HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সিয়াম ও যাকাত

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
সিয়াম ও যাকাত

সংকলন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

সম্পাদনা

মোহাম্মাদ ইমাম হোসাইন কামরুল

ইমাম পাবলিকেশন্স লিঃ, ঢাকা

প্রথম কথা
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِه مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ

আলহামদু-লিল্লাহ! ‘সিয়াম ও যাকাত’ বইটি বের করতে পেরে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করছি। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবায়ে কেরামের উপর।

সিয়াম এবং যাকাত ইসলামের মৌলিক দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সিয়াম পালনের মাধ্যমে মানুষ তাক্বওয়া অর্জনের সুযোগ পায়। আমাদের সমাজে অনেকেই সিয়াম পালন করেন। তবে এর তাৎপর্য ও বিধিবিধান সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখেন না। অথচ প্রত্যেক সিয়ামপালনকারীর কর্তব্য হচ্ছে সিয়ামের বিধিবিধান জেনে নেয়া। এ বইটিতে সিয়াম ও রমাযান মাস সংক্রামত্ম গুরুত্বপূর্ণ বিভিনণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আর যাকাত হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কিমত্মু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে যাকাত ব্যবস্থা চালু নেই। কিছু লোক ব্যক্তি পর্যায়ে যাকাত দিলেও অধিকাংশ লোক যাকাত আদায় করেন না। এর মূল কারণ হচ্ছে, যাকাতের ব্যাপারে মানুষের অজ্ঞতা। যাকাত যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনেকেই অনুধাবন করেন না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের যেসকল স্থানে সালাতের কথা বলেছেন সেসকল স্থানে প্রায়ই যাকাতের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। একজন মানুষকে প্রকৃত মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে।

এ বইটিতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। পাঠকমহল এখান থেকে যাকাত সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান লাভ করতে পারবেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যথাযথভাবে সিয়াম পালন ও যাকাত আদায়ের তাওফীক দান করুন। আমীন

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

মোবা : ০১৯১২-১৭৫৩৯৬

ঢাকা- ২০/০৪/২০১৬ ইং

১ম অধ্যায় কিতাবুস সিয়াম রমাযান মাসের নামকরণ
প্রতিটি বৎসরে বারটি মাস রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আসমান ও জমিন সৃষ্টির শুরু থেকেই এ নিয়ম নির্ধারণ করেছেন। কুরআনুল কারীমে এসেছে,

﴿إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِيْ كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ﴾

যেদিন আল্লাহ তা‘আলা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাস সমূহের সংখ্যা বারটি। এটা আল্লাহর কিতাবে লিখিত।

(সূরা তওবা- ৩৬)

চন্দ্র বৎসরের হিসাব অনুযায়ী বারটি মাসের মধ্যে রমাযান মাসের নামটি অধিক পরিচিত। আর একমাত্র রমাযান মাসের নামটি কুরআন মাজীদে এসেছে। সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে উল্লেখ আছে,

﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْۤ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ﴾

রমাযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক, হেদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন এবং ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।

আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে রমাযান শব্দটি رَمَضٌ (রামায) ধাতু হতে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে,

هُوَ شِدَّةُ الْحَرِّ أَوْ شِدَّةُ وَقْعِ الشَّمْسِ

গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরম অথবা সূর্যের অত্যধিক উত্তাপ। [মুফরাদাতুল কুরআন ২০৩ পৃঃ।]

প্রাচীন ভাষায় এ মাসের নাম ছিল ‘নাতিক’। আরবরা পুরাতন নামগুলো পরিবর্তন করার সময় যে মাস যে ঋতুতে পড়েছিল, সে অনুযায়ী নতুনভাবে চন্দ্র মাসগুলোর নাম দিয়েছিল। পুরাতন ‘নাতিক’ গ্রীষ্মের মধ্যে পড়েছিল। তাই এর নাম দেয়া হয়েছে رَمَضَانَ (রমাযান)।

অপরদিকে رَمَضٌ (রামায) শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, দগ্ধ হওয়া বা পুড়ে যাওয়া। যেহেতু রমাযান মাসে মানুষের পাপসমূহ জ্বলে-পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়, এ কারণেও এ মাসকে رَمَضَانَ (রমাযান) নামে নামকরণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, মীম অক্ষর সাকিন করে ‘রম্যান’ উচ্চারণ না করে মীমের যবরসহ ‘রমাযান’ বলাই সঠিক। যেহেতু পবিত্র কুরআনে এভাবেই এসেছে।

রমাযান মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত
রমাযান মাস অন্যান্য মাস থেকে বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। কেননা রমাযান মাস সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে যত আলোচনা এসেছে অন্য কোন মাস সম্পর্কে ততটা আসেনি। রমাযান মাস নিয়ে যতবেশি চিন্তা-গবেষণা ও লেখা-লেখি করা হয় অন্য কোন মাস নিয়ে ততটা হয় না। প্রতি বছর রমাযান আসে- রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে। রমাযান মাস যখন ঘনিয়ে আসে তখন মুমিনের হৃদয়ে বিরাজ করে চরম আনন্দ। রমাযানকে পাওয়ার আশায় সবাই থাকে অপেক্ষমান। কী টান! কী আকর্ষণ! এ মাসের জন্য। এর কারণ হচ্ছে রমাযান কুরআনের মাস, দু‘আ কবুলের মাস, জীবনের গোনাহসমূহ থেকে মুক্তি পাওয়ার মাস, বেশি বেশি নেকী অর্জন করার মাস।

রমাযানের এত মর্যাদা কেন ?

যেসব কারণে রমাযানের ফযীলত বেড়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, এ মাসেই আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদ নাযিল করেছেন। বিশ্বের মানুষ যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, বর্বরতার ভয়াল থাবায় মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, ঠিক এমনই মুহূর্তে এসব ভ্রামত্ম জাতিকে সত্যের মশাল দেখানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করেন, যা ছিল বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর জন্য চিরস্থায়ী মু’জিযা। এর মাধ্যমে তিনি অসভ্য ও বর্বর জাতির মধ্য থেকে এমন একদল মর্দে মুজাহিদ তৈরি করেছিলেন, যাঁরা সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। এ কুরআন দিয়ে তিনি একটি ঐতিহাসিক বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে রাতে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল শুরু হলো সেই রাতটি হাজার মাস থেকেও উত্তম ও মর্যাদাপূর্ণ। আর সেই রাতটি রমাযান মাসে হওয়াতে পুরো মাসটাই ফযীলতপূর্ণ হলো। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْۤ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ﴾

রমাযান তো সেই মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। (সূরা বাকারা- ১৮৫)

রমাযান মাসের বহুমুখী কল্যাণ :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِيْنُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন রমাযান মাস আরম্ভ হয় তখন আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়; আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়। [সহীহ বুখারী, হা/১৮০০; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৪৮; নাসাঈ, হা/২০৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৭৬৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৩৪; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২১৭২; বায়হাকী, হা/৮২৮৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯২৫২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৮৩৮৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৮৯৬১; মিশকাত, হা/১৯৫২।]

অত্র হাদীসে মুমিনদেরকে তিনটি সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। তা হলো-

১। রমাযান মাসের বিশেষ মর্যাদার কারণে আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অপর বর্ণনায় এসেছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। এ মাসে যেহেতু অজস্রধারায় রহীম ও রহমান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল হতে থাকে এবং রহমতের ফেরেশতারা অবিরাম আসা-যাওয়া করে; মূলত এজন্যই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাদীসের অপর বর্ণনায় এসেছে, এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। কারণ মানুষ এ মাসে বেশি বেশি নেক আমল করে এবং প্রতিটি আমলের জন্য অতিরিক্ত সওয়াব অর্জন করতে সক্ষম হয়, যার ফলে সে জান্নাতের উপযুক্ত হয় এবং জান্নাতের কাছাকাছি চলে যায়।

২। এ মাসে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ এ সময় মানুষ অন্য মাসের চেয়ে কম খারাপ কাজ করে, যার ফলে জাহান্নাম থেকে সে দূরে থাকার সুযোগ পায়।

৩। এ মাসে দুষ্ট শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়। এজন্য শয়তানী কার্যকলাপ কম হয়। তবে এ মাসে শয়তানকে বেঁধে রাখা হলেও অনেকেই গোনাহের কাজ করে থাকে। এর কারণ হচ্ছে,

 মানুষের নফসে আম্মারা তথা কুপ্রবৃত্তি তাকে পাপের দিকে আকৃষ্ট করে।

 শয়তান যাকে ১১ মাস কুমন্ত্রণা দিতে পারে তাকে একমাস কুমন্ত্রণা না দিলেও সে পাপকাজ করে যায়। কারণ সারা বছর শয়তানের কাজ করলে শয়তানী কাজ অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এজন্য একমাস শয়তান শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকলেও পূর্বের অভ্যাসের কারণে মানুষ পাপকাজ করে থাকে।

রমাযান বরকতের মাস :

রমাযান মাস বরকতের মাস। এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রতি অনেক বরকত নাযিল করে থাকেন। যেমন-

১। এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি করে দেন। ফলে অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও খাওয়া-দাওয়ায় তাদের মধ্যে অনেক স্বচ্ছলতা লক্ষ্য করা যায়।

২। এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা শারীরিক শক্তির ক্ষেত্রেও বরকত দান করে থাকেন। ফলে আমাদের পক্ষে অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে সারা দিন না খেয়ে থাকাটা অনেক সহজ মনে হয় এবং কষ্টও কম হয়। তাছাড়া অন্যান্য মাসের তুলনায় আমরা খুব কমই অসুস্থতা বোধ করে থাকি।

৩। এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ইবাদাতেও বরকত দান করে থাকেন। ফলে আমাদের জন্য অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে অধিক হারে ইবাদাত করার সুযোগ লাভ হয়।

৪। এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সওয়াব প্রদানের ক্ষেত্রেও প্রচুর বরকত দান করে থাকেন। অন্যান্য মাসে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে ইবাদাতের প্রতিদানস্বরূপ যদি একটি নেকী প্রদান করে থাকেন, তাহলে এই মাসে উক্ত ইবাদাতের কারণে অনেক বেশি নেকী প্রদান করে থাকেন। এরপরেও আরো বিশেষ কিছু ইবাদাতের জন্য বিশেষ সওয়াব তো রয়েছেই। যেমন- লাইলাতুল কদর, উমরা পালন করা ইত্যাদি।

রমাযান ধৈর্যের মাস :

রমাযান আমাদেরকে সবরের (ধৈর্যের) প্রশিক্ষণ দেয়। ভোর থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন খানা-পিনা ও মনের চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মুমিন এক চরম ধৈর্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। আর ধৈর্য মুমিনের জন্য এমন একটি গুণ, যার প্রতিদান হলো জান্নাত। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ﴾

সবরকারীদেরকে অগণিত পুরস্কার প্রদান করা হবে। (সূরা যুমার- ১০)

রমাযান সাম্য ও সমতার মাস :

রমাযান মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে সাম্যের হাওয়া বয়ে আনে। সাদা-কালো, ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, সকলকে এক ও একাকার করে দেয়। যারা সর্বদা ভোগ-বিলাসের মধ্যে থাকে তাদেরকেও ঐ সকল লোকদের সাথে শামিল হতে হয়, যারা সকালে খেলে দুপুরে খেতে পায় না। যত বড় রাজা-বাদশাহ-ই হোক না কেন এমনটি কখনো হয় না যে, তার জন্য সাহারীর সময় একটু পেছানোর সুযোগ থাকে অথবা নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগে তাকে ইফতারের সুযোগ দেয়া হয়; বরং সকলকে একই সময়ে খাওয়া বন্ধ করতে হয় আবার একই সময়ে খাওয়া শুরু করতে হয়, আবার তারাবীর সালাতে গিয়ে সবাইকে একই কাতারে দাঁড়াতে হয়। এটা সাম্যের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

রমাযান রহমত ও মাগফিরাতের মাস :

আল্লাহ তা‘আলার একটি নাম হচ্ছে ‘রহমান’ তথা অতি দয়ালু। আর আরেকটি নাম হচ্ছে, ‘গাফূর’ তথা ক্ষমাশীল। আল্লাহ তা‘আলা রমাযান মাসে তার এ দুটি নামের পরিপূর্ণ বাসত্মবায়ন ঘটান। একদিকে তিনি এ মাসে বান্দাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে তাদের নেক আমলের সওয়াব বহু গুণে বাড়িয়ে দেন। আর অপরদিকে তিনি তাওবাকারী বান্দাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিয়ে, তাদেরকে জাহান্নামের কঠিন শাসিত্ম থেকে মুক্তি দান করেন।

রমাযান দু‘আ কবুলের মাস :

আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম পালনকারীর দু‘আ কবুল করেন। সূরা বাকারায় রমাযান সংক্রান্ত আলোচনার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِيْ عَنِّيْ فَإِنِّيْ قَرِيْبٌ أُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِيْ وَلْيُؤْمِنُوْا بِيْ لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْنَ﴾

(হে নবী!) আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে তোমার কাছে জানতে চায় তখন তুমি জানিয়ে দাও যে, আমি একেবারেই নিকটে। কোন প্রার্থনাকারী যখন আমাকে ডাকে তখন আমি তার প্রার্থনা কবুল করি। সুতরাং তারা যেন আমার কথা মেনে চলে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস রাখে, যাতে তারা সৎপথ পেতে পারে। (সূরা বাকারা- ১৮৬)

তাছাড়া হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : ثَلَاثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَاتٌ دَعْوَةُ الصَّائِمِ وَدَعْوَةُ الْمَظْلُوْمِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তিন শ্রেণির লোকের দু‘আ ফেরত দেয়া হয় না, ১. রোযাদারের দু‘আ, ২. মাযলুম ব্যক্তির দু‘আ এবং ৩. মুসাফিরের দু‘আ। [দু‘আউ লিত তাবারানী, হা/১৩১৩; জামেউস সগীর, হা/৫৩৪১; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮১৪৮।]

এ থেকে বুঝা যায় যে, রমাযান মাসে দু‘আ কবুলের বিশেষ সুযোগ রয়েছে।

রোযার সংজ্ঞা
রোযা ফারসী শব্দ। কুরআন ও হাদীসের ভাষায় রোযাকে صَوْمٌ সাওম বলে। صَوْمٌ বা صِيَامٌ উভয়টিই মাসদার তথা ক্রিয়ামূল।

আভিধানিক অর্থে صَوْمٌ শব্দের অর্থ হলো, বিরত থাকা। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সুব্হে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা-পিনা, যৌন সম্ভোগ ও রোযা ভঙ্গকারী যাবতীয় কার্যাবলি হতে বিরত থাকাকে সাওম বা রোযা বলা হয়।

রোযার অতীত ও বর্তমান ইতিহাস
 প্রাচীন যুগ থেকে নিয়ে মুহাম্মাদ ﷺ পর্যন্ত সকল নবীদের শরীয়তে রোযার বিধান ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, এর মাধ্যমে হয়ত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা বাকারা- ১৮৩)

অবশ্য রোযার হুকুম-আহকাম, রোযার সংখ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন নবীর শরীয়তে বিভিন্ন রকম ছিল।

 মূসা (আঃ) ও তাঁর উম্মতরা আশুরার দিন রোযা রাখতেন :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : لَمَّا قَدِمَ النَّبِيُّ اَلْمَدِيْنَةَ وَجَدَ الْيَهُوْدَ يَصُوْمُوْنَ عَاشُوْرَاءَ فَسُئِلُوْا عَنْ ذٰلِكَ فَقَالُوْا هٰذَا الْيَوْمُ الَّذِيْ أَظْفَرَ اللهُ فِيْهِ مُوْسٰى وَبَنِيْ إِسْرَائِيْلَ عَلٰى فِرْعَوْنَ وَنَحْنُ نَصُوْمُه تَعْظِيْمًا لَه ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ نَحْنُ أَوْلٰى بِمُوْسٰى مِنْكُمْ ثُمَّ أَمَرَ بِصَوْمِه

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ যখন হিজরত করে মদিনায় আগমন করেন, তখন তিনি ইয়াহুদিদেরকে আশুরার রোযা রাখা অবস্থায় পেলেন। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের রোযা? তারা বলল, এটি একটি মহান দিন। এ দিন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ) ও বনী ইসরাঈলকে ফিরাউনের উপর বিজয় দান করেছিলেন। ফলে আমরা এর সম্মানস্বরূপ এ দিনে রোযা রেখে থাকি। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, মূসা (আঃ) এর বিষয়ে তোমাদের থেকে আমরাই বেশি প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য। তারপর তিনি এ দিনে রোযা রাখার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩৯৪৩; আবু দাউদ, হা/২৪৪৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৮৪; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৭৭; বায়হাকী, হা/৭১৯৮; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৮২।]

 দাঊদ (আঃ) অর্ধেক বছর রোযা রাখতেন :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ لِيْ رَسُوْلُ اللهِ أَحَبُّ الصِّيَامِ إِلَى اللهِ صِيَامُ دَاوُوْدَ كَانَ يَصُوْمُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় রোযা হলো দাঊদ (আঃ) এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন ইফতার করতেন। অর্থাৎ তিনি বছরের অর্ধেক দিন রোযা রাখতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩৪২০; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৯৬; আবু দাউদ, হা/২৪৫০; নাসাঈ, হা/১৬৩০; ইবনে মাজাহ, হা/১৭১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৪৯১; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৩৬৪; বায়হাকী, হা/৪৪৩২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৫১; জামেউস সগীর, হা/১৭০; মুসনাদে হুমাইদী, হা/৬১৭।]

মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর উম্মতের রোযা
 রমাযানের রোযা ফরয হওয়ার আগে নবী ﷺ মুসলমানদেরকে প্রতি মাসে তিনদিন (আইয়ামে বীজের) রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং আশুরার দিন রোযা রাখতে উৎসাহিত করতেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَأْمُرُنَا بِصِيَامِ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ وَيَحُثُّنَا عَلَيْهِ وَيَتَعَاهَدُنَا عِنْدَهٗ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ لَمْ يَأْمُرْنَا وَلَمْ يَنْهَنَا وَلَمْ يَتَعَاهَدْنَا عِنْدَهٗ

জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে আশুরার দিন রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এ ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দিতেন। আমরা রোযা রাখছি কি না- এরও খোঁজ-খবর নিতেন। পরে যখন রমাযানের রোযা ফরয হয়ে গেল তখন এ ব্যাপারে কোন আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না এবং কোন খোঁজ-খবরও নিতেন না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭০৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৯৪৬; মুসনাদে তায়ালুসী, হা/৮২১; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৪০৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৮৩৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯৪৪৯; মিশকাত, হা/২০৬৯।]

عَنْ عَائِشَةَ - رَضِىَ اللهُ عَنْهَا - قَالَتْ كَانَ يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ يَوْمًا تَصُوْمُهٗ قُرَيْشٌ فِى الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يَصُوْمُهٗ فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَلَمَّا قَدِمَ رَسُوْلُ اللهِ - الْمَدِيْنَةَ صَامَهٗ وَأَمَرَ بِصِيَامِه فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ كَانَ هُوَ الْفَرِيْضَةَ وَتُرِكَ عَاشُوْرَاءُ فَمَنْ شَاءَ صَامَهٗ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার দিন রোযা পালন করত। জাহেলী যুগে রাসূলুল্লাহ ﷺ-ও এ দিন রোযা রাখতেন। তিনি যখন মদিনায় আসেন, তখনও (প্রথমদিকে) তিনি এ রোযা রেখেছেন এবং তা রাখার হুকুমও দিয়েছেন। কিন্তু যখন রমাযানের রোযা ফরয হয় তখন তিনি আশুরার রোযা ছেড়ে দেন। অতঃপর যার ইচ্ছা সে তা রাখত আর যার ইচ্ছা সে তা ছেড়ে দিত। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬৬২; সহীহ বুখারী, হা/২০০২; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৬; আবু দাউদ, হা/২৪৪৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬২১; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/২৮৫০; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৯৪; বায়হাকী, হা/৮১৯২; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭০২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৮৪৫।]

 দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে সর্বপ্রথম রমাযান মাসে রোযা রাখার বিধান নাযিল হয়। তবে এতে লোকদেরকে এতটুকু পর্যমত্ম সুযোগ দেয়া হয়েছিল যে, যারা রোযা রাখতে চায় না, তারা প্রতি রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাওয়ালেও চলবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ أَيَّامًا مَّعْدُوْدَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَهٗ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِيْنٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهٗ وَأَنْ تَصُوْمُوْا خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা (এর মাধ্যমে আল্লাহকে) ভয় করতে পার। (রোযা ফরয করা হয়েছে) নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য, তবে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে, তবে সমপরিমাণ দিনের রোযা (সুস্থ হয়ে অথবা সফর থেকে ফিরে এসে) কাযা আদায় করে নেবে; আর যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও রোযা রাখতে চায় না তাদের জন্য এর বিনিময়ে ফিদইয়া দেয়ার সুযোগ থাকবে। আর তা হচ্ছে একজন গরীব ব্যক্তিকে (পেট ভরে) খাবার দেয়া। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি (এর চেয়ে বেশী দিয়ে) ভালো কাজ করতে চায়, তাহলে এ কাজ তার জন্য একান্ত কল্যাণকর হবে। তবে (এ সময়) রোযা রাখা তোমাদের জন্য খুবই ভালো; যদি তোমরা (রোযার উপকারিতা সম্পর্কে) জানতে পার।

(সূরা বাকারা- ১৮৩, ১৮৪)

 উপরোক্ত বিধান নাযিল হওয়ার এক বছর পর সুস্থদের ব্যাপারে যে ছাড় বা সুযোগ দেয়া হয়েছিল তা রহিত করে পুরো মাস রোযা রাখা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয় এবং রোগী ও মুসাফিরদের ব্যাপারে কাযার বিধান বহাল রাখা হয়। তবে যারা রোযা রাখতে অক্ষম তারা ফিদ্ইয়া দিতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْۤ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيْضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ﴾

রমাযান মাস (এমন একটি মাস) যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, আর এই কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে, সে যেন রোযা রাখে, তবে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে তবে সে পরবর্তী দিনগুলোতে গুণে গুণে সেই পরিমাণ কাযা করে নেবে। (এ সুযোগ দিয়ে) আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, কখনই তোমাদের (জীবন) কঠিন করতে চান না। আল্লাহর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমরা যেন গুণে গুণে (রোযার) সংখ্যাগুলো পূর্ণ করতে পার, আর আল্লাহ তোমাদেরকে (জীবন যাপনের) যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন সেজন্য তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে পার এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পার। (সূরা বাকারা- ১৮৫)

 রমাযান মাসে রোযা রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে যাওয়ার পর এর বিস্তারিত বিধি-বিধান সম্পর্কে মুসলমানদেরকে ধারণা দেয়া হয় এবং রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর জেগে উঠে সহবাস করা ও খাওয়া-দাওয়া করাকে হালাল করে দেয়া হয়, যা ইতিপূর্বে হালাল ছিল না। ইবনে কাসীরের বর্ণনায় এসেছে,

কায়েস ইবনে সুরমাহ আল-আনসারী রোযা রেখে সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বললেন, খাওয়ার কিছু আছে কি? স্ত্রী বললেন, না। এরপর স্ত্রী খাবারের খুঁজে বের হলেন। ফিরে এসে দেখেন স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফলে তিনি পরের দিন না খেয়ে রোযা রাখলেন। এক পর্যায়ে তিনি ক্ষুধার জ্বালায় বেহুঁশ হয়ে পড়েন। অতঃপর নবী ﷺ এর কাছে এ ব্যাপারে সংবাদ দেয়া হলো।

অপরদিকে উমর (রাঃ) রোযার রাতে ঘুমানোর পর জেগে উঠে স্ত্রীর সাথে সহবাস করে বসেন। পরে তিনি নিজেকে দোষী মনে করে আক্ষেপের সাথে নবী ﷺ এর কাছে গিয়ে নিজের ঘটনা বললেন। এসব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াত নাযিল করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত সহবাস করা ও খাওয়া-দাওয়াকে বৈধ করে দিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلٰى نِسَآئِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُوْنَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ فَالْاٰنَ بَاشِرُوْهُنَّ وَابْتَغُوْا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتّٰى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ وَلَا تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلَا تَقْرَبُوْهَا كَذٰلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ اٰيَاتِه لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ ﴾

রোযার মাসে রাতের বেলায় তোমাদের স্ত্রীদের সাথে মিলন করা তোমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে, তোমাদের স্ত্রীরা যেমনি তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ, ঠিক তোমরাও তাদের জন্য পোশাক সমতুল্য। আল্লাহ এটা জানেন যে, তোমরা নিজেদের উপর খিয়ানত করে বসবে, তাই তিনি তোমাদের উপর দয়া করলেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। এখন চাইলে তোমরা তাদের সাথে সহবাস করতে পার এবং (এ ব্যাপারে) আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যা (বিধি-বিধান কিংবা সন্তান) লিখে রেখেছেন তা সন্ধান করো। আর তোমরা পানাহার অব্যাহত রাখতে পার যতক্ষণ পর্যন্ত রাতের অন্ধকার রেখার ভিতর থেকে ভোরের শুভ্র আলোকরেখা পরিষ্কার না হয়। অতঃপর তোমরা রাত আসা পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করো। তবে মসজিদে যখন তোমরা ই’তিকাফ অবস্থায় থাকবে তখন নারী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকবে। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। সুতরাং তোমরা এসবের নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা তার যাবতীয় নিদর্শন মানুষের জন্য বলে দিয়েছেন, যেন তারা (এর আলোকে) আল্লাহকে ভয় করতে পারে। (সূরা বাকারা- ১৮৭)

রমাযানের চাঁদ
মহান আল্লাহ চাঁদকে মানুষের জন্য সময় নির্দেশক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা মানুষ নিজেদের ইবাদাত ও অন্যান্য বিষয়ের সময় ও তারিখ নির্ধারণ করে থাকে। সুতরাং বান্দার প্রতি আল্লাহর খাস রহমত এই যে, তিনি ফরয রোযা শুরু হওয়ার বিষয়টি এমন একটি স্পষ্ট চিহ্নের উপর নির্ভরশীল করেছেন, যা সবার সামনে প্রকাশ পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ﴾

লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন! তা হলো মানুষ ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক। (সূরা বাকারা- ১৮৯)

 চাঁদ দেখে রোযা রাখতে হবে :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ ، يَقُوْلُ : قَالَ النَّبِيُّ ، أَوْ قَالَ : قَالَ أَبُو الْقَاسِمِ صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِه وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِه فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوْا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِيْنَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে সাওম শুরু করো আবার চাঁদ দেখে ইফতার (ঈদুল ফেতর) করো। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় তাহলে শা’বান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। তারপর সিয়াম শুরু করো। [সহীহ বুখারী, হা/১৯০৮; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৮; তিরমিযী, হা/৬৮৪; নাসাঈ, হা/২১১৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৫৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৫৯; মুসনাদে দারেমী, হা/১৭২৭; মিশকাত, হা/১৯৭০।]

 চাঁদ দেখা না গেলে রমাযান প্রবেশ হওয়া প্রমাণ করার উপায় হলো, শা’বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করে নেয়া। অবশ্য এ জন্য শা’বান মাসের শুরুর হিসাব রাখতে হবে।

 পূর্ব সতর্কতামূলকভাবে রমাযানের এক দিন আগে থেকে রোযা রাখা বৈধ নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন রমাযানের আগে একটি বা দু’টি রোযা না করে। তবে তার কথা ভিন্ন, যে সেদিনে রোযা রাখায় অভ্যস্ত। যেমন- কেউ প্রতি সোমবার রোযা রাখে, এখন রমাযানের আগের দিন সোমবার হলে সে রোযা রাখতে পারে। [সহীহ বুখারী, হা/১৭১৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৭০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২৭২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫৯২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৩১৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯১২৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭১৮; বায়হাকী, হা/৭৭৩১; মিশকাত, হা/১৯৭৩।]

মাসের উপস্থিতি কীভাবে প্রমাণিত হবে
মাস প্রমাণিত হবে নতুন চাঁদ দেখা বা তার সংবাদ শোনার মাধ্যমে। তাফসীরে রুহুল মা’আনীতে আল্লামা আলুসী (রহ.) লিখেছেন যে,

فَمَنْ حَضَرَ فِي الشَّهْرِ وَلَمْ يَكُنْ مُسَافِرًا فَلْيَصُمْ فِيْهِ أَوْ مَنْ عَلِمَ هِلَالَ الشَّهْرِ وَتَيَقَّنَ بِهٖ فَلْيَصُمْ ،

যে এই মাসে উপস্থিত হলো এবং সে মুসাফির নয় তাহলে তাকে সাওম রাখতে হবে। অথবা যে ব্যক্তি পবিত্র রমাযান মাসের নতুন চাঁদ উদয়ের সংবাদ পেল এবং সংবাদটি তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হলো তার উপরেই সাওম রাখা ফরয। [তাফসীরে রুহুল মা’আনী সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্যঃ।]

রোযা ওয়াজিব হওয়ার জন্য প্রত্যেক মুসলিমকে চাঁদ দেখা শর্ত নয়; কিছু সংখ্যক লোক চাঁদ দেখলে, বরং সঠিক মতে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তি দেখলেই তার দেখা মতে সকলের জন্য রোযা রাখা জরুরি হয়ে যাবে। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ تَرَءَى النَّاسُ الْهِلَالَ فَأَخْبَرْتُ رَسُوْلَ اللهِ - - أَنِّىْ رَأَيْتُهٗ فَصَامَهٗ وَأَمَرَ النَّاسَ بِصِيَامِه

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক মানুষ (রমাযানের) নতুন চাঁদ দেখল। আমি রাসূল ﷺ কে সংবাদ দিলাম যে, আমিও উক্ত চাঁদ দেখেছি। ফলে রাসূল ﷺ নিজে সাওম রাখলেন এবং মানুষকেও সাওম রাখতে নির্দেশ দিলেন। [আবু দাউদ, হা/২৩৪৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৪৭; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৪৮১; বায়হাকী, হা/৭৭৬৭; মিশকাত, হা/১৯৭৯।]

চাঁদ দিয়ে যেই মাস হিসেব করা হয় তাকে বলা হয় চন্দ্রমাস। চন্দ্রমাস ২৯/৩০ দিনে হয়ে থাকে। তাই ৩৫৪ দিনে এক চন্দ্রবৎসর হয়। এজন্য রমাযান মাস ৩৩ বৎসরে সকল মৌসুমে একবার ঘুরে আসে।

পৃথিবীর কোথাও নতুন চাঁদ দেখা গেলে অথবা নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার সংবাদ পেলে অথবা শা‘বান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হয়ে গেলে সিয়াম পালন আরম্ভ করবে। আবার যখন শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখবে অথবা নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার সংবাদ পাবে অথবা রমাযান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হয়ে যাবে তখন সিয়াম পালন থেকে বিরত থাকবে।

১০
রমাযানের রোযার গুরুত্ব
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের উপর যে কয়টি ইবাদাত ফরয করেছেন তার মধ্যে রোযা অন্যতম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেরকমভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করে দেয়া হয়েছিল। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা বাকারা- ১৮৩)

রোযা ইসলামের মূল ভিত্তিসমূহের একটি :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - بُنِىَ الْإِسْلَامُ عَلٰى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهٗ وَرَسُوْلُهٗ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَحَجِّ الْبَيْتِ وَصَوْمِ رَمَضَانَ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত । তা হলো :

১. এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

২. সালাত কায়েম করা।

৩. যাকাত আদায় করা।

৪. বাইতুল্লায় হজ্জ পালন করা।

৫. রমাযান মাসে রোযা রাখা। [সহীহ বুখারী, হা/৮; সহীহ মুসলিম, হা/১২২; তিরমিযী, হা/২৬০৯; নাসাঈ, হা/৫০০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬০১৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩০৯।]

যে ব্যক্তি রমাযান মাস পেয়েও তার গোনাহ ক্ষমা করাতে পারল না তার ব্যাপারে নবী ﷺ এর হাদীস :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهٗ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَىَّ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهٗ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهٗ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ঐ ব্যক্তির নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, যার নিকট আমার নাম উল্লেখ করা হয় অথচ আমার উপর দরূদ পাঠ করে না। আর ঐ ব্যক্তির নাকও ধূলায় ধূসরিত হোক, যে ব্যক্তি রমাযান মাস পেল অথচ তার গোনাহ ক্ষমা হওয়ার আগেই রমাযান মাস শেষ হয়ে গেল। আর ঐ ব্যক্তির নাকও ধূলায় ধূসরিত হোক, যে ব্যক্তি তার পিতামাতাকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অথচ তারা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না (অর্থাৎ তাদের খেদমত করে সে জান্নাত লাভ করতে পারল না)। [তিরমিযী, হা/৩৫৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪৪৪; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৩৬৫; জামেউস সগীর, হা/৫৮২৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৬৮০; শারহুস সুন্নাহ, হা/৬৮৯; মিশকাত, হা/৯২৬।]

১১
যারা রোযা রাখে না তাদের বিধান কী হবে
যদি কেউ রোযা ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে ও বলে যে, রোযা শরীয়তে ফরয নয়, তাহলে সে কাফির ও মুরতাদ। কারণ সে ইসলামের সর্বসম্মত একটি রুকন অস্বীকার করেছে। তার এই মুরতাদ হওয়ার ফলে একজন মুরতাদের মাল ও পরিবারের ব্যাপারে যে বিধান আছে তা কার্যকর হবে। সরকারের কাছে সে হত্যাযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। তার গোসল, কাফন ও জানাযা হবে না এবং মুসলিমদের গোরস্থানে তাকে দাফনও করা যাবে না। অবশ্য যদি কেউ নওমুসলিম হওয়ার ফলে অথবা ইসলামী পরিবেশ ও উলামা থেকে দূরে থাকার ফলে না জেনে এ ধরনের কথা বলে থাকে তাহলে তার কথা ভিন্ন।

আর যদি কেউ অলসতা করে রোযা না রাখে তাহলে সে কবিরা গোনাহ করল।

সারা বছরের রোযাও রমাযান মাসের একটি রোযার সমতুল্য হয় না :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مِنْ غَيْرِ مَرَضٍ وَلاَ رُخْصَةٍ لَمْ يَقْضِهِ صِيَامُ الدَّهْرِ كُلِّهِ إِنْ صَامَهُ .

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা অথবা অন্য কোন ছাড় ব্যতীত রমাযান মাসের একটি রোযা ভঙ্গ করবে, তাহলে সে যদি পূর্ণ বৎসরও রোযা রাখে তবুও এটা তার কাফফারা হবে না। [সহীহ বুখারী, তা‘লীক সূত্রে ‘‘যখন রমযান মাসে স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে’’ নামক অধ্যায়; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৩২৬৫; মুসন্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৪৭৫।]

১২
রোযা না রাখার শাস্তি
যদি কেউ অলসতা করে রোযা না রাখে তাহলে সে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ أُمَامَةَ الْبَاهِلِيُّ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ : بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ إِذْ أَتَانِيْ رَجُلَانِ ، فَأَخَذَا بِضَبْعَيَّ ، فَأَتَيَا بِيْ جَبَلًا وَعْرًا ، فَقَالَا : اصْعَدْ ، فَقُلْتُ : إِنِّيْ لَا أُطِيْقُهٗ ، فَقَالَا : إِنَّا سَنُسَهِّلُهٗ لَكَ ، فَصَعِدْتُ حَتّٰى إِذَا كُنْتُ فِيْ سَوَاءِ الْجَبَلِ إِذَا بِأَصْوَاتٍ شَدِيْدَةٍ ، قُلْتُ : مَا هٰذِهِ الْأَصْوَاتُ ؟ قَالُوْا : هٰذَا عُوَاءُ أَهْلِ النَّارِ ، ثُمَّ انْطُلِقَ بِيْ ، فَإِذَا أَنَا بِقَوْمٍ مُعَلَّقِيْنَ بِعَرَاقِيْبِهِمْ ، مُشَقَّقَةٍ أَشْدَاقُهُمْ ، تَسِيْلُ أَشْدَاقُهُمْ دَمًا قَالَ : قُلْتُ : مَنْ هٰؤُلَاءِ ؟ قَالَ : هٰؤُلَاءِ الَّذِيْنَ يُفْطِرُوْنَ قَبْلَ تَحِلَّةِ صَوْمِهِمْ

আবু উমামা বাহিলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি শুয়েছিলাম এমতাবস্থায় আমার নিকট দু’জন (ফেরেশতা) আসলেন। তারা আমার পার্শ্ব ধরে একটি পাহাড়ের নিকট নিয়ে গেলেন। তারা উভয়ে আমাকে বললেন, পাহাড়ে আরোহণ করুন। আমি বললাম, আমি এতে আরোহণ করতে পারব না। তারা বললেন, আমরা আপনার জন্য তা সহজ করে দেব। তখন আমি সেখানে আরোহণ করলাম, এমনকি আমি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে আমি কঠিন চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম এ আওয়াজ কিসের? তারা বললেন, এ হলো জাহান্নামীদের কান্নাকাটির আওয়াজ। অতঃপর তারা আমাকে নিয়ে সামনে চললেন, সেখানে আমি কিছু লোককে উল্টো ঝুলন্ত অবস্থায় দেখলাম, যাদের মুখ ফাঁটা এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, এরা ঐ সব লোক, যারা রোযার দিন সময় হওয়ার আগেই ইফতার করে নিত। অর্থাৎ তারা যথা নিয়মে রোযা রাখত না। [সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৮৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৭৪৯১; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৩২৭৩; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৬৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩২৯৩।]

আশা করি নাফরমান বেরোযাদার মুসলিম সম্প্রদায় এই আযাবের কথা জেনে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং আল্লাহর সেই আযাবকে ভয় করে যথা নিয়মে রোযা পালন করবে।

১৩
রোযার ফযীলত
রোযা রাখলে গোনাহ মাফ হয় :

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূল ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমাযান মাসে রোযা রাখবে আল্লাহ তা‘আলা তার পেছনের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। [বুখারী, হা/২০১৪; মুসলিম, হা/১৮১৭।]

রোযার বিনিময় আল্লাহ নিজ হাতে দিয়ে থাকেন :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ -- : كُلُّ عَمَلِ ابْنِ اٰدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلٰى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهٗ لِىْ وَأَنَا أَجْزِىْ بِه يَدَعُ شَهْوَتَهٗ وَطَعَامَهٗ مِنْ أَجْلِى

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেকটি নেক আমলের সওয়াব নিম্নে দশ গুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তবে রোযা ব্যতীত। কারণ রোযা আমার জন্যই হয়ে থাকে, তাই এর বদলা আমি নিজেই দেব। যেহেতু বান্দা আমার জন্যই তার কামনা-বাসনা ও খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করেছে। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৩; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৭১২; বায়হাকী, হা/৮১১৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭১০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৮৯৮৭; জামেউস সগীর, হা/৮৬৬৭; মিশকাত, হা/১৯৫৯।]

মূলত সকল ইবাদাতই আল্লাহর জন্য। তা সত্ত্বেও রোযাকে খাস করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন ‘‘এটা আমার জন্য’’। এর কারণ হলো, রোযা একটি গোপন ইবাদাত। অন্যান্য ইবাদাত পালনের সময় কিছু না কিছু বাহ্যিক কাঠামোর আশ্রয় নিতে হয়। যেমন- সালাত আদায় করার সময় ওঠা-বসা ও রুকূ সিজদা করতে হয়। যাকাত আদায়ের সময় তা অপরকে দিতে হয়। হজ্জ করার সময় দীর্ঘ পথ সফর করতে হয়- এসব অন্য লোক দেখতে পায়; কিমুত রোযার মধ্যে তা নেই। রোযা যদি কেউ রেখে থাকে তবে তা আল্লাহর জন্যই রাখবে। কারণ কেউ যদি রোযার সময় গোপনে কিছু খায় তবে কোন মানুষ তা দেখতে পায় না। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, রোযা আমার জন্যই হয়ে থাকে।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন ‘‘রোযার সওয়াব আমিই দেব’’। বান্দা যেহেতু একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রোযা রাখে, যার মধ্যে লোক দেখানো বা অহংকারের লেশমাত্র নেই, তাই আল্লাহ তা‘আলা বান্দার প্রতি এতই সন্তুষ্ট হন যে, এ আমলের সওয়াব দেয়ার জন্য তিনি কোন মাধ্যম অবলম্বন করেন না, কোন পরিমাণের হিসাবও করেন না বরং তিনি নিজ হাতেই যত খুশি তত নেকী বান্দাকে দিয়ে থাকেন অথবা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই রোযার বদলা হয়ে যান। সুবহা-নাল্লাহ!

রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ وَأَبِىْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا- قَالَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُوْلُ إِنَّ الصَّوْمَ لِى وَأَنَا أَجْزِىْ بِه إِنَّ لِلصَّائِمِ فَرْحَتَيْنِ إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ وَإِذَا لَقِىَ اللهَ فَرِحَ

আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘সিয়াম আমারই জন্য এবং আমিই এর প্রতিফল দান করব।’’ সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে। একটি হলো যখন সে ইফতার করে তখন আনন্দিত হয়, অপরটি হলো যখন সে মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন সে আনন্দিত হবে। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৪; নাসাঈ, হা/২২১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭১৭৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯০০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১০০৫; জামেউস সগীর, হা/২৭৮৮; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৭২৩।]

ইফতারের সময় আনন্দের কারণ হচ্ছে, বান্দা সারাদিন রোযা রাখার পর যখন ইফতার সামনে নিয়ে বসে আর দেখে যে, এখনই তার রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে তখন সে নিজেকে ধন্য মনে করে এবং রোযার পুরস্কার পাওয়ার আশা করে। প্রতিটি ঘরে ইফতারীর আয়োজন হয়। একে অপরকে ইফতারী আদান-প্রদান করে। সবার মাঝে যেন আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হতে থাকে। আবার সারাটি মাস রোযা রাখার পর যখন ঈদের দিনটি আসে তখন ঘরে-বাইরে সমগ্র মুসলিম জাতির মধ্যে এক আনন্দের স্রোত বইতে থাকে। নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব, ছোট-বড় সকলের মুখে হাসির ঢেউ খেলতে থাকে।

দ্বিতীয় আনন্দ হবে আখিরাতে। এটা পূর্ণাঙ্গ ও আসল আনন্দ। বান্দা যখন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে অগণিত পুরস্কার এবং বিশেষ মর্যাদা দেবেন তখনই সেই চরম আনন্দ লাভ হবে।

রোযাদারের মুখের গন্ধ মিশ্কে আম্বরের সুগন্ধ :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ وَأَبِىْ سَعِيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا - قَالَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِه لَخُلُوْفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيْحِ الْمِسْكِ

আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সে মহান সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন! নিশ্চয় সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিশ্কের সুগন্ধের চেয়েও তীব্র। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৪; নাসাঈ, হা/২২১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭১৭৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯০০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১০০৫; জামেউস সগীর, হা/২৭৮৮; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৭২৩।]

সারাদিন রোযা রাখার ফলে উপবাসজনিত কারণে রোযাদারের মুখে যে গন্ধ সৃষ্টি হয় সেটা আল্লাহর কাছে খুবই পবিত্র জিনিস। সুগন্ধকে মানুষ যেভাবে ভালোবাসে এবং কাছে টানে, রোযাদারকেও আল্লাহ তা‘আলা সেভাবে ভালোবাসেন এবং রহমতের ছায়াতলে টেনে নেন।

রোযাদারদের জন্য জান্নাতের বিশেষ দরজা রয়েছে :

عَنْ سَهْلٍ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ

সাহল (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, জান্নাতের একটি বিশেষ দরজা রয়েছে যার নাম হলো রাইয়ান। কিয়ামতের দিন কেবল রোযাদাররাই এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তাদের ছাড়া অন্য কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। [সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৬; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৬; নাসাঈ, হা/২২৩৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৪০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৯৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯০২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪২০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৭৫২৯; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২১৬৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৫৬৮৭; বায়হাকী, হা/৭২৯৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭০৯; জামেউস সগীর, হা/৩৮৮৪।]

জান্নাতের বিভিন্ন স্তর ও দরজা রয়েছে এবং এগুলোর বিভিন্ন নাম রয়েছে, এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। রাইয়ান অর্থ- পিপাসামুক্ত, রোযাদাররা দুনিয়াতে ক্ষুধা ও পিপাসা সহ্য করে রোযা রেখেছিল। আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তাদেরকে পরিতৃপ্ত করবেন। তাই যেখানে তাদেরকে রাখা হবে তার নাম দেয়া হয়েছে রাইয়ান বা পিপাসামুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদেরকে বলবেন,

﴿كُلُوْا وَاشْرَبُوْا هَنِيْٓئًا ۢبِمَاۤ أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ﴾

অতীতের দিনগুলোতে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার বিনিময়ে এখন তৃপ্তিসহকারে খাও এবং পান করো। (সূরা হাক্কাহ- ২৪)

১৪
রোযার বিভিন্ন উপকারিতা
 রোযার দ্বারা প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

 জৈবিক ও পাশবিক নেশা নিস্তেজ হয়।

 পশুস্বভাব দূরীভূত হয়।

 মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অন্তর বিগলিত হয়।

 রোযা মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ।

 রোযা মানুষকে শয়তানের আক্রমণ থেকে হেফাযত করে।

 রোযার দ্বারা শারীরিক সুস্থতা অর্জিত হয়।

 রোযার দ্বারা মানুষের অন্তরে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়।

 মানুষের স্বভাবে বিনয় ও নম্রতা সৃষ্টি হয়।

 মানব মনে আল্লাহর মহত্ত্বের ধারণা জাগ্রত হয়।

 অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত হয়।

 দূরদর্শিতা প্রখর হয়।

 মানুষের মধ্যে এক প্রকার রূহানী শক্তি সৃষ্টি হয়।

 মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ এবং পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়।

 রোযা রাখা আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেমের অন্যতম নিদর্শন। কেননা কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মালে তাকে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে প্রেমিক পানাহার বর্জন করে এবং দুনিয়ার সবকিছুকে ভুলে যায়। ঠিক তেমনিভাবে রোযাদার ব্যক্তিও আল্লাহর প্রেমে সবকিছু ছেড়ে দেয়, এমনকি পানাহার পর্যন্ত ভুলে যায়। তাই রোযা আল্লাহ প্রেমের অন্যতম নিদর্শন।

 রোযা মানুষের জন্য রূহানী খাদ্যতুল্য। যারা দুনিয়াতে রোযা রাখবে না তারা পরকালে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকবে।

 রোযার দ্বারা আত্মার পরিশুদ্ধি এবং হৃদয়ের সজীবতা অর্জিত হয়। সর্বোপরি এর দ্বারা অন্তরাত্মায় হাসিল হয় প্রচুর প্রশান্তি এবং দূরীভূত হয় অস্থিরতা। পক্ষান্তরে পানাহারের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি ও অযথা গল্প-গুজব মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গোমরাহীতে লিপ্ত করে দেয়।

১৫
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোযার উপকারিতা
ইসলামের আদেশ-নিষেধ পালন করলে সওয়াব হয় এ কথা সবারই জানা; কিন্তু কেবল সওয়াবই নয়, ইসলামের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ পালনের মধ্যে ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিহিত রয়েছে কল্যাণ ও উপকারিতা। এ বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের যুগে যুক্তি, তর্ক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, ইসলামের প্রতিটি বিধান নিঃসন্দেহে কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক। রোযা তেমনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বিধান। পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে রোযা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি যন্ত্র আবিষ্কারকারী জানেন যে, উক্ত যন্ত্র ঠিক রাখার জন্য ও ভালো সার্ভিস দেয়ার জন্য কোন্ সময় কী ব্যবস্থা নিতে হবে। একইভাবে মানব দেহের নির্মাতা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন যে, শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখার জন্য এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে। উক্ত ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তিনি বছরে একমাস রোযা রাখা ফরয করেছেন। বিভিন্ন প্রকার রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে রোযার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো।

 উচ্চ রক্তচাপ :

রোযা শরীরের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে থাকে এবং সমগ্র প্রবাহ প্রণালীকে নবরূপ দান করে থাকে। রোযা উচ্চ রক্তচাপজনিত ব্যাধি এবং অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধি কমাতে সাহায্য করে।

 ডায়াবেটিস :

গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোযা রাখাতে ডায়াবেটিস রোগীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তাদের সুগার নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। হৃদরোগীদের অস্থিরতা ও শ্বাসকষ্ট হ্রাস পেয়েছে।

 পাকস্থলীর রোগ ও আলসার :

রোযার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় পাকস্থলীর রোগীরা। রোযা পেপটিক আলসার এবং তজ্জনিত পাকস্থলীর দাহ্যতা ও এর প্রদাহ তাড়াতাড়ি উপশম করে। পাকস্থলী একটি বৃহদাকার পেশী বিশেষ। শরীরের অন্যান্য পেশীর মতো এরও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এক মাস রোযা রাখার ফলে পাকস্থলী ও অন্ত্র বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পায় তখনই তা ক্ষতস্থান বা আলসার নিরাময়ে লেগে যায় এবং পূর্বাবস্থা পুনরুদ্ধারে নিয়োজিত হয়।

যারা মনে করেন যে, রোযা রাখলে পেটের ব্যথা বৃদ্ধি পায়, তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। সতের জন রোযাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশি বা কম, রোযা রাখার ফলে তাদের উভয় দোষই সেরে গেছে।

 ধূমপান ত্যাগ :

উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসে ক্যান্সার ও হৃদরোগ থেকে বাঁচার জন্য ধূমপান ত্যাগ করা একান্ত অপরিহার্য। রোযা ধূমপান থেকে বিরত থাকার একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়।

 কিডনী ও মূত্রথলি :

একমাস রোযা রাখার ফলে লিভার, কিডনী, ও মূত্রথলি প্রভৃতি অঙ্গসমূহ বিশ্রাম পায়। এতে অঙ্গগুলো বেশ উপকারিতা লাভ করে। কিডনী ও মূত্রথলির নানা উপসর্গ রোযার ফলে নিরাময় হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

 ওজন কমানো :

যারা বেশি মোটা এবং যাদের শরীরে মেদ থাকে রোযা রাখলে তাদের শরীরের চর্বি শরীরে ব্যবহৃত হয়ে শরীরে শক্তি যোগায় এবং দেহকে অস্বাভাবিক মোটা হতে বাধা দেয়। এতে শরীর ভালো থাকে এবং হার্ট এ্যাটাকের সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং শরীরের ওজন স্বাভাবিক হয়ে আসে।

 প্রজনন অঙ্গ :

জৈবিক চাহিদাকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে রোযার প্রতিক্রিয়া অত্যধিক। নবী ﷺ বিবাহে অসমর্থ যুবকদেরকে বিবাহের অনুমতি না দিয়ে রোযা রাখার পরামর্শ দিতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৫০৬৫; সহীহ মুসলিম, হা/৩৪৬৪।] ইসলামের বিধান হলো দারিদ্রতার কারণে বিবাহ করতে না পারলে রোযা রেখে মনকে পবিত্র রাখা।

 মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র :

রোযা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সর্বাধিক উজ্জীবিত করে। রোযা মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ সবল করে। স্নায়ুবিক দুর্বলতা এবং মস্তিষ্কের অবসাদ দূর করে। যার ফলে মস্তিষ্ক অধিক শক্তি অর্জন করতে পারে। এতে ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার হয়। সুদীর্ঘ অনুশীলন এবং গভীর ধ্যান করা সম্ভব হয়। জ্ঞানীগণ যথার্থই বলেছেন, ‘‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের উৎস’’।

Dr. Alex Heig বলেছেন, ‘‘রোযা হতে মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়, স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি বর্ধিত হয়, প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। খাদ্যে অরুচি দূর হয়।’’

 মানসিক শক্তি ও শান্তি :

শারীরিক কতগুলো ব্যাধির উৎস হচ্ছে মানসিক অশান্তি। এ রোগগুলোকে বলা হয় সাইকোসোম্যাটিক ব্যাধি। মানুষ যদি রোযা রাখে তবে এসব ব্যাধির উপসর্গ কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা রোযার মাধ্যমে মানুষের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

 মুখ ও দাঁত :

রমাযান মাসে খাদ্য গ্রহণের মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় বিধায় মুখ ও দাঁতের যত্নেরও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। সাহারীর পর, সালাতের পূর্বে এবং রাত্রে ঘুমানোর আগে ভালো করে মেসওয়াক বা ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে হবে। নিম গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করা উত্তম। মেসওয়াক করার সময় হাতের আঙ্গুল দিয়ে মাড়ি ম্যাসেজ করলে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, এতে মাড়ি সুস্থ থাকে। সাহারীর পর দু’দাঁতের মধ্যখানে যেসব খাদ্যের কণা আটকে থাকে তা খিলাল দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

 ঘুম :

ঘুম মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় জৈব প্রক্রিয়া। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এর প্রয়োজন অপরিসীম। নিদ্রা মানুষের দুশ্চিন্তাগুলোকে কমিয়ে এনে মানসিক প্রশান্তি দান করে। সেজন্য কুরআনে কয়েক জায়গায় ঘুমকে শান্তি ও আরামের উপায় বলা হয়েছে। যেমন : সূরা নাবার ৯ ও ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি বিশ্রাম এবং রাতকে করেছি আবরণ স্বরূপ।

তবে মাত্রাতিরিক্ত ঘুম ভালো নয়। একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ৫-৬ ঘন্টা ঘুমাতে পারে। যারা বেশি ঘুমায় তাদের চেয়ে যারা কম ঘুমায় তারা অধিক পরিশ্রমী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। তারাই জীবনে সফলকাম হয়। রমাযান মাসে কম ঘুমানোর ট্রেনিংটা জীবনে সাফল্য বয়ে আনতে সাহায্য করে।

১৬
রোযা ফরয হওয়ার শর্তাবলি
১. মুসলিম হওয়া। কেননা অমুসলিমের উপর রোযা ফরয নয়, সে রোযা রাখলেও তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। যেহেতু কোন ইবাদাত কবুল হওয়ার জন্য মূল শর্ত হলো ইসলাম গ্রহণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا مَنَعَهُمْ أَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّاۤ أَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَبِرَسُوْلِه ﴾

তাদের দান গ্রহণে বাধা কেবল এই ছিল যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে। (সূরা তওবা- ৫৪)

যদি কোন কাফির রমাযান মাসে ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তার পেছনের সিয়ামের কাযা আদায় করতে হবে না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿قُلْ لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوْاۤ إِنْ يَنْتَهُوْا يُغْفَرْ لَهُمْ مَّا قَدْ سَلَفَ﴾

কাফিরদেরকে বলে দাও! যদি তারা কুফরী থেকে বিরত হয়, তাহলে তাদের অতীতের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সূরা আনফাল- ৩৮)

২. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া।

৩. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। উপরোক্ত উভয় শর্তের দলীল নিম্নোক্ত হাদীসটি,

عَنْ عَائِشَةَ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ، قَالَ : رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثَةٍ : عَنِ النَّائِمِ حَتّٰى يَسْتَيْقِظَ ، وَعَنِ الصَّغِيْرِ حَتّٰى يَكْبَرَ ، وَعَنِ الْمَجْنُوْنِ حَتّٰى يَعْقِلَ ، أَوْ يُفِيْقَ .

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তিন ব্যক্তির থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে (অর্থাৎ তাদের জন্য সওয়াব ও গোনাহ লেখা হয় না)। (১) ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত। (২) নাবালেগ বাচ্চা বালেগ হওয়া পর্যন্ত। (৩) পাগল ব্যক্তি জ্ঞান ফিরে পাওয়া পর্যন্ত। [সুনানে নাসাঈ, হা/৩৪৩২; ইবনে মাজাহ, হা/২০৪১; আবু দাউদ, হা/৪৪০০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৭৩৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৪২; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯০৫৫; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৪৪০০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২৩৫০; ।]

৪. সুস্থ হওয়া।

৫. মুকীম হওয়া। কেননা অসুস্থ ও মুসাফিরের জন্য রমাযান মাসে সিয়াম না রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে সুস্থ ও মুকীম হওয়ার পর ছুটে যাওয়া সাওমের কাযা করে নেবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿اَيَّامًا مَّعْدُوْدَاتٍؕ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا اَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَرَ﴾

(রোযা ফরয করা হয়েছে) নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য, তবে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে, তবে সমপরিমাণ দিনের রোযা (সুস্থ হয়ে অথবা সফর থেকে ফিরে এসে) কাযা আদায় করে নেবে। (সূরা বাকারা- ১৮৩)

৬. মহিলারা হায়েয ও নেফাস থেকে মুক্ত হওয়া।

উপরোক্ত শর্তাবলির অধিকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই সিয়াম পালন করতে হবে।

অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিশুদেরকে রোযা রাখানো :

অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিশুদেরকে রোযা রাখার নির্দেশ দিতে হবে। শিশু রোযা রাখলে শুদ্ধ হবে এবং সওয়াবও পাবে। আর তার পিতা-মাতার জন্যও রয়েছে ভালো কাজের নির্দেশ দেয়ার সওয়াব।

عَنِ الرُّبَيِّعِ بِنْتِ مُعَوِّذٍ قَالَتْ أَرْسَلَ النَّبِيُّ غَدَاةَ عَاشُوْرَاءَ إِلٰى قُرَى الْأَنْصَارِ مَنْ أَصْبَحَ مُفْطِرًا فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِه ، وَمَنْ أَصْبَحَ صَائِمًا فَلْيَصُمْ قَالَتْ فَكُنَّا نَصُوْمُهٗ بَعْدُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا وَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكٰى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهُ ذَاكَ حَتّٰى يَكُوْنَ عِنْدَ الْإِفْطَارِ

রুবাইয়্যি বিনতে মুআওয়াজ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে রোযা রাখাতাম এবং তাদের জন্য খেলনা রাখতাম। তাদের মধ্যে কেউ যখন খাবারের জন্য কাঁদত তখন আমরা ঐ খেলনা দিতাম। এভাবে ইফতারের সময় হয়ে যেত। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হা/২৭২৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৮৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬২০; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২০১৬২।]

১৭
বালেগ হওয়ার লক্ষণসমূহ
১. স্বপ্নদোষ বা অন্য প্রকারে বীর্যপাত হওয়া।

২. নাভির নিচে মোটা লোম গজানো।

৩. ১৫ বছর বয়স হওয়া।

৪. বালিকাদের ক্ষেত্রে একটি লক্ষণ হলো মাসিক শুরু হওয়া। বালিকার মাসিকের রক্ত আসতে শুরু হলেই সে সাবালিকা; যদিও তার বয়স ১০ বছর হয়।

যেসব ছেলেমেয়ের মধ্যে উপরোক্ত আলামতসমূহ দেখা দেবে, তাদেরকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে। কেননা ঐ সময় থেকে তাদের উপর শরীয়তের সকল আদেশ-নিষেধ পালন করা আবশ্যক হয়ে যায়। সুতরাং কোন কিশোর বা কিশোরী যদি রমাযান মাসে দিনের বেলায় প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তাহলে তাকে দিনের অবশিষ্ট অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। এ দিনের সাওম তার কাযা করতে হবে না। পিতা-মাতার কর্তব্য হলো, এ বিষয়ে সতর্ক থাকা ও সন্তানকে সচেতন করা। সাথে সাথে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার উপর যেসকল ধর্মীয় দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা পালনে দিক-নির্দেশনা দেয়া এবং পাক-পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম-নীতিগুলো সে জানে কি না বা মনে রাখতে পেরেছে কি না- সে বিষয়ে খেয়াল রাখা।

১৮
পাগলের রোযার বিধান
যার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তাকে পাগল বলা হয়। পাগলের উপর রোযা রাখা অথবা রোযার পরিবর্তে দরিদ্রকে আহার করানো ওয়াজিব নয়। কেননা সে ভালো-মন্দের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। কেউ যদি কোন রোগ বা আঘাত ইত্যাদির কারণে বেহুঁশ বা অজ্ঞান হয়ে যায় তাহলে তার রোযা নষ্ট হয় না, যতক্ষণ না সে রোযা ভঙ্গের কোন কাজ করে। যেহেতু সে জ্ঞান থাকা অবস্থায় রোযার নিয়ত করেছে। জিনে ধরা রোগীরও এই বিধান। তবে এ ধরনের ব্যক্তি যখনই সুস্থ হয়ে যাবে তখনই সে সিয়াম পালন শুরু করে দেবে। কিমত্মু যদি এমন হয় যে, দিনের কিছু অংশ সে সুস্থ এবং কিছু অংশ অসুস্থ থাকে, তাহলে সে যখনই সুস্থ হবে তখনই পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং উক্ত দিনের সিয়াম পূর্ণ করবে।

১৯
মাসিক চলাকালে রোযার বিধান
হায়েয (মাসিক বা ঋতুস্রাব) ও নেফাসগ্রস্ত (সন্তান প্রসবোত্তর রক্ত প্রবাহিত হওয়া) মহিলারা হায়েয ও নেফাস চলাকালে রোযা রাখবে না। তারা পরে তাদের ছুটে যাওয়া রোযার কাযা আদায় করবে।

عَنْ مُعَاذَةَ قَالَتْ سَأَلْتُ عَائِشَةَ فَقُلْتُ مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِى الصَّوْمَ وَلَا تَقْضِى الصَّلَاةَ فَقَالَتْ أَحَرُوْرِيَّةٌ أَنْتِ قُلْتُ لَسْتُ بِحَرُوْرِيَّةٍ وَلٰكِنِّىْ أَسْأَلُ . قَالَتْ كَانَ يُصِيْبُنَا ذٰلِكَ فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلَا نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلَاةِ

মুআযা (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করলাম, ঋতুবতী মহিলা সাওম কাযা করবে এবং সালাত কাযা করবে না এটা কেমন কথা? তিনি বললেন, তুমি কি হারূরিয়্যা? আমি বললাম, আমি হারূরিয়্যা নই; বরং আমি (জানার জন্যই) জিজ্ঞেস করছি। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমাদের এরূপ হতো। তখন আমাদেরকে কেবল সাওম কাযা করার নির্দেশ দেয়া হতো, কিমত্মু সালাত কাযা করার নির্দেশ দেয়া হতো না। [সহীহ মুসলিম, হা/৭৮৯; নাসাঈ, হা/২৩১৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৯৯৩; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩২০; বায়হাকী, হা/৭৯০১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/১২৭৭; মিশকাত, হা/২০৩২।]

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ ، قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ فَذٰلِكَ نُقْصَانُ دِيْنِهَا

আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেন, তোমরা যখন হায়েযগ্রস্ত হও তখন সালাত আদায় কর না এবং রোযাও রাখ না- এটা ঠিক নয় কি? আর এটাই হচ্ছে দ্বীনের ব্যাপারে কমতি। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৪৫; মিশকাত, হা/১৯।]

ঋতুবতী মহিলা যদি দিনের কোন এক সময়ে মাসিক থেকে পাক হয়ে যায়, তাহলে দিনের পরবর্তী অংশে সে খাওয়া-দাওয়া করতে পারবে এবং তার স্বামী যদি সফর থেকে আসে তবে মেলামেশাও করতে পারবে।

যদি ঋতুবতী মহিলার ফজরের পূর্বে মাসিক বন্ধ হয়, তাহলে পরের দিন তাকে রোযা রাখতে হবে, যদিও সে সুবহে সাদিকের পূর্বে গোসল না করতে পারে। এমতাবস্থায় সে পরে গোসল করে নেবে।

মাসিক বন্ধ করে রোযা রাখা :

হায়েয মহিলাদের উপর আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিষয়। নবী ﷺ এর সময় কোন মহিলা কৃত্রিম উপায়ে মাসিক বন্ধ করে পূর্ণ মাস রোযা রাখতেন না। সুতরাং এরূপ করাটা নিন্দনীয়। তবে যদি কোন মহিলা ঔষধ ব্যবহার করে মাসিক বন্ধ রাখে এবং পুরো মাস একসাথে রোযা রাখে তবে তার রোযা শুদ্ধ হবে এবং পবিত্র থাকাবস্থায় যেসব হুকুম তার উপর প্রযোজ্য হয়, এ অবস্থায় তার উপর তাই প্রযোজ্য হবে। [সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২ খন্ড, পৃঃ ১১৫।]

২০
মাসিক সংক্রামত্ম কতিপয় মাসআলা
১. যে মহিলার ইস্তেহাযা হয় সে রোযা ভাঙবে না এবং সালাতও কাযা করবে না। ইস্তেহাযা হলো, মাসিকের নির্ধারিত সময়ের পরে অথবা সন্তান প্রসবের ৪০ দিনের পরে যে রক্ত আসে।

২. কোন মহিলা রোযা থাকা অবস্থায় যদি তার ঋতুর রক্ত আসে, তাহলে তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।

৩. ফজরের পরপরই কোন মহিলা ঋতুস্রাবমুক্ত হলে ঐ দিনের খানাপিনা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে না। কেননা সে ঐ দিনের শুরুতে ঋতুবতী থাকার কারণে সেদিনের রোযা তার জন্য শুদ্ধ নয়। আর রোযা যেহেতু শুদ্ধ নয়, সেহেতু খানাপিনা থেকে বিরত থাকারও কোন অর্থ নেই।

ঐ দিনের বাকি অংশে সে খানাপিনা থেকে বিরত থাক বা না থাক তাকে পরবর্তীতে ঐ দিনের রোযার কাযা আদায় করতে হবে।

৪. ঋতুবতী মহিলা যদি ফজরের এক মিনিট আগে হলেও নিশ্চিতভাবে ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত হয়, তাহলে রমাযান মাস হলে তাকে ঐ দিনের রোযা আদায় করতে হবে এবং তার ঐ দিনের রোযা শুদ্ধ রোযা হিসেবে পরিগণিত হবে এবং তাকে কাযা করতে হবে না। তার ফজরের পূর্বে গোসল করার সুযোগ না পেলেও সমস্যা নেই। যেমনিভাবে কোন পুরুষ সহবাসজনিত কারণে অথবা স্বপ্নদোষের কারণে যদি অপবিত্র থাকে এবং ঐ অবস্থায় সাহারী করে নেয়, তাহলে ফজরের আগে গোসল না করলেও তার রোযা শুদ্ধ হবে।

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সহবাসজনিত কারণে ফজরের সময় আরম্ভ হওয়ার পর গোসল করতেন এবং রোযা রাখতেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৩১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫, ১১০৯।]

৫. কোন মহিলার ইফতারের পর অথবা সূর্যাস্তের পরপরই ঋতুস্রাব আসলে তার সেদিনের রোযা শুদ্ধ হবে।

৬. কোন মহিলা যদি রোযা অবস্থায় ঋতুস্রাব আসার চিহ্ন অনুভব করতে পারে এবং সূর্যাস্তের পর রক্ত বের হয়, তাহলেও তার ঐ দিনের রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে।

৭. সদ্য সন্তান প্রসবকারিণী নারী ৪০ দিনের আগে যখনই পবিত্র হবে তখনই তার উপর রোযা রাখা অপরিহার্য হয়ে যাবে- যদি তখন রমাযান মাস চলে। অনুরূপভাবে তার উপর সালাত আদায়ও ফরয হবে এবং তার স্বামীর জন্য তার সাথে সহবাস করাও বৈধ হবে। কেননা সে একজন পবিত্র নারী হিসেবে বিবেচিত হবে। যার মধ্যে সালাত, সিয়াম ও সহবাসের বৈধতায় বাধাদানকারী কোন কিছু অবশিষ্ট নেই।

৮. যদি রমাযান মাসে দিনের বেলায় কোন মহিলার সামান্য রক্তের ফোটা পড়ে এবং সারা রমাযান এই রক্ত চালু থাকা অবস্থায় সে রোযা রাখে, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে। আর এই রক্ত তেমন কোন বিষয় না। কারণ, এটা শিরা থেকে আসে।

৯. কোন মহিলা যদি রক্ত দেখতে পায় কিমত্মু সে নিশ্চিত নয় যে, সেটা ঋতুস্রাবের রক্ত। তাহলে ঐ দিনের রোযা শুদ্ধ হবে। তবে ঋতুর বিষয়টা স্পষ্ট হলে রোযা শুদ্ধ হবে না।

১০. ঋতুবতী এবং ইসেত্মহাযাগ্রসত্ম মহিলা রমাযানে দিনের বেলায় খানাপিনা করবে। তবে উত্তম হলো, খানাপিনা গোপনে করা।

১১. কোন মহিলা অসুস্থ হয়ে থাকলে এবং রোযা কাযা আদায় করতে সক্ষম না হলে যখনই সক্ষম হবে তখনই কাযা আদায় করবে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী রমাযান এসে গেলেও সমস্যা নেই। কিমত্মু যদি তার ওজর না থাকে এবং অজুহাত দেখায় এবং বিষয়টা তুচ্ছজ্ঞান করে তাহলে তার জন্য এক রমাযানের কাযা রোযা অন্য রমাযান পর্যন্ত বিলম্ব করা বৈধ নয়। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার উপর রোযা কাযা থাকত এবং আমি তা শা‘বান মাসে ছাড়া কাযা আদায় করতে পারতাম না। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫০; সহীহ মুসলিম, হা/১৫১, ১১৪৬।]

এই হাদীস প্রমাণ করে যে, এক রমাযানের রোযা পরবর্তী রমাযানের পর পর্যন্ত বিলম্ব করা উচিত নয়। সুতরাং যে মহিলা পরবর্তী রমাযানে পদার্পণ করেছে অথচ বিগত রমাযানের কয়েক দিনের রোযা রাখেনি তাকে তার কৃতকর্মের দরুণ তওবা করতে হবে এবং দ্বিতীয় রমাযানের পর ছেড়ে দেয়া রোযাগুলোর কাযা আদায় করতে হবে।

১২. কোন মহিলা ইসেত্মহাযাগ্রসত্ম অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার দু’মাস পর রক্তের ছোট ছোট কিছু বিন্দু দেখতে পেলে এ ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, মহিলা যখন ঋতুস্রাব ও ইসেত্মহাযা অবস্থা থেকে নিশ্চিতভাবে পবিত্র হয়ে যাবে এরপর ঘোলা বা হলুদ রঙের, যা বের হবে অথবা ২/১ ফোটা যে রক্ত আসবে অথবা সামান্য যে সিক্ততা অনুভূত হবে, সেগুলো আসলে ঋতুস্রাব নয়। সে কারণে এগুলো তাকে সালাত আদায় করা ও সিয়াম পালন করা থেকে বিরত রাখবে না এবং স্বামীকে সহবাস থেকেও বাধা দেবে না। উম্মে আত্বিয়া (রাঃ) বলেন, ঘোলা বা হলুদ রঙের যা বের হয় তাকে আমরা কিছুই গণ্য করতাম না। [সহীহ বুখারী, মুওয়াল্লাক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।]

কিমত্মু পবিত্রতা অর্জনের পূর্বে বিষয়গুলো নিয়ে তাড়াহুড়া না করা আবশ্যক। কেননা কতিপয় মহিলা রক্ত শুকিয়ে গেলে নিশ্চিত পবিত্রতা অর্জনের আগেই তাড়াহুড়া করে গোসল করে নেয়।

২১
গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদের রোযার বিধান
 গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদের যদি গর্ভাবস্থায় বা দুগ্ধদানের কারণে রোযা রাখতে কষ্ট হয় অথবা তাদের সন্তানদের প্রাণহানীর আশঙ্কা থাকে তাহলে তারা রোযা রাখবে না। পরে যখন সুবিধা হয় এবং আশঙ্কা দূর হয়ে যায় তখন কাযা করে নেবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَضَعَ عَنِ الْمُسَافِرِ شَطْرَ الصَّلَاةِ ، وَعَنِ الْمُسَافِرِ وَالْحَامِلِ أَوِ الْمُرْضِعِ الصَّوْمَ ، أَوِ الصِّيَامَ

আল্লাহ তা‘আলা মুসাফিরের অর্ধেক সালাত কমিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীর সিয়াম না রেখে পরে আদায় করার অবকাশ দিয়েছেন। [তিরমিযী, হা/৭১৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯০৬৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৪২; বায়হাকী, হা/৭৮৬৯; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৫৬৬; মিশকাত, হা/২০২৫।]

২২
রোগীর অবস্থা ও তার রোযার বিধান
রোগীর তিনটি অবস্থা হতে পারে :

১. তার রোগটি এমন স্বাভাবিক হবে যে, রোযা রাখাতে তার কোন সমস্যা হবে না। এমন রোগীর জন্য রোযা ভঙ্গ করা জায়েয হবে না।

২. রোগীর অবস্থা এমন হবে যে, রোযা রাখলে তার রোগ বৃদ্ধি পাবে অথবা সুস্থ হতে দেরি হবে। এমনকি রোযা রাখা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমন রোগীর জন্য রোযা ভেঙ্গে ফেলা উত্তম।

যদি কোন রোগীর সিয়াম পালনের কারণে রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে তার জন্য রোযা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। কিমত্মু সুস্থ হওয়ার পর রোযা কাযা আদায় করে নেবে। আললাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ﴾

যদি তোমাদের মধ্যে কেউ রোযার মাসে অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা সফরে থাকে তাহলে পরে গুণে গুণে সেই দিনগুলো পূর্ণ করে নেবে। (সূরা বাকারা- ১৮৪)

৩. রোগীর এমন অবস্থা হবে যে, রোযা রাখলে তার প্রাণনাশের আশঙ্কা হতে পারে। এমতাবস্থায় তার জন্য রোযা রাখা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تَقْتُلُوْاۤ أَنْفُسَكُمْ﴾

তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। (সূরা নিসা- ২৯)

স্থায়ী কারণে রোযা রাখতে অক্ষম যেমন, অতি বৃদ্ধ এবং এমন রোগী যার রোগ ভালো হওয়ার আশা করা যায় না তাদেরকে রোযা রাখতে হবে না। কারণ সে এ কাজের সামর্থ্য রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا﴾

আল্লাহ তা‘আলা কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন না।

(সূরা বাকারা- ২৯৬)

তবে এ ধরনের ব্যক্তির উপর রোযার ফিদইয়া প্রদান করা ওয়াজিব।

২৩
মুসাফিরের অবস্থা ও তার রোযার বিধান
মুসাফিরের তিনটি অবস্থা হতে পারে :

১. রোযা রাখা তার জন্য কষ্টকর হলে তার জন্য রোযা না রাখাই উত্তম। হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ فِيْ سَفَرٍ فَرَأٰى زِحَامًا وَرَجُلًا قَدْ ظُلِّلَ عَلَيْهِ فَقَالَ مَا هٰذَا فَقَالُوْا صَائِمٌ فَقَالَ لَيْسَ مِنَ الْبِرِّ الصَّوْمُ فِي السَّفَرِ .

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন এক সফরে থাকা অবস্থায় এক জায়গায় জটলা দেখতে পেলেন। তার মধ্যে একজন লোককে দেখলেন- যাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? লোকেরা বলল, লোকটি রোযা রেখেছে। এসব শুনে তিনি বললেন, সফরে রোযা রাখা সওয়াবের কাজ নয়। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৪৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৩৩৭; মুসনাদে দারেমী, হা/১৭৫০; বায়হাকী, হা/৭৯৪৩; মিশকাত, হা/২০২১।]

২. সফরে রোযা রাখা তার জন্য কষ্টকর হবে না এবং রোযা রাখার কারণে তাকে অন্যান্য নেক কাজ হতেও বিরত থাকতে হবে না। এমতাবস্থায় তার জন্য রোযা রাখাই উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنْ تَصُوْمُوْا خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ﴾

আর যদি তোমরা রোযা রাখ, তবে সেটা তোমাদের জন্য উত্তম- যদি তোমরা বুঝতে পার। (সূরা বাকারা- ১৮৪)

عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ فِيْ بَعْضِ أَسْفَارِه فِيْ يَوْمٍ حَارٍّ حَتّٰى يَضَعَ الرَّجُلُ يَدَهٗ عَلٰى رَأْسِه مِنْ شِدَّةِ الْحَرِّ وَمَا فِيْنَا صَائِمٌ إِلَّا مَا كَانَ مِنَ النَّبِيِّ وَابْنِ رَوَاحَةَ

আবুদ্-দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, প্রচন্ড গরমের দিনে কোন সফরে আমরা নবী ﷺ এর সাথে বের হলাম। অবস্থা এমন ছিল যে, প্রচন্ড গরমের কারণে প্রত্যেকেই তার হাত মাথার উপর রেখেছিল (সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য)। আর তখন নবী ﷺ ও ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কেউ রোযাদার ছিল না। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৪৫; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৬; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২২৫৫; আবু দাউদ, হা/২৪১১; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৭৪৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৭৭১; বায়হাকী, হা/৭৯৫৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৬৫; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪।]

عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا ، زَوْجِ النَّبِيِّ أَنَّ حَمْزَةَ بْنَ عَمْرٍو الْأَسْلَمِيَّ قَالَ لِلنَّبِيِّ أَأَصُوْمُ فِي السَّفَرِ ، وَكَانَ كَثِيْرَ الصِّيَامِ فَقَالَ إِنْ شِئْتَ فَصُمْ وَإِنْ شِئْتَ فَأَفْطِرْ

নবী ﷺ এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। হামযা ইবনে আমর আসলামী (রাঃ) অধিক পরিমাণে রোযা পালনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি নবী ﷺ কে বললেন, আমি কি সফরেও রোযা রাখব? নবী ﷺ বললেন, তুমি যদি ইচ্ছা করো রোযা রাখো। আর যদি ইচ্ছা করো তবে ছেড়ে দাও। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬৫৩; সহীহ বুখারী, হা/১৯৪৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৭১; তিরমিযী, হা/৭১১; নাসাঈ, হা/২৩০৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪২৪২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০২৮; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৪৬৫৪; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/২৭৯২; বায়হাকী, হা/৭৯৪৫; সুনানে দারেমী, হা/১৭০৭; মিশকাত, হা/২০১৯।]

৩. রোযা রাখা মুসাফিরের জন্য মারাত্মক কষ্টকর হবে, এমনকি এতে তার প্রাণনাশেরও আশঙ্কা থাকবে। এমতাবস্থায় রোযা রাখা তার জন্য হারাম হবে।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ -  - أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - خَرَجَ عَامَ الْفَتْحِ إِلٰى مَكَّةَ فِىْ رَمَضَانَ فَصَامَ حَتّٰى بَلَغَ كُرَاعَ الْغَمِيْمِ فَصَامَ النَّاسُ ثُمَّ دَعَا بِقَدَحٍ مِنْ مَاءٍ فَرَفَعَهٗ حَتّٰى نَظَرَ النَّاسُ إِلَيْهِ ثُمَّ شَرِبَ فَقِيْلَ لَهٗ بَعْدَ ذٰلِكَ إِنَّ بَعْضَ النَّاسِ قَدْ صَامَ فَقَالَ : أُولٰئِكَ الْعُصَاةُ أُولٰئِكَ الْعُصَاةُ

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। মক্কা বিজয়ের বছর রমাযান মাসে সাওমরত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কার উদ্দেশ্যে বের হলেন। এরপর যখন তিনি ‘‘কুরা‘উল গামীম’’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন লোকেরাও সাওমরত ছিল। এরপর তিনি একটি পানির পাত্র চাইলেন। এমনকি লোকেরা তাঁর দিকে তাকাতে লাগল। এরপর তিনি পানি পান করলেন। তখন তাঁকে বলা হলো, কতিপয় লোক সাওমরত রয়েছে। তিনি বললেন, তারা অবাধ্য, তারা অবাধ্য। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৪৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৬; নাসাঈ, হা/২২৬৩; তিরমিযী, হা/৭১০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০১৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৫৩; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১৮৮০; মিশকাত, হা/২০২৭।]

যে ব্যক্তি সফরে থাকবে, সে ইচ্ছা করলে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে, আবার ইচ্ছা করলে রোযা রাখতেও পারে। এমতাবস্থায় রোযা ভঙ্গ করলে সফর শেষে তা পূর্ণ করে নিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْۤ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيْضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ﴾

রমাযান মাস (এমন একটি মাস) যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, আর এই কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে, সে যেন রোযা রাখে, তবে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে তবে সে পরবর্তী দিনগুলোতে গুণে গুণে সেই পরিমাণ কাযা করে নেবে। (এ সুযোগ দিয়ে) আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, কখনোই তোমাদের (জীবন) কঠিন করতে চান না। আল্লাহর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমরা যেন গুণে গুণে (রোযার) সংখ্যাগুলো পূর্ণ করতে পার, আর আল্লাহ তোমাদেরকে (জীবন যাপনের) যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন সেজন্য তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে পার এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পার। (সূরা বাকারা- ১৮৫)

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ اَلْخُدْرِىِّ - قَالَ غَزَوْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ - لِسِتَّ عَشْرَةَ مَضَتْ مِنْ رَمَضَانَ فَمِنَّا مَنْ صَامَ وَمِنَّا مَنْ أَفْطَرَ فَلَمْ يَعِبِ الصَّائِمُ عَلَى الْمُفْطِرِ وَلَا الْمُفْطِرُ عَلَى الصَّائِمِ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রমাযানের ষোল দিন গত হওয়ার পর আমরা নবী ﷺ এর সাথে জিহাদ করেছিলাম, তখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রোযা রেখেছিলেন আবার কেউ কেউ রাখেননি; কিন্তু এ কারণে কেউ কাউকে দোষারোপ করেননি। [সহীহ মুসলিম, হা/২৬৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭২৩; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১০৩৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৬২; মিশকাত, হা/২০২০।]

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ : خَرَجْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ لِثِنْتَيْ عَشْرَةَ لَيْلَةً بَقِيَتْ مِنْ رَمَضَانَ ، مَخْرَجَهٗ إِلَى حُنَيْنٍ فَصَامَ طَوَائِفُ مِنَ النَّاسِ ، وَأَفْطَرَ اٰخَرُوْنَ ، فَلَمْ يَعِبِ الصَّائِمُ عَلَى الْمُفْطِرِ ، وَلَا الْمُفْطِرُ عَلَى الصَّائِمِ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে রমাযান মাসের ১২ দিন বাকি থাকতে বের হলাম। আর আমরা হুনাইনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। তখন লোকেদের একদল রোযা রেখেছিল এবং অন্য দল রোযা ভঙ্গ করেছিল। কিমত্মু রোযাদারগণ রোযা ভঙ্গকারীদেরকে কোনরূপ দোষারূপ করে নাই এবং রোযাভঙ্গকারীগণও রোযাদারদেরকে কোনরূপ দোষারূপ করে নাই। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৪৩১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩৮০৩৫।]

অতএব সফরে যদি রোযা রাখার পরিবেশ ভালো থাকে এবং কষ্ট না হয় তাহলে রোযা রাখাই উত্তম, আর কষ্ট হলে না রাখা উত্তম। কিমত্মু অতিরিক্ত কষ্ট সত্ত্বেও রোযা রাখা মাকরূহ।

সফরে কেউ রোযা রাখা শুরু করলে অনেক কষ্ট দেখা দিলে রোযা ভঙ্গ করে ফেলবে।

২৪
মুসাফির কখন রোযা ভাঙতে পারবে
১. মুসাফির যদি ফজরের পূর্বে সফরের নিয়ত করে, তাহলে এর পরের দিন রোযা রাখবে না।

২. মুসাফির যদি দিনের বেলায় সফর আরম্ভ করে তবে একটি মত হলো ঐ দিনের রোযা ভাঙ্গা তার জন্য বৈধ হবে না। অপর মতে সে ঐ দিনের রোযা ভাঙ্গতে পারবে এবং এ মতটিই সঠিক।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ -  - أَنَّهٗ أَخْبَرَهٗ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - خَرَجَ عَامَ الْفَتْحِ فِىْ رَمَضَانَ فَصَامَ حَتّٰى بَلَغَ الْكَدِيْدَ ثُمَّ أَفْطَرَ وَكَانَ صَحَابَةُ رَسُوْلِ اللهِ - - يَتَّبِعُوْنَ الْأَحْدَثَ فَالْأَحْدَثَ مِنْ أَمْرِه

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ (মক্কা) বিজয়ের বছর রমাযান মাসে সাওমরত অবস্থায় সফরে বের হলেন। অতঃপর কাদীদ নামক স্থানে পৌঁছার পর তিনি সাওম ভেঙ্গে ফেললেন। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে যখনই কোন নতুন বিষয় প্রকাশ পেত, তাঁর সাহাবীগণ তা অনুসরণ করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬৫০; সহীহ বুখারী, হা/১৯৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩২৫৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৩৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫৬৩; মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/২৫১০।]

عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ كَعْبٍ أَنَّهٗ قَالَ أَتَيْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ فِىْ رَمَضَانَ وَهُوَ يُرِيْدُ سَفَرًا وَقَدْ رُحِلَتْ لَهٗ رَاحِلَتُهٗ وَلَبِسَ ثِيَابَ السَّفَرِ فَدَعَا بِطَعَامٍ فَأَكَلَ فَقُلْتُ لَهٗ سُنَّةٌ قَالَ سُنَّةٌ . ثُمَّ رَكِبَ

মুহাম্মাদ ইবনে কাব (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রমাযান মাসে আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) এর কাছে এলাম। তখন তিনি সফরের প্রসত্মুতি নিচ্ছিলেন। এমনকি এজন্য তার বাহনও প্রসত্মুত হয়ে গিয়েছিল এবং তিনিও সফরের পোশাক পরিধান করে নিয়েছিলেন। তখন তিনি খাবার আনতে বললেন। তারপর তিনি খাবার খেলেন। অতঃপর আমি তাকে বললাম, এটা কি সুন্নাত? তিনি বললেন, হ্যাঁ- এটা সুন্নাত। তারপর তিনি আরোহণ করলেন। [তিরমিযী, হা/৭৯৯; বায়হাকী, হা/২৪৭; দার কুতনী, হা/১৮৭।]

২৫
ফিদইয়া দেয়ার নিয়মাবলি
ফিদইয়া কী এবং কার উপর ফিদইয়া ওয়াজিব :

ফিদইয়া হচ্ছে একজন মিসকীনের একদিনের খাবার। যারা বার্ধক্যজনিত কারণে অথবা স্থায়ীভাবে অসুস্থ হওয়ার কারণে সিয়াম পালনে একেবারে অক্ষম না হলেও কষ্ট হবে তারা ফিদইয়া আদায় করবে।

সুতরাং একেবারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং যে অসুস্থ রোগীর সুস্থ হওয়ার কোন আশা নেই- তারা ফিদইয়া আদায় করবে। আর তা হলো প্রতি দিনের সাওমের বিনিময়ে একজন মিসকীনকে খাওয়ানো।

عَنْ عَطَاءٍ سَمِعَ ابْنَ عَبَّاسٍ يَقْرَأُ﴿وَعَلَى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَهٗ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِيْنٍ﴾ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ لَيْسَتْ بِمَنْسُوْخَةٍ هُوَ الشَّيْخُ الْكَبِيْرُ وَالْمَرْأَةُ الْكَبِيْرَةُ لَا يَسْتَطِيْعَانِ أَنْ يَصُوْمَا فَلْيُطْعِمَانِ مَكَانَ كُلِّ يَوْمٍ مِسْكِيْنًا

আত্বা (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) কে বলতে শুনেছেন যে, এ আয়াত- ‘‘যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও রোযা রাখতে চায় না, তাদের জন্য এর বিনিময়ে ফিদইয়া দেয়ার সুযোগ থাকবে’’ পাঠ করার পর বলেন, এ আয়াত মানসুখ হয়ে যায়নি। বরং এটি বৃদ্ধ পুরুষ ও বৃদ্ধা মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা তারা রোযা রাখতে সক্ষম নয়। সুতরাং তারা প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাবার খাওয়াবে। [সহীহ বুখারী, হা/৪৫০৫; আবু দাউদ, হা/২৩২০।]

২৬
রোযা ভঙ্গ হওয়ার কারণ
১. কিছু খাওয়া বা পান করা :

যদি কেউ ইচ্ছা করে কোন কিছু খায় অথবা পান করে, তাহলে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি এরূপ করবে, তাকে অবশ্যই বিনীতভাবে তওবা করতে হবে এবং ঐ রোযার কাযা ও কাফফারা আদায় করতে হবে। তবে কেউ যদি ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলে তবে তার রোযা ভঙ্গ হবে না। কিমত্মু রোযার কথা মনে পড়ার সাথে সাথে খাওয়া বন্ধ করে দেবে। আর যদি অন্য কেউ তাকে এ অবস্থায় দেখে ফেলে, তাহলে তাকে রোযার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾

তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার বিষয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করো না। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর।

(সূরা মায়েদা- ২)

২. ইচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত ঘটানো :

ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ যদি হসত্মমৈথুন করে বা সহবাস ছাড়া অন্য কোন উপায়ে বীর্যপাত ঘটায় তবে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার উপর কাযা আদায় করা ওয়াজিব হবে। এটাই জমহুর উলামাদের মতামত। [সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ২য় খন্ড পৃ: ৯৫।]

কেননা এভাবে বীর্যপাত ঘটানোও শাহাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত। আর রোযাদারের জন্য এটা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলা হাদীসে কুদসীতে বলেছেন,

يَدَعُ شَهْوَتَهٗ وَأَكْلَهٗ وَشُرْبَهٗ مِنْ أَجْلِيْ

রোযাদার আমার জন্য তার শাহাওয়াত, খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে। [সহীহ বুখারী, হা/৭৪৯২; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৩; নাসাঈ, হা/২২১৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫৯৬; বায়হাকী, হা/৮১১৫; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৮৭৯৩; জামেউস সগীর, হা/৮৬৬৭; মিশকাত, হা/১৯৫৯।]

৩. ইঞ্জেকশন গ্রহণ করলে :

রোযা অবস্থায় যদি কেউ এমন কোন ইঞ্জেকশন বা স্যালাইন নেয়, যা পুষ্টি বা খাদ্যের কাজে ব্যবহৃত হয়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে অন্যান্য ইঞ্জেকশন নিলে রোযা ভঙ্গ হবে না। কৃত্রিম উপায়ে শরীরে খাদ্য প্রবেশ করানো খাদ্য খাওয়ার শামিল। যেহেতু শক্তি অর্জনের জন্য মানুষ খাদ্য খায়, আর এরূপ ঔষধ দ্বারা সে শক্তিই অর্জন করা হয়। আর রোযার বিধান হলো বান্দা খাদ্যবসত্মু ত্যাগ করবে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَدَعُ شَهْوَتَهٗ وَأَكْلَهٗ وَشُرْبَهٗ مِنْ أَجْلِيْ

রোযাদার আমার জন্য তার শাহাওয়াত, খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে। [সহীহ বুখারী, হা/৭৪৯২; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৩; নাসাঈ, হা/২২১৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫৯৬; বায়হাকী, হা/৮১১৫; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৮৭৯৩; জামেউস সগীর, হা/৮৬৬৭; মিশকাত, হা/১৯৫৯।]

৪. সহবাসে লিপ্ত হওয়া :

রোযা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এমন ব্যক্তিকে খালিস নিয়তে তওবা করতে হবে এবং তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে।

২৭
রোযার কাফফারা
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلٰى رَسُوْلِ اللهِ فَقَالَ هَلَكْتُ فَقَالَ وَمَا ذَاكَ قَالَ وَقَعْتُ بِأَهْلِيْ فِيْ رَمَضَانَ قَالَ تَجِدُ رَقَبَةً قَالَ : لَا ، قَالَ : فَهَلْ تَسْتَطِيْعُ أَنْ تَصُوْمَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ قَالَ : لَا قَالَ فَتَسْتَطِيْعُ أَنْ تُطْعِمَ سِتِّيْنَ مِسْكِيْنًا قَالَ : لَا قَالَ فَجَاءَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ بِعَرَقٍ - وَالْعَرَقُ الْمِكْتَلُ - فِيْهِ تَمْرٌ فَقَالَ اذْهَبْ بِهٰذَا فَتَصَدَّقْ بِه فَقَالَ : الرَّجُلُ عَلٰى أَفْقَرَ مِنِّيْ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ فَوَاللهِ ! مَا بَيْنَ لَابَتَيْهَا يُرِيْدُ الْحَرَّتَيْنِ أَهْلُ بَيْتٍ أَفْقَرُ مِنْ أَهْلِ بَيْتِيْ، فَضَحِكَ النَّبِيُّ حَتّٰى بَدَتْ أَنْيَابُه ثُمَّ قَالَ : ‏أَطْعِمْهُ أَهْلَكَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এসে বলতে লাগল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। নবী ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ জিনিস তোমাকে ধ্বংস করেছে? সে বলল, আমি রমাযান মাসে দিনের বেলায় রোযা অবস্থায় সহবাসে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। তখন (কাফফারা আদায়ের জন্য) নবী ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি গোলাম আযাদ করার মতো সামর্থ্য আছে? সে বলল, না। আবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এক নাগাড়ে দুই মাস রোযা রাখতে পারবে কি? সে বলল, না। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ৬০ জন মিসকীনকে খাবার দিতে পারবে? সে বলল, না। নবী ﷺ তাকে বললেন, তুমি বসো। অতঃপর নবী ﷺ এর নিকট একটি বড় খেজুর ভর্তি ঝুড়ি আনা হলো। নবী ﷺ বললেন, তুমি এগুলো সাদাকা করে দাও। তখন সে বলল, ‘‘মদিনার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আমার চেয়ে গরীব আর কেউ নেই।’’ নবী তার এ কথা শুনে হাসলেন, এমনকি তাঁর সামনের দাঁতগুলোও বের হয়ে গিয়েছিল। এবার নবী ﷺ বললেন, এগুলো তুমিই নাও এবং তোমার পরিবারকে খেতে দাও। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৩৬; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬৫৭; আবু দাউদ, হা/২৩৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৬৯৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৪৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫২৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮০৭৩; দার কুতনী, হা/২৩৯৭; মিশকাত, হা/২০০৪।]

অতএব যদি কারো রোযার কাফফারা প্রদান করা ওয়াজিব হয়ে যায়, তাহলে একটি গোলাম আযাদ করতে হবে। কিমত্মু যদি কোনভাবে এ কাজ করতে সম্ভব না হয়, তাহলে একাধারে ২ মাস তথা ৬০টি রোযা রাখতে হবে। কিমত্মু যদি কোন ভাবে এটাতেও অক্ষম হয়, তাহলে ৬০টি মিসকীনকে মধ্যম মানের আহার করাতে হবে। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত প্রথম সত্মরের মাধ্যমে কাফফারা আদায় করতে সক্ষম থাকাবস্থায় দ্বিতীয় সত্মরের মাধ্যমে কাফফারা আদায় করা বৈধ হবে না।

উল্লেখ যে, কাফফারা হিসেবে পূর্ণ দুই মাস রোযা রাখার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। তবে কেউ যদি একামত্মই সক্ষম না হয়, তাহলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে রোযা রাখলেও চলবে। অধিকাংশ আলেম এ মত পোষণ করেছেন।

একাধিকবার সহবাস করলে তার বিধান কী :

১. যে ব্যক্তি রমাযান মাসে একই দিনে একাধিকবার সহবাস করবে তাকে একবারই কাফফারা আদায় করতে হবে।

২. যে ব্যক্তি রমাযান মাসের কোন এক দিনে সহবাস করবে, তারপর তার জন্য কাফফারা আদায় করবে; অতঃপর সে ব্যক্তি যদি পুনরায় অন্য দিন সহবাস করে, তাহলে তাকে পুনরায় কাফফারা দিতে হবে।

৩. যে ব্যক্তি রমাযানের কোন এক দিনে সহবাস করল এবং কাফফারা আদায় করার পূর্বেই অন্য দিন আবার সহবাস করল, তার ক্ষেত্রে একটি মত হচ্ছে, তাকে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে আলাদা কাফফারা দিতে হবে। আর অপর মত হচ্ছে, তার জন্য একটি কাফফারাই যথেষ্ট হবে। আর এ মতটিই অধিক নির্ভরযোগ্য। [সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ২য় খন্ড পৃ: ৯৯।]

স্ত্রীর উপর কাফফারা আসবে কি :

স্বামী-স্ত্রী উভয়ে রাজী হয়ে সহবাস করলে উভয়ের উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে কি না- এ ব্যাপারে দুটি মত আছে। একটি মত হলো, মহিলার উপর কাফফারা আসবে না। কেননা নবী ﷺ শুধু পুরুষকেই কাফফারা আদায় করার কথা বলেছেন, নারীকে বলেননি। অপর মত হলো মহিলার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে। যেহেতু সে এ কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করেছে এবং রোযার মর্যাদা নষ্ট করেছে। এ ক্ষেত্রে উভয়ের উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে- এটিই সঠিক মত। [সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ২য় খন্ড পৃ: ৯৮।]

যদি স্বামী স্ত্রীকে বাধ্য করে অথবা সে ভুলে সহবাসে লিপ্ত হয় তাহলে মহিলার উপর সঠিক মত অনুযায়ী কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে না। অনুরূপভাবে পুরুষও যদি ভুলে সহবাসে লিপ্ত হয় তবে তাকে কাযা ও কাফফারা আদায় করতে হবে না। [সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ২য় খন্ড পৃ: ৯৮।]

২৮
যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না
স্বপ্নদোষ হলে :

রোযা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে রোযা ভঙ্গ হবে না, কারণ এটা বান্দার ইচ্ছাধীন নয়।

অনিচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত ঘটলে :

যদি কোন রোগজনিত কারণে এমনিতেই বীর্যপাত হয়ে যায় অথবা সাদা পানি বের হয় অথবা স্ত্রীর দিকে তাকানোর ফলে অথবা যৌন বিষয়ক কোন চিন্তা-ভাবনা করার ফলে বীর্যপাত হয়ে যায় তাতেও রোযা ভঙ্গ হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : إِنَّ اللهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِيْ مَا حَدَّثَتْ بِه أَنْفُسَهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ ، أَوْ تَتَكَلَّمْ قَالَ قَتَادَةُ إِذَا طَلَّقَ فِيْ نَفْسِه فَلَيْسَ بِشَيْءٍ

আবু হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে নবী ﷺ হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের সেসব ধারণা ও চিন্তা ক্ষমা করে দেন, যা তাদের মনে উদয় হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তা কার্যে পরিণত করে বা অন্যের সাথে আলোচনা করে। কাতাদা (রাঃ) বলেন, যখন কেউ মনে মনে ত্বালাক্ব দেয়, তখন এর কোন মূল্য বা কার্যকারিতা নেই। [সহীহ বুখারী, হা/৫২৬৯; সহীহ মুসলিম, হা/৩৪৬; তিরমিযী, হা/১১৭৩; নাসাঈ, হা/৩৪৩৩; শারহুস সুন্নাহ, হা/৫৭; মিশকাত, হা/৬৩।]

গোসল ফরয থাকাবস্থায় রোযা শুরু করলে :

রাতে গোসল ফরয হয়েছে; কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল যে, গোসল করতে গেলে সাহারী খাওয়ার সময় থাকবে না, এ অবস্থায় আগে খেয়ে নেবে এবং পরে গোসল করে ফজরের সালাত পড়বে। এমতাবস্থায় আযানের পরে গোসল করলেও রোযার কোন ক্ষতি হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَ : أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يُدْرِكُهُ الْفَجْرُ وَهُوَ جُنُبٌ مِنْ أَهْلِه ثُمَّ يَغْتَسِلُ وَيَصُوْمُ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রীদের সাথে সহবাসজনিত নাপাকী অবস্থাতেই ফজরের সালাতের সময়ে উপনীত হতেন। অতঃপর তিনি গোসল করতেন এবং রোযার নিয়ত করে রোযা রাখতেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৯২৬; সহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৬; তিরমিযী, হা/৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৭০৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৯৮; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২২৮৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৯০৯৩; জামেউস সগীর, হা/৯০৬৯; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৩৯৭; মিশকাত, হা/২০০১।]

অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে :

ইচ্ছা করে বমি করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং পরে কাযা করতে হবে। কিন্তু অনিচ্ছায় যদি কারো বমি আসে তবে রোযা ভঙ্গ হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ - - قَالَ : مَنْ ذَرَعَهُ الْقَىْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ وَمَنِ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি অনিচ্ছায় বমি করে তাকে রোযা কাযা আদায় করতে হবে না। কিমত্মু যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে বমি করে, তাকে রোযা কাযা আদায় করতে হবে। [তিরমিযী, হা/৭২৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৭৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৪৬৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫১৮; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৫৫; মিশকাত, হা/২০০৭।]

ভুলে কোন কিছু খেয়ে ফেললে :

যদি কেউ ভুলে কোন কিছু আহার করে ফেলে অথবা পানাহার করে, তাহলে তার সিয়াম ভঙ্গ হবে না এবং তার উপর কাযা কাফফারা কোনটাই ওয়াজিব হবে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ -  - قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ -- : مَنْ نَسِىَ وَهُوَ صَائِمٌ فَأَكَلَ أَوْ شَرِبَ فَلْيُتِمَّ صَوْمَهٗ فَإِنَّمَا أَطْعَمَهُ اللهُ وَسَقَاهُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি সিয়াম অবস্থায় ভুলে কিছু খেয়ে ফেলে বা পান করে ফেলে, সে যেন তার সিয়াম পূর্ণ করে। কেননা আল্লাহই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭৭২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৮৫; সুনানে দারেমী, হা/১৭২৬; মিশকাত, হা/২০০৩।]

শিঙ্গা লাগালে :

শিঙ্গা লাগানোর দ্বারা সাওম ভঙ্গ হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ ثَابِتٍ الْبُنَانِيَّ يَسْأَلُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ ، ، أَكُنْتُمْ تَكْرَهُوْنَ الْحِجَامَةَ لِلصَّائِمِ قَالَ : لَا ، إِلَّا مِنْ أَجْلِ الضَّعْفِ

সাবিত আল-বুনানী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) কে প্রশ্ন করা হলো (রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময়) আপনারা কি রোযাদার ব্যক্তির শিঙ্গা লাগানো খারাপ মনে করতেন? তিনি বললেন, না; কিন্তু শিঙ্গা লাগানোর জন্য দুর্বলতা দেখা দেয়ার কারণে তা অপছন্দ করতাম। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৪০; মুসনাদে ইবনে জাদ, হা/১৪৬৬; মিশকাত, হা/২০১৬।]

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ احْتَجَمَ وَهُوَ مُحْرِمٌ وَاحْتَجَمَ وَهُوَ صَائِمٌ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ ইহ্রাম এবং রোযা অবস্থায়ও শিঙ্গা লাগিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৩৮; তিরমিযী, হা/৭৭৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৩২০৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৫৮; মিশকাত, হা/২০০২।]

শিঙ্গা লাগানোর দ্বারা যদি দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে অধিকাংশ সালাফী ফকীহগণের মতে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ ثَوْبَانَ عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ : أَفْطَرَ الْحَاجِمُ وَالْمَحْجُوْمُ

সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগাবে এবং যাকে শিঙ্গা লাগানো হবে তাদের উভয়ের রোযাই ভঙ্গ হয়ে যাবে। [আবু দাউদ, হা/২৩৬৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৫০৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫৩২; মুসনাদুল বাযযার, হা/৪১৫৬।]

স্ত্রীকে চুম্বন করলে :

যে নিজেকে সংযত রাখতে পারে তার জন্য স্ত্রীকে স্পর্শ করা, চুম্বন করা ও আলিঙ্গন করা জায়েয আছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ - رَضِىَ اللهُ عَنْهَا - قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يُقَبِّلُنِىْ وَهُوَ صَائِمٌ وَأَيُّكُمْ يَمْلِكُ إِرْبَهٗ كَمَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - يَمْلِكُ إِرْبَهٗ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাওম অবস্থায় আমাকে চুমু দিতেন। তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে, নিজের কামোদ্দীপনাকে আয়ত্বে রাখতে পারে, যেমন আয়ত্বে রাখতে সক্ষম ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর কামোদ্দীপনাকে। [মুসলিম, হা/২৬৩০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪২২০; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৮৪।]

عَنْ عَائِشَةَ - رَضِىَ اللهُ عَنْهَا - قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يُقَبِّلُنِىْ وَهُوَ صَائِمٌ وَأَنَا صَائِمَةٌ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে চুমু খেতেন। আর তখন তিনিও রোযা অবস্থায় ছিলেন এবং আমিও রোযা অবস্থায় ছিলাম। [আবু দাউদ, হা/২৩৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪৯৫।]

তবে যে অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যায় তার জন্য এসব থেকে বিরত থাকা উচিত; নতুবা জায়েযের পথ ধরে রোযা ভঙ্গ হওয়ার মত কিছু ঘটে যেতে পারে।

عَنْ عُمَرَ بْنِ أَبِىْ سَلَمَةَ أَنَّهٗ سَأَلَ رَسُوْلَ اللهِ - أَيُقَبِّلُ الصَّائِمُ فَقَالَ لَهٗ رَسُوْلُ اللهِ - - سَلْ هٰذِه  . لِأُمِّ سَلَمَةَ فَأَخْبَرَتْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - يَصْنَعُ ذٰلِكَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ . فَقَالَ لَهٗ رَسُوْلُ اللهِ - - أَمَا وَاللهِ إِنِّىْ لَأَتْقَاكُمْ لِلّٰهِ وَأَخْشَاكُمْ لَهٗ

উমর ইবনে আবু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একদা তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, সাওম পালনকারী ব্যক্তি চুম্বন করতে পারে কি? তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, কথাটি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করো। (তাঁকে জিজ্ঞেস করার পর) তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এরূপ করেন। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সমুদয় গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, শোনো, আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহ তা‘আলাকে তোমাদের সকলের চেয়ে অধিক ভয় করি। [সহীহ মুসলিম, হা/২৬৪৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫৩৮; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩১২; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৮২১৫; বায়হাকী, হা/৭৮৯৪।]

রোযা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস ছাড়া অন্যান্য কাজ বৈধ। যদি চুম্বনের ফলে মযী তথা সাদা পানি বের হয় তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই। [আল মাজমু‘ ২য় খন্ড পৃ: ২২৩।]

তবে রোযাদার ব্যক্তি যদি এ ধারণা করে যে, স্ত্রীর সাথে মাখামাখি করতে গেলে তার বীর্যপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তবে তার জন্য এসব করা জায়েয হবে না। যদি সে এসব করে এবং বীর্যপাত ঘটে, তবে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার জন্য কাযা ও কাফফারা দুটিই ওয়াজিব হবে।

নিম্নবর্ণিত কারণে রোযার কোন ক্ষতি হয় না :

 রোযা অবস্থায় মেসওয়াক করাতে কোন দোষ নেই। চাই মেসওয়াক তাজা হোক অথবা শুকনো হোক। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের অথবা লোকদের জন্য যদি কষ্ট মনে না করতাম, তাহলে প্রত্যেক সালাতের সাথে তাদেরকে আমি মেসওয়াক করার জন্য আদেশ করতাম। [সহীহ বুখারী, হা/৮৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৫৩৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮০৭০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৬৬১৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৫।]

 মেসওয়াকের সময় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। তবে রক্ত গলাধঃকরণ করা যাবে না।

 দাঁতের মাজন বা পেস্ট রোযা ভঙ্গকারী নয়, বরং তা মেসওয়াকের মতোই, তবে পেটে যেন না যায় সেজন্য সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যদি অনিচ্ছায় পেটে যায়, তবে সমস্যা নেই। তবে মাজন দ্বারা রাতে দাঁত মাজাই উত্তম।

 মুখের থুথু গিলে ফেললে অথবা দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাদ্যের কণা থুথুর সাথে পেটে চলে গেলে অথবা দাঁতের মাড়ি থেকে সামান্য রক্ত বের হলে রোযা ভঙ্গ হবে না। [সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ২য় খন্ড, পৃ: ১০৬।]

 সাওম পালনকারী গোসল ও শীতলতা অর্জন করলে সাওম ভাঙ্গবে না।

 অক্সিজেন গ্রহণ পানাহার নয়, পানাহারের বিকল্পও নয়। অতএব তা সিয়াম ভঙ্গকারী নয়।

 গোসল করা, শরীরে তেল মালিশ করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, নাকে, কানে ও চোখে ঔষধ দেয়া, চোখে সুরমা ব্যবহার করা সিয়াম ভঙ্গকারী নয়।

 বাবুর্চি বা রান্নার কাজে নিয়োজিত মহিলা প্রয়োজনে তরকারীর স্বাদ পরীক্ষা করতে পারে। তবে প্রয়োজন না হলে স্বাদ না নেয়াই উত্তম। কোন খাদ্যদ্রব্য চিবিয়ে শিশুর মুখে দেয়াতে রোযা ভঙ্গ হবে না। কারণ এসব কাজ সাধারণত খাদ্য গ্রহণের জন্য কেউ করে না, বরং প্রয়োজনের তাগিদে তাকে করতে হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের মধ্যে কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ﴾

তিনি দ্বীনের মধ্যে কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। (সূরা হাজ্জ- ৭৮)

 এমন কিছু কাজ আছে যা করলে রোযা একেবারে ভঙ্গ হয়ে যায় না; তবে রোযা ত্রুটিযুক্ত হয় এবং রোযার সওয়াব কমে যায়। যেমন- গীবত ও চোগলখোরী করা, পরস্পরে গালা-গালি করা, মারা-মারি করা, মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মুসলমানের মান-ইজ্জত নষ্ট করা, রাগান্বিত হওয়া, মূল্যবান সময়কে অনর্থক কাজে নষ্ট করা, অশ্লীল গান অথবা মিউজিক সম্বলিত যে কোন গান শ্রবণ করা, টেলিভিশনের পর্দায় অশ্লীল ছবি দেখা, নারীদের বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও আড্ডা দেয়া ইত্যাদি। এ সকল কাজ সব সময়ের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ; তাই রমাযানে তো বটেই; রমাযান ছাড়া অন্যান্য সময়েও এ সকল কাজ থেকে দূরে থাকা মুসলিম নর-নারীর উপর একান্ত কর্তব্য।

২৯
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে রোযা রাখা
ইবাদাতের ক্ষেত্রে ইসলামের একটি মূলনীতি হচ্ছে, শারীরিক ইবাদাতসমূহে কোন ধরনের প্রতিনিধিত্ব বৈধ নয়। তবে সিয়াম ও হজ্জ এ নীতির অন্তর্ভুক্ত নয়। হাফেয ইবনে আবদুল বার (রহ.) বলেছেন, সালাতের ব্যাপারে সবাই একমত যে, কেউ কারো পক্ষ থেকে সালাত আদায় করবে না, না ফরয, না সুন্নাত, না নফল, না জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে, না মৃত ব্যক্তির। অনুরূপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সিয়াম। তাই জীবিতাবস্থায় একের সাওম অপরের পক্ষ থেকে আদায় হবে না। এতে কারো দ্বিমত নেই। কিমত্মু যে মারা যায়, তার জিম্মায় যদি সিয়াম থাকে, তার ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেছেন, উত্তরাধিকারগণ আদায় করবে, আবার কেউ বলেছেন, উত্তরাধিকারগণ আদায় করবে না।

মৃত ব্যক্তির জিম্মায় যদি সিয়াম থাকে তবে তার দুই অবস্থা :

১. কাযার সুযোগ না পেয়ে মারা যাওয়া। সময়ের সংকীর্ণতা অথবা অসুস্থতা অথবা সফর অথবা সাওমের অক্ষমতার দরুণ কাযার সুযোগ পায়নি। অধিকাংশ আলেমদের মতে তার উপর কিছুই আদায় করতে হবে না।

২. মারা যাওয়ার পূর্বে কাযা আদায় করার সুযোগ ছিল অথচ আদায় করেনি, এ ক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে সাওম রাখবে।

মৃতের জিম্মায় যদি অনেক সিয়াম থাকে, আর সে সংখ্যানুসারে তার পক্ষ থেকে কতক লোক যদি একদিন সিয়াম পালন করে, তাহলে শুদ্ধ হবে।

عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : مَنْ مَاتَ ، وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهٗ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে মারা গেল, অথচ তার উপর কাযা সিয়াম রয়েছে; তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে সাওম রাখবে। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫২; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৮; আবু দাউদ, হা/২৪০২।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ - - فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ أُمِّىْ مَاتَتْ وَعَلَيْهَا صَوْمُ شَهْرٍ أَفَأَقْضِيْهِ عَنْهَا فَقَالَ لَوْ كَانَ عَلٰى أُمِّكَ دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ عَنْهَا . قَالَ نَعَمْ . قَالَ : فَدَيْنُ اللهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضٰى

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় আমার মাতা মৃত্যু বরণ করেছেন। কিমত্মু তার উপর রমাযান মাসের রোযা ফরয ছিল। সুতরাং আমি কি তার পক্ষ হতে কাযা আদায় করব? তখন তিনি বললেন, যদি তোমার মায়ের কোন ঋণ থাকত, তাহলে তুমি কি তা আদায় করতে না? সে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, তাহলে আল্লাহর হক তো আরো অধিক আদায়যোগ্য। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৫০; আবু দাউদ, হা/৩৩১২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩৬; দার কুতনী, হা/২৩৪০; বায়হাকী, হা/৮০১৩।]

৩০
রমাযানের কাযা রোযা আদায়ের নিয়ম
যদি কারো জিম্মায় রমাযানের কাযা রোযা থেকে যায়, তাহলে কোন ওজর না থাকলে রমাযানের কাযা রোযা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়াই উত্তম। কারণ মানুষের হায়াত কখন শেষ হয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা নেক বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

﴿أُولٰٓئِكَ يُسَارِعُوْنَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُوْنَ﴾

তারাই কল্যাণকর কাজসমূহ দ্রুত সম্পাদন করে থাকে এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়। (সূরা মুমিনূন- ৬১)

তবে যদি কোন ওজর থাকে তাহলে সুবিধা অনুযায়ী দেরি করে আদায় করা যাবে। এমনকি যদি দ্বিতীয় রমাযান চলে আসে, তবে দ্বিতীয় রমাযানের ফরয রোযা যথা নিয়মে আদায় করার পর পূর্বের কাযা রোযা আদায় করবে।

عَنْ عَائِشَةَ ، ، تَقُوْلُ كَانَ يَكُوْنُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ فَمَا أَسْتَطِيْعُ أَنْ أَقْضِيَ إِلَّا فِيْ شَعْبَانَ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার উপর রমাযানের কাযা রোযা থাকত, কিন্তু শা‘বান মাস আসার আগে আমি তা আদায় করতে সক্ষম হতাম না। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫০; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৩; তিরমিযী, হা/৭৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৯৭২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৪৯; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯৮১৯; মিশকাত, হা/২০৩০।]

রমাযানের কাযা রোযা আদায় করতে ধারাবাহিকতা শর্ত নয়। বান্দার সুবিধা অনুযায়ী একসাথেও রাখতে পারে আবার মধ্যখানে বিরতি দিয়েও রাখতে পারে।

৩১
সাহারী খাওয়া
রোযা রাখার নিয়তে ভোররাতে যে খাবার খাওয়া হয় তাকে সাহারী বলে। এখানে এ শব্দটির উচ্চারণ ‘সেহ্রী’ বা ‘সাহ্রী’ সঠিক নয়। কারণ আরবি ভাষায় ‘সেহ্রুন’ শব্দের অর্থ যাদু করা। যেমন : সূরা বাকারার ১২০ নং আয়াতে উল্লেখ আছে যে, يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ السِّحْرَ ‘‘তারা মানুষকে যাদু শিখাত।’’ আবার سَحْرٌ সাহ্রুন শব্দের অর্থ হলো বুকের উপরিভাগ। অথচ আরবি ভাষায় রাতের শেষ ভাগ বুঝাতে سَحَر ‘সাহার’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন نَجَّيْنٰهُمْ بِسَحَرِ ‘‘আমি তাদেরকে (লূতের পরিবারকে) রাতের শেষ ভাগে মুক্তি দিয়েছি’’ (সুরা কামার- ৩৪)। তাই এর উচ্চারণে ‘সেহ্রী’ বা ‘সাহ্রী’ না বলে ‘‘সাহারী’’ বলাই শুদ্ধ।

সাহারী খাওয়ার গুরুত্ব :

عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ

আমর ইবনে আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আহলে কিতাব (ইয়াহুদি ও নাসারা) এর রোযা আর আমাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য এই যে, আমরা সাহারী খেয়ে রোযা রাখি আর তারা সাহারী খায় না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৪; আবু দাউদ, হা/২৩৪৫; তিরমিযী, হা/৮০৯; নাসাঈ, হা/২১৬৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৪০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৩৭৭; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৭০৯; মিশকাত, হা/১৯৮৩।]

সাহারীতে বরকত রয়েছে :

عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - تَسَحَّرُوْا فَإِنَّ فِى السُّحُوْرِ بَرَكَةً

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা সাহারী খাও, কেননা সাহারী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে। [সহীহ বুখারী, হা/১৯২২; সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৩; তিরমিযী, হা/৭০৮; নাসাঈ, হা/২১৪৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৮৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৩৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৬৬; জামেউস সগীর, হা/৫২৫৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৬৩; মিশকাত, হা/১৯৮২।]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : تَسَحَّرُوْا وَلَوْ بِجَرْعَةٍ مِنْ مَاءٍ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা সাহারী খাও- এক ঢুক পানি দিয়ে হলেও। [সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৭৬; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা৩৩৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৭৫৯৯; মারেফাতুস সাহাবা, হা/৩৭২২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৭১।]

সাহারী ভক্ষণকারীদের উপর রহমত বর্ষিত হয় :

عَنْ أَبِي سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : السَّحُوْرُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ ، فَلَا تَدَعُوْهُ ، وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ ، فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلَائِكَتَهٗ يُصَلُّوْنَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সাহারী সম্পূর্ণটাই বরকতময়। অতএব তোমরা এটা ছেড়ে দিও না, যদি তোমাদের কেউ এক ঢুক পানি পান করার সুযোগ পায়, তবে যেন তা পান করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সাহারী ভক্ষণকারীদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তাদের জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করতে থাকেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৪১৪; জামেউস সগীর, হা/৫৯৯৬।]

সাহারী দেরিতে খাওয়া উত্তম :

সাহারী খাওয়ার সময় হলো মধ্যরাত থেকে শুরু করে সুবহে সাদিক এর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। তবে বিলম্ব করে (সুবহে সাদিকের পূর্বে) খাওয়া মুস্তাহাব। হাদীসে বর্ণিত আছে,

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ ، ، قَالَ : كُنْتُ أَتَسَحَّرُ فِي أَهْلِي ثُمَّ تَكُوْنُ سُرْعَتِي أَنْ أُدْرِكَ السُّجُوْدَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ .

সাহল ইবনে সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আমার পরিবারের সাথে সাহারী সম্পন্ন করি। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে জামা‘আতে সালাত ধরার জন্য আমাকে তাড়াতাড়ি মসজিদে যেতে হতো। [সহীহ বুখারী, হা/১৯২০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৪২; বায়হাকী, হা/১৯৮১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৫৭৭০।]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল, সাহল ইবনে সা‘দ (রাঃ) সাহারীর একেবারে শেষ সময়ে খাবার গ্রহণ করতেন। অপর হাদীসে বলা হয়েছে,

عَنْ أَنَسٍ عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ ، ، قَالَ تَسَحَّرْنَا مَعَ النَّبِيِّ ثُمَّ قَامَ إِلَى الصَّلَاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ بَيْنَ الْأَذَانِ وَالسَّحُوْرِ قَالَ قَدْرُ خَمْسِيْنَ اٰيَةً

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেন, আমরা নবী ﷺ এর সাথে সাহারী খেয়েছি। তারপর তিনি সালাতে দাঁড়িয়েছেন। বর্ণনাকারী আনাস (রাঃ) বলেন, আমি যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, সাহারী ও আযানের মাঝখানে কত সময়ের ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত পাঠ করার মতো। [সহীহ বুখারী, হা/১৯২১; সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৬; নাসাঈ, হা/২১৫৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৯৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৪১।]

এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে সাহারী খাওয়া ও ফজরের আযানের মধ্যখানে ৫০টি আয়াত পড়ার সমপরিমাণ সময় থাকত। ৫০টি আয়াত পড়তে প্রায় ১৫-২০ মিনিট সময় লাগতে পারে। এ থেকে বুঝা যায় যে, সাহাবীরা খুব আগে সাহারী খেতেন না। আযানের কিছু সময় আগে খাওয়া শেষ করতেন।

৩২
ইফতার প্রসঙ্গ
সূর্য ডুবার সাথে সাথেই ইফতারের সময় হয়ে যায় :

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : إِذَا أَقْبَلَ اللَّيْلُ مِنْ هَاهُنَا وَأَدْبَرَ النَّهَارُ مِنْ هَاهُنَا وَغَرَبَتِ الشَّمْسُ فَقَدْ أَفْطَرَ الصَّائِمُ .

উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যখন রাত্রি আগমন করবে, দিন বিদায় নেবে এবং সূর্য অসত্মমিত হবে, তখন রোযাদার ইফতার করবে। [সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৬১২; তিরমিযী, হা/৬৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫১৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৬০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৪০; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২২৩৬; বায়হাকী, হা/৭৭৯৪; সুনানে দারেমী, হা/১৭০০; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৩৫; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৫৯৫; মিশকাত, হা/১৯৮৫।]

মাগরিবের সালাতের সময় সম্পর্কে সকলেই একমত যে, সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাগরিবের সময় হয়ে যায়। আর মাগরিবের সালাতের সময় বর্ণনা করতে গিয়ে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে :

عَنْ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - كَانَ يُصَلِّى الْمَغْرِبَ إِذَا غَرَبَتِ الشَّمْسُ وَتَوَارَتْ بِالْحِجَابِ

সালামা ইবনে আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সূর্য অস্তমিত হয়ে অদৃশ্য হলেই রাসূলুল্লাহ ﷺ মাগরিবের সালাত আদায় করতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১৪৭২; তিরমিযী, হা/১৬৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৫২৩; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৮৩১; বায়হাকী, হা/১৯৩৮।]

সুতরাং সূর্য অস্তমিত হয়ে অদৃশ্য হলেই ইফতারের সময় হয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ মাগরিবের সালাতের পূর্বেই ইফতার করতেন :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ : كَانَ النَّبِىُّ - - يُفْطِرُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّىَ عَلٰى رُطَبَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ فَتُمَيْرَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تُمَيْرَاتٌ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ মাগরিবের সালাত আদায় করার পূর্বে কয়েকটি তাজা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। কিমত্মু যদি তাজা খেজুর না পেতেন তবে কয়েকটি শুকনো খেজুর খেতেন। আর যদি শুকনো খেজুরও না পেতেন তাহলে কয়েক ঢুক পানি খেয়ে নিতেন। [আবু দাউদ, হা/২৩৫৮; তিরমিযী, হা/৬৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৬৯৮; দার কুতনী, হা/২২৭৮; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/১৫৭৬।]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইফতার করে মাগরিবের সালাত আদায় করার জন্য যেতেন।

কিছু লোক রয়েছে যারা ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ (অতঃপর তোমরা রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো)। এ আয়াতটির ভুল ব্যাখ্যা করে বলে থাকে, মাগরিবের সালাতের পরে ইফতার করতে হবে। এটা কুরআন, সুন্নাহ ও সমস্ত মুসলিমদের ইজমার পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ ﷺ মাগরিবের সালাতের পরে ইফতার করেছেন এর কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং সূর্য অসত্মমিত হওয়ার সাথে সাথে রোযা ভেঙ্গে ফেলাই ইসলামের বিধান।

তাড়াতাড়ি ইফতার করার গুরুত্ব :

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ ، عَجِّلُوا الْفِطْرَ ؛ فَإِنَّ الْيَهُوْدَ يُؤَخِّرُوْنَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, লোকেরা যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে। কারণ ইয়াহুদিরা দেরিতে ইফতার করে থাকে। [ইবনে মাজাহ, হা/১৬৯৮; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৪৩৪-৩৫; সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৮; তিরমিযী, হা/৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৭৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৫৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫০২; জামেউস সগীর, হা/১৩৬৫২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৭৩; মুসনাদে দারেমী, হা/১৭৪১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭৫৯২; মিশকাত, হা/১৯৮৩।]

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ : لَا يَزَالُ الدِّيْنُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارٰى يُؤَخِّرُوْنَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ইসলাম ততদিন পর্যমত্ম প্রভাবশালী হয়ে থাকবে, যতদিন পর্যমত্ম লোকেরা তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। কেননা ইয়াহুদি ও নাসারারা দেরিতে ইফতার করে থাকে। [আবু দাউদ, হা/২৩৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৮০৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫০৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৯৫১; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৭৩; বায়হাকী, হা/৭৯০৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯০৩৭; জামেউস সগীর, হা/১৩৬৪৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৭৫; মিশকাত, হা/১৯৯৫।]

উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, সূর্য ডুবার সাথে সাথে ইফতার করা সুন্নাত এবং দেরি করা সমীচীন নয়।

খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নাত :

عَنْ اَنَسٍ بْنِ مَالِكٍ يَقُوْلُ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يُفْطِرُ عَلٰى رُطَبَاتٍ قَبْلَ أَنْ يُّصَلِّىَ فَاِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ فَعَلٰى تَمَرَاتٍ فَاِنْ لَمْ تَكُنْ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ মাগরিবের সালাত আদায় করার পূর্বে কয়েকটি তাজা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। কিমত্মু যদি তাজা খেজুর না পেতেন তবে কয়েকটি শুকনো খেজুর খেতেন। আর যদি শুকনো খেজুরও না পেতেন তাহলে কয়েক ঢুক পানি খেয়ে নিতেন। [আবু দাউদ, হা/২৩৫৮; তিরমিযী, হা/৬৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৬৯৮; দার কুতনী, হা/২২৭৮; মুস্তাদরাক, হা/১৫৭৬;]

ইফতারের সময় দু‘আ কবুল হয় :

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ ، اَلْإِمَامُ الْعَادِلُ ، وَالصَّائِمُ ، حَتّٰى يُفْطِرَ ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُوْمِ ، يَرْفَعُهَا اللهُ دُوْنَ الْغَمَامِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، وَتُفَتَّحُ لَهَا اَبْوَابُ السَّمَاءِ ، وَيَقُوْلُ : بِعِزَّتِيْ لَأَنْصُرَنَّكِ وَلَوْ بَعْدَ حِيْنٍ

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তিন শ্রেণির লোকের দু‘আ ফেরত দেয়া হয় না, (১) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ, (২) রোযাদার ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ইফতার করে এবং (৩) মাযলুম ব্যক্তির দু‘আ। [তিরমিযী, হা/ ২৫২৬; মিশকাত হা/২২৪৯।]

ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে দু‘আ :

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে এই দু‘আ পড়তেন :

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الَّتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِيْ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিরহমাতিকাল্লাতী ওয়াসি‘আত কুল্লা শায়ইন আন তাগফিরালী।

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার বিশ্বময় প্রশস্ত রহমতের উসিলায় তোমার কাছে আবেদন করি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। [ইবনে মাজাহ, হা/১৭৫৩; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৩৫।]

ইফতারের সময় দু‘আ :

‘বিসমিল্লাহ’ বলে ইফতার শুরু করবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ খাওয়া আরম্ভ করে তখন সে যেন বলে, بِسْمِ اللهِ (বিস্মিল্লা-হ) অর্থাৎ আল্লাহর নামে শুরু করছি। আর কেউ যদি খাবারের শুরুতে বিস্মিল্লা-হ বলতে ভুলে যায়, তাহলে সে যেন বলে

بِسْمِ اللهِ اَوَّلَه وَاٰخِرَه

(বিসমিল্লা-হি আওয়ালাহূ ওয়া আ-খিরাহূ) অর্থাৎ এই খাবারের প্রথমেও বিসমিল্লাহ এবং শেষেও বিসমিল্লাহ। [আবু দাউদ, হা/৩৭৬৯; তিরমিযী, হা/১৮৫৮; ইবনে মাজাহ, হা/৩২৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৭৭৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২১০৭; মিশকাত, হা/৪২০২।]

উল্লেখ্য যে, ইফতারের শুরুতে ‘‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু....’’ এভাবে যে দু‘আ সমাজে প্রচলিত রয়েছে তা দুর্বল হাদীসে বর্ণিত। অতএব সহীহ হাদীসে বর্ণিত দু‘আ পাঠ করাই উচিত।

ইফতারের পর দু‘আ :

ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন ইফতার করতেন তখন এ দু‘আটি পাঠ করতেন,

ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْاَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ

উচ্চারণ : যাহাবায্ যামাউ, ওয়াবতাল্লাতিল ‘উরূকু, ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশা-আল্লা-হু।

অর্থ : পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং নেকী নির্ধারিত হলো যদি আল্লাহ চান। [আবু দাঊদ, হা/২৩৫৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৫৩৯৫; দার কুতনী, হা/২২৭৯; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৩৬; বায়হাকী, হা/৭৯২২; জামেউস সগীর, হা/৮৮০৭; মিশকাত, হা/১৯৯৩।]

কেউ ইফতার করালে তার জন্য দু‘আ :

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ (সিয়াম অবস্থায়) সা‘দ ইবনে উবাদা (রাঃ) এর নিকট গেলেন। তখন সা‘দ (রাঃ) রুটি এবং যায়তুনের তেল নিয়ে আসলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ খাবার শেষ করার পর এই দু‘আ পাঠ করলেন :

اَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُوْنَ وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلَائِكَةُ

উচ্চারণ : আফ্ত্বারা ‘ইন্দাকুমুস সা-’ইমূনা, ওয়া আকালা ত্বা‘আমাকুমুল আবরা-র, ওয়া সাল্লাত ‘আলাইকুমুল মালা-ইকাহ।

অর্থ : সিয়াম পালনকারীগণ তোমাদের নিকট ইফতার করুক, সৎ লোকগণ তোমাদের আহার গ্রহণ করুক এবং ফেরেশতাগণ তোমাদের জন্য দু‘আ করুক। [আবু দাঊদ, হা/৩৮৫৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৪৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫২৯৬; জামেউস সগীর, হা/৮৮০৬।]

রোযাদারকে ইফতার করানোর ফযীলত :

عَنْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهٗ مِثْلُ أَجْرِه غَيْرَ أَنَّهٗ لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا

যায়েদ ইবনে খালেদ আল জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে অথবা কোন যুদ্ধাকে জিহাদের আসবাবপত্র সংগ্রহ করে দেবে বা তার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করবে সে রোযাদার ও মুজাহিদের সমান সওয়াব পাবে এবং তাকে সওয়াব দানের ক্ষেত্রে রোযাদার ও মুজাহিদের থেকে বিন্দু মাত্র কমানো হবে না। [তিরমিযী, হা/৮০৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭০৭৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪২৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৩৭৭৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৫১৩০; বায়হাকী, হা/৭৯২৬।]

৩৩
রমাযান মাসে নেক আমলে অগ্রগামী হওয়া
যেহেতু রমাযান মাসটাকে মহান আললাহ বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, যা আমরা কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তাই এ মাসটাকে ইবাদাত-বন্দেগী ও ভালো কাজের মধ্যে ব্যয় করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর একান্ত কর্তব্য।

রমাযান মাসে মানুষকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এভাবে আহবান করা হয়,

يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ

হে মঙ্গল অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে কুপথগামী! একটু থামো। [তিরমিযী, হা/৬৮২; নাসাঈ, হা/২১০৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৪২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৮১৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৮৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৩৫; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৩২।]

অর্থাৎ এ মাসে যেহেতু রহমতের দরজা খোলা থাকে, তাই তুমি এই সুযোগকে হেলায়-খেলায় নষ্ট করো না। দুনিয়া-আখিরাতে উন্নতি লাভের জন্য তুমি ভালো কাজে তৎপর হও। অপরদিকে এ মাসে যেহেতু শয়তানগুলো বাঁধা থাকে, তাই এ সময়টি হচ্ছে পাপ থেকে দূরে সরে আসার সুবর্ণ সুযোগ। তাই তুমি সচেতন হও, ফিরে আসো তোমার প্রভুর দিকে। রমাযানের এই মর্মস্পর্শী ডাকে সকলের সাড়া দেয়া উচিত।

৩৪
বিশেষ বিশেষ আমলসমূহ
কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী এ মাসে যেসকল আমল করা একান্ত জরুরি এখন আমরা তা জানব এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করব। তাহলেই রোযার মাস আমাদের জন্য সার্থক হবে।

৩৫
কিয়ামুল লাইল তথা রাতের সালাত আদায় করা
قِيَامُ اللَّيْلِ (কিয়ামুল লাইল) শব্দের অর্থ রাতের সালাত। অর্থাৎ এশার সালাতের পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যেসব নফল সালাত আদায় করা হয় তাকে قِيَامُ اللَّيْلِ (কিয়ামুল লাইল) বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّقِيَامًا﴾

আর যারা তাদের প্রভুর সমুতষ্টির লক্ষ্যে সিজদাবনত ও দন্ডায়মান অবস্থায় রাত্রি যাপন করে। (সূরা ফুরকান- ৬৪)

রমাযান মাসে কিয়ামুল লাইলকে ফকীহগণের পরিভাষায় সালাতুত তারাবীহ বা তারাবীর সালাত বলা হয়।

তারাবীহ শব্দের অর্থ হচ্ছে, বিশ্রাম লওয়া, আরাম করা ইত্যাদি। যেহেতু এ সালাতে প্রতি চার রাক‘আত পর পর বিশ্রাম করতে হয় সে কারণে এ সালাতকে তারাবীর সালাত বলা হয়।

কিয়ামুল লাইল এর গুরুত্ব ও ফযীলত :

রমাযান মাসে কিয়ামুল লাইল আদায় করার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এর মধ্যে অনেক সওয়াব নিহিত রয়েছে। এ সালাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমাযান মাসে কিয়ামুল লাইল করবে তার পেছনের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/২৪৯; সহীহ বুখারী, হা/২০০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৭৫; আবু দাউদ, হা/১৩৭৩; তিরমিযী, হা/৮০৮।]

৩৬
তারাবীর সালাতের সূচনা
রাসূলুল্লাহ ﷺ অল্প কয়েক দিন এ সালাত আদায় করেছিলেন। প্রথম দিকে তিনি একা একা এ সালাত আদায় করতেন। তারপর এটা দেখে সাহাবায়ে কেরামও তাঁর সাথে সালাত আদায় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাসূলুল্লাহ ﷺ তা ত্যাগ করেন। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ ذَرٍّ قَالَ صُمْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ - رَمَضَانَ فَلَمْ يَقُمْ بِنَا شَيْئًا مِنَ الشَّهْرِ حَتّٰى بَقِىَ سَبْعٌ فَقَامَ بِنَا حَتّٰى ذَهَبَ ثُلُثُ اللَّيْلِ فَلَمَّا كَانَتِ السَّادِسَةُ لَمْ يَقُمْ بِنَا فَلَمَّا كَانَتِ الْخَامِسَةُ قَامَ بِنَا حَتّٰى ذَهَبَ شَطْرُ اللَّيْلِ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ لَوْ نَفَّلْتَنَا قِيَامَ هٰذِهِ اللَّيْلَةِ . قَالَ فَقَالَ : إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا صَلٰى مَعَ الْإِمَامِ حَتّٰى يَنْصَرِفَ حُسِبَ لَهٗ قِيَامُ لَيْلَةٍ . قَالَ فَلَمَّا كَانَتِ الرَّابِعَةُ لَمْ يَقُمْ فَلَمَّا كَانَتِ الثَّالِثَةُ جَمَعَ أَهْلَهٗ وَنِسَاءَهٗ وَالنَّاسَ فَقَامَ بِنَا حَتّٰى خَشِيْنَا أَنْ يَفُوْتَنَا الْفَلَاحُ . قَالَ قُلْتُ مَا الْفَلَاحُ قَالَ السُّحُوْرُ ثُمَّ لَمْ يَقُمْ بِنَا بَقِيَّةَ الشَّهْرِ

আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক রমাযান মাসে আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে রোযা রাখলাম। যখন উক্ত রমাযান মাসের ৭ দিন বাকি ছিল তখন তিনি আমাদেরকে নিয়ে রাত্রিজাগরণ করলেন। আর সেদিন তিনি রাত্রির এক তৃতীয়াংশ পর্যমত্ম জাগরণ করেন। অতঃপর যখন রমাযান মাসের ৬ দিন বাকি ছিল সেদিন তিনি উঠলেন না। তবে যখন ৫ দিন বাকি ছিল তখন অর্ধরাত্রি পর্যমত্ম জাগরণ করলেন। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি এ রাত্রিজাগরণটা আমাদের জন্য নফল হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হতো! তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, যখন কোন ব্যক্তি ইমামের সাথে সালাম ফিরানোর পূর্ব পর্যমত্ম সালাত আদায় করে তখন তার সেই সালাতকেই কিয়ামুল লাইল হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর যখন রমাযান মাসের ৪ দিন বাকি ছিল তখন তিনি রাত্রিজাগরণ করেননি। তবে যখন রমাযান মাসের ৩ দিন বাকি ছিল তখন তিনি তার পরিবার, স্ত্রী ও লোকদেরকে একত্রিত করলেন এবং আমাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন। (আর তা এত দীর্ঘ করলেন) আমরা ভয় করলাম যে, ফালাহ হতে বঞ্চিত হয়ে যাব। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফালাহ কী? তিনি বললেন, সাহারীর সময় শেষ হয়ে যাওয়া। এরপর রমাযান মাসের বাকি দিনগুলোতে তিনি আমাদেরকে নিয়ে রাত্রিজাগরণ করেননি। [তিরমিযী, হা/৮০৬; আবু দাউদ, হা/১৩৭৭; নাসাঈ, হা/১৩৬৪; ইবনে মাজাহ, হা/১৩২৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২০৬।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَ : أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ خَرَجَ ذَاتَ لَيْلَةٍ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ فَصَلّٰى فِي الْمَسْجِدِ فَصَلّٰى رِجَالٌ بِصَلَاتِه فَأَصْبَحَ النَّاسُ فَتَحَدَّثُوْا فَاجْتَمَعَ أَكْثَرُ مِنْهُمْ فَصَلَّوْا مَعَهٗ فَأَصْبَحَ النَّاسُ فَتَحَدَّثُوْا فَكَثُرَ أَهْلُ الْمَسْجِدِ مِنَ اللَّيْلَةِ الثَّالِثَةِ فَخَرَجَ رَسُوْلُ اللهِ فَصَلَّوْا بِصَلَاتِه فَلَمَّا كَانَتِ اللَّيْلَةُ الرَّابِعَةُ عَجَزَ الْمَسْجِدُ عَنْ أَهْلِه حَتّٰى خَرَجَ لِصَلَاةِ الصُّبْحِ فَلَمَّا قَضَى الْفَجْرَ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَتَشَهَّدَ ثُمَّ قَالَ أَمَّا بَعْدُ ، فَإِنَّهٗ لَمْ يَخْفَ عَلَيَّ مَكَانُكُمْ لٰكِنِّيْ خَشِيْتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ فَتَعْجِزُوْا عَنْهَا ، فَتُوُفِّيَ رَسُوْلُ اللهِ وَالْأَمْرُ عَلٰى ذٰلِكَ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযানের রাতের মধ্যভাগে বের হলেন, অতঃপর মসজিদে সালাত আদায় করলেন এবং লোকজনও তাঁর পেছনে সালাত আদায় করল। পরে সকাল হলে লোকেরা এর চর্চা করল। দ্বিতীয় দিন এর চেয়ে বেশি মানুষ জামা‘আতে উপস্থিত হলো। রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাত আদায় করলেন। লোকেরাও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সালাত আদায় করল। অতঃপর সকাল হলে লোকেরা পরস্পর আলোচনা করল। এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বের হলেন এবং তাঁর সাথে সালাত আদায় করা হলো। তারপর যখন চতুর্থ রাত হলো, তখন মসজিদ তার ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। অতঃপর তিনি ফজরের সালাত আদায় করতে বের হলেন। সালাত শেষ করে তিনি লোকদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন, তিনি তাশাহ্হুদ বা খুৎবা পড়লেন, তারপর বললেন, তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে আমার নিকট কিছুই গোপন নেই। তবে আমি আশঙ্কা করছি, তোমাদের উপর (এ সালাত) ফরয হয়ে যায় কি না। আর তোমরা তা পালন করতে অপারগ হয়ে পড়বে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ মৃত্যুবরণ করলেন আর ব্যাপারটি এমনই রয়ে গেল। [সহীহ বুখারী, হা/৯২৪, ২০১২; সহীহ মুসলিম, হা/১৮২০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪০১; বায়হাকী, হা/৪৩৭৮।]

৩৭
উমর (রাঃ) কর্তৃক জামা‘আতের প্রচলন
তারপর থেকে সাহাবীগণ বিচ্ছিন্নভাবে তারাবীর সালাত আদায় করতেন। পরবর্তীতে উমর (রাঃ) মনে করলেন যে, এখন তো আর ফরয হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি একজন ইমামের পেছনে তারাবীর সালাত আদায় করার ব্যবস্থা করেন। যার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নের হাদীসটিতে রয়েছে :

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ بْنِ عَبْدٍ الْقَارِيِّ أَنَّهٗ قَالَ خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ لَيْلَةً فِيْ رَمَضَانَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَإِذَا النَّاسُ أَوْزَاعٌ مُتَفَرِّقُوْنَ يُصَلِّي الرَّجُلُ لِنَفْسِه وَيُصَلِّي الرَّجُلُ فَيُصَلِّيْ بِصَلَاتِهِ الرَّهْطُ فَقَالَ عُمَرُ إِنِّيْ أَرٰى لَوْ جَمَعْتُ هٰؤُلَاءِ عَلٰى قَارِئٍ وَاحِدٍ لَكَانَ أَمْثَلَ ثُمَّ عَزَمَ فَجَمَعَهُمْ عَلٰى أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ ثُمَّ خَرَجْتُ مَعَهٗ لَيْلَةً أُخْرٰى وَالنَّاسُ يُصَلُّوْنَ بِصَلَاةِ قَارِئِهِمْ قَالَ عُمَرُ نِعْمَ الْبِدْعَةُ هٰذِه وَالَّتِيْ يَنَامُوْنَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِيْ يَقُوْمُوْنَ يُرِيْدُ اٰ خِرَ اللَّيْلِ ، وَكَانَ النَّاسُ يَقُوْمُوْنَ أَوَّلَهٗ

আবদুর রহমান ইবনে আবদুল ক্বারী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি রমাযানের এক রাতে উমর ইবনে খাত্তাবের সাথে মসজিদের দিকে বের হলাম। তখন দেখতে পেলাম, বিভিন্নভাবে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। কেউ একা একা সালাত আদায় করছে। আবার কোথাও এক ব্যক্তি সালাত আদায় করছে এবং কিছু লোকও তার সঙ্গে সালাত আদায় করছে। তখন উমর (রাঃ) বললেন, আমার মনে হয়, এদের সবাইকে একজন ক্বারীর সাথে জামা‘আতবন্দী করে দিলে সবচেয়ে ভালো হবে। এরপর এ ব্যাপারে তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন এবং তাদেরকে উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) এর পেছনে জামা‘আতবন্দী করে দিলেন।

অতঃপর আমি আরেক রাতে আবার তাঁর সাথে বের হলাম। দেখলাম, লোকজন তাদের ইমামের সঙ্গে সালাত আদায় করছে। উমর (রাঃ) বললেন, এটি কতইনা উত্তম বিদআত বা সুন্দর ব্যবস্থা। লোকেরা রাতের যে অংশে সালাত আদায় না করে ঘুমায় তা যে অংশে তারা সালাত আদায় করে তার চেয়ে উত্তম। অর্থাৎ রাতের প্রথমাংশের চেয়ে শেষাংশের সালাতই বেশি উত্তম- এটাই তিনি বুঝাতে চেয়েছেন। আর লোকেরা রাতের প্রথমাংশেই সালাত আদায় করত। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/২৫০; সহীহ বুখারী, হা/২০১০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১১০০; বায়হাকী, হা/৪৩৭৯; মিশকাত, হা/১৩০১।]

এখানে বুঝা গেল, তারাবীর সালাত নিয়মিতভাবে জামা‘আতের সাথে বর্তমানে যেটা চালু আছে এটা উমর (রাঃ) থেকে শুরু হয়েছে। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদার অন্যতম একজন খলীফা। তাই তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করাও আমাদের জন্য সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

তোমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে আমার ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে গ্রহণ করা। তোমরা তা দাঁত দিয়ে শক্তভাবে কামড়ে ধরো। আর তোমাদের উপর আরো আবশ্যক হচ্ছে, তোমরা প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত বিষয় হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী। [আবু দাউদ, হা/৪৬০৯; ইবনে মাজাহ, হা/৪২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৪; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৩২৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৭৩৫; মিশকাত, হা/১৬৫।]

উক্ত বর্ণনাসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রমাযানে কয়েক রাত জামা‘আত সহকারে তারাবীহ পড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের ঐক্যমতে পুরো রমাযান মাস জামা‘আতে তারাবীহ পড়া সুন্নাত।

৩৮
তারাবীর সালাত কত রাক‘আত
তারাবীর সালাতের রাক‘আত নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন বিশ রাক‘আত আবার কেউ বলেছেন আট রাক‘আত। এ ছাড়াও আরো অনেক মতামত রয়েছে। তবে বর্তমানে ২০ রাক‘আত ও ৮ রাকা‘আতের আমলই চালু আছে।

২০ রাক‘আতের দলীল :

عَن أَبُو الْخَصِيْبِ قَالَ : كَانَ يَؤُمُّنَا سُوَيْدُ بْنُ غَفَلَةَ فِىْ رَمَضَانَ فَيُصَلِّىْ خَمْسَ تَرْوِيْحَاتٍ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً

আবুল খাসিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সুওয়াইদ বিন গাফলাহ রমাযান মাসে পাঁচ বৈঠকে বিশ রাক‘আত তারাবীহ পড়িয়েছেন। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৪৮০৩।]

عَنْ أَبِىْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ السُّلَمِىِّ عَنْ عَلِىٍّ قَالَ : دَعَا الْقُرَّاءَ فِى رَمَضَانَ ، فَأَمَرَ مِنْهُمْ رَجُلًا يُصَلِّىْ بِالنَّاسِ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً . قَالَ : وَكَانَ عَلِىٌّ يُوْتِرُ بِهِمْ .

আবু আবদুর রহমান আস সুলামী (রহ.) আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি রমাযান মাসে কুররাদেরকে (হাফেযদেরকে) ডাকলেন এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকে আদেশ দিলেন সে যেন লোকদেরকে নিয়ে ২০ রাক‘আত সালাত আদায় করে। (বর্ণনাকারী বলেন) আলী (রাঃ) তাদের বেতরের ইমামতি করতেন। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৪৮০৪।]

عَنْ عَبْدِ الْعَزِيْزِ بْنِ رُفَيْعٍ ، قَالَ : كَانَ أُبَيّ بْنُ كَعْبٍ يُصَلِّيْ بِالنَّاسِ فِيْ رَمَضَانَ بِالْمَدِيْنَةِ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً وَيُوْتِرُ بِثَلَاثٍ .

আবদুল আযীয বিন রুফাই‘ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) মদিনাতে রমাযান মাসে লোকদেরকে নিয়ে ২০ রাক‘আত সালাত আদায় করতেন এবং বেতর পড়তেন তিন রাক‘আত। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হা/৭৭৬৬।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ  : أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يُصَلِّيْ فِيْ رَمَضَانَ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً وَالْوِتْرَ .

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাসে ২০ রাক‘আত সালাত আদায় করতেন এবং বেতরের সালাতও আদায় করতেন। [মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হা/৭৭৭৪।]

৮ রাক‘আতের দলীল :

عَنْ أَبِيْ سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ أَنَّه سَأَلَ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهَا ، كَيْفَ كَانَتْ صَلَاةُ رَسُوْلِ اللهِ فِيْ رَمَضَانَ فَقَالَتْ مَا كَانَ يَزِيْدُ فِي رَمَضَانَ ، وَلَا فِيْ غَيْرِهَا عَلٰى إِحْدٰى عَشْرَةَ رَكْعَةً يُصَلِّيْ أَرْبَعًا فَلَا تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُوْلِهِنَّ ثُمَّ يُصَلِّيْ أَرْبَعًا فَلَا تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُوْلِهِنَّ ثُمَّ يُصَلِّيْ ثَلَاثًا ، فَقُلْتُ : يَا رَسُوْلَ اللهِ أَتَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوْتِرَ قَالَ يَا عَائِشَةُ إِنَّ عَيْنَيَّ تَنَامَانِ ، وَلَا يَنَامُ قَلْبِيْ

আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান (রহ.) হতে বর্ণিত। একদা তিনি আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, রমাযানের রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, রমাযান মাসে অথবা অন্য সময়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ ১১ রাক‘আতের চেয়ে বেশি সালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে ৪ রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, যার সৌন্দর্য এবং দীর্ঘতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করো না। তারপর এমন ৪ রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি ৩ রাক‘আত সালাত আদায় করতেন। আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন, আমি একদিন বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর আদায়ের পূর্বে ঘুমান? তিনি বললেন, হে আয়েশা! আমার চক্ষু ঘুমালেও হৃদয় ঘুমায় না। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/২৬৩; সহীহ বুখারী, হা/২০১৩; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৫৭; আবু দাউদ, হা/১৩৪৩; তিরমিযী, হা/৪৩৯; নাসাঈ, হা/১৬৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪১১৯।]

উক্ত হাদীসের আলোকে এটা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাসের রাতে বিতর সহ মোট ১১ রাক‘আত সালাত আদায় করতেন।

525 عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ : صَلّٰى بِنَا رَسُوْلُ اللهِ فِيْ شَهْرِ رَمَضَانَ ثَمَانِ رَكَعَاتٍ وَأَوْتَرَ ، فَلَمَّا كَانَتِ الْقَابِلَةُ اجْتَمَعْنَا فِي الْمَسْجِدِ وَرَجَوْنَا أَنْ يَخْرُجَ ، فَلَمْ نَزَلْ فِيْهِ حَتّٰى أَصْبَحْنَا ، ثُمَّ دَخَلْنَا ، فَقُلْنَا : يَا رَسُوْلَ اللهِ ، اجْتَمَعْنَا الْبَارِحَةَ فِي الْمَسْجِدِ ، وَرَجَوْنَا أَنْ تُصَلِّيَ بِنَا ، فَقَالَ : إِنِّيْ خَشِيْتُ أَنْ يُكْتَبَ عَلَيْكُمْ

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাসে আমাদেরকে নিয়ে ৮ রাক‘আত সালাত আদায় করলেন এবং বিতরও আদায় করলেন। অতঃপর আমরা পরবর্তী দিন মসজিদে একত্রিত হলাম এবং আশা করলাম যে, তিনি ঘর থেকে বের হবেন; কিমত্মু তিনি বের হলেন না। ফলে আমরা সুবহে সাদিক পর্যমত্ম বসে থাকলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে গেলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা গত রাতে মসজিদে একত্রিত হয়েছিলাম এবং আশা করেছিলাম যে, আপনি আমাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করবেন। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের উপর ফরয হয়ে যেতে পারে সেই ভয় করছিলাম। [জামেউস সগীর, হা/৫২৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৪০৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১০৭০।]

এই হাদীসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান উল্লেখ রয়েছে। কেননা তারাবীর সালাত সম্পর্কে সকলেই একমত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ একরাত বা কয়েক রাত সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে জামা‘আতে আদায় করেছেন। পরবর্তীতে ফরয হয়ে যাওয়ার ভয়ে তা আর করেনি। কিমত্মু তিনি সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে কত রাক‘আত আদায় করেছিলেন তার বর্ণনা ঐ হাদীসে পাওয়া যায় না। কিমত্মু এই হাদীসে বলা হয়েছে, আমাদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ আট রাক‘আত সালাত আদায় করেছেন এবং বিতর আদায় করেছেন।

সুতরাং যারা বিশ রাক‘আত তারাবীর প্রবক্তা তাদের পক্ষে এই হাদীসের এই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় যে, এটি তাহাজ্জুদের সালাত ছিল আর তারাবীহ ভিন্ন সালাত। কেননা, তাহাজ্জুদের সালাত ফরয হয়ে যাওয়ার ভয়ে এক বা কয়েক রাত আদায় করে ত্যাগ করেছেন- একথা আজ পর্যমত্ম কোন মুহাদ্দিস বা ফকীহ বলেননি। সুতরাং যে সালাতটি ফরয হয়ে যাওয়ার ভয়ে জামা‘আতে আদায় করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেটি অন্য কোন সালাত নয় বরং সেটি ছিল তারাবীর সালাত। আর তা ছিল ৮ রাক‘আত।

অন্য হাদীসে এসেছে,

عَنْ مَالِكٍ ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ يُوْسُفَ ، عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيْدَ ، أَنَّهٗ قَالَ : أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيْمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُوْمَا لِلنَّاسِ بِإِحْدٰى عَشْرَةَ رَكْعَةً قَالَ : وَقَدْ كَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ بِالْمِئِيْنَ ، حَتّٰى كُنَّا نَعْتَمِدُ عَلَى الْعِصِيِّ مِنْ طُوْلِ الْقِيَامِ ، وَمَا كُنَّا نَنْصَرِفُ إِلَّا فِيْ فُرُوْعِ الْفَجْرِ

ইমাম মালিক (রাঃ) মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফের সূত্রে সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ), উবাই ইবনে কাব এবং তামীম দারী (রাঃ) লোকদেরকে নিয়ে ১১ রাক‘আত সালাত আদায় করার নির্দেশ দিলেন। সায়েব (রহ.) বলেন, অথচ কোন কোন সময় ক্বারী ২০০ আয়াত পর্যমত্ম তিলাওয়াত করতেন। আর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর ফলে আমরা লাঠির উপর ভর করতাম এবং আমরা ফজর উদিত না হওয়া পর্যমত্ম সালাত থেকে প্রত্যাবর্তন করতাম না। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/২৫১; সুনানুল কুবরা বায়হাকী, হা/৪৮০০; মিশকাত, হা/১৩০২।]

সুতরাং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো, উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ২০ রাক‘আত তারাবীহ পড়ানোর নির্দেশ দেননি। বরং তিনিও ৮ রাক‘আত তারাবীহ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

২০ রাক‘আতের হাদীসগুলোর অবস্থান :

২০ রাক‘আতের হাদীসগুলো সহীহ সনদে বর্ণিত হয়নি যদিও হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি। দেওবন্দের উসত্মাদ এবং ভারত বিখ্যাত মণীষী আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) বলেন, ২০ রাক‘আত সম্পর্কে যতগুলো হাদীস আছে সবগুলোর সনদই যঈফ। ঐগুলোর যঈফ হওয়া সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ একমত। [আল আরফুশ শাযী ৩০৯ পৃঃ]

হেদায়া কিতাবে বর্ণিত হাদীসসমূহের ভুল-ত্রুটি যাচাইকারী পন্ডিত আল্লামা যায়লায়ী (রহ.) বলেন ২০ রাক‘আতের হাদীস যঈফ হওয়ার সাথে সাথে আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত সহীহ হাদীসের বিরোধী। [নাসবুর রায়হ ২/১৫।]

নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) তার প্রসিদ্ধ ‘তামামূল মিন্নাহ’ নামক কিতাবে বলেন, উসমান (রাঃ) এর থেকে ২০ রাক‘আত তারাবীহ সম্পর্কে দুর্বল সনদেও কোন হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আর উমর ও আলী (রাঃ) থেকে যে হাদীসগুলো বর্ণনা করা হয়েছে তার সবগুলোই দুর্বল। [তামামুল মিন্নাহ ২/২৬৫।]

তাছাড়া জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়ে কেরামদেরকে নিয়ে আট রাক‘আত তারাবীর সালাত আদায় করেছিলেন। তারপর বিতর আদায় করেছিলেন।

মতবিরোধের মূল কারণ :

এখানে মতবিরোধের মূল কারণ হলো, তারাবীহ ও কিয়ামুল লাইল কি একই সালাতের দুটি নাম? নাকি উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন সালাত?

যারা ২০ রাক‘আত তারাবীর প্রবক্তা তারা তারাবীর সালাত ও কিয়ামুল লাইলকে ভিন্ন ভিন্ন সালাত হিসেব করে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসকে তাহাজ্জুদের সালাত সম্পর্কে ধরে নিয়েছেন।

আর যারা তারাবীহ ও কিয়ামুল লাইলকে এক ও অভিন্ন মনে করেন, তারা আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মাধ্যমে ৮ রাক‘আতের দলীল পেশ করেন। আর ২০ রাক‘আতের হাদীসগুলোকে দুর্বল সনদের কারণে গ্রহণযোগ্য নয় বলে বাতিল করে দেন।

৩৯
রমাযান মাসে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা
কুরআন তিলাওয়াত একটি উত্তম ইবাদাত। কুরআন ও হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি খুবই উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং এর যথেষ্ট ফযীলতও বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে,

﴿إِنَّ الَّذِيْنَ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَّعَلَانِيَةً يَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ﴾

নিশ্চয় যারা কুরআন তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিযিক হতে কিছু অংশ গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করে তারা এমন ব্যবসার আশা করে যাতে কখনো লোকসান হবে না। (সূরা ফাতির- ২৯)

এ আয়াতে কুরআন পড়াকে একটি লাভজনক ব্যবসা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهٗ بِه حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُوْلُ الم حَرْفٌ وَلٰكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيْمٌ حَرْفٌ

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর পড়বে সে একটি নেকী পাবে আর একটি নেকী হবে দশটি নেকীর সমান। আমি বলছি না আলিফ, লাম, মীম সব মিলিয়ে একটি হরফ; বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মীম একটি অক্ষর। [তিরমিযী, হা/২৯১০; জামেউস সগীর, হা/১১৪১৫; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৩২৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪১৬; মিশকাত, হা/২১৩৭।]

কুরআন তিলাওয়াতের এসকল ফযীলত সবসময়ের জন্য; কিমুত রমাযান মাসে কুরআন তিলাওয়াতের বিশেষ গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে। কারণ রমাযানের সাথে কুরআনের সম্পর্ক ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত। কুরআন নাযিল শুরু হয়েছে রমাযান মাসে। এ মাসের প্রতিটি রাত্রে জিবরাঈল (আঃ) আসতেন এবং কুরআনের যতটুকু নাযিল হয়েছে তা নবী ﷺ কে পড়ে শোনাতেন এবং পুনরাবৃত্তি করতেন। নবী ﷺ এর ইন্তেকালের বছর তিনি ও জিবরাঈল (আঃ) একে অপরকে সম্পূর্ণ কুরআন দু’বার পড়ে শুনিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/৪৯৯৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯১৭৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭০১০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৩০৯২৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৮৩৫; মিশকাত, হা/২০৯৯।]

অপর একটি হাদীসে রয়েছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : الصِّيَامُ وَالْقُرْاٰنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ ، يَقُوْلُ الصِّيَامُ : رَبِّ إِنِّيْ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ ، وَيَقُوْلُ الْقُرْاٰنُ : مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَيُشَفَّعَانِ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কিয়ামতের দিন কুরআন ও রোযা বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। রোযা বলবে, হে প্রভু! আমি এ বান্দাকে দিনের বেলায় খানাপিনা ও যৌন চাহিদা মিটানো থেকে বিরত রেখেছি, তাই আমার শাফা‘আত কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, হে প্রভু! আমি এ বান্দাকে রাতের বেলায় ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, তাই আমার শাফা‘আত কবুল করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, ২০৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৬২৬, মিশকাত, হা/১৯৬৩।]

এজন্য সালাফুস সালেহীন (পূর্ব যুগের নেককার বান্দারা) বিশেষ করে রমাযান মাসে কুরআন পাঠে খুবই মনোযোগ দিতেন। এ মাসে কুরআন পড়ার জন্য তারা সময়ের একটা বড় অংশ নির্ধারণ করে রাখতেন।

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এসকল মহান মণীষীগণ না বুঝে কুরআন পড়তেন না। তারা আল্লাহর কালাম বুঝে বুঝে পড়তেন এবং এর উপর আমল করতেন। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান এমন আছেন যারা কুরআনের শুধু শব্দগুলো পড়ে প্রতি হরফে দশটি করে নেকী অর্জনের চিন্তা করেন এবং কে কত খতম দিতে পারে- এ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। কুরআন না বুঝে পড়লে এর দ্বারা কুরআন নাযিলের আসল উদ্দেশ্য সফল হয় না। মানুষ যাতে কুরআন পড়ে, বুঝে এবং কুরআন অনুযায়ী তাদের জীবন পরিচালনা করে- এটাই হলো কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য। কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন পড়ার প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করা। না বুঝে পড়লে পড়ার হক আদায় হয় না। না বুঝে ১০০ খতম দেয়ার চেয়ে কেউ যদি দু’চারটি আয়াত অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ বুঝে পড়ে এবং এর উপর আমল করতে পারে তবে এটা তার জন্য হাজার গুণ বেশি উত্তম হবে; যেহেতু সে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করেছে।

একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় কাজ ও ইবাদাত হলো ইসলামের সঠিক জ্ঞান লাভ করা। এজন্য যে শব্দটি দিয়ে কুরআন নাযিল শুরু হয়েছে তা হলো إِقْرَأْ ‘পড়ো’ তার মানে সবকিছুর আগে তোমাকে পড়তে হবে, জানতে হবে। মুসলিম হতে হলে কি কি কাজ করতে হবে, কোন্ কোন্ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কোন্ ধরনের আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করতে হবে তা না জানা পর্যন্ত কেউ যদি হাজার বারও বলে ‘আমি মুসলিম’ তবে সে আল্লাহর কাছে মুসলিম হতে পারবে না। তাই ইসলামের সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান অর্জনের জন্য আল্লাহর কালাম বুঝে পড়তে হবে। কুরআনে এসেছে - وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللهِ قِيْلًا ‘‘আল্লাহর কথার চেয়ে সঠিক কথা আর কার হতে পারে?’’ ذٰلِكَ الْكِتَابُ لَارَيْبَ فِيْهِ ‘‘এটা এমন কিতাব যার কথার মধ্যে কোন সন্দেহ-সংশয় নেই।’’

কুরআন যেহেতু আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে, তাই একে ভালোভাবে বুঝার জন্য আরবি ভাষা শিক্ষা করা সকলের কর্তব্য। কুরআন-হাদীস বুঝার জন্য যদি কেউ আরবি ভাষা শিখে তবে এটা ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে। তাছাড়া কুরআনের বিধিবিধান জানার জন্য মাতৃভাষার সহযোগিতা নেয়া যায়, বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে প্রচলিত যত ভাষা আছে প্রায় সকল ভাষাতেই কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশেও বাংলা ভাষায় কুরআন বুঝার যথেষ্ট উপকরণ বের হয়েছে। কুরআনের শাব্দিক অনুবাদ, ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ, কুরআনের শব্দের অভিধানসহ বেশ কিছু ভালো ভালো তাফসীর গ্রন্থও বাংলা ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং সর্বত্রই এসব পাওয়া যাচ্ছে।

আমাদের ‘ইমাম পাবলিকেশন্স’ থেকে প্রকাশিত একটি বিষয়ভিত্তিক তাফসীর রয়েছে যার নাম ‘তাফসীরুল কুরআন বিল কুরআন’। এতে একেকটি বিষয় সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতগুলো একত্র করে বিভিন্ন পয়েন্টে সাজানো হয়েছে। কুরআনে আলোচিত মৌলিক বিষয়গুলোকে হাদীসের কিতাবের মতো করে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে একেকটি বিষয় সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য কী তা একই জায়গায় ধারাবাহিকভাবে জানা যাবে।

৪০
রমাযান মাসে বেশি বেশি করে দান করা
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، قَالَ : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ أَجْوَدَ النَّاسِ ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُوْنُ فِيْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِيْ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْاٰنَ فَلَرَسُوْلُ اللهِ أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন সমস্ত লোকের চেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। বিশেষত তাঁর দানশীলতা অন্যান্য সময় হতে রমাযান মাসে বেশি বেশি দেখা যেত, যখন জিবরাঈল (আঃ) তাঁর সাক্ষাতে আসতেন। রমাযানের প্রতি রাতেই তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাক্ষাতে উপস্থিত হতেন এবং তাঁকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাতেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযান মাসে দানশীলতায় প্রবাহিত বায়ুর চেয়েও বেশি গতিশীল হয়ে যেতেন (অর্থাৎ বেশি বেশি দান করতেন)। [সহীহ বুখারী, হা/৬; সহীহ মুসলিম, হা/৬১৪৯; নাসাঈ, হা/২০৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬১৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৮৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৪৪০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৫৫২; আদাবুল মুফরাদ, হা/২৯২; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৮৭; মিশকাত, হা/২০৯৮।]

দান করার অনেক দিক রয়েছে। যেমন :

 টাকা-পয়সা দান করা।

 কাপড় বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় জিনিস দান করা।

 অপরকে খাদ্য খাওয়ানো।

 রোযাদারকে ইফতার করানো ইত্যাদি।

জান্নাতবাসী বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰى حُبِّه مِسْكِيْنًا وَّيَتِيْمًا وَّأَسِيْرًا - إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّلَا شُكُوْرًا ﴾

তারা আল্লাহর মহববতে মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীদেরকে খাবার দেয় এবং বলে, আমরা তোমাদেরকে খাওয়াচ্ছি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য; তোমাদের থেকে কোন প্রতিদান এবং কৃতজ্ঞতা আমরা চাই না। (সূরা দাহর- ৮, ৯)

আল্লাহর নেক বান্দাদের মধ্যে এমন অনেক লোক ছিলেন, যারা অপরকে খাদ্য দানের ক্ষেত্রে খুবই উৎসাহী ছিলেন। এক্ষেত্রে তারা শুধু গরীবদেরকে বাছাই করতেন না। অনেকে এমনও ছিলেন, যারা মেহমান ছাড়া খাবার খেতেন না। অপরকে খাদ্য খাওয়ানোতে যথেষ্ট কল্যাণ রয়েছে, এর মধ্যে একটি হচ্ছে- যে খাওয়ায় এবং যাদেরকে খাওয়ানো হয় তাদের মধ্যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, যা জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। নবী ﷺ বলেন,

لَا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتّٰى تُؤْمِنُوْا وَلَا تُؤْمِنُوْا حَتّٰى تَحَابُّوْا

তোমরা মুমিন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না; আর তোমরা পরস্পরে ভালোবাসা ব্যতীত মুমিন হতে পারবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৩; আবু দাউদ, হা/৫১৯৫; তিরমিযী, হা/২৬৮৮; ইবনে মাজাহ, হা/৬৮, ৩৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০১৮০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৩৬; মুসনাদুল বাযযার, হা/২২৩২।]

৪১
রমাযান মাসে উমরা করা
কাবা হলো ইবাদাতের উদ্দেশ্যে নির্মিত পৃথিবীর সর্বপ্রথম গৃহ। এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন। হজ্জ ও উমরার মাধ্যমে এসব নিদর্শন দেখা যায়। উমরার অগণিত ফযীলত রয়েছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ اَلْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ لَيْسَ لَهٗ جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّةُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, একবার উমরা করার পর আবার উমরা করলে তা দুই উমরার মধ্যবর্তী গোনাহসমূহের কাফ্ফারা হয়ে যায়। আর হজ্জে মাবরুরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৭৬৭; সহীহ বুখারী, হা/১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫৫; তিরমিযী, হা/৯৩৩; নাসাঈ, হা/২৬২৯; ইবনে মাজাহ, হা/২৮৮৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৯৪৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৯৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৯৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৮৪৩।]

রমাযান মাসে উমরা করার ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

فَإِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فَاعْتَمِرِىْ فَإِنَّ عُمْرَةً فِيْهِ تَعْدِلُ حَجَّةً

যখন রমাযান মাস আসবে তখন উমরা করো। কেননা এ মাসে উমরা করার সওয়াব একটি হজ্জের সমান। [সহীহ মুসলিম, হা/৩০৯৭; তিরমিযী, হা/৯৩৯; নাসাঈ, হা/২১১০; ইবনে মাজাহ, হা/২৯৯১-৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০২৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৭০০; মিশকাত, হা/২৫০৯।]

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

فَإِنَّ عُمْرَةً فِيْ رَمَضَانَ تَقْضِيْ حَجَّةً مَعِيْ

রমাযান মাসে উমরা করা আমার সাথে হজ্জ করার সমান। [সহীহ বুখারী, হা/১৮৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/৩০৯৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/৩০৭৭; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৭৭৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১১১৮।]

নবী ﷺ এর ইন্তেকালের পরেও তাঁর সাথে হজ্জ করার সমান সওয়াব পাওয়া যায় এমন সুযোগ কে হারায়? এজন্য আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে সামর্থ্য দিয়েছেন তাদের রমাযান মাসে উমরা করা উচিত।

৪২
রমাযান মাসে ই‘তিকাফ করা
 ‘ই‘তিকাফ’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো আবদ্ধ থাকা, কোন নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। ইসলামী পরিভাষায় ই‘তিকাফ হলো, ইবাদাতের নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পদ্ধতি অনুযায়ী কোন মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ রাখা।

ই‘তিকাফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত। নবী করীম ﷺ নিজেই ই‘তিকাফ করেছেন এবং তার স্ত্রীগণ ও সাহাবীরাও ই‘তিকাফ করেছেন। ই‘তিকাফ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ। কারণ এটি এমন এক নির্জনতা, যখন বান্দা দুনিয়ার বিভিন্ন ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর দরজায় হাজির হয় এবং আল্লাহর আনুগত্য ও যিকির করার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখে। বান্দা তার দেহ ও মনকে স্বীয় প্রভুর উদ্দেশ্যে বেঁধে রাখে।

 ই‘তিকাফের বাস্তবরূপটা এমন- যেন কোন ব্যক্তি কারো কাছ থেকে তার দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য তার দরজায় ধর্ণা দেয় এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঐ দরজায় পড়ে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে যারা ই‘তিকাফ করেন তারা মায়ার সংসারকে ভুলে একাধারে কয়েকদিন যাবৎ আল্লাহর দরজায় নিজেদেরকে আটক রাখেন, ফলে আল্লাহ তাদেরকে যথেষ্ট পুরস্কার দান করেন।

এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَنْ تَقَرَّبَ مِنِّىْ شِبْرًا تَقَرَّبْتُ مِنْهُ ذِرَاعًا وَمَنْ تَقَرَّبَ مِنِّىْ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ مِنْهُ بَاعًا وَمَنْ أَتَانِىْ يَمْشِىْ أَتَيْتُه هَرْوَلَةً وَمَنْ لَقِيَنِىْ بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطِيْئَةً لَا يُشْرِكُ بِىْ شَيْئًا لَقِيتُه بِمِثْلِهَا مَغْفِرَةً

যে ব্যক্তি অর্ধ হাত আমার নিকটবর্তী হয় আমি এক হাত তার নিকটবর্তী হই। আর যে ব্যক্তি এক হাত আমার নিকটবর্তী হয় আমি তার দিকে এক গজ নিকটবর্তী হই। আর যে ব্যক্তি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে আসি। আর যে ব্যক্তি জমিন ভর্তি পাপ নিয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে এবং সে আমার সাথে কাউকে শরীক না করে, তাহলে আমিও ঐ পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করি। [সহীহ মুসলিম, হা/৭০০৯; ইবনে মাজাহ, হা/৩৮২১; মিশকাত, হা/২২৬৫।]

অপর এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِيْ بِيْ وَاَنَا مَعَه اِذَا ذَكَرَنِيْ فَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِيْ نَفْسِه ذَكَرْتُه فِيْ نَفْسِيْ وَإِنْ ذَكَرَنِيْ فِيْ مَلَأٍ ذَكَرْتُه فِيْ مَلَأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ

আমি আমার বান্দার সাথে তার ধারণা অনুযায়ী ব্যবহার করে থাকি। আর সে যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সাথেই থাকি। সে যখন আমাকে একা একা স্মরণ করে তখন আমিও এককভাবে তাকে স্মরণ করি। আর সে যখন আমাকে জনসমক্ষে স্মরণ করে, তখন আমি এর থেকে উত্তম মজলিসে তাকে স্মরণ করি। [সহীহ বুখারী, হা/৭৩০৫; সহীহ মুসলিম, হা/৬৯৮১; তিরমিযী, হা/৩৬০৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩৮২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৩৪০; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯১৪২; জামেউস সগীর, হা/১৪০৯৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪৮৭; মিশকাত, হা/২২৬৪।]

৪৩
ই‘তিকাফের সময়
ই‘তিকাফের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো রমাযানের শেষ দশ দিন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ كَانَ النَّبِيُّ يَعْتَكِفُ فِيْ كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ اعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ يَوْمًا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ রমাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। এক বছর তিনি ই‘তিকাফ করতে পারেননি, তাই পরের বছর তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফ করেছেন। [সহীহ বুখারী, হা/২০৪৪; আবু দাউদ, হা/২৪৬৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪১৬; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯০১০; মুসনাদে দারেমী, হা/১৮২০; বায়হাকী, হা/৮৩৪৬; মিশকাত, হা/২১০২।]

এটা হলো সুন্নাত ই‘তিকাফ। আর ই‘তিকাফ করার জন্য মান্নত করলে এটা ওয়াজিব হবে। উল্লেখ্য যে, বছরের যেকোন সময় অল্প সময় হলেও ই‘তিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা যাবে।

ই‘তিকাফের স্থান :

ই‘তিকাফ অবশ্যই মসজিদে করতে হবে। আর এটা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নত। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ সবসময় মসজিদেই ই‘তেকাফ করতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ﴾

আর তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না। (সূরা বাকারা- ১৮৭)

উল্লেখ্য যে, পাঞ্জেগানা মসজিদে ই‘তিকাফ চলে, তবে জামে মসজিদে হলে ভালো হয়।

ই‘তিকাফের নিয়ম :

ই‘তিকাফকারী মসজিদের কোন এক জায়গায় কিছুটা আড়াল করে সেখানে অবস্থান করবে, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করবে। মানবীয় প্রয়োজন যেমন প্রস্রাব-পায়খানা ইত্যাদি ছাড়া মসজিদের বাইরে যাবে না।

ই‘তিকাফের সময় বেশি বেশি নফল ইবাদাত করা উচিত। নফল সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ, তওবা-ইস্তিগফার, দরূদ পাঠ ও মুনাজাত ইত্যাদি কাজে মগ্ন থাকবে। তাছাড়া ধর্মীয় বই-পুসত্মক পড়ে এবং কুরআন-হাদীস চর্চা করে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করবে এবং একে অপরের সাথে ইসলামী কথা আলোচনা করবে- এটাও বড় ধরনের ইবাদাত।

৪৪
ই‘তিকাফ অবস্থায় যেসব কাজ করা যাবে
নিজেকে পরিপাটি রাখা :

ই‘তিকাফকারী ব্যক্তি নিজেকে পরিপাটি রাখার জন্য স্বাভাবিকভাবে যেকোন ধরনের কাজ করতে পারবে। যেমন- গোসল করা, চুল আঁচড়ানো, তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, ভালো পোশাক পরিধান করা। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا ، أَنَّهَا كَانَتْ تُرَجِّلُ النَّبِيَّ وَهِيَ حَائِضٌ وَهُوَ مُعْتَكِفٌ فِي الْمَسْجِدِ وَهِيَ فِي حُجْرَتِهَا يُنَاوِلُهَا رَأْسَهٗ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি মাসিক অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাথার কেশ বিন্যাস করে দিতেন, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় থাকতেন। আয়েশা (রাঃ) তার কক্ষে থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাথার নাগাল পেতেন। [সহীহ বুখারী, হা/২০৪৩; নাসাঈ, হা/৩৮৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬০১৫।]

পরিবারের লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করা :

ই‘তিকাফকারীর পরিবার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে, কথা বলতে পারবে। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফকালীন তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কিমত্মু সাক্ষাৎ দীর্ঘ না হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ صَفِيَّةَ زَوْجِ النَّبِيِّ اَنَّهَا جَاءَتْ رَسُوْلَ ا للهِ تَزُوْ هُ فِي اعْتِكَافِه فِي الْمَسْجِدِ، فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَّمَضَانَ، فَتَحَدَّثَتْ عِنْدَه سَاعَةً، ثُمَّ قَامَتْ تَنْقَلِبُ، فَقَامَ النَّبِيُّ مَعَهَا يَقْلِبُهَا، حَتّٰى اِذَا بَلَغَتْ بَابَ الْمَسْجِدِ عِنْدَ بَابِ أُمِّ سَلَمَةَ مَرَّ رَجُلَانِ مِنَ الْأَنْصَارِ، فَسَلَّمَا عَلٰى رَسُوْلِ ا للهِ فَقَالَ لَهُمَا النَّبِيُّ : ‏ ‏ عَلٰى رِسْلِكُمَا اِنَّمَا هِيَ صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَىٍّ‏ ‏‏ . ‏ فَقَالَا : سُبْحَانَ ا للهِ يَا رَسُوْلَ ا للهِ ‏ . ‏ وَكَبُرَ عَلَيْهِمَا‏ . ‏ فَقَالَ النَّبِيُّ : ‏ اِنَّ الشَّيْطَانَ يَبْلُغُ مِنَ الْإِنْسَانِ مَبْلَغَ الدَّمِ، وَإِنِّيْ خَشِيْتُ اَنْ يَقْذِفَ فِيْ قُلُوْبِكُمَا شَيْئًا‏ ‏‏ .‏

নবী ﷺ এর সহধর্মিণী সাফিয়্যা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি (একবার) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে দেখা করার জন্য মসজিদে গেলেন। তিনি তখন রমাযানের শেষ দশ দিনে ই‘তিকাফে ছিলেন। সাফিয়্যা (রাঃ) তাঁর কাছে (বসে) কিছু সময় কথাবার্তা বললেন। অতঃপর (ঘরে) ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। নবী ﷺ-ও সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন এবং তাঁকে এগিয়ে দেবার জন্য উম্মু সালামা (রাঃ) এর দরজার কাছে মসজিদের দরজা পর্যন্ত গেলেন। তখন দু’জন আনসারী সাহাবী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে সালাম দিলেন। তখন নবী ﷺ তাদেরকে বললেন, তোমরা একটু অপেক্ষা করো। এ মহিলা হলো হুয়াই-এর কন্যা সাফিয়্যা। তাঁরা বললেন, সুবহানাল্লাহ, হে আল্লাহর রাসূল! তখন নবী ﷺ বললেন, শয়তান মানুষের শিরায় পৌঁছতে ক্ষমতা রাখে। তাই আমার ভয় হলো, সে তোমাদের মনে কোন খারাপ ধারণার সৃষ্টি করে দেয় কি না। [সহীহ বুখারী, হা/২০৩৫।]

৪৫
ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান
 ই‘তিকাফকারী যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি মানবীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয় তাহলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হবে না।

 মসজিদে থেকে পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব না হলে বাইরে বের হতে পারবে।

 বাহক না থাকার কারণে ই‘তিকাফকারী পানাহারের প্রয়োজনে বাইরে যেতে পারবে।

 যে মসজিদে ই‘তিকাফ বসেছে সেখানে জুমু‘আর সালাতের ব্যবস্থা না থাকলে জুমু‘আর সালাত আদায়ের জন্য বাইরে যেতে পারবে।

 রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি কাজ করার জন্য ই‘তিকাফকারীর মসজিদ থকে বের হওয়া বৈধ নয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ اَنَّهَا قَالَتِ السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لَّا يَعُوْدَ مَرِيْضًا وَلَا يَشْهَدَ جَنَازَةً وَلَا يَمَسَّ امْرَأَةً وَّلَا يُبَاشِرَهَا وَلَا يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ اِلَّا لِمَا لَا بُدَّ مِنْهُ وَلَا اعْتِكَافَ اِلَّا بِصَوْمٍ وَلَا اعْتِكَافَ اِلَّا فِىْ مَسْجِدٍ جَامِعٍ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হলো, সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না ও তার সাথে মিলন থেকে বিরত থাকবে এবং অতি প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না। [আবু দাউদ, হা/২৪৭৫; বায়হাকী, হা/৮৩৭৭; মিশকাত, হা/২১০৬।]

 ই‘তিকাফের নিয়ম বহির্ভূত কোন কাজের জন্য ই‘তিকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ইত্যাদি।

৪৬
যেসব কারণে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়
ইচ্ছাকৃতভাবে বীর্যপাত ঘটালে :

গোসল ফরয হয় এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র থাকতে হবে। অপবিত্রতা যদি যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী স্ত্রীর মিলনের ফলে হয় তবে সকলের মতে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تُبَاشِرُوْهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُوْنَ فِي الْمَسَاجِدِ﴾

আর তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।

(সূরা বাকারা- ১৮৭)

তবে যদি স্বপ্নদোষের কারণে বীর্যপাত ঘটে তাহলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হবে না। আর যদি হসত্মমৈথুনের কারণে হয় তাহলে সঠিক মতানুসারে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

মহিলাদের হায়েয অথবা নিফাস শুরু হলে :

ই‘তিকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েয-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি। কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম, অবশ্য ইসেত্মহাযা অবস্থায় ই‘তিকাফ করা বৈধ। আয়েশা (রাঃ) বলেন,

اِعْتَكَفَتْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ امْرَأَةٌ مِنْ أَزْوَاجِه فَكَانَتْ تَرَى الدَّمَ وَالصُّفْرَةَ وَالطَّسْتُ تَحْتَهَا وَهِيَ تُصَلِّيْ

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ইসিত্মহাযা অবস্থায় তাঁর স্ত্রীগণের মধ্য হতে কোন একজন ই‘তিকাফ করেছিলেন। তিনি লাল ও হলুদ রঙের স্রাব দেখতে পাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি নিচে পাত্র রেখে সালাত আদায় করলেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩১০; আবু দাউদ, হা/২৪৭৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫০৪২; বায়হাকী, হা/৮৩৮৫।]

বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হলে :

ই‘তিকাফ করার প্রধান শর্তই হচ্ছে ইবাদাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করা। সুতরাং কেউ যদি বিনা প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃতভাবে মসজিদ থেকে বের হয়, তাহলে তার ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে- যদিও তা অল্প সময়ের জন্য হয়।

পাগল বা মাতাল হয়ে গেলে :

ইসলামের যাবতীয় বিধান কেবল সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যই প্রযোজ্য। ফলে পাগল ও মাতালকে ইসলামের বিধান পালন করা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সুতরাং যদি কেউ সুস্থ থাকা অবস্থায় ই‘তিকাফে বসে এবং ই‘তিকাফ শেষ হওয়ার পূর্বেই পাগল অথবা মাতাল হয়ে যায়, তাহলে তার ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৪৭
ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য
১. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা :

ই‘তিকাফ হলো এমন একটি ইবাদাত, যার মাধ্যমে বান্দা সমসত্ম সৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে আসে। বান্দার কাজ হলো তাকে স্মরণ করা, তাকে ভালোবাসা ও তার ইবাদাত করা। সর্বদা তার সমত্মুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়।

২. পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকা :

ই‘তিকাফের মাধ্যমে একজন মানুষ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করার সুযোগ পায়। সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও দু‘আ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।

৩. লাইলাতুল কদর তালাশ করা :

ই‘তিকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীস সে কথারই প্রমাণ বহন করে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إِنِّى اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هٰذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيْتُ فَقِيْلَ لِىْ إِنَّهَا فِى الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ

আমি প্রথম দশকে ই‘তিকাফ করেছি এই রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে। অতঃপর ই‘তিকাফ করেছি মাঝের দশকে। অতঃপর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম। তারপর আমাকে বলা হলো, এটা (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ই‘তিকাফ করতে চায়, তাহলে সে যেন ই‘তিকাফ করে। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮২৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২১৭১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৮৪; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৪৫৯; বায়হাকী, হা/৮৩৫০।]

৪. মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা :

ই‘তিকাফের মাধ্যমে বান্দার অমত্মর মসজিদের সাথে জুড়ে যায়, মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। হাদীস অনুযায়ী যে সাতজন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের ছায়ার নিচে ছায়া দান করবেন, তার মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি, যার হৃদয় মসজিদের সাথে বাধা ছিল। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৭০৯; সহীহ বুখারী, হা/৬৬০; সহীহ মুসলিম, হা/২৪২৭; তিরমিযী, হা/২৩৯১; নাসাঈ, হা/৫৩৮০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৩২০; জামেউস সগীর, হা/৬৯৮৩; মিশকাত, হা/৭০১।]

৪৮
লাইলাতুল কদর
আরবি ভাষায় ক্বাফ বর্ণে যবর ও দাল বর্ণে সাকিন দিয়ে ‘ক্বাদ্রুন’ শব্দের অর্থ হলো- সম্মান ও মর্যাদা। এদিক থেকে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর এর অর্থ হলো সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী।

অন্যদিকে দাল বর্ণে যবর দিয়ে ‘ক্বাদারুন’ শব্দের অর্থ হলো পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা। এ হিসেবে লাইলাতুল কদর অর্থ হলো, ভাগ্য রজনী, তাকদীরের ফয়সালা করার রাত ইত্যাদি।

কদরের রাত আল্লাহ তা‘আলার এক বিশেষ নিয়ামত। এ রাতের রয়েছে বিশেষ সম্মান, বিশেষ মাহাত্ম্য ও বিশেষ ফযীলত। এ রাতের নামে পবিত্র কুরআনে একটি সূরা রয়েছে। এ রাতের ব্যাপারে নবী ﷺ এর অনেক হাদীস রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এ রাতের কেন এত মর্যাদা? কেন এত ফযীলত? উত্তর একটাই, আর তা হলো এ রাতেই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মর্যাদাপূর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মর্যাদাবান ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে মর্যাদাশীল নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর তাঁর মর্যাদাবান উম্মতের পথপ্রদর্শক হিসেবে নাযিল হয়েছে। সুতরাং যেখানে এতগুলো মর্যাদাপূর্ণ বিষয় একত্র হলো সেখানে যে রাতে এগুলোর সমাবেশ ঘটেছে সে রাতটি কি মর্যাদাপূর্ণ না হয়ে পারে?

আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেছেন,

﴿ إِنَّاۤ أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ﴾

নিশ্চয় আমি এটাকে (আল-কুরআনকে) কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি।

(সূরা কদর- ১)

এ রাতে কুরআন নাযিল করার অর্থ হলো- লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে এটি নাযিল হয়, পরে প্রয়োজন অনুপাতে পর্যায়ক্রমে তা নবী ﷺ এর উপর নাযিল হতে থাকে। এর অপর অর্থ হচ্ছে- এ রাতে কুরআন নাযিলের সিলসিলা শুরু হয়েছে এবং দীর্ঘ তেইশ বছরে তা পূর্ণতা লাভ করেছে।

এ রাতের মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَاۤ أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ﴾

তুমি কি জান কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

(সূরা কদর- ২, ৩)

এখানে হাজার মাস বলতে কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বেশি বুঝানোর উদ্দেশ্যে এটা বলা হয়েছে, তার মানে এ রাতটি হাজার হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

উত্তম কথাটির দু’টি ব্যাখ্যা আছে এবং উভয়টিই সঠিক।

১. কদরের রাতটি এমন ফযীলতপূর্ণ যে, এ রাতের ইবাদাত-বন্দেগী হাজার মাসের ইবাদাত-বন্দেগীর চেয়ে উত্তম। নবী ﷺ বলেছেন,

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভের আশায় কদরের রাতে জাগরণ করবে, তার পিছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। [সহীহ বুখারী, হা/৩৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৮১৮; আবু দাউদ, হা/১৩৭৪; তিরমিযী, হা/৬৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৫৫৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৯৪; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯৪৯৫; বায়হাকী, হা/৮৩০৬; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৬৩২; জামেউস সগীর, হা/১১৩৮৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৯২; মিশকাত, হা/১৯৫৮।]

২. এ রাতটি এদিক দিয়ে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম যে, এ রাতে বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করে মানুষের এত কল্যাণ সাধন করা হয়েছে, যা মানব জাতির ইতিহাসে হাজার মাসেও করা হয়নি। কারণ এ কুরআন একটি অসভ্য, বর্বর জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে তাদেরকে সভ্য, ভদ্র ও চরিত্রবান করে উন্নতি ও কল্যাণের চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। কুরআনের বাণী শুনে পাথরের মতো কঠিন অন্তরগুলো পানির মতো নরম হয়ে গিয়েছিল, এর মুজিযা ও মাধুর্যের সামনে সারা বিশ্ব অবাক, হতভম্ব ও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সূরা দুখানে এ কথাটি এভাবে বলা হয়েছে,

﴿ إِنَّاۤ أَنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ﴾

আমি একে এক বরকতময় রাত্রে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা দুখান- ৩)

এখানে কদরের রাতকে বরকতময় বলা হয়েছে। যেহেতু এ রাতে কল্যাণ ও বরকতের এমন ধারা শুরু হয়েছিল, যা সারা দুনিয়ায় এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

কদরের রাতের বিশেষত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿تَنَزَّلُ الْمَلَآئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِّنْ كُلِّ أَمْرٍ﴾

এ রাতে জিবরাঈল ও অন্যান্য ফেরেশতারা তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। (সূরা কদর- ৪)

এ রাত্রে অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন। হাদীসে এসেছে,

إِنَّ الْمَلَائِكَةَ تِلْكَ اللَّيْلَةِ أَكْثَرَ فِي الْأَرْضِ مِنْ عَدَدِ الْحَصٰى

কদরের রাতে ফেরেশতাদের সংখ্যা পৃথিবীর সমুদয় কংকরের চেয়েও বেশি হয়। [সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২১৯৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৭৪৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯৪৪৭; জামেউস সগীর, হা/৯৬০৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২২০৫।]

এই অসংখ্য ফেরেশতারা এ রাতে ইবাদাতকারীদের জন্য দু‘আ করেন।

এ রাতে বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করা হয়। সূরা দুখানে বলা হয়েছে,

﴿فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ﴾

এই রাতে সব ব্যাপারে জ্ঞানগর্ভ ফায়সালা হয়ে থাকে। (সূরা দুখান- ৪)

﴿سَلَامٌ هِيَ حَتّٰى مَطْلَعِ الْفَجْرِ﴾

এ রাতটি ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি শান্তিময়। (সূরা কদর- ৫)

অর্থাৎ এ রাতে শুধু শান্তি আর শান্তি, মঙ্গল আর মঙ্গল। এতে অনিষ্টের নাম গন্ধও নেই। অনাবিল শান্তিপূর্ণ এ রজনীর অফুরন্ত শান্তি ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

৪৯
লাইলাতুল কদর কোন্টি
কদরের রাত কোন্ তারিখে- তা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে কিছু দলীলের ভিত্তিতে এ রাতটি রমাযান মাসে হওয়ার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। যেমন সূরা কদরের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, কুরআন কদরের রাতে নাযিল হয়েছে। আবার সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, রমাযান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। সুতরাং এ আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে এটা নির্দিষ্ট হয়ে গেল যে, কদরের রাতটি রমাযান মাসেই রয়েছে। রমাযান মাসের কোন্ রাত? এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهَا ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, লাইলাতুল কদরকে তোমরা রমাযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে খোঁজ করো। [সহীহ বুখারী, হা/২০১৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪৮৯; বায়হাকী, হা/৮৩১৪; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৮৩৪; জামেউস সগীর, হা/৫২৩৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৬১৬; মিশকাত, হা/২০৮৩।]

এ হাদীস দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এ রাতটি রমাযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোতে রয়েছে। আবার এ রাতটি পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ এ বেজোড় তারিখগুলোর মধ্যে একেক বছর একেক তারিখে হতে পারে।

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ কদরের রাতের তারিখ জানানোর জন্য বের হলেন, তখন মুসলমানদের দু’ব্যক্তি বিতর্কে লিপ্ত হলো, ফলে নবী ﷺ -কে এ রাতটি ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬৯৬; সহীহ বুখারী, হা/৪৯; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৩৩৮০; মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/২৭৫২; জামেউস সগীর, হা/৪২২৬; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৫৯২।]

তবে এ রাতটি নির্দিষ্ট না করার মধ্যে বিরাট কল্যাণ ও হিকমত রয়েছে। এটি নির্দিষ্ট থাকলে কেবল ঐ তারিখেই মানুষ আল্লাহর ইবাদাত করত, এখন অনির্দিষ্ট থাকাতে শেষ দশকের বেজোড় পাঁচটি রাতেই আল্লাহর বান্দারা বেশি বেশি ইবাদাত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পাবে।

عَنْ عَائِشَةَ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهَا ، قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهٗ وَأَحْيَا لَيْلَهٗ وَأَيْقَظَ أَهْلَهٗ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ রমাযানের শেষ দশকের রাতগুলোতে কোমর কষে বাঁধতেন। তিনি নিজে জাগতেন এবং পরিবারের লোকদেরকেও জাগাতেন। [সহীহ বুখারী, হা/২০২৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪২২; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৮২৯; জামেউস সগীর, হা/৮৮৪২; মিশকাত, হা/২০৯০।]

লাইলাতুল কদরে পড়ার দু‘আ :

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি নবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তবে কী পড়ব? তিনি বলেন এ দু‘আ পড়ো,

اَللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউউন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী।

অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি বড়ই ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি ভালোবাস। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। [তিরমিযী, হা/৩৫১৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩৮৫০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৪২৩; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৯৪২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৩৩৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৩৯১; মিশকাত, হা/২০৯১।]

৫০
ফিতরা আদায় করা
ইসলাম সম্পদের আবর্তন চায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿كَيْ لَا يَكُوْنَ دُوْلَةً ۢبَيْنَ الْأَغْنِيَآءِ مِنْكُمْ﴾

সম্পদ শুধুমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে যেন কেন্দ্রীভূত না থাকে। (সূরা হাশর- ৭)

﴿وَفِيْۤ أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّآئِلِ وَالْمَحْرُوْمِ﴾

আর তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। (সূরা যারিয়াত- ১৯)

এজন্যই ইসলাম এমন কিছু বিধান ফরয করেছে, যাতে করে গরীবরা ধনীদের সম্পদের কিছু অংশ ভোগ করতে পারে। এরই একটি অংশ হচ্ছে সাদাকাতুল ফিতর।

দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ সাদাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একটি হলো রোযাকে ত্রুটিমুক্ত করা, অপরটি হলো গরীবদেরকে ঈদের আনন্দে শরীক করা।

মানুষের মধ্যে নানাবিধ দুর্বলতা রয়েছে, আল্লাহর হুকুম পালন করতে কতইনা ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়। বান্দা দীর্ঘ একটি মাস রোযা পালন করেছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। বান্দার এ ঘাটতি যাতে পূর্ণ হয়ে যায়, তাই ইসলাম বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কিছু দান-সাদাকা করার নির্দেশ দিয়েছে।

অপরদিকে ঈদের দিনটি হচ্ছে মুসলিম জাতির এক চরম আনন্দের দিন। কিমুত যারা অর্ধাহারে অনাহারে কালযাপন করছে, আর্থিক সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তারা তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে কী করে ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে? মুসলিম সমাজের এই বৈষম্য দূর করার জন্য বিশেষ করে ঈদের দিনে গরীবদেরকে সাহায্য করে ঈদের আনন্দে তাদেরকে শরীক করার জন্য ইসলাম এই সুন্দর ব্যবস্থা দিয়েছে।

৫১
কী দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে
ফিতরা মূলত গরীবদের হক। এটি সাধারণত নিজ নিজ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য দ্বারা আদায় করা উচিত। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামগণ তাদের প্রধান খাদ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন। যেমন- ভুট্টা, খেজুর, পনীর ইত্যাদি। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ ، يَقُوْلُ كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيْبٍ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা ফিতরার যাকাত এক সা‘ খাদ্য অথবা এক সা‘ ভুট্টা অথবা এক সা‘ খেজুর অথবা এক সা‘ পনীর অথবা এক সা‘ কিসমিস দ্বারা আদায় করতাম। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬২৭; সহীহ বুখারী, হা/১৫০৬; সহীহ মুসলিম, হা/২৩৩০; তিরমিযী, হা/৬৭৩; নাসাঈ, হা/২৫১২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪০৮; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২১৩৩; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৫৯৫; সুনানে দারেমী, হা/১৬৬৩; মিশকাত, হা/১৮১৬।]

অতএব, বাংলাদেশে যেহেতু প্রধান খাদ্য হিসেবে চাল ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে, সুতরাং এখানকার মানুষের জন্য চাল দ্বারা ফিতরা আদায় করাই উত্তম।

যিনি যে মানের খাদ্যদ্রব্য বছরের বেশিরভাগ সময় আহার করেন, তিনি সে মানের খাদ্যদ্রব্য থেকেই সাদকাতুল ফিতর প্রদান করবেন।

আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য চাল। সুতরাং তা দিয়েই ফিতরা প্রদান করা উচিত।

৫২
ফিতরার পরিমাণ
ফিতরা আদায়ের পরিমাণ হচ্ছে এক ‘সা’। ঈদুল ফিতরের দিন প্রত্যেক মুসলিমের পক্ষ হতে এ পরিমাণ খাদ্য প্রদান করা ওয়াজিব। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : فَرَضَ رَسُوْلُ اللهِ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ وَالذَّكَرِ وَالْأُنْثٰى وَالصَّغِيْرِ وَالْكَبِيْرِ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدّٰى قَبْلَ خُرُوْجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلَاةِ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন-পরাধীন, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের উপর এক সা‘ পরিমাণ যব দিয়ে ফিতরা আদায় করা আবশ্যক করে দিয়েছেন এবং ঈদের সালাতে যাওয়ার আগে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৫০৩; নাসাঈ, হা/২৫০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭৮১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪০৪; সুনানে দার কুতনী, হা/২০৭২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪৯৪; বায়হাকী, হা/৭৪৭৭; মিশকাত, হা/১৮১৫।]

সা‘ এর পরিমাণ :

তৎকালীন মদিনায় (হিজায অঞ্চলে) প্রচলিত এক সা‘ এর সমপরিমাণ বর্তমানকালের মেট্রিক পদ্ধতির ওজন নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আলেমদের মাঝে সামান্য মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ দুই কিলো পাঁচশত বিশ গ্রাম (২.৫২০ কিলোগ্রাম) চাল অথবা দুই কিলো একশত ছিয়াত্তর গ্রাম (২.১৭৬ কিলোগ্রাম) গম সাব্যসত্ম করেছেন। আবার কেউ কেউ দুই কিলো চল্লিশ গ্রাম (২.৪০ কিলোগ্রাম) বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। মনে রাখতে হবে যে, খাদ্য বা শস্যদানার ঘনত্ব ও হালকা বা ভারী ধরনের হওয়ার কারণে একই পাত্রের মাপে বিভিন্ন খাদ্য ও শস্যদানার ওজনে কম-বেশি হতে পারে।

এ কারণে সতর্কতার জন্য যে অঞ্চলের লোকদের প্রধান খাদ্য যেটা ঐ অঞ্চলের লোকেরা ঐ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য পূর্ণ আড়াই কিলো হিসেবে আদায় করবে। তাহলে নিশ্চিতভাবে সাদাকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে- ইনশাআল্লাহ।

নিসফে সা‘ গম এর প্রচলন :

দুই মুদ বা অর্ধ সা‘ পরিমাণকে নিসফে সা‘ বলা হয়। নবী ﷺ প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা, আযাদ ও গোলামের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা‘ খেজুর বা এক সা‘ যব আদায় করা ফরয করেছেন। তারপর লোকেরা অর্ধ সা‘ গমকে এক সা‘ খেজুরের সমমান দিতে লাগল। মদিনায় এক সা‘ খেজুরের সাথে সিরিয়ার উন্নত মানের দুই মুদ গম বিনিময় হতো।

তাই খেজুরের মূল্যের পার্থক্যের কারণে নিসফে সা‘ গম প্রদানের বিধান ঐ সময়কার জন্য সঠিক হলেও পরবর্তীকালে গমের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে তা অকার্যকর হয়ে গেছে।

বর্তমানকালে নিসফে সা‘ গমের মূল্য এক সা‘ খেজুরের মূল্যের বিকল্প নয়। কিসমিস ও পনীরের মূল্য গমের চেয়ে অনেক বেশি। এসব কারণে মুহাক্কিক আলেমগণ মনে করেন নিসফে সা‘ গম প্রদানের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নেই। গমের ক্ষেত্রেও ফিতরার পরিমাণ হবে এক সা‘।

৫৩
টাকা দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করার হুকুম
টাকা দ্বারা ফিতরা আদায়ের রীতি ইসলামের সোনালী যুগে ছিল না। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম টাকা দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন মর্মে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মুদ্রা বাজারে চালু থাকা সত্ত্বেও তিনি খাদ্যবসত্মু দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন এবং আদায় করতে বলেছেন। খাদ্য শস্যের কথা বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।

অতএব খাদ্যশস্য দ্বারা যাকাতুল ফিতর আদায় করাই ইসলামী শরীয়তের বিধান। টাকা-পয়সা দ্বারা ফিতরা আদায় করা এর পরিপন্থী। যে ব্যক্তি ২০ টাকা কেজি দরের চাল খান তিনি উক্ত মানের চাল এক সা‘ ফিতরা দিবেন। আর যে ব্যক্তি ৫০ টাকা কেজি দরের চাল খান তিনি উক্ত মানের চাল এক সা‘ ফিতরা দিবেন।

যাকাতুল ফিতর বণ্টনের খাত :

যাকাত বণ্টনের ৮টি খাতই হচ্ছে যাকাতুল ফিতর বণ্টনের খাত। এ সংক্রামত্ম আলোচনা এ বইয়ের কিতাবুয যাকাত অংশে রয়েছে।

৫৪
যাকাতুল ফিতর কাদের উপর ওয়াজিব
কতক আলেমের মতে, যে ব্যক্তি যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব হবে। তবে অধিকাংশ মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের মতে, যাকাতুল ফিতর ফরয হওয়ার জন্য নিসাব পরমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত নয়।

কোন ব্যক্তির নিকট ঈদের দিনে তার ও তার পরিবারের একদিন ও একরাত ভরণ-পোষণের খরচ ছাড়া অতিরিক্ত যাকাতুল ফিতর আদায় করার পরিমাণ অর্থাৎ এক সা‘ পরিমাণ খাদ্য থাকলেই তার উপর যাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। [সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২য় খন্ড ৭২ পৃঃ।]

বিভিন্ন হাদীসের ভাষা থেকে বুঝা যায় যে, কারো নিকট একদিন ও একরাতের খাবার থাকলে তার জন্য ভিক্ষা করা বা হাত পাতা ঠিক নয়। সাহল ইবনে রাবী হানযালী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও সম্পদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অন্যের নিকট কিছু চায়- সে জাহান্নামের আগুন বাড়িয়ে নিল। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! ধনী বা অমুখাপেক্ষী হওয়ার সীমা কী, যার কারণে অন্যের নিকট কিছু চাওয়া অনুচিত হয়? তিনি বললেন, কারো নিকট এমন কিছু সম্পদ থাকা, যা তার সকাল ও সন্ধ্যার প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট। [আবু দাউদ, হা/১৬৩১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৬৬২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮০৫; মিশকাত, হা/১৮৪৮।]

ফিতরা ছোট বড় সকলের পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে :

عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ فَرَضَ رَسُوْلُ اللهِ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ وَالذَّكَرِ وَالْأُنْثٰى وَالصَّغِيْرِ وَالْكَبِيْرِ مِنْ الْمُسْلِمِيْنَ وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدّٰى قَبْلَ خُرُوْجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلَاةِ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন-পরাধীন, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের উপর এক ‘সা’ পরিমাণ যব দিয়ে ফিতরা আদায় করা ফরয করেছেন এবং ঈদের সালাতে যাওয়ার আগে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৫০৩; নাসাঈ, হা/২৫০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭৮১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪০৪; সুনানে দার কুতনী, হা/২০৭২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪৯৪; বায়হাকী, হা/৭৪৭৭; মিশকাত, হা/১৮১৫।]

৫৫
ফিতরা কখন আদায় করবে
হাদীসের ভিত্তিতে যাকাতুল ফিতর প্রদানের দুটি সময় পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে ফযীলতপূর্ণ সময়, আর অপরটি হচ্ছে সাধারণ সময়।

প্রথমত : ফযীলতপূর্ণ সময় :

ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করা। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ فَرَضَ رَسُوْلُ اللهِ - - زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِيْنِ مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلَاةِ فَهِىَ زَكَاةٌ مَقْبُوْلَةٌ وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلَاةِ فَهِىَ صَدَقَةٌ مِنَ الصَّدَقَاتِ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাদাকাতুল ফিতরকে ফরয করেছেন রোযাদারকে (রোযা অবস্থায়) অনর্থক কথা এবং অন্যায় কাজের গোনাহ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলো সেটা হবে গ্রহণীয় যাকাত, আর যে ব্যক্তি সালাতের পরে আদায় করবে সেটা অন্যান্য সাদাকার মতো সাধারণ সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে। [আবু দাউদ, হা/১৬১১; ইবনে মাজাহ, হা/১৮২৭; সুনানে দার কুতনী, হা/২০৬৭; জামেউস সগীর, হা/৫৮৮৩।]

সুতরাং বিনা কারণে সালাতের পর বিলম্ব করলে তা ‘সাদাকাতুল ফিতর’ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ তা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নির্দেশের পরিপন্থী। এজন্য ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্ব করে আদায় করা উচিত যাতে মানুষ সালাতের পূর্বেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।

দ্বিতীয়ত : সাধারণ সময় :

ঈদের এক দু’দিন পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা জায়েয। হাদীসে এসেছে,

فَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يُعْطِيْ ، عَنِ الصَّغِيْرِ وَالْكَبِيْرِ حَتّٰي اِنْ كَانَ يُعْطِيْ عَنْ بَنِيَّ ، وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا يُعْطِيْهَا الَّذِيْنَ يَقْبَلُوْنَهَا وَكَانُوْا يُعْطُوْنَ قَبْلَ الْفِطْرِ بِيَوْمٍ ، أَوْ يَوْمَيْنِ

ইবনে উমর (রাঃ) নিজের এবং ছোট-বড় সমত্মানদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন। তিনি যাকাতের হকদারদেরকে ঈদের একদিন বা দু’দিন পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর পৌঁছে দিতেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৫১১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩৯৭।]

সাদাকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের পূর্বেই আদায় করতে হবে। বিনা কারণে ঈদের সালাতের পর আদায় করা জায়েয নেই। তবে যদি কোন বিশেষ কারণবশত বিলম্ব করে, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যেমন- সে এমন স্থানে আছে যে, তার নিকট আদায় করার মতো কোন বসত্মু নেই বা এমন কোন ব্যক্তিও নেই, যে এর হকদার হবে।

৫৬
ঈদ প্রসঙ্গ
রমাযান মাস শেষে পশ্চিমাকাশে যখন শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখা যায় তখন মুসলিম সমাজে এক নতুন আনন্দ বিরাজ করে। তবে এই খুশিতে শয়তানী কার্যকলাপ না ঢুকিয়ে নবী ﷺ এর শিক্ষা ও আমলের অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।

عِيْدٌ (ঈদ) শব্দটি عَوْدٌ (‘আওদুন) শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে, বার বার ফিরে আসা। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার এ দু’টি দিন প্রতি বছর একবার করে ফিরে আসে বিধায় এ দু’টি দিনকে ইসলামী শরীয়তে ঈদের দিন বলা হয়েছে। তাছাড়া ঈদের অন্য অর্থ হচ্ছে, আনন্দ, উৎসব ইত্যাদি। মুসলিম সমাজ এ দু’টি দিন তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে এবং আনন্দ করে, তাই এ দিনগুলোকে ঈদের দিন বলা হয়।

মহানবী ﷺ মদিনায় হিজরত করার পর দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে প্রথম ঈদের সালাত আদায় করেন। নবী ﷺ বলেছেন,

يَا أَبَا بَكْرٍ إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيْدًا وَهٰذَا عِيْدُنَا

হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতিরই আনন্দোৎসব রয়েছে। আর আমাদের আনন্দোৎসব হচ্ছে এটা (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।) [সহীহ বুখারী, হা/৯৫২; সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৫৭৫; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২১৩৭; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৮৮০৯; বায়হাকী, হা/২০৮০১; শারহুস সুন্নাহ, হা/১১১১; মিশকাত, হা/১৪৩২।]

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ মদিনাতে এলেন, তখন এখানকার বাসিন্দাদের দুটি উৎসব ছিল, যাতে তারা আনন্দ করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে প্রশ্ন করেন, এই দু’দিনে তোমরা কী কর? তারা বলল, আমরা ইসলাম আগমনের পূর্বে এ দু’দিন আনন্দোৎসব করতাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ওগুলোর পরিবর্তে আরো উত্তম কিছু দান করেছেন। একটি হলো রোযা ভাঙ্গার আনন্দের দিন ‘‘ঈদুল ফিতর’’ এবং অপরটি হলো কুরবানীর দিন ‘‘ঈদুল আযহা’’। [নাসাঈ, হা/১৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৮৫০; বায়হাকী, হা/৫৯১৮।]

মদিনাবাসীগণ শুধু খেলাধুলা ও আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দুটি দিন নির্ধারণ করে নিয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা তা পরিবর্তন করে এমন দুটি দিন দান করলেন যে দিন দুটিতে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর যিকির ও তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা ও খাওয়া-দাওয়া করা হয়।

মুসলিমদের ঈদ হলো দু’দিন :

মুসলিমদের ঈদ হলো দু’দিন। সুতরাং ঈদে মীলাদুন্নবী নামে তৃতীয় আরেকটি ঈদ প্রচলন করা নিঃসন্দেহে বিদআত, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

৫৭
ঈদের দিন করণীয়
ঈদের দিন সকালে গোসল করা :

ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মুসত্মাহাব। কেননা এ দিন সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। যে কারণে জুমু‘আর দিন গোসল করা মুসত্মাহাব সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে গোসল করা মুসত্মাহাব। হাদীসে এসেছে,

عَنْ نَافِعٍ، أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يَغْتَسِلُ يَوْمَ الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ يَغْدُوَ إِلَى الْمُصَلّٰى

নাফে‘ (রহ.) হতে বর্ণিত। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৪২৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৩৪৪; মুসনাদে শাফেয়ী, হা/৩২২; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৫৭৫৩।]

শালীনতা বজায় রেখে যথাসম্ভব উত্তম পোশাক পরিধান করা :

আল্লাহর নিয়ামতের প্রকাশ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করণার্থে ঈদের দিন সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা ভালো। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - إِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ يُرٰى أَثَرُ نِعْمَتِه عَلٰى عَبْدِه

আমর ইবনে শু‘আইব (রহ.) তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। [তিরমিযী, হা/২৮১৯; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৭১৮৮; জামেউস সগীর, হা/২৭২৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২৯০; মিশকাত, হা/৪৩৫০।]

ঈদুল আযহার দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া :

عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ - لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّٰى يَطْعَمَ وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ الْأَضْحٰى حَتّٰى يُصَلِّىَ

বুরায়দা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না এবং ঈদুল আযহার দিন সালাত আদায় না করে কিছু খেতেন না। [তিরমিযী, হা/৫৪২; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৫৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৪২৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৮১২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১০৮৮; মিশকাত, হা/১৪৪০।]

ঈদুল ফিতরের দিন কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত :

عَنْ أَنَسٍ ، قَالَ : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ  : لَا يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّٰى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ . وفى رواية وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ‘‘ঈদুল ফিতর’’-এর দিন কিছু খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি তা বেজোড় সংখ্যায় খেতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৯৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২২৯০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৪২৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৮১৪; মিশকাত, হা/১৪৩৩।]

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া :

عَنْ عَلِىِّ بْنِ أَبِىْ طَالِبٍ قَالَ مِنَ السُّنَّةِ أَنْ تَخْرُجَ إِلَى الْعِيْدِ مَاشِيًا وَأَنْ تَأْكُلَ شَيْئًا قَبْلَ أَنْ تَخْرُجَ . قَالَ أَبُوْ عِيْسٰى هٰذَا حَدِيْثٌ حَسَنٌ . وَالْعَمَلُ عَلٰى هٰذَا الْحَدِيْثِ عِنْدَ أَكْثَرِ أَهْلِ الْعِلْمِ يَسْتَحِبُّوْنَ أَنْ يَخْرُجَ الرَّجُلُ إِلَى الْعِيْدِ مَاشِيًا وَأَنْ يَأْكُلَ شَيْئًا قَبْلَ أَنْ يَخْرُجَ لِصَلَاةِ الْفِطْرِ . قَالَ أَبُوْ عِيْسٰى وَيُسْتَحَبُّ أَنْ لَا يَرْكَبَ إِلَّا مِنْ عُذْرٍ

আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সুন্নাত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং বের হওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া। ইমাম তিরমিযী (রহ.) হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান। তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ অনুযায়ী আমল করেন এবং তাদের মত হলো, পুরুষরা ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাবে এবং ঈদুল ফিতরের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে কিছু খেয়ে নেবে। ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, মুসত্মাহাব হচ্ছে, গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়া যানবাহনে আরোহণ করবে না। [তিরমিযী, হা/৫৩০।]

ঈদগাহে আসা-যাওয়ার সময় পথ পরিবর্তন করা :

عَنْ جَابِرٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيْدٍ خَالَفَ الطَّرِيْقَ

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ ঈদের দিন রাসত্মা পরিবর্তন করতেন অর্থাৎ এক পথে যেতেন এবং অন্য পথে আসতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৯৮৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১১০৮; জামেউস সগীর, হা/৮৯০৭; মিশকাত, হা/১৪৩৪।]

ঈদের দিন তাকবীর পাঠ করা জরুরি :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ﴾

আল্লাহ তা‘আলা চান তোমরা রোযার দিনগুলো (রমাযানের সংখ্যা) পূর্ণ করো এবং আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করো, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিখিয়েছেন। তাহলে আশা করা যায়, তোমরা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবে। (সূরা বাকারা- ১৮৫)

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) এ আয়াতের প্রেক্ষিতে বলেন, প্রত্যেক রোযাদারের কর্তব্য হচ্ছে, শাওয়াল মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাকবীর বলতে থাকা- যতক্ষণ না ঈদগাহ থেকে ফিরে আসে। [ফাত্হুল বায়ান ১ম খন্ড ২৩৯ পৃষ্ঠা।]

ঈদুল ফিতরের দিনের তাকবীরের প্রথম এবং শেষ সময়ঃ

তাকবীর আরম্ভ হবে ঈদের জন্য বের হওয়ার সাথে সাথে এবং ঈদের সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার সময় শেষ হয়ে যায়। এক হাদীসে এসেছে,

عَنِ الزُّهْرِيِّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ فَيُكَبِّرُ حَتّٰى يَأْتِيَ الْمُصَلّٰى ، وَحَتّٰى يَقْضِيَ الصَّلَاةَ ، فَإِذَا قَضَى الصَّلَاةَ قَطَعَ التَّكْبِيْرَ

যুহরী (রহ.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল ফিতরের দিনে বের হতেন এবং ঈদগাহে পৌঁছা পর্যমত্ম তাকবীর দিতে থাকতেন। তারপর সালাত সমাপ্ত করতেন। অতঃপর যখন তিনি সালাত সমাপ্ত করতেন, তখন তাকবীর দেয়া বন্ধ করতেন। [সনদ মুরসাল : মুসান্নাফ ইবনু আবি শায়বাহ হা/৫৬৬৭; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৭১।]

নিচের বাক্যগুলোর মাধ্যমে তাকবীর পড়তে হয় :

اَللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ لَا اِلٰهَ إِلَّا اللهُ اَللهُ أَكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ وَ لِلّٰهِ الْحَمْدُ

উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হামদ।

অর্থ : আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন উপাস্য নেই, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। [উমদাতুল কারী ১০/৩১০।]

৫৮
মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার বিধান
মহিলাদের ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুমতি :

عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ أَنْ نُخْرِجَهُنَّ فِي الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى الْعَوَاتِقَ وَالْحُيَّضَ وَذَوَاتِ الْخُدُوْرِ فَأَمَّا الْحُيَّضُ فَيَعْتَزِلْنَ الصَّلَاةَ وَيَشْهَدْنَ الْخَيْرَ وَدَعْوَةَ الْمُسْلِمِيْنَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِحْدَانَا لَا يَكُوْنُ لَهَا جِلْبَابٌ قَالَ لِتُلْبِسْهَا أُخْتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا

উম্মে আতিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, যেন আমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঋতুবতী, সাবালিকা এবং পর্দাশীল নারীদেরকে নিয়ে বের হই। অতঃপর ঋতুবতী নারীরা সালাত আদায় করা হতে পৃথক থাকতেন। কিমত্মু তারা অন্যান্য উত্তম কাজসমূহ ও মুসলিমদের দু‘আয় অংশগ্রহণ করতেন। একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে এমন অনেক নারী আছে, যাদের কোন চাদর নেই। তখন তিনি বললেন, তাদের বোন যেন তাদেরকে চাদর ধার দেয়। [সহীহ বুখারী, হা/৩২৪; সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৮১৮।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، قَالَ : كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ، يَأْمُرُ بَنَاتَهٗ وَنِسَاءَهٗ أَنْ يَخْرُجْنَ فِيْ الْعِيْدَيْنِ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তার কন্যা ও স্ত্রীদেরকে দুই ঈদে বের হওয়ার নির্দেশ দিতেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৫৪; জামেউস সগীর, হা/৯০১৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২১১৫।]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - خَرَجَ يَوْمَ أَضْحٰى أَوْ فِطْرٍ فَصَلّٰى رَكْعَتَيْنِ لَمْ يُصَلِّ قَبْلَهَا وَلَا بَعْدَهَا ثُمَّ أَتَى النِّسَاءَ وَمَعَهٗ بِلَالٌ فَأَمَرَهُنَّ بِالصَّدَقَةِ فَجَعَلَتِ الْمَرْأَةُ تُلْقِىْ خُرْصَهَا وَتُلْقِىْ سِخَابَهَا

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুলস্নাহ ﷺ একবার ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের দিন বের হলেন এবং দু’ রাকআত সালাত আদায় করলেন এবং এর পূর্বে ও পরে কোন সালাত আদায় করলেন না। অতঃপর তিনি মহিলাদের নিকট আসলেন। এ সময় তাঁর সাথে বিলাল (রাঃ) ছিলেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে সাদাকা করার আদেশ দেন। ফলে মহিলারা নিজ নিজ কানের রিং ও গলার হার সাদাকা করতে লাগল। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৪; বায়হাকী, হা/৬০২০; আবু দাউদ, হা/১১৬১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৪৩৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২০৯৮।]

عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ قَالَتْ كُنَّا نُؤْمَرُ أَنْ نَخْرُجَ يَوْمَ الْعِيْدِ حَتّٰى نُخْرِجَ الْبِكْرَ مِنْ خِدْرِهَا حَتّٰى نُخْرِجَ الْحُيَّضَ فَيَكُنَّ خَلْفَ النَّاسِ فَيُكَبِّرْنَ بِتَكْبِيْرِهِمْ وَيَدْعُوْنَ بِدُعَائِهِمْ يَرْجُوْنَ بَرَكَةَ ذٰلِكَ الْيَوْمِ وَطُهْرَتَهٗ

উম্মে আতিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ঈদের দিন আমাদের বের হওয়ার আদেশ দেয়া হতো। এমনকি আমরা কুমারী মেয়েদেরকেও অন্দর মহল হতে বের করতাম এবং ঋতুবতী মেয়েদেরকেও। তারা পুরুষদের পিছনে থাকত এবং তাদের তাকবীরের সাথে তাকবীর বলত ও তাদের দু’আর সাথে দু’আ করত। আর তারা সে দিনের বরকত এবং পবিত্রতার আশা করত। [সহীহ বুখারী, হা/৯৭১।]

উপরোক্ত হাদীসগুলো হতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ প্রাপ্তবয়স্কা, গৃহবাসিণী এবং ঋতুবতী মহিলাদেরকেও উভয় ঈদে ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদেরকেও দুই ঈদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আরো প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ মহিলাদেরকে ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, যদি কোন মহিলার ওড়না/চাদর না থাকে তাহলে তাকে তার অপর বোনের চাদর ধার নিয়ে হলেও ঈদগাহে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, ঋতুবতী মহিলারা নামাযের সময় নামায পড়া হতে বিরত থাকবে এবং অন্যান্য কল্যাণকর কাজে ও মুসলিমদের দু‘আয় শরীক হবে।

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ شَهِدْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ الصَّلَاةَ يَوْمَ الْعِيْدِ فَبَدَأَ بِالصَّلَاةِ قَبْلَ الْخُطْبَةِ بِغَيْرِ أَذَانٍ وَلَا إِقَامَةٍ ثُمَّ قَامَ مُتَوَكِّئًا عَلٰى بِلَالٍ فَأَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ وَحَثَّ عَلٰى طَاعَتِه وَوَعَظَ النَّاسَ وَذَكَّرَهُمْ ثُمَّ مَضٰى حَتّٰى أَتَى النِّسَاءَ فَوَعَظَهُنَّ وَذَكَّرَهُنَّ فَقَالَ تَصَدَّقْنَ فَإِنَّ أَكْثَرَكُنَّ حَطَبُ جَهَنَّمَ فَقَامَتِ امْرَأَةٌ مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ فَقَالَتْ لِمَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ لِأَنَّكُنَّ تُكْثِرْنَ الشَّكَاةَ وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيْرَ قَالَ فَجَعَلْنَ يَتَصَدَّقْنَ مِنْ حُلِيِّهِنَّ يُلْقِيْنَ فِىْ ثَوْبِ بِلَالٍ مِنْ أَقْرِطَتِهِنَّ وَخَوَاتِمِهِنَّ

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ঈদের দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি খুতবার আগে প্রথমে সালাত আদায় করলেন- আযান-ইকামত ছাড়া। অতঃপর তিনি বিলাল (রাঃ) এর উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন এবং ‘‘আল্লাহ ভীতি’’ অর্জন করার আদেশ করলেন ও তাঁর আনুগত্য করার জন্য অনুপ্রাণিত করলেন। অতঃপর তিনি সমবেত জনতার সামনে উপদেশমূলক বক্তৃতা প্রদান করলেন। তারপর বক্তৃতা শেষ করে মহিলাদের কাছে গেলেন। অতঃপর তিনি তাদের সামনেও উপদেশমূলক বক্তৃতা প্রদান করলেন। তারপর বললেন, তোমরা সাদাকা করো। কেননা তোমাদের বেশির ভাগ মহিলাই জাহান্নামের জ্বালানী হবে। (এ কথা শুনে) মহিলাদের মধ্য থেকে উভয় গালে কালো দাগ বিশিষ্ট একজন মহিলা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন- হে আল্লাহর রাসূল? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, কেননা তোমরা বেশি বেশি অজুহাত ও অভিযোগ পেশ করে থাক এবং স্বামীর অবাধ্যাচরণ করে থাক। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর মহিলারা তাদের অলঙ্কারাদি দান করতে শুরু করল। তারা তাদের কানের রিং এবং আংটিসমূহ বিলালের কাপড়ে ফেলতে লাগল। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৮৫; নাসাঈ, হা/১৫৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৪৬০; সুনানে দারেমী, হা/১৬১০; বায়হাকী, হা/৬০১৫।]

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুলস্নাহ ﷺ ঈদের সালাত আদায় করে বিলাল (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মহিলাদের নিকট গিয়েছেন। তাদেরকে দান সাদাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন, এমনকি মহিলারা রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর ওয়াজ-নসীহত শ্রবণ করে তাদের কানের রিং ও গলার হার পর্যমত্মও দান করে দিয়েছেন। উক্ত দানগুলো বিলাল (রাঃ) একত্রিত করে নিয়ে এসেছেন।

কিমত্মু বড় অনুতাপের বিষয় হলো এই যে, মহিলাদের মসজিদে ও ঈদগাহে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুলস্নাহ ﷺ এর সহীহ হাদীস ও অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে অনেক মুসলিম সমাজ মহিলাদেরকে মসজিদ ও ঈদগাহে যাওয়া এবং মুসলিমদের দু‘আ, দ্বীন শিক্ষা ও ওয়াজ-নসীহত শ্রবণ করা হতে বঞ্চিত করছে।

ঈদের সালাতের সময় :

সূর্য পরিপূর্ণভাবে উদিত হওয়ার পর থেকে ঈদের সালাতের সময় আরম্ভ হয় এবং দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সময় এ সালাত আদায় করা যায়।

ঈদুল আযহার সালাত একটু আগে পড়া উত্তম। যেহেতু এরপর পশু কুরবানী করতে হয়। আর ঈদুল ফিতরের সালাত একটু দেরিতে পড়া উত্তম, যাতে লোকেরা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করে ঈদগাহে আসতে পারে। [সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ১/৫২৮।]

৫৯
ঈদের সালাত আদায়ের পদ্ধতি
ঈদের সালাত হলো দু’ রাকআত। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ بْنِ أَبِيْ لَيْلٰى قَالَ قَالَ عُمَرُ : صَلَاةُ الْجُمُعَةِ رَكْعَتَانِ وَصَلَاةُ الْفِطْرِ رَكْعَتَانِ وَصَلَاةُ الْأَضْحٰى رَكْعَتَانِ وَصَلَاةُ السَّفَرِ رَكْعَتَانِ تَمَامٌ غَيْرُ قَصْرٍ عَلٰى لِسَانِ مُحَمَّدٍ

আবদুর রহমান ইবনে আবু লাইলা (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জুমু‘আর সালাত দু’ রাকআত, ঈদুল ফিতরের সালাত দু’ রাকআত, ঈদুল আযহার সালাত দু’ রাকআত ও সফরের সালাতও দু’ রাকআত। [নাসাঈ, হা/১৪২০; ইবনে মাজাহ, হা/১০৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৪২৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৭৮৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৩৩০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/২৪১; বায়হাকী, হা/৫৫১০।]

প্রথমে মনে মনে নিয়ত করে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে সালাত শুরু করবে। তাকবীরে তাহরীমার পর অতিরিক্ত সাতটি তাকবীর দেবে। অতঃপর সূরা ফাতিহাসহ অন্য সূরা পাঠ করে যথারীতি প্রথম রাকআত শেষ করবে। অতঃপর দ্বিতীয় রাকআতের জন্য দাঁড়ানোর পর অতিরিক্ত পাঁচটি তাকবীর দেবে। তাকবীরসমূহ আদায় করার পর সূরা ফাতিহা পড়বে, তারপর অন্য যেকোন সূরা বা আয়াত পাঠ করবে। তারপর যথারীতি দ্বিতীয় রাকআত শেষ করবে।

ঈদের সালাতের মুসত্মাহাব কিরাআত :

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيْرٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ - - يَقْرَأُ فِى الْعِيْدَيْنِ وَفِى الْجُمُعَةِ بِ ﴿سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلٰى﴾ وَ ﴿هَلْ أَتَاكَ حَدِيْثُ الْغَاشِيَةِ﴾ قَالَ وَإِذَا اجْتَمَعَ الْعِيْدُ وَالْجُمُعَةُ فِىْ يَوْمٍ وَاحِدٍ يَقْرَأُ بِهِمَا أَيْضًا فِى الصَّلَاتَيْنِ

নু‘মান ইবনে বাশির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ দু’ ঈদের সালাতে ও জুমু‘আর সালাতে ‘‘সাবিবহিস্মা রাবিবকাল আ‘লা-’’ ও ‘‘হাল আতা-কা হাদীছুল গা-শিয়াহ্’’ সূরাদ্বয় পাঠ করতেন। বর্ণনাকারী বলেন, ঈদ ও জুমু‘আ একই দিনে হলেও তিনি উভয় সালাতে ঐ সূরাদ্বয় পাঠ করতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/২০৬৫; আবু দাউদ, হা/১১২৪; তিরমিযী, হা/৫৩৩; নাসাঈ, হা/১৫৬৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৪৩৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৮২২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৫৯৩৫; মিশকাত, হা/৮৪০।]

أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ سَأَلَ أَبَا وَاقِدٍ اللَّيْثِىَّ مَا كَانَ يَقْرَأُ بِه رَسُوْلُ اللهِ فِى الْأَضْحٰى وَالْفِطْرِ فَقَالَ كَانَ يَقْرَأُ فِيْهِمَا بِ ﴿قٓ وَالْقُرْاٰنِ الْمَجِيْدِ﴾ وَ ﴿اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ﴾

উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) আবু ওয়াক্বিদ আল লাইছী (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলেন, নবী ﷺ ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরে কী কিরাত পড়তেন? তখন তিনি বলেন, নবী ﷺ ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরে সূরা ‘‘ক্বাফ ওয়াল কুরআ-নিল মাজীদ’’ এবং ‘‘ইক্বতারাবাতিস সা-‘আতু ওয়ান শাক্কাল ক্বামারু’’ পাঠ করতেন। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৪৩৩; সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৬; আবু দাউদ, হা/১১৫৬; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/১১৪৮৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৪১২; মিশকাত, হা/৮৪১।]

ঈদের সালাতের পূর্বে বা পরে নফল সালাত নেই :

রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদের সালাতের পূর্বে বা পরে কোন সালাত আদায় করেননি। হাদীসে এসেছে,

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল ফিতরে দু’ রাকআত সালাত আদায় করতেন। এর পূর্বে বা পরে কোন সালাত আদায় করতেন না। [সহীহ বুখারী, হা/৯৬৪; সহীহ মুসলিম, হা/২০৯৪; তিরমিযী, হা/৫৩৭; নাসাঈ, হা/১৫৮৭; ইবনে মাজাহ, হা/১২৯১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩৩; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৪৩৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৮১৮; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৪১৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৫৯০২; মুসনাদে দারেমী, হা/১৬৪৬।]

তবে যদি কোন অসুবিধার কারণে ঈদের সালাত মসজিদে আদায় করতে হয়, তাহলে মসজিদে প্রবেশ করে দু’ রাকআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ আদায় করা যেতে পারে।

ঈদের সালাতের জন্য আযান ও ইকামত নেই :

ঈদের সালাতের জন্য কোন আযান নেই এবং এতে কোন ইকামতও নেই। হাদীসে রয়েছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَعَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَا لَمْ يَكُنْ يُؤَذَّنُ يَوْمَ الْفِطْرِ ، وَلَا يَوْمَ الْأَضْحٰى

ইবনে আববাস (রাঃ) ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) উভয়ে বলেছেন, ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আযহার সালাতে আযান বা ইকামত দেয়া হতো না। [সহীহ বুখারী, হা/৯৬০; সহীহ মুসলিম, হা/১১৯০; তিরমিযী, হা/৫৩২; আবু দাউদ, হা/১১৪৮; ইবনে মাজাহ, হা/১২৭৪।]

ঈদের সালাতের পূর্বে কোন ওয়াজ-নসীহত বা খুতবা নেই :

ঈদের সালাত আদায়ের পর ইমাম সাহেব খুতবা দেবেন। সালাত আদায়ের পূর্বে কোন খুতবা নেই। হাদীসে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন। ঈদগাহে প্রথম সালাত শুরু করতেন। সালাত শেষে মানুষের দিকে ফিরে খুতবা দিতেন। এ খুতবাতে তিনি তাদের ওয়াজ করতেন, উপদেশ দিতেন, বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। আর এ অবস্থায় মানুষেরা তাদের কাতারে বসে থাকত। [সহীহ বুখারী, হা/৯৫৬; বায়হাকী, হা/৫৯২৯; মিশকাত, হা/১৪২৬।]

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ঈদের সালাতের পূর্বে কোন ওয়াজ-নসীহত বা খুতবা দেয়া যাবে না। ইমাম সাহেব ঈদগাহে এসে প্রথমে সালাত শুরু করে দেবেন। অতঃপর লোকদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ-নসীহত বা খুতবা প্রদান করবেন।

উল্লেখ্য যে, ঈদগাহে মাইকে ডাকাডাকি করা, সালাতের পূর্বে বিভিন্ন জনের বক্তব্য দেয়া সুন্নাতের খিলাফ।

৬০
ঈদের সালাতে অতিরিক্ত তাকবীর কয়টি
ঈদের সালাতে অতিরিক্ত তাকবীর হলো ১২টি এবং এর উপরই আমল করা উচিত। হাদীসে বলা হয়েছে,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - كَانَ يُكَبِّرُ فِى الْفِطْرِ وَالْأَضْحٰى فِى الْأُوْلٰى سَبْعَ تَكْبِيْرَاتٍ وَفِى الثَّانِيَةِ خَمْسًا

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাতের প্রথম রাকআতে সাত তাকবীর দিলেন এবং দ্বিতীয় রাকআতে পাঁচ তাকবীর দিলেন। [আবু দাউদ, হা/১১৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৭৩৯; দার কুতনী, হা/১৭৩০; ইবনে মাজাহ, হা/১২৭৯; মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/১৯২৫।]

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ ، عَنْ أَبِيْهِ ، عَنْ جَدِّه  : أَنَّ النَّبِيَّ كَبَّرَ فِيْ عِيْدٍ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ تَكْبِيْرَةً ، سَبْعًا فِي الْأُوْلٰى ، وَخَمْسًا فِي الْاٰخِرَةِ ، وَلَمْ يُصَلِّ قَبْلَهَا ، وَلَا بَعْدَهَا

আমর ইবনে শু‘আইব (রহ.) তিনি তার পিতা হতে তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, নবী ﷺ ঈদের সালাতে ১২টি তাকবীর দিতেন। প্রথম রাকআতে ৭টি এবং শেষ রাকআতে ৫টি। আর তিনি এ সালাতের পূর্বে ও পরে কোন নফল সালাত আদায় করতেন না। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৬৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৫৭৪৩।]

ঈদের সালাতের অতিরিক্ত তাকবীরসমূহে রাফউল ইয়াদাইন করার বিধান :

ঈদের সালাতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অতিরিক্ত তাকবীরগুলোতে রাফউল ইয়াদাইন করা নবী ﷺ থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নেই। তাই ইমাম ইবনে হাযম, ইমাম শাওকানী, ইমাম আলবানী প্রমূখ বিদ্বানগণ উক্ত তাকবীরসমূহের সময় রাফউল ইয়াদাইন না করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। [আল মুহাল্লা- ৫/৮৩, ৮৪; নাইলুল আওতার, তামামুল মিন্নাহ, পৃঃ ৩৪৮-৩৪৯।]

৬১
ঈদের সালাতের পর খুতবা
ঈদের সালাতের পর ইমাম খুতবা দেবেন। সে খুতবায় তিনি আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রশংসা, গুণগান ও অধিক পরিমাণে তাকবীর পাঠ করবেন এবং দ্বীনি শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা করবেন। মুসল্লিরা মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনবেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ قَالَ شَهِدْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ - - الْعِيْدَ فَلَمَّا قَضَى الصَّلَاةَ قَالَ إِنَّا نَخْطُبُ فَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يَجْلِسَ لِلْخُطْبَةِ فَلْيَجْلِسْ وَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يَذْهَبَ فَلْيَذْهَبْ

আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে ঈদে উপস্থিত হলাম। অতঃপর যখন তিনি (ঈদের) সালাত আদায় করা শেষ করলেন তখন বললেন, নিশ্চয় আমরা খুতবা দেব। অতএব খুতবা (শ্রবণ) এর জন্য যে বসা পছন্দ করে সে যেন বসে থাকে এবং যে চলে যেতে ইচ্ছা করে সে যেন চলে যায়। [আবু দাউদ, হা/১১৫৭; ইবনে মাজাহ, হা/১২৯০; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১০৯৩; জামেউস সগীর, হা/৪০৫৩।]

ঈদের খুতবা শেষে সমবেতভাবে হাত উঠিয়ে দু‘আ করা সুন্নাতের খিলাফ :

ঈদের খুতবা শেষে সমবেতভাবে হাত উঠিয়ে দু‘আ করা সুন্নাত বিরোধী কাজ। নবী ﷺ ও সালফে সালেহীনের যুগে এর কোন প্রচলন ছিল না।

৬২
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়
ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো জায়েয আছে। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) জুবায়ের ইবনে নফী (রহ.) এর থেকে হাসান হওয়ার যোগ্যতা রাখে এমন সূত্রে বর্ণনা করেন, সাহাবীগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন,

تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। [ফাতহুল বারী, ২/৪৪৬ পৃঃ।]

‘ঈদ মুবারক’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এ বাক্য ব্যবহার করতেন এবং এতে রয়েছে পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছে দু‘আ।

মুআনাকা করা :

ঈদের দিন মুআনাকা করার খাস কোন দলীল নেই। তবে সুন্নাত মনে না করে যদি কেউ মুআনাকা করে তাতে কোন অসুবিধা নেই। সাহাবীগণ পরস্পর সাক্ষাৎ করলে মুসাফাহা করতেন এবং সফর থেকে ফিরে আসলে মুআনাকা করতেন। [সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬৪৭।]

৬৩
ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া
আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সকল প্রকার মনোমালিন্য দূর করার জন্য ঈদ একটা বিরাট সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দেয়। এসময় তাদের খোঁজ-খবর নেয়া উচিত। কেননা হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে খারাপ সম্পর্ক এমন একটা বিষয়, যা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - قَالَ تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْاِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيْسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا إِلَّا رَجُلًا كَانَتْ بَيْنَه وَبَيْنَ أَخِيْهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ أَنْظِرُوْا هٰذَيْنِ حَتّٰى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوْا هٰذَيْنِ حَتّٰى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوْا هٰذَيْنِ حَتّٰى يَصْطَلِحَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে তাকে ব্যতীত সে দিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। কিমত্মু ঐ দু’ভাইকে ক্ষমা করা হয় না, যাদের মাঝে হিংসা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে- যতক্ষণ না নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে নেয়। বলা হয়ে থাকে, এ দু’জনকে অবকাশ দাও, যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়। এ দু’জনকে অবকাশ দাও, যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়। এ দু’জনকে অবকাশ দাও, যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৬১৮; সহীহ মুসলিম, হা/৬৭০৯; আবু দাউদ, হা/৪৯১৮; তিরমিযী, হা/২০২৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০০০৭; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৬২৩; আদাবুল মুফরাদ, হা/৪১১; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৫২৩; জামেউস সগীর, হা/৫২৮১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৭৬৬; মিশকাত, হা/৫০২৯।]

এ হাদীস দ্বারা অনুধাবন করা যায় যে, নিজেদের মাঝে হিংসা, বিবাদ অথবা দ্বন্দ্ব রাখা এমন অপরাধ, যার কারণে ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সদাচরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে সবচেয়ে বেশি হকদার হলো মাতা-পিতা। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন।

অতএব প্রতিটি ঈদের সময় প্রথমে মাতা-পিতা, তারপর ভাই-বোন, খালা-ফুফু, চাচা-মামা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নেয়া উচিত। প্রয়োজনে তাদের সাথে সারাসরি দেখা করার উদ্দেশ্যে তাদের মেহমান হওয়া অথবা তাদেরকে নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা আরো উত্তম।

৬৪
ঈদের দিন কবর যিয়ারত করার বিধান
কবর যিয়ারত করা শরীয়ত সমর্থিত একটা নেক আমল। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُوْرِ فَزُوْرُوْهَا

ইবনে বুরাইদা (রহ.) তার পিতা হতে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। হ্যাঁ- এখন তোমরা কবর যিয়ারত করবে। [সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৫; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১০৩১; আবু দাউদ, হা/৩২৩৭; তিরমিযী, হা/১০৫৪; নাসাঈ, হা/২০৩২; ইবনে মাজাহ, হা/১৫৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩০৫৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৪৪৩৫; জামেউস সগীর, হা/৪২৪০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩৫৪৪; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৬৭০৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১১৯২৬; মিশকাত, হা/১৭৬২।]

অত্র হাদীসে কবর যিয়ারত করার জন্য বৈধতা প্রদান করা হয়েছে তবে নির্দিষ্ট কোন দিনের কথা বলা হয়নি। তাছাড়া অন্য কোন হাদীসে এ ধরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং ঈদের দিন কবর যিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরীয়তসম্মত নয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَا تَجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ قُبُوْرًا وَلَا تَجْعَلُوْا قَبْرِىْ عِيْدًا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা তোমাদের ঘরসমূহকে কবরে পরিণত করো না এবং আমার কবরে ঈদ উদযাপন করো না। [আবু দাউদ, হা/২০৪৪; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১১৫৯; মিশকাত, হা/৯২৬।]

৬৫
ঈদ উপলক্ষে বর্জনীয় কাজসমূহ
ঈদ হলো আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। কিমত্মু অনেক মুসলিম এ দিনটাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে জানে না। তারা এ দিনে বিভিন্ন অনৈসলামিক কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। নিম্নে এ ধরনের কিছু কাজকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

কাফিরদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ করা :

মুসলিম সমাজের অনেকে চাল-চলনে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অথচ হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। [আবু দাউদ, হা/৪০৩৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/২৯৬৬; মু‘জামুল আওসাত, হা/৮৩২৭; জামেউস সগীর, হা/১১০৯৪; মুখতাসার ইরওয়ালুল গালীল, হা/২৩৮৪; মিশকাত, হা/৪৩৪৭।]

এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হলো, যে কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে কাফির হয়ে যাবে।

পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ :

পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলার পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিন এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ الْمُتَشَبِّهِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ ঐ সকল মহিলাকে অভিশম্পাত করেছেন, যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল পুরুষকেও অভিশম্পাত করেছেন, যারা মহিলার বেশ ধারণ করে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫; আবু দাউদ, হা/৪০৯৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৯০৪; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯৫৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩১৫১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১১৪৮১; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩২০৬; জামেউস সগীর, হা/৯২৩১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৬৮; মিশকাত, হা/৪৪২৯।]

পর্দা লঙ্ঘন করা :

মহিলাদের খোলামেলা ও অশালীন পোশাকে রাসত্মাঘাটে বের হওয়া ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُوْلٰى وَاَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَاٰتِيْنَ الزَّكَاةَ وَاَطِعْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ﴾

আর তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রথম যুগের মূর্খদের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। (সূরা আহযাব- ৩৩)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - .... وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيْلَاتٌ مَائِلَاتٌ رُءُوْسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, অচিরেই এমন একদল মহিলার আগমন ঘটবে, যারা পোশাক পরিধান করেও যেন উলঙ্গ থাকবে। তারা অন্যদেরকে আকৃষ্ট করবে এবং তারাও অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না। যদিও তার সুগন্ধি এতো এতো দূর থেকে পাওয়া যাবে। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৭০৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৩৩৮৬; জামেউস সগীর, হা/৭২৪৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৩২৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৪৪; মিশকাত, হা/৩৫২৪।]

অনেককে দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদের দিন গোনাহের কাজ বেশি করে। নিকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা শরীয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : إِيَّاكُمْ وَالدُّخُوْلَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ .

উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা মেয়েদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে। আনসারী সাহাবীদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! দেবর-ভাসুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তিনি উত্তরে বললেন, এ ধরনের দেবর-ভাসুর তো মৃত্যুর সমতুল্য। [সহীহ বুখারী, হা/৫২৩২; সহীহ মুসলিম, হা/৫৮০৩; তিরমিযী, হা/১১৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩৮৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৯১৭২; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৯০১; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৩২৬১; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪১৮১; শারহুস সুন্নাহ, হা/২২৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৫৮৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১৭৯৫৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৯০৮; মিশকাত, হা/৩১০২।]

এমনসব আত্মীয়, যারা স্বামীর সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম যেমন- স্বামীর ভাই, তার মামা, খালু প্রমুখ তাদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করার কারণ হলো, এসকল আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমেই বেপর্দাজনিত বিপদ বেশি ঘটে থাকে। অথচ এ বিষয়ে আমাদের সমাজ খুবই অসতর্ক।

গান-বাজনা করা :

বর্তমান সময়ে মানুষের কাছে গান-বাজনা অতি সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এটি একটি বড় ধরনের গোনাহের কাজ। আর ঈদের দিনে এ গোনাহের কাজটা আরো বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। দেখে মনে হয় যেন এটি কোন মুসলিম সমাজের ঈদ নয়; বরং অন্য কোন ধর্মের অথবা জাতির আনন্দোৎসব। অথচ ইসলামী শরীয়তে গান ও বাদ্যযন্ত্রের নিষিদ্ধতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْزِّنىٰ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দলের আবির্ভাব ঘটবে, যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে। [সহীহ বুখারী, হা/৫৫৯০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬৭৫৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৩১৭; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৩৩৩৯; জামেউস সগীর, হা/৯৫৯৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৬৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯১; মিশকাত, হা/৫৩৪৩।]

আল্লাহ তা‘আলা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দান করে মুসলিম উম্মাহকে এর মাধ্যমে জাহেলী ঈদ-উৎসব থেকে মুক্ত করেছেন। মুসলিমদের ঈদ হলো ইবাদাত, যা বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য দান করে। আর কাফিরদের ঈদ হলো এর বিপরীত; কেননা সেখানে কুফর ও গোমরাহী প্রদর্শন করা হয় এবং বিভিন্ন শয়তানী কর্মকান্ড সংঘটিত হয়। তাই বছরের অন্যান্য দিনের মতো ঈদের দিনও শয়তানী কর্মকান্ড বর্জন করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

৬৬
নফল রোযার বিবরণ
রমাযান মাস ছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ে কিছু কিছু রোযা রাখার অভ্যাস থাকা খুবই উত্তম এবং বিরাট সওয়াবের কাজ। আবু উমামা (রাঃ) নবী ﷺ কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কোন (ভালো) আমলের কথা বলে দিন। নবী ﷺ বললেন,

عَلَيْكَ بِاالصَّوْمِ فَإِنَّهٗ لَاعَدْلَ لَهٗ

তুমি অবশ্যই রোযা রাখবে, কেননা এর সমতুল্য অন্য কিছু নেই। [নাসাঈ, হা/২২২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৩৩০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৮৯৩; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫৩৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৭৩৩৭; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯৮৯৯; জামেউস সগীর, হা/৭৪৯২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৮৬।]

রমাযান মাস ছাড়াও যে দিনগুলোতে রোযা রাখার বিশেষ ফযীলত রয়েছে হাদীসের প্রমাণসহ নিচে তা উল্লেখ করা হলো :

৬৭
শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা
শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখা সুন্নত। এর অনেক ফযীলত রয়েছে। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِىِّ -  - أَنَّهٗ حَدَّثَهٗ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهٗ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ

আবু আইয়ূব আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে রোযা রাখল এবং শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন সারা বছর রোযা রাখল। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮১৫; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/২৮৭৯; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৩৮১১; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৮০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০০৬; মিশকাত, হা/২০৪৭।]

এ হাদীসটির উপর আমল করা সকলের উচিত। একটি নেক আমলের প্রতিদানে সর্বনিম্ন দশটি নেকী দেয়া হয়। তাই রমাযানের ত্রিশটি রোযা ৩০০ দিন আর শাওয়ালের ৬টি রোযা ৬০ দিনের সমান হয়। এতে ৩৬০ দিন পূর্ণ হয়ে যায়, যা একবছরের বেশি হয়; কারণ আরবি বছর ৩৫৪ দিনে হয়ে থাকে। এ রোযাগুলো শাওয়াল মাসের যেকোন দিন রাখা যায়, একসাথে না রেখে ভেঙ্গে ভেঙ্গেও রাখা যায়।

৬৮
আশুরার রোযা
দশই মুহাররম অনেক ফযীলতপূর্ণ দিন। এদিন রোযা রাখার ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ

রমাযানের পর সর্বোত্তম রোযা হলো মুহাররম মাসের রোযা। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮১২; আবু দাউদ, হা/২৪৩১; তিরমিযী, হা/৪৩৮; নাসাঈ, হা/১৬১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৫১৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১১৩৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৬৩৯৫; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১১৫৫; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২৩৭৬; বায়হাকী, হা/৮২০৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০১৫; জামেউস সগীর, হা/১৯৯৬ মিশকাত, হা/২০৩৯।]

নবী ﷺ আরো বলেন,

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يَّكَفِّرَ السَّنَةَ اللَّتِىْ قَبْلَهٗ

আমি আল্লাহর নিকট আশা রাখি যে, আশুরার রোযা বিগত একবছরের গোনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮০৩; আবু দাউদ, হা/২৪২৭; তিরমিযী, হা/৭৫২; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০১৭; জামেউস সগীর, হা/৭৩০০; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৯০; মিশকাত, হা/২০৪৪।]

আশুরার রোযার আগে বা পরে একদিন মিলিয়ে মোট দু’টি রোযা রাখা উত্তম।

৬৯
আইয়্যামে বীযের রোযা
প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযাকে আইয়্যামে বীযের রোযা বলা হয়। এ রোযার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ আবু যর (রাঃ) কে বললেন,

يَا أَبَا ذَرِّ إِذَا صُمْتَ مِنَ الشَّهْرِ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصُمْ ثَلَاثَ عَشَرَةَ وَأَرْبَعَ عَشَرَةَ وَخَمْسَ عَشَرَةَ

হে আবু যর! তুমি যখন প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখবে তখন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখো। [তিরমিযী, হা/৭৬১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২১২৮; বায়হাকী, হা/৮২২৮; জামেউস সগীর, হা/৬৭৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৩৮; মিশকাত, হা/২০৫৭।]

আবু যর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখল সে যেন সারা বছরই রোযা রাখল। এর সত্যতা স্বরূপ তিনি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের এ আয়াতটি পাঠ করেন,

﴿مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهٗ عَشْرُ أَمْثَالِهَا﴾

যে ব্যক্তি একটি নেক আমল করবে এর বিনিময়ে সে দশটি নেকী পাবে।

(সূরা আনআম- ১৬০)

একদিন দশদিনের সমান এবং তিনদিন এক মাসের সমান। এভাবে প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখলে পূর্ণ বছর রোযা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়।

৭০
আরাফার রোযা
আরাফার দিন তথা যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখের রোযার গুরুত্ব অপরিসীম। এ সম্পর্কে নবী ﷺ বলেন,

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ إِنِّيْ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِيْ قَبْلَهٗ وَالسَّنَةَ الَّتِيْ بَعْدَهٗ

আমি ধারণা করি যে, আরাফার দিনের রোযা গত বছর ও আগামী এক বছরের গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮০৩; তিরমিযী, হা/৭৪৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৩০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৭৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৩২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০১০; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৯০; মিশকাত, হা/২০৪৪।]

৭১
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযা
সপ্তাহে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার অনেক ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হাদীসে এসেছে,

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন,

تُعْرَضُ الْأَعْمَالُ يَوْمَ الْإِثْنَيْنِ وَالْخَمِيْسِ فَأُحِبُّ أَنْ يُّعْرَضَ عَمَلِيْ وَأَنَا صَائِمٌ

সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলসমূহ আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। তাই আমি এটা পছন্দ করি যে, রোযা অবস্থায় আমার আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হোক। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৭১১; তিরমিযী, হা/৭৪৭; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৯৯; জামেউস সগীর, হা/৫২৭০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১০৪১; মিশকাত, হা/২০৫৬।]

৭২
রোযার উদ্দেশ্য
প্রত্যেকটি কাজের পরিকল্পনা গ্রহণের মূলে একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে। সেই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য কাজটি সম্পাদন করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর একমাস রোযা রাখা ফরয করেছেন তাদেরকে উপবাস রেখে অযথা কষ্ট দেয়ার জন্য নয়। রোযা ফরয করার পেছনে এক বিরাট উদ্দেশ্য রয়েছে। যে আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা রোযা ফরয করেছেন সে আয়াতেরই শেষাংশে সেই উদ্দেশ্যের কথা তিনি বলে দিয়েছেন। তাই আমাদের কর্তব্য হলো সে বিষয়টি জানা এবং তা অর্জন করার জন্য চেষ্টা করা। কারণ কোন কাজ যে উদ্দেশ্যে করা হয় সে উদ্দেশ্য যদি সফল না হয় তবে কাজটি বিফলে যায়। আল্লাহ তা‘আলা রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,

﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾

হে ঈমানদারগণ! পূর্ববর্তী উম্মতের মতো তোমাদের উপরও রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, সম্ভবত এর মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা বাকারা- ১৮৩)

এখান থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, তাকওয়া অর্জন করাই রোযার মূল উদ্দেশ্য। তাকওয়া এত মূল্যবান জিনিস যে, এর ফলে যে কল্যাণ ও উপকার পাওয়া যায় অন্য কিছুর দ্বারা তা পাওয়া যায় না। যেমন কুরআন থেকে হেদায়াত লাভে ধন্য হয় মুত্তাকীরা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿هُدًىْ لِّلْمُتَّقِيْنَ﴾

যাদের তাকওয়া আছে তারাই এর থেকে হেদায়াত বা পথের দিশা পায়।

(সূরা বাকারা- ২)

সবচেয়ে বড় ও চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির ঠিকানা জান্নাতে মুত্তাকীরাই যাবে। যত ভালো কাজ ও নেক আমল রয়েছে এর বাহ্যিক কাঠামো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তাকওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾

তোমাদের কুরবানীর পশুর রক্ত এবং গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তাকওয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছে। (সূরা হাজ্জ- ৩৭)

এখন প্রশ্ন হলো, তাকওয়া এমন কোন্ জিনিসের নাম, যার এত মান-মর্যাদা, এত উপকারিতা, যা অর্জন করার জন্য দীর্ঘ একটি মাস সাধনা করতে হয়?

তাকওয়ার শাব্দিক অর্থ রক্ষা করা, বেঁচে চলা, ভয় করা। পূর্ণাঙ্গ অর্থে তাকওয়া হচ্ছে মানুষের ভেতরে লুকায়িত এমন কিছু গুণের নাম, যা আল্লাহর খাওফ ও মুহাববত (ভয় ও ভালোবাসা) থেকে জন্ম নেয়, যা ভালো কাজের প্রেরণা দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। এজন্য যার মধ্যে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়ে যায় সে জাহান্নাম ও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে গোনাহের কাজ করতে পারে না। আর জান্নাত ও আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের আশায় নেক আমল ছাড়তে পারে না। রোযার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ গুণটি অর্জিত হয়।

৭৩
রোযা ও আত্মসংযম
 রোযার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অন্যতম সুফল হলো রোযা মানুষের মধ্যে আত্মসংযমতা তৈরি করে। মানুষের নফস বা প্রবৃত্তি তিন প্রকার :

১. নাফসে আম্মারা : এটি সর্বদা মানুষকে মন্দ কাজের দিকে প্রেরণা দেয়। সূরা ইউসুফের ৫৩ নং আয়াতে এ বিষয়ে উল্লেখ আছে।

২. নাফসে লাওয়ামা : এ নফসের অধিকারী মানুষ খারাপ কাজ করে ফেলে; কিন্তু পরে যখন তার বিবেক সজাগ হয় তখন সে নিজেকে তিরস্কার করে। সূরা কিয়ামার ২ নং আয়াতে এ বিষয়ে উল্লেখ আছে।

৩. নাফসে মুতমাইন্না : প্রশান্ত আত্মা, নফসের উপর চেষ্টা সাধনা করতে করতে যখন এমন স্তরে পৌঁছে যায় যে, তার মধ্যে মন্দ কাজের কোন স্পৃহা থাকে না, গোনাহের কাজে ভয় পায় আর ভালো কাজে খুশি হয় তখন তাকে নাফসে মুতমাইন্না বলা হয়। এ আত্মাকে বলা হবে

﴿يَاۤ أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ اِرْجِعِيْۤ إِلٰى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ وَادْخُلِيْ جَنَّتِيْ﴾

হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি সন্তুষ্ট এবং সন্তোষভাজন হয়ে তোমার প্রভুর দিকে চলো। অতঃপর আমার (নেক) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে। (সূরা ফাজর, ২৭-৩০)

 মানুষের নাফস বা আত্মাকে পর্যায়ক্রমে উন্নত করতে হলে এর উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করতে হয় এবং একে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চালাতে হয়। এটাই হচ্ছে সংযমতা বা আত্মাকে সংযত করা।

 মানুষের মন হলো রাজা আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ হলো প্রজা, মন যা পরিকল্পনা করে শরীরের অঙ্গগুলো তা বাস্তবায়ন করে। এই মনকে ভালো ও কল্যাণকর পরিকল্পনায় নিয়োজিত না করে যে একে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয়, তার অবস্থা হয়ে যায় ঐ অশ্বারোহীর মতো যে তার অশ্বকে কাবু করতে পারে না, অশ্ব যেদিকে যেতে চায় তাকে নিয়ে সেদিকে চলে যায়।

 এ পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাসে যাঁরা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন তাঁরা তাঁদের আভ্যন্তরীণ শক্তিকে নিজেদের অধীন ও অনুগত করে নিয়েছিলেন। তাঁরা কোন দিনই নাফসের লোভ-লালসা এবং আবেগের গোলাম হননি। তাঁদের ইচ্ছা-বাসনা ছিল মযবুত, সংকল্প ছিল অটল।

 মানুষের প্রকৃতিতে পরস্পর বিরোধী দু’টি স্বভাব সমানভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে পশুত্ব, আর অপরটি হচ্ছে মনুষ্যত্ব। যারা পশুত্ব তথা নাফসের দাবি-দাওয়াকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আত্মার উন্নতি সাধন করতে পারেন তারাই সফলতা অর্জন করতে পারেন।

 ইসলাম নাফসের দাবিগুলোকে গলা টিপে হত্যা করার নির্দেশ দেয়নি। অথচ একদল লোক মানবদেহ হতে পশুত্বের উপাদানগুলোর বিলুপ্তি ঘটানোর কাজে লিপ্ত। তারা খাওয়া-দাওয়া, নিদ্রা ও যৌন চাহিদা- মানবপ্রকৃতির এ দাবিগুলোকে একেবারে শেষ করতে চান। তারা সাধু, সন্ন্যাসী ও দরবেশরূপে পৃথিবীবাসীর নিকট পরিচিত।

 আরেকদল পশুত্বকে জীবনের চরম সার্থকতা হিসেবে ধরে নিয়েছেন। আহার, নিদ্রা, যৌনসম্ভোগ ও আরাম-আয়েশ এগুলোকেই তারা জীবনের মূল লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। কিন্তু আসল সত্য এ দুয়ের মাঝখানে রয়েছে। আর তা হলো- মনের চাহিদাগুলোকে সমূলে ধ্বংস করা যাবে না, আবার মন যা চায় তাই করা যাবে না; বরং মনের চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিখানো পন্থায় পূরণ করতে হবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা।

 মানুষের প্রকৃতিতে যৌন চাহিদা রয়েছে। ইসলাম এটাকে মূলোৎপাটন করে ফেলতে বলেনি। আবার লাগামহীনভাবে যে যার সাথে ইচ্ছা মিলিত হবে এটাকেও সমর্থন করেনি। ইসলাম কিছু বিধিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে মাত্র। ছেলে বা মেয়ে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন একে অপরকে পছন্দ করে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এ চাহিদা মিটাবে। এতে একদিকে যেমন মনের চাহিদা মিটবে, অন্যদিকে পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্থায়ী বন্ধনের ফলে ভালোবাসা গাঢ় হবে। সন্তান প্রজন্মের ধারা অব্যাহত থাকবে। মাতৃত্ব, পিতৃত্ব ও বংশের মর্যাদা রক্ষা হবে। এ বিধানকে উপেক্ষা করে যারা যিনা-ব্যভিচারকে লাইসেন্স দিয়ে অবাধে হালাল করে দিয়েছে তাদের চারিত্রিক, পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতির কী যে অবনতি ঘটেছে তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন দেশগুলোর দিকে নজর দিলেই সেই দৃশ্য ফুটে উঠবে।

 মানুষের প্রকৃতিতে পেটের ক্ষুধা রয়েছে, সময় হলে বাঁচার জন্য খেতেই হয়। এছাড়াও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা রয়েছে যা পূরণ করতে হলে টাকা-পয়সার দরকার হয়। তাই উপার্জন করতে হবে। এখন ইসলাম উপার্জনের সকল পথ বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে বলেনি; বরং আরো উৎসাহ দিয়েছে। উপার্জনকারীকে আল্লাহর বন্ধু বলা হয়েছে। ইসলাম উপার্জনের কিছু অবৈধ পন্থাকে নিষিদ্ধ করেছে মাত্র। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি এগুলো যদি হালাল হয়ে যায় তাহলে তো কারো জান-মালের কোন নিরাপত্তাই থাকবে না। সুদ, ঘুষ, ওজনে কম দেয়া, ব্যবসায় প্রতারণা, চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, হাইজ্যাক ইত্যাদির কারণে সমাজে আজ কত অশান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। মানুষ নাফস বা কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হওয়ার কারণেই এমনটি হচ্ছে।

 রোযা মানুষের মনের চাহিদাগুলো মেটানোর ক্ষেত্রে খুবই সুন্দরভাবে আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ দেয়। রোযা মানুষকে সম্বোধন করে বলে যে, দেখো! তুমি রোযা থাকার কারণে সারাটি দিন তোমার জন্য খাওয়া-দাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোযা থাকার কারণে হালাল খাবার পর্যন্ত তোমার উপর হারাম হয়ে গেছে, তাহলে তুমি হারাম পন্থায় কামাই করার চিন্তা কীভাবে করতে পার? রোযা থাকার কারণে দিনের বেলায় তোমার স্ত্রীর সাথেও যৌনমিলন হারাম হয়ে গেছে, তাহলে তুমি যিনা করার চিন্তা কীভাবে করতে পার?

 রোযা আরো বলে যে, ফজরের আযানের সাথে সাথেই তোমাকে খানা-পিনা বন্ধ করে দিতে হবে, আবার সূর্য ডুবার সাথে সাথে খাবার খেতেই হবে, এখন খাওয়ার মধ্যেই কল্যাণ।

 রোযা আরো বলে যে, ইফতারের পরেই তুমি আরামে ঘুমাতে পারবে না; তারাবীর সালাত পড়তে হবে, তবে সারা রাত নয়; মাত্র দেড়-দু’ঘন্টা। তারাবীর পরে তুমি আরামে ঘুমাও, তবে সকাল পর্যন্ত নয়; ভোর রাতে উঠে তোমাকে সাহারী খেতে হবে এরপর আবার ফজরের সালাত পড়তে হবে।

এভাবে রোযা মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এবং মানুষের জীবনকে উন্নত ও কল্যাণকর করতে সাহায্য করে।

৭৪
রোযা ও জিহাদ
 রমাযান যেমন কুরআন নাযিলের মাস তেমনি জিহাদ ও বিজয়ের মাস। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমাসেই গুরুত্বপূর্ণ জিহাদগুলো সংঘঠিত হয়েছে।

 রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময়েই রমাযান মাসে দু’টি যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটি বদরের যুদ্ধ এবং দ্বিতীয়টি মক্কা বিজয়। বদরের যুদ্ধ হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমাযান। বদরের যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ﴾

সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাতিলের উৎখাত করাই এ যুদ্ধের লক্ষ্য, যদিও অপরাধীরা এটা পছন্দ করে না। (সূরা আনফাল- ৮)

 রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাতে মক্কা বিজয় হয় অষ্টম হিজরীর ২০শে রমাযান।

 দ্বিতীয় খলিফা উমর (রাঃ) এর আমলে ১৫ হিজরীর ১৩ই রমাযান আমর বিন আস (রাঃ) জেরুজালেম জয় করেন।

 মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান বায়তুল মুকাদ্দাস এই রমাযান মাসেই জয় হয়।

 পারস্য সম্রাটের প্রধান সেনাপতি রুস্তম মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত ও নিহত হন ১৫ হিজরীর রমাযান মাসে এবং এতে মুসলমানদের বিজয় হয়।

 তারেক বিন যিয়াদ স্পেন জয় করেন ৯২ হিজরীর রমাযান মাসে।

 মুহাম্মাদ বিন কাসিমের হাতে অত্যাচারী সিন্ধু রাজা দাহির পরাজিত হয় ৯২ হিজরীর রমাযান মাসে। এই বিজয়ের ফলে ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয়।

 মুসলিম সেনাপতি যিয়াদ বিন আগলাবরের হাতে ইতালীর সিসিলি দ্বীপ বিজয় হয় ২১২ হিজরীর রমাযান মাসে।

৭৫
কাদের রোযা আল্লাহ কবুল করেন
রোযা আমরা অনেকেই রাখি; কিন্তু আমরা সবাই কি রোযার যাবতীয় নিয়ম রক্ষা করে চলি? রোযার উদ্দেশ্য কি আমাদের মাঝে প্রতিফলিত হয়? আমাদের রোযা কতটুকু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে? এ বিষয়গুলো নিয়েও কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। নতুবা সারাদিন শুধু উপবাস থেকে তেমন কোন ফলাফল আসবে না। নবী ﷺ বলেছেন,

كَمْ مِّنْ صَائِمٍ لَيْسَ لَهٗ مِنْ صِيَامِه إِلَّا الظَّمَأُ وَكَمْ مِّنْ قَائِمٍ لَيْسَ لَهٗ مِنْ قِيَامِه إِلَّا السَّهَرُ

এমন অনেক রোযাদার আছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছু জোটে না। আবার রাত্রিতে ইবাদাতকারী অনেক রয়েছে, রাত্রি জাগরণের কষ্ট ছাড়া তারা আর কিছুই লাভ করতে পারে না। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৬৮৩; সুনানে দারেমী, হা/২৭২০; মিশকাত, হা/২০১৪।]

এ হাদীস থেকে এটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, শুধু উপবাস থাকলেই রোযার পরিপূর্ণ হক আদায় হয়ে যায় না; বরং রোযাকে ফলপ্রসূ ও সার্থক করতে হলে রোযাকে ত্রুটিযুক্ত করে এমনসব কার্যাবলি থেকে দূরে থাকতে হবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সালাতের নিয়ম-কানুন রক্ষা করে সালাত পড়তে হবে। এটা না করে অন্য কোন উদ্দেশ্যে সালাত পড়লে বা রাতে নফল পড়ার কারণে ফজরের জামা‘আত ছেড়ে দিলে এই সালাত তেমন ফলপ্রসূ হবে না। আবার পরিবারের হক আদায় না করে শুধু রাত্রি জাগরণ করাও ঠিক নয়।

রোযার একটি সুদূরপ্রসারী ফলাফল হচ্ছে রোযা মানুষের জন্য ঢালের কাজ করে। নবী ﷺ বলেছেন : اَلصِّيَامُ جُنَّةٌ অর্থাৎ রোযা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। যুদ্ধের সময় বা যে কোন ক্ষেত্রে ঢাল শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করে। অনুরূপভাবে রোযা মানুষকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে, পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঢালের কাজ করে। এর মাধ্যমে বান্দা নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তাই রোযাদারকে রোযা নামক ঢালটিকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য এ কথাটির পরেই নবী ﷺ উম্মতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন,

وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ ، وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهٗ أَحَدٌ ، أَوْ قَاتَلَهٗ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ

তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রোযা থাকবে তখন সে যেন অশ্লীল কাজ ও ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে মারামারিতে লিপ্ত হয় তবে সে যেন পরিষ্কার বলে দেয় যে, আমি রোযাদার। [সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬১১১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৭৮; বায়হাকী, হা/৮০৯৪; জামেউস সগীর, হা/৭৭৭৭; মিশকাত, হা/১৯৫৯।]

রোযাদার তো আগে বেড়ে কোন খারাপ কাজ করবেই না; তবুও কেউ যদি তাকে গালি দিয়ে বসে অথবা তার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তবে সে এসবের জবাব না দিয়ে স্পষ্টভাবে বলে দেবে যে, ভাই! তোমার গালির জবাব দেয়ার ক্ষমতা আমার থাকলেও আমি তা করব না। আমি রোযা রেখেছি, আমার রোযা এসব পছন্দ করে না, তাই তোমার মোকাবেলা করা আমার পক্ষে শোভনীয় নয়। সুতরাং রোযাদারকে কেউ গালি দিলে তার বিনিময়ে গালিদাতাকে আমি রোযা রেখেছি বলা সুন্নাত। এই জবাবে রয়েছে দু’টি উপকার; একটিতে রয়েছে নিজের জন্য সতর্কতা এবং অপরটিতে রয়েছে তার বিরোধী পক্ষের জন্য সতর্কতা।

সুতরাং আমরা যখন না খেয়ে রোযা রাখব, তখন আমাদের শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন : মুখ, চোখ, কান, হাত, পা ও অন্তর এগুলোকেও রোযা রাখাতে হবে। অর্থাৎ এগুলো আল্লাহর নাফরমানী ও গোনাহের কাজে ব্যবহার না করে তাঁর আনুগত্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই আমাদের রোযা ফলপ্রসূ হবে।

৭৬
যবানের রোযা
মুমিনের যবানও রোযা রাখবে। অর্থাৎ প্রত্যেক নোংরা কথা, পরচর্চা বা গীবত, চুগলখোরী, গান-বাজনা, অশ্লীল ও মিথ্যা কথা থেকে সে বিরত থাকবে। যবানকে হেফাযত করার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মহানবী ﷺ বলেন :

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ

যে আল্লাহ এবং পরকালকে বিশ্বাস করে সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা নিরবতা পালন করে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৬৬০; সহীহ বুখারী, হা/৬১৩৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৮২; আবু দাউদ, হা/৫১৫৬; তিরমিযী, হা/২৫০০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৬২১; মিশকাত, হা/৪২৪৩।]

অন্য হাদীসে বলেন,

مَنْ يَّضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لِحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ

যে ব্যক্তি আমার জন্য তার যবান ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করার জামিন হবে, আমি (মুহাম্মাদ) তার জন্য জান্নাতের জামিন হব। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৭৪; বায়হাকী, হা/১৬৪৪৮; শারহুস সুন্নাহ, হা/৪১২২; জামেউস সগীর, হা/১১৫৬৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮৫৬; মিশকাত, হা/৪৮১২।]

অপর হাদীসে বলেন,

مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِه وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلّٰهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهٗ وَشَرَابَهٗ

যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ ছাড়তে পারল না, তার শুধু খানা-পিনা পরিত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৫৭; আবু দাউদ, হা/২৩৬৪; তিরমিযী, হা/৭০৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৮৩৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/১৯৯৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৪২৮; বায়হাকী, হা/৮০৯৫; জামেউস সগীর, হা/১১৪৮৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৭৪৬; মিশকাত, হা/১৯৯৯।]

এ হাদীসে খুব কঠিন ভাষায় এ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, রোযাদার ব্যক্তি কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। সে একদিকে রোযা রাখবে অপরদিকে মিথ্যা কথা ও অশ্লীল কার্যকলাপ করবে- এটা তার পক্ষে শোভা পায় না; বরং তার আল্লাহকে ভয় করা উচিত এবং এসব পাপকাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।

৭৭
কানের রোযা
মুমিনের কানও রোযা রাখে। কান রোযা রাখে নোংরা ও অশ্লীল কথা শোনা থেকে, অবৈধ প্রেম ও ব্যভিচারের দিকে আহবানকারী গান-বাজনা শোনা থেকে। রোযা রাখে আল্লাহর হারামকৃত যেসব কথা তাঁকে ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট করে সেসব কথা শোনা থেকে। মু’মিনের কান রোযা রাখে শয়তানের সুর শোনা থেকে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন বান্দার কান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولٰٓئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُوْلًا﴾

কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর এদের প্রত্যেকটির বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৬)

৭৮
চোখের রোযা
মুমিনের চোখও রোযা রাখে আল্লাহর হারামকৃত জিনিস দেখা হতে বিরত থাকার মাধ্যমে। হারাম কিছু চোখে পড়লে সে তার চক্ষুকে অবনত করে নেয়, অশ্লীল কিছু দেখা হতে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখে। যেমন : নোংরা ফিল্ম, শ্লীলতাহীন টিভি সিরিজ এবং পরনারী ইত্যাদি দেখা হতে বিরত থাকে। মহান আল্লাহ মুমিন পুরুষদেরকে সম্বোধন করে বলেন,

﴿قُلْ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذٰلِكَ أَزْكٰى لَهُمْ﴾

মুমিন পুরুষদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী করে এবং নিজ নিজ যৌনাঙ্গের হেফাযত করে; এটিই তাদের জন্য উত্তম। (সূরা নূর- ৩০)

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুমিন নারীদেরকেও সম্বোধন করে বলেন,

﴿وَقُلْ لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ﴾

আর মুমিন নারীদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী করে এবং নিজ নিজ যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। (সূরা নূর- ৩১)

৭৯
হাত ও পায়ের রোযা
মুমিনের হাত রোযা রাখে হারাম কিছু ধরা ও স্পর্শ করা থেকে। সুতরাং যে মহিলাকে স্পর্শ করা তার জন্য হালাল নয়, তাকে যেন স্পর্শ না করে। তার হাত যেন রোযা রাখে মানুষের উপর অত্যাচার করা থেকে, কাউকে অন্যায়ভাবে মারা থেকে। সুদ, ঘুষ, চুরি ও অন্যান্য হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জন করা থেকেও মুমিনের হাত রোযা রাখে।

মুমিনের পা-ও রোযা রাখে। আর তার রোযা হলো- যে পথে গমন করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সে পথে যাবে না। সকল প্রকার পাপাচারের পথে চলা হতে সে বিরত থাকবে। কারণ হাত-পা দিয়ে পাপ করলে কিয়ামতের ময়দানে এগুলো বান্দার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَلْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلٰۤى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَاۤ أَيْدِيْهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ﴾

আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেব, তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তারা যা করত সে সম্পর্কে তাদের পা সাক্ষ্য দেবে। (সূরা ইয়াসীন- ৬৫)

৮০
পেটের রোযা
মুমিনের পেটও রোযা রাখে। পেট রোযা রাখে হারাম খাদ্য খাওয়া থেকে। সুতরাং সে হারাম খাবার সাহারীতে খায় না এবং ইফতারীতেও খায় না। সুদ, ঘুষ এবং অন্যান্য হারাম উপায়ে উপার্জিত সম্পদ কখনো সে তার পেটে প্রবেশ করায় না। কেননা যে ব্যক্তি নিজ উদরে হারাম মাল প্রবেশ করায়; অর্থাৎ যার খাদ্য ও পানীয় হারাম হয় তার দু‘আ কবুল হয় না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا وَّإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِيْنَ فَقَالَ . ﴿يَاۤ أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا إِنِّىْ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ . وَقَالَ يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ﴾ ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهٗ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهٗ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهٗ حَرَامٌ وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَأَنّٰى يُسْتَجَابُ لِذٰلِكَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, হে লোক সকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুমিনদেরকেও সেই নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র জিনিস খাও এবং নেক আমল করো। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবগত আছি। (সূরা মু’মিনূন- ৫১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে পবিত্র জিনিস খাও। (সূরা বাকারা- ১৭২)

অতঃপর নবী ﷺ এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফর করে, এলোমেলো কেশবিশিষ্ট, ধূলোয় মলিন শরীর, সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারামের দ্বারা সে প্রতিপালিত হয়েছে, সুতরাং কীভাবে তার দু‘আ কবুল হবে? [সহীহ মুসলিম, হা/২৩৯৩; তিরমিযী, হা/২৯৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৩০; বায়হাকী, হা/৬১৮৭; সুনানে দারেমী, হা/২৭১৭; শারহুস সুন্নাহ, হা/২০২৮; জামেউস সগীর, হা/৪৫১০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭১৭; মিশকাত, হা/২৭৬০।]

উপরের হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, ইবাদাত কবুল হওয়ার জন্য হালাল রিযিক খাওয়া পূর্বশর্ত। অন্যথায় ইবাদাত কবুল না হওয়ার কারণে জাহান্নামে যেতে হবে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ عَنِ النَّبِيِّ  : مَنْ نَبَتَ لَحْمُه مِنَ السُّحْتِ فَالنَّارُ أَوْلٰى بِه

আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যে শরীর হারাম দ্বারা প্রতিপালিত তার জন্য জাহান্নামের আগুনই উপযুক্ত। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৭১৬৪; জামেউস সগীর, হা/৮৬৪৮; মিশকাত, হা/২৮২৫।]

৮১
অন্তরের রোযা
 নবী ﷺ বলেছেন, জেনে রাখো! দেহের মধ্যে এমন এক মাংসপিন্ড আছে, যা ভালো হলে সারা দেহ ভালো হবে এবং খারাপ হলে সারা দেহ খারাপ হবে। শোনো! তা হলো অন্তর। [সহীহ বুখারী, হা/৫২; সহীহ মুসলিম, হা/৪১৭৮; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৮৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩৯৮; মুসনাদুল বাযযার, হা/৩২৭৬; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৪৪৩৬; বায়হাকী, হা/১০১৮০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৩১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৭০৮; জামেউস সগীর, হা/৫৫০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২২৪৩৫; মুসনাদে দারেমী, হা/২৫৭৩; মিশকাত, হা/২৭৬২।]

দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা হলো অন্তর। এই অন্তর যখনই রোযা রাখবে, তখনই সকল অঙ্গে তা কার্যকর হবে।

 মুমিনের অন্তর রমাযান মাসে এবং অন্য মাসেও রোযা রাখে। আর তার রোযা হবে তাকে শিরক, বাতিল বিশ্বাস, নোংরা চিন্তা-ভাবনা, হীন পরিকল্পনা এবং খারাপ কল্পনা- এসব থেকে মুক্ত রাখা।

 মুমিনের অন্তর রোযা রাখে গর্ব করা থেকে। কারণ যে ব্যক্তি গর্ব করে এবং চাল-চলনে অহংকার প্রদর্শন করে, সে ব্যক্তি যখন আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তিনি তার প্রতি ক্রোধান্বিত থাকবেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৯৯৫; আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৪৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৯১৮।]

 মুমিনের অন্তর রোযা রাখে অপরের প্রতি হিংসা করা থেকে। কারণ কোন বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা এক সাথে থাকতে পারে না। [নাসাঈ, হা/৩১০৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬০৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৪৪; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮৮৬।]

 মুমিনের অন্তর রোযা রাখে কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা থেকে। কারণ বিদ্বেষ হলো মুন্ডনকারী, তা দ্বীন মুন্ডন (ধ্বংস) করে ফেলে। [তিরমিযী, হা/২৫১০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৩০; মুসনাদুত তায়ালুসী, হা/১৯০; মিশকাত, হা/৫০৩৯।]

 মুমিনের অন্তর রোযা রাখে কৃপণতা থেকে। কারণ কোন বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও কৃপণতা একত্রে জমা হতে পারে না। [নাসাঈ, হা/৩১১০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩২৫১; মুসনাদে সাদ ইবনে মানসূর, হা/২৪০১; আদাবুল মুফরাদ, হা/২৮১; বায়হাকী, হা/১৮২৮৯; শারহুস সুন্নাহ, হা/২৬১৯; মিশকাত, হা/৩৮২৮।]

 এভাবে যদি আমরা রোযা রাখি এবং রোযার দাবি ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তা বাস্তবে প্রয়োগ করি তাহলেই আমাদের রোযা সার্থক ও গ্রহণযোগ্য হবে। তা না হলে দীর্ঘ একটি মাস কষ্ট করে রোযা রেখে যদি এর কোন প্রভাব আমাদের উপর না পড়ে, একটুখানি তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় আমাদের মধ্যে যদি না জাগে, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক এবং পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?

৮২
একটু ভাবুন!
 রমাযান কুরআন নাযিলের মাস; অথচ আমি এই কুরআনকে ভালো করে পড়লাম না, বুঝলাম না, আমলও করলাম না, তাহলে এই কুরআন কি আমার জন্য শাফায়াত করবে?

 আমি রোযা রাখলাম; কিন্তু মিথ্যা বলতে ও পরের দোষচর্চা করতে আমার ভয় হলো না, অশ্লীল গান-বাজনা শোনা থেকে, টেলিভিশনের কুদৃশ্য দেখা থেকে বিরত থাকলাম না, তাহলে এই রোযা কীভাবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং কীভাবে আমার নাজাতের অসীলা হবে?

 রোযার কারণে আমি দিনের বেলায় বিড়ি-সিগারেট থেকে দূরে থাকলাম; কিন্তু ইফতারের পরেই ধূমপান শুরু করে দিলাম- যা শরীয়তের দিক থেকে নিষিদ্ধ এবং স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। তাহলে এই রোযার সার্থকতা কী থাকল? আমার নাফসকে তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না।

 রোযা রাখলাম ঠিকই; কিন্তু হারাম উপার্জন ছাড়লাম না, ব্যবসায় মিথ্যা ও ধোঁকাবাজি ত্যাগ করলাম না, অন্যায় থেকে বিরত হতে পারলাম না, জাহান্নামের আগুনকে একটু ভয় করলাম না, তাহলে রোযা রেখে আমি কতটুকু তাকওয়া অর্জন করতে পারলাম?

 আল্লাহ যিনা-ব্যভিচার হারাম করেছেন এবং যিনাকারী ছেলে-মেয়েকে একশত বেত্রাঘাত করতে বলেছেন; অথচ বর্তমানে অহরহ যিনা হচ্ছে। আল্লাহ অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করেছেন এবং এজন্য ক্বিসাসের বিধান দিয়েছেন; অথচ বর্তমানে পশু-পাখির মতো মানুষ মারা হচ্ছে। আল্লাহ চোর নারী-পুরুষের হাত কেটে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন; অথচ বরাবর চুরি হচ্ছে, কারো হাত কাটা হচ্ছে না। আমরা জানি যে, এ বিধানগুলো পালন করতে হলে সরকারী ক্ষমতার প্রয়োজন। কিন্তু আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য কোন চেষ্টা-ফিকির করলাম না। রোযা রেখে একটি ফরয পালন করলাম; কিন্তু এই মহান ফরযটি পালনের চিন্তাও করলাম না। এখন আমরা আল্লাহর কাছে গিয়ে কী জবাব দেব? অথচ এই দ্বীন কায়েমের জন্য নবী ﷺ সাহাবীদের নিয়ে এই রোযার মাসেই শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য বদর প্রান্তরে যুদ্ধ করেছেন এবং কয়েকজন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেছেন।

 আমি একজন মহিলা, আল্লাহ তা‘আলা আমার সতীত্বকে হেফাযত করতে বলেছেন; কিন্তু আমি পর্দা করলাম না, আমার শরীরের অঙ্গগুলো পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করলাম অথবা রোযার মাসে পর্দা করলাম পরে আর করলাম না, আল্লাহকে ভয় করলাম না তাহলে যে গুণটি অর্জনের জন্য একমাস রোযা রাখলাম তা তো অর্জিত হলো না।

 বৎসরে বার মাসের মধ্যে পূর্ণ একমাস আল্লাহ আমাদেরকে রোযা রাখার হুকুম দিয়েছেন; যেন এই একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার গুণ এতটুকু অর্জিত হয়, যা পরবর্তী এগার মাসের জন্য যথেষ্ট হতে পারে; অথচ দেখা যায়, রোযার মাসটি শেষ হওয়ার পর শাওয়ালের প্রথম দিনেই ঈদকে কেন্দ্র করে শহরে-বন্দরে যেসব অশ্লীলতা, নগ্নতা, যুবক-যুবতীদের অবাধ আড্ডা শুরু হয় তা দেখে মনে হয় যে, একমাসের তাকওয়া পরহেযগারীকে তারা রমাযান মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বমি করে ফেলে দিয়েছে।

 আমাদের মধ্যে অনেক ভাই-বোন রয়েছেন, যারা রোযার মাসে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়েন, মোটামুটি আল্লাহর হুকুম মেনে চলার চেষ্টা করেন; কিন্তু রোযার মাস শেষ হলে তারা আবার আগের মতো হয়ে যান। এতে মনে হয় যে, একমাসের রোযা তাদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর উদাহরণ হচ্ছে এরূপ যেমন : কোন লোক ভাত খেয়ে বমি করে ফেলে দিল। এখন যে উদ্দেশ্যে সে খেয়েছিল তা আর অর্জিত হলো না, যেহেতু হজম হওয়ার আগেই সে তা বের করে দিয়েছে। অনুরূপভাবে যারা রোযার মাসে সালাত পড়েন, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করেন; কিন্তু রোযার পরে তা ছেড়ে দেন তারাও যেন একমাসে যেটুকু আল্লাহর ভয় অর্জিত হয়েছিল রমাযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে তা বমি করে বের করে দেন। এখন তারা রোযা রেখেছেন ঠিকই; কিন্তু রোযার উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি। যদি হতো তাহলে তারা সারা বছর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করত।

 আসল ব্যাপার হচ্ছে, সালাত-রোযাকে আমরা ইবাদাতের অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছি। এর বাইরে এগুলোর কোন প্রভাব পড়ছে না। বিয়ে-শাদী, সমাজগঠন, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন ও রাষ্ট্র পরিচালনা এসব ক্ষেত্রে আমরা ইসলামের বিধান সঠিকভাবে পালন করি না। এটাই আমাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে।

 রমাযান বিদায় নিল, তাই বলে কি মুমিনের আমল ভরা দিনগুলো শেষ হয়ে গেল? না, মুমিনের আমল তো কোন দিন শেষ হওয়ার নয়। মুমিনের কর্তব্য হলো, নিয়মিত আমল করে যাওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ﴾

মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার প্রতিপালকের ইবাদাত করতে থাকো। (সূরা হিজর- ৯৯)

মহানবী ﷺ বলেছেন, আল্লাহর নিকট সেই আমল সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়, যা নিয়মিত পালন করা হয়; যদিও তা পরিমাণে কম হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৪; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৩৫৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৫৩; জামেউস সগীর, হা/১৩৮৪৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩১৭৩; শারহুস সুন্নাহ, হা/৯৩৭; মিশকাত, হা/১২৪২।]

 রোযার মাস বিদায় নিয়েছে; কিন্তু রোযা বিদায় নেয়নি। যেহেতু রমাযানের রোযা ছাড়াও অন্যান্য সুন্নাত ও নফল রোযা রয়েছে।

 তারাবীর সালাতের মাস চলে গেল; কিন্তু নফল সালাত ও কিয়াম চলে যায়নি। কেননা তা কেবল রোযার মাসেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মুমিন ব্যক্তি প্রত্যেক রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের অভ্যাস গড়ে তুলবে।

 কোন নেক আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ এই যে, আমলকারী পুনরায় অন্যান্য সৎকর্ম করে থাকে। সুতরাং রমাযানের পর অন্যান্য নেক আমল করতে থাকলে রোযা ও তারাবীহ মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে বলে বুঝা যাবে ।

 তাই আসুন! আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদা ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলি, সাহাবাদের ঈমানের মতো আমাদের ঈমানকেও মজবুত করি- এটাই হোক রমাযান মাসে আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

 অতএব হে মুসলিম ভাই-বোনেরা! আপনারা আরামের নিদ্রা থেকে জেগে উঠুন। সফরের জন্য কিছু পথের সম্বল সংগ্রহ করে নিন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন, হয়তোবা তাঁর সাড়া পাবেন। তাঁর রহমত পেয়ে সৌভাগ্যবান হবেন। আল্লাহর ভয়ে, জাহান্নামের ভয়ে চোখের পানি ফেলে রমাযান মাসকে বিদায় জানান। কারণ আমরা জানি না আগামী বছর আবার সেই মাসের সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না, আবার ফরয রোযা পালন করার ও তারাবীর সালাত আদায় করার সুযোগ হবে কি না। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন!

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ

৮৩
২য় অধ্যায় কিতাবুয যাকাত
যাকাত হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদাত। ইসলামে সালাতের পরেই যাকাতের স্থান। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্রতা লাভ করে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাতে বরকত দান করেন। অন্যথায় এ সম্পদ ব্যক্তির পারলৌকিক বিপদ বা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

৮৪
যাকাতের সংজ্ঞা
اَلزَّكٰوةُ (আয-যাকাত) এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- বৃদ্ধি পাওয়া, বর্ধিত হওয়া, পবিত্র হওয়া, কোন বস্তুকে পরিশুদ্ধ করা ইত্যাদি।

আর পারিভাষিক অর্থে যাকাত হলো,

حِصَّةٌ مُقَدَّرَةٌ مِنْ مَالٍ مَخْصُوْصٍ فِىْ وَقْتٍ مَخْصُوْصٍ يُصْرَفُ فِىْ جِهَاتٍ مَخْصُوْصَةٍ

নিসাব পরিমাণ মাল হতে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট খাতে নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করার নাম যাকাত। [সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২য় খন্ড, ৫ পৃষ্ঠা।]

৮৫
যাকাতের গুরুত্ব
ভিত্তিগত দিক থেকে ইসলামে যাকাতের অবস্থান তৃতীয়। এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা অনেক প্রকার কল্যাণ নিহিত রেখেছেন। ফলে ইসলামে এর গুরুত্ব অনেক। নিম্নে এ ব্যাপারে বিসত্মারিত আলোচনা করা হলো :

যাকাত হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় মূলভিত্তি :

عَنْ عَبْدِ اللهِ ابْنِ عُمَرَ ، قَالَ : : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلٰى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ ، وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করা অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রাসূল- এ কথার সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, হজ্জ করা এবং রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা। [সহীহ বুখারী, হা/৮; সহীহ মুসলিম, হা/১২১; তিরমিযী, হা/২৬০৯; নাসাঈ, হা/৫০০১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬০১৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/৩০৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৫৮; মিশকাত, হা/৪।]

সকল নবীর যুগেই যাকাতের বিধান ছিল :

﴿وَجَعَلْنَاهُمْ اَئِمَّةً يَّهْدُوْنَ بِاَمْرِنَا وَاَوْحَيْنَاۤ اِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَاِقَامَ الصَّلَاةِ وَاِيْتَآءَ الزَّكَاةِۚ وَكَانُوْا لَنَا عَابِدِيْنَ﴾

তাদেরকে (নবীদেরকে) আমি নেতা বানিয়েছিলাম, যেন তাঁরা আমার নির্দেশানুসারে মানুষকে পথপ্রদর্শন করতে পারে। আর তাঁদের নিকট ওহী প্রেরণ করেছিলাম, যেন তাঁরা সৎকর্ম করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে; আর তাঁরা ছিল আমারই ইবাদাতকারী। (সূরা আম্বিয়া- ৭৩)

সাহাবীরা যাকাত আদায় করতেন :

﴿رِجَالٌ لَّا تُلْهِيْهِمْ تِجَارَةٌ وَّلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَاِقَامِ الصَّلَاةِ وَاِيْتَآءِ الزَّكَاةِۚ يَخَافُوْنَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيْهِ الْقُلُوْبُ وَالْاَبْصَارُ﴾

তাঁরা এমন লোক, যাঁদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান করা হতে বিরত রাখে না। তাঁরা সেদিনকে ভয় করে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। (সূরা নূর- ৩৭)

যাকাত আদায় করা মুমিনের একটি মৌলিক গুণ :

﴿وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيَآءُ بَعْضٍؕ يَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗؕ اُولٰٓئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُؕ اِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ﴾

মুমিন নর-নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। অচিরেই আল্লাহ তাঁদের উপর অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা তওবা- ৭১)

যাকাত হচ্ছে পরকালীন নাজাতের ক্ষেত্রে দলীলস্বরূপ :

عَنْ أَبِىْ مَالِكٍ الأَشْعَرِىَّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : إِسْبَاغُ الْوُضُوْءِ شَطْرُ الْإِيْمَانِ وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ تَمْلَأُ الْمِيْزَانَ وَالتَّسْبِيْحُ وَالتَّكْبِيْرُ يَمْلَأُ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرْضَ وَالصَّلَاةُ نُوْرٌ وَالزَّكَاةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْاٰنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ

আবু মালিক আশ‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, পরিপূর্ণভাবে অযু করা ঈমানের অংশ বিশেষ। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাল্লাকে ভারী করে, ‘সুবহানাল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ আসমান ও জমিনকে পূর্ণ করে। আর সালাত হলো নূর, যাকাত হলো দলীল, ধৈর্য হলো আলো এবং কুরআন হচ্ছে তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলীলস্বরূপ। [নাসাঈ, হা/২৪৩৭; ইবনে মাজাহ, হা/২৮০।]

সরকারিভাবে যাকাত উত্তোলনের জন্য নবী ﷺ এর প্রতি নির্দেশ :

﴿خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْؕ اِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْؕ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾

তাদের সম্পদ হতে যাকাত গ্রহণ করো। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশুদ্ধ করবে। আর তুমি তাদের জন্য দু‘আ করো। নিশ্চয় তোমার দু‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক; আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সূরা তওবা- ১০৩)

রাসূলুল্লাহ ﷺ যাকাত আদায়ের জন্য বাই‘আত গ্রহণ করতেন :

عَنْ جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ : بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ عَلٰى إِقَامِ الصَّلَاةِ ، وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ

জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করার জন্য বাই‘আত গ্রহণ করেছি। [সহীহ বুখারী, হা/৫৭; সহীহ মুসলিম, হা/২০৮; তিরমিযী, হা/১৯২৫; নাসাঈ, হা/৪১৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯১৮৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩১৫; মিশকাত, হা/৪৯৬৭।]

যাকাত হচ্ছে আখিরাতের পুঁজি :

দুনিয়া হচ্ছে মানবজাতির জন্য আখিরাতের বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পুঁজি সংগ্রহ করার স্থান। কেননা সেদিন কোন টাকা-পয়সা, ধন-দৌঁলত, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি কোন কাজে আসবে না; বরং সেদিন কেবল ঐ জিনিসগুলোই কাজে আসবে, যা সে দুনিয়ায় থাকাকালীন সময় আখিরাতের পুঁজি হিসেবে প্রেরণ করেছে। আর যাকাত হচ্ছে সে ধরনেরই একটি পুঁজি। মানুষ যদি যথাযথভাবে যাকাত আদায় করে সে সকল পুঁজিকে সমৃদ্ধশালী করে তুলে, তাহলে পরকালে তার জন্য নাজাত লাভ করা খুবই সহজ হয়ে যাবে। তাছাড়া মানুষ যদি দুনিয়াতে সামান্য পরিমাণ সম্পদ দান করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার পুঁজিকে আরো বহু গুণ সমৃদ্ধশালী করে উপস্থাপন করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَاۤ اٰتَيْتُمْ مِّنْ رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِۤيْ اَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُوْا عِنْدَ اللهِ وَمَاۤ اٰتَيْتُمْ مِّنْ زَكَاةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ﴾

মানুষের ধনসম্পদে তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে- এ আশায় তোমরা যা কিছু সুদে (ঋণ) দিয়ে থাক, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যা কিছু যাকাত হিসেবে দিয়ে থাক, তবে এরূপ লোকের (প্রদত্ত বস্তু) আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পেতে থাকবে। (সূরা রূম- ৩৯)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ ، وَلَا يَقْبَلُ اللهُ إِلَّا الطَّيِّبَ - وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِيْنِه ثُمَّ يُرَبِّيْهَا لِصَاحِبِه كَمَا يُرَبِّيْ أَحَدُكُمْ فَلْوَه حَتّٰى تَكُوْنَ مِثْلَ الْجَبَلِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের পবিত্র (হালাল) উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করল আর আল্লাহর কাছে পবিত্র জিনিসই গৃহীত হয়, আল্লাহ তা‘আলা ঐ দানকে নিজ ডান হাতে কবুল করেন। অতঃপর তা দানকারীর জন্য লালন-পালন করতে থাকেন যেমনিভাবে তোমাদের মধ্য হতে কেউ বকরির বাচ্চাকে লালন-পালন করে থাকে, অতঃপর তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। [সহীহ বুখারী, হা/ ১৪১০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৬৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৩১৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৯৮০; মিশকাত, হা/১৮৮৮।]

শয়তান যাকাত আদায় না করার জন্য কুমন্ত্রণা দেয় :

দুনিয়াতে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হল তার সম্পদ। তারা এগুলো অনেক কষ্ট করে উপার্জন করে থাকে। তাই এগুলোকে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে এবং এগুলো হাত ছাড়া করতে সবসময় নারাজ থাকে। আর শয়তান মানুষের মানসিকতার এ সুযোগটাকেই যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। ফলে অনেক মানুষ এটা জরিমানা বা অর্থদন্ড মনে করে বসে এবং সম্পদ কমে যাওয়া বা গরীব হয়ে যাওয়ার ভয় করে। যাতে করে মানুষ বিভ্রামত্ম হয়ে যাকাত আদায় না করে কুফরীতে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা শয়তানের এসব কুমন্ত্রণা ফাঁস করে দিয়ে বলেন,

﴿اَلشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِۚ وَاللهُ يَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلًاؕ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ﴾

শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ দেয়; অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ অসীম করুণাময় ও মহাজ্ঞানী। (সূরা বাকারা- ২৬৮)

হাদীসে এসেছে,

عَنْ بُرَيْدَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : مَا يَخْرُجُ رَجُلٌ بِشَيْءٍ مِنَ الصَّدَقَةِ حَتّٰى يُفَكَّ عَنْهَا لَحْيَيْ سَبْعِيْنَ شَيْطَانًا

বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখনই কোন ব্যক্তি তার যাকাত বের করে, তখনই সে তার দ্বারা ৭০টি শয়তানের চক্রামত্মকে ব্যর্থ করে দেয়। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৫২১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩০১২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪৫৭; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৮০৭১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২৬৮।]

যাকাত আদায়কারীদের জন্য ফেরেশতাগণ দু‘আ করেন :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ : ‏مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيْهِ إِلَّا مَلَكَانِ يَنْزِلَانِ فَيَقُوْلُ اَحَدُهُمَا : اَللّٰهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُوْلُ الْآخَرُ : اَللّٰهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا‏

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, প্রতিদিন সকালে যখন আল্লাহর বান্দারা ঘুম থেকে উঠে, তখন দু’জন ফেরেশতা আকাশ থেকে অবতরণ করেন। তাদের একজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! দানশীল ব্যক্তিকে প্রতিদান দাও। অপরজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে নিঃশেষ করো। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৪২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩৮৩; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৯১৩৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯২০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯১৪; মিশকাত, হা/১৮৬০।]

৮৬
যাকাতের হুকুম
যাকাত আদায় করা ফরয। যার উপর যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলি পাওয়া যাবে, তাকে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে। আর যে ব্যক্তি এটাকে অস্বীকার করবে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে এবং মুরতাদ হিসেবে বিবেচিত হবে।

যাকাত অমান্যকারী কাফির :

যাকাত হচ্ছে একটি ফরয ইবাদাত। সুতরাং যে ব্যক্তি এর ফরয হওয়াকে অস্বীকার করবে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির ও মুরতাদ হয়ে যাবে।

আর যারা এটাকে মৌখিকভাবে স্বীকার করে; কিমত্মু আমলগতভাবে যাকাত দিতে অস্বীকার করে তাদের ব্যাপারে বড় বড় ফিকহবিদগণের বক্তব্য হচ্ছে, কেউ যদি যাকাত ফরয হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করা সত্ত্বেও যাকাত দিতে অস্বীকার করে, তাহলে দেখতে হবে যে, সে কেন তা অস্বীকার করছে- সে কি নওমুসলিম হিসেবে এ ব্যাপারে এখনও অবহিত হতে পারেনি, নাকি ইসলামী সমাজসভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কারণে এরূপ মনোভাব পোষণ করছে; যদি এরূপ হয়, তাহলে তাকে কাফির বলা যাবে না। তখন প্রথমে তাকে ভালোভাবে বুঝাতে হবে; তারপর তার কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নিতে হবে। এরপরও সে যদি যাকাত দিতে অস্বীকার করে, তাহলে অবশ্যই তাকে কাফির বলতে হবে।

আর যদি বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট হওয়ার পরও সে তা অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে এবং তার উপর মুরতাদ হওয়ার শাসিত্ম কার্যকর হবে। প্রথমে তাকে তওবা করতে বলা হবে এবং তওবা না করলে তাকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে। কেননা যাকাত ফরয হওয়ার বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত এবং তা দ্বীন-ইসলামের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কাজেই তা অস্বীকার করা হলে আল্লাহকেই অস্বীকার করা হয় এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ কেও অমান্য করা হয়। অতএব তাদের কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। নিচে এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য তুলে ধরা হলো:

যাকাত আদায়ের জন্য আল্লাহর নির্দেশ :

আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের অনেক আয়াতেই সালাত কায়েমের সাথে সাথে যাকাত আদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন- তিনি বলেন,

﴿وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاٰتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ﴾

আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো ও যাকাত প্রদান করো এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ করো। (সূরা বাকারা- ৪৩)

﴿وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاٰتُوا الزَّكَاةَ وَاَقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا﴾

সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও।

(সূরা মুয্যাম্মিল- ২০)

মহিলাদের প্রতিও যাকাত আদায়ের নির্দেশ এসেছে :

﴿وَاَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَاٰتِيْنَ الزَّكَاةَ وَاَطِعْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ﴾

তোমরা (মহিলারা) সালাত আদায় করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো। (সূরা আহযাব- ৩৩)

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এককভাবে মহিলাদেরকেও যাকাত প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

যাকাত আদায় করার জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নির্দেশ :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ ادْعُهُمْ إِلٰى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذٰلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذٰلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلٰى فُقَرَائِهِمْ

ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামানে পাঠানোর সময় বললেন, প্রথমে তুমি তাদেরকে এই কালেমার সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যদি তারা এটা মেনে নেয় তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরয করেছেন। যদি তারা এটারও আনুগত্য করে তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের মালের মধ্যে যাকাত ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের থেকে নেয়া হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। [সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৩০; আবু দাউদ, হা/১৫৮৬; তিরমিযী, হা/৬২৫; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮৩; নাসাঈ, হা/২৫২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৭১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৭৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৯৯২৪; দার কুতনী, হা/২০৫৮; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/২১১৫; বায়হাকী, হা/৭০৬৮; সুনানে দারেমী, হা/১৬১৪; মিশকাত, হা/১৭৭২।]

উপরোক্ত আয়াত এবং হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যাকাত আদায় করা ফরয। সুতরাং যার উপর যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলি পাওয়া যাবে, তাকে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে।

৮৭
যাকাত আদায়ের উপকারিতা
যাকাত একটি লাভজনক ব্যবসা :

﴿اِنَّ الَّذِيْنَ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَاَقَامُوا الصَّلَاةَ وَاَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَّعَلَانِيَةً يَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ﴾

যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে যা কিছু রিযিক হিসেবে দান করেছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে; তারা এমন ব্যবসার আশা করে, যাতে কখনো লোকসান হবে না।

(সূরা ফাতির- ২৯)

যাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায় :

বাহ্যিক দৃষ্টিতে যাকাত আদায় করলে সম্পদ কমে যায় বলে মনে হলেও, মূলত এর মাধ্যমে সম্পদ আরো বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُه وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِيْنَ﴾

তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে, তিনি তার বিনিময় দান করবেন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। (সূরা সাবা- ৩৯)

﴿وَمَاۤ اٰتَيْتُمْ مِّنْ رِّبًا لِّيَرْبُوَاۡ فِيْۤ اَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُوْا عِنْدَ اللهِ وَمَاۤ اٰتَيْتُمْ مِّنْ زَكَاةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ﴾

মানুষের ধনসম্পদে তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে- এ আশায় তোমরা যা কিছু সুদে (ঋণ) দিয়ে থাক, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যা কিছু যাকাত হিসেবে দিয়ে থাক; এরূপ লোকের (প্রদত্ত বস্তু) আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পেতে থাকবে। (সূরা রূম- ৩৯)

﴿يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ﴾

আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সূরা বাকারা- ২৭৬)

তাছাড়া হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ - - قَالَ : مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلَّا عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلّٰهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ হতে বর্ণনা করে বলেন, দান সম্পদ কমায় না এবং ক্ষমার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দার সম্মান হ্রাস করেন না; বরং বৃদ্ধি করেন। আর যদি কেউ আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে আরো উন্নত করেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৬৭৫৭; তিরমিযী, হা/২০২৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৯৯৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩২৪৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৪৩৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২৮৭; সুনানে দারেমী, হা/১৬৭৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮৯১; মিশকাত, হা/১৮৮৯।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ : ‏مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيْهِ إِلَّا مَلَكَانِ يَنْزِلَانِ فَيَقُوْلُ أَحَدُهُمَا : اَللّٰهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُوْلُ الْاٰخَرُ : اَللّٰهُمَّ اَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا‏

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, প্রতিদিন সকালে যখন আল্লাহর বান্দারা ঘুম থেকে উঠে, তখন দু’জন ফেরেশতা আকাশ থেকে অবতরণ করেন। তাদের একজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! দানশীল ব্যক্তিকে প্রতিদান দাও। অপরজন বলতে থাকেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে নিঃশেষ করো। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৪২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩৮৩; সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ, হা/৯১৩৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৮০৬৮; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৮৬৭৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯১৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯২০; মিশকাত, হা/১৮৬০।]

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ ، وَلَا يَقْبَلُ اللهُ إِلَّا الطَّيِّبَ - وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِيْنِه ثُمَّ يُرَبِّيْهَا لِصَاحِبِه كَمَا يُرَبِّيْ أَحَدُكُمْ فَلْوَه حَتّٰى تَكُوْنَ مِثْلَ الْجَبَلِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের পবিত্র (হালাল) উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করল আর আল্লাহর কাছে পবিত্র জিনিসই গৃহীত হয়, আল্লাহ তা‘আলা ঐ দানকে নিজ ডান হাতে কবুল করেন। অতঃপর তা দানকারীর জন্য লালন-পালন করতে থাকেন যেমনিভাবে তোমাদের মধ্য হতে কেউ তার বকরির বাচ্চাকে লালন-পালন করে থাকে, অতঃপর তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। [সহীহ বুখারী, হা/ ১৪১০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৬৩; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৩১৯; মুসনাদুল বাযযার, হা/৮৯৮০; মিশকাত, হা/১৮৮৮।]

যাকাত দিলে আত্মা পবিত্র হয় :

﴿خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْؕ اِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْؕ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾

তাদের সম্পদ হতে ‘সাদাকা’ গ্রহণ করবে। এটার দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশুদ্ধ করবে। তুমি তাদের জন্য দু‘আ করবে। তোমার দু‘আ তো তাদের জন্য প্রশান্তি যোগায়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সূরা তওবা- ১০৩)

যাকাত আদায় করলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় :

﴿وَمِنَ الْاَعْرَابِ مَنْ يُّؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُرُبَاتٍ عِنْدَ اللهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُوْلِؕ اَلَاۤ اِنَّهَا قُرْبَةٌ لَّهُمْؕ سَيُدْخِلُهُمُ اللهُ فِيْ رَحْمَتِهٖؕ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾

মরুবাসীদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যাদের কেউ কেউ আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে সেটাকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রাসূলের দু‘আ লাভের উপায় মনে করে। বাস্তবিকই তা তাদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়, (কেননা এর মাধ্যমেই) আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা তওবা- ৯৯)

যাকাত আদায়কারীরা আল্লাহর সাহায্য লাভ করে :

﴿وَقَالَ اللهُ اِنِّيْ مَعَكُمْؕ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ وَاٰتَيْتُمُ الزَّكَاةَ﴾

আল্লাহ তা‘আলা বলেছিলেন, তোমরা যদি সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও, তবে নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথেই আছি। (সূরা মায়েদা- ১২)

যাকাত আদায় করলে আল্লাহর রহমত লাভ হয় :

﴿وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍؕ فَسَاَكْتُبُهَا لِلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِاٰيَاتِنَا يُؤْمِنُوْنَ﴾

আমার দয়া প্রত্যেক বস্তুর উপর প্রশস্ত। সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারণ করব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৬)

যাকাতের প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে :

﴿وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاٰتُوا الزَّكَاةَؕ وَمَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللهِؕ اِنَّ اللهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ﴾

তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো। আর তোমরা নিজেদের জন্য যেসব সৎকর্ম আগে প্রেরণ করেছ তা আল্লাহর নিকট পাবে। তোমরা যা করছ নিশ্চয় আল্লাহ তা দেখছেন। (সূরা বাকারা- ১১০)

যাকাত আদায়কারীরাও সফলতা লাভ করে :

﴿قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ اَ لَّذِيْنَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ﴾

অবশ্যই সফলকাম হয়েছে ঐসব মুমিনগণ, যাঁরা নিজেদের সালাতে বিনয় ও নম্র, যাঁরা অনর্থক ক্রিয়াকলাপ হতে বিরত থাকে, যাঁরা যাকাত দানে সক্রিয়।

(সূরা মু’মিনূন : ১-৪)

যাকাত আদায় করা জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় :

﴿وَسَيُجَنَّبُهَا الْاَتْقٰى اَ لَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَهٗ يَتَزَكّٰى﴾

অচিরেই সে ব্যক্তিকে তা (জাহান্নাম) থেকে দূরে রাখা হবে, যে আল্লাহকে ভয় করে এবং যে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের ধনসম্পদ হতে ব্যয় করে। (সূরা লাইল- ১৭, ১৮)

যাকাত আদায় করলে জান্নাত লাভ করা যায় :

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ أَعْرَابِيًّا جَاءَ إِلٰى رَسُوْلِ اللهِ - - فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ دُلَّنِىْ عَلٰى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُه دَخَلْتُ الْجَنَّةَ . قَالَ : تَعْبُدُ اللهَ لَا تُشْرِكُ بِه شَيْئًا وَتُقِيْمُ الصَّلَاةَ الْمَكْتُوْبَةَ وَتُؤَدِّى الزَّكَاةَ الْمَفْرُوْضَةَ وَتَصُوْمُ رَمَضَانَ . قَالَ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِه لَا أَزِيْدُ عَلٰى هٰذَا شَيْئًا أَبَدًا وَلَا أَنْقُصُ مِنْهُ . فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِىُّ - مَنْ سَرَّه أَنْ يَّنْظُرَ إِلٰى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلٰى هٰذَا

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা এক বেদুইন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে এমন কিছু আমলের কথা বলে দিন, যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তখন তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, ফরয সালাত আদায় করবে, ফরয যাকাত আদায় করবে এবং রমাযান মাসে রোযা রাখবে। তখন লোকটি বলল, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! আমি এর থেকে সামান্যতম বেশিও করব না এবং সামান্যতম কমও করব না। অতঃপর যখন লোকটি চলে গেল তখন নবী ﷺ বললেন, যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী লোককে দেখে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন এই লোকটিকে দেখে। [সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/১১৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৪৯৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৪৮; মিশকাত, হা/১৪।]

যাকাত আদায়কারীরা ইসলামী রাষ্ট্রে নিরাপত্তা লাভ করে থাকে :

﴿فَاِذَا انْسَلَخَ الْاَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِيْنَ حَيْثُ وَجَدْتُّمُوْهُمْ وَخُذُوْهُمْ وَاحْصُرُوْهُمْ وَاقْعُدُوْا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍۚ فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوا الصَّلَاةَ وَاٰتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوْا سَبِيْلَهُمْؕ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾

অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে (বসে) থাকবে। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা তওবা- ৫)

যাকাত আদায় করলে সম্পদ থেকে অকল্যাণ দূর হয় :

عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ : يَا رَسُوْلَ اللهِ أَرَأَيْتَ إِذَا أَدّٰى رَجُلٌ زَكَاةَ مَالِه فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ أَدّٰى زَكَاةَ مَالِه فَقَدْ ذَهَبَ عَنْهُ شَرُّه

জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি কেউ তার সম্পদের যাকাত আদায় করে তাহলে কি হবে? তখন তিনি বলেন, যদি কেউ তার সম্পদের যাকাত আদায় করে, তাহলে তার সম্পদের অকল্যাণ দূর হয়ে যাবে। [মু‘জামুল আওসাত লিত তাবারানী, হা/১৫৭৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৪৩।]

যাকাত আদায় করলে আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায় :

﴿وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُه اِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ اَلَّذِيْنَ اِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلَاةَ وَاٰتَوُا الزَّكَاةَ﴾

আল্লাহ নিশ্চয় তাকে সাহায্য করেন, যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। (সূরা হাজ্জ- ৪০, ৪১)

যাকাত আদায় করলে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায় :

যাকাত হচ্ছে পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতামূলক একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। যাকাতের মাধ্যমে পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপক আদান-প্রদান হয়। যার কারণে যাকাত প্রদানকারী এবং যাকাত গ্রহণকারী উভয় পক্ষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা উভয় পক্ষকে পরস্পর দ্বীনি ভাই হিসেবে সাব্যসত্ম করেছেন। তিনি বলেন,

﴿فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوا الصَّلَاةَ وَاٰتَوُا الزَّكَاةَ فَاِخْوَانُكُمْ فِى الدِّيْنِؕ وَنُفَصِّلُ الْاٰيَاتِ لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ﴾

অতএব যদি তারা সালাত আদায় করে ও যাকাত দেয়, তবে তারা তো তোমাদেরই দ্বীনি ভাই। আর আমি আমার নিদর্শনসমূহ জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে থাকি। (সূরা তওবা- ১১)

যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্রতা দূর হয় :

ইসলামী শরীয়তে যাকাত ফরয হওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে দারিদ্রতা দূর করা। তার উপর এটা সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত একটি বাধ্যতামূলক বিধান। সমাজে যাতে সকলেই স্বাচ্ছন্দের সাথে জীবন পরিচালনা করতে পারে এবং ধনী-গরীবের মধ্যে ব্যবধান না থাকে- এ মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের জন্য যাকাতের বিধান প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং দারিদ্রতা বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা অদ্বিতীয়। যে সমাজে যাকাত ব্যবস্থার যথাযথ প্রচলন রয়েছে, সে সমাজে দারিদ্রতার ছোঁয়া লাগতে পারে না। বরং সেটিই হয়ে উঠে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও সমৃদ্ধশীল সমাজ।

সমাজে অপরাধমূলক কর্মকান্ড কমে যায় :

যে কোন সমাজের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মূল হচ্ছে দারিদ্রতা। দারিদ্রতার কারণে মানুষ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আর যেহেতু যাকাত দারিদ্রতাকে নির্মূল করে দেয়, সুতরাং সমাজে সুষ্ঠভাবে যাকাত ব্যবস্থা চালু থাকলে সমাজে অপরাধমূলক কর্মকান্ডও কমে যাবে।

৮৮
যাকাত আদায় না করার পরিণতি
যাকাত হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আগত রিযিক বণ্টনের একটি সুষম ব্যবস্থা। এতে বান্দাদের জন্য রয়েছে বহুমুখী কল্যাণ। বান্দা এর মাধ্যমে যেমনিভাবে দুনিয়াতে উপকার লাভ করে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে আখিরাতে আরো বেশি উপকার লাভ করতে পারে। অনুরূপভাবে বান্দা যদি এর পূর্ণ বাসত্মবায়ন না করে, তাহলে তাকে উভয় জগতে মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো :

যাকাত আদায় না করাটা মুনাফিকীর লক্ষণ :

আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে মুনাফিকদের যেসব কার্যকলাপ বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে যাকাত আদায় না করা। যেমন- তিনি বলেন,

﴿وَمِنْهُمْ مَّنْ عَاهَدَ اللهَ لَئِنْ اٰتَانَا مِنْ فَضْلِهٖ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُوْنَنَّ مِنَ الصَّالِحِيْنَ فَلَمَّاۤ اٰتَاهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖ بَخِلُوْا بِهٖ وَتَوَلَّوْا وَّهُمْ مُّعْرِضُوْنَ فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِيْ قُلُوْبِهِمْ إِلٰى يَوْمِ يَلْقَوْنَه بِمَاۤ اَخْلَفُوا اللهَ مَا وَعَدُوْهُ وَبِمَا كَانُوْا يَكْذِبُوْنَ﴾

তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকার করেছিল যে, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে দান করলে নিশ্চয় আমরা সাদাকা করব এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর যখন তিনি নিজ কৃপায় তাদেরকে তা দান করলেন, তখন তারা এ বিষয়ে কার্পণ্য করল এবং বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। পরিণামে তাদের অমত্মরে কপটতা স্থান পেল আল্লাহর সহিত ওদের সাক্ষাৎ দিবস পর্যমত্ম। কেননা তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল, তা ভঙ্গ করেছিল; আর তারা ছিল মিথ্যাচারী। (সূরা তাওবা : ৭৫-৭৭)

যারা যাকাত দেবে না তাদের ধ্বংস অনিবার্য :

﴿وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِيْنَ اَ لَّذِيْنَ لَا يُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَهُمْ بِالْاٰخِرَةِ هُمْ كَافِرُوْنَ﴾

দুর্ভোগ মুশরিকদের জন্য, যারা যাকাত প্রদান করে না এবং আখিরাতের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করে না। (সূরা হা-মীম সিজদা- ৬)

তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : مَانِعُ الزَّكَاةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي النَّارِ

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যাকাত ত্যাগকারী কিয়ামতের দিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [মু‘জামূস সগীর লিত তাবারানী, হা/৯৩৫; জামেউস সগীর, হা/১০৭৪৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৬২।]

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها- قَالَتْ دَخَلَ عَلَىَّ رَسُوْلُ اللهِ - - فَرَأٰى فِىْ يَدِىْ فَتَخَاتٍ مِنْ وَرِقٍ فَقَالَ مَا هٰذَا يَا عَائِشَةُ ؟ فَقُلْتُ صَنَعْتُهُنَّ أَتَزَيَّنُ لَكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ . قَالَ : أَتُؤَدِّيْنَ زَكَاتَهُنَّ . قُلْتُ لَا أَوْ مَا شَاءَ اللهُ . قَالَ : هُوَ حَسْبُكِ مِنَ النَّارِ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার নিকট আসলেন। এ সময় তিনি আমার হাতে রূপার তৈরি একটি বড় আংটি দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এটা কী- হে আয়েশা? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উদ্দেশ্যে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য এটা তৈরি করেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এর যাকাত দাও? আমি বললাম, না অথবা আল্লাহর যা ইচ্ছা ছিল। তখন তিনি বললেন, তোমাকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। [আবু দাউদ, হা/১৫৬৭; সুনানে দার কুতনী, হা/১৯৫১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৭৯৭; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪৩৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৬৯।]

যাকাত আদায় না করলে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে :

﴿وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ﴾

যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় না করে, তাদেরকে মর্মান্তিক শাস্তির সুসংবাদ দাও। (সূরা তওবা- ৩৪)

কিয়ামতের দিন তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে :

﴿يَوْمَ يُحْمٰى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوٰى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْؕ هٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ﴾

যেদিন তা (যাকাতের মাল) জাহান্নামের অগ্নিতে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। সেদিন বলা হবে, এটাই তো সেটা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন করো। (সূরা তওবা- ৩৫)

তাদের সম্পদ দিয়ে তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দেয়া হবে :

﴿وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْؕ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ؕ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ يَوْمَ الْقِيَامَةِؕ وَلِلّٰهِ مِيْرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِؕ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ﴾

আল্লাহ যাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ হতে কিছু দান করেছেন, অথচ তারা সে বিষয়ে কার্পণ্য করে, তারা যেন এরূপ ধারণা না করে যে, ওটা তাদের জন্য কল্যাণকর; বরং ওটা তাদের জন্য আরো ক্ষতিকর। তারা যে বিষয়ে কৃপণতা করেছে, কিয়ামতের দিন ওটাই তাদের গলার বেড়িতে পরিণত হবে। (জেনে রেখো) আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্বত্ত্বাধিকারী; আর তোমরা যা করছ আল্লাহ সে বিষয়ে পূর্ণ খবর রাখেন। (সূরা আলে ইমরান- ১৮০)

যাকাতের সম্পদ বিষধর সাপে পরিণত হয়ে দংশন করবে :

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ اٰتَاهُ اللهُ مَالًا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهٗ مُثِّلَ لَهٗ مَالُهٗ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهٗ زَبِيْبَتَانِ يُطَوِّقُهٗ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِيْ بِشِدْقَيْهِ يَقُوْلُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ ثُمَّ تَلَا هٰذِهِ الْاٰيَةَ ﴿وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتَاهُمْ اللهُ مِنْ فَضْلِه هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِه يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّٰهِ مِيْرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ ﴾

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যাকে আল্লাহ তা‘আলা ধনসম্পদ দান করেছেন; কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করেনি, শেষ বিচারের দিন সে ধনসম্পদ এমন বিষধর সাপে পরিণত হবে, যার মাথার উপর থাকবে দু’টি কালো দাগ। এ সাপ সে ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দু’গালে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে, ‘‘আমিই তোমার মাল, আমিই তোমার সঞ্চিত সম্পদ।’’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এ আয়াত পাঠ করলেন- ‘‘আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা কিছু দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য কল্যাণকর হবে; বরং এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর। যেসব জিনিসের ব্যাপারে তারা কার্পণ্য করে কিয়ামতের দিন সেসব ধনসম্পদকে বেড়ি বানিয়ে তাদের গলায় পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও জমিনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ তা‘আলা সে সম্পর্কে জানেন।’’ [সহীহ বুখারী, হা/১৪০৩; বায়হাকী, হা/৭০১৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৫৬০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৬১; মিশকাত, হা/১৭৭৪।]

পশুর যাকাত আদায় না করলে উক্ত পশু দ্বারাই আযাব দেয়া হবে :

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - - مَا مِنْ صَاحِبِ كَنْزٍ لَا يُؤَدِّى زَكَاتَه اِلَّا اُحْمِىَ عَلَيْهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ فَيُجْعَلُ صَفَائِحَ فَيُكْوٰى بِهَا جَنْبَاهُ وَجَبِيْنُه حَتّٰى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَ عِبَادِه فِىْ يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُه خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ ثُمَّ يُرَى سَبِيْلَهٗ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّارِ وَمَا مِنْ صَاحِبِ إِبِلٍ لَا يُؤَدِّى زَكَاتَهَا إِلَّا بُطِحَ لَهَا بِقَاعٍ قَرْقَرٍ كَأَوْفَرِ مَا كَانَتْ تَسْتَنُّ عَلَيْهِ كُلَّمَا مَضٰى عَلَيْهِ أُخْرَاهَا رُدَّتْ عَلَيْهِ أُولَاهَا حَتّٰى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَ عِبَادِه فِى يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهٗ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ ثُمَّ يُرَى سَبِيْلَهٗ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّارِ وَمَا مِنْ صَاحِبِ غَنَمٍ لَا يُؤَدِّىْ زَكَاتَهَا إِلَّا بُطِحَ لَهَا بِقَاعٍ قَرْقَرٍ كَأَوْفَرِ مَا كَانَتْ فَتَطَؤُهُ بِأَظْلَافِهَا وَتَنْطِحُهُ بِقُرُوْنِهَا لَيْسَ فِيهَا عَقْصَاءُ وَلَا جَلْحَاءُ كُلَّمَا مَضٰى عَلَيْهِ أُخْرَاهَا رُدَّتْ عَلَيْهِ أُولَاهَا حَتّٰى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَ عِبَادِهِ فِى يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّوْنَ ثُمَّ يُرَى سَبِيْلَهٗ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّارِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যেসব ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজেদের ধনসম্পদের যাকাত আদায় করে না কিয়ামতের দিন তাদের এ সম্পদ দোযখের আগুনে গরম করে পাত তৈরি করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের দেহের উভয় পার্শ্ব ও ললাটে দাগ দেয়া হবে। তার শাসিত্ম বান্দাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যমত্ম চলতে থাকবে। এ সময়কার একটি দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। অতঃপর কেউ পথ ধরবে জান্নাতের দিকে আর কেউ ধরবে জাহান্নামের দিকে। আর যেসব উটের মালিকরা যাকাত আদায় করবে না তাদেরকে একটি সমতল মাঠে উপুড় করে শুয়ে রাখা হবে এবং ঐসব উট স্থূল দেহ নিয়ে আসবে যেমনটি তারা পৃথিবীতে ছিল এবং এগুলো তাদেরকে পা দিয়ে মাড়াতে মাড়াতে অগ্রসর হবে। এভাবে যখনই এর শেষ দলটি অতিক্রম করবে পুনরায় এর প্রথম দল এসে পৌঁছবে। এগুলো তাদেরকে মাড়াতে থাকবে যতক্ষণ পর্যমত্ম আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের বিচার শেষ না করবেন। আর এ কাজ এমন এক দিনে করা হবে, যা পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হবে। অতঃপর কেউ পথ ধরবে জান্নাতের দিকে আর কেউ ধরবে জাহান্নামের দিকে। আর যেসব ছাগলের মালিকরা তার যাকাত আদায় করবে না তাদেরকে একটি সমতল মাঠে উপুড় করে ফেলে রাখা হবে এবং তার ছাগলগুলো মোটাতাজা অবস্থায় যেমনটি পৃথিবীতে ছিল, সেগুলো এসে তাদের খুর দিয়ে তাকে মাড়াতে থাকবে এবং শিং দিয়ে গুতো মারতে মারতে অগ্রসর হবে। অথচ সেদিন কোন একটি ছাগলই শিং বাঁকা, শিংহীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না। যখন এদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। আর এভাবে আযাব চলতে থাকবে যতক্ষণ না আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের বিচার সমাপ্ত করেন। এ শাসিত্ম এমন এক দিনে হবে, যার পরিমাণ হবে তোমাদের হিসাবানুসারে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। অতঃপর কেউ তার পথ ধরবে জান্নাতের দিকে আর কেউ ধরবে জাহান্নামের দিকে। [সহীহ মুসলিম, হা/২৩৩৯; আবু দাউদ, হা/১৬৬০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫৫৩; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫৮৭৪; বায়হাকী, হা/৭০১৭।]

যাকাত আদায় না করলে দুনিয়াতে আল্লাহর গযব নাযিল হয় :

عَنْ بُرَيْدَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : مَا مَنَعَ قَوْمٌ الزَّكَاةَ ، إِلَّا ابْتَلَاهُمُ اللهُ بِالسِّنِيْنَ

বুরাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন কোন জাতি যাকাত আদায় না করে তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টিতে আক্রামত্ম করেন। [মু‘জামুল আওসাত লিত তাবারানী, হা/৪৫৭৭; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৬৩।]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ ، قَالَ : أَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ ، فَقَالَ : يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِيْنَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ ، وَأَعُوْذُ بِاللهِ أَنْ تُدْرِكُوْهُنَّ : لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِيْ قَوْمٍ قَطُّ ، حَتّٰى يُعْلِنُوْا بِهَا ، إِلَّا فَشَا فِيْهِمُ الطَّاعُوْنُ ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِيْ لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِيْ أَسْلَافِهِمُ الَّذِيْنَ مَضَوْا . وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيْزَانَ ، إِلَّا أُخِذُوْا بِالسِّنِيْنَ ، وَشِدَّةِ الْمَؤُوْنَةِ ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ . وَلَمْ يَمْنَعُوْا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ ، إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوْا . وَلَمْ يَنْقُضُوْا عَهْدَ اللهِ ، وَعَهْدَ رَسُوْلِه ، إِلَّا سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ ، فَأَخَذُوْا بَعْضَ مَا فِيْ أَيْدِيْهِمْ . وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ ، وَيَتَخَيَّرُوْا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ ، إِلَّا جَعَلَ اللهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের নিকট এসে বললেন, হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আশ্রয় চাচ্ছি তোমরা যেন পরীক্ষার সম্মুখীন না হও। (১) যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্য অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সে জাতির উপর প্লেগ রোগের আবির্ভাব হয়। (২) যখন কোন জাতি ওজন ও মাপে কম দেয়, তখন সে জাতির উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বালা-মুসিবত এবং অত্যাচারী শাসক তাদের উপর নিপিড়ন করতে থাকে। (৩) যখন কোন জাতি তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করে না, তখন তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি চতুষ্পদ প্রাণী না থাকত, তাহলে তাদের উপর বৃষ্টিপাত হতো না। (৪) যখন কোন জাতি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার পূরণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের বিজাতীয় দুশমনকে তাদের উপর বিজয়ী করেন; যারা এসে তাদের হাত থেকে কিছু সম্পদ কেড়ে নিয়ে যায়। (৫) আর যখন তাদের ইমামগণ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। [ইবনে মাজাহ, হা/৪০১৯; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৮৬২৩; শু‘আবুল ঈমান, হা/৩০৪২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১০৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৬১।]

সরকার তাদের উপর জবরদসিত্ম করতে পারবে :

যদি তারা ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে সরকার তাদের থেকে যাকাত আদায় করার জন্য জবরদসিত্ম করতে পারবে। কেননা হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتّٰى يَشْهَدُوْا أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ وَيُقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ فَإِذَا فَعَلُوْا ذٰلِكَ عَصَمُوْا مِنِّيْ دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্যিকার ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রাসূল, আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে। তারা যদি এ কাজগুলো করে, তবে আমার পক্ষ থেকে তারা তাদের ব্যাপারে ও তাদের মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে (যেমন : কিসাস, রজম ইত্যাদি) তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর ন্যসত্ম। [সহীহ বুখারী, হা/২৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৩৮; নাসাঈ, হা/৩৯৬৯; ইবনে মাজাহ, হা/৭২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫২৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৪৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৭৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৯৮১০; দার কুতনী, হা/৮৯২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪২৮; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবরানী, হা/১৪৫৩৮; বায়হাকী, হা/৪৯২০; জামেউস সগীর, হা/২২৫১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৪০৮; মিশকাত, হা/১২।]

যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে আবু বকর (রাঃ) যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন :

কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পরেও যেসব কারণে তার জান-মালের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়, তার মধ্যে একটি হচ্ছে যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করা। যার কারণে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ لَمَّا تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ - وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَه وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ الْعَرَبِ قَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ لِأَبِى بَكْرٍ كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ وَقَدْ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ - أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتّٰى يَقُوْلُوْا لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ فَمَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ فَقَدْ عَصَمَ مِنِّىْ مَالَه وَنَفْسَه إِلَّا بِحَقِّه وَحِسَابُه عَلَى اللهِ . فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَاللهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللهِ لَوْ مَنَعُوْنِىْ عِقَالًا كَانُوْا يُؤَدُّوْنَه إِلٰى رَسُوْلِ اللَّهِ - لَقَاتَلْتُهُمْ عَلٰى مَنْعِه . فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَوَاللهِ مَا هُوَ إِلَّا أَنْ رَأَيْتُ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِىْ بَكْرٍ لِلْقِتَالِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ মৃত্যুবরণ করেন, তখন আবু বকর (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত হন। এ সময় আরবের একদল লোক (যাকাত অস্বীকার করে) মুরতাদ হয়ে গেল। [আবু বকর (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সংকল্প করলেন] উমর (রাঃ) বললেন, আপনি কিরূপে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন : ‘‘আমি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ (আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই) আর যে ব্যক্তি ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলল, সে তার জান-মাল আমার হাত থেকে রক্ষা করল। অবশ্য আইনের দাবী আলাদা। (অর্থাৎ ইসলামের বিধান অনুযায়ী দন্ডনীয় কোন অপরাধ করলে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে)। তবে তার আসল বিচারের ভার আল্লাহর উপর ন্যস্ত। তখন আবু বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কেননা যাকাত হচ্ছে মালের (উপর বঞ্চিতের) অধিকার। আল্লাহর কসম! যদি তারা আমাকে একটি রশি প্রদান করতেও অস্বীকৃতি জানায়, যা তারা (যাকাত বাবদ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রদান করত, তাহলে আমি এ অস্বীকৃতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এবার উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! ব্যাপারটা এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আবু বকরের হৃদয়কে যুদ্ধের জন্য প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। আমি স্পষ্টই উপলদ্ধি করলাম, এটাই (আবু বকরের সিদ্ধান্তই) সঠিক এবং যথার্থ। [সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৯-১৪০০; সহীহ মুসলিম, হা/১৩৩; আবু দাউদ, হা/১৫৫৮; নাসাঈ, হা/২৪৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৩৫; মিশকাত, হা/১৭৯০।]

যাকাত না দেয়ার কারণে বাগানওয়ালাদের পরিণতি :

﴿اِنَّا بَلَوْنَاهُمْ كَمَا بَلَوْنَاۤ اَصْحَابَ الْجَنَّةِۚ اِذْ اَقْسَمُوْا لَيَصْرِمُنَّهَا مُصْبِحِيْنَ وَلَا يَسْتَثْنُوْنَ فَطَافَ عَلَيْهَا طَآئِفٌ مِّنْ رَّبِّكَ وَهُمْ نَآئِمُوْنَ فَاَصْبَحَتْ كَالصَّرِيْمِ فَتَنَادَوْا مُصْبِحِيْنَ اَنِ اغْدُوْا عَلٰى حَرْثِكُمْ اِنْ كُنْتُمْ صَارِمِيْنَ فَانْطَلَقُوْا وَهُمْ يَتَخَافَتُوْنَ اَنْ لَّا يَدْخُلَنَّهَا الْيَوْمَ عَلَيْكُمْ مِّسْكِيْنٌ وَغَدَوْا عَلٰى حَرْدٍ قَادِرِيْنَ فَلَمَّا رَاَوْهَا قَالُوْاۤ اِنَّا لَضَآلُّوْنَ بَلْ نَحْنُ مَحْرُوْمُوْنَ قَالَ اَوْسَطُهُمْ اَلَمْ اَقُلْ لَّكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُوْنَ قَالُوْا سُبْحَانَ رَبِّنَاۤ اِنَّا كُنَّا ظَالِمِيْنَ فَاَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلٰى بَعْضٍ يَّتَلَاوَمُوْنَ قَالُوْا يَا وَيْلَنَاۤ اِنَّا كُنَّا طَاغِيْنَ عَسٰى رَبُّنَاۤ اَنْ يُّبْدِلَنَا خَيْرًا مِّنْهَاۤ اِنَّاۤ اِلٰى رَبِّنَا رَاغِبُوْنَ كَذٰلِكَ الْعَذَابُ وَلَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَكْبَرُۘ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ﴾

আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি, যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম বাগানের মালিকদেরকে। যখন তারা এ শপথ করেছিল যে, তারা বাগান হতে প্রত্যুষেই ফল কেটে নেবে; কিন্তু তারা ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেনি। অতঃপর সেই বাগানে তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে এক আযাব পতিত হলো, তখন তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ফলে তা পুড়ে ছাই বর্ণ ধারণ করল। এরপর সকালে তারা একে অপরকে ডেকে বলল, তোমরা যদি ফসল কাটতে চাও তবে সকাল সকাল বাগানে চলো। অতঃপর তারা ফিস ফিস করে এ কথা বলতে বলতে চলল- আজ বাগানে যেন তোমাদের নিকট কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি প্রবেশ করতে না পারে। অতঃপর তারা (অভাবীদেরকে) প্রতিহত করতে সক্ষম- এই বিশ্বাস নিয়ে সকালে রওয়ানা হলো। কিন্তু তারা যখন ঐ বাগান প্রত্যক্ষ করল তখন তারা বলল, আমরা তো পথ ভুলে গেছি। (না) বরং আমরা বঞ্চিত হয়েছি! অতঃপর তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলল, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, যদি তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করতে! তখন তারা বলল, আমরা আমাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি; নিশ্চয় আমরা ছিলাম অত্যাচারী। এভাবে তারা একে অপরকে দোষারোপ করতে লাগল। তারা বলল, হায় দুর্ভোগ! আমরা তো সীমালঙ্ঘনকারী ছিলাম। আমরা আশা রাখি যে, আমাদের রব এর পরিবর্তে আমাদেরকে উত্তম বাগান দান করবেন; আমরা আমাদের রবের দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। শাস্তি এভাবেই এসে থাকে; আর পরকালের শাস্তি তো আরো কঠিন, যদি তারা জানত। (সূরা ক্বালাম : ১৭-৩৩)

যাকাত না দেয়ার কারণে কারূনের করুণ পরিণতি :

﴿اِنَّ قَارُوْنَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوْسٰى فَبَغٰى عَلَيْهِمْ ۪ وَاٰتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوْزِ مَاۤ اِنَّ مَفَاتِحَهٗ لَتَنُوْٓءُ بِالْعُصْبَةِ اُولِى الْقُوَّةِۗ اِذْ قَالَ لَهٗ قَوْمُهٗ لَا تَفْرَحْ اِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِيْنَ وَابْتَغِ فِيْمَاۤ اٰتَاكَ اللهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيْبَكَ مِنَ الدُّنْيَا وَاَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللهُ اِلَيْكَ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِى الْاَرْضِؕ اِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِيْنَ قَالَ اِنَّمَاۤ اُوْتِيْتُهٗ عَلٰى عِلْمٍ عِنْدِيْؕ اَوَلَمْ يَعْلَمْ اَنَّ اللهَ قَدْ اَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهٖ مِنَ الْقُرُوْنِ مَنْ هُوَ اَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَّاَكْثَرُ جَمْعًا وَّلَا يُسْاَلُ عَنْ ذُنُوْبِهِمُ الْمُجْرِمُوْنَ فَخَرَجَ عَلٰى قَوْمِهٖ فِيْ زِيْنَتِهٖؕ قَالَ الَّذِيْنَ يُرِيْدُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا يَا لَيْتَ لَنَا مِثْلَ مَاۤ اُوْتِيَ قَارُوْنُ اِنَّهٗ لَذُوْ حَظٍّ عَظِيْمٍ وَقَالَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ وَيْلَكُمْ ثَوَابُ اللهِ خَيْرٌ لِّمَنْ اٰمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًاۚ وَلَا يُلَقَّاهَاۤ اِلَّا الصَّابِرُوْنَ فَخَسَفْنَا بِهٖ وَبِدَارِهِ الْاَرْضَ فَمَا كَانَ لَهٗ مِنْ فِئَةٍ يَّنْصُرُوْنَهٗ مِنْ دُوْنِ اللهِۗ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِيْنَ وَاَصْبَحَ الَّذِيْنَ تَمَنَّوْا مَكَانَهٗ بِالْاَمْسِ يَقُوْلُوْنَ وَيْكَاَنَّ اللهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهٖ وَيَقْدِرُۚ لَوْلَاۤ اَنْ مَّنَّ اللهُ عَلَيْنَا لَخَسَفَ بِنَاؕ وَيْكَاَنَّهٗ لَا يُفْلِحُ الْكَافِرُوْنَ﴾

কারূন ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত, কিন্তু সে তাদের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছিল। আর আমি তাকে দান করেছিলাম এমন ধনভান্ডার, যার চাবিগুলো বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল। স্মরণ করো, যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, অহংকার করো না, নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারীদেরকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান করো এবং দুনিয়ার অংশ লাভ করতে ভুলে যেও না। তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করো না। (কেননা) আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালোবাসেন না। সে বলল, এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞানবলে প্রাপ্ত হয়েছি। সে কি জানত না- আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, যারা ছিল শক্তিতে তার চেয়ে প্রবল এবং জনসংখ্যায় ছিল অধিক? অপরাধীদেরকে কি তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না? কারূন তার সম্প্রদায়ের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল জাঁকজমক সহকারে। ফলে যারা পার্থিব জীবন কামনা করত তারা বলতে লাগল যে, হায়! কারূনকে যেরূপ দেয়া হয়েছে আমাদেরকেও যদি সেরূপ দেয়া হতো! প্রকৃতই সে মহাভাগ্যবান। কিন্তু যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা বলল, ধিক তোমাদেরকে! যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য আল্লাহর পুরস্কারই সর্বশ্রেষ্ঠ; আর ধৈর্যশীল ব্যতীত তা কেউ লাভ করতে পারবে না। অতঃপর আমি কারূনকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে প্রোত্থিত করলাম। তার স্বপক্ষে এমন কোন দলও ছিল না, যে তাকে আল্লাহর শাস্তি হতে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না। ফলে ইতিপূর্বে যারা তার মতো হতে চেয়েছিল তারা বলতে লাগল, দেখলে তো! আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা তার রিযিক বর্ধিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা হ্রাস করেন। যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি সদয় না হতেন তবে আমাদেরকেও ভূগর্ভে প্রোত্থিত করতেন। দেখলে তো! কাফিররা সফলকাম হয় না। (সূরা ক্বাসাস : ৭৬-৮২)

৮৯
যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ
১. মুসলিম হওয়া :

ইসলামের ইবাদাতসমূহ কেবল মুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য। সুতরাং কোন অমুসলিমের উপর যাকাত আদায় করা ফরয নয়। ঈমান ব্যতীত কোন ইবাদাত গ্রহণযোগ্যও নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿وَمَا مَنَعَهُمْ اَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ اِلَّاۤ اَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَبِرَسُوْلِهٖ﴾

তাদের দান গ্রহণে বাধা কেবল এই ছিল যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করত। (সূরা তওবা- ৫৪)

২. স্বাধীন হওয়া :

যাকাত আদায়ের জন্য স্বাধীন হওয়া পূর্বশর্ত। সুতরাং কৃতদাস ও দাসীর উপর যাকাত আদায় করা ফরয নয়। কেননা তারা নিজেরাই অন্যের সম্পত্তির অংশ বিশেষ এবং তারা কোন সম্পদের মালিক হতে পারে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللهِ - - قَالَ : لَيْسَ فِى الْعَبْدِ صَدَقَةٌ إِلَّا صَدَقَةُ الْفِطْرِ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করে বলেন, সাদাকাতুল ফিতর ব্যতীত ক্রীতদাসের উপর কোন সাদাকা নেই। [সহীহ মুসলিম, হা/২৩২৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৪৩৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৮৯; সুনানে দার কুতনী, হা/২০২৪; জামেউস সগীর, হা/৯৫৪৪।]

৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ হওয়া :

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ মাল বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। সুতরাং যদি কারো নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদের চেয়ে সামান্য পরিমাণ কম সম্পদ বিদ্যমান থাকে, তার উপর যাকাত আদায় করা আবশ্যক নয়। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : لَيْسَ فِيْمَا أَقَلُّ مِنْ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ ، وَلَا فِيْ أَقَلَّ مِنْ خَمْسَةٍ مِنَ الْإِبِلِ الذَّوْدِ صَدَقَةٌ ، وَلَا فِيْ أَقَلَّ مِنْ خَمْسِ أَوَاقٍ مِنَ الْوَرِقِ صَدَقَةٌ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পাঁচ ওয়াসাকের কম উৎপন্ন দ্রব্যের উপর যাকাত নেই, পাঁচটির কম উটের উপর যাকাত নেই এবং পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রৌপ্যের উপরও যাকাত নেই। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৮৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৩১০; আবু দাউদ, হা/১৫৬০; তিরমিযী, হা/৬২৬; নাসাঈ, হা/২৪৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯২১০।]

৪. সম্পদের পূর্ণ দখল (হস্তগত) থাকা :

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য যাকাতের মালের পূর্ণ দখল থাকা আবশ্যক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً ﴾

তাদের সম্পদ হতে যাকাত গ্রহণ করো। (সূরা তওবা- ১০৩)

সুতরাং যেসব সম্পদ এখনও পূর্ণ হসত্মগত হয়নি, সেসব সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা আবশ্যক নয়। বরং যখন হসত্মগত হবে তখন তার উপর যাকাত আবশ্যক হবে।

৫. এক বছর অতিবাহিত হওয়া :

যাকাত প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় প্রদান করতে হয় এবং উক্ত মাল ব্যক্তির নিকট এক বছর যাবৎ হসত্মগত থাকতে হয়। তারপর যদি দেখা যায় যে, তার মাল নিসাব পরিমাণ হয়েছে, তাহলে তার উক্ত মালের যাকাত প্রদান করা আবশ্যক; নতুবা আবশ্যক হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ ، قَالَتْ : سَمِعْتُ رَسُوْل اللهِ يَقُوْلُ : لَا زَكَاةَ فِيْ مَالٍ حَتّٰى يَحُوْلَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, এক বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যমত্ম সম্পদের কোন যাকাত নেই। [ইবনে মাজাহ, হা/১৭৯২; মুসনাদুল বাযযার, হা/৩০৪; সুনানে দার কুতনী, হা/১৮৮৯; জামেউস সগীর, হা/১৩৪৫৪।]

সুতরাং কারো নিকট যদি ৫টি উট অথবা ৩০টি গরু অথবা ৪০টি ছাগল অথবা ৭.৫ ভরি স্বর্ণ থাকে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তার থেকে কিছু অংশ হাত ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে তার উপর যাকাত আদায় করা আবশ্যক হবে না।

তবে জমি হতে উৎপন্ন ফসল কাটার সময়ই যাকাত দিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে এক বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্তটি প্রযোজ্য হবে না।

তাছাড়া গবাদি পশুর বাচ্চা এবং ব্যবসায়িক সম্পদের লভ্যাংশের ক্ষেত্রেও পূর্ণ এক বছর হওয়া শর্ত নয়। বরং এগুলো তাদের মূলের দিকে ফিরে যাবে। অর্থাৎ গবাদি পশুর বাচ্চার হিসাব তার মায়ের হিসাবের সাথে যোগ করা হবে এবং ব্যবসায়িক সম্পদের লভ্যাংশ তার মূলধনের সাথে যোগ করা হবে।

৯০
বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যাকাত আদায়ের বিধান :
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য একটি শর্ত হচ্ছে, নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর হসত্মগত থাকা। তবে কেউ যদি এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যাকাত আদায় করতে চায়, তাহলে তার জন্য তা বৈধ আছে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَلِىٍّ أَنَّ الْعَبَّاسَ سَأَلَ النَّبِىَّ - - فِىْ تَعْجِيْلِ صَدَقَتِه قَبْلَ أَنْ تَحِلَّ فَرَخَّصَ لَه فِىْ ذٰلِكَ

আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় আববাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যাকাত আদায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। [আবু দাউদ, হা/১৬২৬; তিরমিযী, হা/৬৭৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮২২; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৫৪৩১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৯৭৫১; মিশকাত, হা/১৭৮৮।]

৯১
যেসব সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা ফরয
যেসব সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয়- সেগুলা মূলত ৫ প্রকার। যথা -

১. স্বর্ণ ও রৌপ্য :

স্বর্ণ ও রৌপ্য হচ্ছে অনেক মূল্যবান খনিজ পদার্থ। আল্লাহ তা‘আলা এগুলোর উপর পৃথকভাবে যাকাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং যার নিকট নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রৌপ্য পূর্ণ এক বছর পর্যমত্ম বিদ্যমান থাকবে, তাকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে।

২. ব্যবসায়িক পণ্য :

ব্যবসার উদ্দেশ্যে যেসব পণ্য উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, সেগুলোকেই ব্যবসায়িক পণ্য বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা এসব পণ্যের ক্ষেত্রেও যাকাত নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং প্রতি বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসায়িক পণ্যগুলো হিসাব করে তার উপর নির্ধারিত হারে যাকাত প্রদান করা আবশ্যক।

৩. গৃহপালিত পশু :

রাসূলুল্লাহ ﷺ যেসব গৃহপালিত পশুর উপর যাকাত ফরয করেছেন সেগুলো হলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। সুতরাং যার নিকট এসব সম্পদ নিসাব পরিমাণ পূর্ণ এক বছর পর্যমত্ম বিদ্যমান থাকবে, তাকে অবশ্যই যাকাত প্রদান করতে হবে।

৪. ভূমি থেকে উৎপন্ন ফসল :

যেসব ফসল ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়, সেসব ফসল থেকেও যাকাত প্রদান করা আবশ্যক। যেমন- গম, যব, খেজুর, কিসমিস, ধান ইত্যাদি।

৫. খনিজ সম্পদ ও মাটির নিচে সঞ্চিত সম্পদ বা গুপ্তধন :

মাটির নিচে সাধারণত দুই ধরনের সম্পদ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে- খনিজ সম্পদ, যা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য সৃষ্টি করে মাটির নিচে রেখেছেন। যেমন- স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, ইউরেনিয়াম, কয়লা, গ্যাস ইত্যাদি। আর আরেকটি হচ্ছে, পূর্ববর্তী যুগের মানুষ কর্তৃক লুকিয়ে রাখা সম্পদ। যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী যে কারো নিকট হসত্মগত করার ব্যবস্থা করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা উভয় প্রকার সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা আবশ্যক করে দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি এ ধরনের কোন সম্পদ প্রাপ্ত হবে, তার উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাত প্রদান করা আবশ্যক হয়ে যাবে।

৯২
যাকাতের নিসাব
যে পরিমাণ মাল থাকলে যাকাত ফরয হয় তাকে ‘নিসাব’ বলে। আর যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, তাকে ‘সাহেবে নিসাব’ বলা হয়। কোন ব্যক্তির নিকট যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত প্রদান করা ফরয হবে। নিচে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বসত্মুর যাকাতের নিসাব সম্পর্কে বিসত্মারিত আলোচনা করা হলো :

৯৩
স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত
স্বর্ণের নিসাব :

স্বর্ণের যাকাতের ক্ষেত্রে এর নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে ২০ দিনার। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

وَلَيْسَ عَلَيْكَ شَىْءٌ - يَعْنِىْ فِى الذَّهَبِ - حَتّٰى يَكُوْنَ لَكَ عِشْرُوْنَ دِيْنَارًا فَإِذَا كَانَ لَكَ عِشْرُوْنَ دِيْنَارًا وَحَالَ عَلَيْهَا الْحَوْلُ فَفِيْهَا نِصْفُ دِيْنَارٍ فَمَا زَادَ فَبِحِسَابِ ذٰلِكَ

আর যদি তোমার নিকট বিশ দিনারের কম স্বর্ণ মজুদ থাকে, তাহলে তোমার উপর যাকাত ফরয নয়। তবে যদি তোমার নিকট ২০ দিনার পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ থাকে এবং সেটা এক বছর পর্যমত্ম অতিবাহিত হয়, তাহলে তার জন্য অর্ধ দিনার যাকাত দিতে হবে। এরপরে যা বৃদ্ধি পাবে তার হিসাব ঐভাবেই হবে। [আবু দাউদ, হা/১৫৭৫; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৭৮৩।]

উল্লেখ্য যে, ১ দিনার সমান হচ্ছে ৪.২৫ গ্রাম। সুতরাং ২০ দিনার সমান হচ্ছে ২০ × ৪.২৫ = ৮৫ গ্রাম। অতএব ১১.৬৬ গ্রাম সমান যদি ১ ভরি হয়, তাহলে ৮৫ গ্রাম সমান হচ্ছে, ৮৫ ÷ ১১.৬৬ = ৭.২৯ ভরি। তবে স্বর্ণের নিসাব সাড়ে সাত ভরি ধরা হয়।

রৌপ্যের নিসাব :

রৌপ্যের নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে, ৫ উকিয়া বা ২০০ দিরহাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

وَلَا فِيْ أَقَلَّ مِنْ خَمْسِ أَوَاقٍ مِنَ الْوَرِقِ صَدَقَةٌ

পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রৌপ্যে যাকাত নেই। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৮৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৭৬৫।]

উল্লেখ্য যে, ১ উকিয়া সমান হচ্ছে ৪০ দিরহাম। সুতরাং ৫ উকিয়া সমান হচ্ছে ২০০ দিরহাম।

অপর হাদীসে এসেছে,

فَإِذَا كَانَتْ لَكَ مِائَتَا دِرْهَمٍ وَحَالَ عَلَيْهَا الْحَوْلُ فَفِيهَا خَمْسَةُ دَرَاهِمَ ........... فَمَا زَادَ فَبِحِسَابِ ذٰلِكَ

যখন তোমার নিকট ২০০ দিরহাম মজুদ থাকবে এবং সেটা এক বছর র্পযমত্ম অতিবাহিত হবে, তাহলে তা থেকে ৫ দিরহাম যাকাত দিতে হবে। এরপরে যা বৃদ্ধি পাবে তার হিসাব ঐভাবেই হবে। [আবু দাউদ, হা/১৫৭৫; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৭৮৩।]

অপর হাদীসে এসেছে,

هَاتُوْا رُبْعَ الْعُشُوْرِ مِنْ كُلِّ أَرْبَعِيْنَ دِرْهَمًا دِرْهَمٌ وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ شَىْءٌ حَتّٰى تَتِمَّ مِائَتَىْ دِرْهَمٍ فَإِذَا كَانَتْ مِائَتَىْ دِرْهَمٍ فَفِيْهَا خَمْسَةُ دَرَاهِمَ فَمَا زَادَ فَعَلٰى حِسَابِ ذٰلِكَ

তোমরা প্রতি ২০ দিরহামে ১ দিরহাম যাকাত আদায় করবে। আর ২০০ দিরহাম পূর্ণ না হওয়া পর্যমত্ম তোমাদের উপর কোন কিছুই ফরয নয়। অতঃপর ২০০ দিরহাম পূর্ণ হলে এর যাকাত হবে ৫ দিরহাম এবং এর অতিরিক্ত হলে তার যাকাত উপরোক্ত হিসাব অনুযায়ী প্রদান করতে হবে। [আবু দাউদ, হা/১৫৭৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৯৭; সুনানে দুর কাতুনী, হা/১৮৯৮।]

উপরের হাদীস দুটিতে বর্ণিত ২০০ দিরহাম সমান হচ্ছে ৫৯৫ গ্রাম। অতএব ১১.৬৬ গ্রাম সমান যদি ১ ভরি হয়, তাহলে ৫৯৫ গ্রাম সমান হচ্ছে, ৫৯৫ ÷ ১১.৬৬ = ৫১.০২ ভরি। তবে রৌপ্যের নিসাব সাড়ে বায়ান্ন ভরি ধরা হয়।

৯৪
যাকাত নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বর্ণের নিসাব প্রযোজ্য নাকি রৌপ্যের নিসাব
এ ব্যাপারে আলেমদের দু’টি মতামত রয়েছে :

এক : অনেক আলেমের মতে, স্বর্ণ ও রৌপ্যের মধ্য থেকে বাজারে যেটার মূল্য কম থাকবে সেটার নিসাবের সাথে মিলাতে হবে। এতে গরীবদের লাভের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। কেননা বর্তমানে স্বর্ণের মূল্য হিসাব করলে অনেকের উপরই যাকাত ফরয হবে না; কিমত্মু রৌপ্যের মূল্য হিসাব করলে যাকাত ফরয হয়।

দুই : অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক আলেমগণই নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ের মালের যাকাত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণের নিসাবকে মূল নিসাব সাব্যস্ত করেছেন।

উল্লেখ্য যে, স্বর্ণ খাঁটি না হলে মালিকানাধীন স্বর্ণ থেকে খাদ বাদ দিয়ে স্বর্ণের নিট ওজনকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিতে হবে। রৌপ্য যদি খাঁটি না হয় তাহলে রৌপ্যের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে।

৯৫
স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপর যাকাত নগদ অর্থে রূপামত্মরিত করার পদ্ধতি
মালিকানাধীন স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপর যাকাতের পরিমাণ নগদে নির্ণয়ের জন্য যাকাত বাবদ নির্ধারিত পরিমাণকে গ্রাম প্রতি মূল্য দ্বারা গুণ করে নিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, স্বর্ণের বাজার দর প্রতি গ্রাম ২,০০০/- টাকা হলে ৮৫ গ্রামের মূল্য = ১,৭০,০০০/- টাকা, যার উপর যাকাত হবে ২.৫% হারে (১,৭০,০০০ ÷ ৪০) = ৪,২৫০/- টাকা। আর রূপার বাজার দর প্রতি গ্রাম ৫০ টাকা হলে ৫৯৫ গ্রামের মূল্য = ২৯,৭৫০/- টাকা, যার উপর যাকাত হবে ২.৫% হারে (২৯৭৫০ ÷ ৪০) = ৭৪৩.৭৫ টাকা। যাকাত হিসাব করার সময় এসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিক্রয় মূল্যের অর্থাৎ যাকাত হিসাব করার সময় বিক্রয় করতে চাইলে যে মূল্য পাওয়া যাবে এর ভিত্তিতে যাকাত হিসাব করতে হবে।

উল্লেখ্য যে, কারো নিকট যদি স্বর্ণ অথবা রৌপ্য না থাকে; কিমত্মু স্বর্ণের অথবা রৌপ্যের নিসাবের বাজার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ থাকে, তাহলে তাকে স্বর্ণ অথবা রৌপ্যের নিসাব অনুযায়ীই যাকাত দিতে হবে।

৯৬
ব্যবহারী অলংকারের উপর যাকাত
স্বর্ণ ও রৌপ্য যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সর্বাবস্থায় এর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّه أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُوْلَ اللهِ - - وَمَعَهَا ابْنَةٌ لَهَا وَفِىْ يَدِ ابْنَتِهَا مَسَكَتَانِ غَلِيْظَتَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهَا أَتُعْطِيْنَ زَكَاةَ هَذَا قَالَتْ لَا قَالَ أَيَسُرُّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللهُ بِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ قَالَ فَخَلَعَتْهُمَا فَأَلْقَتْهُمَا إِلَى النَّبِىِّ - - وَقَالَتْ هُمَا لِلّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُوْلِه

আমর ইবনে শু‘আইব (রাঃ) তার পিতা, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন, জনৈক মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট আসলেন। সে সময় তার মেয়ের হাতে দুটি স্বর্ণের বালা পরা ছিল। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, তুমি এর যাকাত আদায় করেছ? মেয়েটি উত্তরে বলল, না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমার কাছে কি এটা পছন্দনীয় যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে আগুনের চুড়ি বানিয়ে তোমার হাতে পরিয়ে দিন? (বর্ণনাকারী) বলেন, এরপর মেয়েটি সেগুলো খুলে ফেলল এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট দিয়ে দিল। তারপর বলল, এগুলো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্য। [আবু দাউদ, হা/১৫৬৫; নাসাঈ, হা/২৪৭৯; দার কুতনী, হা/১৯৮২; বায়হাকী, হা/৭৩৪০।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِىِّ - - فَقَالَتْ دَخَلَ عَلَىَّ رَسُوْلُ اللهِ - - فَرَأَى فِىْ يَدِىْ فَتَخَاتٍ مِنْ وَرِقٍ فَقَالَ مَا هٰذَا يَا عَائِشَةُ فَقُلْتُ صَنَعْتُهُنَّ أَتَزَيَّنُ لَكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ . قَالَ أَتُؤَدِّيْنَ زَكَاتَهُنَّ قُلْتُ لَا أَوْ مَا شَاءَ اللهُ . قَالَ هُوَ حَسْبُكِ مِنَ النَّارِ

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার নিকটে এসে দেখেন যে, আমি রূপার আংটি পরে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী- হে আয়েশা? উত্তরে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার জন্যই নিজেকে সজ্জিত করতে এগুলো তৈরি করেছি। তিনি বললেন, তুমি কি এগুলোর যাকাত আদায় করেছ? আমি বললাম, না অথবা মাশাআল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ যেমনটা চেয়েছেন তেমনটাই হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমার জাহান্নামে যাওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। [আবু দাউদ, হা/১৫৬৭; দার কুতনী, হা/১৯৫১; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪৩৭; বায়হাকী, হা/৭৩৩৮।]

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ ، قَالَ : سَأَلَتْهُ امْرَأَةٌ عَنْ حُلِيٍّ لَهَا أَفِيْهِ زَكَاةٌ ؟ قَالَ : إِذَا بَلَغَ مِائَتَيْ دِرْهَمٍ فَزَكِّيْهِ

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, অলংকারের যাকাত দিতে হবে কি? তিনি বললেন, যদি তা ২০০ দিরহামে পৌঁছে, তাহলে তার যাকাত দিতে হবে। [মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৯৪৭৮; সনদটি হাসান।]

সুতরাং ব্যবহারী অলংকার যদি নিসাব পর্যমত্ম পৌঁছে, তাহলে উক্ত অলংকারের উপরও যাকাত প্রদান করা ফরয।

৯৭
একাধিক মালিকানায় স্বর্ণ ও রৌপ্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত ফরয হবে কি
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে, ব্যক্তিকে এককভাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদের পূর্ণ মালিকানা অর্জন করতে হবে। সুতরাং একাধিক মালিকানাভুক্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, তাহলে উক্ত সম্পদের উপর যাকাত আদায় করা আবশ্যক হবে না।

অনুরূপভাবে যদি একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নিকট পৃথক পৃথকভাবে এত পরিমাণ সম্পদ থাকে, যা যাকাতের নিসাবের সমতুল্য, তাহলে তাদের উপর যাকাত ফরয হবে না। বরং যখন পরিবারের কোন সদস্য এককভাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তখন তাকে যাকাত দিতে হবে।

তবে যদি একজনের মালিকানাভুক্ত বসত্মু কয়েকজনে ব্যবহার করে এবং উক্ত সম্পদ নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে উক্ত সম্পদের যাকাত দিতে হবে।

৯৮
ব্যাংক ও বীমা কোম্পানীতে জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত
ব্যাংক ও বীমা কোম্পানীতে যেসব অর্থ জমা দেয়া হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে বিধান হচ্ছে-

১। কোন কোম্পানীতে যেসব অর্থ জমা রাখা হয় তা যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সে সম্পদের যাকাত দিতে হবে। আর যদি তা নিসাব পরিমাণ না হয় তবে অন্যান্য সম্পদের সাথে এটা যোগ করে নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করতে হবে।

২। যদি কোন কোম্পানীতে টাকা জমা রাখার পর এরূপ পরিস্থিতি হয় যে, ঐ টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না, তাহলে তার উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।

৩। যেসব কোম্পানী সুদী কারবারের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাতে অর্থ জমা রাখা বৈধ নয়। যদি কেউ ঐসব প্রতিষ্ঠানে লেনদেন করে তাহলে সে পাপী হবে। তবে মূল জমাকৃত টাকার যাকাত অবশ্যই দিতে হবে। আর সুদ হিসেবে অতিরিক্ত যা কিছু পাবে, তা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে দেবে অথবা দান করে দেবে।

৯৯
পশুর যাকাত
কিছু পশু আছে, মানুষ তাদেরকে বিভিন্নভাবে কাজে ব্যবহার করে থাকে। এসব পশুকে اَلْاَنْعَام (আন‘আম) বা ‘চতুষ্পদ জমত্মু’ বলে। ঐসব প্রাণীর যাকাত দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

- مَا مِنْ رَجُلٍ تَكُوْنُ لَه اِبِلٌ ، أَوْ بَقَرٌ ، أَوْ غَنَمٌ لَا يُؤَدِّيْ حَقَّهَا اِلَّا اُتِيَ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْظَمَ مَا تَكُوْنُ وَأَسْمَنَه تَطَؤُه بِأَخْفَافِهَا وَتَنْطَحُه بِقُرُوْنِهَا كُلَّمَا جَازَتْ أُخْرَاهَا رُدَّتْ عَلَيْهِ أُولَاهَا حَتّٰى يُقْضٰى بَيْنَ النَّاسِ

প্রত্যেক উট, গরু ও ছাগলের অধিকারী ব্যক্তি যে তার যাকাত আদায় করবে না, নিশ্চয় কিয়ামতের দিন তাদেরকে আনা হবে বিরাট আকারে ও অতি মোটাতাজা অবস্থায়। তারা দলে দলে তাকে তাদের ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে এবং মারতে থাকবে তাদের শিং দ্বারা। যখনই তাদের শেষ দল অতিক্রম করবে, পুনরায় প্রথম দল এসে তার সাথে এরূপ করতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যমত্ম না মানুষের বিচার ফায়সালা শেষ হয়ে যায়। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৬০; নাসাঈ, হা/২৪৪০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৫২৯; মিশকাত, হা/১৭৭৫।]

মহিষ ও ভেড়ার যাকাত :

হাদীসে যেসব পশুর উপর যাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে মহিষের কথা পৃথকভাবে উল্লেখ নেই। তবে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, গরু ও মহিষ একই জাতবিশিষ্ট। সুতরাং গরুর উপর যেভাবে যাকাত আদায় করা ফরয, ঠিক তেমনিভাবে মহিষের উপরও যাকাত আদায় করা ফরয এবং উভয়টিই একই নিসাবের অমত্মর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে ভেড়াও ছাগলের অমত্মর্ভুক্ত।

ঘোড়ার যাকাত :

ঘোড়া হচ্ছে এক ধরনের গৃহপালিত পশু। কিমত্মু তা সত্ত্বেও এর উপর যাকাত আদায় করা ফরয নয়। কেননা হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : لَيْسَ عَلَى الْمُسْلِمِ صَدَقَةٌ فِيْ عَبْدِه ، وَلَا فَرَسِه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী ﷺ হতে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মুসলমানদের উপর তাদের গোলাম ও ঘোড়ার যাকাত নেই। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৬৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৬৫৪; মিশকাত, হা/১৭৯৫।]

১০০
পশুর প্রকারভেদ
যাকাত আদায়কে কেন্দ্র করে পশু কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-

১) সায়েমা তথা বছরের বেশিরভাগ সময় বৈধ ঘাসের মাঠে ও চারণভূমিতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে যে পশুগুলো জীবিকা নির্বাহ করে এবং সেগুলোকে বংশবৃদ্ধি ও দুগ্ধ আহরণের জন্য লালন-পালন করা হয়, সেগুলোকে সায়েমা বলে। এসব পশুর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয।

২) যেসব পশু বংশবৃদ্ধি ও দুগ্ধ আহরণের জন্য লালন-পালন করা হয় ঠিকই, কিমত্মু বছরের বেশির ভাগ সময় নিজেরা মাঠে বিচরণ করে ঘাস-পানি খায় না; বরং মালিককে খাদ্য ক্রয় করে বা কেটে এনে খাওয়াতে হয়। এসব পশুর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয নয়।

৩) যেসব পশু বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন- গাড়ি চালানো, পিঠে বোঝা বহন করা, সওয়ার হওয়া, কৃষি কাজে ব্যবহার করা, হালচাষ করা ও পানি উত্তোলন করা ইত্যাদি। অধিকাংশ আলেমের মতে এসব পশুর উপর যাকাত আদায় করা ফরয হবে না।

৪) যেসব পশু ব্যবসার জন্য প্রতিপালন করা হয়, সেগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এর উপর যাকাত সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, বরং মূল্যের ভিত্তিতে ধার্য হবে। এক্ষেত্রে পশুর মালিক পশুর নির্ধারিত মূল্যকে তার মালিকানাধীন নগদ অর্থ ও ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্যের সাথে যোগ করে মোট মূল্যের ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবে।

১০১
গৃহপালিত পশুর উপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য শর্তসমূহ
১. নিসাব পরিমাণ হওয়া :

যাকাত আদায়ের প্রধান শর্তই হচ্ছে সম্পদ নিসাব পরিমাণ হওয়া। যদি নিসাব সংখ্যক পশু থেকে একটিও কম থাকে, তাহলে যাকাত ফরয হবে না। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ اَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيَّ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : لَيْسَ فِيْمَا دُوْنَ خَمْسِ ذَوْدٍ صَدَقَةٌ مِنَ الْإِبِلِ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, পাঁচের কম সংখ্যক উটের মধ্যে কোন যাকাত নেই। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৪৭; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৫৭৭।]

২. পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া :

এসব পশুর উপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য আরো একটি শর্ত হচ্ছে, পশু ব্যক্তির মালিকানায় আসার দিন থেকে নিয়ে পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত করতে হবে; নতুবা যাকাত ফরয হবে না। কেননা হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ ، قَالَتْ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ : لَا زَكَاةَ فِيْ مَالٍ حَتّٰى يَحُوْلَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, সম্পদের মালিকানা এক বছর অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত এর উপর যাকাত আরোপিত হয় না। [ইবনে মাজাহ, হা/১৭৯২; মুসনাদুল বাযযার, হা/৩০৪; দার কুতনী, হা/১৮৮৯; জামেউস সগীর, হা/১৩৪৫৪।]

৩. কাজে ব্যবহৃত পশু না হওয়া :

যেসব গৃহপালিত পশু চাষাবাদের কাজে, পরিবহণের কাজে অথবা অন্য কোন কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে সেসব পশুর উপর যাকাত আদায় করা ওয়াজিব হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَلِىِّ بْنِ أَبِىْ طَالِبٍ أَنَّ النَّبِىَّ - - قَالَ : لَيْسَ فِى الْخَضْرَاوَاتِ صَدَقَةٌ وَلَا فِى الْعَرَايَا صَدَقَةٌ وَلَا فِى أَقَلَّ مِنْ خَمْسَةِ اَوْسُقٍ صَدَقَةٌ وَّلَا فِى الْعَوَامِلِ صَدَقَةٌ وَّلَا فِى الْجَبْهَةِ صَدَقَةٌ . قَالَ الْصَقْرُ الْجَبْهَةُ الْخَيْلُ وَالْبِغَالُ وَالْعَبِيْدُ

আলী ইবনে আবি তালেব (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, শাক-সবজিতে যাকাত নেই, আরিয়াতে যাকাত নেই, পাঁচ ওয়াসাকের কমে যাকাত নেই, কাজে নিয়োজিত পশুতে যাকাত নেই এবং যাবহাতেও যাকাত নেই। সাকার বলেন, জাবহা অর্থ হল, ঘোড়া, খচ্ছর এবং দাস-দাসী। [সুনানে দার কুতনী, হা/১৯৩০; মিশকাত, হা/১৮১৩।]

৪. সায়েমা হওয়া :

সায়েমা এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বিচরণশীল। ইসলামী পরিভাষায় সায়েমা বলা হয় ঐসব পশুকে, যেগুলো বছরের অধিকাংশ সময় চারণভূমিতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে এবং সেগুলোকে কেবল বংশবৃদ্ধি ও দুগ্ধ দোহনের জন্য লালন-পালন করা হয়।

সুতরাং কোন মালিক যদি বছরের অধিকাংশ সময় নিজে খাদ্য সংগ্রহ করে পশুকে খাওয়ায়, তাহলে ঐ পশুর উপর যাকাত ওয়াজিব হবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

وَفِيْ صَدَقَةِ الْغَنَمِ فِيْ سَائِمَتِهَا اِذَا كَانَتْ اَرْبَعِيْنَ اِلٰى عِشْرِيْنَ وَمِئَةٍ شَاةٌ

বিচরণশীল ছাগলের যাকাত চল্লিশটি হতে একশত বিশটি পর্যমত্ম একটি ছাগল। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৫৪; নাসাঈ, হা/২৪৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৬১; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১২৭; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৪৯৯; মিশকাত, হা/১৭৯৬।]

অন্য হাদীসে তিনি বলেন,

فِيْ كُلِّ اِبِلٍ سَائِمَةٍ فِيْ كُلِّ اَرْبَعِيْنَ ابْنَةُ لَبُوْنٍ

বিচরণশীল প্রত্যেক ৪০টি উটে একটি বিনতু লাবুন [বিনতু লাবুন বলা হয় ঐ উটকে, যার বয়স দু’বছর অতিক্রম করে তৃতীয় বছরে পদার্পণ করেছে।]। [নাসাঈ, হা/২৪৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০০৩০; মুসনাদে দারেমী, হা/১৭১৯।]

১০২
গৃহপালিত পশুর যাকাতের নিসাব
হাদীসের আলোকে উট, গরু ও ছাগলের যাকাত ছকের মাধ্যমে দেখানো হল :

১০৩
উটের যাকাতের নিসাব
নিসাব

সংখ্যা

পরিমাণ

৫টি

(এর কম হলে যাকাত ফরয নয়)

১ থেকে ৪ পর্যমত্ম

কোন যাকাত দিতে হবে না

৫ থেকে ৯ পর্যমত্ম

১টি ছাগল

১০ থেকে ১৪ পর্যমত্ম

২টি ছাগল

১৫ থেকে ১৯ পর্যমত্ম

৩টি ছাগল

২০ থেকে ২৪ পর্যমত্ম

৪টি ছাগল

২৫ থেকে ৩৫ পর্যমত্ম

দুই বছর বয়সের ১টি স্ত্রী উট

৩৬ থেকে ৪৫ পর্যমত্ম

তিন বছর বয়সের ১টি স্ত্রী উট

৪৬ থেকে ৬০ পর্যমত্ম

চার বছর বয়সের ১টি স্ত্রী উট

৬১ থেকে ৭৫ পর্যমত্ম

পাঁচ বছর বয়সের ১টি স্ত্রী উট

৭৬ থেকে ৯০ পর্যমত্ম

২ থেকে ৩ বছর বয়সের ২টি স্ত্রী উট

৯১ থেকে ১২০ পর্যমত্ম

৩ থেকে ৪ বছর বয়সের ২টি স্ত্রী উট

যখন উটের সংখ্যা ১২০ এর বেশি হবে, তখন প্রতি ৪০টির জন্য ৩ বছর বয়সের ১টি স্ত্রী উট এবং প্রতি ৫০টি উটের জন্য ৪ বছর বয়সের ১টি স্ত্রী উট দিতে হবে।

১০৪
গরুর যাকাতের নিসাব
নিসাব

সংখ্যা

পরিমাণ

৩০টি

(এর কম হলে যাকাত ফরয নয়)

১ থেকে ২৯ পর্যমত্ম

কোন যাকাত দিতে হবে না

৩০ থেকে ৩৯ পর্যমত্ম

১টি ১ বছর বয়সের ষাঁড়

৪০ থেকে ৫৯ পর্যমত্ম

১টি ২ বছর বয়সের গাভী

৬০ থেকে ৬৯ পর্যমত্ম

২টি ১ বছর বয়সের ষাঁড় বা গাভী

৭০ থেকে ৭৯ পর্যমত্ম

১টি ২ বছর বয়সের গাভী এবং একটি ১ বছর বয়সের ষাঁড়

৮০ থেকে ৮৯ পর্যমত্ম

২টি ২ বছর বয়সের গাভী

৯০ থেকে ৯৯ পর্যমত্ম

৩টি ১ বছর বয়সের গাভী

১০০ থেকে ১০৯ পর্যমত্ম

১টি ২ বছর বয়সের গাভী এবং ২টি ১ বছর বয়সের ষাঁড়

১১০ থেকে ১১৯ পর্যমত্ম

২টি ২ বছর বয়সের গাভী এবং ১টি ১ বছর বয়সের ষাঁড়

১২০ থেকে ১২৯ পর্যমত্ম

৩টি ২ বছর বয়সের গাভী এবং ৪টি ১বছর বয়সের ষাঁড়

এরপর প্রত্যেক ৩০টি গরুর জন্য ১ বছরের ১টি গরু এবং প্রত্যেক ৪০টি গরুর জন্য ২ বছরের ১টি গরু যাকাত দিতে হবে।

১০৫
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার যাকাতের নিসাব
নিসাব

সংখ্যা

পরিমাণ

৪০টি

(এর কম হলে যাকাত ফরয নয়)

১ থেকে ৩৯ পর্যমত্ম

কোন যাকাত দিতে হবে না

৪০ থেকে ১২০ পর্যমত্ম

১টি ছাগল/ভেড়ী/দুম্বা

১২১ থেকে ২০০ পর্যমত্ম

২টি ছাগল/ভেড়ী/দুম্বা

২০১ থেকে ৩০০ পর্যমত্ম

৩টি ছাগল/ভেড়ী/দুম্বা

এর পর প্রতি ১০০টি অতিরিক্ত ছাগল/ভেড়ী/দুম্বার জন্য একটি ছাগল/ভেড়ী/দুম্বা যাকাত বাবদ গণ্য হবে।

১০৬
যেসব পশু দ্বারা যাকাত আদায় করা হবে সেসব পশুর বৈশিষ্ট্যসমূহ
গৃহপালিত পশুর যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি লক্ষ্য করা অত্যাবশ্যক। যেমন-

১। দোষত্রুটি মুক্ত হওয়া :

যেসব পশু দ্বারা যাকাত আদায় করা হবে, সেসব পশুকে অবশ্যই এমন দোষ হতে মুক্ত হতে হবে, যা দ্বারা কুরবানী বৈধ নয়। যেমন- রোগাক্রামত্ম হওয়া, অঙ্গহীন হওয়া, জীর্ণশীর্ণ হওয়া, লেংড়া হওয়া, কানা হওয়া ইত্যাদি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَلَسْتُمْ بِاٰخِذِيْهِ اِلَّاۤ اَنْ تُغْمِضُوْا فِيْهِؕ وَاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য যা বের করেছি তার মধ্য হতে পবিত্র জিনিসসমূহ দান করো। আর তোমরা খারাপ জিনিস দান করার ইচ্ছা করো না। কেননা অন্ধ না হলে তোমরা নিজেরাই তো সেটা গ্রহণ করতে চাও না। জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ সম্পদশালী ও প্রশংসিত। (সূরা বাকারা- ২৬৭)

তাছাড়া হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مُعَاوِيَةَ الْغَاضِرِىِّ - قَالَ قَالَ النَّبِىُّ -- : ثَلَاثٌ مَنْ فَعَلَهُنَّ فَقَدْ طَعِمَ طَعْمَ الْإِيْمَانِ مَنْ عَبَدَ اللهَ وَحْدَه وَاَنَّه لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَاَعْطٰى زَكَاةَ مَالِه طَيِّبَةً بِهَا نَفْسُه رَافِدَةً عَلَيْهِ كُلَّ عَامٍ وَلَا يُعْطِى الْهَرِمَةَ وَلَا الدَّرِنَةَ وَلَا الْمَرِيْضَةَ وَلَا الشَّرَطَ اللَّئِيْمَةَ وَلٰكِنْ مِنْ وَسَطِ اَمْوَالِكُمْ فَاِنَّ اللهَ لَمْ يَسْأَلْكُمْ خَيْرَه وَلَمْ يَأْمُرْكُمْ بِشَرِّه

আবদুল্লাহ ইবনে মুয়াবিয়া আল-গাযিরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, তিন ধরনের লোক যারা এরূপ করবে, তারা পরিপূর্ণ ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে- (১) যে ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহরই ইবাদাত করে। (২) আর যে ব্যক্তি স্বীকার করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। (৩) যে ব্যক্তি প্রত্যেক বছর তার সম্পদের যাকাত হিসেবে উত্তম সম্পদ প্রদান করে এবং বৃদ্ধ বয়সের, রোগাক্রামত্ম, ত্রুটিপূর্ণ, নিকৃষ্ট সম্পদ প্রদান করে না, বরং মধ্যম মানের সম্পদ প্রদান করে। আল্লাহ তোমাদের নিকট তোমাদের উত্তম মাল চান না এবং নিকৃষ্ট মাল প্রদান করতেও নির্দেশ দেননি। [আবু দাউদ, হা/১৫৮৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১০৪৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৫০।]

২। পশু মধ্যম মানের হওয়া :

যেসব পশু দ্বারা যাকাত আদায় করা হবে, সেসব পশুকে অবশ্যই মধ্যম মানের হতে হবে। সুতরাং যেমনিভাবে বাছাই করে অতি উত্তম মানের পশুগুলো যাকাত হিসেবে গ্রহণ করা যাকাত আদায়কারীর জন্য বৈধ নয়, ঠিক তেমনিভাবে বাছাই করে কেবল দুর্বল ও নিকৃষ্ট পশুগুলো দ্বারা যাকাত আদায় করাও মালিকের জন্য বৈধ নয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামানের শাসক নিয়োগ করে পাঠানোর সময় বলেছিলেন,

فَاِنْ هُمْ اَطَاعُوْا لَكَ بِذٰلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ اَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ اَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلٰى فُقَرَائِهِمْ، فَاِنْ هُمْ اَطَاعُوْا لَكَ بِذٰلِكَ فَاِيَّاكَ وَكَرَائِمَ اَمْوَالِهِمْ، وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُوْمِ، فَاِنَّه لَيْسَ بَيْنَه وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ

যদি তারা তোমার এ কথা স্বীকার করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে সংগৃহীত হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। যদি তারা তোমার এ কথাও স্বীকার করে, তবে তাদের ভালো ভালো সম্পদগুলো গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। আর তুমি মাযলুমদের অভিশাপকে ভয় করবে; কেননা মাযলুম ও আল্লাহর মাঝখানে কোন প্রতিবন্ধক নেই (তারা যা দু‘আ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তা কবুল করবেন)। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৯৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৩০; আবু দাউদ, হা/১৫৮৬;তিরমিযী, হা/৬২৫; নাসাঈ, হা/২৫২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৭১; সুনানে দার কুতনী, হা/২০৫৮; সুনানে দারেমী, হা/১৬১৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৫২৬; মিশকাত, হা/১৭৭২।]

তবে মালিক যদি ইচ্ছা করে তাহলে সে স্বতঃষ্ফূর্তভাবে বাছাই করে কেবল উত্তম সম্পদ দ্বারা যাকাত আদায় করতে পারবে। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ حَدَّثَه أَنَّ أَبَا بَكْرٍ كَتَبَ لَه ﴿ الصَّدَقَةَ ﴾ اَلَّتِيْ أَمَرَ اللهُ رَسُوْلَه   وَلَا يُخْرَجُ فِيْ الصَّدَقَةِ هَرِمَةٌ ، وَلَا ذَاتُ عَوَارٍ ، وَلَا تَيْسٌ إِلَّا مَا شَاءَ الْمُصَدِّقُ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের প্রতি যাকাতের যে বিধান দিয়েছেন তা আবু বকর (রাঃ) আনাস (রাঃ) এর নিকট লিখে পাঠান। তাতে লিখা ছিল যে, অধিক বয়সের দাঁত পড়া বৃদ্ধ ও ত্রুটিযুক্ত বকরী এবং পাঁঠা যাকাত হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। তবে যাকাত প্রদানকারী ইচ্ছা করলে (পাঁঠা) দিতে পারেন। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৫৫; সুনানে দার কুতনী, হা/১৯৮৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৫০২; মিশকাত, হা/১৭৯৬।]

১০৭
যাকাত আদায় করার জন্য নির্ধারিত পশু পাওয়া না গেলে করণীয়
যদি মালিকের কাছে নির্দিষ্ট বয়সের পশু পাওয়া না যায়, তাহলে এর করণীয় সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,

عنْ أَنَسٍ أَنَّ أَبَا بَكْرٍ كَتَبَ لَه فَرِيْضَةَ الصَّدَقَةِ الَّتِيْ اَمَرَ اللهُ رَسُوْلَه   مَنْ بَلَغَتْ عِنْدَه مِنَ الْإِبِلِ صَدَقَةُ الْجَذَعَةِ وَلَيْسَتْ عِنْدَه جَذَعَةٌ وَّعِنْدَه حِقَّةٌ فَاِنَّهَا تُقْبَلُ مِنْهُ الْحِقَّةُ وَيَجْعَلُ مَعَهَا شَاتَيْنِ اِنِ اسْتَيْسَرَتَا لَه , اَوْ عِشْرِيْنَ دِرْهَمًا . وَمَنْ بَلَغَتْ عِنْدَه صَدَقَةُ الْحِقَّةِ وَلَيْسَتْ عِنْدَهُ الْحِقَّةُ وَعِنْدَهُ الْجَذَعَةُ، فَاِنَّهَا تُقْبَلُ مِنْهُ الْجَذَعَةُ، وَيُعْطِيْهِ الْمُصَدِّقُ عِشْرِيْنَ دِرْهَمًا اَوْ شَاتَيْنِ . وَمَنْ بَلَغَتْ عِنْدَه صَدَقَةُ الْحِقَّةِ وَلَيْسَتْ عِنْدَه اِلَّا بِنْتُ لَبُوْنٍ فَاِنَّهَا تُقْبَلُ مِنْهُ بِنْتُ لَبُوْنٍ وَيُعْطِيْ شَاتَيْنِ اَوْ عِشْرِيْنَ دِرْهَمًا، وَمَنْ بَلَغَتْ صَدَقَتُه بِنْتَ لَبُوْنٍ وَّعِنْدَه حِقَّةٌ فَاِنَّهَا تُقْبَلُ مِنْهُ الْحِقَّةُ وَيُعْطِيْهِ الْمُصَدِّقُ عِشْرِيْنَ دِرْهَمًا اَوْ شَاتَيْنِ، وَمَنْ بَلَغَتْ صَدَقَتُه بِنْتَ لَبُوْنٍ وَلَيْسَتْ عِنْدَه وَعِنْدَه بِنْتُ مَخَاضٍ، فَاِنَّهَا تُقْبَلُ مِنْهُ بِنْتُ مَخَاضٍ وَيُعْطِيْ مَعَهَا عِشْرِيْنَ دِرْهَمًا اَوْ شَاتَيْنِ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে সাদাকার (যাকাতের) পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারে যে আদেশ করেছিলেন আবু বকর (রাঃ) তা তাকে (আনাসকে) লিখে পাঠিয়েছিলেন। (তার মাঝে এটাও ছিল যে) যার উটের সংখ্যা এত হয়েছে যে, (তার উপর) একটি পাঁচ বছর বয়সের উষ্ট্রী যাকাত বাবদ ওয়াজিব হয় অথচ তার কাছে সেটা নেই, বরং তার কাছে আছে চার বছর বয়সের উষ্ট্রী, তবে চার বছর বয়সের উষ্ট্রীই তার নিকট হতে নেয়া হবে এবং তাকে এর সঙ্গে (অতিরিক্ত) দুটি বকরী দিতে হবে- যদি এটা তার কাছে সহজসাধ্য হয়, অথবা বিশ দিরহাম (দিতে হবে)। আর যার উটের সংখ্যা এত হয়েছে যে, যাকাত বাবদ তার উপর একটি চার বছর বয়সের উষ্ট্রী ওয়াজিব, অথচ তার কাছে চার বছর বয়সের উষ্ট্রী নেই, বরং তার কাছে রয়েছে পাঁচ বছর বয়সের উষ্ট্রী, তবে পাঁচ বছর বয়সের উষ্ট্রীই তার নিকট হতে নেয়া হবে এবং যাকাত আদায়কারী তাকে বিশ দিরহাম অথবা দুটি বকরী দিয়ে দেবে। আর যার উটের সংখ্যা এত হয়েছে যে, যাকাত বাবদ তার উপর একটি চার বছর বয়সের উষ্ট্রী ওয়াজিব, অথচ তার কাছে তিন বছর বয়সের উষ্ট্রী ব্যতীত আর কিছু নেই, তবে তার নিকট হতে তিন বছর বয়সের উষ্ট্রীই নেয়া হবে এবং এর সঙ্গে দুটি বকরী অথবা বিশ দিরহাম নিতে হবে। অনুরূপভাবে যার উপর যাকাত বাবদ একটি তিন বছর বয়সের উষ্ট্রী ওয়াজিব হয়, অথচ তার কাছে চার বছর বয়সের উষ্ট্রী থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে চার বছর বয়সের উষ্ট্রীই নেয়া হবে এবং যাকাত আদায়কারী তাকে বিশ দিরহাম অথবা দুটি বকরী দেবে। আর যার উপর যাকাত বাবদ একটি তিন বছর বয়সের উষ্ট্রী ওয়াজিব হয়, অথচ তা তার কাছে নেই, বরং তার কাছে দুই বছর বয়সের উষ্ট্রী থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে দুই বছর বয়সের উষ্ট্রীই নেয়া হবে এবং এর সাথে বিশ দিরহাম অথবা দুটি বকরী (অতিরিক্ত) নিতে হবে। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৫৩; আবু দাউদ, হা/১৫৬৯; নাসাঈ, হা/২৪৪৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৮১; মিশকাত, হা/১৭৯৬।]

১০৮
ওশর (ভূমি থেকে উৎপন্ন ফসলের যাকাত)
মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ নিয়ামত হচ্ছে, জমিন থেকে বিভিন্ন ধরনের ফসলের ব্যবস্থা করা, যা দ্বারা তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَهُوَ الَّذِيْۤ اَنْشَاَ جَنَّاتٍ مَّعْرُوْشَاتٍ وَّغَيْرَ مَعْرُوْشَاتٍ وَّالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا اُكُلُهٗ وَالزَّيْتُوْنَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَّغَيْرَ مُتَشَابِهٍ كُلُوْا مِنْ ثَمَرِهٖۤ اِذَاۤ اَثْمَرَ وَاٰتُوْا حَقَّهٗ يَوْمَ حَصَادِهٖ وَلَا تُسْرِفُوْاؕ اِنَّهٗ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْنَ﴾

আল্লাহ ঐ সত্তা, যিনি নানা প্রকারের উদ্যান বানিয়েছেন, কিছু লতা-গুল্ম, যা কোন কান্ড ছাড়াই মাচানের উপর তুলে রাখা হয়েছে, (আবার কিছু গাছ), যা মাচানের উপর তুলে রাখা হয়নি (স্বীয় কান্ডের উপর তা এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আরো সৃষ্টি করেছেন), খেজুর গাছ এবং বিভিন্ন (স্বাদ ও) প্রকারবিশিষ্ট খাদ্যশস্য ও আনার। এগুলো (স্বাদে-গন্ধে) এক রকমও হতে পারে, আবার ভিন্ন ধরনেরও হতে পারে, যখন তা ফলবান হয় তোমরা তার ফল খাও, আর তোমরা ফসল তোলার দিন তার হক আদায় করো। আর তোমরা কখনো অপচয় করো না; নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা আন‘আম- ১৪১)

আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে এসব নিয়ামত প্রদানের পর এর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ এর থেকে নির্দিষ্ট একটি অংশ দান করতে বলেছেন। তিনি বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَلَسْتُمْ بِاٰخِذِيْهِ اِلَّاۤ اَنْ تُغْمِضُوْا فِيْهِؕ وَاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য যা বের করেছি তার মধ্য হতে পবিত্র জিনিসসমূহ দান করো। আর তোমরা খারাপ জিনিস দান করার ইচ্ছা করো না। কেননা অন্ধ না হলে তোমরা নিজেরাই তো সেটা গ্রহণ করতে চাও না। জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ সম্পদশালী ও প্রশংসিত। (সূরা বাকারা- ২৬৭)

১০৯
যেসব ফসলের উপর যাকাত আদায় করা আবশ্যক
হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ إِنَّمَا سَنَّ رَسُوْلُ اللهِ - - اَلزَّكَاةَ فِى هٰذِهِ الْأَرْبَعَةِ الْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالزَّبِيْبِ وَالتَّمْرِ

উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ গম, যব, কিসমিস এবং খেজুর এই চারটি শস্যের যাকাত প্রবর্তন করেছেন। [সুনানে দার কুতনী, হা/১৯৩৬; জামেউস সগীর, হা/৫৮৯৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৮৭৯।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ مُوسَى بْنِ طَلْحَةَ ، قَالَ : عِنْدَنَا كِتَابُ مُعَاذٍ ، عَنِ النَّبِيِّ  : أَنَّه إِنَّمَا أَخَذَ الصَّدَقَةَ مِنَ الْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالزَّبِيْبِ وَالتَّمْرِ

মূসা ইবনে তালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক মু‘আয (রাঃ) এর নিকট প্রেরিত পত্র আমাদের নিকট ছিল। যাতে তিনি গম, যব, কিসমিস ও খেজুরের যাকাত গ্রহণ করেছেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০৪১; সুনানে দার কুতনী, হা/১৯১৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৭২৩; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪৫৭; মিশকাত, হা/১৮০৩।]

উল্লেখিত হাদীসদ্বয়ে বর্ণিত চারটি শস্যের যাকাতের কথা বলা হলেও এই চারটিকেই নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং ওজন ও গুদামজাত সম্ভব সকল শস্যই এর অমত্মর্ভুক্ত। যেমন ধান, ভুট্টা ইত্যাদি।

ভূমি থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ও ফল-মূলের মধ্যে ওশর দেয়া ওয়াজিব হবে কি না- এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কতক উলামায়ে কেরামের মত হচ্ছে, শাক-সবজি ও ফল-মূল অর্থাৎ যেসব জিনিস গুদামজাত করা যায় না এবং স্থায়ী থাকে না, তাতে যাকাত আসবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন,

عَنْ مُوسَى بْنِ طَلْحَةَ ، عَنْ أَبِيهِ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ  : لَيْسَ فِي الْخُضْرَوَاتِ صَدَقَةٌ .

মূসা ইবনে তালহা (রহ.) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, শাক-সবজিতে কোন যাকাত (ওশর) নেই। [মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৪০; জামেউস সগীর, হা/৯৫৪২।]

আবার কতক উলামায়ে কেরাম মনে করেন, শাক-সবজি ও ফল-মূলের মধ্যেও ওশর ওয়াজিব হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার বাণী হচ্ছে,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ﴾

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য যা বের করেছি তার মধ্য হতে পবিত্র জিনিসসমূহ দান করো। (সূরা বাকারা- ২৬৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَاٰتُوْا حَقَّهٗ يَوْمَ حَصَادِهٖ وَلَا تُسْرِفُوْاؕ اِنَّهٗ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْنَ﴾

আর তোমরা ফসল তোলার দিন তার হক আদায় করো এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আন‘আম- ১৪১)

উক্ত আয়াতে ব্যাপকভাবে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, জমি থেকে যা উৎপন্ন হয়, তার হক আদায় করতে হবে। এখানে কোন কিছুকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়নি। সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ গ্রন্থকার এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

১১০
উৎপাদিত ফসলের নিসাব
ফসলের যাকাত আদায়ের জন্য সর্বনিম্ন পরিমাণ হচ্ছে পাঁচ ওয়াসাক। পাঁচ ওয়াসাকের কম পরিমাণ কোন ফসলের উপর যাকাত ফরয নয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيَّ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : ....... وَلَيْسَ فِيْمَا دُوْنَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, পাঁচ ওয়াসাকের কম পরিমাণ (শস্য ও ফল) যাকাতের জন্য গণনা করা হয় না। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৫৭৭; সহীহ বুখারী, হা/১৪৪৭, সহীহ মুসলিম, হা/২৩১০, আবু দাউদ, হা/১৫৬০, নাসাঈ, হা/২৪৪৫, ইবনে মাজাহ, হা/১৭৯৪; তিরমিযী, হা/৬২৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১০৪৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৯৪; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৯৭৯; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/৭২৪৯; মুসনাদে দারেমী, হা/১৬৭৪।]

উল্লেখ্য যে, ১ ওয়াসাক = ৬০ সা‘। অতএব ৫ ওয়াসাক = ৬০ × ৫ = ৩০০ সা‘। সুতরাং ১ সা‘ = ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হলে, ৩০০ সা‘ = ৩০০ × ২.৫ = ৭৫০ কেজি অর্থাৎ ১৮ মণ ৩০ কেজি।

অতএব কেউ যদি উপরোক্ত পরিমাণ ফসল পায়, তাহলে নিম্নে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী যাকাত বের করতে হবে :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : فِيْمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالْعُيُوْنُ ،اَوْ كَانَ عَثَرِيًّا اَلْعُشْرُ وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূল ﷺ বলেছেন, বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানির সাহায্যে পরিচালিত সেঁচ কার্য কিংবা ভূ-গর্ভস্থ পানি দ্বারা চালিত চাষাবাদের ক্ষেত্রে যাকাতের পরিমাণ হবে এক দশমাংশ এবং যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরিচালিত সেঁচকার্যের ক্ষেত্রে যাকাতের পরিমাণ হবে এক-দশমাংশের অর্ধেক। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৮৩; তিরমিযী, হা/৬৩৯; ইবনে মাজাহ, হা/১৮১৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩০৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩২৮৫; দার কুতনী, হা/২০৩৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২৯৩৩; বায়হাকী, হা/৭২৭৬; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৫৮০; জামেউস সগীর, হা/৭৭২১; মিশকাত, হা/১৭৯৭।]

অতএব, ব্যয়হীন তথা বৃষ্টির পানি, নদী বা খালের পানি ইত্যাদির মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের যাকাতের পরিমাণ হবে ওশর তথা ১০ ভাগের ১ ভাগ বা ১০%। আর ব্যয়বহুল তথা কূপ খনন করে পানি সংগ্রহ করা বা সেঁচ ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের যাকাতের পরিমাণ হবে নিস্ফুল ওশর তথা ২০ ভাগের ১ ভাগ বা ৫%।

১১১
বৃষ্টির পানি ও কৃত্রিম সেঁচ উভয়ের সমন্বয়ে উৎপাদিত ফসলের যাকাত
যেসব ফসল কেবল বৃষ্টির পানি অথবা কেবল কৃত্রিম সেঁচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় না; বরং কিছু অংশ বৃষ্টির পানিতে এবং কিছু অংশ কৃত্রিম সেঁচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, সেসব ফসলের যাকাত বের করার নিয়ম হল, যদি বৃষ্টির পানির পরিমাণ বেশি হয় তাহলে ১০ ভাগের ১ ভাগ তথা ১০% যাকাত দিতে হবে। আর যদি কৃত্রিম সেঁচের পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে ২০ ভাগের ১ ভাগ তথা ৫% যাকাত দিতে হবে।

আর যদি ফসলের অর্ধেক অংশ বৃষ্টির পানিতে এবং অর্ধেক অংশ কৃত্রিম সেঁচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, তাহলে ৭.৫০% যাকাত দিতে হবে। [ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৫৪ পৃঃ ; নায়লুল আওতার ৪/২০১।]

১১২
ফসলের যাকাত কখন আদায় করবে
শস্য ও ফলের উপর যাকাত নিসাব পূর্ণ হলে তার উপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বরং ফসল কাটার সময় যদি উৎপাদিত শস্য নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে যাকাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ফসল কাটার দিনই এর যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿ وَاٰتُوْا حَقَّهٗ يَوْمَ حَصَادِهٖ وَلَا تُسْرِفُوْاؕ اِنَّهٗ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِيْنَ﴾

আর তোমরা ফসল তোলার দিন তার হক আদায় করো এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আন‘আম- ১৪১)

কাজেই একই বছরে জমিতে যতবার ফসল উৎপন্ন হবে ততবারই যাকাত আদায় করতে হবে।

ফল ও শস্য যখনই পরিপক্ব হয় তখনই তার উপর যাকাত ধার্য হয়। ফসল সংগ্রহ করার আগেই যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার উপর যাকাত ধার্য হবে না। জমির মালিক মারা গেলেও তার উত্তরাধিকারীকে যাকাত পরিশোধ করতে হবে।

সমজাতীয় ফসল একত্র করে পরিমাপ করা যাবে। যেমন- ধানের ক্ষেত্রে মিনিকেট, আঠাশ, উনত্রিশ, স্বর্ণ, চায়না, পারিজা ইত্যাদি। তবে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফসল পৃথকভাবে পরিমাপ করতে হবে। যেমন- ধান, গম ইত্যাদি। [সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ২/৪৫ পৃঃ।]

১১৩
যাকাত আদায়ের সময় চাষাবাদের খরচ বাদ যাবে
জমি চাষ, বীজ বপন, চারা রোপণ, সার প্রয়োগ এবং শস্য কর্তন সম্পর্কিত সমুদয় খরচ বাদ দিয়ে কৃষিপণ্যের উপর যাকাত আদায় করতে হবে। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,

يَقْضِى مَا أَنْفَقَ عَلَى الثَّمَرَةِ ، ثُمَّ يُزَكِّى مَا بَقِىَ

প্রথমে ফল উৎপাদনের জন্য যা ব্যয় করেছে তা পরিশোধ করবে, অতঃপর অবশিষ্টাংশের যাকাত আদায় করবে। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৬৮৫৮; মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/২৫১১।]

উল্লেখ্য যে, শস্য উৎপাদনের জন্য যদি কেউ ঋণ নিয়ে থাকে, তাহলে শস্য কর্তনের পরে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট শস্যের যাকাত আদায় করবে। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন,

يَبْدَأُ بِمَا اسْتَقْرَضَ فَيَقْضِيهِ وَيُزَكِّى مَا بَقِىَ

প্রথমে যে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধ করবে। অতঃপর অবশিষ্টাংশের যাকাত আদায় করবে। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৮৫৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১০১৯২।]

১১৪
ভাড়াকৃত জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাত
ভাড়া গ্রহীতাকে ভাড়াকৃত জমিতে উৎপাদিত ফসলের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। আর জমির মালিক জমির ভাড়াকে তার মালিকানাধীন নগদ অর্থসহ অন্যান্য সম্পদের মূল্যের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করবে।

১১৫
ভাগে চাষাবাদকৃত জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাত
যদি জমির মালিক নিজেই চাষ করে, তাহলে মালিকই উৎপাদিত ফসলের যাকাত প্রদান করবে। কিমত্মু যদি কেউ অপরের জমি নির্দিষ্ট চুক্তিতে ভাগে চাষাবাদ করে, তাহলে উৎপাদিত ফসল থেকে উভয়ের অংশ পৃথক করার পর যার অংশ নিসাব পরিমাণ হবে তাকে যাকাত প্রদান করতে হবে এবং যার অংশ নিসাব পরিমাণ হবে না, তাকে যাকাত প্রদান করতে হবে না।

১১৬
খাজনার জমিতে উৎপাদিত ফসলের যাকাত
যেসব জমির খাজনা দিতে হয়, সেসব জমিতে চাষাবাদ করা হলে তা হতে উৎপাদিত ফসলেরও যাকাত দিতে হবে। কেননা খাজনা ও যাকাত দুটি পৃথক পৃথক বিষয়। খাজনার কারণে যাকাত রহিত হবে না। একদা উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

اَلْخَرَاجُ عَلَى الْأَرْضِ وَفِى الْحَبِّ الزَّكَاةُ

খাজনা হল জমির উপর এবং যাকাত (ওশর) হল ফসলের উপর। [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৭৪৬।]

উল্লেখ্য যে, لَا يَجْتَمِعُ عَلَى الْمُسْلِمِ خَرَاجٌ وَعُشْرٌ ‘‘মুসলিমদের উপর একই সাথে খাজনা ও ওশর একত্রিত হয় না’’- মর্মে বর্ণিত হাদীসটি জাল।

১১৭
খনিজ সম্পদের উপর যাকাত
(ক) ভূ-গর্ভ বা সমুদ্রতল থেকে উত্তোলিত বিভিন্ন রকম খনিজ দ্রব্যকে খনিজ সম্পদ বলে। তরল পেট্রোলিয়াম, কয়লা বা লবণ, বায়বীয় গ্যাস, ধাতব পদার্থ ও লৌহ সবই খনিজ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।

(খ) যাকাতের জন্য খনিজ সম্পদের নিসাবের পরিমাণ স্বর্ণের বা রৌপ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে নিরূপিত হবে।

(গ) খনিজ সম্পদের উপর যাকাত বার্ষিক ভিত্তিতে প্রদান করা হয় না। খনিজ দ্রব্যের উত্তোলিত ও পরিশোধিত অংশের মূল্য নিসাব পরিমাণ পৌঁছলে তাৎক্ষণিকভাবে যাকাত আদায় করতে হবে।

(ঘ) খনিজ সম্পদের উপর যাকাতের হার ২.৫%।

১১৮
মাটির নিচে লুকানো বা গুপ্তধনের উপর যাকাত
যদি কখনো পূর্ববর্তী যুগের মানুষ কর্তৃক লুকায়িত কোন সম্পদ পাওয়া যায়, যার কোন মালিক নেই তাহলে সেসব জিনিসেরও যাকাত প্রদান করতে হবে। এসব সম্পদ ইসলামী পরিভাষায় اَلرِِّكَازِ ‘আর-রিকায’ নামে পরিচিত। এসব জিনিসের যাকাত আদায়ের ব্যাপারে হাদীসে বলা হয়েছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : ... وَفِي الرِّ كَازِ الْخُمُسُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, রিকায পাওয়া গেলে তার এক-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৯৯; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৫৮৫; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৬৫; আবু দাউদ, হা/৩০৮৭; তিরমিযী, হা/৬৪২; নাসাঈ, হা/২৪৯৭; ইবনে মাজাহ, হা/২৫০৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭১২০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩২৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬০০৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭৬৪০; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/৬০৭৫; মুসত্মাখরাজে আবু আওয়ানা, হা/৫১১৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৬৪২; বায়হাকী, হা/৭৪৩৪; মিশকাত, হা/১৭৯৮।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ : الْمَعْدِنُ جُبَارٌ وَالْبِئْرُ جُبَارٌ وَالْعَجْمَاءُ جُبَارٌ وَفِي الرِّكَازِ الْخُمُسُ

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, খনি ও কূপে কাজ করা অবস্থায় কিংবা জন্তু-জানোয়ার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জরিমানা দিতে হবে না। গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। [সহীহ বুখারী, হা/২৩৫৫; মুসনাদুল বাযযার, হা/৭০১৭; সুনানে দার কুতনী, হা/৩৩১০।]

অতএব, এসব সম্পদ পাওয়া গেলে সাথে সাথেই এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়তুল মালে জমা দিতে হবে।

১১৯
ব্যবসায়িক মালের যাকাত
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নিয়োজিত যে কোন ধরনের পণ্যকে ব্যবসায়িক পণ্য বলা হয়। জমি ক্রয়-বিক্রয়, প্লট ব্যবসা, দালান-কোঠা (ফ্ল্যাট ব্যবসা), খাদ্য সামগ্রী ও কৃষি-পণ্য ইত্যাদি যদি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয় হয়, তাহলে সেগুলোও ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

সুতরাং স্থায়ী সম্পত্তি যা প্রতিষ্ঠানকে চালিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় যেমন- কারখানা, দালান-কোঠা, কলকব্জা, যানবাহন, ডেস্ক, আসবাবপত্র, গুদাম, পণ্যদ্রব্য সাজিয়ে রাখার জন্য র‌্যাক বা তাক ইত্যাদির যাকাত আসবে না।

ব্যবসায়িক সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা :

যাকাত নির্ণয় করার সময় বর্তমান বাজারের পাইকারি মূল্যের আলোকেই ব্যবসায়িক সম্পদের মূল্য নির্ধারিত হবে। এক্ষেত্রে বাজারমূল্য ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম না বেশি- তা বিবেচ্য নয়।

১২০
খামারে উৎপাদিত সম্পদের যাকাত
বর্তমান যুগে বিভিন্ন ধরনের খামার গড়ে উঠেছে। যেমন- কৃষি খামার, নার্সারী, হাঁস-মুরগীর খামার, পশু-সম্পদ খামার, দুগ্ধ খামার, মৎস্য খামার, ইত্যাদি। এসব খামার বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হয় বলে ব্যবসায়িক সম্পদ হিসেবে এগুলোর উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে।

ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে খামারে পালিত হাঁস-মুরগি, ডিম ও বাচ্চা ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে যাকাতের আওতাভুক্ত হবে।

ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পশু প্রতিপালন করা হলে সেসকল পশুর বাছুর, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী, মাংস, চামড়া ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং তাতে যাকাত প্রযোজ্য হবে। তাছাড়া মজুদ পশুখাদ্য, ব্যবসার নগদ অর্থ ও অন্যান্য চলতি সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে।

১২১
পাওনা টাকার যাকাত
পাওনা টাকা দু’রকম হতে পারে :

ক) আদায়যোগ্য পাওনা :

যে ঋণ ঋণগ্রহীতা কর্তৃক স্বীকৃত এবং ঋণগ্রহীতা তা পরিশোধ করতে সক্ষম অথবা যদি ঋণ পরিশোধে ঋণগ্রহীতা অস্বীকৃতি জানায়, কিমত্মু তার প্রমাণ রয়েছে এবং আদালতে অভিযুক্ত হলে ঋণ পরিশোধে বাধ্য হবে, তাকে আদায়যোগ্য পাওনা বলে। এরূপ পাওনা মোট সম্পত্তির সাথে যোগ করে যাকাতের আওতাধীন সম্পত্তির পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।

খ) আদায়ের অযোগ্য পাওনা :

ঋণগ্রহীতা যদি দেউলিয়া হয়ে যায়, কিংবা ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায়, কিংবা ঋণের সমর্থনে কোন বৈধ প্রমাণ না থাকে কিংবা ঋণ স্বীকার করলেও ঋণ পরিশোধ করতে অহেতুক গড়িমসি করে তাহলে ঐ ঋণকে আদায়ের অযোগ্য পাওনা বলা হয়। এ ধরনের সন্দেহজনক পাওনা কার্যত আদায় না হওয়া পর্যন্ত যাকাতের আওতায় আসবে না। এ জাতীয় পাওনা আদায় হওয়ার পর মাত্র এক বছরের যাকাত আদায় করতে হবে, এটিই অধিকাংশ আলেমদের অভিমত।

১২২
ঋণগ্রসত্ম ব্যক্তির উপর যাকাত
যদি কোন ব্যক্তি ঋণগ্রসত্ম হয়ে পড়ে, তাহলে প্রথমে তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এরপর যদি দেখা যায় যে, তার অবশিষ্ট সম্পত্তি নিসাব পরিমাণ রয়েছে তাহলে তা থেকে যাকাত দিতে হবে। রমাযান মাস আসলে উসমান (রাঃ) বলতেন,

هٰذَا شَهْرُ زَكَاتِكُمْ فَمَنْ كَانَ عَلَيْهِ دَيْنٌ فَلْيُؤْدِّ دَيْنَه حَتّٰى تَحْصُلَ أَمْوَالُكُمْ فَتُؤَدُّوْنَ مِنْهَا الزَّكَاةَ

এটি (রমাযান) যাকাতের মাস। অতএব যদি কারো উপর ঋণ থাকে, তাহলে সে যেন প্রথমে ঋণ পরিশোধ করে। এরপর অবশিষ্ট সম্পদ নিসাব পরিমাণ হলে তার যাকাত আদায় করবে। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৮৭৩; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৮৫৬]

১২৩
শিশু, ইয়াতীম ও পাগলের মালে যাকাত
যাকাত ফরয হয় মালে। তাই তা ফরয হওয়ার জন্য মালিকের জ্ঞানসম্পন্ন ও সাবালক হওয়া শর্ত নয়। সুতরাং শিশু, ইয়াতীম ও পাগলের মালেও যাকাত আদায় করা ফরয। তাদের পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবক হিসাব করে যাকাত আদায় করবে। এতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে মাল কমতে থাকলেও বাসত্মবে তাদের মালে বরকত বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া অভিভাবকের উচিত, তাদের মাল ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ : اِبْتَغُوْا بِأَمْوَالِ الْيَتَامٰى لَا تَأْكُلُهَا الصَّدَقَةُ

উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমরা ইয়াতীমদের মাল দ্বারা ব্যবসা করো, যাতে সাদাকার মাল তা খেয়ে না ফেলে। [দার কুতনী, হা/১৯৭৩; বায়হাকী, হা/১০৭৬৪।]

উক্ত হাদীসে ইয়াতীমদের মালসমূহ সংরক্ষণ করার অজুহাতে অযথা ফেলে না রেখে ব্যবসা করে বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। যাতে করে এমনটি না হয় যে, উক্ত মালসমূহ থেকে সাদাকা তথা যাকাত দিতে দিতে শেষ হয়ে যায়।

১২৪
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর তা আদায়ের পূর্বে মালিক মৃত্যুবরণ করলে তার হুকুম
যদি কারো উপর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর তা আদায় করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ওয়ারিসদের মধ্যে বণ্টন হওয়ার পূর্বেই তা থেকে যাকাত আদায় করতে হবে। কেননা যাকাত হচ্ছে এক প্রকার ঋণ, যা পরিশোধ করা ওয়াজিব। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : أَتٰى رَجُلٌ النَّبِيَّ فَقَالَ لَهُ إِنَّ أُخْتِيْ نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ وَإِنَّهَا مَاتَتْ فَقَالَ النَّبِيُّ لَوْ كَانَ عَلَيْهَا دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَاقْضِ اللهَ فَهْوَ أَحَقُّ بِالْقَضَاءِ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর নিকট এসে বলল, আমার বোন হজ্জ করতে মানত করেছিলেন। কিমত্মু তা আদায় করার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমার বোনের উপর কারো ঋণ থাকলে তুমি কি তা আদায় করতে না? সে বলল, হ্যাঁ (তা আদায় করতাম)। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তবে আল্লাহর ঋণ আদায় করো। কেননা এটা আদায়ের অধিক হকদার। [সহীহ বুখারী, হা/৬৬৯৯; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৫০; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩৬; মিশকাত, হা/২৬১২।]

অত্র হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মৃত ব্যক্তির ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা ওয়াজিব। আর যাকাত আল্লাহর ঋণের অমত্মর্ভুক্ত।

১২৫
যাকাত ওয়াজিব হয়েছে কিমত্মু তা আদায়ের পূর্বেই বিক্রি করলে তার হুকুম কী হবে
কোন ব্যক্তির উপর যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। কিমত্মু যাকাত আদায়ের পূর্বেই তা বিক্রি করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে উক্ত বিক্রয় বৈধ হবে কি না- এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে সহীহ মত হল, উক্ত বিক্রয় বৈধ। আর এক্ষেত্রে বিক্রেতার উপর উক্ত সম্পদের যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। অর্থাৎ তাকে উক্ত বিক্রয়কৃত সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে।

১২৬
যাকাত না দেয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করা বৈধ নয়
যাকাত আদায় না করার জন্য কৌশল অবলম্বন করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত যাকাত ব্যবস্থাকে মনে-প্রাণে মেনে না নেয়া। অথচ আল্লাহর বিধানকে মেনে নেয়াটাই হচ্ছে ঈমানের পরিচায়ক। তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের নিয়ত অনুযায়ীই তাদের ইবাদাত গ্রহণ করে থাকেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

اِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَاِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَّا نَوٰى

নিশ্চয় প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। [সহীহ বুখারী হা/১; আবু দাউদ, হা/২২০৩; ইবনে মাজাহ, হা/৪২২৭; মিশকাত, হা/১।]

সুতরাং যাকাত আদায় না করার জন্য যে কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করা তথা যাকাত আদায়ের ভয়ে কিছু সম্পদ বিক্রি করে দেয়া অথবা কাউকে হাদিয়া দেয়া অথবা কারো কাছে বন্ধক রাখা, যাতে নিসাব পরিমাণ সম্পদ না হয়- ইত্যাদি কর্মকান্ড বৈধ নয়।

১২৭
কয়েক বছরের যাকাত আদায় না করলে তার হুকুম
না জানার কারণে অথবা গাফলতী করে অথবা বখীলী করে বিগত বছরগুলোতে কেউ যাকাত না দিয়ে থাকলে, সঠিক হিসাব করে বিগত সমসত্ম বছরগুলোর যাকাত আদায় করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে যা চলে গেছে তা মাফ নয়। [ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৬০।]

১২৮
যাকাতের হিসাব বের করার নিয়ম
সম্পদের প্রকারভেদ

টাকা

সোনা, রূপা :

ব্যবহৃত/অব্যবহৃত অলংকার + লকারে রাখা অলংকার ইত্যাদির সম্পূর্ণ অংশ বিক্রি করলে যে দাম পাওয়া যাবে তার বর্তমান মূল্য।

নগদ টাকা : হাতে নগদ + চেক + ডেবিট কার্ডে জমা টাকা।

ব্যাংক একাউন্ট : কারেন্ট + সেভিং + ফিক্সড ডিপোজিট।

সঞ্চয় পত্র + F D R + ইন্স্যুরেন্সকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড + ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম (জমা দেয়া টাকা)।

পাওনা টাকা + বাকিতে বিক্রয় করা মালের পাওনা দাম + ফেরত রাখার পর অবশিষ্ট মালের দাম।

বৈদেশিক মুদ্রার টাকায় পরিবর্তিত পরিমাণ।

ব্যবসায়ের মাল : বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পণ্যের বাজার মূল্য।

বিক্রয়যোগ্য পণ্য, প্রক্রিয়াধীন পণ্য যা কারখানায়/ দোকানে/ গোডাউনে/ বাড়িতে রাখা।

কাঁচামাল, কারখানায়/ দোকানে/ গোডাউনে/ বাড়িতে রাখা।

L/C তে বা অন্য যে কোন খাতে বিনিয়োগকৃত টাকা।

শেয়ারের বাজার মূল্য

যৌথ মালিকানা কারবারের যাকাতযোগ্য সম্পদের অংশ।

মোট সম্পদ : (সোনা + রূপা + নগদ টাকা + ব্যবসার মাল)

বাদ যাবে :

জরুরি প্রয়োজনে নেয়া ব্যক্তিগত ঋণ,

বাকিতে/ কিস্তিতে ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য,

বিদ্যুৎ/ গ্যাস/ পানি/ টেলিফোন ইত্যাদির বিল,

কর্মচারীদের বকেয়া বেতন।

মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ = (মোট সম্পদ - মোট দেনা)

চলতি বছরের যাকাত = (মোট যাকাতযোগ্য সম্পদের ২.৫%) বা (মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ ÷ ৪০)

বাদ যাবে : আগাম আদায়কৃত যাকাত, যা যাকাতের নিয়তে আগেই দেয়া হয়েছে।

যোগ হবে : গত বছরের বকেয়া যাকাত (যদি থাকে)।

মোট যাকাত :

১২৯
যাকাত বণ্টনের খাত
যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَآءِ وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْعَامِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ﴾

যাকাত তাদের জন্য যারা- নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারী, যাদের অন্তঃকরণ আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, যারা আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফির। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

(সূরা তওবা- ৬০)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যাকাত প্রদানের জন্য ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। নিম্নে এ ব্যাপারে বিসত্মারিত আলোচনা করা হল :

১. ফকীর :

ফকীর শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, মুখাপেক্ষী। পারিভাষিক অর্থে ফকীর ঐসব ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই এবং যে ব্যক্তি অভাবের তাড়নায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম এদের কথাই উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে- ইয়াতীম, পরিত্যক্ত শিশুদের নিয়ে গঠিত শিশুসদন, বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা মহিলা, বৃদ্ধ , অসুস্থ ও পঙ্গু ব্যক্তি, খুব কম আয়ের লোক, ছাত্র, বেকার, জেলবন্দী ও যুদ্ধবন্দীদের পরিবার- এসব ব্যক্তিবর্গ।

২. মিসকীন :

মিসকীন শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, নিঃস্ব, অসহায় ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে মিসকীন ঐ অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে বলা হয়, যার বাসস্থান, ব্যবহারী আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই রয়েছে; কিন্তু সে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়। সে সংসারে নানা রকম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে, জীবিকা সংগ্রহের কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না এবং নিজ আত্মমর্যাদাবোধের জন্য মানুষের নিকট চাইতেও পারছে না।

এরা লজ্জার কারণে বা আত্মমর্যাদার কারণে চাইতে পারে না। তাই বলে তাদেরকে যাকাত হতে বঞ্চিত করা যাবে না; বরং তাদেরকেও যাকাত দিতে হবে। এদের পরিচয় দিতে গিয়ে হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : لَيْسَ الْمِسْكِيْنُ الَّذِيْ يَطُوْفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ وَلٰكِنِ الْمِسْكِيْنُ الَّذِيْ لَا يَجِدُ غِنًى يُغْنِيْهِ ، وَلَا يُفْطَنُ بِه فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ ، وَلَا يَقُوْمُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, এমন ব্যক্তি মিসকীন নয়, যে এক মুঠো বা দুই মুঠো খাবারের জন্য কিংবা একটি বা দুটি খেজুরের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তাকে তা দেয়া হলে ফিরে আসে। বরং প্রকৃত মিসকীন হল সেই ব্যক্তি, যার প্রয়োজন পূরণ করার মত যথেষ্ট সঙ্গতী নেই। অথচ তাকে চেনাও যায় না, যাতে লোকে তাকে সাদাকা করতে পারে এবং সে নিজেও মানুষের নিকট কিছু চায় না। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৭৯; জামেউস সগীর, হা/৯৫১৫; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৬৪৫; নাসাঈ, হা/২৫৭২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৩৫২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮২৮; মিশকাত, হা/১৮২৮।]

৩. আমেলীন :

‘আমেলীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্মচারী। অর্থাৎ যারা যাকাত সংগ্রহ করা, যাকাতের সম্পদ সংরক্ষণ করা, পাহারা দেয়া এবং বিতরণ করাসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজে নিয়োজিত থাকে, তাদেরকে আমেলীন বলা হয়। যাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত এসব কর্মচারীকে যাকাতের তহবিল থেকে তাদের পারিশ্রমিক প্রদান করা যাবে। হাদীসে এসেছে,

عَنِ ابْنِ السَّاعِدِىِّ الْمَالِكِىِّ أَنَّه قَالَ اسْتَعْمَلَنِىْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ - - عَلَى الصَّدَقَةِ فَلَمَّا فَرَغْتُ مِنْهَا وَأَدَّيْتُهَا إِلَيْهِ أَمَرَ لِىْ بِعُمَالَةٍ فَقُلْتُ إِنَّمَا عَمِلْتُ لِلّٰهِ وَأَجْرِىْ عَلَى اللهِ . فَقَالَ خُذْ مَا أُعْطِيْتَ فَإِنِّىْ عَمِلْتُ عَلٰى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ - - فَعَمَّلَنِىْ فَقُلْتُ مِثْلَ قَوْلِكَ فَقَالَ لِىْ رَسُوْلُ اللهِ - : إِذَا أُعْطِيْتَ شَيْئًا مِنْ غَيْرِ أَنْ تَسْأَلَ فَكُلْ وَتَصَدَّقْ

ইবনে সায়েদী আল-মালেকী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) আমাকে যাকাত আদায়কারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম এবং তাঁর কাছে পৌঁছে দিলাম তখন তিনি আমাকে পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। আমি বললাম, আমি তো এটা আল্লাহর সমত্মুষ্টি অর্জনের জন্যই করেছি। সুতরাং আমি আল্লাহর নিকট থেকেই এর প্রতিদান নেব। তখন তিনি বললেন, আমি যা দিচ্ছি তা নিয়ে নাও। কেননা আমিও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় যাকাত আদায়কারীর কাজ করেছি। তখন তিনিও আমাকে পারিশ্রমিক প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন আমিও তোমার মত এরূপ কথা বলেছিলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছিলেন, যখন তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে কিছু দেয়া হয়, তখন তুমি তা গ্রহণ কর। তুমি তা নিজে খাও অথবা সাদাকা কর। [সহীহ মুসলিম, হা/২৪৫৫; আবু দাউদ, হা/১৬৪৯; নাসাঈ, হা/২৬০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৭১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩৬৪; মিশকাত, হা/১৮৫৪।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : لَا تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِىٍّ اِلَّا لِخَمْسَةٍ لِغَازٍ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ أَوْ لِعَامِلٍ عَلَيْهَا أَوْ لِغَارِمٍ أَوْ لِرَجُلٍ اشْتَرَاهَا بِمَالِه أَوْ لِرَجُلٍ كَانَ لَه جَارٌ مِسْكِيْنٌ فَتُصُدِّقَ عَلَى الْمِسْكِيْنِ فَأَهْدَاهَا الْمِسْكِيْنُ لِلْغَنِىِّ

আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ করা বৈধ নয়। তবে পাঁচ শ্রেণির ধনীর জন্য তা জায়েয। (১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রসত্ম ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছেন এবং (৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে। [আবু দাউদ, হা/১৬৩৭; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬০৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৫৪৪; মিশকাত, হা/১৮৩৩।]

৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব :

মন জয় করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা ইসলামের বিরোধিতায় ব্যাপকভাবে তৎপর এবং অর্থ দিয়ে যাদের শত্রুদের তীব্রতা ও উগ্রতা হ্রাস করা যেতে পারে কিংবা যারা সবেমাত্র ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং তাদের পূর্বেকার শত্রুতা বা দুর্বলতাগুলো দেখে আশঙ্কা জাগে যে, অর্থ দিয়ে তাদের বশীভূত না করলে তারা আবার কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, এ ধরনের লোকদেরকে স্থায়ীভাবে বৃত্তি দিয়ে বা সাময়িকভাবে এককালীন দানের মাধ্যমে ইসলামের সমর্থক ও সাহায্যকারী অথবা অনুগত করা যায়। এ খাতে গনীমতের মাল ও অন্যান্য উপায়ে অর্জিত অর্থ থেকেও ব্যয় করা যেতে পারে। এ ধরনের লোকদের জন্য ফকীর, মিসকীন বা মুসাফির হওয়ার শর্ত নেই। বরং ধনী ও বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে যাকাত দেয়া যেতে পারে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ قَالَ : بَعَثَ عَلِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ بِذُهَيْبَةٍ فَقَسَمَهَا بَيْنَ الْأَرْبَعَةِ الْأَقْرَعِ بْنِ حَابِسٍ الْحَنْظَلِيِّ ثُمَّ الْمُجَاشِعِيِّ، وَعُيَيْنَةَ بْنِ بَدْرٍ الْفَزَارِيِّ، وَزَيْدٍ الطَّائِيِّ ثُمَّ أَحَدِ بَنِيْ نَبْهَانَ، وَعَلْقَمَةَ بْنِ عُلَاثَةَ الْعَامِرِيِّ ثُمَّ أَحَدِ بَنِيْ كِلَابٍ، فَغَضِبَتْ قُرَيْشٌ وَالْأَنْصَارُ، قَالُوْا يُعْطِيْ صَنَادِيدَ أَهْلِ نَجْدٍ وَيَدَعُنَا؟‏ قَالَ : إِنَّمَا أَتَأَلَّفُهُمْ . فَأَقْبَلَ رَجُلٌ غَائِرُ الْعَيْنَيْنِ مُشْرِفُ الْوَجْنَتَيْنِ، نَاتِئُ الْجَبِيْنِ، كَثُّ اللِّحْيَةِ، مَحْلُوْقٌ فَقَالَ : اتَّقِ اللهَ يَا مُحَمَّدُ . ‏ فَقَالَ : مَنْ يُطِعِ اللهَ إِذَا عَصَيْتُ؟ أَيَأْمَنُنِي اللهُ عَلٰى أَهْلِ الْأَرْضِ فَلَا تَأْمَنُوْنِيْ؟ . ‏ فَسَأَلَه رَجُلٌ قَتْلَه أَحْسِبُه خَالِدَ بْنَ الْوَلِيْدِ فَمَنَعَه ، فَلَمَّا وَلّٰى قَالَ ‏ : إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هٰذَا أَوْ فِيْ عَقِبِ هٰذَا قَوْمٌ يَقْرَءُوْنَ الْقُرْاٰنَ، لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ، يَمْرُقُوْنَ مِنَ الدِّيْنِ مُرُوْقَ السَّهْمِ مِنَ الرَّمِيَّةِ، يَقْتُلُوْنَ أَهْلَ الْإِسْلَامِ، وَيَدَعُوْنَ أَهْلَ الْأَوْثَانِ، لَئِنْ أَنَا أَدْرَكْتُهُمْ لَأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ

আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আলী (রাঃ) নবী ﷺ এর কাছে কিছু স্বর্ণের খন্ড পাঠালেন। তখন তিনি তা চার লোকের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। (এরা হলেন) আকরা ইবনে হাবিস আল-হানযালী, যিনি মুজাশি‘ঈ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, উওয়াইনা ইবনে বাদ্র আল-ফারাযী, যাইদ আত্ তায়ী- যিনি বানু নাবহান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং আলকামা ইবনে উলাসা আল-আমিরী- যিনি বনু কিলাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এতে কুরাইশ ও আনসারগণ রাগান্বিত হলেন এবং বলতে লাগলেন, তিনি নাজ্দবাসীদের নেতৃবৃন্দকে দিচ্ছেন এবং আমাদেরকে উপেক্ষা করছেন। নবী ﷺ বললেন, আমি তো তাদেরকে (ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য) মনোরঞ্জন করছি। তখন এক লোক সামনে (এগিয়ে) আসল, যার চক্ষুদ্বয় দেবে যাওয়া, গন্ডদ্বয় ঝুলে পড়া, কপাল উঁচু, দাড়ি ঘন এবং মাথা মুড়ানো ছিল। সে বলল : হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় কর। তিনি উত্তর দিলেন, আমিই যদি নাফরমানী করি, তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? আল্লাহ তা‘আলা আমাকে বিশ্ববাসীর উপর আমানতদার বানিয়েছেন। আর তোমরা আমাকে আমানতদার মনে করো না? তখন তাঁর নিকট জনৈক লোক একে হত্যা করার অনুমতি চাইল। (আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন) আমার ধারণা, এ লোক খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ছিলেন। কিমত্মু নবী তাঁকে বারণ করেন। অতঃপর (অভিযোগকারী) লোকটি যখন ফিরে চলে গেল, তখন নবী বললেন, এ লোকের গোত্রে অথবা এ লোকের বংশে এমন একদল লোকের আগমন হবে, যারা কুরআন পড়বে, কিমত্মু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। দ্বীন থেকে তারা এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। তারা হত্যা করবে ইসলামের অনুসারীদেরকে, আর মুক্তি ও অব্যাহতি দেবে মূর্তিপূজারীদেরকে। যদি আমি ততদিন বেঁচে থাকি তাহলে আদ জাতির মতো অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করব। [সহীহ বুখারী, হা/৩৩৪৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৪৯৯; নাসাঈ, হা/২৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৬৬৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৫৬১; মিশকাত, হা/৫৮৯৪।]

৫. দাসমুক্তি :

যুদ্ধবন্দী হোক অথবা যেকোন শ্রেণির দাস হোক যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা যায়।

দাস প্রথা বর্তমানে চালু নেই। কাজেই দাসমুক্তির জন্য নির্ধারিত যাকাতের অংশ অন্যান্য খাতে বিতরণ করা উচিত। অবশ্য কোন কোন আলেম মনে করেন যে, যাকাতের এ অংশ মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করা উচিত। যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করতে গিয়ে বন্দী হয়ে আছে।

৬. ঋণগ্রস্ত :

যে ব্যক্তি এরূপ ঋণগ্রস্ত যে, তার ঋণ হতে মুক্তি লাভ করার উপায় নেই। তাকে যাকাতের টাকা দিয়ে সাহায্য করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত প্রযোজ্য হবে। তা হলো :

১. ঋণটি এমন হতে হবে যে, যা পাপ বা অপরাধমূলক কাজ করার জন্য গ্রহণ করা হয়নি; বরং সৎকাজ ও স্বাভাবিক জীবন ধারণের লক্ষ্যেই গ্রহণ করা হয়েছিল।

২. ঋণগ্রহীতাকে এমন হতে হবে যে, তার নিকট যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তা দ্বারা ঋণ পরিশোধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

عَنْ قَبِيْصَةَ بْنِ مُخَارِقٍ الْهِلَالِيِّ قَالَ تَحَمَّلْتُ حَمَالَةً فَأَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ أَسْأَلُه فِيْهَا فَقَالَ أَقِمْ حَتّٰى تَأْتِيَنَا الصَّدَقَةُ فَنَأْمُرَ لَكَ بِهَا قَالَ ثُمَّ قَالَ يَا قَبِيْصَةُ إِنَّ الْمَسْأَلَةَ لَا تَحِلُّ إِلَّا لِأَحَدِ ثَلَاثَةٍ رَجُلٍ تَحَمَّلَ حَمَالَةً فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتّٰى يُصِيْبَهَا ثُمَّ يُمْسِكُ وَرَجُلٌ أَصَابَتْهُ جَائِحَةٌ اجْتَاحَتْ مَالَه فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتّٰى يُصِيْبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ وَرَجُلٌ أَصَابَتْهُ فَاقَةٌ حَتّٰى يَقُوْمَ ثَلَاثَةٌ مِنْ ذَوِي الْحِجَا مِنْ قَوْمِه لَقَدْ أَصَابَتْ فُلَانًا فَاقَةٌ فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتّٰى يُصِيْبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ فَمَا سِوَاهُنَّ مِنْ الْمَسْأَلَةِ يَا قَبِيْصَةُ سُحْتًا يَأْكُلُهَا صَاحِبُهَا سُحْتًا

কাবীসা ইবনে মুখারিক্ব আল-হিলালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি (ঋণের জামিন হয়ে) বিরাট অংকের ঋণী হয়ে পড়লাম। কাজেই আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে এজন্য তাঁর নিকট চাইলাম। তিনি বললেন, যাকাত বা সাদাকার মাল আসা পর্যন্ত আমার কাছে অপেক্ষা কর। তা আসলে আমি তোমাকে তা থেকে দিতে নির্দেশ দেব। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তিনি বললেন : হে কাবীসা! মনে রেখো, তিন ব্যক্তি ছাড়া কারো জন্য হাত পাতা বা সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ নয়। (১) যে ব্যক্তি (কোন ভালো কাজ করতে গিয়ে বা ঋণের জামিন হয়ে) ঋণী হয়ে পড়েছে। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সাহায্য প্রার্থনা করা তার জন্য বৈধ। যখন ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে, তখন সে এ থেকে বিরত থাকবে। (২) যে ব্যক্তি প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়েছে এবং এতে তার যাবতীয় সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে। তার জন্যও সাহায্য চাওয়া হালাল- যতক্ষণ না সে তা দ্বারা নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। বর্ণনাকারীর সন্দেহ- তিনি কি ‘ক্বিওয়াম’ শব্দ বলেছেন না ‘সিদাদ’ শব্দ বলেছেন? (উভয় শব্দের অর্থ একই)। (৩) যে ব্যক্তি এমন অভাবগ্রস্ত হয়েছে যে, তার গোত্রের তিনজন জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক সাক্ষ্য দেয় যে, ‘‘সত্যিই অমুক ব্যক্তি অভাবে পড়েছে’’ তার জন্য জীবিকা নির্বাহের পরিমাণ সম্পদ লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। হে কাবীসা! এ তিন প্রকার লোক ছাড়া অন্যান্য সকলের জন্য সাহায্য চাওয়া হারাম। অতএব এ তিন প্রকার লোক ছাড়া যেসব লোক সাহায্য চেয়ে বেড়ায়, তারা হারাম খায়। [সহীহ মুসলিম, হা/২৪৫১; আবু দাউদ, হা/১৬৪২; নাসাঈ, হা/২৫৮০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩৬১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮১৭; মিশকাত, হা/১৮৩৭।]

৭. ফী সাবীলিল্লাহ :

আল্লাহর পথে মুজাহিদদেরকে জিহাদের জন্য অস্ত্র ও উপকরণ কিনতে যাকাতের তহবিল হতে সাহায্য করা যাবে। এখানে আল্লাহর পথে বলতে আল্লাহর পথে জিহাদ করাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব যুদ্ধ ও সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য কুফরী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যেসব লোক যুদ্ধ ও সংগ্রামে রত থাকে, তারা নিজেরা স্বচ্ছল ও অবস্থাসম্পন্ন হলেও এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন না থাকলেও তাদের সফর খরচ বাবদ এবং বাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সমসত্ম সময় ও শ্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে এ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যও যাকাতের অর্থ এককালীন বা নিয়মিত ব্যয় করা যেতে পারে।

কুফরীর কালিমাকে নীচু এবং আল্লাহর বাণীকে উঁচু ও বিজয়ী করা আর আল্লাহর দ্বীনকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে কায়েম করার জন্য দাওয়াত ও প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে অথবা যুদ্ধ-বিগ্রহের চরম পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা ও কাজ করা হয়, তা সবই এ খাতের আওতাভুক্ত।

عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : لَا تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِىٍّ إِلَّا لِخَمْسَةٍ لِغَازٍ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ أَوْ لِعَامِلٍ عَلَيْهَا أَوْ لِغَارِمٍ أَوْ لِرَجُلٍ اشْتَرَاهَا بِمَالِه أَوْ لِرَجُلٍ كَانَ لَه جَارٌ مِسْكِيْنٌ فَتُصُدِّقَ عَلَى الْمِسْكِيْنِ فَأَهْدَاهَا الْمِسْكِيْنُ لِلْغَنِىِّ

আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ করা বৈধ নয়। তবে পাঁচ শ্রেণির ধনীর জন্য তা জায়েয।

(১) আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তি।

(২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী।

(৩) ঋণগ্রসত্ম ব্যক্তি ।

(৪) যে ব্যক্তি যাকাতের মাল নিজ মাল দ্বারা ক্রয় করেছেন এবং

(৫) মিসকীন প্রতিবেশী তার প্রাপ্ত যাকাত থেকে ধনী ব্যক্তিকে উপঢৌকন দিয়েছে। [আবু দাউদ, হা/১৬৩৭; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/৬০৪; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৩৫৪৪; মিশকাত, হা/১৮৩৩।]

৮. ইবনুস সাবীল :

যারা সফরে বের হয়ে নিঃসম্বল হয়ে পড়েছে এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারছে না তাদেরকে যাকাতের তহবিল হতে সাহায্য করা যাবে।

অসহায় পথচারী বলতে এমন একজন ভ্রমণকারীকে বুঝায়, যার হাতে বাড়িতে ফিরে আসার মত পর্যাপ্ত অর্থ নেই। নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে তার যাকাত পাওয়ার অধিকার আছে,

(ক) সে অবশ্যই তার নিজ এলাকার বাইরে অন্য কোন এলাকায় অবস্থান করবে।

(খ) কোন আইনসঙ্গত বা বৈধ উদ্দেশ্যে এলাকা ত্যাগ করতে হবে।

(গ) নিজ এলাকায় ধনী বলে গণ্য হলেও ভ্রমণকালে তার অর্থাভাব থাকতে হবে।

উল্লেখ্য যে, যাকাতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রে কেবল উপরোক্ত ৮টি খাতই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এর বাহিরে অন্য কাউকে যাকাত প্রদান করা বৈধ হবে না। তবে যাকাতকে সমান হারে ৮ ভাগে ভাগ করে সকল খাতেই যাকাত প্রদান করা আবশ্যক নয়। বরং সেসব খাতগুলোর প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে কমবেশি করেও বণ্টন করা যাবে। এমনকি প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে কোন একটি খাতে সম্পূর্ণ যাকাত প্রদান করলেও তা আদায় হয়ে যাবে।

১৩০
যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না
এমন কিছু খাত রয়েছে, যাতে যাকাত প্রদানের ৮টি খাতের মধ্যে একটিতে পড়া সত্ত্বেও তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না। যেমন-

১। নবীর বংশধর :

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বংশধর, বনী হাশেম, আলী, আকীল, জাফর, আববাস ও হারেসের বংশধরের জন্য যাকাতের মাল বৈধ নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

أَنَّا لَا تَحِلُّ لَنَا الصَّدَقَةُ

অর্থাৎ আমাদের জন্য সাদাকা হালাল করা হয়নি। [সহীহ মুসলিম, হা/২৫২৩; আবু দাউদ, হা/১৬৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৭২২৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩৪৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩২৯৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/১৩৩৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৯২৭; বায়হাকী, হা/২৬৮৮; সুনানে দারেমী, হা/১৫৯১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/১০৮০৭; জামেউস সগীর, হা/৪০৪৪।]

২। যার ভরণ-পোষণ করা ফরয :

যার ভরণ-পোষণ করা ফরয তাকে যাকাতের মাল দেয়া বৈধ নয়। যেমন- পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, দাদা-দাদী, নানা-নানী, নাতি-নাতনী, স্ত্রী প্রভৃতি। এজন্যই এক হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ أَنَّ رَجُلًا أَتَى النَّبِىَّ - - فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ لِىْ مَالًا وَوَلَدًا وَإِنَّ وَالِدِىْ يَجْتَاحُ مَالِىْ . قَالَ : أَنْتَ وَمَالُكَ لِوَالِدِكَ إِنَّ أَوْلَادَكُمْ مِنْ أَطْيَبِ كَسْبِكُمْ فَكُلُوْا مِنْ كَسْبِ أَوْلَادِكُمْ

আমর ইবনে শুয়াইব (রাঃ) তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার সম্পদ ও সমত্মান রয়েছে। আমার পিতা আমার সম্পদের মুখাপেক্ষী। তিনি বললেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য। তোমাদের সমত্মানরা তোমাদের উত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা তোমাদের সমত্মানদের উপার্জন থেকে ভক্ষণ কর। [আবু দাউদ, হা/৩৫৩২; ইবনে মাজাহ, হা/২২৯১; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১৬১৬৭।]

৩। উপার্জন করতে সক্ষম ব্যক্তি :

যে ব্যক্তি উপার্জন করতে সক্ষম এবং সে হাতের কাজ কিংবা দৈনিক অথবা মাসিক বেতনের মাধ্যমে রুজীপ্রাপ্ত হয়, এরূপ ব্যক্তিকে যাকাতের মাল প্রদান করা বৈধ নয়। কেননা হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ : لَا تَحِلُّ الصَّدَقَةُ لِغَنِىٍّ وَلَا لِذِىْ مِرَّةٍ سَوِىٍّ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, সম্পদশালী ও সুস্থ-সবল ব্যক্তির জন্য যাকাত গ্রহণ করা বৈধ নয়। [আবু দাউদ, হা/১৬৩৬; তিরমিযী, হা/৬৫২; নাসাঈ, হা/২৫৯৭; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৩৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৩০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৩৮৭; মিশকাত, হা/১৮৩০।]

অপর হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ عَدِيِّ بْنِ الْخِيَارِ ، قَالَ : أَخْبَرَنِي رَجُلَانِ : أَنَّهُمَا أَتَيَا النَّبِيَّ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ ، وَهُوَ يُقَسِّمُ الصَّدَقَةَ ، فَسَأَلَاهُ مِنْهَا ، فَرَفَعَ فِينَا الْبَصَرَ وَخَفَضَه ، فَرَاٰنَا جَلْدَيْنِ ، فَقَالَ : إِنَّ شِئْتُمَا أَعْطَيْتُكُمَا ، وَلَا حَظَّ فِيْهَا لِغَنِيٍّ ، وَلَا لِقَوِيٍّ مُكْتَسِبٍ

উবায়দুল্লাহ ইবনে আদী ইবনে খিয়ার (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, দুই ব্যক্তি আমাকে বর্ণনা করেছেন যে, তারা বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট আসলেন। তখন তিনি সাদাকা (যাকাত) বণ্টন করছিলেন। তারা উভয়ে তাঁর নিকট (যাকাত) থেকে কিছু চাইলেন। তিনি আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকালেন এবং নিচু করলেন। তিনি দেখলেন যে, আমরা দু’জনই স্বাস্থ্যবান। ফলে তিনি বললেন, যদি তোমরা চাও আমি তোমাদেরকে দেব। তবে তাতে বিত্তশালীর এবং কোন শক্তিশালী ও কর্মক্ষম ব্যক্তির অংশ নেই। [আবু দাউদ, হা/১৬৩৫; নাসাঈ, হা/২৫৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩১১৩; মিশকাত, হা/১৮৩২।]

৪। কাফির, মুনাফিক ও মুশরিক (মতামত্মরে বেনামাযী) :

যাকাতের মাল কেবল মুসলিমদেরই প্রাপ্ত অধিকার। সুতরাং কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে এ সম্পদ থেকে কোন অংশ দেয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানের শাসক হিসেবে নিয়োগ দানকালে উপদেশ দানের হাদীসে এসেছে,

اَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ اَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلٰى فُقَرَائِهِمْ

আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট থেকে সংগৃহীত হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৯৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৩০; আবু দাউদ, হা/১৫৮৬;তিরমিযী, হা/৬২৫; নাসাঈ, হা/২৫২২; মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৭১; সুনানে দার কুতনী, হা/২০৫৮; মিশকাত, হা/১৭৭২।]

তবে কোন কাফিরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে যাকাতের সম্পদ থেকে যদি কোন অংশ দেয়া হয়, তাহলে তা বৈধ হবে। আবার তাদেরকে মানবিকতার খাতিরে নফল দান প্রদান করা যাবে।

৫। বিদআতী, ফাসিক অথবা অন্যায় কাজে অর্থ ব্যয়কারী :

এ ধরনের ব্যক্তি দুই প্রকার হতে পারে। যেমন-

ক) চরম বিদআতী :

যারা এমন বিদআতে লিপ্ত, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এই প্রকার বিদআতীদেরকে সর্বসম্মতিক্রমে যাকাত প্রদান করা বৈধ নয়। কেননা তারা এই বিদআতের মাধ্যমে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে।

খ) সাধারণ বিদআতী ও পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি :

যারা আকীদাগত বা আমলগত এমন কোন বিদআতে লিপ্ত নেই, যার দ্বারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। অথবা এমন কোন সাধারণ মুসলিম, যাদের আকীদাগত কোন সমস্যা নেই, তবে আমলগত ত্রুটি আছে। এ প্রকার লোকদের ব্যাপারে যদি ধারণা করা হয় যে, তারা যাকাতের অর্থ নিজেদের বিদআত অথবা পাপকাজে ব্যয় করবে, তাহলে তাদেরকে বিশুদ্ধ মতানুযায়ী যাকাত দেয়া বৈধ নয়।

অতএব মুসলিমদের উচিত তাদের যাকাতকে যাচাইবাছাই করে গরীব, অভাবগ্রসত্ম, ঋণগ্রসত্মদের ও অন্যান্য হকদারদের মধ্য থেকে যারা শরীয়তের বিধান সঠিকভাবে মেনে চলে তাদেরকে প্রদান করা।

১৩১
স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে যাকাত দেয়ার বিধান
স্ত্রীর যাবতীয় ভরণ-পোষণের দায়িত্ব হচ্ছে স্বামীর। সুতরাং স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দান করা কোনভাবেই বৈধ নয়। তবে স্ত্রী যদি যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় এবং স্বামী যদি নিঃস্ব হয়, তাহলে স্ত্রী তার স্বামীকে যাকাতের মাল প্রদান করতে পারবে। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ زَيْنَبَ امْرَأَةِ عَبْدِ اللهِ قَالَتْ : كُنْتُ فِي الْمَسْجِدِ فَرَأَيْتُ النَّبِيَّ فَقَالَ : ‏تَصَدَّقْنَ وَلَوْ مِنْ حُلِيِّكُنَّ‏‏ . ‏ وَكَانَتْ زَيْنَبُ تُنْفِقُ عَلٰى عَبْدِ اللهِ وَأَيْتَامٍ فِيْ حَجْرِهَا، فَقَالَتْ لِعَبْدِ اللهِ : سَلْ رَسُوْلَ اللهِ أَيَجْزِيْ عَنِّي أَنْ أُنْفِقَ عَلَيْكَ وَعَلٰى أَيْتَامِيْ فِيْ حَجْرِيْ مِنَ الصَّدَقَةِ؟ فَقَالَ : سَلِيْ أَنْتِ رَسُوْلَ اللهِ . ‏ فَانْطَلَقْتُ إِلَى النَّبِيِّ ‏. ‏ فَوَجَدْتُ امْرَأَةً مِنَ الْأَنْصَارِ عَلَى الْبَابِ، حَاجَتُهَا مِثْلُ حَاجَتِيْ، فَمَرَّ عَلَيْنَا بِلَالٌ فَقُلْنَا : سَلِ النَّبِيَّ  : أَيُجْزِيْ عَنِّيْ أَنْ أُنْفِقَ عَلٰى زَوْجِيْ وَأَيْتَامٍ لِيْ فِيْ حَجْرِيْ؟ وَقُلْنَا : لَا تُخْبِرْ بِنَا . ‏ فَدَخَلَ فَسَأَلَه فَقَالَ ‏ : ‏مَنْ هُمَا؟‏ قَالَ : زَيْنَبُ , قَالَ : ‏أَىُّ الزَّيَانِبِ‏؟ قَالَ : اِمْرَأَةُ عَبْدِ اللهِ . ‏ قَالَ : ‏نَعَمْ لَهَا أَجْرَانِ : أَجْرُ الْقَرَابَةِ وَأَجْرُ الصَّدَقَةِ‏

আবদুল্লাহ (ইবনে মাস‘ঊদ) এর স্ত্রী যায়নাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার মসজিদে নববীতে ছিলাম। তখন নবী ﷺ-কে দেখলাম যে, তিনি (মহিলাদেরকে লক্ষ্য করে) বললেন, তোমরা তোমাদের গহনা থেকে হলেও দান করো। আর যায়নাব (তার স্বামী) আবদুল্লাহ এবং যেসব ইয়াতীম তার পোষ্য ছিল তাদের জন্য খরচ করতেন (অর্থাৎ- তাদের ভরণ-পোষণ করতেন)। তিনি (যায়নাব) আবদুল্লাহ (ইবনে মাসঊদ)-কে বললেন, আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করুন, আমি যে আপনার এবং যে ইয়াতীমরা আমার পোষ্য আছে তাদের জন্য খরচ করছি তা কি দান হিসেবে আমার পক্ষে যথেষ্ট হবে? তিনি (আবদুল্লাহ) বলেন, তুমি নিজে গিয়েই রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করো। তখন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে উপস্থিত হলাম এবং দরজার কাছে জনৈকা আনসারী রমণীকে দেখতে পেলাম। তার প্রয়োজনটাও ছিল আমার প্রয়োজনের মতো। তখন বিলাল (রাঃ) আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা তাকে বললাম, আপনি নবী ﷺ-কে প্রশ্ন করুন, আমি যে আমার স্বামী ও যে ইয়াতীমরা আমার তত্ত্বাবধানে আছে তাদের জন্য সাদাকা (ব্যয়) করছি তা কি (দান হিসেবে) আমার পক্ষে যথেষ্ট হবে? আমরা (তাকে) আরো বললাম, [নবী ﷺ এর কাছে] আমাদের নাম বলবেন না। বিলাল (রাঃ) নবী ﷺ এর কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন, ঐ নারী দু’জন কে কে? বিলাল (রাঃ) বললেন, যাইনাব। তিনি (পুনরায়) প্রশ্ন করলেন, কোন্ যাইনাব? বিলাল (রাঃ) বললেন, আবদুল্লাহর (ইবনে মাস‘ঊদ) স্ত্রী। তিনি বললেন, হ্যাঁ- তার দ্বিগুণ পুণ্য হবে- আত্মীয়তার (হক আদায় করার) নেকী এবং দানের নেকী। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৬২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৭৪৪; মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার, হা/৫৬০; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৯।]

১৩২
যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে যাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত
যাকাত বণ্টনের ক্ষেত্রে যেসব খাত রয়েছে, সে অনুযায়ী আত্মীয়-অনাত্মীয়, নিকটবর্তী-দূরবর্তী অনেক মানুষই এর আওতাভুক্ত হয়। কিমত্মু কারো জন্য সবার মাঝে যাকাত বিতরণ করা জরুরি নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যাদেরকে যাকাত প্রদান করলে অধিক উপকার লাভ করা যায়, তাদেরকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। যেমন-

১। আত্মীয়-স্বজন :

যেসব আত্মীয়-স্বজনের ভরণ-পোষণ করা যাকাতদাতার জন্য ফরয নয়, সেসব আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ যদি যাকাতের হকদার হয়, তাহলে তাকে যাকাত দেয়াই সবচেয়ে উত্তম। যেমন- ভাই-বোন, চাচা-চাচী, মামা-মামী, ফুফা-ফুফু, খালা-খালু ইত্যাদি। কেননা এতে দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন- হাদীসে এসেছে,

عَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ الضَّبِّيِّ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِيْنِ صَدَقَةٌ ، وَعَلَى ذِي الْقَرَابَةِ اثْنَتَانِ : صَدَقَةٌ , وَصِلَةٌ

সালমান ইবনে আমের আয-যাবী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মিসকীনকে সাদাকা দেয়া হলে শুধুমাত্র সাদাকার সওয়াব পাওয়া যাবে। আর আত্মীয়-স্বজনদের সাদাকা প্রদান করলে দুইটি সওয়াব পাওয়া যাবে- তার মধ্যে একটি হলো সাদাকার সওয়াব; আর অপরটি হলো আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার সওয়াব। [ইবনে মাজাহ হা/১৮৪৪; তিরমিযী হা/৬৫৮, নাসাঈ, হা/২৫৮২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬২৭২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২০৬৭; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/১৪৭৬; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৬০৮৭; বায়হাকী, হা/৭৫২৪; সুনানে দারেমী, হা/১৬৮০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৮৪৯; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হা/১৯৬২৭; জামেউস সগীর, হা/৭৩০৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮৯২; মিশকাত, হা/১৯৩৯।]

২। আহলুল ইলম :

আহলুল ইলম বলতে ঐসব লোকদেরকে বুঝানো হয়, যারা সর্বদা দ্বীনি জ্ঞান চর্চায় ব্যসত্ম থাকে। যার কারণে তারা উপার্জন করার মতো যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পান না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে বলেন,

﴿لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِى الْاَرْضِؗ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِيَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِۚ تَعْرِفُهُمْ بِسِيْمَاهُمْۚ لَا يَسْاَلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًاؕ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ فَاِنَّ اللهَ بِهٖ عَلِيْمٌ﴾

(দান করতে হবে) ঐ সকল গরীবদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে অবরুদ্ধ থাকার কারণে (রোজগারের জন্য) জমিনে বিচরণ করতে সক্ষম হয় না। ভিক্ষা করা থেকে দূরে থাকার কারণে মূর্খ্য লোকেরা তাদেরকে ধনী বলে মনে করে। তুমি লক্ষণ দ্বারা তাদেরকে চিনতে পারবে। তারা কাকুতি-মিনতি করে মানুষের কাছে চায় না। আর তোমরা উত্তম সম্পদ হতে যা কিছু দান কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে খবর রাখেন। (সূরা বাকারা- ২৭৩)

অত্র আয়াতে যেসব লোকের কথা বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে এমন লোক যারা আল্লাহর দ্বীনের খেদমতে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দেয়। তাদের সমস্ত সময় এ দ্বীনী খেদমতে ব্যয় করার কারণে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কোন কাজকর্ম করার সুযোগ পায় না। নবী ﷺ এর যুগে এ ধরনের একটি দল ছিল। ইতিহাসে তারা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে পরিচিত। যেহেতু তারা ছিলেন সার্বক্ষণিক কর্মী এবং নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার মতো উপকরণও তাদের ছিল না, তাই তাদের সাহায্য করাকে আল্লাহর পথে ব্যয়ের সর্বোত্তম খাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অতএব বর্তমান যুগেও যারা দুনিয়ার কোন স্বার্থ ছাড়াই দ্বীনের জন্য কাজ করে যাবে এবং নিজের জীবিকার জন্য কাজ করার কোন সুযোগ না পাবে তাদের পেছনে খরচ করাও আল্লাহর পথে ব্যয়ের খাত হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা এদেরকে দান করলে একদিকে যেমন যাকাত আদায়ের হক আদায় হয়ে যাবে, অপরদিকে দ্বীনের কাজে সহযোগিতা করারও সওয়াব পাওয়া যাবে।

৩। মুত্তাকী ও পরহেজগার লোক :

যেসব লোক সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর আনুগত্য করে এবং তাঁরই ইবাদাতে ব্যসত্ম থাকে, সেসব লোক যদি যাকাতের হকদার হয়, তাহলে তারাই এর জন্য বেশি হকদার।

১৩৩
সরকারি ফান্ডে যাকাত দেয়া
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্বই হলো যাকাত আদায় করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَلَّذِيْنَ اِنْ مَّكَّنَّاهُمْ فِى الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلَاةَ وَاٰتَوُا الزَّكَاةَ وَاَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِؕ وَلِلّٰهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ﴾

আমি এদেরকে (মুমিনদেরকে) পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, যাতে করে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে। আর সকল কর্মের পরিণাম তো আল্লাহর ইচ্ছাধীন।

(সূরা হাজ্জ- ৪১)

অতএব, যাকাতের সম্পদ থেকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু অংশ আদায় করার পর অবশিষ্ট যা কিছু থাকবে, সেগুলো সরকারি ফান্ডে জমা দেয়াই উত্তম। এতে করে সরকার নিজ দায়িত্বে যাকাতের মাল সুষ্ঠভাবে বণ্টন করে মুসলিম জনগণের অধিক কল্যাণ সাধন করবে।

তবে যেসব সরকার কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার-ফায়সালা করে না; বরং তারা আল্লাহর ইবাদাতের পরিবর্তে জনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী, সেসব সরকারের ফান্ডে যাকাতের সম্পদ জমা দেয়া যাবে না।

যাকাতের মাল মসজিদ ও গোরস্থানের কাজে ব্যবহার করা যাবে না :

যাকাতের টাকা দিয়ে মসজিদ ও গোরস্থান তৈরি করা বৈধ নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যাকাত বণ্টনের জন্য যেসব খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন, মসজিদ ও গোরস্থান তার অমত্মর্ভুক্ত নয়।

১৩৪
ভুলবশত ৮টি খাতের বাইরে যাকাত দিলে আদায় হবে কি
যদি কখনো ভুলক্রমে নির্দিষ্ট ৮টি খাতের বাইরে যাকাত প্রদান করা হয়, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে এবং তা পুনরায় আদায় করতে হবে না। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ قَالَ قَالَ رَجُلٌ لَاتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِه فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ زَانِيَةٍ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ اللَّيْلَةَ عَلٰى زَانِيَةٍ قَالَ اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلٰى زَانِيَةٍ لَاتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِه فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ غَنِيٍّ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ عَلٰى غَنِيٍّ قَالَ اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلٰى غَنِيٍّ لَاتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِه فَوَضَعَهَا فِيْ يَدِ سَارِقٍ فَأَصْبَحُوْا يَتَحَدَّثُوْنَ تُصُدِّقَ عَلٰى سَارِقٍ فَقَالَ اَللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلٰى زَانِيَةٍ وَعَلٰى غَنِيٍّ وَعَلٰى سَارِقٍ فَأُتِيَ فَقِيْلَ لَه أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ أَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا تَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا وَلَعَلَّ الْغَنِيَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللهُ وَلَعَلَّ السَّارِقَ يَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِه

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, এক ব্যক্তি বলল, আমি আজ রাতে কিছু দান-খয়রাত করব। অতঃপর সে সাদাকা নিয়ে বের হয়ে এক যিনাকারীকে তা অর্পণ করল। ভোরে লোকেরা বলাবলি করতে লাগল যে, আজ রাতে এক ব্যক্তি যিনাকারীকে দান-খয়রাত করেছে। অতঃপর সে ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা তোমার জন্য। আমার প্রদত্ত সাদাকা তো যিনাকারীর হাতে গিয়ে পড়েছে। এরপর সে (আবার) বলল, আজ আমি আরো কিছু সাদাকা করব। অতঃপর সে তা নিয়ে বের হয়ে এক ধনী লোকের হাতে অর্পণ করল। লোকজন ভোরে আলাপ করতে লাগল যে, আজ রাতে কে যেন এক ধনী লোককে সাদাকা দিয়ে গেছে। সে বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা তোমার জন্য। আমার সাদাকা তো ধনীর হাতে গিয়ে পড়েছে। তারপর সে পুনরায় বলল, আমি আজ রাতে কিছু সাদাকা দেব। সাদাকা নিয়ে বের হয়ে সে এক চোরের হাতে অর্পণ করল। অতঃপর সকালে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, আজ রাতে কে যেন চোরকে সাদাকা দিয়েছে। সে বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা তোমারই। আমার প্রদত্ত সাদাকা যিনাকারী, ধনী ও চোরের হাতে পড়ে গেছে। অতঃপর এক ব্যক্তি (মালাক বা সে যুগের কোন নবী) এসে তাকে বলল, তোমার প্রদত্ত সকল সাদাকাই কবুল হয়েছে। যিনাকারীকে দেয়া সাদাকা কবুল হওয়ার কারণ হলো- সম্ভবত সে ঐ রাতে যিনা থেকে বিরত ছিল। (কেননা সে পেটের জ্বালায় এ কাজ করত) ধনী ব্যক্তিকে যে সাদাকা দেয়া হয়েছিল তা কবুল হওয়ার কারণ হলো ধনী ব্যক্তি এতে লজ্জিত হয়ে হয়ত উপদেশ গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে সেও দান করবে বলে সঙ্কল্প করেছে। আর চোরকে দেয়া সাদাকা কবুল হওয়ার কারণ হলো সম্ভবত সে ঐ রাতে চুরি থেকে বিরত ছিল। কেননা সেও পেটের তাগিদে চুরি করত। [সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৮০৯৮।]

১৩৫
লুঙ্গি-শাড়ি দিয়ে যাকাত দেয়া
বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় যে, অনেক লোক নিম্নমানের সুতা দ্বারা তৈরি কিছু পোশাক দিয়ে যাকাত আদায় করে থাকে। এমনটি করা উচিত নয়। যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে যাকাত গ্রহণকারীদের প্রয়োজনের দিকটি অধিক বিবেচ্য। বর্তমান যুগে যেহেতু লুঙ্গি-শাড়ির চেয়ে নগদ অর্থই মানুষের জন্য অধিক উপকারী, তাই নগদ অর্থ দ্বারা যাকাত প্রদান করাই সবচেয়ে উত্তম।

তবে যিনি লুঙ্গি-শাড়ির ব্যবসা করেন, তিনি লুঙ্গি-শাড়ি দিয়ে এর যাকাত প্রদান করতে পারবেন। লুঙ্গি-শাড়ি অবশ্যই স্বাভাবিক মানের তৈরি হতে হবে এবং যাকাত আদায়ের জন্য বিশেষভাবে নিম্ন মানের তৈরি করা বৈধ নয়। এগুলো দিয়ে যাকাত আদায় করাটা শুধুমাত্র আল্লাহকে সমত্মুষ্ট করার উদ্দেশ্যেই হতে হবে। এছাড়া অন্য কোন দুনিয়ামুখী উদ্দেশ্য নিয়ে যাকাত প্রদান করা বৈধ হবে না।

১৩৬
হিসাব ব্যতীত যাকাত আদায়ের বিধান
যাকাত একটি বাধ্যতামূলক ইবাদাত এবং এর আদায়ের পরিমাণও নির্দিষ্ট। সুতরাং এ ধরনের ইবাদাতের ক্ষেত্রে হিসাব-নিকাশ বাদ দিয়ে অনুমান করাটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কেউ অনুমানের ভিত্তিতে যাকাত প্রদান করে, তাহলে তা ফরয যাকাত হিসেবে গণ্য হবে না; বরং তা সাধারণ দান হিসেবেই গণ্য হবে।

অপরদিকে যাকাত হচ্ছে গরীবের হক। অনুমানের ভিত্তিতে এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হলে, গরীবদের নির্দিষ্ট হক বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং হিসাব ব্যতীত যাকাত আদায় করা বৈধ নয়।

তবে কেউ যদি যাকাতের নিয়তে কিছু সম্পদ দান করে এবং পরে হিসাব-নিকাশ করে সমন্বয় করে নেয়, তাহলে তা বৈধ হবে।

১৩৭
এক এলাকার যাকাত অন্য এলাকায় স্থানামত্মর করা
যাকাত বণ্টনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী যাকাতের সম্পদ যে এলাকা থেকে গ্রহণ করা হয়, সে এলাকার গরীবদের মধ্যেই প্রাথমিকভাবে বিতরণ করতে হবে। তারপর অবশিষ্ট যা কিছু থাকবে, সেগুলো প্রয়োজনের ভিত্তিতে অন্যান্য শহরেও স্থানামত্মর করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত খাতগুলোকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। যেমন-

১. জিহাদ অর্থাৎ আল্লাহর পথে যুদ্ধরত মুজাহিদদের এলাকায় যাকাত স্থানামত্মর করা।

২. ইসলাম প্রচার ও ইসলামী শিক্ষা বিসত্মারের ক্ষেত্রে যাকাত স্থানামত্মর করা।

৩. দুর্ভিক্ষ এবং দুর্যোগ কবলিত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যাকাত স্থানামত্মর করা।

৪. যাকাতদাতার আত্মীয়কে দেয়ার জন্য যাকাত স্থানামত্মর করা।

১৩৮
যাকাত উত্তোলনকারীর করণীয়
যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা যাবে না :

যাকাত আদায় করতে গিয়ে কোন উপহার গ্রহণ করা, জোর-যুলুম করে আদায় করা, খেয়ানত করা ইত্যাদি হারাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন উবাদা (রাঃ)-কে সাদাকা আদায় করার জন্য প্রেরণ করলেন, তখন বললেন, হে আবু অলীদ! তুমি আল্লাহকে ভয় করো। তুমি যেন কিয়ামতের দিন (নিজ ঘাড়ে) কোন ‘চিঁহি’ রববিশিষ্ট উট, অথবা ‘হাম্বা’ রববিশিষ্ট গাভী অথবা ‘মে-মে’ রববিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় উপস্থিত না হও। উবাদা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ব্যাপারটি কি সত্যই এরূপ? তিনি বললেন, হ্যাঁ- এরূপ। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্যের সাথে প্রেরণ করেছেন, আমি আপনার (বাইতুল মালের) কোন ব্যাপারে কখনো চাকুরী করব না। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৮০; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৯১৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৮৫৭।]

আবু হুমাইদ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আযদ অঞ্চল এর ইবনে লুতবিয়া নামক এক ব্যক্তিকে যাকাত আদায় করার কাজে কর্মচারী নিয়োগ করলেন। সে ব্যক্তি (আদায়কৃত মাল সহ) ফিরে এসে বলল, এটা আপনাদের (বায়তুল মালের), আর এটা আমাকে উপহারস্বরূপ দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ উঠে দন্ডায়মান হয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও সত্মুতি বর্ণনা করে বললেন, অতঃপর বলি যে, আল্লাহ আমাকে যে সকল কর্মের অধিকারী করেছেন তার মধ্য হতে কোন কর্মের জন্য তোমাদের কাউকে কর্মচারী নিয়োগ করলে সে ফিরে এসে বলে কি না, এটা আপনাদের। আর এটা উপহার স্বরূপ আমাকে দেয়া হয়েছে! যদি সে সত্যবাদী হয় তবে তার বাপ-মায়ের ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন, তাকে কোন উপহার দেয়া হচ্ছে কি না? আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন জিনিস অন্যায়ভাবে গ্রহণ করবে সে কিয়ামতের দিন তা তার নিজ ঘাড়ে বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে। অতএব আমি যেন অবশ্যই চিনতে না পারি যে, তোমাদের মধ্য হতে কেউ নিজ ঘাড়ে ‘চিঁহি’ রববিশিষ্ট উট, অথবা ‘হাম্বা’ রববিশিষ্ট গাভী অথবা ‘মে-মে’ রব বিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছ।

আবু হুমাইদ (রাঃ) বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর ডানহাত এতটুকু উঁচু করলেন যে, তাঁর বগলের শুভ্রতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘‘হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছি।’’ বর্ণনাকারী বলেন, আমার চোখ তাঁকে এ কথা বলতে দেখেছে এবং আমার কান তা শুনেছে। [সহীহ বুখারী, হা/৬৯৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/৪৮৪৫।]

১৩৯
যাকাতের মাল আত্মসাৎকারীর পরিণাম
যাকাত হচ্ছে একটি জনকল্যাণমূলক ইবাদাত। এতে গরীব, দুঃখী, ফকীর, মিসকীন অনেকেরই হক রয়েছে। সুতরাং এর থেকে কোন অংশ আত্মসাৎ করলে অনেকের হক আত্মসাৎ করা হয়। ফলে এর গোনাহের পরিমাণ স্বাভাবিক থেকে অনেক বেশি এবং কিয়ামতের দিন এদের পরিণতিও অনেক ভয়াবহ। কেননা হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُبَادَةَ : أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ بَعَثَه عَلَى الصَّدَقَةِ فَقَالَ : يَا أَبَا الْوَلِيْدِ اتَّقِ لَا تَأْتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِبَعِيْرٍ تَحْمِلُه لَه رُغَاءٌ أَوْ بَقَرَةٍ لَهَا خُوَارٌ أَوْ شَاةٍ لَهَا ثُؤَاجٌ . فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ ذٰلِكَ لَكَائِنٌ قَالَ : إِىْ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِه إِنَّ ذٰلِكَ لَكَذٰلِكَ إِلَّا مَنْ رَحِمَ اللهُ ، قَالَ : فَوَالَّذِىْ بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَا أَعْمَلُ عَلٰى شَىْءٍ أَبَدًا أَوْ قَالَ عَلَى اثْنَيْنِ

উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে যাকাত আদায় করার জন্য প্রেরণ করলেন। অতঃপর বললেন, হে আবুল ওয়ালীদ! (যাকাতের সম্পদের ব্যাপারে) আল্লাহকে ভয় করো। কিয়ামতের দিন এমন অবস্থা যেন না আসে যে, তুমি কাঁধের উপর উট বহন করবে, যা শব্দ করতে থাকবে অথবা গাভী বহন করবে, যা শব্দ করবে অথবা ছাগল বহন করবে, যা শব্দ করবে। উবাদা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যাকাতের মাল আত্মসাৎ করার জন্য কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, এটাই হবে পরিণতি। তখন উবাদা (রাঃ) বললেন, সেই সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন। আমি এরূপ যাকাত আদায়ের কাজ কখনো করব না। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৮০; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/৭৯১৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৮৫৭।]

১৪০
যাকাত আদায়ের দায়িত্ব কার
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَ لَّذِيْنَ اِنْ مَّكَّنَّاهُمْ فِى الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلَاةَ وَاٰتَوُا الزَّكَاةَ وَاَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِؕ وَلِلّٰهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ﴾

আমি এদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করলে এরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; (জেনে রেখো) সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে (ইচ্ছাধীন)। (সূরা হজ্জ- ৪১)

অতএব যাকাত আদায় করা এবং তার সুষম বণ্টন করার মূল দায়িত্ব সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। সরকার এ উদ্দেশ্যে কর্মচারী নিয়োগ করে ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করবে এবং নির্দিষ্ট খাতসমূহে বণ্টন করে দেবে।

১৪১
যাকাতদাতার করণীয়
ইখলাস বজায় রাখা :

যে কোন আমল কবুল হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে, তার মধ্যে যথাযথ পরিমাণ ইখলাস বজায় থাকা। সুতরাং যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে ইখলাস থাকা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَسَيُجَنَّبُهَا الْاَتْقٰى اَ لَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَهٗ يَتَزَكّٰى وَمَا لِاَحَدٍ عِنْدَهٗ مِنْ نِّعْمَةٍ تُجْزٰى اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْاَعْلٰى﴾

এ থেকে (জাহান্নাম থেকে) দূরে রাখা হবে আল্লাহভীরু ব্যক্তিদেরকে, যে আত্মশুদ্ধির জন্য তার ধনসম্পদ হতে দান করে। অতঃপর তার উপর মহান পালনকর্তার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদানযোগ্য অনুগ্রহ থাকে না।

(সূরা লায়ল : ১৭-২০)

আর হাদীসে এসেছে, উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, নিশ্চয় সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। [সহীহ বুখারী, হা/১; আবু দাউদ, হা/২২০৩; ইবনে মাজাহ, হা/৪২২৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৮৮; বায়হাকী, হা/১৮১; জামেউস সগীর, হা/৪০৭৪; মিশকাত, হা/১।]

অতএব, যাকাত আদায়কারীকেও অবশ্যই ইখলাসের দিকে মনোযোগী হতে হবে, যাতে কোনভাবে এতে ঘাটতি না থাকে। নতুবা এটি লোক দেখানো আমল হিসেবে পরিগণিত হয়ে বড় ধরনের পাপের ভাগিদার হতে হবে।

প্রকাশ্যে যাকাত দিতে গিয়ে অহংকারী না হওয়া :

শরীয়তের একটি মূলনীতি হচ্ছে ফরয ইবাদাতসমূহ প্রকাশ্যে এবং নফল ইবাদাতসমূহ গোপনে করাই উত্তম। যেহেতু যাকাত ফরয ইবাদাতের অমত্মর্ভুক্ত, সুতরাং যাকাত প্রকাশ্যে আদায় করাই উত্তম। তবে যদি রিয়ার (লোক দেখানোর) ভয় থাকে, তাহলে গোপনে আদায় করাই উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَۚ وَاِنْ تُخْفُوْهَا وَتُؤْتُوْهَا الْفُقَرَآءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْؕ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِّنْ سَيِّئَاتِكُمْؕ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ﴾

তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর, তবে তা উত্তম। আর যদি গোপনে গরীবদেরকে দান কর, তবে তা তোমাদের জন্য আরো ভালো। আল্লাহ তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করেন এবং তোমাদের কর্ম সম্পর্কে খবর রাখেন। (সূরা বাকারা- ২৭১)

অতএব যদি কোন ধরনের গোনাহের ভয় অথবা বিপদের আশংকা না থাকে, তাহলে প্রকাশ্যে যাকাত আদায় করবে এবং অন্যান্য নফল সাদাকা প্রদানের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করবে। কিমত্মু এরপরও যদি তা প্রকাশ পেয়ে যায় এবং এজন্য সে দুনিয়ায় কোন পৃথক সম্মান লাভ করে থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে উক্ত সম্মানটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বলে মনে করবে এবং এ জন্য আরো অধিক হারে শুকরিয়া আদায় করবে।

যাকাত দিয়ে খোঁটা দেয়া যাবে না :

কাউকে কোন কিছু দান করার পর খোঁটা দেয়াটা একটি মারাত্মক অন্যায়। যে ব্যক্তি এরূপ করে তার উক্ত দান সম্পূর্ণভাবে বরবাদ হয়ে যায়। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْاَذٰى﴾

হে ঈমানদারগণ! খোঁটা এবং কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে বরবাদ করে দিও না। (সূরা বাকারা- ২৬৪)

উপরমত্মু যারা এসব কাজ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর খুবই রাগান্বিত হন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَبِى ذَرٍّ عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ : ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ، قَالَ فَقَرَأَهَا رَسُوْلُ اللهِ - - ثَلَاثَ مِرَارٍ . قَالَ أَبُوْ ذَرٍّ خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : اَلْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَه بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ

আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এ কথাটি তিনবার পাঠ করলেন। আবু যর (রাঃ) বলে উঠলেন, তারা তো ধ্বংস হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসূল! এরা কারা? তিনি বললেন, (১) যে ব্যক্তি পায়ের গোছার নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলে, (২) যে ব্যক্তি কোন কিছু দান করে খোঁটা দেয় এবং (৩) যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে। [সহীহ মুসলিম, হা/৩০৬; আবু দাউদ, হা/৪০৮৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৯০৭; সুনানে দারেমী, হা/২৬০৫।]

অতএব, যাকাতদাতাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে, তার মুখ দিয়ে যেন এমন কোন কথা বের না হয়, যা যাকাত গ্রহণকারীর জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

নিজের প্রদানকৃত যাকাতের মাল পুনরায় ক্রয় করা যাবে না :

যাকাত আদায় করার পর উক্ত মাল পুনরায় ক্রয় করে নেয়া বৈধ নয়। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُمَرَ يَقُوْلُ حَمَلْتُ عَلٰى فَرَسٍ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، فَأَضَاعَهُ الَّذِيْ كَانَ عِنْدَه ، فَأَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِيَه ، وَظَنَنْتُ أَنَّه يَبِيْعُه بِرُخْصٍ، فَسَأَلْتُ النَّبِيَّ فَقَالَ ‏لَا تَشْتَرِ وَلَا تَعُدْ فِيْ صَدَقَتِكَ، وَإِنْ أَعْطَاكَه بِدِرْهَمٍ، فَإِنَّ الْعَائِدَ فِيْ صَدَقَتِه كَالْعَائِدِ فِيْ قَيْئِهِ‏

উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি আল্লাহর রাসত্মায় একটি ঘোড়া দান করেছিলাম, কিন্তু যার নিকট ঘোড়াটি ছিল, সে সেটিকে অকর্মণ্য করে দিয়েছিল। আমি তা ক্রয় করতে সংকল্প করলাম। আমি ধারণা করলাম, সে তা কম মূল্যে বিক্রি করবে। তাই আমি নবী ﷺ-কে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, তুমি ওটা ক্রয় করো না। তুমি যা সাদাকা করেছ তা পুনরায় গ্রহণ করো না- যদিও সে এক দিরহামের বিনিময়ে তোমাকে তা দেয়। কেননা সাদাকার মাল পুনরায় গ্রহণকারী বমি ভক্ষণকারীর মতো। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৯০; সহীহ মুসলিম, হা/৪২৫০; নাসাঈ, হা/২৬১৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৬১১; মিশকাত, হা/১৯৫৪।]

পবিত্র এবং উত্তম জিনিসের মাধ্যমে যাকাত আদায় করা :

যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে উত্তম জিনিস দ্বারাই যাকাত প্রদান করা উচিত। কেননা উত্তম জিনিস দান করা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَؕ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ شَيْءٍ فَاِنَّ اللهَ بِهٖ عَلِيْمٌ﴾

তোমরা কখনো যথার্থ নেকী অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস আল্লাহর পথে খরচ কর। আর তোমরা যা কিছুই দান কর আল্লাহ তা জানেন। (সূরা আলে ইমরান- ৯২)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর আবু তালহা (রাঃ) তার সবচেয়ে প্রিয় বাগানটি আল্লাহর রাসত্মায় দান করে দেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، ، يَقُوْلُ كَانَ أَبُو طَلْحَةَ أَكْثَرَ الْأَنْصَارِ بِالْمَدِيْنَةِ مَالًا ، وَكَانَ أَحَبَّ أَمْوَالِه إِلَيْهِ بِيْرُ حَاءَ وَكَانَتْ مُسْتَقْبِلَةَ الْمَسْجِدَ ، وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَدْخُلُهَا وَيَشْرَبُ مِنْ مَاءٍ فِيْهَا طَيِّبٍ فَلَمَّا نَزَلَتْ ﴿لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّونَ﴾ قَامَ أَبُو طَلْحَةَ إِلٰى رَسُوْلِ اللهِ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ اللهَ تَعَالٰى يَقُوْلُ فِيْ كِتَابِه ﴿لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّونَ﴾ وَإِنَّ أَحَبَّ أَمْوَالِيْ إِلَيَّ بِيْرُ حَاءَ وَإِنَّهَا صَدَقَةٌ لِلّٰهِ أَرْجُو بِرَّهَا وَذُخْرَهَا عِنْدَ اللهِ فَضَعْهَا يَا رَسُوْلَ اللهِ حَيْثُ شِئْتَ فَقَالَ بخٍ ذٰلِكَ مَالٌ رَائِحٌ ذٰلِكَ مَالٌ رَائِحٌ قَدْ سَمِعْتُ مَا قُلْتَ فِيْهَا وَأَرٰى أَنْ تَجْعَلَهَا فِي الْأَقْرَبِيْنَ قَالَ أَفْعَلُ يَا رَسُوْلَ اللهِ فَقَسَمَهَا أَبُو طَلْحَةَ فِيْ أَقَارِبِه وَبَنِيْ عَمِّه

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু তালহা (রাঃ) ছিলেন মদিনায় আনসারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার নিকট সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল ‘বীরুহা’ নামক একটি বাগান। বাগানটি মসজিদের সামনেই ছিল। রাসূলুল্লাহ ﷺ মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন এবং তার পানি পান করতেন। যখন এই আয়াত নাযিল হলো, তোমরা কখনো কল্যাণ অর্জন করতে পারবে না যতক্ষণ না ব্যয় করবে তা থেকে যা তোমরা ভালোবাস। তখন আবু তালহা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট গেলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বলেছেন, তোমরা কখনো সওয়াব অর্জন করতে পারবে না যতক্ষণ না ব্যয় করবে তা থেকে, যা তোমরা ভালোবাস। আমার নিকটে সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ হলো এই ‘বীরুহা’ নামক বাগানটি। আমি এখন এটা আল্লাহর রাসত্মায় সাদাকা করে দিলাম। আমি আল্লাহর কাছে এর উত্তম বিনিময় চাই। আপনি এটা যেখানে ইচ্ছা খরচ করুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ওহ! এটাতো খুবই উত্তম সম্পদ! এটা তো খুবই উত্তম সম্পদ। এর ব্যাপারে তুমি যা বলেছ আমি শুনেছি। আমি চাই এটা তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনের মাঝে বণ্টন করে দাও। আবু তালহা বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমি এমনটাই করব। এরপর আবু তালহা (রাঃ) বাগানটি তার আত্মীয়স্বজন এবং তার চাচাতো ভাইয়ের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। [সহীহ বুখারী, হা/২৩১৮, সহীহ মুসলিম, হা/২৩৬২; মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হা/১৮০৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৪৬১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৩৪০; বায়হাকী, হা/১১৭০০; সুনানে দারেমী, হা/১৬৫৫; শারহুস সুন্নাহ, হা/১৬৮৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮৭৫।]

যাকাতের নির্দিষ্ট অংশের চেয়ে বেশি দান করা যাবে :

যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট অংশ পাওয়া না গেলে, তা হতে বেশি পরিমাণ পাওয়া গেলে তাই আদায় করবে। এতে অতিরিক্ত দান করার কারণে অতিরিক্ত নেকী অর্জিত হবে। হাদীসে এসেছে,

উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ আমাকে যাকাত আদায় করার জন্য প্রেরণ করলেন। আমি এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম, সে আমার সামনে তার সম্পদ উপস্থিত করল। তার যে সম্পদ ছিল তাতে তার উপর একটি এক বছর বয়সের উট যাকাত ফরয ছিল। আমি বললাম, এক বছর বয়সের একটি উষ্ট্রী দিয়ে দাও। সে বলল, সে তো দুধও দেবে না এবং তার পিঠে আরোহণও করা যাবে না। কাজেই আমার এই যৌবনে পদার্পণকারী মোটা তাজা উষ্ট্রীটিই গ্রহণ করুন। তখন আমি বললাম, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অনুমতি ছাড়া এটি গ্রহণ করতে পারব না। তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ তোমার থেকে নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করছেন। তুমি যদি চাও তাহলে তুমি তোমার যে উষ্ট্রীটি আমার নিকট পেশ করেছিলে তা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট পেশ করতে পার। যদি তিনি তা গ্রহণ করেন, তাহলে আমিও তা গ্রহণ করব। আর যদি তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আমিও তা প্রত্যাখ্যান করব। সে বলল, আমি তা (রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট) পেশ করব। অতঃপর যে উষ্ট্রী্রটি সে আমার নিকট পেশ করেছিল সেটি নিয়ে আমার সাথে রওনা দিল। এমনকি আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট পৌঁছে গেলাম। তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিয়োজিত যাকাত আদায়কারী আমার কাছে যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্যে এসেছিল। আর আল্লাহর শপথ! ইতিপূর্বে আপনার পক্ষ থেকে কেউ আমার নিকট যাকাত আদায়ের জন্য আসেনি। আমি তার সামনে আমার সম্পদ পেশ করলাম। তখন সে বলল, আমার উপর একটি এক বছরের উষ্ট্রী্র যাকাত ফরয। অথচ সেটি দুধও দেবে না এবং তার পিঠে আরোহণও করা যাবে না। ফলে আমি তার নিকট যৌবনে পদার্পণকারী মোটা তাজা উষ্ট্রী গ্রহণ করার জন্য পেশ করলাম। কিমত্মু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। আর এই হচ্ছে সেই উষ্ট্রী, যা আমি আপনার নিকট নিয়ে এসেছি, আপনি তা গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তোমার উপর ফরয ছিল তাই যা সে বলেছে। কিমত্মু যদি তুমি নিজের খুশিতে ভালো কাজ করতে চাও, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। আর আমরাও তা গ্রহণ করব। সে বলল, এই হচ্ছে সেই উষ্ট্রী যা আপনার নিকট নিয়ে এসেছি। অতএব আপনি তা গ্রহণ করুন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ তা গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন এবং তার সম্পদের বরকতের জন্য দু‘আ করলেন। [আবু দাউদ, হা/১৫৮৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২২৭৭।]

১৪২
যাকাত গ্রহণকারীর জন্য করণীয়
যিনি যাকাতের মাল গ্রহণ করবেন, তাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে :

১. যাকাত গ্রহণকারীকে যাকাতের হকদার হতে হবে।

২. যা পায় তাতেই সমত্মুষ্ট থাকতে হবে। দানকে তুচ্ছ ও ছোট মনে না করে সমত্মুষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে হবে।

৩. প্রয়োজনের বেশি চাইবে না।

৪. দাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করবে। কারণ যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, সে আসলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না।

৫. যাকাতদাতার জন্য দু‘আ করবে, বলবে, صَلَّى اللهُ عَلَيْكَ (সাল্লাল্লাহু আলাইকা) অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করুন। অথবা اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى اٰلِ فُلَانِ (আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা আ-লি ফুলান) অর্থাৎ হে আল্লাহ! অমুকের পরিবারবর্গের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করুন। (ফুলান এর স্থলে দাতার নাম নেবে।)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْؕ اِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْؕ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾

তাদের সম্পদ হতে যাকাত গ্রহণ করো। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশুদ্ধ করবে। আর তুমি তাদের জন্য দু‘আ করো। নিশ্চয় তোমার দু‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক; আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সূরা তওবা- ১০৩)

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

وَمَنْ صَنَعَ إِلَيْكُمْ مَعْرُوْفًا فَكَافِئُوْهُ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوْا مَا تُكَافِئُوْنَه فَادْعُوْا لَه حَتّٰى تَرَوْا أَنَّكُمْ قَدْ كَافَأْتُمُوْهُ

যে ব্যক্তি তোমাদের কোন উপকার করে তোমরা তার প্রতিদান দাও। যদি প্রতিদান দেয়ার মত কিছু না পাও, তাহলে তার জন্য দু‘আ কর। যাতে তোমরা মনে করতে পার যে, তার প্রতিদান দিয়েছ। [আবু দাউদ, হা/১৬৭২; নাসাঈ, হা/২৫৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৩৬৫; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৫৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮৫২। اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي بِنِعْمَتِه تَتِمُّ الصَّالِحَاتُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ ]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন