hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৫৭
সাবা বাসীদের বর্ণনা
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( لَقَدۡ كَانَ لِسَبَإ فِی مَسۡكَنِهِمۡ ءَایَة ۖ جَنَّتَانِ عَن یَمِین وَشِمَال ۖ كُلُوا۟ مِن رِّزۡقِ رَبِّكُمۡ وَٱشۡكُرُوا۟ لَهُۥۚ بَلۡدَة طَیِّبَة وَرَبٌّ غَفُور ۝ فَأَعۡرَضُوا۟ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ سَیۡلَ ٱلۡعَرِمِ وَبَدَّلۡنَـٰهُم بِجَنَّتَیۡهِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل وَشَیۡء مِّن سِدۡر قَلِیل ۝ ذَ  ٰ⁠ لِكَ جَزَیۡنَـٰهُم بِمَا كَفَرُوا۟ۖ وَهَلۡ نُجَـٰزِیۤ إِلَّا ٱلۡكَفُورَ ۝ وَجَعَلۡنَا بَیۡنَهُمۡ وَبَیۡنَ ٱلۡقُرَى ٱلَّتِی بَـٰرَكۡنَا فِیهَا قُر ى ظَـٰهِرَة وَقَدَّرۡنَا فِیهَا ٱلسَّیۡرَۖ سِیرُوا۟ فِیهَا لَیَالِیَ وَأَیَّامًا ءَامِنِینَ ۝ فَقَالُوا۟ رَبَّنَا بَـٰعِدۡ بَیۡنَ أَسۡفَارِنَا وَظَلَمُوۤا۟ أَنفُسَهُمۡ فَجَعَلۡنَـٰهُمۡ أَحَادِیثَ وَمَزَّقۡنَـٰهُمۡ كُلَّ مُمَزَّقٍۚ إِنَّ فِی ذَ  ٰ⁠ لِكَ لَـَٔایَـٰت لِّكُلِّ صَبَّار شَكُور ࣲ)

[Surah Saba' 15 - 19]

“সাবাবাসীদের জন্যে তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শন-দুটো উদ্যান, একটি ডান দিকে অপরটি বাম দিকে। ওদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক প্রদত্ত রিযিক ভোগ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। উত্তম এই স্থান এবং ক্ষমাশীল তোমাদের প্রতিপালক। পরে তারা আদেশ অমান্য করল। ফলে আমি তাদের উপর প্রবাহিত করলাম বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা, এবং তাদের উদ্যান দুটোকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটো উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুল গাছ। আমি তাদেরকে এই শাস্তি দিয়েছিলাম তাদের কুফরীর জন্যে। আমি অকৃতজ্ঞ ব্যতীত আর কাউকে এমন শাস্তি দিই না। ওদের এবং যে সব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, সেগুলোর অন্তর্বর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ কর দিবস ও রজনীতে। কিন্তু তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের সফরের মনযিলের ব্যবধান বর্ধিত করুন।’ এভাবে তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। ফলে আমি ওদেরকে কাহিনীর বিষয়বস্তুতে পরিণত করলাম এবং ওদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম। এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (৩৪ সাবাঃ ১৫-১৯)

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক সহ কুলজী বিশারদগণ বলেছেন যে, সাবার নাম হল আবদ শামস ইবন ইয়াশজব ইবন ইয়ারু ইবন কাহতান। তারা বলেন, এ ব্যক্তিই প্রথম আরব, যাকে বন্দী করা হয়েছিল। তাই তাঁর নাম হল ( سبا ) অর্থাৎ কারারুদ্ধ। তাঁকে আররাইশ বা দাতা নামেও ডাকা হত। কারণ তিনি নিজের ধন-সম্পদ থেকে মানুষকে অকাতরে দান করতেন। সুহায়লী বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম মাথায় মুকুটু পরিধান করেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনি মুসলমান ছিলেন। তাঁর কতক কবিতা আছে সেগুলো তে তিনি প্রিয় নবী (সা)-এর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছেন। তার কতক এইঃ

يملك بعدنا ملكا عظيما - نبي لا يرخص في الحرام

“আমাদের পরে একজন নবী বিশাল রাজত্বের অধিকারী হবেন। তিনি কোন অন্যায় ও হারাম কাজকে প্রশ্রয় দিবেন না।”

