hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

১১
হযরত সুলায়মান (আ)
হাফিজ ইব্‌ন আসাকিরের বর্ণনা মতে, হযরত সুলায়মান (আ)-এর নসবনামা নিম্নরূপঃ সুলায়মান ইবন দাউদ ইবন ঈশা ( ايشا ) ইবন আবীদ ( عويد ) ইবন ‘আবির ইবন সালমূন ইবন নাহশূন ইব্‌ন ‘আমীনাদাব ইবন ইরাম ইবন হাসিরূন ইবন ফারিস ইবন ইয়াহুযা ইবন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম। সুলায়মান (আ) ছিলেন নবীর পুত্র নবী। ইতিহাসের কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি দামিশকে গিয়েছিলেন এবং ইবন খাবুলাও অনুরূপ নসব বর্ণনা করেন। সুলায়মান (আ) প্রসংগে আল্লাহ বলেনঃ

( وَوَرِثَ سُلَیۡمَـٰنُ دَاوُۥدَۖ وَقَالَ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ عُلِّمۡنَا مَنطِقَ ٱلطَّیۡرِ وَأُوتِینَا مِن كُلِّ شَیۡءٍۖ إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡفَضۡلُ ٱلۡمُبِینُ )

[Surah An-Naml 16]

অর্থাৎ, সুলায়মান হয়েছিল দাউদের উত্তরাধিকারী এবং সে বলেছিল, “হে মানুষ! আমাকে পক্ষীকূলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সকল কিছু দেয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই সুস্পষ্ট অনুগ্রহ”। (২৭ নামলঃ ১৬) অর্থাৎ তিনি পিতা দাউদের নবুওয়াত ও রাজত্বের উত্তরাধিকারী হন। এখানে সম্পদের উত্তরাধিকারী অর্থে বলা হয়নি। কেননা, সুলায়মান (আ) ব্যতীত হযরত দাউদ (আ)-এর আরও অনেক পুত্র ছিলেন, তাদেরকে বাদ দিয়ে শুধু সুলায়মানের নামে সম্পদের উল্লেখ করার কোন অর্থ হয় না। তা ছাড়া সহীহ হাদীসে বিভিন্ন সূত্রে একদল সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ( لا نورث ماتركنا فهم صدقه ) অর্থাৎ আমরা উত্তরাধিকারী রেখে যাই না, আমরা যা কিছু রেখে যাই তা সাদকা। আমরা বলতে এখানে নবীদের জামাআত বুঝানো হয়েছে। এ বাক্যে রাসূলুল্লাহ (সা) মানুষকে জানিয়েছেন যে, নবীদের রেখে যাওয়া বৈষয়িক সম্পদের কেউ উত্তরাধিকারী হয় না, যেমন অন্যদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এর দাবীদার নয়, বরং তা সাদকা-দুস্থঃ ও গরীবদেরই প্রাপ্য। কেননা, দুনিয়ার সহায়-সম্পদ যেমন আল্লাহর নিকট তুচ্ছ ও নগণ্য, তেমনি তার মনোনীত নবীগণের নিকটও তা মূল্যহীন ও গুরুত্বহীন। হযরত সুলায়মানের উক্তি,

( یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ عُلِّمۡنَا مَنطِقَ ٱلطَّیۡرِ )

[Surah An-Naml 16]

—“হে মানুষ! আমাকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ হযরত সুলায়মান (আ) পাখীদের ভাষা বুঝতেন, তারা শব্দ করে কি বুঝাতে চায়, তিনি মানুষকে তার ব্যাখ্যা বলতেন। হাফিজ আবু বকর বায়হাকী.... আবু মালিক থেকে বর্ণনা করেন যে, একদিন সুলায়মান (আ) কোথাও যাচ্ছিলেন, পথে দেখেন একটা পুরুষ চড়ুই পাখী আর একটা স্ত্রী চড়ুই পাখীর পাশে ঘোরাঘুরি করছে। সুলায়মান (আ) তার সাথীদেরকে বললেন, ‘তোমরা বুঝেছ কি? চড়ুই পাখীটি কী বলছে?’ তারা বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! এরা কী বলছে?’ সুলায়মান (আ) বললেন, ‘সে তার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছে এবং বলছে তুমি আমাকে বিয়ে কর, তা হলে তোমাকে নিয়ে আমি দামিশকের প্রাসাদের যে কক্ষে চাও, সেখানে বসবাস করব।’ অতঃপর সুলায়মান (আ) এরূপ বলার কারণ ব্যাখ্যা করলেন যে, দামিশকের প্রাসাদ সমূহ শক্ত পাথর দ্বারা নির্মিত। তার মধ্যে কেউই বসবাস করতে পারে না, তবে বিবাহের প্রত্যেক প্রস্তাবকই মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে থাকে। ইবন আসাকির ... বায়হাকী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। চড়ুই ছাড়া অন্যান্য সকল জীব-জন্তু ও প্রাণীর ভাষাও তিনি বুঝতেন। এর প্রমাণ কুরআনের আয়াতঃ

( وَأُوتِینَا مِن كُلِّ شَیۡءٍ )

[Surah An-Naml 16]

অর্থাৎ আমাকে সকল জিনিসের জ্ঞান দান করা হয়েছে। যা একজন বাদশাহর জন্যে প্রয়োজন অর্থাৎ দ্রব্য সামগ্রী, অস্ত্র, আসবাব পত্র, সৈন্য-সামন্ত, জিন, ইনসান, বিহংগকুল, বন্য জন্তু, বিচরণকারী শয়তান, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বাক ও নির্বাক জীবের অন্তরের খবর জানা ইত্যাদি। এরপর আল্লাহ বলেছেন,

( إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡفَضۡلُ ٱلۡمُبِینُ )

[Surah An-Naml 16]

—নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। অর্থাৎ এ সবই সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা ও আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে দান। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

( وَحُشِرَ لِسُلَیۡمَـٰنَ جُنُودُهُۥ مِنَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِ وَٱلطَّیۡرِ فَهُمۡ یُوزَعُونَ ۝ حَتَّىٰۤ إِذَاۤ أَتَوۡا۟ عَلَىٰ وَادِ ٱلنَّمۡلِ قَالَتۡ نَمۡلَة یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّمۡلُ ٱدۡخُلُوا۟ مَسَـٰكِنَكُمۡ لَا یَحۡطِمَنَّكُمۡ سُلَیۡمَـٰنُ وَجُنُودُهُۥ وَهُمۡ لَا یَشۡعُرُونَ ۝ فَتَبَسَّمَ ضَاحِك ا مِّن قَوۡلِهَا وَقَالَ رَبِّ أَوۡزِعۡنِیۤ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِیۤ أَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَعَلَىٰ وَ  ٰ⁠ لِدَیَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَـٰلِح ا تَرۡضَىٰهُ وَأَدۡخِلۡنِی بِرَحۡمَتِكَ فِی عِبَادِكَ ٱلصَّـٰلِحِینَ )

[Surah An-Naml 17 - 19]

—সুলায়মানের সম্মুখে সমবেত করা হল তার বাহিনীকে— জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে এবং এগুলোকে বিন্যস্ত করা হল বিভিন্ন ব্যুহে। যখন ওরা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল তখন একটি পিঁপড়ে বলল, “হে পিপড়ের দল! তোমরা তোমাদের ঘরে প্রবেশ কর, যেন সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পদতলে পিষে না ফেলে।” তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হেসে বলল, “হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা কাশ করতে পারি। আমার প্রতি ও আমার পিতা মাতার প্রতি তুমি যে অনুগ্রহ করেছ, তার জন্যে এবং যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর এবং তোমার অনুগ্রহে আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শামিল কর।’ (২৭ নামলঃ ১৭-১৯)।

উপোরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাঁর বান্দা, নবী ও নবীপুত্র হযরত সুলায়মান ইবন দাউদ (আ) সম্পর্কে জানাচ্ছেন যে, একদা সুলায়মান তাঁর জিন, ইনসান ও পাখী বাহিনী নিয়ে অভিযানে রওয়ানা হন। জিন ও ইনসান তাঁর সাথে সাথে চলে, আর পাখীরা উপরে থেকে রৌদ্র ইত্যাদি হতে ছায়া দান করে। এই তিন বাহিনীর তদারকীরূপে নিযুক্ত ছিল একটি পর্যবেক্ষক দল। তারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতো। ফলে কেউ তার নিজ অবস্থান থেকে আগে যেতে পারতো না। আল্লাহ বলেনঃ

( حَتَّىٰۤ إِذَاۤ أَتَوۡا۟ عَلَىٰ وَادِ ٱلنَّمۡلِ قَالَتۡ نَمۡلَة یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّمۡلُ ٱدۡخُلُوا۟ مَسَـٰكِنَكُمۡ لَا یَحۡطِمَنَّكُمۡ سُلَیۡمَـٰنُ وَجُنُودُهُۥ وَهُمۡ لَا یَشۡعُرُونَ )

[Surah An-Naml 18]

অর্থাৎ, পিঁপড়েটি সুলায়মান ও তার বাহিনীর অজ্ঞাতসারে দুর্ঘটনার বিষয়ে পিঁপড়ের দলকে সাবধান করে দিল। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেছেন, উক্ত ঘটনায় সুলায়মান (আ) তাঁর আসনে আসীন অবস্থায় তায়েফের একটি উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন। ঐ পিঁপড়েটির নাম ছিল জারাস এবং তার গোত্রের নাম বানুশ শায়তান। সে ছিল খোড়া এবং আকৃতিতে নেকড়ে বাঘের মত। কিন্তু এর কোন কথাই সমর্থনযোগ্য নয়। বরং এই ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীতে ঘোড় সওয়ার অবস্থায় ছিলেন; আসনে আসীন ছিলেন না। কেননা যদি তাই হত তাহলে পিপড়ের কোন ভয় থাকতো না, তারা পদদলিত হত না। কারণ তখন আসনের উপরই তাঁর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস, সৈন্য বাহিনী, অশ্ব-উষ্ট্রী, যাবতীয় প্রয়োজনীয় পত্র, তাঁবু চতুস্পদ জন্তু, পাখী ইত্যাদি সব কিছুই থাকত। এ বিষয়ে সামনে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, পিঁপড়েটি তার দলবলকে বুদ্ধিমত্তার সাথে যে সঠিক নির্দেশ দিয়েছিল হযরত সুলায়মান (আ)-তা বুঝেছিলেন এবং আনন্দে মুচকি হেসেছিলেন। কেননা, আল্লাহ কেবল তাকেই এ বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, অন্য কাউকে করেননি। কিন্তু কতিপয় মূর্খ লোক বলেছে যে, সুলায়মান (আ)-এর পূর্বে জীব-জন্তুর বাকশক্তি ছিল এবং মানুষের সাথে তারা কথা বলত। নবী হযরত সুলায়মান তাদের কথা বলা বন্ধ করে দেন, তাদের থেকে অংগীকার আদায় করেন এবং তাদের মুখে লাগাম পরিয়ে দেন। এরপর থেকে তারা আর মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না। কিন্তু এরূপ কথা কেবল অজ্ঞরাই বলতে পারে। ঘটনা যদি এ রকমই হত তাহলে সুলায়মান (আ)-এর জন্যে এটা কোন বৈশিষ্ট্য হত না এবং অন্যদের তুলনায় তাঁর মাহাত্ম রূপে গণ্য হবে না। কেননা তাহলে তো সকল মানুষই জীব-জন্তর কথা বুঝতো। আর যদি তিনি অন্যদের সাথে কথা না বলার অংগীকার নিয়ে থাকেন এবং কেবল নিজেই বুঝবার পথ করে থাকেন, তাহলে এরূপ বন্ধ রাখার মধ্যেও কোন মাহাত্ম্য নেই। তাই তিনি আরয করলেনঃ

( رَبِّ أَوۡزِعۡنِیۤ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِیۤ أَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَعَلَىٰ وَ  ٰ⁠ لِدَیَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَـٰلِح ا تَرۡضَىٰهُ وَأَدۡخِلۡنِی بِرَحۡمَتِكَ فِی عِبَادِكَ ٱلصَّـٰلِحِینَ )

[Surah An-Naml 19]

অর্থাৎ, হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকর্ম করতে পারি এবং আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর। ( أَوۡزِعۡنِیۤ ) অর্থ ( ار شدنى الهمنى ) আমার অন্তরে প্রেরণা জাগিয়ে দিন এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। নবী আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছেন তিনি যেন তাকে সেইসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তওফীক দেন, যা তিনি তাকে দান করেছেন এবং যে সব বিষয়ে অন্যদের উপর তাঁকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি সৎকর্ম করার তওফীক কামনা করছেন এবং মৃত্যুর পরে নেক বান্দাদের সাথে তাঁর হাশর যাতে হয় সেই প্রার্থনাও জানিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর এ প্রার্থনা কবুলও করেছেন। হযরত সুলায়মান (আ)-এর মাতা ছিলেন একজন ইবাদতকারী সৎকর্মশীল মহিলা। যেমন সুনায়দ ইবন দাউদ... জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেন, সুলায়মান ইব্‌ন দাউদের মাতা বলেছিলেন, “হে প্রিয় বৎস! রাত্রে অধিক ঘুমিয়ো না, কেননা এ অভ্যাস মানুষকে কিয়ামতের দিন নিঃস্ব-দরিদ্র করে উঠাবে।” ইবন মাজাহ তার চারজন উস্তাদ সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

আবদুর রাযযাক মা'মারের সূত্রে যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ সুলায়মান ইবন দাউদ (আ) ও তাঁর সৈন্য বাহিনী একদা ইসতিসকা নামায (বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনার নামায) আদায় করার জন্য বের হন। পথে দেখলেন, একটি পিপড়ে তার একটা পা উপরের দিকে উঠিয়ে বৃষ্টি কামনা করছে। এ দৃশ্য দেখে সুলায়মান (আ) সৈন্যদেরকে বললেন, “তোমরা ফিরে চল! তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কেননা এই পিপড়েটি আল্লাহর কাছে বৃষ্টি কামনা করছে। এবং তার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছে।” ইব্‌ন আসাকির লিখেছেন, এ হাদীছ মারফু সনদেও বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর আবদুর রাযযাক মুহাম্মদ ইবন আযীযের সূত্রে ... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেনঃ আল্লাহর এক নবী একবার আল্লাহর কাছে বৃষ্টি কামনার উদ্দেশ্যে লোকজন সাথে নিয়ে বের হয়েছিলেন। পথে তারা দেখতে পান যে, একটি পিপড়ে আকাশের দিকে তার একটি পা উঠিয়ে বৃষ্টি কামনা করছে। অতঃপর ঐ নবী তাঁর সংগীদেরকে বললেন, ‘তোমরা ফিরে চল; কেননা এ পিপড়েটির ওসীলায় তোমাদের জন্যেও বৃষ্টি মঞ্জর হয়েছে।’ সুদ্দীর বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, চলার পথে তারা দেখলেন একটি পিপড়ে দু-পায়ে দাঁড়িয়ে এবং দু-হাত মেলে এই দোয়া করছে, ‘হে আল্লাহ! আমরা আপনারই সৃষ্টিকূলের মধ্যে একটি সৃষ্টি। আপনার অনুগ্রহ থেকে আমরা নিরাশ হইনি।’ অতঃপর আল্লাহ তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আল্লাহর বাণীঃ

( وَتَفَقَّدَ ٱلطَّیۡرَ فَقَالَ مَا لِیَ لَاۤ أَرَى ٱلۡهُدۡهُدَ أَمۡ كَانَ مِنَ ٱلۡغَاۤىِٕبِینَ ۝ لَأُعَذِّبَنَّهُۥ عَذَاب ا شَدِیدًا أَوۡ لَأَا۟ذۡبَحَنَّهُۥۤ أَوۡ لَیَأۡتِیَنِّی بِسُلۡطَـٰن مُّبِین ۝ فَمَكَثَ غَیۡرَ بَعِید فَقَالَ أَحَطتُ بِمَا لَمۡ تُحِطۡ بِهِۦ وَجِئۡتُكَ مِن سَبَإِۭ بِنَبَإ یَقِینٍ ۝ إِنِّی وَجَدتُّ ٱمۡرَأَة تَمۡلِكُهُمۡ وَأُوتِیَتۡ مِن كُلِّ شَیۡء وَلَهَا عَرۡشٌ عَظِیم ۝ وَجَدتُّهَا وَقَوۡمَهَا یَسۡجُدُونَ لِلشَّمۡسِ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَزَیَّنَ لَهُمُ ٱلشَّیۡطَـٰنُ أَعۡمَـٰلَهُمۡ فَصَدَّهُمۡ عَنِ ٱلسَّبِیلِ فَهُمۡ لَا یَهۡتَدُونَ ۝ أَلَّا یَسۡجُدُوا۟ لِلَّهِ ٱلَّذِی یُخۡرِجُ ٱلۡخَبۡءَ فِی ٱلسَّمَـٰوَ  ٰ⁠ تِ وَٱلۡأَرۡضِ وَیَعۡلَمُ مَا تُخۡفُونَ وَمَا تُعۡلِنُونَ ۝ ٱللَّهُ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِیمِ ۩ ۝ ۞ قَالَ سَنَنظُرُ أَصَدَقۡتَ أَمۡ كُنتَ مِنَ ٱلۡكَـٰذِبِینَ ۝ ٱذۡهَب بِّكِتَـٰبِی هَـٰذَا فَأَلۡقِهۡ إِلَیۡهِمۡ ثُمَّ تَوَلَّ عَنۡهُمۡ فَٱنظُرۡ مَاذَا یَرۡجِعُونَ ۝ قَالَتۡ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَؤُا۟ إِنِّیۤ أُلۡقِیَ إِلَیَّ كِتَـٰب كَرِیمٌ ۝ إِنَّهُۥ مِن سُلَیۡمَـٰنَ وَإِنَّهُۥ بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ ۝ أَلَّا تَعۡلُوا۟ عَلَیَّ وَأۡتُونِی مُسۡلِمِینَ ۝ قَالَتۡ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَؤُا۟ أَفۡتُونِی فِیۤ أَمۡرِی مَا كُنتُ قَاطِعَةً أَمۡرًا حَتَّىٰ تَشۡهَدُونِ ۝ قَالُوا۟ نَحۡنُ أُو۟لُوا۟ قُوَّة وَأُو۟لُوا۟ بَأۡس شَدِید وَٱلۡأَمۡرُ إِلَیۡكِ فَٱنظُرِی مَاذَا تَأۡمُرِینَ ۝ قَالَتۡ إِنَّ ٱلۡمُلُوكَ إِذَا دَخَلُوا۟ قَرۡیَةً أَفۡسَدُوهَا وَجَعَلُوۤا۟ أَعِزَّةَ أَهۡلِهَاۤ أَذِلَّة ۚ وَكَذَ  ٰ⁠ لِكَ یَفۡعَلُونَ ۝ وَإِنِّی مُرۡسِلَةٌ إِلَیۡهِم بِهَدِیَّة فَنَاظِرَةُۢ بِمَ یَرۡجِعُ ٱلۡمُرۡسَلُونَ۝فَلَمَّا جَاۤءَ سُلَیۡمَـٰنَ قَالَ أَتُمِدُّونَنِ بِمَال فَمَاۤ ءَاتَىٰنِۦَ ٱللَّهُ خَیۡر مِّمَّاۤ ءَاتَىٰكُمۚ بَلۡ أَنتُم بِهَدِیَّتِكُمۡ تَفۡرَحُونَ ۝ ٱرۡجِعۡ إِلَیۡهِمۡ فَلَنَأۡتِیَنَّهُم بِجُنُود لَّا قِبَلَ لَهُم بِهَا وَلَنُخۡرِجَنَّهُم مِّنۡهَاۤ أَذِلَّة وَهُمۡ صَـٰغِرُونَ )

[Surah An-Naml 20 - 37]

অর্থাৎ, সুলায়মান পক্ষীকুলের সন্ধান নিল এবং বলল, “ব্যাপার কি, হুদহুদকে দেখছি না যে! সে অনুপস্থিত না কি? সে উপযুক্ত কারণ না দর্শালে আমি অবশ্য ওকে কঠিন শাস্তি দিব অথবা যবেহ করব।” কিছুকালের মধ্যেই হুদহুদ এসে পড়ল এবং বলল, “আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি এবং ‘সাবা’ থেকে সুনিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখলাম তাদের উপর রাজত্ব করছে। তাকে সকল কিছু হতে দেয়া হয়েছে এবং তার আছে এক বিরাট সিংহাসন। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান ওদের কার্যাবলী ওদের নিকট শোভন করেছে এবং ওদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে: ফলে তারা সৎপথ পায় না; নিবৃত্ত করেছে এ জন্যে যে, ওরা যেন সিজদা না করে আল্লাহকে, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর লুক্কায়িত বস্তুকে প্রকাশ করেন, যিনি জানেন, যা তোমরা গোপন কর এবং যা তোমরা ব্যক্ত কর। আল্লাহ্’ তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের অধিপতি।” সুলায়মান বলল, “আমি দেখব, তুমি কি সত্য বলেছ, না তুমি মিথ্যাবাদী? তুমি যাও আমার এ পত্র নিয়ে এবং এটা তাদের নিকট অর্পণ কর; এরপর তাদের নিকট হতে সরে থেকো এবং লক্ষ্য করো তাদের প্রতিক্রিয়া কী?” সেই নারী বলল, “হে পারিষদবর্গ! আমাকে এক সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে; এটা সুলায়মানের নিকট হতে এবং তা এই— দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে, অহমিকা বশে আমাকে অমান্য করো না, এবং আনুগত্য স্বীকার করে আমার নিকট উপস্থিত হও।” সেই নারী বলল, “হে পারিষদবর্গ! আমার এ সমস্যায় তোমাদের অভিমত দাও। আমি কোন ব্যাপারে একান্ত সিদ্ধান্ত করি না তোমাদের উপস্থিতি ব্যতীত।” ওরা বলল, “আমরা তো শক্তিশালী ও কঠোর যোদ্ধা; তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই, কী আদেশ করবেন তা আপনি ভেবে দেখুন।" সে বলল, “রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদেরকে অপদস্থ করে; এরাও এরূপই করবে; আমি তাদের নিকট উপটৌকন পাঠাচ্ছি; দেখি দূতরা কী নিয়ে ফিরে আসে।” দূত সুলায়মানের নিকট আসলে সুলায়মান বলল, “তোমরা কি আমাকে ধন-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করছ? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমরা যা দিয়েছ হতে উৎকৃষ্ট অথচ তোমরা তোমাদের উপটৌকন নিয়ে উৎফুল্ল বোধ করছ। ওদের নিকট ফিরে যাও, আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসব এক সৈন্যবাহিনী, যার মুকাবিলা করার শক্তি ওদের নেই। আমি অবশ্যই ওদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করব লাঞ্চিতভাবে এবং ওরা হবে অবনমিত।” (২৭ঃ ২০-৩৭)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ হযরত সুলায়মান (আ) ও হুদহুদ পাখীর ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সফরকালে প্রত্যেক শ্রেণীর পাখীদের থেকে কিছু সংখ্যক সম্মুখভাগে থাকত। তারা সময় মত তাঁর নিকট উপস্থিত হত এবং তাদের থেকে তিনি প্রয়োজনীয় সংবাদ জেনে নিতেন। তারা পালাক্রমে তার কাছে নামত-যেমনটি সেনাবাহিনী রাজা-বাদশাহর সাথে করে থাকে, পাখীর দায়িত্ব সম্পর্কে হযরত ইবন আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেন, কোন শূন্য প্রান্তর অতিক্রমকালে সুলায়মান (আ) ও তাঁর সংগীরা যদি পানির অভাবে পড়তেন, তাহলে সে স্থানে পানি কোথায় আছে, হুদহুদ আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তার সন্ধান দিত। মাটি নীচে কোন স্তরে পানি আছে। হুদহুদ তা বলে দিতে পারত। সুতরাং যেখানে পানি আছে বলে সে নির্দেশ করত, সেখানকার মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে পানি উত্তোলন করা হত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহৃত হতো। একদা সুলায়মান (আ) সফরকালে হুদহুদের সন্ধান করেন, কিন্তু তাকে তার কর্মস্থলে উপস্থিত পেলেন না। তখন তিনি বললেনঃ

( مَا لِیَ لَاۤ أَرَى ٱلۡهُدۡهُدَ أَمۡ كَانَ مِنَ ٱلۡغَاۤىِٕبِینَ )

[Surah An-Naml 20]

অর্থাৎ, ব্যাপার কি, হুদহুদকে দেখছি না যে! সে অনুপস্থিত না কি? অর্থাৎ হুদহুদের হল কি, সে কি এ দলের মধ্যেই নেই। না কি আমার দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে?

( لَأُعَذِّبَنَّهُۥ عَذَاب ا شَدِیدًا )

[Surah An-Naml 21]

–আমি অবশ্যই তাকে কঠিন শাস্তি দিব। হুদহুদকে তিনি কোন কঠিন শাস্তি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। শাস্তির প্রকার সম্পর্কে মুফাসসিরগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন; অথবা আমি তাকে যবেহ করব, অথবা সে আমার নিকট উপযুক্ত কারণ দর্শাবে। অর্থাৎ এমন যুক্তিপূর্ণ কারণ দর্শাতে হবে যা তাকে এ বিপদ থেকে রক্ষার উপযুক্ত হয়।

অল্পক্ষণের মধ্যে হুদহুদ এসে পড়ল, অর্থাৎ হুদহুদ বেশী দেরী না করেই চলে আসল এবং সুলায়মান (আ)-কে বলল, “আপনি যা অবগত নন আমি তা অবগত হয়েছি।" অর্থাৎ আমি এমন বিষয়ের সন্ধান পেয়েছি যার সন্ধান আপনি জানেন না। এবং ‘সাবা’ থেকে সুনিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি। অর্থাৎ সত্য সংবাদ। “আমি এক নারীকে দেখলাম তাদের উপর রাজত্ব করছে। তাকে সবকিছু থেকে দেয়া হয়েছে এবং তার আছে এক বিরাট সিংহাসন।” এখানে ইয়ামানের সাবা রাজন্যবর্গের অবস্থা, শান-শওকত ও রাজত্বের বিশালতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুলায়মান (আ)-এর যুগের সাবার রাজার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তার কন্যার উপর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব ভার অর্পিত হয়।

ছা'লাবীসহ অন্যান্য ইতিহাসবিদ লিখেছেন, বিলকীসের পিতার মৃত্যুর পর তার সম্প্রদায়ের লোকেরা একজন পুরুষ লোককে তাদের রাজা মনোনীত করে। কিন্তু তার অযোগ্যতার কারণে রাজ্যের সর্বত্র বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে। বিলকীস তখন কৌশলে সে রাজার কাছে নিজের বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। ফলে রাজা তাঁকে বিবাহ করেন। বিলকীস স্বামী-গৃহে গিয়ে স্বামীকে মদ্য পান করতে দেন। রাজা যখন মদ পান করে মাতাল অবস্থায় ছিল তখন বিলকীস তার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দরজার উপর লটকিয়ে দেন। জনগণ সেখানে উপস্থিত হয়ে এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে বিলকীসকে সিংহাসনে বসায় এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বিলকীসের বংশপঞ্জি নিম্নরূপঃ বিলকীস বিনত সীরাহ (ইনি হুদহাদ ( هدهاد ) নামে পরিচিত, আবার কেউ কেউ একে শারাহীলও বলেছেন।) ইবন যীজাদান ইবন সীরাহ ইবন হারছ ইবন কায়স ইবন সায়ফী ইব্‌ন সাবা ইবন ইয়াশজাব ইবন ইয়ারাব ইবন কাহতান। বিলকীসের পিতা ছিলেন একজন বিখ্যাত রাজা। তিনি ইয়ামানের কোন নারীকে বিবাহ করতে অস্বীকৃতি জানান। কথিত আছে, তিনি একজন জিন মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। তার নাম ছিল রায়হানা বিনত সাকান। তার গর্ভে একটি মেয়ের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় তালকামা। ইনিই বিলকীস নামে অভিহিত হন।

ছালাবী ...... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ বিলকীসের পিতা-মাতার একজন ছিল জিন। হাদীসটি গরীব পর্যায়ের এবং এর সনদ দুর্বল। ছালাবী ......... আবু বাকরা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, এক দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দরবারে বিলকীসের প্রসংগ নিয়ে আলোচনা উঠলে তিনি বললেনঃ ঐ জাতির কোন মংগল নেই, যারা তাদের কর্তৃত্ব কোন নারীর হাতে তুলে দেয়। এ হাদীসের এক রাবী ইসমাঈল ইবন মুসলিম আল-মাক্কী দুর্বল। ইমাম বুখারী (র) 'আওফ হাসানের মাধ্যমে আবূ বাকরা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যখন এ সংবাদ পৌঁছল যে, পারস্যবাসীরা পারস্য সম্রাটের কন্যাকে তাদের সম্রাজ্ঞী বানিয়েছে, তখন তিনি বলেছিলেনঃ ঐ জাতির কল্যাণ হবে না যারা তাদের নেতৃত্ব কোন নারীর উপর ন্যাস্ত করে ( لن يفلح قوم واوا امرهم امرءة ) ইমাম তিরমিযী এবং নাসাঈও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী একে হাসান সহীহ পর্যায়ের বলে মন্তব্য করেছেন। আল্লাহর বাণীঃ “তাকে সবকিছু থেকে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাদশাহর জন্যে যা কিছু প্রয়োজন তা তাঁকে দেয়া হয়েছিল। “এবং তার ছিল বিরাট সিংহাসন।” অর্থাৎ বিলকীসের সিংহাসন ছিল স্বর্ণ, মনি-মুক্তা খচিত ও বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান ও উজ্জ্বল ধাতু দ্বারা সু-সজ্জিত। এরপর আল্লাহ তা'আলা তাদের কুফরী, অবাধ্যতা, গোমরাহী, সূর্য-পূজা এবং শয়তান কর্তৃক পথভ্রষ্ট হওয়া এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে রাখার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ আল্লাহ তো ঐ সত্তা যিনি আসমান ও যমীনের গোপনীয় বিষয়কে প্রকাশ করেন এবং তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন।

আল্লাহর বাণীঃ

( ٱللَّهُ لَاۤ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِیمِ )

[Surah An-Naml 26]

—আল্লাহ- তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের অধিপতি। অর্থাৎ আল্লাহর এত বড় বিশাল আরশ রয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টি জগতে এর চেয়ে বড় আর কিছুই নেই। যা হোক, এ সময় হযরত সুলায়মান (আ) হুদহুদ পাখীর নিকট একটি পত্র দিয়ে বিলকীসের নিকট পাঠান। চিঠিতে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের প্রতি আহ্বান জানান এবং বশ্যতা স্বীকার করে তাঁর কর্তৃত্ব ও রাজত্বের প্রতি আনুগত্য দেখানোর নির্দেশ দেন। এ আহ্বান ছিল বিলকীসের অধীনস্ত সকল প্রজাদের প্রতিও। তাই তিনি লেখেনঃ “অহমিকা বশে আমাকে অমান্য করো না।” অর্থাৎ আমার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান ও নির্দেশ অমান্য করো না। “এবং আনুগত্য স্বীকার করে আমার নিকট উপস্থিত হও।” এ কথা তোমাকে দ্বিতীয়বার বলা হবে না এবং কোন রকম অনুরোধও করা হবে না। অতঃপর হুদহুদ বিলকীসের নিকট চিঠি নিয়ে আসে। এ ঘটনার পর থেকে মানুষ চিঠির আদান-প্রদান করতে শিখে। কিন্তু সেই অনুগত, বিনয়ী বিচক্ষণ পাখীর আনীত চিঠির মূল্যের সাথে কি আর কোন চিঠির তুলনা করা চলে। বেশ কিছু মুফাসসির ও ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, হুদহুদ পাখী ঐ চিঠি নিয়ে বিলকীসের রাজপ্রাসাদে তার কক্ষে প্রবেশ করে এবং তার সামনে চিঠিটি রেখে দিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে যে, বিলকীস এর কি উত্তর দেন। বিলকীস তার মন্ত্রীবর্গ, পারিষদবর্গ ও অমাত্যদের এক জরুরী পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। “রাণী বিলকীস বলল, হে পারিষদবর্গ! আমাকে একটি সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে।” তারপর তিনি চিঠির শিরোনাম পড়লেন যে, “এটা সুলায়মানের পক্ষ থেকে এবং তা এই অসীম দাতা, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু। আমার মুকাবিলায় শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও।”

অতঃপর রাণী সভাসদবর্গের সাথে পরামর্শে বসেন, সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। সৌজন্য ও ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ “হে পারিষদবর্গ! আমার এই সমস্যায় তোমাদের অভিমত দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।” অর্থাৎ তোমাদের উপস্থিতি ও পরামর্শ ব্যতীত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি একা কখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না। তারা বলল, ‘আমরা শক্তিশালী ও কঠোর যোদ্ধা, এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। অতএব, আপনি ভেবে দেখুন, আমাদেরকে কি আদেশ করবেন।” অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাইল, আমরা দৈহিকভাবে, প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে এবং সমরাস্ত্রে শক্তিশালী, যুদ্ধে কঠোর ও অটল, রণাঙ্গণে শৌর্যবীর্যশালী বীরদের মুকাবিলা করতে সক্ষম। অতএব, আপনি যদি মুকাবিলা করতে চান তবে আমরা তাতে সক্ষম। এভাবে তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব রাণীর উপর ন্যস্ত করে, যাতে রাণী তার নিজের ও জনগণের জন্যে যেটা মংগলজনক ও সঠিক মনে করেন, সেই পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। ফলে দেখা গেল, রাণী যে সিদ্ধান্ত দিলেন, সেটাই ছিল সঠিক ও যথার্থ! তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই চিঠির প্রেরককে পরাভূত করা যাবে না, তার বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। তার প্রতিরোধ করা যাবে না এবং তাকে ধোঁকা দেওয়াও সম্ভব হবে না। রাণী বললেনঃ “রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে অপদস্থ করে। তারাও এরূপই করবে।” রাণী যথার্থ মতামতই ব্যক্ত করেছিলেন যে, এই বাদশাহ যদি আমাদের এ দেশ আক্রমণ করেন ও বিজয়ী হন তাহলে এর দায়-দায়িত্ব আমার উপরই বর্তাবে এবং সমস্ত ক্রোধ, হামলা ও প্রবল চাপ আমার উপরই আসবে। “আমি তাদের নিকট কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছি, দেখি প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব আনে।"

বিলকীস চেয়েছিলেন তার নিজের পক্ষ থেকে ও জনগণের পক্ষ থেকে সুলায়মান (আ)-এর নিকট উপঢৌকন পাঠাতে। তারপর তিনি তা পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার জানা ছিল না যে, আল্লাহর নবী হযরত সুলায়মান (আ) তা গ্রহণ করবেন না। কেননা রাণীর জনগণ ছিল কাফির। আর নবী ও তাঁর সৈন্যবাহিনী এই কাফির গোষ্ঠীকে পরাভূত করতে সক্ষম ছিলেন। তাই যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বলল, “তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক।” রাণী বিলকীস যে উপঢৌকন সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল পরিমাণে প্রচুর এবং মহা মূল্যবান দ্রব্য সম্ভার। মুফাসসিরীনে কিরাম এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। অতঃপর সুলায়মান (আ) দরবারে উপস্থিত লোকজনের সম্মুখে উপঢৌকন বহনকারী দূত ও প্রতিনিধি দলকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে এমন এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসব, যার মুকাবিলা করার শক্তি তাদের নেই। আমি অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত।” দূতকে বলা হচ্ছে যে, যেসব উপঢৌকন আমার কাছে এনেছ তা নিয়ে তুমি ফিরে যাও। কেননা, আল্লাহ আমাকে যে ধন-সম্পদ নিয়ামত হিসেবে দান করেছেন, তা এ উপটৌকন যা নিয়ে তোমরা গৌরব ও অহংকারবোধ করছো, তার তুলনায় অনেক বেশী এবং উৎকৃষ্ট। “আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে নিয়ে আসব এক সৈন্য বাহিনী, যার মুকাবিলার শক্তি ওদের নেই।” অর্থাৎ আমি তাদের বিরুদ্ধে এমন সেনাদল পাঠাব যাদেরকে প্রতিহত করার, প্রতিরোধ গড়ে তোলার ও যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং আমি তাদেরকে তাদের বাড়ি-ঘর, শহর, তাদের লেনদেন ও দেশ থেকে অপদস্থ করে বহিষ্কার করব। “এবং ওরা হবে লাঞ্ছিত।” অর্থাৎ তারা হবে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ঘৃণিত।

রাণী বিলকীসের রাজ্যের জনগণ যখন সুলায়মান (আ)-এর ঘোষণা জানতে পারল। তখন নবীর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। সুতরাং তারা সেই মুহূর্তে নবীর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে রাণীর নিকট এসে সমবেত হল ও বিনয়ের সাথে তাঁর আনুগত্য করে যাওয়ার অংগীকার ব্যক্ত করল। সুলায়মান (আ) যখন তাদের আগমনের ও প্রতিনিধি দল প্রেরণের সংবাদ শুনলেন তখন তার অনুগত এক জিনকে বললেনঃ

( قَالَ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡمَلَؤُا۟ أَیُّكُمۡ یَأۡتِینِی بِعَرۡشِهَا قَبۡلَ أَن یَأۡتُونِی مُسۡلِمِینَ ۝ قَالَ عِفۡرِیت مِّنَ ٱلۡجِنِّ أَنَا۠ ءَاتِیكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن تَقُومَ مِن مَّقَامِكَۖ وَإِنِّی عَلَیۡهِ لَقَوِیٌّ أَمِین ۝ قَالَ ٱلَّذِی عِندَهُۥ عِلۡم مِّنَ ٱلۡكِتَـٰبِ أَنَا۠ ءَاتِیكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن یَرۡتَدَّ إِلَیۡكَ طَرۡفُكَۚ فَلَمَّا رَءَاهُ مُسۡتَقِرًّا عِندَهُۥ قَالَ هَـٰذَا مِن فَضۡلِ رَبِّی لِیَبۡلُوَنِیۤ ءَأَشۡكُرُ أَمۡ أَكۡفُرُۖ وَمَن شَكَرَ فَإِنَّمَا یَشۡكُرُ لِنَفۡسِهِۦۖ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّی غَنِیّ كَرِیم ۝ قَالَ نَكِّرُوا۟ لَهَا عَرۡشَهَا نَنظُرۡ أَتَهۡتَدِیۤ أَمۡ تَكُونُ مِنَ ٱلَّذِینَ لَا یَهۡتَدُونَ ۝ فَلَمَّا جَاۤءَتۡ قِیلَ أَهَـٰكَذَا عَرۡشُكِۖ قَالَتۡ كَأَنَّهُۥ هُوَۚ وَأُوتِینَا ٱلۡعِلۡمَ مِن قَبۡلِهَا وَكُنَّا مُسۡلِمِینَ ۝ وَصَدَّهَا مَا كَانَت تَّعۡبُدُ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ إِنَّهَا كَانَتۡ مِن قَوۡم كَـٰفِرِینَ ۝ قِیلَ لَهَا ٱدۡخُلِی ٱلصَّرۡحَۖ فَلَمَّا رَأَتۡهُ حَسِبَتۡهُ لُجَّة وَكَشَفَتۡ عَن سَاقَیۡهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ صَرۡح مُّمَرَّد مِّن قَوَارِیرَۗ قَالَتۡ رَبِّ إِنِّی ظَلَمۡتُ نَفۡسِی وَأَسۡلَمۡتُ مَعَ سُلَیۡمَـٰنَ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ )

[Surah An-Naml 38 - 44]

—সুলায়মান আরো বলল, ‘হে আমার পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার নিকট আসার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার নিকট নিয়ে আসবে?’ এক শক্তিশালী জিন বলল, “আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান, বিশ্বস্ত।” কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, “আপনি চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দিব।” সুলায়মান যখন তা সম্মুখে রক্ষিত অবস্থায় দেখল তখন সে বলল, ‘এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ না অকৃতজ্ঞ।’ যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজের কল্যাণের জন্যে এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে, আমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, মহানুভব। সুলায়মান বলল, ‘তার সিংহাসনের আকৃতি অপরিচিত করে বদলিয়ে দাও; দেখি সে সঠিক দিশা পায় না সে বিভ্রান্তদের শমিল হয়? সেই নারী যখন আসল ও তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, “তোমার সিংহাসন কি এরূপই?” সে বলল, ‘এতো যেন তাই!’ আমাদেরকে ইতি পূর্বেই প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আত্মসমর্পণও করেছি। আল্লাহর পরিবর্তে সে যার পূজা করত, তা-ই তাকে সত্য হতে নিবৃত্ত করেছিল, সে ছিল কাফির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তাকে বলা হল, এই প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তা দেখল তখন সে ওটাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং সে তার পদদ্বয় (পায়ের গোছা) অনাবৃত করল; সুলায়মান বলল, ‘এতো স্বচ্ছ স্ফটিক খণ্ডিত প্রাসাদ।’ সেই নারী বলল, “হে আমার প্রতিপালক! আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম। আমি সুলায়মানের সহিত জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি।” (২৭ নামলঃ ৩৮-৪৪)

রাণী বিলকীস যে সিংহাসনের উপর বসে রাজ্য পরিচালনা করতেন, ঐ সিংহাসনটি বিলকীসের আগমনের পূর্বেই সুলায়মান (আ)-এর দরবারে হাজির করার জন্যে তিনি যখন জিনদেরকে আহ্বান করেন তখন এক শক্তিশালী জিন্ বললঃ

( قَالَ عِفۡرِیت مِّنَ ٱلۡجِنِّ أَنَا۠ ءَاتِیكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن تَقُومَ مِن مَّقَامِكَ )

[Surah An-Naml 39]

“আপনি আপনার স্থান থেকে উঠবার পূর্বেই আমি তা এনে দেব।”

অর্থাৎ আপনার মজলিস শেষ হবার পূর্বেই আমি তা হাজির করে দেব। কথিত আছে, সুলায়মান (আ) বনী-ইসরাঈলের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে দিনের প্রথম থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত মজলিস করতেন।

وَإِنِّی عَلَیۡهِ لَقَوِیٌّ أَمِین

“এবং এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান, বিশ্বস্ত।” অর্থাৎ উক্ত সিংহাসন আপনার কাছে উপস্থিত করে দিতে আমি সক্ষম এবং তাতে যে সব মূল্যবান মনি-মুক্তা রয়েছে তা যথাযথভাবে আপনার কাছে বুঝিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমি বিশ্বস্ততার পরিচয় দেব।

( قَالَ ٱلَّذِی عِندَهُۥ عِلۡم مِّنَ ٱلۡكِتَـٰبِ )

[Surah An-Naml 40]

–“কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল।” এই উক্তিকারীর নাম আসফ ইবন বারাখইয়া বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে। ইনি ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ)-এর খালাত ভাই। কেউ কেউ বলেন, ইনি ছিলেন একজন মু'মিন জিন্। কথিত আছে যে, ইসমে আজম এই জিনের কণ্ঠস্থ ছিল। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এই ব্যক্তি ছিলেন বনী-ইসরাঈলের একজন বিখ্যাত আলিম। কেউ কেউ বলেছেন, ইনি স্বয়ং হযরত সুলায়মান (আ)। কিন্তু এ মতটি অত্যন্ত দুর্বল। সুহায়লী এ মতকে দুর্বল আখ্যায়িত করে বলেন যে, বাক্যের পূর্বাপর এ কথাকে আদৌ সমর্থন করে না। চতুর্থ আরও একটি মত আছে যে, তিনি হযরত জিবরাঈল (আ)।

“আপনি চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব।” এ কথার ব্যাখ্যায় বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন যেমনঃ (১) যমীনের উপরে আপনার দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত একজন লোকের যেতে ও ফিরে আসতে যত সময় লাগবে, এই সময়ের পূর্বে আমি নিয়ে আসব; (২) দৃষ্টি সীমার মধ্যে সবচেয়ে দূরবর্তী একটি লোকের হেঁটে এসে আপনার কাছে পৌঁছতে যে সময় লাগবে, এই সময়ের পূর্বে; (৩) আপনি পলক বিহীন একটানা দৃষ্টিপাত করতে থাকলে চক্ষু ক্লান্ত হয়ে যখন চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসবে তার পূর্বে; (৪) আপনি সম্মুখপানে সর্ব দূরে দৃষ্টিপাত করে পুনরায় দৃষ্টি নিজের কাছে ফিরিয়ে এনে চক্ষু বন্ধ করার পূর্বে। উল্লেখিত মতামতের মধ্যে এই সর্বশেষ মতটি অধিক যথার্থ বলে মনে হয়। “সুলায়মান যখন তা' সম্মুখে রক্ষিত অবস্থায় দেখলেন" অর্থাৎ হযরত সুলায়মান (আ) বিলকীসের সিংহাসনকে যখন চোখের পলকের মধ্যে সুদূর ইয়ামান থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত দেখতে পেলেন, “তখন সে বলল, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ, না অকৃতজ্ঞ।” অর্থাৎ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার প্রতি অনুগ্রহ বিশেষ। আর বান্দাহর উপর তার অনুগ্রহের উদ্দেশ্য হল তাকে পরীক্ষা করা যে, সে এ অনুগ্রহ পেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, না অকৃতজ্ঞ হয়। “যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তা করে নিজের কল্যাণের জন্যে।” অর্থাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শুভ ফল তারই কাছে ফিরে আসে। “এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে, আমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, মহানুভব।” অর্থাৎ আল্লাহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীর কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন এবং অকৃতজ্ঞদের অকৃতজ্ঞতায় তার কোনই ক্ষতি নেই।

অতঃপর সুলায়মান (আ) বিলকীসের এ সিংহাসনের কারুকার্য পরিবর্তন করে দিতে ও আকৃতি বদলিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল, এর দ্বারা বিলকীসের জ্ঞান-বুদ্ধি পরীক্ষা করা। তাই তিনি বললেনঃ “দেখি, সে সঠিক দিশা পায় নাকি সে বিভ্রান্তদের শামিল হয়?” সে নারী যখন আসল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘তোমার সিংহাসন কি এরূপই?’ সে বলল, “এটা তো যেন তাই।” অর্থাৎ এটা ছিল তার বুদ্ধিমত্তা ও গভীর জ্ঞানের পরিচয়। কারণ এ সিংহাসন তার না হয়ে অন্যের হওয়া তার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। কেননা, এটা সে-ই নির্মাণ করিয়েছে এবং দীর্ঘ দিন একে ইয়ামানে প্রত্যক্ষ করেছে, তার ধারণা ছিল না যে, এ ধরনের আশ্চর্য কারুকার্য খচিত মূল্যবান সিংহাসন অন্য কেউ বানাতে পারে।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা সুলায়মান (আ) ও তার সম্প্রদায়ের সংবাদ দিয়ে বলছেনঃ “আমাদেরকে ইতিপূর্বেই প্রকৃত জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং আমরা আত্মসমর্পণও করেছি। আল্লাহর পরিবর্তে সে যার পূজা করত তাই তাকে সত্য থেকে নিবৃত্ত করেছিল, সে ছিল কাফির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।” অর্থাৎ বিলকীস ও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা পূর্ব-পুরুষদের অন্ধ অনুকরণে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের পূজা করত। এই সূর্য-পূজাই তাদেরকে আল্লাহর সত্য পথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। অথচ সূর্য পূজার পক্ষে তাদের কাছে কোন দলীল-প্রমাণ কিছুই ছিল না। হযরত সুলায়মান (আ) জিনদের দ্বারা একটি কাচের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। প্রাসাদে যাওয়ার পথে তিনি একটি গভীর জলাশয় তৈরি করেন। জলাশয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী ছাড়েন। তারপর জলাশয়ের উপরে ছাদস্বরূপ স্বচ্ছ কাচের আবরণ নির্মাণ করেন। তারপর হযরত সুলায়মান তার সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট থেকে বিলকীসকে ঐ প্রাসাদে প্রবেশ করার আদেশ দেন।

“যখন সে তা দেখল তখন সে এটাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং সে তার পদদ্বয় অনাবৃত করল। সুলায়মান বলল, এ তো স্বচ্ছ স্ফটিক মণ্ডিত প্রাসাদ! সেই নারী বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম, আমি সুলায়মানের সাথে জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি।” কথিত আছে, বিলকীসের পায়ের গোছায় লম্বা লম্বা পশম ছিল। জিনরা চেয়েছিল এই পশম কোন উপায়ে সুলায়মানের সামনে প্রকাশ পাক এবং তা দেখে সুলায়মানের মনে ঘৃণা জন্মুক। জিনদের এরূপ করার কারণ ছিল, বিলকীসের মা ছিল জিন। এখন সুলায়মান যদি বিলকীসকে বিবাহ করেন তা হলে সুলায়মানের সাথে বিলকীসও জিনদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করবে বলে তারা আশংকা করছিল। কেউ কেউ বলেছেন, বিলকীসের পায়ের পাতা ছিল পশুর ক্ষুরের ন্যায়। এ মতটি অত্যন্ত দুর্বল, প্রথম মতটিও সন্দেহমুক্ত নয়। কথিত আছে, হযরত সুলায়মান (আ) যখন বিলকীসকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার পায়ের পশম ফেলে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি মানুষের পরামর্শ নেন। তারা ক্ষুর ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়। বিলকীস এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। এরপর তিনি জিনদেরকে জিজ্ঞেস করেন। তারা সুলায়মান (আ)-এর জন্যে চুনা তৈরি করে এবং একটা হাম্মানখানা নির্মাণ করে। এর পূর্বে মানুষ হাম্মানখানা কি, তা বুঝতো না। তিনিই সর্বপ্রথম হাম্মামখানা তৈরি করেন ও ব্যবহার করেন। সুলায়মান (আ) হাম্মানখানায় প্রবেশ করে চুণ দেখতে পান এবং পরীক্ষামূলকভাবে তা স্পর্শ করেন। স্পর্শ করতেই চুণের ঝাঁজে উহ্ বলে ওঠেন; কিন্তু তার এ উহঃতে কোন কাজ হয়নি। তিবরানী এ ঘটনা রাসূল (সা) থেকে (মারফু ভাবে) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তা সমর্থনযোগ্য নয়।

ছালাবী প্রমুখ লিখেছেন যে, সুলায়মান (আ) বিলকীসের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং তাঁর রাজত্ব বহাল রেখে তাকে ইয়ামানে পাঠিয়ে দেন। তিনি প্রতি মাসে একবার করে ইয়ামানে গমন করতেন এবং তিন দিন বিলকীসের কাছে থেকে পুনরায় চলে আসতেন। যাতায়াতে তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত আসনটি ব্যবহার করতেন। তিনি জিদের দ্বারা ইয়ামানে তিনটি অনুপম প্রাসাদ নির্মাণ করিয়ে দেন। প্রাসাদ তিনটির নাম গামদান, সালিহীন ও বায়তুন। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ...... ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, সুলায়মান (আ) বিলকীসকে নিজে বিবাহ করেন নি। বরং তাকে তিনি হামাদানের বাদশাহর সাথে বিবাহ করিয়ে দেন এবং বিলকীসকে ইয়ামানের রাজত্বে বহাল রাখেন। এরপর তিনি জিনদের বাদশাহ যূবিআকে তাঁর অনুগত করে দেন। সে তথায় উপরোল্লিখিত প্রাসাদ তিনটি নির্মাণ করে। তবে প্রথম বর্ণনাটিই অধিক প্রসিদ্ধ।

হযরত সুলায়মান (আ) প্রসংগে সূরা ‘সাদ’-এ আল্লাহর বাণীঃ

( وَوَهَبۡنَا لِدَاوُۥدَ سُلَیۡمَـٰنَۚ نِعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ إِنَّهُۥۤ أَوَّابٌ ۝ إِذۡ عُرِضَ عَلَیۡهِ بِٱلۡعَشِیِّ ٱلصَّـٰفِنَـٰتُ ٱلۡجِیَادُ ۝ فَقَالَ إِنِّیۤ أَحۡبَبۡتُ حُبَّ ٱلۡخَیۡرِ عَن ذِكۡرِ رَبِّی حَتَّىٰ تَوَارَتۡ بِٱلۡحِجَابِ ۝ رُدُّوهَا عَلَیَّۖ فَطَفِقَ مَسۡحَۢا بِٱلسُّوقِ وَٱلۡأَعۡنَاقِ ۝ وَلَقَدۡ فَتَنَّا سُلَیۡمَـٰنَ وَأَلۡقَیۡنَا عَلَىٰ كُرۡسِیِّهِۦ جَسَد ا ثُمَّ أَنَابَ ۝ قَالَ رَبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَهَبۡ لِی مُلۡك ا لَّا یَنۢبَغِی لِأَحَد مِّنۢ بَعۡدِیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ ۝ فَسَخَّرۡنَا لَهُ ٱلرِّیحَ تَجۡرِی بِأَمۡرِهِۦ رُخَاۤءً حَیۡثُ أَصَابَ ۝ وَٱلشَّیَـٰطِینَ كُلَّ بَنَّاۤء وَغَوَّاص ۝ وَءَاخَرِینَ مُقَرَّنِینَ فِی ٱلۡأَصۡفَادِ ۝ هَـٰذَا عَطَاۤؤُنَا فَٱمۡنُنۡ أَوۡ أَمۡسِكۡ بِغَیۡرِ حِسَاب ۝ وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 30 - 40]

—আমি দাউদকে দান করলাম সুলায়মান। সে ছিল উত্তম বান্দা এবং সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী। যখন অপরাহ্নে তার সম্মুখে ধাবনোদ্যত উৎকৃষ্ট অশ্বরাজিকে উপস্থিত করা হল, তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রতিপালকের স্মরণ হতে বিমুখ হয়ে সম্পদ প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি, এ দিকে সূর্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছে। এগুলোকে পুনরায় আমার সম্মুখে আনয়ন কর। তারপর সে এগুলোর পদ ও গলদেশ ছেদন করতে লাগল। আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং তার আসনের উপর রাখলাম একটি ধড়; তারপর সুলায়মান আমার অভিমুখী হল। সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে দান কর এমন এক রাজ্য, যার অধিকারী আমি ছাড়া কেউ না হয়। তুমি তো পরম দাতা।’ তখন আমি তার অধীন করে ছিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে, সে যেখানে ইচ্ছে করত সেথায় মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হত এবং শয়তানদেরকে, যারা সকলেই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী, এবং শৃঙ্খলে আবদ্ধ আরও অনেককে। এসব আমার অনুগ্রহ, এ থেকে তুমি অন্যকে দিতে অথবা নিজে রাখতে পার। এর জন্যে তোমাকে হিসেব দিতে হবে না। এবং আমার নিকট রয়েছে তার জন্যে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। (৩৮ সাদঃ ৩০-৪০)।

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ এ কথা উল্লেখ করছেন যে, তিনি দাউদকে পুত্র হিসেবে সুলায়মানকে দান করেছেন। এরপর সুলায়মানের প্রশংসার বলেছেন, “সে ছিল উত্তম বান্দা এবং সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী।” অতঃপর আল্লাহ হযরত সুলায়মান ও তার উৎকৃষ্ট, শক্তিশালী অশ্ব সম্পর্কিত ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ( ٱلصَّـٰفِنَـٰتُ ) বা দ্রুতগামী অশ্ব বলতে ঐসব শক্তিশালী অশ্বকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলো তিন পায়ের উপর দাঁড়ায় এবং চতুর্থ পায়ের একাংশের উপর ভর করে দাঁড়ায়।

( حياد ) অর্থ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দ্রুতগামী অশ্ব। “তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রতিপালকের স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে সম্পদ প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি, এদিকে সূর্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছে।” কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, ঘোড়া চোখের আড়ালে চলে গিয়েছে। এগুলোকে পুনরায় আমার সম্মুখে আনয়ন কর। অতঃপর সে ঐগুলোর পদ ও গলদেশ ছেদন করতে লাগল। এ কথার দু'রকম তাফসীর করা হয়েছিল। প্রথম মতে অর্থ হল, তিনি তরবারী দ্বারা ঘাড়ের রগ ও গলদেশ কেটে দিয়েছেন। দ্বিতীয় মতে অর্থ হল, ঘোড়াগুলোকে প্রতিযোগিতা করানোর পর ওগুলোকে ফিরিয়ে এনে তিনি এগুলোর ঘাম মুছে দেন। অধিকাংশ আলিম প্রথম মত সমর্থন করেন। তাঁরা বলেছেন, হযরত সুলায়মান (আ) অশ্বরাজি পরিদর্শন করার কাজে লিপ্ত থাকায় আসরের নামাযের সময় অতিবাহিত হয়ে যায় এবং সূর্য অস্তমিত হয়। হযরত আলীসহ কতিপয় সাহাবী থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্যের উপর আপত্তি তোলা যায় যে, তিনি ওযর ব্যতীত কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে নামায কাযা করেন নি বলে নিশ্চিতরূপে বলা যায়। অবশ্য এ আপত্তির উত্তর এভাবে দেয়া যায় যে, তাঁর অশ্বরাজি ছিল জিহাদের জন্যে প্রস্তুত। তিনি সেগুলো পরিদর্শন করছিলেন আর এ জাতীয় ব্যাপারে নামায আদায় বিলম্ব করা তখনকার শরী'আতে বৈধ ছিল।

একদল আলিম দাবি করেছেন যে, খন্দকের যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ (সা) আসরের নামায কাযা করেন; কারণ তখন পর্যন্ত এরূপ করা বৈধ ছিল। পরবর্তীতে সালাতুল খাওফ (ভয়ের নামায)-এর দ্বারা ঐরূপ কাযা বিধান রহিত হয়ে যায়। ইমাম শাফিঈসহ কতিপয় আলিম এ কথা বলেছেন। কিন্তু মাকহুল, আওযাঈ প্রমুখ বলেছেন, যুদ্ধের প্রচণ্ডতার কারণে নামায বিলম্বে পড়া ও কাযা করা একটা স্থায়ী বিধান এবং ঐরূপ অবস্থায় আজও এ বিধানের কার্যকারিতা রয়েছে। আমরা তাফসীর গ্রন্থে সূরা নিসায় সালাতুল খওফের আলোচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অপর একদল আলিম বলেছেন, খন্দকের যুদ্ধে নবী করীম (সা)-এর আসরের নামায কাযা হয়েছিল ভুলে যাওয়ার কারণে। তাঁরা বলেন, হযরত সুলায়মান (আ)-এরও নামায কাযা হয়েছিল ঐ একই কারণে। যেসব মুফাসসির ঘোড়া আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তাদের মতে সুলায়মান (আ)-এর নামায কাযা হয়নি। এবং

( رُدُّوهَا عَلَیَّۖ فَطَفِقَ مَسۡحَۢا بِٱلسُّوقِ وَٱلۡأَعۡنَاقِ )

[Surah Sad 33]

আয়াতের অর্থ পূর্বের অর্থের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। তখন এর অর্থ হবে, ঘোড়াগুলিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আন। ফিরিয়ে আনার পর তিনি সেগুলোর গলদেশ ও পায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন ও ঘাম মুছিয়ে দেন। ইবন জারীর এই তাফসীরকে সমর্থন করেছেন।

ওয়ালীবী হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে এ কথা বর্ণনা করেছেন। ইবনে জারীর এই তাফসীরকে এ কারণে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, এতে সম্পদ বিনষ্ট করার অভিযোগ এবং বিনা অপরাধে পশুকে রগ কেটে শাস্তি দেওয়ার আপত্তি থাকে না। কিন্তু এ তাফসীরও প্রশ্নাতীত নয়; কেননা, হতে পারে পশু এভাবে যবেহ করা তখনকার শরীআতে বিধিসম্মত ছিল। এ কারণে আমাদের অনেক আলিম বলেছেন, মুসলমানদের যদি আশংকা হয় যে, তাদের গনীমাতে প্রাপ্ত কিংবা অন্য কোন উপায়ে প্রাপ্ত পশু কাফিররা দখল করে নিবে তখন এসব পশু নিজেদের হাতে যবেহ করা ও ধ্বংস করে দেয়া বৈধ, যাতে কাফিররা এগুলো দখল করে শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে। এই যুক্তিতেই হযরত জা'ফর ইবন আবী তালিব (রা) মূতার যুদ্ধে নিজের অশ্বের পা নিজেই কেটে দিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, হযরত সুলায়মান (আ)-এর ছিল বিরাট অশ্ব পাল। কারও মতে দশ হাজার এবং কারও মতে বিশ হাজার। কেউ কেউ বলেছেন যে, এসব অশ্বের মধ্যে বিশটি অশ্ব ছিল ডানা বিশিষ্ট।

আবু দাউদ (র) তাঁর সুনান গ্রন্থে ....... আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাবুক অথবা খায়বার যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাগমন করে যখন বাড়িতে ফিরেন, তখন বাতাসে পর্দা সরে যাওয়ায় ঐ ফাঁক দিয়ে দেখেন, আয়েশা (রা) ঘরের মধ্যে কাপড়ের পুতুল নিয়ে খেলা করছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আয়েশা! এগুলো কি?’ আয়েশা বললেন, ‘এগুলো আমার মেয়ে।’ রাসূলুল্লাহ (সা) পুতুলদের মাঝে দুই ডানা বিশিষ্ট একটা কাপড়ের ঘোড়া দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘মাঝখানের ওটা কি দেখা যায়?’ আয়েশা বললেন, ‘ওটা ঘোড়া।’ রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করেন, ‘ঘোড়ার উপরে ওটা কি?’ আয়েশা বললেন, ‘ওটা ঘোড়ার দুই ডানা।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘ঘোড়ার আবার দুই ডানা হয় নাকি? আয়েশা (রা) বললেন, কি, আপনি কি শুনেন নি যে, সুলায়মান (আ)-এর ঘোড়া ডানা বিশিষ্ট ছিল?’ আয়েশা বলেন, ‘আমার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) এমনভাবে হাসলেন যে, আমি তার মাড়ির শেষ দাঁত পর্যন্ত দেখতে পেলাম।’

কোন কোন আলিম বলেছেন, সুলায়মান (আ) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অশ্বরাজি বিনষ্ট করার পর আল্লাহ তাকে আরও উত্তম বস্তু দান করেন, তা হলো আল্লাহ বাতাসকে তার অনুগত করে দেন, যার সাহায্যে তিনি এক সকালে এক মাসের পথ এবং এক বিকেলে এক মাসের পথ অতিক্রম করতে পারতেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসছে। এর সমর্থনে ইমাম আহমদ ........ কাতাদা ও আবুদ দাহমা (র) থেকে বর্ণনা করেন। তাঁরা দু’জন প্রায়ই বায়তুল্লাহর সফর করতেন। এমনি এক সফরে তাঁদের সাথে এক বেদুইনের সাক্ষাৎ হয়। বেদুইন লোকটি বলেন যে, ‘একদা রাসূলুল্লাহ (সা) আমার হাত ধরে কাছে নিয়ে কিছু বিষয় শিক্ষা দিলেন- যা স্বয়ং আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাকে বললেন, আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ত্যাগ করবে, তার চেয়ে অধিক উত্তম বস্তু আল্লাহ তোমাকে দান করবেন।’ আল্লাহর বাণীঃ “আমি সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং তার আসনের উপর রাখলাম একটি ধড়, অতঃপর সে আমার অভিমুখী হল।” ইবন জারীর, ইবন আবী হাতিমসহ বেশ কিছু সংখ্যক মুফাসসির এ আয়াতের তাফসীরে প্রথম যুগের মনীষীগণের বরতে অনেক রিওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর অধিকাংশই কিংবা সম্পূর্ণটা ইসরাঈলী বর্ণনা। অধিকাংশ ঘটনা খুবই আপত্তিকর। আমরা তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছি। এখানে শুধু আয়াতের উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। তারা যা লিখেছে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, সুলায়মান (আ) সিংহাসন থেকে চল্লিশ দিন অনুপস্থিত থাকেন। চল্লিশ দিন পর পুনরায় সিংহাসনে ফিরে আসেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করার আদেশ দেন। ফলে অত্যন্ত মজবুতভাবে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদটি নির্মিত হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে আমরা লিখে এসেছি যে, সুলায়মান (আ) বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেননি বরং পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। এটি প্রথমে নির্মাণ করেছিলেন ইসরাঈল অর্থাৎ ইয়াকূব (আ)। এ সম্পর্কে হযরত আবু যর (রা)-এর বর্ণিত হাদীস সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সর্বপ্রথম নির্মিত মসজিদ কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘মসজিদুল হারাম।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপরে কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদ।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ দুই মসজিদ নির্মাণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত?’ তিনি বললেন, ‘চল্লিশ বছর।’ এখানে উল্লেখ্য যে, মসজিদে হারামের নির্মাতা হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত সুলায়মান (আ)-এর মাঝে সময়ের ব্যবধান চল্লিশ বছর তো হতেই পারে না; বরং তা এক হাজার বছরেরও বেশী।

উল্লেখিত আয়াতে হযরত সুলায়মান (আ) আল্লাহর নিকট এমন একটা রাজত্ব পাওয়ার আবেদন করেছেন, যেইরূপ রাজত্ব তার পরে আর কাউকে দেওয়া হবে না- এর মর্ম হল, বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, ইবন খুযায়মা, ইবন হিব্বান, হাকিম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ নিজ নিজ সনদে ...... আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সুলায়মান (আ) বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করার সময় আল্লাহর নিকট তিনটি বিষয় চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে তিনটির মধ্যে দুটি দান করেছেন। আশা করি তৃতীয়টি আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন। তিনি আল্লাহর নিকট চেয়েছিলেন এমন ফয়সালা দানের ক্ষমতা, যা আল্লাহর ফয়সালার সাথে মিলে যায়। আল্লাহ তাঁকে তা দান করেন। তিনি আল্লাহর নিকট এমন একটা রাজত্ব পাওয়ার আবেদন করেন, যে রকম রাজত্ব তার পরে আর কাউকে দেয়া হবে না। আল্লাহ এটাও তাকে দান করেন। তিনি আল্লাহর নিকট আবেদন করেন যে, কোন লোক যদি এই (বায়তুল মুকাদ্দাস) মসজিদে কেবল সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বের হয়, সে যেন এমন নিস্পাপ হয়ে বেরিয়ে যায় যেমন নিস্পাপ ছিল সে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার দিন। আমরা আশা করি এই তৃতীয়টা আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন। সুলায়মান (আ) যে ফয়সালা দিতেন তা যে আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ী হতো, সে প্রসংগ আল্লাহ তার ও তার পিতার প্রশংসায় বলেছেনঃ

( وَدَاوُۥدَ وَسُلَیۡمَـٰنَ إِذۡ یَحۡكُمَانِ فِی ٱلۡحَرۡثِ إِذۡ نَفَشَتۡ فِیهِ غَنَمُ ٱلۡقَوۡمِ وَكُنَّا لِحُكۡمِهِمۡ شَـٰهِدِینَ ۝ فَفَهَّمۡنَـٰهَا سُلَیۡمَـٰنَۚ وَكُلًّا ءَاتَیۡنَا حُكۡم ا وَعِلۡم ࣰا)

[Surah Al-Anbiya' 78 - 79]

অর্থাৎ, এবং স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানের কথা, যখন তারা বিচার করছিল শস্যক্ষেত সম্পর্কে; তাতে রাত্রিকালে প্রবেশ করেছিল কোন সম্প্রদায়ের মেষ; আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম তাদের বিচার। এবং আমি সুলায়মানকে এ বিষয়ের মীমাংসা বুঝিষে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। (২১ আম্বিয়াঃ ৭৮-৭৯)।

কাযী শুরায়হ্ ও অন্যান্য কতিপয় প্রাচীন মুফাসসির এ আয়াতের শানে নুযূলে লিখেছেনঃ হযরত দাউদ (আ)-এর নিকট যারা বিচারপ্রার্থী হয়েছিল তাদের আংগুরের ক্ষেত ছিল। অন্য এক সম্প্রদায় তাদের মেষপাল রাত্রিবেলায় ঐ ক্ষেতে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে মেষপাল আঙ্গুরের গাছ খেয়ে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে ফেলে। অতঃপর বাদী-বিবাদী উভয় দল দাউদ (আ)-এর নিকট মীমাংসার জন্যে আসে। ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি আংগুর ক্ষেতের মালিক পক্ষকে তার ক্ষয়-ক্ষতির সমপরিমাণ মূল্য প্রদান করার জন্যে মেষ-মালিক পক্ষকে নির্দেশ দেন। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দাউদ পুত্র সুলায়মানের সংগে তাদের সাক্ষাত হয়। সুলায়মান (আ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর নবী তোমাদেরকে কী ফয়সালা দিয়েছেন?’ তারা ফয়সালার বিবরণ শুনাল। সুলায়মান (আ) বললেন, ‘যদি আমি এ ঘটনার বিচার করতাম তাহলে এই রায় দিতাম না; বরং আমার ফয়সালা হত এভাবে যে, মেষপাল আংগুর ক্ষেতের মালিক পক্ষকে দেয়া হত। তারা এগুলোর দুধ, বাচ্চা, পশম থেকে উপকৃত হতে থাকতো, আর ক্ষেত মেষপালের মালিক পক্ষের নিকট অর্পণ করা হত। তারা তাতে চাষাবাদ করে শস্য উৎপন্ন করত। যখন শস্য ক্ষেত্র মেষপালক দ্বারা বিনষ্ট হওয়ার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যেত, তখন শস্য ক্ষেত্র ক্ষেতের মালিক পক্ষকে এবং মেষপাল মেষের মালিক পক্ষকে প্রত্যর্পণ করা হত।’ এই কথা দাউদ (আ)-এর কর্ণগোচর হলে তিনি পূর্বের রায় রহিত করে সুলায়মানের মত অনুযায়ী পুনরায় রায় দেন।

প্রায় এই ধরনের আর একটি ঘটনা বুখারী শরীফে ........ আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ দুই মহিলা এক সংগে সফর করছিল। উভয়ের কোলে ছিল দুগ্ধপোষ্য শিশু পুত্র। পথে এক শিশুকে বাঘে নিয়ে যায়। অবশিষ্ট শিশুকে উভয় মহিলা নিজের পুত্র বলে দাবি করে এবং পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। দু'জনের মধ্যে বয়োঃজ্যেষ্ঠা মহিলা বলল, ‘তোমার পুত্রকে বাঘ নিয়ে গেছে’; আর কনিষ্ঠা মহিলাটি বলল, ‘বরং তোমার পুত্রকেই বাঘে নিয়েছে।’ অতঃপর মহিলাদ্বয় হযরত দাউদ (আ)-এর নিকট এর মীমাংসার জন্যে যায়। তিনি উভয়ের বিবরণ শুনে জ্যেষ্ঠা মহিলার পক্ষে রায় দেন, কারণ শিশুটি তার কাছে ছিল এবং ছোট জনের পক্ষে কোন সাক্ষী ছিল না। বিচারের পর তারা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন সুলায়মান (আ)-এর সাথে তাদের সাক্ষাত হয়। তিনি বিচারের বর্ণনা শোনার পর একটা ছুরি আনার হুকুম দেন এবং বলেন, ‘আমি শিশুটিকে সমান দু’ভাগ করে প্রত্যেককে অর্ধেক করে দিব।’ তখন কনিষ্ঠা মহিলাটি বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে রহম করুন, আপনি ওকে দ্বি-খণ্ডিত করবেন না, শিশুটি ঐ মহিলারই, আপনি ওকে দিয়ে দিন।’ (তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, শিশুটি কনিষ্ঠা মহিলারই। তাই তিনি শিশুটিকে কনিষ্ঠা মহিলাকেই প্রদান করেন। সম্ভবত উভয় রকম বিচার তখনকার শরী'আতে চালু ছিল। তবে সুলায়মান (আ) এর বিচার ছিল অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এ কারণেই আল্লাহ তা'আলা কুরআন মজীদে প্রথমে সুলায়মান (আ)-এর সুবিচারের প্রশংসা করার পর তাঁর পিতা দাউদ (আ)-এর প্রশংসা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

( وَكُلًّا ءَاتَیۡنَا حُكۡم ا وَعِلۡم اۚ وَسَخَّرۡنَا مَعَ دَاوُۥدَ ٱلۡجِبَالَ یُسَبِّحۡنَ وَٱلطَّیۡرَۚ وَكُنَّا فَـٰعِلِینَ ۝ وَعَلَّمۡنَـٰهُ صَنۡعَةَ لَبُوس لَّكُمۡ لِتُحۡصِنَكُم مِّنۢ بَأۡسِكُمۡۖ فَهَلۡ أَنتُمۡ شَـٰكِرُونَ )

[Surah Al-Anbiya' 79 - 80]

—এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। আমি পর্বত ও বিহংগকুলকে অধীন করে দিয়েছিলাম ওরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করত। আমিই ছিলাম এই সমস্তের কর্তা। আমি তাকে তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা তোমাদের যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে; সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না? (২১ আম্বিয়াঃ ৭৯-৮০)। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

( وَلِسُلَیۡمَـٰنَ ٱلرِّیحَ عَاصِفَة تَجۡرِی بِأَمۡرِهِۦۤ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ٱلَّتِی بَـٰرَكۡنَا فِیهَاۚ وَكُنَّا بِكُلِّ شَیۡءٍ عَـٰلِمِینَ ۝ وَمِنَ ٱلشَّیَـٰطِینِ مَن یَغُوصُونَ لَهُۥ وَیَعۡمَلُونَ عَمَل ا دُونَ ذَ  ٰ⁠ لِكَۖ وَكُنَّا لَهُمۡ حَـٰفِظِینَ )

[Surah Al-Anbiya' 81 - 82]

—এবং সুলায়মানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; তা' তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হত সেই দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত। এবং শয়তানদের মধ্যে কতক তার জন্যে ডুবুরীর কাজ করত; তাছাড়া অন্য কাজও করত; আমি ওদের রক্ষাকারী ছিলাম। (২১ আম্বিয়াঃ ৮১-৮২)

অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ

( فَسَخَّرۡنَا لَهُ ٱلرِّیحَ تَجۡرِی بِأَمۡرِهِۦ رُخَاۤءً حَیۡثُ أَصَابَ ۝ وَٱلشَّیَـٰطِینَ كُلَّ بَنَّاۤء وَغَوَّاص ۝ وَءَاخَرِینَ مُقَرَّنِینَ فِی ٱلۡأَصۡفَادِ ۝ هَـٰذَا عَطَاۤؤُنَا فَٱمۡنُنۡ أَوۡ أَمۡسِكۡ بِغَیۡرِ حِسَاب ۝ وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 36 - 40]

—তখন আমি তার অধীন করে দিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে, সে যেখানে ইচ্ছা করত সেখানে মৃদুমন্দ ভাবে প্রবাহিত হত, এবং শয়তানদেরকে যারা সকলেই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী, এবং শৃঙ্খলে আবদ্ধ আরও অনেককে। এ সবই আমার অনুগ্রহ; এ থেকে তুমি অন্যকে দিতে অথবা নিজে রাখতে পার। এর জন্যে তোমাকে হিসাব দিতে হবে না। এবং আমার নিকট রয়েছে তার জন্যে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। (৩৮ সাদঃ ৩৬-৪০)।

হযরত সুলায়মান (আ) যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার রক্ষিত অশ্বরাজির মায়া ত্যাগ করলেন তখন আল্লাহ তার পরিবর্তে বায়ুকে তাঁর অধীন করে দেন। যা ছিল অশ্বের তুলনায় অধিক দ্রুতগামী ও শক্তিশালী। এতে কোন রকম কষ্টও ছিল না; তাঁর নির্দেশে সে বায়ু প্রবাহিত হত মৃদুমন্দ গতিতে। যেই কোন শহরে তিনি যেতে ইচ্ছে করতেন, বায়ু সেখানেই তাকে নিয়ে যেত। হযরত সুলায়মানের ছিল কাঠের তৈরি এক বিশাল আসন; তাতে পাকা ঘর, প্রাসাদ, তাঁবু, আসবাবপত্র, অশ্ব, উট, ভারি জিনিসপত্র, মানুষ, জিন্ এবং সর্বপ্রকার পশুপাখী প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সবকিছুর স্থান সঙ্কুলান হতো।

যখন তিনি কোথাও কোন সফরে বিনোদনে কিংবা কোন রাজা অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে বের হতেন, তখন ঐসব কিছু ঐ আসনে তুলে বায়ুকে হুকুম করতেন। বায়ু ঐ আসনের নীচে প্রবেশ করে তা শূন্যে উঠিয়ে নিত। অতঃপর আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্তর পর্যন্ত তা উঠার পর মৃদুমন্দ গতিতে চলার নির্দেশ দিলে বায়ু সেভাবে তা' সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যেত। আবার যখন দ্রুত যাওয়ার ইচ্ছে করতেন তখন বায়ুকে যেভাবে নির্দেশ দিতেন; ফলে বায়ু প্রবল বেগে ধাবিত হত এবং অল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়ে দিত। এভাবে তিনি সকাল বেলা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে যাত্রা করে এক মাসের দূরত্বে অবস্থিত ইসতাখারে দ্বিপ্রহরের পূর্বেই পৌঁছে যেতেন এবং সেখানে বিকেল পর্যন্ত অবস্থান করে আবার সন্ধ্যার পূর্বেই বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসতেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( وَلِسُلَیۡمَـٰنَ ٱلرِّیحَ غُدُوُّهَا شَهۡر وَرَوَاحُهَا شَهۡر ۖ وَأَسَلۡنَا لَهُۥ عَیۡنَ ٱلۡقِطۡرِۖ وَمِنَ ٱلۡجِنِّ مَن یَعۡمَلُ بَیۡنَ یَدَیۡهِ بِإِذۡنِ رَبِّهِۦۖ وَمَن یَزِغۡ مِنۡهُمۡ عَنۡ أَمۡرِنَا نُذِقۡهُ مِنۡ عَذَابِ ٱلسَّعِیرِ ۝ یَعۡمَلُونَ لَهُۥ مَا یَشَاۤءُ مِن مَّحَـٰرِیبَ وَتَمَـٰثِیلَ وَجِفَان كَٱلۡجَوَابِ وَقُدُور رَّاسِیَـٰتٍۚ ٱعۡمَلُوۤا۟ ءَالَ دَاوُۥدَ شُكۡر اۚ وَقَلِیل مِّنۡ عِبَادِیَ ٱلشَّكُورُ )

[Surah Saba’ 12 – 13]

—আমি সুলায়মানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে যা প্রভাতে এক মাসের পথ অতিক্রম করত এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছিলাম। তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে জিনদের কতক তার সম্মুখে কাজ করত। ওদের মধ্যে যে আমার নির্দেশ অমান্য করে তাকে আমি জ্বলন্ত অগ্নি-শাস্তি-আস্বাদন করাব। তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাওয-সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত। আমি বলেছিলাম, হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সংগে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ। (৩৪ সাবাঃ ১২-১৩)।

হাসান বসরী (র) বলেছেন, হযরত সুলায়মান (আ) প্রভাতে দামিশক থেকে যাত্রা শুরু করতেন এবং ইসতাখারে পৌঁছে সকালের নাস্তা করতেন। অবার বিকলে বেলা সেখান থেকে যাত্রা করে কাবুলে পৌঁছে রাত্রি যাপন করতেন। অথচ স্বাভাবিক গতিতে দামিশক থেকে ইসতাখার যেতে সময় লাগতো এক মাস। অনুরূপ ইসতাখার থেকে কাবুলের দূরত্ব ছিল এক মাসের। শহর-নগর ও স্থাপত্য শিল্পের বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, ইসতাখার শহরটি জিনরা হযরত সুলায়মান (আ)-এর জন্যে নির্মাণ করেছিল। এটা ছিল প্রাচীন তুর্কিস্তানের রাজধানী। অনুরূপ অন্যান্য কতিপয় শহর যেমন- তাদমুর বায়তুল মুকাদ্দাস, বাবে জাবরূন ও বাবুল বারীদ শেষোক্ত দুটি শহর অনেকের মতে দামিশক অঞ্চলে অবস্থিত।

ইবন আব্বাস (রা) মুজাহিদ, ইকরামা, কাতাদা (র) প্রমুখ অনেকেই ( قطر ) শব্দটির অর্থ করেছেন তামা। কাতাদা বলেন, এই তামা ইয়ামানের খনিজ সম্পদ ছিল। আল্লাহ তা উত্থিত করে ঝর্ণার আকারে সুলায়মান (আ)-এর জন্যে প্রবাহিত করে দেন। সুদ্দী বলেন, তা মাত্র তিন দিন স্থায়ী ছিল। সুলায়মান (আ) তার নির্মাণাদির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ তামা এই সময়ের মধ্যে সগ্রহ করে নেন। আল্লাহর বাণীঃ

“কতক জিন্ তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি তাকে জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি আস্বাদন করাব। অর্থাৎ আল্লাহ কতক জিনকে সুলায়মান (আ)-এর মজুর হিসেবে অধীনস্থ করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে যে কাজ করার আদেশ দিতেন, তারা সে কাজই করত; এতে তারা গাফলতি করতো না বা অবাধ্যও হত না। অবশ্য যে-ই অবাধ্য হত ও আনুগত্য প্রত্যাহার করত, তাকে তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেন। তারা সুলায়মানের জন্যে নির্মাণ করত দুর্গ। ( محاريب ) অর্থ- সুদৃশ্য প্রাসাদ ও সভাকক্ষ ( وتماثيل ) প্রাচীর গাত্রে উত্তীর্ণ ভাস্কর্য। তখনকার শরীআতে তা বৈধ ছিল। ( وجفان كااجواب ) ইবন আব্বাস বলেছেন, জিফানুন অর্থ মাটির গর্ত বা মাটির দ্বারা তৈরি পাত্র যা আকারে হাউযের ন্যায় বড়। মুজাহিদ, হাসান, কাতাদা, যাহ্হাক প্রমুখ মনীষীগণও অনুরূপ বলেছেন। জাওয়াব বহুবচন, এক বচনে জাবিয়াতুন। অর্থ হাওয-যার মধ্যে পানি জমা থাকে। কবি আশা বলেছেনঃ

تروح على أل المحلق جفنه كجابية الشيخ العراقي يفهق

অর্থ- তুমি সাঁঝের বেলা মুহাললাক পরিবারের হাওযের পাড়ে উপস্থিত হবে, যা পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। এ হাওযটি শায়খে ইরাকির হাওযের মত। ( وقدور الراسيات ) (এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ।) এর ব্যাখায় ইকরামা, মুজাহিদ প্রমুখ বলেছেন, কুদূরুর রাসিয়াত বলে চুল্লিতে স্থাপিত ডেগ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এসব ডেগ সর্বদা সেখানে স্থাপিত থাকে, কখনও নামিয়ে রাখা হয় না। এ কথা বলার তাৎপর্য হচ্ছে, তিনি সর্বদা জিন ও ইনসানকে খাদ্য সরবরাহ করতেন এবং তাদের প্রতি বদান্যতা প্রকাশ করতেন।

আল্লাহর বাণীঃ “(হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ।”) আল্লাহর বাণীঃ

“আর শয়তানদিগকে যারা সকলেই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী।”

অর্থাৎ কিছু সংখ্যক শয়তান জিনকে সুলায়মানের অধীন করে দেয়া হয়। যারা প্রাসাদ অট্টালিকা নির্মাণে নিয়োজিত ছিল। আর কিছু জিনকে তিনি সমুদ্রের তলদেশ থেকে মনি-মুক্তা আহরণের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন, এরা সে কাজই করত। “এবং শৃংখলে আবদ্ধ আরও অনেককে।” অর্থাৎ কিছু দুষ্ট জিন্ অবাধ্য হওয়ার কারণে শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে দু'জন দু'জন করে একত্রে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উপরের বর্ণনায় যে সব জিনিসকে সুলায়মান (আ)-এর অধীনস্থ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর উপর তার শাসন ও নির্দেশ কার্যকর ছিল। এটাই হচ্ছে তার সেই রাজত্ব ও কর্তৃত্ব, যার জন্যে তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন, যে তার পরে কিংবা পূর্বে কেউই যেন আর তা না পায়।

ইমাম বুখারী ...... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ গত রাত্রে নামায পড়ার সময় এক দুষ্ট জিন্ আমার নামায নষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমার প্রতি থুথু নিক্ষেপ করে। কিন্তু আল্লাহ আমাকে তার উপর প্রবল করে দেন। আমি তাকে ধরে ফেলেছিলাম এবং মসজিদের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম। তা করলে তোমরা সবাই তাকে দেখতে পেতে। কিন্তু ঐ সময় হযরত সুলায়মানের দোয়া আমার স্মরণ হল- তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেনঃ

( قَالَ رَبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَهَبۡ لِی مُلۡك ا لَّا یَنۢبَغِی لِأَحَد مِّنۢ بَعۡدِیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ )

[Surah Sad 35]

“হে আমার পালনকর্তা, আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান কর, যা আমার পরে আর কেউ পাবে না।” (৩৮ সাদঃ ৩৫) তারপর আমি তাকে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলাম। ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ শা'বী থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম ...... আবুদ দারদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা সালাত আদায় করছিলেন। আমরা শুনলাম, তিনি সালাতের মধ্যে বলছেনঃ ( اعوذ بالله منك العنك بلعنة الله ) ‘আমি আল্লাহর কাছে তোমার থেকে পানাহ চাই, আমি তোমাকে আল্লাহর লা'নতের অভিশাপ দিচ্ছি।’ রাসূলুল্লাহ এ কথাটি তিন বার বললেন। এরপর তিনি হাত সম্প্রসারিত করলেন, মনে হল তিনি কোন কিছু ধরতে যাচ্ছেন। নামায শেষ হওয়ার পর আমরা বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে সালাতের মধ্যে এমন কথা বলতে শুনলাম, যা ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি, আমরা আরও দেখলাম আপনি হাত বাড়িয়ে দিলেন।’ তিনি বললেন, ‘সালাতের মধ্যে আল্লাহর দুশমন ইবলীস আগুনের হলকা নিয়ে এসে আমার মুখমণ্ডলে ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল, তখন আমি তিনবার ( اعوذ بالله منك ) বলি। এরপর আমি ( العنك بلعنة الله ) বাক্যটিও তিনবার উচ্চারণ করি। তাতেও সে পিছালো না। অতঃপর আমি তাকে ধরার উদ্যোগ নেই। আল্লাহর কসম, আমাদের ভাই নবী সুলায়মানের দোয়া যদি না থাকত তা হলে তাকে বেঁধে রাখা হত এবং মদীনার ছেলে-মেয়েরা তাকে নিয়ে খেলা করত।’ ইমাম নাসাঈও এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ ........ আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদা ফজরের সালাত আদায়ের জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন। আমিও তার পিছনে সালাতে শরীক ছিলাম। তিনি কিরাআত পড়ছিলেন; কিন্তু হঠাৎ কিরাআত জড়িয়ে যায়। সালাত শেষে তিনি বললেন, ‘আজকের সালাতে আমার কিরাআত ইবলিস গুলিয়ে দেয়। তোমরা যদি দেখতে পারতে তা হলে বুঝতে পারতে। আমি তার টুটি চেপে ধরি। তার মুখ থেকে লালা বেরিয়ে আসে। এমনকি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীতে তার শীতলতা অনুভব করি। আমার ভাই সুলায়মান (আ)-এর দোয়ার কথা যদি মনে না পড়তো তা হলে মসজিদের খুঁটির সাথে আমি তাকে বেঁধে রাখতাম এবং মদীনার ছেলে-মেয়েরা তাকে নিয়ে খেলা করতো! অতএব, তোমরা চেষ্টা কর যাতে সালাত আদায়ের সময় তোমার ও কিবলার মাঝে অন্য কেউ আড়াল সৃষ্টি না করে।’ আবু দাউদ (র)-ও এ হাদীস ভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছেন।

বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, হযরত সুলায়মান (আ)-এর এক হাজার স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাতশ' ছিলেন স্বাধীন এবং তিনশত বাঁদী। কেউ কেউ এর বিপরীতে তিনশ’ স্বাধীন ও সাতশ’ বাদীর কথা বলেছেন। হযরত সুলায়মান (আ) ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও সক্ষম পুরুষ। ইমাম বুখারী ....... আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ একদা হযরত সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ (আ) বলেছিলেন, আজ রাত্রে আমি সত্তরজন স্ত্রীর কাছে যাব। প্রত্যেক স্ত্রীর গর্ভে একজন করে পুত্র সন্তান জন্ম হবে এবং তারা সকলেই অশ্ব চালনায় পারদর্শী হবে। আল্লাহর রাস্তায় তারা জিহাদ করবে। সুলায়মানের কাছে অবস্থানকারী একজন তখন বলেছিল, ‘ইনশা আল্লাহ' (আল্লাহ যদি চান); কিন্তু সুলায়মান (আ) ইনশা আল্লাহ বলেন নি। ফলে সে রাতে কোন স্ত্রীই সন্তান ধারণ করেন নি। মাত্র একজন স্ত্রী পরে একটি অসম্পূর্ণ সন্তান প্রসব করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘তিনি যদি ইনশা আল্লাহ’ বলতেন, তবে সকল স্ত্রী থেকেই পুত্র সন্তান জন্ম হত এবং তারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করত।’ শু‘আয়ব ও ইবন আবী যিনাদ সত্তরের স্থলে নব্বইজন স্ত্রীর কথা বর্ণনা করেছেন এবং এটাই বিশুদ্ধতম। ইমাম বুখারী একাই এই সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আবু ইয়ালা থেকে ....... আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণিত হাদীছে ‘একশত’ স্ত্রীর কথা উল্লেখিত হয়েছে।

এই শেষোক্ত বর্ণনাটির সনদ সহীহর শর্ত পূরণ করে, যদিও অন্য কেউ এ সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। ইমাম আহমদেরও আবু হুরায়রা (রা)-এর অনুরূপ একটি বর্ণনা রয়েছে।

ইমাম আহমদের অপর এক বর্ণনায় আছে যে, সুলায়মান (আ) ইন্‌শা আল্লাহ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। রাসূল (সা) বললেন, ‘তিনি যদি ইনশা আল্লাহ বলতেন, তা হলে তার সে নেক নিয়্যত এভাবে নিষ্ফল হয়ে যেত না। বরং তাঁর ইচ্ছাই পূরণ হতো।’ বুখারী ও মুসলিমে আবদুর রাযযাক সূত্রে এভাবেই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। ইসহাক ইবন বিশর কর্তৃক আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে অপর এক বর্ণনায় হযরত সুলায়মান (আ)-এর চারশ’ স্ত্রী ও সাতশ’ বাদীর উল্লেখসহ উক্ত ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।

নবী করীম (সা) ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, যদি হযরত সুলায়মান (আ) ইনশা আল্লাহ বলতেন তা হলে যেভাবে তিনি বলেছিলেন সেভাবেই অশ্বারোহী পুত্র সন্তান জন্ম হত এবং আল্লাহর রাস্তায় তারা জিহাদ করত। এই হাদীছের সনদ দুর্বল; কেননা ইসহাক ইবন বিশর হাদীছ বর্ণনায় বিশ্বস্ত নন, তিনি মুনকারুল হাদীছ। তাছাড়া এটি (সংখ্যার ব্যাপারে) সহীহ হাদীছের পরিপন্থী। তবে হযরত সুলায়মান (আ)-এর ছিল বিশাল সাম্রাজ্য। অসংখ্য সৈন্য-সামন্ত। বিভিন্ন প্রজাতির সেনাবাহিনী এবং রাজ্য পরিচালনার অন্যান্য সামগ্রী যা আল্লাহ তার পূর্বেও কাউকে দেননি এবং পরেও কাউকে দেননি। যেমন তিনি বলেছিলেনঃ

( وَأُوتِینَا مِن كُلِّ شَیۡءٍ )

[Surah An-Naml 16]

—আমাকে সবকিছু দেয়া হয়েছে (২৭ নামলঃ ১৬)।

( قَالَ رَبِّ ٱغۡفِرۡ لِی وَهَبۡ لِی مُلۡك ا لَّا یَنۢبَغِی لِأَحَد مِّنۢ بَعۡدِیۤۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ )

[Surah Sad 35]

অর্থাৎ, সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পরে আর কেউ পেতে পারবে না, নিশ্চয় আপনি মহাদাতা (৩৮ সাদঃ ৩৫) সে মতে আল্লাহ সুলায়মানের প্রার্থিত সবকিছুই দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহের কথা আল্লাহ কুরআন মজীদেও নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করেছেনঃ

( هَـٰذَا عَطَاۤؤُنَا فَٱمۡنُنۡ أَوۡ أَمۡسِكۡ بِغَیۡرِ حِسَاب ࣲ)

[Surah Sad 39]

অর্থাৎ, এগুলো আমার অনুগ্রহ। অতএব, এগুলো কাউকে দান কর অথবা নিজে রেখে দাও এর কোন হিসাব দিতে হবে না (৩৮ সাদঃ ৩৯)। অর্থাৎ যাকে ইচ্ছা তাকে দিতে পার এবং যাকে ইচ্ছা নাও দিতে পার! এতে তোমাকে কোন জওয়াবদিহী করতে হবে না। অন্য কথায় তুমি যেইভাবে ইচ্ছা সম্পদ ব্যবহার ও খরচ করতে পার; কেননা তুমি যা-ই করবে তা-ই আল্লাহ তোমার জন্যে বৈধ করে দিয়েছেন। এ জন্যে তোমার কোন জবাব দিতে হবে না। যিনি একই সাথে নবী ও সম্রাট হন- তার মর্যাদা এ রকমই হয়। পক্ষান্তরে যিনি কেবল বান্দা ও রাসূল হন, তার মর্যাদা এ রকম হয় না। কেননা বরং আল্লাহ যেভাবে অনুমতি দেন সেভাবেই তাঁকে কাজ করতে হয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে উক্ত দুই অবস্থানের ( النبي الملك- العبد الرسول ) যে কোন একটিকে গ্রহণ করার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন। তিনি বান্দা ও রাসূল হওয়াকেই বেছে নেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এ ব্যাপারে জিবরাঈল (আ)-এর নিকট পরামর্শ চান। জিবরাঈল তাকে বিনয়ী পথ ( تواضع ) অবলম্বনের দিকে ইঙ্গিত করেন।

সে মতে তিনি বান্দা ও রাসূল হওয়াকেই পছন্দ করেন। অবশ্য নবী (সা)-এর পরে তাঁর উম্মতের মধ্যে খিলাফত ও বাদশাহী উভয়টাই চালু রেখেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। সুতরাং তাঁর উম্মতের একটি দল কিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী হয়ে থাকবে।

হযরত সুলায়মান (আ)-কে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার জীবনে যে সব অনুগ্রহ দান করেছেন তার উল্লেখ শেষে পরকালীন জীবনে যে সব অনুগ্রহ, পুরস্কার সম্মান ও নৈকট্য দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারও উল্লেখ করেছেন যথাঃ

( وَإِنَّ لَهُۥ عِندَنَا لَزُلۡفَىٰ وَحُسۡنَ مَـَٔاب ࣲ)

[Surah Sad 40]

“নিশ্চয়ই তার জন্যে আমার কাছে রয়েছে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণতি। (৩৮ সাদঃ ৪০)।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন