মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
নবী ঈসা (আ) একদা আল্লাহর নিকট নিবেদন করলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুবা কী?’ আল্লাহ জানালেন, ‘তূবা একটি বৃক্ষের নাম। আমি নিজ হাতে তা রোপণ করেছি। এটা প্রত্যেকটা জান্নাতের জন্যই। এর শিকড় রিযওয়ানে এবং তার পানির উৎস তাসনীম। এর শিশির কর্পূরের মত, এর স্বাদ আদার এবং ঘ্রাণ মিশকের মত। যে ব্যক্তি এর থেকে একবার পান করবে সে কখনও পিপাসাবোধ করবে না।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমাকে একবার সে পানি পান করার সুযোগ দিন।’ আল্লাহ বললেন, ‘সেই নবী পান করার পূর্বে অন্য নবীদের জন্যে এটা পান করা নিষিদ্ধ এবং সেই নবীর উম্মতরা পান করার পূর্বে অন্য নবীদের উম্মতদের জন্যে এর স্বাদ গ্রহণ নিষিদ্ধ।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে ঈসা! আমি তোমাকে আমার নিকট উঠিয়ে আনব।’ ঈসা বললেন, ‘প্রভু! কেন আমাকে উঠিয়ে নিবেন?’ আল্লাহ বললেন, ‘আমি প্রথমে তোমাকে উঠিয়ে আনব। তারপর শেষ যামানায় আবার পৃথিবীতে পাঠাব। এতে তুমি সেই নবীর উম্মতের বিস্ময়কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে পারবে এবং অভিশপ্ত দাজ্জালকে হত্যা করার ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। কোন এক নামাযের সময় তোমাকে পৃথিবীতে নামাব। কিন্তু তুমি তাদের নামাযে ইমামতি করবে না। কেননা তারা হচ্ছে রহমতপ্রাপ্ত উম্মত। তাদের যিনি নবী, তারপর আর কোন নবী নেই।’
হিশাম ইবন আম্মার....... যায়দ থেকে বর্ণিত। ঈসা বলেছিলেন, প্রভু! আমাকে এই রহমত প্রাপ্ত উম্মত সম্পর্কে কিছু জানান। আল্লাহ বললেন, তারা আহমদ নবীর উম্মত। তারা হবে নবীতুল্য আলিম ও প্রজ্ঞাবান। আমার অল্প অনুগ্রহে তারা সস্তুষ্ট থাকবে। শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বদৌলতেই তাদেরকে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাবো। তারাই হবে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসী। কেননা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর যিকির দ্বারা তাদের জিহবা যে পরিমাণ সিক্ত হয়েছে, সে পরিমাণ সিক্ত অন্য কোন জাতির হয়নি এবং সিজদা করাতে তাদের গর্দান যতবার ভূ-লুষ্ঠিত হয়েছে, ততবার অন্য কোন জাতির গর্দান ভূলুণ্ঠিত হয়নি। (ইবন আসাকির)
ইবন আসাকির আব্দুল্লাহ ইবন আওসাজা থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে ঈসা ইবন মারয়ামকে বলেন, তোমার চিন্তা-ভাবনায় আমাকেও নিত্য সাথী করে রাখ এবং তোমার আখিরাতের জন্যে আমাকে সম্বলরূপে রাখ। নফল ইবাদতের দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন কর, তাহলে আমি তোমাকে প্রিয় জানবো। আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে তোমার বন্ধু বানিয়ো না। এরূপ করলে তুমি লাঞ্ছিত হবে। বিপদে ধৈর্যধারণ কর এবং তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাক। তোমার মধ্যে আমার সন্তুষ্টিকে জাগ্রত রাখ। কেননা তোমার সন্তুষ্টি আমার আনুগত্যে নিহিত, অবাধ্যতায় নয়। আমার নৈকট্য লাভের চেষ্টা কর, আমাকে সর্বদা স্মরণ রাখ। তোমার অন্তরে যেন আমার ভালবাসা বিরাজ করে। অবসর সময়ে সদা সচেতন থাক। সূক্ষ্ম প্রজ্ঞাকে সুদৃঢ় কর। আমার প্রতি আগ্রহ ও ভীতি পোষণ কর। আমার ভীতি দ্বারা অন্তরকে সমাহিত কর। আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে রাতের সদ্ব্যবহার করবে। এবং দিনের বেলা থাকবে তৃষ্ণার্থ, যাতে করে আমার নিকট পূর্ণ পরিতৃপ্তির দিল লাভ করতে পার। কল্যাণকর কাজে তোমার চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত রাখ। যেখানেই থাক, কল্যাণকর কাজের সহায়ক থাক। মানুষের নিকট আমার উপদেশ পৌঁছিয়ে দাও। আমার ন্যায়পরায়ণতার সাথে আমার বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা কর। তোমার নিকট আমি এমন উপদেশ নাযিল করেছি, যা মনের সন্দেহ-সংশয় ও বিস্মৃতি রোগের নিরাময় স্বরূপ। তা চোখের আবরণ দূর করে ও দৃষ্টিকে প্রখর করে। তুমি কোথাও মৃতবৎ স্থবির হয়ে থেকো না, যতক্ষণ তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলে। হে ঈসা ইবন মারয়াম! আমার প্রতি যে লোকই ঈমান আনে, সে আমাকে ভয় করে। আর যে আমাকে ভয় করে, সে আমার থেকে পুরস্কারেরও আশা রাখে। অতএব, তুমি সাক্ষী থেকো, ঐ ব্যক্তি আমার শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে যতক্ষন না সে আমার নীতি পরিবর্তন করে। হে কুমারী তাপসী মারয়ামের পুত্র ঈসা! জীবনভর কাঁদতে থাক, যেভাবে কেঁদে থাকে পরিবার-পরিজনকে বিদায় দান কালে কোন লোক এবং দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, দুনিয়ার স্বাদ বর্জন করে এবং আপন প্রভুর নিকট পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষায় থাকে। লোকের সাথে কোমল ব্যবহার করবে। সালামের প্রসার ঘটাবে। মানুষ যখন নিদ্রায় বিভোর থাকে তখন তুমি কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা ও বিভীষিকাময় কঠিন ভূ-কম্পনের ভয়ে জাগ্রত থাকবে।
