا خزق
—তরীফা বললো, থাকবেনা আমাদের একটা দিরহামও আমাদের তো অপচয় করার বা দান করার কিছুটা রইলো না।
ان يفن ما عندنا فالله يرزقنا - ممن سوانا ولسنا نحن نرتزق
—আমাদের নিকট যা আছে তা ফুরিয়ে গেলেও আল্লাহ দেবেন আমাদেরকে জীবিকা, এমন লোকদের নিকট থেকে, যারা আমাদের অন্তর্গত নয়। আমরা তো নিজেরা নিজেদের জীবিকা দাতা নই।
مايالف الدرهم اسکاری خرقتنا- ألا يمر عليها ثم ينطلق
—জোড়া লাগাতে পারেনা আমাদের ক্ষয়িষ্ণু দিরহাম আমাদের ছিন্ন বস্ত্রকে তবে কিনা তার উপর দিয়ে বয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত চলে যায়।
إنا اذا اجتمعت يوما دراهمنا - ظلت الى سبل المعروف تستبق
—কোন দিন যদি একত্র হয় আমাদের দিরহাম তাহলে আমরা এমন যে, আমাদের দিরহাম প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে যায় কল্যাণকর কাজে।
আবু বকর ইব্ন আইয়াশ বলেনঃ একদা হাতিম তাঈকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আরবে কি আপনার চাইতে অধিকতর বদান্যশীল কেউ আছেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি আরবই আমার চেয়ে বড় দাতা।’ অতঃপর তিনি বলতে শুরু করেন, এক রাত্রে আমি আরবের এক এতীম বালকের অতিথি হলাম। এতীম বালকটির ছিল একশ ছাগল। সেখান থেকে সে আমার জন্য একটা বকরী জবাই করলো। এবং তা পাক করে আমার নিকট উপস্থিত করলো। বালকটি আমার নিকট বকরীর মগজ উপস্থিত করলে আমি তাকে বললাম-কতই না মজাদার এ মগজ। তিনি বলেন, এ ভাবে সে (এক এক করে বার বার) মগজ আনতে থাকে। অবশেষে যখন ভোর হলো সে একশ টা বকরীই জবাই করে ফেলেছে। তার কাছে আর একটিও নেই। হাতিমকে তখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তখন আপনি কী করলেন?’ তিনি বললেনঃ ‘সব কিছু করেও কী করে আমি তার পূর্ণ শুকরিয়া আদায় করতে পারতাম?’ তিনি বললেন, ‘যাই হোক আমার উৎকৃষ্ট উষ্ট্রগুলোর মধ্য থেকে তাকে আমি একশ’ উষ্ট্রী দান করলাম।
মুহাম্মদ ইবন জাফর আল-খারাইতী তাঁর ‘মাকারিমুল আখলাক’ গ্রন্থে তাঈ গোত্রের জনৈক বৃদ্ধার বরাতে বলেন, হাতিম তাই এর মাতা আনতারা বিনতি আফীফ ইবন আমর ইবন ইমরাউল কায়েস বদান্যতা-দানশীলতার কোন কিছুই বাদ দিতেন না। তার ভাইয়েরা তাঁকে বারণ করতো, তিনি তাদের বাধা মানতেন না। আর তিনি ছিলেন ধনাঢ্য মহিলা। ফলে তার লোকজন তাকে একটা ঘরে এক বছর বন্দী করে রাখে এবং সেখানে তাকে প্রাণে বাঁচার। পরিমাণ মতো খাদ্য সরবরাহ করে, যাতে তিনি তার বদান্যতা থেকে বিরত থাকেন। এক বছর পর তারা তাঁকে সেখান থেকে বের করে আনে। তাদের ধারণা ছিল হয়তো তিনি আগের অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তার লোকজন তার সম্পদ থেকে একখণ্ড রৌপ্য মহিলার নিকট সমর্পণ করে এবং বলে এগুলো ভোগ-ব্যবহার করবে। একদা হাওয়াযিন গোত্রের এক মহিলা তার নিকট আগমণ করে। তিনি তখন তার সম্পদ লুকিয়ে রাখেন। আগন্তুক মহিলাটি তার নিকট যাচ্ঞা করে। তখন তিনি বলেন, সম্পদের এই রৌপ্য খণ্ডটি তুমি নিয়ে যাও। আল্লাহর কসম, আমার এমন ক্ষুধার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোন প্রার্থীকে বিমুখ করব না বলে আমি শপথ করেছি। তখন তিনি আবৃত্তি করতে শুরু করেনঃ
لعمري لقد ما عضنی الجوع عضة - فاليت أن لا أمنع الدهر جائعا
—আমার জীবনের শপথ; ক্ষুধা আমাকে এমনই আঘাত করেছে যে, আমি শপথ করেছি জীবনে কোন ক্ষুধাতুরকে বিমুখ করবো না।
فقولا لهذا اللعين اليوم اعفني - وان انت لم تفعل فعض الاصابعا
—তাই আজ তোমরা এই ভৎসনাকারীকে বলো আমাকে মাফ কর; আর তা না করলে আঙ্গুল কামড়াও।
فماذا عساكم ان تقولوا لاختكم – سوی عذلكم او عذل من كان مانعا
—তবে কি তোমরা বা তোমাদের মত নিবৃত্তকারীরা তোমাদের বোনকে ভৎসনা ছাড়া অন্য কিছু বলবে বলে কি আশা করা যায়,
وماذا ترون اليوم الاطبيعة - فكيف بترکی يا ابن امي الطبائعا
—আজ তোমরা যা দেখছ, তাতো আমার স্বভাব। তবে হে মোর মায়ের সন্তান! কিরূপে আমি আমার স্বভাব বিসর্জন দিতে পারি?
হায়ছাম ইবন আদী আদীর বরাতে বলেনঃ আমি হাতিমের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি নিজেকে ভৎসনা করছিলেন। আমাকে বললেন, ‘বৎস! আমি মনে মনে তিনটি অভ্যাসের প্রতিজ্ঞা করছি। আল্লাহর কসম, আমি প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে কোন সন্দেহজনক আচরণ করিনি কখনো। আমার নিকট যে আমানত রাখা হয়েছে, তা অবশ্যই ফেরৎ দান করেছি এবং আমি কোন দিন কারো মনে কষ্ট দেইনি।’ আবু বকর আল-খারাইতী বলেনঃ আলী ইবন হারব আবু হুরাইরার আযাদকৃত গেলাম মুহাররার থেকে বর্ণনা করেন আবদুল কায়েস গোত্রের একদল লোক হাতিম তাঈ’র কবরের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অবতরণ করে। ঐ দলের আবুল খায়বারী নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার কবরে পায়ের খোঁচা দিয়ে বলেনঃ ‘হে আবু জা’দ! আমাদের মেহমানদারী করুন।’ তখন জনৈক সঙ্গী তাকে বলে, ‘তুমি কি হাড্ডির সঙ্গে কথা বলছ, তাতো পঁচে-গলে গেছে।’ তারপর রাত হলে তারা সকলে ঘুমিয়ে পড়লো। উক্ত আবুল খায়বারী ব্যাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন – ‘হে আমার সম্প্রদায়! নিজ নিজ সওয়ারী গ্রহণ কর। কারণ, হাতিম স্বপ্নে আমার নিকট আগমন করে আমাকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন। আমি তা মুখস্থ করেছি। তিনি বলেনঃ
ابا الخيبري وانت امرؤ ظوم العشيرة شتامها
—হে আবুল খায়বারী! তুমি তো এমন এক ব্যক্তি যে স্বজনের প্রতি অবিচার করে ও তাদেরকে গালমন্দ করে।
اتيت بصحبك تبغي القرى الذى حفرة قد صدت هامها
—তুমি আগমন করেছ সঙ্গী সাথী নিয়ে কামনা কর তুমি আতিথেতায় কবরবাসীর নিকট, যার মাথার খুলিতে মারিচা ধরে গেছে।
اتبغي لي الذنب عند المبيت وحولك طى والعامها
—তুমি কি কামনা কর আমার জন্য পাপ রাত্রি যাপনকারীর নিদ্রা কালে। অথচ তোমার নিকট রয়েছে তাঈ গোত্র আর তার পশুকুল।
وانا لنشبع أضيافنا وتاتي المطي فنعتامها
—আমরা অবশ্যই তৃপ্ত করবো আমাদের অতিথিদেরকে রজনীতে আগমন ঘটবে আমাদের উষ্ট্রীর এবং তা দোহন করবো।
বর্ণনাকারী বলেন, তখন হঠাৎ করে উক্তিকারীর উস্ত্রী আহত হয়ে আগমন করলে তারা তাকে যবাই করে এবং তৃপ্ত হয়ে যায়। তারা বলে, আল্লাহর কসম, হাতিম জীবিত আর মৃত অবস্থায় আমাদের মেহমানদারী করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, ভোরে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের সঙ্গী-সাথী নিয়ে সওয়ার হয়ে গমন করে। তখন জনৈক ব্যক্তি সওয়ার হয়ে আসছিল এবং তাদেরকে উঁচু স্বরে আহ্বান করছিল আর তার সাথে ছিল আরেকটি উট। তখন লোকটি বলে, ‘তোমাদের মধ্যে কে আবুল খায়বারী?’ তিনি বললেন, ‘আমি।’ লোকটি বললো, ‘হাতিম রজনীতে স্বপ্নে আমার কাছে এসে বলেন যে, তিনি তোমার সঙ্গীদের তোমার উট দিয়ে মেহমানদারী করেছেন এবং তোমার নিকট এ উট নিয়ে আসার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই হলো সে উট। তা নাও এবং এই বলে তাকে উটটি দিয়ে দিল।’
আবদুল্লা ইবন জাদ’আন -এর কিছু বৃত্তান্তঃ
তিনি আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন ইবন আমর ইবন কা’ব ইব্ন সাআদ ইবন তাইম ইবন মুররাহ, যিনি ছিলেন বনূ তাইমের নেতা এবং তিনি ছিলেন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর চাচাতো ভাই। তিনি ছিলেন জাহিলী যুগের অন্যতম দাতা ও দয়ালু। জাহিলী যুগে যারা বয়স্কদেরকে খাদ্য দান করতো, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তাঁর নিজের হাতে ছিল তাঁর ব্যাপার। তিনি আহার্য দান করতেন তীব্র দারিদ্র্যক্লিষ্ট ফকীর ব্যক্তিকে। তিনি এমনই দুষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলেন যে, অনেক অপরাধ সংগঠন করেন। এর ফলে জাতি, বংশ-গোত্র পাড়া প্রতিবেশী সকলেই তাকে ঘৃণা আর নিন্দার চোখে দেখতো। সকলের ঘৃণা-নিন্দা আর বর্জনের মুখে একদিন তিনি বিচলিত হয়ে মক্কার গিরিপথে বেরিয়ে পড়েন। পর্বতের মধ্যে একটা গর্ত দেখে তিনি মনে করলেন, এতে ক্ষতিকর কিছু থাকতে পারে। তিনি সেখানে গেলেন এই আশায় যে, হয়তো সেখানে মারা গিয়ে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি গর্তের নিকট গমন করলে একটা আযদাহা তার দিকে ছুটে আসে। আযদাহাটি তাকে দংশন করতে উদ্যত হয়। তিনি তা থেকে দূরে সরে গিয়ে বরং তার উপর হামলা করতে উদ্যত হন। কিন্তু তিনি আযদাহাটির নিকট এসে দেখতে পেলেন যে, তা-তো স্বর্ণের আর তার চক্ষু মুক্তার। তিনি তা ভেঙ্গে চুরে গর্তে নিয়ে যান। গর্তে প্রবেশ করে দেখেন যে, সেখানে রয়েছে জুরহাম গোত্রের শাসকদের কবর। তাদের মধ্যে হারিস ইবন মুযাযও রয়েছেন, যিনি দীর্ঘ দিন অন্তর্ধানে ছিলেন। ফলে তিনি কোথায় কি অবস্থায় আছেন, কিছুই জানা যায় না। তিনি তাদের মাথার দিকে একটা ফলক দেখতে পান, যাতে তাদের মৃত্যুর তারিখ লেখা রয়েছে। সে ফলকে তাদের রাজত্বকালও লেখা আছে। লাশ গুলোর নিকট রয়েছে মণি-মুক্তা সোনা-রুপা অনেক কিছু। তিনি সেখান থেকে নিজের প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করে বেরিয়ে পড়েন। গর্তের দরজা সম্পর্কেও তিনি জ্ঞান লাভ করলেন। জাতির লোকজনের নিকট ফিরে এসে তিনি তাদেরকে সে সব থেকে দান করেন। ফলে তারা তাঁকে ভালোবাসে নেতা বানায় আর তিনিও জাতির লোকজনকে আহার করান। হাতের সম্পদ ফুরিয়ে গেলে তিনি আবার সে গর্তে গমন করে প্রয়োজন পরিমাণ নিয়ে আসতেন। যাদের নিকট থেকে আমরা এ কাহিনী উল্লেখ করছি, তাদের মধ্যে আছেন আবদুল মালিক ইবন হিশাম। তিনি ‘কিতাবুত তীজান’-এ এ কাহিনী উল্লেখ করেছেন। তার রচিত কিতাবের নাম হচ্ছে,
دی العاطش وانس الواحش
তার একটা বড় পেয়ালা ছিল। আরোহী ব্যক্তি সওয়ারীর পৃষ্ঠে বসে এ পেয়ালায় আহার করতো। পেয়ালাটা এমনই বড় ছিল যে, তাতে একজন ছোটখাট মানুষ পতিত হলে ডুবে যেতো।
ইবন কুতাইবা প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন-এর ডেগছির ছায়ায় আমি আশ্রয় নিতাম। তা ছিল এক লিখিত দলীল- অর্থাৎ দুপুরের সময়। আবু জহল এর হত্যার হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে বলেনঃ নিহত ব্যক্তিদের লাশের মধ্যে তোমরা তাকে খুঁজবে। হাঁটুতে আঘাতের চিহ্ন দ্বারা তোমরা তাকে চিনতে পারবে। কারণ, সে এবং আমি আবদুল্লাহ ইবন জাদ’আন এর দস্তরখানে মল্ল যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে সে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে আঘাত পায় এবং তা ভেঙ্গে যায়। তার হাঁটুতে এখনো সে চিহ্ন বর্তমান রয়েছে। রাসূল (সা) যেমন বলেছেন, তাকে তেমনই পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন জাদআন খেজুর আর ছাতু খেতেন এবং দুধ পান করতেন। তিনি উমাইয়া ইবন আবুছ ছালত এর এ উক্তি শ্রবণ করেন -
ولقد رئت الفاعلين وفعلهم - فرأيت اكرمهم بني الديان
—কথা আর তাদের কর্ম আমি দেখেছি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত পেয়েছি আমি বনু দাইয়্যানকে
البر بلبك بالشهاد طعام هم - لا مابعلت لنا بنوجدعان
“নেকী তোমায় জ্ঞানী করে তাদের খাদ্যে উপস্থিতি দ্বারা, তদ্বারা নয়, বনূ জাদ’আন যে লা’নত করে।” অতঃপর জাদ’আন পুত্র শাম দেশে দু’ হাজার উষ্ট্র বোঝাই গম, মধু এবং ঘী প্রেরণ করে। প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী কা’বার পৃষ্ঠ থেকে ঘোষণা দেয়, ইবন জাদ’আন-এর ডেকের দিকে তোমরা ছুটে এসো। এ প্রসঙ্গে উমাইয়্যা বলেনঃ
له داع بمكة مشمعل - وآخر فوق لعبتها نیادی
—তার জন্য মক্কায় আছেন একজন আহ্বানকারী মশালবাহী, অপরজন আছেন কা’বার ছাদে, যিনি আহ্বান করেন।
الى ردح من الشيزی ملا -- لباب البر يلبك بالشهاد
—আহ্বান জানায় দীর্ঘ সময় থেকে কালো কাষ্ঠ নির্মিত পূর্ণ পাত্র পানে, জ্ঞানের দ্বার পানে, যা সাক্ষ্য দ্বারা তোমাকে জ্ঞানী করে।
এতসব কিছু সত্ত্বেও সহীহ মুসলিমে উল্লেখিত আছে যে, “আয়েশা সিদ্দীকা (রা) বলেছেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, জাদ’আন পুত্র আহার করাতেন এবং অতিথির মেহমানদারী করতেন। এতে কি তার কোন উপকার হবে? কিয়ামতের দিন এসব কি তার কোন কাজে আসবে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, না সে তো কোন দিন একথা বলেনি-হে পালনকর্তা, কিয়ামতের দিন আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/489/77
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।