মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্য হালীমা বিনতে আবী যুওয়াইব-এর দুধপানের ব্যবস্থা করা হয়। হালীমার পিতা আবু যুওয়াইব-এর পুরো নাম আবদুল্লাহ ইবন হারিছ। তাঁর বংশলতিকা হচ্ছে এরূপ। আবদুল্লাহ ইবন শাজনাহ ইবন জাবির ইবন রিযাম ইবন নাসিরা ইবন সাদ ইবন বকর ইবন হাওয়াযিন ইবনে মনসুর ইবন ইকরিমা ইবন হাফসা ইবন কায়স আইলান ইবন মুযার। ইবন ইসহাক বলেনঃ আর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুধপিতা-তথা হালীমার স্বামীর নাম হারিছ ইবন আবদুল উযযা ইবন রিফাআ ইবন মিলান ইবন নাসিরা ইবন সা’দ ইবন বকর ইবন হাওয়াযিন। নবী করীম (সা)-এর দুধ ভাই বোনদের নাম যথাক্রমে আবদুল্লাহ ইবন হারিছ, আনীসা বিনতে হারিছ ও হুযাফা বিনতে হারিছ। হুযাফার অপর নাম শায়মা। ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই শায়মাই তার মায়ের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাদের বাড়িতে তার অবস্থানকালে লালন-পালন করতেন।
ইবন ইসহাক আবদুল্লাহ ইবন জাফর ইবন আবু তালিব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি হালিমা বিনতে হারিছ সম্পর্কে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ কোন এক দুর্ভিক্ষের বছর দুগ্ধপোষ্য শিশু সংগ্রহের জন্য বনু সা’দের কয়েকজন মহিলার সঙ্গে আমি মক্কায় যাই। (ওয়াকেদী তার সনদে উল্লেখ করেছেন যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু অন্বেষণকারী মহিলাদের সংখ্যা ছিল দশ)। দুর্বল একটি গাধীতে সওয়ার হয়ে আমি মক্কায় পৌঁছি। আমার সঙ্গে ছিল আমারই একটি শিশু সন্তান আর একটি বুড়ো উটনী। আল্লাহর শপথ! উটনীটি আমার এক ফোঁটা দুধও দিচ্ছিল না। আর শিশুটির যন্ত্রণায় আমরা সেই রাতে একবিন্দুও ঘুমাতে পারিনি। কারণ তাকে খাওয়ার মত না পেয়েছি আমার স্তনে এক ফোটা দুধ, না পেয়েছি তাকে পান করাবার মত উটনীর সামান্য দুধ। তবে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠে স্বচ্ছলতা লাভে আশাবাদী ছিলাম।
যা হোক, অতি দুর্বল গাধীটির পিঠে সওয়ার হয়ে আমরা মক্কা এসে পৌঁছলাম। দুর্বলতার কারণে গাধীটি আমাদেরকে যেন বহন করতে পারছিল না। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমাদের সব ক’জন মহিলার সম্মুখেই রাসুলুল্লাহ (সা)-কে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু শিশুটি এতীম শুনে কেউই তাকে গ্রহণ করতে সম্মত হল না। আমরা বললাম, এই এতীম শিশুর মা আমাদের কি করতে পারবে? আমরা তো শিশুর পিতার নিকট থেকে সুযোগ-সুবিধা আশা করি। আর এই শিশুটির মা তো আমাদের কিছুই করতে পারবে না।
যা হোক, আমি ছাড়া আমার সঙ্গী সব মহিলা একটি করে শিশু নিয়ে নেয়। আমরা যখন মুহাম্মদ ছাড়া আর কোন শিশুই পেলাম না এবং ফেরার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম; তখন আমার স্বামী হারিছকে বললাম, আল্লাহর শপথ, শিশু সন্তান না নিয়ে এইভাবে শূন্য হাতে ফিরে যেতে আমার খারাপ লাগছে। আমি ওই এতীম শিশুটিকে অবশ্যই নিয়ে যাব। স্বামী বললেন, ঠিক আছে, তাই কর! হতে পারে, আল্লাহ তার মধ্যে আমাদের জন্য বরকত রেখেছেন। আমি গিয়ে শিশুটিকে নিয়ে নিলাম। আল্লাহর শপথ, আমি তো তাকে গ্রহণ করেছিলাম অন্য শিশু না পেয়ে নিতান্ত নিরূপায় হয়ে। এতীম মুহাম্মদকে নিয়ে আমি আমার বাহনের কাছে গেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, আমার স্তনদ্বয় পর্যাপ্ত দুধে পরিপূর্ণ। শিশু মুহাম্মদ তৃপ্তির সাথে তা পান করে এবং তার দুধ ভাইও সেই দুধ পান করে তৃপ্ত হয়। আমার স্বামী উটনীর নিকট গেলেন। তিনি দেখতে পান যে, তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ। উটনী থেকে তিনি দুধ দোহন করলেন। নিজে পান করলেন, আমিও তৃপ্তি সহকারে পান করলাম। আমরা শান্তিতে রাত কাটালাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার স্বামী আমাকে বললেন, হালীমা! আল্লাহর শপথ, আমার মনে হচ্ছে, তুমি একটি বরকতময় শিশুই নিয়েছ। দেখলে না, ওকে আনার পর থেকে এই রাতে আমরা কত কল্যাণ ও বরকত লাভ করলাম। এরপর থেকে আল্লাহ আমাদের জন্য এই কল্যাণ আরও বৃদ্ধি করতে থাকেন।
এরপর আমরা সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। শপথ আল্লাহর! আমার গাধীটি আমাদের নিয়ে এত দ্রুতগতিতে ছুটে চলে যে, সঙ্গের একটি গাধাও তার নাগাল পাচ্ছিল না। তা দেখে আমার সঙ্গীরা বলতে শুরু করে যে, আবু যুআইব-এর কন্যা! ব্যাপারটা কী? এই কি তোমার সেই গাধী, যাতে করে তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছিলে? আমি বললাম, হ্যাঁ, এটিই আমার সেই গাধী, যাতে চড়ে আমি তোমাদের সঙ্গে এসেছিলাম। তারা বলল, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় এর বিশেষ কোন রহস্য আছে!
এভাবে আমরা বনু সাদ-এর এলাকায় এসে পৌঁছলাম। তখন এই ভূখণ্ড অপেক্ষা আল্লাহর জমীনে অধিকতর অনুর্বর কোন ভূমি ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমার বকরীর পাল সারাদিন চরে সন্ধ্যাবেলা তৃপ্ত পেটে স্তন ভর্তি দুধ নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করে। আমরা ইচ্ছামত দুধ দোহন করতে লাগলাম। অথচ, আমাদের আশেপাশে তখন কারও বকরীই এক ফেঁটা দুধ দিচ্ছিল না। প্রতিবেশীর বকরীগুলো সারাদিন চরে সন্ধ্যাবেলা ক্ষুধার্ত পেটেই ফিরে আসতো। তারা তাদের রাখালদের বলে দেয় যে, আবু যুআইব-এর কন্যার বকরী পাল যেখানে চরে, আজ থেকে আমাদের বকরীগুলোও তোমরা সেখানেই চরাবে। ফলে, তারা তাদের বকরী আমার বকরী পালের সঙ্গে চরাতে শুরু করে। কিন্তু তার পরও তাদের বকরী সেই দুধবিহীন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরতো আর আমার বকরী ফিরতো তৃপ্তপেটে স্তন ভর্তি দুধ নিয়েই। এইভাবে দু’দু’টি বছর পর্যন্ত আল্লাহ আমাদেরকে বরকত দান করতে থাকেন।
দুর্ভিক্ষের কারণে তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা এই ছিল যে, পরিণত বয়সের একটি যুবককে একটি কিশোরের সঙ্গে তুলনা করা মুশকিল ছিল। কিন্তু আল্লাহর শপথ, দু’টি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতে মুহাম্মদ একটি নাদুস-নুদুস বালকে পরিণত হন। আমরা তাকে তার মায়ের নিকট নিয়ে গেলাম। অথচ, তার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় তাকে ফিরিয়ে দিতে আমাদের মন সায় দিচ্ছিল না। যা হোক, তার মা তাকে দেখার পর আমি বললাম, আরও একটি বছরের জন্য আপনার পুত্রকে আমার নিকট দিয়ে দিন। আমি মক্কার মহামারীতে ছেলেটির আক্রান্ত হয়ে পড়ার আশংকা করছি। আল্লাহর শপথ, আমি কথাটা বারবার বলায় শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হয়ে বললেন, ঠিক আছে নিয়ে যাও!
তাঁকে সঙ্গে করে আমরা বাড়ি চলে গেলাম। দুই কি তিন মাস কেটে গেল। একদিন তিনি তাঁর দুধ-শরীক এক ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ির পেছনে বকরী চরাতে যান। হঠাৎ তাঁর ভাইটি দৌড়ে এসে বলল, আমাদের ঐ কুরাইশী ভাইকে সাদা পোশাক পরা দু’জন লোক এসে তাকে শুইয়ে তার পেট চিরে ফেলেছে! খবর শুনে আমি ও তাঁর দুধ পিতা দৌড়ে তার নিকট গিয়ে দেখতে পেলাম, বিবর্ণ অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তার দুধ পিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবা! তোমার কী হয়েছে?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘সাদা পোশাক পরা দু’জন লোক এসে আমাকে শুইয়ে ফেলে এবং আমার পেট চিরে পেটের ভেতর থেকে কী যেন বের করে ফেলে দিল! তারপর আমার পেট আগে যেমন ছিল তেমনি করে দেয়।’ হালীমা বলেন, ‘আমরা তাকে ঘরে নিয়ে গেলাম।’ তাঁর দুধ পিতা বললেন, ‘হালীমা! আশংকা হয় যে, আমার এই সন্তানটিকে জিনে পেয়ে বসেছে। চল, আমরা যা আশঙ্কা করছি, কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আগেই ভালোয় ভালোয় আমরা তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।’ তাকে নিয়ে আমরা তার মায়ের কাছে চলে গেলাম। দেখে তার মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কী, হে স্নেহশীলা ধাত্রী? আমার পুত্রের প্রতি তোমাদের দু’জনের এত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তোমরা একে ফিরিয়ে আনলে কেন?’ হালীমা ও তার স্বামী বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। এখন এর ব্যাপারে আমাদের মনে নানা আপদ-বিপদের আশংকা হচ্ছে। তাই আপনার পুত্রকে আপনার নিকট ফিরিয়ে দিতে আসলাম।’
তখন তিনি বলেন, ‘তোমরা কিসের আশংকা করছ? কী ঘটেছে সত্যি করে আমাকে খুলে বল!’ আমরা তাকে ঘটনার বৃত্তান্ত শোনালাম। শুনে তিনি বললেন, ‘তোমরা কি এর ব্যাপারে দুষ্ট জিনের ভয় করছ? কখনো নয়, আল্লাহর শপথ! আমার এই পুত্রের উপর শয়তানের কোন হাত থাকতে পারে না। আল্লাহর শপথ! আমরা এই পুত্র ভবিষ্যতে বিরাট কিছু হবে। আমি কি তোমাদেরকে এর ঘটনা শোনাব?’ আমার বললাম, ‘জ্বী হ্যাঁ, শোনান।’ তিনি বললেন, ‘ও যখন আমার গর্ভে, তখন একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, যেন আমার ভেতর থেকে এক ঝলক আলো বের হয়ে তাতে সিরিয়ার সকল রাজপ্রাসাদ আলোকিত হয়ে গেছে। আবার আমি যখন তাকে প্রসব করি, তখন সে আকাশ পানে মাথা তুলে দু’হাতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। সুতরাং তোমরা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না!’ এ বর্ণনাটি আরও একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সীরাত ও মাগাযী বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এটি একটি প্রসিদ্ধ বর্ণনা।
ওয়াকিদী....ইবন আব্বাসের বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হালীমা একদিন নবী করীম (সা)-এর সন্ধানে বের হন। খুঁজে খুঁজে একস্থানে তাকে তার বোনের সঙ্গে পান। তখন তাদের পালের পশুগুলো শুয়ে রয়েছিল। দেখে হালীমা বললেন, ‘তোমরা এই গরমের মধ্যে বসে আছ?’ জবাবে শিশু নবীর বোন বললেন, ‘আম্মা! আমার এ ভাইটির তো গরম পাচ্ছে না। দেখলাম, একখণ্ড মেঘ ওকে ছায়া দিচ্ছে। ও থামলে মেঘও থেমে যায়, ও চললে মেঘও ওর সাথে সাথে চলতে শুরু করে। এই অবস্থায়ই আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি।’
ইবন ইসহাক খালিদ ইবন মাদান সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, কয়েকজন সাহাবী একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, ‘আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘হ্যাঁ, বলছি; ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া ও ঈসার সুসংবাদ। আর আমি গর্ভে থাকাবস্থায় আমার আম্মা স্বপ্নে দেখেন, তার ভেতর থেকে এক ঝলক নূর বেরিয়ে আসে, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে উঠে। সা’দ ইবন বকর গোত্রে আমি লালিত-পালিত হই। একদিন আমি আমাদের ছাগল-ভেড়া চরাচ্ছিলাম। এমন সময় সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন লোক আমার নিকট আসে। সঙ্গে তাদের বরফ ভর্তি একটি সোনার তশতরী। আমাকে তারা শুইয়ে ফেলে, আমার পেট চিরে ফেলে তারপর হৃৎপিণ্ড বের করে তা চিরে ভিতর থেকে কালো রংয়ের একটি রক্তপিণ্ড বের করে ফেলে দেয়। তারপর সাথে আনা বরফ দ্বারা আমার হৃৎপিণ্ড ও পেট ধুয়ে দিয়ে আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। তারপর তাদের একজন অপরজনকে বলে, একে তার দশজন উম্মতের সঙ্গে ওজন কর। অপরজন আমাকে আমার দশজন উম্মতের সঙ্গে ওজন করে। আমার পাল্লা ভারী হয়। তারপর বলে, এবার তাকে তার একশ’ উম্মতের সঙ্গে ওজন কর! সে আমাকে একশ’ জনের সঙ্গে ওজন করে। এবারও আমার পাল্লা ভারী হয়। আবার বলে, এবার তাকে তার উম্মতের এক হাজার জনের সঙ্গে ওজন কর। আমাকে এক হাজার জনের সঙ্গে ওজন করে। এবারও আমার পাল্লা ভারী হয়। এইবার লোকটি বলে, হয়েছে, আর প্রয়োজন নেই! একে তার সমস্ত উম্মতের সঙ্গেও যদি ওজন করা হয়, তবু তার পাল্লাই ভারী হবে।’ এ সনদটি উত্তম।
আবু নুআয়ম তাঁর দালায়িল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, উতবা ইবন আবদুল্লাহ বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রথম জীবনের অবস্থা কেমন ছিল?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘যে মহিলা আমাকে দুধ পান করাতেন, তিনি ছিলেন বনু সাদ গোত্রীয়। একদিন আমি আর তার এক পাল ভেড়া-বকরী চরানোর জন্য মাঠে যাই। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে খাবার কিছু নিয়ে যাইনি। তাই আমি আমার দুধ ভাইকে বললাম, তুমি গিয়ে আম্মার নিকট থেকে খাবার নিয়ে এস। আমার ভাই চলে গেল আর আমি পশুপালের নিকট রয়ে গেলাম। হঠাৎ দেখি, শকুনের মত দুটি সাদা রংয়ের পাখি আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এসে একটি অপরটিকে বলে, এই কি সেই লোক? অপরটি বলল, হ্যাঁ। তারপর তারা দ্রুত আমার একেবারে নিকটে এসে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে আমার পেট চিরে ফেলে। তারপর আমার হৃৎপিণ্ড বের করে তার মধ্য থেকে দুটি কালো রক্তপিণ্ড বের করে। তারপর বরফের পানি দিয়ে আমার পেট ধুয়ে নেয়। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে আমার হৃদপিণ্ড ধোয়। তারপর আমার হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেলে দেয়। তারপর একজন অপরজনকে বলে, এবার সেলাই করে দাও। পেট সেলাই করে আমার ওপর নবুওতের মোহর অংকিত করে দেয়। তারপর একজন অপরজনকে বলে, একে দাঁড়ির এক পাল্লায় রেখে আর তার উম্মতের এক হাজার জনকে অপর পাল্লায় রেখে ওজন কর। সে মতে আমাকে ওজন করা হল। আমি দেখলাম, এক হাজার জনের পাল্লা উপরে ওঠে গেল। আমার ভয় হচ্ছিল, তাদের কেউ আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিনা। তখন একজন বলল, যদি এর সকল উম্মতের সঙ্গেও একে ওজন করা হয়, তবু এর পাল্লা ভারী হবে।
তারপর তারা আমাকে ফেলে চলে যায়। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর মায়ের নিকট গিয়ে ঘটনা খুলে বললাম। শুনে তিনিও শংকিত হয়ে পড়েনঃ পাছে আমার কোন ক্ষতি হয়ে যায়। তাই তিনি বললেন, তোমার জন্য আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উটের পিঠে করে আমাকে আমার আম্মার নিকট নিয়ে গেলেন। বললেন, আমি আমার আমানত বুঝিয়ে দিলাম ও দায়িত্ব পালন করলাম। এই বলে তিনি আমার সব ঘটনা খুলে বললেন। কিন্তু সব শুনেও আমার আম্মা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার ভেতর থেকে এক ঝলক নূর বের হয়, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে যায়।’ এই বর্ণনায় এমন একজন রাবী রয়েছেন যার জাল হাদীস রটনার দুর্নাম রয়েছে-যদ্দরুন হাফিজ ইবন আসাকির বর্ণনা করেন যে, আবুযর গিফারী (রা) বলেছেন, একদিন আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি করে জানলেন এবং কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আপনি নবী?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘শোন হে আবু যর! আমি মক্কার উপকণ্ঠে অবস্থান করছিলাম। এই সময়ে দু’জন ফেরেশতা আমার নিকট আগমন করেন। একজন মাটিতে অবতরণ করেন আর অপরজন আকাশ ও জমিনের মধ্যখানে অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে তাঁদের একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনিই কি সেই লোক? অপরজন বললেন হ্যাঁ, ইনিই সেই লোক। তখন প্রথমজন বললেনঃ একে একজন মানুষের সঙ্গে ওজন কর। ফেরেশতা আমাকে একজন মানুষের সঙ্গে ওজন করে। ওজনে আমার পাল্লা ভারী হয়।’
ইবন আসাকির সম্পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি নবী করীম (সা)-এর বক্ষবিদারণ, বক্ষ সেলাই ও দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুওত স্থাপনের কথাও উল্লেখ করেছেন। এ বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে। এরপর তারা চলে যান। আমি যেন এখনো তা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।
সহীহ মুসলিমে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, একদিন শিশু নবীর নিকট জিবরীল (আ) আগমন করেন। নবী করীম (সা) তখন অন্য বালকদের সাথে খেলা করছিলেন। জিবরীল (আ) শিশু নবীকে ধরে মাটিতে শুইয়ে তার পেট চিরে তাঁর হৃদপিণ্ড বের করে আনেন। তারপর হৃৎপিণ্ড থেকে একটি কালো রক্তপিণ্ড বের করেন এবং বলেন, এটি শয়তানের অংশ। তারপর সোনার একটি পাত্রে যমযমের পানি দ্বারা হৃদপিণ্ডটি ধুয়ে নেন। অতঃপর তা যথাস্থানে স্থাপন করে দেন।
ঘটনা দেখে বালকরা দৌড়ে নবীজির দুধ-মায়ের নিকট এসে বলে, মুহাম্মদকে খুন করা হয়েছে। শুনে সকলে তাঁর নিকট দৌড়ে আসে। তখন তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে। আনাস (রা) বলেন, আমি তার বুকে সেই সেলাইয়ের দাগ দেখতে পেতাম।
ইবন আসাকির আনাস (রা) সূত্রে আরও বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নামায মদীনায় ফরয হয়। দুইজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে তাকে যমযমের কাছে নিয়ে যান। তারপর তার পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে একটি সোনার পেয়ালায় নিয়ে যমযমের পানি দ্বারা তা ধুয়ে দেন। তারপর তার উদরকে প্রজ্ঞা ও ইলম দ্বারা ভরে দেন।
অন্য সূত্রে আনাস (রা) থেকে আরও বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, পরপর তিন রাত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট কয়েকজন ফেরেশতা আগমন করেন। তাদের একজন অন্যদেরকে বলেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাদের নেতাকে নিয়ে চল। ফেরেশতারা তাকে যমযমের নিকট নিয়ে যান এবং তাঁর পেট বিদীর্ণ করেন। তারপর একটি সোনার পাত্র এনে শিশু নবীর পেটকে ধুয়ে তা প্রজ্ঞা ও ঈমান দ্বারা ভরে দেন।
উল্লেখ্য যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত মিরাজের হাদীসেও উক্ত রাতে নবীজির বক্ষবিদারণ এবং যমযমের পানি দ্বারা তা ধৌত করার ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। তবে এতে কোনও বৈপরীত্য নেই। কারণ, হতে পারে একই ঘটনা নবী করীম (সা)-এর জীবনে দু’বার ঘটেছে। একবার তাঁর শৈশবে আর একবার মি’রাজের রাতে, তাঁকে ঊধ্বজগতে আরোহণ এবং আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার উপযোগীর জন্য প্রস্তুতি করার লক্ষ্যে।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে বলতেন, “আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ আরবী, আমি কুরাইশী এবং দুধপান করেছি আমি সা’দ ইবন বকর গোত্রে।”
ইবন ইসহাক আরো বলেন, দুধ ছাড়ানোর পর হালীমা শিশু নবীকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিতে যাওয়ার পথে একদিন তিনি নবীজিকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে নাসারাদের একটি কাফেলার সঙ্গে তাদের সাক্ষাত হয়। দেখে কাফেলার লোকেরা শিশু নবীর দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে চুমো খায় এবং বলে, ‘এই বালকটিকে অবশ্যই আমরা আমাদের রাজার নিকট নিয়ে যাব। কারণ, ছেলেটি ভবিষ্যতে বিরাট কিছু হবে।’ হালীমা বড় কষ্টে পুত্রকে তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনেন। ইবন ইসহাক বলেন, উক্ত কাফেলার হাত থেকে মুক্ত করে তাঁকে নিয়ে যখন হালীমা মক্কার নিকটে চলে আসেন, তখন হঠাৎ শিশু নবী (সা) হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে হালীমা আর তাকে পেলেন না। সংবাদ পেয়ে দাদা আবদুল মুত্তালিব নিজে এবং আরও একদল লোক তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। খুঁজতে খুঁজতে ওয়ারাকা ইবন নওফল ও অপর এক ব্যক্তি তার সন্ধান পান। পেয়ে তাকে তারা দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিকট নিয়ে যান। আবদুল মুত্তালিব শিশু নবীজিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বায়তুল্লাহয় চলে যান এবং তাওয়াফে শিশু নবীজির নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেন। অতঃপর তাকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেন।
উমাবী বর্ণনা করেন যে, আবদুল মুত্তালিব আদেশ করেন, যেন শিশু নবীজিকে সঙ্গে করে নিয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রে ঘুরে তার জন্য একজন দাই-মা ঠিক করে নেয়া হয়। শিশু নবীকে দুধ পান করানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হালীমাকে ঠিক করা হয়।
বর্ণিত আছে যে, শিশু নবী হালীমার নিকট ছয় বছর অবস্থান করেন। এই সময়ে তাঁর দাদা বছরে একবার তাকে দেখতে যেতেন। বক্ষবিদারণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর হালীমা শিশু নবীকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিয়ে যান। তিনি যখন আট বছরের বালক, তখন মা আমিনা মৃত্যুবরণ করেন। এবার দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। তাঁর দশ বছর বয়সের সময় দাদা আবদুল মুত্তালিবও মারা যান। তখন নবীজির লালন-পালনের দায়িত্ব হাতে নেন, তার দুই আপন চাচা যুবায়র ও আবু তালিব। তের বছর বয়সে তিনি চাচা যুবায়র-এর সঙ্গে ইয়ামান গমন করেন। এই সফরে তার কয়েকটি আলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়। তার একটি হলো, চলার পথে একটি উট তাকে দেখেই বসে পড়ে। এমনকি তার বুক মাটি স্পর্শ করে। নবীজি (সা) তাতে চড়ে বসেন। আরেকটি ঘটনা হলো, ইয়ামানের একস্থানে তখন বাঁধভাঙ্গা প্লাবন হচ্ছিল। নবীজির উসিলায় আল্লাহ তাআলা বন্যার পানি শুকিয়ে দেন। কাফেলার সকলে অনায়াসে পথ অতিক্রম করে। তারপর চাচা যুবায়র নবীজির চৌদ্দ বছর বয়সে মারা যান। এইবার চাচা আবু তালিব একাই নবীজি (সা)-কে লালন-পালন করতে শুরু করেন। এ বর্ণনায় একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন।
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শৈশবেই হালীমা সা’দিয়া ও তার পরিবার-পরিজনের ওপর তার বরকত প্রকাশ পায়। তারপর সেই বরকত হাওয়াযিন গোত্রের সকলের ওপর ছড়িয়ে পড়ে; পরবর্তীকালে যখন তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর নবী করীম (সা) তাদেরকে বন্দী করেন তখন তারা সেই দুধপানের দোহাই দিয়ে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। নবী করীম (সা) তাদেরকে মুক্তিদান করেন এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। এটি মক্কা বিজয়ের একমাস পরের ঘটনা। পরে যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসবে, ইনশাআল্লাহ।
হাওয়াযিন-এর ঘটনা সম্পর্কে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আমর ইবনে শুয়াইব এর দাদা বলেছেন, হুনায়নে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তাদের থেকে প্রাপ্ত গনীমতের মাল ও বন্দীদের নিয়ে রওয়ানা হলে হাওয়াযিন-এর একটি প্রতিনিধি দল জিয়িররানা নামক স্থানে তার সঙ্গে সাক্ষাত করে। তারা তখন ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছে। এসে তারা বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার আপনজন ও আত্মীয়। আমরা যে বিপদে পড়েছি তা আপনার অজানা নয়। আপনি আমাদের প্রতি দয়া করুন, আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করবেন।’ যুহায়র ইব্ন সরদ নামক তাদের একজন বক্তা দাঁড়িয়ে বলে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! বন্দী মহিলাদের মধ্যে আপনার ঐসব খালা আর বোনরাও আছে, যারা আপনাকে কোলে-কাঁধে নিয়ে লালন পালন করেছিল। এখন যদি আমরা শিমর এর পুত্র কিংবা নুমান ইবন মুনযির এর পুত্রকে দুধপান করিয়ে থাকতাম এবং পরে যদি তাদের পক্ষ থেকেও আমাদের প্রতি সেইরূপ বিপদ আসতো, যেমন এসেছে, আপনার পক্ষ থেকে, তাহলে তো আমরা তাদের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করতাম। অথচ, আপনি হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ অভিভাবক। এই বলে সে কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেঃ
أمنن علينا رسول الله في كرم – فإنك المرء نرجوه وندخر
أمنن على بيضة قد عاقها قدر – مهزق شملها في دهرها غير
أبقت لنا الدهر هتافا على حزن – على قلوبهم الغماء والغمر
انلم تداركها نعماء تنتروها- يا أرحم الناس حلما حين يختبر
أمنن على نسوة قد كنت ترضعها-اذ فوك يملئه من محيخضها ذكر
أمنن على نسوة قد كنت ترضعها – واذ يزينك ما تأتى وما تدر
إنا لنشكر للعمى وإن كفرت – وعندنا بعد هذا اليوم مدخر
—হে আল্লাহর রসূল! মহানুভবতা দ্বারা আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনিই আমাদের প্রত্যাশিত ও নির্বাচিত ব্যক্তি।
আপনি এমন রমণীর প্রতি অনুগ্রহ করুন, ভাগ্য যাকে (তার স্বগোত্রের কাছে ফিরে যাওয়া থেকে) বিরত রেখেছে, যার জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তার জীবন ধারায় এসেছে পরিবর্তন।
যে আমাদের যুগকে বানিয়ে রেখেছে দুঃখে আর্তনাদকারী। ঐ সকল লোক যাদের রয়েছে সীমাহীন মর্মবেদনা ও দুঃখের প্রচণ্ড চাপ।
যদি না আপনার পক্ষ থেকে সম্প্রসারিত বরকতময় হাত তার ক্ষতিপূরণ করে। হে শ্রেষ্ঠ সহনশীল মানব! যার সহনশীলতা প্রকাশ পায় যখন তাকে পরীক্ষা করা হয়।
আপনি সেই মহিলাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন, যাদের দুধ আপনি পান করেছেন। যখন আপনার সুখ তাদের দুধেপূর্ণ থাকতো। অনুগ্রহ করুন সেই সব মহিলাদের প্রতি তখন আপনার জন্য শোভনীয় হত, আপনি যা করতেন এবং যা করতেন না সবই।
আপনি আমাদের ঐ ব্যক্তির ন্যায় করবেন না, যে মৃত্যুবরণ করেছে। আপনি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখুন। কেননা, আমরা একটি সমুজ্জ্বল সম্প্রদায়।
নিশ্চয় আমরা নিয়ামতের শোকর আদায় করে থাকি, যদিও অন্যত্র তার না-শোকরী করা হয়। আমাদের এ কৃতজ্ঞতা আজকের দিনের পরও বহাল থাকবে।
উল্লেখ্য যে, যুহায়র ইবন সরদ ছিলেন তাঁর গোত্রের নেতা। তিনি বলেন, হুনায়নের দিন আমাদেরকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন আমাদের নারী-পুরুষদের আলাদা করছিলেন, তখন হঠাৎ আমি তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই এবং কবিতার ছন্দে তাঁর হাওয়াযিন গোত্রে প্রতিপালিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেই। অন্য বর্ণনায় এ পংক্তিগুলোতে ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তন সহ বর্ধিত আরো কয়েকটি চরণ আছে, যা নিম্নরূপঃ
فألبس العفو من قد كنت ترضعه – من أمهاټك إن العفو وتنتصر
إنا نؤمل عفوا منك ثلبسه – هذي البرية إذ تعفو وتنتصر
فاغفر عفا الله عما أنت راهبه – يوم القيامة إذ يهدى لك الظفرو
—হে আল্লাহর রাসূল! স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনিই আমাদের কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত ব্যক্তি।
সুতরাং আপনি আপনার যে মায়ের দুধ পান করতেন, তাকে আপনি ক্ষমার পোশাক পরিয়ে দিন। ক্ষমা খ্যাতি প্রসারের হেতু হয়ে থাকে।
আমরা আপনার নিকট ক্ষমার প্রত্যাশা করি, যা দ্বারা আপনি এই কয়েকটি প্রাণীকে আচ্ছাদিত করবেন।
অতএব, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন! আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি থেকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন। যখন আপনাকে সফলতা প্রদান করা হবে।
সবকিছু শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “এই গনীমত ও বন্দীদের মধ্যকার যারা আমার ও বনু আবদুল মুত্তালিবের ভাগে আসবে, তা আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তোমাদেরকে দান করে দিলাম।’
একথা শুনে আনসারগণ বললেন, ‘তাহলে যা আমাদের ভাগে আসবে, আমরাও তা আল্লাহ ও তার রাসূলের খাতিরে দান করলাম।’
এই সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) নারী ও শিশুসহ ছয় হাজার লোককে মুক্তি দান করেছিলেন এবং তাদেরকে বিপুল সংখ্যক পশু ও দাস-দাসী প্রদান করেন। আবুল হুসায়ন ইব্ন ফারিস মন্তব্য করেন যে, সেই দিন নবী করীম (সা) যে সম্পদ ফিরিয়ে দেন এবং যেসব বন্দীদের মুক্ত করে দেন, তার মূল্য ছিল পঞ্চাশ কোটি দেরহাম। আর এইসব ছিল তাদের জীবনে পাওয়া নবীজির নগদ বরকত। যারা দুনিয়ার জীবনে নবী করীম (সা)-এর অনুসরণ করবে, আখিরাতে তারা তাঁর যে কি পরিমাণ বরকত লাভ করবে তা সহজেই অনুমেয়।
ইবন ইসহাক বলেন, হালীমার ঘরে দুধপান পর্ব শেষে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর হেফাজতে মা আমিনা ও পরে দাদা আবদুল মুত্তালিব-এর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। আল্লাহ তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করতে থাকেন। তার বয়স ছয় বছরে উপনীত হলে মা আমিনা ইন্তিকাল করেন।
ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর ইবন মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন হাযম বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর মা আমিনা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী আবওয়া নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন। নবীজিকে সঙ্গে করে তিনি তার মাতুলালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন আদী ইবন নাজ্জার গোত্রভুক্ত। মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে তাঁর ইন্তিকাল হয়।
ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে করে মা মদীনায় তার মাতুলালয়ে যান। দাসী উম্মে আয়মানও সঙ্গে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স তখন ছয় বছর।
উম্মে আয়মান বলেন, এ সময়ে একদিন দু’জন ইহুদী আমার নিকট এসে বলল, ‘আহমদকে নিয়ে এস দেখি! আমরা তাকে দেখতে এসেছি।’ তারা তাঁকে দেখে ফিরিয়ে দিয়ে একজন অপরজনকে বলে, ‘এ ছেলেই এই উম্মতের নবী। আর এটাই হল তাঁর হিজরত স্থল। এঁকে কেন্দ্র করে অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটবে।’ মা আমিনা এ সংবাদ শুনে ঘাবড়ে যান এবং তাঁকে নিয়ে ফেরত রওয়ানা হন। এই ফেরার পথেই আবওয়া নামক স্থানে তার ইন্তিকাল হয়।
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, বুরায়দা (রা) বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে বের হই। ওয়াদ্দান নামক স্থানে উপনীত হলে নবী করীম (সা) বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি আসছি।’ এই বলে তিনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে আসেন। এসে বললেনঃ
আমি আমার আম্মার কবরের কাছে গিয়ে আমার রব-এর নিকট তাঁর জন্য সুপারিশ করার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে তা থেকে বারণ করলেন। আর আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে যিয়ারত করতে বারণ করেছিলাম। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করবে। তিনদিনের পর কুরবানীর পশুর গোশত খেতেও আমি তোমাদেরকে বারণ করেছিলাম। এখন থেকে যে ক’দিন ইচ্ছা তা খেতে পারবে এবং যতদিন ইচ্ছা ধরে রাখতে পারবে। তোমাদেরকে আমি মদের পাত্রে পানি পান করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন থেকে সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিলাম।
বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত বুরায়দা (রা) বলেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) একটি কবরের নিকট গিয়ে বসে পড়েন। দেখাদেখি লোকেরাও তাঁর চতুম্পার্শ্বে বসে পড়ে। বসে নবী করীম (সা) মাথা নাড়তে নাড়তে কাঁদতে লাগলেন। উমর (রা) তাঁর নিকটে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কাঁদছেন কেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘এটি আমার আম্মা আমিনা বিনতে ওহব-এর কবর। আমার রব-এর নিকট আমি তাঁর এই কবরটি যিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দেন, কিন্তু তাঁর মাগফিরাতের আবেদন করার অনুমতি চাইলে তিনি তাতে সম্মতি দিলেন না। মায়ের কথা ভেবে আমি কাঁদছি।’ বর্ণনাকারী বলেন, সেইদিনের মত এত বেশি সময় ধরে কাঁদতে নবীজিকে কখনও দেখা যায়নি।
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)-এর বরাতে বায়হাকী বর্ণনা করেন, ইবন মাসউদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এক দিন কবরস্থান যিয়ারত করতে বের হন। আমরাও তাঁর সঙ্গে বের হলাম। তাঁর আদেশে আমরা এক জায়গায় বসে পড়লাম। তিনি ঘুরে ঘুরে কবর দেখছেন। এক পর্যায়ে একটি কবরের নিকট গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত নিম্নস্বরে কি যেন বলতে থাকেন। তারপর তিনি কেঁদে উঠেন। তাঁর কান্না দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম। অবশেষে তিনি আমাদের কাছে ফিরে আসেন। উমর ইবন খাত্তাব (রা) এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার কান্না তো আমাদেরকেও কাঁদিয়েছে এবং ভয় পাইয়ে দিয়েছে।’ তিনি আমাদের নিকটে এসে বসলেন এবং বললেন, “আমার কান্না বুঝি তোমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে?” আমরা বললাম, “জ্বী হ্যাঁ”। তিনি বললেন, ‘যে কবরটির সামনে আমাকে তোমরা কথা বলতে দেখেছ, সেটি আমিনা বিনতে ওহব-এর কবর। আমার রব-এর নিকট আমি তার যিয়ারত করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি প্রদান করেন। আবার তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতিও চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার রব সেই অনুমতি দিলেন না এবং আমার প্রতি নাযিল করলেনঃ
“আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়। যখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তারা জাহান্নামী। ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে। অতঃপর যখন তার নিকট এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমল-হৃদয় ও সহনশীল।" (তাওবাঃ ১১৩-১১৪)
ফলে মায়ের জন্য পুত্রের হৃদয় যেভাবে বিগলিত হয় আমার অবস্থাও ঠিক তাই হলো। এ কারণেই আমি কেঁদেছি।” বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের। হাদীছের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবে তার উল্লেখ নেই। ইমাম মুসলিম হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেন। তখন তিনি নিজেও কান্নাকাটি করেন এবং আশেপাশের লোকদেরও কাঁদান। তারপর তিনি বলেন, “আমার রব-এর নিকট আমি আমার মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে অনুমতি দেন। কিন্তু মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে আমার রব আমাকে সেই অনুমতি দেননি। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করবে, কবর তোমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।” ইমাম মুসলিম আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! বলুন তো আমার আব্বা কোথায়?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘জাহান্নামে’। একথা শুনে লোকটি ফিরে যেতে উদ্যত হলে তিনি তাকে ডেকে বললেন, “আমার পিতা এবং তোমার পিতা উভয়েই জাহান্নামে।”
বায়হাকী হযরত সা’দ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী করীম (সা)-এর নিকট এসে বলল, ‘আমার আব্বা আত্মীয় বৎসল ছিলেন। তার অমুক অমুক গুণ ছিল। এখন তিনি কোথায় আছেন?’ জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, ‘জাহান্নামে’। বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে বেদুঈন অস্থির হয়ে পড়ে এবং বলে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আপনার পিতা কোথায়?’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘যখনই তুমি কোন কাফিরের কবর অতিক্রম করবে, তাকে জাহান্নামের সংবাদ দেবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি মুসলমান হয়ে যায়।
পরে সে বলে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) আমার উপর একটি কষ্টকর কাজ দিলেন। এরপর থেকে আমি যখনই যে কাফিরের কবরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছি তাকেই জাহান্নামের সংবাদ দিয়েছি।’ এটাও গরীব পর্যায়ের বর্ণনা, বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে অনুক্ত।
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেছেন, একদিন আমরা রাসূলুলাহ (সা)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একজন মহিলা দেখা গেল। তাকে নবী করীম (সা) চিনেছেন বলে আমরা ধারণা করিনি। রাস্তার মধ্যখানে এসে নবী করীম (সা) দাঁড়িয়ে যান। মহিলাও নবীজির নিকটে এসে দাঁড়ান। তখন দেখা গেল, তিনি রাসূলুলাহ (সা)-এর কন্যা ফাতিমা। নবী করীম (সা) বলনে, ‘ফাতিমা! কিসে তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে আনলো?’ ফাতিমা (রা) বললেন, ‘এই গৃহবাসীদের মৃতের আত্মার মাগফেরাত প্রার্থনা ও সমবেদনা প্রকাশের জন্য এখানে এসেছি।’ নবী করীম (সা) বললেন, ‘বোধহয় তুমি তাদের সঙ্গে কবর পর্যন্ত গিয়েছিলে?’ জবাবে তিনি বললেনঃ ‘লোকদের সঙ্গে মৃতের কবর পর্যন্ত যাওয়া থেকে আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন। আমি তো এ বিষয়ে আপনি যা বলে থাকেন তা শুনেছি।’ নবী করীম (সা) বললেন, “যদি তুমি তাদের সঙ্গে কবর পর্যন্ত যেতে, তবে জান্নাত দেখতে পেতে, যতক্ষণ না তোমার বাপের দাদা তা প্রত্যক্ষ করতেন।” আহমদ আবু দাউদ, নাসায়ী ও বায়হাকী প্রমুখ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে এর একজন রাবীকে অনেকে বিতর্কিত বলেছেন। আবদুল মুত্তালিব জাহেলী দীনের অনুসারী রূপেই মারা যান। তবে তার এবং আবু তালিবের দীনের ব্যাপারে শিয়াদের ভিন্নমত রয়েছে। আবু তালিবের ওফাত অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
বায়হাকী তাঁর ‘দালায়লুন নুবুওয়াহ্’ গ্রন্থে এই হাদীসগুলো উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতা-মাতা ও দাদার অবস্থা আখিরাতে কেন এরূপ হবে না? তারা তো পৌত্তলিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ঈসা (আ)-এর দীনেরও তারা অনুসরণ করতেন না। তবে তাঁদের এই কুফরীতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশ পরিচয়ে কোন কলংক আসে না। কারণ, কাফিরে কাফিরে বিবাহ শুদ্ধ। এ কারণেই স্বামী স্ত্রী একত্রে ইসলাম গ্রহণ করলে বিবাহ নবায়ন করতে হয় না বা তাতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে হয় না। উল্লেখ্য যে, একাধিক সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে যে, দুই নবীর মধ্যবর্তী সময়কার মানুষ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু, পাগল এবং বধিরদেরকে কিয়ামতের চত্বরে পরীক্ষা করা হবে। তখন তাদের কেউ জবাব দিতে পারবে, কেউ পারবে না। আমার মতে এই হাদীসের বক্তব্য আর নবী করীম (সা)-এর পিতা-মাতা ও দাদা সম্পর্কে জাহান্নামী হওয়ার সংবাদ প্রদানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কেননা, সে সময় এঁরাও ঐ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা জবাব দানে অক্ষম হবে।
এই আয়াতের তাফসীরে আমি বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।
সুহায়লী কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে আছে যে, আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দোয়ায় আল্লাহ তাআলা তাঁর পিতা-মাতা দু’জনকেই জীবিত করেছিলেন। জীবন পেয়ে তারা নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। আল্লাহর কুদরতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এমনটি সম্ভবপর হলেও প্রকৃত পক্ষে এই বর্ণনাটি একান্তই মুনকার’ পর্যায়ের। সহীহ হাদীসে এর বিপরীত বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।
ইবন ইসহাক বলেন, মা আমিনা বিনতে ওহব-এর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) দাদা আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম-এর তত্ত্বাবধানে থাকেন। সে সময়ে কা’বার ছায়ায় আবদুল মুত্তালিবের জন্য বিছানা পাতা হত। আবদুল মুত্তালিব তাতে বসতেন এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিরা সেই বিছানার চারদিকে বসে পড়ত। তাঁর সম্মানার্থে কেউই বিছানার উপরে উঠে বসত না। নাদুস-নুদুস বালক নবী (সা)-ও সেই মজলিসে আসতেন এবং আবদুল মুত্তালিবের বিছানার ওপর বসে পড়তেন। তা দেখে তাঁর চাচারা তাকে ধরে সরিয়ে বসাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব বলতেন, ‘আমার এ নাতিটিকে তোমরা ছেড়ে দাও। আল্লাহর শপথ! ভবিষ্যতে ও বিরাট কিছু হবে।’ এই বলে আবদুল মুত্তালিব নবীজিকে নিজ হাতে ধরে নিজের বিছানায় বসিয়ে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন এবং তিনি যা করতে চাইতেন, তাতে সহযোগিতা করতেন।
ওয়াকিদী একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মা আমিনার কাছে থাকতেন। মায়ের ইন্তিকাল হলে দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে নিজের ঔরসজাত সন্তানদের চাইতেও বেশি স্নেহ করতেন এবং সব সময় তাঁকে কাছে কাছে রাখতেন। শয়নে-স্বপনে সর্বাবস্থায় নবীজি দাদা আবদুল মুত্তালিবের একান্তে যেতে পারতেন। দাদার বিছানায় গিয়ে বসলে আবদুল মুত্তালিব বলতেন, ‘একে তোমরা ছেড়ে দাও, আমার এই সন্তানটি কাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে।’
বনু মুদলাজ এর একদল লোক আবদুল মুত্তালিবকে বলল, ‘এই ছেলের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখবেন। কারণ এর পায়ের আকৃতি মাকামে ইব্রাহীমের পায়ের আকৃতির সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কোন পা আমরা দেখিনি।’ একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে বললেন, ‘শোন, এরা কী বলছে!’ সেই তখন থেকে আবু তালিব নবী করীম (সা)-কে বিশেষ হেফাজতে রাখতে শুরু করেন। আবদুল মুত্তালিব উম্মে আয়মানকে—যিনি নবীজিকে কোলে-কাঁখে নিতেন-বলেছিলেন, ‘বারাকাহ! আমার এই নাতির ব্যাপারে উদাসীন হয়ো না। আমি একে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট বালকদের সঙ্গে দেখতে পেয়েছি। আর আহলে কিতাবদের ধারণা আমার এই সন্তানটি এই উম্মতের নবী হবে।’ উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব যখনই খানা খেতেন বলতেন, ‘আমার নাতিকে নিয়ে এস।’ তখন নবীজিকে তাঁর কাছে এনে দেয়া হত। মৃত্যুকালে আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেখাশুনা করার জন্য অসিয়ত করে যান। এই অসিয়তের পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং হাজুন নামক স্থানে সমাধিস্থ হন।
ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আট বছরে উপনীত হলে তার দাদা আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি তাঁর কন্যাদের ডেকে তাদের বিলাপ করার আদেশ দেন। সেই মেয়েরা হলো, আরওয়া, উমাইয়া, বাররা, সাফিয়া, আতিকা ও উম্মে হাকীম আল-বায়যা। তাদের পিতাকে শুনিয়ে তারা যে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ইবন ইসহাক সেগুলি উদ্ধৃত করেন। এগুলো ছিল খুবই মর্মস্পশী বিলাপ। ইবন ইসহাক এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবন হিশাম বলেন, এই কবিতাগুলো যে তাদেরই, তা যথার্থ বলে কোন কাব্য বিশারদই স্বীকার করেন নি।
ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিমের মৃত্যুর পর যমযম ও পানি পান করানো (সিকায়া)-এর দায়িত্ব তাঁর পুত্র আব্বাসের ওপর অর্পিত হয়। আব্বাস (রা) বয়সে তার ভাইদের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ। ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভ করা পর্যন্ত এই দায়িত্ব তাঁরই হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা)-ও এই দায়িত্ব তারই হাতে বহাল রাখেন। দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল মুত্তালিবের ওসিয়ত অনুসারে চাচা আবু তালিব-এর তত্ত্বাবধানে থাকতে শুরু করেন। আবু তালিব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতা আবদুল্লাহর সহোদর। তাঁদের দুজনেরই মা হলেন, ফাতিমা বিনতে আমর ইবন আয়িয ইবন ইমরান ইবন মাখযুম। রাসূলুল্লাহ (সা) চাচার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন।
ওয়াকিদীর বর্ণনায় আরো আছে, আবু তালিবের সংসার ছিল অসচ্ছল। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তিনি এত বেশি আদর করতেন যে, নিজের ঔরসজাত সন্তানদেরকে তত আদর করতেন না। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিজের পার্শ্বে না নিয়ে তিনি ঘুমাতেন না। বাইরে কোথাও গেলে তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আহার করতেন। তাকে ছাড়া আহার করলে আবু তালিব এবং তার পরিবারের কারও আহারে তৃপ্তি আসত না। সবাই খেতে বসলে আবু তালিব বলতেন, তোমরা একটু অপেক্ষা কর, আমার আদরের দুলালটি এসে যাক। রাসূলুল্লাহ (সা) এসে তাদের সঙ্গে আহার করলে তাদের আহার্য উদ্বৃত্ত থাকতো। এ ব্যাপারে আবু তালিব বলতেন, ‘তুমি বড় বরকতময়।’ সকালে ঘুম থেকে উঠলে সবাইকে যেখানে মলিন ও আলুথালু মনে হত, সেখানে রাসূলুল্লাহকে অনেক দীপ্তিময় ও লাবণ্যময় দেখাতো।
হাসান ইবন আরাফা (র) বর্ণনা করেন যে, ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেছেন, ভোর হলে আবু তালিব শিশুদের জন্য একপাত্রে খাওয়ার আয়োজন করতেন। শিশুরা বসে কাড়াকাড়ি করে খেতে শুরু করত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স) সেই কাড়াকাড়িতে যোগ দিতেন না। তিনি হাত সরিয়ে নিতেন। দেখে চাচা আবু তালিব তার জন্য আলাদা পাত্রের ব্যবস্থা করেন।
ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, লাহাব গোত্রের এক ব্যক্তি গণক ছিল। লোকটি মক্কায় আসলে কুরাইশের লোকেরা তাদের সন্তানদেরকে তার কাছে নিয়ে যেত। একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপর গণকের চোখ পড়ে। এক পর্যায়ে সে বলে, ওই ছেলেটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তার অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে আবু তালিব তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু গণক বলতে থাকে, ‘আরে এইমাত্র আমি যে ছেলেটিকে দেখলাম, ওকে একটু আমার কাছে নিয়ে এস। আল্লাহর শপথ, ভবিষ্যতে ও বিরাট কিছু হবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, কিন্তু আবু তালিব নবীজিকে নিয়ে সরে পড়েন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/489/89
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।