hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৮৪
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পবিত্র জীবন-চরিত
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

( ٱللَّهُ أَعۡلَمُ حَیۡثُ یَجۡعَلُ رِسَالَتَهُۥ )

[Surah Al-An’am 124]

“আল্লাহ রিসালাতের ভার কার উপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।” (৬ঃ ১২৪)

রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিচয় সম্পর্কে যে ক’টি প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে তিনি একথাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘তোমাদের মাঝে তাঁর বংশ মর্যাদা কেমন?’ উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে তিনি সম্ভ্রান্ত বংশীয়।’ তখন হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন, ‘এমনিভাবে সব রাসূলই নিজ নিজ সমাজের সম্ভ্রান্ত বংশে প্রেরিত হয়ে থাকেন।’ অর্থাৎ রাসূলগণ বংশগতভাবে সকলের চাইতে সম্রান্ত আর তাদের বংশের জনসংখ্যাও সর্বাধিক হয়ে থাকে।

রাসূলুল্লাহ (সা) হলেন আদম সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইহকাল-পরকালে তাদের গর্বের ধন। তাঁর উপনাম আবুল কাসিম ও আবু ইবরাহীম। তিনিই মুহাম্মদ, আহমাদ, আলমাহী- যার মাধ্যমে কুফরের মূলোৎপাটিত হয়। তিনিই আল-আকিব-যার পরে আর কোন নবী নেই। আল-হাশির-যার পদপ্রান্তে সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। তিনি আল-মুকফী, নবীউর রহমত, নবীউত তওবা, নবীউল মালহামাহ, খাতামুন্নাবিয়্যিন, আল-ফাতিহ, ত্বাহা, ইয়াসীন ও আবদুল্লাহ।

বায়হাকী বলেন, কোন কোন আলিম রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আরও অনেক নামের উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁকে রাসূল, নবী, আমীন, শাহিদ, মুবাশশির, নাযীর, দাঈআন ইলাল্লাহি বিইযনিহী, সিরাজাম মুনীরা, রাউফুর রাহীম ও মুযাক্কির অভিধায় অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তাঁকে রহমত, নিয়ামত ও হাদী বানিয়েছেন। সীরাত আলোচনার পর স্বতন্ত্র একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বায়হাকী ও ইবন আসাকির সেগুলো সংকলন করেছেন। তাছাড়া স্বতন্ত্রভাবে অনেকে এ বিষয়ে বহু গ্রন্থও রচনা করেছেন। এমনকি কেউ কেউ তো রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এক হাজার নামের তালিকা সংকলনের কসরত পর্যন্ত করেছেন। তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার ইবনুল আরাবী আল-মালিকী তাঁর ‘আল আহওয়াযী’ গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চৌষট্টিটি নামের উল্লেখ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) হলেন আবদুল্লাহর পুত্র। আবদুল্লাহ ছিলেন তাঁর পিতা আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠ পুত্র। এই আবদুল্লাহই ইতিহাসে দ্বিতীয় যবীহ’ বলে খ্যাত, যার বদলে একশত উট জবাই করা হয়েছিল। পূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

যুহরী বলেন, আবদুল্লাহ ছিলেন কুরাইশের সবচাইতে সুশ্রী ব্যক্তি। তার ভাইরা হচ্ছেন হারিস, যুবায়র, হামযা, যিরার, আবু তালিব (যার আসল নাম আবদে মানাফ), আবু লাহাব (যার আসল নাম আব্দুল উযযা) মুকাওয়িম (যার আসল নাম আবদুল কাবা)। কারও কারও মতে মুকাওয়িম আর আবদুল কা’বা ভিন্ন ভিন্ন দুই ব্যক্তি। হাজাল (যার আসল নাম মুগীরা)-প্রখ্যাত দানশীল, গায়দাক (যার আসল নাম নওফল) কারও কারও মতে গায়দাক আর হাজাল এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। এরা সকলেই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা। তার ফুফী ছিলেন ছয়জন। তারা হলেন, আরওয়া, বাররা, উমায়মাহ, সাফিয়্যাহ, আতিকাহ ও উম্মে হাকীম- যার অপর নাম বায়যা। এদের প্রত্যেকের ব্যাপারে পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এরা সকলে ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের সন্তান। আবদুল মুত্তালিবের আসল নাম ছিল শায়বাহ। তাঁর মাথায় কয়েকটি সাদা চুল ছিল বলে তাঁকে শায়বাহ বলা হতো। আবার তাঁর বদান্যতার কারণে তাঁকে শায়বাতুল হামদও বলা হতো।