ويملك بعده منهم ملوك - يدينون العباد بغير ذام

“তাঁর পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্য থেকে অনেক রাজা আসবে। তারা কোন অপরাধ ছাড়াই মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করবে।”

ويملك بعدهم منا ملوك - يصير الملك فينا باقتسام

“ওদের পর আমাদের বংশ থেকে কতক রাজা হবে। তখন আমাদের মধ্যে রাজত্ব থাকবে ভাগাভাগির ভিত্তিতে।”

ويملك بعد قحطان تبي - تقى جبينه غير الأنام

“কাহতানদের পরে একজন সৎ পূণ্যবান ও পবিত্র নবী রাজা হবেন, তিনি সর্বোত্তম মানব।”

يسمي أحمدا يا ليت آنی أعمر بعد مبعثه بعام

“তাঁর নাম হবে আহমদ! হায়, তাঁর নবুওত প্রাপ্তির পর আমি যদি অন্তত একটি বছর জীবিত থাকতাম।”

فاعضدة وأحبوه بنصري - بكل مدجج وبكل رام

“তাহলে আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতাম এবং তাকে ভালবাসতাম!”

متى يظهر فكونوا ناصرين - ومن يلقاه يبلغه سلامی

“তিনি যখনই আবির্ভূত হন না কেন তোমরা তার সাহায্যকারী হয়ে, তার সাথে যার দেখা হবে আমার সালাম তাঁকে জানিয়ে দিও।”

ইবন দিহয়া তাঁর ‘আততানভীর ফী মাওলিদিল বাশীরিন নাযীর’ গ্রন্থে এগুলো উল্লেখ করেছেন। ইমাম আহমদ-আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল যে, ‘সাবা কি পুরুষ না মহিলা, কোন এলাকার নাম?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ ‘সাবা একজন পুরুষ লোক। তার ১০টি সন্তান ছিল। তাদের ছয়জন ছিল ইয়ামানে আর চারজন সিরিয়াতে। ইয়ামানে বসবাসকারীগণ হল (১) মযহাজ (২) কিন্দা (৩) আযদ (৪) আশ আরি (৫) আনমার ও (৬) হিময়ার। সিরিয়ায় বসবাসকারীগণ হল (১) লাখম (২) জুবাম (৩) আমিলা ও (৪) গাসসান। তাফসীর গ্রন্থে আমরা উল্লেখ করেছি যে, এই প্রশ্নকারী ছিলেন ফারওয়া ইবন মিসসীক আল গাতিকী। আমরা এই হাদীছটি সমস্ত সনদ ও শব্দাবলী সেখানে উল্লেখ করেছি।

মূল কথা হল, সাবাই হচ্ছে এসব আরব গোত্রের আদি পুরুষ। এদের মধ্যে তুব্বাগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। তাবাবি’আ ( تبابعة ) শব্দের একবচন তুব্বা ( تبع )। তুব্বা রাজাগণ বিচারের সময় পারস্য সম্রাট কিসরাদের মত মুকুট পরিধান করতেন। যে ব্যক্তি শাহর ও হাদ্রামাউতসহ ইয়ামানের রাজা হতেন, তাঁকে আরবগণ তুব্বা নামে আখ্যায়িত করত। যেমন কোন লোক দ্বীপাঞ্চল সহ সিরিয়ার রাজা হতে পারলে তাকে কায়সার, পারস্যের রাজাকে কিসরা মিসরের রাজাকে ফিরআওন, হাবশার রাজাকে নাজাশী এবং ভারতবর্ষের রাজাকে বাতলী মূসা বলা হত। হিময়ারী রাজাদের মধ্যে ইয়ামান রাজ্যে রাণী বিলকীসও ছিলেন। হযরত সুলায়মান (আ)-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা রাণী বিলকীসের কথাও আলোচনা করেছি।

সাবা রাজ্যের অধিবাসীগণ পরম সুখ-শান্তিতে বসবাস করত। তাদের সেখানে ছিল খাদ্য দ্রব্য, ফলমূল ও শস্যক্ষেত্রের প্রাচুর্য। এতদসত্ত্বেও তারা সত্যনিষ্ঠা, সরল পথ ও হিদায়াতের পথে জীবন যাপন করত। অবশেষে তারা যখন আল্লাহর নিয়ামতের নাশোকরী করল, আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতিদানে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিল।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ওহব ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতি তের জন নবী প্রেরণ করেছিলেন। সুদ্দী (র) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা বার হাজার নবী তাদের নিকট প্রেরণ করেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

বস্তুত তারা যখন হিদায়াতের পথ ত্যাগ করে গোমরাহীর পথ ধরে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের উপাসনা শুরু করে। সেটা রাণী বিলকীসের রাজত্বকাল এবং তার পূর্বের কথা। পরেও তারা অনবরত সে পথে চলতে থাকে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের উপর বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন প্রেরণ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( فَأَعۡرَضُوا۟ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ سَیۡلَ ٱلۡعَرِمِ وَبَدَّلۡنَـٰهُم بِجَنَّتَیۡهِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل وَشَیۡء مِّن سِدۡر قَلِیل ࣲ)

[Surah Saba' 16]

“পরে তারা আদেশ অমান্য করল, ফলে আমি তাদের উপর প্রবাহিত করলাম বাঁধ ভাঙ্গা বন্যা এবং তাদের উদ্যান দুটোকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটো উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল। ঝাউ গাছ এবং কিছু কুল গাছ। আমি ওদেরকে এই শাস্তি দিয়েছিনাম ওদের কুফরীর জন্যে। আমি কৃতঘ্ন ব্যতীত আর কাউকে এমন শাস্তি দিই না।” (৩৪ সাবাঃ ১৬)

প্রাচীন ও আধুনিক বহু তাফসীরকার ও অন্যান্য উলামা-ই-কিরাম বলেছেন, আরিম বাঁধ নির্মাণের পটভূমি এই যে, পর্বতের মধ্যখানে পানি প্রবাহিত হত। বহু বছর আগে তারা পর্বত দুটোর মধ্যখানে মজবুত করে একটি বাঁধ নির্মাণ করে। এতে পানি উপরের দিকে উঠে আসে এবং পর্বত দু’টির উপরিভাগে এসে পৌঁছায়। তারপর তারা সেখানে ব্যাপক হারে বাগান তৈরী করে, সুস্বাদু ফলমূলের গাছ লাগায় এবং ক্ষেত খামারের ব্যবস্থা করে।

কথিত আছে, সর্বপ্রথম সাবা ইবন ইয়ারুব এ বাঁধ নির্মাণ করেন। প্রায় ৭০টি পাহাড়ী উপত্যকাকে তিনি এ বাঁধের আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি বাঁধে ৩০টি সুইস গেট তৈরী করেন যাতে সেগুলো দিয়ে পানি বেরিয়ে যায়। তিনি অবশ্য বাঁধের সকল কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি। তার পরে রাজা হিময়ার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সকল কাজ সুসম্পন্ন করেন। এটির ব্যাপ্তি প্রায় ৯ বর্গমাইল ছিল। তারা পরম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করছিল।

এ প্রসঙ্গে কাতাদা (র) প্রমুখ বলেন, সে যুগে তাদের ফলমূল এত বেশী ছিল যে, কোন একজন মহিলা মাথায় খালি একটি সোঁয়ামনি ঝুড়ি নিযে পথে বের হলে স্বাভাবিক নিয়মে ঝরে পড়া পাকা ফলে তার ঝুড়ি ভর্তি হয়ে যেত। সে দেশের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এমন সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত ছিল যে, সেখানে কোন মশা-মাছি ও বিষাক্ত জীবজন্তু ছিল না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন.... সাবা বাসীদের জন্যে তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শনঃ দু’টো উদ্যান, একটি ডান দিকে, অপরটি বাম দিকে। তাদেরকে বলা হয়েছিল, “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রদত্ত রিযক ভোগ কর এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। উত্তম এ স্থান এবং ক্ষমাশীল তোমাদের প্রতিপালক।”

আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ

( وَإِذۡ تَأَذَّنَ رَبُّكُمۡ لَىِٕن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِیدَنَّكُمۡۖ وَلَىِٕن كَفَرۡتُمۡ إِنَّ عَذَابِی لَشَدِید ࣱ)

[Surah Ibrahim 7]