সেদিন আপন পরিবার ও ধন-সম্পদ কোনই কাজে আসবে না। নির্বোধরা যখন হাসি ঠাট্টারত থাকে, তখন তুমি চক্ষুদ্বয়কে চিন্তার বিষাদের সুর্মা মেখে রাখ এবং এ ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ কর এবং একে তোমার পুণ্যপ্রাপ্তির হেতু কর। ধৈর্য অবলম্বককারীদের জন্যে আমি যে পুরস্কারের ওয়াদা করেছি, তা যদি তুমি পেয়ে যাও, তবে তোমার জীবন ধন্য। দুনিয়ার মোহ ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে থাক। যে নিয়ামত তোমার আয়ত্বে এসেছে তা থেকে সামান্য স্বাদ গ্রহণ কর। যে নিয়ামত তোমার আয়ত্বে আসেনি তার লোভ করো না। দুনিয়ায় অল্পতেই সন্তুষ্ট থাক। জীবন ধারণের জন্যে একটি শুকনা খেজুরই তোমার জন্যে যথেষ্ট মনে করবে। দুনিয়া কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে তা তুমি প্রত্যক্ষ করছ। পরকালের হিসাবের কথা স্মরণ রেখে আমল করতে থাক। কেননা সেখানে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমি আমার মনোনীত নেককার লোকদের জন্যে সেখানে যেসব পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছি, তা যদি তুমি দেখতে, তাহলে তোমার অন্তর বিগলিত হয়ে যেত এবং সহ্য করতে না পেরে তুমি মারাই যেতে।
আবু দাউদ তাঁর কিতাবে তাকদীর অধ্যায়ে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইবন ইয়াহয়া...... তাউস থেকে বর্ণিত। একদা ঈসা ইবন মারয়ামের সাথে ইবলীসের সাক্ষাত হয়। ঈসা ইবলীসকে বললেন, ‘তুমি তো জান, তোমার তাকদীরে যা লেখা হয়েছে তার ব্যতিক্রম কিছুতেই হবে না।’ ইবলীস বলল, ‘তা হলে আপনি এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠুন এবং সেখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে দেখুন জীবিত থাকেন কিনা।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তুমি জান না, আল্লাহ বলেছেন, বান্দা আমাকে পরীক্ষা করতে পারে না, আমি যা চাই তাই করে থাকি?’ যুহরী বলেছেন, মানুষ কোন বিষয়ে আল্লাহকে পরীক্ষা করতে পারে না, বরং আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। আবু দাউদ বলেন, আহমদ তাঊসের বরাতে বলেন। একবার শয়তান হযরত ঈসার নিকটে এসে বলল, ‘আপনি তো নিজেকে সত্যবাদী বলে মনে করেন, তা হলে আপনি ঊর্ধ্বে উঠে নীচে লাফিয়ে পড়ুন দেখি।’ ঈসা বললেন, ‘তোমার অমঙ্গল হোক, আল্লাহ কি এ কথা বলেন নি যে, হে আদম সন্তান! তোমরা আমার নিকট মৃত্যু কামনা করবে না? কেননা আমি যা চাই তা-ই করে থাকি।’ আবু তাওয়া আর রবী’...... খালিদ ইবন ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত। শয়তান দশ বছর কিংবা দু বছর যাবত ঈসা (আ)-এর সাথে ইবাদত বন্দেগী করতে থাকে। একদিন তারা এক পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছিলেন। তখন শয়তান ঈসা (আ)-কে বলল, ‘আমি যদি এখান থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ি, তাহলে আমার তাকদীরে যা লেখা আছে তার কি কোন ব্যক্তিক্রম ঘটবে?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমি আল্লাহকে পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখি না, বরং আল্লাহর যখন ইচ্ছা আমাকে পরীক্ষা করে থাকেন।’ ঈসা (আ) এতক্ষণে চিনতে পারলেন যে, এ শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং তিনি তাকে তাড়িয়ে দিলেন। আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া...... আবু উছমান (র) থেকে বর্ণিত। একদা হযরত ঈসা (আ) এক পাহাড়ের উপরে সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তার নিকট ইবলীস এসে বলল, ‘আপনি কি এই দাবী করে থাকেন যে, প্রতিটি বিষয়ই তার পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়?’ ঈসা (আ) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ ইবলীস বলল, ‘তাহলে আপনি এ পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ুন এবং বলুন যে, এটাই আমার তাকদীরে ছিল।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘ওহে অভিশপ্ত শয়তান! আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করতে পারেন, কিন্তু বান্দারা কখনও আল্লাহকে পরীক্ষা করতে পারে না।’
আবু বকর ইবন আবিদ দুনিয়া....... সুফিয়ান ইবন উয়ায়না (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা হযরত ঈসার সাথে ইবলীসের সাক্ষাত হয়। ইবলীস বলল, ‘হে ঈসা ইবন মারয়াম! আপনি দোলনায় শিশু অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলেছেন, এটা আপনার প্রভুত্বের বড় নিদর্শন। আপনার পূর্বে আর কোন মানব সন্তান ঐ অবস্থায় কথা বলেনি।‘ ঈসা (আ) বললেন, ‘না। প্রভুত্ব তো ঐ আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত, যিনি আমাকে শিশু অবস্থায় কথা বলার শক্তি দিয়েছেন, এরপরে এক সময় আমাকে মৃত্যু দিবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন।’ ইবলীস বলল, ‘আপনি মৃতকে জীবিত করে থাকেন, এটা আপনার প্রভু হওয়ার বড় প্রমাণ।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘তা হয় কিভাবে, প্রভু তো একমাত্র তিনি, যিনি জীবিত করার প্রকৃত মালিক। এবং আমি যাকে জীবিত করি, তিনি তাকে মৃত্যু দেন এবং পুনরায় তাকে জীবিত করেন।’ ইবলীস বলল, ‘আল্লাহর কসম, আপনি আকাশেরও প্রভু এবং দুনিয়ারও প্রভু।’ এ কথা বলার সাথে সাথে ফেরেশতা জিবরীল (আ) তাকে আপন ডানা দ্বারা এক ঝাপটা মেরে সূর্যের কিনারায় পৌঁছিয়ে দেন। তারপরে আর এক ঝাপটা মেরে সপ্তম সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছিয়ে দেন। এমনকি ইবলীস সমুদ্রের নীচে কাদার সংগে লেগে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ঈসা ইব্ন মারয়ামকে বলে, ‘আমি আপনার থেকে যে শিক্ষা পেলাম, এমন শিক্ষা কেউ কারও থেকে পায় না।’ এ জাতীয় ঘটনা আরও বিশদভাবে ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
হাফিজ আবু বকর আল খাতীব....... আবু সালমা সুয়ায়দ থেকে বর্ণিত। হযরত ঈসা (আ) একদা বায়তুল মুকাদ্দাসে সালাত আদায় করে বাড়ি ফিরছিলেন। একটি গিরিপথ দিয়ে যাওয়ার সময় ইবলীস তার সম্মুখে এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়। ঈসা (আ) ঘুরে গেলে সে আবার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং বলতে থাকে। আপনার জন্যে অন্য কারও দাসত্ব করা শোভা পায় না। এ কথাটি সে বারবার ঈসা (আ)-কে বলতে থাকে। ঈসা (আ) তার হাত থেকে ছুটে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। ইবলীস বারবার এ কথাই বলছিল যে, ‘হে ঈসা! কারও দাস হওয়া আপনাকে মানায় না।’ শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। তখন হযরত জিবরীল ও মিকাঈল ফেরেশতাদ্বয় সেখানে হাজির হলেন। ইবলীস তাদেরকে দেখা মাত্র থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ঐ গিরিপথেই ইবলীস ঈসা (আ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হল। তখন ফিরেশতাদ্বয় ঈসা (আ)-এর সাহায্যে অগ্রসর হলেন। হযরত জিবরীল তার ডানা দ্বারা ঝাপটা মেরে ইবলীসকে বাতনে ওয়াদীতে নিক্ষেপ করে দেন। ইবলীস সেখান থেকে উঠে পুনরায় ঈসা (আ)-এর নিকট আসল। সে ধারণা করল, সে ফেরেশতাদ্বয়কে যা হুকুম করা হয়েছিল তা পালন করে তারা চলে গিয়েছেন, আর আসবেন না। সুতরাং সে ঈসা (আ) কে পুনরায় বলল, ‘আমি আপনাকে ইতিপূর্বেই বলেছি, দাস হওয়া আপনার জন্যে শোভনীয় নয়। আপনার ক্রোধ কোন দাসের ক্রোধ নয়। আপনার সাথে সাক্ষাতকালে প্রকাশিত ক্রোধ থেকে আমি এ কথা বুঝেছি। আমি আপনাকে এমন এক বিষয়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছি যা আপনার জন্যে লাভজনক। আমি শয়তানদেরকে হুকুম দিব, তারা আপনাকে প্রভু মানবে। মানুষ যখন দেখবে জিনরা আপনাকে প্রভু মানছে তখন তারাও আপনাকে প্রভূ বলে মানবে এবং আপনার ইবাদত করবে। আমি এ কথা বলছি না যে, আপনিই একমাত্র মা'বুদ আর কোন মা'বুদ নেই! আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহ থাকবেন আসমানের মা'বুদ আর আপনি হবেন দুনিয়ার মা'বুদ।’
ইবলীসের মুখে এ কথা শুনার পর ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং উঁচু আওয়াজ করেন। তখন হযরত ইসরাফীল (আ) উপর থেকে নীচে নেমে আসেন। জিবরীল ও মীকাঈল ফেরেশতাদ্বয় তাঁর দিকে লক্ষ্য করেন। ইবলীস থেমে যায়। অতঃপর ইসরাফীল তাঁর ডানা দ্বারা ইবলীসকে আঘাত করেন এবং ‘আয়নুশ শামসে’ নিক্ষেপ করেন। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয়বার আঘাত করেন। এরপর ইবলীস সেখান থেকে অবতরণ করে ঈসা (আ) কে একই স্থানে দেখতে পায় এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘হে ঈসা! আজ আমি আপনার জন্যেই দারুণ কষ্ট ভোগ করেছি।’ তারপর তাকে আয়নুশ শামসে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে আয়নুল হামিয়াতে সাত রাজাকে দেখতে পায়, তারা তাকে তাতে ডুবিয়ে দেয়। যখনই সে চিৎকার করেছে তখনই তারা তাকে সেই কর্দমে ডুবিয়ে দেয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ইবলীস কখনও ঈসা (আ) এর নিকট আসেনি। ইসমাঈল আত্তার........ আবু হুযায়ফা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, অতঃপর ইবলীসের নিকট তার দলবল শয়তানরা জমায়েত হয় এবং বলে, ‘হে আমাদের সর্দার! আজ যে আপনাকে খুবই ক্লান্ত শ্রান্ত মনে হচ্ছে!’ ইবলীস হযরত ঈসার প্রতি ইংগিত করে বললঃ ‘তিনি হচ্ছেন আল্লাহর নিস্পাপ বান্দা। তার উপর প্রভাব বিস্তার করার সাধ্য আমার নেই। তবে তাকে কেন্দ্র করে আমি বিপুল সংখ্যক লোককে বিপদগামী করব। বিভিন্ন প্রকার কামনা-বাসনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলব। তাদেরকে নানা দলে-উপদলে বিভক্ত করব। তারা তাঁকে ও তার মাকে আল্লাহর আসনে বসাবে।’ কুরআন মজীদে আল্লাহ হযরত ঈসাকে ইবলীসের ধোঁকা থেকে হেফাজত করাকে তার অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করে বলেনঃ
یا عیسی بن مريم اذكر نعمتى عليك وعلى والدتك اذ ايدتك بروح القدس
—হে মারইয়াম তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার জননীর প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর। পবিত্র আত্মা অর্থাৎ জিবরীল ফেরেশতা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম। হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি কর্দম দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে তুমি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতি ক্রমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমা হতে বনী ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এ তো স্পষ্ট যাদু। (৫ মায়িদাঃ ১১০)
আমি গরীব ও মিসকীন লোকদেরকে তোমার একান্ত ভক্ত ও সাথী বানিয়েছি- যাদের উপরে তুমি সন্তুষ্ট; এমন সব শিষ্য ও সাহায্যকারী তোমাকে দিয়েছি, যারা তোমাকে জান্নাতের পথ প্রদর্শনকারী রূপে পেয়ে সন্তুষ্ট। জেনে রেখো, উক্ত গুণ দুটি বান্দার জন্যে প্রধান গুণ। যারা এ গুণ দুটি নিয়ে আমার কাছে আসবে, তারা আমার নিকট সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও মনোনীত বান্দা হিসেবে গণ্য হবে। বনী ইসরাঈলরা তোমাকে বলবে, আমরা রোজা রেখেছি কিন্তু তা কবুল হয়নি, নামায পড়েছি কিন্তু তা গৃহীত হয়নি, দান-সাদকা করেছি কিন্তু তা মঞ্জুর হয়নি, উটের কান্নার ন্যায় করুণ সুরে কেঁদেছি কিন্তু আমাদের কান্নার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। এ সব অভিযোগের জবাব তাদের কাছে জিজ্ঞেস কর, এমনটা কেন হল? কোন জিনিসটি আমাকে এসব কবুল করা থেকে বাধা দিয়েছে? আসমান ও যমীনের সমস্ত ধন ভাণ্ডার কি আমার হাতে নেই? আমি আমার ধন ভাণ্ডার থেকে যেরূপ ইচ্ছা খরচ করে থাকি। কৃপণতা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি কি প্রার্থনা শ্রবণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম এবং দান করার ব্যাপারে সবচেয়ে উদার সত্তা নই? না আমার দান-অনুগ্রহ সংকুচিত হয়ে গিয়েছে? দুনিয়ার কেউ কারও প্রতি অনুগ্রহশীল হলে সে তো আমারই দয়ার কারণে তা করে থাকে।
হে ঈসা ইবন মারয়াম! ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের অন্তরে আমি যে সব সদগুণ প্রদান করেছিলাম তারা যদি সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাত তা হলে আখিরাতের জীবনের উপরে দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিত না এবং বুঝতে পারত যে, কোথা থেকে তাদেরকে দান করা হয়েছে, আর তারা এটাও বিশ্বাস করত যে, মনের কামনা বাসনাই তাদের বড় দুশমন। তাদের রোজা আমি কিভাবে কবুল করি। যখন হারাম খাবার গ্রহণের মাধ্যমে তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে? তাদের নামায আমি কিভাবে কবুল করি, যখন তাদের অন্তর ঐ সব লোকদের প্রতি আকৃষ্ট যারা আমার বিরোধিতা করে এবং আমার নিষিদ্ধ বস্তুকে হালাল জানে? কি করে তাদের দান-সাদকা আমি মঞ্জুর করি, যখন তারা মানুষের উপর জুলুম করে অবৈধ পন্থায় তাদের ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। হে ঈসা! আমি ঐ সব লোকদেরকে যথাযথ প্রতিদান দিব। হে ঈসা! তাদের কান্নায় আমি দয়া দেখাব কিভাবে, যখন তাদের হাত নবীদের রক্তে রঞ্জিত? এ কারণে তাদের প্রতি আমার ক্রোধ অতি মাত্রায় বেশী। হে ঈসা! যে দিন আমি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছি- সে দিন-ই আমি এ বিষয়টি চূড়ান্ত করে রেখেছি যে, যে ব্যক্তি আমার দাসত্ব কবুল করবে এবং তোমার ও তোমার মা সম্পর্কে আমার বাণীকে সঠিক বলে মেনে নিবে, তাকে আমি তোমার ঘরের প্রতিবেশী বানাব, সফরের সাথী করব এবং অলৌকিক ঘটনা প্রকাশে তোমাশরীক করব। যে দিন আমি আসমান যমীন সৃষ্টি করেছি, সে দিন এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা করে রেখেছি যে, যে সব লোক তোমাকে ও তোমার মাকে আল্লাহর সাথে শরীফ করে প্রভু বানাবে, তাদেরকে আমি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে স্থান দিব। যে দিন আমি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছি, সে দিন এই সিন্ধান্ত চূড়ান্ত করে রেখেছি যে, আমি আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মদের হাতে এ বিষয়টি নিষ্পত্তি করব। তার উপরেই নবুওত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি টানব। তার জন্ম হবে মক্কায়, হিজরতস্থল (মদীনা) তায়্যিবা। শ্যাম দেশ তার করতলগত হবে। সে কর্কশ ভাষী ও কঠোর হৃদয় হবে না, বাজারে চিৎকার করে ফিরবে না, অশ্লীল অশ্রাব্য কথাবার্তা বলবে না। প্রতিটি বিষয়ে উত্তম পন্থা অবলম্বনের জন্যে আমি তাকে তাওফীক দিব। সৎ চরিত্রের যাবতীয় গুণাবলী তাকে প্রদান করব। তার অন্তর থাকবে তাকওয়ায় পরিপূর্ণ। জ্ঞান হবে প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তার স্বভাব, ন্যায় বিচার তার চরিত্র, সত্য তার শরীআত, ইসলাম তার আদর্শ, নাম হবে তার আহমদ।
আমি তার সাহায্যে মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে সঠিক পথ দেখাব, অজ্ঞতা থেকে ফিরিয়ে জ্ঞানের দিকে আনব, নিঃস্ব অবস্থা থেকে স্বচ্ছলতার দিকে আনব, বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে উন্নতির সোপানে উঠাব। তার দ্বারা সঠিক পথ প্রদর্শন করবো। তার সাহায্যে বধির ব্যক্তিকে শ্রবণ শক্তি দান করব, আচ্ছাদিত হৃদয় সমূহকে উন্মুক্ত করে দিব, বিভিন্ন কামনা-বাসনাকে সংযত করব। তার উম্মতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উম্মতের মর্যাদা দান করব। মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্যে তাদের অভ্যুদয় ঘটবে। তারা মানুষকে ভাল কাজে আহবান জানাবে ও গর্হিত কাজ থেকে নিষেধ করবে। আমার নামে তারা নিষ্ঠাবান থাকবে। রাসূলের আনীত আদর্শকে তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে। তারা তাদের মসজিদে, সভা সমিতিতে বাড়ি ঘরে ও চলতে ফিরতে সর্বাবস্থায় আমার তাসবীহ পাঠ করবে, পবিত্রতা ঘোষণা করবে ও লা ইলাহা ইল্লালাহ কলেমা পড়বে। তারা দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় রুকু সিজদার মাধ্যমে আমার জন্যে সালাত আদায় করবে। আমার পথে তারা সারিবদ্ধ হয়ে দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আল্লাহর পথে রক্ত দান হচ্ছে তাদের নিকট পুণ্যকর্ম। সুসংবাদের আশায় তাদের অন্তর ভরপুর, তাদের পুন্য কাজসমূহ প্রদর্শনীমুক্ত। রাতের বেলায় তারা আল্লাহর ধ্যানে মশগুল তাপস আর দিনের বেলায় যুদ্ধের ময়দানে সাক্ষাত সিংহ—এ সবই আমার অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তাকে দিই। আমি মহা অনুগ্রহশীল।
উপরে যা কিছু আলোচনা হল, এর সপক্ষে প্রমাণাদি আমরা সূরা মায়িদা ও সূরা সাফ এর প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করব ইনশা আল্লাহ। আবু হায়ফা ইসহাক ইবন বিশর বিভিন্ন সূত্রে কা'ব আল-আহবার, ওহাব ইবন মুনাব্বিহ, ইবন আব্বাস (রা) ও সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। বর্ণনায় তাদের একজনের বক্তব্য অন্যজনের বক্তব্যের সাথে মিশে গেছে। তারা বলেন যে, হযরত ঈসা ইবন মারয়াম যখন বনী ইসরাঈলের নিকট প্রেরিত হলেন এবং তাদের সম্মুখে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি তুলে ধরলেন তখন বনী ইসরাঈলের মুনাফিক ও কাফির শ্রেণীর লোকেরা তাঁর সাথে উপহাস করতো। তারা জিজ্ঞেস করত, ‘বলুন তো, অমুক গতকাল কী খাবার খেয়েছে এবং বাড়িতে সে কী রেখে এসেছে?’ হযরত ঈসা (আ) তাদেরকে সঠিক জবাব দিয়ে দিতেন। এতে মুমিনদের ঈমান এবং কাফির ও মুনাফিকদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও বেড়ে যেত, এতদসত্ত্বেও হযরত ঈসার মাথা গোঁজায় মত কোন ঘর বাড়ী ছিল না। খোলা আকাশের নীচে মাটির উপর তিনি সালাত ও তাসবীহ আদায় করতেন। তাঁর কোন স্থায়ী আবাসস্থল বা ঠিকানা ছিল না। সর্বপ্রথম তিনি যে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেন সে ঘটনাটি ছিল এরূপঃ-
একদা তিনি কোন এক কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ কবরের নিকটে এক মহিলা বসে কাঁদছিল। ঈসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ মহিলাটি বলল, ‘আমার একটি মাত্র কন্যা ছিল। সে ছাড়া আমার আর কোন সন্তান নেই। আমার সে কন্যাটি মারা গিয়েছে। আমি আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, হয় তিনি আমার কন্যাকে জীবিত করে দিবেন, না হয় আমিও তার মত মারা যাব, এ জায়গা ত্যাগ করব না। আপনি এর দিকে একটু লক্ষ্য করুন।’ ঈসা (আ) বললেন, ‘আমি যদি লক্ষ্য করি তবে কি তুমি এখান থেকে ফিরে যাবে?’ মহিলাটি বলল, ‘হ্যাঁ, তা- ই করব।’ তারপর হযরত ঈসা (আ) দু' রাকআত সালাত আদায় করে কবরের পাশে এসে বসলেন এবং বললেনঃ ‘ওহে অমুক, তুমি আল্লাহর হুকুমে উঠে দাঁড়াও, এবং বের হয়ে এস।’ তখন কবরটি সামান্য কেঁপে উঠল। ঈসা (আ) দ্বিতীয়বার আহবান করলেন। এবার কবরটি ফেটে গেল। তৃতীয়বার আহবান করলে কবরবাসিনী বেরিয়ে আসল এবং মাথার চুল থেকে ধুলাবালি ঝেড়ে ফেলতে লাগল। ঈসা (আ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বের হতে তোমার দেরী হল কেন?’ মেয়েটি বলল, ‘প্রথম আওয়াজ শোনার পর আল্লাহ আমার নিকট একজন ফেরেশতা পাঠান। তিনি আমার দেহের অংগ-প্রত্যংগগুলি জোড়া লাগান। দ্বিতীয় আওয়াজের পর রূহ আমার দেহের ভিতর প্রবেশ করে। তৃতীয় আওয়াজ যখন হল তখন আমার ধারণা হল, এটা কিয়ামতের আওয়াজ। আমি ভীত-শংকিত হয়ে পড়লাম। কিয়ামতের ভয়ে আমার মাথার চুল ও চোখের ভ্রু সব সাদা হয়ে গিয়েছে। তারপর মেয়েটি তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, মা! আপনি আমাকে মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ দুইবার গ্রহণ করালেন কেন? মা! ধৈর্য ধরুন, পুণ্যের আশা করুন। দুনিয়ার উপরে থাকার কোন আগ্রহ আমার নেই। হে রূহুল্লাহ! হে কলেমাতুল্লাহ! আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যেন আমাকে তিনি আখিরাতের জীবন ফিরিয়ে দেন এবং মৃত্যুর কষ্ট কমিয়ে দেন।’ ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন। ফলে মেয়েটির দ্বিতীয়বার মৃত্যু হল এবং তাকে কবরস্থ করা হল। এ সংবাদ ইয়াহদীদের নিকট পৌঁছলে তারা ঈসা (আ)-এর প্রতি পূর্বের চাইতে অধিক বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে উঠে।
ইতিপূর্বে হযরত নূহ (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পরে উল্লেখ করা হয়েছে যে,হযরত নূহের পুত্র সাম-কে জীবিত করে দেয়ার জন্যে বনী ইসরাঈলরা হযরত ঈসার নিকট দাবী জানায়। তিনি সালাত আদায় করে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ফলে আল্লাহ তাঁকে জীবিত করে দেন। সাম জীবিত হয়ে বনী ইসরাঈলদেরকে নূহ (আ)-এর নৌকা সম্বন্ধে অবহিত করেন, ঈসা (আ) পুনরায় দোয়া করলে তিনি আবার মাটির সাথে মিশে যান।
সুদ্দী .... ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হল, বনী ইসরাঈলের কোন এক বাদশাহর মৃত্যু হয়। কবরস্থ করার জন্যে তাকে খাটের উপর রাখা হয়। এ সময় হযরত ঈসা (আ) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। ফলে বাদশাহ জীবিত হয়ে যায়। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে এ আশ্চর্য ও অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। আল্লাহর বাণীঃ-
—আল্লাহ বললেন, ‘হে মারয়াম-তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার মায়ের প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর ও পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে; তোমাকে কিতাব হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি কাদা দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখী সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখী হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে তুমি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতিক্রমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমা হতে বনী ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এতো স্পষ্ট যাদু। আরও স্মরণ কর, আমি যখন হাওয়ারীদেরকে এই আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা তো মুসলিম।’ (৫ মায়িদাঃ ১১০-১১১)
এখানে আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসার প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহসমূহ ও পিতা ব্যতীত মায়ের থেকে সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁকে তিনি মানব জাতির জন্যে নিদর্শন বানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এটা আল্লাহর অসীম ক্ষমতারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। এ সবের পরেও তাকে রাসূল বানিয়ে নিজ অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। “তোমার মায়ের প্রতি আমার অনুগ্রহ” অর্থাৎ প্রথমত, এই বিশাল নিয়ামতের অধিকারী মহান নবীর মা হওয়ার জন্যে তাঁর প্রতি যে কুৎসা রটনা করেছিল তা থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রমাণ উপস্থাপন। “পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম।” পবিত্র আত্মা অর্থ জিবরাঈল ফেরেশতা। জিবরাঈলের দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন এভাবে যে, তিনি তাঁর রূহূকে তার মায়ের জামার হাতার মধ্যে ফুৎকার দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন; রিসালাতের দায়িত্ব পালনকালে তিনি ঈসা (আ)-এর সাথে সাথে থাকতেন এবং নবীর বিরোধীদেরকে তিনি প্রতিহত করতেন। "দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে কথা বলার" অর্থ-তুমি শিশুকালে দোলনায় থাকা অবস্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছ এবং পরিণত বয়সেও তাদেরকে আহ্বান করবে। কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়ার অর্থ লিপি জ্ঞান ও গভীর অনুধাবন শক্তি দান করা। প্রাচীন যুগের আলিম এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। “কাদা দ্বারা পাখীর আকৃতি গঠন” অর্থাৎ আল্লাহর অনুমতিক্রমে তুমি কাদা দ্বারা পাখীর আকৃতি অবয়ব গঠন করতে। “আমার অনুমতিক্রমেপাখী হয়ে যেত।” অনুমতিক্রমে অর্থ আদেশক্রমে, আল্লাহর অনুমতি কথাটি আনার উদ্দেশ্য হল, মানুষ যাতে এই সন্দেহ না করে যে, ঈসা নিজের ক্ষমতা বলেই এরূপ করেছেন। জন্মান্ধ বলতে এখানে কোন কোন আলিম বলেছেনঃ যার কোন চিকিৎসা নেই। কুষ্ঠ রোগীও এমন কুষ্ঠরোগ, যার কোন চিকিৎসা নেই। “মৃতকে জীবিত করা” অর্থাৎ কবর থেকে জীবিত অবস্থায় উঠানো। আমার অনুমতিক্রমে শব্দটির পুনরুক্তি। এ কথা দ্বারা ঐ ঘটনার দিকে ইংগিত করা হয়েছে, যখন বনী ইসরাঈলরা তাকে শূলে চড়াবার জন্যে উদ্যত হয়েছিল। তখন আল্লাহ তাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং আপন সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছিলেন। “আমি যখন হাওয়ারীদেরকে ওহী মারফত আদেশ দিয়েছিলাম এখানে ওহীর দু’প্রকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
এক; ওহী অর্থ ইলহাম বা প্রেরণা জাগিয়ে দেওয়া। এ অর্থে কুরআনের আয়াত যেমনঃ-
( وَأَوۡحَىٰ رَبُّكَ إِلَى ٱلنَّحۡلِ )
তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে উহার অন্তরে ইংগিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন (১৬ নাহলঃ ৬৮)
—মূসার মায়ের অন্তরে আমি ইংগিতে নিদের্শ করলাম, শিশুটিকে স্তন্য দান করতে থাক। যখন তুমি তার সম্পর্কে কোন আশংকা করবে তখন একে দরিয়ায় নিক্ষেপ করে দিও। (২৮ কাসাসঃ ৭)
দুই; রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত ওহী এবং তাদেরকে সত্য গ্রহণের তাওফীক দেওয়া। এ জন্যেই তারা প্রতি উত্তরে বলেছিল ( امنا واشهد باننا مسلمون ) “আমরা ঈমান আনলাম এবং তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম।” হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ সমূহের মধ্যে অন্যতম বড় অনুগ্রহ এই যে, তিনি তাকে এমন একদল সাহায্যকারী ও সেবক দিয়েছিলেন, যারা তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং মানুষকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানাতেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে বলেছেনঃ-
—তিনি তোমাকে আপন সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন; এবং তিনি ওদের পরস্পরের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৮ আনফালঃ ৬২,৬৩)
“এবং তিনি তাকে শিক্ষা দিবেন কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল এবং তাকে বনী ইসরাঈলের জন্যে রাসূল করবেন। সে বলবে, আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্যে কাদা দিয়ে একটি পাখীর আকৃতি গঠন করব; তাতে আমি ফুৎকার দিব; ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করব। তোমরা তোমাদের ঘরে যা আহার কর ও মওজুদ কর তা তোমাদেরকে বলে দেব। তোমরা যদি মুমিন হও তবে এতে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। আর আমি এসেছি আমার সম্মুখে তাওরাতের যা রয়েছে তার সমর্থকরূপে ও তোমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতকগুলোকে বৈধ করতে। এবং আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর ও আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা তার ইবাদত করবে। এটাই সরল পথ। যখন ঈসা তাদের অবিশ্বাস উপলব্ধি করল তখন সে বলল, ‘আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী?’ হাওয়ারীরা বলল, ‘আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহতে ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমর্পণকারী, তুমি এর সাক্ষী থাক। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যা অবতীর্ণ করেছ তাতে আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এই রাসূলের অনুসরণ করেছি। সুতরাং আমাদেরকে সাক্ষ্য দানকারীদের তালিকাভুক্ত কর।’ এবং তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও কৌশল করেছিলেন; আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।” (৩ আলে ইমরানঃ ৪৮-৫৮)
প্রত্যেক নবীর মু'জিযা ছিল তার নিজ যুগের মানুষের চাহিদার উপযোগী। যেমন হযরত মূসা (আ)-এর যুগের লোকেরা ছিল তীক্ষ্ণধী যাদুকর। আল্লাহ তাঁকে এমন মু'জিযা দান করলেন যা যাদুকরদের চোখ ঝলসিয়ে দিয়েছিল এবং যাদুকররা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল। যাদুকররা যাদু সংক্রান্ত তথ্যাদি সম্পর্কে অবগত ছিল। যাদুর দৌড় যে কী পর্যন্ত, সে সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিল। সুতরাং যখন তারা মূসা (আ)-এর মু'জিযা প্রত্যক্ষ করল তখন তারা বুঝতে পারলো যে, এতো মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভূত ব্যাপার। আল্লাহর সাহায্য ও প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যতীত কোন মানুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু প্রকাশ হতে পারে না। কোন নবীর সত্যতা প্রমাণের জন্যে আল্লাহ এরূপ মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভূত কিছু প্রকাশ করে থাকেন। সুতরাং কালবিলম্ব না করে তারা মূসা (আ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। অনুরূপভাবে হযরত ঈসা ইবন মারয়াম (আ)-কে যে যুগে প্রেরণ করা হয় সে যুগটি ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্যে প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তাঁকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন মু'জিযা দান করলেন যা ছিল তাদের ক্ষমতা ও আয়ত্তের বাইরে। একজন চিকিৎসক যখন অন্ধ, খঞ্জ, কুষ্ঠ ও পঙ্গুকে ভাল করতে অক্ষম, সেখানে একজন জন্মান্ধকে ভাল করার প্রশ্নই উঠে না। আর একজন মৃত ব্যক্তিকে কবর থেকে জীবিত উঠাবার শক্তি মানুষের জন্যে তো কল্পনাই করা যায় না। প্রত্যেকেই বুঝে যে, এসব এমন মু'জিযা, যার মাধ্যমে এগুলো প্রকাশ পায় তার দাবির পক্ষে এটা হয়ে থাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং যে সত্তা তাকে প্রেরণ করেন তাঁর কুদরত ও মহাশক্তির প্রমাণ।
একই পদ্ধতিতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে যে যুগে প্রেরণ করা হয় সে যুগটি ছিল বালাগাত-ফাসাহাত তথা অলংকারশাস্ত্রে সমৃদ্ধ উন্নত ভাষা শিল্পের যুগ। আল্লাহ তাঁর উপর কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেন। যে কোন ত্রুটি থেকে তা মুক্ত। কুরআনের বাক্য ও শব্দগুলো এমনই মু'জিযা যে, মানব ও জিন জাতিকে সম্মিলিতভাবে এই কুরআনের অনুরূপ একটি কুরআন, কিংবা অনুরূপ ১০টি সূরা অথবা মাত্র ক্ষুদ্র একটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এরপর দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে যে, তারা কোন দিন এ চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করতে পারবে না-বর্তমানেও না, ভবিষ্যতেও না, এখনই যখন পারেনি, ভবিষ্যতে কখনও পারবে না। এরকম ভাষা তারা তৈরি করতে এ জন্যে পারবে না, যেহেতু এটা আল্লাহর বাণী। আর আল্লাহর সাথে কোন কিছুরই তুলনা হতে পারে না -না তার সত্তার সাথে না তার গুণাবলীর সাথে, না তাঁর কার্যাবলীর সাথে।
হযরত ঈসা (আ) যখন বনী ইসরাঈলের নিকট অকাট্য দলীল-প্রমাণ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তখন তাদের অধিকাংশ লোকই কুফরী, ভ্রষ্টতা, বিদ্বেষ ও অবাধ্যতার উপর অটল থেকে যায়। তবে তাদের একটি ক্ষুদ্র দল তার পক্ষ অবলম্বন করে এবং বিরোধিতাকারীদের প্রতিবাদ জানান। তারা নবীর সাহায্যকারী হন ও তার শিষ্যত্ব বরণ করেন। তাঁরা নবীর আনুগত্য করেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন ও উপদেশ মেনে চলেন। এই ক্ষুদ্র দলটির আত্মপ্রকাশ তখন ঘটে যখন বনী ইসরাঈল তাকে হত্যার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সে যুগের জনৈক বাদশাহর সাথে ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে তাঁকে হত্যা ও শূলে চড়ানোর চক্রান্ত সম্পন্ন করে। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। তাদের মধ্য থেকে নবীকে তাঁর সান্নিধ্যে উঠিয়ে নেন এবং তার একটি শিষ্যকে তাঁর চেহারার অনুরূপ চেহারায় রূপান্তরিত করে দেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলরা তাকে ঈসা মনে করে হত্যা করে ও শূলে চড়ায়। এ ব্যাপারে তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও সত্যকে উপেক্ষা করে। খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক এদের দাবিকে সমর্থন করে। কিন্তু উভয় দলই এ ব্যাপারে ভুলের মধ্যে রয়েছে।
আল্লাহর বাণী “তারা এক চক্রান্ত করেছিল, আর আল্লাহ এক কৌশল অবলম্বন করলেন। আল্লাহই উত্তম কৌশল অবলম্বনকারী।” আল্লাহ আরও বলেনঃ- “স্মরণ কর, মারয়াম তনয় ঈসা বলেছিল, ‘হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সমর্থক এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা।’ পরে সে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের নিকট আসল তারা বলতে লাগল, এতো এক স্পষ্ট যাদু। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহুত হয়েও আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভাতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” (সূরা সাফঃ ৬-৮)
এরপরে আল্লাহ বলেনঃ “হে মুমিনগণ! আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারয়াম তনয় ঈসা বলেছিল তার শিষ্যগণকে, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে?‘ শিষ্যগণ বলেছিল, ‘আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী।’ অতঃপর বনী ইসরাঈলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল। পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শত্রুদের মুকাবিলায়ঃ ফলে তারা বিজয়ী হল। (৬ সূরা সাফঃ ১৪)
অতএব, ঈসা (আ) হলেন বনী ইসরাঈলের শেষ নবী। তিনি তাদের তার পরে আগমনকারী সর্বশেষ নবীর সুসংবাদ দান করেন, তাঁর নাম উল্লেখ করেন এবং তাঁর লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে করে সেই নবী যখন আগমন করবেন তখন তারা তাঁকে চিনতে পারে ও তার আনুগত্য করতে পারে। তারা যাতে কোন রকম অজুহাত তুলতে না পারে, সে জন্যে তিনি দলীল-প্রমাণ চূড়ান্তভাবে পেশ করেন এবং তাদের প্রতি এটা ছিল আল্লাহর অনুকম্পা স্বরূপ। যেমনটি আল্লাহ বলেনঃ “যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়। যে তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার থেকে ও শৃংখল থেকে যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে। তার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (৭ আরাফঃ ১৫৭)