তাঁকে আবদুল মুত্তালিব নামে আখ্যায়িত করার নেপথ্য কারণ এই যে, তার পিতা হাশিম বাণিজ্যোপলক্ষে যখন মদীনার পথে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হন, তখন একস্থানে আমর ইবনে যায়েদ (ইবনে লাবীদ ইবনে হারাম ইবনে খিদাশ ইবনে খানদাফ ইবনে ‘আদী ইবনে নাজ্জার আল-খাজরাজী আন-নাজ্জারী)-এর বাড়িতে মেহমান হন। আমর ইবনে যায়েদ ছিলেন তার সম্প্রদায়ের সরদার। এ সময়ে তার সালমা নাম্নী এক কন্যাকে দেখে হাশিম মুগ্ধ হন। তিনি তাকে বিবাহের জন্য তার পিতার নিকট প্রস্তাব দেন। আমার ইবন যায়েদ এই শর্তে মেয়েকে তার নিকট বিয়ে দেন যে, মেয়ে পিত্রালয়েই অবস্থান করবে। কারো কারো মতে, বিবাহের শর্ত এই ছিল যে, মদিনায় ছাড়া সালমা সন্তান প্রসব করতে পারবে না। সিরিয়া থেকে ফিরে হাশিম স্ত্রী সালমার সঙ্গে বাসর করেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় চলে আসেন। পরে পুনরায় ব্যবসা উপলক্ষে বের হলে স্ত্রীকেও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান। স্ত্রী সালমা তখন গর্ভবতী। ফলে মদীনায় রেখে হাশিম সিরিয়া গমন করেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে গাজায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। স্ত্রী সালমা যথাসময়ে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। তিনি তার নাম রাখেন শায়বা। শায়বা দীর্ঘ সাত বছর তাঁর মাতুলালয় আদী ইবন নাজ্জার গোত্রে অবস্থান করে। এরপর চাচা মুত্তালিব ইবনে আবদ মানাফ এসে একদিন শায়বাকে গোপনে মায়ের নিকট হতে নিয়ে মক্কায় চলে যান। লোকেরা দেখে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার সঙ্গে এই বালকটি কে?’ উত্তরে মুত্তালিব বলেন, ( عبدي ) অর্থাৎ আমার গোলাম। জনতা তাকে সাদরে বরণ করে নেয় এবং তাকে আবদুল মুত্তালিব বা মুত্তালিবের গোলাম বলে ডাকতে শুরু করে এবং এই নামই প্রসিদ্ধি লাভ করে। আবদুল মুত্তালিব ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। এক পর্যায়ে কুরাইশ সমাজের নেতৃত্বের আসন লাভ করেন। সকলের সেরা ব্যক্তি বলে পরিচিতি লাভ করেন। আবদুল মুত্তালিব এখন সকলের মধ্যমণি। হাজীদের পানি পান করানো (সিকায়া) এবং জনকল্যাণমূলক সব কাজ (রিফাদা)-এর নেতৃত্ব মুত্তালিবের পরে এখন তার হাতে। জুরহুমের আমল থেকে পরিত্যক্ত হয়ে থাকা যমযম কূপ তিনি পুনঃ খনন করেন। যমযম খননকালে প্রাপ্ত সোনার হরিণ মূর্তিদ্বয়ের সোনা দ্বারা তিনিই সর্বপ্রথম কাবার দরজায় প্রলেপ দেন। আবদুল মুত্তালিবের ভাই-বোনেরা হচ্ছেন আসাদ, ফুযলা, আবু সাইফী, হায়্যা, খালেদা, রুকাইয়া, শিফা ও যয়ীফা। এরা সকলে হাশিমের পুত্র-কন্যা। হাশিমের আসল নাম আমর। কোনো এক দুর্ভিক্ষের বছর গোশতের সঙ্গে ছারীদ তথা ঝোল মিশ্রিত রুটির টুকরা দুর্ভিক্ষ কবলিত অসহায় লোকদের খাবার দিয়েছিলেন বলে লোকেরা তাঁকে হাশিম নাম দেয়। হাশিম শব্দের অর্থ মিশ্রণকারী। হাশিম ছিলেন তাঁর পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইবন জারীর বর্ণনা করেন যে, হাশিম ছিলেন তাঁর তাই আবদে শামস এর জমজ। হাশিম যখন মায়ের পেট থেকে বের হন তখন তার পা আবদে শামস এর মাথার সঙ্গে আটকে ছিল। এতে দু’জনের শরীর থেকেই রক্তক্ষরণ হয়। এতে লোকের মন্তব্য করে যে, এর ফলে এই দু’ ভাইয়ের সন্তানদের মাঝে বিবাদ জন্ম নেবে। কার্যত হয়েছেও তাই। একশ’ তেত্রিশ হিজরী সনে বনু আব্বাস ও বনু উমাইয়া ইবনে আবদে শামস-এর মধ্যে ভয়াবহ সংঘাত অনুষ্ঠিত হয়।

হাশিমের তৃতীয় সহোদর হলেন মুত্তালিব। মুত্তালিব ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁর মায়ের নাম আতিকা বিনতে মুররা ইবন হিলাল। তার চতুর্থ ভাইয়ের নাম নওফল। নওফল আরেক মায়ের সন্তান। তার নাম ওয়াকিদা বিনতে আমর আল মাযেনিয়াহ। পিতার মৃত্যুর পর এরা প্রত্যেকেই নেতৃত্বে আসীন হন। সমাজের মানুষ তাদেরকে ত্রাণকর্তা বলে অভিহিত করত। কারণ তারা বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কুরাইশদের জন্য যে কোনো দেশে ব্যবসা করতে যাওয়ার অবাধ নিরাপত্তা এনে দিয়েছিলেন। হাশিম সিরিয়া, রোম ও গাসসান থেকে, আবদে শামস হাবশার রাজা বড় নাজাশী থেকে, নওফল কিসরা থেকে এবং মুত্তালিব হিময়ার এর রাজ্যগুলো থেকে নিরাপত্তা এনে দেন। কবির ভাষায়ঃ

يأيها الرجل المحول رحله - الأ نزلت بأل عبد مناف

— ওহে পরিভ্রমণকারী মুসাফির! তুমি তো আবদে মানাফের বংশের লোকদের আতিথেয়তা গ্রহণ না করে ছাড়নি!