“স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দিব আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (১৪ ইব্রাহীমঃ ৭)

সাবা রাজ্যের অধিবাসীগণ অতঃপর আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা শুরু করে। আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়েও তারা দর্প করে। তাদের জনপদ সমূহের অবস্থান কাছাকাছি হওয়া, বাগবাগিচা ও বৃক্ষরাজির কারণে পরিবেশ উন্নত হওয়া এবং যাত্রাপথ নিরাপদ থাকার পর তারা প্রার্থনা জানায় যেন তাদের যাত্রা পথে দূরত্ব সৃষ্টি করে দেওয়া হয় এবং সফরকে কষ্টদায়ক ও কঠিন করে দেয়া হয়। যেমন বনী ইসরাঈলীরা মান্না ও সালাওয়ার পরিবর্তে শাকসবজি, কাঁকড়, গম, ডাল ও পেঁয়াজের জন্য আবদার করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের শহর নগরগুলোকে ধ্বংস করে তাদেরকে দূর-দূরান্তে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দিয়ে ঐ মহা অনুগ্রহ ও সার্বিক কল্যাণ প্রত্যাহার করে নিলেন।

এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( فَأَعۡرَضُوا۟ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمۡ سَیۡلَ ٱلۡعَرِمِ )

[Surah Saba' 16]

“তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ফলে আমি তাদের প্রতি বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন প্রবাহিত করে দিলাম।”

অনেক তাফসীরকার বলেন, আল্লাহ তাআলা এই বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার যখন ইচ্ছে করলেন তখন এটির ভিত্তিমূলে দলে দলে ইদুর পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন যখন তা জানতে পারল তখন তারা ইঁদুর দমনের জন্যে বাঁধ এলাকায় বহু সংখ্যক বিড়াল এনে ছেড়ে দিল। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। কারণ প্রবাদ আছে যে, “পাতিল গরম হয়ে গেলে তখন সতর্ক হয়ে কোন লাভ নেই।” তখন বাঁচার কোন পথ থাকে না। ইঁদুরের আক্রমণে বাঁধের ভিত্তিমূল ঝাঁজরা হয়ে যায় এবং বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ফলে সকল নালা বিনষ্ট হয়ে পানি সমতল অঞ্চলের দিকে গড়িয়ে যায়। ফলমূল বাগ-বাগিচা, ক্ষেত-খামার সব বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মনোরম আবাসিক এলাকা পরিণত হয় বিরান জনপদে। এর পরিবর্তে জন্ম নেয় বিস্বাদ আজেবাজে গাছ-গাছালি ও ফলমূল। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( وَبَدَّلۡنَـٰهُم بِجَنَّتَیۡهِمۡ جَنَّتَیۡنِ ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل ࣲ)

[Surah Saba' 16]

“এবং তাদের উদ্যান দুটোর পরিবর্তে দিলাম এমন দুটো উদ্যান, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউ গাছ। ইবন আব্বাস (রা) মুজাহিদ এবং অনেক ভাষ্যকার বলেছেন যে, ( خَمۡط ) শব্দ দ্বারা পিলু গাছ এবং তার ফল এবং। ( أَثۡل ) শব্দ দ্বারা ঝাউগাছ বুঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ঝাউগাছ জাতীয় এমন একটি গাছ বুঝানো হয়েছে, যা কাঠসর্বস্ব, কোন ফল ধরে না।

( ذَوَاتَیۡ أُكُلٍ خَمۡط وَأَثۡل ࣲ)

—এবং কতক কুল বৃক্ষ। কারণ, জবলী কুল গাছে ফল হয় কম আর তাতে কাটা বেশী। ঐ কুলও তেমনি বিস্বাদ। যেমন প্রবাদ আছে, “উটের গোশত নষ্ট হল উঁচু পাহাড় চূড়ায়, এমন সমতল নয় যে, সেখানে সহজে উঠা যাবে, আবার এমন নাদুস-নুদুস নয় যে, তা’ পরিচ্ছন্ন থাকবে। এ জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

( ذَ لِكَ جَزَیۡنَـٰهُم بِمَا كَفَرُوا۟ۖ وَهَلۡ نُجَـٰزِیۤ إِلَّا ٱلۡكَفُورَ )

[Surah Saba’ 17]

“তাদের কুফরীর কারণে আমি তাদেরকে এই শাস্তি দিয়েছি। অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাউকে আমি এমন শাস্তি দিই না।” অর্থাৎ আমি এমন কঠিন শাস্তি শুধু তাদেরকেই দেই, যারা আমার প্রতি কুফরী করে, আমার রাসূলদেরকে প্রত্যাখ্যান করে আমার নির্দেশের বিরোধিতা করে এবং আমার নিষেধাজ্ঞাগুলো অমান্য করে।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( فَجَعَلۡنَـٰهُمۡ أَحَادِیثَ وَمَزَّقۡنَـٰهُمۡ كُلَّ مُمَزَّقٍۚ )

[Surah Saba' 19]

“ফলে আমি তাদেরকে উপাখ্যানে পরিণত করলাম এবং তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম।”

বক্তৃত তাদের ধন-সম্পদ যখন ধ্বংস হয়ে গেল এবং শহর-নগর বিরান হয়ে পড়ল তখন এলাকা পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে তারা বাধ্য হল। তারা তখন ছত্রভঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন উঁচু ও নীচু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের একদল চলে আসে হিজায তথা আরব এলাকায়। কুযা’আ গোত্র মক্কার উপকণ্ঠে এসে বসতি স্থাপন করে। তাদের বিবরণ পরে আসবে।

তাদের কতক মদীনা মুনাওয়ারায় এসে বসবাস করতে থাকে। এরা মদীনার আদি বাসিন্দা। এরপর বানু কায়নুকা, বানু কুরায়যা ও বনূ নযীর- এই তিন ইয়াহুদী গোত্র মদীনায় তারা এসে আওস ও খাযরাজ গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে এবং সেখানে বসবাস করতে থাকে।

তাদের বিশদ বিবরণ আমরা পরে উল্লেখ করব। সাবার অধিবাসীদের একদল সিরিয়ায় অবতরণ করে। তারাই পরবর্তী কালে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। এরা হল গাসসান, আমিলা, বাহরা, লাখম, জুযাম তানুখ, তাগলিব প্রভৃতি গোত্র। হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর শাসনামলে সিরিয়া বিজয় সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমরা এ গোত্রগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করব।

মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, আবু উবায়দা (রা) আমাকে বলেছেন যে, আশা ইবন কায়স ইবন হা’লাবা ওরকে মায়মুন ইবন কায়স বলেছেনঃ

وفي ذاك للمؤتسي أسوة - ومارم عفى عليها العرم

“আদৰ্শকামী ব্যক্তির জন্যে এর মধ্যে রয়েছে আদর্শ, বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন তো মা’রিম বাঁধকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।”

رخام بنته لهم حمير - اذا جاء موارة لم يرم

“এটি একটি শ্বেত পাথরের তৈরী বাঁধ। হিময়ার তাদের জন্যে এটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রচণ্ড পানির ঢেউ এলেও তা নষ্ট করতে পারতো না।

فاروى الزدوم وأعنانها - على سعة ماؤهم اذا قسم

“এই পানি বণ্টন করে নেয়ার পরও এটি যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষেত খামার ও সংশ্লিষ্ট এলাকা সিঞ্চিত করে দিত।”

فصاروا أيادى لا يقدرون - على شرب طفل اذا ما فطم

“অবশেষে তারা ধ্বংস হয়ে গেল। এমন হল যে, শিশু তার মায়ের দুধ পান ছাড়ার পর তাকে পানীয় দিতে পারছিল না।”

মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক তাঁর সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন, বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনের পূর্বে সর্বপ্রথম যিনি ইয়ামন থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন, তিনি হলেন অমর ইবন আমির লাখমী। লাখম হলেন লাখম ইবন আদী ইবন হারিছ ইবন মুররা ইবন আয়দ ইবন যায়দ ইবন মাহা আবন আমর ইবন আরীব ইবন ইয়াশজুব ইবন যায়দ আবন কাহলান ইবন সাবা। কেউ কেউ তার বংশ তালিকা এরূপ বলেছেন, লাখম ইবন আদী ইবন আমর ইবন সাবা। এটি ইবন হিশাম (র)-এর বর্ণনা।

ইবন ইসহাক বলেন, আমর ইবন আমিরের সাবা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের কারণ সম্পর্কে আবু যায়দ আনসারী আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, আমর একদিন দেখলেন যে, বাঁধ তাদের জন্যে পানি ধরে রাখে এবং তারা প্রয়োজন মাফিক নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী ওখান থেকে পানি সরবরাহ করেন একটি জংলী ইদুর সেই বাধের মধ্যে একটি গর্ত খুঁড়ছে। এতে তিনি বুঝে নিলেন যে, এই বাঁধ আর বেশী দিন টিকবেনা। তাই তিনি ইয়ামন ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তার সম্প্রদায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তাকে চলে যেতে বাধা দেয়। তিনিও একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তার ছোট ছেলেকে বলেন যে, আমি তোমার প্রতি রেগে গিয়ে তোমাকে চড় মারলে তুমিও আমার মুখে চড় মারবে। তার ছেলে নির্দেশানুযায়ী তাই করল।

এরপর আমর বললেন, যে শহরের এমন পরিবেশ যে, আমার ছোট ছেলে আমার মুখে চড় মারতে পারল, আমি আর সেই শহরে থাকব না। তিনি তার ধন-সম্পদ বেচে দেয়ার ঘোষণা দিলেন। সে শহরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা বলল, ‘আমরের রাগকে কাজে লাগাও, এ সুযোগে তার ধন সম্পদ কিনে নাও।’ অতঃপর আমর তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী সবাইকে নিয়ে সাবা এলাকা ত্যাগ করেন। এটা দেখে আযদ গোত্রের লোকেরা বলল, ‘আমর চলে গেলে আমরা এখানে থাকব না।’ তারাও নিজেদের ধন-সম্পদ বিক্রি করে দেয় এবং আমরের সাথে বেরিয়ে পড়ে। যেতে যেতে তাঁরা ‘আক এর অঞ্চলে উপস্থিত হয়। সে দেশ অতিক্রম করে যেতে চাইলে আক গোত্রীয়রা তাদেরকে বাধা দেয় এবং যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের ফলাফল কখনো পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে যায়।এ প্রসংগে আব্বাস ইবন মিরদাস বলেনঃ

وعك بن عدنان ألذين تلعبوا - بغسان حتى طردوا كل مطرد

“আক ইবন আদনান যুদ্ধ খেলা খেলেছ গাসসানী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। শেষে তাদেরকে সদল বলে বিতাড়িত করেছে।”

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তারা আক এর এলাকা অতিক্রম করে বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। জাফনা ইব্‌ন আযর ইবন আমিরের পরিবার বসবাস করতে থাকে সিরিয়ায়। আউস ও খাযরাজ গোত্র অবতরণ করেন ইয়াছরিবে (মদীনা শরীফে )। খুযাআ গোত্র গেল মুর আঞ্চলে। আযদ গোত্রের লোকজন ভিন্ন ভিন্ন উপগোত্রে বিভক্ত হয়ে তাদের কেউ কেউ সারাতে এবং কেউ কেউ ওমানে বসতি স্থাপন করে। এরপর আল্লাহ তা’আলা মারিব বাধে সর্বনাশা প্লাবন প্রেরণ করেলেন। প্লাবনের তোড়ে ভেঙ্গে চুরে ধ্বংস হয় মারিব বাঁধ। এ প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা উপরোক্ত আয়াতগুলো নাযিল করেন।

তাফসীরকার সুদ্দী (র) থেকেও প্রায় এরকম বর্ণনা এসেছে। মুহাম্মদ ইবন ইসহাকের একটি বর্ণনা এরূপ এসেছে যে, আমর ইব্‌ন আমির নিজে জ্যোতিষী ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, আমর নিজে নয়, বরং তাঁর স্ত্রী তারিফা বিনত খায়র হিময়ারীই জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, অতি সত্ত্বর এ জনপদ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা যেন মারিব বাঁধে ইঁদুরের ধ্বংস লীলা দেখতে পেয়েছিল। তাই তারা যা করার তা করে। আল্লাহই ভাল জানেন। ইবন আবী হাতিম তাফসীর গ্রন্থে ইকরামা থেকে এ ঘটনাটিও বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন