মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
“আমি লুকমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তো তা করে নিজেরই জন্যে এবং কেউ অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, প্রশংসাহ। স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশস্থলে তার পুত্রকে বলেছিল, হে বৎস! আল্লাহর কোন শরীক করো না, নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম। আমি তো মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ান হয় দু’বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই। তুমি তাদের কথা মানো না তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সৎভাবে এবং যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবহিত করব। হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং সেটি যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মাটির নিচে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত। হে বৎস! সালাত কায়েম কর সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে আর অসৎ কর্মে নিষেধ করবে এবং আপদে-বিপদে ধৈর্যধারণ করবে। এটিই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ। অহংকার বলে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করবে না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।
তুমি পা ফেলবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিশ্চয় সুরের মধ্যে গর্দভের সুরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।”
আলোচ্য লুকমান হলেন লুকমান ইবন আনকা ইবন সাদূন। কেউ কেউ বলেন, লুকমান বলেন, লুকমান ইবনে ছারান। শেষোক্ত মতটি বর্ণনা করেছেন সুহায়লি ইবনে জারির ও কুতায়বি থেকে। সুহায়লি বলেন, লুকমান ছিলেন আয়লা গোত্রের নূবীয় সাম্প্রদায়ের লোক। আমি বলি, লুকমান একজন ইবাদতগুযার, বাগ্মী, প্রজ্ঞাবান ও পুণ্যবান ব্যক্তি। কেউ কেউ এও বলেছেন যে, লুকমান ছিলেন হযরত দাউদ (আ)-এর যুগের একজন কাযী। আল্লাহই ভাল জানেন।
সুফিয়ান ছাওরী....ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন, লুকমান ছিলেন জনৈক আবিসিনীয় দাস, পেশায়। নাজ্জার বা সূত্রধর কাতাদা আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, লুকমান সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত আপনাদের অভিমত কি নাজ্জার বা সুত্রধর তিনি বললেন, লুকমান ছিলেন খর্বাকৃতি এবং নূবী গোত্রস্থিত চ্যাপ্টা নাক বিশিষ্ট লোক। ইয়াহয়া ইবন সাঈদ আনসারী সাঈদ ইবন মুসায়্যাব থেকে বর্ণনা করেন, লুকমান ছিলেন মিসরীয় কৃষ্ণকায় লোক। তার ওষ্ঠাধর ছিল মোটা ও পুরু; আল্লাহ তাআলা তাঁকে হিকমত ও প্রজ্ঞা দিয়েছিলেন, নবুওত দান করেন নি। আওযায়ী বলেন, আবদুর রহমান ইবন হারমালা বলেছেন জনৈক কৃষাঙ্গ ব্যক্তি সাঈদ ইবন মুসায়্যাব (রা)-এর নিকট এসে কিছু জিজ্ঞাস করলেন...তিনি বললেন, তুমি কৃষ্ণাঙ্গ বলে দুঃখ করো না। কারণ, তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠতম মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তারা হলেন, হযরত বিলাল (রা), হযরত উমার (রা)-এর আজাদকৃত দাস মাহজা' (রা) এবং লুকমান হাকীম। তৃতীয় লুকমান ছিলেন কৃষ্ণকায় নূবীয় বংশোদ্ভূত পুরু ওষ্ঠাধর বিশিষ্ট লোক।
তাফসীরকার মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণিত, লুকমান ছিলেন কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস। ঠোঁট দুটো পুরু এবং পা দুটো ফাটা। এক বর্ণনায় আছে, তিনি ছিলেন চ্যাপ্টা পা বিশিষ্ট।
উমর ইবন কায়স বলেন, লুকমান ছিলেন একজন কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস। ঠোট দু'টো পুরু, পা দুটো চ্যাপ্টা। তিনি যখন লোকজনকে উপদেশ দিচ্ছিলেন এমন সময় একজন লোক এসে বলল, ‘আপনি না আমার সাথে অমুক অমুক স্থানে বকরী চরিয়েছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ লোকটি বলল, ‘তাহলে আমি এখন যা দেখছি, এ পর্যায়ে আপনি উন্নীত হলেন কেমন করে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সত্য বলা এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মৌনতা অবলম্বনের মাধ্যমে।’ এ বর্ণনাটি ইবন জারীরের। ইবন আবী হাতিম আবদুর রহমান ইবন আবী ইয়াযীদ ইবন জাবির থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, লুকমান হাকীমের হিকমত ও প্রজ্ঞার বদৌলতে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তাঁর পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁকে দেখে বলল, ‘আপনি কি অমুকের ক্রীতদাস ছিলেন না? আপনি কি পর্বে বকরী চরাতেন না?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ লোকটি বলেন, ‘কিসে আপনাকে আমার দেখা এ পর্যায়ে উন্নীত করল?’ তিনি বললেন, ‘তকদীরের লিখন, আমানতদারী, সত্যবাদিতা ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় বর্জন।’
‘আফরার আযাতকৃত দাস উমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি লুকমান হাকীমের নিকট উপস্থিত হয় এবং সে বলে, ‘আপনি তো বনী নুহাস গোত্রের ক্রীতদাস লুকমান?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। লোকটি বলল, ‘আপনি সেই কৃষ্ণকায় বকরী চরানো ব্যক্তিই তো?’ তিনি বললেন, ‘আমার কালোবর্ণ বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার কোন বিষয়টি আপনাকে বিস্মিত করছে?’ সে বলল, ‘তা এই যে, লোকজন আপনার কছে জড়ো হচ্ছে, আপনার দরজা ওদেরকে আচ্ছাদিত করছে এবং আপনার বক্তব্যে তারা প্রীতও হচ্ছে।’ লুকমান বললেন, ‘ভাতিজা! আমি তোমাকে যা বলবো, তুমি যদি তা কর তবে তুমিও আমার মত হতে পারবে।’
সে বলল, ‘তা কী?’ লুকমান বললেন, ‘আমি আমার দৃষ্টি অবনত রাখি। আমার জিহবা সংযত রাখি। আমার পানাহার ও যৌনাচারের ব্যাপারে আমি সংযম অবলম্বন করি। আমার দায়িত্ব পালন করি। অঙ্গীকার পূরণ করি। মেহমানদেরকে সম্মান করি। প্রতিবেশীদের হক আদায় করি। অপ্রয়োজনীয় বিষয় বর্জন করি। এ কর্মগুলোই আমাকে এ পর্যায়ে এনে পৌঁছিয়েছে, যা তুমি দেখতে পাচ্ছ।’
ইবন আবী হাতিম …...আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত। লুকমান হাকীমের আলোচনায় একদিন তিনি বললেন, তাঁর না ছিল উল্লেখযোগ্য পরিবার-পরিজন, না ধন-সম্পদ, না কোন বংশ-মর্যাদা, কোন বৈশিষ্ট্য। তবে তিনি ছিলেন সুঠামদেহী নীরবতা অবলম্বনকারী, চিন্তাশীল, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণকারী। দিনের বেলা তিনি কখনও ঘুমাতেন না, তাকে কেউ থুথু ফেলতে দেখেনি, দেখেনি কাশি দিতে, পেশাব-পায়খানা করতে, গোসল করতে কিংবা বাজে কাজকর্ম করতে এবং কেউ তাকে হাসতেও দেখেনি। খুব গভীর কোন জ্ঞানের কথা না হলে বা কেউ জিজ্ঞাসা না করলে তিনি কখনও তাঁর বক্তব্য পুনঃউচ্চারণ করতেন না।
তিনি বিবাহ করেছিলেন এবং তার একাধিক সন্তানও জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এদের মৃত্যুতে তিনি কাঁদেননি। তিনি রাজা-বাদশাহ ও আমীর-উমরাদের নিকট যেতেন তাদের অবস্থা দেখার জন্যে, চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে এবং ওদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্যে। ফলে তিনি এ মর্যাদার অধিকারী হন।
কেউ কেউ বলেন যে, তাকে নবুওত গ্রহণের এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। তিনি নবুওতের গুরু দায়িত্ব পালনে শংকিত হলেন। তাই তিনি হিকমত তথা প্রজ্ঞাকেই বেছে নেন। কারণ, এটি ছিল তাঁর নিকট সহজতর। এ মন্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আল্লাহই ভাল জানেন। এটা হযরত কাতাদা (রা) থেকে বর্ণিত। আমরা পরে তা উল্লেখ করব। ইবন আবী হাতিম ও ইবন জারীর ইকরামা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, লুকমান নবী ছিলেন। বর্ণনাকারী জাবির জুফী এর কারণে এই বর্ণনাটি দুর্বল বর্ণনারূপে গণ্য করা হয়।
জমহুর তথা অধিকাংশ উলামা-ই-কিরামের মতে লুকমান ছিলেন প্রজ্ঞাময় ও বিচক্ষণ একজন ওলী। তিনি নবী ছিলেন না। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে হযরত লুকমানের কথা উল্লেখ করে তাঁর প্রশংসা করেছেন। হযরত লুকমান তার প্রাণপ্রিয় ও সর্বাধিক স্নেহধন্য পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে তাও উল্লেখ করেছেন। লুকমান তার পুত্রকে প্রথম যে উপদেশটি দেন, তাহলোঃ
“হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম।” তিনি পুত্রকে শিরক করতে নিষেধ করলেন এবং সতর্ক করে দিলেন। ইমাম বুখারী ... আব্দুল্লাহ সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ
“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি- আয়াত যখন নাযিল হল, তখন সাহাবা (রা)-এর নিকট এটি গুরুতর বলে মনে হল। তাঁরা বললেন, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তার ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আয়াত দ্বারা তা বুঝানো হয়নি। তোমরা কি লুকমানের উপদেশ শুননি? তিনি বলেছিলেনঃ
“হে বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় শিরক করা চরম জুলুম। ইমাম মুসলিম (র) মুসলিম ইবন মিহরান আল আ’মাশ থেকে উক্ত হাদীছখানা উদ্ধৃত করেছেন।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা প্রসঙ্গক্রমে পিতামাতা সম্পর্কে তার নির্দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সন্তানের ওপর পিতামাতার অধিকারের কথা, তারা মুশরিক হলেও তাদের প্রতি সদাচরণের কথা এবং তাদের দীন কবুল করার ব্যাপারে তাদের আনুগত্য না করার কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর পুত্রের প্রতি লুকমানের এ উপদেশের কথা উল্লেখ করেছেনঃ
“হে বৎস! কোন কিছু যদি সর্ষের দানা পরিমাণও হয় এবং সেটি যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে অথবা মাটির নিচে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবগত।”
এর দ্বারা লুকমান তার পুত্রকে মানুষের প্রতি জুলুম করতে বারণ করলেন। জুলুম যদিও সর্ষে দানা পরিমাণও হয়। কারণ, আল্লাহ তা’আলা জুলুম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জুলুমকে হিসাব নিকাশকালে হাজির করবেন এবং আমলের পাল্লায় রাখবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“এবং কিয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায় বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও আমি সেটি উপস্থিত করব। হিসাব গ্রহণকারী রূপে আমিই যথেষ্ট। (২১ আম্বিয়াঃ ৪৭)
এর দ্বারা জানিয়ে দেয়া হল যে, জুলুম দৃষ্টিতে তিল পরিমাণ ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ হলেও এবং তা দরজা জানালাহীন এমন কি ছিদ্র বিহীন কঠিন পাথরের মধ্যে রাখা হলেও অথবা বিশাল ও বিস্তৃত এই অসীম আসমানের গহীন অন্ধকার স্থান থেকে কোন বস্তুতে পতিত হলেও আল্লাহ তা’আলা সেটি সম্পর্কে অবগত থাকেন।
( إِنَّ ٱللَّهَ لَطِیفٌ خَبِیر ࣱ)
[Surah Luqman 16]
অর্থঃ “আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবহিত।”
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইলম অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তাই সাধারণতঃ যা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, সেই অণু পরিমাণ বিষয়ও তাঁর অগোচরে থাকে না।
“তার অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্য কণাও অংকুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’ (৬ আনআমঃ ৫৯)
“তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত, আকাশরাজি ও পৃথিবীতে তাঁর অগোচর নয় অণু পরিমাণ কিছু, কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু, বরং এর প্রত্যেকটি লিপিবদ্ধ আছে সুস্পষ্ট কিতাবে”
সুদ্দী (র) কতিপয় সাহাবীর (রা) বরাতে বলেন, পূর্বোল্লেখিত আয়াতে ‘সাখরা’ শব্দটি দ্বারা সাত যমীনের নিচে অবস্থিত পাথর বুঝানো হয়েছে। আতিয়্যা আওফী, আবু মালিক ছাওরী ও মিনহাল ইবন উমর (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এই অভিমতের বিশুদ্ধতায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এ ছাড়াও পাথর দ্বারা পৃথিবীর তলদেশের পাথর বুঝানোর ব্যাপারটিও সন্দেহমুক্ত নয়। কেননা, উক্ত আয়াতে ( صخرة ) শব্দটি অনির্দিষ্ট জ্ঞাপক। এটি দ্বারা তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ঐ পাথরটি বুঝানো হলে নির্দিষ্ট বাচক ( الحجره ) শব্দটি ব্যবহৃত হত। বস্তুতঃ আয়াতে এ অর্থ যে কোন পাথর, যেমনটি ইমাম আহমদ (র) আবু সাঈদ খুদরী (র) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
لوان أحدكم يعمل في صخرة صماء ليس لها باب ولا گوة لخرج عمله للناس كائنا ما كان
–“তোমাদের কেউ যদি দরজা ও ছিদ্রহীন পাথরের মধ্যেও কোন আমল করে তাও মানুষের সম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়বে, আমলটি যে পর্যায়েরই হোক না কেন।
এরপর হযরত লুকমান তাঁর পুত্রকে বললেনঃ
( یَـٰبُنَیَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ )
[Surah Luqman 17]
“হে বৎস! নামায কায়েম কর। অর্থাৎ সকল নিয়ম নীতি সহকারে ফরজ, ওয়াজিব, ওয়াক্ত, রুকু সিজদা, ধীর-স্থির ও বিনয় সব কিছুর প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং এতদসম্পর্কিত শরীয়তের নিষিদ্ধ বিষয়াদি পরিহার করে পূর্ণাঙ্গ রূপে নামায আদায় কর।
“সৎকর্মের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কর্মে নিষেধ করবে। অর্থাৎ নিজে শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী তা করবে। হাতে তথা বল প্রয়োগে বাধা দেয়ার ক্ষমতা থাকলে বল প্রয়োগে বাধা দিবে। নতুবা মুখে, তাতেও সমর্থ না হলে অন্তরে। এরপর পুত্রকে নির্দেশ দিলেন ধৈর্য ধারণের। বললেনঃ
( وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَاۤ أَصَابَكَ )
[Surah Luqman 17]
“বিপদে আপদে ধৈর্য ধারণ করো" এ নির্দেশ এ কারণে দিলেন যে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে গেলে সাধারণতঃ বাধা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। তবে এর পরিণাম উৎকৃষ্ট। এটি সর্বজনবিদিত যে, সবুরে মেওয়া ফলে। হযরত লুকমান বলেনঃ
( إِنَّ ذَ ٰ لِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ )
[Surah Luqman 17]
–“এটিতো দৃঢ় সংকল্পের কাজ, এটি অপরিহার্যও বটে”
তিনি বললেনঃ
( وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ )
[Surah Luqman 18]
অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। হযরত ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, ইকরামা, সাঈদ ইবন জুবায়র, যাহ্হাক, ইয়াযীদ ইবন আসাম, আবুল যাওয়া ও অন্যরা বলেছেন যে, এর অর্থ হল মানুষের প্রতি অহংকারী হয়ো না। এবং লোকজনের সাথে কথা বলার সময় তাদের প্রতি গর্ব ভরে ও অবজ্ঞা বশে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না।
ভাষাবিদগণ বলেছেন, ( الصحر ) হচ্ছে উটের ঘাড়ের একটি রোগ বিশেষ, যাতে তার মাথা ঝুঁকে পড়ে। অহংকারী ব্যক্তি যে লোকের সাথে কথা বলতে গেলে দম্ভ ভরে তার মুখমণ্ডল অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখে, তাকে ঐ উটের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
“এবং পৃথিবীতে ঊর্ধ্বভাবে বিচরণ করো না। কারণ, আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” তিনি তাঁর পুত্রকে মানুষের সম্মুখে দম্ভ অহংকর ও ঔদ্ধত্য সহকারে পথ চলতে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভাবে বিচরণ করো না, তুমি কখনই পদভারে ভূ-পৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” (১৭ ইসরাঃ ৩৭)
অর্থাৎ তুমি তোমার দ্রুতগতি সম্পন্ন পথ চলায় সকল শহর, নগর অতিক্রম করে যেতে পারবে না, তোমার পদাঘাতে পৃথিবীকে বিদীর্ণ করতে পারবে না, আর তোমার বিশালত্ব অহংকার ও উচ্চতায় তুমি পাহাড়ের সমান উঁচু হতে পারবে না। সুতরাং নিজের প্রতি তাকাও এবং বুঝে নাও যে, তুমি তোমার সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।
হাদীছ শরীফে আছে, এক ব্যক্তি দু’টো কাপড় পরে গর্ব ভরে পথ চলছিল। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে ভূমিতে প্রোথিত করে দিলেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে নিচের দিকে প্রোথিত হতে থাকবে। অপর এক হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
اياك و اسبال الازار فانما من المجلة لايجبها الله
“গোড়ালীর নিচ পর্যন্ত লুঙ্গি ঝুলিয়ে দেওয়া থেকে তুমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ। কেননা তা অহংকারের পরিচায়ক আল্লাহ তা পছন্দ করেন না।”
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَال ࣲ فَخُور
“আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না”
পথ চলতে অহংকার প্রদর্শন থেকে বারণ করার পর লুকমান তাঁর পুত্রকে মধ্যম গতিতে পথ চলতে নির্দেশ দিলেন। কারণ, পথ চলাতো লাগবেই। তিনি এ বিষয়ে পুত্রকে মন্দ দিক সম্পর্কে নিষেধ করলেন এবং কল্যাণকর দিকটি অবলম্বনের নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেনঃ
( وَٱقۡصِدۡ فِی مَشۡیِكَ )
[Surah Luqman 19]
“পথ চলার মধ্য পন্থা অবলম্বন কর” অর্থাৎ খুব মন্থরগতি কিংবা খুব দ্রুতগতির কোনটাই অবলম্বন করবে না। বরং মধ্যম গতি অবলম্বন করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে তখন তারা বলে সালাম”
এরপর লুকমান তাঁর পুত্রকে বললেনঃ
( وَٱغۡضُضۡ مِن صَوۡتِكَ )
[Surah Luqman 19]
“এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর” অর্থাৎ তুমি যখন কথা বলবে তখন প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ স্বরে কথা বলবে না। কারণ, সর্বোচ্চ এবং সর্বনিকৃষ্ট কণ্ঠস্বর হল গাধার স্বর। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাত্রি বেলায় গাধার ডাক শুনলে রাসূলুল্লাহ (সা) আউযুবিল্লাহ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, গাধা শয়তানকে দেখতে পায়। এ জন্যেই বিনা প্রয়োজনে কণ্ঠস্বর উচ্চ করতে নিষেধ করেছেন। বিশেষতঃ হাঁচি দেয়ার সময়। হাঁচির সময় শব্দ নীচু রাখা এবং মুখ ঢেকে রাখা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (সা) এরূপ করতেন বলে হাদীছে প্রমাণ রয়েছে। অবশ্য, আযানের সময় উচ্চস্বরে আযান দেয়া, যুদ্ধের সময় উচ্চ স্বরে আহ্বান জানানো এবং বিপদ-আপদ ও মৃত্যুর আশংকায় উচ্চস্বরে কাউকে ডাকা শরীয়তসম্মত।
হযরত লুকমান (আ)-এর এসব প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য, কল্যাণকর ও অকল্যাণরোধক উপদেশাবলী আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে উল্লেখ করেছেন। হযরত লুকমান (আ)-এর বিবরণ ও উপদেশাবলী সম্পর্কে আরও বহু বর্ণনা রয়েছে। তাঁর বক্তব্য সম্বলিত হিকমত-ই লুকমান নামে তাঁর বলে কথিত একটি পুস্তক পাওয়া যায়। সে পুস্তক হতে কিছু বক্তব্য এখন আমরা উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।
ইমাম আহমদ— ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে জানালেন যে, লুকমান হাকীম বলতেন, আল্লাহ তা’আলা কোন কিছু আমানত রূপে দিলে তিনি তা হিফাজতও করেন।
ইবন আবী হাতিম কাসিম ইবন মুখায়মারা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, “হে বৎস! হিম্মত ও প্রজ্ঞা দরিদ্রদেরকে রাজার আসনে বসিয়েছে। উবাই.... আওন ইবন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। লুকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! তুমি কোন মজলিশে উপস্থিত হলে ইসলামের রীতি অর্থাৎ সালাম দ্বারা তাদের অন্যায় জয় করবে। তারপর মজলিসের এক পাশে বসে পড়বে। ওদের কথা বলার পূর্বে তুমি কোন কথা বলো না। তারা আল্লাহর যিকর ও আল্লাহ সম্পর্কে আলোচনায় নিয়োজিত হলে তুমি তাদের সাথে আলোচনায় অংশ নিবে। তারা যদি অন্য কোন বিষয়ে আলোচনা করে তবে তুমি তাদেরকে ত্যাগ করে অন্যদের কাছে চলে যাবে।’
উবাই হাফস ইবন উমার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত লুকমান (আ) এক থলে সরিষা পাশে নিয়ে তার পুত্রকে উপদেশ দিতে বসেছিলেন। একটি করে উপদেশ দিচ্ছিলেন আর একটি করে সরিষা থলে থের্কে বের করছিলেন। এভাবে তাঁর সব সরিষা শেষ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, ‘হে বৎস! আমি তোমাকে এমন উপদেশ দিলাম, কোন পর্বতকে এ উপদেশ শুনালে সেটি ফেটে চৌচির হয়ে যেত।’ তাঁর পুত্রের অবস্থাও তাই হয়েছিল।
আবু কাসিম তাবারানী ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ
اتجذوا السودان فان لة ثلثة منهم من أهل الجنة لقمان الحكيم والجا شي وبلال المؤن
“তোমরা কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে সুসম্পর্ক রাখ। তাদের তিনজন নিশ্চিতভাবেই জান্নাতী। লুকমান হাকীম, নাজাশী এবং মুয়াযযিন বিলাল (রা)।”
তাবারানী এর ব্যাখ্যায় বলেন, অর্থাৎ বিলাল হাবশী। হাদীছটি একাধারে গরীব ও মুনকার পর্যায়ের। ইমাম আহমদ (র) তাঁর কিতাবুয যুহদ নামক গ্রন্থে হযরত লুকমান (আ) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর তথ্যাদি পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেছেন, ওয়াকীদী মুজাহিদ সূত্রে
( وَلَقَدۡ ءَاتَیۡنَا لُقۡمَـٰنَ ٱلۡحِكۡمَةَ )
[Surah Luqman 12]
“আমি লুকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি” আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, হিকমত অর্থ ধর্মীয় প্রজ্ঞা ও সত্য প্রাপ্তি, নবুওত নয়।
ওহব ইবন মুতানাব্বিহ ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেন লুকমান ছিলেন হাবশী ক্রীতদাস। আসওয়াদ…… সাঈদ ইবন মুসায়্যাব সূত্রে বর্ণিত, লুকমান (আ) পেশায় ছিলেন দর্জি। সাইয়াদ…… মালিক ইবন দীনারকে উদ্ধৃত করে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! তুমি ব্যবসা রূপে আল্লাহর ইবাদতকে বেছে নাও, তাহলে পুঁজি ছাড়াই লাভ পাবে।’ ইয়াযীদ মুহাম্মদ ইবন ওয়াছিকে উদ্ধৃত করে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে লক্ষ্য করে প্রায়ই বলতেন, ‘হে বৎস! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার অন্তর কলুষিত থাকা অবস্থায় মানুষের শ্রদ্ধা অর্জনের জন্যে তুমি আল্লাহকে ভয় করার ভান করো না।’
ইয়াযীদ খালিদ বিরদকে উদ্ধৃত করে বলেন, লুকমান ছিলেন একজন হাবশী ক্রীতদাস। পেশায় ছুতার। তার মালিক তাঁকে একটি বকরী জবাই করতে বলেছিল। সে মতে তিনি একটি বকরী জবাই করেন। বকরীর উৎকৃষ্টতম দুটো টুকরো আনতে মালিক তাঁকে নির্দেশ দেয়। তিনি বকরীটির জিহ্বা ও হৃৎপিণ্ড নিয়ে আসেন। মালিক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এর চাইতে উৎকৃষ্ট কোন অঙ্গ কি এ বকরীতে নেই?’ তিনি বললেন, ‘না।’ মালিক কিছু সময় চুপ করে থাকার পর আবার তাঁকে বললো, ‘আমার জন্যে অপর একটি বকরী জবাই কর।’ তিনি তার জন্যে অপর একটি বকরী জবাই করলেন। মালিক বললো, ‘এটির নিকৃষ্টতম টুকরো দু’টো ফেলে দাও!’ তিনি বকরীটির জিহবা ও হৃৎপিণ্ড ফেলে দিলেন।মালিক বলল, ‘আমি তোমাকে উৎকৃষ্ট দুটো টুকরো আনতে বললাম। তুমি নিয়ে এলে জিহ্বা আর হৃৎপিন্ড। আবার নিকৃষ্টতম দুটো টুকরা ফেলে দিতে বললাম; তুমি জিহ্বা আর হৃৎপিণ্ড ফেলে দিলে, এর রহস্য কি?’ লুকমান বললেন, ‘জিহ্বা ও হৃৎপিণ্ড যতক্ষণ পবিত্র থাকে ততক্ষণ এ দুটো অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কিছু থাকে না। আর এ দু’টো যখন কলুষিত হয়, তখন এ দু’টো অপেক্ষা ঘৃণিত অন্য কিছু থাকে না।’
দাউদ ইবন রশীদ অবু উছমান সূত্রে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, মূর্খদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী হয়ো না। তাহলে সে মনে করবে যে, তার কর্মে তুমি সন্তুষ্ট। বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অসন্তুষ্টিকে তুচ্ছ ভেবো না। তাহলে সে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে।
দাউদ ইবন উসায়দ আবদুল্লাহ ইবন যায়দ সূত্রে বলেন, লুকমান বলেছেনঃ ‘জেনে নাও যে, প্রজ্ঞাবানদের মুখে আল্লাহর হাত থাকে। তিনি যা তৈরি করে দেন, তা ব্যতীত তারা কথা বলেন না।’
আবদুর রায়যাক বলেন যে, তিনি ইবন জুরায়জকে বলতে শুনেছেন, আমি রাতে মাথা ঢেকে রাখতাম। উমর (রা) আমাকে বললেন, ‘তুমি রাতে মাথা ঢেকে রাখ কেন? তুমি কি জানো যে, লুকমান (আ) বলেছেন, দিনের বেলা মাথা ঢেকে রাখা অপমানজনক এবং রাত্রে তা ওযর বা অপারগতার নিদর্শন। তাহলে তুমি রাতে মাথা ঢাক কেন?’ তখন আমি তাকে বললাম, ‘লুকমান (আ)-এর তো কোন ঋণ ছিল না।’ সুফিয়ান বলেন, লুকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! নীরবতা অবলম্বন করে আমি কখনো লজ্জিত হইনি। কথা বলা যদি রূপা হয় তবে নীরব থাকা হচ্ছে সোনা।’
আবদুস সামাদ কাতাদা সূত্রে বলেন, লুকমান তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! মন্দ থেকে দূরে থাক। তাহলে মন্দ তোমা হতে দূরে থাকবে। কারণ মন্দের জন্যেই মন্দের সৃষ্টি। আবু মুআবিয়া উরওয়া সূত্রে বলেন, হযরত লুকমানের প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্যে আছে, ‘হে বৎস! অতিরিক্ত মাখামাখি পরিহার করবে। কারণ, অতিরিক্ত মাখামাখি ঘনিষ্ঠজনকে ঘনিষ্ঠজন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এবং প্রজ্ঞকে ঠিক তেমনি বিলুপ্ত করে দেয়, যেমনটি আগে উচ্ছাস করে থাকে। হে বৎস! অতি ক্রোধ বর্জন কর, কারণ তা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির অন্তঃকরণকে ধ্বংস করে দেয়।’
ইমাম আহমদ উবায়দ ইবন উমায়র সুত্রে বলেন, লুকমান (আ) উপদেশ স্থলে তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! দেখে শুনে মজলিস বেছে নেবে। যদি এমন মজলিস দেখ, যেখানে আল্লাহর যিকর হয়, তবে তুমি তাদের সাথে সেখানে বসবে। কারণ, তুমি নিজে জ্ঞানী হলে তোমার জ্ঞান তোমার উপকার করবে; আর তুমি মূর্খ হলে মজলিসের লোকেরা তোমাকে জ্ঞান দান করবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের ওপর রহমত নাযিল করলে তাদের সাথে তুমিও রহমতের অংশ পাবে।
হে বৎস! যে মজলিসে আল্লাহর যিকর হয় না, সে মজলিসে বসো না। কারণ, তুমি নিজে জ্ঞানী হলে তখন তোমার জ্ঞান তোমার কোন উপকার করবে না। আর তুমি যদি মূর্খ হও তারা তোমার মূর্খতা আরও বৃদ্ধি করে দিবে। উপরন্তু আল্লাহ তাদের ওপর কোন গযব নাযিল করলে তাদের সাথে তুমিও গযবে পতিত হবে। হে বৎস! ঈমানদারের রক্তপাতকারী শক্তিমান ব্যক্তিকে ঈর্ষা করোনা। কারণ, তার জন্যে আল্লাহর নিকট এমন ঘাতক রয়েছে, যার মৃত্যু নেই।’ আবু মুয়াবিয়া..... উরওয়া (র) সূত্রে বলেন, ‘আলহিকমাহ’ গ্রন্থে রয়েছে যে, ‘হে বৎস! তুমি ভাল কথা বলবে এবং হাসিমুখে থাকবে। তাহলে দানশীল ব্যক্তিদের তুলনায় তুমি মানুষের নিকট অধিকতর প্রিয় হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলহিকমাহ’ গ্রন্থে অথবা তাওরাতে আছে যে, ‘নম্রতা হল প্রজ্ঞার মস্তক স্বরূপ। তিনি এও বলেছেন যে, তাওরাতে আছে, তুমি যেমন দয়া করবে, তেমন দয়া পাবে। তিনি আরও বলেছেন যে, হিকমত গ্রন্থে আছে, যেমন বপন করবে তেমন ফসল তুলবে। তিনি বলেন, ‘আলহিকমাহ’ গ্রন্থে আছে, তোমার বন্ধুকে এবং তোমার পিতার বন্ধুকে ভালবাস।’
আবদুর রাযযাক…… আবু কিলাব সূত্রে বলেন, লুকমান (আ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘কোন ব্যক্তি অধিক ধৈর্যশীল?’ তিনি বললেন, ‘সেই ধৈর্য যার পরে কষ্ট দেওয়া হয় না।’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী?’ তিনি বললেন, ‘সে ব্যক্তি, যে অন্যের জ্ঞান দ্বারা নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করে।’ বলা হল, ‘কোন লোক উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘ধনি ব্যক্তি বলা হল, প্রাচুর্যের অধিকারী? সম্পদের প্রাচুর্য? তিনি বললেন, না বরং আমি সে ব্যক্তিকে বুঝিয়েছি, যার কাছে কোন কোন কল্যাণ চাওয়া হলে তা পাওয়া যায়। তা না হলে অন্তত সে অন্যের দ্বারস্থ হয়।’
সুফিয়ান ইবন উয়ায়না বলেন, লুকমান (আ)-কে বলা হল, ‘নিকৃষ্টতম ব্যক্তি কে?’ তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি এ কথার পরোয়া করে না যে, লোকে তাকে মন্দ কার্যে লিপ্ত দেখবে।’
আবু সামাদ মালিক ইবন দীনার সূত্রে বলেন, ‘প্রজ্ঞাপূর্ণ কথার মধ্যে আমি এটা পেয়েছি যে, মানুষের খেয়াল খুশী ও কৃপ্রবৃত্তি সম্পর্কে সমাজের উপরতলার যে সকল লোক আলাপ-আলোচনা করে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। আমি তাতে আরও পেয়েছি যে, তুমি যা জান তা আমল না করে যা জান না তা জানার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। এটি তো সে ব্যক্তির ন্যায়, যে কাঠ সংগ্রহ করে বোঝা বাঁধে, তারপর তা মাথায় তুলে নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তারপর গিয়ে আরও কাঠ সংগ্রহ করে।’
আবদুল্লাহ ইবন আহমদ আবু সাঈদ (র) সূত্রে বলেন, হযরত লুকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘হে বৎস! পরহেযগার ব্যক্তিরাই যেন তোমার খাদ্য খায় এবং তোমার কাজকর্মে বিজ্ঞজনদের পরামর্শ নিও।’
এ বিষয়ে ইমাম আহমদ (র) যা বর্ণনা করেছেন, এগুলো হচ্ছে তার সারসংক্ষেপ। ইতিপূর্বে আমরা কতক বর্ণনা উল্লেখ করেছি, যা তিনি বর্ণনা করেন নি। আবার তিনি এমন কতক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের নিকট ছিল না। আল্লাহই ভাল জানেন। ইবন আবী হাতিম ……কাতাদা (র) সূত্রে বলেন, আল্লাহ তা’আলা লুকমান হাকীমকে নবুওত ও হিকমতের যে কোন একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন। তিনি নবুওতের পরিবর্তে হিকমতই গ্রহণ করেন। তারপর জিবরাঈল (আ) তাঁর নিকট এলেন। তিনি তখন নিদ্রামগ্ন। জিবরাঈল (আ) তাঁর নিকট হিকমতের বারি বর্ষণ করেন। এরপর থেকে তিনি হিকমতপূর্ণ কথা বলতে শুরু করেন।
সাদ বলেন, আমি কাতাদা (র) কে বলতে শুনেছি যে, লুকমানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি নবুওত না নিয়ে হিকমত নিলেন কেন? আপনাকে তো আপনার প্রতিপালক ইখতিয়ার দিয়েছিলেন।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমাকে যদি বাধ্যতামূলক ভাবে নবুওত দেয়া হত তাহলে আশা করি, আমি ঐ দায়িত্ব পালনে সাফল্য লাভ করতাম। কিন্তু আমাকে যখন যে কোন একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার দেয়া হল, তখন আমি নবুওতী গুরুদায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে যাব বলে আশংকা করলাম। তখন হিকমতই আমার নিকট প্রিয়তর মনে হয়।’
এ বর্ণনাটি সংশয় মুক্ত নয়। কারণ, কাতাদা (র) থেকে সাঈদ ইবন কাছীরের বর্ণনা সম্পর্কে হাদীছবেত্তাগণের বিরূপ সমালোচনা রয়েছে। উপরন্তু সাঈদ ইবন আবী আরূবা কাতাদা (র) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, হিকমত অর্থ প্রজ্ঞা ও ইসলাম। তিনি নবী ছিলেন না, তার প্রতি ওহীও অবতীর্ণ হয়নি। পূর্ববতী কালের উলামা-ই কিরামও স্পষ্টভাবে তা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে মুজাহিদ; সাঈদ ইবন মুসায়্যব ও ইবন আব্বাস (রা) প্রমুখ প্রথম যুগের আলিমগণ দৃঢ়ভাবে এমত পোষণ করতেন। আল্লাহই ভাল জানেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/489/41
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।