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ... রাসূল (সা)-এর কতিপয় সাহাবীদের বরাতে বর্ণনা করেন যে, একদা তাঁরা বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে অবহিত করুন।’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ইবরাহীম (আ)-এর দোয়ার ফলে, ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ। যখন আমি মায়ের পেটে ছিলাম তখন আমার মা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি নূর বের হয়ে শাম দেশের বুসরা নগরী প্রাসাদরাজিকে আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। ইরবায ইবন সারিয়া ও আবু উমামাও রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণনায় এসেছে যে, আমি ইবরাহীম (আ)-এর দোয়া এবং ঈসা (আ)-এর সুসংবাদ। ইবরাহীম (আ) যখন কা'বা ঘর নির্মাণ করেন তখন আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন যে, “হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ কর। (২ বাকারাঃ ১২৯)
অতঃপর বনী ইসরাঈলের মধ্যে নবুওতের ধারাবাহিকতা যখন ঈসা (আ) পর্যন্ত এসে শেষ হল তখন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, তাদের মধ্যে নবী প্রেরণের ধারা শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর আরবদের মধ্যে এক উম্মী নবী আসবেন। তিনি হবেন খাতিমুল আম্বিয়া বা শেষ নবী। তাঁর নাম হবে আহমদ, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম। ইসমাঈল ইবন ইবরাহীমের বংশধর।
আল্লাহ বলেন, “পরে সে যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের নিকট আসল, তারা বলতে লাগল, এতো এক স্পষ্ট যাদু” (৬ সাফঃ ৬)। “সে যখন আসল” এখানে 'সে' সর্বনাম দ্বারা ঈসা (আ)-কেও বুঝানো হতে পারে, এবং আবার মুহাম্মদ (সা)-কেও বুঝানো হতে পারে। তারপর আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে, মুসলমানদেরকে সাহায্য করতে এবং নবীকে সম্মান করতে ও ইকামতে দীন এবং দাওয়াত সম্প্রসারণ কাজে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দান করেন।
আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহর দীনের সাহায্যকারী হও, যেমন মারয়াম-তনয় বলেছিল তার শিষ্যগণকে, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে।” অর্থাৎ আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান জানাবার কাজে কে আমাকে সাহায্য করবে?’ শিষ্যগণ বলেছিল, ‘আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী।” নাসিরা নামক একটি গ্রামে ঈসা নবীর সাথে শিষ্যদের এই কথাবার্তা হয়েছিল; এ জন্যেই পরবর্তীতে তারা নাসারা নামে আখ্যায়িত হয়।
আল্লাহর বাণীঃ- “অতঃপর বনী ইসরাঈলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরী করল।” অথাৎ ঈসা (আ) যখন বনী ইসরাঈলসহ অন্যদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেন তখন কিছু লোক দাওয়াত কবুল করল এবং কিছু লোক প্রত্যাখ্যান করল। সীরাতবেত্তা ইতিহাসবিদ ও তাফসীরবিদগণ লিখেছেন যে, এন্টিয়কের সমস্ত অধিবাসী ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করে। ঈসা (আ) এন্টিয়কে তিনজন দুত প্রেরণ করেন। তাদের এক জনের নাম শামউন আস-সাফা। তারা তার আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ঈমান গ্রহণ করে। সূরা ইয়াসীনে যে তিনজন দূতের উল্লেখ আছে, এরা সেই তিনজন নন, আলাদা তিনজন। আসহাবুল কারিয়ার ঘটনায় আমরা এ বিষয়ে আলোচনা ইতিপূর্বে করেছি। বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ ইয়াহুদী ঈসা (আ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে আল্লাহ ঈমান গ্রহণকারীদেরকে সাহায্য ও শক্তি দান করেন। ফলে তারা ঈমান প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে পর্যুদস্ত করে এবং তাদের উপর বিজয় লাভ করে। এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন, “স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমার মেয়াদ পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে নিচ্ছি এবং যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের মধ্য হতে তোমাকে মুক্ত করছি। আর তোমার অনুসারীগণকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপরে প্রাধান্য দিচ্ছি। (৩ আলে ইমরানঃ ৫৫) এ আয়াতের আলোকে যে সব দল ও সম্প্রদায় হযরত ঈসা(আ)-এর দীন ও দাওয়াতের অধিক নিকটবর্তী, তারা তুলনামূলক নিম্নবর্তীদের উপর বিজয় ও প্রাধান্য লাভ করবে। সুতরাং ঈসা (আ)-এর ব্যাপারে মুসলামানদের বিশ্বাসই যথার্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই। আর তা হচ্ছে তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। সুতরাং নাসারাদের (খ্রীষ্টানদের) উপর তারা বিজয়ী থাকবেন। কেননা, নাসারাগণ তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে তার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে, এবং আল্লাহ্ তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তারা তার চাইতে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছে।
যেহেতু মোটামুটিভাবে অভিশপ্ত ইয়াহুদীদের তুলনায় ঈসা (আ)-এর আদর্শের কাছাকাছি অবস্থানে আছে, সে জন্যে তারা ইয়াহুদীদের উপরে বিজয়ী হয়ে ইসলামের পূর্বেও ছিল এবং ইসলামের আবির্ভাবের পরেও রয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/489/26
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।