পিতার মৃত্যুর পর হাশিমের দায়িত্বে ছিল সিকায়া তথা হাজীদের পানি পান করানো ও রিফাদা তথা জনকল্যাণমূলক কাজ। আর হাশিম ও তার ভাই মুত্তালিবের যৌথ দায়িত্বে ছিল আত্মীয় স্বজনের বংশ তালিকা সংরক্ষণ করা। তারা সব ভাই জাহিলিয়াত ও ইসলামের উভয় পরিবেশে একান্নভুক্ত ছিলেন, কখনো ভিন্ন হননি। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বন্দী জীবনে তাঁরাও গিরিবর্তে তার সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন। সরে গিয়েছিল শুধু আবদে শামস ও নওফল। এ কারণে আবু তালিব তাদের সম্পর্কে বলতেনঃ

جزى الله عنا عبد شمس ونوفلا- عقوبة شرعاجلا غير أجل

—অনতিবিলম্বে আল্লাহ যেন আবদে শামস ও নওফলকে শাস্তি দিয়ে তাদের অপকর্মের বিচার করেন।

আবু তালিবের পুত্রগণ এক একজন এক এক স্থানে মারা যান। অন্য কোন পিতার সন্তানদের সাধারণত এভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায় না। যেমনঃ হাশিম জেরুজালেমের গাজা উপত্যকায় মৃত্যুবরণ করেন, আবদে শামস মারা যায় মক্কায়, নওফল ইরাকের সালামান নামক স্থানে আর মুত্তালিবের মৃত্যু হয় ইয়েমেনের রায়মান নামক জায়গায়। অনুপম রূপের কারণে মুত্তালিবকে কামরও (চন্দ্র) বলা হতো। হাশিম, আবদে শামস, নওফল ও মুত্তালিব এই চার ভাইই সর্বজন পরিচিত। এদের আরেকজন অখ্যাত ভাই ছিলেন, তাঁর নাম ছিল আবু আমর বা আবদ। তবে তার আসল নাম আবদে কুসাই। এই অখ্যাতির কারণে মানুষ তাকে তাদের আপন ভাই বলে গণ্য করত না। এরপর তাদের আর কোনো ভাই ছিলেন না। যুবায়র ইবনে বাক্কার প্রমুখ একথা বলেছেন।

মুত্তালিবের ছয় বোন ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল তামাযুর, হায়্যা, রীতা, কিলাবা, উম্মুল আখসা ও উম্মে সুফিয়ান। এঁরা সকলে আবদে মানাফের সন্তান ছিলেন। মানাফ একটি মূর্তির নাম। আবদে মানাফের প্রকৃত নাম ছিল মুগীরা। পিতার জীবদ্দশাতেই তিনি সমাজের নেতৃত্ব দিতেন। সকলের কাছে তিনি একজন শ্রদ্ধাভাজন ও মাননীয় ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। আবদে মানাফ ছিলেন আবদুদ্দার এর ভাই। আবদুদ্দার ছিলেন পিতার বড় সন্তান। মৃত্যুকালে পিতা তাকেই নিজের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ওসিয়ত করে যান। আবদুল উযয়া, আবদ, বাররাহ এবং তাখাম্মুরও আবদে মানাফের ভাই। এদের মায়ের নাম ছিল হুয়াই বিনতে হালীল। হুয়াই এর পিতা হালীল ছিলেন খুযায়া গোত্রের সর্বশেষ শাসনকর্তা। তারা সকলেই কুসাই-এর সন্তান ছিলেন। কুসাই-এর আসল নাম যায়েদ। কুসাই নামকরণের কারণ হলো, পিতার মৃত্যুর পর তার মা পুনরায় রবীয়া ইবন হিযাম ইবন আযরা এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর রবীয়া স্ত্রীকে নিয়ে নিজ দেশে রওনা হন।। শিশু যায়েদও মায়ের সঙ্গে ছিলেন। সেই থেকে তিনি কুসাই নামে অভিহিত হন। কুসাই শব্দের অর্থ হচ্ছে দূরদেশী। অতঃপর বড় হয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। কুরায়শরা এদিক-সেদিক বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর কুসাই বিভিন্ন এলাকা থেকে খুঁজে এনে আবার তাদেরকে মক্কায় প্রতিষ্ঠিত করেন। বাইতুল্লাহর দখল থেকে বনি খুযাআকে উৎখাত করে তাদেরকে মক্কা থেকে বের করে দেন। সত্য স্ব-স্থানে প্রতিষ্ঠিত এবং কুসাই এককভাবে কুরাইশের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। দৌত্যকর্ম, যমযম কূপ থেকে হাজীদের পান করানো, বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, যুদ্ধের সময় পতাকা বহন এবং দারুন নাদওয়া ইত্যাদি সবকিছুই তাঁর দায়িত্বে ছিল। বিখ্যাত দারুন-নাদওয়া তাঁর ঘরেই ছিল। তাই কবি বলেনঃ

قصى لعمري كان يدعى مجمعا - به جمع الله القبائل من فهر

—আমার জীবনের শপথ! কুসাই ছিলেন সকলের মিলন সাধনকারী। তার মাধ্যমে আল্লাহ ফিহর এর সব কটি গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

কুসাই ছিলেন যাহরার ভাই। তারা দু’জন ছিলেন কিলাবের পুত্র। তাইম ও ইয়াকযা আবু মাখযূমের ভাই। তারা তিনজনই ছিলেন মুররা-এর পুত্র। মুররার ভাই ছিলেন আদী ও হাসীস। তারা তিনজন ছিলেন কা’ব এর পুত্র। কা’ব প্রতি জুমাবারে তার সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আগমনের সুসংবাদ শোনাতেন এবং এ সংক্রান্ত নানা রকম কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। যেমন আমরা পূর্বে বলে এসেছি। কা’ব ছিলেন। আমের, সামাহ, খুযায়মাহ, সাদ, হারিছ ও আওফ-এর ভাই। তারা সাতজন ছিলেন লুওয়াই-এর পুত্র, আল আদরাম-এর ভাই। লুওয়াই ছিলেন তাইম-এর ভাই আবু তাইম আল-আদরাম ছিলেন গালিব এর পুত্র। হারিছ ও গালিবের ভাই ছিলেন মুহারিব। এরা তিনজন ছিলেন ফিহর এর সন্তান। ফিহর ছিল হারিছ-এর ভাই। তাদের পিতা ছিলেন মালিক। মালিক ছিলেন সালত ইয়াখলুদের ভাই। এঁরা তিনজন ছিলেন নাযর এঁর পুত্র। বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে, এই নাযর-ই ছিলেন কুরায়শ বংশের স্থপতি। আমরা পূর্বে এর প্রমাণও পেশ করে এসেছি। নাযর ছিলেন মালিক, মালকান ও আবদে মানাত প্রমুখের ভাই। তারা সকলে ছিলেন কিনানার পুত্র। আসাদ, আসদাহ ও হাওন ছিলেন কিনানার ভাই। এরা সকলেই ছিলেন খুযায়মার পুত্র। খুযায়মা ছিলেন হুযায়লের ভাই। খুযায়মা ও হুযায়ল ছিলেন মুদরিকাহর পুত্র। মুদরিকার আসল নাম ছিল আমর। তার ভাই ছিলেন তাবিখা, যার আসল ছিল নাম আমির। মুদরিকা, তাবিখা, ও কামআ তিন জনই ছিলেন ইলিয়াসের পুত্র। ইলিয়াসের এক ভাই ছিলেন গায়লান। গায়লান ছিলেন কায়স গোত্রের পিতা। এই ইলিয়াস ও গায়লান দুইজন ছিলেন রবীয়ার ভাই মুযার এর সন্তান। মুযার ও রবীয়াকে সরাসরি ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর বলে দাবি করা হয়। আনমার ও ইয়াদ তায়ামুনা নামে এঁদের আরও দুই ভাই ছিলেন। এই চার ভাই ছিলেন কুযাআর ভাই নেযার-এর সন্তান। এই অভিমত তাদের, যারা মনে করেন যে, কুযাআ হিজাযী ও আদনানী বংশোদ্ভূত। উপরে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নেযার ও কুযাআ মা’আদ ইবনে আদনান-এর সন্তান।

আরবদের যে বংশনামা আমরা বর্ণনা করলাম, এ ব্যাপারে আলিমগণের কোনো দ্বিমত নেই। এই বংশ তালিকায় প্রমাণিত হয় যে, আরবের সকল গোত্রের বংশ পরম্পরা এই পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। এ কারণেই হযরত ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ

( قُل لَّاۤ أَسۡـَٔلُكُمۡ عَلَیۡهِ أَجۡرًا إِلَّا ٱلۡمَوَدَّةَ فِی ٱلۡقُرۡبَىٰ )

[Surah Ash-Shura 23]

—বল, আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আত্মীয়ের সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না। (৪২ঃ২৩) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, কুরায়শের যত গোত্র আছে তাতে এমন কোনো গোত্র নেই, যাদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশ সম্পৃক্ত নয়। ইবনে আব্বাস (রা) যথার্থই বলেছেন। আমি তো এ-ও বলতে চাই যে, আরবের সকল আদনানী গোত্র পিতৃকূলের দিক থেকে রাসূল (সা) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। অনেক গোত্র মাতৃকূলের দিক থেকেও এর সাথে সম্পর্কিত। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক প্রমুখ এরূপই বলেছেন। হাফিজ ইবনে আসাকির-এর অভিমতও অনুরূপ। আদনানের জীবন চরিতে আমরা তার বংশনামা এবং সে সম্পর্কিত মতভেদের উল্লেখ করেছি। আর এও বলেছি যে, আদনান নিশ্চিতরূপে ইসমাঈল (আ)-এর বংশধর। যদিও তাদের দু’জনের মধ্যে কত পুরুষের ব্যবধান, তাতে মতবিরোধ রয়েছে। উপরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি। আদনান থেকে আদম (আ) পর্যন্ত বংশধারাও উল্লেখ করেছি এবং এ সম্পর্কিত আবুল আব্বাস এর একটি কবিতাও উদ্ধৃত করেছি। হিজাযী আরবের ইতিহাসে এসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থের প্রথম দিকে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন।

বায়হাকী— আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নবী করীম (সা)-এর নিকট সংবাদ এলো যে, কিনদাহ গোত্রের কতিপয় লোক মনে করে যে, তারা আর নবী করীম (সা) একই বংশোদ্ভূত। এ সংবাদ শুনে নবী করীম (সা) বললেনঃ আব্বাস এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারবও এরূপ বলত এবং নিরাপত্তা লাভ করত। আর আমরা নিজেদের বংশধারা অস্বীকার করি না। আমরা নাযর ইবনে কিনানা এর বংশধর। এ বর্ণনার সনদে সন্দেহ আছে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর নবী করীম (সা) খুতবা দান করেন। তাতে তিনি বলেনঃ

আমি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম ইবন আবদে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবন কা’ব ইবন লুওয়াই ইবন গালিব ইবন ফিহর ইবন মালিক ইবন নযর ইবন কিনানাহ ইবন খুযায়মা ইবন মুদরিকা ইবন ইলিয়াস ইবন মুযার ইবন নিযার। মানুষের গোত্র যেখানেই বিভক্ত হয়েছে সেখানেই আল্লাহ আমাকে উত্তম ভাগে স্থান দিয়েছেন। যেমনঃ আমি পিতা-মাতা থেকে বৈধভাবে জন্মলাভ করেছি, জাহিলিয়াতের ব্যভিচার আমার বংশলতিকাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমার জন্ম বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে, অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়। এই পবিত্রতার ধারা আদম থেকে আমার আব্বা-আম্মা পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলে এসেছে। অতএব ব্যক্তির দিক থেকেও আমি তোমাদের মধ্যে সেরা; বংশের দিক থেকেও। এ সনদটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। এতে কুদামী নামক একজন দুর্বল রাবীর একক বর্ণনা রয়েছে। তবে এর সমর্থনে অন্যান্য বর্ণনা পরে আসছে। আবদুর রাজ্জাক বর্ণনা করেন যে, আবু জাফর আল - বাকির পবিত্র কুরআনের

( لَقَدۡ جَاۤءَكُمۡ رَسُول مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ )

[Surah At-Tawbah 128]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জাহিলী যুগের সন্তান জন্মের কোন অবৈধ উপায় স্পর্শ করেনি। তিনি আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে বলেছেনঃ

إني خرجت من نكاح ولم اخرج من سفاح

— ‘অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়-আমি বৈবাহিক বন্ধন থেকে জন্মলাভ করেছি। এটি একটি উত্তম মুরসাল রিওয়ায়ত।

বায়হাকী.... মুহাম্মদ (র)-এর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে বৈবাহিক বন্ধন থেকে নির্গত করেছেন-অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়। উমর (রা) আলী ইবনে আবু তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেনঃ

إن الله أخرجني من النكاح ولم يخرجني من السفاح

— অবৈধ সম্পর্ক থেকে নয়, বৈবাহিক সম্বন্ধ থেকে আমি নির্গত হয়েছি। আদম থেকে আমার আব্বা-আম্মা আমাকে জন্ম দেওয়া পর্যন্ত আমার বংশধারায় এই পবিত্রতা অব্যাহত ছিল। আমার জন্মে জাহিলিয়াতের কোন অপকর্ম আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বর্ণনাটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।

ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

ما ولدني من نكاح أهل الجاهلية شيئ

—জাহিলী যুগের লোকদের কোন বিবাহ আমাকে জন্ম দেয়নি। যে বিবাহ থেকে আমার জন্ম তা ইসলামের বিবাহ। এ বর্ণনাটিও গরিব পর্যায়ের। মুহাম্মদ ইবন সা’দ বর্ণনা করেন, হযরত আয়েশা (রা)-এর বরাতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবন আসাকির ইবনে আব্বাস (রা) সূত্রে

( وَتَقَلُّبَكَ فِی ٱلسَّـٰجِدِینَ )

[Surah Ash-Shu’ara 219]

(সিজদাকারীদের সঙ্গে তোমার উঠা-বসা দেখেন। ২৬ঃ ২১৯) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ অর্থাৎ এক নবীর পরে আরেক নবী আসেন। এক পর্যায়ে আমিও নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছি। ইবন সা’দ মুহাম্মদ কালবীর পিতার সূত্রে বলেন, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মায়ের বংশধারার পাঁচশত মহিলার তালিকা সংকলন করেছি। তাঁদের কোন একজনকে না ব্যাভিচারী পেয়েছি, না জাহিলিয়াতের কোন অনাচারে সম্পৃক্ত পেয়েছি। বুখারী শরীফে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

بعثث من خير قرون بنى أدم قرنا فقرنا حتى بعثت من القرن الذي كنت فيه

– মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উত্তম যুগে আমি প্রেরিত হয়েছি। এক এক করে বহু যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এই যুগে এসে আমার আবির্ভাব হয়েছে।

সহীহ মুসলিমে ওয়াছিলা ইবন আসকা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহ ইবরাহীমের বংশ থেকে ইসমাঈলকে, ইসমাঈলের বংশ থেকে বনু কিনানাকে, বনু কিনানা থেকে কুরায়শকে এবং কুরায়শ থেকে বনু হাশিমকে নির্বাচিত করেছেন। আর আমাকে নির্বাচিত করেছেন হাশিম থেকে।

ইমাম আহমদ— মুত্তালিব ইবন আবু ওয়াদাআহ আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন,একদা লোকেরা কানাঘুষা শুরু করলে সে খবর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কানে আসে। ফলে তিনি মিম্বরে উঠে বললেনঃ ‘আমি কে?’ জনতা জবাব দিল, ‘আপনি আল্লাহর রাসূল (সা)।’ নবী করীম (সা) বললেনঃ “আমি আবদুল মুত্তালিব এর পুত্র আবদুল্লাহর সন্তান মুহাম্মদ। আল্লাহ জগত সৃষ্টি করে আমাকে সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন। সকল মানুষকে দুইটি দলে বিভক্ত করে আমাকে শ্রেষ্ঠ দলে স্থান দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন গোত্র সৃষ্টি করে আমাকে সেরা গোত্রে রেখেছেন। অতঃপর সব গোত্রকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করে আমাকে তাদের শ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্য করেছেন। ফলে আমি পরিবারের দিক থেকেও তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং ব্যক্তিগত দিক থেকেও তোমাদের মধ্যে সেরা।”

ইয়াকূব ইবন সুফিয়ান —আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি একদিন বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কুরাইশরা যখন নিজেরা পরস্পরে মিলিত হয়, তখন হাসিমুখে মিলিত হয়। আর আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তাদের চেহারায় বৈরীভাব ফুটে ওঠে।’ একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তারপর বললেনঃ

والذي نفس محمد بيده لا يدخل قلب رجل الإيمان حتى يحبكم لله ولرسوله

“যার মুঠোয় মুহাম্মদের জীবন, আমি তাঁর শপথ করে বলছি, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের ভালোবাসবে।” আব্বাস (রা) বলেন, একথা শুনে আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কুরাইশরা একদিন বসে তাদের বংশধারা নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলো। তাতে আপনাকে তারা কোন এক ঊষর ভূমিতে অবস্থিত খেজুর গাছের সঙ্গে তুলনা করল।’ শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ “আল্লাহ বিশ্বজগত সৃষ্টি করে আমাকে সৃষ্টির সেরা দলের অন্তর্ভুক্ত করলেন। অতঃপর সৃষ্টির সব মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করলেন, তাতে গোত্র হিসেবেও আমাকে সকলের শ্রেষ্ঠ গোত্রে রাখলেন। অতঃপর যখন মানুষগুলোকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করলেন, তখনও পরিবারের দিক থেকেও আমাকে সকলের শ্রেষ্ঠ পরিবারভুক্ত করলেন। অতএব আমি ব্যক্তি হিসাবেও সৃষ্টির সেরা পরিবার হিসাবেও সকলের শ্রেষ্ঠ।”

ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুলাহ (সা) বলেছেনঃ

“আল্লাহ সৃষ্টির সকল মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন। তাতে দু’ভাগের মধ্যে যেভাগ শ্রেষ্ঠ, আমাকে তার অন্তর্ভুক্ত করেন।” কুরআনের আয়াতঃ

( وَأَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ مَاۤ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ )

[Surah Al-Waqi’ah 27]

-এর এটাই তাৎপর্য। আমি ( أَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ ) তথা ডানের লোকদের অন্তর্ভুক্ত। আবার আমি ( أَصۡحَـٰبُ ٱلۡیَمِینِ ) এর সকলের সেরা। এই দুই ভাগকে আবার তিনভাগে ভাগ করেন। আমাকে তার মধ্যকার শ্রেষ্ঠ ভাগে রাখেন। পবিত্র কুরআনের আয়াত

( وَأَصۡحَـٰبُ ٱلۡمَشۡـَٔمَةِ مَاۤ أَصۡحَـٰبُ ٱلۡمَشۡـَٔمَةِ ۝ وَٱلسَّـٰبِقُونَ ٱلسَّـٰبِقُونَ )

[Surah Al-Waqi’ah 9 – 10]

-এ একথাই বলা হয়েছে। আমি এই ( سَّـٰبِقُونَ ) বা অগ্রগামীদের সেরা। অতঃপর এই তিন দলকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করেছেন। আমাকে বানিয়েছেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গোত্রের মানুষঃ

( وَجَعَلۡنَـٰكُمۡ شُعُوب ا وَقَبَاۤىِٕلَ لِتَعَارَفُوۤا۟ۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِیمٌ خَبِیر ࣱ)

[Surah Al-Hujurat 13]

(আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। তোমাদের যে যত মুত্তাকী, আল্লাহর নিকট সে তত মর্যাদাবান। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা। (৪৯ঃ ১৩) আয়াতের এটাই অর্থ। আমি আদমের সন্তানদের সর্বাপেক্ষা মুত্তাকী এবং আল্লাহর নিকট সবচাইতে মর্যাদাসম্পন্ন। কথাটা গর্ব নয়। অতঃপর গোত্রগুলোকে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত করেন এবং আমাকে শ্রেষ্ঠ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহর বাণীঃ

( إِنَّمَا یُرِیدُ ٱللَّهُ لِیُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَیۡتِ وَیُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِیر ࣰا)

[Surah Al-Ahzab 33]

(হে আহলে বায়ত! আল্লাহ তোমাদের থেকে পঙ্কিলতা দূর করে তোমাদেরকে সর্বোতভাবে পবিত্র করতে চান।) আয়াতে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফলে আমি ও আমার পরিবার যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র। বর্ণনাটি গরীব ও মুনকার পর্যায়ের। হাকিম ও বায়হাকী.... ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ঘরের আঙ্গিনায় বসা ছিলাম। এ সময় এক মহিলা সে স্থান দিয়ে অতিক্রম করেন। দেখে একজন বলল, ইনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কন্যা। ঠিক তখন আবু সুফিয়ান বলল, হাশিম গোত্রে মুহাম্মদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে গোবরে পদ্মফুলের মতো। মহিলাটি চলে গেলেন এবং কথাটা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কানে দিলেন। শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের নিকট আসলেন। তাঁর চেহারায় তখন অসন্তোষ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল। এসে তিনি বললেনঃ “ব্যাপার কি, আমি কী সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি? আল্লাহ সাত আকাশ সৃষ্টি করে তার ঊর্ধ্বলোকে যাদেরকে ইচ্ছা স্থান দিলেন। অতঃপর তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বনী আদমকে মনোনীত করলেন। বনী আদমের মধ্য থেকে মনোনীত করলেন আরবদেরকে আর আরবদের মধ্য থেকে মনোনীত করলেন মুযারকে। মুযার-এর থেকে মনোনীত করলেন কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে, আর বনু হাশিম থেকে আমাকে। অতএব আমি সেরার সেরা। ফলে যে ব্যক্তি আরবদেরকে ভালোবাসল, সে আমার খাতিরেই তাদেরকে ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি আরবদের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করল, আমার সঙ্গে বিদ্বেষ থাকার কারণেই তাদের সঙ্গে সে বিদ্বেষ পোষণ করল।”

তবে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

أنا سيد ولد آدم يوم القيامة ولا فخر

“আমি কিয়ামতের দিন আদম সন্তানদের সরদার রূপে থাকবো। এটা আমার গর্ব নয়।”

হাকিম ও বায়হাকী...... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ “জিবরাঈল আমাকে বললেন যে, আমি পৃথিবীটা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে দেখলাম, মুহাম্মদ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাউকে পেলাম না। আবার পৃথিবীটা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত উলট-পালট করলাম; কিন্তু হাশিমের গোত্র অপেক্ষা উত্তম কোন গোত্রের খোঁজ পেলাম না।’ বায়হাকী মন্তব্য করেন যে, বর্ণনাগুলোতে দুর্বলতা থাকলেও একটি অপরটির সমর্থক হওয়ায় গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঠিক এই মর্মে আবু তালিব নবী করীম (সা)-এর প্রশংসায় বলতেনঃ

إذا اجتمعت يوما قريش لمفخر - فعبد مناف سرها وصميمها

فإن حملت أشراف عبد منافها - ففى هاشم أشرافها وقديمها

وإن فخرت يوما فإن محمدا - هو المصطفى من سرها وكريمها

تداعت قريش غثها و سمينها علينا فلم تظفر وطاشت حلومها

وكنا قديما لانقر ظلامة- اذا ما ثنوا صعر الخدود نقيمها

ونحمي حماها كل يوم كريهة - ونضرب عن أحجارها من يرومها

بنا إنتعش العود الذاء وإنما- بأكنافنا تنمى وتنمى أرومها

—কুরায়শ যদি কখনো গৌরব করার জন্য সমবেত হয়, তো আবদে মানাফ-ই সেই মহান ব্যক্তি, যাকে নিয়ে কুরাইশ গর্ব করতে পারে। আবার আবদে মানাফের সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত ব্যক্তিদের খুঁজে পেতে চাইলে তাদেরকে হাশিম গোত্রেই খুঁজতে হবে।

তারা যদি আরো গৌরব করতে চায়, তাহলে মুহাম্মদকে নিয়েই তা করতে হবে। কেননা মুহাম্মদই হলেন তাদের মধ্যে মহান ব্যক্তিদের বাছাই করা ব্যক্তি।

কুরাইশের শীর্ণ মোটা সকলে আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি এবং তাদের বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটেছে।

অতীতে আমরা অত্যাচার স্বীকার করতাম না। লোকে অবজ্ঞা ভরে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমরা তা সোজা করে দিতাম। যে কোন দুর্দিনে আমরা তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম আর বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিরোধ করতাম। আমাদের উসিলায় নেতিয়ে পড়া কাঠ সোজা হয়ে দাঁড়াত এবং আমাদের এই সহযোগিতায় তা সজীব হতো এবং বৃদ্ধি লাভ করত।

আবুস সাকান খারীম ইবনে আউস সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাবুক থেকে ফিরে আসা কালে আমি তার দরবারে হাজির হলাম, তখন আমি ইসলাম গ্রহণ করি। তখন শুনতে পেলাম, আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব বলছেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার প্রশংসা করতে চাই।’ জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘আচ্ছা বল, আল্লাহ তোমার মুখে ফুল চন্দন ফুটান।’

অনুমতি পেয়ে বলতে শুরু করলেনঃ

من قبلها طبت في الظلال وفئ - مستودع حيث يخصف الورق

ثم هبطت البلاد لا بشر أ -نت ولا مضغة ولا علق

بل نطقة تركب السفين وقد- الجم نسرا واهله الغرق

تنقل من صلب إلى رحم - إذا مضى عالم بدأ طبق

حتى احتوى بيتك المهيمن من - خندف علياء تحتها النطق

وأنت لما ولدت أشرقت الأرض -وضاءت بنورك الأفق

فنحن في ذالك الضياء وفي أل - نور وسبل الرشاد نخترق

—এক সময়ে আপনি অবস্থান করেছেন, ছায়াময় এবং সংরক্ষিত স্থানে। তারপর আপনি ধরায় অবতরণ করলেন। তখন আপনি না পূর্ণাঙ্গ মানব, না গোশতের টুকরা, না রক্তপিণ্ড। বরং এক ফোটা বীর্য কিশতিতে আরোহণ করে আসলেন। অথচ, তখনকার সব জনপদ ভেসে গিয়েছিল প্লাবনের পানিতে। তারপর আপনি পিতার মেরুদণ্ড থেকে মায়ের গর্ভে স্থানান্তরিত হলেন এবং ধীরে ধীরে একজন পূর্ণাঙ্গ মানবের রূপ ধারণ করলেন। নিজ ঘরের শোভা হয়ে এক সময়ে ভূমিষ্ঠ হলেন পৃথিবীতে। আপনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, তখন আপনার আলোতে আলোকিত হল সমগ্র পৃথিবী। এখন সেই আলোতে আমরা পথ চলি।

এই কবিতাগুলো হাসসান ইবনে সাবিত (রা)-এর নামেও বর্ণিত হয়েছে। যেমনঃ ইবন আসাকির ইবন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমার আব্বা-আম্মা আপনার জন্য কুরবান হোন। বলুন তো, আদম (আ) যখন জান্নাতে, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আমার এ প্রশ্ন শুনে নবী করীম (সা) হেসে উঠলেন। এমনকি তার সামনের ক’টি দাঁত দেখা গেল। তারপর তিনি বললেনঃ ‘আমি আদমের মেরুদণ্ডে ছিলাম। আমার পিতৃপুরুষ নূহ (আ) তাঁর মেরুদণ্ডে করে আমাকে নিয়ে কিশতিতে আরোহণ করেন। তারপর আমাকে আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীমের মেরুদণ্ডে করে (অগ্নিকুণ্ডে) নিক্ষেপ করা হয়। আমার বংশ লতিকার কোন পিতা-মাতাই জীবনে কখনো ব্যভিচারে সম্পৃক্ত হননি। আল্লাহ আমাকে কুলীন মেরুদণ্ড থেকে পূত-পবিত্র জরায়ুতে স্থানান্তরিত করতে থাকেন। আমার পরিচয় হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। যখনই মানুষ ভালো-মন্দ দু’দলে বিভক্ত হয়, আমি ভালো ও শ্রেষ্ঠ দলে থাকি। আল্লাহ নবুওত দ্বারা আমার অঙ্গীকার এবং ইসলাম দ্বারা আমার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। তাওরাত ও ইনজীলে আমার সুসংবাদ প্রকাশ করেছেন এবং প্রত্যেক নবীকে আমার বিস্তারিত পরিচয় জানিয়েছেন। আমার নূরে বিশ্বজগত এবং আমার মুখমণ্ডলে মেঘমালা আলোকিত হয়। আল্লাহ আমাকে তার কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন এবং তার নামে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। আল্লাহ তার নিজের নাম থেকে বের করে আমার নাম রেখেছেন। ফলে আরশের অধিপতি হলেন মাহমুদ আর আমি হলাম মুহাম্মদ ও আহমদ। আল্লাহ আমাকে হাউযে কাওছার দিয়ে ধন্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং আমাকে সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম সুপারিশ মঞ্জুরকৃত ব্যক্তিরূপে মনোনীত করেছেন। এরপর আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ যুগে আমার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। আমার উম্মত অত্যধিক প্রশংসাকারী। তারা সৎকাজের আদেশ করে এবং অন্যায় কাজ থেকে বারণ করে।

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, তখন হাসসান ইবন সাবিত নবী করীম (সা)-এর শানে পূর্বোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন যাতে বলা হয়েছে-

قبلها طبت في الظلال وفي مستودع يوم يخصف الورق ……

শুনে নবী করীম (সা) বললেন, আল্লাহ হাসসানের প্রতি রহমত করুন। তৎক্ষণাৎ আলী ইবন আবু তালিব বলে উঠলেন, ‘কাবার প্রভুর শপথ, হাসসানের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ ইবন আসাকির এ বর্ণনাটিকে ‘গরীব’ বলেছেন। আমার মতে এগুলো মুনকারও বটে।

কাজী ইয়ায তাঁর ‘আশ-শিফা’ গ্রন্থে বলেছেন, বিভিন্ন আসমানী কিতাবে যে আহমদের কথা বলা হয়েছে এবং বিভিন্ন নবীকে যার সংবাদ দেওয়া হয়েছে, তার নামে যেন কারও নামকরণ করা না হয় এবং তার আর্বিভাবের আগে কেউ যেন নিজেকে আহমদ বলে দাবি না করে, কৌশলে আল্লাহ তার পথ রুদ্ধ করে দেন। যাতে দুর্বলমনা লোকদের মধ্যে কোন রকম বিভ্রান্তি বা সন্দেহ সৃষ্টি হতে না পারে। তদ্রুপ নবী কারীম (সা) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরব-অনারবের কারো মুহাম্মদ নামকরণ করা হয়নি। ‘কেবল মুহাম্মদ নামের একজন নবীর আবির্ভাব হবে’- একথাটা ব্যাপক প্রচার লাভ করার পর আরবের গুটিকতেক লোক তাদের ছেলেদের মুহাম্মদ নামে নামকরণ করেছিল এই আশায় যে, এই ছেলেই সেই মুহাম্মদ হয় কিনা। তারা হলো, মুহাম্মদ ইবনে উহায়হা ইবন জাল্লাহ আল-আওসী, মুহাম্মদ ইবন সালামা আনসারী, মুহাম্মদ ইবন বারা আল-কিনদী, মুহাম্মদ ইবন সুফিয়ান ইবন মুজাশি, মুহাম্মদ ইবন হামরান আল জুফী ও মুহাম্মদ ইবন খুযায়ী আস-সালামী। ব্যস, এ পর্যন্তই। কোন সপ্তম ব্যক্তি এ নামে নেই। কারও কারও মতে সর্বপ্রথম যার নাম মুহাম্মদ নামকরণ করা হয়েছিল, সে হলো মুহাম্মদ ইবন সুফিয়ান ইবন মুজাশী। ইয়ামানীদের মতে আযদ এর মুহাম্মদ ইবন লিয়াহমুদই এই নামের প্রথম ব্যাক্তি। কিন্তু আল্লাহ এদের প্রত্যেককে নবুয়ত দাবী করা, অন্য কেউ এদেরকে নবী বলে স্বীকার করা কিংবা নবুয়তের কোন লক্ষণ এদের মধ্যে প্রকাশ পাওয়া থেকে নিবৃত রাখেন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন