মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
হিজরী ১ম শতকে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি তার পরিপূর্ণ রূহ ও দৃশ্যপটসমূহসহ আবির্ভাব এবং ইসলামী হুকুমতের নিজস্ব রূপ ও রীতিনীতি সহকারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল ধর্ম ও নৈতিকতার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং রাজনীতি ও সমাজনীতির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক নতুন ঘটনা। এই বিপ্লবের ফলে পৃথিবীর সভ্যতার গতিধারাই পাল্টে যায়। ইসলামের এই বিরাট আজীমুশশান বিজয়ে জাহিলিয়াত এক অভূতপূর্ব পরীক্ষা ও বিপদের মুখোমুখি হয়। এতদিন পর্যন্ত তার প্রতিপক্ষের (ইসলাম-এর অবস্থানগত মর্যাদা একটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আহ্বানের বেশি ছিল না। এখন হঠাৎ করেই হয়ে গেল সৌভাগ্য ও মুক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ বিধান, আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুবাদের পরিপূর্ণ সমন্বয়, জীবন ও শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি, একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা-সংস্কৃতি, একটি সমাজ, একটি শক্তিশালী হুকুমত এবং একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সংবিধান।
এখন একদিকে ছিল এমন একটি যৌক্তিক, বুদ্ধিগ্রাহ্য ও আমল উপযোগী ধর্ম যা ছিল সরাসরি প্রজ্ঞা ও যুক্তিনির্ভর, আর অপর দিকে ছিল কেবলই কষ্ট-কল্পনা ও আজগুবী কিসসা-কাহিনী। একদিকে ছিল আল্লাহপ্রদত্ত শরীয়ত ও আসমানী ওহী, আর এর বিপক্ষে ছিল শুধুই অনুমান, নিছক মানবীয় অভিজ্ঞতা ও মানবরচিত আইন-কানুন।
একদিকে ছিল এমন শ্রেষ্ঠ ও সমুন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতি যার বুনিয়াদ অনড় অটল এবং যার মূলনীতি অপরিবর্তনীয়। আল্লাহভীতি, সতর্কতা ও বিশ্বস্ততার রূহ এর সমগ্র রীতিনীতি ও বিধিমালাতে সক্রিয় ছিল। এর বৃত্ত ও পরিধির মধ্যে সম্পদ ও সম্মানের মুকাবিলায় নৈতিকতা ও সাধুতা এবং শূন্যগর্ভ আড়ম্বর প্রদর্শনীর মুকাবিলায় প্রাণসত্তা ও মৌলিকত্বের সম্মান ও মূল্যের প্রাধান্য ছিল। লোকের ভেতর সাম্য ছিল, শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যের একমাত্র মানদণ্ড ছিল তাকওয়া। মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আখিরাত। এজন্য তাদের স্বভাবে প্রশান্তি এবং অন্তরে তুষ্টি ছিল। পার্থিব সামান-আসবাবের লোভ ও এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের মধ্যে খুব সামান্যই ছিল। এর বিপক্ষে ছিল জাহেলী সভ্যতা, ছিল গোলযোগপূর্ণ, উত্তাল সংঘাতক্ষুব্ধ অস্থিরতা। বড়রা ছোটদের ওপর জুলুম করত। এবং সবল দুর্বলকে গ্রাস করত। খেল-তামাশা ও চরিত্রহীনতার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং পদ ও সম্পদ, ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের উপকরণ সংগ্রহের জন্য ছিল কঠিন প্রতিযোগিতা। এমন কি এর ফলে পৃথিবী একটি রণক্ষেত্রে এবং জীবন-যন্ত্রণায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল ন্যায়বিচারক ইসলামী হকুমত যা আপন প্রজাদেরকে একই দৃষ্টিতে দেখত। দুর্বলকে শক্তিমানের কাছ থেকে তার হক নিয়ে দিত। লোকে যেমন নিজের ঘরবাড়ি ও জানমালের হেফাজত করে তেমনি ইসলামী হুকুমত তার প্রজাদের নৈতিক চরিত্রের দেখাশোনা ও হেফাজত করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করত। তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিল তাদের শাসকবৃন্দ এবং সর্বাধিক যুহদ তথা ভোগবিমুখ জীবন ছিল তাদের যাদের নিকট সর্বাধিক আরাম-আয়েশের উপকরণ ও ভোগ-বিলাসের অবারিত সুযোগ ছিল। এর মুকাবিলায় ছিল সেসব জাহেলী হুকুমত যেখানে জুলুম-নিপীড়নের অবাধ রাজত্ব ছিল। যে সব হুকুমতের কর্মকর্তারা জনগণের সহায়-সম্পদ আত্মসাৎ করত ও জুলুম-নিপীড়ন চালাত। লোকের সম্ভ্রম হানি ঘটাতে ও রক্তপাত করতে তারা একে অন্যের সঙ্গে। প্রতিযোগিতায় নামত এবং নিজেদের অসৎ চরিত্রের নমুনা পেশ করে জনগণের নৈতিক চরিত্র খারাপ করে দিত। তাদের মধ্যে নিকৃষ্টতম ছিল শাসক ও বাদশাহরা। তাদের রাজত্বে লোকে ক্ষুধায় না খেয়ে মারা যেত। আর তাদের জীব-জানোয়ার, এমন কি কুকুরগুলোও পেট পুরে খেত। তাদের মহলগুলো। মূল্যবান স্বর্ণখচিত পর্দা দ্বারা সজ্জিত থাকত আর ওদিকে শরীর ঢাকার মত এক চিলতে কাপড়ও থাকত না সাধারণ মানুষের।
তারপর লোকের সামনে ইসলাম গ্রহণের পথে আর কোন বাধা ছিল না, ছিল না জাহিলিয়াতকে অগ্রাধিকার দেবার কোন কারণ। ইসলাম কবুল করতে গিয়ে তাদের আর হারাবারও কিছু ছিল না, অথচ হাসিল হচ্ছিল সব কিছুই। ঈমানের মিষ্টতা, ইয়াকীনের শীতলতা, ইসলামের শক্তি-সামর্থ ও বলবীর্য, একটি শক্তিশালী হুকুমতের পৃষ্ঠপোষকতা এবং এমন সব বন্ধু ও সাহায্যকারীদের সাহায্য সমর্থন তারা লাভ করছিল যারা তাদের জন্য প্রয়োজনে নিজেদের জানমাল লুটিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকত। চিত্তের প্রশান্তি ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আস্থা ও তৃপ্তি লাভ ঘটত। মানুষ অনায়াসে জাহিলিয়াত থেকে ইসলামের দিকে ঝুঁকতে লাগল। তারা মুসলমান হতে লাগল। জাহিলিয়াতের এলাকায় ইসলাম বিস্তার লাভ করতে থাকল এবং ইসলামের শক্তি ও ক্ষমতা দৃঢ় ও সুসংহত হতে লাগল, এমন কি দুর্বল-চেতা লোকদের মনেও ইসলাম ও কুফর সম্পর্কে আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অবশিষ্ট রইল না। ফলে নির্ভেজাল আল্লাহর আনুগত্য করা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে গেল।
এই বিপ্লবের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া খুবই সুদূরপ্রসারী ও গভীর ছিল। আল্লাহ পরস্ত্রীর রাস্তা যা জাহিলী হুকুমতে কষ্টকর ও বিপদসঙ্কুল ছিল, এখন তা খুবই সহজগম্য ও নিরাপদ হয়ে গেল। জাহিলিয়াতের পরিবেশে যেখানে আল্লাহর আনুগত্য কঠিন ও কষ্টকর ছিল, ইসলামী পরিবেশে সেখানে আল্লাহর নাফরমানী করা কঠিন ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। এই গতকাল পর্যন্ত প্রকাশ্য সমাবেশে খোলা মাঠে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়ে পাপাচারের দিকে, অন্যায়-অশ্লীলতার দিকে, জাহান্নাম অভিমুখে আহ্বান জানানো হত, সেখানে আর এমনটি করা সহজ ছিল , বরং সুকঠিন ছিল। গতকাল অবধি আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও তাঁর নাফরমানীর কার্যকারণ ও সুযোগ ছিল অবাধ ও অসংখ্য আর তা ছিল ভোলাখুলি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে। আর এখন এর ওপর বিরাট বাধ্যবাধকতা আরোপিত ও বড় রকমের বাধা-প্রতিবন্ধকতা স্থাপিত। কাল পর্যন্ত আল্লাহরই যমীনে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান জানানো ও দাওয়াত প্রদান এমন এক অপরাধ ছিল যার ফলে দাঈ ও মুবাল্লিগকে অত্যন্ত সতর্কতা ও গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ দরকার পড়ত। আর আজ তা এমন এক শুভ কর্ম ছিল, কল্যাণকর কাজ ছিল যার জন্য কোন প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণের প্রয়োজন ছিল না। দাওয়াত প্রদানকারীর কোন প্রকার বিপদ যেমন ছিল না, তেমনি বিপদ ছিল না কবুলকারীরও। কুরআন মজীদে এই পার্থক্যটাই সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে এভাবেঃ
“আর স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে স্বল্প সংখ্যক, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বলরূপে পরিগণিত হতে। তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে অকস্মাৎ ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন এবং তোমাদেরকে উত্তম বস্তুসমূহ রিযিকরূপে দান করেন যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” (সূরা আনফালঃ ২৬)
এই ক্ষমতা ও শক্তির কারণে মুসলমানরা এখন শাব্দিক অর্থেই আমরা বি’ল-মারুফ ও নাহী আনিল-মুনকার তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে থাকে এবং আদেশ ও নিষেধ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য লাভ করে।
যেভাবে বসন্ত মৌসুমে উদ্ভিদ জগত ও মানুষের মেজ মৌসুম দ্বারা প্রভাবিত হয়, ঠিক তেমনি অনুভূত ও অননুভূত পন্থায় মুসলিম শাসন ও সভ্যতার যুগে মানুষের মন-মানসিকতাও পরিবর্তিত ও প্রভাবিত হতে থাকে। চিত্তে কোমলতা ও নম্রতা সৃষ্টি হতে থাকে। ইসলামের মৌল নীতিমালা ও সত্য বাণী মন ও মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট হতে থাকে। বস্তুর মূল্য ও মান সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। গতকাল পর্যন্ত যে সব বস্তু ও গুণাবলী মানুষের দৃষ্টিতে বিরাট মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্ববহ বলে বিবেচিত ছিল আজ আর তা তেমন থাকল না। আর যে সব বস্তু মুসলমানদের নেতৃত্বের যুগ।
গুরুত্বহীন ও মূল্যহীন ছিল আজ তা গুরুত্ববহ ও মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হলো এবং এর অনুসারী ও পূজারীদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধ সৃষ্টি হলো। ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া, এর অভ্যাস, রীতিনীতি ও এর বৈশিষ্ট্যসমূহ এখতিয়ার করা গর্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। দুনিয়া ক্রমান্বয়ে ইসলামের নিকটতর হচ্ছিল। পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী মানুষ যেমন সূর্যের আবর্তন-বিবর্তন সম্পর্কে অনুভব করতে পারে না ঠিক তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও এর মানুষগুলো নিজেদের ইসলামী প্রবণতা ও ইসলামের অভ্যন্তরীণ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনুভব করতে পারত না। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও সভ্যতা-সংস্কৃতি কোনকিছুই এর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। মানুষের বিবেক ও তার অন্তর এসব প্রভাবের সাক্ষ্য দিত এবং তাদের সুকুমার বৃত্তিতে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটত। মুসলমানদের পতনের পরও যে সব সংস্কার। আন্দোলন ঐসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্টি হয় তা ইসলামী প্রভাব ও ইসলামী ধ্যান-ধারণারই ফলস্বরূপ।
ইসলাম তৌহীদ তথা একত্ববাদের দাওয়াত পেশ করে এবং মূর্তিপূজা ও শির্ক-এর এমন নিন্দা জ্ঞাপন করে যে, এগুলো চিরদিনের জন্য হেয় ও অবজ্ঞেয় হয়ে যায়। লোকে অতঃপর এর নামে লজ্জা পেত এবং নিজেদেরকে এর থেকেঃ মুক্ত প্রমাণ করতে চেষ্টা করত অথবা তারা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ও সাফাই। সহকারে এর স্বীকৃতি দিত এবং বিস্ময়ের সঙ্গে বলতঃ
“সে কি বহু ইলাহূকে এক ইলাহ্ বানিয়ে নিয়েছে। এতে এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার!” (সূরা সাদঃ ৫)।
অথবা এখন তারা নিজেদের ধর্মের শির্কমূলক অঙ্গসমূহ ও কর্মকাণ্ডের ভিন্নতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করতে থাকে এবং এমন সব ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করতে থাকে যারা সেগুলোকে তৌহীদ তথা একত্ববাদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন একটি দলের উৎপত্তি ঘটে যারা হযরত ঈসা মসীহ্ (আ)-এর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান এবং ত্রিত্ববাদের আকীদাকে তৌহীদের মোড়কে ব্যাখ্যা দিত। তাদের মধ্যে এমন সব সংস্কারকেরও জন্ম হয় যারা খ্রিস্টানদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় দল-উপদল ও গির্জাধিপতিদের আল্লাহ ও তদীয় বান্দার মধ্যে মাধ্যম হিসাবে অস্বীকার করত, তাদের কঠিন ভাষায় সমালোচনা করত এবং তাদের বিশিষ্ট অধিকারগুলোকেও তারা অগ্রাহ্য করত। খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীতে য়ুরোপে এমন একটি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে যারা পাদ্রীদের সামনে নিজেদের কৃত গোনাহর স্বীকৃতি প্রদানের বিরোধিতা করত এবং যাদের আহ্বান ছিল এই যে, একমাত্র আল্লাহর সকাশেই দো'আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত এবং নিজের পূর্বকৃত গোনাহ ও পাপরাজির স্বীকৃতি কেবল তাঁর সামনেই দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোন মানুষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই।১
ঠিক তেমনি খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দী থেকে ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত য়ুরোপে এই আন্দোলন প্রবল শক্তিতে পরিচালিত হয় যে, ছবি ও মূর্তি একটি ধর্মবিরোধী কাজ এবং এসবের মধ্যে পবিত্রতার কোন কিছু নেই। এই আন্দোলন এত প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে যে, তৃতীয় লুই, কনস্টান্টাইন ৫ম ও চতুর্থ লুই-এর মত প্রবল প্রতাপান্বিত রোমক সম্রাটরা পর্যন্ত একে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রথমোল্লিখিত সম্রাট ৭২৬ খ্রিস্টাব্দে এক রাজকীয় ফরমান জারি করে সরকারীভাবে চিত্র ও মূর্তির পবিত্রতার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ৭৩০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ফরমানে একে তিনি মূর্তিপূজা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। খ্রিস্টান ও মূর্তিপূজক য়ুরোপ এবং রোমক ও গ্রীক সভ্যতায় (যার চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা ও মূর্তি নির্মাণ পৃথিবী বিখ্যাত চিত্র ও মূর্তির বিরুদ্ধে এই অনীহা ও জিহাদ নিশ্চিতই ইসলামের মূর্তি ভাঙা ও তৌহিদী ঘোষণার উচ্চকিত নাদই ছিল যা পাশ্চাত্যে মুসলিম স্পেনের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রভাবাধীনে পৌঁছে। এর সমর্থন এ থেকেও পাওয়া যাবে যে, তুরিযানের প্রধান পাদ্রী-পুরোহিত এবং এই আন্দোলন ও দাওয়াতের বিরাট এক উৎসাহী সমর্থক ও পতাকাবাহী ক্লডিয়াস (যিনি তার প্রভাবাধীন এলাকাতে চিত্র ও ক্রুশ কাষ্ঠ পুড়িয়ে ফেলতেন) সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, তার জন্ম ও লালন পালন স্পেনে হয়েছিল এবং এটা হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর কথা যখন সেখানে মুসলিম শাসন ও মুসলিম সভ্যতা উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছিল।২
য়ুরোপের ধর্মীয় ইতিহাস ও খ্রিস্টীয় গির্জার কাহিনী যদি গভীর দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করা হয় তাহলে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবের আরও অনেক নমুনা ও দৃষ্টান্ত আপনি দেখতে পাবেন। স্বয়ং মার্টিন লুথার কিং-এর বিখ্যাত সংস্কারমূলক আন্দোলন তার অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং ঐতিহাসিকগণ একথা স্বীকার করেছেন, এই আন্দোলনের জনকের ওপর ইসলামী শিক্ষামালার প্রভাব পড়েছিল। কেবল ধর্মই নয়, বরং য়ুরোপের সমগ্র জীবন ও এর সভ্যতা-সংস্কৃতি ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। রবার্ট ব্রিফল্ট (Robert Brfault) তাঁর The Making of Humanity নামক গ্রন্থে বলেনঃ
"For Although, there is not a single aspect of European growth in which the decisive influence of Islamic civilization is not traceable nowhere is it so clear and momentous as in the genesis of that power which constitutes the permanent distinctive force of the modern world and the supreme source of its victory-natural science and scientific spirit."
“য়ুরোপের উন্নতি ও অগ্রগতির কোন শাখা-প্রশাখা কিংবা কোন একটি দিকই এমন নেই যেখানে ইসলামী সভ্যতা তার ছাপ না রেখেছে কিংবা কোন প্রকার প্রভাব না ফেলেছে, উল্লেখযোগ্য ও উজ্জ্বলতর কোন স্মৃতি না রেখেছে। য়ুরোপীয় জীবনের ওপর ইসলাম এক বিরাট প্রভাব ফেলেছে।"১
একই লেখক অন্যত্র বলেনঃ
"Science is the most momentous contribution of Arab Civilization to the modern world... It was not science only which brought Europe back to life. Other and manifold influences from the civilization of Islam communicated its first glow to European life." “কেবল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানই (যেক্ষেত্রে আরব মুসলমানদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত) য়ুরোপে জীবন সঞ্চারের কৃতিত্বের অধিকারী নয়, বরং ইসলামী সভ্যতা য়ুরোপীয় জীবনের ওপর খুবই বিরাট ও বিভিন্নমুখী প্রভাব ফেলেছে। আর এর সূচনা সে সময়ই হয়ে যায় যখন ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রথম আলোকচ্ছটা য়ুরোপের ওপর পড়া শুরু করেছে।”২
[১. The Making of Humanity, P. 190. ]
[২. The Making of Humanity, P. 202. ]
আর এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর চরিত্র ও আচার-ব্যবহার, সমাজ ও আইন প্রণয়নে ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও শরীআর প্রভাব চোখে পড়বে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তার অধিকারসমূহের স্বীকৃতি, বিভিন্ন মানব সম্প্রদায় ও দল-উপদলের মধ্যে সাম্যের মৌল নীতিমালা মুসলিম বিজয় এবং মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশার পর থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকৃত হয়েছে। মোটের ওপর সভ্য দুনিয়ার কোন ধর্ম ও কোন সভ্যতাই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর নবুওত লাভ ও ইসলামের আবির্ভাবের পর এই দাবি করতে পারে না যে, তারা ইসলাম ও মুসলমানদের দ্বারা আদৌ প্রভাবিত হয়নি।
ইসলামী হুকুমত ও ইসলামী সভ্যতার পতন যুগেও ইসলামের আগেকার আহ্বান (দাওয়াত) ও শক্তির প্রভাব-পরিচিতি ও স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট ছিল। এসবের মধ্যে একটি ছিল আল্লাহ্র পরিচিতি যা সমগ্র মুসলিম জগতে সাধারণ ব্যাপার ছিল। আল্লাহর ধ্যান-খেয়াল মুসলমানদের মন ও মস্তিষ্কের গভীরে এভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, তা সর্বপ্রকার বিপ্লব, পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও ধর্মীয় অধঃপতন সত্ত্বেও বের হয়ে যায়নি, বের হতে পারেনি। মুসলমানদের পক্ষে অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া সম্ভব ছিল মুসলমানদের পতন যুগে যা সুস্পষ্টভাবেই দেখা গেছে) কিন্তু আল্লাহর ধ্যান-খেয়াল তাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে বের হতে পারেনি। নফসে লাওয়ামার ভৎসনা, বিবেকের দংশন ও চোখ রাঙানি, সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে আল্লাহ্র উপস্থিতির ধারণা, পরকালের ভয়ভীতি, অন্যায় ও পাপের নেশায় মত্ত আত্মবিস্মৃত অবস্থায়ও অন্তরে উকি মারত এবং কখনো কখনো অলক্ষ্যে তার কাজ করে যেত। এরই ফলে ফাসেক ও ফাজির পাপিষ্ঠ বদকাররাও অনেক সময় হঠাৎ করেই অন্যায় ও পাপাচার থেকে তওবাহ করে অত্যন্ত নেককার মুত্তাকী দলভুক্ত হয়ে যেত। শুড়িখানার মদ্যরাও একটি ঠোক্কর খেয়ে সতর্ক সাবধান হয়ে কা'বার পথ ধরত। বড় বড় শাহযাদা ও বিলাস ব্যসনে লালিত-পালিত আমীর-নন্দন একটা মামুলী ধরনের অদৃশ্য সাবধান বাণী দ্বারা (যার থেকে সহস্র গুণ বেশি সাবধান বাণী বস্তুবাদ ও কুফরের যুগে প্রতিক্রিয়াহীন প্রমাণিত হয়ে থাকে) সিংহাসন ও রাজমুকুট ছেড়ে ফকীরী দরবেশীর ভোগবিমুখ তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করতেন। কোন কোন সময় কুরআন পাঠকারী কুরআন মজীদের এই আয়াত পাঠ করেছেঃ
“যারা ঈমান আনে তাদের ঈমান ভক্তি বিগলিত হবার সময় কি আসেনি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? এবং পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের মত যেন ওরা না হয় বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অদ্ভুকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ওদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী। (সূরা হাদীদঃ ১৬)
কোন কোন লোকের ব্যাপারে জানা গেছে, ঘুম থেকে জেগেই এমন সতর্ক ও সাবধান হয়ে গেছেন যে, তাদের জীবনে চিরদিনের জন্য বিপ্লব ঘটে গেছে।” ইতিহাসের পৃষ্ঠা যাঁদের দৃষ্টান্ত দ্বারা ভরপুর আছে।
বাগদাদের চরম ভোগ-বিলাস ও গাফিলতির যুগেও প্রভাব সৃষ্টিকারী ওয়ায়েজ ও সাহিবে দিল নসীহতকারীদের মজলিস ও মাহফিলগুলো কদাচিৎ এ ধরনের ঘটনা থেকে মুক্ত থাকত। ৫৮০ হিজরীতে বাগদাদ ভ্রমণকারী প্রখ্যাত আরব পর্যটক ইবন জুবায়র আন্দালুসী (মৃ. ৬১৪ হিঃ) শায়খ রাদিয়ুদ্দীন কার্যবীনির ওয়াজ মাহফিলের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “ওয়াজ চলাকালে মানুষের চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল। মানুষ পতঙ্গের মত পাগলের ন্যায় তওবার জন্য তাঁর হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল এবং নিজেদের চুল ছিড়ছিল।”
হাফিজ ইবনে জওযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি (মৃ. ৫৯৭ হি.)-এর ওয়াজ মাহফিলের অবস্থা ছিল এই, “মানুষ চিৎকার করে কাঁদত। মানুষ পাগলপ্রায় হয়ে যেত এবং বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেত। আর লোকেরা তাদেরকে ধরে মাহফিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। নিজেদের কপালের চুল তাঁর হাতে ধরিয়ে দিত আর তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে তাদেরকে সান্ত্বনা দিতেন।”১
হাফিজ ইবনে জওযী (র.) স্বয়ং একবার তাঁর কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, এক লক্ষ মানুষ আমার হাতে তওবা করেছে।২
হি. ৫ম শতাব্দীর বিখ্যাত মুহাদ্দিছ শায়খ ইসমাঈল লাহোরী সম্পর্কে ঐতিহাসিক নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেন।
بزارهاسردم در مجلس وعظوم شرف باسلام شدند
“হাজার হাজার মানুষ তাঁর ওয়াজ-মাহফিলে ইসলাম কবুল করত।৩ ইবনে বত অনেক ভারতীয় ওয়ায়েজীনের ওয়াজের তাছীর সম্পর্কে এ ধরনের কাহিনী লিখেছেন।
[১. রিহলা, ইবন জুবায়র কৃত, ৩০২পৃ. ]
[২. সায়দুল খাতির ও লাফতাতুল-কাবাদ ]
[৩. তাযকিরা-ই-উলামা; ]
কুফর ও ধর্মহীনতার আধিপত্য ও প্রাধান্যের যুগে প্রভাব সৃষ্টির এমন দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যেত। এ যুগে প্রভাবশালী থেকে প্রভাবশালী ধর্মীয় বাগিতা ও নৈতিক উপদেশাবলী প্রভাবশূন্য হয়ে পড়ে।
আল্লাহর ধ্যান-ধারণা সে সময় এরূপ মজ্জাগত হয়ে পড়েছিল যা থেকে কোন কওম, ধর্ম কিংবা দল-উপদল মুক্ত ছিল না। ভাষা ও সাহিত্যে স্রষ্টার পরিচিতি, ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ওহী ও রিসালতের ভাষার শব্দসমষ্টি ও পরিভাষাসমূহ আত্মার ও রক্তের ন্যায় অব্যাহতভাবে এমনি প্রবাহিত ছিল যে, এই ভাষা ও সাহিত্যকে এর থেকে মুক্ত করা যেতে পারে না। ইসলামী টীকা-ব্যাখ্যা, ধর্মীয় শিষ্টাচার ও আদব অমুসলিমদের ভাষাসমূহের ওপর এভাবে জারি হয়ে গিয়েছিল এবং তারা এই পরিমাণে এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, অন্য ভাষার বিকল্প শব্দ ব্যবহারে তাদের মন ভরত না। অমুসলিম সাহিত্যিক ও মনীষীরা অবাধে কুরআন মজীদ হির্জ করতেন। বিখ্যাত অমুসলিম সাহিত্যিক ও লেখক। আবু ইসহাক সাবী সম্পর্কে কথিত আছে, তিনি রমযান মাসে রোযাও রাখতেন। আল্লাহকে পাবার আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক। হাজার হাজার নয়, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষ মুসলিম দেশসমূহের শহরগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা লাভের আগ্রহে এবং আল্লাহওয়ালা মানুষের সন্ধানে মাঠ-ময়দান পাহাড়-পর্বত ও উপত্যকা পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়াত। যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাতেন তাঁরা ছিলেন সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রত্যাবর্তনস্থল ও কেন্দ্রবিন্দু এবং তাঁদের আবাসগুলো আল্লাহ্সন্ধানী ও খোদাপ্রেমিক মানুষের ভিড়ে উপচে পড়ত। তাদের বসতবাড়ির জনসমাগম ও রওনক হুকুমতের প্রাণকেন্দ্র ও শাসকদের রাজধানীসমূহ থেকেও অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও মুখর ছিল। বড় পীর হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রা)-এর মজলিস আব্বাসী খলীফাদের থেকেও অনেক বেশি আঁকজমক ও রওনকপূর্ণ ছিল। আমীর-উমারা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও আল্লাহ-প্রাপ্তির আগ্রহ থেকে মুক্ত ছিল না। জীবনী গ্রন্থগুলো এ ধরনের উদাহরণে ভরপুর।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/788/80
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।