মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সরকারের বিশ্বব্যাপী প্রভাবের আলোচনায় আমরা বলে এসেছি যে, এর প্রভাবে গোটা বিশ্বে (যা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রভাবাধীন ছিল) আল্লাহ-অনুসন্ধানী মানসিকতা ব্যাপকভাবে পাওয়া যেত। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ দীন-ধর্মের খোঁজে ও আল্লাহওয়ালা মানুষের তালাশ করতে গিয়ে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যেত। দুনিয়াদারী ও বস্তুবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে যাবার পর ধর্মীয় প্রবণতা ও আল্লাহ-অনুসন্ধানী মানসিকতার কেন্দ্র ঐ সব মহাপুরুষের সত্রা ও তাদের। আবাসিক স্থানগুলো ছিল যারা অলসতা ও বস্তুবাদের বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রে মনুষ্য জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ-উপদ্বীপ কায়েম করে রেখেছিলেন যেখানে তারা মানুষকে বস্তুবাদের এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের করে এনে তাদেরকে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ দিতেন এবং তাদের ভেতর প্রলয়-তুফানের মুকাবিলা করার যোগ্যতা, সামথ্য ও শক্তি পয়দা করতেন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে তাঁদেরকে সূফী-দরবেশ ও ওলী-আওলিয়া নামে স্মরণ করা হয়েছে।
ঐসব মহামানব ও মহাপুরুষের দিকে প্রত্যাবর্তন এই শেষ শতাব্দীগুলোতে ধর্মের দিকে ঝোঁক, প্রবণতা ও সাধারণ মুসলমানদের আল্লাহ-অনুসন্ধানী মানসিকতার একটা সীমা পর্যন্ত মাপকাঠি যার সাহায্যে আমরা জানতে পারি যে, লোকের মধ্যে সেই যুগে বস্তুবাদ ও দুনিয়াদারী থেকে কতটা পরিমাণ পলায়ন এবং ধর্মের ব্যাপারে কতখানি আগ্রহ পাওয়া যেত।
মুসলিম বিশ্বের প্রধান প্রধান ও কেন্দ্রীয় শহরের প্রায় সর্বত্রই এমন সব ব্যক্তি বর্তমান ছিলেন যাঁদের বরকতময় সত্তা ছিল অন্ধকার সমুদ্রে আলোক মিনার (বাতিঘর। মানুষ পতঙ্গের ন্যায় এই আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। পৃথিবীর দূর-দূরান্তের এলাকাসমূহ থেকে আল্লাহপ্রার্থী মানুষ এসে তাঁদের দরবারে সমবেত হতো আর এসব স্থান হতো এক বিরাট আন্তর্জাতিক জনবসতি যেখানে একই সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, উত্তর ও দক্ষিণের মুসলমানের সাক্ষাত মিলত এবং ইসলামের বিশাল বিস্তৃত জগত সেখানে জড়ো অবস্থায় দেখতে পাওয়া যেত।
মুসলিম বিশ্বের এক প্রান্তে অবস্থিত আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মীয় আবেগ-উৎসাহ ও আগ্রহ-উদ্দীপনা এবং আল্লাহসন্ধানী মানুষের এক বিরাট কেন্দ্র। এখানে প্রতিটি যুগে মুসলিম সুলতান ও রাজা-বাদশাহদের সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক রাজত্বের স্বাধীন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ছিল যেখানে শত শত নয়, হাজার হাজার মানুষ আপন যুগের সর্বপ্রকার বস্তুগত প্ররোচনা ও আকর্ষণ থেকে মুক্ত থেকে এবং হুকুমত ও সিয়াসত তথা সরকার ও রাজনীতির বিবিধ বিপ্লব উপেক্ষা করে নিজেদের কাজ করতেন।
হযরত নিজামুদ্দীন আওলিয়া (র.)-র আধ্যাত্মিক নয়া উপনিবেশ গিয়াছপুর ছিল এর একটি সর্বোত্তম উদাহরণ যিনি ঠিক রাজধানীতে আট জন প্রতাপশালী সুলতানের (গিয়াছুদ্দীন বলবন, ৬৬৪-৬৮৬ খ্রি. থেকে নিয়ে গিয়াছুদ্দীন তুগলক, ৭২০-২৫ খ্রি. পর্যন্ত) শাসনামলে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত তাঁর স্বশাসিত ও স্বনিয়ন্ত্রিত হুকুমত কায়েম রেখেছেন১ এবং যেখানে সিজিস্তান২ থেকে শুরু করে। অযোধ্যা৩ পর্যন্ত সব জায়গার আল্লাহ-সন্ধানী মানুষ পড়ে থাকত। যদি তরীকতের সমস্ত সিলসিলার বুযুর্গদের কেন্দ্রগুলোর জনসংখ্যা এবং তাঁদের দিকে যেই পরিমাণ লোক গমনাগমন করত তার বিস্তৃত বিবরণ লেখা হয় (যদ্বারা সেই যুগে। ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও ঝোঁক এবং ধর্মের প্রতি মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের পরিমাপ করা যায়), তাহলে পুস্তকের পৃষ্ঠায় তা সংকুলান হবে না। এজন্য নমুনাস্বরূপ কেবল একটি সিলসিলার (নকশবান্দিয়া-মুজাদ্দিদিয়া সিলসিলা) কয়েকজন বুযুর্গের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক এবং তাঁদের দিকে সেই যুগের ধাবমান জনস্রোতের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলো যা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে, তাদের যুগে যে যুগ ছিল বস্তুবাদ ও দুনিয়াদারীর উত্থানের যুগ, আল্লাহ-সন্ধানী মানসিকতার অবস্থা কি ছিল এবং ধর্মের প্রতি আকর্ষণ মানুষকে কোথায় কোথায় চুম্বকের ন্যায় টেনে আনত।
[১. হযরত নিজামুদ্দীন আওলিয়া (র.) গিয়াছুদ্দীন বলবনের রাজত্বকালে ৬৬৯ হিজরী দিল্লী আগমন করেন। কিছুদিন তিনি বিভিন্ন মহল্লায় অবস্থান করেন। এরপর বস্তি গিয়াছ পুরে (বর্তমানে বস্তি নিজামুদ্দীন) স্থায়ী আবাস গ্রহণ করেন। ৭২৫ হিজরী পর্যন্ত বিভিন্ন সুলতান তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ সফল হন নি। প্রায় ৬০ বছর কাল তিনি ও তাঁর খানকাহর লোকেরা রাজদরবারের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেন। ]
[২. শায়খ হাসান আলা সিজষী। ]
[৩, শায়খ মাসীরুদ্দীন চেরাগে দিলী। ]
হযরত শায়খ আহমদ সরহিন্দী মুজাদ্দিদ আলফেছানী (মৃ. ১০৩৪ হি.)-র সঙ্গে সম্পর্কিত ভক্ত-অনুরক্তদের তালিকার ওপর যদি দৃষ্টি ক্ষেপণ করা হয় তাহলে আপনি জানতে পারতেন, ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানের কত শত শহর ও পল্লীর কী বিপুল সংখ্যক মানুষ এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের কত বড় বড় আমীর-অমাত্য তার মুরীদ ও বায়আতভুক্ত ছিলেন এবং কত দূর-দূরান্ত থেকে সরহিন্দে এসে মানুষ তাঁর থেকে উপকৃত হয়েছিল।
তার জলীলুল কদর খলীফা হযরত সাইয়েদ আদম বানুরী (মৃ. ১০৫২ হি.)-র খানকায় প্রত্যহ এক হাজার লোক উপস্থিত থাকত এবং দু'বেলা পেট পুরে খানা খেত। তার সওয়ারীর সাথে হাজার হাজার মানুষ ও শত শত আলিম-উলামা থাকত। “তাযকিরায়ে আদমিয়া” নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ১০৫২ হিজরীতে তিনি যখন লাহোরে যান তখন নেতৃস্থানীয় সাইয়েদ, ওলী-বুযুর্গ ও বিভিন্ন শ্রেণীর দশ হাজার মানুষ তার সঙ্গী ছিল। প্রার্থীদের ভিড় এত বেশি থাকত যে, সম্রাট শাহজাহান এতে ভড়কে যান। তিনি কিছু টাকা পাঠিয়ে পেছনে বলে পাঠান, তাঁর ওপর হজ্জ ফরয হয়ে গেছে, তিনি যেন হারামায়ন শরীফায়ন গমন করেন। অনন্তর তিনি ভারতবর্ষ থেকে হিজরত করে চলে যান।
মুজাদ্দিদ আলফেছানী (র.)-র নামকরা খলীফা ও তাঁর পুত্র হযরত খাজা মুহাম্মদ মাসূম (মৃ. ১০৭৯ হি.)-এর হাতে নয় লক্ষ মানুষ বায়আত হয় এবং তওবা করে। সাত হাজার মানুষ তার খেলাফত লাভে ধন্য হয়।১
তাঁর পুত্র খাজা শায়খ সায়ফুদ্দীন সরহিন্দী (র.) , ১০৯৬ হি.]-র দিল্লীস্থ খানকায় প্রার্থীদের ভীড়ের পরিমাপ আপনি এথেকে করতে পারবেন যে, “যায়পুর-রাশহাত” নামক গ্রন্থের গ্রন্থকারের বর্ণনা মুতাবিক এক হাজার চার শ' মানুষ দু'বেলা তাঁর দস্তরখানে আপন পসন্দ ও ফরমায়েশ মাফিক খানা খেত।২
আমীর-উমারা ও বিত্তবান লোকদের বুযুর্গানে দীনের সঙ্গে (ধর্মের প্রতি ভালবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের দরুন) যে সম্পর্ক ছিল তার একটি নমুনা ছিল এই, হযরত খাজা মুহাম্মদ যুবায়র সরহিন্দী (র.) (মৃ. ১১৫১ হি.) যখন মসজিদে যাবার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হতেন তখন আমীর-উমারা রাস্তায় দোশালা ও রূমাল বিছিয়ে দিতেন যাতে তার পা মাটিতে, না পড়ে। কোন রোগীর সেবা-শুশ্রুষা কিংবা অন্য কোন কাজে কোথাও যেতে হলে তার সওয়ারী রাজকীয় কায়দায় বের হতো এবং তার মিছিলে আমীর-উমারা ও বিত্তবান লোকদের পালকি ও সওয়ারী থাকত।৩
[১. নুরহাতুল খাওয়াতির, ৫ম খণ্ড; ]
[২. প্রাগুপ্ত; ]
[৩. দুররুল মাআরিফ, ইরশাদ রহমানিকৃত নু, খা। ]
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক আমলে বিপ্লবী হুকুমতের কিছু কাল আগ পর্যন্ত এই মানসিকতা ও রুচি পুরোপুরি বিদ্যমান ছিল। মির্যা মাজহার জানে জানার খলীফা হযরত শাহ গোলাম আলী (র.) (মৃ. ১২৪০ হি.]-র যুগে দিল্লীর মুজাদ্দিদিয়া খানকাহ সত্যানুসন্ধানীদের বিরাট বড় কেন্দ্র ছিল। স্যার সৈয়দ আহমদ খান তদীয় “আছারুস-সানাদীদ" নামক গ্রন্থে লিখছেনঃ
“আমি হযরতের খানকায় নিজের চোখে রোম (তুরস্ক), শাম-(সিরিয়া, লেবানন, জর্দান ও ফিলিস্তীন যার অন্তর্গত ছিল), বাগদাদ, মিসর, চীন ও আবিসিনিয়ার লোক দেখেছি। তারা দরবারে হাযির হয়ে বায়আত গ্রহণ করত। এবং খানকাহর খেদমত করাকে চিরস্থায়ী সৌভাগ্য জ্ঞান করত। আর ভারতবর্ষ, পাঞ্জাব ও আফগানিস্তানের মত কাছাকাছি জনপদগুলোর তো কোন কথাই নেই। এসব শহরের লোকেরা পতঙ্গের মত দলে দলে এসে হাযির হতো। হযরতের খানকায় পাঁচ শ’ ফকীর-মিসকীনের কম থাকত না এবং এদের অন্নবস্ত্রের দায়-দায়িত্ব তাঁর ওপরই ন্যস্ত ছিল।”১
শাহ রউফ আহমদ মুজাদ্দিদী তাঁর “দুররুল মা'আরিফ” নামক গ্রন্থে কেবল একদিনের আগত লোকদের স্থান ও শহরগুলোর তালিকা লিখেছেন যারা ২৮শে জুমাদাল-উলা, ১২৩১ হিজরীতে আত্মিক উপকার লাভের আশায় দিল্লীর এই খানকাহ্ উপস্থিত ছিল।
এটা ছিল সেই যুগ যখন রেল ছিল না, ছিল না যাতায়াতের সে সব সুবিধা যা আমরা আজ লাভ করেছি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেই যুগে ব্রিটিশ শাসন জেঁকে বসার কিছুটা আগে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও তার জলীলুল কদর সাথী মাওলানা আবদুল হাই বুরহানভী (মৃ. ১২৪২ হি.), মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (শাহাদত ১২৪৬ হি.) এবং তাঁদের একনিষ্ঠ মুবাল্লিগবৃন্দ মুসলমানদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান, (আরবি) “আল্লাহর দিকে ধাবিত হও”র আওয়াজ তোলেন এবং অলসতা, গাফিলতি, অবাধ্যতা ও শরীয়তবিরোধী জীবনের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করেন। মুসলমানেরা যেই আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে এই আহ্বানে সাড়া দেয় এবং যে রকম পতঙ্গের মত এই জামাআতের আমীরের চারপাশে সমবেত হয়, যেই উন্নত মন ও উদার মানসিকতা নিয়ে প্রতিনিধি দলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল এবং নিজেদের ধর্মপ্রেম ও বিনয়ের প্রমাণ দিয়েছিল, এরপর যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামের সকল বাগ-বাগিচার সর্বোত্তম ফুলের নির্যাস তাঁর সমীপে এসে পৌঁছে গিয়েছিল যা ১২৪৬ হিজরীর ঘটনায় বালাকোটের মাটিতে মিশে গিয়েছিল-এ থেকে বেশ ভালভাবেই পরিমাপ করা যায় যে, সেই অধঃপতনের যুগেও মুসলমানদের মধ্যে দীনের প্রতি, ধর্মের প্রতি কতটা আগ্রহ, দিলের টান ও আল্লাহকে পাবার জন্য কতখানি পাগলপারা নেশা, কী পরিমাণ মন-মানসিকতা এবং কতটা ভাল যোগ্যতা ও সামর্থ্য ছিল।
ধর্মের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহের পরিমাপ আপনি সেই তাবলীগী সফরের রোয়েদাদ থেকে করতে পারবেন যা সাইয়েদ সাহেব বড় বড় জামাআতসহ দোআবার কসবা ও শহরগুলোতে এবং এর পরে অযোধ্যায় করেছিলেন।১
মুসলমানদের আগ্রহ-উদ্দীপনার আরও কিছুটা পরিমাপ আপনি সাইয়েদ সাহেবের হজ্জ সফর থেকে করতে পারবেন যা তিনি ১২৩৬ হিজরীতে করেছিলেন। এই গোটা সফরে ভারতবর্ষের সেই পূর্বাঞ্চল যা বর্তমানে তিন প্রদেশ (যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও বাঙলা) নিয়ে গঠিত এবং এই কাফেলার চলার পথ আর এই কাফেলা এ পথ দিয়েই অতিক্রম করত, অব্যাহত নড়াচড়া ও গতির মাঝে ছিল। সর্বত্রই দীনের জন্য পাগলপারা মুসলমানরা পতঙ্গের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। বিগত জীবনের পাপ ও গাফলতি থেকে তারা তওবা করত এবং আল্লাহর কাছে নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতো। গ্রাম-গঞ্জের লোকেরা শত শত সংখ্যায় দলে দলে আসত এবং বায়আত ও তওবা করত। আগ্রহী লোকেরা কাফেলার লোকদেরকে দাওয়াত করে নিজ এলাকা ও বাড়িঘরে নিয়ে যেত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিন্তু বুলন্দ হিম্মতের অধিকারী মুসলমানেরা গোটা কাফেলাকে (যার সংখ্যা কলকাতা পৌঁছুতে পৌঁছুতে সাড়ে সাত শ’তে গিয়ে পৌঁছেছিল) এবং সেই সব শত শত মুসলমানকে যারা আশেপাশের এলাকা থেকে আসত, দিল খুলে কয়েক দিনের মেহমানদারী করত। নেতৃস্থানীয় মুসলমানেরা শাহী মনোবল নিয়ে দীনের কাজে নিজেদের সহায়-সম্পদ ব্যয় করত। এলাহাবাদের নেতৃস্থানীয় জনাব শায়খ গোলাম আলী বার থেকে পনেরো দিনে মোটামুটি হিসাব অনুযায়ী বিশ হাজার টাকা খরচ করেন। তাঁর দস্তরখানে দু'বেলা শত শত মানুষ পেট পুরে খানা খেত। কোন কোন লোকের ধারণা, প্রতি দিন এক হাজার টাকা খানাপিনায় খরচ হত।২
[১. সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ, তৃতীয় সংস্করণ। ]
[২. মানে আহমদী (ফারসী), মওলভী মুহাম্মদ আলীকৃত (ম. ১২৬৬ হি.)।]
মানুষ সাইয়েদ আহমদ শহীদ (র.)-এর দিকে যেভাবে ঝুকেছিল এবং সত্যানুসন্ধানী মানুষের ভীড় এভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, সমগ্র শহরগুলোতে খুব কম লোকই এমন ছিল যারা তওবা ও বায়আত করেনি এবং এই কাফেলার বরকত থেকে মাহরূম হয়ে থাকবে। এলাহাবাদ, মির্যাপুর, বানারস, গাযীপুর, আজীমাবাদ, পাটনা ও কলকাতায় মোটামুটি কয়েক লক্ষ মুসলমান বায়আত হয়, অতীতের গোনাহ থেকে তওবা করে। ধর্মের সাধারণ গুরুত্ব ও এর প্রতি আগ্রহের পরিমাপ এর থেকেও করা যাবে যে, বানারসে হাসপাতালের রোগীরা এই পয়গাম পাঠায়, আমরা অসহায় ও অক্ষম। আপনার খেদমতে যাওয়া আমাদের পক্ষে কষ্টকর। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি যদি আমাদের কাছে আসতেন তাহলে আমরা বায়আত হতে পারতাম। তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে একদিন তিনি কয়েকজন সাথীসহ সেখানে যান এবং ঐসব রোগীকে বায়আত ও তওবা করান।১
কলকাতায় তিনি দু'মাস অবস্থান করেন। দৈনিক এক হাজারের মত মানুষ তাঁর হাতে বায়আত হতো। প্রতিদিনই বায়আত গ্রহণকারীদের ভিড় বেড়ে চলে। বায়আত গ্রহণের জন্য আগত লোকের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, সকাল থেকে রাত দুটো আড়াইটে পর্যন্ত নারী-পুরুষের ভিড় থাকত। সাইয়েদ আহমদ শহীদ (র.) একমাত্র সালাত আদায় ছাড়া খানাপিনা ও মানবীয় প্রয়াজন পূরণের ফুরসত পেতেন না। এক একজন করে পৃথকভাবে বায়আত গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। একটি বিরাট প্রশস্ত হল ঘরে সকলে জমায়েত হতো। তিনি আসতেন। সাত-আটটা পাগড়ী তিনি মানুষের হাতে ধরিয়ে দিতেন। লোকে এগুলো ধরত। এরপর তিনি বায়আতের শব্দগুলো আযানের ন্যায় উচ্চ কণ্ঠে বলতেন। উপস্থিত লোকেরা সেগুলো সাথে সাথে উচ্চারণ করত। দিনে সতেরো-আঠারো বার একইভাবে বায়আত গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতো। আর এভাবেই দৈনিক হাজার হাজার। মানুষ বায়আতভুক্ত হতো।২
ফজর সালাতের পর সাইয়েদ আহমদ শহীদ ১৫-২৯ দিন পর্যন্ত ওয়াজ করেন। দু’দু' হাজার আমীর-উমারা, আলিম-উলামা ও সূফী-দরবেশ প্রতিদিনই তার খেদমতে আসতেন। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের তো কোন সীমা-সংখ্যাই ছিল না! মাওলানা আবদুল হাই সাহেব জুমুআ ও মঙ্গলবার দিন জোহরের সালাতের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়াজ করতেন এবং মানুষ পতঙ্গের মত সমবেত হত। দৈনিক ১০-১৫ জন হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করত।৩
সংস্কার-সংশোধন ও দীনদারী, তওবা ও আল্লাহর দিকে রুজু’র এই সাধারণ পরিবেশের শুভ ক্রিয়া হলো। একেবারে হঠাৎ করেই মদ তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেল। খুঁড়িখানার মালিকরা বৃটিশ গভর্নমেন্টের কাছে অভিযোগ পেশ করল, আমরা অকারণে সরকারী ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছি। বেচা-বিক্রি না থাকায় আমাদের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। যেদিন থেকে একজন বুযুর্গ তাঁর কাফেলা নিয়ে এই শহরে এসেছেন, শহর ও গ্রামের সব মুসলমান তাঁর মুরীদ হয়েছে এবং প্রতিদিনই হচ্ছে। এরপর থেকে তারা যাবতীয় মাদক দ্রব্য থেকে তওবা করেছে। এখন আর কেউ আমাদের দোকানের দিকে ফিরেও চায় না।১
দীন ও দীনদার লোকদের প্রতি মানুষের ভালবাসার অবস্থা ছিল এরূপ, যখন হাজীদের এই কাফেলা যাদের সংখ্যা ছিল সাত শ’, মক্কা মুআজ্জমা থেকে ফেরার পর মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী দেওয়ান গোলাম মুর্তার বাড়িতে গিয়ে উঠল তখন দেওয়ান সাহেব প্রকাশ্য বাজারে ঘোষণা করে দিলেন, সাইয়েদ সাহেবের কাফেলার কোন লোক বাজার থেকে কোন কিছু কিনলে অথবা কাউকে দিয়ে কোন কাজ করালে তার মূল্য কিংবা মজুরি আমি পরিশোধ করব। সাইয়েদ আহমদ শহীদ তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, আপনি এতটা দায়বদ্ধ কেন হচ্ছেন? তিনি জওয়াব দিলেন, কোন মুসলমানের ঘরে যখন হাজী সাহেবের আগমন ঘটে তখন তার বড়ই সৌভাগ্য লাভ ঘটে। আপনাদের পদার্পণ আমার। জন্য যেই সৌভাগ্য বয়ে এনেছে এর জন্য আমি যতই গর্ব করি না কেন, তা নেহাৎ অকিঞ্চিৎকরই হবে। আমার পরম সৌভাগ্য, এত বিপুল সংখ্যক হাজীর শুভাগমন আমাকে ধন্য করেছে।২
[১. ওয়াকায়ে, আহমদী; ]
[২. মনজুরাতুস-সুআদা, সাইয়েদ জাফর আলী নকীকৃত। ']
এরপর যখন সাইয়েদ আহমদ শহীদ (র.) মুসলমানদেরকে জিহাদের দাওয়াত জানালেন তখন মুসলমানরা অত্যন্ত স্যোৎসাহে তা কবুল করে। কৃষক তার লাঙ্গল ছেড়ে, দোকানদার দোকান বন্ধ রেখে, কর্মচারী ও চাকুরীজীবী তার মনিব ও বকে, সালাম জানিয়ে, নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাদের মহল্লা থেকে বেরিয়ে, উলামায়ে কিরাম ও মাশায়েখ-ই-ইজাম স্ব স্ব মাদরাসা-মকতব ও খানকাহ ছেড়ে তার সঙ্গী হয়েছেন এবং একবারের জন্যেও ঘরের দিকে ফিরে তাকান নি, এমন কি প্রাণোৎসর্গকারী জানবার্য মুজাহিদদের শেষ জামাতটি বালাকোটের সংকীর্ণ ও কংকরময় ঘটিতে সেই সব পাথর ও কাঁকরের মাঝে, যার ভেতর দিয়ে পথ চলা পথিকের জন্য মোটেই সহজ নয়, নিজেদের চেয়ে দশ গুণ শত্রুর মুকাবিলায় জীবন বিলিয়ে দিলেন এবং মৃত্যুর মুহূর্তেও ঘরবাড়ির কথা স্মরণে আনেন নি।
এই সব বিস্তারিত বিবরণ এজন্য লিখিত হলো যেন এর পরিমাপ করা যায় মুসলমানদের কর্তৃত্বের শেষ যুগে এবং তাদের অধঃপতনের যৌবনকালেও, কিন্তু পাশ্চাত্য উত্থান ও বিজয় যুগের প্রথম দিকে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের প্রতি আগ্রহ ও সম্মানবোধ, ধর্মীয় চেতনা ও অনুভূতি কতটা প্রবল ছিল এবং তাদের মনোবল কতটা উন্নত ছিল।
ইংরেজ রাজত্বের প্রথম দিকেও যখন পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতি ও শিক্ষা, তাদের নীতি-নৈতিকতা, চরিত্র ও রাজনীতির প্রভাব ভারতবর্ষের সাধারণ জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলেনি, প্রথম যুগের আছর বর্তমান ছিল, যদিও তা ছিল মরণ দশায় এবং হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদী (র.) [১২১৩-১৩০৮ হি.]-র মত বুযুর্গ যিনি এই উভয় যুগই স্বচক্ষে দেখেছিলেন, নিজের যুগের ধর্মীয় দুর্দশাদৃষ্টে আফসোস করতেন এবং বড় ব্যথাভরা কণ্ঠে বলতেনঃ
جو بیچتے تھے دوائے دل وه دكان اپنی بڑھاگئے
“একদা যারা দিলের দাওয়াই বিক্রি করত তারা আজ দোকান-পসারী সাজাতে ব্যস্ত।”
যদিও হেমন্তের হিমেল বাতাস বইতে শুরু করেছিল তবুও শীত মৌসুম তখনও জেঁকে বসেনি। আল্লাহ-সন্ধানী মন-মানসিকতা তখনো বিদ্যমান ছিল। আল্লাহওয়ালা লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক, আত্মিক পরিশুদ্ধি, জীবনের সংস্কার-সংশোধন ও প্রশিক্ষণকে জীবনের একটি প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য শাখা মনে করা হতো। আলিম-উলামা ও দীনদার লোকদের কথা বাদ দিলে সাধারণ কারবারী মুসলমান ও দুনিয়াদার আমীর-উমারাও এই ধারণা থেকে শূন্য ও এই আগ্রহ থেকে মাহরূম ছিলেন না। বড় বড় কেন্দ্রীয় শহর বাদ দিলে ঐ ছোট ছোট গ্রাম ও কসবাও আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী ও আল্লাহর নাম শিক্ষা দানকারী মুসলমানদের জনবসতি, শহর, নগর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ ও পল্লীগুলোতে এমন অব্যাহতভাবে পাওয়া যেত যে, এমন একটা যুগ পাওয়া যাবে না যখন তাঁরা ছিলেন না। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর পূর্বের ভারতবর্ষের দিকে তাকান কিংবা কোন বর্ষীয়ান মুরুব্বী থেকে শুনুন, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত এক সারি আলোকমালা চোখে পড়বে।
ক্রমে ক্রমে এসব ভোরের শুকতারা এক এক করে নিভতে শুরু করে। এক প্রদীপ থেকে আরেক প্রদীপ জ্বলবার চিরাচরিত ধারা থেমে যায়। এই টিমটিমে প্রদীপটুকুও অবশেষে নিভে যায়। মৌসুম ক্রমান্বয়ে তার পরিপূর্ণ প্রভাব আঁকিয়ে বসে। হেমন্তকালে গাছপালা হেলাতে এবং শুকনো পাতা ঝরাতে কে দেখেছে? কিন্তু মৌসুম ও আবহাওয়ার প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় পাতা ও ফুল শুকিয়ে শুকিয়ে আপনাআপনিই ঝরে যায়। ইংরেজ শাসকদের পক্ষ থেকে কখনো এ ঘোষণা আসে নি, খানকাগুলো বন্ধ করে দিন এবং সংস্কার-সংশোধন ও পথ প্রদর্শনের কাজ গুটিয়ে ফেলুন। এর বিপরীতে সে যুগে ভ্রমণের রাস্তা খুলে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দূরদরাজ এলাকায় ভ্রমণ পূর্বের তুলনায় খুবই সহজ হয়ে যায়। কিন্তু হলে কী হবে? মানুষের মন থেকে সেই আগ্রহ-উদ্দীপনাই হারিয়ে যায়, যে আগ্রহ-উদ্দীপনা একদিন সুদূর বুখারা ও সমরকন্দ থেকে ইলম পিয়াসীদের পায়ে হাঁটিয়ে এখানে টেনে আনত। তারা এই বৃক্ষের ওপর কখনো কুড়াল মারে নি, কখনো এই বৃক্ষে আগুন লাগায় নি, কিন্তু গাছের গোড়ায় পানি ঢালায় ও অনুকূল আবহাওয়া ও উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় তার ডালপালাগুলো নিজের থেকেই শুকিয়ে যেতে থাকে এবং ফলে-ফুলে সুশোভিত হওয়া অনেক দিন থেকেই বন্ধ হয়ে যায়।
জীবনে আল্লাহকে পাবার কোন ঘর এবং ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কোন কোণ থাকল না। হৃদয় ও আত্মার জায়গাও পেট ও পাকস্থলী দখল করে নিল। জীবনের সমস্ত উন্নত, পবিত্র ও সূক্ষ্ম হাকীকত চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখন দীর্ঘকাল থেকেই অদৃশ্য লোক থেকে এই আওয়াজ ভেসে আসছেঃ
نه د مونده اہل دل کواب که جوش قلزم فنا
متاع درد جن میں تھی وہ کشتی ڈبوجکا۔
“এখন আর তুমি হৃদয়বান মানুষ সন্ধান করো না; কেননা লোহিত সাগরের উত্তাল ঊর্মি থেমে গেছে।
ব্যথার পুঁজি যাদের ভেতর ছিল সেই নৌকাগুলো ডুবে গেছে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/788/147
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।