hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

লেখকঃ মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)

১৫৩
পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্হ
এই গ্রন্হাবলীর একটি পঞ্চম পর্যায়ও রহিয়াছে। এই পর্যায়ে সেই সব হাদীস গণ্য যাহা ফিকাহবিদ সূফী ও ঐতিহাসিক প্রমুখদের মুখে মুখে প্রচারিত হইয়াছে। উপরোক্ত চার পর্যায়ের হাদীসের সহিত ইহার কোন সামঞ্জস্য নাই।

বে-দ্বীন, বাক-চতুর লোকদের মনগড়া হাদীসও এই পর্যায়ে গণ্য। ইহারা সেই সব হাদীসের সহিত এমন সনদ বা বর্ণনাসূত্র যোগ করিয়া দিয়াছে যাহাতে কোন প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হইতে না পারে। আর এমন সুন্দরভাবে কথাগুলি সাজাইয়া পেশ করিয়াছে যে, রাসূলে করীম (ﷺ) এই কথা বলেন নাই তাহা বাহ্যত জোর করিয়া বলা শক্ত।

বস্তুত এই লোকেরাই ইসলামের এক কঠিন বিপদের সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই বিপদের ঘনঘটা ইসলামের সাংস্কৃতিক আকাশকে বেশী দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে নাই। হাদীস বিজ্ঞানিগণ সমালোচনার কষ্টিপাথরে এই হাদীসসমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন, রাসূলের অনুরূপ ভাবধারার হাদীসসমূহের সহিত উহা মিলিয়া দেখিয়াছেন এবং উহার ‘মনগড়া’ হওয়া রহস্য অকাট্যভাবে উদঘাটন করিয়াছেন। ফলে কোন মনগড়া হাদীসই হাদীস পর্যায়ে গণ্য হইবার সুযোগ পাইতে সমর্থ হয় নাই।

উপরোক্ত আলোচনায় দুইখানি প্রখ্যাত হাদীসগ্রন্হের জন্য কোন পর্যায় উল্লেখ বা নির্ধারণ করা হয় নাই। গ্রন্হদ্বয় হইলঃ (ক) ইবনে মাজাহ (খ) সুনানে দারেমী। এই গ্রন্হদ্বয় কোন পর্যায়ে গণ্য তাহা আলোচনা সাপেক্ষ।

মুহাদ্দিস আবূ হাসান সনদী লিখিয়াছেনঃ

মোটকথা ইবনে মাজাহ মর্যাদার দিক দিয়া প্রধান পাঁচখানি গ্রন্হের পরে ও নিম্নে অবস্থিত।

আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইয়ামানী লিখিয়াছেনঃ

সুনানে ইবনে মাজাহ আবূ দাঊদ ও সুনানে নাসায়ীর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্হ। উহার হাদীসসমূহ পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করা আবশ্যক। কেননা উহাতে ফযীলত সংক্রান্ত অধ্যায়ে একটি মওযু হাদীস রহিয়াছে।

এই সব উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাজাহ তৃতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্হ।

সুনানে দারেমী সম্পর্কেও হাদীস বিজ্ঞানিগণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী (র উহাকে এই তৃতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীর মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। শাহ ওলীউল্লাহ দেহল্‌বী (র)-রও এই মত।

হাদীস বর্ণনায় রাসূল (ﷺ)-এর নৈকট্য

হাদীস গ্রন্হ-প্রণেতাগণ সাধারণত হাদীষ বর্ণনার এমন সব সূত্রের অনুসন্ধান করিয়াছেন, যাহার মাধ্যমে রাসূলের সহিত নিকটতর সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। অর্থাৎ হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নকারী মুহাদ্দিসগণ রাসূলের নিকট হইতে যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে হাদীস লাভ করিতে পারিতেন তাহার জন্য তারা বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেন। ফলে যে হাদীস যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে গ্রন্হকার পর্যন্ত পৌঁছিত, মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে উহার গুরুত্ব ও মর্যাদা ততই বেশি হইত, ততই তাহা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হইত। কেননা হাদীস বর্ণনার সূত্রে মধ্যবর্তী লোক যতই কম হয়, হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারীর পক্ষে রাসূলে করীমের ততই নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, হাদীস বর্ণনা পরম্পরা () যতই সংক্ষিপ্ত ও অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যক বর্ণনাকারী সম্বলিত হয়, তাঁহাদের অবস্থান যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা ততই সহজসাধ্য হয়। হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ভূল-ভ্রান্তিও ততই কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই দিক দিয়া সমস্ত হাদীস গ্রন্হ প্রণেতার মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর স্থান সর্বোচ্চ। ইহার কারণ এই যে, তিনি অন্তত চারজন সাহাবীল সরাসরি সাক্ষাৎ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন।

হাদীষ বর্ণনা সূত্রে দীর্ঘতা ও স্বল্পতার দিক দিয়া কয়েকটি পরিভাষার উদ্ভব হইয়াছে। এখানে উহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

‌১. যেসব হাদীস রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে গ্রন্হ প্রণয়নকারী পর্যন্ত মাত্র একজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পৌঁছিয়াছে, সেইসব হাদীসকে বলা হয় ‘ওয়াহদানীয়াত’ () ‘এক বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীস’।

ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত হাদীস গ্রন্হ এই ধরণের কয়েকটি হাদীসই উদ্ধৃত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

আবূ হানীফা বলিয়াছেন, আমি আয়েশা বিনতে আজরাদকে বলিতে শুনিয়াছিঃ নবী (ﷺ) বলিয়াছেনঃ আল্লাহর সবচেয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্য হইতেছে জুরাদ-(বিশেষ জাতীয় ফড়িং), আমি নিজে উহা খাই না, আর উহাকে হারামও বলি না।

[এই হাদীসটি মুসনাদ আবূ হানীফা গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনের ইতিহাস গ্রন্হেও ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে ।

উদ্ধৃত হাদীসটি রাসূলের নিকট হইতে আবূ হানীফা পর্যন্ত মাত্র একজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পৌঁছিয়াছে। তিনি হইতেছেন হযরত আয়েশা বিনতে আজরাদ নামের একজন মহিলা সাহাবী। এই কারণে এই হাদীসটি ‘ওয়াহদানীয়াত’- এক ব্যক্তির মধ্যস্ততাসম্পন্ন হাদীসের পর্যায়ভুক্ত।

বহু সংখ্যক হাদীস এমন রহিয়াছে, যাহা মাত্র দুই পর্যায়ের বর্ণনাকারীর মাধ্যমেই আবূ হানীফা (র) পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে। তিনি নিজে অপর তাবেয়ীদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন। তাবেয়ী উহা শ্রবণ করিয়াছেন সাহাবীদের নিকট হইতে। হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত রাসূলের নিকট হইতে এই হাদীসটি পৌঁছিতে মাত্র দুই স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যম রহিয়াছে। অতএব পরিভাষার এই হাদীসসমূহে বলা হয় ‘সুনায়ীয়াত ()- দুই স্তরের বর্ণনকারী সম্বলিত হাদীস। ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত ‘কিতাবুল আ-সা-র’ গ্রন্হে এই ধরনের বহু হাদীসই উদ্ধৃত হইয়াছে। এখানে মাত্র দুইটি হাদীসের সনদ উল্লেখ করা হইয়াছে।

(১)

আবূ হানীফা বলেনঃ আমার নিকট আবূয-যুবাইর, তিনি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ হইতে, তিনি রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।………….

এই সনদে বর্ণিত হাদীসটিতে ইমাম আবূ হানীফা ও রাসূলে করীমের মাঝখানে ‘আবুয-যুবাইর তাবেয়ী ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ সাহাবীর মধ্যস্থতা রহিয়াছে।

(২)

আবু হানীফা বলিয়াছেনঃ নাফে আমাদের নিকট ইবনে উমর হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাসূলে করীম (ﷺ) নিষেধ করিয়াছেন।………..

এই সনদে ইমাম আবূ হানীফা পর্যন্ত রাসূলের হাদীস পৌঁছিতে তাবেয়ী নাফে ও সাহাবী ইবন উমর – এই দুই স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে রহিয়াছে মাত্র।

ইমাম মালিক যেহেতু তাবেয়ী নহেন, তিনি হইতেছেন তাবেয়ীদের পরবর্তী স্তরের লোক- তাবে-তাবেয়ী, সেই কারণে তাঁহার সংকলিত হাদীসসমূহের অধিকাংশই এই ‘সুনায়িয়াত পর্যায়ভুক্ত। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম ইবনে হাম্বল কোন তাবেয়ীরও সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারেন নাই। এই কারণে তাঁহাদের সংকলিত হাদীস প্রায়ই সুলাসীয়াত- তিন স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীসের পর্যায়ভুক্ত। সুনানে দারেমী গ্রন্হে পনেরটি হাদীস এমন রহিয়াছে, যাহা তিনি রাসূলের পর তিন স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শুনিতে পাইয়াছিলেন।

সিহাহ-সিত্তা প্রণেতাগণের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম তিরমিযীও কোন কোন তাবেয়ীর সাক্ষাৎ পাইয়াছেন; তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও বর্ণনা করিয়াছেন। এই কারণে সনদের উচ্চতার দিক দিয়া তারাও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সামন স্তরে রহিয়াছেন। যদিও ইমাম শাফেয়ীর ইন্তেকালের সময়ে (মৃঃ ২০৪ হিঃ) ইমাম বুখারীর বয়স হইয়াছিল মাত্র দশ বৎসর, ইমাম আবূ দাঊদের ছিল মাত্র দুই বৎসর, ইমাম ইবনে মাজাহ তো তখন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেন নাই।

ইহাদের গ্রন্হাবলীতে উপরোক্ত তিন স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীসের সনদের সংখ্যা নিম্নরূপঃ

১) সহীহ বুখারী শরীফে ২২টি, ২).সুনানে ইবনে মাজাহ ৫টি, ৩) সুনানে আবূ দাঊদ ১টি ৪) জামে তিরমিযী ১টি।

ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসায়ী সরাসরি কোন তাবেয়ী হইতে হাদীস বর্ণনা করেন নাই। এইজন্য তাঁহাদের বর্ণিত সমস্ত হাদীসই চার স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত।

হাদীস জালকরণ ও উহার কারণ

হাদীস সংকলনের যে দীর্ঘ ইতিহাস ইতিপূর্বে পাঠকদের সম্মুখে পেশ করা হইয়াছে তাহা হইতে এই কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, হাদীসের উৎপত্তিকাল হইতে গ্রন্হকারে সংকলিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরে উহা সংরক্ষণের জন্য সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হইয়াছে। রাসুলের হাদীস যাহাতে সর্বোত্তমভাবে সংরক্ষিত থাকে, উহাতে কোন প্রকার সংমিশ্রণ না ঘটে এবং উহা বিলীন হইয়া না যায় সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রৃহণে কোন এক স্তরেই এক বিন্দু উপেক্ষা, অসতর্কতা বা গাফিলতির প্রশয় দেওয়া হয় নাই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, হাদীসের এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় এমন এক-একটি অব্স্থা দেখা দিয়াছে, যখন দুষ্ট লোকেরা স্বার্থ কিংবা অসদুদ্দেশ্যে প্রণোদিত হইয়া নিজেদের ‘কথা’কে রাসূলের হাদীস নামে চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছে এবং এমন কিছু কিছু ‘কথা’ রাসূলের বিরাট হাদীস সমুদ্রের সহিত মিশিয়া যাইবার সুযোগ লাভ করিয়াছে।

রাসূলের হাদীস সংরক্ষণের এই অবিমিশ্র ও নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় এইরূপ একটি দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটিতে পারিল, তাহা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তাহা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ সাপেক্ষও।

আমরা এখানে হাদীস জালকরণের এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপকভাবে আলোচনা করিব।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পুংখানুপুংখভাবে পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় সর্বপ্রথম হাদীস জালকরণের কাজ প্রখ্যাত ‘খাওয়ারিজ’দের কর্তৃক সূচিত হয়। সিফফীন যুদ্ধে (৩৬ হিঃ) সন্ধিসূত্র লইয়া হযরত আলী (রা)-এর সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক মতভেদ দেখা দেয় এবং তাহারা এই সন্ধিকে মানিয়া লইতে বিন্দুমাত্র রাযী হয় না। অতঃপর তাহারা এক স্বতন্ত্র ধর্মীয় দলের রূপ ধারণ করে।

খাওয়ারিজগণ হাদীস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। তাহারা অন্যান্য লোকের নিকট হইতে কোন কথাকেই সত্যরূপে গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তাহারা মিথ্যুককে মনে করিত কাফির। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাহারা হাদীস জালকরণের কাজ করিতে ও রাসূলের নামে মিথ্যা প্রচার করিতে শুরু করে। আর ইহার মূলে তাহাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজেদের বিশেষ মতের সমর্থন যোগানো মাত্র।

আল্লামা ইবনুল জাওজী তাঁহার ‘কিতাবুল মওজুআত’ নামক গ্রন্হে ইবনে লাহইয়ার নিম্নোক্ত উক্তির উল্লেখ করিয়াছেনঃ

এই হাদীস দ্বীন-ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। দ্বীনের এই ভিত্তিগত জিনিস তোমরা যাহার নিকট হইতে গ্রহণ কর, তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিও। কেননা আমরা যখন যাহা ইচ্ছা করিতাম তখনি উহাকে হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতাম।

অর্থাৎ এই ব্যক্তি পূর্বে খাওয়ারিজ দলভুক্ত ছিল এবং তখন ইচ্ছামত কথা রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিত। খাওয়ারিজদের কর্তৃক হাদীস জালকরণের গোড়ার কথা ইহাই।

ইহারি পর আমরা শিয়া সম্প্রদায়কেও হাদীস জালকরণ কাজে লিপ্ত দেখিতে পাই। তাহারা আসলে ছিল ইসলামের উৎকট দুশমন। ইসলামের মূল বুনিয়াদের উ পর আঘাত হানিবার অবাধ সুযোগ লাভের কুমতলবে তাহারা শিয়া মতবাদের চরম বিভ্রান্তির আশ্রয় লইয়াছিল। প্রথমে তাহারা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত চরম বিকৃতি ও কদর্থ প্রবিষ্ট করাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাতে তাহারা কোন সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না মনে করিয়া রাসূলের হাদীসের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করে এবং রাসূলের হাদীসের নামে অসংখ্য মিথ্যা কথা চালাইয়া দিতে চেষ্টা করে। তাহারা হযরত আলীর উচ্চ প্রশংসা ও হযরত মুয়াবিয়ার মর্যাদা লাঘবের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক হাদীস জাল করে। হযরত আলীর স্বপক্ষে এমন অনেক হাদীস তাহারা চালাইয়া দিয়াছে, যাহার কোন কোনটি হইতে হযরত আলীর নবুয়্যাত এবং কোন কোনটি দ্বারা রাসূলের পরে হযরত আলীর খিলাফতের অধিকার প্রমাণিত হয়।

শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রধান ‘হাদীস রচনাকারী’ হইতেছে মুখতার ইবনে আবূ উবাইদ। তিনি প্রথমে ছিলেন খাওয়ারিজ দলভুক্ত। পরে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সমর্থকদের মধ্যে শামিল হন। আর শেষ পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ শিয়া মত ধারণ ও শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া যান। তিনি প্রকাশ্যভাবে হাদীস জাল করিতেন। তিনি যখন কূফার আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন, তখন জনৈক মুহাদ্দিসকে বলিয়াছেনঃ

আমার জন্য রাসূলের নামে এমন কিছু হাদীস রচনা করিয়া দাও, যাহা হইতে প্রমাণিত হইবে যে, তিনি (মুখতার) তাহার পরই খলীফা হইবেন।

মুসলমানদের মধ্যে যাহারা দুর্বল ঈমানদার তাহারাও রাসূলের নামে অনেক হাদীস জাল করিতে শুরু করে। তাহারা হযরত আলীর সম্মান লাঘব এবং হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের অধিক মর্যাদা প্রমাণের জন্য ও বহু হাদীস রচনা করে।

হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস জালকরণের এক নূতন ফিতনা জাগ্রত হয়। লোকেরা কিসসা-কাহিনী, মিথ্যঅ ও অমূলক কিংবদন্তী হাদীসের রূপে বর্ণনা পরম্পরা সূত্র সহকারে প্রচার করিতে শুরু করে। এই সময়কার হাদীস রচয়িতাদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থবাদী, কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ও গোপনে ধর্মদ্রোহিতাকারী লোকেরাই প্রধান হইয়া দেখা দেয়।

[এই দীর্ঘ আলোচনার উৎসঃ ]

উপরোক্ত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, মোটামুটি তিনটি কারণে ইসলামে হাদীস জালকরণের ফিতনার উদ্ভব হয়ঃ

ক) রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের মতের প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য স্থাপন, নিজেদের আচরিত রাজনৈতিক মতাদর্শকে সপ্রমাণিতকরণ ও জনগণের নিকট উহাকে গ্রহণযোগ্য করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।

খ) জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচার, ওয়ায-নসীহত দ্বারা জনগণকে অধিক ধর্মপ্রাণ বানানো, ইবাদত বন্দেগীতে অধিকতর উৎসাহী বানানো এবং পরকালের ভয়ে অধিক ভীত করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।

গ) ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভ উহাকে সহজসাধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে মনগড়া কথাকে ‘হাদীস’ নামে চালাইয়া দেওয়া।

বিশেষ রাজনৈতিক কারণে হাদীস রচনা করা হয় প্রথমত হযরত আলী (রা)-কে কেন্দ্র করিয়া। নবী করীমের পরে তিনিই যে খলীফা হইবার অধিকারী- অন্য কেহ নয়, এই কথা প্রমাণ করাই এইরূপ হাদীস রচনার উদ্দেশ্য ছিল। এই পর্যায়ের তিনটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ

ক) নবী করীম (ﷺ) বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় ‘গাদীরে খাম’ নামক স্থানে যে ভাষণ দান করেন, তাহাতে তিনি হযরত আলীর প্রতি ইশারা করিয়া নিম্নোক্ত কথাও বলিয়াছিলেন বলিয়া প্রচার করা হয়ঃ

(ক)

এই ব্যক্তিই আমার উত্তরাধিকারী, আমার ভাই, আমার পরে এই-ই খলীফা; অতএব তোমরা সকলে তাহার কথা শোন এবং তাহাকেই মানিয়া চল।

(খ)-

আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ এমন এক পূণ্য যে, ইহা থাকিলে কোন পাপই তাহার ক্ষতি করিতে পারিবে না। পক্ষান্তরে, আলীর প্রতি হিংসা ও শক্রতা পোষণ এমন এক পাপ যে, কোন নেক কাজই তাহাকে কোন ফায়দা দিতে পারে না।

যে ব্যক্তি হযরত আলীর প্রতি হিংসা পোষণ করা অবস্থায় মরিবে, সে হয় ইয়াহুদী কিংবা নাসারা হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইবে।

হাদীস নামে প্রচারিত এই বাক্যত্রয় যে কিছুতেই হাদীসে রাসূল হইতে পারে না; বরং ইহা নিছক রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে স্বকপোলকল্পিত তাহা প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝিতে পারা যায়।

হযরত আলী নবী করীমের উত্তরাধিকারী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে শিয়াগণ যে কত শত হাদীস জাল করিয়া চালাইয়াছে, তাহার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকটি কথাই যে সুস্পষ্ট মিথ্যা, তাহা হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস হইতেও প্রমাণিত হয় এবং তাহা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য বিবেচিত হয়।

ইহার বিপরীত দিকে হযরত আবূ বকর ও উমরের অতিরিক্ত প্রশংসায় যেসব জাল হাদীস প্রচার করা হইয়াছে তাহাও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বিবেচিত হইতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।

দৃষ্টান্তস্বরূপ এই পর্যায়ের দুইটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

আমাকে যখন আকাশের দিকে মি’রাজে লইয়া যাওয়া হইল, তখন আমি বলিলামঃ হে আল্লাহ! আমার পরে আলী ইবনে আবূ তালিবকে খলীফা বানাও। তখন আকাশ-জগত কম্পিত হইয়া উঠিল এবং সর্বদিক হইতে ফেরেশতাগণ অদৃশ্য ধ্বনি করিয়া উঠিলেনঃ হে মুহাম্মদ! আল্লাহর এই আয়াত পাঠ কর, (যাহার অর্থ) তোমরা কিছু চাহিতে পারিবে না, আল্লাহ যাহা চাহিবেন তাহাই হইবে। আর আল্লাহ ইচ্ছা করিয়াছেন যে, তোমার পরে আবূ বকর সিদ্দীকই খলীফা হইবে।

বেহেশতের প্রত্যেকটি বৃক্ষের প্রত্যেকটি পত্রে লিখিত আছেঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, আবূ বকর, উমর ফারুক ও উসমান যুন্নুরাইন।

হযরত মুয়াবিয়ার প্রশংসায়ও হাদীস জাল করা হইয়াছে। যেমনঃ

তোমরা যখন মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বারে দাঁড়াইয়া খুতবা দিতে দেখিবে, তখন তাঁহাকে তোমরা গ্রহণ করিও, কেননা সে বড়ই বিশ্বস্ত-আমানতদার ও সুরক্ষিত।

এইভাবে জনগণের মধ্যে ভিত্তিহীন ও নিতান্ত অমুলক অনেক কথাই রাসূলের হাদীস নামে প্রচার করা হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের আরো তিনটি কথা উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

(ক) – জন্মভূমির প্রেম ঈমানের অংশ।

(খ)- হে মুহাম্মদ! তোমাকে যদি সৃষ্টি করিতে না হইত, তাহা হইলে এই আকাশমণ্ডল ও জগতই সৃষ্টি করিতাম না’।

(গ)- আলী ইবনে আবূ তালিবের জন্য অস্তমি সূর্যকে পুনরুত্থিত করা হয়।

[আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ এই হাদীসের কোন ভিত্তি নাই। ইবনে জাওজী দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ “ইহা হাদীস নয়, রচিত কথা। অবশ্য ইমাম সয়ূতী ও তাহাভী সহীহ বলিয়া দাবি করিয়াছেন। ]

এই তিনটি কথাই হাদীসরূপে সমাজে প্রচারিত হইয়াছে এবং ওয়াজকারীদের মুখে মুখে ব্যাপক প্রচার লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতপকেষ এই তিনটি কথাই সম্পূর্ণ মিথ্যা- জাল।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন