hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?

লেখকঃ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (র.)

১৬৩
চেতনাবোধের প্রশিক্ষণ
কোন জাতির জন্য সর্বাধিক বিপজ্জনক বিষয় হলো, সে জাতি সঠিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনাবোধ থেকে মুক্ত। এমন একটি জাতি, যে সর্বপ্রকার যোগ্যতা ও সামর্থ্যের অধিকারী এবং যে ধর্মীয় ও জাগতিক সম্পদ দ্বারা সম্পদশালী, কিন্তু সে ভাল-মন্দ ও পাপ-পুণ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, দোস্ত-দুশমন চেনে , পেছনের অভিজ্ঞতা থেকে ফায়দা লাভের সামর্থ্য তার ভেতর নেই, তার নেতাদের কর্মকাণ্ডের হিসাব গ্রহণ ও খতিয়ান নেবার এবং জাতীয় অপরাধীদের শাস্তি দেবার তার ভেতর সাহস নেই তারা স্বার্থপর নেতাদের মৃদু মোলায়েম ও মিষ্টি কথায় অভিভূত হয়ে যায় এবং প্রতিবার নতুন করে ধোকা খাওয়া ও প্রতারিত হবার জন্য তৈরি থাকে, সেই জাতি তার যাবতীয় ধর্মীয় উন্নতি-অগ্রগতি ও পার্থিব সাফল্য সত্ত্বেও আস্থাযোগ্য নয়। সেই জাতি পেশাদার, স্বার্থপর ও মুনাফিক নেতাদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়, খেলনায় পরিণত হয়, জাতির সরলতা ও চেতনাহীনতার সুযোগে তাদের যা খুশী তাই করার সুযোগ মেলে। কারণ তারা জানে এবং নিশ্চিন্ত থাকে, তাদেরকে তাদের কৃত কর্মের কখনো। হিসাব দেওয়া কিংবা জওয়াবদিহি করতে হবে না।

মুসলিম দেশগুলো সম্পর্কে যদি আমরা একথা বলতে নাও চাই, তারা জাগ্রত ও সচেতন নয়, তাদের বোধ-বুদ্ধি ও চেতনাবোধ খুবই দুর্বল এবং তারা চেতনার। একেবারে প্রাথমিক স্তরে অবস্থান করছে, কিন্তু আফসোসের সাথে বলতেই হয়, শুভাকাঙ্ক্ষী ও অশুভাকাঙ্ক্ষী উভয়ের সাথে তাদের আচার-ব্যবহার প্রায় একই রকম, বরং কোন কোন সময় অশুভাকাঙ্ক্ষী ও অনিষ্ঠাবান ভণ্ড লোকেরা মুসলমানদের মধ্যে খুব বেশি প্রিয় ও বিশ্বস্ত হয়ে যায়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, “সাপের একই গর্ত থেকে মুমিন দু’বার দংশিত হয় না। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর বাসিন্দারা শত সহস্রবার দংশিত হবার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাদের স্মৃতিশক্তি নেহায়েত দুর্বল। তারা তদের নেতা ও শাসকদের অতীত ও নিকট অতীতের ঘটনাবলী খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক চেতনা খুবই দুর্বল এবং রাজনৈতিক সচেতনতা প্রায় নেই বললেই চলে। এটাই কারণ, তারা বিজয়ী জাতিগোষ্ঠী এবং স্বার্থপর ও স্বার্থশিকারী নেতাদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয় এবং খুব সহজেই তাদেরকে ইচ্ছেমতো যেদিক খুশী ঘোরানো যায়। সরকারগুলো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফয়সালা করতে থাকে এবং যেদিকে চায় লাঠির সাহায্যে ভেড়ার পালের মত হাঁকিয়ে নিয়ে যায়।

পক্ষান্তরে পাশ্চাত্যের জাতিগুলো তাদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দারিদ্র্য এবং তাদের যাবতীয় খারাবী সত্ত্বেও যার বিস্তারিত বিবরণ আমরা এই পুস্তকেই বিবৃত করেছি, নাগরিক ও রাজনৈতিক চেতনার অধিকারী। তারা পরিপকু রাজনৈতিক জ্ঞানের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। তারা নিজেদের লাভ-ক্ষতি চেনে এবং জানে। তারা এও জানে, কে নিষ্ঠাবান আর কে ভণ্ড মুনাফিক, কে যোগ্য আর কে অযোগ্য। এ সবের মধ্যে পার্থক্য করতেও তারা জানে। তারা তাদের নেতৃত্ব এমন সব লোকের হাতে সোপর্দ করে না যারা অযোগ্য, দুর্বল ও আত্মসাৎকারী, খেয়ানতকারী এবং যখন নিজেদের ব্যাপারগুলো কাউকে সোপর্দ করে তখন ভয়-ভীতি ও সতর্কতার সাথেই সোপর্দ করে। যখনই তাদের অযোগ্যতা ও আত্মসাতের ব্যাপার ধরা পড়ে এবং দেখতে পায়, তারা তাদের যিম্মাদারী আদায় করেছে, তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, অমনি তাদেরকে তাদের পদ থেকে, তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে এবং তাদের জায়গায় এমন সব লোক নিয়ে আসে যারা পূর্বের লোকদের তুলনায় অধিকতর যোগ্য ও সেই সময়কার জন্য উপযোগী। এ সময় কোন নেতা কিংবা আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত লোকের পূর্বেকার খেদমত, গৌরবময় অতীত কিংবা কোন যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এই জাতীয় সিদ্ধান্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এটাই কারণ, ঐ সব জাতিগোষ্ঠী পেশাদার রাজনীতিবিদ, অযোগ্য ও আত্মসাতকারী নেতাদের হাত থেকে মুক্ত ও নিরাপদ। তাদের রাজনৈতিক নেতা ও তাদের জনপ্রতিনিধিরা অত্যন্ত সতর্ক, সাবধানী ও আমানতদার হতে বাধ্য হয়। তারা মেপে মেপে পা ফেলে। জাতির ভৎসনা, জনগণের ক্রোধ, অসন্তোষ, জওয়াবদিহির ভয় ও জনমতের ক্রোধাগ্নি আপতিত হবার ভয়ে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে।

মুসলিম বিশ্বের এক বিরাট বড় প্রয়োজন এবং তার এক বিরাট বড় খেদমত এই যে, উম্মাহর বিভিন্ন শ্রেণী ও জনগণের মাঝে সঠিক চেতনা সৃষ্টি করা এবং সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আধিক্যের দ্বারা এটা বোঝায় না, জাতির মধ্যে চেতনাবোধও বিদ্যমান। যদিও এতে কোনই সন্দেহ নেই, সাধারণ শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার-প্রসার দ্বারা চেতনাবোধ জাগ্রত করতে বিরাট সাহায্য পাওয়া যায়, কিন্তু চেতনাবোধ সৃষ্টি করার জন্য সাধারণভাবে স্থায়ী চেষ্টা-সাধনা ও প্রয়াস চালানো আবশ্যক। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও মুসলমানদের মধ্যে যারা সংস্কারমূলক কাজ করতে চান তাদের বেশ ভালভাবে বোঝা দরকার, যেই জাতির মধ্যে গভীর চিন্তা-ভাবনার কমতি রয়েছে সেই জাতি আস্থার যোগ্য নয়, চাই কি তাদের নিজেদের নেতাদের ওপর যতই আস্থা থাকুক এবং তারা তাদের আনুগত্য ও অনুসরণের ক্ষেত্রে যতই চোস্ত ও তৎপর কেন না হোক, তাদের আহ্বানে যত বড় বিরাট কুরবানীই তারা দিক। এজন্য, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের চেতনাবোধ তৈরি হচ্ছে এবং দৃষ্টি যতদিন না পরিণত ও ধারণা পাকাপোক্ত হচ্ছে ততদিন এই বিপদাশংকা থেকেই যাবে, তারা অন্য কোন আহ্বান ও আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত হবে এবং দেখতে না দেখতেই শত শত বছরের শ্রম ও সাধনাকে ব্যর্থ ও নিষ্ফল করে দেবে। যে জাতির চেতনাবোধ জাগে নি এবং যাদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে চিন্তা করার ও ভাল-মন্দ বোঝার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়নি তার দৃষ্টান্ত খড়-কুটো কিংবা মাঠের মধ্যে পড়ে থাকা পাখনার মত যা বিভিন্ন দিক থেকে বাতাস এসে ইচ্ছে মত এদিক থেকে ওদিক এবং ওদিক থেকে এদিক উড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

ইসলাম যদিও একটি আসমানী ধর্ম এবং এর বুনিয়াদ ওহী ও নবুওতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সেও তার অনুসারীদের ভেতর এমন এক বিশেষ চেতনা সৃষ্টি করেছে যা সমস্ত প্রকারের চেতনার মধ্যে অধিকতর পরিপূর্ণ, বিস্তৃত ও ব্যাপক এবং অনেক বেশি গভীর। সে তার অনুসারীদের মধ্যে এক বিশেষ প্রকারের চিন্তাধারা সৃষ্টি করে যা জাহিলী চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে তার অনুসারীদেরকে একটি জাগ্রত, সচেতন ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন চেতনা প্রদান করে যা স্বীয় বিস্তৃতি ও কুদরতী স্থিতিস্থাপকতা সত্ত্বেও ঐ সব চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে কারক করতে পারে না যা তার স্বীকৃত বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল খায় না। এবং সে সব মৌলিক উপাদান ও অঙ্গসমূহকে হযম করতে পারে না যা তার রূহ (প্রাণসত্তা) ও মুলনীতির বিপরীত।

এই ইসলামী চেতনার একটি দৃষ্টান্ত হলো এই, ইসলামের দাওয়াত ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশিক্ষণ ও সাহচর্যের দ্বারা সাহাবায়ে কিরামের মন-মস্তিষ্কে একথা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল, জুলুম এক নিকৃষ্ট জিনিস এবং তা ধর্মীয় ও নৈতিক অপরাধ যা কারুর জন্যই জায়েয নয় এবং এর ওপর তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, একজন মুসলমানকে সকলের সঙ্গেই ইনসাফ করা উচিত, চাই সে কাছের হোক অথবা দূরের, আপন হোক অথবা পর, দোস্ত অথবা দুশমন, পরিচিত অথবা অপরিচিত। তাঁরা জাহিলীসুলভ মর্যাদাবোধ ও জাতীয়, গোত্রীয়, পারিবারিক বা বংশীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে চিরদিনের মতো তওবা করে নিয়েছিলেন এবং বুঝে ফেলেছিলেন, ইসলামে এই অন্ধ জাতীয়তা অথবা সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। মুসলমানের জন্য আবশ্যক, তারা সত্যের সাথী ও সহযোগী হবে, তা সত্য যে পক্ষেই থাকুক না কেন। এটা তাঁদের বদ্ধমূল আকীদা ও বিশ্বাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল এবং এটা তাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে গিয়েছিল, অনুপ্রবেশ করেছিল তাদের শিরায়-উপশিরায়।

একদিন আকস্মিকভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর মুখ থেকে তারা শুনতে পেলেন, “তোমাদের ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে জালেম। হোক অথবা মজলুম।” যদি তাঁদের প্রশিক্ষণের ভেতর সামান্যতম জুটিও থাকত। এবং তাদের মস্তিষ্ক যদি এতটুকু বিক্ষিপ্ত ও বিস্রস্ত হত তাহলে তাঁরা চুপ করে একথা শুনতেন এবং এই কথাকে তারা জাহিলী অর্থে গ্রহণ করে নিতেন যে মাফিক তারা লালিত-পালিত হয়েছিলেন এবং সমগ্র জীবন এর ওপর আমল করার মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছিল। তাঁরা এও জানতেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম (ধর্ম সংক্রান্ত) কোন কথাই নিজের খাহিশ মাফিক বলেন না। তিনি যা বলেন বা করেন তা সরাসরি ওহী হয়ে থাকে। তাঁদের চেয়ে বেশি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী এবং তার সকল কথা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবার মত আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু তারপরও তারা নিশ্ৰুপ থাকতে পারলেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এই উক্তি তাদের আকীদাগত বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও উপলব্ধির সঙ্গে ছিল সাংঘর্ষিক যা ছিল তক্কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষামালা ও প্রশিক্ষণেরই ফল-ফসল। এর দ্বারা তাঁদের ইসলামী চেতনায় আঘাত লাগল এবং তাঁদের মস্তিষ্কের আল নড়বড়ে হয়ে গেল। তাঁরা তাঁদের এই কষ্টের কথা লুকোতে পারলেন না। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা মজলুমকে তত সাহায্য করব, কিন্তু জালেমকে সাহায্য করব কিভাবে?” এতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার কথার ব্যাখ্যায় বললেন, জালেম ভাইকে সাহায্য হলো, তার জুলুমের হাত ধরে তাকে তার কৃত থেকে বিরত রাখা। একথা শুনতেই তাদের মনের যাবতীয় গিট খুলে গেল এবং তাঁদের ইসলামী মানস চেতনা এই বাণীকে এভাবে কবুল করে নিল যেমনটি কবুল করে একটি জানাশোনা সত্যকে। এটাই ইসলামী চেতনাবোধের কমনীয়তা ও মাধুর্য এবং ইসলামী তীক্ষ্ণ অনুভূতির সুস্পষ্ট উদাহরণ।

এর আরেকটি দৃষ্টান্ত নিন। একবার রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একটি সেনাদল পাঠালেন এবং একজন সাহাবীকে তাদের আমীর নিযুক্ত করলেন। অতঃপর তাদেরকে আমীরের আনুগত্যের ব্যাপারে তাকীদ করলেন। সেখানে একটি ঘটনায় আমীর তাদের ওপর নারায হলেন যদ্দরুন তিনি একটি আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে সকলকে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দেন। সৈনিকেরা এ নির্দেশ মানতে অস্বীকার করল এবং বলল, আমরা তো আগুনের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করেছিলাম। এখন কি আমরা আবার তাতেই প্রবেশ করব? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘটনা আনুপূর্বিক শোনার পর সৈনিকদের নির্দেশ পালনের অস্বীকৃতিকে যথার্থ বলে সমর্থন করেন এবং বলেন, যদি সৈনিকেরা আমীরের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আগুনে ঝাপিয়ে পড়ত তাহলে আর কখনো তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।

সাহাবায়ে কিরাম (রা)-এর এই অস্বীকৃতির ভিত্তি ছিল এই, তারা এই উসূলের ওপর ঈমান এনেছিলেন যে, (আরবি) স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করতে হয় সৃষ্টির এমন কোন নির্দেশ মান্য করা যাবে না। (হাদীস) আনুগত্য কেবল তখনই বাধ্যতামূলক হবে যখন তা বৈধ ক্ষেত্রে হবে।

ইসলামী চেতনা ও ইসলামী প্রশিক্ষণের ফলে সাহাবায়ে কিরাম (রা) কোন অন্যায় ও ভুল কথা কিংবা কাজ ও বেইনসাফী বরদাশত করতে পারতেন না আর তা যদি সমকালীন খলীফার দ্বারাও সংঘটিত হতো। যদি খলীফার মধ্যেও কখনো সীমা অতিক্রম দেখতেন তবে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে ও ত্রুটির প্রতি অঙ্গুলি সংকেত করতে তারা আদৌ ইতস্তত করতেন না। একবার খলীফা ওমর (রা) খুতবা দিতে দাঁড়িয়েছেন। এ সময় তাঁর দেহে ছিল এক জোড়া কাপড়। খুতবার শুরুতেই তিনি “ লোকসকল! তোমরা শোন” বলতেই জনৈক মুসলমান উঠে বলল, “না, আমরা শুনব না।” খলীফা ওমর (রা) বললেন, “শুনবে না কেন?” মুসলমান লোকটি বলল, “আপনি তো আমাদের মাঝে একটি করে কাপড় বণ্টন করেছেন, অথচ আপনার শরীরে দেখতে পাচ্ছি এক জোড়া। খলীফা হিসেবে তো আপনাকে বেশি দেওয়া হয়নি।” ওমর (রা) বললেন, “ভাই! তাড়াহুড়ো না করে এই মজলিসে আমারই পুত্র আবদুল্লাহ আছে, সে কি বলে তা শোন।” এই বলে তিনি আবদুল্লাহকে ডাকলেন। দ্বিতীয় ডাকে জওয়াব মিলতেই তিনি আবদুল্লাহকে সম্বোধন করে বললেন, “লুঙ্গি হিসেবে যেই কাপড়টি আমি পরিধান করেছি তা কি তোমার দেয়া নয়?” পুত্র ‘হ’ বলে জওয়াব দিতেই মুসলমান লোকটি বলে উঠল, “হাঁ, আমীরুল মু'মিনীন! এবার আপনি বলতে পারেন। এখন আমরা শুনব।”

এই ইসলামী চেতনা ও ইসলামী প্রশিক্ষণের ফল ছিল এই, বনী উমায়্যাকে তাদের বংশীয় আধিপত্য ও রাজকীয় শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে বিরাট বেগ পেতে হয়েছে। ইসলামী রূহ তথা ইসলামী প্রাণসত্তা বারবার এই রাজকীয় শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করেছে, বিক্ষোভ করেছে এবং বারবার এই আরব শাহীর বিরুদ্ধে জিহাদী পতাকা তুলে ধরেছে। উমায়্যা শাসকরা ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনি যতদিন পর্যন্ত নির্ভীক ও প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোর বংশধারা শেষ না হয়েছে, যাদের ইসলামী মূলনীতির আলোকে প্রশিক্ষণ লাভ ঘটেছিল এবং যারা ইসলামী খেলাফত, ইসলামী রাষ্ট্রনীতি ও শাসন ব্যবস্থাকে অন্তর-মন দিয়ে ভালবাসতেন এবং এর থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হওয়াকেও যারা বেদআত ও বিকৃতির সমার্থক মনে করতেন।

কেবল তাই নয়, বরং প্রকৃত ঘটনা হলো এই, কোন রকমের সংস্কার ও সংশোধন এবং কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব চেতনার জাগরণ ও মানসিক প্রস্তুতি ব্যতিরেকে সংঘটিত হয় না, যদিও ফরাসী বিপ্লবের আলোচনা ইসলামী দাওয়াত ও বিপ্লবের আলোচনার ধারাবাহিকতায় বেয়াদবী হবে বলে মনে করি। কেননা ফরাসী বিপ্লব ছিল একটি অসম্পূর্ণ, সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ বিপ্লব যা আবেগপূর্ণ জোশ ও ভারসাম্যহীনতা থেকে মুক্ত ছিল না। তদ্সত্ত্বেও আমরা তা থেকে এই ফলগত অর্থ বের করতে পারি, যখন কোন সমাজ কিংবা দেশের চেতনা জেগে যায় এবং মানসিক গতি কোন বিশেষ দিকে মোড় নেয় তখন সেই প্লাবনকে থামিয়ে রাখা বিরাট থেকে বিরাটতর পাথর খণ্ডের পক্ষেও দুঃসাধ্য ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসী বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ যাদের মধ্যে অনেকেই বেশ ভাল মন-মানসিকতা, বিদ্যা-বুদ্ধি ও সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এবং যাদের দলে সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও লেখকদের এক বড় বাহিনী ছিল, এক বিশেষ উদ্দেশে ও লক্ষ্যে ফরাসী জনগণের চেতনার প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তারা জনগণের মনে দেশের পুরনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। পুরনো নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোেধ, ধ্যান-ধারণা ও প্রথার বিরুদ্ধে এক সাধারণ অশান্তি, অস্থিরতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে দেয় এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি ও বহির্বিশ্বের থেকে আগেই তাদের চিত্তের মাঝে ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা ও অবজ্ঞার আগুন জ্বেলে দেয়। ফল হলো এই, সেই সময়কার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে যায়। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রিয় শ্লোগানে পরিণত হয়। প্রত্যেক ফরাসী নাগরিকের এটাই ছিল তপজপের একমাত্র মন্ত্র। সেই সময় এই বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটল, আবেগ-উৎসাহ ও ক্রোধের আগ্নেয়গিরি লাভা উদ্গিরণ করল এবং পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার প্রাসাদ-সৌধ ধুলিসাৎ হলো। যদিও এই বিপ্লবের নেতা ও পথ-নির্দেশকরা একে মানবতার জন্য খুব বেশি উপকারী বানাতে পারেন নি আর সম্ভবত এটা তাদের সামনে ছিল না, কিন্তু তারা দেশের মধ্যে বিপ্লব সৃষ্টি করে দেন এবং এই বিপ্লবকে কোন শক্তিই রুখতে পারে নি। এজন্য পারেনি, এই বিপ্লবের উৎসধারা জনগণের মন ও মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হয়েছিল এবং এর পেছনে ছিল জাতির সাধারণ জনমত ও জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের চেতনাবোধ এজন্য প্রস্তুত হয়েছিল।

আজ য়ুরোপ যেসব জিনিসকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে এবং সে সমস্ত দুর্বলতাসহ যেগুলো নিয়ে কোন জাতিই বাঁচতে পারে না, অথচ আজ তারা কেবল বেঁচেই নেই, বরং তারা আজ নেতৃত্বের আসনে সমাসীন। আর তা হলো নাগরিক জীবনের দায়িত্বশীলতার অনুভূতি ও রাজনৈতিক চেতনা। আজ পর্যন্ত ইংরেজ ও আমেরিকানদের মধ্যে এমন লোকের উদাহরণ খুব কমই মিলবে যারা জাতীয় খেয়ানতের দায়ে অভিযুক্ত কিংবা নিজের দেশকে খুব সস্তা দামে বিক্রি করেছে অথবা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস করে দিচ্ছে কিংবা খারাপ ও অচল অস্ত্র ও সমরাস্ত্র ক্রয় করার দায়ে অপরাধী। এ ধরনের উদাহরণ প্রাচ্যে প্রচুর, কিন্তু য়ুরোপে খুবই কম, বলতে গেলে নেই বললেই চলে। য়ুরোপে নৈতিক ও চারিত্রিক বিকৃতি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত। এর যিম্মাদার অবশ্য বড় থেকে বড় মিথ্যা বলতে পারে, বিভিন্ন জাতিকে ধোঁকা দিতে পারে, পৃথিবীর বড় বড় জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দিতে পারে, তাদের অস্তিত্বকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে, কিন্তু তা নিজের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নয়, বরং জাতীয় ও রাষ্ট্রিীয় স্বার্থে। এটা সুনিশ্চিত, ইসলামে এ জাতীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অবকাশ নেই এবং অসৎ ক্রিয়া-কর্ম চাই তা ব্যক্তির সাথে হোক অথবা দলের সাথে, চাই তা ব্যক্তিগত উস্কানিতেই ঘটুক অথবা সামাজিক ও জাতীয় উস্কানির ভিত্তিতেই সংঘটিত হোক, অপরাধ অপরাধই, অন্যায় অন্যায়ই। কিন্তু পশ্চিমারা যা-ই কিছু করে বুঝে শুনে করে, সচেতনভাবে করে এবং সুনির্দিষ্ট নৈতিক দর্শনের আওতায় করে। প্রাচ্যের লোকেরা যা করে না বুঝে করে, অবচেতনভাবে করে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উস্কানি বশে করে।

মুসলিম দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ ও ক্ষমতাসীন শাসকবর্গের পক্ষে এমনটা অসম্ভব নয়, তারা কখনো নিজেদের নগণ্য ফায়দা, আনন্দ ও আকাক্ষা চরিতার্থ করার স্বার্থে নিজেদের দেশকে বন্ধক দেবে কিংবা বিক্রির দলীল সম্পাদন করবে অথবা নিজের জাতিকে ছাগল-ভেড়ার মত বিক্রিই করে দেবে কিংবা নিজের জাতিকে এমন কোন যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেবে যা তার জাতির মর্জির খেলাফ, তার স্বার্থের পরিপন্থী। এর চেয়েও বেশি বিস্ময়কর কথা হলো এই, এতদ্সত্ত্বেও জাতি তাদের নেতৃত্বের পতাকা বহন করে চলেছে, তাদের পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছে এবং তাদের প্রশংসায় মুখে খৈ ফোটে। এই অবস্থা এছাড়া আর কিসের প্রমাণ বহন করে যে, জাতির বিবেক মরে গেছে, তার চিন্তাশক্তি স্থবির ও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে এবং তাদের চেতনা ভোতা হয়ে গেছে। জাতি তার চেতনাবোধ থেকে মাহরূম।

বহু মুসলিম দেশ এমন আছে যেখানে জনগণের সঙ্গে চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় আচরণ করা হয়। যেখানে সাধারণ মানুষ কেবল গতর খাটার জন্য, কেবলই পরিশ্রম করবার জন্য আর ওপরতলার লোকেরা কেবল ভোগ-বিলাস আর আনন্দ-ফুর্তির জন্য বাঁচে। সেখানে প্রকাশ্যে আল্লাহর নাফরমানী হয় এবং হৃদয়হীন কর্মকাণ্ড ও বিবিধ অপরাধ সংঘটিত হয়। শরীয়তের বিধানসমূহকে পদদলিত করা হয়। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও না জনগণের মধ্যে আর না সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কোন প্রকার ক্ষোভ ও ক্রোধ পরিলক্ষিত হয় আর না সাধারণ কষ্টই তারা হৃদয়ে অনুভব করে। আর এ সবই মূলত মানবীয় পৌঁরুষ ও ইসলামী আত্মমর্যাবোধের অভাবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এ অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থার ইঙ্গিতবাহী।

কোন বিপ্লব ও কোন বিদ্রোহেরই কোন মুল্য নেই (বাহ্যত তা দেশ ও জাতির জন্য যত উপকারীই হোক) যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ভিত্তির মাঝে কোন দৃঢ় আকীদা-বিশ্বাস, বিশুদ্ধ চিন্তা-চেতনা এবং প্রশিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না জনমত পুরোপুরি গড়ে ওঠে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন রাজা-বাদশাহ কিংবা সম্রাটের নির্বাসন, কোন বিপ্লবী হুকুমত ও মন্ত্রীসভার পরিবর্তন কোন প্রকার গুরুত্ব বহন করে না এবং এর ওপর নির্ভর করা যায় না। যদি জাতির মধ্যে ঐসব কাজ ও আচার-আচরণের প্রতি ঘৃণা না থাকে তাহলে এই বিপ্লব ও পরিবর্তনের দ্বারা একজন ভুল মানুষ কিংবা ভ্রান্ত দল বা পার্টির জায়গায় আরেক ভুল মানুষ বা ভ্রান্ত দল ও পার্টি আসতে পারে এবং হতে পারে, জাতি তা অনুভবও করতে পারবে না। এজন্যই আসলে নির্ভরযোগ্য বিষয় হলো জাতির বিবেক ও চেতনাবোধ এতখানি জাগ্রত ও সচেতন হবে যে, সে কোন ভুল জিনিস ও পাপ কর্মকে কোন অবস্থাতেই এবং কোন ব্যক্তির নিমিত্তই বরদাশত করবে না।

এজন্য মুসলিম বিশ্বের সবচে' বড় খেদমত হলো, তার ভেতর সঠিক ও সহীহ-শুদ্ধ চেতনাবোধ সৃষ্টি করা, এমন চেতনা যা কোন রকমের জুলুম ও বেইনসাফী রদাশত করে না, ধর্ম ও নৈতিকতার বিকৃতি সহ্য করে না, যা সহীহ-শুদ্ধ ও ভুল-ভ্রান্তি, অকপটতা ও কপটতা, দোস্ত-দুশমন তথা শত্রু-মিত্র, শান্তিকামী ও অশান্তি সৃষ্টিকারীর মধ্যে খুব সহজেই পার্থক্য করতে পারে। অপরাধী ও অন্যায়কারী যেন তার অসন্তোষ ও ক্রোধের হাত থেকে বাচতে না পারে এবং অকপট ও নিষ্ঠাবান মানুষ যেন তার উপযুক্ত কদর ও স্বীকৃতি পাওয়া থেকে মাহরূম না হয়। সে যেন তার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যা-সংকট ও বিষয়াদির ক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মত গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং ফয়সালা করার সামর্থ্য রাখে। যতদিন এই চেতনাবোধের উন্মেষ না ঘটবে, কোন মুসলিম দেশ ও জাতির কর্ম-প্রেরণা, কাজের সামর্থ্য ও যোগ্যতা, ধর্মীয় আবেগ ও মযহাবী জীবনের প্রদর্শনী ও দৃশ্যাবলী খুব বেশি একটা গুরুত্ব বহন করে না।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন