hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

হাদীস সংকলনের ইতিহাস

লেখকঃ মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)

৩৫
হাদীস লিখন
হাদীস সংরক্ষণের যে স্বাভাবিক ব্যবস্থার বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে, হাদীস সংরক্ষণের মূলে তাহাই একমাত্র উপায় ছিল না। বরং ইহা হইতেও অধিকতর দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষিত হইয়াছে। হাদীস সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা হইতেছে হাদীস লিখন।

হাদীস সম্পর্কে সাধারণ একটি ভূল ধারণা অনেক লোকের মনেই বদ্ধমূল দেখা যায়। হাদীসরে শক্রগণ উহাকে হাদীসের অমৌলিকত্ব ও অপ্রামাণিকতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে একটি যুক্তি হিসাবে পেশ করিয়া থাকে। তাহা এই যে, হাদীস নবী করীম (ﷺ)- এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয় নাই, হইয়াছে তাঁহার ইন্তেকালের শতাব্দীকাল পরে। অতএব তাঁহাদের মতে হাদীস বিশ্বাসযোগ্য নহে।

কিন্তু হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করিলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, এই ধারণা আদৌ সত্য নহে, বরং ইহা শক্রদের অপপ্রচার ও মিথ্যা রটনা মাত্র। ইতিহাস ইহার তীব্র প্রতিবাদ করে।বস্তুত হাদীস সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি এতখানি ভিত্তিহীনি ও অপ্রমাণিত থাকিতে পারে না। ইহার সংরক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সম্ভাব্য ব্যবস্থাই যথাসময়ে গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহাকে যেমন মুখস্থ করা ও স্মরণ রাখা হইয়াছে, নানাভাবে ইহার চর্চা করা হইয়াছে; অনুরূপভাবে ইহার জন্য যথাসময়ে ও যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও ব্যবহার এবং প্রয়োগ হইয়াছে- আর সর্বোপরি এই সব ব্যবস্থার মধ্যে কোন একটিরই উপর একান্তভাবে নির্ভর করা হয় নাই, একটির উপর নির্ভর করিয়া অন্য সব উপায়ের প্রতি কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় নাই। বরং একই সঙ্গে ও প্রায় একই সময় এই সব ব্যবস্থাই একটি শ্রেণী পরস্পরা নিমানুযায়ী কার্যকর করা হইয়াছে। হাদীস লিখন সম্পর্কে আমাদের বর্তমান পর্যায়ের আলোচনা হইতেই তাহা পাঠকদের সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠিবে।

প্রথমেই উল্লেখ করিয়াছি, নবুয়্যাতের প্রথমকালে যখন কুরআন মজীদ নাযিল হইতেছিল, তখনই রাসূলে করীম (ﷺ) তাহা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য বহু ‘ওহী লেখক’ নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

[ এক বিবরণ অনুযায়ী ওহী লেখকদের সংখ্যা ছিল অন্ততপক্ষে চল্লিশজন।] হযরতের প্রতি কোন আয়াত বা সূরা নাযিল হইলেই তাহা একদিকে যেমন তিনি সমবেত ইসলামী জনতাকে একটি ভাষণের ন্যায় মুখস্থ পড়িয়া শোনাইতেন, অপরদিকে সেই সঙ্গে উক্ত ওহী লেখকদের দ্বারা তাহা সঠিকরূপে লিখাইয়ও রাখিতেন। ইহা ছিল রাসূলে করীমের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যবস্থা। ইহার ফলেই রাসূলের জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত কুরআন মজীদ পূর্ণ লিখিত ও সংরক্ষিত রূপ লাভ করিতে সমর্থ হয়।

কিন্তু এই সময় কেবল যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘ওহী লেখক’-ই ওহী বা কুরআন লিখিয়া রাকিতেন, আর অপর কোন সাহাবী তাহা লিখিতেন না, তাহা নহে। বরং রাসূলে করীম কর্তৃক নিযুক্ত লেখক ছাড়া আরো বহু সাহাবী রাসূলের দরবারে উপস্থিত থাকিয়া নিজস্বভাবে কুরআনের আয়াত লিখিয়া রাখিতেন।

রাসূলে করীমের হাদীস লিখনের ব্যাপারেও আমরা তাহাই দেখিতে পাই। সেখানে কিছু সংখ্যক সাহাবী রাসূলের অনুমতিক্রমে এবং বহ লোক নিজস্বভাবে স্বকীয় উদ্যোগে হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ইহাতে একটি অসুবিধা দেখা দেয়। তাহা এই যে, বহুসংখ্যক সাহাবী রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছুই শুনিতে পাইতেন, তাহা আল্লাহর বাণী হউক কি রাসূলের নিজস্ব কথা- সবই একসঙ্গে ও একই পাত্রে লিখিতে শুরু করেন। ইহার ফলে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হইয়া যাওয়ার এবং উহাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা কঠিন হইয়া পড়ার তীব্র আশংকা দেখা দেয়। আর ইহার পরিণাম যে কত ভয়াবহ, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। নবী করীম (ﷺ) ইহাকে কিছুতেই সমর্থন করিতে পারেন না। এইরূপ লেখকদের লিখিত জিনিস দেখিয়া তিনি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে হযরত আবূ সাঈদ (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ একদা কিছু সংখ্যক সাহাবী বসিয়া লিখিতেছ? তারা বলিলেনঃ ‘আপনার নিকট হইতে যাহা শুনিতে পাই, তাহাই আমরা লিখিয়া লইতেছি। তখন তিনি বলিলেনঃ আল্লাহর কিতাবের সংগে মিশাইয়া আর একখানা কিতাব লিখিত হইতেছে কি?

ইহার অথ এই যে, কুরআন ও হাদীস একত্র মিলাইয়া মিশাইয়া লিপিবদ্ধ করা ও উহাদের মধ্যে পার্থক্য করার কোন ব্যবস্থা না করা কুরআনের চিরস্থায়ী ও অক্ষুণ্নতার পক্ষে যেমন মারাত্মক, তেমনি মারাত্মক দ্বীন-ইসলামেন ভিত্তির দৃঢ়তা ও নির্ভরযোগ্যতার পক্ষেও। এই কারণে রাসূলে করীম (ﷺ) তাঁহাদিগকে আদেশ দিলেনঃ

এইরূপ লেকার নিয়ম তোমরা ত্যাগ কর। কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাব খালিসভাবে লিপিবদ্ধ কর। উহার সহিত অন্য কিছুই মিলইও না।

ফলে এইসব সাহাবী কর্তৃক কুরআন ও হাদীস মিলাইয়া যাহা কিছু লিখিত হইয়াছিল, তাহা সব বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হয়, অতঃপর কুরআনকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে লিপিবদ্ধ করা হইতে থাকে।

[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭১, মজমায়ুজ জাওয়ায়িদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫২।]

রাসূলে করীমের এই কাজ ও কথার যৌক্তিকতা একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায়। কুরআনকে যদি কোন একজন সাহাবীও হাদীসের সঙ্গে একত্র করিয়া লিখিয়া রাখিতেন, তাহা হইলে উত্তরকালে উহা কুরআন মজীদের নির্ভরযোগ্যতার বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইত। কুরআন মজীদকে বর্তমানের ন্যায় খালিসভাবে অবিকৃত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক মহান গ্রন্হ হিসাবে দুনিয়ার মানুষ কিছুতেই লাভ করিতে পারিত না; আল্লাহর কালাম এবং রাসূলের কথা ও কাজের বিবরণকে আলাদা আলাদাভাবে জানিতে ও চিহ্নিত করিতে সমর্থ হইত না। এই কারণে প্রতশ পর্যায়ে নবী করীম (ﷺ) কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিপিবদ্ধ করিতে সাহাবাগণকে স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায় নিষেধ করিয়াছিলেন; কিন্তু উহার মৌখিক প্রচার ও বর্ণনা করিতে রাসূলে করীম (ﷺ) আদৌ নিষেধ করেন নাই। নবী করীম (ﷺ)-এর বাণী নিম্নরূপঃ

আমার কোন কথাই লিখিও না। কুরআন ব্যতীত আমার নিকট হইতে অন্য কিছু কেহ লিখিয়া থাকিলে তাহা মুছিয়া ফেল। তবে আমার কথা বা আমার সম্পর্কে কথা মৌখিক বর্ণনা কর, তাহাতে দোষ নাই। কিন্তু মৌখিক বর্ণনায়ও যেন কোন প্রকার মিথ্যার প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। বস্তুত যে আমার সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় গ্রহণ করে।

[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৪, আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিতঃ ]

হযরত আবূ সাঈদ বর্ণিত আর একটি হাদীস নিম্নরূপঃ

আমরা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট (কুরআন ছাড়া অন্য কথা-হাদীস) লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার অনুমতি চাহিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি আমাদিগকে অনুমতি দেন নাই।

হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা) হইতেও এই অর্থেরই একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাহা এইঃ

রাসূলে করীম (ﷺ) আমাদিগকে (কুরআন ব্যতীত) কোন কিছুই না লিখিতে আদেশ করিয়াছেন।

[ঐ]

কুরআন ব্যতীত কোন কিছু লিখিতে নিষেধ করার ও সেই ‘অন্য কিছু’ লিখিবার অনুমতি না দেওয়ার গভীর তাৎপর্য রহিয়াছে। রাসূলে করীম (ﷺ)- এর এইরূপ করার মুলীভুত কারণ কি, তাহা অবশ্যই প্রণধানযোগ্য।

ইহার প্রথশ কারণ কুরআনের সাথে অন্য জিনিস মিলাইয়া মিশাইয়া লিখায় ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশংকা। এই সময় পর্যন্ত মুসলমানগণ সাধারভাবে কুরআনের বিশেষ ভাষা, ভাব ও বাণী এবং উহার গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাবধারার সহিত পুরামাত্রায় পরিচিত হইতে পারেন নাই। কুরআন ও অ-কুরআনের মাঝে পার্থক্য করার মত তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও বিবেক-বুদ্ধিও তাহাদের মধ্যে তখনও জাগ্রত হয় নাই। ইহার দ্বিতীয় কারণ এই যে, রাসূলে করীম (ﷺ)- এর এই নিষেধ ছিল সেই সব সাহাবীদের প্রতি, যাহাদের স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, যাঁহারা কানে শুনিয়া খুব সহজেই স্মৃতিপটে মুদ্রিত করিয়া লইতে পারিতেন, কিছু মাত্র ভুলয়া যাইতেন না। কেননা এই শ্রেণীর সাহাবিদণও যদি লেখনীর উপর নির্ভরশীল হওয়ার অভ্যাস করিতে শুরু করেন, তাহা হএল স্মৃতিশক্তির প্রাখর্য হ্রাস পাওয়ার নিশ্চিত আশংকা রহিয়াছে। এবং এইভাবে আল্লাহর এ মহান নিয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন কিছুতেই উচিত হইতে পারে না।

ইমাম নববী ও সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

হাদীস লিখিতে প্রথমত নিষেধ করা হইয়াছিল। কুরআন পরিচিত হওয়ার পূর্বে এই নিষেধ ছিল প্রত্যেকেরই জন্য। তখন কুরআন ব্যতীত অপর কোন কিছুই লিখিয়া রাখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল কুরআনের সঙ্গে উহার মিশ্রিত হওয়ার ও তদ্দরুন সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে। পরে যখন কুরআন সর্বজনপরিচিত হ্য় এবং এই ভয়ের কারণ হইতে নিরাপত্তা লাভ হয় তখন উহা লিখিবার অনুমতি দেওয়া হয়।

আর দ্বিতীয়ত যাঁহাদের স্মরণশক্তি নির্ভরযোগ্য ছিল, তারা কেবল লেখনীর উপর নির্ভর করিয়া বসিতে পারে- এই ভয়ে তাঁহাদিগকে লিখিতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সে নিষেধের ফলে লেখা মূলতই হারাম ছিল না। যাঁহাদের স্মরণশক্তি নির্ভরযোগ্য ছিল না, তাঁহাদিগকে হাদীস লিখিয়া লওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

ইমাম খাত্তাবী এই প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

মনে হয় হাদীস লিখিতে নিষেধ করা প্রথশ যুগের ব্যাপার ছিল। পরবর্তীকালে ইহা জায়েয করা হইয়াছে। আর নিষেধ করা হইয়াছিল কুরআনের সহিত মিশাইয়া একই কাগজে হাদীসি লিখিতে। কেননা তাহার ফলে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হইয়া যাইত এবং তাহা পাঠকদের পক্ষে বড় সন্দেহের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইত।

ইমাম নববী ও ইমাম খাত্তাবীর এই বিশ্লেষণ হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম পর্যায়ে সকলকেই কুরআন ব্যতীত অপর কিছু লিখিতে নিষেধ করা হইলেও তাহাতে ব্যতিক্রম ছিল। নবী করীম (ﷺ) সাহাবীদের স্মরণশক্তিকে পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োজনীয় কাজে প্রয়োগ করিতে চাহিয়াছিনে। এই কারণে প্রচণ্ড স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোকদিগকে হাদীস মুখস্থ করা পরিত্যাগ করিয়া কেবল লেখনী শক্তির উপর নির্ভরশীল হইতে নিষধ করিয়াছিলেন। কিন্তু যাঁহারা স্মরণশক্তি ও লেখনী উভয় শক্তির ব্যবহার করিতে চাহিয়াছেন, তাঁহাদিগকে তিনি হাদীস লিখিতে নিষেধ করেন নাই। বরং তাঁহাদিগকে অনুমতিই দিয়াছেন। নিম্নের হাদীস হইতেও এই কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ঃ

আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি রাসূলের নিকট আসিয়া বলিলেনঃ হে রাসূল ! আমি হাদীস বর্ণনা করিতে চাহি। এইজন্য আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে লেখনীর ও সাহায্য গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, অবশ্য আপনি যদি তাহা পছন্দ করেন। তখন নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ আমার হাদীস লিখিতে চাহিলে উহা স্মরণ রাখার সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়অ রাখার কাজও করিতে পার।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৭।]

শুধু তাহাই নয়, নবী করীম (ﷺ)- এর দরবারে বহু সংখ্যক লেখনীধারক লোকই সব সময় উপস্থিত থাকিতেন এবং রাসূলের মুখে যে কথাই তারা শুনিতে পাইতেন, তাহাই লিখিয়া লইতেন- তাহাও এক ঐতিহাসিক সত্য। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমরের নিম্নোক্ত কথা হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়ঃ

আমরা বহু কয়জন লোক রাসূলের চতুর্থাংশে লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় রাসূলে করীম (ﷺ)-কে প্রশ্ন করা হইলঃ কনস্টান্টিনোপাল নগর প্রথম বিজিত হইবে, না রোম? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ না হেরাক্লিয়াসের শহুর কনস্টান্টিনোপালই প্রথম বিজিত হইবে।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৮।]

এই বর্ণনায় প্রথম বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে করীম (ﷺ) যখনই দরবারে বসিতেন, তখনই তাঁহার চারিপার্শ্বে লেখকগণও বসিয়া যাইতেন। আর এই সব দলীল-প্রমাণ হইতে এই কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, প্রথম পর্যায়ে প্রধানত কেবলমাত্র কুরআন মজীদই লিপিবদ্ধ হইতে থাকে। আর হাদীসি লেখার জন্য সরকারী পর্যায়ে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নাই। তখন হাদীস সাধারণভাবে মুখস্থ করা, মৌখিক চর্চা, বর্ণনা ও আলোচনার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়। এইভাবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর সাহাবিগণকে হাদীসলেখার সাধারণ অনুমতি দেওয়া হয়। তখন হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে কুরআনের মতই সাহাবীদের স্মরণশক্তি, পারস্পরিক চর্চা ও বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে লেখনীশক্তিরও পূর্ণ ব্যবহার হইতে থাকে।

ইবনে কুতাইবা লিখিয়াছেনঃ

প্রথমে হাদীসি লিখিতে নিষেধ করেন এবং পরে লিখিয়া হিফাজত করার প্রযোজনীয়তা বুঝিতে পারেন।

আল্লামা ইবন জাওযী লিখিয়াছেনঃ

প্রথমাবস্থায় লিখিতে নিষেধ করিয়াছেন। পরে লিখিবার অনুমতি দান করেন।

এই পর্যায়ে তিনি সাহাবীদের লক্ষ্য করিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেনঃ

ইলমে হাদীসকে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখ।

ইলমে হাদীসকে লিখন সম্পর্কিত মূল মাসালাটি সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা অবতারণা করা আবশ্যক। হাদীস লিখিয়া রাখা আদৌ জায়েয ছিল কিনা, সে বিষয়েও মতভেদ রহিয়াছে। আমাদের মতে হাদীস লিখিয়া রাখা শুধু জায়েযই নহে, ইহা ছিল দ্বীনের এক অতি জরুরী কাজ। স্বয়ং কুরআন মজীদ সবরকমের জরুরবী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখনী ব্যবহারের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়াছেন। আল্লাহ তা’আল্লা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

লেন-দেন ছোট হউক কি বড় ব্যাপার হউক, নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্তের জন্য তোমরা লিখিয়া রাখিতে একবিন্দু অবহেলা করিও না। লিখিয়া লওয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই ইনসাফপূর্ণ, প্রমাণ রক্ষার জন্য সুষ্ঠু ও সন্দেহ হইতে বাচিঁবার জন্য অতি উত্তম ব্যবস্থা।

[সূরা আল-বাকারা, ২৮২ আয়াত। মনে রাখা আবশ্যক যে, এই সূরাটি হিজরতের পর মদীনীয় জীবনের প্রথম অধ্যায়েই নাযিল হইয়াছিল এবং এই সময়ই সব লিখিয়া লইবার তাকীদ করায় হাদীস লিখিয়া রাখার কাজও সাহাবীগণ অবশ্যই করিয়া থাকিবেন। ফলে ইহাকে রাসূলে করীম (ﷺ) নিশ্চয়ই নিষেধ করেন নাই।]

ইমাম আবু হানিফা (র) এই আয়াতের ভিত্তিতে যুক্তি পেশ করিয়া বলিয়াছেনঃ

আল্লাহ তা’আলা যখন সাধারণ লেনদেনের ব্যাপারও সন্দেহ সৃষ্টির আশংকা লিখিয়া লইতে আদেশ করিয়াছেন, আর ইলম –ইলমে হাদীস- মুখস্ত করিয়া রাখা যখন লেনদেনের কথা স্মরণ রাখা অপেক্ষা অনেক কঠিন, তখন এই সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টির ভয়ে তাহা লিখিয়া লওয়া বৈধ হওয়া অধিক প্রয়োজন ও সবচাইতে বেশী উপযুক্ত ব্যাপার।

আল্লামা আবূ মলীহ অপর এক আয়াতের ভিত্তিতে বলিয়াছেনঃ

লোকেরা মুহাদ্দিসগণকে হাদীস লিখিয়া রাখার জন্য দোষ দেয়। অথচ আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলিয়াছেনঃ পূর্বের জাতিসমূহের অবস্থা আল্লাহর নিকট লিখিতভাবে সংরক্ষিত রহিয়াছে।

অথচ আল্লাহ তা’আলা না বিস্মৃত হন, না বিভ্রান্ত হন। এমতাবস্থায়, মানুষ ভূল-ভ্রান্তির প্রতিমূর্তি হইয়াও লিখার প্রয়োজন হইতে কিরূপে মুক্ত হইতে পারে?

অতএব, হাদীস লিখিয়া রাখা কোন কালেই সম্পূর্ণ হারাম ছিল না। শুরুতে উহাকে সাধারণভাবে মুলতবী রাখা হয়- যদিও এই সময় বিশেষ ব্যক্তিতে ইহার অনুমতিও দেওয়া হইয়াছিল।

এই পর্যায়ে যে মতভেদের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার বিশেষ কোন মূল্য নাই। একেবারে প্রাথমিককাল ছাড়া সবসময়ই হাদীস লিখিয়া রাখা সম্পূর্ণ জায়েয ছিল।

ইবনুস সালাহ লিখিয়াছেনঃ

পরে এই মতভেদ দূর হইয়া যায় এবং হাদীস লিখিয়া রাখা মুবাহ হওয়া সম্পর্কে সমস্ত মুসলমানই একমত হন। কেননা উহা যদি তখন লিখিত না হইত, তাহা হইলে শেষকালে উহা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হইয়া যাইত।

নবী (ﷺ) কর্তৃক লিখিত সম্পদ

ইসলামী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে- মক্কী অধ্যায়ে – নবী করীম (ﷺ) কুরআন মজীদ ব্যতীত অন্যকিছু লিখিয়া রাখিবার অনুমতি দেন নাই। তাই হিজরতের পূর্বে মক্কী জীবনে কোন হাদীস লিখিত হইয়াছে বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তো হিজরতের পর মদীনীয় জিন্দেগী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুরআন ছাড়াও হাদীসের বিরাট সম্পদ লিপিবদ্ধ হইতে থাকে। নিম্নলিখিত প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই কথা জোর করিয়া বলা যাইতে পারে যে, মদীনীয় পর্যায়ে- নবুয়্যাতের এয়োদশ চতুর্দশ বৎসরে- কুরআন ও হাদীসের পারস্পরিক পার্থক্য বোধ সুস্পষ্ট হইয়া উঠার পর একদিকে যেমন হাদীস লিখিয়া লইবার সাধারণ অনুমতি প্রদান করা হয়, অন্যদিকে স্বয়ং নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক লিপিবদ্ধ করানো বিপুল সংখ্যক সম্পদ মুসলমানদের হস্তে সঞ্চিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যাইতে পারে যে, বদরের যুদ্ধ-বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে মদীনায় মুসলিম বালকদিগকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হওয়ার পর

হাদীস লেখা অধিকতর সহজ হয় এবং উহার মাত্রাও অধিক ব্যাপক হইয়া পড়ে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন সাঈদ ইবনুল আ’স মদীনার মসজিদে নববীতে রীতিমত লিখা শিক্ষা দেওয়ার স্কুল খুলিয়া দিয়াছিলেন।

এতদ্বত্যতীত মদীনার নয়টি মসজিদে বালকদিগকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হইয়াছিল।

ফলে উত্তরকালে লিখা জানা বা লিখিতে সক্ষম লোকদের কোন অভাবই ছিল না।

ফলে জরুরী লিখার কাজ সম্পন্ন কারর জন্য নবী করীম (ﷺ) নিজের নিকট বহু ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন এবং বহুসংখ্যক লেখক (লিখিতে সক্ষম) নানা বিষয়ের লিখন কার্য সম্পাদনের জন্য রাসূলের দরবারে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত থাকিতেন। আধুনিক ভাষায় বলিলে বলা যায়, তখন মদীনায় একটি পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় গড়িয়া উঠিয়াছিল ও কাজ করিতেছিল। বিশেষ বিশেষ লিখার কাজ সম্পাদনের জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে হযরত আলী (রা), হযরত উসমান (রা), হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা)

ও হযরত উবাই ইবন কাব (রা) প্রমুখ সাহাবী কুরআন মজীদ লিপিবদ্ষ করণের কাজে দায়িত্বশীল ছিলেন। হযরত যুবায়র ইবনূল আওয়াম (রা) ও জহম ইবনুসসালত (রা) ছিলেন যাকাত-সাদাকাত-এর মাল-সম্পদের হিসাবরক্ষক। হযরত আবদুল্লাহ ইবনুল আরকাম (রা) ও আল-উলা ইবন উকবা (রা) জনগনের পারস্পরিক লেন-দেন ও চুক্তি প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত দলীল-দস্তাবিজ লিখিতেন। হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা) খেজুর ফসলের পরিমাণ ও তাহার উপর ধার্য যাকাতের পরিমাণ অনুমানপূর্বক লিখিয়া রাখিতেন। মুয়াইকীব ইবন আবূ ফাতিমাদসী (রা) রাসূলে করীমের প্রাপ্ত মালের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতেন।

রাসূলে করীম (ﷺ)- এর সময়ে যেসব সাহাবী জিহাদে যোগদান করিতেন তাঁহাদের নাম-ধাম পরিচিতি লিখিয়া রাখারও ব্যবস্থা করা হইয়াছিল।

লেখক হিনযিলা (রা) দরবারে প্রত্যেক অনুপস্থিত লেখকের স্থানে কাজ করিতেন। রাসূলে করীম (ﷺ)-এর সিলমোহরও তিনিই ধারণ ও ব্যবহার করিতেন।

বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের জন্য তাহাদের ভাষায় পত্রাদি লিখার কাজ করার জন্য রাসূলে করীম (ﷺ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তদানীন্তন সভ্য দুনিয়ায় প্রচলিত ভাষাসমূহ শিখিয়া লইয়াছেন বহু কয়জন সাহাবী। হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা) সুরীয়ানী ভাষা শিখিবার জন্য আদিষ্ট হইয়া উহা শিখিয়াছিলেন। এই ভাষায় লিখিত কোন পত্র রাসূলের নিকট আসিলে উহা পাঠ করিয়া লিখিত বিষয় সম্পর্কে রাসূলে করীম (ﷺ)- কে অবহিত করিতেন। রাসূলের দরবারে নিয়োজিনত লেখকদের সম্পর্কে বহু গ্রন্হও রচিত হইয়াছে।

১। নবী করীম (ﷺ) মদীনায় হিজরত করিয়া স্থঅনীয়ভাবে বসবাস শুরু করার পর সর্বপ্রথম যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন, মদীনার ইয়াহুদী ও আশেপাশের খৃষ্টান এবং মদীনার আনসার ও মুহাজির মুসলমানদের পাস্পরিক অনাক্রমণ ও অন্যান্য শর্ত স’লিত এক দীর্ঘ চুক্তিনামা রচনা করা তাহার অন্যতম। উহার ভাষা ছিল এইঃ

মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর নবী ও রাসূল কর্তৃক কুরায়শ বংশের মু’মিন মুসলমান ও মদীনাবাসী যাহারা তাহাদের সঙ্গে মিলিত হইবে ও একত্রে জিহাদ করিবে, তাহাদের মধ্যে লিখিত চুক্তিনামা ইহা। সিদ্ধান্ত এই যে, তাহারা অন্যান্য লোকদের হইতে পৃথক এক স্বতন্ত্র উম্মত তথা জাতি হইবে।

এই চুক্তিনামা ইসলামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক অমূল্য সম্পদ। ইহাতে মোট ৫২টি দফা সন্নিবেশিত হয়। ইহাতে মদীনা শরীফকে মুসলমানদের জন্য ‘হেরম’ ঘোষণা করা হয়।

[কিতাবুল আমওয়াল, আবূ দউদ, পৃষ্ঠা ৩১১।] নিম্নোকত্ উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, চুক্তিনামা যথারীতি লিখিত হইয়াছিল এবং ইসলামে ইহই সর্বপ্রথম লিখিত সম্পদঃ

হযরত ‘রাফে’ ইবন খাদীজা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে- তিনি বলেন, মদীনা একটি হেরেম। রাসূলে করীম (ﷺ) উহাকে হেরেম ঘোষণা করিয়াছেন। আমাদের নিকট এই চুক্তিনামা খাওলানী চর্মে লিখিত রহিয়াছে।

হযরত আলী (রা) –এর নিকট এই লিখিত চুক্তিনামাখানি পরবর্তীকাল পর্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। তিনি বলিয়াছেনঃ

আমার নিকট আল্লাহর কিতাব এবং নবী করীম (ﷺ) হইতে প্রাপ্ত এই সহীফাখানি ছাড়া লিখিত সম্পদ আর কিছু নাই। সহিফাখানিতে লিখিত রহিয়াছেঃ মদীনা হেরেম। উহার সীমানা ‘আয়ের’ পাহাড় হইতে ঐ স্থান পর্যন্ত। এই হেরেমে যে কেহ কোন বিদ’আত উদ্ভাবন ও প্রচলন করিবে কিংবা কোন বিদ’আতকারীকে আশ্রয় দান করিবে, তাহারই উপর আল্লাহর ফেরেশতাদের এবং সমস্ত মানুষের লা’নত হইবে। তাহার নিকট হইতে কোনরূপ ব্যয় বা বিনিময় কবূল করা হইবে না। মুসলমানের প্রদত্ত নিরাপত্তা সর্বতোভাবে সমান মর্যাদায় গণ্য হইবে। কেহ যদি মুসলমানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভংগ করে, তবে তাহার উপরও আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত। তাহার নিকট হইতে কোনরূপ ব্যয় বা বিনিময় গ্রহণ করা হইবে না।

বস্তুত সভ্যতার ইতিহাসে এই চুক্তিনামাই একখানি প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্রের মর্যাদর অধিকারী এবং অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দলীল।

১। রাসূলে করীম (ﷺ) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর মুসলিম নাগরিকদের আদশুমারী গ্রহণ করেন। তিনি এ্ই উদ্দেশ্যে নিম্নোক্তদ্ধৃত ভাষায় এক ফরমান জারী করেনঃ

যে সব লোক ইসলাম কবুল করার কথা বলিয়াছে, তাহাদের নাম-ধাম আমার জন্য লিখিয়া দাও।

হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত হুযায়ফা (রা) বলেনঃ

অতঃপর আমরা রাসূলকে এক হাজার পাঁচশত ব্যক্তির নাম-ধাম ও পরিচয় লিখিয়া দিলাম।

ইহাও রাসূলে করীম (ﷺ)- এর জীবন কালেরই এক লিখিত সম্পদ।

৩। তৃতীয় হিজরী সনের সফর মাসে বনী জামরা গোত্রের সাথে নবী করীম (ﷺ) এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিনামাও লিখিত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে।

অবশ্য নিম্নলিখিত দুইটি বিবরণ হইতে এই কথার ইংগিত পাওয়া যায় যে, হিজরতের অব্যবহিত পূর্বেও নবী করীম (ﷺ) অন্তত দুইটি ক্ষেত্রে লিখিত ফরমান দিয়াছিলেনঃ

(ক) তমীমদারীকে নবী করীম (ﷺ) এক লিখিত পরোয়ানা প্রেরণ করেন।

(খ) হিজরত করিয়া মদীন যাওয়ার পথে নবী করীম (ﷺ) সুরাকার ইবন মালিক মুদলেজীকে এক নিরাপত্তালিপি লিখিয়া দিয়াছিলেন।

আল্লামা ইবন কাসীর উল্লেখ করিয়াছেনঃ

সুরাকা বলিলঃ আমার জন্য একটি দলীল লিখাইয়া দিন, যাহা আমার ও রাসূলের মধ্যবর্তী এই মুক্তির সিদ্ধান্তের প্রমাণ হইবে। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) আমার জন্য হাড় বা পাতা বা ছেঁড়া কাপড়ে একটি লেখা তৈরী করাইয়া দিলেন।

৪। হযরত আবূ হুরায়ারা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, মক্কা বিজলেয়র বৎসর (৮ম হিজরী) খাজায়অ গোত্রের লোকগণ লাইস গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এই সংবাদ রাসূলে করীমের নিকট পৌঁছিলে তিনি তাঁহার জন্তু যানের পৃষ্ঠে সওয়ার থাকা অবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। তাহাতে তিনি হেরেম শরীফের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবৃং নরহত্যার দণ্ড্ ও ‘দিয়ত’ সংক্রান্ত যাবতীয় হুকুম আহকাম বিস্তারিতভাবে বর্ণণা করেন। ভাষণ সমাপ্ত হইলে হযরত আবূ শাহ নামক জনৈক সাহাবী রাসূলে করীম (ﷺ)-কে বলিলেনঃ হে রাসূল ! আমার জন্য ভাষণটি লিখাইয়া দিন।

[আবূ শাহ যে রাসূল প্রদত্ত ভাষণটিই লিখিয়া দিতে বলিয়াছিলেন তাহার প্রমাণ এই যে, এই হাদীসের বর্ণনাকারী আলী ইবন মুসলিম ইমাম আওযায়ীকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘হে রাসূল ! আমার জন্য ইহা লিখাইয়া দিন’ বলিয়া লিখাইয়া দিতে আবূ শাহ রাসূলে করীমকে বলিয়াছেন? ইমাম আওযায়ী বলিলেনঃ ‘রাসূলের দেওয়া যে ভাষণটি তিনি শুনিতে পাইয়াছিলেন ইহা তাহাই’। ] তখন নবী করীম (ﷺ) তাঁহার আবেধন মঞ্জুর করিয়া জনৈক সাহাবীকে বলিলেনঃ- এই ভাষণটি আবূ শাহকে লিখিয়া দাও।

৫। ঐতিহাসিক হাফিয ইবন আবদুল বার লিখিয়াছেনঃ

নবী করীম (ﷺ)আমর ইবন হাজম ও অন্যান্যকে সাদকা, দিয়ত, ফরয ও সুন্নাত সম্পর্কে এক দস্তাবেজ লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

আল্লামা শাওকানী বিভিন্ন স্থানে এই কিতাবখানিরই উল্লেখ করিয়াছেন।

ইমাম মালিক (রা) এই কিতাবখানির উল্লেখ করিয়া বর্ণনা করিয়াছেনঃ

আবদুল্লাহ ইবন আবূ বকর ইবন হাজম হইতে কথাটি বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (ﷺ) আমর ইবন হাজমের জন্য যে কিতাবখানি লিখাইয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে লিখিত রহিয়াছে, কুরআন মজীদকে কেবল পবিত্র ব্যক্তিই স্পর্শ করিবে।

ইমাম বায়হাকী তাঁহার গ্রন্হে এই কিতাবখানি সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনার উল্লেখ করিয়াছেনঃ

আবূ বকর ইবন মুহাম্মদ ইবন হাজম হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তিনি বলেনঃ ইহা নবী করীম (ﷺ) লিখিত সেই কিতাব, যাহা তিনি আমর ইবন হাজমকে ইয়েমেনে পাঠাইবার সময় লিখাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাকে পাঠাইয়াছিলেন সেখানকার অধিবাসীদিগকে দ্বীন-ইসলামের গভীর জ্ঞান দান ও সুন্নাতের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে এবং তাহাদের নিকট হইতে যাকাত আদায় করার জন্য। ইহাতে তাঁহার জন্য নিয়োগপত্র ও প্রতিশ্রুতি এবং সেখানকার লোকদের মধ্যে তাঁহার দায়িত্ব পালনের বিষয়ও লিখিত ছিল।

হিজরী দশম সনে নবী করীম (ﷺ) হযরত আমর ইবন হাজম (রা)- কে নাজরান অধিবাসীদের শাসনকর্তা নিযুকত্ করেন। তিনি যখন নজরান এলাকার দিকে রওয়ানা হইতেছিলেন, তাখন তাঁহাকে উক্ত দস্তাবেজখানা শাসনতান্ত্রিক আইন ও বিধান হিসাবে ব্যবহার করার জন্য প্রদান করা হয়।

 

ইমাম আবূ দাউদ উল্লেখ করিয়াছেনঃ

নবী করীম (ﷺ) নাজরানবাসীদের সহিত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং তাহাদের জন্য একখানি কিতাব লিখাইয়া দিলেন।

৬। এতদ্ব্যতীত নবী করীম (ﷺ) ইয়েমেনের অধিবাসীদের জন্য আর একখানি ‘দস্তাবেজ’ লিখাইয়া পাঠাইয়াছিলেন। উহার নাম ছিল ‘কিতাবুল জিরাহ’ ()। ইহার সূচনায় লিখিয়ত হইয়াছিলঃ

ইহা আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁহার রাসূলের তরফ হইতে প্রদত্ত ফরমানঃ হে ঈমানদার লোকেরা ! তোমরা তোমাদের ওয়াদা্ এ প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণ কর।

এই ঘোষণাপত্র উষ্ট্রচর্মের লিখিত ছিল। হাফিয ইবন কাসীর লিখিয়াছেনঃ

এই গ্রন্হখানি ইসলামের প্রাথমিক ও পরবর্তীকালের সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কর্তৃক সমাদৃত, নিয়মিত পঠিত ও সকল গুরুত্বপর্ণ ব্যাপারে জ্ঞান উৎসরূপে পরিগণিত হইয়া আসিয়াছে। এমন কি-

রাসূলের সাহাবিগণ এই দস্তাবেজের দিকে সবসময়ই তাকাইতেন এবং উহার মুকাবিলায় নিজেদের রায় ও মতামত পরিহার করিতেন।

৭ । বনু সকীফের প্রতিও তিনি এক সন্ধিনামা লিপিবদ্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। উহার শুরুতে লিখিত ছিলঃ

ইহা সকীফ গোত্রের জন্য আল্লাহর রাসূলের লিখিত সন্ধিনামা।

৮। নবী করীম (ﷺ) সদকা ও যাকাত সম্পকের্ক একখানি পূর্ণাঙ্গ দস্তাবেজ লিখাইয়া লইয়াছিলেন। উহাকে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারী দায়িত্বশীল কর্মচারীদের নিকট প্রেরণ করাই ছিল তাঁহার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাহা পাঠাইবার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে ইহা খিলাফতে রাশেদার কার্যপরিচালনার ব্যাপারে পুরাপুরি দিকদর্শন হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

আল্লামা শওকানী এই দস্তাবেজখানি সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

নবী করীম (ﷺ) সদকা সম্পর্কে একখানি কিতাব রচনা করাইয়াছিলেন। কিন্তু উহা তাঁহার কর্মচারীদের নিকট প্রেরণ করার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করিয়া যান। তাঁহার পর হযরত আবূ বকর উহা বাহির করিয়া তদনুযায়ী আমল করেন। তাঁহার ইন্তেকালের পর হযরত উমর উহাকে বাহির করিয়া তদনুযায়ী কাজ করেন। হযরত উমরের ইন্তেকালের পর উহা তাঁহার এক অসিয়তের সহিত নথি করা অবস্থায় পাওয়া যায়।

ইমাম জুহরী এই দস্তাবেজখানি দেখিতে পাইয়াছেন এবং বলিয়াছেন, ইহা নবী করীমের সদকা সম্পর্কে লিখিত কিতাব। জুহরী সালেম ইবন আবদুল্লাহর নিকট উহার পাঠ গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তিনি উহা নিজের মধ্যে আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলেন। উত্তরকালে উমর ইবন আবদুল আযীয খিলাফতের দায়িত্ব করিয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমরের বংশধরদের নিকট হইতে উহা গ্রহণ করেন এবং উহার প্রতিলিপি তৈয়ার করাইয়া লন।

[ঐ, পৃষ্ঠা ১৯০ মুসনাদে ইমাম আহমদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪।]

৯। হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা)- কেও সাদকা সম্পর্কে একখানি দস্তাবেজ লিখাইয়া দিয়াছিলেন। মুসা ইবন তালহা বলেনঃ

আমাদের নিকট নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হইতে প্রাপ্ত মু’আয ইবন জাবালের একখানি কিতাব রহিয়াছে।

[মিশকাত, পৃষ্ঠা ১৫৯।]

এতদ্ব্যতীত নবী করীম (ﷺ)- এর লিখিত আরো বহুসংখ্যক সন্ধিচুক্তি ও অন্যান্য দলীল-দস্তাবেজ পাওয়া গিয়াছে। হাদীস বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সে সবের মূল্য অপরিসীম। এই ধরনের দস্তাবেজ সমূহের সংখ্যা হিসাবে করিলে তিন শতাধিক হইবে। ‘মিফতাহুল আকবা’ গ্রন্হে নবী করীম (ﷺ)- এর প্রেরিত ৩৬ খানা চিঠির প্রতিলিপির উল্লেখ করা হইয়াছে। টংক রাজ্যের তদানীন্তন অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী সাহেবজাদা আবদুর রহীম খান ২৫০ খানা লিখিত দস্তাবেজের উল্লেখ করিয়াছেন।

১। হুদায়বিয়ার সন্ধিনামা।

[কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, পৃষ্ঠা ১৫৭-১৫৮; আল-বিদায়া আন-নিহায়া, ইবনে কাসীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮; সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭১; ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬১০।]

২। বিভিন্ন কবীলা ও গোত্রের প্রতি বিভিন্ন সময়ের লিখিত ফরমান।

[তাবাকাতে ইবনে সায়াদ, কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, পৃষ্ঠা ২১।]

৩। বিভিন্ন দেশের বাদশাহ ও রাষ্ট্রনেতাদের নিকট লিখিত ইসলামী দাওয়াতের পত্রাবলী।

[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩১ কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০-২৩।]

৪। আবদুল্লাহ ইবন হাকীম সাহাবীর নিকট রাসূলের প্রেরিত চিঠি। এই চিঠিতে মৃত জন্তু ইত্যাদি সম্পর্কে আইন লিখিত হইয়াছিল।

[মুজিমুস সগীর তাবরানী।]

৫। ওয়ায়েল ইবন হাজার সাহাবীর জন্য নামায, মদ্যপান ও সুদ ইত্যাদি সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) বিধান লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

[ঐ।]

৬। জহাক ইবনে সুফিয়ান সাহাবীর নিকট রাসূলে করীম (ﷺ)-এর লিখিতও প্রেরিত একখানি হিদায়াতনামা বর্তমান ছিল, তাহাতে স্বামীর পক্ষ হইতে স্ত্রী কর্তৃক রক্তপাতের বদলা () আদায় করার বিধান লিখিত ছিল।

[আবু দাউদ।]

৭। ইয়েমেনবাসীদের প্রতি বিভিন্ন ফসলের যাকাত সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক লিখিত ও প্রেরিত এক দস্তাবেজ।

৮। ইয়েমেনবাসীদের প্রতি রাসূলে করীম (ﷺ)- এর লিখিত অপর একখানি পত্র, যাহাতে লিখিত ছিলঃ

ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে যাহারা ইসলাম কবুল করিবে, তাহারা মু’মিন লোকদের মধ্যে গণ্য হইবে, তাহাদের অধিকার ও কর্তব্য মু’মিনদের সমান হইবে। আর যাহারা ইয়াহুদী বা খৃষ্টান থাকিয়া যাইবে, তাহাদিগকে তাহাদের ধর্মপালন হইতে বিরত রাখার চেষ্টা করা হইবে না, তবে তাহারা ‘জিযিয়া’ আদায় করিতে বাধ্য থাকিবে।

[কিতাবুল আমওয়ালঃ আবূ উবাইদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

৯। হুযায়ফা ইবন আয়ামান (রা)-কে এক ফরমান লিখাইয়া দিয়াছিলেন। তাহাতে যাকাতের ফরযগুলি সম্পর্কে বিবরণ লিখিত ছিল।

[তাবাকাতে ইবন সায়াদ।]

১০। আল-ইবনুল হাজারীকে রাসু করীম (ﷺ) যাকাতের মসলা লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

১১। নবম হিজরী সনে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)- কে আমীরে হজ্জ নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নবী করীম (ﷺ) হজ্জ্বের নিয়ম-পদ্ধতি লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

[তাফসীরে রুহুল মায়ানী, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪ সীরাতে ইবন হিশাম, পৃষ্ঠা ৫৫৬।]

১২। সূরা তওবা নাযিল হওয়ার পর নবম হিজরী সনে মদীনা হইতে হযরত আলী (রা)- কে মক্কার বিশেষ পয়গাম সহকারে প্রেরণ করেন। তাঁহাক হজ্জ্বের সময় লোকদিগকে জানাইয়া দেওয়ার জন্য নিম্নোক্ত ঘোষণা লিখাইয়া দেনঃ

এই বৎসরের পর কোন মুশরিকই কা’বা ঘরের নিকটে যাইতে পারিবে না; উলঙ্গ হইয়া কেহ উহার তওয়াফ করিতে পারিবে না, বেহেশতে মু’মিন ব্যতীত কেহ দাখিল হইতে পারিব না এবং প্রত্যেকে প্রতিশ্রুতি পূরণ করিতে বাধ্য থাকিবে।

[তাফসীরে আবুস সয়ুদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫২, সীরাতে ইবন হিশাম (উর্দূ), পৃষ্ঠা ৫৫৩।]

১৩। উমর ইবন আকসা সুলামীকে এক লিখিত ফরমান পাঠানো হয়, তাহাতে সদকা ও জন্তুর যাকাত সম্পর্কিত আইন-কানুন লিখিত ছিল।

১৪। গালিব ইবন আবদুল্লাহকে এক ফরমান পাঠানো হয়, তাহাতে গনীমতের মাল সম্পর্কে বিস্তারিত মাসলা-মাসায়েল লিখিত হইয়াছিল।

১৫। সুমামা প্রতিনিধিদলকে রাসূলে করীম (ﷺ) ফরযসমূহ এবং সদকার মাসলা লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

১৬। আবূ রাশেদুল আজদীকে নামাযের নিয়ম-কানুন ও আইন লিখাইয়া দেন।

১৭। নজরানাবাসীদের এক পাদ্রীর প্রতি রাসূলে করীম (ﷺ)- এর এক লিখিত ফরমান প্রেরণ করা হয়। উহাতে ইসলাম, ইসলামের দাওয়াত ও জিযিয়ার আদেশ লিখিত হয়।

১৮। ‘হাজরামাউত’-এর শাসনকর্তার নামে নামায, যাকাত ও গনীমনের মালের বিবরণ লিখিয়া পাঠানো হয়।

১৯। ‘দাওমাতুল জান্দাল’ অধিবাসীদের নামে জিযিয়া ও যাকাতের বিধান লিখিয়া পাঠানো হয়।

[কিতাবুল আমওয়াল আবূ উবায়দ, পৃষ্ঠা ১৯৫।]

২০। দাওমাতুল জান্দাল ও কতনের অধিবাসীদের নাম ওশর সম্পর্কীয় মাসলা লিখিয়া পাঠানো হয়।

২১। হররা ও আজরাহ কবীলাসমূহের নামে জিযিয়ার বিধান লিখিয়া পাঠান হয়।

২২। বনু নাহাদ কবীলার নামে যাকাতের পশু সম্পর্কে নির্দেশ পাঠানো হয়।

২৩। বনূ হানীফা কবীলাকে জিযিয়ার মাসলা লিখিয়া পাঠানো হয়।

২৪। ‘হাজার’-বাসীদের প্রতি এক ফরমান পাঠানো হয়। উহাতে ইসলামের উপর মজবুত হইয়া দাঁড়াইতে ও শাসনকর্তার আনুগত্য করিতে বলা হয়।

[ঐ, পৃষ্ঠা ২০০।]

২৫। ‘আয়লা’ ও ‘ইউহানা’ বাসীদিগকে আমন-নামা লিখিয়া দেওয়া হয়। ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

রাসূল তাহাদের জন্য একটি দস্তাবেজ লিখিয়া দেন। উহা তাহাদের নিকট রক্ষিত ছিল। উহার শুরুতে লিখিত হয়ঃ

দয়মায় মেহেরবান আল্লাহর নামে- ইহা আল্লাহ ও তাঁহার নবী মুহাম্মদের তরফ থেকে ‘ইউহানা’ ও ‘আয়লা’- বাসীদের জন্য দেওয়া এক আমানত।

[কিতবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ২০০, নূরুল ইয়াকীন পৃষ্ঠা ২৪৮।]

২৬। তমীমদারী কবীলাকে উপঢৌকন কবুল করা ও স্বর্ণ নির্মিত জিনিসপত্র ব্যবহার করা সম্পর্কে ইসলামী বিধান লিখিয়া দেওয়া হয়।

২৮। আম্মানের শাসনকর্তা জা’ফর ও আবদের নামে ইসলামের দাওয়াত, ‘ওশর’‘যাকাত’ ইত্যাদির মাসলা লিখিয়া পাঠানো হয়।

২৯। খালিদ ইবন জামাদকে ইসলামের ‘আরকান’ লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩০। জুরয়া-ইবন সায়ফকে জিযিয়া ও যাকাতের বিধান লিখিয়া দেওয়া হয়।

[কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ২০১, ]

৩১। রবীয়া ইবন যী-মারহাব হাজরীকে শুল্ক ইত্যাদির মাসলা লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩২। শারহবীল, হারেস, নয়ীম, বনু আবদু-কালানকে গনীমতের মাল, ওশর ও যাকাতের মাসলা লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩৩। মুসলিম জনগণের জন্য এক ফরমানে নবী করীম (ﷺ) ফল পরিপক্ক হওয়ার পূর্বে উহার বিক্রয় ও বায়তুল মালের এক-পঞ্চমাংশ আদায় করা পূর্বে গণীমতের মাল হইতে নিজেদের অংশ গ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামরে বিধি-বিধান লিখাইয়া দিয়াছিলেন।

৩৪। বিক্রয় করার পূর্বে পণ্যদ্রব্যের দোষ প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আদা ইবনে খালিদকে এক বয়ান লিখাইয়া দেওয়া হয়।

৩৫। হযরত উমর (রা)- কে সদকার মাসলাসমূহ লিখিয়া দেওয়া হয়।

৩৬। হযরত আবূ বকর (রা)- কে যাকাতের যাবতীয় হুকুম-আহকাম লিখিয়া দেন।

৩৭। তমীমদারী ইসলাম কবুল করিলে তাঁহার গ্রামরে একখণ্ড জমি লিখিয়া দেওয়া হয়। হযরত উমর (রা) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর সেই লিখিত দস্তাবেজ তাঁহার নিকট পেশ করা হয় এবং তিনি উক্ত ভূমিখণ্ড তাঁহার জন্যই বরাদ্দ করেন।

[কিতাবুল আমওয়াল-আবু উবাইদ, পৃ: ২৭৪]

৩৮। মজ্জায়া ইয়ামনীকে একখণ্ড জমি লিখিয়া দেওয়া হয় এবং ইহার জন্য দস্তাবেজ তৈয়ার করিয়া দেওয়া হয়। আবূ সা’লাবাত খুশানীকেও অনুরূপ দস্তাবেজ তৈয়ার করিয়া একখণ্ড জমি দেওয়া হয়।

৩৯। মতরফ ইবন কাহেন বাহেলীকে যাকাহের মাসলা-মাসায়েল লিখিয়া দেন।

৪০। মুনযির ইবন সাবীকে জিযিয়ার মাসলা লিখাইয়া দেওয়া হয়। অগ্নিপূজকদের প্রতি ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কেও এক বয়ান লিখাইয়া দেওয়া হয়।

[ঐ, পৃ: ২৮০ ও ২৮১ ]

৪১। ‘আকীদর’ বংশের লোকদিগকে এক ফরমান লিখাইয়া দেওয়া হয়। তখন পর্যন্ত রাসূল (ﷺ)-এর নবুয়্যাতী (সরকারী) স্ট্যাস্প তৈয়ার না হওয়ার কারণে উহার উপর হযরতের টিপসহি লাগানো হয়।

[আল ইসাবাহ, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৩১।]

৪২। মুসাইলমাতুল কাযযাবের নামে রাসূলে করীম (ﷺ) এক ফরমান লিখাইয়া পাঠাইয়াছিলেন (এই ফরমানের আলোকচিত্র ১৮৯৬ সনে লণ্ডনের Picture Mahazine পত্রিকায় প্রকাশিত হয়)।

৪৩। খায়বারের ইয়াহুদীদের এলাকায় হযরত আবদুল্লাহ ইবন সাহল (রা)-কে মুতাবস্থায় পাওয়া যায়। তখন নবী করীম (ﷺ) ইয়াহুদীদিগকে উহার দিয়ত দেওয়া সম্পর্কে এক পত্র লিখিয়া পাঠান।

[সীরাতে ইবনে হিশাম (উর্দু), পৃষ্ঠা ৪৭৩।]

৪৪। ইয়েমেনাবাসীদিগকে লিখিয়া পাঠানো হয় যে, মধুরও যাকাত দেওয়া কর্তব্য।

বায়হাকী উল্লেখ করিয়াছেনঃ

নবী করীম (ﷺ) ইয়েমেনবাসীদিগকে লিখিলেন যে, মধু চাষকারীদের নিকট হইতে যাকাত লওয়া হইবে।

৪৫। হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা)-কে নবী করীম (ﷺ) নগদ টাকা ও স্বর্ণের যাকাত সম্পর্কে এক বিধান লিখিয়া পাঠানঃ

নবী করীম (ﷺ) মু’আয ইবনে জাবাল (রা)-কে লিখিয়া পাঠান যে, প্রতি দুইশত দিরহাম হইতে পাঁচ দিরহাম ও প্রতি কুড়ি মিসকাল স্বর্ণ হইতে অর্ধ মিসকাল যাকাত গ্রহণ করিবে।

[ প্রথম খণ্ড, কিতাবুযযাকাত পৃষ্ঠা, ১৭৫, দারে কুতনী।]

৪৬। ইয়েমেনবাসীদের প্রতি প্রেরিত অপর এক ফরমান সম্পর্কে ইমাম দারেমী লিখিয়াছেনঃ

নবী করীম (ﷺ) ইয়েমেনের অধিবাসীদিগকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, কুরআন মজীদকে কেবল পাক ব্যক্তিই স্পর্শ করিবে, বিবাহের মালিকানার বা স্বামীত্ব লাভের পূর্বে তালাক হইতে পারে না এবং খরিদ করিয়া লওয়ার পূর্বে গোলাম আযাদ করা যায় না।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ২৯৩।]

৪৭। আরবের সকল কবীলার নামেই নবী করীম (ﷺ) এক সময় দিয়তের মাসলা লিখাইয়া পাঠাইয়াছিলেন।

[বুখারী, নাসায়ী, দারে কুতনী, নায়লুল আওতার, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪২।]

৪৮। খায়বারের দখলকৃত জমি ইয়াহুদিদের মধ্যে বন্টনের চুক্তিনামা লিখিত হয়।

[ফতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৩৬-৪২।]

৪৯। নবী করীম (ﷺ) ‘হামাদান’ গোত্রের প্রতি এক পত্র হযরত আলী (রা)- এর মাধ্যমে পাঠাইয়াছিলেন। এই পত্র তাহাদিগকে পাঠ করিয়া শোনাইলে তাহারা সকলেই ইসলাম কবুল করে। আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

হযরত আলী তাহাদিগকে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর পত্র পাছ করিয়া শোনাইলেন। তাহারা যখন সব শুনিলেন, তখন ‘হামদান’ গোত্রের সব লোক একত্রে ইসলাম কবুল কর।

৫০। জুরবা ও আযরাহবাসীদের নামেও রাসূলে করীম (ﷺ)-কে আমান-নামা লিখিয়া দেন।

আল্লামা ইবন কাসীর লিখিয়াছেনঃ

রাসূলে করীম (ﷺ) জুরবা ও আযরাহবাসীদের জন্য আমান-নামা লিখিলেন। উহার শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখার পর লিখিত হয়ঃ ইহা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের তরফ হইতে জুরবা ও আযরাহবাসীদের জন্য লিখিত দলীল, তাহারা আল্লাহর ও মুহাম্মদের নিকট হইতে প্রদত্ত আমান ও পূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে থাকিবে।

[ ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬-১৭।]

৫১। হেমইয়ারের বাদশাহদের প্রতি রাসূলের লিখিত পত্র।

আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

রাসূলে করীম (ﷺ) তাঁহাদের প্রতি পত্র লিখিলেন।

৫২। নবী করীম (ﷺ) নাজরানের বিশপ পাদ্রীর নামে এক পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহাতে লিখিত ছিলঃ

আল্লাহর রাসূল ও নবী মুহাম্মদের তরফ হইতে নাজরানের বিশপের প্রতিঃ তুমি ইসলাম কবুল কর, আমি তোমার নিকট ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহর হামদ করিতেছি। অতঃপর আমি তোমাদিগকে বান্দার দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার ও মানুষের বন্ধুত্ব পৃষ্ঠপোষকতা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া আল্লাহর বন্ধুত্ব-পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয় গ্রহণের আহবান জানাইতেছি। ইহা কবুল না করিলে তোমরা জিযিয়া দিতে বাধ্য থাকিবে। আর তাহাও অস্বীকার করিলে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিব।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন