hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৯৩
জিনদের অদৃশ্য আহবান
ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, ভবিষ্যত বক্তা শিক ও সাতীহ নবী করীম (সা)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে ইয়ামানের রাজা রাবীআ ইবন নাসরকে বলেছিলেনঃ “তিনি পুতঃ পবিত্র রাসূল, উর্ধ্বজগত থেকে তাঁর নিকট ওহী আসবে।” রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম বৃত্তান্ত বিষয়ক অধ্যায়ে আবদুল মসীহকে লক্ষ্য করে প্রদত্ত সাতীহ-এর নিম্নের বক্তব্য আসবে “যখন তিলাওয়াতের প্রাচুর্য ঘটবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে এবং মহা-মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে।” এ কথার দ্বারা তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বুঝিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে আসছে। বুখারী আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত উমর (রা)-কে যত বিষয়ে এ কথা বলতে শুনেছি “এবিষয়ে আমার ধারণা এই” তা সব ক’টাই তার ধারণা মুতাবিকই হয়েছে।

একদিনের ঘটনা। হযরত উমর (রা) এক জায়গায় বসা ছিলেন। তার পাশ দিয়ে একজন সুদর্শন লোক হেঁটে গেল। তিনি বললেন, “হয়ত আমার ধারণা ভুল হবে, নতুবা এটা নিশ্চিত যে, এ লোক তার জাহিলী যুগের ধর্ম অনুসরণ করে চলছে অথবা কোন এক সময় লোকটি গণক ছিল। লোকটিকে আমার নিকট নিয়ে এস।” তখন লোকটিকে ডাকা হলো। হযরত উমর (রা) তাঁর ধারণার কথা লোকটির নিকট ব্যক্ত করলেন। উত্তরে লোকটি বলল, “আজ আমাকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হলো কোন মুসলমানকে ইতিপূর্বে এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে আমি দেখিনি।” হযরত উমর (রা) বললেন, “তোমার বৃত্তান্ত না বলা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছাড়ছি না।” সে বলল, “জাহিলী যুগে আমি গণক ছিলাম।” হযরত উমর (রা) বললেন “তোমার জিন তোমার নিকট যত সংবাদ এনেছে তার মধ্যে সর্বাধিক আশ্চর্যজনক সংবাদ কোনটি?” সে বলল, ‘একদিন আমি বাজারের মধ্যে ছিলাম। তখন দেখলাম, অত্যন্ত অস্থির ও অশান্তভাবে সে আমার নিকট উপস্থিত হলো এবং বললঃ

ألم تر الجن وابلاسها ويأسها من بعد النكاسها

ولحوقها بالقلاص واحلاسها

— আপনি কি দেখেছেন জিন জাতিকে এবং তাদের নৈরাশ্যকে? এবং উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তাদের হতাশাকে? আরও কি দেখেছেন সফরের জন্যে তাদের উষ্ট্রী প্রস্তুত করা?

হযরত উমর (রা) বললেন, ‘সে ঠিকই বলেছে। একদিন আমি ওদের দেবতাদের পাশে ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে দেখি, এক আগন্তুক একটি বাছুর নিয়ে উপস্থিত। সে বাছুরটি জবাই করে দিল। তখন এক অদৃশ্য চিৎকারকারী এমন বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল যা আমি আগে কখনো শুনিনি। চিৎকার দিয়ে সে বলল, হে বীর ও সাহসী ব্যক্তি! সফলতার পথ এসেছে। প্রাঞ্জলভাষী এক ব্যক্তি এসেছেন, তিনি বলছেন “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।” তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে লোকজন দলে দলে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখন আমি বললাম, “এরূপ স্বপ্নের মধ্যে কী রহস্য আছে তা না জানা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না। এরপর পুনরায় উক্ত ঘোষক ঘোষণা দিল, হে বীর ও সাহসী ব্যক্তি। সফলতার পথ এসে গেছে। প্রাঞ্জলভাষী লোকটি এসে গেছেন। তিনি বলছেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।” তখন আমি উঠে দাঁড়ালাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাকে বলে দেয়া হলো যে, ইনি নবী।’ হাদীসটি ইমাম বুখারী (র) এককভাবে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

হযরত উমর (রা) যে লোকটিকে ডেকে এনেছিলেন তার নাম সাওয়াদ ইবনে কারিব আল আযদী। কেউ কেউ বলেন, তিনি বালকা পর্বতের পাহাড়ী উপত্যকার অধিবাসী ও সাদুস বংশীয় লোক ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গ পেয়েছেন এবং তাঁর প্ররিত প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছিলেন। আবু হাতিম এবং ইবনে মান্দা বলেন, সাঈদ ইবনে জুবায়র ও আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী প্রমুখ তাঁর বরাতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আহমদ ইবনে রাওহ আল-বারযাঈ দারা কুতনী প্রমুখ সাহাবীর নামের তালিকায় তার নাম উল্লেখ করেছেন। হাফিজ আবদুল গণী ইবনে সাঈদ আল মিসরী বলেছেন, উক্ত ব্যক্তির নাম ওয়াও বর্ণে তাশদীদ বিহীন সাওয়াদ ইবনে কারিব। মুহাম্মদ ইবনে কাব আল কুরাযী সূত্রে উছমান আল ওয়াককাসী বলেছেন, উক্ত ব্যক্তি ইয়ামানের সম্ভ্রান্ত লোকদের একজন ছিলেন। আবু নুআয়ম ‘আদ দালাইল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত হাদীস অন্যান্য সনদে ইমাম বুখারীর বর্ণনা অপেক্ষা দীর্ঘতরও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন, হযরত উমর (রা) একদিন মসজিদে নববীতে লোকজনের সমাবেশে উপবিষ্ট ছিলেন। তখন একজন আরব হযরত উমর (রা)-এর খোঁজে মসজিদে প্রবেশ করে। লোকটির দিকে তাকিয়ে উমর (রা) বললেন, এই লোকটি হয় তো মাত্র কিছুদিন আগে শিরক্ ত্যাগ করেছে নতুবা জাহেলী যুগে সে গণক ছিল। লোকটি তাঁকে সালাম দিল এবং সেখানে বসে পড়ল। উমর (রা) তাকে বললেন, “আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করেছেন?” ‘হে আমীরুল মুমিনীন! হ্যাঁ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি,’ ঐ ব্যক্তি উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি কী জাহেলী যুগে গণক ছিলেন?’ লোকটি বলল, ‘সুবহানাল্লাহ! হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আমার ব্যাপারে এমন একটি ধারণা পোষণ করেছেন এবং আমাকে এমন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন আমার মনে হয় শাসনভার গ্রহণ করার পর কোন লোককেই আপনি এমন প্রশ্ন করেন নি।’

হযরত উমর (রা) বললেন, ‘হে আল্লাহ! ক্ষমা করুন, আমরা তো জাহেলী যুগে এর চেয়ে অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত ছিলাম। আমরা মূর্তিপূজা করতাম এবং প্রতিমার সাথে কোলাকুলি করতাম। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূল ও ইসলাম দ্বারা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন।’ ঐ ব্যক্তিটি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন! জাহেলী যুগে আমি গণক ছিলাম।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘তাহলে বলুন দেখি আপনার সাথী শয়তান আপনাকে কি সংবাদ দিয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘ইসলামের আবির্ভাবের মাসখানেক কিংবা তারও কম সময় পূর্বে আমার সাথী শয়তান আমার নিকট এসে বলল,

ألم تر الى الجن وابلاسها - وایأسها من دينها ولحوقها بالقلاص واحلاسه

— আপনি জিন জাতিকে এবং তাদের নৈরাশ্যকে দেখেছেন কী? এবং আপনি কি দেখেছেন তাদের উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার পর দীন সম্পর্কে তাদের হতাশা? এও কি দেখেছেন যে, তারা উষ্ট্রীর নিকট গিয়ে উষ্ট্রীকে সফরের জন্যে প্রস্তুত করছে?

ইবনে ইসহাক বলেন, উপরোক্ত বক্তব্য ছন্দোবদ্ধ গদ্য বটে, কবিতা নয়, তখন হযরত উমর (রা) লোকজনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি জাহেলী যুগে একদিন কুরায়শ বংশীয় কতক লোকের সাথে এক প্রতিমার নিকট ছিলাম। জনৈক আরব ওই প্রতিমার উদ্দেশে একটি বাছুর জবাই করল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম যে, সেটির গোশতের একটা অংশ আমাদেরকে দেয়া হবে। হঠাৎ ওই বাছুরের পেট থেকে আমি একটা বিকট চিৎকার শুনতে পাই, তেমন বিকট চিৎকার আমি ইতিপূর্বে কোনদিন শুনিনি। এটি ইসলামের আবির্ভাবের মাস খানেক কিংবা তারও কম সময়ের পূর্বের ঘটনা। ঐ শব্দ ছিল, “হে বীর ও সাহসী ব্যক্তি! সফলতার পথ এসে গেছে। প্রাঞ্জলভাষী লোক ডেকে ডেকে বলছেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ -আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।” ইবনে হিশামের বর্ণনায় এসেছে “আবির্ভূত হয়েছেন একজন লোক যিনি প্রাঞ্জল ভাষায় উচ্চ স্বরে ডেকে ডেকে বলছেন— লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।” ইবনে হিশাম বলেন, কেউ কেউ আমার নিকট কবিতা আকারে এভাবে পাঠ করেছেন।

عجبت للجن وابلسها وشدها العيس باحلاسها

— জিনদেরকে দেখে, তাদের হতাশা দেখে এবং সফরের উদ্দেশ্যে উষ্ট্রীর পিঠে আসন প্রস্তুত দেখে আমি অবাক হয়েছি।

تهوي الى مكة تبغي الهدى مامؤمنوا الجن كانجاسها

— তারা মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করছে হেদায়াতের অন্বেষণে ঈমানদার জিনগণ তাদের নাপাক বেঈমানদারদের মত নয়।

হাফিজ আবু ইয়া’লা মূসিলী - মুহাম্মদ ইবনে কা’ব আল-কুরাযী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, একদিন উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বসা ছিলেন, তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক লোক। একজন বলল, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এ লোকটিকে চেনেন?’ তিনি বললেন, ‘ঐ লোক কে?’ লোকজন বলল, ‘সে তো সাওয়াদ ইবন কারিব। তার জিন সহচর তার নিকট রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের সংবাদ নিয়ে এসেছিল।’ উমর (রা) তাকে ডেকে পাঠালেন। আর তিনি বললেন, ‘আপনি কি সাওয়াদ ইবনে কারিব?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘আপনি কি এখনও আপনার গণক পেশায় নিয়োজিত আছেন?’ এতে ঐ ব্যক্তি রেগে যান এবং বলেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! আমার ইসলাম গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত কেউ আমাকে এরূপ অপমানজনক কথা বলেনি।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তাতে কি? আমাদের শিরকবাদী জীবনে আমরা আপনার গণক পেশার চেয়ে অধিক মন্দ কাজে লিপ্ত ছিলাম। যা হোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অবির্ভাব সম্পর্কে আপনার জিন সহচর আপনাকে কি বলেছিল তা আমাদেরকে একটু বলুন।’ তিনি বললেন, “আমীরুল মুমিনীন! একরাতে আমি কিছুটা নিদ্রা ও কিছুটা সজাগ এমন অবস্থায় ছিলাম। আমাকে পদাঘাত করে তখন আমার জিন সহচর বলল, সাওয়াদ ইবনে কারিব! ওঠ, ওঠ, আমি যা বলি তা শোন এবং বিবেক থাকলে তা বুঝে নাও। লুওয়াই ইব্‌ন গালিবের বংশধর থেকে একজন রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর ইবাদতের প্রতি ডাকছেন। তারপর সে এই কবিতা পাঠ করেঃ

عجبت للجن وتطلابها وشؤها العيس بأقتابها

— জিনদেরকে দেখে ও তাদের অন্বেষণ প্রক্রিয়া দেখে এবং উষ্ট্রীর পিঠে আসন লাগিয়ে তাদের সফর প্রস্তুতি দেখে আমি অবাক হয়েছি।

تهوى الى مكة تبغي الهدى ما صادق الجن ككذابها

— তারা যাত্রা করছে মক্কার উদ্দেশে হেদায়ত অন্বেষণে সত্য প্রাণ জিন তাদের মধ্যকার মিথ্যুকদের ন্যায় নয়।

فارحل الى الصفوة من هاشم ليس قداماها كأذنابها

— অতএব, তুমি বনী হাশিম গোত্রের ঐ বিশিষ্ট পূত পবিত্র মানুষটির নিকট যাও! জিনদের অগ্রবর্তী দল তাদের পশ্চাৎবর্তীদলের মত নয়।

তখন আমি বললাম, ‘রেখে দাও তোমার ওসব, আমাকে একটু ঘুমোতে দাও! সন্ধ্যা থেকেই আমার ঘুম পেয়েছে।’ অতঃপর দ্বিতীয় রাতেও সে আমার নিকট আসে এবং আমাকে পদাঘাত করে পূর্বোল্লিখিত কথাগুলো বলে এবং ঐ কবিতার পংক্তিগুলো আবৃত্তি করে পদাঘাত করে।

আমি বললাম, ‘ছাড় ছাড় আমাকে ঘুমোতে দাও। সন্ধ্যা থেকেই আমার ঘুম পেয়েছে।’ তৃতীয় রাতেও সে আমার নিকট আসে এবং আমাকে পদাঘাত করে পূর্বের কথাগুলো ও কবিতার পুনরাবৃত্তি করে।

লোকটি বলল, এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বললাম, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে পরীক্ষা করছেন।’

আমি আমার উষ্ট্ৰীতে সওয়ার হয়ে শহরে অর্থাৎ মক্কায় এলাম। সেখানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীদেরকে দেখলাম। আমি তাঁর নিকটবর্তী হলাম এবং বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আমার কথা শুনুন।’ তিনি বললেন, ‘বল!’ তখন আমি এই কবিতা পাঠ করলাম,

أتاني نجي بعد مرء ورقه ولم يك فيما قد تلوت بكاذب

— বিশ্রাম গ্রহণ ও শয়নের পর আমার গোপন সহচর উপস্থিত হয়েছে আমার নিকট। আমি যা বলছি তা মোটেই মিথ্যা নয়।

ثلاث ليال قول كل ليلة أتاك رسول من لؤي بن غالب

— সে এসেছে একে একে তিন রাত। প্রতিরাতে তার বক্তব্য ছিল লুওয়াই ইব্‌ন গালিবের বংশ থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন।

فشمرت عن ذيل الازار ووسطت - بي الرعلب الؤحناء غير السباسب

— অতঃপর আমি আমার লুঙ্গি গুটিয়ে ফেলে সফর শুরু করি। আমার প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী উষ্ট্রী আমাকে নিয়ে বিস্তৃত বিশাল বালুময় প্রান্তর অতিক্রম করে।

فأشهد أن الله لا شيئ غيره وانك مامون على كل غالب

— এখন আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সকল বিজয়ী বীরের মোকাবিলায় আপনি সর্বদা নিরাপদ থাকবেন।

وانك أدنى المرسلين وسيلة الى الله يا ابن الأكرمين الأطالب

— আল্লাহর সাথে মিলনের ক্ষেত্রে আপনি আল্লাহর নিকটতম রাসূল, হে পবিত্র ও সম্মানিত বংশের বংশধর।

فمرنا بما ياتي ياخير من مشی وان كان فيما جاء شيب الذوائب

— হে পৃথিবীতে পদচারণকারী ও পদার্পণকারী সকল লোকের মধ্যে উৎকৃষ্টতম ব্যক্তি। আপনার নিকট যা এসেছে আমাদেরকে তা পালনের নির্দেশ দিন। যদিও তার মধ্যে থাকে চুল পাকিয়ে দেয়ার মত কঠিন বিষয়সমূহ।

وكن لى شفيعا يوم لا ذو شفاعة سواك بمغن عن سوادبن قارب

— আপনি সেদিন আমার জন্যে সুপারিশকারী হবেন যেদিন এ সাওয়াদ ইবনে কারিবকে রক্ষা করার মত কোন সুপারিশকারী থাকবে না।

আমার কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ খুবই আনন্দিত হলেন। তাঁদের মুখমণ্ডলে খুশির চিহ্ন ফুঠে ওঠে।

বর্ণনাকারী বলেন, সাওয়াদ ইবনে কারিবের বক্তব্য শুনে হযরত উমর (রা) লাফিয়ে উঠে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আপনার মুখ থেকে এ বর্ণনা শোনার জন্যে আমি অনেক দিন থেকে আকাঙ্ক্ষা করে আসছিলাম। আচ্ছা, আপনার ঐ জিন সহচর এখনও কি আপনার নিকট আসে?’ জবাবে সাওয়াদ বললেন, ‘না। আমি যখন থেকে কুরআন মজীদ পাঠ করতে শুরু করেছি তখন থেকে সে আমার নিকট আর আসে না। ঐ জিনের স্থলে আল্লাহর কিতাব কতই না উত্তম।’

এরপর হযরত উমর (রা) বললেন, একদিন আমি কুরাইশের আলে যরীহ নামক এক গোত্রের মধ্যে ছিলাম। তারা একটি বাছুর জবাই করেছিল। কসাই সেটিকে কাটাকুটা করছিল। হঠাৎ বাছুরটির পেট থেকে আমরা এক শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু চোখে কিছু দেখলাম না। ঐ শব্দমালা ছিলঃ হে যরীহ্ বংশের লোকজন! সফলতার পথ এসে গেছে। একজন ঘোষক প্রাঞ্জল ভাষায় ঘোষণা দিচ্ছেন এবং সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। এই সনদে হাদীসটির সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। তবে ইমাম বুখারী (র)-এর বর্ণনায় এর সমর্থন মিলে। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, বাছুরের পেট থেকে শব্দ শ্রবণকারী ছিলেন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)।

হাফিজ খাইরাতী তাঁর হাওয়াতিফুল জান পুস্তকে উল্লেখ করেছেন যে, আবু মূসা ইমরান ইবনে মূসা ....... আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী সূত্রে বলেন, সাওয়াদ ইবনে কারিব মাদুসী হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর সাথে সাক্ষাত করলেন। উমর ইব্‌ন খাত্তাব (রা) বললেন, ‘হে সাওয়াদ ইব্‌ন কারিব! আমি আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, বলুন তো, আপনি কি আপনার গণক পেশায় এখনও বহাল আছেন?’ সাওয়াদ বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! সুবহানাল্লাহ্, আপনি আমাকে যে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন আপনার কোন সাথীকে আপনি কখনো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন করেন নি।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ, হে সাওয়াদ! আমাদের শিরকবাদী জীবনে আমরা যা করেছি তা আপনার গণক পেশা অপেক্ষা জঘন্যতর ছিল। আল্লাহর কসম, হে সাওয়াদ! আপনার একটি ঘটনার বর্ণনা আমার নিকট পৌঁছেছে যা খুবই চমৎকার।’ সাওয়াদ বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! হ্যাঁ, সেটি খুবই আশ্চর্যজনক বটে।’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘ঠিক আছে ঐ ঘটনাটি আমাকে শোনান।’

সাওয়াদ বললেন, ‘জাহেলী যুগে আমি গণক পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। তারপর তিনি জিনের পরপর তিনরাত আগমন ও কবিতা আবৃত্তির কথা বিশদভাবে তাঁর নিকট বর্ণনা করেন। তারপর তার ইসলাম গ্রহণ ও কবিতা আবৃত্তির কথাও তাঁকে শোনান। তারপর হযরত উমরের সাথে তার কথোপকথনের কথাও উল্লেখিত হয়েছে। অতঃপর পূর্বোল্লিখিত ঘটনার ন্যায় বর্ণনা করে যখন তিনি কবিতার শেষের পংক্তিটিতে বললেনঃ

وكن لي شفيعا يوم لا ذو قرابة سواك بمغن عن سؤاد بن قارب

— এবং আপনি আমার জন্যে সুপারিশকারী হবেন সেদিন, যেদিন আপনি ব্যতীত সাওয়াদ ইবনে কারিবকে রক্ষা করার কোন নিকটাত্মীয় থাকবে না।

তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মাঝে এ কবিতাটি আবৃত্তি কর।’

হাফিজ ইবনে আসাকির ও সাঈদ ইবনে জুবায়র (র) সূত্রে উক্ত ঘটনাটি আনুপূর্বিক বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি এতটুকু অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন যে, কবিতার শেষ চরণ আবৃত্তি করার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) এমনভাবে হেসে উঠলেন যে, তাঁর মাড়ির দাঁতগুলো দেখা গেল। তিনি বললেন, ‘হে সাওয়াদ! তুমি সফলকাম হয়েছ।’

আবু নুআয়ম তাঁর ‘দালাইল’ গ্রন্থে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাফর আব্দুল্লাহ্ আল ওমানী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের মধ্যে মাযিন ইবনে আয়ুব নামে এক লোক ছিল। সে একটি মূর্তির সেবায়েত ছিল। মূর্তিটি অবস্থিত ছিল ওমানের মায়া নামক গ্রামে। বানু সামিত, বানু হুতামা ও মুহরা গোত্রগুলো ঐ মূর্তির পূজা করত। তারা মাযিনের মাতুল গোত্র। তার মায়ের নাম যায়নাব বিনত আব্দুল্লাহ্ ইবনে রবী’আ ইবনে খুওয়াইস। খুওয়াইস হলো বানু নারানের অন্তর্ভুক্ত।

মাযিন বলেন, একদিনের ঘটনা। আমরা বলি ও মূর্তির উদ্দেশে আমরা একটি পশু বলি দেই। তখন মূর্তির ভেতর থেকে আমি একটি শব্দ শুনতে পাই। সে বলছিল, ‘হে মাযিন! আমি যা বলি তা শোন তাহলে তুমি খুশিই হতে। কল্যাণ এসে গেছে। অকল্যাণ বিলুপ্ত হয়েছে। মুদার গোত্র হতে একজন নবী প্রেরিত হয়েছেন মহান আল্লাহর দীন নিয়ে। সুতরাং পাথরের তৈরি মূর্তি পরিত্যাগ কর। তাহলে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে।

মাযিন বললেন, ‘এতে আমি ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ি। কয়েক দিন পর আমরা ওই মূর্তির উদ্দেশে আরেকটি পশু বলি দেই। তখন পুনরায় আমি ওই মূর্তিটিকে বলতে শুনি, সে বলছিল— তুমি আমার নিকট আস, আমার নিকট আস, আমি যা বলি তা শোন, অগ্রাহ্য করো না। ইনি প্রেরিত নবী ও রাসূল। আসমানী সত্য নিয়ে তিনি আবিৰ্ভুত হয়েছেন। তুমি তার প্রতি ঈমান আন, তাহলে লেলিহান শিখাময় আগুন থেকে রক্ষা পাবে। ওই আগুনের জ্বালানি হবে বড় বড় পাথর।

মাযিন বলেন, আমি তখন মনে মনে বললাম, এটি তো নিশ্চয়ই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। এটি তো আমার জন্যে কল্যাণকর। এ সময়ে আরব অঞ্চল থেকে একজন লোক আমাদের নিকট আসে। আমি বললাম, ‘ওখানকার সংবাদ কী?’ সে বলল, ‘সেখানে আহমদ নামে একজন লোক আবির্ভূত হয়েছেন। যারা তাঁর নিকট আসে তিনি তাদেরকে বলেন, “তোমরা আল্লাহর প্রতি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দাও।’ আমি বললাম, ‘এটি তো আমি যা শুনেছি তার বাস্তব রূপ।’ অতঃপর আমি মূর্তিটির উপর ঝাপিয়ে পড়ি এবং সেটি ভেঙে চুরমার করে ফেলি। এরপর আমি সওয়ারীতে আরোহণ করি এবং সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হই। আল্লাহ তাআলা আমার বক্ষকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে প্রশস্ত করে দেন। আমি ইসলাম গ্রহণ করি। তখন আমি বলিঃ

كسرت بأجرا أجزاذا وكان لنا ربا نطيف به ضلا بتضلال

— আমি বাজির মূর্তিকে ভেঙে খান খান করে ফেলেছি। অথচ এক সময় সেটি আমাদের উপাস্য ছিল। আমরা চরম গোমরাহী ও ভ্রান্তিহেতু সেটির চারদিকে তাওয়াফ করতাম।

فالهاشمي هدانا من ضلالتنا ولم يكن دينه منى على مال

— হাশেম বংশীয় লোক মুহাম্মদ (সা) আমাদেরকে গোমরাহী থেকে বের করে এনে হেদায়ত দিয়েছেন তাঁর দীন-ধর্ম আর তা কখনও আমার কল্পনায়ও ছিল না।

يا راكبا بلغن عمروا واخوتها أني لمن قال ربي بأجر قالی

— হে আরোহী পথিক! আমর ও তার সম্প্রদায়কে জানিয়ে দাও, যে ব্যক্তি বলবে, আমার প্রভু বাজির মূর্তি, আমি তার শত্রু।

এখানে তিনি আমর দ্বারা সামিতকে এবং তার গোত্রের দ্বারা হুতামা গোত্রকে বুঝিয়েছেন। মাযিন বলেন, অতপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি তো একজন আনন্দপিয়াসী এবং নারীসঙ্গ ও সুরাপানে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপকারী মানুষ। সময়ের বিবর্তন আমাকে পর্যুদস্ত করেছে এবং তা আমাদের ধন-সম্পদ বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমার ক্রীতদাসীদেরকে দুর্বল করে দিয়েছে। আমার কোন সন্তান-সন্ততি নেই। ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা)! আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, আমার সমস্যাগুলো তিনি যেন দূর করে দেন, আমাকে যেন লজ্জাবোধ দান করেন এবং আমাকে একটি সন্তান প্রদান করেন।’ তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘হে আল্লাহ! তাকে আনন্দ পিয়াসের পরিবর্তে কুরআন পাঠের আগ্রহ, হারামের পরিবর্তে হালাল, পাপাচারিতা ও ব্যভিচারের পরিবর্তে পবিত্রতা দান করুন। আপনি তাকে লজ্জাবোধ এবং সন্তান দান করুন।’

মাযিন বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তাআলা আমার বিপদগুলো দূর করে দিলেন। ওমান অঞ্চল উর্বর ও উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে। আমি ৪ জন মহিলাকে বিয়ে করি। কুরআন মজীদের অর্ধাংশ মুখস্ত করে ফেলি এবং আল্লাহ তা’আলা আমাকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। তার নাম রাখি হাইয়ান ইবনে মাফিন। অতপর মাযিন এই কবিতাটি আবৃত্তি করেনঃ

اليك رسول الله خښت مطيتي تجوب ألفيا في من عمان إلى العرج

— হে আল্লাহর রাসূল! আমার সওয়ারী আপনার নিকটই এসেছে। বহু মরু বিয়াবান অতিক্রম করে ওমান থেকে সে আরজে এসেছে।

لتشفع لى يا خير من وطئ الحصى فيغفرلی ربی فارجع بالفلج

— হে পৃথিবী পৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব, যেন আপনি আমার জন্যে সুপারিশ করেন। ফলশ্রুতিতে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দেন এবং আমি সফলকাম হয়ে ফিরে যাই।

الى معشر خالفت في الله دينهم فلا رأيهم رای ولا شرجهم شرجي

— আমি ফিরে যাব এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আমি যাদের ধর্মের বিরোধিতা করছি। সুতরাং তাদের মতবাদ আমার মতবাদ নয় এবং তাদের অবস্থান আমার অবস্থানের মত নয়।

وكنت امرأ ، بالخمر والعهر مولعا شبابى حتى اذن الجسم بالنهج

— আমার যৌবনকালে আমি সুরা ও নারী সম্ভোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। এক সময় আমার শরীর দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার জানান দেয়।

فبدلني بالخمر خوفا وخشية وبالعهر احصانا فحصن لي فرجی

— অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আমাকে মদ্য পানের পরিবর্তে খোদাভীতি দান করলেন। আর ব্যভিচারের পরিবর্তে দিলেন পবিত্রতা। অনন্তর তিনি আমার যৌনাঙ্গকে অবৈধ ব্যবহার থেকে পবিত্র রাখলেন।

فأصبحت همي في الجهاد ونيتي فلله ماصومی ولله ماحجي

— অতঃপর আমার মন-মানসিকতা ও ইচ্ছা - অনুভূতি জিহাদমুখী হয়ে পড়ে। সুতরাং আমার রোযা ও হজ্জ একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশেই নিবেদিত।

মাযিন বলেন, আমি আমার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলে তারা আমাকে দূরে তাড়িয়ে একঘরে করে দিল এবং আমাকে গালমন্দ করল। তারা তাদের জনৈক কবিকে আমার প্রতি নিন্দাবাদ বর্ষণের জন্যে বলল। সে আমার নিন্দাবাদ করল। আমি বললাম, আমি যদি তার জবাব দিতে যাই তবে তা হবে নিজেরই নিন্দাবাদ। অতঃপর আমি ওদেরকে ছেড়ে চলে আসি। তাদের মধ্য থেকে বহু লোকের একটি দল আমার সাথে সাক্ষাত করে। ইতিপূর্বে আমি তাদের দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধান করতাম। তারা বলল, ‘চাচাত ভাই! আমরা আপনার প্রতি অন্যায় আচরণ করেছি। এখন সেজন্যে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনি যদি আপনার নতুন ধর্মত্যাগে অস্বীকৃতি জানান তবে তা আপনার ব্যাপার। এখন আপনি আমাদের সাথে ফিরে চলুন এবং আমাদেরকে দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধানের কাজ করুন। আপনার ব্যাপার আপনার নিজেরই এখতিয়ারে থাকবে। তখন আমি তাদের সাথে ফিরে যাই এবং বলিঃ

لبفضكم عندنا مر مذاقته وبفضنا عندكم يا قوم لبن

— আমাদের প্রতি তোমাদের বিদ্বেষকে আমরা তিক্ত জ্ঞান করি। আর তোমাদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষকে হে আমার সম্প্রদায় তোমরা দুধ সম জ্ঞান কর।

لا يفطن الدهر ان بئت معائكم - ولكم حين يثني عيبنا فطن

— আমি যখন তোমাদের দোষ বর্ণনা করি তখন আমি চালাক ও কুশলী বলে বিবেচিত হই না, কিন্তু তোমরা যখন আমাদের দোষ বর্ণনা কর তখন তা’ চাতুর্য বলে বিবেচিত হয়।

شاعرنا مفحم عنكم وشاعركم في حدبنا مبلغ في شتمنا لسن

— তোমাদের নিন্দাবাদে আমাদের কবি থাকে নীরব আর তোমাদের কবি আমাদেরকে গালাগাল দিয়ে ঘাড় বাঁকা করে দিতে সিদ্ধহস্ত। আমাদেরকে গালমন্দ করতে সে বাকপটু।

ما في القلوب عليكم فاعلموا وغر وفي قلوبكم البغضاء والأحن

— মনে রেখো, আমাদের অন্তরে তোমাদের প্রতি কোন হিংসা-বিদ্বেষ নেই। অথচ তোমাদের মনে রয়েছে বিদ্বেষ ও গোপন শত্রুতা।

মাযিন বলেন, অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সকলকে হেদায়ত দান করেন এবং তাদের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে।

হাফিজ আবু লুআয়ম..... হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের সংবাদ সর্বপ্রথম মদীনায় পৌঁছে এভাবে যে, মদীনার জনৈকা মহিলার অনুগত একটি জিন ছিল। একদিন সাদা পাখির আকৃতি নিয়ে সে মহিলার নিকট আসে এবং একটি দেয়ালের ওপর বসে থাকে। মহিলা বলে, “তুমি নেমে আমাদের নিকটে আসছ না কেন? আস, আমরা পরস্পরে কথার্বাতা বলি এবং সংবাদ আদান-প্রদান করি।’ জবাবে জিনটি বলল, “মক্কায় একজন নবী প্রেরিত হয়েছেন। তিনি ব্যভিচার নিষিদ্ধ করেছেন এবং আমাদের মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছেন।”

ওয়াকিদী বলেন...... আলী ইবনে হুসায়ন সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে মদীনায় প্রথম সংবাদ আসে এভাবে যে, সেখানে ফাতিমা নাম্নী এক মহিলা ছিল। তার ছিল একটি অনুগত জিন। একদিন জিনটি তার নিকট এল এবং দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে রইল। সে বলল, ‘তুমি নেমে আসছ না কেন?’ জিনটি বলল, ‘না, নামবো না। কারণ একজন রাসূল প্রেরিত হয়েছেন, তিনি ব্যভিচার হারাম করে দিয়েছেন।’

অন্য এক তাবেঈ মুরসালভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, ওই জিনটির নাম ছিল ইবন লাওযান। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, দীর্ঘদিন যাবত জিনটি মহিলার নিকট অনুপস্থিত ছিল। পরে যখন জিনটি আসে তখন সে জিনটিকে গালমন্দ করে। তখন জিনটি বলল, ‘আমি ওই প্রেরিত রাসূলের নিকট গিয়েছিলাম। আমি তাকে ব্যভিচার হারাম ঘোষণা করতে শুনেছি। সুতরাং তোমার প্রতি সালাম। তোমার নিকট থেকে চির বিদায়।’

ওয়াকিদী বলেন, মুহাম্মদ ইবনে সালিহ উসমান ইবনে আফফান (রা) সূত্রে বলেছেন, একসময় একটি ব্যবসায়ী কাফেলার সদস্যরূপে আমরা সিরিয়া যাত্রা করি। এটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের পূর্বের ঘটনা। আমরা যখন সিরিয়ার প্রবেশদ্বারে পৌঁছি তখন সেখানকার জনৈক গণক মহিলা আমাদের নিকট এলো। সে বলল, ‘আমার জিন সাথী আমার নিকট এসে দেয়ালের ওপর অবস্থান নিল। আমি বললাম ভেতরে আসছ না কেন? সে বলল, এখন আমার জন্যে সে পথ খোলা নেই। আহমদ নামের একজন নবী আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে এসেছেন যার বিরোধিতা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’ হযরত উসমান (রা) বলেন, এরপর আমি মক্কায় ফিরে আসি। সেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে পেলাম যে, তিনি রাসূলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন এবং মানুষকে আল্লাহর প্রতি ডাকছেন।

ওয়াকিদী বলেন, মুহাম্মদ ইব্‌ন আবদুল্লাহ যুহরী বলেছেন, পূর্বযুগে ওহী বিষয়ক আলোচনা শোনা যেত। জিনরা তা শুনতে পেত। ইসলামের যখন আগমন ঘটল তখন জিনদেরকে ওহী শোনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হলো। বানু আসাদ গোত্রে সাঈরা নামে এক মহিলার একটি অনুগত জিন ছিল। যখন দেখা গেল যে, ওহী শোনা আর সম্ভব হচ্ছে না তখন জিনটি মহিলার নিকট উপস্থিত হয় এবং তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। এরপর সে একটি চিৎকার দেয় যে, ওই মহিলা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। তার বুকের মধ্য থেকে জিনটি বলতে শুরু করে কঠোরতা কার্যকর করা হয়েছে, দলে দলে জিনদের ঊর্ধ্বাকাশে গমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাধ্যাতীত নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আর আহমদ (সা) ব্যভিচার হারাম ঘোষণা করেছেন।

হাফিজ আবু বকর খারাইতী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ বালভী......মিরদাস ইবনে কায়স সাদূসী সূত্রে বর্ণনা করেন— আমি একসময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট হাজির হই। তখন তার সম্মুখে গণক পেশা সম্পর্কে এবং তার আবির্ভাবের ফলে কীভাবে ওই গণক পেশা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে, সে সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা)! এ বিষয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। আমি তা আপনার সম্মুখে ব্যক্ত করছি। আমাদের একজন ক্রীতদাসী ছিল, তার নাম খালাসাহ্। তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া খারাপ ধারণা আমরা কোনদিন পোষণ করিনি। একদিনের ঘটনা, সে আমাদের নিকট এসে বলে, হে দাওস সম্প্রদায়! আশ্চর্য, আমার ওপর যা ঘটে গেল তা ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার। আপনারা কি আমার ব্যাপারে ভাল ছাড়া অন্য কোন ধারণা পোষণ করেন?’ আমরা বললাম, ‘ব্যাপার কী?’ সে বলল, ‘আমি আমার বকরী পালের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ একটি অন্ধকার এসে আমাকে ঢেকে ফেলে, এরই মধ্যে আমি নারী- পুরুষের যৌন সঙ্গম অনুভব করি। এখন তো আমি আশংকা করছি যে, হয়ত আমি গর্ভবতী হয়ে পড়েছি।’ মূলত তাই হলো। তার প্রসবকালীন সময় ঘনিয়ে এলো। সে একটি চ্যাপ্টা ও ঝুলন্ত কান বিশিষ্ট সন্তান প্রসব করে। তার কান দুটো ছিল কুকুরের কানের মতো। সে আমাদের মধ্যে কিছুদিন থাকার পরই অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা শুরু করে। হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে এবং নিজের পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘হায় দুর্ভোগ! হায় দুর্ভোগ! হায় ক্রন্দন! হায় ক্রন্দন! গানাম গোত্রের জন্য দুর্ভোগ। ফাহম গোত্রের জন্যে দুর্ভোগ। খায়ল ভূমিতে আগুন প্রজ্বলনকারীর জন্যে দুর্ভোগ। আকাবার অধিবাসীদের সাথে আল্লাহ আছেন। এদের মধ্যে কতক সুদর্শন সাহসী উত্তম যুবক রয়েছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা সওয়রীতে আরোহণ করলাম এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম। এরপর আমরা বললাম, ‘ধুত্তরি, এখন তুমি কী করতে বল?’ সে বলে, ‘কোন ঋতুমতি মহিলা সংগ্রহ করা যাবে?’ আমরা বললাম, ‘আমাদের মধ্য থেকে কে তার দায়িত্ব নেবে?’ সে বলল, ‘আমাদের মধ্য থেকে একজন বৃদ্ধ লোক তার দায়িত্ব নেবে। তবে আল্লাহর কসম, ওই মহিলা আমার নিকট একজন সতী সাধবী মা বটে।’ আমরা বললাম, ‘ঠিক আছে ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।’ মহিলাটিকে নিয়ে আসা হলো। ওই শিশু একটি পাহাড়ে উঠল। মহিলাটিকে সে বলল, ‘আপনার জামা-কাপড় খুলে ফেলে দিন এবং আপনি ওদের সম্মুখে বের হন।’ উপস্থিত লোকজনকে সে বলল, ‘তোমরা তার পেছনে পেছনে যাও।’ আমাদের মধ্যে এক লোকের নাম ছিল আহমদ ইবনে হাবিস। সে বলল, ‘হে আহমদ ইবনে হাবিস! আপনি বিপক্ষদলের প্রথম অশ্বারোহীকে ঠেকাবেন। আহমদ আক্রমণ করলেন। ওদের প্রথম অশ্বারোহীকে তিনি বর্শাঘাত করলেন। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অন্য সবাই পালিয়ে গেল। আমরা ওদের ফেলে যাওয়া মালামাল লুটে নিলাম। সেখানে আমরা একটি গৃহ নির্মাণ করি। সেটির নাম দেই যুল খালাসাহ। ওই শিশুটি আমাদেরকে যা যা বলত, বাস্তবে তা-ই ঘটত। ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! অবশেষে যখন আপনার অবির্ভাবের সময় হলো তখন একদিন সে আমাদেরকে বলল, হে দাওস সম্প্রদায়! বানু হারিছ ইবনে কা’ব হামলা করেছে। তখন আমরা সওয়ারীতে আরোহণ করলাম। সে আমাদেরকে বলল, ‘আপনারা খুব দ্রুত ঘোড়া ছোটাবেন। তাদের চোখে-মুখে মাটি নিক্ষেপ করবেন। সকাল বেলা ওদেরকে দেশান্তর করবেন। সন্ধ্যাবেলা আপনারা মদপান করবেন।’ তার নির্দেশমত আমরা ওদের মুখোমুখি হলাম। কিন্তু তারা আমাদেরকে পরাজিত করে এবং আমাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। এরপর আমরা তার নিকট ফিরে এসে বলি, ‘তোমার কী অবস্থা?’ সে আমাদের দিকে তাকাল। চোখ দুটো তার রক্তিম। কান দুটো ফোলা ফোলা। রাগে সে যেন ফেটে পড়বে। সে উঠে দাঁড়ায়। আমরা সওয়ারীতে উঠে বসি। কিছু সময় আমরা তার নিকট থেকে দূরে সরে থাকি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে আমাদেরকে ডাকে এবং বলে, ‘আপনারা কি এমন কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী আছেন যে যুদ্ধ আপনাদের জন্যে সম্মান, গৌরব, শক্তিশালী রাজ্য এবং আপনাদের হাতে ধন সম্পদ এনে দেবে?’ আমরা বললাম, ‘তা তো আমাদের খুবই প্রয়োজন।’ সে বলল, ‘আপনারা সওয়ারীতে আরোহণ করুন আমরা সওয়ারীতে উঠলাম।’ ‘এবার কী নির্দেশ?’ আমরা বললাম। সে বলল, ‘বানু হারিছ ইবনে মাসলামাহ্ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলুন।’ এরপর বলল, ‘একটু থামুন।’ আমরা থামলাম। সে বলল, ‘বরং ফাহম গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে যান।’ এরপর বলল, ‘না, ওদেরকে তো আপনারা ধ্বংস করতে পারবেন না। আপনারা বরং মুদার গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হউন। ওদের প্রচুর পশু ও ধন সম্পদ রয়েছে।’ এরপর বলল, ‘না, ওদিকে নয় বরং দুরায়দ ইবনে সুম্মা-এর গোত্রের দিকে অগ্রসর হন। ওরা সংখ্যায়ও কম, শক্তিতে দুর্বল।’ এরপর সে বলল, ‘আপনারা বরং কা’ব ইবনে রবী’আ গোত্রের বিরুদ্ধে অগ্রসর হউন। আমির ইবনে সাসা’আ-এর স্বামী পরিত্যক্তা স্ত্রীরা ওদেরকে বসবাস করার স্থান দিয়েছে। সুতরাং যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে হোক।’ তার নির্দেশনায় আমরা কা’ব ইবনে রবী’আ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। কিন্তু ওরা আমাদেরকে পরাজিত করে এবং পর্যদস্ত ও লাঞ্ছিত করে ছেড়ে দেয়। আমরা ফিরে আসি। আমরা তাকে বললাম, ‘দুর্ভোগ তোমার। আমাদেরকে নিয়ে তুমি কী কাণ্ড শুরু করে দিয়েছ?’ সে বলল, ‘আমি নিজেই তো এর রহস্য খুঁজে পাচ্ছি না। আমার গোপন সহচর ইতিপূর্বে আমার সাথে সত্য কথা বলত। এখন দেখি সে মিথ্যা বলছে। আপনারা এক কাজ করুন। একাধারে তিনদিন আপনারা আমাকে আমার ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখুন। এরপর আপনারা আমার নিকট আসবেন।’ তার কথামত আমরা তাকে বন্দী করে রাখি। তিনদিন পর দরজা খুলে আমরা তার নিকট যাই। তখন তাকে দেখাচ্ছিল সে যেন একটি জ্বলন্ত পাথর। সে বলল, ‘হে দাওস সম্প্রদায়! আকাশকে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আগমন করেছেন।’ আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়?’ সে বলল, ‘মক্কায়। আরো শুনে নিন, অচিরেই আমার মৃত্যু হবে। আপনারা তখন আমাকে পাহাড়ের চূড়ায় দাফন করবেন। কারণ অবিলম্বে আমি আগুন রূপে জ্বলে উঠব। আপনারা যদি আমাকে রেখে দেন তবে আমি আপনাদের লাঞ্ছনার কারণ হবো। আপনারা যখন লক্ষ্য করবেন যে, আমি জ্বলে উঠেছি এবং শিখাময় হয়ে গিয়েছি তখন আমার প্রতি তিনটি পাথর নিক্ষেপ করবেন।

প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় বলবেন, হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়ে এ পাথর নিক্ষেপ করছি। তাহলে আমি প্রশমিত হবো ও নির্বাপিত হবো।’ যথাসময়ে তার মৃত্যু হয় এবং সে শিখাময় আগুনে পরিণত হয়। তার নির্দেশ মোতাবেক আমরা সব কিছুর ব্যবস্থা করি! “হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়ে নিক্ষেপ করছি” বলে আমরা তিনটি পাথর নিক্ষেপ করি। ফলে সে প্রশমিত হয় ও নিভে যায়। এরপর আমরা কিছুদিন অপেক্ষা করি। অতঃপর আমাদের এলাকার হজ্জে গমনকারী লোকেরা হজ্জ থেকে ফিরে আসে। ইয়া রাসূলুল্লাহ্! তারা এসে আমাদেরকে আপনার আবির্ভাবের সংবাদ দেয়। উল্লেখ্য যে, হাদীস শাস্ত্রবিশারদদের মতে এটি নিতান্তই গরীব পর্যায়ের হাদীস।

আল ওয়াকিদী....... নাদর ইবনে সুফয়ান হুযালী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমাদের এক ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে একবার আমরা সিরিয়া যাত্রা করি। যারকা ও মা’আন নামক স্থানের মাঝে যাত্রা বিরতি করে আমরা রাত্রি যাপন করছিলাম। হঠাৎ আমরা দেখতে পাই এক অশ্বারোহীকে। আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে দাঁড়িয়ে সে বলছে, “হে নিদ্রামগ্ন ব্যক্তিগণ! জেগে ওঠ, জেগে ওঠ। এখন ঘুমানোর সময় নয়। নবী আহমদ (সা) আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে জিনদেরকে চূড়ান্তভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে।” একথা শুনে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা সবাই ছিলাম তরুণ সহযাত্রী, আমরা সকলেই ওই ঘোষণা শুনেছি। এ অবস্থায় আমরা নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের নিকট ফিরে আসি। আমরা এসে শুনতে পাই যে, আমাদের দেশে কুরাইশ বংশীয় লোকদের মত-পার্থক্যের কথা আলোচনা হচ্ছে যে, বানু আবদুল মুত্তালিব গোত্র থেকে আবির্ভূত এক নবী নিয়ে কুরাইশগণ মতভেদ করছিল। ওই নবীর নাম আহমদ। এ বর্ণনাটি আবু নু’আয়মের। খারাইতী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ বলভী...... ইয়াহয়া ইবনে উরওয়া তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ওয়ারাকা ইবনে নাওফল, যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল, আব্দুল্লাহ্ ইবনে জাহশ এবং উছমান ইবনে হুওয়াইরিছ প্রমুখ ব্যক্তিসহ একদল কুরায়শী লোক একদিন তাদের একটি প্রতিমার নিকট ছিলো। প্রতি বছর ওই দিনটিকে তারা উৎসবের দিনরূপে নির্ধারিত করেছিল। তারা ওই প্রতিমাটি শ্রদ্ধা করত এবং সেটির উদ্দেশ্যে পশু বলি দিত। তারপর ধুমধামের সাথে খাওয়া-দাওয়া ও মদপান করত। তারা সেটির নিকট অবস্থান এবং তা প্রদক্ষিণ করতো, ওইদিন তারা রাত্রি বেলা প্রতিমার নিকট যায়। তারা সেটিকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে। তাতে তারা ব্যথিত হয়। তারা মূর্তিটিকে যথাস্থানে পুনঃস্থাপন করে। সেটি অবিলম্বে দুঃখজনকভাবে উল্টে পড়ে যায়। তারা আবার সেটিকে যথাস্থানে স্থাপন করে। সেটি আবার পড়ে যায়। এ অবস্থা দেখে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এটিকে একটি গুরুতর বিষয়রূপে গণ্য করে। উছমান ইবনে হুওয়াইরিছ বললেন, ‘মূর্তিটির হলো কি? বারবার পড়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই কোন গুরুতর ঘটনা ঘটেছে।’ মূলত এ ঘটনা ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্মগ্রহণের রাতে। অতঃপর উছমান আবৃত্তি করেনঃ

آیا صنم العيد الذي صف حوله - صناديد وفد من بعيد وقريب

— হে উৎসব পালনের মূর্তি! যার চতুর্দিকে উপস্থিত হয়েছে কাছের ও দূরের প্রতিনিধি দলের নেতৃবর্গ।

تنگست مقلوبا فما اذاك قل لنا آذاك سفينة أم تنكست للعشب

— তুমি তো উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছ। আমাদেরকে তুমি বলে দাও, কোন নির্বোধ ব্যক্তি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে কি? না তুমি রাগান্বিত হয়ে পড়ে রয়েছ।

فان كان من ذنب أتينا فاننا نبوء باقرار ونلوى عن الذنب

— যদি আমরা কোন অপরাধ করে থাকি তবে আমরা সেই অপরাধ স্বীকার করব এবং ওই অপরাধ থেকে ফিরে আসব।

وان گنت مغلوبا ونكست صاغرا - فما أنت في الأوثان بالسيد الرب

— আর তুমি যদি পরাজিত হয়ে থাক এবং লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে থাক তবে তো নিশ্চিতভাবে তুমি প্রতিমাগুলোর নেতা ও শ্রেষ্ঠতম নও।

এরপর তারা মূর্তিটিকে ধরে যথা স্থানে পুনঃস্থাপন করে দেয়। যথাযথভাবে স্থাপিত হওয়ার পর সেটির ভেতর থেকে এক অদৃশ্য ঘোষক চিৎকার করে তাদের উদ্দেশে বলতে শুরু করে,

تروى لمولود انارت بنوره جميع فجاج الأرض في الشرق والغرب

— সে তো ধ্বংস হয়েছে এক নব জাতকের কারণে। যার জ্যোতিতে পূর্বে-পশ্চিমে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠেছে।

وخرت له الأوثان طرا وأرعدت قلوب ملوك الأرض طرا من الرعب

— তাঁর আবির্ভাবে মুগ্ধ হয়ে সকল প্রতিমা মাথা নত করেছে। আর তার ভয়ে বিশ্বের সকল রাজা-বাদশাহর অন্তর কেঁপে উঠেছে।

ونار جميع الفرس باخت و اظلمت - وقد بات شاه الفرس في أعظم الكرب

— অগ্নিপূজক সকল পারস্যবাসীর আগুন নিভে গিয়েছে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। পারস্যের প্রতাপশালী সম্রাট প্রচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে রাত্রি যাপন করেছে।

وصيت عن الكهان بالغيب جنها فلا مخبر عنهم بحق ولا كذب

— গণকদের জিনগুলো তাদের নিকট অদৃশ্যের সংবাদ আনয়নে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সুতরাং তাদের নিকট সত্য-মিথ্যা কোন প্রকার সংবাদ আনয়নের কেউ থাকল না।

فيا لقصى ارجعوا عن ضلالكم وهبوا الى الاسلام والمنزل الرحب

— সুতরাং হে কুসাই বংশভুক্ত লোকজন! তোমরা তোমাদের গোমরাহী থেকে ফিরে আস। আর ইসলাম ও বিশাল প্রাঙ্গণের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাও।

এ শব্দ শুনে তারা নির্জনে গিয়ে পরামর্শ করে পরস্পরে বলাবলি করল। আসুন আমরা সবাই একমত হই যে, এ বিষয়টি আমরা সম্পূর্ণরূপে গোপন রেখে দেই। কাউকেই জানতে দেব না। সবাই একথায় রাজী হলো। তবে ওয়ারাকা ইবনে নওফল বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা তো জান যে, তোমাদের সম্প্রদায় প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তারা সঠিক ও যুক্তিসম্মত পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এবং ইবরাহীম (আ)-এর দীন ছেড়ে দিয়েছে। তোমরা পাথরের তৈরি যে মূর্তির তাওয়াফ করছ সেটি তো কিছুই শুনতে পায় না। কিছুই দেখতে পায় না। কোন কল্যাণও করতে পারে না, অকল্যাণও নয়। হে আমার সম্প্রদায়। তোমরা নিজেদের জন্যে সঠিক ধর্ম খুঁজে নাও।’ একথা শুনে তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইব্রাহীম (আ)-এর হানীফ ও সত্য ধর্ম খুঁজতে থাকে। বস্তুত ওয়ারাকা ইবনে নওফল খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন এবং কিতাবাদি অধ্যয়ন করে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন।

উছমান ইবনে হুওয়াইরিছ রোমান সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হয়ে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্রাটের দরবারে মর্যাদা লাভ করেন। যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল বের হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বন্দী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি বের হয়ে জাকিরা অঞ্চলের রিককা নামক স্থানে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে একজন অভিজ্ঞ ধর্মযাজকের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। নিজের অভিপ্রায়ের কথা যাজকের নিকট প্রকাশ করেন। যাজক বললেন, ‘আপনি তো এমন এক দীন ধর্মের সন্ধান করেছেন, আপনাকে কেউই দেখতে পারবে না। তবে শুনুন– এমন এক সময় ঘনিয়ে এসেছে যে সময়ে আপনার নিজ শহর থেকে একজন নবী আত্মপ্রকাশ করবেন। তিনি দীন-ই হানীফ তথা সঠিক দীন সহকারে প্রেরিত হবেন।’ একথা শুনে তিনি মক্কার উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা করেন। পথিমধ্যে লাখম গোত্রীয় ডাকাতেরা তার উপর হামলা চালায় এবং তাকে হত্যা করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ মক্কাতেই থেকে যান। এক সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাব ঘটে। হাবশায় হিজরতকারী দলের সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশও হাবশা গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত খৃস্ট ধর্মের উপর তার মৃত্যু হয়। যায়দ ইবনে আমর ইবনে নুফায়লের জীবনী প্রসঙ্গে এ বর্ণনার সমর্থক একটি বর্ণনা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

খারাইতী বলেন, আহমদ ইবনে ইসহাক...... আব্বাস ইবনে মিরদাস সূত্রে বর্ণনা করেন, একদিন দুপুর বেলা তিনি তার দুগ্ধবতী উষ্ট্রীগুলোর পরিচর্যা করছিলেন। হঠাৎ তিনি একটি সাদা উটপাখি দেখতে পান। পাখিটির পিঠে ছিল একজন দুগ্ধধবল পোশাক পরিহিত আরোহী। সে বলল, ‘হে আব্বাস ইবনে মিরদাস! তুমি কি দেখনি যে, আকাশ তার প্রহরীদের দ্বারা নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে, যুদ্ধ কয়েকবার তার পানীয় পান করেছে এবং অশ্বদলের পিঠের আসন খুলে রাখা হয়েছে? মনে রেখ যিনি সততা ও খোদাভীতি সহকারে সোমবারের দিনে মঙ্গলবারের রাতে আগমন করলেন তিনি কুসওয়া উষ্ট্রীর মালিক।’ একথা শুনে শংকিত সন্ত্রস্ত হয়ে আমি ফিরে আসি। যা আমি দেখলাম এবং যা আমি শুনলাম তাতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। অতঃপর আমি আমাদের নিজস্ব একটি প্রতিমার নিকট উপস্থিত হই। প্রতিমাটির নাম যামাদ। আমরা সেটির উপাসনা করতাম এবং সেটির মধ্যে অবস্থানকারী জিনের সাথে কথা বলতাম। আমি তার চারপাশ ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করলাম, তারপর সেটির দেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে সেটিকে চুমু খেলাম তখন শুনতে পেলাম যে, তার মধ্যে অবস্থানকারী জিনটি বলছেঃ

قل للقبائل من سليم گلها هلك الضماد وفاز أهل المسجد

— সমগ্র সুলায়ম গোত্রে বলে দাও যে, যামাদ প্রতিমা ধ্বংস হয়েছে এবং মসজিদওয়ালা লোকেরা সফলকাম হয়েছে।

هلك الضماد وكان يعبد مرة قبل الصلاة مع النبي محمد

— যামাদ প্রতিমা ধ্বংস হয়েছে! নবী মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে নামায আদায়ের নিয়ম চালু হওয়ার পূর্বে এক সময় তার পূজা করা হতো বটে।

ان الذي ورث النبوة والهدی بعد ابن مريم من قريش مهتد

— মরিয়ম তনয় ঈসা (আ) এরপর কুরায়শ বংশীয় যিনি নবুয়ত ও হেদায়তের ক্ষেত্রে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নিশ্চয় তিনি প্রকৃত সত্য পথের দিশা পেয়েছেন।

মূর্তির নিকট থেকে এ বক্তব্য শুনে আতংকগ্রস্ত হয়ে আমি আমার সম্প্রদায়ের নিকট আসি এবং তাদেরকে সকল ঘটনা খুলে বলি। এরপর আমার গোত্র বানু হারিছা গোত্রের প্রায় তিনশ’ লোক সহকারে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। তিনি তখন মদীনায় অবস্থান করছিলেন। আমরা মদীনার মসজিদে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘হে আব্বাস! তুমি কোন প্রেক্ষাপটে ইসলাম গ্রহণের জন্যে এসেছ তা বল দেখি।’ আমি ইতিপূর্বে সংঘটিত ঘটনা তার নিকট বর্ণনা করলাম। বিস্তারিত শুনে তিনি খুশি হলেন। তখন আমি নিজে এবং আমার সম্প্রদায় সকলে ইসলাম গ্রহণ করি। হাফিজ আবু নুআয়ম ‘আদদালাইল” গ্রন্থে আবু বকর ইবনে আবী আসিম সূত্রে আমর ইবনে উছমান থেকে এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। এরপর তিনি আসমাঈ আব্বাস ইবনে মিরদাস সুলামী থেকে বর্ণনা করেছেন, আব্বাস বলেছেন আমার ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক প্রেক্ষাপট এই ছিল যে, আমার পিতা মিরদাস যখন মৃত্যুপথ যাত্রী। তখন তিনি আমাকে ওসীয়ত করেন আমি যেন তাঁর প্রিয় প্রতিমা ‘যামাদ’-এর সেবাযত্ন করি। তার ওসীয়ত অনুযায়ী আমি মূর্তিটিকে একটি ঘরে স্থাপন করি। দৈনিক একবার করে আমি তার নিকট যেতাম। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের পর একদা মধ্য রাতে আমি একটি শব্দ শুনতে পাই। শব্দটি আমাকে আতংকিত করে তোলে। কালবিলম্ব না করে সাহায্যের আশায় আমি যামাদ প্রতিমার নিকট উপস্থিত হই। তখন সেটির ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছিলঃ সে পূর্বোল্লিখিত পংক্তিগুলো ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ আবৃত্তি করছিল।

এ ঘটনা আমি লোকজনের নিকট থেকে গোপন রাখি। লোকজন উৎসব থেকে ফিরে আসার পর একদিন আমি যাতু ইরক অঞ্চলের আকীক নামক স্থানে আমার উট বহরের মধ্যে শুয়েছিলাম। তখন হঠাৎ আমি একটি শব্দ শুনি। তাকিয়ে দেখি একটি উটপাখির ডানাতে অবস্থানরত এক লোক বলছে, সেই জ্যোতির কথা বলছি যেটি সোমবার দিবাগত রাতে বানু আনকা গোত্রের দেশে আল-আদবা উষ্ট্রীর মালিকের উপর নাযিল হয়েছে। এরপর তাঁর উত্তর দিক থেকে ঘোষণা দানকারী এক ঘোষক প্রত্যুত্তরে বলল,

بشر الجن وابلاسها ان وضعت المطى أحلاسها

وكلات السماء أحراسها

— হতাশাগ্রস্ত জিন জাতিকে জানিয়ে দাও যে, বাহন উট তার পৃষ্ঠে আসন স্থাপন করেছে। এবং আকাশ তার প্রহরীদেরকে সুসজ্জিত করেছে। এ সব দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমি লাফিয়ে উঠি। আমি উপলব্ধি করি, নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা) প্রেরিত হয়েছেন। আমি তখন আমার অশ্বে আরোহণ করি এবং দ্রুত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হই। আমি তার হাতে বাই’আত করি। এরপর আমি যামাদ’ মূর্তির নিকট ফিরে গিয়ে সেটিকে আগুনে পুড়িয়া ফেলি। তারপর পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ফিরে আসি।

তখন আমি নিম্নের কবিতাটি আবৃত্তি করি,

لعمرك اني يوم اجعل جاهلا ضمادا لرب العلمين مشارگا

— আপনার জীবনের কসম, যে সময়ে আমি যামাদ’ মূর্তিকে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সমকক্ষ নির্ধারণ করতাম সে সময়ে আমি নিশ্চয়ই মূর্খ ও অজ্ঞ ছিলাম।

وتركى رسول الله وللاوس حوله أولئك أنصار له ما أولئك

— রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আমি যে বর্জন করেছিলাম এবং তাঁর চারদিকে থাকা আওস সম্প্রদায়কে, ওরা তো রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহায্যকারী আনসারগণ।

كتارك سهل الأرض والحزن يبتغي - ليسلك في وعث الأمور مسالگا

— আমার ওই বর্জন হলো সে ব্যক্তির ন্যায় যে আপদকালীন সময়ে সমতল ও নম্রভূমি বর্জন করে কঠিন ও বন্ধুর পথের খোঁজ করে।

فامنت بالله الذي أنا عبده وخالفت من أمسى يريد المهالگا

— আমি ওই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি আমি যাঁর বান্দা এবং আমি বিরোধিতা করেছি সেই ব্যক্তির, যে ধ্বংসের পথ কামনায় দিন গুজরান করে।

ووجهت وجهي نحو مكة قاصدا أبايع نبي الأكرمين المباركا

— আমি আমার মুখ ফিরিয়ে মক্কা অভিমুখী হয়েছি- শ্রেষ্ঠতম ও বরকতময় নবীর হাতে বাইয়াত করার উদ্দেশ্যে।

نبي أتانا بعد عیسی بناطق من الحق فيه الفصل كذلك

— ঈসা (আ)-এর পর এই নবী আমাদের নিকট আগমন করেছেন এমন এক আসমানী গ্রন্থ নিয়ে যেটি সত্য বর্ণনা করে এবং যার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট ফয়সালা।

أمين على القران أول شافع واول مبعوث يجيب اللائگا

— এই নবী কুরআন মজীদের আমানতদার। তিনি সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম তিনি পুনরুজ্জিত হবেন। তিনি ফেরেশতাদের ডাকে সাড়া দেন।

تلا في عرى الاسلام بعد انتقاضها فأحمها حتى أقام المناسكا

— ইসলামের হাতলগুলো ভেঙে যাওয়ার পর তিনি সেগুলোকে জোড়া লাগিয়েছেন এবং মজবুত ও শক্তিশালী করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পরিপূর্ণ ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করলেন।

عنيتك يا خير البرية كلها - توسطت في الفرعين والمجد مالگا

— হে সমগ্র জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি! আমি ইতিপূর্বে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। উভয় জগতে আপনি সর্বোত্তম এবং মর্যাদার অধিকারী।

وانت المصفى من قريش اذا سمت على ضمرها تبقى القرون المباركا

— আপনি কুরাইশ বংশের স্বচ্ছ ও পুতঃপবিত্র মানুষ। যুগযুগ ধরে তারা বরকতময় থাকবে যদি তারা আপনার পথের পথিক হয়।

اذا انتسب الحيان كعب ومالك وجدنان محضا والتساء العوارگا

— যখন কা’ব গোত্র ও মালিক গোত্রের বংশ পরিচয় বর্ণনা করা হয়, তখন আমরা আপনাকে খাঁটি ও নির্ভেজাল অভিজাত বংশোদ্ভূত পাই আর ওই গোত্রগুলোর মহিলাদেরকে পাই পুতঃপবিত্র।

খারাইতী বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ বলভী....... মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক সূত্রে বলেছেন, মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্-এর বংশীয় আবদুল্লাহ্ ইবনে মাহমুদ নামের একজন আনসার শায়খ আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে, খাছ‘আমে বংশের কয়েকজন লোক এ কথা বলত যে, নিম্নোক্ত ঘটনা আমাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা মূর্তিপূজা করতাম। একদিন আমরা আমাদের এক প্রতিমার নিকট ছিলাম; তখন একদল লোক ওই প্রতিমার নিকট এসেছিল ফরিয়াদ করার জন্যে, তাদের মধ্যেকার কোন এক বিরোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে। তখন তাদের উদ্দেশে এক অদৃশ্য ঘোষক ঘোষণা দেয়ঃ

يا يها الناس ذوو الاخسام من بين اشياخ الي غلام

— হে বিশালকায় লোক সকল! ছেলে বুড়ো সবাই,

ما أنتم وطائش الأحلام ومسند الحكم الى الأصنام

— আর কতকাল তোমরা স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবে? আর সকল বিধি-বিধান প্রতিমাদের বলে মেনে চলবে?

كلكم في حيرة نيام أم لا ترون ما الذي امامی

— তোমাদের সকলেই কি অস্থিরতায় ভুগছ এবং নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছ? আমার সম্মুখে কি আছে তার কিছুই কি তোমরা দেখছো না?

من ساطع يجلو دجي الظلام قد لاح للناظر من تهام

— আমার সম্মুখে রয়েছে আলোক খণ্ড। সেটি অন্ধকারের কালিমাকে দূরীভূত করে দিচ্ছে। দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট তিনি দৃশ্যমান। তিনি এসেছেন তিহামা অঞ্চল থেকে।

ذاك نبي سيد الأنام - قد جاء بعد الكفر بالاسلام

— তিনি নবী, তিনি মানবকুল শ্রেষ্ঠ। কুফরী যুগের পর তিনি ইসলাম নিয়ে এসেছেন।

أكرمه الرحمن من امام ومن رسول صادق الكلام

— আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে ইমামতি ও নেতৃত্ব দিয়ে এবং সত্যবাদী রাসূলরূপে প্রেরণ করে সম্মানিত করেছেন।

أعدل ذي حكم من الأحكام يأمر بالصلاة والصيام

— তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক। তিনি নামায-রোযার নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

وللبر والصلات للارحام ويزجر الناس عن الآثام

— সদাচরণ করতে এবং আত্মীয়তা অক্ষুন্ন রাখতে তিনি নির্দেশ দেন। পাপাচারিতা ও অন্যায় আচরণ থেকে মানুষকে তিনি সতর্ক করেন।

والرجس والأوثان والحرام - من هاشم في ذروة السنام

— তিনি লোকদেরকে নিবৃত্ত করেন অপবিত্রতা থেকে, মূর্তিপূজা থেকে এবং হারাম কর্ম থেকে। তিনি এসেছেন সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন হাশেমী বংশ থেকে।

مستعلنا في البلد الحرام

— সম্মানিত শহর মক্কা শরীফে তিনি তাঁর বাণী প্রচার করছেন। আমরা শুনে সেখান থেকে এসে নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করি।

খারাইতি বলেন, আবদুল্লাহ বলভী.......সাঈদ ইবনে জুবায়র (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, তামীম গোত্রের রাফি ইবনে উমায়র নামক এক ব্যক্তি পথঘাট যার সবচেয়ে বেশি চেনা-জানা ছিল—গোত্রের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক রাত্রি ভ্রমণকারী ছিলেন। বিপদাপদের মোকাবেলায় তিনি ছিলেন সকলের অগ্রণী। পথঘাট সম্পর্কে অবগতি ও রাত্রি ভ্রমণের দুঃসাহসের কারণে আরবগণ তাঁকে ‘আরবের দামূস’ নামে অভিহিত করত। [( دعموص ) দামুস এক প্রকার জলজ প্রাণী] তিনি তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করে বলেনঃ একরাতে আমি এক বালুকাময় অঞ্চল অতিক্রম করছিলাম। এক সময় আমার প্রচণ্ড ঘুম পায়। সওয়ারী থেকে নেমে সেটিকে বসিয়ে দিয়ে তার সম্মুখের দু’পায়ে মাথা রেখে আমি শুয়ে পড়ি এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। ঘুমানোর পূর্বে আত্মরক্ষার জন্যে আমি নিম্নোক্ত বাক্য উচ্চারণ করিঃ “এই উপত্যকার নেতৃত্বে আসীন জিনের নিকট আমি সকল প্রকারের অত্যাচার ও দুঃখকষ্ট থেকে আশ্রয় কামনা করছি।” তখন আমি স্বপ্নে দেখি এক যুবা পুরুষ। সে আমার উষ্ট্রীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তার হাতে একটি বর্শা। বর্শার আঘাতে সে আমার উষ্ট্রীর বক্ষ চিরে ফেলতে উদ্যত। এ স্বপ্ন দেখে আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই। মনে মনে বললাম, এটি শয়তানের কুমন্ত্রণা। পুনরায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এবারও একই স্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠি এবং উষ্ট্রীর চারদিকে ঘুরেফিরে খোঁজাখুঁজি করি কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে এতটুকু দেখলাম যে, উষ্ট্রীটি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আবারও সেই একই স্বপ্ন দেখি। এবারও আমি জেগে উঠি। তখন আমার উষ্ট্ৰীটি দস্তুর মত ছটফট করছে। এমন সময় হঠাৎ আমার দৃষ্টিগোচর হয় এক যুবা পুরুষ। স্বপ্নে যেমনটি দেখেছি ঠিক তেমন। তার হাতে একটি বর্শা। সেখানে একজন বৃদ্ধ লোক। তিনি যুবকের বর্শাটিকে আমার উষ্ট্রী থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বৃদ্ধ লোকটি ওই যুবককে লক্ষ্য করে বলছেনঃ

يا مالك بن مهلهل بن دثار - مهلا فدى لك مشزرى وازاری

অর্থাৎ, হে মালিক ইবন মুহালিহিল ইবন দিছার! থাম, থাম, আমার ফিতা পাজামা সবকিছু তোমার জন্যে উৎসর্গ হোক।

عن ناقة الانسي لا تعرض لها - واختربها ما شئت من أثواری

অর্থাৎ, ওই মানব সন্তানের উষ্ট্রীর ওপর আক্রমণ করা থেকে তুমি বিরত থাক। সেটির ওপর হামলা করো না, সেটির পরিবর্তে আমার ষাঁড়গুলো থেকে যা তোমার পছন্দ হয় নিয়ে যাও।

ولقد بدالي منك ما لم أحتسب - الأ رعیت قرابتی وذماري

অর্থাৎ, তোমার নিকট থেকে আমি এমন আচরণ পেয়েছি যা আমি কখনও কল্পনা করিনি। তুমি তো আমার আত্মীয়তার মর্যাদা দাওনি এবং আমার যতটুকু সম্ভ্রম রক্ষা করা তোমার কর্তব্য ছিল তাও করনি।

تسمو اليه بحربة مسمومة تبالفعلك يا أبا الغفار

অর্থাৎ, আশ্চর্য! বিষমিশ্রিত বর্শা তুমি তার প্রতি উত্তোলন করেছ। ধিক তোমার অপকর্ম! হে আবুল গিফার।

لولا الحياء وان أهلك حيرة - لعلمت ما كشفت من أخباری

অর্থাৎ, চক্ষুলজ্জা যদি না থাকত আর তোমার পরিবারবর্গ যদি আমার প্রতিবেশী না হতো তবে। তুমি অবশ্য দেখতে পেতে আমার কী পরিমাণ ক্ষোভের তুমি সঞ্চার করে দিয়েছ।

উত্তরে যুবা পুরুষটি বলল,

أاردت أن تعلو وتخفض ذكرنا - في غير مزربة أبا العيزار

অর্থাৎ, হে আবুল ঈযার! তুমি কি নিজে সম্মান লাভের চেষ্টা করছ? আর আমাদের কোন দোষ-ত্রুটি ব্যতীত আমাদের সুনাম সুখ্যাতি কমিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছ?

ماكان فيهم سيد فيما مضى - ان الخيار مهو بنوا الخيار

অর্থাৎ, অতীত যুগে ওদের মধ্যে তো কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জন্মায় নি। ভাল মানুষরা তো ভাল মানুষেরই সন্তান হয়ে থাকে।

فاقصد لقصدك يا معكبر انما - كان المجير مهلهل بن دثار

অর্থাৎ, হে বন্য পশু! তুমি তোমার পথে যাও। মূলত মুহালহিল ইবন দিছারই এতদঞ্চলের আশ্রয়দাতা ছিল।

ওরা দু’জন কথা কাটাকাটি করছিল। হঠাৎ তিনটি বন্য ষাঁড় বেরিয়ে এলো। যুবককে লক্ষ্য করে বৃদ্ধ বললেন, ‘ভাতিজা! আমার আশ্রয় প্রার্থী লোকটির উষ্ট্রীর পরিবর্তে এই তিনটি ষাঁড়ের মধ্যে যেটি তোমার পছন্দ হয় সেটি তুমি নিয়ে যাও!’ একটি ষাঁড় নিয়ে যুবকটি চলে গেল। অতঃপর বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বলল, ‘হে মানব সন্তান! কোন মাঠ-প্রান্তরে অবতরণ করলে এবং সেখানকার ভয়-ভীতিতে শংকিত হলে এভাবে আশ্রয় কামনা করবে, “হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতিপালক! এই প্রান্তরের ক্ষয়ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” খবরদার! কোন জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করো না। ওদের কাজ-কর্ম ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন বাতিল ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।’ আমি তাকে বললাম, ‘কে সেই মুহাম্মদ?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘তিনি একজন আরবী নবী। এককভাবে পূর্বেরও নন, পশ্চিমেরও নন। সোমবার তিনি দুনিয়াতে এসেছেন।’ ‘তাঁর বাসস্থান কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ‘খেজুর বাগানসমৃদ্ধ ইয়াসরিব নগরীতে তিনি বসবাস করেন।’ ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হওয়ার পর আমি আমার সওয়ারীতে আরোহণ করি এবং দ্রুত অগ্রসর হয়ে মদীনায় গিয়ে পৌঁছি। রাসূলুল্লাহ (সা) আমায় দেখেন। আমি কিছু বলার পূর্বেই তিনি আমাকে উপলক্ষ করে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বলে দিলেন। তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। সাঈদ ইবন জুবায়র (রা) বলেন আমরা এই অভিমত পেশ করি যে,

وأنه كان رجال من الانس - يعوذون برجال من الجن فزادوهم رهقا

কতক মানুষ কতক জিনের আশ্রয় কামনা করত ফলে ওরা জিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত আয়াতটি আল্লাহ্ তা’আলা এই ব্যক্তি সম্পর্কে নাযিল করেছেন।

খারাইতি-হযরত আলী (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যদি তুমি কোন পার্বত্য উপত্যকায় যাও এবং হিংস্র জীবজন্তুর আশংকা কর তবে এই দোয়া পাঠ করবে,

( اعوذ بدانيال والجب من شر الاسد )

আমি দানিয়াল ও তার শরণ নিচ্ছি সিংহের আক্রমণের বিপদ থেকে।

বালাভী ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে জিনদের সাথে হযরত আলী (রা)-এর লড়াইয়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আলী (রা)-কে পানি আনয়নের জন্যে পাঠিয়েছিলেন, জিনরা তাঁকে বাধা দেয় এবং তাঁর বালতির রশি কেটে ফেলে। তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এ ঘটনাটি ঘটেছিল জুহফা অঞ্চলে যাতুল আলম নামীয় কূপের নিকট। এটি একটি দীর্ঘ বর্ণনা এবং বর্ণনাটি অগ্রহণযোগ্যও বটে।

খারাইতি বলেন, আবুল হারিছ .......শাবী (র) সূত্রে জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি একদিন উমর ইবন খাত্তাব (রা)-এর মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। একদল সাহাবী তখন তাঁর নিকট বসা অবস্থায় ছিলেন। তারা কুরআন মজীদের ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। একজন বললেন, ‘সূরা নাহলের শেষ দিকের আয়াতগুলো অধিক ফযীলতময়।’ কেউ বললেন, ‘সূরা ইয়াসীন।’ হযরত আলী (রা) বললেন, ‘আয়াতুল কুরসী-এর ফযীলত সম্পর্কে আপনারা কতটুকু জানেন? বস্তুত আয়তুল কুরসীতে ৭০টি শব্দ রয়েছে এবং প্রত্যেক শব্দের বরকত রয়েছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, ওই মজলিসে আমর ইবন মা’দীকারাবও ছিলেন। তিনি কোন মন্তব্য করছিলেন না। এবার তিনি বললেন, ‘হায়! ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর ফযীলত সম্পর্কে আপনারা কেউ কিছু বলছেন না যে,’ তাকে লক্ষ্য করে হযরত উমর (রা) বললেন, ‘এ বিষয়ে আপনি আপনার বক্তব্য পেশ করুন।’

আমর ইবন মাদীকারাব বলতে শুরু করলেনঃ জাহেলিয়াতের যুগে সংঘটিত আমার এক ঘটনার কথা বলছি। একদিন আমার প্রচণ্ড ক্ষিধে পায়। খাদ্যের খোঁজে আমি আমার ঘোড়া নিয়ে এক বনের মধ্যে ঢুকে পড়ি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর উটপাখির কয়েকটি ডিম ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। তা নিয়েই আমি ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি এক আরবী বৃদ্ধ লোক তার তাঁবুতে বসে রয়েছেন। তাঁর পাশে একটি বালিকা। বালিকাটি উদীয়মান সূর্যের ন্যায় ফুটফুটে সুন্দরী। বৃদ্ধের অল্প কয়েকটি ছাগল ছিল। আমি তাঁকে বললাম, ‘তোমার মা ধ্বংস হোক, তুমি আমার হাতে বন্দী।’ সে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যুবক! তুমি যদি আমার আতিথ্য পেতে চাও তবে সওয়ারী থেকে নেমে আমার এখানে আস। আর যদি আমার পক্ষ থেকে কোন সাহায্য চাও, তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করবো।’ আমি বললাম, ‘না তুমি আমার হাতে বন্দী।’ এবার সে বলল,

عرضنا عليك النزل منا تكرما - فلم تروی جهلا كفعل الأشائم

অর্থাৎ, আমাদের পক্ষ থেকে সম্মানজনকভাবে আমরা তোমাকে আতিথ্যের প্রস্তাব দিলাম। অভদ্রদের ন্যায় অজ্ঞতা হেতু তুমি তা প্রত্যাখ্যান করলে।

وجئت ببهتان وزور ودون ما - تمنيته بالبيض حز الغلاصم

অর্থাৎ, তুমি বরং অপবাদ ও মিথ্যা নিয়ে এসেছ। ওই ডিম দ্বারা তুমি যা কামনা করছ তার পরিণামে তোমার গর্দান কাটা যাবে।

অতঃপর সে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বিশাল দেহের তলায় আমি যেন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। সে বলল, “আমি কি তোমাকে মেরে ফেলব? না কি ছেড়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘আমাকে ছেড়ে দাও!’ সে আমাকে ছেড়ে দিল।

আমার প্রবৃত্তি আমাকে পুনরায় তার বিরুদ্ধে যুঝতে প্ররোচিত করে। আমি বললাম, ‘তোমার মা। সন্তান হারা হোক! তুমি আমার হাতে বন্দী।’ সে বললঃ

بسم الله الرحمن فزنا - هنالك والرحيم به قهرنا

অর্থাৎ, দয়াময় আল্লাহর নামে আমি তখন সফল হয়েছি। পরম করুণাময় আল্লাহর নামে আমি তাকে পরাস্ত করেছি।

وما تغنی جلادة ذي حقاظ - اذا يوما لمعركة برزنا

অর্থাৎ, যদি আমরা কোন দিন যুদ্ধের জন্যে বের হই তবে কোন রক্ষাকর্তার শক্তিমত্তা আমাদের হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। অতঃপর সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি যেন তার শরীরের নিচে মাটিতে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। সে বলল, ‘এখন তোমাকে মেরে ফেলব, না ছেড়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘বরং ছেড়ে দাও।’ সে আমাকে ছেড়ে দেয়। মুক্তি পেয়ে আমি কিছুদূর চলে যাই। এরপর আমি নিজেকে নিজে বলি, হে আমর! ওই বৃদ্ধ লোকটি তোমাকে হারিয়ে দিল? তোমার জন্যে এখন বাঁচার চাইতে মরাই ভাল। আমি পুনরায় তার নিকট ফিরে আসি। আমি তাকে বলিঃ ‘তুমি আমার হাতে বন্দী। তোমার মা সন্তানহারা হোক।’ সে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে পুনরায় আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার দেহের নিচে আমি যেন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। সে বলল, ‘এবার তোমাকে মেরে ফেলব, না ছেড়ে দেব?’ আমি বললাম, ‘ছেড়ে দাও।’ সে বলল, ‘না, না, আর নয়, তোমার মুক্তি সুদূর পরাহত। এই মেয়ে, ছুরিটা নিয়ে এসো।’ মেয়েটি ছুরি নিয়ে আসলো। বৃদ্ধ লোকটি আমার কপালের উপরের দিকের চুল কেটে দিল। আরবের প্রথা ছিল কারো উপর বিজয় লাভ করলে তার মাথার সম্মুখ ভাগের চুল কেটে দিয়ে তাকে ক্রীতদাস বানিয়ে নিত। এরপর অনেকদিন ক্রীতদাস রূপে আমি তার সেবা করেছি। একদিন সে বলল, ‘হে আমর! আমি চাই তুমি আমার সাথে সওয়ারীতে বসবে এবং প্রান্তরে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াবে। তোমার পক্ষ থেকে আমি কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা করি না। কারণ আমি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর বরকতে পরম বিশ্বাসী।’

আমরা যাত্রা করলাম। যেতে যেতে বহুদূরে এক ভয়ংকর জিন-ভূত ভর্তি জঙ্গলে এসে পৌঁছি। উচ্চস্বরে সে বলে ওঠেঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। ফলে সেখানকার সকল পাখি নিজ নিজ বাসা ছেড়ে উড়ে যায়। সে পুনরায় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে ওঠে। এবার সকল হিংস্র জীবজন্তু নিজ নিজ বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে পুনরায় এর পুনরাবৃত্তি করে। এবার আমি দেখতে পেলাম যে, আমাদের সম্মুখে এক হাবশি লোক। ওই জঙ্গল থেকে সে বেরিয়ে আসছে। তাকে একটি দীর্ঘকায় খেজুর গাছের মতো দেখাচ্ছিল। আমার সাথী বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বলল, ‘হে আমর! তুমি যখন দেখবে যে, আমরা প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি তখন তুমি বলবে, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”-এর বরকতে আমার সাথী ওর বিরুদ্ধে জয়ী হোক।’ আমি যখন দেখলাম, তারা দুজনেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে তখন আমি বললাম, “লাত ও উযযা মূর্তির আশীর্বাদে আমার সাথী তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়ী হোক।’ দেখা গেল আমার বৃদ্ধ সাথী তার প্রতিপক্ষকে মোটেই জব্দ করতে পারছে না। আমার নিকট ফিরে এসে সে বলল, ‘আমি বুঝেছি তুমি আমার নির্দেশের বিপরীত কথা বলেছ।’ আমি দোষ স্বীকার করে বলি- ‘হ্যাঁ, তা করেছি বটে, আর ওরূপ করব না।’ সে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার যখন আমাদেরকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত দেখবে তখন তুমি বলবে, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম”-এর বরকতে আমার সাথী জয়ী হোক।’ আমি সম্মতিসূচক উত্তরে বলি, ‘হ্যাঁ, তা-ই হবে।’

আমি যখন দেখলাম, তারা দুজনে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তখন বললাম, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমের বরকতে আমার সাথী জয়ী হোক।’ এবার আমার বৃদ্ধ সাথী তার প্রতিপক্ষকে চেপে ধরল এবং ছুরিকাঘাতে তার পেট চিরে ফেলল। তখন তার দেহ থেকে চিমনীর কালো কালির ন্যায় একটি বস্তু বের হলো। আমার সাথী বলল, ‘হে আমর! এটি হলো তার হিংসা ও বিদ্বেষ।’

‘ওই বালিকাটিকে তুমি চেন কি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘না, চিনি না।’ সে বলল, ‘বালিকাটি হলো সম্ভ্রান্ত জিন সালীল জুরহুনীর কন্যা ফারিআ।’ ওরা হলো তার বংশের লোক। তার জ্ঞাতি ভাই। প্রতিবছর তারা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর বরকতে একজন লোক সব সময় আমাকে ওদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে। এরপর সে বলল, ‘এ কালো লোকটির প্রতি আমি কী আচরণ করেছি দেখেছ তো? এখন আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। তুমি আমাকে কিছু একটা এনে দাও, আমি খেয়ে নিই।’ খাদ্য সংগ্রহের জন্যে ঘোড়া ছুটিয়ে আমি বনের ভেতর ঢুকে পড়ি। খুঁজে পাই উট পাখির কয়েকটি ডিম। আমি তা নিয়ে আসি। তখন বৃদ্ধ নিদ্রামগ্ন। তার মাথার নিচে আমি কাঠের ন্যায় কি একটা লক্ষ্য করলাম, আমি চুপিসারে সেটি টেনে নিলাম। দেখলাম সেটি একটি তরবারি। দৈর্ঘ্যে সাত বিঘত, আর প্রস্থে এক বিঘত। তরবারি দ্বারা আমি তার পায়ের নলায় আঘাত করি। তার নলাসহ পা দু’টো আলাদা হয়ে যায়। পিঠে ভর দিয়ে সে সোজা হয়ে ওঠে এবং বলে ওঠে, ‘আল্লাহ্ তোকে ধ্বংস করুন। হে বিশ্বাসঘাতক! কেমনতর বিশ্বাস ঘাতকতা করলি তুই!’

হযরত উমর (রা) বললেন, ‘তারপর তুমি কী করলে?’ আমি বললাম, ‘অতঃপর আমি তাকে একের পর এক আঘাত করতে থাকি এবং তাকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলি।’ তখন রাগে গরগর করতে করতে সে এ কবিতাটি আবৃত্তি করে,

بالغدر نلت أخا الإسلام عن كتب - ما ان معت كذا في مسالف العرب

অর্থাৎ, বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি একজন মুসলমানকে কাবু করলে! পূর্ববর্তী যুগের আরবদের কেউ এমনটি করেছে বলে আমি কখনো শুনিনি।

والعجم تائف مما جته گرما - تبا لما جئت في السيد الأرب

অর্থাৎ, সদাচরণের বিনিময়ে তুমি যা করলে অনাবর লোকেরা তার নিন্দা করে। একজন জ্ঞানবান নেতার ব্যাপারে তুমি যা করেছ তার জন্যে তুমি ধ্বংস হও।

اني لاعجب انى نائف قتلته أم كيف جازاك عند الذنب لم تب

অর্থাৎ, তোমাকে হত্যা করতে পারলে আমি খুশি হতাম। অন্যথায় যে পাপের তুমি প্রতিবিধান করোনি তার প্রতিফল কী হবে?

قرم عفا عنك مرات وقد علقت - بالجسم منك يداه موضع العطب

অর্থাৎ, তিনি একজন নেতৃস্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি বারবার তোমাকে ক্ষমা করেছেন। অথচ তোমার কারণে তাঁর হাত ঝুলছে দেহের সাথে। তিনি এখন মৃত্যুপথযাত্রী।

জাহেলী যুগে শিরকপন্থী ও খৃষ্টবাদীরা যা করত ইসলাম প্রহণের পর আমি যদি তা করতাম,

তাহলে আমার পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ তুমি এমন একটি তরবারির আক্রমণ পেতে যা আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যে দুঃখ ও ধ্বংসই ডেকে আনে।

হযরত উমর (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘বালিকাটির কি হলো?’ আমি বললাম, ‘এরপর আমি বালিকাটির নিকট যাই।’

আমাকে দেখে সে বলল, ‘বৃদ্ধটির কী হলো?’ আমি বললাম, ‘হাবশি লোকটি তাকে খুন করেছে।’ সে বলল, ‘এটি তোমার মিথ্যাচার; বরং তুমিই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে খুন করেছ।’ এরপর সে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলঃ

يا عين جودى للفارس المغوار - هم جودی بواكفات غزار

অর্থাৎ, হে নয়ন আমার! অশ্রু বর্ষণ কর ওই সাহসী অশ্বারোহী যোদ্ধার শোকে। অঝোর অশ্রু প্রবাহে তুমি পুনরায় ক্রন্দন কর।

لا تملى البكاء اذا خانك الدهر - بواف حقيقة صبار

অর্থাৎ, যুগ যখন একজন পরিপূর্ণ ও প্রকৃত ধৈর্যশীল মানুষ সম্পর্কে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তখন আর কান্না বন্ধ করো না।

وتقى وذى وقار وحلم - وعديل الفخار يوم الفخار -

অর্থাৎ, এমন একজন মানুষ সম্পর্কে যিনি ছিলেন পরহেজগার, সংযমী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বুদ্ধিমান, ন্যায়পরায়ণ এবং গৌরব প্রকাশের প্রতিযোগিতায় প্রকৃত গৌরব প্রদর্শনের যোগ্য ব্যক্তি।

لهف نفسي على بقائك عمرو - اسلمتك الأعمار للاقدار

অর্থাৎ, হায় আমার আক্ষেপ হে আমর! তোমার বেঁচে থাকার জন্যে আয়ু তোমাকে নিরাপদ রেখেছে তোমার ভাগ্যের লিখন ভোগ করার জন্যে।

ولعمري لو لم ترمه بغدر - رمت ليثا كصارم بتار

অর্থাৎ, আমার জীবনের কসম, যদি বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত স্বাভাবিকভাবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে তবে তুমি সম্মুখীন হতে এক দুঃসাহসী সিংহের যে ধারাল তরবারির মত কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়।

আমর বলেন, তার কথায় আমি রেগে যাই। আমি আমার তরবারি কোষমুক্ত করি এবং তাকে খুন করার জন্যে তাঁবুতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু তাঁবুতে কাউকেই খুঁজে পেলাম না। অতঃপর সেখানকার পশুগুলো নিয়ে আমি আমার বাড়ি ফিরে আসি।

এটি একটি বিস্ময়কর বর্ণনা বটে। স্পষ্টত বোঝা যায় যে, ওই বৃদ্ধ লোকটি একজন জিন ছিলেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি কুরআন শিক্ষা করেছলেন। “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ তার জানা ছিল। এই কলেমার দ্বারা তিনি বিপদ থেকে আশ্রয় কামনা করতেন। খারাইতি বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ বলভী আসমা বিনতে আবু বকর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল এবং ওয়ারাকা ইবন নাওফল সম্পর্কে কথিত আছে যে, তারা দুজনে বাদশাহ্ নাজাশী-এর দরবারে গিয়েছিলেন। এটি হলো আবরাহা বাদশাহের মক্কা ত্যাগের পরের ঘটনা। তাঁরা বলেন, আমরা তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘হে কুরায়শদ্বয়! আপনারা সত্যি করে বলুন তো আপনাদের মধ্যে এমন কোন শিশুর জন্ম হয়েছি কি না যার পিতা তাকে জবাই করতে চেয়েছিলেন? জবাই করার জন্যে নিশ্চয়তা লাভের উদ্দেশ্যে লটারি দেওয়া হলে ওই শিশুটি বেঁচে যায় এবং তার পরিবর্তে প্রচুর উট কুরবানী দেওয়া হয়।’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত ওই লোকটির কি হলো?’ আমরা বললাম, ‘সে আমিনা বিনত ওহাব নামের এক মহিলাকে বিয়ে করেছে এবং তাকে অন্তঃসত্ত্বা রেখে সফরে বেরিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘ওর কোন ছেলেমেয়ে জন্মেছে কিনা?’

ওয়ারাকা ইবন নাওফাল বললেন, ‘জাঁহাপনা! সে সম্পর্কে আমি আপনাকে বলছি শুনুন। একরাতে আমি আমাদের এক মূর্তির পাশে রাত কাটাই। আমরা ওই মূর্তির তাওয়াফ ও উপাসনা করতাম। হঠাৎ আমি তার উদর থেকে শুনতে পাই, সে বলছে,

ولد النبي فزلت الأملاك - ونای الضلال وأدبر الاشتراك

অর্থাৎ, নবী জন্মগ্রহণ করেছেন, রাজা-বাদশাহগণ লাঞ্ছিত হয়েছে। গোমরাহী বিদূরিত হয়েছে এবং শিরক পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়েছে। এতটুকু বলে মূর্তিটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

এবার যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়ল বললেন, ‘জাঁহাপনা! এ বিষয়ে আমারও কিছুটা জানা আছে।’ নাজাশী বললেন, ‘বলুন!’ যায়দ ইবন আমর বলতে লাগলেনঃ ‘উনি যে রাতের ঘটনা বলেছেন ওই রাতেই আমি আমার বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। আমার পরিবারের লোকেরা তখন আমিনার গর্ভের সন্তান সম্পর্কে আলোচনা করছিল। আমি আবু কুবায়স পাহাড়ে এসে উঠি। উদ্দেশ্য ছিল যে বিষয়টি নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম সে বিষয়ে নির্জনে চিন্তা-ভাবনা করব। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম, একজন লোক আকাশ থেকে কুবায়স পাহাড়ের ওপর অবতরণ করল, তার দুটো সবুজ পাখা। সে মক্কা নগরীর দিকে তাকিয়ে বলল, শয়তান লাঞ্ছিত হয়েছে, মূর্তি-প্রতিমা বাতিল ও অকার্যকর হয়েছে এবং বিশ্বাসভাজন আল-আমীন জন্মগ্রহণ করেছেন। এরপর তার সাথে থাকা একটি কাপড় সে পূর্ব দিগন্তে ও পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল। আমি দেখলাম ওই কাপড়ে আকাশের নিচের সব কিছু ঢেকে গিয়েছে এবং এমন একটি জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়েছে যে, আমার দৃষ্টি শক্তি যেন ছিনিয়ে নেবে। এ দৃশ্য দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। এই আগন্তুক ডানা মেলে উড়ে গিয়ে কাবা গৃহের উপর নামে আর তার দেহ থেকে এমন আলো ছড়িয়ে পড়ে যে, সমগ্র তেহামা অঞ্চল আলোকিত হয়ে যায়। সে বলল, এবার ভূমি পবিত্র হলো এবং তার বসন্তকাল শুরু হলো। কা’বা গৃহে অবস্থিত মূর্তিগুলোর প্রতি সে ইঙ্গিত করল আর সাথে সাথে সবগুলো মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।’

নাজাশী বললেন, ‘হায়! আপনারা এবার এ বিষয়ে আমি যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি তা শুনুন। আপনারা যে রাতের কথা বলেছেন সে রাতে আমি আমার নির্জন প্রকোষ্ঠে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি মাটি ফাঁক করে একটি ঘাড় ও মাথা বেরিয়ে এলো। সে বলছিল, হস্তী বাহিনীর ওপর ধ্বংস কার্যকর হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবীল ওদের প্রতি পাথরের কংকর নিক্ষেপ করেছে। হারাম শরীফের ইজ্জত বিনষ্টকারী ও দম্ভ প্রদর্শনকারী আশরাম [আবরাহার পূর্ণ নাম আবরাহাতুল আশরাম বা ঠোঁট কাটা আবরাহা ছিল] নিহত হয়েছে। মক্কা ও হারাম শরীফের অধিবাসী উম্মী নবী জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর আহ্বানে যে সাড়া দেবে সে ভাগ্যবান হবে, আর যে প্রত্যাখ্যান করবে সে ধ্বংস হবে। এতটুকু বলে ওই মাথাটি জমীনের নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। এদৃশ্য দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করছিলাম কিন্তু আমি কোন কথা উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। আমি দাঁড়াতে চেয়েছিলাম কিন্তু দাঁড়াতে পারিনি। এবার আমি স্বহস্তে আমার নির্জন প্রকোষ্ঠের পর্দাগুলো ছিড়ে ফেলি। আমার পরিবারের লোকেরা তা শুনতে পায় এবং আমার নিকট আসে। আমার দৃষ্টিসীমা থেকে হাবশী লোকদেরকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে আমি নির্দেশ দেই। তারা ওদেরকে সরিয়ে দেয়। এরপর আমার মুখ ও পা জড়তা মুক্ত হয়।’

পারস্য সম্রাট কিসরার রাজপ্রাসাদের ১৪টি চূড়া নিচে পড়ে যাওয়া, তাদের পূজার অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়া তাদের দু’জন বিজ্ঞ ব্যক্তির স্বপ্ন এবং সাতীহ-এর বক্তব্য ‘আবদুল মসীহ-এর হাতে’ এর ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মগ্রহণ বিষয়ক অধ্যায়ে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ্।

ইবন আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হারিছ ইবন হানী-এর জন্ম বৃত্তান্তে যমল ইবন আমর আল্-আদাবীর বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বলেছেন, বানু আযরা গোত্রের একটি প্রতিমা ছিল। সেটির নাম ছিল সাম্মাম। তারা এর ভক্ত ছিল। সেটি অবস্থিত ছিল বানু হিন্দ ইবন হারাম ইবন দুব্বা ইবন আবদ ইবন কাছীর ইবন আযরা গোত্রের এলাকায়। তারিক নামের এক লোক তার সেবায় ছিল। তারা ওই প্রতিমার নিকট পশু বলি দিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন আবির্ভূত হলেন তখন আমরা একটি শব্দ শুনলাম। ওই মূর্তি বলছে, ‘হে বানু হিন্দ ইবন হারাম গোত্র! সত্য প্রকাশিত হয়েছে, হাম্মাম মূর্তি ধ্বংস হয়েছে। ইসলাম ধর্ম এসে শিরক বিদূরিত করে দিয়েছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে আমরা সবাই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা ভয় পেয়ে যাই। এ অবস্থায় কয়েক দিন অতিবাহিত হয়। এরপর আমরা পুনরায় শুনতে পাই ওই মূর্তিটি বলছেঃ ‘হে তারিক! হে তারিক! সত্যবাদী নবী প্রেরিত হয়েছেন বক্তব্য সম্বলিত ওহী সহকারে, তিহামা অঞ্চলে এক ঘোষক ঘোষণা দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাহায্যকারিগণের জন্যে রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা আর তাঁর প্রতি অবাধ্য যারা তাদের জন্যে রয়েছে অপমান ও অনুশোচনা। এখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের নিকট থেকে আমার বিদায়।

যমল বলেন, অতঃপর মূর্তিটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। এরপর আমি একটি সওয়ারী ক্রয় করি এবং সেটির পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করি। অবশেষে আমার সম্প্রদায়ের কতগুলো লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হই। তখন তাঁর উদ্দেশে আমি এই কবিতা আবৃত্তি করি,

اليك رسول الله أعملت نصها - وكلفتها حزنا و غورا من الرمل

অর্থাৎ, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এই উষ্ট্রীকে আমি আপনার নিকট দ্রুত চালিয়ে এনেছি এবং পাথুরে শক্তভূমি ও নিচু বালুকাময় প্রান্তর অতিক্রম করে তাকে আসতে বাধ্য করেছি।

لأنصر خير الناس نصرا موزرا - واعقد حبلا من حبالك في حبلى

অর্থাৎ, এ উদ্দেশ্যে যে, আমি শ্রেষ্ঠতম মানুষটিকে দৃঢ়তার সাথে সাহায্য করব এবং আপনার রশিগুলোর সাথে আমার রশিকে গ্রথিত করে দেবো।

وأشهد أن الله لا شيئ غيره - أدين به ما اثقلت قدمی نعلی

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন আমি এই দীন অনুসরণ করব।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমি ইসলাম গ্রহণ করি এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে বাইআত করি। আমি ইতিপূর্বে প্রতিমাটির মুখ থেকে যা শুনেছিলাম তা তাঁকে জানাই। তিনি বললেন, ‘এটি জিনের উক্তি।’ এরপর তিনি বললেন, ‘হে আরব সম্প্রদায়! আমি তোমাদের প্রতি এবং সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহর রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি। আমি সকলকে আল্লাহর আনুগত্য ও তার একত্ববাদের প্রতি আহ্বান করছি। আমি তাঁর বান্দা ও রাসূল। তোমরা আল্লাহর ঘরে হজ্জ করবে, বার মাসের মধ্যে এক মাস তথা রমযান মাসের রোযা রাখবে। যে ব্যক্তি আমার ডাকে সাড়া দেবে তার আতিথ্যের জন্যে থাকবে জান্নাত আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্য হবে, তার আবাসস্থল রূপে থাকবে জাহান্নাম।’

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করি এবং রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের জন্যে একটি পতাকা বেঁধে দেন। তিনি আমাদের পক্ষে একটি সনদপত্র লিখে দেন।

তাতে লেখা ছিলঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর পক্ষ থেকে যুসল ইবন আমর ও তার সাথে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের প্রতি প্রদত্ত। আমি তাকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি নেতারূপে প্রেরণ করলাম। যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করবে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দলভুক্ত হবে আর যে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে তার জন্যে মাত্র দু’মাস মেয়াদের নিরাপত্তা থাকবে। এ বর্ণনার সাক্ষী থাকেন হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা) ও মুহাম্মদ ইবন মাসলামা আনসারী। ইবন আসাকির এটিকে গরীব তথা অত্যন্ত বিরল বর্ণনা বলে মন্তব্য করেছেন।

সাঈদ ইবন ইয়াহয়া ইবন সাঈদ উমাভী তাঁর ‘মাগাযী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তার চাচা মুহাম্মদ ইবন সাঈদ....... ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একটি জিন আবু কুবায়স পাহাড়ের উপর থেকে চিৎকার দিয়ে বলেছিল,

قبح الله رأيكم أل فهر - ما أدق العقول والأفهام

অর্থাৎ, হে ফিহরের বংশধরগণ! আল্লাহ তোমাদের অভিমতকে শ্রীহীন করে দিন। তোমাদের বিবেক-বিবেচনা কতই না ক্ষীণ!

حين كقصى لمن يعيب عليها - دين ابائها الحماة الكرام

অর্থাৎ, যখন তোমরা অবাধ্য হচ্ছো সেই ব্যক্তির, যে এতদঞ্চলে তার সম্মানিত ও মর্যাদাবান পূর্ব পুরুষদের ধর্মকে দোষারোপ ও সমালোচনা করেছে।

حالف الجن جن بصری علیكم - ورجال الخيل والأطام

অর্থাৎ, সে তো তোমাদের বিরুদ্ধে জিনদের সাথেও মৈত্রী চুক্তি করেছে। ওরা ছিল বুসরা অঞ্চলের জিন। সে খেজুর বাগান সমৃদ্ধ এবং পাথরের তৈরি দুর্গের অধিবাসীদের সাথেও মৈত্রী বন্ধন স্থাপন করেছিল।

توشك الخيل أن تردها تهادى - تقتل القوم في حرام بهام

অর্থাৎ, অবিলম্বে অশ্বদল ক্ষিপ্র গতিতে এতদঞ্চলে প্রবেশ করবে এবং হারাম শরীফ এলাকায় নিজ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করবে।

هل كريم منكم له نفس حر - ماجد الوالدين والأعمام

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে এমন কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আছে কি, যার মধ্যে স্বাধীন মানুষের আত্মা ও মন-মানসিকতা আছে, যার পিতৃকুল-মাতৃকুল সম্ভ্রান্ত?

ضارب ضربة تكون نكالا - ورواحا من گربة واغتمام

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে প্রচণ্ড আঘাত হানার ও আক্রমণ করার কোন লোক আছে কি? যার আক্রমণ হবে ওদের জন্যে উপযুক্ত শাস্তি? যার আঘাত এ সম্প্রদায়কে সকল দুঃখ-কষ্ট ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবে?

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, অতঃপর এই কবিতাটি মক্কাবাসীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। তারা এটি আবৃত্তি করতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এ হলো এক শয়তান, মানুষকে মূর্তিপূজার দিকে ডাকছে। তার নাম মিসআর। আল্লাহ্ তাকে লাঞ্ছিত করবেনই।” এ অবস্থায় তিনদিন অতিবাহিত হয়। তখন শোনা গেল যে, জনৈক অদৃশ্য ঘোষণাকারী ঐ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে,

نحن قتلنا في ثلث مسعرا - اذسقه الجن وسن المنكرا

অর্থাৎ, তিন দিনের মধ্যেই আমরা মিসআরকে খুন করে ফেলেছি। যখন সে জিন জাতিকে মূর্খ বলে সাব্যস্ত করেছে এবং একটি মন্দ পথের সূচনা করেছে।

قنعته سینفا حساما مشهرا - بشتمه نبينا المطهرا

অর্থাৎ, একটি তীক্ষ্ণধার নাঙ্গা তরবারি দ্বারা আমি তার ঘাড়ে আঘাত করেছি। কারণ সে আমাদের পুত-পবিত্র নবীকে গালি দিয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘এটি হলো এক শক্তিশালী জিন। তার নাম সামাজ। সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে, আমি তার নাম রেখেছি আবদুল্লাহ। ইতিপূর্বে সে জানিয়েছিল যে, তিনদিন যাবত সে ঐ দুষ্ট জিনটিকে খুঁজছিল।’ তখন হযরত আলী (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ্ তা’আলা তাকে উত্তম প্রতিফল দান করুন।’

হাফিজ আবু নুআয়ম ‘আদ-দালাইল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবদুল্লাহ্ ইবন মুহাম্মদ ...., হযরত সাদ ইবন উবাদা (রা) সূত্রে বলেছেন, হিজরতের পূর্বে কোন এক সময়ে একটি কাজে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ‘হাদ্রামাওতে’ পাঠিয়েছিলেন। পথে রাত হয়ে যায়। রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর আমি এক অদৃশ্য ঘোষকের ঘোষণা শুনতে পাই। সে বলছিল,

أبا عمرو ناوبني السهو - وراح النوم وامتنع الهجور

অর্থাৎ, হে আবু আমর! নিদ্রাহীনতার বিপদ তো আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার নিদ্রা পালিয়েছে। এবং আমার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে।

لذكر عصابة سافوا و بادوا - وكل الخلق قصرهم يبياد

অর্থাৎ, আমি স্মরণ করছি সে সকল লোকের কথা, যারা ইতিপূর্বে ছিল এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যে কেউ তাদেরকে খাটো করবে, সে নিশ্চিত ধ্বংস হবে।

تولوا واردين الى المنايا - حياضا ليس بنهلها الوردور

অর্থাৎ, মৃত্যুর ঘাটে অবতরণ করে তারা চলে গিয়েছেন। তাঁরা গিয়েছেন এমন কূয়োতে, সেখানে অবতরণ করা পানি পানের জন্যে নয়।

مضوا لسبيلهم وبقيت خلفا وحيدا ليس يسعفني وحي د

অর্থাৎ, তাঁরা তাঁদের পথে চলে গিয়েছেন আর আমি একা পেছনে পড়ে রয়েছি। কেউই এখন আমাকে সাহায্য-সহায়তা করছে না।

سدي لا أستطيع علاج أمر - اذا ما عالج الطفل الوليد

অর্থাৎ, আমি এখন বেকার। কোন কিছুরই প্রতিবিধান করার ক্ষমতা আমার নেই। অথচ ছোট ছোট শিশু-কিশোররা পর্যন্ত সব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছে।

فلايا مابقيت الى أناس - وقد باتت بمهلكها ثمود

অর্থাৎ, মানব সমাজে আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার জীবন দুর্বিষহ ও সংকটময় থাকবে। সামুদ গোত্র তো তাদের ধ্বংসস্থলে রাত্রিযাপন করেছিল।

وعاد والقرون بذى شعوب - سواء كلهم ارم حصيد

অর্থাৎ, তেমনিভাবে ধ্বংস হয়েছে আদ সম্প্রদায় এবং গিরিপথে বসবাসকারী কতক জনপদ। ওরা সবাই ক্ষত-বিক্ষত ও বিধ্বস্ত ইরাম সম্প্রদায়ের পর্যায়ভুক্ত।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর অন্য একজন চিৎকার করে বলতে শুরু করে। ‘হে সুদর্শন পুরুষ! তোমার চমৎকারিত্ব ও সৌন্দর্যের দিন ফুরিয়ে গিয়েছে। সকল সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্ব এখন যাহরা ও ইয়াসরিবের মধ্যবর্তী স্থানে।’ অপরজন বলল, ‘হে দুর্বল ব্যক্তি! সেটি কি?’ উত্তরে সে বলল, ‘শান্তির নবী, কল্যাণকর বাণী নিয়ে সমগ্র জগতের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন। অতঃপর তাঁকে হারাম শরীফ থেকে বের করে খর্জুর বীথি ও পাথর-নির্মিত গৃহাঞ্চলের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।’ অন্যজন বলল, ‘ওই নাযিলকৃত কিতাব, প্রেরিত নবী এবং মর্যাদাবান উম্মী নবীর পরিচয় কি?’ উত্তরে সে বলল, ‘তিনি হলেন লুওয়াই ইবন গালিব ফিহর ইবন মালিক ইবন নাদর ইবন কিনানা-এর বংশধর।

সে বলল, দূরে অনেক দূরে তার তুলনায় আমি তো অনেক বুড়িয়ে গিয়েছি। তার যুগের তুলনায় আমার যুগ অতীত হয়ে গিয়েছে। আমি তো দেখেছি যে, আমি আর নাদর ইবন কিনানা দুজনে একই লক্ষ্যবস্তুতে তীর নিক্ষেপ করেছি। আমরা একই সাথে ঠাণ্ডা দুধ পান করেছি। একদিন রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে এক প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিকট থেকে আমি আর সে এক সাথে বের হই। সূর্যোদয়ের সময় সে বেরিয়ে পড়ে এবং সূর্যাস্তের সময় ঘরে ফিরে যায়। এ সময়ে সে যা যা শুনেছে তার সবই বর্ণনা করেছে এবং যা কিছু দেখেছে তার সবই স্মরণ রেখেছে। আলোচ্য ব্যক্তি যদি নাদর ইবন কিনানা-এর বংশধর হন, তবে তরবারি এখন কোষমুক্ত হবে, ভয়ভীতি দূরীভূত হবে, ব্যভিচার নির্মূল হবে এবং সুদ মূলোৎপাটিত হবে। সে বলল, ঠিক আছে পরবর্তীতে কী ঘটবে সে সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন! উত্তরে সে বলল, দুর্দশা, দুর্ভিক্ষ এবং দুঃসাহসিকতা বিদূরিত হবে তবে খুযাআ গোত্রে তার কিছুটা অবশিষ্ট থাকবে। দুঃখ-কষ্ট এবং মিথ্যাচার বিলীন হয়ে যাবে। তবে খাযরাজ ও আওস গোত্রে তার কিছুটা অবশিষ্ট থাকবে। অহংকার, দাম্ভিকতা, পরনিন্দা ও বিশ্বাসঘাতকতা নির্মূল হবে। তবে বানু বাকর তথা হাওয়াযিন গোত্রে তার কিছুটা অবশিষ্ট থাকবে। লজ্জাকর কর্মগুলো এবং পাপাচারমূলক কাজসমূহ অপসৃত হবে। তবে খাছ’আম গোত্রে কিছুটা তার অবশিষ্ট থাকবে। সে বললঃ অতঃপর কি ঘটবে সে সম্পর্কে কিছু বলুন!’ উত্তরে সে বলল, ‘জংলী লোকেরা যখন বিজয় লাভ করবে আর হাররা অঞ্চল যখন নিস্তেজ হয়ে যাবে তখন তুমি হিজরত নগরী মদীনা থেকে বেরিয়ে যাবে। আর সালাম বিনিময় প্রথা যখন রহিত হবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তখন মক্কা শরীফ থেকে বেরিয়ে যাবে।’

সে বলল, ‘আরো কিছু বলুন।’ উত্তরে সে বলল, ‘কান যদি না শুনত আর চোখ যদি ঝলমল করে না উঠত তবে আমি তোমাকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিতাম যা শুনে তুমি অস্থির ও বিচলিত হয়ে পড়তে।’ এরপর সে বলল,

لا منام هدأته بنعيم - يا ابن غوط ولا صباح أتانا

অর্থাৎ, হে ইবন গাওত! শান্তির ঘুম তুমি আর ঘুমাতে পারবে না। সুপ্রভাত আর কোনদিন আমাদের নিকট আসবে না।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর সে এমন প্রচণ্ড আর্তচিৎকার করল, সেটি যেন গর্ভবতী মহিলার প্রসবকালীন আর্তচিৎকার। ক্রমান্বয়ে ভোর হলো। আমি গিয়ে দেখি একটি মৃত গুইসাপ ও একটি মৃত সাপ। বর্ণনাকারী বলেন, এ থেকেই আমি আঁচ করতে পারি যে রাসূলুল্লাহ (সা) ইতিমধ্যেই মদীনা শরীফ হিজরত করেছেন।

মুহাম্মাদ ইবন জাফর - সাদ ইবন উবাদাহ্ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আকাবার শপথের রাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাতে বায়’আত করার পর আমি বিশেষ প্রয়োজনে হাদ্রামাওত অঞ্চলের দিকে রওয়ানা করি। যথারীতি প্রয়োজন সেরে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। পথেই আমার ঘুম পায়! গভীর রাতে এক বিকট চিৎকারে আমি ভড়কে যাই। আমি শুনতে পাই এক চিৎকারকারী চিৎকার করে বলছে,

أبا عمرو ناوبني السهور - وراح النوم واز قطع الهجور

অর্থাৎ, হে আবু আমর! আমাকে নিদ্রাহীনতার বিপদ পেয়ে বসেছে। আমার নিদ্রা পালিয়েছে এবং শয়ন হারাম হয়ে গেছে। এরপর সে উপরোল্লিখিত দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করে।

আবু নুআয়ম বলেন, মুহাম্মাদ ইবন জাফর তামীম আদ্দারী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন নবুওত লাভ করেন, তখন আমি সিরিয়াতে অবস্থান করছিলাম। এক জরুরী কাজে আমি পথে বের হই। এ অবস্থায় রাত হয়ে যায়। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী আমি বলি, এ রাতে এ প্রান্তরের নেতৃস্থানীয় জিনের আশ্রয়ে আমি নিজেকে সোপর্দ করলাম। অতঃপর আমি যখন নিদ্রামগ্ন হই তখন স্বপ্নে দেখি এক ঘোষককে। ইতিপূর্বে কখনো আমি তাকে দেখিনি। সে বলছে, “তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। কারণ আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কোন জিন কাউকে আশ্রয় দিতে পারবে না।” আমি বললাম, “হায়! আল্লাহর কসম, আপনি এ কী বলছেন?” সে বলল, ‘আল-আমীন আল্লাহর রসূলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। হাজুন অঞ্চলে আমরা তার পেছনে নামায পড়েছি। অতঃপর আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমরা তার আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। জিনদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে এবং তাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তুমি এখনি বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর নিকট যাও এবং ইসলাম গ্রহণ কর।

বর্ণনাকারী তামীম আদদারী (রা) বলেন, সকাল বেলা আমি দীরুই আইয়ুব নামক উপাসনালয়ে জনৈক ইহুদী ধর্মযাজকের সাথে সাক্ষাত করি এবং তাঁকে উক্ত ঘটনা অবহিত করি। তিনি বললেন, ‘ওরা তোমাকে যথার্থই বলেছে। ওই নবী আবির্ভূত হওয়ার কথা মক্কার হারম শরীফে। তার হিজরত স্থল মদীনার হারম শরীফ। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সুতরাং তুমি অতি শীঘ্র তাঁর নিকট উপস্থিত হও।’ তামীম (রা) বলেন, অতঃপর আমি এ শহর থেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশে রওয়ানা করি এবং তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করি।

হাতিম ইবন ইসমাঈল...... সাইদা হুযালী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, একদিন আমরা আমাদের প্রতিমা সুওয়া-এর নিকট ছিলাম। আমাদের রোগাক্রান্ত দু’শটি বকরী আমরা তখন তার নিকট বরকত লাভের জন্যে উপস্থিত করি। উদ্দেশ্য ছিল সেগুলোর রোগমুক্তি। তখন আমি শুনতে পাই যে, এক ঘোষক ওই মূর্তির পেট থেকে বলছে, “জিনদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, আমাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব হচ্ছে একজন নবীর কারণে। তার নাম মুহাম্মদ (সা)।’ তখন আমি বললাম, ‘আল্লাহর কসম, আমি তো ভুল স্থানে এসে পড়েছি।’ অতঃপর আমি বকরীর পাল নিয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ির দিকে যাত্রা করি। পথে এক ব্যক্তির সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সে আমাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের কথা জানায়। আবু নুআয়ম বর্ণনাটি এভাবেই সনদ ছাড়া উল্লেখ করেছেন।

এরপর আবু নুআয়ম বলেনঃ উমর ইবন মুহাম্মাদ .......রাশেদ ইবন আবদ রাব্বিহী সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সুওয়া নামের মূর্তিটি অবস্থিত ছিল মুআল্লাত নামক স্থানে। হুযায়ল ও বানু যফর ইবনে সুলায়ম গোত্রের লোকজন এটির পূজা করত। একদিন সুলায়ম গোত্রের পক্ষ থেকে কিছু উপঢৌকন দিয়ে বানু যফর গোত্রের লোকেরা রাশেদ ইবন আবদ রাব্বিহীকে সুওয়া প্রতিমার নিকট প্রেরণ করে। রাশেদ বলেন, সুওয়া প্রতিমার নিকট পৌঁছার পূর্বে পথিমধ্যে ভোরবেলা আমি অন্য এক প্রতিমার নিকট পৌঁছি। হঠাৎ আমি শুনতে পাই, এই প্রতিমার পেট থেকে একজন যেন চিৎকার করে বলছে, ‘অবাক কাণ্ড! অবাক কান্ড! আবদুল মুত্তালিবের বংশ থেকে এক নবী আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি ব্যভিচার, সুদ এবং মূর্তির উদ্দেশ্যে বলিদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তার আগমনে আকাশকে সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছে এবং আমাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হচ্ছে। হায়রে আশ্চর্য ব্যাপার! ভীষণ আশ্চর্য ব্যাপার!’ এরপর অন্য একটি প্রতিমার পেট থেকে একজন চিৎকার করে বলতে শুরু করল, “দাম্মার প্রতিমা পরিত্যক্ত হয়েছে, সেটির তো উপাসনা করা হতো। নবী আহমদ (সা) আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি নামায পড়েন, যাকাত দান ও রোযা পালনের নির্দেশ দেন এবং পুণ্যকাজ ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চলার নির্দেশ দেন।’ এরপর অপর একটি প্রতিমার পেট থেকে অন্য একজন চিৎকার দিয়ে বললঃ

ان الذي ورث النبوة والهدى - بعد ابن مريم من قريش مهتد

অর্থাৎ, মারয়াম পুত্র ঈসা (আ)-এর পর কুরায়শ বংশের যিনি নবুওত ও হেদায়ত করার দায়িত্ব পেয়েছেন নিশ্চয়ই তিনি সৎপথ প্রাপ্ত হয়েছেন।

نبى أتى يخبر بما سبق - وبما يكون اليوم حقا أو غد

অর্থাৎ, সেই নবী আগমন করেছেন, অতীতে ঘটে যাওয়া এবং ভবিষ্যতে ঘটিতব্য সকল বিষয়ের যথার্থ সংবাদ নিয়ে।

রাশেদ বলেন, ভোরবেলা আমি ‘সুওয়া প্রতিমার নিকট যাই। সেখানে দেখতে পাই যে, দুটো শেয়াল তার চারদিকে জিভ দিয়ে চাটছে, তার উদ্দেশে নিবেদিত নৈবেদ্যগুলো খেয়ে ফেলছে এবং ওই প্রতিমার গায়ে পেশাব করে তার ওপর হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। এ অবস্থায় রাশেদ বললেনঃ

ارب يبول الثعلبان برأسه - لقدذل من بالت عليه الثعالب

অর্থাৎ, হায়! এটি কেমন দেবতা যার মাথায় দু’দুটো শেয়াল পেশাব করছে? যার গায়ে শেয়াল পেশাব করে তার জন্য সে তো নিশ্চিতভাবে লাঞ্ছিত।

এ ঘটনা ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মদীনায় হিজরত কালে। লোকজন তখন তাঁর আগমন সম্পর্কে পরস্পর আলাপ-আলোচনা করছিল। রাশেদ তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং মদীনায় এসে তার সাথে সাক্ষাত করেন। তার সাথে কিন্তু তার পোষা কুকুরটিও ছিল। তখন রাশেদের নাম ছিল যালিম আর কুকুরের নাম ছিল রাশেদ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে তার নাম জিজ্ঞেস করেন। তিনি বললেন, তার নাম যালিম। এবার তিনি তার কুকুরের নাম জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, কুকুরের নাম রাশেদ। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘না, বরং তোমার নাম রাশেদ আর কুকুরের নাম যালিম।’ এ বলে তিনি মুচকি হাসলেন। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে বায়’আত হন এবং তার সাথে কিছুদিন মক্কায় অবস্থান করেন। পরবর্তীতে ওয়াহাত অঞ্চলের একখণ্ড জমি তার নামে বরাদ্দ দেয়ার জন্যে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আবেদন করেন। সংশ্লিষ্ট জমির বর্ণনাও তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ওয়াহাত ভূখণ্ডের উঁচু অংশ তার নামে বরাদ্দ দেন। বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ হলো পরপর তিনবার পাথর নিক্ষেপের শেষ সীমানা পর্যন্ত। তিনি তাকে একটি পানি ভর্তি পাত্র দান করলেন। তাতে তিনি ফু দিয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন যে, এ পানি জমির উপরিভাগে ঢেলে দিবে আর অতিরিক্ত পানি নিতে লোকজনকে বাধা দেবে। তিনি তাই করলেন। ওই পানি সদা প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হয়। আজও সেটি প্রবহমান রয়েছে। তিনি ওই জমিতে খেজুর বাগান করেছিলেন। কথিত আছে যে, ওই পানি থেকে সমগ্র অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হতো। লোকজন ওই অঞ্চলকে “রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পানির এলাকা” নামে আখ্যায়িত করতো। ওয়াহাতের অধিবাসীরা ওখানে গিয়ে গোসল করতো। রাশেদের নিক্ষিপ্ত পাথর রাকাব অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছে। ওই অঞ্চল “রাকাব আল হাজার” নামে পরিচিত। পরবর্তীতে রাশেদ উক্ত সুওয়া প্রতিমার নিকট যান এবং সেটিকে ভেঙে ফেলেন।

আবু নু’আয়ম বলেন, সুলায়মান ইব্‌ন আহমদ আমর ইবন মুররা আল জুহানী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন জাহেলী যুগের ঘটনা। আমার সম্প্রদায়ের কতক লোক নিয়ে আমি হজ্জ করতে যাই। একরাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখি। তখন আমি মক্কায় অবস্থান করছিলাম।

আমি দেখি একটি উজ্জ্বল জ্যোতি কা’বা গৃহ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে এবং সুদূর ইয়াসরিবের পাহাড়গুলো ও জুহায়না গোত্রের জঙ্গল পর্যন্ত আলোকিত করে তুলছে। ওই জ্যোতির মধ্যে আমি শুনতে পেলাম যে, সে বলছে, অন্ধকার কেটে গিয়েছে আলো ছড়িয়ে পড়ছে, শেষ নবী প্রেরিত হয়েছেন। এরপর পুনরায় জ্যোতি ছড়িয়ে পড়লো। ওই জ্যোতিতে আমি হীরা নগরীর রাজপ্রাসাদসমূহ এবং মাদাইন নগরীর শুভ্রতা স্পষ্ট দেখতে পাই। ওই জ্যোতির মধ্যে আমি শুনতে পাই কে যেন বলছে, ‘ইসলাম প্রকাশিত হয়েছে, মূর্তি প্রতিমা ভেঙে গিয়েছে, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষিত হয়েছে।’ এস্বপ্ন দেখে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সজাগ হয়ে যাই। আমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে ডেকে বলি যে, আল্লাহর কসম এ কুরায়শ গোত্রে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা ঘটবে। আমি যা দেখেছি তাদের নিকট তা প্রকাশ করি।

আমরা যখন আমাদের দেশে ফিরে আসি তখন একজন লোক আমাদের নিকট আসেন এবং আমাদেরকে বলেন যে, আহমদ নামে এক ব্যক্তি রাসূলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তখন আমি তাঁর নিকট গিয়ে আমার স্বপ্নের কথা তাঁকে বলি। তিনি বললেন, ‘হে আমর ইবন মুররা! আমিই রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি সমগ্র মানবকুলের প্রতি। আমি তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করি। পরস্পর খুনোখুনি ও রক্তপাত বন্ধ করা, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা, আল্লাহর ইবাদত করা, মূর্তিপূজা বর্জন করা, বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ করা এবং বার মাসের মধ্যে এক মাস অর্থাৎ রমযান মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দেই। আমার আহ্বানে যে সাড়া দিবে সে জান্নাত পাবে। যে আমার অবাধ্য হবে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নাম। হে আমর ইবন মুররা! তুমি ঈমান আনয়ন কর, আল্লাহ্ তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।’

أشهد أن لا اله الا الله و انك رسول الله

তখন আমি বললাম, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আপনিই আল্লাহর রাসূল। আপনি হালাল হারাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন আমি তার সবই সত্য বলে বিশ্বাস করলাম— যদিও তাতে বহু মানুষ অসন্তুষ্ট হয়। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখে কবিতার কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করি। এগুলো আমি তখনই রচনা করেছিলাম যখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাবের সংবাদ শুনেছিলাম। আমাদের একটি প্রতিমা ছিল। আমার পিতা ছিলেন সেটির সেবায়েত। আমি তখন প্রতিমাটির দিকে এগিয়ে যাই এবং সেটি ভেঙে ফেলি। তারপর আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হই। আমি এ কবিতা তার সম্মুখে আবৃত্তি করি,

شهدت بأن الله حق وانني - لآلهة الأحجار اول تارك

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ তা’আলা সত্য এবং পাথরের তৈরি উপাস্যগুলোকে আমিই প্রথম বর্জনকারী।

قشمرت عن ساقی از ار مهاجر - اليك ادب التمور بعد الدكادك

অর্থাৎ, আপনার প্রতি হিজরত করার মানসে আমি আমার লুঙ্গি পায়ের গোছার ওপর গুটিয়ে ফেলি। আমার দ্রুতগামী ঘোড়াকে আমি ধুলা উড়িয়ে ছুটিয়ে আপনার নিকট নিয়ে আসি।

لأصحب خير الناس نفسا ووالدا - رسول مليك الناس فوق الحبائك

অর্থাৎ, আমি রওয়ানা করেছি যিনি ব্যক্তিগত ও বংশগতভাবে শ্রেষ্ঠতম মানুষ তাঁর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে। ঊর্ধ্ব জগতে আসীন মানব জাতির মালিক মহান আল্লাহর তিনি রাসূল।

তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “মারহাবা হে আমর ইবন মুররা! তোমার প্রতি সাদর অভিনন্দন!’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কুরবান হোক! আপনি আমাকে দায়িত্ব দিয়ে আমার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করুন। হতে পারে, আল্লাহ্ তাআলা আমার মাধ্যমে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন- যেমন আপনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা) সত্যি সত্যি আমাকে ওদের প্রতি পাঠালেন। আমাকে উপদেশ দিয়ে তিনি বললেন, অবশ্যই সদা সত্য ও সঠিক কথা বলবে। রুক্ষ, অহংকারী এবং হিংসাপোষণকারী হবে না। আমার সম্প্রদায়ের নিকট আমি গমন করি। আমি তাদেরকে ডেকে বলি, ‘হে বনী রিফা’আ সম্প্রদায়! হে বনী জুহায় সম্প্রদায়! আমি রাসূল (সা)-এর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিরূপে তোমাদের কাছে এসেছি। আমি তোমাদেরকে জান্নাতের দিকে আহ্বান করছি এবং জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করছি। আমি তোমাদেরকে রক্তপাত বন্ধ করা, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা, আল্লাহর ইবাদত করা, মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করা, বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্জ করা এবং বার মাসের মধ্যে এক মাস অর্থাৎ রমযান মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দিচ্ছি। যে ব্যক্তি আমার ডাকে সাড়া দিবে সে জান্নাত পাবে আর যে ব্যক্তি তা অমান্য করবে তার জন্যে রয়েছে জাহান্নাম। হে জুহায়না সম্প্রদায়! সকল প্রশংসা আল্লাহর। তোমরা যে বংশের অন্তর্ভুক্ত, সে বংশের মধ্যে তিনি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ গোত্রের মর্যাদা দিয়েছেন। জাহেলী যুগে অন্যদের নিকট যে সকল পাপাচারিতা ও অশ্লীলতা প্রিয় ছিল, তিনি সেগুলো তোমাদের নিকট অপ্রিয় সাব্যস্ত করে দিয়েছেন। অন্যরা তো দু’বোনকে একত্রে বিয়ে করত, পুত্রকে তার পিতার স্ত্রীর মালিকানা দিত এবং সম্মানিত মাসে পাপাচার করত, সুতরাং হে জুহায়না সম্প্রদায়! তোমরা লুওয়াই ইবন গালিবের বংশভুক্ত রাসূলরূপে আবির্ভূত এই নবীর ডাকে সাড়া দাও, তাহলে তোমরা দুনিয়ার সম্মান ও আখিরাতের মর্যাদা লাভ করতে পারবে। দ্রুত অতি দ্রুত তোমরা এ কাজে এগিয়ে যাও, তাহলে আল্লাহর নিকট তোমরা সম্মান লাভ করবে।’ একজন ব্যতীত সকলেই তার আহবানে সাড়া দিল। ওই একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আমর ইবন মুররা! আল্লাহ্ তোমার জীবনকে তিক্ত ও বিস্বাদ করে দিন। তুমি কি আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছ যে, আমরা আমাদের উপাস্যগুলোকে পরিত্যাগ করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম বর্জন করে তিহামাবাসী ওই কুরায়শ বংশীয় লোকটির আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করি? না, না, তা কোন প্রশংসাযোগ্য কাজ নয়। তাতে কোন মর্যাদা নেই।’ এরপর সে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করল,

ان ابن مرة قد أتى بمقالة - ليست مقاله من يريد صلاحا

অর্থাৎ, ইবন মুররা এমন বক্তব্য নিয়ে এসেছে যা কল্যাণকামী কোন লোকের বক্তব্য হতে পারে না।

انی لأ حسب قوله وفعاله يوما وان طال الزمان رياحا

অর্থাৎ, আমি মনে করি, তার কথা ও কাজ বাতাসের ন্যায় শেকড়হীন ও অস্থায়ী।

أتسفه الأشياخ ممن قد مضى - من رام ذلك لا أصاب فلاحا

অর্থাৎ, তুমি কি অতীত হয়ে যাওয়া মুরব্বী ও বৃদ্ধদেরকে মূর্খ ঠাওরাচ্ছ? যে ব্যক্তি এরূপ করে সে কখনো সফলতার মুখ দেখবে না। উত্তরে আমর ইবন মুররা বলেন, আমার এবং তোমার মধ্যে যে মিথ্যাবাদী আল্লাহ্ তার জীবনকে বিস্বাদ করে দিন, তার বাকশক্তি রহিত করে বোবা বানিয়ে দিন এবং তাকে দৃষ্টিহীন অন্ধ বানিয়ে দিন।’ আমর ইবন মুররা বলেন, অবশেষে সে এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে যে, তার মুখ অকেজো হয়ে পড়েছিল, কোন খাদ্যের স্বাদ সে পেত না এবং সে অন্ধ ও বোবা হয়ে গিয়েছিল।

আমর ইবন মুররা ও তার সাথে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা সকলে নবী করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে সাদর বরণ করে নিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে কিছু উপহার এবং তাদের জন্যে একটি ফরমান লিখে দিয়েছিলেন। ঐ ফরমানটি ছিল এরূপ— বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফরমান। এটি সত্য বাণী ও সত্য প্রকাশক। এটি প্রেরণ করা হলো আমর ইবন মুররা জুহানী-এর মাধ্যমে যুহায়না ইবন যায়দ গোত্রের নিকট। এ ভূখণ্ডের নিম্নাঞ্চল ও সমতল ভূমি, গভীর ও উঁচু ভূমি তোমাদের জন্যে বরাদ্দ দেয়া হলো। তোমরা এর ভূমিতে পশু চরাবে এবং এর পানি পান করবে। উৎপাদিত পণ্যের ১ অংশ দিতে বাধ্য থাকবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে। একই সাথে তবীয়া ও সারিমা (এক বছরের বাছুর আর দুধ ছেড়েছে অমন বাছুর) এর জন্যে একত্রে থাকলে দুটো বকরী আর আলাদা আলাদাভাবে হলে একটি করে বকরী প্রদান করতে হবে। কৃষি কাজে ব্যবহৃত পশুর ওপর যাকাত ফরয নয়। ফুল জাতীয় বস্তুর ওপরও যাকাত ফরয নয়। আমাদের সাথে যে সকল মুসলমান উপস্থিত ছিলেন তাঁরা কায়স ইবন শাম্মসের লিখিত এ লিপিটির সাক্ষীরূপে থাকেন। ওই সময়ে আমর ইবন মুররা আবৃত্তি করছিলেন,

ألم تر أن الله أظهر دينه - وبين برهان القران لعامر

অর্থাৎ, তুমি দেখছ না যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর দীনকে বিজয়ী করে দিয়েছেন এবং অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্যে কুরআনোর দলীলগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

كتاب من الرحمن نور لجمعنا - وآخلافنا في كل باد وحاضر

অর্থাৎ, এটি দয়াময় আল্লাহর কিতাব আমাদের সকলের জন্যে এবং আমাদের মিত্রদের জন্যে শহরে-পল্লীতে সর্বত্রই এটি নূর।

الى خير من يمشي على الأرض كلها - وافضلها عند اعتكار الصرائر

অর্থাৎ, এটি নাযিল হয়েছে সে ব্যক্তির ওপর যিনি পৃথিবীতে পদচারণাকারী সকলের শ্রেষ্ঠ এবং বংশগতভাবেও যিনি সর্বোত্তম।

أطعنا رسول الله لما تقطعت - بطون الأعادي بالظبي والخواطر

অর্থাৎ, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুসরণ করেছি তখনও যখন শত্ৰুভূমি বিপদসংকুল ও ভীতিকর জনপদে পরিণত হয়েছে।

فنحن قبيل قد بنى المجد حولنا - اذا اجتلبت في الحرب هام الأكابر

অর্থাৎ, আমরা এমন এক জাতি যে, আমাদের চারদিকে মর্যাদা ও সম্মানের প্রাচীর নির্মিত। আমরা তখনও মর্যাদাবান, যুদ্ধে যখন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের খুলি উড়িয়ে দেয়া হয়।

بنو الحرب نفريها بايد طويلة - وبيض تلالا في أكف المغاور

অর্থাৎ, আমরা যোদ্ধা জাতি, দীর্ঘহাতে আমরা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হই। প্রচণ্ড যোদ্ধার হাতে তখন উজ্জ্বল তরবারি ঝলমলিয়ে ওঠে।

تری حوله الأنصار تحمى أميرهم - بسم العوالي والصفاح البواتر

অর্থাৎ, তুমি দেখতে পাবে তার চারপাশে আনসারদেরকে। তারা তাদের সেনাপতিকে প্রহরা দিচ্ছে উচু উচু বর্শা ও শানিত তরবারি দ্বারা।

اذا الحرب دارت عند كل عظيمة - ودارت رحاها بالليوث الهواصر

অর্থাৎ, বড় বড় ঘটনায় যুদ্ধ যখন চলতে থাকে আর দুঃসাহসী হিংস্র সিংহদেরকে উপলক্ষ করে যখন যুদ্ধের চাকা ঘুরতে থাকে।

تبلج منه اللون وازداد وجهه - كمثل ضياء البدر بين الزواهر

অর্থাৎ, তখন তার চেহারার জ্যোতির উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, যেমন নক্ষত্ররাজির মধ্যে পূর্ণিমার চাঁদের আলো। আবু উসমান সাঈদ ইবন ইয়াহয়া উমাভী তাঁর মাগাযী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবদুল্লাহ...... জুহায়না গোত্রের জনৈক বৃদ্ধের বরাতে বলেছেন, একদা আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। তখন তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। আমরা তার জন্যে কবর খনন করে ফেলি এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করি। দীর্ঘক্ষণ অচেতন থাকার পর হঠাৎ সে চোখ খুললো এবং তার হুঁশ ফিরে এলো। তখন সে বলল, ‘তোমরা কি আমার জন্যে কবর খুঁড়েছ?’ ওরা বলল, ‘হ্যাঁ।’ সে বলল, ‘ফুসাল কেমন আছে?’ ফুসাল ছিল তার চাচাতো ভাই। আমরা বললাম, ‘সে ভাল আছে।’ একটু আগে সে তোমার কুশল জিজ্ঞেস করে গেল। সে বলল, ‘বস্তুত তাকেই এ কবরে কবরস্থ করা হবে। আমি যখন অচেতন ছিলাম তখন আমার নিকট এক ব্যক্তি এসে বলেছে, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, তুমি দেখছ না যে তোমার কবর খোঁড়া হচ্ছে? তোমার মা তো তোমার শোকে মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছে। আচ্ছা বল দেখি আমরা যদি এই কবর থেকে তোমাকে রক্ষা করি তারপর বড় বড় পাথর দিয়ে সেটি ভরে দিই এবং তারপর সেটিতে ফুসালকে নিক্ষেপ করি, যে ফুসাল তোমাকে এ অবস্থায় দেখে নিরুদ্বেগে চলে গেল এবং সে ধারণা করল যে, তার এমন পরিণতি হবে না তাহলে তুমি কি তোমার প্রতিপালকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে এবং তুমি কি শিরক ও পথভ্রষ্টতা ত্যাগ করবে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তাই করব।’ ওই আগন্তুক বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি এখন উঠে দাঁড়াও, তোমার রোগ সেরে গিয়েছে।’ এবার লোকটি সুস্থ হয়ে গেল আর ফুসাল মারা গেল এবং তাকে ওই কবরে কবরস্থ করা হলো। জুহায়নী বলেন, এরপর আমি আমার জুহায়না গোত্রের ওই লোকটিকে দেখেছি যে নামায পড়ত, প্রতিমার নিন্দাবাদ করত।

উমাভী বলেন, আবদুল্লাহ বলেছেন, আমরা উমর ইবন খাত্তাব (রা)-এর সাথে একটি মজলিসে ছিলাম। সেখানে তাঁরা জিন সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। খুরায়ম ইবন ফাতিক আসাদী বললেন, আমি কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করলাম তা আপনাকে বলবো কি? হযরত উমর (রা) বললেন, ‘ঠিক আছে, বলুন।’ তিনি বলতে শুরু করলেন- একদিন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া উটের পালের খোজে বের হই। আমি সেগুলোর পদচিহ্ন অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছিলাম। উটের পাল উপরের দিকে উঠেছে আমি তেমন চিহ্ন দেখতে পাই। যেতে যেতে আমি ইরাকের আবরাক নামক স্থানে পৌঁছি। সেখানে আমি আমার বাহন থামিয়ে যাত্রা বিরতি করি। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আমি বললাম, “এ শহরের প্রধান জিন এবং এ প্রান্তরের সর্দারের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” তখন আমি শুনতে পাই যে, আমার উদ্দেশে অদৃশ্য থেকে কে একজন বলছে,

ويحك عذ بالله ذي الجلال - والمجد والعلياء والافضال

অর্থাৎ, ওহে তুমি মর্যাদাময় আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর! তিনি সম্মানের অধিকারী এবং মাহাত্ম ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক।

ثم اتل أيات من الأنفال - ووحد الله ولا تبالي

এরপর সূরা আনফালের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত কর এবং আল্লাহর একত্ব ঘোষণা কর। কোন পরোয়া নেই। খুরায়ম আসাদী বলেন, এতে আমি খুব ভড়কে যাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সম্বিৎ ফিরে পাই এবং বলিঃ

يا أيها الهاتف ماتقول - أرشد عندك أم تضليل

অর্থাৎ, হে নেপথ্যচারী ঘোষক! আপনি কি বলছেন? আপনার নিকট কি সত্যপথের দিকনির্দেশনা আছে? না কি পথভ্রষ্টতা?

بين هداك الله ما الحويل

অর্থাৎ, আল্লাহ আপনাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন, সত্যপথ কোনটি স্পষ্টভাবে বলে দিন। জবাবে সে বলল,

هذا رسول الله و الخيرات- بيثرب يدعو الى النجاة

অর্থাৎ, ইনি আল্লাহর রাসূল, সকল কল্যাণের আধার। তিনি অবস্থান করছেন ইয়াসরিব নগরীতে। ডাকছেন জান্নাত ও মুক্তির দিকে।

يأمر بالبر والصلاة - ويزع الناس عن الهنات

অর্থাৎ, তিনি সৎকর্ম ও নামায আদায়ের নির্দেশ দেন। মানব জাতিকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন।

তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম, ওই রাসূলের নিকট গিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না। অতঃপর আমি আমার বাহনে আরোহণ করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমি বললাম -

ارشدني أرشدني هديتا - لا جعت ما عشت ولا عريتا

অর্থাৎ, আমাকে ওই রাসূলের নিকট পৌঁছার পথ দেখিয়ে দিন। আপনি সৎপথ পেয়েছেন। যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন অভুক্ত ও বিবস্ত্র হবেন না।

ولا برحت سيدا مقيتا - لا تؤثر الخير الذي أتيتا

على جميع الجن مابقينا

অর্থাৎ, আজীবন আপনি নেতা ও তত্ত্বাবধায়ক থাকুন সকল জিনের ওপর। যে কল্যাণ আপনি অর্জন করেছেন তার ওপর অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেবেন না। এবার সে বলল,

صاحبك الله وادی رحلگا - وعظم الأجر وعافا نفسكا

অর্থাৎ, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সাথে থাকবেন এবং তোমার সওয়ারী গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেবেন। তিনি তোমাকে মহান প্রতিদান প্রদান করবেন এবং তোমাকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন।

امن به افلج ربي حقكا - وانصره نصرا عزيزا نصركا

অর্থাৎ, তুমি তার প্রতি ঈমান আনয়ন কর। আমার প্রতিপালক তোমার পাওনা পরিপূর্ণভাবে প্রদান করবেন। তুমি প্রবল ও দৃঢ়ভাবে তাঁকে সাহায্য কর তিনি তোমাকে সাহায্য করবেন।

আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন, আপনি কে? আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পৌঁছলে আপনার কথা বলব।’ তখন উত্তর এলো— ‘আমি জিনদের রাজপুত্র নসীবায়নের জিনদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিয়োগকৃত নেতা। তোমার উটগুলোর জন্যে আমি যথেষ্ট। আমি ওগুলো ইনশাআল্লাহ্ তোমার বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেব।’

বর্ণনাকারী বলেন, আমি মদীনা অভিমুখে যাত্রা করে জুমাবারে সেখানে গিয়ে পৌঁছি। লোকজন তখন মসজিদের দিকে আসছে। নবী করীম (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে মুসল্লীদের উদ্দেশে খুতবা দিচ্ছিলেন। তাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের মত দেখাচ্ছিল। আমি স্থির করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব। এরপর তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করব এবং আমার ইসলাম গ্রহণের উপরোক্ত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাকে জানাবো।

মসজিদের দরজায় আমার বাহনটি দাঁড় করানোর পর হযরত আবু বকর (রা) বেরিয়ে এলেন এবং আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘আপনার ইসলাম গ্রহণের কথা আমরা পূর্বেই জেনেছি। আপনি মসজিদে ঢুকে পড়ুন এবং নামায আদায় করে নিন।’ আমি তাই করলাম। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে আমার ইসলাম গ্রহণের প্রেক্ষাপট নিজেই জানিয়ে দিলেন। আল্লাহর তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি বললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ্ সকল প্রশংসা আল্লাহর।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ‘তোমার সাথী যে জিন সে তোমাকে দেয়া তার অঙ্গীকার পালন করেছে। বস্তুত ওই প্রকারের কাজ করার যোগ্যতা সে রাখে বটে। তোমার হারানো উটগুলো সে তোমার বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়েছে।’

তাবারানী (র) তাঁর “মুজাম আলকবীর” গ্রন্থে খুরায়ম ইবন ফাতিকের জীবনী প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, হুসায়ন ইবন ইসহাক...... হযরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, খুরায়ম ইবন ফাতিক (রা) হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা)-কে বলেছিলেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আমার ইসলাম গ্রহণের সূচনালগ্ন সম্পর্কে আমি কি আপনাকে জানাব?’ হযরত উমর (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ জানান।’ তারপর তিনি পূর্বোক্ত বর্ণনার অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করলেন। তবে এ বর্ণনায় কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এতে আছে “আমার নিকট এসেছিলেন হযরত আবু বকর (রা)। তিনি আমাকে বললেন, “মসজিদে প্রবেশ করুন, আপনার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ আমরা পেয়েছি।’ আমি বললাম, ‘আমি তো ভালভাবে পবিত্রতা অর্জন করতে জানি না। তিনি আমাকে পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। এরপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখলাম যে, তিনি যেন পূর্ণিমার চাঁদ।’ তিনি বলছিলেন,

ما من مسلم توضأ فأحسن وضوءه ثم صلی صلاه يحفظها ويعقلها الا دخل الجنة

অর্থাৎ, যে মুসলিম ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে এবং যথাযথভাবে ও পরিপূর্ণ মনোযোগের সাথে যে নামায আদায় করে সে নিশ্চয় জান্নাতে প্রবেশ করবে। হযরত উমর (রা) আমাকে বললেন, ‘আপনার বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ পেশ করুন নতুবা আমি আপনাকে শাস্তি দেব।’ তখন কুরায়শী শায়খ হযরত উসমান ইবন আফফান (রা) আমার সমর্থনে সাক্ষ্য দিলেন। হযরত উমর (রা) তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন।

মুহাম্মদ ইবন উসমান সূত্রে বর্ণিত আছে যে, উমর ইবন খাত্তাব (রা) খুরায়ম ইবন ফাতিক (রা)-কে বলেছিলেন আমাকে এমন একটি ঘটনা শুনিয়ে দিন যা আমাকে তাক লাগিয়ে দেয়, তখন তিনি পূর্ববর্তী বর্ণনাটির অনুরূপ ঘটনা বর্ণনা করেন।

আবু নুআয়ম বলেন, সুলায়মান আবদুল্লাহ্ ইবন দায়লামী থেকে বর্ণিত। এক লোক হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট এসে বলল, আমরা শুনেছি যে, আপনি সাতীহ সম্পর্কে আলোচনা করেন, এমনকি আপনি বলে থাকেন যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন যে, অন্য কোন মানুষকে সেরূপ সৃষ্টি করেননি। ইবন আব্বাস (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ আল্লাহ তা’আলা সাতীহ গাসসানীকে সৃষ্টি করেছেন গোলাকার কাঠের উপর স্তুপীকৃত গোশতের ন্যায়। তার শরীরে হাড়ও ছিল না রগও ছিল না। ছিল শুধু মাথায় খুলি আর হাতের দু’টো তালু। তার পা দুটোকে সে গলার সাথে ভাজ করে রাখত যেমন কাপড় ভাঁজ করে রাখা হয়। জিহ্বা ব্যতীত তার দেহে এমন কোন অঙ্গ ছিল না যা নড়াচড়া করতে পারত। মক্কা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তার দেহকে কাঠের ওপর উঠানো হয় এবং এভাবে সে মক্কা পোঁছে। কুরায়শ বংশের নেতৃস্থানীয় চার ব্যক্তি অর্থাৎ আবদ শামস ইবন আবদ মানাফ, হাশিম ইবন আবদ মানাফ ইবন কুসাই, আহওয়াশ ইবন ফিহর এবং আকীল ইবন আবী ওয়াক্কাস তার নিকট উপস্থিত হন। তারা নিজেদের বংশপরিচয় গোপন করে বলেন, আমরা জুমাহ গোত্রের লোক, আপনার আগমন সংবাদ পেয়ে আপনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি। আমরা মনে করি আপনার সম্মানার্থে আপনার সাথে দেখা করা আমাদের কর্তব্য। আকীল তার জন্যে উপহার স্বরূপ একটি ভারতীয় তরবারি এবং একটি রাদীনী বর্শা নিয়ে যান। সাতীহ সেগুলো দেখতে পায় কিনা তা যাচাই করার জন্যে তারা সেগুলো রাখেন কা’বা গৃহের দরজার ওপর। সাতীহ বলল, ‘হে আকীল। তোমার হাতখানা আমাকে দেখাও তো,’ সে তার হাত দেখাল। তখন সাতীহ বলল, ‘হে আকীল। গোপন বিষয়ে জ্ঞাত সত্তার কসম, পাপ মোচনকারী এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণকারী সত্তার কসম, এই কাবাগৃহের কসম, তুমি তো কিছু উপহার নিয়ে এসেছ আর তা হলো ভারতীয় তরবারি ও রাদীনী বর্শা।’ তারা বললেন, ‘সাতীহ! আপনি ঠিকই বলেছেন।’

এবার সে বলল, ‘আনন্দ দানকারীর কসম, রঙধনুর কসম, অন্যান্য আনন্দ সামগ্রীর কসম, আরবী ঘোড়ার কসম, খেজুর গাছ, তাজা ও কাঁচা খেজুরের কসম, কাক যেখানেই যায় ধরা পড়ে যায়। এখন তোমাদের বলে দিচ্ছি তোমরা তো জুমাহ গোত্রের লোক নও। তোমরা আরববাসী কুরায়শ গোত্রের লোক।’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, হে সাতীহ! আমরা কাবা শরীফ এলাকার অধিবাসী। আপনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্বন্ধে আমরা যা শুনেছি তার প্রেক্ষিতে আমরা আপনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি। এখন আপনি আমাদের বলুন, আমাদের যুগে কি কি ঘটবে তারপরে কি কি ঘটবে। এ বিষয়ে নিশ্চয় আপনার অবগতি আছে।’ সে বলল, ‘তোমরা ঠিকই বলেছ। আমার কথা আমার প্রতি মহান আল্লাহর ইলহাম তথা গোপন সংবাদের কথা শোন।

হে আরব বংশীয় প্রতিনিধি দল! এখন তোমরা তোমাদের বার্ধক্যে পৌঁছে গেছ। তোমাদের আর অনারবদের দূরদৃষ্টি এখন সমান সমান। এখন তোমাদের কোন জ্ঞানও নেই প্রজ্ঞাও নেই। তোমাদের বংশধর থেকে অনেক পরম জ্ঞানী লোকের আবির্ভাব ঘটবে। নানা প্রকারের জ্ঞান তারা অর্জন করবে। তারা মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলবে। তারা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে। অনারবদের হত্যা করবে। বকরীর পাল খুঁজে নেবে।’

‘হে সাতীহ! প্রতিনিধি দলের ওরা কারা?’ সাতীহ বলল, ‘রুকন বিশিষ্ট, নিরাপদ ও বসবাসকারী সমৃদ্ধ গৃহের কসম, তোমাদেরই বংশধর থেকে কতগুলো সন্তান জন্ম নেবে যারা প্রতিমাগুলো ভাংচুর করবে, শয়তানের উপাসনা প্রত্যাখ্যান করবে, দয়াময় আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করবে, সকল দীনের শ্রেষ্ঠ দীন প্রচার করবে। তারা উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে এবং যুব সমাজকে দলে টেনে নিবে।’ তারা বলল, ‘হে সাতীহ! কার বংশে ওরা জন্ম নেবে?’ বলল, ‘সর্বাধিক মর্যাদাশীল সত্তার কসম, মর্যাদার স্তরে উন্নীতকারীর কসম, মরুভূমির বালুরাশি স্থানান্তরকারীর কসম এবং দ্বিগুণ চতুগুণে বর্ধিতকারীর কসম, ওরা হাজার হাজার লোক জন্ম নিবে আবদ শামস ও আবদ মানাফের বংশে। বংশ পরম্পরায় তারা এভাবে জন্ম নিবে।’

তারা বলল, ‘হায়রে দুঃখ! হে সাতীহ! আপনি আমাদেরকে যা জানালেন তা তো আমাদের জন্যে অকল্যাণকর বটে। আচ্ছা বলুন তো ওরা কোন শহর থেকে বের হবে?’ সাতীহ বলল, ‘চিরঞ্জীব সত্তার কসম, অনাদি অনন্ত সত্তার কসম, নিশ্চয় এই শহর থেকে বের হবে এক যুবক যে সৎপথের দিক নির্দেশনা দেবে। ইয়াগূছ ও ফানাদ প্রতিমা বর্জন করবে।

আল্লাহর শরীকরূপে কল্পিত সকল উপাস্যের উপাসনা থেকে মুক্ত থাকবে। একক প্রতিপালকের ইবাদত করবে। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে সুনাম অর্জনকারী ও প্রশংসিতরূপে জীবন অবসান করবেন। পৃথিবী থেকে তিনি বিদায় নিবেন। ঊর্ধ্ব জগতে থাকবে তার সাক্ষ্যগণ। এরপর তাঁর কর্মভার গ্রহণ করবেন সিদ্দীক (রা)। তিনি যখন বিচার করবেন, ন্যায় বিচার করবেন। মানুষের অধিকার ও পাওনা পরিশোধে তাঁর কোন ভয়ভীতি ও দায়িত্বহীনতা থাকবে না। এরপর ওই শাসনভার গ্রহণ করবেন সঠিক দীনের অনুসারী একজন শ্রদ্ধাভাজন ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অসত্য কথাবার্তা তিনি কঠোরতার সাথে দমন করবেন। সৎলোকদের তিনি আপ্যায়ন করাবেন। সঠিক ধর্মমতকে তিনি সুদৃঢ় করবেন। এরপর একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে তার দায়িত্ব ন্যস্ত করবেন। এ ব্যক্তি একই সাথে জনমত এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আত্মীয়তা দুটোরই অধিকারী হবেন। ফলে শত্রুগণ শত্রুতা ও বিদ্বেষবশত তাঁকে হত্যা করবে। এরপর একজন মান্যগণ্য ব্যক্তিকে ওই দায়িত্ব দেয়া হবে। এক সময় তাঁকেও হত্যা করা হবে। তাঁর হত্যার বিরুদ্ধে কতক লোক প্রতিবাদমুখর হবে।

এরপর একজন সাহায্যকারী ওই দায়িত্ব নেবে। তাঁর অভিমত দুষ্টলোকের অভিমতের সাথে মিলে যাবে। তখন পৃথিবীতে সেনাতন্ত্র চালু হবে। এরপর তাঁর পুত্র ওই দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সে ধনসম্পদ সংগ্রহে মনোনিবেশ করবে। লোকমুখে তার প্রশংসা হ্রাস পাবে। ধনসম্পদ আত্মসাত করবে এবং সে একাই সেগুলো ভোগ করবে। তারপর তার বংশধররা প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হবে। এরপর একাধিক রাজা ওই পদে আসীন হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তাদের মধ্যে খুনোখুনি ও রক্তপাত হবে।

এরপর একজন খোদাভীরু দরবেশ লোক ওই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি ওদেরকে কাপড়ের ন্যায় ভাঁজ করে গুটিয়ে ফেলবেন। এরপর দায়িত্ব নিবে একজন পাপাচারী লোক। সে সত্যকে দূরে সরিয়ে দেবে এবং ক্ষতিকর কাজগুলো কাছে টেনে নেবে। অন্যায়ভাবে রাজ্যগুলো জয় করবে। এরপর একজন খর্বকায় লোক ওই দায়িত্ব নেবে। তার পৃষ্ঠদেশে একটি চিহ্ন থাকবে বটে। শান্তির সাথে তার মৃত্যু হবে। এরপর অল্পদিনের জন্যে একজন অল্প বয়স্ক বালক ওই দায়িত্ব নেবে। সে রাজত্ব ত্যাগ করার পর তার শাসন রীতি বহাল রেখে তার ভাই প্রকাশ্যে ওই দায়িত্ব নেবে। ধনসম্পদ ও সিংহাসনের প্রতি তার চরম আকর্ষণ থাকবে! এরপর দায়িত্ব নেবে একজন কর্মচঞ্চল ব্যক্তি। সে হবে দুনিয়াদার ও ভোগবিলাসী। তার বন্ধু-বান্ধবগণ হবে তার উপদেষ্টা। এক সময় তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং তাকে পরিত্যাগ করবে। পরবর্তীতে তাকে হত্যা করে রাজত্ব দখল করে নেবে। এরপর ক্ষমতা নেবে একজন অথর্ব। অকর্মণ্য লোক। দেশটিকে সে বরবাদ করে ছাড়বে। তার রাজত্বে তার ছেলেরা সব ঘৃণার্থ হবে। তারপর সকল নগ্নদেহী তথা নিকৃষ্ট লোকেরা রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টা করবে এবং আক্ষেপকারী ব্যক্তি ক্ষমতা লাভ করবে। সে কাহতান বংশের নেযার গোত্রের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। লেবানন ও বিনয়ানের মধ্যবর্তীস্থান দামেস্কে যখন দু’দল মুখোমুখি হবে তখন সে ইয়ামানকে দুভাগে ভাগ করবে। একদল হবে পরামর্শভিত্তিক শাসক, অপর দল হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত। তখন তুমি অশ্বারোহী ও তরবারির মাঝখানে শুধু হাত-পা বাঁধা শিকল পরা বন্দীদের দেখতে পাবে। তখন ঘর-দোর ও জনপদগুলো ধ্বংস হবে। বিধবাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠিত হবে। গর্ভবতীদের গর্ভপাত ঘটবে। ভূমিকম্প শুরু হবে। দেশ তখন একজন আশ্রয়দাতা খুঁজবে। তখন নেযার গোত্র বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। তারা ক্রীতদাস ও মন্দ লোকদেরকে কাছে টানবে। ভাল ও উত্তম লোকদেরকে দূরে ঠেলে দিবে। সফর মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাবে। দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। তারপর তারা পরিখা বিশিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করবে। ওই স্থানটি হবে বৃক্ষরাজি বিশিষ্ট। নদনদী গতিরোধ করবে। দিবসের প্রথম ভাগে সে শত্রুদেরকে পরাজিত করবে। তখন ভাল মানুষগুলো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু নিদ্রা ও বিশ্রাম তাদের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। অবশেষে সে এক শহরে প্রবেশ করবে। সেখানে তার ইনতিকাল হবে। তারপর পদাতিক তীরন্দাজ বাহিনী আসবে সাহসী লোকদেরকে হত্যা করতে এবং প্রহরীদেরকে বন্দী করতে। পথভ্রষ্টগণ তখন ধ্বংস হবে এবং তার মৃত্যু হবে উপকূল অঞ্চলে।

এরপর দীন ধর্ম বিনষ্ট হবে। কাজকর্ম উল্টে যাবে। আসমানী গ্রন্থ প্রত্যাখ্যান করা হবে। পুল ভেঙে ফেলা হবে। দ্বীপাঞ্চলে যারা থাকবে তারা ব্যতীত অন্য কেউ মাসের শেষ দিবস পর্যন্ত জীবিত থাকবে না। এরপর খাদ্যশস্য ধ্বংস হতে থাকবে। বেদুইন গ্রাম্য লোকেরা ক্ষমতা দখল করবে। সেই দুর্ভোগের যুগে তাদের মধ্যে এমন কোন লোক থাকবে না যে পাপাচারীদেরকে এবং বিধর্মীদেরকে দোষত্রুটি ধরিয়ে দেবে। তখন যারা জীবিত থাকবে তারা মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে না।’

প্রতিনিধি দল বলল, ‘হে সাতীহ! এরপর কী হবে?’ সে বলল, ‘এরপর লম্বা রশির ন্যায় দীর্ঘকায় একজন ইয়ামানী লোক বেরিয়ে আসবে। তার দ্বারা আল্লাহ তা’আলা সকল ফিতনা-ফাসাদ নির্মূল করে দেবেন।’

উপরোক্ত বর্ণনা একটি বিস্ময়কর ও বিরল বর্ণনা বটে। এটির মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ এবং শেষ যুগের বিপর্যয় সম্পর্কিত আলোচনা থাকার কারণে এবং এটির অসাধারণত্বের কারণে আমরা এটি উল্লেখ করেছি।

ইয়ামানের রাজা রাবী’আ ইবন নাসরের সাথে শিক ও সাতীহের সাক্ষাত ও আলোচনা এবং রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে তাদের সুসংবাদ দানের বিষয় ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে আপন ভাগ্নে আবদুল মাসীহের সাথে সাতীহের সংঘটিত ঘটনা যখন বানু সাসান বংশীয় পারস্য সম্রাট তাকে পাঠিয়েছিল রাজপ্রাসাদের চূড়া ধ্বংস এবং উপাসনার অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়ার ঘটনা জানার জন্য, তাও ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

পারস্যের বিচারক ও আইন শাস্ত্রবিদের দেখা স্বপ্নের কথাও আলোচিত হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটেছিল প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জন্মগ্রহণের রাতে। তাঁর শরীয়ত ও ধর্ম তো অন্য সকল দীন-ধর্মকে রহিত করে দিয়েছে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন